Site icon BnBoi.Com

নেই, কিছু নেই – তসলিমা নাসরিন

নেই, কিছু নেই - তসলিমা নাসরিন

০১. মা, কেমন আছো তুমি?

নেই, কিছু নেই – আত্মজীবনী ষষ্ঠ খণ্ড – তসলিমা নাসরিন
প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০১০
পরিমার্জিত দ্বিতীয় সংস্করণ : নভেম্বর ২০১১

.

মা,

কেমন আছো তুমি?

কতদিন তোমার সঙ্গে আমার কথা হয় না। কত দীর্ঘদিন! তুমি কি হিসেব করছে দিনগুলো! চিরকালই তো তুমি দিন হিসেব কর, আঙুলের কড়ায় গোনো দিন। এতগুলো দিন এখন কি তুমি গুনতে পারছো? এখন তো দিন বা মাসের হিসেবে কুলোবে না। তোমাকে বছর হিসেব করতে হবে। বছর! ভাবলে কেমন গা কাঁপে। একসময় তো ঘণ্টা হিসেব করতে। ক’ ঘণ্টা ক’ মিনিট ঘরে ফিরছিনা, কোথায় কাটাচ্ছি, খেয়েছি কিনা, কোনও অসুবিধে হল কিনা কোথাও, এসব ভাবতে। বারান্দায় বসে থাকতে যতক্ষণ বাড়ি না ফিরি। তারপর তোমাকে ছেড়ে অন্য শহরে যখন চলে গেলাম, তখন কি আর ঘণ্টা হিসেব করে কুলোতেপারতে! তখন তোমার দিন হিসেব শুরু হল। আমি ফিরেছি তোমার কাছে, আমাকে দেখেই সঙ্গে সঙ্গে বলতে কতদিন পর এলাম আমি। তেতাল্লিশ দিন পর নাকি সাতাত্তর দিন পর। তুমি প্রতিদিন মনে রাখতে দিন কটা গেল। কী করে পারতে মা! তখন তোমাকে খুব বোকা ভাবতাম। বলতামও তোমার কি আর খেয়ে দেয় কাজ নেই, এসব হিসেব করো কেন বসে বসে! ’ হিসেব করা কিন্তু মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। যে করে, সে খেয়ে দেয়ে কাজ থাকলেও করে। যেকরে না, তার অখণ্ড অবসরেও সে করে না। আমি কোনওদিন কোনও কিছুর হিসেব করিনি, তোমার সঙ্গে দেখা না হওয়ার কোনও কিছু। না ঘণ্টা, না দিন, না মাস, না বছর। এক দুই তিন করে বছর চলে গেছে শুধু নিজের চারদিকে আবর্তিত হতে হতে, বুঝিওনি যে চলে গেছে।

তোমার কি কিছু ছিল না আর অপেক্ষা ছাড়া? ছিলই তোনা! কী ছিল তোমার যে কারও জন্য অপেক্ষা না করলেও চলবে তোমার! সংসারটা ছিল, যেটাকে সবচেয়ে আপন ভাবতে তুমি। সংসারে স্বামী আর চারটে সন্তান। বাবাকে আসলে তোমার স্বামী বলে কোনওদিন আমার মনে হয়নি। মানুষটাকে বাবা হিসেবেমানাতো। পুত্র, পৌত্র, প্রপৌত্র, ভাইপো, বাবা, কাকা, জ্যাঠা, মামা সবকিছুতেই মানাতো। শুধু ওই স্বামীটা মানাতো না। বিশেষ করে তোমার স্বামী। তোমার কি কোনওদিন তা মনে হয়েছে, মা? মনে নিশ্চয়ই হয়েছে। কোনওদিন বলোনি কাউকে। একসময় মনে হত, তুমি বুঝি সব কথা বলো। যেহেতু ভাবতাম তুমি বেশি কথা বলো। পরে বড় হয়ে, আরও অনেক বড় হয়ে বুঝেছিসব কথা তুমি কোনওদিনই বলোনি। তোমার অনেক কথা ছিল, যেসব কেউ কখনও জানেনি। শুধু তুমিই জানতে নিভৃতে। তোমার ভেতরে তোমার নিজস্ব কিছু কথা, কষ্টের কথা, একান্ত তোমারই কথা, তা জানার, আমার মনে হয় না কারও কখনও কোনওদিন কোনও উৎসাহ ছিল। সংসারে তুমি ছিলে, যেহেতু ওই সংসারটা ছাড়া কিছু ছিল না তোমার। ভাবলে শিউরে উঠি। গোটা একটা জীবনে আর কিছু নেই, শুধু খাঁ খাঁ করা ফাঁপা একটা সংসার পড়ে আছে, ইচ্ছে না হলেও এই ফাঁপা ফাঁকা জিনিসটা নিয়ে বাকি জীবন পার করতে হবে।

তুমি তো কোনওদিন শিউরে ওঠোনি! বরং শুরু থেকে শেষ অবধি এই সংসারটাই চেয়েছিলে যেন তোমার হয়। তোমার নিজের হয়। যে সংসারে তোমার জন্য কারওর কোনও ভালোবাসা ছিল না, সেই সংসারটাকে ভালোবাসা দিতে দিতে তুমি নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলে। নিঃস্ব রিক্ত সর্বস্বান্ত। সব হারিয়ে সব ফুরিয়ে তুমি আমার পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে। কেন যে তোমার মনে হতো, নির্বাসন থেকে আমি ফিরতে পারবো কখনও বা ফিরবো কখনও। মা, আমি কি তোমার কাছে ফেরার কথা ভেবেছিলাম কখনও? মনে হয় না। আমি চেয়েছিলাম দেশে ফিরতে। আমার ঘরে, আমার সংসারে। আমার বন্ধুদের কাছে। আমার শিল্প সাহিত্যের জগতে। আমার শৈশব কৈশোর যৌবনের স্মৃতির কাছে। চেনা বাড়িঘর, মাঠ মাটি, গাছ নদীর কাছে। স্বজনের কাছে। স্বজন বলতে কত কারও মুখ ভাসতো। তোমার মুখ কি আমার মনে পড়েছে কখনও? কখনও পড়েছে বলে তো মনে পড়ে না। তোমাকে, তুমি খুব ভালো করেই জানতে, যে, ভালো আমি বাসিনি। অভিযোগ করোনি কোনওদিন। ভালোবাসা দাবি করোনি। দাবি কি কারও কাছেই করেছিলে! স্বামীর ভালোবাসা দাবি করারও তোমার স্পর্ধা হয়নি কোনওদিন। শুধু ঘৃণা অবজ্ঞা অবহেলার বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে অনুযোগ করতে। যাদের ভালোবাসো, তাদের কাছে কাঁদতে। কাঁদার সময় কখনও বলতে না যে স্বামী ভালোবাসে না বলে তোমার মনে কষ্ট। মনে কষ্ট কারণ স্বামী অপমান করছে প্রতিদিন, কেউ তার ক্রীতদাসীর সঙ্গেও এমন ব্যবহার করে না, যে ব্যবহার তোমার স্বামী তোমার সঙ্গে করে। স্বামী যদি ঘৃণাটা কমাতো, যদি বিষ চোখে না তাকাতো তোমার দিকে, যদি দূর দূর করে না তাড়াতো, তাহলেই যেন ভালো ছিলে তুমি। আর কিছুর আশা তুমি করোনি। সত্যি, ভালোবাসা আশা করার সাহস তোমার হয়নি। ভালোবাসা, তুমি, আমার মনে হয় কারও কাছ থেকেই আশা করোনি। না তোমার ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে, না স্বামীর কাছ থেকে।

ভালোবাসা ছাড়াকীকরে বাঁচতে! এখন ভাবলে কী রকম যেনহুহু করে ওঠে বুকের ভেতরটা। একটা মানুষ অন্যকে কেবল দিয়েই যাচ্ছে, দিয়েই যাচ্ছে, চোখ বুজে, মুখ বুজে কেবল দিয়েই যাচ্ছে। কারও কাছে কিছু চাইছে না। কেউ কিছু দিতে চাইলে বা দিলে নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে নিচ্ছে। নিয়ে তোমার অভ্যেস ছিল না মা। তাই গুটিয়ে নিতে। লজ্জা পেতে। পেতে কিন্তু ভেতরে ভালো লাগার বীণা বেজে উঠত তোমার, গোপনে গোপনে অহংকার হত খুব। দাদা কোনও শাড়ি এনে দিলে সেই শাড়ির কথা তুমি অনেককে বলতে। নানিবাড়িতে ছুটে গিয়ে বলে আসতে সবাইকে। শাড়িটা সস্তা হলেও বলতে দামি। শাড়িটা যেন তেন হলেও নানাভাবে বোঝাতে চাইতে যে শাড়িটা আসলে টিকবে অনেকদিন, শাড়ির জমিন খুব ভালো। যদিশাড়িটা পরতে বলা হত তোমাকে, পরতে পারতে না। পরতে লজ্জা হত তোমার। নয়তো চোখে জল চলে আসতো খুশিতে। শাড়িটা আমাকে দিয়ে দিতে, নয়তো ইয়াসমিনকে। তুমি তোমার পুরোনো মলিন ছেঁড়া শাড়ি পরেই থাকতে। ওই যে অহংকার করতে, ওই অহংকারটাও করতে তোমার সংকোচ হত। অহংকার করেও তো তোমার অভ্যেস ছিল না। তোমাকে কেউ ভালোবাসছে, ভালোবেসে কেউ দিচ্ছে, তোমাকে নিয়ে ভাবছে, এটা কী যে অসম্ভব ঘটনা ছিল আমাদের বাড়িতে! কী করে ছিলে বাড়িটায়? আমি তোমার জায়গায় হলে বিয়ের পর দিনই হয় স্বামীকে বাড়ি থেকে বের করে দিতাম, নয়তো কোনও এক সময় নিজেই বেরিয়ে যেতাম। বেরোতে কি তুমি কম চেয়েছিলে! পারোনি। কে তোমাকে আশ্রয় দেবে, তোমার বাবা মা ভাই বোনরা তখন তো ধারণাই করতে পারতো না যে মেয়েরা স্বামীকে ত্যাগ করতে পারে! আবার তোমার ওই অশান্তির সংসারে এক এক করে সন্তান জন্ম নিল, সন্তানদের মুখ চেয়েও সংসার ছাড়তে তুমি পারোনি। ভেবেছিলে, ওরাই তোমার দুঃখ ঘোচাবে কোনও একদিন। সন্তান জন্ম দিলে আমিও হয়তো তোমার মতোই ভাবতাম! বিশেষ করে তোমার মতো যদি কপর্দকশূন্য হতাম বা যদি কোথাও আশ্রয় পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা না থাকতো। তুমি বলতে কোনও বড় বা মাঝারি চাকরি তুমি নিতে পারো না, কারণ তোমার আইএ বিএ পাশ হয়নি। আবার খুব ছোট চাকরি, যেমন লোকের বাড়িতে রান্না করা কাপড় ধোয়া বাসন মাজা, সেটাও তুমি নিতে পারো না, কারণ ও-কাজও তোমাকে দেবে না কেউ, কারণ তুমি খুব গরিব ঘরে জন্ম নাওনি, তোমার আত্মীয় স্বজন কেউ রাস্তায় ভিক্ষে করে না। তোমার কোনও উপায় ছিল না মা। উপায় থাকলে তুমি চলে যেতে। একবার বছর দশেকের ছোটদাকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা চলে গিয়েছিলে চাকরি খুঁজতে। ঢাকা গিয়েছিলে কারণ ময়মনসিংহে তোমার চাকরি পাওয়া সম্ভব নয়। নামি দামি ডাক্তারের বউ ছোটখাটো কোনও চাকরি করতে চাইছে, এ কেউ মানবে না। আবার বাড়ি থেকেও তোমাকে বাইরে চাকরি করতে যেতে কেউ দেবে না। ঢাকার হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেছো নার্সের চাকরি পেতে। কেউ তোমাকে সে চাকরি দেয়নি। দেয়নি কারণ তারাও কোনও না কোনওভাবে জেনে গেছে তোমার স্বামী একজন ডাক্তার। ডাক্তারের স্ত্রীর তো এত চাকরির প্রয়োজন নেই, দেবে কেন! আর সংসার ফেলে তুমি চাকরি করবে, তাই বা আমাদের সমাজের কর্তারা মানবে কেন। তুমি মোটেও বলতে চাওনি যে তোমার স্বামী ডাক্তার, কিন্তু খুঁচিয়ে তোমার সবকিছু জেনেও নিয়েছে ওরা। মিথ্যেও বলতে পারোনি। মিথ্যে বলতে তুমি জানতে না। স্বামী ডাক্তার, সে তো স্বামী, তুমি তো নও। টাকা পয়সা সে তো স্বামীর, তোমার তো নয়। এ কথা যত বোঝাতে চেয়েছো, তত ব্যর্থ হয়েছে। নিরাশ হয়ে ফিরে এসেছিলে ময়মনসিংহে। বাড়িতে ছোট কাজই করতে, কিন্তু মাইনে ছাড়া বিনে পয়সার কাজ। তুমি চলে গেলে কোনও একদিন কোনও এক সৎ মা এসে আমাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে, এই দুশ্চিন্তাও তোমার ছিল, কোথাও শেষ পর্যন্ত তোমার যাওয়া হয়নি। শৈশব কৈশোর জুড়ে শুনেছি, তুমি কোথাও চলে যাবে। খুব ছোট যখন ছিলাম, ভয় হত, তুমি চলে গেলে আবার কী না কী হয় আমাদের। তুমি চলে গেলে তোমার কী হবে ভাবিনি। ভেবেছি, আমাদের কে খাওয়াবে, কে নাওয়াবে, আদর যত্ন করবে কে। ভয় ছিল, আবার রাগও হত তোমার ওপর। আরেকটু বড় হয়ে, আরেকটু বুদ্ধি হওয়ার পর তোমাকে জিজ্ঞেস করতাম, গেলে ঠিক কোথায় যাবে তুমি। তোমার মুখে দ্রুত কোনও উত্তর ফুটতো না। ভাবতে তুমি। ঠিকই তো, কোথায় যাবে! আসলে তুমি বুঝতে যে পৃথিবীর কোনও বাড়ি নেই যেখানে তোমার থাকার জায়গা হবে, পৃথিবীতে মানুষ কেউ নেই যে তোমাকে আশ্রয় দিতে পারে। ‘কোথায় আর, কোনও জঙ্গলে টঙ্গলে’, বলতে। খুব দূরের কোনও জঙ্গলের ইঙ্গিত করতে তুমি, যেখানে কেউ পৌঁছোতে পারে না সহজে, আর যেখান থেকে কেউ কোনওদিন ফিরেও আসতে পারে না। মনে মনে তুমি কোন জঙ্গলের কথা ভাবতে? চোখের সামনে তোমার যে ভেসে উঠবে কোনও জঙ্গল, সে কোন জঙ্গল! তুমি তো দেখনি কোনও জঙ্গল, শহরের কাছেই যে মধুপুরের জঙ্গল, সে জঙ্গলও তোমার দেখার সৌভাগ্য হয়নি। ওসব জঙ্গলে তো বড় হয়ে কত আমরা চলে গেছি, ঘুরে বেড়িয়েছি, কোনওদিন তো ভুলেও তোমাকে নেওয়ার কথা ভাবিনি। আত্মীয় স্বজনকে নিয়ে যেতাম গাড়িতে, বন্ধু বান্ধব খুঁজতাম কাকে নিয়ে বেড়াতে যেতে পারি। তোমার কথা কোনওদিন মনে হয়নি মা। এখন প্রশ্ন করি নিজেকে, কেন মনে হয়নি। আসলে মনে হওয়ার মতো করে তোমাকে ছোটবেলা থেকে দেখিনি, বড়বেলায় যে বোধ জাগতে হয়, সেই বোধটা জাগেনি। ঘরে বসে, আমরা যারা হৈহুল্লোড় করে মধুপুর জঙ্গলে বেড়াতে যাবো, তারা কখন ফিরে আসবো তার অপেক্ষা করবে তুমি। নানা রকম সুস্বাদু খাবার তৈরি করে আমাদের জন্য দরজায় বা জানালায় দাঁড়িয়ে অস্থির অপেক্ষা করবে। দেরি হতে থাকলে তুমি বিড়বিড় করে সুরা পড়তে থাকবে যেন সব অমঙ্গল অতিক্রম করে ফিরতে পারি ভালোয় ভালোয়। জঙ্গলটাও বোধহয় তুমি কল্পনা করেই নিয়েছিলে। সিনেমায় দেখা কোনও জঙ্গলের কথা মনে করতে সম্ভবত। রাজাদের গল্পে মানুষকে বনবাস দেওয়া হত, অথবা সব হারিয়ে কেউ কেউ দুঃখে শোকে একা একা জঙ্গলে চলে যেত। তোমার কল্পনার জঙ্গলটি ঠিক কী রকম গভীর ছিল, জানি না। আমি আমার মতো করে তোমার জঙ্গলটি ভেবে নিতাম, যেখানে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। একবার কেউ সে জঙ্গলে হারিয়ে গেলে, জন্মের মতো হারিয়ে যায়। তোমার জন্য কী আমার ভয় হত? মনে হয় না। বরং রোমাঞ্চকর গল্পের মতো মনে হত সবকিছু। তোমার দিকে লাফিয়ে বাঘ আসছে, সাপ তোমাকে পেঁচিয়ে ধরেছে, তুমি চিৎকার করে বাঁচতে চাইছো, পারছে না। তোমার জন্য খুব মায়া হত বলেও আমার মনে হয় না। জিজ্ঞেস করতাম, কী খাবে জঙ্গলে? বলতে, আল্লাহর এই এত বড় দুনিয়ায় খাওয়ার অভাব হবেনা। আরও চাপ দিয়ে কথা বের করতে চাইলে বলতে যে ফলফলান্তি খেয়েই তোমার কেটে যাবে। আমি ভাবতে চেষ্টা করতাম, নানারকম ফল খাচ্ছো। ফল খেতে আসলেই তুমি খুব ভালোবাসতে। বাড়িতে কত ফলের গাছ লাগিয়েছিলে। কিছু কি খেয়েছে কোনওদিন? হঠাৎহয়তো গোপনে কামড় দিতে কোনও ফলে। গোপনেই। তুমি কি আর প্রকাশ্যে কিছু খেতে পারতে! বাবা লজ্জা দিত বলে খেতে না। খেতে আমাদের ফেলে রাখা আধ-খাওয়া কোনও ফল। নিজে গোটা একটা ফল কখনও খেয়েছো দেখিনি। খেলে চেখে দেখার জন্য খেয়েছে। ফলটা মিষ্টিকী না, রসালো কী না, ভালো জাতের কী না বোঝার জন্য। সবকিছু ছিল তোমার ছেলেমেয়েদের জন্য, ছিল বাবার জন্য, কাজের মানুষের হক আছে বলে তাদেরও দিতে। তোমার নিজেরহকের কথা তুমি নিজে কখনও বলেনি। হয়তো জানতেও না যে তোমার আদৌ কোনও হক আছে, জানলেও ভুলে গিয়েছিলে। আর, আমরাও স্মরণ করিয়ে দিইনি।

সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলে, হয়তো তারাই কোনও একদিন তোমার দুঃখ ঘোচাবে, কিছুই ঘোচায়নি কেউ। দাদা তোমাকে চাকরি পাওয়ার পর ঈদের সময় বছরে একটা সস্তা শাড়ি দিত। তাই পেয়েই কী ভীষণ খুশি হতে তুমি। এই দেওয়াটাও বন্ধ হয়ে গেল দাদাবিয়ে করারপর। দেওয়া বন্ধ হলেও কথা ছিল, কী ভীষণ অশান্তি আর অসুখ তোমাকে দিত দাদা আর তার বউ মিলে। ছোটদা তো অল্প বয়সেই বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করলো। তোমার কোল খালি করে চলে গেল তোমার আদরের ছেলে। তার হিন্দু মেয়ে বিয়ে করাটাও মেনে নিলে তুমি। ছেলেকে বউসহ বাড়ি ফিরিয়ে আনলে। গীতাকে বড় আদর করে আফরোজা বলে ডাকতে। না, নামটা তুমি দাওনি। ওদেরই দেওয়া। কিন্তু ওইযে ঘেমে নেয়ে রান্নাঘরে সারাদিন পড়েপড়ে খাটতে দুই বউকে খাওয়ানোর জন্য, ওদের মুখে হাসি ফোঁটানোর জন্য, যেন তোমার ছেলেদের মুখে হাসি ফোটে, কী হল শেষ অবধি! ওরাও তোমাকে দাসীই মনে করেছে। দাসীর মতো খাটতে বলে দাসীরা যেমন ব্যবহার পায়, তেমন ব্যবহার পেয়েছে। আমরা চার ভাই বোন যেমন ব্যবহার করেছি, ওই দুই বউএর কাছ থেকে তেমনই পেয়েছে ব্যবহার। ছোটদার ছেলে হল, আর সেই ছেলে পোষার ভারপড়লো তোমার ওপর। তুমি পাগল হয়ে গেলে। সত্যি বলতে কী, পাগলই হয়ে গেলে তুমি। ওভাবে কেউ দেবশিশু পুষতে পারে, মানুষ নয়। দিন রাত্তির ব্যস্ততা তোমার। কী থেকে আবার কী হয়ে যায়, তটস্থ ছিলে তুমি। তোমার ঘুম হারাম হয়ে গেল। নাওয়া খাওয়ার কোনও ঠিক নেই। ভয়ে কাঁপতে। এদিকে আবার মায়াও তৈরি হল। ছেলেটার জন্য কী ভীষণ মায়া, কী অসম্ভব ভালোবাসা। তুমি পারোও ভালোবাসতে। পুষতে বলে ছোটদাও দেওয়া শুরু করলোপরবে উৎসবে তোমাকে শাড়ি পরব বলতে তো ওই একটাই। ঈদ। নতুনপরবহল, তার ছেলের জন্মদিন। তুমি খাটছো, তার ছেলেকে জন্মের পর থেকে মানুষ করছে। বিনিময়ে তোমাকে একটা সুতির শাড়ি। ঘরে পরার। তুমি ফিরেও তাকাতে না সে শাড়ির দিকে। দিনমান তাকিয়ে থাকতে দেবশিশুর দিকে না তাকিয়ে থাকলে ও যদি হাঁটতে গিয়ে পড়ে যায়, দৌড়োতে গিয়ে কোথাও লাগে। অসাবধানে কিছু যেন না হয়। হাত সাতবার গরম জলে ধুতে ওকে ছুঁতে গেলে, ওর দুধের বোতল, ওর থালা বাটি ফুটন্ত জলে সাতবার ডোবাতে পারলে নিজের সারা গা ডেটলে ডুবিয়ে রাখতে। পেট যেন খারাপ না হয় ছেলের। হঠাৎহঠাৎ ঢাকা থেকে লং ড্রাইভে ছোটদা আর তার বউ চলে আসতো, বেড়ানোও হল, ছেলে দেখাও হল। তুমি তটস্থ হয়ে থাকতে। যত্ন আত্তিতে আবার কোনও ত্রুটি ধরাপড়ে গেল কীনা। তোমার জীবনে বোধহয় অত কঠিন মানসিক চাপ আর কখনও আসেনি। সবচেয়ে বড় কোনও পরীক্ষার প্র্যাকটিক্যাল দেওয়ার মতো। ছোটদারা এলে ওদের সামনে ছেলেকে নিয়ে তুমি দেখাতে যে কত হাসছে, খেলছে। মা বলতে শিখছে। আরও বড় হলে বলতে হাঁটতে শিখছে, পড়তে শিখছে, আঁকতে শিখছে। ছোটদারা দেখে যেত কতটা শিখেছে। তাদের কোনও পরিশ্রম ছাড়াই ছেলে বড় হয়ে যাচ্ছে, বেস্ট বয় হচ্ছে, এতে খুশি হবেনা তোঅবকাশে এলেই গীতা মুখবিষকরে রাখতো। যেন তুমিমানুষ করছে ঠিকই, ঠিকমতো করছোনা। আচ্ছাওরকনুইয়ের কাছে আবার কিসের দাগ? পড়ে গেছলোনাকি? যেন এক্সামিনার প্রশ্নকরছেন। তোমার মুখ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে যেত। দূরে গিয়ে কাঁদতে। আঁচলে মুছতে চোখের জল। একসময় এসে খন্ডন করতে গীতার অভিযোগ। আলোয় এনে দেখাতে সুহৃদের কনুইয়ে কোনও দাগ নেই। জামা জুতো খুলে সারা শরীর দেখিয়ে দিতে। নিটোল নিখুঁত। ওদের মুখে হাসি ফোঁটাবার জন্য কী রকম যে আকুল ছিলে, মা। দাসী ছিলে তুমি। কিন্তু তুমি তো মা, তুমি দাসী হবে কেন? দাসীরা তো মাইনেপায়, দাসীদের স্বাধীনতা থাকে বাড়ি বদল করার। ক্রীতদাসী ছিলে।

তোমাকে ভালোবাসার কোনও চল আমাদের বাড়িতে কখনও ছিলো না। বাবাকে যমের মতো ভয় পেতাম। বাবা ছিল আমাদের শিক্ষক। আমাদের নীতি আদর্শ বোঝাতো। সকাল সন্ধে কেবল জ্ঞান দিত। বড় হবার, ভালো হবার, সৎহবার, মানুষের মতো মানুষ হবার। বাবার টাকায় আমাদের খাওয়া হত। বাবা কিনে দিলে কাপড় জামা পেতাম। বাবাইস্কুলে ভর্তি করাতো, বইখাতা কিনে দিত, মাস্টার রেখে দিত। বাবা কলেজে পড়াতো, কলেজে যাবার রিক্সাভাড়া দিত। বাবার বাড়ি। বাবার টাকা। বাবার সব। বাবা ভালোবেসে কাছে টানতো। রাগ হলে পেটাতো। জন্মেরপর বাবাকেই দেখেছি পরিবারের সবচেয়ে বড় একজন মানুষ। যেসবচেয়ে বেশি বিদ্বান। যার আদেশে যার উপদেশে সংসার, সন্তান চলে। তুমি ক্রীতদাসী, পড়ে থাকতে রান্নাঘরে, দৌড়ে দৌড়ে বাবার আদেশ মতো কাজ করতে। বাবার ধমক খেতে। বাবাকে খুশি করার জন্য তোমার পরিশ্রমের শেষ ছিল না। সেই ছোটবেলায় বাবার প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে তোমার প্রতি হব কেন বলো তো! যমের মতো ভয় পেতাম, আবার মানুষটিকে ভালোবাসতাম। তার অপকর্মের জন্য যত ক্ষমা তাকে করেছি, তার সামান্যও তোমাকে করিনি। অপকর্ম না করলেও তোমার পান থেকে চুন খসলেই গর্জে উঠেছি, বাবা যেমন গর্জে উঠতো। বাবা যেমন তোমাকে মানুষ বলে মনে করতে না, আমরাও করতাম না মা। বাবা ছিল আমার, আমাদের শিক্ষক। তুমি চাইতে বাবার কথা শুনি, বাবার উপদেশমানি, আবার তোমাকেও একেবারে হেলা না করি। শিক্ষক তোমাকে হেলা করতো, তাই হেলা করতে শিখেছি। শিক্ষক যা বলে, তাই কি শুধু শুনেছিলাম, শিখেছিলাম; শিক্ষক যা করে, তাও করেছিলাম! পুরোটা শৈশব, কৈশোর, যৌবন জুড়ে শিখেছি। তোমাকে হেলা করতেই শিখেছি। আসলে মানসিকতা ওই শৈশব কৈশোরেই গড়ে ওঠে। সেটি নিয়েই আমরা বাকি জীবন কাটাই। খুব বড় কোনও পরিবর্তন পরবর্তী জীবনে আসে বলে মনে হয় না। তা না হলে তোমার একাকীত্বের দিকে কখনও আমি তাকাইনি কেন? আমি তো কত কারও কষ্টে কেঁদেছি, তোমার কষ্ট আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি কেন? তোমাকে ক্রীতদাসী ভেবেছিলাম, ভাবতে শিখিয়েছিল বাবা, তোমার স্বামী, তোমার প্রভু। আমি জানি না বাবার দোষ দিয়ে আমি একরকম পার পেতে চাই হয়তো। নিজের দায়িত্ব বলে কিছুকি ছিল না আমার, যখন বড় হলাম? তোমার প্রতি কোনও দায়িত্ব আমি বোধ করিনি। তুমি মা। তাতে কি? যখন আঘাত পেতে, বারবার বলতে ‘আমি তো মা, আমি তো মা’। তুমি যে মা সে কথা ভুলে থাকি বলে অভিযোগ করতে। হয়তো অভিযোগও করতে না, একা একা কষ্ট পেতে পেতে স্বগতোক্তি করতে! তোমার সঙ্গে অত জঘন্য আচরণ করি কেন, তুমি তো মা। মা বলে তুমি ভালোবাসা আশা করতে না, না পেতে পেতে তোমার অভ্যেস ছিল না পাওয়ার, শুধু চাইতে তোমাকে অত বিচ্ছিরিভাবে অপমান যেন না করি। যেন অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে বাবার মতো না হই। বাবারমতোহওয়ার স্বপ্নই তো ছিল আমার জীবনভর। বাবার মতো আদর্শবান, পর্বতের মতো উঁচু, ভেঙে না পড়া, মচকে না যাওয়া, পরোয়া না করা, দৃঢ়, ঋজু। বাবার মতো বস্তুবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক, কুসংস্কার-না-মানা, ধর্ম-না-মানা, কর্মঠ, নিষ্ঠ। এই গুণগুলোকে না ভালোবাসার কোনও কারণ ছিল না। বাবার সঙ্গে আমার নানা বিষয়ে মতবিরোধ হওয়ারপরও বাবা হতে চাওয়া থেকে আমি বিরত থাকিনি। বাবার মতো সবল, সাহসী, সত্যবদ্ধ আর সুশৃঙ্খল আমরাও যেন হই, চাইতে। কিন্তু বাবার চেয়েও মানুষ হিসেবে বড় হই, সহিষ্ণু হই, বিনম্র হই, নিরহংকার হই, উদার হই, এও চাইতে। তুমি কি তোমার নিজের জন্য অপমানিত না হওয়া চাইতে! নিজেকে ভালো লাগা দিতে! আসলে আমাদের জন্যই চাইতে। যেন আমরা কাউকে ঘৃণা না করে, কাউকে অশ্রদ্ধা না করে মানুষ হই, বড় মানুষ। বাবাও চাইতো আমরা যেন মানুষ হই। তোমাদের চাওয়ায় কোনও কার্পণ্য ছিলো না। শুধু মানুষ বলতে দুজনে দুরকম বুঝতে।

দাদা, ছোটদা, ইয়াসমিন কাউকে দেখি না এখন আক্ষেপ করতে যে, যে শ্রদ্ধা তোমার প্রাপ্য ছিল, তুমি তা পাওনি। তোমার প্রতি কোনও কর্তব্য বা দায়িত্ব পালনে তাদের কোনও ত্রুটি ছিল, এমন কথা ভুলেও কেউ উচ্চারণ করে না। সবাই অবিশ্বাস্য রকম শীতল, ভারমুক্ত, তৃপ্ত। অথচ আমি জানি মা, কতটা ভুল আমার মতো তারাও করেছে। আক্ষেপ আমার হয়, অনুতাপ আমার হয়। আমি খুব ভালো করেই জানি যে তোমাকে যত অবজ্ঞা করেছি, তত অবজ্ঞা আমি কাউকে করিনি। তত অসম্মান পৃথিবীর কাউকে আমি করিনি। যত ঘৃণা করেছি আমি তোমাকে, সত্যি বলতে কী, তত আর কাউকে করিনি। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, অনুশোচনা আমি কেন করি এখন? তুমি নেই বলেই তো! তুমি যদি থাকতে, এই অনুশোচনাটা করতাম বলে মনে হয় না। যেমন তোমাকে ভুলে ছিলাম, তেমনই থাকতাম। কারও বোধোদয় হওয়ার জন্য যদি অন্য কারও মৃত্যুর প্রয়োজন হয়, তবে সেই বোধোদয়ের মূল্য কি সত্যিই কিছু? আমার এই বোধের জন্য, বিশ্বাস করো বা না করো, আমারই লজ্জা হয়।

তোমার একাকীত্ব নিয়ে কোনওদিন সামান্যও ভাবিনি। ছোটবেলায় না হয় ভাবিনি। বড়বেলাতেও কেন একবারের জন্যও মনে হয়নি, কী দুঃসহ জীবন তুমি কাটিয়েছো তোমার সারাজীবন। কেন একবারও ভাবিনি কী ভীষণ একা তুমি। বুদ্ধি হবার পর কোনওদিন দেখিনি বাবা আর তুমি এক বিছানায় ঘুমোচ্ছো। বাবা তো তোমার সঙ্গে শুতো না। তার মেয়ে ছিল শোয়ার। তুমি কেঁদে কেটে বুক ভাসিয়ে, চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে, বাবাকে ফেরাতে চেয়েছো, পারোনি। তুমি ব্যর্থতার আরেক নাম। বাবা তোমার সামনে দিয়ে গটগট করে বেরিয়ে যেতে। মেয়েমানুষের অভাব বাবার থাকবে কেন, দেখতে অসম্ভব সুন্দর ছিল, তার ওপর ডাক্তার, আবার নামকরা ডাক্তার, রোগীতে ভরে থাকতো চেম্বার, হয় বাবা বড় সিভিল সার্জন, নয় মেডিকেল কলেজের প্রফেসর। এমন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, গুণে জ্ঞানে ভরপুর পুরুষ শহরের কজন দেখেছে! মেয়েরা বাবার প্রেমেপড়তো। তবে বাবার কপালও যে খুব ভালো ছিল, তানয়। কোন এক ফর্সা বিবাহিত মহিলার সঙ্গে বাবা সেই যৌবনেই এমন ভিড়ে গিয়েছিল যে সেই মহিলা তার স্বামীর কাছ থেকে তালাক নিয়ে বাবাকে চাপ দিয়ে বিয়ে পর্যন্ত করিয়ে নিয়েছিল। এসব আমরা কেউ জানতাম না। হঠাৎহঠাৎ লোকমুখে শুনতাম। লোকের কথা বিশ্বাস হত না। বাইরের প্রেম ভালোবাসা, সোহাগ সম্ভোগের খবর বাবা কোনওকালেই বাড়িতে আনেনি। বাবার না হয় শরীর জুড়োতো, তোমার কী হত! তোমাকে স্পর্শ করার কোনও প্রাণী তো কোথাও ছিল না। আমাণুদ্দৌলা কদিন তোমার সঙ্গে সম্ভবত গল্প করার ছুতোয় তোমার হাত ছুঁয়েছে, কিন্তু সে যে খুব বেশিদূর যেতে পেরেছিল, মনে হয় না। আমিই তো তোমার একটা বন্ধু সম্বোধন করে লেখা চিঠি কোত্থেকে আবিষ্কার করে বাড়ির সবার সামনে একদিন চিৎকার করে জানিয়ে দিয়েছিলাম। ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল তোমার মুখখানা। আমরা সবাই খাওয়ার টেবিলে বসে খাচ্ছিলাম, বাবা, দাদা, ছোটদা, আমি … ওইসময়ই ঘৃণা ছুঁড়তেছুঁড়তে বলেছিলাম সে কথা, যে, তুমি একটা প্রেমপত্র লিখেছো কাউকে, কী লিখেছো তাও বলেছি, অল্প বয়সে মস্তিষ্কের ঘর বারান্দা বড় তকতকে থাকে, দাঁড়ি কমাও মুখস্ত হয়ে যায়। সেই চিঠিটা কাকে লিখেছো, তা যে অনুমান করতেপারছি, এবং সেই অনুমানটিও সবাইকে আরও দ্বিগুণ চেঁচিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলাম, তা ওই ঘৃণার জন্য। তোমাকে, সত্যি কথা বলতে কী মা, আমি ঘৃণা করতাম। তোমার কিছুই আমার পছন্দ হতো না। তোমার অসহায়তা আমার ভেতরে কোনও করুণা সৃষ্টি করতো না। পৃথিবীর সব নির্যাতিত অসহায় মানুষের জন্য আমার মায়া হত, কিন্তু তোমার জন্য হত না। কেন আমি সেদিন ছোট একটা চিঠি, তোমার দুঃখ বুঝতে চাইছে বা পারছে, এমন কাউকে সমমর্মী মনে করে লিখেছো, পড়ে তোমাকে ছিছি করেছিলাম! আজ আমার ভাবতে লজ্জা হয় সেই কথা মনে করে যে পরিবারের সবার সামনে তোমাকে ওভাবে নির্লজ্জের মতো লজ্জা দিয়েছিলাম, তোমার জগৎ এক কুঁয়ে ধসিয়ে দিয়েছিলাম। ভাবতে লজ্জা হয় তোমার জন্য বাইরের মানুষের সহানুভূতি ছিল, আমার ছিল না। শুধু লজ্জা নয়, নিজের ওপর ঘৃণাও হয়। আমাকে হয়তো অনেকে সান্ত্বনা দেবে এই বলে যে, আমার মানসিকতাও আর সব মেয়ের মতোপুরুষতান্ত্রিক সমাজে থেকে থেকে পুরুষতান্ত্রিক হয়েই গড়ে উঠেছিলো, এ দোষ তাই আমার নয়। দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাবার অভ্যেস নেই আমার। দোষ আমারই। এ কথা সম্পূর্ণই ঠিক যে, আমি আসলেই ভেতরে ভেতরে বিশ্বাস করতাম মেয়েদের নিজের কোনও জীবন থাকতে নেই, তাদের জন্মই হয়েছে স্বামীসেবার জন্য, জন্মই হয়েছে পুরুষের দাসত্ব করার জন্য। পুরুষের অধিকার আছে স্ত্রীর বাইরে যে কারও সঙ্গে মানসিক বা শারীরিক সম্পর্ক করার, কোনও মেয়ের সে অধিকার নেই। ভালো মেয়ে হতে চাইলে একনিষ্ঠ হতে হয়, পতিব্রতা হতে হয়। আমার পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা তোমাকে একা পেয়ে, নিরীহ পেয়ে, শক্তিহীন পেয়ে চরম আঘাত করেছে।

ছোটবেলায় তুমি আমার মাথায় নারকেল তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে দিতে। উকুন হলে উকুন বেছে দিতে, জামা কাপড় নিজে সেলাই মেশিনে তৈরি করে দিতে, নোংরা হলে কেচে দিতে। আমার বিছানা, আলনা, আলমারি, কাপড়চোপড়, বইপত্র গুছিয়ে রাখতে। দিন রাতপড়ছি, মাথাটা যেন ভালো কাজ করে, মাথাটা যেন পড়া মনে রাখে, সে কারণে আমার যে একটু ডিম দুধ খাওয়া দরকার, মাছ মাংস খাওয়া দরকার, একটু যে ফল দরকার –এগুলো বাবার কাছে কতভাবে যে বলতে। আমরা তো সবাই বাবার ওপরই নির্ভর ছিলাম, এরকম তোনয় যে তোমার সাধ্য ছিল কিছু কেনার। সাধ্য থাকলে কী না করতে তুমি! তোমার হাতে যখনই কিছু টাকা এসেছে, তখনই তুমি কারও না কারও জন্য কিছু কিনেছে। নিজের জন্য কিছুই কোনওদিন কেনননি। যখন নানি বাড়ি বা তোমার বোনের বাড়ি যেতে, সেই যাওয়াররিক্সাভাড়াটাও, দুটাকা কী তিন টাকা, তোমাকে চেয়ে চেয়ে নিতে হত বাবার কাছ থেকে। বেশির ভাগ সময়ই বাবা দিত না। তুমি তোমার ভাই বোনের কাছ থেকে চাইতে। সংকোচ হত তোমার। কিন্তু উপায়ই বা কী ছিল। তোমার ভাই বোনকে, তোমার বাবা মাকে তুমি অনেক কিছু, সামান্য কিছুহলেও উপহার দিতে চাইতে। কাউকে কিছু দিতে পারার ক্ষমতা ছিল না তোমার। তোমার মতো নিঃস্ব কী জগতে দ্বিতীয় কেউ ছিল! চাকরি করাকালীন আমি জানি না কখনও তোমার হাতে কোনও টাকা দিয়েছি কিনা। যদি দিয়েও থাকি কোনওদিন, টাকাটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই সামান্য কটা টাকা নিয়েই চলে যেতে আমার জন্য আমার ভালো লাগে এমন কিছু কিনে আনতে। মা, আমার আজ মনে হয়, তুমি বোধহয় তোমাকে ভালোবাসতে না। স্বামী সন্তানকে ভালোবাসলে যে নিজেকে ভালোবাসতে হয় না, কে তোমাকে শিখিয়েছিলো!

তোমার একাকীত্বের কথা মনে হলেই মনেপড়ে শীতের সন্ধেগুলোর কথা। ডাল পাতা খড় যোগাড় করে কোনও কোনও রাতে উঠোনে আগুন জ্বালাতে। সেই আগুনে মাঝে মাঝে দেখতাম তুমি হাত পা তাপাতে। জ্বলন্ত কয়লার দুপাশে পা রেখে তুমি দাঁড়াতে। তাপটা নিতে ঊরুতে, ঊরুসন্ধিতে। ওই তাপ কি তোমাকে কোনও সুখ দিত? তোমার মুখটায় লজ্জা, ভয় আর কীসব যেন মিশে থাকতো। শীতে তোমাকে খুব কাবু করতো, নাকি মাঝে মাঝে যৌন তৃষ্ণাও? এত ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিলো তোমার শরীর, একটু আগুন দরকার ছিলো তোমার। মা জাতীয় মানুষদের আবার ওইসব নোংরা জিনিসের কোনও উপদ্রব থাকে এ আমার কখনও মনে হতো না। পুরুষহীন জীবনই তো কাটিয়েছে, প্রায় সবটা জীবনই। যতই তোমাকে দাসী বা ক্রীতদাসীর মতো রাখুক, বাবাকে ভালোবাসতে তুমি। প্রচণ্ড ভালোবাসতে। অতভালোবেসেও বাবার সামান্য ভালোবাসাও

তুমি পেতে পারোনি। বাড়ির বাইরে বাবা যার তার সঙ্গে মিশতে, কোনও বাছবিচার ছিল না। তোমার বেলাতেই ছিল নাক সিটকানো। দশ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল তোমার। পরের বছরেই দাদাকে পেটে ধরেছো। ঋতু দেখেছো কী দেখনি, গর্ভবতী হলে। আমার চেয়ে বড়জোর কুড়ি একুশ বছরের বড় ছিলে বয়সে। তুমি যখন তোমার যৌবন জুড়ে একা, বাবা তখন তার ফর্সা ফর্সা রোগিণীদের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। একাকীত্ব কী, আমি জানি। আমারও তো সারা শরীরে একাকীত্ব। জীবনে আমিও সত্যিকার কোনও প্রেমিক পাইনি। সত্যিকার বলছি এই জন্য যে, ‘তোমাকে ভালোবাসি’ ইত্যাদি বলার লোকের অভাব ছিল না, ও শুধু মুখের বলা, হৃদয়ের নয়। সত্যিকার ভালোবাসা, সে কারওরই ছিল না। তোমার কষ্ট অনুভব করার জন্য বোধহয় জীবন আমাকে এক-জীবন একাকীত্ব উপহার দিয়েছে। –বাবা ইওরোপে আমার কাছে এসেছিলো। বাবাকে ডেনমার্ক, জার্মানি, ইংলন্ডে নিয়ে গেছি। আমাকে দেওয়া বিদেশিদের অনেক সম্মান, সংবর্ধনা দেখেছে বাবা। দাদাও এসেছিলো, দাদা অবশ্য আমার ওপর বিদেশের বড় বড় কোনও অনুষ্ঠানই দেখেনি। কিন্তু দাদাকে আমি স্পেন আর পর্তুগাল বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলাম। ছোটদাও এসেছিল। চাইতাম সবাই আসুক আমার কাছে। দেশে যদি না-ই যেতে পারি এখন, আমার সঙ্গে দেখা যোক আমার স্বজনদের সবাইকে তো আমার কাছে আসতে বলতাম। কিন্তু কখনও তোমাকে আসতে বলিনি। আর যার কথাই মনে আসুক, তোমার কথা আসে না। তোমাকে তো কোনওদিন কোথাও বেড়াতে নিইনি দেশে থাকাকালীনও। বিদেশে কেন আসতে বলবো। তুমি নিজে থেকেই আসতে চেয়েছে অনাহুতের মতো। হঠাৎ করে তুমি জানালে যে তুমি আসছো আমার কাছে। আমি অবাক হয়েছিলাম। তুমি যখন আসবে বললে, সুইডেনের উপলান্ডস ভিয়েসবি, চার নম্বর মুনিনভ্যাগেনে মস্তিষ্কে-মনে একশ ভাগ সুইডিশ ভদ্রলোক সুয়েনসনের শহরতলির ঘোর নির্জন বাড়ি আমার ঠিকানা। এমনিতে সুইডেন দেশটাই ফাঁকা, ওই উপলান্ডস ভিয়েসবি তারও চেয়ে বেশি ফাঁকা। পরের বাড়িতে উঠতে রুচিতে আমার চিরকালই বাধে। নিজের দেশে নিজের বাড়ি রেখে পরের দেশে পরের বাড়িতে থাকা, নিজের দেশে নিজের গাড়ি রেখে পরের দেশে পরের গাড়ি চড়া যে খুব স্বস্তির নয়, সুখের নয়, তা আমার মতো আর কে জানে মা। সুয়েনসন মানুষটা কেমন, মানুষটা কী, তার কতই আর জেনেছি। দেখা হয়েছে সাকুল্যে চারবার। সুয়েনসনের বাড়িতে উঠেছিলাম জার্মানি থেকে ফিরে এসে। বিদেশে কোথাও চাকরি করি না। ইওরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে বের হওয়া বইয়ের রয়্যালটি আর কিছু পুরস্কার পাওয়ার টাকা আমার সম্বল। বসে খেলে রাজার ধনও ফুরিয়ে যায়, আমার ধনও ফুরোবে, এই আশংকা আমার ভেতর বাসা বেঁধেছে। তোমাকে তো জীবনের কোনও গল্পই বলিনি মা। অনেককে বলেছি, তোমাকে বলার কোনও প্রয়োজন বোধ করিনি। কখনও যদি ফোনে তোমার সঙ্গে কথা বলেছি, তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে চেঁচিয়ে তোমাকে কাঁদিয়েছি। তুমি কেঁদেছো। শরাফ মামা আমার বাড়িতে কেন এল, তুমি কেন ঢুকতে দিলে? আমার পুরোনো দুটো সালোয়ার কামিজ, গায়ে আমার আঁটে না, দিয়েছিলে বড় মামার দুই মেয়ে শিপ্রা আর শুভ্রাকে। বড়মামার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়, মেয়েদুটো অভাবে থাকে, তাই। আমি তোমাকে ধমকে বললাম, ‘আমার অনুমতি ছাড়া কেন তুমি আমার জিনিস অন্যকে দেবে? ’ ‘তুমি তো অনেক বছর ধরে ওগুলো আর পরো না মা।‘ তুমি খুব মোলায়েম স্বরে বলেছো। তোমার মোলায়েম স্বর আমাকে সামান্যও মোলায়েম করতে পারেনি। আমি চিৎকার করি, আমি পরি কী নাপরি সে আমি বুঝবোনাপরি, ওগুলো থাকবে, যেভাবে ছিল। আমি যখন ফিরবো দেশে, তখন দেখবো আমার পুরোনো ছোট হয়ে যাওয়া কাপড়গুলোও। যেভাবে যা রেখে এসেছি, সেভাবেই যেন সব থাকে। তুমি বললে, ‘আমি ভেবেছিলাম গরিব দুঃখীকে সাহায্য করলে বোধহয় তোমার ভালো লাগবে। মনে আছে কী রকম রুক্ষ কণ্ঠে তোমাকে বলেছিলাম, কোনও গরিব দুঃখীকে আমার দেওয়ার দরকার নেই। তুমি টাকা দিয়ে বরং ওদের কাপড় চোপড় কিনে দাও। আমার স্মৃতি তুমি নষ্ট করো না। তুমি ওদের জামা কাপড় যা দান করেছিলে, ফেরত নিয়ে এসেছিলে মা। সম্ভবত ওদের গা থেকে খুলে নিয়ে এসেছিলে। এখন যখন ভাবি তোমার কেমন লেগেছিল কাজটা করতে, বুক ফেটে যায়। মাথা তোমার কতটুকু নত হয়েছিলো বড়মামার সামনে, শিপ্রা আর শুভ্রার সামনে, বুঝি। তুমি তো গুছিয়ে রাখতে যা আমি রেখে এসেছিলাম সব, নিজের শাড়ি নেই, তবু আমার বড় কাঠের আলমারিগুলোর পাঁচশ শাড়ির একটিতেও তুমি হাত দাওনি। যেন পোকা না কাটে, যেন নষ্ট না হয়ে যায়, বারান্দায় শীতলপাটি বিছিয়ে রোদে দিতে শাড়িগুলো, রোদে দিয়ে পাশে বসে থাকতে। দেখতে শাড়িগুলো, যেন আমাকে দেখতে। স্পর্শ করতে, যেন আমাকে স্পর্শ করতে। তোমার চোখের জল টুপ টুপ করে পড়তো, বার বার মুছে নিতে হত জল তোমার, যেন শাড়ির ওপর পড়ে শাড়ি নষ্ট না হয়। এভাবেই তো যত্ন করেছিলে আমার সবকটা জিনিস। আঁচল দিয়ে মুছে মুছে রাখতে আমার পড়ার টেবিল, আমার বই, কাগজপত্র। ফ্রেমে বাঁধানো আমার ছবিগুলো। মুছতে আর কাঁদতে। কবে আমি ফিরে আসতে পারবো, জিজ্ঞেস করতে সবাইকে। কেউ তোমাকে কোনও উত্তর দিত না। কেউ বলতো, খালেদা গিয়ে হাসিনা এলেই ফিরতে পারবো। কেউ বলতে, বিশেষ করে ছোটদা, জীবনেও আমি ফিরতেপারবো না। শুনে তুমি হাউমাউ করে কাঁদতে। একবার ব্যারিস্টার কামাল হোসেনের কাছে যেতে বলতে। একবার সারা হোসেনকে আমাকে যেন দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে বলতে বলতে। কেউ কারও কাছে যেত না। তুমি দাদাকে অনুরোধ করতে, ছোটদাকে করতে। চোখের জল ফেলে ফেলে করতে। কে শোনে তোমার কথা! তুমি তো অশিক্ষিত। তুমি যে অশিক্ষিত, এ কথা বাবা আমাদের ছোটবেলা থেকেই বোঝাতো। আমরাও মাথার খুলি খুলে ঢুকিয়ে নিতাম বাবার দেওয়া জ্ঞান। তুমি নিজেও অবশ্য বলতে তুমি ইস্কুল পার হতে পারোনি, কলেজেও পড়া সম্ভব হয়নি, তাই অনেক কিছু জানো না বা বোঝো না। আমার বিষয়ে বাবা বা দাদারা কেউ যদি কোনও কথা বলতো, কোনও গুরুত্বপূর্ণ কথা, তোমাকে শুনতে দিত না, তুমি বুঝবে না বলে। তুমি জানতে চাইলে বাবা চোখ ইশারা করে দাদাদের মুখ বন্ধ রাখতো। এর মানে হচ্ছে, ও কিছু বুঝবে না, অকারণে ওকে বলে কী লাভ, বরং ও আবার মৌলবাদীদের কাছে খবর পৌঁছে দিতে পারে। হ্যাঁ এই দোষ তোমাকে দেওয়া হত, যে, তুমি বোধহয় কাউকে জানিয়ে দেবে আমার সম্পর্কে কোনও তথ্য। কারণ কী? কারণ তুমি বোকা। তুমি মূর্খ। তোমাকে কোনওদিনই তাই আমার কোনও ঠিকানা বা ফোন নম্বর দেয়নি ওরা। আরও না দেওয়ার কারণ তুমি আমার যোগাযোগের ঠিকানা বা নম্বর তোমার ভাইবোনদের দেবে, ওরা আমাকে ফোন করে নিজেদের দুঃখ দুর্দশার কাহিনী বলে আমার কাছে টাকা চাইবে। একটা জিনিসই ওরা খুব ভালো বুঝতো, সে হলো টাকা। দেশে আমার টাকা ছিল, বিদেশে আমার আরও টাকা, টাকার ওপর যেন গড়াগড়ি খাচ্ছি। এসব সত্য অনেক পরে জেনেছি মা। ফোনে তাই আমার কাছেও তুমি জানতে চাওনি আমি কোথায় থাকি, আমার ফোন নম্বর বা ফ্যাক্স নম্বর কী। কারণ, ওসব চাইতে তোমার ভয় হত। ভয় হত, কারণ আমি যদি তোমাকে সন্দেহ করি। ওদিকে আমি ভাবতাম, কেউ তো একটা চিঠিও আমাকে লেখে না। মা হয়ে তুমিও তো লেখো না। চোখের জলে ভিজিয়ে কত কত চিঠি তুমি আমাকে লিখে তোশকের তলায় রেখে দিয়েছো মা। পরে ওসব চিঠি আমি পেয়েছি, পেয়েছি যে, তুমি জানতেও পারোনি। জানবে কী করে, তুমি তো ছিলে না যে জানবে।

দেশ ছেড়ে চলে আসার দিন থেকে চার চারটে বছর তুমি আমার পথের দিকে চেয়ে কাটিয়েছিলে। উড়োজাহাজের শব্দ শুনে দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতে। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে হয়তো আমি এসেছি। তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ তোমার ভিজে উঠতো! কত কেউ দেশে ফেরে, কেবল আমি ফিরি না। বাড়ির দরজায় আর সবাই কড়া নাড়ে, কেবল আমিই নাড়ি না। তোমার শরীরটাও, তুমি টের পাচ্ছো, যে, ভালো যাচ্ছে না। কেন ভালো যাচ্ছে না? জিজ্ঞেস করলে ফোনে তুমি উত্তর দিতে না। আসলে তুমি জানো না মা, আমি ভাবতাম তুমি মিথ্যে বলছে। ওই যে সেই কত আগে থেকেই বলতে যে তোমার কী নাকি একটা অসুখ, রক্ত যাওয়ার অসুখ আছে, নাম পাইলস। বাবা বলতো ও কিছু না। আমরাও বলতাম ও কিছুনা। আমি তো ও কিছুনাতে থেমে থাকিনি বলতাম, ‘শুধু শুধু কমপ্লেইন করবে না তো! তোমার শরীর খুবই ভালো আছে, চমৎকার আছে। আমি জানিনা কেন বিশ্বাস করতাম সবাইকে বিরক্ত করতেই শুধু অভিযোগ নিয়ে আসো, এখানে ব্যথা, ওখানে কষ্ট। অথচ বাবার সামান্য অসুখেই আমি বিচলিত বোধ করতাম। জানি তার রক্তচাপ বেশি, একবার ছোটখাটো একটা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশান হয়েছে শুনেছি। জানি তার ডায়বেটিস। জানি যে কোনও সময় বাবার দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাই বাবা নিয়েই আমার রাজ্যির দুর্ভাবনা, দুশ্চিন্তা। মা, তুমি যখনই তোমার অসুখের কথা বলতে, আমি বলতাম, ‘অসুখ যদি থাকে সে বাবার, তোমার নয়। তখন হার্ট মানে কী, হার্টের অসুখ মানে কী, এনলার্জড় হার্ট মানে কী, মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশান মানে কী তা বেশ জোরে সোরেই তোমাকে বুঝিয়ে দিতাম। তুমি হাঁ হয়ে শুনতে। এরপর আর কষ্ট পেলেও কষ্টের কথা বলতে না পাছেমিছে অভিযোগ মনে করে ধমক দিই। হ্যাঁ বরাবরই আমার উদ্বেগ বাবাকে নিয়ে। বাবার সেবা যত্ন ঠিকমতো হচ্ছেনা। সারাদিন চেম্বারে বসে রোগী দেখছে, বাড়ি বাড়ি রোগী দেখতে যাচ্ছে, বাজারে যাচ্ছে বাবা কখন খাবে, কী খাবে, কখন বিশ্রাম নেবে, কতক্ষণ নেবে, বাবার দেখাশোনা কে করবে ময়মনসিংহে! দুশ্চিন্তার মুঠোর ভেতর বন্দি হয়ে ছটফট করি। বাবাকে ফোন করে বাবার কথা জিজ্ঞেস করি, তোমাকে ফোন করে ওই বাবার কথাই জিজ্ঞেস করি। না গো মা, তুমি কেমন আছো, এ কথা জিজ্ঞেস করি না। করি না কারণ, জানি, আগেও যেমন জানতাম, এখনও জানি যে, ভালো আছো তুমি। বাবা ভালো নেই বলে আমার উৎকণ্ঠা এবং উদ্বেগ দিন দিন এমনই বাড়ে যে প্রবল ভাবনায় থাকি বাবা যে প্রতিদিন অবকাশ থেকে নতুন বাজারে চেম্বারে যায়, রাতে চেম্বার থেকে বাড়ি ফেরে, গ্রামের জমি দেখতে মাঝে মাঝে নান্দাইল যায়, সব যাওয়া আসা যেন পায়ে হেঁটে, রিক্সায়, বাসে না হয়ে গাড়িতে হয়। আমার নিজের গাড়ি পড়ে আছে ঢাকায়। ছোটদা সেটা ব্যবহার করে। ছোটদাকে অনেক বলেছি গাড়িটা যেন বাবাকে ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়। যতবারই ছোটদাকে গাড়ি পাঠানোর কথা বলি, ছোটদা বলে, বাবা গাড়ি নেবে না। নেবে না আবার কী, গাড়ি তুমি ময়মনসিংহে চালিয়ে নিয়ে গিয়ে বাড়িতে রেখে ট্রেনে করে ঢাকা চলে এসো। ছোটদা অবশ্য বলে যে হ্যাঁ ঠিক আছে তাই করবো। সম্ভবত দূরের একটা গর্দভকে শান্ত করার জন্যই বলে। এক দুই করে মাস যেতে থাকে, খবর নিয়ে দেখি ছোটদা বাবাকে গাড়ি দেয়নি। আমার নিজের গাড়ির ওপর আমার কোনও অধিকার নেই, অধিকার ছোটদার। গাড়ি সে কাউকে দেবে না, কারণ গাড়ি সে ব্যবহার করে। ছোটদা একবার আমাকে গাড়ি কিনে দেবে বলে টাকা নিয়ে গিয়েছিল, আর ফেরত দেয়নি। অনেকদিন সেই টাকার জন্য অপেক্ষা করে পরে নিজেই একটি গাড়ি কিনি, ভেতরে দামি সিট কভার, মেঝেয় ম্যাট, পারফিউম, জানালার রোদপর্দা ইত্যাদি কত কিছু দিয়ে গাড়িটি সাজানোর পরপরই আমাকে দেশ ছাড়তে হলো। গাড়িটি ব্যবহার করতে শুরু করলো একা ছোটদা। তুমি যে ঢাকায় বেরোতে, তোমাকেও তো কোনওদিন আমার গাড়ি ব্যবহার করতে দেয়নি। তুমি বাজারে যেতে, বড় মামার বাড়ি যেতে, ঝুনুখালার বাড়ি যেতে, সবখানেই রিক্সায় যেতে। আমার গাড়ির ওপর তোমারও কোনও অধিকার ছিল না, কোনও অধিকার দাবি করার কথাও কোনওদিন কল্পনাও করোনি। ছোটদা তার বান্ধবীদের নিয়ে গাড়ি নিয়ে ঘুরবে, যেন সেটাই নিয়ম ছিল। ওই নিয়মের বাইরে অন্য কোনও কিছু যে হতে পারে, খুব স্বাভাবিক কিছু, তা ভুলেই গিয়েছিলে বা ছোটা তোমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিলো। বাবা ঢাকায় এলেও তাই হতো। বাসে ঢাকায় আসতো, ঢাকায় যদি কাজ থাকতো কোথাও, বিক্সায় যেত। আর দেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে বসে এক গর্দভ বাবার রিক্সায় চলার বিরুদ্ধে চেঁচাতো। আমার চেঁচানোর কোনও মূল্য ছোটদার কাছে কখনও ছিল না। শেষপর্যন্ত আমি সিদ্ধান্ত নিই যে বাবাকে গাড়ি কেনার জন্য টাকাঁপাঠাবো। বাবা বলে দিল কোনও টাকা পাঠানোর দরকার নেই। কিন্তু বললেই তো হবে না, আমাকে তো দুশ্চিন্তামুক্ত হতে হবে, বাবা কৃপণ বলে আমি তো কৃপণনই। আমি ভুল ভেবেছিলাম, ভেবেছিলাম বাবা কৃপণ বলে নিজের টাকা খরচ করে না, সম্ভবত অন্যের টাকা খরচ করবে। কিন্তু যে নিজের টাকা খরচ করে না, সে যে অন্যেরটাও করে না, তা আমার বোঝা উচিত ছিল। বাবা কিছুতেই তার ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বর আমাকে জানাবে না। আগেও তো জানায়নি। তখন তোমার অ্যাকাউন্টে আমি বাবার জন্য টাকা পাঠিয়েছিলাম। নিজের অ্যাকাউন্ট নম্বর আমাকে জানাবেই না, শেষ পর্যন্ত দাদার অ্যাকাউন্ট নম্বর নিয়ে ওখানে বাবার গাড়ি কেনার জন্য টাকা পাঠালাম। সাড়ে চার লাখ বা পাঁচ লাখ টাকা। দাদা বললো রেজিস্ট্রেশনের জন্য তো টাকা লাগবে। তাও পাঠালাম। দাদাকে পই পই করে বলে দিই যেন বাবার নামে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন হয়। গাড়ি কেনা হচ্ছে কিনা, কবে কেনা হবে, এসব আমি প্রতিদিনই বাবা আর দাদাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করি। তাগাদা দিই তাড়াতাড়ি করার জন্য। সব কিছুর কারণ ছিল, বাবা যেন ভেবে মনে সুখ পায় যে গাড়িটা তার, গাড়িটা তাকে তার সুযোগ্য কন্যা উপহার দিয়েছে। গাড়িটা যেন বাবা তার নিজের চলাফেরার জন্য ব্যবহার করে। গাড়ি কেনা হল, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন হল, সব আমিই ফোন করে করে খবর নিয়েছি। এরকম নয় যে দাদা বা বাবা নিজে থেকে আমাকেকিছু জানিয়েছে। গাড়ির রেজিস্ট্রেশন বাবার নামে হয়েছে তো, বারবার জিজ্ঞেস করি। দাদা বললো বাবার নামেই হয়েছে। গাড়ি কেনার পরও আমার প্রতিদিনের ফোন করায় কোনও ছেদ পড়ে না। কী হল, বাবা গাড়ি চড়ছে তো! বাবা সুন্দর বলে দিল, চড়ছি। দাদাকে জিজ্ঞেস করি, দাদা বললো, ড্রাইভার এখনও রাখা হয়নি। ড্রাইভার রাখা হলে আবারও খবর নিই। তোমার কাছে ফোন করে জানতে চাই বাবা গাড়ি চড়ছে কি না। তুমি বললে, ”গাড়ি তো শুধু নোমান চড়ে, আর নোমানের বউ ছেলেরা চড়ে, তোর বাবা তো চড়ে না। রেগে আগুন হই আমি। ওই আগুনে আমি একা একাই পুড়ি। আমি টাকা পাঠাতে পারি, কিন্তু টাকা দিয়ে যা করা হবে, তা তো আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। সে শক্তি আমার নেই। আমার শুধু টাকার শক্তি। আমার শুধু যার আছে, তাকে দেওয়ার উৎসাহ।

তুমি ঢাকা ময়মনসিংহ দৌড়োদৌড়ি করো, বাসে করো, তুমি যে ময়মনসিংহে গিয়ে এর বাড়ি ওর বাড়ি যাও, রিক্সায় যাও। কোনওদিন গাড়ি চড়োনি। না মা, তুমি চড়োনি। তুমি তো ভালো আছো। তুমি চড়বে কেন। কিন্তু ভালো থাকা তুমি একদিন শুনি আমাকে দেখতে সুইডেনে আসবে। শরীরটা নাকি ভালো নেই। শরীর ভালো না থাকার কথা বলা তোমার নতুন নয়। ও আমাকে মোটেও উদ্বিগ্ন করে না। ছোটদাকে ঘন ঘন ফোন করি, বাবাকে আসতে বলো। ছোটদা জানালো, বাবা আসতে চাইছে না, মা আসবে। আমার সাফ কথা, মা যখন আসতে চাইছে আসুক, সবচেয়ে ভালো হয় বাবা এলে। কারণ বাবা তো অসুস্থ। এ সময় তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিদেশ থেকেপরীক্ষা করিয়ে নেবো, অসুখ বিসুখ থাকলে বিদেশেই চিকিৎসাটা হবে। বাবা আসবে না, কারণ তার কাজের চাপ। অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার, তার কী এমন কাজ যে মেয়েকে দেখতে আসতে পারবে না! খুব মন খারাপ হয়ে যায়। বাবাকেই বেশি চাই দেখতে। তোমার আসায় না আসায়, সত্যি বলছি, কিছু যায় আসে না আমার।

বাবাকে রাজি করাতে না পেরে ছোটদা আমাকে জানিয়ে দিল তুমি একা আসছে। বিমানে চাকরি করার কারণে নিজের বাবা মার জন্য ছোট দা ফ্রি টিকিট পায়, সেই টিকিট ব্যবহার করে ব্রাসেলস অবধি তোমাকে আনতে তার কোনও অসুবিধে নেই। ব্রাসেলস থেকে তোমাকে তুলে নেওয়ার দায়িত্ব আমার। চার বছর পর তোমাকে দেখার উত্তেজনা ছিল। বাড়ির কারও সঙ্গে দেখা। তুমি না হয়ে যে কেউ হলেই উত্তেজনাটা থাকতো বোধহয়। ওরকম নির্জন নির্বাসনে বছরের পর বছর একা পড়ে থাকলে আত্মীয় বা বন্ধু কাউকে পাওয়ার অর্থ যে কী তোমাকে বোঝাতে পারবো না। আত্মীয় বন্ধুর কথা ছেড়ে দাও। চেনা কেউ, চেনা না হলেও দেশের কেউ, বাংলা ভাষায় কথা বলে কেউ, তাকেই কত আপন মনে হয়। শুধু তাই নয়, ভারত, পাকিস্তান, এমনকী শ্রীলঙ্কার লোকদেরও আপন মনে হয়। বিদেশি কোনও লোক বাংলাদেশ বা ভারত ঘুরেছে শুনলে তাকেও মনে হয় ঘরের লোক। ব্রাসেলস বিমান বন্দরে আমাকে নিতে এসেছিল ছোটদা। সে যে কী আনন্দ আমার ছোটদাকে দেখে। ছোটদাকে তো চারবছরে আরও কয়েকবার দেখেছি। একবার সেই আমস্টারডাম গিয়ে। ওকে স্টকহোমেও নিয়ে গিয়েছিলাম। অক্সফোর্ডে এসেছিল বাবাকে আমার কাছে তুলে দিতে। এরপর একবার নিয়ে এসেছিলাম বার্লিনে। তারপরও ছোটদাকে দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরি। মাকে নিয়ে এলে না কেন এয়ারপোর্টে? ছোটদা বললো, মা শীতে কাঁপছে, তাই বার করিনি বাইরে। শহর ছাড়িয়ে একটি মাঝারি গোছের হোটেলে বিমানের ক্রুরা থাকে। সেই হোটেল নভোটেলের নিচতলার একটি ঘরে তখন তুমি। তোমাকে দেখে আমি চমকে উঠি প্রথম। এ কাকে দেখছি! যে মাকে শেষ দেখেছিলাম, এ তো সে মা নয়। তোমাকে অমন চেহারায় এর আগে দেখিনি কোনওদিন। যতই বলছি এ কেমন শরীর হয়েছে তোমার! তুমি বলছো, ডায়বেটিস। ডায়বেটিসে জানি শরীর শুকিয়ে যায়। কিন্তু তোমাকে কি এতটাই ডায়বেটিস ধরেছে! ছোটদা বললো তুমি নাকি ইনসুলিন নাও, তাও আবার নিজে নিজে।

উফ, এর মতো মর্মান্তিক আর কিছু আছে কী! তোমার সঙ্গে বাংলাদেশের শেষ কটা মাস ভাববাচ্যে কথা বলতাম। এতগুলো বছর ফোনেও ভাববাচ্যে চালিয়েছি। যখন দেখা হল বিদেশ বিভুইএ, তখনও ভাববাচ্যে। নিজের মা, তার সঙ্গে ভাববাচ্যে কথা! সারা জীবন যদি নিজের বাবার সঙ্গে ভাববাচ্যে কথা বলি, নয় কেন! শুধু কি বাবার সঙ্গেই! নানিবাড়ির প্রায় সবার সঙ্গেই তো। আমার মনে হয় এত লোকের সঙ্গে ভাববাচ্যে কথা চালানো আমি ছাড়া জগতের আর কেউ পারেনি। কী করে যেপারি, ভাবলে বিস্ময় জাগে। কোনও এক সময় কিছু একটা করেছিলে, বকেছিলে বা কিছু, যে কারণে তোমাকে তুমি বলে সম্বোধন করা বন্ধ করেছি। তোমাকে কতগুলো বছর দেখিনি, কত দূরের দেশে একলা পড়ে আছি, তারপরও তোমাকে আমি ক্ষমা করি না। জানিনা তোমার কোন ভুলের জন্য দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে নির্বাসিত আমি তোমাকে ক্ষমা করতে পারিনা। তুমি শুধু আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদোই। আমি বলতে থাকি, কী ব্যাপার শরীরের এই অবস্থা কেন? না, তুমি তোমার শরীর নিয়ে একটুও ভাবছো না। ভাবছো আমাকে নিয়ে। আমি ততদিনে ফুলে ঢোল, সুতরাং তোমার বলার কোনও উপায় নেই যে আমি ঠিকমতো খাচ্ছিনা। শরীরের দিকে নজর যেন আমি দিই, বলছে না। আমার মুখে পিঠে বুকে হাতে পায়ে তুমি হাত বুলিয়ে দিচ্ছ। কতদিন আমাকে না ছুঁতে পারার কষ্ট তোমার আঙুলে, আমাকে দীর্ঘ কাল না দেখতে পারার কান্না তোমার চোখে। আমার চোখে জল ছিল না। আমি হাসছিলাম। অনেকদিন পর ফ্যামিলি গেট টুগেদারের যে আনন্দ, সেই আনন্দ উথলে উঠছিলো। যথারীতি বাবার অসুখ নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা এবং তার আরোগ্য নিয়ে তার যে উদাসীনতা সে নিয়েও আমার শেষ না হওয়া উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেতে থাকে আমার কথাবার্তায়। কথা বেশি বলছিলাম ছোটদার সঙ্গে। ছোটদার সঙ্গে আমার ভাববাচ্য চলে না। বলছিলাম দেশের কথা, দশের কথা। ওসব তো তোমার সঙ্গে আলোচনার কথা নয়। ছোটদাই বললো তুমি উমরাহ করে এসেছে। উমরাহ। ছি ছি। এ নিয়ে চললো আমার ছিছিককার। কেন উমরাহ করতে গেলে! এ কোনও কাজের কাজ! ছোটদার ফ্রি টিকিট ছিল, তাই যেতে পেরেছো তুমি। তোমার স্বপ্ন ছিল কোনওদিন আরব দেশে যাবে, সে স্বপ্ন বা শখ মিটেছে। আমি মনে করিয়ে দিয়েছি তোমার আমিরুল্লাহ পীরের কথা, যে বলেছিল তোমাদের নাকি আল্লাহর অলৌকিক বাহনে করে উড়িয়ে আরব দেশে নিয়ে যাবে। ওভাবে উড়ে যে যাওয়া তোমার হল না, মানুষের তৈরি উড়োজাহাজে যেতে হল–তাই বলে বলে আমি হাসছিলাম। শ্লেষের হাসি। তুমি কেবল আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলে আর চোখের জল ফেলছিলে। ফেলছিলে আমাকে দেখার আনন্দে। আর আমার নাস্তিকতার প্রমাণ আমি দিচ্ছিলাম তোমাকে আঘাত করে করে। নাস্তিকরা কি খুব নিষ্ঠুর হয়? হয় বোধহয়। নাকি আমিই নিষ্ঠুর! জগতে এক আমিই নিষ্ঠুর। যে মা আমার সঙ্গে জন্মের পর থেকে যতদিন দেশে ছিলাম, পাশে ছিল, তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চার চারটে বছর পার হওয়ার পর যখন তাকে প্রথম দেখি তার ধর্মবিশ্বাস নিয়ে ব্যঙ্গ করছি আমি, তার অন্ধ বিশ্বাসের কারণে সে যেন নুয়ে থাকে, লজ্জা পায়, তার চেষ্টা আমি করছি। আমি থামছিনা। আমি তাকে আঘাত করছি জেনেও আঘাত করছি। তোমার কষ্ট দেখে আমার অভ্যেস আছে। তোমার ধর্মবিশ্বাস নিয়ে চিরকালই আমি কটুক্তি করেছি। এ নতুন কিছু নয়। আমি যে সেই আমিই আছি, তা বোঝানোও হয়তো গেল কিছু। দেশ থেকে মৌলবাদীদের উৎপাতে নির্বাসন হলেও আমি যে আমার আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হইনি তাও বোঝানো গেল। আর, এও আমি বোঝাতে চাইলাম যে বিদেশের সংস্কৃতিতে বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমি, জানি অনেক, বুঝি অনেক। মা দেশি লোক। বিদেশে প্রথম। আরব দেশকে আর বিদেশ বলি না। সাদাদের ইওরোপ আমেরিকাকেই সত্যিকার বিদেশ বলি। মাকে আমার শেখাবার অনেক কিছু আছে। শেখাতে শুরু করে দিই তড়িঘড়ি। শীতকাল। শীতকালে ইওরোপে দেখার কিছু নেই। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় জমে যেতে হবে। সবচেয়ে ভালো হল সামার। আমি গরমকাল কে আর গরমকাল বা গ্রীষ্মকাল বলি না। সামার বলি। তোমাকে গরম কাপড় পরতে হবে। স্যান্ডেল চলবে না, জুতোপরতে হবে। খুব পাতলা মোজাপরলে চলবে না। উলেন মোজা চাই। ইনার চাই, থারমাল চাই। মাথায় টুপি চাই। তুমি বিস্ময় চোখে দেখতে লাগলে আমাকে। কী দেখছিলে? আমি যে বিদেশের কত কিছু শিখে গেছি? আমি যে অনেক বিদেশি হয়ে গেছি, দেখছিলে? আমি তোপরে এসেছিলাম ওভারকোট, মাথায় টুপি, পায়ে ছেলেদের জুতোর মতো বুটজুতো। আমি বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম, ছেলেদের মতো দেখতে তোমার মনে হতে পারে, কারণ দেশে তো মেয়েরা এরকম জুতো পরে না, কিন্তু এ জুতো মেয়েদের জুতো। তুমি বুঝলে; কিন্তু জুতোয়, জামায়, কোটে, ওভারকোটে, টুপিতে তোমার কোনও কৌতূহল নেই। কৌতূহল আমাকে নিয়ে। কী করছি, কী খাচ্ছি, মন কেমন, শরীর কেমন, কবে দেশে ফিরতে পারবো, দেশে ফিরতে যা যা করতে হয় তা কি করছি? যদি না করি, কেন করছিনা? তোমার কৌতূহল মেটাতে আমার মোটেও ইচ্ছে হয় না। আমি তোমার রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতা নিয়ে আবারও বিদ্রূপ করি। কোনও চেষ্টা করলেও যে কোনও লাভ হবে না, দেশে যে আমাকে ফিরতে দেওয়া হবে না, এ যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যে তুমি বোঝো না, তা যে কেবল আমি বুঝি আর ছোটদা বোঝে, সেটাই তোমাকে বোঝাই। আমাকে দেশে ঢুকতে দিলে সে যে সরকারই হোক, ধর্মবাদীদের ভোট পাবে না বলে ভয়ে আমাকে ঢুকতে দেয় না। তুমি কী বুঝলে কতটুকু বুঝলে কিছুই বলল না, শুধু বলো, যেন চেষ্টা করি দেশে ফেরার। যেন ফিরি। একটা মানুষ কী করে চেষ্টা করতে পারে, কী করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে টলিয়ে ফেলতে পারে, মৌলবাদে ছেয়ে যাচ্ছে দেশ, রাজনীতিবিদরা মৌলবাদেরপক্ষে যাবে, নাকিআমার পক্ষে গিয়ে বিপদ ডেকে আনবে নিজেদের, এসব জিজ্ঞেস করি তোমাকে। তোমার পক্ষে তো এসবের উত্তর দেওয়া সম্ভব হয় না, শুধু বলো, দেশে ফেরো দেশে ফেরো। একসময় বলল, তোমাকে না নিয়ে আমি দেশে ফিরবো না। তোমার বালখিল্য কথা আবারও হাস্যরসের যোগান দেয়। তুমি জগতের দুর্বলতম মানুষ, তুমি কিনা আমাকে দেশে ফিরিয়ে নেবে! না হেসে কী করবো। তোমার মুখে হাসি নেই। সারা মুখে আমাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংকল্প, একই সঙ্গে কষ্টে ডুবে থাকা চোখ। তোমার ভেতর এমন দৃঢ়তা আগে কখনও দেখেছি বলে মনে করতেপারি না। তোমার ওজন অস্বাভাবিক কমে যাওয়া, চিরকালের দুর্বল মনের মানুষটির সবল হওয়া দুটোই আমার কাছে নতুন। তুমি ঠিক আগের তুমিনও। সামান্য হলেও কিছুপরিবর্তন তোমার মধ্যে ঘটেছে। কিন্তু তোমার আর কত, সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন যে ঘটেছে আমার মধ্যে। আমি শীত গ্রীষ্ম জানি, বিদেশের পথে একা একা হাঁটতে জানি। কোন দোকানে কী পাওয়া যায়, কী জিনিস দিয়ে কী করতে হয় জানি। এমনকী এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে যেতে জানি। এসব কিছুই তুমি জানো না মা। তুমি দেশে পড়ে থাকা আটপৌরে শাড়ি পরা অবুঝ অশিক্ষিত মা। বিদেশে আমাকে নিয়ে কী সব কাণ্ড হয়েছে তোমাকে বলি। কত কাণ্ড। বাবা কি কিছু গিয়ে বলেছে? না বলেনি। আমি যে ছোটদার হাতে এত এত ভিডিও ক্যাসেট পাঠিয়ে দিয়েছি, এত এত বই, অ্যালবাম! না তুমি কিছু দেখনি।

তোমাকে দেখতে দেওয়া হয়নি। সব নাকি গুছিয়ে রাখা হয়েছে, কেউ যেন স্পর্শ না করে তার ব্যবস্থা হয়েছে। তুমি দেখনি! পড়োনি। বোঝোনি। আমাকে নিয়ে বিশ্ব তোলপাড়, এ নিয়ে বাবা আর দাদার প্রচণ্ড আগ্রহ, তোমার নেই। তুমি চাও ঘরের মেয়েকে ঘরে ফেরাতে, তুমি চাও সে নিজের দেশে, নিজের বাড়িতে ফিরুক, আত্মীয় স্বজনের মধ্যে থাকুক, নিজের ভাষায় কথা বলুক, ভাত মাছ খাক, তুমি চাও আগের মতো। কিন্তু কিছু যে আগের মতো নেই তা বুঝতে চাও না। তোমার একটাই অনুরোধ, আমি যেন ঘোষণা করে দিই, ইসলামের বিরুদ্ধে আমি কিছু আর লিখবো না, সুতরাং আমাকে যেন দেশে ফিরতে দেওয়া হয়। তোমাকে যত বলি, যে, এটা আমি লিখবো না, তাহলে আমি আর আমি থাকি না। তুমি বোঝো না। তুমি এমনকী বলো, যেন ক্ষমা চাই। আমি বলে দিই কোনও দোষ তো আমি করিনি। তোমার তারপরও ইচ্ছে, আমাকে না নিয়ে দেশে তুমি একা একা ফিরবে না।

ছোটদাদের নোভোটেল হোটেলে ছোটদাই শুধু খেতে পারবে নাস্তা। তাতে কী! আমার কি টাকা ছিল না তোমার আর আমার জন্য নাস্তা কিনে আনা? না একে ফাঁকি দেওয়ার একটা ব্যবস্থা ছোটদা বার করলো। আমাকে নিয়ে নাস্তা খেতে গেল হোটলের ব্রেকফাস্ট রুমে, আর তোমার জন্য পকেটে করে দু চাক রুটি আর একটা সেদ্ধ ডিম নিয়ে এল। তুমি হলে বাড়তি, বুঝলে মা, তোমাকেও আমরা বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম তুমি হলে বাড়তি একটা মানুষ যার নাস্তার টেবিলে বসে আর সবার মতো কোলের ওপর ন্যাপকিন রেখে চামচে করে ওটমিল, বা ব্রেডের ওপর বাটার আর চিজ বা জ্যাম লাগিয়ে খাওয়ার উপায় নেই। কেউ লুকিয়ে কিছু খাবার দিলে তোমার পক্ষে খাওয়া সম্ভব হতো না। তুমি অপরাধবোধে ভুগতে। তুমিও ভয়ে লুকিয়ে রাখতে ওই দু চাকু রুটি বা ডিম বা কলা। অবৈধ জিনিস তুমি কোনওদিন খাওনি। এখনই বা খাবে কেন? কিন্তু উপায় না দেখে ক্ষিধেয় তুমি কামড় দিয়েছো ওসবে। স্বস্তি ছিল কি ওই কামড়ে? ছিল না মা। বিদেশে ওই ছিল তোমার নাস্তা। আর আমি? তোমাকে ঝকঝকে জগৎ দেখাবো বলে নিয়ে গিয়েছি ব্রাসেলস শহরে। গ্র্যান্ড প্লাজার সামনে দাঁড় করিয়েছি, দূর দূরপথ তোমাকে হাঁটিয়েছি। হাঁটতে তোমার কষ্ট হতো। তুমি পিছিয়ে পড়লে তিরস্কার করেছি। কেন দ্রুত হাঁটতে পারছে না? তুমি তোপঙ্গু নও বা এমন কিছু বুড়ো হয়ে যাওনি। এই মুশকিল তোমাদের নিয়ে। এখানে সবাই হাঁটে। হাঁটাটা স্বাস্থ্যের জন্য খুব ভালো। আমি তো দশ মাইল কুড়ি মাইল দিব্যি হাঁটি, প্রতিদিনই হাঁটি। তোমাকে বললাম হাঁটা শিখতে। বলেছিলে ঢাকার রমনায় প্রতিদিন হাঁটতে যেতে। তোমার হাঁটার নমুনা দেখে আমার মনে হয় না রমনায় কোনওদিন হেঁটেছে। বেদনাকে কী প্রাণপণে আড়াল করেছো, বুঝিনি তখন যে আড়াল করেছো। আড়াল তুমি করেই চলতে। স্বাস্থ্য ভালো হবে, আমি, তোমার ডাক্তার মেয়ে ভরসা দিচ্ছি, তুমি তাই যে করেই হোক হাঁটছে। পিছিয়ে না পড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। তবুআমার বিরক্তি প্রকাশে কোনও বিরতি ছিল না। না হাঁটলে তোমার ডায়বেটিস ভালো হবে না, বারবার সতর্ক করে দিই। আমার উপদেশ মতো ডায়বেটিস দূর করার চেষ্টাও হয়তো করেছিলে। কিন্তু শেষপর্যন্ত পারোনি, কোনও ট্যাক্সি ডাকা যায় কিনা জিজ্ঞেস করেছে। ছোটদা বলেছে, ওতে প্রচুর টাকা। এরপর তুমি আর ট্যাক্সির কথা বলোনি। তুমি চাও না তোমার জন্য কারও টাকা খরচ হোক। রাস্তায় মানুষ হাঁটছে, সব বয়সের মানুষ, বিদেশের মানুষের বুদ্ধি আছে বলে হাঁটে, তাদের স্বাস্থ্যও তাই ভালো থাকে। এদেশের মানুষ আমাদের দেশিদের মতো গণ্ডমূর্খ নয়, এই জ্ঞান দিতে দিতে তোমাকে হাঁটালাম। গ্র্যান্ড প্লাজা থেকে ধমকে টাউন হলের পাশ দিয়ে কয়েকশ মিটার তোমাকে হাঁটিয়ে মানেনকেন পিস নামের বিখ্যাত ন্যাংটো একটা বাচ্চার পেচ্ছাব করা মূর্তির কাছে আনলাম। ষোলোশা আঠারো সালে মূর্তিটি ওখানে বসানো হয়েছিল, নানারকম গল্প আছে মূর্তি নিয়ে। কিছু গল্প তোমাকে বলি। মানেনকেন পিস দেখে আমি যে খুশি হচ্ছি, তাই দেখে বোধহয় তোমার আনন্দ হচ্ছিল, যদি হওয়া সম্ভব সামান্য আনন্দ আদৌ। ব্রাসেলসের বড় বড় প্রাসাদ দেখে তুমি মুগ্ধ হও, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করো, চাইছিলাম। এমন ভাবে সব দেখাচ্ছিলাম যেন শহরটা আমার। দেশটা তোমার, বিদেশটা আমার, যেন এমন। দেশের অভাব, অশিক্ষা, অসুন্দর, অজ্ঞতা সব তোমার। বিদেশের বৈভব, বিত্ত, বিশালতা, বিলাসিতা, বিচিত্রতা, বিজ্ঞতা আমার। তোমাকে রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেলাম, যে রেস্তোরাঁর খাবার আমি আর ছোটদা খেতে পারলেও তুমি পারোনি। ওসব কাঁচা বা প্রায় কাঁচা মাছ তুমি খেতে পারো না। ঝিনুক নিলাম। ইচ্ছে করেই। দেখাতে যে যে খাবারগুলোকে অসম্ভব ভাবো-খাওয়া, সেগুলো খাওয়া কত সম্ভব। ছোটদা কিছু ঝিনুক খেল, আমিও কি আর ওসব খুব খেতে পারি! তোমাকে দেখানোর উদ্দেশ্যটাই ছিল আসল। খুব যে উৎসাহী চোখে তুমি খাবার দেখলে, তা নয়। তুমি প্রায় কিছুই খেতে চাইলে না। স্বাদ পেতে পারো, এমন কিছু খাবারও দেখলাম খেলে না। রেস্তোরাঁর বিল বেলজিয়ান ফ্রাঁয়ে দিয়ে টাকায় কত হয়, তাও তোমাকে বলতে ভুলোম না। তোমার মুখ সঙ্গে সঙ্গেই খুব মলিন হয়ে উঠলো। কেন শুনিয়েছিলাম তোমাকে টাকার অংক, আমি খুব ধনী তা বোঝাতে, নাকি বিদেশের রকম সকম বোঝাতে! আমার একবারও মনে হয়নি টাকার অংক শোনারপর তুমি এমনই সতর্ক হয়ে উঠবে যে রেস্তোরাঁয় আর খেতে চাইবে না। তার চেয়ে না খেয়ে থাকবে।

এই বেলজিয়ামে কত যে উৎসব হয়েছে আমাকে নিয়ে। এই ব্রাসেলসএর রাস্তায় ছিল আমার বুলেটপ্রুফ গাড়ির সামনে পেছনেপুলিশের গাড়ি, রেড কার্পেট রিসেপশান। ছিল প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ। ব্রাসেলস বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিসমাসের ছুটি হয়ে যাওয়ার পরও আমার বক্তৃতা শুনবে বলে সবারই বসে থাকা, গেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার ডকটর অনোরিস কোজা’ বা ডক্টরেট পাওয়া, সঙ্গে আমি ছাড়া যাঁরা পেয়েছিলেন, সবাই আগে নোবেলপুরস্কার পেয়েছেন। বেলজিয়ামের এয়ারলাইনস সাবেনা ভয় পেয়ে আমাকে, ফতোয়া আক্রান্ত লেখককে, উড়ানে নেয়নি বলে প্রেস কনফারেন্সে সাংবাদিকদের ক্ষোভে ফেটে পড়া, আমাকে বিপুল সমর্থন জানানো। জনগণ আমাকে দুদণ্ড দেখার জন্য উতলা। সেই একই আমি ব্রাসেলসএর রাস্তায় যখন হাঁটছি, আমি নিতান্তই বাদামি রঙের এক মেয়ে, সম্ভাব্য ইমিগ্রেন্ট, ইললিগ্যাল। টুরিস্ট নই। বাদামি রঙের মেয়েরা সাধারণত গরিব দেশের, পর্যটক হওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই। যত তোমাকে আমার সেই ঝলমলে দিনের কথা বলেছি, তুমি তত বোধহয় অবাক হয়েছে। কারণ তুমি এসে যা দেখছো, তার সঙ্গে আমার গল্পের কিছু মিলছে না। আমি এখন রাস্তার যে কোনও মানুষের মতো। কেউ চিনতে পারছেনা আমাকে। আমার গল্প তুমি শোনো, কিন্তু এ নিয়ে তুমি আরও শোনার আরও জানার কোনও আগ্রহ দেখাও না। আর যদি দেখতেইমহোৎসব, খুব কিপুলকিত হতে! মনে হয় না আমার। তুমি ওই ঘরের মেয়ের ঘরে ফেরার কথাই ভাবতে।

.

ছোটদাকে ব্রাসেলসে রেখে, তোমাকে নিয়ে সুইডেনে ফিরি। যে বাড়িতে তোমাকে ওঠালাম সুইডেনে, বাড়িটা বড়, আধখানা মাটির তলায়, আধখানা ওপরে, বাড়িটার সামনে পেছনে মাঠ আছে, মাঠে গাছগাছালি আছে, কিন্তু বাড়িটা আমার নয়, বাড়িটা অন্যের। গোপনে তুমি কি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলে? হয়তো ফেলেছিলে। কেন নয়! আমি তো কোনও পুরুষের বাড়িতে আশ্রিতা হিসেবে থাকার মানুষ কোনওদিনই ছিলাম না। দেশে থাকাকালীন যুদ্ধ করেছি একা থাকার জন্য! ঢাকা শহরে আর কোনও মেয়ে কি একা থাকতে পেরেছিলো আমার মতো! নোংরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সঙ্গে কী ভীষণ লড়াই করেই না শুধু মনের জোরে আমি একা থাকতে শুরু করেছিলাম। একা দাঁড়িয়েছি। একা বেঁচেছি। সেই আমিই কিনা একশ বছর পিছিয়ে গেলাম। একটা লোকের সঙ্গে আমার বাস। লোকটাকে আমি মানিয়ে চলি। হ্যাঁ মা, মানিয়ে চলি। আমি যতই তোমাকে বোঝাতে চেয়েছি, আমরা বন্ধু, যে যার মতো থাকি, আমার যেমন ইচ্ছে তেমন চলি, তার যেমন ইচ্ছে সে তেমন চলে। কিন্তু তোমার চোখ তো মা, মায়ের চোখ, মায়ের চোখ বোধহয় এমনই হয়, কিছু বলার দরকার হয় না। তোমার চোখকে ফাঁকি দেওয়ার উপায় নেই। আমার মানিয়ে চলাটা আমার চোখে না পড়লেও তোমার চোখে পড়ে। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসতো। আমরা ঘরবন্দি পড়ে থাকতাম। তোমাকে নিচের তলায় একটা ছোট ঘরে জায়গা করে দিয়েছিলাম মা। ঘরটা সম্ভবত বারো বাই দশ ফুটের একটা ছোট ঘর। তুমি আসার আগেই ঘরটাকে একটুখানি গুছিয়েছিলাম, একটা ছোট টেবিল আর একটা বুকসেল্ফ পেতে, বিছানায় ভালো চাঁদর পেতে। পুরো বাড়িটা কাঠের। সুইডেনের চিরাচরিত লাল বাড়ি, জানালাদরজার সাদা বর্ডার। ওপরতলায় একটা শোবার ঘর, সে ঘরের সঙ্গে একটা স্নানঘর, পাশে লন্ডি। শোবার ঘরে ঢুকতে হয় বাঁদিকে রান্নাঘর আর খাবার ঘর রেখে। খাবার ঘরের মাঝখান দিয়ে নিচের তলায় চলে গেছে সিঁড়ি। ওপরে সিঁড়ির দুকিনারে দুটো ঘর, একটা ছোট, আরেকটা খানিকটা বড়। ছোটটায় সুয়েনসনের বইপত্তর, বড়টায় আমার ডেস্ক, বইয়ের আলমারি, যাবতীয়। মা তুমি তো এসেই দেখেছো এসব। দেখেছো আমার আর সুয়েনসনের শোবার ঘর একই। আমরা এক বিছানায় শুই। তোমাকে এত যে রক্ষণশীল বলে ধমক দিই, তুমি কিন্তু একবারও প্রশ্ন করোনি ওর সঙ্গে আমি শুই কেন। যে সম্পর্ক হলে শুতে হয়, সম্ভবত সম্পর্কটা সেই সম্পর্ক, তুমি ভেবে নাও। আগেও দেখেছো কায়সারের সঙ্গে বিয়ে না হয়েও একটা সম্পর্ক ছিল আমার। এই সম্পর্ক নিয়েও তুমি মাথা ঘামাও না। মাথা ঘামাও আমি কেমন আছি, তা নিয়ে। তখন কি আমি প্রাণপণে প্রমাণ করতে চাইছিলাম না যে খুব ভালো আছি? হ্যাঁ চাইছিলাম। বিদেশ বিভুইএ যে একাকীত্বে ভুগছি না, সঙ্গে যে একটা সঙ্গী আছে, সে সঙ্গী যেমনই হোক, শরীরের চাওয়া পূরণ করার জন্য কেউ যে আছে, তা তোমাকে দেখিয়ে দিই যেন তুমি স্বস্তি পাও। তুমি কি স্বস্তি পেয়েছিলে মা? আমার মন বলে, পাওনি। পাওনি বলে বারবার তুমি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছো। বুঝেছিলে, লোকটি, যে লোকটির সঙ্গে আমি ঘুমোই রাতে, তার সঙ্গে আমার লক্ষ যোজন ব্যবধান। এই ব্যবধান নিয়ে আর যাই গড়া যাক, কোনও সম্পর্ক গড়া যায় না। আমিই কি আর তা জানি না? কিন্তু তোমাকে বলিনি যে আমার আর উপায় নেই। দেশে যেমন ছিলাম আমি, যে তেজ, যে আগুন, যে জোর নিয়ে আমি বাঁচতাম, দেখেছো নেই। তলোয়ারের ঘায়ে দেশ আমাকে শত টুকরো করতে চাইলেও এমনশক্তিময়ী ছিলাম যে আমাকে স্পর্শ করতে পারতো না। আমার ধারের কাছে এসে ধারালো তলোয়ারও ভেঙেপড়তো। দেখলে, আমার সব গেছে। শরীরের সেই অসাধারণ সৌন্দর্যও আর নেই। সেই তন্বী সুন্দরী এখন মেদবহুল পিপে। একটার পর একটা সিগারেট ফুকছে। তুমি টিকতে পারছে না দুর্গন্ধে। কিন্তু এ তোমার প্রাণের চেয়ে প্রিয় মেয়ের মুখ থেকে বেরোচ্ছে, তার সারা শরীর থেকে কাপড় চোপড় থেকে, তার বিছানা বালিশ থেকে–তুমি কী করে দূরে সরো, তোমাকে ওই দুর্গন্ধে অভ্যস্ত হতেই হবে। এ ছাড়া তোমার করারই বা কী ছিল। না, গন্ধ সইতে তোমার ভালো লাগছেনা বলে নয়, বারবার তুমি আমাকে সিগারেট ছাড়তে বলো আমার ভালোর জন্য। সিগারেট খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর। সে তো আমি জানিই, তারপরও বলো। বলো মুখে কিছুলবঙ্গ বা এলাচ রাখতে, নয়তো চুইংগাম রাখতে, কিছু একটা রাখতে বলো যেন সিগারেট ছাড়া যায়। আমি তোমাকে বিষম হেসে সিগারেটের নানাবিধ উপকারিতা বর্ণনা করি। বাপ ভাইরাই যেখানে সিগারেট খায়নি কোনওদিন, সেপরিবারে মেয়ে হয়ে সিগারেট খাচ্ছি, সংস্কার টংস্কার সব গুঁড়িয়ে দিয়েছি, রীতি নীতিরপরোয়া করি না। কার সাধ্য আছে এত সাহসী হয় আমার মতো!

নিচতলায় তোমার ওই ঘরের লাগোয়া কোনও বাথরুম নেই। তোমার ঘরের সামনে একটা ঘর পড়ে আছে যেখানে একটা চেয়ার, নড়বড়ে একটা হলুদ আর কাঠের পুরোনো একটা লম্বা সোফা। টেলিভিশন। একটা বেঢপ কাঠের তাক। তাকে পুরোনো গানের রেকর্ড। এটাকে বৈঠকঘরই হয়তো বলতে হয়, কিন্তু এত করুণ বৈঠকঘর তুমি কি আমার কোনও বাড়িতে দেখেছো? দেখনি। আমার রুচি ছিল, সৌন্দর্য বোধ ছিল। কোনও কাঠখোট্টা অসামাজিক পুরুষের বাড়িতে রুচির আশা করা নিতান্তই বৃথা। ওই বৈঠকঘরের পেছনে একটা আয়তক্ষেত্রর মতো ঘরে হাবিজাবি জিনিস রাখা। ভাঙা টেবিল চেয়ার, মাল নেওয়ানেওয়ির কাগজের বাক্স। কায়ক্লেশে ওসব ডিঙিয়ে গিয়ে এক কোণে ছোট্ট একটি ঘর আছে, ওই ঘরটি প্রথম দিনই তোমাকে দেখিয়ে এনেছি। কাঠের দু সারি বেঞ্চ, সামনে আগুন জ্বালানোর জিনিস। ওই সওনায় বসে লোকে আগুন তাপায়। তারপর ঠাণ্ডা জলে স্নান করে নেয়। কেউ কেউ আবার বাইরের বরফে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সওনার ব্যাপারটি নিশ্চয়ই তোমার কাছে অদ্ভুত লেগেছিলো। দেশের বীভৎস গরমে বছর বছর তোমার ত্বকে ঘামাচি বেরোয়, তুমি তিষ্ঠোতে পারো না। আর এদেশে লোকে কিনা গায়ে গরম লাগাতে চায়শখ করে! বুঝতে তোমার অসুবিধে হয়। শীতের দেশের বরফের কথা শুনেছো, বরফ যে ঠিক কী জিনিস, তুমি নিজের চোখে দেখলে একদিন। সেদিন কী যে আনন্দ তোমার। কী যে বিস্ময় তোমার চোখে, কী যে মুগ্ধতা। দেখে আমার খুব ভালো লাগলো। আর কিছু না দেখাতে পারি, আমাকে নিয়ে কোনও উৎসব বা মহোৎসব, অন্তত তোমাকে এ দেশের বরফ দেখাতে পারলাম। কিছু একটা দেখলে জীবনে, যা জীবনে দেখনি কোনওদিন। শুধু কী বরফ, যা তুমি আগে কখনও দেখনি, তাও তো দেখলে, দেখলে ঝাঁক ঝাঁক অন্ধকার। আলোর মুখ দেখছো না তুমি। দুপুরের দিকে একটু আবছা আলো যাও আসে, ঝুপ করে আঁধার নেমে যায় ওর ওপর। দেখলে আমরা জানালায় বাতি জ্বালিয়ে রাখি শীতকালে। কত নতুন কিছু দেখছো, বোঝালে বুঝছও। কিন্তু তোমার যে বিদেশের নাড়ি নক্ষত্র জানার আদৌ কোনও আগ্রহ আছে, তা আমি টের পাই না। যতটুকু দেখ, আমাকে খুশি করতেই দেখ। যা শোনো, আমাকে আনন্দ দেবার জন্যই শোনো। তোমার আগ্রহ আমাকে নিয়ে। আমি ডানে গেলে তুমি ডানে যাবে, বাঁয়ে গেলে বাঁয়ে। পেছনে হীরের খনি পড়ে থাকলেও ফিরে তাকাবে না তুমি।

কেমন ছিলে মা তুমি ওই ছোট্ট ঘরে? ওপরে আমি, আমার শোওয়ার ঘর, ওপরে খাবার টেবিল রান্না ঘর, ওপরে সব। আর তুমি নিচে। তুমি একা। কেমন ছিলে মা? তুমি হয়তো ভেবেছিলে আমার সঙ্গে রাতে শোবে তুমি, আমার সঙ্গে ঘুমোবে প্রতিরাতে। গায়ে হাত বুলিয়ে দেবে, চুলে বিলি কেটে দেবে। সেই পুরোনো দিনের মতো রূপকথার সেই প্রিয় প্রিয় গল্পগুলো শোনাবে, গান শোনাবে। শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে পড়বো, ছোটবেলার মতো। এরকম নিশ্চয়ই ভেবেছিলে যখন দেখতে আসছে আমাকে। একটি রাতও তো ওইনিচের ঘরে তোমার সঙ্গে ঘুমোইনি আমি। খুব একা লাগতো তোমার? কাঁদতে? একাই তো ছিলে সারাজীবন, আমার কাছে এসেও সেই একাই রয়ে গেলে। যে তোমার একাকীত্ব কোনওদিন অনুভব করেনি, হঠাৎ করে সে কেন এখন অনুভব করতে যাবে! বিদেশ বলে? দেশ আর বিদেশে হাজার ফারাক থাকুক, চুরানব্বই সাল আর সাতানব্বই সালের ব্যবধান থাকুক, আমি সেই আমিই ছিলাম। বয়স বেড়েছে, শরীরে পাল্টেছে, মন পাল্টায়নি। তোমাকে না বোঝার মন।

তুমিও এলে, আর আমারও বই লেখার শখ হলো। এমন লেখা নিয়ে পড়েছিলাম যে দিন রাত আর কিছুর ভাবনা ছিল না আমার। সেই চুরানব্বইয়ে এসেছিনির্বাসনে। চুরানব্বইপঁচানব্বই ছিয়ানব্বই চলে গেল সামান্য কিছু কবিতা ছাড়া লিখিনি কিছু, সাতানব্বইএর নভেম্বর থেকে আদাজল খেয়ে লিখতে আরম্ভ করলাম। সাহিত্যিক হয়ে উঠলাম হঠাৎ। যে সেবইনয়, রীতিমত আত্মজীবনী। আত্মজীবনী লেখার ভাবনা কোত্থেকে এলো, কেন এলো জানি না। সম্ভবত তুমি আমার সেই ছোটবেলার কথা স্মরণ করছিলে বলে। পুরোনো দিনের কথা তুমি বলছো, আর আমি পরিকল্পনা করছি ওই স্মৃতি নিয়ে বই লেখার। বই যখন লিখছি, বইই লিখছি, আর কিছু করার আমার সময় নেই মোটেও। তুমি অসুখ শরীরে আমাকে চা বানিয়ে দিতে, রান্না করতে, আমাকে খাওয়াতে, বাসন কোসন মাজতে, ঘরবাড়ি গুছিয়ে রাখতে। কাউকে নেমন্তন্ন করতাম তো তাদের সবার জন্যই রাঁধতে, সবারই এঁটো বাসন মাজতে। আমার চুল আঁচড়ে দিতে। গায়ে লোশন লাগিয়ে দিতে। বসে থেকে থেকে পা ফুলে গেলে সেই পা মালিশ করে করে ফোলা কমিয়ে দিতে। সারাদিন তুমি আমার যত্ন করতে, যেমন করতে দেশে। তোমার দিকে ফিরে তাকাতাম না আমি, দেশেও যেমন তাকাতামনা। যেমন একা কাটাতে, তেমনই একাই কাটিয়েছো আমার সঙ্গে। তবে তোমাকে যে সবসময় দূরে সরিয়ে রাখতাম তা নয়। তোমাকে কাছে ডাকতাম তথ্যের জন্য। নানা নানি, দাদা দাদি, তোমার ইস্কুল, তোমার বিয়ে হওয়ার কাহিনী, তোমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন, তোমার বাপের বাড়ির সবাই কে কেমন ছিল, কী কী ঘটতে দেখেছো, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতাম সব। তুমি বলতে, তবে বুঝে পেতে না এত অজরুরি তথ্য আমার কেন এত প্রয়োজন। এমন অভিজ্ঞতা আগে তোমার হয়নি। তোমার জীবন নিয়ে এত উৎসাহ আগে কখনও দেখাইনি। আমার এই উৎসাহ তোমাকে আনন্দ দিত, নিজেকে খুব মূল্যবান কিছু মনে হয়েছিলো কি তোমার? আসলে আমার কাছে তোমার চেয়ে তোমার তথ্যের গুরুত্ব ছিলো বেশি। তুমি নির্দ্বিধায় আমাকে তথ্য দান করেছে। নিজের পরিবারের দারিদ্র্য, দুঃখ, দুর্দশা কিছু বাদ দিয়ে বলোনি। তুমি তো মিথ্যে বলতে জানতে না মা। তোমার বাবার আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল হওয়ার আগে, তুমি যখন খুব ছোট, তোমার মা নারকেলের বরফি বানিয়ে দিত, সেই বরফির বাক্স নিয়ে গিয়ে তোমার বাবা বাজারে বিক্রি করতো, এই সত্য তোমার ভাই বোনেরা গোপন করলেও তুমি কোনওদিন করোনি। দরিদ্রের প্রতি তোমার কোনওদিনই কোনও অশ্রদ্ধা ছিলো না। সত্যকে, সে যত অপ্রিয়ই হোক না কেন, স্বীকার করতে তোমার কোনও সংকোচ হতো না। তুমি অকপটে বলেছো তোমার ভাই বোনদের ভালো মন্দ। তোমার নিজের দুঃখ সুখ। আমাকে এত বিশ্বাস করেছিলে কেন মা? তুমি তো জানতে আমি সব লিখছি। একবারও তোমার কিছু লুকোতে ইচ্ছে করলো না কেন?

জানতে লিখছি, জানতে না যে যা বলোনি, তাও লিখেছি আমি। একদিন কোথাও বোধহয় গিয়েছি বাড়িতে তোমাকে একলা ফেলে। ফিরে দেখি তুমি খুব মন খারাপ করে বসে আছে। কমপিউটার থেকে লেখার কিছু প্রিন্ট আউট বের করেছিলাম, ওগুলো টেবিলের ওপরই ছিলো। হয়তো তুমি আমার লেখার ঘরটা গুছোতে গিয়ে দুএকটা কাগজপড়ে ফেলেছো, তোমার নিন্দা তো পাতায় পাতায় ছিল। ফজলি খালা সম্পর্কে যা লেখা হয়েছে, তা পড়ে খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো তোমার। তুমি বাড়ি থেকে রান্না করা খাবার বা বাড়ির ফলমূল লুকিয়ে নিয়ে যেতে পীরবাড়িতে, নিজের ভালো ভালো শাড়ি দিয়ে দিতে ফজলিখালাকে, ফজলিখালা আর তার মেয়েরা সেগুলো কেটে ওড়না বানিয়ে পরতো। তোমাকে হয়তো ভালোবাসিনি মা, কিন্তু চাইনি তুমি ওসব পড়ো, চাইনি তুমি কষ্ট পাও। তোমার মন খারাপ দেখে, সত্যি বলছি, আমারও মন খারাপ হয়েছে। ছোটবেলায় সেই যে বিশ্বাস জন্মেছিলো তুমি বোধহয় সব ঢেলে দিচ্ছো পীরবাড়িতে, সেই বিশ্বাসের কথাই আমি লিখেছি। বিশ্বাসটা জন্মাতে বাবাই বোধহয় সাহায্য করেছিলো, আর তোমার ঘন ঘন পীরবাড়ি যাওয়াকে বাড়ির কেউই তো আমরা ভালো চোখে দেখিনি। তোমার মন যেন খারাপ না হয়, বাড়ির জিনিসপত্র লুকিয়ে, পালিয়ে বিয়ে করে ছোটদা যে নতুন সংসার গড়েছিলো, ওই সংসারে দিয়েছে, তা আমার লেখার আরেকটা অংশ থেকে জোরে জোরেপড়ে শুনিয়েও দিই। এ থেকে অবশ্য কিছু প্রমাণ হয়নি যে, ফজলিখালাকে দাওনি। তোমাকে বোকা বানাতে চেয়েছিলাম। তুমি শুধু একটা অনুরোধই আমাকে করেছিলে, ফজলিখালার নামটা যেনপাল্টেদিই। তুমি বুঝেছিলে, ঘটনাপাল্টবো না। কোনওদিন ফজলিখালা যদি পড়ে বইটা, কষ্ট পাবে। ফজলিখালাকে তুমি কষ্ট দিতে চাওনি। তোমার নিজের কষ্ট হয় হোক। তোমার কথা রেখেছিলাম মা, ফজলিখালার নামটা পাল্টে দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রথম সংস্করণেই। দ্বিতীয় সংস্করণ থেকে ফজলিখালা ফজলিখালা নামেই রয়ে গেছে। নাম পালে কি মানুষ পাল্টে যায়!

০২. তোমার সম্পর্কেও এমন কথা

তোমার সম্পর্কেও এমন কথা লিখেছি যে জানি না পড়লে কতটুকু কষ্ট পেতে। লিখেছি আমানউদ্দৌলার সঙ্গে তুমি বিছানায় ঘন হয়ে বসে সন্ধেবেলায় কথা বলতে। আমি খুব অপছন্দ করতাম ওই লোকটার সঙ্গে তোমার অমন গল্প করা। তোমাকে আমার ঘেন্না হত বাবা ছাড়া অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বললে। সে তোমার দেবর, তাতে কী! দেবরের সঙ্গে অত মাখামাখির কী দরকার। সম্ভবত আমানউদ্দৌলার সঙ্গে তোমার কোনও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল না, তোমরা শুধু সুখ দুঃখের কথাই বলতে। সুযোগ কোথায় ছিল সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার। কিন্তু মা, আজ আমি ভাবি, তোমাকে যদি আমানউদ্দৌলা কখনও কোনওদিন শরীরে আনন্দ দিয়ে থাকে, মনে তোমার খুশি দিয়ে থাকে, তবে সাত বছর বয়সী আমাকে একদিন ন্যাংটো করে ঘোরতর যে অপরাধ সে করেছিলো, তার সেই অমার্জনীয় অমানুষিক অপরাধও, তার সেই দানবিক দুষ্কর্মও আমি ক্ষমা দেব। আজ যে বোধ আমার, সে বোধ যদি তখন থাকতো, তবে আমি আলগোছে তোমার ঘরের ওই খোলা দরজা, কেউ যেন না দেখে, না বোঝে, বন্ধ করে দিতাম, যেন তুমি আমানউদ্দৌলার কাছে যা চাও, তা নির্বিঘ্নে পেতে পারো। যেন তোমার অতৃপ্ত শরীর তৃপ্ত হয়। আমানউদ্দৌলা কী স্বার্থে তোমার কাছে আসতো জানি না। লোকটা খারাপ, কিন্তু খারাপ লোকও তো কাউকে কাউকে ভালো লাগা দিতেপারে, কাউকে কাউকে ভালোবাসতে পারে। এই সান্ত্বনা পেতে চাই ভেবে, সে তোমাকে অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও সুখী করেছিলো। তবে এই আশংকাও আমার খুব, তোমাকে সে আঘাত ছাড়া আর কিছুই করেনি। হতে পারে তোমরা নিজেদের সুখ দুঃখের কথাই খানিকটা বন্ধুর মতো পরস্পরকে বলতে। দেবরদের সঙ্গে ভাবী বৌদির সম্পর্ক তো বন্ধুত্বেরই হয় সাধারণত। যারা আমরা দূর থেকে দেখতাম তোমাদের বন্ধুত্ব, ভেবে নিতাম এর মধ্যে নোংরামো আছে। অনাত্মীয় নারী পুরুষের সম্পর্ক মানেই নিষিদ্ধ যৌনতা, এমনই ধারণা পেয়ে এসেছি। যৌনগন্ধহীন বন্ধুত্ব যে তাদের মধ্যেও হতে পারে, এই শিক্ষা দেওয়ার কেউ ছিল না কোথাও।

তুমি আমার সেবা করতে, আর আমি নিশ্চিন্তে নির্ভাবনায় লিখতাম আমার আত্মজীবনীর প্রথম বই। ঠিক দেশের মতো জীবন যাপন শুরু হল বিদেশে। আমার জীবনের শুরু থেকে তুমি তো ওভাবেই সেবা করে গেছ, যখন ইস্কুলে, যখন কলেজে, এমনকী যখন চাকরি করি। খাওয়াতে, পরাতে, যত্ন করতে, আদর করতে, ভালোবাসতে। সব উদ্বেগ, সব উচাটন তোমার ওপর চাপিয়ে আনন্দ করে গেছি। ইস্কুল কলেজ ভালো ভাবে পাশ হল, চাকরি হল, সাহিত্যের লেখাপড়া শুরু হল, নাম হল। পেছনে যে আমাকে আমার বড় হওয়ায় নীরবে নিঃশব্দে নিরন্তর সাহায্য করে গেছে, সেতুমি। বাবার আদেশ উপদেশগুলোই চোখে পড়ে, কিন্তু তোমার পরিশ্রম কী সহজেই ভুলে যেতে পারি! টাকাটাকে সবচেয়ে বড় করে দেখি, ভালোবাসাকে দেখি না। বাবা টাকা দিত বলে বাবাকেই ঈশ্বর বলে মনে করতাম। তুমি যে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিতে, সেটা কেন চোখে পড়েনি আমাদের কারওরই? যে আমি ভালোবাসাকে এত মূল্য দিই, রাস্তার বখাটে ছেলেদের তেরচা চোখের তাকানোকেও ভালোবাসা মনে করেছি, হৃদয় উপুড় করে দেওয়া তোমার ভালোবাসাকেও ভালোবাসা বলে মনে করিনি। অথবা মনে করলেও অর্থের মতো কঠিন পদার্থের সামনে ভালোবাসার মতো বায়বীয় পদার্থের আদৌ যে কোনও ওজন নেই, একে অসত্য ভাবার কোনও কারণ দেখিনি।

লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় তোমাকে নিয়ে বেশি কোথাও আমার যাওয়া হয়নি। একদিন ভাবলাম শহর দেখাবো। শহর বরফে ছাওয়া। শহরে কী একটা শীতের উৎসব হচ্ছে, ওতে তোমাকে নিয়ে গেলাম ঠাণ্ডার মধ্যে। এর মধ্যে তোমাকে বরফে হাঁটার জুতো, আর গরম ওভারকোট কিনে দিয়েছি, পুরু পশমের একটা রাশান টুপিওএসব পেয়ে তুমিও সেই আগের মতোই শুরু করলে, আমাকে পরতে হবে আগে। তুমি কোনও নতুন পোশাক কেন যে পরতে অস্বস্তি বোধ করতে! নতুন কিছু পরার মতো মূল্যবান নিজেকে কখনও তোমার মনে হয়নি! শহরের স্কানসেন নামের জায়গাটায় মেলা বসেছে, পিচ্ছিল বরফে হাঁটতে তোমার অসুবিধে হচ্ছে, সুয়েনসনকে বলেছিলাম ও যেন তোমাকে হাঁটতে সাহায্য করে। সাহায্য করতে নিলেই তুমি পিছলে পড়লে। তারপরও তোমাকে বরফে হাঁটালাম। আমি যে বরফে হাঁটতে শিখেছি, তা দেখাতেই কী তোমাকে ওই অতক্ষণ ওখানে রেখেছিলাম! দূর থেকে চিড়িয়াখানার কিছু প্রাণী দেখলে তুমি। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা হরিণ, বড় হরিণের মতো মুস, ষাঁড়ের মতো প্রাণী, খুব বেশি কিছু দেখনি, কিন্তু যা দেখেছো, তাতেই তুমি খুশি। কী অল্পতে খুশি হতে তুমি মা! তোমাকে কত অল্পতে খুশি করা যেত। ভালোবাসি এই বাক্যটি কোনওদিন তোমার জন্য কেউই উচ্চারণ করিনি। করলে তুমি কী করতে, তা আমি অনুমান করতেও পারি না। নিজের দেশটাই তোমার দেখা হয়নি, দেশের কোনও চিড়িয়াখানাতেই তুমি যাওনি কখনও, বিদেশের চিড়িয়াখানার দুটো সাদামাটা প্রাণী দেখে তুমি খুশিতে বাচ্চা মেয়ের মতো হাসলে। অবশ্য তোমার সব আনন্দ নষ্ট করে দিয়েছিলাম আমি, স্কানসেন থেকে বাড়ি ফেরারপথে যখন তোমার আঙুলের ওপর গাড়ির শক্ত ইস্পাতের দরজা প্রবল বেগে ছুঁড়ে দিয়েছিলাম। অবশ্য না জেনেই দিয়েছিলাম মা। আমি জানতাম না তুমি যে গাড়ি থেকে নামতে গেলে বা গাড়িতে উঠতে গেলে গাড়ির সামনে কোথাও ধরে নামো বা ওঠো। কঁকিয়ে উঠলে ব্যথায়। আরও হয়তো কঁকাতে, আমি তোমাকে ব্যথা দিয়েছি এই ভেবে আমি যদি কষ্ট পাই, তাই তাকাওনি। বাড়ি ফিরে মাখন তোলার একটি ছোট কাঠের চামচ আর দড়ি দিয়ে তোমার ওই থেতলে যাওয়া আঙুলটা সোজা করে বেঁধে দিয়েছিলাম। হাড় ভেঙে গিয়ে থাকলে আঙুলের নড়াচড়া বন্ধ রাখতে হয়। পরদিন এক্সরে করিয়ে আনলাম। আমার ওইটুকু শুশ্রূষা পেয়ে তোমার সমস্ত যন্ত্রণা দূর হয়ে গিয়েছিলো। এক তোড়া সুখ এসে বেদনার ভারি বোঝাকে তুলোর চেয়েও হালকা করে দিয়েছিলো। পারো কী করে, মা? আমার যদি ওরকম হতো তোমার কোনও ভুলের জন্য, আমি তোমার দিকে ছুঁড়ে দিতাম যত গালি আমি জানি, যত নিন্দা জানি, সব। তোমাকে এমন দোষী করতাম, যেন সারাজীবন তোমাকে কেঁদে কাটাতে হয়।

তোমার বিশ্বাস, তোমার কোনও একটা অসুখ হয়েছে। অসুখটা, তুমি ভাবতে খুব বড় কোনও অসুখ। তোমার এই অসুখের চিকিৎসার জন্য তুমি দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে। কেউ তোমার অসুখ সারায়নি। তোমার অসুখ নিয়ে ভাবার কারও কোনও সময় ছিল না। বাবাকে বলেছে, দাদাকে বলেছো, বাবা আর দাদা তোমার অসুখ নিয়ে বিদ্রম্প করেছে। তুমি কি ভেবেছিলে আমিই হবো তোমার সহায়? হ্যাঁ ভেবেছিলে। তোমার শেষ ভরসা ছিলাম আমি। কিন্তু আমিও তো তোমার অসুখ নিয়ে ভাবিনি। অসুখের কথা শুনতে চাইনি। শুনতে চাওয়ার, ভাবার আমার সময় ছিল কি? ছিল না। তোমার জন্য সময় খরচ করে আমার অভ্যেস নেই। তুমি এসেছো বিদেশে আমাকে দেখতে। আমার জন্য রান্না করবে, আমাকে মুখে তুলে খাওয়াবে, আমার বাসন মাজবে, আমাকে চা করে দেবে, আমার কাপড় চোপড় গুছিয়ে দেবে, আমার বিছানা পরিষ্কার করে দেবে, যেমন করতে দেশে। দেশ থেকে বিদেশ এসেছি, তাই বলে মানুষটা তো বদলে যাইনি। স্বভাব চরিত্র যাবে কোথায়! হেসে উড়িয়ে দিয়েছি তোমার ওই ন্যাকামো। অসুখ আবার কী! ডায়বেটিস হয়েছে। ডায়বেটিসের জন্য ইনসুলিন নিচ্ছো, ব্যস। এখন খাওয়া কন্ট্রোল করো। ছোট গ্রামমতো জায়গাটির ছোটখাটো একটি ডাক্তারখানায় নিয়ে তোমার রক্তের চিনি মাপিয়ে এনেছি। ইনসুলিনেও কমছে না চিনি। তোমাকে সব অখাদ্য খাওয়ানোর আয়োজন করলাম। লিক নামের অখাদ্য তোমাকে খেতে হবে। আমিই কি কোনওদিন খেয়েছি লিক? গা গুলিয়ে উঠতো তোমার, তারপরও অখাদ্য গিলতে বাধ্য হতে। ভাবতে তোমার অসুখ বুঝি সেরে যাবে। আমি তোমার ডায়বেটিস নিয়ে চিন্তিত, কিন্তু তোমার ও নিয়ে অত ভাবনা নেই। আমাকে দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেওয়ার চিন্তা তোমার। তাই একরকম না খেয়ে, অল্প খেয়ে, অচেনা অখাদ্য খেয়ে আমাকে দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই দিতে। তোমার চিনির মাত্রাটা স্বাভাবিক করার সংকল্প আমার, তাতেই ভেবে নিয়েছি তোমার অসুখের চিকিৎসা হবে। নিজের মেয়ের ডাক্তার হওয়ার সুফলটাও তুমি হাতে নাতে পেয়ে যাবে। কিন্তু মা, ডাক্তার হওয়ার পেছনে এই যে দীর্ঘ বছর ব্যয় করেছি, আর এই দীর্ঘ বছরে তুমি যে দিনরাত স্বপ্ন দেখে গেছো, মেয়ে ডাক্তার হচ্ছে, কোনও অসুখ বিসুখে মেয়ে

তোমাকে ভুগতে দেবে না, যে স্বপ্ন নিয়ে তুমি আমাকে পাঁচ বছর ডাক্তারি পড়ার সময় যত্ন করেছো, ডাক্তারি করার আটটা বছর সময় শুধু যত্নই করোনি, আশা নিয়ে আকুল চোখে তাকিয়ে থেকেছো আমার দিকে, কী লাভ হলো? কোনওদিন আমি তো তোমার ওই পাইলস নামক অসুখটিকে অসুখ বলে মনে করিনি। কোনওদিন বলিনি, চল তোমাকে একদিন হাসপাতালে নিয়ে যাবো বা কোনও ডাক্তার দেখাবো। আমিও আমার বাবার মতো তোমাকে বলে দিয়েছি, ওই পাইলস টাইলসের কোনও চিকিৎসা নেই। তুমি কি হতাশ হতে মা? নিশ্চয়ই হতে। অথবা নিজেকে বোঝাতে যে মেয়ে তো আর মিথ্যে বলছে না, বোধহয় চিকিৎসা নেই, বোধহয় এই অবিরাম রক্তস্রোতের মধ্যে ভেসে ভেসেই জীবন কাটাতে হবে, বোধহয় এ সমস্যা কোনও গুরুতর কোনও সমস্যা নয়। নিশ্চয়ই নয়, তা না হলে নিজের মেয়েই তো চিকিৎসা করাতো। স্বামী না হয় ভালোবাসে না, স্বামী না হয় ফিরে তাকায় না। কিন্তু নাড়িছেঁড়া ধন ব্যস্ততার জন্য হয়তো মার কাছে দুদণ্ড বসার, দুকথা শোনার সময় পায় না, তাই বলে কি চিকিৎসা করবে না, যদি পাইলসের ঘটনাটি স্বাস্থ্যের কোনও সত্যিকার সমস্যাই করতে! যতই রক্তপাত হোহাক, এ কোনও সমস্যা নয় –আমার এই বাণী তোমাকে স্বস্তি দিয়েছিল। হ্যাঁ, ডাক্তার-কন্যা থেকে পাওয়া আশ্বাস। এর চেয়ে বড় আর কী থাকতে পারে একজন মা’র জীবনে। আর কার ওপরই বা তুমি এত ভরসা করতে পারো!

মা, আমি কি ইচ্ছে করলেইপারতাম না তোমাকে বড় কোনও ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে? পারতাম। তুমি যখন বলেছিলে, তোমার একটা অসুখ আছে, আমি কি পারতাম না মন দিয়ে তোমার অসুখের উপসর্গগুলো শুনতে এবং বুঝতে? আমাকে যখন বলেছো তোমার একটা অসুখ আছে, হেসে উড়িয়ে দিয়েছি, জানতে চাইনি কী অসুখ। তুমি দেখিয়েছো তলপেটের বাঁদিকটায় তোমার ব্যথা। বলেছি, ও কিছুনা। বলেছি ‘ও সম্ভবত তোমার কনস্টিপেশনের কারণে হয়েছে। ফাইবার খাও ঠিক হয়ে যাবে। তোমার তো কোষ্ঠ কাঠিন্য নেই। তবে কিসের ব্যথা! হবে কিছুর। কিছুর না কিছুর তো হবেই। বলে দিলাম ওই জায়গাটায় পুরোনো মল জমে আছে, মল জমে তোমার অন্ত্রের দেওয়ালকে ছিঁড়ে ফেলেছে তাই ব্যথা। কিছু জমে থাকলে ব্যথা মাঝে মাঝে হবেই, ও কিছুনা। শুনে তুমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলে না হয়তো। কারণ মল নিষ্ক্রান্ত হওয়ার পরও দেখেছো ব্যথার কোনও কমে যাওয়া নেই। আমি এখনও বুঝি না এত দীর্ঘ বছর ডাক্তারি বিদ্যের মধ্যে ডুবে থেকে ব্যথা হওয়ার কারণ বলতে গিয়ে আমি কেন ভুল করি! এই যদি আমার ডাক্তারি বিদ্যের নমুনা, তবে আমার ডাক্তার পরিচয়টি তো জন্মের মতো মুছে ফেলা উচিত, এবং এই ভয়ংকর নির্বুদ্ধিতার শাস্তিও আমার পাওয়া উচিত। কে আমাকে শাস্তি দেবে! আমাকে তো শাস্তি দেওয়ার কেউ নেই। আমি নিজে মহামানব হয়ে বসে আছি। মা, নিজেকে, আমি ডাক্তার বলতে চাই না আর। বলতে আমার লজ্জা হয় এখন। আমি শতধিক দিই আমার ডাক্তারি জ্ঞানকে। শতধিক দিই আমার ডাক্তার পরিচয়কে।

তোমার কষ্ট হচ্ছিল কিন্তু অভিযোগ করলে আমি বিরক্ত হতে পারি, আমার আরাম আয়েশে ব্যাঘাত ঘটতে পারে, তাই তুমি অভিযোগ করোনি মা। তলপেটের বাঁ দিকে প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়ে তুমি হাঁটতে, সিঁড়ি বেয়ে প্রতিদিন বারবারই উঠতে নামতে। তোমাকে তো নিচের তলায় দিয়েছিলাম থাকতে, সিঁড়ি বেয়ে ওপরে না উঠলে আমার নাগাল কী করে পাবে! ওপরে উঠতেই হতো তোমাকে, কষ্ট পেতেই হতো। তোমার বাথরুম নিচে, তোমার ঘর নিচে, নিচেও তোমাকে নামতে হত, না চাইলেও। তুমি মা। তুমি আমাকে প্রায় চার বছর পর দেখলে, তুমি ছুটে এসেছো বিদেশ বিভুইয়ে আমাকে দেখবে বলে, আমাকে যে করে তোক দেশে ফেরত নেবে বলে, তুমি মা, তুমি গোটা চার বছর প্রতিদিন কেঁদেছো আমার জন্য, প্রতিরাত কেঁদেছো। তুমি মা। তোমাকে আমি একটা বড় ডাক্তার দেখাইনি। তুমি নিজ মুখে বলেছো তোমার একটা বড় অসুখ আছে, তারপরও না। কারণ তোমাকে আমি বিশ্বাস করিনি। তোমাকে আমি মিথ্যে ডাক্তারি দিয়ে আমার ভুল আমার অজ্ঞতা আমার মুখ দিয়ে শান্ত করেছি। ওপরেশান্ত ছিলে, আমাকে বিরক্ত করোনি। ভেতরে যন্ত্রণাপুষে ওপরে হেসেছো। আমি তো এখন বুঝি। আমি ছিলাম একটা অপদার্থ হীনম্মন্য ভীতু ভীরু অমানুষের সঙ্গে। বড় ডাক্তার দেখাতে চাইলে ওই অমানুষের কাছ থেকে কোনও রকম সাহায্য পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা ছিলো না। সাহায্য বলতে তো ওটুকুই। বিশেষজ্ঞের নাম ঠিকানা টেলিফোন ডিরেক্টরি থেকে বের করা। ওদের ফোন করে, ওরা ইংরেজি না জানলে সুইডিশ ভাষায় কথা বলে দেখা করার একটা তারিখ নেওয়া। এই তো! সুয়েনসন সাহায্য না করলেও অন্য কোনও সুইডিশ বন্ধুকে ডাকতে পারতাম এটুকুকরে দেওয়ার জন্য। আমি সুইডিশ ভাষা জানি না। আমার নিজের কোনও গাড়ি নেই। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার নিয়ম টিয়ম শিখিনি। কারও না কারও ওপর নির্ভর করতেই হয় আমাকে। কিন্তু মা, এগুলোকে অতিক্রম কি

আমি করতে পারতাম না! মাইব্রিটকে কেন ডাকিনি? ও তো আমার অনেকদিনের বন্ধু। কেন আমি সুইডেনের সরকার বা সুইডেনের লেখক গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করে বলিনি, খুব তো আমাকে বিশাল খবর করে এনেছিলে এ দেশে, তোমরা এখন কোথায়, আমারমার জন্য ডাক্তারের ব্যবস্থা করো। মেডিসিন সাঁ ফ্রন্টিয়ার্সের অনুষ্ঠানেও তো আমাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। ডাক্তারদের সংগঠন। অ্যানডার্স নামে একটা ডাক্তারের সঙ্গেও তো পরিচয় ছিল। ফোন করে তাকে একবারপাইনি। খবর রাখারপরও সে ফোন করেনি আমাকে, তাতেই অভিমান করেছিলাম, তাকেও তো সবঅভিমান ভুলে আবার ফোন করতে পারতাম! তুমি যখন দানদিরুদ হাসপাতালে, তখন তো দেখেওছিলাম তাকে ওখানে, বলিওনি, বরং পাশ কাটিয়ে গিয়েছি। আমাকে দেখতে পেলে হয়তো কথা বলতো। জানি গাড়ি চালিয়ে এখানে ওখানে নেওয়া ছাড়া সুয়েনসনের দ্বারা ভিন্ন কিছু করার মানসিক ক্ষমতা তার নেই। আমি চেষ্টা করলে পারতাম মা, আজ বুঝি যে পারতাম। কিন্তু চেষ্টাটাই তো করিনি। নিজের মার জন্য সামান্য এটুকু চেষ্টা তো যে কেউ করতো, দেশি বিদেশি যে কেউ। কেবল আমিই করিনি। চেষ্টা তো দূরের কথা, তোমার ধর্মবিশ্বাস নিয়ে সারাক্ষণ কটাক্ষ করতাম। মা তুমি কেন নামাজ পড়ো, কেন আল্লাহ বিশ্বাস করো? আল্লাহ বলে কিছু নেই কোথাও। ধরো, এত যে নামাজ রোজা করলে, গিয়ে যদি দেখ হাশরের ময়দান নেই, আখেরাত নেই, কোনও পুলসেরাত নেই? তুমি বলতে, না থাকলে তো নেইই। কিন্তু যদি থাকে? যদি থাকে, এই আশংকায় তুমি ধর্মকর্ম করো, যদি না থাকে কোনও পরকাল, তবে যে বৃথা হবে এই সময় নষ্ট, এর উত্তরে তুমি চুপ করে থাকতে। মৃদু হাসতে। না মা, বড় হওয়ার পর তুমি শুধু বলেছে, তওবা করে যেন নামাজ শুরু করি। তুমি এবার আমাকে আর নামাজ শুরু করতে বলোনি। শুধু বলেছো দেশে যেন ফিরি, যদি বলতে হয় যদি ঘোষণা দিতে হয় যে আমি আর ইসলাম বিরোধী কিছু লিখবো না, যেন সেই ঘোষণা দিয়ে হলেও, দেশের মেয়ে দেশে ফিরি। কিছু লিখবো না, এই ঘোষণা দিতে আমি নারাজ, আমি ভুল করেছি, এরকম কথাও বলবো না, তবে কী করে ফিরবো দেশে। তুমি মা কত কাউকে নিজে থেকে ফোন করেছো, তুমি বোরখা পরা মেয়ে, চিরকাল অন্দরমহলে কাটানো, পরপুরুষকে কোনওদিন নিজের মুখ না দেখানো মা তুমি শামসুর রাহমানের ফোন নম্বর যোগাড় করে তাঁকে ফোন করেছিলে, যেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলেন আমাকে দেশে ফিরিয়ে নিতে। বলেছিলে তোমাকে রূঢ় কণ্ঠে শামসুর রাহমান বলেছিলেন, আমি বললে কে বলেছেউনি ফিরিয়ে আনবেন! না আপনারা তো কাছে কাছেই থাকেন, তাই আপনারা বললে তো কাজ হবে। তোমার এই কথায় তিনি জবাব দিয়েছিলেন, কে বলেছে আমি কাছে কাছে থাকি! ’ শামসুর রাহমান ফোন রেখে দিলে তুমি কেঁদেছিলে। আর যাদেরই পাও, যাকেই পাও, তাদেরই, তাকেই হাতে পায়ে ধরেছো যেন আমাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। মা, এত ভালোবাসতে আমাকে তুমি! তুমি আমাকে ঘটনাগুলো বলার পরও আমি বুঝিনি তুমি যে ভালোবাসো।

তোমার ধর্মবিশ্বাস নিয়ে ব্যঙ্গ করা আমার কখনও ফুরোতো না। যেদিন রোজা রাখবে বললে, তোমার রোজা রাখার ইচ্ছেকে আমি যাচ্ছেতাই ভাষায় গুঁড়ো করে দিতে চাইলাম। তুমি যে তর্ক করবে, চিৎকার করবে তা কিন্তু করলে না, বরং মিষ্টি হেসে, আমার চুলে পিঠে হাতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললে, জীবনের হয়তো শেষ রোজা মা, কোনওদিনই ভাঙিনি, এবার ভাঙবো না। আমায় রাখতে দাও মা। আমি হো হো করে খুব জোরে হেসে উঠতাম। আমার অট্টহাসি তোমাকে বিব্রত করতো। আমি চাইতাম তোমাকে বিব্রত করতে, আমি চাইতাম তুমি কষ্ট পাও। তোমার ওই ধর্মবিশ্বাসের অপরাধে ইচ্ছে করেই তোমাকে কষ্ট দিতে চাইতাম আমি। তোমার ধর্মবিশ্বাসকে, তোমার বোরখা পরাকে, তোমার ওই কোরান হাদিস পড়াকে, তসবিহ জপাকে সেই ছোটবেলা থেকেই ঘণা করতাম। তোমাকে মা হিসেবে মানতে আমার লজ্জা হতো। তোমাকে বোকা, বুদ্ধিহীন, গবেট, গদর্ভ ছাড়া কিছু মনে হয়নি। যাকে দেখতে নারি তার চরণ বাঁকা বলে একটা কথা আছেনা? তোমার কিছুই আমার পছন্দ হতো না। তোমাকে দেখতেও লাগতো খুব বিচ্ছিরি। তুমি আর নিজের দিকে তাকাবার সময় পেতে কোথায় মা? তোমাকে তো বাবা বলেই দিয়েছিল যে তুমি কুৎসিত। সুন্দর করে কুচি দিয়ে শাড়ি পরে, চুল আঁচড়ে, মুখে পাউডার লাগিয়ে বাবার সামনে দাঁড়িয়েও দেখেছো বাবা ফিরেও তাকায় না তোমার দিকে, বরং আরও জোরে সোরেই কুৎসিত বলে গালি দেয়। তুমি এরপর ছেড়েই দিয়েছিলে নিজের যত্ন নিতে। তোমার সময়ই বা কোথায় ছিল। সারাদিন তো রান্নাঘরেই যেতো তোমার। সবার জন্য রান্না, সবার জন্য বাড়া। সবাইকে খুশি রাখা। গোসল করে তোমার ভেজা চুল হাতের কাছে যা পেতে তাই দিয়ে, দড়ি বা গামছা, বেঁধে রাখতে। ওভাবে রাখতে রাখতেচুলপড়তে শুরু করলো, তাতেই বা তোমার ভূক্ষেপ হবে কেন? কে আর তোমাকে কবে কেশবতী বলবে! কুরূপা কুৎসিত নামই তো খোদাই করে জীবনে গেঁথে দেওয়া হয়েছে। ঠোঁট শুকিয়ে চড়চড় করতো। ধুলোবালি, আগুন, ছাই আর নোংরার মধ্যে থাকতে থাকতে তুমি জানতে না নিজের শরীর বলে কিছু আছে তোমার। নিজের জীবন বলে কিছু আছে। অন্যের গোলামি করার জন্য তোমার জন্ম। তোমাকে কুৎসিত বললে তোমার আর কোনও দুঃখ হতো না। তুমি নিজেও বলতে আমাদের, আমি তো কুৎসিত, কিন্তু তোমরা সুন্দর হয়ে থাকো। তোমার দুটো মেয়ে যেন প্রতিদিন গোসল করে, চুল শুকোয়, চুল আঁচড়ায়, মুখে ক্রিম দেয়, গায়ে অলিভ ওয়েল মাখে, ত্বকের যত্ন করে বলতে। নিজের কথা ভাবার তোমার কোনও প্রয়োজন ছিল না। আর নিজের যত্ন যদিকরতে চাইতে, তাহলে সংসারের কাজে ফাঁকি দিচ্ছ বলেই মনে করবে হয়তো, তাই যত্ন করতে হয়তো ভয়ও পেতে। সেই তোমাকে, সুইডেনে প্রথম বললাম আমি, মা, তুমি তো খুব সুন্দর। বললাম, কারণ তুমি আসলেই খুব সুন্দর। তুমি আমার কথা শুনে চমকে উঠেছে, বিশ্বাস করোনি। কারণ তুমি বিশ্বাস করো না যে সৌন্দর্যের ছিটেফোঁটা তোমার শরীরে কোথাও আছে। তোমার জীবনে তুমি বোধহয় আর কিছুতে অত খুশি হওনি, যত খুশি হয়েছিলে তোমাকে সুন্দর লাগছে বলায়। কোনওদিন যে কথাটি তুমি কারও কাছ থেকে শোনোনি, সে কথাটি তোমার, পঞ্চাশোর্ধ বয়সে প্রথম শুনলে, তোমার কন্যা বললো। আর কী চাই তোমার! ভালোবাসা এর চেয়ে বেশি তুমি কোনওদিন অনুভব করোনি। তুমি কুৎসিত, এই অপবাদ দিয়ে তোমার স্বামী তোমাকে সারাটা জীবন ছি ছি করেছে, পায়ে ঠেলেছে, ঝি চাকরের মতো ব্যবহার করেছে, বাইরে অন্য মহিলা নিয়ে ঘুরেছে, এমনকী বিয়েও করেছে তাদের, সেই তুমি শুনছো যে তুমি সুন্দর। আমার এই বাক্য, যদিও বিশ্বাস করোনি তুমি, চোখে তোমার জল এনেছে। বলেছো, তুমি তো ভালোবাসো আমাকে, তাই বলছে।

কে বলেছে তোমাকে ভালোবাসি আমি, মা? তোমাকে তো কোনওদিন ভালোবাসিনি। জার্মানি থেকে আনা তোমাকেশ্যাম্পুদিয়েছিলাম, বার বার বলেছি, খুব ভালো শ্যাম্পু। সারাজীবন দুদণ্ড সময় পাওনি নিজের শরীরের যত্ন করার, ভেজা চুল বেঁধে রেখে চুল উঠিয়েছে, চুলের বারোটা বাজিয়েছে, সেই চুলকেই যখন দেখতাম সুন্দর লাগতো, বলেছি, বাহ কেশবতী লাগছে। তোমাকে। আসলে তোমার চুলের প্রশংসা না করে আমি ওই বিদেশি শ্যাম্পুর প্রশংসা করতাম। তুমি চলে যাওয়ার অনেক পরে আমি নিচের তলার স্নানঘরে গিয়ে দেখেছিলাম আমার দেওয়া সেই বিখ্যাত শ্যাম্পুটিকে। আসলে ওটা ছিল কনডিশনার। শ্যাম্পু ছিল না। আমার তো জার্মান ভাষা বোঝার ক্ষমতা নেই, তাই তোমার কপালে ওই কনডিশনার জুটেছিল। আমি নিজে তো শ্যাম্পুই ব্যবহার করতাম, তোমাকে যখন দিলাম ব্যবহার করতে শ্যাম্পু, এই ভুলটা কেন হয়েছিল? আসলে আমি ইচ্ছে করে ওই ভুল করিনি। খুব তাড়াহুড়ো করেছিলাম নিশ্চয়ই, বুঝতে চেষ্টা করিনি, ও কি সত্যিই শ্যাম্পু নাকি অন্য কিছু। তুমি কি যে খুশি হয়েছিলে, বিদেশি ক্রিম বা শ্যাম্পু তোমাকে ব্যবহার করতে দিচ্ছি বলে। ওসবকেই তুমি ভালোবাসা বলে ভুল করেছিলে। আসলে বিদেশে তো বিদেশি জিনিসই মেলে মা। আমার তো সুইডেনের মতো দেশে দিশি সাবান শ্যাম্পু পাওয়ার কথা ছিল না। না মা না, ভালো তোমাকে কোনওদিন বাসিনি। বাসলে তোমাকে দেশে থাকাকালীনই ভালোবাসতাম। চার বছর বিদেশে থাকার পর তোমাকে হঠাৎ করে ভালোবাসবো, অত ভালো তো আমি নই মা। ভালোবাসলে তোমাকে আমি যে করেই হোক একজন বড় ডাক্তার দেখাতাম, আমার একটা বড় অসুখ আছে, তোমার ওই কথাকে আমি গুরুত্ব দিতাম, ভালোবাসলে তোমাকে নিয়ে আমি ভালো কোনও হোটেলে থাকতাম, শুধু তুমি আর আমি, অন্যের বাড়িতে অন্যের অঙ্গুলি নির্দেশে চলতাম না, ভালোবাসলে তোমাকে আমি টাকা পাঠাতাম, প্রচুর তো পাঠিয়েছি বাবাকে। যার ছিল তাকে দিয়েছি, যে কোনওদিন টাকা পয়সার মুখ দেখেনি, তাকে কেবল অন্যরাই বঞ্চিত করেনি, আমিও করেছি। ভালোবাসলে তোমাকে রান্নাঘরের দিকে ঠেলে দিয়ে আমি বই লিখতে বসতাম না। ভালোবাসলে তোমার ভালোবাসাকে আমি মূল্য দিতাম। কিছুই করিনি আমি। বরং এক ঘর অতিথির সামনে তোমাকে অশিক্ষিত বলেছি, যেহেতু তুমি সহজে ইংরেজি বলতেপারো না। ভালোবাসলে তোমাকে সামান্য হলেও শ্রদ্ধা করতাম আমি। অথচ এই তুমিই কি না বলেছো যখন সুইডেনে গিয়েছিলে আমি নাকিতখন প্রচুর ভালোবেসেছি তোমাকে, অথচ এই তুমিই বলেছো, তোমার জীবনের সবচেয়ে সুখের সময় তুমি কাটিয়েছো সুইডেনে। আহ মা, এমন কেন তুমি ভাবলে বলো তো! এক তুষার ছাড়া আর তো কিছু দেখনি। আর তো কিছু তোমাকে দেখাইনি। আর তোকিছুই তোমার জন্য করিনি। তুষার কী আমি দেখিয়েছিনাকি। ও তো আকাশ থেকে ঝরেছে বলে দেখেছো। তুষারপাত দেখে তোমার সে কী বিস্ময়। না, তোমার ওই মুগ্ধতার পেছনে আমার কোনও ভূমিকা নেই মা। আমি শুধু তুষারে বা বরফে তোমাকে ছেড়ে দিয়ে কিছু ছবি তুলেছি তোমার ভিডিও ক্যামেরা কিনেছিলাম, তোমার ওই বরফ বিস্ময় তুলে রেখেছি। এ ছাড়া আমি তো আর তোমার জন্য ভালো কিছু করিনি মা। যদি তোমার চিকিৎসা করাতাম, তুমি বেঁচে যেতে মা। তোমার ওই ভয়ংকর অসুখ থেকে বাঁচতে তুমি। আমি তো করিনি। আমি তো বাঁচাইনি তোমাকে, বরং মেরেছি। তুমি হয়তো স্বীকার করবে না যে আমি তোমাকে মেরেছি, কিন্তু আমি তো জানি মা। স্বীকার না করলেও মনে মনে তো জানো তুমি মা। তোমার স্বামী, তোমার দুই ছেলে, তোমার দুই মেয়ে, অবহেলা করতে করতে তোমাকে মেরেছে। চিকিৎসা না করাতে করাতে মেরেছে। তোমার খুব আশা ছিল আমার কাছে এলে আমি তোমার ডাক্তার মেয়ে, বোধহয় তোমার ওই ভয়ংকর অসুখের, যে অসুখকে অসুখ বলে কেউ মানিনি, কিন্তু তুমি বুঝতে, তুমি একাই শুধু বুঝতে, চিকিৎসা আমি করাবো। কিন্তু মা, তোমার শুধু আশায় বসতি। তোমার ডাক্তার মেয়ে, যাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখতে, সে তোমার ওই অসুখের দিকে ফিরেও তাকায়নি। যতদিন সুইডেনে ছিলে, আমি শুধু বাবার কথাই বলেছি, বাবার অসুখের কথা। তুমি যখন বলতে বাবা ভালো আছে, বেশ ভালো আছে, তোমাকে আমি খুব হিংসুটে, কুচুটে এক মহিলা ভেবেছি, শুধু ভাবিইনি, প্রকাশও করেছি সে কথা। বাবার একবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে, আবার যে কোনও সময় হতে পারে, তার রক্তচাপ বেশি, যে কোনও সময় যে কোনও একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে বলে কত দুশ্চিন্তা করেছি, তোমাকে সামনে রেখে বসে বসে দুশ্চিন্তা করেছি, সরবেনীরবে। অথচ নিজেই তুমি আস্ত একটি দুর্ঘটনা হতে যাচ্ছো, সেই দুর্ঘটনার আশংকার দিকে একবারও তাকিয়ে দেখিনি, দেখতে কি চেয়েছিলাম, চাইলে তো ঠিকই দেখতাম! কুকুর বেড়ালের কষ্টের দিকে কত মায়া চোখে তাকিয়েছি, তোমার দিকে সামান্য করুণার চোখেও তাকানোর অভ্যেস কোনওদিনই আমার ছিল না। তুমি আমার কাছে এলে, তোমাকে আসতে বলিনি কোনওদিন, তারপরও এলে। আসতে বলতাম বাবাকে। তুমি একা কেন এলে, বাবা কেন এলোনা, এ নিয়েও তোমাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে জর্জরিত করেছি। যেন তুমি একা এসেছো, বাবা আসেনি, এ তোমার দোষ। তুমি ভয়ে ভয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে। অত দূর পথ পার হয়ে আমাকে দেখতে আসার স্পর্ধার জন্য ভয়। তুমি ছিলে আমার অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি। তুমি তো জানতে সে কথা, মা। তুমি বলোনি, কিন্তু বুঝতে। বাবাকে দেখলে যত খুশি আমি হতাম, তোমাকে দেখে তার সামান্যও হইনি। দিন রাত গেছে বাবার অসুখ নিয়ে আমার ব্যগ্রতায়, ব্যাকুলতায়। তুমি দেখেছো আমার উদ্বেগ। বাবার প্রতি আমার তীব্র ভালোবাসা দেখেছো, অপরিসীম শ্রদ্ধা দেখেছো। এত যে বলেছো বাবা তোমার হাতে একটা পয়সাও দেয় না, তুমি কী করে চলছে চলবে সে খবর বাবা রাখে না, এমনকী অবকাশের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তোমার কাছ থেকে কেড়ে দাদার বউকে দিয়েছে, যে বাড়ি থেকে যে সংসার থেকে তোমাকে বাধ্য হয়ে বিদেয় নিতে হয়েছে, সে বাড়িতে ঢাকা থেকে মাঝে মাঝে গেলে বাবা তোমার দিকে রেগে মেগে তেড়ে আসে, বাড়ির সবচেয়ে ছোট ঘরটিতে যে খাটে তুমি ঘুমোতে, সে খাট ভেঙেপড়ে আছে, বাবা তা উঠোনে ফেলে রেখেছে, আর খাটে যে ছেঁড়া তোশকটা পেতে শুতে, সেটাও শতচ্ছিন্ন, বাবাকে শত বলেও খাট সারাতে পারোনি, শত বলেও কোনও একটা নতুন তোশক কোতে পারোনি, তুমি ঘুমোতে সামনের বারান্দায় মেঝেয়, মশার কামড় খেতে খেতে, রাস্তার অচল অক্ষম ভিখিরির মতো, বাবাও সামনে আসতো না, দাদাও না, হাসিনাও না, দাদার ছোট ছেলে সৌখিন একদিন বলেছিলো, ‘দাদু তুমি যে মাটিতে মশারি ছাড়া ঘুমাও, তোমার কষ্ট হয় না? ’ শুনে তুমি কেঁদেছে। অন্ধকারে চোখের জল বুঝি কারও চোখেপড়ে! সবাই তো বিছানায় আরাম করে সারা রাত্তির ঘুমিয়েছে, তুমি বারান্দায় একা, অন্ধকারে, মশার কামড়ে –এসব শুনেও আমি বাবা বাবাই করেছি। আমার একটুও বাবার ওপর রাগ হয়নি। দাদা বা হাসিনার ওপরও হয়নি। কেন হয়নি মা? তোমার গল্প কি আমি বিশ্বাস করিনি? নাকি তোমার গল্প আমার খুব চেনা গল্প! নাকি তোমার গল্পগুলো আমার গা সওয়া হয়ে গেছে! তুমি তো এমনই ব্যবহার পেয়ে এসেছো, আমি তো জন্ম থেকে দেখেছি। জন্ম থেকে চেনা হলে কোনও অন্যায়কে বোধহয় আর অন্যায় মনে হয় না। আশ্চর্য, কত কিছুরই তো জীবনে প্রতিবাদ করেছি, কেবল তোমার ওপর কোনও অন্যায়ের প্রতিবাদ আমি করিনি। তোমাকে ভালোবাসিনি কোনওদিন। জন্ম দিলেই বুঝি সন্তান ভালোবাসে মাকে? তুমি তো দাদাকেও জন্ম দিয়েছিলে, দাদাকে ভালো তো তুমি কম বাসোনি। দাদা তো কই বিয়ে করার পর বউ সঙ্গে নিয়ে তোমাকে জ্বালাতো। তোমার জ্বর হলে একটু ওষুধের জন্য যখন অনুরোধ করতে, পচাপুরোনোপ্যারাসিটামল এনে দিত, মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া অচেনা দিশি কোম্পানির বাতিল অ্যান্টিবায়োটিক দিত। দাদার হাতেই ছিল বাবার ওষুধের দোকান আরোগ্য বিতানের দায়িত্ব। ওষুধপত্রের হিসেব নিকেশ দাদাই রাখতো। দাদাই তখন ডাক্তার। তোমার পেটের ছেলে, মা। তুমি ভাবতে ছোটদা তোমাকে খুব ভালোবাসে। কেন মা? যেহেতু সে বিমানের ডিউটি সেরে বাড়িতে বিমানের কিছু স্যান্ডুইচ, আপেল বা কমলার রস নিয়ে আসতো? ওসব তো গীতা থাকাকালীন তোমাকে কোনওদিন দেয়নি। গীতা ছিল না বলে অগত্যা তোমার হাতে পড়েছে। ওগুলোর জন্য তো একটি পয়সা খরচ হয়নি ছোটদার। ফ্রি জিনিস। বাড়তি জিনিস। ফেলে দেওয়া মাল। ক্রুরা বাড়িতে নিয়ে আসে বিমানেপড়ে থাকা জিনিস। আনতো বলে তুমি ভাবতে কী ভীষণই না ভালোবাসে ছোটদা তোমাকে। কেউ তোমাকে একবিন্দু দিলে তুমি তাকে এক সমুদ্র দিতে। তোমার তো টাকা পয়সা ছিল না দেওয়ার। তুমি অবকাশে গেলে বাবা আর দাদার সেবা করতে। আর ছোটদার জন্য বাবার কাছে চেয়ে চেয়ে নিয়ে আসতে চাল ডাল মাছ মাংস। ওগুলো আমার শান্তিনগরের বাড়িতে নিজে রান্না করে খাওয়াতে ছোটদাকে। বাবা থাকতে অবকাশে দাদার যত্ন করার জন্য, তোমার কাজ ছিল ঢাকায় বসে ছোটদার যত্ন করা। শুধু রান্না করে খাওয়ানো নয়, ছোটদার কাপড় কাঁচা, ইস্ত্রি করা, তার যাবতীয় সবকিছু গোছানো, সব দায়িত্ব তোমার। তোমার যত্ন কে করতো মা? ছোটদা বিমানের কাজে প্রায়ই বিদেশে চলে যেতো। তুমি থাকতে তার পথ চেয়ে। ফিরে এসে মা বলে ডাকবে, ঘরে ঢুকে হয়তো একটু জড়িয়ে ধরবে। জড়িয়ে ধরার অভ্যেস তার হয়েছে গীতাকে জড়িয়ে ধরতে ধরতে। ওই ওটুকু স্পর্শই তোমাকে আনন্দ দিত। ছোটদা কি আর বাড়িতে দুদণ্ড বসতো! কাপড় পাল্টেওই তো ছুটে যেতো বান্ধবীদের কাছে। কখনও বাড়ি ফিরতো গভীর রাতে, বেশির ভাগফিরতো না। মদ খাওয়ার অভ্যেস তো ইতিমধ্যে বেশ করে নিয়েছে। তুমি মদকে মদ বলতে না। বলতে কী সব যেন’। বিয়ারের ক্যানগুলোকে বলতে সবুজ কৌটোর কোক’। বুঝতে ওসব খাওয়া ভালো নয়, বুঝতে নিশ্চয়ই। ছোটদার বিরুদ্ধে তোমার কোনও অভিযোগ ছিল না। ছোটদা কেন আমার বাড়িতে থাকে, কেন সে অন্য কোথাও চলে যায় না এসব নিয়ে আমি কম চিল্লিয়েছি? তুমি চুপ করে শুনে গেছো, মন খারাপ হয়েছে তোমার। বলতে, বাবাও তোমাকে উঠতে বসতে অপমান করে, দাদাও করে। এক ছোটদাই তোমাকে ভালোবাসে, ছোটদা সেই ছোটবেলায় বিয়ে করে বাড়ি ছেড়েছিলো, গীতা কোনওদিন ছোটদাকে বাবা মার কাছে ভিড়তে দেয়নি, ছেলেমেয়ে নিয়ে গীতা আমেরিকায় চলে যাওয়ার পর ছোটদাকে এতকাল পর কাছে পেয়েছো, সে দূরে চলে গেলে তোমাকে দেখার কেউ নেই, কিন্তু আমার বাড়িতে কে থাকবে না থাকবে তার সিদ্ধান্ত তো আমিই নেব, তাও বুঝতে। তুমি অসহায় বসে থাকতে আমার আস্ফালন দেখে। তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি জেনেই কষ্ট দিয়েছি। শান্তিনগরের যে বাড়িতে তোমরা থাকে, সে তো আমার বাড়ি, তা আমি চিৎকার করে, গালাগালি করে, যাচ্ছেতাই কথা বলে বোঝাবো। তা না হলে বুঝবে কী করে তুমি! তোমাকে তো বোঝাতে হবে আমার প্রতাপ। তোমার নরম মনটি যে কত নরম তা বোঝার সাধ্য কেন আমার হবে। আমি তো দুর্যোগ সইছি। দেশ ছাড়তে হয়েছে। তোমাদের সবাইকে ত্যাগ করতে হয়েছে। নিজের বাড়িগাড়ি, নিজের সাজানো ঘর, নিজের যা কিছুসব ত্যাগ করতে হয়েছে। যখন বললে যে হাশেম মামার বড় মেয়ে শাবানা তার স্বামী নিয়ে দুদিন এসেছিলো আমার বাড়িতে। আমি চমকে বললাম, শুনেছি ওই স্বামী লোকটা ইসলামি শিবিরের লোক! সে কেন এসেছে আমার বাড়িতে! মুখ তোমার মুহূর্তে বেগুনি হয়ে গেল, বললে স্বামী লোকটা নাকি আমার লেখার ঘরে বসে আমার একটি বই পড়ে আমার লেখার প্রশংসা করছিলো, সে হতে পারে ধার্মিক, কিন্তু মৌলবাদী নয়। আমি তো ধার্মিক আর মৌলবাদীতে পার্থক্য করিনা, তুমি করো। তোমাকে আমি দোষ দিয়েছিতুমি আমার শত্রুদের আমার বাড়িতে আপ্যায়ন করেছো বলে। আমার একটুও মনে হয়নি, একা একা যে বাড়িতে দিনের পর দিন কাটাও, সেখানে কেউ এলে, আত্মীয় স্বজন কেউ, তোমার ভালো লাগে। নিজের সংসার হারিয়ে মেয়ের সংসারকে নিজের বলে মনে করেছিলে। তা আমি মনে করতে দেব কেন! তুমি যে আমার বাড়িতে থাকছো, সে আমি করুণা করছি বলে সে বাড়িতে তুমি থাকতে পারছো, কিন্তু বাড়িতে কে ঢুকবে বা না ঢুকবে তার সিদ্ধান্ত আমি ছাড়া আর কারর নেওয়ার অধিকার নেই, তুমি মা হয়েছে তাতে কী, তোমারও নেই। সে কথা আমি তোমাকে তিরস্কার করে বোঝাই। শরাফ মামা মালোয়েশিয়া গিয়েছিল, মালোয়েশিয়াতে তাকে, জানিনা কী কারণে, সম্ভবত বৈধ পাসপোর্ট না থাকায় জেলে ভরে রেখেছিলো, সেই জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ঢাকায় পৌঁছে আমার শান্তিনগরের বাড়িতে একটা রাত কাটিয়ে পরদিন ময়মনসিংহে চলে যায়। কিন্তু কেন আমার বাড়িতে শরাফ মামা এলো, তা নিয়ে আমি তোমাকে তুলোধুনো করলাম। শরাফ মামার মতো বদমাশ মৌলবাদী, যে আমার বিরুদ্ধে মিছিল করেছে, কেন ঢুকলো আমার বাড়িতে? তার উত্তরে তুমি মাথা নিচু করে থেকেছো। মাঝে মাঝে নরম স্বরে কেবল বলেছো, ও খুব অসহায়। বলেছো, মিছিল শরাফ করেনি। আমি যদি শুনে থাকি কোথাও, ভুল শুনেছি। ভাইএর পক্ষ নিয়ে কথা বলছো বলে তোমাকে আমি স্বার্থপর, মাথামোটা, বদ, বোকা –কত কথাই না বলেছি। হ্যাঁ বলেছি মা। তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য বলেছি। তোমাকে আমি ভালোবাসি না বলে বলেছি। তুমি তো আমার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য ছিলে না। তোমার মতো ধর্মভীরু মানুষকে শ্রদ্ধা করার বা ভালোবাসার আমার তো কোনও কারণ ছিল না। শরাফ মামার মতো দাড়িওলাটুপিপরা লোককে, যে শুনেছি আমার বিরুদ্ধে ময়মনসিংহে সে সময় মিছিল করেছিলো; সারাদেশ জুড়ে যখন দাবি উঠছে আমার ফাঁসির জন্য, যে মৌলবাদীতাণ্ডবের কারণে সরকার আমার বিপক্ষে গেল, আমাকে দেশ ছাড়তে হলো, যারা আমার ফাঁসি চেয়েছে সে হোক না আমার আত্মীয়, হোক না মামা, আমি তাকে ক্ষমা করবো কেন? আমার বাড়িতে সে কী সাহসে পা রাখে। এই পা রাখার সাহস তো আমি যদি ও বাড়িতে থাকতাম পেতো না। পেলো তুমি ছিলে বলে। তুমিই সব নষ্টের গোড়া। আমারই বাড়িতে আমার শত্রুকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কী করে সইবো এ খবর আমি! তুমি আমাকে বোঝাতে চাইলে শরাফের কানাকড়ি কিছু নেই। যে করেই হোক মালোয়েশিয়া গিয়েছিল দুটো টাকা রোজগার করতে, যেন সংসার চালাতে পারে। তাও ভাগ্যে হলো না। শরাফ মামা শুধু একটা রাত কাটিয়েছে আমার বাড়িতে, দীর্ঘ যাত্রার পর বিমান বন্দর থেকে আবার বাসে করে ময়মনসিংহে যেতে তার শরীর কুলোচ্ছিল না, একটা রাতের বিশ্রাম দরকার ছিল। মালোয়েশিয়ার জেলে এমনকী মেরেছেও তাকে। কিন্তু আমি শুনবো কেন। আমার কেন মায়া হবে শরাফ মামার জন্য। আজ আমার মনে হয় না, বাবা যে বলেছিলো শরাফ মামা মিছিলে গিয়েছিল, সত্যিই সে গিয়েছিল। শরাফ মামা পরে আমাকে বলেছে মিছিলে যায়নি সে। বরং মিছিলের লোকদের চেষ্টা করেছিলো সরিয়ে নিতে। মামাদের কাউকে তো বাবা পছন্দ করতো না। তাই হয়তো বলেছিলো। যখন দেশে তাণ্ডব চলছিল, শরাফ মামা একবার আমার শান্তিনগরের বাড়িতে আসতে চেয়েছিলো দেখা করতে, ইন্টারকমে তুমি শুনেছো নিচে সে দাঁড়িয়ে আছে। খুব ভয় পেয়েছিলে, আবার খবর টবর নিতে এলো না তো! কোথায় আমি, কী করছি! তুমি শরাফ মামাকে বাড়িতে ঢুকতে দাওনি। আমার কোনও খবরইতুমি দাওনি তাকে। তুমি তো তোমার ভাইদের চেয়েও বেশি ভালোবাসতে আমাকে মা। আমি সব ভুলে গিয়েছিলাম, সব। তোমাকে কাঁদিয়েছি, দিনেরপর দিন তোমাকে কাঁদিয়েছি। তারপরও তুমি চোখ মুছে বলেছে, দেশে চল মা। কী করে পেরেছো আমাকে ক্ষমা করতে মা? কী করে আবার বুকে টেনে নিতে পেরেছো আমাকে মা। এত কষ্ট দিয়েছি, তারপরও বলো তুমি নাকি জীবনের সবচেয়ে সুখের সময় কাটিয়েছো আমার কাছে। আমি নাকি তোমাকে খুব ভালোবাসা দিয়েছি। তুমি না পেতে না পেতে এতই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলে যে সামান্য ওই পাওয়াই তোমার স্বর্গসুখের মতো মনে, হয়। তোমাকে যে সুন্দর বলেছিলাম, তোমাকে যে দুটো গরম জামা জুতো কিনে দিয়েছিলাম সুইডেনের ভয়াবহ শীতকালটা কাটাতে, তোমার যে সামান্য কটা ছবি তুলেছিলাম, তাই বোধহয় বলেছে। তা না হলে আর কী! তোমাকে চিকিৎসা না করানো, ভালো ডাক্তার না দেখানো, তোমাকে কাঁদানো, তোমাকে যাচ্ছেতাই ভাষায় অপমান করা, কষ্ট দেওয়া সব ভুলে তুমি ওইটুকুই কেবল মনে রেখেছে। ওইটুকু সুখের স্মৃতি নিয়ে তুমি ফিরে গেছে। তুমি কিন্তু তোমার গরম জামা জুতো টুপি মোজা যা দিয়েছিলাম, কিছুই নিয়ে যাওনি, সব রেখে গেছে। শুধু তাই নয়, তোমার নিজের সালোয়ার কামিজ, তোমার নিজের নতুন সব জামা কাপড় সব রেখে গেছো আমার জন্য। আমি যেনপরি, যদি কোনওদিনপরতে ইচ্ছে হয়। আমাকে দেশে ফেরত নেওয়ার যে সংকল্প ছিল তোমার, স্বপ্ন ছিল সব কিছুকেপুড়িয়ে ছাই করে কবর দিয়ে দিয়েছি, নিজের চোখে দেখে গেছে। আরবদেশে উমরাহ করতে গিয়ে আমার জন্য হাতের চুড়ি আর আল্লাহু লেখা লকেট সহ সোনার চেইন কিনেছিলে, সবপরিয়ে গেছে আমাকে। ছোটদা বলেছিল আমার পাঠানো টাকা জমিয়ে নাকি তুমি ওই গয়না কিনেছো। আমার ফিক্সড ডিপোজিট থেকে যে ইন্টারেস্ট চলে যেত ইয়াসমিনের ব্যাংকে, ও আমেরিকা চলে যাওয়ার আগে ওই টাকাটা তোমার নামে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে ওখানে সরাসরি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। তিন মাসে ছ হাজার টাকা। ও কোনও টাকা হলো! তোমার হাত খরচের টাকা। আর ও টাকাই তুমি জমিয়ে আমার জন্য সোনার গয়না কিনলে। একটি টাকাও তুমি নিজের জন্য খরচ করোনি মা। সুইডেনের বাড়িতেও অনেকটা দাসীর মতো কাজ করতে। যাওয়ার আগে আমার আলমারি গুছিয়ে দিলে নিজের হাতে। কে জানতো যে তোমার যা কিছু ছিল, যা কিছু এনেছিলে সব রেখে যাচ্ছো তুমি। তুমি জিনিসপত্রের জন্য এসেছে, জিনিসপত্র কেনা হয়ে গেছে, এখন চলে যেতে চাইছো এসব বলে কম কাঁদিয়েছি তোমাকে। যেদিন বলেছি, সেদিন গিয়ে আকুল হয়ে কেঁদেছে। আমি ওপরতলা থেকে তোমার কান্নার শব্দ পাচ্ছিলাম। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলে জিনিসপত্রের জন্য তুমি আসোনি। তুমি শুধু ফোনে ছোটদাকে জিজ্ঞেস করেছিলে কবে ছোটদা আসবে, কবে তোমাকে দেশে ফেরত নিয়ে যাবে। আর ওই শুনে আমার মাথায় রক্ত চড়লো। তখনই তোমাকে ওসব বলেছিলাম। লোভী ভেবেছিলাম তোমাকে। লোভী বলেওছিলাম তোমাকে। তোমার মতো মানুষকে। জগতের সবচেয়ে নির্লোভ, সবচেয়ে নিঃস্বার্থ মানুষকে নির্দ্বিধায় দোষী করেছিলাম। কী ভীষণ কষ্ট তুমি পেয়েছিলে মনে, আমি এখন অনুমান করার চেষ্টা করি। তোমার জায়গায় আমি হলে আমার মতো পাষণ্ড মেয়ের বুদবুদেঅহংকারে, কুৎসিত আত্মাভিমানে কষে লাথি মেরে চলে যেতাম। ও মেয়ের মুখ কোনওদিন দেখার প্রয়োজন আমি বোধ করতাম না। ছোটদাকে জিজ্ঞেস করেছিলে কবে ছোটদা তোমাকে নিতে আসবে, কারণ অসুখ নিয়ে খুব আশংকা হচ্ছিল তোমার। এখন আমি বুঝি, অসুখটা যে ভয়ংকর কোনও অসুখ তা তুমি ঠিক ঠিক বুঝতে পেরেছিলে। অসুখটা যে আমার বা আমার বাবার বা আমার দাদার ভাষায় কিছুই না, তা নয়। কিছুই।

কেন তুমি বলেছিলে তোমাকে খুব ভালোবেসেছি আমি? জীবনে সবচেয়ে সুখের সময় বুঝি ওই সময়? রোজা রাখতে চেয়েছিলে, জীবনের নাকি ও তোমার শেষ রোজা। আমি বলেছিলাম শেষ রাতে খাওয়ার কোনও নিয়ম ও বাড়িতে নেই, সুতরাং সেহরি খাওয়া চলবে না। শুনে বলেছিলে সন্ধেবেলায় তোমার ঘরে থালায় করে খাবার নিয়ে রাখবে, কাউকে জাগতে হবে না, আমার ঘুমের কোনও ব্যাঘাত ঘটবে না। না। তাতেও আমি রাজি হইনি। রোজা তোমাকে রাখতেই দেব না। যে দেশে শীতের সময় বড়জোর দুঘণ্টা আলো থাকে, তাও আবছা আলো, সেখানে রোজা তো দুঘন্টার চেয়ে বেশি হতে পারে না। সূর্যোদয় হয় বেলা এগারোটায়, দুপুর একটায় সূর্যাস্ত। তোমাকে বলেছিলাম, ভালো যে শীতকালে রোজা পড়েছে, বুঝতে গরমকালের রোজার মজা। সূর্যের কোনও অস্ত যাওয়া নেই। তোমাকে এও বলেছি তোমার ওই রোজার নিয়ম কানুন যারা তৈরি করেছিলো আরব দেশে, তাদের পৃথিবী সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে যে সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয়ের অবস্থা ভিন্ন, সে সম্পর্কে জ্ঞান থাকলে নিয়ম অন্যরকম হতো। অজ্ঞতার এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী আছে! তোমাকে হঠাৎ আমি ধর্ম থেকে মুক্ত করতে চাইছিলাম। অজ্ঞ আর অশিক্ষিতদের কবল থেকে উদ্ধার করতে চাইছিলাম। অপমান করে, ভ্রূকুটি করে, গা-জ্বালা কথা বলে চাইছিলাম তোমাকে নাস্তিক বানাতে। তোমার আল্লাহতায়ালা যদি মহান কেউ হন, যদি দয়ালু কেউ হন, তাহলে যারা তার পায়ে মাথা নোয়াইনি, তার জপ করিনি, তাদেরপুঁজ রক্ত খাইয়ে, গায়ে গরম পানি ঢেলে, আগুনে পোড়াবেন কেন? এ কি ক্ষমাশীল হওয়ার, উদার হওয়ার, মহান হওয়ার নমুনা? তুমি চুপ করে থাকতে। জানি না তোমার মনে কোনও সংশয় জাগতো কি না। আল্লাহকে যে এত জপছো, এই আল্লাহ তোমাকে বেহেস্তে নেবেন ঠিকই, কিন্তু বেহেস্তে বাবাকেই পাবে তুমি সঙ্গী হিসেবে, যে বাবা তোমাকে সারাজীবন লাঞ্ছিত করেছে, আর বাবা পাবে সাতাত্তর জন হুরী সুন্দরী। ওদের নিয়ে বাবা ফুর্তি করবে তোমার চোখের সামনে, সব সইতে হবে তোমাকে। ইহকালেও ভুগলে, পরকালেও ভুগতে হবে। এ কেমন বিচার বলো? বাবা যেহেতু সারাজীবন ধর্ম পালন করেনি, বাবাকে যদি দোযখে পাঠানো হয়, তাহলে তো তোমাকে একাই থাকতে হবে অনন্তকাল। হেসে হেসে বলতাম, বেহেস্তে তো তোমাকে সব কুৎসিত কুচক্রী মোল্লাদের সঙ্গে কাটাতে হবে। আর, আমি, দোযখে তোমার সব প্রিয় প্রিয় নায়ক নায়িকাঁদের সঙ্গে থাকবো, তোমার উত্তম সুচিত্রা, তোমার পাহাড়ি সান্যাল, তোমার ছবি বিশ্বাস। ওরা হিন্দু বলে ওদের তো সবাইকে ধরে ধরে দোযখে পাঠানো হবে। বড় বড় বিজ্ঞানী, বড় বড় দার্শনিক যারা কোনওদিন ধর্মবিশ্বাস করেনি, তাদের সঙ্গে দোযখে কাটাবো, আমার আর চিন্তা কী! ্যাঁ উত্তম সুচিত্রার জন্য তো পাগল ছিলে। পালিয়ে পালিয়ে গিয়ে সিনেমা দেখতে। সেই তুমি কি না সিনেমা ছেড়ে সব ছেড়ে ধর্মে মন দিলে। দোযখের ভয় এমনই ধরানো হয়েছিল, যে, ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতে, ধর্ম কর্ম বাধ্য হয়ে করতে। অভাগিনীর কী আছে আর, ধর্ম ছাড়া! কিন্তু বুদ্ধি খাটালে তো অসারতা টের পেতে মা। পেতে না?

আমি তোমাকে শ্রদ্ধা করিনি, করলে তোমার রোজা নিয়ে অত ঠাট্টা মশকরা করতাম না। বিয়ে হয়েছে বলে ইস্কুলে পড়তে দেয়নি তোমার বাবা, অথচ কত পড়তে চেয়েছো, এমনকী তোমার ছেলেমেয়েরা যখন মাধ্যমিক দিচ্ছে, ওদের সঙ্গে তুমিও প্রাইভেটে মাধ্যমিক পরীক্ষা চেয়েছে দিতে, এমনকী তোমার নাতিও যখন দিচ্ছে, চেয়েছে; সেই তোমাকে অশিক্ষিত বলে গালি দিয়েছি। অসুখ নিয়ে মেয়েকে শেষ দেখা দেখতে এসেছে সুইডেনে, ওখানেও লোকের সামনে তোমাকে তুচ্ছ করেছি। কী করে ভাবো তোমাকে ভালোবেসেছিলাম! জীবনে ভালো খাবার তোমার পাতে পড়েনি। ভালো খাবার তোমাকে খেতে দিইনি আমি। তোমার ডায়বেটিস, সুতরাং তোমাকেসব অখাদ্য খেতে উপদেশ দিতাম। লিককিনেছি, ব্রকলি কিনেছি। ডায়বেটিসের জন্য ভালো। এ দুটো তুমি জোর করে গিলতে। ব্রকলিকে চুলের মতো লাগতো, লিক খেতে ঘাসের মতো লাগতো। কিন্তু ওসব অখাদ্যই তোমাকে খেতে হয়েছে। মাঝে মাঝে মুরগি রান্না হয়েছে। অবশ্য তোমার পাতে রান তুলে দিয়েছি, দেখে তুমি অপ্রস্তুত হয়েছে মা। তুমি তো কোনওদিন বাড়িতে মুরগি রান্না হলে রান পাওনি খেতে। সব অন্যদের খাইয়েছো। রান খাবে মা? এ হয় নাকি। তোমার জন্য তো ছিল গলার হাড়, বুকের হাড়। এ ছাড়া কোনওদিন কি খেয়েছো ভালো কিছু? ওই রান খেতে দিয়েছিলাম বলেই হয়তো তুমি বলেছো ভালোবাসা পেয়েছো আমার। না মা, মুরগি হল বিদেশে সবচেয়ে সস্তার জিনিস। ওর চেয়ে সস্তায় আর কোনও খাবার মেলে না। বিশেষ করে ফ্রোজেন চিকেন। তোমাকে তো আর ফ্রেশ কিছু খাওয়াইনি। ফ্রেশ যে কেনা যায়, তাজা টাটকা কিছু যে কেনা যায়, কিনে যে বেশ সুস্বাদুকরে রান্না করা যায়, এ আমার ধারণাতেই ছিল না। যার বাড়িতে থাকতাম, সে সস্তার জিনিস কেনার জন্য চাপ দিত আমাকে। ওর নিজের যেমন কোনওদিন অভ্যেস ছিল না ভালো জিনিস কেনার, সস্তাপচা জিনিসে অভ্যস্ত ছিল, আমাকেও অভ্যস্ত করিয়েছিল। তুমি টমোটো ভালোবাসতে। অনেক রকম টমেটো ছিল বাজারে। খুব ভালো, মাঝারি ভালো, সাধারণ ভালো, আর প্রায় নষ্ট। আমি খুব ভালোগুলো বা মাঝারি ভালোগুলো কিনতে চাইলে সুয়েনসন তেড়ে আসতো, বলতো করছো কী, যেটার দাম কম, সেটা কেনো, তার মানে ওই প্রায় নষ্টগুলো, বাজে জাতেরগুলো কেনো। ওর ধারণা ছিল, ও কম পয়সায় জিনিস কিনে বুদ্ধিমানের কাজ করে। যারা দামি জিনিস কেনে, তারা বোকা। দোকানিরা তোক ঠকাতে চায়, আর সে কম দামি জিনিস কিনে দোকানিদের ঠকিয়ে আসে। এই বিশ্বাস নিয়েই সে বাঁচে। কিন্তু আমি তো পারতাম বলতে যে আমার মা এসেছে, তোমার ওই সস্তা নীতি আজ থেকে আমি মানবো না। আমি তো বলিনি! আমি তো তোমার জন্য কোনও অভ্যেসের প্রতিবাদ করিনি। বাজার তো সুয়েনসনের টাকায় হত না, বাজার আমার টাকায় হতো। আমার কি টাকার অভাব ছিল মা? ছিল না। আমি সুইডেনের কুর্ট টুখোলস্কি সাহিত্যপুরস্কার পেয়েছি, ইওরোপিয়ান পার্লামেন্ট থেকে শাখারভ পুরস্কার পেয়েছি, নান্তের এডিট দ্য নান্তপুরস্কার, ফরাসি সরকার থেকে পাওয়া মানবাধিকার পুরস্কার, এক একটা পুরস্কারের টাকা বাংলাদেশের টাকায় তিরিশ চল্লিশ লাখ। তারপর বইয়ের রয়্যালটির টাকা। ইওরোপের বিভিন্ন ভাষায় বই বের করার আগে প্রকাশকরা অগ্রিম রয়্যালটি দিয়েছে, সেও অনেক। প্রায় দু কোটি টাকা পড়ে আছে ব্যাংকে। কিন্তু টাকা আমি সবার জন্য খরচ করতে চাইলেও তোমার জন্য চাইনি। মুরগির রান পাতে পেয়ে তোমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠতো। তুমি লজ্জা পেতে খেতে। আমার থালায় তুলে দিতে। কিন্তু রানের তো অভাব ছিল না। বাড়িতে খাবার লোক মোটে তিনজন। তোমার তো আর ছেলেমেয়ে ছিল না ও বাড়িতে যাদের জন্য রেখে দেবে। তুমি রান খেয়ে যে খুশি হতে তা নয়, তোমাকে আমি ভালোবাসি এ কথা ভেবে খুশি হতে। আমি যে তোমাকে সারাজীবন যা খেয়ে এসেছে সেই বুকের হাড় বা গলার হাড় দিইনি, বরং আমরা যা খেতাম, সেই রান খেতে দিয়েছি, সে কারণেই হয়তো তোমার মনে হতো তোমাকে ভালোবাসি। সে আর কতদিনই বা খেতে পেরেছো! একসময় তো মাছ মাংস বন্ধ করে শুধু তোমাকে সেদ্ধ শাক সবজি খাওয়ার অর্ডার দিলাম। খুব মাখন ভালোবাসতে, ও পদার্থ তোমাকে স্পর্শ করতে দিইনি। পনির খুবপছন্দ করতে। বাজারে একশ রকম পনির তুমি মুগ্ধ হয়ে দেখতে। আমি ধমকে তোমাকে পনিরের জায়গা থেকে সরিয়ে এনেছি। বলেছি এসব খাওয়া চলবে না তোমার, ডায়বেটিস বাড়বে। পনির একবার কিনেছিলাম অবশ্য, সেও বাজারের সবচেয়ে কম দামি, মোটেও খেতে ভালো নয়, এমন পনির। তুমি তো আর জানোনা, ভালো কী মন্দ, কিনেছি যে পনির, সে কারণেও হয়তো তোমার মনে হয়েছিল তোমাকে ভালোবাসি।

.

এত কম খেতে, বিস্বাদ বিদঘুঁটে জিনিস খেতে, এত কৃচ্ছসাধন, অথচ তোমার রক্ত থেকে চিনি কমতো না। আমি বিরক্ত হতাম। আমার এই বিরক্তি তোমাকে অস্বস্তিতে ফেলতো। তোমার জন্য তোমার মেয়ের দুর্ভাবনা হচ্ছে, মেয়ে তোমার সুগার নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে, এ তোমার ভালো লাগতো না। তুমি না খেয়ে না খেয়ে চাইতে সুগার কমাতে, তোমাকে সুস্থতা দিতে নয়, আমাকে স্বস্তি দিতে। তুমি তোমার জন্য নয়, আমার জন্য ভাবতে। কারণ ডায়বেটিস নিয়ে তোমার দুশ্চিন্তা ছিল না, বিরক্তি ছিল হয়তো, কিন্তু আমাকে যেন বিরক্ত হতে না হয়, আমি যেন আমোদে প্রমোদে উৎকণ্ঠাহীন জীবন কাটাই, তা নিয়েই ভাবতে। তুমি তো জানো তোমার অন্য একটা বড় অসুখ আছে। আমি তো সে বড় অসুখের কথা একবারও ভাবিনি, ভেবেছি ডায়বেটিস নিয়ে। আমিই তো শুধু ভোগাইনি। বাজে বাজে ডাক্তারেরা তোমাকে কী ভীষণ ভুগিয়েছে মা। কী ভীষণ ভুগিয়েছে। ওইসব ডাক্তার, যেহেতু তাদের রং সাদা, যেহেতু তারা ধনী দেশের ডাক্তার, তোমাকে বলেছি, এরা বিদেশি ডাক্তার, অনেক বড়, অনেক ভালো, আমাদের গরিব দেশের ডাক্তাররা তো কিছুই জানে না, ডাক্তারিশাস্ত্র এদেরই আবিষ্কার, এরাই জানে সব, এরাই বোঝে সব, এদের চিকিৎসা পেলে তোমার সব অসুখ সেরে যাবে। আমার ভেতরে তখনও ওই হীনম্মন্য বোধটা ছিল। ভাবতাম সাদাদের জ্ঞান বেশি, বুদ্ধি বেশি। সাদারা আমাদের চেয়ে, কালো-বাদামি মানুষের চেয়ে অনেক বেশি বোঝে, সব কিছুতেই আমাদের চেয়ে পারদর্শী বেশি। দেখ না, দেশগুলো কী রকম বানিয়েছে! দেখলেই তা মনে হতো, স্বর্গ বানিয়ে রেখেছে, স্বর্গ। সুতরাং, আমাদের চেয়ে ওরা উন্নতমানের মানুষ। বুঝলে মা, সত্যিকার হীনম্মন্যতা। নিশ্চিতই একটা বর্ণবাদী ছিলাম, সুয়েনসনও বর্ণবাদী। দুজনেই ভাবতাম সাদারা কালোদের চেয়ে সবকিছুতে ভালো। এক বর্ণবাদী আরেক বর্ণবাদীকে তো বর্ণবাদী হিসেবে চিনতে পারে না। সাদাদের বড় মনে করতাম, না হলে সুয়েনসনের মতো লোকের সঙ্গে আমি কেন থাকি? কী যোগ্যতা ছিল তার আমার সঙ্গ পাওয়ার? যন্ত্রের মতো একটা মাথামোটা লোক, অনুভূতি বলতে লেশমাত্র কিছু নেই। একে হিংসুক, তার ওপর স্বার্থপর। তাকে কোনও উপহার দিলে রাগ করতো, ভাবতে বিনিময়ে বুঝি আমাকে কিছু দিতে হবে তার। কিছু নিতে চাইতো না, দিতে হবে এই ভয়ে। আমার তো আবার দেওয়ার অভ্যেস। দিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছি, আমাকে না দিলেও চলবে। আমি ও দেশের ভাষা জানি না, কিচ্ছু না। বড় একজন ডাক্তারের দেখা কী করে পেতে হয়, আমি তার কিছু জানি না। আমাকে কোনও পথ সে দেখায়নি। জানে সে পথের কথা, তারপরও মুখ বুজে থেকেছে। একটা কাজই সে আমার জন্য করতে পারতো, গাড়ি চালিয়ে এখানে ওখানে নিয়ে যেতেপারতো। গাড়ি সে আমাকে ভালোবেসে বা আমার কোনও উপকার হবে বলে চালাতো না। চালাতে তার ভালো লাগতো বলে চালাতো। কত যে গ্রামের অলি গলিতে অনর্থক ঘুরেছে। ভেবেছি আমাদের নিয়ে সে বেড়াচ্ছে। আসলে সে একা একাই ওসব করে। বন্ধু বান্ধব কিছু নেই। হয় বই নিয়ে পড়ে থাকে, যতসব ক্রাইম স্টোরি আর ফ্যান্টাসি, নয় অনর্থক অলিগলিতে গাড়ি চালায়। আমি দুবছরেও যা বুঝিনি, তুমি দুদিনেই তা বুঝেছিলে। আমাকে বলতে দেশে যেন ফিরে যাই। তুমি কোনওদিন ভাবোনি সুয়েনসন আমাকে ভালোবাসে, বা তার বাড়িতে থাকার আমার কোনও প্রয়োজন আছে। আমার এক বন্ধু মাইকেলকেই বরং তোমার আপন মনে হয়েছিল। ওকে জড়িয়ে ধরে চলে যাবার আগের দিন কেঁদেছিলে, বলেছিলে, আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো। তুমি কিন্তু ইংরেজিতেই বলেছিলে। সুইডেনে মাত্র কদিন থেকেই ইংরেজি শিখে গিয়েছিলে। ইস্কুলের গণ্ডি তোমার পেরোনো হয়নি বলে তোমাকে আমি কম তুচ্ছ করেছি! প্রয়োজনে ইংরেজি কেন, সুইডেনে আর কিছুদিন থেকে গেলে তুমি সুইডিশও বলতে পারতে, ফরাসি দেশে থাকলে দুদিনে ফরাসিও হয়তো বলতে পারতে। আমার মতো নির্বোধ তুমি তো নও। কেবল বাবার সংসারে থেকে তোমার প্রতিভার কোনও স্ফুরণ হয়নি। তুমি সমাজেরপুরুষতন্ত্রের নির্মম শিকার ছাড়া আর কী! কেউ তো তোমাকে গভীরভাবে দেখেনি, তোমাকে বুঝতে চেষ্টা করেনি। তোমার জ্ঞান বুদ্ধি, বিচক্ষণতার মূল্য কোনওদিন পাওনি। ধর্মে আশ্রয় নিয়েছিলে অভিমান করেই। এই জগতের প্রতি অভিমান। ধর্ম কি ভেতরে ভেতরে জানতে না তুমি যে কী রকম যুক্তিহীন! তুমি ভালোবাসতে জানতে, আবেগ ছিল প্রচণ্ড, তাই বলে একেবারে যুক্তিবুদ্ধিহীন ছিলে না তো! বর্ণবাদের লেশমাত্র তোমার ভেতরে ছিল না। ডাক্তারদের রং সাদা বলে, ধনী দেশের লোক বলে তাদের তুমি আমাদের গরিব দেশের কালো বা বাদামির চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান বলে একবারও মনে করোনি। আবার কোনও সাদাকেও তুমি ছোট ভাবোনি। রাস্তায় একদিন একটা সাদা বাচ্চা-ছেলেকে দৌড়োতে গিয়ে পড়ে যেতে দেখে ছুটে গিয়ে আহারে ব্যথা পেয়েছে বলে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে হাঁটুর ধুলো মুছতে শুরু করে দিলে। আমি তোমাকে টেনে সরিয়েছি ওই মহৎ কাজ থেকে। প্যারামবুলেটরে কোনও বাচ্চাকে দেখলেও, সাদা কী কালো কী বাদামি, বাবুসোনা গো’ বলে আদর করতে চাইতে। তোমাকে বলেছি, অচেনা লোকের আদর এদেশের মানুষ গ্রহণ করে না। তোমার সরল মন বুঝে পেত না ভালোবাসার জন্য চেনা অচেনার প্রয়োজন কেন হয় বা হবে। তোমার ভেতরে এক বাচ্চা মেয়ে ছিল। এক শীতের বিকেলে বাচ্চাদের খেলার মাঠের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তুমি দিব্যি ওখানে দোলনায় চড়ে দুলে দুলে গান গাইতে লাগলে, তোমার শৈশবের গান। শৈশবে শোনা কিছু গান তুমি মনে রেখেছো বটে। তোমার তো কোনও শৈশব ছিল না। যখন দোলনায় দুলে, ছুটে বেড়িয়ে, খেলাধুলা করে শৈশব কাটাবে, তখনই তোমাকে বিয়ে দিয়ে বয়স্ক করে দেওয়া হল, কোলে বাচ্চা দিয়ে মা করে দেওয়া হল। সংসার সন্তানের দুরূহ দায়িত্ব ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হল। দেশের কোনও দোলনায় তুমি চড়তে পারতে না, সে প্রশ্নই উঠতো না। অবকাশের মাঠে যখন বাবা আমাদের জন্য দোলনা বসিয়ে দিয়েছিল, তোমার নিশ্চয়ই ইচ্ছে করতো চড়তে! কোনওদিন তোমার ইচ্ছের কথা কাউকে বলোনি। তোমার কন্যাদের জন্য দোলনা, সেই দোলনায় তোমাকে চড়লে লোকে তোমাকে আস্ত পাগল বলবে! গভীর রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তারপর যে দোলনায় চড়ে না পাওয়া শৈশবকে একটুখানি পাবে, তারও উপায় ছিল না। বাবা হা হা করে তেড়ে আসবে এই আশংকা ছিল তোমার। শুধু বাবা কেন, তেড়ে তো নিশ্চয়ই আমরাও আসতাম। পাগল ভেবে হয়তো তোমাকে শেকলে বেঁধে রাখার ব্যবস্থা হত। আহা, তোমাকে যদি টেনে এনে একদিন বলতাম, মা তুমিও দোলনা চড়ো। ইচ্ছেগুলোকে কী দীর্ঘ দীর্ঘকাল তুমি শাসন করেছো মা। স্বাধীনতার স্বাদ কখনও তুমি পাওনি। যদি ক্ষমতা থাকতো, তোমাকে তোমার শৈশব ফিরিয়ে দিতাম আমি। যে শৈশবে তুমি শিশু যেভাবে বেড়ে ওঠে, উঠতে, তোমার কৈশোরকে তুমি যাপন করতে, যৌবনকে উপভোগ করতে। কী দোষ করেছিলে যে জীবনের শুরুতেই এক গাদা বার্ধক্যের বোঝা ফেলে তোমাকে পিষে ফেলা হল!

০৩. নিজেকে সঁপে দিয়েছিলে

নিজেকে সঁপে দিয়েছিলে আমার কাছেই। আর আমি তোমাকে কী করলাম মা? তলপেটের বাঁ দিকে তোমার ব্যথা নিয়ে গেলাম বাড়ির কাছের বাজারের ভেতরে একটা ছোটখাটো ডাক্তারখানায়। ডাক্তার তোমার পেটের ওদিকটায় চাপ দিতেই তুমি কঁকিয়ে উঠলে। ডাক্তার তোমাকে পাঠালো আলট্রাসোনোগ্রাম করতে। ঠিক একইঞ্চি জায়গা বলে দিয়েছে ওই পরীক্ষাটা করতে। ইঞ্চি মেপে দেয় তো ওরা। ওরা মেপে সব কিছু করে। সুয়েনসন রান্না করতে গেলে যেমন মেপে চাল দেয়, বা জল দেয়, বা দুধ ঢালে। রান্নাঘরে এদের মশলা পাতি মাপার জন্য যেমন দাঁড়িপাল্লা থাকে, কাপ গেলাসেও মিলিলিটার ডেসিলিটারের দাগ বসানো থাকে। যে নার্স তোমার পেটের ওইইঞ্চি বা সেন্টিমিটারের জায়গাটুকুতে আন্ট্রাসোনোগ্রাম করছিল, তোমার মনে আছে কিনা জানি না আমি বলেছিলাম যন্ত্রটা আরেকটু এদিক ওদিক ঘোরাতে, দেখছেই যখন পেটের আরও কিছু জায়গা দেখে নিক। না, ডাক্তারের মাথায় কিডনি, শুধু কিডনিই দেখতে বলেছে। কিডনির এলাকার বাইরে এক সুতোও যাবে না নার্স। দেখা গেল কিডনি ভালো। ডাক্তারের ওই ছোট মাথায় শুধু ডায়বেটিস ছিল। ডায়বেটিসের কারণে কিডনি নষ্ট হতে পারে, তাই কিডনি দেখতে চাওয়া। তোমার রক্ত পরীক্ষায় নিশ্চয়ই কিডনি ভালো থাকার প্রমাণ ছিল। কতটুকু অশিক্ষিত হলে ডাক্তার কিডনিই শুধু দেখতে পায়। তুমি ব্যথায় উঁ করে উঠেছিলে, যখন ডাক্তার তোমার ওই তলপেটের বাঁদিকে চাপ দিয়েছিল। ডাক্তারের মাথায় গোবর না থাকলে মেপে দিত না ইঞ্চি। বলতো, পুরো পেটের আলট্রাসোনোগ্রাম করে নিয়ে এসো। তাহলেই তো ধরা পড়তো তোমার ওই ভয়ংকর অসুখটা, মা। আর, আমার মাথায় কী ছিল? বর্ণবাদ ছিল ঠাসা। না থাকলে আমি ডাক্তারের নির্বুদ্ধিতাকে গ্রহণ না করে নিজে আমি পয়সা দিয়ে তোমার পেটের পরীক্ষাটা করাতাম। পয়সা দিলে কী না হয়! একটা নিয়ম আছে জানি, ছোট ডাক্তারের কাছে আগে যেতে হয়, অসুবিধে দেখলে ছোট ডাক্তার পাঠিয়ে দেবে বড় ডাক্তারের কাছে। কিন্তু আমার ছোট ডাক্তার যদি অসুবিধেটা না বোঝে, তবে তো দায়িত্বটা নেওয়া উচিত ছিল আমার। কিন্তু আমি তো নিইনি মা। ছোট ডাক্তার বলে দিল কিডনি ঠিক আছে, কিচ্ছু হয়নি। তোমাকে আঁশ আছে এমন খাবার খেতে না করে দিল। ব্যস, শাক সবজি বন্ধ। তোমাকে শুধু মাছের সুপ গেলানো হচ্ছে। তুমি খেতে পারতে না ওইসব সামুদ্রিক মাছ। খেতে ইচ্ছে করতো না ওসব দুর্গন্ধ জিনিস। কিন্তু কী করবে মা, পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশে, বিদ্যাবুদ্ধির বিশেষজ্ঞ সাদা ডাক্তারদের চিকিৎসার সুবিধেপাচ্ছো, তোমার মতো ভাগ্যবতী কে আছে বলো। তোমাকে বলতাম আমি। মাছের সুপ খাইয়ে তোমাকে আমি বলতাম, নিশ্চয়ই এখন ওই ব্যথাটা তোমার জন্মের মতো গেছে। তুমি মলিন হাসতে। মাথা নেড়ে বলতে, এখনও আছে। এখনও আছে? বাজে কথা বলছো কেন? আমার অবিশ্বাস দেখে মনে মনে নিশ্চয়ই তুমি দীর্ঘশ্বাস ফেলতে। অথবা একা একা নিচের ওই খুপরি ঘরটায় গিয়ে কাঁদতে। সারাদিন না খেয়ে থাকলেও, তিনবেলা ইনসুলিন নিলেও তোমার ব্লাড সুগার যেমন উঁচুতে তেমন উঁচুতেই। এসবের কোনও কারণ জানার ইচ্ছে ওই সাদা ডাক্তারের হয়নি। তোমার বমি হয়ে যেত মাছের সুপ খেতে গিয়ে। ধমক দিয়ে বলতাম–এসবই তোমাকে খেতে হবে। এসব খেলেই তোমার অসুখ সারবে। তুমি নিশ্চয়ই ভয় পেতে আমাকে, তোমার অসুখের কিছুই বুঝতে পারেনি ডাক্তার–এ কথাটা বলতে ভয় পেতে। ভয় তোমার আমি বিরক্ত হব, আমার শান্তি নষ্ট হবে। তোমার মতো ক্ষুদ্র তুচ্ছ মানুষ আমার মতো বিশাল বিখ্যাতর শান্তি নষ্ট করলে চলবে কেন! তুমি আমাকে বললে না যে তোমার কোনও কষ্ট আর আছে, বললে না ব্যথাটা আছে। কিন্তু পেটে হাত রেখে যখন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে, লক্ষ করে বলতাম, কী ব্যাপার, পেটে হাত কেন? ব্যথা এখনও আছেনাকি? তুমি অপ্রস্তুত হতে। ওষুধ দিয়েছে ডাক্তার ব্যথা কমার, সুপ খেতে বলেছে, ফাইবার বন্ধ। তারপরও ব্যথা না কমার তো কোনও কারণ নেই। মানে, দোষটা ডাক্তারের নয়, চিকিৎসার নয়, দোষটা ওষুধের নয়, দোষটা ফিস সুপের নয়, দোষটা তোমার। তোমার শরীরের। তোমার শরীর নিয়ে, তোমার নিজেকে নিয়ে তোমার কুণ্ঠার শেষ ছিল না। ওই দূর নির্বাসনে তুমি আমাকে আর অস্বস্তি দিতে চাওনি। তাই নিজের রোগশোক লুকিয়ে রাখতে। বলতে না যে কমোড ভরে যায় রক্তে। বলতে না, কারণ এসেই তোমার ডায়বেটিসের দুশ্চিন্তা আমাকে দিয়েছো, পেটের ব্যথার সমস্যা দিয়েছে। ডাক্তারের কাছে দৌড়োদৌড়ি করেও না কমানো যাচ্ছে তোমার ডায়বেটিস, না পেটের ব্যথা। আবার যদি রক্তপাতের সমস্যার কথা বলো, তাহলে পাগল হয়ে যাবো। তাই বলোনি মা। তাই গোপন রেখেছিলে ওই সমস্যা। তুমি বেশ বুঝতে পারছিলে, ওই রক্তপাতের সঙ্গে তোমার ওই ভয়ংকর অসুখের কোনও সম্পর্ক আছে আর ওই ভয়ংকর অসুখের সঙ্গে তোমার পেটের ব্যথাটিরও সম্পর্ক আছে। ডায়বেটিস আর কিডনি আর ফাইবার আর ফিস সুপ এসবঅহেতুক, এসব অনর্থক। কিন্তু আমি যেহেতু তোমার বলার পরও বুঝতে পারছি না, অথবা বুঝতে চাইছি না, তুমি আর যাই করো, শরীরের সমস্যার কথা বলে আমাকে বিপর্যস্ত করোনি। সাদায় আমার ভক্তি ছিল, তোমার কাছে সাদা-কালো-বাদামি মানুষ হিসেবে সবাই সমান ছিল। সাদা দেখলে তুমি ভক্তি শ্রদ্ধায় মাথা নোয়াতে না। সাদা ডাক্তাররা যে তোমার অসুখটা খুঁজে পায়নি, তা আমি বুঝিনি, তুমি বুঝেছিলে। তোমাকে কষ্ট কি কম দিয়েছি মা! পাড়ার ছোট ডাক্তার রক্ত পরীক্ষা করতে ক্যারোলিন্সকা হাসপাতালে পাঠিয়েছিল। ক্যারোলিন্সকা সুইডেনের বড় হাসপাতাল। ওখানকার ল্যাবরটরিতে রক্ত পরীক্ষা হয়েছে। ওখানকার ডাক্তার বলে দিয়েছে রক্তে কী একটা ভয়ংকর জীবাণু পাওয়া গেছে। ডাক্তার আমাকে জরুরি তলব করলো। তোমার যে কটা নষ্ট দাঁত আছে, সব নাকি ফেলে দিতে হবে। কেন? সেই জীবাণু নাকি পচা দাঁতে জন্ম নেয়, আর দাঁত থেকে সোজা দৌড়ে যায় হৃৎপিণ্ডে, হৃৎপিণ্ডে গিয়ে যা ইচ্ছে তাই করে। তুমি হাসলে শুনে। তোমাকে দাঁতের ডাক্তারের কাছে টেনে নিয়ে গেলাম, তোমার দাঁত পরীক্ষা করে ডাক্তার বললো, আমার দাঁতের চেয়ে তোমার দাঁত বেশি মজবুত, কোনও নষ্ট বা পচা দাঁত তোমার নেই। কিন্তু ছোট ডাক্তার ক্যারোলিন্সকার বড় ডাক্তারের উপদেশ শুনে বলে দিল, দাঁত যে করেই হোক ফেলতে হবে, তা না হলে হৃৎপিণ্ডে গিয়ে হৃৎপিণ্ড অচল করে দেবে ভয়ংকর ব্যাকটেরিয়া। তোমার দাঁতে কোনও সমস্যা ছিল না। তারপরও ভালো ভালো দাঁত একের পর এক তোলা হল। সাদা ডাক্তারদের চিকিৎসা। তোমাকে মানতেই হবে। তুমি না মানতে চাইলেও আমার জোর জবরদস্তিতে তুমি রাজি হলে। রাজি না হয়ে তোমার উপায় কী ছিল মা। দাঁতের ডাক্তারের খুব খারাপ লেগেছিল হয়তো ভালো দাঁতগুলো ওভাবে সাঁড়াশি দিয়ে তুলে তুলে আনতে। কিন্তু বাজে ব্যাকটেরিয়ার ব্যাপার। দাঁতের ডাক্তারের আর করার কী ছিল! হয়তো ভেবেছিলো কালো মানুষদের দাঁত থাকলেই কী, না থাকলেই কী। তাই প্রশ্ন করেনি। আফশোস করেনি। যন্ত্রের মতো মানুষদের মনে কী হচ্ছে, তা বোঝা সত্যিই শক্ত। মা, তোমাকে জোর করে দাঁত তুলিয়েই যে তোমাকে নিস্তার দিয়েছি তা নয়। তোমাকে তক্ষুণি ভর্তি করাতে বললো দানদিরুদ হাসপাতালে। দানদিরুদ হাসপাতালটা সংক্রামক রোগের জন্য। তোমার ওই ব্যাকটেরিয়া নির্মূল করতে হলে ওই হাসপাতালেই ভর্তি করতে হবে। করিয়ে দিলাম ভর্তি। সন্ধেবেলা সুয়েনসন বাড়ি ফিরলে ওর সঙ্গে একটুক্ষণের জন্য তোমাকে দেখতে যেতাম। তুমি চাইতে না আমি আমার সময় নষ্ট করি তোমার কাছে বসে থেকে। বলতে যেন বাড়ি চলে যাই। তুমি হয়তো ভেবেছিলে হাসপাতালে যখন ভর্তি হয়েছে, বড় বড় ডাক্তার তোমাকে দেখবে। তোমার ওই ভয়ংকর অসুখটা নিশ্চয়ই এবার ধরতে পারবে ওরা। কিন্তু ক্যারোলিন্সকার ল্যাবরটরিতে পাওয়া ওই ব্যাকটেরিয়া দূর করার দায়িত্ব শুধু ওরা নিয়েছে। ওরা তোমার কোনও অসুখ আবিষ্কারের জন্য তো বসে নেই। ওরা তোমাকে সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিকের চেয়ে লক্ষ গুণ বেশি ক্ষমতার খুব কড়া কড়া অ্যান্টিবায়োটিক দিল স্যালাইনের সঙ্গে। তুমি কি ভেবেছিলে ওরকম স্যালাইনের সঙ্গে ওষুধ দিয়ে তোমার ভয়ংকর অসুখটাকে হয়তো নির্মূল করবে! না মা না। সাতদিন তোমাকে ভয়ংকর যন্ত্রণা দিল। সিরিঞ্জ ভরে ভরে প্রতিদিন তোমার রক্ত নিয়েছে আর ব্যাগ ভরে ভরে তোমার শরীরে ঢুকিয়েছে ভয়ংকর জীবাণু দূর করার জন্য ভয়ংকর জীবাণুনাশক। সাতদিন প্রায় একা একা তোমাকে থাকতে হল। তুমি থাকতে চাওনি হাসপাতালে, কারণ আমি ওই যে যাই তোমাকে দেখতে, ভেবেছো আমার স্বাভাবিক জীবন যাপনে ব্যাঘাত ঘটছে, তোমার জন্য বাড়তি ঝামেলা আমার হোক, তা মেনে নেবে কেন! তুমি বাড়ি ফিরে আসার পরদিন হাসপাতাল থেকে জানিয়ে দিয়েছে, ক্যারোলিন্সকা ল্যাবরটরির পরীক্ষায় যে ডেডলি ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গিয়েছে বলা হয়েছিল, তা ভুল। ল্যাবরটরির ভুল। ওরকম কোনও ব্যাকটেরিয়া আসলে ছিল না রক্তে। কোথাও তাদের ভুল হয়েছিল। বাহ। তোমার দাঁতগুলো ফেলে দেওয়ারপর, তোমাকে জীবননাশ করা জীবাণুনাশক রক্তে প্রবেশ করিয়ে বলে দিল, ভুল। এই ক্যারোলিন্সকা ইনস্টিটিউট থেকে মেডিসিনে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয় মা। কী করবো, কোথায় যাবো। কারও বেলায় এমন হয় না, তোমার বেলায় হলো। ভুল শুধু তোমার বেলায় হয়। ভুগতে হয় তোমাকেই। হয় তোমার চিকিৎসা হয় না, যদি হলোও কখনও জীবনে, ভুল হলো। মাড়িতে দাঁত নেই, বলতে চিবোতে পারছো না খাবার। অভিযোগ করোনি, শুধু বলেছো। হেসেই বলেছো। সান্ত্বনা দিয়েছি, দাঁত গেলে এমন কী, বাঁধানো যাবে। তোমার চুলে কোনও পাক ধরেনি। ত্বকে কোনও ভাঁজপড়েনি। এত কম বয়সী একজনের দাঁত বিদেশি ডাক্তাররা মিছিমিছি তুলে নিল? আমেরিকায় হলে এই ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী রোগীরা বিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ মামলা করতো। কিন্তু আমি কী করে কার বিরুদ্ধে মামলা করবো? মানুষ আমাকে সেলিব্রিটি ভাবে, বিশাল ক্ষমতাশালী কিছু একটা ভাবে, কিন্তু আমার মতো নিরীহ নিরুপায় মানুষ কজন আছে! নেই, সে কথা এখন জানি আমি। তখন জানিনি। দেশে থাকলে তোমার চিকিৎসা করাতে কোনও তো অসুবিধে হতো না মা। ওখানে আমার বন্ধুদের, বা পরিচিত ডাক্তারদের নিশ্চয়ই পেয়ে যেতাম যে কোনও হাসপাতালে। আর না পেলেও আমাকে তো সবাই চিনতো। সুইডেনে একসময় মানুষ সবাই আমাকে চিনেছিলো, খুব বড় খবর ছিলাম আমি। ধীরে ধীরে সবাই ভুলে গেছে। একসময় তো রাস্তাঘাটে চলতে গেলে মানুষ আমাকে দেখতে ভিড় করতো, দৌড়ে এসে অটোগ্রাফ চাইতো, নয়তো দূর থেকে অভিনন্দন বা শুভেচ্ছা জানাতো। এখন আমি যে কোনও সাধারণ মানুষের মতো। সারাক্ষণ যদি টিভিতে, পত্রিকার পাতায় ছবি না বেরোয়, তবে ভুলে যেতে আর কতক্ষণ এই মুখটি! রং সাদা নয় বলে যে কোনও অভিবাসীর মতোই আমি, অর্থনৈতিক সুবিধের জন্য গরিব দেশ থেকে যেমন হাজার হাজার লোক এসে ধনী দেশে আশ্রয় চায়, তাদের মতোই তো দেখতে আমি। আমার দিকে সাদারা নিশ্চয়ই তেমন চোখেই তাকায়, যেমন চোখে আর সব ডার্টি ইমিগ্রেন্টদের দিকে তাকায়। তবে নামটি শুনে এখনও লোকে স্মৃতি হাতড়ে তুলে আনে, তুমি তো লেখক, তাই না? আজকাল না বলি। নিজের পরিচয় দিতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু ডাক্তারদের কাছে তো তোমার নাম বলতে হয়েছে, আমার নাম নয়। আগ বাড়িয়ে নিজের নাম পরিচয় দিয়ে সুবিধে চাইবো, সে রুচি আমার কোনওদিনই ছিল না, তখনও হয়নি যখন তোমার জন্য সুবিধের বড় দরকার ছিল। তোমার জন্য ব্যক্তিত্বটা একটুখানি বিসর্জন দিয়ে যে নিজেকে চেনাবো, আমি যে ডার্টি কোনও ইমিগ্রেন্ট নই, রীতিমত একজন নামকরা লোক, মনে করিয়ে দিলেই লোকের মনে পড়বে, আমার মাকে ভালোভাবে দেখবে, ভালো চিকিৎসা করবে, তা তো করিনি। এমন স্বর্গের মতো দেশ, এমন সমতা আর সাম্যের দেশ, মনে হত সবাইকে সমান চোখেই নিশ্চয়ই দেখে এই দেশ। পরে এসব ভুল আমার ভেঙেছে মা। সুইডেনেও ওই একই, স্বজনপ্রীতি বলো, ক্ষমতা ব্যবহার বলো, সবই চলে। লেখক হলে, নামী দামী কিছু হলে খাতির জুটবেই। তুমি যখন ছিলে, এসব সত্য উদ্ধারের কোনও চেষ্টা আমি করিনি। নিজের নাম পরিচয় লুকিয়ে সাধারণ যে কোনও মানুষের মতো হাসপাতালে গিয়েছি। সবাই মিলে তোমাকে যন্ত্রণা দিয়েছি। দানদিরুদ হাসপাতালে ডাক্তার অ্যানডার্সকে দেখার পর নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি যেন আমাকে দেখতে না পায়। ওখানেও ওই একই ব্যাপার হয়তো কাজ করেছিলো, কমপ্লেক্স। অ্যানডার্সকে গিয়ে যে বলবো আমার মা অসুস্থ, এই হাসপাতালে ভর্তি, বলিনি। যে অ্যানডার্স আমার ফোনের উত্তর দেয়নি, তার সঙ্গে কেন আমি কথা বলবো! হীনম্মন্যতা নাকি অহংকার কে জানে। অ্যানডার্স চোখের ডাক্তারের নাম ঠিকানা দিয়েছিলো বাবার চোখের ছানি কেটে যখন লেন্স পাল্টে দেওয়া হয়েছিল। বাবা চোখে কী ঝকঝকে দেখেছিল তারপর। প্রচুর টাকা লেগেছিলো সোফিয়া হেমেটের মতো বড় হাসপাতালে। পেন ক্লাবকে বলে দেবে টাকাটা দিয়ে দিতে, অ্যানডার্স বলেছিল। আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে বলেছি, পেন ক্লাব দেবে কেন, আমিই নিজেই বিল মেটাবো। পরদিনইপঁয়ত্রিশ হাজার ক্রোনার পাঠিয়ে দিয়েছিলাম ডাক্তারের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। পরে অ্যানডার্স একদিন এসে আমাকে ডিনারে নিয়ে গিয়ে বলেছিলো, সব টাকা দিয়ে দিলে? নয় কেন? আমার বাবার চোখ অপারেশনের টাকা আমি দেব না তো কে দেবে? আমি কি ভিখিরি নাকি যে অন্যের কাছে চাইবো? সুইডিশ পেন ক্লাব থেকেপাওয়া কুর্ট টুযোলস্কি পুরস্কারের টাকা ওভাবেই খরচা করেছি। টেলিফোন বিলে, বাবার চোখ অপারেশনে, আর বাকিটা হাবিজাবিতে। টাকা উড়ে যেতে খুব বেশিদিন সময় নেয়নি। বাবার বেলায় তো এমন কাণ্ড ঘটেনি। বাবাকে একরাতও হাসপাতালে থাকতে হয়নি। যেদিন অপারেশন, সেদিনই বাড়ি ফেরা। রোগ ধরতে ডাক্তারদের কোনও অসুবিধে হয়নি। কোনও ভুল চিকিৎসা হয়নি। কী দোষ করেছিলে যার শাস্তি তোমাকে জীবনভর পেতে হলো! সম্ভবত দোষ করোনি বলেই শাস্তি পেতে হয়েছে। আমাকে নির্বাসনের শাস্তি পেতে হলো দোষ না করে, মানুষের ভালো করতে গিয়ে। তুমিও তো সারাজীবনে কেবল মানুষের ভালো করেছে, তাই সারাজীবনই তোমাকেযন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে। সুখ পাওনি কারও কাছ থেকে। অন্যের ভালো করা যার স্বভাবে চরিত্রে রক্তে, তা কী করে কেদূর করবে! এর কারণে ভুগলেও স্বভাব কোথায় যাবে। মানুষের মার খাবে, তারপরও মানুষের জন্যই জীবন দেবে।

.

একদিন সকালে তোমার ওই নিচের তলার ছোট ঘরটিতে গিয়ে দেখি তুমি জ্বরে কাতরাচ্ছো। সারারাত আমাকে ডাকোনি। কপালে হাত রেখে দেখি গা তোমার পুড়ে যাচ্ছে। সেদিন আমি তোমার জন্য মায়ায় করুণায় কথা বলছিলাম কেঁদে কেঁদে, বলছিলাম, চলো, হাসপাতালে চলো। আমি তোমার জন্য কাঁদছি, তোমার এমন ভীষণ জ্বর হয়েছে বলে। ওই জ্বরের কষ্ট তুমি মুহূর্তে ভুলে গেলে, তোমার মুখে কী একটা দাতি ছিল মা। পরে তুমি আমার জন্য কাঁদছিলে মা? ” বলছিলে যখন, তোমার চোখ বেয়ে বৃষ্টির মতো জল ঝরছিল। ওই জ্বর-কাতর মুখে তৃপ্তি। প্রথম বোধহয় কাউকে জীবনে তোমার জন্য কাঁদতে দেখেছো। কতটুকু আর কেঁদেছি, কয়েক ফোঁটা চোখের জল। তোমাকে জ্বর থেকে বাঁচাতে হবে। জ্বর কমছিল না কিছুতেই তোমার। যাচ্ছে আসছে। ঠান্ডা জল-ভেজা তোয়ালে দিয়ে গা মুছিয়ে দিচ্ছি। ওষুধ দিচ্ছি। আবার আগুন হয়ে যাচ্ছে শরীর। শেষে হাসপাতাল। হাসপাতাল থেকে ফিরে তুমি দেশে ফিরে গেলে মা। আর থাকোনি। আমিও আর থাকতে বলিনি। তোমাকে ব্রাসেলসে ছোটদার কাছে দিয়ে এসেছিলাম। তোমাদের সঙ্গে একদিন থেকে, তোমাদের বিমান বন্দরে বিদায় জানিয়ে তবে আমি স্টকহোম ফিরেছি। বিদেশে একা একা চলা ফেরায় আমি ভীষণ অভ্যস্ত। তোমার হাতে বলেছিলাম আমি কিছুটাকা দিয়ে দেব। শেষ অবধি দিইনি মা। বলেছি, ‘ছোটদার খুব টাকার লোভ, ও তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবে। ছোটদার স্বভাব থেকে সাবধান থাকার জন্য আমি কপর্দকশূন্য তোমাকে কপর্দকশূন্য হিসেবেই দেশেপাঠালাম। বলেছিলাম, তোমার হাতে না দিয়ে টাকা তোমার ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেব। তুমিও গেলে, আমিও টাকা পাঠানোর কথা ভুলে গেলাম। তোমার হাতে কোনও টাকা পয়সা দেবার তো কেউ ছিল না মা কোনওদিন। আমার কাছে হয়তো আশা করেছিলে মনে মনে, কিন্তু পেলে না। আমি ইচ্ছে করলেই কি টাকা তোমাকে দিতে পারতাম না? আমার তো অভাব ছিল না মা! কেন তবে তুমি বলো যে জীবনের সবচেয়ে সুখের সময় তুমি সুইডেনে আমার সঙ্গে কাটিয়েছে, কেন বলো তোমাকে আমি ভালোবাসা দিয়েছি খুব! দিইনি মা, সারাজীবন ঠকেছো তুমি। তোমাকে তোমার মেয়ে আবারও ঠকালো। তুমি বোকা, চিরকালের বোকা, তাই বোঝোনি কিছু।

তুমি ছোটদার পক্ষ নিয়ে কথা বলতে, বলতে ও তোমাকে ভালোবাসে। এ আমার সইতে না। ছোটদা যে মোটেও ভালো ছেলে নয়, ও যে আমার উপদেশ অমান্য করে তার বউ ছেলেমেয়েকে আমেরিকায় পাঠিয়ে মস্ত ভুল করেছে, তা-ই তোমাকে আমি দিনের পর দিন বুঝিয়েছি। সুহৃদের মানসিক অবস্থা যে খুব খারাপ বুঝিয়েছি, সুহৃদকে যে এখনও তার মা শারীরিক মানসিক অত্যাচারের মধ্যে রাখে বুঝিয়েছি, সুহৃদ হয় পাগল হয়ে যাবে, নয় আত্মহত্যা করবে বুঝিয়েছি, সুহৃদকে মানুষ করতে হলে তার মার কবল থেকে যে তাকে বাঁচাতে হবে বুঝিয়েছি। তুমি মাথা নিচু করে বুঝেছো। ছোটদার ওপর তার পরও তোমার রাগ হয় না। তুমি তারপরও আমার মতো করে ছোটদাকে দোষ দাও না। দেখে তোমার ওপরই অসন্তুষ্ট হই আমি। তোমাকে বলেছিলাম ছোটদা যে সুহৃদের জীবনটা নষ্ট করে দিল, সে সম্পর্কে কিছু বলতে। ভিডিওতে আমাদের অনেক কথপোকথন রেকর্ড করার মতো তোমার মন্তব্যও রেকর্ড করতে চাইছিলাম আমি। ছোটদা যে একটা অপদার্থ আর লোভী গোছের পাষণ্ড সে সম্পর্কে কিছু বলো চাইছিলাম। তুমি বলেছিলে, ‘এসব কথা থাক। এ নিয়ে তুমি কিছু বলতে চাও নি। ছোটদার কাছে কৃতজ্ঞ ছিলে তুমি। আমাকে ঢাকায় যখন পুলিশের গ্রেফতার এড়াতে আর মৌলবাদীদের ফাঁসি এড়াতে দীর্ঘ দুমাস লোকের বাড়িতে বাড়িতে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল, ব্যারিস্টার সারা হোসেন খুব জরুরি হলে বাড়ির কাউকে ডেকে পাঠালে দাদা বা ছোটদা দুজনই যেত, যেহেতু দাদাকে আবার ময়মনসিংহে চলে যেতে হত, ছোটদাই অনেক সময় যেত দেখা করতে। সারা হোসেন রলে দিত, হাইকোর্টে আমার সারেন্ডার করার সম্ভাব্য তারিখের কথা। একবার ছোটদার সঙ্গে গোপন ফোনে কথা বলে তাকে রাতের অন্ধকারে ঝএর বাড়িতে আসতে বলেছিলাম। জগতের কেউ জানে না আমি কোথায়, শুধু ছোটদা জানে, তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। ছোটদারই ক্ষমতা আছে আমার সঙ্গে দেখা করার। তখন থেকেই তুমি ছোটদাকে ভগবানের উচ্চতায় বসিয়ে দিলে। ছোটদা বাড়িতে এসে ভাব দেখাতো যে সে বিশাল কিছু একটা করছে আমার জন্য। বিশাল কিছু আমার জন্য করতো ক, খ, গ, ঘরা, তুমি জানতে না। কিন্তু আমার সঙ্গে যেহেতু বাড়ির আর কারও যোগাযোগ নেই, শুধু ছোটদার সঙ্গেই আছে, তুমি ভাবতে, ছোটদাই বুঝি আমার এখন সবচেয়ে বড় ভরসা। ছোটদাই আমাকে জায়গায় জায়গায় লুকিয়ে রাখছে, ছোটদাই আমাকে মৌলবাদীদের হাত থেকে রক্ষা করছে, ছোটদাই ব্যারিস্টারদের সঙ্গে কথা বলে আমাকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করছে। তুমি তখন ছোটদাকে রাজার আদরে তো বটেই, গীতাকেও রানির আদরে রেখেছিলে। সবাই তখন আমার শান্তিনগরের বাড়িতে। কোথায় ছোটদাকে সাহায্য করলাম আমি, ডেকে নিয়ে আমার ব্যাংক থেকে যত খুশি টাকা তোলার অধিকার লিখিতভাবে দিয়ে দিলাম, আর আমাকে সাহায্য করার নাম কামালো ছোটদা।

সুইডেনে শেষের দিকে তুমি অল্প কিছু খেতে, একসময় সেও আর খেতে পাচ্ছিলে না। প্রায়ই বলছিলে ক্ষিধে নেই। পেট ভরা ভরা লাগে, খেলে গা গুলিয়ে আসে। বমি ভাব হয়। ভাব কেন, বমিই হয় তোমার। খেতে পাচ্ছো না, খেলে বমি হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং না খেয়ে কাটাবে স্থির করলে, আর আমিও তা মেনে নিলাম। এর নাম যদি ভালোবাসা, তবে অবজ্ঞা, অবহেলা, অপমান কাকে বলে মা? তোমার চলে যাওয়া ছাড়া আর কী উপায় ছিল। আমি লেখায় ব্যস্ত। তুমি যে কত বললে কত কাঁদলে যেন দেশে ফিরি, অবুঝ তুমি, তোমাকে বুঝিয়ে বললাম, আমার যাওয়া হবেনা দেশে। দেশে আমাকে ঢুকতেই দেবেনা। তখন আমার হাতে জাতিসংঘের ট্রাভেল ডকুমেন্ট। নিজের দেশের পাসপোর্টটি নেই আমার কাছে। ওটিকে আর নবায়ন করা হয় বাংলাদেশে দূতাবাস থেকে। তুমি আমাকে না নিয়ে দেশে ফিরবেনা, একথা প্রতিদিন বলতে, বারবার বলতে, সেই প্রথম দিন থেকে বলে আসছে। কিন্তু আমাকে না নিয়েই তোমাকে ফিরতে হলো মা। একা ফিরলে। তোমার দীর্ঘশ্বাসের কোনও শেষ ছিল না। কেঁদেছিলে খুব। আমি কি কেঁদেছিলাম? না মা, বরং হাতে করে নিয়ে যাওয়ার সুটকেসটায় এত বেশি কী জিনিস ভরেছো তাই নিয়ে আমি রাগ দেখাচ্ছিলাম। চাকাঅলা কোনও সুটকেস ছিল না তোমার। ব্রাসেলস এয়ারপোর্টে নিজেই তুমি বয়েছো সুটকেসটা। আমি তোমার ওই ভার বহন করিনি। আমার কিছু পুরোনো জুতো আমি ফেলে দিচ্ছিলাম, ওগুলো নিয়েছিলে দেশের গরিব মানুষকে দেওয়ার জন্য। নিজের জন্য কিছু নাওনি মা। নিজের জন্য একটা সুতোও তুমি নাওনি। যা কিনে দিয়েছিলাম, সব ধুয়ে পরিষ্কার করে ভাঁজ করে আমার আলমারিতে রেখে গেছো আমার জন্য। ওই অসুস্থ শরীরে হাবিজাবিতে ভরা ভারি সুটকেসখানি বইতে তোমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। ওগুলো আমিই তোমাকে দিয়েছি, আবার ওগুলো এনেছো বলে আবার ফুঁসছি তোমার ওপর রাগে। অবশ্য ফুঁসছিলাম যতক্ষণ আমাকে বইতে হচ্ছিল। তোমার কাঁধে সুটকেস বহনের দায়িত্ব দেওয়ার পর আমার ফোঁসা কমে গেছে। একবারও কি ভেবেছিলাম তোমার তলপেটের যন্ত্রণার কথা! তোমার তো কোনও অসুখ নেই। ডাক্তাররা বলে দিয়েছে কিডনি ভালো, সুতরাং সব ভালো। বেশি বেশি করে ইনসুলিন দেবে, ডায়বেটিসটা কমাও, ব্যস সব ঠিক। আমি তো যাচ্ছি সুহৃদের দায়িত্ব নিতে আমেরিকায়। আমি তো ভালো, আমি তো প্রকাণ্ড হৃদয়বান। পরিবারে আমার মতো দায়িত্ববান আর কেউ আছে? কেউ নেই, তা প্রমাণ তো আমাকে করতেই হবে। যে তোমার মতো মানুষের একফোঁটা দায়িত্ব নিল না, সে ঠিক ঠিক চলে গেল আমেরিকায় অন্যের দায়িত্ব নিতে।

আমি তোমার কত কিছুই বুঝিনি মা। মাইকেল যেদিন তার মার বাড়িতে নিয়ে গেল আমাদের, যেহেতু তার মার আলজাইমার অসুখ, দূর অতীতের কথা মনে থাকলেও কাছের অতীতের কথা ভুলে যান, একই কথা বার বার যখন বলছেন, চায়ে চিনি দেবেন কী দেবেন না, এক বিস্কুট তোমাকে অন্তত পঁচিশবার নিতে বললেন, তুমি না শব্দটিও পঁচিশবার বলেছো, একটুও বিরক্ত হওনি। চা খাওয়ার মাঝখানে একবার তুমি বাথরুমে গেলে। বাথরুম থেকে মলিন মুখে এসে বসার পর জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? বমি? তুমি স্নান হেসে মাথা নেড়েছিলে। না। হয়নি বমি। কিন্তু মা, তোমার তো ভীষণ রক্ত গিয়েছিল। একই রকম ব্রাসেলসের হোটেলেও কমোড ভরে রক্ত গিয়েছে। আমাকে বলোনি কিন্তু কিছুই বলোনি আমাকে, লুকিয়ে রেখেছে। যাবার আগে আমাকে আর বিব্রত করতে চাওনি। তুমি এই যে আমাকে নিতে এসেছিলে, বলেছিলে আমাকে ছাড়া তুমি দেশে ফিরবে না, তোমার এই আবদারকে আমি ছেলেমানুষি ভেবেছিলাম, আর সবার মতো, বাবা, দাদা, ছোটদা সবার মতো। তুমি কিন্তু একে ছেলেমানুষি বলে ভাবোনি। তোমার নিজের জীবনের চেয়েও তোমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল আমার দেশে ফেরা। তাই ভেঙে গেলে, টুকরো টুকরো হয়ে গেলে, নিঃশেষ হয়ে গেলে, আমাকে তুমি শত চেষ্টা করেও দেশে ফেরাতে পারোনি। তারপরও আমাকে বলে এসেছো, অন্তত সুইডেন থেকে যেন যাই, আমেরিকায় যেতে চাইছি তাই যেন যাই, তবে যেখানেই থাকি, দেশে ফেরার চেষ্টা যেন করে যাই। নিজের বাড়িঘর, নিজের আত্মীয়স্বজন ছেড়ে যেন বিদেশ বিভুইএ না থাকি। মা, ব্রাসেলস এয়ারপোর্টে তোমাদের যখন বিদেয় দিচ্ছিলাম, খুব অসহায়, খুব মলিন লাগছিলো তোমার মুখ। মা, তুমি বিদেশের ঝকঝকে দালানকোঠা দোকানপাটের দিকে মোটেও তাকাওনি। কেবল আমার দিকে তাকিয়েছিলে। কী প্রচণ্ড ভালোবাসতে পারো তুমি মা! ভালোবেসে নিজের জীবন উৎসর্গ নাকি করে মানুষ, শুনেছি, কোনওদিন দেখিনি। তোমাকেই দেখলাম। আমাকে দুশ্চিন্তা দেওয়ার চাইতে নিজেকেই দিলে দুরারোগ্য ব্যাধি।

.

মাইকেল যখন তার মার চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে কাঁধে অল্প অল্প করে দুহাতে চাপ দিয়ে দিয়ে মালিশ করে দিচ্ছিল, তোমার বিস্মিত চোখ সে থেকে সরেনি, একসময় অঝোরে ঝরতে থাকা নিজের চোখের জল মুছতে শুরু করলে। কেন কাঁদছো জিজ্ঞেস করলে তুমি কোনও উত্তর দিতে পারোনি। যেন ভাবতে চেষ্টা করেছিলে কেঁদেছিলে কেন! আবারও জিজ্ঞেস করেছিলাম, দেশে চলে যাচ্ছে বলে? না। পেট ব্যথা করছিল? না। তবে কেন? মাইকেল তার মাকে খুব ভালোবাসে, এই দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগছিল, তাই। তাই কাঁদবে কেন? ভালো লাগলে মানুষ তো মাঝে মাঝে কাঁদেও। আনন্দাশ্রু। হ্যাঁ তাই। তোমার কি মনে হচ্ছিল, তোমাকে ওভাবে তো তোমার ছেলে মেয়েরা কেউ আদর করে দেয় না! কী গো মা, এত কাজ করছে, এসো তোমার পিঠটায় একটু মালিশ করে দিই, কেউ তো বলিনি কোনওদিন তোমাকে। কেউ তার মাকে আদর করছে দেখলে তোমার চোখে জল আসে কেন! কেউ তার মাকে ভালোবাসলে তোমার ভালো লাগে কেন এত! কী তুমি পাওনি, কী থেকে তুমি বঞ্চিত, তা নিশ্চয়ই তখন বুঝতে পারো। যে মায়েরা ছেলেমেয়েদের আদরপায় তাদের খুব ভাগ্যবতী বলে মনে হয় তোমার, তাই হয়তো ওদের ভাগ্য দেখে, ওদের আনন্দ দেখে তোমার চোখে আনন্দাশ্রু জমা হয়। তুমি কি মাইকেলের জায়গায় দাদাকে বা ছোটদাকে আর মাইকেলের মা’র জায়গায় তোমাকে কল্পনা করে নিয়েছিলে, তাই তোমার ওই ভালো লাগার বোধটা ছিলো? কিছুই বলেনি। তুমি যে কী নিখুঁত শিল্পী মা, কী যে উঁচু মানের মানুষ, কী যে শিক্ষিত, কী যে ভদ্র, কী যে আধুনিক, কী যে বুদ্ধিমতী তুমি–সুইডেনে ওই কটা মাস তোমাকে না দেখলে কোনওদিন জানতে হয়তো পেতাম না। তোমাকে আগে তেমন দেখিনি যেমন দেখেছিলাম। অথবা কী রকম যে তুমি, তা তখন না অনুধাবন করলেও পরে করেছি। এক এক করে যখন মনে পড়েছে তোমার সব হাসিখুশিকে, দুঃখবেদনাকে, মনে পড়েছে তোমার কথা, কাজ, তোমার বিচক্ষণতা, বুদ্ধিমত্তা। যাকে বোকা হিসেবে চিরকাল বিচার করেছি, তার বুদ্ধি দেখার পরও সেটাকে ঠিক বুদ্ধি বলে তক্ষুনি মনে হয় না। কোনও বাজে প্যাঁচাল, কোনও বাড়তি কথা বলেনি। অনর্গল বলেছি আমি। আজকাল যখনই পেছনের দিকে তাকাই, তোমাকে দেখি। তখন আমার চোখ থাকলে দেখতে পেতাম তোমাকে। স্থিত, স্নিগ্ধ তোমাকে। তুমি হয়তো বুঝতে পেরেছিলে আমাকে আর তোমার অসুখ সম্পর্কে বলে লাভ নেই। যে আমি বুঝতে পারছি না, সে আমি বুঝতে পারবোও না। দেশে ফিরে যাওয়ার আগের দিন তোমাকে ব্রাসেলস শহর থেকে খানিকটা দূরে নিয়ে গিয়েছিলাম, একটা গুহায়। গুহার ভেতর অসংখ্য স্ফটিক। হাজার বছর ধরে জল জমে জমে জল বরফ হয়ে শেষে ক্রিস্টাল হয়ে গেছে। গুহার ছাদ থেকে ঝুলে আছে, নানা আকারের ক্রিস্টাল। ভাবা যায় কোনও একসময় এরা শুধু জল ছিল! গুহাটা দেখতে প্রচুর লোক আসে। গুহায় যেতে হলে প্রচুর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হয়। নামতে চাইছিলে না তুমি। চাইছিলে না কারণ ওঠা নামা করলে তোমার প্রচণ্ড ব্যথা হয় পেটে। আমি তা শুনবো কেন! তোমাকে জগৎ দেখাবো। বিদেশ যে চমৎকার জায়গা তা তোমাকে না দেখালে আমার চলবে কেন? জোর করে নামালাম তোমাকে। বলতে বলতে নামালাম যে জীবনে এই জিনিসটা না দেখলে তোমার জীবন অপূর্ণ থেকে যাবে। কিন্তু ঘামতে ঘামতে হাঁপাতে হাঁপাতে কষ্টে গোঙরাতে গোঙরাতে নেমেছে বটে। উঠতে তো পারছে না। উঠতে গিয়ে কাঁদছো। কী অসহায় ছিলে তুমি! তোমাকে ক্রমাগত কঠিন কঠিন কথা বলে যাচ্ছিলাম যেন যে করেই হোক ওপরে ওঠো। তুমি সিঁড়ির রেলিং ধরে যন্ত্রণায় নীল হওয়া মা, ধীরে ধীরে ওপরে উঠলে আমার তাড়ায়। এরকম আগেও একবার তুলেছিলাম মা তোমাকে ওপরে, এক রাতে গিয়েছিলাম ইনসুলিনের পেনসিল-সিরিঞ্জ নিতে স্টকহোমের এক চেনা লোকের কাছ থেকে। সেই লোকের বাড়ি চারতলায়। তুমি উঠতে চাইছিলে না। বললে তুমি উঠে নিয়ে এসো, আমি এখানে দাঁড়াই। আমি তোমাকে বললাম না, না, ওঠো। কেন উঠিয়েই ছাড়লাম তোমাকে? তোমার না উঠতে চাওয়ার ইচ্ছেকে কোনও মূল্যই কেন দিইনি, দিতে চাইনি? তা আমি আজও ভাবি। ওর পেছনে বোধহয় একটিই কারণ, তোমাকে মানুষ মনে করিনি কোনওদিন। ভেবেছি তোমার একটিইপরিচয়–তুমি ইস্কুল কলেজপাশ করোনি, তুমি পরনির্ভর, দুনিয়ার কিছু জানোনা বোঝো না, তোমাকে চলতে হবে আমরা যেভাবে বলি সেভাবে। সেভাবেই তো চলেছো জীবনভর। সেভাবে ছাড়া তোমাকে মানাবে কেন মা? এর নাম আর যাই হোক মা, ভালোবাসা নয়। একে অন্তত ভালোবাসা বোলো না।

যতদিন ছিলে আমার সঙ্গে, কিছুই দেখনি তুমি, আমার খ্যাতি, প্রতিপত্তি, যশ, কিছুই। কোনও দেশ থেকেও আমার জন্য কোনও আমন্ত্রণ আসেনি। আমি যে কত দেশে বক্তৃতা করেছি, কত সম্মান পেয়েছি, কত পুরস্কার, কিছুই তোমার নিজের চোখে দেখা হয়নি। ওসবে তোমার আগ্রহ খুব বেশি নেই। তুমি মনের খবর নিতে চাও। ভালো আছি তো। সুখে আছি তো। আমার সুখ দেখতে চাও তুমি। আর কিছু না। আমার ভালো লাগতো না একটুও, যে, তুমি দেখছো না মানুষ কী করে কত হাততালি দেয় আমার বক্তৃতা শুনে। একটা কোনও স্বর্ণপদকও পেতে দেখনি। কী দেখেছো মা তুমি? বাবা তো দেখেছিলো অনেক, আমার সঙ্গে দেশও ঘুরেছিলো অনেকগুলো। আমার বাবা বলে বাবাকেও অনেক সম্মান করেছে মানুষ। তুমিই সম্মান পাওনি। তোমাকেই কোথাও নিয়ে যেতে পারেনি। অন্য লোকের বাড়ির নিচতলায় পড়ে ছিলে, যতদিন ছিলে। আমি যে ঠিক স্বনির্ভর নই, দেখে গেছে। আমার মতো একশ ভাগ স্বনির্ভর মানুষকে পরনির্ভর হতে দেখে তোমার খুব দুঃখ হয়েছে সম্ভবত। একবার, রোজার সময় তোমাকে বলেছিলাম চল তুরস্ক থেকে ঘুরে আসি। ওটা মুসলিম দেশ, রোজা রাখতে পারবে। তুমি রাজি। কিন্তু একটা গরিব দেশের পাসপোর্ট বহন করছে বলে তোমাকে তুরস্কের ভিসা দেওয়া হল না। আমরা ফিরে এলাম ঘরে। তোমার মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমার হাতে রাষ্ট্রপুঞ্জের ট্রাভেল ডকুমেন্ট। বাংলাদেশ ছাড়া আর সব দেশে ভ্রমণ করার অধিকার আমার আছে। তুরস্কেও যেতে পারি। কিন্তু তোমার পাসপোর্টে ভিসাই দেওয়া হবে না তোমাকে। নিয়ম হলো ভিসা নিজের দেশ থেকে সংগ্রহ করতে হয়, অন্য দেশ থেকে ভিসা হয় না। কিন্তু মা, বাবাকে এই সুইডেন থেকেই জার্মানির ভিসা, ডেনমার্কের ভিসা, ইংলন্ডের ভিসা তখন করিয়ে দিয়েছিলাম। ওসব জায়গায় সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। আসলে সরকার থেকে বা বড় কোনও প্রতিষ্ঠান থেকে যখন আমন্ত্রণ জানানো হয়, তখন বস্তাপচা নিয়ম কানুনগুলো খাটে না। এত যে বিদেশের নিয়ম কানুনের সতোর প্রশংসা করে মুখে ফেনা তুলে ফেলি, একটু তলিয়ে দেখলেই তো দেখি, মামা কাকার জোর এখানেও খাটে। সরকারের লোক সাহায্য করলে এখানেও অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। তুমি আমাকে দেখেছো পরনির্ভর তোমার মতোই, আমার সেই জেদ তেজ, আমার সেই অহংকার, আত্মবিশ্বাস, আশ্চর্য সৌন্দর্য, সেই প্রাণ, সেই প্রতাপ কিছুআর নেই। পথে যখন বেরোই, আমি সেই আমি নই যাকে একশ লোকে চেনে। দেখেছো কেউ হয়তো কনুই ঠেলে চলে গেল। এত যে লোক ছিলো, রাস্তায় আমি হাঁটলে কাছে এগিয়ে আসতো, তুমি যতদিন সঙ্গে ছিলে, কেউ আসেনি আমার কাছে। আমি আর তুমি বরফ ছাওয়া রাস্তায় হেঁটেছি, ধনী সাদাদের দেশে দরিদ্র কালোরা যেভাবে হাঁটে, সেভাবে পায়ে পায়ে আড়ষ্টতা, হীনম্মন্যতা, সংশয়, শংকা। অন্তত আমি হেঁটেছি ওভাবে, তোমার ভেতরে কালো সাদা নিয়ে আমি কোনও রকম হীনম্মন্যতা দেখিনি। তুমি যে আন্তরিক স্বরে কালোদের সঙ্গে কথা বলো, সাদাদের সঙ্গে একই স্বরে বলো। তুমি সাদা শরীর যেরকম হৃদয় দিয়ে স্পর্শ করো, কালো বা বাদামি শরীর একই ভাবে করো। সাদাদের বেশি আদর করার, বা তাদের বড় মনে করার কোনও রকম প্রবণতা তোমার মধ্যে দেখিনি। এত আধুনিক তো আমিও সামান্য হতে পারিনি মা।

একসময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সুয়েনসনের সঙ্গে কোনও কিছু নিয়ে কথা কাটাকাটি হওয়ায় সম্ভবত, যে, ওর গাড়ি আর ব্যবহার করবো না। এই সিদ্ধান্তটি তুমি থাকাকালীন ভয়াবহ শীতকালটায় না নিলেও পারতাম। তুমি চলে যাওয়ার পর সিদ্ধান্ত তো ঠিকই বদলেছিলাম। তোমাকে নিয়ে বাইরে বাজার করতে গিয়েছি বাসে চড়ে, পিচ্ছিল বরফে পায়ে হেঁটে। ওই জমে যাওয়া ঠাণ্ডায় বের করে করে তোমার নিউমোনিয়া বাধিয়ে ফেললাম। মা, খুব কষ্ট দিয়েছিলাম তোমাকে। আমি ট্যাক্সি নিতে পারতাম। কিন্তু নেবো কেন? তুমি সুইডেনে আসারপর হাড়কিপ্টের মতো হঠাৎ টাকার হিসেব করতে শুরু করেছিলাম মা। জানি না কেন, তুমি বলেই কী? আমি তো অঢেল টাকা পাঠাচ্ছিলাম অনেককে। কলকাতার এক বন্ধুকে গাড়ি কেনার টাকা, বাবাকেও গাড়ি কেনার টাকা, মাঝে মাঝে অকারণে টাকা, সুহৃদকে থিয়েটার, কনসার্ট ইত্যাদি দেখার জন্য, বড় বড় রেস্তোরাঁয় খাওয়ার জন্য, জমিয়ে কালচার করার জন্য টাকা। সুহৃদের টাকা পাঠাতাম ওয়ারেন নামে আমার এক আমেরিকার বন্ধুর কাছে। ওকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম সুহৃদকে মানুষ করার জন্য বা মস্ত একটা আঁতেল বানানোর জন্য।

.

আমাকে নিতে এসেছিলে, ফিরে গেছো একা। খালি হাতে। এ নিয়ে তোমার দুঃখ ছিল। আমার ছিল না। জাতিসংঘের পাসপোর্টে বাংলাদেশ যাওয়া যাবে না, এ কথা বলে তোমার সব ইচ্ছেকে দুমড়ে দিয়েছি। তুমি দেশে ফিরে গেলে। আমি রয়ে গেলাম, অন্যের বাড়িতে, অন্যের আশ্রয়ে, অন্যের আদেশ নিষেধ মেনে। অন্যের বাড়িতে বাড়ি ভাড়া দিতে হতো না, কিন্তু বাকি দায়িত্ব ছিল আমার। কেউ দেয়নি সে দায়িত্ব, নিজেই নিয়েছিলাম। বাড়ির জিনিসপত্র কেনা, ঘরে বাইরে খাওয়া দাওয়া, ঘোরাঘুরি, সব আমার টাকায়। মাঝে মাঝে ভাবি, যে টাকা খরচ হতো আমার, তা দিয়ে দিব্যি শহরে কোনও বাড়ি ভাড়া নিতে পারতাম, এবং নিজের মতো করে থাকতে পারতাম। কিন্তু মা, যে দেশের ভাষা জানি না, চেনা মানুষগুলো হাওয়া হয়ে গেছে, সরকারি শুভাকাঙ্ক্ষীগুলোও হাওয়া, তখন কেমন যেন ভয় হতো বিদেশ বিভুইএ একা বাস করতে। অবশ্য হাওয়া কি সত্যিই হয়েছিল? নিজ থেকে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করার আমার অভ্যেস ছিল না, ওরা যোগাযোগ করলে তবে যোগাযোগ হবে। ওরা না করলে? আগ বাড়িয়ে আজ অবধি কারও সঙ্গে যেচে কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভবহয় না। তুরস্কে তো তোমাকে যেতে দিল না। সুইডেনের কোথাও তোমাকে নিয়ে যাওয়া হয়নি। শুধু স্টকহোম শহরটা দেখেছে। ফিনল্যান্ডে নিয়ে যাবো তোমাকে, জাহাজে করে সারারাতে যাবো, সারাদিন হেলসিংকি শহরে ঘুরে ফিরে আসবোপরদিন, এই সিদ্ধান্ত নিলাম একদিন। তোমাকে নিয়ে যা কিছু করছি, রাজি তো তুমি হচ্ছই। যা কিছু করতে ইচ্ছে হয় করে যেন ফিরে যাই দেশে তোমার সঙ্গে, দেশে। ফিনল্যাণ্ডে যাওয়ার তিনটেটিকিট কাটলাম। সুয়েনসনকেও সঙ্গে নিয়েছিলাম। গাব্রিয়েলা নামের বিশাল জাহাজটি দেখে তোমার খুব ভালো লেগেছিলো। কিন্তু সকালে হেলসিংকিতে যখন থামলো জাহাজ, কী আশ্চর্য সবাই তরতর করে নেমে যাচ্ছে জাহাজ থেকে হেলসিংকি শহরে, শুধু আমার আর তোমার পাসপোর্ট দেখতে চাওয়া হল। জাহাজ ভর্তি লোক সবাই সাদা, শুধু আমার আর তোমার রংই অসাদা। সুয়েনসন পার হয়ে গেছে। আমিও জাতিসংঘের পাসপোর্ট দেখিয়ে পার পেয়ে গেলাম। কিন্তু তোমাকেই বাধা দেওয়া হল। তোমাকে স্পর্শ করতে দেওয়া হবে না ফিনল্যান্ডের মাটি। হায় মাটি, কত যে পবিত্র মাটি! তোমার মতো পাপী মানুষের পা সেখানে রাখতে দেওয়া যাবে না। পাপ করেছে গরিব দেশে জন্মে মা। সুয়েনসনকে বলেছিলাম, তুমি বলো যে তোমার সঙ্গে মাকে এনেছো। বললে, আমার বিশ্বাস ইমিগ্রেশনের লোকেরা তোমাকে শহর দেখতে যেতে দিত। তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছো, সুয়েনসন কিছু বলতে চায়নি। শত অনুরোধেও সে মুখ খোলেনি। এরা এমনই মা, ভেতরে ভেতরে সবাই বোধহয় বর্ণবাদী, শুধু বর্ণবাদীই নয়, ভীতু, হিংসুক, স্বার্থপর। অনেক তো দেখা হল, উদার মানুষ যে নেই তা নয়, প্রচুর আছে। আমার কপালেই শুধু জোটে এসব। আমি বেরোলাম জাহাজ থেকে, আর লোকটি হনহন করে চলে গেল আগে আগে। আমি তাকে পেছনে বারবার ডেকেও থামাতে পারিনি। দুপুরের জন্য কিছু খাবার কিনে, খাবার আর কী, কিছু স্যান্ডুইচ কিনে নিয়ে এলাম। হেলসিংকি শহরে আগে আমি এসেছি। সরকারি আমন্ত্রণে, লেখকদের আমন্ত্রণেও। একা একা দেখা শহর আবার নতুন করে দেখার কোনও ইচ্ছে আমার ছিল না। খুব ক্ষিধে পেয়েছিলো তোমার। বসে থেকেছো নতুন একটি দেশের নদীর কিনারে। জাহাজের ছোট ঘরে। কিছুই তোমার দেখা হয়নি। রাতে তোমাকে খেতে নেবো জাহাজের রেস্টুরেন্টে, অপেক্ষা করছি সুয়েনসনের। সুয়েনসন উদয় হল, তাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে গেলাম। চক্ষুলজ্জা নেই লোকটির, আমার টাকায় জাহাজে এলো, আমার টাকায় দিব্যি খেলো, যত দামি খাবার মন চায়, খেলো। সারাদিনের জন্য যে হাওয়া হয়ে গিয়েছিলো আমাদের একা ফেলে, একটুও কিন্তু অনুতাপ করলো না। তুমি উদার, তোমার উদারতা আমার রক্তে। কিন্তু সুয়েনসনের মতো লোক উদারতার বিন্দুমাত্র পায়নি কোথাও থেকে। এভাবেই তুমি আর আমি মানুষকে উজাড় করে দিয়ে যাই। আমি পৃথিবীর আর সবার প্রতি উদার হলেও তোমার প্রতি নই। আর তুমি কী না বলো আমি তোমাকে ভালোবেসেছি! জাহাজেও তুমি খেতেপারছিলে না। বমিভাব ছিল। বমি হয়তো করেওছিলো কিছু খেতে গেলেই বলতে একেবারে গলা পর্যন্ত ভরে আছে, ক্ষিধে নেই। আমার কি একবারও সন্দেহ হতো, যে তোমার পেটে হয়তো সত্যিই কোনও অসুখ আছে! না, মা, হতো না।

.

মা, তুমি আমার কাছে তোমার অসুখের চিকিৎসা করাতে এসেছিলে। অসহায় চোখে তাকিয়েছিলে যেন চিকিৎসা করি। ভিক্ষে চাইছিলে। চিকিৎসা ভিক্ষে চাইছিলে আমার কাছে, মা। যেন সুস্থ করে তুলি তোমাকে। না মা, তোমাকে আমি কিছুই করিনি। আমাকে আর কোনও বিরক্তি দিতে তুমি চাওনি। আর কোনও অসুবিধে, অশান্তি দিতে তুমি চাওনি। বুঝেছো যে অসুখ নিয়েই তোমাকে চলে যেতে হচ্ছে। তিনমাস আমার কাছে থেকেও, আমাকে বারবার অসুখের কথা বলেও দেখেছো কোনও লাভ হয়নি। আমি তোমার অসুখের কোনও উপসর্গকে কোনও উপসর্গ বলেই মনে করিনি। দেখলে আমি আমার লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত। দেশ ছাড়ার পর লিখিনি কিছু, বসে বসে সময় কাটিয়েছি, আর যেই না তুমি এলে, দিন রাত লেখা নিয়ে পড়ে থেকেছি। তুমি দেখলে আমার অন্যরকম বিদেশি জীবন নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত আমি। আমার ব্যস্ততায় তুমি ব্যাঘাত ঘটাতে চাওনি। চলে গেলে। যেতে বাধ্য হলে। কী করবে? আমি তো তোমাকে জানিয়ে দিয়েছি তোমার কোনও অসুখ নেই। তুমি দিব্যি সুস্থ। বড় বড় ডাক্তাররা দেখেছে তোমাকে। তোমার মতো ভাগ্য কজনের আছে! তুমি কি এই ভেবেও চলে গিয়েছিলে মা যে তোমার হয়তো সময় আর বেশিদিন নেই! হয়তো চিকিৎসা করাতেও আসেনি। তুমি বুঝতে পেরেছিলে তোমার ভেতরের ভীষণ অসুখটি তোমাকে বাঁচতে দেবে না, তাই তুমি আমাকে শেষ দেখা দেখতে এসেছিলে। আমাকে নিয়ে দেশে ফেরত যেতে চেয়েছিলে। যেন আমি ক্ষমা চেয়ে হলেও দেশে ফিরতে পারি। তুমি সবকিছুতে ব্যর্থ হলে।

মা তোমার তো কোনও শৈশব ছিলো না, কোনও কৈশোর ছিলো না। যখন বলতে, ক্লাস ফোরে যখন পড়ো, বিয়ে হয়ে গেছে, আমি সারাজীবন একবারও ভাবিনি তোমার ওই ন দশ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে। ভাবতাম, তুমি বোধহয় খারাপ ছাত্রী ছিলে, কুড়ি বছর বয়সে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়েছে। বিয়ের পর ওই শিশু বয়সে তোমার ওপর শারীরিক কষ্ট গেছে। নিজে শিশু হয়ে শিশু জন্ম দিয়েছো। অভাবে অনাহারে কাটিয়েছে। স্বামী ডাক্তারি পড়ছে। তোমার বাবার দয়া দাক্ষিণ্যে তুমি বাঁচছো। শিশুর কোলে শিশু। যৌবনে পৌঁছেলে যখন, দেখলে স্বামী আসক্ত অন্য রমণীতে। কোনওদিন তোমার ভালোবাসা কী জিনিস জানা হয়নি। তোমার জীবনের কথা ভাবলে আমি কেমন শিউরে উঠি আজকাল। চারদিকে তাকিয়ে দেখি তোমার মতো অসহায়, তোমার মতো দুর্ভাগা আর দ্বিতীয় একটি মানুষ পৃথিবীতে আছে কী না। নেই মা। বস্তিতে বাস করা মেয়েগুলোও তোমার চেয়ে অনেক সুখী। তারাও কারও না কারও ভালোবাসা পায়, আদর পায়। ঘুঁটে কুড়োনি মেয়েরাও আমোদ আহ্লাদ করে। ইট ভাঙার কাজ করে যে মেয়েরা, তারাও নিজেরপয়সায় নিজের যা খুশি তাই করার সুযোগপায়। ভিখিরি মেয়েরাও তোমার মতো অসহায় নয়।

তুমি চলে যাওয়ার পর বেশিদিন থাকিনি সুইডেনে। নিউইয়র্কে গিয়ে ইয়াসমিন যে দালানে থাকে সেই দালানেরই সাত তলায় একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিলাম। গীতা আমাকে অনুরোধ করছিল অনেকদিন থেকেই, সেই সুইডেনে থাকাকালীনই, যেন সুহৃদকে নিয়ে যাই আমার কাছে। গীতা নাকি আর পারছে না ওকে রাখতে, ভাবতে পারো মা, যে সুহৃদকে কোনওদিন আমাদের কাছে আসতে দিত না, এখন সে স্বেচ্ছায় ওকে দিয়ে দিতে চাইছে, যেন নিয়ে যাই, যেখানে খুশি সেখানে। সুহৃদ থাকতে শুরু করলো আমার সঙ্গে। ওর জন্য জীবন প্রায় উৎসর্গ করলাম। সেই ছোট্ট সুহৃদ পাঁচ/ছ বছর বয়স অবদি অবকাশে বড় হয়েছে। তারপর তো ওকে ছিনিয়ে নিয়েছিলো ওর বাবা মা। কিন্তু বুঝি যে সুহৃদ এর মধ্যে অনেকটাই পাল্টে গেছে। পনেরো বছর বয়স, ভালো শিক্ষা পায়নি বলে বেয়াড়া, বেপরোয়া, বেয়াদপ হয়ে বেড়ে উঠেছে। আমার কাছে আছে বটে সুহৃদ, কিন্তু আমার কোনও উপদেশ শোনার তার কোনও ইচ্ছে নেই। বুঝি যে, সময় অনেকটাই চলে গেছে। সুহৃদ যদি তার বাবার কাছে বাংলাদেশে থাকে, তবেই হয়তো পড়াশোনা করে বড় হতে পারবে। পড়ার কোনও ইচ্ছে আমি দেখি না সুহৃদের আছে। আসলে আমি হয়তো তাকে আগের মতোই দেখতে চেয়েছিলাম। অবকাশের সেই সুহৃদকে চেয়েছিলাম দেখতে। ইওরোপে ছিলাম, কিন্তু যখনই আমেরিকায় এসেছি সুহৃদকে নিয়ে ওয়াশিংটন ডিসি, ম্যারিল্যান্ড, পেনসিলভেনিয়া, বাফেলো, নায়াগ্রা, ফ্লোরিডায় বেড়াতে নিয়ে গিয়েছি। ডিসনি ওয়ার্ল্ড, স্মিথসোনিয়াম, হেরিটেজ মিউজিয়াম, মেট্রোপলিটন, মডার্ন আর্ট মিউজিয়াম, সব দেখিয়েছি, ছেলেটার যেন মন ভালো থাকে, যেন জ্ঞান বিজ্ঞানে আকর্ষণ বাড়ে। ছোটদাকে বলি সুহৃদকে বাংলাদেশে নিয়ে নিজের কাছে রাখতে। ইয়াসমিন ছোটখাটো একটা কাজ করে, বড় কাজ আর ভালো কাজ করতে বারবার বলেও কোনও কাজ হয় না, ওর আত্মবিশ্বাস শূন্যতে এসে দাঁড়িয়েছে। ওর নিজের ওপর সামান্যও আর বিশ্বাস নেই। ভালোবাসাকে ছেড়ে দূরে কোথাও যাবে না। ঘরের কাছে ছোট কাজ, ছোট কাজ করেই ওর স্বস্তি। ভালোবাসাকে ইস্কুলে দিয়ে আসে, ইস্কুল থেকে নিয়ে আসে। রান্নাবান্না করে, ঘরে থাকে। আমার সঙ্গে যেরকম দেখা হবে ভেবেছিলাম, হয় না। ও কদাচিৎ আমার কাছে বেড়াতে আসার মতো আসে। কেন ঠিক এরকমটি হয়, জানি না। ওর অ্যাপার্টমেন্টে বাড়তি ঘর নেই বলে আমাকে ভাড়া নিতে হলো নতুন অ্যাপার্টমেন্ট। একটা সংসারে যা যা থাকা দরকার সব কিনে নিলাম। বিছানা, সোফা, ডাইনিং টেবিল, ডেস্ক, বুকশেল্ফ, চেয়ার, কমপিউটার, আলমারি, রান্না ঘরের ক থেকে চন্দ্রবিন্দু। জীবনে যে কতবার সংসার সাজাতে হল মা! বিদেশ বিভুইয়ে দুটো মাত্র বোন দেশ ছেড়ে, নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পড়ে আছে, সেখানেও আলাদা থাকতে হয়! কী জানি, জানি না, কষ্ট কেন হয়। বুঝি যে ইয়াসমিন আমার মতো একা থাকেনা। একটা সংসার আছে ওর। কিন্তু ওর স্বামী সন্তান নিয়েই তো ঢাকায় আমার কাছে থাকতো। বিদেশ কি তবে আমাদের সবাইকে আলাদা করে দিল! দেশের আত্মীয়দের থেকে আলাদা, এমন কী বিদেশেও পরস্পর থেকে আলাদা, নিজেদের মধ্যেও দাঁড়িয়ে গেছে শক্ত দেয়াল। কে এই দেয়াল দাঁড় করায়, সময় নাকি অন্য কিছু! এই ব্যবধান, এই বিচ্ছেদ, এই বাধা, এই বিদেশ আমার মানতে ইচ্ছে করে না। মাঝে মাঝে চিৎকার করে মনে হয় কাঁদি। ভালো যে আমি কোনও পুরুষের সঙ্গে সংসার পাতিনি, তাহলে বোধহয় আমিও আর সবার মতো বৈষয়িক হয়ে যেতাম। আমার জগৎ সংসার ওই চার দেয়ালের মধ্যেই খাবি খেতো। তুমি থাকাকালীন কিছু না এলেও তুমি দেশে ফিরে যাওয়ার পর পরই আমার আমন্ত্রণ আসাও শুরু হলো বিভিন্ন দেশ থেকে। নিউইয়র্ক থেকেইতালি যাচ্ছি, স্পেন যাচ্ছি, ফ্রান্স যাচ্ছি, অস্ট্রিয়া যাচ্ছি, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। যেদিন অস্ট্রিয়া থেকে নিউইয়র্ক ফিরে এলাম, সেদিন ফোন এলো ঢাকা থেকে। ছোটদা বললো, তুমি নাকি কিছু আর খেতে পাচ্ছিলে না, কিছু মুখে নিলেই বমি হয়ে যাচ্ছিল। ডাক্তার দেখিয়েছে, ডাক্তার বলেছে কোলোনোস্কোপি করতে। কোলোনোস্কপি করারপর খুব বড় টিউমার পাওয়া গেছে পেটে। বায়োপসির রেজাল্টও এসে গেছে। আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল, শুধু জিজ্ঞেস করলাম, ডায়াগনসিস কী লিখেছে? ছোটদা অসুখের নাম বললো, কোলনকারসিনোমা। তার মানে? তার মানে তোমার ক্যানসার হয়েছেমা। ক্যানসার। শুনে বিশ্বাস করো, দুনিয়া দুলতে শুরু করলো আমার সামনে। সারা জীবনে কি এর চেয়ে বড় কোনও দুঃসংবাদ আমি শুনেছিনাকি শুনবো! এই ক্যানসার নিয়েই তুমি আমার কাছে এসেছিলে মা, এই ক্যানসারকেই তুমি বলেছিলে খুব বড় এক অসুখ, ঠিক যে জায়গাটায় ক্যানসার, পেটের সে জায়গাটা তুমি আমাকে অনেক অনেক বার দেখিয়েছে, আমি তোমাকে বলেছি ও কিছুনা, বার বার বলেছিও কিছুনা, একটু বোধহয় তোমার খাদ্যনালীর চামড়ায় কিছুর ঘসা টসা লেগেছে, তাই ব্যথা। নিজের মেয়ে বলেছে তোমাকে। যে মেয়েকে আদর যত্ন করেছে ডাক্তারি যখন পড়েছে, বছরের পর বছর তার আদেশ আবদার সব মেনেছো, আদরে ভরিয়ে রেখেছো। তুমি বুঝতে পারছো, তোমার বড় কোনও অসুখ হয়েছে, তোমার আদরের ডাক্তার মেয়ে তা বোঝেনি। এতদিন থেকেছিলে আমার কাছে, আমি তোমাকে বুঝতে চেষ্টা করিনি। চেষ্টা করিনি বলে আমাকে একটুও চাপ দাওনি চেষ্টা করার জন্য। বাবা তোমাকে কোনও টাকা পয়সা দেয় না, দাদার দেবার তো প্রশ্ন ওঠে না, ছোটদা তো নেবে আরও, দেবে কী, যাদের ভূরি ভূরি আছে তাদেরই যখন আমি ঢেলে দিচ্ছি, তখন তোমাকে শূন্য হাতে ফেরত পাঠালাম। দেশে ফিরে তোমার সেই সমস্যাগুলো ক্রমশ বাড়ছিল মা। পরে সব জেনেছি যে বাড়ছিলো। তুমি ঢাকায় একা, তুমি অসুস্থ, তুমি খেতে পারছে না, যদিখাও কিছু, বমি হয়ে যাচ্ছে। ওইশরীর নিয়েই তুমি ময়মনসিংহে গেলে বাসে। এই বাসে করেই তো তুমি বাবার কাছ থেকে চাল ডাল তেল নুন নিয়ে ঢাকা এসেছে। অসুখ শরীরেও এসব তোমাকে করতে হয়েছে। ছোটদাকে রান্না করে খাওয়াবে। তুমি তার দায়িত্ব না নিলে নেবে কে? যখন আর পারছে না, হাতে কোনও টাকা নেই ঢাকায় কোনও ডাক্তার দেখানোর, তুমি ময়মনসিংহে গিয়ে বাবাকে বললে অসুখের কথা। কিছু খেলেই বমি হচ্ছে, পেট ফুলে আছে, ব্যথা হচ্ছে প্রচণ্ড। শুনে বাবা কটমট করে তোমার দিকে তাকালো। চেম্বার থেকে, যে চেম্বারে বসে রোগী দেখছিল, তোমাকেদূরদূর করে তাড়ালো। জ্বর কফ কাশির রোগীদের যত্ন করে দেখলো, তোমাকে দেখলো না। কেন ময়মনসিংহে এসেছো, ঢাকায় ছোটদার খাওয়া দাওয়ার অসুবিধে করে তোমাকে কে আসতে বলেছে ময়মনসিংহে, প্রচণ্ড গালাগালি খেলে তুমি। তোমার এই অসুখটসুখের কথা শুনতে ইচ্ছে করে না তার। বাবা বাড়ি ফিরলেও বারবার বলেছো, তোমার পেটের ভেতর কিছু একটা ভয়ংকর লুকিয়ে আছে। তাতে বাবার কী আসে যায়! বাবা জিজ্ঞেস করছিল, আমার কাছ থেকে কত টাকা এনেছো। তুমি যতবারই বলেছে যে আমি তোমাকে কোনও টাকা দিইনি, বাবা বিশ্বাস করছিল না, ভেবেছিলো তুমি মিথ্যে বলছে, বলেছে নাক মুখ খিঁচিয়ে যে তুমি মিথ্যে বলছে, প্রচুর টাকা নাকি আমি দিয়েছি। আল্লাহর কসম কেটে বলেছে, কোরান ছুঁয়ে বলেছে, কেঁদে কেঁদে প্রায় পায়ে পড়ে বলেছো যে না তোমার কাছে কোনও টাকা নেই, আমি তোমাকে একটি পয়সাও দিইনি। বাবার কী খুব হিংসে হচ্ছিল, রাগ হচ্ছিল! তোমার হাতে টাকা পয়সা থাকুক, তুমি স্বস্তিতে শান্তিতে থাকো, তা কি বাবা কোনওদিন চেয়েছিলো? না, বাবা তোমার কান্নাকে মোটেও কান্না বলে মনে করেনি। তুমি নানিবাড়িতে যাবে, রিক্সায় চড়তে পারো না, রিক্সার ঝাঁকুনিতে তোমার পেটে ভীষণ ব্যথা হয়। দাদাকে অনুরোধ করলে তার গাড়িটা দিয়ে একটু নানিবাড়িতে পৌঁছে দিতে। দাদা সোজা না করে দিল। তোমার অসুখ, তোমার পেটে কোনও কিছু এমনকী জল অবদি থাকছে না, পেটে প্রচণ্ড ব্যথা, তাতে দাদার কিছু যায় আসে না। যতরকম টিপ্পনি আছে, সব কাটলো দাদা। অপমান যতভাবে করা যায় করলো। গাড়ি দিল না তোমাকে। তুমি রিক্সা নিয়েই নানিবাড়ি গেলে। যখন ঝাঁকুনি খাচ্ছিল রিক্সা, তুমি সিট থেকে শরীরটাকে উঠিয়ে রাখলে, ভয়ংকর ব্যথা থেকে বাঁচতে। নানিবাড়িতে তো আর কোনও ডাক্তার নেই। কিন্তু বাড়ির সামনে সুলেখাদের বাড়ি। সুলেখার ছোট ভাই জাহাঙ্গীর ডাক্তারি পড়েছে। সে তো অন্তত বিনে পয়সায় তোমাকে দেখে দেবে। তোমার অসুখটা অন্তত বুঝতে পারবে। মা, তোমার নিজের মেয়ে তোমাকে দেখলো না, তোমার স্বামী দেখলো না, তোমার ছেলেরা দেখলো না। অনাত্মীয় একজন দেখলো। পাশের বাড়ির কেউ দেখলো। জাহাঙ্গীর বললো পেটের একটা এক্সরে করতে। এক্সরে করার টাকা কোথায় পাবে তুমি? কে দেবে টাকা! বাবাকে দাদাকে দুজনকেই বললে, এক্সরে করতে হবে। বাবা তো জাহাঙ্গীরকে অসুখ দেখিয়েছো শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। তোমাকে প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়ে অবকাশ থেকে তাড়ায়। অসুখ নিয়ে তোমার বাড়াবাড়ি যে সীমা ছাড়িয়ে গেছে তাই বললো বাবা। এক্সরে করতে হবে! ’দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বাবা তোমারপণ্ডিতিকে ব্যঙ্গ করলো। তুমি যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে সব শুনলে মা। এক্সরে করতে অনেক টাকা লাগে। ছটকুর কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করে গেলে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ, যে কলেজের অধ্যাপক ছিল তোমার স্বামী, যে কলেজ থেকে পাশ করেছে তোমার মেয়ে, সেই কলেজের হাসপাতালের এমারজেন্সিতে। হাসপাতালে আর সব দরিদ্র রোগীদের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে তুমি পেটের এক্সরে করালে মা। না, এতে তোমার কোনও গ্লানি হয়নি। দরিদ্রদের তুমি কখনও হেলা করোনি। তোমার তো ওদের সঙ্গেই ছিল বেশি ওঠাবসা। এক্সরে বাবাকে দেখাতে গেলে, বাবা দেখলোও না। অন্য কোনও ডাক্তারকে যে এক্সরে দেখাবে, সে টাকা তোমার ছিল না। ছটকুর কাছে লজ্জায় আরও টাকা চাইতে পারোনি। বাড়ির ডাবগাছগুলো থেকে ডাবনারকেল পাড়িয়ে বিক্রি করে দুশ তিনশ টাকা হতো তোমার। সেটাও তো হাতছাড়া হয়ে গেলো। ঢাকা থেকে এসে অবকাশের ডাবওয়ালাকে ডেকে পাঠাতে গিয়ে দেখলে দাদার বউ সব বিক্রি করে দিয়েছে। সে-ই টাকা নিয়ে বসে আছে। সামান্য যে অধিকারটুকু ছিল তোমার অবকাশে, সেটুকুও হাসিনা ছিনিয়ে নিলো। তুমি ফিরে এলে ঢাকায়। শয্যা নিলে। তোমাকে সুস্থ করার কেউ নেই। টয়লেট ভরে রক্ত, বেসিন ভরে বমি –এই চলছে। আর চলছে তোমার কান্না, তোমার অসহায়তা, তোমার ভয়াবহ একাকীত্ব। ছোটদা বিমানের বিদেশ ডিউটি করে এসে একদিন বাড়ির কাছের এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। ছোটদাই শেষ অবধি তোমার সহায় হল। তোমার প্রচণ্ড অসুস্থ শরীরটাকে কোনওভাবে নিয়ে ফেললো ডাক্তারের চেম্বারে। ওই ডাক্তারই পরীক্ষা করে বলে দিল, ক্যানসার। বারডেমে তোমার অপারেশন হবে। এসবের তো আমি কিছুই জানতাম না মা। পরে শুনেছি। তুমিই বলেছো অসুখ ধরা পড়ার আগে তোমার দুঃসহ দিনগুলোর কথা। বাবা আর দাদার দুর্ব্যবহারের কথা। আমি তো তোমাকে কোনও করিনি। তুমি দেশে ফিরে যাওয়ারপর তোমার ব্যাংকে সরাসরি টাকা পাঠিয়ে দেওয়ার যে কথা ছিল, সেটা পাঠালে তোমাকে তো বাবা আর দাদার কাছ থেকে চিকিৎসা ভিক্ষে করতে হত না, এক্সরে করার জন্য হাত পাততে হত না, নিজেই ডাক্তার দেখাতে পারতে। তোমাকে আমার চেয়ে বেশি আর কে ঠকিয়েছে মা? কেউ না। কেন আমাকে সব বুঝেও ক্ষমা করে দিয়েছিলে মা? আর যাকেই ক্ষমা করো, আমাকে করো না মা। আমি তো নিজেকে ক্ষমা করিনি। আজও করিনি। কোনওদিন করবো না। মা, তোমার অসুখের নামটা জানারপর তুমি যদি দেখতে কীভাবে স্তব্ধ হয়ে বসে থেকেছি, অনুশোচনার আগুনে কী করেপুড়েছি, কীভাবে কেঁদেছি দিনের পর দিন! মা, তোমার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে গিয়েও চিৎকার করে কেঁদেছিমা। অপরাধবোধে সেই যে ভুগতে শুরু করেছি, আজও ভুগছি। কী রকম যেন শকুনে খেয়ে যাওয়া কিছুর মতো মনে হয়, যেন বধ্যভূমিতে পড়ে আছি কোনও খুলি, কোনও পাঁজর। বারডেম হাসপাতালের ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জরুরি অপারেশন করতে হবে। তোমার নিশ্চয়ই তখন ভালো লাগছিলো এই ভেবে যে, শেষ অবধি চিকিৎসা হচ্ছে। যে রোগের চিকিৎসা তোমার সতেরো বছর ধরে হয়নি, সেটির চিকিৎসা শেষপর্যন্ত হচ্ছে তোমার। হাসপাতালে তখন দাদাও এলো, বাবাও এলো। চারদিকে যত স্বজন আছে, সবাই এলো। তখন সবাই তোমার সেবায় নিয়োজিত। সেবা কিন্তু কোনও টাকা পয়সা দিয়ে সেবা নয়। চিকিৎসার খাতে যা খরচ হয়, সব আমিই দেব, টাকা পয়সার জন্য যেন কোনও কিছু আটকে না থাকে, তা বারবারই বাবা, দাদা, ছোটদা সবাইকে বলে দিয়েছিলাম। তোমাকে জানানো হয়নি কী অসুখ তোমার হয়েছে। শুধু বলা হয়েছে পেটে তোমার টিউমার হয়েছে। ফোনে আমাকে বলছিলে, মাগো, তোমাকে তো বলেছিলাম, বলেছিলাম না পেটে আমার ব্যথা হয়, আর ডাক্তার যখন পেটে চাপ দিয়েছিলে, আমি উ করে উঠেছিলাম ব্যথায়। তোমার মনে আছে? মনে আমার থাকবে না কেন মা? মনে না থাকার কোনও তো কারণ নেই। এই নিয়েই তো কত অশ্রদ্ধা করেছি তোমাকে, ভেবেছি বানিয়ে বানিয়ে অসুখের গল্প করছো। বলেছি ওইসব ফালতু ব্যথা ট্যাথার কথা ভুলে ডায়বেটিস নিয়ে ভাবো, ওটিই আসল রোগ। তুমি কী কম দীর্ঘশ্বাস ফেলেছো! সব দীর্ঘশ্বাস এখন আমি ফেলছি মা। যে তুমি ভিখিরির মত নিঃসঙ্গ ছিলে, তোমার ভয়ংকর অসুখটিকে শুধু সঙ্গী করে, সেই তুমি আর একা নও। এখন তোমাকে দিব্যি ঘিরে আছে তোমার আত্মীয় স্বজন। এতকাল একা একা ভুগেছো, এখন তোমারপাশেপরিবারের সবাই এসে দাঁড়িয়েছে।

যারা তোমার কিচ্ছুহয়নি, কোনও অসুখ হয়নি বলে অবজ্ঞা করেছে, তুমি নাকি বানিয়ে অভিযোগ করছে বলে অভিযোগ করেছে, তারা আজ সবাই স্বীকার করছে যে তোমার এমন এক বড় অসুখ হয়েছে, যে অসুখে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে, এমনকী অপারেশন করতে হবে। হাসপাতালে তোমার অপারেশন হচ্ছে, দাদা অপরাশেন থিয়েটারের বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো, ছোটদা রইলো, বাবা রইলো। বাবাও নাকি খুব চুকচুক করে দুঃখ করেছে, বাবাও নাকি মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিল। ফোনে বাবাকে আমি খুব দোষ দিয়েছি, তুমি এত কাঁদারপরও বাবা তোমার অসুখ সারায়নি বলে। যে ডাক্তার শহরের নামকরা ডাক্তার, অন্য ডাক্তাররা রোগ ধরতে না পারলে যে ডাক্তার যে কোনও রোগ ধরতে পারে, সেই ডাক্তার বাবাকে আমি ধিক্কার দিই। বাবা বারে বারেই বললো, আমি তো বুঝতে পারিনি। আমাকেও একবার বললো, তোমার কাছে তো কয়েক মাস ছিলো, তুমি কেন চিকিৎসা করালে না? ’ এর কী উত্তরই বা আমি দেব! আমার কি কোনও ভাষা আছে কিছু বলার? মুখ দেখানোর মুখ কি আছে? আর যার যে প্রশ্নেরই যে উত্তর দিই না কেন, এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারি না। তোমার কাছে কত বড় অপরাধী হিসেবে আমি যে দাঁড়ালাম, তা এক আমিই জানি। তোমার সঙ্গে যখন ফোনে কথা বলছিলাম, তোমার কণ্ঠস্বর কী যে শিশুর মতো শোনাচ্ছিল। তুমি জানছো যে তোমার পেটে টিউমার হয়েছে, অপারেশন করে সেই টিউমার ফেলে দিলেই তুমি আবার আগের মতো ভালো হয়ে উঠবে। তোমার এই জানাটা যে সত্য নয়, তা এক আমি জানি, আর বাবা জানে। পাইলস পাইলস করে সতেরো বছর চিকিৎসার জন্য কেঁদেছো। সতেরো বছর পর প্রথম তুমি চিকিৎসা পেয়ে এখন সুস্থ হয়ে উঠবে, তুমি তো খুশি হবেই। তোমার আনন্দই তো স্থবির দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হবে আমাদের।

মা, তখন আমি তোমার কাছে প্রাণপণে যেতে চাইছি। কিন্তু আর যেকেউ যেতে পারলেও আমার যাওয়া সম্ভব নয়। প্রতিদিন ছটফট করছি। বারবার ফোন করছি। চার বছরে যে ফোন করিনি, চারদিনে তার চেয়ে বেশি করছি। অপরাধবোধ? হ্যাঁ নিশ্চিতই মা, অপরাধবোধ। এর চেয়ে বড় অপরাধ কি কেউ করে জীবনে! আমি টুকরো টুকরো হয়ে গেলাম গ্লানিতে। শত ধিক দিলাম নিজেকে। ভেসে গেলাম অনুতাপে, অনুশোচনায়, ডুবে রইলাম লজ্জায়, ঘৃণায়। নিজের ওপর ঘৃণা মা। অপারেশন যে ডাক্তার করবেন, তাঁর ফোন নম্বর দাদার কাছ থেকে নিয়ে ফোনে অনেকবারই তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি। কী মনে হচ্ছে, সাদাসিধে কোনও টিউমার কি হতে পারে না? ডাক্তার বললেন কোলোনোস্কপি করে তা মনে হচ্ছে না। টিউমার সাদাসিধে হোক, অপারেশনের পর তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো, আমি প্রাণপণে আশা করতে থাকি। আমার তো কোনও ঈশ্বর নেই প্রার্থনা করার মা। আমি এই নিষ্ঠুর প্রকৃতির কাছেই তোমার প্রাণভিক্ষা চাই। তোমার সততা, তোমার পবিত্রতা, তোমার অকৃত্রিমতাকে ঈশ্বর মেনে তার কাছে প্রার্থনা করি তোমার সুস্থ। সারাজীবন যে যন্ত্রণা পেয়েছে, যে কষ্ট তোমাকে কামড়ে খেয়েছে, সেই তোমাকে একটু আনন্দ দিতে আমি মরিয়া হয়ে উঠি। অসুখ তোমার কেউ সারায়নি বলে আশা ছেড়ে দিয়েছিলে। আমাকে শেষ দেখা দেখতে এসেছিলে মা, যে করেই হোক এসেছিলে। বাবা মা দুজনের জন্য ভিসার ব্যবস্থা করেছিলাম। বাবাকে না নিয়ে একা এসেছো বলে তোমাকে অপমান করেছি। বাবা যে নিজেই আসতে চায়নি, সে কথা আমাকে বলেছো, বলেছে যে বাবা ভালো আছে, তারপরও আমি বিশ্বাস করিনি যে বাবা ভালো আছে। তুমি ভালো আছো, বাবা ভালো নেই, এই বিশ্বাস নিয়েই ছিলাম আমি। আমার বিশ্বাস থেকে কেউ আমাকে নড়াতে পারেনি। সেই মিথ্যে জগৎ আমার ভেঙে চুর্ণ হয়ে গেল। কী বলে সান্ত্বনা দেব আমি আমাকে!

জীবনে প্রথম কোনও অপারেশন তোমার। ছোটদা তার এক বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার করে চিকিৎসার খরচ দিচ্ছে, তাকে বলা আছে সব খরচ আমি মেটাবো। তুমি তো জানো সব। তোমার কি একবারও রাগ হয়নি, চিকিৎসার খরচ কেন বাবা দেবে না? বাবা এসেছে ঢাকায় অসুস্থ তোমার পাশে থাকতে, এটাই তোমাকে সব ভুলিয়ে দিয়েছে। বাবার মতো মানুষের এইটুকু ভালোবাসা পেয়েই বোধহয় ধন্য হলে। এত ক্ষমা জানি না কেমন করে করতে পারো তুমি।

অপারেশন যেদিন হচ্ছে, সেদিন আমি দিন রাত ফোন করছিলাম মা। দাদা, ছোটদা, বাবা সবার কাছ থেকে জানতে চাইছিলাম কী ঘটছে। এমনকী সার্জনের সঙ্গেও কথা বলেছিলাম। অপারেশন করে টিউমার বার করে তারপর বায়োপসি করতে হবে। যদি ওই টিউমারটি সাদাসিধে না হয়ে ম্যালিগনেন্ট হয়, যদি কারসিনোমাই হয়, বা ক্যানসারই হয়, তবে মেটাসটাসিস হয়নি তো! সাধারণত কোলন থেকে লিভারে মেটাসটাসিস হয়। লিভারের সবপরীক্ষা করানো হয়েছে। ডাক্তার বলে দিলেন, একেবারে পারফেক্ট আছে লিভার। কিডনি, হার্ট সব ঠিক আছে। কোথাও কোনও সমস্যা নেই। ডাক্তারের কথা সমুদ্রে ডুবে যেতে থাকা মানুষের জন্য খড়কুটোর মতো। রক্তপরীক্ষায় দেখা গেছে তোমার ওই এক কোলন ছাড়া শরীরের কোথাও কোনও অসুখ নেই। ডাক্তার বললেন, এই ক্ষেত্রে একটা র‍্যাডিক্যাল সার্জারি করতে হবে। অসুস্থ কোলনের আশেপাশে যা কিছু আছে, সব কেটে বাদ দিতে হবে। যখন তোমার অপারেশন হচ্ছিল, মামা খালারাও এসেছিলো। তোমার রক্তের দরকার হবে, ছটকু, শরাফ মামা সব দাঁড়িয়ে ছিল তোমাকে রক্ত দেওয়ার জন্য। তুমি দেখতে পাচ্ছো তোমার অনেক আত্মীয়কে। এত আদর করে তোমার সঙ্গে বোধহয় আগে কেউ কথা বলেনি। অপারেশন হল সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে। আমি ফোন নিয়ে বসে আছি। অপেক্ষা করছি অপারেশন কেমন হলো, টিউমারের আকার আকৃতি চরিত্র স্বভাব কেমন, সেইসব খবর শোনার জন্য। কী যে অস্থির সেই অপেক্ষা। পায়চারি করছি ঘরময়। জল খাচ্ছি ঘনঘন, চোখের জল মুছছি ঘনঘন। শেষ পর্যন্ত ডাক্তার জানালেন খবর। আমি বাকরুদ্ধ বসে রইলাম সে খবর পেয়ে। অবিরল চোখের ধারাকে আমি বন্ধ করতে পারছিলাম না। ডাক্তার জানালেন, সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে তোমার যা কিছু আছে পেটে সব কেটে বাদ দিয়ে, ক্ষুদ্রান্ত্রের, বৃহদন্ত্রের প্রায় সব ফেলে দিয়ে শুধু পাকস্থলির সঙ্গে সামান্য বৃহদন্ত্র জোড়া লাগিয়ে দিয়েছে। লিম্ফ নোড টোড সব ফেলে দিয়েছে। আশেপাশে যা থাকে, সব সাফ করার পর পেট সেলাই করার আগে লিভারটা হাত দিয়ে পরখ করেছে, দেখেছে তিনটেনড়ল। তার মানে লিভারে ধরে গেছে ক্যানসার। লিভারে যদি ধরেই যায়, তখন এভাবে সব ফেলে অপারেশন করতে হয় না। তখন খুব দ্রুত শুধু অন্ত্রের টিউমারটা বের করে পেট সেলাই করে দিতে হয়। দীর্ঘক্ষণ অপারেশন করা মানে, রক্ত দেওয়া মানে ক্যানসারকে সারা শরীরে ছড়িয়ে দেওয়া। ডাক্তাররা তাই করেছেন বাংলাদেশে। তোমাকে বাঁচানোর বদলে তোমাকে মেরেছেন। সবার শেষে নয়, পেট খুলেই অপারেশন শুরু করার আগে তাঁদের উচিত ছিল তোমার লিভার পরীক্ষা করে দেখা। তাই দেখেন যে কোনও অভিজ্ঞ ডাক্তার। কিন্তু ওঁরা ল্যাবরটরির লিভার পরীক্ষার ফলের ওপর ভরসা করে তোমার লিভারটা ওই বিরাট অপারেশন শুরু করার আগে পরখ করে নেননি। ওঁদের লিভার টেস্ট ভুল রিপোর্ট দিয়েছে মা। তুমি তো শুয়ে আছো, তুমি তো জানো তোমার এতদিনে চিকিৎসা হল, তুমি সুস্থ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কী যে ভয়ংকর ভুল চিকিৎসা হল তোমার, তুমি জানো না। তুমি জানো না তোমার ক্যানসার হয়েছে। জানো তোমার ওই অসুখটা সারার সব ব্যবস্থা করা। হচ্ছে। রক্ত দেওয়া হচ্ছে। ইন্টারনেট ঘেঁটে মেডিক্যাল জার্নাল যোগাড় করে তোমার অসুখ নিয়ে যত তথ্য আছে, সবপড়েছি। ভুলে যাওয়া ডাক্তারি বিদ্যেকে আবার ঝালিয়ে নিতে বিভিন্ন হাসপাতালের ওয়েব সাইট আমাকে সাহায্য করে। সারাদিন নেটেই ঝুঁকে থাকি। কোলন ক্যানসারকে খুব ভালো ক্যানসার হিসেবে বিচার করা হয়। যখন অন্ত্রে কোনও পলিপ দেখা দেয়, সেই পলিপ থেকে রক্তক্ষরণ হতে থাকে। সেই পলিপটাকে কেটে বিদেয় করে দিলেই পলিপ আর ক্যানসারে পরিণত হয় না। কিন্তু তোমার অন্ত্রের পলিপকে কেউ আমরা বিদেয় করতে সাহায্য করিনি। অচেনা অজানা কত শত মানুষেরপলিপ বিদেয় করেছি, মানুষকে বাঁচিয়েছি। পলিপ বহু বছর নেয় বড় হতে। খুব ধীরে ধীরে বড় হয়। রক্ত যায়, লোকে পাইলসের রক্ত ভেবে ভুল করে। কোলন ক্যানসার আগেভাগে চিকিৎসা করলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অন্য যে কোনও ক্যানসারের চেয়েও বেশি। তুমি ওই যে অত দীর্ঘদিন কাটালে আমার কাছে, ওই সময় যদি ওই সুইডেনের গাধা-ডাক্তাররা ধরতেপারতো তোমার অসুখ, তুমি বাঁচতে, তখনও লিভারেনিশ্চয়ই এই সর্বনাশা রোগটি গিয়ে বাসা বাঁধেনি। মেটাসটাসিস না হলে, রোগটা কোলন থেকে বাইরে না গেলেও তো অন্তত কেমোথেরাপি দিয়ে দিয়ে ভালো থাকতে পারতে। কিছুই তুমি জানো না এসবের। সত্য লুকোনো হয়েছে তোমার কাছে। তোমাকে বলা হয়েছে, যে, অপারেশনের পরই তুমি ভালো হয়ে উঠবে।

ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করি, লিভারের অপারেশন করা যায় কি না। ডাক্তার বললেন, দেশে ওই অপারেশন হয় না। বিদেশে হবে? বললেন, হতে পারে, চেষ্টা করে দেখতে পারি। আমি অনুযোগ করলাম, কোনও লাভ নেই জেনেও করলাম, কেন র‍্যাডিক্যাল সার্জারি করতে গেলেন, এতে তো ক্যানসার আরও ছড়িয়েছে! ডাক্তার আর কী বলবেন, ওই লিভারের রিপোর্টকেই দোষ দিয়ে নিজের ভুলের কথা এড়িয়ে যান। এক বুক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আমি বসে থাকি, একা।

ছোটদার বান্ধবী জুই নিউইয়র্কে আসছে শুনে তোমার জন্য জ্যাকসন হাইটসের সোনার দোকান থেকে গয়নার সেট কিনলাম। গলার হার, কানের দুল, হাতের চুড়ি। জীবনে তোমার খুব শখ ছিল সোনার গয়না পরার। দাদা তার বিয়ের আগে তোমাকে দুটো অনন্তবালা গড়িয়ে দিয়েছিল। সে দুটো তুমি দিয়েও দিয়েছোপরে, একটা তোমার মাকে, আরেকটা তোমার মেয়েকে। ইয়াসমিনকে। ইয়াসমিনেরও অলংকারের সাধ। আমারই গয়নাগাটির সাধ আহ্লাদ কিছু নেই। মা, যে মানুষ জীবনে তোমার জন্য কিছুই কিনিনি, সে আমি কত দামি জিনিস অকাতরে কিনে ফেললাম! তোমাকে একটুখানি সুখ দিতে। সত্যি বলতে তোমার সময় আর বেশি নেই বলেই চাইছি তোমাকে আনন্দ দিতে, নিজের গ্লানি মোচন করতে নিজের অপরাধ ঢাকতে চাইছি। তা ছাড়া আর কী! যখন জুইকে তার হোটেলে গিয়ে দিতে চাই তোমার গয়নার বাক্স, কিছুতেই সে নিতে চাইছিল না। সে নাকি ছোটদার প্রেমিকা, তোমাকে না কি সে খুব ভালোবাসে। তাদের নাকি ইমিগ্রেশনে চেক হয়, বাড়তি কোনও জিনিস থাকলে খুব নাকি ঝককি পোহাতে হয়। অথচ দেখ প্রতিবারই বিদেশ এসে ক্রুরা বিস্তর জিনিস কিনে নিয়ে দেশে ফেরে, ওগুলো বেশি দামে বিক্রি করে যা টাকা ওরা রোজগার করে, তা ওদের চাকরির মাইনের টাকার চেয়েও বেশি। আর তোমার জন্য সামান্য ওইটুকু অলংকার নেওয়া জুইএর কাছে মনে হচ্ছিল যেন গোটা একটা হিমালয় বয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো। যখন অনেক বলে কয়ে রাজি করালাম, বিরক্ত কণ্ঠে বললো, বাক্সটা ফেলে দিয়ে গয়নাগুলো তাকে পরে নিতে হবে। নিক, যে করেই হোক নিক। আমি চাই তোমার মুখে হাসি ফোঁটাতে। তোমাকে সামান্য ভালো লাগা দিতে। সারাজীবনে ভালোবাসা তো কিছুই পাওনি। অন্তত তোমার এই অপদার্থ মেয়েটি তোমাকে ভালোবাসে -এই ভেবেও যেন তোমার সামান্য সুখ হয়। ক্যানসার নামের ভয়ংকর রোগে তুমি আক্রান্ত, তোমার অন্ত্র আক্রান্ত, ক্যানসারের চেয়েও ভয়ংকর হলো মেটাসটাসিস, তাতেও আক্রান্ত তুমি। এসবের কিছুই জানতে না তুমি। জানতো বাড়ির সবাই। জানতাম আমি। অনুতাপ আমাকে দিয়ে ইয়াসমিনকে বারবার অনুরোধ করালো। যা তুই মার কাছে যা। মার কাছে থাক। মাকে একটু আদর কর গেগিয়ে। মার তো কোনওদিন কিছু পাওয়া হয়নি আমাদের কাছ থেকে। মাকে অনেক কিছু উপহার দে। মাকে বোঝা যে ভালোবাসিস খুব। মা, তুমি তো জানো না ইয়াসমিনকে আমি বলে বলে পাঠিয়েছিলাম যেন সারাক্ষণ তোমার সঙ্গে সময় কাটায়। তোমার যেন ভালো লাগে। তোমার যেন আনন্দ হয়। কয়েক হাজার ডলার দিলাম তোমার জন্য। সব খরচ করে আয় মার জন্য। হায়, তোমার জন্য খরচ করার আর কী কিছু আছে! ধার কর্জ যা করেছে হাসপাতালের খরচ মেটাতে, সব যেন মেটায়। তোমার যা খেতে ইচ্ছে করে, যা করতে ইচ্ছে করে, সব যেন করতে পারো, খেতে পারো। দুজনই খুব দামি দামি জামা কাপড় কিনলাম তোমার জন্য। না, মা, টাকার হিসেব তখন আর করিনি। পারলে তোমাকে পৃথিবীর যত ভালো কিছু আছে, সব কিনে দিই। ইয়াসমিন তোমার কাছে যাওয়ার পর নির্ভার হলাম, অন্তত কিছুটা হলেও সুখ স্বস্তি তো পাচ্ছো। মেয়ে সঙ্গে আছে। ছেলেদের সঙ্গে থাকা আর মেয়ের সঙ্গে থাকার মধ্যে অনেক তফাৎ। ঠিক মনে নেই ইয়াসমিন কতদিন ছিল, ফিরে এলো যখন, দেখলাম ও খুব ঘুরেছে এর ওর বাড়ি, ভিডিও করেছে দেখালো, প্রচুর জিনিস কিনে এনেছে, গলায় তার চেইন, আল্লাহু লেখা লকেট। বললো, তুমি টাকা দিয়েছো কিনতে, কিনেছে। কোথায় ও তোমার জন্য করবে, নয়তো তুমিই ওকে আদর করে ওর জন্য খরচ করেছো। আমি সারাক্ষণই অস্থির তখন, কী করে যাবো তোমার কাছে। কী করে তোমাকে সুখ দেব, যে সুখ কোনওদিন পাওনি, সেই সুখ। তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসা দেবার জন্য হৃদয় পেতে বসে ছিলাম মা, তোমার কাছে পৌঁছোবার কোনও সাধ্য আমার ছিল না। দেশে গিয়েছিল বলে ইয়াসমিনকে ইমিগ্রেশনের লোকেরা প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেছে, আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া মানুষ দেশে যাবে কেন, এর মানে কি এই যে দেশে তার কোনও রাজনৈতিক সমস্যা নেই! ইয়াসমিনের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো আমার ওপর। বললো, আমিই নাকি ওর সর্বনাশ করেছি দেশে পাঠিয়ে। কী হবে ওর আমেরিকার গ্রিন কার্ড দিয়ে, পাসপোর্ট দিয়ে! কী জানি কেন যে নিজের মার জীবনের চেয়ে বেশি মূল্যবান মনে করে ওরা বিদেশের পাসপোর্টকে। কী হয়পাসপোর্ট দিয়ে? রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছে, পাসপোের্ট একদিন না একদিন হবেই ওর। তাই বলে অনুতাপ করবে, কেন তোমাকে দেখতে দেশে গেল, কেন সে নিজের জীবনের এত বড় ক্ষতি করলো! কী অনুশোচনা! আমি যেন কোত্থেকে এক ডাইনি এসেছি ওকে মারতে! আমি শুধু নরম গলায় বলেছি, ‘আমি যেহেতু যেতেপারছি না, তাই তোকে বলেছি দেশে যেতে। আজ যে তুই আফশোস করছিস মাকে দেখতে গিয়েছিস বলে, আজ যে ভাবছিস মাকে দেখতে গিয়ে ভুল করেছিস, সেটা কোনও একদিন তুই করবি না। কোনও একদিন তোর মনে হবে, জীবনে কোনও যদি ভালো কাজ করে থাকিস, ওই ওটাই। অসুস্থ মার পাশে কিছুদিন কাটিয়ে এসেছিস, মার চিরতরে চলে যাবার আগেমার সঙ্গে থেকে মাকে একটুখানি সুখ দিয়েছিস।

ওদিকে ঢাকায় কিমোথেরাপি শুরু হয়ে গেছে তোমার। বাড়িতে লোক এসে দিয়ে যায় ইনজেকশন। ওসব ইনজেকশনে কোনও কাজ হয় না। তোমার লিভারে অসুখ ছড়িয়েছে। তারপরও কিমোথেরাপি নেওয়ারপর তুমি আশ্চর্য এক স্বস্তি পেতে। কিছু একটা চিকিৎসা তোমার হচ্ছে, এ ভেবেই বোধহয় পেতে। কিমোথেরাপির বিষ তোমার শরীরে যাওয়ারপর তোমার তো আরও অসুস্থ হয়ে পড়ার কথা। না, তুমি বরং বলতে যে তোমার এখন ভালো লাগছে। আসলে ও তোমার মনের ভালো লাগা, শরীরে কিমোথেরাপির ওষুধ কোনও ভালো লাগা দেয় না। বরং শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে ফেলে, চারদিকের ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আগের চেয়ে আরও বেশি আক্রান্ত হতে থাকো। অত বড় অপারেশনের ধকলও কাটিয়ে উঠলে। তুমি ভাবছো তুমি সুস্থ হয়ে উঠছে। আমি তো বুঝতে পারছি, সুইডেনে তোমার অসুখ না ধরতে পারা, বাংলাদেশে তোমার ভুল অপারেশন করা সবকিছু তোমার অসুখ যত না ভয়ংকর, তার চেয়েও বেশি ভয়ংকর করে তুলেছে। ঘণ্টা বাজছে, সেই শব্দ আমি শুনতে পাচ্ছি। বাবা ডাক্তার, বাবাও নিশ্চয়ই শুনতে পাচ্ছিল। আমি মরিয়া হয়ে উঠলাম কোথাও কোনও আধুনিক চিকিৎসা আছে কিনা দেখতে। তোমাকে ভারতে নিয়ে যাওয়া যায় কিনা, সিঙ্গাপুরে, নাকি সুইডেনে, নাকি আমেরিকায়। ভারতের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে হাসপাতাল আর ডাক্তার সবই ঠিক করে ফেললাম, কিন্তু মুশকিল হল ও দেশ আমাকে ভিসা দেয় না। কীকরে যাবো! সিঙ্গাপুর আর সুইডেনে কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু সুইডেনের ওপর আমার প্রচণ্ড ক্ষোভ, তোমার অসুখ ধরতে পারেনি, তারপর তোমাকে দিনের পর দিন ভুল চিকিৎসা দিয়ে ভুগিয়েছে। আমেরিকায় কিছু পাওয়া যায় কি না তা দেখি। নেট ঘেঁটে নিউইয়র্কের মেমোরিয়াল স্লোন কেটেরিং হাসপাতালের সন্ধান পেলাম। নিউইয়র্ক শহরেই সেই ক্যানসার হাসপাতাল। কোলন ক্যানসারে যে লিভার মেটাসটাসিস হয়, তার বিশেষজ্ঞ আছে ওই হাসপাতালে। তারা নতুন একটি জাপানি উদ্ভিদের রস সরাসরি রক্তে ঢুকিয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নাকি ভালো ফল পাচ্ছে। আমি ওটিই ভাবলাম চেষ্টা করবো তোমার জন্য। শেষ চেষ্টা। তোমাকে বাঁচানোর জন্য পাগল হয়ে উঠলাম মা। ওই স্লোন কেটেরিং হাসপাতালে একদিন গিয়ে জেনে এসেছি নিয়ম কানুন। আমার আমেরিকান বন্ধু ওয়ারেন অ্যালেন স্মিথকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। রোগীর সোশাল সিকিউরিটি নম্বর লাগবে, তবেই ওরা চিকিৎসা করবে। পরে ফোনে খবর নিয়ে জেনেছি, অন্য দেশের রোগীদের ক্ষেত্রে তেরো হাজার ডলার জমা দিতে হবে, ওরাই বিমান বন্দর থেকে রোগী নিয়ে আসা থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী সব চিকিৎসা করবে। হাসপাতালেও ভর্তি হওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে। এসব খোঁজ খবর নেওয়া, দিনে কুড়িবার করে দেশে ফোন করে আমেরিকার দূতাবাসে গিয়ে ভিসা যেন সময় মতোনাও তার তাগাদা দিচ্ছিলাম। পাশে কাউকেপাইনি আমাকে সাহায্য করার। ইয়াসমিন যখন শুনলো আমি তোমাকে আমেরিকায় আনছি চিকিৎসার জন্য, সে খুশি না হয়ে বরং উল্টেআমার সঙ্গে মেজাজ দেখালো। তুমি যদি আসবেই, তাহলে শুধু শুধু তাকে দেশে যেতে হলো কেন! কেন আমি তার আমেরিকার নাগরিকত্ব পাওয়ার বারোটা বাজিয়ে দিলাম! রাজনৈতিক আশ্রয় আমার বোন হিসেবেই সে পেয়েছে। তার বারোটার কিছুই বাজেনি মা, কিন্তু আমেরিকার নাগরিকত্ব পেতে আবার কোনও অসুবিধে হয় কি না এই আশংকায় সে বীভৎস হয়ে উঠলো। আমি যে কত একা ছিলাম দিন রাত, কত যে তোমার জন্য একা একা ভেবেছি, কেঁদেছি, সে আমিই জানি। তুমি আর বাবা এলে। বিমান বন্দরে আমি গেলাম, ইয়াসমিন যায়নি। সে কেন যাবে, সে তো ফুঁসছে। তোমার জন্য বাংলাদেশে গিয়ে ভীষণ ভুল সে করে ফেলেছে, সেই ভুলের সব দায় দায়িত্ব আমার, পারলে আমার মুখ দেখা সে বন্ধ করে দেয়। তার কাছে আমেরিকার নাগরিকত্বের চেয়ে বড় কোনও কিছু এই জগতে নেই। বাবা মা ভাই বোন তার কাছে আর বড় ব্যাপার নয়। তার নিজের আর তার স্বামী সন্তানের নাগরিক ভবিষ্যৎ নিয়েই তার যাবতীয় ভাবনা। ওর ভেতরে যে আবেগ ছিল, যে ভালোবাসা ছিল, সে কোথায় গেল, আমি বুঝে পাই না। আমেরিকার স্বপ্ন তাকে ছোটদা আর মিলন শিখিয়েছে দেখতে। তা না হলে ও একটা হৃদয়হীন মানুষের মতো এমন অসভ্য আচরণ করতো না। ওর নাগরিকত্ব পেতে সামান্যও কোনও ব্যাঘাত ঘটেনি মা। যখন পাওয়ার, নির্বিঘ্নে পেয়ে গেছে।

বাংলাদেশ বিমানে ছোটদাই ফ্রি টিকিটে তোমাদের নিয়ে এলো। এয়ারপোর্টে তোমাদের নামিয়ে দিয়ে আবার চলেও গেল। আমার পাঠানো গয়নাগুলো তুমি পরে এসেছে। না মা, তোমাকে সুন্দর দেখাবে বলে নয়, আমাকে খুশি করতে পরেছে। আমাকে খুশি করার জন্য তুমি আগেও যেমন সব করেছে, তখনও করেছে। আমি বোধহয় ওই প্রথম আমার জীবনে তোমাকে খুশি করতে চাইছিলাম। আমি কি পারছিলাম মা? তুমি অসম্ভব শান্ত, স্নিগ্ধ, তোমাকে দেখে একটুও মনে হচ্ছিল না যে প্রায় তিরিশ ঘণ্টার একটা দীর্ঘ ক্লান্তিকর যাত্রা সবে শেষ করেছো। বাড়ির পথে যেতে যেতে ট্যাক্সির জানালায় তোমাকে নিইউয়র্ক শহরটাকে দেখাতে চাইছিলাম। না, মা, তুমি শুধু আমার দিকেই তাকিয়েছিলে। আমার একটা হাত ধরে বসেছিলে, সেই হাতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলে। পরেও যখন তোমাকে ম্যানহাটনের দিকে যেতে উঁচু উঁচু দালানগুলো দেখাতে চেয়েছি, তুমি একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিয়েছে। পৃথিবীর সব লোকই এসে অবাক চোখে ওই উঁচু বাড়িগুলো দেখে, এসব দেখে তোমার কোনও বিস্ময় জাগে না। যেন তুমি এসব অনেক দেখেছো। এত নিস্পৃহ চোখে জগৎ দেখতে আর কাউকে দেখিনি আমি। এত উৎসাহ ভরে মানুষ দেখতেও আর কাউকে দেখিনি। তোমার কাছে মানুষ আর মানুষের হৃদয়ের দাম ছিল সবচেয়ে বেশি।

এই স্লোন কেটেরিংও যে আমাকে এত ভোগাবে কে জানতো। আমার কোনও ঘুম ছিল না মা, রাত দিন আমি কুঁদ হয়ে ছিলাম তোমার জন্য কোনও চিকিৎসা পেতে। খুঁজে খুঁজে যা পেয়েছিলাম, তাকেই বিশ্বাস করে তোমাকে বললাম চলে আসতে আমেরিকায়। তোমার আর বাবার ভিসার ব্যবস্থাও করলাম। কী করে যে এত সব করেছিলাম ভাবলে এখন অবাক হই। পেন আমেরিকার লেখকদের বলেই তোমার আর বাবার আমেরিকা আসার জন্য ভিসা করিয়েছিলাম। তুমি আসার আগে সাড়ে ছ হাজার ডলার জমা দিতে হয়েছিলো হাসপাতালে। তারপর যেদিন হাসপাতালে গেলাম ডাক্তার দেখাতে, অন্য সব রোগীদের সঙ্গে তোমাকে দীর্ঘ সময় বসে থাকতে হলো। সব রোগীকেই দেখছে, তোমার বেলায় বলা হলো, বিদেশি রোগী, বাকি টাকা জমা না পড়লে ডাক্তার দেখবে না। তখনই দৌড়ে হাসপাতালের বিদেশবিভাগে গিয়ে বাকি সাড়ে ছ হাজার ডলার জমা দিয়ে তোমাকে ডাক্তার দেখালাম। এমআরআই করা হয়েছিলো তোমার, তার রিপোর্ট দেখে আর তোমাকে খানিকটাপরীক্ষা করে ডাক্তার বলে দিল, লিভারে অনেকগুলো মেটাসটাসিসের নডল আছে। তিনটে থেকে এত দ্রুত কী করে অনেকগুলো হয়ে উঠলো, সে আমি অনুমান করতে পারি। তোমার ওই সাড়ে চার ঘণ্টার অপারেশন, আর ব্যাগের পর ব্যাগ রক্ত ঢালা, সে কারণেই। জিজ্ঞেস করলাম, লিভার অপারেশন করা যায় না? মেটাসটাসিস যেখানে যেখানে হয়েছে, সেসব জায়গা কেটে বাদ দেওয়া? ডাক্তার বললো, না। হবে না। লিম্ফ নোডে ছড়িয়েপড়েছে। বললো, লিভার অপারেশন করে লাভ নেই। তারপর খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে, এতটুকু কাঁপলো না ডাক্তারের কণ্ঠস্বর, এতটুকু মায়া নেই তার কণ্ঠে, বললো আর মাত্র তিন মাস তুমি বাঁচবে। তিনমাস, এই শব্দটা আমার বুকে বিষমাখা তিরের মতো ছুটে এসে বিধতে তিন মুহূর্ত সময় নেয়নি। আর কোনও চিকিৎসা? আর কোনও কি চিকিৎসা নেই? আমি কাতর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম। পাথরের মতো মুখ ডাক্তারের। বললো, রোগীকে দেশে ফেরত পাঠান।

ডাক্তারের চেম্বারে শুয়ে থাকা তোমার কাছে ফিরে এসে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। তুমি ফ্যাকাসে মুখে বললে, কাঁদছো কেন? কী বলেছে ডাক্তার? আমি মরে যাবো? ’আমি কিছু বলিনি নাকি মাথা নেড়ে না বলেছিলাম মনে নেই। তবে কাঁদছিলাম। চোখের জল থামাতে পারিনি অনেকক্ষণ। তুমি হয়তো যা বোঝার, বুঝেই নিয়েছে। বললে, খুব নরম স্বরে বললে, সবার মা কি আর সারাজীবন বাঁচে? তুমি কেঁদো না মা। তোমার চোখে একফোঁটা জল ছিল না।

ডাক্তারের ওই জবাব দিয়ে দেওয়ায় আমি কি তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়ি চলে যাবো নাকি! আমি তার পেছন পেছন গিয়ে বললাম, আমি নিজে একজন ডাক্তার, আমাকে বলুন কিছু। লিভার মেটাসটাসিস হলে নতুন যে ট্রায়াল দেওয়া হচ্ছে এই হাসপাতালে, কিছু তো ভালো ফল পাওয়া গেছে। আমার মার জন্য সেই ট্রায়ালের ব্যবস্থা করলে কেমন হয়! সেই ডাক্তার, তুমি জানোনা মা, খেঁকিয়ে উঠে বললো, ”হেই তুমি কি ইংরেজি ভাষা জানো না? যা বলার বলেই দিয়েছি। দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করে আমাকে বিরক্ত করো না। যাও। ডাক্তার সরে গেল, আমার সঙ্গে আর কোনও কথাই বলতে চায়নি। আমিও তো হাসপাতালে ডাক্তারি করেছি। কোনও রোগী বা রোগীর আত্মীয়র সঙ্গে এমন অকথ্য ব্যবহার নিজে তো করিইনি, কাউকে করতেও দেখিনি। যে মেয়ে এইমাত্র শুনলো যে তার মা আর তিন মাস পর মারা যাবে, তার সঙ্গে ডাক্তাররা কী ভাষায় কথা বলবে, তা ওই ডাক্তার শেখেনি। হাসপাতালের ওয়েবসাইট থেকে অনেক লিভার মেটাসটাসিস বিশেষজ্ঞরমধ্যে ওই মহিলাকে আমি পছন্দ করেছিলাম। অনেক ডিগ্রিতার, অনেক পড়াশোনা, অনেক অভিজ্ঞতা। আমার মনে হয় না কোনও সাদা রোগীর সঙ্গে অমন ব্যবহারের সুযোগ সে পেত। আমাকে বা তোমাকে ওই ডাক্তার মানুষ বলে মনে করেনি। মনে করেছে। কোন জঙ্গল থেকে জন্তু জানোয়ার কিছু গেছি হয়তো তার কাছে। এখন ভাবি আমার তো আমেরিকার কিছু লেখক কবিদের সঙ্গে পরিচয় ছিল। লেখক সংগঠন পেন আমাকে যথেষ্টই গুরুত্ব দিত। তাদের কাউকে আমি সঙ্গে নিয়ে গেলাম না কেন! সঙ্গে নিলে এই আচরণ থেকে অন্তত রেহাই পেতাম, কিন্তু তোমার কি আর কোনও চিকিৎসা পেতাম! অন্তত লিভার মেটাসটাসিসের যে চিকিৎসা চলছে, সে সম্পর্কে কিছুক্ষণ তো কথা বলতে পারতাম। আসলে কী জানো, বিদেশের ভাবসাব দেখে, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তাদের বিস্তর শ্লোগান টোগান শুনে বিশ্বাস হয়না সাদাদের বেশির ভাগের রন্ধ্রে রন্ধ্রেলুকিয়ে আছে বর্ণবাদ। বিশ্বাস হয় না যে সুযোগ পেলেই তারা তাদের ঘৃণা উগরে দেবে। ডাক্তার, সত্যি বলতে কী, আমাকে অনেকটা দূর করেই দিল তার চোখের সামনে থেকে। আমি যে ডাক্তার, তা বোধহয় বিশ্বাসও করেনি। আর, গরিব দেশের ডাক্তাররা যে ডাক্তার তা-ই বোধহয় মনে করে না। এই ব্যবহার পাওয়ার জন্য তেরো হাজার ডলার দিয়েছি।

তোমার অসুখের কথা আমি তোমাকে কিছু বলিনি। কী অসুখ, ডাক্তার কী বলেছে, তার কিছুই না। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিলে কিছু একটা খবর গোপন করছি আমি। গোপন করলে কোন খবরটা গোপন করতে পারি, তা অনুমান করার মতো বুদ্ধি তোমার আছে! ডাক্তারকে আগেই অনুরোধ করেছিলাম যা জানানোর আমাকে যেন জানায়, তোমাকে নয়। বিদেশে ডাক্তাররা রোগীদের সব জানিয়ে দেয় কী অসুখ, কোথায় অসুখ, বাঁচার আশা আছে কী নেই, থাকলে কদিন বা ক’মাস, সব। জানার পর রোগীরা নিজের জীবনের বাকি কাজগুলো ওই সময়ের মধ্যে সেরে নেয়। গুছিয়ে নেয় সব। তোমার তো কোনও সহায় সম্পদ নেই গোছাবার। তোমার তো কোনও জমি জায়গা নেই কাউকে লিখে দিয়ে যাবার। তুমি নিঃস্ব এক মানুষ। কী দরকার জেনে কদিন বাঁচবে তুমি। কী দরকার জেনে ওই অসুখটির নাম। কী দরকার আর কষ্ট পেয়ে, জীবনে কষ্ট তো তুমি কম পাওনি। বাকি দিনগুলো অন্তত এটুকু জেনে স্বস্তি পাও যে তোমার চিকিৎসা চলছে, তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে শীঘ্র।

একদিন তোমাকে বলে দিলাম কত টাকা আমাকে হাসপাতালে জমা দিতে হয়েছে। সেটা তোমার জন্য কত লক্ষ টাকা খরচ করছি সেটা বোঝাবার জন্য নয়, তোমার জন্য কত ক্ষতি আমার হচ্ছে, সেটা বোঝাবার জন্য নয়। তোমাকে ভালোবাসি, তোমার সুস্থ হওয়াটা চাই, টাকা আমার কাছে তুচ্ছ, তোমার সুস্থ হওয়াটা বড়, এ কথাটা বোঝাবার জন্য। তুমি কি বুঝেছিলে? নাকি ভেবেছিলে টাকা খরচ নিয়ে আমার অনুশোচনা হচ্ছে। ভেতরে ভেতরে তুমি সাংঘাতিক অভিমানী মেয়ে ছিলে। সংবেদনশীল, স্পর্শকাতর। জানি না কী মনে হয়েছিলো তোমার। কেমন যেন চুপচাপ থাকতে। যেন তোমার কিছুই হয়নি, কোনও অসুখ হয়নি, যেন দিব্যি আছো। কার সঙ্গে অভিনয় করতে, মা? কাকে ফাঁকি দিতে? একবারও এরপর জিজ্ঞেস করোনি, ডাক্তার কী বলেছিলো যে আমি কাঁদছিলাম। একবারও কেন তুমি জানতে চাওনি। তুমি তো কত কিছুর খুঁটিনাটি জানতে চাইতো কী করে বিদেশে বাজার করি, কী করে রান্না করি, হাত পুড়ে যায় কিনা রাঁধতে গিয়ে, টাকা পয়সা ঠিক ঠিক আছে কিনা, হিসেব করে খরচ করি কিনা। দেশে ফেরার জন্য কোনও চিঠিপত্র লিখছি কী না দেশের সরকারকে, ব্যারিস্টার কামাল হোসেনকে জানাচ্ছি। কী না দেশে ফেরাবার ব্যবস্থা করার জন্য, সব।

০৪. তোমাকে নিয়ে এলাম বটে বাড়িতে

তোমাকে নিয়ে এলাম বটে বাড়িতে। কিন্তু কী করবো! বুকের ধুধু প্রান্তর জুড়ে হাহাকারের ঝড়। আমি তো তোমাকে সর্বাধুনিক চিকিৎসা দেবার জন্য দেশ থেকে নিয়ে এসেছি এই দূর দূরান্তে। এত দূর এসেছো, চিকিৎসা তো আমাকে করাতে হবে। উৎসুক অপেক্ষা করছে, জানি। তুমি বাঁচতে চাইছে, জানি। কতটুকু দুর্বল তুমি ভেতরে, কতটুকু শক্ত হয়ে আছো বাইরে, হাসছে, কথা বলছো, খাচ্ছো, গল্প করছো, বুঝি। মাঝে মাঝে মনে হয় চিৎকার করে সারা শহর ফাটিয়ে কাঁদি। কেউ নেই আমাকে সাহায্য করার। কেউ নেই তোমাকে বাঁচাবার। ডাক্তার আমাকে পরামর্শ দেয়নি নতুন ওষুধটি তোমাকে দেওয়ার। কিন্তু ডাক্তার বললেই আমি শুনবো কেন? সুইডেনের সাদা ডাক্তারদের আমি দেখে এসেছি কেমন চমৎকার তাদের চিকিৎসা। আমার ওই সাদা-মোহ আর নেই। ডাক্তারদের বিশ্বাস করাও আমি জানি যে আমার উচিত নয়। ডাক্তারের ওই তিন মাস বাঁচার ঘোষণা আমাকে দুমড়ে মুচড়ে, ভেঙে চুরে, আমার হৃৎপিণ্ড পিষে, আমার রক্ত শুষে নিয়ে, আমার মস্তিষ্ক কামড়ে, আমার ত্বক কেটে কেটে, আমার হাড়ে মজ্জায় আগুন ধরিয়ে, আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ছিদ্র করে আমাকে ভয়াবহ মৃত্যুর সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। যেন তুমি নও, আর মাত্র তিন মাস আয়ু আমার। যেন তোমার নয়, এ আমার মৃত্যুসংবাদ। নরকের গহ্বরে। কেউ আমাকে পেছন থেকে আচমকা ধাক্কা মেরে যেন ফেলে দিল। তার চেয়ে বোধহয় এই ভালো ছিল এই কুৎসিত খবরটি না জানা। তার চেয়ে বোধহয় এই ভালো ছিল আশায় আশায় থাকা। দেশেই থাকতে, কিমোথেরাপি চলতে থাকতো। জানতাম, অপারেশন হয়েছে, কিমোথেরাপিও কাজ করছে, জানতাম তুমি সুস্থ হয়ে উঠছো, উঠবে। দুঃসংবাদ শোনার চেয়ে না শোনাই ভালো। নিষ্ঠুর সত্য জানার চেয়ে সুন্দর মিথ্যে জানাও হয়তো ভালো। যদি এও না জানতাম, যে, তোমার ওই রোগটির নাম ক্যানসার! যদি না জানতাম লিভার পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে তোমার রোগ, যদি মূখের মতো সুখে থাকতে পারতাম! মা।

সারারাত আমি ঘুমোতে পারি না। বাবাকে ড্রইংরুমে শুতে দিয়ে আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোই। যে আদর তোমাকে সারাজীবন করিনি, সেই আদর করি। আমার বিশ্বাস হতে চায় না ক্যানসার হাসপাতালের ডাক্তারের কথা, আমি সবলে সর্বশক্তি দিয়ে অস্বীকার করতে চাই ডাক্তারের ভবিষ্যদ্বাণী। আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না ঢাকার ডাক্তারের ডায়াগনোসিস। যদি ভুল হতো সব! টিউমারপরীক্ষা করতে গিয়ে এমন তো হয়প্যাথোলজির লোক ভুল করেছে। অ্যাডেনোকারসিনোমা বলেছে, আসলে অ্যাডেনোকারসিনোমা নয়, ক্যানসার নয়। লিভার মেটাসটাসিস বলছে, আসলে তা নয়। প্রতিদিন তো ডাক্তাররা রোগীর রোগ ধরতে ভুল করছে। তোমার রোগ ধরতেই কম ভুল তো ডাক্তাররা এ যাবৎ করেনি। তবে কেন এখন ভুল হবে না! কেন সব ডাক্তার হঠাৎ করে নির্ভুল হয়ে গেল। দেশে বিদেশে সবখানে!

পরদিন তোমাকে স্লোন কেটেরিং হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে সেই ট্রায়াল চিকিৎসাটি নিই তোমার জন্য। জাপানের কী একটা উদ্ভিদের নির্যাস। নাম, সিপিটি ইলেভেন। ইনজেকশন নিতে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হয় না। আমার সিদ্ধান্ত আমি নেব। টাকা দিচ্ছি, ইনজেকশন দাও। বিদেশে তোমার চিকিৎসা হচ্ছে, তোমার চেহারায়তি ফিরে এলো। বেশ খুশি মনেই হাসপাতালে গেলে। ভাবছিলে, চিকিৎসা নিশ্চয়ই আছে তোমার রোগের। রোগটা কী, এ পর্যন্ত তোমার সামনে কেউ উচ্চারণ করেনি। হয়তো ভেবেছিলে যে অপারেশনেরপরও যে পেটে একটা অস্বস্তি রয়ে গেছে, সেটা কাটাতে নিউইয়র্ক এনে চিকিৎসা করাতে হচ্ছে। ভেবেছিলে নাকি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলে কী অসুখ হয়েছে তোমার! তখন না মনে হলেও এখন মনে হয় তুমি প্রথম থেকে ঠিকই বুঝেছিলে সব। এমনকী তুমি তো বলছোই যে ঢাকায় কিমোথেরাপি নেওয়ার পর শরীরটা তোমার ভালো লাগতো। ওইবিষ শরীরে নেওয়ারপর তোমার শরীর ভালো লাগার তো কোনও কারণ নেই, ভালো লেগেছিলো তোমার মন। কিছু একটু চিকিৎসা হচ্ছে, চিকিৎসা হওয়া মানেই কোনও না কোনও একদিন ভালো হয়ে ওঠা, গোপনে এই একটি বিশ্বাস তোমার ভেতরে কাজ করতো। অথবা কোনও আশা নেই, কিন্তু প্রাণপণে একটু আশার সন্ধান করতে। মা। খুব বাঁচতে চাইতে তুমি। সারাজীবন তুমি মৃত্যুর কথা বলেছো, আর যেদিন মৃত্যু সত্যি সত্যিই উপস্থিত হলো, একবারও উচ্চারণ করোনি মৃত্যুর কথা। জীবনের কথা বলতে। ভবিষ্যতের কথা বলতে। তুমি কি আমাদের ফাঁকি দিতে চাইতে, বোঝাতে চাইতে তুমি আদৌ জানো না কী রোগে আক্রান্ত তুমি? তোমাকে আমরা বুঝতে দিতে চাইতাম না তোমার অসুখের কিছু, তুমিও অভিনয় করতে যেন কিছুই জানো না। তুমি আমাদের স্বস্তি দিতে চাইতে না বোঝার অভিনয় করে। তোমাকে ওই অভিনয়টুকু করতেই হয়তো হয়েছিলো। নিজের জীবন দিয়ে আমাদের মুখে হাসি ফোঁটালে, নিজের জীবন দিয়ে আমাদের তুমি সুখ আর স্বস্তি দিয়ে গেলে। অবুঝের মতো থেকে গেলে। তুমি তো কিমোথেরাপির কথা বলেছো। বলেছো অপারেশনের পর তোমাকে ‘কিমো’ দেওয়া হচ্ছে। তুমি তো জানো হাশেম মামার লিভার ক্যানসার হয়েছে, তাকে কিমোথেরাপি দেওয়া হয়। সংক্ষেপে যাকে হাশেম মামা আর অন্যরা কিমো বলতো। কিমো শব্দটি তো ক্যানসার ছাড়া অন্য কোনও অসুখের চিকিৎসার বেলায় ব্যবহার করা হয় না। তুমি যে তোমার বেলায় দিব্যি ব্যবহার করলে! কাউকেই তো প্রশ্ন করোনি, তোমাকে স্যালাইনে ভরে যে ওষুধটি দেওয়া হচ্ছে। সেটিকে কি কারণে কিমো বলা হয়, কিমো তো ক্যানসারের ওষুধ! কাউকে অপ্রস্তুত করতে চাওনি বুঝি!

সিপিটির বিষ তোমার শরীরে বিষের ক্রিয়াই করেছিলো। স্যালাইনে একটু একটু করে ওই বিষ তোমার শরীরে ঢুকেছে। ট্যাক্সিতে যখন হাসপাতাল থেকে ফিরছিলাম, তোমার গা গুলিয়ে ওঠা শরীর নিয়ে তুমি চুপ হয়ে বসে ছিলে। মনের জোরে বসেছিলে মা। যখন জিজ্ঞেস করেছি, খারাপ লাগছে কি না। তুমি মুখে বলোনি, মাথা নেড়ে উত্তর দিয়েছো যে তুমি ঠিক আছে। আসলে তুমি প্রাণপণ চেষ্টা করছিলে, বিষ ধারণ করতে শরীরে। মনের শক্তি কি শরীরের ওপর সত্যিই খাটে! খাটলে তোমার বেলায় খাটতো। সুইডেনে না হয় ছোট ডাক্তাররা তোমাকে দেখেছিলো। আমেরিকায় তো সবচেয়ে বড় হাসপাতালের বড় বিশেষজ্ঞ তোমাকেপরীক্ষা করেছে। মনে তোমার তো শক্তি পাওয়ারই কথা। ডাক্তার তোমাকে সিপিটি ইনজেকশন দেওয়ার কথা বলেনি, এ আমার একার সিদ্ধান্ত, কিছুই তোমাকে বলিনি। তুমি তো ভেবেছিলে, ডাক্তারের পরামর্শে আমি তোমাকে ইনজেকশন দিচ্ছি। তোমাকে কত কিছু যে লুকিয়েছি! তোমাকে বুঝতে দিতে চাইতাম না যে আর কোনও চিকিৎসা তোমার নেই। বিশেষজ্ঞর পরামর্শ আমি মানিনি বটে, কিন্তু মনে মনে কি ধারণা করিনি যে ডাক্তার ভুল কথা বলছেনা! কিন্তু তারপরও হয়তো আমার অলৌকিকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়েছিল। অথবা এ ছাড়া আমার কোনও পথ ছিল না। তাই বলে যে তোমাকে ঝাড় ফুক দেওয়ার কথা বলবো, তা তো নয়। তুমি যখন ট্যাক্সি থেকে নেমে আমাকে ভর করে হাঁটছিলে আমার সাত তলার অ্যাপার্টমেন্টের দিকে, আমাকে বলেছিলে, ‘এখন থেকে তোমার কাছেই থাকবো আমি। বাকি জীবন তোমার কাছেই। আমি আর কোথাও যাবো না তোমাকে ছেড়ে। কেন বলেছিলে? কারণ তোমার চিকিৎসা নিয়ে আমার ব্যস্ততা, ছুটোছুটি দেখে তোমার মনে হয়েছিল, তোমাকে খুব ভালোবাসি! তোমার কি মনে হয়েছিল, যে ভালোবাসে তার কাছেই তোমার থেকে যাওয়া উচিত। ভালোবাসাকেই মনে হয়েছিল তোমার আশ্রয়! আমার মনে হয় না আমাকে তুমি খুশি করতে ও-কথা বলেছিলে। তোমার তো সংশয় হওয়ার কথা বাকি জীবন আমার কাছে থেকে যেতে চাওয়ায় আমি চমকিত হতে পারি, কিন্তু পুলকিত হব না। সম্ভবত তোমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিলো যে তোমাকে না ভালোবাসলে তোমার জন্য আমি কাঁদতে পারতাম না, আর তোমাকে দূর বিদেশে এনে অঢেল টাকা ঢেলে তোমার চিকিৎসা করতাম না। তুমি আমাকে খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরেছিলে। কিন্তু বাড়ি ফিরে খুব বেশিক্ষণ তুমি ভালো থাকার অভিনয় করতে পারোনি। এমন বীভৎসভাবে বমি করলে যেন ভেতরে যা কিছু আছে সব ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে। সামনে দাঁড়িয়ে ওসব দেখার সাহস আমার হয়নি। বাবা তোমার শুশ্রূষা করেছে। ভীষণ জ্বর হলো রাতে। পরদিন স্লোন কেটেরিংএর ইমারজেন্সিতে নিয়ে গেলাম, ওই অসুস্থ তোমাকে, জ্বরে পুড়ে যাওয়া তোমাকে, শরীরে জল কমে গিয়ে যে তুমি প্রায় অবশ হাত পা পড়ে আছে। একটা স্যালাইন চালিয়ে দেওয়া হলো। স্যালাইন শেষ হবার পর ডাক্তার বললো তোমাকে যেন বাড়ি নিয়ে যাই। তুমি এত ক্লান্ত, উঠতে চাইছিলে না। তোমাকে বলেছি, বিছানা খালি করে দিতে হবে। যে তুমি সব কষ্ট সইতে পারো, আমার সব আবদার মেনে নাও, সে রাতে তুমি মানতে চাওনি। কতটুকু কষ্ট শরীরে হলে তুমি ওইনাছোড়বান্দার মতো থাকতে চাইতে পারো, সে বুঝি। বাকিটা রাত তুমি ভিক্ষে চাইছিলে মা, শরীরে তোমার এক ফোঁটা শক্তি ছিল না বিছানা থেকে ওঠার। তুমি কাতর অনুনয় করলে রাতটা যেন যেখানে আছে সেখানেই থাকতেপারো। হাঁপাচ্ছিলে, কথা ঠিকমতো বলতে পারছিলে নীলকণ্ঠ তুমি। আমি কাকে অনুরোধ করবো! কেউ জানে না আমি নিজে একজন ডাক্তার, কেউ জানে না আমি একজন লেখক। কেউ জানে না আমি কোনও অখ্যাত কিছুনই। এ দেশ থেকে দু দুটো বই বেরিয়েছে আমার। এদেশের বড় বড় পত্রিকায় আমার প্রশংসা করে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। এমনকী নিউ ইয়র্ক টাইমস, লস এঞ্জেলেস টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্টের মতো কাগজে সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে আমাকে নিয়ে। কিন্তু যে লোকগুলো আমাকে চেনে না, তাদের কাছে গরিব দেশের বাদামি রঙের মেয়ে ছাড়া আমার আর কোনও পরিচয় নেই। আমার অসুস্থ মাকে ধাক্ক দিয়ে বেড থেকে নামাবেনা তো কী! অথচ এই শহরেই আমার বক্তৃতা শুনতে লোক ভিড় করেছে। এই দেশে আমি তো অচেনা কিছু নই। কত তো আমার পাঠক শুভাকক্ষী আছে। তারা সব কোথায়! তারা কোথায় আমি জানি না। আমি কারও কোনও খবর জানি না। সমগ্র বিশ্বে একটা বিন্দুর মতো আমি একা। আর তুমি, আমার মা, আমাকে নিশ্চিন্তি দেবে, নির্ভাবনা দেবে বলে নিজের অসুখের কথা বলেও যখন দেখেছো আমাকে ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে, তুমি আর বলোনি। তুমি জোর করোনি। বলেনি যে তোমাকে ছোটখাটো ডাক্তার দেখালে চলবে না, বড় ডাক্তার দেখাতে হবে। তুমি আমাকে বিরক্ত করতে চাওনি। মৃত্যুকেই তুমি বেছে নিয়েছে। নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছে আমাকে ভারমুক্ত করতে, মা। তা ছাড়া আর কী, বলো। সে রাতে, ক্যানসার হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে জ্বরে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা তোমাকে একটা রাত শুধু মাত্র আর কয়েক ঘণ্টা শুয়ে থাকার অনুমতি যত চাইছি, তারা ততই বলে দিল, না হবে না, বেড খালি করে দিতে হবে। কী সুবিধে পাওয়ার জন্য এত টাকা অগ্রিম দিলাম তাহলে! না, ইমারজেন্সির ডাক্তার কিছুতেই শুনবেনা। হাসপাতালে ভর্তি করাবে না তোমাকে। শুধু লাত্থি দিয়ে তোমাকে নামাবে। এ সময় পাশে কেউ নেই। পাশে কেউই নেই মা। আমার মতো হতবুদ্ধি আর অসহায় তখন কেউ ছিল না। বিছানা থেকে করুণ ক্লান্ত তোমাকে নামিয়ে আনলাম। রাত তিনটেয় ট্যাক্সি ডেকে বাড়ি ফিরতে হলো। সারাপথ আমি কোনও কথা বলতে পারিনি তোমার সঙ্গে, পৃথিবীটাকে শুধু নির্মম মনে হয়নি, বড় নোংরা মনে হয়েছে।

আকাশের নক্ষত্ররাজির দিকে তাকিয়ে ভাবি তোমার কথা, খুব অনুতাপ করি তোমার সেরাতের কষ্টের জন্য। যদি তোমাকে ওভাবেই রাখতাম, বিছানা থেকে না নামিয়ে নিতাম, যদি ওই ডাক্তারের গালে জোরে একটা চড় কষাতে পারতাম, যদি পুলিশ ডাকতাম, যদি মামলা ঠুকে দিতাম! কিছুই করিনি। সুইডেনে তোমাকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে আমি টাকার অভাব বোধ করেছিলাম। তখন থই থই কৃপণতা আমার। আর যখন তোমার চিকিৎসা না করিয়ে তোমাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলাম, তখন আমি উদার হস্ত, আমার মতো দরদি আর দুটি নেই। তোমার অসুখ ধরাপড়ারপর আমাকে যদি কেউ বলতো তোমার মার ভালো চিকিৎসা হতে পারে, তোমার মা বেঁচে উঠবে, তোমার যা আছে সহায় সম্পদ সব দিয়ে দাও। আমি হয়তো তক্ষুণি সব দিয়ে দিতাম।

শ্লোন কেটেরিংএর আশা আমাকে বাদই দিতে হল। তোমার অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। সিপিটির বিষে তুমি নীল হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। ইমারজেন্সির স্যালাইনও তোমাকে সুস্থ করতে পারলো না। আবার জ্বর হল তোমার। আবার বমি। তোমাকে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে পাশের হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, ওখানেও সারারাত ধরে স্যালাইন দেওয়া হল। তোমার গা থেকে জল হাওয়া হয়ে যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে কেন যাচ্ছে কে জানে। শরীরের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতাও কমে গেছে, বার বার কোথাও না কোথাও ইনফেকশন হচ্ছে তোমার, তাই জ্বর। ক্যানসার, মেটাসটেসিস, ভুল অপারেশন, কিমোথেরাপি, সিপিটি নামের জাপানি বিষ –সব তোমাকে গিলে খাচ্ছিল। অন্তত এই বোধটুকু আমার হয়েছে যে দেশ থেকে অতদূর বিদেশে এসে তোমার ক্ষতি ছাড়া লাভ কিছু হয়নি। আমি তো ক্ষতি তোমার করেইছিলাম দেশে, সুইডেনে, আবার অতদূরপথ পাড়ি দিয়ে আমারই ক্ষতির শিকার তোমাকে হতে হল। তোমার শরীরে আর যে ওই বিষ ঢোকানো চলবে না, সে আমি হাড়ে হাড়ে বুঝি। তিন মাস আয়ুর ভবিষ্যদ্বাণী আমাকে কানে বারবার হায়েনার হাসির মতো বাজতে থাকে। আমারও যেন গা থেকে জল কমে যাচ্ছে, সারা শরীর আমার কাঁপে, আশংকায়।

আমি তখন সেই কাজটি করি মা। তুমি জানো না কী করে আমি ফোন করতে শুরু করলাম দেশে। দেশে ডঃ কামাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। বললাম তোমার কথা, বললাম তোমাকে দেশে ফেরত যেতে হবে, বললাম, আমাকেও দেশে ফিরতে হবে। ডঃ কামাল হোসেন বললেন তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন। জানি না তিনিই নাকি অন্য কেউ আমাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোন নম্বর দিয়েছিলেন। আমি নিজেই ফোন করলাম তাঁকে। রফিকুল ইসলামকে আমি চিনি বৈকি। মুক্তিযোদ্ধা, বীর উত্তম খেতাব পেয়েছেন। একদিন আমার শান্তিবাগের বাড়িতে এসে মুক্তিযুদ্ধের ওপর তাঁর নিজের লেখা কিছু বই দিয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে যখন বললাম, যে, আমার মা অসুস্থ, আর মাত্র তিনমাস বাঁচবেন বলে ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছেন, মার সঙ্গে তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলো আমি কাটাতে চাই। মাকে নিয়ে আমি দেশে ফিরবো, যে করেই হোক আমাকে ফিরতে হবেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন আমি নিশ্চয়ই ফিরতে পারি, কোনও অসুবিধে নেই। তারপরও, বললেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে নিতে চান। এর দুদিন পর তিনি আমাকে জানিয়ে দিলেন, যে, শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা হয়েছে তাঁর। তিনি তাঁকে আমার মার আর মাত্র তিন মাস বাঁচার কথা বলেছেন কিন্তু হাসিনা চান না আমি দেশে ফিরি। সুতরাং, আমার ফেরা সম্ভব নয়। ফিরলে আমাকে বিমান বন্দর থেকেই বিদেশে ফেরত পাঠানো হবে, দেশে ঢুকতে দেওয়া হবে না। কী কারণ, কী অন্যায় আমি করেছি? নিরুত্তর ওদিকটা। অন্যায় আসলে কে কার সঙ্গে করছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারেন। তাঁর ইচ্ছেয় হোক, অনিচ্ছেয় হোক আমাকে তিনি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ জানিয়ে দিলেন, কোনও অবস্থাতেই যেন দেশে না ফিরি। বিমূঢ় বসে রইলাম। তোমাকে তো ফিরতেই হবে। তোমাকে দেশে ফেরত পাঠানোর কথাবার্তা চলছে শুনে লেমার বিস্মিত দুচোখ, দেশে কেন পাঠাবো, তোমাকে তো চিকিৎসার জন্য এদেশে আনিয়েছি, তবে চিকিৎসা না করে বিদেয় করতে চাইছি কেন? তোমার এই প্রশ্নটির উত্তর আমি তোমাকে দিতে পারিনি। কী দেব উত্তর, আমি কী বলবো মা, তোমার কোনও আর চিকিৎসা নেই? তোমাকে এখন দেশে গিয়ে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হতে হবে? বিদেশের মাটিতে তোমার মরার দরকার নেই, দেশে গিয়ে আত্মীয় স্বজনের মাঝখানে বসে তোমাকে মরতে হবে। আমার মনে হত, আত্মীয় স্বজনের ধরা ছোঁয়ার মধ্যে মত্যু হলে সেই মত্যু বুঝি চমৎকার হয়। কেন আমার মনে হয়েছিল ওসব? তোমার দুটো মেয়ে বিদেশে, তুমি কার কোলে মাথা রেখে মরার জন্য দেশে ফিরবে! কে আর কোল পেতে বসে আছে তোমার জন্য! যে আদর বাবা তোমাকে কোনওদিন করেনি, সে আদর করছে সে অসুখ ধরা পড়ার পর থেকে। বাবা তোমার সঙ্গে এক বিছানায় ঘুমোচ্ছে। তোমাকে রাতে রাতে উঠে বাথরুমে নিচ্ছে। তোমার সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, তোমার সঙ্গে নরম গলায় কথা বলছে, এসব ছেড়ে তোমার আর কোথায় যাওয়ার প্রয়োজন! বিশেষ করে সেই দেশে যে দেশে ফিরে গেলে তুমি আমাকে পাবে না, ইয়াসমিনকেপাবে না। কিন্তু জানিনা, আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, দেশের আর সব আত্মীয়দের তুমি দেখ, চোখ বোজার আগে তোমার জন্য ফেলা তাদের চোখের জলও তুমি দেখ। তুমি দেখ, তোমাকে শুধু আমি নই, আরও মানুষ আছে ভালোবাসার।

কিন্তু দেশে ফিরে গেলে শেষ কটা দিন তোমার পাশে কে থাকবে মা! পৃথিবীটায় যে তুমি ভালোবাসা পেয়েছে, শুধুই আঘাত পাওনি, এ তোমাকে কে বোঝাবে? আমি সারাদিন ছটফট করি, সারারাত এপাশ ওপাশ করি। আমার আঙুলে একের পর এক সিগারেট পুড়তে থাকে। ভাবনা জট পাকিয়ে যায়, ভাবনাকে খুলে খুলে আলাদা করি। আবার জটপাকায়। তোমার যেমন সময় নেই, আমারও সময় নেই হাতে। নিউইয়র্কের সুইডিশ অ্যামবেসিতে ছুটে যাই, বলি আমি আপনাদের রাজনৈতিক আশ্রয় নিজ দায়িত্বে বাতিল করতে চাইছি, রাজনৈতিক শরণার্থীর জন্য জাতিসংঘের যেপাসপোর্ট আমার আছে, তাও আমি নিজ দায়িত্বে ত্যাগ করছি, আমাকে আমার বাংলাদেশের পাসপোর্টটি ফেরত দিন। জরুরি। দূতাবাস থেকে বলা হল, তাহলে আপনি কিন্তু আর ফিরেপাবেন না আপনার রাজনৈতিকশরণার্থীর সম্মান, এই জাতিসংঘের ট্রাভেল ডকুমেন্টও আর জুটবে না। আমি থোড়াই পরোয়া করি ওসবের। জীবনের ঝুঁকি আমি নেব, তবু আমার মার পাশে আমি থাকবো। নিরাপদ বিদেশ আর ততোধিক নিরাপদ বিদেশি পাসপোর্টে আমার কোনও মোহ নেই। আমি সমস্ত ত্যাগ করতে পারি নিমেষে। সুইডেনের দূতাবাস দ্রুতই আমার কথা রাখলো। সুইডেন থেকে জরুরি তলবে আনিয়ে দিল আমার পাসপোর্ট। ফেরত নিয়ে নিল জাতিসংঘের নথিপত্র। তখনও আয়ু আছে ওই পাসপোর্টের। এখন কিনতে হবে আমার দেশে যাওয়ার টিকিট। অন্য কোনও বিমানে আমার যাওয়া চলবে না, যেতে হবে বাংলাদেশ বিমানেই। কারণ তোমার আর বাবার বাংলাদেশ বিমানেরই ফেরত যাত্রার টিকিট। কিন্তু বিমানের টিকিট কাটতে আমি যদি বিমান অফিসে যাই, মুহূর্তে রাষ্ট্র হয়ে যাবে আমি দেশে ফিরছি। অন্য কাউকে দিয়ে টিকিট কাটালেও আমার নাম নিয়ে সমস্যা। এ নাম তো জগতে দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তির নেই, এক আমার ছাড়া! মিলনকে পাঠালাম টিকিট কাটতে, তসলিমা নাসরিন নামে নয়, যেন টি, নাসরিন নামে টিকিট কাটে। তাই হল, বিমান অফিসের কেউ বুঝলো না এই টি. নাসরিনটি যে আসলে আমি। হতে পারে তৌহিদা নাসরিন, হতে পারে তাবাসসুমা নাসরিন। আমার যাবার খবরটি শুধু হাতে গোনা কজন জানে। বাবা, তুমি, ইয়াসমিন, মিলন, সুহৃদ। একজনের বাইরে আর কাউকেই আমি জানতে দিইনি। ছোটদার সঙ্গে প্রতিদিন ফোনে কথা হচ্ছে, তাকেও বলিনি যে আমি যাচ্ছি। বাংলাদেশে কোনও প্রাণী এ খবর জানুক আমি চাইনি। জানাজানি হয়ে গেলে মৌলবাদীদের প্রয়োজন হবে না, হাসিনা সরকারই আমাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে, সরকারি আদেশ অমান্য করার অপরাধ কী যে সে অপরাধ!

ইয়াসমিন আর মিলন গেল বিমান বন্দরে বিদায় জানাতে। ইয়াসমিনকে বলেছি, এ তোর শেষ দেখা মাকে। শেষবার দেখে নে, ছুঁয়ে নে, মাকে যে ভালোবাসিস বারবার বল। যে কথা আমরা কোনওদিন বলিনি, সে কথা বলে দে। শেষবার। ইয়াসমিন কাঁদলো। তবে জানি না তুমি যে কদিন ছিলে নিউ ইয়র্কে, আমার বাড়িতে সে কেন অতিথির মতো আসতো, কিছুক্ষণ থেকেই তার যাই যাই শুরু হত। এক রাতও সে তোমার সঙ্গে ঘুমোয়নি! দিনে সে কাজ করতো। মুদির দোকানের ছোট কাজ। অনেক বলেছি কাজ টাজ বাদ দে, মার কাছে থাক। থাকেনি। তার টাকার দরকার। প্রচুর টাকা নাকি ধার করেছে দেশে যেতে গিয়ে, সুতরাং ধার শোধ করতে হবে। ধারের টাকা কত বল, আমি দিয়ে দিই, তবু মার কাছে থাক। মাকে আর কদিন পাবি। ডাক্তার বলে দিয়েছে তিন মাস মাত্র মা আছেন। তিন মাসের খবরটি যখন ছোটদাকেও জানিয়েছিলাম, কোনও প্রতিক্রিয়া দেখিনি। কী জানি, ওদের কাছে তিন মাসকে তিন যুগের মতো মনে হয়েছিল কি না। ইয়াসমিন তার কাজ থেকে ফিরে ভালোবাসাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠতো, ওর নাওয়া খাওয়া, ওর ঘুম, ওর কাপড় চোপড়। ভালোবাসাকে নিয়েই এখানে থাক, সবাই একসঙ্গে। না, ইয়াসমিনের যুক্তি ও খুব জ্বালায় সবাইকে। তা জ্বালাক। মার তো সঙ্গ চাই, মা তো ভালোবাসার জ্বালায় জ্বলছে না, তবে কেন! ইয়াসমিন একদিন তোমাকে নেমন্তন্ন করলো তার বাড়িতে। এতদিনে ওই একদিনেই সাত তলা থেকে তিনতলায় ওর বাড়িতে গিয়েছিলে। প্রচুর রান্না কান্না করেছিলো, সেসব খাওয়ালো সবাইকে। বাড়ি বলতে একটি মাত্র ঘর। মিলন ছোট কাজ করে, সে নিজেও ছোট কাজ ধরেছে। একটি ঘর ছাড়া কোনও বড় অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। ও খুশি হত ও যদি তোমাকে তার ঘর, তার দারিদ্র না দেখাতে পারতো। ও বোঝাতে চায় না যে ওর অল্প টাকা আয়, বোঝাতে চায় না যে আমেরিকায় সে এমন কোনও ভালো অবস্থায় নেই। ওর দারিদ্র দেখে তুমি আর বাবা দুঃখপাবে, হয়তো সে কারণে। নাকি অর্থ কড়ি নিয়ে ওর নিজের অহংকার করার কিছু নেই বলে ওই হীনম্মন্যতা! তোর মা আর মাত্র কটা দিন বাঁচবে। তোর কী আছে কী নেই, সেটার হিসেব না করলে কি চলে না রে ইয়াসমিন! জানিনা ইয়াসমিনের হীনম্মন্যতার এও কোনও কারণ ছিল কি না যে আমি যেমন পারছি, ও তোমার জন্য তেমন খরচ করতে পারছে না। ওর দেনার দায়, এই দায় আমার নেই। এর নাম কি তবে ঈর্ষা? তুমি অসুস্থ আর হঠাৎ করে ওর এমন তীব্র সংসারী হয়ে ওঠা, তোমাকে সময় দেওয়ার সময় না পাওয়া কেন! আমি খুব বিরক্ত হতাম ওর আচরণে, ওর না আসায়, না থাকায়। তুমি অনুযোগ করতে না। ও যেতে চাইলে ওকে যেতে দিয়েছো, বাধা দাওমি। একদিন জামার ওপর ও একটা ওড়না পরে এসেছিলো, আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, এটা কোথায় পেয়েছিস, এটা তো আমার শাড়ি ছিলো। হ্যাঁ দেশে গিয়ে ও আমার শাড়ি কেটে ওড়না বানিয়েছে। শাড়ি দিয়ে কী করবো আমি মা, পাঁচশ শাড়ি পড়ে আছে দেশে। বিদেশে তো আমি শাড়ি পরি না। ওই পুরোনো সুতির সস্তা একটা শাড়ি কেটে যদি ও একটা ওড়না বানায়, যে জিনিসগুলো ব্যবহার হচ্ছেনা, সে যদি আমারই ছোট বোন ব্যবহার করে, তবে খুশিই তো আমার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমি বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম, যেভাবে আমি আমার জিনিসপত্র রেখে এসেছি, সব সেভাবেই থাকুক আমি চেয়েছিলাম, এই চাওয়াটাকে মোটে মূল্য দিলি না। কেন বলেছিলাম মা? আগে না হয় বলেছি, দেশে ফেলে আসা আমার ঘর দুয়োর আমি সব আগের মতো ফিরে পাবো, এই স্বপ্ন হয়তো অনেক বড় স্বপ্ন নির্বাসিত এক মানুষের জন্য। কিন্তু তোমার ভয়াবহ অসুখটি হওয়ার পর, ডাক্তার তোমাকে হাতে গুনে কদিন বাঁচবে তা বলে দেওয়ার পর জিনিসপত্র, ঘর বাড়ি, বা কোনও কিছুর কি মূল্য আর থাকার কথা! আমার যা আছে, সব কিছু তো ইয়াসমিনের নামেই লিখে দিয়ে যাবো, তবে কেন ওই স্মৃতিকাতরতা আমার! নির্বাসিতার স্বপ্ন টপ্নও কি তখন তুচ্ছ হওয়ার কথা নয়! তুমিই যদি বেঁচে না থাকে, তবে কোথায় আমি আর ফিরবো? আমার জিনিসপত্রের কাছে, বাড়িঘরের কাছে? ওইইটকাঠসিমেন্ট কংক্রিটকাপড়চোপড় কি দেশের আরেক নাম। তুমিই যেখানে স্মৃতি হয়ে উঠবে আর কদিন পর, কোন স্মৃতি আছে জগতে, যে স্মৃতি তোমার স্মৃতির চেয়ে মূল্যবান? ইয়াসমিনের সঙ্গে অমন ব্যবহার যদি করেইছিলাম, তোমার সামনে করেছিলাম কেন, আমি যে খুব ছোট মনের একটা মেয়ে, স্মৃতি ফিরে পাওয়ার শখে অসভ্যের মতো আকুল, তা তোমাকে দেখিয়ে কি তোমার কিছু ভালো করেছিলাম আমি! যতই আমি তোমাকে শুধু প্রশান্তি দেব, শুধু ভালোবাসার কথা শোনাবো ভাবি, রূঢ় রুক্ষ বাস্তব এসে সব এলোমেলো করে দেয়।

ছোটদাকে সময় তারিখ দিয়ে জানিয়ে দিলাম তোমাকে আর বাবাকে ঢাকার বিমান বন্দর থেকে তুলে নেওয়ার জন্য সে যেন প্রস্তুত থাকে। বাংলাদেশ বিমানে অনেকেই আমাকে চিনে ফেলে, কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাচ্ছেন? এই প্রশ্নের উত্তর যথাসম্ভব এড়িয়ে যাই। কেউ ভাবতে পারছেনা আমি দেশে যাচ্ছি। উত্তর না পেয়ে আবার প্রশ্ন, ব্রাসেলস? আমি হ্যাঁ বা না দুটোই হয়, এমনভাবে মাথা নাড়ি। বিমানের ভেতরের কাউকেই আমি জানতে দিতে চাইনা যে আমি ঢাকায় নামবো। দেশে যে আমাকে ঢুকতে দেওয়া হবে না তা প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ডঃ কামাল হোসেন আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন, সুতরাং দেশের আশা আমার না করাই উচিত। তোমাকেও বলেছি, তুমিও যেন আশা না করো, যদি দেখ ঢাকায় ঢুকতে আমাকে বাধা দেওয়া হচ্ছে, তখন যেন নিষ্ঠুর বাস্তবকে মেনে নেওয়ার শক্তি তোমার থাকে মা। এই দীর্ঘ আকাশ যাত্রায় আমরা একসঙ্গে আছি, অন্তত এটুকুই না হয় আমাদের পাওয়া হোক। তুমি কখনই বুঝে পাওনি, কেন মানুষ এত নিষ্ঠুর হয়। কেন আমার মতো একজন নিরীহ মানুষকে মানুষ দেশছাড়া করে। কেন তার অসুস্থ মার পাশে থাকার জন্য তার আবেদনও অগ্রাহ্য করে। বিমানের যে লোকগুলো ভেবেছিলো আমি ব্রাসেলসে নেমে যাবো, তারা বিস্ফারিত চোখে দেখলো ব্রাসেলসে আমি নামিনি। সম্ভবত ভেবেছে দিল্লিতে নেমে যাবো। দিল্লিতেও নামিনি। তখন কিছু কিছু চোখে স্থির হয়ে ছিল বিস্ময়। আমার পরনে ছিল সাদা সালোয়ার কামিজ। পর্দানশীন মেয়ের মতো মাথায় ওড়না। মাথা ঢাকলেইকি আমার পাসপোর্টের নাম পাল্টতে পারবো! আমি না হয় দেখতে আগের চেয়ে অনেকপাল্টে গেছি, সহসা কেউ আমাকে আমি বলে চিনতে পারবেনা কিন্তু আমি তত আমিই আসলে। বিমান যখন বাংলাদেশের আকাশের ওপর, আঁধার কেটে সব আলো ফুটছে, একটু একটু করে দেশটা ভেসে উঠছে, আমার এই দেশ, এই মাটি জন্ম জন্ম চেনা। কত সহস্র মাইল দূরের নির্বাসন থেকে আজ আমি ফিরছি দেশে, সেদিন যদিতুমি আমার সঙ্গে না থাকতে, তোমার অসুখ যদি না থাকতো, তবে এই দেশের আকাশ থেকে কতকাল না দেখা দেশটার জন্য ফোঁটা ফোঁটা চোখের জল ঝরতো আমার। কিন্তু না মা, চোখে জল আমার ঠিকই ছিল, কিন্তু ওই দেশটার জন্য নয়, এতকাল পরে নিজের দেশের মুখ দেখার সুযোগ পেয়ে নয়। চোখে জল তোমাকে ভেবে, সব থেকে যাবে, ওই অরণ্য, ওই নদী, ওই মানুষ, ঘরবাড়ি, শুধু তুমিই থাকবে না। ঢাকার বিমান বন্দরে নেমে আমি সোজা আর সব যাত্রীর মতো হেঁটে যাই ইমিগ্রেশনের দিকে। আমি জানি আমাকে যে কোনও মুহূর্তে পেছন থেকে, বা ডান বা বাঁ দিক থেকে খপ ধরে ফেলবেপুলিশের লোক। আমি জানি ইমিগ্রেশনেই ওঁত পেতে আছে আমার পথ আটকে দেওয়ার লোক। এই বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশনই একবার আমাকে দেশ থেকে বেরোবার পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছিলো। আর আজ দাঁড়াবে আমার দেশে ঢোকার পথ রোধ করে। একটা মানুষের ওপর আর কত বছর অন্যায় চলবে! আমার চোয়াল শক্ত হতে থাকে। জানিনা দুর্যোগের সময় এক শরীর শক্তি আমি কোত্থেকে পাই। আমার হাঁটায় দৃঢ়তা, আমার পিঠ টান টান, আমার মাথা উঁচু। হ্যাঁ আমি দেশে ফিরছি, আমার নিজের দেশে, এ দেশ তোমাদের কেনা নয়, এ দেশের আর সবার মতো এ দেশ আমারও। এ দেশ শেখ হাসিনার একার দেশ নয়, এ দেশ খালেদা জিয়ার বাপের সম্পত্তি নয়, এ দেশ আমারও। এ দেশ মৌলবাদীদের বধ্যভূমি নয়, এ দেশ আমার মতো সৎ ও সাহসী মানুষের দেশ। আমি কোনও অন্যায় করিনি, যারা অবৈধ ভাবে আমাকে ঢুকতে দেবে না দেশে, অন্যায় তারা করবে। মা, তোমাকে দেখছিলাম তুমি আমার মতোই মাথা উঁচু করে হাঁটছো। বাবা বোধহয় বারবার পিছিয়ে পড়ছিলো। তুমি আর আমি হেঁটে যাচ্ছিলাম আর সবার মতো। ইমিগ্রেশনের লোকের হাতে তিনটে বাংলাদেশের পাসপোর্ট আমি নিজেই দিই। তুমি আমাকে আলগোছে আড়াল করে দাঁড়ালে। তোমার বুক কি ঠাণ্ডা হয়ে ছিলো নাকি তুমিও দাঁতে দাঁত চেপে সাহসে বুক বেঁধেছিলে! আমরা কেউ কোনও কথা বলছিলাম না। আমি প্রার্থনা করছিলাম এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, এই জগৎ, এই প্রকৃতি, এই জীবনের কাছে, তুমি যদি মানবিক হও, তোমার ক্রুরতা থেকে আজ নিজেকে মুক্ত করো, আমার বঞ্চিত, নিপীড়িত, আমার দুঃখিনী মাকে আজ একটু করুণা করো। মাথা নিচু করে বসে থাকা লোকটি মুখ তোলেনি, তিনটে পাসপোর্টেই খটাশ খটাশ টাশ করে সিল মেরে দিল। ঠিক ওই মুহূর্তকে জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত বলে মনে হয়েছিল আমার। যত দ্রুত সম্ভব, বিমান বন্দর থেকে বেরোই। গাড়ি নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে ছোটদা। আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। তা তো উঠবেই। তার তো গভীর বিশ্বাস ছিলো জীবনে কখনও আমি দেশে ফিরতে পারবো না। রাষ্ট্রও করে দিয়েছিলো যে বাংলাদেশের মাটিতে আমার ফেরা অসম্ভব। তুমি মুষড়ে পড়তে ছোটদার অদ্ভুত উচ্চারণে। তুমিই আমাকে ফিরিয়েছো মা। কোনও রাজনীতিবিদ, কোনও কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী আমাকে ফেরায়নি। তুমিই তোমার ঘরের মেয়েকে ঘরে ফিরিয়েছো। আত্মীয় স্বজন সবাইকে পেয়ে, নিজের দেশ, নিজের বাড়ি ফিরে পেয়ে আমার অদ্ভুত আনন্দ হয়, একই সঙ্গে বিষাদ এসে ঘিরে রাখে আমাকে। তুমি আমার দেশে ফেরার আনন্দে যেন অনেকটাই সুস্থ হয়ে ওঠো, ভুলে যেতে থাকো নিজের অসুখের কথা। পরদিন দেশের সব পত্রিকায় ছাপা হয়ে গেল যে আমি দেশে ফিরেছি। সাংবাদিকদের ভিড় গেইটের সামনে, বলে দেওয়া হল আমার বাড়ি তালাবন্ধ, ভেতরে কেউ নেই। দেখেছো তো রাতে ঘরের আলো জ্বালাতাম না, দরজা জানালা বন্ধ থাকতো, যেন বাইরে থেকে বোঝার কোনও উপায় না থাকে বাড়ির ভেতর কোনও প্রাণী আছে। কথাও বলতাম আমরা প্রায় নিঃশব্দে। মানুষ খবর চায় আমার, কিন্তু পাবে কী করে। পত্রিকাগুলো প্রতিদিন গল্প ছাপাতে শুরু করলো। আমি নাকি ময়মনসিংহে, কাল নান্দাইলে গিয়েছি বাবার পৈত্রিক বাড়িতে। আবার অন্য পত্রিকায় লেখা আমাকে নাকি দেখা গেছে ডঃ কামাল হোসেনের বাড়িতে ঢুকছি, দেখা গেছে শ্যামলীর দিকেনীল একটি গাড়ি করে লাল একটি শাড়িপরে কোথায় কোন আত্মীয়ের বাড়ির দিকে যাচ্ছি। এসব গল্পে একটা লাভ হয়, কেউ আমার শান্তিনগরের বাড়িতে আর ভিড় করে না। তুমি চাও আমি যা লিখেছি তার জন্য ক্ষমা চেয়ে আবার আগের মতো নিরাপদ জীবন যাপন শুরু করি। চাও সাংবাদিকদের যেন জানিয়ে দিই যে আমি ক্ষমা চাইছি। সে আমি করবো কেন, আমি কোনও ভুল করিনি, আমি কোনও মিথ্যে বলিনি, ক্ষমা চাওয়ার তো প্রশ্ন ওঠে না। তুমিও হয়তো জানতে যে আমি ভুল করিনি, কিন্তু আপোস করতে চেয়েছিলে, আমার নিরাপত্তার কথা ভেবেই চেয়েছিলে তুমি। তুমি জানো মৌলবাদীরা এখন ওদের তরবারিতে শাণ দিচ্ছে, সরকার পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছে আমাকে পাকড়াও করার জন্য। পত্রিকার গল্পের সূত্র ধরেপুলিশ নাকি নানা জায়গায় আমার খোঁজ করছে। যেখানে আমার যত আত্মীয় আছে তাদের বাড়িতে বাড়িতে তো যাচ্ছেই। যেখানে যত বন্ধু ছিল আমার, তাদের বাড়িতেও হানা দিচ্ছে। যখন আর লুকোনোর উপায় নেই যে আমি দেশে, পত্রিকা অফিসকে পুলিশ যখন তথ্যের সত্যতা জানিয়েই দিয়েছে যে হ্যাঁ আমি দেশে, তখন বন্ধু সাংবাদিক ফরিদ হোসেনকে আর বাধা দিইনি আমার সঙ্গে দেখা করতে। ফরিদকে তুমি বলেও দিলে, যে, তোমার মেয়ের হয়ে তুমি দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইছো, তারা যেন তোমার মেয়েকে ক্ষমা করে দেয়, এবং মেয়েকে নিজের দেশে নিরাপদে বাস করতে দেয়। ফরিদ ছাপিয়েছিলো এমন একটা খবর, কিন্তু এরপর কি মৌলবাদীরা আমাকে ক্ষমা করেছিলো মা? বলে দিয়েছে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করতে পারে, কিন্তু তারা করবে না। এই আল্লাহ খোদায় বিশ্বাসীদের, আমি লক্ষ করেছিলাম, তুমি যেন খুব একটা বিশ্বাস করছে না। তুমি জানো পীর বাড়ির লোকেরা তোমাকে কী করে জঘন্য অপমান করে তাড়িয়েছে। তাদের মতে তুমি একটা ক্ষমার অযোগ্য পাপ করেছে, আমার মতো নাস্তিককে জন্ম দিয়েছো। তোমার একটাই অপরাধ, তুমি আমার মা। তুমি যদি অস্বীকার করতে তুমি আমার মা নও, আমাকে তুমি আর মেয়ে বলে স্বীকার করো না, তাহলে ওরা তোমাকে পীর বাড়িতে ঢুকতে দিতো। ওদের ওই চাপ সত্ত্বেও তুমি আমার বিরুদ্ধে কোনও শব্দ উচ্চারণ করোনি। তুমি আমাকে নয়, বরং ওদের ত্যাগ করেছে। আমার সততা আর উদারতার প্রসঙ্গ টেনে বরং ওদের সঙ্গে তুমি তর্ক করেছে। হাদিস কোরানের কথা শুনতে তুমি গুলকিবাড়ির একটা বাড়িতে যেতে, যেখানে এক মহিলা ভালোবেসে তোমাকে কাছে টেনেছিলো। হয়তো ভালোবাসাকেই মূল্য দিতে বেশি। তুমি ভালোবাসাকেই মূল্য দিতে বেশি। ধর্মের নামে নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা, অসহিষ্ণুতা, অন্যায় তুমি নিজেও মেনে নিতে পারোনি। তাই এতকাল ধরে বিচরণ করা পীরবাড়ির আঙিনা ছেড়ে আসতে কোনও দ্বিধা করোনি।

সরাসরি সৌদি আরব থেকে এনে তার এক ছাত্রী তাকে উপহার দিয়েছে, সেই কোরান পাঠের ক্যাসেটগুলো ঝুনু খালা তোমার জন্য এনেছিলো, ওই ক্যাসেট আমি সারাদিন চালিয়ে রাখতাম, যেন তুমি শোনো। আমি কোনওদিন লক্ষ করিনি তুমি ওগুলো মন দিয়ে শুনছো বা শুনতে চাইছো। কোনও কোনও সময় বলতে যেন এবার একটু বন্ধ করি ওসব। তুমি আমাকে পাশে নিয়ে বসে গল্প করতে চাইতে। আমি তোমাকে আনন্দ দিতে তখন মরিয়া হয়ে উঠেছি, তোমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে সেই ছোটবেলায় পড়া সুরাগুলো আওড়েছি, ভুলগুলো তুমি সুদ্ধ করে  দিতে, হয়তো খুশি হতে দেখে যে, যে কাজটা আমাকে একসময় তুমি করতে বলতে, করিনি, আর আজ আমি স্বেচ্ছায় তা করছি। তোমার চুল পাখার হাওয়ায় উড়তে আর তোমাকে কী যে পরিতৃপ্ত মনে হত। পরে আমি লক্ষ করেছি, এমন কী তোমার প্রিয় কোনও সিনেমার গান গাইলেও তুমি একই রকম খুশি হও। একদিন তো টেলিভিশনে সবার ওপরে নাকি শাপমোচন নাকি হারানো সুর কী একটা ছবি হচ্ছে, তুমি ড্রইং রুমে গিয়ে সিনেমাটা দেখছিলে, একসময় কী ভালোই না বাসতে তুমি উত্তম সুচিত্রার সিনেমা দেখতে। তোমাকে দেখতে আমার ভীষণ ভালো লাগছিল। অন্যরকম। ধর্মের আফিম খেয়ে যেমন সিনেমা দেখা বাদ দিয়েছিলে, টেলিভিশন দেখাও বন্ধ করেছিলে, কারণ পীর বাড়ি থেকে ওসব দেখার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি হয়েছিল। সেই তুমি সব নিষেধ উড়িয়ে দিয়ে সেই তোমার তরুণী বয়সের মতো সিনেমা দেখছে। চোখে তোমার আগের মতো সেই উজ্জ্বলতা। বাড়িতে লোক চলে এলে অবশ্য তুমি উঠে গিয়েছো, একটু কি লজ্জা হয়েছিলো তোমার! কেন মা? ধার্মিক হিসেবে তোমাকে সবাই জানে বলে কি তোমার যা ভালো লাগে তা তুমি করবে না? আমার এখন অনুশোচনা হয়, কেন আমি তোমার প্রিয় প্রিয় সিনেমাগুলোর ভিডিও ক্যাসেট বা ডিভিডি এনে তোমাকে দেখাইনি? কেন আমি ওই কোরান আবৃত্তি দিনের পর দিন ছেড়ে রাখতাম! তুমি তো কোরান পড়তে দোযখে যেতে হবে, সেই ভয়ে। তুমি তো সিনেমা দেখতে কোনও ভয়ে নয়, আনন্দে। তোমাকে আনন্দ দেওয়াই যদি আমার উদ্দেশ্য হয়, তবে কেন আমি ও কাজটা করিনি! সারাদিন তোমাকে অসুস্থ মানুষের মতো শুইয়ে রাখতে চাইতাম। কিন্তু সারাদিনই তুমি বিছানায় শরীর ছোঁয়াতে চাইতে না। একদিন বাড়িতে ক্যারম খেলা হচ্ছিল। তুমি এলে ক্যারম খেলতে। আমার উৎসাহ পেয়ে তুমি আরও যেন কিশোরী হয়ে উঠেছিলে। তুমি যেন ছুটে ছুটে যেতে চাইছিলে তোমার শৈশবে, কৈশোরে, তোমার যৌবনে। বাড়ির কেউ তোমাকে কোনওকিছু নিয়ে বিদ্রূপ করছে না, ঘৃণা করছে না, তোমার কেন ছুটতে ইচ্ছে করবে না, বলো।

মাঝে মাঝে ভাবি, যদি তোমার ভয়ংকর অসুখটা না ধরা পড়তো, এবং কেউ না জানতো যে আর কটা দিন পরই দুনিয়া থেকে তোমাকে বিয়ে নিতে হবে, তবে তোমাকে বোধহয় আগের মতোই অবহেলা অপমানে জীবনের শেষ দিনগুলোও পার করতে হত। বাবার মতো লোক যে কিনা ময়মনসিংহের চেম্বার ছাড়া আর অবকাশ ছাড়া এক মুহূর্তও কোথাও থাকতে চায় না, সে দিনের পর দিন মাসের পর মাস নিউইয়র্কে আর ঢাকায় পড়ে আছে, তোমাকে সঙ্গ দেবে বলে। অসুখটা না হলে পেতে বাবাকে এত কাছে? নিউইয়র্কের বাড়িতে বাবা তোমাকে পাশে নিয়ে খেয়েছে, রাত জেগে তোমার যত্ন করেছে, ঘুমোয়নি রাতের পর রাত। তোমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। হ্যাঁ মা, হঠাৎকরে তোমার জন্য সবার ভালোবাসা উথলে উঠেছিলো। দাদা অবকাশ থেকে চলে এসে দিনরাত ফুটফরমাশ খাটছে। তাকে পাঠাচ্ছি বাইরের কাজগুলো করতে, ওষুধ আনা, ডাক্তার আনা, কিমোথেরাপি দেওয়ার লোক আনা, ডলার ভাঙানো, ব্যাংকের স্টেটমেন্ট আনা, বাজার করা। দাদা মুখ বুজে সব করে যাচ্ছে। বড় মামা, ফকরুল মামা, ঝুনু খালা তোমাকে দেখতে আসছে। যে নানিকেশত বলেও ঢাকায় আনা যায় না, সেই নানিও চলে এসেছে শান্তিনগরে। তোমাকে সঙ্গ দিতে। ছটকু আসে ময়মনসিংহ থেকে তোমাকে দেখতে। ফেলু মামা আর হাশেম মামার ছেলে সুমন এসেছিলো তোমাকে দেখতে, তাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। শরাফ মামাকেও না। কেন যে ওদের ঢুকতে দেওয়া হল না! আবার কে না কে কাকে জানিয়ে দেয় যে আমি কোথায় আছি, সে কারণেই। হাশেম মামার মেয়ে সুলতানার বিয়ে হওয়ার পর ঢাকায় থাকে, ও একদিন বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে এসেছিলো তোমাকে দেখতে। আমি তখন লেখার ঘরে দরজা বন্ধ করে বসেছিলাম। এখন ভাবি, এদের নিয়ে আমার ভয় পাওয়ার কী ছিলো মা! আশংকা আমার চেয়ে বেশি হয়তো তোমার হতো। তুমি চাইতে আমার সঙ্গে কারও দেখা না হোক। আমাকে পেয়ে তোমার নিজের আত্মীয়দেরও তুমি বিশ্বাস করোনি। ওদের থেকেও দূরে থাকতে চেয়েছে। নানিও থাকুক তোমার সঙ্গে, চাওনি। অনেকবার নানিকে তুমি বলেছো যে বাড়িতে হাশেম মামা অসুস্থ, তাকে রেখে নানি কেন ঢাকায় এসেছে। তোমাকে আমরা কেউ বলিনি যে হাশেম মামা মারা গেছে। তুমি কষ্ট পাবে বলে বলিনি। নানিকে মিথ্যে কথা বলতে হল যে এখন হাশেম মামাকে দেখার লোক আছে। আমরা সবাই চাইছিলাম নানি তোমার কাছে থাকুক। বাবাও। নানি সারাদিন কোরানপড়ে তোমার মাথায় মুখে শরীরে ফুঁ দিয়ে দেয়। আমার মনে হয় না এসব ফুঁ টু তোমার ভালো লাগে। আগে হয়তো লাগতো, এখন আর লাগেনা। এখন তুমি কিমোথেরাপি নিতে চাও কাজ হয় না জেনেও কিমোথেরাপিদিই তোমাকে, তোমার ভালো লাগবে বলে দিই, কিছু একটা চিকিৎসা তোমার হচ্ছে এই ভেবে তোমার ভালো লাগে। কিমোথেরাপি দেওয়া হলে, না মা, তোমার শরীর ফুরফুরে লাগে বলে যা বলল, তা ভুল বললো, তোমার মন ফুরফুরে লাগে। কিন্তু তোমার রক্তের শ্বেত কণিকা এত কমিয়ে ফেলে এই বিষ যে দুদিনপরই তোমাকে হু হু জ্বরেপড়তে হয়। ওষুধ খাইয়েও, সারা গায়ে ঠাণ্ডা স্পঞ্জ করেও তোমার জ্বর কমাতে পারি না। পাশের বাড়ির ডাক্তার প্রজেশকে ডাকা হয়, প্রজেশ আমার শিক্ষক ছিলেন মেডিকেল কলেজে। তোমাকে দেখে বলে দেন হাসপাতালে ভর্তি করতে। তুমি ভর্তি হলে দাদা আর বাবা হাসপাতালে যাতায়াত করলো। আমি ঘরে। আমার পক্ষে তো তোমাকে দেখতে যাওয়ার উপায় নেই। মৌলবাদীরা কোথায় ওঁত পেতে আছে কে জানে, ওঁত না পেতে থাকলেও, দেখে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ার লোকও কম নেই এ শহরে। হাসপাতালে তোমার জন্য খাবার পাঠানো ছাড়া বাড়িতে আমার তখন আর কাজ থাকেনা। অবশ্য খাবার তৈরি করে শেফালিই। শেফালি বাড়ির সব কাজ একাই করে, তোমার কাজও। তুমি যখন হাসপাতালে, আমাকে দেখতে শামসুর রাহমান আর নির্মলেন্দু গুণ এসেছিলেন। আমার একটুও মনে হয়নি ওঁদের সঙ্গে আমার বহু বছর পর দেখা হল, আগে যেমন আড্ডা হত, তেমনই হলো আমার লেখার ঘরে বসে। আড্ডার বিষয় ছিলো মূলত রাজনীতি আর একটু আধটু সাহিত্য। কাছের কিছু মানুষকে আমার জানাতেই হয়েছে আমি কোথায় আছি। দেশ বিদেশের সাংবাদিকদের মধ্যে এক বিবিসির ডেভিড সেসানকেই সাক্ষাৎকার দিয়েছি, আমি কোথায় আছি সে খবর গোপন রাখবে এই শর্তে। সাক্ষাৎকারে বলেছি, দেশ থেকে বেরোনোর কোনও ইচ্ছে আমার নেই। মৌলবাদীদের ফতোয়া বা তাণ্ডবের আমি পরোয়া করি না। লেখার মাধ্যমে সমতা আর সমানাধিকারের জন্য সংগ্রাম করছি। যাদের জন্য লিখি সেই মানুষ থেকে এবং যে ভাষায় লিখি, সে ভাষা থেকে দূরে সরে গেলে লেখালেখি সম্ভব নয়। এদিকে শুনি পুলিশ খুঁজছে আমাকে। যে ইমিগ্রেশনের লোকটি আমাকে দেশে ঢুকতে দিয়েছিলো তার নাকি চাকরিও গেছে। মতিঝিল থানা থেকে পুলিশ এসে বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশগুলো জানেও না কেন তারা এখানে, আমার জন্য গুপ্তচর না কি আমার জন্য পাহারা, আমিই কী আর জানি! আমার বিরুদ্ধে নতুন কোনও ফতোয়া জারি হয় না, কোনও মিছিল বেরোয় না রাস্তায়। কিছু যদি দুর্ঘটনা না ঘটতে থাকে, তবে সাহস এসে ভর করে মা। আমি একদিন রাত বিরেতে চলে গেলাম ঝুনু খালার বাড়িতে। আবার একদিন বারডেম হাসপাতালে দেখতে গেলাম তোমাকে। ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বললাম। ইনসুলিন দিচ্ছে তোমাকে। কী আর খাচ্ছো তখন যে এত এত ইনসুলিন দিতে হয়! নার্সরা যখন সুঁই ফোঁটায় তোমার গায়ে, আমি অন্যদিকে তাকিয়ে থাকি। দেখলে মনে হয় সুই যেন আমার গায়ে ফোঁটালো। সুঁই তো নিজেই তুমি নিজের গায়ে ফোঁটাও যখন নিজে তুমি দিনে তিনবেলা ইনসুলিন নাও। আমি বুঝে পাই না কী করে পারো তুমি। তোমার অভ্যেস হয়ে গেছে, নিজের গায়ে সুঁই ফোঁটাতে তোমার আর কষ্ট হয় না। কিন্তু বুঝি না, তুমি নিতান্তই সামান্য কিছু মুখে দিচ্ছ, কেন তবু তোমার রক্তের চিনি উঁচুতেই উঠে থাকে। সম্ভবত তোমার অসুখটিই চিনিকে কমতে দেয় না, দিনের পর দিন তুমি উপোস থাকলেও। কিমোথেরাপির লোক এসে যখন বাড়িতে তোমার হাতের শিরা বের করে সুই ঢোকাতে চাইতো, আমি চাইনি তুমি কোনও ব্যথা পাও, জায়গাটা অবশ করার জন্য একটা মলম কিনেছি, সেটা লাগিয়ে তারপর সুই ঢোকাতে দিয়েছি। কেন অমন করেছি মা? সুইএর ব্যথা কি তোমার কাছে আদৌ কোনও ব্যথা, তোমার তো ক্রমাগতই ব্যথা হচ্ছে পেটে। মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করেছি ব্যথা কি কমেছে? তুমি ম্লান হেসেছে। উত্তর দিয়ে আমার মন খারাপ করতে চাওনি। তবে কোনও কোনও সময় বলেছে, যে, ব্যথা সবসময় আছেই। একদিন বললে, ব্যথা নয়, ব্যথার চেয়েও বড় কিছুতুমি অনুভব করো। সেটা যে কী তুমি কোনও শব্দে বা ভাষায় বোঝাতেপারোনি। আমার তো বোঝার ক্ষমতাই নেই। কী করে থাকবে, আমার কি সারা শরীর ছাওয়া ক্যানসারে! একটু একটু করে আমি তো বুঝতে পারছিলাম তোমার শরীর বদলে যাচ্ছে, তোমার পেটে পানি আসছে, পেট ফুলে যাচ্ছে, তুমি ওড়না দিয়ে পেট ঢেকে রাখো। কেন মা? কেন আমাকে বলোনি যে তোমার পেট ফুলে উঠছে দিন দিন? জিজ্ঞেস করলে তুমি নিজেকে আড়াল করো। তুমি কি আমাকে বুঝতে দিতে চাইতে না? অসুখ লুকোতে চাইতে মা? কাকে খুশি করতে? কেন চিৎকার করে বলোনি, তোমার তো চিকিৎসা হলো, সাড়ে চার ঘণ্টার একটা বড় অপারেশন হলো, শরীরে অনেক রক্ত দেওয়া হল, বিদেশের হাসপাতালে চিকিৎসা হল, তোমার তো ভালো হয়ে যাওয়ার কথা, তবে পেট ফোলে কেন, কেন ব্যথা দিন দিন বাড়ছে? কেন শরীরের অবস্থা ভালো হওয়ার বদলে আরও খারাপ হচ্ছে? কেন তোমার বিবমিষা, কেন খেতে পারছো না? একবারও তো কাউকে বলোনি, না আমাকে, না বাবাকে, না ডাক্তারকে, না তোমার মাকে, বা ভাই বোনকে! যখন তোমারপাইলসের রক্ত যাচ্ছিল, অভিযোগের সীমা ছিল না। চিকিৎসাপাওয়ার জন্য চিৎকার করতে। তখন কেউ আমরা তোমার চিৎকারের গুরুত্ব দিইনি। আর যখন তোমার একটি শব্দকেও আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি, তোমার পাশে পাশে থাকছি, তোমাকে কী করে ভালো রাখা যায় তার চেষ্টা করছি, তখন তুমি একবারও তোমার শরীরের কোনও কিছু নিয়ে কারও সঙ্গে আর কথা বলছো না। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে হয় উত্তর দিচ্ছ না, এড়িয়ে যাচ্ছো, নয়তো ভালো আছি ধরনের কিছু বলে প্রসঙ্গ বদলাচ্ছো। কেন মা? বুঝতে পেরেছিলে তোমার অসুখ সেরে যাওয়ার অসুখ নয়! একটুও তো তখন মৃত্যুর কথা বলেনি। একটুও তো মুষড়ে পড়োনি, কাঁদোনি। একটুও তো ভয় পাওনি। শিউরে ওঠোনি। একটুও তো কোরান নিয়ে বসোনি। আগে তো মৃত্যুর কথা বলে বলে কাঁদতে, যখন সুস্থ ছিলে!

হাসপাতাল থেকে জ্বর খানিকটা কমানো হয়েছে কড়া অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে। তোমাকে বাড়ি আনা হল। কিমোথেরাপি শেষ পর্যন্ত বন্ধ করতে হলো। কারণ তোমার শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। তোমার ঘর আগপাশতলা ডেটল দিয়ে পরিষ্কার করে তোমাকে বিছানায় শোয়ালাম। তোমার ধারে কাছে যেন কেউ না আসে সেই ব্যবস্থা করলাম। কারও শরীর থেকে যেন কোনও জীবাণু গিয়ে তোমাকে না আক্রমণ করে। যারা তোমার ঘরে ঢুকতো, নিয়ম করে দিয়েছিলাম ঢুকবে পায়ের জুতো খুলে, হাতপা ধুয়ে। দূরে চেয়ারে বসতে দিতাম তোমাকে দেখার জন্য। বুঝি না কেন আমি তোমাকে সবার থেকে দূরে সরিয়ে রাখছিলাম। কী লাভ, শরীরের ভেতরটাতো তোমার ক্ষয়ে যাচ্ছিল। কটা দিন যেন বেশি বাঁচো? কিন্তু মানুষের স্পর্শ তোমাকে তো আনন্দ দিতে পারতো কিছুটা! স্পর্শের আশ্চর্য এক শক্তি আছে। আমিও আশংকায় তোমাকে স্পর্শ করিনি।

হঠাৎ করেই যেন শয্যাশায়ী হয়ে গেলে মা। অথচ নিউইয়র্ক থেকে ফিরে এসে দিব্যি তো ছিলে, বাজার আসছে, মাছ মাংস আলাদা করছে। কী রান্না হবে তা বলে দিচ্ছ, দেখিয়ে দিচ্ছ। আমি প্রথম প্রথম বলেছিলাম তুমি ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকো, এসব আমি দেখছি। কিন্তু তুমি শোনোনি। বাড়ির দেখাশোনার দায়িত্ব তুমি নিলে। এখন বুঝি সেই নেওয়াটা কত প্রয়োজন ছিলো তোমার। তুমি অসুস্থ মানুষের মতো শুয়ে থাকতে চাওনি। শরীরের শেষশক্তি পর্যন্ত তুমি উঠেছো, হেঁটেছে, ব্যস্ত থেকেছে। আমার সংসার তখন তোমার সংসার। তোমার নিজের সংসার তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে তোমার ছেলের বউ, মেয়ের সংসারের দায়িত্ব শুধুনাওনি, মেয়ের টাকা পয়সা বাঁচাবার চেষ্টা করেছে খুব। প্রচুর টাকার বাজার করতে পাঠাতাম কিন্তু তুমি হিসেব করে রান্না করতে বলতে। এই হিসেবটা আমার ভালো লাগতো না। আমি চাইতাম প্রচুর রান্না হোক, বাড়িতে সবাই আমরা, তার ওপরনানি আছে, ঝুনু খালা আসছে, অন্যরাও আসছে। তোমার আত্মীয়রা সবাই আসুক তোমার কাছে, সবাই থাকুক। তোমাকে ঘিরে থাকুক সবাই, তোমাকে যারা ভালোবাসে, অথবা তুমি যাদের ভালোবাসোসবার ভালোবাসা পেয়ে তোমার যেন মন ভরে। শরীরের কষ্টটাকে কেউ তো আমরা দূর করতে পারবোনা। যতদিন বেঁচে আছো, যেন তুমি কোনও দুর্ঘটনা না দেখ, দুঃসংবাদ না শোনো, যেন কোনও কান্নার শব্দ, যেন কোনও হাহাকার, যেন ঝগড়া, যেন হিংসে, যেন কটুকথা না শোনো। শুধু ভরে থাকো হাসিতে আনন্দে। কিন্তু আমার চাওয়ার মতো সবকিছু ঘটে না। তুমি বলোনি কিন্তু বুঝতে পারতাম যে তুমি চাইতে

ঝুনু খালা আসুক এত ঘন ঘন। তুমি এমনকী নানিকেও বারবার বলছো যেন ময়মনসিংহে ফিরে যায়। তোমাকে কোনও প্রশ্ন করিনি। কিন্তু আমার খারাপ লাগতো। আমি লক্ষ করতাম দুপুর বা রাতের খাবারের সময় টেবিলে এসে বসছো। তুমি সবাইকে বেড়ে দিচ্ছ যার যার খাবার। এসবের কী দরকার ছিল! বলেছি, মা, তুমি নিজের খাবার খাও, আমরাই আমাদের খাবার বেড়ে নিতে পারবো। তুমি শোনোনি। যেহেতু আমি চেয়েছিলাম যেমনভাবে ভালো লাগে তেমন ভাবেই চলো। যা করতে ইচ্ছে হয়, তাই যেন করো। তাই তোমার থালায় খাবার বেড়ে দেওয়াকে বন্ধ করতে চাইনি জোর করে। এতে যদি আনন্দ পাও, পাও। নিজে তুমি খেতে না, তোমার খাওয়ার মধ্যে সকালে আধসেদ্ধ ডিম, দুপুরে তরল করে বানানো এক বাটি মুরগির স্যুপ, মাঝে মাঝে আধবাটি মুড়ি। আর কিছু পেটে নিতে তোমার ইচ্ছে করতো না। আমাদের সবার থালায় খাবার বেড়ে দেওয়ার সময় আমি লক্ষ করতাম, তুমি নানির থালায় ছোট এক টুকরো মাছ বা মাংসের টুকরো দিয়েছো, ঝুনু খালা বা ছেলের থালাতেও। আর আমার থালায় বিশাল কিছু একটা দিয়ে বসে আছে। দেখে আমার এত লজ্জা হত যে আমি মাথা নিচু করে খেতাম, মনে মনে ক্ষমা চাইতাম ওদের কাছে। বাড়িতে আরও বেশি রান্না হলেই তোপারে। এতগুলো লোকের কী এত কম রান্নায় হয়! কী হচ্ছে এসব? এসব নিয়ে চেঁচাতে ইচ্ছে হত আমার। কিন্তু তোমার যদি মন খারাপ হয়, তাই মুখ বুজে থাকতাম। আমি যা পছন্দ করি খেতে, তুমি তাই রাঁধতে বলতে। একবার লাটি মাছের ভর্তা করলে। সেও কেবল আমাকেই খাওয়াতে চাইলে। তোমার। চরিত্র, সত্যি বলছি, আমার খুব অচেনা ঠেকেছে। তুমি শুধু দিতেই মানুষকে, যত পারতে ঢেলে দিতে। সেই তুমি কী হয়েছে যে পাল্টেগেছ? নানিকে কেন তুমি চাওনি তোমার সঙ্গে থাকুক? তুমি কি আমার খরচ বাঁচাতে চাইতে? তুমি দেখেছো পনেরো হাজার ডলার আমি আমেরিকা থেকে এনেছি। দশ লাখ টাকারও বেশি। এসেই নতুন একটা রেফ্রিজারেটর কিনেছি, কী দরকার। ছিল কেনার আগের সেই সুন্দর লাল রেফ্রিজারেটরটা তত ছিলোই। কিন্তু তারপরও মা, মনে হয়েছিলো তুমি হয়তো খুশি হবে। আমি যে জাঁকিয়ে বসছি আমার সংসারে তা দেখে তোমার আনন্দ হবে, তোমার এতকালের স্বপ্ন আমাকে ঘরে ফেরানো, সেই স্বপ্ন পূরণের উৎসব কিছু একটা দিয়ে না হয় তোক। কেনার পেছনে আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল যে বাড়িতে এখন তোমাকে দেখার জন্য আত্মীয় স্বজন চেনা পরিচিতরা আসবে, আতিথেয়তা ছিল তোমার সবচেয়ে বড় ধর্ম, যে ধর্মটা বাবার সংসারে থেকে তুমি পালন করতে পারোনি, পারোনি তোমার ভাই বোনকে অবকাশে নেমন্তন্ন করতে। তোমার মাকে ভালো ভালো রান্না করে খাওয়াতে পারোনি তোমার কোনও বান্ধবী বা কাউকে বাড়িতে আপ্যায়ন করতে। আজ যেন এই সংসারকে তোমার সংসার মনে করে তুমি যা করতে পারোনি আগে, তা করতে পারার অবাধ স্বাধীনতা ভোগকরো। আমি ডলারগুলো সব তোমার হাতেই তুলে দিয়েছি। অথচ আশ্চর্য, তোমার সেই স্বতঃস্ফূর্ততা আমি দেখছিলাম না। নানিকে কেন তুমি বারবার বলছিলে চলে যেতে, তোমার কি মনে হচ্ছিল নানি আমার টাকার লোভ করছে? না, মা, মোটেও করেনি। নানি সম্পূর্ণই তোমার পাশে থাকতে চেয়েছিলো। আর কোনও উদ্দেশ্য নানির ছিলো না। হাশেম মামাকে কবরে শুইয়ে নানি তোমার কাছে এসেছে, তুমিই ছিলে একমাত্র যেনানিকেনিঃস্বার্থ ভাবে সেবা করেছো, তুমিই ছিলে একমাত্র যে নানিকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছো, তোমার তিন মাস বাঁচার খবর তো নানি জানে, নানি কেন ছুটে আসবেনা, জগতের সব ফেলে ঘর বাড়ি সংসার, কেন তোমার কাছে থাকবেনা, মা? তুমি হয়তো ভাবছিলে বাড়িতে হাশেম মামাকে অসুস্থ রেখে নানির তোমার কাছে ছুটে আসা, নিরবধি তোমার সঙ্গে থাকার পেছনে কোনও উদ্দেশ্য আছে, যে উদ্দেশ্যটি খুবমহৎনয়। হাশেম মামার অসুখের চেয়ে তোমার অসুখ কেন নানির কাছে বড় হল, তাই নিয়ে হয়তো নানারকম অংক কষছিলে। হাশেম মামা দুরারোগ্য ক্যানসার রোগে আক্রান্ত। তোমার তো চিকিৎসা হয়েছে, তোমার পাশে তোমার স্বামী পুত্র কন্যা আছে! তোমার অসুখ তো দুরারোগ্য নয়। নানি বরং পাশে থেকে হাশেম মামাকে একটুখানি শরীরের আরাম না দিতে পারুক, মনের আরাম দিক। অথবা তোমার নিজের চেয়ে হাশেম মামাকে তুমি ভালোবাসতে বেশি, তা হাশেম মামার কাছে যেহেতু তুমি যেতে পারছে না, অন্তত নানি যেন পাশে থাকে, তাই চাইছিলে। হাশেম মামা যে আর নেই, সে কথাও তোমাকে বলা যাচ্ছে না। আমি আজও বুঝি না ঝুনু খালাকেও কেন তুমি চাইতে না যে আসুক, বাড়িতে থাকুক। তোমারই তো ছোট বোন, ওকে তো কত ভালোবাসতে তুমি। সম্ভবত ওদের হাত থেকে আমাকে বাঁচাতে চাইতে। কেন ওই কৃপণতাগুলো ছিলো তোমার। তোমার মতো বড় মনের মানুষের ওই ক্ষুদ্রতা দেখে আমি অবাক বনেছিলাম। আমি বুঝে পাচ্ছিলাম না কেন তুমি তোমার আত্মীয় স্বজনকে দূরে সরাতে চাইছো। ওরা এলে, ওরা থাকলে, তোমার অসুখকে দুরারোগ্য কোনও অসুখ বলে মনে হয় বলে? তাই কি তুমি চাইছিলে না কেউ এসে তোমার মাথার কাছে কোরান পড়ে পড়ে ফুঁ দিক, ওসব যেহেতু মৃত্যুপথযাত্রীর জন্যই মানুষ করে! তুমি নিজেকে ভাবতে চাইছিলে তুমি সুস্থ, তোমার অসুখ বিসুখ যা ছিল সব সেরে গেছে। তোমার অসুখটি যে খুব অদুরারোগ্য নয়, তা বিশ্বাস করতে চাইছিলে না? আজও আমি জানি, কী কারণ ছিলো তোমার ওই অসহিষ্ণুতার। নানি শেষ পর্যন্ত চলে যেতে বাধ্য হল, তোমাকে স্বস্তি দিতেই বাধ্য হল। তোমাকে লুকিয়ে আমি পাঁচশ টাকা দিয়েছিলাম নানিকে। মাত্র পাঁচশ, সম্ভবত তুমি চাইছো না বলে অত কম দিয়েছিলাম। আসলে আরও বেশি টাকা নানিকে দেওয়া উচিত ছিল, পথ ঘাটের বিপদ আপদের কথা ভাবা উচিত ছিল আমার। তোমার যে মার জন্য তুমি জীবন দিয়ে দিতে, সেই তোমার মাকে আমাকে লুকিয়ে টাকা দিতে হয়েছে, ভাবতে পারি না। আমার তো তোমাকে বলার কথা যে নানিকে আমি টাকা দিয়েছি। আগে যদি এমন ঘটতো, খুশি তো হতে তুমিই। কিন্তু যেদিন জিজ্ঞেস করলে, নানিকে কোনও টাকা দিয়েছি কি না। আমি না বলেছিলাম। তোমার কিনানির দিকে ঈর্ষা হতো মা? নানির চলে যাওয়ায় আমার বুক ভেঙে যাচ্ছিল। সংসারে নানির মতো এত বুদ্ধিদীপ্ত, এত পরিশ্রমী, এত দৃঢ়চিত্ত দ্বিতীয় কেউ নেই, তোমার প্রতি নানির ভালোবাসাকে, তুমি, নানা কিছু অনুমান করি হয়তো, আজও আমি সঠিক করে জানি না, কেন মূল্য দাওনি। নানিকে আর ঝুনুখালাকে আড়ালে ডেকে তোমার অদ্ভুত নির্লিপ্তি নিয়ে কথা বলেছি। জিজ্ঞেস করেছি তারা আদৌ বুঝতেপারছেকিনা তুমি যা কোনওদিন করোনি, সে তা কেন আজ করছো! ঝুনু খালা জানে না, কিন্তু নানি বললো, সম্ভবত আমাকে আগলে রাখতে চাইছো, আমার জন্য ভয় হচ্ছে তোমার। আমি না আবার অন্যের দুঃখে কষ্টে কাতর হয়ে নিজেকে নিঃস্ব করি। নানির কাছে তোমার হয়ে ক্ষমা চাইলাম আমি। বললাম, মা যত যাই বলুক, এসব নিয়ে নানি যেন একটুও মন খারাপ না করে, যেন ময়মনসিংহেনা ফিরে যায়, যেন বড়মামা বা ফকরুল মামার বাড়িতে কটা দিন থেকে আবার ফিরে আসে। মাকে বলা হবেনানি ময়মনসিংহে গিয়ে সব ঠিকঠাক করে রেখে এসেছে। ঝুনু খালার কাছে ক্ষমা চাইলাম। ঝুনু খালা রিউমাটয়েড আর্থাটাইসে ভুগছে অনেক বছর। শীতের সময় তার হাড়ের জোড়াগুলো সব তালাবন্ধ থাকে। এসময় তুমিইঝুনুখালাকে সাহায্য করতে। আর কেছিল তারপাশে দাঁড়ানোর। তুমিই জীবনভর ছিলে। আর বিশেষ করে ঢাকায় যখন ছিলে, তখন তুমিই ছিলে ঝুনুখালার সবচেয়ে বড় সহায়। তোমার মতো উদার হৃদয় তো ভাইবোনের মধ্যে আর কেউ ছিলো না। কিন্তু সেই তুমি কী করে বুনুখালার অসুখ নিয়ে মোটেও ভাবছিলে না! তোমার ভূমিকাটা আসলে আমিই নিয়েছিলাম। সম্ভবত তুমি চাওনি তোমার ভূমিকায় আমাকে দেখতে। যাবার আগে নানি আমাকে বলেছে, হতে পারে তুমি মায়া কাটাতে চাইছো, চলে যাওয়ার আগে কারও কারও নাকি এমন হয়। মা, বছর খানিক আগে তো নানি মরেই যাচ্ছিল। হাড়ে যক্ষ্মা হয়েছিলো। কোনও ডাক্তার ধরতে পারেনি। নানি বিছানা ছেড়ে উঠতে পারতো না, হাঁটতে পারতো না। কিছু খেতে পারতোনা, কথা বলতে পারতো না। পেচ্ছাবপায়খানায় যেতে পারতো না, সব বিছানায় করতো। তুমি তো তারপাশে থেকে তার পেচ্ছাবপায়খানাপরিষ্কার করতে। সারারাত জেগে জেগে কাটাতে। আর নানির জন্য আকুল হয়ে কাঁদতে। সবাই ভেবেছিলো নানি মারা যাচ্ছে। নানিকে শেষ বিদায় জানিয়ে দিয়েছিলো সবাই। কোথায় কবর দেওয়া হবে তাও ঠিকহয়ে গিয়েছিলো। কাফনের কাপড়ও কেনা হয়ে গিয়েছিলো। সেই নানির যক্ষ্মা রোগ ধরাপড়ার পর যক্ষ্মার দুটো ইনজেকশন পেয়ে প্রায় কবর থেকে উঠে আসার মতো উঠে এলো। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলো কদিনের মধ্যেই। তোমার মা তোমার চেয়ে সুস্থ, এ নিয়ে তো তোমার ঈর্ষা হওয়ার কথা নয়। তুমি তো ভীষণ ভালোবাসতে তোমার মাকে। তবে কি এই সত্য যে তোমার নিজের মা, যাকে তুমি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতে, সেই মায়ের চেয়েও আমি তোমার বেশি প্রিয়, আমাকে তুমি তার চেয়েও বেশি ভালোবাসো? আমার সামনে তোমার মা, তোমার ভাই বোন, সবাই তুচ্ছ! এ কথা ভাবতে আমার ভালো লাগে না, কিন্তু আমার ওরকমই মনে হয়েছে। ছোটদা বাড়িতে থাকতো না। ছুটি পেয়েও সে তোমার কাছে দুদণ্ড বসতো না। অনেক রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরতো। ফিরে আমার লেখার ঘরে বসে আরও মদ খেতো, খেতে খেতে ফোনে মেয়েদের সঙ্গে গল্প করতো। মেয়েরা জানিনা কী কারণে ছোটদাকে এত পছন্দ করে। আমি অবাক হয়ে দেখতাম, এই ছোটদা, তুমি বলেছো, যে, তোমাকে নাকি ভালোবাসে। এই কি ভালোবাসার নমুনা! তবে কি ছোটদা আমার দেশে ফেরায় খুশি হয়নি। এই প্রশ্নটা তোমারও মনে নিশ্চয়ই এসেছিলো। যেদিন সে আমার সঙ্গে বাড়ি ফাটিয়ে চিৎকার করে কথা বললো, যেহেতু বলেছিলাম, ব্যাংকের টাকাগুলো আমি চলে যাওয়ার পর কেন সে আমাকে না বলে সব তুলে নিয়েছে, তখন তুমিও অবাক হয়ে দেখলে ছোটদার ব্যবহার। তোমার জন্য ইয়াসমিন যখন এসেছিলো দেশে, তখন পাঠিয়েছিলাম ওর হাতে অনেক টাকা, যেন অপারেশন খরচ এবং আরও যা খরচ সব মেটানো হয়। আমি এলেও ছোটদা যখন বলেছেআরও বেশি টাকা লাগবে, তার নাকি তোমার জন্য আরও খরচ হয়েছে, যা চেয়েছে, যা দাবি করেছে সব দিয়েছি। দেখতে চাইনি কোনও হাসপাতালের বিল বা কিছু। বাড়ির চার বছরের ইলেকট্রিসিটি বিল, ফোন বিল সব মিটিয়ে দিয়েছি এসে। একটা মোবাইল ফোন নিয়েছি, তার জন্য যা চেয়েছে, ইন্টারন্যাশনাল লাইনের জন্য ডিপোজিট, সব দিয়েছি। টাকা টাকা টাকা। ছোটদা শুধু একটা জিনিসই চেনে। দাদাকে দিয়ে আমার ব্যাংক স্টেটমেন্ট আনিয়েছিলাম, কত টাকা আছে ব্যাংকে দেখতে। দেখে তাজ্জব হয়ে যাই যে আমি দেশ ছাড়ার পর সাড়ে সাত লাখ টাকা ছিল। আমেরিকার হিউমেন রাইটস ওয়াচ আমাকে একটি গ্র্যান্ট দিয়েছিল, ছ হাজার ডলারের গ্র্যান্ট। ওটিও জমা হয়েছিল অ্যাকাউন্টে। ছোটদা আমাকে জানায়নি। বরং যা টাকা ছিল, সব সে তুলে নিয়েছে ব্যাংক থেকে। কোনওদিন জানতেও পারিনি। তুমিও কখনও জানতে না যে ছোটদা আমার ব্যাংকের টাকা তুলে নেয়, একটি পয়সাও তুমি কোনওদিন দেখনি। আমি ভাবতাম ও তোমার হাত খরচে দরকার পড়ে হয়তো। হায় ভাবনা। তোমাকে একদিন পাঁচ শ ডলার পাঠিয়েছিলাম বিদেশ থেকে ছোটদার হাতে। তোমাকে চিঠিটা দিয়েছিল, তবে চিঠির খাম খুলে ডলারগুলো সরিয়ে নিয়ে, তারপর। তোমাকে ফোনে বোধহয় জিজ্ঞেস করেছিলাম, ডলার পেয়েছে কিনা, বললে চিঠি পেয়েছো শুধু। আর ব্যাংকের স্টেটমেন্ট দেখারপর কিছুক্ষণ হাঁ হয়ে থেকে যখন তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি ব্যাংকের মাধ্যমে যে তোমাকে টাকা পাঠিয়েছি সেটা অথবা সেগুলো ঠিকঠাক পেয়েছে কিনা। তুমি মাথা নেড়ে বললে, আমি তোমাকে কোনওদিন টাকা পাঠাইনি। আমি হঠাৎ চুপ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার তর্ক করতে ইচ্ছে হয়নি। ভাবতে চেষ্টা করেছি কোনওদিনও পাঠিয়েছি কি। নিশ্চয়ই পাঠিয়েছি, অন্তত একবার হলেও, কেন তবে জানো না! কারণ ওই টাকা সম্ভবত কোনওদিন ছুঁয়ে দেখার তোমার সুযোগ হয়নি। ছোটদাকেই তুমি চেকের বইএ সই করে দিতে। কেন নিচ্ছে, কত টাকা, এসব সেই জানতো। তোমার নিজের অ্যাকাউন্টের খবর তুমি নিজে রাখোনি, রেখেছে ছোটদা। তোমাকে কোনওদিন জানায়নি, কী তোমার আছে, কী তোমার যাচ্ছে। হাতে আমার প্রচুর ডলার। ডলারের দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকে ছোটদা। একদিন দেখি তোমার খালি ঘর থেকে বেরোচ্ছে। যে মানুষ আমি বা তুমি থাকলে ও ঘর মাড়ায়নি, ওখানে সে একা একা কী করছে! কী আর করবে, সম্ভবত দেখছে কোথাও ডলার আছে কিনা। কেন তার এত টাকার প্রয়োজন, আমি বুঝি না। যথেষ্ট টাকা উপার্জন করে ছোটদা। এর মধ্যে প্রায় সবটাই গীতাকে পাঠিয়ে দেয় বিদেশে। যে গীতার সঙ্গে তার আর মানসিক বা শারীরিক সম্পর্ক নেই, তাকে সেপুষে যাচ্ছে এখনও। আমার বাড়িতে থাকছে, আমার গাড়ি চড়ছে, বাপের হোটেলে খাচ্ছে। যে বান্ধবীদের নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সবাই স্বনির্ভর। তারপরও ছোটদার টাকার লোভ দিন দিন আগুনের মতো বাড়ছে। আমার বাড়িটায় আমি যদি আবার থেকে যাই দেশে যখন ফিরেছি, তাই সে আমার দেশে ফেরাকেও পছন্দ করছে না। এ এক আশ্চর্য মানুষ। আমার সঙ্গে বদ্ধ মাতাল চেঁচিয়ে কথা বলছে। ওই চেঁচানোর, ওই কথার কোনও মাথামুণ্ডু ছিল না। বিকট চিৎকার। বোধহয় বলছিল, মার কাছে বসার আমার কোনও দরকার নেই, আমি যা করার করেছিমার জন্য, এইবার তুইকর। তুমি তখন খুব শান্ত গলায় ছোটদাকে বললে সে যেন আলাদা বাড়ি নিয়ে চলে যায়। আমি আজও জানি না কেন তুমি ছোটদাকে হঠাৎ চলে যেতে বলেছিলে, কার ওপর অভিমান করে, আমার ওপর, নাকি ছোটদার ওপর! আমি এমন চাইনি, আমি চাইনি তোমার আদরের ছেলেকে তুমি চলে যেতে বলে। আমার একটাই অনুরোধ ছিল সে যেন অনর্থক বাইরে বাইরে না ঘুরে তোমাকে একটু সময় দেয়। ছোটদার জন্য তোমার আদরআমি দেখেছি। আমার কাপড়চোপড়েরসুটকেসপড়ে ছিলো ড্রইংরুমে। আমারই আলমারির একটা অংশে ছোটদার কাপড়চোপড় রাখা। তুমি কিন্তু দেখেও একবারও ছোটদাকে বলোনি আমার আলমারি থেকে ছোটদার কাপড় সরাতে। আমিই একদিন নিজে বললাম, ছোটদা পরে ওগুলো তার যে একটা স্টিলের আলমারি এনে রেখেছিলো আমার বাড়িতে, ওতে রেখে দেয়। আজ ভাবি, কেন আমি বলতে গিয়েছিলাম তোমাকে আলমারি খালি করে দিতে। কী দরকার ছিলো। যেভাবে ছিলো, সেভাবেই থাকতো, আমার কি একটু ঈর্ষা হচ্ছিল, তুমি আমার চেয়ে বেশি তোমার ছেলেকে ভালোবাসো। যে ছেলে তোমার পাশে বসছে না, খবর নিচ্ছে না, যে ছেলে তোমার জন্য একটি পয়সা খরচ করে না, অপারেশনের টাকা দুদুবার করে নিয়ে গেল। সেই ছেলেকে কি ভালোবাসো কারণ সে তোমাকে বাবা আর দাদার মতো অত বেশি তুচ্ছ করেনি, অত অপমান করেনি বলে! নাকি ভালোবাসো তোমাকে উমরাহ করতে নিয়ে গিয়েছিলো বলে! সেও তো নিয়েছিলো বিনে পয়সায়। ঈর্ষা কেন করেছিলাম আমি, তোমার ভালোবাসার কি কোনও কমতি ছিলো আমার জন্য! তুমি তো উজাড় করে দিচ্ছিলে। সব কি আমি নিজের জন্য চাইছিলাম নাকি ছোটদারনিষ্ঠুরতা আমার আর সহ্য হচ্ছিলো না! কিন্তু ছোটদা যদি তোমার পাশে বসতো, ছোটদা যদি একটু ভালোবাসা প্রকাশ করতো তোমার জন্য, সব চেয়ে খুশি তো হতাম আমিই। যে করেই হোক চাইছিলাম তোমার মন ভালো থাক, তুমি ভালো থাকো। তুমিও কি ছোটদার ব্যবহারে কষ্ট পাওনি! হয়তো পেয়েছো! অথবা পাওনি। ছোটদার সঙ্গে এত ভালো মনের মিল ছিলো যে ছোটদা তোমার পাশে এসে না বসলেও জানো তুমি যে সে তোমাকে ভালোবাসে। তুমি তাকে তার মতো করেই থাকতে দিয়েছে। ছোটদাকে তোমার পাশে থাকার জন্য, কাছে আসার জন্য বলোনি, কিছুর দাবিই কারও কাছে করোনি। আমার বাড়ি থেকে যদি ছোটদাকে চলে যেতে হয়, সে তুমি বেঁচে থাকা অবস্থায় নয়। চারদিকের মনোমালিন্য, অহংকার, অভিযোগ, বিরোধ, বিদ্রোহ, রাগ, জেদ, এসব জাদুবলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছি। অসুন্দর কিছু যেন স্পর্শ না করতে পারে তোমাকে, চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম মিথ্যে করে হলেও মানুষ বলুক তোমাকে ভালোবাসে। তুমি দেখ, সবাই মিলে মিশে আমরা হাসি আনন্দে আছি। তোমার শৈশবের না-পাওয়া-দোলনায় আমরা সুখের দোলা দুলছি। তুমি যাদের ভালোবাসো, তারা ভালো আছি। পরস্পরকে ভালোবাসছি। কিন্তু ছোটদাকে তুমি ঠাণ্ডা গলায় বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার কথা বলায় আমার হয়তো, যে অভিযোগ আমার ছোটদার বিরুদ্ধে, খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু আমি খুশি হই না। অদৃশ্য একটা চাবুক এসে পড়ে আমার ওপর। ধনুকের মতো বেঁকে যায় আমার অহংকারের পিঠ।

.

ঝুনু খালা আর ফকরুল মামাকে পাঠিয়ে পুরোনো ঢাকার শাড়ির হোলসেল মার্কেট থেকে একশ শাড়ি আর লুঙ্গি কিনেছিলাম যেন তুমি গরিবদের দান করতে পারো ওসব। চিরকাল গরিবের অভাব ঘোচাতে চেয়েছে। কোথাও কোনও গরিব দেখলেই তোমার হাত নিশপিশ করেছেসাহায্য করার জন্য। টাকার অভাবে পারোনি। তোমার নিজের হাতে, আমি চেয়েছি, শাড়ি আর লুঙ্গি গরিবদের দান করো। চেয়েছি তোমার ভালো লাগবে বলে। নানি কিছু শাড়ি নিজের চেনা লোকদের দেবে বলে আলাদা করে রাখলো। নানিবাড়ির পাশেই বস্তিতে যে গরিবেরা থাকে, তারা তোমারও চেনা। তুমি তো নিশ্চয়ই ওদের দেবে। কোন শাড়ি খারাপ, কোন শাড়ি ভালো তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেল নানি আর ঝুনুখালার মধ্যে, দূর থেকে তুমি দেখছিলে। নানি বলতেই পারে যে আত্মীয়দের মধ্যেই যারা গরিব আছে, তাদেরও দেওয়া হোক শাড়ি। শুনেছ, কোনও মন্তব্য করোনি। নানি যখন সাদা একটা ভালো শাড়ি দেখে বললো, ও শাড়ি নানি নিজেইপরতে পারবে, জানিনানির এই কথা শুনতে তোমার ভালো লাগেনি। পার্থিব জিনিসপত্র থেকে তুমি নিজেকে খুব দূরে সরিয়ে নিয়েছিলে। মৃত্যু এসে দরজার কাছে বসে থাকলে বোধহয় এসব জিনিসপত্রকে বড় তুচ্ছ মনে হয়, এ নিয়ে মানুষের আনোচনাকেও মনে হয় বড় অশ্রাব্য। শাড়িগুলো তোমার হাত দিয়েই গরিবদের দেওয়া হয়েছে। সারাজীবন যা করতে পারোনি, শুধু আশা করেছে, সেই কাজটা করাতে চেয়েছি আমি। জানি না কতটুকু ভালো লাগা দিতে পেরেছি তোমাকে। হঠাৎ অসুখ হওয়ার পর সবঅসম্ভবও যখন সম্ভব হয়ে গেল, তোমার কেমন লাগছিলো মা? আমাদের সবার ওপর রাগ হয়নি? তুমি রাগ দেখালে আমাদের ভালো লাগবে না বলে হয়তো রাগ দেখাওনি। না হলে তোমাকে খুশি করার এই নাটক দেখেও তুমি চুপ হয়ে ছিলে কেন? তোমার জায়গায় আমি হলে হয়তো এসব নাটক বন্ধ করতে বলতাম। বলতাম, যেভাবে অভাবে জীবন কাটিয়েছি, শেষ কটা দিন ওভাবেই কাটাতে দে।

আমার ভীষণ ইচ্ছে ছিল তোমার নামে একটা ইস্কুল করবো ময়মনসিংহে। ঈদুল ওয়ারা বালিকা বিদ্যালয়। চারদিকে খোঁজ খবরও নিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ অবদি যা শুনলাম, ইস্কুল করতে গেলে প্রচুর সময় লাগবে। না, আমার সময় খুব কম। এই কম সময়ের মধ্যে কী কী করা যায়, তাই করতে আমি ঝাঁপিয়ে পড়ি। ইস্কুল না হয়পরে হবে, কিন্তু তুমি দেখতে পারো এমন কী করা যায়। দ্রুত ভেবে নিলাম যে তোমার নামে একটা বৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করবো। সপ্তম থেকে দশম শ্রেণীর মেয়েদের, যারা গরিব, কিন্তু ভালো ছাত্রী, তাদের কয়েকজনকে। দাদাকে টাকা দিয়ে ময়মনসিংহেপাঠিয়ে দিলাম। মুকুল নিকেতনের আমিরুল ইসলাম রতন, যতীন সরকার, আর দুজন নামি শিক্ষক বিচারক হবেন। তারাই নির্বাচন করবেন ছাত্রী। ফোনে আমিরুল ইসলাম রতনের সঙ্গে কথাও বলেছি, তুমি আর অল্প কদিন আছো, তুমি যেন দেখে যেতে পারো বৃত্তির অনুষ্ঠান। পড়াশোনা করতে চেয়েছিলে তুমি, ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্রী ছিলে, কিন্তু তোমাকে পড়তে দেওয়া হয়নি। ইস্কুল থেকে জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। আর যেন কোনও মেয়েকে বাল্যবিবাহের শিকার হতে না হয়, আর যেন কোনও মেয়েকে পূতিগন্ধময় পুরুষতান্ত্রিক পরিস্থিতির শিকার না হতে হয়। মেয়েদের শিক্ষিত হওয়া, আর স্বনির্ভর হওয়ার মূল্য কী, তা নিজের জীবন দিয়ে তুমি বুঝেছো। এখন থেকে প্রতিবছর তোমার আদর্শের প্রতি মাথা নুইয়ে ঈদুল ওয়ারা বৃত্তি গ্রহণ করবে মেয়েরা। তুমি যা পারোনি, তা যেন অন্যরা পারে। তুমি স্বপ্ন রচে দিয়ে গেলে সবার মধ্যে। তোমার কথাগুলোই লিখে আমি পাঠিয়ে দিই। আয়োজনটা খুব দ্রুত করার জন্য তাগাদা দিই। সবাই বুঝতে পারে তাড়াহুড়োর কারণ। অনুষ্ঠান করতে খুব বেশিদিন সময় নেয়নি। মোট পাঁচজনকে দশ হাজার টাকা করে বৃত্তি দেওয়া হয়। রীতিমত বড় সড় বৃত্তি দানের অনুষ্ঠান হয় মুকুল নিকেতনে। ময়মনসিংহের বুদ্ধিজীবিরা অনুষ্ঠানে তোমার প্রশংসা করে বক্তব্য রাখেন। দাদা সেসবের ভিডিও ক্যাসেট আর তোমার ছবি দিয়ে বানানো বিরাট ব্যানারটিও ঢাকায় নিয়ে আসে। ব্যানারে বড় বড় করে লেখা ঈদুল ওয়ারা বৃত্তি। সেগুলো তোমাকে দেখাই আমি মা। তোমার যেন অহংকার হয়, দেখাই। তোমার যেন ভালো লাগে, দেখাই। আমি জানি না তোমার চোখে খুব বিস্ময় ছিল নাকি বেদনা ছিল। ভিডিও দেখাতে গিয়ে বারবার আমাকে তা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। কারণ বারবারই বক্তারা তোমার ক্যানসার আর তোমার আসন্ন মৃত্যুর কথা বলছিলেন। আমি চাইনি ওসবকথা তুমি শোনো। দাদার বক্তব্যের ওই কথাটা অবশ্য শুনলে, কিছু বলেনি। আমি চট করে বন্ধ করতে পারিনি। দাদা বলছিলো, আমার মায়ের শেষ ইচ্ছে.। নিশ্চয়ই ভেবেছো শেষ ইচ্ছে কেন হবে? তবে কি বাঁচবেনা? একবারও তুমি এই শেষ ইচ্ছে নিয়ে প্রশ্ন করোনি। একবারও আমাকে বলোনি, যতীন সরকার বা অন্যদের পুরো বক্তৃতা কেন তোমাকে শোনাচ্ছি না। বক্তৃতা দিতে গিয়ে তোমাকে মহীয়সী নারী, মহান মানুষ এসব বলছিলেন ওঁরা, শুনে কি তোমার বাঁচতে ইচ্ছে করছিলো মা, পৃথিবীটাকে খুব সুন্দর মনে হচ্ছিল, মা?

নানি বললেন, নিজেদের আত্মীয়ের মধ্যেই তো কত গরিব আছে, ওদের তো বৃত্তি দিলেও পারতাম। আমি বললাম, এটা বিচারকদের সিদ্ধান্ত। নানি আসলে বলতে চাইছিলেন টুটু মামার প্রথম বউএর ছেলে মেয়েরা চরম অভাবে দিন কাটাচ্ছে। টুটু মামা অন্য এক মহিলাকে বিয়ে করে নতুন সংসার পেতেছে, প্রথম বউকে তালাক দেওয়ারপর সেই বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে বাপের বাড়িতে করুণ অবস্থায় পড়ে আছে। টুটু মামা তার ছেলে মেয়ের কোনও খবরই নিচ্ছে না। ওদের দারিদ্র যদি এই টাকায় ঘুচতো! শরাফ মামার ছেলেরাও আছে, অভাব যাদের ঘর থেকে কিছুতেই বিদেয় হতে চায় না। আসলে ওদের সাহায্য করা, আর তোমার নামে বৃত্তি প্রতিষ্ঠিত করা, দুটো তো আলাদা জিনিস। তুমি নানির মন্তব্যে খুশি হওনি। কিন্তু মা, নানি তো সারাজীবন নানার বেহিসেবী খরচ থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে বুদ্ধি করে ওভাবেই সংসার চালিয়েছে। আমি

তোমাদের একটা ঠান্ডা মনোমালিন্যকে চেষ্টা করি দূর করতে। তুমি শান্ত, স্থিত, স্নিগ্ধ। তোমার ভালো লাগছে কী লাগছে না, তা অনুমান করতে হচ্ছে আমার। প্রকাশ করছো না কিছু। যে তুমি এত আবেগপ্রবণ ছিলে, সে তুমি কীরকম ভীষণ ভাবলেশহীন হয়ে গিয়েছিলে। শয্যাশায়ী না হয়ে নিপুণ গৃহিণীর মতো সংসার তদারকি করছিলে। আমার জন্য কী রাঁধতে হবে, কার জন্য কী বাড়তে হবে, এইসব। যেন অন্য যে কোনওদিনের মতো দিন। ভালো লাগছে মা? হ্যাঁ লাগছে। জানি না কীরকম লাগতো ভেতরে তোমার। জানি অসহ্য যন্ত্রণা ছিলো শরীরে, তোমার শরীর সুস্থ করার ক্ষমতা ছিলো না আমার। শুধু মন নিয়ে তাই ব্যস্ত ছিলাম, মনটায় যদি একটু ভালো লাগা দিতে পারি। কোনও কারণে যেন তোমার মনে সামান্যও আঘাত লাগতে পারে, সেই কোনও কিছু না ঘটাতে আমি সদা ব্যস্ত। কিন্তু মা, একদিন তুমি ভেঙে পড়লে, একদিন তুমি কাঁদলে, চিৎকার করে কাঁদলে। দোষ কাকে দেব, শেফালিকে! শেফালিকেই দোষ দেব। সে আলগোছে শোবার ঘরের ফোনটা তোমাকে দিয়েছিল শুনতে। ড্রইংরুমে বসে বাবা কার সঙ্গে কথা বলছে, সে বাবার ব্যাপার। কিন্তু শেফালি তোমাকে রিসিভারটা কানে লাগিয়ে দেয় শোনার জন্য। তুমি রেখে দিতে পারতে, রাখোনি। তুমি তো আড়িপাততে চাওনি বাবার কথায়। শেফালির অতি উৎসাহে তুমি শুনছিলে বাবার গলা নামিয়ে বলা কথাগুলো। শুনছিলে কারণ বাবা তোমার সম্পর্কে কথা বলছিলো। এরপর তুমি ফোন রেখে আমার কাছে এলে। আমি আমার লেখার ঘরে বসে বই পড়ছিলাম। মা, তুমি ডুকরে কেঁদে উঠলে, কাঁদতে কাঁদতে বললে যে বাবা নাকি কাকে বলছে তুমি নাকি মরে যাবে কিছুদিনের মধ্যে, ডাক্তার নাকি বলেছে তিন মাসের বেশি বাঁচবে না, তুমি মরে গেলেই বাবা ঝামেলামুক্ত হয়ে যাবে। যে মহিলার সঙ্গে কথা বলছিলো, তাকে বিয়ে করবে বা এরকম কিছু। মা, বাবার চরিত্র তুমি তো জানোই, বাইরের মহিলাদের সঙ্গে প্রেম কি তার আজকের ব্যাপার! সে তো আমার জন্মের আগে থেকেই করছে। তবে কেন কেঁদেছিলে মা? তুমি মরে যাচ্ছো শিঘ্রি এই খবরটা শুনে তুমি তো আঁতকে ওঠোনি। তোমার ভেতর তো বিন্দুমাত্র ভয়ের কিছু দেখিনি। আমাকে একবারও জিজ্ঞেস করোনি যে ডাক্তার কি তিন মাস বাঁচার কথা বলেছে? বা তুমি কি সত্যি সত্যি মরে যাবে? বরং বাবার কোনও এক প্রেমিকার সঙ্গে তোমাকে চরম অপমান করে কথা বলায় এত কষ্ট পেয়েছিলে যে অসুখে ভুগে ইস্পাতের মতো হয়ে যাওয়া তুমিও চুরমার হয়ে গেলে। আর আমার এতদিনের তোমাকে আগলে আগলে রাখা, তোমাকে আশ্বাস দেওয়া সব তাসের ঘরের মতো এক তুড়িতে ধসে গেল। দেখ নানি অমন চরম অসুখ থেকে বেঁচে উঠেছে, দিব্যি সুস্থ, সেরকম তুমিও সুস্থ হয়ে উঠবে–সব আশ্বাস, সব আশা, সব ভরসা, তোমাকে সুখ দেবার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল। শেফালির ওপর সব রাগগিয়ে পড়ে আমার। বাবার ওপরও। বাবাকে আমি অপমান কম করিনি সেদিন। ধিক্কার দিয়েছি বারবার। বাবা মাথা নিচু করে বসে ছিলোপরদিন আমি তোমার নামে যে বৃত্তি হচ্ছে, বাবার নামে যে কোনওদিন হবে না, বাবার মতো দুশ্চরিত্র মানুষের নামে, তা তোমার সামনেই তাকে বললাম। বাবা যতই দুনিয়া বাদ দিয়ে এসে তোমার পাশে বসে থাকুক, যতই সে তোমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিক, যতই সে তোমার সঙ্গে করা তার সারাজীবনের অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাক নিরন্তর তোমাকে সঙ্গ দিয়ে, আমি তাকে ক্ষমা করি না। আমি নিজেকেও কি ক্ষমা করি মা? বাবাকে যখন তোমার প্রয়োজন ছিল, তুমি পাওনি তাকে। আজ আর তাকে তোমার কিসের প্রয়োজন! তোমার তো আর চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। শরীরের প্রয়োজনও ফুরিয়েছে। মনের যেটুকু ছিল অবশিষ্ট, অন্তত ভেবেছিলে যাকে সারাজীবন পাশে চেয়েছে, পাওনি, আজ পাচ্ছো, আজ সে জগৎ ভুলে তোমার সেবায় নিয়োজিত, তোমার পাশে ঘুমোয়, তোমাকে আদর করে দেয়–সামান্য সেই মনের আরামটুকুও সেদিন জন্মের মতো গেল। তোমার আর কী রইলো তবে?

দিন দিন তোমার পেট ফুলে উঠছে জলে, ফুলে উঠছে ফুঁসে উঠছে আর তুমি ঢেকে রাখছে। তুমি কাউকে বুঝতে দিতে চাইছে না যে কিছু একটা ভয়ংকর ঘটছে তোমার শরীরে। আমরা সবাই বুঝতেপারছি, কিন্তু বলছিনা তোমাকে। সবাই কি আমরা তোমার সঙ্গে অভিনয় করছিলাম, আর তুমিও অভিনয় করছিলে আমাদের সবার সঙ্গে! কিছু না বুঝতে পারার অভিনয়! মা!

বাড়িতে বড় মামা, ফকরুল মামা তোমাকে দেখতে এলে তোমাকে আর কতক্ষণ কে দেখতো, আসর বসে যেতো আমার লেখার ঘরে। ধর্ম, আল্লাহ খোদা, মোহাম্মদ, কোরান হাদিস নিয়ে আমাদের হাস্যরসের আসর। বড় মামা ছিল আমাদের গুরু। কোরানের ক থেকে চন্দ্রবিন্দুপর্যন্ত যার মুখস্ত। তুমি বড় মামার ওপর একসময় রাগ করতে, আমাকে নাকি আসকারা দেয় ধর্মের বিরুদ্ধে লেখার জন্য। বড় মামা আসকারা দেবে কেন, আমি নিজেই কি জানিনা ধর্ম কী এবং কেন! ধর্মের বিরুদ্ধে লিখি বলে ধর্মের জন্য তোমার মায়া হত না, মায়া আমার জন্য হত। তোমার আশংকা হত আমার বিপদ হবে। সে আমি এখন না হয় বুঝি, তখন তোমার আশংকাকে ধর্মভীরুতা বা ধর্মান্ধতা বলে মনে করতাম, আর কতরকম করে যে তোমাকে নির্বোধ ভাবতাম তখন। তখনও তো দেশছাড়া হইনি। তোমার আশংকাই শেষ অবদি সত্যি হয়েছিল মা।

০৫. তুমি অন্য ঘরে

তুমি অন্য ঘরে, আর তোমাকে লুকিয়ে এ ঘরেহইরই চলছে। ধর্মের বারোটা বাজাচ্ছি সবাই।

সবকিছুর মধ্যে একদিন শুনি গুঞ্জন। বাবা আর দাদার গুঞ্জন। হঠাৎ সেই কথোপকথন আমার কানে যেতেই শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।

হিসেব আছে?

কিসের?

আমেরিকা থেকে আসার পর মাস কটা গেল..?

তিন মাস তো কালকে পূর্ণ হল।

কিন্তু কোনও তত লক্ষণ নেই কিছুর।

হ্যাঁ দিব্যি তো হাঁটছে, চলছে।

মনে হয় শরীরে আগের চেয়ে আরও জোর পেয়েছে।

ডাক্তার তো বলেছিলো তিন মাসের কথা।

কিন্তু তিন মাস তো পার হয়ে গেল।

ডাক্তার কি ভুল বলেছে?

ডাক্তারের হয়তো ভুল হয়েছে কোথাও।

কিন্তু ভুল হওয়ার তো কথা নয়। বড় ডাক্তার।

দিব্যি সুস্থ।

তবে কি সেই সিপিটি ওষুধটা কাজ করেছিলো, যেটা কাজ করেনি বলে ভাবা হয়েছিল?

আমিও হয়তো ভেতরে ভেতরে দিন গুনছিলাম। আমার মতো অন্যরাও তবে গোপনে দিন গুনছিলো! তিন মাস পরও তোমাকে সুস্থ দেখাচ্ছে। বললে মাছ ভাত খাবে, টেবিলে বসে আর সবার সঙ্গে খেলেও। এ কি সবাইকে স্বস্তির নিঃশ্বাস দিচ্ছে, নাকি অস্বস্তির দীর্ঘশ্বাস দিচ্ছে। কথোপকথনে হঠাৎ ঢুকেপড়ি আমি। বাবা আমাকে কাছে টেনে নিয়ে বললো, ফিসফিস করে, মনে হয় ওই ইনজেকশানটা কাজ করেছে।

কোন ইনজেকশান? ওই যে ওই সিপিটি।

না, ওই ইনজেকশান অনেকগুলো নিতে হয়। কোর্স তো শেষ হয়নি। আর, ইনজেকশান মার শরীরে উল্টে প্রতিক্রিয়া করেছে।

তাহলে যে..

কী?

খেলোও তো আজকে রীতিমত আমাদের মতো..

তোমার মৃত্যু এবং হঠাৎ মাঝপথে তোমার সুস্থ হয়ে ওই ওঠার আলোচনায় একসময় বড় মামা, ফকরুল মামা, ঝুনু খালাও যোগ দেয়। আমার দিকে আলোচনার মাঝখানে তাকায় কজন, আমার মনে হয় ওই চোখে কোনও সংশয় আছে, আমি কি তাহলে ঠিক বলেছিলাম ওই তিন মাসের কথা! অর্থাৎ ডাক্তার কি সত্যিই আমাকে তিন মাসের কথা বলেছে, নাকি আমি বানিয়ে বলেছি! আমার ভয় হয় মা। এই আলোচনার অর্থ কি আমি বুঝে নেবো, সবারই খুব ভালো লাগছে যে তুমি সুস্থ হয়ে উঠছো? যে সিপিটি ইনজেকশনের ষোলোটার মধ্যে একটা নিয়েই তুমি মরতে বসেছিলে, বাকিপনেরোটা তোমার নেওয়াই হয়নি, সেই একইনজেকশন যে কোনও কারণেই কাজ করেছে ভেবে সবাই আহ্লাদিত? নাকি ভেতরে ভেতরে সবাই ভাবছে, তুমি মরতে সময় বেশি নিয়ে নিচ্ছে। আমার ভয় হয় ভাবতে যে আমরা, আমি, দাদা, আর বাবা ভাবছি তুমি তোমার নির্ধারিত সময়ের বাইরে চলে যাচ্ছো। আমরা কি এখন আঙুলের কড়ায় একটি একটি করে দিন গুনতে থাকবো! ওই ভরা আসরে আমার একবার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, তোমরা কি আশংকা করছো যে মা মারা যাচ্ছে না, বা যাবে না? দুশ্চিন্তার কিছু নেই, মা মারা, যাবে। তোমরা দুঃখ করো না, মা মারা যাবে।

.

একটা সময় আমি লক্ষ করলাম আমি সারাদিন ইন্টারনেটে সময় কাটাচ্ছি। বিদেশে চিঠি লিখছি। নভোকভের লোলিতা বইটা সঙ্গে ছিল আমার। সেটাও সবটা পড়ে শেষ করে ফেললাম। খুব দ্রুত পড়িনি, ধীরে ধীরেই পড়েছি। কোনও পর্বভালো লাগলে দুতিনবার পড়েছি। এত সময় যদি বইকে দিই, তবে তোমাকে কী দিয়েছি! তোমাকে সময় যদি দিয়েই থাকি, তবে বই পড়ার সময় কী করে পেলাম! বই তো পরেও পড়া যেত। কী দরকার ছিল, অত বড় বইটা পড়ে সময় নষ্ট করার! তুমি তো বেশিদিন থাকবে না সঙ্গে, সে তো আমি জানতাম! বই তো থেকেই যেত। বইয়ের তো কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই বাঁচার। বই পড়ছিলাম কেন, তোমার সঙ্গে বসে গল্প করতে, তোমার যত্ন করতে আমার আর ভালো লাগছিল না! শেফালিই তো তোমার সব করে দিত। শেফালিকে তোমার কাছে চাপিয়ে দিয়ে আমি কি মুক্তি চাইছিলাম! হাঁপিয়ে উঠেছিলাম কি? মরছো না বলে? তিন মাস পার হয়ে গেল বলে? আমি, বাবা, দাদা সবাই? টেলিভিশনে ক্রিকেট খেলা দেখতে বসে যাচ্ছে সবাই। সুহৃদকে আমেরিকা থেকে নিয়ে এসেছে ছোটদা। আমি বলেছিলাম আমার নিউইয়র্কের বাড়ির জিনিসপত্র ইয়াসমিন আর ছোটদা যে যতটাপারে নিয়ে গিয়ে যা থাকে তা বিক্রি করে দিয়ে যেন সুহৃদ চলে আসে। তার মা যদি তাকে ত্যাজ্যই করে থাকে, বাড়িতে আর জায়গা দিতে না চায়, তবে সে তার বাবার কাছে থাকুক। দেশেই লেখাপড়া করুক। সুহৃদকে তার মা আর ফেরত নেয়নি, অগত্যা ঢাকা। তোমার আদরের নাতি, যাকে জন্মের পর থেকে গাধার মতো খেটে বড় করেছে, সেই সুহৃদ তোমাকে ফাঁকে ফাঁকে এসে দেখে যায় বটে, কিন্তু আমার কাছে ক্রিকেট ব্যাট কেনার টাকা চেয়ে তুলকালাম কাণ্ড করে। টেলিভিশনে খেলা হচ্ছে, তার এক্ষুনি ব্যাট বল কিনতে হবে, খেলতে হবে। আমি চাইছিলাম না ব্যাটবল কিনে দিতে, কারণ চাইছিলাম তোমার কাছে থাকুক সবাই, খেলায় না মাতুক। সুহৃদের অমন অভদ্রতা, অসভ্যতা দেখে তুমি বললে, খবরদার, তুমি আমার মেয়ের সঙ্গে এভাবে ব্যবহার করবে না। সুহৃদকে ওই প্রথম তুমি ওভাবে ধমক দিলে। তুমি বোধহয় যাবার আগে ওকে একটু মানুষ করতে চেয়েছিলে। নাকি আমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলে, যাদের জন্য জীবন দিয়ে দিই, তাদের দ্বারাই অপমানিত হই বলে? ও যে বখাটে ছেলেদের মতো আচরণ করছে, লক্ষ করছিলে। ও শেষপর্যন্ত কিনলোই ব্যাট বল। ও দিয়ে খেলতে শুরু করলো বাড়ির ভেতরে। প্রচণ্ড ব্যস্ত সে খেলা নিয়ে। একসময় রাতে রাতে দাদা যোগ দেয় খেলায়। একসময় আমি। আমার অবাক লাগে ভাবতে, একটা মানুষ দিন দিন অসুস্থ হচ্ছে, তার আর সময় বেশি নেই। আমরা কি করে পারি, ব্যাটে বল লাগানোর জন্য মরিয়া হতে!

হয়তো বুঝেছিলে তোমার আর দেরি করা উচিত নয়। জ্বর হল। হাসপাতালে গেলে। হাসপাতাল থেকে এসেতুমি আর বিছানা থেকে উঠলে না। হঠাৎ করে শরীরের চেয়েও বেশি মনের যে জোরে চলাফেরা করছিলে, সেটিও গেল। আমি বললাম ময়মনসিংহে চলো। কেন ময়মনসিংহে আমি নিতে চাইছি! আমি বললাম, ওখানে অনেকের সঙ্গে তোমার দেখা হবে, ভালো লাগবে। তুমি নিউইয়র্কেও বলেছিলে, কেন ঢাকায় নিতে চাইছি। তুমি কি হেসেছিলে মনে মনে যে তোমাকে নানা কায়দা করে আসলে কবরখানার পাশে নিয়ে যেতে চাইছি আমি। ঢাকায় তোমার মলত্যাগে কষ্ট হচ্ছিল শেষের দিকে। গ্লাবস কিনে এনে আমি নিজের হাতে তোমার মল নিয়ে আসতাম অনড় অন্ত্র থেকে। তুমি তো তখন আর বেশি কিছু খেতে পারো না। ধীরে ধীরে তোমার খাওয়া কমে গেছে। আবার সেই সুপে এসে থেমেছে। তোমার নোংরা আমি নিজের হাতে পরিষ্কার করছি, আমার একটুও ওতে আপত্তি ছিলো না। কিন্তু আপত্তি ছিলো তোমার তুমি মানতেপারোনি। লজ্জায় দ্বিধায় সাদা হয়ে থাকতে। আমি বারবার বলেছি তোমাকে, মা, তুমিও তো তোমার মার সেবা এভাবে করেছে। আমাকেও করতে দাও, তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো। যখন সুস্থ হয়ে ওঠার কথা বলি, যখন ওই মিথ্যে কথাটা উচ্চারণ করি, শুনতে এত ভালো লাগে। পৃথিবীর আর কোনও মিথ্যে বোধহয় এত সুন্দর নয়। তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে। আহা যদি সত্যিই সুস্থ হয়ে উঠতে তুমি। যদি জাদুবলে সত্যি হয়ে উঠতো ওই মিথ্যেটি।

বুড়ো বয়সে নানির একবার ঋতুস্রাব শুরু হয়েছিলো। অনেক বছর আগে ঋতু বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ শুরু হওয়ায় নানি তখন চূড়ান্ত অস্বস্তিতেপড়েছিলো। তোমাকে কানে কানে বলেছিলো। তুমিও আমার কানে কানে খবরটা জানিয়েছিলে। আমি তখন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়েছিলাম। আমারই একসময় শিক্ষক ছিলেন তিনি। সেই জোবায়েদ হোসেন আমাকে বললেন, নানির ক্যানসার হয়েছে জরায়ুতে, বাঁচতে হলে তার জরায়ু কেটে ফেলে দিতে হবে। নানি কিছুতেই কিছু ফেলে দেওয়ার পক্ষপাতি ছিল না। নানি কোনও অপারেশন করেনি। দুতিন বছর পরস্রাব আপনাতেই চলে গেছে। নানি যেমন সুস্থ ছিল, তেমনই আছে। কত কত বছর আগের কথা। এরকম কিছু তোমার বেলায় হতে পারে না? ডাক্তারের সব ভবিষ্যৎ বাণী, সব ডায়াগনোসিস মিথ্যে প্রমাণ করে তুমি বেঁচে উঠতে পারো না মা, নানির মতো?

সব ক্যানসারের রোগীদের স্টেরয়েড দেওয়া হয়। ফুরফুরে থাকার জন্য, তাজা থাকার জন্য, শক্তি পাবার জন্য। তোমাকে কোনও ডাক্তারই এই জরুরি ওষুধটি দেয়নি কেন, জানি না। আর আমি তো ডাক্তারি বিদ্যে সব গুলে খেয়েছি। এত কিছু ইন্টারনেটে ঘেঁটেছি, এটি ঘাঁটিনি। এই প্রাথমিক বিদ্যেটুকু জানার জন্য যে সামান্য খোঁজটুকু করতে হয়, সেটিও করিনি। তোমাকে স্টেরয়েড দেওয়া হয়নি। ওটি খেলে বলবো না সুস্থ হয়ে উঠতে, কিন্তু অসহ্য যন্ত্রণা যতটা পেয়েছো, তারচেয়ে খানিকটা কম পেতে। শরীরে সামান্য হলেও কিছু ভালো লাগা এসে বসতো। তুমি কি আর অত ভাগ্য নিয়ে জন্মেছো মা! যন্ত্রণায় ভুগেছো সারা জীবন, শেষ দিন পর্যন্ত তাই ভুগবে।

হ্যাঁ ময়মনসিংহে নিয়ে যেতে হবে তোমাকে। সিদ্ধান্ত সব আমিই নিই। সবাই শ্রোতা বা দর্শক। শ্রোতা বা দর্শক ছাড়া তারা আর হবেই বা কী। সিদ্ধান্ত নিলে দায়িত্ব নিতে হয়। দায়িত্ব যখন আমার, সিদ্ধান্তও আমার। এতে কেউ আপাতত প্রতিবাদ করছে না। যা কিছু হোক না কেন, সিদ্ধান্ত সংসারে সাধারণতপুরুষরাই নেয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পুরুষেরা সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে দূরে থাকছে কারণ আবার ও করতে নিয়ে দায়িত্ব ভার না আবার তাদের ঘাড়ে চাপে। সংসারে মেয়ে হয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়াটা তাই আমারই থাকে। অবশ্য যে মানুষ আজ আছে কাল নেই, তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত তো নিতান্তই ক্ষণিকের ব্যাপার। ক্ষণিকের বলেই সম্ভবত আমার সিদ্ধান্তে কেউ অসন্তুষ্ট হয় না। টাকা পয়সার জোরেই সিদ্ধান্তটা মেয়ে হয়েও নিতে পারি। সংসারে টাকা একটা সাংঘাতিক ক্ষমতার জিনিস মা। তোমার চেয়ে বেশি আর কে জানে তা!

যখন চলে যাচ্ছিলে ঢাকার বাড়ি থেকে, এমন ভাবে যাচ্ছিলে যেন কদিন পর ময়মনসিংহ থেকে তুমি ফিরে আসবে। তোমার ঘর থেকে বেরোনোর দৃশ্য দেখে বারবার আমার মনে হচ্ছিল, এ বাড়ি থেকে এ তোমার শেষ চলে যাওয়া। এ বাড়িতে, যে বাড়িটা আমার জন্য তুমি ধুয়ে মুছে রাখতে, যে বাড়িটাই তোমার একমাত্র আশ্রয় ছিল, যেটাকে অন্তত নিজের বাড়ি বলে ভাবতে পারতে, যে বাড়িটায় কত কত বছর তুমি থেকেছো, যে বাড়িটায় তোমার কাপড় চোপড়, তোমার সব জিনিসপত্র তোমার নিজের হাতে সব গোছানো, সেখানে আর তুমি ফিরবেনা। কোনওদিনই আর ফিরবেনা। ভেবে হু হু করে কান্না এলো। ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে তুমি আমার সেই কান্নার দিকে মুহূর্তে ভাবলেশহীন মুখে ফিরে তাকালে। মা, তুমি কি বুঝেছিলে কেন আমি কাঁদছি!

গাড়িতে যখন যাচ্ছিলাম আমরা ময়মনসিংহের দিকে, তুমি সতর্ক ছিলে আমাকে যেন রাস্তার কেউ চিনে না ফেলে। আমার ওপর যেন আবার অতর্কিতে কোনও আক্রমণ না আসে। বারবারই বলছিলে মুখখানা যেন একটু আড়াল করে রাখি। যে তুমি বিছানা থেকে গাড়ি পর্যন্ত নিজে একা হেঁটে আসতে পারোনি, যে তুমি নিজের পেটের ভেতরের ব্যথাকে ব্যাখ্যা করতেপারো না, ব্যথা বা যন্ত্রণা বা কষ্ট নামেও ওদের চিহ্নিত করতে চাও না, অন্য কিছু, ভীষণ কিছু, ভয়ংকর কিছু, যে ভয়ংকর কিছুটাকে কী নাম দেওয়া যায় তুমি জানো না, সেই তুমি নিজের শরীরের ভেতর ভাষায় বা শব্দে বর্ণনা করা যায় না সেই ভয়ংকর কিছুকে, ভয়ংকর সেই ভিসুভিয়াসের ক্রমাগত বিস্ফোরণকে ভুলে গিয়ে আমাকে বাঁচাতে চাইছিলে ধর্মান্ধ নির্বোধদের হাত থেকে। মা, কী করে পেরেছিলে সারাপথ কেবল আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে? তুমি কি মানুষ ছিলেমা, মা-রা বুঝি মানুষের চেয়েও বড় কিছু হয়। সব মা-ই? নাকি শুধু তুমিই? চারদিকের স্বার্থপর, নিচ, ক্ষুদ্র, কূপমণ্ডুকের মধ্যে বাস করে কী করে অত বড় একজন, মানুষের চেয়েও বড় একজন হতে পেরেছিলে মা?

.

আগেই বলে রেখেছিলাম যেন একটা খাট কিনে রাখা হয় তোমার জন্য। তোমার তো কিছু ছিল না। অবকাশে গিয়ে উঠোনে তোমার ভাঙা খাটটা দেখলাম পড়ে আছে, কেউ ছিল না ওটি সারানোর। আজ তোমার জন্য নতুন একটি খাট, নরম বিছানা। তুমি মরবে বলে। বেঁচে থাকতে তো আরাম জোটেনি, মরার সময় একটু না হয় আরামে মরো। তোমার ভয়ংকর অসুখটা না হলে এই নতুন বিছানাটা তুমি পেতে না। ভেঙে পড়ার আগে তুমি তো সেই খাটেই শুচ্ছিলে যেটা বিয়ের সময় নানি বাড়ি থেকে তোমাকে দেওয়া হয়েছিলো। আসলে কী জানেনা মা, ভয়ংকর অসুখ হলেও, তুমি কদিন পরই মরবে জানলেও কেউ তোমাকে নতুন ওই বিছানা দিত না। আমি ছিলাম বলে, আমার নির্দেশেই হয়েছে। তোমার জন্য সবচেয়ে যে ছোট ঘরটি, সেটিতে ওই নতুন খাট পেতে রাখা হয়েছে। হাসিনা বললো, কাজের লোককে দিয়ে ঘরখানা সে মুছিয়ে রেখেছে। বিরাট কাজ করেছেহাসিনা। এতদিনেশাশুড়ির সেবা করতে সে একপায়ে দাঁড়ানো। তোমার জন্য খামোক একটা সে ছুটোছুটির ভাব দেখাচ্ছে। রান্নাঘরে দৌড়ে গেল কিছু খাবার আনতে। অবকাশে সে যেদিন থেকে এসেছে কোনওদিন তো অত আনন্দে সে ছুটে যায়নি। তোমার জন্য কিছু আনতে। আমি জানি, তুমি মরে যাবে এই খবর বাড়ির একজনকেই খুশি করেছে, সে হাসিনা। হাসিনা সবচেয়ে বেশি যার মৃত্যু চায়, সে বাবার, এ আমি অনুমান করতে পারি। তারপর চায়, তোমার মৃত্যু। আশ্চর্য, দেখলাম তুমি হাসিনার আনাপানিটা খেলে। হাসিনাকে তুমি আদর করে দিলে। কেন মা? ওকে কী কারণে ক্ষমা করেছো? খুব বেশিদিন তোহয়নি যে তুমি ওর কুৎসিত ব্যবহারে অবকাশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। যখন ব্যথায় ককাচ্ছিলে, পানি খেতে গিয়েও দেখেছো তোমার বমি হয়ে যাচ্ছে, ও তো ঘর থেকেও বের হয়নি, আর বের হলেও নাক সিটকে তাকিয়েছিলো তোমার অসুস্থতার দিকে। জানিনা কেন তুমি হাসিনার হাতে খেতে চাইলে। কেন চাইলে মা? কেন আমার হাতে নয়? আমিই তো ছিলাম তোমাকেপানি খাওয়াবার, শেফালি ছিলো। নাকি তুমি ভাবতে চাইলে হাসিনা তোমাকে ভালোবাসে, তাই তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছে। যে তোমাকে সারাজীবন কষ্ট দিয়েছে, তার হাতে খেয়ে তুমি কি তাকে ক্ষমা করে দিতে চাইছিলে মা? তুমি হয়তো ক্ষমা করেছে মা, আমি করিনি। আজ ওর হাতে পানি খাবার তোমার তো দরকার ছিল না। তোমার আসলেপানিই খাবার দরকার ছিলো না। কিন্তু খেলে। তুমি কি হাসিনাকে মুক্ত করতে চেয়েছিলে ওর অপরাধবোধ থেকে? হাসিনার, কেন ভেবেছো যে, অপরাধবোধ ছিল? ছিল না মা। অপরাধবোধ জন্ম নেওয়ার জন্য সামান্য মানুষ হতে হয়। আমরা এই যে চারদিকে এত মানুষের সঙ্গে মিশি, এদের বেশির ভাগই আসলে মানুষ নয়। তুমি তো তোমার চোখে তোমার মতো করে মানুষগুলোকে দেখ, তাই ওদের মানুষ বলে ভাবো। তোমার হৃদয় আছে বলে তুমি ভাবো যে সবারই বুঝি হৃদয় আছে। তা তো নয়। নয় মা। আমার মনে হয়, আমি আমার মৃত্যুশয্যাতেও কোনও অপরাধীকে, কোনও দুশ্চরিত্র পাষণ্ডকে ক্ষমা করতে পারবো।

ওই ছোট ঘরটা থেকে বড় ঘরে, বাবার ঘরে, যে ঘরটায় ছোটবেলায় আমরা থাকতাম, সেই ঘরটায় তোমাকে সরিয়ে নিলাম। বাবা ঘুমোলো ছোট ঘরটায়, আমি আর নানি তোমার বিছানার কাছেই একটা বড় বিছানায়। তোমাকে চোখে চোখে রাখতে হয় আমার। রাতে ঘুমোই না। শুয়ে শুয়ে তোমাকে দেখি। এদিকে ময়মনসিংহে এসে বাবা দিব্যি পাল্টে গেল। সেই আগের মতো সাত সকালেই স্নান করে সাজগোজ করে নিচ্ছে। সার্ট, প্যান্ট, স্যুট, টাইপরে চেম্বারে চলে যেতে শুরু করলো। ফিরতে শুরু করলো সেই অনেক রাত্তিরে। যেন এ বাড়িতে কিছুই ঘটে নি, কিছুই ঘটছে না। যেন তুমি শুয়ে আছো না। যেন তোমার শরীর খুব দ্রুত অবশ হয়ে যাচ্ছে না।

.

তুমি আর উঠে দাঁড়ালে না মা। অবকাশের মাটিতে তোমার আর পায়ের ছাপ পড়েনি। একবার বিছানা থেকে নামালাম তোমাকে। বিছানাবন্দি যেন না থাকো, তোমাকে চেয়ারে বসিয়ে চেয়ারসহ তোমাকে উঠিয়ে নিয়ে গেলাম বারান্দায়। কী যে খুশি হলে! নিজের হাতে লাগানো ফলের গাছগুলো দেখলে, আম, পেয়ারা, কামরাঙা, লেবু, কলা, জামরুল, নারকেল! কী নয় বলো! গাছগুলোয় ফল ধরে আছে। শুধু কচি কামরাঙা গাছটায় বললে কঞ্চির ঠেস দিয়ে দিতে। এই কামরাঙার বীজ তুমি লাগিয়েছিলে। খুব ভালো জাতের কামরাঙা। বললে তুমি সুস্থ হয়ে উঠে এই কামরাঙা সবাইকে নিজের হাতে খাওয়াবে। মা, শুনেছি সেই কামরাঙা গাছটা এখন ঝুঁকে থাকে শত শত কামরাঙায়। তুমি জানো কি? কোথাও থেকে কি দেখ? এরকম যদি হত, সত্যিই দেখ। সত্যিই তুমি দেখতে পাচ্ছো সবকিছু! তোমার চেনা সব মানুষ কে কেমন আছে! তোমাকে কেউ মনে রেখেছে কি না। মানুষ তো নিষ্ঠুর। বোধহয় ওই গাছগুলো মনে রেখেছে তোমাকে। বোধহয় তোমার ওই প্রিয় গাছগুলো তোমার জন্য গভীর রাত্তিরে মাঝে মাঝে কাঁদে। সেদিন বারান্দায় বেশিক্ষণ তোমাকে রাখিনি। ঘরে নিয়ে আবার সেই বিছানায় শুইয়ে দিয়েছি। এখন ভাবি, কেন আরও বেশিক্ষণ তোমাকে রাখিনি। কেন তোমাকে পুরো উঠোন ঘোরাইনি ওভাবে। দিন দিন তোমার পেটের পানি বেড়ে চলেছে। তুমি এখন আর কিছুদিয়ে সেটা আড়াল করতে পারো না। দিন দিন তুমি শরীরে ভারি হয়ে উঠছো, যত ভারি হচ্ছো, তত তোমার মাথা হালকা হয়ে উঠছে, তুমি ঝিমোচ্ছো, নয়তো ঘুমোচ্ছো। একদিন আমাকে হঠাৎ অনুরোধ করলে যেন নামাজ পড়ি। আমি বললাম, নামাজ টামাজ তো আমি পড়তে জানি না। তুমি বললে নানি যখন পড়ে, তখন যেন নানির সঙ্গে পড়ি। নামাজের সুরা যে আমি জানি না, আমার যে মনে নেই, সে তুমিও জানো। তারপরও বললে। আগের মতো আমি তোমাকে কটাক্ষ করিনি। না, সেদিন আমি আর তোমার ধর্মান্ধতা নিয়ে বিদ্রূপ করিনি। আগে কোনওদিন তোমার এই অনুরোধ রাখিনি। কিন্তু সেদিন রাখলাম। তোমার বিছানার পাশে তোমার চোখের সামনে দুটো জায়নামাজ পেতে, একটিতে নানি, আর একটিতে আমি দাঁড়ালাম। তোমার যেন প্রাণের আরাম হয়, তোমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে আমি নামাজ পড়লাম। নামাজ পড়া মানে নানি যখন যখন মাথা নোয়ালো, দেখে আমিও নোয়ালাম, মাথা ওঠালো, আমিও ওঠালাম। ঘাড় ডানে বামে বাঁকালো, আমিও বাঁকালাম। যেসবে আমার বিশ্বাস নেই, আমি তা করি না কোনওদিন। কিন্তু তোমার জন্যই করেছিলাম মা। নামাজ শেষে মোনাজাতের হাত তুলে নানি নিঃশব্দে তোমার জন্য প্রার্থনা করলো যেন আল্লাহ তোমাকে সুস্থ করে তোলেন। নানির হাত দুটো ভিজে যেতে থাকলো চোখের জলে। দুদিন পর তুমি আর খোঁজ নাওনি আমি নামাজ পড়েছি কি না। তুমি যেন থেকে থেকে হারিয়ে যেতে কোথাও। আমি নিজেই অন্য ঘর থেকে এসে বলতাম, নানির সঙ্গে নামাজ পড়েছি আমি, না পড়েও বলেছি পড়েছি। মা, তোমার সারাজীবনে আমি তোমাকে কোনও সুখ দিতে পারিনি, তাই সুখ স্বস্তি সব উজাড় করে দিতে চাইছিলাম। তুমি আমাকে নামাজ পড়তে বলেছিলে কেন? অনেককাল তো বলোনি। ও তোমার জন্য দোয়া করার জন্য বলোনি, আমার জন্য বলেছিলে, যদি আল্লাহ বলে কোথাও কিছু থেকে থাকে, তবে তার নিষ্ঠুর শাস্তি থেকে যেন তার জপ করে বাঁচতে পারি। হ্যাঁ তোমার হয়তো মনে হয়েছিলো, যদি সত্যি সত্যিই থেকে থাকে দোযখ বা বেহেস্ত বলে কিছু, যদি সত্যি হয় ধর্মের রূপকথাগুলো, তবে আমাকে তো পুড়তে হবে দোযখের আগুনে। জানি না ঘুমিয়ে স্বপ্নের মধ্যে আমাকে আগুনে ঝলসে যেতে দেখেছিলে কিনা। আমি দেখ, সৌখিনকে ধরে এনে তোমার বিছানার পাশেশীতল পাটিতে তসবিহ দিয়ে বসিয়ে দিতাম, বলতাম, দরুদ পড়ে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করো, যেন তোমার দাদু ভালো হয়ে ওঠে। বলতাম, বলো আল্লাহ তুমি আমার দাদুকে ভালো করে দাও। আমি কিন্তু কখনই বলিনি বলে আমার দাদুকে তুমি বেহেসতে নিও। বেহেসতের কথা এলে মৃত্যুর গন্ধ সঙ্গে আসে। আমি মৃত্যুর ত্রিসীমানায় কোনও শুভকামনাকে নিতে চাইনা। শুধু সুস্থ হয়ে ওঠার প্রার্থনা যেন তুমি শোনো। তোমার একজন নাতি তোমার জন্য দোয়া করছে, এ যেন দেখতে তোমার ভালো লাগে। সুহৃদ আর শুভর তো তোমার কাছে এসে বসার সময় নেই। সারাদিন মাঠে মাঠে খেলছে। সৌখিন ছোট বলেই ওকে বসাতে পেরেছিলাম। বিশ্বাসের বাইরে কতদূর গিয়েছিলাম মা, শুধু তোমার জন্য। সুহৃদকে টেনে টেনে এনে অনেকদিন তোমার পাশে বসিয়েছি। বলেছি যেন সে বলে তার দাদুকে সে ভীষণ ভীষণ ভালোবাসে। সুহৃদ তোমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়েছে। ওকে তুমি আদর করে করে কানে কানে বলেছো, তুমি খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করে অনেক বড় হবে তো! সুহৃদ কথা দিয়েছে, হবে। দেখতে কী যে ভালো লাগে আমার! তোমার ভালো লাগছে এমন কিছুই আমাকে ভালো লাগা দিত। ইয়াসমিন কদাচিৎ ফোন করতো। কেন যে ও প্রতিদিন ফোন করে তোমার সঙ্গে কথা বলতোনা! ওর সঙ্গে অভিমান করে আমিও খুব ঘন ঘন ওকে ফোন করিনি, তোমার সঙ্গে কথা বলিয়ে দিইনি। আজ মনে হয়, কেন দিইনি। কিসের অভিমান ছিল আমার। ও ফোন করে না, হয়তো ফোনের খরচ নিয়ে ভাবে, অথবা ধীরে ধীরে তুমি আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছো, এই দুঃসংবাদ তার শুনতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু তাই বলে আমি অভিমান করে কী এমন ভালো করেছি ওর বা তোমার!

গুলকিবাড়িতে কোনও এক মহিলা পীরের কাছে তুমি যেতে, তার ব্যবহার তোমার ভালো লাগতো, বলেছিলে আমাকে। তার ঠিকানা যোগাড় করে তাকে তার সব মুরিদসহ অবকাশে আমন্ত্রণ জানালাম। তোমার জন্য মিলাদের আয়োজন করলাম, যে ঘরে তুমি শুয়েছিলে, সে ঘরেই। তোমার কন্যা নাস্তিক বলে নওমহলের পীর বাড়ি থেকে তোমাকে বের করে দেওয়া হয়েছিল, তুমি শেষ অবদি গুলকিবাড়ির ওইপীরের খোঁজ পেয়ে তার কাছেই যেতে। প্রেসক্লাবের বিরিয়ানি প্যাকেট করে আনিয়েছিলাম, ওদের সবাইকে দিয়েছিলাম। ধর্মে বিশ্বাস না থাকার পরও ওই ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন আমি করেছিলাম, শুধু তোমাকে একটুখানি ভালো লাগা দেওয়ার জন্য। সবাই তোমার জন্য দীর্ঘ সময় ধরে মোনাজাত করেছে। তোমার সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য কোনও এক অদৃশ্য আল্লাহকে কেঁদে কেঁদে অনুরোধ করেছে। প্রাণভরে প্রার্থনা করেছে। দেখে যদি একটুও ভালো লাগে তোমার, তাই এই আয়োজন মা। আর কিছু নয়। ভালো লাগা তো আর কখনও দিতে পারিনি তোমাকে। জীবনের শেষ মুহূর্তে যেভাবে সম্ভব ভালো লাগা দিতে চেয়েছি। বাবাও আল্লাহ বা রসুলে বা ইসলামে বা মিলাদে বিশ্বাসী না হয়েও একটা মৌলবী ধরে এনেছিলো, তাকে দিয়েই ড্রইংরুমে বড়সড় মিলাদ পড়ানোর ব্যবস্থা করেছে। ধর্মে বিশ্বাস না করেও বাবা শুধু তোমার জন্যই করেছে, যা করেছে। আমিও জানি, বাবাও জানে, মৌলবীরা যতই তোমার সুস্থতার জন্য আল্লাহর কাছে মোনাজাত করে যাক না কেন, তুমি সুস্থ হবে না। তুমি শুয়ে শুয়ে মিলাদের আওয়াজ শুনলে। তোমার কি ভেতরে ভেতরে একটু হলেও বিশ্বাস জন্ম নিত যে সুস্থ হয়তো হয়েও যেতে পারো হঠাৎ, জাদুর মতো! নানি যেমন মৃত্যুর দরজায় পা দিয়েও ফিরে এসেছিলো, সেরকম একটা জাদু তুমি হয়তো চেয়েছিলে। আমিও হয়তো তোমার মতো অবস্থা হলে চাইতাম।

.

তুমি লক্ষ করছিলে যে তোমাকে আর কোনও ওষুধ দেওয়া হচ্ছে না। সব চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তুমি চাইলেও সেটি তোমাকে দিচ্ছি না কেউ। যে আমি তোমার চিকিৎসার জন্য দূর আমেরিকায় তোমাকে নিয়ে গিয়েছি, সেই আমিই এখন চিকিৎসা বন্ধ করে দিয়েছি। নিশ্চয়ই চিকিৎসার আর কিছু নেই বলেই বন্ধ করেছি। মনে মনে লৌকিকে আশা ছেড়ে অলৌকিকের কথা ভাবছিলে কী! বৈঠকঘরে মিলাদেরপর যখন মোনাজাত হচ্ছে, তুমি শুনছিলে, দেখলাম তোমার মাথায় কোনও কাপড় নেই। তুমি সাধারণত এসব সময় আলগোছে মাথায় একটু কাপড় উঠিয়ে দাও। অভ্যেস অনেকদিনের। অভ্যেস থেকে তুমি বেরিয়ে আসছে। নিউইয়র্কে আর শান্তিনগরে দেখেছি তুমি বিছানায় বসে নামাজ পড়তে। যখন বসতে অসুবিধে হতো, শুয়ে পড়তে। অবকাশে এসেও মাথায় একটু কাপড় তুলে দিয়ে, শুয়ে থেকেই চোখ বুজে বিড়বিড় করছে। কয়েকদিন করেছে। তারপর লক্ষ করছি, নামাজ তোমার আর শুয়েও পড়া হয় না। নামাজের সময় চলে যায়, তুমি ঘুমিয়ে থাকো। দিন আর রাত তোমার একাকার হয়ে যাচ্ছে। কারও অসুখ হলে আমরা বিশ্রাম নিতে বলি, শুয়ে থাকা বা ঘুমিয়ে থাকাটাইতাদের জন্য স্বাভাবিক বলে মনে করি। কিন্তু তোমার ঘুম স্বাভাবিকতার আওতা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। চিরকালের অভ্যেস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছো তুমি। তুমি জানো না যে বেরিয়ে যাচ্ছো। জগৎ থেকে সরে যাচ্ছো তুমি। একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছো। তুমি আগের চেয়ে অনেক বেশি ঘুমিয়ে কাটাচ্ছো। তুমি জানো না যে তুমি ঘুমোচ্ছা। আমি জানি। আমি টের পাচ্ছি যে এই ঘুম প্রয়োজনের ঘুম নয়। এ অপ্রয়োজনের ঘুম। এ ঘুম তোমাকে জাগতিক সব কিছু থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরিয়ে নেওয়ার ঘুম। এই ঘুম ভালো ঘুম নয়। এই ঘুম চেতন থেকে ধীরে ধীরে তোমাকে অচেতনের দিকে টেনে নেওয়ার ঘুম। কিন্তু সেও কি তখন আর বুঝতে পেরেছিলাম অত! এখন পেছন ফিরে তাকালে অনেক ধোঁয়াই কেটে যায়।

.

ধীরে ধীরে, সামান্য যা খেতে, তাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, টের পাচ্ছি। খুব কষ্ট করে গিলতে হয় যা কিছুই খাও। সুপ খেলেও, জল খেলেও। কিছু পেটে পড়লেই পেটের ভেতর তোমার সেই ভিসুভিয়াস ফুঁসে ওঠে। তারপরও যুদ্ধ করে যাচ্ছিলে, তোমার ওই একার যুদ্ধ। তোমার জন্য স্যালাইন এনে রেখেছি, অক্সিজেন এনেছি, ব্যথা কমানোর পেথিডিন এনেছি। ধীরে ধীরে তুমি যে কী কঙ্কালের মতো হয়ে যাচ্ছিলে মা! আমি জানি না তোমার সামনে আয়না ধরেছিলাম কিনা দেখতে। তুমি নিজেই হয়তো বুঝতে পাচ্ছিলে। আমার আবার কী রোগ হয়েছিলো জানিনা, প্রায়ই ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়াতাম তোমার ছবি তুলতে। বাবাকে পাশে বসিয়ে ছবি তুলছি, তোমার একার ছবি, তোমার রুগ্ন পাণ্ডুর মুখের ছবি, তোমার কঙ্কালসার শরীরের ছবি। কেন তুলছিলাম মা? তুমি চাইতে না ছবি তুলতে। তুমি বাধা দিতে। একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন চাইছো না? তুমি করুণ কণ্ঠে বলতে, এখন তো দেখতে আমি ভালো না, এখন ছবি তোলোনা। সম্ভবত চাইতে না তোমার ওই চেহারার মাকে আমরা দেখি। আমি বুঝিনি তখন। ঠিকই বলতে, তোমার ওসব ছবির দিকে এখন তাকাতে পারি না। ও তো তুমি নও, অন্য কেউ। যখন সুস্থ ছিলে, হৃষ্টপুষ্ট ছিলে, যুবতী ছিলে, বাড়ির সবার ছবি তুললেও তোমার ছবি আমরা কেউই তুলিনি। হঠাৎ করে মৃত্যুশয্যায় রুগ্ন মায়ের ছবি তুলতে উগ্রীব। সারাজীবন ভুল করে শেষ দিনে এসে শোধরাতে চাইলে সব ভুল শোধরানো যায় না! বড় দেরি হয়ে যায়। যখন সুস্থ ছিলে, হাতে গোনা। তখনকার দুএকটা ছবি ছাড়া তোমার আর কোনও ছবি নেই কোনও অ্যালবামে। যা আছে, তাও তোমার একার ছবি নয়। অনেকের সঙ্গে তুমি। সুহৃদকে গোসল করাচ্ছো, বা পড়াচ্ছো। আসলে ও ছবি তোমার জন্য তোলা হয়নি, সুহৃদের জন্য হয়েছিল। বা ওর জন্মদিনের কেক কাটার সময় আর সবার মধ্যে তুমিও আছে। সবসময়ই দূরে, কিনারে, অর্ধেক কাটা পড়েছে, ইনসিগনিফিকেন্ট ক্যারেকটারের মতো। তোমাকে ওঠানো হতো না, তুমি অ্যাক্সিডেন্টালি উঠে যেতে।

.

হাশেম মামাকে ভালোবাসতে তুমি খুব। কাকে ভালো বাসতে না বলল। হাশেম মামার ক্যানসার ধরা পড়ার পর তুমি পাগলের মতো কেঁদেছো। তোমার মতো এত তো কেউ কাঁদেনি। তোমার ছোট ভাই, তার ক্যানসার তুমি মেনে নিতে পারোনি। হাশেম মামা আমাকে খুব স্নেহ করতো, আমি ঢাকা থেকে এলেই চলে আসতো আমার কাছে আমার নতুন কী বই বেরিয়েছে, নিতে। হাশেম মামা তুমি নিউইয়র্কে থাকাকালীনই মারা গেছে, খবরটা তোমার কাছে আমরা সবাই ইচ্ছে করেই লুকিয়েছি, জানলে তুমি কষ্ট পাবে তাই। কী দরকার কষ্টের এক দুঃসহ বোঝার ওপর নতুন কষ্টের বোঝা উপুড় করার। জেনে কী লাভ তোমার! এমন তো নয় যে, একদিন সুস্থ হয়ে উঠবে, আর নানিবাড়ি গিয়ে আবিষ্কার করবে হাশেম মামা নেই। আমরা তো সবাই জানি যে এরকম কোনও ঘটনা আদৌ ঘটবে না। আমরা তো সবাই জানি দিন দিন তুমি শরীরের সব শক্তি হারিয়ে ফেলছো, তুমি মিশে যাচ্ছো বিছানায়, উঠে বসারও শক্তি তোমার নেই, তুমি একটু একটু করে চলে যাচ্ছো, একটু একটু করে তোমার চেতন হারাচ্ছে, তুমি তলিয়ে যাচ্ছো, তুমি ফিরছো না। তুমি যে ফিরবে না, সে তো সবাই জানি। তোমাকে যদি না জানানো হয় হাশেম মামার মৃত্যুর খবর, তাতে তোমার কোনও ক্ষতি হওয়ার নেই কিছু। মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ তুমি করছো, তোমার প্রিয়জনের মৃত্যুর খবর তোমাকে দিয়ে তোমাকে কি আরও শক্তিময়ী করতে পারবো! কী করবে তুমি হাশেম মামার মৃত্যুর খবর জেনে? কী লাভ হবে তোমার! রুনু খালার স্বামী রাসু খালু একদিন এসে বসেছিলো তোমার সামনে। দিব্যি বলতে লাগলো, হাশেম ভাই যেদিন মারা গেল, সেদিন তো আমি.. কোনও দরকার ছিল না তোমাকে ওই গল্প শোনানোর। আসলে কারও মৃত্যুতে এই টুপি দাড়িঅলা মানুষগুলোর কোনও কষ্ট হয় না। তারা বিশ্বাস করে মৃত্যু মানে আল্লাহর কাছে যাওয়া। হাশেম মামা মারা গেছে এই খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তুমি চমকে তাকালে আমার দিকে। কী যে অসহায় তুমি তখন! কী যে বোবা দৃষ্টি তোমার। মুহূর্তে আচমকা এক গাদা অন্ধকার তোমার ক্রমশ অন্ধকার হতে থাকা জগৎকে কোথাও ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আমি আর বলতে পারিনি যে রাসু খালু মিথ্যে কথা বলছে। বলতে পারিনি হাশেম মামা বেঁচে আছে এবং ভালো আছে। কারণ মিথ্যে হলে রাসু খালু ওভাবে বলতো না। আমি তোমার বিছানার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে বললাম, মা, হাশেম মামা খুব কষ্ট পাচ্ছিল, হয়তো এ তার জন্য ভালোই হল যে ওই ভয়ংকর কষ্ট আর তাকে পেতে হচ্ছেনা। কষ্ট থেকে মুক্তি পাক হাশেম মামা, তুমি তো চাও, তাই না মা? অত কষ্ট মামা আর সইতে পারছিলো না। কী আর বলবো মা, কী বলে সান্ত্বনা তোমাকে দেব। আমি জানি না কতটুকু কী বুঝলে তুমি, তুমি শান্ত মেয়ের মতো শুয়ে পড়লে, ভেতরে কী হচ্ছিল তোমার, কী রকম যন্ত্রণা, জানি না। তোমার চোখের কিনার বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অবিরল জল। তুমি কি তখন ভাবছিলে যে, তোমার কষ্ট থেকে তোমার মুক্তি হোক, সেও আমি মনে মনে চাইছি! মানুষ ঠিক ওরকম অবস্থায় মনে মনে কী ভাবে, আমার পক্ষে সম্ভব নয় অনুমান করা। মৃত্যুর নিশ্বাসের কাছে বসে দেখতে হবে কী ভাবছি আমি। জানি না, মা, তখন কি অন্য কারও মৃত্যুর জন্য কান্না পাবে আমার? নিজেই যখন যাচ্ছি, কে গেছে বা যাচ্ছে, তার কথা ভেবে আমি কি কাঁদবো! আমি কি বাঁচবো যে সে ছাড়া আমার খালি খালি লাগবে। কেন কাঁদছিলে মা? হাশেম মামার মৃত্যু তুমি সইতে পারছিলে না কেন মা? তোমার নিজের মৃত্যুর চেয়ে অন্যের মৃত্যু তোমাকে কাঁদায় কেন বেশি মা? কেন তুমি আমাকে বিরক্ত করার চেয়ে নিজের মৃত্যুকেই বেছে নিলে, মা? বাবা বিরক্ত হত, দাদা বিরক্ত হত, নিজের চিকিৎসার জন্য সামান্য সাহায্য চেয়ে তাই ওদের বিরক্ত করতে চাওনি আর। তাই আমার কাছে গিয়েছিলে, দেখলে তোমার অসুখের কথা শুনে আমিও বিরক্ত হচ্ছি। তাই আমাকেও চাওনি বিরক্ত করতে। নিজের অসুখ নিয়ে নিজেই একা পড়ে রইলে। বিরক্ত হওয়া থেকে আমাদের বাকি জীবনের জন্য বাঁচালে। পারো কি করে? জীবন তো তুমি জানতে একবারই আসে। যত ধর্মকর্মই তুমি করো না কেন, ভেতরে ভেতরে তো বুঝতে এই জীবনের পরে আসলে আর কোনও জীবন নেই।

অবকাশের কালো ফটকে তালা দিয়ে বাবাকে আটকে রাখতে চেয়েছিলাম বাড়িতে। আমার ধমক, ভয় দেখানো, রাগ হওয়া কিছুই কাজ করেনি। যে করেই হোক বাবা যাবেই। তালাবন্ধ করে আর যাকেই যায়, বাবাকে আটকে রাখা যায় না। নিউইয়র্কে আর ঢাকায় তোমার পাশে যে বাবা ছিল দিন রাত, মনে হয় না এই বাবাই সেই বাবা। সব ভুলে আগের দিনের মতো বাবা চেম্বারে রোগী দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমি শত চেষ্টা করেও বাবাকে থামাতে পারিনি। তোমাকে বলিওনি বাবা সেই আগের মতো দিব্যি সুটেড বুটেড হয়ে চিরকালের মতো বাইরে যাচ্ছে। তুমি কি খেয়াল করেছো বাবা এসে কাছে আর খুব একটা বসছেনা। উঁকি দিয়ে তোমাকে দেখে চলে যাচ্ছে। কী আশ্চর্য, দুদিন সাহেব হয়ে বসে তোমার সঙ্গে কিছু ছবি তুললো। বিশ্বাস হয়নি এই বাবাকেই নিউইয়র্কের হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলাম প্রায় ধরে বেঁধে। ডাক্তার সব পরীক্ষা করে ওষুধ লিখে দিলেন। রক্তচাপ কমিয়ে রাখার ঠিকঠাক ওষুধ বাবা কোনওদিন খায়নি। আমি যা হাতে দিতাম, শিশুর মতো তাই খেয়ে নিত। আমি যে কত ভুল ওষুধ দিয়েছি। ডাক্তার লিখে দিয়েছে ওষুধ, কিন্তু কখন খাবে তার সময় লিখে দেয়নি। আমি সেগুলো একসঙ্গে বাবাকে খেতে দিতাম, বাবা খেয়ে নিত, জিজ্ঞেসও করতো না কী দিচ্ছি, কেন দিচ্ছি। আমাকে এত বিশ্বাস ছিল বাবার। এত অসহায় ছিল মানুষটা। ঢাকায় পর্যন্ত অসহায় ছিল। আর ময়মনসিংহে এসেই দিব্যি পূর্ণ তেজ ফিরে পেয়েছে। নিজের রক্তচাপ, ডায়বেটিস আর তোমার অসুস্থতা সব ভুলে বাবা এখন শহরের ব্যস্ত ডাক্তার, আগের মতো। মানুষের মনের শক্তিই বোধহয় সব চেয়ে বড় শক্তি। অন্তত বাবার বেলায়। তোমার মনে যত জোর আনছো, কোনও কাজেই তা লাগছে না। দিন দিন তুমি আরও বেশি দুর্বল হয়ে পড়ছে। বাবার কি এ কদিনেই ক্লান্তি এসে গেছে তোমার সেবা করতে করতে, তোমাকে সময় দিতে দিতে! তা না হলে ময়মনসিংহে ফিরে এসে বাবা কেন এভাবে বদলে গেল। মা, সত্যি কথা বলতে কী, সবাই কেমন যেন ক্লান্তই হয়ে পড়ছিলো। ছুতোনাতায় নিজের জীবনে ফিরতে চাইছিলো। তুমি চলেই যাবে যখন, না হয় চলেই যাও। তোমার জন্য যে সময় নির্ধারিত ছিল, সে সময়ের চেয়ে খানিকটা বেশি বেঁচে ফেলছো তুমি, মানুষ হতাশ হবে না কেন। চারপাশের মানুষগুলোর ক্লান্তি আমি টের পাই। আমারও কি ক্লান্তি আসেনি মা! এসেছে। আমারও মনে হয়েছে, অনেক হল, যে যাবার সে যাক। আমরা, সে যত আপনই হোক, খুব বেশি সময় খরচ করতে চাই না কারও জন্য। ভালোবাসায় আমাদের ক্লান্তি চলে আসে। তুমি কি টের পেয়েছিলে? টের পেয়েছিলে যে আমরা কেউ আর তুমি আরও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকো, চাইছিলাম না! টের না পাওয়ার কিছু তো ছিলো না। ধীরে ধীরে তুমিও লক্ষ করছিলে, দূর থেকে যারা এসেছে, তারা তোমাকে শেষ বিদায় জানিয়ে গেছে। কাছে যারা ছিল, তাদের উপস্থিতির ঘনত্ব দিন দিন কমছে। তুমি কি আমার মুখেও টের পেয়েছিলে, ক্লান্তি! তোমার কাছ থেকে বারবার আমি উঠে চলে গিয়ে অন্য কোথাও বসে গল্প করছি। আমারও আর ভালো লাগছেনা এভাবে মৃত্যুর সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে বসে থাকতে, মৃত্যুর মতো নির্মম কিছুকে এত পলকহীন চোখে বেশিদিন দেখা যায় না। আমারও ইচ্ছে করছে নিজের জীবনে, জীবনের উৎসবে, উচ্ছলতায় ফিরে যেতে। এক বিকেলে বাড়ির কয়েকজনকে নিয়ে যেদিকে দুচোখ যায়, সেদিকে চলে যেতে যেতে দিব্যি হালুয়াঘাট থেকে ঘুরে এলাম। মুক্তি তো চাইছিলামই। বিদেশ থেকে আমন্ত্রণ এলে, ভেতরে ভেতরে আমার খুব লোভ হচ্ছিল যাওয়ার। ফ্রান্সের জাতীয় সংসদে বক্তৃতা করার আমন্ত্রণ। অনেকগুলো ফোন পেয়েছিফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতের। ফরাসি সরকারের এই আমন্ত্রণ রক্ষা করার জন্য আমাকে ক্রমাগতই অনুরোধ জানানো হচ্ছে। আমি বলে দিয়েছিলাম, আমার মার অসুখ, কোথাও এ সময় আমি যেতে পারবো না। পরে আবার একদিন মনে হয়েছে, দুদিনের জন্য ঘুরে এলে কী এমন ক্ষতি। না, মা, এই লোভ আমি সামলাতে পারিনি। এমনকী বাবাও অবাক হয়েছে আমার গোপন পরিকল্পনার কথা জেনে, যে বাবা সবসময় চাইতো বিদেশের সম্মানগুলো নিতে যেন কোনও আলস্য না করি। যেদিন তোমাকে বললাম, খুব বড় আমন্ত্রণ এসেছে ফ্রান্স থেকে, না গেলেই নয়, কদিন পরই ফিরে আসবো। তুমি করুণ চোখে তাকিয়েছিলে আমার দিকে। সেই চোখে বিস্ময়ও ছিল। তুমি হয়তো বুঝে পাওনি কী করে আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছি। কী করে অন্য কোনও কিছু, সে যত বড় আমন্ত্রণই হোক না কেন, মত্যুশয্যায় পড়ে থাকা মায়ের চেয়ে বড় হল। মাঝে মাঝে ভাবি কেন আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইছিলাম, বড় বড় আমন্ত্রণে কি আমি এ যাবৎ কম রক্ষা করেছি! জীবনে কি বিশাল সব মঞ্চে আমি কম বক্তৃতা দিয়েছি! কেন আমি তোমাকে ওই আজ আছে কাল নেই অবস্থায় ফেলে অন্য কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা মনে এনেছিলাম। নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না। নিজেকে ক্ষমা করা আমার সম্ভব নয়। তোমাকে যে আঘাত দিয়েছিলাম, সে আঘাত তুমি নিভে যেতে থাকা জীবনে ধারণ করতে বাধ্য হয়েছিলে, প্রকাশ করোনি কিন্তু বিস্ময় বোধটা তুমি লুকোতেও পারোনি। অবশ্য তারপরই মাথা নেড়ে বলেছিলে যেতে, যেন যাই, বড় আমন্ত্রণে যেন যাই আমি। আমাকে সুখ দিয়েছিলে মা। যতটুকু উদার তুমি হতে পেরেছিলে, আমি কেন তার ছিটেফোঁটাও হতে পারিনি। শেষ অবদি আমি যাইনি কোথাও, কিন্তু যেতে তো চেয়েছিলাম, যেতে চাওয়ায় এবং যাওয়ায় কতই আর পার্থক্য!

যে তুমি বাঁচতে ভালোবাসতে, সেই তুমিই চাওনি আমার কোনও কষ্ট হোক তোমার জন্য। তুমি এমনকী যে মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করছিলে প্রাণপণে, আমার ক্লান্তি বা কষ্টের কথা ভেবে তুমি তোমার নিজের মৃত্যু কামনা করলে। আমাকে মুক্তি দিতে চাইলে তোমার নিরন্তর সেবা থেকে। আমার ক্লান্তি থেকে। অবকাশেও যখন তোমাকে আমার সাহায্য করতে হলো মলত্যাগে, তুমি ভেবেছো আমার নিশ্চয়ই ঘেন্না হচ্ছে এসবে। তুমি সইতে পারোনি। একদিন শুধু বলেছো, তোমার এই কষ্ট আমি আর সইতে পারছি না। আল্লাহর কাছে বলে আমাকে যেন নিয়ে যান। না, মা। ও কারণে আমার কোনও কষ্ট হয়নি। সম্ভবত কষ্ট হয়নি এই ভেবে যে, এ তো আর দীর্ঘদিনের জন্য নয়। নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমি করছিলাম, নাকি যা কিছু করছিলাম, করছিলাম তোমাকে ভালোবাসি বলে! মাঝে মাঝে ভাবি, বোধহয় প্রায়শ্চিত্তই করছিলাম। প্রায়শ্চিত্ত করতে বেশিদিন মানুষের ভালো লাগেনা। ভালোবাসলে কোনও ক্লান্তি আসতো না, ভালোবাসলে গোপনে গোপনে নিস্তার চাইতাম না। কত মানুষ এই পৃথিবীতেই আছে, যারা মাথা নষ্ট হওয়া, শরীর স্থবির হওয়া, বিছানায় পড়ে থাকা মাকে বছরের পর বছর, যুগেরপর যুগ সেবা করে যাচ্ছে, কোনও ক্লান্তি নেই, কোনও অভিযোগ নেই। তারা ভালোবাসে বলেই পারে। আমি সেই ভালোবাসা কোথায় পাবো মা! তোমার জন্য জন্ম থেকেই তা ছিলো না। হঠাৎ করে জন্মাবে কী করে, আমার দোষে তোমার অসুখ হয়েছে বলে! করুণা হয়েছে, মায়া হয়েছে, মমতা বোধ করেছি, আহা আহা করেছি। কিন্তু ভালোবাসা তীব্র ছিলো না বলে ওই অল্প সময়টুকুকেই দীর্ঘ দীর্ঘ বলে মনে হয়েছে। দিন হিসেব করেছি। ডাক্তারের দেওয়া তিন মাস পার হয়ে গেলে বিস্মিত হয়েছি। একটি দিনের বেশি হওয়াও হিসেবে রেখেছি। এসব অজান্তে ঘটেছে মা। আমার নিজেরই অজান্তে। আমার উদার ব্যক্তিত্বের ভেতরে বসে থাকা অনুদার স্বার্থপর আমিটিকে আমি ফাঁকি দিতে পারিনি। তোমার মহানুভবতার সামনে আমি অতি তুচ্ছ, অতি ক্ষুদ্র এক জীব। যেটুকু ভালো আমার, সেটুকু তোমার কারণে, যেটুকু মন্দ আমি, আমার কারণে।

তোমার শরীরের শক্তি দ্রুত ফুরোচ্ছিল। আজ তুমি পা নাড়াতে পারছো, কাল পারছে না। দুপুরে এপাশ ওপাশ করলে, বিকেলে আর সেটা পারলে না। তোমাকে দেখছিলাম আমি। লক্ষ করছিলাম তোমার শক্তি ফুরোনো। এ নিয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলেছি, দাদা আর হাসিনার সঙ্গেও বলেছি। কাউকে সামান্য উদ্বিগ্ন হতে দেখলাম না। সম্ভবত তারা উদ্বিগ্ন তুমি এত সময় নিচ্ছো কেন মরতে, সম্ভবত তাদের আশংকা এভাবেই তোমার আবার আরও কয়েক মাস, আরও কয়েক বছর কেটে যায় কিনা। এরাই তো সেই মানুষ, যাদের সেবায় তুমি জীবন উজাড় করে দিয়েছিলে। তোমাকে দেখার আর কেউ ছিল না। তোমার মাথার কাছে বসে থাকতো নানি, বসে বসে কোরান পড়তো। কোরান পড়ে কোনও লাভ নেই জানি, তুমি সুস্থ হবে না। তারপরও আমি বাধা দিইনি। তুমি তো জীবনের অনেকটা সময় কোরান পড়েছো মা, নানি তার ভালোবাসা কী করে প্রকাশ করবে, নানি তো অন্য কিছু শেখেনি। কোরানইশিখেছে, তাই কোরানই পড়ছে। বাকি যারা আসতো তোমাকে দেখতে, টুটু মামা, আর মাঝে মাঝে শরাফ মামা। টুটু মামা তো শেষ দিকে রাত জেগে তোমার বিছানার সামনে বসে নামাজ পড়তো, দোয়া দরুদ পড়তো। মিলাদপড়ার মতোও দাঁড়িয়ে ইয়া নবি সালাম আলায়কা, ইয়া রসুল সালাম আলায়কা বলতো। আমিও দাঁড়াতাম ওদের সঙ্গে, তোমার সঙ্গে যেমন ছোটবেলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, হাত দুটো পেটের কাছে মুড়ে রেখে জোরে জোরে বলতাম ওগুলো, যে কথাগুলো কোনওদিন বুঝিনি। নাস্তিক হয়েও কেন আমি দাঁড়াতাম মা! তুমি যেন আমাকে দেখে খুশি হও? তুমি কি খুশি হতে মা? কতটুকু চোখ মেলতে পারতে আর তুমি, কতটুকু দেখতে পারতে, কতটুকু সুখের অনুভব তোমার তখন আছে? তারপরও আমার মনে হত, যদি থাকে, সামান্যও যদি থাকে, তুমি খুশি হও, একবার জীবনে তোমার নাস্তিক কন্যার বোধোদয় হয়েছে ভেবেও সুখপাও। সে সুখ মিথ্যে হলেও পাও। জীবনের শেষ মুহূর্তে অন্তত কিছুসুখ তুমি পাও। মাঝে মাঝে আসতো ছটকু, ফেলু মামা। ফেলু মামাকে দিয়ে তো তোমার স্টিলের আলমারিটা রং করিয়ে আনলাম। তোমাকে দেখতে বললাম আলমারির গোলাপি গোলাপি রংটা চমৎকার হয়েছে কীনা। একটু ঘাড় পেছনে নিয়ে দেখেছিলে মা। ওটিও তোমাকে সুখ দেওয়ার জন্য। তোমাকে বললামও, এই আলমারিতে এখন থেকে তোমার সবকিছু সুন্দর করে সাজিয়ে রাখবে মা, ঠিক আছে?

তুমি মাথা নেড়ে বললে, হ্যাঁ ঠিক আছে।

তুমি তো সুস্থ হয়ে উঠবে মা।

এ কথা শুনে তোমার ওই ক্লান্ত চোখ দুটোকেও স্বপ্নের জল এসে উজ্জ্বল করে তুলতে। জানি না তুমি বিশ্বাস করতে কী না। বিশ্বাস হয়তো হতে চাইতো না, কিন্তু তারপরও বিশ্বাস করতে হয়তো ভালো লাগতো। আমি ঠিক জানিনা ঠিক কী ভাবতে তুমি। মৃত্যুর অত কাছাকাছি চলে এলে কী রকম ভাবনা মানুষের মনে আসে, তা আমার জানা নেই। অসুখ ধরা পড়ার পর তুমি তো মৃত্যু শব্দটির নাম গন্ধ সইতে পারতে না, উচ্চারণ করতে না। সচেতন ভাবেই হয়তো করতে না। তুমি কি বিশ্বাস করতে চাইতে না তুমি যে সত্যি সত্যি মারা যাচ্ছো, নাকি তুমি প্রচণ্ড মনের শক্তি দিয়ে বেঁচে উঠতে চাইতে বলে অলক্ষুণে মৃত্যুর নামোচ্চারণ করতে না, নাকি মারা যাচ্ছো জেনেও তোমার প্রিয়জনকে বোঝাতে চাইতে না যে তুমি বুঝতে পারছো যে মরছে, ভাবতে প্রিয়জনেরা কষ্ট পাবে ভেবে যে তুমি জেনে গেছো গোপন ব্যাপারটি, জেনে তোমার কষ্ট হচ্ছে। আমার মনে হয় না তোমাকে অত কেউ কোনওদিন ভালোবাসতো যে তোমার কষ্টের কথা ভেবে কষ্ট পাবে। সারাজীবন কেউ বাসেনি জানেনা। হয়তো ভেবেছিলে, মরে যাচ্ছে বলে বুঝি ভালোবাসা জাগবে। না মা, যে সারাজীবনে ভালোবাসেনি, চোখের সামনে মরছো দেখলে তোমার জন্য তাদের ভালোবাসা উথলে ওঠার কোনও কারণ নেই। বেঁচে থাকলেও তোমার মৃত্যু চেয়েছে, মরতে থাকলে তো আরও চাইছে, দেরি সইতে পারছে না। তোমার কি কষ্ট হচ্ছে শুনতে? তুমি তো সব কিছুর ঊর্ধ্বে এখন মা, কষ্ট যন্ত্রণা এগুলো তোমাকে আর স্পর্শ করতে পারে না। পারবে কেন, তোমার নাগালই কেউ এখন আর পাবে না, পাবে না কারণ জলে স্থলে অন্তরীক্ষে তুমি আর নেই এখন। কোথাও নেই তুমি না থাকা মানুষের আবার দুঃখ কী। আমিও তো তোমার মতো না-থাকা হয়ে যাবো, দিন তো আসবেই কোনও না কোনও দিন। দিন তো সবারই আসে, আমার কেন নয়! তোমার অন্তত এইটুকু সান্ত্বনা হোক মা, তোমার মৃত্যু দেখে দেখে যাদের মনে হয়েছে, তুমি অভাগা তাই মরছে, তাদেরও মৃত্যুর সময় হবে মা। তারাও যাবে, তারাও চোখ বুজবে। মাঝে মাঝে মনে হয় কেন আমি তোমাকে ওই অবকাশে নিয়ে গিয়েছিলাম, অবকাশ নামের বাড়িটিতে তোমার মৃত্যু হোক, কেন চেয়েছিলাম আমি? ওই বাড়িতে তিরিশ বছরের স্মৃতি তোমার। কিন্তু তোমার সেই স্মৃতি তো মধুর নয়, মা। যে বাড়িতে তোমাকে অপমান করেছে তোমার স্বামী, বছরের পর বছর, প্রতি দিন, যে বাড়িতে তোমার পুত্র কন্যারা তোমাকে অবজ্ঞা করেছে, তোমার পুত্রবধূরা তোমাকে লাঞ্ছিত করেছে, সেই বাড়ির কোনও একটি ঘরের কোনও একটি বিছানায় শুয়ে তোমার মৃত্যু হোক, এই বা আমি চেয়েছিলাম কেন? আমি যে কথাটা ভেবে তোমাকে ময়মনসিংহেনিয়েছিলাম, সেটি হল, তোমার এতকালের পরিচিত চেনা মানুষগুলোর সঙ্গে তোমার দেখা হবে। বাকি আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা হবে। তোমাদের বাড়ির পাশের বস্তি থেকে তইতই, তেঁতুর মা, আর আরও আরও তোমার চেনা বান্ধবীদের ডেকে ওদের তোমার বালিকাবেলার গান গাইতে বলেছি, ওরা গেয়েছে, তুমি শুনেছো, শুনে তোমার মুখে হাসি ফুটেছে, ওই হাসিটুকু তুমি হাসো, তোমার একটুখানি ভালো লাগুক চেয়েছি। আমি নিজেই বলেছি ওদের সবার হাতে টাকা দিয়ে দাও। গুনে তোমার হাতেই দিয়েছি টাকা, যেন তোমার হাতেই ওদের দাও। কারও কারও জন্য বলেছি, আরও কিছু দাও মা। একটুও দ্বিধা করো না। যত ইচ্ছে করে দিতে, দাও। কোনওদিন তো চাইলেও দিতে পারোনি। মানুষের দারিদ্র্য দেখে তোমার হৃদয় কাঁদতো, তোমার নিজের দারিদ্র্যের চেয়েও অন্যের দারিদ্র্য তোমাকে কাঁদাতো বেশি। সাহায্য করতে চাইতে। কিন্তু কী করে কোত্থেকে তুমি কাকে পয়সা দেবে। তোমাকেই কে দেয়! তোমাকে তো উপার্জন করতেও কেউ দেয়নি। নিজের পায়ে দাঁড়াবার ইচ্ছে তোমার মতো আর কাউকে দেখিনি। তবুও নিজের অনিষ্ট করে হাতে যা কিছুই ছিল তোমার, আটআনা বা একটাকা, একটাকা বা দুটাকা, হয়তো রিক্সাভাড়াই ছিল, দিয়ে দিয়েছে। হেঁটে বাড়ি ফিরেছো। রোদ্দুরে ভিজতে ভিজতে ক্ষিধে তৃষ্ণায় ভুগতে ভুগতে মাইলের পর মাইল হেঁটেছে। আর জীবনে প্রথম পাঁচশ টাকা হাজার টাকা ওই গরিব দুঃখী সইসাথীদের দিতে পেরে তোমার কি একটু, সামান্য একটু শান্তি হয়েছিল মা! ওটুকুই চেয়েছিলাম। বাড়ির অন্যরা, বাবা দাদা আর হাসিনা তিনজন তো কানে কানে কথা বলে আর কটাক্ষ করে আর মুখ টিপে হাসে, বাড়িতে করছি কী আমি! কিসের হাট বসিয়েছি! গরিব গরিব লোক ডেকে আনছি বস্তি থেকে, মাথা টাথা নিশ্চয়ই আমার মায়ের মতোই আমার গেছে। কদিন আর? এই একটিই সান্ত্বনা তাদের, বেশিদিন নয়। কালো ফটক পেরিয়ে গরিবগুলো রীতিমত ঘরের ভেতর ঢুকে মার বিছানার কাছে পেতে দেওয়া শীতল পাটিতে বসে পুরোনো দিনের সুখের স্মৃতিচারণ, গান গাওয়া, হাসি আনন্দ-কদিন আর? এই তো শেষ নিঃশ্বাসের সময় হল বলে। বাবা কি হাসিনাকে খুশি করতে হাতের আঙুল গুনে দিন বলে দেয়, আর কদিন! বাবা তো বোঝে কদিন। আমার চেয়েও বেশি বোঝে, কদিন। আমার চেয়েও হাজারগুণ অভিজ্ঞ ডাক্তার আমার বাবা। নাড়ি না টিপেও বলে দিতে পারে নাড়ির খবর।

.

মা, জগৎটা যে কী নিষ্ঠুর, তা নিজেই তো দেখেছো। তোমার আদরের ধন কামালকে পাওনি খুব বেশি বছর, অল্প বয়সে বিয়ে করে গীতার সম্পত্তি হয়ে গিয়েছিল, সেই আদরের ধনকে প্রাণ ভরে সেবা করার জন্য হাতের কাছে জীবনের শেষ কটা বছর পেয়েছিলে তুমি। কী ভালোই না বাসতে। অথচ মা, আমি তোমার সেই আদরের ধনকে চেয়েছি তোমার কাছে এসে বসুক, একটু তোমার সুখ হোক। ঢাকায় যখন শয্যাশায়ী তুমি, ছোটদাকে শত বলেও বসাতে পারিনি কাছে। ছোটবেলা থেকে ছোটদার টাকা পয়সার প্রতি প্রবল আকর্ষণের কথা আমরা সবাই জানি। জানা জিনিসকে মুখে বললে এত বিচ্ছিরি শোনায় কেন জানি না! একবার শান্তিনগরের বাড়িতে তোমার জন্য একটা ওষুধ আনতে বলেছিলাম, দু তিন টাকা বোধহয় দাম। সেই টাকাও সে বললো আমাকে দিতে। আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, নিজের মায়ের ওষুধের জন্য নিজের পকেট থেকে দুটো টাকাও সে খরচ করতে চাইছে না! সেই ছোটদা কেন আসবে তোমাকে দেখতে ময়মনসিংহে। একবার খুব হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করে আনলাম বটে, এসেই বলে দিল তার প্রচণ্ড ব্যস্ততা, তার ফ্লাইট, তার নানা কিছু। তার সময় নেই ময়মনসিংহে আসার, তার সময় নেই সময় নষ্ট করার। বলেছিলাম, তুমি এসেছো দেখলে মা তো খুশি হয়, মাকে শেষ সময়ে কিছু খুশি দাও। ছোটদার কথা, তোমার জন্য সব সে করেছে, কিছুই করিনি আমি। সব টাকা সে খরচা করেছে, কয়েক লক্ষ টাকা এর মধ্যে তার খরচ হয়েছে, কিছুই করিনি আমি। তোমার স্বপ্ন পূরণ সে করেছে, আরব দেশে নিয়ে উমরাহ করিয়ে এনেছে। না, এর বেশি তোমার জন্য ছোটদার করার কিছু নেইও, ইচ্ছেও নেই। এই তার শেষ কথা। শেষ কথা সে চিৎকার করে জানিয়ে দিল, অবকাশের দেয়াল ফাটিয়ে জানিয়ে দিল। সব পাশের ঘর থেকে শুনলে তুমি। ছোটদা হিংস্র জানোয়ারের মতো চেঁচায়, যখন চেঁচায়। কিছু কিছু মানুষ মনে করে চেঁচিয়ে কিছু কথা বললে, সেই কথা সত্য বলে প্রমাণিত হয়। আসলে জঘন্য মিথ্যেও যে জোর গলায় চেঁচিয়ে বলা যায়, আর তা যে মাথায় যাদের ঘিলু বলে পদার্থ আছে তা জানে, তা তারা জানে না। সময় ছোটদার অঢেল আছে মা, সময় নেই শুধু তাদের জন্য, যাদের জন্য সময় কাটাতে তার ভালো লাগে না। ভালো লাগে মদের আড্ডা, ভালো লাগে মেয়ে পটানো। গীতার বশংবদ ভত্যের এই হাল। ছোটদার জন্য সেই ছোটবেলা থেকে আমার মায়া। শুধু আমার কেন, তোমার, ইয়াসমিনের, সবারই মায়া। বাড়িতে আমরা, বিশেষ করে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম ছোটদাকে। লেখাপড়া শেষ না করে বিয়ে করে প্রথম দিকে খুব টাকাপয়সা ছিল না বলে মন খারাপ থাকতো ছোটদার, সেই মন খারাপ ছোটদা এখন বিরাট টাকা পয়সার মালিক হয়েছে, কিন্তু আমাদের সবার সেই আদর এখনও তার ওপর একই রকম বর্ষিত হয়। বাবাও ছোটদা বলতে পাগল। চোখের আড়ালে বেশি থাকলে বা দূরের শহরে বাস করলে যা হয়, আদরটা বেশি জোটে। ছোটদার তাই জুটতো। এখনও তাই জোটে। আমি হয়তো অত সহজে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় যেভাবে ছোটদাকে ব্যাংকের যাবতীয় টাকা তোলার অধিকার দিয়েছিলাম, অমন আর কাউকে দিতেপারতাম না। কেন যে বিশ্বাস করতাম এই ছোটদাকে, বিশ্বাস বারবার ভেঙেছে, তারপরও। আসলে যে বিশ্বাস ভাঙে তার দোষ নয়, যে বিশ্বাস করে তার দোষ। ছোটদার ব্যবহারে জানিনা তুমি কষ্ট পেয়েছিলে কি না। শেষের দিকে কষ্টের বোধ তোমার হয়তো আর ছিল না। ছোটদা এক বিকেলে, ওই একটি বিকেলেই তোমারপাশে বসেছিল, মাথায় টুপিপরে সে কোরানপড়ছিল। সে যে কোরান পড়তে জানে তা আমার জানা ছিল না। ইদানিং জুইয়ের সঙ্গে মিশে সম্ভবত শিখেছে। জুই খুব ধার্মিক শুনেছি। ওই একদিনই ছোটদাকে পেরেছিলাম তোমার পাশে বসাতে। কোরান থেকে জানি না কী পাঠ করলো জোরে জোরে, কী যে সেদিন ভালো লেগেছিলো ছোটদা তোমার কাছে বসেছে বলে। ছোটদার মতো ছোটলোককে সেদিন আমি ক্ষমা করে দিয়েছি, যেহেতু তার ওইটুকুপাশে বসা দিয়ে তোমাকে ভালো লাগা দিয়েছিলো। ছোটদার জুইকে বিয়ে করা, কোরানপড়া, এসবের পেছনে আছে একরাতের এক দুর্ঘটনা। সে রাতে ছোটদা গাড়ি চালাচ্ছিলো, গাড়িতে বসেছিলো জুই আর জুই-এর মা। গাড়ি একসময় কোনও এক রেললাইনের ঠিক ওপরে এসে বন্ধ হয়ে গেল। গাড়ি আর চলছে না, না সামনে, না পেছনে। ঠিক তখনই ট্রেনের শব্দ, তিরের মতো ছুটে আসছে ট্রেন। ছোটদা শুধু চিৎকার করে বললো সবাইকে বেরোতে। জুই বেরিয়ে দৌড়। ছোটদাও। কিন্তু পেছন ফিরে দেখলো গাড়িতে আটকে আছে জুই-এর মা। ছোটদা ছুটে গেল গাড়ির ভেতর থেকে জুই-এর মাকে বের করতে। ট্রেন তখন নাকের ডগায়। টেনে সে বের করে নিয়ে আসে বটে জুইয়ের মাকে, কিন্তু ট্রেনের ধাক্কয় নিজে ছিটকে পড়ে। ছোটদার গাড়ি গুঁড়ো করে দিয়ে ট্রেন চলে যায়। গায়ের হাড়গোড় কিছু ভাঙ্গলেও ছোটদা বেঁচে যায় শেষ পর্যন্ত। জুইয়ের মা ট্রেনের আঘাতে নয় কিন্তু, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায় হাসপাতালে। এই মৃত্যু ছোটদাকে আমূল বদলে ফেলে। এত অপরাধবোধে ভোগায় যে জুইয়ের এতদিনকার স্বপ্ন সে পূরণ করে, জুইকে বিয়ে করে। জুইয়ের মার মৃত্যুর জন্য কেন ছোটদা নিজেকে দায়ী করে! যদি সে টেনে তাঁকে বের না করতো গাড়ি থেকে, দুমুহূর্ত পরই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতেন তিনি। আমার মনে হয় না ছোটদা ছাড়া পৃথিবীর অন্য কেউ ট্রেনের ওইছুটে আসার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রেমিকার মা কেন, নিজের মাকেও বাঁচাতে যেতো।

ছোটদা পরদিনই চলে যায়। তোমার শরীর দ্রুত খারাপ হচ্ছে, ছোটদা যেন আরও পাশে থাকে, যেন চলে না যায়, আমার অনুরোধ ছোটদাকে অবকাশে রাখতে পারে না। আমার টয়োটা গাড়ি নিয়ে আসে, ওই গাড়ি নিয়েই বেরিয়ে যায় ঢাকার পথে। সবাই ভুলে গেছে, এমন কী ছোটদাও, যে, গাড়িটা আমার, ভুলে গেছে শান্তিনগরের বাড়িটাও আমার। সবাই কথাই বলে এভাবে, ‘কামাল তোর গাড়ি কোথায় পার্ক করলি? ’ বা ‘তুমি কি তোমার ঢাকার বাড়িতে সেদিন ছিলে?’ না আমার আড়ালে নয়, বাক্যগুলো আমার সামনেই উচ্চারিত হয়। আমি বুঝি, সময় অনেক কিছু পাল্টে দিয়েছে। আমি এ দেশে এ বাড়িতে, এ পরিবারে অনেকটাই অবাঞ্ছিত। কেবল তোমার কাছেই বাঞ্ছিত, কেবল তুমিই আমাকে সমস্ত জীবন দিয়ে চাইছ, সমস্ত জীবনের বিনিময়ে চাইছ। এই চাওয়ার মধ্যে এক ফোঁটা ফাঁকি নেই।

.

রোজার সময় তখন। টুটু মামা রোজা রাখতো। সারারাত সে নাকি আল্লাহনাম জপ করে। শুনে আমিই তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম তোমার পাশে রাতভর যেন তাই করে। সন্ধেবেলায় এসে টুটু মামা সারারাত জেগে থাকতো, সকালে বাড়ি চলে যেত ঘুমোতে। টুটু মামার বাড়িতে আসা দাদা পছন্দ করতো না। দাদার কাছ থেকে কবে নাকি টুটু মামা টাকা ধার করেছিলো, সে টাকা আর ফেরত দেয়নি। সে কারণেই টুটু মামার ছায়াও সহ্য হত না দাদার। টুটু মামা টাকা ফেরত দেয়নি। তাতে কী! পারেনি ফেরত দিতে, তাই ফেরত দেয়নি। বাবার কানে টুটু মামা সম্পর্কে যত রাজ্যির মন্দ কথা আছে, দাদা দেয়। বাবার মনও টুটু মামা থেকে সরিয়েছে দাদা। বাবা, আমি লক্ষ করেছি, আগে যেমন মামাদের সঙ্গে গল্প করতো, তেমন আর করে না। হাশেম মামা শুনেছি লিভারের ক্যানসার নিয়ে বাবার চেম্বারে বসে থাকতো। একটু যেন ওষুধ বাবা দেয়। জানি না বাবা কতটুকু সাহায্য হাশেম মামাকে করতো। মামাদের সম্পর্কে বাবার অভিযোগ যত থাক, নিজের কোনও দুর্যোগ এলে মামাদেরই বাবা সবসময় কাছে ডাকতো। হাশেম মামা তোমাকে বলেছিলো আমি যেন তার জন্য কিছু টাকা পাঠাই। আশ্চর্য, মা, কোনও টাকা আমি পাঠাইনি। পরে অবশ্য তার ছেলে সুমনকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পাঠিয়েছিলাম, তখন হাশেম মামা আর বেঁচে নেই। হাশেম মামাকে সুইডেনে এনে চিকিৎসা করার জন্য ভিসার ব্যবস্থাও করেছিলাম। হাশেম মামার আর আসা হয়নি। মামার কথা ভাবলে এখনও বুকের ভেতরে একটা চিনচিন কষ্ট হয় আমার। মুক্তিযোদ্ধা ছিল হাশেম মামা। কী সুন্দর দেখতে ছিল। কী রকম সুঠাম সুদর্শন যুবক। টুটু মামার সঙ্গে তার সুন্দরী বউএর কোনও একদিন প্রেম হচ্ছে ধরা পড়ার পর সেই যে হাশেম মামা দাড়ি কাড়ি রেখে উদাস হয়ে গেল, আর ফিরে এলো না হৈ চৈ এ। টুটু মামাকে তুমিও চাইতে থাকুক। সারারাত সে সুর করে করে সুরা পড়ে, সে সুর বড় মধুর লাগে। টুটু মামাকে রাতের শেহরি খাওয়ার ব্যবস্থা নিজের উদ্যোগে করি। তোমাকে যে মনে শান্তি দিতে পারছে, তাকে খুশি করতে আমি তখন সব করতে রাজি। বাবা আর দাদার ধারণা টুটু মামা কোনও বদ উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে আসে। ঝুনু খালাও একদিন কানে কানে বলে গেল, টুটু মামা নাকি অসুস্থ হাশেম মামাকে একদিনের বেশি দেখতে যায়নি। তোমার অসুখে তার মতো পাষণ্ডর দুঃখ হওয়ার তো কিছু নেই। এই দুঃখটা নাকি বানানো, এখানে ভেড়ার উদ্দেশ্য, আমার কাছ থেকে বড় অংকের একটা টাকা দাবি করা। না, মা। এসব আমার বিশ্বাসহয়নি। তোমার এগারো জন ভাইবোনদের মধ্যে একজনের সঙ্গে আরেকজনের যেমন বন্ধুত্ব ছিল, শত্রুতাও ছিল, তোমার সঙ্গে কারওরশত্রুতা ছিল না। তুমি সবাইকে ভালোবাসতে। সবাই তোমাকে ভালোবাসতো। টুটু মামার যে উদ্দেশ্যই থাকুক, তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে থাকে। তার কাছ থেকে যা পেয়েছি, সে পাওয়া অমূল্য। কোনও টাকায় আমি তার ঋণ শোধ করতে পারবো না। কোনও লক্ষ টাকা দিয়েও না।

.

তোমার চৈতন্য ফিকে হচ্ছে খুব দ্রুত। আগের চেয়ে অনেক বেশি ঝিমোচ্ছো, অথবা ঘুমোচ্ছো। তোমাকে শারীরিক কোনও সুস্থতা দিতে আমি পারছি না। শারীরিক কোনও সুস্থতা দিতে কোনওদিনই পারিনি। তোমার অসুখের দিকে তোমার মৃত্যু হবে জানারপর শুধু ফিরে চেয়েছি। আমি মরিয়া হয়ে উঠছি, যতটুকুসুখী করতে তোমাকেপারা যায়, করতে। জিজ্ঞেস করছি তোমাকে, কাকে কাকে তোমার দেখতে ইচ্ছে করে বলল, কার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে, কে কাছে এলে তোমার ভালো লাগবো। তুমি যাদের নাম বলেছে, সবাই দরিদ্র, বস্তির লোক, গ্রামের অভাবী লোক। জ্যোৎস্নাকেতুমি দেখতে চাইলে। জ্যোত্সা একসময় কাজ করতো অবকাশে। ইয়াসমিনের মেয়ে ভালোবাসাকে যখন লালন পালন করতে তুমি, জ্যোৎস্না তোমাকে সাহায্য করতো। জ্যোৎস্নাকে ইয়াসমিনের শ্বশুর বাড়ির কেউ দিয়েছিলো। সানকিপাড়া থেকে ইয়াসমিনের শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের ডেকে এনে অনুরোধ করলাম, জ্যোৎস্নাকে নিয়ে আসতে। ওরা বললো, সম্ভব নয়। জ্যোৎস্না গ্রামে চলে গেছে, ওর ঠিকানা কেউ জানে না। কিন্তু আমার উপর্যুপরি অনুরোধ যে করেই হোক খুঁজে আনতেই হবে জ্যোৎস্নাকে। লোককে গাড়ি দিয়ে, টাকা দিয়ে একদিন নয়, দিনেরপর দিনপাঠাচ্ছি। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে জ্যোৎস্নাকে খুঁজতে হবে। জগতের যেখান থেকে হোক, জ্যোৎস্না নামের মেয়েকে নিয়ে আসতে হবে। শেষপর্যন্ত জ্যোৎস্নার খোঁজ মেলে। কোনও এক গহন গ্রাম থেকে ওকে নিয়ে আসা হল। একই রকম কোনও ঠিকানা না জানা ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম ফকরুলকে, লিলি বা লিলির মাকে খুঁজে আনতে। দুতিন গ্রাম তন্ন তন্ন করেও লিলির মার খোঁজ পাওয়া যায়নি। তুমি জ্যোৎস্নাকে দেখে ঝরঝর করে কাঁদলে। ওকে কাছে ডেকে বুকে জড়িয়ে রাখলে। কোনও একদিন কী কারণে জ্যোৎস্নাকে তুমি মেরেছিলে, তাই তার কাছে আকুল হয়ে ক্ষমা চাইলে। চোখের জলে নিজের মুখ বুক ভিজিয়ে ক্ষমা চাইলে তুমি। জ্যোৎস্নাকে শাড়ি দিলে, টাকা দিলে, যা ওর পাওনা ছিল, তার চেয়েও অনেক বেশি দিলে। জ্যোৎস্নার হাত ধরে জানতে চেয়েছো, ও তোমাকে ক্ষমা করেছে কি না। জ্যোৎস্না খুব অবাক হয়েছে কিসের ক্ষমা, কেন ক্ষমা। লোকের বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে লাথিঝাঁটা খেয়েই জীবন কাটে। কেউ তাদের কাছে কোনও অন্যায়ের জন্য ক্ষমা চায় না। ক্ষমা তো আছেই, তারপর না চাইতেই এত টাকা পেয়ে যাওয়া! সবই ছিল জ্যোৎস্নার জন্য অবিশ্বাস্য। ওকে রাতের খাবার খাইয়ে দিতে বললে। বাড়িতে আমি এমন ব্যবস্থাই করেছি। কেউ যেন না খেয়ে না যায়। তোমার আত্মীয় স্বজনের এ বাড়িতে খাওয়ার চল খুব ছিল না। আমি কাউকে না খেয়ে দুপুর বা রাতে যেতে দিচ্ছি না। তোমার ভাই বোন, তোমার যে আত্মীয়ই আসছে, সবাইকে খাওয়াচ্ছি। তোমাকে বলছি, সবাইকে খাইয়ে দিচ্ছি। একদিন শরাফ মামার গোটা পরিবারকেই তোমার বিছানার সামনে শীতল পাটিয়ে বসিয়ে তুমি যেন দেখ, যত্ন করে খাইয়েছি। আমার টাকায় মাছ মাংসের বাজারও তাই করছি, যেন অধিকার থাকে যাকে ইচ্ছে খাওয়ানোর। আসলে মা, খাওয়া তো সবার বাড়িতে আছে। তোমার ভাই বোনেরা বাড়ি গিয়ে এ বাড়ির খাবারের চেয়ে ভালো খাবার খেতে পারবে, কিন্তু ওই আপ্যায়ন, ওই যে বসিয়ে খাওয়ানো, ও করেই আমরা আদর বোঝাই, বোঝাই যে ভালোবাসি। তুমি যেমন অতিথিপরায়ণ, আমিও তেমন। তাই ওদের যখন আদর করে ডেকে খেতে বলি, আমি অভিনয় করি না। মামাদের সঙ্গেই আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে। ওদের সঙ্গে হাজার বছর পর দেখা হলেও মনে হয় যেন প্রতিদিনই দেখা হয়। শরাফ মামার ওপর আমার যে রাগ নেই, তা তোমাকে বোঝানোর প্রবল ইচ্ছে আমার। তুমি যে থালায়, বা বাটিতে, বা কাপে খাচ্ছিলে, অতিথিরা যেসবেখাচ্ছিল, চেয়েছিলাম সেগুলো খুব সুন্দর দেখতে হোক। যে তালাবন্ধ আলমারিতে থালাবাটি থাকে, সেগুলোর চাবি চেয়েছি, ওগুলো বের করবো বলে। যা কিছু সুন্দর ওখানে, ওই আলমারিতে, তার প্রায় সবই আমি কিনে দিয়েছিলাম দাদাকে, যখন জার্মানি গিয়েছিলো। সেগুলোই সাজিয়ে রাখা। কিন্তু হাসিনা আমাকে চাবিও দেয়নি, নিজেও সব বের করে দেয়নি। দুটো বাটি বের করে আলমারি বন্ধ করে বললো, এত নাড়াচাড়ায় ভেঙে যেতে পারে। মানুষ কী করে এত কুৎসিত হতে পারে, আমি বুঝি না। মানুষ যে এই তুচ্ছ বিষয় আশয় ছেড়ে, পার্থিব সব কিছু ফেলে চিরতরে চলে যায়, তা চোখের সামনে দেখেও তারা কেন এসবই আঁকড়ে পড়ে থাকে, কিছু বুঝি না এর।

.

লিলি আর লিলির মার কাছেও ক্ষমা চাওয়ার ইচ্ছে ছিল তোমার। পাওনা টাকাগুলো দিতে চেয়েছে ওদের। পারোনি। তোমার এই একটি চাওয়া আমি মেটাতে পারিনি। দুলুর মাকেও পারিনি, আনুর মাকেও পারিনি আনতে। অবশ্য ওদের দেখা পাওয়া গেছে, তখন খুব দেরি হয়ে গেছে। আহা, মা, যদি একবার ওদেরও নিজের হাতে কিছু টাকা দিতে পারতে। তোমার যে দেওয়ার হাত ছিল, কিন্তু হাতে কিছু ছিল না, সেই তোমার হাতে জীবনে প্রথম টাকা এলো। প্রচুর টাকা। তুমি গুনেও দেখতে পারোনি। এত টাকা তুমি বোধহয় গুনতেও জানতে না। জীবনে একটি টাকা, একটি মাত্র টাকার জন্য হাত পেতেছো স্বামী সন্তানদের কাছে। বেশির ভাগ সময়ই পাওনি। এখন তুমি ভুলে যাও তোমার নিজের হাতব্যাগে অগুনতি টাকা। তুমি মুঠোর মধ্যে সে টাকা তোলো। কিন্তু লক্ষ করেছি তুমি ওই টাকার কিছুআর অনুভব করো না। টাকা আর আবর্জনার বাক্সের কোনও বাতিল কাগজের মধ্যে কোনও পার্থক্য করতে পারো না। ওই টাকা তোমাকে সুখ দেয় না। নিজের জন্য কিছু তো চাওনি কোনওদিন। অন্যের জন্য চেয়েছিলে। প্রতিরাতে ঘুমিয়ে পড়ছো মাথার কাছে কয়েক লক্ষ টাকার ব্যাগ রেখে। টাকা তোমাকে আর আকর্ষণ করে না। ও টাকা দুর্বল দুটো হাতে ঠেলে সরিয়ে দাও। ডিম, দুধ, কলা এই তিনটি জিনিস খেতে চাইতে তুমি স্বাস্থ্যের জন্য। পেতে না। আর এই তিনটি তোমার সামনে অঢেল এখন, খেতে পারো না তুমি মা। কিছুই তুমি মুখে নিতে পারো না। দুর্গন্ধ সবকিছুতে। তোমার প্রিয় ডিম, প্রিয় দুধ মুখের কাছে ধরছি। তুমি মুখ সরিয়ে নাও। লিভারে যার ক্যান্সার ছড়িয়েছে, তার তো খাওয়া ফুরোলো মা, সে কি আমি বুঝি না! কিন্তু তারপরও প্রথম দিকে খেতে চাইতে তুমি। ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইতে। বাঁচতে চাইতে। এত মনোবল তোমার কোথায় ছিল! ছিল সব সময়, কিন্তু ওই মনোবল নিয়ে কোথাও পোঁছোতে পারোনি। যে মানুষগুলো তোমাকে তোমার নিজের পায়ে দাঁড়াতে দেয়নি, তারা তোমার চেয়েও অনেক শক্তিমান। তুমি নিরীহ নিরুপদ্রব নারী। তুমি পারোনি শক্তিমানদের সঙ্গে একা যুদ্ধ করে জিততে। তোমার এই হাঁমুখো অসুখের বিরুদ্ধে তুমি একাই দাঁড়িয়েছে।

একদিন, হঠাৎই একদিন, ঝিমিয়ে থাকা তুমি হঠাৎ জেগে উঠলে। তোমার ক্ষিধে পেলো প্রচণ্ড। তুমি ভাত খেতে চাইলে। মাছ মাংস যা আছে সব দিয়ে ভাত। যে তুমি সামান্য তরল পদার্থও মুখে নিতে পারছে না, সে তুমি ভাত খাবে। প্রায় প্রতিদিনই লোক পাঠিয়ে বাজার করছি আমি। একদিন শুভ আর সৌখিনের জন্য বাবা কিনে আনলো এক ডজন বাচ্চা মুরগি। বাবার কাছ থেকে নিয়ে মুরগিগুলো দেখালাম তোমাকে, বললাম বাবা তোমার জন্য কিনেছে। দেখালাম এই জন্য যে যেন তুমি ভাবো কেবল আমি নই, বাবাও তোমার জন্য ভাবছে, তোমাকে ভালোবেসে তোমাকে ভালো স্যুপ খাওয়ানোর জন্য বাজার করছে বাবা। একটু যেন তুমি খুশি হও। কোনওদিন তো বাবা তোমার জন্য কিছু কেনেনি। কোনওদিন চায়নি তুমি ভালো কিছু খাও। কখনও কি মুরগির কোনও ভালো টুকরো নিজে তুমি নিজের পাতে নিতে পেরেছো! বাবার ভয়েই পারোনি কোনওদিন। তুমি নিজে খাবে না, অন্যকে খাওয়াবে, তাইতো সবাই চাইতো। মিথ্যে করে হলেও তুমি জানলে যে বাবা চাইছে তুমি ভালো খেয়ে নেতিয়ে পড়া শরীরে শক্তি অর্জন করো, সুস্থ হয়ে ওঠো। বাবার ভালোবাসা তুমি সারাজীবন প্রার্থনা করেছো, পাওনি। অন্তত একবার জেনে স্বস্তি পাও, শুধু আমি নই, বাড়ির সবাই তোমাকে ভালোবাসে। মিথ্যে করে হলেও জানো, মা। বৈঠক ঘরে বসে বাবা আর দাদা দুজন পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে কানা কানি করছে, আমার আদিখ্যেতার নিন্দে করছে। তারপরও আমি বাবাকে আর দাদাকে অনুরোধ করেছি টেলিভিশনের সামনে না বসে তোমার সামনে বসতে। টেলিভিশন তারা অনেকপাবে, তোমাকে পাবে না। বলি তোমাকে পুরোনো দিনের কথা বলতে, কোনও সুখের স্মৃতি যদি তোমাকে নিয়ে তাদের থাকে, বলতে। বলতে, যে, তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে, বলতে যে, তোমাকেতারা ভালোবাসে। হোক না মিথ্যে, তারপরও। অন্তত হাতে গোনা যে কটা দিন তোমার আছে, তুমি সুখ পাও। কিন্তু অত কি সহজ এই সহজ কাজটি। কারও সময় নেই। বাবা চেম্বারে যাবে, রোগী দেখার নেশা। তোমার অসুখের কথা বলে বাবাকে থামানো যায়নি। বাবার নিজের শরীর ভালো নয় বলেও বাধা দিয়েছি। কিন্তু কোনও বাধাই কাজে লাগেনি। যে গাড়িটি বাবার জন্য কিনেছিলাম, সেই গাড়ি বাবা কোনওদিন চড়েও দেখেনি। শত বলেও বাবাকে ও গাড়ি দিয়ে চেম্বারে নেওয়াতে পারিনি। বাবাকে কিনে দেওয়া গাড়িটি এখন দাদার। সবাই বলে, দাদার গাড়ি। দাবি করতে ওদের কারও লজ্জা হয় না, বরং প্রতিবাদ করতে লজ্জা হয় আমার। যেদিন তোমার ক্ষিধে পেলো প্রচণ্ড, রান্নাঘরে গিয়ে কাজের লোকদের বারবারই তাগাদা দিলাম যেন রুই মাছের একটি টুকরো হলেও তোমার জন্য তাড়াতাড়ি রান্না করে দেওয়া হয়। কোথায় পাবো মাছ! মাছ রান্না হতে দেরি হবে হাসিনা জানিয়ে দিল। এখন শুভ আর সৌখিনের জন্য মুরগি রান্না হচ্ছে। মুরগি তো চিরকালই রান্না হবে, তোমার জন্য মাছটা আগে করে দিক। ভাত রান্না হয়েছে? হয়নি। ডাল? না, তখনও না। শুভ আর সৌখিনের জন্য আলাদা যে খাবার, সেগুলো আগে রান্না হচ্ছে। তারপর অন্য সবার রান্না শুরু হবে। রান্নার লোককে বললাম, সব বন্ধ করে মার জন্য ভাত, ডাল, আর রুইমাছের তরকারি তাড়াতাড়ি যেন রান্না করে দেয়। কিন্তু আমার নির্দেশ মানার কোনও লক্ষণ আমি কারও মধ্যে দেখি না। রান্নার লোকের কথায় এবং আচরণে বুঝি যে হাসিনা যা আদেশ করবে, তাই পালন করবে ওরা। আমার বা তোমার, অবকাশ নামের বাড়িতে কোনও অধিকার নেই। একসময় দেখি, হাসিনা তোমাকে মুখে তুলে খাওয়াচ্ছে, বাসি কাঁচকি মাছ, বাসি ডাল আর বাসি ভাত। আমি হতবাক দাঁড়িয়ে রইলাম, যদি আমি তখন বলি যে হাসিনা তোমাকে বাসি জিনিস খাওয়াচ্ছে, তুমি মনে কষ্ট পাবে বাসি জিনিস তোমাকে খাওয়ানো হচ্ছে বলে, তাই চুপ করে জানালার দিকে তাকিয়ে আমি বসে রইলাম। ক্ষুধার্ত তোমার দিকে, একটু ভাত খাওয়ার জন্য তোমার ব্যগ্রতার দিকে আমি তাকাতে পারছিলাম না। আমি তোমাকে বলিনি যে হাসিনা ইচ্ছে করলেই আজকের রুই মাছটা রান্না করার জন্য বলতে পারতো, বলেনি। মা, ওই খাওয়াই তোমার শেষ খাওয়া ছিল। তোমার জীবনের শেষ ভাত, শেষ মাছ, শেষ ডাল। খাবার সময় যখন রুইমাছ আমার থালায় এলো, গরম ভাত এলো, নতুন রান্না করা ডাল এলো, আমি খেতে পারিনি। কেউ লক্ষ করেনি আমার ওই ভাত, ডাল আর মাছের টুকরোর ওপর আমার চোখের জল টুপটুপ করে পড়েছে। কে লক্ষ করবে, সবাই তো পা নাচিয়ে গল্প করছে নয়তো টেলিভিশন দেখছে। টেলিভিশনের শব্দ শুনলে আমার খুব রাগ হতো। আমার রাগ দেখে শুভ, হাসিনা, দাদা-সবাই রাগে ফুঁসতো। আমি তোমার ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখতাম, যেন শব্দ কম আসে। দেখ তোমরা নাচ নাটক যা কিছু, শব্দটা কমিয়ে রাখো, মা যেন না বোঝে যে পাশের ঘরে উৎসব চলছে। মা যেন বোঝে বাড়ির সবাই মার জন্য কাঁদছে। অবশ্য আমার রাগ হওয়ায় বা দুঃখপাওয়ায় কারও কিছু যায় আসেনি। তুমি এক ঘরে দিন দিন একটু একটু করে মরে যাচ্ছো, পাশের ঘরে টেলিভিশন চলেছে, যে কোনও দিনের মতোই চলেছে। ভাবলে এখনও আমার বুকের ভেতরটা কাঁপে। আমার বেলায় যদি এরকম হত মা! আমি চাইনা এরকম কোনও কদর্য দৃশ্য দেখতে। তার চেয়ে পাশের ঘরে টেলিভিশনের শব্দ, আর হৈ হুল্লোড় আনন্দের শব্দ শুনতে শুনতে আমি একা একা নিঃশব্দে মরেও শান্তি পাবো, যদি জানি যারা আনন্দ করছে তাদের কাউকে আমি চিনি না, তারা কেউ আমার আত্মীয় নয়, তারা কেউ স্বজন নয়, কাউকে আমি কোনওদিন ভালোবাসিনি। আপন নয় তারা, যদি আপন হতো, দৃশ্য অন্যরকম হতো।

০৬. কাকারা এলো একদিন

কাকারা এলো একদিন। গ্রাম থেকে আরও কয়েকজন এসেছিলো তোমাকে দেখতে। তোমার চেয়ে বয়সে বড়রা দিব্যি সুস্থ বেঁচে আছে। অতিথিদের বসার জন্য যে চেয়ার রেখেছিলাম তোমার সামনে, সেখানে বসে রিয়াজউদ্দিন কাকা বললো, ভাবী, মাফ সাফ করে দিয়েন। শুনে আমার কী যে রাগ হল। তোমাকে বুঝিয়ে দিতে চাইছে যে তুমি মারা যাচ্ছে। তাই মাফ চাইতে এসেছে। সারাজীবন তুমি এদের মাটির চুলোয় কুঁকনি ফুকে, গায়ে কাপড়ে কালি ঝুলি লেগেছে খেয়াল করোনি, রান্না করে খাইয়েছে। বিনিময়ে কারও কাছ থেকে কোনওদিন কিছু পাওনি। রিয়াজউদ্দিন কাকা যাওয়ার সময় তার শুকনো চোখদুটো অযথাই ডলতে শুরু করলো, আর একটা দীর্ঘশ্বাসও ফেললে আমাকে দেখিয়ে, দীর্ঘশ্বাসটা নকল, বুঝি। তোমাকে যেন কেউ বুঝতে না দেয় যে

তুমি মারা যাচ্ছো, আমি সতর্ক করে দিতাম সবাইকেই যারাই তোমাকে দেখতে আসতো। কিন্তু কে শোনে কার কথা! আমাকে নিতান্তই অবুঝ একটা মেয়েমানুষ বলে ভাবে। যে মেয়েমানুষ মত্যুর আগে আগে কী করতে হয় জানে না। জানে না, মত্যুপথযাত্রীর কাছে নিজেরা যত অপকর্ম এ যাবৎকরেছে, সব কিছুর জন্য মাফ সাফ চেয়ে সাফসুফ হয়ে থাকতে হয়। এখন তুমি ওপরে যাচ্ছো, ওপরে তুমি আল্লাহর কাছে তাদের বেহেসতের জন্য তদবির করবে, তাদের সালাম পৌঁছে দেবে পয়গম্বরকে! স্বজনপ্রীতিটা ভালো চলে পরকালে, তাই তোমার কাছে ধর্না দেওয়া। আমি অবুঝ মেয়েমানুষ, আমি চাই না তুমি একটুও টের পাও যে তোমার দিন ফুরোচ্ছে।

একদিন আমানুদ্দৌলার বউ এসেছিলো ছেলেমেয়ে নিয়ে। আমাণুদ্দৌলার বউএর নজর আমার দিকে। তুমি কেমন আছো, কেমন বোধ করছো, এ নিয়ে তার কোনও উৎসাহ নেই। ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে শুরু করলো তার সংসারের নানা সমস্যার কথা। তার মেয়ে জুয়েল কলেজ পাশ করেছে, এখন ওর জন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা আমার না করে দিলেই নয়। আমাণুদ্দৌলার বউ ক্রমাগত বলেই চললো এক কথা। আমি তাকে আমি কী করে চাকরির ব্যবস্থা করবো, আমার তো এই ক্ষমতা নেই’ বলার পরও সে থামলো না। ‘ঠিক আছে চেষ্টা করবো’ বলেও থামাতে পারি না তাকে। তুমি তখন বউএর দিকে তাকিয়ে বললে, ‘এত চাই চাই কেন তোমাদের! একটু মানবিক হও, একটু নিঃস্বার্থ হও।‘ না, মা। তোমার এই উপদেশের মর্মার্থ বোঝা তার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি খসরুকে চিঠি লিখে দিয়েছিলাম জুয়েলকে একটা চাকরি দেওয়ার জন্য। খসরু তাকে চাকরি দিয়েছে। জুয়েল ঢাকা শহরে বহাল তবিয়তে আছে। নিঃস্বার্থ ওরা কেউ হয়নি মা। চাকরি পাওয়ার পর আমাকে ওরা খবরটাও দেয়নি যে চাকরি পেয়েছে। বছর কয়েক পর দাদা কথায় কথায় বলেছিলো যে জুয়েল খসরুর বিশাল অফিসে বেশ ভালো মাইনের চাকরি করছে।

একদিন আমাণুদ্দৌলা এলো। তোমাকে আগে জিজ্ঞেস করে নিলাম, তুমি ওর সঙ্গে দেখা করতে চাও কিনা। কাছের আত্মীয় ছাড়া অন্য কেউ এলে জিজ্ঞেস করে নিই তোমাকে। আমাণুদ্দৌলার সঙ্গে আদৌ দেখা করতে না চাইলে তাকে দেখা করতে দেব না, সে যত বড় প্রেমিকই হোক না কেন। তুমি মাথা নেড়ে বললে, হ্যাঁ। আমাণুদ্দৌলাকে ঘরে ঢুকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। খুব বেশিক্ষণ সে থাকেনি তোমার ঘরে। আমি চেয়েছিলাম আরও কিছুক্ষণ থাকুক, আরও কিছুক্ষণ তোমার হাত ধরে সে বসে থাকুক, আরও কিছুক্ষণ সে দীর্ঘশ্বাস ফেলুক, আরও কিছুক্ষণ সে, যদি ভালোবাসে, বলুক ভালোবাসে।

.

তুমি যেহেতু এক ফোঁটা জলও আর খেতে পারছিলে না, তোমার নাকে নল ঢোকালাম তরল খাদ্য খাওয়ানোর জন্য। তোমার অসহ্য লাগতো ওই নাকের নল। কিন্তু তোমাকে আদর করে পেটে কিছুনাপড়লে তুমি যে শরীরে শক্তি পাবে না বলে বলে রাজি করালাম। রাজি তুমি তোমার জন্য নয়, আমার জন্যই হলে। একসময় শরীরে জল শুকিয়ে এলো এত যে স্যালাইন দিতে হল। তোমার চোখ লক্ষ করছি হলুদ হয়ে উঠছে। শরীরের ভেতর কী যে হচ্ছে তোমার, ভাবলে আমার মাথা বনবন করে ঘুরতে থাকে। সারারাত জেগে থাকি, তোমার অসহ্য ব্যথা হলে পেথিডিন দেবো। সারাদিন জেগে থাকি, তাকিয়ে থাকি তোমার দিকে। তুমি পাশ ফিরতে চাইতে। কিন্তু ফিরতে গেলেই বলতে তুমি পড়ে যাচ্ছো, যেন একটু ধরি। পেট এত ফুলে উঠেছিল যে, ধীরে ধীরে এপাশ ওপাশ ফেরার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছিলে। তোমার গা মুছে গায়ে যে জামা পরিয়ে দিতাম, প্রয়োজনে তা আর পাল্টে দেওয়াও সম্ভব হচ্ছিল না। একদিন কেটে বের করে নিলাম জামা, তুমি জামা ছাড়াই রয়ে গেলে। শুধু লেপ বা কাঁথায় ঢেকে রাখলাম পেট ফুলে ওঠা তোমার কংকালসার শরীর।

এর মধ্যেই যেদিন সকালে তোমার শ্বাসকষ্ট শুরু হলো, সুহৃদকেপাঠিয়ে দিলাম নানিবাড়িতে, মামাদের সবাইকে ডেকে আনতে। সুহৃদ রিক্সা করে গিয়ে খবর দিয়ে এলো। এক এক করে মামারা সবাই এলো। তোমাকে অক্সিজেন দিলাম মা। অক্সিজেন আনিয়েছিলাম, প্রয়োজন হলে ব্যবহার করবো বলে। সেদিন প্রয়োজন হল মা। তোমার শ্বাসকষ্ট ওই অক্সিজেনে কিছুই কমলো না। ডাক্তার ডেকে আনালাম। কাছাকাছি আমার যে ডাক্তার বন্ধুরা থাকে, সবাইকেই ডেকে পাঠালাম। আমার ওপরের ক্লাসে পড়তো সেলিম, খুব ভালো ছাত্র ছিল, তাকে ডাকিয়ে আনলাম ছটকুকে দিয়ে। সবাই দেখলো, কেউ কোনও আশার কথা শোনালোনা। সবাই দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপরও আরও বড় ডাক্তার এলো। বললো, বাড়ির সবাই উনার কাছে বসে থাকো। সারাদিন তুমি শ্বাসকষ্টে ভুগলে। ধীরে ধীরে তুমি চেতন হারালে। ওই অচেতন অবস্থাতেও তুমি শুধু প্রাণপণে শ্বাস নিতে চাইছো। স্যালাইনে দিতে লাগলাম জীবন বাঁচানোর স্টেরোয়েড। স্টেরোয়েডেরপর স্টেরোয়েড। রাতের দিকে স্টেরোয়েড শেষ হয়ে গেল। সুহৃদকে পাঠালাম চড়পাড়ার ওষুধের দোকান থেকে আরও কিছু নিয়ে আসতে। কেন আনতে পাঠালাম মা, আমি কি বুঝতে পারছিলাম না কী হতে যাচ্ছে? পারছিলাম মা।

সকালেই যখন তোমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে দেখলাম, চিৎকার করে বাড়ির সবাইকে জানিয়েছিলাম সে কথা। শুনে দাদা ছুটে এসেছিলো, বিছানায় তোমার পাশে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর নেমে গিয়ে অযু করে পাজামা পাঞ্জাবি আর মাথায় একটা টুপি পরে এলো, হঠাৎ করে তার পোশাক পাল্টাবার কী হল, বুঝলাম না। তাহলে কি দাদা ধরেই নিয়েছে যে তুমি মারা যাচ্ছো? খানিকপর দাদা আবার নেমে গেল বিছানা থেকে। সম্ভবত যে কারণে বিছানায় তোমার মাথার কাছে বসে ছিলো দাদা, যে শেষ নিশ্বাস একেবারে নিজের চোখের সামনে দেখবে বলে, সেই শেষ নিশ্বাসটিই তুমি তাকে দেখতে দিলে না সারা সকাল। নানি সেই আগের মতোই তোমার শিয়রের কাছে বসেপড়ে যাচ্ছে কোরান। নানির চোখ থেকে জলপড়েপড়ে কোরানের লেখাগুলো ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছে। মামারা জোরে জোরে আসোলামু আলায়কুম ইয়া রহমতুল্লাহ না কী কী সব বলে যাচ্ছে। আমার ভয় করছিল মা, খুব ভয় করছিল আমার। যারাই দেখতে আসছিল তোমাকে, বলে যাচ্ছিল তুমি যেন তাদের সালাম পৌঁছে দাও নবীজিকে। এর চেয়ে বীভৎস কোনও দৃশ্য আমি দেখিনি কোনওদিন মা। আমি চেষ্টা করছিলাম তোমাকে আরও জীবন বাঁচানো ওষুধ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে। আমি কোনও ভগবান আল্লাহ বা কোনও রকম ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না। বিজ্ঞানে বিশ্বাস করা আমি একটি অলৌকিক কিছু চাইছিলাম, অনেকে তো মৃত্যুর দুয়ার থেকেও বেঁচে ওঠে মা। কত কেউ তো বেঁচেছে। তুমিও এরকম হঠাৎ কোমা থেকে ফিরে আসতে পারো না জগতে? সবাইকে অবাক করে দিয়ে চোখ মেলে তাকাও যদি আবার! আমি প্রকৃতির কাছে ভিক্ষে চাইছিলাম তোমাকে ফিরিয়ে দিতে, তোমার অচেতনতাকে ভেঙে দিতে। তোমার মাথা থেকে আগুন বেরোচ্ছিল, ছোট একটা ফ্যান চালিয়ে মাথা ঠাণ্ডা করতে চাইছিলাম। তোমার পায়ের পাতা দুটো বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছিল। তোমার পায়ের কাছে বসে আমি ইস্ত্রিতে কাপড় গরম করে করে সে কাপড় চেপে ধরে তোমার পা দুটো থেকে ঠান্ডা সরাচ্ছিলাম। লাভ নেই, তারপরও। তুমি কী আর বুঝতে পারছিলে তোমার শরীরের কোথাও তাপমাত্রা কমে যাচ্ছে! বাইরের তাপ দিয়ে আমি আর কতটুকু কী উষ্ণ করতে পারবো! আমার ভয় হচ্ছিল। খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছিল তোমার সঙ্গে আমার। শেফালিকে পা গরম করতে দিয়ে আমি তোমার হাত দুটো ধরে শুধু বসে রইলাম। সেই হাতে তাপ ছিল, সেই হাতে তুমি ছিলে না মা। তুমি কিছু টের পাচ্ছিলে না। হাতে তোমার কোনও জোর ছিল না। আমার খুব ভয় হচ্ছিল। খুব ভয়। সবাই ভাবছিল এই বুঝি তুমি আর নিঃশ্বাস নেবে না। কিন্তু তুমি নিচ্ছিলে। প্রাণপণে তুমি বাঁচতে চাইছিলে। শ্বাসে কোনও ছন্দ ছিল না, কিন্তু নিচ্ছিলে। তোমার শরীর কোনও আর অক্সিজেন চাইছিল না নিতে, তোমার ফুসফুস বাধা দিচ্ছিলো, কিন্তু নিচ্ছিলে তুমি। তোমার হৃৎপিণ্ড বাধা দিচ্ছিল, কিন্তু তুমি শুনছিলে না। যে করেই হোক নিচ্ছিলে। তোমার ভেতরের সব ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল, সবপচে গিয়েছিল, তোমার অন্ত্র, তোমার পাকস্থলী, তোমার যকৃত, তোমার কিডনি, কিন্তু শ্বাস নিচ্ছিলে। মানুষ তোমাকে বিদায় দিচ্ছে, তোমারই স্বামী, পুত্র, নাতি, তোমারই ভাই বোন তোমাকে বিদায় দিচ্ছে, তুমি বিদায় নিতে চাইছে না। তুমি এই পৃথিবী ছেড়ে তোমার সংসার তোমার স্বজন ছেড়ে কোথাও যেতে চাইছিলে না, মা। কার জন্য থাকতে চাইছিলে মা? এই জগৎ সংসারে তোমার কে ছিলো যে তুমি ছেড়ে যেতে চাইছিলে না? তোমার জায়গায় আমি হলে সম্ভবত মরে শান্তি পেতাম, মরে বাঁচতাম। ভালোবাসা বুঝি তোমার দেবার কিছু বাকি ছিল আমাদের যে থেকে যেতে চাইছিলে?

আমি তোমার কাছে বসছি, একবার বারান্দায় যাচ্ছি, একবার ঘরে ঢুকছি। মামারাও এক এক করে যাচ্ছে, আবার আসছে। কে ঠিক কী করবে বুঝতে পারছে না। ওই সকালেই নাকি দুপুরের দিকটায় হাসু খালু বলতে শুরু করলো আমরা তো তৈরি হয়েই এসেছি, লাশ নিয়ে যাবার জন্য যারা যারা আসার কথা, সবাই এসে গেছে জাতীয় কথা। আমার কানে যেন গরম লাভা পড়লো মা। বাবাকে বলি তোমার কাছে বসার জন্য। বাবাকে খুব ধীর স্থির লাগছিলো, বাবা কি সত্যিই নিস্পৃহ ছিল, নাকি বাবারও আমার মতো ভীষণ ভয় হচ্ছিল, বাবাও ভীষণ একা হয়ে যাচ্ছিল, যে কথা আমার মতো বাবাও কাউকে বুঝতে দিতে চাইছিলো না! দাদাকেও বলেছি যেন কাছে এসে বসে, যেন ধরে থাকে তোমার শরীর! কী যে কষ্ট করছো তুমি প্রতিটি নিঃশ্বাস নিতে। জীবন বেরিয়ে যাচ্ছে তোমার জীবন বাঁচাতে। ওদিকে দুপুর থেকেই আবার বৈঠক ঘরে দাদা আর বাবার চিরাচরিত বৈঠক। বাবা দাদাকে, অথবা দাদা বাবাকে ক্রমাগত বলে যাচ্ছে কবর, কোদাল, জানাজা, কাফন এসব কুৎসিত আর অশ্লীল শব্দযুক্ত বাক্য। তার চেয়ে বধির হয়ে যেতাম, তার চেয়ে অন্ধ হয়ে যেতাম। আমাকে দেখতে হত না এই ভয়ংকর দৃশ্য, শুনতে হত না নোংরা শব্দগুলো। তুমি এখনও শ্বাস নিচ্ছ মা, তুমি এখনও মরে যাওনি। কারও চোখে এক ফোঁটা জল নেই। হাসিনা তার ছেলেদের নাওয়া খাওয়া বিশ্রাম ইত্যাদির তদারকি করছে, যেমন করে প্রতিদিন। বাড়িতে একটি মানুষ যে কোনও মুহূর্তে আর নিশ্বাস নিতে পারবে না, কে বিশ্বাস করবে! ঠিক কী করবো বুঝতে পারছি না। কোথায় যাবো, কার সঙ্গে কথা বলবো কিছুই জানি না। মা, মা, মা বলে তোমাকে ডাকছি, যেন তুমি অন্তত কথা শোনো আমার। তুমি ছাড়া আর কেউ নেই আমার তখন। আমার সেদিন অনেকবার মনে হয়েছে, তার চেয়ে এই যন্ত্রণাটা তুমি না পাও, তার চেয়ে নিশ্বাস তুমি আর না নাও। কার জন্য নিতে চাইছো, এই সংসারে কে আছে তোমার! আমিই বা কী করেছি তোমার জন্য সারাজীবন! জীবনে যা করা উচিত ছিল করিনি, এখন উজাড় করে দিচ্ছি মত্যুর সঙ্গে রোজ যখন তোমার পাঁচবেলা দেখা হচ্ছে। যখন জীবন বলে সত্যিকার কিছু নেই, তখন। তুমি বিছানায় মিশে যাচ্ছো। বসার, হাঁটার, চলার, খাওয়ার কিছুরই উপায় তোমার নেই যখন, তখন। মা, তখন তুমি সবই মেনে নিচ্ছো। তোমার জীবন তুমি ছেড়ে দিয়েছো আমার হাতে। যেন আমার এই হাতই, এই অভিজ্ঞ এবং আন্তরিক হাতই মৃত্যুর মুখ থেকে ছিনিয়ে আনবে তোমাকে। এরকম তো কত গল্প শুনেছো কত বাঁচার। ডাক্তার আসছে, কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যাচ্ছে। অন্য ঘরে কবরের গল্প হচ্ছে। তুমি একা পড়ে আছো, চোখ বোজা, নাকে অক্সিজেন, হাতে স্যালাইন। নিশ্বাস নেওয়ার জন্য যুদ্ধ করেই যাচ্ছে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হচ্ছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সকালের দিকে একটা ভিড় হয়েছিল তোমার পাশে, সেই ভিড় হালকা হয়ে গেল। কার সময় আছে মৃত্যু দেখার জন্য অত সময় অপেক্ষা করার। তুমি মরে গিয়ে ওদের সময় যদি বাঁচাতে, খুশি হত ওরা। আমি স্তব্ধ বসে আছিমা। তোমাকে খাওয়াবার, পেচ্ছাব পায়খানা করাবার, গা মুছিয়ে দেবার, কাপড় পাল্টে দেবার কোনও কাজ আমার নেই। কাউকে ডেকে এনে তোমার সঙ্গে দেখা করাবার নেই। তোমার মন ভালো করার জন্য নানারকম আয়োজন করারও কিছু নেই। আমি শুধু স্তব্ধ বসে আছি। স্তব্ধ বসে আছি শুধু। মা, তুমি একা একা কষ্ট পেয়ে যাচ্ছো। তুমি হারিয়ে যাচ্ছো। সন্ধে হলে টেলিভিশন ছাড়া হল। শুভ আর সৌখিন দেখবে। বাবাও বোধহয়। নাকি বাবা তোমার দাফন কাফন নিয়ে দাদার সঙ্গে ক্রমাগতপরামর্শ করে যাচ্ছে কে জানে। টেলিভিশনের নাচ গান বিজ্ঞাপনের শব্দের নিচে হারিয়ে যাচ্ছে তোমার শ্বাস কষ্টের শব্দ। জানি না কেন বারান্দায় গিয়ে স্তব্ধ রাত্তিরের দিকে তাকিয়ে আমি মা মা মা বলে চিৎকার করলাম। ওই বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই শৈশব থেকে মা মা বলে ডেকেছি, আর যেখানেই ছিলে তুমি, রান্নাঘরে, শোবার ঘরে, ছাদে বা উঠোনে, ডাক শুনে ছুটে এসেছে। আর যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি চিৎকার করে তোমাকে ডাকছি, বাড়ির সবাই শুনছে, পাড়াপড়শি শুনছে, পথচারি শুনছে, একেবারে কাছের ঘরটায় শুয়ে আছো তুমি, শুধু তুমিই শুনছে না।

বাবা তখনও বৈঠক ঘরে ব্যস্ত দাদার সঙ্গে প্রতিদিনের মতো খুঁটিনাটি আলোচনায়। কাকে কাকে খবর দিতে হবে, কী করতে হবে। বাড়ির কারও চোখে জল নেই মা, না, আমার চোখেও নেই। সত্যি বলছি মা, আমি চাইছিলামও তুমি ওই শ্বাস আর না নাও। কারণ ওই শ্বাস তোমাকে শ্বাস ফিরিয়ে দেবে না। অক্সিজেন কি খুলে দেব? স্যালাইনের নলে আর কি ধীরে ধীরে ঢালবো না ওষুধগুলো! ভাবি ঢালবো না, কিন্তু না ঢেলেপারি না। যতক্ষণ বেঁচে থাকতেপারো, যেভাবেই পারো, বাঁচো। জীবন তো একটাই মা, পরকাল বলে কিছু আছে বলে যদিবিশ্বাস করতাম, তোমাকে বিদায় দিতে কোনও কষ্ট হত না।

বাবা তোমার দশ বছর বয়স থেকে তোমার সঙ্গে। এত বছর মানুষটার সঙ্গে এক বাড়িতে কাটিয়েছে বাবা, কোনওদিন ভালোবাসেনি বরং সারাজীবন কষ্ট দিয়েছে। যে অসুখটা সারাতে চাইতে, সেই অসুখের কথায় বাবা মুখ ভেংচে টিটকিরি দিয়েছে তোমাকে, সেই অসুখে চিকিৎসাহীন অবস্থায় আজকে তুমি মারা যাচ্ছ, আর একটু পরেই সব কষ্ট সব যন্ত্রণার অবসান হবে। বাবা আজ কী করে স্থির থাকছে, তোমাকে মাটিতে পুঁতে দেওয়ার পরিকল্পনা করে যাচ্ছে, আমি ভাবতে পারি না। মানুষের দীর্ঘ বছরের সম্পর্ক কি এমনই ঠুনকো হয় নাকি হতে পারে! সম্পর্ক নামের জিনিসটা তবে কী! দাদার চোখেও তো একফোঁটা জল নেই। এই দাদাকে শিশু ছিলে যখন, বা অল্প বয়সি কিশোরী ছিলে, জন্ম দিয়েছিলে, এই দাদার কারণে তুমি তোমার শৈশব কৈশোর কিছুই উপভোগ করতেপারোনি। দাদাকে আনাড়ি হাতে একা একা মানুষ করেছো। সেই তুমি চলে যাচ্ছ, অভাগা তুমি। দাদার চোখে জল নেই, দাদা ব্যস্ত তোমাকে মাটিতে পুঁতে ফেলার আয়োজনে, কাকে কাকে জানাজায় খবর দেবে তার তালিকা তৈরি করছে। ফকরুল মামা ঢাকা থেকো এলো রাতে, এসেই শ্বাসকষ্ট হতে থাকা অচেতন তোমাকে দেখলো। দাদার ঘরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কেঁদেছে কেন সে দেরি করলো, কেন আগে সে এলো না, বলে বলে। এ বাড়িতে প্রথম একজন কেউ কাঁদলো। অন্তত একজন মানুষের কান্নার শব্দ আমাকে স্বস্তি দেয় মা। আসার তো ফকরুল মামার কথাই ছিল, তাকে পাঁচশ টাকা তোমার হাত দিয়েই গাড়িভাড়ার কথা বলে দিয়েছিলাম, যেন আসে তোমাকে দেখতে। এলো, সে যে এলো তুমি দেখতে পেলে না। ফকরুল মামার টাকার অভাব নেই, তারপরও আমি ভেবেছিলাম যদি কখনও আবার ভেবে বসে যে আসবে না, গাড়িভাড়াটা হাতে থাকলে অন্তত একটা তাগাদা থাকবে আসার জন্য, তাই দেওয়া। ঝুনু খালা আসেনি। বড় মামাও না। তোমাকে এখন দেখতে এসেই বা কী লাভ! তোমার মৃত্যু দেখতে কি মানুষকে আসতে বলেছিলাম! তখনই তোমার প্রয়োজন মানুষের উপস্থিতর, যখন কথা বলতে পারতে, কাছের মানুষদের কাছে পেয়ে ভালো লাগা পেতে পারতে। এখন কী দরকার! সারাজীবন তো মানুষ তোমার অনেকটা বেঁচে-না-থাকার মতো বেঁচে থাকা দেখেছে। মৃত্যুময় জীবন দেখেছে। এখন তাকিয়ে তাকিয়ে তোমার মৃত্যু উপভোগ করার প্রয়োজন কেন তাদের! মারা যখন যাচ্ছোই, একা একাই যাও। সবাইকে এত দুঃসহ দুর্ভোগ দেখাবে কেন! সারা জীবন ধরে তারা তো দেখেইছে যা দেখার। একটা সময়, মা, আমি কিছু আর উপলব্ধি করি না। আমি তাকিয়ে থাকি তোমার দিকে। মানুষগুলোর দিকে। বাইরের কালো উঠোনের দিকে। বাবা আর দাদার আলোচনার দিকে। হাসিনার হাসি হাসি মুখের দিকে। শুভ আর সৌখিনের প্রতিদিনের রুটিনের দিকে।

জানিনা কেন সবাইকে আবারও কাছে আসতে বললাম। তখন শ্বাস নেওয়ায় ছন্দপতন হচ্ছিল, যখন বিরতি বেড়ে উঠছিলো, প্রথম নিঃশ্বাস থেকে দ্বিতীয় নিঃশ্বাসের মধ্যে। যখন ভেঙে ভেঙে যাচ্ছিল শ্বাস, আবার দীর্ঘ হয়ে উঠছিলো, যখন খুব সময় নিয়ে শ্বাস নিচ্ছিলে; এভাবে নিতে নিতে আর নেবেনা শ্বাস, জানি। সবাই এলো, দাদা তোমার শিয়রের কাছে গিয়ে বসলো। না, আমি বিছানায় উঠিনি। বাবা দূরে দাঁড়িয়ে রইলো ঘরে। ঘরে একটু একটু করে ভিড় বাড়তে শুরু হল। এবার নিশ্চয়ই তুমি মরতে সময় নেবে না। না সময় নাওনি, মা। সারাদিন নিয়েছে, রাতে আর নাওনি। রাতে তো সবাই রাতের খাবার শেষে যার যার শুভ্র বিছানায় শুতে যাবে, সেসবে আর ব্যাঘাত ঘটাওনি। দাদা হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো, নাসরিন, কী হইব। মা নাই! দাদার চিৎকারে সামান্যও চমকে উঠি না। তোমার হাতের আঙুলগুলো খুব মন দিয়ে নাড়ছিলাম আমি। নেড়ে যাচ্ছিলাম। তোমার নখগুলো অনেকদিন কাটা হয়নি দেখছিলাম, আঙুলগুলোয় কয়েকদিন লোশন পড়েনি, দেখছিলাম। সুহৃদ ওষুধ নিয়ে ঢুকলো তখন। এসেই সে তোমাকে দুহাতে জড়িয়ে জোরে কেঁদে উঠলো। কান্নার সুহৃদকে সঙ্গে সঙ্গে ফকরুল মামা তুলে নিয়ে থামাতে চেষ্টা করলো। আমি বুঝতেপারিনা সুহৃদের কান্না থামানোর তার কী প্রয়োজন! তোমার দেবশিশু যদি আজ না কাঁদে কবে কাঁদবে? সুহৃদের জীবনের সবচেয়ে বেশি ঋণ তত তোমার কাছেই। সেই তুমি মারা যাবে, আর সুহৃদ কাঁদতে পারবে না! কারও কাঁদা উচিত নয়, কে এই নিয়ম তৈরি করেছে? সমাজ, নাকি ধর্ম। মনে আছে ফজলি খালা কারও মৃত্যুতে কাঁদতে বারণ করতো। বলতো, আল্লাহর জিনিস আল্লাহর কাছে যাচ্ছে, এতে দুঃখ করার কিছু নেই। কাঁদলে নীরবে চোখেরপানি ফেল, কিন্তু শব্দ করো না। শব্দ করে কাঁদলে, বুক থাপড়ালে, কপাল চাপড়ালে আল্লাহ খুব অখুশি হবেন। কিন্তু ফকরুল মামা তো ধর্ম মানে না। সুহৃদের সশব্দ ক্রন্দন তাকে পীড়া দিল কেন! নাকি সে ভাবছিলো, কেঁদে আবার সুহৃদনিজের কোনও ক্ষতি না করে ফেলে। কত আর ক্ষতি হয় কাঁদলে! বাকিজীবন যে ভেতরে বাইরে আমি কেঁদে চলেছি, কী ক্ষতি আমার হচ্ছে! মানুষকে কাঁদতে হয়, অন্যের প্রতি নিজের এবং অন্যান্যের নীচতা, নিষ্ঠুরতা, তঞ্চকতা দেখে কাঁদতে হয়। না কাঁদলে মানুষ মানুষ হবে কী করে!

.

তুমি আর শ্বাস নিলে না মা। রাত তখন দশটা অথবা সাড়ে দশটা কিছু বাজে। ঘরের ভিড় কমলে আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকি। তুমি তখন ঠাণ্ডা হয়ে গেছ। আর কোনও কষ্ট নেই। শ্বাস নেবার দায় নেই। তোমাকে ক্লান্ত কিন্তু ভারমুক্ত বলে মনে হচ্ছিল। বিশ্বাস হচ্ছিল না তুমি আর জেগে উঠবে না, তুমি আর কথা বলবে না বা হাসবে না। তোমার নরম শরীরটা আর নরম নেই। শুয়ে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মা। প্রায় চার মাসের একটানা অবসাদশরীরে। হঠাৎ কিছুর শব্দ পেয়ে চমকে উঠি। কী! ফজলি খালা ঘরে এসেছে, চেয়ারে বসে বিছানায় নিথর নিস্তব্ধ তোমার দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি চিৎকার করি, চিৎকার আমি করবো এই পরিকল্পনা করে চিৎকার করিনি, ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে চিৎকার, ওই চিৎকার, বাড়ি কাঁপানো চিৎকার, জানালার কাঁচে ঝিনঝিন শব্দ হতে থাকা চিৎকার, আকাশ বাতাস কাঁপানো চিৎকার। যে গালি আমি দিই না, সেই গালি, যে ঘৃণা আমি ছুড়ি না, সেই ঘৃণা আমার ভেতর থেকে বোমার মতো বেরিয়েছে। যে বোনকেতুমি ভালোবাসতে, যে বোনেরপায়ের শব্দ শোনার জন্য তুমি কান পেতে ছিলে, সেই প্রিয় তোমার বোনকে উদ্দেশ্য করে কেন এসেছে শুয়োরের বাচ্চা এখানে, কী দেখতে এসেছে। বেরিয়ে যা, এক্ষুনি। এক্ষুনি বেরিয়ে যা। এক্ষুণি বেরো এই বাড়ি থেকে। হারামজাদি আজকে এসেছে, মড়া দেখতে এসেছে। শুয়োরের বাচ্চা মজা করতে এসেছে। বেরো এক্ষুনি এই মুহূর্তে। আমি আমি ছিলাম না মা। আমার সহ্য হয়নি ফজলি খালার এই উপস্থিত। কত যে তাকে তোমাকে দেখতে আসার জন্য ডেকেছি। ফজলি খালা ছিল তোমার সবচেয়ে আদরের বোন। অসুস্থ জেনেও, মরে যাবে জেনেও একদিনও সে দেখতে আসেনি নিজের বোনকে। কারণ হচ্ছি আমি। আমি নাস্তিক, তাই যে বাড়িতে নাস্তিক আছে, সে বাড়িতে তার মতো পবিত্র আস্তিক পা রাখতে পারে না। ছটকুকে দিয়ে, শরাফ মামাকে দিয়ে, টুটু মামাকে দিয়ে, ফেলু মামাকে দিয়ে, রুনু খালাকে দিয়ে দিনের পর দিন অনুরোধ করেছি। বলেছিনাস্তিক তোমার চোখের সামনে থাকবেনা, তুমি শুধু তোমার বড়বুকে দেখতে এসো, শেষ দেখা দেখতে এসো, তোমাকে দেখে শান্তি পাবে তোমার বড়বু। না, ফজলি খালা আসেনি। এলো ঠিকই, তুমি জানলে না যে এসেছে। এই আসার কী দরকার। তার এই আসা, তোমার স্থবিরশরীর, তোমার বরফের মতো ঠাণ্ডা কঠিন শরীর দেখতে আসা আমার সইবে কেন! আমার সমস্ত ক্রোধ, রাগ, সমস্ত অভিমান, দুঃখ, আমার শত শোক সে রাতে আগুন হয়ে ঝরলো। তুমি শুয়ে আছে। কিছুই তোমাকে আর স্পর্শ করছে না। জগতের নিষ্ঠুরতা অনেক দেখেছো। বেঁচে থাকতে আমার নিষ্ঠুরতাও দেখেছো অনেক। তুমি দিব্যি মরে রইলে, আর আমি অবাধে নিষ্ঠুরতা করলাম। তবে এই প্রথম তোমাকে ভালোবেসে একটি কুৎসিত নিষ্ঠুরতা করলাম, মা। ফজলি খালাকে আমি ক্ষমা করতে পারিনি। তুমি পারো ক্ষমা করতে অনেক কিছু। আমিও কি কম করেছি ক্ষমা এ জীবনে! সে রাতে পারিনি। ফজলি খালা আমার চিৎকারে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হল। এরপর তোমার শরীর নিয়ে কত যে কাণ্ড শুরু হল। সেই রাতেই তোমাকে কলের পাড়ে নিয়ে গিয়ে গোসল করিয়ে গায়ে সাদা কাপড় পেঁচিয়ে দেওয়া হল। কাপড়ে রক্ত লেগে রইলো। তা লাগুক। আমি গোসলেরপূতপবিত্রতায় বিশ্বাস করিনা। যারা মনে করে তুমি এখন আল্লাহ বাপয়গম্বরের কাছে যাচ্ছে তারা হয়তো এসব গোসল, সাদা কাপড়, সুরমা বা আতরে বিশ্বাস করে। গোসল করাবার জন্য কোত্থেকে সব মেয়ে ভাড়া করে আনা হয়েছে। হাসিনা মহা উৎসাহে ছুটোছুটি করছে, একবারদাদা বা বাবার কাছেআরেকবার কলপাড়ের লোকদের কাছে। মনে আছে তুমি একবার বলেছিলে, তুমি মারা যাওয়ারপরফজলি খালারননদ জোহরা, তুমি চাও, যেন তোমাকে গোসল করায়। জোহরার মধ্যে সততা আর সারল্যের সন্ধান পেয়েছিলে হয়তো। আমি ও নাম নিইনি। বেচে থাকতে তোমার কোনও ইচ্ছেপূরণ হয়নি। মরে গেলে তোমার ধর্মবিশ্বাস থেকে প্রসূত ইচ্ছেগুলোর কী হল, তা আমার জানতে ইচ্ছে করে না। তোমার ওই প্রাণহীন শরীরটি তুমিনও হাসিনা, দাদা, বাবা এরা তো তোমার জীবন নিয়ে কিছুভাবেনি, মৃত্যু নিয়ে ভেবেছে। মধ্য রাত্তিরে কী করে এত কিছুঘটে যাচ্ছে জানিনা। ব্যবস্থাপনায় কেছিল, কারা ছিল জানি না। যা কিছু হয়েছে, আমার আড়ালেই হয়েছে। সবকিছুর ব্যবস্থাপক যে বাবা, অনুমান করতে পারি। কী সুন্দর আগরবাতির গন্ধ চারদিকে। আগরবাতি আগে থেকে ঠিক করা ছিল তবে! কাফনের কাপড়টিও আগে থেকেই কেনা ছিল! আমার শুধু সারারাত মনেপড়েছে, সারাদিন মনেপড়েছে তোমার দুঃসহ জীবনের কথা। বাড়িতে এখন উৎসব লেগেছে। উঠোনে আলো। কোত্থেকে একটি কাঠের সস্তা খাঁটিয়া না কী নিয়ে এসেছে কে জানে, সাদা কাপড়ে মোড়ানো তোমাকে ওতে শুইয়ে বৈঠকঘরে এনে রাখা হল। এখন তুমি বাবার আর দাদার সম্পত্তি। আমার কিছু নও। তোমার শরীর নিয়ে এখন কী করা হবে, কী করা উচিত, তা আমার কাছে কেউ আর জানতে চাইছেনা। যখন শ্বাস নিয়েছে, আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমি করতে চেয়েছি, তোমাকে ভালোবেসেছি, পাশে থেকেছি, তোমারশরীর ভালো করার কোনও উপায় আমারছিল না, তোমার মন ভালো করার জন্য, তোমার মনে সামান্য সুখ দেওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছি। শ্বাস আর নিচ্ছেনা, আমার ছুটি, হ্যাঁ মা, ছুটিই। তোমাকে বৈঠকঘরের মেঝেয় শুইয়ে দেবার পর কি ওরা টেলিভিশন চালিয়েছিল! মনে নেই। চালালেও অবাক হওয়ার আমার কিছুছিলনা। আমার সব অবাক হওয়া, সব দুঃখ পাওয়া, কষ্ট পাওয়া তোমার মতোই স্থবির পড়ে আছে, প্রাণহীন। সকালে অদ্ভুত সব কাণ্ড হতে লাগলো। সবই বাবার মস্তিষ্ক প্রসূত। রিক্সা করে কে যেন বাইরে মাইকে ঘোষণা করছে, ডাক্তার রজব আলীর স্ত্রী গতকাল রাত সাড়ে দশ ঘটিকায় ইন্তেকাল করেছেন, ইন্নালিল্লাহে কিছুএকটা রাজেউন। দুনিয়ার লোককে তোমার মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে দেওয়ার কী প্রয়োজন আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। আমার খুব অস্বস্তি হয় ওই ঘোষণা শুনতে। তোমার নিঃশব্দেচলে যাওয়া সশব্দে প্রচারিত হচ্ছে। মানুষ যার যার জীবন নিয়ে সবাই ব্যস্ত। তারা তোমার মৃত্যুর খবর জেনে কী করবে, উৎসব করবে, নাকি কাঁদতে বসবে? কজন আর চিনতো তোমাকে! তুমি বোরখা পরেই চিরকাল বাইরে বেরিয়েছে। কেউ তোমারমুখটাও কোনওদিন দেখেনি। পাড়ার কারও সঙ্গে তোমার তো খুব সখ্য ছিল না। কিন্তু বাবার এসব কার্যকলাপে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। তুমি যেই না চোখ বুজলে, এ বাড়িতে আমি মুহূর্তে অস্পৃশ্য হয়ে উঠলাম। মূল্যহীন হয়ে উঠলাম। আমার কোনও পরামর্শ বা চাওয়া না চাওয়ার কোনও দাম নেই তখন।

আমি লাশ শব্দটা উচ্চারণ করি না, কবর শব্দটাও আমি উচ্চারণ করি না। মরে গেছে শব্দটা আমি লক্ষ করি আমি উচ্চারণ করি না। আমি শুধু বাবাকে বলি, মা অবকাশে থাকবে, অবকাশ থেকে মাকে বাইরে বের যেন না করা হয়। অবকাশে মা মার হাতের লাগানো কোনও গাছের তলায় থাকুক। আমি পাগলের প্রলাপ বকছি বাবা ভেবেছে। বাবা ব্যস্ত। অবকাশে প্রথম কেউ মারা গেল। কত দায়িত্ব, কত কর্তব্য তার। তোমাকে নাকি আকুয়ার কবরখানায় রেখে আসা হবে। কী রকম যেন অদ্ভুত লাগে সমস্ত ব্যাপারটা। তোমার মরে যাওয়া, ওদের ছুটোছুটি, ওদের মাইকের ঘোষণা, ওদের কাফনের কাপড় কেনা, ওদের মাটি খোঁড়া, তোমাকে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া, তোমাকেপুঁতে দেওয়া, তোমাকে ফেলে আসা, তোমাকে একা ফেলে আসা, অন্ধকারে, গর্তে-সবকিছুকেই চরম নিষ্ঠুরতা ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। মা। আমি তাকাতে পারি না ওসবের দিকে। মানুষগুলোকে আমার মনে হয় আমি চিনি না। শুধু তোমাকে চিনি, শুয়ে থাকা তুমি, যদিও শ্বাস ফেলছো না, যদিও চোখ খুলছে না, তোমাকেই চিনি।

যে বিছানায় যে চাঁদরে শুয়েছিল, সেই বিছানায় তোমার স্পর্শ লাগা চাঁদরে আমি শুয়ে থাকি। ওদিকে তোমারশরীর নিয়ে উৎসব চলছেই। ছোটদাকে ফোন করে আগেইমৃত্যুর খবর জানিয়েছে বাবা। ছোটদা বলে গিয়েছিল, ‘কিছু হলে’ তাকে যেন ফোন করা হয়। কিছুটা এতদিনে হয়েছে। কিছুটার জন্য এখন ছোটদা আসবে অবকাশে, কিছু হলে যে জিনিসগুলো করতে হয়, সে জিনিসগুলো করবে ছোটদা। এই আড়ম্বর, এই অভিনয় আমার খুব হাস্যকর লাগে। যে ছোটদার কোনওদিন সময় হয়নি তোমার চেতন থাকা অবস্থায় তোমাকে সঙ্গ দিতে, এখন অচেতন তোমাকে, ঠাণ্ডা পাথর তোমাকে, মৃত তোমাকে হিরোর মতো দেখতে আসবে সে। সে হিরো। হিরোরা সবসময় দূর থেকে আসে, হিরোদের কাছাকাছি কোথাও থাকতে নেই। হিরোর জন্য তোমাকে শুইয়ে রাখা হল। জানাজাপড়ানোরজন্য শুনলাম মামারা আর দাদা মসজিদেমসজিদে ইমাম বা মৌলবী খুঁজেছে। শহরের কোনও মসজিদ থেকে কোনও ইমাম আসবে না জানিয়ে দিয়েছে। দাদা বললো, ‘তোর জন্য। যত ইমাম আছে সবাই একবাক্যে একটা কথাই বলেছে, নাস্তিকের মার জানাজা তারা পড়বে না।‘

.

আমার ইচ্ছে করে তোমাকে বরফে ডুবিয়ে রাখি, কোনওদিন যদিমানুষ বাঁচানোরপদ্ধতি আবিষ্কার হয়, বাঁচাবো তোমাকে। কিন্তু কে শুনবে আমার কথা! তোমার শরীর ওরা আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। বৈঠক ঘরে তুমি শুয়ে আছে, আর ওদিকে কালো ফটক খুলে দেওয়া হয়েছে, তোমাকে পাড়ার স্ত্রী পুরুষ যার ইচ্ছে হচ্ছে দেখে যাচ্ছে। যে কেউ এসে দেখে যেতে পারছে। সবার জন্য আজ বন্ধ দুয়ার খুলে গেছে। মৃত্যু যে দেখার বিষয় হয় কোনওদিন, জানা ছিল না। বেঁচে যখন ছিলে, কজন দেখতে এসেছে? প্রতিবেশীরা বেশির ভাগই হিন্দু। বাবা বড় পাঁচিল তুলে দিয়েছিলো বাড়ির সামনে, প্রতিবেশী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার জন্য। রাস্তার অচেনা লোকেরই বা বাড়ি ঢুকে প্রাণহীন একটি মানুষকে দেখার প্রয়োজনটা কী? তুমি তো আর কোনও রাজনীতির লোক ছিলে না। তুমি ছিলে বোরখা পরা একটি মেয়ে। আজ অনাবৃত করা হয়েছে তোমার মুখ। আজ আর তোমার বোরখার প্রয়োজন নেই। জীবিত থাকলে তোমাকে ঢেকে রাখতে হবে, তোমাকে লুকোতে হবে, মরলেই তোমার সব বন্ধন মুক্ত, মরলেই তোমার মুক্তি। না মরে তোমার বোধহয় মুক্তি ছিল না, কোনও মেয়েরই কি আছে! আমার ভালো লাগে না বাড়ির আয়োজন। হাসিনাকে কেউ একজন বলে গেছে যেদিন কেউ মারা যায়, সেদিন বাড়িতে রান্না চড়াতে হয় না। রান্না না চড়ানোটাও উৎসবের ব্যাপার। পিকনিক পিকনিক আনন্দ। আমি ঠিক জানি না বাইরে থেকে কারা খাবার দিয়েছিলো, আমি খাইনি কিছু। খাওয়ার কোনও রুচি হয়নি। উঠোনের পেছন দিকটায় হেঁটেছি। তোমার হাতে লাগানো ফুল ফলের গাছগুলো দেখেছি। ফলের গাছগুলো ফল দিচ্ছে, সব ফুলগাছে ফুল। কী ভালোই না বাসতে এই অবকাশের সব কিছু। অথচ এবাড়িতেই তোমার থাকা হয়নি। তোমাকে থাকতে দেওয়া হয়নি। হাসিনার হাতে সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে তোমাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছিল বাবা। তারপরও তুমি এ বাড়িতে অনাহুতের মতো আসতে। আঘাত পেতে সবার ব্যবহারে কাঁদতে। তারপরও মায়া যায়নি। এই গাছগুলোই ছিল তোমার আপন। গাছগুলোয় জল সার দিতে। গাছগুলোর সঙ্গে মনে মনে কথা। বলতে। সেই গাছগুলোর কাছে গিয়ে যেন কেউ না দেখে, কাঁদলাম। কান্না এলো মা। তোমার জন্য তো তোমার অসুখ ধরা পড়ার পর থেকে কাঁদছি। আগে কাঁদিনি। আগে একা কেঁদেছো তুমি। আর অসুখেরপর? একটুও কাঁদোনি। যেন তোমার মতো সুস্থ আর কেউ নয়। সুস্থ মানুষের অভিনয় করেছে, একই সঙ্গে একা যুদ্ধ করেছো। তুমি তো হেরে গেছো যুদ্ধে। তুমি হেরেছো, নাকি আমরা হেরেছি, মা? আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমাকে আর বাবাকে তুমি চরম হারিয়ে দিয়েছে। আমাদের ডাক্তারি বিদ্যে দিয়ে যে আশংকাটি আমরা করতে পারিনি, কোনও ডাক্তারি বিদ্যে ছাড়াইতুমি সেই আশংকা করেছে। আমাদের কোনও সাহায্য ছাড়াইতুমি বলেছো, তোমার বড় একটা অসুখ হয়েছে। আমাদের জ্ঞানকেই শুধু তুমি হারাওনি, আমাদের মনুষ্যত্বকেও হারিয়েছে। আমাদের মতো নির্মম নিষ্ঠুর মানুষেরা তোমার মহত্বের কাছে হেরেছি। কী ভীষণ স্বার্থপর চারদিকের মানুষগুলো। বলছে তোমাকে নাকি এখন নিয়ে যাওয়া হবে বাড়ি থেকে। ওই বৈঠকঘরের ভিড়ের মধ্যে তোমাকে ঘিরে সার্কাস চলছে। সার্কাসে বড় বিরক্তি আমার। খাঁটিয়ায় শুয়ে থাকা তুমি অথচ তুমি-নওকে দেখার মোটে ইচ্ছে নেই আমার। কিন্তু কারা যেন আমাকে টেনে নিয়ে গেল ওঘরে, তোমার কাছে। তোমাকে শেষ দেখা দেখার জন্য। বড় মামাই বোধহয়। আমি শুধু হাঁটু গেড়ে বসে তোমার মুখে, তোমার গালে, বুজে থাকা চোখে, তোমার কপালে আলতো হাত বুলোলাম। ঠাণ্ডা পাথর হয়ে থাকা তোমার মুখ। জলে উপচে উঠেছে চোখ, যতটা পেরেছি আড়াল করেছি। বড় মামা পাশে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেপকেট থেকে রুমাল বের করে বললো যে ওই রুমালটা তুমি তাকে দিয়েছিলে। ওই রুমালে বড়মামা নিজের চোখের জল মুছলো মা। তোমার দেওয়া রুমালে। তুমি তো তাকে মিয়াভাই বলে আর ডাকবে না। হঠাৎ তোমাকে কারা যেন উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল। সম্ভবত মামারা। আমি হতবাক দাঁড়িয়ে রইলাম দরজায়। এই অবকাশে, এই বাড়িতে তুমি আর ফিরবে না মা। তুমি আর কোনওদিন আবদার করবে না এক বাটি দুধ, দুটো কলা আর একটা ডিমের জন্য, তোমার ভেঙে যাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য বাবার কাছে আর কোনও আবদার করবে না। দাদার কাছে আর আবদার করবেনা কোনও একটা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার জন্য, বা গাড়িটা একটু চড়তে দেওয়ার জন্য। তোমার ছেঁড়া লেপ আর নষ্ট হয়ে যাওয়া তোশক পাল্টানোর জন্য কাউকে অনুরোধ করবে না। ভেঙে যাওয়া খাটটি সারাবার জন্যও আর কাউকে না। ডাব বিক্রি করতে এসে আর তুমি দেখবে না হাসিনা সব বিক্রি করে ফেলেছে। আর তোমাকে মশার কামড়ে বাইরের বারান্দার মেঝেতে রাত কাটাতে হবে না। এই অবকাশ থেকে আর অপমানিত হতে হতে প্রত্যাখ্যাত হতে হতে তোমাকে চোখের জলে বিদেয় নিতে হবে না। তুমি মুক্তি দিয়ে গেলে সবাইকে। সবাই এখন সুখে শান্তিতে বেঁচে থাক। সবাই এখন হাসি আনন্দে জীবনের গান গেয়ে যাক।

.

অবকাশ দেখে কেউ বুঝবে না আজ এ বাড়ি থেকে মা নামের একজন চলে গেল, এই চলে যাওয়া মানে কখনও আর ফিরে আসা নয়। সন্ধেবেলায় যথারীতি টেলিভিশন চালালো কেউ। নাচের গানের অনুষ্ঠান হচ্ছে। নাটক হচ্ছে। বড় মামা তার মেয়েকে নিয়ে এসেছিল, থেকে যেতে বললাম। ফকরুল মামাও থাকলো। নানিও সেদিনটা রইলো। আমার জন্যই বোধহয় রইলো। আমি না থাকলে তোমার যে কী করুণ অবস্থা হত, তাই বললো সবাই। আমি ছিলাম বলে জীবনের শেষ কটা দিন তুমি আমার সেবা পেয়েছ। আমি তো জানি, এসব সেবার কোনও মূল্য নেই। সত্যিকার সেবা করা হত, যদি আমি সময় মতো তোমার চিকিৎসা করতে পারতাম। যখন দুরারোগ্য ব্যাধি বাসা বেঁধেই ফেলেছে তোমার শরীরে, তখন যে সেবাআমি করেছি, সেই সেবার কী মানে, বলো? চেয়ে চেয়ে তোমার মরে যাওয়া দেখা ছাড়া আর কিছু নয়। না, মা, আমি ক্ষমা চাইনি তোমার কাছে। ক্ষমা আমি চাইবো না কোনওদিন। আমাকে তুমি ক্ষমা কোরো না। বাবা তোমার চিকিৎসা করেনি, বাবা তোমাকে কোনওদিন ভালো বাসেনি। আমি তো তোমার কন্যা ছিলাম মা, আমাকে তুমি প্রচণ্ড ভালোবাসতে। কত শত মানুষের চিকিৎসা করেছি। রাত জেগে জেগে হাসপাতালের কঠিন কঠিন রোগের চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলেছি কত অসুস্থ মানুষকে। তোমাকে কেন করিনি মা। তুমি যে অভিযোগগুলো করতে, ওই রক্তপাতের অভিযোগ, তা অন্য কেউ করলে আমি তো অবহেলা করিনি। নানারকম পরীক্ষা করিয়েছি। কেবল তোমার বেলায় গা করিনি। আর সবাইকেই ক্ষমা করে দিলেও আমাকে কোরো না মা।

.

পরদিন মুন্নি এসেছিল অবকাশে। আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করে গেল। বললো, মার কথা সারাজীবনই মনে পড়বে। মাকে কখনও ভোলা হয় না। মুন্নি ঠিক কথা বলেছিলো মা, এই দেখ, আজ দশ বছর তুমি নেই। তোমাকে তো একটি দিনের জন্যও ভুলে থাকিনি। এখনও দেখ, চিঠি লিখতে গিয়ে চোখের জল রোধ করতে পারছি না। মানুষের কষ্টে কষ্ট পাওয়া, উজাড় করে কেবল দেওয়া আর দেওয়া, নিজে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া–তোমার এই জীবনবোধ, বাকিটা জীবন, অবচেতনেই আমি চর্চা করবো জানি। তোমার বোধের এই উত্তরাধিকার, আমি অহংকার করে বলি, আমার।

শুনেছি তোমাকেআকুয়ারকবরখানায় কবর দেওয়া হয়েছে। শুনেছি তোমার জানাজা হয়েছে, জানাজা শেষ পর্যন্ত পড়িয়েছে ফজলিখালার ছেলে মোহাম্মদ, যে মোহাম্মদ তোমাকে দেখতে এসে পীরের মতো তোমাকে তোমার মেয়ের বিরুদ্ধে, মেয়ে কী করে দোযখের আগুনে পুড়বে, আর তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে তুমিও যেপুড়বে দোযখের আগুনে, সেসব ভয়াবহ কথা সুর করে করে বলে গিয়েছিলো। শুনে তোমার খুব মন খারাপ হয়েছিল। ধর্মের নিষ্ঠুরতা দেখতে দেখতে আমার বিশ্বাস, ধর্মে তোমার বিশ্বাস হারিয়েছিল। তোমার মতো ভালোবাসা আর দয়া আর করুণা আর স্নেহ শ্রদ্ধায় যার হৃদয়পূর্ণ সে কী করে পারে নিষ্ঠুরতা মেনে নিতে! মোহাম্মদ চলে যাওয়ার পর আমি ছুটে এসেছিলাম তোমার কাছে, ভেবেছিলাম তোমার মুখে দেখবো তৃপ্তির হাসি। পীর আমিরুল্লাহর মৃত্যু হওয়ার পর, আমিরুল্লাহরসবেধনপুত্ররও মৃত্যু হবারপর, তারপুত্র মোহাম্মদ এখনপীর বাড়িরনতুনপীর। এই নতুনপীরের নছিহত পেয়ে তোমার তো খুশি হওয়ার কথা, কিন্তু বিষঃ তুমি বললে, এই এখনকার ছেলেরা আসলে কিছু জানে না।

আমি না হয় সারাজীবন তোমার সঙ্গে অন্যায় করেও জীবনের শেষ কটা দিন তোমাকে একটু শান্তি দিতে চেয়েছিলাম। বাবা করলো তুমি অবকাশ থেকে জন্মের মতো চলে যাওয়ার পর। বাইরের মাঠে বড় সামিয়ানা টাঙিয়ে কী সব মিলাদটিলাদপড়া হল। প্রচুর খাওয়া দাওয়ার আয়োজন হল। ভিখিরিদের খাওয়ানো হল। খরচ বাবাই করলো। তাঁর মতো পাঁড় নাস্তিকের হঠাৎ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করার কারণ কী আমি জানিনা। বাবা যেভাবে বলছে, দাদা সব করছে। আমিও দাদাকে যা আদেশ করেছিলাম, পালন করেছিলো। তোমার সামনে বসে একদিন অনেক হাসির গল্প শোনাতে বলেছি। দাদা শুনিয়েছে, প্রচুর হেসেছো তুমি। আমিও হেসেছি। হাসতে হাসতে, তোমার নির্মল হাসি দেখতে দেখতে চোখে জল এসেছে আমার। যেন নিজেরহাসিরকারণে চোখেজল এসেছে, এমনকরে চোখের জল মুছেছি। আমার ফুটফরমাশ দাদা বাধ্য ছেলের মতো শুধু ঢাকায় নয়, ময়মনসিংহেও খেটেছে। দাদাকে দিয়ে শীতলপাটি, এটাসেটা, গুলকিবাড়িরপীর আর তার মুরিদদের জন্য প্রেসক্লাবের বিরিয়ানি, অক্সিজেন সিলিণ্ডার, স্যালাইন, ওষুধপত্র সব আনিয়েছি। ছোটদাকে দিয়ে এসব কাজ সম্ভব হত না। সে উড়ে এসেছে। তোমাকে মাটি দেওয়ার জন্য, জানাজা পড়ার জন্য। তখন তার ছুটি, এমনকী অবকাশেও দুটো দিন বেশ কাটিয়ে দিল। তুমি বেঁচে থাকতে দেয়নি। আর আমি যখন তোমার কবরে একটি শ্বেত পাথরের এপিটাফ আর তোমার শিয়রের কাছে একটি শিউলি ফুলের গাছ পুঁতে দেওয়ার আয়োজন করছি, এত আদিখ্যেতা ছোটদা মোটেও পছন্দ করেনি। বিশেষ করে পছন্দ করেনি আমি যখন শরাফ মামাকে দিয়ে স্বদেশী বাজারে পাঠিয়ে সত্যি সত্যি তোমার এপিটাফ লিখিয়ে আনলাম, যেখানে লেখা ছিল–অনাহারে, অবহেলায়, অপমানে, অনাদরে যার সারা জীবন কেটেছে সেই দুঃখবতী নারী শুয়ে আছে এখানে। বেগম ঈদুল ওয়ারা। বয়স ষাট। শরাফ মামা লিখিয়ে আনলো, তবে ওপরে আরবিতে কিছু একটা জুড়ে দিয়ে। কী? না, কবরের ফেরেসতাকে সালাম জানানো, ওটা নাকি দিতেই হয়, সব এপিটাফেই দেওয়া থাকে। শরাফ মামার এ কাজটা সংগত কারণেই আমার ভালো লাগেনি। বড় মামারও লাগেনি। শরাফ মামাকে বললোও বড় মামা ‘তোকে তো আরবিতে সালাম জানানোর কথা লিখতে বলা হয়নি। এটা তো বিশ্বাস ভঙ্গ করা।’ শরাফ মামার নিজের বিশ্বাস শ্বেতপাথরে চাপিয়ে দেওয়া হল। ছোটদার বক্তব্য আমি পরিবারের মাথা নিচু করে দিতে চাইছি, মা অনাহারে ছিলো না, মাকে অবহেলা কেউ করেনি, মা সারাজীবন খুব সুখে কাটিয়েছে। এত বড় মিথ্যে আমি লিখেছি কেন, এই এপিটাফ কোথাও যাবে না। আমি বললাম, যাবে। ছোটদার প্রচণ্ড বিরোধিতা সত্বেও টুটু মামা, শরাফ মামা আর ছটকুর সহযোগিতায় কাজটা করি আমি। ওই এপিটাফই একটি স্তম্ভ বানিয়ে লাগানোহল। একটু হলেও স্বস্তি পাই। বড় মামা এপিটাফে তোমার ষাট বছর বয়স দেখে চমকে উঠেছে। বয়সতিন বছর বাড়িয়ে দিয়েছি আমি। বয়স তখনও বড়মামারইষাট হয়নি। বড় মামার আর তোমার জন্ম সাল লেখাপুরোনো নথি বের করে দেখালেন, বয়স তোমার সবে সাতান্ন হয়েছিলো। মামাদের বলেছিলাম, শ্বেতপাথরে লেখার লোক এনে ষাটকে সাতান্ন করে দিতে। জানিনা দিয়েছে কী না। জানি না তোমার শিয়রেপুঁতে দেওয়া গাছটিতে ফুল ফুটেছে কিনা। কবরে আমার আকর্ষণ নেই। তুমি ওখানে নেই মা। ওই মাটির নিচে কবেই তোমার ঠান্ডা শরীরটাপচে গেছে। তোমার হাতপামুখ, তোমার পা, পায়ের আঙুল, জন্ম থেকে চেনা তোমার ওই শরীর আমিশত চাইলেও দেখতে পাবো না। তুমি কোথাও নেই মা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোথাও নেই মা। এপিটাফ, শিউলি ফুলের গাছ সবই আমার জন্য, আমার শান্তির জন্য। আমার প্রায়শ্চিত্তের জন্য।

.

দুদিন পর নানি বাড়ি গিয়েছিলাম। নানির সঙ্গে বিছানায় শুয়ে শুয়ে বলেছি তোমার কথা। নানি ক্রমাগত কেঁদেই চলেছে। কেঁদে কেঁদেনানি একটাই কথা বলে, ঈদুন তো নাই, আমারে দেখার কেউনাই। নানিবাড়িতে সবাই আমাকে খুব আদর করলো। আদর করলোকারণআমি নিরন্তর তোমাকে সঙ্গ দিয়েছি, সবার কাছে অভাবনীয় যে সেবা, সে সেবা করেছি। কেউ কেউ বললো, তুমি নাকি খুব ভাগ্যবতী, আমার সেবা পেয়েছে। এসব শুনলে আরও অপরাধ বোধ জাগে, আর কেউ না জানলেও আমি তো জানি, এই সেবা অর্থহীন। নানিবাড়ি থেকে তোমার লেখা আরবি গ্রামারের বড় বড় খাতা নিয়ে এলাম। অবকাশে তোমার নতুন রং করা আলমারিতে তোমার সব জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখলাম, তোমার বই খাতা, তোমার কাপড়চোপড়, তোমার ব্যবহারের জিনিসপত্র। তোমার লেখা চিঠিপত্র। চিরকুট। মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে লেখা পত্রিকায় পাঠানো চিঠির খসড়া। তুমি চিঠি লিখতে, আমার মা হিসেবে নয়, পাঠক হিসেবে, একজন সচেতন মানুষ হিসেবে লিখতে, তসলিমার ফাঁসি যারা চেয়েছে, তারা ইসলামের কিছুই জানে না। তারা মুসলমান নামের কলংক। একজন সংবেদনশীল সৎ লেখককে আজ বাধ্য হয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছে। আর দেশের ভেতর ইসলামের নামে যে অসহিষ্ণু মোল্লাতন্ত্র মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, তারাই ইসলামের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি করছে। ইসলামকে তসলিমা বিপন্ন করেনি, মোল্লাতন্ত্র করছে। সরকারের কাছে আমরা দাবি জানাচ্ছিতসলিমাকে দেশেফিরিয়ে আনুন। তসলিমাকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিন। …এসব পড়ে চোখ আমার বারবার জলে ভিজেছে। কেউ কি ভালোবেসেছে আমাকে অমন করে, সংসারের কেউ? তুমি ছাড়া আমার কেউ ছিলো না। এ কথা আমি কোনওদিন জানিনি, যে, তুমি ছাড়া আমাকে ভালোবাসার কেউ ছিল না। কী যে খালি খালি লাগছিল আমার। কী যে শূন্য লাগছিল জগৎ। কী যে অন্ধকার লাগছিলো চারদিক, কী করে বোঝাবো তোমাকে। এখনও লাগে মা, এখনও। আমি আমার শূন্যতার কথা ভেবে কাঁদি না। যখন কাঁদি, জীবনে যে কষ্ট তুমি করেছে, সে কথা ভেবেই কাঁদি। তোমার কষ্ট লাঘব করার কত সুযোগ আমার ছিল, লাঘব করিনি। সেই বেদনায় কাঁদি আমি।

মা, অবকাশ থেকে তুমি চলে যাওয়ার পর দুলুর মা এসেছিল। এই দুলুর মাকে সারা শহর লোক দিয়ে খুঁজিয়েছি। কোথাও তাকে পাওয়া যায়নি। আশেপাশের যত বস্তি আছে, সব বস্তিতে শুধু দুলুর মাকে কেন, আনুরমাকেও খুঁজিয়েছি। আনুর মা, তুমি বলেছিলে, নদীর পাড়ের কোনও এক বস্তিতে থাকে। কত জনকে বস্তি খোঁজ করতে পাঠিয়েছিলাম। খোঁজ করে ওদের পাওয়া যায়নি। ওরা এমনিতেই তোমার সঙ্গে দেখা করতে অবকাশে এসে শোনে যেতুমি নেই। দুলুর মা, আনুর মা দুজনই আকুল হয়ে কেঁদেছে তোমার জন্য। লোক দেখানো কান্না নয়, সত্যিকারের কান্না। মা, তোমার অনেক আত্মীয়র চোখে ওই জল দেখিনি, দেখেছি ওই দীন দরিদ্রর চোখে। ওরাই তোমার সত্যিকারের আপন ছিল, মা। ওরাই হয়তো তোমাকে বুঝতো। হয়তো তুমি দরিদ্র ছিলে, তাই।

.

মা, তুমি ফিরিয়ে নিয়েছিলে আমাকে দেশে। আর কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি। এক তুমিই পেরেছিলে। কিন্তু তুমি জানোনা, যে, দেশ থেকে আমাকে দ্রুত বেরিয়ে যেতে হয়েছে। তুমি জানো, এখনও আমি দেশেই আছি। এটুকুই তো জেনে ছিলে। জীবন দিয়ে আমাকে আগলে রেখেছিলে। যেন কারও স্বার্থপরতা আমাকে স্পর্শ না করতে পারে। না, মা। দেশে থাকা আমার সম্ভব হয়নি। আমার নিরাপত্তার জন্য যেসব রক্ষী সরকার থেকে দেওয়া হয়েছিল, তাদের ঠেলে সরিয়ে যে কেউ আমাকে হত্যা করতেপারত। ময়মনসিংহের বারান্দার ঘরটার সোফায় বসেওরা ঘুমোতো। পায়ের কাছে পড়ে থাকতো ওদের লম্বা লম্বা পুরোনো রাইফেল। যে কেউ এসে রাইফেল তুলে নিয়ে দৌড় দিলে বোঝার ওদের কোনও উপায় ছিলো না। আমার মনে হয় না ওরা ঠিক জানত, ওরা ঠিক কী করতে এ বাড়িতে এসেছে। বাবা ওদের যত্ন করতো খুব, চা নাস্তা দিত। যখন ঢাকা যাবো, পুলিশের কারও সঙ্গে যাবার নিয়ম নেই। আমার তো কাজ নেই আর ময়মনসিংহে। তুমি নেই। অবকাশেআমার ঘরটি এখন শুভরঘর। ইয়াসমিনের ঘরটি সৌখিনের ঘর। বাবারঘরটিতেই হয়তো থাকা যেত। কিন্তু কদিন! অবকাশের সর্বময় কী এখন হাসিনা। বাবা হাসিনার হাতে সংসার ছেড়ে দিয়েছে, এ সংসারে আমি নিতান্তই ক্ষণিকের এক অতিথি। কিছুই আমার নয়। আমি এ বাড়িতে তোমার মতোই বাড়তি লোক। বড় একটি গাড়ি ভাড়া করে ওতে মামাদের নিয়ে, দাদা আর বাবাকে তুলে ঢাকা চলে গেলাম একদিন। টুটু মামা নিজ দায়িত্বে এনেছে লোহার ডাণ্ডা টাণ্ডা, তার ভাষায় অস্ত্র, সস্ত্র, মেঝেয় ঢাকা দেওয়া কালো কাপড়ে। আমার নিরাপত্তা রক্ষীর কাজ তারাই করছে। এতে নিরাপদ বোধ করেছি কিছুটা, বাকিটা স্বস্তি। স্বজনদের সতেজ সমর্থন আমাকে সবটাই স্বস্তি দেয়। মামারা আমাকে কাছের মানুষ বলে বেশি মনে করছে। যেশরাফ মামাকে মালোয়েশিয়া থেকে আমার বাড়িতে একদিন আশ্রয় দিয়েছিলে বলে হেন কটু কথা নেই তোমাকে বলিনি, সেই শরাফ মামাকে তোমার সামনে আমি যত্ন করে খাইয়েছি। ওই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছি, মা। তোমার মনে কষ্ট দেওয়ার প্রায়শ্চিত্ত। তুমি যে তোমার আদরের বাবা মা ভাই বোনের চেয়েও আমাকে বেশি ভালোবাসতে, তা আমার বোঝা হয়েছে তুমি যখন কাউকেই আর কাছে ভিড়তে দিতে চাওনি। এমন কি নানিকে, ঝুনু খালাকেও। ওরা তো তোমার আপন ছিল খুব। তুমি ভেবেছিলে, ওরা বোধহয় ওদের স্বার্থের কারণে, ।আমার কাছ থেকে টাকা পয়সা নেবার কারণে তোমাকে দেখতে আসছে। আর আমি যেহেতু খুব দরদী, আমার যা আছে সব উজাড় করে দেব ওদের জন্য। না, মা। ওই আশংকাতুমি না করলেও পারতে মা। তোমার মা বা বোন কেউ অত স্বার্থান্ধ নয়, যত তোমার নাড়িছেঁড়াপুত্রধন কামাল, আমার ছোটদা। তোমার মা, বোন কেউ আমার কাছে কিছু চায়নি।

আমি তো দেশে ফিরেছিলাম মা। তুমি আমাকে ফিরিয়েছিলে। দেশেই থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি জানো না কী ভীষণ কাণ্ড ঘটেছে হঠাৎ একদিন। ভালো যে, ঘটনাটা তুমি দেখোনি। দ্বিতীয়বারের দেশ ছাড়াটা তোমাকে যে দেখতে হয়নি, তা একদিক থেকে ভালো। কবি শামসুর রাহমানের বাড়িতে কে বা কারা রাতের অন্ধকারে ঢুকে অতর্কিতে কুড়োল টুড়োল নিয়ে আক্রমণ করেছিল, মেরে ফেলা উদ্দেশ্য ছিল, উনি অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছেন। কিন্তু পুলিশ ওই আততায়ীদের ধরে হাজতে নিয়েছে, এবং যা আবিষ্কার করেছে, তা শুনে তুমি চমকে উঠবে। আততায়ীরা হরকাতুল জেহাদ নামের একটি ধর্মীয় সংগঠনের লোক। নতুন এইইসলাম-বাঁচাও দল গড়ে উঠেছিল সেইনব্বই দশকের প্রথম দিকে। এই হুজির সন্ত্রাসীদের পেটের খবর পুলিশ নিয়েছে, এবং পকেটে যে ওদের সেই কাগজটা পাওয়া গেছে, যাদের হত্যা করার আদেশ ওদের নেতারা দিয়েছে। যাদের হত্যা করতে হবে, তারা হল, ১. তসলিমা নাসরিন, ২. শামসুর রাহমান, ৩. কবীর চৌধুরী আর ৪. ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের একজন, মাওলানা আবদুল আওয়াল। তুমি বলতে পারো আমাদের মধ্যে আবার মাওলানা কেন। হতেই পারে। এই মাওলানার সঙ্গে হুজির ইসলামপন্থীদের মতপার্থক্য আছে, তাই। আমার নাম একনম্বরে। পত্রিকাগুলোর সবচেয়ে বড় সংবাদ এটি। আমি সত্যি বলতে কী মা, ভয় পেলাম। যদি হুজির সন্ত্রাসীরা আমার বাড়িতে এসে আমাকে মেরে ফেলে! কে আটকাবে? কোনও পুলিশ নেই বাড়ির সামনে বা দরজার সামনে। আর থাকলেই বা কী! যে কেউ ঢুকতেপারে বাড়িতে পুলিশ কাউকে কোনও বাধা দেয় না। তারা ঠিক জানেও না কী কারণে তাদের বসানো হয়। আগে যখন পুলিশ ছিলো, ওদের বলেছিলাম, দিব্যি ঘুমোচ্ছিল, ঘুম থেকে ডেকে তুলে, কী কারণে আপনারা এখানে বসেছেন? ওরা সরল মুখে বললো, থানা থেকেপাঠিয়েছে। কী কারণে পাঠিয়েছে, জিজ্ঞেস করায় বললো, তারা জানে না। যারা এ বাড়িতে ঢুকতে চায় তাদের তল্লাশি করার কোনও কথা কি বলেছে? ভালো মানুষ পুলিশেরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললো, না। আমার নাম বললাম, এই নামের কারও কথা কি তারা শুনেছে? তাও বললো, না। এমনই আতংক এসে নাছোড়বান্দার মতো বসেছিলো যে কবীর চৌধুরীকে ফোনে জিজ্ঞেস করলাম, তাঁর বাড়িতে আমি চলে যাব কী না। আমার বাড়িতে মোটেও স্বস্তি বোধ করছি না। কবীর চৌধুরীর বাড়িতে পুলিশ পাহারা বসেছে। এদিকে দূতাবাস থেকে আমাকে ক্রমাগতই জানোনো হচ্ছে যে এক্ষুনি আমাকে দেশের বাইরে চলে যেতে হবে, কারণ তাদের কাছেও খবর এসেছে যে আমাকে মেরে ফেলারসবরকমপরিকল্পনা করা হয়ে গেছে।

.

ফরাসি রাষ্ট্রদূত বাড়িতে এসে বলে গেলেন দেশ ছাড়তে। কী একটা আমন্ত্রণপত্রও দিয়ে গেলেন। ফ্রান্সের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি থেকে আসা আমন্ত্রণপত্র, যার কথা আগেই বলে তাগাদা দিয়েছিলেন আমাকে। এর মধ্যেই হঠাৎ নতুন একটি মামলা উঠলো আমার বিরুদ্ধে। নির্বাচিত কলাম বইটা লেখার অপরাধে, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হল। ওই একই মামলা, ২৯৫ এ। লোকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আমি আঘাত দিয়েছি। মত প্রকাশের বিরুদ্ধে একটি গণতান্ত্রিক দেশে এই আইন কী বিচারে থাকে, জানি না। আমাকে আবারও কোর্টে যেতে হল জামিন নিতে। আবারও সেই হুড়োহুড়ি করে জীবনের প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে কোর্ট থেকে দৌড়ে পেছনের দরজা দিয়ে গাড়িতে ওঠা। মিডিয়া আর মৌলবাদীর হাত থেকে বাঁচা। বই লেখার অপরাধে আমার বিরুদ্ধে অনেক মামলাই অনেক মৌলবাদী করেছে। কিন্তু হুলিয়া জারি হয়নি খালেদা সরকারের করা মামলা ছাড়া। এই আইন খাঁটিয়ে যখন মামলা করা হয়, অদ্ভুত জিনিস হল, সরকারি অনুমতি ছাড়া এই মামলা করার অধিকার কারও নেই। শেখ হাসিনার অনুমতি নিয়ে মামলা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এ দেশে আমাকে বাস করতে দেবেন না। বুঝি না, ক্ষমতায় এলেই কেন এঁরা দেশটাকে নিজের সম্পত্তি বলে মনে করেন। দেখমা, মানুষ খালেদা জিয়ারশাসনে এবং শোষণে অতিষ্ঠ হয়ে শেখ হাসিনাকে চাইছিলো। কী পার্থক্য হাসিনা আর খালেদায়! তাঁদের নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ থাকতে পারে, একজন আরেকজনের দুচোক্ষের বিষ হতে পারেন, নিরবধি চুলোচুলি করতে পারেন, একজনের পান থেকে চুন খসলে আরেকজন লাফিয়ে উঠে আরেকজনের গলা টিপে ধরতে পারেন, কিন্তু আমার ব্যাপারে তাঁরা একশভাগ একমত। আমাকে মেরে কেটে আমার সর্বনাশ করে তবে তাঁদের শান্তি। রাজনীতির লোক না হয়েও কী করে আমাকে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের শিকার হতে হলে আমি ভাবি। ভেবেছিলাম এভাবেই থেকে যাবো দেশে। কিন্তু হুজির গোপন খুনের তালিকায় আমার নাম প্রথমে থাকা আর দূতাবাসগুলোর একই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের চাপ সবই আমাকে আবার ঘরছাড়া করলো। ভালো যে তুমি এই ভয়ংকর ঘটনাটি দেখার আগেই চোখ বুজেছো। দেখলে তুমি যে কী ভয়ংকর কষ্ট পেতে, ভেবে আমি শিউরে উঠি।

দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্তটি নিতে আমি শেষপর্যন্ত বাধ্য হই। যাবার দিন সন্ধেয় শরাফ মামা আর টুটু মামাকে কুড়ি হাজার টাকা দিই। আর বাকি কজনের জন্য সামান্য পাঁচ হাজার টাকা করে উপহার। আমি জানি, এই টাকাটা তাদের অনেক কাজে লাগবে। বিদেশের ভালো কোনও রেস্তোরাঁয় একবেলা খেলেই তো আমার দশ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। বাবা আর দাদারা অসন্তুষ্ট মামাদের আমি টাকা দিয়েছি বলে। যত টাকা বাড়তি ছিলো হাতে, তা বাবার পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছি। মামাদের সব মিলিয়ে যা দিয়েছি, তার চেয়েও বেশি বাবাকে। বাবা তো টাকা পয়সা খরচ করে না। বাবাকে যা দিই, সবই হয় দাদা নয়তো ছোটদার পকেটে চলে যায়।

আমি তখন না জানলেও এখন তো জানি যেতুমি সবচেয়ে বেশি আপন ছিলে। তুমি নেই। বাবাকে আপন যত ভাবি, বাবা হয়তো তত ভাবে না। তারপরও, বাবার অমঙ্গল আমি কিছুতেই কামনা করতে পারিনি। চেয়েছি বাবা সুস্থ থাকুক, ভালো থাকুক, আনন্দে থাকুক। যেভাবেই থাকুক, খুশি থাকুক।

.

আবার সেই আগের মতো। ঢাকা থেকে স্টকহোম। চুরানব্বই সালের আগস্ট মাসে এভাবেই দেশ থেকে বেরোতে হয়েছিল। যেসুইডেনে তুমি ছিলে, আমারপক্ষে সেই সুইডেনে, সুয়েনসনের যে বাড়িতে তুমি ছিলে, আমার পক্ষে সেই বাড়িতে বাসা করা অসম্ভব হয়ে উঠলো। তোমার স্মৃতি, তোমার অসুখ, তোমার চিকিৎসা না হওয়া, তোমাকে বড় চিকিৎসকের কাছে না দেখিয়ে বাড়িতে বসিয়ে রাখা, গ্রামেরপথেপথে অনর্থক ঘোরাঘুরি করা, তোমাকে কষ্ট দেওয়া সব মাকড়শার জালের মতো আমাকে আঁকড়ে ধরে আমাকে খেয়ে ফেলতে লাগলো। ওই জালে তড়পাচ্ছি, আর তখন আমন্ত্রণ এলো ফ্রান্স থেকে। ক্লদ ভাইজ নামের এক ফরাসি চলচ্চিত্র পরিচালক তাঁর সিনেমা-পরিচালক সংস্থার পক্ষ থেকে আমাকে আমার শোধ বইয়ের চিত্রনাট্য লেখার জন্য ফ্রান্সের নরমাণ্ডির মুলাঁ দন্দেতে আমন্ত্রণ জানালেন তিন মাসের জন্য। ওখানে বসে আমাকে চিত্রনাট্য লিখতে হবে সিনেমার জন্য। জীবনে কোনওদিন চিত্রনাট্য লিখিনি, কিন্তু রাজি হয়ে গেলাম, রাজি হলাম সুইডেন নামের নিষ্ঠুর দেশটাকেআর সইতে পারছিলাম না বলে। সুইডেনের ওই বাড়িতে তোমার স্পর্শ লেগে থাকা তোমার বিছানা বালিশ, তোমার গুছিয়ে রাখা কাপড়চোপড় দেখে আমার দম বন্ধ দম বন্ধ লাগছিলো। মনে হচ্ছিল ওই বাড়িটাকে আগুনে পুড়িয়ে দিই। নিজের বাড়ি হলে হয়তো তাই করতাম। একবার তোমার স্মৃতির জন্য ইচ্ছে করে থেকে যাই ওই বাড়িতে। আবার ওই একই স্মৃতির জন্য ইচ্ছে করে পালাই। আনন্দ বেদনা দুইই দেয় স্মৃতি। কাছে আসতে চাই, আবার দূরেও সরতে চাই। যেটুকু সুখ পেয়েছিলে সেটুকুই নিয়ে, ইচ্ছে করে, থেকে যাই। আবার বেদনার স্মৃতিগুলো আমাকে দূরে, অনেক দূরে সরে যেতে বলে। মনে হয় পৃথিবীর অন্য পারে গেলে হয়তো স্বস্তি মিলবে। ইচ্ছে করে সুয়েনসনকে কুড়োল দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলি, আবার মনে হয় কী লাভ মেরে ফেলে! দোষ তো আমারই। আমি কেন তার সাহায্যের আশায় বসে ছিলাম। দোষ আমার নির্বুদ্ধিতার। আমি না হয় নির্বোধ, লোকটা যদি ওই সময় সামান্য সহযোগিতা করতো, তুমি আজ বেঁচে থাকতে পারতে। সুয়েনসনের চেহারা দেখতে শুধু রাগ নয়, আমার ঘেন্না হচ্ছিল। আমি ফ্রান্সে চলে গেলাম।

.

ফ্রান্সের নরমান্ডিতে জীবন শুরু হল আমার। সে অন্যরকম জীবন। আমি মুলাঁ দন্দেতে এলাম বটে, কিন্তু আর যা কিছুই লিখি, চিত্রনাট্য লেখা আমার আর হয়ে ওঠে না। বিশাল এলাকা জুড়ে সুজান লিপনস্কি নামের এক সুন্দরী ফরাসি মহিলা মুলাঁ বা মিল বা কারখানার মালিক। আমাদের দেশে না হলেও ইওরোপের সভ্য দেশগুলোয়পুরোনো বাড়িঘর বা ইতিহাসের মূল্য হীরের চেয়েও বেশি। পুরোনো আমলে জলের ওপর বড় কাঠের চাকা বসানো হত, সেই চাকা জলের স্রোতে ঘুরলে, চাকার সঙ্গে লাগানো কাঠের গুঁড়িতে স্রোতেরশক্তিটা এসে বসতো, সেই শক্তি কাজে লাগিয়ে গম ভাঙিয়ে আটা করতে লোকে। আরও অনেক কাজে ওই শক্তি ব্যবহার করা হত। মেশিন আবিষ্কার হওয়ার পর ওই মিলগুলোপুরোনো দিনের ইতিহাস হয়ে রয়ে গেছে। জলের ওপর সেই চাকাগুলো ছবির মতো স্থির হয়ে আছে। এক একটি মিলই এখন এক একটি জাদুঘর। প্যারিস শহরে মুলাঁ রুজ বলে একটি বিখ্যাত ক্যাবারে আছে। সেই ক্যাবারে বাড়ির মাথার ওপর মাথা উঁচিয়ে আছে লাল চাকা। নরমাণ্ডির মিলটি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন সুজান। কিন্তু এলাকা জুড়ে প্রচুর ঘরবাড়ি উনি নিজের কাজে ব্যবহার না করে, বিক্রি না করে শিল্পীদের বাড়ি বানিয়েছেন। ঘরবাড়িগুলো এখন শিল্পী সাহিত্যিকদের বাসভবন। তিন মাস থেকে শুরু করে এক বা দু বছর এখানে সঙ্গীতশিল্পী, চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, লেখক বাস করবেন। থাকা খাওয়ার জন্য খরচ দিতে হয়, দিতে পারলেই যে তোমাকে নির্বাচন করা হবে তা নয়। অনেকে আবেদন জানায়, কেউ কেউ নির্বাচিত হয়। আমার খরচ পোষাবেদ ভাইজের সিনেমা পরিচালক সংস্থা। আমাকে মুলাঁ দন্দেতে চমৎকার একটা ঘর দেওয়া হয়। ঘরে যা কিছু দরকার লেখালেখির জন্য, সবই দেওয়া হয়। কমপিউটার, প্রিন্টার। টেবিল চেয়ার তো আছেই, বিছানা বালিশ সব। কাজের লোক আছে, অনেকটা হোটেলের মতো। ঘর দোর সাফ করে দিয়ে যায়, বিছানার চাঁদর পাল্টেদিয়ে যায়, স্নানঘরে তোয়ালে দিয়ে যায়। সেইন নদীর পাড়ে বাড়িগুলো। বাড়িগুলোর মাঝখানে বিশাল খাবার ঘর, ওখানে দিনে তিনবেলা সবাই বসে এক সঙ্গে খায়। কড়িকাঠ বসানোপুরোনো বাড়িগুলো দেখতে পর্যটকের ভিড় জমে যায়। লোকে দেখতে আসে মিল। বিখ্যাত ফরাসিপরিচালক ফ্রাসোয়া তুফোর বিখ্যাত ছবি জুলি এণ্ড জিমের সুটিংও এখানে হয়েছিল। ছবিটি মিলে বসেই দেখেছি। মিলে সিনেমা দেখার ঘরও আছে। প্রচুর ভিডিও ক্যাসেট আছে সিনেমার। সিনেমার সঙ্গে জড়িত লোকদের মধ্যে অনেকেই সত্যজিৎ রায়ের কথা জানে। উচ্চারণ করে শেতাজিত রায়। জেনেছি সত্যজিতের জলসাঘর ছবিটা ওদের সবচেয়ে পছন্দের ছবি। আধুনিক একটি অডিটোরিয়াম আছে, ওখানে ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর বসে। নানা দেশ থেকে সঙ্গীত বিশারদরা আসেন। সেইন নদীর পাড়ে গাছগাছালিতে ছাওয়া এইপুরোনো মিলের বাড়িগুলোয় নিশ্চিন্তে নিরাপদে নির্ভাবনায় নিরিবিলিতে শিল্পীরা কাজ করে যাচ্ছেন, আর দেখ এমন সুন্দর জায়গায় বসে আমার লেখা হয় না। আমার শুধু তোমার কথা মনে পড়ে। রাশিয়ার শিল্পী ম্লাদিমির এর সঙ্গে আলাপহল, ও ওখানেইঅনেক বছর ধরেআছে। কেউ কেউ সারাজীবনের জন্য থেকে যায়। মরিস নামের ফরাসি এক লেখক আমি যে দোতলার ঘরে থাকি, তাঁর নিচের তলাতেই থাকেন। ওঁর এটাই বাড়িঘর, এখানেই বাকি জীবন কাটাবেন। যারা এখানে জীবনভর থাকবেন বলেপণ করেছেন, এই শিল্পী-বাড়ির পরিচালনার দায়িত্বও তাদের কিছুনা কিছু দেওয়া হয়েছে। ব্লাদিমিরকে দিয়ে তোমার একটি বড় পোট্রট করিয়েছি মা। তেল রঙের ছবি। পাঁচ হাজার ফ্রাঁ নিয়েছে। তুমি তো আর নেই। তোমাকে সামনে বসিয়ে ছবি আঁকার সৌভাগ্য ম্লাদিমিরের হয়নি। তোমার একটা ছবি দিয়েছিলাম ওকে, সেই ছবিটাই ছিলো শিল্পীর সম্বল। তোমার ছবির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবি, কী সুন্দর ছিলে তুমি। মা, তুমি কি এখন শুধুই ছবি!

মিলে যে শিল্পীরা থাকেন, তাঁরাই যে খাবার খান তা নয়। প্যারিস থেকেও অনেক শিল্পীরা আসেন দুপুর বা রাতের খাবার মিলের শিল্পীদের সবার সঙ্গে বসে খাওয়ার জন্য। এই মিলেই প্রতি খাবারের সময় ফরাসিদের মতো ওয়াইন আর পনির খাওয়া আমার শেখা হয়। ফরাসি খাবারের প্রতি ভালোবাসা এই মিলেই জন্ম নেয়। ফরাসি অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়। আমি ফরাসি দেশে এক জনপ্রিয় লেখক। জনপ্রিয়তাটা টের পাই। আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য ফরাসিরা উন্মুখ হয়ে থাকে। কিন্তু ওদের যেমন ভাষা সমস্যা, আমারও। ওরা শুধু ফরাসি জানে, এদিকে আমি ফরাসির কিছুই জানি না। আমাকে ফরাসি ভাষা শেখানোর গুরু দায়িত্ব মিরিয়াম মর্তু, শিল্পী-বাড়ির পরিচালক, সুজানের সহকর্মী নিজেই নিয়েছে। আমার বেশ সখ্যও গড়ে ওঠে মিরিয়ামের সঙ্গে। এই গড়ে ওঠার পেছনে পরিশ্রম একা মিরিয়ামের। সারাক্ষণ, দিন রাত, সে আমাকে নিয়ে ব্যস্ত। পরিচালকের কাজ, সে কী কম কাজ! কিন্তু কিছুই সে করবে না। আমার অনেকগুলো বই কিনে এনেছে, সেগুলোপড়ছে। বাকিটা সময় আমাকে নিয়ে বেড়াতে বেরোচ্ছে, ফ্রান্সের উত্তরে যে শহর বা গ্রাম আছে, সব দেখাচ্ছে। আর আমার সঙ্গেই তার দিন রাত। আমার মতো সিগারেট ফোঁকে সে। তবে আমার চেয়ে দ্বিগুণ ফোঁকে। এর মধ্যে এই মেয়ে আবার আমার গভীর প্রেমে পড়ে বসে আছে। এদিকে কানাডার এক লেখক পিয়ের লরু, অসাধারণ সুন্দর দেখতে যুবক, তার দিকে চোখ পড়ে আমার। সে যুবকেরও চোখ পড়ে আমার দিকে। দুজন আমরা এক সঙ্গে হাঁটতে বেরোই। ফাঁক পেলেই গল্প করি। মিরিয়ামের কিছুতে সহ্য হয় না এসব। পিয়ের আমার ঘরে একদিন শ্যাম্পেন নিয়ে এলো, আমার জন্মদিন নাকি ওর জন্মদিন পালন করবে, মিরিয়াম এসে পিয়েরকে তাড়ালো। সে কিছুতেই আমার আশে পাশে নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে সহ্য করে না। দিন দিন অবাক হতে থাকি মিরিয়ামের অতিপ্রেমের নির্লজ্জ প্রকাশ দেখে। কিন্তু পিয়ের ছাড়া আর কারও জন্য আমার প্রেমের উদ্রেক হয় না। ইমানুয়েল নামের এক ফরাসি সঙ্গীতরসিক ভদ্রমহিলা আমাকে তার বাড়িতে নেমন্তন্ন করতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। ইমানুয়েলের সঙ্গেও আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। মিরিয়ামের তাও পছন্দ হয় না। কারও সঙ্গে মিশলেই তার সম্পর্কে মিরিয়াম আমাকে মন্দ কথা বলবেই বলবে। এরকম চরিত্র বাংলাদেশে মেলে জানতাম, এমন চরিত্র যে সুসভ্য দেশের ততোধিক সুসভ্য শিক্ষিত শিল্পী-বাড়িতেও মেলে, তা জানতাম না!

শিল্পী-বাড়িতে আমার খেয়ে দেয়ে গল্প করে গান শুনে সিনেমা দেখে আর ঘুরে বেড়িয়েই কাটে। যেখানেই যাই, যে কোনও সুন্দর জায়গায়, মনে হয়, আহ তুমি যদি দেখতে। যা-ই দেখি, মনে মনে তোমার চোখ দিয়ে দেখি। সমুদ্রের পাড়ে গেলাম একদিন। মন হু হু করে উঠলো। তোমাকে চেয়েছিলাম সমুদ্র দেখাতে, নিউইয়র্কে যখন ছিলে, ওয়ারেন অ্যালেন স্মিথকে বলেছিলাম আমার মাকে সমুদ্র দেখাতে চাই। শুনেই একটা গাড়ি যোগাড় করে নিয়ে এলো, প্রায় আশি বছর বয়স, ওই বয়সে নিজেই গাড়ি চালালো। কিন্তু মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে সমুদ্র নামের যে জায়গাটায় নিয়ে এলো, দেখেই আমার মন খারাপ হয়ে গেল। ঘিঞ্জি কনি আইল্যান্ড, বাচ্চারা চেঁচিয়ে খেলছে, রোলার কোস্টার চড়ছে, সমুদ্র অনেক দূরে। ওই সমুদ্রের কিনারে হেঁটে যাওয়াও তোমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। দূর থেকে এক চিলতে সমুদ্র দেখার কী মানে! আসলে ওয়ারেন সমুদ্র বলতে ওই জায়গাটা কেন বেছে নিয়েছিলো কে জানে, তুমি তো আর রোলার কোস্টার চড়বে না। ওয়ারেনের বুদ্ধিতে যা কুলিয়েছে, তাই করেছে সে। খুব বুদ্ধি করে সে আবার একখানা হুইল চেয়ার নিয়ে এসেছিলো, যেন তোমাকে ওই চেয়ারে বসিয়ে আমরা সমুদ্রের পাড়ে নিয়ে যেতে পারি। বালির ওপর দিয়ে ওই চেয়ার চালানো সম্ভব হবে না, তাছাড়া তুমিও চাওনি যেতে। হয়তো বিরক্ত হয়েছিলে হই চইএর বাজার দেখে। আমি ওয়ারেনকেও যে ধমকে বলবো ভুল জায়গায় এনেছো কেন। বলিনি। ওর আন্তরিকতা ছিল, এতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু যেরকম চেয়েছিলাম, একটা উদার একটা উতল, অথৈ জলে যেন জগৎ ডুবে আছে, যেখানে স্নান করতে নেমে সূর্য তার আগুন নিবিয়ে ফেলে সন্ধেবেলা, এমন কিছু দেখাতে। আমার সেই সাধ অতলান্তিকের পাড়ের আমেরিকায় বসেও পূরণ হয়নি। ফ্রান্সের উত্তরে এত্ৰেতেত এর সমুদ্র দেখে তোমার কথা বড় মনে পড়ে। জল দেখতে দেখতে চোখ ভরে ওঠে জলে। চোখের জলের এক একটি কণায় তোমাকে হারানোর কষ্ট। নরমাণ্ডির অনেক জায়গায় চরকির মতো ঘুরি মিরিয়মের সঙ্গে। রুয়োঁয় গিয়ে জোয়ান অব আর্কের সেই গির্জা, যে গির্জার আঙিনায় ওকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, দেখে অবাক দাঁড়িয়ে থাকি। ধর্মের লোকেরা শতাব্দীরপর শতাব্দী এভাবেই মেয়েদের অত্যাচার করেছে, পুড়িয়ে মেরেছে। আজ না হয় এসব দেশে ধর্মের অত্যাচারের অবসান হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে, শুধু আমাদের দেশে নয়, যে দেশগুলোয় মুসলমানের বাস, এখনও ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে। জোয়ান অব আর্ক ছেলেদের পোশাক পরেছিলো বলে ওকে জেলে ভরেছে লোকে। সেদিনও সুদানে এই একবিংশ শতাব্দীতে লুবনা আহমেদ নামের এক মেয়ে ট্রাউজার পরেছিলো বলে ওকে জেল খাটতে হয়েছে। ওকে জোয়ানের মতো পোড়ানো হয়নি, তবে ওকে চাবুক মারার আদেশ দেওয়া হয়েছে।

নরমাণ্ডিতে জিভারনি নামের গ্রামে ফ্রান্সের বিখ্যাত শিল্পী ক্লদমনের বাড়ি দেখতেও ভালো লাগতো, ওটি এখন জাদুঘর, সেসব দৃশ্য এখনও আছে, শুধু ক্লদ মনে নেই, সেই বাগান, সেই লেক, সেই পদ্মপাতা, সেই মাঠ, সেই নদী দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, মানুষ থাকে না, কিন্তু মানুষের কাজ থেকে যায়। আমার লেখা, আমি মরে যাওয়ার পর টিকে থাকবেকী থাকবে না, অনেকে এ নিয়ে জল্পনা কল্পনা করে। এসবে আমার আগ্রহ একেবারেই নেই। বেঁচে থাকলে থাকবে, না থাকলে থাকবেনা। আমি অমরত্বে বিশ্বাস করি না। জীবনে যা দেখবো, জীবনে যা পাবো, তার মূল্যই আমার কাছে বেশি। মৃত্যুর পর কী হবে না হবে, তা নিয়ে আমার ভাবতেও ইচ্ছে করে না। বরং এই পৃথিবীর, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোথায় কী ঘটবে, বিবর্তন মানুষকেই বা কতদূর নেবে, এসব জানতেইচ্ছে করে। অনেকেতৃপ্তি পায় ভেবে তার শিল্প বেঁচে থাকবে হাজার বছর। এইপৃথিবীটাইকদিন বেঁচে থাকে দেখ। পৃথিবীর সবুজ যেহারে বিনাশ করা হচ্ছে, যেভাবে দূষণ ছড়াচ্ছে সবখানে, পাঁচ বিলিয়ন বছর আর অপেক্ষা করতে হবে না সূর্যের আলো ফুরিয়ে যাওয়ার জন্য। তার আগেই পৃথিবী ধ্বংস হবে। পৃথিবীতে এপর্যন্ত যত প্রজাতি জন্মেছে, তার নিরানব্বই ভাগই নিমূল হয়ে গেছে। নিয়ানডারথাল নামে একধরনের মানুষও ছিলোপৃথিবীতেও। আড়াইলক্ষ বছর বেঁচে থেকেওরাও জাতসুদ্ধ নেই হয়ে গেছে। মানুষ বলতে হোমোসাপিয়ানই আছে। এই মানুষই সভ্যতা গড়ে তুলেছে, অন্য সব প্রাণীর চেয়ে বুদ্ধি ধারণ করে বেশি, এই মানুষই মানুষ ভালোবাসে, আবার এই মানুষই মানুষ ধ্বংস করে। তুমি তো আফগানিস্তান বা ইরাকের যুদ্ধ দেখে যাওনি মা। যদি দেখতে, মানুষগুলোর জন্য কাঁদতে, যারা মরেছে, বা যুদ্ধে যারা সব হারিয়েছে। তুমি খুব অবাক হতে যারা দেশে দেশে বোমা ফেলে তাদের নিষ্ঠুরতা দেখে। তুমি তো মাটির মানুষ ছিলে। মানুষের এত নির্মমতা দেখেছো, তবু মানুষের নির্মমতা তোমাকে কাঁদায়। তুমি যেমন শক্ত হতে পারোনি, পাথর হতে পারোনি, আমিও পারিনি।

 ০৭. তিন মাস পর

তিন মাস পর নরমাণ্ডির মুলাঁ দন্দের পাট চুকলো আমার। এবার কোথায় ফিরবো? ভাবতে আমার খারাপ লাগে যেসুইডেনে ফিরতে হবে, আবার দেখতে হবে সুয়েনসনের মুখ। সুইডেনে কোনও বাড়ি ভাড়া নিতেপারি। কিন্তু ওই দেশটার ওপরই ভীষণ একঅভিমান আমার। আসলে সুইডেন নামের দেশটাও আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠেছে। যে দেশে আমার একটিও বন্ধু নেই, শুভাকাঙ্ক্ষী নেই, যে দেশে অসহায় আমাকে সাহায্য করার একটিও প্রাণী নেই, যে দেশের ডাক্তারেরা তোমাকে হত্যা করেছে, সে দেশে কেন থাকবো আমি! ইওরোপে এক ফ্রান্সেই আমার সবচেয়ে বেশি বই ছাপা হয়েছে। ওখানেই মানুষ আমাকে সবচেয়ে বেশি চেনে, শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। ফ্রান্স সুইডেনেরমতো দেশনয়, যেখানে আমাকে ব্যবহার করে বিশ্বে বাহবা জুটিয়ে ব্যস দিব্যি ভুলে গেছে, আমি মরে আছি না বেঁচে আছি, কোনও রাজনীতিকই আর জানতে চায়নি। লেখকগোষ্ঠীর ভেতরে দলাদলি, মারামারি এসব তো আছেই, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই সকলে ব্যস্ত। কেউ যদি লিখে নাম করে, ব্যস আলাদা হয়ে গিয়ে নিজের লেখালেখিতে মন দেয়, আর লিখে নাম না করতে পারলে তো যাতে নাম হবে, বিভিন্ন সমিতি সংগঠনে আঠার মতো লেগে থেকে, তার চেষ্টাই অহর্নিশি করে যায়। এখন আমার কোনও কিছুতে নাম লিখিয়ে নাম করার কিছু নেই। ওসবের রুচি কোনওদিন ছিল না আমার, এখনও নেই। নামের কাঙাল আমি কোনওদিনই ছিলাম না, না চাইতেই নাম বলো, দুর্নাম বলোসর পেয়েছি।

সুয়েনসন একটা কাঠের বা লোহার তৈরি মানুষের মতো। নিজের স্বার্থ ছাড়া একবিন্দু কিছু বোঝে না। কোনও সহমর্মিতা বা সহানুভূতি বলে কিছু নেই কারও জন্য। হীনম্মন্যতা তার সর্বক্ষণিক সঙ্গী। তার সারাক্ষণই সংশয়, তাকে না আবার কেউ কোনওদিক দিয়ে মন্দ বলছে। এধরনের লোকের সঙ্গে এক ছাদের নিচে বাস করা মানে নিজের সর্বনাশ করা, আর কিছুনয়। তাছাড়া সুইডেনের ওই বাড়িতে বাস করা, যেখানে তোমার কষ্টের স্মৃতি আমাকে তাড়া করে, সম্ভব নয়। নরমাণ্ডিতে থাকাকালীনই সিদ্ধান্ত নিই, সুইডেনে থাকার যেহেতু কোনও ইচ্ছে নেই আমার, প্যারিসে থাকবো।

.

ক্রিশ্চান বেসকে বললামপ্যারিসে থাকবো। সুজানকেও বললাম। সুজান বললো প্যারিসে তার বাড়িতে অ্যাপার্টমেন্ট আছে। সেই অ্যাপার্টমেন্ট দেখেও এলাম। মিরিয়ামের প্রচণ্ড উৎসাহ যেন সুজানের বাড়ির ওই অ্যাপার্টমেন্টটি ভাড়া নিই। কিন্তু বাধ সাধলো ক্রিশ্চান। তার ঠিক করা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিতে হবে, তার আবদার। সুজানের অ্যাপার্টমেন্টটি সুন্দর হলেও, কম ভাড়ার হলেও, ভালো এলাকায় হলেও ক্রিশ্চানের অনুরোধে তার কোনও একডাক্তার বান্ধবীর ফেলে রাখা অ্যাপার্টমেন্টটিই ভাড়া নিতে হল। ভাবতে পারো মা, নিজের অত বড় বাড়ি ফেলে ছোট একটা ঘরে বাস করা! সুইডেনে গিয়ে আমার বই পত্র, কাপড় চোপড় সব প্যারিসে নিয়ে চলে আসি। এক দেশ থেকে আরেক দেশে এক বাড়ি জিনিসপত্র আনা খুব সহজ ব্যাপার নয়। খরচ যেমন, খাটনিও তেমন। সব একাই করি। সুয়েনসন তার স্বভাবের বদগুণে আমাকে কোনও সাহায্য করে না। তোমার জন্য টেলিফোন ডাইরেক্টরি খুঁজে ডাক্তার বের করতে না পারলেও মালামাল সরবরাহের আন্তর্জাতিক কোম্পানি খুঁজে বের করি। আসবাবপত্র কিছুআনিনি, আরও অনেক কিছুআনিনি। ওগুলো সুয়েনসনকে দান করে দিই। আসবাব এবং সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নিয়েছিপ্যারিস থেকে। আমার নতুন সংসার শুরু হয় প্যারিসের পনেরো রুদ্য ভুইয়ে ঠিকানায়।

.

আমার রয়্যালটি জমা ছিল ক্রিশ্চানের কাছে। ক্রিশ্চান ধনীর মেয়ে। নিজেই ক্লিনিং কোম্পানির লোক ডেকে আমার রয়্যালটি থেকে পাঁচ হাজার ফ্রাঁ দিয়ে কার্পেট পরিষ্কার করালেন। কল্পনা করতে পারো, কেউ একজন পাঁচ মিনিটে দশ বাই বারো ফুট কার্পেট ভ্যাকুয়াম করে পাঁচ হাজার ফ্রাঁ অর্থাৎ প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা নিয়ে চলে যায়! রয়্যালটির টাকা ওভাবেইনাশ হতে থাকে। অ্যাপার্টমেন্টে নাকি নতুন লাগানো হয়েছে ওভেন, ওই ওভেনের টাকা আমাকে দিতে হবে। প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্টেই রেফ্রিজারেটর, হিটার, ওভেন, ডিশ ওয়াশার বা ওয়াশিং মেশিন এসব লাগানোই থাকে। ভাড়াটেদের কিছু কিনতে হয় না। কিন্তু এমন মন্দ কপালের ভাড়াটে সারা ফ্রান্সেপাওয়া যাবেনা। প্যারিসে থিতুহয়ে বসার পরপরই একদিন রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে পা মচকে গেল আমার। হাসপাতালে সেই পায়ে প্লাস্টার লাগানো, ফিজিওথেরাপি দেওয়া ইত্যাদি কাণ্ডতে আরও গেল টাকা। আমার হেলথ ইনসুরেন্স আছে সুইডেনে, আর তখনও আমার পাসপোর্ট রাষ্ট্রপুঞ্জের বা জাতিসংঘের, যে পাসপোর্ট ফেলে দিয়েছিলাম দেশে যাওয়ার আগে, সেটা ওরা নিজেরাই দেশ থেকে আমি ফেরার পর দিব্যি ফেরত দিয়েছে। এখানে ফ্রান্সে চিকিৎসায় যা খরচ হয়েছে, তা সুইডেনে নিয়ে দেখালে ওরা টাকা ফেরত দেবে, এরকম একটা আভাস পেয়েছিলাম। কিন্তু শেষ অবদি ওসব করাও হয়নি, টাকাও ফেরত পাওয়া হয়নি। টাকা যদি কেউ একবার নেয়, সেটা ফেরত নেওয়ার জন্য চেষ্টা করা কোনওদিন অন্তত আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। ব্যক্তিগত ধারের টাকা ফেরত নেওয়ার চেষ্টা করার তো প্রশ্নই ওঠে না। দেড় দুবছরের পাওনা বেতনই তুলতে পারিনি মেডিকেল কলেজ থেকে। অফিস কাছারিতে টাকার জন্য, এমনকী পাওনা টাকার জন্য দৌড়োতে কোনওদিনই আমার ইচ্ছে করেনি। যা গেছে গেছে ভেবে অন্য কাজে মন দিই। এই টাকা জিনিসটা খুব চমৎকার, আবার খুবই বিচ্ছিরি। এটি আমার তীরে জলের মতো এসেছে, জলের মতো চলেও গেছে। আমার তো আবার খাল কাটায় জুড়ি নেই। খাল কেটে কেটে যথেষ্টই কুমীর এনেছি প্যারিসে থাকাকালীন।

.

ক্রিশ্চান বেস আমার জন্য ফরাসি সংস্কৃতি দপ্তর থেকে একটা চমৎকার স্কলারশিপ জুটিয়ে ফেললেন, দেড় লাখ ফ্রেঞ্চ ফ্রাঁ। প্যারিসের একটা ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে সে টাকা জমা রাখা হল। টাকাটা উড়িয়ে ফেলতে বেশিদিন অবশ্য সময় যায় না। সুইডেনের বড় বাড়ি ফেলেপ্যারিসে ছোট একটা অ্যাপার্টমেন্টে থাকা, তাতে কী! ওখানেই শান্তি পেতাম। আমার যেমন ইচ্ছের জীবনে কেউ বাধা দেওয়ার নেই। এর চেয়ে আনন্দ আর কী আছে মা! যেদিন প্যারিসের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকেছি সেদিনই আমার ইন্টারনেট চাই। ১৯৯৮ সাল। তখনও প্যারিসে লোকের ঘরে ঘরে কম্পিউটার ছিল না। ইন্টারনেটে আমি অভ্যস্ত অনেককাল আগে থেকেই। মোবাইল ফোনও তখন এত হাতে হাতে ছিল না। কিন্তু যে কোনও নতুন প্রযুক্তি শুরু হওয়ার শুরু থেকে তাআমার চাই। বিজ্ঞানের লোকশুধু নই, বিজ্ঞানে অগাধ বিশ্বাস থেকেই প্রযুক্তিরওপর কোনওদিন আস্থা হারাইনি। কমপিউটারকে এত বিশ্বাস করি, সম্ভবত মানুষের চেয়ে বেশি, তাই ব্যাক আপ রাখা বলে যে একটা কথা আছে, ওটাও রাখিনা। সারাদিন মগ্ন হয়ে থাকতাম কমপিউটারেতাস খেলায়। সারারাত আমার সময় সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে উড়ে যেতো। আমি আমি ছিলাম না মা। একসময় শরীর শরীর করে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। হাহাকারকে আর নেবার ক্ষমতা থাকে না মনের, তখন শরীরে সুখ দিয়ে সেই হাহাকারকে আপাতত দাবিয়ে রাখা জরুরি হয়ে ওঠে। হরমোনের হইচই আচমকা বেড়ে যায়, হয়তো শরীরই এভাবে নিজগুণে সামলাতে চায় কষ্টের বানে ভাসিয়ে নিতে থাকা জীবন। তাই মনে হয় আমার। সম্ভবত ভেতরের কষ্টগুলোকে লাঘব করার জন্য, অথবা ভুলে থাকার জন্য আমি নই, আমার শরীরই শরীরের বর্ম ভেঙে বেরিয়ে আসে। হঠাৎ খুব পুরুষের জন্য শরীর কাতর হতে শুরু করলো। ব্যস্ত থাকতাম নেটের চ্যাট সাইটগুলোয়। অচেনা কারুর সঙ্গে বিছানায় যেতে চাওয়ায় আমার একটুও দ্বিধা হত না, ঘেন্না হত না। এরকম আগে কখনও দেখিনি। তোমার অসুখের পর থেকেই আমার ভেতরের সুশৃঙ্খল সুসভ্য মানুষটি যেন নীতি দুমড়ে রীতি ভেঙে বেরিয়ে গেল। আমিই, অবাক হয়ে দেখলাম, ক্রমশ নয়, আকস্মিকভাবে আমার অবাধ্য হয়ে উঠলাম আমি। আমারই অচেনা আমি। ভেতরের হাহাকার আর বিশাল এক শূন্যতাপূরণ করার জন্যই সম্ভবত এই তীব্র যৌনকাতরতা হাঁমুখ করে বসে থাকে। তোমাকে নিয়ে যে আমার প্রচণ্ড অপরাধবোধ ছিল, ব্যথা বেদনা ক্ৰোধ কান্না ছিল, তা থেকে মুক্তি পেতেই কি এই করি? নিজের বিরুদ্ধে নিজেই প্রতিশোধ নিই! কিন্তু নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্তকি ওভাবে করা যায়! আমার বোধহয় আর কোনও উপায় ছিল না। নিজের ভেতরটা ভেঙে গেলে বোধহয় নিজের বাহিরটাও ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে হয়। অথবা আপনাতেই সব ভেঙে পড়ে। নিজেকে প্রবোধ দেওয়ার কোনও শক্তি আমার মধ্যে ছিল না।

কিন্তু চিন্তাশক্তি লোপ পেয়ে যাওয়া, শরীরে উত্তপ্ত হতে থাকা, মন পাথরের মতো শীতল হয়ে ওঠা এ সবই সাময়িক। ভোগবাদী দেশে বাস করলেও ভোগে আমার রুচি হয় না অল্প কিছুদিন পরই। ভেতরের সভ্য সুন্দর মানুষটি আমাকে একটা সময়ে আমারই সামনে এসে অনড় দাঁড়ায়। খুব বেশি উজ্জ্বল হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনা। আমার যখন চূড়ান্ত ডিপ্রেশন চলছে, প্যারিসে অনেকে আসতো আমার সঙ্গে দেখা করতে, অবশ্য সেপ্যারিস বলেই আসতো। শহর দেখানোর দায়িত্ব ছিল আমার। ম্যাট চেরি এসেছিলো। ম্যাট আমার একটি ইংরেজ বন্ধু, মানববাদী, হিউম্যানিস্ট এণ্ড এথিক্যাল ইউনিয়নের কর্মকর্তা। আমাকে এই সংগঠন শ্রেষ্ঠ মানববাদী হিসেবে পুরস্কারও দিয়েছে। ম্যাট তার ম্যানচেস্টারের বাড়ি ছেড়ে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছে, ওখানে সেন্টার ফর ইনকোয়ারিতে চাকরি করে। সেই আমেরিকার বাফেলো থেকে চলে এলো আমার সঙ্গে দেখা করতে। দুজনে মানববাদ নিয়ে, নাস্তিকতা নিয়ে সিরিয়াস সিরিয়াস কথা বলি। কিন্তু কোথায় থাকতে দিই বলল, একটি মাত্র ঘর। ভেতরের অতিথিপরায়ণ বাঙালি জেগে ওঠে। অতিথি নারায়ণতুল্য। অতিথিকে তাই বিছানা দিয়ে নিজে আমি মেঝেয় বিছানা করে শুই। কিন্তু দুরাত ওভাবে কাটাবারপর চেনা একজন ফরাসিমানববাদীর বাড়িতে ম্যাটকে রেখে এলাম, আমার পক্ষে ওভাবে কষ্ট করে ঘুমোনো সম্ভবনয়। সম্ভব হত, যদি ম্যাট কোনও সমবেদনা দেখাতো, যদি নিজেই বলত, তুমি বিছানায় শোও, আমি মাটিতে শুই বা কোনও হোটেলে চলে যাই। অথবা আমরা দুজনেই শুতে পারতাম বিছানায়। জানিনা ম্যাটের ওভাবে আমার কাছে আমেরিকা থেকে প্যারিস চলে আসার কারণ কী ছিল! একটি ঘর জেনেও তার কেন ইচ্ছে হয়েছিল, আমার সঙ্গে ওই একটি ঘরেই থাকার! ম্যাটের কি গোপনে প্রেম করার ইচ্ছে ছিল আমার সঙ্গে! ম্যাট দেখতে এমন কোনও সুদর্শন নয় যে ম্যাটের প্রেমে আমি পড়তে পিরবো। গুণে জ্ঞানে ম্যাট টইটম্বুর তাঠিক, কিন্তু দেখতে ভালো না হলে আমার পক্ষে প্রেম করা সম্ভব হয় না। যদি জনমনুষ্যিবিহীন কোনও মরুভূমিতে বাস করতে বাধ্য হতাম, তাহলেই হয়তো প্রেম করতে বাধ্য হতাম। শখের প্রেম চারদিকের সুন্দরের ভিড়ে কোনও এক অসুন্দরের সঙ্গে হয় না। ঢাকার প্রকাশক মেজবাহউদ্দিন এসেছিলেন প্যারিসে, উনি মেঝেয়বিছানা পেতে ঘুমিয়েছেন। আমি ভুলেও তাকে বলিনি বিছানায় শুতে। বাড়তি লেপ ছিল না, বড় জোর তার জন্য একটি লেপ কিনে দিয়েছি। অতিথিকে খাওয়াচ্ছি দাওয়াচ্ছি, নিজের পয়সায় প্যারিস দেখাচ্ছি, আর রাতে ঘরে ফিরে কিনা মাটিতে শোবো! এত ত্যাগ পোষায় না। তাছাড়া আরও একটা কারণে আমি ত্যাগ করিনা, কারণ মেয়েরাই পুরুষের জন্য নিজের আরাম আয়েশত্যাগ করবে, এটাই যেন জগতের নিয়ম। এই নিয়মকে আমি ভাঙি। অতিথিকে আপ্যায়ন করি, সাধ্যের বাইরেও তাদের জন্য করি, তাদের প্রাণের আরাম দিই। কিন্তু অতিথিকে নারায়ণ জ্ঞান করার ইচ্ছে আমার নেই। অতিথিকেনারায়ণের আরাম দেওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখি। কে আমার জন্য করে বলো! মেজবাহ আমার বই যে ছাপাচ্ছেন, কোনও রয়্যালটি দেওয়ার নামগন্ধ নেই। সব সমর্থন কেবল কথায়, কাজে নয়। মেজবাহ বলেন আমার বই নাকি এখন বাংলাদেশে মোটেও চলে না। আমার অবাক লাগে ভাবতে, একসময় পাগলের মতো লোকে বই কিনতো, পড়তো। আর যেই না দেশ থেকে দূর করে দিল সরকার, অমনি পাঠক মুখ ঘুরিয়ে নিল, বই পড়া বন্ধ করে দিলে! মৌলবাদীরা যখন বিরুদ্ধে ছিল, পাঠক তো আমার বইপড়া থেকে বিরত থাকেনি। সরকার আমার বিরুদ্ধে গেলে বইপড়া বন্ধ করে দেবার কারণ কী! এসবের কোনও উত্তর মেজবাহউদ্দিনের জানা নেই। শুধু পাঠক নয়, পত্রিকার সম্পাদকরাও শত্রু হয়ে যায়। যখনই সরকার আমাকে পিষে মারতে শুরু করলো বা দেশ থেকে তাড়িয়ে দিল, সব কাগজেই একযোগে আমার লেখা ছাপানো বন্ধ হয়ে গেল। কলকাতা থেকে শিবনারায়ণ রায় বেড়াতে এসেছিলেন। তাঁকে হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। যত জাদুঘর আছে, সব দেখিয়েছি। সুইডেন থেকে সুয়েনসন এসেছিল, তাকেও শহর দেখিয়েছি। এত কাল বিদেশে আমি অর্ধেক-তুমি অর্ধেক সংস্কৃতি দেখেও আমার শেখা হয়নি। আমিই একা ঢেলে দিই। ফরাসি বন্ধুরাও জানে বন্ধুদের নিয়ে রেস্তোরাঁয় বা ক্যাফেতে খেলে আমি একাই বিল মেটাই। গুনে গুনে নিজের পয়সা বের করে নিজের ভাগটুকু আলাদা করে দেওয়া আমার একেবারে পছন্দ হয় না। আমি একদিন খাওয়ালাম সবাইকে। পরের বার নিশ্চয়ই আমাকে সবাই খাওয়াবে। খাওয়ালাম বলে ধন্যবাদ বলে গালে চুমু খেয়ে খেয়ে সবাই চলে যায়। কিন্তু তারপর আবার যখন রেস্তোরাঁয় গেলাম, যাদের খাইয়েছিলাম, তারা যার যার পয়সা মেটায়, আমারটা আমাকেই মেটাতে হয়। কত হাবিজাবি লোককে যে খাইয়েছি মা, কী বলবো। এসব তোমার চরিত্র থেকে পাওয়া। টাকা ফুরিয়ে তলানিতে এসে গেলেও এই স্বভাব আমার যায় না। চেষ্টা করেছি, এবার থেকে নিজেকে আর বোকা বনতে দেব না। পণ করি বটে, কিন্তু রক্তে যদি স্বভাবটা থাকে, কী করে বদলাবো বলো। আসলে কী জানো মা, যারা আমার জন্য ত্যাগ করে, তাদের বেশির ভাগের জন্য আমার কিছু করা হয় না। দেখেছি, যাদের জন্য করি, তাদের জন্য শুধু করেই যাই ত্যাগ। তারা কোনওদিন বিন্দুমাত্র ত্যাগ তো করেইনি, বরং ফাঁক ফোকর পেলেই ঠকিয়েছে। বন্ধু ভাগ্য আমার খুব ভালো নয়। আমি লক্ষ করেছি, যারা আমার বন্ধু হয়, তারা আমাকে বন্ধু হিসেবে নির্বাচন করে। এখানেই ভুলটি আমি করি। আসলে তার সঙ্গেই আমার মেশা উচিত, যাকে আমার ভালো লাগে। প্রেমিক বলো, বন্ধু বলো কাউকেই আমি নির্বাচন করি না। এ কি কোনও কমপ্লেক্স থেকে, কে জানে? সুপিরিওরিটি অথবা ইনফিরিওরিটি। কিছু একটা হবে। আমার অনেক সময় মনে হয় আত্মবিশ্বাস কম থাকার কারণে যাকে আমার পছন্দ, তার কাছে আমার যাওয়া হয় না। আমাকে যদি তার পছন্দ না হয়, আমাকে যদি সে ভালো না বাসে এই অনিশ্চয়তা থেকেই। অপমানিত হওয়ার ঝুঁকি আমি নিতে চাই না। তার চেয়ে যারা আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করার জন্য উন্মাদ হয়ে ওঠে, দিনরাত যারা জপ করে নাম, লেগে থাকে জোঁকের মতো, তাদের সঙ্গেই ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব হয়। উন্মাদের দলে সত্যিকারের উন্মাদও বেশ কিছু জুটে যায়।

.

আর প্রেমের জন্য যেরকম পুরুষ আমার পছন্দ, সেরকম পুরুষ কি চাইলেই আমি পেতে পারি। অনেকেপায়। আমার পাওয়া হয়নি কোনওদিন। তুমি তো সারাজীবন পাওনি। বাবাকেইপাওনি। আর কাউকে তো পেতে চাওনি। বাবাকেই এক চেয়েছিলে। আর বাবা, তোমাকে ছাড়া পৃথিবীর সব মেয়েকেই চেয়েছিল। কতটা পেয়েছে কী পেয়েছে কে জানে, যাদের পেয়েছিল, তারা কি কেউ তোমার চেয়ে ভালো ছিল! তোমার প্রতি জানি না কী কারণে বাবার অনাসক্তি ছিল। একটা ভালোবাসাহীন সংসারে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত থেকে গেলে। তোমার মতো জীবন আমি যাপন করিনি। ভালোবাসাহীন কোনও সংসারে আমি থাকিনি। তার চেয়ে বরং একা থাকাটাকেই মেনেছি। এর মতো স্বস্তির কিছু আর নেই। কোনও পুরুষের সঙ্গে বাস করা কোনও সচেতন মেয়ের পক্ষে সম্ভব নয়, সে পুরুষ যদিনা মনে প্রাণে নারীর স্বাধীনতা একশ ভাগবিশ্বাস করে, এবং সেই বিশ্বাসকে নিজের জীবনে প্রমাণ না করে। কিন্তু খুব বেশি পুরুষের মধ্যে এই গুণটি আমি দেখিনি। অনেককাল আগে যেসব দেশে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত, সেসব দেশের অনেক পুরুষের মধ্যে এই গুণটি আছে, কিন্তু মনের মতো বিদেশি কোনও পুরুষ পাওয়া একটি দেশি মেয়ের পক্ষে খুব কি সম্ভব! প্রথম কথা, আমি তো খুঁজতে বসিনি কোনওদিন। ওসব আমার স্বভাবের বাইরে। স্বভাবের বাইরে বেরোনো আমার পক্ষে কোনওকালেই সম্ভব নয়। বিশেষ করে যে স্বভাবগুলো ভেতরে পুঁতে দেওয়া। এই স্বভাব বোধহয় তোমার কাছ থেকে পেয়েছিমা। তুমিও কোনও পুরুষের দিকে ফিরে তাকাতে না। যদিও বোরখার আড়ালে জীবনের প্রায় সবটা সময়ই কাটিয়ে দিয়েছে, কিন্তু আড়াল থেকে কাউকে হয়তো দেখেছো, কিন্তু তোমাকে তো দেখেনি কেউ। ’তোমাকে ভালোবাসি’ এই কথাটা তুমি কোনওদিন কারও কাছ থেকে শোনোনি। ভাবলে আমার খুব কান্না পায়। বাবা তো বলেইনি তোমাকে কোনওদিন। জানিনা কোনওদিন আমাণুদ্দৌলা বলেছিলো কিনা। আমার কেন যেন মনে হয়, বলেনি। আমাণুদ্দৌলার বিয়ে করার রোগছিলো। একইসঙ্গে কয়েকটা শহরে কয়েকটা বউ রাখতো। যেখানে বিয়ে করার সম্ভাবনা আছে, সেখানেই ভিড়তো। তোমার কাছে ভিড়তে চেয়েছিলো, সে তো বিয়ের জন্য নয় নিশ্চয়ই। আহ, জীবনে যদি তুমি কোনও সৎ পুরুষের দেখা পেতে মা! যদি জানতে, কেউ তোমাকে ভালোবাসে! ভালোবাসি শব্দটা আমি অনেক শুনেছিমা, আমার কোনও অতৃপ্তি নেই। তোমার শরীরটাকেও তুমি তৃপ্ত করতে পারোনি। চারটে সন্তান জন্মেছে বটে তোমার। সে খুব। সুখের মিলনে জন্মেছে বলে আমার মনে হয় না। জন্মানোর দরকার ছিল বলেই হয়তো জন্মেছে। সমাজের বাধা তো আছেই, মনের বাধাও কি কম? আমি সমাজের আর মনের সব বাধাই ডিঙিয়েছি। কিন্তু তারপরও কোথায় যেন হেরে যাই। জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে দেখি, আমি হয় নোবডি নয় সেলিব্রিটি। নোবড়ি আর সেলিব্রিটির প্রেমে সাধারণত কেউ পড়ে না। নোবডিকে লোকে তুচ্ছ করে, আর সেলিব্রিটির কাছ ঘেঁষতে দ্বিধা করে, ভেবেই নেয় যে ও নিশ্চয়ই যে কারও প্রেমে পড়বে না। যত মনের জোর আর সাহস থাকুক না কেন আমার, লক্ষ করেছি, কোনও পুরুষকে আগ বাড়িয়ে আমি বলতে পারি না, না দেশে না বিদেশে, তোমাকে ভালো লাগে বা এধরনের কিছু। জগতে বোধহয় আর কোনও আধুনিক মেয়ে নেই, যে কিনা এত দীর্ঘদীর্ঘদিন যৌনগন্ধহীন সন্ন্যাস জীবন কাটায়। আমাদের বোধহয় সমস্যা একইরকম ছিলো, সত্যিকার প্রেম আমরা পাইনি। পাইনি বলে যেন তেন কাউকে মেনে নিতেও পারিনি। এ নিয়ে তুমি কি আফশোস করো নীরবে, নিভৃতে? আমি করি। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার এই জীবন যদি আবার শুরু থেকে পেতাম, অন্য রকম করে যাপন করতাম। আসলে অনেকেরই এই ইচ্ছেটা হয়, শুধু আমার নয়। সংবেদনশীল মানুষ হলে অতৃপ্তিটা মৃত্যু অবধি থাকে।

.

ফরাসি একটি ছেলের সঙ্গে আমার সম্পর্কহয়। সম্পর্কটা শুরু হয় শরীরের আকর্ষণের কারণে, একে প্রেম জানি না বলা যায় কি না। ছেলেটা সুন্দর দেখতে। সুদর্শন সুপুরুষ বলতে ঠিক যা বোঝায়, তা। বয়সে আমার চেয়ে ছ বছরের ছোট। একসময় ভাবতাম বয়সে ছোটর সঙ্গে বুঝি প্রেম হতে পারে না। ভাবতাম বাংলায় কথা যে না বলতে পারে, তার সঙ্গে কখনও প্রেম হতে পারে না। সম্পূর্ণ ভুল। যে কোনও ভাষাতেই প্রেম সম্ভব। ছেলেটা ইংরেজি জানে। ইংরেজিতেই কথা হয় আমার সঙ্গে। ফরাসি ভাষা যেটুকু শিখেছি তাতে বেশিক্ষণ কথা চালানো যায় না। যখন ফরাসিতে তার প্রেমের কথা শোনাতে থাকে, খুব ভালো লাগে শুনতে। ফরাসি ভাষা, অনেকে বলে, প্রেমের জন্য চমৎকার ভাষা। ছেলেটা সত্যি বলতে কী, মা, আমাকে শরীরের প্রেম শিখিয়েছে। কত যে অশিক্ষিত ছিলাম শরীরের ব্যাপারে। নিজের শরীর, অথচ এই শরীরই কত অচেনা ছিল আমার। ছেলেটা আমার প্রেম পাবার জন্য দিন দিন অস্থির হয়ে ওঠে। ছেলের বউ বাচ্চা আছে, কিন্তু বউএর সঙ্গে নাকি শারীরিক সম্পর্ক নেই। এসব আমি বিশ্বাস করি না। কারণ সব বিবাহিত পুরুষই অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করতে গেলে এসব কথা বলে। আমার কোনও অসুবিধে নেই সে ছেলে আর কারও সঙ্গে শুলে। আমি আমার একলা জীবনে মাঝে মাঝে যদি শরীরের তৃষ্ণা মেটাতে কোনও এক চমৎকার সুপুরুষকে পাই, যে আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসছে বলছে, কেন নয়, বলো? ছেলে দূরের একটা শহর থেকে প্রায়ই চলে আসতো, দু টো তিনটে দিন আমার সঙ্গে কাটিয়ে যেত। বিমানবাহিনীর পাইলট। আমিই প্যারিস শহরে তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। মেট্রো সবাই চড়ছে। আমার আবার পাতালে যেতে ইচ্ছে করে না। ট্যাক্সিতে সব জায়গায় যাওয়া চাই আমার। টাকা পয়সার প্রতি কোনও আকর্ষণ নেই বলেই হয়তো ওভাবে খরচ করতাম। ছেলেটা আমার কাণ্ড অবাক হয়ে দেখতে।

দেশ থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর ছ বছর ভারতীয় দূতাবাসের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও ভারত যাওয়ার অনুমতি পাইনি। বাংলাদেশ তো আমাকে ঢুকতেই দেয় না দেশে, ভারতে যেতে চাইছি কতকাল, সেইভারতও আমাকে ভারতে ঢোকার অনুমতি দিচ্ছেনা। শেষঅবধি নিরানব্বইএর শেষ দিকে আমাকে ভারতের ভিসা দেওয়া হয়। কী যে আনন্দ হয়েছিলো তখন। অন্তত দেশে না হোক, দেশের কাছাকাছি কোনও দেশে তো পৌঁছোতে পারবো। কলকাতা তো শুধুই আর পাশের দেশের কোনওশহরনয়! কলকাতার কত মানুষই তো আমার বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী। অনেকে বলে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে বলেই ভিসা পেয়েছি। কোন দল সরকারে এলো, সে নিয়ে আমার ভাবনা নেই, আমার ভারত যাওয়া নিয়ে কথা। বিজেপি যদিছ বছরের নিষেধাজ্ঞা ঘোচায়, তবে বিজেপিকে ধন্যবাদ জানানোর কোনও কারণ নেই। আমার ভারত যাওয়া মানে, কলকাতায় যাওয়া। কলকাতায় যাবো, খুশিতে নাচছি আমি। ফরাসি প্রেমিক, লরোঁ নাম, বললো, সেও যেতে চায় সঙ্গে। আমার আপত্তি নেই। খুশিতে সেও নাচলো। কিন্তু নিজের টিকিট করার সময় ছেলে বললো তার টাকা নেই টিকিটের পেছনে খরচ করার! বলে কী! ফরাসি যুবক, বিমান বাহিনীতে পাইলটের কাজ করেছে, ওদিকে আবার তুলুজ নামের শহরের নামকরা কলেজে বৈমানিক প্রকৌশল বিদ্যা শিখছে, তার টাকা নেই? অবাক হলাম বটে, কিন্তু আমিই টিকিট করলাম দুজনের। এয়ার ফ্রান্সে বোম্বে হয়ে কলকাতা। আমি ছাড়া কে করবে এসব! আমার মতো আবেগ সর্বস্ব বুদ্ধিহীন মেয়েমানুষ ছাড়া! ওই তোমার মতোই। আমি ঠিক জানি, তুমি আমার জায়গায় হলে তাই করতে। ইয়াসমিনও করতো। আমরা এই তিনজন হয়তো আঘাত পাওয়ার জন্যই জন্মেছি। ছেলেকে বিশাল সম্মান জানিয়ে সবখানে আমার সঙ্গে রাখলাম। এমনকী জ্যোতি বসুর সঙ্গে যখন দেখা করলাম, যে ঘরে অন্য কারও ঢোকা নিষেধ ছিল, ফরাসিকে ঢোকালাম। ফরাসি মনের আনন্দে সব নেমন্তন্ন, সব সংবর্ধনা, সব আনন্দ, সব সুখ উপভোগ করলো। প্রচুর উপঢৌকনও পেয়েছিল শুধু আমার প্রেমিক হওয়ার কারণে।

শুধু ফরাসি যুবক নয়, ফরাসি ওয়াইন নিয়েও গিয়েছিলাম। তাজ বেঙ্গলে একটা সুইট ভাড়া নিয়েছিলাম। দিনে বারো হাজার টাকাই যার ভাড়া। আসলে কী জানো, প্রাণের টানে যে জায়গায় এসেছি, সেখানে আর যা কিছুরই হিসেব করি, টাকার করি না। আমি সবসময় বলি, আমাকে বলো লক্ষ টাকা দান করতে, করবো। কোনও আপত্তি নেই আমার। কিন্তু আমাকে ঠকিয়ে যদি দুপয়সা নিতে চাও, আমি মানবো না। বলি বটে, কিন্তু তাও মেনে নিতে বাধ্য হতে হয়। প্রথম রাতেই আমার হোটেলের ঘরে কলকাতার পুরোনো চার বন্ধু এসেছিল ওয়াইন খেতে। অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা হল, খাওয়া হল। ফ্রান্স থেকে আনা ওয়াইন শেষ হয়ে গেলে হোটেলের রিসিপশানে ফোন করে ফরাসি ওয়াইন থাকলে দিতে বলি। লোক এসে দুবোতল ওয়াইন খুলে দিয়ে যায়। পরদিন সকালে ওই ওয়াইনের বিল দেখালো এক লক্ষ টাকারও বেশি। অত দামি ওয়াইন দিতে গেলে তার দামটা তো আগে বলে নেবে! আমার প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই। বলেছিলাম, যেন দাম কমিয়ে রাখে। রাখেনি। ওই টাকা আমাকে একাই দিতে হয়েছে। ওয়াইন খেয়ে অনেক রাতে যখন বন্ধুরা চলে যাচ্ছে, আমার দ্বিগুণ বয়সী একজন বিদায় আলিঙ্গন করার নামে অযথাই আমার স্তন টিপে গেল। কী সুখ পেলো কে জানে। আমি হতবাক দাঁড়িয়ে রইলাম। এসবেপুরুষের কোনও লজ্জা হয় না, লজ্জা আমার হয়। আমার শুধু লজ্জা হয় না, রাগও হয়। কিন্তু আমি জানি, সব মানুষ এক রকম নয়। ভালো লোক মন্দ লোক সব দেশেই আছে। তবে জানো তো, মন্দ লোক আমি সহজে চিনতেপারি না। স্বভাব-গুণে অথবা দোষে সবাইকে ভালো লোক বলেই ভাবি। যখন মুখোশ খুলে পড়ে ওদের, বিস্মিত হই, দুঃখ পাই। ছোট একটা কবিতা লিখেছিলাম সেদিনের সেই বিস্মিত বিষাদনিয়ে।

রাস্তার ছেলে আর কবি।
এ গল্প আগেই করেছি, ওই যে ছোটবেলায় একদিন নদীর ধারে হাঁটছিলাম
আর ধাঁ করে উড়ে এসে এক রাস্তার ছেলে আমার স্তন টিপে
দৌড়ে পালিয়ে গেল, অপমানে নীল হয়ে বাড়ি ফিরে সারারাত কেঁদেছিলাম।

এ গল্প এখনও করিনি যে বড় হয়ে, কবিতা লিখতে শুরু করে
কবিদের আড্ডায় যেই না বসি,
হাতির মতো কবিরা স্তন টিপে দিয়ে চলে যায়।
পরদিন দেখা হলে বলে, কাল খুব মদ পড়েছিল পেটে।
মদের দোহাই দিয়ে কবিরা বাঁচে,
কবিতার দোহাই দিয়েও পার পায় বটে।

মন খারাপ হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে তা ঠিক, কিন্তু মন ভালো হওয়ারও অনেক কিছু ঘটেছে। শান্তিনিকেতনেকণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে, যার গান শুনে আমার কৈশোর আর আমার যৌবন কেটেছে, যার গান আমাকে বিদেশ বিভুইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে, দেখা হল। মুগ্ধতা আমাকে নির্বাক করে রেখেছিলো। উনি গান শোনালেন। গান শুনে কী জানি কী কারণে আমার চোখ ভরে ওঠে জলে। আড়াল করি চোখের জল। আসলে কী জানো মা, তোমার বয়সি কেউ যদি আমাকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসে, আমাকে স্নেহ করে, আদর করে কথা বলে, চোখের জল রোধ করতে পারি না। সাংবাদিকদের ভয়াবহ ভিড়। কী বলবোমা, লেখক তো নই, যেন বোম্বে থেকে সিনেমার স্টার এসেছি। আমার এত আলো, এত সাংবাদিক, এত প্রশ্ন ভালো লাগে না। বার বার ওদের বলেছি, ক্যামেরা দূরে সরাতে। বারবার বলেছি সাক্ষাৎকার দেব না। কে শোনে আমার কথা। বুঝি ওরা ভালোবাসে। ভালোবাসার মূল্য আমি না দিয়ে পারি না। এই একটি ব্যাপারে আমি খুব বোকা হয়ে পড়ি। শুধু তোমার ভালোবাসারই মূল্য দিইনি, জানি।

.

কত কিছু যে ঘটে কলকাতায়। অন্নদাশংকর রায়, শিবনারায়ণ রায়, অম্লান দত্তের মতো বড় মনীষীরা আমাকে স্নেহ করছেন, ভালোবাসছেন, তাঁরা আমার লেখাকে, লেখার জন্য আমার নির্বাসনকে ঐতিহাসিক বলে মত দিচ্ছেন। নিজের সম্পর্কে এত বড় ধারণা আমার নিজেরই কোনওদিন ছিল না, বা নেই। কিন্তু বড় মানুষদের ঔদার্য দেখে ভালোও লাগে, কুণ্ঠিতও হই। নিজে আমি সাধারণ এক মানুষ। সাধারণের মধ্যে থেকেই আমি স্বস্তি বোধ করি। অসাধারণ মানুষের ভিড়ে আমি বুঝি যে আমি নিতান্তই ক্ষুদ্র তুচ্ছতৃণ। তারপরও বড় বড় মানুষেরা আমাকে ভালোবাসা বা প্রশ্রয় দিতে মোটেও কার্পণ্য করেন না। নিখিল সরকার বটবৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁর মহানুভবতার তুলনা হয় না। তিনি আমাকে পরমাত্মীয়র মতো কাছে টেনে নিজের দেশ, নিজের বাড়িঘর, নিজের আত্মীয় স্বজন সব হারিয়েছি বটে, কলকাতা আমাকে সব ফিরিয়ে দেয় কদিনেই।

আমি অবাক হয়ে লক্ষ করি, আমাকে এক পলক দেখার জন্য, আমার অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য, আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য কলকাতায় শুভাকাঙ্ক্ষীর ভিড়। সেই যে চুরানব্বই সালের মে মাসে প্যারিস হয়ে ঢাকা ফেরার পথে কলকাতায় গিয়েছিলাম, তার পর এই প্রথম আমি কলকাতায়। কলকাতা আমাকে বুকে টেনে নিল ভালোবেসে। অথচ পাশেই নিজের দেশ। যে দেশে আমাকে মানুষ ঘৃণা করে, অথচ বাঙালি ওরাও, বাঙালি এরাও। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ভালোবাসা পেয়ে আমার দীর্ঘ নির্বাসনের কষ্ট অনেকটাই মোচন হয়। যারা ভালোবাসে, তাদেরই আমার স্বজন, আমার আত্মীয় বলে মনে হয়। এদিকে ফরাসিটা চারদিকে আমার জনপ্রিয়তা দেখে কই খুশি হবে না তো কালকেউটের মতো ফণা তুলছে। এক রাতে, সারাদিনের হৈ চৈ এর পর পরদিন আমার অনুষ্ঠান, অনেকদিন বাংলা না বলে না পড়ে অনেকটা ভুলে যাওয়ার মতো অবস্থা, তারপর কী পড়বো, কোন কবিতা, কী বলবো নতুন বই নিয়ে, কিছুই ঠিক নেই, একবার দেখে নিতে চাইছি, মনোযোগ লেখায়, পড়ায়। না, লরে আমাকে কিছুইপড়তে দেবে না, লিখতে দেবে না, ভাবতে দেবে না। তাকে সময় দিতে হবে, তার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে, তার সঙ্গে গল্প করতে হবে, তার সঙ্গে প্রেম করতে হবে, তার শরীরে সাঁতার কাটতে হবে। আমি সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই আপদকে জীবন থেকে সরাতে হবে। যে প্রেমে শ্রদ্ধা থাকে না, সে প্রেমকে আমি প্রেম বলি না। এত স্বার্থপর, হিংসুক, হীনম্মন্য লোককে নিয়ে চলাফেরা করার কী প্রয়োজন আমার! শরীরে সুখ হয় তা ঠিক। কিন্তু অন্যের ইচ্ছের খাঁচায় বন্দি হয়ে সে সুখ নেওয়ার কোনও শখ নেই আমার। ফরাসির জায়গায় কোনও বাঙালি পুরুষহলেও সম্ভবত একইভাবেঈর্ষা করতো। পুরুষের ঈর্ষা যে কী ভয়ংকর, তা আমি হাড়ে মজ্জায় টের পেয়েছি। জীবনে যে কজন পুরুষের সঙ্গে আমি সম্পর্ক গড়েছি, ওই একটি কারণেই মূলত সে সম্পর্ক ভেঙেছে, ঈর্ষা। লোকে বলে, মেয়েরা নাকি ঈর্ষাকাতর। পুরুষের তুলনায় মেয়েরা সামান্যও তা নয়। দেশে দেশে যত অপরাধ ঘটছে, তার সিংহ ভাগপুরুষের ঈর্ষার কারণে। মেয়েদের শরীরে অ্যাসিড ছুঁড়ছে, মেয়েদের গুলি করে, কুপিয়ে, পিটিয়ে, গলা টিপে হত্যা করছে পুরুষেরা। ঈর্ষায়। কটা পুরুষকে মেয়েদের ঈর্ষার কারণে জীবন দিতে হয়, কটা পুরুষের সর্বনাশ মেয়েরা করেছে, বলো?

.

এতদিন পর কলকাতায় এলাম, যেন দেশে ফিরলাম, যেন বাড়ি ফিরলাম। মা তুমি কখনও দেখনি মানুষ আমাকে ভালোবাসে। জীবনভর তুমি দেখেছো মানুষ আমাকে ঘৃণা করে, কাগজে কাগজে আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটায়, আমাকে অতর্কিতে আক্রমণ করে মেলায়, আমার বিরুদ্ধে মিছিল করে শহরে, আমাকে মেরে ফেলতে চায়, মাথার দাম ঘোষণা করে। কলকাতায় মানুষের ভালোবাসা দেখে আমার খুব তোমার কথা মনে পড়ছিল। আরও অনেক দেশে যখনই মানুষের ভালোবাসা, মানুষের উচ্ছ্বাস, আর আবেগ দেখেছি, শুধু তোমার কথা মনে পড়েছে, মনে মনে বলেছি, দেখ মা, তোমার মেয়েকে কত মানুষ ভালোবাসে। দেখতে কি পেতে কিছু! আমার কেন যেন বিশ্বাস করতে ভালো লাগতো, হয়তো দেখছো, যে কোনও কোথাও থেকে হয়তো দেখছো, দেখে হয়তো তোমার মনে আনন্দ হচ্ছে, হয়তো তোমার চোখে জল চলে আসছে। শিশির মঞ্চে আবৃত্তিলোক আমাকে সংবর্ধনা দিয়েছিলো। একা আমারই কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান ছিল। আমার এক পাশে বসেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আরেক পাশে শঙ্খ ঘোষ। একসময় যখন আমার ‘মায়ের গল্প’ নামের কবিতাটা পড়তে শুরু করলাম, কণ্ঠ বুজে এল, কিছুতেই পারছিলাম না পড়ে যেতে। সুনীল সান্ত্বনার একটি হাত রাখলেন পিঠে। কোনও সান্ত্বনা আমার দুঃখ দূর করতে পারেনা, মা। কোনও সান্ত্বনা আমার গ্লানি থেকে আমাকে মুক্ত করতে পারে না। তুমি যদি জীবনে সুখে থাকতে একটুখানি, আনন্দে থাকতে, তুমি যদি সামান্য ভালোবাসা পেতে আমাদের, তবে এই কষ্ট আমার হত না মা। মরে তো কত মানুষ যায়। তোমার মতো এত কষ্ট পেয়েকজন যায় বলো! সেই জন্মেরপর থেকে কষ্ট করছে। ভেবেছিলে কষ্ট বুঝি দূর হবে কোনও একদিন। তোমার চেয়ে ওই দুলুর মা বা আনুর মাও অনেক ভালো ছিল। তুমিও বুঝতে যে ওরা ভালো আছে, কেউ না কেউ আছে ওদের ভালোবাসার। তোমার তো কেউ ছিল না। এই যে কেউ ছিল না তোমার, সেটি আমি সইতে পারি না। নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না আমি। কোনওদিনই পারবো না।

.

তুমি আর জাগলে না, চোখ খুললে না, কথা বললে না সম্ভবত জানুয়ারির এগারো তারিখে। জানি না এই তারিখটা কেন আমার মনে আছে। আমি মনে রাখতে চাই না, তারপরও মন থেকে তারিখটা কেন উবে যায় না! কত কিছুই তো মনে রাখতে পারি না, এই তারিখটা কেন মনে রাখি, জানি না। না, বছর বছর এগারো জানুয়ারি এলে আমি কিছুই করি না, হয়তো তারিখটি এসে চলে গেলে মনে পড়ে তারিখটি এসেছিলো। তিনশ পঁয়ষট্টি দিনের মধ্যে একটি দিন ওই দিনটি। ওই দিনটিতে আলাদা করে তোমাকে মনে করার, দুঃখ পাওয়ার আমি কোনও কারণ দেখি না। তিনশ পঁয়ষট্টি দিনই আমি তোমাকে মনে রাখতে চাই। বছরে তিনশ পঁয়ষট্টি দিনই আমি তোমাকে ভালোবাসতে চাই, তোমার মতো হাজারো মাকে চাই, মানুষকে চাই। তিনশ পঁয়ষট্টি দিনই নির্যাতিত সব মেয়েদের জন্য দু ফোঁটা চোখের জল ফেলতে চাই। তাদের জন্য মুষ্টিবদ্ধ করতে চাই হাত অথবা তাদের দিকে বাড়িয়ে দিতে চাই নিজের দুহাত। যদি আলাদা করে কোনও দিন তারিখের কথা আমাকে মনে রাখতেই হয়, আমি শুধুমনে রাখতে চাই তোমার জন্মের তারিখ। কোনও সাল তারিখ জানা ছিল না জন্মের। শুধু জানতে কোনও এক ঈদে তুমি জন্মেছিলে। তাই তোমার নাম রাখা হয়েছিল ঈদুল। নানা, নানি বড়মামা আর বাবা তোমাকে ঈদুন বলে ডাকতো। ল কেন যেন হয়ে গিয়েছিল ডাকার বেলায়!

তোমাকে হারিয়ে আমি নিজেকে হারালাম, মা। আমার কাছে পৃথিবীটাকে আর মূল্যবান কিছু মনে হল না। জগৎ তার সৌন্দর্য, তার হৃদয় সব নিমেষে হারিয়ে ফেললো। পড়ে রইলো নোংরা নর্দমার মত, পুঁজ আর পচা রক্তের মতো প্রাণহীন, দুর্গন্ধ, কুৎসিত। এই জগতে আমি একা বসে করবোটা কী, বলো তো! অপরাধবোধ আমাকে দিনে সাত টুকরো করে, রাতে সাত টুকরো করে। আমিটুকরোহই, রক্তাক্ত হই, তারপরও দেখি বেঁচে আছি। এই বেঁচে থাকা আমিটার জন্য আমার কোনও ভালোবাসা জন্ম নেয় না। ঘৃণা জন্ম নেয়। নিজের জন্য এই ঘৃণাটা আমি পুষে রাখি নিজের ভেতর। ঘৃণাটা আগুনের মতো, একবার হাওয়া লাগলে নিজেকে পুড়িয়ে ফেলে। আমি পুড়তে থাকি। প্রতিদিন। প্রতিরাত। এরকম ভাবেই আমি বেঁচে থাকি, যেখানেই থাকি।

.

বইমেলায় ঝড় বৃষ্টির রাতেও রীতিমত লাইনে দাঁড়িয়ে ‘আমার মেয়েবেলা’ বইটা কিনেছে পাঠক। তুমি সুইডেনে আসার পর যে বইটা দিনভর, রাতভর আমি লিখতে শুরু করেছিলাম, সেই বই। যে বইটা লিখছি বলে তোমাকে সময় দেওয়ার সময় হয়নি আমার, সেই বই। তোমার সাহায্য না পেলে যে বইটা আমার লেখা হতো না, সেই বইয়ের জন্য আমি পেলাম আনন্দপুরস্কার। এই বইএর কিছু তথ্যপড়েও খুব দুঃখ করেছিলে। কিন্তু তোমার দুঃখ তো তোমার দুঃখ। ও আমার দুঃখ নয়। তাই কোনও তথ্য আমি বদলে দিইনি। তুমিও সুইডেন ছাড়লে, আমার লেখাও শেষ হলো। পাণ্ডুলিপি পড়ে ফ্রান্সের প্রকাশক ক্রিশ্চান বেস এত বেশি আপ্লুত যে অনুবাদ হয়ে যাওয়ার পর, অল্প কিছু জিনিস সংশোধন করার জন্য নিউইয়র্কে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন অনুবাদক ফিলিপ বেনোয়াকে। কিছু শব্দ, আর বাক্য বিশেষ করে আরবি ফারসি যে শব্দগুলো ব্যবহার করেছি, তাদের অর্থ জেনে নিয়ে সে শহর বেড়াতে বেরিয়ে পড়তো। সেই ফিলিপ বেনোয়া প্যারিসে ফিরে যাওয়ার পরপরই বই বেরোলো এডিশনস স্টক থেকে। ‘আমার মেয়েবেলা’ প্রথম বেরিয়েছে ফরাসি ভাষায়। বাংলায় বেরোলো অনেক পরে। মূল ভাষার পাণ্ডুলিপি যথারীতি আনন্দ পাবলিশার্সকে দেওয়া হয়েছিলো। যেহেতু আনন্দই আমার বই ছাপায়। কিন্তু পাণ্ডুলিপি পড়ে আনন্দ সিদ্ধান্ত নিল যে এ বই তাদের পক্ষে ছাপানো অসম্ভব। শুনেছি, দেশ, সানন্দাইত্যাদি পত্রিকা বাংলাদেশে যাচ্ছে, এখন আমার বই প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকারকে ক্ষেপিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে আনন্দ পাবলিশার্সের নেই। কেউ চাইছেনা, দেশ আর সানন্দা বাংলাদেশে আমার কারণে নিষিদ্ধ হয়ে যাক। আর, ইসলাম নিয়ে যেসব কথা বইতে আছে, তাতে বাংলাদেশ সরকার আপত্তি করতেই পারে। যদি আনন্দ বই ছাপায়, তবে কিছুকিছু অংশ বিশেষ করে ধর্ম নিয়ে মন্তব্য বাদ দিতে হবে। আনন্দ এর আগে এমন আবদার করেনি, অবাক হই, কিন্তু কোনও কিছু বাদ দিতে আমি রাজি হই না। না রাজি হলে আনন্দ ছাপাবে না বই। ওরা এর আগে আমার কোনও বই ছাপাতে আপত্তি করেনি। এবার করেছে, এর পেছনে আরও এক কারণ আমি শুনেছি, ওরা ঢাকায় আনন্দ পাবলিশার্সের একটা শাখা খুলবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এ নিয়ে কথাও হয়ে গেছে। ইসলাম সম্পর্কে সমালোচনা আছে আমার এমন কোনও বই যদি এখন ছাপায়, তাহলে ঢাকায় ওদের নতুন শাখার ওপর মৌলবাদী আক্রমণ হওয়ার আশংকা আছে।

নিখিল সরকার তখন চেষ্টা করলেন অন্য প্রকাশককে বই দিতে। স্ত্রী নামের একটি প্রকাশনী সংস্থা এগিয়ে এলো। লেখক অমিতাভ ঘোষের সঙ্গেও নিখিল সরকারের এ নিয়ে কথা হয়। তিনিই চেয়েছিলেন স্ত্রীকে দেওয়া হোকপাণ্ডুলিপি। কিন্তু নিখিল সরকার শেষ পর্যন্ত দিলেন না, বললেন স্ত্রীও পারবেনা বাদ না দিয়ে বই প্রকাশ করতে। তাঁর বন্ধুদের মাধ্যমেই পিবিএস নামের ছোটখাটো একটি প্রকাশনীর খোঁজপাওয়া গেল। ওই প্রকাশনীকেই নিখিল সরকার দিয়ে দিলেন বই। পিবিএস নিজেদের আদর্শের বাইরের কোনও বই ছাপায় না। আমার বই পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তবে পিবিএস এর কর্তারা এক মত হয়েছেন যে এই বই তাঁদের আদর্শের পরিপন্থী নয়। পিবিএস ছোট প্রকাশক। আনন্দের মতো বড় প্রকাশকবই ছাপাতে নারাজ শুনে অন্য বড় প্রকাশকও ভয়ে পিছিয়ে গেছে। পিবিএসএর ভয় ডর কমই। ছোট বলে নয়। আদর্শের কারণে। সমাজতন্ত্র, সমতা, সততা, সমানাধিকার, এসআমারও যেমন বিষয়, তাদেরও। আজকাল তো আর সব থাক, এই আদর্শটাই নেই মানুষের। মানুষ ক্রমে ক্রমে বিচাত হচ্ছে মানবতাবোধ থেকে। নিখিল সরকার বই থেকে বেশ কিছু শব্দ বাক্য কেটে বাদ দিয়েছেন। তাঁর আশংকা, ওগুলো পড়ে মুসলমানরা আমাকে মেরে ফেলবে। আমি মৃত্যুর ভয় করি না। সেই বাদ দেওয়া শব্দ বাক্যগুলো যখন চোখেপড়ে, রীতিমত যুদ্ধ করেওগুলোআবার আমি ঢুকিয়ে দিয়েছিবইয়েরপরের সংস্করণে। পিবিএস এর কর্তারা নিজেরা ধর্মমুক্ত হওয়ায় কোনও ঝামেলা করেনি। নিখিল সরকার নিজে ধর্মমুক্ত হলেও আমার কোনও ক্ষতি হতে পারে আশংকায় আমার অতি-সাহসে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে শ্রদ্ধা করলেও আমি কাটাছেঁড়ার ব্যাপারটি মেনে নিতে পারিনি। বিশাল এক প্রকাশনা উৎসব হয়েছিলো বইয়ের, সম্ভবত ওটাই আমার লেখা কোনও বইয়ের প্রথম প্রকাশনা উৎসব।

বইটি তোমার কারণেই লেখা হয়েছিল, মা। ছোটবেলার কত ঘটনা তুমি আমাকে বলেছো। অপ্রিয় কত সত্য কথাই তো তুমি বলেছো। তুমি যেরকম লুকোওনি, আমিও লুকোইনি। বই লিখছি জেনেও তো তুমি তোমার মেয়েবেলার সব দুঃখ সুখের কথা বলেছো, তোমার যৌবনের, তোমার সংসার জীবনের সব। তুমি না বললে আমি লিখতে পারতাম না আমার মেয়েবেলা, তুমিই শুরু করে দিয়ে গেলে আমার আত্মজীবনী লেখা। নির্বাসনের কারণে আমার লেখালেখি যেমন বন্ধ ছিল, তেমন বন্ধই থাকত। তুমি এলে, তোমার উপস্থিতিতে আমার আমিকে আমি নতুন করে যেন আবিষ্কার করলাম। তুমি আমাকে দেখতে না এলে আমার অতীতের দিকে আমি তাকাতাম না, বই লেখার কথা আমার ভাবনার মধ্যে আসতো না। তুমি যখন এসেছিলে, তুমি তোমার আঁচলে করে শিউলি ফুলের মতো আমার শৈশব কৈশোর নিয়ে এসেছিলে। তোমার গা থেকে শিউলির সেই ঘ্রাণই ভেসে আসতো। এখনও চোখ বুজে তোমাকে ভাবলে সেই ঘ্রাণ পাই আমি। বড় চেনা ঘ্রাণ। বড় হারিয়ে যাওয়া, আবার না যাওয়াও।

আমার মেয়েবেলা বইটা বাবাকে উৎসর্গ করেছিলাম, তোমার সম্পর্কে কম কুকথা ছিল ও বইটায়! তখনও তো তুমি ছিলে, বেঁচে ছিলে। দ্বিতীয় আর তৃতীয় খণ্ড উতল হাওয়া আর দ্বিখণ্ডিত বইদুটোতে তোমার দিকে অন্য চোখে তাকালাম। সত্যি বলতে কী, তাকালাম তোমার দিকে। এতকাল তো তাকাইনি। তোমাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করেছি, মজা করেছি। তাকাইনি। আমার মেয়েবেলা যখন বাংলায় বের হলো, অনুতাপ আমাকে এমনই কাঁদাচ্ছিলো যে তোমাকেই বইটা উৎসর্গ করলাম। বইয়ের ফরাসি সংস্করণটি কিন্তু বাবাকে উৎসর্গ করা। কী নামে ডাকবে তুমি এই অস্থিরতাকে? আচমকা যেন আমার চেতনার কবাট খুলে গেছে। আচমকা যেন আমি নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে প্রথম নিজের আসল চেহারাটি দেখছি। নিজের ওপর কি কম ঘেন্না আমার হয়েছে! কিছুতেই নিজের গ্লানিকে একবিন্দুআমি মুছতে পারি না। আমার ভেঙে যাওয়া, সব ছেড়ে ছুঁড়ে আমার সন্ন্যাস বরণ দেখে বন্ধুরা বলেছিলো, গ্লানি থেকে মুক্ত হও, গ্লানি মানুষকে ধ্বংস করে ফেলে। ফেলুক, তাই তো চাইছিলাম। আমি তখন মরে গেলেও আমার কিছু যেতো আসতো না।

.

কলকাতা থেকে ভিসা ফুরোলে চলে যেতে হল প্যারিসে। প্যারিসে আমার কাজ কী বলো। শুধু বসে থাকাই তো। এইপ্যারিসেই আমাকেরানির মতো রেখেছিলো, আমার গাড়ির সামনে পেছনে প্যাঁপু বাজিয়ে গাড়ি যেতো। প্যারিসের অর্ধেক রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হত আমি রাস্তায় চলবো বলে। আর সেই একই আমিপ্যারিসের রাস্তায় হেঁটে বেড়াই, যে কোনও মানুষের মতো, বাদামি রঙের মেয়ে, এশিয়ার, ভারতীয় উপমহাদেশের, গরিব দেশের বাদামি মেয়ে, কেউ ফিরে তাকায় না। অথচ এই আমাকে দেখার জন্য এই শহরেই একসময় মানুষ উপচে পড়তো, বইয়ে সই নেওয়ার জন্য ভিড় বাড়তো। নিরাপত্তা পুলিশের বাধায় কত কত মানুষ আমাকে এক পলক। দেখারও সুযোগ পায়নি। যখন মনে পড়ে ওসব কথা, মা, হাসি পায়। ওই উত্থানটা সত্যি ছিল, না এই পতনটা সত্যি! আমার এসবকে উত্থান বা পতন বলে মনে হয় না। যেখানে ছিলাম আমি, সেখানেই আছি। আমি খুব সাধারণ মানুষ, তোমার মতোই সাধারণ, নিরীহ। মাঝে মাঝে আমাকে অসাধারণ বলে প্রদর্শন করা হয়, আমার জীবনের এই সংগ্রামের জন্য, আমার লেখার কারণে, আমার আদর্শের কারণে। যে মানুষটি আমি রাস্তায় একা হাঁটি, বাসে বা মেট্রোয় চড়ি, বা ট্যাক্সিতে, তাকে মানুষ চেনে না বলে ঘিরে ধরে না। যদি জানতো আমি কে, ছুটে আসতো। এই যে দেখলে চেনে না, তা আমার জন্য একরকম ভালো। আমি নিজের মতো করে জীবন যাপন করতে পারি। ওই অসাধারণ জীবন, ওই খ্যাতি আমাকে অস্বস্তি দেয়। ভীষণ চাপ ওই জীবনে। দেবীর ভূমিকায় বেশিক্ষণ তিষ্ঠোনো যায় না। ওই জীবনটা ক্ষণস্থায়ী, এই জীবনটাই আসল। প্যারিসে আমি একটা ভীষণ ভুল করি। ক্রিশ্চান বেস আমাকে ভালোবাসছেন, বলেছেন তিনি আমার মায়ের মতো। অমনি আমি তোমার গলার হারটি দিয়ে দিই ওকে। মা, মা কি সবাই হতে পারে, নাকি হয়? যেই না আদর দেখায়, খুব, আমার পা ভেঙেছে বলে আমার অ্যাপার্টমেন্টে এসে ঘর দোর পরিষ্কার করতে শুরু করে, তখনই খুব আপন ভাবতে শুরু করেছিলাম। কত মানুষকে যে আমি আপন ভাবি। পরে অবশ্য বোধোদয় হয়। তবে আমার বোধোদয় হতে সবসময়ই খুব দেরি হয়।

প্যারিস শহরে থাকতে থাকতেই আমি বুঝতে পারি, বেশির ভাগ মানুষ যাদের আমি বন্ধু বলছি, তারা আসলে আমার বন্ধু নয়। খুব সহজে কয়েকদিনের পরিচয়ের পর আমরা স্বচ্ছন্দে সবাইকে বন্ধু বলে ডাকি। আমার খ্যাতি, অর্থ আর উদারতা–এ তিনটেকে ভাঙিয়ে তাদের নিজেদের সুবিধে স্বার্থের জন্য যা কিছু পারে, দুহাত ভরে নেবে। এ ছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্য নেই। মানুষের কৃত্রিমতাকে, বেশ কয়েক বছর, ধরে নাও, যে, আমি বুঝবো না। যে যত বড় অভিনেতা হবে, কৃত্রিমতা দিয়েই বছর পার করবে। অভিনয়ে কাঁচা হলে হয়তো কয়েক মাসেই ধরতেপারবো। মুলাঁ দন্দের মিরিয়াম অভিনয়ে খুব পাকা ছিল। যেই না দেখলো, আমাকে সে ভালোবাসছে আর আমি তার ভালোবাসায় সাড়া দিচ্ছি না, প্রতিশোধ নিল। কানাডার সেই লেখক পিয়ের লরুর সঙ্গে মুলাঁ দন্দে ছেড়ে চলে আসার পরও আমার যোগাযোগ আছে, এমিরিয়ামের সহ্য হয়নি। একদিন পিয়েরকে আমি নিয়ে গিয়েছিলাম রেস্তোরাঁয়। পিয়ের আমার কাছে দুহাজার ফ্রাঁ ধার চেয়েছে, এসব আমি নিজেই মিরিয়ামকে জানিয়েছিলাম। শুনে সে সোজা ক্রিশ্চান বেসের শরণাপন্ন হল, পিয়ের ভালো লোক নয়, পিয়ের আমাকে বোকা পেয়ে ধোঁকা দিচ্ছে। ক্রিশ্চান বেস মনে করেন আমি কোনও অঘটন ঘটিয়ে ফেলবো, বুদ্ধিমান কিছু লোকের সাহায্য ছাড়া আমি চলতে পারবো না। তিনি হামলে পড়লেন, না এসব চলবে না। কিছুতেই পিয়েরকে টাকা ধার দেবে না, ওর সঙ্গে আজই এখনই সম্পর্ক ছেদ করো। ওকে তোমার ধারে কাছে আসতে দেবে না। ঠিকমিরিয়াম যা চেয়েছিল, যেভাবে, ঠিক সেভাবেই সে ঘটনাটা ঘটালো। ক্রিশ্চানের অনুমতি নিয়ে পিয়েরকে সে আমার হয়ে গুডবাই জানিয়ে দিল। তখন পিয়ের আর আমি দুজনের কেউইমুলাঁ দন্দে নেই, দুজনইপ্যারিসে। পিয়েরের টাকার অভাব ছিল, চাইতেই পারে সে টাকা, আমি দিতেই পারি তাকে। মিরিয়ামের কেন এত জ্বালা। আমাকে সে খুব ভালোবাসে? আমার টাকা পয়সা সে খুব বাঁচাতে চায়? আসলে ওসব কাণ্ড করার মূল উদ্দেশ্য পিয়ের নামের হবু প্রেমিককে আমার ত্রিসীমানা থেকে বিদেয় করা। আমার ভাঙা পা দেখতে পিযের আসতো মাঝে মাঝে। দাবা নিয়ে আসতো, খেলতো আমার সঙ্গে। ক্রাচ নিয়ে এসেছিলো। প্যারিসের একলা ঘরে শুয়ে থাকা আমাকে সে সঙ্গ দিত। একদিন ওয়াইন নিয়ে এলো। ফ্রান্সের ক্লোদ লোলুর মতো চিত্রপরিচালক পিয়েরের গল্প নিয়ে ছবি করেছে। আমরা দুজনে সিনেমার গল্প লেখার পরিকল্পনা করি। খেতে খেতে গল্প। অমন আশ্চর্য সুন্দরের দিকে তাকিয়ে আমার মন জুড়োত। সেই পিয়েরকে কায়দা করে মিরিয়াম তাড়ালো। কারণ মিরিয়াম আমাকে চায়। আমি অবাক হয়ে দেখেছি এরা ভালোবাসতে যেমন পারে, প্রতিশোধ নিতেও পারে। ভালোবাসা এদের উদার করে না, হিংস্র করে তোলে। পিয়েরের সঙ্গে যখন মুলাঁ দন্দে থেকে যে রাতে চাঁদের আলোয় হাঁটতে গিয়েছিলাম, মিরিয়াম সারারাত কেঁদেছে আর মদ খেয়েছে। তার সহ্য হয়নি পিয়েরের প্রতি আমার আকর্ষণ। সে রাতেই চুরি হয়ে যায় আমার ঘরে রাখা কয়েক হাজার ডলার। আমার ঘরের একটা চাবি মিরিয়ামের কাছে থাকতো। মিরিয়াম ওই বিশাল মুলাঁ দন্দের পরিচালনার দায়িত্বে ছিল বলে অবাধ অধিকার ছিল সব কিছুতে। কে নিয়েছের প্রশ্ন উঠলে মিরিয়াম বলে হয়তো ঘর পরিষ্কার করতে আসা মেয়েরা। ওই মেয়েরা তিন মাসে কোনওদিন আমার ওই বাক্সে হাত দেয়নি, যে বাক্সে ডলার আর তোমার সোনার গয়নাগুলো ছিলো। মিরিয়ামকে আমার –কখনও সন্দেহ হয়নি। কিন্তু পরে একটি ঘটনা ঘটায় আমি বুঝি কে আসলে ছোটলোকি ওই প্রতিশোধটা নিয়েছে। মিরিয়ামের ঈর্ষা যেমন ভয়ংকর, প্রেমও ভয়ংকর। ব্রাজিলের সাও পাওলো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হল বক্তৃতা দিতে। আমি রাজি হয়েছিলাম যেতে। ওরা টিকিটও পাঠিয়ে দিয়েছিল। মিরিয়াম বললো, সেও যাবে আমার সঙ্গে। মুলাঁ দন্দের কাজ ফেলে সে নিজের টিকিট করে ফেললো। তারপরআমারপামচকালো, আমি শুয়ে আছি। ব্রাজিলকে জানিয়ে দিলাম, যেতে পারছি না। মিরিয়াম একাই চলে গেল ব্রাজিল। একাই সে হোটেলে বসে বসে আমার কথা ভাবলো আর কাঁদলো। ফিরেই সে সোজা আমার কাছে। আমার সেবা করবে, আমাকে ভালোবাসবে। মুলায় তার মন বসে না। ওখানে গেলেও সে প্রতিরাতে চলে আসে প্যারিসে আমার বাড়িতে, ভোরে ঘুম থেকে উঠে চলে যায়। মুলাঁ থেকে গাড়ি চালিয়ে প্যারিস আসতে তিন ঘণ্টা সময় নেয়। এতার কাছে কিছুই নয়। আমার জন্য যত তার আবেগ, আমার তার জন্য কিছুই নেই। মাঝে মাঝে আমার নির্লিপ্তি দেখে সে ফুঁসে ওঠে। চেঁচায়। কাঁদে। আমার কী করার আছে বলো। মিরিয়ামের শরীরের প্রতি, সে শরীর যতই সুন্দর হোক, আমার কোনও আকর্ষণ জন্মায় না। আমার প্রেম পেতে মিরিয়াম মরিয়া হয়ে ওঠে। নিজেকে সে সমকামী বলে না। এর আগে যাদের সঙ্গে সে প্রেম করেছে, সকলেই পুরুষ ছিল। এই প্রথম সে নাকি এক মেয়ের প্রেমে পড়লো। হয়তো তাই। কিন্তু ও একা প্রেমে পড়লে তো হবেনা, আমাকেও পড়তে হবে। এক গভীর রাতে মুলাঁ দন্দের ঘরে আমার বিছানায় আচমকা এসে আমার শরীরের প্রতিটি রোমকূপে উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলছিলো। সেনা হয় অন্যরকম এক রাত দিয়েছিল আমাকে। কিন্তু প্রতি রাতে তার দাবি করলে চলবে কেন! আমার শরীর বা হৃদয় কোনওটাই আমি তাকে দিতে পারি না। বন্ধুত্বই শুধু পারি দিতে, কিন্তু শুধু বন্ধুত্বে তার চলে না। দিন দিন উন্মাদ হয়ে ওঠে মিরিয়াম। আমি তখন ঘর সাজাচ্ছি প্যারিসে, সে চলে আসতো নিজের কাজ ফেলে। আমাকে নিয়ে গাড়ি করে সেই ইকিয়ায় যাওয়া, আমার খাট চাই, সোফা চাই, বইয়ের আলমারি চাই, টেবিল চাই, চেয়ার চাই, খাবার টেবিল চাই, চেস্ট অব ড্রয়ার চাই, থালা বাসন চাই। আমি যে মিরিয়ামকে ডাকিতানয়। নিজেই সে গাড়ি করে আমাকে দোকানে নিয়ে যায়। নিজেই আসবাব পত্র টেনে ঘরে ওঠায়, জোড়া লাগিয়ে দেয়। এত সব তার করার কথা নয়, কিন্তু করে। মুলার কাজ ফাঁকি দিয়ে সে করে এসব। ঘরে জায়গা হয় না বলে, তার ওপর এত বিদেশ ভ্রমণ করতে হয় আমার, ঘরে দামি জিনিসপত্তর রাখা নিরাপদ নয় বলে লাল সুটকেসে সব ভরে মিরিয়াম নিজেই বলে সুটকেসটা তার বাড়িতেই রেখে দেবে সে। নিয়েও যায়। এই মিরিয়ামকে একদিন আমার দূরে সরাতে হল, তাকে বলে দিলাম আমার পক্ষে সম্ভব নয় তার সঙ্গে প্রেম করা, বা শরীর মেলানো। বহুঁকাল অভুক্ত থাকলে মেয়েদের স্পর্শে হয়ত জেগে উঠতে পারি। তার মানে এই নয় যে আমি সমকামী। মিরিয়াম ক্ষুব্ধ হতে লাগলো। আমার জন্য তার ক্রন্দন সীমা ছাড়াতে লাগলো। বিদেয় তাকে শেষপর্যন্ত হতেইহল। ফরাসি প্রেমিকের সঙ্গে প্রথম রাত কাটানোর দিন মিরিয়াম এসেছিলো আমার কাছে। তাকে আমি ঘরে ঢুকতে দিইনি। অনেকক্ষণ দরজায় বেল বাজিয়ে সেচলে যায়। চলে সেসম্পূর্ণ যায়নি। সারারাত সে রাস্তায় তার গাড়িতে বসেছিলো। এমনভাবে বসেছিলো, যেন গাড়ির জানালা দিয়ে সে ঘরের জানালা দেখতেপায়। আর বারবারই আমাকে ফোন করে অভিযোগ করছিল, চিৎকার করছিল, কাঁদছিলো। আমি বারবারই তাকে চলে যেতে বলি। বলি যে আমার এক বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি আমি, আজ তার সঙ্গে দেখা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আসলে আমি চাইনি যে সুদর্শন যুবকের সঙ্গে আমার আশ্চর্য সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তাকেও মিরিয়াম তাড়াক, যেভাবে পিয়েরকে তাড়িয়েছিল। এরপর কয়েক মাস গেলে, একদিন সুটকেসে রাখা কোনও জিনিস খুঁজতে গিয়ে পাতিপাতি করে খুঁজে

পাওয়ার পর মনে পড়লো, লাল সুটকেসে ছিল ও জিনিস, আর সেই সুটকেস মিরিয়ামের বাড়িতে। ওকে ফোন করলাম, আমার সুটকেসটা চাই। মিরিয়াম বললো, কিসের সুটকেস? সেই যে আমার লাল সুটকেস, ঘরে জায়গা নেই বলে বা ঘর নিরাপদ নয় বলে যেটি তুমি নিয়ে গিয়েছিলে! মিরিয়াম বললে কোনও সুটকেস টুককেস তার কাছে নেই। সে কিছুই নেয়নি। আমি ভাবলাম, বোধহয় একটু মজা করছে আমার সঙ্গে। কিন্তু আবার বলাতে সে আবারও সাফ বলে দিল, কোনও সুটকেসই সে নেয়নি। তার কাছে আমার কিছু নেই। ফোন রেখে দিল। এভাবেই প্রতিশোধ সে নিল তার সঙ্গে প্রেম না করার। বড়লোক মানুষ এরা, অথচ দেখ কত নিচে নামতে পারে। ওর ভালোবাসা কি ভালোবাসা ছিল মা? আমি তো কাউকে একবার ভালোবাসলে, সেই ভালোবাসা উবে গেলেও এত নিষ্ঠুর হতে পারতাম না। আর ভালোবাসার দরকার কী, কোনও ঘোরশত্রুর সঙ্গেও কি এই অন্যায় করতে পারবো আমি! অসম্ভব। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে লরোঁকে দেখেছি সে কী করেছে। লরোঁ বলতো আমাকে সে ভীষণ ভালবাসে। আমার বিশ্বাস হত না। কলকাতা থেকে ফিরে লরোঁকে বিদেয় করে দিই, কিন্তু তারপরও ঠিক বিদেয় করা হয় না। রাতদিন ফোন করে হু হু করে কাঁদতো, আমাকে ছাড়া নাকি বাঁচবেনা। ছুটি পেলেই ছুটে আসতো আমার কাছে। একবার তো আমাকে ওর বাবা মার বাড়ি আর বোনের বাড়িতে নিয়ে গেল। ওদের সঙ্গে আমাকে ওর প্রেমিকা হিসেবেই পরিচয় করালো। আমাকে ওরা নামে চিনতো, পেয়ে মহা খুশি। ওর বাবা মা আমাকে আর লরোঁকে এক ঘরে ঘুমোতে দিল রাতে। বাবামার বাড়িতে প্রেমিকা নিয়ে যাওয়া পশ্চিমের দেশগুলোতে খুব বড় ব্যাপার। সম্পর্ক অতীব গুরুত্বপূর্ণ না হলে এঘটনা ঘটে না। নিজের বউকে প্রথম দিনই আমাদের সম্পর্কের কথা জানিয়ে দিয়েছিলো। প্রয়োজনে ফোন করে লরোঁকেনা পেলে আমার বাড়িতেই ফোন করতে লরোঁর বউ। লরোঁ বউ বাচ্চা ছেড়ে আমার সঙ্গে বাকি জীবন থাকার স্বপ্ন দেখছিলো। বার বার আমাকে বলেছে আমি যেন প্যারিস ছেড়ে তুলুজ চলে গিয়ে ওর সঙ্গে জীবন যাপন শুরু করি। শহরে আলাদা একটা অ্যাপার্টমেন্টও সে ভাড়া নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু কখনও মন সায় দেয়নি আমার। ওর বাড়িতে গিয়ে ওর সঙ্গে বাস করার ইচ্ছে আমার হয়নি। খুব যেতে বলায় একবার দিন পাঁচেকের জন্য বেড়াতে গিয়েছিলাম। লরোঁকে আমি ভালোবাসতাম কিনা জানি না, তবে ওর সুন্দর শরীরটার দিকে তাকালে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করতো। কলকাতার হোটেলে প্রথম ওকে আমি জীবন থেকে বিদেয় করার কথা ভাবি। দ্বিতীয়বার ভাবি লন্ডনের কমপিউটারের দোকানে। আমি একটা ল্যাপটপ দেখছি কেনার জন্য। আমি যেটাপছন্দকরছি, সেটা সে কিছুতেই আমাকে নিতে দেবে না। বলে, এত দাম দিয়ে এটা কিনো না। তোমাকে ঠকাচ্ছে এরা। কম দামে কমপিউটার কিনে সব হার্ডওয়্যার সফটওয়্যার লাগিয়ে নেবে। আমি বললাম, এটাই আমি কিনবো, এটাই আমারপছন্দ হয়েছে। শুনে সেফুসতে শুরু করলো। উপদেশনা শুনলে পুরুষদের আবারভীষণ রাগ হয়। রাগেফুসতে থাকে বুনো মোষের মতো, আর বলতেই থাকেআমি বোকার মতো কাজ করেছি। আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম, হ্যাঁ করেছি, আমারইচ্ছেহয়েছে করেছি। ডিনারেও যখন দেখলাম, তার আদেশ বা উপদেশ না মানার কারণে তার ফুঁসে থাকা বহাল রয়েছে, আমি শান্ত কণ্ঠে বললাম, এই সম্পর্কটা অনেক আগেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, মনে হয় শেষ হয়ে যাওয়াই উচিত। রাতে হোটেলে ফিরে এলে লরোঁ বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো, তুমি কি সত্যিই শেষ করে দেবে সম্পর্ক? সত্যিই আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? বলি, হ্যাঁ। অমনি সে নমি কি ত্য পা, নমি কি ত্য পা বলে কাঁদতে লাগলো, এরপর দেয়ালে মাথা ঠুকতে লাগলো। মাথা ফেটে রক্ত বেরোবে এবার ছেলের। দেয়াল থেকে আমি টেনে আনলাম লরোঁকে। সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো, নমি কি ত্য পা, ছেড়োনা আমায়। এরপর আমাকে আদর করলো বেঘোরে। শরীর চায় ওকে, শরীরই বলে। কিন্তু মন চায় না। পরদিন লণ্ডন থেকেপ্যারিসে ফেরার পথে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ওর বোনের বাড়িতে আমরা রাত কাটাই। রাতেও একই প্রশ্ন, তুমি কি সত্যিই ছেড়ে যাবে আমাকে? বললাম, হ্যাঁ যাবো। যতবার প্রশ্ন করে, একই উত্তর পায়। একসময় লরোঁর ভেতরের বুনো মোষটি ধারালো শিং বাগিয়ে তাড়া করে আমাকে। আমাকে সে বেরিয়ে যেতে বলে বাড়ি থেকে। আমি যত বলি, সকালে বেরোবো, এখন নয়। সে বলে, এক্ষুনি। কাপড়ের ব্যাগটা নিয়ে সে আমাকে বাড়ির বাইরে বের করে দিয়ে আসে। রাত তখন দেড়টা বোধহয়। রাস্তার মাতাল বদমাশ একলা মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কী করবে লরোঁ একবারও ভাবেনা। না, ও সময় কোথায় ট্রেন, কোথায় বাস, কোথায় ট্যাক্সি জানি না। প্যারিস অনেক দূর, কোনও পথেই প্যারিসে যাওয়ার উপায় নেই। শেষে বেল টিপলাম বাড়ির। অন্তত লরোঁর বোন এভলিন ঘুম থেকে উঠে তার দাদার কাণ্ড দেখুক। কিন্তু বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দেয় লরোঁ। আমি বলি, আমাকে রাতটা এখানে থাকতেই হবে। সকালে বেরিয়ে যাবো। রাত কাটিয়ে সকালে একা বেরোতে নিলে লরো সঙ্গে যায়। পথে পাগলকে আমি আর ছেড়ে যাওয়ার কথা কিছু বলি না। শুধু স্তব্ধতার মধ্যে কাটে আমার দীর্ঘ সময়। আমার প্যারিসের অ্যাপার্টমেন্টে সেও ঢোকে। অপেক্ষা করি তার চলে যাওয়ার। লরোঁ বলে, আমাকে বিদেয় করার জন্য অস্থির হচ্ছো তাইনা! মনেমনে বলি, হচ্ছি। লরোঁ অস্থির পায়চারি করতে থাকে ঘরে, আর আমি ভয় পেতে থাকি। ভালোয় ভালোয় আপদ বিদেয় হলে বাঁচি। আবার যেন কোনও অঘটন না ঘটায়। তার সমস্ত রাগ গিয়ে আবার দেয়ালে পড়ে। প্রচণ্ড এক ঘুষি মেরে দেয়াল দাবিয়ে দেয়। আমি চোখ বুজে শুয়ে থাকি। একসময় বাথরুম থেকে অদ্ভুত শব্দ এলে গিয়ে দেখি লরোঁ বাথটাবের জলে শুয়ে আছে, হাতে তার ছুরি। সে হাতের শিরা কাটছে। আমি তড়িঘড়ি হাতে ব্যাণ্ডেজ করে লরোঁকে টেনে তুলে আনি জল থেকে। বিদেয় শেষ পর্যন্ত তাকে হতেই হবে। তাকে তুলুজ ফিরতে হবে। লরোঁ বেরিয়ে যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করি। কী যে আমার স্বস্তি হয় মা, তোমাকে বোঝাতে পারবো না। মনে হয় দীর্ঘ সময় আমি এক বদ্ধ পাগলের সঙ্গে এক খাঁচায় বন্দি হয়ে ছিলাম। সবেমুক্তি পেলাম। মুক্তির আনন্দ অসীম। এরপর লরোঁ অনেক ফোন, ইমেইল, ইত্যাদিতে অনেক চেষ্টা করেছে যোগাযোগ করতে, আমি সাড়া দিইনি। যখন বুঝেছে কোনও আর উপায় নেই আমাকে পাওয়ার, তখনই সে চিঠি লিখতে শুরু করে। দেশে বিদেশে আমার যত বন্ধু আছে, যাদের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে, অথবা হয়নি, ক্রিশ্চান বেস থেকে শুরু করে কলকাতার ছোটখাটো সাংবাদিক সবাইকেই। তার মূল উদ্দেশ্য, আমাকে ধ্বংস করা। ধ্বংস করতে গেলে আমার যারা চেনাপরিচিত বন্ধু, যারা আমাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, স্নেহ করে, তাদের মনে আমার সম্পর্কে বিরূপ ধারণা দিতে হবে, আমার সম্পর্কে মন্দ কথা বলতে হবে, যেন বন্ধুরা আমাকে ত্যাগ করে। লরোঁর স্বপ্ন সার্থক হয়নি। কেউ আমাকে ত্যাগ করেনি। চিঠির খবরটা আমার বন্ধুরাই আমাকে দিয়েছে। আমি জানি, মিরিয়ামের চেয়েও লরো অনেক বেশি ভয়ংকর। প্রতিশোধপ্রবণতা, কুৎসিত ঈর্ষা, হিংসে, মানুষকে আর মানুষ রাখে না।

প্রেম ও যৌনতা আমাকে প্রভূত আনন্দ দিতে পারে, কিন্তু নিজের স্বাধীনতায় কেউ নাক গলাতে এলে যত বড় প্রেমিক হোক, যত নিখুঁত যৌনসঙ্গী হোক, আমার কোনও দ্বিধা হয় না তাকে গেট আউট বলতে। এই সম্পর্কটি শেষ হবার পর আবার তুমি, জীবন জুড়ে তোমার না থাকা। যৌনতা তোমাকে ভুলিয়ে রাখে। যৌনতার ছুটি হয়ে গেলে তোমার মৃত্যু আমাকে হতাশার অতলে টেনে নিয়ে যায়। যেখানে শুধু নেই, নেই আর নেই। আমি কাতরাতে থাকি তোমার শোকে। এদিকে আরশোলায় বাড়ি ভরে ওঠে। অবাধে আমার গায়ে রাতে হাঁটাহাঁটি করে। আমার শরীরও তাদের উৎসবের চমৎকার ঘরবাড়ি হয়ে ওঠে। পরিবারের সবার প্রতি আমার অভিমানে নিজেকে সবার কাছ থেকে সরিয়ে এনে অদ্ভুত এক আঁধারে ডুবে যেতে থাকি। কারও সাধ্য নেই আমাকে সেই আঁধার থেকে তোলে। অদৃশ্য মাটি এসে জীবন্ত আমাকে কবর দিয়ে যায়।

.

মৃত্যুময় নিস্তব্ধতার মধ্যে ভাসতে থাকি। খা খা করে বুকের ভেতর, বড় খালি খালি লাগে। কবিতা লিখতে থাকি। অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে কবিতাগুলো লিখি! বাড়ি এলোমেলো পড়ে থাকে। ওর মধ্যেই আমি শুয়ে থাকি। ওর মধ্যেই আমার সারাদিন, ওর মধ্যেই সারারাত। কারও কোনও ফোন ধরি না। কারও সঙ্গে কথা বলি না। জগৎ একদিকে, আর তোমার না থাকা নিয়ে আমি অন্যদিকে। রান্না করি না। বাইরে থেকে তৈরি খাবার কিনে কমপিউটারে লিখতে লিখতেই খাই, এঁটো বাসনপত্র টেবিলে বিছানায়, মেঝেয়, রান্নাঘরে এলোমেলো পড়ে থাকে। কাগজের ঠোঙায় ঘর ভরে যায়। আরশোলারা অবাধে আনন্দ করে। তুমি কিভাবতেপারো তোমাকে নিয়ে কবিতা লিখেছি আমি। যেখানেই থাকো, কবিতাগুলো পড়োমা। তোমার নিশ্চয়ই বিশ্বাস হচ্ছে না মা। কবে যেন হঠাৎ রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে দেখি এক মহিলা সামনে হাঁটছেন, ঠিক তুমি যেমন করে হাঁটতে, মুখের ডানদিকটা সামান্য এক ঝলক যেটুকু দেখা গেছে, মনে হল, ঠিক তোমার মুখের ডানদিকটার মতো। আমি জানি না কী কারণে দ্রুত হাঁটতে শুরু করলাম, যেন মহিলার কাছাকাছি পৌঁছোতে পারি। দ্রুত, প্রায় দৌড়ে, মহিলার সামনে গিয়ে মুখটা দেখতে চাইছিলাম। একসময় গতি শ্লথ হয়ে এলো আমার। হঠাৎ লক্ষ করি, চোখ উপচে জল বেরোচ্ছে আমার। হাতের তেলোয় সেই জল মুছে মুছে হেঁটেছি, তারপর যতটাই হেঁটেছি।

তোমাকে মনে করে আগে লিখিনি কোনওদিন কিছু। তোমাকে ভালোই তো বাসিনি কোনওদিন। তুমি না চলে গেলে তুমি কী ছিলে, কী যন্ত্রণা তুমি জীবনভর পেয়ে গেছে, তা আমি হয়তো টের পেতাম না। ওভাবেই তোমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে যেতাম। যেভাবে করছিলাম। তুমি কে ছিলে, মানুষ হিসেবে কত বড় ছিলে, হঠাৎ যেন টের পেলাম, হৃদয়ে, মস্তিষ্কে, টের পেলাম হাড়ে মজ্জায়। বোধাদয় হলো আমার। চোখের সামনে থেকে সরে গেছে ভারি একটা কালো পর্দা। এসব কবিতা নিয়ে জলপদ্য নামের যে বইটা বেরিয়েছিল, ওর ভূমিকায় লিখেছি, মা বলেছিলো বছরের প্রথম দিনে কাঁদিস না, কাঁদলে সারা বছর কাঁদতে হবে। মা নেই, সারা বছর আমি কাঁদলেই কার কী? মা, তোমার কেমন লাগছে জেনে যে তোমার জন্য দিনের পর দিন কেঁদেছি আমি! বিশ্বাস হচ্ছে না? মা, সত্যি অনেক কেঁদেছি। জীবন কেমন বীভৎস রকম শূন্য হয়ে গেলো হঠাৎ। তুমি ছিলে, মনে হতো চিরকালই তুমি থাকবে। তুমি তো কবিতা ভালোবাসতে খুব। এগুলোকে ঠিক কবিতা বলবো না। তোমার না থাকার দীর্ঘশ্বাস এসব, না থাকার হাহাকার।

 ০৮. তোমার না থাকা

তোমার না থাকা

তুমি কি কোথাও আছ
মেঘ বা রঙধনুর আড়ালে!
হুহু বাতাসের পিঠে ভর করে মাঝে মধ্যে আসো, আমাকে ছুঁয়ে যাও!
তুমি কি দেখছ চা জুড়িয়ে জল হচ্ছে আমার
আর আমি তাকিয়ে আছি সামনে যে বাড়ি ঘর, মানুষ, যন্ত্রযান
দুপুরের আগুনে রাস্তা, ঝরে পড়া শুকনোপাতা, মরা ডাল
বুড়ো কুকুরের লালা ঝরা লাল জিভের দিকে
আর তোমার না থাকার দিকে!

তুমি কি খুব গোপনে দেখছ তাকিয়ে থাকতে থাকতে
চোখ কেমন জ্বালা করছে আমার–
তুমি কি কোনও বৃক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছ কোথাও,
কোনও পাখি বা প্রজাপতি!
কোনও নুড়ি কোনও অচিন দেশে!

মানুষগুলো খাচ্ছে পান করছে হাঁটছে হাসছে
দৌড়োচ্ছে, জিরোচ্ছে, ভালবাসছে
তোমার না থাকা মাঝখানে বসে আছে, একা।

.

একটি মৃত্যু, কয়েকটি জীবন

একটি মৃত্যুকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল কয়েকটি জীবন।

কয়েক মুহূর্ত পর জীবনগুলো চলে গেল
যার যার জীবনের দিকে।

মৃত্যুপড়ে রইল একা, অন্ধকারে
কেঁচো আর কাদায়–

জীবন ওদিকে হিসেব পত্তরে,
বাড়িঘরে,
সংসারে, সঙ্গমে।

.

আমার মায়ের গল্প

১.
চোখ হলুদ হচ্ছিল মা’র,
শেষে এমন, যেন আস্ত দুটো ডিমের কুসুম!
পেট এমন তেড়ে ফুলছিল, যেন জেঁকে বসা বিশাল পাথর
নাকি এক পুকুর জল–বুঝি ফেটে বেরোবে!
মা দাঁড়াতে পারছে না,
না বসতে,
না নাড়তে হাতের আঙুল,
না কিছু।
মা’কে মা বলে চেনা যাচ্ছিল না, শেষে এমন।
আত্মীয়রা সকাল সন্ধে শুনিয়ে যাচ্ছে
ভাল একটি শুক্রবার দেখে যেন তৈরি মা..
যেন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলতে বলতে
যেন মুনকার নকির সওয়াল জবাবের জন্য এলে বিমুখ না হয়
যেন পাক পবিত্র থাকে ঘর দুয়োর, হাতের কাছে থাকে সুরমা আর আতর।

হামুখো অসুখ মা’র শরীরে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে সেদিন,
গিলে ফেলছে দুফোঁটা যে শক্তি ছিল শেষের, সেটুকুও।
কোটর থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে চোখ,
চড়চড় করছে জিভ শুকিয়ে,
ফুসফুসে বাতাস কমে আসছে মা’র,
শ্বাস নেবার জন্য কী অসম্ভব কাতরাচ্ছে–
যন্ত্রণায় কুঁচকে আছে কপাল, কালো ভুরু
গোটা বাড়ি তখন চেঁচিয়ে মাকে বলছে তাদের সালাম পৌঁছে দিতে নবীজিকে,
কারও কোনও সংশয় নেই যে মা জান্নাতুল ফিরদাউসে যাচ্ছে,
নবীজির হাত ধরে বিকেলে বাগানে হাঁটবে,
পাখির মাংস আর আঙুরের রস খাবে দুজন বসে,
অমনই তো স্বপ্ন ছিল, মা’র অমনই স্বপ্ন ছিল।
আশ্চর্য, মা তবু কোথাও এক পা যেতে চাইছিলো না।
চাইছিলো বিরুই চালের ভাত বেঁধে খাওয়াতে আমাকে,
টাকি মাছের ভর্তা আর ইলিশ ভাজা। নতুন ওঠা জাম-আলুর ঝোল।
একখানা কচি ডাব পেড়ে দিতে চাইছিলো দক্ষিণের গাছ থেকে,
চাইছিলো হাতপাখায় বাতাস করতে চুল সরিয়ে দিতে দিতে–
কপালের কটি এলো চুল।
নতুন চাঁদর বিছিয়ে দিতে চাইছিলো বিছানায়,
আর জামা বানিয়ে দিতে, ফুল তোলা..

চাইছিলো উঠোনে খালি পায়ে হাঁটতে,
হেলে পড়া কামরাঙা গাছটির গায়ে বাঁশের কঞ্চির ঠেস দিতে
চাইছিলো হাসনুহেনার বাগানে বসে গান গাইতে ওগো মায়াভরা চাঁদ আর
মায়াবিনী রাত, আসেনি তো বুঝি আর জীবনে আমার। ….

বিষম বাঁচতে চেয়েছিলো মা।

.

২.

আমি জানি পরকাল, পুলসেরাত বলে কিছু নেই।
আমি জানি ওসব ধর্মবাদীদের টোপ
ওসব বেহেসত, পাখির মাংস, মদ আর গোলাপি মেয়েমানুষ!

আমি জানি জান্নাতুল ফিরদাউস নামের কোনও বেহেসতে
যাবে না, কারও সঙ্গে বাগানে হাঁটবেনা মা!
কবর খুঁড়ে মা’র মাংস খেয়ে যাবেপাড়ার শেয়াল
শাদা হাড়গুলো বিচ্ছিরিরকম ছড়িয়ে–
গোরখাদক একদিন তাও তুলে ফেলে দেবে কোথাও,
জন্মের মত মা নিশ্চিহ্ন হবে।

তবু আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে
সাত আসমানের ওপরে অথবা কোথাও
বেহেসত বলে কিছু আছে,
জান্নাতুল ফিরদাউস বলে কিছু,
চমৎকার কিছু,
চোখ ঝলসানো কিছু।
মা তরতর করে পুলসেরাতপার হয়ে গেছে
পলক ফেলা যায় না দেখলে এমন সুদর্শন, নবীজি,
বেহেসতের সদর দরজায় দাঁড়িয়ে মা’কে আলিঙ্গন করছেন;
মাখনের মত মা মিশে যাচ্ছে নবীজির লোমশ বুকে।
ঝরণার পানিতে মা’র স্নান করতে ইচ্ছে হচ্ছে
মা’র দৌড়োতে ইচ্ছে হচ্ছে
বেহেসতের এ মাথা থেকে ও মাথা–
মা স্নান করছে,
দৌড়োচ্ছে, লাফাচ্ছে।
রেকাবি ভরে পাখির মাংস এসে গেছে, মা খাচ্ছে।
মা’কে দেখতে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা পায়ে হেঁটে
বাগান অবদি এসেছেন।
মা’র খোঁপায় গুঁজে দিচ্ছেন লাল একটি ফুল,
মা’কে চুমু খাচ্ছেন।
আদরে আহ্লাদে মা নাচছে, গাইছে।

মা ঘুমোত গেছে পালকের বিছানায়,
সাতশ হুর মা’কে বাতাস করছে,
রুপোর গেলাশ ভরে মা’র জন্য পানি আনছে গেলবান।
মা হাসছে, মা’র সারা শরীর হাসছে
আনন্দে।
পৃথিবীতে এক দুঃসহ জীবন ছিল মা’র, মা’র মনে নেই।

এত যে ঘোর নাস্তিক আমি,
আমার বিশ্বাস করতে ভাল লাগছে বেহেসত বলে কিছু আছে কোথাও।

.

দুঃখবতী মা

মা’র দুঃখগুলোর ওপর গোলাপ-জল ছিটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল,
যেন দুঃখগুলো সুগন্ধ পেতে পেতে ঘুমিয়ে পড়ে কোথাও
ঘুমটি ঘরের বারান্দায়, কুয়োর পাড়ে কিম্বা কড়ই তলায়।
সন্ধেবেলায় আলতো করে তুলে বাড়ির ছাদে রেখে এলে
দুঃখগুলো দুঃখ ভুলে চাঁদের সঙ্গে খেলত হয়ত বুড়িছোঁয়া খেলা।

দুঃখরা মা’কে ছেড়ে কলতলা অবদি যায়নি কোনওদিন।
যেন এরা পরম আত্মীয়, খানিকটা আড়াল হলে বিষম একা পড়ে যাবেন মা;
কাদায় পিছলে পড়বেন, বাঘে ভালুকে খাবে, দুষ্ট জ্বিনেরা গাছের মগডালে
বসিয়ে রাখবে মা’কে–
দুঃখগুলো মা’র সঙ্গে নিভৃতে কী সব কথা বলত…
কে জানে কী সব কথা

মা’কে দুঃখের হাতে সঁপে বাড়ির মানুষগুলো অসম্ভব স্বস্তি পেত।
দুঃখগুলোকে পিড়ি দিত বসতে,
লেবুর শরবত দিত, বাটায় পান দিত,
দুঃখগুলোর আঙুলের ডগায় চুন লেগে থাকত..
ওভাবেই পাতা বিছানায় দুঃখগুলো দুপুরের দিকে গড়িয়ে নিয়ে
বিকেলেই আবার আড়মোড়া ভেঙে অযুর পানি চাইত,
জায়নামাজও বিছিয়ে দেওয়া হত ঘরের মাঝখানে।
দুঃখগুলো মার কাছ থেকে একসুতো সরেনি কোনওদিন।

ইচ্ছে ছিল লোহার সিন্দুকে উই আর
তেলাপোকার সঙ্গে, তেলাপোকা আর
নেপথলিনের সঙ্গে ওদেরপুরে রাখি।
ইচ্ছে ছিল বেড়াতে নিয়ে গিয়ে ব্রহ্মপুত্রের জলে, কেউ জানবে না,
ভাসিয়ে দেব একদিন
কচুরিপানার মতো, খড়কুটোর মতো, মরা সাপের মতো ভাসতে ভাসতে দুঃখরা
চলে যাবে কুচবিহারের দিকে…
ইচ্ছে ছিল

দুঃখগুলো মা’র সঙ্গে শেষ অবদি কবর অবদি গেছে,
তুলে নিয়ে কোথাও পুতে রাখব অথবা ছেঁড়া পুঁতির মালার মত ছুড়ব রেললাইনে,
বাঁশঝাড়ে, পচা পুকুরে। হল কই!
মা ঘুমিয়ে আছেন, মা’র শিথানের কাছে মার দুঃখগুলো আছে,
নিশুত রাতেও জেগে আছে একা একা।

.

দেশ বলতে এখন দেশ

এখন আমার কাছে আস্ত একটি শ্মশান,
শ্মশানে দাঁড়িয়ে প্রতিরাতে একটি কুকুর কাঁদে,
আর এক কোণে নেশাগ্রস্ত পড়ে থাকে চিতা জ্বালানোর কজন তোক।
দেশ এখন আমার কাছে আর শস্যের সবুজ ক্ষেত নয়,
স্রোতস্বিনী নদী নয়, রোদে ঝিলমিল দীঘি নয়,
ঘাস নয়, ঘাসফুল নয় …

দেশ ছিল ‘র ধনেখালি শাড়ির আঁচল
যে আঁচলে ঘাম মুছে, চোখের জল মুছে দাঁড়িয়ে থাকতেন মা, দরজায়।
দেশ ছিল ‘র গভীর কালো চোখ,
যে চোখ ডানা মেলে উড়ে যেত রোদ্দুরে, রাত্তিরে
যেখানেই ভাসি, ডুবি, পাড় পাই–খুঁজত আমাকে।
দেশ ছিল ‘র এলো চুলের হাতখোঁপা,
ভেঙে পড়ত, হেলে পড়ত, রাজ্যির শরম ঢাকত আমার।

দেশ ছিল ‘র হাতে সর্ষের তেলে মাখা মুড়ি
মেঘলা দিনে ভাজা ইলিশ, ভুনো খিচুড়ি
দেশ ছিল মা’র হাতের ছ’জোড়া রঙিন চুড়ি।
দেশ ছিল বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে মা মা বলে ডাকার আনন্দ।
কনকনে শীতে মা’র কাঁথার তলে গুটিসুটি শুয়ে পড়া,
ভোরবেলায় শিউলি ছাওয়া মাঠে বসে ঝাল-পিঠে খাওয়া..

অন্ধকারে মুড়ে,
দূরে,
নৈঃশব্দ্যের তলে মাটি খুঁড়ে
দেশটিকে পুরে,
পালিয়েছে কারা যেন,
দেশ বলে কেউ নেই এখন, কিছু নেই আমার।
খাঁ খাঁ একটি শ্মশান সামনে, একটি কুকুর, আর কজন নেশাগ্রস্ত লোক।

.

তুমি নেই বলে

তুমি নেই বলে ক’টি বিষাক্ত সাপ উঠে এসেছে উঠোনে, ফিরে যাচ্ছে না
জলায় বা জংলায়।

কাপড়ের ভাঁজে, টাকা পয়সার ড্রয়ারে, বালিশের নিচে, গ্লাসে-বাটিতে, ফুলদানিতে,
চৌবাচ্চায়, জলকলের মুখে
ইঁদুর আর তেলাপোকার বিশাল সংসার এখন,
তোমার সবকটি কবিতার বইএ এখন উই।
তুমি নেই বলে মাধবীলতাও আর ফোটে না
দেয়াল ঘেঁসে যে রজনীগন্ধার গাছ ছিল, কামিনীর,
ওরা মরে গেছে, হাসনুহানাও।
গোলাপ বাগানে গোলাপের বদলে শুধু কাঁটা আর পোকা খাওয়া পাতা।

বুড়ো জাম গাছের গায়ে বিচ্ছুদের বাসা, পেয়ারা গাছটি হঠাৎ একদিন
ঝড় নেই বাতাস নেই গুঁড়িসুদ্ধ উপড়ে পড়ল।
মিষ্টি আমের গাছে একটি আমও আর ধরে না, নারকেল গাছে
না একখানা নারকেল।
সুপুরি গাছেদের নাচের ইশকুল বন্ধ এখন।

তুমি নেই বলে সবজির বাগান পঙ্গপাল এসে খেয়ে গেছে
সবুজ মাঠটি ভরে গেছে খড়ে, আগাছায়।
তুমি নেই বলে মানুষগুলো এখন ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে পারে যে কাউকে।

তুমি নেই
তোমার না থাকা জুড়ে দাপট এখন অদ্ভুত অসুস্থতার,
আমার শ্বাসরোধ করে আনে দূষিত বাতাস..
আমিও তোমার মতো যে কোনও সময় নেই হয়ে যেতে চাই।

(তোমার না থাকার দৈত্য ঝাঁপিয়ে পড়ছে ঘাড়ে,
তোমার না থাকার শকুন ছিঁড়ে খাচ্ছে আমার সর্বাঙ্গ,
তোমার না থাকার উন্মত্ত আগুন পুড়িয়ে ছাই করছে
তোমার না থাকার সর্বগ্রাসী জল আমাকে ডুবিয়ে নিচ্ছে…)

.

ফেরা

মা একদিন ফিরে আসবেন বলে
মা’র ঘটিবাটি, দু’জোড়া চটি
বিছানার চাঁদর, লেপ কাঁথা,
ডালের ঘুটনি, হাতা
ক’টি কাপড়, ক’টি চুড়ি দুল
চিরুনিখানি, ওতে আটকা চুল
ফুল ফলের ছবি, মা’র আঁকা
যেখানে যা কিছু ছিল, তেমন করেই রাখা।

মা ফিরে আসবেন
ফিরে কলতলায় পায়ের কাদা ধুতে ধুতে বলবেন
খুব দূরে এক অরণ্যে গিয়েছিলাম!
তোরা সব ভাল ছিলি তো!
খাসনি বুঝি! আহা, মুখটা কেন শুকনো লাগছে এত!
বাঘ ভালুকের গল্প শোনাতে শোনাতে মা আমাদের খাওয়াবেন রাতে
অনেকদিন পর মাও খাবেন মাছের ঝোল মেখে ভাতে,
খেয়ে, নেপথলিনের গন্ধঅলা লালপাড় শাড়ি পরে একটি তবক দেওয়া পান
হেসে, আগের মত গাইবেন সেই চাঁদের দেশের গান।

একদিন ফিরে আসবেন মা
ফিরে আসবেন বলে আমি ঘর ছেড়ে দু’পা কোথাও বেরোই না
জানালায় এসে বসে দু একটি পাখি,
ওরাও জানে মা ফিরবেন, বিকেলের দুঃখী হাওয়াও, ..
আকাশের সবকটা নক্ষত্র জানে, আমি জানি।

.

একটি অকবিতা

।আমার মা যখন মারা যাচ্ছিলেন, সকালবেলা স্নান করে জামা জুতো পরে ঘরবার হলেন বাবা, চিরকেলে অভ্যেস। বড়দা সকালের নাস্তায় ছ’টি ঘিয়ে ভাজাপরোল নিলেন, সঙ্গে কষানো খাসির মাংস, এ না হলে নাকি জিভে রোচে না তাঁর। ছোড়দা এক মেয়েকে বুকে মুখে হাত বুলিয়ে সাধাসাধি করছিলেন বিছানায় নিতে। সারা গায়ে হলুদ মেখে বসেছিলেন বড়বৌদি, ফর্সা হবেন; গুনগুন করে হিন্দি ছবির গান গাইছিলেন, চাকরবাকরদের বলে দিয়েছেন ইলিশ ভাজতে, সঙ্গে ভুনা খিচুড়ি। ভাইয়ের ছেলেগুলো মাঠে ক্রিকেট খেলছিল, ছক্ক মেরেপাড়া ফাটিয়ে হাসছিল। মন ঢেলে সংসার করা বোন আমার স্বামী আর কন্যা নিয়ে বেড়াতে বেরোল শিশুপার্কে। মামারা ইতিউতি তাকিয়ে মা’র বালিশের তলায় হাত দিচ্ছিল সোনার চুড়ি বাপাঁচশ টাকার নোট পেতে। খালি ঘরে টেলিভিশন চলছিল, যেতে আসতে যে কেউ খানিক থেমে দেখে নেয় তিব্বত টুথপেস্ট নয়তপাকিজা শাড়ির বিজ্ঞাপন। আমি ছাদে বসে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে নারীবাদ নিয়ে চমৎকার একটি কবিতা লেখার শক্ত শক্ত শব্দ খুঁজছিলাম।

মা মারা গেলেন।

বাবা ঘরে ফিরে জামাকাপড় ছাড়লেন। বড়দা খেয়ে দেয়ে ঢেঁকুর তুললেন। ছোড়দা রতিকর্ম শেষ করে বিছানা ছেড়ে নামলেন। বড়বৌদি স্নান সেরে মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে ইলিশ ভাজা দিয়ে গোগ্রাসে কিছুখিচুড়ি গিলে মুখ মুছলেন। ভাইয়ের ছেলেগুলো ব্যাট বল হাতে নিয়ে মাঠ ছাড়ল। স্বামী কন্যা নিয়ে বোনটি শিশুপার্ক থেকে ফিরল। মামারা হাত গুটিয়ে রাখলেন। আমি ছাদ থেকে নেমে এলাম। ছোটরা মেঝেয় আসন পেতে বসে গেল, টেলিভিশনে নাটক শুরু হয়েছে। বড়দের এক চোখ মায়ের দিকে, আরেক চোখ টেলিভিশনে। মায়ের দিকে তাকানো চোখটি শুকনো, নাটকের বিয়োগান্তক দৃশ্য দেখে অন্য চোখে জল।

.

যদি

কাউকে বাঁচতে দেখলে অসম্ভব রাগ হয় আমার।
পৃথিবীর সব গাছ যদি মরে কাঠ হয়ে যেত
পাহাড়গুলো ধসেপড়ত বাড়িঘরের ওপর,
নদী সমুদ্র শুকিয়ে চর হয়ে যেত, সেই চরে
পশুপাখি মানুষ এক বিষম অসুখে কাতরে কাতরে মরে যেত!
কদাকার পিন্ডটি যদি মহাকাশে ছিঁড়ে পড়ত হঠাৎ,
সুর্যের দুহাত কাছে গিয়ে ঝলসে যেত, ছাই হয়ে যেত!

এরকম স্বপ্ন নিয়ে আজকাল আমি বেঁচে থাকি
আর এই বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন বিবমিষা, প্রতিদিন ঘৃণা..

.

মা কষ্ট পেলে আমাদের কিছু যেত আসত না

আমার একটি মা ছিল
চমৎকার দেখতে একটি মা,
একটি মা আমার ছিল

মা আমাদের খাওয়াত শোয়াত ঘুম পাড়াত,
গায়ে কোনও ধুলো লাগতে দিত, পিঁপড়ে উঠতে না,
মনে কোনও আঁচড় পড়তে দিত না
মাথায় কোনও চোট পেতে না।
অথচ
মাকে লোকেরা কালো পেঁচি বলত,
আমরাও।
বোকা বুদ্ধ বলে গাল দিতাম মা’কে।
মা কষ্ট পেত।
মা কষ্ট পেলে আমাদের কিছু যেত আসত না।

আমাদের কিছুতে কিছু যেত আসত না,
মা জ্বরে ভুগলেও না,
মা জলে পড়লেও না,
মা না খেয়ে শুকিয়ে কাঁটা হয়ে গেলেও না
পরনের শাড়ি ছিঁড়ে ত্যানা হয়ে গেলেও না,
মা’কে মা বলে মনে হত, মানুষ বলে না।
মা মানে সংসারের ঘানি টানে যে
মা মানে সবচেয়ে ভাল রাঁধে যে, বাড়ে যে,
কাপড় চোপড় ধুয়ে রাখে গুছিয়ে রাখে যে
মা মানে হাড় মাংস কালি করে সকাল সন্ধে খাটে যে
যার খেতে নেই, শুতে নেই, ঘুমোতে নেই
যার হাসতে নেই।

যাকে কেবল কাঁদলে মানায়
শোকের নদীতে যার নাক অবদি ডুবে থাকা মানায়
মা মানে যার নিজের কোনও জীবন থাকে না।
মা’দের নিজের কোনও জীবন থাকতে নেই!
মা ব্যথায় চেঁচাতে থাকলে বলি
ও কিছুনা, খামোকা আহ্লাদ!
মরে গেলে মাকে পুঁতে রাখে মাটির তলায়,
ভাবি যে বিষম এক কর্তব্য পালন হল

মা নেই।
আমাদের এতেও কিছু যায় আসে না।

.

সাধ

তোমাকে কখনও বেড়াতে নিইনি

যেখানে চাঁদের নাগাল পেতে পাহাড়ের কাঁখে চড়ে বসে থাকে একটি দুধু নদী, গায়ে-হলুদের দিনে একঝাঁকনক্ষত্রের চোখ ফাঁকি দিয়ে চুপ চুপ, টুপ করে জলে পড়ে নদীর সারা গায়ে চুমু খায় চাঁদ!

তোমাকে কি নিয়েছি

যেখানে সমুদ্র মন খারাপ করে বসে থাকে, আর তার জলতুতোপাখিগুলো অরণ্যের বিছানায় শুয়ে রাতভর কাঁদে। সমুদ্রের মন ভাল হলে নেমন্তন্ন করেপাখিদের, অঢেল খাবার আরপানীয়ের ছড়াছড়ি–পাখিরা বিষম খুশি, কিছু ফেলে, কিছু খায়। নাচে, গায়!

তোমাকে বড় নিতে ইচ্ছে করে

যেখানে বরফের চাঁইএর হাঁটুতে মাথা রেখে সুবোধ বালকেরমত ঘুমিয়ে আছে আগ্নেয়গিরি, আর দিগন্তের মাথায় ঠোকর খেয়ে কেঁদে কেটে চোখ লাল করে অভিমানে দৌড়ে বাড়ি ফেরে হাওয়ার কিশোরী, দেখে বরফের চোখেও জল জমে মায়ায়।

তোমাকে কত কোথাও নিতে ইচ্ছে।

যেখানে সাতরঙ জামা পরে প্রজাপতি চুমু খেতে যায় ঘাসফুলের ঠোঁটে, পাড়ার ন্যাংটো হরিণ তার জামা কেড়ে নিতে দৌড়ে আসে, দেখে প্রজাপতি লুকোয় রাধাচূড়া মাসির শাড়ির আঁচলে, ঘাসফুল ভেজা ঠোঁটে অপেক্ষা করে আরেকটি চুমুর।

তুমি নেই বলেই কি ইচ্ছেরা জড়ো হচ্ছে এমন ..

.

প্রায়শ্চিত্ত

একটি অসুখ চাইছি আমি, ঠিক সেই অসুখটি–
সেই বৃহদন্ত্রের অসুখ, হামাগুড়ি দিয়ে যকৃতে পৌঁছবে,
যকৃত থেকে হেঁটে হেঁটে হাড়ে, হাড় থেকে দৌড়ে ধরবে ফুসফুস
ফুসফুস পেরিয়ে রক্তনদী সাঁতরে মস্তিষ্ক।
ভুল কাটাছেঁড়া, ভুল ওষুধ, ভুল রক্তের চালান
অসুখের পেশিতে শক্তির যোগান দেবে, কুরুক্ষেত্রে বাড়তি সৈন্য, রণতরী।
সেরকম পড়ে থাকব বিষণ্ণ বিছানায় একা, যেরকম ছিলে তুমি
যেরকম আস্ত কঙ্কাল, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া হাড়ের কঙ্কাল
মাংস খসে পড়ছে, রক্ত ঝরে যাচ্ছে
ধসে পড়ছে স্নায়ুর ঘরবারান্দা

ঠিক সেরকম হোক আমারও,
আমারও যেন চোখের তারা জন্মের মত অচল হয়
যেন তীব্র শ্বাসকষ্ট হয়, ফুসফুস
ফুলে ঢোল হয়ে থাকে জলে, নিশ্বাসের হাওয়া পেতে যেন কাতরাই,
যেন হাত পা ছুঁড়ি,
যেন না পাই।
যেন কারও স্পর্শ পেতে আকুল হই,
যেন কাতরাই, হাত বাড়াই,
যেন না পাই।

০৯. প্যারিস থেকে আবার কলকাতা

 

প্যারিস থেকে আবার কলকাতা চলে যাই। বইমেলায় যাবো। বাঁচতে যাই কলকাতায়। তোমাকে সম্ভবত আবার ভুলে থাকতে যাই। কিন্তু সত্যি কি ভোলা হয়! তুমি কখনও কলকাতায় আসোনি মা। তোমাকে দেশের কোথাও নিয়ে যাইনি, কলকাতায় নিয়ে আসার কথা কল্পনার মধ্যেও কখনও ছিলো না। দেশে যখন ছিলাম, বন্ধুদের নিয়ে কলকাতা বেড়াতে আসতাম। তুমি যখন ছোট ছিলে, তোমার বাবা কলকাতা থেকে তোমার জন্য লাল একটা জামা কিনে নিয়ে গিয়েছিল। কলকাতার কথা শুনেছো শুধু, কোনওদিন দেখনি কলকাতা কেমন দেখতে। আমি যখন দেশে ফিরে কলকাতার গল্প করতাম, তুমি নিঃশব্দে শুনতে। কোনওদিন বলোনি আমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে কলকাতা। বলার সাহস হয়তো পেতে না। তোমার স্বপ্নগুলো ঠিক কেমন ছিল মা? কখনও উড়তো কি? নাকি চিরকালই খাঁচায় বন্দি ছিল? তুমি যেমন ছিলে? এবার বাবাকে কলকাতায় আসতে বলি। আমি বললেই তো ঘটনা ঘটে যায় না। বাবাকে রাজি করানো মানে হিমালয় পর্বতকে নড়ানো। ময়মনসিংহ থেকে তাকে ঢাকায় আনা, ভিসা করা, টিকিট করা, বিমানে ওঠানো ছোটদাই করে এই কাজগুলো। বাবা আর সুহৃদ আসে কলকাতায় আমার সঙ্গে দেখা করতে। তবে বইমেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পর, একেবারে ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে মাত্র কয়েক দিনের জন্য আসে। তখন কলকাতায় একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করা হচ্ছে। বাবাকে নিয়ে শহীদ মিনারে ফুল দিই। ঢাকার শহীদ মিনারে একুশে ফ্রেব্রুয়ারির ভোরে খালি পায়ে হেঁটে ফুল দিতাম, হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে। সেই শহীদ মিনারের তুলনায় কলকাতার মিনার কিছু নয়। লোকও নেই বেশি। তারপরও তো শহীদ মিনার। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা স্মরণ করছে বাংলা ভাষার জন্য পূর্ববঙ্গের বাঙালির আত্মত্যাগ এ বড় ভালো লাগা দেয়। বাংলার পূর্ব আর পশ্চিমকে আমি আলাদা করে দেখি না। দেখিনা বলেই আমি কলকাতায় এলে মনে করি দেশে ফিরেছি। যে দেশে এলে নিজের দেশের মানুষের সঙ্গে দেখা হতে পারে, সে দেশ দেশ নয়তো কী!

তাজ বেঙ্গল হোটেলেই আমার সঙ্গে কদিন থাকে বাবা আর সুহৃদ। সুহৃদ সেই যে তোমার অসুখের সময় দেশে গিয়েছিলো, দেশেই থেকে গেছে। ওকে দেশেরইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে সে চাইলেও আর ফিরতে পারছে না আমেরিকায়। আমেরিকায় ফেরারই কী দরকার, আমি বুঝি না। আমার শান্তিনগরের বাড়িতে থাকে। ওকে নিয়মিত টাকা পাঠাই বিদেশ থেকে। বই, কমপিউটার, কাপড়চোপড়, বইপত্র, খাওয়া দাওয়া যা দরকার সবকিছুর জন্য। তার নাকি দেশের পড়াশোনা ভালো লাগে না। আসলে সত্যি বলতে কী, আমেরিকার ইস্কুলের তুলনায় দেশের ইস্কুলেরপড়াশোনার চাপ বেশি, তাই ভালো না লাগায় ধরেছে। ছোটদা ছেলেকে খুব মানুষ করতে পারছে আমার মনে হয় না। সুহৃদ, লক্ষ করলাম, বন্ধুদের জন্য আনা যে হুইস্কি আনিয়েছিলাম, তার থেকে খানিকটা খেয়ে নিয়েছে। খেয়ে ধরা পড়ারপরও মিথ্যে বলছে যে খায়নি। বিশ্বাস হয় না এই ছেলেকে কী ভীষণ আদর দিয়েই না বড় করেছিলে! ছোটদাতার অগুণতি প্রেমিকা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে ছেলের দেখাশোনা করবে কখন, বলো! মাস্টার রেখে দিয়েছে, সে মাস্টারের কাছেও নাকি যায় না। আমেরিকার ক্লাস এইটের ছেলের বিদ্যে বাংলাদেশের ইস্কুলে ক্লাস ফাইভের ছেলের মতো। প্রাইভেটে পরীক্ষা দেবে ব্রিটিশ ইস্কুলের নিয়মে, ও লেভেল। কিন্তু পড়াশোনা করার ছেলে কি ও? এই অতি-চাপ থেকে বাঁচতে ওর এক চিন্তা আমেরিকায় ফিরে যাবে কী করে। আমেরিকার গ্রিন কার্ডও তখন ওর হয়নি। বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে এবার আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। পড়াশোনা না করলেও টেনিস খেলাটা সে নিয়মিত খেলছে। টেনিসের দল নিয়ে এশিয়ায় কোন কোন দেশে নাকি খেলেও এসেছে। কলকাতায় আসার কয়েক মাস পর কয়েকজন টেনিস খেলোয়ারের সঙ্গে লন্ডন গেছে খেলতে, ওখান থেকেপরিকল্পনা কানাডাতে খেলতে যাবে, কানাডা থেকে আমেরিকায়। তখনও আমেরিকার ভিসাতার জোটেনি। ছোটদা লন্ডনে ফ্রি টিকিটে নিয়ে এলো সুহৃদকে। ওকে দিয়ে আমাকে ফোন করালোপ্যারিসে, চলে যাচ্ছে আমেরিকায়, দেখা কবে হয় কে জানে। আমি যেন এক্ষুণি চলে আসি লন্ডনে।

আমাকে একটিবার দেখতে চায়, যেহেতু কাছেই আছি। আমি খবর পেয়ে উড়ে চলে গেলাম লন্ডনে। ছোটদা আর সুহৃদকে পেয়ে আমার কী যে ভালো লাগলো। কিন্তু খানিক পরই ছোটদা সোজাসুজি বলে দিল, সে লন্ডন পর্যন্ত সুহৃদকে এনেছে। কালই সে ঢাকা ফিরে যাচ্ছে বিমানে, সুহৃদকে কানাডা বা আমেরিকার টিকিটের টাকা দেওয়া, ওখানে থাকা খাওয়ার খরচ দেওয়া তারপক্ষে সম্ভব নয়। তার মানে টাকা আমাকে দিতে হবে। আসলে আমি জানতাম না, আমাকে দেখার জন্য নয়, সুহৃদকে দিয়ে প্যারিস থেকে আমাকে লন্ডন ডেকে পাঠানোর মূল উদ্দেশ্য হল, আমার ঘাড়ে সুহৃদকে ফেলা। যে ছেলেকে তার জন্ম থেকে ভালোবাসছি, সে ছেলেকে তো মাঝপথে রেখে তার বাবা চলে গেলেও আমি চলে যেতে পারি না। তার জন্য আমি তো নিঃস্ব হয়ে গেলেও, জীবন দিয়ে হলেও যা কিছু করার করবো। কিন্তু আমি তো অঢেল টাকা আনিনি। ছোটদার সে নিয়ে ভাবনা নেই। সে জানেনা কী করে সমস্যার সমাধান হবে। চলে গেল ছোটদা। আমার ওপর সুহৃদের সব দায়িত্ব ওর কানাডায় যাওয়া, হোটেলে থাকা, কানাডা থেকে আমেরিকা, যদি আমেরিকায় ঢুকতে না দেয় তবে ঢাকায় ফেরত যাওয়া, তার ওপর আবার যদি কোনও অঘটন ঘটে, সেই অঘটন সামলান। লন্ডনের কোনও এক হোটেলে গিয়ে ক্রেডিট কার্ড থেকে যত ক্যাশ টাকা তোলা যায় তুলোম। কিন্তু ও টাকায় ওর যাত্রা হবেনা। ছোটদা দেখ আমাকে কী দুরবস্থার মধ্যে ফেলে চলে গেল। এখন কোত্থেকে আমি টাকা পাবো, লন্ডনে আমার কোনও ব্যাংক নেই যে আমি টাকা তুলবো। প্রত্যেকটা ক্রেডিট কার্ডের জন্য একটা নির্দিষ্ট টাকার অংক থাকে, যেটুকু তুমি তুলতে পারো। আশংকা আমাকে আঁকড়ে ধরে লন্ডনের ব্যাংক থেকে জার্মানির হামবুর্গেশহরের ব্যাংকের ফোন নম্বর যোগাড় করি, সেখানে ফোন করে ব্যাংকের লোকদের লন্ডনের ওই ব্যাংকে এক্ষুণি দশ হাজার ডয়েচে মার্কপাঠিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করি। সাধারণত এ ধরনের অনুরোধ মানে না ব্যাংক, কিন্তু জানি না কেন, মানলো। যে কেউ তো এমন উড়ো ফোন করে টাকা চাইতে পারে। কী করে জার্মানির ব্যাংক জানবে যে ফোনটা আমিই করেছি! কিছুরই তো প্রমাণ নেই। হাতে তো আমার অ্যাকাউন্টের তথ্যাদিও কিছুই ছিল না যে ওদের জানাবো। কণ্ঠস্বরও চেনা হওয়ার খুব কোনও কারণ ছিল না। সুহৃদকে টিকিট করে দিলাম কানাডা যাওয়ার নানা দেশের টাকা আমার ওয়ালেটে থাকে, ওসব ভাঙিয়েও কানাডার টাকা করে দিলাম। জার্মানির ডয়েচে মার্ককে পাউণ্ড করা, পাউণ্ডকে ডলার করা। এভাবেই আব্দার আহ্লাদ যার ছোটবেলা থেকেইপূরণ করে আসছি, পূরণ করি। সুহৃদকে কানাডার উড়োজাহাজে তুলে দিয়েতবে আমি ফিরলাম প্যারিসে। সুহৃদ শেষ অবদি পৌঁছেছিল নিউইয়র্কে, বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়েই। যে টাকা দিয়েছিলাম, তার অর্ধেকও তার দরকার পড়েনি। একদিন নাকি নিউইয়র্কের রাস্তায় কালো একদল গুণ্ডা তার বাকি টাকাগুলো কেড়ে নিয়েছে। এভাবেই আমার কষ্টের উপার্জন গেছে। বাবাকে কলকাতায় ডাক্তার দেখালাম। ওষুধপত্র যেভাবে খেতে বলেছে, সেভাবে বারবার অনুরোধ করলাম খেতে। চেয়েছিলাম বাবা আরও কটা দিন থাকুক। কিন্তু যে মানুষ ময়মনসিংহের বাড়ি আর চেম্বার ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না, তাকে আর কতদিন রাখা যায়! শুধু তোমার অসুখের সময় বেরিয়েছিল। আমাকে দেখতে বেরোলো বটে, কলকাতায়, কিন্তু যেহেতু আমি আর দুদিন বাদে মরছি না, বাবার যাই যাইটা মাত্রা ছাড়া হয়ে উঠলো। জোর করে, ধমক দিয়ে, বুঝিয়ে, অনুরোধ করেও বাবাকে বেশিদিন রাখতে পারিনি। একটাই বিছানা ছিল বড় তাজের সুইটে। ওতে বাবা, সুহৃদ আর আমি একসঙ্গে ঘুমিয়েছি। অনেক রাত জেগে গল্প করেছি। বাবার বোনের ছেলে মোতালেব এসেছিলো। ওকে দিয়ে খাবারটাবার বাইরে থেকে আনিয়েছি। হোটেলের রেস্তোরাঁয় খেতে চাইনি, অকারণে অত্যধিক দাম, তাই। এখন আবার ভাবি, কেন আমি বাবাকে ভালো রেস্তোরাঁয় প্রতিদিন খাওয়াইনি। কেন বাবাকে যত সময় দিয়েছি তার চেয়েও বেশি দিইনি। নিখিল সরকারের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম বাবাকে। বাবা অনেকটা যেন স্বস্তি পেলেন কেউ আমাকে বাবার মতো স্নেহ করছে দেখে। যে মেয়ে দেশে ফিরতে পারছে না, সেই মেয়েকে যারা ভালোবাসছে, তার ভালো মন্দ যারা দেখছে, তাদের সঙ্গে কথা বলে বাবা বিনয়ে গলে পড়েছে। সুইডেন থেকে দেশে ফিরে যাওয়ার আগের দিন মাইকেলকে জড়িয়ে ধরে ‘টেইক কেয়ার মাই ডটার, প্লিজ মাইলে, টেক কেয়ার মাই ডটার’ বলে জোরে জোরে কাঁদছিলে তুমি। নিখিল সরকারকে জড়িয়ে ধরে না কাঁদলেও বাবার চোখে মুখে তোমার সেই আকুতিই ছিলো। বুদ্ধদেব গুহ আমার হোটেলে এসেছিলেন। তাঁকে দেখে, তাঁর গান শুনে বাবা বিষম মুগ্ধ। দেশ থেকে জাদুকর জুয়েল আইচ এসেছিলেন। তাঁর জাদু দেখেও বাবা ভীষণ খুশি। এমনকী কোনও এক কালে বাবার চণ্ডিপাশা ইস্কুলের ছাত্র ছিলো দাবি করে এক বয়স্ক লোক বাবার সঙ্গে দেখা করার নাম করে মূলত আমাকেই দেখতে আসতো, তাঁর সঙ্গেও বাবা ঘণ্টা দুঘণ্টা বসে কী কথা বলতো কে জানে। বাবা একসময় কী কথায় যেন বাড়িঘর জমিজমা ভাগ করার পরিকল্পনা করছে বললো। আমি বলেছিলাম সব চারভাগেসমান ভাবে ভাগকরতে। পরে অবশ্য বলেছিলাম, আমার কিছুই চাইনা, শুধু অবকাশটা চাই। আমার বড় হয়ে ওঠা, আমার কৈশোর, যৌবন যে বাড়িতে, যে আঙিনায় কেটেছে, দাবি করেছি সেই স্মৃতিটুকুই। বাবা শুধু রহস্যের হাসি হাসলো। বাবার এই হাসি আমার জন্ম থেকে চেনা। বাবার রহস্য চিরকালই আমার কাছে রহস্যই থেকে যেত। যেদিন বাবাকে কলকাতার দমদম বিমান বন্দরে নামিয়ে দিতে গেলাম, বুক ফেটে যাচ্ছিল। শুধু মনে হচ্ছিল, বাবার সঙ্গে এই বোধহয় আমার শেষ দেখা! আমার সেই মনে হওয়াটা ভুল ছিল না মা। বাবার সঙ্গে ওই-ই ছিল আমার শেষ দেখা।

বাবা দেশে ফিরে যাওয়ার কিছুদিন পর আমিও ফিরে যাই প্যারিসে। কেন যে যাই কে জানে। অবশ্য কলকাতায় বাড়ি নেই ঘর নেই, এক হোটেলে হোটেলে আর কদিন থাকবো। আর ভিসাও তো ফুরিয়ে যায় দেখতে দেখতে। কিন্তু সেবার কী হলো শোনেনা, বোম্বে থেকে আমার হোটেলে ফোন করলেন অশোক সাহানি, এক মারাঠি লোক, তিনি আমার শোধ উপন্যাসটা বাংলা থেকে মারাঠি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। বইটা ছাপাও হয়েছে বোম্বেতে। অশোক সাহানির আবদার এবার যেন কলকাতা থেকেপ্যারিস ফেরারপথে বোম্বেতে আমি কয়েকঘণ্টার জন্য থামি, বইটার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকি। রাজি না হওয়ার কিছু নেই। কলকাতা থেকে সন্ধেয় বোম্বেতে পৌঁছেপ্যারিসের রাতের বিমান ধরার বদলে সকালে বোম্বে পৌঁছে শোধের অনুষ্ঠান শেষ করে রাতে প্যারিসের দিকে রওনা হবো, এতে ক্ষতি নেই কোনও কিন্তু বিশাল গণ্ডগোল বেধে গেল। অশোক সাহানি আমার বোম্বের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার খবর ছাপিয়ে দিয়েছেন ওখানকার পত্রিকায়। আর সঙ্গে সঙ্গে বোম্বের মুসলিম মৌলবাদীদের মিছিল শুরু হয়ে যায়। তারা ঘোষণা করে দেয় বোম্বের মাটিতে পা দেওয়ার কোনও অধিকার আমার নেই। আমি এলে বিমান বন্দরে ওরা আগুন জ্বালিয়ে দেবে। এদিকে এসবখবরে বোম্বের মৌলবাদবিরোধী দলগুলোর প্রতিবাদ শুরু হল। মুহুর্মুহু ফোন আসতে শুরু করলো তিস্তা শীতলবাদি, জাভেদ আনন্দ, এমনকী জাভেদ আখতারেরও। তাঁরা চান আমি যেন আবার ঘুণাক্ষরেও না সিদ্ধান্ত নিই বোম্বে না আসার। আসলে আমি সিদ্ধান্ত না নিলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর উপদেশ ছিল বোম্বে হয়ে না গিয়ে দিল্লি হয়ে যেন প্যারিস যাই। ওতেই রাজি ছিলাম। কিন্তু যতবার ওঁদের বলি, বোম্বে হয়ে যাবো না, ততবারই ওঁরা বলেন, আমি না গেলে মৌলবাদীদের বিজয় ঘোষিত হবে, মৌলবাদীরাপার পেয়ে যাবে এই অবৈধ ফতোয়া দিয়ে। ওঁরা নাহয় আন্দোলন করছেন, কিন্তু মরতে তেহবে একা আমাকে, আমিই যখন টার্গেট। লেখার আরও বই আছে বাকি, জেনে শুনে জীবন হারাতে চাই না এখন। বোম্বের মাটিতেপা দিলে আমাকে মেরে ফেলবে, যারা ঘোষণা করেছে, তারা ছোটখাটো কোনও দল নয়। তারা যে কত ভয়ংকর, তা আমি বাংলাদেশে দেখে এসেছি। মূর্খ উন্মাদের সামনে বুক পেতে দাঁড়াবার কী প্রয়োজন। আর পাশ্চাত্যের নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার অভিজ্ঞতা যার আছে, তার কখনও এ দেশের নড়বড়ে নিরাপত্তার ওপর আস্থা রাখার প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু ওঁরা বলেই চলেছেন, সরকারের সঙ্গে কথা হয়েছে ওঁদের। নিরাপত্তার ব্যবস্থা কঠোর করা হবে। শেষে অন্তত এইটুকু বলে নিস্তার পেতে চাই যে মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন না বোম্বেতে আমি যাই। ওঁরাও জোঁকের মতো লেগে থেকে মুখ্যমন্ত্রীকে রাজি করালেন। বোম্বে যেদিন নামলাম, আমি তো অবাক, মহেশ ভাট, আমার প্রিয়পরিচালক দাঁড়িয়ে আছেন আমার অপেক্ষায়, হাতে ফুল। দাঁড়িয়ে আছেন আমার প্রিয় গীতিকার জাভেদ আখতার, দাঁড়িয়ে আছেন শাবানা আজমি, আমার প্রিয় অভিনেত্রী। শাবানা আজমি দিল্লিতে ছিলেন। দিল্লি থেকে চলে এসেছেন বোম্বের বিমান বন্দরে আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে। পুনে থেকে লজ্জার প্রকাশক এসেছেন। তিস্তা, জাভেদ ওঁরা তো ছিলেনই। ওঁরা হিন্দু মৌলবাদের বিপক্ষে যেমন লড়েন, মুসলিম মৌলবাদের বিপক্ষেও লড়েন। বিমান বন্দরের ভিআইপি রুম আমাকে বিশ্রামের জন্য দেওয়া হল। বিশ্রামের কোনও দরকার ছিল না। আমি রীতিমত উত্তেজিত। কী যে কথা বলবো ওঁদের সঙ্গে বুঝতে পারছিলাম না। সাংবাদিকদের ভীষণ ভিড়। বিমান বন্দর ঘিরে আছে শত শত পুলিশ। আয়োজকরাই বললেন, আমাকে নাকি জেড সিকিউরিটি দেওয়া হচ্ছে। একশ চুয়াল্লিশ ধারা জারি করা হয়েছে শহরে। বোম্বের রাস্তা থেকে জঙ্গিদের গ্রেফতার করাও হচ্ছে। আমাকে প্রথম জুহু বিচে জাভেদ আনন্দর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। ওখানে দুপুরের খাওয়া। নিজে সে পারসি। কিন্তু ধর্মমুক্ত। কমব্যাট নামের একটা মৌলবাদ বিরোধী ম্যাগাজিন ছাপান তিস্তা আর জাভেদ। ওই বাড়ির উঠোনে বসেশাবানা, জাভেদ আখতার, তিস্তা–ওঁদের সবার সঙ্গে মৌলবাদের উত্থান নিয়ে আলোচনা হয়। মহেশ ভাট বলেন, আমার জীবন নিয়ে তিনি একটা সিনেমা বানাতে চান। কোথাও ঘোষণাও দিয়ে দেন। বিদেশে আমাকে ঘিরে অনেক উৎসব হয়। যত বড় আর জমকালোই হোক না কেন সেইসব উৎসব বা সংবর্ধনা, বোম্বের এই উৎসব আমাকে উত্তেজনা দেয়, কারণ এঁদের কাজের সঙ্গে আমি পরিচিত, আর এঁরা একই লড়াই করছেন, যে লড়াই আমি আমার লেখার মাধ্যমে করছি বহু বছর। আমরা একই উপমহাদেশের মানুষ। আমাদের ইতিহাসটাও যেমন এক, আমাদের লড়াইটাও প্রায় একইরকম। এর আগে জাভেদ আখতারের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল স্টকহোমে। তিনি ভারতীয় অভিবাসীদের আমন্ত্রণে ওখানে গিয়েছিলেন, কবিতা শোনাচ্ছিলেন। আমাকে দেখে ডেকেপাশে বসালেন, পড়েছিলেনও আমাকে নিয়ে একটা কবিতা শব্দের জাদুকর তিনি। কিন্তু কাছে এলে বুঝি কী সাধারণ মানুষ এঁরা। শাবানাও। আমার মতোই সাধারণ। দুঃখ সুখ এঁদেরও আর সবার মতোই। আসলে দেশেবিদেশে যত বড় মানুষের সঙ্গেপরিচয় হয়েছে, কাউকে আমার খুব দুর্বোধ্য ঠেকেনি। রাতে অনুষ্ঠানেরপর জাভেদ আখতার বসে রইলেন টেলিভিশনের সামনে, কখন আমাদের অনুষ্ঠানের খবর বা আমার খবর দেখায় দেখতে। অনুষ্ঠানে সবাই বক্তৃতা করেছিলেন। শোধ বইয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটা প্রচুর পুলিশ পাহারায়হয়, মূলত মৌলবাদবিরোধী মূল্যবান একটা অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে।

প্যারিসে পৌঁছোনোর পর খবর পাই, ‘আমার মেয়েবেলা’ বইএর জন্য আমি এবারের আনন্দ পুরস্কার পেয়েছি। কত তোপুরস্কার পেয়েছি বিদেশে। কিছুই আমাকে এত সুখ দিতেপারে না, যত সুখ আনন্দ পুরস্কারের খবরটি দেয়। খুব গোপন একটি তথ্য আমাকেপুরস্কার কমিটির একজন জানান, তা হল, বিরানব্বই সালে কমিটির একজনই আমার আনন্দ পুরস্কার পাওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন, এবার দুহাজার সালেও ওই একজনই বিরোধিতা করলেন, তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। মানুষের মুখ ও মুখোশ আমি কখনও আলাদা করতে পারি না। মুখোশকেই মুখ বলে চিরকাল মনে করেছি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার কোনওকালেই কিছু নিয়ে বিরোধ ছিল না। তাঁকে শ্রদ্ধা করি, লেখক হিসেবে তো বটেই, তাঁর নাস্তিকতা এবং বাংলা ভাষা নিয়ে তাঁর লড়াইএর ঘোর সমর্থকআমি। তিনিও সবসময় বলে আসছেন, আমাকে ভালোবাসেন, স্নেহ করেন। অনেক আগে, বাংলাদেশে লজ্জা নিষিদ্ধ করার পর বিবিসি একটা তথ্যচিত্র করেছিলো আমার ওপর। ওই তথ্যচিত্রেই দেখিয়েছে আমার সম্পর্কে কলকাতার কফি হাউজে বসে বুদ্ধদেব গুহ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নবনীতা দেব সেন–তিন বড় সাহিত্যিকের আলোচনা। তিনজনের মধ্যে একজনই আমার অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন, তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁকে সবসময় খুব কাছের মানুষ ভাবতাম। কখনও কল্পনাও করিনি আনন্দ পুরস্কার কমিটির সভায় বসে আমার বিরুদ্ধে বলেন তিনি। হতেই পারে যে তিনি মনে করছেন না পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য আমি। হতেই পারে তিনি আমাকে লেখক বলেই মনে করছেন না। কিন্তু মুশকিল হল তাঁর সঙ্গে কথা বললে সেটা বোঝার কোনও উপায় থাকে না। বরং মনে হয়, আমাকে বিশাল গুরুত্বপূর্ণ লেখক ভাবেন আর আমার পক্ষে এইমাত্রই হয়তো কোথাও থেকে যুদ্ধ করে এলেন। এরপর তোমা, তুমি জানোনাপশ্চিমবঙ্গে আমার বই নিষিদ্ধ হয়, এবং যে কয়েকজন বুদ্ধিজীবী আমার বই নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন, তার মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একজন। কিছু কিছু সত্যকে, আজও, সবকিছু জানার পরও, আমার অসম্ভব বলে মনে হয়।

দুদুবার বিজেপি সরকার আমাকে ভিসা দিয়েছে ভারত ভ্রমণের। কিন্তু আনন্দপুরস্কার নিতে কলকাতায় যাওয়ার জন্য ভারতের ভিসা নিতে গেলে দূতাবাস থেকে বলে দিলো ভিসা দেবে না। কী কারণ, বোম্বেয় আমার বিরুদ্ধে মুসলমানদের মিছিল হয়েছে, তাই। কলকাতায় জানিয়ে দিলাম খবর, আমাকে ভিসা দেওয়া হচ্ছে না। মহেশ ভাটের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, তাঁকেও জানালাম। কী কী সব মন্ত্রী টস্ত্রীর সঙ্গে নাকি কথা বলেছেন, তাতে কাজ হবে বলে মনে করেছিলেন। শেষে দেখলেন অসম্ভব। ওদিকে কলকাতা থেকে আনন্দবাজারের মালিক অভীক সরকার চেষ্টা করতে লাগলেন, শুনলাম তিনি দিল্লি অবধি গেছেন এ নিয়ে সরকারের বড় কারও সঙ্গে কথা বলতে। অবাক হই ভেবে বিজেপি নাকি মুসলমান বিরোধী। বিরোধীদলে বসে অনেক কিছুই হয়তো বলে, কিন্তু ক্ষমতায় বসে অন্য দল যেভাবে দেশ চালায়, বিজেপিও একইভাবে চালায়। মুসলমান মৌলবাদীদের অন্যায় আব্দার অন্য দলের মতো বিজিপিও মেনে নেয়। মুসলমানের ব্যক্তিগত আইন যেটি খুব উলঙ্গভাবে নারীবিরোধী, সেটি দূর করে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কথা বললেও ক্ষমতায় এসে সেই বিধি ভাবনা উড়িয়ে দেয় বিজেপি। অনেক চেষ্টা তদবিরের পর শেষ মুহূর্তে ভিসার অনুমতি জোটে। কিন্তু যারা আমাকে আগে রীতিমত আদর যত্ন করেছিলো দূতাবাসে, তারা আদর যত্ন তো দূরের কথা, বরং গম্ভীর মুখে আমাকে শর্তের একটি কাগজ দেয় সই করার জন্য। ভিসা পেতে হলে যা আমাকে মানতে হবে, তা হল, ভারতের রাজনীতি নিয়ে কোনও শব্দ উচ্চারণ করা চলবে না, কলকাতা ছাড়া আর কোনও শহরে পা দেওয়া চলবে না, পুরস্কার সম্পর্কিত অথবা সাহিত্য সম্পর্কিত বিষয় ছাড়া কোনও সাক্ষাৎকার দেওয়া চলবে না। ভিসা দেওয়ার আগে টিকিট দেখে নিয়েছে যে ফিরছিপাঁচদিনপর। না, পাঁচদিনের বেশি আমাকে ভিসা দেওয়া হয়নি।

টিকিট পড়ে রইলো টেবিলের কাগজপত্রে ডুবে। ভিসা পাসপোর্টও কিছুর তলায়। সেদিন আমি ভুলে গেছি যে আমার কলকাতায় যাওয়ার কথা। দিব্যি মগ্ন ছিলাম কবিতায়, ভাসছিলাম, ডুবছিলাম চিরাচরিত নিঃসঙ্গতায়। যারা আমার জন্য অপেক্ষা করছিল দমদম বিমান বন্দরে, তাদের ফোনে আমার গভীর রাতের ঘুম ভাঙে। তুমি আসোনি কলকাতায়? বললাম, কাল আমার ফ্লাইট। বলো কি, তোমার তো ফ্লাইট আজকে ছিলো! উঠে কাগজপত্রের জঙ্গল থেকে টিকিট বের করে দেখলাম ভুল আমিই করেছি। কলকাতা থেকে আবার জরুরি টিকিটের ব্যবস্থা করে দিল যেন পরদিন আমি ফ্লাইট ধরতে পারি। যেদিন আনন্দ পুরস্কার দেওয়া হবে সেদিন গিয়ে কলকাতা পৌঁছোলাম। বন্ধুরা আমার পুরস্কার পাওয়ায় রীতিমত উত্তেজিত। আমার দুএকটা সাদামাটা শাড়ি দেখে বিশ্ব রায় দৌড়ে গিয়ে গরদের একটা লাল পাড় শাড়ি কিনে নিয়ে এলো, ব্লাউজও বানিয়ে নিয়ে এলো অল্প সময়ে। বিশ্ব রায় গতবারের কলকাতা ভ্রমণে চমৎকার বন্ধু হয়ে উঠেছিলো। যত বেশি থাকা হয় কলকাতায়, তত বেশি বন্ধু গড়ে ওঠে। অনেকে নাম দেখে, যশ দেখে বন্ধু হতে চায়। কিন্তু সেই বন্ধুত্বে কোনও না কোনওসময় চিড় ধরেই। বাঙালিরা, লক্ষ করেছি খুব দ্রুত বন্ধু হতে পারে। বিদেশিরাও বন্ধু হয়, তবে এমন তুড়ি বাজিয়ে হয় না। বন্ধু হতে ওরা সময় নেয় অনেক। স্বতস্ফূর্ততা আমার রক্তে। বাঙালির ভালোবাসা আমার নির্জনতা নিমেষে ঘুচিয়ে দেয়। জানি না কী দেয় আমাকে, মনে হয় হারিয়ে যাওয়া গোটা একটা দেশ দেয়।

বাবার সঙ্গে আরেকবার দেখা হতে আমারপারতো। কলকাতার আনন্দপুরস্কার অনুষ্ঠানে বাবাকে অনেক বলেছিলাম আসতে, আসেনি। সম্ভবত আমার চেয়েও তখন তার প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে দেশের বাড়ি, চেম্বার, তার সকাল সন্ধে রোগী দেখা, দাদার সংসারের দায়িত্ব নেওয়া। আনন্দ পুরস্কার দেওয়া হয়েছিলো আমার মেয়েবেলার জন্য, যে আনন্দ থেকে আমার বইটা ছাপানো হয়নি, সেই আনন্দই আমাকে পুরস্কার দিল! এই প্রথম পুরস্কার অনুষ্ঠান গ্র্যান্ড হোটেলের বদলে রবীন্দ্র সদনে করা হল। পুরস্কার অনুষ্ঠানের মঞ্চ অসাধারণ, যেন বনেদি একটি বৈঠক ঘর। সেই অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তোমার কথা বলেছিলাম মা। বক্তৃতার পুরোটাই তোমাকে শোনাতে ইচ্ছে করছে, শোনো।

নমস্কার। এখানে আগেও এসেছিলাম আমি, এই মঞ্চে, এসেছিলাম পাশের দেশ থেকে, তখন ঢাকার হাসপাতালে চাকরি করি, পাশাপাশি লিখি, কটি মাত্র বই বেরিয়েছে। এবার এলাম, তবে আর পাশের দেশ থেকে নয়, বহু দূরের দেশ থেকে, এখন আর ডাক্তারি করা হয় না, কেবল লেখাই কাজ। তখনকার সেই বিরানব্বই সালের আমি আর আজকের আমির মধ্যে অনেক পার্থক্য। মাঝখানে আট বছর কেটে গেছে, আর এই আট বছরে অনেক কিছু ঘটে গেছে এই একটি জীবনে। যা ঘটেছে, সবই লেখার কারণে। লিখি বলে ডাক্তারি ছাড়তে হয়েছে, লিখি বলে মিছিল হয়েছে, হত্যার হুমকি এসেছে, মাথার মূল্য ধার্য হয়েছে, লিখি বলে মামলা জারি হয়েছে, হুলিয়া বেরিয়েছে, ধর্মঘট হয়েছে, মানুষ খুন হয়েছে, লিখি বলে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি পালাতে হয়েছে রাতের পর রাত। লিখি বলে স্বজন বন্ধু সব ছাড়তে হয়েছে, ছাড়তে হয়েছে ঘর বাড়ি, ব্রহ্মপুত্র, দেশ। লিখি বলে আবার পুরস্কারও জুটেছে।

জীবন এমনই! অনিশ্চিত। আজ সম্মান পাচ্ছি, কাল হয়ত অসম্মানের চূড়ান্ত হব। আজ ঢিল ছুঁড়ছে কেউ তো কাল বাহবা দেবে। আজ মনে রাখছে তো কাল ভুলে যাবে। আজ বেঁচে আছি, কাল মরে যাব। জীবনের কোনও তো অর্থ নেই আসলে, যদি না নিজেরা অর্থপূর্ণ করি জীবনকে। একটি ব্যাপার আমি বেশ বুঝতে পেরেছি, ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীরা আমাকে তাড়া করতে করতে যেখানে নিয়ে ফেলেছে, অনাত্মীয় একটি পরিবেশে, অচেনা একটি জগতে, যেন আমি একা একা কষ্ট পেতে পেতে মরে যাই, যেন আমি হারিয়ে যাই বিষম বিরুদ্ধ স্রোতে, ভুলে যাই কী কারণে এই আমি, আমি সেখানে, এটা ঠিক, আমাকে রীতিমত যুদ্ধ করতে হচ্ছে, নিজের সঙ্গে নিজেকেই। এক আমি চাই সবার অলক্ষ্যে একটি বিন্দুর মত, ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যেতে, অভিমানে, বিষাদে। আরেক আমি হঠাৎ হঠাৎ বিষাদ ঝেড়ে উঠে দাঁড়াই বাঁচব বলে। বেঁচে থাকতে হলে আর এমন কিছু নেই আমার, যে, নিয়ে বাঁচি। এক লেখা ছাড়া।

বাংলা থেকে দূরে আমি, লিখি বাংলায়। বাঙালির জীবন থেকে হাজার মাইল দূরে বসে বাঙালির গল্প লিখি। এ যে কী রকম কঠিন কাজ, সে আমি বুঝি। আমার প্রতিদিনকার জীবন যাপনে বাংলার ছিটেফোঁটা নেই। স্মৃতি নির্ভর সব, যা কিছুই লিখি। ছ বছরপর কলকাতায় আসার সুযোগ হল, এ আমার জন্য পরম পাওয়া! এ সুযোগ আমি হারাতে চাই না। এর মধ্যেই সুযোগটি কেড়ে নেবার পাঁয়তারা চলছে, জানি না, ভারতে এই আমার শেষ আসা কিনা। আগেই বলেছি, জীবন অনিশ্চিত। আর আমার জীবনে অনিশ্চয়তা বরাবরই বড় বেশি।

.

যে বইটির জন্য আজ পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে, সেই বইটিই, মাত্র আধঘণ্টার উড়ান দূরত্বে, পাশের দেশে, আমার নিজের দেশে, নিষিদ্ধ। ওখানে ছাপা হওয়ার আগেই এটি নিষিদ্ধ। বলা হয়েছে, এ অশ্লীল একটি বই, বলা হয়েছে, এটিপড়লে লোকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে। এরকম কথা আমার অন্য বই সম্পর্কেও বলা হয়, যা কিছুই উচ্চারণ করি আমি, ওই একই দোষ। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছি এই অপরাধে আমাকে বারবার আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। এসব আমার অধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়। কিন্তু কারও অধর্মীয় অনুভূতিকে মোটে মূল্য দেওয়ার বিধান কোথাও নেই, কোনও আইন নেই যে আশ্রয় নেব। আমার জন্য এই দিনটি অবিশ্বাস্য একটি দিন, যখন বাংলা সাহিত্য থেকে দূরত্ব আমার ক্রমশ বাড়ছে, এবং আমি আশংকা করছি দিন দিন এই ভেবে যে লেখার শক্তি বুঝি আমার ফুরিয়ে গেছে, আমার বুঝি শুরুতেই সারা হল, তখনই এই আশ্চর্য সম্মান নাছোড়বান্দার মত একটি ইচ্ছে জাগাচ্ছে ভেতরে আমার, লেখার ইচ্ছে। …আজ যদি আমার মা বেঁচে থাকতেন, বিষম খুশি হতেন। স্বামী এবং কন্যা চিকিৎসক, আর তাঁকে মরে যেতে হয়েছে বিনা চিকিৎসায়। অভাবে, অনাহারে, অনাদরে, অবহেলায়, অসম্মানে, অত্যাচারে মার সারা জীবন কেটেছে। আমার মার একার গল্পই যথেষ্ট সমাজে নারীর অবস্থান জানতে। আমি যখন নারী পুরুষের বৈষম্যের বিরুদ্ধে লিখছিলাম, লিখে নাম করছিলাম, আমি কিন্তু নিজের মার দিকে ফিরে তাকাইনি। দেখিনি কতটা যন্ত্রণা তিনি সইছেন, দেখিনি পুরুষতন্ত্রের পাকে পড়ে কেমন একটি দাসী বনেছেন তিনি, যে দাসীর প্রধান এবং প্রথম কাজ স্বামী সন্তানের সেবা করা, তাদের সুখী করা। মা আমাদের সবাইকে সুখী করেছিলেন নিরন্তর সেবায়, তাঁর নিজের যে আলাদা একটি জীবন আছে, এবং সে জীবনটি যে কেবল তাঁরই, সে জীবনটি যেমন ইচ্ছে যাপন করার অধিকার তাঁর আছে, তা তাঁকে কখনই জানতে দেওয়া হয়নি। নারী যে সম্পূর্ণ মানুষ তা সেই আদিকাল থেকেই স্বীকার করা হয়নি, আজও হয় না। পুরুষের পাঁজর থেকে তৈরি নারী, পুরুষেরা যাহা বলিবে, নারীকে তাহাই করিতে হইবে, না করিলে তাহাকে আচ্ছা করিয়া পিটাইতে হইবে। নারীর ঘাড়ের একটি হাড় বাঁকা, তাই তারা বাঁকা পথে চলে। স্বাধীনতায়, আর যারই অধিকার থাকুক, কুকুর বেড়াল গরু ছাগল, নারীর অধিকার নৈব নৈব চ। এই আমিও, নারীবাদের জন্য দিনরাত আপোসহীন লড়াই করেও মাকে আমি মা ছাড়া আলাদা কোনও নারী হিসেবে দেখিনি, আর মা মানেই তো, সমাজ আমাদের যা শিখিয়েছে, সংসারের ঘানি টানে যে, সবচেয়ে ভাল রাঁধে যে, বাড়ে যে, কাপড় চোপড় ধুয়ে রাখে, গুছিয়ে রাখে যে; মা মানে হাড় মাংস কালি করে সকাল সন্ধে খাটে যে, যার হাসতে নেই, যাকে কেবল কাঁদলে মানায়, শোকের নদীতে যার নাক অবদি ডুবে থাকা মানায়। সমাজের অনেক কিছুই আমরা মেনে নিই না বটে, প্রতিবাদ করি, কিন্তু অজান্তে অনেক সংস্কারই গোপনে লুকিয়ে থাকে এই আমাদের ভেতরই। আসলে পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্র এত শক্ত হয়ে বসে আছে আমাদের ঘাড়ে, এত বেশি ছড়িয়ে আছে আমাদের রক্তে, মস্তিষ্কে, অনেক সময় এ থেকে দূরে এসেছি ভেবেও কিন্তু এরই বীর্যে খাবি খেতে থাকি।

ভাবলে আমার অবাক লাগে যে, যত বিজ্ঞান নির্ভর হচ্ছে মানুষ, ততই যেন ধর্মের বিস্তার হচ্ছে জগত্ময়। বিবর্তন তত্ত্বেষথেষ্ট প্রমাণ নেই, এই কারণ দেখিয়ে অলৌকিক সৃষ্টিতে বিশ্বাসী হওয়ার আন্দোলন চলছেতথাকথিত উন্নত বিশ্বেও। সভ্যতা কি শেষ অবদি পেছন দিকে হাঁটবে, মধ্যযুগের অন্ধকারই কি তবে মানুষের গন্তব্য! ধর্মের জালে সবচেয়ে বেশি আটকা পড়ে নারী, এ আমরা সবাই জানি। পুরুষের তৈরি এই ধর্ম, এই সমাজ এই জঞ্জাল থেকে নারী যদি বেরিয়ে না আসে, আগেও বহুবার বলেছি, আবারও বলছি, নারীর মুক্তি নেই। কেবল নারীর নয়, পুরুষেরও নেই। দারিদ্র্য, বন্যা, খরা পীড়িত দেশে পুংলিঙ্গের জয় জয়কার যেমন, পুঁজি-পীড়িত দেশেও তেমন। কোথাও আমি দেখিনি একটি সত্যিকার বৈষম্যহীন সুস্থ সমাজ। অর্থনৈতিক মুক্তিই সকল বৈষম্য থেকে মুক্তি দেবে মানুষকে, এ কেবলই তত্ত্বকথা। যুক্তি এবং মুক্তচিন্তার সুষ্ঠু চর্চাই অন্ধকার সরাতে পারে, পারে ক্ষুধা, অজ্ঞানতা, অশিক্ষা, অন্ধতা, বৈষম্য আর সন্ত্রাসের গ্রাস থেকে বাঁচাতে মানুষকে। আমার মেয়েবেলা বইটির অনেক চরিত্রই, আমার চারপাশের, দরিদ্র নয়, কিন্তু অতি নিচ, অন্ধ, অজ্ঞান। আমি জীবন যেমন দেখেছি, লিখেছি। ও কেবল আমার জীবন নয়, সমাজের অধিকাংশ মেয়ের জীবনই ওরকম। ভয়ে কুঁকড়ে থাকা, বিষাদে বিবর্ণ হয়ে থাকা। ওই বয়সেই মেয়েরা শিখে নিতে বাধ্য হয় যে মেয়েতে ছেলেতে তফাৎ অনেক, মেয়েদের অনেককিছু করতে নেই, ভাবতে নেই, অনেক কিছু বুঝতে নেই, বলতে নেই। আমিও তেমন শিখেছিলাম।

মাত্র দুশ কী আড়াইশ পাতায় পুরো শৈশব কৈশোর কি তুলে আনা সম্ভব! ছিটেফোঁটা যা মনে পড়েছে, আধখেচড়া, অনেকটা খসড়া মত, লেখা। ধোঁয়াটে, ধুলোটে; অস্পষ্ট, অপুষ্ট, অদক্ষ হাতের স্কেচ। সামান্য বইটির জন্য আজ যে অসামান্য সম্মান আমাকে দেওয়া হচ্ছে, তা আমাকে কুণ্ঠিত করছে, সেই সঙ্গে গর্বিতও। আমি ক্ষুদ্র তুচ্ছ মানুষ। ভালবাসা আমি ঢের পেয়েছি, এত ভালবাসা পাবার যোগ্য আমি নই। এ জীবনে দুঃখ সুখ দুটোই বড় প্রবল হয়ে আমার কাছে ভিড়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয় এত দুঃখ পাবারও আমার মত সামান্য একজন মানুষের জন্য প্রয়োজন ছিল না। আমার বুঝি ওই ভাল ছিল, সূর্যাস্তের সবগুলো রঙ গায়ে মেখে কাশফুলে ছাওয়া ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে ক্লান্তিহীন, বাতাসের উল্টোদিকে, কেবল দৌড়ে যাওয়া। আমার বুঝি ওই ভাল ছিল, জীবনভর জীবন দেখতে দেখতে যাওয়া। ছোট ছোট দুঃখ সুখে দোলা। বেশ ভাল করেই জানি আমি ভাল সাহিত্যিক নই, ভাল নারীবাদীও নই। জীবন যেহেতু অর্থহীন, আর এই জীবন যেহেতু বড় এক প্রাপ্তিও, তাই জীবনের যা কিছু, সবই ভোগ করতে চাই, আর এই ভোগে যা কিছুই বাধা হয়ে আসে, ডিঙোতে চাই, রীতি, নীতি, যন্ত্র, মন্ত্র, পুরুষতন্ত্র, ধর্ম, বর্ম সবই। মাত্র কদিনের এই জীবনকে খামোকো অদ্ভুত সব নিয়মের জালে জড়াবো কেন! কেনই বা শেকলে বাঁধব! স্বাধীনতা, এই শব্দটির মূল্য আমার কাছে অনেক। এটি পেতে গিয়ে বার বার আমি পরাধীন হয়েছি। বারবার শেকল ছিঁড়েছি। নারীমাংসের গন্ধ পেলে হাঁ-মুখোপরাধীনতা একশ দাঁত মেলে দৌড়ে আসে, কামড়ে খেতে চায়। নারীর জীবন চলে যায় কেবল জীবন বাঁচাতে।

আমি আর যাই করি, প্রতারণা করি না, না নিজের সঙ্গে, না অন্যের সঙ্গে। অকপটে সত্য বলতে আমার বেশ আনন্দ হয়। জীবনে এ নিয়ে অনেক ভুগতে হয়েছে আমাকে। নিজের দেশে যেমন, অন্য দেশেও তেমন। আর লেখার বেলাতেও, বানিয়ে গল্প লেখার চেয়ে সত্য ঘটনা লেখায় আমার আগ্রহ বেশি। চারপাশে কত গল্প ঘটছে আমাদের। কেন বানাতে যাব! আমার কল্পনাশক্তি সম্ভবত কম, আমার স্মরণশক্তির মত। আগাগোড়া দুর্বল মানুষ আমি, লোকে সবল বলে ভাবে, ভুল করে। যত যাই বলি না কেন, আমি নেহাতই সাদাসিধে মানুষ, যারাই আমার কাছে এসেছে, বুঝেছে। আমি খোলস বা মুখোশ এগুলো একেবারে গায়ে রাখতে পারি না, ওসব গায়ে আছে ভাবলেও হাঁসফাঁস লাগে। নিজের জীবনকাহিনী লিখছি, নিজেকে চিনি বলে। নিজের

জীবনের গল্প বলা শেষ হয়ে গেলে হয়ত অন্য কারও জীবন নিয়ে লিখব, যাকে চিনি, যার চরিত্রের গভীরে যেতে পারি অনায়াসে। মানুষ, এখনও আমার কাছে বড় চেনা, আবার বড় অচেনাও। কারও সঙ্গে বত্রিশ বছর কাটিয়েও মনে হয়, তাকে ঠিক চেনা হয়নি আমার। আবার নিজের কথাও মাঝে মাঝে ভাবি, এত যে চিনি বলে ভাবি, নিজেকে কি আসলেই আমি ভাল চিনি!

একসময় বলতাম সকলেরই দু একজন আত্মীয়, সংসার, ঘরে ফেরা, ইত্যাদি কিছু না কিছু থাকে, কেবল আমারই কিছু নেই, কেবল আমারই খরায় ফাটা বুকে বেশরম পড়ে থাকে শূন্য কলস। সকলেরই জল থাকে, দল থাকে, ফুল ফল থাকেই, আমারই কিছু নেই, সমস্ত জীবন জুড়ে ধুধু একপরবাস ছাড়া। এখন আর তেমন করে বলছি না। পরবাস আছে বটে জীবনে, এখন আপনারাও আছেন, যে ভালবাসা আমি পাচ্ছি আজ, তা সঙ্গে করে নিয়ে যাব দূরের দেশে। আমার আকাশ জুড়ে হাজার তারার মত ফুটে থাকবে এসব; অন্ধকারে, দুর্যোগে আমাকে আলো দেবে, আশা দেবে। আমি নিজেকে আরও আরও চিনতে শিখব। আমি লিখতে শিখব। আপনারা, সম্ভবত, প্রায় মরে যাওয়া লেখককে একটু একটু করে বাঁচিয়ে তুলছেন। কী দেব? শুভেচ্ছা, ভালবাসা, শ্রদ্ধা সবই গ্রহণ করুন, আমাকে ধন্য করুন। হোক না অন্য দেশে আমার জন্ম, না হয় থাকি দূরের কোনও দেশে, আমি তো আপনাদেরই মানুষ, আত্মীয়-মতো, আপন। আমার কি কোথাও আর আপন কেউ আছে? নমস্কার।

আনন্দ পুরস্কার আমি দ্বিতীয়বার পেলাম। আমি একাই পেলাম। পাঁচ লক্ষ টাকা পুরস্কার। টাকাটা আমাকে সত্যিই আকৃষ্ট করে না। এর আগে বিরানব্বই সালে যখন পেয়েছিলাম আনন্দ পুরস্কার, পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা হয়েছিলো পুরস্কার। আর এবার এক লক্ষ থেকে হলো পাঁচ লক্ষ। অনেকে ভাবতে পারে আমার লক্ষ্মী ভাগ্য বা লক্ষ ভাগ্য ভালো। আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি না। প্যারিসের ব্যাংকে ও টাকা জমা করে দেওয়ার পর আমারই অজান্তে দ্রুত উড়ে যায়। আমার লক্ষ টাকার পিঠে অদৃশ্য পাখা থাকে। উড়ে যায় বলে মনোকষ্ট নেই। মনোকষ্ট শুধু তোমার জন্য। যে টাকার অভাবে তুমি সারাজীবন ছিলে, সেই টাকা আমার কাছে যত কাড়ি কাড়ি আসে, তত সেই টাকাকে আমার তুচ্ছ মনে হয়, অপ্রয়োজনীয় মনে হয়, সেই টাকাকে আমার বড় ঘৃণা হয়, মা। সংসারে তুমি ছিলে একা, আর আমি একা। আমার স্বামী সন্তানের উপদ্রব নেই। আমার ধন সম্পদও কারও জন্য রেখে যাওয়ার নেই। এভাবেই জীবন উড়তে থাকে, যে জীবনের, মনে হয় কোনও অর্থ নেই। এভাবেই জীবন ভেসে যেতে থাকে, যে জীবনকে খড়কুটো বলেও মনে হয় না।

বুঝলে মাপ্যারিসহলোইওরোপের কেন্দ্র। আর আমার যত ভ্রমণ, সব এইপ্যারিস থেকেই। বিভিন্ন দেশে যাওয়া আসা হচ্ছেই। বিভিন্ন দেশ থেকে আমন্ত্রণ আসছে, নারীর অধিকার বা মানবাধিকার বিষয়ে কথা বলার জন্য আমন্ত্রণ। ইওনেস্কোতে আমি আন্তর্জাতিক ধর্মমুক্ত মানববাদী আইএইচইইউ এর ডেলেগেশন হয়ে যাই, ওখানে ধর্মমুক্ত রাষ্ট্র, আইন, সমাজ ও শিক্ষার পক্ষে কড়া বক্তব্য রাখি। ইউনেস্কোয় নাকি এমন কঠিন বক্তব্য আগে কেউ রাখেনি। সব নড়েচড়ে বসেছিলো। সবখানেই তাই হয়। ক্রিশ্চান, ইহুদি বা অন্য কোনও ধর্মীয় পরিবারে জন্ম নিয়ে যে কেউ ঠিক একই কথা, যা আমি বলেছি, বললে কেউ চমকায় না। কিন্তু মুসলিম পরিবারে জন্মে ধর্মের সমালোচনা, তাও আবার সব ধর্মের সমালোচনা করলে লোকে চমকে ওঠে। আসলে আমার সংগ্রাম তো আর ধর্ম নাশ করার সংগ্রাম নয়। আমার সংগ্রাম মানবতার জন্য মূলত, সমানাধিকারের জন্য। ধর্মের সঙ্গে নারীর সমানাধিকারের বিরোধ আজন্ম। যেখানেই যাই, যত কোলাহল বা কলরবের মধ্যেই যাই, ফিরে আসি নিজের নিঃসঙ্গতায়। ফোনটা হাতের কাছে, ইচ্ছে করে কেউ জিজ্ঞেস করুক, কেমন আছি, দেশে ফিরবো কবে, ইচ্ছে করে কেউ বলুক আমার জন্য কোথাও সে অপেক্ষা করছে। বলুক আমাকে ভালোবাসে, জিজ্ঞেস করুক, কেমন আছি, কী খাচ্ছি। তুমি নেই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনও পারে যে তোমাকে বলবো কেমন আছি আমি, কেমন থাকি প্রতিদিন। তুমি কোনও দেশে নেই, কোনও শহরে বা গ্রামে নেই। কোনও বাড়িতে নেই। তোমার কোনও ঠিকানা নেই। তোমার কোনও টেলিফোন নম্বর নেই। তোমার কিচ্ছু নেই মা। তোমার এত নেই এর কাঁটা বুকের ভেতরটায় বিঁধে থাকে।

প্যারিসে বসে কবিতার একটি বই ছাড়া আর কিছুই লিখিনি। ফরাসি প্রকাশক, বুঝি, যে, অসন্তুষ্ট। ভালো ভালো উপন্যাস চাইছে প্রকাশক। আমি যে লেখক, আমি যে ভালো লেখক, সে কথা আরও প্রমাণ করি আমি, চাইছে। আমি যে কেবল ধর্মের বিপক্ষে লেখা, মৌলবাদীদের ফতোয়া পাওয়া কোনও নির্যাতিত নির্বাসিত বস্তু নই, তা ফরাসি প্রকাশকও প্রমাণ করতে চান। ফরাসি দেশে নাম আছে, কিন্তু নতুন বই নেই। বন্ধু বলে যাদের কাছে টানি, কিছুদিন পর তাদেরও ঠিক বন্ধু বলে আর মনে হয় না। ভালো না লাগা, হেথা নয়-হোথা নয়-অন্য কোথার বৈরাগ্য জীবন জুড়ে, ঝাঁক ঝাঁক দুশ্চিন্তা মস্তিষ্ক দখল করে নেয়। ঘোর বিষাদ আমাকে গ্রাস করে ফেলে। সুয়েনসনকে জানালাম এখানে আর আমার থাকা সম্ভব হচ্ছেনা। বললো, চলে এসো সুইডেনে। কী এক অদ্ভুত অভিমানে আমি প্যারিস ছাড়লাম। বড় অনিচ্ছায় আমি ফিরে গেলাম। ক্রিশ্চান বেসও আপত্তি করেননি। তিনি যদি বলতেন না যেতে, তাহলে জীবন অন্যরকম হতো। তিনি তো জানতেনই যে সুইডেনকেচিরবিদায় জানিয়ে এসেছিলাম। প্যারিস আমার জন্য শেষ অবধি কোনও আশ্রয় হলো না। নিজেই স্বপ্ন গড়েছিলাম, নিজেই সেই স্বপ্ন ভেঙে ফেলি। আসবাবপত্র যা কিনেছিলাম প্যারিসে, দিয়ে দিলাম যাকে তাকে। বাড়ির কনসিয়াজকে ডেকে এনে বলি, যা ইচ্ছে করে নিয়ে যান ঘর থেকে। ছুটে এসে নিয়ে গেলো, যা ভালো লাগেসব। শুধুবই, কাপড়চোপড়, আর কমপিউটার, প্রিন্টার এসব জরুরি জিনিস নিয়ে গেলাম। আবারও মুভার ডাকো। আবারও হাজার হাজার টাকা খরচ করো। কিন্তু ডিপ্রেশনের ডিপোর কাছে ফিরে গেলে কি আমার ডিপ্রেশন সারবে! সুয়েনসনের বাড়িটা সুন্দর করে সাজিয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিলাম। কিন্তু অন্যের বাড়ি নিজের রুচিমতো নিজের টাকা খরচ করে সাজালেই বা কী, ও তো আর নিজের বাড়ি হয়ে যাবে না।

এর মধ্যে ভয়ংকর সব কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে। একটা রক্তচাপ মাপার মেশিন কিনেছিলাম প্যারিস থেকে। ডাক্তারি পড়াকালীন সময় থেকেই মেশিন থাকে আমার কাছে। আগের মেশিনটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর অনেক দিন কোনও নতুন মেশিন কেনা হয়নি বলে কিনেছি। বন্ধু বান্ধবদের অসুখ বিসুখ হলে মেপে দেখি রক্তচাপ নিজেরটাও বছরে দুবছরে হয়তো মাপি। ওই মেশিনটা কেনারপর মাস চলে গেলে প্রথম ব্যবহার করলাম, সুয়েনসনের রক্তচাপ মাপার জন্য। মেশিনেরও উদ্বোধন করার জন্য। সুয়েনসনের রক্তচাপ একেবারে স্বাভাবিক। এরপর নিজের রক্তচাপ দেখে তো আমি আকাশ থেকে পড়লাম। মেশিনের গণ্ডগোল হয়েছে বলে আবার মাপলাম। একই মাপ দেখাচ্ছে। ২৫০/১৫০। সুয়েনসনের রক্তচাপ আবার মেপে দেখি ১২০/৭৫। তার মানে মেশিন ঠিক আছে। ওর বেলায় যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছে না, আমার বেলায় করছে। তার মানে। কি এই যে আমি এখন ব্লাড প্রেশারের রোগী? ব্যাপারটি মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শবাসনে অনেকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবারও মাপলাম। কোনও দুশ্চিন্তা নেই, কিছু নিয়ে কোনও অস্থিরতা নেই, তবে এই ভয়ংকর রক্তচাপটা কেন! এ নিয়ে তো বসে থাকা খুব ঝুঁকিপূর্ণ, যে কোনও সময়ই দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। সুয়েনসনকে বললাম ক্যারোলিন্সকা হাসপাতালে নিয়ে যেতে। কিছুতেই সে যাবে না। অনর্গল বলে যাচ্ছে এসব আমার ন্যাকামি। তোমার অসুখ হলে বাবা তোমাকে বলতো, তেমন। উল্টো দিকের বাড়িতে পিয়া নামের এক সুইডিশ মেয়ে থাকে, ও হাসপাতালের নার্স। মধ্যরাতে ওর কাছে দৌড়ে যাই, অন্তত যদি কোনও ওষুধ থাকে, অথবা ও যদি কোনও হাসপাতালে আমাকে নিয়ে যায়। না, পিয়া নেই বাড়িতে। আমার দুশ্চিন্তা বেড়ে তখন কী অবস্থায় গিয়েছিলো তোমাকে বোঝাতে পারবো না। অনেক অনুরোধের পর গজগজ করতে করতে গেলো সুয়েনসন আমার সঙ্গে হাসপাতালে। ক্যারোলিন্সকা হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে গিয়ে তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরও দেখি ডাক্তার আসছেনা, রাগ করে বাড়ি চলে এলাম। এই হল বিদেশের বিপদ। আমি নিজে বলি না আমি কে বা আমি কী। বিদেশের ক্রিমিনাল, বাটপাড়, অ আ ক খরসঙ্গে এক সারিতে বসে আমাকে অপেক্ষা করতে হবে ডাক্তারের। ওই অপেক্ষার সময় এমন হতে পারে যে মাথায় রক্তক্ষরণ হলো অথবা হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে গেলো। দেশে থাকলে নিজে ডাক্তার বলে, বা চেনা বলে আমাকে তড়িঘড়ি দেখা হত। বিদেশে বিশেষ করে সুইডেনে তা হবার জো নেই। সারারাত চরম অস্থিরতায় এক ফোঁটা ঘুমোত পারিনি। সাত সকালে উপসালা শহরে গিয়ে আগে এক বন্ধুর কাছ থেকে চেয়ে একটা নিফিকার্ডিন নিয়ে জিভের তলায় রেখে দুম করে স্বর্গ থেকে রক্তচাপকে নামিয়ে আনি মর্তে। বাবার পকেটে সবসময় ওই নিফিকার্ডিন নামের ওষুধ থাকে। ওভাবে দ্রুত রক্তচাপ কমানো অনুচিত জেনেও বাবা ওভাবেই কমায়। বন্ধুর বাড়িতে আগে গিয়েছি, জেনেই গিয়েছি যে তার নিজের একটা হৃত্যন্ত্রের অসুখ সম্প্রতি হয়েছিল বলে রক্তচাপ কমিয়ে রাখার ওষুধপত্র রাখছে বাড়িতে। বন্ধুটি শান্তনু দাশগুপ্ত, তুমি তো চেন, উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোবায়োলজির রিসার্চার। সুয়েনসনের বাড়িতে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলো। ওর বাড়ি থেকে উপসালার অ্যাকাডেমিস্কা হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে যাই। শান্তনুর সুইডিশ বান্ধবী লেনা সঙ্গে গেল। তখন অনেক কম রক্তচাপ, ওই ওষুধটা খাওয়াতে। কম হলেও স্বাভাবিক হয়নি। ডাক্তার রক্তচাপ কমানোর ওষুধ দিলেন। কিন্তু বিটা ব্লকার আমি খাবো কেন? আমি এ দেশের ডাক্তারদের বিশ্বাস করবো কেন? এ দেশে ডাক্তার দেখানোর কারণ হলো একটাই, এখানে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশান ছাড়া কোনও ওষুধ কেনা যায় না। অ্যাকাডেমিস্কা থেকে দেওয়া ওষুধ আমার পছন্দ হয়নি। ইন্টারনেট ঘেঁটে নতুন মেডিক্যাল জার্নালগুলো পড়ে মনে হয়েছে যে এসিই ইনহিবিটর ওষুধটা ভালো। সুতরাং অন্য এক হাসপাতালে গিয়ে বললাম, আমার হার্ট দেখ, আমার ইসিজি দেখ, আমাকে এসিইইনহিবিটর লিখে দাও, আমাকে সোফিয়া হেমেটে রেফার করো। সোফিয়া হেমেট সুইডেনের সবচেয়ে নামকরা হাসপাতাল, সবচেয়ে দামি। আমার যেহেতু এখন সুইডিশ পাসপোর্ট, আমি বিনে পয়সায় ওখানে দেখাতে পারি। রেফার না করলে সোফিয়া হেমেটে কেউ দেখাতে পারে না। বাবার চোখের চিকিৎসা সোফিয়াতে করিয়েছিলাম, হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালোটায়। সুতরাং সবচেয়ে ভালো জায়গাতেই আমি যাবো। ছোটখাটো আনাড়ি ডাক্তারদের হাতে তোমাকে মরতে হয়েছে, আমাকে মারতে আমি ওদের দেব না। সোফিয়া হেমেটে গিয়েও আমি ওই ওষুধ দাবি করলাম যে ওষুধকে আমি মনে করছি ভালো। মা, তোমার জীবন দিয়ে তুমি আমাকে শিক্ষা দিয়ে গেলে। আমি মুখ খুলিনি, কথা বলিনি, আনাড়ি ডাক্তাররা যা বলেছিলো, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে তোমাকে হত্যা করেছি আমি। কোনও চ্যালেঞ্জ করিনি, প্রতিবাদ করিনি, আপোস করেছি সারাক্ষণ। নিজের বেলায় যদি আমিনা হতে দিই, তাহলেও যদি অন্তত প্রতিশোধ নেওয়া যায়। জানি তোমার ভালো লাগছে আমার এই সচেতনতা দেখে। কিন্তু মা, আমার কি প্রতি প্রতিবাদে তোমাকে মনে পড়ছেনা, গায়ে আমার জ্বালা ধরছেনা, এখন যা করছি, অনুতাপ করছিনা এই বলে যে, তখন তা করিনি কেন? আমার শক্তি আমার সাহস কোথায় কোন গুহায় হারিয়ে গিয়েছিল? জানি ওরা আমাকে বোবা বানিয়ে রেখেছিলো, ওরা কোনও তৃতীয় বিশ্বের মেয়েকে জোর গলায় কথা বলতে দেখতে চায় না। কিন্তু নিজের আমিত্ব বিসর্জন দিয়ে ওদের সুখী করে কী পেলাম আমি? আমি তো সব হারালাম, যখন তোমাকেই হারালাম।

বাবাকে জানিয়েছি আমার রক্তচাপ বাড়ার কথা। এত অল্প বয়সে রক্তচাপ বাড়লো বলে বাবাও অবাক। আমার রক্তে ছিল এই রোগ, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। কিন্তু দুশ্চিন্তা ত্বরান্বিত করেছে রোগটি। চল্লিশে পড়িনি এখনও, উচ্চ রক্তচাপের রোগী হলাম। দায়ী কে মা, দুশ্চিন্তা কে দিচ্ছে আমাকে! মানুষগুলোই তো, যারা আমাকে নিয়ে বছরের পর বছর ধরে রাজনীতির নোংরা খেলা খেলছে! তোমার না থাকা দিচ্ছে, ভাই বোনের নির্লিপ্তি দিচ্ছে। যাদের ভালোবাসি, তারা যদি দূর থেকে ক্রমশ দূরেই যেতে থাকে, তবে হতাশার কোলে বসে আমি দিন রাত দোল খাবো না কেন, বলো। সুইডেনে বসে এক লেখা ছাড়া আর করার কিছু থাকে না। সামাজিকতা মাচায় তুলে যে সুইডেনের মতো দেশে থাকতে হয়, তা তো দেখেছেই। তবে তুমি একেবারে নির্মম অবস্থাটাই দেখে গেছে। একটা অন্য গ্রহে যেন বসবাস। মানুষের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। কারও যাওয়া আসা নেই বাড়িতে। শুধু ভূতের মতো বসে থাকো, যেখানে বসে আছো। প্যারিসে আমার কাছে বন্ধুবান্ধব দেশ বিদেশ থেকে ছুটে আসতো, আমাকে দেখার নাম করে প্যারিসকেই দেখতো তারা। আর সুইডেনে থাকলে কেউ আমাকে দেখতে আসতে চায় না। এই অন্ধকার দেশে কে আসবে বলো। অন্ধকার ঠিক কেমন অন্ধকার, তো তুমি দেখেইছে। তবে গ্রীষ্মকালের দিন রাতের ঝকঝকে আলো, এই মধ্যরাতের সূর্যের দেশটায় প্যারিসের পাট চুকিয়ে ফিরে এসে ঘরদোর ভীষণভাবে সাজিয়ে লেখালেখিতে মনও দিলাম। বাড়ি সাজানোয় তো আমার কোনও লাভ নেই, আপাতত না বুঝলেও কিছুদিন পর তো হাড়ে হাড়ে টের পাবো, ওতে শরীর, মন, অর্থ ঢেলে লাভ কিছু নেই। বিদেশ বিভুইএ থাকারইচ্ছেও আমার নেই, তাছাড়া অন্যের বাড়ি সাজালে অন্যের লাভ হয়, নিজের কিছু হয় না, বিশেষ করে সেই অন্যের সঙ্গে যদি হৃদয়ের কোনও সম্পর্ক না হয়। ওসব ফালতু কাজ। ভালো কাজের মধ্যে যা করেছি, তা চারটে বই লিখেছি, ফরাসি প্রেমিক নামের একটি উপন্যাস, খালি খালি লাগে নামের একটি কবিতার বই, উতল হাওয়া আর দ্বিখণ্ডিত, আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খন্ড আর তৃতীয় খন্ড।

অভিমান আমাকে কুঁকড়ে রেখেছিলো। আমি তো সেই যে দেশ ছাড়লাম, পরিবারের সবাইকেই ছাড়লাম। দাদা, ছোটদার কাছে কোনও কোনও করিনি, এমনকী ইয়াসমিনের সঙ্গেও যোগাযোগ পুরোটাই বন্ধ করে দিয়েছি। কারও স্বার্থপরতাকে ক্ষমা করতে আমি পারিনি। আমার কেনা গাড়ির মালিক হয়ে বসে আছে দাদা, যে মালিক তোমার ওই অসুস্থ অবস্থাতেও সে গাড়িটা চড়তে দেয়নি তোমাকে। তার বউ ছেলে মিলে তোমাকে জ্বালিয়েছে। তারা মশারির নিচে নরম বিছানায় ঘুমিয়েছে। আর তুমি বারান্দার মেঝেয় মশার কামড় খেতে খেতে রাত পার করেছে। যে টাকা তোমার সম্বল ছিলো অবকাশের নারকেল ডাব বিক্রি করে কিছু টাকা পেতে, সেটিও হাসিনা নিজে বিক্রি করে দেয় তোমার অনুপস্থিতিতে। শুভও জেনে গেছে, তুমি এ বাড়ির সবচেয়ে অবহেলা পাওয়া, অবজ্ঞা পাওয়া একটা তুচ্ছক্ষুদ্র মেয়ে মানুষ, আদরে আহ্লাদে বড় হওয়া লাটসাব হওয়া, নবাব হওয়া শুভও তোমাকে মানুষ বলে মনে করে না। গ্লানি আমাকে কুরে খাচ্ছে, আমি আর তোমাকে অবজ্ঞা করা মানুষদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে গ্লানির ভার বাড়াতে চাই না। তুমি যদি একটুখানি ভালোবাসা পেতে, উজাড় করে দিতে, আসলে তোমার টাকা পয়সা ছিলো না বলে হয়তো তুমি ভালোবাসা পাওনি। ভালোবাসার সঙ্গে তো আজকাল অর্থকড়ির সম্পর্ক বেশ আছে। তুমি যা পারতে, যেভাবেই পারতে, সেভাবে মানুষের জন্য করেছে। ভিক্ষে করতে যারা আসতো, তুমি বাড়ির গৃহিণী বলে মনে করতো তুমিও বুঝি ধনী। তুমি ওদের কাছে ডেকে বলে দিতে, তুমি ধনীর বাড়িতে থাকে, কিন্তু তুমিও ওদের মতো দরিদ্র, বলতে, আসলে ওদের চেয়েও বেশি দরিদ্র, ওদের তোভিক্ষে করে যা হোক কিছু উপার্জনের সামর্থ্য আছে, ওদেরও একধরনের স্বাধীনতা আছে যা তোমার নেই। একটা সময়, আমার মনে আছে, তোমাকে যখন পড়াশোনা কেউ করতে দিলোই না, তোমার যখন কোনও চাকরি বাকরি করার অধিকারও নেই, তখন বলতে তোমার মানুষের বাড়িতে কাজ করে জীবন চালাতে ইচ্ছে করে। মানুষের বাড়িতে কাজ করলে খাবারও জোটে, মাস গেলে বেতনও জোটে। স্বনির্ভর হতে চাইতে। দারিদ্রে তোমার আপত্তি ছিলো না, কিন্তু অত কুৎসিত ভাবে অপমানিত হতে চাইতে না। অপমান তোমাকে করেছি সবাই, মানুষ বলে মনে করিনি। বাবার কাছ থেকেই সম্ভবত সবাই শিখেছি। কিন্তু বাবার অনেক কিছুই তো আমি মানিনি। কিন্তু তোমাকে অপমান করাটাই শুধু মেনেছি। বাকি আর যা কিছুমানি বা না মানি। বাবার সঙ্গে তোমার যে কোনও দ্বন্দ্বে আমি তো চিরকালই বাবার পক্ষই নিয়েছি। বিদেশ থেকে বাবাকে টাকা পাঠিয়েছি। বাবা তার অ্যাকাউন্ট নম্বর কোনওদিন দেয়নি আমাকে। তখন টাকা তোমার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়েছি, বলেছিপুরো টাকা তুলে নিয়ে গিয়ে বাবাকে দিয়ে আসতে। হ্যাঁ তুমি তাই করেছে। বাবাকে কেন আমি টাকা পাঠাতাম? বাবার কি টাকার অভাব ছিলো? ছিলো না। বাবা ভালো জামা কাপড় কেনে না, ভালো জুতো কেনে না, ভালো সেইভিং কিটস কেনে না, সে তো অভাবের জন্য নয়, সে তো স্বভাবের জন্য। সারা জীবন তা জেনেও আমি জানিনি। বাবার প্রতি ভালোবাসা বোঝাবার আর বোধহয় অন্য কোনও পথ আমার ছিলো না। যাকে বাবা বলে, যাকে তুমি বলে কোনওদিন ডাকতে পারিনি, তাকে কী করে বলবো ভালোবাসার কথা। তোমাকেও তো একসময় তুমি বলা আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম, তোমার সঙ্গে ভাববাচ্যে কথা বলতাম। বোধহয় ভাববাচ্যেই কয়েক বছর কাটিয়েছিলাম। সুইডেনে ফের সম্বোধন করতে শুরু করেছি। ওটাই বোধহয় তোমার জন্য ছিল সুখের ঘটনা। একদিনই তোমার বাথটাবে স্নান করতে দিয়েছিলাম, ফেনা বানিয়ে ফেনার মধ্যে তোমাকে ডুবিয়ে। তুমি বাচ্চা মেয়ের মতো খুশি হয়েছিলে। কী অল্পতে তুমি খুশি হতে মা, অথচ তোমাকে খুশি করতে কেউ আমরা সামান্য চেষ্টাও করিনি। কী কঠিন ছিল হৃদয় আমার। তোমারই সন্তান, তোমার মতো মাটির মানুষের, তোমার মতো বিরাট মনের। অথচ স্বার্থপরতা, হীনতা, নীচতা সব আমাদের সম্বল ছিল। তুমি আমার জীবন বদলে দিয়েছে। টাকা পয়সা এখন আমার কাছে তুচ্ছ একটি জিনিস। তোমার চলে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া আমাকে জীবনের নতুন অর্থ দিয়েছে, একইসঙ্গে অর্থহীনতাও। যদি কিছুর মূল্য আমি দিই জীবনে, সে ভালোবাসার, আর কিছুর নয়। পরিবার পরিজন, বন্ধু, স্বজন, নাম যশ খ্যাতি সব অর্থহীন আমার কাছে। যেখানে ভালোবাসা, সেখানেই দৌড়ে যাই। যাকে ভালোবাসি, তাকে উজাড় করে দিই, তাকেই বোঝাই যে ভালোবাসি। ভালোবাসার জন্য মাইল মাইল পাড়ি দিই। জীবন বাজি রাখি।

যে মানুষ আর যে বাড়ি ছেড়ে আমি একবার বেরিয়ে গেছি, সেখানে তার কাছে ফিরে আসা ঠিক কী রকম, তুমি নিশ্চয়ই বোঝে। বুঝবে না কেন, তুমি তো সব বুঝতে। ভাবতাম, কিছুই বোধহয় বোঝে না, তুমি যে কত সংবেদনশীল মানুষ ছিলে, সহজ এবং সরল, সহৃদয় এবং সহিষ্ণু, তোমার আশেপাশের মানুষদের কেউ তো তেমন ছিল না। ভেতরে ভেতরে এত যে বুঝতে, জগৎ এবং জীবন তুমি কী চোখে দেখতে, কী গভীর চোখে, তা বোঝার সাধ্য আমার কেন, কারওরই ছিল না। তোমাকে আমি চিনতে শুরু করলাম তোমার অসুখের পর, তোমার মতো আপন মানুষটিকে হারানোর যে ক্ষত এবং ক্ষতি তা আমি জীবন দিয়ে এখন অনুভব করি।

 ১০. উৎসর্গ করেছি তোমাকে

মা, ‘খালি খালি লাগে’ বইটিও উৎসর্গ করেছি তোমাকে। উৎসর্গ পাতায় লিখেছি। তাকে, যাকে ভালবাসার কথা ছিল, অথচ বাসিনি। এই বইতেও লিখেছি কিছু কবিতা, তোমাকে মনে করে। কিছুক্ষণ থাকো’ নামে আরও একটি কবিতার বইপরে লিখেছি, ওতেও আছে কিছু তোমাকে নিয়ে। কবিতা পড়তে তুমি তো খুব ভালোবাসতে। জানি না, কী করে তোমার সময় কাটে, চিঠি যদি পড়তে না চাও, পড়ো না, সম্ভব হলে শুধু কবিতাগুলো পড়ো।

.

যদি হত

এরকম যদি হত তুমি আছ কোথাও, কোথাও না কোথাও আছ, একদিন দেখা হবে,
একদিন চাঁদের আলোয় ভিজে ভিজে গল্প হবে অনেক, যে কথাটি বলা হয়নি, হবে
যে কোনও একদিন দেখা হবে, যে স্পর্শটি করা হয়নি, হবে
আজ হতে পারে, পরশু, অথবা কুড়ি বছর পর, যে চুমুটি খাওয়া হয়নি, হবে

অথবা দেখা হবে না, কুড়ি কেটে যাচ্ছে, দু কুড়িও
তুমি আছ কোথাও, ভাবা যেত তুমি হাঁটছ বাগানে, গন্ধরাজের গন্ধ নিচ্ছ
গোলাপের গোড়ায় জল দিচ্ছ, কামিনীর গা থেকে আলগোছে সরিয়ে নিচ্ছ মাধবীলতা,
অথবা স্নান করছ, খোঁপা করছ, দু এক কলি গাইছ কিছু
অথবা শুয়ে আছ, দক্ষিণের জানালায় এক ঝাঁক হাওয়া নিয়ে বসেছে লাল-ঠোঁট পাখি,
অথবা ভাবছ আমাকে, পুরোনো চিঠিগুলো ছুঁয়ে দেখছ, ছবিগুলো।

গা পোড়া রোদ্দুর আর কোথাকার কোন ঘন মেঘ চোখে বৃষ্টি ঝরাচ্ছে তোমার ..
অথবা ভাবা যেত আমি বলে কেউ কোনওদিন কোথাও ছিলাম তুমি ভুলে গেছ,
তবু ভাবা তো যেত।

.

বেঁচে থাকা

।একটি কফিনের ভেতর যাপন করছি আমি জীবন
আমার সঙ্গে একশ তেলাপোকা
আর কিছু কেঁচো।

যাপন করছি জীবন, যেহেতু যাপন ছাড়া কোনও পরিত্রাণ নেই
যেহেতু তেলাপোকাঁদেরও যাপন করতে হবে, কেঁচোগুলোকেও
যেহেতু শ্বাস নিচ্ছি আমি, তেলাপোকা আর কেঁচো
যেহেতু শ্বাস ফেলছি, বেঁচে থাকছি
বেঁচে থাকছি যেহেতু বেঁচে থাকছি।

একটি কফিনের ভেতর কিছু প্রাণী
পরস্পরের দিকে বড় করুণ চোখে তাকিয়ে আছি
আমরা পরস্পরকে খাচ্ছিপান করছি
এবং নিজেদের জিজ্ঞেস করছি, কী লাভ বেঁচে!

না আমি না তেলাপোকা না কেঁচো কেউ এর উত্তর জানি না।

.

স্মৃতিরা পোহায় রোদ্দুর

।কেউ আর রোদে দিচ্ছে না লেপ কাঁথা তোষক বালিশ
পোকা ধরা চাল ডাল, আমের আচার
দড়িতে ঝুলছে না কারও ভেজা শাড়ি, শায়া
একটি শাদা বেড়াল বাদামি রঙের কুকুরের পাশে শুয়ে মোজা পরা
কবুতরের ওড়াওড়ি দেখছে না, কেউ স্নান করছে না জলচৌকিতে বসে তোলা জলে।
কোনও কিশোরী জিভে শব্দ করে খাচ্ছে না নুন লংকা মাখা তেঁতুল
চুলোর পাড়ে বসে কেউ ফুঁকনি ফুঁকছে না,
টগবগ শব্দে বিরুই চালের ভাত ফুটছে না,
কেউ ঝালপিঠে খাবার বায়না ধরছে না কারো কাছে,
উঠোনে কেবল দুই পা মেলে স্মৃতিরা পোহাচ্ছে রোদ্দুর।

ঘাসগুলো বড় হতে হতে সিঁড়ির মাথা ছুঁয়েছে,
একটি পেয়ারাও নেই, একটি ডালিমও, নারকেলের শুকনো ফুল ঝরে গেছে,
লেবু তলায় কালো কালো মৈসাপের বাসা,
জামগাছের বাকল জুড়ে বসে আছে লক্ষ বিচ্ছু
কেউ নেই, স্মৃতিরাই কেবল পোহায় রোদ্দুর।

.

তোমার শরীর, তুমি নেই

একটু সরে শোও, পাশে একটু জায়গা দাও আমাকে শোবার
কত কথা জমে আছে
কত স্পর্শ
কত মৌনতা, মুগ্ধতা।
সেই সব সুদূর পারের কথা শোনাব তোমাকে
শুনতে শুনতে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে,
কয়েক ফোঁটা কষ্ট তোমার উদাস দুচোখে বসবে
শুনতে শুনতে হাসবে, হাসতে হাসতে চোখে জল।
ভেবেছিলাম রোদেলা দুপুরে সাঁতার কাটবহাঁসপুকুরে,
পূর্ণিমায় ভিজব, নাচব গাইব।
ভেবেছিলাম যে কথা কোনওদিন বলিনি তোমাকে, বলব।

এখন ডাকলেও চোখ খোলো না
স্পর্শ করলেও কাঁপো না,
এখন এপার ওপার কোনও পারের গল্পই তোমাকে ফেরায় না
নাগালের ভেতর তোমার শরীর, তুমি নেই।

.

খালি খালি লাগে

সেই যে গেলে, জন্মের মত গেলে
ঘর দোর ফেলে।
আমাকে একলা রেখে বিজন বনবাসে
কে এখন ভাল বাসে,
তুমি নেই, কেউ নেই পাশে।

কে এখন দেখে রাখে তোমার বাগান
তুমিহীন রোদ্দুরে গা কারা পোহায়
কে গায় গান পূর্ণিমায়
তুমিহীন ঘরটিতে কি জানি কে ঘুমোয় কে জাগে।
জীবন যায়, যেতে থাকে,
যেখানেই যাই যে পথে বা যে বাঁকে দাঁড়াই
যে ঘাটে বা যে হাটে, বড় খালি খালি লাগে।

.

ঠিক তাই তাই চাই

একটি চমৎকার বাগানঅলা বাড়ির বড় শখ ছিল আমার,
ব্যক্তিগত গাড়ির, এমনকি জাহাজেরও, জলে ভাসার-ওড়ার।
ভালবাসার কারও সঙ্গে নিত্য সংসারের,
আমার সাধ্যের মধ্যে যদিও এখন সব,
আমার সাধ্যের মধ্যে এখন আমার সুখী হওয়া
সুখকে বিষম ঘেন্না এখন
আমি এখন আমার জন্য এমন কিছু চাই না যা দেখলে আনন্দ হত তোমার–
আমার আর ইচ্ছে করে না সমুদ্রের সামনে দাঁড়াতে,
তুমি ইচ্ছে করেছিলে একদিন দাঁড়াবে।

তুমি কিছু হারাচ্ছ না, এই দেখ আমার সারা গায়ে ক্ষত,
স্মৃতির তল থেকে তুলে আনছি মুঠো মুঠো অচেতন মন,
অমল বৃষ্টি থেকে রামধনু থেকে চোখ সরিয়ে রাখি, এই স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে বসে
ঠিক তাই তাই চাই, যা দেখলে কষ্ট পেতে, বেঁচে থাকায় ছোবল দিত কালনাগিনী,
আমি অসুস্থ হতে চাই প্রতিদিনই।

.

শিউলি বিছানো পথ

শিউলি বিছানো পথে প্রতিদিন সকালে হাঁটতে হটিতে মনে পড়ে তোমাকে
কী ভীষণ ভালোবাসতে তুমি শিউলি!
একটি ফুলও এখন আর হাতে নিই না আমি, বড় দুর্গন্ধ ফুলে।
আমি হাঁটছি, হেঁটে যাচ্ছি, কিন্তু হেঁটে কোথাও পোঁছোচ্ছি না।
কোথাও পৌঁছব বলে আমি আর পথ চলি না। কোনও গন্তব্য, আগে যেমন ছিল, নেই। অপ্রকতন্থের মত দক্ষিণে উত্তরে পুবেপশ্চিমে হাঁটি,
হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে কোথাও ফিরি না আমি।
এখন তো কোথাও কেউ আর আমার জন্য অপেক্ষা করে নেই।
এখন তো এমন কোনও কড়া নেই যে নাড়ব
আর ভেতর থেকে তুমি খুলে দেবে দরজা।
এখন তো কেউ আমাকে বুকে টেনে নেবে না সে আমি যেখান থেকেই ফিরি

শিউলি বিছানো পথে প্রতিদিন বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে তোমাকে
কী ভীষণ ভালবাসতে তুমি শিউলি।
ফুলগুলো আমি পায়ে পিষে পিষে হাঁটি। তুমি ভালবাসতে এমন কিছু ফুটে আছে কোথাও
দেখলে বড় রাগ হয় আমার।
গোলাপ কী রজনীগন্ধা কী দোলনচাঁপা কী আমি।
এদের আমি দশ নখে ছিঁড়ি,
দাঁতে কাটি, আগুনে পোড়াই। তুমিই যদি নেই, এদের আর থাকা কেন!
তুমি ছিলে বলেইনা গোলাপে সুগন্ধ হত,
তুমি ছিলে বলেই এক একটি সূর্যোদয় থেকে কণা কণা স্বপ্ন বিচ্ছুরিত হত,
তুমি ছিলে বলেই বৃষ্টির বিকেলগুলোয় প্রকৃতির আঙুলে সেতার এত চমৎকার বাজত।
তুমি নেই, বৃষ্টি আর পায়ে কোনও নূপুর পরে না,
স্নান সেরে রুপোলি চাঁদরে গা ঢেকে আকাশে চুল মেলে দিয়ে আগের মত চাঁদও আর গল্প
শোনায় না।

তুমি নেই, কোনও গন্তব্যও নেই আমার। কোনও কড়া নেই, কোনও দরজা।
হেঁটে হেঁটে জীবন পার করি। কাঁধের ওপর বিশাল পাহাড়ের মত তোমার না থাকা।
গায়ে পেঁচিয়ে আছে তোমার না থাকার হাঁ-মুখো অজগর
পায়ের তলায় তোমার না থাকার সাহারা,
পুবে পশ্চিমে দক্ষিণে উত্তরে হাঁটছি আমি, আমার সঙ্গে হাঁটছে বিকট তোমার না থাকা।

যত হাঁটি দেখি পথগুলো তত শিউলি ছাওয়া
তুমি সে যে কি ভালবাসতে শিউলি
কী দরকার আর শিউলি ফুটে, যদি তুমিই নেই!
কী দরকার আর ফুলের সুগন্ধের, তুমিই যদি নেই!

কী দরকার আমার!

.

ঈদুল আরা

ঈদুল আরার বইখাতা ছিঁড়ে নর্দমায় ফেলেছে ঈদুল আরার স্বামী
ঈদুল আরা এখন রাঁধবে বাড়বে, সন্তান জন্ম দেবে।

ঈদুল আরা রাঁধে বাড়ে সন্তান জন্ম দেয়,
তবু ঈদুল আরার মন পড়ে থাকে বইয়ে, ঈদুল আরার দীর্ঘশ্বাস বাতাসে ওড়ে,

কেউ দেখে না
দীর্ঘশ্বাস তো দেখার জিনিস নয়।
ঈদুল আরার স্বামী দীর্ঘশ্বাসও দেখে তৃতীয় নয়নে
ছিঁড়ে দুটুকরো করে নর্দমায় ছুঁড়ে দেয় দীর্ঘশ্বাস
ঈদুল আরা এখন সন্তানকে খাওয়াবে গোসল করাবে ঘুম পাড়াবে।

ঈদুল আরা সন্তানকে খাওয়ায়, গোসল করায়, ঘুম পাড়ায়,
তবু ঈদুল আরার মন পড়ে থাকে দীর্ঘশ্বাসে, ঈদুল আরার দুঃখ বাতাসে ওড়ে,

কেউ দেখে না
দুঃখ তো দেখার জিনিস নয়।
ঈদুল আরার স্বামী তৃতীয় নয়নে এই দুঃখ দেখে না,
নারীর দুঃখ ঈদুল আরার স্বামীর চোখে কেন, দেবতাদের চোখেও পড়ে না।

.

আমার মনুষ্যত্ব

নিজের মাকে কখনও বলিনি ভালবাসি,
অন্যের মাকে বলেছি,
নিজের মার কোনও অসুখ কোনওদিন সারাইনি,
অন্যের মার সারিয়েছি।
নিজের মার জন্য কাঁদিনি, অন্যের মার কষ্টে কেঁদেছি
এই করে করে জগতের কাছে উদার হয়েছি।
তার পাশে কখনও বসিনি, যে ডাকত
একটি হাত ভুলেও কখনও রাখিনি তার হাতে,
একটি চোখ কখনও ফেলিনি সেই চোখে।
সবচেয়ে বেশি যে ভালবাসত, তাকেই বাসিনি
যে বাসেনি, তাকেই দিয়েছি সব, যা ছিল যা না ছিল
এই করে করে মহান হয়েছি,
মানুষের চোখে মানুষ হয়েছি।

.

তুমি একটা কবরে শুয়ে আছো

মা কাঁপছে শীতে, কেউ একটি লেপ পৌঁছে দিচ্ছে না মাকে,
মা’র ক্ষিদে পাচ্ছে, কেউ কোনও খাবারও খেতে দিচ্ছে না,
অন্ধকার গর্তে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে মার
একটু আলো পেতে, হাওয়া পেতে, শুকনো জিভে একফোঁটা জল পেতে
কাতরাচ্ছে মা, বেরোতে চাইছে,
কেউ তাকে দিচ্ছে না।
মা ছিল মাটির,
জ্যান্ত মানুষগুলো পাথর।

মা তুমি একটি পাখি হয়ে এই পাথুরে পৃথিবী ছেড়ে
অন্য কোনও গ্রহে কোনও পাখির দেশে চলে যাচ্ছ না কেন!
তোমার সঙ্গে দেখা হবে না আমার, নাহোক।
জানব ভাল আছ।

.

পূর্বপশ্চিম

মারগটের বাগান দেখলে আমার মায়ের বাগানটির কথা মনে পড়ে,
আমার মায়ের বাগানও ছিল এরকম
সুগন্ধী ফুলের গাছ, সুস্বাদু ফলের, সবজির
আমার মা যেমন গাছের গোড়ায় জল ঢালতেন, মারগটও ঢালে তেমন।
মারগটের বাগানে চারটে আপেল গাছ, ছোট্ট একটি পুকুর-মত, ওতে পদ্ম ফোটে
আরও একটি বাড়তি জিনিস আমার মার বাগানে ছিল না,
সূর্যঘড়ি।
মার কখনও সময় দেখা হয়নি, মার সময় উড়ে গেছে হাওয়ায়
মার দিনগুলো গেছে, এভাবেই বছরগুলো।
মারগট বাগান করে মারগটের জন্য
আমার মা বাগান করতেন অন্যের জন্য
একটি ফুলের ঘ্রাণও তিনি নিতেন না, একটি ফলের স্বাদও
একটি সবজিও মুখে তুলতেন না।
আমার মা অন্যের জন্য নিজের জীবন যাপন করতেন, নিজের জন্য নয়।
মারগট নিজের জন্য ঘর করে, নিজের জন্য বাগান, নিজের জন্য পদ্ম ফোঁটায় ও,
মারগটের স্বামী সন্তান সব আছে, মার যেমন ছিল।
মারগট নিজের জন্য বাঁচে, মা নিজের জন্য বাঁচেননি।

.

মায়ের কাছে চিঠি

কেমন আছ তুমি? কতদিন, কত সহস্র দিন তোমাকে দেখি না মা, কত সহস্র দিন তোমার
কণ্ঠ শুনি না, কত সহস্র দিন কোনও স্পর্শ নেই তোমার।
তুমি ছিলে, কখনও বুঝিনি ছিলে।
যেন তুমি থাকবেই, যতদিন আমি থাকি ততদিন তুমি–যেন এরকমই কথা ছিল।

আমার সব ইচ্ছে মেটাতে যাদুকরের মত। কখন আমার ক্ষিধে পাচ্ছে, কখন তেষ্টা পাচ্ছে,
কি পড়তে চাই, কী পরতে, কখন খেলতে চাই, ফেলতে চাই, মেলতে চাই হৃদয়, আমি বোঝার
আগেই বুঝতে তুমি।
সব দিতে হাতের কাছে, পায়ের কাছে, মুখের কাছে। থাকতে নেপথ্যে।
তোমাকে চোখের আড়ালে রেখে, মনের আড়ালে রেখে যত সুখ আছে নিয়েছি নিজের
জন্য।
তোমাকে দেয়নি কিছু কেউ, ভালবাসেনি, আমিও দিইনি, বাসিনি।
তুমি ছিলে নেপথ্যের মানুষ। তুমি কি মানুষ ছিলে? মানুষ বলে তো ভাবিনি কোনওদিন,
দাসী ছিলে, দাসীর মত সুখের যোগান দিতে।
যাদুকরের মত হাতের কাছে, পায়ের কাছে, মুখের কাছে যা কিছু চাই দিতে, না চাইতেই
দিতে।
একটি মিষ্টি হাসিও তুমি পাওনি বিনিময়ে, ছিলে নেপথ্যে, ছিলে জাঁকালো উৎসবের বাইরে
নিমগাছতলে অন্ধকারে, একা। তুমি কি মানুষ ছিলে! তুমি ছিলে সংসারের খুঁটি, দাবার ঘুটি,
মানুষ ছিলে না।
তুমি ফুঁকনি ফোঁকা মেয়ে, ধোঁয়ার আড়ালে ছিলে, তোমার বেদনার ভার একাই বইতে
তুমি, তোমার কষ্টে তুমি একাই কেঁদেছ। কেউ ছিল না তোমাকে স্পর্শ করার, আমিও না।
যাদুকরের মত সারিয়ে তুলতে অন্যের অসুখ বিসুখ, তোমার নিজের অসুখ সারায়নি কেউ,
আমি তো নইই, বরং তোমাকে, তুমি বোঝার আগেই হত্যা করেছি।

তুমি নেই, হঠাৎ আমি হাড়েমাংসেমজ্জায় টের পাচ্ছি তুমি নেই। যখন ছিলে, বুঝিনি ছিলে।
যখন ছিলে, কেমন ছিলে জানতে চাইনি। তোমার না থাকার বিশাল পাথরের তলে চাপা পড়ে
আছে আমার দম্ভ।
যে কষ্ট তোমাকে দিয়েছি, সে কষ্ট আমাকেও চেয়েছি দিতে, পারিনি। কি করে পারব বল!
আমি তো তোমার মত অত নিঃস্বার্থ নই, আমি তো তোমার মত অত বড় মানুষ নই।

.

ছিল, নেই

মানুষটি শ্বাস নিত, এখন নিচ্ছে না।
মানুষটি কথা বলত, এখন বলছে না।
মানুষটি হাসত, এখন হাসছে না।
মানুষটি কাঁদত, এখন কাঁদছে না।
মানুষটি জাগত, এখন জাগছে না।
মানুষটি স্নান করত, এখন করছে না।
মানুষটি খেত, এখন খাচ্ছে না।
মানুষটি হাঁটত, এখন হাঁটছে না।
মানুষটি দৌড়োত, এখন দৌড়োচ্ছে না।
মানুষটি বসত, এখন বসছে না।
মানুষটি ভালবাসত, এখন বাসছে না।
মানুষটি রাগ করত, এখন করছে না।
মানুষটি শ্বাস ফেলত, এখন ফেলছে না। .

মানুষটি ছিল, মানুষটি নেই।

দিন পেরোতে থাকে, মানুষটি ফিরে আসে না।
রাত পেরোতে থাকে, মানুষটি ফিরে আসে না।
মানুষটি আর মানুষের মধ্যে ফিরে আসে না।
মানুষ ধীরে ধীরে ভুলে যেতে থাকে যে মানুষটি নেই,
মানুষ ধীরে ধীরে ভুলে যেতে থাকে যে মানুষটি ছিল।

মানুষটি কখনও আর মানুষের মধ্যে ফিরে আসবে না।
মানুষটি কখনও আর আকাশ দেখবে না, উদাস হবে না।
মানুষটি কখনও আর কবিতা পড়বে না, গান গাইবে না।
মানুষটি কখনও আর ফুলের ঘ্রাণ শুঁকবে না।
মানুষটি কখনও আর স্বপ্ন দেখবে না।
মানুষটি নেই।
মানুষটি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে, মানুষটি ছাই হয়ে গেছে, মানুষটি জল হয়ে গেছে।
কেউ বলে মানুষটি আকাশের নক্ষত্র হয়ে গেছে।
যে যাই বলুক, মানুষটি নেই।
কোথাও নেই। কোনও অরণ্যে নেই, কোনও সমুদ্রে নেই।
কোনও মরুভূমিতে নেই, লোকালয়ে নেই, দূরে বহুদূরে একলা একটি দ্বীপ, মানুষটি ওতেও
নেই।
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও আর যাকে পাওয়া যাক,
মানুষটিকে পাওয়া যাবে না।
মানুষটি নেই।

মানুষটি ছিল, ছিল যখন, মানুষটিকে মানুষেরা দুঃখ দিত অনেক।
মানুষটি ছিল, ছিল যখন, মানুষটির দিকে মানুষেরা ছুঁড়ে দিত ঘৃণা।
মানুষটি ছিল, ছিল যখন, মানুষটিকে ভালবাসার কথা কোনও মানুষ ভাবেনি।
মানুষটি যে মানুষদের লালন করেছিল, তারা আছে, কেবল মানুষটি নেই।
বৃক্ষগুলোও আছে, যা সে রোপণ করেছিল, কেবল মানুষটি নেই।
যে বাড়িতে তার জন্ম হয়েছিল, সে বাড়িটি আছে।
যে বাড়িতে তার শৈশব কেটেছিল, সে বাড়িটি আছে।
যে বাড়িতে তার কৈশোর কেটেছিল, সে বাড়িটি আছে।
যে বাড়িতে তার যৌবন কেটেছিল, সে বাড়িটি আছে।
যে মাঠে সে খেলা খেলেছিল, সে মাঠটি আছে।
যে পুকুরে সে স্নান করেছিল, সেপুকুরটি আছে।
যে গলিতে সে হেঁটেছিল, সে গলিটি আছে।
যে রাস্তায় সে হেঁটেছিল, সে রাস্তাটি আছে।
যে গাছের ফল সে পেড়ে খেয়েছিল, সে গাছটি আছে।
যে বিছানায় সে ঘুমোতো, সে বিছানাটি আছে।
যে বালিশে সে মাথা রাখত, বালিশটি আছে।
যে কাঁথাটি সে গায়ে দিত, সে কাঁথাটি আছে।
যে গেলাসে সে জল পান করত, সে গেলাসটি আছে।
যে চটিজোড়া সে পরত, সে চটিজোড়াও আছে।
যে পোশাক সেপরত, সে পোশাকও আছে।
যে সুগন্ধী সে গায়ে মাখত, সে সুগন্ধীও আছে।
কেবল সে নেই।
যে আকাশে সে তাকাত, সে আকাশটি আছে
কেবল সে নেই।
যে বাড়ি ঘর যে মাঠ যে গাছ যে ঘাস যে ঘাসফুলের দিকে সে তাকাত, সব আছে
কেবল সে নেই।

মানুষটি ছিল, মানুষটি নেই।

.

না-থাকা

একটি ভীষণ না-থাকাকে সঙ্গে নিয়ে আমি প্রতি রাত্তিরে ঘুমোতে যাই;
ঘুমোই, ঘুম থেকে উঠি, কলঘরে যাই-না-থাকাটি সঙ্গে থাকে।

দিনের হই চই শুরু হয়ে যায় দিনের শুরুতেই,
একশ একটা লোকের সঙ্গে ওঠাবসা–
এই কর সেই করব দৌড়োদৌড়ি–
লেখালেখি–
এ কাগজ পাচ্ছি তো ও কাগজ গেল কই!
হাটবাজার, খাওয়াখাদ্যি, সব কিছুর মধ্যে ওই না-থাকাটি থাকে।

সন্ধেবেলা থিয়েটারে
রেস্তোরাঁ বা ক্যাফের আড্ডার হুল্লোড়ে, হাসিতে
এ বাড়িতে ও বাড়িতে অভিনন্দনে, আনন্দে
ছাদে বসে থাকায়, বসে চাঁদ দেখায়
দেখে চুমু খাওয়ায়,
নিভৃতে থাকে, না-থাকাটি থাকে।

যখন ভেঙে আসি,
বই গড়িয়ে পড়েছে, চশমাটিও–
হেলে পড়াশরীরটিকে আলতো ছুঁয়ে
মাঝরাত্তিরে চুলে বিলি কেটে কেটে না-থাকাটি বলে,
‘মা গো, বড় ক্লান্ত তুমি, এবার ঘুমোতে যাও।’

.

যেও না

যেও না। আমাকে ছেড়ে তুমি এক পাও কোথাও আর যেও না।
গিয়েছো জানি, এখন উঠে এসো। যেখানে শুয়ে আছো,
যেখানে তোমাকে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে।
সেখান থেকে লক্ষ্মী মেয়ের মত উঠে এসো।
থাকো আমার কাছে, যেও না। কোথাও আর কোনওদিন যেও না।
কেউ নিতে চাইলেও যেও না।
রঙিন রঙিন লোভ দেখিয়ে কত কেউ বলবে, এসো। সোজা বলে দেবে যাবো না।
সারাক্ষণ আমার হাতদুটো ধরে রাখো,
সারাক্ষণ শরীর স্পর্শ করে রাখো,
কাছে থাকো, চোখের সামনে থাকো,
নিঃশ্বাসের সঙ্গে থাকো,
মিশে থাকো।
আর কোনওদিন কেউ ডাকলেও যেও না।
কেউ ভয় দেখালেও না।
হেঁচকা টানলেও না।
ছিঁড়ে ফেললেও না।
যেও না।
আমি যেখানে থাকি, সেখানে থাকো, সারাক্ষণ থাকো।
আবার যাপন করো জীবন,
যেরকম চেয়েছিলে সেরকম জীবন তুমি যাপন করো আবার।
হাত ধরো, এই হাত থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি সুখ তুলে নাও।
আমাকে বুকে রাখো, আমাকে ছুঁয়ে থাকো, যেও না।
তোমাকে ভালোবাসবো আমি, যেও না।
তোমাকে খুব খুব ভালোবাসবো, যেও না।
কোনওদিন আর কষ্ট দেব না, যেও না।
চোখের আড়াল করবো না কোনওদিন, তুমি যেও না।
তুমি উঠে এসো, যেখানে ওরা তোমাকে শুইয়ে দিয়েছে,
সেখানে আর তুমি শুয়ে থেকো না,
তুমি এসো, আমি অপেক্ষা করছি, তুমি এসো।
তোমার মুখের ওপর চেপে দেওয়া মাটি সরিয়ে তুমি উঠে এসো,
একবার উঠে এসো, একবার শুধু।
আমি আর কোনওদিন কোথাও তোমাকে একা একা যেতে দেব না।
কথা দিচ্ছি, দেব না।
তুমি উঠে এসো।
তোমাকে ভালোবাসবো, উঠে এসো।

.

ছিলে

একটু আগে তুমি ছিলে, ভীষণরকম ছিলে, নদীটার মত ছিলে, নদীটা তো আছে,
পুকুরটা আছে, খালটা আছে।
এই শহরটার মত, ওই গ্রামটার মত ছিলে। ঘাসগুলোর মত, গাছগুলোর মত।
ছিলে তুমি, হাসছিলে, কথা বলছিলে, ধরা যাক কাঁদছিলেই,
কিন্তু কাঁদছিলে তো, কিছু একটা তো করছিলে, যা কিছুই করো না কেন, ছিলে তো!
ছিলে তো তুমি, একটু আগেই ছিলে।

কিছু ঘটলো না কোথাও, কিছু হলো না, হঠাৎ যদি এখন বলো যে তুমি নেই!
কেউ এসে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলে যে তুমি নেই,
বসে আছি, লিখছি বা কিছু, রান্নাঘরে লবঙ্গ আছে কি না খুঁজছি,
আর অমনি শুনতে হল
তুমি নেই। তুমি নেই, কোথাও নেই, তুমি নাকি একেবারে নেইই,
তোমাকে নাকি চাইলেই আর কোনওদিন দেখতে পাবো না!
আর কোনওদিন নাকি কথা বলবে না, হাসবে না, কাঁদবে না, খাবে না, দাবে না,
ঘুমোবে না, জাগবে না, কিছুই নাকি আর করবে না!

যত ইচ্ছে বলে যাও যে তুমি নেই, যত ইচ্ছে যে যার খুশি বলুক,
কোনও আপত্তি নেই আমার, কেন থাকবে, আমার কী! তোমাদের বলা না বলায়
কী যায় আসে আমার! আমার শুধু একটাই অনুরোধ,
করজোড়ে একটা অনুরোধই করি,
আমাকে শুধু বিশ্বাস করতে বোলো না যে তুমি নেই।

.

ফিরে এসো

কোনও একদিন ফিরে এসো, যে কোনও একদিন, যেদিন খুশি
আমি কোনও দিন দিচ্ছি না, কোনও সময় বলে দিচ্ছি না, যে কোনও সময়।
তুমি ফিরে না এলে এই যে কী করে কাটাচ্ছি দিন
কী সব কাণ্ড করছি,
কোথায় গেলাম, কী দেখলাম
কী ভালো লেগেছে, কী না লেগেছে–কাকে বলবো!
তুমি ফিরে এলে বলবো বলে আমি সব গল্পগুলো রেখে দিচ্ছি।
চোখের পুকুরটা সেচে সেচে খালি করে দিচ্ছি, তুমি ফিরে এলে যেন
এই জগৎসংসারে দুঃখ বলে কিছু না থাকে।
তুমি ফিরে আসবে বলে বেঁচে আছি, বেঁচে থেকে যেখানেই যা কিছু সুন্দর পাচ্ছি, দেখে
রাখছি,
তুমি এলেই সব যেন তোমাকে দেখাতে পারি।
যে কোনও একদিন ফিরে এসো, ভর দুপুরে হোক, মধ্যরাত্তিরে হোক–
তোমার ফিরে আসার চেয়ে সুন্দর এই পৃথিবীতে আর কিছু নেই।
বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত সুন্দর জড়ো করলেও
তোমার এক ফিরে আসার সুন্দরের সমান হবে না।
ফিরে এসো,
যখন খুশি।
নাও যদি ইচ্ছে করে ফিরে আসতে,
তবু একদিন এসো, আমার জন্যই না হয় এসো,
আমি চাইছি বলে এসো,
আমি খুব বেশি চাইছি বলে।
আমি কিছু চাইলে কখনও তো তুমি না দিয়ে থাকোনি!

মা, বিশ্বাস করো, একটি কবিতাও বানিয়ে লেখা নয়। প্রতিটি কবিতা লিখতে লিখতে চোখের জল ঝরেছে। তুমি দেখনি অনুতাপের ভয়াবহ আগুনে কী ভীষণ পুড়ছি আমি, এখনও পুড়ি। তোমার কথা আমি কোথাও, আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে, বা বন্ধুদের সঙ্গে উচ্চারণ করি না। তুমি বুকের ভেতরে থাকো। অপরাধবোধ থেকে, পশ্চিমের অনেক বন্ধুই বলেছে মুক্তি পাওয়া উচিত আমার। কারণ এই বোধটি খুব ক্ষতিকর। তুমি জানো না, চোখে আমার জল কত ছিল তোমার জন্য। জগৎটাই এখন বড় খালি খালি লাগে। একটু যদি কোথাও থেকে দেখতে পেতে, একটুও যদি ভালো লাগতো তোমার, একটু যদি শান্তি পেতে, যে শান্তি তোমার কোনওদিন পাওয়া হয়নি! আমার চোখে তোমার জন্য কোনওদিন তো জল দেখোনি। একবার শুধু দেখেছিলে মা, নাকি দুবার। জল তো কত এখন চোখে, তুমি কি দেখতে পাও!

এগুলোর পর আর কি কোনও কবিতা তোমাকে নিয়ে লিখেছি! নতুন কবিতার বইয়ে মাত্র একটি কবিতা। সম্ভবত ধীরে ধীরে তোমাকে ভুলে যাচ্ছি মা। হয়তো তোমাকে এখন আগের চেয়ে কম মনে পড়ে। আগের চেয়ে চোখের জলও ফেলি কম। আগে যেমন প্রতিরাতে স্বপ্ন দেখতাম তোমাকে, একটি স্বপ্নই দেখতাম, স্বপ্নটি অনেকদিন আর দেখি না। নতুন বইয়ের কবিতাটাও লিখে দিলাম, পড়ো।

আশ্চর্য একটা গাছ দেখি পথে যেতে যেতে, যে গাছে সারা বছর শিউলি ফোটে।
গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখে জল উপচে ওঠে,
শিউলি পড়ে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা সাদা হয়ে থাকে মাঠ।
তার কথা মনে পড়ে, শিউলির মালা গেঁথে গেঁথে
শীতের সকালগুলোয় দিত,
দুহাতে শিউলি এনে পড়ার টেবিলে রেখে চলে যেত।
শীত ফুরিয়ে গেলে দীর্ঘ দীর্ঘ শ্বাস ফেলতে, তাকে মনে পড়ে।
একবার যদি দুনিয়াটা এরকম হতে পারতো যে নেই সে আসলে আছে,
একবার যদি তাকে আমি কোথাও পেতাম, কোনওখানে,
তার সেই হাত, যে হাতে শিউলির ঘ্রাণ এখনও লেগে আছে,
এখনও হলুদ জাফরান রং আঙুলের ফাঁকে, ছুঁয়ে থাকতাম,
মুখ গুঁজে রাখতাম সেই হাতে।
সেই হাত ধরে তাকে নিয়ে যেতাম নতুন গাছটার কাছে,
মালা গেঁথে গেঁথে তাকে পরাতাম, যত ফুল আছে তুলে
বৃষ্টির মতো ছড়াতাম তার গায়ে।

দুনিয়াটা যদি এরকম হয় আসলে সে আছে,
শিউলির ঋতু এলে কোনও একটা গাছের কাছে সে যাবে,
মালা গেঁথে মনে মনে কাউকে পরাবে, দুহাতে শিউলি নিয়ে
কারও পড়ার টেবিলে চুপচাপ রেখে দেবে,
তাহলে পথে যেতে যেতে যে গাছটা দেখি, সেটায়
হেলান দিয়ে আমি দাঁড়িয়ে থাকবো, যতদিন ফুল ফোটে ততদিন।

তুমি শিউলি ভালোবাসতে খুব মা। শিউলি ফুল দেখলেই তাই তোমাকে মনে পড়ে। বুক ফেটে যায়। এই বোবা কষ্টের কোনও নাম নেই মা। আমি এই কষ্টের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারি না। আমি আত্মায় বিশ্বাস করি না, তুমি তো জানো। আমি পরকালে বিশ্বাস করি না। যে হাশরের ময়দানের কথা ভেবে তুমি শিউরে উঠতে, সেই হাশরের ময়দানেও আমার বিশ্বাস নেই। কিন্তু প্রাণপণে আমি এখন বিশ্বাস করতে চাই ওসবে। আমার মতো সুখী আর কেউ হবে না যদি আমি দেখি যে আসলে আল্লাহ বলে কেউ কোথাও আছেন, আমার মতো সুখী আর কেউ হবে না যদি দেখি আখেরাত বলে, পুলসেরাত বলে কিছু আছে। যদিও জানি ওসবের অস্তিত্ব নেই, যদিও আমি ভীষণ ভাবে বিবর্তনে, বিজ্ঞানে বিশ্বাসী, তারপরও আমি চাই বিজ্ঞান মিথ্যে হোক, ধর্ম সত্যি হোক। আমি আমার সমস্ত জীবন দিয়ে চাই, আমার সমস্ত লেখা আমার সমস্ত বিশ্বাস, আমার দর্শন ধসে যাক ভূমিকম্পে যেমন ধসে যায় ইমারত। আমি চাই, তুমি সুখী হও, তুমি বেহেস্তবাসী হও, আমি চাই তুমি সুখভোগ করো। এই কামনাই এখন আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য। আমি চাই আমি মিথ্যে হই, আমি ভুল হই, তুমি সত্য হও, তোমার এতদিনকার ইবাদত সত্য হোক, তোমার স্বস্তি হোক। আমি চাই অনন্তকাল তুমি আনন্দ করো।

.

মা

অনেকে আমার মা হতে চেয়েছে, অনেকে বাবা
অনেকে মামা কাকা খালা ফুপু
অনেকে সেসব বন্ধু, যাদের হারিয়েছি।

চেষ্টা চরিত্তির করে অনেকে বাবা হয়েছে অনেকটাই
কষ্টেসৃষ্টে মামা কাকা খালা ফুপু।
অনেকে বন্ধু হয়েছে নিমেষেই, কায়ক্লেশে নয়।
মা হতে অনেকে চেষ্টা করেছিল, মা হতে সেই অনেকের পর
আরও অনেকে চেষ্টা করেছিল
সেই আরও অনেকেরপর আরও অনেকে। দিনের পর দিন অকথ্য পরিশ্রম
করেছিল মা হতে তবু কেউ মা হতে পারেনি
ছিটেফোঁটা মা কেউ হতে পারেনি
এক ফোঁটা মা কেউ হতে পারেনি।
এক বিন্দু মা হতে পারেনি।

১১. শেফালিকে অবকাশে রেখে

মা, শেফালিকে অবকাশে রেখে চলে গেছে, আমিও ওকে রেখে এসেছি অবকাশে। শেফালির সৎমার সংসারে আপন বলতে একটি মাত্র ভাই, সে ভাইও জানি না কী অপরাধ করে এখন জেলখানায়। শেফালি তার বেতনের টাকা জমিয়ে ভাইকে দিয়ে আসতো দুতিন মাস পর পর। একদিন ভাইটি বেরোবে জেল থেকে, বিয়েথা করে সংসার শুরু করবে, শেফালির এই একটিই স্বপ্ন। তার আর কোনও স্বপ্নের কথা আমি জানি না। বয়স আঠারো বা উনিশ, ছিলো বোধহয় কোনও স্বপ্ন, তুমি সম্ভবত জানো। এক শেফালি ছাড়া আর কেউ তোমার ওপর নির্ভর ছিলো না, তুমি ওকে একা রেখে চলে যাওয়ার পর বাবার দেখাশোনা করার দায়িত্ব শেফালি নিজেই নিলো। সে কাজটা বাড়তি কাজ, বাড়ির সবার জন্য সারাদিনের খাটাখাটনির পর বাবার ঘরটা গুছিয়ে রাখবে, বাবাকে খাবার দেবে। শেফালিকে প্রায়ই ফোন করে খুব আদর করে বলি, যেন বাবাকে দেখে রাখে, বাবার যেন কিছুতে খুব মন খারাপ না হয়। সেই হাসিখুশি শেফালি, ছুটে ছুটে বাড়ির সব কাজ একাই সেরে ফেলা শেফালি, হঠাৎ শুনি, মারা গেছে। সকালে কাপড় কাঁচতে গিয়ে কলের পাইপে হাত দিতেই ইলেকট্রিক শক লেগে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। চিৎকার করেছিলো, সে চিৎকারে বাড়ির লোক দৌড়ে গিয়েছে বটে কাছে, কিন্তু ওকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে কেউ সাহস পায়নি। মা, যে মেয়েটা তোমার কাছে কাছে থাকতো অনেক বছর, তুমি মারা গেলে সবচেয়ে বেশি কেঁদেছে যে মেয়ে, যে মেয়ে বাড়ির সবার আরামের জন্য দিন রাত পরিশ্রম করেছে, তাকে ইচ্ছে করলেই বাঁচানো যেত, কিন্তু সবাই দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখেছে ওর মরে যাওয়া। শেফালির ভাই মোটা অংকের একটা টাকা দাবি করেছিলো, নাহলে মামলা করবে বলেছিলো। দাদা নানা রকম আয়োজন করেছে টাকা না দিয়ে মীমাংসা করার। অথবা যদি দিতেই হয় টাকা, দাদার মাথায় শুধু যত কম দিয়ে পার পাওয়া যায় সেই ভাবনা। আমি টাকার পরিমাণ দাদাকে বারবার বলি বাড়াতে। কিন্তু আমার বলায় কী যায় আসে বলো! ওদের সবার কাছে আমি তোমার মতোই মৃত। আমার কণ্ঠস্বরকে ওরা কণ্ঠস্বর বলে মনে করে না। কণ্ঠস্বরের ওপারে যে জলজ্যান্ত একটা মানুষ আমি, তা তাদের আচরণে কোনওদিন প্রকাশ পায়নি। টাকা জিনিসটা চারদিকের সবার কাছে অত্যন্ত প্রিয়। শেফালির চলে যাওয়া সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে বাবাকে। তুমি নেই, আমি নেই, ইয়াসমিন নেই, শেফালি নেই। বাবাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার আর কেউ তখন সংসারে নেই। দাদা আর হাসিনার ইচ্ছের মুঠোয় বাবাকে বন্দি হতে হল।

বাবা কেমন আছে, কী করছে খোঁজ নিতে প্রায়ই ফোন করি। বাবা বলে বটে যে ভালো আছে, কিন্তু বাবার কণ্ঠস্বরে আমি টের পাই বাবা ভালো নেই। বাবা কোনওদিনই তার অসুখের কথা কাউকে জানায় না। একদিন দাদা খুব সহজ শান্ত গলায় বললো বাবার কিডনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শুনে আমার বুকের ভেতর থেকে ঠাণ্ডা একটা, জানি না কী নাম তার, মুহূর্তে সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল। কিডনি কবে থেকে নষ্ট হচ্ছে? দাদার বক্তব্য আমার নাকি জানার কথা সব। সেই যে বাবা কলকাতায় এসেছিলো, তখনই নাকি কলকাতার ডাক্তাররা বলেছিলো কিডনি নষ্ট হচ্ছে। এসবের কিছুই জানি না আমি। কোনও ডাক্তার আমাকে বাবার কিডনি নষ্ট হওয়ার কথা কিছু বলেনি। ঘরে বাইরে সারাদিন অস্থির পায়চারি করলাম। ভেতরে বুদবুদের মতো দেশে ফেরার ব্যাকুলতা। বাবার এই দুঃসময়ে যদি পাশে না থাকতে পারি, তবে বেঁচে থাকার কী অর্থ! আশংকায় আমি কুঁকড়ে থাকি। অন্ধকারে নিজেকে মুড়ে একাপড়ে থাকি ঘরের কোনও কোণে। ফোন বাজলে বুকের ধুকপুক এমন বাড়ে যে মনে হয় দৌড়ে পালাই। একদিন অভিমানের গায়ে পাথর চাপা দিয়ে ইয়াসমিনকেই কাতর অনুনয় করি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেন সে দেশে যায়। ইয়াসমিনেরও নিজের সমস্যার অন্ত নেই। বলতেও পারতো সে যাবে না, কিন্তু তোমার মৃত্যু তার স্নায়ুর ঘরবাড়িতে ভূকম্পন তুলে জানিয়ে গেছে মৃত্যু জিনিসটা ঠিক কী। কারও মৃত্যু না হলে আমরা বোধহয় দেখতে পাই না মৃত্যুর সত্যিকার চেহারা। ইয়াসমিন তড়িঘড়ি বাবার জন্য খাবার দাবার কাপড় চোপড় আর নানারকম উপহার কিনে রওনা হলো দেশে।

দাদার অভিযোগ শুরু হয়েছে বাবার নাকি হরেকরকম বান্ধবী আছে। বান্ধবীরা বাবার সঙ্গে দেখা করতে বাড়িতে ঢুকতে চায়। ওদের অর্ধচন্দ্র দিয়ে বাড়ি থেকে প্রতিদিনই বিদেয় করে দাদা। বিদেয় করার ঘটনা দাদা বেশ বীরত্বের সঙ্গে বর্ণনা করে। তার বীরত্ব আমাকে মোটেও পুলকিত করে না। দাদাকে বলি যা ইচ্ছে হয় বাবার, তাই যেন তাকে করতে দেওয়া হয়। বান্ধবীদের সঙ্গে বাড়িতে বসে বাবা কথা বলতে চাইলে বলবে। শুতে চাইলে শোবে। বাবার চরিত্র সংশোধনের গুরুদায়িত্ব দাদাকে নিতে বারবার বারণ করি। জীবন একটিই, এই জীবনটি যেমন ইচ্ছে যাপন করার অধিকার আরসবারমতো বাবারও আছে। সারা জীবন স্বাধীনতা ভোগ করে আসা মানুষকে অসুখের দোহাই দিয়ে টেনে হিঁচড়ে একটি বন্ধ ঘরে ঢুকিয়ে বন্দি করা হলে কেমন অস্থির হয় তার ভেতর বাহির, তা বাবা না হয়েও আমি অনুভব করি। বাবার মন ভেঙে যাচ্ছে, শরীর ভেঙে যাওয়ার চেয়েও তা অনেক বেশি ক্ষতিকর। শরীর যখন যাবার, যাবে। মনকে মরতে দিতে নেই। তুমি নেই মা, এখন আর বাবাকে তার বান্ধবীদের কাছ থেকে জোর করে দূরে সরিয়ে কার কী ভালো দাদা করছে! তুমি থাকাকালীন যে কাজটা কেউ কোনওদিন করেনি, তুমি না-থাকাকালীন কেন? বাবাকে এরকমও আর আশ্বাস দেওয়া হচ্ছেনা যে সে তার হারিয়ে যাওয়া জগৎটি ফিরে পাবে একদিন। অবকাশের অন্দরে বন্দি করে বাবার মতো কাজপাগল মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া বাবার আর কাজ কিছু নেই। কী ভয়ংকর নিষ্ঠুর এই আচরণ। বাবার চেম্বারে চিরতরে তালা লাগিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা দাদার একার। ধীরে ধীরে বাবাকে নিজের মুঠোয় নিয়ে দাদা কী খেলা খেলছিলো কে জানে! কারও কথায় বাবা উঠছে বসছে, দৃশ্যটি বড় অচেনা ঠেকে। কী করে জানিনা দাদার হাতের ক্রীড়নক হয়ে পড়েছিল বাবার মতো ভয়ংকর একগুঁয়ে মানুষ! সম্ভবত কিডনি নষ্ট হওয়ার খবর বাবাকে বদলে দিয়েছিলো আগাগোড়া। মনে আছে, অবকাশের একটি ঘরে মৃত্যুর সঙ্গে রোজ যুদ্ধ করে চলেছো, বাবা বাড়ির বাইরে যেতে চাইলে আমি কালো ফটকে তালা দিয়ে রাখতাম, চাইতাম বাবা বাড়ি থাকুক। দিন দিন তুমি যুদ্ধে হেরে যাচ্ছো, মৃত্যু তোমার শরীর জুড়ে উলঙ্গ নৃত্য করছে, আমি চাইনি বাবা এ সময় বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যাক। কিন্তু বাবার ওপর জোর চালিয়ে শেষ পর্যন্ত আমি জিততে পারিনি। যে করেই হোক বেরিয়ে গেছে বাবা। কেঁদে কেটে, অনশন করে, অভিমান করে, রাগ করে, চিৎকার করে হলেও বেরিয়েছে। তুমি মরে যাচ্ছে, তাতে কী, বাবা তো বেঁচে আছে, বেঁচে থাকতে হলে সবার আগে তাকে তার জগতে ফিরতে হবে। সেই জগৎ আমাদের সবার জগৎ থেকে আলাদা। সেখানে রোগী আছে, রোগিণী আছে। রোগ শোক চিকিৎসা বন্ধু বান্ধব আড্ডা গল্পগুজব চানাচুর বাদাম ইত্যাদি আছে। বহুঁকাল ধরে গড়ে তোলা বাবার নিজস্ব এই জগৎ। কোনও কিছুই তাকে সেই জগৎ থেকে সরাতে পারে না। তোমার মৃত্যুও নয়। সেই জগৎটি বাবার কাছ থেকে হঠাৎ কেড়ে নেওয়া হল। অনেককাল আগে বাবা আমাকে বলেছিলো তার মৃত্যু যেন হয় ওই চেম্বারের ওই চেয়ারে বসে, রোগীর প্রেসক্রিপশান লিখতে লিখতে, হঠাৎ। যে বাবা কোনওদিন একটি মুহূর্তের জন্য অবসরে বিশ্বাস করতো না, তার কেন ভালো লাগবে ভয়াবহ অবসর! বাবা যতটা অসুস্থ ছিল, তার চেয়ে বেশি অসুস্থ হতে লাগলো। অস্থিরতা চরমে উঠে সর্বনাশ করতে লাগলো তার। জীবনে প্রথম তাকে ভোগ করতে হচ্ছে বন্দিত্ব, প্রথম তাকে বুঝতে হচ্ছে যে তার ইচ্ছের কোনও মূল্য নেই আর। পুরুষদের সঙ্গে দেখা করার অধিকার বাবার আছে, মহিলাদের সঙ্গে নেই। এই নেইটা দাদার আদেশ। প্রথম প্রথম উপদেশ দিতো হয়তো, সেই উপদেশ ধীরে ধীরে আদেশে পরিণত হয়েছে। বাবার শারীরিক বা মানসিক অবস্থার কথা ভাবার কারও সময় নেই তখন! দাদা আর ছোটদা অলক্ষ্যে হয়তো বাবাকে মৃত্যুর জন্য তৈরি করেছিলো। ইচ্ছে করে ছুটে যাই, বাবাকে বাবার মতো করে তার শেষ কটা দিন বাঁচতে দিই। কিন্তু বন্দি তো বাবার চেয়েও বেশি আমি। বাবার মন প্রফুল্ল থাকে, আনন্দময় থাকে, এমন পরিবেশই বাবাকে দেওয়া হোক, এক এক করে ভাইদের, আত্মীয়দের সবাইকেই বলি। কিন্তু দূরের মানুষের দীর্ঘশ্বাস বা উপদেশ কিছুই কেউ গ্রাহ্য করে না। খুব ভালো করে বুঝি যে বাবা আর আগের বাবা নেই। কণ্ঠে অবসাদ। আশার আঙিনাগুলো আশংকায় আচ্ছাদিত। দাদা আগে বাবার কানে কানে কথা বলতো, মামা খালাদের বিরুদ্ধে যা নয় তা বলে কান ভারি করতে বাবার। কানাকানি দাদা এখন বাবার সঙ্গে করে না, যদি করে, করে ছোটদার সঙ্গে। কী করে বাবাকে শেকলে বাঁধা যায় এ নিয়ে জল্পনা। বাবা নাকি কথা শোনে না, বাইরে বেরিয়ে যায়। বাবাকে হয়তো শেকল দিয়ে বাঁধারই বন্দোবস্ত হচ্ছিল। বেঁধেছিল কি না জানি না, তবে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে যে শেকল দিয়েছিল তা জানি। কেন, খুব নাকিপাগলামি করে বাড়ি থেকে বাইরে বেরোনোর জন্য? যদি বাইরে বেরিয়ে আবার ওই মহিলাদের বাড়ি চলে যায়! দুএকজন মহিলা নিয়ে দাদার তখন মাথা খারাপ হবার যোগাড়। কেন, মহিলারা বাবার বান্ধবী। এ বাবার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তুমি যখন হা হুতাশ করে মরতে, বাবার বান্ধবী বা স্ত্রী নিয়ে তুমি যখন বছরের পর বছর কেঁদে বুক ভাসাচ্ছো, কই দাদা তো মোটেও বাবার বান্ধবী-নেশা ঘোচানোর কোনও চেষ্টা করেনি। এখন হঠাৎ কেন? কারণ তুমি কি অনুমান করতে পারছে না মা? দাদার একটিই কেবল দুশ্চিন্তা। ওই মহিলাদের কাউকে আবার বিয়ে টিয়ে করে বসেনি তো কখনও। তাহলে তো বাবার বিরাট সম্পত্তির কোনও অংশ ওদের কারও হাতে চলে যাবে।

তোমার অবর্তমানে শুনেছিলাম কোন এক বিধবা ভদ্রমহিলার সঙ্গে নাকি বাবার বিয়ে জাতীয় কিছুকরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, বৈধভাবে তারা মেলামেশা করতে পারবে এরকম কিছু। অবকাশে দাদারাই এটি ঘটার ব্যবস্থা করেছিলো। ভদ্রমহিলা নাকি অবকাশে প্রায়ই যেত, বাবাও যেতে তার বাড়িতে। যার সঙ্গে বাবা ঢাকায় বসে ফোনে কথা বলেছিলো, শুনে তুমি কেঁদেছিলে, তার সঙ্গেই এই ঘটনা। মেলামেশা করার আর কোনও রকম আইন আছে কিনা বিয়ে ছাড়া, আমার জানা নেই। তবে মুসলমানের আইন তো, পুরুষের বহুগামিতার সুযোগ সুবিধে বিস্তর। আমি তো দূরের মানুষ, দেশে আর কোনও দিন ফিরতে না পারা মানুষ। আমাকে খুব বেশি কিছু। জানানোও হয় না। নিজে ফোন করে বার বার জিজ্ঞেস করে করে যদি কিছু জানি তো জানি।

বাবা যা কিছুই করুক, তোমার অসুস্থতার সময় বাবার ওপর আমার যত রাগছিল, তুমি না থাকার পর কী করে যেন সব জল হয়ে গেল। তাকেই আঁকড়ে ধরে তোমার শূন্যতাকে আড়াল করতে চাইতাম মনে মনে। আমার সব মনে মনেই ছিল মা। তোমার সঙ্গে তোমার জীবনের বেশির ভাগ সময়ই বাবা অন্যায় ছাড়া আর কোনও আচরণ করেনি জানি মা। কিন্তু তারপরও বাবাকে আমি শ্রদ্ধা না করে পারি না। তুমিও তো চাওনি বাবার সঙ্গে কোনও অশোভন আচরণ করি। চিরকাল ভয়ে সিঁটিয়ে থেকেছি। বাবা আমাদের পেটাতো, ভয় দেখাতো। কিন্তু ভালোও তো বাসতো। তার ভালোবাসা কখনও অন্য বাবাদের ভালোবাসার মতো ছিল না। বাবারশাসনে জানি না ছেলেমেয়েরা কতটুকু মানুষ হয়েছে। দাদা তো চিরকালই বাবার ওপর নির্ভর করেই জীবন কাটালো। ছোটদাও অনেকটা। বাবার স্বপ্নপূরণ এক আমিই করেছিলাম। হুট করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলো। কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত আমার সিদ্ধান্ত। আমি সম্ভবত বাবার মতো হয়েছিলাম। আমার মনোবলটা বাবার কাছ থেকে পাওয়া। ঝড় ঝঞ্জার সামনে ঋজু দাঁড়িয়ে থাকা বাবা। ভয় না পাওয়া, রুখে ওঠা, প্রতিবাদ করা বাবা। স্বনির্ভর হওয়া, মাথা উঁচু করে বাঁচা, বাবা। অহংকার, আত্মবিশ্বাস, বাবা। আর তুমি হচ্ছ আমার ভেতরে যে অবিশ্বাস্যরকম যে এক নরম হৃদয় আছে, মানুষের জন্য কাঁদা, কেঁদে বুক ভাসানো, সেটা বিলিয়ে দেওয়া, ভালোবেসে অকাতরে দান করা, তুমি। মাঝে মাঝে তীব্র হতাশায় যখন ডুবে থাকি, মনে হতে থাকে পৃথিবীতে কেউ বুঝি আমাকে ভালোবাসে না, আমি একা, একটি বিন্দুর মতো আমি একা, মনে হতে থাকে কী দরকার এই বেঁচে থাকার–সেটা তুমি। ছেলেমেয়েদের আর কারও মধ্যে এত তীব্র ভাবে তোমাদের দুজনের উপস্থিত নেই। ইয়াসমিন একটা সময় দুর্বিনীত দুরন্ত মেয়ে ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে বয়স বাড়ার পর বাবার সব গুণ চলে গিয়ে তুমি এসে উপস্থিত হয়েছে ওর মধ্যে। ঠিক তোমার মতোই অশান্তির সংসার ও করে যাচ্ছে। প্রায়ই স্বামীকে ত্যাগ করার কথা বলে, কিন্তু সন্তানের জন্য পারে না। আত্মবিশ্বাসের এক ফোঁটা কিছু নেই। নিজেকে কুৎসিত বলে মনে করছে, যদিও কুৎসিত নয়। তোমার আত্মবিশ্বাস ছিল, কিন্তু তোমার উপায় ছিল না। ইয়াসমিনের উপায় থাকলেও মনের জোর নেই। আসলে তোমার গুণগুলো ওর মধ্যে গিয়ে দোষে পরিণত হয়েছে। গুণএর মাত্রা অতিরিক্ত হলে সেটা আর গুণ থাকে না। ধরো মানুষের জন্য জীবন দেওয়ার গুণ যদি আমার ভেতরে আরও বেশি মাত্রায় থাকে, আমাকে হয়তো আত্মহত্যা করতে হবে। আর, বাবার গুণই ধরো, শক্তি সাহস, সংকল্প, দৃঢ়তা ঋজুতা ইত্যাদি অতিরিক্ত হলে জানি না কী করবো, হয়তো মৌলবাদীর সশস্ত্র মিছিলের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বলবো, সাবধান এক পা এগোবি না। দাদা আর ছোটদার মধ্যে আমি তোমাকে দেখি না। বাবার মেয়েমানুষের দোষ দ্বিগুণ বা ত্রিগুণ হয়ে ছোটদাকে ধরেছে। একসঙ্গে বেশ কটি সুন্দরীর সঙ্গে গোপন সম্পর্ক রাখতে সে পারদর্শী। বাবার সেদিক থেকে কপাল ভালো ছিল না। বিবাহিতা, অসুখী, অসুন্দরী, নিগুণ, এমনই দুএকটি ছিল হয়তো কপালে, কেউই কিন্তু তোমার চেয়ে দেখতে ভালো, তোমার চেয়ে বুদ্ধিমতী বা কম বয়সি ছিলো না, অন্তত যে দুজনের কথা শুনেছি। দাদার মাথা থেকে পা পর্যন্ত বাবার একটি গুণই দোষের মতো দেখা দেয়। বাবার মিতব্যয়িতা দাদার ভেতরে প্রবল পরিমাণে ঢুকে কৃপণতার আকার ধারণ করেছে। বাকিগুণ বা দোষ অত প্রকাশিত নয়। কৃপণতা অবশ্য তার বউ ছেলেদের ক্ষেত্রে তত নেই, যতটা বাকি পৃথিবীর জন্য।

মা, মাঝে মাঝে মনে হয় বহুগামিতা মানুষ নামক প্রজাতির স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। আমরা সমাজের বিধি নিষেধ নিজেদের ভেতর ধারণ করে আমাদের স্বভাবজাত বহুগামিতাকে শরীরের না হলেও মনের শক্তি দিয়ে রোধ করি। ভালোবাসা নামক একটি দেয়াল এসে আমাদের সামনে অনড় দাঁড়ায়। সেই দেয়াল ডিঙিয়ে আমরা তথাকথিত পরনারী বাপরপুরুষের কাছে যেতে পারি না। বাবা যদি বহুগামিনা হতো, তোমরা দুজনেই খুব সুখী হতে পারতে। হঠাৎহঠাৎ যখন বাবার সঙ্গে তোমার ঘনিষ্ঠতা হতো, দুজনকেই কী প্রফুল্ল দেখতাম। ওরকম যদি সবসময় থাকতে পারতে। জানি তোমার উদ্যোগে কোনও কাজ হত না। বাবা যদি এগিয়ে আসতো, তবেই সম্ভব হত সম্পর্ক মধুর করা। তুমি তো একপায়ে সারাজীবন খাড়াই ছিলে বাবার সামান্য ভালোবাসা পেতে। তোমার অসুখ ধরা পড়ার পর বাবা যে বাধ্য স্বামীর মতো তোমাকে আদরযত্ন করতে শুরু করলো, নিজের বাড়িঘর, রোগী দেখা, বান্ধবী, সব ফেলে সব ভুলে–জানি না ওর পেছনে কী কাজ করেছিলো? অপরাধবোধ! মনে হয়। দুজনই তোমার অসুস্থতার সময় সবচেয়ে বেশি নিঃস্বার্থভাবে সেবা করেছে, সে বাবা আর আমি। বাবার আর আমার আরও গুরুত্বপূর্ণ মিল বোধহয় এটাও।

বাবাকে কোনওদিন কি বোঝাতে পেরেছি ভালোবাসি? তোমার জীবনের শেষ কটা দিন তোমার পাশে থেকে না হয় মিথ্যে হোক সত্যি হোক, বুঝিয়েছি ভালোবাসি। বাবার সেবা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি মা। সুইডেনের বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে আমার পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন করলাম, শেখ হাসিনার কাছে চিঠিও লিখলাম যেন আমাকে কিছুদিনের জন্য অনুমতি দেন দেশে ফেরার। জানিয়েছি, বাবা ভীষণ অসুস্থ, তাকে না দেখলেই নয় আমার। তারপরও কোনও উত্তর নেই। রাষ্ট্রদূত নিজে বেশ কয়েকবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠালেন এর গুরুত্ব বুঝিয়ে, সেসবেরও কোনও উত্তর নেই। উত্তর নেই ঠিক বলবো না, উত্তর হচ্ছে, না। অথচ দেখ, উঠতে বসতে শেখ হাসিনা কী কান্নাই না কাঁদছেন তাঁর নিজের বাবার জন্য! অথচ আমার বাবাকে দেখতে যেতে দিতে তাঁর আপত্তি। ওদিকে বাবা আমাকে যে কথা আগে কখনও বলেনি, বলছে যেন দেশে ফেরার চেষ্টা করি। বুঝি আমাকে দেখার জন্য বাবা ব্যাকুল হচ্ছে। ভয় নাপাওয়া বাবাও, বুঝি যে ভেঙেপড়েছে। আমারআর্তনাদ, আমারআকুলতা কিছুই বাংলাদেশ সরকারকে স্পর্শ করে না। বাবা তার মেয়েকে ডাক্তার বানালো, বাবার অসুস্থতার পাশে সবাই আছে, শুধু তার ডাক্তার মেয়েটি নেই। ডাক্তারির কিছুই না জানা দুই পুত্রধন বাবার পাশে আছে, যারা অনেকটা বাবার চিকিৎসকের ভূমিকা নিয়েছে। বিশেষ করে দাদা। দাদা নিজেকে প্রায়শ ডাক্তার বলে মনে করে। নিজের ডাক্তারি পড়া হয়নি, ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেছে, গ্রামে গঞ্জে ওষুধ নিয়ে গেছে, গ্রামের অশিক্ষিত লোকেরা দাদাকে ডাক্তার বলে ডেকেছে। তারপর চাকরি ছেড়ে বাবার ফার্মেসিতে বসেছে, ওষুধ নিয়ে কারবার বলে বাজারের মাছওলা, তরকারিওলা ভাবতো ডাক্তারের ছেলে বুঝি ডাক্তারই হয়েছে। তারাও দাদাকে ডাক্তার ঠাওরাতো। ও কারণেও দাদারও ধারণা হয়েছে দাদা বুঝি ডাক্তারই। এখন বাবার অসুখের চিকিৎসা দাদা নিজ দায়িত্বে নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। দাদাই সিদ্ধান্ত নেয় বাবাকে কখন হাসপাতালে যেতে হবে, বা ডাক্তার দেখাতে হবে। বাবা, কী কারণে জানিনা নিজের কোনও অসুখের জন্য বড় কোনও ডাক্তার দেখাতো না। নিজের চিকিৎসা নিজেই করতো। জানতে চিকিৎসা, কিন্তু কখনও কখনও তো অভিজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। শহরে নতুন নতুন বিলেত ফেরত ডাক্তার এসেছে। অনেকে বাবার ছাত্র। ডাক্তারি বিদ্যায় বাবার জ্ঞান এমন ছিল যে বিলেত ফেরত এফ আর সি। এস পাশ করা ডাক্তারের হাতে রোগী মরতে বসলে বাবার কাছে এসে বাঁচতো। বাবাকে অনেক বলতাম বড় ডাক্তার দেখাতে, কখনও রাজি হত না। কলকাতার ডাক্তার যে ওষুধ দিয়েছিলো সেগুলো কখন কোনটা খেতে হবে, বড় কাগজে লিখে দিয়েছিলাম, যেন ভুলে না যায় বাবা, প্রয়োজনে যেন ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখে। দেশে ফিরে বাবা ওই কাগজও ফেলে দিয়েছে, ডাক্তারের দেওয়া ওষুধও খায়নি। নিজের যা পছন্দ তাই খেয়েছে। খেয়ে তো দিব্যি ভালো ছিল মা। হৃদপিণ্ডের কোনও অসুখে তাকে ভুগতে হয়নি। রক্তচাপ নিজের মতো করে ওষুধ খেয়ে কমিয়ে রেখেছে। গোলটা বাধলো ডায়বেটিস নিয়ে। ওটাও ঠিক থাকতো যদি খাবারটা বাবার ঠিক থাকতো। বাড়িতে সবার জন্য যে খাবার রান্না হয়েছে সেগুলোই তো বাবাকে খেতে হয়েছে। কোনওদিন মদ সিগারেট খায়নি। শাক সবজি খেতো। স্বাস্থ্যকর বা পুষ্টিকর খাবার বাড়িতে আনতো। যখন দাদা বা সিনা দায়িত্ব নিয়ে নিল বাড়ির সব ব্যাপারের, সংসার খরচের টাকা পয়সাও তখন তাদের হাতে, তারাই সিদ্ধান্ত নেয় কী তারা খাবে। বাজার থেকে মাছমাংস অঢেল আসে। দই মিষ্টি আসে। বাবার খাবারের জন্য কিছু আসার চল ছিল না। ক্ষিধে পেলে বাবা হয়তো’সামনে যা পেতো খেয়ে নিতো। কলকাতায় যখন এসেছিলো, বাবাকে শর্করামুক্ত খাবার খাওয়ানোর দিকে খেয়াল করিনি। বাবার ডায়বেটিস ধরা পড়ার পর, তুমি যতদিন অবকাশে ছিলে, শাক সবজিই বেশি খাওয়াতে। তুমি বাবার খাবারটা ঠিকঠাক দিতে, তুমি না থাকলে দেওয়ার কেউ নেই। বাবার সবকিছু ওলোট পালোট হয়ে গেলো। চেম্বার নেই। রোগী দেখা নেই। বাড়িতে যখন বসেছিলো, বাড়িতে দুটো তিনটে রোগী আসতো। কিন্তু বাড়ি তো আর চেম্বার নয়, এতকালের চেম্বারের স্বাধীনতা বাবা বাড়িতে পেতো না, সেই আনন্দও আর ছিল না। কারও ওপর নির্ভরশীল বাবা কোনওকালেই ছিল না। নিজের অসুখ নিয়ে অন্যের মাথাব্যথাও কোনওদিন সইতে পারতো না।

একসময় শুনি বাবাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। কী করে এলো বাবা? না, যে গাড়ি বাবার জন্য কেনা হয়েছিল, সেটায় নয়, বাসে করে। আমার দেওয়া সেই গাড়ি হাসিনার এদিক ওদিক ঘোরার কাজে লাগবে, অসুস্থ বাবার জন্য গাড়ি ব্যবহার করলে চলবে কেন! বাবাকে ঢাকার হাসপাতালে নিয়ে গেল দাদারা। আমি সারাক্ষণ ফোনে খবর নিচ্ছি বাবাকে সান্ত্বনা দিচ্ছি। এত কালের প্রতাপশালী মানুষের বিষঃ কণ্ঠস্বর। বাবার মতো মানুষকে ভীত হওয়া মানায় না। বাবাকে জানাতে খুব কষ্ট হয়, যে, আমাকে দেশে যেতে দিচ্ছে না সরকার। বাবা যে কী অসহায় বোধ করছে, সে আমি বুঝি। বাবা তো আমার জন্ম থেকে চেনা। তারশক্তি যেমন জানি, তার দুর্বলতাও জানি। চিরকাল শক্তিমান হিসেবেই বাবা থেকেছে সবার কাছে। ভেতরে কোনও কারণে দুর্বল হলেও প্রকাশ করেনি কোনওদিন। কিন্তু ভালোবাসলে টেরপাওয়া যায়। যায় না মা? শক্তিমানেরও হৃদয় থাকে, সেই হৃদয় একসময় ভাঙে। বাবা যে কত অভিমানী ছিল, তা আমি আগে না বুঝলেও এখন বুঝি। বাবা অনেকটা শিশুর মতোও ছিলো। নিউইয়র্কের হাসপাতালে যখন চেকআপের জন্য ধরে বেঁধে ভর্তি করিয়েছিলাম, মনে আছে একবার ডাক্তার এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার জন্ম তারিখটা বলুন তো! বাবা বললো, কোনটা বলবো? পাসপোর্টেরটা, সার্টিফিকেটেরটা, নাকি অরিজিনালটা। আমি হাসবো না কাঁদবো, বুঝিনি। বাবার কথা শুনে ডাক্তাররা মুখ টিপে হেসে বলেছিলেন, অরিজিনালটা বলুন।

বারডেম হাসপাতালের ডায়ালাইসিসের যন্ত্রপাতি সব আধুনিক। ডাক্তাররা যত্ন নিয়ে বাবাকে দেখছে, ওখানকার অনেক বিশেষজ্ঞই বাবার ছাত্র। দাদার কাছে এসব শুনে খানিকটা স্বস্তি হয়। কিন্তু একদিন অন্তর অন্তর শরীরের রক্ত পাল্টেনতুন রক্ত ভরতে বাবা কি আদৌ কোনও স্বস্তি পাবে, আমি বুঝে পাই না কী করবো। অকেজো কিডনির জায়গায় নতুন কিডনি বসানোর ব্যবস্থা যে করেই হোক করতে হবে। বাবাকে বলি কিডনি পাওয়া যাবে, অনেকে কিডনি দান করে, বিক্রি করে, কোনও একটা কিডনি তার জন্য পাওয়া যাবেই। একটুও যেন না ঘাবড়ে যায় বাবা। প্রতিদিনই মানুষের কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হচ্ছে। ট্রান্সপ্লান্টের জন্য তাকে বিদেশে নিয়ে আসবো, ইওরোপের কোনও দেশে নয়তো ভারতে। ওখানে কিডনি বিক্রি করার জন্য প্রচুর গরিব বসে আছে। কড়ি ফেললেই কেনা যায়। বাবা শুনে ভরসা পায়, কিন্তু বুঝি কী ভীষণ কষ্টকরই না এই অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা। টাকা পয়সার ব্যাপারে একদম না ভাবতে বলি বাবাকে। কিডনি নিয়ে দরদাম করার কোনও দরকার নেই। যত টাকা দরকার হয় কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের জন্য, সব আমি দেব। বাবা একদিন জানালো, নান্দাইলএর এক লোক টাকার বিনিময়ে কিডনি দিতে রাজি। তাহলে কী আর ভাবনা, ওই লোককে নিয়ে বিদেশে যেতে হবে ট্রান্সপ্লান্টের জন্য। আমিও বসে নেই, বিভিন্ন দেশে হাসপাতাল আর ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে কিডনির ব্যাপারে পাকাঁপাকি একটা ব্যবস্থা করতে থাকি। বাবার ডায়ালাইসিস এবং হাসপাতাল খরচের টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিই দাদার অ্যাকাউন্টে। বাবার কি টাকা নেই মা? তবে এই টাকা কেন আমাকে পাঠাতে হয়? এই প্রশ্নটি নিজে আমি করি না। কেউ চায়নি টাকা, তারপরও পাঠিয়ে দিই। পাঠিয়ে দিই এই কারণে যে বাবার টাকা পয়সার তদারকি এখন দাদা করছে। আর দাদার মতো কল্পণ লোক টাকা খরচের ভয়ে যদি চিকিৎসায় গাফিলতি করে, এই আশংকায় আমি পাঠাই। আমার টাকা নিয়ে অন্তত কৃপণতা করবে না এই একটি বিশ্বাস আমার। কিন্তু যারই টাকা হোক, যার পকেটে যখন যায়, সেটি তখন তার নিজের টাকা। আমার পাঠানো টাকা তখন দাদার হাতে, সে টাকা তখন দাদার, সুতরাং স্বভাবজাত কৃপণতা তার শুরু হয়ে গেল। দ্বিতীয়দিন যখন বাবা ডায়ালাইসিস করতে গেল বারডেমে, ডাক্তার বলেছিলো অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে স্যালাইনের সঙ্গে। কিন্তু দাদা বাবাকে হাসপাতালে রাখতে রাজি নয়। রাজি নয়ের কারণ একটিই, খামোকা টাকা খরচ। বাবার গলায় ফুটো করে নল ঢুকিয়েছে ডাক্তার, কড়া অ্যান্টিবায়োটিক সরাসরি রক্তে ঢোকাতে হবে, মুখের ওষুধে কাজ হবে না। হাসপাতালে ডাক্তারদের কড়া নজরে রাখতে হবে বাবাকে। কিন্তু ডাক্তারদের কথা দাদা শুনবে কেন? বাবার নিজের কি আর মত দেওয়ার সামর্থ্য আছে, দাদা যা ভালো বোঝে তাই করবে। বাবা এখন দাদার সম্পত্তি। আমি যে ফোন করে বারবার বলছি, ডাক্তার যা বলে তাই করো, নিজে কোনও সিদ্ধান্ত নিও না। দাদা আমাকে শান্ত করতে বলে দিল, ডাক্তার নাকি বলেছে বাড়ি নিয়ে যেতে পারে, মুখের ওষুধ দিয়ে দিয়েছে। গলায় কাঁচা ফুটো নিয়ে বাড়ি যাবে, আমার কিছুতে মন সায় দেয় না। কিন্তু দূর থেকে কতটুকুই বা করতে পারি আমি! বাবার সঙ্গে কথা কী বলবো, শরীরের ওই অবস্থায় বাবা শারীরিক ভাবে যত না, মানসিক ভাবে তার চেয়ে অনেক দুর্বল। ডাক্তার যখন দেখলো রোগীকে বাড়ি নিয়ে যাবেই দাদা, বললো পারলে বাড়িতে যেন স্যালাইনে কড়া অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশান দেওয়ার ব্যবস্থা করে। না তা দেওয়া যাবে না, অগত্যা দাদা মুখে খাওয়ার কড়া ওষুধ লিখিয়ে নিয়ে এলো। কিন্তু ওই ওষুধের দাম যদি একটা পাঁচ টাকা হয়, দাদা নিশ্চিতই ভাববে ওষুধ কোম্পানিগুলোর মাথা খারাপ, লোক ঠকানোর ব্যবসায় নেমেছে ওরা। কী করবে দাদা? দেশি কোনও কোম্পানির অ্যান্টিবায়োটিক কিনে আনবে যেটার পঞ্চাশ পয়সা করে দাম। তাই করলো দাদা। সাংঘাতিক বুদ্ধিমানের কাজ করলো বটে। নিজের অতিবুদ্ধির জন্য দাদা নিজে বেশ গর্বিতও। সাধারণের চেয়ে বুদ্ধি তার বেশি, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে দাদার মতো খুব বেশি কেউ আর নেই।

কী হল তারপর, বাড়িতে ভীষণ জ্বরে পড়লো বাবা। জ্বরে অনেকটাই অজ্ঞান। তখন হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার বলে দিল, সেপটিসেমিয়া। সারা শরীরে, সারা রক্তে তখন ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। বাবার মাথাও অকেজো করে দিয়েছে। সেপটিকশকে চলে গেছে বাবা। যেন মুহূর্তের মধ্যে হয়ে গেল এমন। বাবা তখন কিছু বুঝতে পারে না, কিছু বলতে পারে না, মুখ দিয়ে শুধু গাঁ গ্যাঁ শব্দ বেরোয়। ভেবেছিলাম বেঁচে থাকলে বাবাকে কোনও না কোনও একদিন বাবা বলে ডাকবো, ভেবেছিলাম বাবাকে তুমি বলে ডাকবো। ডাকি বাবাকে। বাবার কানের কাছে ফোন দেওয়া হয়। বাবা তখন তো বোবা, বধির। বাবাকে বাবা বলে ডেকেছি, বলেছি বাবা তুমি জেগে ওঠো। হ্যাঁ, যখন সত্যি ডাকলাম, বাবা আমার এই ডাক শুনতে পায়নি। বড় দেরি হয়ে গেল মা।

বড় মামা, ঝুনু খালা সব গেছে দেখতে। তারা এই বোবা বাবাকে দেখে বিমূঢ়। আমি স্তব্ধ হয়ে আছি দূর বিদেশে। আমার সারা গা কাঁপছে আশংকায়। যদি আমাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হত, বাবার এই অবস্থা হতে পারতো না মা। তুমি ভাগ্যে বিশ্বাস করতে পারো, আমি করি না। আমি মনে করি না কোথাও কেউ মানুষের জন্ম মৃত্যুর তারিখ লিখে রেখেছে। এবং সেই তারিখ অনুযায়ী সব ঘটছে। বাবা আজও বেঁচে থাকতে পারতো, বিদেশে তার কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হতে পারতো, দিব্যি আগের মতো জীবন যাপন করতে পারতো। জীবন তো মানুষের একটাই। এই জীবনটাকে যে করেই হোক বাঁচিয়ে রাখতে চাই আমরা। কিন্তু তুমি যদি জীবনের মূল্য না বোঝে, তবেই তুমি টাকা পয়সার হিসেব করবে, হাসপাতালে অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসার জন্য না রেখে তুমি বাড়ি নিয়ে আসবে, কারণ এতে সুবিধে, দৌড়োদৌড়িটা কম হয়।

বাবা আবার কথা বলতে পারবে, এই আশায় আমি বসে থাকি, বার বার শুনছি অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। দাদা, ছোটদা, ঝুনু খালা, বড় মামা, ফকরুল মামা সবার সঙ্গে কথা বলি। সবাই বিষণ্ণ। বাবা ফিরছেনা। তাকাচ্ছে চারদিকে, সেই তাকানো অর্থহীন। মুখের শব্দকে কেউ কেউ অনুবাদ করার চেষ্টা করছে, কিন্তু সবই নিশ্চয়ই ভুল অনুবাদ। ঝুনু খালা শুধু বললো, দুলাভাই কিছু বলতে চাইছে, পারছে না। কী বলতে চাইছিলো বাবা?

একসময় আমাকে জানিয়ে দেওয়া হল, বাবা আর শ্বাস নিচ্ছেনা। ঝুনু খালা ফোনে হাউমাউ করে কাঁদলো। আমি আর জানতে চাইনি এরপর কী ঘটছে। বাবাকে নিয়ে কী মৃত্যুউৎসব তারা করছে, জানতে চাইনি। আমার আগ্রহ, আবেগ সব বেঁচে থাকাকালীন। আমি মৃত্যুরপরের কোনও কিছুতেই বিশ্বাসী নই। জগৎ আমার সম্পূর্ণই ফাঁকা হয়ে গেছেমা। শেষ আশ্রয় বলে কিছু থাকে, বাবা আমার তাই ছিলো। বাবা ছিলো আমার গৌরব, জীবনের সবচেয়ে বড় অহংকার। বাবা ছিলো আমার পথ প্রদর্শক, আমার সাহস আর শক্তির উৎস। বাবা ছিলো বলেই আমি আজ আমি, এই যে মাথা উঁচু করে আজ পৃথিবীর সব দেশে চলতে পারি, সে বাবা আমাকে গড়ে দিয়েছিলো বলেই। আমার বাবা যদি অন্য কেউ হতো, তাহলে আজি আমিও অন্য কেউ হতাম। জীবনের যা কিছুই আমার কৃতিত্ব, বাবা ছাড়া কিছুই সম্ভব হতো না। সংগ্রামী বাবাকে দেখে দেখেই সংগ্রাম করতে শিখেছি। সামনে দুর্যোগ এলে বাবা যেমন করে সামলাতো, তেমন সামলাতে আমিও শিখেছি। আদর্শের জন্য প্রাণপাত করতে বাবা ছাড়া আর কাকে দেখেছি, চোখের সামনে!

.

তোমাকে যেমন অবকাশে অত্যাচার করছিলো দাদা আর দাদার বউ, একইরকম ভাবে বাবার ওপর শুরু হল অত্যাচার। এসব আমাকে বাবাই বলতো আর কাঁদতো। একসময় অবকাশে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো। নিজের বাড়ি। নিজের টাকা। সব নিজের অথচ খাবার জোটেনি বাবার। অভিমানে বাবা, ডায়বেটিসে কিডনি নষ্ট হতে থাকা বাবা, যেখানে তার মাছমাংস খাওয়া বারণ, ছটকুর রেস্তোরাঁয় গিয়ে ওসবই খেতো৷ কী করবে বলো! কে তাকে আদর করে সবুজ সবজি সেদ্ধ করে দেবে। হাসিনা তো দেবে না। হাসিনার সঙ্গে রাগ করে বা অভিমান করে বাবা কথা বন্ধ করে দিলে লাভ হাসিনারই হয়। হাসিনা, আমার ধারণা, চাইছিলো বাবা যেন তাড়াতাড়ি মারা যায়। যেমন চাইছিলো তুমি যেন মারা যাও। কষ্ট পেতে পেতে, দুর্ভোগ পোহাতে পোহাতে যেন মরো। এত আদর করে বউকে ঘরে তুলেছিলে। মুখে তুলে খাওয়াতে। কোনওদিন যাকে রান্নাঘরের ছায়াও মাড়াতে হয়নি। কারও জন্য রাঁধা তো দূরের কথা। বরং বিয়েরপর বাবা তাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিল, বিএড এমএড পাশ করতে। বউ কলেজ থেকে ফিরলে তুমি তাকে আদর করে খেতে বসাও, ঠিক যেমন করে তোমাদের ছেলেমেয়েদের খাওয়াও। যে বউ শুধু আমাদের দু বোনকে অপমান করে অবজ্ঞা করে অপদস্থ করে ছাড়েনি, এমনকী গায়েও হাত তুলেছে। ভেবেছিলাম দুবোনকেই বোধহয় শুধু। কিন্তু তোমার মতো মাটির মানুষকে, যে মানুষ জীবন দিয়ে দেয় ছেলে মেয়েদের জন্য, ছেলের বউদের জন্য, তাকে চোখের জলে ভাসাতো। তোমার টাকাপয়সা ধন দৌলত কিছু ছিল না। ছিল বড় একটা হৃদয়। এই তোমাকেই যে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে, সে বাবাকে দেবে না কেন! বাবার আজীবন প্রতাপছিল। যে বাবাকে দেখে ভয়ে কেঁপেছি সারাজীবন, সেই বাবা দুর্বল হয়ে পড়লে গালি গালাজ করার স্পর্ধা তো আমাদের কারও হয়নি। হয়েছে হাসিনার। হাসিনা দিনভর অকথ্য ভাষায় বাবাকে গালি দিত। উঠতে বসতে অপমান করতো। বাবার সেই রোষ আর ছিল না। দাদা ভেঙে দিয়েছিল। বাবাকে ঘরবন্দি করে ভেঙে দিয়েছিল বাবার সব দাপট। বাবার চেম্বারবিক্রি করে দিয়ে গুঁড়ো করে দিয়েছিল বাবার সব স্বাধীনতা। পরাধীন বাবা মাথা নিচু করে দাদার আর দাদার বউএর অত্যাচার সইতো। প্রতিদিন। যে মামাদের বিরুদ্ধে কথা বলে বলে বাবা সময় কাটাতো দাদার সঙ্গে, দাদার বউএর অত্যাচার থেকে বাঁচতে সেই মামাদের কাছে গিয়ে বাবা আশ্রয় নিতো। ছটকুর কাছে সংসারের দুঃখের কাহিনী বাবা বলতো। সব শুনে ছটকু আমাকে ফোন করতো। যেন বাবার সমস্যার সমাধান করি, যেন বাবার কান্নাগুলো শুনি। বাবা সত্যি সত্যি কাঁদতো। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বাবা, কোনও দুর্যোগ দুঃসময় যাকে ভাঙতে বা মচকাতেপারতোনা, সেইভয়ংকর প্রতাপশালী বাবা কী করে এমন অসহায় হয়ে যেতে পারে! কে তাকে অত নিরস্ত্র করেছিলো? বয়স? ওই বয়সে মানুষ দাপিয়ে বেড়ায়। অসুখ? অসুখ তো বাবাকে কোনওদিনই কাবু করতে পারেনি। কী অসুখ ছিল বাবার? ধীরে ধীরে কিডনি নষ্ট হচ্ছিল। হচ্ছিল, হয়ে তো আর যায়নি। কত কিডনি নষ্ট হওয়া মানুষকে দেখেছি, রক্ত পাল্টাচ্ছে, আর দিব্যি বেঁচে থাকছে। আত্মীয় স্বজন আর বন্ধুরা পাশে থাকলে শরীরে অসুখ থাকলেও, মনে সুখ থাকে। কিন্তু বাবার শারীরিক কষ্টের চেয়ে মানসিক কষ্টটাই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। বাবার টাকায় দাদা তার বউ বাচ্চা নিয়ে বাবার বাড়িতে থাকছে, খাচ্ছে, পরছে। সেই বাবাই বাড়িতে জবুথবু বসে থাকে। শুভ, তার আদরের নাতি তাকে ছুরি নিয়ে তাড়া করে, বাবা ছুরির ভয়ে দৌড়ে পালায়। না, নাতির সঙ্গে দাদাভাইয়ের খেলা নয়, বাবা সত্যি সত্যি ভয়ে দৌড়োয়। কাঁদতে কাঁদতে আমাকে তো বললোও হাসিনা নাকি ফাঁক পেলেই বলে, দুনিয়ার কত কেউ মরে, বুড়োটা মরে না কেন!’ বাবার চুল পাকেনি, বয়স সত্তরও হয়নি, মাথায় কোনও গণ্ডগোল হয়নি, দিব্যি শক্ত সমর্থ মানুষ, সেই বাবাকে বুড়ো, দুর্বল, পঙ্গুর মতো ঘরে বসিয়ে রাখলো, ঘরে বসিয়ে বাবার মতো কর্মঠ কাজপাগল মানুষকে মেরে ফেললো! হ্যাঁ মা, বাবা আর সেই বাবা ছিল না। দাদা দৌড়োচ্ছে বাবার সম্পত্তি পেতে। দাদার বউ ঘরে অতিষ্ঠ করে মারছে বাবাকে। যে অসুখে যে খাবার খাওয়া বারণ বাবার, বাবার কপালে সেসব ছাড়া আর কিছু জুটছেনা। ক্ষিধে পেলে বাবা করবে কী? তার নিজের বাড়ির রান্না করার তোক তো আর তার কথা শুনবে না, শুনবে দাদা, হাসিনা আর তাদের ছেলেদের হুকুম। বাবার কান্না শুনতে হয় আমাকে দিনের পর দিন। দাদাকে জিজ্ঞেস করেছি, বাবা কেন খাচ্ছেনা বাড়িতে? ’দাদার ঠাণ্ডা উত্তর, বাবা কথা শোনে না, বাইরে বেরিয়ে যায়, বাড়িতে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বাবা খাওয়া বন্ধ করেছে, এতে দাদার কী। তার কোনও উদ্বেগ নেই। দাদার উদ্বেগ অন্য কিছুতে। বাবা আবার গোপনে কোনও বিয়ে নিয়ে যদি করে বসে তাহলে তো সম্পত্তির ভাগ চলে যাবে অন্য কোনওদিকে। বাবাকে সত্যিকার বাঘ বা সিংহের মতো চেপে ধরে দাদা একদিন শুনে নিল বাবা নাকি এদিকে ওদিকে দুএকটি বিয়েও করে রেখেছে। মা, তোমার কি কষ্ট হচ্ছে শুনতে? নাকি কষ্টের ওপারে চলে গেছ! বাবার কোনও স্থলনে তোমার হয়তো আর কষ্ট হয় না। জানতেও না। তো কত কিছু। যখন অসুখ তোমার, অসুখ যখন ধরা পড়লো, শুধু ধরা পড়া বলবো কেন, যখন ডাক্তার বলে দিয়েছে সব, কবে তুমি মরে যাবে, সব জেনেও তোমাকে তো কাঁদিয়েছে বাবা। জীবনে কেঁদেছো মা অনেক। দাদা তো বাবার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মাথা কখনও ঘামায়নি। কিন্তু হঠাৎ এমনই অসভ্যের মতো ঘামানো শুরু করলো যে দেখলে হয়তো তোমার ভালো লাগতো। কিন্তু ভালো কি সত্যিই লাগত! তুমি তো নিশ্চয়ই জানতে এই ঘামানোটা আসলে বাবার সম্পত্তির ভাগ বাইরের কাউকে না দেওয়ার জন্য ঘামানো।

আমার জন্য বাংলাদেশের দরজা বন্ধ। ইয়াসমিনকে পাঠিয়েছিলাম বাংলাদেশে বাবার সঙ্গে থাকার জন্য। ইয়াসমিন গিয়ে হাসিনার দাপট উপেক্ষা করে কিছুটা বাবার যত্ন করেছিল বটে, কিন্তু ও চলে আসার সঙ্গে সঙ্গে আবার আগের মতো দুরবস্থায় ফিরে যেতে হয়েছিল বাবাকে। ইয়াসমিনকে দিয়েও দাদা যে কাজটি করতো, সে কাজ করিয়েছে। বাবার বান্ধবীরা বাবার সঙ্গে দেখা করতে এলে অপমান করে বাড়ির ফটক থেকে তাড়িয়েছে। জানিনা সবাই হয়তো ভেবেছে, বাবার সাংঘাতিক উপকার তারা করে ফেলেছে। কী জানি কিসের উপকার। বাবাকে তারা জীবনের শেষ সময়ে এসে সতী সাধ্বী পুরুষ বানাতে চাইছিল হয়তো। বাবা একা একা পড়ে থাকতো হতাশার চরমে ডুবে। ওষুধ টষুধ সম্ভবত খেতো না। ওষুধ খাওয়াবার দায়িত্ব নেবে দাদা, সে সময় তার কই! আমার কেন যেন মনে হয়, হাসিনা বাবার মৃত্যুর জন্য দিন রাত প্রার্থনাই শুধু করছিল না, মরতে হলে যা যা করা প্রয়োজন তার সবই প্রাণপণে করে যাচ্ছিল। দাদা তড়িঘড়ি সব গুছিয়ে রাখছিল বাবার মৃত্যু হলে যেন তার কোনও অসুবিধে না হয়। বাবাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জেনেছে কাকে কাকে বিয়ে করেছে, তাদের সবাইকে দাদাই বাবার সই নিয়ে তালাকনামা পাঠিয়ে দিয়েছে। পুংখানুপুঙ্খ হিসেব নিচ্ছিল দাদা, বাবার ধন দৌলত কোথায় কী আছে। কোথায় কোন অঞ্চলে কোন মাটি লুকিয়ে আছে। ইয়াসমিন দেশ থেকে ফিরে খবর দিল, বাবা উকিল ডাকছে বাড়িতে, দাদার সঙ্গে বসে পরামর্শ করছে সম্পত্তির ব্যাপারে। বিশাল সম্পত্তির মালিক বাবা, এ তো আমরা জানতাম। ঠিক কীরকম বিশাল সেই সম্পত্তি, তা হয়তো জানা ছিল না। বাবা যখন দাদার সঙ্গে জমি জমা নিয়ে কথা বলতে, ইয়াসমিন ঘরে ঢুকলে দুজনই চুপ হয়ে যেত। বাড়িতে উকিল এসে কথা বললেও সে ঘরে বাবার সঙ্গে দাদা থাকতো, ইয়াসমিনের থাকাটা কেউ চাইতো না। ইয়াসমিন বুঝতে পারছিল, তার উপস্থিতি অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু বাবার সন্তান হিসেবে দাদার যেটুকু অধিকার, সেটুকু তো ইয়াসমিনেরও অধিকার। বাবা যদি হিসেব করতে বসে তার সম্পদ সম্পত্তির, সেখানে তার সব সন্তানের উপস্থিতিই তো স্বাভাবিক। আলোচনা থেকে ইয়াসমিনকে বাদ দেওয়া হয় কেন! কেন হয়েছে তার রহস্য তখন না বুঝলেও সে অবশ্য পরে বুঝেছে।

বাবার মতো মানুষ, যে জীবনে কোনওদিন প্যান্ট সার্ট কোট ছাড়া কিছুপরেনি। পাজামা পাঞ্জাবি শুধুঈদের সময় পরতো। অনেকটা সামাজিক কারণেইপরতো। ধর্মীয় কোনও কারণ তো বাবার ছিল না। পাঞ্জাবিপাজামা টুপি দাড়িঅলা পাঁচবেলা নামাজ পড়া বিচক্ষণ বড়লোক এম এ কাহহার আর তারই ভাই মোমেনকে বাবা খুব শ্রদ্ধা করতো। বাবা কিন্তু ওদের পোশাক দ্বারা কোনও রকম প্রভাবিত হত না। এম এ কাহহার নিজেরপাড়ায় একটি মাদ্রাসা আর মসজিদ গড়ে দিয়েছে। বাবা জীবনে কখনও মসজিদে যায়নি, মাদ্রাসাতেও যায়নি, ওসব তৈরি করা তো দূরের কথা। মসজিদের চাঁদাও কখনও দিয়েছে বলে মনে হয় না। শুধু কি ওরাই, বাবার চারদিকে যারা ছিলো তাদের সবারই তো ধর্মের দোষ ছিল! বাবা কেন মোটেও চারপাশ দ্বারা প্রভাবিত হয়নি, অন্তত এই বিশ্বাসের ব্যাপারে! অন্য কত কিছুতে তো প্রভাবিত হত। জীবনের সব কিছু তো বাবার নিজের উদ্ভাবনের বিষয় ছিল না! নিজে ঘোষিত নাস্তিক না হয়েও কী করে দিব্যি ধর্ম থেকে। যোজন দূরে বাস করেছে! বছরে দুবার শুধু নামাজে দাঁড়াতো। তাও ওইঈদের মাঠে। সামাজিকতা বজায় রাখার জ্ঞান আবার টনটনে ছিলো। ওটা না করলে চলে না। কিন্তু নামাজ তত বাবা পড়তে জানতো না। কোনও সুরা সে জানতো না। লোকরা মাথা নোয়ালে সেও নোয়াতো, ওঠালে ওঠাতো। এ ছাড়া আর কী! একবার সুরা শেখার জন্য একটা লোক রেখেছিলো মনে আছে, জানিনা ওটা আবার কারপাল্লায়পড়ে করেছিলো। দুদিনপর লোককে বিদেয় করে দিয়েছে। ও বাবার পোষাতো না।

মানুষ তো এমন, বয়স বাড়লো, হঠাৎ হুট করে টুপি দাড়ি শুরু হল, পাজামা পাঞ্জাবি শুরু হল, পাঁচবেলা নামাজ শুরু হল। কিন্তু বাবা কেন কোনওদিন সামান্যও বদলাতে চায়নি নিজেকে! .. একটুও ধর্মচিন্তা তার ভেতরে আসেনি। বাবার ওই মেয়েমানুষের দোষ ছাড়া আর তোমাকে অবহেলা করা ছাড়া আর তো কোনও দোষ ছিল না। সব তো তার গুণই ছিল। তারপরও দেখ মেয়েদের নিয়ে যা করতো, সব কিন্তু বাইরে করতো। কোনওদিন ঘরে কোনও মেয়েকে আনেনি। কোনওদিন আমাদের কাউকে বুঝতে দেয়নি আদৌ তার কোনও সম্পর্ক কারও সঙ্গে আছে। কেবল শুনেছি, প্রমাণ পাইনি। নিজের কোনওকিছু ছেলেমেয়েদের না জানানোর মানসিকতাই। বা কোথায় বাবা পেয়েছিলো, যখন অন্যরা দিব্যি দ্বিতীয় বিয়ে করে বাড়িতে বউ তুলছে! বাবা তার নিজের ব্যক্তি-জীবন, অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্ক বা বিয়ে আমাদের জীবন এবং জীবন যাপন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা রেখেছিলো। এক শহরেই বাস করি, অথচ কোনওদিন আমাদের জানা ছিল না বাবা বাড়ির বাইরে কোথায় কার সঙ্গে কী সম্পর্ক করছে। এমন কোনও রাত নেই, যে রাতে বাবা অবকাশে রাত কাটায়নি। শুধু শহরের বাইরে কোনও মেডিকেল কলেজে পরীক্ষা নিতে গেলে বা চাকরিসূত্রে কোথাও গেলে দেখেছি বাবা নেই অবকাশে। ইস্কুল শেষ না হতেই দেখতাম মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। শহরের অন্য বাবারা তো মেয়েদের যে লেখাপড়া করে বড় হবার, নিজের পায়ে দাঁড়াবার দরকার আছে, তা-ই মনে করেনি। কিন্তু বাবা তো ওদের মতো ছিল না। এমনকী বন্ধু কাহহার বা মোমিনের মেয়েদেরও তো ইস্কুলের গণ্ডি পেরোতে না পেরোতে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে, শুধু ছেলেদের লেখাপড়ার জন্য যা করার সব করেছে। বাবা ওদের কাছ থেকে শেখেনি সমাজের এই নিয়মটা। তার কাছে প্রতিদিন লোক আসতো মেয়েদের বিয়ের জন্য পাত্রর খোঁজ নিয়ে, সবাইকে এক বাক্যে বাবা না করে দিত। বাবা তো ওই সমাজেই বাস করতো, যেখানে মেয়েদের অল্পবয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়াটাকেই যৌক্তিক মনে করতে সবাই। বাবা তো তার গন্ডগ্রাম নান্দাইল থেকে মেয়েদের ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানানোর চিন্তাধারা নিয়ে আসেনি! যদি বাবাকেশিখতেই হয় অন্যদের থেকে, যদি তার নিজের না হয় এই আবিষ্কার, তবে দেখ, যারা শহরের শিক্ষিত বনেদি বাড়ির বড় বড় লোক, যাদের মেয়েরা লেখাপড়া চালিয়ে যেত, বড় হতো, সেসব বাড়ির সঙ্গে বাবার খুব মেলামেশা না থাকার পরও বাবা ওদের ওই নিয়মকে পছন্দ করলো কেন, কেন সমাজের বেশির ভাগ মানুষের নিয়মকে নয়!

মনে আছে বাবার ওপর ক্ষুব্ধ তখন আমি, যখন তোমার ওই বৃত্তির ব্যানারটা দেখিয়ে দেখিয়ে বলেছিলাম, হ্যাঁ মার নামে ইস্কুল হবে, মার নামে বৃত্তি হয়ে গেল, বাবার মতো চরিত্রের লোকদের জন্য কিছুহবেনা। কেউ করবেনাইস্কুল, কেউ দেবে না বৃত্তি। বাবা তোমার পাশে বসে শুনলো। বাবাকে অপমান করার জন্য জোরে জোরেই বলছিলাম। তোমাকে খুশি করার জন্য, তৃপ্তি দেওয়ার জন্য, বাবাকে কেঁচোর মতো কুঁচকে ফেলার জন্য। জীবনে যে কখনও ভেঙে পড়ে না, তাকে ভাঙতে চাইছিলাম। যার জীবনে কোনও কষ্ট নেই, তাকে কষ্ট দিতে চাইছিলাম। তোমাকে এতকাল যেভাবে বাবা অপমান করেছে, সেই অপমানের প্রতিশোধ নিচ্ছিলাম মা। কীরকম বেপরোয়া আর বেয়াদপ হয়ে উঠেছিলাম। যে বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে কোনওদিন কথা বলার সাহস ছিল না, সেই বাবাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার সব আয়োজন আমি করছি। তোমারও বোধহয় আমার ব্যবহার দৃষ্টিকটু লাগছিল। তুমি সম্ভবত বলেছিলে, এরকম বলো না, তোমার বাবারও তো শরীর ভালো নয়, পরে এই ব্যবহারের জন্য তোমারই কষ্ট হবে। তুমি ঠিকই জানতে মা, ওই ব্যবহারের জন্য আমার পরে কষ্ট হবে। বাবা শিশুর মতো বলেছিলো, আমার জন্যও ইস্কুল হবে। কোনওদিন কাঁদতে দেখিনি বাবাকে। কোনওদিন কোনও কারণে চোখের জল ফেলতে দেখিনি। কিন্তু যখন বলছিলো আমার নামেও ইস্কুল হবে, নান্দাইলে। বাবার ঠোঁট কেঁপে উঠছিল অভিমানে, অপমানে। হয়তো চোখও ভিজে উঠেছিল। বাবা বোধহয় একটু আড়াল করে চোখটা মুছেও নিয়েছিল মা। সারাজীবন বাবার কাছ থেকে যে দুঃখ পেয়েছো তুমি, তার শোধ নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শোধ নিতে গিয়ে বাবাকে যে কষ্ট দিয়েছি, সেটাও কি এখন আমাকে কম ভোগাচ্ছে!

নান্দাইলে বাবার নামে ইস্কুল তো হওয়া উচিত মা। বাবা কাদামাটি থেকে উঠে এসে নিজে একার চেষ্টায় লেখাপড়া করে ডাক্তার হয়েছে। নিজের বই ছিল না, বই কেনার টাকা ছিল না, মেডিকেল কলেজের এক সহপাঠীকে অনুরোধ করে করে রাজি করিয়েছিলে রাতে যখন সে ঘুমিয়ে যাবে, তখন তার অ্যানাটমি বা ফিজিওলজি বই নিয়ে আসবে বাবা, রাত জেগে সে বই পড়ে ভোরবেলা সহপাঠীর বাড়িতে গিয়ে বই ফেরত দিয়ে আসবে। হ্যাঁ মা, রাতে সহপাঠীর বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতো, কখন সহপাঠী ঘুমোত যাবে, আর তার বইটা বাবা পাবে। রাত জেগে বাবা ধার করা বই এনে পড়তো। সকালে সে বই সহপাঠীর বাড়িতে ফেরত দিয়ে পরে কলেজে যেতো। এভাবেই পড়ে বাবা ক্লাসে সবচেয়ে ভালো নম্বর পেতো। এই বাবার নামে ইস্কুল কেন হবেনা, মা? নিজের ছেলেমেয়ে তো বটেই, কাকাঁদের, কাকার ছেলেমেয়েদের, ফুপুদের ছেলেমেয়ে সবাইকেই তো বাবা লেখাপড়া করিয়েছে। এমনকী অবকাশে রেখে ওদের অনেককেইস্কুল কলেজে পড়িয়েছে। যত তার আত্মীয়, দূর আত্মীয় সবাইকে লেখাপড়া করিয়েছে, গ্রামের কত গরিবদের লেখাপড়া করার জন্য ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে, লেখাপড়ার খরচ জুগিয়েছে। বাড়ির বউদেরও ছাড় দেয়নি। ওদের সংসার করা বন্ধ করে কলেজে ইউনিভার্সিটিতে পাঠিয়েছে। তার নামে কেন ইস্কুল হবে না? চিরকাল পড়াশোনা করে বড় হও, নিজের পায়ে দাঁড়াও, ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে শুধু শুকনো উপদেশ দেয়নি, দিন রাত ওদের পেছনেই অর্থ আর সময় ব্যয় করেছে। আমার সুযোগ থাকলে আমি ওই গ্রামে বাবার নামে ইস্কুল খুলতাম একটা। বাবা ছাড়া কে আর আছে ওই গ্রামের ছেলে যে লেখাপড়াকে সবচেয়ে মূল্য দিয়েছে! আমার কেন ইস্কুল খুলতে হবে, ওই গ্রামের লোকদের যদি বিবেক বলে কিছু থাকে, বাবার নামে ইস্কুল কলেজ খুলবে।

বাবার হয়তো জমিজমা কেনার আগ্রহ ছিলো, সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবেঅথবা নিজের শেকড়ের টানে। কিন্তু তাছাড়া পার্থিব জিনিসের প্রতি লোভ বাবার ছিলো না। কোনওদিন কারও দেওয়া কোনও উপহার ছুঁয়ে দেখেনি। দাদা, ছোটদা, আমি, ইয়াসমিন কত উপহার দিয়েছি তাকে। সবকিছুই আলমারিতে যত্ন করে রেখে দিতো। তোমার অসুখের সময় যখন বাবার ঘরটা তোমার জন্য পরিষ্কার করছিলাম, তোমাকে ও ঘরে শোয়াবো বলে, বাবার আলমারি খুলে দেখি আমার দেওয়া সব লোশন, পারফিউম, অডিটয়লেট, অডি কোলন, শেভিং কিটস, জামা জুতো, আরও নানা রকম উপহার সব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা কিছুই বাবা এত বছরে ব্যবহার করেনি। কিন্তু আলমারি খুলে প্রতিদিনই দেখতে সব, আলমারি তো নয়, তার এক বিচিত্র জাদুঘর। আলমারির চাবিটা খুব যত্ন করে পকেটে রেখে দিত, কাউকে দিত না। নিজের জামা জুতো না ছেঁড়া অবদি কিনতো না। সেলাই করে পরার অভ্যেস ছিলো। টুথ ব্রাশের দাঁতগুলো প্রায় সব ভেঙে গেলে তবে নতুন কিনতো। আমি কিনে দিলে সেটা যত্ন করে রেখে দিত, নিজে একটা কমদামি কিছু কিনে নিতো। দাড়ি কামাবার ব্রাশও, সেই কোন আমলের প্রায় ভোঁতা রেজর দিয়েই কামাতো, গাল কেটে কেটে যেতে। ফোম, আফটার শেভ? ওগুলো আলমারিতে পড়ে থাকতো। বাবা বোধহয় ভুলে যেতো না গ্রামের গরিব ঘর থেকে উঠে এসেছে সে। ঝকমকে ঝলমলে জিনিস তার জন্য নয়। নিউইয়র্কে একটা গাউন জোর করে ঘরে যখন থাকতো, পরিয়ে রাখতাম। হয়তো ভালো লাগতো তার, কিন্তু কী যেন আবার সব তাকে খুলিয়ে রাখতো।

কলকাতায় যখন এসেছিলো, হোটেল ঘরে বাবা আমার বই পেয়েছিল, আমার মেয়েবেলা। আমি তো নানা কাজে ব্যস্ত থাকি। হঠাৎ একদিন দেখি বাবা বইটা মন দিয়ে পড়ছে। আমি কেড়ে নিয়েছি বই। বাবাকে ওই বই আমার পড়তে দিতে ইচ্ছে করেনি। আমি জানি বাবা কষ্ট পাবে পড়লে যেসব অংশে বাবার সব দুষ্কর্মের কথা লেখা আছে, ওই যে গভীর রাতে বাড়ির কাজের মহিলার সঙ্গে একরাতে শুতে গিয়েছিলো। না, মা। আমি বাবাকে বাঁচিয়ে বা কাউকে বাঁচিয়ে আত্মজীবনী লিখতে পারিনি। এক রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে দেখি বাবা বই পড়ছে। আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়েও নিয়েছে বইয়ের অনেকটা। দেশে ফিরে যাওয়ার সময় যখন নিয়ে যেতে চাইলো একটা বই, জানি না কী ভেবে আর না করিনি। দাদার কাছে শুনতাম, বাবা নাকি আমার মেয়েবেলা বইটা যত্ন করে বালিশের তলায় রেখে দিয়েছে। প্রতিরাতে শুয়ে শুয়ে বইটাপড়ে। উতল হাওয়া বইটাও যোগাড় করেছিল। ওটাও বালিশের তলায় রেখে দিত। প্রতিদিন পড়তো, চেম্বারে যাওয়ার আগে, চেম্বার থেকে ফিরে। বাবা আমার লেখা ভালোবাসতো, তাই পড়তো। কিন্তু কষ্ট কী কম পেয়েছে। কোনওদিন আমাকে বলেনি কেন আমি তার কথা ওভাবে লিখেছি! কেন তার সম্মান আমি গুঁড়িয়ে দিয়েছি। কোনওদিন না। এই না বলা, এই না ধমক দেওয়া, এই না অভিযোগ করা, এই না নিন্দা করা আমাকে আরও ভুগিয়েছে। একবার দাদাকে বলেছিলাম আমার মেয়েবেলা আর উতল হাওয়া বইদুটো যেন যতীন সরকারকে আমার পক্ষ থেকে উপহার দেয়। যতীন সরকার একদিন অবকাশেও গিয়েছিলেন বইদুটো নিতে। কিন্তু বাবা তাঁকে বই দিতে চায়নি। বই না নিয়েই তাকে ফিরে যেতে হয়। কেন বাবা বই দিতে চায়নি আমি বুঝি। লজ্জায়। নিজের অহংকার, নিজের মাথা অন্যের সামনে মাটিতে মিশে যাক চায়নি। কিন্তু জগৎ যেপড়ছে! একদিকে ভালো হয়েছে, বইদুটোই বাংলাদেশে বেরোবার আগেই বা বেরোবার সঙ্গে সঙ্গেই নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। আমি মনে মনে স্বস্তিই পেয়েছি মা। তা না হলে কত লোক বই পড়ে বাবাকে হয়তো বলতো, কী ব্যাপার, মেয়ে তো লিখে দিয়েছে তার দুশ্চরিত্র বাবার কীর্তি কাহিনী। বাবা যে প্রতিদিন আমার বইদুটো পড়তো, বাবা কোন অংশগুলো পড়তো, বাবাকে নিয়ে আমার প্রশংসার কথা, নাকি নিন্দার কথা! বাবাকে কেন প্রতিদিন বইদুটো পড়তে হত। কী পেত বাবা ওই বইয়ের মধ্যে। অতীত? হারিয়ে যাওয়া অতীত, সে যত নিষ্ঠুরই হোক, মধুরও তো ছিল মা।

দাদার কাছে আমার মেয়েবেলা বইটা খুব ভালো লাগে। দাদা বলে, কবিতার মতো। একদিন বাবাকে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ফোনে, যেন ভুলে গিয়েছি বাবা সম্পর্কে যত মন্দ কথা লিখেছি, সব, কেমন লেগেছে বই? বাবা বললো, খুব ভালো। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ভালো? বাবা আবারও বললো, হ্যাঁ খুব ভালো। তোমার লেখার হাত খুব ভালো। ভাষাটা চমৎকার। খুব সুন্দর লিখতেপারো তুমি। বাবা কিছু বলেনি তার সম্পর্কে যা লিখেছি তার কোনও কথা। আমিও বলিনি। বাবার প্রশংসা শুনতে শুনতে আমার চোখে জল চলে এসেছে। আমি আর কথা বলতে পারিনি বাবার সঙ্গে। গলা বুজে আসছিল। বই নিয়ে বাবার প্রশংসা আমাকেই বাবার সামনে ছোট করে দিয়েছে। ইচ্ছে হয়েছে বাবার চুলে সেই ছোটবেলার মতো হাত বুলিয়ে দিই। বাবার চুলে এখন তো আর কেউ হাত বুলোয় না।

তুমিও নেই। বাবাও নেই। আমার আর দেশে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনও ইচ্ছে, হয়নি। প্রায় বছর গেলে যোগাযোগটা করতে হয়েছে তোমার নামে যে বৃত্তি দিচ্ছিলাম, সেটি যেন প্রতি বছর দেওয়া হয় সেই তাগাদা দিতে। আমার যে ফিক্সড ডিপোজিট আছে বাংলাদেশের ব্যাংকে, সেটির ইন্টারেস্ট চলে যায় বৃত্তির অ্যাকাউন্টে। কিন্তু ও টাকায় তো বৃত্তি সম্ভব নয়। আবারও টাকা পাঠিয়ে দিলাম যেন বৃত্তি দেওয়ায় কোনও ছেদ না পড়ে। দেওয়া হল বৃত্তি। তবে ছবি দাদা যা পাঠালো, দেখে অবাক আমি। হাসিনাকে সামনে আনা হয়েছে বৃত্তি অনুষ্ঠানে। যে তোমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতো, আমি চাইনি এই বৃত্তির অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি। যে তোমাকে ভালোবাসেনি কোনওদিন, সে কেন তোমার পবিত্র অনুষ্ঠানাদিতে তার কুৎসিত মন নিয়ে সরবে উপস্থিত হবে! শুধু উপস্থিত নয়, রীতিমত ভালো কাজের নেত্রী বনে যাবে! দূর থেকে কী আর করতে পারি আমি, শুধু কষ্ট পেয়ে যাওয়া ছাড়া আমার করার কিছু নেই।

.

খবর পাই অবকাশ পুরো পাল্টে ফেলেছে দাদা। কত কোটি টাকা থাকলে বাড়িটাকে ওরকম বিরাট বড়লোকের বাড়ি করা যায়, তা না দেখলে নাকি বোঝা যাবে না। বাড়ির মোজাইক মেঝে ফেলে দিয়ে মার্বেল বসিয়েছে। বিশাল বিশাল সবুজ দরজা ভেঙে এখন নাকি লাগিয়েছে ছোট ছোট খয়েরি রঙের দরজা। বাবার ঘরটাকে শুভর ঘর করে দিয়েছে। ঝকঝকে তকতকে সব। সেই জানালাগুলোও নেই, সেই নানা রঙের কাঁচের জানালাগুলো। অবকাশের স্থাপত্য শিল্প আমাকে সবসময় মুগ্ধ করেছে। জানি না কী করে পুরোনো স্থাপত্য ভেঙে ম্যাচবাক্স করতে পারে লোকে। কী করে উঁচু সিলিং ধ্বংস করে, কড়িকাঠ ভেঙে মাথার এক হাত ওপরে নামাতে পারে ছাদ। কী করে কেটে ফেলতে পারে দেয়ালের বা কাঠের কারুকাজ। পশ্চিমের দেশগুলোয় দেখেছি যে কোনও মূল্যে তারা পুরোনো বাড়িগুলোকে রক্ষা করে। পুরোনো স্থাপত্য অমূল্য সম্পদ। দাদাকে আন্দালুসিয়া নিয়ে গিয়েছিলাম, স্পেনের দক্ষিণে। ওখানে তো তার দেখা হয়েছে। পুরোনো স্থাপত্য কী করে হাজার বছর ধরে রক্ষা করা হচ্ছে। এমনকী ঘোর শত্রুর বানানো বাড়ি বা মসজিদকিছুই স্পেনের লোকেরা ফেলে দেয়নি। ওখান থেকেও দাদা কিছু শেখেনি। আমার কেন যেন মনে হয় মা, বাড়ি ভেঙে নতুন করে বানানো, দাদার নয়, হাসিনার আবদার। দাদা এখন আর দাদার কথায় ওঠে বসে না। উঠোনের দুটো টিনের ঘরও ভেঙে ফেলেছে। বাইরের কালো ফটক পাল্টে ফেলেছে। ফটকের দুধারে কামিনী আর মাধবীলতার গাছও আর নেই। নারকেল গাছগুলোর পায়ে সাদা মোজা পরিয়েছে। বাথরুম ভেঙে নতুন করা হয়েছে, কমোড লাগানো হয়েছে। শুভর জন্য আলাদা বাথরুম, অ্যাটাচড। বাড়ির সামনের সেই রক আর সিঁড়ি সব ভেঙে মোগলদের বাড়ির মতো বড় থাম বসিয়ে ওপরে বড় করে অবকাশ নাম বসানো হয়েছে। যে অবস্থা বাড়িঘরের, অবকাশ নামটা যে রেখেছে, এই হয়তো বেশি। হয়তো অবকাশ বাদ দিয়ে ব্ল হেভেন বা ইডেন গার্ডেন রাখতে পারতো। বৈঠক ঘর আর আমার শোবার ঘরের মাঝখানে যে অসাধারণ তিনটে গরাদওয়ালা দরজা ছিল, সেগুলো আর নেই। দেয়াল তুলে দিয়ে ঘর জুড়ে পেল্লাই সব রাজা বাদশাদের বাড়ির মতো আসবাবপত্র বসানো হয়েছে। হঠাৎ করে আমাদের সেই অবকাশ ধনী লোকের আধুনিক বাড়িতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। পেয়ারা গাছ, জাম গাছ, কাঁঠাল গাছ, সেগুন গাছ কিছু আর নেই। যে গাছটা শেষে লাগিয়েছিলে, সেই কামরাঙা গাছটা, ওটা বিশাল বড় হয়ে ঝুঁকে আছে শত শত সবুজ কামরাঙায়। দেখলে নিশ্চয়ই তোমার খুব ভালো লাগতো। হয়তো ভেবেছিলে, ছেলে মেয়েরা খাবে। ছেলেরা নাতিরা হয়তো খায় মা, তোমার কথা কেউ মনেও করে না। বাড়িতে মামা খালাদের কোনও যাওয়া আসা নেই। যাওয়া আসা শুধু হাসিনার আত্মীয়দের। হাসিনা রানির মতো বাস করে। তার দুই পুত্র প্রাসাদের রাজপুত্তুর। অবকাশে আমাদের কোনও চিহ্ন রাখা হয়নি। আমাদের কারওরনা। অবকাশ এখন আগাগোড়াই হাসিনার বাড়ি। যেন হাসিনাই জন্ম থেকে থাকে ও বাড়িতে। হাসিনার বাপ দাদা কেউ বানিয়েছে বাড়ি, উত্তরাধিকার সূত্রে সে বাড়ির দখল পেয়েছে। দেখে মনে হয়, এরকম দামি আসবাবপত্রে, এরকম দামি মার্বেলে বাড়ি সাজাবে বলেই সে অপেক্ষা করছিল, কখন তুমি যাবে, কখন বাবা যাবে। জন্মের মতো যাবে। কখন বাড়ি খালি হবে। তোমাদের নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই সে করছিল। কী ভয়ংকর এবং কী রকম বীভৎস যে সেই লোভ, রাজত্বের লোভ! হাসিনার সারা শরীরে মনে অদ্ভুত পরিতৃপ্তি। কী ভীষণ কষ্টই না দিত ও তোমাকে! কী অপমানই না করেছে তোমাকে! তোমার মতো নিরীহ ভালো মানুষকে খুশি করতে খুব বেশি কিছুর দরকার ছিল না। তারপরও তোমাকে তোমারই সংসারে ক্রীতদাসীর মতো রেখেছে। বাবাকেও ওরকমভাবে বাবার বাড়িতে, বাবার খেয়ে, বাবার পরে, বাবাকে একইরকম ভাবে ক্রীতদাস করেছে। কাউকেই ছাড়েনি। এই যে বাবা তার দুই মেয়েকে বঞ্চিত করে সব সহায় সম্পত্তি দুই ছেলের নামে লিখে দিয়েছে, হাসিনা তো তাই চেয়েছিল, অঢেল সম্পদ একা একা ভোগ করার বাসনা তার অনেক দিন থেকেই ছিল। বিরাট প্রাসাদের রানি হওয়ার স্বপ্ন সে পূরণ করেছে। দাদা অসুখে ভুগছে, যে কোনও একদিন মরে যাবে। এর মধ্যে ছোটদা তার ভাগ যে করে হোক কবজা করেছে। বাবার বিশাল এসটেট মূলত এখন ভোগ করছে হাসিনা তার ছেলেদুটো সহ তার বাপের বাড়ির আত্মীয় স্বজন। বাবা কি ওর জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সমস্ত বিষয় আশয় করেছিলো? কোটি কোটি নগদ টাকা কি বাবা হাসিনার আরাম আয়েশের জন্য রেখে গিয়েছিলো?

.

বাবা মারা যাবার বছর দুই পর আমি দাদার কাছে জানতে চেয়েছি, বাবার জমি জমা টাকা পয়সা বাড়ি ঘরের কী করা হবে, কবে হবে ভাগবাঁটোয়ারা। বাংলাদেশ সরকার যেহেতু আমাকে দেশে ফিরতে দিচ্ছে না, ভাগাভাগির সময় ইয়াসমিনের যদি দেশে যাওয়ার দরকার হয়, যাবে। দাদা বললো, বাবা তার যা কিছু আছে, উইল করে দিয়ে গেছে তার চার ছেলেমেয়েকে। উইলের একটা কপি দাদা একদিন আমেরিকায় পাঠিয়ে দিল। জমি জমা ভাগের কথা আমার মাথায় আসতো না, যদি না আমি ইয়াসমিনের অর্থনৈতিক দুরবস্থা দেখতাম। উইল দেখে আমি আকাশ থেকে পড়ি। নান্দাইলের হাজার হাজার একর জমি, শহরের চব্বিশটা বাড়ি, অবকাশ, ঢাকার সবচেয়ে দামি এলাকা বারিধারার বিশাল প্লট সব ভাগ করা হয়েছে দাদা আর ছোটদার মধ্যে। বাবাকে অসুস্থ অবস্থাতেই ঢাকায় টেনে এনে বারিধারার জমিটা তার নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছিলো ছোটদা। ঢাকার বারিধারার জমি, জানিনা সেটা দশ কোটি নাকি কুড়ি কোটি টাকা দাম, ছোটদার। নান্দাইলের বিশাল জমিদারি দাদার। শহরের বাড়িগুলোও দাদার আর ছোটদার, আমি আর ইয়াসমিন শুধু ওই বাড়িগুলো থেকে ভাড়া যা আসে, তার শতকরা পনেরো ভাগ পাবো। ওই বাড়িগুলোর মালিক আমরা কোনওদিন হতেপারবো না। অবকাশ দাদার। অবকাশের পেছনে যে উঠোন আছে, সেই সেদিকটায়, ওই তেমনই, শতকরা পনেরো ভাগদু মেয়ে পাবে। কী দরকার ছিল বাবার এই উইলটা করার? বাবার সই আছেউইলে, এসইকি সত্যিই বাবার সই, আমি বারবার দেখি। হ্যাঁ বাবার সই, কিন্তু বিশ্বাস হয় না বাবা এই উইল সুস্থ মাথায় করেছে। কোনও উইল যদি বাবা না করতো, চারভাইবোনের মধ্যে সব ভাগ হতো। বাংলাদেশে যে নারীবিরোধী ইসলামি উত্তরাধিকার আইন আছে, সেই আইনেও যদি ভাগ করা হতো, তাহলেও আমার আর ইয়াসমিনের অর্থনৈতিক দুরবস্থা চিরকালের মতো ঘুচে যেতো। মা, তুমি কি জানতে বাবা এত সম্পদশালী ছিলো? আমার জানা ছিলো না। উইলের কোথাও লেখা নেই বাবার ব্যাংকের টাকার কথা। বাবার নতুন বাজারের চেম্বার, আরোগ্য বিতান এবং আরও কয়েকটা দোকান বিক্রি করে সব টাকা ব্যাংকে রেখেছিলো বাবা, সেসব হয়তো দাদা আর ছোটদাকে আগেই দিয়ে দিয়েছে। শুধু স্থাবর সম্পত্তির কথাই লেখা উইলে। আমার ভেবে কষ্ট হয়, বাবা তার দুই মেয়েকে কখনও ভালোবাসেনি। বাবা আর তার দুই পুত্র যদি ভেবেই থাকে, যে, আমি বিশাল এক ধনী কেউ, বাবার কোনও সম্পদ বা সম্পত্তি আমার না হলেও চলবে, তাহলে ইয়াসমিনের কথা কেউ ভাবেনি কেন? ইয়াসমিন তো অভাবে থাকে, ছোট একটা মুদির দোকানে কাজ করে। বাবা আর তুমি নিজের চোখে দেখে গেছো ইয়াসমিনের অভাব। তাহলে কে স্বচ্ছল, আর কেনয়, তার ওপর ভিত্তিকরে উইল হয়নি, উইল করা হয়েছে লিঙ্গের ভিত্তিতে। পুরুষ লিঙ্গ বেশি পাবে, স্ত্রী লিঙ্গ কমপাবে, অথবা পাবেনা। আমি বুঝি না কী করে বাবা এই চরম অসাম্যকে সমর্থন করেছে। দুটো মেয়ে যেন তার সম্পত্তির কিছু না পেতে পারে, সে কারণেই উইলটি করা হয়েছে বাবার মৃত্যুর আগে। বাবা যে বলতো, আমার লেখা বাবা খুব ভালোবাসে। নারী পুরুষের সমানাধিকারের কথাই তো জীবনভর লিখে গেছি। আসলেই কি সত্যিই ভালোবাসতো বাবা আমার লেখা! উইল তো তা বলে না মা। আমার আরও একটি কারণে, বিশ্বাস হয় না এই উইল বাবা কোনও চাপ ছাড়া করেছে। ধরা যাক, বাবা সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছেতে এই উইল করেছে, দাদাদের কোনও চাপ বাবার ওপর ছিলো না। কিন্তু দাদারা যদি বিশ্বাস করতো বোনদের উত্তরাধিকারে, তবে বাবার লেখা উইল তারা মেনে নিতো না। মেনে নেওয়ার একটাই কারণ তারা মেয়েদের কোনও অধিকারে বিশ্বাস করে না। সম্পত্তি ভাগ করার কথা আমি শত বলার পরও তারা যখন সমান ভাগে বা দেশের উত্তরাধিকার আইনেও ভাগ করছে না, তাতে আরও প্রমাণ হয় বাবাকে এই উইল করাতে বাধ্য করেছে দাদা আর ছোটদা। আমাদের চার ভাই বোনের মধ্যে শুধু অভাবেই নয়, সবচেয়ে বেশি মানসিক কষ্টে আছে ইয়াসমিন। আজ যদি ও বাবার সম্পত্তির ভাগ পেতো, তাহলে ও অশান্তির সংসার ছেড়ে একা বেঁচে থাকার মনোবল পেতো। দুই দাদা ওর কথা ভাবে না। ভাবলে কি আর বাবার বিশাল সম্পত্তি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিত! আমি দাদাদের অনেক বোঝাতে চেয়েছি। বাবা যেভাবে ভাগ করেছে তার সম্পদ সম্পত্তি, তা অন্যায়। বাবা ভুল করেছে, অন্যায় করেছে, তোমরা তা মেনে নিচ্ছো কেন! তোমরা তো বলো আমার লেখা বই তোমাদের ভালো লাগে, আমি খুব সত্য কথা বলি, আমার আদর্শকে তোমরা সম্মান করো আমার বইয়ে আমি তো মেয়েদের অধিকারের কথাই বলি। বাবার সম্পত্তি ভাই বোনের মধ্যে সমান ভাগের কথা বলি। বাবা ভুল করেছে এ তো জানো তোমরা, তবে বাবার ভুলটা সংশোধন করছো না কেন, বাবার অন্যায়টা মেনে নিচ্ছো কেন? অনেক চিঠি পাঠিয়েছি। বলেছি, বাবার সম্পত্তি সমান ভাগ করতে প্রাণ না চায়, তাহলে দেশি আইনেই ভাগটাই বা করছে না কেন, যে ভাগে তোমরাই বেশি পাবে, আমরা কম পাবো? না, ওরা দু বোনকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করবেই। দেশে ফেরার অনেক চেষ্টা আমি করেছি। সে খালেদা বলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলো, হাসিনা বলো, কেউ আমাকে দেশে ফিরতে দিচ্ছেনা। ফেরার সব পথ যদি বন্ধ করে রাখে, তবে কী করে কী করবো বলো, কী করে দাদাদের এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবো! ইয়াসমিনের বিশ্বাস বাবা স্বেচ্ছায় ঠাণ্ডা মাথায় এই উইল করেছে। ইয়াসমিনের বিশ্বাস বাবাপুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের লোক, বাবার কাছে পুত্ররাই তার বংশের লোক, কন্যারা নয়। বাবা যদি এত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার মানুষ হতো, তাহলে মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য প্রাণপাত করেছে কেন, পনেরো বছর বয়স হলে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দেয়নি কেন? ছেলেদের ইস্কুল কলেজ নিয়ে যা করেছে, মেয়েদের ইস্কুল কলেজ নিয়ে তার চেয়ে কিছু কম তা করেনি! কী করে তবে বিশ্বাস করবো বাবা পুরুষতান্ত্রিকতায় বিশ্বাস করতো! সবচেয়ে মজার ব্যাপার, উইলে যে তিল পরিমাণ উত্তরাধিকার আমার আর ইয়াসমিনের, সেটুকুও আমরা কোনওদিন পাইনি। বাড়িগুলোর ভাড়া থেকে যে সামান্য আমাদের কাছে আসা উচিত, তা তো আসেইনি, অবকাশের উঠোনও ভাগহয়নি। দাদা আর ছোটদাইসব ভোগ করছে। দুভাইয়ে আগে এত সখ্য ছিলো না, বাবার অসুস্থতার সময় এবং বাবা মারা যাওয়ার সময় তাদের বন্ধুত্ব এবং ভ্রাতৃত্ববোধ তুঙ্গে উঠেছে। চারভাইবোনের মধ্যে অর্থনৈতিক অবস্থা সবচেয়ে খারাপইয়াসমিনের আর সবচেয়ে অনিশ্চিত জীবন আমার। আজ খেয়ে পরে বেঁচে আছি, কিন্তু কাল পারবো কিনা জানি না। লেখালেখি আমার উপার্জনের উৎস। তার ওপর আমি বাংলায় বই লিখি, পাশ্চাত্যের কোনও ভাষায় লিখি না। বাংলাদেশ থেকে বইয়ের কোনও রয়্যালটি আমি পাইনা। অন্য দেশে আজ বই চলছে, কাল হয়তো চলবে না। ভারতে বা বাংলাদেশে, যেখানে জীবন যাপনপশ্চিমের দেশগুলোর মতো এত ব্যয়বহুল নয়, আমার বাস করার কোনও অধিকার নেই। আজপশ্চিমে আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে, কাল কী হবে জানি না। জমানো টাকা ফুরিয়ে যেতে সময় খুব নেয় না। দাদারা যে আমাদের এই অনিশ্চয়তা জানে না, তা তো নয়, খুব ভালো করে জানে। কিন্তু একটা জিনিসই তারা নির্লিপ্ত থেকে প্রমাণ করেছে, আমাদের অভাবে অসুখে তাদের কিছু যায় আসে না।

কেমনপুত্রধন পেটে ধরেছিলে মা? তোমার সততা, তোমার বিবেক, তোমার মায়া মমতার এক ফোঁটা ওরা কিছুপায়নি কেন! বাবার উদারতা, বিচক্ষণতা, বাবার আদর্শ, মনোবলও তো ওরা কিছু পায়নি। যে দিকটা বাবার মন্দ ছিল, সেই মন্দটাই বিকট করে বীভৎস করে দুজনকে গড়ে তুলেছে। ওরা ধনলোভ, কৃপণতা, স্বার্থপরতা পেয়েছে। বাবাও কিন্তু এতপাষণ্ড কোনওকালে ছিল না। বাবা শুধু তোমার সঙ্গেই নিষ্ঠুরতা করেছে, আর কারও সঙ্গে তো করেনি। শেষ বয়সে তার দুটো কন্যার সঙ্গে এই নিষ্ঠুরতা সত্যিই করেছে কিনা কোনওদিন তা জানার সুযোগ না হলেও, এই বোধোদয়ের সুযোগটা অন্তত হচ্ছে, যে, আপন দুটো ভাইয়ের সামান্যও ভালোবাসা দু বোনের জন্য নেই। ভাবতে দুঃখ হয়, ওরা আমার ভাই। কী জানি কী সুখ ওরা পায় বোনদের ঠকিয়ে। দুটো মাত্র বোন, এমন তো নয়, যে, সম্পত্তি অতি সামান্য, এমন তো নয় যে বারো কী তেরোটি বোন তাদের ভাগ নিয়ে নিলে ভাইদের কিছু কম পড়ে যাবে। বেঁচে থাকার জন্য কত টাকার দরকার হয় মা! কত সম্পদের দরকার! জানি, তুমি এই অন্যায় মেনে নিতে পারতে না। বাবা নিজেই অন্যায়টি জেনে বুঝে করে গিয়েছিলো, নাকি তাকে ভয় দেখিয়ে, ভুল বুঝিয়ে অন্যায়টি করতে বাধ্য করা হয়েছিল! আমরাও তো বাবারই সন্তান ছিলাম, আমাদের বঞ্চিত করার জন্য বাবা এত উদগ্রীব ছিলো কেন! এই রহস্যের সমাধান কোনওদিনই করা সম্ভব নয়। কারণ দাদা আর ছোটদা ছাড়া আর কেউ জানে না আসলে ঘটেছিল কী। তারা আমাদের কিছুই জানাচ্ছে না, শুধু এটুকুই বলছে যে বাবা নিজে উইল লিখে গেছে। বাবা যা করে গেছে তা যদি সত্যিই বাবার একক সিদ্ধান্তে হয়, ভাইরা, আমি অনুমান করি, ক্রমাগত এই মন্ত্রই বাবার কানে দিয়েছে যে আমাকে আর ইয়াসমিনকে সম্পদ বা সম্পত্তির যা-ই দেওয়া হবে, নিশ্চিতই সব মামাদের হাতে চলে যাবে। আমরা দু বোন মায়ের মতো মন পেয়েছি, সহানুভূতি সমবেদনা ইত্যাদি এত বেশি যে মামাদের অভাব দেখলে আমাদের যা কিছু আছে, সব ঢেলে দেব। বিশেষ করে আমি, মামাদের দুঃখ দুর্দশা ঘোচাবার পণ করেছি আমি, না দিয়ে আমি পারবো না। ভালো যে তুমি বেঁচে নেই মা, বেঁচে থেকে এসব দেখনি। আরও কষ্ট পেতে মা। তোমার বাবা মার জমিজমা তোমার ভাই বোনের মধ্যে দেশের উত্তরাধিকার আইনে ভাগ হয়েছিলো। ভাইরা দুভাগ পেয়েছে, তুমি আর তোমার বোনেরা একভাগ করে পেয়েছে। তোমার ভাগটায় শরাফ মামা একটা ঘর বানিয়ে থাকছে, নিজে যা পেয়েছিলো, তা সে বিক্রি করে দিয়েছে। তোমার ভাগে কে থাকছে, না থাকছে তা নিয়ে মাথা ঘামাওনি তুমি। শরাফ মামাকে তোমার ভাগটা লিখে দিতে তোমার আপত্তি ছিলো না, তোমার উত্তরাধিকারী হিসেবে আমার আর ইয়াসমিনেরও আপত্তি ছিল না যে তোমার ভাইদের কেউ নিয়ে যাক তোমার অংশ। এখনও নেই। কিন্তু তোমার ওইটুকু ছোট্ট জমিই নাকি এখন দাদা দাবি করেছে। যেহেতু লিখে পড়ে দাওনি কিছু, তাই দাদা ওটুকুও ছাড়েনি। যে ভাগ তুমি নিতে চাওনি, আজ তোমার গর্ভের সন্তান, তোমার প্রতি ভালোবাসা না দেখালেও তোমার জমির প্রতি তার ভালোবাসা দেখাচ্ছে। তোমাকে ছেড়ে দিতে তার মায়া হয়নি, তোমার ওই ছোট্ট সামান্য জমিটুকু ছাড়তে তার মায়া। তুমি কী দেখ এসব মা, আকাশের কোথাও থেকে দেখ? দেখে কী তোমার লজ্জা হয় না?

১২. ইতি তোমার আদরের নাসরিন

যতই বলি না কেন যে বাবা তার জীবনের শেষ সময়ে চরম নিষ্ঠুরতা করে গেছে তার দুই কন্যার সঙ্গে, অসম্ভব অপমান করেছে দুই কন্যাকে, বাবার জন্য তবু আমার কষ্ট হয়। তার পরও বাবার না থাকা আমাকে কাঁদায়। বাবা কবে থেকে নেই? মনে নেই। হয়তো দুহাজার এক বা দুই সাল হবে। তোমার আর বাবার ক্ষেত্রে মারা গেছে এই শব্দ আমি উচ্চারণ করি না কখনও। আমি পারি না। এরমধ্যে একদিন বাংলাদেশের একপুরোনোপরিচিতর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। কথায় কথায় আমার ভাই বোন কে কেমন আছে প্রশ্ন ওঠায় বলেছিলাম, বাবা তো সব সহায় সম্পত্তি ছেলেদের নামে উইল করে দিয়ে গেছে। যার সঙ্গে কথা বলছিলাম, শুনে তাজ্জব, বলে, বাংলাদেশের ইসলামি আইনে তো উইল চলে না? চলে না? না চলে না। সমস্ত সম্পত্তির তিন ভাগের একভাগ শুধু লিখে দিতে পারে কাউকে, তাও আবার উত্তরাধিকারীদের অনুমতি নিয়ে। তাছাড়া সম্পত্তি লিখে দেওয়ার বা উইল করার নিয়ম নেই। ছোটদাকে একদিন বলেছিলাম, তুমি কি জানো যে বাংলাদেশে উইল চলে না? বললো, জানি। তাহলে বাবার উইলটা তো অবৈধ। ছোটদা বললো, তোরা মেনে নিলে বৈধ, না মেনে নিলে অবৈধ। আমি বললাম, আমরা তো মেনে নিইনি এই উইল, তাহলে সম্পত্তি ভাগ করার ব্যবস্থা করো। ছোটদা বললো, সম্পত্তি ভাগ আমরা করবো না, বাবা যা দিয়ে গেছে আমাদের, তা নেব। বললাম, আইনের আশ্রয় যদিনিই? ছোটদা বললো, নে, দেখি কী করে নিতে পারিস। ছোটা এবং দাদা জানে যে আমার পক্ষে দেশে ফেরা সম্ভব নয়। আর ইয়াসমিনের সেই মানসিক সবলতা বা সুস্থতা নেই যে ভাইদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। অগত্যা আর সব দুর্ভাগা মেয়েরা বাংলাদেশে যেভাবে বঞ্চিত হয়, আমাদেরও তেমন ভাবেই বঞ্চিত হতে হবে। কিন্তু যে আমি সমানাধিকারের পক্ষে এতকাল লড়াই করে এসেছি, মেয়েদের বিরুদ্ধে সমাজের আর আইনের যে অন্যায় চলে, তার প্রতিবাদ করে এসেছি সেই অন্যায় যখন নিজের পরিবারে, নিজের জীবনে, তখন আপোস করবো? আপোস যদি করি, তাহলে আমার বিশ্বাসের সঙ্গে আমার নিজেরই প্রতারণা করা। না, মা, সম্পত্তির লোভ আমার নেই। পরিবারের সবার জন্য আমার উপার্জিত টাকার সিংহভাগ আমি খরচ করেছি ইচ্ছে করেই করেছি, ভালোবেসে করেছি। কিছু পাওয়ার আশায় করিনি। কিন্তু যাদের জন্য জীবন দিই, তারাই যখন পেছন থেকে পিঠে ছুরি বসানোর পরিকল্পনা করে, এবং বসায়, তখন চমকে উঠি। বিশ্বাস হতে চায় না রূঢ় নিষ্ঠুর বাস্তব।

ছোটদার সঙ্গে আরও কথা বলার পর যা বুঝেছি তা আরও ভয়ংকর। আমার টাকা পয়সার ওপর, সে মনে করে, তার অধিকার একশ ভাগ। কারণ আমার স্বামী নেই, সন্তান নেই, তার মানে আমার ‘সংসার’ নেই, এবং আমি যেহেতু পুরুষ নই, মেয়ে, আমার টাকায় আমার ওপর আমার যত অধিকার, ভাইদের অথবাপুরুষ আত্মীয়দের তার চেয়ে অনেক বেশি অধিকার। সুতরাং আমার যা কিছু আছে, তা আসলে ছোটদার। আমি মরে গেলে আমার সব সে পাবে। আর স্বামী সন্তানহীন সংসারহীন বেঁচে থাকা মানে তো ঠিক বেঁচে থাকা নয়, তাই আমি বেঁচেও মৃত, আর যে দেশে আমার জন্ম বড় হওয়া, যে দেশে আমার সম্পদ সম্পত্তি এখনও বর্তমান, সে দেশেই যেহেতু আমি বেঁচে থাকা অবস্থায় উপস্থিত থাকতে পারবো না, তাই বিদেশের বরফে ডুবে থাকা আর মরে থাকা ওই একই কথা। বাবার উত্তরাধিকারী হওয়ার যোগ্য আমি নই।

তুমি যদি এই নিষ্ঠুর পৃথিবীটায় থাকতে, তবে সইতে পারতে এই অন্যায়! পারতে না। তোমার স্বামী পুত্রদের এই অনাচার আর অবিচারের বিরুদ্ধে তুমি মুখর হতে। নিশ্চয়ই হতে। কতই বা আর লড়াই করার ক্ষমতা ছিল তোমার! জানি তুমি কষ্ট পেতে, বাকি জীবনভর কাঁদতে। কেঁদে তো জীবনে কিছুই অর্জন করতে পারোনি। রাগ করে, চেঁচিয়েও তো কিছু করতে পারোনি। তোমার চিৎকার অবকাশের চার দেয়ালের ভেতর ধাক্কা খেয়ে খেয়ে তোমার কাছেই ফিরে এসেছে। তোমার চোখের জল নদী হয়ে হয়ে তোমাকেই ভাসিয়েছে, ডুবিয়েছে।

মা, আপন আসলে কাঁদের বলবো মা? ভাইরা কি আপন? কী করে ছোটদাপারলো তার যে বোনটা দেশে ফিরতে পারছে না, তার বাড়িতে থেকে তারই সর্বনাশ করতে? তুমি যতদিন ছিলে, আমার যা কিছু সব যত্ন করে রেখেছিলে। ছোটদাকে তুমি খুব ভালোবাসতে বাসতে তো মা। আমার বাড়িতে ছিলে একসঙ্গে। কী হিসেবে ছিলে মা? ছোটদার দাসী হিসেবে, তাকে খাওয়ানো দাওয়ানো তো আছেই, তার কাপড়চোপড় ধোয়া, ইস্ত্রি করা, ফ্লাইটে যাওয়ার আগে তার সুটকেস গুছিয়ে দেওয়া, তার ঘর দোর, বিছানাপত্র সাজিয়ে রাখা, তার জন্য অপেক্ষা করা। কখন ফিরবে অপেক্ষা। ভোগবাদী ছোটদা বাইরে থাকতো প্রেম করতে, অথবা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে, বাড়ি ফিরতো মদ খেয়ে মাতাল হয়ে, অথবা বাড়িতে বসেই মদ খেতো। তুমি ওগুলোকে মদ বলতে না, হাইনেকেন বিয়ার কে তুমি ভাবতে সবুজ কোকোকোলার ক্যান। কিন্তু ওই সবুজ কোক খেয়ে তোমার ছেলে অমন মাতাল হয় কেন, জীবনে কোনওদিন মাতাল না দেখা তুমি, কী রকম দুঃখ পেতে, তা আমি বেশ বুঝি। এই আদরের ছেলে যে অল্প বয়সে বিয়ে করে গীতা গীতা করে জীবন পার করলো, গীতার মুঠোর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা ছেলেকে তুমি প্রথম পেলে। কিন্তু কী রকম সে পাওয়া তোমার! ছোটদার আমার মনে হয় না তোমার প্রতি কোনও ভালোবাসা ছিল।

তুমি ঢাকায় এক ছেলের যত্ন করবে। আর বাবা ময়মনসিংহে আরেক ছেলের যত্ন করবে। এই তত ছিল অলিখিত নিয়ম, মা। তোমাদের যত্ন করার, তোমাদের কথা ভাবার কেউ ছিল না মা। সবাই যার যার নিজের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। তোমার আদরের ধনেরা। তুমি বোধহয় আশা করতে তোমার বিপদে আপদে, অসুখে বিসুখে তোমার সন্তানেরা তোমার পাশে থাকবে। কিন্তু হল কই মা। কাউকেই তো পাওনি। আমার যে বাড়িটা তুমি গুছিয়ে রাখতে, আগলে রাখতে, তুমি বিদেয় নেওয়ার পর সংসারে আর কেউ নেই তুমি যা করতে, তার সামান্য হলেও করার। আমার আলমারিগুলো দেশ থেকে আমি বেরোবার পরই ছোটদা খুলে ফেললো সব। আমার এতদিনকার সব কিছু আমার জরুরি, অতি জরুরি কাগজপত্র, চিঠি, অপ্রকাশিত গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ কবিতা–সব ছোটা খুলে দিল সবার জন্য। যে কেউ এসে যা ইচ্ছে করতে পারে আমার সব প্রয়োজনীয় সবকিছুকেই। ভেঙে ফেলতে পারে, আবর্জনার বাক্সে ফেলে দিতেপারে, নির্দ্বিধায় নিজের মনে করে নিয়ে যেতে পারে, ছিঁড়ে ফেলতে পারে। হ্যাঁ মা, বিশ্বাস করো নাই করো, আমার যক্ষের ধনকে ছোটদা বিলিয়ে দিল যার তার কাছে। যে কাউকে যা ইচ্ছে তাই করার অধিকার ছোটদা দিয়ে দিল। আমার কিছু আর আমার রইলো না। ছোটদা কেন এই কাজটি করেছে আমি আজও ভাবি। তার টাকার দরকার, সে সবকটি আলমারির তালা ভেঙে টাকা পয়সা খুঁজে যা কিছু তার দরকার নিয়ে আবার ঠিক সেরকম করেই রেখে দিতে পারতো যেমন ছিল সব, যেমন আমি রেখেছিলাম। একটি মেয়ে দেশে ফিরতেপারছে না, একটি মেয়ে নির্বাসনের দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, সে তার নিজের যা কিছু গড়েছিল, সব ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছে, আর তার বাড়িতে থেকে এত বড় অকৃতজ্ঞ হতে পারে কেউ মা? পারে, ছোটদা পারে। বাড়িতে কত কেউ থেকেছে, কী করেছে কে জানে। তোমার আলমারিটায় আমি তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে, যেভাবে তুমি নিজের হাতে রেখেছিল, সেভাবেই, তোমার চিঠিপত্র, তোমার বইখাতা, তোমার ব্যবহারের জিনিসপত্র, তোমার জগৎটাকে রেখে তালা লাগিয়ে এসেছিলাম। ইয়াসমিনকে বলেছিলাম, তুই দেশে গেলে ঢাকা আর ময়মনসিংহে রাখা মার দুটো আলমারি খুলে মার স্মৃতিগুলো স্পর্শ করিস। ইয়াসমিন গিয়েছিলো বটে দেশে, কিন্তু তোমার ময়মনসিংহে আলমারি খুলে তোমার জিনিসপত্রগুলোকে স্পর্শ করার তার সময় বা ইচ্ছে কোনওটাই হয়নি। ঢাকার বাড়িতে রাখা তোমার আলমারি ও বললো, খোলা। ঢাকায় এখন শুভ থাকে, তোমার আলমারিতে শুভ তার কাপড় চোপড় রাখে। শুনে আমি বাকরুদ্ধ বসে ছিলাম। শুভর কাপড় চোপড় রাখার জন্য মার আলমারি খুলে দিতে হল ছোটদাকে! শুভর জন্য কি কোনও আলমারি কিনে দেওয়া যেত না! ছোটদা ঠিক কী দিয়ে গড়া মানুষ, আমি জানি না। তোমার গর্ভ থেকেই তো জন্ম মা। তোমার হৃদয় উপচে ওঠা মায়া মমতার সামান্য এক তিলও পায়নি কি ছোটদা? কিন্তু পেয়েছে তো, সেটা ও কাজে লাগায় শুধু তার বেলায়, অথবা জুইএর বেলায়। তোমার সব স্মৃতি এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে তার এতটুকু বাধে না। আমার জগৎকেপায়ের তলায় পিষে ফেলতে তার কোনও কষ্ট হয় না। সে তোমাকে আমাকে সবাইকে বিনা দ্বিধায় হাটে বাজারে বিক্রি করে দিতে পারে। সেই বিক্রির টাকাগুলো ডলার করে গীতার চরণে উৎসর্গ করতে পারে। কিন্তু গীতার সঙ্গে তো শারীরিক এবং সামাজিক সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলে জুইকে বিয়ে করে তার সঙ্গেই জীবনযাপন করছে। তাহলে গীতার প্রতি তার এখনও এই ভালোবাসা কেন! আজও সে গীতার মতো দুষ্টু চরিত্রের মহিলার বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করে না, কারণ কি? গীতা, ছোটা বেশ জানে যে আমাদের বাড়ির সবাইকে ভুগিয়েছে। বাবাকে, তোমাকে, আমাকে, ইয়াসমিনকে অকথ্য অপমান করতে ছাড়েনি। গীতাকে কোনওদিন সে এ কারণে দোষ দেয়নি। ভালোবাসতে যে ছোটদা পারে না, তা নয়, পারে। নিজের জীবনে সে তা প্রমাণ করেছে। তবে বহুগামিতা তার রক্তে, তাকে দমন করার কোনও ইচ্ছে তার নেই। আমি পারি না এমন। দাদা, আমি, তুমি, ইয়াসমিন বড় দুর্ভাগ্যজনকভাবে একগামি। আমাদের পরিবারের সবচেয়ে সুখী এবং পরিপূর্ণ মানুষ ছোটদাই। দুঃখতার ধারে কাছে ঘেঁষতে পারে না। আমার চেয়ে বয়সে আট বছরের বড় হলেও তাকে দেখতে এখনও আমার চেয়েও কমবয়সি। আনন্দে থাকার এই একটা গুণ, মনের বয়স যেমন বাড়ে না, শরীরের বয়সও কোন অদৃশ্য গুহায় যেন লুকিয়ে থাকে। তুমি ভেবো না এরপরও ছোটদাকে আমি কোনও মন্দ কথা বলি। দেখা হলে এখনও আগের মতো আনন্দে ফেটে পড়ি। তার সামান্য কটা চুল পেকেছে বলে আমার সে কী মন খারাপ, কলপ লাগিয়ে কালো করার পরামর্শ দিই। ছোটদা অবশ্য বললো, মেয়েরা নাকি বলে ওই গ্রেতেই তাকে বেশি সেক্সি দেখতে লাগে। এই সেদিনও ছোটদার প্রেমে মেয়েরা কী করে উন্মাদ হয়, তার হাই-ইস্কুল-সুইটহার্টনাসরিন এতকাল পর কী করে স্বামী সন্তান ফেলে ছোটদার কাছে ছুটে ছুটে আসে, বললো। ছোটদার মন ভালো আছে, ভাবলে আমার ভালো লাগে। ছোটদা যা খেতে ভালোবাসে, তাই তাকে আদর করে খাওয়াই। ওয়াইন খেতে ভালোবাসে, সবচেয়ে ভালো ওয়াইন কিনে রাখি ওর জন্য। এই সেদিনও ছোটদাকে তার দুই ছেলেমেয়েসহ লাস ভেগাস আর গ্র্যাণ্ড ক্যানিয়েন বেড়াতে নিয়ে গিয়েছি, সবচেয়ে ভালো হোটেলে থেকেছি, ভালো রেস্তোরাঁগুলোয় খেয়েছি। আর সারাদিন রাত শুধু তুমুল হৈহল্লা আর গল্প করে কাটিয়েছি। যেন ছোটদার ভাল লাগে। ছোটদা খালি হাতে এলেও কখনও তাকে খালি হাতে বিদেয় দিই না। নিউইয়র্কে আমার বাড়িতে তাকে জোর করেই রেখে দিই, আমার বিছানায় তাকে ঘুমোতে দিয়ে যে বিছানায় আমার ভালো ঘুম হয় না, সে বিছানাতেই আমি রাত কাটাই। ছোটদার যেন আরাম হয়, ছোটদার যেন ভালো ঘুম হয় চাই। ইয়াসমিন আমার চেয়েও আরও এক কাঠি ওপরে, ছোটদা বলতে পাগল সে। ছোটদা আসবে শুনলে সে বাড়িঘরপরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অভিযানে নেমে যায়, সারাদিনপনেরো যোলো রকম খাবার রান্না করে। দাদার জন্য একইরকম করি। কলকাতায় দাদা আমাকে দেখতে আসতো। খালি হাতেই আসতো, তবে একবার মুক্তাগাছার মণ্ডা আর গরুর মাংসের ঝুরি নিয়ে এসেছিলো, দুটোই আনার সময় গরমে নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু রেফ্রিজারেটরে ওইনষ্টগুলোই রেখে দিয়েছিলাম অনেকদিন। খেতে পারিনি, কিন্তু দেখে ভালো লাগতো, দাদা কিছু এনেছে। বন্ধুদের বলেছি, দাদা আমার জন্য দেশ থেকে কত কিছু নিয়ে এনেছে। দাদার রক্তে বেশি সুগার পেয়ে আমি দিন রাত ব্যস্ত হয়ে পড়লাম তার সুগার কমাতে, ডাক্তারের কাছে নিয়ে ইনসুলিন কতটা নেবে কী নেবে তা শুধু জেনে আসা নয়, সবচেয়ে আধুনিক যে ইনসুলিন বেরিয়েছে, সেসব ব্যবহার করিয়ে, তাকে পথ্য খাইয়ে, তার সুগার কমিয়ে, তার হতাশা দুর্বলতা ইত্যাদি ঘুচিয়ে পরে আমি শান্ত হলাম। দাদা নাটক দেখতে ভালোবাসে, তাকে প্রায় সন্ধেয় নাটক দেখাতে নিয়ে যেতাম। গান ভালোবাসে, একশ গানের সিডি কিনে দিই। তরুণ মজুমদারের সিনেমা তার ভালো লাগে, তাঁর সঙ্গেও যে করেই হোক আলাপ করিয়ে দিই। দাদার তাজমহল দেখার ইচ্ছে, সেই তাজমহলও দাদাকে দেখিয়েছি। রেডফোর্ট, আগ্রাফোর্ট সব। তোমাকে যেমন সেবা করেছিলাম, দাদাকে কিছু আমি কম করি না, মা। বাবার সম্পত্তি নিয়ে যা করেছে, সব জানার পরও দাদাকে পেলে জগৎ সরিয়ে রেখে দাদার শরীর মন সব সুস্থ করে তুলি। দাদা চলে গেলে চোখের জলে ভাসি। ভালোবাসাটা জগদ্দল পাথরের মতো হৃদয়ে বসে থাকে, সম্পত্তি বা টাকা পয়সার মতো তুচ্ছ কারণ এসে সে পাথর নড়াতে পারে না।

.

জীবন অনেক বদলে গেছে মা। তোমার স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত সফল হলো না। বাংলাদেশে ফেরার আমার কোনও উপায় নেই। আমার পাসপোর্টের মেয়াদ উত্তীর্ণ করা হয় না। বিদেশের বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোয় ধর্না দিয়ে ওই একই উত্তর শুনতে হয়, তারা আমার পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়াবে না। আমি যেন দেশে যেতে না পারি তার সবরকম কায়দা কানুন ওরা করে রেখেছে। সুইডেনের পাসপোর্ট হাতে, ওতেও বাংলাদেশের ভিসার জন্য আবেদন করেছি। একই উত্তর মা। না। যে সরকারই বাংলাদেশে আসে, নিজেদের মধ্যে আর সব বিষয়ে তাদের মত পার্থক্য থাকলেও আমার ব্যাপারে সবাই একমত, আমাকে দেশের মাটিতে পা রাখতে দেবে না তারা। অগত্যা সুয়েনসনের বাড়িটিকেই নিজের বাড়ি মনে করে সাজিয়ে তুলোম। ঢাকায় ফেলে আসা আমার সবকিছুকে ভুলে তো যেতে পারি না, কিন্তু আর কতকাল জীবন আমাকে কেবল শেকড়হীন হাহাকার দিয়ে যাবে, যেন রূঢ় বাস্তবতার বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়ালাম। স্বপ্নের বীজ ছড়াতে শুরু করলাম জীবনের ধূসর ঊষর অকর্ষিত জমিতে। কিন্তু তাই বা কদিন বলো। ভিন দেশে ভিন মানুষের সঙ্গে তুমি চলতে ফিরতে পারো, কিন্তু কোথায় যেন কিসের এক ফাঁক থেকে যায়, অথবা ফাঁকি। অস্তিত্বের লড়াই শুরু হয় অলক্ষ্যে। সুয়েনসনের বাড়িতে অন্তত চোখ কান নাক মুখ বুজে একটি কাজ করা যায়, সে লেখা। প্যারিস থেকে ফিরে এসে ফরাসি প্রেমিক নামে বড় উপন্যাস লিখে ফেলেছি। উপন্যাস লেখা আমার হয় না, ও লেখা একরকম বাদই দিয়েছিলাম। আমার মেয়েবেলার কথা তো জানোই। বইটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে বেরোবার আগেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কলকাতায় আমার বই বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে লোক এসে কিনে নিয়ে যান। এরকমই বোধহয় নির্দেশ। সে বই তারা নিজেরা পড়ে মত জানান, অথবা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়ে দেন। প্রধানমন্ত্রী পড়ে বা নাপড়ে বই নিষিদ্ধ করেন। কেন, কী বুঝে, কে জানে। অবাক লাগে এসব চরিত্র দেখে। চারদিকে এই বই নিয়ে উচ্ছাস। আর এটি কি না যে দেশের কাহিনী, সে দেশেই নিষিদ্ধ। হাসিনা কী কারণে যেন ফ্রান্সে এসেছিলেন। ওকে দেখে ফরাসি সাংবাদিকরা ছুটে গিয়ে একটা প্রশ্নই করেছে, আপনি তসলিমার আমার মেয়েবেলা নিষিদ্ধ করেছেন কেন, হাসিনা ঠেটি উল্টে বলে দিয়েছেন, ও বই ভালগার, পর্নোগ্রাফি। ভেবেছেন বেশ বিজ্ঞের মতো বুঝিমন্তব্যটি করা হল। ফরাসিরা ওই বইটা পড়েছে, হাসিনার মন্তব্য শুনে তাজ্জব বনে যায়। ল্য মন্দ পত্রিকার সাংবাদিক ব্রুনো আমাকে পরে বলেছে এমহিলা দেখি আগাগোড়া মূর্খ। ফরাসিরা জানে বইটা কী বই, ভালগারের কিছু আদৌ আছে কী বইয়ে। তাদের তো আর বোকা বানানো যাবে না। নিজেকেই বরং বোকা হয়ে যেতে হবে। সরকার বই নিষিদ্ধ করে, সে সরকারের দোষ। আমি আমার লেখাকে, আমার মতকে অস্বীকার করবো কেন, নিষিদ্ধ করবো কেন। নিজের লেখা নিজের নিষিদ্ধ করার মতো ভয়ংকর আর কিছু নেই। বলো, বই কি আমি কাউকে খুশি করতে লিখি নাকি? যা বিশ্বাস করি, তাই তো লিখি। আমার মেয়েবেলা শুধু ফরাসি ভাষায় নয়, জার্মানির বড় একটি প্রকাশকও বের করেছে। আমেরিকাতেও বের হয়েছে। আমেরিকায় আবার আমাকে বুক ট্যুরে যেতে হল, আমেরিকার উত্তর দক্ষিণপূর্বপশ্চিম সব অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়ে বা বড় বড় মঞ্চে বই প্রকাশ উপলক্ষে আমার বক্ততা হল। আমেরিকার প্রায় সবপত্রিকায় বইয়ের সমালোচনা বের হল, সবাই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা তো করলোই, লস এঞ্জেলেস টাইমস আর গ্লোব এণ্ড মেইল নামের দুটো নামি পত্রিকা বইটিকে দুহাজার দুই সালের শ্রেষ্ঠ নন ফিকশন বইএর লিস্টেও রাখলো। কিন্তু রয়্যালটির টাকা? পাইনি বললেই চলে। আমেরিকার ওই প্রকাশক এককালীন টাকা দিয়ে ফরাসি প্রকাশকের কাছ থেকে কপিরাইট কিনে নিয়েছে। আমেরিকায় ভালো বিক্রি হয়েছে বই। হলিউড থেকে একটি মুভি কোম্পানি যোগাযোগ করেছিলো। বই নিয়ে ছবি বানাতে চায়। লিটারেরি এজেন্ট থাকলে এসব সমস্যা হয় না। কিন্তু ওইসব এজেন্ট টেজেন্ট রাখা আমার ভালো লাগে না, লেখাটা আমার পেশা, কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি সেই এলোমেলো লেখক, লেখা যার নেশা। পেশা হলেও পেশাদারি মনোভাব আমার আসে না। ভারতের বিভিন্ন ভাষাতেও বইটি ছাপা হয়েছে। কোথায় কে ছাপাচ্ছে, কী ছাপাচ্ছে, তার হিসেবও আমার রাখা হয় না। মহেশ ভাট অনেকদিন আগেই বলেছিলেন, আমার জীবন নিয়ে ছবি বানাবেন, সে কথা অবশ্য কথাতেই রয়ে গেছে। উতল হাওয়া নামে দ্বিতীয় আত্মজীবনীর দ্বিতীয় ভাগটিও একদিন লেখা হয়ে যায়। বাংলার বাইরে অন্য ভাষাতেও এ বই অনূদিত হয়। ফরাসি প্রকাশক লুফে নেন উতল হাওয়া। লেখাই আমার আশ্রয় হয়ে ওঠে। তুমি নেই, বাবা নেই, সব আশ্রয় যখন শেষ হয়ে যায়, বোধহয় আশ্রয় খুঁজি অন্য কিছুতে। ফরাসি প্রেমিক বইটি বাংলাদেশে বের হয়, এই বইটির যেখানেই যৌনতা পেয়েছে, কেটে বাদ দিয়েছে বাংলাদেশের প্রকাশক। কলকাতার প্রকাশক বাদ দেয়নি কিছু। বিরাট করে বইটি বের করেছে, এবং পেঙ্গুইন ইন্ডিয়াও বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করে ছাপিয়েছে। এত সব লেখালেখি, এর মধ্যে তোমাকে কি ভুলে থাকি একটি দিনের জন্য? না, মা, ভুলে থাকতে পারি না। উতল হাওয়ায় তোমাদের কথাই লিখি, তোমার কথা, বাবার কথা। লিখতে লিখতে কাঁদি। চোখ মুছি। আবার লিখি। আমার শব্দে, আমার স্মৃতিতে তুমি জীবন্ত হয়ে দেখা দাও। পুরোনো দিনগুলোয় ফিরে যেতে হলে কী যে প্রয়োজন হয় রেখে আসা কত কিছুর। দাদাকে বলি রুদ্রর চিঠিগুলো অন্তত পাঠিয়ে দিতে। শান্তিনগরের বাড়িতে আমার লেখার ঘরে কত চিঠি যে পড়ে আছে, কত যে ডায়রি, কত যে বই, স্মৃতির পাহাড় ওখানে। গোটা পাহাড় কে পাঠাবে বলো! রুদ্রকে লেখা আমার চিঠিগুলোই পেয়েছি, আমাদের বিচ্ছেদের সময়ই ওর কাছ থেকে চিঠিগুলো নিয়ে এসেছিলাম। আমাকে লেখা রুদ্রর চিঠির খুব অল্প কিছু ছাড়া আর কিছু পাঠায়নি দাদা। বলেছেপায়নি। কোথায় সব গেল জানি না। শুধু কিরুদ্রর চিঠি, বাক্সরপর বাক্স চিঠিতে বোঝাই ছিল। পাঠকদের চিঠি, দেশ বিদেশের শিল্পী সাহিত্যিকদের চিঠি। আমাকে লেখা বাবার এক ট্রাংক চিঠি। নিজের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় নিয়ে আত্মজীবনীর তৃতীয় বইটি যখন লিখছি, তখন তথ্যের দরকার পড়েছে। যদি হাতের কাছে তথ্য না থাকে, তবে কত আর স্মৃতি থেকে লেখা যায় বলো! আমার লেখক জীবন কী করে শুরু হল, সেই সব জনপ্রিয়তা, একইসঙ্গে সমাজের সব বাধার বিরুদ্ধে আমার রুখে দাঁড়ানো, হাসপাতালের ব্যস্ততা, সরকারের বিরোধিতা, পাসপোর্ট আটকে রাখা, ফতোয়া, মিছিল, বইমেলায় আমাকে আক্রমণ, বইমেলায় আমার উপস্থিতি নিষিদ্ধ হওয়া, বই বাজেয়াপ্ত হওয়া, দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন, ব্যক্তিজীবনের ভয়াবহ অস্থিরতা আর সব কিছু ভেঙেচুরে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রবল মনোবল আর শক্তি নিয়ে কুৎসিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একটি মেয়ের মাথা উঁচু করে একা থাকা, এত কিছু নিয়ে বড় একটি বই লেখা শুধু স্মৃতির ওপর নির্ভর রইলো।

শান্তিনগরের আমার বাড়িটা দাদা আর ছোটদা দুজনই ব্যবহার করে। বাড়িটা ভাড়া দিলে বা বিক্রি করে দিলে ভালো টাকা পেতাম। কিন্তু কিছুই করি না আমি। নিজের ভাইদের কাজে লাগছে বাড়ি, লাগুক। ইট কাঠ কংক্রিটের কোনও মোহ আমার নেই। আমার মন পড়ে থাকে আমার সেই বইগুলোয়, সেই আধ-লেখা লেখাগুলোয়, আমার সেই সহস্র রকম খেরোখাতার লেখালেখিতে। কত যে অপ্রকাশিত লেখা আমার কমপিউটারের ভেতরে বা বাইরে ছিল। কার এত সময় বাইচ্ছে আছে ওগুলো যত্ন করে রাখার, বা আমাকে পাঠিয়ে দেওয়ার। ছোটদা আসে আমেরিকায়। সুটকেস ভরে ভরে গীতার জন্য জিনিসপত্র নিয়ে আসে, তার সুটকেসে আমার প্রয়োজনীয় কোনও কিছুর জায়গা হয় না। আসলে জায়গা বড় ব্যাপার নয়, মা, ইচ্ছে হয় না। আমি এখন তাদের কাছে কোনও আর মূল্যবান কিছু নই। আমার রেখে আসা জিনিসপত্র অনেকটাই আবর্জনা তাদের কাছে। তারা হয়তো ঝেড়ে ফেলে দেয়, নয়তো কাউকে দিয়ে দেয়, এসবে কোনও মমতা নেই তাদের। তুমি যখন ছিলে, কাজের লোক ঘর ঝাড় দেওয়ার সময় বলতে, ঘর থেকে কোনওদিন যেন কোনও কাগজ না বেরোয়। মেঝেয় পড়ে থাকা হাবিজাবি কাগজও তুমি কোনওদিন ফেলতে দিতে না। আবর্জনার ঝুড়ি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে আসতে যে কোনও কাগজ। অথচ কত মূল্যবান কত কিছু ছোটদা ফেলে দিচ্ছে। কারণ তার ওসব দরকার নেই। আমি আর বেঁচে থাকতে ও দেশে ফিরতে পারবো না, সুতরাং ওসবপুরোনো জিনিসে ঘর ভরে থাকলে তাদের চলবে কেন। কলকাতায় যখন ছিলাম, দাদাকে বলেছিলাম দেশে যখন ফেরা কোনওদিনই সম্ভব হবার নয়, যেন পাঠিয়ে দেয় শান্তিনগরের বাড়ি থেকে আমার যা আছে সব। দাদা একাঁপারবে না বলে মিলনকে টিকিট পাঠিয়েছি আমেরিকা থেকে দেশে যাওয়ার। বিয়াল্লিশটা বড় বড় কার্টুনে সব ভরে ওরা কুরিয়ার করে দিয়েছে। কিন্তু কলকাতায় সামান্য কিছু বই এসে পৌঁছেছে। বাকিগুলো নাকি কুরিয়ারের লোক বলে দিয়েছে কাস্টমস-এ আটকে রেখেছে। ওগুলো ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা কেউ করেনি। আমার জিনিসপত্র সব দূর করে বাড়িঘর এখন বেশ হালকা করা গেছে। সবার জন্য বিস্তর জায়গা হয়েছে এখন। কী বলবো মা, শোকে পাথর হয়ে যাই। জোরে যে কাঁদবো, পারি না। বুঝি, জীবন তছনছ হয়ে গেছে, এ জীবনে স্মৃতি ছাড়া আর কিছু নেই নিয়ে বাঁচার।

.

এদিকে যত আমি সুয়েনসনের বাড়িতে শেকড় গাড়ছি, যত আমি তার এলোমেলো বাড়িকে সাজাচ্ছি, তত রুক্ষ হতে শুরু করলো সুয়েনসনের ব্যবহার। তার অটিজম রোগ কোনও নতুন কিছু সহ্য করতে পারে না। যেটা যেখানে ছিল, সেভাবে থাকলেই স্বস্তি বোধ করে। আমার একটা রুট ক্যানেলের দাঁত ছিলো তোমার মনে আছে? ওই দাঁতটার ওপর যে ছোট্ট একটা মুকুট পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই মুকুটের একটা অংশ একদিন ভেঙে গিয়েছিলো। দাঁতেরহাসপাতালের জরুরি বিভাগে দেখালে বললো মুকুট একটা নতুন বানিয়ে নিতে হবে। পরসালিন মুকুট বানাবো, এরকম ঠিকও করে রাখলাম। কিন্তু দাঁতের হাসপাতাল বাড়ি থেকে দূর, কত আর দূর, পনেরো মিনিট লাগে যেতে। সুয়েনসনের পরামর্শ, তার চেয়ে পাঁচ মিনিট সময় নেবে, এমন কাছের কোনও ক্লিনিকে যাওয়া উচিত, যে ক্লিনিকে অন্য সব রোগের চিকিৎসার পাশাপাশি দাঁতের ব্যাপারটাও আছে। সুয়েনসনের অবসর সময়ে তাই করলো, বাড়ির কাছের ক্লিনিকে নিয়ে গেল আমাকে। থেরেস নামের এক বেঁটে মেয়ে, দাঁতের ডাক্তার বলে কিছুতেই তাকে মনে হবে না, নার্স বলেও মনে হবে না, আমার রুট ক্যানেলের দাঁতের ওপর থেকে মুকুটটা সামান্য ভেঙে গেছে, মুকুটটা যেন লাগিয়ে দেয় সে, বলাতে যত দাঁত আছে আমার মুখে, সবগুলো দাঁতের আলাদা আলাদা করে এক্সরে নিল। যত বেশি এক্সরে, তত বেশি ক্যানসারের সম্ভাবনা, জানো তো। তোমার কোলন ক্যানসার হয়েছিল, তাই তোমার সব ছেলেমেয়েদের কোলন ক্যানসার হওয়ার আশংকা আছে। এর মধ্যে একটা কেলোনোস্কপি আমাকে করতে হয়েছে। হাশেম মামার ক্যানসার হল, তোমার হলো। আমাদের শরীরে ক্যানসার হওয়ার আশংকা, যাদের পরিবারে ক্যানসার নেই, তাদের চেয়ে বেশি। বিজ্ঞান তাই বলে, মা। আমি থেরেসকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, প্রত্যেকটা দাঁতের আলাদা এক্সরে করছো কেন? দুটি দাঁতের তো এক এক্সরেই যথেষ্ট! দাঁতাল হাসি দিয়ে মেয়ে বলে, তাদের ক্লিনিকে নাকি ওই সুবিধে নেই। আসলে কি জানো, তখনই আমার উঠে চলে আসা উচিত ছিল। এখনও আমি অনুতাপ করি, কেন আমি উঠে আসিনি। এক্সরে করে ফিরে আসার কদিন পর থেরেসের ফোন আসে আমার কাছে। তার দাবি, আমার রুট ক্যানেলের দাঁতের ওপরের হাড়ে ব্যাকটেরিয়া জমেছে, সুতরাং আমি যেন এক্ষুনি গিয়ে দাঁতটা ফেলে আসি। বলে কী! দাঁত ফেলতে হবে কেন! তখন আমার উচিত ছিল দাঁতের হাসপাতালে বড় দাঁতের ডাক্তারের কাছেগিয়ে জিজ্ঞেস করা, তোমরা যে বলেছো মুকুট পরিয়ে দেবে দাঁতের ওপর, তো ওদিকে যে আমাকে ডাকা হচ্ছে দাঁত ফেলতে। বলো তো ঘটনা কী! ঘটনা ওরা বলে দিতে পারতো, থেরেস দন্ত বিজ্ঞানের কচু জানে। রুট ক্যানেলের দাঁতের ওপরের হাড়ে একটু ছায়াপড়েছে, ওটা ইনফেকশন নয়। কিন্তু দাঁতের হাসপাতালে নাগিয়ে আমি থেরেসের আহ্বানে বাড়ির কাছের সেই ক্লিনিকে উপস্থিত হলাম। অবশ্য জিজ্ঞেস করেছিলাম, দাঁত তোলার আগে, যে, আমি কিনতুন দাঁত বসাতে পারবো ওখানে, ইমপ্ল্যান্ট করতে পারবো? থেরেস সঙ্গে সঙ্গে বললো, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। তারপর যে কী ঘটলো, সে যে কী ভয়াবহ দৃশ্য, তুমি না দেখলে বিশ্বাস করতেপারবেনা। মাড়ি অবশ করে শুরু করে দিল থেরেস তার অজ্ঞতার চর্চা। নানারকম সাঁড়াশি দিয়ে চেষ্টা করেও কিছুতেই সে আমার শক্ত পোক্ত দাঁত তুলতে পারে না। শেষ পর্যন্ত আশা ছেড়ে দিয়ে সে ডেকে আনলো তার মতোই এক অজ্ঞতার পিণ্ডকে। সেই পিণ্ডও অনেক ছুরি কাচি চালিয়ে মাড়ি কেটে ব্যর্থ হয়ে কোত্থেকে কুড়োল, কোদাল, করাত নিয়ে এলো জানি না, দাঁতের ওপরের হাড় কাটতে লাগলো, হাড় একটু কেটে দাঁত টেনে তোলার চেষ্টা করলো, হল না। আবারও কাটতে লাগলো। হাড় কাটার সময়, মা, আমার চোখ বেয়ে অঝোরে জল ঝরছিলো। খুলির ভেতর মস্তিষ্ক প্রতি কুড়োল আর করাতের আঘাতে প্রবল নড়ছিলো। অবশ করা কিছুই আর অবশ ছিলো না। ওই প্রবল আঘাতগুলোতে আমার হাড় গোড় সব ভেঙে যাবার অবস্থা। আমি বুঝতে পারছিলাম। ওদের বলার চেষ্টা করলাম, এবার থামো। তোমরা ভুল করছো, তোমাদের কোথাও ভুল হচ্ছে। তোমরা আমার হাড় কেটে ফেলছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা, সাদা মূর্খগুলো বাদামি রঙের বুদ্ধিকে সহ্য করে না। ধমক দিয়ে থামায়। আমি এখন তাদের হাতের মুঠোয়, তারা যা ইচ্ছে তাই করবে। ক্রুদ্ধ কসাই দুটো আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মনে হচ্ছিল, খুলি ফেটে মস্তিষ্ক ছিটকে বেরিয়ে পড়বে। তখনও যদি আমি ওভাবেই উঠে চলে আসতে পারতাম। আমার যদি তখন মনে হতো, এই সুইডেনের ডাক্তাররা তোমাকে ভুল চিকিৎসা দিয়ে মেরেছে। আমাকেও মারতে যাচ্ছে। যদি মনে হতো, এদের হাতে মরার আমার কোনও সাধ নেই। কিন্তু আমাকে ওরা জোর করে চেপে ধরেছে এমন করে যে বাঁচার আর উপায় ছিল না। অসহায় চোখে সুয়েনসনের দিকে তাকাচ্ছিলাম। ও যদি আমাকে এই বর্ণবাদী অজ্ঞদের হাত থেকে বাঁচাতে পারে। কিন্তু সুয়েনসনের মুখে মিষ্টি মিষ্টিহাসিও হয়তো বোঝেইনি কী ঘটছে, আর বুঝলেও প্রতিবাদ করার চরিত্র ওর নেই। সুয়েনসন তো ওদের চেয়ে আলাদা নয়, তারও বিশ্বাস বাদামির চেয়ে সাদা বেশি বোঝে, বেশি জানে। সুতরাং আমাকে যদি ওই ওখানে মরে পড়ে থাকতে হতো, তাহলেও সুয়েনসন মনে করতো, নিশ্চয়ই মৃত্যুটাও আমার প্রাপ্য ছিলো। আমি জানি না কেন আমি এই দেশ তোমাকে মেরেছে জেনেও আমি এই দেশের অজ্ঞদের হাতে নিজেকে সঁপে দিয়েছি! আমার উচিত ছিল ওই হাড়কাটা দস্যুদের কবল থেকে দৌড়ে পালিয়ে আসা। চার ঘণ্টা সময় ওরা নিল আমার হাড় কাটতে, আমার সর্বনাশ করতে। পিণ্ড চলে গেল। থেরেসকে তারপরও জিজ্ঞেস করলাম, দাঁত ইমপ্ল্যান্ট হবে তো! সে সজোরে মাথা নেড়ে আবার বললো নিশ্চয়ই। মাড়ি কাটা হাড় কাটা অবস্থায় ফেরত এলাম। সঙ্গেতৃপ্ত সন্তুষ্ট সুয়েনসন। এর মাথার ব্যারাম আছে সে গ্রীসেই দেখেছি। এথেন্সের এক ট্যাক্সি ড্রাইভার যখন আমাকে অন্ধকার গলিতে থামিয়ে কয়েক হাজার ডলার ডাকাতি করে নিয়ে গেল, সুয়েনসন পাশে থেকেও বুঝতে পারেনি কী ঘটেছে। পরে গলি থেকে বেরিয়ে এথেন্সের এক ক্যাফেতে বসে ওকে যখন বলেছি, কী ঘটেছে, ওর গা এত কাঁপছিলো যে হাতে ধরা গ্লাসটিও কাঁপছিলো, ছলকে উঠছিলো গ্লাসের পানীয়। দাঁতের ডাক্তাররা যে হাড় কেটে ভুল করেছে, তা সুয়েনসনকে বলার পরও তার বোঝা সম্ভব হয়নি। পরদিন দাঁতের হাসপাতালে গিয়ে বড় ডাক্তারদের বললাম ইমপ্ল্যান্ট করতে চাই। ডাক্তাররা এক্সরে দেখে নিয়ে আমাকে বললেন, তোমার হাড় এত বেশি কাটা হয়েছে যে কোনও ইমপ্ল্যান্ট আর সম্ভব নয়। বলেছিলাম, হাড়ে কিইনফেকশন হয়েছিলো? বড় ডাক্তার সোজাসুজি বলে দিলেন, দাঁত ফেলার কোনও প্রয়োজন। ছিলো না। ওসব ইনফেকশন নয়। কালো যে ছায়াপড়ে, রুট ক্যানেল করা দাঁতের ওপরের হাড়ে ওই ছায়া স্বাভাবিক। হাড় কি গজাবে? আমার প্রশ্নের উত্তরে বিশেষজ্ঞরা বললেন, হাড় গজায় বটে, তবে তোমার হাড় অনেকটাই কেটে নিয়েছে, গজালেও এত গজাবে না যে নতুন একটা দাঁত লাগানো সম্ভব হবে। নতুন দাঁতের জন্য হাড় চাই। তখন কী করতে ইচ্ছে হয় বলো! মনে হয় না ওই থেরেস আর এই অজ্ঞতার পিণ্ডকে গিয়ে গলা টিপে মেরে আসি! যেমন ইচ্ছে হয়েছিলো ওই অজ্ঞ ডাক্তারটিকে, কুপিয়ে মেরে ফেলতে, যে তোমাকে দেখেছিলো! ইচ্ছেই শুধু হয়, কারও বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেওয়া বলো, কারও অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। আমি অসহায়পড়ে থাকি একা পাশে সুয়েনসনও থাকেনা দুটো সান্ত্বনার কথা শোনাবার জন্য! হাসিতে আমার আর মুক্তো ঝরবে না আগের মতো। সে কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, সৌন্দর্যের বারোটা বেজেছে সামনের চার নম্বর দাঁত না থাকায়, সে কথাও চলো ভুলে যাই। মস্তিষ্ক যেভাবে খাবি খেয়েছে, ওতে যদি আবার ওতে কোনও সমস্যা দেখা দেয়, কাটা হাড় পড়ে থেকে থেকে হাড়ে ঘা হয়ে যদি আবার হাড়ের ক্যানসার হয়ে যায়! এসবে ওই অজ্ঞদের ওপর যত রাগ হয়েছে, তার চেয়ে বেশি হয়েছে নিজের ওপর রাগ। কেন আমি চলে এলাম না! কেন আমি তখনই প্রতিবাদ করিনি যখন ঘটনা ঘটছে। তোমাকে কেন আমি বড় ডাক্তার দেখাইনি, সে কারণে নিজের ওপর আমার যেমন রাগ হয়, দাঁতাল দস্যুদের হাত থেকে নিজেকে কেন বাঁচাইনি, নিজের ওপর সেই রাগটাও হয়। সুয়েনসন একটা আবেগহীন অপদার্থ। আর কিছুদিন ও দেশে থাকলে আমাকে অঘোরে প্রাণ দিতে হবে। নিজেকে বাঁচাই আমি অতঃপর। চিরবিদায় জানিয়ে দিই দেশটাকে। আমার বইপত্র, আমার যাবতীয় সবপড়ে থাকে সুয়েনসনের বাড়িতে। আমি চরম হতাশা আর শূন্যতার হাত থেকে বাঁচতে দেশ ত্যাগ করি। অনেকবার আমার এও মনে হয়েছে, এই শাস্তি বুঝি আমার প্রাপ্য ছিলো। তোমার ভালো ভালো দাঁতগুলোও যখন ফেলে দিয়েছিলো, তখন তো আমি প্রতিবাদ করিনি। তুমি জানতে তোমার দাঁত ফেলে দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত ওরা নিয়েছে, ভুল নিয়েছে। কোথাও ওদের ভুল হচ্ছে। তুমি অসহায় চোখে তাকিয়েছিলে আমার দিকে। ওদের হাত থেকে বাঁচতে চাইছিলে। কিন্তু আমার হাত থেকে তো বাঁচোনি মা। আমি তো ডাক্তারদের বিশ্বাস করেছিলাম। ওই অজ্ঞ অশিক্ষিত ডাক্তারদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনও প্রতিশোধও নিইনি। প্রতিবাদও করিনি। নিজের জীবনে যখন ঘটলো একই রকম দুর্ঘটনা, ভুল চিকিৎসা, ভুল সিদ্ধান্ত, নিজে যখন একই রকম অসহায় হলাম, নিজে যখন কষ্ট পেলাম অন্যের নির্বুদ্ধিতার কারণে, তখনই তোমাকে আমি অনুভব করলাম সত্যিকারের। নিজের জীবন দিয়ে অনুভব না করলে সম্ভবত কোনও অনুভবই এত তীব্র হয় না।

আমেরিকার হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে গেলে হারভার্ডের এক প্রফেসর আমার খোঁজ করেন, তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান। সুয়ানি হান্ট, বিখ্যাত মহিলা। উনিই দুপুরের খাবার খাওয়াতে খাওয়াতে আমাকে প্রস্তাব দেন হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও ফেলোশিপ করতে চাই কিনা। লুফে নিই প্রস্তাব। কদিন পর যখন চিঠি আসে হারভার্ড থেকে, যাবো কী যাবো নার দোলনায় দুলি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার কোনও পড়ানোর দায়িত্ব পড়লে আমার লেখালেখি নষ্ট হবে। কিন্তু সুইডেন ছাড়ার ইচ্ছেয় জানিয়ে দিলাম রাজি আছি। জে ওয়ান ভিসা, যেটি স্কলার বা প্রফেসরদের জন্য নিয়ে রওনা হলাম বোস্টন শহরেরপাশে কেমব্রিজ শহরে। প্রফেসর ডাক্তার জো গারস্টেনের বাড়িতে দুদিন থেকে একসময় কেমব্রিজে একটা বাড়িও ভাড়া করে নিলাম। প্রফেসর জো গারস্টেন সাহায্য করলেন বাড়ি নিতে। উনি ম্যাসাচুস্টেস-এর মানববাদী দলের একজন। নিজে মানববাদী, তাই বিশ্বের চারদিকে মানববাদী মানুষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ। নারীবাদীদের সঙ্গেও। মানুষের মঙ্গলের জন্য, সত্যের জন্য সংগ্রামে বিশ্বাসী আমি, এই সংগ্রামে, এই ত্যাগে খ্যাতি জোটে হয়তো, যশ জোটে না। সম্মান জোটে কিন্তু প্রাচুর্য জোটে না। যে সাধারণ সাদাসিধে সরল সহজ মানুষ ছিলাম আমি, তেমনই থেকে যাই। টাকা পয়সা আগের মতোই আমার কাছে নিতান্তই অনাকর্ষণীয় হয়ে পড়ে থাকে। হারভার্ডে বসে সেই সব অন্ধকার, আত্মজীবনীর চতুর্থ খণ্ড লিখতে থাকি। মাঝে মাঝে নিউইয়র্কে ইয়াসমিনকে দেখতে যাই। ইয়াসমিন আমার প্রায় এক বছরের হারভার্ডের জীবনে একদিন এসেছিলো বেড়াতে, তাও একদিনের জন্য। প্রচুর জামা প্যান্ট কিনে দিয়ে গেছে আমাকে। সুহৃদ, মিলন, আর ছোটদাও এসেছিলো। সুহৃদকে হারভার্ডের বিশাল লাইব্রেরিটা দেখিয়ে বলেছি যেন সে একদিন বড় হয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়েপড়তে আসে, এই লাইব্রেরিতে বসেপড়তে পারে অনেক দুর্লভ বই। দূর থেকে কিছু বন্ধু বান্ধবও এসেছিলো। ম্যাট চেরি, পুরোনো সেই ইংরেজ মানববাদী বন্ধুটি আমেরিকার এক মেয়েকে বিয়ে করেছে, বউ নিয়ে দুদিন থেকে গেল আমার কাছে। হারভার্ডের বাড়িটি বড়, অতিথিদের জন্য কোনও অসুবিধে হয় না। টাঙ্গাইলের সেই রতন এসেছিলো, ছোটবেলায় যে ছেলেটা আসতো অবকাশে। জার্মানিতে ও রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলো, আমার সাহায্য চেয়ে লিখেছিলো। আমি লিখে দিয়েছিলাম সত্য কথা যে রতনকে আমি চিনি বটে কিন্তু ও আমার কোনও অনুসারি ছিল না, আমার জন্য কোনও মিছিল তাকে আমি করতে দেখিনি। ও চিঠির পর জার্মানিতে তার আর রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া হয়নি। ঘুরে ঘুরে কানাডায় এসে বসত শুরু করেছে। অনেককালপর যোগাযোগ হয়। রতন দেখতে আসে আমাকে বোস্টনে। ওকে বোস্টন থেকে নিউইয়র্কেও নিয়ে যাই। ইয়াসমিনের বাড়িতে দুদিন থেকে ও ফিরে যায় কানাডায়। ওর জন্য খুব মায়া হয়েছিল। এখন ভালো আছে দেখতে পেয়ে ভালো লাগে। পূরবী বসুকে তো তুমি চেন, সাহিত্যিক, আমার শান্তিনগরের বাড়িতে যেতেন। উনিও এসেছিলেন তার স্বামী জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, আর বন্ধু সংবাদপত্রিকার সম্পাদক বজলুর রহমানকে নিয়ে। ওঁরাও থেকেছেন ও বাড়িতে। ওঁদের অনেক বলেছি, আমাকে দেশে ফিরিয়ে নিন। কেউ আমার দেশে ফেরার ব্যাপারে খুব একটা কিছু রা শব্দ করেন না। ওঁরা মনে করেন আমি বিদেশেই ভালো আছি। আমাকে যে কেউ দেখলেই ভাবে আমি বেশ আছি। কিন্তু আমি সত্যি ঠিক কেমন আছি কাউকে বোঝাতে পারি না। দেশে ফিরলে মৌলবাদীরা আমাকে মেরে ফেলবে বা তারা আবার তাদের নোংরা আন্দোলন শুরু করবে, এই ভয় সবার। দেখলে বড় রাগ হয় আমার। হারভার্ডের জীবন আমার অন্যরকম। রক্তের চিনি প্রায় সীমানা ছুঁয়েছিলো বলে স্বাস্থ্যের প্রতি এমন সচেতন হই যে বিকট বেড়ে যাওয়া ওজন প্রচুর কমিয়ে নিই, এতে চিনি বাপ বাপ করে আমাকে ছেড়ে পালায়, রক্তচাপও এত কমে যায় যে ডাক্তারের কাছে গেলে হারভার্ডের ডাক্তার ইসিজি করে বলে, আমার নাকি একটা হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। দুঃসংবাদটি শুনেই আমার হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়েছিল। অ্যাম্বুলেন্সে করে বোস্টনের উইমেন এণ্ড ব্রিঘাম হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয় ওরা। ওখানে বড় হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এসে নানারকম সব পরীক্ষা করেন, পরীক্ষার ফল হাতে নিয়ে বলে দেন, তোমার কিচ্ছুহয়নি। তোমার হৃদপিণ্ড যে কোনও সুস্থ সবল মানুষের হৃৎপিণ্ডের চেয়েও বেশি সুস্থ। বললেন, রক্তচাপ কমাবার ওষুধ আর খেতে হবে না। জিজ্ঞেস করলাম, তবে যে হারভার্ড হেলথ সেন্টার থেকে বললো, হার্ট অ্যাটাক? বললো, ওদের ইসিজি করতে কিছু গোলমাল হয়েছিল। তবে বিদায় দেবার আগে একটা কথা জিজ্ঞেস করেন, তোমার পরিবারে কারও কি রক্তচাপ বেশি? হ্যাঁ বাবার ছিল। ডায়বেটিস? বলি, বাবা মা দুজনের। কবে ওরা মারা গেছেন? বলি। আজকাল ডাক্তারদের কাছে বাবা মার কত বছর বয়সে মৃত্যু হয়েছে, এ খুব জরুরি তথ্য। বাবা মার যে বয়সে মৃত্যু হয়, সন্তানদেরও ওই একই বয়সে মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বলেন, সিগারেট খাও? বলি খাই। দিনে কটা? দুপ্যাকেট। তারপর জিজ্ঞেস করেন, বাঁচতে চাও? বলি, চাই। বলেন, বাঁচতে চাইলে সিগারেট খাওয়া বন্ধ করো। হাসপাতালে পৌঁছেইইয়াসমিনকে খবর দিয়েছিলাম। ইয়াসমিন ওই রাতেই নিউইয়র্ক থেকে মিলন আর সুহৃদকে বোস্টনে পাঠিয়ে দিয়েছিল। ওরা আসায় খুব ভালো লাগে। নিজেকে খুব একা মনে হয় না। জীবনে ওরা না থাকলেও, অন্তত মৃত্যুর সময় পাশে থাকবে এই বিশ্বাস আমার হয়। কিন্তু মৃত্যু নিয়ে আমার বিলাসিতা নেই। সঙ্গে কেউ না থাকলেও আমার চলবে। আমি চাই, আমার জীবনে ওরা পাশে থাকুক। বিশেষ করে ইয়াসমিন আর সুহৃদ। ওদের দুজনের জন্য আমার ভালোবাসা প্রচণ্ড। বোস্টনের হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আমি আর সিগারেট খাইনি মা। তুমি আমাকে কত বলেছো সিগারেট না খেতে। তোমার অনুরোধ শুনিনি। বলেছো সিগারেটের তৃষ্ণা পেলে মুখে এলাচ রাখতে, চুইংগাম চিবোতে। তোমার ওসব অনুরোধ হেসে উড়িয়ে দিয়েছি। আর মৃত্যুর কথা যখন মনে করিয়ে দিল ডাক্তাররা, তখনই সিগারেট খাওয়া বন্ধ করলাম। মৃত্যু জিনিসটাকে আমি সহ্য করতে পারি না। স্টেম সেল রিসার্চ হচ্ছে, তোমাকে বলেছিলাম বিজ্ঞানের এই আবিষ্কারের কথা? বাচ্চাদের নাভিতে অনেক স্টেম সেল থাকে, এক একটা সেল থেকে শরীরের এক একটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সব তৈরি হয়। বাড়তি সেলগুলো বিনা কাজেপড়ে থাকে। ওই সেলগুলো থেকেই গজিয়ে ওঠে নতুন অঙ্গ। ধরো তোমার লিভার যখন নষ্ট হয়ে গেল, লিভারের একটা স্টেম সেল ঢুকিয়ে দিলেই নতুন একটা লিভার তৈরি হয়ে যেত তোমার শরীরে। তোমার শরীরে যেপ্যানক্রিয়াস নামের একটা জিনিস ছিল, সেটাপর্যাপ্তপরিমাণ ইনসুলিন তৈরি করতে পারছিলো না বলে তোমার ডায়বেটিস হয়েছিল। সেই পুরোনো অকেজো প্যানক্রিয়াসটা ফেলে দিয়ে প্যানক্রিয়াসের একটা নতুন সেল লাগিয়ে দিলে নতুন প্যানক্রিয়াস তৈরি হতে পারতো, তুমি দিব্যি সব রোগ শোক ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে পারতে। জরায়ুর মধ্যে থাকাকালীন বাচ্চাদের শরীর তৈরি হতে থাকে এসব সেল থেকে। তবে একটা অঙ্গের জন্য কেবল একটা সেল বা কোষ অপেক্ষা করে থাকে না, অনেকগুলোই থাকে, একটা শুধু কাজে লাগে। বাকিগুলো, যেগুলো কাজে লাগে না, তা অসুখে বিসুখে নষ্ট হয়ে যাওয়া, ক্ষয় হতে থাকা মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে রীতিমত গড়ে দিতে পারে। বিজ্ঞানের এই আশ্চর্য আবিষ্কার মানবজীবনকে অনন্তকাল বাঁচিয়ে রাখবে। ডারউইনের বিবর্তন প্রমাণ যদি মানুষের বিশ্বাস না হয়, তবে এই স্টেম সেলের ঘটনাতেই ধর্ম তাসের ঘরের মতো ভেঙে যেতে বাধ্য। কিন্তু মা, মূর্খরা ধর্মকে বাঁচিয়ে রাখতেপণ করেছে। মূর্খ যতদিন থাকবেপৃথিবীতে, ততদিন ধর্ম থাকবে। আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে না, পৃথিবীতে হাজার বছর থেকে দেখতে চাই কী হয় পৃথিবীর, পৃথিবীর মানুষের, কী হয় এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের। কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে চাইলেই কি আর বেঁচে থাকতে পারবো মা! তোমার মতো, বাবার মতো আমাকেও চলে যেতে হবে একদিন। যারা ধর্মে বিশ্বাসী, কারও মৃত্যু হলে তাদের কোনও কষ্ট হয় না। আল্লাহর জিনিস আল্লাহ নিয়ে যাচ্ছে, সুতরাং দুঃখ পাওয়ার তারা কোনও কারণ দেখে না। পরপারে একদিন তাদের আবার দেখা হবে, এই ভেবে একধরনের সান্ত্বনা পায়। আচ্ছা তুমিই বলো মা, তুমি কি এখন আল্লাহর কছে পোঁছেছে, আল্লাহ ঠিক কেমন দেখতে বলো তো আমাকে! ওখান থেকে পৃথিবীর কারও সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যবস্থা নেই বুঝি! তোমার কি ইচ্ছে হয় না তোমার ভালোবাসার মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে? ইচ্ছে নিশ্চয়ই হয়, তুমি পারো না। তাহলে কিপরকালে মানুষের সাধ আহ্লাদের কোনও মূল্য থাকতে নেই, সব আল্লাহর ইচ্ছেয় ঘটবে! তাহলে নিশ্চিতই একনায়কতন্ত্র চলছে ওখানে। পৃথিবীর একনায়কদের আমরা পছন্দ করি না জানো তো। ডিকটেটরদের বিরুদ্ধে মানুষ কী রকম আন্দোলন করে দেখেছো। পরকালেও দেখবে মানুষ একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে উঠছে। না, মা, পরকাল বিশ্বাসের কোনও কারণ আমার নেই। কারও মৃত্যু হলেই আমার কষ্ট হয়। কেউ, যে কেউ, যদি চলে যায়, জানি ফিরে আসবে না সে কোনওদিন। কোনওদিন আর তার সঙ্গে তার ভালোবাসার মানুষদের দেখা হবে না, কথা হবে না। এ আমাকে কষ্ট দেবে না কেন, বলো! অবিশ্বাসীদের কষ্ট অনেক বেশি। হারভার্ডে থাকাকালীন স্টিভ লেসির মৃত্যু আমাকে দেখতে হল। খুব বড় জাজ বাদক ছিলেন, থেলোনিয়াস মংকের নামি জাজ দলের সঙ্গে যৌবনে বাজাতেন। শুরু থেকেই সপ্রানো বাজাতেন স্টিভ। আমেরিকায় জন্ম। ইহুদি। ইওরোপে থেকেছেন বহু বছর। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, যখন আমি জার্মানিতে। আমার অনেকগুলো কবিতা, যেগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে, সেগুলোতে সুর দিয়ে সাত জন জাজ বাদক নিয়ে সারা পৃথিবীতে গেয়েছেন। স্টিভের সুর দেওয়া গান গেয়েছেন সুইজারল্যান্ডের মেয়ে ইরেন এবি। স্টিভ আর ইরেন বেশি বয়সে বিয়ে করেছেন। জার্মানিতেই ওঁদের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে আমার তখনই। তারপর ওঁরাপ্যারিসে চলে যান। দুবছর পর আমিও প্যারিস থাকতে শুরু করি। ওঁদের সঙ্গে দেখা হতো প্রায়ই। আবার প্যারিস থেকে বোস্টনে চলে যান ওঁরা, আর তার পর পরই আমিও বোস্টনের পাশের শহর ক্যামব্রিজ শহরে ডেরা বাঁধি। কী আশ্চর্য যোগাযোগ! হারভার্ড থেকে প্রায়ই চলে যেতাম ওঁদের বাড়িতে। স্টিভ তখন নিউ ইংলেণ্ড কনজারভেটরিতে সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে চাকরি করছেন। ওইসময় একদিন ধরা পড়ে স্টিভের লিভার ক্যানসার। স্টিভ খুব ভালোবাসতেন আমাকে। ম্যাকআরথার জিনিয়াস পুরস্কার পাওয়া এত বড় একজন সঙ্গীতশিল্পী কিনা আমার মতো এক ছোট কবির এতগুলো কবিতা গানে রূপ দিয়ে ইওরোপ আমেরিকায় বড় বড় থিয়েটারে গাইছেন। মাঝে মাঝে স্বপ্নের মতো মনে হয় এই ঘটনাগুলো। বিশ্বাস হতে চায় না সত্যি সত্যি ঘটছে এসব। স্টিভের ক্যানসার ধরা পড়ার পর দিব্যি আছেন। সপ্রানো বাজাচ্ছেন, বইপড়ছেন, সিনেমা দেখছেন, লোকের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলে বলেন, দিব্যি আছি। কী করে যে পারেন মৃত্যুর মতো বীভৎস কিছুকে মেনে নিতে। স্টিভ কোনও ধর্ম বিশ্বাস করেন না। অসাধারণ এক দার্শনিক তিনি। স্টিভের সঙ্গে সময় কাটাতে যখনই সুযোগপাই, যাই। খুব বেশিদিন স্টিভকে কষ্ট করতে হয়নি। শরীর কেমন কেমন করছে বলে হাসপাতালে গেলেন, আর ফেরেননি। আমি ভেবেছিলাম তোমার মৃত্যুর পর আর কারও মৃত্যুতে আমার কষ্ট হবে না। কিন্তু স্টিভের জন্য হয়। একসময় যে মানুষটি আমার খুব কাছের মানুষ ছিলেন, সেই নিখিল সরকারেরও শুনি ফুসফুসে ক্যানসার হয়েছে। ফুসফুস থেকে মাথায় উঠেছে ক্যানসার। মৃত্যু সামনে এসে দাঁড়ালে মানুষ যোদ্ধা হয়ে ওঠে। নিখিল সরকারকে কাঁদতে বা হাহাকার করতে দেখিনি। বরং নিজের অপ্রকাশিত লেখাগুলো প্রকাশের ব্যবস্থা করলেন, জীবনে যে কাজগুলো করার স্বপ্ন দেখে ছিলেন, তাড়াহুড়ো করে তার সবটা না হলেও কিছুটা করে নিলেন, নিপাট গুছিয়ে নিলেন সব। তোমার কোনও কিছু ছিল না গুছোবার। নাহলে তুমিও হয়তো গুছিয়ে নিতে। তোমার ছিল না কিছু কাউকে দেবার, না হলে দিয়ে যেতে। শূন্য হাতে সারাজীবন ছিলে, শূন্য হাতে গেলে। তোমার মৃত্যু আমাকে পার্থিব জিনিসপত্রের প্রতি আমার সব মোহ জন্মের মতো ঘুচিয়ে দিয়েছে মা। আমার এখন প্রচুর টাকা খোয়া গেলে, বা যা কিছু অর্জন উপার্জন সব হাওয়া হয়ে গেলেও কিছু কষ্ট হয় না। আমি অমরত্বে বিশ্বাস করি না। আমি আমার লেখার মাধ্যমে বা সন্তানের মাধ্যমে, বা কোনও কিছুর মাধ্যমে বেঁচে থাকবো, এই ভেবে আমার কোনও সুখ হয় না। জীবন যতদিন আছে, ততদিনই যা পাওয়ার পাবো। ভালোবাসা ছাড়া আর কোনওকিছুর গুরুত্ব আমার কাছে নেই। সাধারণ মানুষের যে ভালোবাসা জোটে, ওতেই আমার মন ভরে। নিখিল সরকারের মৃত্যু আমাকে কাঁদিয়েছে। কাছের মানুষগুলো একে একে চলে যাচ্ছে মা। যারা ভালোবাসতেন, তাঁদের অনেকেই আর নেই। অন্নদাশংকর রায় নেই। শিবনারায়ণ রায় নেই। বড় খালি খালি লাগে এই জগৎ। ভেবেছিলাম তোমার মৃত্যুর পর আর কারও মৃত্যু আমাকে কষ্ট দেবে না। কিন্তু ভুল ভেবেছিলাম মা। সবার মৃত্যুই আমাকে কষ্ট দেয়।

.

হারভার্ড থেকে যে বছর গেলাম কলকাতার বই মেলায়, সে বছর আমার আত্মজীবনীর তৃতীয় খণ্ড দ্বিখণ্ডিত পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিষিদ্ধ করেছে। একই বই ক নামে বেরিয়েছিলো বাংলাদেশে, বেশ কিছুদিন আগে সেটিও নিষিদ্ধ হয়েছে। কলকাতার মেলায় আত্মজীবনীর চতুর্থ খণ্ড সেই সব অন্ধকার বইটার উদ্বোধন হলো, এই বইও বাংলাদেশে প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। পৃথিবীতে কোথাও কোনও লেখক পাবে না, যার এতগুলো বই নিষিদ্ধ। বাংলাদেশ ছাড়া কোথাও কোনও দেশ তুমি পাবে না যে দেশে বই নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়নি। পৃথিবীর কোথাও তুমি এমন অসম্ভব ঘটনা দেখবে না, যেখানে লেখক-বুদ্ধিজীবীরা বই নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারকে অনুরোধ করেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়ান। পশ্চিমবঙ্গে নিষিদ্ধ দ্বিখণ্ডিতর জাল বই বেরিয়ে গেছে। বই বাজেয়াপ্ত করার বুদ্ধি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, তাঁকে পঁচিশ জন লেখক-বুদ্ধিজীবী দিয়েছেন। দ্বিখণ্ডিত লেখার জন্য সৈয়দ শামসুল হক বাংলাদেশে আমার বিরুদ্ধে এক কোটি টাকার মানহানির মামলা করেছেন। তাঁর রাগ, তাঁর শালির সঙ্গে তাঁর গোপন সম্পর্ক ফাঁস করে দিয়েছি। কলকাতার এক ছোটখাটো কবিও একই কাণ্ড করেছে। সেও এককোটি টাকার মানহানির মামলা করেছে। মানহানির উকিল বললেন, কবিটি আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে ওর সঙ্গে আমার দুদিনের ওই আকস্মিক সম্পর্কের কথা ফাঁস হয়ে গেছে বলে নয়, তার হিন্দু বিরোধী মানসিকতা ফাঁস হয়েছে বলে।

.

সুযোগ পেলেই কলকাতা চলে যাই। ঝুনু খালা কলকাতায় আমাকে দেখতে আসে। ঝুনু খালাকে পেয়ে আমার মনে হয়েছে যেন তোমাকেই পেয়েছি। ঝরঝর করে ঝুনু খালা কাঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরে! জানিনা আমার জন্য কাঁদে, নাকি তোমার জন্য। কলকাতার একটা হোটেলে আমি অনেকদিন ছিলাম। ওখানে ঝুনু খালাও ছিল আমার সঙ্গে। ঝুনু খালার রিউমাটয়েড আরথ্রাইটিস সারাবার জন্য বড় ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। তাকেও শারীরিক মানসিক সুস্থতা দিতে যা কিছু করার সব করি। যেখানে যাই, সব জায়গায় সঙ্গে নিয়ে যাই ঝুনুখালাকে। ভারতের সিকিম নামের পাহাড়ি এলাকায় ঝুনু খালাকে বেড়াতে নিয়ে গেছি। লক্ষ করি, ঝুনু খালা তোমার বোন হলেও তার আর তোমার মধ্যে এক পাহাড় পার্থক্য। প্রিয়জনের মৃত্যু মানুষকে পাথর করে তোলে, আবার কিছু মানুষ যেমন ছিল, তেমনই রয়ে যায়। ঝুনু খালা আগের মতোই আছে, হাসিখুশি, ঝকঝকে। আরথ্রাইটিস নিয়ে খুব একটা দুর্ভাবনা নেই। ঝুনু খালার সঙ্গেও আমি তোমাকে নিয়ে কথা বলি না। মাঝে মাঝে ঝুনু খালা হয়তো বলতে শুরু করে কিছু আমি থামিয়ে দিই। তোমার না-থাকার কষ্টকে আমি কারও কাছে বলে হালকা করতে চাই না। কষ্টটা যেমন আছে থাক। কষ্টটা আমার একার। আর যা কিছু দুঃখ সুখ ভাগ করি না কেন, এই কষ্টটাকে কারও সঙ্গে আমি ভাগ করি না। ফকরুল মামা তার মেয়ের অসুখ দেখাতে কলকাতার হাসপাতালে ছিল কদিন। অনেক আগেই আমার কাছে এক লাখ টাকা ধার চেয়েছিলো। সেদিন সেই টাকার কথাটা তুললে পাঁচশ ডলার ছিল হাতে, দিয়ে দিই। ধার নয়, এমনিতেই দিই। এ কারণে আরও, যে, তোমার অসুখের সময় ঢাকায় যখন ছিলে, তোমাকে দেখতে নিয়মিত আসতো। তোমার হয়তো খারাপ লাগবে শুনে যে ফকরুল মামা টাকা চাইছে। কিন্তু মা, তোমার মতো কজন আছে যে দিতে চায়, নিতে চায় না? ছটকুও এসেছিল। বউএর জন্য অনেক কিছু কিনে নিয়ে যায়। নানির শাড়ি কেনার জন্য কিছু টাকা দিই। নিজের অনেক শাড়িও দিয়ে দিই গরিবদের দিতে। দিতে আমার তোমার মতোই ভালো লাগে। কারও কাছ থেকে কিছু আমার চাওয়ার নেই। আমি না পেতে জানি। তুমিও যেমন না পেতে জানতে। এর আরও দুবছর পর আবারও কলকাতায় যখন আমি, দাদা, ঝুনু খালা, বড় মামা, বড় মামার দুই ছেলে বিক্রম আর রুদ্র, ছটকুসবাই আমার সঙ্গে দেখা করতে কলকাতা এসেছিলো, কীযে ভালো লেগেছিলো আমার! যেন এক ঝাঁক তুমি এসেছো। তুমি ছিলে না ওই ভরা আসরে, কিন্তু তুমি ছিলে মা। তোমার হয়ে আমি ছিলাম। বড়মামা একদিন অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমার মুখের দিকে, বললো, তোকে একেবারে ঈদুনের মতো দেখতে লাগছে। শুনে, যেন শুনিনি, আমি বাথরুমে চলে যাই, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখটা দেখি, দেখতে দেখতে চোখের জলও দেখি আমার। অনেকক্ষণ দেখি।

আমি জানিনা নিজে ডাক্তার বলে, নাকি বাবা আর তোমার মৃত্যু আমাকে এত ভয় পাইয়ে দিয়েছে যে চাইনা কারও অসুখ হোক, কেউমরে যাক। যাদের ভালোবাসি তাদের সামান্য অসুস্থতার খবর পেলে আমি অস্থির হয়ে উঠি। বড় মামাকে ডাক্তার দেখিয়ে দিই। রক্তের চিনি কমিয়ে রাখার জন্য দিনরাতপরামর্শ দিই। আসলে ডায়বেটিস যাদের আছে, তাদের বোধহয় অত নিয়ম কানুন মানতে ইচ্ছে করে না। সবাই এমন নয়। তুমি মানতে। আর তো কাউকে দেখিনা যে মেনে চলে। বেঁচে থাকার জন্য তোমার যে প্রচণ্ড ইচ্ছে ছিল, এই ইচ্ছে সবার মধ্যে নেই। তুমি অত যে ভুগতে জীবন নিয়ে, তারপরও চাইতে বেঁচে থাকতে। তুমি কি খুব ধার্মিক ছিলে! ধর্ম তো তোমাকে বলে, মরে গেলেই তুমি সোজা আল্লাহর কাছে পৌঁছে যাবে, আর কোনও দুর্ভাবনা তোমার নেই। কিন্তু মৃত্যু নিয়ে তোমার দুর্ভাবনা ছিল। তোমার সব ভাই বোনদের মধ্যে বড় মামাকে আমি সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করি। মানুষটার যুক্তি তর্ক, মানুষটার আদর্শ সেই ছোটবেলা থেকেই আমার পছন্দ। কদিন কলকাতায় কাটিয়ে কলকাতা থেকে শাড়ি কাপড়, শাল এসব কিনে সবাই ফিরে যায় দেশে। ছোট খাটো সাংসারিক আর ব্যবহারিক জিনিস থেকে মানুষের মন ওঠানো খুব সহজ কথা নয় মা। আমি সেই জায়গায় এসে পৌঁছে গেছি, যেখানে জিনিসপত্রের জন্য কোনও মোহ থাকে না। চারদিকের আর কাউকে দেখি না মোহ থেকে মুক্ত হতে। সবাইকে আমি ভালোবাসা বিলিয়ে দিই। যা চাই, তা নিতান্তই ভালোবাসা, অন্য কিছু নয়। তবে মাঝে মাঝে কষ্ট হয়, এই মামা খালারা কেউ আমাকে কখনও দূর বিদেশে একা পড়ে থাকি যখন, ফোন করে জিজ্ঞেস করে না কেমন আছি। দেশ থেকে কারও ফোন আমি পাই না। দাদারাও খোঁজ করে না। আমি বেঁচে আছি কী মরে গেছি, কারও জানার প্রয়োজন হয় না। এরা কি সত্যিই আমার আত্মীয়! যে যার জীবন নিয়ে চমৎকার বেঁচে আছে। যদি আমি স্বার্থপর হতাম, হয়তো চমৎকার আমিও বেঁচে থাকতে পারতাম। কিন্তু পারি না মা। তোমার রক্ত বইছে আমার শরীরে। ভালো থাকা আমাদের জন্য নয়। মা, আসলেই কি ওরা চমৎকার বেঁচে আছে! নাকি আমি নদীর এপারের মতো, ওপারেই যত সুখ আছে বলে আমার বিশ্বাস! ওরাও হয়তো ভাবে, আমি ওদের ভুলে থাকি। ওরাও হয়তো ভাবে, আমার জাঁকজমকের জীবনে আমি চাইনা ওদের মতো ছাপোষা লোকদের সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করতে! অভিমান আমি করি, নাকি ওরা করে, বুঝি না।

.

আমার ইচ্ছে করে মামা খালাদের সবার অভাব আমি দূর করি। ওরা তোমারই ভাই বোন। ভালো তো তোমাকে ওরা কিছু হলেও বাসতো। শুধু তোমার ভাই বোন বলে যে ওদের আমি ভলোবাসি নয়। কাকা ফুপুদের চেয়েও মামা খালাদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই আমার ঘনিষ্ঠতা বেশি। আমি জন্মেছি ওদের বাড়িতে। শৈশব কেটেছে ওদের কোলে কাখে, ওদের সঙ্গে উঠোনে মাঠে সারা বিকেল খেলে, একই খাবার খেয়ে, ভূতের গল্প শুনে, একই ইস্কুলে পড়ে। ওদের কারও দুঃখ দেখলে মন আমার কাঁদবে না কেন! আশ্চর্য কী, জানো মা, ওদের সঙ্গে দেখা হলে মনে হয় না যে আমাদের দেখা হয়নি অনেক বছর, সেই আগের মতো কথা বলি, সেই শৈশব কৈশোরের মতো। অবশ্য বয়স দেখলে চমকে উঠি, ছটকুর পাকা চুল দেখে, শরাফ মামার হাড়গিলে শরীর দেখে, ফেলু মামার হতাশা দেখে বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠেছিলো। ওদের অভাব ইচ্ছে করলেও ঘোচাতেপারি না আমি। শুধু তোমার ভাইবোনের নয়, ইচ্ছে করে তোমার আদরের ওই গরিব ভিখিরিদের দারিদ্র ঘুচিয়ে দিই। কিন্তু কী করে পারবো দূর থেকে, ওদের কাছে পৌঁছোনোর ক্ষমতা আমার নেই। কলকাতায় গিয়ে গরিবদের দুহাত ভরেদান করি। ওখানেও তুমি চারদিকে গরিব দেখতে পাবে। পৃথিবীর সব দেশেই গরিব আছে। গরিবদের জীবন পৃথিবীর সব দেশেই প্রায় একইরকম। তুমি আমার ভবিষ্যতের কথা ভাবতে। আমার সে কথা ভাবতে ইচ্ছে করে না। ভবিষ্যৎ–এই ব্যাপারটাকে আমি আর বিশ্বাস করি না। আমার এক অতীত ছিল। আর আছে এক বর্তমান। অতীতই আমার সম্পদ। বর্তমানটা আমি শুধু যাপন করি। তোমার মৃত্যু আমাকেপার্থিব জীবন থেকে কতটা যে দূরে সরিয়েছে, কতটা নির্মোহ করেছে, তা না দেখলে তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না। জীবনে কোনও চাওয়া নেই আমার আর। শুধু দেশে ফিরতে চাই, তুমি আমার দেশে ফেরা চাইতে বলে। তুমি নেই বলে দেশে ফেরার ইচ্ছেটা অনেকটা উবে যায়, কিন্তু যেহেতু তুমি চাইতে ফিরি, ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরি, সেই ঘরের মেয়েটি তার ঘরে ফিরে তোমার স্বপ্নপূরণ করতে চায়। দেশের দুয়ার যেহেতুবন্ধ, কলকাতায় বসবাস শুরু করেছিলাম, সে আরও অনেক পরে। কলকাতায় দাদা তার মস্ত এক অসুখ নিয়ে এসেছিলো। হাঁটা চলা করতে পারতো না, কথা বলতে পারতো না ভালো করে। যত বড় বড় ডাক্তার আছে কলকাতায়, সবাইকে দেখিয়ে তার চিকিৎসা করার ব্যবস্থা করি। হ্যাঁ মা, কাড়িকাড়ি টাকা খরচ করি খুব দামি সব চিকিৎসায়। জীবন ঢেলে দিই এই দাদার জন্য, যে দাদা তোমার চিকিৎসার জন্য এক পা নড়তে চায়নি, যে দাদা বাবার মৃত্যুর জন্য দায়ী। তারপরও কী হয় জানি না, দাদাকে অসুস্থ দেখে আমি স্থির থাকতে পারি না। বুঝি এ তোমার কারণেই, তোমার যে চরিত্র আমার ভেতরে স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছে, সেখানে উদারতা ছাড়া, ক্ষমা ছাড়া, মায়া মমতা ছাড়া, শর্তহীন ভালোবাসা ছাড়া কিছু নেই। তুমিও তো সেই দাদাকেই ভালোবাসতে, যে তোমাকে ভালোবাসেনি। তুমিও তো সেই মানুষদের কাছে টেনে নিতে, যারা তোমাকে দিনের পর দিন অপমান করেছে। তোমার সেই চরিত্রকে আমি নিন্দা করি বটে, কিন্তু ভেতরে বুঝি, চরিত্রটি আমারও। যে মৌলবাদীরা আমার মুণ্ডু চেয়ে মিছিল করে, সম্ভবত ওদের কাউকে বিপদে পড়তে দেখলে আমিই গিয়ে সবার আগে ওদের বাঁচাবো। মুসলমানদের মধ্যে নাস্তিক বা খুব প্রগতিশীল, সমানাধিকারে, মানববাদে বিশ্বাসী না হলে আমার মতের সঙ্গে একমত তো হবেই না বরং তীব্র নিন্দাই করবে। গোটা একটা সমাজের মানুষের মানসিকতার এই হাল দেখলে অবশ্যই মন খারাপ হয়ে যাওয়ার কথা। তারপরও দেখ, যখন দেখলাম হিন্দু মৌলবাদী দ্বারা ভারতে গুজরাতের মুসলমানরা আক্রান্ত হয়েছে, উদ্বাস্তু হয়েছে হাজার হাজার গরিব মুসলমান, আমি উঠে দাঁড়ালাম। আমি তো মিছিল মিটিং করায় পারদর্শী নই। কলকাতায় বসে কবিশঙ্খ ঘোষ গুজরাতের ওই আক্রান্ত মুসলমানদের সাহায্য করার জন্য টাকা তুলছিলেন, শঙ্খ ঘোষের হাতে দশ হাজার টাকা দিয়ে এসেছি। বলেই দিয়েছি, প্রচারের জন্য নয়। তুমি যেমন দিতে মানুষকে, তোমাকে লোকে ভালো বলুক বা বাহবা দিক, সে কারণে কিন্তু দিতে না। তোমার মন কাঁদতে মানুষের জন্য, তাই দিতে। মানুষ যদি কষ্ট পায়, সে মানুষ হিন্দু হোক, বৌদ্ধ হোক, খ্রিস্টান বা মুসলমান হোক, পাশে দাঁড়াই। তাদের ধর্ম পরিচয়কে আমি কোনওদিন মূল্য দিইনি। মানুষ পরিচয়কেই দিই। খুব বেশি সামর্থ্য আমার নেই। যেটুকু আছে সাধ্য, তার মধ্যে অথবা তার বাইরেও করি বা করার চেষ্টা করি। মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় যে কাজটি করি, তা আমার লেখা। কেউ লেখা বোঝে, কেউ বোঝে না। কিন্তু জীবনের ওপর নেমে আসা শত ঝড় ঝঞ্ঝার মধ্যেও লেখা আমি বন্ধ করতে পারি না। তুমিও তোআমার লেখা ভালোবাসতে, শুধু ধর্মকে আক্রমণ করে লিখতে আমাকে বারণ করতে। কিন্তু মা, মেয়েদের স্বাধীনতার কথা লিখতে গেলে সবচেয়ে বড় যে বাধা, ধর্ম, এবং পুরুষতন্ত্র, এদুটোর বিরুদ্ধে কথা না বললে চলবে কেন বলো। বাধা রেখে কি স্বাধীনতা বা অধিকার আদায় করা যায়! বড় বাধার পরও শত শত ছোট বাধা আছে, সেগুলো ডিঙোনোও তো চাট্টিখানি কথা নয়। ছোট ছোট বাধার বিরুদ্ধে বললে লোকেরা খুব আপত্তি করে না। বড় বাধার কথা বললেই বড় বড় লোকেরা আমার লেখায় বাধা দিতে শুরু করে, আমার জীবন তছনছ করে দিতে তাদের কোনও দ্বিধা হয় না। ধর্মের সমালোচনা আর না করলেই যে ধর্মান্ধ, ধার্মিক বা ধর্মব্যবসায়ীরা আমাকে মুক্তি দেবে তা আর হবার নয়। ওদের স্বার্থ উদ্ধার করতে, ওদের শক্তি প্রদর্শন করতে একটা সমাজকে পিছনে টেনে নেওয়ার জন্য, পুরো জগতে ধর্মের আইন কায়েম করতে ওরা আমাকে হত্যা করতে চাইবেই অথবা আমার মুণ্ডু কেটে নেওয়ার জন্য, বা আমার ফাঁসির জন্য রাস্তায় নামবেই। এব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। আমাকে খুন করে যে কোনও মূর্খ ধর্মান্ধ বেহেসতে যেতে চাইবেই। সারা পৃথিবীতে তাই ঘটছে। ভারত বা বাংলাদেশে কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে না। আমেরিকার টুইন টাওয়ারের পতনের কথা তুমি জানো না। মুসলমান মৌলবাদীরা আল্লাহর নাম নিয়ে শত শত নিরপরাধ মানুষকে ওই টুইন টাওয়ারের ভাঙনের মধ্যে ফেলে মেরেছে। আমি জানি, ওদের ওই অপকর্মের কথা শুনলে তুমি শিউরে উঠতে। তুমি মরে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য দুঃখ পেতে। তোমার কাছেও তো মানুষ সবচেয়ে বড়, যে ধর্মের বা যে লিঙ্গেরই সে হোক না কেন। হিন্দুদের, কাফেরদের ঘৃণা করার জন্য তোমাকে পীরবাড়ি থেকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তুমি মন থেকে কখনও পারোনি ওদের ঘৃণা করতে। পাশের বাড়ির ডলি পালকে ডেকে এনে গল্প করতে। ওর দুরবস্থায় ওকে সাহায্যও করেছে। এসব আমার নিজের চোখে দেখা। তুমি মানুষ ছিলে মা। সব ধর্মের ঊর্ধ্বে ছিলে, তুমি নিজেই জানতে না যে, ছিলে। তুমি যদি কোরানের অর্থ ঠিক ঠিক জানতে, হয়তো ওই ধর্ম ছেড়ে যোদ্ধার মতো বেরিয়ে আসতে। তুমি তো মূর্খ ছিলে না মা। বুদ্ধিমতী ছিলে। কিন্তু সমাজের নারীবিরোধী সংস্কারের শেকলে বন্দি হতে হয়েছিল তোমাকে, যে বন্দিত্ব থেকে মুক্তি কিছুতেই পেতে পারোনি।

.

আমার জীবন সম্পূর্ণই একার জীবন মা। রাজনৈতিক, সামাজিক, বৈষয়িক, ব্যক্তিক, শারীরিক, মানসিক, পারিপার্শ্বিক সব প্রলয় আমাকেই একা সামলাতে হয়। অনেকে বলে, পাশে আছি। এ ঠিক পাশে থাকা বলে না। তারা আমাকে সমর্থন করে, ভালোবাসে, তা ঠিক। এ মনে কিছুটা আনন্দ দেয় বৈকি, কিন্তু দুর্দশায় যখন আমি আক্রান্ত, তখন কেউই আসলে পাশে থাকে না। মনের জোর আমার কম হলে অনেক আগেই আমি মরে যেতাম মা। অথবা যেভাবে বাঁচতাম, সেই বাঁচার কোনও মানে থাকতো না। তোমাদের আমি পুরোনো পন্থার মানুষ বলে কত গালি দিয়েছি। অথচ দেখ, বিয়ে করলাম, ছাড়লাম, বিয়েতে মত হয়তো দাওনি, কিন্তু বিচ্ছেদে বা তালাকে কোনও দ্বিমত তোমাদের কারওর ছিল না। সাধারণত অন্য যে কোনও পরিবারেই স্বামী যেমনই হোক, যত অযোগ্য এবং পাষণ্ডই হোক, কেউ চায় না, বিচ্ছেদ হোক। কায়সারের সঙ্গে বিয়ের বাইরে সম্পর্ক মেনে নিতে তোমার তো কোনওদিন কোনও অসুবিধে হয়নি। তুমি তো চিরকালই সতী সাধ্বী ধর্মকর্ম করা নীতি আদর্শের মানুষ ছিলে। কেন একদিনের জন্যও আপত্তি করোনি! আমার যশ খ্যাতি ছিলো বলে আমাকে ভয় পেতে! না মা, আমার মনে হয় না। আমার মনে হয় তোমার কাছে আমাদের যৌনসম্পর্ককে অযৌক্তিক, অসুন্দর, অবৈধ বলে মনে হয়নি। তুমি বোরখা পরতে, জানি না কেন পরতে, অভ্যেস হয়ে গিয়েছিলো বলে হয়তো। অবশ্য শেষের দিকে কোনও বোরখাপরোনি, সুইডেনে, আমেরিকায়, তারপর দেশেও যে বাইরে বেরোলে, কোনও বোরখার চিহ্ন দেখিনি। মা, তুমি খুব আধুনিক মানুষ ছিলে। সম্ভবত বাড়ির সবার চেয়ে। খুব গভীর ভাবে দেখতে গেলে, আসলে অনেক ক্ষেত্রে বাবার চেয়েও বেশি আধুনিক ছিলে তুমি। বাবা হয়তো বিজ্ঞানমনস্ক বেশি ছিলো তোমার চেয়ে। ক্ষুদ্রতা, হীনম্মন্যতা, কূপমণ্ডুকতা এসবের অনেক ঊর্ধ্বে ছিলে তুমি। বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও তোমার অসম্ভব মনের জোর ছিল। কিন্তু মনের জোরে স্বামীর সংসার ছাড়তে পারোনি। আমার মনের জোরের সঙ্গে অর্থের জোর ছিলো বলে পেরেছি। তা না হলে স্বামীর আদেশ নির্দেশ মেনে দুতিন ছেলে মেয়ের মা হয়ে সংসারের ঘানি টানতে হতো কোথাও, বাংলাদেশের কোনও অজপাড়াগাঁয়ে, অথবা শহরে বন্দরে কোথাও। এটা ঠিক, সাংসারিক অশান্তি থাকলেও কোনও রাজনৈতিক অশান্তি থাকতো না।

.

তুমি নেই। তারপরও জগৎ চলছে। তোমার স্বজন আত্মীয়, চেনা পরিচিতরা যে যার মতো আগের মতোই জীবন যাপন করছে। তুমি নেই বলে কারও জীবন কোথাও থমকে নেই। ইয়াসমিনের মানসিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। সুখের ছিটেফোঁটা ওর সংসারে নেই। ভালোবাসা ক্রমশ ভালোবাসাহীন হিংসুক প্রাণী হয়ে উঠেছে। হতাশার গহ্বরে তলিয়ে থাকে ইয়াসমিন, ওকে সবরকম চেষ্টা করেছি জীবনের দিকে ফেরাতে। বাড়ির অস্বাস্থ্যকর চিৎকার চেঁচামেচির পরিবেশেই ও অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ফ্লাসিং নামের ওই এলাকায় বছরের পর বছর থেকে যাচ্ছে, একই বাড়িতে, আরশোলা, ছারপোকা আর ইঁদুরের সঙ্গে, অসুখীআর হতাশাগ্রস্ত মানুষগুলোর সঙ্গে। ওর বেড়ানো বলতে, জ্যাকসন হাইটসে বাজার করতে যাওয়া, বা অন্য কোনও দোকানে কেনাকাটা করতে যাওয়া। আজকাল ওকে জোর করেও কোথাও নিয়ে যাওয়া যায় না। কোনও সিনেমা থিয়েটারে, কোনও লেকচারে, বা কনসার্টে, কোথাও নিতে পারি না। অথচ এই ইয়াসমিন টই টই করে ময়মনসিংহ শহর ঘুরে বেড়াতো। কত বন্ধু ছিল ওর। এখন কোনও বন্ধু নেই। মেয়েটা কবিতা আবৃত্তি করত, কী অসাধারণ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতো। এখন কবিতা, গান, বই সব ওর জীবন থেকে সহস্র মাইল দূরে। আমেরিকায় ভালো কোনও চাকরি করার চেষ্টা করেনি। ভালোবাসার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে একরকম। নিজের জীবন নষ্ট করে মেয়েকে মানুষ করতে গিয়ে দেখে নিজের জীবনও গেছে, মেয়েও মানুষ হয়নি। মেয়ে সারাদিন ইংরেজিতে গালিগালাজ করে মাকে। ইয়াসমিন মনে করে ব্যাপারটা জেনেটিক। মিলনের জিন পেয়েছে ভালোবাসা, দেখতেও মিলনেরমতোও, স্বভাব চরিত্র ব্যবহার সবই মিলন। সুবুদ্ধি, কুবুদ্ধি, চতুরতা, হীনম্মন্যতা সব এক। ভালোবাসা একসময় সুন্দরপদ্য লিখতো, ওকে প্রচুর সাহিত্যের বই কিনে দিয়েছিলাম, না, একটারও পাতা উল্টে দেখেনি। সুহৃদও ভালো লিখতো, খুব ভালো ছিলো কবিতা লেখার হাত। ছবি আঁকতে চাইতো বলে ছবি আঁকার যাবতীয় সরঞ্জাম ওকে দিয়েছিলাম। না কোনওটাই বেশিদিন চালালো না। ওকে প্রেরণা দিয়ে গেছি বছরের পর বছর। শেষ অবধি দেখেছি কারও শিল্পী বা সাহিত্যিক হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি সত্যিকার কোনও আকর্ষণ কারওর নেই। পরিবারে একজন লেখক আছে, এ নিয়ে কোনও গৌরব কারওর নেই। আমার লেখা কেউ পড়েও দেখেনি, আমাকে নিয়ে কারও উৎসাহও নেই। ছোটদা আর গীতার রক্ত সুহৃদের ভেতরে। শুধু রক্তই তো সবনয় মা, পরিপার্শ্ব, সমাজ, সংস্কৃতি এগুলোও একজনের গড়ে ওঠার পেছনে বড় ভূমিকা রাখে। কিন্তু মনে হচ্ছে, পরিপার্শ্ব ছাপিয়ে রক্তটাই আমাদের পরিবারের সবার মধ্যে যেন বেশি কাজ করেছে। সুহৃদ তার বাবা আর মার চরিত্রই পেয়েছে, নিজের কোনও আলাদা চরিত্র নেই ওর। ইয়াসমিন যে জীবনটা যাপন করছে, তা প্রায় একশ ভাগ তোমার জীবন। ইয়াসমিন দেশে ফেরার স্বপ্ন দেখে। ভালোবাসাকে অনেক চেষ্টা করেছে। দেশে ফেরাতে, ও ফিরবে না। ও ফেরে না বলে ইয়াসমিনও ফিরতে পারে না। ভালোবাসা বড় হয়ে কলেজের হোস্টেলে চলে গেলে ভাবছে দেশে ফিরবে, কিন্তু আমি জানি ওর কোথাও ফেরা হবে না। ভালোবাসার টানে ওকে থেকেই যেতে হবে বিদেশ বিভুইয়ে। দেশ তো আসলে শৈশব কৈশোরের স্মৃতি ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু দেশে ফিরলেই কী আর ও দেশ পাবে। যে দেশে মা নেই, সে দেশ আবার কী রকম দেশ মা! ইয়াসমিন ফিরেছিল, হতাশার গভীর গহ্বর থেকে পালিয়েছিলো, পুরোনো বন্ধুদের কাছে, আত্মীয়দের কাছে। হাসি আনন্দে ছিলো, কলকাতাতেও ওকে ঘিরে উৎসবের আয়োজন করেছি। সব উৎসব আনন্দ ছেড়ে ও আবারও আমেরিকায় ছুটে যায় ভালোবাসার টানে। কিন্তু যেই না মিলনের দুর্ব্যবহারের শিকার হয়, আবারও নিঃসঙ্গতার হাঁমুখ ওকে গিলে ফেলতে থাকে। মিলনকে ছাড়াও ওর চলে না, আবার মিলনকে নিয়েও ওর চলে না। দেশে বিদেশে কত কত মেয়ে আমার প্রেরণায় উঠে দাঁড়ায়, নিজের মতো করে বাঁচে। আর জন্ম থেকে যে আমার ছায়ার মতো ছিলো, সেই বোনটিই পারেনা কিছু।

মা, ইয়াসমিন আমাকে ঠিক তোমার মতো করে আদর করে। ও যে আমার ছোট বোন, মাঝে মাঝে ভুলে যাই। যেন মা ও। ঠিক তোমার মতোই কষ্ট ও করে যাচ্ছে প্রতিদিন, স্বামী সন্তান ওর হাড়মাংস জ্বালিয়ে যায়। তারপরও ও থেকে যাচ্ছে ওদেরই আঁকড়ে ধরে। মাঝে মাঝে মনে হয় তোমার আর ওর জীবনে কোনও পার্থক্য নেই। কতবার ওকে বের করতে চেয়েছি বাড়ি থেকে, বলেছি চল দুজনে দুরে কোথাও যাই, শুধু আনন্দ করবো ও রাজি নয়। বলেছি তাহলে বাড়ির সবাইকে নিয়ে চল দূরে কোথাও কোনও পাহাড়ের কাছে, বা সমুদ্রের ধারে চল, মন ভালো লাগবে, ও তবুও যেতে চায় না কোথাও, ওকে এক চুল নড়াতে পারি না বদ্ধ ঘর থেকে। ও ঠিক তোমার মতোই ভাবে আমার টাকা পয়সা যেন খামোকা খরচা না হয়। আমাকে বাঁচাতে চায় ও ঠিক তোমার মতো করে। যেখানেই ছিলাম, যে দেশেই, ইয়াসমিনকে দেখতে গিয়েছি প্রায় প্রতি বছরই। ওকে বের করতে পেরেছি একবারই, জোর করেই, প্রায় টেনে হিঁচড়ে। একটা ভাড়া গাড়ি নিয়ে চলে গিয়েছিলাম অতলান্তিকের পাড় ধরে যত শহর আছে, যত পাহাড় পর্বত, সব কিছুর কাছে, নায়াগ্রা জলপ্রপাতেও নিয়ে গেলাম, জলপ্রপাতের ধোঁয়ার মধ্যে, ও যে কী খুশি হয়েছিলো। তুমি বিশ্বাস করো বা না করো, ওকে আনন্দ দিলে আমার মনে হয়, আমি তোমাকে আনন্দ দিচ্ছি। নিউইয়র্ক শহরের ব্রডওয়ে মিউজিকাল শো গুলোতে জোর করে করে নিয়ে গেছি। পূতিগন্ধময় পরিবেশ থেকে বেরিয়ে ও যেন জীবনের সুঘ্রাণ পায়, সুন্দরের স্বাদ পায়। ইয়াসমিনের বাড়িতে একবার আমার হোঁচট খেয়ে পা মচকে গিয়েছিলো, ও আমাকে শুশৃষা করলো ঠিক তোমার মতো করে। ঠিক তোমার মতোই রান্না করে ও, আমাকে তোমার মতো করেই যত্ন করে খাওয়ায়, মুখে তুলে। আমরা দুজন কখনও তোমাকে নিয়ে আলোচনা করি না। খুব সচেতন ভাবেই করি না। তুমি নেই, এ কথা আমরা ভাবতে চাই না বলে করি না। যেন তুমি আছো কোথাও। দূরে আছো, কিন্তু আছো।

.

দাদা আর ছোটদা দুজনই নিজেদের কিডনি নিয়ে অতি সচেতন। যদিও কিডনিতে কিছুই ঘটেনি, কিন্তু বাবার কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়া ওদের ভীষণ ভয় পাইয়ে দিয়েছে। কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে থাকলে যে খাবারগুলো খাওয়া বারণ, কিডনি সম্পূর্ণ সুস্থ থাকা অবস্থাতেও তারা ওগুলো মুখে তুলছেনা। তুমি মারা যাওয়ারপরও আমার আরইয়াসমিনের আশংকা হয়েছিলে বুঝি আমাদেরও কোলন ক্যানসার হয়েছে। সারাশরীরে মনে হতো, ক্যানসার। ছুটে ছুটে গিয়ে স্তন, জরায়ু, কোলন কোথাও কোনও ক্যানসারের ছিটেফোঁটা কিছু আছে কিনা পরীক্ষা করিয়েছি।

নানি বেঁচে আছে। তবে নানিকে তার নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছে। ফেলু মামার সংসারে আরও জায়গা চাই, সোফা বসাতে হবে, বাড়তি খাট বসাতে হবে, তাইনানিকে একরকম বেরই করে দিয়েছে নানির ঘর থেকে। নানিবাড়ির লাগোয়া উঠোনটার ছোট্ট ঘরটায় যেখানে আমরা ছোটবেলায় একসময় থাকতাম, সেই টিনের ঘরটিতে নানির জায়গা হয়েছে। সারাদিন শুয়ে থাকছে আর নিজের মৃত্যু কামনা করছে। বেঁচে থাকা নানির জন্য এখন লজ্জা। হাশেম মামা নেই, তুমি নেই, টুটু মামাও হঠাৎ একদিন মরে গেল। তিন তিনটে সন্তান বেঁচে নেই, মা এখনও বেশি বয়সেও বেঁচে আছে, এ নানির জন্য লজ্জাই বইকি। অসুখ না থাকলেও অসুখ আছে এমন ভান করতে হয় তাকে, অন্যকে স্বস্তি দিতে। তারপরও নানিকে দেখে লোকে চোখ কপালে তোলে। নানিকে দেখাশোনার দায়িত্ব ছটকুর হাতে। মাঝে মাঝে একটু টাকা পয়সা পাঠাতে চাই নানির জন্য, হয় না মা। যা পাঠিয়েছি এপর্যন্ত, অতি সামান্যই। না মা, নানি আমার কাছে কোনও অর্থকড়ি কখনও চায়নি। নানিকে অনেকদিন ফোনে বলেছি, যেন উঠে হাঁটাচলা করে, যেন পাশের বাড়িগুলোয় বেড়াতে যায়। ছটকুদেরও বলেছি, নানি যে বেঁচে আছে, এ আমাদের সবার জন্য অনেক বড় গর্ব। নানিকে অবহেলা যেন না করে, নানির মৃত্যু কামনা যেন না করে। বলি বটে, কিন্তু নানিকে ওরা যদি বাড়তি বোঝা বলে বিশ্বাস করে, তবে আমিই বা কতটুকু বদ্ধমূল বিশ্বাসের বদল করতে পারবো! তবুও বলি, যদিও সে কথার কোনও মূল্য কারও কাছে নেই। নানির মতো সাহসী মানুষও কী রকম হতাশায় ডুবে থাকে! একটা সভ্য সমাজে মানুষের দীর্ঘকাল বেঁচে থাকাটা রীতিমত উৎসবের ব্যাপার। আর একটা অসভ্য সমাজে যখনই কারও প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, তখনই তাকে খড়কুটোর মতো ফেলে দেওয়া হয়। আসলে অভাব মানুষকে অত ভোগায় না, যত ভোগায় অভাববোধ। অভাবে মানুষ নিষ্ঠুর হয় না; অভাববোধের কারণে হয়। ধনী লোকেরও এই অভাববোধ থাকতে পারে, দরিদ্রের নাও থাকতে পারে। দরিদ্রর যত অভাববোধ দেখেছি, তার চেয়ে বেশি দেখেছি অভাব যাদের নেই, তাদের অভাববোধ। তোমার অভাব ছিল, অভাববোধ ছিল না। তবে সত্যি বলছি মা, নানিকে যতটা সাহায্য করা আমার উচিত ছিল, তার কিছুই করা হয় না। নানি বলে, ওই তোমার মতোই বলে, যেন দেশে ফিরি। চোখ ভিজে যায় শুনে। খুব ইচ্ছে করে নানির কাছে বসেপুরোনো দিনের গল্প করি। শুনি। নানির সঙ্গে গল্প করার সময় কারও নেই। ওই বাড়িটা ভাগ হয়ে গেছে, যে যার ভাগের মধ্যে দেয়াল তুলে দিয়েছে। বাড়ি নাতি পুতিতে গমগম করছে, কারও সময় নেই নানির কাছে এসে দুদণ্ড বসার। একটা ভুলে যাওয়া বাড়তি মানুষ উঠোনের এক কোণে একটা ভাঙা টিনের ঘরে পড়ে আছে। গরমকালে আগুন হয়ে থাকে টিন, আর শীতে অজস্র ফুটো দিয়ে ঠাণ্ডা ঢোকে। নানির জন্য অতি সামান্যই খরচ হয় ছটকুর। নানিরশরীর ঠিক আছেমা, মন ঠিক নেই। অসুস্থতার অভিনয় করতে হয়, মুহুর্মুহু মৃত্যুর কথা বলতে হয় লোককে ভারমুক্ত করতে, লোকের কপালে ওঠা চোখকে কপাল থেকে নামাতে। নানির জন্য খুব কষ্ট হয় আমার। নানি আমাকে অনুরোধ করেছিলো দু সপ্তাহ পর পর যেন তার সঙ্গে ফোনে কথা বলি। দু বছর পার হয়ে যায়, নানিকে ফোন করা হয় না আমার। কেন হয় না জানি না। জীবন বোধহয় এরকমই মা, দূরত্ব আরও দূরত্ব রচনা করে।

ফজলিখালা কেমন আছে জানি না। ফজলি খালাকে সেই যে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলাম, তার পর আর দেখা হয়নি। জীবনে কখনও হয়তো আর ফজলিখালার সঙ্গে দেখা হবে না। রাগ করে তার সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেছিলাম, সে কথা ভাবলে আমার, সত্যি বলছি, মন খারাপ হয়ে যায়। ফজলিখালা কি আমাকে ক্ষমা করবে কখনও? কোনওদিন যদি দেখা হয়, তার দুটো হাত ধরে আমি ক্ষমা চাইবো মা। তার ওইহাত স্পর্শ করলে আমার মনে হতেই পারে তোমার হাতই আমি স্পর্শ করেছি। রুনু খালা কেমন আছে, তাও জানি না। সেদিন শুনেছি রাসু খালু মারা গেছে। আজকাল আত্মীয়দের কেউ মারা গেলেও আর জানানো হয় না আমাকে, অনেকদিন পর হয়তো কারও মুখে শুনি। শুনে সারাদিন মন খারাপ থাকে। হাডসন নদীকে হাডসন মনে হয় না, যেন ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বসে আছি রাসু খালা, রুনু খালা, ঝুনু খালা, তুমি, আর আমি, ভাজা মুড়ি আর গরম চা খেতে খেতে গল্প করছি সেইসব দিনের কথা, একাত্তরের যুদ্ধে শহর ছেড়ে যখন রাসুখালুর গ্রামের বাড়িতে উঠেছিলাম, কী যত্ন করেই না রাসুখালুর বাড়ির সবাই আমাদের খাওয়াতো, রঙিন ফুল আঁকা গ্লাসে জল দিতো খেতে, নিজেদের লেপ তোশক বালিশ দিয়ে আমাদের বিছানা করে দিয়ে ওরা শুধু মাদুরে ঘুমোতো।

.

ঝুনু খালা ভিখারুন্নিসা ইস্কুলে পড়াচ্ছে আগের মতোই। অনেকবার বলেছিলাম ছোটদাকে যে আমার বাড়িতে এখন থেকে ঝুনুখালা থাকুক। আমার বাড়ি খালি পড়ে আছে, ঝুনু খালা থাকলে ঢাকা শহরে তার বাড়িভাড়ার খরচটা বাঁচতো। কিন্তু ছোটদা কিছুতেই চায় না ঝুনুখালা থাকুক আমার বাড়িতে। আসলে শান্তিনগরের ওই বাড়িটা, ছোটদা বিশ্বাস করে, ছোটদার। ছোটদাই সিদ্ধান্ত নেয় ও বাড়িতে কে থাকবে না থাকবে। আমি দূরের মানুষ। মৃত। ছোটদা একরকম আমাকে জানিয়ে দিয়েছে, বুঝিয়েও দিয়েছে, যে, বাড়িটা ওর। যেহেতু আমি মেয়েমানুষ, আমার উপস্থিতি যদি না থাকে ও দেশে, আমি একরকম মৃতই, উত্তরাধিকারসূত্রে বাড়িটা এখন ও পেয়ে গেছে। অথবা জোর যার দখল তার তত্ত্বে ও চলছে। এসব যখন শুনি, দেখি, মনে হয় তুমি বোধহয় পৃথিবী থেকে চলে গিয়ে একরকম ভালোই করেছো। তোমাকে হয়তো আরও কাঁদতে হতো। আমাকেও কাঁদতে হয় মা, যতদিন পৃথিবীতে মেয়েদের, শুধু তারা মেয়ে বলে, কষ্ট সইতে হচ্ছে দেখি, আমি না কেঁদে পারি না। ঝুনু খালার জন্য আমার খুব মায়া হয়। তুমি যখন ছিলে, ঢাকা শহরে তার একটা আশ্রয় ছিলো। তুমিও নেই, আমিও নেই। ঝুনু খালার নিশ্চয়ই খুব একা লাগে।

.

মা, আমার জীবন তছনছ হয়েছে আগের চেয়েও অনেক বেশি। হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট শেষ হলে, যেহেতু বাংলাদেশের দরজা আমার জন্য বন্ধ, কলকাতায় থাকতে শুরু করেছিলাম। যে ভাষায় আমি লিখি, যে ভাষায় আমি কথা বলি, সে আমার মাতৃভাষা, সে তোমার ভাষা মা। এই ভাষা আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলো কলকাতায়। চার বছর থাকার পরপশ্চিমবঙ্গও বাংলাদেশ হয়ে ওঠে। শুধু কলকাতা থেকে নয়, আমাকে ভারত থেকেই তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু জঙ্গি মৌলবাদী আমার বিরুদ্ধে চেঁচিয়েছে বলে কোনও সরকারই আমাকে আর ও দেশে থাকতে দিতে চায় না। বাংলার মেয়ের বাংলায় ঠাঁই নেই। এখন উদ্বাস্তুর জীবন আমার, পৃথিবীর পথে পথে অনাথের মতো হাঁটি। তোমার স্বপ্নটাই ঘুরে ফিরে দেখি, ঘরের মেয়ে কি কোনওদিন ঘরে ফিরবে না! মাঝে মাঝে স্বপ্নটাও খুব ধোঁয়ার মতো, কী চাই বুঝি না, মাটি না মানুষ!

.

মা, আমাদেরও তো যাওয়ার সময় হচ্ছে। যে কোনও সময় যে কোনও দিন হুট করে চলে যাবো। কোথায় যাবো, বলোতো! এরকম যদি হত, কোথাও তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে, তোমার সঙ্গে বাকি জীবন আমি কাটাতে পারবো, পৃথিবীর মায়া তুচ্ছ করে চলে যেতাম। আসলে তুমি যখন গেছ, পৃথিবীর জন্য যে মায়া আমার ছিল, সেটি অনেকটা কাটিয়ে দিয়েও গেছ। এখন যেতে আমারও আর আপত্তি নেই। তুমিহীনপৃথিবীটা বড় ফাঁকা, বড় স্নেহহীন, বড় ভালোবাসাহীন, বড় নিষ্ঠুর, বড় কঠিন, বড় স্বার্থপর। কিন্তু আমি তো ভেতরে ভেতরে জানি, কোনও বেহেসতে বা দোযখে তুমি বা আমি কেউ যাবো না। তোমার সঙ্গে কোথাও দেখা হওয়ার, তোমার সঙ্গে একত্ৰ বাসের কোনও সম্ভাবনা নেই। মরে যাওয়ার কথা ভাবলে আজকাল আর অবাক হই না। একে অসম্ভব কোনও ঘটনা বলেও আর মনে হয় না। যার যাওয়ার সে চলে যায়। তবে যেভাবেই যাই, মা, তোমার মতো এত ভুগতে ভুগতে যেতে চাইনা। স্বার্থপরদের ধারে কাছেও মৃত্যুর সময় থাকতে চাইনা। কোনও একদিন হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মরে যাবো, কোনওদিন কোনও বিমান আকাশে বিস্ফোরণ ঘটাবে, ছাই হয়ে হয়ে উড়ে যাবো বা কোনও মহাসমুদ্রের অতলে বিলীন হয়ে যাবো। যেন কষ্ট না হয়। যেন তোমার মতো শুয়ে থেকে থেকে আমার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা স্বজনদের চোখের অস্থিরতা পড়তে না হয়, যেন দ্রুত মৃত্যু হয়, যেন কেউ কোদাল শাবল আর কাফনের কাপড় হাতে অপেক্ষা করছে দেখতে না হয়। তুমি তো সারাজীবন প্রার্থনা করতে, আমার জন্য বেশি করতে, যেন তোমার আল্লাহতায়ালা আমাকে ক্ষমা করে দেন, যেন আমাকে দোযখে নিক্ষেপ না করেন, যেন দোযখের আগুন থেকে আমাকে রক্ষা করেন। তেমন প্রার্থনাই না হয় কয়রা, এই নিষ্ঠুর পৃথিবী আর এই প্রকৃতির কাছে প্রার্থনা করো যেন মৃত্যু হয় আমার, দ্রুত। যেন আমাকে দেখতে না হয় দোযখের আগুনের চেয়ে যে আগুন বেশি ভয়ংকর, সে আগুন। যাদের ভালোবাসি, তাদের নির্লিপ্তির আগুন, তাদের ভালোবাসাহীনতার আগুন।

জানি না কোথায় আছে, কেমন আছো। জানিনা কোথাও আদৌ আছে কিনা। এই চিঠিটা তুমি পড়ো বা না পড়ো, তোমার জন্য লেখা। তোমাকে লেখা চিঠি জগৎ দেখছে দেখুক। জগৎ আমাকে ক্ষমা করবে না, না করুক। আমি কোনও ক্ষমা চাইছি না। আমি চাইছি যে গ্লানিতে আমি ভুগছি, যে অপরাধবোধ আমাকে নিরন্তর ভোগাচ্ছে, এভাবেই যেন বাকিটা জীবন আমি ভুগি। এ থেকে, যতদিন বাঁচি, যেন আমার মুক্তি না হয়। এ প্রায়শ্চিত্ত নয় মা, এ স্বীকারোক্তি। আমি যতটুকু ভালো, তা তোমার কারণে, যতটুকু মন্দ আমি, আমার নিজের কারণে। আমার মন্দটুকুর দায়িত্ব আমাকেই নিতে দাও।

Exit mobile version