মাহার সন্তান দলিত সমাজের নেতা আম্বেদকরকে তখন যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল আমন্ত্রণ করে মহারাষ্ট্র থেকে পূর্ববঙ্গ নিয়ে যান। নিজে পদত্যাগ করে সেই কেন্দ্র থেকে পুনঃনির্বাচনের মাধ্যমে আম্বেদকরকে সংবিধান সভায় প্রতিনিধি করে পাঠান। যোগেন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন–দলিত স্বার্থ রক্ষার পক্ষে আমার চেয়ে অনেক যোগ্য ব্যক্তি বাবা সাহেব আম্বেদকর।
এই ঘটনাই উচ্চবর্ণ অহমিকায় পদাঘাত করে। পূর্ববঙ্গে নমঃশূদ্র জাতি তাদের বিষ নজরে পড়ে যায়। তারা ভয় পায় মাহার আর নমঃ ঐক্য যদি গড়ে ওঠে ব্রাহ্মণ্যবাদী ক্ষমতার সামনে বড় বিপদ দেখা দেবে। এই কারণে তারা দেশভাগের সময় বরিশাল, ফরিদপুর, খুলনা যশোর এই সব নমঃশূদ্র অধুষিত জেলাগুলো পূর্ব পাকিস্তানে ঠেলে দেয়।
জাতিগত কারণে দেশভাগ। তাই যদি হয়, ওই চার জেলা থাকা দরকার ভারতে আর মালদা মুর্শিদাবাদ নদীয়া এই মুসলমান প্রধান জেলাগুলো যাওয়া দরকার পাকিস্তানে। তেমন করা হয়নি শুধু এই আক্রোশবশতঃ অন্ধ প্রতিহিংসার কারণে। এর ফলে একটা শক্তিশালী দলিত জনগোষ্ঠি ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে। কিছু রয়ে গেছে ওপার বাংলায় যাদের সংখ্যা প্রায় এক কোটি। তিন কোটি আছে এপারে। যার কিছু দণ্ডকারণ্যে কিছু মহারাষ্ট্রে কিছু নৈনিতালে কিছু মীরাটে আর কিছু পশ্চিমবঙ্গের রেল লাইনের ধারে, খাল পাড়ে ফুটপাতে। ছিন্নভিন্ন এই জাতিকে দিয়ে আর ভয় পাবার কিছু নেই। ভয়মুক্ত হয়ে গেছে উচ্চবর্ণ স্বার্থ।
আর একটা স্বার্থ সুরক্ষিত হয়েছে এই দেশভাগের ফলে। সেটা প্রদেশিক। দুই বাংলা এক থাকলে তার যা আয়তন–কমপক্ষে একশো পনের কুড়িটা সংসদীয় নির্বাচন ক্ষেত্র থেকে শুধু বাঙালি সাংসদ নির্বাচিত হয়ে দিল্লির সংসদ ভবনে যেত। এত সাংসদ আর কোন প্রদেশ পেত না। আজ যে দল পশ্চিমবঙ্গেশাসন ক্ষমতায় আসে, সব দলের এক অভিযোগ–দিল্লির বিমাতৃ সুলভ আচরণ। তখন এমন হলে বাংলার বঞ্চনার বিরুদ্ধে একশো সাংসদ একযোগে উঠে দাঁড়ালে দিল্লির বড় নেতারা সব কেঁপে যেত। সে ভয় এখন আর নেই। দুই ভাগ ওপারে, এক ভাগ এপারে-এই খণ্ডিত শক্তি নিয়ে বাঙালি আর কোনদিন মাথা উঁচু করতে পারবে না।
পারবে যদি আবার কোনদিন দুই বাংলা এক হয়। বন্দুকের ডগায় ভাগ করে দেওয়া দুই জার্মানি কত বছর পরে আবার এক হয়ে গেছে। তাদের ভাষা খাদ্য পোষাক সংস্কৃতি সব এক–তাই সহজ হয়েছে মিলন। আমাদের ভাষা খাদ্য পোষাক সংস্কৃতি খানিকটা মিল আর মাঝখানে এসে পথ আগলে দাঁড়িয়ে পড়েছে ধর্ম। তাই আমরা মিলতে পারব না। মানুষে মানুষে যত বিভেদ, যত অনৈক্য ধর্ম সৃষ্টি করেছে–আর কিছুতে তা পারেনি।
আমি এক এক সময় ভাবি ইস্রায়েল একটা দেশ বর্তমানে যার জন সংখ্যা মাত্র আশি লক্ষ। ওদেরও এক সময় কোন দেশ ছিল না। উদ্বাস্তু হয়ে তাড়া খেয়ে ফিরেছে পৃথিবীর পথে পথে। জার্মানিতে নাৎসী সমর নায়ক হিটলার ইহুদি মানুষগুলোকে ধরে ধরে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে বিনা দোষে মেরে ফেলেছে। শোনা যায় তাদের সংখ্যা দশ লক্ষেরও বেশী।
আর আমরা নমঃ মানুষ, ওপারে এক কোটি এপারে তিন। চার কোটি মানুষ মিলে এক সাথে উঠে দাঁড়ালে এক কোটি প্রাণের বিনিময়ে কী নিজেদের একটা দেশ গড়ে নিতে পারি না। এপারে আমাদের পরিচয় বাস্তুহারা শরণার্থী অনুপ্রবেশকারী রিফিউজি উদ্বাস্তু আর বাঙ্গাল। ওপারে ওদের পরিচয় বিধর্মী কাফের মালাউন হিঁদু। কোন পার-ই আমাদের আপনজন বলে স্বীকার করে না। তাহলে আমরা কোন পার এর? কোনো পার যখন আমাদের নয়, আমরা আমাদের জন্য একটা নতুন পার কেন গড়ে নিচ্ছি না? আশি লক্ষ যদি পারে, চারকোটি কেন পারে না?
বলছি বটে তবে আমিও জানি পারি না, পারে না; পারব না। কারণ আমরা যে জাতিতে বাঙালি। বলি বটে আমরা বীরের জাতি, কিন্তু ইতিহাস অন্য সাক্ষ্য দেয়।
আমাদের এক রাজা লক্ষণ সেন। দুপুরবেলায় কই মাছের ঝোল দিয়ে ভাত মেখে সবে মুখে তুলেছে। এমন সময় রাজদ্বারে এসে দাঁড়াল আঠারোজন তুর্কী সেনা। আঠারো হাজার নয় আঠারো শত নয় একশো আঠারো নয় শুধু আঠারো। রাজার আর ভাত খাওয়া হল না। কইমাছ পাতে পড়ে রইল। এঁটো হাত নিয়ে রাজা পিছন দরজা দিয়ে ছুট মেরে পালিয়ে গেলেন।
আমাদের এক নেতা এম.এন.রায়, আর এক নেতা রাস বিহারী বোস আর এক নেতা সুভাষ বোস–তারাও পালিয়েছিলেন দেশ ছেড়ে। পৃথিবীর অনেক দেশ যেমন রাশিয়ার লেনিন, চিনের মাও-সে-তুং, কিউবার ফিদেল কাস্ত্রো, ভিয়েতনামের হো চি মিন –এরা কিন্তু কেউই দেশ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যান নি। মাছের মধ্যে জলের মত তারা জনগণের সঙ্গে মিশে থেকেছেন জনগণকে সংগঠিত করেছেন লড়াই লড়েছেন। সবশেষে অর্জন করেছেন বিজয়। বাঙালি নেতাদের বেলা উল্টো। রাজার চোখ লাল হবার সাথে সাথে হাওয়া।
এক নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। দেশ ভাগের প্রাক্কালে নমঃশুদ্র মানুষদের বলেছিলেন তিনি, তোমরা কেউ দেশ ছেড়ে যেও না। আমি আছি তোমাদের সহায়। তার ভরসায় নমঃশূদ্ররা বড় সংখ্যায় রয়ে গেল ওপার বাংলায়। তারপর একদিন সেই অসহায় মানুষগুলোকে ফেলে যেভাবে ভেড়ার পালকে হিংস্র ক্ষুধার্ত বাঘের সামনে ফেলে রাখাল পালায়, তিনি পালিয়ে ভারতে চলে এলেন। নিজের প্রাণ তো বাঁচালেন, মরে গেল লক্ষ লক্ষ অসহায় নমঃ মানুষ। ওপারে থাকার উপায় নেই–এপারে আসার পথ নেই। চোরা পথে যদি বা আসে–আহার নেই আশ্রয় নেই, স্বীকৃতি নেই।