Site icon BnBoi.Com

সেইসব অন্ধকার – তসলিমা নাসরিন

সেইসব অন্ধকার - তসলিমা নাসরিন

১. প্যারিসের ডায়রি – ০১

জিল গনজালেজ ফরস্টার যেদিন এল আমার বাড়িতে, সেদিন অষ্ট্রেলেশিয়া কাপের খেলা হচ্ছে, খেলছে ভারত আর পাকিস্তান। জিলকে ইশারায় বসতে বললাম সোফায়, আমার মতই সে মন দিয়ে খেলা দেখতে লাগল। এক ঘন্টা কেটে গেল খেলা দেখেই। এই একটি ঘন্টা আমি জিলের সঙ্গে কোনওরকম কথা বলিনি, বলিনি কারণ আমি নিশ্চিত যে খেলার মাঝখানে কথা বললে ছেলে বিরক্ত হবে। আমাদের বাড়িতে এরকমই নিয়ম, আর যেসময় বিরক্ত কর কর, খেলা দেখার সময় নয়, বিশেষ করে ক্রিকেট খেলার সময় নয়, আরও বিশেষ করে সে খেলা যদি ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে হয়। জাদেজা শূন্য করে বিদেয় হল। শচিনও বাইশ না তেইশ করে প্যাভিলিয়নে ফিরে গেল। আজহার তিন করে শেষ। এরপর ধুত্তুরি বলে খেলা থেকে চোখ সরিয়ে জিল কোন দলের সমর্থক তা জানতে চাই। প্রশ্ন শুনে বোকা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করে–এই খেলার নাম কি?

খেলার নাম কি মানে? তুমি জানো না কী খেলা এটি! আকাশ থেকে আমার সত্যিকার পড়া যাকে বলে।

জিল মাথা নাড়ে। সে জানে না। খেলার মাথামুণ্ডু কিছুই সে বোঝেনি।

বলে কি! ইউরোপের ছেলে, ইংলেন্ডের পাশের দেশে তার দেশ, আর সে কি না ক্রিকেট কি, কাকে বলে তার কিছুই জানে না! না, জানে না! ক্রিকেট খেলা জিল তার বাপের জন্মে দেখেনি, শোনেওনি ক্রিকেট বলে একটি খেলা আছে এই জগতে। একবার কবে কোথাও শুনেছিল ইংরেজরা একটি খেলা খেলে, যে খেলায় বেশির ভাগই খেলোয়াড়ই মাঠের মধ্যে ভূতের মত দাঁড়িয়ে থাকে, একজন বা দুজন কেবল দৌড়োয়; সেই উদ্ভট খেলাটির নামই যে ক্রিকেট, তা আজ সে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছে।

তাহলে এক ঘন্টা যে মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখলে!

দেখলাম! কী আর করতে পারি! তুমি তো কথা বলছিলে না। তুমি ব্যস্ত।

হায় কান্ড।

আমি ভেবেছিলাম আমার চেয়ে জিলই বুঝি বেশি উপভোগ করছে খেলা। যাই হোক, যখন কথা বলার সময় হল, তখন বেচারার যাওয়ার সময়ও হল। হাতে মাত্র একঘন্টা সময় নিয়ে সে এসেছিল আমার বাড়িতে। বলল কাল সে আমাকে নিয়ে যাবে ফরাসি দূতাবাসে। এই দূতাবাসেই আমি আগে গিয়েছিলাম ভিসার জন্য। আমাকে পাঠানো রিপোর্টার্স সাঁ ফ্রন্টিয়ার্স আর আর্তে টেলিভিশনের আমন্ত্রণ দেখেও দূতাবাসের লোকেরা কঠিন কণ্ঠে বলে দিয়েছে যে এসব আমন্ত্রণে কাজ হবে না, ভিসা হবে না। কেন হবে না, কী কারণ, তার কিছুই বলেনি। ভিসা হবেনার খবর শুনে রিপোর্টাস সাঁ ফ্রন্টিয়ার্সের লোকেরা জিলকে পাঠিয়ে দিয়েছে প্যারিস থেকে ঢাকায়, যেন ভিসার ব্যবস্থা করে আমাকে নিরাপদে নির্বিঘ্নে প্যারিস নিয়ে পৌঁছোয়।

জিল আমাকে পরদিন দূতাবাসে নিয়ে গিয়ে ভিসা পাইয়ে দিল। যে ভিসা দিতে চায়নি দূতাবাস, সেই ভিসাই কী চমৎকার দিয়ে দিল। যে জিনিসটি হবে না বলে জানি, সেটি কী যে কী অজ্ঞাত কারণে মাঝে মাঝে হয়ে বসে থাকে! জিল টিকিট নিয়ে এসেছে। ঢাকা থেকে থাই এয়ারলাইন্সে ব্যাংকক হয়ে এয়ার ফ্রান্সে প্যারিস। যে আমার পাসপোর্টই ছিল না, সে আমার পাসপোর্ট হয়েছে, দুর্লভ পাসপোর্টে দুর্লভ ভিসাও জুটে গেছে। পাসপোর্টটি কখনই হয়ত পেতাম না যদি না বিদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো তাদের সরকারকে চাপ দিত আমার পাসপোর্ট ফেরত পাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য। পাসপোর্ট ফেরত পাওয়ার আশা আমি আসলে একরকম ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু আমেরিকা নাক গলালে হুকুম নড়ে তো হাকিম নড়ে না প্রবাদটি বোধহয় অচল হয়ে যায়। আমার বিশ্বাস, এই অসম্ভবটি সম্ভব করার পেছনে লেখক সংগঠন পেন এর ভূমিকা আছে, পেন যদি প্যানপ্যান না করত, তবে আমেরিকার সরকার মোটে সজাগ হত না। ফতোয়ার খবর, মোল্লাদের আন্দোলনের খবর তো আছেই, নিউ ইয়র্ক টাইমসে লেখা আমার উপসম্পাদকীয়টিও সম্ভবত অনেকটা কাজ করেছে আমার ব্যাপারে আমেরিকার সরকারের উদ্যোগী হওয়ার। তা না হলে তাদের কি দায় পড়েছিল বাড়ি বয়ে এসে আমার পাসপোর্টের ব্যবস্থা করে যাওয়ার! কত মানুষের ওপর এ দেশে অন্যায় হচ্ছে, কত নিরপরাধ মিছিমিছি জেলে পচে মরছে, কত মানুষকে উদ্বাস্তু বানানো হচ্ছে, দেশছাড়া করা হচ্ছে, কই তাদের সাহায্য করার জন্য আমাদের আমেরিকান অ্যান্ড্রু সাহেব কি দৌড়োদৌড়ি করছেন কিছু!

সুটকেসে কাপড় চোপড় গুছিয়ে নিলাম। এপ্রিলে এখানে গরমে সেদ্ধ হলেও ওখানে তো অন্তত শীত শীত আবহাওয়ার মধ্যে পড়তে হবে। তবু শাড়ি নিলাম কিছু। প্যান্ট সার্ট ভাল তেমন নেই আমার। লালমাটিয়ায় গিয়ে ছোটদার কাছ থেকে তাঁর একটি কোট নিয়ে এলাম। দু তিনটি সার্ট প্যান্টও নিলাম। গায়ে আমার ঢ্যালঢ্যাল করে ওসব, কিন্তু চলে। বাড়ি কেনার পর টাকা পয়সার অত ছড়াছড়ি নেই যে নতুন কাপড় কিনব।

জিল মোটা একটি বই নিয়ে এসেছে আমার জন্য। রিপোর্টার্স সাঁ ফ্রন্টিয়ার্স বের করেছে। পৃথিবীর কোথায় কোথায় লেখক সাংবাদিকদের কলম কেড়ে নেওয়া আছে, কাকে জেলে ঢোকানো হচ্ছে, কাকে পেটানো হচ্ছে, কাকে মেরে ফেলা হচ্ছে, তার খবর। বাংলাদেশ সম্পর্কে লেখা, দেশটি অতি দরিদ্র। বন্যা ঘূর্ণিঝড় দারিদ্র পীড়িত এই দেশে একজন লেখক আছে, তাকে মৌলবাদীরা আক্রমণ করছে। সরকার তার বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, তার পাসপোর্ট আটক করেছে। জিল বলল,জ্ঞবাংলাদেশে এই আমি প্রথম এলাম। এ দেশ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না আমরা। কেবল তোমার কথা জানি। প্যারিসে তোমার সঙ্গে দেখা করতে অনেকেই আসবে, সবাই ওরা তোমার সম্পর্কে জানে। আমরা তোমাকে জানতে চাই। তোমার বই পড়তে চাই।’ জিল এখানকার কিছু সাংবাদিকদের সঙ্গে সংবাদপষেনর স্বাধীনতা বিষয়ে কথা বলেছে। জিলকে নিয়ে শামসুর রাহমানের বাড়ি ঘুরে এসে শেরাটন হোটেলের ক্যাফেতে বসে চা খেতে খেতে জানতে চাইলাম এখানকার সাংবাদিকদের তার কেমন লেগেছে? জিল পকেট থেকে কিছু নামের কার্ড বের করে বলল এদেঁর সঙ্গে সে কথা বলেছে। নামগুলোর মধ্যে একটি নামই আমি পেলাম চেনা। মুহম্মদ জাহাঙ্গীর।

–এ লোকটি নিশ্চয়ই আর সবার চেয়ে ভাল?

জিল কাঁধ নাড়িয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ‘এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার মাত্র কয়েকমিনিট কথা হয়েছে, বললেন, তোমরা ধনী দেশ, তোমরা এই গরীব দেশের সাংবাদিকদের জন্য টাকা পাঠাচ্ছে! না কেন! টাকা পেলে এখানকার সাংবাদিকদের অনেক সুবিধে হবে। টাকা পাঠাও যদি সত্যিই সাংবাদিকদের জন্য কিছু করতেই চাও।’

জিলের সংগঠনটি, আমি যদ্দুর বুঝি যে কাউকে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করার জন্য নয়। সাংবাদিকদের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করার জন্য সংগঠনটি। সাংবাদিকরা যেন স্বাধীনভাবে যে কোনও খবরই পরিবেশন করতে পারেন, তাঁদের যেন এ কারণে কেউ হেনস্থা করতে না পারে, তাঁদের যেন কেউ ঝামেলায় ফেলতে, জেলে ভরতে না পারে। তাঁদের যেন কণ্ঠরোধ করা না হয়, তাঁদের কলাম যেন কেড়ে নেওয়া না হয়। সংগঠনটির কাজ বিভিন্ন দেশের সাংবাদিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, সংবাদপষেনর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। এ দেশের সাংবাদিক সম্বন্ধে ধারণা দেওয়ার আগেই জিলের ধারণা জন্মে গেছে।

জিল যে বাড়িতে উঠেছে, বাড়িটি এক বাঙালি ভদ্রলোকের, বউ ফরাসি। এর আগে প্যারিসের গামা ফটো এজেন্সি থেকে জিল সসেয়ার এসেছিল, সেও গুলশানের এ বাড়িটিতে ছিল। সেই জিলের সূত্র ধরেই এই জিল এ বাড়িতে উঠেছে। সেই জিল কয়েক হাজার ছবি তুলে নিয়ে গেছে আমার, এমনকী আমাকে নিয়ে ময়মনসিংহে গেছে, অবকাশে পরিবারের সবার সঙ্গে ছবি তুলেছে, বিশেষ করে মার সঙ্গে। ছাদে। মার সঙ্গে ছবি? মা অপ্রস্তুত ছিলেন। মার তো কখনও এভাবে কখনও ছবি তোলা হয় না। মাকে গুরুত্ব দেওয়াটা বাড়ির সবাইকে তো বটেই, মাকেও অবাক করেছে। এখন এই জিল, জিল গনজালেজ গুলশানে। এ বাড়িতে সেদিন অনেককে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল, নিমন্ত্রিত বাঙালি অতিথিদের জিল বড় গর্ব করে বলেছে, তোমাদের তসলিমাকে আমি প্যারিসে নিয়ে যেতে এসেছি। ওখানে ওর অনুষ্ঠান আছে। আর্তে টেলিভিশনে ও প্রেস ফ্রিডম সম্পর্কে বলবে। শুনে, জিল বলল, ওরা মোটেও খুশি হয়নি, বরং বলেছে, ওর লেখা তো আমরা পছন্দ করি না।

জিল সাত ফুট লম্বা। মেদহীন ছিমছিমে শরীর। নীল চোখের সোনালি চুলের আশ্চর্য সুন্দর যুবক। ছবির দেশের কবিতার দেশের যুবক। জিল বলে, ফরাসিরা খুব সরল। জটিলতা কম বোঝে। এটি আমার খুব যে বিশ্বাস হয়েছে, তা নয়। এলিজাবেথকেই তো দেখেছি। ফ্রান্স থেকে এসেছিল আমার ওপর একটি তথ্যচিত্র করতে। বড় রহস্যময়ী। বিশাল বিশাল ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে এলিজাবেথের পেছন পেছন এসেছিল ফিলিপ। আমার সাক্ষাৎকার নেওয়ার মাঝখানে মাঝখানে ফিলিপ আর এলিজাবেথ আড়ালে গিয়ে ফরাসি ভাষায় কথা বলে। আমি সামনে গেলেই কথা বন্ধ করে ফেলে। আরে বাবা, বলে যাও, আমি কি আর ফরাসি ভাষা বুঝি! এলিজাবেথ আমাকে সিলেটের সাহাবা সৈনিক পরিষদের হাবীবুর রহমানের কথা জিজ্ঞেস করল, যা জানি তা জানালে বলেছিল যাবে সে সিলেটে। সিলেটে যাবে? কি করে ওখানে হাবীবুর রহমানকে খুঁজে পাবে? আমার প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে এলিজাবেথ আবার ফিলিপের সঙ্গে ফিসফিস করল। এরপর আমাকে একেবারে সাফ সাফ জানিয়ে দিল, আসলে তাদের সময় নেই সিলেটে যাবার, তারা যাচ্ছে না। আসলে কিন্তু সিলেটে তারা গিয়েছিল। পত্রিকায় দেখেছি খবর। আমার কাছে লুকোনোর কী কারণ থাকতে পারে আমার বোঝা হয়নি। জটিলতা হয়ত জিল কম বোঝে।

শেষ রাত্তিরে বিমান উড়বে আকাশে। আমাকে বিমান বন্দরে পৌঁছে দেবার জন্য সাহাবুদ্দিন আমার বাড়িতে রাত কাটালেন। জিলকে গুলশান থেকে তুলে নিয়ে বিমান বন্দরে গেলাম, রাত তখন তিনটে কি চারটে। গিয়ে শুনি সময় মত আমরা বিমানে চড়তে পারছি না, দেরি হবে তিন ঘন্টা। রাতে আমার ঘুম হয়নি, জিলেরও হয়নি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বিমানে ঘুমোবো। ক্লান্তিতে নুয়ে আসছিল শরীর, রেস্তোরাঁর এক কোণায় তিনটে করে চেয়ার সাজিয়ে আমরা শুয়ে পড়লাম। এমন জায়গায় শুলেই তো ঘুম আসে না। দুজন গল্প করতে শুরু করলাম। জিল এই প্রথম এশিয়ার কোনও দেশে এসেছে। বিমান বন্দরটি সম্পর্কে বলল, ইস কী ছোট বন্দর, মাত্র কটা মাত্র বিমান! কেমন লেগেছে ঢাকা শহরটি দেখতে! বলল, খুব ভিড়, রিক্সার, মানুষের। বলল, প্যারিসে কেবল গাড়ি। গাড়ি আর গাড়ি। গাড়ির কথায় এও বলল যে ওখানে সবাই নিজে গাড়ি চালায়। ড্রাইভার রাখে না। খুব ভিআইপি হলে রাখে। যেমন? যেমন প্রেসিডেন্ট, প্রাইম মিনিস্টার। আমার গাড়ির ড্রাইভার দেখে জিল বলেছিল, তুমি খুব ধনী। শুনে হেসে বাঁচি না। না, ধনী হতে হয় না। এখানে সবাই ড্রাইভার রাখে। ড্রাইভারের বেতন এখানে তো খুব বেশি নয়, তাই রাখতে পারে। আমার বাড়িতে, প্রথমদিনই জিল বলেছিল, জ্যোৎস্না নামের ন বছর বয়সী মেয়েটিকে দেখে, যে চা দিয়েছিল আমাদের, ও কি তোমার ভাই?

না, ও এখানে কাজ করে।

কাজ করে? জিল অবাক হয়। কাজ করার মানুষ যারা রাখে, তারা তো খুব ধনী হয়, জিলের ধারণা।

জ্যোৎস্নার ন্যাড়া মাথা দেখে জিল বলে, ওর মাথায় চুল নেই কেন?

চুল ফেলে দেওয়া হয়েছে, আবার ভাল চুল গজাবে বলে।

ভাল চুল গজাবে! জিলের নীল চোখদুটো অনেকক্ষণ বড় হয়ে ছিল বিস্ময়ে। কানাডার মেয়ে লীনাও অবাক হয়েছিল ভালবাসার ন্যাড়া মাথা দেখে। ওকে পরে আমি বুঝিয়ে বলেছি, এখানে এরকম একটি বিশ্বাস চালু আছে যে যত বেশি চুল কাটা হয় বাচ্চাদের, তত ঘন ও কালো চুল গজায়। এটির পেছনে কোনও বৈজ্ঞানিক কারণ আছে বলে আমার জানা নেই। জিলের আরও একটি ধারণা দেখে আমি হেসেছিলাম। মৌলবাদীদের একটি মিছিল দেখে জিজ্ঞেস করেছিল, ওরা কি মুসলিম?

জিল মুসলিম বলতে মৌলবাদী বোঝে। ক্রিশ্চান মৌলবাদীদের ও ক্রিশ্চান বলে। ক্রিশ্চান শব্দটি উচ্চারণের সময় ওর নাক কুঁচকে ওঠে। মুসলিম শব্দটি ভয়ংকর একটি শব্দ, ওর উচ্চারণে আমি তা অনুমান করি।

রেস্তোরাঁয় চেয়ার পেতে শুয়ে আর কতক্ষণ থাকা যায়! উঠে হাঁটাহাঁটি করে সময় কাটাতে থাকি। বিমান বন্দরের জানালায় দাঁড়িয়ে আমরা যখন দেখছিলাম বিমান উড়ছে, নামছে, সৌদিয়া, পিআইএ, বাংলাদেশ বিমান, জিল মন্তব্য করল, দেখেছো সব বিমানগুলোয় সবুজ রং!

তাতে কি?

সবুজ হচ্ছে ইসলামের প্রতীক। সব মুসলিম দেশের পতাকাতেই সবুজ রং থাকে।

আমি তো জানি সবুজ হচ্ছে তারুণ্যের রং। সবুজ হচ্ছে প্রকৃতির রং।

তুমি দেখো, সব মুসলিম দেশেরই পতাকায় সবুজ আছে। কিছু না কিছু সবুজ আছেই।

আমি মাথা নেড়ে বললাম, না। ঠিক বলনি। তুরস্কের পতাকায় নেই।

জিল মাথা চুলকোয়। এটি তার মাথায় ছিল না।

তুরস্ক ছাড়া সব মুসলিম দেশের পতাকায় সবুজ আছে।

খানিকক্ষণ ভেবে বলি, মালোয়েশিয়ায় নেই, তিউনেশিয়ায় নেই। কাতারের পতাকায় নেই।

অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে জিল বলে, গুনে দেখবে বেশির ভাগ দেশগুলোতেই আছে।

অনেক অমুসলিম দেশের পতাকায় সবুজে ভর্তি। ব্রাজিল। ভারত। বুলগেরিয়া। আয়ারল্যাণ্ড। ইতালি। মেক্সিকো। দক্ষিণ আফ্রিকা। আমি নিশ্চিত, আরও অনেক দেশে আছে।

হ্যাঁ থাকতে পারে। কিন্তু মুসলিম দেশের পতাকায় বেশি।

বাংলাদেশের পতাকার সবুজের ব্যাখ্যাটি করে দিলাম, বাংলাদেশ ইসলামিক দেশ নয়। এখনও দেশটির নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। পতাকার সবুজ হচ্ছে আমাদের সবুজ প্রকৃতি।

বাংলাদেশ ছাড়ার আগে জিল সাংবাদিকদের সঙ্গে তার অভিজ্ঞতার কথা বলে। বলে যে অনেক সাংবাদিকের সঙ্গেই তার কথা হয়েছে। আমার সম্পর্কে ওদের সে জিজ্ঞেস করেছে। ওরা অদ্ভুত করে নাকি হেসেছে। বলেছে, ও তো পুরুষ বিদ্বেষী। ও যে রকম নারী স্বাধীনতার কথা বলে, সেটি এ দেশের জন্য খাটে না। জিল আমাকে জিজ্ঞেস করে, সরল জিজ্ঞাসা, সাংবাদিকদের ভ্রূ কুঞ্চন হয় কেন আমার নাম শুনলে? জিল ওদের ভ্রূ কুঞ্চন দেখে বেশ আহত হয়েছে। কী জানি, মনে মনে ভাবছে বোধহয় যে আমাকে এতটা সম্মান জানাতে প্যারিস অবদি নিয়ে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না। আমি সংকোচে চোখ ফিরিয়ে নিই। জিলের মুখখানার দিকে তাকিয়ে আমার বোঝা হয় না কোনও অনুশোচনা হচ্ছে কি না তার। বোধহয় হচ্ছে, বোধহয় হচ্ছে না। আমি এই হচ্ছে আর হচ্ছে নার মাঝখানে দুলতে থাকি একা একা। এখানকার সাংবাদিকদের চরিত্র আমি বেশ জানি, তারা কি বলল না বলল তা নিয়ে আমি মোটেও মাথা ঘামাই না। জিলের জন্য আমার মায়া হতে থাকে। সে কষ্ট পাক, চাই না।

ব্যাংককে পৌঁছে দেখি আমাদের ন কি দশ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হবে প্যারিসের বিমান ধরার জন্য। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বিমান বন্দরে দুটো ঘর নেয় জিল। জিল দুটো ঘর নেয় কেন? ছ ঘন্টায় একটি ঘর চল্লিশ ডলার করে। এত টাকা খরচা করার কোনও মানে নেই। একটি ঘরেই আছে দুটো বিছানা। এতেই তো দুজনের চলত। কি জানি এ বোধহয় সভ্য দেশের বিশেষত্ব। ঢাকা বিমান বন্দরে এক শাদা লোককে দেখিয়ে জিলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, লোকটি কি ফরাসি? জিল এক পলক দেখেই সোজা বলে দিল, না।

–না বললে কেন? কি করে বুঝলে যে লোকটি ফরাসি নয়? ফরাসিদের চেহারায় কি বিশেষ কোনও কিছু আছে?

নিশ্চয়ই, বলে রেস্তোরাঁয় কয়েকটি শাদা লোকের দিকে তাকিয়ে ফট করে একটিকে দেখিয়ে বলে দিল, ওই লোকটি ফরাসি।

তাই বুঝি!

ফিরে ফিরে তাকিয়ে কিছু একটা বিশেষত্ব খুঁজছিলাম চেহারায়, আচার, আচরণে। আছে কি? হুঁ, তা আছে বটে কিছু।

যদিও বিশ্রামের জন্য আমরা ঘর নিয়েছিলাম, ঘুম আমারও হয়নি, জিলেরও হয়নি। আমরা আবার সিদ্ধান্ত নিই, বিমানে ঘুমোবো। বন্দর ঘুরে জিলের জন্য চকলেট কিনেছি। দেখে খুশিতে ফেটে পড়ে। আমি যখন বিশ্রাম নিচ্ছিল!ম ঘরে, তখনই জিল দুজনের পাসপোর্ট আর টিকিট দেখিয়ে দুটো বোর্ডিং কার্ড নিয়ে নিয়েছে। পরে আমাকে মন খারাপ করে বলল, বোর্ডিং কার্ড দিচ্ছে যে মেয়েটি, জিজ্ঞেস করেছে জিলকে, আপনার হাতে বাংলাদেশের পাসপোর্ট কেন? কে এই বাংলাদেশি মেয়ে? একে আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছি প্যারিসে। উত্তর শুনে মেয়েটি জিলের দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়েছে। অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখেছে, একে ওকে ডেকে এনে পাসপোর্ট দেখিয়েছে। এসব শুনে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। বাংলাদেশের পাসপোর্টধারীদের কী ভীষণ ঘৃণা করে মানুষ! তারা যে কোনও দেশেই অবৈধ ভাবে ঢুকে যেতে পারে, এই আশঙ্কা সবার। আমি সেই দেশেরই মানুষ বেরিয়েছি পৃথিবীর পথে, যার দিকে দেশে দেশে লোকেরা সন্দেহের চোখে তাকাবে। জিল অনেকবার গৌরব করে বলেছে যে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দেশ ফ্রান্স, সবচেয়ে সুন্দর শহর প্যারিস। সে জার্মানি পছন্দ করে না, কারণ বড় শক্ত শক্ত নিয়ম কানুন ও দেশে, আমেরিকাও তার পছন্দ নয়, কোনও সংস্কৃতি নেই বলে। তবে, জিল, না বললেও বুঝি, যে, বাংলাদেশকে পছন্দ করে না। আর তার অপছন্দের দেশের, প্রচণ্ড গরীব আর সভ্য না হওয়া দেশের মানুষ আমি, আমাকেও নিশ্চয়ই সে পছন্দ করছে না। যদি করে কিছু, সে করুণা।

যখনই বিমানের ভেতর ঢোকার জন্য লোকদের ঠেলাঠেলি ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল, জিল জোরে হেসে উঠে বলে, ‘এরা এমন পাগল হয়ে যাচ্ছে কেন আগে যাওয়ার জন্য, আগে গেলে কি ভাল জায়গায় বসতে পারবে নাকি?’ আমাদের মধ্যেই আগে যাওয়ার কোনও তাড়া ছিল না। আগে গেলেও পরে গেলেও ওই বাহান্নো নম্বর আসনেই বসতে হবে। বিমানের ভেতরে দুজন পাশাপাশি বসে এয়ার হোস্টেসদের দিয়ে যাওয়া কমলার রস পান করছি যখন, জিল বলল, জ্ঞখেয়াল করেছো, এয়ার হোস্টেসদের হাসিগুলো? কি রকম কৃত্রিম হাসি, দেখেছো! যেন রোবটের মুখে হাসি বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ রসের গেলাস যখন নিতে এল আরেক এয়ার হোস্টেস, মোটেও না হেসে, জিল আমার কানের কাছে মুখ এনে আস্তে বলে, ‘এ এখনও ট্রেইনি, নকল হাসি রপ্ত করতে শেখেনি।’ ঘুম আমাদের, যা ভেবেছিলাম, হবে, হয়নি। ওরকম বসে বসে কি ঘুমোনো যায়! ঘুমোতে চেষ্টা করে আমারও ঘুম হয়নি, জিলেরও হয়নি। বিমান চলছে কাঠমুণ্ড দিল্লি হয়ে পাকিস্তান আফগানিস্তান পার হয়ে প্যারিসের দিকে। জানালা খুলে দিলে ঝাঁক ঝাঁক আলো এসে সম্ভাষণ জানায়। প্যারিসে যখন নামলো বিমান, চলমান সিঁড়িতে নয়, তুমি হাঁটছো চলন্ত কার্পেটের ওপর দিয়ে, ওতে আর সবার মত হাঁটতে গিয়ে যেহেতু অভ্যস্ত নও, হুমড়ি খেয়ে পড়তে নিয়েছো বেশ কবার। খুব দ্রুত এক দালান থেকে আরেক দালানে পারাপারের জন্য এই যান্ত্রিক ব্যবস্থাটি করেছে ফরাসিরা। কিন্তু বন্যা ঘূর্ণিঝড় আর দারিদ্রপীড়িত দেশের মানুষ এসব যান্ত্রিক জিনিসে কি করে য়চ্ছন্দ হবে! কোনও কারণ নেই। হাঁ হয়ে দেখি বন্দরটি। কি বিশাল! কি বিশাল! বন্দরের নাম শার্ল দ্য গোল। বন্দরটিতে হাজার হাজার মানুষ ছুটছে, মিনিটে মিনিটে বন্দরের উঠোনে বিমান নামছে, উঠোনে বসে থাকা বিমান উড়ে যাচ্ছে। এই আছে, এই নেই। চোখের পলকে দৃশ্যগুলো বদলে যাচ্ছে। ছোটোবেলায় দেখা বায়স্কোপের ছবির মত। এমন দৃশ্য সত্যিকার এই প্রথম দেখছি জীবনে। আমাকে স্বাগতম জানানোর জন্য অপেক্ষা করছিলেন রিপোর্টার্স সাঁ ফ্রন্টিয়ার্সের প্রধান রবার্ট মিনার্ড। জিল যাকে হোবিয়া মিনা বলে, অন্তত আমার কানে এরকমই শোনা যায়। রবার্ট মিনার্ড আর হোবিয়া মিনা যে এক ব্যক্তি তা আমার পক্ষে প্রথম বোঝা সম্ভব হয়নি। আমি জানি যে ফরাসি উচ্চারণ ঠিক বানানের মত হয় না। বানানে রিমবাউড হলেও ফরাসি কবির নাম র‌্যাঁবো, তারপরও শুনি র‌্যাঁবোও ওরা আমাদের মত উচ্চারণ করে না, কান পাতলে শোনা যাবে খ্যাঁবো। ওদের সম্পর্কে পড়ে আর শুনে জানা এক জিনিস, আর ওদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ওদের সম্পর্কে জানা আরেক জিনিস। হোবিয়া মিনা আমাকে জড়িয়ে ধরে দু গালে চুমু খেলেন। আমি ভীষণ অপ্রস্তুত। অনভ্যাসে কাঠ হয়ে ছিলাম। চকিতে সরিয়েও নিয়েছিলাম মুখ যখন তাঁর মুখ আমার মুখের দিকে এগিয়ে আসছিল। জানতাম ফরাসিরা গালে চুমু খায়, কিন্তু চুমুর সামনে পড়লে মাথার এই জানা বিদ্যেটা চড়ুই পাখির মত উড়ে যায়। হোবিয়া মিনা একটি অক্ষর ইংরেজি জানেন না। আমাদের মধ্যে দোভাষীর কাজ করছে জিল।

বন্দর থেকে বাইরে বেরোলেই তেরো ডিগ্রি সেলসিয়াস। একটি শীত শীত সুই আমার গায়ে বিঁধল এসে। জিল তার গায়ের কোটটি খুলে আমার পিঠে ছড়িয়ে দিল। আমরা গাড়ি করে প্যারিসের দিকে যাচ্ছি। গাড়ি খুব দ্রুত চলছে, সব গাড়িগুলোই খুব দ্রুত চলে এখানে। হোবিয়া মিনা আর জিল দুজন অনর্গল কথা বলছে, জিল দেখছি নোট করে নিচ্ছে যা যা কথা হচ্ছে, লম্বা একটি কাগজ ভরে গেল লিখতে লিখতে। মাঝে মাঝে জিল আবার অনুবাদ করে দিচ্ছে আমাকে, ‘তোমার সঙ্গে একজন দেখা করতে চাইছে, এডিশন দ্য ফাম থেকে, উনি আবার মন্ত্রীও।’ ফ্রান্সের মন্ত্রী দেখা করতে চাইছে! অবাক হই। আমি কি মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার যোগ্য! এরা হাজার বছরের শিক্ষিত। আর আমার বংশে আমার নানা দাদা দুজনই টিপসই এর চেয়ে বেশি যা পারতেন, তা নিজের নামখানা লিখতে কেবল। আমার বিশ্বাস হতে চায় না আমি এই জায়গায় এসে পৌঁচেছি। বিশ্বাস হতে চায় না পৃথিবীতে এমন সুন্দর কোনও শহর থাকতে পারে। নিজেকে ভুলতে থাকি আমি। আমার ভেতরে আর আমি নেই। যেন অন্য কেউ, অন্য কেউ অন্য কোনও গ্রহে। অথবা যেন ছবি সব। যেন এসব সত্য নয় প্যারিসের ভেতর যখন আমাদের গাড়ি চলছিল, ছবির মত লাগছিল। ছবিতে দেখেছি এমন সব দৃশ্য। প্যারিসে ঢোকা না তো আশ্চর্য সুন্দর একটি ছবির মধ্যে ঢুকে পড়া। এমন সুন্দর চারদিক, যে দেখতে দেখতে শ্বাস নিতে ভুলে যাচ্ছি। প্যারিসে শুনেছি বিখ্যাত অনেক যাদুঘর আছে, কিন্তু পুরো প্যারিসই যে আস্ত একটি যাদুঘর, তা আমার জানা ছিল না আগে।

আমার ঘোর কাটে না। আমার বিস্ময় কাটে না। যত দেখি প্যারিস, তত আরও দেখতে ইচ্ছে করে। শহরটিকে কুড়ি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। কিছু এলাকাকে বলা হয় ধনী এলাকা, কিছু এলাকাকে গরিব এলাকা। বেলভিল নামের এক গরিব এলাকা যখন আমাকে দেখানো হল, আমি আতি পাতি করে দারিদ্র খুঁজছিলাম। বিশাল বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট বাড়ি, বাড়িতে যারা থাকছে প্রায় সকলেরই গাড়ি আছে, সকলের পরনে সার্ট প্যান্ট, সকলের পায়ে জুতো, এরা আবার গরিব হবে কেন!

–গরিব এলাকা দেখাবে বলেছিলে? জিলকে জিজ্ঞেস করি।

–ওই তো দেখালাম। এতক্ষণ কি দেখলে!

–একে তোমরা গরিব এলাকা বল! আমি হেসে উঠি। আমার চোখে দেখা আর ফরাসিদের চোখে দেখা দারিদ্রে আকাশ পাতাল পার্থক্য।

জিল আমাকে নিয়ে গেল একটি ব্রাসারিতে দুপুরে খাওয়াতে। ব্রাসারির ভেতর একটি বার। তাকে সারি সারি মদের বোতল সাজানো। জিল জানি না কি খাবার দিতে বলেছে দুজনের জন্য। অদ্ভুত খাবার, কখনও খাইনি আগে। আমার পক্ষে খাওয়া সম্ভব হয় না। ক্ষিধে ছিল পেটে, কিন্তু মন এমন ভরে আছে প্যারিসের সৌন্দর্যে! পেটের ক্ষিধে যে কোথায় উবে গেছে কে জানে।

জিল আমাকে নিয়ে গেল শাঁ জার্মা দি প্রের একটি ক্যাফেতে। বিখ্যাত ক্যাফে। ক্যাফে দ্য ফ্লোর। জিলের বোন দোমিনিক অপেক্ষা করছিল ওখানে আমাদের জন্য। ক্যাফেটিতে একসময় জ্যাঁ পল সাষর্ন আর সিমোন দ্য বোভোয়া বসতেন, আড্ডা দিতেন, লিখতেন, সাহিত্য আর দর্শন নিয়ে বক্তৃতা করতেন। ওঁদের নাম লেখা আছে চেয়ারের পিঠে, যে চেয়ারে দিনের পর দিন বসে কাটিয়েছেন। দোমিনিক আর জিলের মধ্যে খুব বন্ধুত্ব। একজন আরেকজনের প্রশংসা করছে, আড়ালে। আর সামনে খুনসুঁটিতে ব্যস্ত। দুজন বড় হয়েছে হিপি পরিবারে। মা স্প্যানিশ গনজালেজ আর বাবা জার্মান ফরস্টার পরিবারের। হিপিরা সমাজের কোনও নিয়ম মেনে চলত না। জিল আর দোমিনিক ছোটোবেলায় বাবা মার কোনও রকম শাসন পায়নি। কোনো নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে ওরা জীবন যাপন করত না। কেউ বলেনি ওদের নাও খাও, পড়তে বসো, ঘুমোতে যাও বা কিছু। যখন যা ইচ্ছে করে জিলরা তাই করেছে। বাবা মাও তেমন। যেমন ইচ্ছে তেমন জীবন যাপন করেছে। কোনও বাঁধাধরা নিয়ম ছিল না কিছুতে। জিলের বাবা মা কখনও বিয়েই করেনি। ছেলেমেয়েরা বাবা মাকে নাম ধরে ডাকত। জিলও তার মাকে ক্লদিয়া বলে ডাকে। আশ্চর্য, ওই পরিবেশে বড় হয়েও জিল তার বাবা মা আর বোনের জন্য কি গভীর ভালবাসা পুষে রাখে। ওরাও জিলের জন্য।

যখন আমাকে জিজ্ঞেস করা হল, কী দেখতে চাই প্যারিসে। প্রথমেই আমি বললাম, মিউজিয়াম। র‍্যোঁদার ওপর একটি বই পড়া আছে আমার। র‍্যোঁদার ভাস্কর্যগুলো এখনও মনের ভেতর। জিল আর দোমিনিক আমাকে নিয়ে গেল র‍্যোঁদা মিউজিয়ামে। খুব সুন্দর এই মিউজিয়াম। র‍্যোঁদার ভাস্কর্যগুলো সামনে থেকে দেখি আর ভেবে কূল পাই না কি করে পাথর কেটে কেটে এমন সব আশ্চর্য সুন্দর মূর্তি গড়তে পারে কেউ। র‍্যোঁদার পুরো জীবনটি আমার চোখের সামনে ভাসতে থাকে। কি করে তিনি তার মডেল কন্যাদের ব্যবহার করেছেন কাজে। কামি কদেলকে খুঁজি তাঁর কাজে। ইচ্ছে করে ছুঁয়ে দেখি। না, এখানে কিছুই স্পর্শ করা যাবে না। ক্যামেরায় ছবি তুললে ফ্লাশ বন্ধ করে তুলতে হয়, কারণ ওই আলোয় শিল্পকর্ম নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কোথাও কোথাও এমন আছে যে হাজার বছর আগের গুহার ছবিগুলো দেখাও এখন সাধারণ মানুষের জন্য নিষিদ্ধ, কারণ মানুষের শ্বাস প্রশ্বাসের কারণে ছবি মলিন হয়ে যায়। মিউজিয়ামের বাইরে রাখা আছে র‍্যোঁদার ভাবুক মূর্তিটি। হাঁটুর ওপর কনুই রেখে চিবুকের নিচে হাত রেখে ভাবছে মানুষটি। রাখা নরকের দ্বারও। র‍্যোঁদার ভাস্কর্য দেখা শেষ হলে জিল নিয়ে গেল ভিক্টর উগোর বাড়িতে। প্লাস দ্য বোজ এ। মাঝখানে একটি মাঠ, আর চার কিনারে একরকম সব বাড়ি। এলাকাটি ধনী এলাকা। ধনীরা থাকতেন একসময়, এখনও ধনীরাই থাকেন। বাড়িগুলো মোটেও আমাদের বাড়ির মত নয়। এসব বাড়িতে কোনও ছাদ নেই। কেউ বিকেলবেলা ছাদে ওঠে না। ছাদগুলো কালো ইস্পাত বা সবুজ কপারে মাথা মুড়ে আছে, মাথার তলে ছোট ছোট ঘুলঘুলিগুলো পাখির নীড়ের মত। একসময় ওপরতলার ছোট ছোট ঘরে কাজের মেয়েরা থাকত। ফরাসি রেভুলেশনের পর শ্রেণীর তফাৎটি দূর হয়েছে। তুমি প্রভু, আমি ভৃত্য–এই ব্যাপার আর নেই। আহা এরকম একটি সমাজ যদি আমাদের দেশেও হত। ভিক্টর উগোর বাড়িটিতে তাঁর আঁকা ছবি, তাঁর লেখা পান্ডুলিপি দেখলাম। একটি জিনিস আমার খুব অবাক লেগেছে, তাঁর মেয়ে সেইন নদীতে পড়ে মারা যাওয়ার পর উগো এমনই ভেঙে পড়েছিলেন যে মেয়ের আত্মার সঙ্গে তিনি কথা বলতেন বলে ভাবতেন। টেবিলে টোকা পড়ত আর তিনি টোকাগুলো অনুবাদ করতেন। মাসের পর মাস বসে বসে অপ্রকৃতিস্থের মত কেবল অনুবাদ করতেন। মোটা মোটা খাতা ভরে ফেলেছেন লিখে মেয়ের আত্মার সঙ্গে তাঁর কথোপকথন। রবীন্দ্রনাথও প্ল্যানচ্যাট করতেন। জানি না বড় বড় মানুষগুলো বেশি বয়সে এসে এমন নির্বোধ হয়ে যান কেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ভিক্টর উগোর মিল অনেক। দুজনের মধ্যে বয়সে একশ বছরের তফাৎ। দুজনে সঙ্গীত ভালবাসতেন। দুজনে ছবি আঁকতেন। উগো প্রেমে পড়েছিলেন তাঁর দাদার প্রেমিকার, আর রবীন্দ্রনাথ প্রেমে পড়েছিলেন তাঁর দাদার স্ত্রীর। উগো কন্যার মৃত্যুতে শোকে বিহ্বল ছিলেন। রবীন্দ্রনাথও। দুজনই মানবতার কথা বলতেন।

ল্যুভর মিউজিয়ামটি সেইন নদীর পাড়ে। আশ্চর্য ‌এই মিউজিয়ামটি বাইরে থেকে ঘন্টার পর ঘন্টা দেখলেও দেখা ফুরোবে না। এমনই নিখুঁত স্থাপত্য এর। বিশাল এই বাড়িটির গায়ে গায়ে মূর্তি বসানো। হোটেল দ্য ভিলের গায়েও মূর্তি বসানো। প্রথম যখন চমৎকার বাড়িটির নাম জিল বলল হোটেল দ্য ভিল, আমি তো ভেবেইছিলাম এটি সত্যিই কোনও হোটেল, যেখানে লোকে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। আরে তা হবে কেন! ওটি টাউন হল। প্যারিস শহরের মেয়রের আপিস। সরকারি এরকম বাড়িগুলোকে ফরাসিরা হোটেল বলে। বেসরকারি কিন্তু বড় কোনও বাড়ি হলেও বলে, যেমন হোটেল পারতিকুলিয়ে।

জ্যাঁ শার্ল বারথেয়ার আর দোমিনিক আমাকে নিয়ে গেল ল্যুভর মিউজিয়াম দেখাতে। জ্যাঁ শার্ল এসেছিল হোটেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে। বারথেয়ার আমার অনুবাদক। লজ্জা বইটি অনুবাদের কাজ নিয়েছে সে। বারথেয়ার আর দোমিনিক আমার দুপাশে, আমি জগতের সকল বিস্ময় নিয়ে দেখছি ল্যুভর মিউজিয়াম। অর্ধেক দিন মিউজিয়ামে হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ব্যথা হয়ে যায়, তবু মিউজিয়ামের হাজার ভাগের এক ভাগও দেখা হয় না। পুরোনো তেলচিত্রগুলো সেই সতেরো আঠারো শতাব্দির, প্রধানত যীশুর ছবি। যীশুর মুখমাথা থেকে আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। আধন্যাংটো যীশুই দখল করে আছেন তখনকার শিল্পকলা। আজদাহা সব ক্যানভাস। আর কি যে নিখুঁত সব কাজ! একটি ছবিতে যীশু আর তাঁর পাশে অনেকগুলো লোক, কেউ খাচ্ছে, কেউ গান গাইছে, কারও কারও আবার ভীষণ রকম উদ্বিগ্ন মুখ। দোমিনিককে জিজ্ঞেস করি, এই দৃশ্যের গল্পটি বলতে। দোমিনিক বলল যে ধর্ম সম্পর্কে খুবই কম জানে সে। আমি যখন প্রশ্ন করে উত্তর পাচ্ছি না, তখন ভিড় থেকে এক লোক এসে বলল, মানুষগুলো সবসময় যে বাইবেলের চরিত্র তা নয়, শিল্পী যীশুর আশেপাশের লোকজনের মুখে তখনকার নামকরা সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের মুখ বসিয়ে দিতেন। কখনও কখনও আবার দেখা যায় ভিড়ের মধ্যে ধর্মের লোকজনের মধ্যে আকারে ছোট একটি মানুষ, সে মানুষটি হয়ত তিনি, যিনি শিল্পীকে দিয়ে এই ছবি আঁকিয়েছিলেন। পয়সার বিনিময়ে ছবি আঁকতে গেলে অনেক অনুরোধ মেনে চলতে হয়। রাজা বাদশারা বা ধনী লোকেরা শিল্পীদের দিয়ে ছবি আঁকাতেন, শর্ত থাকত যীশুর পায়ের কাছে কোনও কিনারে যেন তাঁরা খানিকটা শোভা পান। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে সেই সব মুখ এখনও শোভা পাচ্ছে ক্যানভাসে, ধর্মের গল্পের অংশীদার হয়ে।

দোমিনিকের সঙ্গে শিল্প সংস্কৃতি নিয়ে কথা হয়, বারথেয়ারের সঙ্গে তেমন হয় না। বারথেয়ার না জানে ইংরেজি, না জানে বাংলা, যদিও সে দাবি করে যে সে বাংলা জানে। এ পর্যন্ত একটি বাংলা শব্দও আমি তার মুখে উচ্চারিত হতে শুনিনি। আমি বেশ কয়েকবার বাংলায় কথা বলতে চেয়েছি, জিজ্ঞেস করেছি, আপনি কি অনুবাদ শুরু করে দিয়েছেন? বাংলা ভাষা শিখেছেন কোথায়? এসবের উত্তরে আচমকা ঠা ঠা করে হেসে উঠেছে সে। এখন তার যা বলার ইচ্ছে তা সে ফরাসি ভাষায় দোমিনিককে বলছে, দোমিনিক তা অনুবাদ করে আমাকে শোনাচ্ছে। আমার ভয় লাগে ভেবে যে এই বাংলা না জানা লোকটি লজ্জা বইটি বাংলা থেকে ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করবে, কেবল করবে না, অনুবাদ নাকি শুরুও করে দিয়েছে। আমি নিশ্চিত, লোকটির দ্বারা আর যাই হোক, অনুবাদ হবে না। যাই হোক, ওতে আমি আপাতত মন দিচ্ছি না, মন দিচ্ছি শিল্পে। চারদিকে যীশুর এত ন্যাংটো ন্যাংটো ছবি দেখে তাকে কিন্তু ধর্মের লোক বলে মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে পর্নোগ্রাফির চরিত্র। শেষে একটি মন্তব্য করলাম, ধর্মের প্রয়োজন শিল্পের জন্য, জীবনের জন্য নয়। দোমিনিক সঙ্গে সঙ্গে মেনে নিল আমার কথা। বলল, ধর্ম মানুষকে নানারকম কল্পনা দিয়েছে। কল্পনাকে ভিত্তি করেই এইসব আঁকাআঁকি।

–দোমিনিক, তুমি কি বাহবাটা শেষ পর্যন্ত ধর্মকে দিতে চাইছো? আমি কিন্তু মানুষকে দিতে চাইছি সবটুকু কৃতিত্ব। মানুষই ধর্ম সৃষ্টি করেছে। মানুষই ধর্ম নিয়ে ছবি একেঁছে, বই লিখেছে। মানুষের ভেতর প্রতিভা ছিল বলেই না এসব করতে পেয়েছে।

 ১. প্যারিসের ডায়রি – ০২

রাতে জঁ শার্ল বারথেয়ার খাওয়াবে আমাকে। জিল চলে গেছে জিলের বান্ধবীর বাড়ি। সে ক্লান্ত। বারথেয়ার, দোমিনিক আর আমি মোঁপারনাসে ক্লজারি দ্যা লিলা নামের একটি বিখ্যাত রেস্তোঁরায় খেতে গেলাম। এটি বিখ্যাত এই জন্য যে, এখানে একসময় কবি সাহিত্যিক শিল্পীরা আড্ডা দিতেন। উনিশ শতকের শুরুর দিকে আমেরিকায় মদ নিষিদ্ধ করার ফলে অনেক আমেরিকান লেখক প্যারিসে চলে এসেছিলেন। তাঁরা এই বাধানিষেধহীন স্বপ্নপুরীতে বসে মহানন্দে মদ খেতেন। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তো এই রেস্তোরাঁয় বসে পুরো একটি বই লিখেছেন। প্যারিসে এরকম বহু ক্যাফে আছে, যেখানে শিল্পী সাহিত্যিক দার্শনিকরা ক্যাফে সংস্কৃতির শুরু করেছিল।

রেস্তোরাঁটিতে দেখছি ছেলেমেয়েরা মদ খাচ্ছে, পরস্পরকে জড়িয়ে ধরছে, চুমু খাচ্ছে। কেউ ওদের দিকে তাকাচ্ছে না। আমি তাকাই। চোখ মেলে দেখি সব। কি চমৎকার পরিবেশ। ইচ্ছেগুলোকে কেউ দমন করছে না। চুমু খেতে ইচ্ছে করছে, খাচ্ছে। চোখ কপাল কুঁচকে মুখে রাগ ঘৃণা হিংসা নিয়ে বসে থাকা ঝগড়া করা মানুষ দেখার চাইতে তো হাসি মুখের খুশি মুখের প্রেম দেখা চুমু দেখা অনেক ভাল। মন ভাল হয়ে যায়। পৃথিবীকে বড় সুন্দর মনে হয়। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয়।

বরফের থালায় আমাদের জন্য ঝিনুক এল। দেখে আঁতকে উঠি। কি রে বাবা ঝিনুক খাবে কে! বারথেয়ার আর দোমিনিক ওয়াও ওয়াও বলে একের পর এক ওগুলো খেতে শুরু করল। ভেবেছিলাম ওয়াও শব্দটির পর বলবে কি বাজে। কিন্তু বলল ওয়ান্ডারফুল। কি করে এই বিদঘুটে জিনিসটি ওয়াণ্ডারফুল হয় জানি না। বহু কষ্টে গলায় উঠে আসা বমি আটকে রাখি। দুজনই আমাকে সাধাসাধি করে খেতে। আমি সোজা না বলে দিই। আমার না এ কাজ হয় না। দোমিনিক আমাকে যে করেই হোক ঝিনুকের স্বাদ নেওয়াবেই। আমার চোখ বন্ধ করল ওরা, নাক বন্ধ করল, এরপর মুখটি হাঁ করিয়ে ঢুকিয়ে দিল একটি আস্ত ঝিনুক। গলা বেয়ে সুরসুর করে চলে গেল জিনিসটি, যেন কারও একদলা থিকথিকে সর্দি গিলে ফেললাম। বারথেয়ারের অনেক খরচ হয়ে গেল এই রেস্তোরাঁয়। আমি টাকা দিতে চাইলে, বারথেয়ার আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তোমার বই অনুবাদ করার জন্য ম্যালা টাকা পেয়েছি আমি।

রাত দেড়টায় আমরা বেরোলাম রেস্তোরাঁ থেকে। রেস্তোরাঁ তখনও জমজমাট। প্যারিস কি ঘুমোয় রাতে! আমার মনে হয় না। বিদায় নেওয়ার সময় দোমিনিক আর বারথেয়ার জড়িয়ে ধরে চুমু খেল গালে। একদিনের পরিচয়ে গালে চুমু খাওয়া এ দেশে কোনও ব্যাপারই নয়। দোমিনিক আমাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে যায়। রাতে ভাল ঘুম হয় আমার। আন্তয়ান দ্য গুডমারকে ফোন করেছিলাম। আমি প্যারিসে শুনে খুশিতে চেঁচিয়ে বলল, ইনক্রিডবল। ইনক্রিডবল শব্দটি এরা খুব ব্যবহার করে। ক্রিশ্চান বেসকে ফোন করলেও ও বলেছে, ইনক্রিডবল, তুমি প্যারিসে! সকালে আন্তোয়ান এল হোটেলে। আমাকে নিয়ে কাছেই একটি ক্যাফেতে গেল নাস্তা খেতে। ঝকঝকে রোদ উঠেছে। আন্তোয়ান রোদ দেখে বারবারই বলছে, আহ, কি চমৎকার দিন আজ। কি সুন্দর রোদ!

উফ, রোদ আমার ভাল লাগে না। আমি রোদ থেকে গা বাঁচিয়ে ছায়া ধরে হাঁটি।

কি বল! রোদ ভালবাসো না তুমি!

–নাহ।

–আমাদের এখানে উৎসব শুরু হয়ে যায় রোদ উঠলে। বসন্তের প্রথম রোদ। তুমি যেন তোমার দেশের চমৎকার রোদ এই ঠাণ্ডা মেঘলা স্যাঁতসেঁতে প্যারিসে নিয়ে এলে! তোমাকে ধন্যবাদ।

–রোদ নিয়ে কী ভীষণ উচ্ছাস তোমাদের। আমি রোদের দেশের মানুষ। রোদ আমাদের গা পুড়িয়ে দেয়।

–আমাদের সূর্য ভাল লাগে।

–আমাদের চাঁদ ভাল।

–এখানে রোদ মানে আনন্দ। রোদ মানে সুখ।

–ওখানে রোদ মানে জ্বালা পোড়া, রোদ মানে অশান্তি। ছায়া আমাদের প্রাণ জুড়োয়।

কি পার্থক্য তাই না! আবহাওয়া নিয়েই গুডমার কথা বলল আধঘন্টা। বৃষ্টি ভাল লাগে আমার। বৃষ্টি অসহ্য গুডমারের। মেঘলা দিনকে গুডমার,কেবল গুডমার নয়, এখানকার সবাই, বলে খারাপ দিন। আমি বলি চমৎকার দিন। গুডমার আমাকে তার পত্রিকা দিল, লিবারেশন। এটি ফ্রান্সের বামপন্থী পত্রিকা। লিবারেশনে আমার প্যারিসে আসার খবর ছাপা হয়েছে। গুডমার ঢাকায় গিয়ে আমার যে সাক্ষাৎকার নিয়েছিল, সেটি যে দু পাতা জুড়ে বিশাল করে ছাপা হয়েছিল এ পত্রিকায়, সে লেখাটিও দিল। পত্রিকা খুলে নিজের ছবি আর নাম ছাড়া কোনও কিছু আমার পক্ষে চেনা সম্ভব হয় না। ভাষা রোমান হরফে, কিন্তু ভাষার খুব বেশি কিছু উদ্ধার করতে আমি পারি না। ক্যাফে থেকে হোটেলে ফিরে দেখি ক্রিশ্চান বেস আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। ক্রিশ্চানের বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে, অত্যাধুনিক পোশাক পরা সোনালী চুলের মাদাম, ফরাসি অ্যারিস্টোক্রেট। কিন্তু গাম্ভীর্যের বিন্দু মাত্র কিছু নেই। হই হই করা মানুষ তিনি। চকাশ চকাশ করে দু গালে চুমু খেয়ে তিনি আমাকে কাছের আরেকটি ক্যাফেতে নিয়ে গেলেন নাস্তা খেতে। ক্যাফের ভেতরে যেতে চাইলে না না করে উঠলেন ক্রিশ্চান। বাইরের রোদে বসবেন তিনি। ক্যাফের সামনে রাস্তার ওপরের ফুটপাতে চেয়ার পাতা, ওখানে রোদ পড়েছে, রোদে বসে গুডমারও খেয়েছে, ক্রিশ্চানও খেলেন। প্যারিসের এই হল সৌন্দর্য। গরম শুরু হতে না হতেই ক্যাফে রেস্তোরাঁগুলোর বাইরে পাতা চেয়ার টেবিলে খেতে বা পান করতে কিলবিল ভিড় লেগে যাবে।

লম্বা একধরনের রুটি আছে, ফরাসিরা এই রুটিকে বাগেত বলে। এটি তাদের খুব প্রিয় রুটি। বগলে করে একটি বাগেত নিয়ে লোকেরা রাতে বাড়ি ফেরে। অথবা সকালে ঘুম ঘুম চোখে বেরিয়ে মোড়ের বুলোনজরি থেকে একটি সবে বানানো গরম বাগেত কিনে বগলে করে বাড়ি যায়। বাগেত খেতে আর যে কোনও রুটির মতই স্বাদ। আমি জানি না, কেন ছোট রুটি না বানিয়ে দু হাত লম্বা রুটি বানাতে হয় এদের। ট্রাডিশন বলে একটি ব্যাপার আছে, ফরাসিরা তা সহজে হারাতে চায় না। কত রকম যে রুটি আছে এই দেশে! ক্রিশ্চান সকালে ক্রোসোঁ বলে একটি শঙ্খের মত দেখতে রুটি খাচ্ছেন, সঙ্গে কালো কফি। এই হল তাঁর সকালের নাস্তা। অনর্গল বকতে পারেন তিনি। ইংরেজি বলেন কড়া ফরাসি উচ্চারণে। বার বার করে জানতে চাইছেন আমার ফ্রান্সের প্রোগ্রাম। কবে হবে, কখন হবে, কোথায় হবে, কী হবে — সব তিনি জানতে চান। আমি, সত্যি কথা বলতে কি জানিও না আমার কখন কোথায় কি অনুষ্ঠান আছে। ক্রিশ্চানকে বড় আন্তরিক মনে হয়। দুজন খেয়ে দেয়ে হোটেলে ফিরে দেখি বারথেয়ার অপেক্ষা করছে। মোটা একটি বই এনেছে রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথের আঁকা একটি ছবি দেখালো, এটি নাকি লজ্জার পঈচ্ছদ হবে। এরপরই জিল এল আমাকে নিতে। বারথেয়ারকে বিদায় দিয়ে জিল ট্যাক্সি ডাকল, সোজা আমাকে নিয়ে গেল রেডিও ফ্রান্সে। রেডিওতে সাক্ষাৎকার দিতে হল। জিল বলল যে তিন তারিখে রেডিওতে নাকি আমার আরেকটি সাক্ষাৎকার আছে। জিল জানে সব।ও জানে কখন কোথায় আমাকে যেতে হবে। রেডিও থেকে নিয়ে গেল একটি পত্রিকা আপিসে। সুন্দর গোছানো ছিমছাম আপিস। বড়। গাদাগাদি করে বাংলাদেশের পত্রিকা আপিসে যেমন সাংবাদিকরা বসে, সেরকম নয়। ওখানেও সাক্ষাৎকার। এরপর দুজন বেরিয়ে ক্যাফের বাইরে বসে দুপুরের খাবার খেলাম। খেয়ে হোটেলে ফেরার পর দেখি সিগমা নামের ফটো এজেন্সি থেকে ফটোগ্রাফার এসে বসে আছে, ফটো তুলবে আমার। হোটেলে তুলবে না, বাইরে তুলবে। বাইরের রোদে। ফটোগ্রাফার তার গাড়ি করে আমাদের নিয়ে গেল ল্যুভর মিউজিয়ামের সামনের বাগানে। কচি কলাপাতা রঙের সবুজ ঘাসে ফুটে আছে শাদা শাদা ফুল। গায়ে অনেক পাপড়ি। প্রেমিক প্রেমিকারা এই ফুলের পাপড়িগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে একটি খেলা খেলে। পাপড়ি ছেঁড়ে আর বলে, তোমায় আমি ভালবাসি, খুব ভালবাসি, পাগলের মত ভালবাসি, ভালবাসি না। ছিঁড়তে ছিঁড়তে যে পাপড়িটি একদম শেষে গিয়ে ছিঁড়বে সেটিই হবে মনের কথা। ছবির জন্য বিভিন্ন মূর্তির সামনে দাঁড়াতে হচ্ছে, আর আমার থেকে থেকে চোখ চলে যাচ্ছে ফুলের দিকে। বাগানের ভেতর যুবক যুবতী চুমু খাচ্ছে। খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। গভীর চুমু। এই চুমুর নামই বোধহয় ফরাসি চুমু। দীর্ঘক্ষণ এত ঘন হয়ে বসে এইযে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে গভীর করে চুমু খাচ্ছে, খেয়েই যাচ্ছে, তড়িঘড়ি কোনও কর্ম সারার কথা, দেখে মনে হয়, মোটেও ভাবছে না। পাশ দিয়ে এত লোক হেঁটে যাচ্ছে, কেউ একবার ফিরেও তাকাচ্ছে না চুমু খাওয়া জোড়ার দিকে। বাংলাদেশে হলে ভিড় লেগে যেত। জোড়া তো ছাড়াতোই লোকে, দুজনের হাত পায়ের জোড়াও ভেঙে দিত মেরে।

আমরা জোন অব আর্কের ঘোড়ায় বসা সোনালী মূর্তির কাছেই একটি ক্যাফেতে বসি। এও বাইরে। ফটোগ্রাফার ভাল ইংরেজি জানে না। আধো আধো করে বলার চেষ্টা করল কিছু। এখানে, ফ্রান্সে, বেশির ভাগ মানুষই ইংরেজি ভাষাটি জানে না। সভ্য হতে গেলে যে ইংরেজি জানতে হয় না, তা ফ্রান্সে এসে আমার বেশ ভাল করেই বোধ হয়। উপমহাদেশেই এই ধারণাটি বদ্ধমূল, দুশ বছর ইংরেজ শাসনে থেকে এই হয়েছে মানসিকতা। প্রভুর ভাষা শিখে জাতে ওঠার তপস্যা।

সন্ধেটা হোটেলে বিশ্রাম নিতে গিয়ে দেখি ঘুমে ঢলে পড়ছি। কিন্তু অসময়ে ঘুমোলে চলবে কেন! এখানকার সময়ের সঙ্গে আমার শরীরকে মানিয়ে নিতে হবে। রাত নটায় জিল এসে ডেকে নিয়ে গেল। হোটেল থেকেই ট্যাক্সি ডাকে জিল। দু মিনিটের মধ্যে ট্যাক্সি এসে দরজার সামনে দাঁড়ায়। আমরা চলে যাই দূরে কোথাও। ঝলমলে রেস্তোরাঁ এলাকায়। খেতে খেতে দুজন রাজ্যির গল্প করি। বিকেলে ক্রিশ্চান এসেছিল হোটেলে, আমাকে পায়নি। চিঠি লিখে গেছে, যে ভিলেজ ভয়েজ এর এক সময়ের মোস্ট ইম্পর্টেন্ট নারীবাদী লেখক মারিন ওয়ারনার আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। শুনে জিল বলে, কিছু হলেই বলে ফেলে মোস্ট মোস্ট মোস্ট। ওই লেখকের নাম আমি কখনও শুনিনি। ক্রিশ্চানের সব উচ্ছাসকে জিল বলে, সব টাকার জন্য, সব ব্যবসার কারণে। যারা আন্দোলন করছে, নারীর জন্য লড়াই করছে, বই তাদের দেওয়া উচিত, আদর্শ বলে কথা। ব্যবসায়ী প্রকাশককে তোমার বই দিও না। জিল যখন ক্রিশ্চানের সামনে বলেছিল যে আমাকে স্ট্রাসবুর্গ যেতে হবে, ক্রিশ্চান লাফিয়ে উঠেছিল আনন্দে, জিল ওই আনন্দকেও বলেছে, ছো! সব টাকার জন্য। তোমাকে খুশি করে তোমার কাছ থেকে বই বাগাতে চাইছে। এই উদ্দেশ্য। টাকা টাকা টাকা। জিল হেসে, হঠাৎ বলল, আমি এই নতুন চাকরিতে ভাল করতে পারছি না।

–নতুন চাকরি?

–হ্যাঁ তোমার প্রাইভেট সেক্রেটারির চাকরি।

জিলের মপোলিয়েঁ ফিরে যাবার কথা ছিল। কিন্তু আমার জন্য চার তারিখ পর্যন্ত থেকে যাচ্ছে ও প্যারিসে। রাত তখন সাড়ে বারো। ভিড় উপচে পড়ছে রেস্তোরাঁগুলোয়। ছেলে মেয়েরা হাতে হাত ধরে রাস্তায় হাঁটছে। ঝলমলে আনন্দ চারদিকে। হঠাৎ দেখি নাকের সামনে একটি তাজা লাল গোলাপ। গোলাপটি বাড়িয়ে ধরে থাকা লোকটিকে দেখি। চোখে চোখ পড়ে। লোকটিকে বাঙালি মনে হচ্ছে। ফুল কিনব কি কিনব না তা না জেনেই লোকটি দ্রুত সরে গেল সামনে থেকে। লক্ষ করি, দূর থেকে আবার পেছন দিকে তাকাল আমার দিকে। লোকটি কি চিনতে পারল আমাকে! সম্ভবত! অথবা আমি যে তার দেশ অথবা তার পাশের দেশ থেকে এসেছি, সে সম্পর্কে সে নিশ্চিত। –লোকটি কি বাংলাদেশি! জিল জিজ্ঞেস করে।

–আমার কিন্তু তাই মনে হচ্ছে।

চারদিকে কলকলে আনন্দের মধ্যে, শাদা শাদা হাস্যোজ্জ্বল ফরাসিদের মধ্যে একটি বিষণ্ন বাদামী মুখ, ফুলঅলাটির মুখটি মনে পড়তে থাকে।

–আমার খুব খারাপ লাগে, খুব কষ্ট হয় যখন দেখি আমাদের দেশের ছেলেরা ইওরোপ আমেরিকায় এসে রেস্তোরাঁয় বাসন মাজে, রাস্তায় ফুল বিক্রি করে। শিক্ষিত লোকেরাও সোনার হরিণের সন্ধানে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

জিল চোখ বড় বড় করে বলে, বাহ! খারাপ লাগবে কেন! তুমি তো পছন্দ কর দেশের বাইরে যাওয়া।

বললাম, সে তো বেড়াতে। এরকমভাবে, বাসন মাজতে, ঝাড়ু দিতে, ময়লা পরিষ্কার করতে আমাদের দেশের শিক্ষিত লোকেরা ধনী দেশগুলোয় দৌড়োচ্ছে।

জিল বলল, বোধহয় কাজ নেই দেশে, তাই।

একটু জোরেই বলি, দেশে থেকে কাজ করার জন্য চেষ্টা তো করতে হবে। কাজ যেন পাওয়া যায় দেশে, সেরকম অবস্থা করার জন্য সংগ্রাম তো করতে হবে। যে লোকটিকে দেখলাম, সম্ভবত সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার ডিগ্রি করে এ দেশে এসেছে, এখন ফুল বিক্রি করছে। ফুল বিক্রি করার জন্য কি পদার্থবিজ্ঞান জানার দরকার হয়! মেধাগুলো পাচার হয়ে যাচ্ছে গরিব দেশ থেকে ধনী দেশে। দেশে থেকে দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক অবস্থা পরিবর্তনের জন্য কে তবে চেষ্টা করবে যদি যুব সমাজ কি করে খানিকটা বেশি টাকা কামাবে, সেই কারণে যদি বিসর্জন দেয় সব আদর্শ!

জিল মাথা নাড়ল। সায় দিল আমার কথায়।

কথা ছিল আমি আর জিল নৌকো নিয়ে সেইন নদীতে ঘুরে বেড়াবো। কিন্তু আর ইচ্ছে করেনি সেইনে ভাসতে।

পরদিন উনত্রিশ তারিখ। উনত্রিশে এপ্রিলের ডায়রি আমাকে লিখতে হবে প্যারিসের বিখ্যাত পত্রিকা লা নভল অবজারভেতর এর জন্য। পত্রিকাটির সম্পাদক জঁ দানিয়েল ঢাকায় আমাকে অনেকগুলো ফ্যাক্স পাঠিয়েছেন ডায়রি লেখার জন্য অনুরোধ করে। পৃথিবীর বিখ্যাত সব লেখক ওতে লিখবেন। উনত্রিশ তারিখটি তাঁরা কেমন কাটিয়েছেন, তার বর্ণনা করে। এই দিনটিতেই আমাকে স্ট্রাসবুর্গে যেতে হবে। ক্রিশ্চান সকালেই ফোন করেছিল। শুভসকাল জানিয়ে বললেন কাল আসবেন তিনি আমাকে নিতে আরেকটি টিভি প্রোগ্রামের জন্য। সিগমার আরেকজন ফটোগ্রাফার আবার আসবে। সকালে গরম জলে গোসল করে গোলাপি একটি শাড়ি পরে নিই। প্যারিসে এই প্রথম আমার শাড়ি পরা। শাড়ি পরে শেষ করিনি, নিচ থেকে ফিলিপ ডেমেনএর আসার খবর দেওয়া হল। লা ভি নামে এক পত্রিকার সাংবাদিক এই ফিলিপ। হোটেলের নিচতলায় একটি ক্যাফে আছে, ক্যাফেতে বসি দুজন। নাস্তা খেতে খেতে সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তর দিই। একই রকম প্রশ্ন, একই রকম উত্তর। এর মধ্যে জিল আসে বড় একটি লিস ফুলের তোড়া নিয়ে। কি যে ভাল লাগল চমৎকার ফুলগুলো দেখে। ফুল দেখলেই আমার নাক কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নেওয়ার অভ্যেস। লক্ষ করেছি, ফরাসিরা ফুলের সৌন্দর্য দেখে, ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য নাক বাড়ায় না তেমন। এখানকার ফুলে ঘ্রাণও খুব কম থাকে। বাণিজ্যিক কারণে ফুল ফোটানো হলে তাতে ঘ্রাণ কোথায় থাকবে! ফিলিপ তখনও যায়নি, এল লা ফিগারো পত্রিকার সাংবাদিক সঙ্গে ফটোগ্রাফার নিয়ে। হোটেলের কাছের রাস্তায় ছবি তুলল ফটোগ্রাফার। আমার হোটেলের নাম মারসেলিয়র অপেরা, অবশ্য যদি আমি উচ্চারণ করি। আমার উচ্চারণ শুনে একটি ফরাসিও বোঝে না কি বলছি আমি। আমাকে বানান করে দিতে হয় হোটেলের নাম। ওরা মাসেই অপেয়া জাতীয় কিছু একটা বলে। ফিগারোর সাংবাদিক মারি এমিলি লোমবার্ড সঙ্গে কথা বলার আমার সময় নেই, কারণ আমাকে যেতে হবে স্ট্রাসবুর্গ। জিল যাচ্ছে না স্ট্রাসবুর্গে, যেহেতু অন্য সাংবাদিকরাও যাচ্ছেন টিভি প্রোগ্রামের জন্য। তাছাড়া মারি এমিলি যাচ্ছে আমার সঙ্গে। জিল বলে দিল, অবশ্যই যেন স্ট্রাসবুর্গের ক্যাথিড্রালটি দেখি। মারি এমিলি আর আমি প্যারিসের অরলি বিমানবন্দর চলে গেলাম। মারিকে পথে জিজ্ঞেস করলাম, তোমারও কি কোনও প্রোগ্রাম আছে টিভিতে?

মারি হেসে বলল, না, আমি কেবলই তোমার সাক্ষাৎকার নেবার জন্য যাচ্ছি। তুমি এত ব্যস্ত যে যদি অন্য সময় সময় না পাও, তাই বিমানে বসে সাক্ষাৎকার নেব। বিমান বন্দরেই পরিচয় হয় আলজেরিয়ার আর ক্যামেরুনের সাংবাদিকের সঙ্গে। ক্যামেরুনের বিশাল দেহী সাংবাদিকটি কিছু ইংরেজি জানলেও আলজেরিয়ার সাংবাদিক একটি ইংরেজি শব্দও বলতে পারেন না। ভেবেছিলাম বিমানের জানালা দিয়ে দেখতে দেখতে যাবো পাখির চোখে ফ্রান্স। কিন্তু মারির প্রশ্নের জ্বালায় তা সম্ভব হয় না। ভেবেছিলাম প্যারিসের বাইরে কোনও এক ছোট মফঃস্বল শহর স্ট্রাসবুর্গ, তেমন আহামরি কিছু দেখতে হবে না। কিন্তু পৌঁছে চারদিক দেখে আবারও বিস্ময় জাগে। নিখুঁত শহর। রূপের কোনও কমতি নেই। দুটো গাড়ি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল বিমান বন্দরে। একটিতে আমি, মারি, আর ক্যামেরুনের সাংবাদিকটি। আরেকটিতে বাকিরা। ক্যামেরুনের লোকটি লম্বা একটি রঙিন আলখাল্লা পরেছে, মাথায় একটি রঙিন টুপিও লাগিয়েছে। বলল, পোশাকটি ক্যামেরুনের মুসলমানদের পোশাক, যদিও সে খ্রিস্টান, এ পোশাক তার ভাল লাগে বলে পরেছে। বিমানে বসে জ্যঁ শার্ল বারথেয়ারের দেওয়া প্যাকেটটি খুলি, সকালেই জ্যঁ শার্ল হন্তদন্ত হয়ে প্যাকেটটি হাতে দিয়ে বলে গেছেন, এটি বিমানে উঠে খুলবে, তার আগে নয়। প্যাকেটের ভেতরে একটি নিনা রিচি নামের সুগন্ধী, আরেকটি চকোলেটের বাক্স। চকোলেটের বাক্সটি কাউকে দিয়ে দেব, চকোলেট আমার পছন্দ নয়। ফরাসিদের তিনটে জিনিস খুব প্রিয়, এবং এই তিনটে জিনিসই আমার একদম সয় না, কফি, চকোলেট, চিজ। ওদের আমি বলেছিও তোমাদের তিনটে জিনিস আমার কাছে অখাদ্য, তিনটিই শুরু সি দিয়ে। নামগুলো বললে ওরা ভিমড়ি খায়। আমাকে আদৌ মানুষ বলে ভাবে কি না কে জানে।

টেলিভিশনের বাড়িটি চমৎকার। আমাদের জন্য ওখানেও অপেক্ষা করছিল অনেকে। একজন হাত বাড়িয়ে বলল, আমি ফ্রেড্রিক গারডেল। ফ্রেড্রিকই তো আমাকে আর্তে টেলিভিশন থেকে আমন্ত্রণ পত্র পাঠিয়েছিলেন। দুজন বাঙালি মেয়ে দেখি গুটি গুটি হেঁটে আসছে আমার দিকে। কাছে এসে বলল, আমরা আপনার অনুবাদক। এতদিন পর কারো মুখে স্পষ্ট বাংলা শুনলাম, মন নেচে ওঠে, কলকল করে আমি বাংলায় কথা বলে উঠি, পাখি যেমন মনের আনন্দে বসন্ত এলে গান গাইতে থাকে, তেমন। প্যারিসে কার মুখে শুনব বাংলা! বারথেয়ার দাবি করছে সে বাংলা জানে। এখনও শোনা হয়নি একটি শব্দও। মেয়ে দুজনকে প্যারিস থেকে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ আনিয়েছেন। ফ্রেড্রিক ফরাসিতে বলে যাচ্ছেন পুরো অনুষ্ঠানটি কি হবে, কি জিজ্ঞেস করা হবে, কোন কোন তথ্যচিত্র দেখানো হবে মাঝখানে, কে আমাদের প্রশ্ন করবে, সব। দোভাষীদুজন −ফ্রড্রিকের কথাগুলো অনুবাদ করে দিল। দুপুরের খাবারের আয়োজন করা হল ওখানে। খাবার বলতে এক হাত লম্বা একটি স্যান্ডুউইচ। ওটি আমার পক্ষে খাওয়া সম্ভব হয়নি। মেকআপ রুমে নিয়ে যাওয়া হল আমাকে। ওখানে এসে অনুষ্ঠানের প্রযোজক দেখা করে গেলেন। ফ্রেড্রিক আমার জন্য, যেহেতু কফি খাই না, চা নিয়ে এলেন, আর দেখে শুনে ছোট আর নরম রুটির স্যান্ডুউইচ। মেকআপ শেষ হতেই স্টুডিও। আলোয় ফেটে পড়ছিল ঘরটি। এই প্রথম ইউরোপের কোনও স্টুডিওতে বসে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা। দানিয়েল লাকন্ত বসলেন মাঝখানে। দানিয়েল অনুষ্ঠান পরিচালনা করবেন। তাঁর বাঁ পাশে আমি। ডানে আলজেরিয়ার সাংবাদিক। আমার বাঁ পাশে ক্যামেরুনের সাংবাদিক। ক্যামেরুন সরকার যাঁকে সরকারের বিরুদ্ধে লেখার কারণে জেলে পাঠিয়েছিল। আলজেরিয়ার সাংবাদিককে মুসলিম মৌলবাদীরা দিয়েছিল হত্যার হুমকি, গুলিও করেছিল। অবশ্য প্রাণে বেঁচে গেছেন তিনি। একজন কার্টুনিস্ট বসেছেন সামনে। কার্টুন এঁকে যাচ্ছেন আপন মনে। তাঁর আঁকা কার্টুনগুলো আমরা আবার সামনে রাখা মনিটরে দেখতে পাচ্ছি। সবার কানে কানফোন লাগানো আছে। আমার কানফোনে বাংলায় শুনতে পাচ্ছি যারা যে কথাই বলছে। হোবিয়া মিনা বসেছে আমাদের থেকে দূরে, এক কোণে। জার্মানি থেকে এসেছে এক সাংবাদিক, নাম ক্রিশ্চিনা। অনুষ্ঠানের সকলে ফরাসি বলছে। ক্রিশ্চিনা জার্মান বলছে, আমি বাংলা। কিন্তু সবার কথাই আমরা নিজের ভাষায় শুনতে পাচ্ছি। তড়িৎ গতিতে অনুবাদের আয়োজন। ক্রিশ্চিনার আর আমার কথাগুলো ফরাসি ভাষায় অনুবাদ হয়ে যাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে। প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতা বিষয়ে প্রশ্ন শুরু হল। মাঝে মাঝে তথ্যচিত্র দেখানো হচ্ছে। মেক্সিকোতে এক সাংবাদিক ড্রাগ মাফিয়ার বিরুদ্ধে লিখতে গিয়ে ভয়ংকর অসুবিধেয় পড়েছে, কারণ মেক্সিকোর সরকার ড্রাগ ব্যবসায় জড়িত। মোট তেষট্টি জন সাংবাদিককে সারা বিশ্বে মেরে ফেলা হয়েছে। ১২৪ জন সাংবাদিক হুমকির সম্মুখিন। আলজেরিয়ার সাংবাদিক বলল, ওখানে সাংবাদিকরা মৌলবাদিদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ। মৌলবাদিরা যখন তখন যাকে তাকে মেরে ফেলছে। বিশেষ করে সেইসব সাংবাদিকদের যারা মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে লিখছে।

এরপর প্রশ্ন হল, যেহেতু এটি বাক্‌ স্বাধীনতার প্রশ্ন, মৌলবাদীদের স্বাধীনতা থাকা উচিত কি না যা কিছু বলার।

আমি আপত্তি করলাম। বললাম-–‘না, মৌলবাদীদের বেলায় আমি এই ছাড় দিতে রাজি নই। আমাদের দেশের মৌলবাদীরা ধনী আরব দেশগুলোর টাকা পেয়ে এখন অস্ত্রবান হয়েছে। সমাজটাকে নষ্ট করে ফেলছে। দেশজুড়ে এক ভয়াবহ অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছে। মানুষকে বিনা দ্বিধায় মেরে ফেলছে, হাত পায়ের রগ কেটে দিচ্ছে। অবাধে ধর্ম প্রচার করে যাচ্ছে। নিরীহ মানুষগুলোকে ধর্মের বাণী শুনিয়ে বোকা বানিয়ে দলে ভেড়াচ্ছে। একসময় আমাদের দেশে এদের কোনও অধিকার ছিল না রাজনীতি করার। এখন তারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার অধিকার পেয়ে দেশজুড়ে তান্ডব চালাচ্ছে। একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে এখন ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য উন্মাদ হয়ে গেছে। ধর্মীয় শিক্ষা ছড়িয়ে ধর্মীয় আইন জারি করে দেশটিকে ধ্বংস করে দিতে চাইছে। সময় থাকতে এই সর্বনাশকে রুখে দাঁড়াতে হবে।’ এরপর আলজেরিয়ার সাংবাদিকের কাছে একই প্রশ্ন রাখা হল। তিনি বললেন, জ্ঞআগে তসলিমার মত এরকম আমাদের দেশেও ভাবা হত। কিন্তু এখন এই ভাবনার পরিবর্তন হয়েছে। আমরা যারা মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি, তারাই বলছি, মৌলবাদীদেরও স্বাধীনতা থাকা উচিত মত প্রকাশের জন্য। গণতন্ত্রের নিয়মই তো এই।’ আরও অনেকক্ষণ প্রশ্নোত্তর চলল। শেষ প্রশ্নটি আমাকে করা হয়, ফ্রান্স আর জার্মানির বাকস্বাধীনতা নিয়ে এই যে তথ্যচিত্র দেখলে, যেখানে বলা হচ্ছে এখানেও সাংবাদিকরা অনেক কিছু বলছে না বা বলতে পারছে না, কারণ সংবাদপষেনর বিজ্ঞাপনদাতাদের অনুমতি না পেলে সমাজের অনেক অন্যায় সম্পর্কে মুখ খোলা যায় না। এটি আমাদের দেশের তুলনায় কেমন? আমি বললাম, ‘এখানেও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ হচ্ছে, অবশ্যই। তবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা আরও বেশি কম। রেডিও টেলিভিশন সরকারি মালিকানায় থাকায় এগুলো সরকারি প্রচারের জন্য ব্যবহৃত হয়। সংবাদপত্র বেশির ভাগ যদিও ব্যক্তি মালিকানাধীন, তারওপরও কোনও সংবাদপষেন যদি সরকার বিরোধী কিছু প্রকাশ পায়, সরকার সময় সময় তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে,তাদের গ্রেফতার করতে, এমন কী পত্রিকা বন্ধ করে দিতে দ্বিধা করে না। বেসরকারি পত্রিকাগুলোকেও বাঁচতে হয় সরকারি বিজ্ঞাপনে, সুতরাং বিজ্ঞাপনের জন্য অনেক সংবাদপত্রই সরকারি আদেশ মান্য করতে বাধ্য হয়।’

অনুষ্ঠান শেষে জার্মানির ক্রিস্টিনা আমাকে একটি সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য অনুরোধ করল। সময় নেই। অল্প কিছুক্ষণ কথা বলে দৌড়ে অপেক্ষমান গাড়িতে চড়ে বসতে হল। সোজা বিমানবন্দর। ম্যারিও ফিরল প্যারিসে আমার সঙ্গে। আঠার মত লেগে থেকে আমার কিছু কবিতা ফটোকপি করে নিল। ঘুমে আমার শরীর ভেঙে আসছিল। এই হচ্ছে প্রতি বিকেলে। প্যারিসের সময়ের সঙ্গে শরীর খাপ খাইতে চাইছে না। এখনও দেশের সময়ে শরীর নেতিয়ে পড়ছে, শরীর আড়মোড়া ভাঙছে। জিল ফোন করলে বলে দিই, না বাবা, এখন কোথাও যাবো না, ঘুমোবো।

জিলের দশটায় আসার কথা থাকলেও সে তার বান্ধবী নাতালিকে নিয়ে আগেই চলে আসে হোটেলে। আইফেল টাওয়ার দেখতে যেতে হবে। নাতালি মেয়েটির ডাগর ডাগর চোখ, মুখে মিষ্টি মিষ্টি হাসি। মেয়েটিকে আমার বেশ ভাল লাগে। জিল বলেছিল যদিও তারা একসঙ্গে থাকে, এখনও নাকি তার সঙ্গে নাতালির গভীর কোনও ভালবাসা হয়নি। এ খুবই সত্য কথা যে একসঙ্গে থাকলেই এক বিছানায় ঘুমোলেই ভালবাসা গড়ে ওঠে না। আমরা কিছুদূর হেঁটে একটি ট্যাক্সি নিয়ে আইফেল টাওয়ারের কাছে গেলাম। তিনতলা বন্ধ হয়ে গেছে টাওয়ারের, উঠলে তিনতলায় ওঠাই ভাল। আমার কিন্তু অত চুড়োয় ওঠার কোনও তীব্র ইচ্ছে নেই। দূর থেকেই দেখি না কেন! আলো ঝলমল পরিবেশটি আমার ভাল লাগে। আজদাহা টাওয়ারটি লোহা লককরের একটি স্তম্ভ। জানি না কেন লোকে এটি পছন্দ করে। প্যারিসের লোকেরা অবশ্য এটিকে জঘন্য একটি জিনিস বলে ছো! ছো! করে। ১৮৮৯ সালে প্যারিসের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর জন্য গুস্তাব আইফেল নামের এক লোক এটি বানিয়েছিলেন, তিনশ মিটার লম্বা টাওয়ারটি, সাত হাজার টন ওজন। কথা ছিল প্রদর্শনীর পর এটি তুলে ফেলা হবে। কিন্তু শেষ অবদি তোলা হয়নি, রয়ে গেছে। এলাকাটি, জিল বলে, ধনী। ধনীর ছেলেরা একটুকরো চাকাঅলা কাঠের ওপর চড়ে ভয়ংকর ভাবে দৌড়োচ্ছে। গরম পড়তেই নাকি এখানে এমন শুরু হয়ে যায়। আমরা নৌকো চড়ব বলে নদীর কাছে গিয়ে দেখি নৌকো নেই। এ কারণে যে মন খারাপ হবে তা নয়। আমার ওরকম হাঁটতেই ভাল লাগছিল। পাশাপাশি তিনজন। ভাল লাগছিল রকমারি মানুষের ভিড়। আনন্দিত মুখ। হাঁটতে হাঁটতে আমরা আর্ক দ্য ট্রায়াম্ফএর কাছে পৌঁছে যাই। জিল আর নাতালি দুজন বাড়িতে খেয়ে এসেছে। আমার রাতের খাওয়া তখনও হয়নি বলে শাঁর্লস এ লিজের এক রেস্তোরাঁয় বসি। ভেতরে নয়, বাইরে, তেরাসে। অনেক রাত অবদি। রাত গভীর হলেও বোঝার উপায় নেই। হৈ হুল্লোড়, মানুষের ভিড়, যানবাহনের ভিড়। কি অদ্ভুত এক অন্যরকম জগতের মধ্যে আমি!

পরদিন। সকালে ক্যামেরুনের সাংবাদিকের সঙ্গে নাস্তা খাওয়ার কথা। ধুৎ কি নাস্তা খাব। সকালে বিছানায় বসে চা খাচ্ছি আরাম করে। ক্যামেরুনের কথা আপাতত ভুলে যাই। ক্রিশ্চান বেস অপেক্ষা করছেন নিচে। আবার জিলের ফোন। ক্রিশ্চান এসেছে খবরটি দিলে জিল বলল, ‘তাহলে তুমি ক্রিশ্চানকে নিয়েই রেডিওতে চলে যাও। আমি তোমাকে নিয়ে আসতে গেলে দেরি হয়ে যেতে পারে। আমি আমার এখান থেকেই তাহলে সোজা রেডিওতে চলে যাচ্ছি।’ খানিক পর আবার জিলের ফোন। জ্ঞপ্রযোজক নেই এখন রেডিওতে, তোমার ওখানে গেছে কী না, খানিকক্ষণ অপেক্ষা কর।’ ক্রিশ্চানের সঙ্গে চা কফি নিয়ে বসলাম আধঘন্টা মত। ক্রিশ্চান বার বারই একটি কথা বলল, ‘আমি তোমার নামের জন্য তোমার বই ছাপতে চাইছি না। ছাপতে চাইছি তোমার সাহিত্যের জন্য। লেখক হিসেবে তোমাকে চাইছি। তোমাকে ফতোয়া দিয়েছে, তোমার এখন চারদিকে নাম, সেজন্য তাড়াহুড়ো করে তোমার একটি বই ছেপে হটকেকের মত বিক্রি করে তোমায় ভুলে যেতে চাইছি না। সত্যি কথা বলতে কী, তুমি যে লেখক, তুমি যে ভাল একজন লেখক, তা মানুষকে জানাতে চাইছি।’ রেডিওর লোকের জন্য বসে থাকতে ইচ্ছে করে না। আমরা উঠে পড়ি। ক্রিশ্চান আমাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যেতে এসেছেন। ছোট্ট একটি লাল গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলেন তাঁর প্রেসিডেন্ট উইলসন রোডের বাড়িতে। অসম্ভব রকম কর্মঠ তিনি, অবসর বলতে কিছু তাঁর জীবনে নেই। ক্রিশ্চান অনর্গল কথা বলেন। কোনও একটিও কিন্তু বাজে কথা নয়। ফরাসিরা কথা বলতে গেলে হাত পা মুখ মাথা ঠোঁট চোখ খুব নাড়ে। এটা ওদের সম্ভবত জাতীয় অভ্যেস। এডিশন দ্য ফামের মহিলা মিশেল ইডেল ফোন করছে, দেখা করতে চাইছে শুনে ক্রিশ্চান নাক সিঁটকে বলল, জ্ঞনারীবাদ নারীবাদ নারীবাদ। উফ! অসহ্য। নারীবাদ নিয়ে যারা লাফায়, আমি তাদের সহ্য করতে পারি না। এ হচ্ছে একধরনের সীমাবদ্ধতা। এও আরেক ধরনের মৌলবাদ। যে কোনও কিছুতেই আমরা নারী আমরা নারী। নারীর এই হয়নি সেই হয়নি। এই চাই সেই চাই। এই হতে হবে সেই হতে হবে। এ আবার কী! মানুষের কথা ভাব, মানুষের জন্য বল, মানুষের জন্য কর, নারী পুরুষ শিশু সবার কথা ভাব! কেবল নারীরই কি সব সমস্যা? শিশুদের নেই? পুরুষের নেই? হু!নারীবাদীদের উদ্দেশ্য নারী নিয়ে ব্যবসা করা, আর কিছু নয়।’

ক্রিশ্চান রাস্তার কিনারে গাড়ি রেখে তাঁর বাড়ির সামনের সড়কদ্বীপে বাজার বসেছে, সেখানে যায়। বাজারটি এই দ্বীপে বুধবার আর শনিবারে বসে। দুপুরের মধ্যেই বাজারটি উঠে যাবে। আবার সব ঝকঝকে তকতকে আগের মত। বিকেলে দেখলে কারও বোঝার উপায় থাকবে না এখানে একটি জমজমাট বাজার ছিল সকালবেলা। আমাদের কাঁচা বাজারের মত নয় এটি। সবকিছুর এখানে নির্ধারিত দাম। আমাদের দেশের মত চিৎকার করে দরদাম করতে হয় না। ক্রিশ্চান ফুল কেনে। লিলি অব দ্য ভ্যালি। চমৎকার ঘ্রাণ ফুলের, ছোট শাদা ফুল। ক্রিশ্চানের বাড়িটি তিনতলায়। এমন সুন্দর বাড়ি আমি জীবনে কমই দেখেছি। যেন বাড়ি নয়, আস্ত একটি মিউজিয়াম। সাতশ সিসি মেফেয়ার গাড়িটি দেখে মনেই হয়নি তাঁর বাড়িতে আছে খৃষ্টপূর্ব চারশ শতাব্দির প্রাচীন মূর্তি, ব্যাবিলিয়ন, সুমেরিয়ান সভ্যতার অমূল্য সব সম্পদ। প্রাচীন সব রঙিন পাথরের অলংকার। মিশরের গুহা থেকে তুলে আনা সেই আমলের জিনিসপত্র। আমি থ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি মূর্তিগুলোর সামনে, যেমন থ হয়ে ছিলাম ল্যুভরে। বাড়িটির দেয়ালে দেয়ালে যত তেলচিত্র আছে, সবই বড় বড় শিল্পীর। সবই আসল, নকল বলতে কিছু নেই। বাড়ির আসবাবপত্রগুলোও শিল্পীর তৈরি। যে কাপে চা খেতে দিল, সেটিও কয়েকশ বছর আগের। অ্যান্টিকে বাড়িটি ভর্তি। একটি অ্যান্টিক ল্যাণ্ডও আছে। অমিতাভ ঘোষের অ্যান্টিক ল্যাণ্ড বইটি ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেছেন ক্রিশ্চান নিজে। বইটির নামে ইজিপ্ট দেখে আমি ধন্দে পড়ি। ক্রিশ্চান বললেন বাণিজ্যিক কারণে তিনি নামটি পাল্টে দিয়েছেন। বাণিজ্যিক শব্দটি উচ্চারণ করতে এখানে কারও কোনও গ্লানি নেই। আমার চা খাওয়া শেষ হয়নি। টেলিভিশনের লোকেরা এল। জ্যঁ শার্ল বারথেয়ারও এল। একবার বাংলায় একবার ইংরেজিতে সাক্ষাৎকার নিল ওরা। এরপর নিচে, খানিকটা হেঁটে গিয়ে মডার্ন মিউজিয়ামের বারান্দায় আরেক দফা সাক্ষাৎকার। হাঁটছি, কথা বলছি, ক্যামেরা আমার প্রতি অঙ্গভঙ্গি তুলে রাখছে।

প্যারিস কেমন লাগছে?

এত সৌন্দর্য প্যারিসের, তা আমি আগে কল্পনাও করিনি।

জ্যঁ শার্ল বারথেয়ারকে অনুবাদক হিসেবে নিয়েছে টিভির লোকেরা। একসময় আমি মনিক আতলাঁকে, সাংবাদিক পরিচালক দুটোই তিনি, বলি যে বাংলা থেকে ফরাসিতে অনুবাদ হলে, আমি ইংরেজিতে একই প্রশ্নের উত্তরে যা বলেছি, সেটির সঙ্গে যেন মিলিয়ে দেখে নেন বক্তব্য ঠিক আছে কি না। লক্ষ করিনি জ্যঁ শার্ল আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। বলল, আপনি বিসওয়াস খরেন না? চমকে উঠি। তাকিয়ে বারথেয়ারের মুখ দেখি বিষণ্ন মুখ। বড় অপ্রস্তুত হই! বলি, ‘না না আপনাকে আমি বিশ্বাস করি। তবু এই আর কী! আপনার তো কিছু ভুল হতে পারে। যেমন ধরুন অনেক কঠিন কঠিন বাংলা শব্দ যদি না বুঝতে পারেন, তাই।’ আমার এই সান্ত্বনায় বারথেয়ারের বিষণ্নতা দূর হয় না। মায়া হয় মানুষটির জন্য। এমন ভাবে বলাটা বোধহয় উচিত হয়নি। ক্রিশ্চান বেস আর মনিক আতলাঁ হাঁটছি কথা বলতে বলতে, ফাঁকে ফাঁকে আমার ব্যাগ আর চশমা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বারথেয়ারের বিষণ্ন মলিন মুখটি দেখছি। নীল চোখ তার, ঘাড় অবদি সোনালী চুল, পরনে জিনসের জ্যাকেট — খানিকটা গবেট গবেট মনে হয় তাকে, বারথেয়ারকে, এত স্পর্শকাতর হবে ভাবিনি। কোনও ফরাসি পুরুষ এমন অভিমান করে মলিনতার চাদরে নিজেকে ঢেকে ফেলতে পারে, এই প্রথম দেখলাম। ক্রিশ্চানের গাড়ির কাছে যেতে যেতে সবার থেকে নিজেকে আলগোছে সরিয়ে দু কদম পিছিয়ে নিয়ে বারথেয়ারের সঙ্গে কথা বলতে থাকি আমি। এমনি কথা। ছোটোখাটো কথা। এতদিন আসলে বারথেয়ারকে বিষম এড়িয়ে চলেছি। ক্রিশ্চান যখন আমাকে নিয়ে গাড়িতে উঠবে, বারথেয়ারকে বললাম, আপনিও চলুন আমাদের সঙ্গে, আমরা দুপুরের খাবার খেতে যাচ্ছি, চলুন। বারথেয়ারের মুখটি মুহূর্তের জন্য উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কিন্তু ক্রিশ্চান তাকে ফরাসিতে কিছু বলল, কি বলল জানি না। সঙ্গে সঙ্গে বারথেয়ার আমাকে থতমত ঠাণ্ডা গলায় বলে দিল যে সে যেতে পারছে না, জরুরি কিছু কাজ আছে তার। তবে তিনি বারথেয়ার অপেরায় নিয়ে যাবেন আমাকে, অপেরার টিকিট কেটে এনেছিলেন। তিনি বললেন, সাতটায় হোটেলে যাবেন আমাকে অপেরায় নিয়ে যেতে। ক্রিশ্চান আমাকে লেবানিজ একটি রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেলেন। মুরগির কাবাবমত, আর কাঁচা বাধাকপি, নানা রকম কাঁচা পাতা, যা কখনও কাঁচা খাওয়া যায় বলে আমার ধারণা ছিল না। খেতে খেতে ক্রিশ্চানের সঙ্গে কথা বলি ফরাসি সাহিত্য নিয়ে। ফরাসি সাহিত্যিকরা কেমন লিখছেন, কী লিখছেন! ক্রিশ্চান সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট উল্টে বললেন, বাজে বাজে বাজে। নতুন প্রজন্মের সবাই আমবিলিকাসের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে সবই তো আছে তাদের। তারাই তো জনক শিল্পের সাহিত্যের। সুতরাং নতুন কিছুর আর কী দরকার! ক্রিশ্চান খুবই হতাশ ফরাসি লেখকদের নিয়ে। বললেন, জ্ঞআমি অনেক পাণ্ডুলিপি পাই ফরাসি লেখকদের। সবই অখাদ্য। কেবল বর্ণনা। কিছুই নতুন নয়। নতুন ভাষা নেই। নতুন বক্তব্য নেই।’

১. প্যারিসের ডায়রি – ০৩

ক্রিশ্চান জ্যঁ শার্লকে দিয়ে লজ্জা অনুবাদ করাচ্ছেন। এখন লজ্জা নিয়ে তিনি আর ভাবছেন না। ভাবছেন আমার অন্য বই নিয়ে। জ্যঁ শার্ল লন্ডন থেকে আমার বাংলা বই কিনে এনেছে। শোধ, নিমন্ত্রণ, ভ্রমর কইও গিয়া সবই তাঁর পড়া হয়ে গেছে। শোধের গল্পটি সে ক্রিশ্চানকে শুনিয়েছেন। খাতা কলম বের করে ক্রিশ্চান লিখে নিলেন কি কি বই এ পর্যন্ত লিখেছি আমি। কি কি তাঁকে আমি এখন দিতে পারব ছাপতে। এ পর্যন্ত আমি যা লিখেছি সবই তিনি চান এবং এখন যেটি লিখছি, কোরানের নারী, সেটিও তাঁর চাই। সব তাঁর চাই, যা আছে। কবে পাঠাতে পারব সব। কখন। সব তাঁর জানা চাই। বাংলায় পাঠাই, ইংরেজিতে পাঠাই তাঁর কোনও অসুবিধে নেই। ইংরেজিতে পাঠালে তিনি নিজে অনুবাদ করে নেবেন। বাংলায় হলে বাংলা জানে এমন কাউকে দিয়ে প্রাথমিক অনুবাদ করিয়ে নিয়ে নিজে তিনি সংশোধন করবেন। আমি প্যারিসে থাকাকালীনই তিনি আমাকে দিয়ে কনট্রাক্ট ফর্ম সই করাতে চান। বারবারই বললেন, ‘তসলিমা, তোমার নামকে নয়, আমরা তোমার লেখাকে ছাপতে চাই।’

টেলিভিশনের জন্য ক্রিশ্চানের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। জিজ্ঞেস করিনি, নিজেই বললেন যে আমার সম্পর্কে জরুরি যে কথাটি বলেছেন তা হল, ‘তসলিমার হাতে একটি অস্ত্র আছে, অস্ত্রটির নাম কলম।’

আমার ঘড়িটি প্যারিসে আসার পথেই বন্ধ হয়ে আছে। ক্রিশ্চানও ঘড়ি পরতে পছন্দ করেন না। এদিকে দিন দেখে বোঝার উপায় নেই কটা বাজে। যে দেশে রাত দশটা অবদি আলো থাকে, কি করে অনুমান করব কখন সে দেশে দুপুর হয়, কখন বিকেল আর কখন সন্ধে। হোটেলে ফিরতে হবে, এডিশন স্টক থেকে ফটোগ্রাফার আসবে ছবি তোলার জন্য। দ্য ফাম প্রকাশনীর মিশেল ইডেল আসবেন। মিশেলএর সঙ্গে আমার দেখা করার ইচ্ছে কারণ মিশেলই প্রথম ফরাসি প্রকাশক আমার সঙ্গে ঢাকায় যোগাযোগ করেছিলেন। দ্য ফাম থেকেই আমার বই চাওয়া হয়েছিল সবার আগে। ওদেরই প্রথম আমি কথা দিয়েছিলাম লজ্জা বইটি ওদেরই দেব। শেষ পর্যন্ত লজ্জা আমি এডিশন স্টককে, ক্রিশ্চানের প্রকাশনীকেই দিই। মিশেল ওদিকে বইয়ের জন্য ফোন করছেন রাত দিন। জ্ঞদেখ তসলিমা আমরাই প্রথম তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, আর তুমি কেন চুপ করে আছ, কেন বার বার ফোন করেও তোমাকে পেতে পারি না। কেন তুমি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছ না। টাকার প্রয়োজন তোমার? কত টাকা চাও? এডিশন স্টক কত টাকা দিতে চাইছে তোমায়, তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা আমরা দেব। তবু লজ্জা ছাপার অনুমতি আমাদের দাও।’ লজ্জা ছাপবেন বলে কনট্রাক্ট ফর্ম পাঠিয়েছেন, নিজেদের ছাপানো বই পত্র পাঠিয়েছেন যেন দেখে সিদ্ধান্ত নিই। বলেছেন, ‘দেখ তসলিমা দয়া করে আমাদের অনুমতি দাও লজ্জা ছাপার। আমরা আং সাং সুচির বই ছেপেছি, সুচি ইউনেস্কো পুরস্কার পেয়েছে। আন্তোনেত ফুক তোমার জন্যও ইউনেস্কো পুরস্কারের ব্যবস্থা করবেন।’ শুনে ভীষণ বিব্রত আমি। আমাকে কি লোভ দেখানো হচ্ছে! আমি তো লোভে পড়ছি না, টোপমাখা বাক্য শুনে বরং লজ্জায় পড়ছি। লজ্জার জন্য দুটো প্রকাশনী এমনই উন্মাদ হয়ে উঠেছে যে মাঝখানে পড়ে আমি লজ্জায় মুখ লুকোই। দুজনকেই আমি বোঝাতে চেষ্টা করেছি, দেখ লজ্জা এমন একটা বই নয় যেটা তোমাদের পাঠকের আদৌ ভাল লাগবে,বইটি বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সমস্যা নিয়ে লেখা, তার ওপর বইটি তথ্যভিত্তিক বই। ফরাসি পাঠকের এই বই মোটেও ভাল লাগবে না, ওরা বুঝবেও না। না, আমার কথা কেউ মানবেন না। তাঁদের বই চাই, চাইই, যে করেই হোক চাই। ক্রিশ্চানের চাপে আর তাপে বইটি তাঁকে ছাপার অনুমতি দেওয়ার পর মিশেলের জন্য সত্যিই আমার কষ্ট হতে থাকে। লজ্জার মত অসাধারণ একটি বই তিনি পেলেন না বলে নয়, তাঁর ইচ্ছের আমি মূল্য দিইনি বলে তিনি যে কষ্ট পেয়েছেন, সে কারণে। হোটেলে সাড়ে পাঁচটায় পৌঁছে দেখি চারটা থেকে অপেক্ষা করছে এডেন, ছবি তোলার মেয়ে। অপেক্ষা করছে মিশেল ইডেল। মিশেলের বয়স চল্লিশের ওপর। আমাকে আমার দেশে লম্বা মেয়ে বলা হয়, আমার চেয়েও দেড় হাত লম্বা মিশেল, নিখুঁত সুন্দরী। মুখে হাসি লেগেই আছে। ডানে ক্রিশ্চান বামে মিশেলকে নিয়ে আমি তখন কী করি, কোথায় যাই বুঝতে পারছি না। সত্যি, এমন অস্বস্তিকর অবস্থায় আমি আর পড়িনি। সারাপথ ক্রিশ্চান বলে বলে এসেছেন, ‘প্রকাশক একজন থাকা উচিত তোমার এ দেশে। দুজন প্রকাশক থাকবে কেন! কারণ কি বল! এখানে কোনও লেখকই একাধিক প্রকাশককে বই দেন না। তুমি দেখ আমাদের প্রকাশনীটিকে! দেখ আমরা কী ধরনের বই প্রকাশ করছি। কী মানের বই তুমি নিজে এসে দেখে যাও। আজে বাজে ছোট প্রকাশকের সঙ্গে তোমার দেখা করাই উচিত নয়। আমি অবাক হয়ে যাই তোমার রুচি দেখে। দ্য ফাম!! তারা? তাদের তুমি পছন্দ করলে কি করে? তারা সব বাজে। জঘন্য। নারী নারী নারী বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলল! যত্তসব। এইসব বাজে জিনিস দেখেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি প্রকাশনায় যাওয়ার। তসলিমা, কোনও কিছুর জন্য আমি তোমাকে চাপ দিতে চাই না। দেব না। তোমার অধিকার আছে যা কিছু করার, যাকে খুশি বই দেবার। কিন্তু তোমার তো রুচি থাকা উচিত। অন্তত সামান্য রুচি তো তোমার কাছে আশা করি। তুমি কি করে ওদের প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলে? উফ, ভাবতেই পারি না। ভাল যে আমি এসে বাঁচিয়েছিলাম তোমাকে ওদের হাত থেকে। এখন আবার বলছ যে তুমি ওদের সেমিনারে যাবে? তোমার কি মাথা টাথা খারাপ হয়েছে? থার্ড ক্লাস। থার্ড ক্লাস। গেলেই বুঝবে। শোনো, মাথায় যদি তোমার সামান্য ঘিলু থেকে থাকে, তবে আমার কথা তুমি রাখবে, আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, যেও না। যেও না ওদের সেমিনারে। নিজের মানটা নষ্ট কেরো না। হাস্যকর পরিবেশে গিয়ে নিজেকে হাস্যকর কোরো না।’ একটি প্রার্থনাই আমি মনে মনে করেছি হোটেলে ফেরার পথে, মিশেল ইডেল আমার জন্য হোটেলে অপেক্ষা করতে করতে আমি ফিরছি না বলে যেন তিনি বিরক্ত হয়ে ফিরে যান। আমার প্রার্থনা কোনও খোদা বা ভগবানের কাছে নয়, এই জগতের রহস্যময় জটিল প্রকৃতির কাছে। প্রকৃতি আমার ডাকে সাড়া দেয় না। মিশেল ইডেল তাঁর হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা নিয়ে হোটেলের দরজায় দণ্ডায়মান। আমি আর ক্রিশ্চান মুখোমুখি মিশেলের। আমি এখন কাকে সামলাবো। ক্রিশ্চান মোটেও মিশেলের দিকে ফিরে না তাকিয়ে একদমে বলে যান, ‘তসলিমা, তোমাকে এখন ছবি তুলতে হবে, এডেন বসে আছে অনেকক্ষণ। তাড়াতাড়ি চল। ছবি তুলে তারপর তো তোমাকে অপেরায় যেতে হবে, জানো তো! জ্যঁ শার্ল আসবে ঠিক সাতটায়। মনে আছে তো! তাড়াতাড়ি কর।’

আমি মরা কণ্ঠে এডেনকে জিজ্ঞেস করি, তুমি কি ঘরে ছবি তুলবে, না কি বাইরে? সুন্দরী এডেন মধুর হেসে বলল, বাইরে।

বাইরে?

ইতস্তত করি।

এডেন আবারও হেসে বলল, দূরে নয়। কাছেই। কাছেই পেলে দ্য রয়াল। ওখানকার বাগানে।

খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে কিন্তু। বেশি সময় নেই আমার। কারণ.. ক্রিশ্চানের দিকে যতটা সম্ভব না তাকিয়ে বলি, কারণ মিশেল এসেছে আমাকে নিতে, সেমিনারে যেতে হবে।

ক্রিশ্চান হা হা করে উঠল, কিসের সেমিনার? কোন সেমিনার? তুমি না অপেরায় যাচ্ছ! জ্যঁ শার্ল তোমাকে নিতে আসবে। ও টিকিট করে রেখেছে।

এবার আমাকে একটি পক্ষ নিতে হবে। ক্রিশ্চান বিদেয় হলে এখন আমি বাঁচি। এ সময় মিশেলকে ফিরিয়ে দেওয়া আমার উচিত নয়। এত বড় অমানবিক কাজটি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমি সেমিনারে যাবো, কথা যখন দিয়েছি, যাবই।

ক্রিশ্চানকে এড়িয়ে আমি বলি, চল একটা ট্যাক্সি ডাকি, এডেন মিশেল আর আমি একসঙ্গেই চল বাগানটিতে যাই। ওখান থেকে মিশেল আর আমি চলে যাব।

ক্রিশ্চান গাড়ির দিকে যাচ্ছে, যেন আমার কথা শোনেনি, বলল, চল চল বাগানে চল, আমি তোমাদের দুজনকে নিয়ে যেতে পারব। এডেন এসো, তসলিমা এসো।

আরে বাবা মিশেল কোথায় যাবে! মিশেলের কি হবে? মিশেল হতভম্ব দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি তাঁর হাত ধরে বললাম, আপনিও চলুন।

মিশেল গাড়িতে উঠতে যাচ্ছেন, ক্রিশ্চান বলেন, আমার গাড়িতে তো দুজনের বেশি জায়গা হবে না।

হবে হবে। আমি বলি, সামনে আমি বসছি। পেছনে ওরা দুজন বসবে, জায়গা হবে না কেন! ঠিকই হবে।

ক্রিশ্চান ভেতরে গজগজ করছেন তা ঠিকই বুঝি। বাগানে ফটাফট কটি ছবি তুলে আর সময় দিতে পারব না বলে কেটে পড়ি। মিশেল একটি ট্যাক্সি ডেকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন, ওতে উঠে পড়ি। দুজনে কথা বলতে থাকি বিরতিহীন, যেন অনেককালের সম্পর্ক আমাদের। আমাকে মিশেল নিয়ে গেলেন অনুষ্ঠানে, বিশাল সেমিনার কক্ষটির মঞ্চের দিকে, যে মঞ্চে বসে আছেন কয়েকজনের সঙ্গে হুইল চেয়ারে একজন, সেই একজনের দিকে, আন্তোয়ানেত ফুকের দিকে। ষাট দশকের নারী আন্দোলনের নেষনী এই ফুক। এখন ইউরোপীয় পার্লামেণ্টে সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য। এডিশন দ্য ফাম নামের প্রকাশনীর মালিক প্রকাশক তিনিই। তাঁকেই মিশেল ইডেল গুরু মানেন। ফুকের সঙ্গে করমর্দন হল। হাসি বিনিময় হল। চুমোচুমি হল। মঞ্চ থেকে ঘোষণা করে দেওয়া হল আমার আগমন বার্তা, তসলিমা শব্দটি শুধু চিনতে পারলাম একগাদা ফরাসি শব্দের ভিড়ে। সঙ্গে সঙ্গে বিশাল ঘর ভর্তি নারী পুরুষ প্রচণ্ড হাততালি দিতে শুরু করলেন, হাততালি দিতে দিতে দাঁড়িয়ে গেলেন সকলে। এমন দৃশ্য আগে কখনও দেখিনি। এত মানুষ আমাকে অভিবাদন জানাচ্ছেন। আমি অভিভূত। বিস্মিত। শিহরিত। কিছুটা বিব্রতও। চোখে আমার জল চলে এল। আজ কি সত্যিই এখানে এসে পৌঁছেছি আমি! এ কি আমার জন্য অতিরিক্ত নয়! এত আমার প্রাপ্য ছিল না। আমাকে কিছু বলতে বলা হল মঞ্চে দাঁড়িয়ে। কী বলব! কী কথা বলা যায় এখানে। সকলের চেয়ারের সামনে লেখার জন্য টেবিল। নারীবাদের ওপর দামি দামি কথাবার্তা হচ্ছিল এখানে, সকলে লিখে নিচ্ছিলেন আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো। সব থামিয়ে দেওয়া হল আমি বক্তৃতা দেব বলে! কোনও কিছু কি আমি বলতে পারবো যা এঁদের কাছে নতুন! মিশেল আর আন্তোয়ানেতকে মিনমিন করে বললাম, দেখ আমাকে তো আগে বলা হয়নি যে আমাকে বক্তৃতা করতে হবে! আমার তো কোনও প্রস্তুতি নেই, তাছাড়া আমি ক্লান্ত, আমাকে যেতেও হবে এক্ষুনি। এত অপ্রতিভ বোধ করছিলাম যে বেরিয়েই এলাম। বেরিয়ে এসে মনে হল আহা ওই অভিবাদনের উত্তরে অন্তত ধন্যবাদ জানানো উচিত ছিল।

আমার আর মিশেলের পেছন পেছন কয়েকজন তরুণী বেরিয়ে এল। মিশেলকে বললাম, আমার কিছু বলা উচিত ছিল ওখানে। সবাই নিশ্চয়ই মন্দ বলবে।মিশেল হেসে আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘কী যে বলছ তসলিমা। সবাই ভীষণ খুশি তোমাকে দেখে। তোমার উপস্থিতিটাই বড়। বলতেই যে হবে এমন কোনও কথা নেই।’ সবাই আমরা কাছের একটি ক্যাফেতে গিয়ে বসলাম। এক ফরাসি তরুণী কাঁপা কাঁপা হাতে আমার হাত ছুঁয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমি ধন্য হলাম। ক্যাফেতে আমাকে ঘিরে বসে সবাই আমি কেমন আছি, কি করছি, কি ভাবছি, সবই জানতে চাইছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুই জানে না তারা, জানে কেবল আমাকে। আমার জন্য সবাই দুশ্চিন্তা করছে। ফতোয়ার খবর পাওয়ার পর প্যারিসের রাস্তায় নেমেছিল নারীবাদীরা, বাংলাদেশ দূতাবাসের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছে আমরা তসলিমার সমর্থক লেখা বড় বড় প্ল্যাকার্ড নিয়ে। তারা আমার লেখা পড়তে চায়। কবে বেরোবে বই জানতে অস্থির হয়ে ওঠে। হবেই তো। পৃথিবীর অপর প্রান্তে কোনও এক বন্যা আর ঘূর্ণিঝড়ের দেশের এক মেয়ে নারী স্বাধীনতার কথা লিখতে গিয়ে ফতোয়ার শিকার হয়েছে, কী লিখেছে সে যে এত লোক ক্ষেপে গেল, তা জানার আগ্রহ তো এদের থাকবেই। মনে মনে ভাবি, এই যে লজ্জা বইটির জন্য এমন অপেক্ষা করে বসে আছে পড়বে বলে, লজ্জায় তো নারীবাদের কথা নেই। কেউ যদি ভেবে থাকে ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু বলেছি বলে লজ্জা বাজেয়াপ্ত করেছে বাংলাদেশ সরকার অথবা ইসলামি মৌলবাদীরা আমার মাথার মূল্য ধার্য করেছে তবে তা যে সম্পূর্ণ ভুল তা আমি কী করে কাকে বোঝাবো! ক্যারোল টাং ও অপেক্ষা করছেন আমার বই পড়ার জন্য। ক্যারোল টাং ইওরোপীয় পার্লামেণ্টের মন্ত্রী। তিনিই উদ্যোগ নিয়েছিলেন কুড়ি দফা দাবি পেশ করার, আমার পাসপোর্ট যদি ফেরত না দেওয়া হয়, নিরাপত্তা যদি না দেওয়া হয় আমাকে তবে ইউরোপ থেকে বাংলাদেশের কোনও অর্থ-সাহায্য পাওয়ার বারোটা বাজবে ইত্যাদি। রেসোলুশনটি পাশ হয়েছে এপ্রিলের একুশ তারিখে।

ফ্রান্স থেকে কদিন পরই দেশে ফিরে যাচ্ছি শুনে সকলে অবাক হয়। বিস্ফারিত চোখ একেকজনের।

–ওখানে তো আপনাকে মেরে ফেলবে। দেশে ফেরা আপনার উচিত হবে না।

–দেশে কি আর আমি একা লড়াই করছি। আমার পাশে অনেকে আছেন।

–আপনার জীবন মূল্যবান। আপনাকে লিখতে হবে। দেশে যদি আপনাকে মেরে ফেলে তাহলে লিখবেন কি করে? আপনি ফ্রান্সে থাকুন। লিখতে হলে বেঁচে থাকতে হবে তসলিমা।

–লেখালেখি দেশে বসেই করব। দেশ ছাড়ব না।

–এ কোনও কথা হল? আপনার ভয় করে না?

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেকদিন থেকে আছি, এভাবে থাকাটাই এখন অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। লড়াই করে বাঁচতে চাই। পালিয়ে নয়। যদি মরতে হয়, মরে যাবো। এ আর এমন কী! কত লোকে মরছে।

সকলের বিস্মিত চোখের সামনে সাতটা বেজে গেলে আমি উঠে পড়ি। মিশেল আমাকে হোটেলে পৌঁছে দেবার সময় বার বার করে বললেন যেন আন্তোয়ানেতের জন্য কোনও একদিন সময় রাখি। আমাকে নিয়ে তাঁরা প্যারিসের বাইরে কোথাও যেতে চান। আরও অনেক কিছুর ইচ্ছে আছে। সেজেগুজে পাটবাবুটি হয়ে যথারীতি হোটেলে অপেক্ষা করছিলেন জ্যঁ শার্ল। আমার যে অপেরায় যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল তা নয়, অনেকটা জ্যঁ শার্লকে আহত না করার জন্য, যেহেতু যথেষ্টই করা হয়েছে ইতিমধ্যে, আর কিছুটা জিলকে এড়াবার জন্য আমার এই অপেরায় যাওয়া। জিল বারবারই বলেছে, আমি যেন একটু ফাঁক পেলেই তাকে ফোন করি, ফোন করলেই চলে আসবে সে। আমি চাইছিলাম না জিলকে ফোন করতে। থাকে সে মপঁলিওতে। ফ্রান্সের দক্ষিণ প্রান্তের এক শহরে। আর তার প্রেমিকা বাস করে প্যারিসে। নাতালির সঙ্গে তার সময় কাটানো নিশ্চয়ই আনন্দের, অন্তত আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর চাইতে। তাছাড়া জিলকে আমার এত ভাল লাগে যে, তার জন্য মন কেমন করা থেকে নিজেকেও একরকম বাঁচাতে চাই। নাহ, জিল নাতালির সঙ্গে সময় কাটাক, আমার জন্য তার সারাদিনটি নষ্ট করার প্রয়োজন নেই। জিল নাতালিকে ভালবাসে, বাসুক। আমার মন যেন এত জিলে পড়ে না থাকে। আসলে, এত চমৎকার না হলেও সে পারত। আমার চেয়ে বয়সে সে চার বছরের ছোট। আশ্চর্য, কখনও কোনওদিন আমার চেয়ে অল্প বয়সের কারও জন্য আমার মন কেমন করেনি। জিলের জন্য কেন করে বুঝিনা।

প্যারিসের নতুন অপেরাটি আধুনিক স্থাপত্যের একটি উদাহরণ বটে। ফরাসি লেখক জর্জ পেরেক এটিকে অবশ্য বড় মাপের পাবলিক টয়লেটের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ফরাসিরা শহর ভর্তি চমৎকার পুরোনো স্থাপত্যের মধ্যে হুট করে একটি বেঢপ দালান তুলতে মোটেও রাজি ছিল না। রাস্তায় নেমে রীতিমত আন্দোলন করেছে নতুন অপেরাটির নির্মাণের বিপক্ষে। আন্দোলনে কাজ হয়নি, শেষ অবদি ফরাসি নন্দনতাত্ত্বিকদের বিচারে যে বস্তুটি একটি কুৎসিত স্থাপত্য, সেটিই আধুনিক অপেরা হিসেবে ঠিক ঠিক দাঁড়িয়ে গেল। অপেরায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল জ্যঁ শার্লের স্ত্রী নাতাশা। আমাকে মাঝখানে বসিয়ে দু পাশে বসে গেল দুজন। নাতাশা নাদুস নাদুস মেয়ে। তার হাঙ্গেরিয়ান মা ওয়ার এণ্ড পিস পড়ে এত মুগ্ধ হয়েছিলেন যে কন্যা জন্মালে নাম রাখলেন নাতাশা। নাতাশা আর জ্যঁ শার্ল তাদের ছেলের নাম রেখেছে সত্যজিৎ। শুনে এত ভাল লাগে। প্যারিসের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সেদিন দেখেছি সত্যজিৎ রায়ের ছবি চলছে, সাতদিনের সত্যজিৎ উৎসব। আনন্দে এমনই ভেসেছিলাম যে চোখে জল চলে এসেছিল। হয় এমন।

এখানকার নাটক থিয়েটারের শেষে যে জিনিসটি হয়, তা আমাদের দেশের নাট্যমঞ্চে দেখিনি। নাটকের শেষে শিল্পীরা যখন সবাই মঞ্চে এসে দাঁড়ায় বিদায় জানাতে, দর্শকরা তাদের করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানায়। কিন্তু দর্শকের যদি কোনও নাটক খুব ভাল লাগে, সেই করতালি আর সহজে থামে না। যতক্ষণ না থামে ততক্ষণ বার বারই শিল্পীদের মঞ্চে এসে এসে অভিনন্দন গ্রহণ করতে হয়। অপেরা থেকে রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খেতে গিয়ে রেস্তোরাঁয় একটি টেবিল পেতেই আমাদের অপেক্ষা করতে হয় এক ঘন্টা। অনেক রাত অবদি রেস্তোরাঁয় বসে তরুণ তরুণীর পরস্পরকে যথারীতি জড়িয়ে ধরা, একশ লোকের সামনে চুমু খাওয়ার দৃশ্য দেখতে দেখতে গল্প করতে থাকি। গল্পে গল্পে এইডসের প্রসঙ্গ ওঠে। নাতাশা আর জ্যঁ শার্ল দুজনেই বলল, প্রায় প্রতিদিনই এই রোগে কেউ না কেউ মারা যাচ্ছে ফ্রান্সে। তিরিশ হাজার ফরাসি এইডস রোগে ভুগছে। ইউরোপের মধ্যে ফ্রান্সেই সবচেয়ে বেশি এইডস রোগী। ফরাসিদের মধ্যে এখন সচেতনতা বেড়েছে। এইডসের ভয়ে অনেকে আগ্রহ হারাচ্ছে যৌনসম্পর্কে, এমনকী প্রেমেও। এইডসের রোগীরা ক্রমে ক্রমে নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছে, কেউ মিশতে চাইছে না, কাজ করতে চাইছে না তাদের সঙ্গে। এসব মন খারাপ করা ঘটনা শুনে হোটেলে যখন ফিরে আসি আমি, বড় ক্লান্ত। শরীরটিকে বিছানায় এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে আসার আগে চোখ পড়ে জিলের দেওয়া লিস ফুলে। কি সুন্দর ফুটে আছে ফুলগুলো। জিল কেমন আছে। কী করছে! নিশ্চয়ই ঘরে নেই। শনিবার রাতে কেন সে ঘরে থাকবে! নাতালিকে নিয়ে নিশ্চয়ই রাতের প্যারিস জুড়ে আনন্দ করছে। যারা যারা ফোন করেছিল, হোটেলের লোক কাগজে লিখে রাখে। নামগুলোর ওপর দ্রুত চোখ বুলিয়ে জিলের নাম খুঁজি। নেই।

১. প্যারিসের ডায়রি – ০৪

পরদিন পয়লা মে। ঘুম ভাঙে ফোনের কর্কশ শব্দে। জিল হলে শব্দটি হয়ত এত কর্কশ মনে হত না, ক্যামেরুনের সাংবাদিক পিয়েস বলেই হয়। আজও তার একসঙ্গে নাস্তা খাওয়ার আবদার। এক হোটেলে পাশের ঘরে থাকছে, অথচ দেখা হচ্ছে না, কথা হচ্ছে না। কাল চারটের সময় চা খাওয়ার কথা ছিল, ফিরতে পারিনি চারটেয়। নটায় নিচতলায় নেমে পিয়েসএর সঙ্গে নাস্তা করলাম। আমার পরনে ছিল সার্ট প্যান্ট, খাচ্ছিল!ম শখের সিগারেট। পিয়েস বলল, তুমি কি মুসলিম দেশে এরকম পোশাক পরতে পারো, সিগারেট খেতে পারো? আমি বললাম, সার্ট প্যান্ট পরা যায়, তবে রাস্তাঘাটে খুব য়চ্ছন্দে চলাফেরা করা যায় না। আর মেয়ে হয়ে সিগারেট খেলে লোকে ছি ছি করে। পিয়েস হেসে বলল, ক্যামেরুনে এসবে কোনও অসুবিধে নেই। পিয়েসের আরেকটি আবদার, আমার একটি সাক্ষাৎকার তার চাইই চাই। জ্ঞচলুন আমার ঘরে যাই, ওখানে আমার রেকর্ডার আছে। বাড়তি শব্দ কম হবে ঘরে।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে পিয়েসের আবদার নাকচ করে দিই। যদিও তাকে রজার মিল্লারের মত দেখতে লাগে, তবু দানবের মত বিশাল দেখতে লোকটির ঘরে গিয়ে সাক্ষাৎকার দিতে আমার মোটেও ইচ্ছে হয় না। কী জানি, ভয় ভয়ও হয়ত করে। এটি কি, আমি জানি না, মস্তিষ্কের গোপন কোনও কোষে, বিশ্বাসের মত আছে, কালো কুচকুচে কিছু মানেই ভূত বা ওই জাতীয় ভয়ংকর কিছু। জ্যঁ শার্ল আসার আগে, জিলকে করব না করব না করেও ফোন করি।

ফোন পেয়ে জিল বলল, কি খবর তোমার! তোমার ফোনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমি এখন ক্লান্ত হয়ে গেছি।

–আমার ফোনের জন্য অপেক্ষা করছিলে! কেন তুমি নিজে একবার ফোন করোনি।

–তুমি কখন হোটেলে থাকো না থাকো তার ঠিক নেই। তার চেয়ে, আগেই তো বলেছি, তুমি যখন ব্যস্ত থাকবে না, আমাকে ফোন করো। আমি চলে যাবো তোমার কাছে। এখন বল, কি প্রোগ্রাম তোমার আজকে? আমি চাইছি তুমি আমার সঙ্গে প্যারিসটা ঘুরে দেখ!

–না হবে না। জ্যঁ শার্ল আসবে এখন। বেরোবো। তারপর বিকেলে মিশেল আসবে নিতে।

–এত ব্যস্ততা!

আমি হেসে ফোন রেখে জ্যঁ শার্ল এলে বেরিয়ে পড়ি। জ্যঁ শার্ল গাড়ি আনেনি আজ। রাস্তায় মিছিল মিটিং হচ্ছে, পুলিশ সব জায়গায় গাড়ি চলতে দিচ্ছে না, তাই। মে দিবস আজ। দোকান পাট বন্ধ। অন্যরকম প্যারিসের চেহারা। আমরা হেঁটে হেঁটে জোন অব আর্কের মূর্তির পাশে গেলাম। মূর্তির সামনে প্রচুর ফুল পড়ে আছে। খুব অবাক হলাম শুনে যে চরম ডানপন্থী দল মে দিবসে জোন অব আর্কের পাদদেশে ফুল দেয়, এবং জোন অব আর্ককে ডানপন্থীরাই নিজেদের প্রতীক হিসেবে নিয়ে নিয়েছে। জোন অব আর্কের মূর্তিতে ফুল দিতে চাইলে জ্যঁ শার্ল না না করে উঠল, বলল এতে ফুল দেওয়া মানে তুমিও ফ্যাসিস্ট দলের মত আচরণ করলে।

–বল কি!

–ফ্যাসিস্ট ছাড়া আর কেউ ফুল দেয় না জোন অব আর্কের মূর্তিতে?

–না।

–জোন অব আর্ক তো ফ্রান্সের গৌরব। কেন নয়?

–কারণ চরম ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী লিপেনের দলের রানী সে।

–কেন এরকম হল?

–হল কারণ জোন অব আর্ক ফ্রান্সের জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। লিপেনও ভাবছে, তারাও তাই করছে। এই চরমপন্থীরা সব বিদেশি ইমিগ্রেন্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এ হচ্ছে জঘন্য জাতীয়তাবাদ।

–জাতীয়তাবাদ তো আমাদের উপমহাদেশে পজেটিভ একটি শব্দ।

–হিটলার জাতীয়তাবাদী ছিল। ইউরোপে জাতীয়তাবাদ শব্দটি খুব নিগেটিভ। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে নিজের দেশকে মুক্ত করার জন্য শোষিতদের জাতীয়তাবাদী হওয়া আর স্বদেশে বসে ইউরোপীয় ঔপনিবেশবাদী শাসককুলের ভিন্ন জাতের প্রতি ঘৃণা পোষা, তাদের দূর দূর করে তাড়ানো আর নিজের জাতের অহংকারে জাতীয়বাদী হওয়া দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস।

জ্যঁ শার্ল পেশায় সায়কোএনালিস্ট। তাকে বাইরে থেকে দেখলে মানসিক রোগী মনে হলেও ভেতরে মানুষটি বুদ্ধিমান। আমি ফরাসি ভাষা জানলে অথবা জ্যঁ শার্ল ভাল বাংলা জানলে আমাদের আড্ডা চমৎকার জমতে পারতো, পরস্পরকে আমরা আরও বুঝতে পারতাম নিশ্চয়ই। হাঁটতে হাঁটতে অচিরে আমরা দেখতে পেলাম ল্যুভর মিউজিয়ামের পেছনে একটি খোলা জায়গায় লিপেনের দলের বিশাল সভা। লাল নীল সবুজ হলুদ বেলুন উড়ছে, মঞ্চে বসে আছে কিছু লোক, মঞ্চের সামনে হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে শুনছে বক্তৃতা। বক্তা ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সোশ্যালিস্ট দলের নেতা ফ্রাঁসোয়া মিতেরোঁর কথা কিছু বলছে, আর শুনে খুশিতে লাফাচ্ছে শ্রোতা। জ্যঁ শার্লকে জিজ্ঞেস করি, মিতেরোঁকে কি বলছে?

–গালি দিচ্ছে।

–কী বলে গালি দিচ্ছে?

জ্যঁ বলল, শুয়োর।

মঞ্চে কেবল পুরুষ নেতাই নন, নারী নেষনীও বসে আছেন। আশ্চর্য, তাঁরা কি গণতন্ত্রের চর্চা করছে মঞ্চের ওপর! এই ডানপন্থী দলটিই তো মেয়েদের চাকরি বাকরি ছেড়ে দিয়ে ঘরে ফিরে যাওয়ার কথা বলছে, বলছে ঘরে ফিরে যেন মেয়েরা শাদা শাদা সন্তানের জন্ম দেয়, কারণ কালো আর বাদামীরা জন্মে জন্মে পৃথিবী দখল করে নিচ্ছে। সুতরাং এই চরম ডানপন্থী বর্ণবাদী ফ্যাসিস্ট দলের উপদেশ হল, মেয়েরা এতকাল ধরে সংগ্রাম করে যে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তা যেন দেশের স্বার্থে শাদা বর্ণের স্বার্থে বিসর্জন দেয়! মিশেল ইডেল বলেছেন সেদিন, লিপেনের দল এরকম একটি আইন তৈরি করতে চাইছে, যে বাচ্চা বিয়োলে মেয়েরা কাজ করে যে টাকা উপার্জন করত, সেই পরিমাণ অথবা তারও চেয়ে বেশি টাকা কাজ না করেই ঘরে বসে পেয়ে যাবে। চাকরি বাকরি করার জন্য মেয়েরা সন্তান জন্ম দিতে আগ্রহী হচ্ছে না, এটি নিয়ে লিপেনের খুব মাথা ব্যথা। তাহলে তো সর্বনাশ গো। মিশেলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মেয়েরা কি এখন সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হওয়ার আদিম ব্যবস্থায় ফিরে যাবে বসে বসে টাকা পাওয়ার লোভে? মিশেল বলেছেন, জ্ঞনাহ! ফ্রান্সের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন এমন কিছু ভাল নয়। এটি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। মেয়েরা বেকার হওয়ার ঝুঁকি নেবে না। ভাল যে লিপেন ক্ষমতায় নেই।’ আমার আশঙ্কা কবে না জানি আবার লিপেনের দল ভোটে জিতে যায়! ফ্রান্সে ভোট দিতে যাওয়ার লোক খুব কম। ভোটের দিন তারা হয় দূরে কোথাও বেড়াতে চলে যায়, নয়ত ঘরে বসে আরাম করে। ভোটের প্রতি সাধারণ মানুষের এই অনীহার এই সুযোগে আবার লিপেনের দল কোনও দিন না জিতে যায়! তখন কালো বাদামী মানুষের জন্য তো সমস্যাই, শাদা মেয়েদের জন্যও সমস্যা।

বয়স্ক কিছু লোক তাদের এককালের বুকে ব্যাজ লাগানো মেডেল লাগানো সেনা- পোশাক পরে এসেছে লিপেনের সভায়। আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছি, তার বাঁ পাশেই এক ইয়া মোচঅলা লোক সেনা পোশাকে দাঁিড়য়ে ছিল, জ্যঁ বলল, লোকটি আলজেরিয়ায় যুদ্ধ করেছে। লোকের সঙ্গে একটি বুড়ো কুকুর। দেখে জ্যঁ চোখ বড় বড় করে বলে, কুকুরটিরও ট্রেনিং আছে আলজেরিয়ানদের কামড়ানো। বলে কি! তাই নাকি? জ্যঁ নিশ্চিত স্বরে বলল, নিশ্চয়ই। লোকটির হাতে একটি বড় পোস্টার, ফরাসি ভাষায় কি লেখা আছে জানতে চাইলে জ্যঁ বলল, ইওরোপ এক হওয়ার বিরোধী। জাতীয়তাবাদ যাকে বলে। আমরা ফরাসি, আমাদের জাত অন্য জাতের চেয়ে ভাল। আমরা অন্য কোনও জাতের সঙ্গে এক হব না।

সামনে নির্বাচন ফ্রান্সে। আমি জ্যঁ শার্লকে জিজ্ঞেস করি, এরা যদি জিতে যায়!

জ্যঁ ঠোঁট উল্টে বলল, আরে না! এরা খুবই ছোট দল।

যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখান থেকে সরে ল্যুভরের বারান্দায় ধরে হাঁটতে গিয়ে লক্ষ করি, কিছু লোক তীক্ষ্ণ চোখে আমাকে দেখছে। হঠাৎ জ্যঁ আমাকে টেনে উল্টো দিকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ওদিকে যেও না।

–কেন যাবো না?

–বিদেশিদের ওপর ওদের খুব রাগ। গালাগাল করতে পারে।

–গালাগাল করবে? আমি তো বুঝবও না গালি।

–তুমি না বুঝলেও আমি তো বুঝব।

–কী বলে গালি দেবে?

–বলবে নিজের দেশে ফিরে যা। এখানে এসেছিস আমাদের দেশের সুযোগ সুবিধে ভোগ করতে। আমাদের চাকরি খেতে!

–আমি তো সে কারণে আসিনি। আমাকে তো আমন্ত্রণ জানিয়ে আনা হয়েছে, আমি তো অতিথি।

–তোমার গায়ে তো লেখা নেই যে তুমি অতিথি।

–গালাগাল করলে আমার কী! চল হাঁটি ওদিকে, লোকেরা জট পাকিয়ে কি করছে, দেখে আসি।

–দরকার নেই বাবা। চল এ জায়গা থেকে সরে যাই।

জ্যঁ বড় বড় পা ফেলে উল্টোদিকে হাঁটতে থাকে। জ্যঁকে থামিয়ে বলি, আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে কি হচ্ছে এখানে। জ্যঁ আমার হাত ধরে টেনে বলছে, চল সরে যাই! হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আমি ধমকে উঠি, — গালাগালকে তোমার এত ভয়!

–গালাগাল তো তেমন কিছু না। এরা মেরেও ফেলতে পারে তোমাকে।

–বল কি!

–ঠিকই বলছি। এদের সম্পর্কে তোমার স্পষ্ট ধারণা নেই। এরা খুব ভয়ংকর।

জ্যঁ জোরে হেঁটে হেঁটে বামপন্থীদের মিছিলে আমাকে নিয়ে যেতে চাইছিল। কিন্তু মিছিল ততক্ষণে শেষ হয়ে গেছে। মিছিল আর সভা ছাড়া রাস্তায় খুব লোক নেই। এসময় নাকি প্রতিবছরই ডামে আর বামে কিছু মারপিট হয় রাস্তায়। মারপিট হয়? মারপিট দেখব। গোঁ ধরলে জ্যঁ বলল, ‘ও আশা ছেড়ে দাও। বামের সভা শেষ হয়ে গেছে।’ অগত্যা কাছেই এক ক্যাফেতে দুজন বসে চা কফি খেতে খেতে দেখতে থাকি রাস্তার কিনারের দৃশ্যগুলো। এক লোক মূর্তি সেজে দাঁড়িয়ে আছে, নড়ন চড়ন নেই, সামনে মাথার টুপি উল্টো করে রাখা, কেউ যদি পয়সা দেয়। তিনটে ছেলে মূকাভিনয় করছে। তাদেরও সামনে টুপি। জ্যঁ বলল, ‘এরা সম্ভবত পোলান্ডের ছেলে। ছাত্র। ফ্রান্সে বেড়াতে এসেছে। এভাবেই পয়সা তুলে চলছে।’ বাহ। বেশ তো। বসন্তের প্রথম থেকে একবারে গ্রীষ্মের শেষ অবদি ছাত্র ছাত্রীরা বেড়াতে যায় বিভিন্ন দেশে। যাদের টাকা পয়সা নেই ঘুরে বেড়াবার, তারা রাস্তায় গান গেয়ে, অভিনয় দেখিয়ে, মূর্তি সেজে টাকা উপার্জন করে সেই টাকায় রেলের টিকিট কাটে, থাকা খাওয়ার খরচা মেটায়। আমি ওদের দেখতে দেখতে ভাবি আমাদের দেশের তরুণ তরুণীরা এভাবে বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর জন্য মোটেও আগ্রহী নয় কেন! পকেটে টাকা পয়সা না নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ার ঝুঁকি কেউ নিতে চায় না কেন! অনেকে এখানে স্কুল কলেজ ছুটি হলেও রেস্তোরাঁয় বাসন মাজার কাজ নিয়ে নেয়, তা থেকে যা উপার্জন করে, তা দিয়ে অন্য দেশে বেড়াতে যায়। মধ্যবিত্ত কোনও ছেলে কি আমাদের দেশে বাসন মাজার কাজ করবে? আমি নিশ্চিত তা করবে না। এতে তাদের মান যাবে। কিন্তু ইউরোপ আমেরিকায় এসে আমাদের শিক্ষিত আদরের দুলালেরা কিন্তু তাই করছে, এতে মান যায় বলে মনে করছে না। আবার এও ঠিক, দেশের রেস্তোরাঁয় বাসন মাজলে কত টাকা আর পাবে! রাস্তায় সং সেজে দাঁড়ালেই বা তাদের কে দেবে টাকা! এখানে ছোট ছোট কাজেও ম্যালা টাকা মেলে। ছোট কাজ বলে ঠকানোর তেমন কোনও রাস্তা নেই। খুব কম করে হলেও ঘন্টায় পঞ্চাশ ফ্রাঁ। বাংলাদেশি টাকায় চারশ টাকা। ঘন্টায় কোন বাসনমাজনেওয়ালাকে চারশ টাকা দেবে আমাদের লোকেরা! তা ই বা দেবে কোত্থেকে! কজনের হাতে টাকা আছে দেশে! চাকরি করে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়াররাই যে টাকা রোজগার করে, তা দিয়ে বাড়িভাড়া তো দূরের কথা, প্রতিদিন দুবেলা খাবারও জুটবে না। তাইতো দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হয় সবাইকে। পুলিশের দুর্নীতির কথা লোকে হামেশাই বলে! ঘুষ কেন খাবে না একজন পুলিশ! মাসে বেতন কত পায় সে! যে টাকা বেতন পায়, সেই টাকায় তার বউ বাচ্চা নিয়ে তার কি বেঁচে থাকা সম্ভব! দুর্নীতি দমন নিয়ে কত বড় বড় কথা লোকে বলে, কিন্তু দুর্নীতি কোনওদিন ঘুচবে না যতদিন না সকলের উপার্জন এমন হয়, যে উপার্জন দিয়ে থাকা খাওয়া পরার ব্যবস্থা করা যায়। আবার এও ভাবি, বড় দুর্নীতিগুলো বড় বড় লোকেরাই করে। যাদের অনেক আছে। গুটিকয়েকের হাতে অঢেল টাকা। বেশির ভাগ কায়ক্লেশে জীবন চালায়। কোনওমতে মাথা গোঁজার ঠাঁই আর দিনে দুবেলা ভাতের জোগান হলেই আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ খুশি। ধনী দেশেই অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের পর আরেকটি জিনিসের প্রয়োজন অনুভব করে সবাই, তা হল আনন্দ, স্ফূর্তি। আনন্দ স্ফূর্তিকে আমাদের দেশে মোটেও প্রয়োজনীয় বলে ভাবা হয় না, ভাবা হয় বিলাসিতা। এটি কেন! দর্শনের এই তফাৎ কি দারিদ্র্যের কারণে! নাকি অন্য কোনও কারণ আছে। একবার ভাবি জ্যঁ র সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করি। পরেই আবার উৎসাহ দেখাই না। ভাবনাগুলো আমার মাথায় যায় আসে। আসে যায়। ভাবনাগুলো কোথাও স্থির হয়ে থাকে না। বাতাসে ধুলোর মত ওড়ে, তুলোর মত ওড়ে। খেই হারিয়ে যায়, আবার ফিরে ফিরে আসে। মানুষ নামের জাতি একটিই। অথচ কী বিভেদ এই মানুষের মধ্যে। কেউ পাবে, কেউ পাবে না। কেউ খাবে, কেউ খাবে না। কেউ সুখে থাকবে, কেউ থাকবে না। কারও সব হবে, কারও কিছুই হবে না। কারও কাছে জীবন মানে আনন্দ, কারও কাছে জীবন দুর্বিসহ। যে শিশুটি জন্মাচ্ছে আজ ফ্রান্সে, আর যে শিশুটি জন্মাচ্ছে বাংলাদেশে, কী তাদের মধ্যে পার্থক্য! মানুষ হিসেবে কোনও পার্থক্য নেই, অথচ কী ভীষণ রকম ভিন্ন অবস্থায় পরিবেশে দুটো শিশু দু দেশে বড় হচ্ছে। আবারও ভাবি খুব কি পার্থক্য? আমি যে প্যারিসের ধনী ক্রিশ্চান বেসের বাড়ি গেলাম, আর ঢাকার গুলশানে এনায়েতুল্লাহ খানের বাড়ি গিয়েছিলাম, কী এমন পার্থক্য দুবাড়ির মধ্যে? কি এমন তফাৎ দু জনের জীবন যাপনে? না, খুব একটা নেই। ধনীরা, সে যে দেশেই হোক, একই রকম আরামে থাকে। তবে গরিবের অবস্থা হয়ত ভিন্ন। বাংলাদেশের গরিব আর ফ্রান্সের গরিব তো একরকম অবস্থায় থাকে না! গরিবের যে চেহারা দেখেছি বেলভিলে, এই যদি গরিব হয়, তবে তেজগাঁর বস্তিকে কি বলা যাবে! দুর্গন্ধ পাগারের ওপর বাঁশ পুঁতে ওর ওপর একখানা তক্তা বিছিয়ে ঘর বানিয়ে গু মুতের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে। তেজগাঁ বস্তির দুর্গন্ধটি প্যারিসের ক্যাফেতে বসেও হঠাৎ আমার নাকে এসে লাগে। চারদিকে বিশ্বায়ন নিয়ে কথা হচ্ছে। কার জন্য বিশ্বায়ন! পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে বলা হয়। কিন্তু কাদের কাছে ছোট? বাংলাদেশের একজন সাধারণ লোকের কাছে বিশ্বায়নের অর্থ কি! তাকে তো কেবল শ্রম দিতে হবে ধনীর ধন বাড়াতে। বিশ্বায়নে কেবল তো পণ্যদ্রব্যই এক দেশ থেকে আরেক দেশে অবাধে যাবে। গরিব দেশ থেকে কটা জিনিস বিদেশের বাজারে পৌঁছবে! গরিব দেশের কটা লোক ইচ্ছে করলেই দেশের সীমানা পেরোতে পারবে! গরিব হলে হাত পা কেমন বাঁধা পড়ে যায়। সীমানা কত মাপা হয়ে যায়! স্বাধীনতা কত সীমিত হয়ে যায়! সবাই পৃথিবীরই সন্তান, কিন্তু কারও কারও জন্য এক নিয়ম, কারও কারও জন্য অন্য। কারও জন্য বেঁচে থাকা, কারও জন্য মৃত্যু। কারও জন্য সুখ, কারও জন্য দুঃখ। হঠাৎ সুখ শব্দটি আমাকে দোলাতে থাকে। সুখ কি ধন দৌলত হলেই হয়! তেজগাঁর বস্তির এক মেয়েকে দেখেছি গায়ে ছেড়াঁ কাপড় পায়ে জুতো নেই, মায়ের চুলে বিলি কেটে কেটে উকুন আনছে আর খিলখিল করে হাসছে, রেললাইনের ধারে একটি মাটির চুলোয় শুকনো ডাল পাতা জ্বালিয়ে মেয়ের মা’টি ভাত ফুটোচ্ছে, মাও হাসছে। ওই সময়টিতে মা আর মেয়ে দুজনেই খুব সুখী ছিল। আর এখানে এই প্যারিসে ক্রিশ্চানের বাড়িতে তার অঢেল সম্পদের মালিক স্বামী টনিকে দেখেছি একটি একলা ঘরে বিষণ্ন বসে থাকতে, মোটেও মনে হয়নি তিনি খুব সুখে আছেন।

জ্যঁ শার্ল আমাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে চলে যায় টেলিভিশনে। ওখানে আমার দেওয়া বাংলা সাক্ষাৎকারের ফরাসি অনুবাদ করার দায়িত্ব পেয়েছে সে। জিল হোটেলে খবর দিয়ে রেখেছে আমি যেন ফিরেই একবার তাকে ফোন করি। ফোন হাতে নিয়ে বসে থাকি। ইচ্ছে করেই জিলের ফোন নম্বরটি আমি ভুলে যাই। ক্রিশ্চান ফোন করে, ‘উফ তোমাকে তো পাওয়াই যায় না সুন্দরী, করছ কি সারাদিন! বল, সেদিনের সেমিনার কেমন হল? নিশ্চয়ই খুব হাস্যকর! নিশ্চয়ই তোমার ভাল লাগেনি।’

আমি শান্ত গলায় বলেছি, আমার ভাল লেগেছে।

–বল কি?

–হ্যাঁ ভাল লেগেছে। আমি বেশিক্ষণ ছিলাম না ওখানে। তবে যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, খুব ভাল মানুষ তারা।

ক্রিশ্চান হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘তুমি এখনও ভাল করে চেনোনি ওদের।’

আমি আর কথা বাড়াইনি। ক্রিশ্চানের আন্তরিক কণ্ঠ বার বার ধ্বনিত হচ্ছে, বল, তোমার –কিছু লাগবে কি না বল।

–না, আমার কিছু লাগবে না।

–কেন লাগবে না! যা কিছুই লাগে, আমাকে বলবে। আমি তোমার সেবায় নিয়োজিত। ভুলো না কিন্তু।

মিশেল ইডেল এলে মিশেলকে আমার হোটেলের ঘরে চলে আসতে বলি। ঘরে বসে দুজন খানিকক্ষণ গল্প করে ক্যাফে দ্য ফ্লোরএ যাই, ওখানে বসে দুদেশের মেয়েদের অবস্থা নিয়ে কথা বলি। কথা হয় ভোট নিয়ে। পঞ্চাশ বছর আগে ফ্রান্সের মেয়েরা ভোটের অধিকার পেয়েছে। মিশেল জানতে চান কবে আমাদের ওদিককার মেয়েরা পেয়েছে এই অধিকার। খুব সোজা, সাতচল্লিশ সালে ব্রিটিশ দূর হল ভারতবর্ষ থেকে, গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হল, পুরুষ এবং নারী উভয়েই ভোটের অধিকার পেল। মিশেলের একটি কথায় আমি বিস্ময়ে দুমিনিট কথা বলতে পারি না। সুইৎজারল্যাণ্ডের মেয়েরা নাকি ভোটের অধিকার পেয়েছে উনিশশ একাত্তর সালে।

সে রাত আমার কাটে আন্তোয়ানেত ফুকের বাড়িতে। বিশাল বাড়ি। আন্তোয়ানেতের এক অনুসারী, তাঁরও মিশেল বলে নাম, আমার সাক্ষাৎকার নিলেন ভিডিওতে। আমার বড় অস্বস্তি হচ্ছিল। এত প্রশ্ন এত উত্তর আমার আর সইছিল না। বার বারই শেষ করতে চাইছিলাম, কিন্তু আন্তোয়ানেত ফুকের ইচ্ছে আমার যাবতীয় কথাবার্তা তিনি রেকর্ড করে রাখবেন। কিন্তু কেন? কাজে লাগবে। কি কাজে? তোমার ওপরই একটি তথ্যচিত্র করছি আমরা! আমার অস্বস্তি উত্তরোত্তর বাড়ে।

পরদিন। সকাল নটায় জিল এল হোটেলে। খবর পেয়ে গোসল করে শাদা একটি সার্ট আর বাদামী রঙের একটি প্যান্ট পরে ফুরফুরে মেজাজে নিচে যাই। চা নাস্তা নিয়ে দুজন বসি মুখোমুখি। জিল দাড়ি কামায়নি। আগের সেই কালো জিনস পরনে তার। অমল হাসি ঝলমল করে জিলের মুখে।

–কেমন আছ তসলিমা।

–ভাল। তুমি?

–ভাল। জিল হেসে ওঠে বলে।

কাল রাতে জিল বলেছিল আজ সে কাঁটায় কাঁটায় নটায় আসবে। নটার এক মিনিট দেরি হলে আমি নাকি বেরিয়ে যেতে পারি। মনে মনে বলেছিলাম, যাবোই তো। তোমার জন্য আমি কেন অপেক্ষা করব জিল?

–তোমাকে দুদিন সময় দিলাম জিল। যেন নাতালির সঙ্গে সময় কাটাতে পারো। যেন আমার চাকরি করতে না হয়।

–ওহ না। তসলিমা কি বলছ তুমি! আমি সবসময় অপেক্ষা করেছিলাম তোমার ফোনের।

–তুমি তো ফোন করনি!

–হ্যাঁ করেছি। তুমি নেই।

–সে তো আমি ইচ্ছে করেই নেই। যেন তুমি নাতালির সঙ্গে..

–কি বলছ তুমি!

–হ্যাঁ, সত্যি।

–নাতালির সঙ্গে, তুমি জানো, আমার কোনও গভীর সম্পর্ক নেই। ওর সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটাতে, বিশ্বাস কর, আমার ভাল লাগে না। সময়ই কাটতে চায় না।

তবে কি আমার সঙ্গে ভাল লাগে? মনে মনে বলি তাহলে চলে এলে না কেন!

জিলের নীল দুটি চোখে চোখ রেখে বলি, তিনবার ফোন করেছো। এ কোনও ফোন করা হল? জিল হেসে বলে, ‘ঠিক আছে যাও, প্রতি দশ মিনিট পর পর এখন থেকে ফোন করব। ঠিক আছে?’

আমি বুঝিনা জিলকে দেখলে কেন মনে হয় আমি খুব ভাল আছি। যেন সব ক্লান্তি কেটে গেছে, সব দুর্ভাবনা দূর হয়েছে। আমরা বসে থাকতে থাকতেই নাতালি এল। কাল সে ফোন করেছিল, আজ আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে বলেছে। এই নাতালি জিলের প্রেমিকা নাতালি নয়। নাতালি বনফুরা প্যারিসের সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা শেখে। আমার খবর পেয়েছে শিশির ভট্টাচার্যের কাছে। শিশির বাংলাদেশের ছেলে, প্যারিসে কয়েক বছরের জন্য বাংলা পড়াতে এসেছেন। নাতালির কাছে খবর পেয়ে তার প্রায় লেজে লেজেই এসেছে নীলরতন, ভোলার ছেলে, প্যারিসে লেখাপড়া করছে। নাতালি মেয়েটি চমৎকার। আমার খুব ভাল লাগে ওকে। যেন ওর অনেকদিনের বন্ধু আমি। নাতালি সুন্দর বাংলা বলে, সুন্দর বাংলা লেখেও। জিল আমার বাংলা লেখা দেখে বলে, এ তো কোনও ভাষা নয়, এ হচ্ছে আর্ট। নাতালি হঠাৎ বলে আমাকে সে ফরাসি ভাষা শেখাবে।

–বাহ বেশ তো শেখাও।

–কি শিখতে চাও প্রথম?

–আমি তোমাকে ভালবাসি।

–জ তেম।

এক এক করে সে লিখল, কেমন আছ, ভাল আছি। কামা সাবা? সাবা। ধন্যবাদ। ম্যারসি। জিলকে বললাম, জিল, জ তেম।

জিলের চোখ মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। উত্তরে সে ফরাসি ভাষায় কি বলল বুঝিনি। নাতালি লিখে যাচ্ছে আরও কিছু ফরাসি শব্দ। জিল বলল, ‘আজ সারাদিন কিন্তু তোমার সঙ্গে থাকব। আমাকে ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়া আজ তোমার চলবে না। চলবে না।’ এর মধ্যেই জ্যঁ শার্ল এসে উপস্থিত। গতকাল তিনি ন ঘন্টা টেলিভিশনে কাটিয়েছেন আমার বাংলা অনুবাদ করতে। জিলকে বিগলিত হেসে কেলিয়ে বলে দি আমাকে নিয়ে তিনি অপেরায় গিয়েছিলেন।

জিল বলল, কি ব্যাপার তুমি তো বলনি তুমি যে অপেরায় গিয়েছিলে!

হেসে বলি, মনে ছিল না।

মনে ছিল না?

জিল হেসে ওঠে। শিশুর হাসির মত হাসি।

বারোটা বেজে গেল। সকালেই ক্রিশ্চান হোটেলে ফ্যাক্স পাঠিয়ে জানিয়েছেন যে আমাকে তিনি সাড়ে বারোটায় এসে নিয়ে যাবেন, ফেরত দিয়ে যাবেন তিনটেয়। অষ্ট্রেলিয়ার টেলিভিশন থেকে পিটার নামের এক লোক চার পৃষ্ঠা লম্বা ফ্যাক্স পাঠিয়েছেন, কোত্থেকে যে এই লোক খবর পেলেন আমি কোথায় আছি, জানি না। জিলকে বলি ফ্যাক্সটি পড়ে শোনাতে, আমার পক্ষে অত লম্বা জিনিস পড়া সম্ভব নয়। জিল বাধ্য ছেলের মত শোনায়। ক্রিশ্চান এলে জিলকে সঙ্গে নিই। সোজা এডিশন স্টক, ক্রিশ্চানের প্রকাশনীতে। কি বিশাল প্রকাশনীর বাড়িটি। সকলে আমাকে দেখে বিষম উচ্ছঅজ্ঞসত। দু গাল যে কত বার কতজনের কাছে পেতে দিতে হল চুমু খেতে। অভ্যস্ত নই এসবে। কিন্তু ওদের অভ্যেসের কাছে আমার গালদুখানি বিসর্জন দিতে হয়।

রাতে এলিজাবেথ আসে। তার তথ্যচিষেনর ভিডিও ক্যাসেট দিল আমাকে, যা ও তৈরি করেছিল ঢাকায় গিয়ে। বলল, বাইশটি দেশ এই তথ্যচিত্রটি কিনে নিয়েছে। সুইৎজারল্যাণ্ড, ইতালি, স্পেন, ইংলেণ্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, আমেরিকা..। এলিজাবেথ ঢাকায় যেমন রহস্যে মোড়া ছিল, এবার আর তা নয়। বলল, ঢাকায় তার ঝামেলা হয়েছিল। তিরিশ জন পুলিশ তার পেছনে যখন সে শাখারিপট্টিতে পৌঁচেছে। কি করে তার যাবার খবর পুলিশ জানে, তা এখনও তার কাছে রহস্য। ফৈয়াজ নামে যে ছেলেটি তাকে বাংলা থেকে ফরাসিতে অনুবাদ করে দিয়েছিল, এলিজাবেথ চলে আসার পরই তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ, থানায় নিয়ে কয়েক হাজার প্রশ্ন করেছে। পুলিশের কারণে এলিজাবেথের আর শাখারিপট্টিতে ছবি তোলা সম্ভব হয়নি। জিজ্ঞেস করলাম, বাইশটি দেশ তোমার এই ছবি কিনে নিল? আশ্চর্য! –হ্যাঁ। ভীষণ পছন্দ করেছে ওরা। প্রচুর চিঠি আসছে আমার কাছে। ওরা তোমাকে সহমর্মিতা জানাতে চায়। তোমার ঠিকানা চাইছে ।

–আর যাবে না ঢাকায়?

এলিজাবেথ হেসে বলল, আমার জন্য ঢাকা যাওয়ার পথ বোধহয় বন্ধ হয়ে গেল। আমাকে আর ঢুকতে দেবে বলে মনে হয় না।

এলিজাবেথ চলে যাবার সঙ্গে নাতালি এল, সঙ্গে নীলরতন আর শ্যামল চক্রবর্তী নামে একটি ছেলে। শ্যামল নীলরতনের বন্ধু। নীলরতন রান্না করে নিয়ে এসেছে। মুরগি, ফুলকপি আর বাসমতি চালের ভাত। নীল চামচ দিয়েছিল থালায়। সরিয়ে দিয়ে হাত ডুবিয়ে দিই ভাতে। কতদিন পর ভাতের স্বাদ পাওয়া! আহা। শ্যামল বার বারই বলছে, দিদি আপনার সঙ্গে পরিচিত হবার ইচ্ছে সেই কতদিনের। কি যে ভাল লাগছে দিদি!

নাতালি এসে কানে ওয়াকম্যান লাগিয়ে বাংলা গান শুনতে বসে গেছে। নাতালি, আপাদমস্তক ফরাসি মেয়ে, কি চমৎকার বাংলা বলে, বাংলা লেখে। বাংলা গানের পাগল। জিজ্ঞেস করি, এই তুমি শাড়ি পরতে পারো?

মাথা নেড়ে বলল, না।

ওকে একটা লাল শাড়ি দিলাম। নীলরতনকে শার্ট।

‘নিয়ে নাও। আমার লাগবে না।’ সে যে খুশি দুজন।

শ্যামল মেট্রোতে বাদাম বিক্রি করে। সে এখানে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছে। জানেনা, ফরাসি সরকার তাকে আশ্রয় দেবে কি না। না দিলে তাকে দেশে চলে যেতে হবে। বাদাম বিক্রি করে দিনে একশ ফ্রাঁ জোটে তার।

–এখানে জিনিসের সে যে কি আগুনে দাম, এই টাকায় কি চলতে পারো!

–কষ্ট করে চলি দিদি।

শ্যামল বড় করুণ স্বরে বলতে থাকে, –এক ঘরে সাত আটজন গাদাগাদি করে থাকি। বাঙালিরা মেট্রো স্টেশনে বাদাম বিক্রি করে, কাপড় বিক্রি করে, ফুল ফল বিক্রি করে। এসব বিক্রি করা মেট্রোতে নিষিদ্ধ। পুলিশ প্রায়ই ধরে নিয়ে যায়। মারধোর করে।

খেতে খেতে শ্যামলের গল্প শুনি।

–পনেরো তারিখে আপনার ওপর একটা অনুষ্ঠান হয়েছে টেলিভিশনে। দু ঘন্টা আগে থেকেই বিজ্ঞাপন দিচ্ছিল। বসে ছিলাম আপনাকে দেখব বলে। কী যে ভাল লেগেছে দিদি।

নীলরতন বলল, এখানকার কাগজে সেদিন পড়লাম ফ্রান্সের ইস্কুল কলেজগুলো আপনার ওপর একটি বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠান হচ্ছে। গর্বে বুক ভরে গেছে। খাওয়া শেষ হলে আমরা সবাই মিলে বাইরে যাই। অনেকটা পথ রাতের প্যারিস জুড়ে হাঁটি। বাংলায় কথা বলতে বলতে হাঁটি। রাতে অষ্ট্রেলিয়া টেলিভিশন থেকে ফোন, আমার ওপর একটি তথ্যচিত্র বানাতে ওরা বাংলাদেশে যেতে চায়। আমি রাজি কি না জানতে চাইছে। এসব কাণ্ড যত দেখছি, তত অবাক হই। আমি তো সেই আমিই! সেই অবকাশের আমি।

নাতালি রাতে থেকে যায় আমার ঘরে। অনেকটা রাত গল্প করে কাটায়। সকালে ঘুম ভেঙে যায় টেলিফোনের শব্দে। নিচে ফটোগ্রাফার অপেক্ষা করছে। গামা নয়ত সিগমা ফটোএজেন্সি থেকে এসেছে। বলে দিই যে নিচে যেতে পারব না, চাইলে ওপরে যেন চলে আসে। মেয়েটি আমার ঘরে চলে এসে পাগলের মত ছবি তুলতে থাকে। ছবি তোলা তখনও শেষ হয়নি, তুলুজ থেকে এলেন ক্যারোলিন ম্যাকোনজি। তখন চা খাচ্ছি। ফটোগ্রাফার অপেক্ষা করছে। ক্যারোলিন খুব কাছে মুখোমুখি বসে বললেন, ‘একটা উপন্যাস আমাকে ছাপতে দিন।’

‘উপন্যাস তো কিছু নেই বাকি। এডিশন স্টককে দিয়ে দিয়েছি।’

‘উপন্যাস যদি না দিতে পারেন, অন্তত একটা গল্পের বই দিন।’

‘কিছু তো নেই। গল্প যা আছে, তা স্টককে দেব বলে কথা তো দিয়ে ফেলেছি।’ ‘কিন্তু আমরা যে চাইছি। সেই কতদিন থেকে আমরা ঢাকায় আপনার কাছে ফোন করছি, ফ্যাক্স করছি। কিছু একটা আমাদের দিতেই হবে তসলিমা। দয়া করুন আমাদের। আপনার লজ্জা বেরোবে সেপ্টেম্বরে। এই সেপ্টেম্বরের মধ্যেই আমাকে ছোট গল্পের পাণ্ডুলিপি দিন। দিতেই হবে।’

না বলতে আমি পারি না। জানি না, না বলতে আমার কষ্ট হয় কেন। বড় করে একটি না বলে দেব, পারি না। কণ্ঠে স্বর ওঠে না। লজ্জা হয় না বলতে। কেমন যেন মায়া হয় মানুষটির জন্য। আমি খুব ভাল করেই জানি যে আমি এমন কিছু লিখিনি যা কি না ফরাসি ভাষায় প্রকাশ পেতে পারে। লজ্জা তো নয়ই। ক্রিশ্চান যখন আমার কাছে যা কিছুই এ পর্যন্ত লিখেছি সবই চেয়েছে, আমি সত্যিই লজ্জায় পড়েছি। আন্তোয়ানেত ফুক আর মিশেল ইডেল যখন চেয়ে মরেছে, লজ্জা আমার কম হয়নি। তবু বড় দ্বিধায় নির্বাচিত কলামটি দিয়েছি। যে স্বাধীনতার কথা বলেছি নির্বাচিত কলামে, সে স্বাধীনতা এখানকার মেয়েরা বহু আগেই পেয়ে গেছে। আমার নারীবাদ এদের কাছে নিতান্তই পুরোনো জিনিস। আর যে কটি লেখাই লিখেছি, সবই তো আমাদের দেশ আর সমাজ সম্পর্কিত, কতটুকুই বা ফরাসিরা অত দূর দেশের নিত্যদিনের সমস্যার সঙ্গে জড়িত! ক্যারোলিন কনট্রাক্ট ফরম নিয়ে এসেছেন। বলেছি, এখন সই করব না, আগে দেশে ফিরে দেখি আদৌ কোনও গল্প আমার কাছে আছে কি না। থাকলে কোন কোনটি আপনাকে পাঠানো যায়। ক্যারোলিন একটি প্যাকেট আমার হাতে দিয়ে বললেন, এটা তোমার জন্য। খুলে দেখি একটি ঘড়ি। বললেন, জ্যঁ শার্ল বলেছে, তোমার একটি ঘড়ি দরকার।

জ্যঁ শার্লকে আমি বলিনি, আমার ঘড়ি দরকার। নিশ্চয়ই সে লক্ষ করেছে যে আমার হাতে ঘড়ি নেই। প্যারিসের অনেক মেয়েই দেখেছি রঙিন ঘড়ি পরে। রঙিন ঘড়ি আমার পক্ষে পরা সম্ভব নয়, মনে মনে বলি, কেমন যেন বাচ্চা বাচ্চা লাগে। তখনও আমি জানি না সোয়াচ ঘড়ি, সে রঙিন হলেই কি, না হলেই কি, এর মূল্য অনেক। এদিকে ফটোগ্রাফারের মেশিনগান চলছে। ক্যাটক্যাটক্যাটক্যাটক্যাট। থামাথামি নেই। এত ছবি তুলে কি হবে গো? কি করবে এত ছবি!

নাতালি পরে বলেছে, বোঝো না কি করবে এসব ছবি? বিক্রি করবে।

বিক্রি? কোথায়?

ফ্রান্সের কাগজে। কেবল কি ফ্রান্সের! বিভিন্ন দেশের পত্রিকায়। কেবল কি পত্রিকায়! বইয়ের প্রকাশনী আছে, পোস্টার কোম্পানী আছে. টেলিভিশন আছে..।

এই ক্যাটক্যাট যেতে না যেতেই লা হিউমানিতের সাংবাদিক এলেন। লা হিউমানিতে বামপন্থীদের পত্রিকা। সাংবাদিকের সঙ্গে সমাজতন্ত্র বিষয়ে বিস্তর কথা হল। সমাজতন্ত্রে কেন আমি বিশ্বাস করি। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর আমি কি আশাবাদী, যদি আশাবাদী, কেন আশাবাদী। সাক্ষাৎকার যখন চলছিল, তখনই জিল এল। যেতে হবে রেডিওতে। নাতালিকেও সঙ্গে নিলাম। জ্যঁ শার্ল আগেই গিয়ে বসে আছে ওখানে। আমি আর সাংবাদিক মেয়েটি, যে আমার সাক্ষাৎকার নেবে, গিয়ে বসলাম একটি গোল টেবিলের ঘরে, টেবিল ঘিরে মাইক্রোফোন, কাচের দেয়ালের ওপাশে একটি ঘর। ইংরেজিতে প্রশ্ন করা হবে, আমি বাংলায় উত্তর দেব, জ্যঁ শার্ল সঙ্গে সঙ্গে আমার বাংলা ফরাসিতে অনুবাদ করে দেবে। নাতালিও বসেছে একটি চেয়ারে। কাচের দেয়ালের ওপাশে ঘরটিতে রেকর্ডিং কন্ট্রোল হচ্ছে, ও ঘরটিতেই দাঁড়িয়ে আছে জিল। এক একটি প্রশ্নের উত্তর দিই আর জিলের দিকে তাকাই। জিল মিষ্টি করে হাসে। চোখ টিপে বাহবা জানায়। জিলকে আমার এত আপন মনে হয় যে ভুল করে তার সঙ্গে আমি প্রায়ই বাংলায় কথা বলে ফেলি। রেডিও থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে পিকাসো মিউজিয়ামে যাই। পিকাসো মিউজিয়াম দেখব এরকম একটি ইচ্ছে প্যারিসে নামার পর থেকেই ছিল। জিল বলল, বোধহয় বন্ধ, তবু চল। গিয়ে ঠিক ঠিকই দেখা গেল বন্ধ। প্যারিসের মিউজিয়ামগুলো কোনওটি সোমবার, কোনওটি মঙ্গলবার বন্ধ থাকে, এরকম নয় যে সপ্তাহের দুটোদিন শনি রবিবার মিউজিয়ামগুলোও বন্ধ থাকবে। হাঁটতে হাঁটতে কোথাও খাবো বলে একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকি। জিল বলল, এটা ইহুদিদের রেস্তোরাঁ, এদের খাবার খুব ভাল হয়। রেস্তোরাঁর চেহারাটি অন্যরকম। যেন ধ্বংসস্তূপ। অথবা কোনও গুহা। এরকম করেই বানানো হয়েছে। আমাদের দেশে যেমন বাড়িঘর রং করলে ভাবা হয় সুন্দর, এখানে কিন্তু সব সময় তা নয়। যত পুরোনো বাড়ি, যত প্রাচীন, মলিন, তত তার মর্যাদা বেশি। প্যারিসের বড় বাড়িগুলো সব পাথরে বানানো, কোনও রঙের প্রয়োজন হয় না, সেগুলোই প্যারিসের সৌন্দর্য। ইট সিমেণ্টের বাড়িগুলোকে, উঁচু হোক, ঝকঝকে হোক, মোটেও সুন্দর বলে মনে করা হয় না। আমি আমাদের কথাই ভাবি, পুরোনো বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি বানানোর ধুম চলে। আমাদের অবকাশ খুব পুরোনো বাড়ি। বিশাল বিশাল দরজা জানালা, উঁচু সিলিং, দেয়ালের কারুকাজকে মোটেও ভাবা হয় না সুন্দর কিছু। অবকাশ ভেঙে নতুন ডিজাইনের বাড়ি করার ইচ্ছে বাড়ির প্রায় সবারই। তার ওপর সেই পুরোনো কাঠের কারুকাজ করা আসবাবপত্রগুলোকে পারলে ভেঙে খড়ি বানানোর ইচ্ছে সবার। সিংহের মুখ অলা খাটের পায়াগুলোকে পুরোনো পচা ভাবা হয়, তার চেয়ে কোনও পায়াহীন বাক্সের মত খাটগুলোকে মনে করা হয় সুন্দর, আধুনিক। আধুনিক আসবাবপত্র, বাড়িঘরের প্রতি ওখানে আকর্ষণ প্রচণ্ড। প্যারিসে ঠিক তার উল্টো। বিশাল ঝকঝকে তকতকে অত্যাধুনিক দোকানের জানালায় দেখেছি সাজানো আছে চটের বস্তা, পোড়া খড়ি, ভাঙা ইট, মরা ডাল। ওগুলোই এখানে সৌন্দর্য। এসব দেখে আমার একটি জিনিস মনে হয়, আধুনিকতার শীর্ষে উঠে এদের আর আধুনিকে আকর্ষণ নেই, আর প্রাচীনতম দেশগুলোয় পা পা করে যেখানে আধুনিকতা উঁকি দিচ্ছে, সেখানে মানুষ হুড়মুড় করে গিয়ে আঁকড়ে ধরছে সেটি। আধুনিকতা মানে কি? নিজের কাছেই প্রশ্ন করি। স্থাপত্যে, আসবাবে, পোশাকে নতুন ঢংএর নামই কি আধুনিকতা! মনের আধুনিকতাকে যদি সত্যিকার আধুনিকতা বলি, তবে ধনী দরিদ্র নতুন প্রাচীন সব দেশেই আছে সেই আধুনিকতা। দেশ বা সমাজ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু আমরা যারা পুরোনো মূল্যবোধ পেছনে ফেলে নতুন দিকে নতুন করে নতুন ভাবে নতুন সময়ের কথা ভাবছি, তাদের ভাবনাগুলো এক। আর যারা ধর্মান্ধতা, অজ্ঞতা, হিংস্রতা ইত্যাদি নিয়ে আছে, তাদের আচরণগুলোও এক।

ইহুদিদের খাবার খুব আলাদা স্বাদের। জিল বলে।

আমি বলি, তা কেন হবে? কোনও খাবারই ধর্মভিত্তিক নয়। এগুলো দেশভিত্তিক, এলাকা ভিত্তিক।

জিল সবেগে মাথা নেড়ে আমাকে অস্বীকার করে বলে, না, ইহুদিদের খাবার অন্যরকম।

–কী বলছো আবোলতাবোল! কোনও খাবারকে তুমি বলতে পারো না এই খাবার ইহুদিদের, এই খাবার মুসলমানদের বা খ্রিস্টানদের। ফ্রান্সে যে ইহুদিরা হাজার বছর থেকে বাস করছে, তাদের খাবার ইহুদি-খাবার হবে কেন, হবে ফরাসি খাবার! বাংলাদেশের মুসলমানের খাবার আর ইরাকের মুসলমানের খাবার এক নয়। ভারতের খ্রিস্টানদের খাবার আর ইতালির খ্রিস্টানদের খাবার এক নয়। আরবের ইহুদি আর জার্মানির ইহুদির খাবারও এক নয়।

জিল বলে, এক।

এক হওয়ার তো কারণ নেই।

জিল আবারও বলে, এক। এক, কারণ সব দেশেই তাদের বিশেষ খাবারগুলো তারা এক রকম করে তৈরি করে।

না, আমি তোমার কথা মানতে পারলাম না।

না মানতে পারলে আমার কিছু করার নেই। কিন্তু আমি যা বলছি, তা ঠিক। ইহুদিরা প্রতিটি দেশেই একরকম করে খাবার তৈরি করে।

আমি সজোরে মাথা নেড়ে বললাম, ধর্মের সঙ্গে খাবারের কোনও সম্পর্ক নেই, থাকতে পারে না। আমি নিশ্চিত ভারতের ইহুদি আর ফ্রান্সের ইহুদি একরকম খাবার তৈরি করে না। ভারতের উত্তরাঞ্চলের হিন্দু আর দক্ষিণাঞ্চলের হিন্দুদের খাবারই ভিন্ন। এসব নির্ভর করে এলাকার ওপর। নির্ভর করে সেই এলাকার সংস্কৃতির ওপর।

জিল তার মত ফেরায় না। আমিও না।

যে কটি খাবারের কথা বলা হয়েছে, এক এক করে সব আসে। সবগুলোর মধ্যে কিছু না কিছু বেগুন আছে, তাও আবার বিস্বাদ। ঝাল। জিলের থালায় বড় একটি মরিচ সেদ্ধ। শাকপাতার ভেতর ভাত ভরে মুড়ে দিয়েছে। কি অদ্ভুত খাবার বাবা! আমার পক্ষে খাওয়া সম্ভব হয় না। আমার থাল থেকে জিল খেল, আমি জিলের থেকে খানিকটা। ব্যাস।রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে যখন হাঁটছি, হঠাৎ দেখি একটি রেস্তোরাঁর নাম ভলতেয়ার রেস্তোরাঁ, ভলতেয়ারের নামে রাস্তা।

এখানে কি ভলতেয়ার থাকতেন?

জিল বলে, না, সম্মান জানানো হচ্ছে।

জ্যঁ শার্ল বলে, তসলিমার নামেও একদিন প্যারিসে রাস্তা হবে।

হো হো করে হেসে উঠি।

মডার্ন আর্ট মিউজিয়ামটি বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে আস্ত একটি তেলের কারখানা। নানারকম নল দিয়ে বানানো মিউজিয়ামের দেয়ালটি। এলাকাটিতে লোকের ভিড়, কিছু না কিছু লেগেই আছে। নাতালি বলল এখানে নাকি বেশ কিছু বাঙালি কাজ করে। পথে কোনও বাঙালি দেখলেই সে হেসে আমার দিকে তাকায়, কানে কানে বলে, দেখলে বাঙালি। কিছু বাঙালি দেখলাম, রাস্তায় দাঁড়িয়ে চালের মধ্যে নাম লিখে লকেট বিক্রি করছে। অত ছোট চালের মধ্যে কি করে নাম লেখা যায়, তা আমার মাথায় ঢোকে না। মেট্রোয় রেল চড়া হল, কোনও বাদামঅলা বাঙালি চোখে পড়ল না। নাতালি বলল, গরম পড়ে গেছে, ওরা বাইরে চলে এসেছে।

১. প্যারিসের ডায়রি – ০৫

একটি পার্কার কলম কেনার শখ হল হঠাৎ। ভীষণ দাম।

–জিল, আমাদের দেশেও পার্কার কলম পাওয়া যায়। কিন্তু এত দাম নয় তো ওগুলো!

–ওগুলো নিশ্চয়ই আসল নয়, নকল। তাই দাম কম। তুমি প্যারিস থেকেই পার্কার কেনো। এগুলো আসল।

–পার্কারের গায়ে ঠিক এরকমই তো লেখা থাকে, কেন আসল হবে না আমাদের দেশেরগুলো?

জিল বলে, হয়ত নিবটা এত ভাল না, এগুলোর যেমন ভাল।

জিল তার মত পাল্টাবে না কিছুতেই। শেষ অবদি দাম দিয়েই একটি পার্কার কলম কেনা হয়। যে কোনও দাম দেখলেই আমি আট দিয়ে গুণ করে ফেলি। বইয়ের দোকানে ঢুকেও কিছু আর কেনা সম্ভব নয়। বিশাল একখানা বই ল্যুভরের ওপর। দামেও কুলোতে পারব না, ওজনেও না। তাই বাদ। আরও কিছুক্ষণ বইয়ের দোকানগুলোয় সময় কাটাবো, তার সময় নেই। টেলিভিশনে যেতে হবে, জিল তাড়া দিল।

–ধ্যুৎ এত টেলিভিশন আমার ভাল লাগে না। হলই তো কত।

–এটিই শেষ। জিল মিনতি করে।

একপ্রশ্ন, এক উত্তর। আর ভাল লাগে না। লজ্জা কেন সরকার বাজেয়াপ্ত করল, ফতোয়া দিল কেন, আমার কেমন লেগেছে ফতোয়ার পর, কোনও সমর্থন আছে কি না দেশে, এসবই তো। ফরাসিরা তো শুনেছেই এসব, আর কত শুনবে! আমার ভাল লাগে না।

জিল বলে, বুঝি আমি। আমি যদি তুমি হতাম, আমারও এমন লাগত, যেমন লাগছে তোমার। কিন্তু ওরা এমন করে ধরেছে, এবারটিই শেষ, তোমাকে আর কষ্ট দেব না। আমি শান্ত গলায় বলি, জিল, আমি সাধারণ একজন মানুষ। খুব সরল ভাষায় খুব সাধারণ জিনিস লিখি। আমাকে নিয়ে এত হৈ চৈ কেন! আমি তো ভেবেছিলাম স্ট্রাসবুর্গে অনুষ্ঠানটি করে ফিরে যাবো দেশে। মাঝখান থেকে প্যারিসটা দেখব। প্যারিস দেখারইচ্ছে আমার বহুদিনের। এইসব রেডিও টেলিভিশন এত না করে প্যারিসটা ঘুরে বেড়ালে ভাল লাগত। অথবা তোমাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে।

জিল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জিলও সম্ভবত বাঁধা তার এই সংগঠনের চাকরিতে। তারও কিছু করার নেই। আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে রিপোর্টার্স সাঁ ফ্রন্টিয়ার্স আর আর্তে টেলিভিশন, এত খরচ করছে এরা আমার পেছনে, না হয়, যা অনুরোধ করছে, মেনেই নিলাম কিছু। কালই তো চলে যাবো। হোটেলে পৌঁছে জিল বলল, তোমাকে তিন মিনিট সময় দিলাম। এর মধ্যে তৈরি হয়ে নাও।

জিলের কাছে আবদার করে দশ মিনিট সময় নিয়ে স্নান করে একটি বালুচরি শাড়ি পরলাম। গাঢ় খয়েরি রঙের। জিলের এই রংটি খুব পছন্দ। আগেই এই শাড়িটি দেখে বলেছিল, এটি তোমাকে একদিন পরতে হবে,অন্তত আমার জন্য। শাড়িটির আঁচলে একটি মেয়ে কলসি হাতে, একটি ছেলে ঘোড়া চালাচ্ছে এসব দেখে বলেছিল, প্রেমের গল্প বুঝি!

আমি নিচে নেমে এলে জিল শাড়ির আঁচলটি হাতে নিয়ে মিষ্টি করে হাসে। চোখদুটোও হাসে তার। টেলিভিশনে গিয়ে দেখি প্রচণ্ড সব ব্যক্তিত্বের মহিলা। আমার খুব ভাল লাগে মেয়ে-সাংবাদিক আর মেয়ে-ফটোগ্রাফারদের দেখতে। আমাদের দেশে হাতে গোনা মেয়ে সাংবাদিকতার কাজ করে। করবেই বা কি! লেখাপড়া শেষ করতে না করতেই তো তাদের বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়, আর প্রভু স্বামীরা যা আদেশ করে মেয়েরা তো তাই মাথা নত করে পালন করে। পুরুষের পাশাপাশি বসে লেখালেখি করা, খবর যোগাড় করতে ছুটোছুটি করার কাজ মেয়েদের মানাবে না সিদ্ধান্তই নিয়ে নেওয়া হয়। যে মহিলাটি আমার সাক্ষাৎকার নেবেন, তিনি আমাকে বাংলায় প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। ফরাসিরা ইংরেজি পছন্দ করে না। ইংরেজি জানলেও পারতপক্ষে বলতে চায় না। মাতৃভাষাটিই এদের কাছে পছন্দ। কথা বললে আমি আমার মাতৃভাষায় কথা বলব, অনুবাদক তারা যত খরচা হোক আনিয়ে নেবে, তবু আমাকে ইংরেজিতে কথা বলতে দেবে না। ইংরেজি ভাষাটি ফরাসিরা মোটেও পছন্দ করে না। ইংরেজের সঙ্গে এদের দীর্ঘ দীর্ঘ কালের বিরোধ এর পেছনে কাজ করে সম্ভবত।

কাকে ডাকবে বাংলা থেকে ফরাসি অনুবাদের জন্য? জ্যঁ শার্ল দাঁতের ডাক্তারের কাছে গেছে, আসতে পারেনি। সাড়ে ছটায় এটি প্রচার হবে, সুতরাং এক্ষুনি লাগবে। অতএব নাতালি, তুমি পারবে? নাতালি ভয়ে নীল হয়ে, তার ওইটুকু বাংলা বিদ্যে নিয়ে মোটে ভরসা পায় না। অতএব আমাকেই বাংলায় বলে বাংলাটুকুর ইংরেজি অনুবাদ লিখে দিয়ে আসতে হয়, নাতালি ও থেকে ফরাসি করে নেবে। সে রয়ে যায় টিভিতে। হোবিয়া মিনা বলবেন আমাকে নিয়ে, আমার পরই।

জিল এবার আমাকে নিয়ে গেল, প্রায় দৌড়ে, শার্লস এ লিজের ফন্যাকে। ফন্যাককে সাহিত্য সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বলা যায়। বই পত্র, গানের যন্ত্র, ক্যাসেট সিডি সব বিক্রি হয়, পাশাপাশি সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি হয়। প্রায়ই লেখকরা তাঁদের বই থেকে পড়েন। আন্তর্জাতিক প্রেস ফ্রিডম দিবস পালন হচ্ছে ফন্যাকে। বড় একটি প্রদর্শনী হচ্ছে। রিপোটার্স সাঁ ফ্রন্টিয়ার্স এখানে আয়োজন করেছে আলোচনা সভার। জিল বলল, তোমার এখানে ইংরেজিতেই বলতে হবে মনে হচ্ছে। জ্যঁ শার্ল তো আসতে পারছে না। বাংলা থেকে ফরাসি করার কেউ নেই। আমার ইংরেজির যে হাল, পছন্দ মত কোনও শব্দই খুঁজে পাওয়া যায় না। রেডিও টিভিতে যা হোক ফরাসিতে তক্ষুনি তক্ষুনি অনুবাদ হয়ে যায় যা বলি। কিন্তু একেবারে দর্শক শ্রোতার সামনে! একটি চেয়ারও খালি নেই। ঘরটি পুরো ভরে গেছে। ফরাসিরা ভাল ইংরেজি জানে না, এটিই আমার ভরসা। এরকম যখন ভাবছি, তখনই দেখি এক ঝাঁক বাঙালি। ঝাঁকের মধ্যে নীলরতন, পার্থপ্রতিম মজুমদার। পার্থ বাংলাদেশের ছেলে, মূকাভিনয়ে পাকা। ঢাকায় আমার সঙ্গে দেখা করতে আমার বাড়িতে গিয়েছিলেন, তখনই আলাপ। পার্থর সঙ্গে প্যারিসের অভ্যেসে হাত মেলালাম।

–একজন বাঙালি খুঁজছিলাম, আপনাকে পাওয়া গেল।

বাঙালিরা ততক্ষণে আমাকে ঘিরে ধরেছে, কবে এসেছি, কোথায় উঠেছি, কতদিন থাকব, ইত্যাদি হাজার রকম প্রশ্ন। উচ্ছঅজ্ঞসত সব।

পার্থপ্রতিম, যেন আমার হাজার বছরের বন্ধু, বারবারই বলতে লাগলেন, ‘কেন আমাদের খবর দাওনি যেদিন এলে? সেদিনই ফোন করে দেওয়া যেত না! আমাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করতে পারতাম!’ পার্থর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক লোক বললেন, ‘চলুন আমাদের বাড়িতে যাবেন আজকে, একবেলা অন্তত খাবেন।’ কালই চলে যাবো শুনে ইস ইস আহা আহা করে ওঠে সবাই। কেন আগে থেকে ওরা জানল না, কোথায় আছি আমি। তাহলে তো আমাকে হোটেল থেকে তুলে নিয়ে যেতে পারতেন। আগে জানলে আমরা তো একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারতাম। এখানে বাঙালিদের ছোটখাটো সংগঠন আছে, সব সংগঠনের পরিচালকরাই চুক চুক করে দুঃখ করছেন। সকলকেই আমার বিনীত স্বরে জানাতে হল, এখন তো আর সময় নেই ভাই। কালই চলে যাবো। কেন আর কটা দিন থাকছি না। এভাবে প্যারিসে এসে তাদের বাড়িতে না গিয়ে দুটো বাঙালি খাবার না খেয়ে বিদায় নেব, এ কেমন কথা হল!

গপ্প করলে চলবে না, মঞ্চে বক্তারা বসে গেছেন। আমাকে ডাকা হচ্ছে। মঞ্চে আমাকে নিয়ে বসালেন রিপোর্টার্স সাঁ ফ্রন্টিয়ার্সের সভানেষনী, অনুষ্ঠানের উপস্থাপকপি রচালক। সভানেষনীর বাঁ পাশে বসনিয়ার সাংবাদিক, ডান পাশে আমি, আমার পাশে ক্যামেরুন, ক্যামেরুনের ডানে আলজেরিয়া। ফ্রান্সের লোকেরা আফ্রিকার খবর খুব ভাল রাখে। আলজেরিয়া তো বলতে গেলে ফ্রান্সের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। বসনিয়ার খবরও বেশ রাখে। কেবল ভারতবর্ষ সম্পর্কে আগ্রহ খুব নেই। জানেও না খুব বেশি কিছু।

এক এক করে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন সাংবাদিকরা। সকলেই ফরাসি ভাষায় বলছেন। আমাকেই কেবল ইংরেজিতে বলতে হবে। ইংরেজি থেকে ফরাসিতে অনুবাদ করে দেবে কেন। যেহেতু এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় অনুবাদ করতেই হবে, তখন বাংলা থেকেই নয় কেন। বাঙালির দলটির দিকে যেই না প্রস্তাবটি দেওয়া হল, প্রীতি সান্ন্যাল নামের এক বাঙালি মহিলা মঞ্চে এলেন আমার অনুবাদ করতে। একটি উত্তরের অনুবাদ করে তিনি দর্শকের আসনে বসা কাউকে দেখে আমার চেয়ে ভাল অনুবাদক একজনকে দিচ্ছি বলে নিজে কেটে পড়ে যাঁকে পাঠালেন, তিনি অমিতাভ চক্রবর্তী। প্রীতি সান্ন্যালের নিজের ওপর আস্থা কিছুটা কম। জিল দাঁড়িয়ে আছে, চেয়ার একটিও খালি নেই যে বসবে। বার বার তার দিকে আমার চোখ চলে যায়। জিলের চেয়ে সুদর্শন আর কোনও ফরাসিকে কি আমি এ অবদি দেখেছি! নাহ! দেখিনি। জিল গলগল করে ফরাসিতে কথা বলে, শুনতে বেশ লাগে। তার ইংরেজি বলাও বেশ মজার, বেশির ভাগ বাক্যই সে শুরু করে আই অ্যাম গোয়িং দিয়ে। আই অ্যাম গোয়িং টু কাম টু ইয়োর হোটেল, আই অ্যাম গোয়িং টু গো টু নাতালিস হাউস, আই অ্যাম গোয়িং টু বাই এ টিকেট এরকম। হঠাৎ নাতালিকে দেখি, নীলরতনকেও। নীলরতন আমার দেওয়া শার্টটি পরে এসেছে। অমিতাভ চক্রবর্তী অনর্গল আমার কানের কাছে মুখ এনে বলে যাচ্ছেন মঞ্চের বক্তারা কে কি বলছেন। বক্তাদের বক্তব্য শেষ হলে দর্শকদের মধ্য থেকে প্রশ্ন শুরু হল। মূলত ফরাসি-ভিড় থেকে প্রশ্ন। একজন জার্মান ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, ইউরোপ থেকে তাঁরা কি করে আমাকে সাহায্য করতে পারেন। আমি বললাম, দেশ ও বিদেশের যুক্তিবাদী বিবেকবান সচেতন মানুষের সহযোগিতা ছাড়া আমার পক্ষে পাসপোর্ট পাওয়া সম্ভব হত না। পশ্চিমের দেশগুলো যে দেশগুলো বাক স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারে বিশ্বাস করে, অনেকে আমার পাসপোর্ট ফেরত দেবার জন্য, আমার নিরাপত্তার জন্য, লজ্জা বইটির ওপর থেকে সরকারি নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়ার জন্য প্রচুর চিঠি লিখেছেন। তাদের আন্দোলনের ফলেই আমি আমার পাসপোর্ট ফেরত পেয়েছি। আপনাদের কাছে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ। হয়ত একদিন আমি নিরাপত্তা পাবো দেশে। হয়ত লজ্জা বইটির ওপরও আর নিষেধাজ্ঞা থাকবে না।

একসময় দেখি লাল একটি জামা পরে নাতালি ঢুকছে, জিলের নাতালি। নাতালি ঢুকেই জিলকে নিয়ে দরজার বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল। জিল কি এখন নাতালির সঙ্গে চলে যাচ্ছে কোথাও! আমার মন খারাপ হয়ে যায়। জিল, তুমি তো বলেছো নাতালির সঙ্গে তোমার গভীর কোনও প্রেম নেই! তবে যাচ্ছে! কোথায়!

মিশেল ইডেলের সংগঠনের মেয়ে তেরেসকে দেখি । মিশেল ফোন করেছিলেন হোটেলে, আমাকে নিতে আসবেন সন্ধ্যা সাতটায়। আন্তোয়ানেত ফুকের বাড়িতে নেমন্তন্ন। জিল উদয় হয়। মন ভাল হয়ে যায়। হোবিয়া মিনার হাসি-মুখটিও পলকের জন্য চোখে পড়ে। লোকটি আমার ছায়া মাড়ান না। ভাষার অসুবিধের জন্য এই দূরত্ব তিনি নিজেই তৈরি করেছেন। ইচ্ছে করে ফরাসি ভাষাটি শিখে নিতে, কিন্তু কি করে সম্ভব! নাতালির সঙ্গে চেষ্টা করে দেখেছি, হয় না। জিভকে গোল করে পেঁচিয়ে গলার তল থেকে অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ ওরা বের করে, ওরকম শব্দ শত চেষ্টা করলেও আমার গলা থেকে বেরোবে বলে মনে হয় না। অনুষ্ঠান শেষ হতেই আমাকে ঘিরে ধরলো অনেকে। জার্মানি থেকে এসেছেন এক নারী সংগঠনের নেষনী। তিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন জার্মানির অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করার।

আমি বলে দিই, দেশে গিয়ে জানাবো আপনাকে। এখনই কথা দিতে পারছি না। অনুষ্ঠানের ফরাসি দর্শকরা আমার কাছে ভিড় করেন অটোগ্রাফ পেতে।

আপনার বই কবে বেরোবে?

সম্ভবত সেপ্টেম্বরে।

আমরা অধীর আগ্রহে বসে আছি আপনার বই পড়ব বলে।

আমি বিষণ্ন হাসি। আমার দিকে বড় মায়ায় তাকিয়ে একটি মেয়ে বলল, আপনি কি ফ্রান্সেই থাকবেন এখন থেকে?

না, আমি কাল দেশে ফিরে যাচ্ছি।

দেশে কেন ফিরবেন? ওখানে যদি আপনাকে মেরে ফেলে!

আমি দেশে ফিরছি শুনে আরও পাঁচ ছজন ফরাসি মেয়ে বিস্ময়ের ঘোরে বলতে থাকে, না না না দেশে ফিরবেন না। দেশে আপনি কি করে বেঁচে থাকবেন ফতোয়া নিয়ে! এমন একটা ফতোয়া দিয়ে দিল, আর আপনি ফেরার কথা ভাবছেন, কি করে ভাবছেন!

তাই বলে নিজের দেশ ছাড়ব! অসম্ভব।

আপনার বুঝি প্রাণের মায়া নেই? যে করেই হোক বেঁচে থাকতে হবে তো। বেঁচে না থাকলে লিখবেন কি করে!

মানুষগুলোর চোখের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা মায়া মমতাগুলো আমি অনুবাদ করে নিই।

এরপর যে কজন বাঙালি এসেছিলেন অনুষ্ঠানে, আবার ঘিরে ধরলেন আমাকে। চলুন আমাদের বাড়ি চলুন।

আজ তো পারছি না ভাই। রাতে নেমন্তন্ন আছে।

তবে কাল!

কাল চলে যাবো।

আমরা কি কিছুই করতে পারবো না আপনার জন্য?

এবার তো হল না। পরের বার এলে নিশ্চয়ই যাবো আপনাদের বাড়িতে।

পার্থ প্রতিম পরিচয় করিয়ে দিলেন শিশির ভট্টাচার্যের সঙ্গে। শিশির কালো মত খাটো মত বাচ্চা বাচ্চা চেহারার এক লোক। শিশিরকে বললাম, শুনেছি ভাল অনুবাদ করেন, আপনার কথা আমি আমার প্রকাশককে বলব, এখানকার ফরাসিদের বাংলায় আমার খুব একটা আস্থা নেই।

সকলেই খুশি হল যে বাঙালিদের কাউকে দিয়েই অনুবাদের কাজ হবে বলে। খানিক পর পার্থ আমাকে খানিকটা দূরে সরিয়ে প্রলয় রায় নামের এক লোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, প্রলয় রায় চট্টগ্রামের ছেলে। বহুদিন থেকে আছেন এদেশে। প্রলয় বেশ ভাল অনুবাদ করতে পারবে। কিছু অনুবাদও করেছে। তুলনা হয় না। কোনও বাঙালিই ওর মত ভাল ফরাসি লিখতে পারে না।

প্রলয় আর শিশির দুজনের নম্বরই পার্থর কাছ থেকে নিলাম। জ্যঁ শার্ল এর বাংলায় আমি মোটেও সন্তুষ্ট নই। প্রলয়ের নামই না হয় ক্রিশ্চান বেসের কাছে প্রস্তাব করব, ভাবি মনে মনে। এক জাপানি দাঁড়িয়ে ছিল হাঁ করে। কাছে এসে বললেন, জাপান থেকে তারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চান। আমি যেন কী একটা বিশাল কিছু হয়ে গেছি। কিন্তু আমি কি হয়েছি কিছু? খুব ভাল জানি যে আমি কিছুই হইনি। যে আমি, সে আমিই আছি, অবকাশের আমি, গোবেচারা আমি, খানিকটা বোকা বুদ্ধু, খানিকটা আদর্শ মানা, খানিকটা স্রোতে গা ভাসানো, কিছু বোঝা, কিছু না বোঝা মেয়ে।

জিলের সঙ্গে বাকিটা সময় কাটানো সম্ভব হয়নি। মিশেল ইডেল আর আন্তোয়ানেত ফুকের সঙ্গে মধ্যরাত অবদি কাটাতে হয়।

Exit mobile version