Site icon BnBoi.Com

নির্বাসন – তসলিমা নাসরিন

নির্বাসন - তসলিমা নাসরিন

০১. নিষিদ্ধ মত, দ্বিখণ্ডিত পথ

নির্বাসন
আত্মজীবনী সপ্তম খণ্ড
তসলিমা নাসরিন
প্রথম প্রকাশ জানুয়ারী ২০১২
মদনজিৎ সিং শ্রদ্ধাস্পদে

.

০১. নিষিদ্ধ মত, দ্বিখণ্ডিত পথ

হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা অদ্ভুতও নয়-চমৎকারও নয়-খুব যাচ্ছে তাই নয়-আবার খুব ঝলমলেও নয় জীবন পার করেছি। টানা এক বছর। হারভার্ড ল’ ইস্কুলের উল্টোদিকে পঞ্চাশ ল্যাঙ্গডন স্ট্রিটের সাদা তিনতলা বাড়ির তিনতলাটি ভাড়া নিয়ে নিই হঠাৎ একদিন। বাড়ি থেকে হেঁটে হেঁটে হারভার্ডের কেনেডি ইস্কুলএ যাই। কেনেডি ইস্কুল অব গভর্মেন্ট। হারভার্ডের এই ইস্কুলটিই শুনেছি সবচেয়ে নামি-দামি। নামি, দামি, বিখ্যাত, বিরাট এসব শব্দ আমাকে আকষ্ট করে না। মানুষগুলো ভালো কি না, সৎ কি না, মনে যা, মুখে তা-ই কি না সেটাই আমি আগে দেখি। কেনেডি ইস্কুলের হিউম্যান রাইটস সেন্টারে আমার জন্য অফিস, ডেস্ক, কমপিউটার, ইন্টারনেট, প্রিন্টার, কাগজ, কলম, স্টেপলার, আলপিন খুঁটিনাটি। অফিসের দরজা খুলে বেরোলেই করিডরে চা কফি বিস্কুট। নিচের ক্যাফেটেরিয়ায় সুস্বাদু স্বাস্থ্যকর খাবার। গলায় আমার হারভার্ডের আইডি ঝোলে। ‘রিসার্চ স্কলার’, কেনেডি ইস্কুল, হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়। এই আইডি জাদুর মতো কাজ করে। হারভার্ডের অলি গলি চষে বেড়ানো যায়। অত বড় লাইব্রেরি থেকে যখন তখন দুষ্প্রাপ্য বই নিতে পারা, রাতে যতক্ষণ খুশি অফিসে কাটাতে পারা, দু’মিনিটে ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট হয়ে যাওয়া, মুহূর্তে চিকিৎসা হয়ে যাওয়া যে কোনও অসুখের! কী নয়।

দিনে প্রায় সারাদিন অফিসেই থাকি। কাছের কোনো রেস্তোরাঁয় খেতে যাই দুপুরে। কখনও ভারতীয় রেস্তোরাঁ, কখনও সাদামাটা আমেরিকান, কখনও সী ফুড। বিকেলে সাঁতার কাটি নয়তো মানুষের গোছানোবা এলোমেলো জীবন দেখতে দেখতে অনেকটা পথ অবধি আনমনে হাঁটি। ওজন পঞ্চাশ কিলো। জিনস, টপস। দেখতে কিশোরী কিশোরী। সুদর্শন হারভার্ড ফেলো গ্রেগ কারের সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে হতে হয় না, স্টেডিয়ামে পাশে বসিয়ে হারভার্ড আর ব্রাউনের ফুটবল খেলা বোঝালো, সুইটি টুইটি বলে বেশ ই-মেইল করলো অনেকদিন, ফেরারিতে চড়ে চলে এলো বাড়িতে, নেমন্তন্নও করলো তার পেন্টহাউজে। কিন্তু হঠাৎ কী কারণে জানি না, আমেরিকার ইরাকে বোমা ফেলাকে পছন্দ করিনি বলে নাকি এ নিয়ে বেজায় তর্ক করেছি বলে, যোগাযোগ দুম করে প্রায় বন্ধ করে দিল। অত প্রেম নিমেষে উড়ে গেল! বড়লোকদের শখ আর রকম সকমে আমার উৎসাহ চিরকালই কম। তবে গ্রেগ কারকে আমি শ্রদ্ধা করি এবং করবো, হারভার্ডে হিউমেন রাইটসের সেন্টার খুলেছেন বলে। টাকা তো অনেকের হাতেই আছে, ক’জন আর মানবাধিকারের সেবায় কোটি কোটি টাকা ঢালে! হারভার্ডের ফেলো আর প্রফেসরের সঙ্গে মাঝে মাঝেই জগতের একশ’ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। কবিতা লিখি। আত্মজীবনী লিখি। প্রবন্ধ লিখি। দূরের কোনো অচেনা মানুষের জন্য প্রেমের চিঠি লিখি। আবার হারভার্ডের জন্য সেকুলারিজম এর ওপর একটা বড় লেখাও লিখতে হয়। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক যাওয়া হয়, দেশে, দেশের বাইরে, ইউরোপে, কিছু না কিছুতে, পুরস্কার আনতে, নয়তো কবিতা

পড়তে, বক্তৃতা দিতে। বক্তৃতাটা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে, বক্তৃতা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে, সঙ্গে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার নেত্রী মেরি রবিনসন, বস্টনের কেমব্রিজ সেন্টারে কবিতা পাঠ, সঙ্গে ভ্যাজাইনা মনোলগ-এর ইভ এন্সলার, হারভার্ডের উইমেন স্টাডিস ডিপার্টমেন্টের ফাণ্ড রেইজেংএ সাহায্য করা, মাইকেল ইগনাটিফ বা স্যামুয়েল হান্টিংটঙের ক্লাস বা হারভার্ডে আসাবিখ্যাত অতিথিদের বক্তৃতা শোনা, নোয়াম চমস্কির সঙ্গে তাঁর এমআইটির ঘরে আড্ডা আর ইমেইলে ইরাক যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা, যুদ্ধের প্রতিবাদে আমার লেখালেখি, দল বেঁধে বস্টনের ফেনওয়ে স্টেডিয়ামে গিয়ে রেড সক্সএর বিখ্যাত বেইসবল দেখা, হঠাৎ ক্যান্সারে আক্রান্ত দীর্ঘদিনের বন্ধু স্টিভ লেসিকে দেখতে যাওয়া, হারভার্ড চ্যাপলেন্সিতে মানববাদীদের সঙ্গে মানববাদ নিয়ে আলোচনা, সুয়ানি হান্টের বাড়িতে পাঁচমিশেলি অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করা, মাঝে মাঝে কিছুদিন নিউইয়র্ক, হঠাৎ আবার কলকাতা ঘুরে আসা বইমেলায়। আবার হারভার্ড।

.

এর মধ্যে খবর পাই বাংলাদেশ তেতে উঠেছে। বিবিসি খবরটা দেয়। কলকাতায় প্রকাশিত আমার আত্মজীবনীর তৃতীয় খণ্ড ‘দ্বিখণ্ডিত’র বাংলাদেশ সংস্করণের নাম ‘ক’। প্রথমে ‘ক’ ই ছিল নাম। পশ্চিমবঙ্গের প্রকাশক ‘ক’ নামটায় আপত্তি করায় নাম দিয়েছি”দ্বিখণ্ডিত। ‘ক’ বেরোবার সঙ্গে সঙ্গেই নাকি আগুন জ্বলছে। আমাকে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগালি করা হচ্ছে সব পত্রিকায়। লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিক আমার বিরুদ্ধে ক্লান্তিহীন নিন্দায় মেতে আছেন। কার কার সঙ্গে শুয়েছি তাই নাকি লিখেছি আমি বইয়ে, আমার মতো নির্লজ্জ বেশ্যা’ আর জগতে নেই। বইয়ের যে পাতায় লেখা আছে আমার ‘শোয়াশুয়ি’র ঘটনা, সেই পাতা ফটোকপি করে ছড়ানো হচ্ছে সবখানে। সৈয়দ শামসুল হক একবার আমাকে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন দুরে। সেখানে গিয়ে আমার যে ধারণা জন্মেছে তাঁর সম্পর্কে, নিতান্তই তার নিটোল বর্ণনা ছিল এক জায়গায়। এ নিয়ে তাঁর রাগ করার কিছু আমি দেখি না। কিন্তু শুনেছি তিনি রাগে নাকি হায়েনার মতো করছেন। এ কথা প্রথম জানিয়েছিলেন মেজবাহউদ্দিন, বইয়ের প্রকাশক। তাঁর শ্যালিকার সঙ্গে তাঁর যে একটা গোপন সম্পর্ক আছে, তা আমার লুকোনো উচিত ছিল, কিন্তু আমি লুকোইনি। সৈয়দ হকের রাগের কারণ এটিই। শ্যালিকা নিয়ে লেখা বইয়ে একটিই বাক্য সম্ভবত আছে, ওই বাক্যটি পড়েই তিনি উত্তেজিত। আমি নাকি যা লিখেছি সব মিথ্যে, মামলা ঠুকে দিলেন ১০ কোটি টাকার। সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন সবখানে, ‘তসলিমা আমার চরিত্র হনন করেছে। মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। ৫২ বছরে লেখক হিসেবে আমি যে সম্মান কুড়িয়েছিলাম তা আজ ধুলোয় ধূলিস্যাৎ। নিশ্চয়ই এর পিছনে কিছু রহস্য আছে। না হলে তিনি দেশের এত সম্মানিত লেখক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে লিখতে সাহস পেতেন না। আমার মনে হয়েছে, প্রতিবাদ করা দরকার। তাই মামলা ঠুকে প্রতিবাদ জানালাম। তসলিমার বইয়ে এ ধরনের আরও যাদের নাম রয়েছে, আমি আশা করবো তারাও কোনো না কোনো পদক্ষেপ নেবেন। আমারটা আমি ভেবেছি, আইনের আশ্রয় নিয়ে করবো।’

বিবিসি থেকে আমার মন্তব্য চাইতে ফোন করলো, শুনিয়েও দিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর সৈয়দ হক আমার বিরুদ্ধে কী নিন্দা করেছেন সেসব। ক্রোধ,ঘৃণা, বিদ্রূপ, কটাক্ষ দুজনের কণ্ঠেই। সৈয়দ শামসুল হক না হয় তার গোপন সত্য প্রকাশ হওয়ায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য, চেঁচিয়ে, লাফিয়ে, হম্বিতম্বি করে, গালি দিয়ে, থুতু ছুঁড়ে, মামলা করে বোঝাতে চাইছেন যে তাঁর সম্পর্কে যা লিখেছি আমি তা ভুল। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিয়ে বইয়ে তেমন কোনো কথা নেই। তার এত রাগ কেন! তিনি তো কোনো ‘পুরুষ রক্ষা সমিতি’র সদস্যও নন। তিনি বারবারই বলেছেন, দুটো মানুষের মধ্যে দরজা বন্ধ করে। যা ঘটে, তা কখনো বাইরে প্রকাশ করতে হয় না। বাইরে প্রকাশ করা যাবে না, এমন কাজ অপরাধীরাই করে। আর অপরাধীদের বাঁচানোর দায়িত্ব কে বলেছে সব মেয়েকেই নিতে হবে। আগুন যেমন এক অরণ্য থেকে আরেক অরণ্যে বাতাসের আগে ছুটে যায়, তেমন গেল, কলকাতাতেও সাহিত্য মহলের একাংশে নিন্দার ঝড় বইছে, এই ঝড়ের দেবতা, কেউ কেউ বললো, স্বয়ং সুনীল। যদিও তাঁর কিছুই আমি ফাঁস করিনি, কিন্তু কিছু যদি করি পরের বইগুলোতে, এই ভয়। আমাকে বাতিল করে, ব্যান করে, ত্যাগ করে, ত্যাজ্য করে পাঠকের কাছে আমাকে মিথ্যুক, অযোগ্য, কাণ্ডজ্ঞানহীন, ভারসাম্যহীন লেখক হিসেবে দাঁড় করাতে পারলে কেউ আমার কথা আর বিশ্বাস করবে না, আমার লেখা আর পড়বে না। এই নিন্দার ঝড়তুফান শান্ত হওয়ার আগেই খবর ছাপা হয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘দ্বিখণ্ডিত’ নিষিদ্ধ করেছেন। পঁচিশ জন লেখক, বুদ্ধিজীবী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন আমার ‘দ্বিখণ্ডিত’ নিষিদ্ধ করার জন্য। মুখ্যমন্ত্রী সবার কথা শুনেছেন, নিজেও বইটি কয়েকবার পড়েছেন। পড়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নিষিদ্ধ করার। নিষিদ্ধ করা হয়েছে অবশ্য অন্য কারণ দেখিয়ে, আমি নাকি মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছি। ওদিকে বাংলাদেশে ‘ক’ নিষিদ্ধ। হাইকোর্টে সৈয়দ শামসুল হক আমার বিরুদ্ধে দশ কোটি টাকার মামলা করেছেন মানহানির, বই নিষিদ্ধ করার আকুল আবেদন জানিয়েছেন সরকারের কাছে। সরকার বই নিষিদ্ধ করার আগেই হাইকোর্ট নিষিদ্ধ করেছে। এসবে অনুপ্রাণিত হয়ে কী না জানি না, কলকাতায় প্রায় অচেনা এক কবি মানহানির মামলা ঠুকে দেয়, এ আবার এগারো কোটির। লেখকরা বই নিষিদ্ধ করছেন, লেখকরা লেখকের বিরুদ্ধে মামলা করছেন। জগতের কোথাও এমন ঘটনা ঘটে না। সভ্য লেখকরা লেখকের বাক স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়ান, বই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে কথা বলেন। বাংলার লেখকদের যত দেখি, তত অবাক হই। বেশির ভাগই স্বার্থপর, সুযোগসন্ধানী, সরকারী আনুকূল্য ছাড়া বাঁচতে জানেন না। আদর্শ! নীতি! ওসব মুখে বা বইয়ে। অন্তরে নেই, বিশ্বাসে নেই, জীবন যাপনে নেই।

.

পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের বিখ্যাত সাহিত্যিকরা আমার নিন্দায় বিষম মেতে আছেন। নিন্দা কী রকম বীভৎস হতে পারে, কুৎসা কী রকম নির্মম হতে পারে, ঘৃণা কী রকম ভয়ংকর হতে পারে, তা অনুমান করতে হলে শুনতে হয় ওঁরা কী বলছেন, কী লিখছেন আমাকে নিয়ে। বাংলাদেশের লেখক হুমায়ুন আজাদ লিখলেন, “আমি ‘ক’ বইটি পড়ার উপযুক্ত মনে করিনি বলেই পড়িনি। এই বইয়ে আমাকেও নানারকম গালাগালি করা হয়েছে, মিথ্যে কথা লেখা হয়েছে। কিন্তু আমার সম্পর্কে কোনও যৌনতার অভিযোগ আনতে পারেনি। কারণ আমি কখনই তসলিমার ডাকে সাড়া দিইনি। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ক’ বইটি সম্পর্কে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় পড়ে আমার মনে হয়েছে, এটি একটি পতিতার নগ্ন আত্মকথন অথবা একজন নিকৃষ্টতম জীবনের কুরুচিপূর্ণ বর্ণনা।’

হুমায়ুন আজাদ প্রায়ই ধর্মের সমালোচনা করেন। আমি নারীর অধিকার নিয়ে লিখতে শুরু করার পর তিনিও একই বিষয় নিয়ে একটি বই লিখতে শুরু করেন। বই লিখেছেন কিন্তু মেয়েদের প্রতি কখনও তার কোনও শ্রদ্ধাবোধ দেখিনি। একসময় নারী বিরোধী প্রবচন লিখেছেন। নারীর পক্ষে লিখলে জনপ্রিয়তা অর্জন সম্ভব হতে পারে, তা আমার ‘নির্বাচিত কলাম’এর জনপ্রিয়তা দেখেই ‘নারী’ নামে বই লিখেছেন, কিন্তু নারীকে যৌনবস্তু ভাবার মন বই লেখার আগে যেমন ছিল, তেমনই রয়ে গেছে। কোনও পরিবর্তন হয়নি। আমার সম্পর্কে মিথ্যে উচ্চারণে হুমায়ুন আজাদের কোনও অসুবিধে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর তিনি, বলে ফেললেন তসলিমার ডাকে আমি সাড়া দিইনি। যেন আমি তাঁকে ডেকেছিলাম কোনওদিন! একজন ডাক্তার, তার ওপর জনপ্রিয় লেখক, সাহিত্য পুরস্কার সহ প্রচুর মানবাধিকার পুরস্কার পাওয়া প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন নারীর আত্মজীবনীকে তিনি বলে দিলেন ‘পতিতার নগ্ন আত্মকথন এবং নিকৃষ্টতম জীবনের কুরুচিপূর্ণ বর্ণনা’। প্রচণ্ড নারীঘৃণাকারী বদমাশও কোনো নারী সম্পর্কে না জেনে না বুঝে এই মন্তব্য করতে না। হুমায়ুন আজাদের মতো দুশ্চরিত্র, মিথ্যুক, ঈর্ষাকাতর, ছোট-লোক যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হন, তবে নতুন প্রজন্ম কী শিক্ষা পেয়ে বড় হবে, ভেবে আমি শংকিত হই, সত্যি। নারী বিরোধী সমাজে নারী বিরোধী হুমায়ুন আজাদকে ঘিরে থাকার জন্য নারী বিরোধী বালককুলের অভাব হয় না।

নিমা হক বলেছেন, ‘স্বাধীনতা ভোগের একটা সীমা আছে। তসলিমা সে সীমা লঙ্ঘন করেছেন। সাহিত্যের নামে এই ধৃষ্টতার জন্য তার শুধু তিরস্কারই প্রাপ্য নয়, প্রাপ্য শাস্তিও’। আসাদ চৌধুরীকে বহুকাল চিনি, খুব প্রশংসা করতেন আমার লেখার। তিনি বলেছেন, ‘ব্যক্তি সমাজ বিশাল জনগোষ্ঠী নিয়েই সাহিত্য, কোনও লাম্পট্যের নির্লজ্জ বর্ণনা কখনো সাহিত্য হতে পারে না’।

এদিকে পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত লেখকরা শকুনের মতো খামছে ধরেছেন আমাকে। সমরেশ মজুমদার লিখলেন, ‘প্রায় ৯০ বছর আগে কলকাতার সোনাগাছিতে খ্যাতনামা বেশ্যা থাকতেন। তাঁর নাম ছিল নন্দরানী। কলকাতার প্রায় সমস্ত খ্যাতনামা ব্যক্তিদের যাতায়াত ছিল তাঁর কাছে। অবশ্যই খদ্দের হিসেবে। তিনি যদি এঁদের নিয়ে উপন্যাস রচনা করার কথা ভাবতেন তাহলে তিনি তা অনেকদিন আগেই করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে সমাজে চুপচাপ থাকার ভদ্রতা ও সৌজন্যের পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু তসলিমা নাসরিন নন্দরানীর সেই আত্মসম্মানবোধের অংশীদার হতে পারেননি। তসলিমা শাড়ি বদলাবার মতো করে পুরুষ বদলেছেন। মানসিক সম্পর্কের চেয়ে শারীরিক সম্পর্কের ওপর জোর দিয়ে এসেছেন। সাধারণ মেয়েরা তাঁর এই দ্বিচারিতার কথা জানতে পারেনি। তবে সবারই বাক স্বাধীনতা আছে। তসলিমা বলেছেন, আমরা শুনেছি। বিচার করার ক্ষমতা নিজেদের ওপর নির্ভর করছে। ঘরের ভিতর বন্ধুবান্ধবের মধ্যে খিস্তি খেউর করা যায় কিন্তু প্রকাশ্যে তা করলেই তাকে অশ্লীলতা বলে। এখন যা তিনি প্রকাশ্যে বলছেন, একসময় সেই কাজে নিজেই সহযোগিতা করেছেন। আসলে ওঁর উদ্দেশ্য ছিল বই বিক্রি করা এবং প্রচার পাওয়া। পশ্চিমবঙ্গের কবি সুবোধ সরকার লিখেছেন, তিনি সুইডেন থেকে ‘ক’ নামে একটি যৌন বোমা পাঠিয়েছেন ঢাকায় এবং ঢাকায় সেটি ফেটেছে। বইটিতে নাকি সমাজ নিয়ে, পরিবার নিয়ে, ধর্ম নিয়ে কথা আছে, কিন্তু কে শোনে ওদের কথা, যখন একই মোড়কে রয়েছে বেশ কয়েকটি রগরগে বেড সিন। বেডসিনের কাছে এই মর পৃথিবীতে ইরাক-আমেরিকাও তুচ্ছ সেটা আবার বোঝা গেল। ..হায়রে, যৌনতা কি তসলিমার ভেতরের কোনো দুরারোগ্য ব্যাধি, যা তার বাবাকে ছাড়ে না, বাবার বয়সীদেরও ছাড়ে না! শুনেছি আপনার যৌনকেচ্ছার তালিকা নাকি আরও বেরোবে। কলকাতার লেখকরাও দিন গুনছেন। নিশ্চয়ই আপনার স্টকে ফরাসি ইতালিয়ানরাও আছেন। অচিরেই আপনার নাম বিখ্যাত বাঈজির তালিকায় উঠবে। দু’একজন বাঙালি স্কলার আপনাকে নিয়ে বই লিখবে, একজন লেখিকা কোন আর্থ সামাজিক চাপে বাঈজি হয়ে গেলেন। ভাগ্যিস, আপনি সুইডেনে থাকেন। খারাপ পাড়ার লোকেরা এরপর জানতে চাইবেন, কীসে আপনার পেমেন্ট হয়, ডলারে, সুইডিশ ক্রোনারে, টাকায় না রুপিতে? ভাষাহীন মেয়েদের ভাষা দিতে চেয়েছিলেন আপনি, সেই মহৎ ইমেজ আর থাকলো না। এবার মেয়েরাও আপনাকে ছুলে ডেটল দিয়ে হাত ধোবেন। আরবের আতরও আপনার ছোট্ট দুটো হাতের গন্ধ দূর করতে পারবে না কোনোদিন’।

আরেক বিখ্যাত লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘শুনেছি বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তার যৌনসম্পর্কের নানা বর্ণনা তিনি দিয়েছেন। আমি এটাকে অশ্লীল বলে মনে করি না। তিনি যদি তার বিবেক মুক্তির জন্য লিখে থাকতেন তাহলে বলার কিছু ছিল না। কিন্তু চমক সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে লিখেছেন। এটাকে আমি মেনে নিতে পারি না। সাহিত্য ও অশ্লীলতার মধ্যে সীমারেখা টানতে জানাই সাহিত্যিকদের দায়িত্ববোধের পরিচয়’।

নবনীতা দেব সেনও বলেছেন মন্দ। বাণী বসুও মন্দ। বাণী বসু বলেছেন, ‘আত্মজীবনী পড়ে যদি গিমিক মনে হয় তাহলে তার সততা নিয়ে সকলে প্রশ্ন তোলে। পাঠকের এই কৌতূহল সাময়িক। সাহিত্য বিচারে তার লেখা নিম্নমানের। এই ধরনের লেখার কোনো সাহিত্যমূল্য নেই। এই বাণী বসুও অবশ্য পরে দৈনিক স্টেটসম্যানএ ছাপা হওয়া আমার কলাম পড়ে ফোন করেছিলেন আমাকে, বলেছিলেন আমার লেখা নাকি খুব ভালো লাগে তাঁর। অবশ্য আমি জানি না আমি ছাড়া বাইরের কাউকে তিনি তার মুগ্ধতার কথা জানতে দিয়েছেন কি না।

মল্লিকা সেনগুপ্ত, নতুন নারীবাদী কবি, লিখলেন, এখানে শুধু শোওয়ার জন্য শোওয়া। একের পর এক তালিকা। এটা কোনো আত্মজীবনী হতে পারে না। এর মধ্যে কতটা সত্যি আছে জানি না, কারণ অতীতেও তার সততায় সংশয় ছিল। এর সাহিত্যিক সততা এবং নারীবাদী সততা আমার কাছে স্বচ্ছ নয়। প্রতিটি সম্পর্ক তসলিমা নিজেই তৈরি করেছেন। সেখানে কার সঙ্গে শুয়েছেন, কার সঙ্গে কি করেছেন সেটা চমক তো বটে। এর মধ্যে কোনো বিশেষত্ব নেই। তসলিমার এই জীবনলেখ মানুষের আস্থা হারিয়েছে।… শোবার ঘরের অন্য গল্প আছে, কিন্তু তাঁর মতো রগরগে ভাষায় লেখার রুচি সকলের হয় না। হয় না বলেই সাহিত্য টিকে আছে। তসলিমার শোবার ঘরের চেয়ে অনেক বড় জায়গায় নারীবাদের লড়াই বেঁচে আছে।

গৌতম ঘোষ দস্তিদারকে বন্ধু-কবি বলেই জানতাম। তিনি দ্বিখণ্ডিত সম্পর্কে লিখলেন, ‘এই স্ববিরোধিতা, এইসব সচেতন যুক্তিহীনতা, অর্ধসত্য, ক্লেদ আর নির্লজ্জতাই তসলিমার চরিত্র। মূল্যবোধ জাতীয় কোনো শব্দ তসলিমার অভিধানে নেই। খ্যাতি, খ্যাতি আর খ্যাতি ছাড়া কোনো লক্ষ্য নেই। অখ্যাতিকেও তিনি খ্যাতি বলে ভাবেন। ফলে, সত্যের অছিলায় নিজের জীবনকাহিনী লিখতে গিয়ে নিজেকেই কেবল নগ্ন করে দেখান না, অন্যকেও নগ্ন করেন। এখানেই তার মূল্যবোধহীনতা প্রকট হয়ে ওঠে। আমরা যদি তার এইসব যৌনগাথাগুলিকে সত্যি বলেও ধরে নিই, তাহলেও প্রশ্ন ওঠে, এই গোপন তিনি প্রকাশ্যে করতে পারেন কি না, তাতে সম্পর্কের (হোক তাজৈব) শর্ত ভাঙে কি না। অবশ্য, তসলিমার কাছে এইসব স্বাভাবিক বৃত্তি আশা করা বৃথা। প্রথমাবধিই তাঁর এই জাতীয় মূল্যবোধ গড়ে ওঠেনি’।

আর কমিউনিস্ট লেখক আজিজুল হক লিখলেন, ‘শারীরিক এবং মানসিকভাবে দেউলিয়া লেখিকা লজ্জা বিসর্জন দিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। পোশাক পরে আছেন নেহাত অভ্যাসবশত। ..এটা নাকি বাক স্বাধীনতা। ভাদুরে কুকুর রক্ষা সমিতির দাবি, পাগলা কুকুরদের খ্যাক খ্যাক করে তেড়ে আসার অধিকারটাও হিউম্যান ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে কুকুরীয় স্বাধীনতা। কারুর যদি যা খুশি বলার স্বাধীনতা থাকে, অন্য কারুর হাতের স্বাধীনতা থাকতেই পারে। গলাটা টিপে দেওয়ার স্বাধীনতাই বা থাকবে না কেন! কোনো মহিলা যদি নিজের দেহকে পাবলিক ইউরিনাল করে সাজিয়ে তুলে ধরেন, কী বলবেন? সুলভ কমপ্লেক্স হলে পে এণ্ড ইউজ। এতে হইচই করার কী আছে? .. নিষিদ্ধ নয়, বর্জন করুন এই বর্জ্য পদার্থ। রাস্তায় বর্জ্য পদার্থ পড়ে থাকলে কেউ লাথি মারে না। হয় ডিঙিয়ে যায়, না হয় সাফাইকর্মী ডাকে। সাফাইকর্মীরা সাফ করুক। প্রতিরোধ গড়ে উঠুক ছাপাখানায়। বাইণ্ডারদের কারখানায়। জবাব এটাই। ..সুস্থ সংস্কৃতির জন্য যারা গলা ফাটান, তাঁরা কোথায়? কোথায় গেলেন সেই কর্মী বাহিনী, যারা প্রকাশক, মুদ্রক, এবং বাঁধাইখানার সামনে পিকেট করে আমাদের সংহতি বিনষ্টকারী বর্জ্য পদার্থটিকে (বই বলতে ঘৃণা হয়) বর্জনের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলবেন?’

আজকাল পত্রিকার সম্পাদক অশোক দাশগুপ্ত লিখেছেন, ‘তসলিমার দ্বিখণ্ডিত দুটি কারণে জঘন্য, বর্জনীয়। প্রথমত রুচি, অশালীনতা, অবাধ চরিত্রহনন। মামলা হয়েছে ঢাকায়, কলকাতায়। রাজ্য সরকার সে জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি। কিন্তু আমরা এই প্রথম কারণটিও একটু দেখব। ক. সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ও প্রাপ্ত বয়স্ক নারী যদি স্বেচ্ছায় কোনও সম্পর্ক স্থাপন করেন, তা একধরনের চুক্তি, যে কোনও একজন নিজের স্বার্থে তা প্রচার করতে পারেন না। অন্তত, উচিত নয়। খ. ফুটপাতের হলুদ মলাটের বইয়ে হয়তো আরও রগরগে বর্ণনা থাকে, কিন্তু সেখানে সব চরিত্র কাল্পনিক, জীবিত, পরিচিত ব্যক্তিদের টেনে আনা হয় না। গ. কোনো লেখক বা লেখিকা তার পরিচিত ব্যক্তিদের নাম করে যা খুশি লিখেছেন, কেন মানতে হবে সে সব সত্যি? কী করে বলা যাবে যে অতিরঞ্জিত বা বিকৃতি নেই? ঘ. তসলিমা নিজে না হয় চালচুলোহীন, সামাজিক দায়দায়িত্বের ধার ধারেন না, যাঁদের সম্পর্কে লিখেছেন, সত্যি অথবা মিথ্যে, তাঁদের সামাজিক সম্মান নেই? তাঁদের সন্তান নেই? পারিবারিক বৃত্ত নেই? .. তসলিমার ৩৯৩ পাতার আবর্জনাকে যদি বা উপেক্ষা করা যায়, ২ পাতার প্ররোচনামূলক অসভ্যতাকে ক্ষমা করা যায় না। শঙ্খ ঘোষ বা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কোনো বই নিষিদ্ধ ঘোষণার পক্ষে নন। কিন্তু এই একটি বইকে ওঁরা ব্যতিক্রম মনে করছেন।’

.

বিষ মাখানো নিন্দা আর ঘৃণার তীর যখন দুই বাংলা থেকে ছোঁড়া হচ্ছিল, তখনই দেশ পত্রিকা থেকে আমাকে অনুরোধ করা হয়েছিলো প্রতিক্রিয়া লিখতে। লিখেছিলাম, নিউইয়র্কে বসে, এক মধ্যরাতে। ঠিক এভাবেই লিখেছিলাম —

‘Freedom is always and exclusively freedom for the one who thinks differ ently.’ –Rosa Luxemburg

জীবনের অনেকগুলো বছর পেরিয়ে যখন দেখি পিছনের দিনগুলো ধূসর ধূসর, আর সেই ধূসরতার শরীর থেকে হঠাৎ হঠাৎ কোনো ভুলে যাওয়া স্বপ্ন এসে আচমকা সামনে দাঁড়ায় বা কোনো স্মৃতি টুপ করে ঢুকে পড়ে আমার একাকী নির্জন ঘরে, আমাকে কাঁপায়, আমাকে কাঁদায়, আমাকে টেনে নিয়ে যায় সেই দিনগুলোর দিকে –তখন কী জীবনের সেই অলিগলির অন্ধকার সরিয়ে সরিয়ে কিছু শীতার্ত স্মৃতি কুড়িয়ে আনতে আমি না হেঁটে পারি! কী লাভ হেঁটে! কী লাভ স্মৃতি কুড়িয়ে এনে! যা গেছে তা তো গেছেই! যে স্বপ্নগুলো অনেককাল মৃত, যে স্বপ্নগুলোকে এখন আর স্বপ্ন বলে চেনা যায় না, মাকড়সার জাল সরিয়ে ধুলোর আস্তর ভেঙে কী লাভ সেগুলোকে আর নরম আঙুলে তুলে এনে! যা গেছে, তা তো গেছেই। জানি সব, তবুও আমার নির্বাসনের জীবন আমাকে বারবার পিছনে ফিরিয়েছে, আমি আমার অতীত জুড়ে মোহগ্রস্তের মতো হেঁটেছি। দুঃস্বপ্নের রাতের মতো এক একটি রাত আমাকে ঘোর বিষাদে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তখনই মেয়েটির গল্প বলতে শুরু করেছি আমি।

একটি ভীরু লাজুক মেয়ে, যে মেয়ে সাত চড়েও রা করেনি, পারিবারিক কড়া শাসন এবংশোষণে ছোট্ট একটি গণ্ডির মধ্যে বড় হয়ে উঠেছে, যে-মেয়ের সাধ-আহ্লাদ প্রতিদিনই ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে আবর্জনার স্তূপে, যে-মেয়েটির ছোট্ট শরীরের দিকে লোমশ লোমশ লোভী হাত এগিয়ে এসেছে বারবার, আমি সেই মেয়ের গল্প বলেছি। যে-মেয়েটি কিশোর বয়সে ছোট ছোট কিছু স্বপ্ন লালন করতে শুরু করেছে, যে-মেয়েটি হঠাৎ একদিন প্রেমে পড়েছে, যৌবনের শুরুতে বিয়ের মতো একটি কাণ্ড গোপনে ঘটিয়ে আর দশটি সাধারণ মেয়ের মতো জীবন যাপন করতে চেয়েছে, আমি সেই সাধারণ মেয়েটির গল্প বলেছি। যে-মেয়েটির সঙ্গে প্রতারণা করেছে তার স্বামী তার সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ, যে মেয়েটির বিশ্বাসের দালানকোঠা ভেঙে পড়েছে খড়ের ঘরের মতো, যে-মেয়েটি শোকে, সন্তাপে, বেদনায়, বিষাদে কুঁকড়ে থেকেছে। চরম লজ্জা আর লাঞ্ছনা যাকে আত্মহত্যা করার মতো একটি ভয়ংকর পথে নিয়ে যেতে চেয়েছে, চুরমার হয়ে ভেঙে পড়া স্বপ্নগুলো জড়ো করে যে-মেয়েটি আবার বাঁচতে চেয়েছে, নিষ্ঠুর নির্দয় সমাজে নিজের জন্য সামান্য একটু জায়গা চেয়েছে, যে-মেয়েটি বাধ্য হয়েছে সমাজের রীতিনীতি মেনে পুরুষ নামক অভিভাবকের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে, আর তার পরও যে মেয়েটির ওপর আবার নেমে এসেছে একের পর এক আঘাত, যে-আঘাত গর্ভের জ্বণটিকে নষ্ট করে দেয়, যে আঘাত প্রতি রাতে তাকে রক্তাক্ত করে, যে-আঘাত তার, কুটিলতার, অবিশ্বাসের আর, অসহ্য অপমানের আমি সেই দলিত দংশিত দুঃখিতার গল্প বলেছি মাত্র। দুঃখিতাটি তার শরীরে আর মনে যেটুকু জোর ছিল অবশিষ্ট, সেটুকু নিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়েছে, দাঁড়াবার জন্য সামান্য জায়গা পেতে কারও দ্বারস্থ হয়নি এবার, একাই লড়েছে সে, একাই বেঁচেছে, নিজেই নিজের আশ্রয় হয়েছে, এবার আর কারও কাছে নিজেকে সমর্পণ করেনি, বঞ্চিত হয়েছে বলে যোগিনী সাজেনি, কারও ছিঃ ছিঃর দিকে ফিরে তাকায়নি এই ফিরে না তাকানোর গল্প আমি বলেছি। সমাজের সাত রকম সংস্কারের ধার ধারেনি মেয়ে, বারবার তার পতনই তাকে দাঁড়াতে শিখিয়েছে, বারবার তার হোঁচট খাওয়াই তাকে হাঁটতে শিখিয়েছে, বারবার তার পথ হারানোই তাকে পথ খুঁজে দিয়েছে। ধীরে ধীরে নিজের ভেতরে যে-নতুন একটি বোধ আর বিশ্বাসকে সে জন্ম নিতে দেখেছে, তা হল, তার নিজের জীবনটি কেবল তারই, অন্য কারও নয়। এই জীবনটির কর্তৃত্ব করার অধিকার কেবল তারই। আমি মেয়েটির সেই গড়ে ওঠার গল্প বলেছি যে পরিবেশ প্রতিবেশ তাকে বিবর্তিত করেছে, তাকে নির্মাণ করেছে, পিতৃতন্ত্রের আগুনে পুড়ে যে-মেয়ে শেষ পর্যন্ত দগ্ধ হল না, পরিণত হল ইস্পাতে, সেই গল্প।

আমি কি অন্যায় কিছু করেছি? আমার কাছে অন্যায় বলে মনে না হলেও আজ অনেকের কাছে এটি ঘোরতর অন্যায়। আমি ভয়াবহ রকম অপরাধ করেছি গল্পটি বলে। অপরাধ করেছি বলে জনতার আদালতের কাঠগড়ায় আমাকে দাঁড়াতে হচ্ছে। অপরাধ হয়তো হতো না যদি না আমি প্রকাশ করতাম যে, যে-মেয়েটির গল্প আমি বলেছি সে মেয়েটি আমি, আমি তসলিমা। কল্পনায় আমি যথেচ্ছাচার করতে পারি, মিথ্যে মিথ্যে আমি লিখতে পারি কোনো সাধারণ মেয়ের আর দশটি মেয়ে থেকে ভিন্ন হওয়ার গল্প, ও না হয় ক্ষমা করে দেওয়া যায়। কিন্তু এই বাস্তব জগৎটিতে দাঁড়িয়ে রক্তমাংসের মেয়ে হয়ে কোন স্পর্ধায় আমি ঘোষণা করছি যে, ওই মেয়েটি আমি, আমি দুঃখ ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছি, আমার যেমন ইচ্ছে তেমন করে নিজের জীবনটি যাপন করবো বলে পণ করেছি, আমার এই দুর্বিনীত আচরণ লোকে মানবে কেন! এরকম স্পর্ধা কোনো মেয়েকেই মানায় না। বড় বেমানান আমি পুরো পিতৃতান্ত্রিক পরিবেশে।

আমার প্রিয় দেশটিতে, প্রিয় পশ্চিমবঙ্গে আজ আমি একটি নিষিদ্ধ নাম, একটি নিষিদ্ধ মানুষ, একটি নিষিদ্ধ বই। আমাকে উচ্চারণ করা যাবে না, আমাকে ছোঁয়া যাবে না, আমাকে পড়া যাবে না। উচ্চারণ করলে জিভ নষ্ট হবে, চুলে হাত নোংরা হবে, পড়লে গা রি রি করবে।

এরকমই তো আমি। সে কি আজ থেকে!

‘দ্বিখণ্ডিত’ লেখার কারণে যদি সহস্র খণ্ড হতে হয় আমাকে, তবু আমি স্বীকার করতে চাই না যে আমি কোনো অপরাধ করেছি। আত্মজীবনী লেখা কি অপরাধ? জীবনের গভীর গোপন সত্যগুলো প্রকাশ করা কি অপরাধ? আত্মজীবনীর প্রধান শর্ত তো এই যে, জীবনের সব কিছু খুলে মেলে ধরবো, কোনো গোপন কথা কোনো কিছুর তলায় লুকিয়ে রাখবো না। যা-কিছু গোপন, যা-কিছু অজানা, তা বলার জন্যই তো আত্মজীবনী। এই শর্তটিই সতোর সঙ্গে পালন করতে চেষ্টা করেছি। আত্মজীবনীর প্রথম দুই খণ্ড ‘আমার মেয়েবেলা’ আর ‘উতল হাওয়া’ নিয়ে কোনোরকম বিতর্ক না হলেও তৃতীয় খণ্ডটি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই বিতর্ক কিন্তু আমি সৃষ্টি করিনি, করেছে অন্যরা। বিতর্ক হওয়ার মতো উত্তেজক বিষয়, অনেকেই বলেছেন, আমি বেছে নিয়েছি। এই প্রশ্ন আর যখনইউঠুক, আত্মজীবনীর ক্ষেত্রে ওঠা উচিত নয়। কারণ সব রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমার বড় হওয়া বা বেড়ে ওঠার ঘটনাগুলোই আমি বর্ণনা করেছি। আমার দর্শন অদর্শন, আমার হতাশা-আশা, আমার সুন্দর, আমার কুৎসিত, আমার শোক সুখ, আমার ক্রোধ আর কান্নাগুলোর কথাই বলেছি। কোনো স্পর্শকাতর বা উত্তেজক বিষয় শখ করে বেছে নিইনি, আমার জীবনটিই আমি বেছে নিয়েছি জীবনী লেখার জন্য। এই জীবনটা যদি স্পর্শকাতর আর উত্তেজক হয়, তবে এই জীবনের কথা লিখতে গিয়ে আমি অস্পর্শকাতর আর অনুত্তেজক বিষয় কোত্থেকে পাবো? বিতর্ক তৈরি করার জন্য বা চমক সৃষ্টি করার জন্য আমি নাকি বই লিখেছি। যেন বদ একটি কারণ থাকতেই হবে বই লেখার পিছনে। যেন সততা আর সরলতা কোনও কারণ হতে পারে না। যেন সাহস, যে-সাহসের প্রশংসা করা হত যে, আমি সাহস করে নাকি অনেক কিছুই বলি বাকরি, সেই সাহসটিও এখন আর কোনও কারণ হতে পারে না। আমার লেখা নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। লেখালেখির শুরু থেকেই তা হচ্ছে। এটিই কি মোদ্দা কথা নয় যে পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজের সঙ্গে আপোস না করলেই বিতর্ক হয়।

আত্মজীবনীর সংজ্ঞা অনেকের কাছে অনেক রকম। বেশির ভাগ মানুষই সেই জীবনীকে গ্রহণ করতে অভ্যস্ত, যে জীবনীটি ভূরি ভূরি ভালো কথা আর চমৎকার সব আদর্শ উপস্থাপন করে। সাধারণত মনীষীরাই আত্মজীবনী লিখে যান অন্যকে নিজের জীবনাদর্শে আলোকিত করতে, সত্যের সন্ধান দিতে, পথ দেখাতে। আমি কোনও জ্ঞানী গুণী মানুষ নই, কোনও মনীষী নই, কোনও মহামানব নই, কিছু নই, অন্ধজনে আলো দেওয়ার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে আমি জীবনী লিখছি না। আমি কেবল ক্ষুদ্র একটি মানুষের ক্ষতগুলো ক্ষোভগুলো খুলে দেখাচ্ছি।

কোনও বড় সাহিত্যিক বা বড় কোনো ব্যক্তিত্ব না হলেও এ কথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, খুব বড় বড় ঘটনা ঘটে গেছে আমার জীবনটিতে। আমার বিশ্বাস এবং আদর্শের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ যদি পথে নামে আমার ফাঁসির দাবি নিয়ে, যদি ভিন্ন মতের কারণে একের পর এক আমার বই নিষিদ্ধ করা হয়, যদি সত্য কথা বলার অপরাধে একটি রাষ্ট্রযন্ত্র আমার নিজের দেশে বাস করার অধিকার হরণ করে নেয়, তবে নিশ্চয়ই জীবনটি একটি সাদামাটা জীবন নয়। এই জীবনের কাহিনী অন্যের মুখে নানা ঢঙে নানা রঙে প্রচারিত যখন হচ্ছেই, তখন আমি কেন দায়িত্ব নেব না জীবনের আদ্যোপান্ত বর্ণনা করতে। আমার এই জীবনটিকে আমি যত বেশি জানি, তত তোআর অন্য কেউ জানে না।

নিজেকে যদি উন্মুক্তনাকরি, নিজের সবটুকু যদি প্রকাশ না করি, বিশেষ করে জীবনের সেইসব কথা বা ঘটনা, যা আমাকে আলোড়িত করেছে, যদি প্রকাশ না করি নিজের ভালো মন্দ, দোষ গুণ, শুভ অশুভ, আনন্দ বেদনা, উদারতা ক্রুরতা, তবে আর যাই হোক সেটি আত্মজীবনী নয়, অন্তত আমার কাছে নয়। কেবল সাহিত্যের জন্যই সাহিত্যই আমার কাছে শেষ কথা নয়, সততা বলে একটি জিনিস আছে, সেটিকে আমি খুব মূল্য দিই।

যে-রকমই জীবন হোক আমার, যে-রকমই নিকৃষ্ট, যে-রকমই নিন্দা, নিজের জীবন কাহিনী লিখতে বসে আমি কিন্তু প্রতারণা করছি না নিজের সঙ্গে। পাঠক আমার গল্প শুনে আমাকে ঘৃণা করুক কী আমাকে ছুঁড়ে ফেলুক, এটুকুই আমার সন্তুষ্টি যে, আমার পাঠকের সঙ্গে আমি প্রতারণা করছি না। আত্মজীবনী নাম দিয়ে পাঠককে কোনো বানানো গল্প উপহার দিচ্ছি না। জীবনের সব সত্য, সত্য সবসময় শোভন বা সুন্দর না হলেও, সঙ্কোচহীন বলে যাচ্ছি। জীবনে যা কিছু ঘটে গেছে, তা তো ঘটেই গেছে, তা তো আমি বদলে দিতে পারবো না, আর অস্বীকারও করতে পারবো না এই বলে যে, যা ঘটেছে তা আসলে ঘটেনি। সুন্দরকে যেমন পারি, অসুন্দরকেও তেমন আমি স্বীকার করতে পারি।

চারদিক থেকে এখন বিদ্রুপের তির ছোঁড়া হচ্ছে আমাকে লক্ষ্য করে, অপমান আর অপবাদের কাদায় আমাকে ডুবিয়ে দেওয়া হচ্ছে এর কারণ একটিই, আমি সত্য কথা বলেছি। সত্য সবসময় সবার সয় না। আমার মেয়েবেলা’ আর ‘উতল হাওয়া’র সত্য সইলেও দ্বিখণ্ডিত’র সত্য সবার সইছে না। আমার মেয়েবেলায় আমাকে অপদস্থ করার কাহিনী যখন বর্ণনা করেছি, সেটি পড়ে লোকে চুকচুক করে দুঃখ করেছে আমার জন্য, উতল হাওয়ায় যখন স্বামী দ্বারা প্রতারিত হয়েছি, তখনও আহা আহা করেছে আমার জন্য, আর দ্বিখণ্ডিত’য় যখন বর্ণনা করেছি পর পর একের অধিক পুরুষের সঙ্গে আমার। সম্পর্কের কথা, তখন ছিঃ ছিঃ করতে শুরু করেছে। এর অর্থ তো একটিই, যে, যতক্ষণ একটি মেয়ে অত্যাচারিত এবং অসহায়, যখনই সে দুর্বল, এবং যখন তার দুঃসময়, ততক্ষণই তার জন্য মায়া জাগে, ততক্ষণই তাকে ভালো লাগে। আর যখনই মেয়েটি আর অসহায় নয়, যখনই সে মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়ায়, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে,নিজের শরীরের এবং মনের স্বাধীনতার জন্য সমাজের নষ্ট নিয়মগুলো ভাঙে, তখন তাকে আর ভালো লাগে না, বরং তার প্রতি ঘৃণা জন্মে। আমাদের সমাজের এই চরিত্র আমি জানি, জেনেও কোনও দ্বিধা করিনি নিজেকে জানাতে।

দ্বিখণ্ডিত বইটি নিয়ে বিতর্কের একটি বড় কারণ, যৌন স্বাধীনতা। আমাদের এই সমাজের বেশির ভাগ মানুষ যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক সংস্কারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, তাই একজন। নারীর যৌন স্বাধীনতার অকপট ঘোষণায় বিরক্ত, ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ। যে যৌন স্বাধীনতার কথা আমি বলি, তা কেবল আমার বিশ্বাসের কথাই নয়, নিজের জীবন দিয়ে সেই স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেছি, অথচ যে-কোনও পুরুষ আমাকে কামনা করলেই পাবে না। এই সমাজ এখনও কোনও নারীর এমন স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত নয়। প্রস্তুত নয় এটা শিরোধার্য করতে যে, কোনও নারী তার ইচ্ছেমতো পুরুষকে সম্ভোগ করতে পারে এবং তা করেও কঠোরভাবে যৌন-সতীত্ব বজায় রাখতে পারে।

আমাদের নামি-দামি পুরুষ লেখকেরা আমাকে এখন মহানন্দে পতিতা বলে গালি দিচ্ছেন। গালি দিয়ে নিজেরাই প্রমাণ করছেন কী ভীষণ নোংরা পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সুবিধেভোগী পুরুষ-কর্তা তাঁরা। পতিতাকে তাঁরা ভোগের জন্য ব্যবহার করেন, আবার পতিতা শব্দটিকে তারা সময় সুযোগমতো গালি হিসেবেও ব্যবহার করেন। নারীকে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করার নিয়ম আজকের নয়। যদিও দ্বিখণ্ডিত বইটিতে পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে আমার লড়াইএর কথা বলেছি, বলেছি নারী আর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সমাজের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কথা, কেউ কিন্তু সে নিয়ে একটি কথাও বলছেন না, যারাই বলছেন, বলছেন যৌনতার কথা। আমার কোনও কষ্টের দিকে, কান্নার দিকে কারও চোখ গেল না, চোখ গেল শুধু যৌনতার দিকে। চোখ গেল আমার সঙ্গে পুরুষের সম্পর্কগুলোর দিকে। যৌনতার মতো গভীর গোপন কুৎসিত আর কদর্য বিষয় নিয়ে আমার মুখ খোলার স্পর্ধার দিকে চোখ।

পৃথিবীর ইতিহাসে, কোনো অন্ধকার সমাজে যখনই কোনও নারী পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে উঠেছে, নিজের স্বাধীনতার কথা বলেছে, ভাঙতে চেয়েছে পরাধীনতার শেকল, তাকেই গাল দেওয়া হয়েছে পতিতা বলে। অনেক আগে নষ্ট মেয়ের নষ্ট গদ্য বইটর ভূমিকায় আমি লিখেছিলাম, নিজেকে এই সমাজের চোখে আমি নষ্ট বলতে ভালোবাসি। কারণ এ কথা সত্য যে, যদি কোনো নারী নিজের দুঃখ দুর্দশা মোচন করতে চায়, যদি কোনও নারী কোনও ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের নোংরানিয়মের বিপক্ষে রুখে দাঁড়ায়, তাকে অবদমনের সকল পদ্ধতির প্রতিবাদ করে, যদি কোনও নারী নিজের অধিকার সম্পর্কে সজাগ হয়, তবে তাকে নষ্ট বলে সমাজের ভদ্রলোকেরা। নারীর শুদ্ধ হওয়ার প্রথম শর্ত নষ্ট হওয়া। নষ্ট না হলে এই সমাজের নাগপাশ থেকে কোনও নারীর মুক্তি নেই। সেই নারী সত্যিকার সুস্থ ও শুদ্ধ মানুষ, লোকে যাকে নষ্ট বলে। আজও এ কথা আমি বিশ্বাস করি যে, কোনও নারী যদি তার সত্যিকার স্বাধীনতা অর্জন করতে চায়, তবে এই সমাজের চোখে তাকে নষ্ট হতে হয়। এই নষ্ট সমাজ থেকে নষ্ট বা পতিতা আখ্যা উপহার পাওয়া একজন নারীর জন্য কম সৌভাগ্যের ব্যাপার নয়। এ যাবৎ যত পুরস্কার আমি পেয়েছি, পতিতা উপাধির পুরস্কারটিকেই আমি সর্বোত্তম বলে বিচার করছি। পুরুষতন্ত্রের নষ্টামির শরীরে সত্যিকার আঘাত করতে পেরেছি বলেই এই উপাধিটি আমি অর্জন করেছি। এ আমার লেখকজীবনের, আমার নারীজীবনের, আমার দীর্ঘকালের সংগ্রামের সার্থকতা।

বইটি লিখেছি বলে বাংলাদেশের একজন লেখক আমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছেন, কলকাতাতেও একজন বাংলাদেশি লেখকটির পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। কেবল মানহানির মামলা করেই ক্ষান্ত হননি, দুজনই আমার বইটি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। আমি ঠিক বুঝি না, কী করে একজন লেখক আর একজন লেখকের বই। নিষিদ্ধ করার দাবি করতে পারেন। কী করে সমাজের সেই শ্রেণীর মানুষ, যাঁদের দায়িত্ব মুক্তচিন্তা আর বাক স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা, মৌলবাদীদের মতো আচরণ করেন। আমাকে নিয়ে এ যাবৎ অনেক মিথ্যে, অনেক কল্পকাহিনী লেখা হয়েছে, আমি তো তাদের কোনও লেখা নিষিদ্ধ করার দাবি নিয়ে আদালতে দৌড়ইনি। আমি বিশ্বাস করি, এভলিন বিয়াট্রিস হল যা বলেছিলেন, ”I disapprove of what you say, but I will defend to the death your right to say it” –আমি তোমার মতের সঙ্গে একমত না হতে পারি, কিন্তু আমি আমৃত্যু তোমার কথা বলার অধিকারের জন্য লড়ে যাবো। কেন আমাদের বিদগ্ধ লেখকগণ বাক-স্বাধীনতার পক্ষে এই চরম সত্যটি অস্বীকার করতে চান!

পৃথিবীর কত লেখকই তোলিখে গেছেন নিজেদের জীবনের কথা। জীবন থেকে কেবল পরিশুদ্ধ জিনিস ঘেঁকে নিয়ে তারা পরিবেশন করেননি। জীবনে ভ্রান্তি থাকে, ভুল থাকে, জীবনে কালি থাকে, কাঁটা থাকে, কিছুনা কিছু থাকেই, সে যদি মানুষের জীবন হয়। যাদের মহামানব বলে শ্রদ্ধা করা হয়, তাঁদেরও থাকে। ক্রিস্টান ধর্মগুরু অগুস্ত (৩৩৫-৪৩০ খ্রি.) নিজেই লিখে গেছেন তার জীবনকাহিনী, আলজেরিয়ায় তিনি যেভাবে জীবন কাটাতেন, যে রকম অসামাজিক অনৈতিক বাধনহীন জীবন কিছুই প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি। তার যৌন স্বেচ্ছাচারিতা, উচ্ছংখলতা, জারজ সন্তানের জন্ম দেওয়ার কোনও কাহিনীই গোপন করেননি। মহাত্মা গান্ধীও তো স্বীকার করেছেন কী করে তিনি তার বিছানায় মেয়েদের শুইয়ে নিজের ব্রহ্মচারিতার পরীক্ষা করতেন। ফরাসি লেখক জ জ্যাক রুশোর (১৭১২-১৭৭৮ খ্রি.) কথাই ধরি, তার স্বীকারোক্তি গ্রন্থটিতে স্বীকার করে গেছেন জীবনে কী কী করেছেন তিনি। কোনও গোপন কৌটোয় কোনও মন্দ কথা নিজের জন্য তুলে রাখেননি। সেই আমলে রুশোর আদর্শ মেনে নেওয়ার মানসিকতা খুব কম মানুষেরই ছিল। তাতে কী! তিনি তার পরোয়া না করে অকাতরে বর্ণনা করেছেন নিজের কুকীর্তির কাহিনী। মাদমাজোল গতোঁ তো আছেই, আরও অনেক রমণীকে দেখে, এমনকী মাদাম দ্য ওয়ারেন, যাঁকে মা বলে ডাকতেন, তাঁকে দেখেও বলেন যে তার যৌনাকাঙ্ক্ষা জাগতো। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন (১৭০৯-১৭৯০ খ্রি.) তাঁর আত্মকথায় যৌবনের উতল উন্মাতাল সময়গুলোর বর্ণনা করেছেন, জারজ পুত্র উইলিয়ামকে নিজের সংসারে তুলে এনেছিলেন, তাও বলেছেন। বার্সাণ্ড রাসেল তাঁর জীবনীগ্রন্থে লিখে গেছেন বিভিন্ন রমণীর সঙ্গে তাঁর অবৈধ সম্পর্কের কথা। টিএস এলিয়টের স্ত্রী ভিভিয়ানের সঙ্গে, লেডি অটোলিন মোমেলের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা কে না জানে! লিও তলস্তয় লিখেছেন চৌদ্দ বছর বয়সেই তাঁর গণিকাগমনের কাহিনী, সমাজের নিচুতলার মেয়ে, এমনকী পরস্ত্রীদের সঙ্গে তার যৌন সম্পর্ক, এমনকী তার যৌনরোগে ভোগার কথাও গোপন করেননি। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন তাঁরা, সমাজ যা মেনে নিতে পারে না, এমন তথ্য পাঠককে শোনাতে গেলেন! শোনানোর নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে। নিজেদের আসল পরিচয়টি তারা লুকোতে চাননি অথবা এই অভিজ্ঞতাগুলো তাদের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই শুনিয়েছেন। এতে কি তাঁদের জাত গিয়েছে নাকি তাদের মন্দ বলে কেউ? কেউই তাদের মন্দ বলে না, যে অবস্থানে ছিলেন তাঁরা সে অবস্থানে আছেনই, বরং সত্য প্রকাশ করে নিজেদের আরও মহিমান্বিত করেছেন। পশ্চিমি দেশগুলোয় নারী পুরুষ সম্পর্কটি বহুকাল হল আর আড়াল করার ব্যাপার নয়। হালের ফরাসি মেয়ে ক্যাথারিন মিলে তার নিজের কথাই লিখেছেন La Vie Sexuelle de Catherine M বইটিতে। পুরো বই জুড়ে আছে ষাটের দশকে অবাধ যৌনতার যুগে তার বহু পুরুষ-ভোগের রোমাঞ্চকর কাহিনী। মৈথুনের নিখুঁত বর্ণনা। এ কারণে বইটিকে কি সাহিত্যের বইয়ের তাকে রাখা হয়নি? হয়েছে। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেও Vivir para contara বইটিতে পরনারীদের সঙ্গে আঁর লীলাখেলার কিছুই বলতে বাদ রাখেননি। মার্কেজকে কি কেউ মন্দ বলবে তাঁর জীবনটির জন্য, নাকি কেউ আদালতে যাবে বইটি নিষিদ্ধ করতে?

পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই বিখ্যাত মানুষদের জীবনী প্রকাশ হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে গবেষণা করে সেসব জীবনী লিখছেন জীবনীকাররা। খুঁড়ে খুঁড়ে বের করা হচ্ছে সব গোপন খবর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোপন কথাটিও তো রইছে না গোপনে। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে কথা বলেও তিনি কেন নিজের বালিকা-কন্যাটির বিয়ের আয়োজন করেছিলেন, সেই কারণটি মানুষ আজ জানছে। প্রশ্ন হল, এইসব তথ্য কী আদৌ পাঠকের জানা প্রয়োজন? কে কবে কোথায় কী করেছিলেন, কী বলেছিলেন, জীবনাচরণ ঠিক কেমন ছিল কার, তা জানা যদি নিতান্তই অবান্তর হত, তবে তা নিয়ে গবেষণা হয় কেন? জীবনীকার গবেষকরা যেসব মানুষ সম্পর্কে অজানা তথ্য জানাচ্ছেন, সেসব তথ্যের আলোয় শুধু মানুষটি নন, তাঁর সৃষ্টিরও নতুন করে বিচার ও বিশ্লেষণ সম্ভব হচ্ছে।

বাঙালি পুরুষ লেখকদের অনেকেই গোপনে গোপনে বহু নারীর সঙ্গে শরীরী প্রেমের খেলা খেলতে কুণ্ঠিত নন, নিজেদের জীবনকাহিনীতে সেসব ঘটনা আলগোছে বাদ দিয়ে গেলেও উপন্যাসের চরিত্রদের দিয়ে সেসব ঘটাতে মোটেও সংকোচ বোধ করেন না। কেউ কিন্তু এ নিয়ে প্রশ্ন তোলে না। প্রশ্ন ওঠে, কোনও মেয়ে যদি যৌনতা নিয়ে কথা বলে। সে গল্প উপন্যাসে হোক, সে আত্মজীবনীতে হোক। যৌনতা তো পুরুষের ‘বাপের সম্পত্তি’। আমার তো পুরুষ-লেখকদের মতো লিখলে চলবে না। আমার তো রয়ে সয়ে লিখতে হবে। রেখে ঢেকে লিখতে হবে। কারণ আমি তো নারী। নারীর শরীর, তার নিতম্ব, স্তন, উরু, যোনি এসব নিয়ে খেলা বা লেখার অধিকার তো কেবল পুরুষেরই আছে। নারীর থাকবে কেন? এই অধিকার পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আমাকে দেয়নি, দেয়নি বলে তোয়াক্কা না করে আমি যে লিখে ফেলেছি, যত করুণ হোক, যত মর্মান্তিক হোক, আমার সে কাহিনী, আমি যে অনধিকার চর্চা করেছি, তাতেই আপত্তি।

পুরুষের জন্য একাধিক প্রেম বা একাধিক নারীসম্ভোগ চিরকালই গৌরবের ব্যাপার। আর একটি মেয়ে সতোর সঙ্গে কাগজকলমে নিজের প্রেম বা যৌনতা নিয়ে যেই না লিখেছে, অমনি সেই মেয়ে বিশ্বাসঘাতিনী, সেই মেয়ে অসতী, সেই মেয়ে দুশ্চরিত্র। আমার আত্মজীবনীতে আমি এমন কথা বলেছি, যা বলতে নেই। আমি সীমা লঙ্ঘন করেছি, আমি বাড়াবাড়ি করেছি, আমি অশ্লীলতা করেছি, নোংরা কুৎসিত ব্যাপার ঘেঁটেছি। দরজা বন্ধ করে যে ঘটনাগুলো ঘটানো হয়, পারস্পরিক বোঝাঁপড়ায় যে সম্পর্কগুলো হয়, সেসব নাকি বলা অনুচিত। সেসব নাকি বলা জরুরি নয়। কিন্তু আমি তো মনে করি উচিত, আমি তো মনে করি জরুরি। কারণ আমার সংস্কার সংস্কৃতি, ধ্যান, ধারণা, বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে আজ এই যে আমি, এই তসলিমার নির্মাণ কাজে জীবনের সেইসব ঘটনা বা দুর্ঘটনাই অন্যতম মৌলিক উপাদান। আমি যে ভূঁইফোড় নই, তিল তিল করে চারপাশের সমাজ নির্মাণ করেছে তিলোত্তমার বিপরীত এই অবাধ্য কন্যার। নিজেকে বোঝার জন্য, আমি মনে করি, জরুরি এই আত্মবিশ্লেষণ।

নিজের সম্মান না হয় নষ্ট করেছি, অন্যের সম্মান কেন নষ্ট করতে গেলাম। যদিও অন্যের জীবনী আমি লিখছিনা, লিখছি নিজের জীবনী, কিন্তু অন্যের পারিবারিক সামাজিক ইত্যাদি সম্মানহানির বিষয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। আমি ঠিক বুঝি না, নিজের মান সম্মানের ব্যাপারে যারা এত সচেতন, তাঁরা এমন কাণ্ড জীবনে ঘটান কেন, যে কাণ্ডে তাঁরা ভালো করে জানেন যে তাঁদের মানের হানি হবে। আমি বিশ্বাসভঙ্গ করেছি? কিন্তু, আমি তো কাউকে প্রতিশ্রুতি দিইনি যে এসব কথা কোনওদিন প্রকাশ করবো না! অলিখিত চুক্তি নাকি থাকে। আসলে এই চুক্তির অজুহাত তাঁরাই তুলছেন, গোপন কথা ফাঁস হয়ে গেলে নিজেদের দেবতা চরিত্রটিতে দাগ পড়বে বলে যাঁরা আশংকা করছেন। আর তাই চোখ রাঙিয়ে শাসিয়ে দিতে চান যে সীমানা লঘন করলে চুক্তিভঙ্গের অপরাধে আমার শাস্তি হবে।

আমি যা প্রকাশ করতে চাই তা যদি আমার কাছে উচিত বলে মনে হয়–তবে? উচিত অনুচিতের সংজ্ঞা কে কাকে শেখাবে? আমার কাছে যদি অশ্লীল মনে না হয় সে কথাটি, যে কথাটি আমি উচ্চারণ করেছি তবে? শ্লীল অশ্লীল হিসেব করার মাতব্বরটি কে? সীমা মেপে দেওয়ার দায়িত্বটি কার? আত্মজীবনীতে আমি কী লিখবো, বা লিখবো না, তার সিদ্ধান্ত তো আমিই নেব! নাকি অন্য কেউ, কোনও মকসুদ আলী, কোনও কেরামত মিয়া বা পরিতোষ বা হরিদাস পাল বলে দেবে কী লিখবো, কতটুকু লিখবো!

সমালোচকরা আমার স্বাধীনতাকে চিহ্নিত করতে চাইছেন স্বেচ্ছাচারিতা বলে। আসলে আমাদের সুরুচি কুরুচি বোধ, পাপ পুণ্য বোধ, সুন্দর অসুন্দর বোধ, সবই যুগ যুগান্ত ধরে পিতৃতন্ত্রের শিক্ষার পরিণাম। নারীর নম্রতা, নতমস্তকতা, সতীত্ব, সৌন্দর্য, সহিষ্ণুতা সেই শিক্ষার ফলেই নারীর বৈশিষ্ট্য হিসেবে স্বীকৃত। আমাদের সুনিয়ন্ত্রিত চেতনা কোনও রূঢ় সত্যের মুখোমুখি হতে তাই আতঙ্ক বোধ করে। কোনও নিষ্ঠুর বাক্য শুনলে কানে আঙুল দিতেইচ্ছে করে, ঘৃণায় ঘিনঘিন করে গা, অনেক সমালোচকেরও বাস্তবে তাই হচ্ছে। আমি লেখক কি না, আমার আত্মজীবনী তাও আবার ধারাবাহিকভাবে লেখার অধিকার আছে কি না, এমন প্রশ্নও তুলেছেন। বস্তুত সবার, যে কোনও মানুষেরই আত্মকথা লেখার অধিকার আছে। এমনকী আত্মম্ভর সেই সাংবাদিকদেরও সেই অধিকার আছে যিনি মনে করেন আমার হাতে কলম থাকাই একটি ঘোর অলুক্ষণে ব্যাপার। আমাকে দোষ দেওয়া হচ্ছে এই বলে যে, আমি চরম দায়িত্বহীনতার কাজ করেছি। আমি দায়িত্বহীন হতে পারি, যুক্তিহীন হতে পারি, তবু কিন্তু আমার অধিকারটি তাগ করতে আমি রাজি নই। জর্জ বার্নার্ড শ বলেছিলেন, A reasonable man adapts himself to the world. An unreasoble man persists in trying to adapt the world to himself. Therefore, all progress depends upon the unreasonable man. বুদ্ধিমান বা যুক্তিবাদী লোকেরা পৃথিবীর সঙ্গে মানিয়ে চলে। নির্বোধ বা যুক্তিহীনরা চেষ্টা করে পৃথিবীকে তার সঙ্গে মানিয়ে চলতে। অতএব সব প্রগতি নির্ভর করে এই যুক্তিহীনদের ওপর। আমি তসলিমা সেই যুক্তিহীনদেরই একজন। আমি তুচ্ছ একজন লেখক, এত বড় দাবি আমি করছি না যে পৃথিবীর প্রগতি আমার ওপর সামান্যতম নির্ভর করে আছে। তবে বিজ্ঞদের বিচারে আমি নির্বোধ বা যুক্তিহীন হতে সানন্দে রাজি। নির্বোধ বলেই পিতৃতন্ত্রের রাঘব বোয়ালরা আমাকে পিষে মারতে আসছে দেখেও দৃঢ় দাঁড়িয়ে থেকেছি। আমার মূর্খতাই, আমার নির্বুদ্ধিতাই, আমার যুক্তিহীনতাই সম্ভবত আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ।

ধর্মের কথাও উঠেছে। আমি, যারা আমাকে জানেন, জানেন যে, সব ধরনের ধর্মীয় দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলি। ধর্ম তো আগাগোড়াই পুরুষতান্ত্রিক। ধর্মীয় পুরুষ ও পুঁথির অবমাননা করলে সইবে কেন পুরুষতান্ত্রিক ধারক এবং বাহকগণ। ওই মহাপুরুষরাই তো আমাকে দেশছাড়া করেছেন। সত্যের মূল্য আমি আমার জীবন দিয়ে দিয়েছি। আর কত মূল্য আমাকে দিতে হবে।

দাঙ্গার অজুহাত দেখিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম নয়, এর আগে বাংলাদেশেও আমার বই নিষিদ্ধ হয়েছে। এই যে নিরন্তর দাঙ্গা হচ্ছে উপমহাদেশে, আমার বই বা বক্তব্য কিন্তু দাঙ্গার কোনও কারণ নয়। কারণ অন্য। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারে, গুজরাতের মুসলমান নিধনে, অসমে বিহারি নিগ্রহে, খ্রিস্টানদের ওপর হামলায়, পাকিস্তানে সিয়া সুন্নি হানাহানিতে আমি আদৌ কোনও ঘটনা নই। অকিঞ্চিৎকর লেখক হলেও আমি মানবতার জন্যই লিখি। ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষই যে সমান, সকলেরই যে সমান অধিকার মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার, সে কথাটিই হৃদয় দিয়ে লিখি। না, আমার লেখার কারণে দাঙ্গার মতো ভয়াবহ কোনও দুর্ঘটনা কোথাও ঘটে না। যদি কিছু ঘটে, সে আমার জীবনেই ঘটে। আমার লেখার কারণে শাস্তি এক আমাকেই পেতে হয়, অন্য কাউকে নয়। আগুন আমার ঘরেই লাগে। সকল গৃহ হারাতে হয় এক আমাকেই।

চারদিকের এত ভয়ংকর নিন্দার বিরুদ্ধে আনন্দবাজার পাশে দাঁড়ালোআমার। দেশ পত্রিকায় আমাকেই প্রচ্ছদ কাহিনী করা হল। শিবনারায়ণ রায়, আমার, এবং আরও ক’জনের লেখা নিয়ে বেরোলো দেশ। দেশ এর সম্পাদকীয় ছিল অসাধারণ। না স্মরণ করে পারছি না!

‘সে কালে মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করতে চার জন যুবক। সে ছিল কবিতার কাল, কল্পনার সাম্রাজ্য। যুগ বদলেছে। এখন, মধ্যরাতে নয়, দিনে দুপুরে, কবির কল্পনায় নয়, আমজনতার চাক্ষুষ বাস্তবে, কলকাতা শাসন করেন দু’ডজন বুদ্ধিজীবী। না, কেবল কলকাতা নয়, তামাম পশ্চিমবঙ্গ। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর পশ্চিমবঙ্গ। নাট্যকার, অনুবাদক, সংস্কৃতিমনস্ক, নন্দনপ্রেমী আমাদের মুখ্যমন্ত্রী তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনীর তৃতীয় পর্ব ‘দ্বিখণ্ডিত’র ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। কেন এই নিষেধাজ্ঞা? এ বইয়ের কিছু অংশ নাকি সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে, তাই। বইটির কয়েক হাজার কপিইতিমধ্যেই ক্রেতার হাতে পৌঁছে গেছে। তসলিমার অন্য সব লেখার মতোই এই লেখা নিয়েও তর্কবিতর্ক, বাদপ্রতিবাদ হয়েছে, এমনকী মামলা-মোকদ্দমাও। কিন্তু কোথাও সাম্প্রদায়িক অশান্তির কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। সেটা এই সমাজের বড় হয়ে ওঠার লক্ষণ। মস্ত সুলক্ষণ। তা হলে পশ্চিমবঙ্গের উন্নততর বামফ্রন্ট সরকারের গণতন্ত্র-অন্ত-প্রাণ কর্তারা এমন দমননীতি জারি করলেন কেন? পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ২৫ জনের মত নিয়েছি। তাদের পড়িয়েছি। তার পরেই এই সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ, ওই কতিপয় বুদ্ধিজীবীর সুপারিশ অনুসারেই এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তিন দশকের প্রবীণ বামফ্রন্ট সরকার। লেখকের স্বাধীনতা, নিজের কথা নিজের মতো করে লেখার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাঁদের সুপরামর্শে। সত্য সেলুকাস। পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ সরকার হামেশাই বইপত্র নিষিদ্ধ করতো, কিন্তু তার দায়িত্ব নিতো নিজেরাই। জরুরি অবস্থার কালো দিনগুলোতেও এমন অনেক নিষেধ জারি হয়েছে, কিন্তু সে জন্য ইন্দিরা গান্ধী বা সিদ্ধার্থশংকর রায়কে বুদ্ধিজীবীদের দোহাই পাড়তে শোনা যায়নি। উন্নততর বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী এ এক নতুন মডেল চালু করলেন বটে। সেই মডেলের সার কথাটি হল, হুকুম জারি করবো, কিন্তু তার দায় নেব না। অবশ্য নেবেনই বা কোন দুঃখে? হাত বাড়ালেই যদি এক ঝাঁক গণ্যমান্য স্বনামধন্যের হাত মিলে যায়, যারা মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে (মাপ করবেন, অনুরোধে) রাত জেগে তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনী পড়ে ফেলে চটপট সুপারিশ জানিয়ে দিতে প্রস্তুত, তবে তো প্রশাসনের পৌষমাস–সংস্কৃতির ঘাড়ে বন্দুক রেখে সংস্কৃতি শাসনের এমন সুযোগ রাজপুরুষরা ছাড়বেন কেন? বিশেষত, সেই রাজপুরুষদের যদি আবার সংস্কৃতির নন্দনকাননে বিহারের বাসনা থাকে?

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং তার পরামর্শদাতারা কী ভেবে দেখেছেন, তাদের এই যৌথ উদ্যোগের তাড়নায় দেশে ও বিদেশে এই রাজ্যের গণতান্ত্রিকতার মর্যাদা কোন ধুলোয় লুটোলো? গোটা দুনিয়া জেনে গেল, পশ্চিমবঙ্গে একটি স্তালিন-রাজ জারি রয়েছে, যেখানে রাষ্ট্র শক্তি সম্পূর্ণ খেয়ালখুশি মতো আপনার কণ্ঠরোধ করতে পারে এবং সেই চণ্ডনীতিতে সাহিত্য, শিল্প সংস্কৃতির জগৎ থেকে নামজাদা কিছু নাগরিকের সমর্থন যোগাড় করে নিতে পারে। এ যদি সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের লক্ষণ না হয়, তবে সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ কাকে বলে, মাননীয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মহাশয় বলে দেবেন কি? কে জানে হয়তো বা তসলিমা নাসরিনের বই নিষিদ্ধ করা এবং করানোর জন্য এই উদগ্র তৎপরতার পিছনে আসলে অন্য কারণ আছে। যে মেয়ে নিজের জীবনের বৃত্তান্ত লিখতে গিয়ে ক্রমাগত আরও অনেকের জীবনের বৃত্তান্ত জনসমক্ষে মেলে ধরে, তাকে আত্মপ্রকাশের অধিকার দেওয়াটা বোধহয় এ বার অতিমাত্রায় বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। তা না হলে, পঁচিশ জন বুদ্ধিজীবী বললেন, তাই বই নিষিদ্ধ করলাম –এমন হাস্যকর নাবালকোচিত কৈফিয়ৎ, আস্তে কন, ঘুড়ায় হাসব।

বাংলার, দুই বাংলার সবচেয়ে বড় মনীষী শিবনারায়ণ রায় লিখেছেন ‘.. এ কথা নিশ্চয় করে বলতে পারি সমকালীন দুই বাংলা মিলিয়ে মেরি ওলস্টনক্রাফটের যোগ্যতমা উত্তরসাধিকা হচ্ছেন স্বদেশ থেকে নির্বাসিতা তসলিমা নাসরিন। দ্বিখণ্ডিত’ নামে তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনীর যে তৃতীয় খণ্ডটি প্রথমে বাংলাদেশে এবং সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দ্বারা নিষিদ্ধ হয়েছে, আমার বিবেচনায় সেটি একটি অসামান্য গ্রন্থ। মাতৃগর্ভে আমাদের চেহারা নানা রূপের ভিতর দিয়ে মনুষ্য রূপ ধারণ করে। কিন্তু জন্মের পর থেকেই নানাভাবে চেষ্টা চলে শিশুকে সমাজ-স্বীকৃত একটি ধাঁচে গড়ে তুলবার। বিভিন্ন সমাজে, বিভিন্ন যুগে ধাঁচটির অদলবদল ঘটে, কিন্তু উদ্দেশ্যের অদলবদল ঘটে না। সেই উদ্দেশ্যটি হল সমষ্টিস্বীকৃত একটি ধাঁচের মধ্যে ফেলে ব্যক্তির স্বকীয় স্বাধীন বিকাশের সম্ভাবনাকে বিলুপ্ত করা। সমাজে যারা ক্ষমতার দখলদার তারা ধর্ম, ঐতিহ্য, শাস্ত্র, লোকাঁচার ইত্যাদির নামে এই ধাঁচে ফেলবার প্রক্রিয়াটি চালু করে। কিন্তু প্রতি শিশুর মধ্যে নিহিত থাকে নিজস্ব একটি অস্মিতা অর্জনের সামর্থ্য। তবে সেই অর্জনের জন্য লাগে ইচ্ছাশক্তি ও প্রয়াস, যুক্তিশীলতা এবং সততা, একনিষ্ঠ সাধনা ও অনুশীলন। এখনও পর্যন্ত দেখা যায় অধিকাংশ মানুষ সমাজ স্বীকৃত ছাঁচেই গড়ে ওঠে। কিন্তু কেউ কেউ তাঁদের প্রাজাতিক সামর্থ্যকে নিজের চেষ্টায় শত বাধাবিপত্তির সঙ্গে লড়াই করেই ক্রমে বাস্তবায়িত করেন তাঁদের স্বোপার্জিত অস্মিতা তাঁদের জীবনযাত্রায়, চিন্তায়, কার্যকলাপে ভাবনায়, এবং রচনায় প্রকাশিত হয়। এইভাবেই আমরা পাই সক্রেটিস থেকে বিদ্যাসাগর, জ্যোদানো ব্রুনো থেকে মানবেন্দ্রনাথ রায়। কিন্তু কীভাবে তারা নিজেদের এই অনন্যতন্ত্র, অস্মিতা গড়ে তুলেছিলেন তার বিবরণ কচিৎ মেলে। এ ক্ষেত্রে ফরাসি দার্শনিক সিমোন দ্য বোভায়ার-এর মতো তসলিমা নাসরিনকেও ব্যতিক্রমী মনে করি। খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনীর, এবং বিশেষ করে দ্বিখণ্ডিত’ নামে তাঁর তৃতীয় খণ্ডটির সবচাইতে বড় মূল্য এবং আকর্ষণ এটির ভিতর দিয়ে আমরা অনেকটা জানতে পারি কীভাবে বহু বাধাবিপত্তি, আঘাত, অপমান আর ব্যর্থতার ভিতর দিয়ে মুসলমান মধ্যবিত্ত ঘরের একটি সাধারণ মেয়ে তাঁর আত্মশক্তি আবিষ্কার করেন, অপ্রতিম তসলিমা নাসরিন হয়ে ওঠেন। প্রথম দুটি খণ্ডে যে ভূমিকা রচিত হয়েছিল তৃতীয় খণ্ডে তা পরিণতি পায়। এই গ্রন্থের যেমন ঐতিহাসিক তেমনি সাহিত্যিক মূল্য প্রচুর। দুই বাংলার সরকারি নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এই বই অনেকে পড়বেন, এর ঢাকঢাক গুড়গুড়হীন স্পষ্টতা অনেকের অপছন্দ হবে। আবার অনেকেই এ বই থেকে আত্মরূপান্তরের প্রেরণা পাবেন। পশ্চিমবঙ্গে এখন যেসব বই জনপ্রিয় তাদের বেশির ভাগই অবক্ষয় এবং আপজাত্যের কাহিনী, অথবা লঘু রম্যরচনা। তসলিমার কষ্টের অন্ত নেই, কিন্তু তিনি পারিপার্শ্বিক চাপের কাছে হার মানেননি, নারী এবং পুরুষ উভয়েরই ভিতরে মনুষ্যত্বের উজ্জীবনে তার প্রয়াস আজও ক্লান্তিহীন।… তসলিমা তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম দুটি খণ্ডে তাঁর বাল্যকাল এবং বয়ঃপ্রাপ্তির বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন। কিছুই রেখেঢেকে লেখেননি। ফলে দুই বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের অধিকাংশ স্ত্রী-পুরুষ–যাঁরা সমস্ত অপ্রিয় সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে রাখাকেই সভ্যতার আবশ্যিক শর্ত বিবেচনা করেন –স্বভাবতই খুব বিচলিত হয়েছিলেন। ..

এখন থেকে প্রায় একশো বছর আগে বেগম রোকেয়া লিখেছিলেন, আমাদের যথাসম্ভব অবনতি হওয়ার পর দাসত্বের বিরুদ্ধে কখনও মাথা তুলিতে পারি নাই, তাহার প্রধান কারণ এই বোধ হয় যে যখনই কোনো ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, তখনই ধর্মের দোহাই অথবা শাস্ত্রের বচন রূপ অস্ত্রাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। আমাদের অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ওই ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। এই দুঃসাহসী সত্যঘোষণার জন্য তাকে যথেষ্টনিগ্রহ সইতে হয়, এবং গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময়ে নবনূর এ প্রকাশিত মূল প্রবন্ধটির কিছু অংশ বাদ দিতে হয়। একশো বছর পরেও প্রস্তাব শুনছি তসলিমার বইটি থেকেও কিছু অংশ বাদ দিলে সেটির ওপরে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হতে পারে। একশো বছর পরেও কি আমরা অতীত সময়ের সেই দুঃসহ বিন্দুটিতে দাঁড়িয়ে?

পশ্চিমবঙ্গের অনেক কাগজেই বই নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদ বেরিয়েছে। অনেক কাগজের সম্পাদকীয় বা কলামে অনেকে বই নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে মুখর হয়েছেন, যদিও বড় কিছু লেখক এবং শিল্পী সরকারি নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন করেছেন। ঢাকার কোনো কাগজেই বই নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে খুব বেশি কেউ টু শব্দ করেননি বরং প্রায় সবাই সায় দিয়েছেন বই নিষিদ্ধের মতো নিষিদ্ধ কাজে। ঘৃণার মতো সংক্রামক আর কিছু নেই। কেউ যদি একবার কারও বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচার করে, সেই ঘৃণা সম্পূর্ণই মিথ্যের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হলেও আলোর গতিরও আগে ছোটে সেই ঘৃণা।

কত কিছু ঘটে গেল ‘দ্বিখণ্ডিত’ নিয়ে। নিষিদ্ধ হল একটি মত, ‘দ্বিখণ্ডিত’ হল পাঠকের পথ। কেউ বলছে নিষিদ্ধ হোক, কেউ বলছে না হোক। কেউ বলছে ধর্ম নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করা যাবে না, কেউ বলছে যাবে। কেউ ভয়ে কেঁপে উঠে বলছে, দাঙ্গা লেগে যাবে। কেউ ঠোঁট উল্টে বলছে, দাঙ্গার কোনোআভাসই কখনো দেখা দেয়নি। কেউ বলছে, মুসলমানের ভোট পাওয়ার জন্য সরকারের এই নিষিদ্ধকরণ। কেউ বলছে, পয়গম্বরকে অশ্রদ্ধা করা হয়েছে সুতরাং নিষিদ্ধ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। যে যাই বলুক, আমি মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে। কেবল নিজের মত নয়, অন্যের মতও, সে মত আমার মতের যতই বিপরীত হোক। এ বিষয়ে আমার নিজের বিশ্বাস সামান্যও খণ্ডিত হয়নি। আমি অখণ্ডই থেকে গেছি যেমন ছিলাম।

বাংলাদেশ আমার পাঁচটি বই নিষিদ্ধ করেছে। সে তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ কম করেছে। একটি। কিন্তু নিষিদ্ধ করার কারণ দু সরকারই একই দেখিয়েছে, মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত করেছি। ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষার অজুহাতে চিরকালই শাসককুল মানুষের কণ্ঠরোধ করেছে। আমরা তো এখনও সেই যুগকেই ‘অন্ধকার যুগ’ বলি, যে যুগে ধর্ম দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হত!

‘দ্বিখণ্ডিত’ নিষিদ্ধ করায় যে অন্ধকার কেঁপে নেমেছিল, সে থেকে মানুষকে বাঁচাবার দায়িত্ব প্রথম নিয়েছিলেন সুজাত ভদ্র। তিনিই আদালতে গেলেন জরুরি একটি প্রশ্ন নিয়ে, ‘আমি এ দেশের নাগরিক, এ দেশে প্রকাশিত ‘দ্বিখণ্ডিত’ নামের বইটি আমি পড়তে চাই। কে আমার পড়ার অধিকার খর্ব করছে? তাঁকেই সাহায্য করতে গিয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে জয়মাল্য বাগচি তাঁর অসাধারণ যুক্তি পেশ করে আদালত মুগ্ধ করলেন। ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞতা আমি সুজাত ভদ্র বা জয়মাল্য বাগচিকে জানাইনি। জানাইনি মহামান্য বিচারকদেরও, যারা দ্বিখণ্ডিত’ নিষিদ্ধ হওয়ার বিপক্ষে রায় দিয়েছেন। জানাইনি, কারণ যদিও বইটি আমার লেখা, আপাতদৃষ্টিতে এ আমার ব্যক্তিগত বটে, কিন্তু নিষিদ্ধ হওয়ার পর ব্যাপারটি মোটেই আমার ব্যক্তিগত নয়। নিষিদ্ধ হলে আপনাতেই লেখক আড়ালে চলে যান, সামনে এসে দাঁড়ায় বড় প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো লেখার অধিকার। কেবল তার নয়, সবার। সবার ন্যায্য অধিকারের পক্ষে চিরকালই লড়াই করেন গুটিকয় মানুষ। তারা অলক্ষ্যে অজান্তে ইতিহাস রচনা করেন। সভ্যতার ইতিহাস। সুজাত ভদ্র এই ভারতবর্ষে এক আকাশ আলো ছড়িয়ে সেই ইতিহাসটিই রচনা করলেন। দু’বছর নিষিদ্ধ থাকার পর ‘দ্বিখণ্ডিত’ মুক্তি পেল। আদালতের রায়ে নিষিদ্ধ ‘দ্বিখণ্ডিত’র মুক্তি পাওয়া আমার ব্যক্তিগত কোনো জয় নয়, এ জয় মুক্তচিন্তার জয়, বাক স্বাধীনতার জয়, এ মত প্রকাশের অধিকারের জয়। অনেকেই যোদ্ধা ছিলেন। লেখক আর প্রকাশক তো ছিলেনই, আদালতে শুনানির দিন নিষিদ্ধের বিপক্ষে, অনেকে আবার বাক স্বাধীনতার পক্ষে উপস্থিত থাকতেন। যত দুরাশাই দেখা দিক, একটি সান্ত্বনা এই, অধিকাংশ মানুষ বই নিষিদ্ধ হোক চায় না, সে যে মতের বইই হোক না কেন। তবে একই সঙ্গে একটি আশংকা এই, অধিকাংশ এই মানুষ মুখ বুজে থাকে।

০২. হঠাৎ একদিন

হারভার্ডের জীবন শেষ হওয়ার পর ভাবি এবার কোথায়! কোন দেশ? কোন শহর! কোথাও দাঁড়াতে চাই, পায়ের তলায় মাটি চাই। যাযাবর জীবনের ইতি বারবার টানতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছি, আর যেন ব্যর্থ না হই। বাংলার মেয়ে বাংলায় ফিরবো। দীর্ঘদিনের এই স্বপ্ন আমায় তাড়া করে, আমার পায়ে পায়ে হাঁটে, সেঁটে থাকে গায়ে। এত কিছু ঘটে গেল বাংলায়! বই নিষিদ্ধ, অবান্তর কুৎসা, নিন্দা, তারপরও বাংলায় ফেরার ইচ্ছে। বিশুদ্ধ জল হাওয়া, ঝলমলে নগর, নিরাপদ জীবন ফেলে কলকাতায় ফিরি। বিদেশ থেকেই ট্রায়াংগুলার পার্কে একটি আসবাবওয়ালা বাড়ি এক মাসের জন্য ভাড়া নেওয়ার ব্যাপারটা পাকা করে, তবে। হোটেলে থাকার আর একদমই ইচ্ছে নেই। ইচ্ছে কি কোনওকালে ছিল। উপায় ছিল না বলে থাকতে হয়েছে। ট্রায়াংগুলার পার্কের বাড়িতে মানুষে, কোলাহলে, বন্ধুতে, ব্যস্ততায়, বিস্ময়ে, কৌতূহলে পুরো একমাস কাটাই। খোঁজ করতে থাকি একটি বাড়ির যেখানে অস্থায়ী নয়, রীতিমত স্থায়ী বাস করব, যতদিন বেঁচে থাকি, ততদিন। স্বপ্নগুলো পাখা মেলতে থাকে, সেইসব অচিন দেশের অচিন পাখির অচিন পাখা। অতিকায় সব পাখা আমাকে অদৃশ্য করে ফেলে।

সুইডেনের ভারতীয় দূতাবাসে আমার লেখা পছন্দ করেন এমন একজন হৃদয়বান মানুষ ছিলেন, কেন ছিলেন কে জানে! ভিসা করতে গেলে দিব্যি আমাকে ‘এক্স ভিসা দিয়ে দিলেন, যেটির, পরে জেনেছি, মেয়াদ ছমাস অন্তর অন্তর বাড়িয়ে অনন্ত কাল ভারতে থাকা যায়। এখন থেকে আর পর্যটক নই, রীতিমত বাসিন্দা আমি। কত শত স্বপ্ন মনের উঠোনে এক্কা দোক্কা খেলে, হঠাৎ যে কখন কোন্ ঘরটা কেনা হয়ে যায়, কোন্ স্বপ্নটা পূরণ হয়ে যায় নিজের অজান্তেই।

এক সকালে কলকাতা বিমান বন্দরে নেমেই কোনো একটা নম্বরে ফোন করে বাড়ি ভাড়া নেব, এক্ষুণি এই মুহূর্তে বললে ওপারের অচেনা এক কণ্ঠস্বর থেকে এক থোকা বিস্ময় ঝরে পড়ে। এভাবে বাড়ির কিছুই না দেখে বাড়ি ভাড়া কেউ নিয়েছে বলে তার জানা নেই। ধুলোধূসরিত খালি বাড়িতে খালি হাতে উঠে তোশক বালিশ খাট সোফা বাসন কিনে নিয়ে আসি, হ্যাঁ সেই সকালেই, সেদিনই। কোথায় বাড়ি ভাড়া পাওয়া যাবে, কোথায় আসবাব পত্র, কোথায় চাল ডাল, সে ধারণা দেওয়ারও অবশ্য লোক ছিল না। প্রশ্ন করলে, যারা ঘিরে থাকে, আমি নামী বলে, বা আমি আমি বলে সবাই অপ্রস্তুত হয়, উত্তর নেই, অথবা ভুল উত্তর। সংসার ওই ভুল দিয়েই শুরু হয় আমার। আমার কলকাতার সংসার।

দু’দিনেই বাড়ি বাসযোগ্য করে ফেলি। চারদিনে সাজানো। সাতদিনে ঝলমলে। ছ’মাসে মনে হয় তিরিশ বছরের সংসার। বারান্দায় শৈশবের সব ফুল। নানা রঙের ফুল ফুটে সুবাস ছড়াতে থাকে বাড়িময়। রাতে হাসনুহেনার গন্ধে বাড়ি ভেসে যায়। প্রায়ই একটি হাসনুহেনার টব শিয়রের কাছে এনে রাখি। ঘ্রাণ শুকতে শুকতে শৈশবে যেমন ঘুমোতাম, তেমন ঘুমোই। শহরের মধ্যিখানে চমৎকার বাড়ি। নিরাপদ বাড়ি। ঠিক রাস্তার ওপরে নয়। দুদুটো লোহার ফটক পেরিয়ে, দারোয়ান পেরিয়ে তবে ভেতরে ঢুকতে হয়। খোলা বারান্দা। মশলার সুগন্ধ ভেসে আসে রান্নাঘর থেকে, বারান্দায় অল্প অল্প উড়তে থাকে শুকোতে দেওয়া কাপড়। কী আশ্চর্য সুন্দর এই দৃশ্য! কতকাল আমি আমার শৈশব কৈশোরকে এত কাছ থেকে দেখি না। আলোয়, হাওয়ায় বাড়িটি সত্যিকার বাড়ি হয়ে ওঠে। আমার সাত নম্বর রাওডন স্ট্রিটের বাড়ি।

শহর আগের মতোই, তবে দীর্ঘদিনের বন্ধুটি নেই শহরে। যে বন্ধু সুসময়ে দুঃসময়ে ঠিক একই রকম পাশে থাকতেন, যাঁর সঙ্গে যে কোনো বিষয়ে যে কোনো সময় কথা বলা যেত, সেই নিখিল সরকার, নেই। সেই অথৈ সমুদ্র, সেই নিমগ্ন সাধক, সেই জ্ঞানের ভাণ্ডার নেই। জগৎ আমার, টের পাই, ঠিক বুঝে ওঠার আগেই কী রকম খালি হয়ে যাচ্ছে। মাও নেই, বাবাও নেই, নিখিল সরকারও নেই। আত্মীয় স্বজন থেকেও নেই, চেনা পরিচিত লোকদের বন্ধু বলে ডাকি। ঘন ঘন দেখা করতে আসা ভক্তদেরও বন্ধু বলি। তাড়াহুড়ো করে একটা তাসের ঘরের মতো কিছু গড়ে তুলছি কি! মাঝে মাঝে সবকিছুকে অদ্ভুত এক মায়া, রহস্যের জালের মতো মায়াবি এক জাল অথবা জীবন নিয়ে নিতান্তই বালখিল্য রসিকতা বলে মনে হয়।

রাওডন স্ট্রিটের বাড়ির দুয়ার সবার জন্য খোলা। সবার জন্য, এমন কী অচেনা মানুষের জন্যও আপ্যায়নের অন্ত নেই। আতিথেয়তা আমার অন্তরে। কত ঠিক-মানুষ, কত বেঠিক মানুষ, কত ভুল, কত ধূর্ত আমার ঘরের চৌকাঠ পেরিয়েছে। কাউকেই বেঠিক বা ভুল ভাবতে আমার ইচ্ছে করেনি। আজও করে না। এরকমই আমি। এরকমই সাদাসিধে আর নিরীহ। ঘরের পোশাকে আর হাওয়াই চপ্পলে হেঁটে হেঁটে দিব্যি ঘুরে বেড়াই শহর। ফুটপাত থেকে সস্তা জিনিস পত্তর কিনি। গড়িয়াহাটের বাজার থেকে বেড়ালছানা তুলে এনে আদরে আহ্লাদে বড় করি। সাদামাটা ধুলোবালির জীবন। আবার এই জীবনই মুহূর্তে ঝলমলে হয়ে উঠতে পারে। বই মেলায় স্টলের দরজা বন্ধ করে রাখতে হয় ভিড় ঠেকাতে। পুলিশের লাঠিচার্জের দরকার হয় ভক্তদের উন্মাদনা দূর করতে। তারপরও পাঠকদের সঙ্গেই সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সাহিত্যজগতের মাতব্বরদের সঙ্গে ওঠা বসা নেই মোটেই। কাউকে দাক্ষিণ্য দেওয়া বা গুরু মানা আমার স্বভাবে নেই। সত্য কথা কোনও রাখঢাক না। করে বলে দেওয়া, মাতব্বরদের, শুনেছি, একেবারেই পছন্দ নয়। নিভৃতে আমি বাস করি আমার মতো। দেশি জীবনের বাইরেও আরেক জীবন আছে। পশ্চিমের দেশে যেতে হয় ঘন ঘন। অনুষ্ঠানে কবিতা পড়তে বা বক্তৃতা দিতে, বা পুরস্কার নিতে। কোনও না কোনও আমন্ত্রণ থাকেই। শুধু পশ্চিমের দেশেই ভালো ঘটনা ঘটছে, তা বলবো না। ভালো কিছু কলকাতাতেও ঘটে। ব্যাগ ফিল্মস আমার ‘ফরাসি প্রেমিক’-এর গল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্র তৈরি করার জন্য চুক্তিপত্রে সই নিয়ে যায়, কণিমাইটের টাকাও দিয়ে যায়। খুব ঘটা করে আমার লেখা ভূমিকা সম্বলিত শত বছরের রবিবাসরীয় গল্পগুলোর নির্বাচিত একটি সংকলন বের হয় ‘আনন্দ’ পাবলিশার্স থেকে। ‘আনন্দ’ আমার লেখা বইগুলোর সমগ্র করার জন্যও উদ্যোগ নেয়। আমার ‘শোধ’ গল্পটি নিয়ে টেলিভিশনে এক মাসের একটি সিরিয়াল দেখানো হয়। অন্য সব সিরিয়ালের চেয়েও জনপ্রিয় হয় এটি। মেগা সিরিয়ালের গল্প লেখার জন্য আমন্ত্রণ জোটে। লিখতে থাকি মেগাসিরিয়ালের গল্প। গল্পের নাম দিই ‘দুঃসহবাস’। ওদিকে সুটিংও হতে থাকে। ‘ফেরা’ গল্প নিয়ে অনেকদিন হল নাটক হচ্ছে। বিভিন্ন মঞ্চে। গিরিশ মঞ্চে, মধুসূদন মঞ্চে, রবীন্দ্র সদনে সেই নাটক দেখি। তা ছাড়া বিভিন্ন গ্রুপ থিয়েটারের অসাধারণ সব নাটক দেখাও হয়। একবার নান্দীকার আয়োজন করলো নাট্যসপ্তাহের, সেইসব নাটক শেষ হলে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত আমাকে মঞ্চে ডাকতেন যেন বিজয়ী কলা কুশলীদের মাল্যদান করি। নিজেকে কলকাতার সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক জগতের একজন মনে হয়। কখনও মনে হয় না আমি কলকাতার লোক নই, আমি অন্য দেশ থেকে এসেছি। সেই কিশোরী বয়স থেকেই তো কলকাতার সঙ্গে সখ্য আমার। সেকালে সেঁজুতিতে যাদের কবিতা ছাপাতাম, অথবা যাদের লিটল ম্যাগে আমার কবিতা ছাপা হত, একদিন ওদের যে ক’জনেরই খোঁজ পাওয়া যায়, সবাইকেই আ আর রাতের খাবারের নেমন্তন্ন করি বাড়িতে। কেউ এখনও লিখছে, কিন্তু যে জায়গায় ছিল সেই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে, কেউ তান্ত্রিক হয়ে গেছে, কেউ ব্যবসায়ী, তারপরও পুরোনো দিনগুলো ফিরে পেতে চাওয়ার আকুলতা আমি টের পাই আমার ভেতর। দেশ থেকে দাদা আসে। ঝুনু খালা আসে। দাদার ছেলে শুভও বেড়াতে আসে। সবাইকেই আদরে ডুবিয়ে রাখি। আর কলকাতা দিতে থাকে আমাকে দুহাত ভরে। সকালে বাংলা খবরের কাগজ পড়ার সুযোগ কোথায় আর পেতাম জগতে। বিকেলে কোনও একটা বাংলা ম্যাগাজিন, বা বই হাতে নিয়ে শুয়ে পড়া। সন্ধেয় বাংলায় আড্ডা আর রাতে এক গুচ্ছ বাঙালি মিলে হৈ হৈ করে বাঙালি খাবার! তাছাড়া তো আছেই টেলিভিশনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, বিভিন্ন বিষয়ে মত প্রকাশ করার আমন্ত্রণ। আর আছে বিভিন্ন চিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন করা। নানা লেখক কবির বইএর ফিতে কাটা। বিভিন্ন মঞ্চে কবিতা পড়া। আর ‘ধর্ম মুক্ত মানববাদী মঞ্চ’ নিয়ে স্বপ্ন দেখা। বাঙালি মুসলমান পরিবারে জন্ম কিন্তু ধর্মমুক্ত মানুষদের জড়ো করে একটি মানববাদী সংগঠন গড়ে তুলি, নিজেকে ইচ্ছে করেই রাখি নেপথ্যে। সংগঠনের উদ্দেশ্য সত্যিকার ধর্মমুক্ত রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষা এবং আইন প্রতিষ্ঠা করা, মেয়েদের শিক্ষিত আর স্বাধীন করা, মসজিদ মাদ্রাসার উৎপাত বন্ধ করা। পশ্চিমবঙ্গের আনাচ কানাচ থেকে আগ্রহীরা জড়ো হতে থাকে। অন্ধকারে পড়ে থাকা মুসলমান সমাজকে আলোকিত করার উদ্যোগ নিই, খুব ছোট বটে দল, কিন্তু স্বপ্ন ছোট নয়। বাতি খুব উজ্জ্বল, কিন্তু সব আঁধার ঘরে, সব অন্ধকার গলিতে পৌঁছে দেবার লোকবল নেই। না থাকুক, কলকাতার বিভিন্ন মঞ্চে অনুষ্ঠান করা, লিফলেট বিতরণ, মিটিং মিছিল চলতে থাকে।

দৈনিক স্টেটসম্যানে নিয়মিত কলাম লিখি। এক একটি কলাম হাজার বছরের সংস্কার ভেঙে নতুন সময়ের দিকে, নারী পুরুষের সমতার দিকে, একটি সুস্থ সুন্দর সমাজের স্বপ্ন দেখাতে দেখাতে হাত ধরে নিয়ে চলে। নিখিল সরকার নেই, তবে শিবনারায়ণ রায়, অম্লান দত্ত আর প্রশান্ত রায়-এর সঙ্গে হয় সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক বৌদ্ধিক আলোচনা। একদিন ঘটা করে মরণোত্তর দেহদানও করে ফেলি। মরে গেলে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা পড়বে শরীর। দুটো চোখ আর দুটো কিডনি চলে যাবে যাদের প্রয়োজন, তাদের কাছে। দেশের নানা রাজ্য থেকে আমন্ত্রণ এলে ঘুরে আসি, বইয়ের উদ্বোধন, নয়তো ভাষণ। যেখানেই যাই একদিকে ভক্তের ভিড়, আরেকদিকে মৌলবাদী বিক্ষোভ। কেরালা, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম, মহারাষ্ট্র, দিল্লি। বাকি জীবন কলকাতায় থাকবো, এতে কোনো দ্বিধা নেই বলে একটা গাড়ি কিনে ফেলি একদিনের নোটিশে। বাড়িও কিনি, চমৎকার একটা দোতলা বাড়ি।

এক উঠতি কবির সঙ্গে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। এক ডাক্তারের সঙ্গেও অদ্ভুত একটাঅমীমাংসিত সম্পর্ক গড়াতে থাকে। এমন সময় সেই দিনটি আসে, কালো সেই দিনটি।

বাড়ি থেকে অনেকদিন বেরোই না। অনেকদিন একটানা বসে থেকে ভালোও লাগছিল না। ডক্টর ইনাইয়া বলছিলেন হায়দারাবাদে আমার ‘শোধ’ বইটা বেরোচ্ছে, তাঁর স্ত্রী অনুবাদ করেছেন, যেন যাই একবার ওখানে, বই উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতায়। এর আগে দুবার তিনি আমাকে সম্বর্ধনা দেওয়া বা আমার বক্তৃতা শোনা ইত্যাদি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন, যেতে রাজি হইনি। এবার রাজি হয়েছি। রাজি হওয়ার কারণ বোধহয় নতুন জায়গা, আমার একটু হাওয়া পাল্টানো, একটুখানি কলকাতার একঘেয়েমি কাটানো। সকালে গিয়ে বিকেলে ফিরবো, কোনও সুটকেস, কোনও টুথব্রাস, কোনও কাপড় চোপড় নেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। নীল শিফনের একটা শাড়ি পরে নিলাম। ইস্ত্রিও করা নেই। দলামোচা হলেও খুব একটা বোঝা যায় না। আর গেলেই বা কী! কাপড় চোপড় নিয়ে মাথা আমি ঘামাই না। সাজগোজ নিয়েও না। একসময় তো লিপস্টিক পরাও বাদ দিয়েছিলাম। এখন চুলটা এলোমেলো হলে একটুখানি আঁচড়াই আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক পরি, এতে শুকিয়ে চড়চড় হওয়া থেকে ঠোঁটের বাঁচা হয়।

হায়দারাবাদ বিমান বন্দরে নেমে ডক্টর ইনাইয়াকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি একটু অবাক হই। নিরাপত্তা-পুলিশ কোথায়! ভেবে নিই, পুলিশ অনুষ্ঠানে থাকবে, বিমান বন্দরে আসেনি। ঝকঝকে একখানা গাড়িতে আমাকে উঠিয়ে হোটেলে নিয়ে গেলেন ইনাইয়া। পাঁচতারা হোটেলের একটা ঘর তিনি ভাড়া নিয়েছেন অনুষ্ঠানের আগে আমার বিশ্রামের জন্য। ঘরটা সুন্দর। বিছানায় শুয়ে একটুখানি টেলিভিশন দেখি। উঠে চা বানিয়ে খাই। এরমধ্যেই ফোন। কী, নিচে নামতে হবে। অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। অনুষ্ঠান কোথায়, কী ধরনের অনুষ্ঠান, তার কিছু আমি জানি না। ইনাইয়াকে জিজ্ঞেস করলে কড়া অস্ত্রের উচ্চারণে তিনি ঠিক কী বলেন বা বলতে চান, তার বেশির ভাগই বুঝতে পারি না। জিজ্ঞেস করলাম, পুলিশ প্রোটেকশন রাখেন নি?

ইনাইয়া এর উত্তরে কী বললেন, আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব হল না।

‘যে রাজ্যেই যাই, আমার জন্য তো নিরাপত্তা রক্ষীর ব্যবস্থা করা হয়। আপনি করেননি?’

এবার যা বললেন, তা খুব কান পেতে শুনে বোঝার চেষ্টা করে যেটুকু উদ্ধার করতে পারলাম, তা হলো–‘করিনি.. হে হে। ছোটখাটো অনুষ্ঠান। তেমন প্রচার হয়নি। খামোক পুলিশের ঝামেলা করার দরকার কী!’

‘ও। আসলে ঝামেলা করতে নয়, পুলিশ প্রোটেকশন বরং ঝামেলা এড়াতেই রাখতে হয়।‘

‘হে হে।‘

আমি জানিনা ইনাইয়াকে কেন স্মরণ করিয়ে দিলাম না যে এই হায়দারাবাদে আমি গত দু’দুবার আমন্ত্রণ পেয়েও আসা বাতিল করেছি, তার একমাত্র কারণ এ শহরকে আমি নিরাপদ বলে ভাবিনি। কারণ মুসলমানরা এ শহরে আমার বিরুদ্ধে এর আগে কিছু হৈ চৈ করেছে, কাগজে পড়েছি বইয়ের দোকান ভাংচুর করেছে আমার লজ্জা বিক্রি করছিলো বলে। আমার ভুলো মন। ভুলেই হয়তো গিয়েছিলাম এ শহরে মুসলমানের সংখ্যা অন্য অনেক শহরের তুলনায় বেশি। মুসলমানের সংখ্যা বেশি হলেই মুসলমান মৌলবাদীর সংখ্যা বেশি হওয়ার আশংকা থাকে। মৌলবাদীরা আমাকে বহুবছর ইসলাম-বিরোধী খেতাব দিয়ে বসে আছে। সব মোছা যায়, এই খেতাব মোছা যায় না। আমার নাস্তিকতা, আমার মানববাদ, আমার বিজ্ঞানমনস্কতা, আমার মানবতা কিছুই মানুষের মস্তিষ্কে গভীর করে গেঁথে যাওয়া ‘আমি ইসলাম-বিরোধী এই বিশ্বাসের কাঁটাটি উপড়ে ফেলতে পারেনি।

অনুষ্ঠান হায়দারাবাদের প্রেসক্লাবে। উদ্বোধন হলোবইয়ের। আমার ‘শোধ’ উপন্যাসের তেলুগু অনুবাদ। একজন তেলুগু লেখক এবং একজন অনুবাদক নিজেদের লেখা এবং অনুবাদ সম্পর্কে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বললেন। আমি বললাম মানবাধিকার বিষয়ে। ‘শোধ’ নারীবাদী বই। শোধের প্রধান চরিত্র ঝুমুর নিজেকে পুরুষের সম্পত্তি হতে দেয়নি, প্রতিবাদ করেছে। নারী যে পুরুষের বা সমাজের সম্পত্তি নয়, এ কথাই চিরাচরিত কোমল কণ্ঠে বললাম। আমার কণ্ঠস্বর কিছুতেই ‘মিছিলের ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’ বলা মেয়েদের মতো হয়ে ওঠে না। শান্ত, শিষ্ট, নম্র, নরমই রয়ে যায় যতই ক্রুদ্ধই হই না কেন, যত কঠিন কথাই বলি না কেন!

অনুষ্ঠান শেষে বেরোবো দুপুরের খাবার খেতে, তখনই ঘটনাটি ঘটে। প্রেস ক্লাবের সামনের দরজা দিয়ে কিছু লোক ভিতরে ঢুকে তেলুগু ভাষায় চিৎকার করতে করতে আমার দিকে এগোতে থাকে। চিৎকার করে কী বলছে তা বোঝার সাধ্য আমার নেই। আমার দিকেই বা এগোচ্ছে কেন, তাও জানি না। হঠাৎ দেখি, হাতের কাছে যা পাচ্ছে, ফুলের তোড়া, বই, ব্যাগ, চেয়ার–সব ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে আমাকে লক্ষ্য করে। ঠেকাতে গিয়ে ক’জন আহত হলেন। সাংবাদিকরা ব্যস্ত ক্যামেরায় ছবি তুলতে। আমি ওদের পেছনে নিজেকে আড়াল করার ব্যর্থ চেষ্টা করছি। আমার গায়ে কী এসে লাগল, নিয়ে ভাবছিলাম না। ভাবছিলাম, ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকা মৃত্যু থেকে কী করে বাঁচবো আমি। কেউ একজন আমাকে টেনে পেছনের দরজার কাছে নিয়ে গেল, ক্লাবঘর থেকে আমাকে বের করে নেবে, গাড়িতে ওঠাবে। আক্রমণকারীরা তখন পেছনের দরজার দিকে দৌড়ে আসছে। বুঝে যাই, গাড়িতে ওঠা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। পেছনের দরজাটি আমি দ্রুত বন্ধ করে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে জোরে লাথি মেরে দরজার কাঁচ ভেঙে ফেললো ওরা। কী করে বাঁচবো, এই ভাবনা মাথায়, অন্য সব ভাবনার লেশমাত্র কিছু নেই কোথাও। দৌড়ে যাই সামনের দরজায়। না, ওদিক দিয়েও বেরোনোর কোনও উপায় নেই। প্রেস ক্লাব ঘিরে ফেলেছে আক্রমণকারীরা। সামনের দরজাও ভেতর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হল। ক্লাব ঘরটার ভেতর আমি আর কিছু নিরীহ নারী। দু’একজন পুরুষও সম্ভবত ছিলেন। ওঁরা ভাঙা দরজার সামনে চেয়ার ফেলে উঁচু বাঁধ তৈরি করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। আমাকে বললেন থামের আড়ালে লুকোতে। কেউ বললেন টেবিলের তলায় ঢুকে যেতে। কিন্তু ফাঁকা ঘরটার মধ্যে যেখানেই লুকোই আমি, বাঁধ ভেঙে ঢুকে পড়লে আমাকে হাতের মুঠোয় পেয়েই যাবে ওরা। বাইরে বিকট শব্দে তখন জানি না ক’জন লোকের স্লোগান চলছে, ‘ নাসরিন মুর্দাবাদ’। স্লোগান ছাড়াও অন্য চিৎকারের শব্দ। এমন সময় মঞ্চের নীল পর্দার পেছনে যে একটি গোপন দরজা ছিল, শুনি সেটি খোলার চেষ্টা চলছে বাইরে থেকে। দরজা ভেঙে ঢুকে পড়লে থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা আমাকে পেয়ে যাবে চোখের সামনে। আবার থামের আড়াল থেকে অন্য আড়ালে দাঁড়ালে বাঁধ দেওয়া দরজা ভেঙে ঠিকই খপ করে ধরে ফেলবে আমাকে। বাঁধের দরজা ভাঙতে বাইরে থেকে বাধা দিচ্ছিলেন সাংবাদিকরা। নিজেরা আহত হয়েও ঠেকাতে চাইছিলেন ওই ভয়ংকর মারমুখো লোকদের। ছবি তোলা বাদ দিয়ে অনেকে তখন আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। মৃত্যু যে কোনও মুহূর্তে আমার খুব কাছে এসে দাঁড়াবে। মুহূর্তগুলো আমার বুকের ভেতর ঢং ঢং করে বাজছিল। যে কোনও সময় শেষ মুহূর্তের ঘণ্টা বাজবে। অসহায় আমি ঘরটির মধ্যে এক আড়াল থেকে আরেক আড়ালে যাচ্ছি। শখ করে পরা গলার মঙ্গলসূত্ৰ কখন ছিঁড়ে পড়ে গেছে, খেয়াল করিনি। কেউ জানে না, কী করে বাঁচানো যাবে আমাকে। দরজার বাঁধের কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের ভীষণ, বিকট আওয়াজের দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছেন ঘরের কয়েকজন। যে কোনও মুহূর্তে ধাক্কা খেয়ে ওঁরা উল্টে পড়বেন। বাইরের চিৎকার আর স্লোগানের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। বুকের ভেতরে ঢং ঢং ঘণ্টা বেজেই চলেছে। অনুরোধ করে যাচ্ছি কেউ যেন একবার পুলিশে খবর দেয়। কিন্তু কে দেবে? সকলেই উদভ্রান্ত। এমন ঘটনা কোনোদিন তাঁরা চোখের সামনে ঘটতে দেখেননি। ছুটোছুটি। কারও কারও আর্ত চিৎকার। যখন প্রাণে মারা হবে আমাকে, কিছু বুলেট ছিটকে গিয়ে বা ছুরির কোনো অংশ বেকায়দায় ওদের পেটে পিঠে লেগে গিয়ে ওঁরা আবার আহত হন কি না, এ নিয়ে কী ওঁরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কে জানে। প্রথম দিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো দৃশ্যগুলো দেখতে থাকলেও বিস্ফোরণের আশংকা করে আয়োজক এবং দর্শকের মধ্য থেকেও অনেকে পালিয়ে যাচ্ছেন। আমি একা পড়ে যাচ্ছি। ক্রমশ দেয়ালের দিকে যাচ্ছি। আর কোনও আড়াল নেই সামনে। আমার মনে হতে থাকে ডানদিকের দরজা ভাঙা প্রায় বুঝি সারা, মনে হতে থাকে বাঁ দিকের দরজায় বাঁধের কাছাকাছি এগিয়ে আসছে হত্যাকারীরা। কয়েকটা লাথি, কয়েকটা ধাক্কা, তাহলেই উল্টে পড়বে উঁচু করে রাখা চেয়ারগুলো। পা পা করে এগিয়ে আসতে থাকা মৃত্যুর পায়ের আওয়াজ পাচ্ছি আমি। আর অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছি পুলিশের আওয়াজ পেতে। না, পুলিশ ত্রিভুবনে নেই। কেউ জানে না কী ঘটছে হায়দারাবাদের প্রেসক্লাবে। আমার যে চোখ ফেটে জল আসবে তাও আসছিল না। শরীর শিথিল হয়ে মেঝেয় লুটিয়ে পড়বে, তাও পড়ছিল না। হত্যাকারীদের সঙ্গে যদি পিস্তল থাকে। গুলি ছুড়বে। যদি ছুরি থাকে, কুপিয়ে মারবে। আর, কিছু যদি না থাকে, মাথায় আঘাত করবে লোহার চেয়ারগুলো দিয়ে। নয়তো পিষে মারবে পায়ের তলায়। এরা তো অনেকজন। আমি একা। ক্রমশ একা হচ্ছিলাম। ঢং ঢং শব্দ আরও বিকট স্বরে বাজছিল। আমি তো জানি এরাই ফতোয়া দেয় আমার বিরুদ্ধে। এরাই মাথার দাম ঘোষণা করে, এরাই চিৎকার করে মুন্ডু চায়, এরাই ফাঁসির দাবিতে পথে নামে, এরাই ক’দিন পরপর আমার কুশপুত্তলিকা পোড়ায়, বই পোড়ায়। এর আগে কোনোদিনই এরা এতটা হাতের কাছে আমাকে পায়নি। এরা এখন যা ইচ্ছে তাই করতে পারে আমাকে। যে কোনও মুহূর্তেই এখন আমি দেখতে পাবো জীবনের শেষ মুহূর্তকে। মৃত্যু ঠিক কী রকম। খুব কষ্ট হবে কী! এরা কি বুকে বা মাথায় গুলি করবে, নাকি কেটে কেটে কষ্ট দিয়ে দিয়ে ধর্ষণ করে করে পিষে পিষে মারবে।

হঠাৎ পুলিশ এলো। ওই ভাঙা দরজার বাঁধ ভেঙে পুলিশ ঢুকলো, হত্যাকারী ঢোকার আগে। আমার নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা ওরাই করলো। দেয়ালে সেঁটে থাকা আমার পাথর শরীর অথবা অস্থির শরীর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হল, মুষ্ঠি আলগা হল হাতের। শুনলাম মৌলবাদীদের ভোলা হচ্ছে পুলিশের ট্রাকে। তারপর আমাকেও নিরাপত্তার শক্ত বেষ্টনীতে নিয়ে পুলিশের গাড়িতে তোলা হল, দ্রুত আড়াল করা হল। শুভাকাঙ্খীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।

এর মধ্যে মৃত্যুর মুখটি তো আমার দেখা হয়ে গেছে। ওরা যখন হত্যা করে, ওভাবেই করে। সব তছনছ করে। জানিয়ে শুনিয়ে দেখিয়ে। পয়গম্বরের নাম নিতে নিতে। পতাকা ওড়াতে ওড়াতে। আজ আমার অলৌকিক বেঁচে যাওয়া। জীবন আর মৃত্যুর ব্যবধান ছিল এক সুতোর। আমার আশংকা মৃত্যু আমার ওভাবেই হবে কোনও একদিন। কোথাও যখন আমি কবিতা পড়ছি, কোথাও যখন আমি মানবতার কথা বলছি, অতর্কিতে কেউ আমার হৎপিন্ড ফুটো করবে।

কী দোষ করেছি আমি? ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, নির্যাতন, আর নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে কথা বলা কি অন্যায়? মানবাধিকার আর মানববাদের পক্ষে দাঁড়ানো কি অন্যায়? ঘৃণার আগুনে আমাকে যে করেই হোক তারা পুড়িয়ে মারবে। কেন, কার কী ক্ষতি আমি করেছি?

আমাকে জীবন দিয়েছে মানুষের ভালোবাসা। শুধু ভারতবর্ষ থেকেই নয়, ভারতবর্ষের বাইরে থেকেও পেয়ে যাচ্ছি যুক্তিবাদী, মুক্তবুদ্ধি আর শুভবুদ্ধির মানুষের সমর্থন। চোখে আমার জল এসেছে মৌলবাদীদের আক্রোশ আর তাদের বিষ দাঁত দেখে নয়। যখন বিধ্বস্ত আমি, যখন মৃত্যুর গুহা থেকে আমাকে বাঁচিয়ে আনা হল, যখন শুনছিলাম কারও উদ্বিগ্ন কণ্ঠ, ‘ভালো আছো তো? বা আমি তোমার সঙ্গে আছি, বা আমরা তোমার পাশে আছি, তখন এসেছে চোখে জল।

আমার আর একা লাগে না। জানি আমরা সংখ্যায় বেশি, আমরা, যারা গণতন্ত্রে আর মত প্রকাশের অধিকারে বিশ্বাস করি। আর তারা চিরকালই সংখ্যায় কম, যারা বাক স্বাধীনতা বিরোধী, মানবতাবিরোধী, অসহিষ্ণু, মৌলবাদী। যুদ্ধ কি আমার একার সঙ্গে তাদের? যুদ্ধ তো আমাদের সবার সঙ্গে তাদের! একটি সুস্থ সমাজ গড়ার জন্য, একটি সুন্দর দেশ গড়ার জন্য, একটি বাসযোগ্য জগৎ গড়ার জন্য আমরা ওই ভয়ংকর অথচ ক্ষুদ্র শক্তির বিরুদ্ধে আপোসহীন ভাবে লড়তে পারি। আমরা সবাই। পারি না?

আমার ভাবনাগুলোকে থামিয়ে দিয়ে গাড়ি সশব্দে থামে খোদ পুলিশ হেডকোয়ার্টারে। প্রকৃতির কাছে তখন আমার প্রার্থনা শুরু হয়, যেন হিন্দু বেষ্টিত হয়ে থাকি, যেন কোনও মুসলমান পুলিশের মুখোমুখি না হই। দোতলায় উঠিয়ে পুলিশের বড় বড় লোকদের সঙ্গে পরিচয় করানো হচ্ছে। ধর্ম বড় ভয়ংকর। বড়কর্তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলে আড়চোখে বুকে লাগানো নামখানা পড়ে নিশ্চিন্ত হয়ে নিই। পুলিশের সবাই খুব অমায়িক আর আন্তরিক। আক্রমণকারী মৌলবাদীদের সবাইকেই চেনেন পুলিশের লোকেরা। ঘরের টিভিতে প্রেসক্লাবের কুৎসিত আক্রমণের ঘটনাই দেখানো হচ্ছে। থেকে থেকে বড়কর্তা মন্তব্য করছেন। আমাকে দিয়ে ওদের বিরুদ্ধে দুটো অভিযোগপত্র লিখিয়ে নিয়ে আমাকেও বলছেন, ‘সব কটাকে হাজতে নেওয়া হচ্ছে, একটুও ভাববেন না। আমার আর ভাবনার কী! আমি তো শহর ছেড়ে চলেই যাচ্ছি। এ শহরে কখনও আর আসা হবে বলেও মনে হয় না।

সন্ধ্যেয় ফেরার কথা ছিল কলকাতায়, এয়ারলাইনসে ফোন করে সময়টা এগিয়ে আনলেন বড়কর্তা। বিকেলে আমাকে বিমানবন্দরে নিয়ে গেলেন পুলিশ কর্তারা। কোনও সাংবাদিকের জানার কথা নয় আমি কখন বিমান বন্দরে পৌঁছোবো। তারপরও সাংবাদিকের ভিড়। সম্ভবত সারাদিন বসে থেকে অপেক্ষা করারই উদ্দেশ্য ওদের। স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম, সাক্ষাৎকার দেব না। কিন্তু কেউই বন্দর থেকে সরে যায় না। ভিড় করেই থাকে। কলকাতায় পৌঁছেও ওই একই অবস্থা দেখি। বন্দর ছেয়ে আছে সাংবাদিকে। কী করে লোক জানলো কখন আসছি আমি, কে জানে! বাড়িতে দেখি আঙিনা ভরে আছে। টিভি ক্যামেরায়, সাংবাদিকে। কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দিইনি। কারও সঙ্গেই কথা বলিনি। ঘটনা যা ঘটেছে, তার প্রতিবাদ অন্যরা করুক। আমাকে করতে হবে কেন প্রতিবাদ! সেই কতকাল থেকে লড়ছি মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে। আমার মলিন মুখখানাই, আমার সন্ত্রস্ত দেহখানাই টিভিতে দেখিয়ে বলতে হবে কেন যে আমি মত প্রকাশের স্বাধীনতা চাই। মানুষ মুখ খুলুক। সারা দেশ দেখেছে কী ঘটেছে। নিজের ওপর হামলার ঘটনা নিজে আর কত বর্ণনা করবো। যথেষ্ট কি হয়নি। আমার কি ক্লান্তি বলতে কিছু নেই! আমার কি রাগ হওয়া উচিত নয়। আমি কি লেখক হয়েছি লেখার জন্য নাকি লেখার অধিকারের জন্য লড়াই করার জন্য। আর কত আমাকে মার খেতে হবে, অনুযোগ করতে হবে, তাড়া খেতে হবে, কাঁদতে হবে।

বাড়িতে উদ্বিগ্ন বন্ধুরা, আমার ফেরার অপেক্ষা করছিলো। ভেতরের অসহ্য আগুন বা শীতলতা আমাকে স্তব্ধ করে রাখছিলো। সবাই জানতে চাইছিল কী ঘটেছে, কেন ঘটেছে, আদ্যোপান্ত। কাউকেই আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল না। শুধু বেড়ালটাকে খুঁজছিলাম। ফোন বেজে চলেছে। কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করেনি। শুধু বেড়ালটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করেছে। চাইছিলাম বন্ধুরা সবাই বাড়ি থেকে চলে যাক। আমাকে একা থাকতে দিক। আমার ঘুম পেয়েছিলো। খুব ঘুম। যেন হাজার বছর ঘুমোইনি। কিন্তু ঘুমোতে কি পেরেছি! বারবারই সেই মুখগুলো ভাসছিল চোখের সামনে, আততায়ীদের ভয়ংকর ক্রুদ্ধ মুখ, হিংস্র শরীর। মৃত্যু একেবারে দু’হাত দূরে এসে দাঁড়ালে মানুষের ঠিক যেমন লাগে, আমারও তেমন লেগেছিলো। আমাকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্য হয়তো ওদের ছিল না। কিন্তু সেসময় তো আমার জানা ছিল না ওরা বিধায়ক, দলের জনপ্রিয়তা কমে গেছে বলে এসেছিলো আমাকে আক্রমণ করে এলাকায় নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়াতে। আমি তো ভেবেছিলাম ধর্মান্ধ ফতোয়াবাজ মৌলবাদী গোষ্ঠী এতদিনে আমাকে হাতের কাছে পেয়েছে। নিরাপত্তাহীন, নিরস্ত্র আমাকে হত্যা করে বেহেসতে যাবার এমন মোক্ষম সুযোগ ওরা হাতছাড়া করবে না। অনেক ছোটখাটো মৃত্যুর ফাঁদ থেকে বেঁচে বেরিয়েছি। এবার আর কোনও উপায় নেই। ওদের থাবা থেকে আমার বাঁচার এবার আর উপায় নেই। প্রাণে আমাকে মারেনি। পারেনি বলবো না। ইচ্ছে করলেই পারতো। ইচ্ছে না করলেও ক্রোধ মানুষকে এমন অমানুষ করে ফেলে যে মেরে ফেলা তখন খুব কঠিন হয় না। তখন বরং মারাটাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

মৃত্যু থেকে উঠে আসা আমি। পুনরুত্থিত আমি। দ্বিতীয় জীবন আমি।

ইসলাম সম্পর্কে একটি শব্দ উচ্চারণ না করেও হায়দারাবাদে আমাকে মৌলবাদীদের আচমকা আক্রমণের রাজনীতির শিকার হতে হয়েছে। আমাকে আক্রমণের পিছনে, যা শুনলাম, ছিল এলাকায় জনপ্রিয় হওয়ার বাসনা। হামলা চালিয়েছিল হায়দারাবাদের মজলিস ইত্তেহাদুল মুসলিমিন নামের এক রাজনৈতিক দল। অন্ধ্র প্রদেশের বিধানসভায় এই দলের এক বড় নেতা বলেছেন, ‘ধর্মদ্রোহী কথাবার্তা যারা বলে, তাদের কোতল করাই উচিত।‘ প্রেসক্লাবে গতকালের হামলার পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে তাঁর বক্তব্য, আমাদের বিধায়করা যা করেছেন, তার জন্য মুসলিমরা গর্বিত। তাঁদের সাধুবাদ পাওয়া উচিত। মোহম্মদের প্রতি কোনও অসম্মান আমরা বরদাস্ত করবো না।

অন্য একটি ইসলামি গোষ্ঠী উঠে এসেছে। মজলিস বাঁচাও তেহেরিক। এই গোষ্ঠী বলছে, আমাকে নাকি মেরে ফেলারই পরিকল্পনা করা হয়েছিল, এমআইএম (মজলিস ইত্তেহাদুল মুসলিমিন) বরং আমাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এমআইএমের তিন বিধায়ককে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল, জামিনে ওরা ছাড়াও পেয়ে গেছে। দলের নেতা সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, নির্ভুল উচ্চারণে নির্মেদ ভাষায় ঘোষণা করে দিয়েছেন, হায়দারাবাদে ফের যদি যাই কখনও, আমাকে মেরে ফেলা হবে। হ্যাঁ, আমাকে মেরে ফেলবেন ওঁরা। কী কারণ এসবের? এই প্রশ্নের উত্তর চারদিক থেকে যা পাই তা হল, পুরসভা নির্বাচনের আগে ইসলামি গোষ্ঠীগুলো নিজেদের গুরুত্ব বাড়িয়ে নিতে চাইছে। আমাকে যারা আক্রমণ করবে, আঘাত করবে, তারা ইসলামকে বাঁচাবে। ইসলামকে যারা বাঁচাতে পারবে, তাদেরই মুসলমানরা চোখ বুজে সমর্থন করবে, ভোট দেবে। তসলিমা নামের এক মেয়ে ইসলামকে ধ্বংস করে ফেলছে, সুতরাং তসলিমার হাত থেকেইসলামকে বাঁচাতে হলে ওকে মেরে ফেলতে হবে, ওকে মারলে এপারে ফতোয়ার অগাধ টাকা পাওয়া যাবে, ওপারে বেহেস্তলাভ হবে। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে আজ মুসলিম মৌলবাদীরা ঠিক এভাবেই দরিদ্র অশিক্ষিত অজ্ঞান মুসলমানদের উস্কানি দিচ্ছে এবং তাদের ভোটও ছলে বলে কৌশলে বাগিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থাও পাকা করছে। দেশের প্রায় পঁচিশ ভাগ লোক মুসলমান, এবং মৌলবাদীরা এই বিশাল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। কোনো সুসভ্য, সুশিক্ষিত সেকুলার, যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক লোককে এই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ভাবা হয় না। এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কী আছে!

সংসদে আমার প্রসঙ্গ ওঠে, ঘটনার নিন্দা করা হয়। টিভিতে আলোচনার আসর বসে। বাক স্বাধীনতা নিয়ে তর্ক তুঙ্গে ওঠে। হায়দারাবাদের মৌলবাদীরাও সেই আসরে বসে রীতিমত বাক স্বাধীনতা নিয়ে নিজেদের মত প্রকাশ করে। আমি ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলেছি, মোহাম্মদকে অপমান করেছি, মুসলমানদের অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছি, সুতরাং আমাকে মারা হয়েছে, মারটাকম হয়েছে, আরোমারা উচিত ছিল। কেবলবে, যে, সেদিনের আমার ভাষণে ইসলাম শব্দটিই ছিল না! ওদের মূল বক্তব্য, আমাকে ভারত থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে। আমি বিদেশি, আমার কোনো অধিকার নেই এ দেশের মুসলমানের মনে আঘাত দেওয়ার। মনে মনে বলি, ‘বিদেশিদের অধিকার নেই, তবে কি তোমাদের মনে আঘাত দেওয়ার অধিকার দেশিদের আছে?’ সোজা কথা বললেই তো হয় যে ‘জগতের কারও অধিকার নেই মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার’! বললেই তো হয়, যে, ‘আমরা বাক স্বাধীনতায়, মত প্রকাশের অধিকারে এক ফোঁটাও বিশ্বাস করি না!’

জীবনে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। অনেক যন্ত্রণা সয়েছি। কিন্তু মাঝে মাঝে যন্ত্রণার ওপর পরশ বুলিয়ে যায় কারও কিছু কথা। সকালবেলাতেই আনন্দবাজারের সম্পাদকীয়টি পড়ে মন ভালো হয়ে যায়।

‘স্বাধীনতার হীরকজয়ন্তি পূর্তির অব্যবহিত আগে তসলিমা নাসরিনের উপর ব্যক্তিগত আক্রমণের ঘটনা এ দেশের সাংস্কৃতিক অশক্ত, দুর্বল অবয়বটি আবার চিনাইয়া দিল। হায়দরাবাদের প্রেস ক্লাবে এই সুখ্যাত ও বিতর্কিত লেখকের উপর শারীরিক-মানসিক নিগ্রহের যে প্রয়াস দেখা গেল, তাহা এক কথায়, বর্বরতা। এমন একটি ঘটনার নেতৃত্ব দিলেন তিন বিধায়ক, ইহা প্রমাণ করে যে এ দেশের সাংস্কৃতিক অসহিষ্ণুতা কোনও প্রান্তিক বা বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়, মূলস্রোতের রাজনীতির উপর-পরতেও তাহা যথেষ্ট দৃশ্যমান। এবং এই অসহিষ্ণুতার প্রকাশ যথেষ্ট পরিকল্পিত ও সংগঠিত। তসলিমা নাসরিন তাঁহার বিতর্ক ফুলিঙ্গ-বিধৃত রচনার জন্য স্বদেশ এবং অন্যান্য দেশে মুসলিম মৌলবাদীদের আক্রমণের মুখে পড়িয়াছেন, কিন্তু দুনিয়ার অন্যতম বৃহৎ গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষ, বহু-সংস্কৃতিবাদী ভারতবর্ষে তাঁহার এই অভিজ্ঞতার স্বাদ নিশ্চয় অনেকাংশে আলাদা। তিনিও নিশ্চয় এখন এ দেশের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে স্বাধীন যাতায়াতের আগে পুনর্বিবেচনা করিবেন, হয়তো এখন হইতে অতিরিক্ত নিরাপত্তার ঘেরাটোপে আশ্রয় লইয়া গণতন্ত্রের আওতা হইতে খানিক দূরত্বে বসবাস করিবেন। দুর্ভাগ্য এই আত্মগর্বিত দেশেরও –-ব্যক্তিগত মতামত ও সামাজিক সহিষ্ণুতার ভিতরে সীমারেখাঁটি কী ও কেমন, ষাট বৎসরের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র যাহাকে শিখাইয়া উঠিতে পারে নাই।

সমস্যার মূলটি এইখানেই। এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার তীব্র সমালোচনা সর্বত্র, এমনকী রাজনৈতিক দলগুলিও প্রতিবাদ জানাইয়াছে।

ব্যক্তিগত মতামত ও সামাজিক সহিষ্ণুতার এই প্রথম পাঠ বিভেদরেখার সকল দিকের মানুষকেই গ্রহণ করিতে হইবে, গত্যন্তর নাই। আদিমতা হইতে আধুনিকতার যাত্রাপথে একটি বিষয় স্পষ্ট হইয়া গিয়াছে, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর বিশ্বাস ও মতামতকে শ্রদ্ধা করা না গেলেও সহ্য করিতেই হইবে, ইহা সভ্যতার মৌলিক ভিত্তি। অর্থাৎ ইহা কেবল বাঞ্ছনীয় নয়, ইহা একেবারে আবশ্যিকএর পর্যায়ে। প্রয়োজনে অধৈর্য ও অসহিষ্ণুতার অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োজন। দেব দেবীর প্রেমলীলাঅঙ্কন করিয়াছেন বলিয়াশিল্পীকে যাহারা। লাঞ্ছনা করেন, কিংবা ধর্মপুরুষের অবমাননা রচনা হইয়াছে বলিয়া যাহারা লেখকের দিকে আক্রমণার্থে ধাবিত হন, তাহাদের সকলেরই কঠিন শাস্তি পাওয়া উচিত। সমাজ যদি নিজে হইতে সভ্যতা ও সুশীলতার সংস্কৃতি গড়িয়া তুলিতে না পারে, পরস্পর-সহনের বোধটিতে পৌঁছাইতে না পারে, তবে রাষ্ট্রেরই আগাইয়া আসিতে হইবে, উপায় কী!

প্রতিবাদ এমন অনেক হয়েছে। না, শাস্তি ওই হায়দারাবাদি মৌলবাদীদের কারওরই হয়নি। গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে গেছে, থানায় কিছুক্ষণ রেখে, সম্ভবত চা বিস্কুট খাইয়ে, ছেড়ে দিয়েছে। সরকারি দলের জোটশক্তি ওরা। সুতরাং সত্যিকার শাস্তি, অনেকে বলছে, ওদের কেউ দেবে না। এমনিতে পার পেয়ে যাবে।

মানুষ কেন এত মূর্খ হয়, কেন এত নিষ্ঠুর হয়, আমি বুঝতে পারি না। ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে মুখতা আর নিষ্ঠুরতার সম্পর্ক খুব গভীর। নিষ্ঠুরতা খুব সংক্রামক। হায়দারাবাদে আমাকে আক্রমণ করা হলো, কিন্তু যে শহরে থাকি সে শহরে কোনও জুৎসই আক্রমণ এখনও হলো না, এ নিয়ে কলকাতার মৌলবাদীরা দুঃখ প্রকাশ করতে শুরু করলো। দুঃখ ঝেড়ে একদিন সোজা নেমে পড়লো আমার মাথার দাম ঘোষণা করতে বা কুশপুতুল পোড়াতে। মাঠে নামানো হল মাদ্রাসার ছাত্রদের, যারা জানেই না আমার নাম,বা কিছু। মাদ্রাসার এক পাল ছেলে আমার কুশপুতুল পোড়াচ্ছে, অথচ কোনওদিন পড়েনি আমার একটিও বই। কেন পোড়াচ্ছে, কারণ তাদের মৌলবাদী নেতা বলেছে, আমি নাকি ইসলামের বারোটা বাজিয়েছি, ইসলামকে প্রায় ধ্বংসই করে ফেলেছি, এখন তাদের সবার দায়িত্ব ইসলামের যেটুকু অবশিষ্ট আছে, সেটুকু বাঁচানো। মাদ্রাসা-মসজিদে এভাবেই আমার বিরুদ্ধে মগজ ধোলাই চলে। আমার সম্পর্কে না হয় তারা না জানলো, ইসলামকে পুঁজি করে মিটিং মিছিলের আয়োজন করতে গেলে ইসলাম সম্পর্কে তো সামান্য কিছু জানতে হয়। ধর্মতলার জনসভায় হায়দারাবাদ থেকে মৌলবাদীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে আনা হয়েছে। সবাই মিলে মহাসমারোহে আমার মাথার দাম ঘোষণা করলো। দামটা কত জানতে চাইলো মৌলবাদী দর্শক শ্রোতা। মঞ্চ থেকে একজন নেতা বললো, পাঁচ লাখ। হায়দারাবাদের বড় নেতা সঙ্গে সঙ্গে পাঁচ লাখকে শুধরে দিয়ে বললো ‘আনলিমিটেড। মঞ্চের বাকিরা চেঁচিয়ে বললো। ‘আনলিমিটেড। শত শত টুপি মাথার লোক উল্লাসে উচ্ছাসে ফতোয়াকে স্বাগত জানালো। জনসভায় পুলিশের বড়কর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের সামনেই আমার মাথার দাম ঘোষণা হল। সব মৌলবাদীই বুক ফুলিয়ে ফতোয়া দিল, বুক ফুলিয়ে পুলিশের নাকের ডগায় হেঁটেও গেল। এই অবৈধ ফতোয়া জারিতে কারো বিন্দুমাত্র কোনো অসুবিধে হলো না। কী চমৎকার জীবনই না এরা যাপন করে ভারতবর্ষে।

হায়দারাবাদ থেকে কলকাতায় ফেরার পর দুটো ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা আমার জন্য। দরজার কাছে বেশ কয়েকজন নতুন পুলিশ বসেছে। কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে পুলিশের কাছে নাম ঠিকানা লিখে ঢুকতে হয় ভেতরে। দুনম্বর, আমাকে বাড়ি থেকে কোথাও বেরোতে দেওয়া হয় না। যেখানেই যেতে চাই, পুলিশ বলে দেয়, বড়বাবুর অনুমতি নিতে হবে। অনুমতির জন্য ওরা ছোটবাবুকে ফোন করে। ছোটবাবু করে বড়বাবুকে। অনুমতি মেলে না। বেশ কিছুদিন এরকম হবার পর আমি বুঝে নিলাম, আমাকে গৃহবন্দি করা হয়েছে। বাড়িতে বন্ধুরা আসছে বটে, কিন্তু কোথাও আমার বেরোনো নিষেধ। বাজারে যাবো, না যেতে দেওয়া হবে না। বন্ধুর বাড়ি, না। অসুস্থ বন্ধুকে দেখতে, না কোথাও না। এরকম গৃহবন্দি জীবন আগে কাটাইনি। ভেবেছিলাম, কিছুদিন পর বোধহয় অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে আসবে। কিন্তু তার কোনও লক্ষণ দেখি না। এদিকে তাইওয়ান থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমি তাইওয়ান যাবো। সুতরাং ট্রাভেল এজেন্সিতে আমাকে যেতে হবে। বড়বাবু এবার যেতে দেবেন। অবশ্য তাইপেই-এ কবিতা উৎসবে যাওয়ার জন্য কোনো ট্রাভেল এজেন্সিতে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না আমার। ইলেকট্রনিক টিকিট ইমেইল করে দিলেই হয়। শুধু শহরটা দেখার জন্য, বাইরের হাওয়াটা নেওয়ার জন্য ফুসফুসে, স্বাধীনতার স্বাদটা নেওয়ার জন্য অন্তরে, আমার বের হতে চাওয়া। স্বাধীনতা কাকে বলে আমি জানি। স্বাধীনতার রূপ রস গন্ধ আমি চিনি। স্বাধীনতা ফিরে পেতে আমার প্রতি বিন্দু রক্ত টগবগ করে, ফুঁসে ওঠে, ফুলে ওঠে। সমুদ্রে বাঁধ দিয়ে দেখুক কেউ, কী হয়। ঘরের বাইরে কোথাও যেতে না দেওয়া, শুধু ট্রাভেল এজেন্সিতে যেতে দেওয়ার অর্থ আমি টের পাই, শুধু দেশের বাইরে বেরোনোর অনুমতি পেতে পারি, দেশের ভেতরে আমার চলাফেরা নিষিদ্ধ।

বাড়ির সামনে বসা পুলিশদের সকাল বিকেল চা দেওয়া হচ্ছে। ওদের জন্য বিস্কুট আনাচ্ছি। মিঠাই থেকে মিষ্টি আনাচ্ছি, দই আনাচ্ছি। চিড়ে ভাজা, মুড়ি ভাজা। নিজে নুডলস বেঁধে দিচ্ছি। দিনে কয়েকবার চা। কয়েকবার আমপোড়া শরবত, অরেঞ্জ স্কোয়াশ। নিচে যারা বসেছে বাইরের গেইটের কাছে, ওপরে যারা ফ্ল্যাটের দরজার কাছে, কেউ যেন শুকনো মুখে বসে না থাকে, সেদিকে কড়া নজর আমার। অনেকগুলো শারদীয়া, ম্যাগাজিন, বই দেওয়া আছে, যার পড়তে ইচ্ছে করে পড়বে। ফ্যান দুদুটো কিনেছি। যেন হাওয়া খেতে পারে। চেয়ার তো প্রথম দিনই বেশ অনেকগুলো কিনে দেওয়া হয়েছিল। সবাইকেই অতিথির মতোই আপ্যায়ন করি। মাঝে মাঝে পুলিশেরা এসে বসে ঘরে। টেলিভিশনে খেলা দেখে। একজন তো সোফায় লম্বা হয়ে ঘুমোয় দুপুরের খাবারের পর। পুলিশের মধ্যে এমনিতেই একটা কাড়াকাড়ি চুলোচুলি আছে আমার ডিউটি করার। কেউ বদলি হলো তো রীতিমত কেঁদে কেটে বুক ভাসাবে। আমার ওপর চিঠি লেখার চাপ আসে, ”দিদি, লিখে দিন আমি খুব ভালো দেহরক্ষী, আমাকে ছাড়া আপনার অসুবিধে হচ্ছে, আমাকে ছাড়া চলবে না।

শুধু বোঝার জন্য সরকারের সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হয়েছে কি না, দেড় বা দু’সপ্তাহ পর পর পুলিশকে বলি, যে, বাইরে যেতে চাই। শংকরকেই বলি এক মন কেমন করা বিকেলে, আজ বাইরে যাবো, শংকর বললো, –কোথায় যাবেন? এরকম কখনও আগে আমাকে জিজ্ঞেস করা হতো না। আমিই যখন খুশি বেরিয়ে গাড়িতে উঠে তবে শংকর বা তপনকে বলতাম কোথায় যেতে চাই। দিন হঠাৎ করে পাল্টে গেছে। একটু চমকাই, কিন্তু সামলে নিই। শান্ত কণ্ঠে বলি, –দীপংকরদা’র বাড়ি যাবো, বেহালায়। শংকর আর তপন রীতিমত আত্মীয়র মতোই হয়ে গিয়েছিল। দু’জনের বাড়িতে আমাকে নিয়ে গেছে, আদর করে খাইয়েছে। আমার বাড়িকেও নিজের বাড়ির মতোই অনেকটা মনে করতো। হঠাৎ ওলোট পালোট হয়ে গেছে সবকিছু, সব সম্পর্ক, সব চলাফেরা, সব নিয়ম, সব বিশ্বাস। একটা বড় প্রশ্ন বোধক চিহ্ন ঝুলে থাকে মাথার ওপর সারাক্ষণ। চিহ্নটি দিন দিন অতিকায় হচ্ছে। শংকর নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। অপেক্ষা করতে থাকি আমি। পনেরো মিনিট বা আধঘণ্টা পর শংকর এসে রবোটের গলায় বলে, –ওখানে যাওয়ার অনুমতি নেই।

–কেন নেই?

–সে তো জানি না।

–আপনার তো জানা উচিত। কেন আমি আজ বেহালায় যাওয়ার অনুমতি পাবো?

–আমি অফিসারকে জানালাম। অফিসার বড়বাবুকে জানালেন। বড়বাবু কিছুক্ষণ পর ফোনে জানিয়ে দিলেন, যাওয়া যাবে না।

–কেন? কেন যাওয়া যাবে না?

–সে সম্পর্কে কিছু বলেননি।

–কেন বলেননি? জিজ্ঞেস করুন। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, কেন যাওয়া যাবে না, কী অসুবিধে।

শংকর ঘর থেকে বেরোয় তবে না মানুষের গলায়, না রবোটের গলায় আমাকে আর সে জানাতে আসে না আমার বেহালায় যাওয়ার অনুমতি না পাওয়ার কোনও কারণ।

এরপর আরেকদিন সল্টলেক যাবো, তৈরি হয়ে নিই। শিবনারায়ণ রায়ের বাড়ি আমাকে যেতেই হবে। উনি অসুস্থ।

বড়বাবুর আদেশ জানিয়ে দেওয়া হল আমাকে, –না, হচ্ছে না।

–না কেন?

–না, কারণ কলকাতা জুরিসডিকশনের বাইরে সল্টলেক।

–সারা বছর তো কত বারই সল্টলেক গেলাম, জুরিসডিকশনের প্রশ্ন তো ওঠেনি।

শংকর বা তপন চুপ। ওদের মুখেও ভয় আর একধরণের কী-হচ্ছে-কিছু-বুঝতে-না পারা থমথম করে।

অনেকদিন বিরাটি যাইনি। যাওয়া খুব জরুরি।

ওই একই উত্তর, বড়বাবু জানিয়ে দিয়েছেন, সম্ভব নয়।

এর কদিন পর আবারও আমার ইচ্ছের কথা জানাই, হাওড়া যাবো।

–না হবে না।

এরপর আরও কাছাকাছি কোথাও যাবো। জুরিসডিকশনের মধ্যে কোথাও যাবো। ভবানীপুর যাবো, যদুবাবুর বাজারে।

–সম্ভব নয়।

–এখন তো কলকাতা শহরের মধ্যেই, সম্ভব নয় কেন?

–সে সম্পর্কে কিছু জানায়নি আমাকে।

–কে বাজার করবে? না খেয়ে থাকবো?

–তা জানি না। শুধু জানি, যে, হবে না যাওয়া।

–এতকাল নিজে বাজার করেছি। এখন বাজারটাও করতে পারবো না!

–বড়বাবু বলে দিয়েছেন, সম্ভব নয়।

–কেন?

–কেন, তা বলেননি।

–সিদ্ধান্ত কি বড়বাবুর?

–হ্যাঁ।

আমার ধারণা হয়, সিদ্ধান্ত আরও ওপরের।

বাড়িতেই শুধু নয়, পরিবর্তন লক্ষ করি অন্যত্র। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসররা আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বক্তৃতা করতে। প্রায় বছর হল চেষ্টা করছেন আমাকে রাজি করাতে। শেষ রাজি হয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় উচ্ছ্বসিত। কিন্তু হায়দারাবাদের ঘটনার পর আমাকে সংক্ষিপ্ত চিঠিতে ওঁরা জানিয়ে দিলেন, আমার অনুষ্ঠান বাতিল করতে ওঁরা বাধ্য হচ্ছেন। কেন বাতিল করেছেন, তা অবশ্য জানালেন না। জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি। অনুষ্ঠান বাতিল করার পেছনের কারণ, ওঁরা নিশ্চিত যে, আমি বুঝবো। তবে একটা সত্য ওঁরা হয়তো জানেন না, যে, আমি মৌলবাদীদের আস্ফালন খুব ভালো বুঝি, ওদের চেঁচামেচির আসল কারণটাও আমার জানা, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক, বা সাহিত্য সংস্কৃতির লোক, বা সরকারের লোক বা রাজনীতির লোক –এঁদের ভয় বা কুঁকড়ে থাকাটা আমি ঠিক বুঝি না। অথবা বুঝি কিন্তু মানতে পারি না।

এক ফতোয়ায় জীবন অতিষ্ঠ। তার ওপর আরেক ফতোয়া জারি করে বসলেন জনপ্রিয় গায়ক কবীর সুমন, এককালের সুমন চট্টোপাধ্যায়। টিভিতে আমার ‘দ্বিখণ্ডিত বইটি খুলে মুহম্মদ সম্পর্কে কোথায় কী লিখেছি তা শুধু পড়ে শুনিয়ে শান্ত হননি সুমন, বইয়ের কোন পৃষ্ঠায় কী আছে, তাও বলে দিয়েছেন, এবং এও বলেছেন আমার বিরুদ্ধে মৌলবাদীদের জারি করা ফতোয়াকে তিনি সমর্থন করেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর, সত্যি বলতে কী, অতিরিক্ত মুসলমান হয়েছেন তিনি। এমনিতে নব্য মুসলমানদের সম্পর্কে কথাই আছে যে পারলে মৌলবাদীদের চেয়েও দু’কাঠি বেশি মৌলবাদী। সত্যি কথা বলতে কী, মৌলবাদীদের অত ভয়ংকর ফতোয়াকেও আমি অত বেশি ভয়ংকর মনে করিনি, যত করেছি সুমনের ফতোয়াকে। বারবারই সুমন বলেছেন, তাঁর পয়গম্বর সম্পর্কে আমি জঘন্য কথা লিখেছি–ক্রুদ্ধ, ভয়ংকর সুমন, যে সুমন এতকাল নাস্তিক বলেই পরিচিত ছিলেন, গানও লিখেছেন ভগবানকে অপমান করে। আমার বিশ্বাস হয় না সুমন মুহম্মদকে পয়গম্বর মানেন, বা ইসলামে বিশ্বাস করেন। আগাগোড়াই ধর্মের রাজনীতি তাঁর। সে রাতে ভয়ে আমার বুক কেঁপেছে। সে রাতেই আমি প্রথম জানালা দরজাগুলো ভালো করে লাগানো হয়েছে কী না তা পরখ করে শুয়েছি। সে রাতে আমি সারারাত ঘুমোত পারিনি। সে রাতেই আমার মনে হয়েছে, মৌলবাদীরা আমাকে সত্যিকার ফতোয়া দেয়নি, দিয়েছেন সুমন। মৌলবাদীরা কোনোদিনই স্পষ্ট করে বলতে পারেনি ইসলাম সম্পর্কে ঠিক কী লিখেছি, প্রমাণ দেখাতে পারেনি আমি ইসলামের অবমাননা করেছি, কিন্তু সুমন আমার বই হাতে নিয়ে ক্যামেরার সামনে বসেছেন, পড়েছেন সেই সব লেখা, যুক্তি দিয়ে ধর্ম খণ্ডন করা। দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশে বলেছেন, বিশ্বাস না হয় আপনারই পড়ুন, দেখুন কী লিখেছে। ক্যামেরা তখন ‘দ্বিখণ্ডিত’ বইয়ের সেইসব পৃষ্ঠায়। যে কোনও জঙ্গি মুসলমান সে রাতে ভাবতে পারতো, ‘মরি তো মরবো, ওকে মেরে মরবো’। এই কাজটা কে করলো! না কোনও মৌলবাদী নয়, সাংস্কৃতিক জগতের নামি দামি প্রগতিশীল বলে খ্যাত এক শিল্পী। অবিশ্বাস্য লাগে সবকিছু। কেমন যেন স্বাসকষ্ট হতে থাকে। যেন সুস্থ স্নিগ্ধ খোলা হাওয়া নেই আর কোথাও। মৌলবাদীদের আক্রমণের পর যাদের আমার পাশে থাকার কথা, তাঁদেরই দেখি দূরে চলে যেতে, শুধু দুরেই চলে যান না, মৌলবাদীদের চেয়েও দ্বিগুণ আক্রমণ করে আমাকে স্থবির করে দেন। আমি একা হতে থাকি। ভীষণ একা। পায়ের তল থেকে মাটি সরে যেতে থাকে। বুঝি। টের পাই। যাঁদের কাছে আমার লেখা, আমার আদর্শ, আমার নীতি মোটেও দোষের নয়, তাঁরাও আমার দোষ ধরতে থাকেন। যারা ধর্মের সমালোচনা করে অভ্যস্ত, তাঁরাও আমার ধর্ম নিয়ে কথা বলাকে সইতে পারেন না।

পায়ে আমার অদৃশ্য শেকল। চলতে গেলেই বাজে এই শেকল। শেকলই বলে দেয়, কোথায় এবং কতদূর যেতে পারি আমি। অন্যায় মেনে নেওয়ার মানুষ তো আমি নই। বিনা অপরাধে আমাকে বন্দি করা হবে কেন? আমার মনে আর শরীরে লক্ষ করি প্রতিবাদের বুদবুদ। অস্থির আমি কেবল ঘর-বারান্দা করি। এত প্রিয় ঘর, এটিকেই মনে হতে থাকে কারাগার। বন্ধুরা যারাই আসে, এই বন্দিত্বের কথা শোনে, চুক চুক করে দুঃখ করে চলে যায়। হয়তো কারওরই কিছু করার নেই। অথবা করার থাকলেও করা উচিত হবে কী না ঠিক বুঝে পায় না। একদিন হঠাৎই দেখতে চাই সরকারি নিষেধাজ্ঞা কত দূর গেছে, বা যেতে পারে। পুলিশদের জানিয়ে দিই, জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করবো। সঙ্গে সঙ্গে ওপরতলায় খবর চলে গেল। জ্যোতি বসুর বাড়ি যেতে চাইছি আমি। সত্যি বলতে কী, জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করা জরুরি ছিল না আমার। মনে হয়েছিল, উনিই হয়তো একমাত্র মানুষ এ শহরে, যার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে আমার পায়ের শেকল খুলে দেওয়া হবে। জ্যোতি বসু প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীই শুধু নন, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। শুরু থেকেই আছেন এই পার্টির সঙ্গে। সাতাত্তর থেকে দু’হাজার সাল, সবচেয়ে দীর্ঘ সময় তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। জ্যোতি বসুকে ফোন করে দেখা করতে চাই’ বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাজি হয়েছেন। মানুষটি অসাধারণ। একবারও ভাবলেন না, তাঁর পার্টির সরকার আমার বই নিষিদ্ধ করেছে, আর এখন হায়দারাবাদে আমার ওপর হামলা হওয়ার পর কোথায় আমাকে পাশে দাঁড়াবে, তা নয়, আমাকে গৃহবন্দি করেছে, আমার সঙ্গে দেখা করাটা তার উচিত হবে না। একবারও জিজ্ঞেস করেননি, কী কারণে দেখা করতে চাই, কী কথা বলতে চাই বা এ জাতীয় কোনও প্রশ্ন।

বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এখন অনুমতি দেন কী না প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে, সেটিই দেখার বিষয়। আমাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। মুহূর্তে খবর চলে এলো, দেবেন দেখা করতে। হাসি ফুটলো শংকরের মুখে। পুলিশগুলো ভালোবাসে আমাকে। আমার বন্দিত্ব এদেরও পীড়া দেয়। ছোট সরকারি চাকুরে, সরকারি সিদ্ধান্ত বদল করার শক্তি এদের নেই। ফুলের বড় একটা তোড়া নিয়ে, মিঠাই থেকে অনেক দই আর রসগোল্লা নিয়ে রওনা হই মহান নেতার ইন্দিরা ভবনে। কী আনন্দ যে হয়! আনন্দ হয় মুক্তির স্বাদ পেয়েছি বলে। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছি বলে বারবারই বিপদের মুখে পড়ছি। বারবার পরাধীনতার শৃংখলে জড়িয়ে পড়ছি। সে আমি জানি। তারপরও আপোস করার কথা মুহূর্তের জন্যও মনে আনি না।

ইন্দিরা ভবনে পৌঁছোনোর পর জয়কৃষ্ণ, জ্যোতি বসুর দেখাশোনা করার ভার যার ওপর, জানিয়ে দিলেন, কোনও মিষ্টিই ঘরে আনার দরকার নেই, তিনি খাবেন না। কী কাণ্ড! খাবেন না, অতিথিদের তো খাওয়াতে পারেন! জয়কৃষ্ণের তীব্র সতর্কতার অথবা কঠিন আদেশের সঙ্গে তর্ক করতে ইচ্ছে করেনি। ঘরে ঢুকে তাঁর জন্য অপেক্ষা করি। তিনি এসে মুখে সেই রহস্যের হাসি, হাত জোড় করে নমস্কার জানালেন। উঠে দাঁড়িয়ে আমিও। খুব বেশি কারও সঙ্গে আজকাল দেখা করেন না। অসুস্থ। পরনে সবুজ একখানা লুঙ্গি আর সাদা ফতুয়া। তাঁর সঙ্গে আগে আরও দুবার আমার দেখা হয়েছে, এই ইন্দিরা ভবনেই। এত বড় একজন মানুষ, অথচ আমার সঙ্গে বসে কী সহজে কথা বলেন। কথা বলতে বলতে আমি ভুলে যেতে থাকি তার সঙ্গে বসে গল্প করার যোগ্য আমি নই। সম্ভবত রাজনীতির খুব বেশি কিছু আমি বুঝি না বলেই কোনওদিনই রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ভালো কথা বলতে জানি না আমি।

খুব বড় মানুষদের সঙ্গে যেচে কোনোদিন পরিচিত হতে বা খাতির জমাতে যাই না। এ আমার স্বভাবের বাইরে। বড়রা যদি আমার ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহ দেখান, তাহলেই সশরীরে উপস্থিত থেকে বড়দের আগ্রহ যথাসম্ভব মেটাতে অথবাদূর করতে তেমন আপত্তি করি না। বড়দের কাছে আমার না যাওয়ার কারণ কিন্তু অহংকার নয়, নিতান্তই সংকোচ। বড়রা ব্যস্ত মানুষ, অযথা তাদের বিরক্ত না করে দুর থেকে তাদের সরবে নীরবে শ্রদ্ধা করে যাওয়াই স্বাস্থ্যসম্মত। কিন্তু আমারই তৈরি এই নিয়ম অনিচ্ছাসত্ত্বেও কখনো কখনো আমাকে ভাঙতে হয়েছে। ফ্রাঁসোয়া মিতেরোঁর সঙ্গে দেখা করতে হবে, জ্যাক শিরাখের সঙ্গেও। লিওনেল জসপা তোমাকে ডেকেছেন, সিমোন ভেইল অপেক্ষা করছেন, গুন্টার গ্রাসের সঙ্গে দেখা করবে এসো, অ্যালেন গিন্সবার্গ কথা বলবেন। বাধ্য হয়েছি দেখা করতে। বড়দের সঙ্গে সত্যি বলতে কী কখনো কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে না আমার। ওঁদের সঙ্গে দেখা হয়, ওঁরা চমৎকার কথা বলেন, কেউ কেউ বেশ আদর যত্নও করেন। কিন্তু বিদেয়টা শেষ বিদেয়ই হয়। যোগাযোগে আলসেমি আছে বলে ও পথ মাড়াই না, আর বড়রা বড় বলে খুব স্বাভাবিক, যে, কোনো খোঁজ খবরও আর করেন না। জ্যোতি বসুর সঙ্গে বছর সাত আগে এভাবেই আমার দেখা হয়েছে। প্রথম দেখা। কারও কাছে কোনো আবদার করিনি, কোনো ইচ্ছে প্রকাশ করিনি দেখা করতে চাওয়ার, হঠাৎ শুনি তাঁর সঙ্গে আমার দেখা করার দিন তারিখ সব ঠিক। ঘটনাটি ঘটিয়েছিলেন আমার এক শুভাকাঙ্খী, সম্ভবত তিনি আমাকে বড় জাতের কিছু বলে ধারণা করেছিলেন। জ্যোতি বসুর মতো বিশাল এক মানুষের সঙ্গে আমার মতো ক্ষুদ্র লেখক রাজনীতির মাথামুণ্ডু যে কিচ্ছু জানে না, কী কথা বলবে! নিজের মুখতা আর অজ্ঞতা নিয়ে আশংকায় কুঁকড়ে ছিলাম। আমি ক্ষুদ্র জেনেও আমার সঙ্গে দেখা করতে কোনো অনীহা ছিল না জ্যোতি বসুর। তিনি তো এলেনই, তাঁর স্ত্রীও এলেন, এমনভাবে কথা বলছিলেন যেন আমাকে কতকাল চেনেন, যেন আমি তাঁদের কতকালের চেনা বা আত্মীয়। মানুষ খুব বড় হলে সম্ভবত অচেনা অজানা লোক আর নিজের মাঝখানে কোনো দেয়াল রাখেন না। এই প্রথম আমি কোনো বড় মানুষের কাছাকাছি এসে বোধ করলাম যে মানুষটির সঙ্গে আবার কখনও আমার দেখা হতে পারে। তাঁর সঙ্গে রাজনীতির সাদা কালো, মন্দ ভালোর গল্প করার আমার কোনো দরকার নেই। আমি শুধু তার শৈশব কৈশোরের গল্প, তার দুঃখ সুখের, আনন্দ বেদনার ছোট ছোট কথা কাহিনী শুনেই মুগ্ধ।

যখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার আমার বই নিষিদ্ধ করেছিলো, সিদ্ধান্তটি যদিও অগণতান্ত্রিক এবং বাক স্বাধীনতা বিরোধী, দলের সিদ্ধান্ত বলেই আশংকা করেছিলাম জ্যোতি বসুও বই নিষিদ্ধের পক্ষে। কিন্তু আমাকে বিস্মিত করে দলের একজনই, তিনি, বই নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন। কখনও কারওর পায়ের ধুলো নিইনা আমি। জ্যোতি বসুরও নিইনি। যখনই দেখা হয়েছে, শ্রদ্ধা ভরে নমস্কার করেছি। কৃতজ্ঞতা প্রকাশে চিরকালই আমি খুব আনাড়ি। জানি না তিনি বুঝতে পেরেছেন কি না তাঁর দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে হলেও মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে কথা বলে শুধু নিজেকেই মহান করেননি, আমরা যারা লড়াই করছি এই অধিকারের পক্ষে, আমাদের প্রচুর শক্তি আর সাহস জুগিয়েছেন। জ্যোতি বসু সম্পর্কে মন্দ কথা বলার লোকের অভাব নেই। উন্নাসিক ছিলেন? হয়তো ছিলেন। কিন্তু বই নিষিদ্ধের বিপক্ষে তাঁর বক্তব্য শুনে, তাঁকে উন্নাসিক তো নয়ই, বরং বড় বিচক্ষণ, বড় বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ বলে আমার মনে হয়েছে। অন্য কোনো কমিউনিস্ট নেতা, দলের সিদ্ধান্ত, সে সিদ্ধান্ত ভুল হলেও, আদর্শগত কারণে তা মানতে না পারলেও মুখ ফুটে কিছু বলেননি। এর চেয়ে মর্মান্তিক আর কী হতে পারে কোনো দলে নাম লেখাতে হলে যদি নিজস্ব বোধবুদ্ধিবিবেক বিসর্জন দিয়ে তবে লেখাতে হয়। যদিও কমিউনিজমে ধর্ম মানা নেই, তারপরও ধর্মের সমালোচনা করেছি এই দোষে আমাকে দোষী করে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্টরা আমার বই নিষিদ্ধ করে মত প্রকাশের স্বাধীনতার চিতার ওপর ধর্মীয় মৌলবাদীদের বিজয় পতাকা উড়িয়ে দিলেন। এই বিজয় মৌলবাদীদের এত উৎসাহ দিয়েছে যে প্রকাশ্যে তারা একের পর এক আমার মাথার দাম ঘোষণা করতে কোনো দ্বিধা করেনি, রাস্তায় আগুন জ্বালানোর সাহসও তাদের হয়েছে।

যে সময় পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট নেতাদের কেউই আমার সঙ্গে দেখা করেন না, আমি একটা ভয়ংকর নিষিদ্ধ নাম, আমাকে সমর্থন করা মানে, তাদের বদ্ধ বিশ্বাস, জেনেশুনে মুসলমানের ভোট হারানো সে সময় জ্যোতি বসু আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। কারও বিরুদ্ধে আমি কোনো অভিযোগ করতে যাইনি তাঁর কাছে। দুজন আমরা গল্প করছিলাম সেই আগের দিনের মতো। তিনি তাঁর দেশের বাড়ি, তাঁর পাড়া পড়শি, তাঁর শৈশব কৈশোরের কথা বলছিলেন। বলছিলেন দেশভাগ, ধর্মান্ধতা, মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতার কথা। আমার লেখালেখি আর এর ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা।

দিন যায়। যেতে থাকে। জ্যোতি বসু ছাড়া আর কারও সঙ্গে আমাকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি দেশের ভেতর। দেশের বাইরে যেতে দেওয়া হয়েছে। তাইপেই কবিতা উৎসব থেকে ফিরে আসি। প্যারিসে গিয়েও অনুষ্ঠান শেষে ফিরি। আমার ফিরে আসাটি যে কাঙ্ক্ষিত নয়, টের পাই। ফেরার সঙ্গে সঙ্গে, যে জীবন যাপন করছিলাম, সেই জীবন আবার যাপন করতে বাধ্য হই। নীরবে নিভৃতে গৃহবন্দি জীবন। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, কতদিন, ঠিক কত মাস বা বছর আমার স্বাধীনতা আমি ফিরে পাবো না। কেউ নেই আমার এই প্রশ্নের উত্তর দেবে। অনেকটা চোখ বুজে, মুখ বুজে, দাঁত কামড়ে পড়ে থাকি। পায়ে অদৃশ্য শেকল। যাঁরা শেকল পরিয়েছেন তাঁরা জানেন, আর যার পায়ে শেকল সে জানে, এ ছাড়া খুব বেশি মানুষের জানা সম্ভব হয় না শেকলের কাহিনী।

০৪. কথোপকথন

বন্দি আমি। ঘরের বাইরে বেরোনো নিষেধ। গায়ে শ্যাওলা পড়ছে। মনে ভুতুড়ে বাড়ির উঠোনের বড় বড় ঘাসের মতো ঘাস। এর মধ্যেই তিনি এলেন। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় এক সন্ধ্যায়। আসার দশ মিনিট আগে ডিজি এসবি বিনীত গোয়েল ফোনে বলে দিলেন সিপিআসছেন। পুলিশ কমিশনারকে সংক্ষেপে সিপি বলা হয়। মুখ্যমন্ত্রীকে বলা হয় সিএম। চিফ এর প্রথম বর্ণ সি আর মিনিস্টারের প্রথম বর্ণ এম নিয়ে সিএম। পশ্চিমবঙ্গের সিএম বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সিপি প্রসূন মুখোপাধ্যায়। প্রসূন মুখোপাধ্যায় আমার বাড়ি আসবেন। কী কান্ড, এত বড় একজন মানুষ আমার বাড়ি আসছেন কেন? এই প্রশ্নের আমি কোনও উত্তর জানি না। উত্তর খোঁজারও চেষ্টা করিনি। হতে পারে এমনি সৌজন্য সাক্ষাৎ! আমাকে নিরাপত্তা দিচ্ছেন, আমি তো আর হাবিজাবি কোনও মানুষ নই। দেখা করার ইচ্ছে ওঁর হতেই পারে। পুলিশের বড় দু’জন অফিসার এর আগে একবার সৌজন্য সাক্ষাৎ করে গেছেন। বলেছেন, আমি যেন কোনও দুশ্চিন্তা না করি, আমার নিরাপত্তার জন্য সবরকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অফিসার দুজনের মধ্যে একজন ছিলেন জাভেদ শামীম, রীতিমত সুদর্শন। কথায় কথায় বললেন, ‘হায়দারাবাদে যারা আপনার ওপর হামলা চালিয়েছিলো, তারা হেলা করার মতো লোক নয় কিন্তু। সবাই উচ্চশিক্ষিত। লেখাপড়া করতে বিলেত পর্যন্ত গেছে ওরা। চমৎকার ইংরেজি বলে। ওদের ইংরেজি শুনলে বোঝাই যায় না ওরা ভারতীয়। জাভেদ শামীমের চোখে ছিল হায়দারাবাদের ওয়াইসি বংশের লোকদের জন্য সমীহ আর মুগ্ধতা! প্রসূন মুখোপাধ্যায় এলে মিষ্টি, বিস্কুট, চা, চানাচুর ইত্যাদি নানা কিছু দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। এর আগে ফোনে ওঁর সঙ্গে কথা হয়েছে। দেখা যদি হয়েও থাকে কোথাও, কেমন আছেন, ভালো জাতীয় মামুলী কথা ছাড়া বেশি কিছু কথা হয়নি। কথোপকথন মোট দুঘণ্টার। মোদ্দা কথাগুলো এরকম।

প্র– অবস্থা তো খুব খারাপ।

ত–কী রকম খারাপ?

প্র—কিছু নন-বেঙ্গলি মুসলিম তো আপনাকে মেরে ফেলার সব প্ল্যান করে ফেলেছে।

ত–তাই নাকি?

প্র–যা তাই। আমি তো আপনাকে সিকিউরিটি দিচ্ছি। আমার ছেলেরা তো সব আছে এখানে। সিকিউরিটি বাড়িয়েছি তো অনেক। জানেন তো?

ত–হা নিশ্চয়ই। অনেক ধন্যবাদ। আমি খুব নিরাপদ বোধ করছি এখন।

প্র–কিন্তু আপনি হায়দারাবাদে না গেলেই পারতেন। হায়দারাবাদে যাওয়াটা উচিত হয়নি আপনার।

ত–আসলে কয়েক বছর থেকেই যেতে বলছিলো। বারবারই না বলে দিয়েছি। কিন্তু এবার আমার বই এর প্রকাশনা উৎসবের আয়োজন করে এমন করুণভাবে ডাকাডাকি করলো যে, মনে হল, না হয় ঘুরেই আসি। শহরটায় আগে যাইনি কখনও, যাওয়াও হল।

প্র–যাওয়া উচিত হয়নি।

ত–ওখানে যে সিকিউরিটির ব্যবস্থা ছিল না, আমি জানতামই না। আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল যারা, বুঝতে পারেনি এরকম কিছু ঘটতে পারে।

প্র–হুম। খুব ভুল করেছেন।

ত–ভুল করবো কেন? হায়দারাবাদে যে অমন ঘটনা ঘটবে, তা তো আর আমি আগে থেকে জানি না!

প্র–হায়দারাবাদে কেন গিয়েছিলেন?

ত–আমার একটা বই তেলুগু ভাষায় বেরিয়েছে। বইটার উদ্বোধন করতে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন হায়দারাবাদের প্রকাশক।

প্র–আপনার বই? হায়দারাবাদে? কেন? কেন ওরা তেলুগু ভাষায় বের করেছে? কী কারণে?

ত–আমি তো বই লিখি বাংলা ভাষায়।

প্র–সেটা জানি।

ত–বাংলা ভাষায় বই বেরোলে সে বই বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়। তেলুগু ভাষায়ও হয়েছে।

প্র–তাই নাকি?

ত–হ্যাঁ। তেলুগু ভাষা ছাড়াও অন্য ভাষাতেও আছে বই।

প্র–সত্যি বলছেন?

ত–মিথ্যে বলবো কেন?

প্র–আর কোন ভাষায় বই বেরিয়েছে?

ত–মারাঠি, হিন্দি, উড়িয়া, অসমীয়া, পাঞ্জাবি, মালায়ালাম..

প্র–তাই নাকি? কেন? কেন ওসব ভাষায় বেরিয়েছে?

ত–বেরিয়েছে কারণ ওসব ভাষার মানুষ আমার বই পড়তে চেয়েছে। তাই পাবলিশাররা ছাপিয়েছে।

প্র–যাই হোক। আপনার হায়দারাবাদে যাওয়াটা উচিত হয়নি।

ত–গিয়েছি তো ভারতের অনেকগুলো রাজ্যে। ওসব জায়গায় সংবর্ধনা দিয়েছে। আমার ভালোও লাগে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে মিশতে। আর পাঠকের সঙ্গে কথোপকথন তো ভালো লাগারই কথা।

প্র–হায়দারাবাদ ছাড়াও অন্য জায়গায় গিয়েছেন?

ত–তা তো গিয়েছিই। দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকেই আমাকে ডাকা হয়।

প্র–কেন ডাকে আপনাকে? কে ডাকে?

ত–প্রকাশক আমন্ত্রণ জানান। সাহিত্য সংগঠন থেকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। সব সময় যাওয়া হয় না। মাঝে মাঝে যাই। কখনও তো কোথাও ভালো ছাড়া মন্দ কিছু ঘটে না। সব রাজ্যেই অবশ্য নিরাপত্তার একটা ব্যবস্থা থাকে। দিল্লিতে দুবার গিয়েছি। একবার উইমেনস ওয়ার্ল্ডের আমন্ত্রণে। আরেকবার রাডিক্যাল হিউম্যানিস্টদের আমন্ত্রণে। তখন কোনও সিকিউরিটিই ছিল না। কিছু তোবিপদ হয়নি।

প্র–তাই নাকি? কেন ডেকেছিল ওরা?

ত–মানবাধিকার নিয়ে বা নারীর অধিকার নিয়ে কিছু বলার জন্য, অথবা নিজের লেখা থেকে পড়ার জন্য, এরকম আমন্ত্রণ তো জানানোই হয়।

প্র–কারা শোনে?

ত–মানুষ।

প্র–ও।

ত–(দীর্ঘশ্বাস)

প্র–কী বলেছিলেন আপনি হায়দরাবাদে? কেন আপনাকে অ্যাটাক করলো?

ত–শোধ বইটার অনুবাদ হয়েছে ওখানে, একটা মেয়ের জীবনকাহিনী। আমার বক্তব্যে আমি শুধু মেয়েদের নিজের ডিগনিটি নিয়ে, সম্মান নিয়ে বাঁচার অধিকারের কথা বলেছি।

প্র–ধর্ম নিয়ে কিছু বলেছিলেন?

ত–ধর্মের ধ-ও উচ্চারণ করিনি। ইসলামের ই-ও উচ্চারণ করিনি।

প্র–তাহলে ওরা ক্ষেপলো কেন?

ত–আমার সম্পর্কে একটা প্রচার হয়েছে চারদিকে, আমি নাকি অ্যান্টি ইসলাম, সে কারণেই অ্যাটাক। অবশ্য পরে নানা লেখালেখি থেকে যা জানলাম তা হল, মুসলমানদের ভোট পাওয়ার জন্য আমাকে আক্রমণ করে বোঝাতে চেয়েছে ওরা ইসলামকে আমার হাত থেকে বাঁচাচ্ছে।

প্র–আপনার বিরুদ্ধে কলকাতায় ফতোয়াও জারি হয়েছে।

ত–ফতোয়া তো অনেক জারি হয়েছে। এখন তো ফতোয়া নিয়ে তেমন কিছু আর হচ্ছে না। আর আপনি তো টিপু সুলতান মসজিদের ইমামকে ডেকে এনে একবার বোঝাতে পারেন। আগের বার ফতোয়া দেওয়ার পর আপনি তাকে ঘরে ডেকে নিয়ে কথা বলার পর সে বলেছিল, ফতোয়াই নাকি দেয়নি। ওরকম করে এবার তো তাকে ডাকতে পারেন।

প্র–ওই ইমামের কথা বাদ দিন। ইমাম কোনও ভয়ংকর লোক নয়। যারা সামনে আসছে, ফতোয়া দিচ্ছে, ওরা ভালো। খারাপ লোক নয়। খারাপ লোক সব দল পাকাচ্ছে। তারা ডেনজারাস। গোপনে গোপনে সব তৈরি হয়ে আছে। আমাদের কাছে খবর আছে, ওদের প্ল্যান প্রোগ্রাম হয়ে গেছে আপনাকে মারার।

ত–আপনি জানেন কারা ওরা?

প্র–জানি।

ত–সব খবর যদি জানেন কারা এসব করছে, তাহলে তো অ্যারেস্ট করতে পারেন।

প্র–না, সেটা সম্ভব না।

ত–আমার মনে হয়না কিছু হবে। আমার সঙ্গে তোসিকিউরিটির লোক আছে। মনে হয়না ওরা এই কলকাতায় একজনকে প্রাণে মেরে ফেলার সাহস পাবে।

প্র–কী করে জানেন আপনি? আমি কি খবর না জেনে বলছি?

ত–কিছু তো ঘটছে না। সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীরা বলেছিলো মহাকরণ ঘেরাও করবে। সেই প্রোগ্রামও তত বাদ দিয়েছে।

প্র–(ধমক মেরে, জোরে) আপনি আমাকে ইনফরমেশন দেবেন নাকি আমি আপনাকে ইনফরমেশন দেব?

ত–কাগজে পড়লাম বলে বলছি।

প্র–খবরের কাগজ কিচ্ছু জানে না। আমরা সব জানি। গোপনে কী হচ্ছে শহরে, তা জার্নালিস্টরা কী করে জানবে! (ধমক)

ত—তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু, যারা মেরে ফেলার প্ল্যান করছে, তাদেরকে অ্যারেস্টকরা যায় না? কারণ মেরে ফেলার প্ল্যান করা তো আইনের চোখে অপরাধ, তাই না?

প্র–না, অ্যারেস্ট করা যায় না। বিশেষ করে যখন মাইনরিটির ব্যাপার, তখন যায় না।

ত–এটা কোনও কথা হল? আইন তো সবার জন্য এক হওয়া উচিত।

প্ৰ–রিলিজিয়াস সেন্টিমেন্ট আলাদা জিনিস।

ত–তা ঠিক। কিন্তু এই টেরোরিস্ট, যাদের কথা আপনি বলছেন, তারা কি আমার বই পড়েছে? মনে তো হয় না।

প্ৰ–তা জানি না। তবে ওরা তৈরি আপনাকে মারার জন্য। সব আয়োজন কমপ্লিট। এখন শুধু টাইমের অপেক্ষা। আর নভেম্বরের মাঝামাঝি তো বিরাট করে বন্ধ ডাকা হচ্ছে আপনার বিরুদ্ধে। খুব বিচ্ছিরি কান্ড হতে যাচ্ছে।

ত–কী রকম?

প্র–মব চলে আসতে পারে আপনার বাড়িতে।

ত–তাই নাকি? বাড়ি অবদি চলে আসার আগে নিশ্চয়ই বাধা দেওয়া হবে।

প্র–আমি তো আপনাকে প্রোটেকশান দিচ্ছি। নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন প্রোটেকশান বাড়িয়েছি অনেক। কিন্তু মব চলে এলে যদি আমার ছেলেরা ওদের একটাকে গুলি করে, তাহলেই তো রায়ট লেগে যাবে।

ত–বলছেন কী?

প্র–ঠিকই বলছি।

ত–রায়ট লাগবে কেন?

প্র–যা রায়ট লেগে যাবে। আপনি চান গুলি চলুক? আপনি চান আপনার কারণে কাউকে গুলি করা হোক?

ত–না আমি চাই না।

প্র–ওদের কারও গায়ে গুলি করলেই রায়ট বাধবেই। মুসলমানদের পাড়ায় খবর হয়ে যাবে। ব্যস।

ত–রায়ট কেন? এখানে কোনও তো হিন্দু মুসলমানের ব্যাপার নেই। এটা ক্রিমিনালিটির ব্যাপার। আইন কি হিন্দু মুসলমান বিচার করে?

প্র–করতে হয়। আইনের কথা বলছেন? আপনি দেখছেন না আপনার বেলায় কী হচ্ছে। কোনও সাপোর্ট পেয়েছেন কারওর? এই যে হায়দারাবাদে মার খেলেন, কেউ কি আপনাকে সাপোর্ট করেছে? কোনও পলিটিক্যাল পার্টি? সবারই মুসলিম ভোট দরকার। সুতরাং এগুলোআপনাকে বুঝতে হবে। আপনার কিন্তু সোসাইটিতে কোনও সাপোর্ট নেই।

ত–আমি তো সাধারণ মানুষের সাপোর্ট পাই।

প্র–কে বলেছে আপনাকে?

ত–আমি বলছি। মানুষ আমাকে ফোন করছে। চিঠি লিখছে। বলছে, আমার লেখা তাদের ভালো লাগে।

প্র–ওসবে কিস্যু হবে না। কোনও পলিটিক্যাল পার্টি আপনাকে সাপোর্ট করছে না, সেটা বড় কথা। খুব বাজে অবস্থা আপনার। চা বিস্কুট খেতে খেতে প্রসূন মুখার্জি কথা বলতে থাকেন।

প্র–মাইনরিটি লিডাররা দেখা করবে সিএম-এর সঙ্গে। ওরা তো আপনাকে ডিপোর্টেশনের দাবিতে পথে নামছে। ওরা প্ল্যান করছে সিএমএর কনভয় আটকাবে। আটকালে আমাদের তো লাঠিচার্জ করতে হবে। আর লাঠিচার্জ করার মানে জানেন? খবর হয়ে যাবে। বিরাট রায়ট লেগে যাবে। লাগবেই।

ত–অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

প্র–অবিশ্বাস্য নয়। আপনার জন্য তো রায়ট লাগবে কলকাতায়। আপনি থাকলে রায়ট লাগবেই।

ত–কলকাতায় আমি থাকলে রায়ট লেগে যাবে। এত বছর কলকাতায় আছি আমি, কোনওদিন কিছু হয়নি। আর হঠাৎ করে রায়টের মতো কাণ্ড ঘটবে, এ আমার বিশ্বাস হয় না।

প্র–বিশ্বাস না হলে সেটা আপনার প্রবলেম। তবে ঘটনাটা তাই ঘটতে যাচ্ছে। এখন আপনাকে ডিসিশান নিতে হবে।

ত–কী ডিসিশান?

প্র–আপনি কিছুদিনের জন্য কোথাও চলে যান। ত মানে? প্র মানে আপনাকে কিছুদিনের জন্য কলকাতার বাইরে কোথাও যেতে হবে। ত কোথায়?

প্ৰ–ইওরোপে চলে যান না।

ত–ইওরোপে? কিন্তু ওখানে তো আমার বাড়িঘর নেই।

প্র–দেখুন, কোথাও থাকার বন্দোবস্ত করুন।

ত–ফিরবো কবে?

প্র–পরিস্থিতি শান্ত হলে ফিরবেন।

ত–(হেসে) মনে পড়ছে বাংলাদেশ থেকে যখন চুরানব্বই সালে আমাকে প্লেনে তুলে দেওয়া হয়, আমাকেও বলা হয়েছিল, পরিস্থিতি শান্ত হলে ফিরবেন। আজ তেরো বছর হয়ে গেল, পরিস্থিতি এখনও শান্ত হয়নি।

প্র–আপনি ফিরে আসতে চাইলে নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন।

ত–কিন্তু আমি তোইওরোপে যেতে পারবোনা। ওখানে সব গুটিয়ে আমি এসেছি। গেলে ওখানে আমাকে হোটেলে থাকতে হবে। সে আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আর আমার কাছে আমার বোন আসছে দুদিন পর। অনেকদিন থাকবে।

প্র–বোনকে নিয়ে চলে যান।

ত–কোথায় যাবো?

প্র–আমেরিকায় চলে যান।

ত–আমেরিকা থেকেই তো আসছে আমার কাছে। ওকে নিয়ে আমি আমেরিকা যাবো কেন?

প্র–তবে অন্য কোথাও চলে যান।

ত–আমি তো বললাম আপনাকে, ইওরোপ বা আমেরিকায় যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। আমি অত খরচ কুলোতে পারবো না।

প্র–তাহলে ভারতের কোথাও যান।

ত–কোথায় যাবো?

প্ৰ–সে আপনি খুঁজে দেখুন কোথায় যাবেন। কেউ নেই আপনার চেনা পরিচিত কোথাও ভারতের কোনও রাজ্যে?

ত–আমার চেনা আছে তোঅনেকে। আমার পাবলিশার আছে কেরালায়, মহারাষ্ট্রে, উড়িষ্যায়। কেরালার সরকার আমাকে বেশ ভালোবাসে। এডুকেশন মিনিস্টিার এমএ বেবি আমাকে তার বাড়িতে নেমন্তন্ন করেছেন। ফরেস্ট মিনিস্টারের বাড়িতেও ব্রেকফাস্টের জন্য ডেকেছিলেন। ওঁরা বেশ চমৎকার মানুষ।

প্ৰ–কেরালায় চলে যান। আপনার পাবলিশারকে বলুন আপনার থাকার ব্যবস্থা করতে।

ত–কিন্তু ওখানে তো মানুষ জেনে যাবে যে আমি গেছি। গতবার কেরালায় কিছু মুসলিম মৌলবাদী আবার আমার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়েছিল।

প্র–কেরালায় জানিয়ে দিন আপনি আসছেন। ওখানে প্রোটেকশনের ব্যবস্থা করবে, সে নিয়ে চিন্তা করবেন না। আর কোথায় বললেন, মহারাষ্ট্র?

ত–ওখানে আমার মারাঠী পাবলিশার আছেন। অনিল মেহতা। উনিও খুব ভালো।

প্র–মধ্যপ্রদেশে চলে যান না, ওখানে তো বিশাল জঙ্গল আছে।

ত–আপনি আমাকে জঙ্গলে পাঠিয়ে দিতে চান?

প্র–(অপ্রস্তুত হেসে) না, আসলে আমি তো জঙ্গল খুব ভালোবাসি, তাই বলছি।

ত–আমার জঙ্গল ভালো লাগে না।

প্র–তাহলে কী ভালো লাগে?

ত–সমুদ্র, পাহাড় এসব ভালো লাগে।

প্র–তাহলে কেরালায় চলে যান। ওখানে এনজয় করুন সমুদ্র।

ত–ফিরবো কবে?

প্র–তিনচার মাস থাকুন। এদিকের আগুনটা কমলে ফিরবেন।

ত–আগুনের তো কিছু দেখছি না।

প্র–আপনি দেখছেন না, আমরা তো দেখছি।

ত–ও।

প্র–আর ফিরে এসে আপনি এই ফ্ল্যাটটা পাল্টে নেবেন। সাউথের দিকে কোথাও ফ্ল্যাট নিন। বালিগঞ্জের দিকে নিন। এটা মুসলিম এরিয়ার খুব কাছে।

ত–ফ্ল্যাট খুঁজে পাওয়া এত কষ্টের। প্রচুর ফ্ল্যাট দেখেছি। ভালো জায়গায় ভালো ফ্ল্যাট এখনও পাওয়া হয়নি। এই ফ্ল্যাটটা খুব তাড়াহুড়ো করে নিয়েছিলাম। কোনও উপায় ছিল না। ভাড়া খুব বেশি। একটু কম ভাড়ার ফ্ল্যাট পেলে ভালো হয়।

প্র–কোনও চিন্তা করবেন না। আমরাই খুঁজে দেব।

ত–এই বাড়ি ফেলে এতদিনের জন্য কী করে আমি দূরে থাকবো? আমার তো খুব দরকারি জিনিসপত্র আছে এ বাড়িতে। কত বই। কত সার্টিফিকেট, ডকুমেন্টস! সব কি এভাবে ফেলে চলে যাওয়া ঠিক হবে?

প্র–দামি কী আছে?

ত–সোনার মেডেল টেডেল আছে…

প্র–শুনুন, ভ্যালুবল জিনিস বরং নিয়ে যান।

ত–নিয়ে যাবো? ওগুলো নিয়ে পথে পথে ঘুরবো? আর ঘর বাড়ি এভাবেই পড়ে থাকবে? আমার বেড়ালটা কোথায় যাবে?

প্ৰ–একটুও চিন্তা করবেন না। আমার ছেলেরা দেখবে আপনার ফ্ল্যাট। বেড়াল নিয়েও দুশ্চিন্তার কিছু নেই।

ত–আপনি যে এভাবে বাইরে চলে যেতে বলছেন। কতদিনের জন্য বলছেন যেতে। ফিরবো কবে? ফেরার কথা ঠিক করে তো বলছেন না।

প্র–যান। দুতিন মাস পর ফিরে আসুন।

ত–দুতিন মাসে কি পরিস্থিতি শান্ত হবে বলে আপনার বিশ্বাস?

প্র–হ্যাঁ হয়ে যাবে। কত আর নেবে? কয়েক মাস পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। বছর। খানেকের মধ্যে তো হবেই মনে হচ্ছে।

ত পরিস্থিতি তত আমি মোটেও অশান্ত দেখছি না। কিন্তু আমি কলকাতায় থাকলে, যা আপনি বলছেন, পরিস্থিতি অশান্ত হয়। তাহলে তো আমি ফিরে এলে আবার পরিস্থিতি অশান্ত হবে। আমি ফিরে এলে ওরা কি চুপ করে বসে থাকবে? মেনে নেবে?

প্র–এ নিয়ে ভাববেন না। তখনেরটা তখন দেখা যাবে।

ত–তাহলে এখনেরটা এখন দেখাই ভালো। পালিয়ে গিয়ে কোনও সমস্যার কি সত্যিকার সমাধান হয়? ওরা যদি জানে যে আমি ওদের ভয়ে চলে গেছি, তাহলে বিরাট ভিকটরি হবে ওদের।

প্ৰ–আপনার এই ফ্ল্যাটটা কবে নিয়েছেন?

ত–এই তো বছর তিনেক আগে।

প্র–জায়গাটা ভালো না। মুসলিম এরিয়ার খুব কাছে। যে কোনও সময় অ্যাটাক হতে পারে। দেখি তো ফ্ল্যাটটা, কত স্কোয়ার ফুট?

ত–ঠিক জানি না, মনে হয় সতেরোশ। দুহাজারও হতে পারে। একেকজন একেকরকম বলে।

প্র–(উঠে ফ্ল্যাট দেখতে দেখতে) হা এরকমই একটা আমরা দেখে রাখবো। ওদিকে বাথরুম?

ত–হ্যাঁ ওদিকে বাথরুম।

প্র–(স্টাডিতে এসে) স্টাডি?

ত–হ্যাঁ। এখানেই বেশির ভাগ সময় থাকি।

প্র–এখানেই বেশির ভাগ সময়? কেন, এখানে কী করেন?

ত–লেখা পড়া করি।

প্র–(কমপিউটারের কাছে এসে) কমপিউটারে লেখেন?

ত–হ্যাঁ।

প্র–বাংলায় লেখেন?

ত–হ্যাঁ।

প্র–আশ্চর্য!

ত–আশ্চর্য কেন।

প্র–কী করে লেখেন, দেখান তো।

ত–(বাংলা একটি লাইন ‘আমার পক্ষে কোথাও যাওয়া অসম্ভব। না, এ হতে পারে না’ –লিখে) এভাবেই বাংলা লিখি।

প্ৰ–(মৃদু হেসে) কী করে জানেন কোন্‌ কী তে কোন্ বাংলা অক্ষর আছে?

ত–অনেক বছর ধরে লিখছি কমপিউটারে। কোন রোমান হরফের তলায় বাংলা কোন হরফ লুকিয়ে আছে, জানা হয়ে গেছে।

প্ৰ–(দরজার কাছে, চলে যেতে যেতে) আপনার বোন কবে আসছে যেন?

ত–এই তো দুদিন পর। ও অসুস্থ। কিছু ডাক্তার টাক্তার দেখাবে।

প্র–শুনুন। আপনি কিন্তু চলে যান অ্যাজ সুন আজ পসিবল। কবে যাচ্ছেন এটা আমাকে তাড়াতাড়ি ফোনে জানিয়ে দেন।

ত–আমাকে একটু ভাবতে হবে।

প্র–ভাবার কিছু নেই। অ্যাজ সুন আজ পসিবল চলে যেতে হবে।

প্রসূন মুখার্জি বেরিয়ে গেলেন। দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশগুলো সব মুহূর্তে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। অসম্ভব সমীহ করে এরা উঁচু পদের কর্মকর্তাদের। আমি দরজা বন্ধ করে স্টাডিতে এসে স্থবির বসে থাকি। কণ্ঠের কাছে থোক থোক কষ্ট এসে জমছে। উস্রি চলে গেল, আমি চরাচর জুড়ে একা। পায়ের তলায় যেন মাটি কাঁপছে। সবচেয়ে কাছের যে মানুষের সঙ্গে মনে হল এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারি, তিনি মানস ঘোষ। তাঁর পত্রিকায় প্রতি বুধবার আমার কলাম বেরোয়। মানস ঘোষকে ফোনে খবরটা দেবার সঙ্গে সঙ্গে বললেন, সৌগত রায়কে খবরটা জানাবেন তিনি। আমার যে ক্ষুদ্র পরিচয়ের গন্ডি, এর মধ্যে রাজনীতি বোঝার লোক বাদুঃসময়ে উপদেশ দেওয়ার খুব বেশি কেউ নেই। হাতে গোনা ক’জন ছাড়া বাকি সব চেনা জানা সব আমার মতোই রাজনীতি না-বোঝা মানুষ। দু’জনই, মানস ঘোষ আর সৌগত রায় আমার বাড়ি পৌঁছোলন। প্রসূন মুখার্জি আমার বাড়িতে এসে ঘণ্টাদুয়েক ছিলেন, আমাকে কলকাতা ছাড়তে বলছেন, শুনে মানস ঘোষ ঠিক কী বলা উচিত কিছু বুঝতে পারছেন না। বারবারই এক কথা বলছেন, খুব খারাপ খুব খারাপ। খুব খারাপের পর যে ঠিক কী, তা অনেকক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেও অনুমান করতে পারিনি। সৌগত রায় তো বলেই ফেলতে লাগলেন, ‘হা তুমি ছিলে, ভালোই লাগতো শহরটায়। তোমাকে খুব মিস করবো’।

শুনে বুক কেঁপে ওঠে। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠ আমার। মিস করবেন মানে? আপনি কি সত্যি সত্যি ভাবছেন আমাকে চলে যেতে হবে?

‘প্রশাসন যখন বলছেন, তোমার নিরাপত্তার কথা ভেবেই বলছেন। এখন তো তুমি, জানি না কোথায় যাবে, ইওরোপে?’

‘না। আমি কোথাও যাবো না।‘

সৌগত রায় প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সিকে ফোন করলেন। ওপার থেকে যা ভেসে এলো তা হল, আমি হায়দারাবাদ থেকে ফেরার পর প্রিয়রঞ্জনবাবু আমার পক্ষে কথা বলেছিলেন। অপরাধীদের কঠিন শাস্তি দেওয়ার কথাও বলেছিলেন। ছাপাও হয়েছিলো কাগজে। সে কারণে তাঁকে অসুবিধে পোহাতে হয়েছে।

কী অসুবিধে?

উত্তর মেলে না। ধারণা করে নিতে হয় যে তাঁর দলের সদস্যরা অথবা দলের মুসলিমরা আপত্তি করেছেন। আপত্তির কারণে তিনি সিদ্ধান্ত বদল করেছেন।

প্রসূন মুখার্জি যখন বলেছেন, যখন নিজে আমার বাড়িতে এসে বলেছেন, শহর শান্ত থাকলেও, হয়তো কারওরই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল না যে শহর শান্ত। পুলিশ কমিশনার তো ফাজলামো করতে আসেননি, নিশ্চয়ই আমার নিরাপত্তার এমনই অভাব হয়ে দাঁড়াচ্ছে যে পুরো রাজ্যের পুলিশ বাহিনী, আমাকে, আমার মতো একলা প্রাণীকে কোনও নিরাপত্তা দিতে অপারগ। অপারগ বলেই তো চলে যাওয়ার কথা বলা। তাঁরা একরকম মেনে নিলেন। এবং মনে মনে আমার দুরবস্থার জন্য দুঃখ করা ছাড়া তাদের খুব বেশি উপায় আছে বলে তারা মনে করলেন না। আমাকে সান্ত্বনা দিতেই হয়তো, বললেন, যে, আজ তো বিশেষ আলোচনা হওয়ার সুযোগ নেই, অনেক রাত হয়ে গেছে, কাল, আগামিকাল, বিকেল তিনটেয় বসা যাবে এখানে, এই ঘরে, আমার লেখার ঘরে, বাঁচার কোনও উপায় আছে কী না তা নিয়ে কথা বলতে।

সারারাত অস্থিরতায় কাটে। পরদিন দুজন এলেন বটে, কিন্তু কোনও সমস্যার সমাধান হয় না। সিদ্ধান্ত নিই, নিজেই নিই, কোথাও যাবো না আমি।

এদিকে একটি ঘটনা আগুনের মতো বড় হচ্ছে কলকাতা শহরে। রিজওয়ান নামের এক গরিব মুসলমান ছেলের সঙ্গে প্রিয়াঙ্কা নামের এক ধনী হিন্দু মেয়ের প্রেম, স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে বিয়ে, প্রিয়াঙ্কার বাপের বাড়ি চলে যাওয়া, রিজওয়ানের মৃত্যু। কেউ বলছে আত্মহত্যা। কেউ বলছে খুন। পুলিশের বড় কর্তারা নাক গলিয়েছিল প্রাপ্ত বয়স্ক রিজওয়ান আর প্রিয়াঙ্কার ব্যক্তিগত সম্পর্কে, বিয়েতে। লালবাজারে পুলিশ অফিসে ডেকে পাঠানো হয়েছিল দম্পতিকে। প্রচার মাধ্যম নিরবধি এই গল্পই পরিবেশন করে চলেছে। অভিযোগের আঙুল পুলিশের বড়কর্তাদের দিকে। অবস্থা খুব ভালো নয় প্রসূন মুখার্জিসহ দুজন বড় কর্তার। ভালো অবস্থা না থাকুক, তাতে কার কী! ফোন করলেন প্রসূন মুখার্জি। কী, আমাকে রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে হবে।

এবারের কথোপকথন ফোনে।

প্র—হ্যাঁলো।

ত–নমস্কার। ভালো আছেন?

প্র–ভালো থাকার কোনও উপায় আছে? কী হচ্ছে এদিকে টিভিতে, দেখছেন তো! যত্তসব। তা আপনি এখনও যাচ্ছেন না যে!

ত–কোথায় যাবো?

প্ৰ–যে কোনও কোথাও চলে যান। আপনাকে কত বার বলবো যে কলকাতায় আপনি থাকলে গন্ডগোল হবে। রায়ট লাগবে। মুসলিম অরগাইনেজশনগুলো খুব বড় প্ল্যান করছে। বুঝতে পাচ্ছেন না আপনি..

ত–আমার তো যাওয়ার কোনও জায়গা নেই।

প্র–কিন্তু কোথাও না কোথাও তো আপনাকে যেতে হবে।

ত–জায়গা যদি না থাকে, তবে যাবো কোথায়?

প্র–কেরালা যাচ্ছেন না কেন?

ত–কেরালাতেও ওই একই ব্যাপার ঘটবে। কেরালা-সরকার আমাকে রাখতে চাইবেন না কেরালায়। ওখানে কিছু যদি একটা ঘটে যায়, সেই ভয় আপনাদের মতো ওঁরাও তো পাবেন। আপনারা নিরাপত্তা দিতে পারছেন না। ওঁরা কী করে দেবেন? আমি পশ্চিমবঙ্গে থাকি, কেরালা সরকার জানেন। কেরালায় কেন ওঁরা আমার নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবেন! মাঝে মাঝে অনুষ্ঠানে দুতিনদিনের জন্য যাই, সেটা আলাদা কথা।

প্র–হুম। আপনাকে গোপন রাখতে হবে ব্যাপারটা।

ত–কী করে গোপন রাখবো। আমাকে গোপন রাখতে দেবে কে? অন্যরা রাখবে গোপন।

প্র–গোপন রাখা যাবে না কেন? কাউকে বলবেন না আপনি এসেছেন।

ত–আমি তো ঢোল পিটিয়ে কোথাও কিছু বলে বেড়াই না। কিছু কি আর সত্যি গোপন থাকে? জানাজানি হবেই। আমার মনে হয় না গোপনে গোপনে এত বড় একটা কাজ করা যাবে। গোপনে চলে যাওয়া কেরালায়। এসব তো কেরালা সরকার মানবেন না। আমার পক্ষে সিকিউরিটি ছাড়া কোথাও থাকা সম্ভব হবে না। এত বড় ঝুঁকি নেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।

প্র–আচ্ছা, আপনি থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুরে কোথাও যেতে পারেন না?

ত–ওখানে কী করে যাবো? ওখানে কাউকে চিনি না আমি। আর কোথায় থাকবোই বা? আমার তো কাড়ি কাড়ি টাকা নেই হোটেলে গিয়ে থাকার!

প্র–আপনি বুঝতে পারছেন না, এখানে বিচ্ছিরি সব ব ট ডাকছে।

ত–আমার মনে হয় না খুব বড় কোনও দল ওরা..

প্র–আপনি না হয় শান্তিনিকেতনেই চলে যান।

ত–শান্তিনিকেতনে?

প্র–ওখানে কেউ নেই আপনার?

ত–না। কেউ নেই।

প্র–আপনার এত বন্ধু বান্ধর, তাদের বাড়ি টাড়ি নেই ওখানে?

ত–আছে কারও কারও। কিন্তু..কী করে বলবো। আপনারা বলুন না, সুনীলদার বাড়ি আছে, ওখানে থাকার ব্যবস্থা হলে হয়তো থাকতে পারি।

প্র–আপনার তো কলকাতা ছাড়তে হবে। কোথাও যান, বুঝলেন। আমাকে জানাবেন শিগরি। দেরি করাটা ঠিক হবে না।

ত–দেখি। আমি চেষ্টা করবো।

আমি সত্যি সত্যি ভাবতে বসি, কোথায় যাওয়া যায়। যদিও আমার মনে হচ্ছে না খুব মন্দ কিছু ঘটবে। কত কত দিন কলকাতার রাস্তায় নিরাপত্তা রক্ষী ছাড়াই ঘুরে বেরিয়েছি। শহরে অত শত্রু থাকলে কোনও না কোনও একদিন কিছু ঘটতোই। অন্তত আক্রমণের কোনও চেষ্টা হয়তো হতো। ঠিক বুঝে পাই না কী করবো। হাতের কাছে কোনও বন্ধু নেই যে কথা বলবো এ নিয়ে। দু একজন যাদের সঙ্গে কথা বলি, ওরা বোঝে না কী বলছি আমি। অথবা বুঝলেও এ নিয়ে কী মন্তব্য করবে, তা ঠিক জানে না।

কয়েকদিন পর আবার ফোন প্রসূনবাবুর। তিনি এবার প্রথম কথাটাই বললেন এভাবে–

প্র–শুনুন, সিএম বলেছেন আপনাকে কেরালা চলে যেতে। খুব শিগরি, পারলে আজই যান।

ত–কেরালা?

প্ৰ–হ্যাঁ কেরালা। ওখানে সরকারের সঙ্গে কথা বলে নিরাপত্তার সব ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। আপনাকে চলে যেতে হবে।

ত–কেরালায় লোকে যখন জানবে আমি ওখানে? ওখানেও তো মুসলমান মৌলবাদী আছে। ওরা বসে থাকবে? কলকাতায় যারা আমাকে মেরে ফেলবে বলছিলেন, ওরা বসে থাকবে? ওরা তো কেরালায় গিয়ে আমাকে মেরে আসবে।

প্র–আপনাকে যেতে হবে যে করেই হোক, সিএম বলেছেন।

ত–হ্যাঁ বুঝতে পারছি। কিন্তু আমাকে তো আমার জীবনটার কথা ভাবতে হবে। আমি তো, আপনি বলবেন, আর, দিব্যি কোথাও মরতে যেতে পারি না। আপনারা যে আমাকে নির্দেশ দিচ্ছেন কলকাতা ছাড়ার জন্য, তা তো আমাকে জানাতে হবে। তা না হলে আমি যদি কেরালায় গিয়ে মরে যাই, মানে কেউ আমাকে মেরে ফেললে দোষ আমার হবে। লোকে বলবে, হঠাৎ আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো, কলকাতা ছেড়ে কেরালায় চলে গেছি! কেন গেছি, কী কারণে গেছি তা না জেনে, লোকে আমাকেই দোষী করবে। গেলে আমাকে জানিয়ে যেতে হবে। লুকিয়ে পালিয়ে চুপিচুপি কোথাও যাবো না।

প্র–না না না এসব ব্যাপার খুব কনফিডেনশিয়ালি করতে হবে। কেউ যেন না জানতে পারে।

ত–গোপন রাখতে চাইলেই তো গোপন রাখা যায় না। আমার চেহারা তো মানুষ চিনে ফেলে, জানেন তো! চিনে ফেলবে। কোথাও গিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখা যাবে না। আর, আমি কেন গোপন রাখবো, বলুন তো। আমি তো মিথ্যে বলি না। আর মুখ বুজে থাকলেও ওরা কারণ বের করে ফেলবে। গোপনে গোপনে রাজ্যের বাইরে যাবো। কেউ জানবে কী করতে আমি কেরালা গিয়েছি? সবাই ভাববে শখে গিয়েছি, শখে মরতে গিয়েছি। তা কেন, বলুন! তার চেয়ে জানাই সবাইকে যে যাচ্ছি।

প্ৰ–না না। গোপন রাখতে হবে।

ত–আমি তো গোপন রাখতে চাইছি না। আমি তো চাইছি জানাতে। হয় আপনি জানাবেন, নয়তো আমি জানাবো। যে কোনও একজনকে তো জানাতে হবে। আপনাকে বলতে হবে, আপনারা আমাকে কলকাতা থেকে চলে যেতে বলছেন, কারণ আমাকে নিরাপত্তা দিতে পারবেন না। অথবা আমি জানাবো। হয় আপনি প্রেস কনফারেন্স করুন, নয়তো আমি করবো।

প্র–হ্যাঁ আমিই করবো।

খটাশ করে ফোন রেখে দিলেন।

রেখে দিন। কিন্তু মনে আমার অদ্ভুত এক প্রশান্তি। যে কথাগুলো বলা উচিত, সে কথাগুলো বলেছি বলে, বলতে পেরেছি বলে। আমার আর হারানোর কী আছে! জীবনে তো সবই হারিয়েছি। কী দোষ করেছি আমি যে গোপনে আমাকে শহর ছাড়তে হবে, আরেক শহরের গর্তে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে হবে!

এর ক’দিন পর ফোন করলেন লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে সবচেয়ে সুসম্পর্ক যে লেখকের। আমার সঙ্গেও ছিল দীর্ঘকালের বন্ধুত্ব।

সু–হ্যালো তসলিমা, আমি সুনীলদা বলছি।

ত–সুনীলদা, ভালো আছেন? কতদিন পর আপনার সঙ্গে কথা হচ্ছে। ভালো আছেন তো সুনীল দা?

সু–হ্যাঁ ভালো। তুমি কেমন আছ?

ত–নাহ, সুনীলদা, ভালো নেই। আমাকে কোথাও বেরোতে দিচ্ছে না।

সু–হুম।

ত–ঘর থেকে বেরোতে চাইলেই বলছে, না সম্ভব নয়। এভাবে ঘরে বসে থাকাটা ভালো লাগে? আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, কী রকম দমবন্ধ লাগছে আমার।

সু–শোনো, তোমাকে যে জরুরি কারণে ফোন করেছি, তা হল, পুলিশের কাছে খবর আছে, এখানে কিছু অবাঙালি মুসলমান তোমাকে মেরে ফেলার জন্য তৈরি হয়ে আছে। এখন, সবচেয়ে ভালো, তুমি যদি বিদেশে কোথাও চলে যাও।

ত–আমি জানি। প্রসূনবাবু আমাকে বলেছেন। তিনিও বলেছেন বিদেশে চলে যাই যেন। কিন্তু সুনীলদা, পৃথিবীর সব জায়গায় মুসলিম মৌলবাদী আছে। ইওরোপে, আমেরিকায়, কোথায় মৌলবাদী নেই? জীবনের ঝুঁকি পৃথিবীর সব জায়গায় আছে। আর আমি এ দেশ ছেড়ে যাবো কোথায়? বাংলাদেশে যদি যাওয়া সম্ভব হত, আজই চলে যেতাম। এত অপমান সয়ে এ দেশে থাকতাম না। আর, সত্যি কথা বলতে কী, আমার যাওয়ার কোনও জায়গা নেই সুনীলদা। ইওরোপের পাট চুকিয়ে এদেশে এসেছি, কলকাতায় থাকবো বলে। ইওরোপ আমেরিকায় আমি তো থেকেছি। ওসব দেশে থাকার কোনও ইচ্ছে আমার নেই। আর, এই কলকাতায় যদি আমাকে মেরে ফেলে কেউ, মেরে ফেলুক। আমি কলকাতা ছেড়ে কোথাও যাবো না।

সু–আমার মনে হয় তুমি আরও ভেবে দেখো।

ত–আমি ভেবে দেখেছি সুনীল’দা। আমার কোথাও যাওয়ার নেই। মরলে এ শহরেই মরবো।

সু–আচ্ছা। কী আর বলবো তবে। রাখছি।

ত–ঠিক আছে। আপনি ভালো থাকবেন।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ফোন আমাকে ভেতরে কাঁপায়। মুখ্যমন্ত্রী প্রসূন মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সবাইকে দিয়ে আমাকে বলাচ্ছেন কলকাতা ছাড়ার জন্য!

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ফোনের বেশ কিছুদিন পরে এলো আরও একজন বড় লেখকের ফোন। বুদ্ধদেব গুহ। বললেন, ঐ একই কথা, চলে যাও। কী দরকার কলকাতায় থেকে? কী আছে এখানে। তিনি সরাসরিই বললেন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সাথে কথা হয়েছে। তিনি চাইছেন আমি কলকাতা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাই।

এর ক’দিন পর বাড়িওয়ালার বউ ফোন করলেন। বাড়িওয়ালা ডাক্তার দেবল সেন। কিন্তু যোগাযোগ আমার সঙ্গে রাখেন শর্মিলা সেন, দেবল সেন এর স্ত্রী। তিনি সবসময়ই খুব আন্তরিক। বাড়ি ভাড়া আঠারো হাজার ছিল, কিন্তু দু’মাস পর ওটাকে কুড়ি হাজার করেছিলেন, বলেই নিয়েছিলেন, কুড়ি হাজারের নিচে ও বাড়ি ভাড়া হয় না। আমি একফোঁটা আপত্তি করিনি। এদিকে আবার মেইনটেইনেন্স খরচ দিতে হয় আড়াই হাজারের মতো। সব মিলিয়ে সাড়ে বাইশ হাজারে চমৎকার চলছিলাম। যদিও বাড়িতে থাকার পর থেকে অন্য ভাড়াটেরা যা পায়, তা থেকে আমি বঞ্চিতই হয়েছি। ইন্টারকম ক’দিন কাজ করে আর করেনি। অভিযোগ করার পরও কেউ ও যন্ত্রটা সারাতেও আসেনি। বাড়িওয়ালার কিছু ছারপোকা-ওয়ালা চেয়ার টেবিল আমাকে পুষতে হয়েছে। আর পুজোর ঘর বলে একটা ঘর আছে, ও ঘরটায় বাড়িওয়ালার কাগজপত্র ঠাসা বাক্সও পুষেছি। না, ও নিয়েও আমি কখনও আপত্তি করিনি। শর্মিলা সেন বলেছিলেন, তাঁর বাড়িতে জায়গা। নেই বলে এখানেই রেখেছেন। বাড়িটিতে ঢোকার পর অবশ্য বাড়িটিকে বাসযোগ্য করার জন্য পকেটের টাকা খরচ করে বাড়ির ভাঙা অকেজোনানাকিছু সারাতে হয়েছে। এ নিয়েও অভিযোগ করিনি। দেবল সেন খুব বড় কার্ডিওলোজিস্ট, কিন্তু বড় একজন ফটোগ্রাফারও। একদিন তার ফটোগ্রাফির বই দিয়ে গেলেন। বন্য জন্তুর ফটো তোলা তার শখ। তবে একে ঠিক শখের ফটোগ্রাফি বলা যায় না, রীতিমত পাকা হাতের কাজ। সেই ভদ্র বিনীত দেবল সেন এর কণ্ঠস্বরও বছর তিন পর পাল্টে যেতে দেখলাম। তাঁর বাড়িতে আমি ভাড়া থাকি, এ কথাটা কাগজে লিখে দিতে হয়, ছ’ মাস পর পর যখন আমার রেসিডেন্স পারমিটের মেয়াদ বাড়ানোর সময় আসে। অ্যাড্রেস প্রুফ বলে একটা ব্যাপার আছে, আমি কোথায় থাকি, কোন ঠিকানায়, তা আমার কাছে যখন কোনও প্রমাণ নেই, বাড়ির ইলেকট্রিসিটি বিল যেহেতু দেবল সেন এর নামেই আসে, তাকেই সই করে দিতে হয় কাগজে যে হ্যাঁ ও বাড়িতে আমি থাকি। ওটাই প্রমাণ করে আমি রাস্তাঘাটের ঠিকানাহীন সন্ত্রাসী নই, আমার একটা ঠিকানা আছে। তবে এ বার তিনি কাগজ দেখে আকাশ থেকে পড়লেন, এ কীসের কাগজ তিনি চিনতে পারলেন না, এবং সই করলেন না। এদিকে শর্মিলা সেনও, যিনি আমার বাড়িতে এসে বাড়ি এত সুন্দর সাজানো, এত যত্ন করে রাখা, এত চমৎকার লাগছে –বলে প্রশংসা করে যেতেন, একদিন ফোন করে বলেন, এ বাড়ি আমাকে ছেড়ে দিতে হবে। অদ্ভুত শোনায় তাঁর এবারের কণ্ঠস্বর।

শ–আমার বাড়িটা কিন্তু আপনাকে ছাড়তে হবে। ত–মানে? বাড়ি ছাড়ার প্রশ্ন উঠছে কেন?

শ–আসলে কী জানেন, খুব বেশি ভাড়া দেবে, এমন একজনকে পেয়েছি। তাঁকে কথাও দিয়েছি। এখন সামনের মাসেই সেই ভাড়াটেকে দিতে হবে বাড়ি।

ত–এরকম বললে তো হয় না। আমার তো কোনও একটা অ্যাপার্টমেন্ট পেতে হবে আগে। তা না হলে কোথায় যাবো!

শ–আপনি যদি এ মাসের মধ্যেই বাড়িটা ছেড়ে দেন, ভালো হয়। আপনার অনেক বন্ধু আছে। তাদের খুঁজতে বলুন বাড়ি।

ত–ঠিক আছে, আমি বাড়ি খুঁজতে থাকি। পেলে আমি নিশ্চয়ই চলে যাবো।

শ–বুঝলেন তো, যে কম ভাড়ায় আপনি থাকছেন, এরকম ফ্ল্যাটে এত কম ভাড়ায় কেউ থাকে না।

ত–কত টাকা ভাড়া চাইছেন? যদি আমি দিই তত টাকা, তাহলে তো নিশ্চয়ই আমাকে বাড়ি ছাড়তে বলবেন না।

শ–এ বাড়ির ভাড়া পঞ্চাশ হাজার টাকা। তবে আপনার জন্য পঁয়তাল্লিশে রাজি হতে পারি।

চমকে উঠি। এত টাকা ভাড়া হয় নাকি! কুড়ি হাজার থেকে লাফিয়ে পঁয়তাল্লিশ হাজার! কখনও শুনিনি এমন।

ত–ভাড়া, যতদূর জানি, এক দু’হাজার করে বাড়ানো হয়। এভাবে দ্বিগুণের বেশি কেউ কি বাড়ায়?

শ–আমাকে বাড়াতে হবে। আর কোনও উপায় নেই আমার। একজন যখন অত টাকায় ভাড়া নেবে বলেছে, তখন তো বসে থাকতে পারি না। কালই দেখতে আসবে বাড়ি।

ত–তা দেখুন। কিন্তু আমাকে আপনার সময় দিতে হবে, যতক্ষণ না আমি কোনও জায়গা পাচ্ছি।

শ–খুব হারি। ঠিক আছে?

এর কিছুদিন পর আবারও শর্মিলার ফোন। ওই একই কথা। বাড়ি ছাড়ুন। আবারও ফোন। প্রায়ই ফোন। প্রায় প্রতিদিন ফোন। বাড়ি ছাড়ুন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কি বাড়িওয়ালাকেও বলেছেন আমাকে বাড়ি থেকে তাড়াতে? কে যেন বলেছিল, দেবল সেন সরকারের খুব ঘনিষ্ঠ লোক।

বিনীত গোয়েল এক সময় খুব সমীহ করে কথা বলতেন। এখন ফোন করেন, তবে কণ্ঠস্বর বিনীত নয়, ভাষাও ভিন্ন, স্বর এবং সুর দুই-ই পাল্টে গেছে।

বি–আপনাকে কোথাও তো চলে যেতে হবে।

ত–মানে?

বি–শহরের অবস্থা খুব খারাপ। কিছুদিন বাইরে কোথাও থেকে আসুন।

ত–শহর তো ঠিক আগের মতোই। কিছুই তো দেখছি না অন্যরকম।

বি–বড় মিছিল বেরোবে আপনার বিরুদ্ধে।

ত–সেকারণে শহর ছাড়তে হবে কেন? অনেকের বিরুদ্ধে তোমিছিল বেরোয়, তারা কি তাই বলে শহর ছেড়ে চলে যায়?

বি–দেখুন, আপনার ভালোর জন্য বলছি। আপনি কি চান না আপনাকে আমরা নিরাপত্তা দিই? চারদিকে গণ্ডগোল শুরু হলে আমরা কিন্তু আপনাকে নিরাপত্তা দিতে পারবোনা। নিরাপত্তা ছাড়া শহরে কী করে থাকবেন।

.

অন্ধকার আমাকে গ্রাস করতে থাকে।

০৫. জানালার ওপারেই দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যু

আমার চারদিকে মৃত্যু। আমি মরবো, আজনয়তোকাল। এই আতংক পুলিশের বড়কর্তারা আমার ভেতরে ঠেলে ধাক্কিয়ে ঢোকাতে চেয়েছেন। তাঁরা আমাকে সারাক্ষণের একটা সঙ্গী দিয়ে গেছেন বেঁচে থাকার। সঙ্গীর নাম মৃত্যু। আমার রক্তে ইনজেক্ট করে দিয়ে গেছেন মৃত্ম। আমার মস্তিষ্কের কোষের ভেতর সন্তর্পণে একটি দৃশ্য ঢুকিয়ে দিয়ে গেছেন, পাঁচ হাজার মুসলমান ঢুকে গেছে বাড়িতে, আমাকে গুলি করে মারছে, গুলি করছে সারা শরীরে। বড় বড় ছুরি বের করে মাথা কেটে নিচ্ছে, হাত পা কেটে নিচ্ছে। টুকরো টুকরো করছে আমাকে। করছে, আর উল্লাস করছে। এই দৃশ্যটি আমি সারাদিন দেখি, সারারাত দেখি। জানালায় চোখ রাখলে এখন আর আকাশ দেখি না, আমার মৃতমুখ দেখি। বারান্দায় হাসনুহানা গাছের কাছে এসে দাঁড়ালে আমি রক্তে ভেসে যাওয়া গাছ দেখি। চারদিকে কিছু আর সবুজ নয়, সব লাল। ঘোরের মধ্যে, গৃহবন্দি আমি, লিখতে থাকি মৃত্যুর কথা।

মৃত্যু


ঠিক জানালার ওপারেই দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যু।
দরজা খুললেই চোখের দিকে কোনওরকম
সংকোচ না করে তাকাবে,
বসলে পাশের চেয়ারটায় এসে বসবে,
বলা যায় না হাতও রাখতে পারে হাতে,
তারপরই কি আমাকে হেঁচকা টান দিয়ে নিয়ে যাবে যেখানে নেওয়ার!
কোথাও বসতে, শুতে, দাঁড়াতে গেলেই আমার মনে হতে থাকে
মৃত্যু আড়াল থেকে আমাকে দেখে দেখে হাসছে।
স্নানঘরে জলের শব্দের মধ্যে মৃত্যুর শব্দ বাজতে থাকে,
চুপচাপ বিকেলে কানের কাছে মৃত্যু এসে তার নাম ঠিকানা জানিয়ে যায়,
গভীর রাতেও মৃত্যুর স্তব্ধতার শব্দে বারবার ঘুম ভেঙে যায়।

যেই না ঘর থেকে বার হই, পায়ে পায়ে মৃত্যু হাঁটে
যেখানেই যাই, যে রস্তি বা প্রাসাদে, মৃত্যু যায়,
ঘাড় যেদিকেই ঘোরাই, সে ঘোরায়,
আকাশ দেখি, সেও দেখে,
ভিড়ের বাজারে গায়ে সেঁটে থাকে,
শ্বাস নিই, মৃত্যু দ্রুত ঢুকে পড়ে ফুসফুসে
এত মৃত্যু নিয়ে কি বাঁচা যায়, কেউ বাঁচে?
মৃত্যু থেকে বাঁচতে আমাকে মৃত্যুরই আশ্রয় নিতে হবে,
এ ছাড়া উপায় কী?

.

আরও ক’দিন বাঁচতে দাও, কমাস দাও,
আরও ক’বছর দাও সোনা,
আর বছর দুয়েক, হাতের কাজগুলো সারা হলে আর না বলবো না।

যদি বছর পাঁচেক দাও, খুব ভালো হয়।
দেবে তো? কী এমন ক্ষতি তোমার করেছি,
মৃত্যুর বিরুদ্ধে কোনও শব্দ উচ্চারণ করিনি,
একটি অক্ষরও কোথাও লিখিনি কোনওদিন!
বছর পাঁচেকে কতটুকু আর পারবো জমে থাকা কাজের পাহাড় নামাতে!
সাত আট বছর পেলে হয়তো চলে
চলে বলবো না, চালিয়ে নেব। চালিয়ে তো নিতেই হয় কাউকে না কাউকে।
দশ হলে মোটামুটি হয়। দশ কি আর দেবে তুমি সোনা?
তোমারও তো জীবন আছে, তুমি আর কতদিন বসে বসে প্রহর গুনবে!
প্রহর যদি গোনোই কিছুটা, যদি রাজি হও,
তবে শেষ কথা বলি, শোনো, দশ যদি মানো, তবে
দু’বছর কী আর এমন বছর, দিলে বারো বছরই দিও,
জানি দেখতে না দেখতে ওটুকুও ফুরিয়ে যাবে।
জানি না কী! বছর বারো আগেই তো তার সাথে দেখা হল,
এখনও মনে হয় এই সেদিন, এখনও যেন চোখের পাতা ফেলিনি,
এখনও তাকিয়ে আছি, বারো বছর কী রকম মুহূর্তে কেটে যায়, দেখেছো?
ও মরণ, ও জাদু, ভালোবেসে পনেরো কুড়িও তো দিতে পারো,
ও-ও দেখতে না দেখতে কেটে যাবে দেখো।
বছর পেরোতে কি আর বছর লাগে?

আমাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছো,
কী থেকে কী হয় কে জানে!
স্বাধীনতা থাকলে কী আর ভিক্ষে করতাম দিন!
যত খুশি যাপন করা যেত।
এখন চাইলেই কেউ তো আর বাঁচতে দিতে রাজি নয়।
তুমিও ছড়ি উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকো গায়ের ওপর,
এখন কিছুই আর আগের দিনের মতো নেই। তুমিও তো বাঁচতে চাও,
মরণও বাঁচতে চায়।

আর আমি? এখন এক একটি দিন বাঁচি তুমি যদি করুণা কর,
এক একটি মাস বছর বাঁচি, যদি বাঁচাও।
জীবনের কাছে নয়, ঋণী যদি থাকি কারও কাছে, সে তোমার কাছে,
তোমার অনুগ্রহের কাছে।
ক্ষমাঘেন্না করে আরও কটা বছর বাঁচাও সোনা।
মৃত্যুর বিপক্ষে মনের খায়েশ মিটিয়ে দু’কলম লিখে তবে মরি।

.

রামদা বল্লম নিয়ে নেমেছে ওরা,
তলোয়ার নিয়ে,
বিষাক্তসাপ নিয়ে
মাথায় ধর্মমন্ত্র
বুকে ঘৃণা,
কোমরে মারণাস্ত্র
আমাকে হত্যা করে ধর্ম বাচাবে।

কম নয়, হাজার বছর মানুষ হত্যা করে
ধর্মকে বাঁচিয়েছে মানুষ।
মানুষের রক্তে স্নান করে দেশে দেশে
এককালে ধর্ম ছড়িয়েছিল মানুষই,
মানবতার চেয়ে ধর্মকে চিরকালই মহান করেছে মানুষই।

ধর্মের পুঁথি মানুষই লিখেছে,
নিঃসাড় পুঁথিকে মানুষখেকো বানিয়েছে মানুষই।
ধর্মের হাত পা বাঁধা, মুখে সেলাই।
ছাড়া পেলে ধর্মও চেঁচিয়ে বলতো, পাষন্ডরা মর।
প্রাণ থাকলে লজ্জায় আত্মহত্যা করতো ধর্ম,
করতো দুহাজার বছর আগেই,
করতো মানুষের জন্য, মানুষের মঙ্গলের জন্য।

.

ওপারে কেউ নেই কিছু নেই, ফাঁকা,
আসলে ওপার বলে কিছু নেই কোথাও।
মৃত্যু আমাকে কোনও পারে নিয়ে যাবে না, কোনও বিচার সভায় না,
কোনও দরজার কাছে এনে দাঁড় করাবে না, যে দরজা পেরোলেই
হয় পুঁজ,রক্ত আর আগুন, নয় ঝরনার জল, না-ফুরোনো আমোদ প্রমোদ।

বিশ্বব্রহ্মা থেকে আমার বিদেয় হয়ে গেলে
শরীর পড়ে থাকবে কিছুদিন শব ব্যবচ্ছেদ কক্ষে কাঁটা ছেঁড়া হতে,
হয়ে গেলে হাড়গোড় সের দরে কারও কাছে বেচে দেবে কেউ
ওসবও একদিন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়বে, ধুলো হবে,
ধুলোও নিশ্চিহ্ন হবে কোনও এক গোধূলিতে।

যাদের ওপারে বিশ্বাস, না হয় তারাই যাক, মৃত্যুকে চুম্বন করে
রত্নখচিত দরজায় কড়া নাড়ুক,
ভেতরে অপেক্ষা করছে অগাধ জৌলুস, অপেক্ষা করছে মদ মেয়েমানুষ।
আমাকে থাকতে দিক পৃথিবীতে, থাকতে দিক অরণ্যে, পর্বতে, উতল সমুদ্রে, আমাকে ঘুমোতে দিক ঘাসে, ঘাসফুলে, আমাকে জাগতে দিক পাখিদের গানে কোলাহলে, সর্বাঙ্গে মাখতে দিক সূর্যের কিরণ, হাসতে দিক, ভরা জ্যোৎস্নায় ভালোবাসতে দিক, মানুষের ভিড়ে রোদে বৃষ্টিতে ভিজে হাঁটতে দিক, বাঁচতে দিক।

যাদের ওপার নিয়ে সুখ, তারা সুখে থাক,
পৃথিবীতে আমাকে যদি দুঃখ পোহাতে হয় তোক,
পৃথিবীই আমার এপার, পৃথিবীই ওপার।

.

জীবন জীবন করে পাগল যে হই,
দরজায় দাঁড়িয়ে আছে বলেই তো সে,
তিনবেলা চোখাচোখি হয়, প্রেমিকের মতো মুচকি হাসেও,
জানি খুব ভালোবাসে সে আমাকে, জানি খুব কাছে পেতে চায়।

ওভাবে সে চুমু খেতে না চাইলে অত করে ভালোবাসতে চাইতাম বুঝি!
ওভাবে দাঁড়িয়ে না থাকলে আঁকড়ে ধরতাম বুঝি
অত শক্ত করে পায়ের আঙুলে মাটি?
ঠেকিয়ে রাখতাম পিঠ দেয়ালে? খামচে ধরতাম হাতের কাছে যা পাই?

ওভাবে আমাকে নাগাল পেতে বাড়িয়ে না দিলে হাত,
পাড়াপড়শি গ্রাম শহর নগর বন্দর জাগিয়ে উত্তরে দক্ষিণে
ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োতাম না জীবনের খোঁজে।
ওভাবে যদি না দাঁড়িয়ে থাকতো মৃত্যু দরজায়,
একবারও চাইতাম না তাকে ঠেলে সরাতে,
পালাতে চাইতাম না কোথাও, বরং চরাচর খুঁজে তাকেই বাড়ি নিয়ে এসে বসতে দিতাম।

০৬. নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে

কী এক ঘোরের মধ্যে আমি নিজের সঙ্গে কথা বলতে থাকি। বলতে থাকি—

আমার জন্ম ভারতবর্ষে নয়। অথচ দেখতে শুনতে রুচিতে সংস্কৃতিতে আমি সামান্যও অভারতীয় নই। কিছু বছর এগিয়ে জন্মালেই আমি ভারতীয় হতে পারতাম। আমার বাবা জন্মেছিলো ভারতভাগের আগে। এই ভারতের ইতিহাস আমার বাবাকে তিনটে দেশের নাগরিক করেছে। আমাকে করেছে দুটো দেশের।

পূর্ববাংলার গ্রামে হারাধন সরকার নামে এক হিন্দু কৃষক ছিল। হারাধন সরকারের একটি ছেলে জানি না কী কারণে মুসলমান হয়ে গিয়েছিল, হয়তো সে ছেলের নাম ছিল যতীন্দ্র, হয়েছে জমির, অথবা কমল থেকে কামাল। সেই সরকার বংশের মেয়ে আমি। হারাধন সরকার আমার ছ’ পুরুষ আগের পূর্ব পুরুষ, তার অন্য সন্তানদের বংশধরেরা নিশ্চয়ই ভারতে চলে এসেছে দেশভাগের পর। তারা এখন ভারতের নাগরিক। আমার ঠাকুরদা জমির সরকার অথবা কামাল সরকার দেশ ত্যাগ করেননি কারণ তার নামটা ছিল মুসলমান নাম।

যখন ছোট, শুনেছিলাম, মুসলমানের একতা একটা অসম্ভব ঘটনা, মুসলমানে মুসলমানে যুদ্ধ হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমান পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য। যদিও আমি ভারতভাগের পরে জন্মেছি, অবিভক্ত ভারতের জন্য শৈশব থেকেই আমার একটা আকর্ষণ ছিল। অল্প বয়সে অনেক গদ্য পদ্য লিখেছি অবিভক্ত বাংলা নিয়ে, অবিভক্ত ভারত নিয়ে। এসব লিখেছি আমার প্রথম ভারত ভ্রমণের অনেক আগেই। একই ভাষার এবং একই সংস্কৃতির মানুষের মাঝখানে, বন্ধু এবং আত্মীয়দের মাঝখানে কোনও কাঁটাতার আমি মানি না, আমি বিশ্বাস করি না। ছোটবেলা থেকেই বাংলা সাহিত্যের পাঠক আমি, দুই বাংলার গল্প, উপন্যাস, কবিতা প্রবন্ধ গোগ্রাসে পড়তে পড়তে বড় হয়েছি। খুব অবচেতনেই আমি বাঙালি লেখকদের সঙ্গে আত্মীয়তা অনুভব করেছি। লেখকতালিকার বেশির ভাগ লেখকেরই বাস পশ্চিমবঙ্গে।

শৈশব থেকেই আমি ধর্মমুক্ত। আমার সচেতন মন আমাকে মানববাদ আর নারীবাদে বিশ্বাসী করিয়েছে। আমার বাবা ছিলেন ধর্মমুক্ত মানুষ, সম্ভবত অবচেতনে তার দ্বারাই আমি প্রভাবিত। আমার বেড়ে ওঠা এভাবেই হয়েছে: নারীবিরোধী সংস্কার, ঐতিহ্য, রীতিনীতি ইত্যাদিকে ভাঙতে ভাঙতে। যখন ১৯৮৯ সালে আমি প্রথম ভারত ভ্রমণ করি, একবারের জন্যও অনুভব করিনি পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের অন্যান্য রাজ্য বা অঞ্চল কোনও ভিন্ন দেশ। যেদিন প্রথম আমি পা দিই ভারতে, সেদিন থেকে এখন অবধি আমি বিশ্বাস করি আমি অখণ্ড ভারতের মেয়ে, ভারত থেকে আমি বাংলাদেশকে সত্যি বলতে কী, আলাদা করতে পারি না। আমার সেই হিন্দু পূর্বপুরুষের জন্য নয়, ভারতের অনেক সংস্কৃতির একটি সংস্কৃতি আমার বলে নয়, বা এর একটি ভাষায় আমি কথা বলি বলে নয় আমি দেখতে ভারতীয় বলে নয়, ভারতীয় সত্তা আমার ভেতর গভীরভাবে প্রোথিত বলে। এই সত্তা আমার ভেতর প্রোথিত করেছে ভারতের ইতিহাস। আমি ইতিহাসের শিকার একজন, অথবা ইতিহাস দ্বারা আমি সমৃদ্ধ, যতটুকুই সমৃদ্ধ। এর দারিদ্র, উপনিবেশিকতা, এর ধর্ম, এর ধর্মান্ধতা, এর হিংসে, হিন্দু মুসলমান, রক্তপাত, দেশভাগ, মাইগ্রেশন, একজোড়াস, এর দ্বিজাতিতত্ত্ব, বা টু নেশন থিউরি, এর অগণতন্ত্র, এর জাতপাত, রায়ট, যুদ্ধের শিকার আমি। এসব আমাকে ভারতীয় করেছে, যতটাই করেছে। এসবের ওপর বাংলাদেশ নামের এক মৌলবাদ, সন্ত্রাস, স্বৈরতন্ত্র, দুর্নীতি, দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ পীড়িত দেশ আমাকে আরও বেশি অভিজ্ঞ করেছে।

মুসলিম মৌলবাদীদের অন্ধতা, অশিক্ষা, আর অসহিষ্ণুতা ভারতের ইতিহাসের একটি টুকরো বাংলাদেশ থেকে আমাকে নির্বাসন দিল। দেশের দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ হল। আমি সেই তখন থেকেই ভারতের দরজায় কড়া নাড়ছি। যেদিন দরজা খোলা হল, আর আমি নির্বিঘ্নে ঢুকে গেলাম, মনে হয়নি কোনো বিদেশে ঢুকেছি। কেন মনে হয়নি? কেন আজ এশিয়ার অন্য দেশগুলোকে, ইউরোপ আর আমেরিকার দেশগুলোকে বিদেশ বলে মনে হয় আমার, কিন্তু ভারতবর্ষকে নয়। ইউরোপে বারো বছর কাটিয়েও ইউরোপকে নিজের দেশ বলে মনে করতে পারিনি। ভারতবর্ষে একটি বছরও কাটাতে হয়নি একে নিজের দেশ বলে মনে করার জন্য। একই ইতিহাস বহন করি বলেই তো! আজ যদি আদি ভারতের একটি টুকরোর, পূর্ববাংলার বা নতুন নাম ধারন করা বাংলাদেশের মানুষের (ভারতবর্ষের মাটিতে ইসলাম প্রচারকদের আসার কারণে ধর্মান্তরিত হওয়া মানুষের) ধর্মান্ধতা রাজনৈতিক নেতাদের ধর্মভীরুতা এবং দুরভিসন্ধির কারণে এমনই তুঙ্গে ওঠে যে গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা এবং মুক্তচিন্তাকে সবলে অস্বীকার করে এবং মানবাধিকার, মানবতার পক্ষের আপাদমস্তক সেকুলার লেখিকাকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে ওঠে, তবে সেই লেখিকাকে বাঁচাবার দায় কি সুদূর ইউরোপের নাকি আমেরিকার নাকি সেকুলার ভারতের?

আমার ওই দুঃসময়ে ভারতের দরজা ছিল বন্ধ। ইউরোপ নিয়েছিল আমাকে লুফে। সেই ইউরোপের সমাজে সবসময় নিজেকে মনে হয়েছে বহিরাগত। ইউরোপ ছেড়ে ভারতে এসেছি, ভারতে আসার পর মনে হয়েছে, বারো বছরের দীর্ঘ মৃত্যুময় নিস্তব্ধতা যেন শেষ হল। এই সমাজ যেহেতু আমার চেনা সমাজ, আমি যেহেতু এরকম সমাজেই বড় হয়েছি, তাই এত শান্তি স্বস্তি আর ভালো লাগা। সেই আগের মতো লেখালেখি নতুন উদ্যমে চালিয়ে যাচ্ছি। এই সমাজের জন্য ভালও কিছু করার সংকল্প আমার। মেয়েরা যেন নিজেদের শিক্ষা এবং স্বনির্ভরতা অর্জন করার জন্য সচেতন হয়, নিজেদের স্বাধীনতা এবং অধিকারের জন্য সংগ্রাম করার সাহস অর্জন করে। চিরকালের নতমুখ, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত নারী ভয় কাটিয়ে সেই আত্মবিশ্বাসটাই, সেই সাহসটাই, সেই শক্তিটাই যেন আমার লেখা থেকে পায়।

এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কী আছে যে বাংলাদেশে যে অবস্থা আমার হয়েছিল, প্রায় একই অবস্থা হতে যাচ্ছে এই প্রগতিশীল ভারতে, ততোধিক প্রগতিশীল পশ্চিমবঙ্গে। আমাকে গৃহবন্দি জীবন কাটাতে হচ্ছে। কোনও ‘পাবলিক প্লেস’-ই নাকি আমার জন্য আর নিরাপদ নয়। শুধু তাই নয়, কোনো বন্ধুর বাড়িও নিরাপদ নয়, আমি শুধু অন্ধকার ঘরে বন্দি জীবন কাটাবো। যারা প্রকাশ্যে খুনের হুমকি দিচ্ছে, তাদের জন্য এ রাজ্যের প্রতিটি ইঞ্চি নিরাপদ। যা ইচ্ছে তাই করার অধিকার তারা রাখে। রাস্তা অবরোধ করে মানুষকে ভোগাবার, ধর্মের নামে যাকে ইচ্ছে তাকে সর্বনাশ করার সব অধিকারই তাদের অলিখিত ভাবে দেওয়া হয়েছে। ওইসব সন্ত্রাসীদের সবরকম স্বাধীনতা আছে সন্ত্রাস করে যাওয়ার। আর যারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, অসত্য আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলছে, তাদের মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থা হচ্ছে। আমাকে মুহুর্মুহু উপদেশ দেওয়া হচ্ছে মৌলবাদীদের মিছিল মিটিং হবে, অতএব আমি যেন ঘর বাড়ি ছেড়ে, শহর ছেড়ে কোথাও চলে যাই। হাঁ, পরিস্থিতি শান্ত হলে ফিরে এসো। পরিস্থিতি কি কোনোদিন শান্ত হয়? বাংলাদেশ থেকেও একই কথা বলে আমাকে বের করা হয়েছিল। আজ তেরো বছর পরও পরিস্থিতি শান্ত হয়নি। আর এ কথাও আমার মনে হয়েছে, মৌলবাদীদের ভয়ে আমি যদি দূরে চলে যাই, তবে এ তাদের জন্য বিশাল এক বিজয় হবে। মুক্তচিন্তা, বাক স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ও সেকুলারিজম ধর্মমুক্ত পদ্ধতির বিপক্ষে বিরাট এক বিজয়। এই বিজয়টিই তাদের কিছুতেই দেওয়া উচিত নয়। যদি তারা জয়ী হয়, তাতে আমার যত ক্ষতি, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি ভারতবর্ষের। আমাকে দেশছাড়া করিয়ে তাদের দাবি যদি পুরণ করা হয়, তবে তাদের দাবির অন্ত থাকবে না। একটার পর একটা দাবি তারা করতেই থাকবে, গণতন্ত্র বিরোধী আস্ফালন করতে দ্বিগুণ উৎসাহী হয়ে উঠবে। একে তাড়াও, ওকে বন্দি করো, তার বই নিষিদ্ধ করো, একে মারো, তাকে পোড়াও চলতেই থাকবে। আর বশংবদ ধর্মনিরপেক্ষগণ ধর্মীয় মৌলবাদীদের সব আদেশ নিষেধ মাথা পেতে বরণ করে নেবে। মৌলবাদীদের দাবির কাছে নতি স্বীকার করলে মৌলবাদীরা কখনও তুষ্ট হয়, তারা আরও ভয়ংকর গণতন্ত্রবিরোধী দাবি নিয়ে আরও ভয়ংকর রূপে উপস্থিত হয়।

আমার দুঃস্বপ্নের মধ্যে কখনও এমন ছিল না যে ভারতেও আমাকে বাংলাদেশের মতো ভুগতে হবে। এক দেশে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ, আরেক দেশে সংখ্যালঘু, কিন্তু দাপট প্রায় একই। ধর্মান্ধতা, অসহিষ্ণুতা, মেরে ফেলা, কেটে ফেলা, মুণ্ডু চাওয়া, প্রগতি, বিজ্ঞান ইত্যদিকে বাজে কাগজের মতো উড়িয়ে দেওয়া সব এক। আমাকে মেরে তাদের লাভ কী হবে, মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে। মৌলবাদী নেতারা ভালো করে জানে যে এতে তাদের লাভ থাকলেও থাকতে পারে, ইসলামের কোনও লাভ নেই। ইসলাম যেমন আছে, তেমনই থাকবে। ইসলামকে স্পর্শ করার সাধ্য আমার কেন, কোনও প্রাণীরই নেই। ধর্ম ধর্মের মতো থাকে, মানুষ ধর্ম আঁকড়ে ধরে নয়তা ধর্ম থেকে দূরে সরে। মৌলবাদের চেহারা পৃথিবীর সব দেশে এক। তাদের ভাষা এক, তাদের ক্রুরতা এক, চরিত্র এক, তাদের স্বপ্ন এক। সমাজকে কয়েক হাজার বছর পেছনে ঠেলে দেওয়ার আরামটা পেতে চায়, ও থেকে বঞ্চিত হওয়ার আদৌ কোনোও ইচ্ছে নেই কারও।

ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে আমার পৃথিবী। শহর জুড়ে যেমন ইচ্ছে ঘুরে বেড়ানোর মানুষ আমি। এখন আমার হাতে পায়ে শেকল। সব বলে ফেলার মানুষ আমি, এখন আমার জিভে সেলাই। বাইরে নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল, আমি অংশ নিতে পারছি না। বাইরে চলচ্চিত্রের, নাটকের, গানের উৎসব, আমি উপভোগ করতে পারছি না। আমাকে একটি দরজা জানালা সাঁটা ঘরে দমবন্ধ অবস্থায় বসে থাকতে হবে। না, একে আমি আমার নিয়তি মানছি না। আমি এখনও বিশ্বাস করছি, আমি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবো। এখনও বিশ্বাস করছি, ভারত আমাকে সেই শাস্তি দেবে না, যে শাস্তি মৌলবাদ অধ্যুষিত বাংলাদেশ দিয়েছে। এখনও বিশ্বাস করছি, এ দেশই আমাকে নিরাপত্তা দেবে। মানুষের ভালোবাসাই আমার নিরাপত্তা হবে। আমি এ দেশেই বাকি জীবন নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে কাটাতে পারবো। এই দেশকে আমি ভালোবাসি। এই মাটিকে আমি নিজের মাটি বলে ভাবি। এই দেশও যদি আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, তবে আমার শেষ ভরসা, শেষ অবলম্বন, আমার শেষ স্বপ্নকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা ছাড়া আর কিছু নয়।

আমার তো যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। কোনো দেশ নেই, কোনো ঘর নেই, এক ভারতবর্ষই দেশ আমার। এখানেই আমার ঘর। সত্য বলার অপরাধে আমাকে আর কত শাস্তি দেবে ধর্মবাদীরা আর ধর্ম ব্যবহার করে ভোট পেতে চাওয়া রাজনীতিকরা? এই যে এত ভোগান্তি, এত লাথি, এত গুঁতো, এত ঘাড় ধাক্কা। এত কিছুর পরও আমার স্বপ্ন আমি সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে পারি না। এখনও স্বপ্ন দেখি যে উপমহাদেশের একজন সৎ, সত্যবাদী, সেকুলার লেখকের জন্য ভারতবর্ষই দেশ, সবচেয়ে নিরাপদ দেশ।

০৭. ফেয়ারওয়েল, ২২ নভেম্বর, ২০০৭

গতকাল সকালে ছোট একটা মিছিল বেরিয়েছিল পার্কসার্কাসে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘নন্দীগ্রাম তাণ্ডব’, ‘রিজওয়ান হত্যা’, আর ‘তসলিমা হঠাও’ নিয়ে কিছু একটা হবে। গোটা পঞ্চাশেক মৌলবী রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছিল। এরা কেউই আন্দোলনের মতলব নিয়ে এসেছে বলে মনে হয়নি। বাড়িতে ঘুমোচ্ছিল হয়তো, ঠেলে রাস্তায় নামানো হয়েছে। পুলিশ সবাইকে ভ্যানে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেছে। এদের মাতব্বরটিকেও। মাতব্বরটি ‘অল ইণ্ডিয়া মাইনরিটি ফোরাম’এর নামে প্রায়ই এ ধরনের গণ্ডগোল সৃষ্টি করার উদ্যোগ নেয়।

কিন্তু এর পর পরই দেখা গেল পার্কসার্কাসের এক গলি থেকে অল্প বয়সের কিছু ছেলে বেরিয়ে পুলিশের দিকে ঢিল ছুঁড়তে লাগলো। ছুঁড়ে মারতে লাগলো কোক খেয়ে কোকের বোতল, আর হিহি হাসি। পুলিশেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের মার খেলো আর মাঝে মাঝে কাঁদানে গ্যাস ছুড়লো। লুঙ্গি আর স্যাণ্ডো গেঞ্জি ছেলেরা হুল্লোড় করতে করতে গাড়ি পোড়াতে লাগলো, বাস ট্রাক পোড়াতে লাগলো, সাংবাদিকদের ক্যামেরা ভাঙতে লাগলো। এই ভাংচুর, এই জ্বালাও পোড়াও, এই হৈ-হল্লা অনেকটা সংক্রামক, এর পেছনে কোনও উদ্দেশ্য থাকার প্রয়োজন হয় না। অনেকটা পকেটমারকে পেটানোর মতো। পিটিয়ে আনন্দ। পার্কসার্কাসের রাস্তায় পুলিশ আর গাড়ি বা কিছু চলতে দিচ্ছে না। সারা শহরে ট্রাফিক জ্যাম শুরু হয়ে গেল। দুতিনটে ছেলে গলির ভেতর কাগজে ‘তসলিমা গো ব্যাক’ লিখে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালো। কলকাতার কয়েকজন বন্ধুকে ফোনে জিজ্ঞেস করি, ‘কারা ওরা?’ প্রায় সবাই বললো, ‘ওরা জানে না তসলিমা কে, কী জিনিস, তসলিমার বই কোনোদিন পড়েনি, উর্দুভাষী অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত মুসলমান, পকেটমার, ছিচকে চোর, মুদির দোকানি, ফেরিঅলা। ওদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। ওদের পথে নেমে ঠিক যা যা করতে বলা হয়েছে, সব করছে ওরা। আমি হতবাক বসে থাকি। টেলিভিশনে যা দেখলাম, নীল পোশাকের অভিজ্ঞ পুলিশ র‍্যাফ নামলো, সেনা নামলো। শহরময় টহল দিল। কাফু জারি হল। আর রাতে সিপিএমএর রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বললেন, ‘তসলিমাকে নিয়ে ঝামেলা হলে তসলিমার এ শহর ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত।’

পুলিশের নিরাপত্তা প্রধান আগেও যেমন জানিয়েছিলেন, সেদিনও এবং পরদিনও জানালেন আমাকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত একেবারে পাকা। মৌলবাদীরা আসছে আমার বাড়িতে, শুক্রবার নামাজের পর। আগেও জিজ্ঞেস করেছিলাম, এবারও করি, ওদের অ্যারেস্ট করছেন না কেন?

বি–অসুবিধে আছে।

ত–কী অসুবিধে? আপনারা আছেন, নিশ্চয়ই ওরা বাড়িতে আসার সাহস পাবে না।

বি–আমরা ওদের কিছু করতে পারবো না।

ত–কেন?

বি–মুসলমানদের গায়ে হাত দেওয়া যাবে না। রায়ট লেগে যাবে।

ত–হিন্দু মুসলমানের ব্যাপার নয়, টেরোরিস্ট হল টেরোরিস্ট। কেউ অন্যায় করলে তাকে শাস্তি দেবেন। রায়ট লেগে যাবে, এ কোনও যুক্তি হল কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার?

বি–রায়টের রিস্ক নিতে পারবো না। ত তাহলে কী করতে হবে?

বি–আপনাকে দু’দিনের জন্য জয়পুরে যেতেই হবে।

ত–দু’দিন?

বি–হাঁ, ঠিক দু’দিন।

ত–দু’দিনে সব ঠিক হয়ে যাবে?

বি–সিওর।

ত–জয়পুরে কেন?

বি–জয়পুরে লাক্সারি রিসর্ট আছে আমাদের। ওখানে দু’দিন একটু বিশ্রাম নিন। আমরা দুদিন পর আপনাকে ফেরত নিয়ে আসবো।

ত–আমি জয়পুর যাবোনা। আপনারা যদি আমার বাড়িতে আমাকে নিরাপত্তা দিতে পারেন, তাহলে আমি বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে শুক্রবার দিনটা কাটাই।

বি–কোথায়?

ত–বেহালায়।

বি–না, বেহালায় সিকিউরিটি ছাড়া আপনাকে থাকতে হবে। যেখানেই যাবেন, নিজ দায়িত্বে।

ত–সল্টলেকে?

বি–আমাদের পক্ষে সিকিউরিটি দেওয়া সম্ভব নয় সল্টলেকে। আপনার নিজ দায়িত্বে থাকতে হবে।

ত–আমি বেলঘরিয়া যাবো। একদিনের তো ব্যাপার। আমার পাবলিশারের বাড়ি ওখানে।

বি–হবে না।

ত–দুর্গাপুরে, বোলপুরে?

বি–সবখানেই আপনার সিকিউরিটির দায়িত্ব আপনার।

ত–আপনারাই বলছেন আমাকে মেরে ফেলার জন্য দল তৈরি হয়ে গেছে। আবার বলছেন কোথাও সিকিউরিটি দেওয়া সম্ভব নয়! এতদিন যে নিরাপত্তা দিলেন, কেন দিলেন! হঠাৎ বিপদের সময় বন্ধ করে দেবেন কেন? বিপদের কথা তো আমার জানা ছিল না। আপনারাই জানাচ্ছেন, এখন সবচেয়ে বেশি বিপদ। আর আপনারাই এখন বলছেন, নিরাপত্তা দেবেন না। কী করবো আমি, কিছু তো বুঝতে পারছি না।

বি–আপনি আমাদের কথা শুনুন। আপনি জয়পুর যান। আপনার ভালোর জন্যই বলছি।

ত–আমি অবাক হচ্ছি, এত বড় পুলিশ বাহিনী গোটা কয় লোকের মার্ডার প্ল্যানএর বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবে না। যদি আচমকা কিছু ঘটতো, সে না হয় বুঝতাম। এ তো আপনাদের নলেজের মধ্যে। কেন আমাকে বাঁচাতে পারবেন না?

বি–সরি। আমরা পারবো না।

সাফ সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমাকে মেরে ফেলবে মৌলবাদীরা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ কোনো নিরাপত্তা আমাকে দিতে পারবে না। আমি স্তম্ভিত বসে থাকি। এ কী ঘটছে! কোনোদিন নিরাপত্তা চাইনি সরকারের কাছে। কিন্তু ভারতে যখনই এসেছি বা থেকেছি, সেই তিরানব্বই সাল থেকে আমার নিরাপত্তার জন্য পুলিশ মোতায়েন করেছে সরকার। আমাকে একদিনের জন্যও নিরাপত্তাহীন অবস্থায় রাখেনি। আর আজ কি না আমাকে বলা হচ্ছে আমাকে আক্রমণ করা হবে, পুলিশ কোনো নিরাপত্তা আমাকে দেবে না, আমাকে পশ্চিমবঙ্গ ত্যাগ করতে হবে, তাহলেই সরকার আমার পাশে দাঁড়াবে, নয়তো দাঁড়াবে না। এমন অদ্ভুত যুক্তি আগে শুনিনি, এমন অদ্ভুত ব্যবহার আজ অবধি কোথাও পাইনি। কস্মিনকালেও নিরাপত্তাব্যবস্থা আমি চাইনি, সবসময় যা চেয়েছি, তা হলো, আর দশজন মুক্ত মানুষের মতো চলাফেরা করতে। আমি চাইনি আমার জন্য সরকারের কোনো টাকা খরচ হোক। আমি সাধারণ মানুষ, সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন করতে চেয়েছি। প্রথম দিকে প্রচুর পুলিশ থাকতো ঠিকই, ধীরে ধীরে কমে গিয়ে মোটে দুজনে এসে দাঁড়িয়েছিল। বাড়ির বাইরে কোথাও যেতে হলে একজন সাদা পোশাকের কেউ যেত আমার সঙ্গে। আমি বাড়ি ফিরলে সেই সাদা পোশাক চলেও যেত নিজের বাড়ি। দু’শ থেকে দু’জন হওয়ার অর্থ এ শহরে আমার জীবনের ঝুঁকি নেই। আমিই চাইছিলাম রক্ষীর সংখ্যা কমে কমে যেন শূন্যতে চলে আসতে পারে। মানুষের ভালোবাসাই যেন আমার নিরাপত্তা হয়। কিন্তু আশ্চর্য! এই শহরই আজ আমার নিরাপত্তা ব্যবস্থা বন্ধ করে দিতে চাইছে, এই খবরটি দিয়ে, যে, আমাকে আজ বা কাল মেরে ফেলা হবে, মেরে ফেলার সব ব্যবস্থা পাকা হয়ে গেছে। আমাকে আমার আততায়ীদের খবরটা জানিয়ে নিরাপত্তা বন্ধ করা কেন? না জানিয়েই বন্ধ করলে আমি অন্তত দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে পারতাম!

দুপুরে পুলিশের লোক এসে আমাকে নিয়ে গেল কলকাতা বিমান বন্দরে। দাদা ছিল আমার সঙ্গে। আমার হাতে দুটো ওয়ান ওয়ে টিকিট দিল ওরা। কোথায় যেতে হবে? জয়পুর। একগাদা পুলিশ আমাকে এয়ারক্রাফটের ভেতর বসিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল বাইরে। উড়োজাহাজ উড়লো, তারপরও দাঁড়িয়ে রইল। কলকাতার আকাশে যতক্ষণ উড়োজাহাজের চিহ্ন দেখা যায়, রইল। ফেয়ারওয়েল ওরা এমন নিঃশব্দেই জানালো। আমি তখনও জানি না আর কলকাতায় ফিরতে দেওয়া হবে না আমাকে। তখনও জানি, আমাকে বাংলা থেকে চির জীবনের জন্য দূর করতে যে চক্রান্ত চলেছে, তা সেদিন সার্থক হল।

জয়পুর নামার পর দেখি পুলিশে ছেয়ে আছে বিমান বন্দর। তারা নাকি মাত্র কিছুক্ষণ আগে খবর পেয়েছে যে আমি আসছি। কলকাতার পুলিশ বলেছে, আমি নাকি এখানে কোন সাহিত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছি। পুলিশ নিয়ে গেল আমাকে একটা সস্তা হোটেলে। এই হোটেলই নাকি আমার জন্য ঠিক করা হয়েছে কলকাতা থেকে। অথচ বলা হয়েছিল, লাক্সারি রিসর্ট। লাক্সারি তোদূরের কথা, এঅনেকটাময়মনসিংহের নদীর পাড়ের দেড়টাকা দামের চিৎ কাত হোটেলের মতো। এমন হোটেলে কখনও থাকিনি আগে। অভিজ্ঞতাও বটে। পুলিশেরা জিজ্ঞেস করতে লাগলো, তোমার প্রোগ্রাম কাল কখন?

ত–আমার কোনো প্রোগ্রাম নেই।

পু–তবে কেন এসেছো কেন?

ত–আমাকে পাঠানো হয়েছে কলকাতা থেকে।

পু–কে পাঠিয়েছে?

ত–কলকাতার পুলিশ।

পু–কেন পাঠিয়েছে?

ত–জানি না। বলেছে দু’দিনের জন্য জয়পুরে থাকতে।

পু–ওরা আমাদের মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়েছে, কী একটা নাকি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছে।

ত–কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার ব্যাপার নেই।’

পুলিশের মধ্যে রাজস্থানী ভাষায় আলোচনা চলতে থাকে। একটু পর পর একজন আসে, কাল আমার ক’টায় প্রোগ্রাম জানার জন্য মরিয়া ওরা। প্রোগ্রাম কিছু নেই, এমনি এসেছি –এ কথা বারবারই বলছি, বারবারই শুনছে, বারবারই বিষম খাচ্ছে। ভড়কে গেছে হোটেলের সামনে সাংবাদিক আর ক্যামেরার ভিড় দেখে। আমার জানা হতো না ক্যামেরার ভিড় সম্পর্কে, যদি না হোটেল-ঘরের টেলিভিশনটা চালাতাম। টেলিভিশনে দেখি আমার খবর দেখানো হচ্ছে, আমি জয়পুরের কোন হোটেলে এখন আছি, কত নম্বর রুমে আছি, সব। আমি নিজেই জানতাম না হোটেলের নাম আর রুম নম্বর। টেলিভিশন থেকে জানা হয়, জানালার পর্দা সামান্য ফাঁক করে দেখাও হয় রাস্তার সারি সারি ক্যামেরা কী করে তাক করে আছে ঘরের দিকে। বুক কাঁপে আমার। মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা আমার রক্ত চায় জানার পরও কোনও সুস্থ সাংবাদিক কি জানাবে আমি কোথায় আছি না আছি, এভাবে? এরাকি তাহলে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে সন্ত্রাসীদের যে তোদের শিকারের সন্ধান পাওয়া গেছে, আয় ছুটে আয়, এসে শিকারটাকে ইচ্ছে মতো ছিঁড়ে খা। ছিঁড়ে খা যেন আমরা সেটা ক্যামেরায় চমৎকার ধরে রাখতে পারি, আর সারাদিন ধরে প্রচার করতে পারি, আমাদের দর্শক বাড়বে, আমাদের চ্যানেলের নাম হবে!

ছটফট করি। একে ওকে ফোন করি। কলকাতার পুলিশেরা কেউ এখন আমার ফোন ধরছে না। জয়পুর পুলিশ না বোঝে ইংরেজি, না বোঝে হিন্দি। আমি প্রমাদ গুণতে থাকি। কী করে রাস্তায় ভিড় করা সাংবাদিকদের মিনতি করবো আমাকে প্রাণে মারার এই আয়োজন বন্ধ করতে! এক ফোঁটা ঘুম নেই। রাত একটার দিকে ঘরের দরজা ভেঙে ফেলছে এমন শব্দ। জিজ্ঞেস করি, কে?

পু–দরজা খুলুন।

ত–না, দরজা খুলবো না। কে আপনি?

পু–আমি পুলিশ সুপার। আপনাকে এক্ষুণি চলে যেতে হবে রাজ্য ছেড়ে।

ত–কিছু বুঝতে পারছি না কী বলছেন।

পু–দরজা খুলুন।

ত–আমি দুঃখিত, এত রাতে আমি দরজা খুলবো না। যা বলবেন সকালে বলবেন।

পু–সকালে বললে চলবে না। আপনাকে বেরিয়ে যেতে হবে। মুখ্যমন্ত্রীর অর্ডার।

ত–আপনি রিসেপশন থেকে ফোন করুন ঘরের ফোনে। আমি কথা বলছি।

রিসেপশান থেকে ফোনে আমাকে পুলিশের বড় কর্তা বললেন–আপনি এক্ষুণি। হোটেল ছাড়ুন।

ত–হোটেল ছেড়ে আমি যাবো কোথায় এত রাতে?

পু–সে আপনার ব্যাপার, আপনি কোথায় যাবেন।

ত–এখন তো কোনো ফ্লাইট নেই কলকাতায় যাওয়ার।

পু–আমরা অত কিছু জানি না। শুধু জানি আপনার রাজস্থানে থাকা চলবে না।

ত–কেন চলবে না?

পু–আমাদের এখানে মুসলমানরা অসন্তুষ্ট হতে পারে। ল এণ্ড অর্ডার প্রবলেম হতে। পারে। সে কারণে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন আপনাকে রাজস্থান ছাড়তে।

ত–কিছু কি প্রবলেম হয়েছে এর মধ্যে?

পু–হয়নি। কিন্তু যে কোনও সময় হতে পারে।

ত–মানে ‘হতে পারে’ অনুমান করে আমাকে চলে যেতে বলছেন।

পু–হ্যাঁ।

ত–সে আমি ছাড়বো হোটেল। সকালটা হতে দিন। আমি এয়ারপোর্টে চলে যাবো কলকাতার ফ্লাইট ধরতে।

পু–সকাল হতে দিতে পারছি না। সকালের আগেই যেতে হবে। সূর্য ওঠার আগে।

ত–সূর্য ওঠার ঠিক কত আগে বলুন।

পু–আপনাকে পাঁচটার আগেই বেরিয়ে যেতে হবে।

ত–ঠিক আছে।

পু–পাঁচটার পাঁচ মিনিট আগেই আপনি রুম ছেড়ে নিচে নেমে আসবেন। গাড়ি অপেক্ষা করবে আপনাকে এয়ারপোর্টে নেওয়ার জন্য।

ঠিক আছে বলে ফোন রাখলাম। সত্যি বলতে কী, স্বস্তি পেলাম অনেক। এই রাষ্ট্র হয়ে যাওয়া ঠিকানা যত শীঘ্র সম্ভব ত্যাগ করা উচিত। রাজস্থান ছাড়তে হবে, কলকাতায় ফেরার জন্য এ চমৎকার একটি কারণ। আমি হয়তো একটুখানি ঘুমিয়ে নেওয়ার সময় পেলাম, দাদা একেবারে ঠায় বসে রইলো বিছানায়। দাদাও বাবার মতো, ভোরে কোথাও যাওয়ার থাকলে সারারাত বসে বসে ভোর হওয়ার অপেক্ষা করে। ভোর পাঁচটায় নিচে নেমে দেখি পুলিশ আর সাংবাদিকদের ভিড়ে গিজগিজ করছে রাস্তা। ক্যামেরা আর সাংবাদিক ঠেলে সরিয়ে পুলিশ আমাকে গাড়িতে ওঠালো। এক সারি গাড়ি চললো। আমার গাড়ির পেছনে আরও পুলিশের গাড়ি, পুলিশের গাড়ির পেছনে সাংবাদিকদের গাড়ি। গাড়ি চলছে তো চলছেই। একসময় আমার খটকা লাগে, গাড়ি এত চলছে কোথায়! বিমান বন্দরে পৌঁছোতে তো এত সময় লাগার কথা নয়। জিজ্ঞেস করলাম, ‘এত সময় লাগছে কেন এয়ারপোর্টে যেতে?’

গোঁফওয়ালা ডাকাত-ডাকাত দেখতে কয়েকজন পুলিশ গাড়িতে। পেছনের সিটে কিছু, সামনের সিটে কিছু, মাঝখানের সিটে আমি আর দাদা। আমার প্রশ্নের কেউ কোনও উত্তর দিল না। আমি আবারও জিজ্ঞেস করি। কোনও উত্তর নেই। আবারও।

ত–এয়ারপোর্টে যেতে এত দেরি হচ্ছে কেন? এয়ারপোর্ট তো এত দূরে নয়।

পু–যাচ্ছি না এয়ারপোর্টে।

ত–তবে কোথায় যাচ্ছেন?

পু–দিল্লি।

ত–দিল্লি কেন?

পুলিশ চুপ।

ত–দিল্লি কেন যাবো আমি? আমি কলকাতায় ফিরবো। আমাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যান।

পুলিশ চুপ।

ইংরেজি বোঝে না। দাদাকে বললাম, হিন্দিতে বলতে। দাদা হিন্দি আমার চেয়ে ভালো জানে। কিন্তু হিন্দিতে জিজ্ঞেস করা প্রশ্নেরও কোনও উত্তর নেই। ওরা নিজেদের মধ্যে রাজস্থানী ভাষায় কথা বলতে থাকে। যেন আমাদের কোনও প্রশ্নই ওরা শুনতে পায়নি অথবা আমরা যে আছি গাড়িতে, সে বেমালুম ভুলে গেছে।

অন্ধকার কেটে যাচ্ছে, আলো ফুটছে। ভোরের ঘুম ঘুম রাস্তায় গাড়ি হাওয়ার বেগে ছুটছে। পুলিশগুলো বারবার পেছনে তাকাচ্ছে, দেখছে এ গাড়ির কেউ পিছু নিচ্ছে কি না। পেছন ফিরে একজন হঠাৎ হিন্দিতে বললো, দিল্লিতে যাচ্ছি, কারণ আমাদের সেরকমই বলা হয়েছে।

ত–কে বলেছে?

পু–সেরকমই অর্ডার।

ত–কে অর্ডার দিয়েছে?

পুলিশ চুপ।

ত–আমি তো কলকাতা ফিরবো। আমাকে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কেন?

পু–আমরা অত সব জানি না।

ত–কলকাতায় না গিয়ে দিল্লি যাওয়ার কারণ কী?

পুলিশ চুপ।

ত–দিল্লিই যখন যাচ্ছেন, তখন দিল্লিতে প্লেনে না গিয়ে গাড়িতে যাচ্ছেন কেন?

এ কথাটা পাঁচবার জিজ্ঞেস করার পর উত্তর জোটে, সিকিউরিটি।

গাড়ি চলছে। এরমধ্যে ফোন। কলকাতা থেকে। খবর পেলাম, আমার গাড়িকে অনুসরণ করছে স্টার আনন্দের দিল্লি সংবাদদাতা। স্টার আনন্দতে সরাসরি প্রচার করা হচ্ছে অজানার উদ্দেশে আমার যাত্রা। গাড়ি জয়পুর ছাড়িয়ে যাচ্ছে, কোথাও না কোথাও যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে জানি না। একসময় স্টার আনন্দর অনুসরণ করা সাংবাদিক ফোন করলো আমাকে, ‘দিদি, কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আপনাকে?’ উত্তেজিত কণ্ঠস্বর।

ত–জানি না। ওরা তো বলছে দিল্লি। কিছু বুঝতে পারছি না। দিল্লি কেন নেবে জানি না।

সা–এই আমার ফোন নম্বর। প্লিজ আমাকে জানাবেন কী হচ্ছে না হচ্ছে। আমরা আছি আপনার সঙ্গে। দিদি, কোনও চিন্তা করবেন না।

ত–কলকাতায় যাবো সকালের ফ্লাইটে। তাই কথা হল রাজস্থানের পুলিশের সঙ্গে। এখন আমাকে কি না দিল্লি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কী রকম ধন্দের মধ্যে পড়েছি, দেখুন তো!

সা–আমরা তো আছি। ঘটনাটা কোথায় গিয়ে গড়ায়, দেখিই না। শুধু আমি নই, আমার মতো লক্ষ লক্ষ লোক আপনাকে ভীষণ রেসপেক্ট করে, দিদি।

ওই দিদি ডাক, ওই বাংলায় কথা বলা, হোক না ভাঙা বাংলায়, আমাকে স্বস্তি দেয়। আমি একা নই, আমার এই ভয়াবহ নিরুদ্দেশ যাত্রায় কেউ পাশে আছে, এই ভাবনাটিই আমার দুশ্চিন্তা ঘুচিয়ে দেয়।

জানি না কতদূর গিয়ে একসময় গাড়ি ঢুকে পড়ে একটা মোটেলের পেছনের নির্জন কোণায়। এক পুলিশ গাড়িতে থাকে, বাকি পুলিশ নেমে যায়। কোথায় যায় কে জানে, আর ফিরে আসে না। নতুন কিছু পুলিশ গাড়িতে ওঠে আধঘণ্টা পর। গাড়ি চলতে শুরু করে রাজপথে। আবারও হাওয়ার বেগে। কিছুক্ষণ পর সেই স্টার আনন্দের সাংবাদিক, কণ্ঠে আতংক আর অস্থিরতা, বলে, আমাদের সব সাংবাদিককে গাড়ি থামিয়ে গাড়ি থেকে বের করে মেরেছে পুলিশেরা। এখন মোটেলের একটা রুমে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে শেকল দিয়ে চলে গেছে।

ত–কী বলছেন এসব! ভয়ংকর কাণ্ড!

সা–ওরা আপনার গাড়িকে ফলো করতে দেবে না।

ত–তাই বলে মারবে?

সা–যাচ্ছেতাই ভাবে পিটিয়েছে।

ত–আহা। বেরোবেন কী করে এখন?

সা–জানি না। মনে হচ্ছে হোটেলের লোকদের বলে দিয়েছে শেকল না খুলতে।

একসময় পুলিশদের জিজ্ঞেস করলাম, দিল্লিতে আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? দিল্লির কোথায়? কোনও জায়গা আছে নির্দিষ্ট? পুলিশদের মধ্যে একজনই আছেন, যিনি হিন্দিতে অন্তত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন। যদিও উত্তর দেওয়ার ইচ্ছে তার আদৌ আছে বলে মনে হয় না। উত্তর দিতে পারা পুলিশটিও গোঁফওয়ালা, ডাকাত-ডাকাত।

পু–না। জায়গা আপনাকে বের করতে হবে। আমরা দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছে দেব।

ত–দিল্লিতে পুলিশের হাতে দেবেন তো আমাকে? মানে সিকিউরিটি পুলিশের হাতে?

পু–দিল্লির যে ঠিকানায় যেতে চান, সে ঠিকানায় আমরা আপনাকে পৌঁছে দেবো৷ হোটেলের নাম টাম জানেন?

ত–আমার কোনও ঠিকানা নেই দিল্লিতে।

পু–কী নেই?

ত–ঠিকানা।

ভ’বাবুকে ফোন করি। সরকারের বড় পদে এই ভদ্রলোককেই আমি চিনি। খুব দ্রুত, খুব ব্যস্ত মানুষটিকে তথ্য জানিয়ে দিই, তিনি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই।

ত–‘আমাকে কলকাতা থেকে জয়পুর পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, কাল রাতে জয়পুর পৌঁচেছি। এখন ওখান থেকে কয়েক ঘণ্টা পরই আমাকে, সকাল হওয়ার আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে দিল্লি। কলকাতায় ফিরতে চাইলাম। কিন্তু না জানিয়ে দিল্লি পাঠানোর কোনও কারণ আমি জানি না। দিল্লিতে নাকি কোনো পুলিশের সঙ্গে ওদের কথা হয়নি। আমার কাছে জানতে চাইছে কোথায় যাবো আমি।

ভ’বাবু বললেন কেন আমাকে পাঠানো হচ্ছে দিল্লিতে, কী ঘটেছে রাজস্থানে, এসব খবর নিয়ে তিনি আমাকে জানাবেন। তিনি আর জানাননি। তার সেক্রেটারি ফোন করে বললেন, আমি যেন রাজস্থানী পুলিশদের বলি আমাকে দিল্লির পুলিশ-স্টেশনে নামিয়ে দিতে। ওখান থেকেই আমাকে তুলে নিতে আসবেন ভ’বাবুর লোক।

‘তাহলে সিকিউরিটির লোকেরা ওখান থেকে আমাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাক। আমি চলে যাবো কলকাতায়।‘

ওদিকে ভ’বাবুর সেক্রেটারি। শুনছেন।

‘দেখুন তো, এর কোনও মানে হয়। আমাকে জয়পুরে থাকতে দেবে না দুদিন, তো আমাকে বাড়ি ফিরতে দাও। জয়পুর থেকে কলকাতা চলে গেলেই ঝামেলা চুকে যেতো। এখন জয়পুর থেকে দিল্লি, দিল্লি থেকে কলকাতা। এত ঘুরপথের দরকার কী ছিল, বুঝি না।

ভ’বাবুর সেক্রেটারি বললেন, হুম।

আমি বললাম, ”আচ্ছা বলুন তো, দিল্লি শহর থেকে এয়ারপোর্ট কি খুব দূর? ঠিক মনে পড়ছে না। আজকেই তো ফ্লাইট ধরা যাবে, তাই না।

সেক্রেটারি বললেন, ‘আগে দিল্লি পৌঁছোন তো। পরেরটা পরে দেখা যাবে।

হঠাৎ পথে একজায়গায় গাড়ি থামিয়ে পুলিশেরা আবার হাওয়া হয়ে গেল, পুলিশের সবগুলো গাড়ি থেকেই পুলিশ হাওয়া। অনেকক্ষণ বাদে ফিরে এলো সাদা পোশাকে। গা থেকে হঠাৎ ওরা পুলিশের ইউনিফর্ম খুলে ফেললো কেন! দাদা ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো, গাড়ির নম্বর প্লেটও খুলে ফেলেছে। লক্ষ্য করি, আমি যে গাড়িতে বসে আছি, সে গাড়ির তো বটেই, আমার গাড়ির সামনের এবং পেছনের গাড়িগুলোর নম্বর প্লেট নেই। দু’জন সাদা পোশাকের তাগড়া পুলিশ সব পুলিশকে বলছে রাইফেলগুলো সব লুকিয়ে ফেলতে। তার মানে কেউ যেন বুঝতে না পারে, আর্মস নিয়ে একদল লোক কোথাও যাচ্ছে! দাদা আর আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাগড়া দুজন বললো, ‘মোবাইল ফোন অফ করো। মোবাইল ফোন অফ করবো, হচ্ছেটা কী? কেন করবো অফ?’ বলতে নিচ্ছি, অমনি বিরাট ধমক, ‘অফ করোনি এখনও, এক্ষুণি অফ করো।‘ যে পুলিশ গাড়ি চালাচ্ছিল, আমার দিকে কটমট করে তাকালো, দৃষ্টিটি লোলুপ, নাকি দৃষ্টিটি রাগে ঘৃণায় ফোলা, বুঝতে পারি না।

দুপুর পার হয়ে গেছে, তখনও দিল্লি পৌঁছোনোর তোনামইনেই বরং রাস্তার সাইনবোর্ডগুলো দেখে বুঝি দিল্লির উল্টো পথে চলছে আমাদের গাড়ি। দিল্লি পেছনে। বুক ধুকধুক করে। ভয়ে কণ্ঠ শুকিয়ে খরা। গাড়ি একসময় বড় রাস্তা থেকে নেমে যায় অলিতে গলিতে, মাঠে ময়দানে, ক্ষেতে। ক্ষেত মাড়িয়ে গাড়ি চলে, পারলে নর্দৰ্মায় নেমে যায়। আমার মনে হতে থাকে, এই লোকগুলো সত্যিকার পুলিশ নয়। এরা আমাকে অপহরণ করেছে। আইএসআই বলে কী যেন ভয়ংকর কী আছে, সম্ভবত এরাই। এরাই আমাকে জয়পুর থেকে ছলে বলে কৌশলে বের করে নিয়ে এসেছে। অজ পাড়া গাঁ’র কোনও ঝাড় জঙ্গলে নিয়ে মেরে ফেলে রাখবে। মরে পচে থাকবো, কেউ জানবেও না।

দিল্লির রাস্তা থেকে এরা অনেক আগেই গাড়ির বহর ঘুরিয়ে নিয়েছে। কোথায় যাচ্ছে, তা অনুমান করার সাধ্য আমার নেই। নিজেদের মধ্যে রাজস্থানী ভাষায় কথা বলছে, আর ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। ড্রাইভারের চোখে এখনও আমাকে গিলে খাওয়ার দৃষ্টি। দেখে নিচ্ছে আমি ঠিক আছি কি না, আমার পেছনের সিটে যারা আছে, তারা ঠিক কি না, এই গাড়ির পেছনের গাড়িটায় কোনও অসুবিধে হচ্ছে কি না, এবং পেছনের গাড়িটার পেছনে কোনও সন্দেহজনক গাড়ির চিহ্ন আছে কি না। আমি নিশ্চিত এরা পুলিশ নয়, এরা আমার আততায়ী। আমার ফোন বন্ধ, দাদাকাঠ, আমি বোবা, গাড়ির নম্বর প্লেট নেই, লোকগুলোর গায়ে পুলিশের পোশাক নেই, হাসছে হা হা। ওদের কোনও প্রশ্ন করবো বা মোবাইলে কাউকে চুপচুপ করে এসএমএসে জানাবো অবস্থা, সে সাহস নেই, দাদার সঙ্গে কানে কানে কথা বলবো সেই শক্তিও নেই। গাড়ি এসে থামলো একটা নির্জন এলাকায় এক একলা বাড়িতে। সেই বাড়িতে একটি প্রাণী নেই, সেখানে আমাদের একটা ঘরে বসতে বলা হল। আমার রক্তচাপ, আমি নিশ্চিত, বেড়ে আকাশে উঠেছে। বাথরুমে ঢুকে ফিসফিস করে, যেন আততায়ীরা টের না পায়, ফোনে কথা বলি ভ’বাবুর ঘনিষ্ঠ এক লোকের সঙ্গে। ‘আমার মনে হচ্ছে আমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। এরা নিশ্চয়ই মুসলিম মৌলবাদী, আমাকে খুন করতে এতদুর নিয়ে এসেছে, দিল্লি না গিয়ে আমাকে একটা জঙ্গলের মধ্যে, লোকালয় থেকে দূরে একটা বাড়িতে ঢুকিয়েছে। আমার ভয় হচ্ছে। চেনা লোক ভ’বাবুর কাছ থেকে খবর নিয়ে খানিক বাদে আমাকে জানালো, যে, ভ’বাবু মনে করছেন না আমাকে অপহরণ করা হয়েছে। আমার দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। এর চেয়ে স্বস্তির আর কী হতে পারে! জোরে শ্বাস নিই। কয়েকটা ঘণ্টা প্রায় শ্বাস বন্ধ করে পড়েছিলাম গাড়িতে। কয়েকটা ঘণ্টা আমার রক্তে, নাড়িতে আতংকের তুফান বয়ে গেছে। জোরে শ্বাস নিয়ে বিধ্বস্ত সন্ত্রস্ত মনটাকে আরাম দিতে চেষ্টা করি।

একজন পুলিশ এসে জানান, জয়পুর থেকে কয়েকজন অফিসার আসছেন, আমার সঙ্গে কথা বলবেন। অফিসারদের দেখে যে মৃত্যুভয় আমার ঘাড়ের ওপর শকুনের মতো বসে মাথার খুলি ঠুকরে ঠুকরে খুলে অবশ করে দিচ্ছিলো মস্তিষ্ক, পালায় লেজ গুটিয়ে। রাতের খাওয়ার সময় আমাকে বললেন ওঁরা, যে, এত সাংবাদিকের গাড়ি আমার গাড়ির পিছু নিয়েছিলো যে ওঁদের এড়াতে পুলিশ আমার গাড়ির প্লেট খুলে নিয়েছে, নিজেদের পোশাক বদলে ফেলেছে, যেন আমার গাড়ির পিছু নিতে কেউ না পারে, যেন আমার গাড়ি বলে গাড়িকে চিনতে না পারে। যে সময়ে আমার পৌঁছানোর কথা দিল্লিতে, সে সময় না পৌঁছোনো নিরাপত্তার কারণেই। সাংবাদিক থেকে, খবর থেকে নিরাপদ দুরত্বে থাকা।

ঘটনাটি এত কেন গোপন রাখা হচ্ছে, বুঝি না। এ কথা বললেই হতো আমাকে যে সাংবাদিকদের এড়ানোর জন্য এসব করা হচ্ছে। এত রহস্যের জট তো আমি খুলতে পারি না।

নিশ্চিন্তে দিল্লি চলি। সঙ্গে চারজন অফিসার। পথে যেতে যেতেই শুনি রাজস্থানের সরকার বিজেপি সরকার, মুখ্যমন্ত্রীর নাম বসুন্ধরা রাজে, মহিলা। এসবের কিছুই আমার জানা ছিল না। অফিসারদের মধ্যে একজন বাঙালি। যেন প্রাণ ফিরে পাই। তার সঙ্গেই গল্প করি বেশি।

দিল্লির রাজস্থান হাউজে গাড়ি থামলো। এত যে সতর্কতা ছিল সাংবাদিকদের কবলে না পড়ার, কই সে তো পড়তেই হল। ক্যামেরার ঝলসানো আলোর মধ্য দিয়ে আমাকে গাড়ি থেকে দ্রুত নামিয়ে দোতলায় ওঠানো হল। একটা সুইট দেওয়া হল বিশ্রাম নিতে। আজ রাতটা এখানে কাটালে কাল সকালে আমাকে কোনও এক নিরাপদ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে। এ কথা আমাকে ভ’বাবু ফোনে বললেন। এও বললেন, আমার জন্য কেউ একজন কাপড় চোপড় কিনে নিয়ে আসছে।

ত–কাপড় কেন?

ভ–কাপড় তো লাগবে। কিছু কি এনেছেন সঙ্গে?

ত–না। শুধু ল্যাপটপ।

ভ–কাপড়চোপড়, আর যা যা দরকার, সেসব দেওয়া হবে আপনাকে। অফিসাররা আপনার গছে পৌঁছে যাবে। ওরাই আপনার দেখাশোনা করবে।

ত–আমি তো কলকাতায় ফিরবো। আমার কাপড়ের দরকার নেই। কালই তো ফিরে যেতে পারি। যেটা পরে আছি, সেটা পরে রাতটা কাটিয়ে দিতে পারবো, কোনও অসুবিধে হবে না। এক রাতের জন্য কাপড় চোপড়ের দরকার নেই।

ভ–না। এখন কলকাতায় ফেরা যাবে না। আপনাকে অন্য একটা বাড়িতে কাল সিফট করা হবে। সেই বাড়ির ব্যবস্থা করছি আমরা।

ত–বাড়ি?

ভ–হাঁ, সেই হাউজ।

ত–কিন্তু..

ভ–আপনি থাকুন। খাওয়া দাওয়া ওখানে ভালোই দেবে আশা করি। কোনও প্রবলেম হবে না। কিছুর দরকার হলে আমাকে ফোন করবেন।

খাওয়ার আয়োজন ভালো। একসঙ্গে আমার জন্য বরাদ্দ সুইটের বৈঠকঘরে বসেই সবাই খেলেন।

পরদিন সকালে কেন্দ্রর অফিসার এলেন ক’জন। বেশি বয়সী, অল্প বয়সী। ওঁরা বসেই রইলেন। লক্ষ্য করি জয়পুরের অফিসাররা কেন্দ্রর অফিসারদের ঠিক পছন্দ করছেন না, একটু পর পর কিছু না কিছু নিয়ে তর্ক শুরু করছেন। দাদা টেলিভিশন নিয়ে ব্যস্ত। টেলিভিশনে, বিশেষ করে কলকাতার চ্যানেলগুলোয় আমার খবর দেখিয়ে যাচ্ছে। আমি

কোথায়, কিভাবে, কেন ইত্যাদি। আমার সঙ্গে কারও যোগাযোগ করার উপায় নেই। ভ’বাবুর পাঠানো অফিসাররা বলে দিয়েছেন, কোনও সাংবাদিকের সঙ্গে যেন কথা না বলি। বললেন, খুব বিপদ হবে সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বললে। এদিকে জয়পুরের অফিসাররা আলাদা করে আমাকে বলছেন, যেন কথা বলি, খুব বাছাই করে হলেও। বাইরে প্রচুর সাংবাদিক ভিড় করে আছে। চব্বিশ ঘণ্টা ওরা বাইরেই দাঁড়িয়ে আছে। অন্তত কয়েকজনের সঙ্গে যেন কথা বলি। আমি ঠিক বুঝে পাই না কী করবো। দু’দিক থেকে দু’রকম চাপ। মাঝখানে আমি বিমূঢ়। তবে কেন্দ্রর অফিসাররা যা বলছেন তাই আমি মেনে নিই। ভ’বাবু ওঁদের পাঠিয়েছেন। ভ’বাবু আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, নিশ্চয়ই যা বলছেন আমার ভালোর জন্যই বলছেন।

জয়পুরের অফিসাররা বললেন কাল আমাকে এখান থেকে সরিয়ে ফেলা হলে ওঁরা জয়পুরে ফিরে যাবেন। কিন্তু কাল আসে। দিল্লির অফিসাররা আসেন। গলার স্বর যথাসম্ভব নরম করে জানান, আরও একদিন সময় লাগবে নিরাপদ বাড়ি খুঁজতে। অতএব আমি রয়ে যাই। সাংবাদিকরাও দিন রাত রয়ে যায়। বাড়ি ঘিরে থাকা পুলিশও রয়ে যায়। দাদা টিভিতে ব্যস্ত। আমাকে দেখায় খানিক পর পর, আমি কোথায়, কী করে আমাকে তাড়ানো হয়েছে কলকাতা থেকে, এসব নিয়ে আলোচনা চলে। স্টার আনন্দ থেকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে লোক, ময়মনসিংহে আমার আত্মীয় স্বজনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে। নিজের বউ বাচ্চার কথা শুনতে শুনতে খুশিতে দাদার চোখে জল।

কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে যেন কথা না বলি, উপদেশ দিতেই থাকেন দিল্লির অফিসাররা। সাংবাদিকদের সঙ্গে যেন কথা বলি, উপদেশ দিতেই থাকেন জয়পুরের অফিসাররা। এর মধ্যে দিল্লির অফিসারদের অনুপস্থিতি এবং আমার অন্যমনস্কতার সুযোগে এক ফটোগ্রাফার আমার পটাপট বেশ কিছু ছবি তুলে ফেলে ঘরে ঢুকে। কে এই লোক প্রশ্ন করতেই জয়পুর বললেন, এই হাউজের নিজস্ব ফটোগ্রাফার। এক ফটোগ্রাফারকে রাজস্থান হাউজের নিজস্ব ফটোগ্রাফার বলে আমার ঘরে ঢুকিয়ে দিলেন জয়পুর। পরে ওই ছবি বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হতে দেখেছি। গভীর রাতে হঠাৎ আমাকে বলা নেই কওয়া নেই, বরখা দত্তকে ঢোকালেন জয়পুর। যেখানে সাংবাদিকদের শত অনুরোধ সত্ত্বেও কারও সঙ্গে দেখা করছি না, সবাইকে এক বাক্যে ফিরিয়ে দিচ্ছি, চেনা অচেনা কারও ফোন ধরছি না, কারও আবেদনে অনুরোধে রাজি হচ্ছি না, তখন ঘরের ভেতর ক্যামেরা আর একজন সাংবাদিক। এভাবে একজনকে খাতির করবো কেন! জয়পুরের অফিসাররা আকাশ থেকে পড়েন, তুমি বরখাকে চেনোনা, ও ভারতের সবচেয়ে নামকরা সাংবাদিক। না, আমি বরখাকে চিনি না, আমি তো করন থাপরকেও চিনতাম না। সাক্ষাৎকার চাইলে মুখের ওপর না বলে দিয়েছিলাম। করন থাপরকেই কলকাতা যেতে হয়েছিল। সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়ও বুঝিনি তিনি নামকরা কোনোও লোক। আরও পরে লোকের মুখে করন থাপরের কথা শুনে বা সিএনএন-এ ডেভিলস এডভোকেট দেখে, হিন্দুস্থান টাইমসে কলাম পড়ে বুঝেছি উনি নামী লোক। বরখা সাক্ষাৎকার চাইছেন, নানাভাবে আমাকে রাজি করানোর চেষ্টা করছেন। আমার কথা বলা উচিত। আমি কথা বললে কী ঘটেছে তা লোকে জানতে পারবে, আমি জনতার সমর্থন পাবো। জয়পুর জোর করছেন। অপ্রস্তুত অবস্থা আমার। ভ’বাবুর কথা অমান্য করা আমার উচিত নয়। অনেক জোরাজুরির পর কথা বলতে রাজি হলাম, তবে সাক্ষাৎকার নয়। শুধু একটা বিবৃতি, ‘আমি কলকাতায় ফিরতে চাই’, এর বেশি একটিও কথা নয়।

বিজেপির এক নেতা এসেছিলেন। তেমন কোনও কোনও কথা হয়নি। উনি কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে গেছেন। তবে মহাত্মা গান্ধির নাতনি তারা গান্ধি এসেছিলেন দেখা করতে, উপহার দিয়ে গেলেন নিজের হাতে বোনা একটি ব্যাগ, তাঁর সঙ্গেই গল্প করেছি। তারা গান্ধির সঙ্গে ওই আমার প্রথম আলাপ। বললেন, তিনি যোগাযোগ রাখবেন। তাঁর ভাই গোপালকৃষ্ণ গান্ধি তখন পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর। রাজভবনে একবার কবিতা পড়েছিলাম, মন দিয়ে বাংলা কবিতা শুনেছিলেন, প্রশংসা করেছিলেন খুব। একবার কথাও হয়েছিলো ফোনে, যখন কলকাতায় আমাকে বাড়ি থেকে বেরোতে দিচ্ছিল না পশ্চিমবঙ্গ সরকার। আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি শুনে উনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন, আমি যেন কেন্দ্রকে কোনওরকম দেরি না করে খবরটা জানাই। কেন্দ্র বলতে আমি যা বুঝি, তিনি ভ। এক ভ’র সঙ্গেই কালে ভদ্রে আমার কথা হয়, যেটুকুই হয়। এক ভ’কেই আমি বলতে পারি কী ঘটছে। ভ’কে সম্ভবত বলেছিলাম। উনি ব্যাপারটা দেখবেন’ বলেছিলেন।

প্রথম দিনই মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে বলেছিলেন, ”যতদিন দরকার হয়, থাকুন রাজস্থান হাউজে’, অফিসাররাও বলেছিলেন। এই তাঁরাই তিন দিন পর বললেন, আজই আপনাকে বেরিয়ে যেতে হবে রাজস্থান হাউজ থেকে। হ্যাঁ আজই। মুখ্যমন্ত্রী আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, আজই। ভ’বাবুর লোকদের আমি ফোনে জানিয়ে দিলাম, আমাকে বেরিয়ে যেতে বলছে, আজই’। আমি হয়তো দুনিয়ার অনেক কিছু বুঝি, শুধু রাজনীতির মাথামুণ্ডু কিচ্ছু বুঝি না। যে অফিসাররা এত আন্তরিক ছিলেন, এত শ্রদ্ধাভরে কথা বলতেন, তাঁরাই কী ভীষণ ক্রুদ্ধ এখন, তাঁদের ভাষাই কী ভীষণ কঠিন এখন, তাঁদের আচরণে স্পষ্ট অশ্রদ্ধা এখন। আমি এটুকু বুঝেছিলাম, তারা আমার ওপর সন্তুষ্ট নন, যেহেতু আমি দিল্লির অফিসারদের উপদেশ রেখেছিলাম, কোনও সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দিইনি। জয়পুরীদের যুক্তি ছিল, তোমার এখন খারাপ সময়, মিডিয়া তোমার পক্ষে, তুমি মিডিয়াকে অ্যাভোয়েড করছো, মিডিয়াকে ক্ষেপিয়ে তুলছো, তুমি বুঝতে পারছে না মিডিয়াতে যতক্ষণ তুমি আছো, মিডিয়া যতক্ষণ তোমার পাশে আছে, ততক্ষণ কোনও সরকার, কোনও পলিটিক্যাল পার্টি তোমাকে কিছু করতে পারবে না। তুমি মিডিয়াতে নেই, যে কোনও খেলাই তোমাকে নিয়ে খেলতে পারবে যে কেউ। সিপিএম তোমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কীভাবে বের করেছে, জানাও সবাইকে। কেউ কিছু যদি না জানে, তা হলে মানুষের সাপোর্ট তুমি কী করে পাবে? এ দেশের মানুষ তোমাকে ভালোবাসে। তুমি এদের কাছ থেকে দূরে সরে থাকবে কেন? মিডিয়াকে ব্যবহার করো মানুষের কাছে পৌঁছোননার জন্য। সারাদিন জয়পুর বলেই চলেছেন, ‘তুমি ভুল করছো, বেছে বেছে হাতে গোনা দুতিনটে মিডিয়ার সঙ্গে তোমার কথা বলা উচিত। এত বলার পরও আমি রাজি হইনি। শীলা রেড্ডির সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছিলাম, সাক্ষাৎকার দিতে নয়, সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে। আউটলুকের সাংবাদিক শীলা। আমাকে দিয়ে কয়েকটি লেখা লিখিয়েছিলেন আউটলুকের জন্য। শীলা রেডিও বলেছিলেন, যতক্ষণ মিডিয়া আছে সঙ্গে, ততক্ষণ সরকার আমার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে না।

কিন্তু সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হইনি বলে একটি রাজ্যের একটি সরকারি বাড়ি থেকে অতিথি হিসেবে বরণ করে নিয়েও আমাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলা হবে, এ আমার বিশ্বাস হয় না। হয়তো অন্য কোনও কারণ আছে। সে কারণ আমার কাছে চিরকাল অজানাই থেকে যাবে।

রাত বিরেতে পেছনের দরজা দিয়ে বের করা হল আমাকে। বের করার আগে দিল্লির অফিসাররা এক অফিসারকে তসলিমা সাজিয়ে বোরখা পরিয়ে রাজস্থান হাউজ থেকে বের করলো, গাড়িতে ওঠালো। সেই গাড়ির পেছনে যখন সাংবাদিকদের দল ছুটলো, সন্তর্পণে সত্যিকার আমাকে পেছনের দরজা দিয়ে বের করে নিয়ে সোজা ক্যান্টনমেন্ট। ওখানে দুদিন রেখে আমাকে আরেক ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হল। ঠিকানা জানি না। আমার অজ্ঞাতবাস শুরু হল এখানেই। অনেক কিছুই দেওয়া হল আমাকে। মোবাইল। ইন্টারনেট। কাপড় চোপড়। সাবান শ্যাম্পু। যা খেতে চাই, সব। বিছানা, টেবিল চেয়ার, সোফা, টিভি আর আমাকে সঙ্গ দিতে, বা পাহারা দিতে, বা চোখে চোখে রাখতে দু’জন করে সরকারি অফিসার। সব আছে, একটি জিনিসই নেই অজ্ঞাতবাসে, কোথাও যাবার, ঘর থেকে বেরোবার বা কারও সঙ্গে দেখা করার অধিকার বা স্বাধীনতা।

অফিসাররা মাঝে মাঝেই বলেন, স্বাধীনতাহীন বেঁচে থাকাটা ভয়ংকর।

আমি চুপ হয়ে শুনি। ওঁরা আমার মুখে অপলক তাকিয়ে লক্ষ্য করতে থাকেন, ত্বকের কোন অঞ্চলে ভাঁজ পড়ছে, ক’টা শিরা দপদপ করছে, ক’টা স্নায়ু নড়ছে, পেশিগুলোর কী হাল।

দাদা অস্থির হয়ে পড়ে দেশে ফেরার জন্য। কিছুতেই তাকে আর রাখার উপায় নেই। বোনকে এই অবস্থায় ফেলে কেন যেতে চাইছো, তোমাদের কী কোনও মায়া নেই, কখন কী হয় কে জানে, যদি মরে যাই, এসব কথা বা আমার চোখের জল কিছুই দাদাকে রুখতে পারে না। দাদাও কি মনে মনে ফেয়ারওয়েল জানায় আমাকে! পরম আনন্দে কলকাতা হয়ে ঢাকায় ফিরে যায় দাদা। মুক্তি পায়। আমি একা। আমার সংগ্রাম চিরকালই আমার একার।

০৮. নিরাপদ বাড়ির কবিতা

অ.

সত্য বললে কিছু লোক আছে খুব রাগ করে, এখন থেকে আর সত্য বোলো না তসলিমা। গ্যালিলিওর যুগ নয় এই যুগ, কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দীতেও সত্য বললে একঘরে করে সমাজ, দেশছাড়া করে দেশ। গৃহবন্দি করে রাষ্ট্র, রাষ্ট্র শাস্তি দেয়, সত্য বোলো না।

তার চেয়ে মিথ্যে বলো, বলো যে পৃথিবীর চারদিকে সূর্য ঘোরে, বলো যে সূর্যের যেমন নিজের আলোআছে, চাঁদেরও আছে,বলল যে পাহাড়গুলো পৃথিবীর গায়ে পেরেকের মতো পুঁতে দেওয়া, বলল যে পুরুষের পাঁজরের হাড় থেকে নারীকে বানানো, বলো যে নারীর ঘাড়ের কী যেন একটা হাড় খুব বাঁকা। বলল যে শেষ-বিচারের দিনে মানুষেরা সব কবর থেকে, ছাই থেকে, নষ্ট হাড়গোড় থেকে টাটকা যুবক যুবতী হয়ে আচমকা জেগে উঠবে, স্বর্গ বা নরকে অনন্তকালের জন্য জীবন কাটাতে যাবে। তুমি মিথ্যে বলো তসলিমা। বলো যে বিশ্ব ব্রহ্মারে অগুনতি গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্ররাজি মিথ্যে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি মিথ্যে, মানুষ চাঁদে গিয়েছিলো, মিথ্যে।

মিথ্যে বললে তুমি নির্বাসন থেকে মুক্তি পাবে, তুমি দেশ পাবে, প্রচুর বন্ধু পাবে, হাত পায়ের শেকল খুলে দেওয়া হবে, তুমি আলো দেখবে, আকাশ দেখবে। একা একা অন্ধকারে হমুখো মৃত্যুর মুখে ছুঁড়ে দেবে না তোমাকে কেউ।

তুমি সত্য বলো না তসলিমা, বাঁচো।

.

আ.

আমার শহর যাকে বলেছিলাম, সে শহর আমার নয়, সে শহর ধুরন্ধর রাজনীতিক, অসৎ ব্যবসায়ী, আর নারী-পাচারকারীর শহর। বেশ্যার দালালের শহর, লম্পটের শহর। ধর্ষকের শহর সে শহর। আমার শহর নয়, সে শহর কেউ খুন বা ধর্ষিতা হলে, অত্যাচারিত হলে কিছু যায়-আসে-না-দের শহর। আমার শহর নয়, সে শহর মুখে-এক-মনে-আরেকদের শহর। বস্তির না-খাওয়াদের পাশ দিয়ে নির্বিকার হেঁটে যাওয়াদের শহর, ফুটপাথে মরে থাকা-ভিখিরিকে আলগোছে ডিঙিয়ে যাওয়াদের শহর। বিপদের আঁচ পেলে তড়িঘড়ি গা-বাঁচানোদের শহর। অন্যায়ের স্তূপে বসে মুখ-বুজে-থাকাঁদের শহর। আমার নয়। ইহ আর-পরলোক নিয়ে-বঁদ-হয়ে-থাকাঁদের শহর, জ্যোতিষীর শহর, আখের-গুছোতে-ব্যস্ত থাকাঁদের শহর, সুযোগসন্ধানীর শহর।

সে শহর আমার শহর নয়। কিছুতেই। সে মিথুকের শহর। কূপমন্ডুকের শহর। ঠগ, জোচ্চোরের শহর, আমার নয়। সে শহর সুবিধেবাদীর, স্বার্থান্ধর, পাঁড় ধর্মান্ধদের শহর। তাদের শহরে আমরা গুটিকয় মুক্তচিন্তার মানুষ, কিছু যুক্তিবাদী, প্রতিবাদী, কিছু সৎ, সজ্জন বড় ভয়ে ভয়ে বাস করি।

.

ই.

রাত তিনটেয় ঘুম ভেঙে গেলে এখন আর বিরক্ত হই না। রাতে ভালো ঘুম না হলে দিনটা ভালো কাটে না–এরকম বলে লোকে। দিন যদি ভালো না কাটে, তাতে কি কিছু যায় আসে! আমার দিনই বা কেন, রাতই বা কেন। দিন দিনের মতো বসে থাকে দূরে, রাতও রাতের মতো, ঘুমিয়ে থাকার গায়ে মুখ গুঁজে গুটিশুটি শুয়ে থাকে জেগে থাকা। এসব দিন রাত, এসব সময়, এসব দিয়ে আমার করার কিছু নেই, জীবন আর মৃত্যু একাকার হয়ে গেলে কিছু আর করার থাকে না কিছু দিয়ে। আমি এখন মৃত্যু থেকে জীবনকে বলে কয়েও সরাতে পারি না, জীবন থেকে মৃত্যুকে আলগোছে তুলে নিয়ে রাখতেও পারি না কোথাও আপাতত।

.

ঈ.

বন্দুক হাতে সেনারা ঘুরছে চারদিকে, মাঝখানে নিরস্ত্র আমি। সেনারা কেউ আমাকে চেনে না , নিরস্ত্র নারীর দিকে মাঝে মাঝে অদ্ভুত চোখে তাকায়। কেউ জানে না এখানে হঠাৎ কী কারণে আমি! ময়লা শরীর, মলিন কাপড়চোপড়, মনমরা উড়ুক্কু চুল, গায়েপায়ে শেকল নেই আমার, কিন্তু কোথাও না কোথাও আছে, টের পায় ওরা, চাইলেও দু’পা এগোতে পারবো না টের পায়। ওদের চোখের তারায় বীভৎস এক টের পাওয়া দেখি। বন্দুকগুলো, জানে ওরা, ভয় দেখাতে, বেয়নেটগুলো, বুটজুতোগুলো ভয় দেখাতে। ভয় না পেলে ওরা আঘাত পাবে খুব, কাউকে আঘাত দেওয়ার অধিকার আমার আইনত নেই। ওরা যদি ওপরতলায় খবর পাঠিয়ে বলে, এর তো দেখি ডর ভয় নেই। শেকল ভাঙতে চাইছে প্রাণপণে। ওপরতলা আমাকে নির্ঘাত ফাঁসি দেবে। ফঁসির দিনক্ষণ ঠিক হলে, খেতে দেবে মাছের ঝোল, ইলিশ চিংড়ি ইত্যাদি।

যদি বলি, খাবো না! ফাঁসির মঞ্চে উঠে যদি একটাও দীর্ঘশ্বাস না ফেলি? গলায় দড়ি পরাবার পরও যদি ভয় না পাওয়ার দুঃসাহস আমার হয়?

.

উ.

কয়েকবছর ধরে আমি মৃত্যুর খুব কাছে, প্রায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। আমার মার সামনে, আমার বাবা, প্রিয় কিছু মানুষের সামনে বাকরুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছি কয়েক বছর। কয়েক বছর ধরে আমি জানি না ঠিক বেঁচে আছি কি না, কয়েক বছর ধরে বেঁচে থাকা এবং না থাকার ব্যবধান কমে কমে শূন্যে এসে সুতোর মতো নড়ছে। কয়েক বছর ধরে আমার ভেতরে বাইরে যে মানুষটা বাস করে, সে বীভৎস বোবা একটা মানুষ, যার বৃক্ষ থেকে শেষ শুকনো পাতাটাও ঝরে গেছে, জীবন থেকে জন্মের মতো বিদেয় নিয়েছে বসন্ত। আমার যদি মৃত্যু হয় আজ রাতে, কেউ কিছু বোলো না, শুধু কোথাও কোনও শিউলি গাছের নিচে একটা এপিটাফ পুঁতে দিও, কয়েক বছর ধরে লেখা আমার এপিটাফ, সাদা কাগজের গায়ে সাদা। রঙে, সযত্নে লেখা এপিটাফ।

.

ঊ.

কোনও কবিকে কি কখনও গৃহবন্দি করা হয়েছিলো কখনও? কবি নিয়ে রাজনীতি অনেক হয়েছে হয়তো, কবি নিয়ে ইট পাটকেলও হয়েছে, আগুন হয়েছে, কবিকে কেউ গৃহবন্দি করেনি, কোনও দেশ। এই ভারতবর্ষ, এই সভ্যতা, এই একবিংশ শতাব্দী, কবিকে গ্রহণ করেছিলো, মুহূর্তেবর্জনও করেছে এর বালখিল্য ধর্ম, এর নিষ্ঠুর রাজনীতি। কোনও অপরাধ করেনি কবি, কবি আজ গৃহবন্দি। কবি এখন আকাশ না দেখে দেখে জানে না আকাশ কেমন দেখতে, মানুষ না দেখে দেখে জানে না মানুষ কেমন, কবির সামনে এক জগৎ অন্ধকার ফেলে চলে গেছে তারা, তারা আর এ পথ মাড়াবে না বলে গেছে। আজ একশ পঞ্চান্ন দিন কবি গৃহবন্দি, একশ পঞ্চান্ন দিন কবি জানেনা হৃদয় আছে এমন কেউ পৃথিবীতে আর বাস করে কি না, একশ পঞ্চান্ন দিন কবি জানে না, কবি বেঁচে আছে কি নেই। কার কাছে সে তার দিনগুলো ফেরত চাইবে, অন্ধকার সামনে নিয়ে বসে কবি ভাবে, কে তার জীবনে দেবে রোদ্দুর ফিরিয়ে, কে তাকে নিভৃতে জীবনের মন্ত্র দেবে কোনও একদিন। অন্তত সান্ত্বনা দিতে কবিকে তো বলুক মানুষ, এর আগে গৃহবন্দি ছিল যারা, অধিকাংশই কবি ছিল–নিঃসঙ্গতা থেকে মনে মনেও কিছুটা মুক্তি পাক সে।

.

ঋ.

চেয়েছিলাম মানুষের অন্ধত্ব দূর করতে, চেয়েছিলাম মানুষের মোহর করা হৃদয় থেকে বৈষম্যের, হিংসের, অন্ধকারের আর অসুস্থতার শেকড় উপড়ে ফেলে ভালোবাসা রোপণ করতে। আমার চাওয়ার শাস্তি আমাকে দিয়েছে প্রিয় ভারতবর্ষ।

.

এ.

কিন্তু কী করে দুশ্চিন্তামুক্ত হবে এই অজ্ঞাতবাসে, একটা স্বাধীনচেতা মানুষকে জন্মের মতো তুলে এনে আচমকা খাঁচায় বন্দি করলে কী করে দুশ্চিন্তামুক্ত হবে সে! খাঁচা থেকে আদৌ কোনওদিন মুক্তি পাবে কি না, মানুষের কোলাহলে মানুষের মতো কোনওদিন জীবনখানি যাপন করতে পারবে কি না, জানতে না পারলে দুশ্চিন্তামুক্ত কী করে হবে সে! আলোর মানুষেরা কতদিন পারে অন্ধকারে অন্ধের মতো সাঁতরাতে। আমার শরীরে তীরের মতো বিঁধে রয়েছে দুশ্চিন্তা, যতক্ষণ ওই খাঁচা থেকে মুক্তি নেই, ততক্ষণ তীর থেকেও নেই।

.

ঐ.

কাল রাতে দেখি একটি টিকটিকি কোত্থেকে লাফিয়ে গায়ে পড়ে বাহু বেয়ে আমার ঘাড়ের দিকে চলে গেল, ঘাড় পার হয়ে মাথার দিকে, চুলের জঙ্গলে শরীর আড়াল করে দ্বিতীয় টিকটিকির দিকে ঘণ্টা দুয়েক অপলক তাকিয়ে থেকে ভোররাত্তিরের দিকে কানের পাশ দিয়ে নেমে শিরদাঁড়ায় গিয়ে বসে রইল। দ্বিতীয়টি স্থির শুয়ে ছিল আমার ডান পায়ের ঘঁটু থেকে ইঞ্চি দুয়েক নিচে। সারারাত একচুলও নড়েনি। ওদের সরাতে চেয়ে ব্যর্থ হয়ে অগত্যা আমি যা করছিলাম, তাই করি, চোখ বুজে পড়ে থাকি। মনে মনে একশ থেকে এক অবধি বারবার করে গুনি। কোনও কারণ নেই গোনার, তারপরও গুনি।

যে বিছানায় আমি ঘুমোচ্ছি, দীর্ঘদিন হল সেটি আধোয়া কাপড়, এঁটো বাসন, হিজিবিজির খাতা, চায়ের দাগে বাদামি হয়ে থাকা পুরোনো পত্রিকা, চুল আটকে থাকা চিরুনি, মিইয়ে যাওয়া মুড়ি, খোলা ওষুধপত্র, কালি ফুরিয়ে যাওয়া কলম ইত্যাদির স্থূপ। দুশর মতো বড় বড় কালো পিঁপড়ে সারা বিছানা জুড়ে কদিন হল নোঙর ফেলেছে। আটঘাট বেঁধে লেগে গেছে নতুন বসত তৈরি করতে।

আমাকে দখল করে নিচ্ছে ওরা। ওরা খুব ক্ষুদ্র প্রাণী। কুঁকড়ে থেকে থেকে দিন দিন ওদের মতোই ক্ষুদ্র হয়ে যাচ্ছি আমি। এ অবধি একটি পিঁপড়েও, আশ্চর্য, আমার শরীর জুড়ে উৎসব করছে ধ্রুপদী নৃত্যের, ভুলেও কামড় দেয়নি। আমাকে, আমার বিশ্বাস, ওদেরই একজন মনে করে ওরা!!

সম্ভবত মানুষের জগতের চেয়েও এই পোকামাকড়ের জগতেই বেশি নিরাপদ আমি।

.

ও.

দিনের পর দিন যাচ্ছে, স্নান করি না। মাস পেরোচ্ছে, গা থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে, স্নানের তবু কোনও ইচ্ছে জাগে না, কেনই বা স্নান করবো, কী লাভ স্নান করে। এক অদ্ভুত অনীহা আমাকে অধিকার করে রাখে।

তিনবেলা লোক আসে খাবার নিয়ে পছন্দ হোক বা না হোক, খেতে হয়। না খেয়ে যদি বাঁচা যেত–বলে দিতাম কাল থেকে যাই দিক, অন্তত খাবারটা যেন না দেয়।

ঘুমোতে যাবার আগে ভয় হয়, যদি কিছু হয়! যদি আর না জাগি! ঘুমোলে চমকে চমকে বার বার উঠে যাই, আশেপাশে তাকাই, আমার ঘর কি এ ঘর? না, এ আমার ঘর নয়।

নির্বাসন নেহাতই একটা দুঃস্বপ্ন, এ সত্যি নয়–এই স্বপ্নটি সারাদিন দেখি, ঘুমোলে স্বপ্ন যদি উবে যায়, ঘুমোতে ভয় হয়।

চার দেওয়াল ঘেরা ওই চতুষ্কোণ ঘরটির মধ্যেই হাঁটাচলা করো যদি নিতান্তই করতে হয়–

এরকমই আদেশ এসেছে। ঘর ঘরের মতো পড়ে থাকে, আমি এক কোণে আদেশে অবশ হয়ে, স্তব্ধ বসে ভাবি, বিশাল বিস্তৃত এই পৃথিবী, কবে থেকে এত কৃপণ হল!

জেলেও শুনেছি কিছু নিয়ম থাকে, দেখা সাক্ষাৎএর সময় ইত্যাদি নাকি থাকেই, আমারই কিছু নেই। স্বজন বন্ধু বলতে কিছু থাকতে নেই এক আমারই, জেলের সুবিধে চেয়ে আবেদন করি প্রতিদিন, নিরুত্তর সবাই।

.

ঔ.

এভাবেই, যেভাবে রেখেছে আমাকে, সেভাবেই থাকতে হবে, যদি থাকি, যদি নিতান্তই থাকতে চাই এদেশে। এভাবেই কারাগারে, বন্ধ ঘরে, একা। কতদিন, কত মাস বা বছর? তার কোনও ঠিক নেই। কোনওদিন কি জীবন ফিরে পাবো? ঠিক নেই।

কী কারণ এই বন্ধ ঘরের? বেরোলেই দেশের দশটা লোকের মৃত্যু হতে পারে।

চমকে উঠি। –আমার কারণে? চোখ নিচু করে লোক বলে, –হ্যাঁ। বলি, –একবার মুক্তি দিয়েই দেখুন, দেখুন কতটা যুক্তিহীন এই অভিযোগ। ওদিকে মানুষ তো ভেবে বসে আছে, আমার জন্য বুঝি সব আয়োজন, নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা আমার জন্য, আমি যেন না মরি! কাউকে না কাউকে নিরাপত্তা দিতে, হয়তো এ পৃথিবীরই নিয়ম, কাউকে না কাউকে হারিয়ে যেতে হয় অদ্ভুত আঁধারে। আমার বন্দিত্ব দশটা লোককে নিরাপত্তা দিচ্ছে, আমার বন্দিত্ব দশটা লোককে অভাবনীয় নিশ্চিন্তি দিচ্ছে,

খুব জানতে ইচ্ছে করে, কারা সেই দশজন? তারা কি রাস্তার লোক নাকি রঙিন দালানবাড়ির লোক! তারা কি আদপেই লোক, নাকি লোকেদের লোকাতীত লোকনীতি? কাঁদের বাঁচাতে আজ আমাকে প্রতিদিন দেখতে হচ্ছে মৃত্যুর বীভৎস মুখ!

.

ক.

এমন একটা নিরাপদ বাড়িতে আমাকে বাস করতে হচ্ছে যেখানে ভালো না লাগলে বলতে পারার আমার কোনও অধিকার নেই যে ভালো লাগছে না। এমন একটা নিরাপদ বাড়ি যেখানে কষ্ট পেতে থাকবো আমি, কিন্তু কাঁদতে পারবো না। চোখ নামিয়ে রাখতে হবে আমাকে, কেউ যেন দেখতে না পারে কোনও অমীমাংসিত যন্ত্রণা।

এমন একটা বাড়ি যেখানে ইচ্ছেগুলোকে প্রতিদিন ভোরবেলা খুন হয়ে যেতে হয়, আর সন্ধের আগে আগেই বাড়ির উঠোনে পুঁতে দিতে হয় ইচ্ছের মলিন মৃতদেহ।

দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নৈঃশব্দ্য ভাঙি নিরাপদ বাড়ির, দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই বাড়ির বাইরে বা ভেতরে। প্রতিদিন ভয়ে ভয়ে ঘুমোতে যাই, ভয়ে ভয়ে জাগি, নিজের ছায়ার সঙ্গে যতক্ষণ জেগে থাকি মনে মনে কথা বলি। জানি না কোত্থেকে বিষদাত সাপ এসে থিকথিকে ক্রোধ আর ঘৃণা ছড়াতে ছতে সারাদিন আমার শরীর বেয়ে হাঁটাহাঁটি করে, হিসহিস করে বলতে থাকে, চলে যাও, সীমান্ত পার হয়ে দূরে কোথাও, কাক পক্ষী না দেখে কোনও দুর্গম পর্বতের দিকে কোথাও চলে যাও। ছায়াটির শরীর বেয়েও সাপ বলতে বলতে যায়, যাও, জন্মের মতো যাও। বন্ধুরা, প্রার্থনা করো, নিরাপদ বাড়ি থেকে কোনও একদিন যেন নিরাপদে বেরোতে পারি বেঁচে। প্রার্থনা করো, যেন কোনও একদিন একটি অনিরাপদ বাড়িতে বাস করার সৌভাগ্য আমার হয়।

.

খ.

একটু মানুষ দেখতে দেবেন? রাস্তার মানুষ? মানুষ হাঁটছে, হাসছে, মানুষ ডানদিকে যেতে গিয়ে কী মনে হল বাঁদিকে হেঁটে গেল, মানুষ মাঠে, দোকানে, সিনেমায়, জলসায়, থিয়েটারে। মানুষ দৌড়োচ্ছে। মানুষ গাড়িতে, বাসে, ট্রামে, ট্রেনে, মানুষ চলছে, দেবেন?

একটু মানুষ দেখতে দেবেন? বাড়িঘরের মানুষ, ভালোবাসছে, স্বপ্ন-দেখছে মানুষ? ভাবছে। দেবেন দেখতে?

‘জানালার ফাঁক ফোকর দিয়ে যেটুকু ছিটেফোঁটা মেঘ বা রোদ্র দেখা যায়, তা দেখেই বাঁচতে হবে’, ‘মানুষ’, ওঁরা বলে দিয়েছেন ‘হবে না। আমার মানবজীবন এভাবেই পার করতে হবে মানুষবিহীন।

.

গ.

নিজের দেশই যদি তোমাকে দেশ না দেয়, তবে পৃথিবীতে কোন দেশ আছে তোমাকে দেশ দেবে, বলো! ঘুরে ফিরে দেশগুলো তো অনেকটা একইরকম, শাসকের চেহারা চরিত্র একইরকম। কষ্ট দিতে চাইলে একইরকম করে তোমাকে কষ্ট দেবে, একইরকম আহাদে সুঁই ফোঁটাবে, তোমার কান্নার সামনে পাথর-মুখে বসে মনে মনে নৃত্য করবে। নাম ধাম ভিন্ন হতে পারে, অন্ধকারেও ঠিকই চিনবে ওদের চিৎকার, ফিসফিস, হাঁটাচলার শব্দ শুনে বুঝবে কারা ওরা, যেদিকে হাওয়া, সেদিকে ওদের দৌড়ে যাওয়ার সময় হাওয়াই তোমাকে বলবে কারা ওরা। শাসকেরা শেষ অবধি শাসকই।

যতই তুমি নিজেকে বোঝাও কোনও শাসকের সম্পত্তি নয় দেশ, দেশ মানুষের, যারা ভালোবাসে দেশ, দেশ তাদের। যতই তুমি যাকে বোঝাও এ তোমার দেশ, তুমি একে নির্মাণ করেছো তোমার হৃদয়ে, তোমার শ্রম আর স্বপ্নের তুলিতে এঁকেছো এর মানচিত্র। শাসকেরা তোমাকে দূর দূর করে তাড়ালে কোথায় যাবে! কোন দেশ আর দরজা খুলে দাঁড়ায় তাড়া খাওয়া কাউকে আশ্রয় দিতে! কোন দেশ তোমাকে আর কোন মুখে দেশ দেবে বলো!

তুমি কেউ নও এখন আর, মানুষও বোধহয় নও। হারাবার তোমার বাকিই বা কী আছে! এখনই সময় জগৎকে টেনে বাইরে এনে বলে দাও, তোমাকে ওখানেই দাঁড়াবার জায়গা দিক, ওখানেই ঠাঁই দিক, দেশের সীমানা ফুরোলে ‘কারও মাটি নয়’ অথবা নো ম্যানস ল্যান্ড বলে যেটুকু মাটি থাকে, সেই অবাঞ্ছিত মাটিই, সেটুকুই না হয় আজ থেকে তোমার দেশ হোক।

.

ঘ.

ভারতবর্ষ শুধু ভারতবর্ষ নয়, আমার জন্মের আগে থেকেই ভারতবর্ষ আমার ইতিহাস। বিরোধ আর বিদ্বেষের ছুরিতে দ্বিখন্ডিত হওয়া, ভয়াবহ ভাঙন বুকে নিয়ে উধ্বশ্বাস ছোটা অনিশ্চিত সম্ভাবনার দিকে আমার ইতিহাস। রক্তাক্ত হওয়া ইতিহাস, মৃত্যু ইতিহাস। এই ভারতবর্ষ আমাকে ভাষা দিয়েছে, আমাকে সমৃদ্ধ করেছে সংস্কৃতিতে। শক্তিময়ী করেছে। স্বপ্নে। এই ভারতবর্ষ এখন ইচ্ছে করলেই কেড়ে নিতে পারে সব ইতিহাস, আমার জীবন থেকে আমার অস্তিত্ব, আমার স্বপ্ন থেকে আমার স্বদেশ।

নিঃশেষ করতে চাইছে বলে আমি আজ নিঃস্ব হব কেন! ভারতবর্ষ তো জন্ম দিয়েছে। মহাত্মাদের। আজ তাঁরা হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন আমার দিকে, এই অসহায়, এই অনাথ, এই অনাকাঙ্খিত আমার দিকে। দেশের চেয়েও দীর্ঘ এই হাত, দেশ কাল ছাপিয়ে এই গোটা কয় হাত আমাকে জাগতিক সব নিষ্ঠুরতা থেকে বড় মমতায় নিরাপত্তা দেয়। তাদেরই আমি দেশ বলে আজ ডাকি, তাঁদের হৃদয়ই আজ আমার সত্যিকার স্বদেশ।

.

ঙ.

আমার দেশটি তাকিয়ে তাকিয়ে আমার যন্ত্রণা দেখছে আজ এক যুগেরও বেশি। আমার দেশটি দেশে দেশে আমার বন্দিত্ব দেখছে, দূরত্ব বেড়ে গেলে দূরবীন লাগিয়ে দেখছে, বেজায় হাসছে,পনেরো কোটি মানুষ তারিয়ে তারিয়ে ভোগ করছে আমার সর্বনাশ।

আমার দেশ এমন ছিল না আগে, দেশের হৃদয় বলে কিছু ছিল, দেশে মানুষ বলে কিছু ছিল। দেশ এখন আর দেশ নেই। কতগুলো স্থবির নদী শুধু, কতগুলো গ্রাম আর শহর। এখানে ওখানে কিছু গাছপালা, কিছু ঘরবাড়ি, দোকানপাট। আর, ধূসর চরাচরে মানুষের মতো দেখতে কিছু মানুষ।

আমার দেশে এককালে প্রাণ ছিল খুব, এককালে কবিতা আওড়াতে খুব মানুষ, এখন কবিকে নির্বাসন দিতে কেউ দু’বার ভাবে না, এখন কবিকে মাঝরাত্তিরে নিশ্চিন্তে ফাঁসি দিয়ে ফেলে গোটা দেশ, পনেরো কোটি মানুষ তারিয়ে তারিয়ে ভোগ করে মর্মন্তুদ মৃত্যু।

দেশটি ভালোবাসতে জানতো আগে, দেশ এখন হিংসে শিখেছে, চোখ রাঙানো শিখেছে। দেশের হাতে এখন ধারালো সব তলোয়ার থাকে, দেশের কোমরে গোঁজা মারণাস্ত্র, মারাত্মক সব বোমা, দেশ এখন আর গান গাইতে জানে না।

দুনিয়া তছনছ করে দেশ-খুঁজছি এক যুগেরও বেশি, এক যুগেরও বেশি ঘুম নেই, উন্মাদের মতো দেশ দেশ করে দেশের কিনারে এসে দেশকে স্পর্শ করতে দু হাত বাড়িয়ে আছি। আর শুনি কিনা, হাতের কাছে দেশ যদি একবার পায় আমাকে, তবে নাকি আমার রক্ষে নেই।

.

চ.

আমার বাংলা আর বাংলা নেই, সোনার বাংলা এখন ক্ষয়ে যাওয়া, আমার রুপোলি বাংলার গায়ে মরচে, পূর্ব পশ্চিম আজ একাকার। ধর্মান্ধরা ছড়ি ঘোরায়, ভীতুরা মাথা নত করে হাঁটে, নিশ্চিতই কবন্ধের যুগ এই যুগ। সাহস আর সতোর নির্বাসন হয়ে গেছে, বাংলা এখন কুচক্রী শাসক আর তাঁবেদারে ঠাসা, বাকিরা নির্লিপ্ত, জীবনযাপনকারী, হয় জড়, নয় জঞ্জাল।

এই বাংলার জন্য যত জল আমার দুচোখে আছে দিলাম, কোনওদিন একদিন যেন উর্বর হয় মাটি, যেন জন্ম নেয় মানুষ, যেন দুর্ভাগা-বাংলা মানুষের বাসযোগ্য হয় কোনওদিন একদিন।

.

ছ.

মরে গেলে লাশখানা রেখে এসো ওখানে, মেডিক্যালের শব-ব্যবচ্ছেদ কক্ষে, মরণোত্তর দেহদান ওখানেই করেছি, রেখে এসো কলকাতা শহরে লাশ। জীবিত নেবে না আমাকে ও শহর। মরলে নেবে তো? প্রিয় কলকাতা!

.

জ.

মিনু নেহাত বেড়াল নয়। আমার কন্যা। কন্যাটিকে ফেলে আসতে হয়েছে কলকাতায়, নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে বসেছিল দীর্ঘদিন, এখনও মলিন মুখে জানালায় বসে থাকে, দিন গোনে। শীত কাটাতে হল একা একা, নরম লেপের তলায় আমার উষ্ণতা পেতে পেতে এ বছর আর ঘুমোনো হল না ওর। আমার অপেক্ষা করে ওর শীত গেল, ছুটির গরমকাল যেন না যায়! যে-করেই হোক আমাকে ও চায়, ফিরে পেতে চায় নির্ভাবনার সেইসব দিন।

গড়িয়াহাট থেকে তুলে আনা শিশুটি কয়েকবছরে ধীরে ধীরে বুকের ধন হয়ে উঠেছিল। স্বজন বলতে এক আমিই ছিলাম ওর, জগৎ বলতে এক আমিই। আমার কিশোরী কন্যাটি তার ঘর বাড়ি, তার বিছানা বালিশ ছেড়ে রোদ্দুরে ভেসে যাওয়া প্রিয় বারান্দাটি ছেড়ে, খেলনা-ইঁদুর ছেড়ে মন-মরা বসে আছে স্যাঁতসেঁতে অন্ধকারে, দিনশেষে চোখ ভেসে যেতে থাকে চোখের জলে। কলকাতা, আমাকে দাওনি, আমার নিরাশ্রয় কন্যাটিকে আশ্রয় দিও, আমাকে রাখোনি, আমার অনাথ কন্যাটিকে দেখে রেখো।

.

ঝ.

কূপমন্ডুকের দল বিপক্ষে গেলেও, কট্টরপন্থীরা আস্ফালন করলেও, কবন্ধরাঘিরে ধরলেও, মানুষ থাকে পাশে, শুভাকাঙ্ক্ষীরা থাকে। যখন রাজ্য তাড়ায়, যখন ক্ষমতা বিপক্ষে যায়, যখন রাষ্ট্রযন্ত্র বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, মানুষ সরতে থাকে, মানুষ পালায়। শুভাকাঙ্ক্ষী বলে পরিচিতরাও নিরাপদ আড়াল খোঁজে, প্রতিষ্ঠান সরে যায়, বেসরকারি ক্ষুদ্র দলও ক্ষুদ্র গর্তে লুকোয়, স্বনামধন্যরা চোখ বুজে থাকে। বন্ধু বলে যাদের চিনি, তারাও আচমকা অন্যত্র ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

হাতে গোনা কিছু মানুষ শুধু পাশে থাকে, নির্ভেজাল কিছু মানুষ। সাহস আর সততা সম্বল করে সত্যিকার কিছু স্বার্থহীন বন্ধু থাকে পাশে।

ওরা আজ মিছিল করছে, ওরা মোমবাতি হাতে হাঁটছে সন্ধের শহরে, জোট বেঁধে বিচার চাইছে অবিচারের। কে বলেছে এই সংগ্রাম একার আমার? বাক স্বাধীনতা রক্ষা হলে এদেশের মানুষেরই হবে, এ আমার একার নয়, স্বপ্নবান মানুষের সবার সংগ্রাম। এই দুঃসময় আমার একার নয়, আমাদের সবার দুঃসময়। যদি কোনওদিন জয় হয় মুক্তচিন্তার–ব্যক্তি আমার চেয়ে শতগুণ হবে ভারতবর্ষের জয়।

এ আমার একার কিছু নয়, আমার পাশে ওরা নয়, বরং ওদেরই পাশে, ওই অবস্থান ধর্মঘটের পাশে, অনশনের পাশে, ওই মিছিলের মানুষের পাশে, ভারতবর্ষের পাশে, আমি আছি, দূর কারাবাস থেকেও আছি, ঘোর অনিশ্চয়তা আর অন্ধকার থেকেও আছি পাশে।

ঞ.

বেঁচে আছি!

.

ট.

তোমাকে তোমার বাড়ি থেকে ছিনতাই করে নিয়ে গেছে ওরা, তোমার জীবন থেকে তোমাকে কেড়ে নিয়ে বন্দি করেছে ব্যালটবাক্সে। কোনও স্বজনের একটি হাতও, সামান্য সুযোগ নেই, একবার স্পর্শ করো, তোমারই জীবনের কণামাত্র তোমার অধিকারে নিয়ে তোমার সুযোগ নেই একবার যাপন করো। মানো বা নাই মানো, অন্যের সম্পত্তি এখন তুমি, তোমার কিছুই আর তোমার নেই, একঘর হাহাকার ছাড়া তোমার জন্য বরাদ্দ একফোঁটা কিছু নেই। স্বাধীনতা সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারের ভুতুড়ে জিনিস।

ওদের ইচ্ছে তুমি উন্মাদ হও, স্নায়ুতন্ত্রে যদি খুব শক্তি ধরো, উন্মাদ হতে যদি না-ই পারো, তবে দেশ ছাড়ো, যে করেই হোক ছাড়ো, এ দেশ তোমার নয়। মাটি কামড়ে কতদিন কে-ই বা পড়ে থাকতে পারে! এত ঘৃণা, এত থুতু, এত লাথি কতদিন সইতে পারে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখা মানুষ। ওরা চাইছে, উন্মাদ যদি না-ই হও, দেশ যদি না-ই ছাড়ো, অন্তত মরো।

তুমি সাফ কথা জানিয়ে দিয়েছে গতকাল, যা হয় তা হোক, আপাতত কোনওটিরই সম্ভাবনা নেই। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিনীত কণ্ঠে বলেছে, দিনে দিনে তোমাকে অসম্ভব সহিষ্ণু করে গড়ে তোলার পেছনে অবদান ওদেরই। এখন আগুনে পোড়ালেও তুমি পুড়ে পুড়ে আর দগ্ধ হবে না, বড়জোর যদি কিছু হও ইস্পাত হবে।

.

ঠ.

আমি তো মানুষ ছিলাম, সমাজ সংসার ছিল, স্বপ্ন ছিল। বারান্দার ফুলগাছ, বাজার হাট, বিকেলবেলার থিয়েটার, বন্ধুর বাড়ি–আর সবার মতো আমারও ছিল। হঠাৎ কিছু লোক তুড়ি মেরে মুহূর্তে আমাকে নিষিদ্ধ বস্তু বানিয়ে দিল!

কার কী নষ্ট করেছিলাম আমি? কিছুই তো ছিল না আমার, শুধু ওই স্বপ্নটুকু ছিল, ওই স্বপ্ন সম্বল করে বেঁচে ছিলাম সুখে দুখে, নিজের মতো। ব্যস্ত শহরের ভিড়ে, রোদে ভিজে, আর সব মানুষের মতো আমার ওই সামান্য বেঁচে থাকাটুকু–কেন কেড়ে নিতে হবে কারও!

নিষিদ্ধ বস্তুকে গর্তে পুরে রেখেছে রাজার লোকেরা। ধর্ম-ধ্বংস-করা ডাইনিকে অবশেষে পাকড়াও করা গেছে ঢাড়া পিটিয়ে পুরো বিশ্বকে জানিয়ে দিচ্ছে খবর, ধর্মান্ধদের হ্যাঁ করা মুখে ঢেলে দিচ্ছে সুস্বাদু খাদ্য, সন্ত্রাসীদের জিভ থেকে ঝরানো হচ্ছে গনগনে লাভা।

কারও খেলার জিনিস তো নয়। আমার জীবন তো জীবন! জনতার আদালত বলে কোনও আদালত কোথাও কি নেই?

.

ড.

বাড়িটা তুই, আছিস কেমন? তোর বুঝি খুব একলা লাগে? আমারও তো, আমারও খুব। রাত্তিরে কি ভয় করে না? জানলাগুলো হঠাৎ করে ধড়াস করে খুলে গেলে? কেউ এসে কি দরজা নাড়ে? ধুলোয় ধূসর ঘরবারান্দায় কেউ ঢোকে কি, ভয় জাগে যে? চোর ডাকাতের বাড় বেড়েছে। নাকি হাওয়াই ঢোকে, ঝড়ো হাওয়া! হাওয়াই বা কোথায় এখন, সম্ভবত আমিই ঢুকি, মনে মনে আমিই বোধহয়। হেঁটে বেড়াই ঘরগুলোতে, অন্ধকারে চিনতে পারিস। পায়ের আওয়াজ বুঝিস কিছু? বাড়িটা তুই, লেখার ঘরটা দেখে রাখিস, সবকিছুই তো ওই ঘরে রে, জীবনটাই লেখার জীবন, ন-আলমারি বইপত্তর, লেখাপড়ার দুনিয়াটা, ওসব ছেড়ে ভালো থাকি! মনে মনে আমিই বোধহয় অশরীরী ঘুরি ফিরি ফেলে আসা ঘরদুয়ারে চোখের জল ফেলে আসি! বারান্দার গাছগুলোতে জল যে দেবে, কেউ তো নেই! চোখের জলে বাঁচবে না গাছ? চোখে আমার এক নদী জল, এক সমুদ্র চাস যদি বল, পাঠিয়ে দেব, বাড়িটা তুই, বেঁচে থাকিস। তোকে ছাড়া নির্বাসনে এক মুহূর্ত মন বসে না, বেড়ালটাও বাড়িতে নেই, খাঁ খাঁ করছে বাড়ির ভেতর, ধুলোয় তুই ডুবে আছিস, আঁচল দিয়ে মুছে দেব, চোখের জলে ধুয়ে দেব, অপেক্ষা কর, বাড়িট। তুই। তুই কি আর শুধুই বাড়ি। তুই তো আমার হারানো দেশ। তুই তো আমার মাতৃভাষা। তুই কি আর শুধুই বাড়ি! এক যুগেরও বেশি সময় বুকের ভেতর তোকে লালন করেছি তুই জানিস তো সব। দীর্ঘকালের স্বপ্ন তুই, স্বপ্ন বলেই তোকে ডাকি, বাড়িটা তুই, বেঁচে থাকিস, আমায় একটু বাঁচিয়ে রাখিস।

.

ঢ.

আশাগুলো একটু একটু করে চোখের জলের মতো টুপটাপ ঝরে পড়ছে, আশাগুলোকে উড়িয়ে নিচ্ছে নিরাশার লু হাওয়া। এই কঠোর নির্বাসনে স্বজন বন্ধু থেকে বিচ্ছিন্ন। কোনও অপরাধ না করে আমি অপরাধী, যে কোনও মুহূর্তে মৃত্যুদন্ড ঘোষিত হবে। একটু আশার আশায় সারাদিন বসে থাকি, কোনও ফাঁক ফোকর দিয়ে যদি ভুল করেও ঢোকে। সারারাত জেগে থাকি, ধুলোর ওপরও উপুড় হয়ে আশা বলে কিছু যদি আচমকা চিকচিক করে, খুঁজি। কিছু নেই। জীবন পেতে আছি, পারো তো কিছু আশা দিও, সামান্য হলেও ক্ষতি নেই, দিও। মিথ্যে করে হলেও দিও, তবু দিও।

.

ণ.

অপরাধীরা বড় নিশ্চিন্তে যাপন করছে তাদের জীবন, ধাপ্পাবাজি, ধর্মব্যবসা, সবকিছুই দেদার চলছে, বুক ফুলিয়ে পাড়ায় হাঁটছে, আরও কী কী অপরাধ করা যায়, তার মতলব আঁটছে, অপরাধীরা চমৎকার আছে ভারতবর্ষে, তাদের গায়ে টোকা দেওয়ার দুঃসাহস কারও নেই।

তারা অন্যায় করেছে বলে, শাস্তি তারা নয়, আমি পাচ্ছি, আমি শাস্তি পাচ্ছি যেহেতু তারা আমার বিরুদ্ধে অন্যায় করেছে। তারা আমাকে দেশ ছাড়ার হুমকি দিয়েছে বলে,আমাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করার ব্যবস্থা চলছে সাতমাস ধরে। আমাকে হত্যা করার বেআইনি ফতোয়া জারি করেছে বলে, দেশের আইন ভেঙেছে বলে, তারা নয়, শাস্তি পাচ্ছি আমি।

অপরাধ করিনি বলে এখনও অপেক্ষা করছি। দেখছি হেঁচকা টান দিয়ে নিরপরাধের গোটা জীবনটা তুলে কোথাও কোনও অজ্ঞাতস্থানে ঝুলিয়ে রাখতে কতদিন পারে দেশ। দেখছি একশ কোটি মানুষের দেশের কতদিন লাগে অবশেষে মানবিক হতে!

এ দেশ আমার পূর্বপুরুষ বা পূর্বনারীর মাতৃভূমি বলে নয়, এরই জল-হাওয়ায় আমার বেড়ে ওঠা বলে নয়, এরই সংস্কৃতি আমাকে সমৃদ্ধ করেছে বলে নয়। আমি মানুষ বলে দাবি, মানুষের হয়ে দাবি –ভারতবর্ষকে ভালোবেসে এই দাবি–অপরাধীকে শাস্তি -দেওয়া যদি নীতি হয়, তোক, নিরপরাধকে নির্যাতন করার নীতি যেন না হয় এ-দেশের।

.

ত.

অথৈ অন্ধকারে, অদ্ভুত অজ্ঞাতবাসে পড়ে থাকা অসার আমার কাছে কেউ নেই আসে। চাঁদের দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকি, মানুষের কাছে, আশ্চর্য, চাঁদও শিখেছে ফাঁকি। জীবনে অমাবস্যা ঢেলে দিয়ে পূর্ণিমা পালায়,পেছনে দৌড়ে দৌড়ে কত ডাকি, আয়, ফিরে আয়। চাঁদের কী আসে যায়! মানুষের কাছে দুদন্ড ইদানীং মানুষই থাকে না, দূরত্ব খোঁজে আত্মার আত্মীয়, জন্ম জন্ম চেনা।

দক্ষিণ থেকে উতল হাওয়ারা ছুটে ছুটে ছুঁতে আসে, হাওয়াই ভরসা ছিল অতপর অজ্ঞাতবাসে। হা কপাল! হাওয়াও উজাড় করে হাহাকার দিল, জীবনে যা কিছু ছিল বা না-ছিল, নিল। আকাশের কাছে কিছুই চাই না, ও আর কী দেবে? দিলে এক শূন্যতা দেবে। ও আমার যথেষ্ট আছে, ও নিয়েই আছি, ও নিয়েই ভারতবর্ষের অজ্ঞাতবাসে বাঁচি।

.

থ.

তোমরা সবাই মিলে কিছু একটা দোষ আমার বার করো, কিছু একটা দোষ তোমরা সবাই মিলে বার করো, না হলে অকল্যাণ হবে তোমাদের। সবাই মিলে তোমরা বলো কী কারণে আমাকে নির্বাসন দিয়েছে। আমার জন্য কোথাও মড়ক লেগেছে। কোথাও শিশুমৃত্যু, ধর্ষণ বা গণহত্যার মতো কোনও অপরাধ আমি করেছি, এরকম কিছু একটা বলল, নির্বাসনের পক্ষে অন্তত দুটো তিনটে যুক্তি হলেও দাঁড় করাও। যতদিন না জুৎসই কোনও দোষ ধরতে পারছো, যতদিন না কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ঘৃণার আঙুল তুলে দেখাতে পারছে কুলাঙ্গারকে, ততদিন কী করে ক্ষমা করবে নিজেদের! কিছু একটা দোষ পেলে আমিও স্বস্তি পেতাম। নির্বাসনকে অতটা নির্বাসন বলে মনে হত না। কিছু একটা দোষ বার হোক আমিও চাই, শুভাকাঙ্ক্ষী ভেবে তোমাদের ফের আলিঙ্গন করতে আমিও চাই।

কী দোষে আমাকে সমাজচ্যুত করেছে, বলো। কিছু একটা দোষ বার করো, দোষ বার করে দোষ-স্থলন করো নিজেদের। ইতিহাসকে কেন সুযোগ দেবে কুটি করার! একখন্ড মধ্যযুগ এনে সভ্যতাকে কেন কলঙ্কিত করেছে, কিছু কারণ বার করো এর। না যদি পারো, আমাকে বাঁচাতে নয়, তোমাদের বাঁচাতেই আমাকে মুক্তি দাও..

.

দ.

অন্নদাশংকর রায় একবার বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ তসলিমার মা, পশ্চিমবঙ্গ তসলিমার মাসি’। মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি ছিল, একটা সময় এমন কথাও বলতো লোকে।

বন বাদাড় আর নদ পেরিয়ে, মাসির কোলে এসেছিলাম কাঁদতে আমি মায়ের শোকে।

মাসিই কিনা কোল দিল না, কাঁদার জন্য কাঁধ দিল না, মাসির প্রিয় বুনো ফুল, হঠাৎ হল চক্ষুশূল। সকাল সন্ধে মাসিই তাড়ায়, মাসিই বলে মর গে যা, কোথায় যাবে অনাথ মেয়ে, কোন মুলুকে খুঁজবে মা?

.

ধ.

আমি ভালো নেই, তুমি ভালো থেকো প্রিয় কলকাতা। ভালো নেই আমি, এভাবে কেউ কোনওদিন ভালো থাকেনি কোথাও। এভাবেই তুমি আমাকে রেখেছো কলকাতা, এভাবেই নির্বাসনে, এভাবেই একঘরে করে। এভাবেই অন্ধ কূপে। পায়ের তলায় পিষছে প্রতিদিন, প্রতিদিন পিষছো পায়ের তলায়। গলাটিপে ধরেছো কথা বলেছি বলে, হাত কেটে নিয়েছো লিখেছি বলে। কাউকে হত্যা করিনি, কারও অনিষ্ট করিনি, কারও দিকে পাথর ছুঁড়িনি, মানবতার পক্ষে কিছু অপ্রিয় সত্য উচ্চারণ করেছি বলে আমাকে তোমার পছন্দ নয়। আমাকে উৎখাত করেছে আমার মাতৃভাষা থেকে, উৎখাত করেছে আমার মাটি ও মানুষ থেকে, উৎখাত করেছো জন্ম-জন্মান্তরের ইতিহাস থেকে, উৎখাত করেছো ঘর বাড়ি বাসস্থান থেকে, পৃথিবীতে আমার সর্বশেষ আশ্রয় থেকে। আমি ভালো নেই তাতে কী! তুমি ভালো থেকো, তুমি বড় বড় কবির শহর, সাহিত্যিকের শহর, দার্শনিক শুভবুদ্ধির শহর, ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রগতিশীল শহর তুমি, কলকাতা, তুমি তো সংস্কৃতির পীঠস্থান, কলকাতা, তুমি ভালো থেকো। তুমি সুখে থেকো প্রিয় কলকাতা, নাচে গানে থেকো, উৎসবে আনন্দে, মেলায় খেলায় থেকো সুখে। তুমি তো মহান, তুমি বিরাট, তুমি অট্টহাসি হাসো, জগৎ দেখুক।

.

ন.

একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রতিদিন এক থোকা গোলাপ পাঠাতেন আমার কলকাতার বাড়িতে। তিনি এদেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন, গণতন্ত্রের জন্য করেছিলেন, বাক স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন তিনি, তাঁর কাছ থেকে আমি গোলাপ পেয়েছি প্রতিদিন। ক্ষমতার চাবুক মেরে যারা আমার মনকে রক্তাক্ত করছে, জীবনকে, জীবনের সব স্বপ্নকে প্রতিদিন রক্তাক্ত করছে, তারা শুধু আমাকে নয়, ওই স্বাধীনতা সংগ্রামীকেও রক্তাক্ত করছে চাবুক মেরে, প্রতিদিন। তারা জানেনা স্বাধীনতা সংগ্রামীর ওই গোলাপের রঙ রক্তের চেয়েও লাল। এখন আর গোলাপ নয়, এখন এক ঠিকানাহীন ঠিকানায় প্রতিদিন আমার জন্য মনে মনে চোখের জল পাঠান তিনি, এই জল দিয়ে আমার ক্ষতগুলোর শুশ্রূষা করি। গোলাপের স্মৃতি থেকে বিশুদ্ধ সুগন্ধ বাতাস নিয়ে এই স্বাসরোধ করা পরিবেশে খাস নিই। এই স্বাধীন দেশের গোপন কুঠুরিতে পরাধীনতার শক্ত-শেকলে বাঁধা নির্বাসিত নিঃস্ব নারী, তাকে আজ মুক্ত করার শক্তি নেই কোনও স্বাধীনতা সংগ্রামীরও। স্বাধীনতা হয়তো এ জীবনে আমার দুরূহই হবে পাওয়া। ওই গোলাপগুলোকে ডাকবো স্বাধীনতা বলে, ওই চোখের জলগুলোই আমার স্বাধীনতা।

.

প.

সারা বছর বসে থাকি এই মেলাটি আসবে বলে। এই মেলাটির অলি গলির ভিড়ের মধ্যে নতুন বইয়ের গন্ধে ঘ্রাণে, ধুলোবালির ধূসর হাওয়ায়, হারিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। এই মেলাটি আসবে বলে আকাশপারের উতল হাওয়ায় ইচ্ছে মতো ঘুড়ি ওড়াই। বছর বছর এই মেলাটি আসে বলেই স্যাঁতসেঁতে এক ঘরের কোণেও খুব গোপনে ভীষণ সুখে, স্বপ্নসহ বেঁচে থাকি। আমার তো আর পুজো-আচ্চা, ঈদ-বড়োদিন নেই, আমার একটি মেলাই আছে, প্রাণের মেলা,এই একটি মেলায় মানুষ দেখি কাছের মানুষ, সাত-নদী-জল সাঁতরে তবু একটুখানি ছুঁতে আসে। এই মেলাটিই ধর্মকর্ম, ধূপের কাঠি, ধানদুব্বো। এই একটি পরব, একটি সুখ-ই, নিজের জন্য তুলে রাখি। শিল্প-মেলায় আগ্রহ নেই, জুয়োর মাঠ, ব্যবসা পাতি, সন্ধে হলে উৎসবে নেই, ককটেলে নেই। এই একটি মেলাই একমাত্র। এই মেলাটিই শৈশব দেয়, কৈশোর দেয়, ব্রহ্মপুত্র পাড়ের সেসব এঁটেল মাটির আনন্দ দেয়। এই মেলাটির সারা গায়ে মাতৃভাষা, মাথার ওপর স্নেহসিক্ত মায়ের আঁচল। এই মেলাকেই অন্য অর্থে জীবন বলি।

এটিও তুমি কেড়ে নিলে? স্বদেশহারা স্বজনহারা সামান্য এই সর্বহারার সবটুকু সুখ বুকের ওপর হামলে পড়ে আঁচড়ে কামড়ে এক থাবাতে ছিনিয়ে নিতে পারলে তুমি ভারতবর্ষ? দাঁত বসিয়ে কামড় মেরে ছিঁড়েই নিলে যা-ছিল-সব? হৃদয় বলতে কিছুই কি নেই ভারতবর্ষ? হৃদয় তবে কোথায় থাকে ভারতবর্ষ?

.

ফ.

আজ যদি বেঁচে থাকতেন গান্ধিজী, যে করেই হোক বন্দি শিবির থেকে আমাকে উদ্ধার করতেন। নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দিতেন। এ আমি হলফ করে বলতে পারি, দিতেন। হৃদয় বলে যেহেতু তার কিছু ছিল, তিনি দিতেন। বাড়ির ঘর দোর উঠোন আঙিনায় নিশ্চিন্তে হাঁটাহাঁটি, উছলে পড়া খুশি, বিন্দু বিন্দু স্বপ্ন দিয়ে সাজানো সংসার-সমুদ্রে আমার সঞ্জীবনী সাঁতার দেখে বড় সস্নেহে হাসতেন তিনি। হৃদয় বলে যেহেতু কিছু ছিল তাঁর, হাসতেন। আমাকে আমার মতো যাপন করতে দিয়ে আমার জীবন, আমি নিশ্চিত, তিনি স্বস্তি পেতেন। গান্ধিজী যদি বেঁচে থাকতেন আজ, দেশের দুর্দশা দেখে তার দুঃখ হত। কালসাপের মতো ফঁসে ওঠা অসহিষ্ণুতার সন্ত্রাস বন্ধ করতে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিতেন তিনি। নিশ্চয়ই দিতেন। আমাকে আর কতটুকু, মূলত দেশটাকেই বাঁচাতেন।

.

ব.

বরং বাঘ টাঘ নিয়ে বলো, কৃষ্ণসার হরিণ নিয়ে কথা বলে। মানুষের কথা বলোনা, মানুষ খুব ভয়ংকর। বাঘকে খাঁচাবে তো রক্ষে নেই। হরিণের গায়ে হাত তুলেছো কী মরেছো। মানুষকে খোঁচালে চলে, বোমা মেরে উড়িয়ে দিলেও ঠিক আছে। যে মানুষ যুক্তি দেখায়, তর্ক করে, ভাবে, ভাবনাটা ছড়ায়, তারা মানুষ তো নয়, আগুন।

আগুন যে করেই হোক নেভাতে হয়। যে মানুষগুলো জন্তুর মতো, ভাবনা নেই, বেশ আছে, খায় দায় ঘুমোয়, যেভাবে অন্যরা চলে, সেভাবে চলে। ওদের বাঁচিয়ে রাখো। জন্তুরা খায় দায় ঘুমোয়, আর জঙ্গলের শোভাবর্ধন করে। এই চিন্তাশক্তিহীন লোকগুলোও লোকালয় শোভিত করে আছে বহুকাল। এরাই থাকুক বেঁচে। দুধে ভাতে। চিন্তকদের কথা ছাড়ো, কৌশলে বন্দি করো ওদের, পারলে মেরে ফেলো!

ওদের কথা নয়, বরং অন্য কথা বলল। হরিণ টরিণ।

.

ভ.

একটা কথা আমার মুখ থেকে শুনবে বলে সবাই বসে আছে। একটা বাক্য শুনবে বলে বসে আছে, দুটো শব্দ শুনবে বলে, দুটো মাত্র শব্দ। আতঙ্কে,ভয়ে, বিবর্ণ হয়ে, কাঠ হয়ে, যেন বলে ফেলি একদিন, গুডবাই ইন্ডিয়া। দিন যাচ্ছে, সপ্তাহ শেষ হচ্ছে, মাস পেরোচ্ছে, মাসের পর মাস। আমার মুখের দিকে কয়েকশ রক্তচক্ষু, কয়েকশ বছর আগে বন্ধ হয়ে থাকা পুরোনো ঘড়ির কাঁটার মতো স্থির, ডানে বামে ওপরে নিচে সর্বত্র বাদুরের কানের মতো উৎসুক কান, জগতের সবচেয়ে মধুর শব্দদ্বয় শুনবে বলে, গুডবাই ইন্ডিয়া। আমি এখনও উচ্চারণ করছি না শব্দদুটো, এখনও বিশ্বাস করছি সত্যে। সততায়। বিশ্বাস করছি সৌন্দর্যে। শিল্পে। সহমর্মিতায়।

যেদিন আমাকে উচ্চারণ করতে হবে শব্দদুটো, যদি আমাকে করতেই হয়–দু’চারটে ঘৃণাই যেদিন উথলে উঠে সুনামি ঘটাবে, যদি ঘটায়ই মনুষ্যত্ব পায়ে পিষে ধর্মান্ধতার নিশান ওড়াবে মানুষ শহর নগর জুড়ে যেদিন –যেদিন আমারই রক্তের ওপর আমি লাশ হয়ে ভেসে থাকবো, ঠুকরে খাবে একপাল শকুন আমার ফুসফুস যেদিন আমাকে উচ্চারণ করতেই হবে শব্দদুটো, সেদিন যেন গভীর রাত্তির হয়, আমাকে যেন দেখতে না হয় দেশটির মুখ, দেখতে না হয় দুপুরের শান্ত পুকুর, আমগাছতলা, উঠোনের রোদ্দুর, যেন ভুলে যাই দেশটির সঙ্গে কখনও আমার কোনও আত্মীয়তা ছিল। আমি এখনও উচ্চারণ করছি না শব্দদুটো, এখনও প্রাণপণে পাথর করে রেখেছি জিভ। আমি উচ্চারণ করতে চাইছি না–এখনও চাইছি ভালোবাসার জয় হোক।

.

ম.

যাদের সঙ্গে বাস করবে বলে আমি অন্ধকূপে পড়ে আছি, অপেক্ষা করছি, এক একটা মুহূর্ত এক একটা যুগের মতো যদিও দীর্ঘ, করছি। যাদের সঙ্গে বাস করবো বলে ত্যাগ করছি আনন্দ উৎসব, জীবন যাপন, সমাজ সংসার, স্বাধীনতা, যাদের সঙ্গে বাস করবো বলে শরীর ক্ষয় করছি, ভেঙে গুঁড়ো হতে দিচ্ছি মন। যাদের সঙ্গে বাস করবো বলে প্রতিদিন জল ফেলছি চোখের, নিঃসঙ্গতার গায়ে সারারাত ধরে টুপটুপ ঝরে পড়ছে সে জল, ভেসে যাচ্ছে বয়স, যাদের সঙ্গে বাস করবো বলে বুকের মধ্যে বিশাল এক প্রত্যাশার প্রাসাদ গড়েছি, তারা কারা? তারা কি আমাকে মনে করে একবারও? কখনও হঠাৎ? কোনও দিন? কাঁদের সঙ্গে বাস করবো বলে ভয়ংকর দাতালের বিরুদ্ধে এক বিন্দু পিঁপড়ে হয়েও লড়াই এ নেমেছি? তারা কি আমার মতো ভালোবাসা জানে? আদৌ কি তারা ভালোবাসে?

.

য.

আমাকে কোনও একদিন কোনও বরফের দেশে, নির্বাসনে পাঠাবে ভারতবর্ষ। জমে যেতে যেতে একটু তাপ চাইবো, সামান্য উত্তাপ, দূর পরবাসে কে আছে যে দেবে কিছু স্মৃতিই যদি একমাত্র বাঁচায় আমাকে। সেইসব দিনই যদি উত্তাপ দেয়, দেবে।

আমার মধ্য কলকাতার আকাশ ছাওয়া বেড়াল-বেড়াল-বাড়িটাতে, বিকেল বেলা সুস্মিতা আসতেন কিছু না কিছু নিয়ে, কোনওদিন রাবড়ি, কোনওদিন ধনে পাতার আচার। গল্প বলতেন জীবনের, পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে কী করে তিনি তিনি হলেন। স্বাতী আর স্বপ্নার তুমুল তারুণ্য, উরি উচ্ছ্বাস, ঢোলের মতো বাজতো ঘরদোরে। শর্মিষ্ঠা নামের মেয়ে কত কত কবিতা আওড়ে সন্ধেগুলো উজ্জ্বল করেছে। বড় ভালোবেসেছিল শিবানী, বড় স্বজন ছিল শর্মিলা। বর্ধমান থেকে জয়প্রকাশ চলে আসতেন, হাতে সীলভোগ, হাতে মিহিদানা, মুখে সলজ্জ সম্ভাষণ। হঠাৎ উদয় হয়ে সকৌতুকে জীবন বলতো রঞ্জন। সুমিতাভে মগ্ন হওয়া সেই তীব্র বর্ষাগুলো। আর সেইসব সুব্রতময় দিন!

বরফে জমতে থাকা আমার শীতার্ত নির্বাসনে সেইসব দিনই যদি উত্তাপ দেয় দেবে। জঙ্গিপুর থেকে গিয়াসউদ্দিন আসতেন, চব্বিশ পরগনা থেকে মোজাফফর, আমাদের চোখের সরোবরে স্বপ্ন সাঁতার কাটতো,অবিশ্বাস্য সব সুন্দরের স্বপ্ন।

দেশ থেকে দাদা আসতো একতাল শৈশব নিয়ে, কাঁধে করে উঠিয়ে আনতো দেশের বাড়ি, দাদার গা থেকে গন্ধ বেরোতো হাসনুহানার। হাসনুহানার ওই গন্ধই যদি উত্তাপ দেয়, দেবে। দূর পরবাসে জমে জমে বরফ হতে থাকা আমাকে কে বাঁচাবে আর, যদি স্মৃতিই না বাঁচায়।

.

র.

বিখ্যাতদের সঙ্গে ওঠাবসা আমার কখনও ছিল না। নামী নামী লোকেরা আমার আশেপাশে খুব একটা ঘেঁসেনি কোনওদিন, অথবা সন্তর্পণে আমিই দূরে দূরে থেকেছি ভয়ে বা সংকোচে। আমার মতো করে তাই বাস করতে পারতাম শহরে, আমার মতো করে মাটিতে মাটির মানুষের সাথে। সহজ সাধারণরাই সাধারণত আমার স্বজন, বাজারের ঝকাওয়ালা, তরকারিওয়ালা, মাছ কাটার টগবগে ছেলেরা, মাছওয়ালা, চায়ের দোকানের বেজায় ভদ্রলোকটি, ধনঞ্জয় ধোপা, আর সেই মল্লিকপুর থেকে আসা মঙ্গলা, সোনারপুরের সপ্তমী, এদের ছেড়ে কোথায় কার কাছে যাবো? ওদিকে দুর্গা প্রতিমার মতো মুনা, কল্যাণী থেকে ছুটে আসা গার্গী, মানসী মেয়েটির ওই একবার ছুঁয়ে দেখতে চাওয়া, ছেড়ে কোথায় কোন নির্বাসনে যাবো আমি? উঠোনের ঘাসে ফুটে থাকা মনকাড়া ফুল, ‘মালিদা মালিদা, ও ফুলের নাম কী?’ একগাল হেসে মালিদা কতদিন বলেছে, ‘ও ফুলের তো দিদি কোনও নাম নেই।

দিগন্ত অবধি কত মাঠ জুড়ে কত সুগন্ধ ছড়ানো কত নামহীন ফুল,ছেড়ে কোথায় কার কাছে যাবো?

.

ল.

যারা দিচ্ছে কারাগারে আমাকে পাহারা, তাকায় বিস্ময় নিয়ে মাঝে মধ্যে তারা, কী কারণে পড়ে আছি একা একা জেলে জগৎ সংসার দূরে বহুদূরে ফেলে! বুঝতে পারেনা তারা, চোখের তারায় হয়তো কফোঁটা জল কাঁপে করুণায়! কানে কানে বারবারই প্রশ্ন করে যায় কে বাঁচে এভাবে স্বাধীনতাহীনতায়? আমি কি বুঝিনা বুঝি? একা অন্ধকারে বসে থেকে দুরারোগ্য ব্যাধি বাড়ে হাড়ে। কী করে এতটা ধৈর্য কোথায় পেলাম? ধৈর্যের পরীক্ষা হলে কার বদনাম! কে কার পরীক্ষা নেবে, মানবে কে হার! আমাকে করেছে বন্দি ক্ষুব্ধ সরকার। পরীক্ষা আমার নয়, তাদের এবার, কতদিনে করে দেখি বিষফোঁড়া পার। ধৈর্যের যা কিছু বাঁধ, ভেঙে সর্বনাশ, লাভ নেই টেনে ধরে ইস্পাতের রাশ! আপাতত করে নিচ্ছে ধর্মবাদ চাষ! পরেরটা পরে হবে, পরে রাজহাঁস। চুনোপুটি ধৈর্য ধরে বছর যাওয়াবে, তিমিরা সইবে কেন! আস্ত গিলে খাবে। আমার না হয় আশা আজকাল ক্ষীণ। ধর্মবাদের ফসল কোনও একদিন তাদের তুলতে হবে নিজেদের ঘরে, ভরে যাবে সবকটা ঘর বিষধরে। কালসাপগুলো পোষা দুধ কলা দিয়ে, একেকজনকে খাবে গিলে বা চিবিয়ে। সেদিনের কিন্তু খুব বেশি নেই বাকি, যেদিন জানবে তারা নিজেদেরই ফাঁকি দিয়ে গেছে দিন দিন, মনোবলহীন, তুখোড় রাজনীতিক, দূরদৃষ্টিহীন।

.

ষ.

আমি জেলে থাকি তাতে কার কী! এরকম কত লোক জেলে আছে! অন্যায় করিনি তাতেই বা কী! কত নিরপরাধ মরে পড়ে আছে কতখানে! ফাঁসি হয়ে যায় কত নির্দোষের, যাবজ্জীবনও হচ্ছে তো প্রতিদিনই। আমি কারাগারে এ আর এমন কী! এ তথ্য নতুন নয়। অনেক লেখককে শাসকেরা ভুগিয়েছে বিভিন্ন দেশে। খুব কিছু অভিনব নয় কারাগার-বাস। এরকম বলে দায়িত্ব এড়ান বড় বড় লোক। হঠাৎ কখনও রহস্যময় মৃত্যুটি এসে গেলে খবর বেরোবে, আপদ মরেছে অবশেষে। তাতেই বা কারও কিছুই কি যায় আসে। কজন দাঁড়াবে জানতে মৃত্যুর কারণ, প্রতিবাদ মিছিলে সাকুল্যে কুড়িজন হবে তোক? অভিজ্ঞতা আমাকে সমৃদ্ধ করেছে বটে, ক্ষমতাকে কম বেশি সবাই আমরা চিনি। নির্বাসনে না গেলে মানুষ কি চেনা যায়। এই মেরুদন্ডহীনের দেশে ভাবতে লজ্জা হয় ভালোবেসে বাস করি। হাতে গোনা কিছু সৎ ও সাহসী মানুষ হৃদয়ে রয়ে যাবে যতদিন বাঁচি, এই দেশ থেকে আর প্রাপ্তির কিছু নেই।

.

স.

অভিজ্ঞতার জন্য সবার অন্তত এক বার নির্বাসনের জীবন ভোগের প্রচন্ড দরকার।

পরাধীনতার কিছু না পোহালে স্বাধীনতা কী জিনিস কী করে বুঝবে, কেই বা বুঝবে। মর্যাদা দেবে কেন! স্বাধীনতা পেতে লড়াই করছি শৈশব থেকে প্রায়, আমি বুঝি এর গভীর অর্থ, আবশ্যকতা কত। জীবন দেখেছি বলে প্রাণপণে জীবন ফেরত চাই অনেকের মতো নাহলে নিতাম পরাধীনতায় ঠাই। স্বাধীনতা ভোগ যারা প্রতিদিনই করছে জানেনা এর আসল মানেটা আসলে খুবই সামান্য কিছু কি না। পরাধীনরাও গৃহস্থঘরে মরে পচে গলে যায়, সারাজীবনেও জানতে পারেনা কী যে তারা অসহায়।

যুদ্ধ করেই বোঝাতে চাইছি যুদ্ধ করতে হয়, স্বাধীনতা চাই সবাইকে দিতে, কেবল আমাকে নয়, নিজে না ভাঙলে, নিজের শেকল কেউই ভাঙেনা এসে, প্রয়োজনে পাশে মানুষ কোথায় দাঁড়াবে যে ভালোবেসে! ধর্মতন্ত্র আমাকে ফাঁসিয়ে মিথ্যেকে দিল জয়। লক্ষ নারীকে পুরুষতন্ত্র বন্দি করেছে ঘরে, বিক্রি হচ্ছে শত শত লোক ধর্মান্ধের কাছে। স্বাধীনতা আজ দুর্লভ খুব দুর্ভাগাদের দেশে।

.

হ.

একটা সরল সোজামানুষকে নিয়ে রাজনীতিকরছো তোমরা, তার সত্য কথাবলা তোমাদের সহ্য হচ্ছে না, তার সততা তোমাদের আর পছন্দ হচ্ছে না। তাকে রাজ্য ছাড়া করেছে, আচমকা তাকে তার ঘর থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে মিথ্যে ভয় দেখিয়ে বিমান বন্দরে, ঘর বাড়ি যেমন ছিল, ওভাবেই এখনও পড়ে আছে, যে বইটা পড়ছিলাম, সেটা ওভাবেই খোলা, লেখার খাতাটাও ওভাবে, কলমের নিব খোলা থেকে থেকে কালি শুকিয়ে গেছে সম্ভবত, লেখকের কলমের কালি শুকিয়ে ফেলতে চাইছো তোমরা। লেখককে তার লেখার ঘরে যেতে দিতে চাইছো না, লেখককে বন্দি করেছো, যেভাবে কোনও ঘৃণ্য হত্যাকারীকে বন্দি করো। যেভাবে ফাঁসি দেওয়ার জন্য রেখে দাও দাগী আসামীকে, সেভাবে আমাকে রেখে দিয়েছে, কোথায় কোন গুহায় রেখেছো কাউকে জানতে দিচ্ছো না, পৃথিবীর কাউকে না, আমাকেও না।

লেখককে ভাবতে দিতে চাইছো না, লেখককে লিখতে দিতে চাইছো না, লেখককে বাঁচতে দিতে চাইছো না, তোমাদের না-চাওয়াগুলো স্পষ্ট দেখছে পৃথিবী। ভাবনা কী। তোমাদের বশীভূত লেখকেরা, পোষ্য ঐতিহাসিকেরা স্বর্ণাক্ষরে তো লিখেই রাখবে ইতিহাসে তোমাদের নাম!

.

ড়.

আমি এখন একটা ঘরে বাস করি, যে ঘরে বন্ধ একটা জানালা আছে, যে জানালা আমি ইচ্ছে করলেই খুলতে পারি না। ভারি পর্দায় জানালাটা ঢাকা, ইচ্ছে করলেই আমি সেটা সরাতে পারি না। এখন একটা ঘরে আমি বাস করি, ইচ্ছে করলেই যে ঘরের দরজা আমি খুলতে পারি না, চৌকাঠ ডিঙোতে পারি না। এমন একটা ঘরে বাস করি, যে ঘরে আমি ছাড়া প্রাণী বলতে দক্ষিণের দেয়ালে দুটো দুস্থ টিকটিকি। মানুষ বা মানুষের মতো দেখতে কোনও প্রাণীর এ ঘরে প্রবেশাধিকার নেই। একটা ঘরে আমি বাস করি, যে ঘরে শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয় আমার।

আর কোনও শব্দ নেই চারদিকে, শুধু মাথা ঠোকার শব্দ। জগতের কেউ দেখে না, শুধু টিকটিকিদুটো দেখে, বড় বড় চোখ করে দেখে, কী জানি কষ্ট পায় কিনা–মনে হয় পায়। ওরাও কি কাঁদে, যখন কাঁদি? একটা ঘরে আমি বাস করি, যে ঘরে বাস করতে আমি চাই না। একটা ঘরে আমি বাস করতে বাধ্য হই, একটা ঘরে আমাকে দিনের পর দিন বাস করতে বাধ্য করে গণতন্ত্র, একটা ঘরে, একটা অন্ধকারে, একটা অনিশ্চয়তায়, একটা আশংকায় একটা কষ্টে, শ্বাসকষ্টে আমাকে বাস করতে বাধ্য করে গণতন্ত্র। একটা ঘরে আমাকে তিলে তিলে হত্যা করছে ধর্মনিরপেক্ষতা।

একটা ঘরে আমাকে বাধ্য করছে প্রিয় ভারতবর্ষ…..

ভীষণ রকম ব্যস্তসমস্ত মানুষ এবং মানুষের মতো দেখতে প্রাণীদের সেদিন দু’সেকেন্ড জানি না সময় হবে কিনা দেখার, ঘর থেকে যেদিন জড়বস্তুটি বেরোবে, যেদিন পচা গলা একটা পিন্ড। যেদিন হাড়গোড়। মৃত্যুই কি মুক্তি দেবে শেষ অবধি? মৃত্যুই বোধহয় স্বাধীনতা দেয় অতপর চৌকাঠ ডিঙোনোর! টিকটিকিদুটো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে সারাদিন, ওদেরও হয়তো দুঃখ হবে মনে। গণতন্ত্রের পতাকা পেঁচিয়ে প্রিয় ভারতবর্ষের মাটিতে আমাকে পুঁতে দেবে কেউ, কোনও সরকারি লোক সম্ভবত। সেখানেও ঘর পাবো, যে ঘরে চৌকাঠ নেই ডিঙোতে চাওয়ার, সেখানেও ঘর পাবো, যে ঘরে শ্বাসকষ্ট নেই।

.

ঢ়.

কখনও কোনওদিন যদি অন্তরিন হতে হয় তোমাকে, যদি শেকল পরায় কেউ পায়ে, আমাকে মনে কোরো। যদি কোনওদিন যে ঘরটিতে তুমি আছো সে ঘরের দরজা ভেতর থেকে নয়, বাইরে থেকে বন্ধ করে কেউ চলে যায়, মনে কোরো। সারা তল্লাটে কেউ নেই তোমার শব্দ শোনে, মুখ বাঁধা, ঠোঁটে শক্ত সেলাই। কথা বলতে চাইছো, কিন্তু পারছে না। অথবা কথা বলছো, কেউ শুনতে পাচ্ছে না, অথবা শুনছে, শুনেও গা করছে না, মনে কোরো। তুমি যেমন খুব চাইবে কেউ দরজাটা খুলে দিক, তোমার শেকল সেলাই সব খুলে দিক, আমিও তেমন চেয়েছিলাম, মাস পেরোলেও কেউ এ পথ মাড়ায়নি, দরজা খুলে দিলে আবার কী হয় না হয় ভেবে খোলেনি কেউ। মনে কোরো।

তোমার যখন খুব কষ্ট হবে, মনে কোরো আমারও হয়েছিলো, খুব ভয়ে ভয়ে সাবধানে মেপে মেপে জীবন চললৈও আচমকা অন্তরিন হয়ে যেতে পারে যে কেউ, তুমিও। তখন তুমি আমি সব একাকার, দুজনে এক সুতো তফাৎ নেই, তুমিও আমার মতো, তুমিও অপেক্ষা করো মানুষের, অন্ধকার কেঁপে আসে, মানুষ আসে না।

.

য়.

এমনই অপরাধী, মানবতার এমনই শত্ৰু আমি, এমনই কি দেশদ্রোহী যে দেশ বলে কিছু থাকতে নেই আমার। দেশই তবে কেড়ে নেবে আমার বাকিটা জীবন থেকে আমার স্বদেশ। দেশ দেশ বলে অন্ধের মতো উত্তর থেকে দক্ষিণ গোলার্ধ পাহাড় সমুদ্র আর সারি সারি বৃক্ষ অন্ধের মতো আকাশ চাঁদ কুয়াশা রোদ্দুর, অন্ধের মতো ঘাস লতাগুল্ম মাটি আর মানুষ হাতড়ে হাতড়ে দেশ খুঁজেছি। পৃথিবী ফুরিয়ে অবশেষে জীবন ফুরোতে দেশের তীরে এসে বসা ক্লান্ত পিপাসার্ত মানুষের নিশ্চিন্তিকে তুমি যদি টেনে হিঁচড়ে তুলে নিয়ে যাও, আঁজলার জলটাও ছুঁড়ে দিয়ে আমাকে মৃত্যুদন্ড দাও, তবে কী নামে ডাকবো তোমাকে, দেশ?

বুকের ওপর মস্ত পর্বতের মতো দাঁড়িয়ে বুটজুতোর পা দিয়ে গলা পিষছো, খুঁচিয়ে তুলে নিয়েছো দুটো চোখ, মুখ থেকে টেনে বের করে নিয়েছে জিভ, টুকরো করেছে, চাবুক মেরে চামড়া তুলে নিয়েছে, গুঁড়ো করে দিয়েছে পা,পায়ের আঙুল, খুলি খুলে মস্তিষ্ক থেঁতলে দিচ্ছো, বন্দি করেছে, যেন মরি, যেন মরে যাই, আমি তবু দেশ বলেই তোমাকে ডাকি, বড় ভালোবেসে ডাকি। কিছু সত্য উচ্চারণ করেছি বলে আমি দেশদ্রোহী, মিথুকের মিছিলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তুমি চলবে বলে আজ আমি দেশদ্রোহী। মানবতাকে যেন মাটি দিয়ে দিই নয়তো সাত আসমানে উড়িয়ে দিই–তর্জনী তুলে বলে দিয়েছে। আর যা কিছুই থাক বা না থাক, দেশ বলে কিছু থাকতে নেই আমার। আমার জীবন থেকে, তুমি দেশ, হৃদয় খুঁড়ে নিয়ে গেলে আমারই স্বদেশ।

.

ৎ.

ওদেরই তাহলে স্বাধীনতা দেওয়া হোক, ওদের জন্যই খুলে দেওয়া হোক অতপর অস্ত্রাগার। তলোয়ারগুলো তুলে নিক, কোমরে গুঁজে নিক পিস্তল, হাতে হাত-বোমা, দারুল ইসলাম এর মন্ত্র মাথায় নিয়ে ওরা না হয় বেরিয়ে পড়ুক, যেদিকে যত মুরতাদ পাক মুণ্ডু কেটে নিক। মেয়েদের মারুক, মেরে ফেলুক। নতমস্তক নারীদের গায়ে বোরখা চাপিয়ে দিক, ঘরবন্দি করুক। ঘন ঘন পুত্র পয়দা করতে ঘরে ঘরে ধর্ষণ চলুক। পৃথিবীর যত পুরুষ আছে, এক যোগে সবাই না হয় তালিবান হয়ে যাক, আর্জেন্টিনা থেকে আইসল্যান্ড, মালদ্বীপ থেকে মরক্কো, বাংলাদেশ থেকে বাহরাইন ওদের দখলে চলে আসুক। ইসলামের পবিত্র জমিতে পরম শ্রদ্ধায় মাথা ঠেকাক আমাদের জননেতাগণ। মুকুট পরিয়ে দিক এক একটা জঙ্গির মাথায়। কৃতকর্মের জন্য করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করুক জননেতাগণ। ধর্মান্ধর পা-ধোয়া পানি পান করে পুণ্যবান হোক আমাদের জননেতাগণ।

 ০৯.১ ডায়রির পাতা

২৪ নভেম্বর

করন থাপর লিখেছেন হিন্দুস্থান টাইমস। ‘ডু উই পাস দ্য তসলিমা টেস্ট?’ ‘The India I would be proud of would welcome Taslima Nasreen and grant her sanctuary. The India I’m embarrassed by wreaks violence on the streets of Calcutta, van dalises art schools in Baroda and threatens peaceful worshippers in Sirsa. Alas, that is the India I live in.’

চমৎকার লেখা। কিন্তু লেখাটির শুরুতে লিখেছেন, ‘Taslima Nasreen may not be a great novelist. She may even be motivated by a quest for publicity. And many say she deliberately and calculatedly compromises other people by revealing their personal secrets. But those are literary or moral judgements. No doubt each of us will accept or reject them as we deem fit. The question is, do we have a right to silence her voice because of them?’

করন থাপর আমার লেখা পড়েননি, তা অনুমান করতে পারি। লেখা না পড়েও লেখকের মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। লেখা যারা বুঝে পড়েছেন, আমাকে যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে সঠিক চিনেছেন, তাঁরা জানেন আমি কী লিখি, কেন লিখি। পাবলিসিটি পাওয়ার জন্য লিখি, ভালো কোনও সাহিত্যিক নই, বিতর্ক তৈরি করার জন্য লিখি –ইত্যাদি কথা বাতাসে ভাসতে শুরু করেছে সে অনেক বছর। সেই বাংলাদেশের আমল থেকেই। বাংলাদেশ আর ভারতে পার্থক্য তো খুব বেশি নেই, থাকলেও বাতাসের পার্থক্যটা নেই বললেই চলে। এই হাওয়ার মন্ত্র থেকে মন সরিয়ে অন্য একটি বিশ্বাস এবং ধারণা তৈরি করা কম কঠিন নয়। অনেকে কঠিন কাজটি করেন। অনেকে বাতাসে ভর দিয়েই চলেন। যদি একটুও নিজের প্রতি যত্ন নিতাম, তবে লেখার প্রতিও যত্ন নিতাম, ইংরেজি এবং অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ বার করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু এ ব্যাপারে আমার চিরকালের উদাসীনতা। লিটারেরি এজেন্টদের তাড়িয়েছি। জাল বইয়ে ভারত আর বাংলাদেশ ছেয়ে গেছে। বই নিয়ে যা ইচ্ছে তাই হয়েছে। জগতের কত লোক বই পড়তে চেয়েছে, সুযোগই হয়নি।

.

২৭ নভেম্বর

‘..তসলিমা নাসরিনকে পশ্চিমবঙ্গ হইতে সরাইয়া দিবার সিদ্ধান্ত আগেই পাকা হইয়া গিয়াছিল। এই সিদ্ধান্ত, এবং যে ভাবে তাহা কার্যকর হইয়াছে, তাহা সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত এবং অনৈতিক। প্রথমত, তসলিমা নাসরিনের নিরাপত্তার জন্য তাঁহাকে অন্য রাজ্যে প্রেরণের কোনও প্রয়োজন ছিল না, এই শহরেই তাহার সুবন্দোবস্ত করা সরকারের অসাধ্য ছিল না। সঙ্গত কারণেই সন্দেহ হয়, নিরাপত্তার যুক্তিটি অজুহাত মাত্র, তাঁহার মৌলবাদী বিরোধীদের সন্তুষ্ট করিবার বাসনাতেই তাঁহাকে অপসারণ করা হইয়াছিল। দ্বিতীয়ত, যে প্রক্রিয়ায় এই স্থানান্তর তথা অপসারণ ঘটানো হইয়াছে, তাহা অত্যন্ত আপত্তিকর। প্রশাসন, দল, এবং উভয়ের ঘনিষ্ঠ প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিবর্গের এই যোগসাজসের পরম্পরা একটি সামগ্রিকভাবে অসুস্থ পরিবেশের সংকেত দেয়, যাহা একটি উদার আধুনিক শাসনতন্ত্রের পরিপন্থী। তৃতীয়ত, ইহা মৌলবাদীদের অন্যায় দাবির নিকট আত্মসমর্পণ। এবং ইহাই সর্বাপেক্ষা উদ্বেগজনক। পশ্চিমবঙ্গের শাসকরা উঠিতে বসিতে নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষতার বড়াই করেন, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে বার বার দেখা যায়, মুসলিম মৌলবাদীদের তোষণে তাঁহারা অতীব তৎপর। তসলিমা নাসরিন সম্পর্কিত ঘটনাবলি তাহার প্রমাণ এবং প্রতীক। …পশ্চিমবঙ্গের ধর্মনিরপেক্ষ শাসকরা মুসলমান তোষণ করিতেছেন না, মুসলিম মৌলবাদীদের তোষণ করিতেছেন। দলের মন্ত্রণাদাতারা হয়তো বিশ্বাস করেন, এই তোষণের ফলে সংখ্যালঘু ভোটব্যাংক সুরক্ষিত থাকিবে। কিন্তু ভোটব্যাংক রাজনীতির তাড়নায় এমন ভয়ানক অন্যায়কে তোষণ করিলে তাহার পরিণাম অশুভ হইতে বাধ্য।‘ –আনন্দবাজার পত্রিকা।

আনন্দবাজার অন্য সময় সঙ্গে থাক বা না থাক, কলকাতা থেকে আমাকে তাড়াবার শুরু থেকে পাশে আছে। স্টার আনন্দতে এ নিয়ে খবর হচ্ছে, আলোচনা হচ্ছে। আমার সাক্ষাৎকারও নিলেন সুমন দে। আনন্দবাজার থেকে মিলন দত্ত বড় একটা সাক্ষাৎকার নেবেন। হায়দারাবাদ থেকে ফেরার পর আমাকে কী করে আটকে রাখা হয়েছিলো বাড়িতে, কী বলেছিলো কে, কীভাবে আমাকে কলকাতা থেকে বিদেয় করা হল, শুরু থেকে সব শুনতে চান তিনি। প্রশ্ন করা হচ্ছে, আমি উত্তর দিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ একটা গুঞ্জন। ফোনেই শুনতে পাচ্ছি মিলন দত্তকে কেউ ডাকছেন। কথা বলছেন। আলোচনা করছেন। শেষ পর্যন্ত আমাকে মিলন দত্ত জানিয়ে দিলেন, অভীক বাবু বলেছেন সাক্ষাৎকার বন্ধ করতে, কারণ প্রণব বাবুর সঙ্গে তার কথা হয়েছে, প্রণব বাবু বলেছেন এখন যেন আমার কোনও খবর, সাক্ষাৎকার ইত্যাদি মোটেও প্রচার করা না হয়, তিনি কথা দিয়েছেন দিন পনেরোর মধ্যে আমাকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনছেন।

ওদিকে স্টার আনন্দও সব আলোচনা বন্ধ করে দিল। আমার পক্ষে জনমত গড়ে ওঠার সম্ভাবনার এখানেই ইতি টানা হল।

.

২৮ নভেম্বর

‘তসলিমা নাসরিন প্রসঙ্গে সকলকে, বিশেষত মুসলমান বুদ্ধিজীবীদের, একটা কথা ভেবে দেখতে অনুরোধ করবো। ভদ্রমহিলা তার মতবিরোধীদের ইট মারেননি, গাড়ি পোড়াননি, খুন করে দেওয়ার কথাও বলেননি। তবে বিশেষত মুসলমান মেয়েদের ওপর নির্যাতন প্রসঙ্গে তিনি যা লিখেছেন তা বুদ্ধিজীবীদের একাংশের মতে ইসলামবিরোধী। কিন্তু তাঁকে তাঁর কথা বলতে না দিলে তসলিমার সমালোচকরাও অনুচ্চারিত ইসলাম বিরোধী বক্তব্যের সমুচিত জবাব দিতে পারবেন না। এতে গণতন্ত্র বিপন্ন হবে। গণতন্ত্র না থাকলে সবার আগে, এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাই। তাই তসলিমার স্বাধীনভাবে এবং অকপটে লেখার অধিকার রক্ষার দাবি শেষ বিচারে গণতন্ত্র রক্ষারই সংগ্রাম।‘ –সুনন্দ সান্যাল

প্রণব মুখার্জি লোকসভায় আমার প্রসঙ্গে বলবেন। সে গতকাল থেকেই জানা। বসে আছি অপেক্ষায়। বারোটায় বলবেন। সাড়ে বারোটায় বলবেন। এরকম শুনছিলাম। যা বললেন তা হল –“Throughout history, India has never refused shelter to those who have come and sought our protection. This civilisational heritage which is now a government policy, will continue and India will provide shelter to Ms Nasreen. Those who have been granted shelter here have always undertaken to eschew political activities in India or any action, which may harm India’s relation with friendly countries. It is also expected that the guest will refrain from activities and expressions that may hurt the sentiments of our people. While these guests are in India the Union and the state governments provide them protection –this policy will also apply in Ms Taslima Nasreen’s case”

দাদা বললো, ‘একেবারে রিয়েল ডিপ্লোমেট’।

যে ডুবছে, সে একটা খড়কুটো চায়। আমাকে যে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না এ দেশ থেকে, আমাকে যে থাকতে দেওয়া হবে, এই খবরটিই আমার কাছে সবচেয়ে বড় খবর। . আমি আশা করেছিলাম অন্য এক বিবৃতির যার বাংলা করলে এরকম দাঁড়ায় –‘ভারত এমন একটি দেশ, যে উদার, অতিথিপরায়ণ, পৃথিবীর নানা দেশের নানা সংস্কৃতির মানুষকে বিভিন্ন সময়ে বরণ করে নিয়েছে এবং ঋদ্ধ হয়েছে। তসলিমা একজন নির্যাতিত এবং নির্বাসিত লেখক, বাংলা তাঁর মাতুভুমি। পুর্ব বাংলায় না হলেও পশ্চিম বাংলায় বাস করার তাঁর এই ইচ্ছেকে আমরা স্বাগত জানাই। ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র। এখানে যারা বাস করছে, সবারই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিজের মত প্রকাশের অধিকার আছে। কিন্তু ২১শে নভেম্বর কলকাতার রাস্তায় যা ঘটেছে, তা বর্বরতা ছাড়া আর কিছু নয়। সেকুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রথম এবং প্রধান শর্ত, মত প্রকাশের স্বাধীনতা। মত প্রকাশের অধিকার এবং বাক স্বাধীনতা আর সবার মতো তসলিমা নাসরিনের আছে। সুতরাং তাঁর মত প্রকাশের অধিকার ছিনিয়ে নেবার উদ্দেশ্যে যারা রাস্তায় নেমেছে এবং লুঠপাট, আগুন জ্বালানো এবং জনগণের জীবন নিরাপত্তাহীন করে তুলেছিল, তাদের অগণতান্ত্রিক আচরণের কারণে তাদের বিরুদ্ধে সরকার অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে এবং ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের অশুভ কাজ থেকে বিরত থাকে সে ব্যাপারে প্রশাসন সতর্ক থাকবে। সেকুলার গণতন্ত্রের ভাবমূর্তি নষ্ট না হয়, এ ব্যাপারে প্রত্যেককে সচেতন থাকতে হবে। তসলিমা নাসরিনকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কেন তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে অন্য রাজ্যে স্থানান্তর করা হল, সে ব্যাপারে তদন্ত চলবে। এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা হবে। এবং ২১ নভেম্বরের তান্ডবকারীদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা হবে। তসলিমাকে আগামীকাল কেন্দ্র থেকে কলকাতায় পাঠানো হবে। কেন্দ্র চাইছে পশ্চিমবঙ্গে তসলিমার পূর্ণ নিরাপত্তা। শুধু তাই নয়, পশ্চিমবঙ্গের বাইরেও তাঁর পূর্ণ নিরাপত্তা তাঁকে দেবে ভারত সরকার এবং রাজ্য সরকার। শুধু তসলিমা নয়, এদেশের সব নাগরিকের, অতিথিদের, এবং আশ্রয়প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ভারতের নিয়ম একই, ভিন্ন নয়।’

হ্যাঁ এরকম হবে মনে মনে ভেবেছিলাম। কিন্তু যা হল তা ঠিক কী হল, বুঝে পাচ্ছি না। একটাই স্বস্তি পাচ্ছি তা হল রেসিডেন্স পারমিটই আর দেওয়া হবে না–এমন কিছু বলা হয়নি।

.

৩০ নভেম্বর

‘সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম পুলিশ আর পার্টির ভাড়াটেদের বন্দুকনির্ভর নির্মম দখলদারির পর্ব পেরিয়ে তসলিমা ইস্যুতে এসে একটা দমকা হাওয়াতে উড়ে গিয়েছে সিপিএম-এর এতদিনের সযত্ন লালিত ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশটা।

.. তসলিমা দেশে দেশে, রাজ্যে রাজ্যে এভাবেই ছিন্নমূল ঘুরতে থাকুন, আর আমরা কড়ায় গণ্ডায় ভোটের হিসেব করি। নিক্তিতে মেপে দেখি, তসলিমা এখানে থাকলে তাদের লাভ বেশি,

বিদেয় হলে। কী করলে, কী বললে মুসলিম ভোট টানা যাবে। কোন ইস্যুতে মৌলবাদের কথায়। ঘাড় নাড়তে হবে, কোন ইস্যুতে রাস্তায় নেমে মৌলবাদের বিরুদ্ধে মিছিল করে চেঁচাতে হবে, সবই ভোটের নিক্তিতে ওজন করা।‘–আশিস ঘোষ

সকালে এনামুল কবীর ফোন করলেন বীরভূম থেকে। না, এখন অবধি কোনও রাজনৈতিক দল বলেনি সিপিএম যা করেছে ভুল করেছে, এভাবে কোনও লেখিকাকে তাড়িয়ে দেওয়াটা অন্যায়।

আজ দ্বিখণ্ডিত থেকে কিছু বাক্য বাদ দিয়ে দিলাম। সারা দেশে এই চরম দুঃখের খবরটি হৈ হৈ করে ছাপা হল।

.

২ ডিসেম্বর

ক্যান্টনমেন্টের প্রধান একদিন দেখা করে গেছেন। সম্মান দেখিয়ে গেছেন। সজ্জন শিক্ষিত ভদ্রলোক। বললেন, লজ্জার লেখকের সঙ্গে দেখা হবে কোনোদিন, এ কল্পনাও করেননি। সবাই আমার নাম জানেন লজ্জা’র লেখক হিসেবে। লজ্জা পড়েননি, ভারতবর্ষের শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে এমন লোক কমই আছে। পেঙ্গুইন ঘোষণা করেছে, লজ্জা ভারতবর্ষের মুদ্রণশিল্পের ইতিহাসে সবচেয়ে বিক্রিত বই।

ভদ্রলোকের নামের পদবী, সেন। বাঙালি ভেবে কী খুশিই না হয়েছিলাম। পরে শুনলাম, উনি বাঙালি নন।

.

৪ ডিসেম্বর

‘She does not have any choices. She is just like a person who has now got the protection of the mafia which is the state in some way. She has nowhere to go. She has no protection. She just has to blunder her way through this kind of humiliation and I really feel for her’. –Arundhati Roy

আজ দাদার বিয়ের পঁচিশ বছর পূর্তি উৎসব। প্রতিবছর এই দিনটি দাদা উদযাপন করে। কিন্তু দিল্লির এই অজ্ঞাতবাসে উদযাপনের কিছু নেই। আজ সকালে দাদা স্নান করে তৈরি হয়ে রইলো। দুপুরের খাবার খেয়েই রওনা হয়ে গেল। দিল্লি থেকে কলকাতা গেল। বিকেল পাঁচটায় কলকাতায় নামবে। আমরা একসঙ্গে কলকাতা থেকে এসেছিলাম, দাদা একা ফিরে গেল। আমি যেতে পারলাম না। আমার যাওয়া সম্ভব নয়। দাদার চলে যাওয়ার দিকে তাকাতে ইচ্ছে করেনি। বুক ফেটে যাচ্ছিল। দাদাও কষ্ট পাচ্ছিল হয়তো। কিন্তু এখানে থেকেই বা কী করবে! ভালো লাগে এভাবে লুকিয়ে থাকতে!

.

৫ ডিসেম্বর

‘Secularism is not appeasing fundamentalism and terrorism. The November 21 incidents could have led to communal riots in Kolkata. Fundamentalism, whether Muslim or Hindu is a challenge which must be taken very seriously. The Taslima Nasreen issue is no longer about Taslima Nasreen the writer. It has revealed a much larger conspiracy in the making.

It was a test case, and the CPM’s decision has conveyed to the Islamic fundamentalists that they have won the round one!’ -Bhaskar Roy.

আজ উল্লেখ করার মতো তিনটে জিনিস পেলাম, দ্য হিন্দুর সম্পাদকীয়, আনন্দবাজারের উপসম্পাদকীয় আর একটি ঘটনা, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের বইয়ে মুহম্মদ নবীর একটি ছবি ছাপানো হয়েছে বলে কলকাতায় বিক্ষোভ শুরু হতেই দিল্লির প্রকাশককে ক্ষমা চাইতে হয়েছে। হিন্দু লিখেছে, এই ২৯৫(ক)ই তো বাংলাদেশে আমার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেছিল সরকার। সেই পনেরো ষোলো বছর থেকে বাক স্বাধীনতাবিরোধী আইনটিকে বাদ দেওয়ার কথা বলছি। আমার এবং আমার মতো দু’একজনের কথা কে শোনে।

আজকের আনন্দবাজার পত্রিকার লেখাটি দেখে হ্যাঁ হয়ে গেলাম। কদিন আগেই আমাকে সমর্থন করেছে, আর আজ একশ’ আশি ডিগ্রি ঘুরে গেল! হতবাক হতে হয় আমাকে। বাকরুদ্ধ বসে থাকি। কল্যাণ সান্যাল আমার বিরুদ্ধে একটি উপসম্পাদকীয় লিখেছেন। বিতর্কের জন্য যদি ছাপানো হয়ে থাকে লেখাটি তাহলে কোনও আপত্তি নেই। সুস্থ বিতর্ক সবসময়ই ভালো। কিন্তু যদি এ বাক-স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান হিসেবে হয়, তাহলে নিশ্চিতই আশংকার কারণ বৈকি। আমি অনুমান করি, আমার পক্ষে লেখা কোনও নিবন্ধ বা চিঠি এখন আনন্দবাজার ছাপাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কল্যাণ সান্যালের বক্তব্য শিল্প মানেই শুদ্ধ নয়, রাজনীতি মানেই দূষিত নয়। সিপিএমের রাজনীতি দূষিত নয়, আমার লেখা শুদ্ধ নয়। আমার লেখা যেহেতু শুদ্ধ নয়, আমাকে রাজনীতিকরা বা ক্ষমতাবানরা তাড়িয়ে দিতেই পারে, এতে কোনও অসুবিধে নেই। আরও লিখেছেন, আমার লেখার ধরন এবং মর্মবস্তু কোনওটাই তিনি পছন্দ করেন না। পছন্দ করেন না, সুতরাং যেন তাড়িয়ে দেওয়াটায় অন্যায় কিছু নেই। তিনি সিপিএমের বিরোধিতা করছেন নন্দীগ্রামের ব্যাপারে। কিন্তু আমার ব্যাপারে তিনি সরকারের পক্ষ নিচ্ছেন। আমার একটা ধারণা হয়. কল্যাণ সান্যালের মতের পক্ষে বেশির ভাগ শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী, তা না হলে আমার বিরুদ্ধে যে অন্যায় সিপিএম সরকার করেছে, তার কোনও প্রতিবাদ নেই কেন?

.

৬ ডিসেম্বর

আজ বাবরি মসজিদ আক্রমণের পনেরো বছর পূর্তি। লজ্জা লিখেছিলাম পনেরো বছর আগে। দিন যে কীভাবে উড়ে যায়! মনে হয় এই সেদিন। ভালোবাসা জন্মেছিল ঠিক পনেরো বছর আগে, ৬ ডিসেম্বর তারিখে, ১৯৯২ সালে। আজ নাকি হরকাতুল জিহাদি দলের সদস্যরা একটা সাদা গাড়ি করে উত্তরপ্রদেশের দেওবন্দ থেকে দিল্লিতে ঢুকেছে, ইচ্ছে কিছু জনবহুল জায়গায় বোমা মেরে মানুষকে সন্ত্রস্ত করা। যদুর মনে পড়ে এই হরকাতুল জিহাদি দলটি বাংলাদেশে গড়ে উঠেছিল, আমার বিরুদ্ধে ধর্মবাদীদের আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন। কী লাভ হচ্ছে তাদের মানুষ মেরে, আমি জানি না।

আজ প্রশান্ত রায়ের সঙ্গে কথা বললাম ফোনে সকালে, অনেকক্ষণ। উনি আশাবাদী কলকাতায় কিছু একটা আন্দোলন হবে আমার পক্ষে। আমি বললাম আন্দোলন হলে শুরুতেই হত। চোখের সামনে মানুষ দেখলো আমাকে কী করে বের করে দেওয়া হল পশ্চিমবঙ্গ থেকে। কী ভয়ংকর অন্যায়ভাবে বের করা হল। দিনের পর দিন মনের ওপর অত্যাচার চালিয়ে তারপর বের করলো। তারপরও কোনও একটি মিছিল বেরোলো না কলকাতার রাস্তায়! নিজেদের হাতে লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়াতে হল আমার চার পাঁচজন বন্ধুকে। কেউ নেই আমার জন্য? আমার জন্য কেউ না থাকুক, অন্তত বর্বর একটি ঘটনার বিরুদ্ধে কি কারও দাঁড়াবার নেই? হ্যাঁ কিছু লেখা হচ্ছে বটে এদিক ওদিক কিন্তু জনগণকে ততটুকু ক্ষুব্ধ করছে না, যতটুকু ক্ষুব্ধ হলে মিছিলে যেতে হয়।

পাগলের মতোকাঁদলাম। তপন রায় চৌধুরী ফোন করেছিলেন। বললাম যেন আমাকে কলকাতা নিয়ে যান। যদি কলকাতা না-ই যেতে পারি, যদি পশ্চিমবঙ্গ আমাকে না-ই নেয়, আমাকে যেন বাংলাদেশেই পাঠিয়ে দেয়। ওখানে হুজি ফুজিরা কখনও মেরে ফেলে রাখবে। তাই ভালো। তবু পরের দেশকে নিজের দেশ ভেবে ভুল যে করেছিলাম, মানুষকে ভালোবাসলেও মানুষ যে শেষ অবধি ভালোবাসে না, বরং দূরে বসে মজা দেখে, তা তো আর নিজের চোখে দেখতে হবে না।

আমার ছিঁড়ে যাচ্ছে মাথা। আর পারছি না সইতে। প্রভুকে বললাম, আমাকে বাংলাদেশে ফেলে আসুন। ওখানেই যা হবার হোক। প্রভু শুনলেন। কণ্ঠে তার আগ্রহ আরও কিছু শোনার। এরকম কিছু শোনার জন্য যেন অনেকদিন অপেক্ষা করছেন। মনে আছে প্রভুর মতোই আরও একজন সরকারি বড় অফিসার বলেছিলেন, রাজস্থান হাউজে বসে, আমি যেখানে নিরাপদ, সেখানেই থাকা উচিত আমার।

জিজ্ঞেস করেছিলাম, কোথায় নিরাপদ?

লোকটি বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে কি নিরাপদ জায়গার অভাব আছে?’

‘কোথায় সেই নিরাপদ জায়গা, শুনি!’

‘কেন, ইওরোপ বা আমেরিকা!’

‘না। আমি বিদেশ যাবো না।‘

কী রকম যেন ভয় লাগছিল আমার।

.

৭ ডিসেম্বর

সকালে কলকাতা থেকে শর্মিলা ফোনে শোনালো আজকের প্রতিদিনের উইকএন্ডে বের হওয়া জয় গোস্বামীর একটা লেখা। ‘কোনও লেখককে যদি তার কোনও লেখা প্রত্যাহার করে নিতে হয়, তখন কী অনুভূতি হয় তাঁর? কী অপরিসীম কষ্টের মধ্য দিয়ে তসলিমাকে যেতে হয়েছে এই প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিতে, তা, আমরা অনুমান মাত্র করতে পারি। কারণ, আমাদের কাউকেই নিজের দেশ থেকে নির্বাসিত অবস্থায় দিনের পর দিন, দেশের পর দেশে, নিরাপত্তা রক্ষী পরিবৃত হয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়নি। আমাদের কারোরই নিজের দেশে ফেরার পথ বন্ধ নয়। আমাদের কারো বই বেরোনো মাত্র নিজের দেশে পর পর নিষিদ্ধ হয়ে আসছে না। আর আমরা কেউই জানি না, নিজের মাথার উপর মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া ঝুলে থাকলে কেমন লাগে।

আমরা শুধু তসলিমার সমালোচনা করতে পারি। এটা লেখা তসলিমার উচিত হয়নি। ওটা বলা তসলিমার ঠিক হল না। এমনকী, আমরা এতটাও বলেছি কখনো যে, এসবই তসলিমা প্রচার পাওয়ার জন্য করেছেন। হয়াঁ, নিজের জীবন শেষ হয়ে যেতে পারে কোনও উন্মাদ ধর্মান্ধ ঘাতকের হাতে এটা জানার পরেও হয়তো প্রচারের জন্যই করেছেন। এতটাও বলেছি আমরা।’

শুধু এটুকুই নয়, আমার অবস্থা বোঝাতে বোঝাতে গ্যালিলিওর প্রসঙ্গও এনেছেন জয়। গ্যালিলিকেও পুড়িয়ে মারার ভয় দেখানো হয়েছিল। অসম্ভব চাপের সামনে শেষ ম্যে ভেঙে পড়লেন গ্যালিলিও। প্রত্যাহার করে নিলেন নিজের মতবাদ। বললেন, ‘চার্চই ঠিক, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে।‘ চোখ রাঙালে না হয় গ্যালিলিও বলে দিলেন পৃথিবী ঘুরছে না, পৃথিবী তবু ঘুরছে, ঘুরবেও যতই তাকে চোখ রাঙাও না।

শিবনারায়ণ রায়কে ফোন করেছিলাম, ওঁর শরীর মন কোনওটাই ভালো নেই। লিখতেও, বললেন, পারছেন না। বললাম ‘ব্লাড প্রেশার হয়তো খুব বেশি, ডাক্তার দেখান। নাহ, ডাক্তার দেখানোর খুব আগ্রহ নেই। বয়স বাড়লে, সবাই যেন কেমন কুঁকড়ে যান, ‘বেঁচে না থাকলেও চলে, অনেক তো হল’ ধরনের বাক্য আওড়ান।

বয়স ছিয়াশি। বললাম ‘জ্যোতিবাবুর বয়স তো পঁচানব্বই। আপনার চেয়ে তো অনেক বেশি বয়স।‘

কী অন্যায় করেছি যে আমাকে শাস্তি পেতে হবে? শিবনারায়ণ রায় বললেন, ‘কে বলেছে মানুষ শাস্তি পায় অন্যায় করলেই? তুমি একটা ক্ষমতাসীন শক্তির স্বার্থে আঘাত দিয়েছে, সে কারণে শাস্তি পাচ্ছো।

আজ ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’এ একটা লেখা পড়ে খুব ভালো লাগলো। মনের সঙ্গে মিলে যাওয়া কথা। সৌদি আরবের এক মেয়ে অপহরণ আর গণধর্ষণের শিকার। ইসলামের বিচারে ধর্ষকদের কোনও শাস্তি হল না। শাস্তি হল মেয়েটির। জেল হল। চাবুক হল। সুদানে এক ইস্কুল শিক্ষিকাকেও শাস্তি পেতে হল, কারণ পড়াতে গিয়ে টেডি বেয়ারের নাম রেখেছিল মুহম্মদ। এদিকে আমাকে পেতে হল শাস্তি। কবে কোন বইএ কী লিখেছি তা তাদের পছন্দ হয়নি বলে। তো ইসলামে নাকি বেশির ভাগ মুসলমানই অমৌলবাদী। ইসলামকে নাকি কিছু মৌলবাদীরা হাইজ্যাক করেছে। তাছাড়া ইসলাম খুব ভালো, ভালোর অন্ত নেই। লেখকের মতো আমারও প্রশ্ন, সেই মডারেটরা বা নরমপন্থীরা বা আধুনিক মুসলমানরা এখন কোথায়? তাঁরা মৌলবাদীদের কোনও দাঙ্গা হাঙ্গামা, কোনও শঠতা শয়তানি, কোনও ধর্ষণ লুঠের বিরুদ্ধে কিছু বলেন না তো, তাঁরা তো পথে নামেন না দল বেঁধে! অল্প কিছু মুসলমান এত বড় জঘন্য কান্ড ঘটাচ্ছে, আর বেশির ভাগই চুপ করে বসে দেখছে, তা কি হয়? মাঝে মাঝে আমার কিন্তু মনে হয় মডারেট’ বলে কিছু নেই। মুসলমান সমাজে দু’ধরনের মানুষ আছে, এক ইসলাম-বিশ্বাসী, আরেক ইসলামে অবিশ্বাসী। ইসলামে অবিশ্বাসীর সংখ্যা তুলনায় খুব কম, খুবই কম। বাদবাকি পুরোটাই ইসলাম-বিশ্বাসী। এই ইসলাম-বিশ্বাসীদের কেউ কেউ টুপি পরে, জোব্বা পরে, দাড়ি রাখে। কেউ কেউ এই পোশাকের বাইরে অন্য পোশাক পরে। বিশ্বাসীদের কেউ কেউ নামাজ রোজা ইত্যাদি করে, কেউ কেউ করে না। এই হল ঘটনা। বিশ্বাসীদের কেউ কেউ যখন মানবতার বিরুদ্ধে নামে, তার প্রতিবাদ বিশ্বাসীদের মধ্য থেকে আসে না। মডারেটদের তাই চোখে পড়ে না। মডারেট বা নরমপন্থী বলতে কিছু নেই বলেই চোখে পড়ে না।

সারাদিন কিছু ফোন। পাটনা থেকে কেয়া। বীরভুম থেকে এনামুল। ২৪ পরগণা থেকে মোজাফফর। আর একটি চিঠি পেয়ে মন ভরে গেল আজ। পাচুর চিঠি। চিঠি বলতে ই মেইলকেই বুঝি। অনেকমাস ধরে যোগাযোগ নেই পাঁচর সঙ্গে। এমন ভালো বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ না থাকার পিছনে কারণ ছিল, অভিমান। পাচু লিখেছে, ‘নিরাপদে আছিস এটা বুঝি। কিন্তু তোর মন যে একেবারে তছনছ, সেটা ভেবে বড় ব্যাকুল লাগে। আমাদের এই সময় কি তাহলে শাসিত হবে শুধুই ধর্ম, শুধুই মৌলবাদ, শুধুই ভোট কেন্দ্রিকতার যাঁতাকলে? কী ভয়ানক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখোমুখি হয়ে তুমি তিনটি পাতা প্রত্যাহার করেছো বুঝে শরীর মন হিম হয়ে যায়। আশা রাখবো এই দুর্দিন আবার কাটবে, তুমি আবার ফিরে আসবে তোমাতে, আবার ঝলসাবে তোমার কলম অনির্বাণ! ভালো থাকিস। এই অবস্থায় যতটুকু ভালো থাকা যায়। উত্তরে আমি লিখলাম, ‘পাচু তোর চিঠি পেয়ে ভালো লাগলো এই অসহ্য কষ্টের মধ্যেও। জানি না কী করবো আমি। কলকাতা যেতে চাই। কিন্তু প্রগতিশীল কলকাতা তো আমাকে নিচ্ছে না। আমি একটা অন্ধকার ঘরে হতাশা আর অনিশ্চয়তায় ডুবে আছি। এরা হয়তো চাইছে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগে একদিন আমি আত্মহত্যা করি নয়তো এদেশ ছেড়ে চলে যাই। উত্তর লিখলো পাচু। তসলিমা, কাকেই প্রগতিশীল কলকাতা বলিস জানি না। যে কলকাতায়, আমরা জানি, মৌলবাদকে নির্লজ্জ ব্যবহার করে লাল ঝান্ডাওলা একটি দল স্রেফ মুসলিম ভোটের কারণে যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে উঠতে গিয়ে অন্য ঝাল্ডাধারীরা সুতীব্র ধিক্কারে এককাট্টা হয়ে গলা ফাটিয়ে সর্বব্যাপী আওয়াজ তুলতে পারে না–যারা বোঝে না কোন অসহনীয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মুখে অসহায় একজন লড়াকু লেখককে তার সাধের তিনটি পাতা ছিঁড়ে ফেলতে হয়–সেই কলকাতাকে তুই প্রগতিশীল কলকাতা বলবি? এই চরম অন্যায়ের শোধ তুই একদিন না একদিন নিতে পারবি। এত অন্ধকারেও আমি বিশ্বাস করি, মৌলবার শেষ কথা বলে না।

বলে না? বাংলাদেশে তো আজও মৌলবাদই শেষ কথা বলে তেরো বছর হয়ে, গেল, ফিরতে পারি না। আর কী কথা বাকি আছে বাংলাদেশের বলার? চুপ করে আছে পশ্চিমবঙ্গ, আর কী কথাই বা তার শেষ কথা। নীরবতা, প্রত্যাখ্যান, অবজ্ঞা, অপমান, মৌলবাদই তো শেষ কথা।

যেখানে আছি আমি, একটি ঘর, সামনে একচিলতে বারান্দা, বারান্দার লাগোয়া একটা ছাদ। ছাদে দাঁড়ালে বা হাঁটলে আবার কেউ না কেউ কোথাও থেকে দেখে ফেললে আবার কী না কী হয়, তাই ওদিকটায় যাই-ই না। যেন না যাই, আমাকে বলে দেওয়া হল। এ আর কী, ঘরবন্দি হয়ে থাকতে তো পারিই আমি। মাসের পর মাস তো কাটিয়েছি, দেশে, বিদেশে। নিরাপত্তার নামে যন্ত্রণা ভোগ কী কম করেছি। শেকল ভাঙার কথা বলতে গিয়ে নিজের পায়ে শেকল পরতে হয়েছে, সে কী আজ থেকে!

.

৮ ডিসেম্বর

‘I think the Taslima Nasreen case has tested, and will test, the integrity of the Left intelligentsia even more than Nandigram’–Ramachandra Guha.

৬ ডিসেম্বরে কলকাতায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পনেরো বছর উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তিনি বললেন, রাম হচ্ছে কবির কল্পনা। রামসেতুটা প্রাকৃতিক সেতু। রামসেতু নিয়ে যা হচ্ছে তা ধর্মীয় উন্মাদনা। টেলিভিশনে কাল এই খবরটি দেখে আমি তাজ্জব। কদিন আগে মুসলিম মৌলবাদীদের দাবি মেনে নিলেন, শহরে ওদের বর্বরতা আর উন্মাদনার বিরুদ্ধে একটা শব্দ খরচ করলেন না, বরং বললেন, কারওর অধিকার নেই ওদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার। আর এদিকে দোষীকে শাস্তি দেবার বদলে নির্দোষকে রাজ্যছাড়া করলেন, তারপর আজ কি না তিনি হিন্দুর ধর্মীয় অনুভূতিতে নিজেই আঘাত দিচ্ছেন।

.

৯ ডিসেম্বর ‘অধিকাংশের মতামতের সঙ্গে একমত না হওয়ার অধিকার চিন্তাশীল মানুষের প্রাথমিক, মৌলিক, সর্বশ্রেষ্ঠ অধিকার। এক লেখককে ‘তুমি এত দূর অবধি লিখতে পারো, কিন্তু তার বেশি এগোবে না’ বলা আর ‘তুমি কিছুই লিখবে না’ বলার মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। কারণ আসলে বলা হচ্ছে ‘তুমি বাপু বাক পরাধীন, তবে আমার ন্যাজে পা না-দেওয়া অবধি বাকস্বাধীন’। এই থ্রেট-সহ ছাড় স্বাধীনতা নয়। খাঁচার মধ্যে পায়চারি করার অনুমতি।

বাক স্বাধীনতার কোনও চৌকাঠ হয় না। সীমা হয় না। কারণ তা হলে যে কোনও ক্ষমতাশীল গোষ্ঠী (রাষ্ট্র। মৌলবাদী/ফাটাকেষ্ট ও চ্যালারা) যখন খুশি ইচ্ছেমতো চৌকাঠ নির্মাণ করবে, এবং পৃথিবীর যে কোনও শিল্পকেই নিজের সুবিধেমত কারও না কারও ভাবাবেগ-আঘাতকারী হিসেবে চিহ্নিত করবে, তার পর গুলি’। –চন্দ্রিল ভট্টাচার্য

একটা চিঠি লিখলাম তাঁকে। চিঠি তাঁকে পাঠানো হয়তো সম্ভব নয়, তবু লিখতে ইচ্ছে হল একটি চিঠি

মাননীয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য,

আমার অশেষ শ্রদ্ধা জানবেন। আপনার সঙ্গে একসময় আমার আলাপছিল, বেশ কয়েকদিন কথাও হয়েছে। আপনাকে একজন আন্তরিক মানুষ হিসেবেই তো আমি জানতাম। মনে আছে নন্দনে বসে আপনি একবার আমার বম্বে হয়ে প্যারিস যাবার বদলে দিল্লি হয়ে প্যারিস যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কারণ বোম্বের মৌলবাদী মুসলিমরাবিক্ষোভ দেখাচ্ছিল আমার বোম্বে যাওয়ার বিরুদ্ধে, বিমানবন্দর নাকি জ্বালিয়ে দেবে, আমাকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারবে। আমি আপনার প্রস্তাব মেনে নিচ্ছিলাম, কিন্তু শাবানা আজমি, জাভেদ আখতার, জাভেদ আনন্দ আর তিস্তা শীতলবাদীরা যখন বারবার আমাকে ফোন করছিলেন, বলছিলেন আমাকে যেতেই হবে বোম্বে, আমাকে বোঝাতেই হবে যে মৌলবাদীরা যা দাবি করে, তা হতে দেওয়া যায় না, বোম্বে যেতে হবেই, না যাওয়া মানে মৌলবাদীর কাছে নতি স্বীকার করা, না যাওয়া মানে তাদের অন্যায্য দাবি মেনে নিয়ে তাদের বিজয়ী করা। আমি আপনার উপদেশ মেনে চলছিলাম বলে তাঁরা আপনার শরণাপন্ন হলেন। আপনাকেই বোঝালেন কত যে জরুরি আমার বোম্বে যাওয়া। আপনি বুঝলেন এবং মেনে নিলেন আমার বোম্বে হয়ে প্যারিস যাওয়া।

তারপরও ওই নন্দনেই দু’একবার দেখা হয়েছে। আমজাদ আলী খানের সরোদ শুনতে গিয়েও একবার দেখা হল, সম্ভাষণ বিনিময় হল। শ্রদ্ধেয় আমজাদ আলী খান আপনাকে এবং আমাকে নমস্কার জানিয়ে বাজনা শুরু করলেন। তখন ২০০২ সাল, কলকাতায় পাকাঁপাকিভাবে বাস করার ইচ্ছে মনে, মনে আছে চারদিকে ফ্ল্যাট খুঁজে বেড়াচ্ছি কেনার জন্য। আপনি আমাকে সাহায্য করছিলেন একটা ফ্ল্যাট কিনতে। মন্ত্রী গৌতম দেবএর জন্য যে একটা ফ্ল্যাট বরাদ্দ ছিল উদিতায়, বলেছিলেন সেই ফ্ল্যাটটি আমার কিনে নিতে কোনও অসুবিধে নেই। আমি তৈরি ছিলাম। কাগজপত্র পাঠানো হয়েছে দিল্লি নাকি বোম্বেতে। রিজার্ভ ব্যাংক থেকে নাকি অনুমতি চলে আসছে। না, সেই অনুমতি অবশ্য আমার কোনওদিন পাওয়া হয়নি। কোনও কাগজপত্র ফেরত পাইনি। ফ্ল্যাট কেনাও হয়নি। কিছুই হয়নি। আপনার সঙ্গেও আর কোনও সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়নি। সম্ভব হয়নি আপনার আর নাগাল পাওয়া। আপনার বন্ধুরা, যারা আমারও বন্ধু ছিল, হঠাৎ আমার পর হয়ে উঠলো।

মনে হচ্ছে এই সেদিনের কথা এসব। কী থেকে কী হয়ে গেল, অবিশ্বাস্য সব ওলোটপালোট।

আমি তখন হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকুলারিজমের ওপর একটা ফেলোশিপ করছি। ওখানেই শুনি আপনি আমার দ্বিখন্ডিত বইটিকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। সত্যি, যেন আকাশ থেকে পড়লাম। এও কি সম্ভব? কলকাতার বন্ধুরা জানালো, সম্ভব। ছোটবেলা থেকে বামপন্থায় বিশ্বাস আমার। বামপন্থী রুশ লেখকদের লেখা পড়ে বড় হয়েছি। আমি তো ‘দ্বিখন্ডিত’তে মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমার লড়াইএর কথা লিখেছি, নারীর স্বাধীনতা আর অধিকারের কথা লিখেছি, আমি তো সমতার কথা লিখেছি! কোথায় তবে বামপন্থার সঙ্গে সংঘাত হল আমার? আমি শুনলাম আপনি বলছেন, কয়েকজন বুদ্ধিজীবী আপনাকে বলেছেন বইটাকে নিষিদ্ধ করতে, এবং আপনিও একাধিকবার পড়ে দেখেছেন ওটা, ওটা নাকি নিষিদ্ধ হওয়ার মতোই বই। তাই কি? আপনি কি মন থেকে বলেছেন ওসব কথা, আপনি কি সত্যিই মনে করেন যে আমি যা লিখেছি, একটি শব্দ বা বাক্য ভুল লিখেছি? যদি মনে করেন লিখিনি, তবে কি আশংকা জন্মেছিল আপনার, যে, শহরে কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগে যাবে বইয়ের কারণে? কোথাও তো দাঙ্গার আভাস মেলেনি। হাইকোর্ট বইটাকে মুক্ত করে দেওয়ার পর তো বই চলেছে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। কোথাও তো দাঙ্গা লাগেনি। কোনও একজন মুসলমানও তো আপত্তি করেনি। বইটি নিষিদ্ধ করার কারণ দেখাতে গিয়ে বলা হয়েছিল, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হবে। দুটো সম্প্রদায়ে নাকি দাঙ্গা লাগবে। পরে হাইকোর্টে এই কারণটি উড়িয়ে দেওয়া হয় এই বলে যে, দুটো সম্প্রদায় এখানে জড়িত নয়। তখন নিষিদ্ধ করার পক্ষে আপনি নতুন কারণ দেখালেন যে, বইটি মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেবে। তিনজন বিচারক রায় দিলেন বইয়ের নিষেধাজ্ঞার বিপক্ষে। না, বুদ্ধবাবু, সবিনয়ে জানাই, রায় আমার দেওয়া নয়। নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে মামলাও, আমার নয়, কলকাতার একজন মানবাধিকার কর্মীর রুজু করা। আপনি আমার বই নিষিদ্ধ করেছেন, তারপরও আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা কিছু কমেনি। চেষ্টা করেছি আপনার সঙ্গে দেখা করতে, সম্ভব হয়নি। আপনার কাছে পৌঁছোনোর সব দরজা জানালা আপনি বন্ধ করে রেখেছেন। আপনার যাঁরা কাছের মানুষ, যাঁদের সঙ্গে আমারও যোগাযোগ ছিল, তারাও দূরে সরে গেলেন হঠাৎ। তারপরও বিশ্বাস হারাইনি আপনার ওপর থেকে। ‘ভালো ছবি’ নামে একটা সিনে ক্লাব গড়ে তুলেছিলাম, ইচ্ছে ছিল বিদেশ থেকে সংগ্রহ করা আমার ভালো ভালো সব ছবি কলকাতার মানুষকে দেখাবো। নন্দনে দেখাতে পারবো, এরকম একটি আশ্বস অংশু সূরের কাছ থেকে পেয়ে পৃথিবীর প্রায় দু’হাজার শ্রেষ্ঠ ছবি যোগাড় করে দেখলাম, নন্দনে আমি নিষিদ্ধ। আমি বোকার হদ্দ, অনেক পরে ধীরে ধীরে বুঝেছি আমি মানুষটাই আসলে নিষিদ্ধ সব সরকারি জায়গায়। সরকার আয়োজিত কোনও উৎসব অনুষ্ঠানে যাওয়ার অধিকার আমার নেই, অংশ নেওয়ার তো প্রশ্ন ওঠে না। কী ভীষণ একা হয়ে গেলাম।

এত ঘৃণা কেন আমার প্রতি আপনার? আমি ইসলাম ধর্ম নিয়ে লিখেছি বলে? আপনি সত্যি করে বলুন তো আপনি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করেন? ইসলাম গেল ইসলাম গেল বলে যারা চেঁচাচ্ছে, আমার মুন্ডু চাইছে, কুশপুত্তলিকা পোড়াচ্ছে, আমাকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেবার কথা বলছে, তাদের কি ভালো লোক বা সৎ লোক বলে আপনার মনে হয়? তাদের দাবিকে ন্যায্য দাবি বলে আপনি মনে করেন? যদি তা না মনে করেন, তা হলে বলছেন না কেন? হিন্দু মৌলবাদীরা অন্যায্য দাবি করলে, রামসেতু নিয়ে লাফালে আপনি তো পছন্দ করেন না। ওদের চেঁচামেচিকে নির্দ্বিধায় বলেন, ধর্মীয় উন্মাদনা। মুসলমান মৌলবাদীদের সামনে আপনি নাকি আমাকে ‘বাজে মহিলা’, ‘হরেবল উওম্যান’ বলেছেন, এবং আমাকে রাজ্য ছাড়া করবেন বলে ওদের কথা দিয়েছেন। বিশ্বাসে, আদর্শে, চেতনায় আমি তো ভেবেছিলাম আমি আপনার কাছের মানুষ, কিন্তু আশ্চর্য আপনি তাদের আপন মনে করেছেন, যারা সমাজটাকে অন্ধকারে ছুঁড়ে ফেলতে চায়, যে অন্ধকারে মেয়েরা নির্যাতিত হচ্ছে দিনের পর দিন, যেখানে সত্য এবং সাম্যের পক্ষে মুখ খোলা নিষেধ।

কী অন্যায় করেছি আমি, আমার কী অপরাধের শাস্তি আপনি আমাকে দিলেন, খুব জানতে ইচ্ছে করে আমার। আপনার দলের পত্রিকা এবং বন্ধুর পত্রিকায় আমাকে বছরের পর বছর যা তা ভাষায় গালি দেওয়া হচ্ছে। আমার সম্পর্কে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা লেখা হচ্ছে। দেখেও বছরের পর বছর মুখ বুজে থেকেছি। পথে প্রান্তরে সিঙ্গুর নিয়ে, নন্দীগ্রাম নিয়ে, রিজওয়ান নিয়ে মানুষ প্রতিবাদ করছে, কোনওদিনও কিছু বলতে পারিনি, লিখতে পারিনি। এদেশি লোক নই, এদেশি রাজনীতি নিয়ে আমার মুখ খোলা নাকি উচিত নয়। বন্ধুরা বলেছে, আমি পথে নামলেই আপনি আমার ওপর প্রতিশোধ নেবেন, পশ্চিমবঙ্গে আমাকে আর থাকতে দেবেন না। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করা আমার স্বভাববিরুদ্ধ, তারপরও আমি নির্লজ্জের মতো মুখ বুজে থেকেছি। হাঁ, পশ্চিমবঙ্গে থাকাটা আমার জন্য ভীষণ জরুরি বলে মুখ বুজে থেকেছি। আজ যদি বাংলাদেশ আমাকে দেশান্তরী না করতো, বাংলাদেশে বাস করা আমার পক্ষে সম্ভব হত, তাহলে ওখানেই থাকতাম। এখানে বাস করতে চাইতাম না। এগারো বছর আমি ইওরোপের এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরেছি। কোথাও মন বসাতে পারিনি। কোনও দেশকেই নিজের দেশ বলে মনে হয়নি আমার। ওসব দেশে আমাকে যথেষ্ট সম্মান করা হয়েছে, বাক স্বাধীনতা নিয়ে কোনওদিন কোনও শর্ত দেওয়া হয়নি, আশ্রিত বলে আমাকে সংযত হয়ে কথা বলতে বলেনি কেউ, তারপরও আমি আমার নিজের দেশে চলে যেতে চেয়েছি, নিজের বাবা মা, ভাইবোনের কাছে ফিরতে চেয়েছি, বন্ধুদের কাছে ফিরতে চেয়েছি। নির্বাসন জীবন শুরুর পর ইওরোপে বসে বসে হতাশায় ভুগতে ভুগতে বাংলাদেশের দরজায় কড়া নেড়ে বিফল হয়ে ভারতের দরজায় কড়া নেড়েছি। ভারত খুলেছে দরজা, তবে ছ’ছটি বছর নিয়েছে দরজা খুলতে। অল্প যে-কদিনের জন্য অনুমতি দেওয়া হত ভারত ভ্রমণের, সে কদিনই এসে থেকে যেতাম পশ্চিমবঙ্গে। প্রাণ ভরে দেশের স্বাদ নিতাম। ওপার থেকে আত্মীয়স্বজন আসতো এপারে আমার সঙ্গে দেখা করতে। ভারতে বাস করার অনুমতি বছর তিন আগে মিলেছে, মেলার পর এক মুহূর্ত দেরি করিনি, থাকতে শুরু করেছি। পশ্চিমবঙ্গে বাস করা আমার কাছে পশ্চিমবঙ্গে বাস করা কখনও ছিল না।

বছর তিনেক কলকাতায় বাস করছি। কারও তো অনিষ্ট করিনি। নিজের ঘরে বসে নিজের লেখালেখি করি, কিছু বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়। কারও সাতে নেই, পাঁচে নেই। রাজনীতি বুঝিও না। রাজনীতি থেকে সহস্র মাইল দূরে থাকি। আমার শান্তশিষ্ট জীবন কার বাড়া ভাতে ছাই দিল? পশ্চিমবঙ্গের ঘরটি আমার কাছে শুধু ঘর ছিল না। ঘরের চেয়েও অনেক বড়। আমার নিজের যে একটি ঘর ছিল বাংলাদেশে, যে ঘরটি ছেড়ে আমাকে নির্বাসিত হতে হয়েছিল, সেই ঘরটি আমি প্রাণপণে ফিরে পেতে চেয়েছিলাম। অপেক্ষার প্রহর গেছে কেবল সেই স্বপ্নের কাছে যেতে। সেই ঘর, সেই স্বপ্ন, ভিন্ন ভাষা আর ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে পাওয়া যায় না। সেই ঘরটি, নিজের সেই ঘরটি, আমার দীর্ঘ এগারো বছরের পথে পথে ঘোরার ক্লান্তির পর পেয়েছিলাম কলকাতায়, পশ্চিমবঙ্গে, আমার বাংলায়। বাংলাকে আমি কোনওদিনই ভাগ করে দেখিনি, তাই পেরেছিলাম অত দ্রুত পশ্চিমবঙ্গকে নিজের দেশ করে নিতে, কলকাতাকে নিজের শহর করে নিতে। পশ্চিমবঙ্গের ঘর শুধু ঘর ছিল না, বহুকালের হারানো স্বপ্ন ফিরে পাওয়া ছিল। নিজের যে ঘরটি যে স্বপ্নটি আমাকে ত্যাগ করতে হয়েছিলো, সে ঘরটি ফিরে পাওয়া, সেই স্বপ্নকে ফিরে পাওয়া, সেই নিশ্চিন্তিটি, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। দীর্ঘ বছরের সাধনার পর সাধের ধন ফিরে পাওয়া। আমার মা খুব চেয়েছিলেন দেশের মেয়ে দেশে ফিরে আসি। বিদেশে আমার বিষণ্ণ পড়ে থাকা দেখে তিনি কাঁদতেন। চেয়েছিলেন যে করেই হোক যেন নিজের বাড়িঘরে, নিজের আত্মীয় বন্ধুদের নিয়ে থাকি। মার সেই স্বপ্ন সফল হয়নি, শত চেষ্টা করেও আমি দেশে ফিরতে পারিনি। কিন্তু বেঁচে থাকলে মা নিশ্চয়ই অন্তত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেন এই ভেবে যে, অন্তত বাঙালির মধ্যে আছি, দেশ না হলেও দেশের মতো জায়গায় আছি।

নিশ্চিন্তে নির্বিয় ছিলাম কলকাতায়। হঠাৎ হায়দারাবাদে আমার ওপর মৌলবাদীদের আক্রমণ হল। সাধারণ মানুষ সহানুভূতি প্রকাশ করলো। না, বুদ্ধবাবু, আপনি ফিরেও তাকালেন না। আমি মার খাই, কী মরে যাই, তাতে আপনার কিছু যায় আসে না। একটিবার বললেন না হায়দারাবাদে যা হয়েছে, তা হওয়া উচিত হয়নি। না, বুদ্ধবাবু, হায়দারাবাদের অনুষ্ঠানে ধর্ম নিয়ে আমি একটি শব্দও উচ্চারণ করিনি। তারপরও অসভ্য ঘটনাটি ঘটেছে। ঘটিয়েছে মৌলবাদীরা। এই ঘটনার পর কোথায় আমি সহানুভূতি পাবো, তা নয়, এই আপনারই শহরে, ধর্মতলার মোড়ে আমার মাথার দাম ঘোষণা করলো ক’জন মৌলবাদী। না, তাদের কাউকে আইন অমান্যের দোষে গ্রেফতার করা হয়নি। ওরকম ফতোয়া পেয়ে আমার অভ্যেস আছে। জীবন তো আমার কখনও কোনওদিন মসৃণ ছিল না। সইতে হয়েছে মৌলবাদীদের অনেক হুমকি, অনেক ফতোয়া, অনেক নির্যাতন, অনেক নিষেধাজ্ঞা। জীবন আমার এরকমই। ফতোয়ায় ভয় পাইনি। আপনি অনুগ্রহ করে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছেন, তাই দুশ্চিন্তা কখনও ছিল না। আর, সত্যি কথা কী, আমার মনে হয়নি কলকাতায় আমাকে কেউ মেরে ফেলবে। নিরাপত্তা রক্ষীদের বিদেয় করে কত আমি গড়িয়াহাটে, যদুবাবুর বাজারে একা একা বাজার করেছি, ভিড়ের রাস্তায় একা একা হেঁটেছি। কই, কখনও তো কেউ মারতে আসেনি। যারা এসেছে, ভালোবেসে কাছে এসেছে।

এমন জীবনে হঠাৎ দেখি আমাকে বলা হচ্ছে ঘরের বাইরে আর বেরোনো চলবে না। কেন, বাইরে কী? নিরাপত্তা রক্ষীরা বলেন, ওপর থেকে অর্ডার পেয়েছেন ওরা, আমার বাইরে যাওয়া সম্পূর্ণই বন্ধ। রাস্তাঘাটে বাজার হাটে তো নয়ই, কারও বাড়িতেও নয়। নিভৃতে, কেউ জানবে না, তাও নয়। এমনকী দু’গাড়ি নিরাপত্তা রক্ষী নিয়েও বেরোনো যাবে না। পায়ে যে আসলে শেকল পরানো হচ্ছে, বুঝিনি। ভেবেছিলাম, সত্যি বুঝি ঘরের বাইরে আমাকে মেরে ফেলার ফাঁদ পাতা আছে। প্রসূন মুখার্জি যেদিন বাড়ি এসে দু’ঘণ্টা কথা বলেছেন, বুঝিয়েছেন, আমি বাইরে বেরোলেই আমাকে মেরে ফেলা হবে, উন্মত্ত ধর্মান্ধরা সব ধেয়ে আসবে আমার বাড়িতে আমাকে মেরে ফেলতে, এবং আমার জন্য কিছুতেই এই কলকাতায়, এই পশ্চিমবঙ্গে থাকা নিরাপদ নয়, আমি যেন চনে যাই, চলে যাই ইওরোপ আমেরিকায়, চলে যাই সিঙ্গাপুর থাইল্যান্ডে, চলে যাই কেরালা বা মধ্যপ্রদেশ, কোথাও, যেন কিছুতেই পশ্চিমবঙ্গে না থাকি, থাকলে রায়ট লেগে যাবে–সেদিনও বুঝিনি আসলে আতঙ্ক সৃষ্টি করে আমাকে দেশ থেকে বা রাজ্য থেকে বের করাই আসল উদ্দেশ্য। আমার নিরাপত্তার কথা ভেবে কিছুই করা হচ্ছে না। এরপরও প্রসূনবাবু ফোন করে করে চলে যাবার কথা বলতেন। হুমকির মতো শোনাতো তার কথা। শেষ ফোনটি যেদিন করেছিলেন আমাকে, নিজেই বললেন, সিএম বলেছেন আপনাকে অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল চলে যেতে। উনি কেরালায় সব ঠিকঠাক করে ফেলেছেন। ওখানে সরকারের সঙ্গে কথাও হয়েছে সিএমের। ওখানে আপনাকে সিকিউরিটি দেওয়া হবে।

আমি, বিশ্বাস করুন বুদ্ধবাবু, বিশ্বাস করতে পারিনি আপনি প্রসূন মুখার্জিকে পাঠাতেন, আমাকে বুঝিয়ে, না বুঝলে ভয় দেখিয়ে, নানা কায়দায় আতংক সৃষ্টি করে, আমাকে দেশ ছাড়া, নয়তো রাজ্য ছাড়া করতে। আমি বলেছিলাম আমাকে যে এই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নিরাপত্তা দিতে পারছে না, আমাকে যে অন্য রাজ্যে চলে যেতে বলা হচ্ছে, মানুষ জানুক তা, কারণ কেরালায় গেলে ওখানেও তো হানা দিতে পারে আততায়ীরা। কী ভরসা আছে বাঁচবো আমি! আমি যে কেরালায় নিজের ইচ্ছেয় মরতে যাইনি, তা আমি তাহলে বলি সবাইকে। প্রসূন মুখার্জি বললেন, না, যেন গোপনে চলে যাই, যেন ঘুণাক্ষরেও কাউকে এসব না জানাই। শুধু প্রসূনবাবুকে দিয়ে নয়, আপনি আপনার দু’একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের দিয়েও, যাদের আমি শ্রদ্ধা করি, বলিয়েছেন চলে যেতে। অন্যায় করেছি আমি, আপনার আদেশ আমি মানিনি, আমি কলকাতা ছেড়ে কোথাও যাইনি। যাইনি কারণ আমি ভেবেছিলাম আপনি আমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত, তাই আমাকে চলে যেতে বলছেন। শহর শান্ত, নিরাপত্তার অভাব কী করে হবে, ভেবে পাইনি। তারপর তো শহর একদিন অশান্ত হল। অশান্ত হওয়ার কথা ছিল না, কিন্তু হল।

আপনি আমাকে কলকাতাতেই শাস্তি দিয়েছেন। ঘর থেকে এক পা বার হওয়াও নিষেধ আমার জন্য। পাগল হয়ে যেতাম। বিশ্বাস করুন বুদ্ধবাবু, আমি পাগল হয়ে যেতাম। ঠিক আমার জায়গায় নিজেকে ফেলে দেখেছেন কেমন লাগে? ধরুন আপনাকে যদি ওভাবে বন্দি করে রাখা হত, যে বন্ধুদের আপনি কাছে পেতে চাইতেন, দেখতেন তারা আর আসছে আপনার কাছে, কারণ আপনার দরজায় যে পুলিশেরা বসে, সেই পুলিশেরা যারাই আসতো আপনার সঙ্গে দেখা করতে তাদের নাম ঠিকানা লিখে রাখতো, কবে আবার কী না কী হয়, এই ভয়ে যদি বন্ধুদের আসা বন্ধ হয়ে যেত এবং আপনি একা বসে থাকতেন ঘরে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, কেমন লাগতো? আপনার নিশ্চয়ই শ্বাসকষ্ট হত। একটা ঘরের দরজা যখন বাইরে থেকে বন্ধ থাকে, এবং কোনও শক্তি থাকে না, উপায় থাকে নাসেই দরজা খোলার, তখন নিশ্চয়ই মৃত্যুময় নিস্তব্ধতা ঘিরে থাকে চারদিক, অসহায়তা আর হতাশা ডুবিয়ে নিতে থাকে অদ্ভুত অন্ধকারে। আমার জন্য খুব গোপনেও কি আপনার একবার দুঃখ হয়নি?

প্রসূনবাবু পুলিশ কমিশনারের পদ থেকে চলে যাবার পর আমাকে গৃহবন্দি করা, ভয় দেখানো, হুমকি দেওয়ার দায়িত্ব পড়লো নিরাপত্তা প্রধান বিনীত গোয়েল বাবুর ওপর। উনি প্রায়ই ফোন করতেন। কেরালা বা মধ্যপ্রদেশে বা বিদেশে অজানা কোথাও উনি আমাকে ফেলে দেননি। উনি প্রথম থেকেই বলেছেন জয়পুর যেতে। জয়পুরে আমার জন্য সব আয়োজন থাকবে, একটা চমৎকার রিসর্ট থাকবে, কুক থাকবে, আমি ওখানে দু’দিন যেন থেকে আসি, যাওয়ার ব্যবস্থা উনি নিজেই করবেন। কেন যাবো, কারণ এখানে এই কলকাতায় মুসলিম মৌলবাদীরা আমাকে মেরে ফেলবে। বাঁচার জন্য যেতে হবে জয়পুর। একে গৃহবন্দি, তার ওপর যারা আমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করছেন, তাঁরা বারবারই আমাকে জানাচ্ছেন যে আমি যদি সরকারের উপদেশ না মানি, নিজ দায়িত্বে কোথাও চলে যেতে পারি। জয়পুর কেন, পরে আমি বুঝতে পারলাম যখন সন্দীপ ভুটোরিয়া আমাকে ফোন করতে শুরু করলেন। বিনীত গোয়েলের হয়ে অতপর সন্দীপ ভুটোরিয়ার কাজ আমাকে বোঝানো, যেন জয়পুর চলে যাই। ওখানে থাকার সব বন্দোবস্ত তিনিই সব করে দেবেন। যেন একটুও দুশ্চিন্তা না করি। ক’দিন কাটিয়ে পরিস্থিতি একটু শান্ত হলেই ফিরে আসতে পারবো। প্রসূনবাবু আমার চেনা এমন কাউকে খুঁজে পাননি, যাকে বিশ্বাস করে অন্য রাজ্যে পাড়ি জমাতে পারি। বিনীত গোয়েল আগে লোক খুঁজেছেন, পেয়েছেন, তারপর আমাকে পার করতে নেমেছেন। অন্য রাজ্যে আমি কী করে যাবো, কোথায় থাকবো, নিরাপত্তার ব্যবস্থা কী, এসব ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিতে বিনীত গোয়েল এবং তাঁর বন্ধু, আমার চেনা পরিচিত সন্দীপ ভুটোরিয়া লেগে রইলেন। আমি কী যে ভুল করছি, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পড়ে রয়েছি কলকাতায়। মাথায় এক ছটাক বুদ্ধি থাকলে, মোদ্দা কথা প্রাণে বাঁচতে চাইলে জয়পুরে চলে যেতাম, ক্রমাগতই বলে চলেছেন দুজন।

যে পনেরো নভেম্বর তারিখে সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীদের ‘বনধ’ পালন হওয়ার কথা, এবং সেই ভয়ে আগে থেকেই পুলিশ কর্তারা আমাকে দেশ বা রাজ্য ছাড়ার জন্য বলতেন, সেই পনেরো নভেম্বরে বনধ তো হলই না, একটা মিছিল হল শুধু, অথচ ভোর পাঁচটায় আমাকে তড়িঘড়ি বের করে রাসবিহারী অ্যাভিয়ে ডলি রায়ের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। ওখানে আমাকে একা রেখে পুলিশরা সবাই চলে গেল। কোথায় গেল? খবর নিয়ে দেখি সবাই পুলিশ অফিসে গিয়ে খামোকা বসে আছে। শেষ বিকেলে বিনীত গোয়েলকে ফোন করেছিলাম জানতে কখন বাড়ি ফিরবো। ভীষণ ক্রুদ্ধ তিনি আমার ওপর, বললেল, কখন বাড়ি ফিরবেন তার আমি কী জানি? তাঁর রাগ, আমি জয়পুর যাইনি, তার জয়পুরী দূতকে বারে বারেই ফিরিয়ে দিয়েছি। আতঙ্কে কেটেছে সারাদিন। আতঙ্ক তৈরি করার চেষ্টা ১৫ নভেম্বরের আগেই শুরু হয়েছিল যখন আমার বাড়িতে নিরাপত্তারক্ষী কমিয়ে দেওয়া হল। কী, না, যারা বাড়ির সামনে বসে, তারা এখন থেকে পুলিশ অফিসে বসবে। কেন পুলিশ অফিসে? না, এমনি। ১৫ নভেম্বরে মিল্লি ইত্তেহাদ পরিষদের অর্থাৎ সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীদের পথ অবরোধ বিকেলে। ইস্যু নন্দীগ্রাম, রিজওয়ান, সাচার কমিটির রিপোর্ট, আমি। টেলিভিশনে দেখি আমার বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে নয় ধর্মান্ধগুলো আমার কুশ পুতুল পোড়াচ্ছে। উন্মত্ত ধর্মান্ধতা আমার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে, ভয় সত্যিই হল। সাদা পোশাকের যে পুলিশরা আগস্ট মাসের ন’তারিখ থেকে আমার বাড়ির সামনে ছিল, তারা তখন সবাই বসে আছে অফিসে। যে দিনটায় তাদের থাকার কথা সবচেয় জরুরি, সে দিনটাতেই ওরা নেই। আমি ওদের অনুরোধ করলাম আসতে। ওরা এলো। কিন্তু মিনিট পনেরো থেকে চলেও গেল। কুশ পুতুল পোড়ার আগুন নেভেনি তখনও।

একুশ তারিখে কিছু হওয়ার কথা ছিল না, কিন্তু হল। ভেবেছিলাম ইদ্রিস আলীর সংগঠন কী আর এমন করতে পারবে, যখন ১২টা সংগঠনই পনেরাই নভেম্বরে তেমন কিছু গন্ডগোল বাধাতে পারেনি। কিন্তু ২১ তারিখের ভয়াবহ কান্ড টেলিভিশনে দেখে স্তম্ভিত বসে রইলাম। স্তম্ভিত এইজন্য যে, এরা কারা, এরা তো আমার বই পড়ার ছেলে নয়, এরা আমাকে তাড়াতে চাইছে কেন, এদের তো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার কোনও কারণ নেই। দীর্ঘদিন থেকে এদের কি ব্রেইনওয়াশ চলেছে, নাকি কেউ লেলিয়ে দিয়েছে আজ? পেছনে কোনও চক্রান্ত নিশ্চয়ই কাজ করছে। ছেলেরা লুঙ্গি তুলে পুলিশদের পুরুষাঙ্গ দেখাচ্ছে। বিভিন্ন অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করছে। পুলিশ মারার পুলকে একেকজন দিশেহারা। এরা তো আমাকে চেনে না জানে না, কোনওদিন পড়েওনি আমাকে। শুধু কি আমাকে, এরা তো মনে হয় না এদের ধর্মগ্রন্থও কোনওদিন পড়ে দেখেছে! যেহেতু ওরা শুনেছে যে আমি ইসলাম বিরোধী, তাই আমি ইসলাম-বিরোধী, তাই আমাকে দেশ থেকে তাড়াতে হবে, এই দাবি নিয়ে কি পুলিশের দিকে ঢিল ছুড়ছিল, গাড়ি পোড়াচ্ছিল? এদের মুখ দেখে আমার মনে হচ্ছিল, পুলিশের ওপর এদের রাগও প্রচন্ড, রিজওয়ান হত্যার শোধ যেন নিচ্ছিল এরা। না, নন্দীগ্রাম নিয়ে এদের কোনও মাথাব্যথা ছিল বলে মনে হয় না। আমি হিম হয়ে যাচ্ছিলাম দেখে যে পুলিশ নীরব দর্শক হয়ে বসে আছে। পুলিশদের গুলি চালালো না, র‍্যাফ নামলো, র‍্যাফও চালালো না, সেনা নামানো হল, সেনাদেরও বলা আছে। গুলি যেন না ছোঁড়ে কারও দিকে। আমার ধারণা, উন্মত্ত ছেলেগুলো যদি আমার বাড়ির দিকে আসে আমাকে খুন করতে, পুলিশ, র‍্যাফ, সেনা এভাবেই নিশ্ৰুপ বসে থাকবে। নড়বে চড়বে না। ওদের বলে দেওয়া আছে মার খাওয়ার, মার না দেওয়ার।

একুশ তারিখ রাতে বাড়ি এলেন সন্দীপ ভুটোরিয়া। ভক্ত হিসেব দেখা সাক্ষাৎ করেন মাঝে মাঝে। একবার দরিদ্র শিশুদের সাহায্যের জন্য জয়পুরের একটা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, গিয়েছিলাম। রাজভবনে অনুষ্ঠান হয়েছিল। প্রতিভা পাটেল ছিলেন সভানেত্রী, আমি প্রধান অতিথি। সন্দীপের সেই ওই একই কথা। আপনি তো জানেন জয়পুরে আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি, আপনি নামবেন জয়পুরে, সরকারকে ওখানে সব বলে রাখা আছে, আপনাকে প্রটেকশন দেবার সব ব্যবস্থা পাকা, আপনি কদিন একটু বেড়াতে যাবেন। খাবেন, দাবেন, ঘুরবেন, একটু বেড়িয়ে আসুন। এখানে যে কোনও মুহূর্তে এরা মেরে ফেলবে। এত বোকার মতো কাজ কেন করছেন। সন্দীপকে সোজা বলে দিই, স্পষ্ট বলে দিই, আমি যাবো না কোথাও।

পরদিন টিভিতে সকাল থেকেই দেখাচ্ছে পার্কসার্কাস মোড়ের লোকদের। কেউ কেউ বলছে, ‘আমি তসলিমাকে খুন করবো, এতে যদি আমার প্রাণ যায় যাবে। কী ভীষণ বর্বরতা আর হিংস্রতা কণ্ঠস্বরে ওদের। দুপুরে কথা হল বিনীত গোয়েলের সঙ্গে। কাল শুক্রবার নামাজের পর আমার বাড়িতে আক্রমণ হবে, খবর দিলেন। এরকম হলে চলে যাই সল্ট লেক বা বেলঘরিয়া, বা বেহালা বা গোলপার্ক, বা এরকম কোনও জায়গায়, আমি বললাম। না, ওসব জায়গায় সিকিউরিটি ছাড়া থাকতে হবে। সিকিউরিটি থাকলে তোক জেনে যাবে। সিকিউরিটি ছাড়া থাকা তো নিরাপদ নয়, ইন কেইস। না সে দায়িত্ব আমরা নিতে পারবো না। বিনীতবাবুর সাফ কথা, আমাকে বাঁচতে হলে জয়পুর যেতে হবে। তিনি সব ব্যবস্থা পাকা করে রেখেছেন। জয়পুর না গেলে বাঁচবো না, আমার জন্য বাঁচার কোনও রাস্তা খোলা নেই এই শহরে। আগামিকাল জুম্মার নামাজ, নামাজ শেষে মুসলমান মৌলবাদীরা, একুশ তারিখের বিজয়ী উন্মত্তরা বেরিয়ে পড়বে, গত চারমাস ধরে ভয় আর আতঙ্ক আমার ভেতর জোর জবরদস্তি করে ঢোকানোর চেষ্টা করে অবশেষে সফল হলেন বিনীতবাবু। আতঙ্ক আমার সর্বশরীরে, বেঁচে থাকতে হবে, লিখতে হবে, তাহলে দুদিনের জন্য যাই জয়পুর। তক্ষুনি একটা সাদা অ্যামবাসাডার পাঠালেন তিনি, যেন ঝড়ের মতো উড়ে এলো গাড়ি। কেবল ল্যাপটপটা নিলাম, আর কিছু নেওয়ার সময় হল না। পুলিশের লোকেরা হাতে টিকিট দিলেন বিমান বন্দরে। এভাবেই কলকাতা আমাকে গুডবাই জানালো। স্টালিন বুঝি এভাবেই মানুষকে গুলাগ পাঠাতো। স্টালিন তাদেরই পাঠাতো, যারা কট্টর স্টালিন বিরোধী ছিল। কিন্তু আমি তো বুদ্ধবিরোধী ছিলাম না।

তারপর তোজয়পুরে পৌঁছে বুঝলাম, বিনীতবাবু এবং তার জয়পুরী দূত যা বলেছিলেন সব ভুল। জয়পুরের পুলিশদের বলা হয়েছে আমি কোনও এক সাহিত্য অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছি, আমাকে একটি সস্তা হোটেলে তোলা হল, ওই হোটেল বিনীত গোয়েল আর জয়পুরী দূত কলকাতা থেকেই ঠিক করে রেখেছেন। গভীর রাতে পুলিশ আমাকে জানিয়ে দিল যে আমাকে রাজস্থান থেকে চলে যেতে হবে, কারণ ল এন্ড অর্ডার প্রবলেম শুরু হবে বা শুরু হয়ে গিয়েছে। গা হিম হয়ে গেল। ঠিক আছে, কলকাতায় চলে যাবো। কিন্তু দেখি ভোরবেলা আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এয়ারপোর্টে নয়, কলকাতার পথে নয়, দিল্লির পথে। উড়োজাহাজে নয়, গাড়িতে। কেন, সে পরে জেনেছি, রাজস্থানে যেমন আমাকে লাথি দিয়ে ফেলা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ থেকে, তেমনি রাজস্থান থেকেও একই রকম লাথি দিয়ে আমাকে পশ্চিমবঙ্গে ফেলতে চেয়েছিল রাজ্যসরকার। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ জানিয়ে দিয়েছে, বল যেন তার এলাকায় এসে না পড়ে। বল তারা চায় না। অতএব ডাম্প করতে দিল্লি, কেন্দ্র। কোনও নো ম্যানস ল্যান্ডের দিকে, উদ্বাস্তু, রাজ্যহারা, এতিম, অনাথ, অসহায়কে নিয়ে চললো পুলিশ। বসে আছি পথ চেয়ে, কবে ফিরবো কলকাতা। আপনি যদিও জানিয়ে দিয়েছেন যে আপনি কিছু জানেন না আমার বিষয়ে, জানে কেন্দ্র, সিদ্ধান্ত নেবে কেন্দ্র। আসলে কিন্তু কেন্দ্রকে নিজের সিদ্ধান্তটি আপনি দিয়েই রেখেছেন, আপনি আমাকে চাননা কলকাতায়, চাননা পশ্চিমবঙ্গে।

লোকে বলে, আপনার ভয়, আমি পশ্চিমবঙ্গে বাস করলে আপনি মুসলমান ধর্মান্ধদের সমর্থন পাবেন না, না পেলে পুরো মুসলমান জাতটারই ভোট পাবেন না। তাই আমাকে তাড়িয়ে দিয়ে ভোট নিশ্চিত করেছেন। ধর্মান্ধতা ঘোচানোর জন্য আমি লিখি, আপনি আমাকে সমর্থন না করে সমর্থন করলেন উন্মত্ত ধর্মান্ধতাকে। ওদের জিতিয়ে দিলেন। ওরা কি আপনাকে ভালোবাসে বলে আপনি মনে করেন? ওরা কি নিজেরাই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতো আপনার মুণ্ডু চাইবে না একদিন?

কলকাতায় বাড়িঘর পড়ে আছে, আমার লেখালেখি সব পড়ে আছে। সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন আমি, নিজের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন, আমি ঠিক কোথায় আমি জানি না। এখানে আপনার অনুমতির অপেক্ষায় কত দিন বসে থাকতে হবে আমি জানি না। আপনি কবে আমাকে বাড়ি ফিরতে অনুমতি দেবেন জানি না। হতাশায়, অনিশ্চয়তায়, অস্থিরতায় আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমার রক্তচাপ বাড়ছে, প্রচন্ড উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা আমাকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করছে। আপনি খুশি হবেন, তাই আমি আপনার চক্ষুশূল ওই ‘দ্বিখন্ডিত বইটির যে লাইনগুলোকে সহ্য করতে পারতেন না, তুলে নিয়েছি। না, মৌলবাদীদের ভয়ে আমি আমার লেখা তুলে নিইনি। আমি ভয় করেছি আপনাদের, ভয় করেছি সেকুলার এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোকে, ভয় পেয়েছি আশ্রিতের জন্য যে ধর্ম বেঁধে দেওয়া হয়েছে, সেটিকে। ভয় পেয়েছি অগুনতি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের ভয়াবহ মুখ বুজে থাকাকে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা আমার নিজের দেশে ছিল না বলেই তো আমি আজ নিজের দেশের বাইরে, এখানে আমি সেই অধিকার পাবো বলেই তো আজ আমি এখানে। একটি গণতন্ত্র যদি আমাকে অধিকারটি না দেয়, কে দেবে? আমাকে যে মুখ বুজে থাকতে বলা হল, আমাকে যে বাধ্য করা হল নিজের লেখাকে অস্বীকার করতে, নিজের বই ছিঁড়ে ফেলতে, এ কার অপমান? আমার?

বুদ্ধবাবু, আমার বিশ্বাস হয় না আমার কারণে আপনার দলের ভোট পাওয়ায় কোনও হেরফের হবে। আপনার দল খুব শক্তিশালী দল। ভয় পাবেন না, আপনার দল যে কোনও নির্বাচনেই জিতে যাবে। তারপরও যদি আপনার বিশ্বাস হয়, যে, আমাকে তাড়িয়েছেন বলে দুটো ভোট আপনার বেশি হতে যাচ্ছে, তাহলে সেই ভোট আপনার নির্বিঘ্নে জুটুক, আপনার আরাম হোক। ভোট শেষ হলে, আপনি বিজয়ী হলে আমাকে আমার ঘরে ফিরতে দেবেন তো! অপেক্ষা করছি আপনার অনুমতির। কোনও ক্ষতি আমি আপনার করিনি। করতে চাই না। আমাকে শুধু নিরুপদ্রব নিজের লেখালেখি নিজের মতো করতে দিন। আমি আপনার শত্রু নই। শত্ৰু তারা, ওই মৌলবাদী, যাদের বন্ধু বলে জড়িয়ে ধরেছেন আপনি, সমাজকে অন্ধকার আর কুসংস্কার আর ভয়াবহ সংকীর্ণতা দিয়ে গ্রাস করতে চাইছে, এ আপনি জানেন না, আমি বিশ্বাস করি না।

আপনি যদি বিশ্বাস করেন সত্যিকার সেকুলারিজমে, সমতায়, সততায়, সাহসে, তবে আমাকে বন্ধু বলে মনে করতে আপনার তো অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। ভোটই জগতের এবং জীবনের শেষ কথা নয়। মানবতা বলে একটি কথা আছে, আদর্শ বলেও একটি কথা আছে। সেসব খুইয়ে ফেললে কী আর থাকে। জেতে তো কত রাজাই। রাজারা সিংহাসন থেকে আবার কখনও কখনও খসেও পড়ে। রাজা কতদিন সিংহাসনে ছিল, তা দিয়ে রাজার চরিত্র বিচার হয় না। রাজার কাজ দিয়েই রাজার চরিত্র বিচার হয়।

তসলিমা

.

১০ ডিসেম্বর

‘তসলিমাকে এভাবে আটক করে রাখাটা ভারতের মতো একটি দেশের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাহানিকর। সাম্প্রতিককালে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার সঙ্গে তুলনা করলে বলা যায় এই ঘটনা আমাদের খুব ছোট করে দিয়েছে।.. Taslima has suffered too much and has gone through prolonged distress and agony. This must be brought to an end without delay. She should also, without much ado, be allowed to return to Kolkata, her preferred place for stay. Moreover, she should be granted Indian citizenship before her current visa expires so that her creative work does not suffer and she is never again rendered fugitive and stateless. The award of citizenship would also make it easier for her to protect her rights. In urging this, I am not alone; hundreds of millions of Indians desire likewise.’

-Muchkund Dubey

আজ মানবাধিকার দিবস। দীর্ঘ দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলছি জীবনের কথা ভেবে। দীর্ঘ তেরো বছরের নির্বাসন জীবন আমার। আজও নিজের দেশ বাংলাদেশে যাওয়ার এবং বাস করার কোনও অধিকার আমার নেই। কী কারণে বাংলাদেশ সরকার আমার নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন করছে, তা কোনওদিনই আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি।

আজ মানবাধিকার দিবস। আমি পড়ে আছি প্রিয় বাংলা থেকে শত শত মাইল দূরে অজানা একটা ঠিকানায়। পূর্ববঙ্গও নির্বাসন দিল, পশ্চিমবঙ্গও পাঠালোনির্বাসনে। বাংলায় আমার ঠাঁই নেই। আমি কোথায় আছি তা কেউ জানবে না, তা কারও জানার নিয়ম নেই। কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। আমিও কারও সঙ্গে দেখা করতে পারবো না।

একা একা সকাল হয়। একা একা দুপুর, বিকেল। একা একা রাত হয়। মানবাধিকার দিবস জুড়ে বসে থাকি এক জীবন অধিকারহীনতা নিয়ে। অসহায়। অনাথ। অবলা। হ্যাঁ অবলাই তো। কথা বলার অধিকারও তো আমার নেই। আমি যেন কথা না বলি। কথা বলার অধিকার বা মত প্রকাশের অধিকারকেও তো মানবাধিকার বলে। কথা না বলতে বলতে, মত প্রকাশ না করতে করতে আমার মনে হচ্ছে, আমি ভুলে যাব কথা বলতে। আমি ভুলে যাবো ভাবতে। ভুলে যাবো নিজের কোনও মত যে থাকতে হয়, ভিন্ন মত হলেও যে থাকতে হয়, এবং তা প্রকাশ করতে হয়, তা। ভুলে যাবো মানবাধিকারের মূল অর্থ কী। প্রতি বছর দশই ডিসেম্বর যাবে, আসবে। আমার কিছু যাবে আসবে না।

আজ রাতেই এলেন প্রভু। প্রভু আসা মানে নতুন কোনো খবর আসা। মূলত যা বললেন, তা হল, সুদূর সুইডেন থেকে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন মিস্টার সুয়েনসন, তাঁকে আমার অজ্ঞাত ঠিকানায় আনার কোনও অধিকার আমার নেই, এমনকী আমারও অধিকার নেই তার হোটেলে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করার, যদি দেখা করার অনুমতি প্রার্থনা করে আমি দরখাস্ত করি, এবং যদি ওপরওয়ালা রাজি হন, তবে বড়জোর ঘণ্টাখানেকের জন্য তৃতীয় কোনও জায়গায় দু’জনকেই পৃথক পৃথক ভাবে নিয়ে গিয়ে দুজনের দেখা করাবার একটি ব্যবস্থা করা হবে। এর বেশি কিছু যেন আমি আশা না করি। ওপরওয়ালা এখানে ভগবান জাতীয় কিছু নন, সত্যি বলতে কী, ভগবানের চেয়েও শক্তিমান।

দুনিয়া জুড়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর ব্যক্তিগত স্বাধীনতার আবশ্যকতা নিয়ে বলছি সেই কতকাল, বিভিন্ন মঞ্চে, বিশ্ববিদ্যালয়ে। কত শত মানুষ কত শত দেশে অনুপ্রাণিত হচ্ছে। আর আমাকে কি না কোনো একটা ঘরে আটকে রেখে বলা হচ্ছে, এ করা যাবে না, ও করা যাবে না? যাঁরা আমাকে বন্দি করছেন এবং নানারকম নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করছেন, শেকল পরাচ্ছেন পায়ে, চোখ বেঁধে রেখেছেন কাপড়ে, তাঁরা আদৌ জানেন না আমি কে, কোনোদিন শোনেননি আমার সামান্য ইতিহাস!

আমার তো কলকাতায় থাকার কথা ছিল, সুয়েনসনের কলকাতায় আমার কাছে বেড়াতে আসার কথা ছিল। আমি কলকাতায় থাকলে তো সুয়েনসন নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে আমার কলকাতার বাড়িতে আমার সঙ্গে ক’দিন কাটাতে পারতো। স্টকহোম-কলকাতা টিকিট ছিল তার। তিন চার মাস আগেই করে রাখা টিকিট। আমি দিল্লিতে আছি শুনে কলকাতা বদলে গন্তব্য দিল্লি করে নিয়েছে শুধু। তাকে বলেছি ফোনে, দিল্লিতে আমি অনেকটা গৃহবন্দি অবস্থায় কাটাচ্ছি, তোমার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হবে কি না জানি না। সুয়েনসন খুশি নয় আমার কথায়। তার বক্তব্য, ওঁরা যা বলছেন, তা কেন আমি মেনে নিচ্ছি! কেন আমি যে করেই হোক তাকে আমার কাছে রাখায় যে বাধা তৈরি করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি না! যুদ্ধ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় জেনেও সুয়েনসন টিকিট বাতিল করেনি। সস্তা টিকিট বাতিল করলে টাকা ফেরত পাওয়া যায় না। দিব্যি উড়ে চলে এলো।

আমার এই মানসিক অবস্থায় হাতে গোনা দু’একজন বন্ধুর সঙ্গে আমি যদি দেখা করতে না পারি, তাহলে কী ধরনের জীবন আমি যাপন করবো এখানে, এই অজ্ঞাতবাসে? আমি তো স্বাস বন্ধ হয়ে মারা পড়বো! অন্তত কলকাতার বন্দি জীবনে বন্ধুরা আসতে পারতো আমার বাড়িতে। এখানে তো জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন আমি। প্রভু একসময় যা বললেন, প্রসূন মুখার্জির কথার মতো লাগলো শুনতে, বললেন, ‘এত যখন উনার সঙ্গে দেখা করার আপনার প্রয়োজন, আপনি সুইডেনে গিয়ে দেখা করে আসুন না! তাহলে কি ওঁরা এই-ই চাইছেন যে আমি এ দেশ ছেড়ে চলে যাই?

আহ, আজ তো মানবাধিকার দিবস! প্রভু কি জানেন আজ মানবাধিকার দিবস!

.

১১ ডিসেম্বর

যদি এই কমপিউটারটা না নিয়ে আসতাম আমি, যদি ইন্টারনেট আমার না থাকতো এই কমপিউটারে, আমি বোধহয় নির্ঘাত মারা পড়তাম। দুদিনের জন্য জয়পুর যেতে হচ্ছে, দু’দিন কী আর এমন লিখবো, কী দরকার কমপিউটার নিয়ে। একবার ভেবেছিলাম। পরে আবার ভাবলাম, যদি দু’একটা কবিতাও লেখা হয়। হাতে শুধু কমপিউটার, আর কিছু নেই। এভাবেই বেরিয়েছিলাম ঘর থেকে।

লেখাপড়া আমাকে বাঁচিয়ে রাখছে। যখন রবেন দ্বীপে নেলসন ম্যাণ্ডেলার সেই সেলটা, যেখানে তাঁর সাতাশ বছরের বন্দীজীবনের আঠারোবছরই কাটাতে হয়েছিলো, দেখেছিলাম, চোখের জল রোধ করতে পারিনি আমি। অবিরল ঝরে যাচ্ছিল। ভাবছিলাম ওই লাইম স্টোন কাটার বাইরে আর কী করতেন তিনি, ছোট্ট একটুকরো ঘরে বই ছিল পড়ার, কাগজ কলম ছিল লেখার! লিখতে পড়তে দিলে অনেক কষ্টই হয়তো ভুলে থাকা যায়।

কলকাতা থেকে প্রায়ই ফোন আসে ওখানকার বাংলা কাগজে আমার সম্পর্কে কারও যদি খুব ভালো কোনও লেখা থাকে, পড়ে শোনানোর জন্য। এনামুল কবীর আজকাল ফোনে এই পড়ে শোনানোর কাজটা করছেন। সকালে বর্তমান পত্রিকার উপসম্পাদকীয় পড়ে শোনালেন। সুখরঞ্জন দাশগুপ্তের লেখা। লেখক ইতিহাস থেকে নমুনা এনে এনে দেখিয়েছেন রাজনৈতিক আশ্রয় যে দেওয়া হয়েছে ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে কত মানুষকে, কখনও শর্ত আরোপ করা হয়নি। আমার মতো নিরাশ্রয় লেখককে যদি আশ্রয় দেওয়া হয় তবে তিনি এই গণতন্ত্র, এই ধর্মনিরপেক্ষতা, এই ভারত, ভারতীয় জাতকে শত ধিক দিয়েছেন। সুখরঞ্জন দাশগুপ্তের সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। অপরিচিত অচেনা কত কত মানুষ যে দাঁড়িয়েছেন আমার পক্ষে। এখন আমার পক্ষে দাঁড়ানো মানে ভীষণ রকম একটা অন্যায়ের বিপক্ষে দাঁড়ানো।

অরুন্ধতী রায় এসএমএস পাঠালেন কলকাতা থেকে। অ্যাম ইন কলকাতা। এভরিবডি আই মীট ওয়ান্টস ইউ ব্যাক হিয়ার। আই অ্যাম সিওর ইট উইল হ্যাঁপেন। স্টে স্ট্রং। অ্যাম ইন এ ক্রাউড। উইল কল হোয়েন আই ক্যান। সি ইউ। লটস অব লাভ’।

কী যে ভালো লাগে অরুন্ধতীর ওইটুকু লেখা পেয়ে। ওঁর সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে এই ‘সেইফ হাউজে’ ঢোকার প্রথম দিনই। করন থাপরের মাধ্যমেই যোগাযোগ। অরুন্ধতাঁকে সব বলি, সেই শুরু থেকে, হায়দারাবাদ থেকে ফেরার পর আমাকে বাড়ির বাইরে আর বেরোতে না দেওয়া, কলকাতার পুলিশ কমিশনারের আমার বাড়িতে আসা, আমাকে চলে যেতে বলা, ২১শে নভেম্বরের তাণ্ডব, ২২ শে নভেম্বর আমাকে মিথ্যে কথা বলে জয়পুরের উড়োজাহাজে তুলে দেওয়া, সব। অরুন্ধতাঁকে পরে আমার ব্যাপারে কথা বলার জন্য করন থাপর ডেভিলস এডভোকেটে ডাকেন। অসাধারণ বলেছিলেন অরুন্ধতী। আমার ওপর যে অত্যাচার চলেছে, এরকম তাঁর ওপর চললে তিনি লেখালেখি বন্ধ করে দিয়ে অন্য কিছু করতেন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমাকে বের করার কারণ তিনি মনে করেন, সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রামে যে নির্যাতন আর হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ও থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরানো। পার্ক সার্কাসের রাস্তায় একটা মিছিল নামক নাটক করে আমাকে ওই ছুতোয় রাজ্য ছাড়া করা হয়েছে। গ্রামে মুসলমান মরেছে, রিজওয়ান নামের একটা মুসলমান ছেলেও পুলিশের অত্যাচারে মরেছে–এসব খবর বাতাসের আগে রাষ্ট্র হয়েছে। দীর্ঘ বছর ক্ষমতায় থাকা বামপন্থীরা এই প্রথম মুসলমানের ভোট হারানোর ভয়ে কাতর। হাতের কাছে আর কিছু না থাক, আমি আছি। আমার গায়ে ইসলামবিরোধী তকমা আঁটার মতো সহজ কাজ আর কী আছে, আর আমার মতো অসহায় একা একটি প্রাণীকে ঘাড় ধরে বের করে দিলে কার কী এমন ক্ষতি! এতে যদি একটা ছোটখাটো ভোটও কোনও তসলিমা বিরোধী মুসলমান খুশি হয়ে দেয়!

সেই যে তেইশে নভেম্বরের রাতে কথা হয়েছিল ভ’র সঙ্গে, এর পর আর কথা হয়নি। যদিও বলেছিলেন, যখন প্রয়োজন মনে করি, যেন ফোন করি। কিন্তু প্রয়োজন মনে করলেও ফোন করিনি। এত বড় একজন মানুষ, তাঁকে বিরক্ত করতে ইচ্ছে হয় না। আজ তাকে ফোন করার কারণ, সুয়েনসন। সুয়েনসন আমি যেখানে আছি, সেখানে থাকবে দু’সপ্তাহ, এ আমার ইচ্ছে। ভ বললেন একটা যেন দরখাস্ত লিখি। এও বললেন মৌলবাদীরা আমাকেই শুধু অসুবিধে করেনি, তাঁকেও করেছে। কীরকম সেসব, কিছুই বলেননি। অনুমান করি, তিনি আমাকে দেখা শোনা করার ভার নিয়েছেন, আমাকে দেশ থেকে বের না করে উল্টে খাওয়াচ্ছেন, পরাচ্ছেন, এ কারণে তাঁকে তিরস্কার করেছে মুসলমানরা।

কবে ফিরতে পারবো? আমার হঠাৎ প্রশ্ন। কবে ফিরতে পারবোকলকাতায় তার তিনি কিছু বলতে পারলেন না। শুধু বললেন, সবই নির্ভর করে হুজুগের ওপর। যা হয়েছে তা হুজুগে হয়েছে। অন্য একটা হুজুগে লোক যদি আবার মাতে, হয়তো পরিস্থিতি আমার জন্য স্বাভাবিক হবে। তার আগ অবধি আমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাইরে থাকতে হবে, অন্তত থাকাটা উচিত।

ব্রাত্য আমি। আমাকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিচ্ছে না। ব্রাত্য আমি, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আমাকে চাইছে না। কেউ কেউ চাইছে, কিন্তু খুব জোর দিয়ে কেউ চাইছে না। এরকম যে কিছু ঘটতে পারে জগতে, বা ঘটবে কোনওদিন, তা আমার ভাবনার ধারে কাছেও আসেনি কখনও।

.

১২ ডিসেম্বর

দিনগুলো কাটছে। কী করে কাটছে, ঠিক বুঝতেও পারি না। একটা কালো সোয়েটার কিনে দিয়েছে ওরা। ত্বকে খরা পড়েছে। ভেনোসিয়া বলে একটা ক্রিম লাগাতে বলেছেন ত্বক বিশেষজ্ঞ মালাকার। ওরা তাও কিনে দিলো। দুজোড়া মোজাও দিল। সকালে নাস্তা তৈরি, দুপুরে ওই একই ধরনের খাবার, রাতেও তাই। দিন চলে যাচ্ছে, যেমন যায়। খাবারের ডাক পড়ে। খাই। কেন যে খাই, বুঝি না। খুব যে ক্ষিধে পায়, তাও মনে হয় না। অনুভূতিগুলো কেমন যেন ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে মনে হচ্ছে মৃত্যু এসে বসছে আমার শরীরে। ক’দিন আগে চিৎকার করে কেঁদেছিলাম। প্রভুকে বলেছিলাম, বিষ নিয়ে আসুন। প্রভু আমার এই রিকোয়েস্টটিকেও সিরিয়াসলিই নিয়েছেন। এই রিকোয়েস্টটিকেও পুট করেছে নির্দিষ্ট দপ্তরে।

দুতিনটে পাথুরে মুখ আমার সামনে মাঝে মাঝে দেখা যায়। তারা আমাকে নিরাপত্তা দিচ্ছে, নাকি নজরবন্দি রাখছে ঠিক বুঝতে পারি না। গৃহবন্দি এবং নজরবন্দি এই দুই অবস্থার মধ্যে পেণ্ডুলামের মতো আমি ঘুরছি। পাথরগুলোও আমার ধৈর্য দেখে অতিষ্ঠ হচ্ছে। কবে একবার মুখ ফুটে বলবো, ”না আর পারছি না, এ দেশ থেকে চলে যাবো আমি। –তখনই সম্ভবত পাথুরে চেহারায় প্রাণ দেখা দেবে। শুধোবে, কোন দেশ ম্যাডাম? টিকিট কি ইকোনোমি ক্লাস করবো, নাকি বিজনেস ক্লাস?

আমার স্বাসকষ্ট হচ্ছে, কেউ দেখতে পাচ্ছে না। কেউ টের পাচ্ছে না, কেউ শুনতে পাচ্ছে না শ্বাসকষ্টের শব্দ। এই শব্দ কি কেউ কোনওদিন পাবে শুনতে! স্বাসকষ্টের শব্দ মোড়া থাকে নৈঃশব্দে।

জানি না কোন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। জানি না আমি আবার কোনওদিনও ফিরতে পারবো কি না বাংলায়। বাংলা হয়তো একটা স্বপ্ন অথবা দুঃস্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে চিরকাল।

জয় গোস্বামী একটা খুব ভালো লেখা লিখেছেন আমাকে নিয়ে। ওর সঙ্গে কথা বললাম ফোনে। ও বললো, আপনার জন্য আমাদের গর্ব হয়।

অপর্ণা সেন বিকেলে ফোন করলেন। দুঃখ করে বললেন, যারা অপরাধী তাদের শাস্তি দিয়ে নিরপরাধকে শাস্তি দেওয়া হল। হ্যাঁ হল। এই হওয়াটাকে কি মেনে নেওয়া হবে? অবশেষে বললেন, কিছু একটা করার চেষ্টা করবেন।

জয়শ্রী দাশগুপ্তও ফোন করলেন, আমার জন্য দুঃখ করলেন। কিন্তু কলকাতার বাইরেই অন্য কোথাও আমি থাকবো, তা-ই মনে করছেন তিনি। কিন্তু আমি তো কলকাতায় ফিরবো, জয়শ্রীদি।

রাতে ফোন করলেন ডলি রায় আর সৌগত রায়। সৌগত রায় বললেন, ‘সিপিএম তোমাকে চায় না। আমাদের ক্ষমতা নেই তোমাকে আনার।‘

আমি যখন বলছি, ‘বলছেন কী, আমি কি ফিরবোনা কলকাতায়? আমাকে তোফিরতে হবে কলকাতায়। সৌগত রায় বললেন, ”দেখি, আমি একবার প্রিয়দা আর প্রণবদার সঙ্গে কথা বলে দেখবো। কী অবস্থা একটু বুঝবো।’

বললাম, কণ্ঠ ভেজা, ‘আজও ফোন করেননি?’

হয়তো একটু অপ্রস্তুত হলেন। ওখানে, কলকাতায়, আমি অনুমান করি, প্রায় সকলেই হয়তো ভেবেই নিয়েছেন আমাকে আর কলকাতায় ফেরত যেতে দেবে না। এবং আমার পক্ষেও সম্ভব নয় ফেরা। তারা কেউ কেউ প্রসঙ্গ উঠলে দুঃখ করবেন। কেউ কেউ বলবেন, ‘মিস করছি’। কেউ কেউ বলবেন, ‘বেচারা’। আমার কপালের প্রসঙ্গও হয়তো কেউ তুলবেন। কপালটাই খারাপ।

আর যারা আমাকে জানে না, চেনে না, বোঝে না, তারা তো বলবেই ইচ্ছে করেই এমন সব করেছি, যেন নাম হয়, যেন জনপ্রিয়তা বাড়ে, যেন বই বিক্রি হয়, যেন বিতর্ক হয়।

এসবের জন্য ঠিক কী করেছি তারা বলতে পারবে না কিন্তু। অনেকে শান্তি পাবে বলে যে আমার লেখায় সাহিত্যগুণ এক ছটাকও নেই। সাহিত্যগুণ না থাকলে রাজ্য থেকে যে কোনও লেখককে তাড়িয়ে দেওয়া যায়, দিলে খুব একটা ক্ষতি কিছু হয় না। অথবা গন্ডগোলের অজুহাত দিয়েও তাড়ানো চলে। তাড়ানো নিয়ে কথা।

.

১৩ ডিসেম্বর

তুমি যখন একা, তোমার কেউ থাকে না। সলিটারি কনফাইনমেন্ট থাকে শুধু। এক ঘর বন্দিত্ব থাকে। তুমি যখন একা, তুমি তখন একাই। জগতে কেউ নেই তোমার জন্য।

.

১৪ ডিসেম্বর

কলকাতা থেকে প্রায়ই ফোন করছেন তপন রায় চৌধুরী। উনি নামি দামি লোক। বই লিখেছেন। ভারত সরকারের পদ্মবিভূষণ পুরস্কার পেয়েছেন। আমাকে একদিন বললেন, ‘ওদের খুব বড় একজনের সঙ্গে কথা বললাম। আমাকে বললেন, অবস্থা ভীষণ খারাপ।’

ত–খারাপ অবস্থা, কোথায়?

চৌ–দেশে।

ত–কেন হবে খারাপ অবস্থা! কোনও খারাপ অবস্থাই তো দেখছি না।

চৌ কে বলেছে? লস্কর-এ-তৈবার একটা লোক তো বলছে যে তোমাকে মেরে ফেলবে, খুঁজছে নাকি তোমাকে।

ত–না। এরকম কোনও খবর আমি পড়িনি।

চৌ–টেলিগ্রাফে আছে।

ত–আমার মনে হয় না টেলিগ্রাফে এসব কিছু লিখেছে। বাংলাদেশের হুজির কথা সম্ভবত পড়েছেন। ওরা বেশ অনেক বছর আগে আমাকে মেরে ফেলার একটা প্রোগ্রাম করেছিল। এখন কেউই চাইছে না। যে গুন্ডা পাণ্ডাআর অ্যান্টি সোশাল ছেলেরা নভেম্বরের একুশ তারিখে কলকাতায় হাঙ্গামা বাধাতে নেমেছিল, ওরা আমার বই টই পড়েনি। ওদের নামানোর পেছনে অন্য কোনও ষড়যন্ত্র আছে।

চৌ–এখন একটা নিগোসিয়েসন হোক। তোমাকে লিখিত দিতে হবে কিনা কিছু, মৌলবাদীরা এখন কী দাবি করছে, সেটা জানার চেষ্টা হচ্ছে। যে দাবিই ওরা করুক, সেই দাবি মতো ওদের সঙ্গে একটা বোঝাঁপড়া হওয়া ভালো।

ত–আমি দ্বিখন্ডিত থেকে বাদ দিয়েছি কিছু অংশ। তারপর ওদের বড় বড় নেতাই বলে দিয়েছেন, ম্যাটার ক্লোজড। ব্যস। এখন আবার কী? যে কেউ যে কোনও দাবি করলেই আমাকে মেনে নিতে হবে কেন?

চৌ–লিখিত দিলে হয়তো ওরা শান্ত হবে।

ত–লিখিত মানে?

চৌ–লিখিত, যে, তুমি তোমার বই থেকে কিছু আপত্তিকর পৃষ্ঠা বাদ দিয়েছে।

ত–সে তো বলাই হয়ে গেছে। টিভিগুলোতে দেখিয়েছে। সারাদিন ধরে প্রচার করেছে এ খবর। বইএর ওই অংশটুকু কেটে বাদ দিয়ে নতুন এডিশনও ছাপা হয়ে গেছে।

চৌ–ওরা তো মানছে না।

ত–কে বলেছে মানছে না? ওরা মানছে। বিমানবাবু মানছেন না। উনি বলছেন আরও বই লিখেছি। আরও বই থেকেও কেটে বাদ দেওয়া হোক। আসলে কি জানেন, না মানতে চাইলে কিছুতেই মানবে না। লিখিত দিলেও মানবে না। শয়তানি করতে চাইলে আপনি কি পারবেন শয়তানি বন্ধ করতে?

চৌ–পরিস্থিতি তো অশান্ত।

ত–পরিস্থিতি অশান্ত ভাবলেই অশান্ত। না ভাবলেই শান্ত। কে বললো পরিস্থিতি শান্ত নয়?

চৌ–ওরা বললো। মৌলবাদীরা নাকি ভীষণ তান্ডব করছে।

ত–কিছুই করছে না। ওদের আস্কারা দিলেই তাণ্ডব করবে। যদি মিডিয়া ওদের খবর কভার করে, পলিটিশিয়ানরা নমো নমো করে, তাহলেই যা ইচ্ছে তাই করবে। এখন করছে না, করলে আপনি দেখতে পেতেন। দেখছেন কোনও মিটিং মিছিল! কিছুই দেখেননি। টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম শুধু একবার বলেছেন তিনি নাকি কী মানেন না। ইমামকে একটা ধমক দিলেই ইমাম মানা না মানা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। গতবার একটা ফতোয়া দিয়েছিলেন তিনি। বেশ হম্বিতম্বি করলেন, যেই না পুলিশ কমিশনার তাঁকে ডেকে নিয়ে একটা ধমক দিয়ে দিলেন, বা হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিলেন, অমনি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ইমাম টেলিভিশনে বললেন, না তো, কোনও ফতোয়া তো দিই নি। আমার মতো লোকের ফতোয়া দেওয়ার এক্তিয়ার নেই। মুশকিল হল, ওই চাওয়া নিয়ে। ওই ধমকটা তো এখন দিতে চাইছেন না কেউ। পরিস্থিতি সামাল যাঁরা ইচ্ছে করলেই দিতে পারেন, তাঁরা চাইছেন না দিতে।

চৌ–তা তো বুঝতে পারছি। কিন্তু এরা তো সব পলিটিক্স করছে। এটা কি কোনও সভ্য দেশ হল! সব শুয়োরের বাচ্চা।

এসব কথা তপন রায় চৌধুরীর সঙ্গে হয়েছিল। উনি বলেছিলেন, খুব বড় একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন, আজ বা কাল। জিজ্ঞেস করেছিলাম, বড় একজনটি কে। বলেননি। শুধু বলেছেন, আমি নাম বলবো না, তবে আমি জানি তিনিই একমাত্র তোমাকে সাহায্য করতে পারেন, সত্যি কথা বলতে কী, বাঁচাতে পারেন তোমার এই ভয়ংকর দুর্দশা থেকে তোমাকে’। বলেছিলেন আমার বিষয়েই তাঁর সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছেন।

আমি আশায় আশায় ছিলাম। জানি তপন রায় চৌধুরী আমাকে খুব স্নেহ করেন। কিন্তু সেই বিরাট বড় মানুষটির সঙ্গে কথা বলে এসে তিনি যা বললেন আমাকে, শুনে আমি থ।

চৌ–শোনো, কথা বললাম, উনি বললেন, সবচেয়ে ভালো হয় এখন যদি তুমি বিদেশে চলে যাও। তোমার কোনও পয়সাকড়ি খরচ হবে না। ভারত সরকারই তোমার প্লেন টিকিট দেবে, বিদেশে তোমাকে রাখার খরচও ভারত সরকার দেবে।

ত–বলছেন কী? কে বলেছে?

চৌ–তাঁর নাম বলা যাবে না। তাঁর নাম তুমি আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না। তবে খুব বড় একজন।

ত–আমাকে তাহলে বের করে দিতে চাইছেন ওঁরা!

চৌ–একটুও না। তোমার ভিসা এক্সটেনশানটা হয়ে যাওয়ার পর তুমি যাবে। সুতরাং কোনও চিন্তা নেই। ভিসা থাকলে ফিরতে তো পারবেই।

ত–ভিসা থাকলেও ইমিগ্রেশনে আটকে দিতে পারে।

চৌ–না। কোনওদিন হতে পারে না।

ত–পারে। নিশ্চয়ই পারে। সরকারি সিদ্ধান্ত হলেই পারে।

চৌ–ভারতবর্ষে কোনওদিন এরকম হয় না। কোনওদিন এরকম হতে শুনিনি।

ত–ভারতবর্ষের কোনও রাজ্য থেকে কোনও লেখককে তাড়িয়ে দিতে শুনেছেন এর আগে?।

চৌ-না।

ত–দেখলেন তো আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া হল! আমার তো রেসিডেন্স পারমিট আছে। কলকাতায় থাকার অধিকার তো আমার আছে। যেতে পারছি কলকাতায়?

চৌ না।

ত–একবার ভারত থেকে চলে গেলেও আমাকে আর ঢুকতে দেওয়া হবে না। যেভাবে এখন ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না পশ্চিমবঙ্গে। আর, একটা কথা কি আপনার মনে হয়নি কখনও, যে, কেন আমাকে যেতে হবে ভারতের বাইরে?

চৌ–একটা নিগোসিয়েশন করার চেষ্টা করছিলাম। বলেছি, ও আমার মেয়ের মতো। ও কলকাতায় ফিরবে। লেখালেখি করবে। কী করতে হবে তার জন্য বলুন।

ত–কিসের নিগোসিয়েশন?

চৌ–যেন তুমি ফিরতে পারো।

ত–ফেরার জন্য হলে ফিরবো কলকাতায়। বিদেশ যাবো কেন?

চৌ–ওরা ওদের ভোটের ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে চায়।

ত–যথেষ্ট কি হয়নি? রাজ্য থেকে বের করলো। বই থেকে কেটে বাদ দেওয়া হল। মৌলবাদীরা চুপ হয়ে আছে। তারা খুশি। তারপরও আর কী দাবি তাদের মেটাতে চাইছে? এতগুলো দাবি মেটানোর পরও ভোট পাবে বলে তাদের মনে হচ্ছে না? এখন আমাকে ভারতবর্ষ ছাড়তে হবে? এরপর মৌলবাদীরা ডিমান্ড করবে, তসলিমাকে মেরে ফেললো, তাহলে তোমাদের ভোট দেব। তখন কি আমাকে ওরা মারতে আসবে ভোটের জন্য? দাবির কি সীমা আছে? দাবি মেটানোর কি সীমা আছে? দাবি সম্ভবত নিজেরাই তুলছে, দাবি নিজেরাই তুলে নিজেরাই মিটিয়ে অশিক্ষিত মূর্খদের ভোট চাইছে।

প্রভু এলেন রাতে। ভ’বাবুর পরামর্শ মতো যে দরখাস্ত লিখে প্রভুর হাতে দিয়েছিলাম, প্রভু তা যথাস্থানে বিবেচনার জন্য পাঠানোর পর আজ সেই দরখাস্তের জবাব এসেছে। জবাব শোনার জন্য কান পেতে থাকি। প্রভু বললেন, হবেনা, আমার সুইডেনের বন্ধু আমার কাছে আসতে পারবে না, আমিও তার কাছে যেতে পারবো না। আমাদের যদি দেখা হয় কোথাও, তৃতীয় কোনও জায়গায় হবে সেই দেখা। আয়োজনটা আমার বা বন্ধুর ইচ্ছেমতো হবে না। আমি আবেদন পেশ করবো, সেই আবেদন ওপরওয়ালা মঞ্জুর করলেই প্রভু আমাকে তৃতীয় জায়গায় নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করবেন।

কেন দেখা করা যাবে না? কী কারণে আমার বন্ধুরা আমার কাছে আসতে পারবে না, বা আমি তাদের কাছে যেতে পারবো না। এর উত্তর প্রভু বললেন, তিনি জানেন না। তিনি শুধু ওপরওয়ালার নির্দেশ আমাকে জানিয়েছেন।

আমি যতই বলি না কেন যে আমার কষ্ট হচ্ছে, এভাবে মানুষ বাস করতে পারে না, আমি একটা স্বাভাবিক জীবন চাই, এমন জীবন যেখানে আমি শ্বাস নিতে পারবো, যেখানে আমি ইচ্ছে হলে বাইরে বেরোতে পারবো, বন্ধুরা আমার বাড়ি আসতে পারবে, আমি যেতে পিরবো তাদের বাড়ি, একটা স্বাভাবিক জীবন নাহলে চলছে না–প্রভুর কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। মাছের মতো মুখ করে শোনেন আমাকে। রোবটের সামনে কথা বলারও হয়তো কোনও মানে হয়। প্রভু রোবটের চেয়েও প্রাণহীন। দেয়ালের মতো। মাথা ঠুকলে মাথা ভাঙে, দেয়ালের কিছু হয় না।

রাতে ফোন করে প্রভু জানতে চাইলেন, যে লেখকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, তাঁর পুরো নাম ঠিকানা ইত্যাদি।

ত–তপন রায় চৌধুরী।

প্র–রাইট তপন রায় চৌধুরী। উনি আর কী বললেন?

ত–সব তো বলেছিই আপনাকে।

প্র–উনি তো নিগোসিয়েশনের ব্যাপারে কথা বলেছেন।

ত–যাঁ, কিন্তু আমি মেনে নিইনি। আর যা কিছুই মেনে নিই, আমাকে দেশ ছাড়ার কথা বললে তা আমি মেনে নেবো না।

প্ৰ–কেন মানবেন না?

ত-মানবোনা কারণ কলকাতা ফেরার জন্য বিদেশ যাওয়ার শর্ত নিতান্তই যুক্তিহীন।

প্র–যুক্তিহীন?

ত–হ্যাঁ যুক্তিহীন।

আচ্ছা আপনিই বলুন, বিদেশ চলে গেলে কলকাতা যাওয়ার পথ সুগম হবে, এ কথা তপন বাবু যে এত বার বললেন, এর মাথামুণ্ডু আপনি কিছু বুঝতে পারেন? আপনি হয়তো পারেন, আমি পারি না। আর আসল কথা, আমি তো কচি খুকি নই। আরে বাবা, আমার তো একটা দেশ ছাড়ার অভিজ্ঞতা আছে। এখনও ঘা-টা খুব কাঁচা। আমাকেও তো এভাবে বলা হয়েছিল, ক’দিনের জন্য যাও, কিছুদিন পর ফিরে আসতে পারবে। যারা দেশ থেকে তাড়ায়, তারাই ‘বিদেশ’, ‘কিছুদিন পর’ এই শব্দগুলো ব্যবহার করে। আর যারা তাড়ায় না, তারা কোথাও কাউকে আটকে রাখে না, যার যেখানে যাওয়ার, সেখানে যাওয়ার ব্যবস্থা করে যে করেই হোক। কোনও কিছুর ছুতোয় কারও যাত্রা ভঙ্গ করে না।

.

১৫ ডিসেম্বর

সকালে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় এক নিরাপদ বাড়ি থেকে আরেক নিরাপদ বাড়িতে, সেখানে রক্ত নেওয়ার একটা লোককে ধরে আনা হয়েছে। রক্ত নিল লোক। কাগজে আমার নাম লেখা হল, মিকু শ্রীবাস্তব।

.

১৬ ডিসেম্বর

দিন যেভাবে কাটে, সেভাবেই কাটছে। মৃত কচ্ছপ পড়ে আছে। দিন বলে ডাকি তাকে।

আজ বাংলাদেশে বিজয় দিবস। বাঙালির বাংলা ভাষাকে বাঁচানোর আন্দোলন বড় হতে হতে যুদ্ধে গিয়ে থামে। আজ এই দিনটিতে আমি বাংলার এক মেয়ে, বাংলা ভাষার লেখক, বন্দি। বিজয় বলতে কিছু নেই আমার। আইন ও সালিশ কেন্দ্রর হামিদা হোসেন বাংলাদেশে আমার চরম দুঃসময়ে পাশে ছিলেন, তাঁকে লিখেছিলাম অনেক বছর কোনও যোগাযোগ নেই। আশা করি ভালো আছেন। আমার জীবনের দুর্ভোগ তো আজও কমলো না। দেশে ফিরতে তো সবসময় চাই। এখন কি ফিরতে পারবো দেশে? যদি মামলাগুলো তুলে নেওয়া হয়, সরকার আমাকে ফিরতে বাধা না দেয়, নিরাপত্তা দেয় তবে তো ফিরতে পারি, সেটা কি সম্ভব হবে? আপনি যদি আমাকে সাহায্য করেন ফেরার ব্যাপারে, কৃতজ্ঞ থাকবো।

এর উত্তরে উনি লিখেছেন, .. ‘তোমার ভুলে গেলে চলবে না যে তোমার বিরুদ্ধে কোনও মামলা যদি নাও থাকে, কিছু লোক তো আছেই তারা তোমার বিরুদ্ধে রাস্তায় নামবে নিজেদের সুবিধে আদায় করতে। তুমি নিশ্চয়ই প্রথম আলো’র কার্টুনিস্টএর কথা শুনেছো। ও এখন জেলে। ওর জামিনের জন্য চেষ্টা চলছে। দেখা যাক কী হয়। আসলে আমাদের সেই স্বাধীনতা এখনও নেই, যে স্বাধীনতা যা বলতে চাই আমাকে তা বলতে দেবে। আমার মনে হয় ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করাটা এখন আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে গেছে। লেখক সাংবাদিকদের সতর্ক থাকতে হয়। সাংস্কৃতিক আর রাজনৈতিক দিক থেকে তো মনে হচ্ছে আমরা আরও বেশি সংকীর্ণ হয়েছি।

আরিফুর রহমানের কথা জানি, বেচারা কার্টুনিস্ট জেলে বসে আছে। কী অপরাধ ছিল তার! প্রথম আলোর কার্টুন ম্যাগাজিন আলপিনে কার্টুন এঁকেছিল। গ্রামের এক মোল্লা, বেড়াল কোলে নিয়ে হেঁটে বেড়ানো এক গরিব বাচ্চা ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই তোর নাম কী?’ ছেলে বললো, ‘বাবু।‘ মোল্লা ধমক দিয়ে বললো, ‘নামের আগে মোহাম্মদ বলতে হয় জানিস না?’ ছেলে ভয়ে বিস্ময়ে কুঁকড়ে গেল। এর পর আবার মোল্লার জিজ্ঞাসা, ‘তোর বাবার নাম কী?’ ছেলে বললো, ‘মোহাম্মদ আবু’। মোল্লা খুশি হল। এবার জিজ্ঞেস করলো, ‘তোর কোলে এটা কী?’ ছেলে বললো, ‘মোহাম্মদ বেড়াল।’

অশিক্ষিত কাঠমোল্লাগুলো যারা মনে করে সব নামের আগেই হয়তো মোহাম্মদ বসাতে হবে, তা যে ভুল এবং হাস্যকর, তা বোঝাতেই সম্ভবত আরিফুর রহমান ওই কার্টুন এঁকেছিল। কিন্তু কুড়ি পঁচিশ হাজার লোক বেরিয়ে গেছে ওই কার্টুনের বিরুদ্ধে মিছিল করতে। প্রথম আলোর সম্পাদক প্রাক্তন কমিউনিস্ট মতিউর রহমান এরপর ভয়ংকর লজ্জাজনক কাজ করলেন। তিনি কার্টুনিস্ট আর কার্টুন পত্রিকার সম্পাদক দুজনকেই চাকরি থেকে বরখাস্ত করলেন। দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইলেন। শুধু তাই নয়, ক্ষমা চাইলেন বায়তুল মোকাররমের খতিবের কাছেও, তার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে।

কে যেন বলেছিল, কমিউনিস্ট যখন পচে, ভীষণ পচে। দেশ ভেসে যায় দুর্গন্ধে।

যে দেশে বাক স্বাধীনতা নেই, সে দেশ আমার নয়। এই বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ নয়। এই বাংলাদেশ পেতে তিরিশ লক্ষ মানুষ জীবন দেয়নি, দু’লক্ষ মেয়ে ধর্ষিতা হয়নি।

.

১৭ ডিসেম্বর

ইঁদুর ঘোরাঘুরি করছে সুয়েনসনের হোটেলের ঘরে, আর তীব্র গন্ধ নাকি আসছে কেরোসিনের। বাথরুমের জানলা খোলা, টেনেও বন্ধ করা যায় না। অশোকা প্যালেসে বসে সুয়েনসন এই অভিযোগ করলো।

প্রভু আমাকে জানিয়েছেন, সুয়েনসনের কোনোঅসুবিধে হচ্ছেনা, তারাই তাকে বিমান বন্দর থেকে নিয়ে এসেছেন, হোটেলে রাখছেন, খাওয়াচ্ছেন, ঘোরাচ্ছেন। এই আরামে থেকে সুয়েনসন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ তো করছেই না, বরং খুঁত ধরার চেষ্টা করছে। সে তো কস্মিনকালেও পৃথিবীর কোথাও কোনও সরকারি লোক দ্বারা আপ্যায়িত হয়নি। ইউরোপের কোথাও যদি কখনও এরকম হতো যে তাকে বিমান বন্দর থেকে নিয়ে এসে খাইয়ে দাইয়ে, শহর দেখিয়ে ঘুরিয়ে, শহরের পাঁচতারা হোটেলে ঘর দেওয়া হচ্ছে ঘুমোতে দিন রাত শুধু মাথা নুইয়েই পড়ে থাকতো সুয়েনসন। ওর হাতে একটা কাঠিলজেন্সও যদি কোনও সাদা লোক দেয়, অনন্তকাল ধরে চলতে থাকে সাদা লোকের আর কাঠিলজেন্সের প্রশংসা। আর কালোবা বাদামি উজাড় করে দিলেও ও নাক সিঁটকাবে। ভেতরে ভেতরে আস্ত একটা বর্ণবাদী এই সুয়েনসন, আজ নয়, বহুদিন আগেই আমি টের পেয়েছি। সুয়েনসনের সঙ্গে আমি দেখা করতে চাইছি, ‘আমার বাটীতে সে থাকিবেক’ এই আবেদন জানিয়ে আমি দরখাস্তও করেছি, যত না সুয়েনসনের জন্য, তার চেয়ে দ্বিগুণ ত্রিগুণ চতুগুণ আমার জন্য। আমার স্বাধীনতার জন্য। বাক স্বাধীনতার জন্য।

দুপুরে আমাকে নিয়ে আসা হল রক্ত যেখানে নিতে এসেছিল সেই বাড়িতে। ওখানে অন্য একটি গাড়িতে করে সুয়েনসনকে আনা হল। সাক্ষাৎএর অনুমতি শুধু। প্রভু বললেন, সাক্ষাতের সময় তিনি নিজে থেকে বাড়িয়ে দিয়েছেন। এক ঘণ্টার বদলে আমাদের তিন ঘণ্টা সময় দিয়েছেন দেখা করার। কী চান প্রভু, যেন কৃতজ্ঞতায় নুয়ে থাকি। এক ঘণ্টাকে তিন ঘণ্টা করা হয়েছে বলে? আমি চোর না ডাকাত না খুনী! আমার কি জেল হয়েছে। আমার ভাবতে খুব অবাক লাগে, আমি কতক্ষণ ঘরের বাইরে থাকতে পারবো, কতক্ষণ আমার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে পারবো, তার সিদ্ধান্ত অন্য কেউ নিচ্ছে, আমার নেওয়ার অধিকার নেই।

দুপুরের খাওয়ার ব্যবস্থা প্রভুই করলেন ও বাড়িতে। বাড়িটাতে কেউ থাকে না। খুব নির্জন নিঝুম বাড়ি। সরকারি বাড়ি, হঠাৎ হঠাৎ কোনও গোপন দেখা সাক্ষাৎএর জন্য ব্যবহার হয়, বিশাল টেবিল জুড়ে নানারকম খাবার এমন সাজিয়ে দেওয়া হয় যে কেউ বুঝতেই পারবে না সবই বাইরে থেকে কিনে আনা, ঘরের রান্না নয়। বাড়িটা সম্পর্কে খুব বেশি কিছু আমি জানি না, কারণ আমার কৌতূহলের কোনও জবাব প্রভু কখনও দেন না।

বিকেলে জীবনের দুর্ভোগের কথা ভাবতে ভাবতে কেঁপে কান্না এলো৷ কান্না রাতে ঘুমোবার আগ অবধি থামেনি।

.

১৮ ডিসেম্বর

আজ ঘুম ভালো হয়নি। জেগে গেছি শেষ রাতে। ইন্টারনেটে খবর দেখতে গিয়ে দেখি গ্লোরিয়া স্টাইনেম কলকাতায়। আমার সম্পর্কে বলছেন। দিজ ইজ অ্যান আউটরেজাস ভায়োলেশন অব হার হিউমেন রাইটস। শি হ্যাঁজ এ রাইট টু বি সেইফ”। আমি যে দ্বিখন্ডিত থেকে তুলে নিয়েছি অংশ, সে নিয়ে গ্লোরিয়া বলেছেন, একজন লেখক যখন নিজের ইচ্ছেয় তার লেখা কাটে সে এক ব্যাপার, আর যখন সে কাটতে বাধ্য হয়, সেটা অন্য ব্যাপার। কী সহজ ভাষায় গ্লোরিয়া বলতে পারেন সত্য! চিন্তার খোরাক জোটাতে সবসময়ই তিনি পারেন। বলেছেন তার মেজ ম্যাগাজিনে লিখেছেন আমাকে নিয়ে, আমার লেখাও ছেপেছেন। দেখা হয়েছিল দিল্লিতে সাউথ এশিয়ান লেখক সম্মেলনে, বলেছেন। গ্লোরিয়াকে নিয়েও তো আমি কত লিখেছি। আজ যদি কলকাতায় সেই জীবন আমার থাকতো, গ্লোরিয়াকে আমার বাড়িতে নিয়ে যেতাম। তাঁর সান্নিধ্য পেতে পারতাম। তাঁর উপস্থিতির উৎসব করতাম।

ষাট-সত্তর দশকের জগৎ কাঁপানো নারীবাদী লেখিকা গ্লোরিয়া। সেই ষাট দশকে যা ভাবতেন, যা বলতেন, গ্লোরিয়ার কোনও বই বা লেখানা পড়েও আশির দশকে আমি একই যন্ত্রণা অনুভব করেছি, একই ভাষায় প্রতিবাদ করেছি, একই যুক্তি ব্যবহার করেছি, একই কথা ভেবেছি আর বলেছি।

.

১৯ ডিসেম্বর

আমন্ত্রণ জুটলো লেখক খুশবন্ত সিংএর সঙ্গে দেখা করার। ওঁর বাড়িতে আমাকে যেতে হবে শনিবার সন্ধ্যে সাতটায়। পেশ করেছি আবেদনটি। খুশবন্ত সিংএর নাম ঠিকানা ফোন নম্বর লিখে প্রভুর হাতে দিয়েছি। উনি যথাস্থানে জানিয়েছিলেন। কিন্তু নাকচ হয়ে গেছে আবেদন। কমিউনিস্ট পার্টির বৃন্দা কারাতের সঙ্গেও একবার দেখা করার দিন তারিখ ঠিক করেছিলাম, সেটিও নাকচ।

বৃন্দা কারাতের সঙ্গে ফোনে যেদিন প্রথম কথা হল, বললেন, তোমাকে পশ্চিমবঙ্গে ফেরত নেওয়া সম্পূর্ণ কেন্দ্র’র হাতে, রাজ্যের হাতে নয়। ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। নানা লোকেনানাকথা বলে, কোনটাকে বিশ্বাস করবো, কোনটাকে করবোনা, বুঝতে পারি না। সবার কথাই বিশ্বাস হয়। কেউ মিথ্যে বলতে পারে, কেউ বানিয়ে অযথা কিছু বলতে পারে, আমার বিশ্বাস হতে চায় না। এত মিথ্যে শুনেও, এত ঠকেও বুদ্ধি বাড়ে না আমার। আমি রাজ্য, কেন্দ্র বুঝি না। মারপাঁচ বুঝি না। খুব সরল সোজা সত্য কথা বুঝি। বুঝি যে আমি কোনো অন্যায় করিনি। বুঝি যে শাস্তি আমি পাচ্ছি, তা পাওয়া আমার উচিত নয়।

সময় যাচ্ছে। বুঝি যে যাচ্ছে। আগে সাংবাদিকরা পাগল হয়ে যেতো কী করছি, কেমন আছি, কী ভাবছি জানার জন্য। এখন তেমন কেউ পাগল নয়। ফোন বাজে না আগের মতো। অবশ্য ফোন যখন ঘন ঘন বাজতো, আমি তো ফোনই ধরিনি। সাংবাদিকদের। এড়িয়ে চলেছি, কাউকে সাক্ষাৎকার দিইনি, কারও সঙ্গেই কথা বলিনি। প্রভু বারবারই সাংবাদিক মহল সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন। এরা সব লোভী, যা করে টাকার জন্য বা নামের জন্য। এরা কাজ ফুরোলে চলে যাবে। তুমি মরলে কী বাঁচলে তার দিকে ফিরেও তাকাবে না। প্রভু যে সবসময় খুব ভুল বলেন, তা নয়।

গ্লোরিয়া স্টাইনেমের একটা ইমেইল পেলাম। লিখেছেন, ”প্লিজ প্লিজ টেল মি ইফ আই ক্যান ডু এনিথিং –অ্যান্ড ইউ অলওয়েজ হ্যাঁভ এ রুম উইথ মি ইন নিউইয়র্ক। বিষণ্ণ মন মুহূর্তে ভালো হয়ে যায়। কিছু ভালো মানুষ এখনও বাস করে বলে পৃথিবীটা এখনও সুন্দর। এত বাধা, এত নিষেধ, এত অনাচার, অবিচার –কিন্তু তারপরও বাঁচতে ইচ্ছে করে।

আজ ঘটলো সেই ঘটনাটি, যেটি ঘটা উচিত নয় এই দেশে। এই দেশ তো গণতন্ত্র। গণতন্ত্র মানেই তো সবার বাক স্বাধীনতা থাকবে এ দেশে। এই দেশ হৃদয়ে অনেক বড়, এমনই তো জানি। বড় এক মন্ত্রণালয়ের বড় এক অফিসার এসেছিলেন। কী পদে আছেন, বললেন না। জানি না কী কারণে নামটা বললেন। ধরা যাক নাম তার সনাতন সেনগুপ্ত। এও অনেকটা প্রভুর মতো, নাম বলেন, কোথায় চাকরি করছেন, কী করছেন, বলেন না। আমার কাছে লুকোনোর কী কারণ থাকতে পারে, জানি না। অনুমান করি ভ’বাবুই তাঁকে পাঠিয়েছেন। কী বলতে এসেছেন তিনি? নতুন কিছু নয়, অনেকটা সে কথাই বলতে এসেছেন যে কথা প্রসূন মুখার্জি কলকাতায় বলেছেন।

স–আপনি চলে যান।

ত–কোথায় যাবো?

স–ভারত ছাড়ুন।

ত–কেন?

স–আপনি কেন আছেন এ দেশে? কলকাতায় যাওয়ার জন্য তো! ওই অপেক্ষাই তো করছেন? তাই না?

ত–হা করছি। ওখানে আমার বাড়িঘর। আমার সব কিছু। আমার বইপত্র, কাপড়চোপড়।

স–কিন্তু আপনার কলকাতায় যাওয়া চলবে না।

ত–কেন চলবে না?

স–ওখানে আপনাকে মেরে ফেলবে। তার চেয়েও বড় কথা আমাদের লোকদের জীবন বাঁচাতে হবে।

ত–আমাদের লোকদেরও জীবন বাঁচাতে হবে, মানে? স মানে হল, আপনার কারণে মানুষ মরবে এ দেশে।

ত–এ কেমন কথা!

স–আপনি কি চান আপনার কারণে দশটা লোক মরে যাক?

ত–আমি কেন কারণ হতে যাবো মানুষের মৃত্যুর! আমি মানবতায় বিশ্বাস করি। মানবতার কথা বলি। লিখি। মানুষকে বাঁচার কথা বলি। আমি মানুষ মারতে যাবো কেন?

স–আপনার জন্য মিছিল হবে, সেই মিছিলে গুলি হবে, মানুষ মরবে।

ত–আমার মনে হয় না এসবের কিছু হবে। কই, মিছিলের তো কোনো আভাস দেখছি না। কেউ তো বলছে না মিছিল করবে! কোনো কারণ নেই হঠাৎ করে মিছিল হওয়ার। আর, মিছিল হলেই বা মানুষ মরবে কেন?

স–আপনি কি চান আপনার জন্য একজন বৃদ্ধ মরে যাক?

ত–আমি কেন চাইবো আমার জন্য একজন বৃদ্ধ মরে যাক। কিন্তু কী কারণে একজন বৃদ্ধকে মরে যেতে হবে? কে মারবে বৃদ্ধকে?

স–আপনি কি চান আপনার জন্য নিষ্পাপ শিশুরা মরে যাক? ওদের মৃত্যুর কারণ হতে চান আপনি?

ত–আশ্চর্য! শিশুরা মরবে কেন? আমিই বা চাইব কেন ওরা মরে যাক।

স–না চাইলে আপনি চলে যান।

ত–আমি চাই না একটি প্রাণীরও মৃত্যু। কিন্তু আমি মনে করি না, চাই না বলে আমাকে দেশ ছাড়তে হবে। মিছিল যদি হয়ই, হবে। কত লোকের বিরুদ্ধেই তো লোকে মিছিল করে। তাদেরকে কি চলে যেতে হয় দেশ ছেড়ে?

স–এটা তো আপনার দেশ নয়।

ত–আমি জানি এ দেশ আমার দেশ নয়। এ দেশে আমি রেসিডেন্স পারমিট নিয়ে থাকি। আজ রেসিডেন্স পারমিট আছে, তাই থাকছি। কাল যদি তা না থাকে, আমাকে চলে যেতে হবে।

স–হ্যাঁ। আপনি চলে যান, আপনি যদি মনে করেন, আপনি চলে গেলে আপনার রেসিডেন্স পারমিট পাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে, না, বন্ধ হবে না। রেসিডেন্স পারমিট যেমন পাচ্ছিলেন, তেমন পেয়ে যাবেন। আমি কথা দিচ্ছি। আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন দশটা লোক এ দেশে বাঁচুক।

ত–আমি যাবো না। আমি কারও ক্ষতি করছি না। আমি কোনও অন্যায় করিনি। কোনো অপরাধ করিনি আমি। আপাদমস্তক একজন সৎ মানুষ আমি। অনেক বছর কলকাতায় থাকছি। কোনোদিন কেউ আমাকে মারতে আসেনি, কেউ আমার জন্য মরেওনি। আমাকে পারলে কলকাতায় পাঠিয়ে দিন। আমাকে নিয়ে আপনাদের এত দুশ্চিন্তা করতে হবে না।

স–আপনি বিদেশে যাবেন না?

ত–না। আমি ভারত ছেড়ে কোথাও যাবো না। স এ দেশ আপনার দেশ নয়।

ত–তারপরও আমি এ দেশেই থাকবো। এ দেশ আমার পূর্বপুরুষের দেশ বলে নয়, এ দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবাসি বলেই আমি এ দেশে থাকি, থাকতে চাই এবং থাকবো। ঘাড় ধরে ঠেলে ধাক্কিয়ে দূর করবেন, করুন।

.

২০ ডিসেম্বর

অরুন্ধতী রায় বললেন, ‘পলিটিশিয়ানদের কখনও বিশ্বাস করো না। এরা তোমাকে মানুষ মনে করে না, মনে করে কারেন্সি। তোমাকে নিয়ে ব্যবসা করবে। তোমাকে ভালোবাসবে না’।

আজ আমার সারাদিন মন খারাপ। ভীষণ মন খারাপ। আজ আমি ভেঙে যাওয়া। সন্ধ্যায় প্রভু এসেছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। কাল সনাতন সেনগুপ্ত আমাকে চলে যাওয়ার কথা বলার পর আমার সিদ্ধান্ত জানতেই সম্ভবত এসেছেন। আমি সনাতন বাবুকেও বলেছি, প্রভুকেও জানিয়ে দিলাম, আমি কোথাও যাবো না। দাঙ্গা হাঙ্গামার পেছনে লেখক শিল্পীরা থাকে না, থাকে অন্য লোক। থাকে রাজনীতি। মানুষ মারার পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকে। লেখক শিল্পীরা বই লেখেন, ছবি আঁকেন, দাঙ্গা তাঁরা বাধান না।

.

২১ ডিসেম্বর

আজ একুশ তারিখ। একমাস হল কলকাতার রাস্তায় ছেলে ছোঁকরাদের গুন্ডামির পর। মনে হচ্ছে এই সেদিন ঘটলো যেন। দিন কী করে উড়ে যাচ্ছে।এখনও চোখ বুজলেই ভেসে ওঠে রাস্তার ওই অভদ্র অশিক্ষিত ছেলেগুলোর নোংরামো, ওদের নোংরা আনন্দনৃত্য।

রাতে আর পারিনি। ভ’বাবু ফোন ধরছেন না, এত ব্যস্ত মানুষের ফোন না ধরার কারণ আমি বুঝতে পারি। এসএমএস করি না পারতপক্ষে। এসএমএস পড়ার কি ব্যস্ত মানুষদের সময় থাকে। তবু লিখলাম, অনেক করেছেন আমার জন্য। আমি কৃতজ্ঞ। আপনার ওপরই ভরসা করি। এভাবে বন্দি জীবন কাটাতে খুব কষ্ট হচ্ছে। দিল্লিতে তো একটু স্বাভাবিক জীবন পেতে পারি? বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে তো বাঁচতে পারবো না। একদিন কি . দেখা করতে পারি আপনার সঙ্গে?

.

২২ ডিসেম্বর

‘In response to demands from a few religious fundamentalists, India’s demo cratic and secular government has placed a writer of international repute under virtual house arrest. Shorn of all cant, that is what the Centre’s treatment of Tas lima Nasreen amounts to. She was forced into exile from her native Bangladesh because of the books she had written and it looks as if the UPA government is about to repeat the same gesture by placing intolerable restrictions on her stay in India.

She is living under guard in an undisclosed location. She will not be allowed to come out in public or meet people, including her friends. Without quite say ing so, the government is clearly sending her a message that she isn’t welcome in India and ought to leave. Earlier, she was turfed out of West Bengal by the state government. It’s not quite clear who’s ahead in the competition to pander to fundamentalist opinion, the Centre or the West Bengal government. Earlier, Left Front chairman Biman Bose had said that Taslima should leave Kolkata if her stay disturbed the peace, but had to retract the statement later. Now ex ternal affairs minister Pranab Mukherjee echoes Bose by asking whether it is”desirable” to keep her in Kolkata if that”amounts to killing 10 people”. In other words, if somebody says or writes something and somebody else gets suffi ciently provoked to kill 10 people, then it is not the killer’s but the writer’s fault.

That is an astounding statement for the foreign minister of a liberal dem ocratic state to make. The Greek philosopher Plato thought that artists were dangerous people and exiled them from his ideal Republic. But such views can hardly be reconciled with modern democracy, which survives on tolerance. De mocracy also accords a valuable place to the arts, where boundaries are pushed and new thinking becomes possible. Taslima’s views on women’s rights may seem threatening from the point of view of patriarchal codes governing society. That would explain why the animus towards her is not confined to Muslim con servatives, but includes Congress and Left luminaries.

The ministry of external affairs must think through the implications of what it is doing. If it forces Taslima out of the country, India will be placed on the same platform as Bangladesh, which is close to becoming a failed state. At a time when India’s image is ascendant in world affairs the official guardians of that image must not act like weaklings who cave in to every illiberal or funda mentalist threat to this republic’s constitutional values.’ –Times of India

কাল আমাকে ফেরানোর দাবিতে মিছিল হয়েছে কলকাতায়। কেউ বলে পাঁচশ লোক। কেউ বলে এক হাজার। ওরা তো ওদিকে ছিল অনেক হাজার। গত বছর সিদ্দিকুল্লাহর মিছিলে ছিল এক লাখ, আর রাস্তার ছেলেরাও নাকি একুশ তারিখে ছিল দশ থেকে পনেরো হাজার। গাড়িঘোড়া আটকে না থাকলে বড় মিছিল চোখে পড়ে না। ইট না ছুড়লে কারও গায়ে লাগে না। কম তো শব্দ খরচা হল না। অনেকে তো লিখেইছেন। তারপরও কি সত্যিকার কিছু হল?

.

২৩ ডিসেম্বর

সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বললেও বিপদ, না বললেও বিপদ। কথা বললে লোকে বলে আমি পাবলিসিটি চাই। আর না বললে, যেসব পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিইনা, সাংবাদিকদের এড়িয়ে চলি, তারা যা তাদের ইচ্ছে করে তা-ই ছাপিয়ে দেয়। আজ ডিএনএ পত্রিকায় লিখলো, নরেন্দ্র মোদি এসেছিলেন দিল্লিতে, আর আমি নাকি তাঁর সঙ্গে দেখা করে আমাকে গুজরাটে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেছি। মনে আছে বোম্বের মিড-ডে পত্রিকা আমার কোনও একটা ছবি ইন্টারনেট থেকে যোগাড় করে সারা গা মাথা কালি দিয়ে ঢেকে পেছনে বোম্বের দালানকোঠা জুড়ে দিয়ে প্রথম পাতায় ছাপালো, খবরের শিরোনাম দিল, তসলিমা বোরখা পরে বোম্বেতে চলে এসেছে। কত শত মানুষ যে বিশ্বাস করেছিল এই মিথ্যে খবর। সাধারণ মানুষ ছাপার অক্ষরে কিছু দেখলেই সত্যি বলে বিশ্বাস করে।

ভারতে বসে ‘পলিটিক্যাল গেইম’ যেন না খেলি, প্রভু বিরক্ত কণ্ঠে জানিয়ে দিয়েছেন। গেইমটা কখন খেলোম, কিভাবে খেলোম তা আমি অবশ্য জানি না। আমাকে লোকে কেন ভুল বোঝে তা আমি বুঝে পাই না। আমার আচরণে কিছু কি থাকে যে আমাকে মনে হয় আমি রাজনীতির মতো দুর্বোধ্য কিছু জিনিস নিয়ে খেলছি! অতি সরল, অতি সোজা, একটু গবেট, খানিকটা বোকা –এই আমাকে খেলোয়াড় ভাবে তারাই যারা নানা রকম খেলা দেখতে দেখতে, খেলোয়াড় দেখতে দেখতে চোখ নষ্ট করে ফেলেছে, এখন চোখের সামনে যাকে দেখে তাকেই খেলোয়াড় বলে মনে করে।

টেলিগ্রাফে মিথ্যে মিথ্যে খবর ছাপা হচ্ছে আজকাল, আমি নাকি একটা হেয়ার ড্রায়ারএর জন্য আমার যারা দেখাশোনা করছে, তাদের জ্বালিয়ে মারছি। শ্যাম্পু করবো, আর হেয়ার ড্রায়ার থাকবে না, তা কী করে হয়? ‘অ্যান অফিশিয়াল’এর সূত্র দিয়ে মিথ্যে খবর। একবার লিখলো, আমি মাছ খাবার জন্য নাকি উন্মাদ হয়ে গেছি, নানা রকম মাছের অর্ডার দিয়েছি। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমার রসনা তৃপ্তির জন্য সরকার থেকে সব যোগাড় করা হচ্ছে। এমন একটি চিত্র তুলে ধরছে ওরা, যেন আমি সরকারি বাড়িতে শুধু রাজার হালে নয়, অত্যাচারী রাজার হালে আছি। আবদারে আদেশে অতিষ্ঠ করে মারছি সবাইকে। প্রভুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘অফিসিয়াল সূত্রের খবর, তার মানে আপনাদের অফিস থেকে খবরগুলো যাচ্ছে। কিন্তু কে দিচ্ছে খবর!

প্রভু সোজা বললেন, মন্ত্রণালয় থেকে কেউ কোনও খবর ওদের জানায় না। ওরা বানিয়ে লেখে।

দিনের পর দিন টেলিগ্রাফের মতো একটা উন্নতমানের কাগজ বানিয়ে বানিয়ে গল্প লিখবে অন্যের নামে! আমি ধন্দে পড়ি। এক সাংবাদিক বন্ধুর কাছ থেকে পরে জেনেছি, মন্ত্রণালয় থেকে লিখতে বলা হয় এসব। তবে কারও নাম উল্লেখ না করে অফিসিয়াল সূত্র’ লিখে দেওয়াটাই শর্ত। অফিস থেকে স্বীকার বা অস্বীকার করাও সময় বুঝে করা যায়। কোনও ব্যক্তির কাঁধও দায় দায়িত্ব থেকে মুক্ত থাকে। এগুলো না হয় কমজোর দুর্বল সাংবাদিকরা লিখলেন। বীর সাংবাদিকরাও কম যান না। নামকরা বীর সাংভি লিখলেন আমার বিরুদ্ধে কলাম। ক্ষুদ্র তুচ্ছর ঊর্ধ্বে উঠেছি অনেক, কিন্তু মানুষ যখন আমাকে দেখে বা বিচার করে, ঊর্ধ্বে উঠে করে না। নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজের দেখা ক্ষুদ্র রাজনীতি আর ক্ষুদ্র সমাজ আর স্বার্থপর সুযোগসন্ধানী নিজেদের এবং সতীর্থদের ক্ষুদ্র মানসিকতার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে তোলে আমাকে নিয়ে কোনও মত। কোনওদিনই তাদের আর বোঝা হয় না যে তারা ভুল, কোনওদিন আর ভুল শোধরানোও তাদের হয়ে ওঠে না। কাছ থেকে আমার জীবন দেখার এবং বোঝার কোনও সুযোগ তাদের ঘটে না। কী আনন্দ পেলেন বীর সাংভি আমার সম্পর্কে বস্তা বস্তা মিথ্যে বলে, কে জানে! একটা বিচ্ছিরিরকম অসহায় মানুষ, ঘরবন্দি অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছে, অনিশ্চয়তার অন্ধকারে পড়ে আছে, যাকে নিয়ে রাজনীতির খেলা চলছে চারদিকে, আর তাকেই বলা হচ্ছে যে সে নাকি খবরের হেডলাইন হওয়ার জন্য চেষ্টা করছে। তার নাকি সাংবাদিকদের ফোন করে করেই দিন যাচ্ছে! লেখার সময় নেই। ঠিক এভাবে বাংলাদেশের মৌলবাদীরা অভিযোগ করতো। যখনই সত্যের চাবুক এসে ওদের গায়ে লাগতো, বলতো আমি যা করছি সবই নাকি খ্যাতি পাওয়ার জন্য করছি।

সম্ভবত বরখা দত্ত আর করন থাপর-এর কাছে শুনেছে আমি ওদের ফোন করেছিলাম। হা করেছিলাম। করেছিলাম জানার জন্য কী হচ্ছে আমাকে নিয়ে। সরকারি লোক যেদিন আমাকে জানিয়ে দিয়েছে যে কিছুই সম্ভব হবে না, না কলকাতা যাওয়া, না দিল্লিতে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা, না বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করা, আউট অব সাইট হতে হবে, দেশ ছাড়তে হবে –আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গিয়েছিল, আকাশ টুকরো হয়ে গিয়েছিল, জগৎ চুপসে গিয়েছিলো। এত বড় শক্তির সঙ্গে আমার মতো তুচ্ছ প্রাণীর তো পেরে ওঠার কথা নয়। বিদেশের জগৎটা আমার দেখা, সেই জগতে আমি আর যেতে চাই না। বাংলাদেশ নেই, ভারতই ছিল একমাত্র, আর এই ভারতই কি না দুলে উঠছে, কেঁপে উঠছে, সরে যাচ্ছে আমার নাগাল থেকে তখনই করন থাপর আর বরখা দত্তকে ফোন করেছিলাম জানতে, যেহেতু তারা রাজনীতি ভালো বোঝেন, কী হচ্ছে যা হচ্ছে, যা হচ্ছে। তা কেনই বা হচ্ছে, আমি থাকলে দশটা লোকের মৃত্যু হবে এ দেশে, এসব কথা এত জোর দিয়ে বলছেন কেন, যাঁরাই বলছেন!

টেলিভিশনের জন্য সাক্ষাঙ্কার চেয়েছিলেন করণ থাপর। দিইনি। বলেছি, সরকারের লোকেরা এমন সব দুর্বোধ্য কথা বলছেন, আপনি কি অনুগ্রহ করে মনমোহন সিং বা সোনিয়া গান্ধির সঙ্গে একটু কথা বলবেন। একটু দেখবেন, কী ওঁরা চাইছেন। করণ থাপর বললেন, তিনি জানতে চাইলে কেউ তাঁকে কিছু জানাবেন না। তিনি কথা বললে কেউ শুনবেনও না।

তারপর সন্ধেবেলায় সিএনএন জানালো সেদিন নাকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটা মিটিং হয়েছে সেক্রেটারি এবং আইবির মধ্যে, আমার ব্যাপারে বলা হয়েছে হয় দিল্লি থাকতে হবে যেভাবে আছে সেভাবে নয়তো চলে যেতে হবে দেশ ছেড়ে। আমি চূর্ণ হয়ে গেছি, আমি আর আমি নেই। প্রতিক্রিয়া চাইলে বললাম আমাকে যা যা বলে গেছে সরকারি লোক। এও বললাম, আমাকে একরকম গৃহবন্দি করা হয়েছে।

বীর সাংভির রাগ, কেন আমি জানিয়েছি আমি গৃহবন্দি অবস্থায় আছি। একই সঙ্গে নাকি ছ’টা এক্সকুসিভ দিচ্ছি। বাথরুমে যাওয়ার টাইম নেই। ফরেনার হয়ে নিরাপত্তা পাচ্ছি। কী দরকার আমাকে এত খাতির করার। এত টাকা পয়সা আমার মতো খারাপ লেখকের পেছনে খরচ করার। খারাপ লেখক আমি, তাবীর সাংভি জেনেছেন আমার বই পড়ে নয়, কলকাতার কেউ নাকি বলেছেন। অবশ্য কে বলেছেন তা তিনি বলেননি। এদিকে সরকারি অফিসাররা নাকি বলছেন, তাঁদের কাছে আশ্রয় চাইছি, তারপর দৌড়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁদের বিরুদ্ধে বলছি। বীর সাংভির প্রশ্ন, বিরুদ্ধে কেন বলবো ফরেনার হয়ে! আমি নাকি হেডলাইন হয়েছি নানারকম কান্ড করে। মনে মনে বলি, কান্ড কি আমি করলাম? আমি তো আমার মতো কলকাতায় আমার ফ্ল্যাটখানায় লেখাপড়া করছিলাম, কারও পাকা ধানে মই দিইনি। তোদের সরকারই তো তাড়ালো, আমাকে হেডলাইন বানালো। তোদের সরকারই তো আমাকে আটকে রেখেছে ঘরে, বেরোতে দিচ্ছে না, কাউকে আসতে দিচ্ছে না আমার কাছে। হেডলাইন তো তোরা বানাস। রাজনৈতিক অত্যাচার আমার ওপর করে আমাকে হেডলাইন তো তোরা করিস বাপু। আমাকে তোরা তোদের ধর্ম আর রাজনীতির শিকার বানিয়েছিস। তোরা তো তোদের শিকারকে হেডলাইন করছিস। ভিকটিম তো ভিকটিম হতে চায়নি। ভিকটিম মাথা উঁচু করে বাঁচতে চেয়েছিল। কবে কোন পাঁচ বছর আগে সে কী লিখেছিল, তা নিষিদ্ধ করে তোরাই তো হেডলাইন বানালি তাকে। হাইকোর্ট সেই লেখা যে নিষিদ্ধ হওয়ার মতো নয় তা দুনিয়াকে জানিয়ে বইটাকে মুক্তি দিয়ে তো আবারও হেডলাইন করলো তাকে। তারপর তোদের ধর্মবাদীরা তো আবার সেই লেখার ওপর হামলে পড়লো, তোদের অধর্মবাদীরাও ধর্মবাদীদের খুশি করতে বেচারা আমার ওপর ঝপালো। তোদের ঝপাঝাপি, তোদের তান্ডব নেত্য তো আমাকে বারবার ‘হেডলাইন’ করছে। পাঠক নির্বিঘ্নে পড়ছিল আমার বই। বই তো বছরের পর বছর ছিল বইয়ের বাজারে। কেউ তো কিছু বলেনি। তোরা গন্ডগোল করবি, আর দোষ দিবি আমাকে। তোরাই রাগ দেখিয়ে বলবি, ফরেনার হয়ে অত বাড় বেড়েছে কেন, অত হেডলাইন হওয়া কেন!

সারাদিন মন খারাপ ছিল।

সন্ধের দিকে এক বন্ধু বললো, বীর সাংভিকে নাকি ভ’বাবু ওই লেখাটি লিখতে বলেছিলেন। আরও কিছু সম্পাদক এবং সাংবাদিককেও নাকি বলেছেন, আমার নামটি কোথাও তিনি ছাপার অক্ষরে দেখতে চান না।

মানুষ যে কেন ধর্মীয় মৌলবাদীদের দোষ দেয়! ওদের যত না দোষ, তার চেয়ে বেশি দোষ এইসব রাজনীতিক, সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী যাঁরা মৌলবাদী দ্বারা আক্রান্তদের অনুভূতির আঘাতের দিকে ফিরে তাকান না, কিন্তু আক্রমণকারী মৌলবাদীদের অনুভূতির আঘাত নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন, এবং সহানুভূতিশীল।

.

২৪ ডিসেম্বর

সুয়েনসনের সঙ্গে দেখা করতে চাইলাম। নাকচ হল অনুরোধ। ওকে আমার হিন্দি প্রকাশক অরুণ মাহেশ্বরীর কাছে চলে যেতে বললাম। আমার প্রকাশকই নিলেন ওর দেখাশোনার ভার।

আর এদিকে আমি। মন খারাপের আমি। অবশ্য আজ একটু একটু করে মন ভালো হল ক’টি ফোন পেয়ে। কলকাতা থেকে বিভুতিভূষণ নন্দী, সুনন্দ সান্যাল, দেবব্রত বন্দোপাধ্যায় ফোন করে সহানুভূতি প্রকাশ করলেন। একজন তো বললেন, নেলসন ম্যান্ডেলার কথা ভাবতে। ম্যাণ্ডেলা দু’যুগেরও বেশি ছিলেন জেলে। এই অবস্থা আমার থাকবে না দীর্ঘদিন, এরকমই আশ্বাস দিলেন সকলে। লিখতে বললেন। লেখার চেয়ে বড় আশ্রয় আমার আর কোথাও নেই, বললেন। আমি কী আর বুঝি না! লিখতে গেলে জানিনা কী এসে আমাকে উদাস করে দেয়। তাকিয়ে থাকি জানালার ওপারে, দীর্ঘশ্বাস আমাকে ডুবিয়ে নিতে থাকে।

আউটলুকের শীলা রেড্ডি বললেন, লেখক বুদ্ধিজীবীরা সই দিলেন আমার সমর্থনে। এও জানালেন, বৃন্দা কারাত দিতে চাননি।

ইউনেস্কোর গুডউইল অ্যামবাসাডার মনজিৎ সিং জ্যোতি বসুকে চিঠি লিখেছেন, টাইমস অব ইন্ডিয়ার একটা সম্পাদকীয় আমার লেখা একটি চিঠির সঙ্গে সেঁটে দিয়ে। মদনজিৎ সিংএর তুলনা হয় না। মানুষটার সঙ্গে ভালো করে কোনোদিন কথাও হয়নি, অথচ আমার জন্য কী আশ্চর্য সব কাজ করছেন।

অরুণ মাহেশ্বরী বললেন, তাঁর লেখকরা সব একজোট হয়ে আন্দোলন করছেন।

কলকাতা থেকে কিছু বন্ধু দিল্লিতে এসে অনশনে বসতে চাইছে। সোজা না বলে দিলাম। এসব করে কিছু লাভ হবে না, সে বুঝি। কারণ এই একশ কোটি লোকের দেশে লাখ লোক মিছিল করলে কাজ হয় হয়তো, দু’চারজন লোকের অভিমান বা অনশনের দিকে কেউ তাকায় না।

মন ভালো ছিল, রাতে খারাপ হয়ে গেল। দ্য স্টেটসম্যানে দেখি কলকাতায় বসে লেখা। ‘নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে’ এর অনুবাদ ব্যানিসড উইদিন অ্যান্ড উইদাউট’ লেখাটা ছাপা হয়েছে, কিন্তু লেখার শেষে যে তারিখটা উল্লেখ করেছিলাম, সেটা নেই। তারিখ উড়িয়ে দিয়ে ঘটা করে এই বলে ছাপা হল, দিল্লির সরকারের কান্ডকারখানা দেখে বিরক্ত হয়ে লিখেছি। স্টেটসম্যানের কান্ডকারখানা দেখে আমিও বিরক্ত। তারিখ জানালে জানি না ওদের কেন ভয় হয় যে পাঠক লেখা পড়বে না। ইতিহাসের মূল্য কি তবে কিছু নেই? তুই নিষিদ্ধ, তুই কথা কইস না’ বিভিন্ন সময় ধরে আমার প্রকাশিত লেখার একটা সংকলন। সদ্য বেরিয়েছে। উনিশশ তিরানব্বই সালে লেখা প্রথম লেখাটি। শেষ লেখাটি এ বছরের। মাঝখানে বিভিন্ন সময়ে দেশের কথা মনে করে ইওরোপে বসে, অথবাকলকাতায় বেড়াতে এসে লেখা। সাল উল্লেখ না করে প্রকাশক দেখাতে চাইলো, সবই এবছর লেখা। শুধু তাই নয়, ভাবটা এমন, কলকাতা থেকে আমার নির্বাসন হওয়ার পর কেঁদে কেটে লেখাগুলো লিখেছি। ঘটনায় ঘনঘটায় দিল্লিতে ছিটকে পড়েছি, এখান থেকেই পাঠিয়েছি পান্ডুলিপি। এসব কি পাঠক ঠকানো ছাড়া অন্য কিছু? এই অসততা আমি একেবারে সইতে পারি না।

আকাশে বড় একটা গোল চাঁদ। আজ হয়তো পূর্ণিমা। পূর্ণিমা হলেই বা কী! আমি কি পূর্ণিমায় ভিজে ভিজে কোথাও কারও সঙ্গে খোলা মাঠে গান গাইতে পারবোআর। জানালা দিয়েও আনমনে চাঁদ দেখা যায়। কতদিন পর চাঁদের মুখ! আমিও চাঁদের মতো খুব একা। চারদিক ঘোর কালো আঁধার। আমি আর চাঁদ শুধু জেগে থাকি, একা একা।

.

২৫ ডিসেম্বর

সেই বাড়িটায় নিয়ে যাওয়া হল আমাকে নিয়ে আসা হল সুয়েনসনকে, নিয়ে আসা হল অশেষ আর মুনাকে। অশেষ আর মুনা এসেছে কলকাতা থেকে আমার সঙ্গে দেখা করতে। একটা ছোট সুটকেসে ভরে কলকাতার বাড়ি থেকে কিছু জরুরি জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে। যেহেতু যেখানে আছি, সেখানে কারও আসার নিয়ম নেই, তৃতীয় জায়গায় দেখা করে সুটকেসটি নেওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন প্রভু। ওদেরকে হোটেল থেকে তুলে এ গলি ও গলি ঘুরিয়ে গোলক ধাঁধার মধ্যে ফেলে নিয়ে আসা হয়েছে। সবাইকেই তাই করা হয়, যাদেরকে এই গোপন জায়গাটিতে এ পর্যন্ত আনা হয়েছে। সুটকেসের ঘটনা আছে বলেই অশেষ আর মুনার সঙ্গে দেখা হতে পারলো। অবশ্য কোনো ঘটনাই ঘটনা নয়, প্রভু যাঁর সঙ্গে লিয়াজোঁ রাখছেন, তিনি সম্মতি দিলেই তবে দেখা হওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন প্রভু। প্রভু একা কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক নন, হলে তিনি আমাকে অনেক আগেই কলকাতা পাঠিয়ে দিতেন।

সুয়েনসনের জন্য একটা ঝাউ গাছ, গাছ সাজানোর যাবতীয় জিনিস সবই ভারত সরকারের দান। দুপুরে বিশাল খানাপিনা। সেও সরকার। খাওয়ার পর চকলেট কেক। সেটাও। এমনকী সুয়েনসনকে যে একটাবই উপহার দিলাম, সেটাও। আমি বলিনি এসবের ব্যবস্থা করতে, শুধু বলেছিলাম সুয়েনসন নিশ্চয়ই বড় দিনটা কাটাতে চায় আমার সঙ্গে। সুয়েনসন নাস্তিক লোক। কিন্তু নাস্তিক হয়েই বড় দিনের উৎসবটা দেখেছি ঠিকই করে। অযৌক্তিক গাছ সাজানো আর পরস্পরকে এটা সেটা উপহার দেওয়া ধার্মিক উৎসবের চেয়েও বড় সামাজিক উৎসব।

অশেষরা একসময় চলে গেল। ট্রেন ধরবে কলকাতা ফেরার। ওদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি। আমারও তো ঘর ওই শহরে। কেবল আমারই ফেরার কোনও উপায় নেই। আর সবাই, গাধা ঘোড়া গরু মোষ, চোর ডাকাত খুনী সন্ত্রাসী কলকাতা শহরে ফিরতে পারে, কেবল আমি পারি না।

সারাদিনে বড়দিনের উপহার এল টেলিভিশনে। কলকাতা থেকে এক বন্ধু ফোনে বললো যে জ্যোতি বসু আমাকে বলেছেন কলকাতায় স্বাগতম। টেলিভিশনের সব চ্যানেলগুলোই দেখাচ্ছে জ্যোতি বসুর কথা। স্বাগত আমাকে জানিয়েছেন বটে তিনি, তবে জানানোর পরই বলে দিয়েছেন আমার নিরাপত্তার দায়িত্ব কেন্দ্রের। তাহলে তো কমিউনিস্ট নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসু, সিতারাম ইয়েচুরির কথার মতোই কথা হল অনেকটা। ওঁরাও মাঝে মাঝে বলছেন, নিরাপত্তার দায়িত্ব কেন্দ্রকে নিতে হবে। তবে জ্যোতি বসুর মুখে ওই ‘স্বাগতম’ শব্দটি, শুনেছি মেয়েটার মন খারাপ’ বাক্যদুটো আমার মন ছুঁয়ে যায়। জানি যে এর পরের কথাগুলো খুব রাজনৈতিক, কেন্দ্রের কাঁধে দায়িত্ব দেওয়া। দ্বিখন্ডিত বইয়ে যা লিখেছি তা লেখা আমার উচিত হয়নি, এ লেখা কোনও মুসলমান মানতে পারবে না। জ্যোতি বসু বললেন। এসব কী কোনও নাস্তিকের মুখে মানায়! নাকি হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ইহুদিদেরই নাস্তিক হওয়া মানায়, তাদেরই অধিকার আছে ধর্ম নিয়ে সমালোচনা করার, মুসলমানের নেই, কারণ মুসলমান মৌলবাদীরা তা সইতে পারে না বলে? পিছিয়ে পড়া একটি অন্ধকার সমাজকে কেবল সংস্কার দিয়ে আলোকিত করা যায় না, আঘাত দিয়ে আগে সজাগ করতে হয়। সজাগ না হলে অন্ধকারে যে ডুবে আছে, তা কী করে টের পাবে। আর সত্যি কথা বলতে কী, মুসলমান সমাজকে আলোকিত করার উদ্দেশ্যে আমি কোনও লেখালেখি করি না। লিখি মনের কথা, বিশ্বাসের কথা। লিখতে গিয়ে কোনও সম্প্রদায় বা কোনও লিঙ্গ ভাবনা আমাকে আঁকড়ে ধরে না। মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি আমি, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে মানুষকে ভাগ করি না। নিজে ধর্মমুক্ত, সম্প্রদায়মুক্ত, সংস্কারমুক্ত হলেই সবাইকে সমান চোখে দেখা সম্ভব।

সন্ধেয় প্রভু ফিরলেন তৃতীয় বাড়িতে। প্রভুর ফেরা মানে বিদায় ঘণ্টা। এখন চলে যেতে হবে আবার সেই ঘরটিতে, লোকচক্ষুর আড়ালে, যে ঘরটিতে থাকার কারণ নিরাপত্তা নয়, কারণ রাজনীতি। যে রাজনীতি আমি বুঝি, কিন্তু মেনে নিতে পারি না। সারাপথ প্রভু শুধু একটিই তথ্য দিলেন, আমার সঙ্গে ইউটিভির রাম মার্চেনড়ানির দেখা হবে না। ইউটিভি আমার ওপর ছবি বানাতে চাইছে। কর্তারা দেখা করে চাইছেন কথা বলতে। দেখা হওয়ার জন্য যে প্রভুর কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম, তা নাকচ হয়ে গেছে। কে নাকচ করলো, তা প্রভুও বলেন না, আমিও জানতে চাই না। প্রভু বলেছিলেন, আমার আবেদন নিবেদন তিনি যথাস্থানে জানিয়ে দেন, সেই যথাস্থান থেকে যা আদেশ আসে, তাই তিনি মাথা নত করে পালন করেন।

প্রভু বিদায় না নিয়েই চলে গেলেন। এরকম হয় না কখনও। তাঁর রাগের কারণ আমি বুঝি। রাগ তাঁর, আমি কেন জ্যোতিবাবুর বক্তব্যের উত্তরে টিভিতে আমার অনুভূতি ব্যক্ত করেছি। প্রচুর সাংবাদিকের ফোন বেজেই চলছিল, একজন চেনা সাংবাদিককে শুধু বলেছি, ‘খুব ভালো লাগছে জ্যোতি বাবুর কথায়, আশা করি একদিন মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হবে, একদিন আমিও ফিরতে পারবো আমার প্রিয় শহরটিতে। এইটুকু কেন বলবো না আমি! জ্যোতি বাবু আমাকে স্নেহ করতেন, তিনি স্বাগতম বলার পরও আমাকে কেন মুখ বন্ধ রাখতে হবে, কেনই বা আমি আমার ইচ্ছেগুলোর কিছুই মুখ ফুটে বলতে পারবোনা! প্রভুর কড়া আদেশ এবং অনুরোধ ছিল, প্রেস খারাপ, প্রেসের চৌদ্দ গুষ্ঠি খারাপ, প্রেসের সঙ্গে ফোনে কথা বলোনা। প্রভুর আদেশ আমি প্রথম দিন থেকেই মেনে চলছিলাম। ধীরে ধীরে প্রভুকে যত দেখছি, তত জানছি, প্রভু এবং প্রভুর ওপরওয়ালারা কেউই দেবতা নন।

.

২৭ ডিসেম্বর

সন্ধেবেলায় প্রভুর সঙ্গে বসে কথা বলছিলাম। টেলিভিশনে ‘টাইমস নাও’ চ্যানেলের হেডলাইন খবরে প্রণব মুখার্জির মন্তব্য দেখাচ্ছিল তখন, যে, কারও নিরাপত্তা দেওয়া রাজ্যের দায়িত্ব, কিন্তু রাজ্য যদি এ ক্ষেত্রে বাড়তি নিরাপত্তার জন্য কেন্দ্রকে বলে, কেন্দ্র সানন্দে সেই বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে। এই খবরের মধ্যে হঠাৎ রাওয়ালপিন্ডিতে বেনজিরের নির্বাচনী সভায় বোমা হামলার খবর। টেলিভিশনে চোখ আমার। কিছু লোক মরে পড়ে আছে, কারও ঠ্যাং নেই, কারও খুলি উড়ে গেছে, মানুষ ছোটাছুটি করছে, চিৎকার করছে, কাঁদছে। কী ভয়ংকর! কী বীভৎস দৃশ্য! নিচের স্ট্রিপগুলো দেখছি, বেনজির সেইফ। এর একমিনিট পর বেনজির ইনজুর্ড, এর কিছুক্ষণ পর বেনজির আনকনশাস। এর আধমিনিট পর বিশাল বড় ব্রেকিং নিউজ, বেনজির ডেড। স্তব্ধ হয়ে গেলাম। শুধু অস্ফুট উচ্চারণ, এ কী! এ কী কান্ড! এ কী সত্যি! এ কী হতে পারে!

হ্যাঁ হতে পারে। পাকিস্তান নামের দেশটিতে সবই হতে পারে। সন্ত্রাস ছড়াতে এবং সন্ত্রাসী তৈরিতে এর চেয়ে চমৎকার দেশ আর জগতে কোথাও নেই। ভয়, ও দেশের কোনও পাগল যদি পারমাণবিক বোমাগুলোর নাগাল পায়! জগৎটা নিমেষে ছাইয়ের মতো উড়িয়ে দেবে।

বেনজির আমার কাছে এমাসেই দুটো চিঠি লিখেছিলেন। প্রথম চিঠির উত্তর অনেকদিন পর দিয়েছিলাম। একটু একটু সন্দেহ ছিল। সত্যিই কি বেনজির ভুট্টো আমাকে চিঠি লিখেছেন। কেন তিনি এত ব্যস্ততার মধ্যে আমার মতো অরাজনৈতিক একজন মানুষকে চিঠি লিখে যাচ্ছেন। আমাকে সমর্থন করা মানে তো তাঁর মুসলমানের ভোট না পাওয়া। আমার এরকম একটি সংজ্ঞাই তো এই উপমহাদেশের গোপন অভিধানে করা হয়েছে। এ খবর যদি লোকে জেনে যায়, তবে তাঁরই বিপদ হবে ভীষণ। জীবনে আমি কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কোনও চিঠি-টিঠি পাইনি। এই প্রথম। তারপরও হটমেইলের ঠিকানা দেখে মনে খটকা তো লেগেই আছে, যে, বেনজির নয়, অন্য কোনও লোক মজা করার জন্য, অথবা কোনও বদ উদ্দেশ্যে চিঠি লিখেছে। চিঠি সম্পর্কে প্রভুকেই কিছু বলিনি, যে প্রভুকে আমি সব কথাই বলি। কী করছি, কী ভাবছি, সব। প্রথম চিঠিটি পাওয়ার বেশ কিছুদিন পর বেনজিরকে একটি চিঠি পাঠাই আমি। সাদামাটা ধন্যবাদ জানানো চিঠি। চিঠি পাঠানোর দুদিনের মধ্যেই তার দ্বিতীয় চিঠিটি আসে। দ্বিতীয় চিঠি পাওয়ার পর কোনও উত্তর দিইনি। কারণ হটমেইল থেকে কোনও বড় রাজনৈতিক দলের চিঠি আসবে, এটা অনেক ভেবে দেখেছি, মানতে পারিনি। হটমেইল যদি কষ্টেসৃষ্ঠে মেনে নেওয়া যায়, সোনিয়া মানা যায়। তিনি একজন নেত্রী, আরেকজন নেত্রীকে মিসেস সোনিয়া গান্ধি অথবা সোনিয়া গান্ধি না বলে শুধু সোনিয়া বলে ডাকবেন না। কোথাও ভুল হচ্ছে। নিশ্চয়ই এই চিঠি বেনজিরের পাঠানো নয়। নিশ্চয়ই কেউ মজা করছে। কিন্তু কারইবা মজা করার দায় পড়েছে! মজাটা করে কার কী লাভ! দ্বিতীয় চিঠির কোনও উত্তর বেনজির ভুট্টো পাননি, সোনিয়া গান্ধিকে সোনিয়া লেখার অপরাধে।

এই সেই চিঠি, যেগুলো একবার পড়লে মনে হয় হ্যাঁ বেনজিরের লেখা। আবার মনে হয়, না, তাঁর লেখা নয়। হয়তো তাঁরই লেখা ছিল। মাত্র আট নদিন আগে পাঠিয়েছেন চিঠি। দ্বিতীয় চিঠির উত্তর না দিয়ে আমি হয়তো ভুলই করেছিলাম। না, চিঠি বড় কথা নয়। জলজ্যান্ত মানুষটা একটু আগে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়ে মঞ্চ থেকে নামলেন, নেমে গাড়িতে উঠলেন, গাড়ি সামান্য এগোতেই তাঁকে গুলি করা হল, তাকে মেরে ফেলা হল। আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ হল। কিন্তু আততায়ী কী করে বেনজিরের গাড়ির এত কাছে আসতে পারলো! পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের জন্য যে ধরনের কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা, সে রকম বেনজিরের জন্য ছিল না।

প্রথম চিঠি–

Dear Ms. Taslima Nasreen,

I have been impressed by your courage and determination in the face of such backwardness and fundamentalism. I was not able to contact you before due to my pressing engagements at home. I would extend my unflinching sup port to you. I have contacted Sonia and have urged her to provide you with all legal avenues of protection. I was saddened to know that you had to make amends in your book. Your prose and poetry have been an integral part of my collection and I would like it to bloom further with fresh and bold ideas like yours. Keep up the struggle but please remember that some times discretion is the better part of valor.

With warm regards.
Benazir Bhutto
Chairperson –Pakistan Peoples Party

দ্বিতীয় চিঠি —

Dear Ms Taslima Nasreen,

I am so glad that you are fine. I know what it is like to live under the puritani cal yoke of our backward looking societies. It is like trying to find fresh oxygen in a room filled with smoke. I hope you reach a safe and functional destination soon. I am sure Sonia will chalk out something for your safety. Congress should enhance its liberal image by extending all support to you.

Remember dear, home is where your human soul finds resonance. Wishing you all the best.

Sincere regards
Benazir Bhutto
Chairperson –Pakistan Peoples Party

শুনেছি জারদারি একটি অপদার্থ লোক। অনেকে বলে বেনজিরের মতো শিক্ষিত মহিলা কী করে জারদারির মতো একটা চোর আর অপদার্থকে বিয়ে করে! ঠিক এরকমও আমার বেলায়, আমিও তো বিয়ে করেছিলাম অপদার্থ আর বদমাশকে। ভুল যে কেউ করতে পারে। বেনজিরের আর আমার মধ্যে পার্থক্য হল, আমি তালাক দিয়েছি অপদার্থদের, বেনজির দেননি। আরও একটি বড় পার্থক্য, বেনজির ভোটের জন্য অনেক মৌলবাদীর সঙ্গে আপোস করেছেন, আমি কোনও স্বার্থে বা কোনও কারণেই মৌলবাদীদের সঙ্গে আপোস করিনি।

.

২৮ ডিসেম্বর

‘নির্ভীক, সত্যসন্ধ, বিশ্ববিশ্রুত বাঙালি লেখিকা তসলিমা নাসরিন সম্প্রতি দিল্লিতে বস্তুত নিঃসঙ্গ গৃহবন্দি। যদিও তাঁর অনেক রচনা ভারতের বিভিন্ন ভাষায় এবং পশ্চিমের অধিকাংশ প্রধান ভাষায় তর্জমাকৃত রূপে প্রকাশিত হয়েছে, তাঁর মাতৃভাষা বাংলা, এবং সেই ভাষাতেই তিনি অসামান্য শক্তিশালী লেখিকা। তাঁর সাহসী সত্যকথনের জন্য তিনি বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত। তসলিমা শিল্পের জন্যই শিল্প এই তত্ত্বের শিল্পী নন। তিনি চান সমাজ এবং সংস্কৃতির ব্যাপক পরিবর্তন –উভয়ক্ষেত্রেই স্বাধীনতা, সাম্য, ন্যায়, সতোর প্রতিষ্ঠা। ভাষা তাঁর নিপুণ হাতে সেই যন্ত্র যাকে তিনি প্রয়োগ করেন মানুষের রচিত শৃঙ্খলের মোচনে, সেই মহৎ প্রয়াসে অত্যাচারিতের চেতনায় উদ্যোগের উদ্দীপনে’ –শিবনারায়ণ রায়।

বুদ্ধিজীবীদের বিবৃতি শেষ পর্যন্ত ছাপা হল পত্রিকায়। শীলা রেড্ডি বিবৃতিটা লিখেছেন বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ করে আমার খুব খারাপ সময়ে তাকে যে কথাগুলো বলেছি, সেগুলোই সাজিয়ে। পড়ে আমি সত্যিই আহত হই। এ কারণেই কি শীলা একবারও আমাকে পড়ে শোনায়নি বিবৃতি? শোনালেই আমি আপত্তি করবো বলে! সই করেছেন খুশবন্ত সিং, অরুন্ধতী রায়, শ্যাম বেনেগাল, গিরিশ কারনাড, এম এ বেবি, আউটলুকের সম্পাদক বিনোদ মেহতা। এ আর ক’জন। শীলা তো বলেছিল প্রচুর বুদ্ধিজীবী নাকি সই দিচ্ছেন। উচিত ছিল ওঁদের নিজেদের বলা, আমার অভিযোগ উল্লেখ করে বিবৃতি তৈরি করাতে আমার এমন মনে হচ্ছে যে মুক্ত চিন্তার বা মত প্রকাশের অধিকার চাওয়াটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। অভিযোগগুলো আমি তো বিবৃতিতে ব্যবহার করার জন্য করিনি। সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার কারণে এখন যদি আমার ওপর বুলডোজার চলে, কেউ কি আমাকে বাঁচাবেন। এসব কারণে মন খারাপ।

বেনজিরের মৃত্যু এখনও চোখের সামনে। আল কায়দা আজ জানিয়ে দিয়েছে তারা মেরেছে বেনজিরকে। আমাকেও কি একদিন এভাবে মেরে ফেলবে আল কায়দার লোক? যখন বাংলাদেশে ছিলাম, যখন আল কায়দার নাম বা দুর্নাম কিছু হয়নি, ওসামা বিন লাদেনও চেনা কোনও নাম নয়, তখনই একবার লেখা হয়েছিল ওসামা বিন লাদেন এবং আফগানিস্তান থেকে জঙ্গী ট্রেনিং নিয়ে আসা বাংলাদেশি তালিবানরাও নাকি আমার মৃত্যু চায়। তারপর নানা কারণে ওসামা বিখ্যাত বা কুখ্যাত হয়ে উঠলো। আমাকে ভুলে গিয়ে বা আমার চেয়ে বড় টার্গেট পেয়ে গিয়ে বাঁচিয়েছে আমাকে। বাংলাদেশে হরকতুল জেহাদি ঠিক ওই সময়টাতেই গড়ে উঠেছিল, উঠেই আমার ফাঁসি চাইতে শুরু করে। তাদের নাম এখন বিশ্বের বাজারে হুজি। হুজি এখন বড় সন্ত্রাসী দল। শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারতেও সময় সময় বোমা ফাটিয়ে যায়। প্রচুর নিরীহ মানুষকে নিশ্চিন্তে খুন করে যায়।

মেরে কি সত্যিই আমাকে ফেলবে কোনও ইসলামি সন্ত্রাসী দল। বিশ্বাস হতে চায় na, আবার মনে হয় বুক বরাবর গুলি ঢুকে গেল, মনে হয় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলাম কোনও আত্মঘাতী বোমা হামলায়। হয়তো মরতেই হবে ওভাবে। এই ভয়ে ইঁদুরের মতো গর্তে লুকিয়ে থাকতে হবে কেন আমাকে? মরবো বলে কি বাঁচবো না?

রাতে টিপু সুলতান মসজিদের ইমামের বক্তব্য পড়লাম নেটে। প্রেস কনফারেন্স করেছে ইমাম। ইমামের বক্তব্য, আমি কলকাতায় ফেরত গেলে আগুন জ্বলবে, এত বুলেট নেই পুলিশের শেষ করার, এত বড় জেলখানা নেই এত মুসলিমকে পোরার। জ্যোতি বসুর বক্তব্য তাদের ভালো লাগেনি। তারা কলকাতায় আমাকে চায় না। এই হল মোদ্দা কথা। আমার নাকি দ্বিখন্ডিতর পৃষ্ঠা বাদ দিয়ে সব শেষ হয়নি। ক্ষমা চাইতে হবে এতদিন যত ইসলামবিরোধী লেখা লিখেছি তার জন্য, তারপর কলমা পড়ে মুসলমান হতে হবে। অল ইণ্ডিয়া মাইনরিটি কমিটির ইদ্রিস আলীও ভিড়েছে দলে। হাউমাউখাউ করে জানিয়ে দিল, রাস্তায় নাকি মুসলমানের ঢল নামবে আমি কলকাতায় ফিরলে।

কোন দেশে বাস করছি। এ কি পাকিস্তান নাকি বাংলাদেশ।

ইচ্ছে করলেই কি সিপিএম আর কংগ্রেসের নেতারা সামাল দিতে পারতেন না এই মোল্লাদের! শুনেছি, ইমাম সিপিএমের দালাল, আর ইদ্রিস আলী কংগ্রেসের। কোনও দল থেকে কি এদের বালখিল্য উগ্রতার জন্য ধমক দেওয়া হয়েছে। কেউ এদের তো কিছু বলছেই না। কেউ কেউ বলছে, কানে আসছে, কোথাও কোথাও পড়ছি যে এদের দিয়ে নাকি করানোও হচ্ছে এই দাঙ্গা হাঙ্গামা। যেন এদের ধমকে হুমকিতে আমি কলকাতা যেতে না পারি। আর মুসলিম ভোট হারানোর কোনও ঝুঁকিও কারও রইলো না।

যে ইদ্রিস আলীকে ২১ নভেম্বরের কীর্তির জন্য কংগ্রেস বহিষ্কার করেছিল, সেই কুখ্যাত ইদ্রিস আলীকে দেখতে জেলখানায় গেলেন কংগ্রেস নেতারা। কংগ্রেসে তাকে ফিরিয়ে তো নেওয়া হলই, রীতিমত সংবর্ধনা দেওয়া হল। এই যদি হয়, এতই যদি আস্কারা ইদ্রিস আলীকে দেওয়া হয়, যা কিছু করার ছাড়পত্র তাকে যদি দেওয়াই হয়, তবে দেবে না কেন সে হুমকি!

২৯ ডিসেম্বর সারাদিন কী করে কাটলো? না, কিছু করে কাটলো না। কিছু না করে কাটলো। আমার এই অবস্থাকে আমি হাউজ অ্যারেস্ট বলি না। বলি না এই কারণে যে হাউজ অ্যারেস্ট হলে লোক আসতে পারতো দেখা করতে। হাউজ অ্যারেস্ট হলে দেশ থেকে বেরোতে দেয় না। আমি দেশ থেকে বেরোতে চাইলে এরা খুশিতে লাফিয়ে বিমান বন্দরে গিয়ে বিমানের সৰ্বোত্তম আসনে আমাকে বসিয়ে দিয়ে আসবে।

একে আমি জেলখানাও বলি না। বলি না কারণ জেলখানায় ভিজিটিং আওয়ার্স থাকে। আমার এখানে নেই। জেলখানার ঠিকানা আছে, আমার কোনও ঠিকানা নেই। জেলখানায় যারা আছে, তারা জানে কতদিনের জন্য তাদের জেল হয়েছে। তারা জানে কবে তারা বেরোবে। আমি জানি না আমার মুক্তি কবে।

এরকম জায়গায়, তথাকথিত ‘সেইফ হাউজ’এ রাখা হয় বড় ক্রিমিনালদের। গোয়েন্দারা পুঁতিয়ে, খুঁচিয়ে, লাথি মেরে, কিল মেরে, চুল টেনে, গায়ে গরম জল ঢেলে ক্রিমিনালদের পেটের কথা বার করে। কিন্তু এত দীর্ঘদিন কাউকেই রাখা হয় না। আমাকেই রাখা হচ্ছে। আমি ক্রিমিনাল নই, আমার পেটে কোনো গোপন কথা নেই খুঁচিয়ে বার করার। যখনই আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, কে ফোন করেছে, কী কথা হয়েছে, কোথায় কী হচ্ছে আমাকে নিয়ে, আমার মনে কী হচ্ছে, কী ভাবছি, কী ভাবছি না, সবই বলে দিই প্রভুকে।

ফোনে আড়ি পাতার ব্যাপারটা আমি ধারণা করতে পারি না। কিন্তু কয়েকজন বন্ধু কোনো রকম প্রমাণ ছাড়া এবং দ্বিধা ছাড়া বলেছে আমার ফোনে আড়ি পাতা হয়। বলার পর আমি বুঝতে চেষ্টা করেছি আড়ি পাতা ব্যাপারটা ঠিক কেমন। বেশ কিছুদিন পর লক্ষ্য করেছি যে ওদের দেওয়া ফোনটায় কেউ ফোন করলে কথা খুব আস্তে শোনা যায়। প্রভু কথা বললে কিন্তু অত আস্তে শোনা যায় না। আমি জানি না আড়ি পাতা ফোনের এমনই চরিত্র কি না।

আমি নজরবন্দি নাকি আমি গৃহবন্দি। ওপরওয়ালারা বলে দিয়েছেন, আমি গৃহবন্দি নই। কেউ তো এসে দেখে যেতে পারবে না, আমার বন্দিত্বের ধরন। কেউ আমার ত্রিসীমানায় আসতে পারবে না। কেউ জানবে না কোনওদিন কেমন আছি, কীভাবে আছি। একা একা এখানেই আমি পচে মরবো। এই বন্দিত্ব ঠিক কী কারণে, এর ধরনটাই বা কী, কাউকে আমি বোঝাতে পারি না। নিজেও কি খুব বুঝি আমি! মেইনস্ট্রিম পত্রিকার সম্পাদক সুমিত চক্রবর্তী, শীলা রেড্ডি এবং আরও কয়েকজন আমাকে নিয়মিতই ফোন করেন। এরা আমার চেয়ে অনেক কিছুই অনেক বেশি বোঝেন। শীলা রেড্ডির কাছে একবার জানতে চেয়েছিলাম আমাকে কলকাতায় না যেতে দিয়ে এ জায়গাটায় রেখেছে কেন, শীলা রেড্ডি দিব্যি বলল, তোমাকে মানসিক অত্যাচার এমন করবে যেন তুমি বাধ্য হয়ে এ দেশ ছেড়ে চলে যাও।

কিন্তু সংসদে তো বলা হয়েছে অতিথিকে বাস করতে দেওয়া হবে, এ ভারতের ঐতিহ্য!’ ভাঙা কণ্ঠ আমার, ‘আমি তো কোনো দোষ করিনি।’

‘দোষ করেছো তুমি।‘

‘কী দোষ?’

‘মৌলবাদী ক্ষেপিয়েছো, ওটাই দোষ।’

শীলা রেড্ডি রহস্যের হাসি হাসেন।

তাহলে মানসিক কষ্ট দেওয়া কেন? এত কিছুর দরকার কী। টেনে হিঁচড়ে বিমানবন্দরে ফেলে এলেই হয়। চলে যেতে তো বাধ্যই হব। আর এই আসছে ফেব্রুয়ারিতে যদি ভিসা বাড়ানোনা হয়, তা হলে তো চলেই যেতে হবে আমাকে।

সিগারেট আনানোর ব্যবস্থা করলাম। যে সিগারেট চার বছর আগে ছেড়ে দিয়েছি, সেই সিগারেট। আনার ব্যবস্থা করা মানে যে প্রভুর অফিসারের কাউকে আমার ইচ্ছের কথাটা জানাবো, সেই অফিসার যে লোকটা খাবার দিতে আসে, তাকে পয়সা দিয়ে দেবে, সে যখন আবার খাবার দিতে আসবে, সিগারেট নিয়ে আসবে। যে সিগারেটের গন্ধ পর্যন্ত সইতে পারিনি এই চার বছর, সেই সিগারেট। জীবন অর্থহীন লাগছে। জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে। সিগারেট কি আমার দুঃখ কমাবে? কমায় যদি, দেখি না! সিগারেট আনিয়েছি, এই ঘটনাও অফিসারদের জানাতে হয় ওপরে। আমার প্রতিমুহূর্তের নড়াচড়া, কথাবার্তা, দাঁড়ি কমা, সব। কিছুই এখানে প্রভুর অফিসারদের আড়ালে হতে পারে না, যা হবে, সবই ওদের সামনে হতে হবে। শুধু আমার ভাবনাগুলো ওরা না পারে দেখতে, না পারে শুকতে, না পারে স্পর্শ করতে, না পারে অনুমান করতে, না পারে নথিবদ্ধ করতে।

তাদের চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি এখানেই। আমার ঘরের লাগোয়া ঘরগুলোয় থাকে। একদল আজ আসে কাল চলে যায়, আরেক দল কাল যারা আসে পরশু চলে যায়। কারও দিনে, কারও রাতে। তাদের প্রায় সবার সঙ্গেই আমার খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সবাই খুব আন্তরিক, সহানুভূতিশীল, নম্র, ভদ্র। সবাই আমার মতোই তো মানুষ। তাদের জীবনের সুখ দুঃখের সব কাহিনী আমি জানতে পারবো, শুধু পিরবোনা জানতে কী চাকরি করছে তারা, কোন পদে করছে, নামের পদবীই বা কী।

আজ অঝোরে আবার কাঁদলাম। কেঁদে কেটে শান্ত হয়ে গাফফার চৌধুরীকে ফোন করলাম। তাঁকে বললাম, দেশের সরকারের কারও সঙ্গে পরিচয় থাকলে তিনি যেন আমার হয়ে একটু বলেন ওঁদের, আমাকে যে করেই হোক দেশে ফেরাতে যেন বলেন। যে কোনও শর্ত মেনেই আমি দেশে ফিরতে চাই। হাতের কাছে নিজের দেশ, যে দেশে জন্মেছি, বড় হয়েছি, যে দেশে বাবা মা, যে দেশে আত্মীয় স্বজন, যে দেশে শৈশব কৈশোর, যে দেশে স্মৃতি, সে দেশে যাওয়ার অধিকার আমার নেই। কেন থাকবে না আমার অধিকার? আর কত দিন এভাবে এ দেশে ও দেশে ঘুরবো! এবার ফিরতে দিন আমাকে। গাফফার চৌধুরী আমাকে কোনো আশার বাণী শোনান না।

এই বন্দি জীবন আমার আর সইছে না। আমার পক্ষে আর সম্ভব নয় এখানে থাকা। ফোন ট্যাপড হয়। কারা আড়ি পেতে শোনে আমার কথা মনে মনে নিশ্চয়ই খুশি হয় শুনে যে আমি কাঁদছি, নিশ্চয়ই খুশি হয় যে এ দেশ থেকে চলে যেতে চাইছি। হৃদয় বলে কারও কিছু নেই। কিছু নেই কেন? একটা অসহায় মানুষের জন্য সামান্য করুণাও কেন কারওর হয় না?

আমি ভেঙে পড়তে থাকি। আমার স্বপ্ন সাধ সব ভেঙে পড়তে থাকে। পায়ের তলার মাটি নাকি সরে যাচ্ছে আমার। কোথায় যাবো? দেশ ছাড়া, আর এই ভারত ছাড়া আমার আর কোনো মাটি নেই দাঁড়াবার।

শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে কথা বললাম। কান্না রোধ করতে পারি না। এত কাঁদছি কেন আমি? কোনওদিন তোএত কাঁদিনি। কোনওদিনই এত কাঁদিনি। মার অসুখের খবর পেয়ে কিছুদিন কেঁদেছিলাম। সেই তো মনে হয় শেষ কাদা। শঙ্খ ঘোষও কোনো আশা দেন না।

দীর্ঘ দীর্ঘ দীর্ঘ দিন পর পাচু ফোন করলো। বললো, কী ভাবে আমাকে রাখা হয়েছে, বাইরের কেউ জানে না। সবাই ভাবছে ভালোই আছি। আমি যে কীভাবে বাস করছি, কতটা পরাধীনতার শৃঙ্খল আমার গায়ে পায়ে জড়ানো, তা কল্পনাও কেউ করছে না।

পাচু বললো, বর্বরতা ছাড়া এ আর কিছু নয়। বললো, তুমি রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার, মৌলবাদের নয়।

কী রকম ভয় হতে থাকে আমার। মৌলবাদীরা যদি না চেঁচাতে, রাষ্ট্রের কেউ আমাকে নিয়ে মাথা ঘামাতো না। ওপরওয়ালা যদি ইচ্ছে করেন মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারেন, আবার ইচ্ছে করলে মৌলবাদীদের তোষণ করতেও পারেন। তোষণ করতে গেলে ক্ষতিটা অবশ্য আমার হয়। এ পর্যন্ত যত ক্ষতি আমার করেছে, আমাকে গৃহহীন, সমাজহীন, স্বজনহীন, বন্ধুহীন করেছে রাষ্ট্রের লোকই, মৌলবাদীরা নয়। রাষ্ট্রের লোকই আমাকে রাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করেছে, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগিয়েছে, ছুঁড়ে দিয়েছে শূন্যে, মহাশূন্যে।

মৌলবাদীদের এবং মৌলবাদী তোষণকারীদের অত্যাচারে কোনও সত্যিকার পার্থক্য আছে কি না আমার জানা নেই।

.

৩০ ডিসেম্বর

‘তসলিমাকে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে তিনি যেন সতর্ক হন, কাউকে যেন আঘাত দিয়ে কথা বলেন। কিন্তু এই সৎ পরামর্শ শুধু তসলিমাকে দেওয়া হচ্ছে, মৌলবাদী নেতাদের দেওয়া হচ্ছে না কেন? এসব পক্ষপাতিত্বের সুদূর এমনকী অনতিদূর পরিণাম কিন্তু ভয়ংকর। প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধে যারা সরব হন তাঁদের বাক্যে কিছু মানুষ অনিবার্যভাবে আঘাত পায়। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরছে, এই কথাটা একদিন ইউরোপের কিছু ধর্মবিশ্বাসী মানুষকে আঘাত দিয়েছিল। সব নতুন চিন্তাই কিছু মানুষকে আঘাত দেয়। তসলিমা নিজের মানবিক পরিচয়কে অকুণ্ঠভাবে স্থাপন করেছেন সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে। এই সাহসী প্রত্যয়ের জন্যই তিনি আজ বিশেষভাবে শ্রদ্ধার যোগ্য। তার জন্য রক্ষা করা হোক উদার আতিথ্যের আসন।‘ –অম্লান দত্ত

আমি যেভাবে বেঁচে আছি, সেভাবে বেঁচে থাকাকে বেঁচে থাকা বলে না। কোনও অন্যায় করিনি আমি। অথচ কলকাতায় আমার বাড়িতে আমাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল। দীর্ঘ চার মাস আমাকে ঘর থেকে বেরোতে দেওয়া হয়নি। শুধু তা-ই নয়, বারবারই সরকার পক্ষ থেকে আমাকে জানানো হয়েছে দেশ ছেড়ে নয়তো রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে কোথাও। আমি মাটি কামড়ে পড়ে ছিলাম। কলকাতা ছেড়ে, প্রিয় শহর ছেড়ে, দীর্ঘদিন ধরে সাজানো সংসারটি ছেড়ে, নিজের বাড়ি ছেড়ে, কোথাও যাইনি। যাইনি, কারণ যাওয়ার কোনও কারণ দেখিনি। আমি বিশ্বাস করিনি আমার কারণে শহরে দাঙ্গা লাগবে। বিশ্বাস করিনি আমার কারণে শহরে মানুষ মরবে। আমি তো জানি যে এই শহরেই আমি সবচেয়ে নিরাপদ বোধ করি। এই শহরেই কোনও নিরাপত্তারক্ষী ছাড়া দিনের পর দিন আমি নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়িয়েছি। কোনওদিন কোনও মৌলবাদী এগিয়ে আসেনি সামনে, যারাই কাছে এসেছে, ভালোবেসে এসেছে। যে দুএকজন মুসলমান নেতা আমার বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে কথা বলেন, তাঁদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে বলে বলেন। তারা যখন সাধারণ মানুষকে প্ররোচিত করেন, কোনও ধর্মীয় অনুভূতি থেকে করেন না। উদ্দেশ্য সম্পূর্ণই রাজনৈতিক। একুশে নভেম্বরের তান্ডবের সঙ্গে, আমি বিশ্বাস করি, আমার লেখার কোনও সম্পর্ক নেই। যদি সম্পর্ক থাকতো তাহলে ‘দ্বিখন্ডিত’ থেকে বিতর্কিত অংশ বাদ দেওয়ার

পর আমি কলকাতায় ফিরতে পারতাম।

আমি নিশ্চিত, যে ছেলেরা একুশে নভেম্বরে পথে নেমেছিল, তারা কেউ আমার লেখা পড়েনি। যে ঘৃণায় বা যে ক্রোধে তারা পুলিশের দিকে ইট ছুঁড়েছে, সেই ঘৃণা অন্য কারণে, সেই ক্রোধ অন্য কারণে, আমি কলকাতা শহরে বাস করি বলে নয়। উত্তেজনা তাদের মধ্যে যা ছিল, তা আরোপ করা।

দেশ থেকে বা রাজ্য থেকে আমাকে বের করে দেওয়ার যে ষড়যন্ত্র দীর্ঘদিন থেকে চলছিল, তা বাইশে নভেম্বর যে করেই হোক সফল করা হল। কিন্তু কী দোষ আমি করেছি? কী দোষে কলকাতায় আমাকে গৃহবন্দি থাকতে হল, কী দোষে আমাকে কলকাতা থেকে বের করে দেওয়া হল, কী দোষে চরম অনিশ্চয়তা, হতাশা আর শূন্যতা নিয়ে পড়ে আছি দিল্লির কোনও একটি ঠিকানাহীন ঘরে, যে ঘর থেকে বাইরে বেরোনোর কোনও অধিকার আমার নেই! যে ঘরে আমার কোনও আত্মীয় বা কোনও বন্ধু কোনওদিন ঢুকতে পারবে না! কী দোষে আমাকে প্রতিদিন দম বন্ধ হয়ে যাওয়া পরিবেশে ফেলে রাখা হয়েছে? কী দোষ আমি করেছি? কেন্দ্রীয় সরকার বলেছেন, আমাকে নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর নাম কি নিরাপত্তা? আমাকে বন্দি করে কি নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে আমাকে নাকি নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে অন্য কাউকে? জেলখানাতেও ভিজিটিং আওয়ার্স থাকে, আমার এখানে নেই। জেলখানাতেও কয়েদিরা জানে কবে তারা মুক্তি পাবে। আমি জানি না কবে এই দুঃসহ একাকীত্ব থেকে, ভয়াবহ অনিশ্চয়তা থেকে, মৃত্যুময় নিস্তব্ধতা থেকে আমার মুক্তি জুটবে। কলকাতায় আমাকে গৃহবন্দি করার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল যেন দেশ ছেড়ে বা রাজ্য ছেড়ে কোথাও চলে যাই। আর দিল্লির এই ঠিকানাহীন জায়গায় এভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য আমাকে পুরে রাখার কারণ কি এই, যে, অতিষ্ঠ হয়ে নিজেই যেন এ দেশ ছেড়ে কোথাও চলে যাই? যদি তা না হয়, তবে কেন আমাকে পরাধীনতার শেকলে বাঁধা হয়েছে? কী কারণে শত অনুরোধ করার পরও আমাকে কলকাতায় যেতে দেওয়া হচ্ছে না? কী কারণে আমাকে দিল্লিতেও কোনও স্বাভাবিক সামাজিক জীবন যাপন করতে দেওয়া হচ্ছে না?

না, দিল্লির কোথাও আমার বিরুদ্ধে কোনও সভা হয়নি, কোনও মিছিল হয়নি। আমার জীবনের ওপর কোনও হুমকি নেই। বরং সুশীল সমাজের সত্যিকার সেকুলার, সচেতন মানুষই আমার পক্ষে সভা করেছেন, মিছিল করেছেন, বুদ্ধিজীবীরা লিখছেন, লিখেছেন। তারপরও কেন বন্দি জীবন যাপন করতে হবে আমাকে? যদি হুমকি দেয় কেউ, তবে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হয়। যেমন এ দেশের প্রচুর মানুষের জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে। (বিদেশে প্রতিটি দেশেই আমার জন্য নিরাপত্তা দেওয়া হয়, ওসব দেশের আমি নাগরিক নই, তবুও। ভারত তো জাতিসঙ্রে বা রাষ্ট্রপুঞ্জেরই একটি দেশ।) জীবন যাপন স্তব্ধ করে কি কেউ বসে আছে? আমার কেন তবে সব স্তব্ধ হবে? কী যুক্তি এর পেছনে?

এ অবধি আমার সঙ্গে যে কাউকেই দেখা করতে দেওয়া হয়নি তা নয়। দেওয়া হয়েছে, তবে যেভাবে দেওয়া হয়েছে তা ভয়ংকর। ফাঁসির আসামি বা বড় কোনও ক্রিমিনালের বেলায় সম্ভবত এমন করা হয়। আমি যদি কারও সঙ্গে দেখা করতে চাই, যারা আমাকে এই জায়গায় রেখেছেন, তাঁদের কাছে বলতে হবে, একজনের সঙ্গে দেখা করতে চাই আমি। সেই একজনটি কে, কোথায় বাড়ি, কী করেন, ইত্যাদি নানা কিছু জেনে তারা যথাস্থানে আমার লিখিত বা মৌখিক আবেদন জানিয়ে দেবেন। ওখানে আমার ব্যাপারে। যারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তাঁরা কারা আমি জানি না, কয়েকদিন সময় নেবেন। দিন কয় পর আমার আবেদনের উত্তর তারা জানিয়ে দেবেন, দেখা হবে অথবা দেখা হবে না। বেশির ভাগ আবেদনকেই দেখা না হওয়ার কাতারে ফেলে দেওয়া হয়। যদি তারা দেখা করানোর সিদ্ধান্ত নেন, তবে কবে কখন কোথায় কতক্ষণের জন্য দেখা হবে, তার নির্দেশ তারাই দেন। এসবে কোনও স্বাধীনতা আমার নেই। তারপর দেখা করার যে দিনক্ষণ যা তাঁরা নির্ধারণ করেন, সেই অনুযায়ী আমাকে একটি কালো কাঁচ গাড়িতে ওঠানো হয়, গাড়িকে একটি তৃতীয় জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়, ওখানে আমাকে বসানো হয়। আমার যে বন্ধুর সঙ্গে আমি দেখা করবো, তার জায়গা থেকে তাকেও একই ভাবে আরেকটি কালো কাঁচ গাড়ি করে তৃতীয় জায়গায় নিয়ে আসা হয়। সেখানে তাদের বেঁধে দেওয়া সময় পর্যন্ত আমি বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে পারবো। কী কথা বলবো, কী করবো তা লক্ষ্য রাখা হবে। রোমহর্ষক এই দেখা হওয়া। কী অর্থ এসবের? যেন আতঙ্কে, যেন ভয়ে, যেন কুণ্ঠায় আমি কুঁকড়ে থাকি। যেন মরে যাই? যেন দেশ ছেড়ে চলে যাই এসব আর সইতে না পেরে? এ ছাড়া আর কী? এ ছাড়া আর কিছুই না।

কিন্তু এ দেশ ছেড়ে আমি যাবো না। যাবো না কারণ এ দেশ ছাড়া পৃথিবীতে অন্য কোনও দেশ নেই যে দেশকে আমি নিজের দেশ বলে ভাবতে পারি। এ দেশে সবচেয়ে বড় হুমকি পাওয়া মানুষ আমি নই। হুমকি পৃথিবীর যে কোনও দেশেই যে কেউ দিতে পারে। আজ তেরো বছর আমাকে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। যতনা আমি মৌলবাদের হুমকির শিকার, তার চেয়ে বেশি আমি মৌলবাদ -তোষণের রাজনীতির শিকার। আমাকে মৌলবাদীরা বাংলাদেশ থেকে বের করেনি, বের করেছিল বাংলাদেশ সরকার। আমাকে আজও যে দেশে ফিরতে দেওয়া হচ্ছে না, তা কার নির্দেশে? কোনও মৌলবাদীর নির্দেশ এ নয়, এ সরকারের নির্দেশ। আমি বিশ্বাস করি না সরকার আমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। বাংলাদেশ সরকার নিজেদের নিরাপত্তার কথাই ভেবে এসেছেন বরাবর।

আমি ভারতকে বাংলাদেশ বলে ভাবতে চাই না। যেটুকু নিরাপত্তা আমার দরকার, সেটুকু দিয়ে আমাকে স্বাভাবিক সামাজিক জীবন যাপন করতে দিতে, আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, ভারত সরকার পারেন। আমার কারণে কোথাও দাঙ্গা বাধবে, মানুষ মরবে, এসব আশংকা সম্পূর্ণই অমূলক। এসব আতঙ্ক তৈরি করার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল, আছে। আমার কারণে কোনওদিন পৃথিবীর কোথাও দাঙ্গা লাগেনি। কোনও লেখকের কারণে দাঙ্গা কোথাও লাগে না। কিছু মৌলবাদী আমার দ্বিখন্ডিত বইটির অংশ নিয়ে আপত্তি করেছেন। বইটি নিষিদ্ধ হওয়ার আগে, এবং নিষেধাজ্ঞা থেকে হাইকোর্ট বইটিকে মুক্তি দেওয়ার পর বইটি বাজারে বিক্রি হয়েছে, নির্বিঘ্নে, একটি দিনের জন্য বইএর বিরুদ্ধে কোনও বিক্ষোভ দেখায়নি কেউ। দাঙ্গার ভয় আমাকে অনেক দেখানো হয়েছে। ভয় দেখিয়ে আমাকে তাড়াবার চেষ্টা অনেক হয়েছে। আমি শুধু এই কথা বলতে চাই, আমি দোষী নই। আমি এও বলেছি, যে, আমি কারও অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার উদ্দেশ্যে কিছু লিখিনি, যদি কেউ আঘাত পেয়ে থাকেন আমি দুঃখিত। দ্বিখন্ডিত থেকে, নিজের লেখা বই থেকে দুটো প্যারাগ্রাফ বাদ দেওয়ার পর জামাতুল উলেমা হিন্দের প্রধান মৌলানা মাদানি, যিনি আমার বিরুদ্ধে বিষোদগার প্রচুর করেছেন, তিনিও বলছেন, ব্যস, ম্যাটার ক্লোজড, তসলিমা এ দেশে থাকতে পারেন, যে শহরে তার থাকার ইচ্ছে থাকতে পারেন, আমরা আর বিরোধিতা করছি না। তবে কোন বিরুদ্ধ-শক্তি আমাকে কলকাতায় যেতে বাধা দিচ্ছে?

ইমাম বরকতি আর ইদ্রিস আলী সেদিন আস্কারা পেয়ে চেঁচিয়েছেন। মনে আছে, সেই দুহাজার ছয় সালে, ইমাম বরকতি ফট করে মনের সুখে একটা ফতোয়া দিয়ে ফেলেছিলেন, মাথা নাকি কিসের যেন একটা দামও ঘোষণা করে ফেলেছিলেন, তারপর পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখার্জি তাঁর ঘরে ইমামকে ডেকে নিয়ে কিছু তাঁকে বোঝালেন, ঘর থেকে বেরিয়ে ইমাম বরকতি পুরো অস্বীকার করলেন ফতোয়ার কথা, তিনি নাকি আদৌ কোনও ফতোয়াই দেননি। ইমাম বরকতি বা ইদ্রিস আলীকে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মত প্রকাশের অধিকার সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়ার আজ কেউ নেই কেন? দাঙ্গা বাধাবার, ফতোয়া দেওয়ার, সন্ত্রাস করার অধিকার যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কারওরই থাকার কথা নয়, সে কথা তাদের বোঝাবার কেউ নেই আজ। সন্ত্রাস করার পর যদি তাদের সংবর্ধনা জোটে, তাহলে কেনই বা তারা বিরত থাকবে সন্ত্রাস থেকে? এও তো কথা।

কী অন্যায় করেছি আমি? হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সবাইকে আমি মানুষ হিসেবে দেখি। এ কি অন্যায়? মানুষের মধ্যে আমি সমতা চাই। মানবতার জন্য, সমানাধিকারের জন্য আমি নিরলস লিখে যাচ্ছি। মৌলবাদী, রক্ষণশীল, অনুদার, সংকীর্ণমন-লোকেরা আমার বিরুদ্ধে বলছে, তারপরও আমি লিখে যাচ্ছি মানুষের জন্য, মানুষের কথা। যে মানুষ দারিদ্রের শিকার, শিক্ষা স্বাস্থ্য থেকে বঞ্চিত, ভিন্ন ধর্মবিশ্বাসের কারণে যার মানবাধিকার লঙ্খন করা হয়, তার পাশে আমি চিরকাল দাঁড়াই। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানের পাশে আমি ঠিক একইভাবে দাঁড়াই, যেভাবে দাঁড়িয়েছিলাম বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুর পাশে। ইসলাম নিয়ে রাজনীতি করার অসৎ উদ্দেশ্যে যে স্বার্থান্বেষী মৌলবাদীরা তাদের গলা চড়াচ্ছে, তারা কোনও কারণেই পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের প্রতিনিধি নয়।

এখনও কি চিহ্নিত করার সময় আসেনি কে সমাজের শত্ৰু, কে নয়? এখনও কি এই অযৌক্তিক বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার আমার সময় আসেনি? মানবতার জন্য লিখে, চিন্তার স্বাধীনতার পক্ষে লিখে, নিজের মত প্রকাশ করে আমি কি তবে ভুল করেছি এই ভারতবর্ষে? কী অন্যায়ের শাস্তি আমাকে ভারত সরকার দিচ্ছেন? পুরো ভারতবাসী কি তাহলে দেখবে যে –যন্ত্রণায়, কষ্টে, স্বাসকষ্টে, হতাশায়, শূন্যতায় ভুগতে ভুগতে, অন্ধকারে, সবার চোখের আড়ালে পড়ে থেকে যেন ধীরে ধীরে আমি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাই? দেশহীন, রাষ্ট্রহীন, রাজ্যহীন, সমাজহীন, বান্ধবহীন হয়ে যেন আমি মরে যাই? কী অপরাধ করেছি আমি, যার শাস্তি এই সেকুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আমাকে দিচ্ছে? রাজনীতি আমি কোনওদিনই করিনি। আমি রাজনীতি বুঝিও না। একজন লেখককে নিয়ে রাজনীতি, অনুরোধ করছি, বন্ধ করা হোক। একজন লেখককে দেওয়া হোক লেখার পরিবেশ, মুক্তচিন্তার পরিবেশ। একজন লেখককে দেওয়া হোক নির্ভয়ে লেখার অধিকার। আমার বিনীত অনুরোধ এই। এই দেশের কাছে, এই রাষ্ট্রের কাছে আমার এই একটিই চাওয়া। সেই আদিকাল থেকে যে মানুষই আশ্রয় চেয়েছে, ভারতবর্ষ তাকে আশ্রয় দিয়েছে। ভারতবর্ষের এই মহান উদার ঐতিহ্য নিয়ে আমি গৌরব করি। এই ভারতবর্ষ নিয়ে লেখক হিসেবেও আমি যেন বাকি জীবন গৌরব করতে পারি।

আপনারা যারা আজ আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন, যারা আজ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে সমবেত হয়েছেন, তাঁদের আমি অন্তরের কৃতজ্ঞতা জানাই। আপনাদের কাছে করজোড়ে আমি বলছি, আমাকে উদ্ধার করুন আপনারা। নিরন্তর মানসিক যন্ত্রণা থেকে আমাকে বাঁচান। আপনারাই আমার আত্মীয়, বন্ধু। জগতে আপনারা ছাড়া আমার কোনও স্বজন নেই। শুভবুদ্ধির মানুষের চেষ্টায় আমি কোনও একদিন মুক্তি পাবো, এই বিশ্বাসে আমি এখনও এখানে শ্বাস নিচ্ছি। এই একটি আলোই, এই একটি আশাই এখন আমার সামনে। বাকি সব অন্ধকার।

 ০৯.২ ডায়রির পাতা (জানুয়ারি)

১ জানুয়ারি

‘মৌলবাদীদের মন রাখতেই বুদ্ধদেব তসলিমা নাসরিনকে কলকাতা থেকে হাপিস করলেন।

–মহাশ্বেতা দেবী

আজ সুয়েনসনের সঙ্গে দেখা করানোর ব্যবস্থা করার কথা ছিল। হল দেখা। বেচারা বিদেশি। দিল্লির রাস্তাঘাট চেনে না। তাকেও ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে, একেকদিন একেক রাস্তা দিয়ে নিয়ে আসা হয় ওই গোপন জায়গাটিতে। দেখা হওয়ার জায়গাটিতে।

অনেকটা সময়ই কাটালাম। ভালো খাবার দাবারের ব্যবস্থা করা হল। মাঠটাতে একটু হাঁটার সুযোগও হল। খালি পায়ে হাঁটলাম। একটা মাঠ পাওয়া জগৎ পাওয়ার মতো। গত বছরের আগস্ট মাস থেকে মাটির ছোঁয়া পাইনি।

.

২ জানুয়ারি

আজ কলকাতায় মহাবোধি সোসাইটি হলে আমাকে কলকাতায় ফিরিয়ে নেওয়ার উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠান করলো এপিডিআর, কলকাতার মানবাধিকার সংগঠন অথবা গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার সংগঠন। মহাশ্বেতা দেবী ছিলেন অনুষ্ঠানের সভানেত্রী। দীপংকর চক্রবর্তী, সুজাত ভদ্র, শুভাপ্রসন্ন, অনন্যা চট্টোপাধ্যায় বক্তৃতা করেছেন। উপস্থিত থাকার কথা ছিল শঙ্খ ঘোষ, অপর্ণা সেন, শাঁওলি মিত্রের। সকলেই নানা অসুবিধেয় পড়ে আসতে পারেননি। অনুষ্ঠানে প্রতুল মুখোপাধ্যায় গান গাইলেন, সেটি শুনলাম ফোনে। অসাধারণ। কী সুন্দর গান লিখেছেন আমাকে নিয়ে। হায় হায় হায় কী শরম কেয়া বাত, মার্কস বাদী পার্টি নাচে মৌলবাদ কা সাথ, দেশ ছাড়া এক তেজি মেয়ে থাকতো কলকাতায়, তার কাটতো সময় লেখাপড়ায়, সভায় আর আড্ডায়।..তারপর কী করে আমাকে পগার পার করা হল, সেই গল্প। কোনওদিন দেখা হয়নি প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তাঁর গানের মুগ্ধ শ্রোতা আমি। কলকাতায় গেলে দেখা হবে, দেখা আমাদের নিশ্চয়ই একদিন হবে।

আজ শেষ দিন সুয়েনসনের। বিকেলটা একসঙ্গে কাটানো হল। হল বটে, কিন্তু ওর প্রতি কি সত্যিই আমার কোনও অনুরাগ আছে? আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে, কোনও আত্মবিশ্বাসী সচেতন মেয়ে ওর মুখদর্শন করতো না। সন্ধেয় খেয়ে দেয়ে ও চলে গেল। মানুষটা অদ্ভুত। খুব হাত পা ছড়িয়ে উপভোগ করলো ভারত সরকারের আতিথ্য। আমি কি এরকম পারতাম? ওর জায়গায় নিজেকে বসিয়ে বুঝি, অসম্ভব। আমার সংকোচ হত। কোনও দেশ যদি বিপদে পড়ে আমার খরচ বহন করতে চাইতো, কিছুতেই আমি নিতাম না সে খরচ। নিজে যা পারি, নিজের যা সামর্থ, তা দিয়ে আমি চলতাম। আজ পর্যন্ত এত যে বিদেশে থেকেছি, কোথাও কোনো সরকারের দান বা করুণা নিইনি। যদিও রাজনৈতিক শরণার্থী হিসেবে আমার নেওয়ারই কথা ছিল।

সুয়েনসনকে সরকারের কোনো এক লোক তাজমহল পর্যন্ত দেখিয়ে এনেছে, জয়পুর নিয়ে গেছে, উদয়পুরেও, দিল্লির অনেক কিছু দেখিয়েছে। খাওয়া খরচ, হোটেল খরচ সব অকাতরে দিয়েছে। আমি বলেছিলাম, এসব খরচ তো তুমিই দিতে পারো। সুয়েনসন বললো, ‘ওরা যখন দিচ্ছে, দিক। প্রভুকে বলেছিলাম বটে সুয়েনসনকে একটু ঘুরিয়ে দেখাতে, বেচারা আমার সঙ্গে কাটাতে পারছে না, তার চেয়ে ঘুরে বেড়ালে মন ভালো থাকবে। ওকে একটু সাহায্য করা। ওর গাইড হওয়া। কিন্তু যা আশা করিনি, যা চাইনি তাই করলেন প্রভু। জানি না কেন করলেন। প্রভু জানালেন সুয়েনসনকে তিনি অতিথির মতো দেখাশোনা করবেন। আমাকে খুশি করতেই সুয়েনসনের সব দায়িত্ব নিয়েছেন প্রভু। প্রভু কি ভেবেছিলেন, আমার করুণ অবস্থা দেখে সুয়েনসন আমাকে বলবে যেন ভারত ছেড়ে চলে যাই, অথবা আমাকে তার সঙ্গে যে করেই হোক সুইডেনে নিয়ে যাবে! প্রভু যা ভেবেই যা কিছুই করুন, সুয়েনসনের উচিত হয়নি এভাবে গোগ্রাসে সব গ্রহণ করা। ধন্যবাদ জানিয়ে বলতে পারতো, ওর নিজের খরচাটা ও নিজে দেবে। মাগনা পেলে কিছু লোক বিষ্ঠাও খায়। বিদেশিদের ভাবা হয়, বিশেষ করে সুইডিশদের, যে, এরা অন্যকে ঠকায় না, অন্যকে বিরক্ত করে না। তথ্য সম্পূর্ণ ভুল। সুযোগ পেলে এরা রক্ত চুষে খায়। নিজেদের মধ্যে ঠকানোটা কম, যেই না অন্য জাতের কাউকে পেল, অমনি ঘাড় কামড়ে ধরবে। বিদেশিদের মধ্যে আমি যত স্বার্থপর, চশমখোর দেখেছি, দেশিদের মধ্যে তত দেখিনি। দেশিদের মধ্যে যে উদারতা, যে দয়া, এবং স্বার্থহীনতার সন্ধান আমি পেয়েছি, তার তুলনা হয় না। ভালো মন্দ দু সংস্কৃতিতেই মেলে। কার সঙ্গে দেখা হচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছি, মিলছি–তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে। সুয়েনসনের জন্য সরকারের যে টাকা খরচা হয়েছে, সে টাকার অংক অনুমান করে আমি শিউরে উঠি। টাকা আমি যে করে হোক, ফেরত দিতে চাই। আমার জন্য যা হচ্ছে হচ্ছে, আমার বন্ধুর জন্য হবে কেন? আমার বন্ধুকে আমি যে জায়গায় থাকছি, সেই জায়গায় না আসতে দিলে তো বাইরের বন্দোবস্ত করতেই হয়। কিন্তু তাই বলে কেন সুয়েনসনকে অন্যের কাঁধে ভর দিয়ে চলতে হবে। আমার সঙ্গে ওর থাকা হবে না, এ তো একরকম জেনেই ও এসেছে। থাকা হবে না বলে ওর সমস্ত দায়িত্ব কেন আমাকে নিতে হবে! কেন যে এত দরদ আমার মানুষের প্রতি। স্বার্থপরতা, সংকীর্ণতা আর ক্ষুদ্রতা তত কম দেখিনি আমি সুয়েনসনের। ও তো আমাকে কম কাদায়নি। আমাকে অসহায় পেয়ে ও তো আমাকে কম পেষেনি! আর ওকেই কি না দেওয়া হল বিশাল আতিথেয়তা। এসব পাওয়ার যোগ্যতা ওর নেই। কিন্তু যা পেয়েছে, লুফে নিয়েছে। আজ যদি ওকে জানাই, যে, তোমার জন্য সরকারের যে টাকা খরচ হয়েছে, সেই টাকা আমাকে ফেরত দিতে হবে সরকারকে। আমি জানি, ও শুধু”ঠিক আছে বলে দায় সারবে।

আমার ডিএনএতে যে আমার মার চরিত্র। কী করে পালাবো এ থেকে। ক্ষমা করে দিতে দিতে গেছি দুনিয়ার সব বদমাশকে। ক্ষমা আর ভালোবাসা –এ দুটো রক্তে আমার। মা’র যেমন ছিল। মা কিন্তু দুঃখই পেয়ে গেছেন মানুষের কাছ থেকে, সারাজীবন। আমারও একই নিয়তি।

.

৩ জানুয়ারি

গতকাল অনুষ্ঠান হল, কোনও বাংলাপত্রিকায় তার কোনও খবর নেই শুধুদৈনিকস্টেটসম্যান ছাড়া। যেহেতু সিপিএমের নেতারা আমার ওপর অমানবিক আচরণ করেছেন, যেহেতু দৈনিক স্টেটসম্যান এখনও সিপিএম বিরোধিতা চালিয়ে যাচ্ছে, আমার পক্ষে লিখছে। এ ক্ষেত্রে এটি সাহসী ভূমিকাই। কারণ সিপিএম বিরোধী তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। আমার পক্ষে তো একটি কথাও বলছেন না তিনি! সিপিএমের চুন থেকে পান খসলে তিনি তেড়ে আসেন। কই, সিপিএম আমার সঙ্গে যা করেছে তা নিয়ে একটি সমালোচনার বাক্যও তোত তিনি উচ্চারণ করছেন না! কেউ বলে, আনন্দবাজার আপস করেছে, কেউ কেউ বলে আতাঁত করেছে। আনন্দবাজার যা করেছে, তাকে আপস বলে নাকি আঁতাত বলে জানি না। তবে অনেককাল চুপ থাকছে। মহাবোধির অনুষ্ঠান নিয়ে একটি বাক্যও খরচ করেনি। আনন্দবাজারের ভূমিকা নিয়ে মানুষের সংশয় তৈরি হয়েছে সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম নিয়ে যখন মানুষের পক্ষে না দাঁড়িয়ে সরকার পক্ষে দাঁড়িয়েছিল।

প্রসূন ভৌমিক আমাকে ফোনে অনুরোধ করেছিল একটা যেন লেখা দিই সেদিন অনুষ্ঠানে পড়ার জন্য। তো লিখে ফেললাম তক্ষুণি। ওই যে, স্বভাব তো আছেই আমার, ফরমায়েশ থাকলে লেখা হয়, নয়তো নয়। লেখাটা, বারবার বলে দিয়েছি, পড়ার জন্য মঞ্চে। কোথাও ছাপাবার জন্য নয়। কিন্তু পড়ার পর শুনেছি মহাশ্বেতা দেবী ঘোষণা করে দিয়েছেন এটা দৈনিক স্টেটসম্যানে ছাপা হবে।

পত্রিকায় ছাপা হওয়া মানে হাওয়ার আগে ছড়িয়ে যাওয়া সর্বত্র। সরকারের কোনও সমালোচনা আমার মুখ থেকে বেরোনো মাত্র লুফে নেয় তাবৎ সাংবাদিক। একবারও ভেবে দেখে না এতে আমার ক্ষতি কিছু হবে কি না। মৌলবাদীরা আক্রমণ করতে পারে এই আশংকা থাকার পরও কি জয়পুরের হোটেলের নাম আর রুম নম্বর জানিয়ে দেয়নি পুরো পৃথিবীকে? দিয়েছে। সাংবাদিকরা ভালো হয়, খারাপও কম হয় না। পিটিআইএর এক ছেলে, খুব ভালো সম্পর্ক আমার সঙ্গে, বারবারই বলছে আমার জন্য দুশ্চিন্তায় দিন পার করছে, কিন্তু মহাবোধি সোসাইটি হলে যাবে না। দিল্লির অফিস থেকে চাপ এলে ডেস্কে বসে এর ওর কাছ থেকে শুনে খবর লিখবে। আর আমি তো শুধু ক’টি ডায়াল দূরত্বে, আমাকে সহজেই পাওয়া যায়। কিন্তু সেটা না করে এদিক ওদিক থেকে আমি কী বলেছি, কোনো সরকারবিরোধী কিছু বলেছি কি না, জেনে যাচাই করা নেই কিছু নেই, ঢুকিয়ে দেবে আমার নামে। আমি যে যুক্তির কথা বলছি, বুঝিয়ে বলছি, সেগুলোতে কান কেউ দিতে চায় না। খালি বিস্ফোরক কিছু দিয়েই ভরতে চায় খবরের শিরোনাম, খবর।

তপন রায় চৌধুরী কলকাতা থেকে দিল্লি এসেছেন। আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। দেখা করার ব্যবস্থা করলেন প্রভু, সেই গোপন জায়গাতেই। তবে এই দেখা করার ব্যাপারটিতে আমার চেয়েও বেশি উৎসাহ প্রভুর। তপন রায় চৌধুরীকে দেখে কী যে ভালো লাগলো। আমাকে বড় ভালোবাসেন। না হলে দেখা করতে চাইবেন কেন! দিল্লিতে এসে নাকি প্রথম। ভ’বাবুর সঙ্গে দেখা করেছেন, দ্বিতীয় কাজ আমার সঙ্গে দেখা করা। কলকাতা থেকে ছুটে এসেছেন শুধু এক কারণেই। আমার ব্যাপারে ভ’র সঙ্গে কথা বলতে। আমি উন্মুখ বসে রইলাম শোনার জন্য, বারবারই জিজ্ঞেস করলাম, ভ’বাবু কী বলেছেন? আমাকে কবে যেতে দেবেন কলকাতায়?

এর উত্তর না দিয়ে প্রভুর দিকে দূর থেকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে বললেন, মনে হচ্ছে র’ এর লোক।

–র’এর লোক? মনে হয় না।

–আমার মনে হচ্ছে এরা র’ এর লোকই হবে।

-এঁরা খুবই ভালোমানুষ। খুব যত্ন নিচ্ছেন। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যা দরকার আমার, তা হল কলকাতায় ফেরা, স্বাধীন স্বাভাবিক জীবন যাপন করা, যা এতকাল করছিলাম।

আমি যতই কলকাতার কথা বলি, কবে যেতে পারবো, সেই দিন তারিখটি শুনতে চাই। তপন বাবু ততই এড়িয়ে চলেন আমার কথা। মৌলবাদীরা যে কত ভয়ংকর, তারা যে আমাকে মেরে ফেলার জন্য ছুরিতে শান দিয়ে রেখেছে, পিস্তলে গুলি ভরে রেখেছে, তলোয়ার খাপ থেকে বের করে এনেছে সে কথাই তিনি থেকে থেকে শোনান।

বহুকাল বিদেশের নিরাপদ জীবন যাপনে অভ্যস্ত মানুষগুলো সব কিছুতে বড় ভয় পান। তিনি ভাবছেন বিরাট কোনও সন্ত্রাসী মুসলিম মৌলবাদী দল বোধহয় আমাকে টার্গেট করেছে। নিরাপত্তার কথা ভাবছেন। ভ’র সঙ্গে কথা বলে, তিনি যা বুঝেছেন, খুব তাড়াতাড়ি আমার কলকাতা ফেরা হবে না।

.

৪ জানুয়ারি

দুপুরে একটুখানি রোদে বসা। গাছগাছালির দিকে বড় শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকা। এ হল প্রতিদিনকার হু হু করা দুপুরের গল্প। আজ ওরকম দুপুরে শীলা রেড্ডিকে বললাম কাল তপন রায় চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা। আসলে আমি যে আগ বাড়িয়ে সব বলি, তা নয়। শীলাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চান সবকিছু, কী ঘটছে, কী হচ্ছে, কী করছি, কী ভাবছি। শীলা বললেন, ”তুমি ওঁকেই বলো সাহায্য করতে। তোমাকে কলকাতায় পাঠানো যদি না-ই হয়, অন্তত এখানে, এই দিল্লিতেই যেন কিছুটা স্বাভাবিক জীবন দেওয়া হয়, তার জন্য তুমি কেন, তপনবাবুই ভ’কে বলুন।

শীলার আরও উপদেশ, শ্যাম বেনেগালকে ফোন করো, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাও। আমি এসব বড় মানুষদের ফোন করে অভ্যস্ত নই, বিশেষ করে যাদের সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্বের সম্পর্ক নেই। কিন্তু শীলা অনেকটা মনোবিজ্ঞানীর মতো, কী করে কী করে যেন আমাকে একবারে তাঁর প্রায় মুঠোর মধ্যে নিয়ে নিয়েছেন। তিনি যা বলেন, তার অনেকটাই আমি মানতে না চাইলেও মানি। শ্যাম বেনেগালকে ফোন না করলে শীলা বলবেন, ”তুমি আসলে তোমার এই অবস্থা থেকে বেরোতেই চাও না। তাই চেষ্টাও করো না। এরকম আগে বলেছেন যখনই লক্ষ্য করেছেন তার উপদেশ আমি অক্ষরে অক্ষরে মানিনি। যেদিন উপদেশ দেন, তার পরদিন থেকে তিনি খবর নিতে শুরু করেন উপদেশের কটা এবং কতটুকু আমি মেনেছি।

শ্যাম বেনেগালকে ফোনে পেলাম না। উনি ফোন করলেন বোম্বে থেকে। ধন্যবাদ জানালাম সই করার জন্য পিটিশানে। বোম্বে থেকে দিল্লি আসতে আসতে তাঁর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। তার মানে দেখা হচ্ছে না। বন্ধু আর শুভাকাঙ্গীদের সঙ্গে দেখা করার যে কথা ভেবেছি, তা আপাতত অন্যের সঙ্গে হলেও শ্যাম বেনেগালের সঙ্গে হচ্ছে না। না হোক, অন্তত এ ভেবে ভালো লাগছে যে তিনি আমার অবস্থা নিয়ে ভাবছেন। নিজে থেকে বললেন সরকারের কারও সঙ্গে তিনি কথা বলবেন। বলে কালই আমাকে জানাবেন। শ্যাম বেনেগাল জানান বা না-জানান, তিনি ভারতে আমার সবচেয়ে প্রিয় পরিচালক। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা আমার একইরকম রয়ে যাবে। এমএ বেবিও বলেছিলেন জানাবেন। এমএ বেবি ওই তৃতীয় বাড়িতে দেখা করেছিলেন আমার সঙ্গে। পুরোনো কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, বুদ্ধবাবু আসলেই কেরালাতে আমাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। আর আমি যখন জানিয়েছিলাম আমি কোথায় আছি, ‘সেইফ হাউজ’এর জীবন ঠিক কী রকম জীবন, ভেবেছিলাম তিনি বলবেন যে যে করেই হোক আমাকে এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করার সবরকম চেষ্টা তিনি করবেন। বলেননি, তবে বলেছেন গান শুনতে, ভালো লাগার গানগুলো শুনতে। এমএ বেবিও পরে আর জানালেন না, কেন জানালেন না! নাকি জানানোর, আশা দেওয়ার, আশ্বাস দেওয়ার কিছু নেই আর!

.

৫ জানুয়ারি

দুটো কবিতা লিখলাম আজ। বহুদিন পর কবিতা। গৌতম ঘোষ দস্তিদার কলকাতা থেকে একটা ইমেইল পাঠিয়েছে তার ‘রক্তমাংস’ লিটল ম্যাগের জন্য কবিতা পাঠাতে অনুরোধ করে। কেউ না চাইলে আজকাল আর দেখি লেখা হয় না। লেখা চাইলেই লেখা হয়। কবিতা লিখতে লিখতে চোখ বেয়ে জল ঝরে। ঝরতে থাকে, লিখতে থাকি। লং লিভ ডিমোক্রেসি!’ ‘কোনও কবিকে কি কখনও গৃহবন্দি করা হয়েছিলো কখনও?

.

৬ জানুয়ারি

বাংলাদেশ আমার কাছে ভুলে যাওয়া নাম। সম্ভবত। বাংলাদেশ আমার সুখের এবং কষ্টের স্মৃতি। আমি ভাবতে পারি না যে বাংলাদেশে আমার বাবা মা আর নেই। তাঁদের বাড়ি ঘর খালি পড়ে আছে। এইটুকু ভাবার সাহস আমার হয় না। আমি ভাবি না। ওই ভাবনাটা আসতে গেলেই আমি ভাবনাকে সজোরে আড়াল করি। বড় খালি খালি লাগে। বুক ফেটে যায়। আমি ধারণ করতে পারি না এই শূন্যতা। তাই কোনওদিনই বাবা মায়ের থাকার কথা স্মরণ করি না। না-থাকার স্মৃতি মুছে ফেলতে চাই।

আজ কী রকম যেন ঘটনা ঘটলো। নেটে আমার বিষয়ে নতুন খবর খুঁজতে গিয়ে সকালে দেখলাম, কে এম সোবহানের ওপর একটা লেখা ডেইলি স্টারে, লেখক লিখছেন, কে এম সোবহান তসলিমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ‘ছিলেন’ শব্দটি আমার গা কাঁপিয়ে দেয়। তাহলে কি এখন নেই তিনি?

সকালে কলকাতা থেকে ফোন এল। কে এম সোবহানের লেখা ছাপা হয়েছে দৈনিক স্টেটসম্যানে। কে এম সোবহান, বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের প্রাক্তন বিচারক, মারা গেছেন গত সোমবার। এটিই তাঁর জীবনের শেষ লেখা। জীবনের শেষ লেখাটি আমাকে নিয়ে। কণ্ঠে জমা হতে থাকলো কষ্টের মেঘ। হ্যাঁ বাংলাদেশে হাতে গোনা যে ক’জন বুদ্ধিজীবী আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে কেএম সোবহান অন্যতম।

লিখেছেন, তসলিমা নাসরিনকে বাংলাদেশ ধারণ করতে পারেনি, এ লজ্জা বাঙালির ধরে রাখার জায়গা নেই। এই বাঙালি লেখিকাকে বাংলাদেশ দিতে পারেনি তার সাংবিধানিক অধিকার।.. আপস করেছে বামফ্রন্ট সরকার জঙ্গি ধর্মান্ধদের কাছে নতজানু হয়ে।’

নিজের ওপর রাগ হয় কত বাজে কাজে সময় নষ্ট করেছি জীবনে, কোনওদিন এই মানুষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করিনি। পৃথিবীর কত কাউকেই তো কত ফোন করেছি, কোনওদিন কেন কেএম সোবহানকে ফোন করিনি। তারও নিশ্চয়ই খুব ভালো লাগতো, যদি হত কথা মাঝে মধ্যে। কার ওপর অভিমান আমার? এই মানুষগুলো তো ভীষণভাবে আমাকে সমর্থন করে গেছেন, তাদের তো ক্ষমতা ছিল না আমাকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার। শামসুর রাহমানও নেই আর। ওয়াহিদুর রহমানও চলে গেলেন। ওয়াহিদুর রহমান খুব ভালোবাসতেন আমাকে। আমার কথা নাকি খুব বলতেন। জনকণ্ঠে কলাম লিখতেন। তাঁর শেষ লেখাটিও শুনেছি আমাকে নিয়ে ছিল। চোখ জলে ভরে যায় শুনলে। এত বড় উদার মানুষদের কাছ থেকে আমাকে দুরে সরিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ সরকার। আমাকে আমার প্রাপ্য স্নেহ থেকে বঞ্চিত করেছে বাংলাদেশের ঘৃণ্য রাজনীতি।

চারদিকে শুধু শূন্যতা। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, খান সারোয়ার মুরশিদ, কলিম শরাফী, কবীর চৌধুরী এঁদের তো বয়স হয়েছে অনেক। কবে চলে যান, ভয় হয়। আর থাকলেই বা কী! আমি তো যোজন যোজন দূরে। শামিম সিকদার, রুবি রহমান, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর কথাও বড় মনে পড়ে। এত দূরে চলে এলাম! এত যে যেতে চাই দেশটিতে! কেউ কি বোঝে? কেউ কি বোঝে যে পারি না যেতে? কেন বেরিয়েছিলাম দেশ থেকে। মৃত্যু হত, ওখানেই হত। বিদেশে বিদেশে ঘুরে মৃত্যু কি আমার কিছু কম হয়েছে?

বাংলাদেশের বড় মানুষগুলো আমার পাশে ছিলেন, সবসময় ছিলেন। কলকাতায় ছিলেন অন্নদাশংকর রায়। তিনি এখন নেই। আছেন শিবনারায়ণ রায়, খুব পাশে আছেন। আছেন অম্লান দত্ত। ওঁদেরও বয়স মধ্য আশি। যদি ওঁরাও চলে যান, বড় একা হয়ে যাবো। জগতে কেউ আর থাকবে না পাশে দাঁড়াবার। যতটা বড়রা বোঝেন আমাকে, লক্ষ্য করেছি মাঝারি বা ছোটরা ততটা বোঝেন না। অবশ্য বয়স হলেই যে বুঝবেন, তা নয়। বোঝার মন আছে। বলেই বোঝেন।

রাজনীতি আমাকে বড় একা করে দিল। বাবা মা থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। আত্মীয় স্বজন থেকে দূরে। যাঁরা স্নেহ করেন, শ্রদ্ধা করেন তাঁদের সবার থেকে দূরে। কী অদ্ভুত এক জীবন!

যে করেই হোক, যে ভাবেই হোক, যদি বাংলাদেশে চলে যেতে পারতাম। ইচ্ছে হয় ভ’বাবুকে বলি, আমাকে যেন দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেন। ভ’বাবুর সঙ্গে নিশ্চয়ই ভালো সম্পর্ক ওখানকার সরকারের। ভারতের সঙ্গে তো বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন আগের চেয়েও ভালো হওয়ারই কথা, কিছুদিন আগে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশকে ভারত একশ কোটি টাকা দান করলো। যদি ভ’বাবু কোনও উদ্যোগ নিতেন আমাকে পাঠানোর। যেন হাসিনা আমার বিরুদ্ধে জারি করা হাবিজাবি মামলাগুলো তুলে নেন, যেন নিরাপত্তা দেন। আহ, যেতে পারতাম যদি নিজের বাড়িতে। নিজের ঘরে যদি বাকি জীবন বাস করতে পারতাম! মা’র অনেক আশা ছিল, স্বপ্ন ছিল দেশে ফিরি। ‘‘র স্বপ্ন পূরণ করতে ইচ্ছে হয়। বেঁচে থাকা কালীন তাঁর কোনও স্বপ্নই তো পূরণ করিনি। নিজেরও কি আমার দেশে ফেরার স্বপ্ন নেই। বুকের ভেতরের খুব গোপন কুঠুরিতে থাকে আমার সেই স্বপ্ন। ওখানেই রেখে দিই ওদের, পূরণ-না-হওয়া স্বপ্নগুলোকে আমি আর চোখের সামনে মেলে ধরি না। আড়াল করে রাখি। আড়ালে রেখে যে জীবনটা যাপন করি, সে জীবনটা হয়তো আসল জীবন নয়, বানানো।

.

৭ জানুয়ারি

কাল সারাদিন টেলিভিশনে তথ্যমন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির ক্ষোভ দেখানো হল। তিনি খুবই রেগে আছেন আমার ওপর। কেন আমি ইসলামের সমালোচনা করেছি। আমার কোনও অধিকারই নেই কোনও ধর্ম নিয়ে সমালোচনা করার। এটা ভারতবর্ষ, এখানে এসব চলে না। বলেছেন আমাকে করজোড়ে ক্ষমা চাইতে হবে সব মুসলমানের কাছে। ইসলাম নিয়ে যা যা এ পর্যন্ত লিখেছি, সব কিছুর জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। বই থেকে ধর্ম নিয়ে লেখা যা কিছুই লেখা হয়েছে সব তুলে নেওয়া উচিত। আসলে, দ্বিখন্ডিত বইটিই নিষিদ্ধ করা উচিত। এর নাম ভারতবর্ষ, এখানে থাকতে হলে ধর্ম নিয়ে কথা বলা চলবে না।

এই প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সিই হায়দারাবাদে আমার ওপর আক্রমণ হওয়ার পর তীব্র নিন্দা করেছিলেন সেই আক্রমণের, এমনকী এও বলেছিলেন, তসলিমাকে নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারে কেন্দ্র এখন ভেবে দেখবে। শুনে মনে হয়েছিল নাগরিকত্ব প্রায় হয়েই আছে, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি শুধু শুভদিনটি ঘোষণা করবেন আজ বা কাল।

প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি কি ইসলামে বিশ্বাস করেন? আমার মনে হয় না, বিশ্বাস করলে তিনি ধর্মান্তরিত হতেন। তিনি হিন্দুধর্মে বিশ্বাস করেন সম্ভবত, অথবা কোনও ধর্মেই বিশ্বাস করেন না। তিনি নিশ্চয়ই জানেন ‘দ্বিখন্ডিত’র কিছু অংশ আমি বাদ দিয়ে দিয়েছি। দুঃখিতও হয়েছি কেউ দুঃখ পেয়ে থাকলে। তাহলে কে বা কী তাকে হঠাৎ করে আমার বিরুদ্ধে আগুন হতে বললো। লোকে বলে, মুসলমানের ভোট পাওয়ার জন্য এরকম করছেন রাজনীতিকরা। আমার খুব অবাক লাগে, ভোটের জন্য কি নীতি আর আদর্শ সব বিসর্জন দিতে হয়। বিসর্জন দিয়ে ভোট পেতে কি সত্যিই কারও কোনও আনন্দ হয়? নীতি আর আদর্শের কথা এইজন্য বললাম, যে, গণতন্ত্রের তো একটা নীতি আছে। সবারই কথা বলার অধিকার আছে, কারও কথা পছন্দ না হলে পাল্টা কথা বলল। গায়ে হাত তোলো কেন? মুন্ডু চাও কেন? তান্ডব করো কেন? মানুষের ক্ষতি করো কেন? আগুন জ্বালাও কেন? এসব তিনি মানেন না বলেই নয়ই আগস্টে হায়দারাবাদে আমার ওপর হামলা হওয়ার পরদিন আমার পক্ষে কথা বলেছিলেন। দশই আগস্টের সেই প্রিয়রঞ্জনকে আমার মানুষ প্রিয়রঞ্জন বলে মনে হয়। তখন তিনি সত্যিকার তাঁর বিশ্বাসের কথাই বলেছিলেন। তারপর এখন যা বলছেন, মুসলমানদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইতে হবে, রাজনীতিক হিসেবে বলছেন। মানুষ প্রিয়রঞ্জন আর রাজনীতিক প্রিয়রঞ্জন এক নয়, ভিন্ন লোক। রাজনীতিক হতে হলে হয়তো মানুষ হওয়া যায় না, মানুষটাকে বাদ দিয়ে রাজনীতিক হতে হয়।

কুড়ি বছর কম হলে বয়স, ওঁদের জন্য দুঃখ করতাম। এখন নিজের জন্য করি। নিজের দুর্ভাগ্যের জন্য করি।

একটা অতি সাধারণ জন্ম, অতি সাধারণ বড় হওয়া, অতি সাধারণ জীবন যাপন করা মানুষের এ কী হাল! সে নাকি হয়ে গেল লোকের রাজনীতি করার বস্তু? তা-ও আবার এত বড় দেশ ভারতে? না, এই বস্তুটি হওয়ার যোগ্য নই আমি। এই বস্তু হতে গেলে আরও হয়তো যোগ্যতা থাকতে হয়। যারা অতি প্রশংসা করেন আমার, সেটা পাওয়ারও যেমন যোগ্য আমি নই, যারা অতি নিন্দা করেন, তা পাওয়ারও যোগ্য নই।

আজ টাইমস নাও টেলিভিশন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির মন্তব্যের পর বললো যে যেদিন থেকে তসলিমাকে তাড়ানো হল কলকাতা থেকে, সেদিন থেকেই তসলিমা হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে অস্পৃশ্য। যাকে বলে আনটাচেবল। তা ঠিক। তসলিমা এখন এই ভারতবর্ষে আনটাচেবল একজন। কলকাতায় এখন ফেরা সম্ভব হত, যদি বড় একটা গণআন্দোলন হত। কিন্তু আমার পক্ষে কোনও গণআন্দোলন হওয়া সম্ভব নয় কোনও দেশে। কোনও জনমত গড়ে তোলার কাজও কেউ করবে না। আমি একজন লেখক। আমার কোনও দল নেই, সংগঠন নেই। আমি আগাগোড়াই একা একজন মানুষ। ভালোবেসে লিখি। তাগিদে লিখি। লিখে বাঁচি। শরীর বাঁচানোর চেয়ে বড়, মন বাঁচানো। বড় নিরীহ, বড় নিরুপদ্রব একটা মানুষ আমি। কিছু ধর্ম ব্যবসায়ী আর রাজনীতিক আমাকে ব্যবহার করছে নিজেদের স্বার্থে, এ আজ থেকে নয়, শুরু হয়েছে বহুকাল। আজও শেষ হয়নি। বিনা অপরাধে শাস্তি কী আর কোনও লেখক এমন পেয়েছে? অনেক লেখকের জেল ফাঁসি হয়েছে অনেক দেশে। কিন্তু এত দুর্ভোগ আর কাকে পোহাতে হয়েছে! যে লেখক নির্বাসনে আজ আছে, কাল সরকার বদল হলে তার নির্বাসন জীবনের ইতি ঘটে। আমার জীবনে নির্বাসনের কোন কূল নেই, কিনার নেই।

শঙ্খ ঘোষ ফোন করেছিলেন, ভেবেছিলাম কোনও সুখবর দেবেন। না, সুখবর দেবার জন্য নয়। দ্য স্টেটসম্যানে বের হওয়া আমার ব্যানিশড উইদ এন্ড উইদাউটটা বাংলায় কেউ অনুবাদ করে লিটল ম্যাগাজিনে ছাপাতে চাইছে, সেটার জন্য। কেউ কোনও সুখবর আর দিচ্ছেন না। শঙ্খ ঘোষের কাছে আর সুখবর নেই। তিনি কি ইচ্ছে করলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ফোন করে বলতে পারেন না আমাকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিতে? দু’জনে তো ভালো বন্ধুত্ব। হয়তো ভাবছেন, বললে কোনও কাজ হবে না। এ কিন্তু একেবারে কেউই ভাবছেন না, কে জানে, হতেও পারে কাজ!!

যত দিন যাচ্ছে, তত আমার অস্থিরতা বাড়ছে। যত দিন যাচ্ছে তত বেশি কঠিন হচ্ছে কলকাতায় ফেরা। যত দিন যাচ্ছে তত রাজনীতি বাড়ছে আমাকে নিয়ে।

.

৮ জানুয়ারি

টাইমস অব ইন্ডিয়ায় সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে, রাইটার ব্লকড় শিরোনামে। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি যে আমাকে করজোড়েমুসলিমদের কাছে ক্ষমা চাইতে বলছেন, সেটার সমালোচনা করে লেখা। লেখাটির শেষ দিকটা এরকম ..The problem with such a political strat egy is that the more one appeases fundamentalists, thinking their point of view to be representative of a community, the more demands they’ll raise. And the more powerful they’ll become, once they’re seen to be effective in translating their views into state policy.

A secular state has to draw the line somewhere, otherwise it will give rise to a game of competitive fundamentalism that will damage the nation’s multicul tural fabric. Moreover, a democracy cannot stifle individual dissent. An individ ual, after all, is the smallest minority. It’s on his defence that democracy rests. When calling on Taslima to bend and scrape before religious authorities, it’s these democratic basics that the good information and broadcasting minister appears to have lost sight of.

আজ খবরে দেখলাম, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির বক্তব্য মেনে নিচ্ছে কংগ্রেস পার্টি। কংগ্রেসএর মুখপাত্র বলেছেন, ঠিক কথাই নাকি প্রিয়রঞ্জন বলেছেন, এবং কংগ্রেস এ কথা বিশ্বাস করে যে আমার ক্ষমা চাওয়া উচিত সমস্ত মুসলিমের কাছে।

কী ভয়ংকর সংবাদ!

এসব শুনে বিজেপি বলছে, যে, সোনিয়া গান্ধি আর মনমোহন সিংকেও ক্ষমা চাইতে হবে রামসেতুর মন্তব্যের জন্য। রাম বলে কেউ ছিল না কোনওদিন, রাম হল কবির কল্পনা, এ কথা বললে হিন্দুর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে। সুতরাং ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্ন যদি ওঠে, তাহলে শুধু এক ধর্মের মানুষের কাছে কেন, সব ধর্মের মানুষের কাছে নয় কেন? ওরা যদি আঘাত পেতে পারে, এরাও আঘাত পেতে পারে।

আমি একটা অবিশ্বাস্যরকম নির্বোধ। একটা গাধার গাধা। দেশে দেশে অত্যাচারিত নানাভাবে। প্রাণের টানে বাংলায় থাকতে এসেছিলাম, নিজের মতো ছিলাম, নিজের ছোট্ট গন্ডি নিয়ে, বেশির ভাগ সময়ই ভীষণ একাকীত্বে ভুগেছি। আর আমাকে নিয়ে করা হচ্ছে রাজনীতি! ভারতবর্ষে! ভয়ে আমি খাস নিতে পারি না। আমার গা কাঁপে। হাত পা কাঁপে। এর পরিণতি কী? এভাবে একটা খোপের মধ্যে আমাকে আর কতদিন বাস করতে হবে।

.

৯ জানুয়ারি

আশ্চর্য, এও ঘটতে পারে। সাতটা মুসলিম সংগঠন, জামাতে ইসলামি, জমিয়তে উলেমা হিন্দ এবং আরও কটা সংগঠন সরকারের কাছে বলছে আমাকে যেন দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়। কোনও ভিসা যেন না দেওয়া হয়। জমিয়তে উলেমা হিন্দের যে মাদানি, যে লোক দ্বিখন্ডিত থেকে কিছু অংশ বাদ দেওয়ার পর বলেছিল, তারা আমার বিরোধিতায় আর যাচ্ছে না–এখন সেসব কথা ভুলে গিয়ে মহাসমারোহে লেগেছে আমার বিরুদ্ধে। জমিয়তের আরেক প্রধান নুমানি বলতে চাইছে যে হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধেও লিখেছি, সুতরাং সব ধর্মের লোকেরা জড়ো হয়ে আমার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করুক। তারা এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাচ্ছে আমাকে ভারত থেকে তাড়ানোর জন্য। যোলো তারিখে নাকি আবার সর্বধর্মের সমন্বয়ে একটা সভাও করবে।

ওদিকে কলকাতার খবর হল, ওখানে সমাজবাদী দল আমার বিরুদ্ধে নেমেছে। ইদ্রিস আলী, যাকে ফুরফুরার ত্বহা সিদ্দিকী বলেছিল যে চেনেই না, ২১ নভেম্বরের ঘটনা থেকে নিজেদের অনেক কসরত করে সরাতে চেয়েছিলো, বলেছিল ইদ্রিস ডেকেছিল অবরোধের ডাক, ফুরফুরা ওতে মোটেও নেই, সেই ফুরফুরাই এখন ইদ্রিশের গলায় মালা পরাচ্ছে। যে কংগ্রেস দল থেকে ইদ্রিসকে বের করে দেওয়া হয়েছিল ২১ তারিখের পর, তাকেই যদি দলে ফের ফেরত নেওয়া হয়, প্রদেশ কংগ্রেসের নেতারা তান্ডবকারীদের ইন্ধন জোগানোর লোকটাকে যদি হাজতে দেখতে যেতে পারেন, ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে সংবর্ধনা দিতে পারেন, ফুরফুরা দেবে না কেন! এখন আবার সমাজবাদী দলের নেতা বিজয় উপাধ্যায়। নাকি বিষোদগার করেছে আমার বিরুদ্ধে। বইমেলা কমিটির কাছে চিঠি দিয়েছে, তারা চায়না তসলিমার কোনও বই মেলায় থাকুক। যদি তসলিমার বই মেলায় বিক্রি হয়, তবে ঘোষণা করে দিয়েছে, অগ্নিগর্ভ অবস্থা হবে আবার। এ নিয়ে নাকি গোয়েন্দা বিভাগ চিন্তিত। কী হবে তাহলে। আগে প্রশান্ত রায়কে বলেছিলাম কোনও বইযেন আমার না থাকে বইমেলায়। কিছু একটা গন্ডগোল হলে ওগুলো আবার ছুতো হবে আমাকে তাড়ানোর।

আজ শীলা রেড্ডি বললো, ‘কেন বই থাকবে না মেলায়, নিশ্চয়ই থাকবে। যা হয় হোক। আগুন লাগাবে? লাগাক। এত পিছু হটার কী আছে। ওরা বড় রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে ছাড়পত্র পেয়ে গেছে যা কিছু করার। তাই করছে। এখন কোন জায়গায় সরকার একটা সীমারেখা টানবে, তার বোধহয় ভাবার সময় এসেছে।’

দিন দিন একা হয়ে যাচ্ছি।

অবস্থা দেখে মনে হয় না যে খুব ভালো দিকে এগোচ্ছে। সবচেয়ে জরুরী যে প্রশ্ন, তা হল, আমাকে বন্দি করা হয়েছে কেন। সরকার বলছে মুখ বন্ধ করে থাকো। আনন্দবাজার, যে পত্রিকা জনমত তৈরি করতে পারতো, করছে না, বরং বলছে, মুখ বন্ধ করে থাকো। শঙ্খ ঘোষ, যার ওপর আশা করে বসে আছি যে সরকারের সঙ্গে কথা বলবেন, বলছেন মুখ বন্ধ রাখো কিছুদিন, শীলা বলছে, তুমি মুখ বন্ধ রাখো, তোমার সম্পর্কে অন্যরা এবার বলুক।

কিন্তু অন্যরা তো কিছু বলছে না।

খবর দেবেন বলেছিলেন শ্যাম বেনেগাল। উত্তর এলো না। এমএ বেবি জানাবেন বলেছিলেন কংগ্রেসের কারও সঙ্গে কথা বলার পর, জানালেন না। ভ’বাবুর একজন। কাছের লোক আগে প্রায়ই ফোন করতো খবরাখবর জানার জন্য, এখন আর করে না। ও যা কিছু করে ভ’বাবুর অনুমতি নিয়ে করে। তবে কি আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করার কথা কেউ তাকে বলেছে? ভ’বাবুও কিছু জানাচ্ছেন না। তপন রায় চৌধুরী দেখা করেছিলেন তাঁর সঙ্গে। আমার সম্পর্কে কথা হয়েছে। ভ’বাবু নাকি বলেছেন যে তিনি। কলকাতায় আমাকে পাঠাবেন, চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু তপন রায় চৌধুরী ভরসা পাচ্ছেন না। বললেন, রাজনীতিকদের তিনি বিশ্বাস করেন না। টাইমস নাওএর সম্বিত পাল একদিন। ফোন করে বললো, ”দিদি, ভরসা তো কিছু দেখছি না, আমরা তো যতটা সম্ভব খবর করে যাচ্ছি, কিন্তু আপনার পক্ষে তো তেমন কোনও আন্দোলন গড়ে উঠছে না। জনমত তৈরি করার চেষ্টা করেও তো জনমত তৈরি করা যাচ্ছে না।

ঝাঁক ঝাঁক বিষণ্ণতার মধ্যে সুদুর থেকে সুখবর ভেসে আসে। আমাকে প্যারিসে সিমোন দ্য বোভোয়ার একশ বছর পূর্তি উপলক্ষে, মেয়েদের স্বাধীনতার জন্য লড়ার জন্য ‘সিমোন দ্য বোডোয়া পুরস্কার প্রদান করা হল। কাল রাতে আমার বক্তব্য লিখে পাঠিয়েছিলাম। ক্রিশ্চান বেস সেটা ফরাসিতে অনুবাদ করে পড়ে শুনিয়েছেন অনুষ্ঠানে। আমার পুরস্কারখানিও গ্রহণ করেছেন। সন্ধেয় ক্রিশ্চান বেস জানালেন যে মানুষ নাকি প্রচুর হাততালি দিয়ে আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছে। সকলে আমার নিরাপত্তা আর মুক্তির জন্য আওয়াজ তুলেছে।

ভারতবর্ষের মাটি কামড়ে পড়ে আছি মাটিকে ভালোবেসে, আর যে মাটি আমাকে টানে না, সেই মাটিতে মানুষ আমাকে ভালোবেসে পুরস্কার দিচ্ছে।

আমি কার? মাটির না মানুষের?

.

১০ জানুয়ারি

এক.

কলকাতায় বইমেলা। প্রতিবছরের মতো এবছরও। আমি থাকবো না।

ভারতে আসার অনুমতি যখন থেকে পেয়েছি, কোনও বছরই কলকাতার বইমেলায়। আমি অনুপস্থিত থাকিনি। বিদেশে যত কাজই থাকুক, ছুটে ছুটে এসেছি কলকাতায়, শুধু বইমেলার জন্য। আর, যখন থেকে কলকাতায় বাস করতে শুরু করেছি, বইমেলা তো ছিলই, বাড়ির কাছে, হাত বাড়ালে-ছোঁয়া-যায় দূরত্বে। একজন লেখকের জন্য বইমেলাই, আমার বিশ্বাস, সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। চারদিকে বই, লেখক কথা বলছেন পাঠকের সঙ্গে। লেখকের সঙ্গে দেখা হচ্ছে লেখকের বই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। নতুন ভাবনারা ঘোরাফেরা করছে। মুক্তচিন্তার সবচেয়ে সুন্দর পরিবেশ তো বইমেলাই আমাদের দেয়।

কলকাতার বইমেলায় এবছর উপস্থিত থাকার কোনও সম্ভাবনাই, আমি আশংকা করছি, আমার নেই। কেন নেই, সে প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না। খুব দুঃসময় এলে শুধু প্রশ্নই থাকে, উত্তর থাকে না।

খবর এলো, আমার বই যদি বইমেলায় থাকে, মৌলবাদীরা নাকি তান্ডব করবে। তান্ডব করাটা এখন খুব সহজ হয়ে গেছে অনেকের কাছে। তান্ডব করলে, যদি জানে, যে, তাদের ক্ষতি হওয়ার কোনও আশংকা নেই, বরং বাড়তি কিছু লাভ হবে, তবে করবে না-ই বা কেন!

নিজের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। আমার চাওয়া কোনওকালেই খুব বড় কোনও চাওয়া ছিল না। বাংলার মেয়ে বাংলার মাটিতে নিভৃতে নিজের মতো করে বাস করতে চেয়েছিলাম, ওপারে সম্ভব না হলে, এপারে। কলকাতায় যে কটা বছর ছিলাম, আমি কোনও ক্ষতি তো করিনি কারও কারও পাকা ধানে মই দিইনি। কারও কিছু কেড়ে নিইনি। বরং অকাতরে দিয়েছি। যা-ই সম্ভব, যতটাই সম্ভব। নিজের বিশ্বাসের কথা লিখেছি। প্রায় দু’যুগ ধরে মানবাধিকার আর নারীর অধিকারের পক্ষে গোটা তিরিশেক বই লেখার পর কিনা আমাকে ইসলাম-বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা হল। যেন ইসলামের বিরোধিতা করাই আমার লেখালেখির উদ্দেশ্য, আর কিছু নয়। এত ভুল, এত মিথ্যে গায়ে সেঁটে দিলে কী ভয়ংকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, সে কী দেখছি না! একজন সমাজ-সচেতন লেখকের জন্য এর চেয়ে ক্ষতিকর আর কী হতে পারে! রাজনীতির ধারে-কাছে-না-থাকা কোনও লেখককে যদি রাজনীতির খুঁটি হতে হয়, তবে দুর্যোগের কিছু আর বাকি থাকে না।

কলকাতায় আমার একলা-পড়ে-থাকা বাড়িটির প্রায়-আঙিনায় বইমেলা হচ্ছে এবার। পার্কাসে। আমার বন্ধুরা, চেনা-পরিচিতরা, মুখচেনা-অচেনারা সবাই যাবে মেলায়, কেবল আমারই যাওয়ার কোনও উপায় নেই। যতদিন বইমেলা চলবে কলকাতায়, ততদিন দিল্লির একটি ঠিকানাহীন ঘরে একলা বসে থাকতে হবে সারাবেলা ধুলোয় ধূসর হয়ে মেলায় ঘুরে বেড়ানোর সেইসব স্মৃতি সামনে নিয়ে। আমার তো হাত পা বাঁধা। মানুষের স্বাধীনতার কথা লিখে নিজের স্বাধীনতাই হারাতে হয়েছে। আমার তো কোনও শক্তি নেই বইমেলায় আগের মতো হাঁটার, চলার। আগের মতো উৎসবে সামিল হওয়ার।

আমি বিশ্বাস করতে চাই না আমার জীবন থেকে বাংলার বইমেলা চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে। বিশ্বাস করতে চাই না আমার সুখ, স্বপ্ন, আমার ভালোলাগা, ভালোবাসা সবকিছুরই কবর হয়ে গেছে।

এখনও আমি স্বপ্ন দেখি। এখনও ভালোবাসা পেতে সাত সমুদ্র পেরোই। একা, এক-ঘর অন্ধকারে, ভীষণ বেদনায় যখন নুয়ে থাকি, হতাশার চাবুক এসে জীবনকে রক্তাক্ত করতে থাকে, ভালোবেসে একখানা হাত কেউ যদি তখন রাখে হাতে, কী যে আশ্চর্য বেঁচে উঠি। ওই ওটুকু স্পর্শই আমাকে আবার স্বপ্নের দিকে আলোর গতিতে টেনে নিয়ে যায়।

একজন লেখকের সঙ্গে যেমন শব্দের একটা গভীর সম্পর্ক থাকে, বাঙালি একজন পাঠকের সঙ্গেও থাকে বাংলা-বইমেলার সেই সম্পর্ক। এ বছর আমাকে না হয় বিচ্ছিন্ন করা হল। প্রিয় বইমেলা থেকে, আগামি বছর থেকে বাকি জীবন যেন বাংলার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন থাকে, অবিচ্ছেদ্য থাকে।

কেউ কেউ আমার নিরাপত্তার কথা বলছে। আমি জানি, মানুষের ভালোবাসাই আমার সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা। গত তিনবছর কলকাতা শহরের ভিড়ের রাস্তায় কোনও নিরাপত্তারক্ষী ছাড়াই আমি নির্বিঘ্নে হেঁটেছি। আমাকে কোনওদিন বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহার করতে হয়নি। হঠাৎ কী এমন ঘটে গেল! দুটো লোক সিটি বাজাবে বলে কি আমরাসিনেমা দেখতে যাই না, বাজার হাট করি না। আমরা কি জানি না দুটো লোকের সিটি বাজানোয় সায় দিলে দশটা লোকে সিটি বাজায়! আমরা জানি সব। তারপরও মুখ বুজে থাকি। মুখ বুজে থাকতে থাকতে আমরা বছর গেলে, বয়স গেলে বুঝি যে, মুখ বুজে থাকাটাই আমাদের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দুই.

সকালে সিগারেট খাচ্ছিলাম। মরতে চাইছি মনে হয়। হ্যাঁ তাই তো। তা না হলে সিগারেট আনাবো কেন? একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছি কেন। আমি কি জানি না সিগারেট আমাকে বছরের পর বছর কী করে খেয়েছে! কী কষ্ট হয়েছে সিগারেট ছাড়তে, ভুলে যাওয়ার কোনও তো কারণ নেই! সব জেনেও, সব বুঝেও আমি সিগারেট ধরাই। হাসিখুশি অফিসার মেয়েটির চোখে আমার জন্য করুণা।

–কেন, সিগারেট কেন?

–উত্তর তো খুব সোজা।

–কীরকম সোজা?

–ডিপ্রেশন।

–এদের রাজনীতির কারণে তুমি তোমার এসেন্সকে নষ্ট করবে কেন? তুমি তোমাকে ধ্বংস করবে কেন? তুমি এসবের ঊর্ধ্বে। এইসব তুচ্ছ রাজনীতি, নোংরামির কাদায় তুমি নিজেকে ডোবাবে কেন? তুমি কি এসবকে তুচ্ছ করতে পারো না?

–কী হবে..

–কী আর হবে। যা হয় তা হবে। এত ভাববারই বা কী আছে। তুমি অনেক বড়। তুমি কোনও ভুল করোনি। তোমাকে আটকে রেখেছে বলে তুমি নিজেকে ঝরে যেতে দেবে কেন? তাহলে তো তাদেরই জয় হল। বেঁচে থাকো, তোমার আদর্শ, তোমার দৃঢ়তা সবকিছু নিয়ে তীব্র ভাবে বাঁচো। তোমাকে নিয়ে আমরা গর্ব করি। এখানকার রাজনীতি নিয়ে গর্ব করার কিছু নেই।

–কবে যে শেষ হবে এখানকার বাস….

–শেষ তো নিশ্চয়ই একদিন হবে। এইভাবে তো চলতে পারে না। নিশ্চয়ই কোনও কোনও সমাধানে আসবে সরকার।

–খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে। সিগারেট এই যে খাচ্ছি, অবশ্য ভেতরে ফুসফুসে ধোঁয়া নিচ্ছি। আশংকা হচ্ছে, আবার না নেশা হয়ে যায় ..

–সিগারেট ছাড়ো। বাঁচো। ইন্ডিয়া ইজ নট এভরিথিং।

ইন্ডিয়াইজ নট এভরিথিং, এই বাক্যটি আমাকে একটু হয়তো শক্তি দিল। দুপুরে লিখলাম। বিকেলে স্নান করলাম। পরিষ্কার জামা কাপড় পরলাম। সন্ধের দিকে যখন পাখিদের নীড়ে ফেরার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, পাখিরা নীড়ে ফিরছে, আমারই নীড় নেই ফেরার, মেয়েটি পাশে বসে বললো, ‘ওদের তো নীড় ভেঙে যায়। আবার গড়ে।’

–হ্যাঁ আমার মতো। কত নীড় গড়লাম। কত দেশে। ভাঙলো। আবার গড়লাম।

–তোমার কি কখনও ইচ্ছে হয় কেউ থাকুক জীবনে? সঙ্গে কেউ আছে, পাশে কেউ আছে, এই অনুভূতিটা ইচ্ছে হয় না?

–হ্যাঁ ইচ্ছে হয়। কিন্তু সবসময় ভুল মানুষকে সঙ্গী ভেবে ভুগেছি।

–একা লাগে না?

–লাগে হয়তো মাঝে মধ্যে। কিন্তু একাই তো বাস করছি দীর্ঘকাল। কেউ এসে আমার স্বাধীনতার ব্যাঘাত ঘটাক চাই না। ভালোবাসায় আপত্তি নেই।

.

১১ জানুয়ারি

৪.২৭ একটা দুঃস্বপ্ন আমাকে ঘুম ভাঙিয়ে দিল। দুঃস্বপ্ন, আমার ওই নীল বইটা, ভারত বাসের অনুমতির বইটা কারা যেন ছিঁড়ে ফেলেছে টুকরো টুকরো করে। কোথাও একটা ঝগড়াঝাটি চলছে। টুকরোগুলো কুড়োতে চেষ্টা করছি আমি, টুকরোগুলো জোড়া দেওয়ার চেষ্টা করছি। কোত্থেকে দমকা হাওয়া এসে টুকরোগুলোকে উড়িয়ে নিচ্ছে। আমার ঠিক মনে নেই আমি ওই কাগজগুলোর পেছনে দৌড়োচ্ছিলাম নাকি স্তম্ভিত দাঁড়িয়ে ছিলাম।

৪.৩০ সিলিংএর দিকে তাকিয়ে থাকি। সাদা সিলিং। সাদা একটা পাখা ঝুলে আছে। প্রায় একই রঙের। পাখাটা স্থির হয়ে আছে। এ দেশে স্থির হয়ে থাকা পাখা খুব চেনা দৃশ্য নয়। ঘুরতে থাকা পাখা দেখেই মানুষ অভ্যস্ত। পাখার মতো আমিও ঝুলে আছি। জানিনা কোত্থেকে ঝুলে আছি, আর যদি বাঁধন ছুটে যায়, তাহলে ঝুলে থাকা আমার পতন হবে কোথাও কোথায়, জানি না।

৪.৪০ বুকটা বড় খালি খালি লাগে। প্রচন্ড শীত করতে থাকে।

৪.৪২ মাকে মনে পড়ে। আমি চোখ বুজি। মাকে আমার স্পর্শ করতে ইচ্ছে হয়। মাকে বড় জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়। মার কানে কানে বলতে ইচ্ছে হয়, মা তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো, মা তুমি আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো।

৪.৪৫ বালিশে গড়িয়ে পড়তে থাকে চোখের জল।

৪.৪৬ আমার ভারী নিশ্বাসের শব্দ শুধু। চারদিকে আর কোনও শব্দ নেই। কবরের নিস্তব্ধতা চারদিকে। চোখের জল পড়ার কোনও শব্দ হয় না। ও নিঃশব্দে পড়ে।

৪.৪৮ বিছানা ছেড়ে উঠি। বিছানার এক পা দূরেই ছোট একটা টেবিলের ওপর আমার ল্যাপটপ। ল্যাপটপ চালু করি। এই ল্যাপটপটিই নিয়ে বেরিয়েছিলাম, যখন বেরিয়েছিলাম। দুদিনের জন্য যেতে বলেছিল, কোথায় নাকি কোন রিসর্ট আছে, থেকে রোববার কী সোমবার ফিরে আসবো। এখনও ভাবলে কেমন গা ছমছম করে। আমাকে। তাড়াবার জন্য কী ভীষণ ফাঁদ পেতেছিলো ওরা।

৪.৫০ গুগলে খবরগুলো দেখি। মেরিনিউজ ডট কমের একটি খবর পেয়ে খুব মন খারাপ হয়ে যায়। লেখক বলছেন আমি সরকারের বিরুদ্ধে নালিশ করছি। বলেছি আমি নাকি গৃহবন্দি অবস্থায় আছি। আমি নাকি এখানে সুখে নেই। কত বড় স্পর্ধা আমার যে সুখ চাইছি। দাবির শেষ নেই আমার। কত টাকা খরচ হচ্ছে আমার পেছনে, অথচ সাত হাজার কী দশ হাজার মেয়ে আজ দিল্লির রাস্তায় গৃহহীন পড়ে আছে।

লেখাটা আমাকে চুপসে দেয়। আমি কি ইচ্ছে করে এখানে এসেছি? সরকারের টাকায় খাওয়া দাওয়ার ইচ্ছে কি আমার ছিল, নাকি আছে? আমি তো নিজের পয়সায় থাকি এ দেশে। কেউ আমাকে দুটো পয়সা দিয়ে সাহায্য করে না। বরং আমিই দিই। দরিদ্রকে যখনই যেভাবে পারি সাহায্য করি। এখানে গৃহবন্দি আমাকে করতে বলেছে কে? একটা জিনিসই আমি প্রাণপণে চাই, সে হল মুক্তি। স্বাধীনতা এবং স্বনির্ভরতা ফিরে পেতে চাই, যে দুটো পেতে জীবনভর কঠিন সংগ্রাম করছি।

৪.৫০ দীর্ঘশ্বাস। দীর্ঘশ্বাস। দীর্ঘশ্বাস।

৫.০০ ইমেইলগুলো পড়ি। একটা ইমেইল প্যারিস থেকে। আমি সেই পুরস্কারটি কালই পেয়ে গেছি। সিমোন দ্য বোভোয়া’র জন্মশতবার্ষিকীতে পুরস্কারটি দেওয়া হল। সিমোন দ্য বোভোয়া পুরস্কার। খুব বড় বড় দার্শনিক, লেখকেরা ছিলেন, কেট মিলেটও ছিলেন জুরি হিসেবে।

৫.২০ একটা ভালো লাগা আমাকে ছুঁয়ে থাকে। আমি কল্পনা করে নিতে পারি প্যারিসের কোনও বড় অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠান ঠিক কেমন হতে পারে, ওরকম অনেক অনুষ্ঠানে আমি কথা বলেছি। হাজার হাজার শিক্ষিত, সচেতন, বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিল্পী, দার্শনিকের সামনে আমি বক্তৃতা দিয়েছি। ওই দূর দেশের সমর্থন আমার কাছে কী রকম যেন এখন রূপকথার মতো লাগে তবু। এই বন্দি জীবনে সুদূরের সমর্থন আমাকে মুক্তির কোনও গল্প শোনাতে পারে না।

.

১২ জানুয়ারি

এক.

মাঝে মাঝে ভাবি কলকাতায় থাকার জন্য এত পাগল কেন আমি? কলকাতা আমাকে কী দিয়েছে? আমার কি খুব সামাজিক জীবন ছিল কলকাতায়। দিনের পর দিন কি আমি একাকীত্বে ভুগিনি? কোনও সাহিত্যিক আজ্ঞা কি হত আমার বাড়িতে? না। চারদিকে অনুষ্ঠান, চারদিকে উৎসব লেগেই থাকতো কলকাতায়। কোথাও কি খুব ডাক পড়তে আমার! মাঝে মাঝে রঞ্জন হয়তো কোথাও যেতে বলতো, তাও তার যদি অকস্মাৎ কোনও কারণে আমার কথা মনে পড়তো, অথবা কেউ যদি তাকে বলতো আমাকে ডাকার জন্য। যে হাতে গোনা ক’দিন আমি গিয়েছি সন্ধের পার্টিতে, আমার ভালো লাগেনি। মদ খেতে পছন্দ করলে, অথবা সাজগোজের অভ্যেস থাকলে হয়তো ওসব খুব পছন্দ হত, কিন্তু ওসব পছন্দ করার অন্তত আমার কোনও কারণ ছিল না। ভালো লাগার মধ্যে কিছু মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়া। কিছু মানুষের সঙ্গে দু চারটে কথা বলা। যে কোনও কথাই তো আমার মনে ধরে না। বুদ্ধিদীপ্ত কথা খুব শুনিনি। যশ খ্যাতির পেছনে দেখেছি লোকে পড়ি কী মরি দৌড়োয়।

কলকাতায় বাস শুরু করার বছরখানিক পর থেকেই লক্ষ্য করেছি আমাকে এড়িয়ে চলেছে আনন্দবাজার। বড়লোকের খেয়াল। নারীর কোনও দেশ নেই’ পান্ডুলিপি আনন্দ পাবলিশার্সে দেওয়ার পরও ছাপাবে না বলে ফেরত দিয়ে দিয়েছে। আমার খবর হয়তো মাঝে সাঝে ছাপায়, যেহেতু ওগুলো খবর। কিন্তু লেখক হিসেবে নামটা মুছে দিয়েছে। দু’দুবার আনন্দ পুরস্কার দেওয়ার পরও। দুঃখ করা ছাড়া আমার কিছু করার নেই। দৈনিক স্টেটসম্যান-এ প্রতি বুধবারে লিখতাম। নিয়মিত কোথাও লিখতে পেরে অনেকটা দুঃখ ঘুচেছিল বটে। সামাজিক জীবন বলতে সত্যি কিছু ছিল না। হাতে গোনা ক’জন বন্ধু বাড়ি আসতো। তারা বেশির ভাগই সাহিত্যশিল্প জগতের বাইরের লোক। ওই জগতের যাদের সঙ্গেই যোগাযোগ ছিল, ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে গিয়েছিল সেটা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার বই নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারকে আবেদন করার পর থেকে এবং সরকার সে আবেদন রক্ষা করার পর থেকে সুনীল এবং সুনীলের শিল্পী সাহিত্যিক বন্ধু ও শিষ্য এবং সরকারের ঘনিষ্ঠ শিল্পী সাহিত্যিক শিষ্য সবাই আমাকে তাদের শত্রু জ্ঞান করাটাকেই রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে যৌক্তিক বলে মনে করেছেন এবং আমার থেকে দূরে থেকেছেন। যদিও আমি অসম্ভব আন্তরিক, এবং প্রাণবন্ত একজন মানুষ, এই আমাকেই নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হয়েছে কলকাতায়, মাসের পর মাস। তাহলে কী আছে কলকাতায়? কেবল কি ভাষাটার জন্য? কেবল কি মাঝে মাঝে ওই দু’একজন বাঙালির সঙ্গে বাংলায় কথা বলার জন্য? মাঝে মাঝে বাংলা কোনও নাটক দেখার সুযোগ হয়, সে কারণে? ভোরে ঘুম থেকে। উঠে চা খেতে খেতে পড়া যায় বাংলা পত্রিকা? তাছাড়া আর কী?

আমার কোনও দ্বিধা নেই বলতে, যে–আমি খুব বেশি কোনও সাহিত্যিক বা সাংস্কৃতিক পরিবেশ পাইনি। ব্রাত্য ছিলাম নাকি সেলিব্রিটি ছিলাম! দুটোতে মাঝে মাঝে তফাৎ খুব একটা থাকে না।

সুবিধে লুটতে অনেকে আসতো। রঞ্জন সেনগুপ্ত নামে এক বয়স্ক লোক হঠাৎ বন্ধু সেজে উদয় হল। ছলে কৌশলে কেবল টাকা নিত। দুদিন বাদে ফেরত দেবে বলে একবার বিরাশি হাজার টাকা ধার নিয়ে আর ফেরত দেয়নি।

কাজের লোক নিয়েও ভুগেছি কম নয়। এমন বন্ধু কেউ ছিল না যে একজন বিশ্বস্ত কাউকে দেবে ঘরের কাজকর্মে আমাকে সাহায্য করার জন্য। বিশ্বাস করে যাকেই ঘরে ঢুকিয়েছি, সেই বিশ্বাস ভেঙেছে।

দুই.

আমাকে নজরবন্দি করার জন্য বা আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য, বা আমাকে সাহায্য করার জন্য যে দুজন লোক থাকে, যদিও ওরা বলে যে আমার কাছে ওরা আসছে আমাকে দেশ থেকে তাড়াবার কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে নয়, আমার মনে হয় ওরা বোধহয় সত্য বলছে না, ওরা জানে সবকিছু, ওরা কায়দা করে আমার ভেতরের খবর নেয়–কিছু ভাবছি কি না, ভাবলে কী ভাবছি, চলে যাওয়ার চিন্তা মাথায় আসছে কি না। হঠাৎ কেউ কেউ তো বলেই, ‘তারচেয়ে বিদেশই ভালো। যে দেশে ফ্রিডম আছে, সে দেশই তো ভালো। মাঝে মাঝে না হয় বেড়াতে এলে ভারতে। ওরা কি এই কথা শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে বলে, বন্ধু ভেবে বলে, না কি ওপরওয়ালারা শিখিয়ে দিয়েছে বলতে, তাই বলে! আমি বুঝে পাই না। আমার বোধহয় খুব সন্দেহ-মন, অথবা পরিস্থিতি আমাকে সন্দেহপ্রবণ করেছে। অথবা চারপাশে যা চলছে, তা আরও অনেক গভীর জলের খেলা। আমি শুধু ওপর থেকে দেখছি এবং বিচার করছি। আমি আস্ত একটা বোকা।

সারাদিন লেখার চেষ্টার সঙ্গে লিখতে পারা এবং না পারা মিলিয়ে দিলে যা হয়, হয়েছে। সারাদিন আরও কিছু ঘটেছে। কিছু ছেলেমেয়ে আমাকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সই সংগ্রহ করতে বেরিয়েছে কলকাতায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সই দিলেন, তবে বললেন, ‘যেরকম প্রচার করা হচ্ছে ওর ব্যাপারে, যে, দিল্লিতে ওকে নিজের মতো থাকতে দিচ্ছে না, তা কিন্তু ঠিক নয়। ও কিন্তু খুব ভালো আছে। মৃণাল সেনএর কাছেও গিয়েছিল ওরা। মৃণাল সেন এমনকী ফোনে আমার সঙ্গে কথাও বললেন। আমি কেমন আছি শুনে তিনি বললেন, এ কী, এ তো কল্পনা করা যায় না। কিন্তু সই দেননি। ওদেরকে বলেছেন, ‘লেখাটা কড়া হয়ে গেছে, আরেকটু নরম করে লিখে নিয়ে এসো, সই দেব।

ওরা যখন বললো যে আপনিই নরম করে লিখে সই করে দিন। তখন তিনি নিজে লেখার বদলে মনসিজ মজুমদারকে ফোনে বললেন, নরম করে লিখে দিতে।

সই দিয়েছেন বিজয়া মুখোপাধ্যায়, তবে নাকি কিছু কথা শুনিয়ে, অ্যাপোয়েন্টমেন্ট না করে গেছে কেন, ইতাদি। শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় ঘুমোচ্ছিলেন, সই দিতে পারেননি। বাংলার কবিদের মধ্য থেকে সততা দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু শরৎএর মধ্যে এখনও অবশিষ্ট আছে। এখনও তিনি দিব্যি তসলিমার মতো নিষিদ্ধ লেখককে নিয়ে খচখচ করে দুটো তিনটে কবিতা লিখে চমকে দিতে পারেন লোকদের। দিব্যেন্দু পালিত সই দিয়েছেন, তবে বলেছেন, ‘এসব সরকারের ব্যাপার, সই দেওয়ার কোনও অর্থ হয় না।

কী হয় সইয়ে? এর আগে দু’জন ছেলে, আমার সঙ্গে পরিচয় নেই, শুনেছি, পত্রিকায় পড়েছি, রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনার দাবিতে সই সংগ্রহ করেছিলো। ছ’হাজার সই দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠিয়েছিল। কোথায় ওই সইওয়ালা কাগজগুলো? নিশ্চয়ই ময়লা ফেলার বাক্সে।

.

১৩ জানুয়ারি

সকালে এনামুল কবীর পড়ে শোনালেন কলকাতা থেকে আজকের কাগজে লেখা গিয়াসুদ্দিনের একটা লেখা। এনামুল কবীর প্রায় প্রতিদিনই এ কাজটি করছেন। তসলিমা, আপনার অপরাধ আপনি মুসলিম পিতামাতার সন্তান। গিয়াসুদ্দিন অকপটে জানাচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু মৌলবাদীরা ছাড়া মুসলিম মৌলবাদীদের সবাই ভয় পায়। মহান নেতা নেত্রী বুদ্ধিজীবী লেখক শিল্পী সাহিত্যিক সবাই। মুসলমানদের মধ্যে যারা গোঁড়া নয়, তারা ভয়ে কাঠ হয়ে থাকে। আর, অমুসলমান আর অসাম্প্রদায়িক যারা, তাদের ভয়, পাছে যদি ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তিতে দাগ লেগে যায়। হিন্দু মৌলবাদীদের দ্বারা যারা আক্রান্ত, তাদের পাশে বিদ্বজ্জনেরা দাঁড়ান, কিন্তু মুসলিম মৌলবাদীদের দ্বারা আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ান না।

গিয়াসউদ্দিন বলছেন, রাজনীতিকদের এই প্রশ্নটা তিনি করছেন না। কারণ ওরা ক্ষমতার দাস, মোল্লা তোষণ ওদের ধর্ম। প্রশ্নটা লেখক শিল্পী সাহিত্যিক বিদ্বজ্জনের কাছে। যাঁরা হিন্দু মৌলবাদী দ্বারা আক্রান্ত সংখ্যালঘুর পাশে দাঁড়ান, তাঁরা মুসলিম মৌলবাদীর হাতে আক্রান্ত কারও পাশে, বিশেষ করে সে যদি মুসলমান পরিবার থেকে আসে, দাঁড়াতে পারেন না কেন? উত্তর তিনিই দিয়েছেন। উত্তর হল, মুসলিম মৌলবাদীদেরকে ভয়। আর, তারা ভাবেন, যারা আক্রান্ত এবং আক্রমণকারী তারা উভয়ে মুসলমান, সুতরাং ওসব মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।

গিয়াসউদ্দিন বলছেন, তসলিমা, আপনার প্রশ্ন কী দোষে আপনাকে শাস্তি পেতে হচ্ছে? আপনার বিরুদ্ধে যে দোষগুলোর কথা বলা হচ্ছে, তা সব আরোপিত, সব মনগড়া, সব অযৌক্তিক। আসলে দোষ আপনার একটাই, আপনার জন্ম মুসলিম পরিবারে। মুসলিম পরিবারে জন্মালে যুক্তিবাদী হওয়া যায় না, নারীবাদী হওয়া যায় না, মানববাদী হওয়া যায় না, প্রতিবাদী হওয়া যায় না। আপনি এসবই হয়েছেন, তাই মোল্লা মুফতিরা আপনাকে ক্ষমা করবে না। কোরান হাদিস আপনাকে ক্ষমা করতে বলেনি। আর মোল্লারা যাকে শত্রু ঘোষণা করে, আমাদের বিদ্বজ্জনেরা তাদের পাশে দাঁড়ায় না। আমাদের বিদ্বজ্জনেরা যে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’, আপনার পাশে দাঁড়িয়ে কেন তারা সাম্প্রদায়িক হতে যাবেন?

এসব কথা আগেও হয়েছে। হিন্দুরা, বা হিন্দু বংশোদ্ভূত অতি সৎ ও সাহসী সেকুলাররা লিখেছেন। মুসলমানরা লেখেন না এভাবে। গিয়াসুদ্দিন আপাদমস্তক নাস্তিক বলেই লিখতে পেরেছেন। তবে ভারতবর্ষে মুসলমান পরিবারে জন্মে নাস্তিক হওয়ার চল খুব বেশি নেই। গিয়াসউদ্দিনের মতো আরও কয়েকজনকে আমি একসময় আবিষ্কার করে একত্র করেছিলাম। ধর্মমুক্ত মানববাদী মঞ্চ গড়ে তুলেছিলাম। যেন মুসলমানদের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা, ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারমুক্ত মানসিকতা গড়ে ওঠে। ধর্মীয় সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ, এবং ধর্মমুক্ত শিক্ষার দাবি, নারীর সমানাধিকার, মানবাধিকার ইত্যাদি দাবি নিয়েই গড়া হয়েছিল মানববাদী মঞ্চ।

গিয়াসউদ্দিনকে ফোনে ধন্যবাদ জানাই। কাল ওদের প্রেস কনফারেন্স। কলকাতায়।

আজ মন ভালো করা আরও একটা খবর আছে। হিন্দুস্থান টাইমসে করন থাপর খুব ভালো লিখেছেন। লিখেছেন প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি, ভারতের তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী যে আমাকে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইতে বললেন মুসলমানদের কাছে, যেহেতু তাদের অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছি, মূলত সেটার সমালোচনা করেই লেখা। থাপর বলছেন, কারা তারা, যাদের অনুভূতিতে মোটেও আঘাত দেওয়া যাবে না? কারা তারা, যাদের সামনে তসলিমাকে নত হতে হবে এবং করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে? নিশ্চয়ই তারা আমরা নই, আমি নই, আপনি নন, কোনও উদার সহনশীল মানুষ নন, কোনও যুক্তিবাদী, মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী মানুষ নন, শিক্ষিত, সচেতন কেউ নন, তারা সংকীর্ণ, স্বার্থান্ধ, ধর্মান্ধ, মোল্লাশ্রেণী। আমাদের স্বাধীনতার সীমানা কি তারা মেপে দেবে? এ দেশে কী মানা যাবে এবং কী যাবে না তার নিয়ম তৈরি করার দায়িত্ব তাদের কে দিয়েছে?

I have to assert that when Mr. Mukherjee says Taslima Nasreen must not say, do or write things that”hurt the sentiments of our people”, I do not recognise the pronoun ‘our’. Am I part of it? Are you? Is he? Or does he only have in mind a small but vocal and violent minority –perhaps disowned by, or at least, em barrassing to the majority of their co-religionists –who, he believes, delivers votes?

We don’t expect very much of our politicians –if there is one lesson experi ence has taught us, it must be this –but, at the very least, they should stand up for our freedoms. Otherwise, they could soon be tolling the bell for them selves. Let them remember what they deny Taslima or us today; they could end up losing themselves tomorrow.

প্রভু, যিনি আমার স্বাধীনতার বাহন নিয়ে আসেন এখানে, তিনি এলেন। কী, আমাকে দাঁতের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন। কোথাও যাবার প্রস্তাব এলে আমি লাফিয়ে উঠি। কিছুক্ষণের জন্য হলেও বেরোনো তো যাবে এই বন্দিত্ব থেকে। সে যে উদ্দেশে হোক না কেন।

গাড়ি চলতে শুরু করলো। নতুন পথ। চারদিক দেখতে দেখতে যাই। এ অনেকটা প্রিজন ভ্যানে করে কোথাও যাবার মতো। কালো কাঁচ জানালাটা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। বাইরে জীবন। মানুষ যারা যাচ্ছে নিজের কাজে, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, কার কী দায় পড়েছে আমাকে চেনার, আমাকে নিয়ে ভাবার, আমাকে মারার! কারও না। গাড়িতে তো নিরাপত্তা রক্ষী নেই। গাড়ির সামনের কাঁচ দিয়ে রাস্তার লোকে আমাকে দেখছে, তাতে হয়েছেটা কী? কারও কিছু যায় আসে না। যে চেনে, সে চেনে। যে চেনে না, সে চেনে না। তবে কেন বন্দি করা আমাকে?

আমি বেরোলে নাকি দেশের দশটা লোক মরে যাবে। এই প্রশ্নের উত্তর তারা যা দেন, আমি তা মানি না। ওই উত্তরের কোনও যুক্তি নেই।

আমার আনন্দ হয় নতুন রাস্তা দেখে, তার মানে আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ডেন্টিস্টের ক্লিনিকে। প্রভুকে কিছু জিজ্ঞেস করি না। কিন্তু যখন একটা গলিতে ঢোকে গাড়ি, চুপসে যাই, এ তো সেই গলি। সেই চেনা গলি। সেই ভুতুড়ে নিরাপদ বাড়ি’র গলি। সেই একই বাড়িতে আনা হল আমাকে, যে বাড়িতে কেউ বাস করে না। উঁচু দেয়াল ঘেরা বাড়ি। উঁচু লোহার গেটওয়ালা বাড়ি। বাড়িটিতে চা বিস্কুট দেওয়ার জন্য লোক আছে, এ লোক আমার বিশ্বাস, খবর পেয়ে বাড়িতে আসে।

মাঠটায় হাঁটি। ওই মাঠটুকুই আমার স্বাধীনতা। গন্ডি যখন কমে আসে মানুষের, এক টুকরো জায়গাই কী বিশাল বলে মনে হয়।

ডেন্টিস্ট আসেন। ছোট পুঁটলিতে করে দাঁত দেখার জিনিসপত্র নিয়ে এসেছেন। কী হত, যদি তার ক্লিনিকে যেতাম? ওষুধপত্র লিখে দিলেন। ফেরার পথে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে ওষুধপত্র কিনে প্রভু আমাকে রেখে চলে গেলেন। কারাগারটিতে রেখে গেলেন।

বাকি সময় আমার পেরোলো। যে কোনও দিনের মতোই। যে কোনও রাতের মতোই।

.

১৪ জানুয়ারি

আজ কলকাতায় মুসলমানদের প্রেস কনফারেন্স হচ্ছে। প্রগতিশীল মুসলমান অথবা প্রাক্তন মুসলমান অথবা মুসলমান সম্প্রদায়ের মুসলমান নামের ধর্মহীন মানুষেরা প্রেস কনফারেন্সে বলবেন, যে, তসলিমাকে তারা ফেরত চান কলকাতায়। মুসলমান সমাজের উন্নতির জন্যই তসলিমাকে তাঁদের প্রয়োজন।

না। আজ বিশেষ কিছু ঘটলো না। পিটিআইএর সুপ্রতীককে সিমোন দ্য বোভোয়া পুরস্কারের কথা বলাতে আজ দ্য হিন্দু আর হিন্দুস্থান টাইমসসহ কিছু কাগজে দেখলাম খবরটা। যে লেখালেখির জন্য ফ্রান্সে আমাকে পুরস্কৃত করা হচ্ছে, সেই একই লেখালেখির জন্য বাংলাদেশে আর ভারতে আমাকে অপমানিত করা হল। এ ছাড়া বলার আমার কিছু নেই।

ফোন কিছু কলকাতা থেকে আসে। ফোন কিছু যায়। ফোনের আসা যাওয়ার সংখ্যা ধীরে ধীরে কমছে। হ্যাঁ কমছে। শঙ্খ ঘোষ ফোন করলেন। অভিনন্দন জানালেন সিমোন দ্য বোভোয়া পুরস্কার পাবার জন্য। জিজ্ঞেস করলেন, ফ্রান্সে লিখেছি, যে, এখানে কেউ নেই পাশে’, সে কেন। বললাম ‘পুরোনো একটা লেখার অনুবাদ ওটি। তখন সত্যি বলতে কী কেউ ছিল না। মনে মনে বলি, এখনই বা কে আছে, কী আছে! গুটিকয় মানুষ আছে শুধু, রাজনৈতিক অরাজনৈতিক কোনও দল টল তো নেইই। বললাম, প্রথম দিকে, মহাশ্বেতা দেবীরা সভা বা মৌন মিছিল করার আগে, সত্যিই তো কিছু তো হচ্ছিল না। ঠিকই তো, কোনও রাজনৈতিক দল কি বলেছে কিছু, এত নারীবাদী সংগঠন, এত মানবাধিকার সংগঠন, কিছু তো বলেনি তারা। সেই সময়টায় ওই লেখাটা লিখেছিলাম। ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করে ল্য মদ ছাপিয়েছে।

বললাম, তা ছাড়া পরে যে লেখাটা লিখেছি, যেটা আপনি কিছু লাইন কাটলেন, সেখানে তো সবাইকে আমি ধন্যবাদই জানিয়েছি।

–হ্যাঁ। সেটা পরের লেখা। ছাপা হওয়াটা আগের লেখা।

বুঝলেন শঙ্খ ঘোষ।

শঙ্খ ঘোষ বারবার বোঝাতে চাইছেন অনেকে আছেন আমার সঙ্গে। বলেছিলেন ভ’বাবুকে বলবেন আমাকে যেন কলকাতায় ফেরত পাঠান। ভ’বাবুকে অবশ্য এখনও তাঁর সেই জরুরি ফোনটা করা হয়নি। তিনি কি সত্যিই পাশে আছেন! যখন অভিযোগ করা হচ্ছে আমি মুসলিম বিরোধী, তিনি চুপচাপ শুনছেন। কোনোদিন তো প্রতিবাদ করেননি, বলেননি সেই ঘটনাটির কথা, বছর কয়েক আগে আমি যে তাঁর হাতে দশ হাজার টাকা দিয়েছিলাম গুজরাতের দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মুসলমানদের জন্য সাহায্য করতে। টাকা সংগ্রহ করার ভার ছিল তাঁর। আমি ফলাও করে প্রচার চাইনি কিন্তু মিথ্যে অভিযোগে যখন আমাকে দেশ থেকে তাড়ানো হচ্ছে, তখন তো বলা যেত।

শঙ্খ ঘোষ যে সাহায্যটি করলেন, তা হল, আমার যে লেখাটা পড়া হবে অনুষ্ঠানে বা ছাপা হবে পত্রিকায়, সেটি সংশোধন করে দিলেন, মৌলবাদী মুসলমানদের আঘাত করতে পারে, বা সরকার ক্ষুব্ধ হতে পারেন এমন কোনো শব্দ বা বাক্যের অস্তিত্ব যেন না থাকে। এসবের আঁচ যেখানে পেয়েছেন, সেখানে কেটে বাদ দিয়েছেন বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। বাদ দেওয়াটুকুই হয়েছে, তসলিমাকে কলকাতায় ফেরানোর ওই অনুষ্ঠানে তিনি কথা দিয়েও উপস্থিত থাকতে পারেননি। অন্য কাজ ছিল তাঁর।

কবে আমাদের বড় লেখক কবিরা ব্যানে এবং সেন্সরশিপে অগাধ বিশ্বাস থেকে নিজেদের মুক্ত করবেন, জানিনা।

আজ বিকেলে হাঁটছিলাম ছাদটায়, আকাশে কয়েকটা তারা শুধু। হাঁটছিলাম আর কথা বলছিলাম প্রভুর সঙ্গে। প্রভু এবং তাঁর বাহিনী নিজেদের অফিসের কাজ ফেলে আমার পেছনে সময় দিয়ে যাচ্ছে। আমি চাই না আমার জন্য কারও কোনও ক্ষতি হোক। কিন্তু ক্ষতি তো সরকারের হচ্ছে। সরকারি কাজ ফেলে আমাকে পাহারা দেওয়া বা সঙ্গ দেওয়া তো দিনের পর দিন চলতে পারে না। আমি ভালোবেসে এ দেশে থাকতে চাই। কারও কোনও অনিষ্ট হোক চাই না। কেবল চাই অবসান হোক এই অবস্থার। একসময় হঠাৎ প্রভু জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কলকাতার বাড়িটা ছেড়ে দেননি?

–না।

–শুধু শুধু টাকা খরচ হচ্ছে না? ভাড়া লাগছে।

–হ্যাঁ তা লাগছে।

–কত টাকা যেন ভাড়া?

–কুড়ি। আর মেইনটেনেন্স আড়াইহাজার।

–এত টাকা প্রতিমাসে দিয়ে যাচ্ছেন?

–কী আর করবো! আমার পাবলিশারকে বলেছি ভাড়া দিয়ে যেতে। রয়ালটি থেকে কেটে রাখবেন।

–ছেড়ে দিতে পারেন ফ্ল্যাটটা।

–ছেড়ে নতুন একটা ফ্ল্যাট নেওয়া যেত। কিন্তু কে বাড়ি বদলাবে আমি ছাড়া। বাড়ি তো আমার গিয়ে দেখতে হবে। একটু কমের মধ্যে যদি একটা ফ্ল্যাট পাই, ভালো।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রভু আবার কথা শুরু করেন।

–পুরস্কার আনতে ফ্রান্সে যাবেন না?

আমি বললাম, ওটা তো হয়ে গেছে। অনুষ্ঠান হয়ে গেছে। আমার ফরাসি প্রকাশক আমার পক্ষ থেকে পুরস্কার নিয়েছেন।

–অনুষ্ঠান হয়ে গেছে?

–হ্যাঁ হয়ে গেছে।

–কবে?

–এই তো ন’ তারিখে।

–তো পুরস্কারের জিনিসগুলো আনতে তো আপনাকে প্যারিসে যেতে হবে? তাই না?

–না। সার্টিফিকেট আর টাকাই তো। সার্টিফিকেট পাঠিয়ে দেবে কুরিয়ার করে। টাকা পাঠিয়ে দেবে আমার ব্যাংকে।

–সুয়েনসন কী বলে?

–কী ব্যাপারে?

–ফোন করে না?

–তা করে।

–বলে না কিছু?

–কী বলবে?

–আপনাকে সুইডেনে যেতে বলে না?

–কোথায়?

–সুইডেনে?

–কেন বলবে?

–দেখে গেল আপনার মানসিক অবস্থা। খুব খারাপ আছেন। এসব দেখে কি আপনাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে চাইছে না?

–না।

–বলছেন কী।

–চাইবে কেন, সে তো জানে এই দেশে থাকতে আমি পছন্দ করি। এ দেশেই আমি থাকতে চাই। সে তো জানে যে আমি বিদেশে থাকতে চাই না। বিদেশে থাকা আমি পছন্দ করি না। আর ওদেশে আমি যাবোই বা কেন, কী করবো ওখানে গিয়ে? এখানে এখন না হয় স্বাধীনতা নেই আমার, কিন্তু এভাবে তো বেশিদিন থাকবো না। এসবের তো শেষ হবে একদিন।

বুঝি। হাড়ে হাড়ে একটা জিনিস বুঝি। প্রভুকে বলা হয়েছে আমার ভেতরের কথা জানতে। কী ভাবছি। বিদেশে চলে যাবার কথা ভাবছি কি না। না ভাবলে কেন ভাবছি না। আমাকে ভাববার জন্য বলা হচ্ছে। আমাকে ভাবনাটা দিচ্ছেন প্রভু। আমি বুঝি না, দেশ ছাড়ার কোনও ভাবনা আমার মাথায় কেন আসে না!

আরেকদিন একজন অফিসার হঠাৎ বলেছিল, ‘ফ্রিডম তো আসল। জীবনে স্বাধীনতাই যদি না থাকলে তাহলে আর কী। কেন তুমি চলে যাচ্ছো না, কী দরকার এভাবে বন্দি থেকে?’

আমি চমকে গিয়েছিলাম সেদিন ওর কথা শুনেও।

আমাকে ভাঙতে চাইছে ওরা। ওদের কি কেউ দায়িত্ব দিয়েছে আমাকে ভাঙতে? নাকি এমনিতে কথায় কথায় বলছে ওরা। কিছু বুঝতে পারি না।

কিন্তু যদি না ভাঙি? ওরা কি কিছু ভেবেছে, যদি না ভাঙি, তাহলে কী করবে ওরা?

যে করেই হোক ভাঙার ব্যবস্থা করবে? ভয় পাওয়া আমার উচিত নয়, তারপরও অন্ধকার কেঁপে আসার মতো ভয় আসে কেঁপে।

.

১৫ জানুয়ারি

দিন গুলো কি যাচ্ছে, নাকি যাচ্ছে না? আমার এখানে ক্যালেন্ডার নেই। সকালের খবরের কাগজগুলোয় দেখি দিন যাচ্ছে। প্রভু দাঁতের অবস্থা জানার জন্য ফোন করেছিলেন। আমি কোনও খবর আছে কি না জানতে চেয়েছি। খবর বলতে যা শুনতে চেয়েছি, কর্তারা আমার কলকাতা ফেরত যাওয়ার ব্যাপারে কিছু বলছেন কি না। না খবর নেই, প্রভুর যান্ত্রিক স্বর।

ভালো বা মন্দ যে কোনও একটি খবরই আমি জানতে চাই। এভাবে বাঁচতে কেউ পারে না। স্বাধীনতার জন্য সারাজীবন লড়াই করার পর আমাকে শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে, পরাধীনতার শাস্তি। একশ’ কোটিরও বেশি লোক এ দেশে। এই দেশে একজন লেখককে কোথাও আটকে রাখা হয়েছে। দিনের পর দিন যাচ্ছে। কেন আমি কলকাতায় ফিরতে পারবো না, তার কোনও তো কারণ নেই। আমার বাড়ি থেকে আমাকে তুলে এনে অন্য একটা শহরে একটা ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে। এ ঘটছে ভারতবর্ষে। মাঝে মাঝে আমি বিশ্বাস করতে পারি না।

আগে যারা ফোন করতো, তাদের অনেকেই এখন আর ফোন করে না। সম্ভবত আমি এখন সরকারি খাতায় বাতিলের তালিকায় বলে। বাতিলের খাতায় নাম উঠলে বা কালো তালিকাভুক্ত হলে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলাটাই মঙ্গল বলে বেশির ভাগ লোকে জানে।

মানস ঘোষের পত্রিকায় খুব ছোট করে কালকের ধর্মমুক্ত মানববাদী মঞ্চের খবরটা ছাপা হয়েছে। অগ্রিম খবর দেওয়াই হয়নি যে মুসলমান সমাজের প্রগতিশীল বিজ্ঞানমনস্ক মানুষেরা একত্র হচ্ছেন তসলিমাকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনার জন্য। কথা নাকি ছিল দেওয়া হবে। আর, অনুষ্ঠান হয়ে যাবার পর এই এতটুকু সংবাদ। অথচ ফিরিয়ে আনার প্রথম র‍্যালির খবর ছিল বিরাট করে প্রথম পাতায়। মানস ঘোষও কি দুরে সরে যাচ্ছেন? কাছের মানুষগুলো, আপন মানুষগুলো কেন যে দূরে সরে যায়! আনন্দবাজার তো অনেক আগেই দূরে সরে গেছে। অন্যান্য পত্রিকার চরিত্র বোঝা দায়। একমাত্র দৈনিক স্টেটসম্যানই ছিল পাশে। নতুন পত্রিকা। তারপরও খুব দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিল।

দুপুরে ঘুমোলাম। আজকাল ঘুমোলেই দুঃস্বপ্ন এসে ঘুম নষ্ট করে দেয়। ভীষণ একা লাগে। বাবা মার কথা খুব মনে পড়ে। মনে পড়ে আর একা লাগে। এত একা বোধহয় আমার কখনও লাগেনি আগে।

কাল ফকরুল মামা ফোন করেছিল। কী রকম যেন লাগে এমন ফোনে। সেই যে কবে কলকাতায় সাত কী আট বছর আগে দেখা হয়েছিল। তারপর আর কোনও যোগাযোগ নেই। আর দেখা নেই। কাল ফোন। আমি কোথায় আছি জিজ্ঞেস করলো। বুক হু হু করে ওঠে। এরাই তো আমার আত্মীয়। আমি কি ওদের ভুলে থাকি নাকি ওরা আমাকে ভুলে থাকে? আমি তো চাই সবাইকে নিয়ে এক শহরে থাকতে। আমি তো চাই সবার সুখে দুঃখে কাছাকাছি থাকতে। চাই ভালোবাসা পেতে। ভালোবাসা দিতে।

পারি না।

.

১৬ জানুয়ারি

আজ সকালে কলকাতা থেকে ফোন এল। দৈনিক স্টেটসম্যানে আমাকে নিয়ে শাঁওলি মিত্র আর ভবানীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন। গিল্ডের খবর আছে, মিল্লি ইত্তেহাদ পরিষদ যে গিল্ডকে চিঠি পাঠিয়েছে আমার বই যেন না থাকে, থাকলে মেলায় গন্ডগোল হবে, সেই চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছেন গিল্ডের কর্তারা আমার প্রকাশকদের কাছে। ভালো উত্তর দিয়েছেন শিবানী মুখোপাধ্যায়, বলেছেন, আমরা বই নেব, ব্যস। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে সুবীর মিত্র বলেছেন, বই মেলার দেরি আছে, এখনও ভাবার সময় আছে। বই থাকাই তো স্বাভাবিক। অনিমা বলেছেন গাঙচিল থেকে, আমরা যে বই ছাপিয়েছি সে বইয়ে ধর্ম বিষয়ে কোনও কথা নেই।

সকালে মানস ঘোষকে ফোন করলাম। কথা বলতে বলতে গলা বুজে আসে। এরপর দেখি চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। মুছে ফেলছি হাতে, আবার ভিজে যাচ্ছি।

প্রশান্ত রায়ের সঙ্গে কথা হল, ওই গিল্ডের ব্যাপার নিয়েই। গিল্ডের কাছে চিঠি, গিল্ড নিজে সামলাবে এসব সমস্যা, তা নয়, চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছে প্রকাশকের কাছে, যেন প্রকাশকের দায়িত্ব এটি।

শাঁওলি মিত্র জিজ্ঞেস করেছেন, আমাকে কেন আটকে রাখা হয়েছে, আমি কি গণহত্যাকারীদের চেয়েও ক্ষতিকর। ভবানীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, যেভাবে লিখছি আমি, সেভাবে লেখায় কাজ হবে না। আমাকে মুসলিম সমাজের অশিক্ষিত লোকদের কাছে গিয়ে গিয়ে বোঝাতে হবে। বিদ্যাসাগরকে লোকে মানতেন কারণ তিনি হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে সরাসরি কোনও বাজে কথা বলেননি।

কিন্তু আমার প্রশ্ন, ওভাবেই কি করতে হবে সমাজের পরিবর্তন। বছর তো গেছে অনেক। নিয়ম কি বদলাবে না! বা আমি যদি অন্যের নিয়মের বাইরে বেরিয়ে নিজের নিয়মে কাজ করি। গ্রামে গ্রামে হেঁটে হেঁটে কাউকে না বুঝিয়ে শুধু যদি লিখি, যা আমি সবচেয়ে ভালো পারি! এ কী দোষ? লেখাটা?

সুদীপমৈত্র সংস্কার কুসংস্কার নিয়ে প্রতি বুধবারে নিয়মিত লেখেন। অসাধারণ লেখা। এবার মৌলবাদ আর ধর্মবিশ্বাস নিয়ে লিখেছেন। ‘ধর্মবিশ্বাস ঠিক আছে, মৌলবাদটা ঠিক নেই’ –এই বহু পুরোনো ধারণার সমালোচনা, যেটা আমার লেখায় বারবার খন্ডন করেছি। নিজে তো আজ বন্দি হয়ে আছি। আমার লেখা, আমার ভাবনা আমার বিশ্বাসও বন্দি। আমার আদর্শের কথা যদি কোথাও দেখি কেউ লিখছে, ভালো লাগে বড়। আজ দৈনিক স্টেটসম্যানে ফোন করে সুদীপকে অভিনন্দন জানালাম। সুদীপ খুব খুশি হল। ওর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি কখনও। বন্ধুত্ব তো দূরের কথা। একটু আফশোস হয়, কলকাতায় অনেক ভুল মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা করেছি। খাঁটি মানুষগুলোই রয়ে গেছে। দূরে। কলকাতায় যাবার পর জীবনটাই পাল্টে ফেলবো, সিদ্ধান্ত নিই।

কিছুই ঘটে না আর। কিছু একটা ঘটুক চাই।

.

১৭ জানুয়ারি

রাতে আবারও দুঃস্বপ্ন। সারারাত আবারও অস্থিরতায় ভুগেছি। দুঃস্বপ্ন আমার কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। জেগে ওঠার পরও অনেকক্ষণ এই কিডনি নষ্ট হওয়া, মরে যাওয়াটা গেঁথে ছিল ভেতরে। অনেক পরে, সূর্য ওঠারও পরে আমার বোধ হল যে, না, ওটা স্বপ্ন ছিল, সত্যি ছিল না। স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন সত্যি মিথ্যে সব কেমন একাকার হয়ে গেছে। আলাদা করে কোনওটাকে আমি এখন চিনতে পারি না। আজ কোথাও কিছু নেই। কোনও পত্রিকা কিছু লেখেনি। কেউ ফোন করেনি। তপন রায় চৌধুরীর বাড়িতে ফোন করে জানলাম, যে চিঠিটি তাঁর লেখার কথা ছিল ভ’কে, আমাকে একটু যেন বেরোতে দেওয়া হয়, একটু যেন বন্দিত্ব শিথিল করা হয়, সেই চিঠিটি এখনও লেখা হয়নি। তিনি রাজ্য সরকারের কারও সঙ্গে আমার বিষয়ে যে কথা বলবেন বলে বলেছিলেন, সে কথাটাও তাঁর আজও বলা হয়নি। আমার কী রকম বাজে লাগে কাউকে ফোন করে কিছুর জন্য অনুরোধ করতে। বিশেষ করে সেই কিছুটা যদি নিজের জন্য হয়।

আমার এই এখানে এই অচেনা জায়গায় পড়ে থাকা, কী রকম অদ্ভুত লাগে সব কিছু। জোরে জোরে শ্বাস নিই। জোরে শ্বাস নিলে শ্বাসকষ্ট কিছু কমে। কত কেউ কথা দিয়েছিলো রোজ ফোন করবে, অথবা প্রায়ই, তারা সব ভুলে গেছে। যে কেউ ফোন করলে কলকাতা থেকে, অনুরোধ করি, যেন ফোন করে, যেন আবার, যেন কাল, যেন পরশু। বুঝি আমি, কী রকম ভয়াবহ অসহায়তা আমাকে চেপে ধরেছে।

বিকেলে কিছু ঘটলো। সিএনএন এর এক ছেলে কিছু প্রশ্ন পাঠিয়ে তার উত্তরগুলো লিখে নিলো। ওদের ওয়েবসাইটে আমার সঙ্গে পাঠকের চ্যাটের আয়োজন করেছিলো। কিছুটা সময় কাটলো অন্তত প্রশ্ন উত্তরে। কিন্তু তারপর? তার আর পর নেই। আবারও একলা বসে থাকা। বসে থাকা আর জানালায় তাকিয়ে থাকা। তাকিয়ে থাকা আর দীর্ঘশ্বাস ফেলা। সত্যি কথা বলতে কী, আমার লেখায় পড়ায় কিছুতেই মন বসছে না। কবে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা স্বাভাবিক স্বাধীন জীবন যাপন করতে পারবো, এই ভাবনা।

শিবানীর সঙ্গে ফোনে আমাদের সেই বইমেলা যাপনের কথা স্মরণ করছি শেষ বিকেলের দিকে। বলছি সেই কফি হাউজে আমাদের সেই দিনগুলোর কথা–পিপলস বুক সোসাইটির একটা ভালো ঘর হবে কলেজ স্ট্রিটে কোথাও, যাবো প্রায়ই, আড্ডা দেব, এরকম আমাদের স্বপ্ন ছিল। সেই ভালো ঘর শেষ অবদি নেওয়া হয়েছে। কবে মুভ করবে ভালো ঘরটিতে, কবে সাজাবে ঘরটি, কবে আচ্ছা! শিবানী বললো, ”তুমি ফিরে এলে।

কথোপকথন শেষ হলে চা খাচ্ছি, প্রভু টেলিভিশন দেখছেন আর হাসছেন, হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন তার, আপনার ফ্ল্যাট কি বিক্রি করে দিলেন?

–কেন? আমার প্রশ্ন।

–ওই যে কথা বললেন ফোনে। ফ্ল্যাটের কথা কী বললেন?

–না। ওটা আমার ফ্ল্যাট নয়। ওটা আমার পাবলিশারের দোকান। নতুন দোকান নিয়েছে।

প্রভু আমার ব্যক্তিগত জীবন, ফ্ল্যাট ইত্যাদি নিয়ে নাক গলানোর লোকই নন। এই নাক গলানোটা, আমার আশংকা, তার চাকরির নাক গলানো। আমার মনে হতে থাকে, তাঁকে বলে দেওয়া হয়েছে আমার খোঁজ খবর রাখার জন্য, লক্ষ্য রাখার জন্য আমি কবে কাত হব, কবে বিদেয় হব, গুটিকয় আশা ফুরোতে ফুরোতে কবে আমি নিঃস্ব হব। এই নির্দেশগুলো একেবারে ওপরতলা, একেবারে ভ’ থেকে আসছে, ভ যে এত স্নেহ করতেন, সব এক ফুৎকারে উবে গেল। আমি তো কোনও অন্যায় করিনি। উনি কি জানেন না আমি কষ্ট পাচ্ছি। আমার জন্য একটুও কেন কারও মায়া হচ্ছে না?

সন্ধেয় ফোন এলো ফ্রান্স থেকে। ক্রিশ্চান বেসএর ফোন। যে করেই হোক, একটা বই চাইছেন ছাপাতে। ভারত সরকার দ্বারা ভারতেই নির্বাসিত হওয়ার কাহিনী নিয়ে বই। বললেন, ফরাসি প্রেসিডেন্টকে দিয়ে হয়তো সম্ভব হবে না, তার সঙ্গে যেমন্ত্রী বা উঁচুপদের সরকারি যারা আসবেন ভারতে, তাদের কাউকে দিয়ে চেষ্টা করছেন যেন সিমোন দ্য বোভোয়া পুরস্কারটি আমাকেই এই ভারতেই দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়!

খুব জোরে জোরে শ্বাস নিলাম ক’টা। জানি না সামান্য বল কোথাও থেকে পেলাম কী না। একটা সাদা কাগজে টেনে নিয়ে লিখে দিলাম, কী চাই আমি। প্রভুকে আমার এই চাওয়ার লিস্টিটি দিই। এই চাওয়াগুলো মুখে জানিয়েছি অনেকবার, বেশ অনেকদিন, অনেক সপ্তাহ।

দেখা করতে চাই।

১.জাবির হোসেন, সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত কবি এবং রাজ্যসভা সদস্য।

২.সুধীরনাথ, বন্ধু এবং কার্টুনিস্ট

৩.অরুণ মাহেশ্বরী, প্রকাশক এবং বন্ধু

৪.শীলা রেড্ডি, বন্ধু।

৫.একজন মেডিসিনের ডাক্তার, যে আমার উঁচু রক্তচাপ, রক্তের চিনি, কোলেস্টোরল পরীক্ষা করবেন এবং চিকিৎসা করবেন।

৬.একজন থেরাপিস্ট বা মনোবিশেষজ্ঞ, যিনি আমার চরম মানসিক অবসাদ, হতাশা, দুশ্চিন্তা ইত্যাদির চিকিৎসা করবেন।

৭.বাইরে বেরোতে চাই, মানুষ দেখতে, মানুষ হাঁটছে, চলছে, বেড়াচ্ছে, এসব দেখতে, জীবন দেখতে।

প্রভু বললেন, তিনি যথাস্থানে জানাবেন আমার আবেদন।

.

১৮ জানুয়ারি

কলকাতায় একটা পত্রিকাই ছিল আমার পক্ষে, আমার পাশে। দৈনিক স্টেটসম্যান। অন্য কাগজগুলো চুপ। ‘আজকাল’ সিপিএমের মুখপত্র। লজ্জা বেরোনোর পর থেকেই আমার বিরুদ্ধে বিষোদগার করে যাচ্ছে। দৈনিক স্টেটসম্যান-এর মানস ঘোষকে অনেকদিন ধরে চিনিও। বাংলাদেশে গিয়েছিলেন অনেক বছর আগে, দ্য স্টেটসম্যান এর জন্য আমার সাক্ষাৎকার নিতে। সেই মানস ঘোষ যখন বাংলা দৈনিক স্টেটসম্যান শুরু করলেন, খুব স্বাভাবিক কারণেই খুব শুভাকাঙ্ক্ষী তিনি আমার। নিয়মিত আমি লিখতামও তার কাগজে। দুঃসময়ে যখন কোনও পত্রিকা পাশে নেই, তখন দৈনিক স্টেটসম্যানই দিনের পর দিন ছাপিয়ে গেছে আমার পক্ষে সবার নিবন্ধ, প্রবন্ধ, খবরাখবর। হঠাৎ স্টেটসম্যান হাউজ, টের পাচ্ছি, দূরে সরার সব আয়োজন আনুষ্ঠানিকভাবেই সেরেছে।

মানস ঘোষ ফোন করেন না আগের মতো। স্টেটসম্যানে নিয়মিত কলাম আমি আবার লিখতে শুরু করবো বলার পর মানস ঘোষ এখন না’ বলে এড়িয়ে গেলেন। পরশু দুটো লেখা আমাকে নিয়ে ছাপা হল। ভবানীপ্রসাদের লেখায় আমার বিরুদ্ধে যে মন্তব্য আছে, তা বড় করে ছাপানো হল। কাল একটা চিঠি ছাপানো হল বিরুদ্ধে। ভারতের আইন বিরুদ্ধ কাজ করেছি, তা বলা হল। আজকে সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের একটা লেখা ছাপা হল দ্য স্টেটসম্যানে। সেখানে তিনি লিখেছেন, একজন বিদেশি নাগরিকের আইনত কোনও অধিকার নেই এদেশের মানুষের ধর্ম নিয়ে কথা বলার, কুড়ি কোটি মুসলমানের মনে আঘাত দেওয়ার। সে ক্ষেত্রে বিদেশি নাগরিকের ভিসাই বাতিল করা উচিত।

এই লেখাটা পড়েই আমার সন্দেহ জাগল আদৌ আমার ভিসা ভারত সরকার দেবে কি না। না দেবার যথেষ্ট লক্ষণ আছে। আমার প্রতি যদি সরকারের সহানুভূতি থাকতো, তবে তার আঁচ আমি পেতাম। আমাকে এমন দুঃসহ জীবন যাপন করতে হত না। যদি কলকাতায় ফেরা রাজনৈতিক কারণে সম্ভব এখন নাও হত, আমাকে ভ’বাবু নিজ মুখে। বলতে পারতেন, এখন সম্ভব হচ্ছে না, তুমি দিল্লিতেই আপাতত থাকো। আমি দিল্লিতেই নিজের মতো করে থাকতাম। যদি নিরাপত্তার দরকার হত, তবে ব্যবস্থা এখানেই করা হত, এই দিল্লিতেই। আমি চলাফেরা করতাম নিজের মতো, নিরাপত্তা রক্ষীর প্রয়োজন হলে নিরাপত্তা রক্ষী থাকতো।

আর এক মাস আছে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার। বিদেশ মন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেছেন বটে সংসদে যে, আমার ভিসার মেয়াদ বাড়ানো হবে। কিন্তু কোনও না কোনও কারণ দেখিয়ে তো সরকার পারেন তা বাতিল করতে। নিশ্চয়ই পারেন। নিজের দেশই আস্ত আমাকে বাতিল করে দিল। আর ভারতকে যতই নিজের দেশ বলে মনে করি না কেন, কাগজপত্রে এ তো পরের দেশ। পরের দেশ আমার ভিসা বাতিল করার অধিকার তো বেশ ভালোই রাখে। কিন্তু একটা কারণ তো দেখাতে হবে বাতিল করার। কেউ কি বলতে পারবে সত্যি করে কেন বাতিল করা হচ্ছে। ওর বিরুদ্ধে রাস্তায় কিছু ছেলে ছোঁকরা নেমেছিলো বলে ওকে আর ভিসা দেওয়া হবে না। ছেলে ছোরারা দাবি করেছিলো তসলিমাকে দেশ ছাড়া করো! এই তো! ছেলেদের ক’টা দাবি আসলে মেনে নেওয়া হয়। কোনো দিন হয়েছে কি?

স্বপ্নের এমন ভাঙন আর কারও জীবনে কি ঘটে, আমার ছাড়া? না, এ দেশে বড় কোনও আন্দোলন ঘটেনি। আমার জন্য ঘটে না কিছুই। কিছু বড় পত্রিকায় পক্ষে কিছুকলাম লেখা হয়েছে। আর, আমারই বন্ধুরা কলকাতায় পথে নেমেছে বা সভা করেছে। এই।

একজন দেখলাম প্রশ্ন করছে, ‘কোথায় মানবাধিকার রক্ষা করার সব বড় বড় বিপ্লবীরা? কোথায় অরুন্ধতী রায়, রোমিলা থাপার, তিস্তা শীতলবাদি, শাবানা আজমি, রাম পুন্যানি, দিনেশ দিসুজা, বিজু মেথিউ, জন দায়াল। কোথায় সোনিয়া গান্ধি? কোথায় তেহেলকা ম্যাগাজিন। হিন্দু মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে যাওয়া, মুসলিম বা ক্রিশ্চান মৌলবাদীরা অন্যায় করলে মুখ বুজে থাকাটাই এদেশে প্রগতিবাদ, মানবাধিকার রক্ষা, ধর্মনিরপেক্ষতা, এবং সেকুলারিজম’।

আমার বুকে কষ্টের একটা পাথর। পাথরটাকে সরাতে পারি না।

আজ আবদুল গাফফার চৌধুরীর সঙ্গে কথা হল। তাকে বলেছিলাম, বাংলাদেশে ফেরত যেতে চাই, যেন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে কথাবলেন। আমাকে যেন আমার দেশে থাকার অধিকার তাঁরা দেন। গাফফার চৌধুরী জানালেন, তিনি ফকরুদ্দিনের সঙ্গে কথা বলেছেন, ফকরুদ্দিন নাকি আমার নাম শুনেই ভয় পেয়ে গেছেন। ডঃ কামাল হোসেনের সঙ্গেও নাকি কথা বলেছেন। নাম শুনে তিনিও ভয় পেয়েছেন। আমাকে কেউ সাহায্য করতে রাজি নন। কেউ আমার দেশে ফেরত চান না। বারবারই গাফফার চৌধুরী বললেন, ‘দেশে তোমাকে মেরে ফেলবে। তোমাকে কপি করে যে লোক লেখা শুরু করেছিল, তাকে মেরে ফেললো।’

–কে?

–কেন, হুমায়ুন আজাদ? তোমাকে পায়নি বলে হুমায়ুন আজাদকে মেরেছে। তুমি দেশে থাকলে তোমাকেও ওই একইভাবে মারতো।

আশিষ নন্দীর সঙ্গে কথা হল। তাঁকে এ দেশে পলিটিক্যাল সায়কোলজিস্ট বলে ডাকা হয়। আশিষ নন্দী আমার প্রশ্নর উত্তরে কিছু কথা বললেন, যে, আমাকে, তিনি মনে করেন ভিসা দেবে ভারত সরকার। বললেন, সোনিয়া পছন্দ করেন আমাকে।

–ভ’বাবুও তো স্নেহ করতেন। উনি কি স্নেহ আর এখনও করেন? যদি করেনই, তবে বন্দি কেন করেছেন? একটু মানবিক কি কেউ হতে পারছেন না? একটু বাইরে বেরোতে দেওয়া। একটু মানুষের মতো বাঁচতে দেওয়া।

–হয়তো ভয় পাচ্ছেন।

–কিসের ভয়?

–কিছু যদি হয়ে যায়।

–যদি কিছু তো যে কোনো সময়ই হতে পারতো।

কিছু খটকা থেকে যায়। তারপরও আশিষের আশ্বাস আশীর্বাদের মতো মনে হয়।

.

২০ জানুয়ারি

অরুন্ধতী আর রিতু মেনন ইন্দিরা জয়সিংএর কথা বলেছিলেন। ইন্দিরা জয়সিং খুব বড় মানবাধিকার ল’ইয়ার। এই ল’ইয়ার আমাকে সাহায্য করতে পারে, যদি আদৌ কেউ পারে সাহায্য করতে। মানবাধিকার ল’ইয়ারএর এক কথা, ‘মামলা করো।

–মামলা কার বিরুদ্ধে?

–সরকারের বিরুদ্ধে। আমি সোজা বলে দিলাম, এ আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

–কেন সম্ভব নয়, তুমি মামলা করলেই জিতে যাবে।

ইন্দিরা জয়সিং প্রায়ই ফোন করে আমার সিদ্ধান্ত জানতে চান। অরুন্ধতী আর রিতুরও ওই একই কথা, মামলা করা ছাড়া তোমার আর বেরোবার পথ নেই। কিন্তু আমি রাজি হই না।

বলি, আমি ভারতের নাগরিক নই, আমাকে যে ভারত বাসের অনুমতি দিয়েছেন সরকার, আমি কৃতজ্ঞ। আমি মামলা করবো না। যদি মানবাধিকারে, মত প্রকাশের অধিকারে যারা বিশ্বাস করে, তারা একজোট হয়ে সরকারের কাছে দাবি জানান, আমার বিশ্বাস, আমি মুক্তি পাবো।

আমার কোনো কথাই লইয়ার মানেন না। বলেন, ”তুমি শুধু কাগজে সই দেবে, আমাকে তোমার পক্ষ হয়ে লড়ার অনুমতিটা দেবে। আমি বাকি সব কাজ করবো। এক মামলা করেই তুমি ওই বন্দিজীবন থেকে বেরোতে পারো। তা না হলে তোমাকে লাথি মেরে দেশ থেকে বের করে দেবে যে কোনওদিন, আর কখনো ফিরতে পারবে না। একবার ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে, এ সম্ভব হবে না। কিছু মৌলবাদী তোমার বিরুদ্ধে মিছিল করেছে বলে তোমাকে তোমার বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে অন্য এক শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য একটা অজ্ঞাতস্থানে রেখে দিয়েছে, এ কারণে তোমার মানসিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। মামলা করলে তোমার হারাবার কিছু নেই। তুমি এর মধ্যে সবই হারিয়েছে। এখন দেশ থেকে তোমাকে তাড়িয়ে দিলে মামলা করার সুযোগ তোমার জুটবে না, তসলিমা। ভেবে দেখো। ভাবার সময় চাও যদি, নাও।

কিছুদিন পর আবারও ফোন করে ইন্দিরা ওই একই কথা জিজ্ঞেস করেন। আমি রাজি কি না মামলা করতে।

আমি রাজি নই। এভাবেই চলতে থাকে। একদিন আমি বলি, যা-ই হোক, যা ইচ্ছে তাই হোক, সরকারের বিরুদ্ধে মামলা আমি করবো না। আমি অপেক্ষা করবো যতদিন না সরকারের সিদ্ধান্ত বদল হয়।

ইন্দিরা জয়সিং রাগ করে ফোন রেখে দেন।

.

২৩ জানুয়ারি

প্রভুকে বার বার জিজ্ঞেস করার পর জানিয়ে দিলেন, কদিন আগে কী-চাই-আমি বলে যে একটি লিস্ট দিয়েছিলাম তার হাতে, সেটির কোনওটিই মানা ভারত সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।

.

২৭ জানুয়ারি

‘এই সর্বদলীয় পাষণ্ডামি এবং তৎসহ ছলনাময় অকথ্য রাজনীতি যাঁরা করেন, তাদের মুখোশ এই প্রথম, কিংবা কেবল এইবারই লোকসমক্ষে ঝুলে পড়েছে, তা বলবো না। কিন্তু মানবিকতার প্রশ্নে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার দাবিতে কিংবা সর্বাপেক্ষা মূল্যবান যে প্রশ্ন, সংবিধানের অন্তর্নিহিত মহান আদর্শটির সংরক্ষণের দায়িত্বে এবার তাদের ব্যর্থতা আমাদের বুকে তীরের মতো বিঁধছে। তসলিমাকে নিয়ে যে অগ্নিপরীক্ষায় আমাদের রাজ্যের, অথবা কেন্দ্রের পীড়াদায়ক রাজনীতি চলছে, তার কোনও তুলনা হতে পারে না। এই লজ্জা তসলিমার লেখা বই ‘লজ্জা’র মলাট দিয়েও ঢাকা যাবে না। –শ্রীনিরেপেক্ষ

যারা পাহারা দিচ্ছে, তারা এখন কথায় কথায় আমাকে উৎসাহ দিচ্ছে দেশ ছাড়ার জন্য। ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটছে। মানসিক পীড়ন যে কতদূর পৌঁছোতে পারে, তা দেখা হল ডাক্তারের বেলায়। ডাক্তার দেখাতে চাইছি, রক্তচাপ বাড়ছে শরীরে। কিন্তু ডাক্তার দেখানোর নামগন্ধ নেই। মুখে বলে কাজ হচ্ছে না বলে লিখিত অনুরোধ জানালাম যে ডাক্তার চাই। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার চাই। কার্ডিওলজিস্ট চাই। কারণ, রক্তচাপ বাড়ছে, ওষুধের মাত্রা বাড়িয়েও কমার কোনও লক্ষণ নেই। তিন সপ্তাহ কোনও যোগাযোগ করলেন না প্রভু। একজন ডাক্তার দেখানোর জন্য কাতর অনুনয়ের পরও প্রভু কর্ণপাত করলেন না। আমার জামা জুতো সাবান শ্যাম্পু লাগলে তা দিচ্ছেন, কিন্তু ডাক্তার দরকার হলে দিচ্ছেন না। প্রভু তো বলেই দিয়েছেন, সম্ভব নয়।

ত–সম্ভব নয়, কেন?

প্ৰ–বিকজ অব সিকিউরিটি।

ত–সিকিউরিটির কারণে আমি কোনও ডাক্তার দেখাতে পারবো না?

প্র–নো ম্যাডাম।

ত–সিকিউরিটির অসুবিধেটা কী হবে, শুনি?

প্র–কোনও ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়া সম্ভব হবে না।

ত–তাহলে ডাক্তার নিয়ে আসুন। আমার ব্লাড প্রেশার এখন একশ’ সত্তর বাই একশ’ কুড়ি। আর আপনি বলছেন সিকিউরিটির কারণে ডাক্তার দেখানো সম্ভব নয়।

প্র–ডাক্তার নিয়ে আসাও সম্ভব নয়।

ত–তাহলে ওই তৃতীয় জায়গায় নিয়ে চলুন, যেখানে নিয়ে আসতে পারেন কাউকে।

প্র–আমি আপনার প্রস্তাব যথাস্থানে জানিয়ে দেবো। স্যরি ম্যাডাম। আমি যা নির্দেশ পাই, তা-ই আপনাকে জানাই। আপনি ভুল বুঝবেন না। আপনাকেও বুঝতে হবে আপনার সিকিউরিটির ব্যাপার। আপনার একটি জিনিস নিয়েই আমরা চিন্তিত, সে আপনার নিরাপত্তা।

ত–ডাক্তার দেখালে আমার নিরাপত্তা নষ্ট হবে। কিন্তু ডাক্তার না দেখালে, ওষুধ না খেলে আমি তো মরে যাবো।

প্র–আমি দেখছি, কী করতে পারি।

প্রায় দু’মাস ডাক্তারের জন্য অনুরোধ করার পর আমি যখন তাকে বলতে লাগলাম, আমার কিন্তু হার্ট অ্যাটাক হবে, প্রভু চমকালেন না। একটু কী স্বস্তি পেলেন! হার্ট অ্যাটাক হলে তো আপদ বিদেয় হয়, একদিক দিয়ে ভালোই। এও বলি, ”আমি মারা গেলে কিন্তু লোক ভাববে আপনারা মেরে ফেলেছেন। প্রভুর পাথর-মুখে দুশ্চিন্তার কিছু ছায়া পড়েছে বলবো না। তারপর মিডিয়াকে যেদিন জানালাম, আমাকে ডাক্তার দেখাতে দেওয়া হচ্ছে না’, প্রভু ডাক্তারের ব্যবস্থা করলেন। সেই তৃতীয় জায়গায় আমাকে নিয়ে গেলেন। সেখানে যে ডাক্তারের দেখা পেলাম, তাকে আমার পছন্দ হওয়ার কোনও কারণ নেই। ডাক্তার তাঁর পরিচয় পত্র দেখালেন না, নাম বললেন না। প্রভুর বারণ আছে। ডাক্তার ডাক্তারি জানেন বলে আমার মনে হয়নি। আমাকে দেখে যথারীতি চিনে ফেলে একরকম কাপছিলেন। তার কোনও ওষুধ লেখারও দরকার হয়নি। কারণ তিনি ঠিক বুঝে পাচ্ছিলেন না তিনি কী ওষুধ লিখবেন। ওই ডাক্তারের চেয়েও রক্তচাপ বিষয়ে জ্ঞান আমার বেশি, এ শুধু ডাক্তার বোঝেননি, পাশে বসে থেকে প্রভুও বুঝেছেন। ডাক্তার চলে গেলেন, আমাকেও নিয়ে আসা হল নিরাপদ বাড়িতে।

এরপর নিজেই কলকাতায় ডাক্তারদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে ওষুধ কী খাবো, তা জেনে নিই। রক্তচাপ একশ ষাট-একশ সত্তর/একশ-একশ দশ এরকম থাকছে। এনালাপ্রিল পাঁচ মিলিগ্রাম আর হাইড্রোক্লোরোথায়াজাইড সাড়ে বারো মিলিগ্রাম দিলেন কলকাতার ডাক্তার। সকালে ওষুধ খেয়েও নিলাম একদিন। যেদিন খেলাম ওষুধ, সেদিন প্রভু ফোনে বেশ উৎফুল্ল কণ্ঠে জানালেন, বিরাট হাসপাতালের বিরাট কার্ডিওলজিস্ট আনা হচ্ছে। বাহ, চমৎকার! তৃতীয় জায়গায় সন্ধে বেলা আমাকে নিয়ে যাওয়া হল। এবারের ডাক্তারকে ডাক্তার বলে মনে হল। ডাক্তার রক্তচাপ মাপলেন। ওষুধ লিখে দিলেন। রক্তচাপের জন্য আড়াই মিলিগ্রাম এনালাপ্রিল খাচ্ছিলাম। আমাকে লিখে দেওয়া হল তিন ওষুধের কমবিনেশন ড্রাগ। ঘরে ফিরে লিখে দেওয়া নতুন ওষুধগুলোর মধ্য থেকে একটা অ্যামলোডিপিন, ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীর শিথিল হয়ে আসে। শরীর কুলকুল করে ঘামতে থাকে। সারা শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে, টের পাচ্ছি। কখনও শরীরে এমন অনুভূতি হয়নি। আমি বুঝতে পারছি আমি হারিয়ে যাচ্ছি, তলিয়ে যাচ্ছি। তখনও শরীরে সামান্য যেটুকু শক্তি ছিল, সেটুকু প্রয়োগ করে ফোন করলাম আকাশকে। অফিসার আকাশ। আকাশ এলো বটে, তবে আর আকাশের সঙ্গে কথা বলতে পারছি না আমি। আমাকে নিয়ে যাওয়া হল স্ট্রেচারে করে হাসপাতালে। স্ট্রেচার এই ক্যান্টনমেন্টেরই সম্ভবত। হাসপাতালের দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রভু। ডাক্তার ছিলেন। ভর্তি করা হল সিসিইউতে। করোনারি কেয়ার উইনিটে। কথা বলতে চাইলাম, তবে কথা স্বাভাবিক নয়। একটি শব্দ বলতে দীর্ঘক্ষণ সময় নিচ্ছি। সিসিইউতে মনিটরে দেখা হচ্ছে রক্তচাপ, হৃদস্পন্দন। দেখা হচ্ছে ইসিজি। ডাক্তার খুব চেষ্টা করছেন জানতে আমার গা চুলকোচ্ছে কি না, গায়ের কোথাও অ্যালার্জির রিয়েকশান দেখা দিয়েছে কি না। না, দেখা দেয়নি। সম্ভবত অ্যামলোডিপিনের প্রতিক্রিয়া, বললাম ডাক্তারকে। অথবা সারাদিনে তিন তিনটে ওষুধ খাওয়া, এটা অতিরিক্ত ওষুধের কারণে হয়ে থাকতে পারে। রাত দুটোর দিকে মরতে বসেছিলাম। আবার গা ঘামতে শুরু করলো। আবার শরীর অবশ হতে শুরু করলো। পালকের মতো হালকা হতে শুরু করলো। মনিটরে দেখি রক্তচাপ কমতে কমতে প্রায় শূন্যতে নেমে যাচ্ছে। ডাক্তারকে ডাকছি, যেন আমাকে বাঁচান। অল্প বয়সী ডাক্তার। স্যালাইনএর গতি সম্পূর্ণ বাড়িয়ে দিল। একের পর এক স্টেরয়েড চলতে লাগলো। জীবন বাঁচানোর ওষুধ। আমি পৃথিবীর কাছে বিদায় নিয়ে নিচ্ছি তখন। বিদায় অবকাশ, বিদায় ময়মনসিংহ, বিদায় বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিদায় পৃথিবী, বন্ধুরা, গুণীজনগণ, অনুরাগীগণ। বিদায় জানাচ্ছি, স্টেরয়েড চলছে হৃদপিন্ডকে ফেরানোর জন্য। স্যালাইন চলছে পুরোদমে। দু’ঘণ্টা পর ধীরে ধীরে ফিরতে থাকি মাটির পৃথিবীতে। মৃত্যুর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পর্ব সারা হল। আঙুল স্পর্শ করাই হয়েছে শুধু, নিবিড় আলিঙ্গনটিই বাকি।

পরদিন বড় ডাক্তার সব দেখেশুনে বললেন, ওষুধের ‘পয়জনাস রিয়েকশ্যান’ হয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন, তিন তিনটে ওষুধে, নাকি অ্যামলোডিপিনে? ডাক্তার বললেন, ঠিক বলা যাচ্ছে না। তবে অ্যামলোডিপিনে হলে ওই ওষুধ আপনি আর কখনও খেতে পারবেন না। সেদিন আমি প্রভুকে বার বার বললাম, আমি ভ’বাবুর সঙ্গে কথা বলতে চাই। প্রভু একসময় বললেন, তিনি জানিয়ে দিয়েছেন আমার অনুরোধ। এবার আমি প্রশ্ন করলাম, যে মানুষ রক্তচাপ কমাতে একটি আড়াই মিলিগ্রামের ওষুধ খাচ্ছিল, তাকে রক্তচাপ কমানোর তিন রকম ওষুধের কম্বিনেশন কি কেউ দেয়? কোনো ডাক্তার দিতে পারে? ডাক্তার বললেন,সাধারণত এমন হয় না। যদি ভুল হয়েই থাকে, হয়েই গেছে, পুরনো কথা ভেবে লাভ কী? আপনাকে সুস্থ হয়ে উঠতে হবে, আপাতত সেটাই ভাবা হোক না কেন! টেনশন ফ্রি থাকার চেষ্টা করুন।

রোববার সেদিন। প্রভু আমাকে দেখতে এলেন। কিন্তু ভ’বাবুর সঙ্গে ফোনে কথা বলতে দিলেন না। বললেন, ওঁর সঙ্গে কথা হয়েছে, উনি বলেছেন পরে তিনি কথা বলবেন।

রক্তচাপ গ্যাসবেলুনের মতো একবার ওপরে ওঠে, একবার ধপাস করে তলিয়ে যায়। এরকমই চলতে থাকে। ডাক্তাররা একেবারে সম্পূর্ণ বিশ্রাম দিয়ে রেখেছেন। কোনও ওঠা নামা মানা। বারবারই বলেছেন, স্ট্রেস, টেনশন এসব আমার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে না। দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ আমার জীবনে সবচেয়ে ক্ষতিকর, এগুলো অনেকটা মৃত্যু ডেকে আনছে। বাঁচতে চাইলে এগুলো আমাকে ত্যাগ করতে হবে। ত্যাগ কি চাইলেই করা যায়। পরদিন, তারপরের দিনও আমি সিসিইউতে। তারপরের দিনও। ডাক্তার বলে দিলেন, যতদিন না রক্তচাপ স্বাভাবিক হবে ততদিন থাকতে হবে হাসপাতালে। এবং ওষুধ পত্র কী খেতে হবে, তা বুঝিয়ে দিয়ে আমাকে বিদেয় দেওয়া হবে, তার আগে নয়। ডাক্তারদের এই সিদ্ধান্ত অবশ্য ডাক্তাররাই পরে পাল্টে ফেললেন। প্রভু ওঁদের আলাদা করে ডেকে নিয়ে কিছু বলেছিলেন, জানি না কী বলেছিলেন।

সরকারি সিদ্ধান্ত আমাকে হাসপাতাল ছাড়তে হবে। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা অতপর সরকারি অফিসারের আদেশ পালন করলেন, রোগীকে বিদেয় করলেন। তখন অনুমান করা সম্ভব ছিল না, পরে অনুমান করি, টাইমস অব ইন্ডিয়ায় আমার হাসপাতালে ভর্তির খবর ছাপা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার জীবন কী হবে না হবে এই ব্যাপারে যারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমাকে আর হাসপাতালে রাখা যাবে না, কাউকে জানতে দেওয়া যাবে না আমার অসুখ বিসুখের খবর। লোকে তবে জেনে যাবে, কেমন আছি, কোথায় আছি, কী অবস্থায় আছি, আমাকে নিয়ে কী হচ্ছে না হচ্ছে, সব! মিডিয়াকে সরকারি লোকেরা পছন্দ করেন, তবে সবসময় নয়। তাছাড়া আমাকে যেতে হবে ভ’ বাবুর কাছে। তিনি কথা বলতে চেয়েছেন। কথা বলতে চেয়েছেন, তো ফোনে কথা বললেই হয়। না, সেটি হবে না। ভ’বাবু দেখা করতে চেয়েছেন। তিনি কি আসতে পারবেন না সিসিইউতে? মানুষ তো রোগী দেখতে হাসপাতালে যায়। আমার এই প্রশ্নটি অবাক করে প্রভুকে। আসলে আমিও বোকার হদ্দ। একজন মন্ত্রী মানুষ হবেন কেন! উনি তো মন্ত্রী। মন্ত্রী আমার মতো সাধারণ মানুষকে দেখতে হাসপাতালে আসবেন কেন? সিসিইউ থেকে তুলে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল ভ’বাবুর কাছে। তার সঙ্গে দেখা করার সময়ের আগে যে সময়টা, বাড়তি, হাতে পাওয়া, তা হাসপাতালেও খরচ করা হল না। নিয়ে আসা হল ‘নিরাপদ বাড়ি’তে আবার। ‘নিরাপদ বাড়ি’ থেকে ভ’বাবুর কাছে। কাছে ঠিক নয়, একটি খালি বাড়িতে। সেটিও হয়তো আরেকটি নিরাপদ বাড়ি। ও বাড়িতে আমাকে বসানো হল। সম্ভবত কোনও সরকারি অতিথিশালা। রাস্তার পাড়ে, এরকম একতলা অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর বাড়ি। বাড়িগুলো কোথায়, ঠিকানা কী, এসব কিছুই প্রভু বললেন না। প্রভু তাঁর নিজের পদ এবং পদবি দুটোই যখন গোপন রাখেন, কেন বলবেন জায়গাটা কোথায়, কোথায় এনেছেন আমাকে। একটা অদ্ভুত রহস্যের মধ্যে সব ঘুরপাক খায়।

বেশ কিছুক্ষণ পর চা এলো। প্রভুকে বলছি, আমাকে এই অসুস্থ অবস্থায় আর যেন কোনও কারাগারে রাখা না হয়, আমাকে যেন অতি অবশ্যই কলকাতায়, আমার বাড়ি পাঠানো হয়। কলকাতায় থাকলে তো আমি এভাবে মরতে বসতাম না। এই নির্বাসনে আমার থাকা মানে আমার রক্তচাপ বাড়তে থাকা, আমার হৃদযন্ত্রের ক্ষতি হতে থাকা। ভ’বাবু এলেন মিনিট পনেরোর মধ্যেই। প্রভুর মুখে একগাল হাসি। সারাক্ষণই আজ তিনি খুশি খুশি। এত খুশির কারণ কী! কোনও ভালো কিছু কি ঘটতে যাচ্ছে! আমার জানার সাধ্য নেই। সম্ভবত প্রভু জানেন যে আজ ভ’বাবু আমাকে কলকাতায় পাঠানোর ব্যবস্থা পাকা করবেন। অথবা প্রভুর খুশির কারণ ভ’বাবুর প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছেন তিনি, তাঁর উপদেশ বা পরামর্শ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। অত্যন্ত নিষ্ঠ, কর্মঠ, বিশ্বস্ত। আমি ক্লান্ত। অসুস্থ। আশা আমাকে আলোকিত করে বটে, তবে এ বড় ফ্যাকাসে আলো। আমার রক্তচাপ এখনও স্বাভাবিক নয়। এখনও শরীরে টের পাই ওষুধের বিষক্রিয়া, এখনও টের পাই রক্তচাপ আকাশে উঠছে, আবার পাতালে নামছে। প্রভু কখনও কিছুই পরিষ্কার করে আমাকে বলেন না। সম্ভবত এমনই নির্দেশ তাকে দেওয়া হয়েছে। প্রভুকে অনেক সময় একটি পুতুলের মতো মনে হয়। চাবি দেওয়া পুতুল। যা বলেন তিনি, সবই শিখিয়ে দেওয়া কথা। এই খুশি খুশি মুখটাও কি শিখিয়ে দেওয়া! কে জানে!

অন্য একটি ঘরে ভ’বাবু এবং একজন অচেনা ভদ্রলোক। ভ’বাবু দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে নমস্কার করছেন। আমিও নমস্কার জানিয়ে মুখোমুখি বসলাম। এই মানুষটি কী ভাবছেন, আমার সম্পর্কে তাঁর কী চিন্তাভাবনা, কী পরিকল্পনা তার আমি কিছুই জানি না। কিন্তু এই মানুষটির কাছ থেকে স্নেহ, সমর্থন সব আমি পেয়েছি। এই মানুষটিই তো আমার সবচেয়ে শুভাকাঙ্ক্ষী। তাঁর বাড়িতে কত গেছি, কত ফোনে কথা হয়েছে। সব প্রতিকূলতার মধ্যে তিনিই তো আমার ভারত-বাসের অনুমতিকে বাড়িয়ে চলেছেন। নিশ্চয়ই আমাকে কলকাতার বাড়িতে ফেরাতে খুব চেষ্টা করছেন।

খুব কাছের মানুষের কাছে যেভাবে অভিযোগ করে মানুষ, সেভাবেই অভিযোগ করলাম এত যে ডাক্তার দেখাতে চেয়েছি, তারপরও প্রভু দেরি করেছেন ডাক্তার দেখাতে। প্রায় দু’মাস পর ডাক্তারের ব্যবস্থা করলেন বটে, প্রথম তো হাতুড়ে ডাক্তার, তারপর একজন হাসপাতালের ডাক্তার, ওঁর ওষুধ খেয়েই শরীর খারাপ হল। হাসপাতালে তো মরতেই বসেছিলাম, জীবন বাঁচানোর ওষুধ দিয়ে বাঁচিয়েছে।

প্রভু বসাই ছিলেন অদূরে। ভেবেছিলাম প্রভুকে এবার ভ’বাবু কিছু ধমক দেবেন। কাজে ফাঁকি দিলে যেভাবে ধমক দেওয়া হয় অধস্তনদের। বলবেন তাঁর কারণেই আমার জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্য কোনও কটুক্তি নয়, কিছু নয়। ভ’বাবু আমার শরীর এবং মৃত্যুর দুয়ার থেকে আমার ফিরে আসা, এখনও রক্তচাপের স্থিতাবস্থায় না আসা, এখনও যে কোনও সময় দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার আশংকা, এসবের তোয়াক্কা না করে বললেন, আপনার সঙ্গে আমি এই কারণে কথা বলতে এসেছি যে, আপনি তো এ দেশের সম্মানিত অতিথি, আপনি নিশ্চয়ই, যেহেতু আমরা কথা দিয়েছি যে, এ দেশের আতিথ্য আপনি পাবেন, আপনি ভিসা পাবেন, নিশ্চয়ই পাবেন। আপনার ভিসার মেয়াদ আমরা সামনের ফেব্রুয়ারিতে বাড়াবো। নিশ্চয়ই বাড়াবো। তাই আপনি যদি এ সময় ফ্রান্সে যে পুরস্কারটা আপনি পেয়েছেন, সেটা আনতে যান, খুব ভালো হয়। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে আমি বলেছি, এরকম তো নিয়ম নেই যে ফ্রান্সের পুরস্কার ভারতে দেওয়া যাবে। যে দেশ পুরস্কার দেয়, সেই দেশে অথবা যে দেশের মানুষকে পুরস্কার দেওয়া হয়, সেই দেশে পুরস্কার দিতে হয়।

আমি বলে উঠি, ‘কিন্তু পুরস্কার তো …..’

ভ’বাবু কঠিন স্বরে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আমার কথা শুনুন।‘

আমি চুপ হয়ে যাই। তিনি বলতে থাকেন, আপনি তো ভারতের নাগরিক নন, সে কারণে এ দেশে তো পুরস্কার দেওয়া যাবে না। আপনাকে হয় বাংলাদেশ যেতে হবে, নয়তো ফ্রান্সে যেতে হবে পুরস্কার নিতে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট আপনাকে ফ্রান্সেই আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ওখানে আপনার যাওয়ার সব ব্যবস্থাও করে দেওয়া হবে। আমরাই করে দেব। কোনও অসুবিধে নেই। আপনি পুরস্কার নিতে যান।

আমি ক্ষীণ কণ্ঠে বলি, ভ’বাবুর দিকে বড় সরল চোখে তাকিয়ে, ‘যে পুরস্কারটা আমি পেয়েছি সেটার অনুষ্ঠান গত নয়ই জানুয়ারি প্যারিসে হয়ে গেছে। ওখানে আমার প্রকাশক পুরস্কার গ্রহণও করেছেন। সার্টিফিকেটটা তাঁর কাছে আছে, ওটা আমার কলকাতার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে বলেছি।

‘হুম’। ভ’বাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, আপনি যদি ফ্রান্সে কিছুদিনের জন্য যান, ভালো হয়। আমি মন্ত্রী হিসেবে বলছি, আপনার কোনও অসুবিধে হবে না বিদেশে থাকার। এখান থেকে সব ব্যবস্থা করেই আমরা পাঠাবো। কোথায় থাকবেন ফ্রান্সে, তার কথা ভাবতে হবে। না আপনার। ফ্রান্স থেকে যদি আপনি অন্য কোনও দেশে বেড়াতে যেতে চান, সেই ব্যবস্থা আমরা করে দেব। টাকা পয়সার ব্যাপারে আপনি কোনও চিন্তা করবেন না। সব ভারত সরকার করবে।

ভ’বাবুর দিকে তাকালাম। তিনি আমার দিকে নয়, অন্য দিকে তাকিয়ে আমার উদ্দেশে কথা বলে যাচ্ছেন। তার পাশের লোকটি লিখে নিচ্ছেন খাতায় কথাবার্তা, প্রভুও খাতা বের করে লিখছেন। আমরা যা কথা বলছি, তা আমাদের দুদিকে দু’জন বসে লিখে যাচ্ছেন। আশ্চর্য, এ কেমন এক সরকারি দেখা হওয়া! ভ’বাবুর গায়ে সুট, মাথায় উলের টুপি। তাঁকে এই পোশাকে কোনওদিন দেখিনি আগে। যতবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাঁকে ধুতি পাঞ্জাবিতেই দেখেছি। সেই হাসি মুখের আন্তরিক মানুষটি কোথায়! এই মুখে সেই মুখটি খুঁজি। নেই। তিনি বিরতিহীন বলে যাচ্ছেন আপনার কলকাতা যাওয়ার ব্যাপারে এ সময় তো নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। ওরা আবার হৈ চৈ শুরু করতে পারে, ভিসা বাড়ানোর আগে আগে। সতেরো তারিখে আপনার ভিসার এক্সটেনশন হবে, যোলো তারিখেই একটা হৈচৈ করবে ওরা। তখন ওদের বলা যাবে যে ‘উনি দেশে নেই। উনাকে আনার ব্যাপারে পরে বিবেচনা করা হবে। পরিস্থিতি শান্ত হলে নিশ্চয়ই আপনি ফিরে আসতে পারবেন। আপনার যদি মনে হয় আপনি আর আসতে পারবেন না এ দেশে, তাহলে তো ভুল মনে হওয়া। নিশ্চয়ই পারবেন। আমি তো তপন রায় চৌধুরীকে বলেই দিয়েছি। উনি তো খুব স্নেহ করেন আপনাকে। আপনার বয়সী উনার মেয়েও আছে। খুব মেয়ের মতো স্নেহ করেন। তাকে বলেছিলাম আপনাকে বলার জন্য। আপনি ইচ্ছে করলে তাঁর বাড়িতে, অক্সফোর্ডে তার বাড়িতেও থাকতে পারেন। কোনও দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই আপনার। কবে যাবেন, তা যে এক্ষুনি ঠিক করতে হবে আপনার, তা তো নয়। আপনি দু’একদিন সময় নিন। দু’একদিন পর জানালেও চলবে।

ভ’বাবু যখন আমাকে দেশ ছাড়ার পরামর্শ দিচ্ছেন, বলছেন কিছু দিনের জন্য যেন যাই, আমি শিরদাঁড়ায় টের পাই, এ যাওয়া কিছু দিনের জন্য নয়। এ যাওয়া জন্মের মতো যাওয়া। সারাজীবনের জন্য যাওয়া। বাংলাদেশেও বলেছিলো, কিছু দিনের জন্য যাও, পরিস্থিতি শান্ত হলে ফিরে এসো। পরিস্থিতি শান্ত, আজ প্রায় চৌদ্দ বছর হতে চলল, হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ থেকেও আমাকে তাড়িয়ে দেওয়ার সময় বলেছে, দুদিনের জন্য যাও, দুদিন পর ফিরে এসো। তিন মাস হতে চললো, আজও পশ্চিমবঙ্গে আমার ফেরা হয়নি।

‘আপনি থাকুন কিছুদিন বাইরে, আপনি গেলে আমাদের পক্ষে সুবিধে হবে আপনাকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনা। তখন আপনি ফ্রান্স থেকে বাইওরোপের যে কোনও দেশ থেকে সোজা কলকাতায় ফিরতে পারবেন। আপনার কোনও দুশ্চিন্তা করার দরকার নেই। কী করে যাবেন না যাবেন, সব ব্যবস্থা আমরা করে দেব। আপনি এ দেশের সম্মানিত অতিথি। দেখুন, আপনার সঙ্গে কারও দেখা করতে দিচ্ছি না, আপনাকে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে দিচ্ছি না, সে নিরাপত্তার কারণে। পঁচানব্বইটা লোক ভালো, কিন্তু পাঁচটা লোক তো খারাপ হতে পারে। সে কারণেই কোনও রিস্ক আমরা নিচ্ছি না।

কথা যখন বলছেন উনি, মাঝে মাঝে তাকাই তাঁর মুখের দিকে। কপালের ভাঁজগুলোয় স্পষ্টতই বিরক্তি। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, এই মানুষটিই সেই মানুষ, একসময় যাঁর বাড়িতে আমি যেতাম। চা খাওয়াতেন। আমি বই উপহার দিতাম। মিষ্টি, দই, ফুল এসব নিতাম তার জন্য। তিনি বসে বসে আমার কবিতা পড়তেন। বলতেন, কবিতা তাঁর খুব ভালো লাগে। একবার ভালো কবিদের সব ভালো কবিতার বইই তাঁকে দিয়ে এলাম তার বাড়িতে। যতদিনই তাঁকে ফোন করেছি, বলেছেন তাঁর বাড়িতে যেতে। দলের সাক্ষাৎপ্রার্থী কর্মীরা বসে থাকতেন, সবাইকে রেখে আমার সঙ্গে দেখা করেছেন, কথা বলেছেন। সবচেয়ে বেশি সময় আমাকেই দিয়েছেন। আমার রেসিডেন্স পারমিটের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আগেই তিনি খোঁজ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বলে দিতেন। বলতেন আমাকে, যে, বলে দিয়েছেন। সেই ভ’ বাবু। ভ’বাবু শত্রুর মতো কথা বলছেন, কণ্ঠে তাঁর এতটুকু মমতা নেই, তারপরও আমার বিশ্বাস হয় না তিনি সত্যিই এখন আমার শত্রু। আমার এই এক মুশকিল, কাউকে মন্দ লোক বলে বিশ্বাস হতে চায় না। তিনি বলতে থাকেন, ওই একই কথা, বারবার নানারকম ভাবে নানা দিক থেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে থাকেন। সংক্ষেপ করলে একটি বাক্যই বেরিয়ে আসে, আপনি ভারত ছাড়ুন। আমি কি ছাড়বো ভারত? এককালে যাকে আমি সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতাম, যিনি আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, আজ রাজনীতি তাঁকে তার নীতি বা আদর্শ থেকে দূরে সরিয়েছে, আমার প্রতি মায়ামমতা স্নেহ যা ছিল সব ছুঁড়ে ফেলে তিনি একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে আমাকে লোভ দেখাচ্ছেন, মুখোশটা পরে আছেন আমার শুভাকাঙ্ক্ষীর।

এখন বলার পালা আমার। খুব শান্ত কণ্ঠ আমার। অসম্ভব শান্ত স্বর। সবে মৃত্যুর মুখ দেখে আসা আমি। এখনও আমার আকাশ পাতাল করা রক্তচাপের কাঁধে বসে দুষ্টু মৃত্যু আমার সঙ্গে নিজে নিজেই লুকোচুরি খেলছে। জাগতিক সবকিছু আমার কাছে নিতান্তই তুচ্ছ। সেখানে রাজনীতির মারপাঁচ, স্বার্থপরতা, নোংরামো আমার কাছ থেকে সহস্র আলোকবর্ষ দূরে। শান্ত কণ্ঠে বলি, ‘বিদেশে আমি দশ বছর ছিলাম। দশ বছরে একটি দিনের জন্য আমি ওই সমাজে, মনে করতে পারিনি যে আমি বিলং করি। আমি যদি কোনো সোসাইটিতে বিলং করি বলে না মনে করতে পারি, তবে সেই সোসাইটিতে জীবন খুব দুঃসহ হয়ে ওঠে। যদিও আমার অনেক নাম ছিল, অনেক পুরস্কার পেয়েছি বিদেশ থেকে, কিন্তু কোনওদিনই আমি মনে করতে পারিনি বিদেশ আমার দেশ। এই ভারতবর্ষ, এখানে আমি অফিসিয়ালি বিদেশি, ফরেনার। কিন্তু কখনো আমার মনে হয় না আমি এখানে বিদেশি। আমি এ দেশে নিজের ভাষায় কথা বলছি। এখানের কালচার আমার কালচার। আমি জন্ম থেকে বড় হয়েছি এই বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে। তাছাড়া শুধু বাংলা নয়, ভারতের যে অংশে, যে অঞ্চলেই আমি যাই না কেন, মনে হয়, আমি এ দেশের, এ মাটির মানুষ। কখনো মনে হয় না আমি ফরেনার, কখনো মনে হয় না আমি এ দেশে বিলং করি না। একটিবারের জন্যও এই দেশে আমার মনে হয় না আমি বিদেশি। আগে তো টুরিস্ট ভিসা দেওয়া হত, যখনই ভিসা পেতাম, চলে আসতাম কলকাতায়। আর যখন থেকে রেসিডেন্স পারমিট দেওয়া হল, তখন থেকে তো থাকতে শুরু করলাম। আমার যা কিছু ছিল বিদেশে, প্রায় সব নিয়ে এসেছি কলকাতার বাড়িতে। দেশ থেকে আমার দাদাদেরও পাঠিয়ে দিতে বলেছি আমার বইপত্র। আপনিই তো আমার রেসিডেন্স পারমিট এক্সটেনশন করায় সাহায্য করতেন, সবসময় এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করে এসেছেন। আপনি যদি আমার বাড়িতে যান কলকাতায়, দেখবেন, মনে হবে যেন তিরিশ বছরের সংসার, এমন। এই স্বপ্ন, এই সংসার ছেড়ে আমি যাবো কোথায়! আমি বাঙালি, বাংলায় লেখালেখি করি, তাই বাংলায় একটু জায়গা চাই। নিজের মতো করে থাকা, লেখালেখি করা। এর বেশি কিছু তো চাই না। বাংলাদেশে যদি সম্ভব হত, চলে যেতাম। চেষ্টা যে করিনি, তা নয়। ওখানে আমার ল’ইয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি…’।

–‘আপনার ল’ইয়ার তো সারা হোসেন, তাই না?’ ভ’বাবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করেন।

আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘হ্যাঁ সারা, সারার বাবা ডক্টর কামাল হোসেন। ডক্টর কামাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। উনি আমার দেশে ফেরার ব্যাপারে কোনো কথাই বলতে চান না। ওঁর স্ত্রী হামিদা হোসেনকেও তো চিঠি লিখলাম। মোটেও আগ্রহ দেখালেন না। ফেরা সম্ভব হলে ফিরতাম। এই দেশে থাকার চেষ্টা করতাম না। কোথাও কোনো জায়গা নেই বলে এই দেশে থাকি। প্রাণের টানে, ভাষার টানে, শেকড়ের টানে থাকি। এখানে লেখার মধ্যে থাকতে পারি, বাঙালি বন্ধু, বাঙালি পাঠক, এসবের মধ্যে থাকার প্রয়োজন তো খুব একজন বাঙালি লেখকের। দেশ থেকে কিছু আত্মীয় স্বজনও আসতে পারে। আমি তো ইসলাম নিয়ে এখন কিছু লিখিনি। অনেকদিন আগে লেখা বই দ্বিখণ্ডিত। ভারতে থাকা শুরু করার অনেক আগে। দ্বিখণ্ডিত বিদেশে বসে লেখা বই। ভারতে থেকে আমি ইসলাম নিয়ে লিখিনি কিছু। ওই বই থেকে তো পার্লামেন্টে প্রণব বাবু বলার পর ডিলিটও করে দিলাম। আপনার সঙ্গে প্রণব বাবুর কথা হয় কী না জানি না। উনি জানেন আমি যে ডিলিট করেছি।

ভ’ বাবু মাথা নাড়লেন।

‘এখন যদি আমার রেসিডেন্স পারমিটটা এক্সটেন্ড না করেন, তবে তো আমাকে চলে যেতেই হবে এ দেশ ছেড়ে। বুঝবো আমার জন্য এই উপমহাদেশে কোনও জায়গা নেই’।

এ সময় আমার গলা বুজে আসে কান্নায়। বলতে থাকি আমি। দু’চোখ বেয়ে ঝরতে থাকে জল। বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করছে আর চোখ বেয়ে জল ঝরছে। ঝরেই যাচ্ছে। ভ’বাবু এত বড় একটি দেশের এত বড় ক্ষমতাবান ব্যক্তি, যে দেশটি অদূর ভবিষ্যতে ‘সুপার পাওয়ার হওয়ার মতো যোগ্যতা রাখছে, সেই দেশটি আমার মতো স্বদেশ হারা, স্বজনহারানো একটি অসহায় লেখককে জায়গা দিতে পারছে না একশ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার দেশে, মাত্র হাতে গোনা কজন মৌলবাদী চাইছে না বলে। অবিশ্বাস্য লাগে সবকিছু। মৌলবাদীদের সন্তুষ্টি করা ভোটের জন্য দরকার, ক্ষমতায় থাকার জন্য দরকার। শুনেছি। ক্ষমতার এত লোভ সবার! সমাজটাকে নষ্ট করে হলেও ক্ষমতা চাই।

বলতে থাকি, চোখের জল মুছে নিয়ে বলতে থাকি, ‘বিদেশে আমি হয়তো প্রাণে বেঁচে থাকতে পারি, কিন্তু সেই বেঁচে থাকা সত্যিকার বেঁচে থাকা নয়। সত্যিকার বেঁচে থাকতে হলে, আমাকে বাংলাদেশে নয়তো ভারতে থাকতে হবে। ওসব দেশে আমি বেঁচে থাকতে পিরবো, কিন্তু লেখক হিসেবে বেঁচে থাকতে পারবো না। আমি বিদেশে যেতে চাই না। ওসব দেশে থাকতে আমার ভালো লাগে না। ওসব দেশে আমি এক মুহূর্তের জন্য ভালো থাকি না। আমি কোথাও যাবো না। দিল্লিতেই থাকবো, যেখানে রেখেছেন সেখানেই। যেদিন কলকাতা যেতে দেবেন, সেদিনই যাবো কলকাতায়। তার আগ অবধি এখানেই থাকবো। আমাকে এ দেশের অনেকে তো ভালোবাসে।

ভ’বাবু মাথা নেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ তা নিশ্চয়ই বাসে।

‘যারা চাইছে না আমি এ দেশে থাকি, ওরা তো অল্প কজন লোক। ওরা চাইছে বলে আমার জীবন নষ্ট হবে কেন! ওদের হুমকি তোত আমার জীবনে নতুন কিছু নয়। ওরা এমন হুমকি কোনো একটা উদ্দেশ্যে দেয়, পরে আবার চুপ হয়ে যায়। এখন যদি এখানে, এই সেইফ হাইজে কিছুদিন থাকতে হয়, অপেক্ষা করতে হয়, আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি শুধু চাইবোদু’একজন বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে যেন দেখা করতে দেওয়া হয়..।

ভ’বাবুও তাঁর কথাগুলো পুনরায় বললেন। আমিও অত্যন্ত শান্তকণ্ঠে একই কথা আবার বললাম। কোথাও যাবো না। এরপর তিনি হঠাৎ ঘড়ি দেখলেন। তাঁর তাড়া আছে। যেতে হবে।

‘আপনাকে তো আমি ফোন করতে চাই। কিন্তু আপনার ব্যস্ততা আছে ভেবে ফোন করতে কুণ্ঠা বোধ করি।

হেসে বললেন, ”রাত দশটার পর ফোন করবেন। দেখি আমি পশ্চিমবঙ্গের সরকারের সঙ্গে কথা বলে দেখি..

এতক্ষণের এই কথোপকথনের পর আমি ভাবলাম ভ’বাবুর মন বোধহয় আমার জন্য একটু নরম হয়েছে। কিন্তু কোথায় নরম। গাড়ি করে আমাকে যখন পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে কারাগারে, পথে ফোন এল ভ’ বাবুর, প্রভুর কাছে। এক নম্বর, তিনি জেনুইনলি চাইছেন আমাকে হেল্প করতে। সুতরাং এটা যেন আমি বুঝতে চেষ্টা করি। দুই নম্বর, আজকের সাক্ষাতের কথা যেন মিডিয়া না জানে।

পথে প্রভুকে অনেক অনুরোধ করলাম চলুন কোনো ক্যাফেতে, কোথাও না কোথাও, কোনও রেস্তোরাঁয়, চলুন বাইরে কোথাও। আমি আসলে মাঝে মাঝে ভুলে যাই যে আমি বন্দি। তাই অমন আবদার করি। প্রভু আমাকে কোথাও নেন না। কারাগারে ফিরে আসেন। পায়চারি করি ভোলা ছাদে। সঙ্গে প্রভু। উনি রহস্যময় মানুষ। বললেন, ”আপনার প্রেজেন্টেশনটা দারুণ। আমি মুগ্ধ।

আমি বলি, ‘আমি তো ওখানে অভিনয় করতে যাইনি। আমার মনের কথাগুলোই বলেছি।

পায়চারি করার সময় মনে থাকে না, ভুলে যাই যে, আমি মাত্র সিসিইউ থেকে উঠে আসা। কোনো বাঁধন না মানা রক্তচাপ থেকে উঠে আসা। রক্তচাপ মেপে দেখলাম, ২২০/১২০।

–চলুন এক্ষুণি যেতে হবে হাসপাতালে। ভর্তি হতে হবে। –কিন্তু ভর্তি করবে না। গিয়ে লাভ নেই।

–কেন করবে না। ওরাই তো বলেছিলো ব্লাড প্রেসার স্বাভাবিক না হলে হাসপাতাল থেকে ছাড়বে না। এখনও তো স্টেবল হয়নি। এই ব্লাড প্রেশার নিয়ে আমি হাসপাতালের বাইরে থাকবো না। কালই আমার রক্তচাপ দু’শ থেকে পঞ্চাশে নেমেছিলো। আমি ভরসা পাচ্ছি না এখানে থাকতে।

প্রভুর যাওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই। কিন্তু আমি যাবোই। ভর্তি হওয়ার জন্য কিছু কাপড় চোপড়ও নিলাম। হাসপাতালে আরও কটা দিন থেকে যাওয়া উচিত, এ কথা ডাক্তাররাও বলেছিলেন। কিন্তু থাকতে দেওয়া হল না আমাকে। প্রভু এবং ডাক্তারদের মধ্যে কী কথা হল। যে ডাক্তাররা বলেছিলেন, থাকা জরুরি, তাঁরাই বলে দিলেন, জরুরি নয়। সরকারি হাসপাতাল এইমস হাসপাতাল। সরকারি আদেশ মাথা পেতে নেবেনই সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা।

আমি ভাবছিলাম, খুব গভীরভাবে ভাবছিলাম, আমাকে যে ভ’বাবু দেশ ছাড়ার কথা বলেছেন, তা অতটা অমানবিক নয়, যতটা অমানবিক সিসিইউ থেকে রক্তচাপের রোগী উঠিয়ে পনেরো মাইল দূরে নিয়ে গিয়ে সবচেয়ে ভয়ংকর সংবাদটি দেওয়া। এর চেয়ে অমানবিক আর কী হতে পারে! আমার দুর্বল হৃদপিণ্ডটি তো বন্ধ হয়ে যেতে পারতো!

আর কোনও রাখ ঢাক রইলো না। এ কথা এখন দিনের আলোর মতো, যে করেই হোক তারা চাইছেন চলে যাই। অসুখে বিসুখে মানুষের মন দুর্বল থাকে। দুর্বল সময়টাকেই বেছে নিয়েছেন কঠিন দাওয়াইটি দেওয়ার জন্য। আমি বললাম বটে আমি যাবো না, কিন্তু তিনি কি আর মানবেন! তিনি নিশ্চয়ই আগুন হয়ে আছেন আমার স্পর্ধা দেখে। হাল ছাড়েন নি। একা মানুষ। তার আবার শক্তি কতটুকু। কতদিন সে বইতে পারবে একাকীত্ব আর পরাধীনতার যন্ত্রণা!

হাসপাতালে গিয়েও ফেরত আসতে হল। ভর্তি নেয়নি।

বাড়িঘর ছেড়ে, প্রিয় বেড়াল ছেড়ে, বইপত্র, বন্ধুদের ছেড়ে, নিজের জীবন ছেড়ে, অনিশ্চয়তার বোঁটকা-গন্ধ-কাঁথায় মুখ-মাথা ঢেকে, দিনের পর দিন পড়ে থাকা কোথায় পড়ে থাকা কতদিন কিছুই না জানা –হৃদপিন্ডকে দাঁতে নখে কামড়েছে ভীষণ।

তারপর তো হৃদয় স্তব্ধ হলে অগত্যা সিসিইউ। যায়-যায় জীবনকে কোনওমতে টেনে আনা হল, ধুকধুক বুক ফিরে যেতে চায়, রুগ্ন শরীর ফিরে যেতে চায় ঘরে। বেড়ালের কাছে, বন্ধুর কাছে, স্পর্শের কাছে প্রিয়।

কে আর তোয়াক্কা করে হৃদয়ের! সিসিইউ থেকে তুলে নিয়ে তাকে শোনানো হল বড় গম্ভীর, গা কাঁপানো স্বর, অন্য কোনও দেশে চলে যাও, এ-দেশ ছাড়ো। কোথায় যাবো, কোথাও তো যাওয়ার নেই আর, মরলে এ মাটিতেই মাটি দিও।

মাটি খুঁড়ে দেখতে চাও তো দেখে নিও আমার শেকড়। কারই বা কী দায় পড়েছে দেখার, কারই বাদায় পড়েছে চোখের জলে ভেসে যাওয়া মানুষের কাতরানো দেখে কাতর হওয়ার! সিসিইউ থেকে আবার নির্বাসনে, আবার অন্ধকারের গায়ে আবর্জনার মতোছুঁড়ে হাত ধুয়ে বাড়ি চলে গেলেন ওঁরা, ওঁরা খুব বড় বড় লোক, হাতজোড় করে নতমস্তকে নমস্কার করি ওঁদের।

০৯.৩ ডায়রির পাতা (ফেব্রুয়ারি)

৫ ফেব্রুয়ারি

আমি কি শুধু আমার জন্য বাঁচি! আমি কি শুধু আমার কথাই ভাবি! তা হলে সেই কবেই আপোস করে ক্ষমা চেয়ে নিরাপদ জীবনের দিকেই যেতে পারতাম! যাইনি তো! আমার বাক স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করি, এভাবেই আর সবার বাক স্বাধীনতা আর মত প্রকাশের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করি। যে দেশ বা যে রাজ্য থেকে আমাকে তাড়ানো হয়েছে, সেই দেশে বা রাজ্যে আমি ফিরতে চাই, যেন সেই দেশে বা রাজ্যে মত প্রকাশের অধিকারের মর্যাদা দেওয়া হয়। যেন সারা পৃথিবীতেই দেওয়া হয় মর্যাদা। যে কোনও বিষয়ে নিজের মত প্রকাশের অবাধ অধিকার থেকে যেন বঞ্চিত না হয় কেউ। যেন অন্ধত্ব আঁকড়ে ধরে সমাজকে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়। যেন সামনে এগোয়। সামনে আলোর দিকে। নারী বিদ্বেষ, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কুশিক্ষা, মূর্খতা, কূপমন্ডুকতা থেকে দেশ বাঁচে, সমাজ বাঁচে, মানুষ বাঁচে। বেঁচে থাকতে বড় কোনও পরিবর্তনের সামান্য স্পর্শও আমি পাবোনা জানি, না পাই, মানুষ তো টিকে থাকবে আরও লক্ষ বছর। ভবিষ্যতের মানুষ বাঁচুক স্বস্তিতে, শান্তিতে, নিরাপত্তায়, নিশ্চিন্তে, বৈষম্যহীনতায়। মানুষ বাঁচুক ধর্ম, কুসংস্কার, ইত্যাদির নাগপাশ থেকে, মানুষ বাঁচুক ঘৃণার বীভৎস কামড় থেকে। দুধে ভাতে বাঁচুক, ফুলের সুবাস নিয়ে বাঁচুক, ভালোবেসে বাঁচুক।

.

৭ ফেব্রুয়ারি

দেশি টিভি পারেনি আমাকে দেখাতে, নিরাপদ বাড়িতে আমি কেমন আছি। ঠিকঠিক ফ্রান্সের টিভি দেখিয়ে ফেললো সব। ফ্রান্সের সাংবাদিকরা এসেছিলো ভারতে। কলকাতায় গেছে, আমার শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে কথা বলেছে। মিছিল মিটিংএর ছবি নিয়েছে, আর স্কাইগে আমার ইন্টারভিউ নিয়েছে।

.

৯ ফেব্রুয়ারি

দিনগুলো ঠায় বসে আছে বলে মনে হয়। ঠেলেও এক সুতো এগোতে পারি না। দিনগুলো অহেতুক মন খারাপ করে বসে থাকে। দিনগুলো সামনে থেকে সরে না। অজ্ঞাতবাসে এখন শুধু অপেক্ষা সতেরো ফেব্রুয়ারিতে আমার ভারতে বসবাসের অনুমতি আদৌ হবে কী না। যদি না হয়, কোথায় যাবো, কী করবো, কিছু জানি না। অনুমতি পাবো, এরকমই তো জানতাম। অনুমতি নাও দিতে পারে, এই সংশয়টা হচ্ছে। সংসদে আমার ভিসা পাওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক বক্তব্য শোনার পরও আমার সংশয় যায় না।

.

২১ ফেব্রুয়ারি

অনেকদিন হল আমি কিছু লিখিনি। লিখতে ইচ্ছে করেনি। কত কিছু ঘটে গেল এই দীর্ঘ এক মাসে। লেখালেখির মধ্যে করেছি একটিই, কিছু কবিতা লিখেছি। আজ একুশে ফেব্রুয়ারি।

এই দিন কী চমৎকার উদযাপিত হত বাংলাদেশে। বাংলাদেশ কি আমার দেশ! আমার বিশ্বাস হয় না ওই দেশ আমার দেশ। ভারতকেও, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গকে নিজের দেশ বলে ভেবেছিলাম। এও মুহূর্তে মিথ্যে হয়ে গেল। আমার স্বপ্ন সম্পূর্ণই নির্ভর করছিল দু’একজনের মর্জির ওপর।

আজ কলকাতায় আমাকে ফিরিয়ে আনার দাবিতে অনশন শুরু হয়েছে কিছু মানুষের। বয়স্ক কিছু মানুষ, পঁয়ষট্টি থেকে আশি পঁচাশি বছর বয়স, বেহালার রাস্তায় মঞ্চ বানিয়ে অনশনে বসেছেন। সারাদিন ধরে চলছে বক্তৃতা। একুশ বাইশ তেইশ এই তিনদিন চলবে অনশন অনুষ্ঠান। সুনন্দ সান্যাল, অম্লান দত্ত, এবং আরও অনেকে ছিলেন। মন ভালো হয়ে যায় খবর শুনলে।

আজ সকালে এনামুল কবীরের সঙ্গে ফোনে কথা বলে খুব অবাক হই। তিনি আমাকে ভারত ছাড়ার উপদেশ দিচ্ছেন। যে মানুষ এত কাছের মানুষ, সবসময় সমর্থন করে এসেছেন আমার ভাবনা চিন্তা, ধর্মমুক্ত মানববাদী মঞ্চে’র যিনি সাধারণ সম্পাদক, তিনি এমন হঠাৎ পাল্টে গেলেন! উত্তেজিত কণ্ঠে তিনি যা জানালেন, বুদ্ধদের ভট্টাচার্যকে তিনি চিঠি লিখেছিলেন, তাঁর সাহিত্য পত্রিকা ‘নবমানব’ও পাঠিয়েছিলেন। চিঠি পেয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নিজে এনামুলকে দুটো চিঠি লিখেছেন। ফোন নম্বর পাঠিয়েছেন দ্বিতীয় চিঠিতে। ফোনে কথা হয়েছে দুজনের।

‘ভাই এনামুল পরিস্থিতি খুব জটিল ..’ এই বলে ফোনে কথা শুরু করেছেন বুদ্ধবাবু। এরপর কী বলেছেন তা আর এনামুল কবীর না বললেও অনুমান করা যায়। কারণ এনামুলের আচরণেই তা স্পষ্ট হয়। তিনি বলতে থাকেন, এই দেশ আমাকে এত হেনস্থা করছে, কেন এই দেশের মুখে লাথি মেরে আমি চলে যাচ্ছি না! এনামুলের মুখে আমার দেশ ছাড়ার কথা? হ্যাঁ তাঁর যুক্তি, আমাকে বুদ্ধবাবু কখনই চাননা কলকাতায় ফিরিয়ে আনতে। তিনি চান আমি চলে যাই! আমার চলে যাওয়াই উচিত। এনামুলকে বললাম, খুঁটিয়ে দেখলে সব দেশেরই ত্রুটি বিচ্যুতি ধরা পড়বে, এর সমাধান লাথি মেরে চলে যাওয়া নয়। তাহলে সব দেশ থেকেই অমন চলে যেতে হয়।

তপন রায় চৌধুরীও ক্ষমতার সামনে নীতি আদর্শ বিলিয়ে দিয়েছিলেন। এনামুলও। একজনকে ভ’বাবু কাজে লাগিয়েছেন। আরেকজনকে বুদ্ধবাবু।

চরম হতাশার মধ্যেও এই অনশনের সংবাদ আমাকে একটুখানি প্রাণ দেয়। রাজনীতিবিদ, সরকার, মৌলবাদী, অজ্ঞ, অশিক্ষিত, চোর, বদমাশ, বলেই, বলবেই মত প্রকাশের অধিকারের বিরুদ্ধে। ওরা বলে আসছে যুগ যুগ ধরে। কিন্তু যুগ যুগ ধরে সত্যের পক্ষে, স্বাধীনতার পক্ষে বলে আসছেন শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী। যেদিন এই শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী গলা মেলাতে শুরু করবে সরকারের সঙ্গে, মৌলবাদীদের সঙ্গে সেদিন বুঝতে হবে, সমাজে পচন ধরেছে। আমি বাংলার সমাজের এই পচন দেখে উদ্বিগ্ন। এই চরম উদ্বিগ্নতার মধ্যেও অনশনের সংবাদ আমাকে একটুখানি শান্তি দেয়।

.

২২ ফেব্রুয়ারি

ফরাসি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হল না। কিন্তু যেই না বলেছি সুইডেনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করবো, অমনি আয়োজন। রাষ্ট্রদূত আমাকে দুপুরের খাবারের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। দূতাবাসে যেতে আমি রাজি হইনি। রাজি হইনি কারণ সুইডিশ দূতাবাসে ঢুকে গেলে আমি আইনত সুইডেনের সীমানায়, ভারতের বাইরে। প্রভু আমাকে দূতাবাসে পৌঁছে দিয়ে আমাকে সেখান ফেরত আনতে নাও পারেন। রাষ্ট্রদূত লার্স ওলোফ লিন্ডগ্রেনই ঠিক করলেন তাজ হোটেলের চেম্বার্স রুমে দেখা হবে,দুপুরের খাবার ওখানেই। প্রভু খুশিতে আটখানা। চেম্বার্স রুমে একেবারে একটা সুইট সাজিয়ে ওখানে খাবার টেবিল বসিয়ে দিলেন। রাজকীয় আয়োজন। কেন! এর একটিই কারণ, যেন চলে যাই। যেন ভারত ছাড়ি। যেন চলে যাই –অণুক্ষণই চেষ্টা চলছে এর। রাষ্ট্রদূতকে কি উৎকোচ দেওয়া হচ্ছে, আমাকে যেন বুঝিয়ে সুঝিয়ে সুইডেন পাঠিয়ে দেন! তা নয়তো প্রভুর বা প্রভুর প্রভুর কী দায় পড়েছে সুইডেনের রাষ্ট্রদূতের নেমন্তন্নকে নিজের ঘাড়ে নিয়ে এটিকে এমন উৎসবে রূপ দেওয়ার। দূতাবাসের অফিসারদেরও নেমন্তন্ন করা হয়েছিল। খাওয়া হল, গল্প হল। কিন্তু অ্যামবাসাডার আমাকে ভারত ছেড়ে সুইডেন যাওয়ার ব্যাপারে কোনও উপদেশ দেননি। সেইফ হাউজে বা নিরাপদ বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় আমি বুঝি যে প্রভু উন্মুখ হয়ে আছেন আমি সুইডেনে চলে যাবো এরকম কিছু শোনার জন্য। অনেকক্ষণ যখন কোনো কিছু বলিনি এ নিয়ে, কী কথা হয়েছে, যেচে জানতে চেয়েছেন।

প্র–কী কথা হল?

ত–কেমন আছি। কী করছি।

প্র–কী বললেন?

ত–বললাম, যেমন আছি, যেমন অনুভব করছি, সব।

প্র–সব বললেন?

ত–হ্যাঁ। আমি তো কিছু লুকিয়ে রাখি না।

প্র–ভালো নেই আপনি, বললেন?

ত–বললাম সব আছে, শুধু যেখানে খুশি সেখানে যাওয়ার স্বাধীনতা নেই।

প্র–কী বললেন উনি?

ত–শুনলেন। কিছু বললেন না।

প্র–উনাকে তো বেশ চমৎকার ভদ্রলোক বলে মনে হল।

ত–হ্যাঁ। আপাদমস্তক আধুনিক মানুষ। আচ্ছা, আপনারা খেয়েছেন তো?

প্র–যা খেয়েছি। উনি আর কী বললেন?

ত–কী ব্যাপারে?

প্র–আপনার ব্যাপারে।

ত–আমার ব্যাপারে মনে তো হয় উনি ভালো জানেন। কী ঘটেছে কলকাতায়, কেন ঘটেছে, কী ঘটেছিলো বাংলাদেশে, কেন ঘটেছিলো, সব উনি বেশ ভালো বোঝেন।

প্র–আর দিল্লিতে যা ঘটছে?

ত–এ নিয়ে তো কথাই হল। উনার আর বলার কী আছে। উনি তো এ দেশের লোক নন।

প্র–তা জানি। কিন্তু আপনি তত উনার দেশের লোক।

ত–হা কাগজে কলমে। আমাকে কি দেখতে শুনতে সুইডিশ মনে হয়, না কি ভারতীয় মনে হয়, বলুন তো!

প্র–এই যে আপনি এখন সেইফ হাউজে আছেন, কোনও ফ্রিডম নেই। কলকাতাতেও আপনার যাওয়া হবে না। ভারতের রাজনীতির আপনি শিকার, এ নিয়ে কোনও কথা হয়নি?

ত–জানেন উনি এসব।

প্র–কিছু উপদেশ দেননি?

ত–উপদেশ দেবেন কেন? আমি কি ছোট বাচ্চা নাকি? আমি কি নিজে বুঝি না কী করতে হবে?

প্র–তারপরও অভিজ্ঞ মানুষের উপদেশ খুব মূল্যবান।

ত–উনি মনে করেননি আমার কোনও উপদেশের প্রয়োজন আছে।

অনেকক্ষণ চুপ করে ছিলেন প্রভু। নিরাপদ বাড়ির কাছাকাছি এসে প্রশ্ন করলেন, অ্যামবাসাডার আপনাকে সুইডেন যাওয়ার কথা কিছু বলেননি?

ত–কোথায় যাওয়ার কথা?

প্র–সুইডেনে।

ত–না তো!

প্র–কিছুই বলেননি? বলেননি যে এখানে কোনও স্বাধীনতা ছাড়া কী করে বাঁচবেন আপনি, লেখালেখির ক্ষতি হচ্ছে। আপনার টেনশন হচ্ছে। শরীর খারাপ হচ্ছে। মনের ওপর চাপ পড়ছে ভীষণ। তারচেয়ে সুইডেনে চলে যান?

ত–নাহ, এরকম কিছু বলেননি।

প্র–কিছুই না?

ত–না।

প্র–কেন বলেননি?

ত-বলেননি কারণ উনি জানেন, আমি ইচ্ছে করলেই সুইডেনে যেতে পারি, কিন্তু ও দেশে আমি যেতে চাই না। আমি ভারতে থাকতে চাই।

.

২৩ ফেব্রুয়ারি

আমি, যেখানে ইচ্ছে, আজ প্রভু আমাকে জানিয়ে দিলেন, যেতে পারি, তবে নিজের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিজেকেই করে নিতে হবে। তুমুল রক্তচাপ বেড়ে গেল। আমি অসুস্থ হয়ে পড়ছি। আমি মরে যাচ্ছি একটু একটু করে। বাঁচার জন্য চেষ্টা করবো, নাকি এভাবেই মরে পড়ে থাকবো।

২৪ ফ্রেব্রুয়ারি

আমার মনে হচ্ছে না, এ দেশে আর আমার পক্ষে থাকা সম্ভব হবে।

২৬ ফেব্রুয়ারি

সকালে খবর পেলাম শিবনারায়ণ রায় মারা গেছেন। আনন্দবাজারে আমার সম্পর্কে লিখতে চেয়েছিলেন ‘নারীর কোনও দেশ নেই’ বইটি সম্পর্কে, আনন্দবাজার কোনও আগ্রহ দেখায়নি। লেখাটা শেষ হয়েছিল কি, না কি অসমাপ্ত রেখেই চলে গেলেন।

অন্নদাশংকর রায় নেই। নিখিল সরকার নেই। শিবনারায়ণ রায় নেই। যারা সবচেয়ে বড় বন্ধু ছিলেন আমার, নেই। আছে কে আমার জন্য, কলকাতায়? অনিল দত্ত একদিন চলে যাবেন। সত্যিকার বন্ধু বলে কেউ থাকবে না আমার। একা।

খুব উঁচু মানুষ শিবনারায়ণ রায়। একটা মানুষ ছিলেন আমার পাশে। আমার যে কোনো দুঃসময়ে তিনি পাশে ছিলেন। পৃথিবীর যে প্রান্তেই ছিলাম, ছিলেন। নির্ভীক লড়াকু মানুষটি। প্রশাসন আমার পাশে নেই, প্রতিষ্ঠান পাশে নেই, পরোয়া করেননি, তিনি ছিলেন। এত উঁচু মানুষ ছিলেন তিনি, তাঁর নাগাল পাওয়া, তাঁর বিদগ্ধ চোখদুটোয় তাকানো সহজ ছিল না কারও। এই সেদিনও আমার এই ঘোর দুঃসহবাসে টুকরো টুকরো হয়ে আমার আর আমার স্বপ্নগুলোর ভেঙে পড়ায় এতটুকু কাতর না হয়ে বলেছিলেন, লেখো, যেখানে যেভাবেই থাকো, যে ভাবে যে পরিস্থিতিতেই লিখে যাও। তোমার জীবন হলো তোমার কলম। শিথিল হয়ে আসা কলম আমি আবার শক্ত মুঠোয় ধরেছি, মানুষটি ছিলেন পাশে, আগুনের মতো ছিলেন। গোটা পৃথিবীও যখন ত্যাগ করে সরে যায়, তখনও জানি, একজনও যদি কেউ সঙ্গে থাকেন, তিনি তিনি। উঁচু মানুষেরা হারিয়ে যাচ্ছেন একা একা। নির্ভীক নিঃস্বার্থের সংখ্যা ক্রমে ক্রমে কমে কমে শূন্য হচ্ছে। এই ভীতু আর স্বার্থান্ধ আর ক্ষুদ্রদের পৃথিবীতে বড় একা হয়ে যাচ্ছি। তাদের চিৎকারে দাপটে বধির হচ্ছি। তাদের রক্তচক্ষু দেখে দেখে বোবা।

উঁচু মানুষটি নেই। শীতার্ত অন্ধকার গ্রাস করে নিচ্ছে আমার নিঃসঙ্গ জগৎ।

২৮ ফেব্রুয়ারি

দৈনিক স্টেটসম্যানে কবিতা ছাপা হচ্ছে আমার। প্রতিদিন। প্রতিদিন ফোন আসে, কবিতা পড়ে সকলেই উচ্ছ্বসিত। বসে থাকে পরদিনের কবিতার জন্য। শমীক বন্দোপাধ্যায়, ইংরেজি সাহিত্যের পণ্ডিত, একদিন নিজেই অনুবাদ করে ফেললেন কবিতা। ভীষণ উত্তেজিত। বললেন, ইংরেজি অনুবাদের সংকলনই প্রকাশ করে ফেলবেন তিনি। কবিতায় নিরাপদ বাড়িতে আমার দৈনন্দিন জীবনের কথা বলি। বন্দি অথচ ঠিক বন্দিও নই।

লোকে বলতে পারে, কারাগারের চেয়ে অনেক ভালো আছি। বা মানুষ আরও দুর্ভোগ পোহায় জীবনে। ঠিক। কিন্তু এই দুর্ভোগ অন্য দুর্ভোগের চেয়ে কম বলে এই কম-দুর্ভোগকে মেনে নিতে হবে কেন! আমার একটি পদক্ষেপেও বাধা দিতে চাইলে আমি রুখে উঠবো। যাদের একশটি পদক্ষেপ রোধ করা হয়, তাদের চেয়ে ভালো আছি, কারণ আমার মাত্র কুড়িটি পদক্ষেপ রোধ করা হচ্ছে, এই ভেবে সুখ পাওয়ার মানুষ আমি নই। আমার একটি পদক্ষেপও রোধ তোমরা করো না। কারণ যে কারণে রোধ করছো তা ভয়ংকর ভুল একটি কারণ। আমি কথা বলেছি, আমি লিখেছি, তা কারও পছন্দ নয় বলে আমার সামনে কেন বাধা হয়ে দাঁড়াবে। যাদের পছন্দ হচ্ছে না বলে আমাকে মার দিতে চাইছে, তাদের গিয়ে একটু স্বাধীনতার সংজ্ঞাটা শিখিয়ে এসো। কোনও কোনও মাথা খারাপ লোক স্বাধীনতার সংজ্ঞা জানবে না বলে, অথবা জানলেও মানবে না বলে তার দায় আমাকে নিতে হবে কেন! সরকারে যারা আছো, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যারা আছো, প্রচার মাধ্যমে আরা আছো, তারা দায়িত্ব নাও মানুষকে শিক্ষিত করার, দিনভর শেখাতে থাকো, ইহাকে স্বাধীনতা বলে, উহাকে গণতন্ত্র বলে, ইহাকে অধিকার বলে, উহাকে মত প্রকাশ বলে।

০৯.৪ ডায়রির পাতা (মার্চ)

২ মার্চ

আমি অবাক হয়ে যাই মানুষের ধর্মবিশ্বাস দেখে। মঙ্গলবার এরা মাছ মাংস খাবে না। হনুমানজির পুজো আছে। প্রত্যেকে পুজো করে। প্রত্যেকে ধর্ম বিশ্বাসী। সবারই হাতে লাল সুতো বাঁধা। শুধু ধর্মে নয়, যত রকম কুসংস্কার আছে, সবকিছুতে বিশ্বাসী। একজন ডাক্তার পেলাম না, যে ডাক্তার ধর্মের কথা বলে না। প্রতিটি ডাক্তারই, ছোট বা বড়, ভগবান যে আমার শরীরটা বানিয়েছেন, ভগবান যে অসুখ দিয়েছেন এবং ভগবানই যে অসুখটা সারাবেন তা বেশ জোর দিয়েই বললেন। আমি থ হয়ে বসে থাকি। শিক্ষিত অশিক্ষিত, নারী পুরুষ, গরিব ধনী নির্বিশেষে এই দেশে প্রায় সবাই ধর্মবিশ্বাসী।

এত ধর্ম বিশ্বাস, এত ধর্ম পালন, এত উপোষ, এত সংস্কার, এত লাল সুতো আমি আর কোনো দেশে দেখিনি। বাংলাদেশেও দেখিনি। ভারতকে যখন পশ্চিমের দেশ বলে ধর্মের দেশ, আমি আপত্তি করতাম, সেইসব পুরোনো নাস্তিকদের কথা, লোকায়ত দর্শনের কথা আওড়াতাম। কোথায় সেসব, চিহ্নমাত্র নেই। নাস্তিকের সংখ্যা সত্যি বলতে কী, হাতে গোনা। কুসংস্কারে, জ্যোতিষীতে, ধর্মান্ধতায় ঠাসা এ দেশ। সেনানিবাসে একটি মন্দির আছে, সারাদিন সারারাত মন্দিরটিতে গান বাজে। যত মানুষ বাস করে এই সেনানিবাসে, সেনা বা অ-সেনা এক আমি ছাড়া, সবাই আস্তিক। গা ছমছম করে ভাবলে।

সেনানিবাসের গেটের কাছে ছোট একটা ঘর আছে, ওই ঘরের বাইরে বড় করে লেখা আছে –‘এক বার খেলে তুমি যোগী, দুইবার খেলে তুমি ভোগী, তিনবার খেলে তুমি লোভী, আর চারবার খেলে তোমার এক পা অলরেডি কবরে। কী ভুল এসব তথ্য। আমি হাঁহয়ে থাকি। এই ভগবানের দেশকে শোধরানোর কোনো উপায় আমার নেই।

আমার তাদের সঙ্গে কথা বলতে হয়, সেই নারী পুরুষের সঙ্গে যারা ভয়ংকর পুরুষতান্ত্রিক, ধর্ম আর কুসংস্কারে ঠাসা। মানুষগুলোর সঙ্গে প্রতিদিন আমাকে বাক্য বিনিময় করতে হয়। এরাই আমার সঙ্গী। আমার পছন্দের সঙ্গী নির্বাচন করার কোনো অধিকার আমার নেই।

৩ মার্চ

বন্ধু অনেক হারিয়েছি এর মধ্যে। কেউ কেউ আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখাকে রাজনৈতিক ভাবে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেছে। আবার বন্ধু দু’একজন জুটেছে, নতুন বন্ধু। কিন্তু কদিন কোন বন্ধুত্ব টেকে তা কে বলবে! কেয়া নামের এক মেয়ে পাটনা থেকে প্রতি রাতে ফোন করে, দীর্ঘক্ষণ কথা বলে। পাগলের মতো আমার বই পড়ে, ভালোবাসে। সুমিত চক্রবর্তী খবর নেন নিয়মিত। কেমন আছি জানতে ফোন করেন আরও-কিছু-নাম-ভুলে-গেছি-স্ত্রী-পুরুষ। দীপ্তেশ নামের এক সাংবাদিক, সেও খবর নেয়। ওকেই দিতে বলেছিলাম বাঙালি কোনও কার্ডিওলোজিস্টের নাম দিয়েও ছিল। সেই ডাঃ তরুণ বাগচির সঙ্গে কথাও হয়েছিলো ক’দিন। হঠাৎ একদিন তিনি আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন, কোনওদিন আর ফোন ওঠাননি। প্রভুকে বলেছিলাম, ডাক্তার তরুণ বাগচির সঙ্গে দেখা করতে চাই। নাকচ হয়ে যায় আমার প্রস্তাব। প্রভু বলেছেন, ওই সরকারি ডাক্তারের সঙ্গেই শলা পরামর্শ করতে হবে। অন্য কোনও ডাক্তার চলবে না। দীপ্তেশকেও ফোনে পাওয়া যায় না। হঠাৎ করে। একদিন ধরে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপারটা কী, এড়িয়ে চলছে নাকি। দীপ্তেশ চুপ থেকে কিছুক্ষণ, বললো, আর বলবেন না, ভয়ংকর অবস্থা চলছে, আমাকে খুঁজতে তো পুলিশ এসেছিলো অফিসে, আমি কে, কী করি, নাড়ি নক্ষত্র।

–কেন?

–ডাক্তারের নাম আপনাকে দিয়েছি বলে।

–ডাক্তার বাগচি?

–হ্যাঁ।

–ডাক্তার তো ফোন ধরছেন না। কয়েকদিন ধরে করেই যাচ্ছি।

–উনি আর কথা বলবেন না। ভীষণ ভয় পেয়েছেন। ওর চেম্বারেও পুলিশ গিয়ে থ্রেট করে এসেছে।

–ডাক্তারবাবু আর কথা বলবেন না? আশ্চর্য। এসব কি সত্যি বলছো তুমি? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না পুলিশ গিয়ে কোনো ইনোসেন্ট ডাক্তারকে থ্রেট করবে ফোনে আমার সঙ্গে কথা বলেছে বলে! আনবিলিভবল।

–আমি আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সব পাল্টে ফেলেছি।

–কেন?

–সরকারি নজর আমার ওপর। ভয়ংকর অবস্থা।

–এত ভয় পেও না দীপ্তেশ।

এইমসএর যে ডাক্তার আমাকে দেখেছেন, ডাক্তার বেহাল, একদিন দীপ্তেশ বললো, তার নিজের ডাক্তার। ডাক্তার বেহালের মোবাইল নম্বর চেয়েছিলাম দীপ্তেশের কাছে। সরাসরি কথা বলতে। রক্তচাপএর অদ্ভুত ওঠানামা নিয়ে একটু আলোচনা করতে। যেহেতু তিনি হাসপাতালে রেখে আমার রক্তচাপ স্থির করে দেননি, তাই তাঁর সঙ্গে জরুরি অবস্থায় কথা বলা জরুরি। ডাক্তার বেহালের নম্বর অনেক চেয়েও প্রভুর কাছ থেকে পাইনি। প্রভু আমার কাছে প্রশ্ন শুনে ডাক্তার বেহালকে জানাতেন, তার থেকে উত্তর প্রভু আমাকে জানাতেন ডাক্তার বেহাল কী বলেছেন। ডাক্তার বেহালের ডিপার্টমেন্টে ঘোট ঘোট যে ডাক্তার আছেন, তাদের সঙ্গেও সরাসরি কথা বলতে আমাকে প্রভু দেননি। কোনও প্রশ্ন থাকলে যেন অফিসারদের বলি, অফিসাররা ওই ডাক্তারদের কাছ থেকে জেনে আমাকে বলবে। আমি যদি নিজে ডাক্তার না হতাম, এই ব্যবস্থাটা আমাকে পীড়া দিত না। দিয়েছে কারণ একজন ডাক্তারের সঙ্গে সরাসরি ডাক্তারি ভাষায় কথা না বলে বলতে হচ্ছে একজন অ-ডাক্তারের মাধ্যমে। দীপ্তেশ ডাক্তার বেহালের নম্বর আমাকে দিতে পারেনি, কারণ ডাক্তার বেহাল বলেছেন না দিতে। বলেছেন, চাকরিটা তিনি খোয়াতে চান না। আশ্চর্য, আমি তাঁর রোগী, তিনি চান না আমার সঙ্গে কথা বলতে?

দীপ্তেশ অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললো, না।

দীপ্তেশের কথাগুলো আজগুবি শোনায়। পুলিশ, ওর অফিস, ডাক্তারের চেম্বার, ফোন নম্বর –সব কিছু দীপ্তেশ কি বানিয়ে বলছে! বানিয়ে কেন বলবে, কী স্বার্থ তার! সে কি আর চাইছে না আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে! একজন সাংবাদিক, যে আমার লেখা খুব পছন্দ করে, যে করেই হোক চাইবে আমার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে, ভাঙতে চাইবে কেন? তাহলে কি তাকে কেউ বলেছে যেন সব বন্ধ করে দেয়, সব যোগাযোগ! কে বলবে, সরকার। সরকারেরই বা স্বার্থ কী! আমি বুঝে পাই না এসবের কিছু।

১০ মার্চ

কলকাতা থেকে তপন রায় চৌধুরী এলেন। এ নিয়ে দুবার আসা। যখন দেখা করলেন, ভ’র পক্ষে সওয়াল করেননি অত। দ্বিতীয়বার এই কারণেই এসেছেন আমাকে কয়েকঘণ্টা ধরে বোঝাতে, যেন আমি দেশ ছাড়ি। অনেকক্ষণ কেবল ভ’রই প্রশংসা করলেন। ভ হচ্ছেন মহামানুষ। উনি কেন ছোটখাটো পুরস্কার পাবেন। উনার ভারতরত্ন পাওয়া উচিত।

তিক্ত বিরক্ত স্বরে বললেন, তোমার চলে যাওয়া উচিত। কেন তুমি এ দেশ ছাড়ছে? ইওরোপ বা আমেরিকায় বসে নিশ্চন্তে নিজের লেখালেখি করো। আর তা ছাড়া..

–তা ছাড়া কী?

–এদেশে তোমার থ্রেট আছে।

–কী করে জানেন যে থ্রেট আছে?

–রাজ্যপাল বলেছেন যে থ্রেট আছে। আমি বলেছি, থ্রেট তো আছেই। থ্রেট নিয়েই তো পনেরো কুড়ি বছর বেঁচে আছি। থ্রেট পৃথিবীর কোথায় নেই? মুসলিম মৌলবাদীরা পৃথিবীর কোন জায়গায় নেই বলুন তো! কাজ হাসিল করতে ওরা কোথায় বা না যেতে পারে?

আমি কোথায় যাবো, কোন দেশে আমাকে যেতে বলা হচ্ছে। যে কোনো দেশে। এ দেশ থেকে বেরোই, সেটাই আসল কথা। এর পর আমি মরি বা বাঁচি তাতে কারওর কিছু যায় আসে না। না, কারওর না।

তপন রায় চৌধুরী বললেন, সিপিএম ক্যাডাররা পছন্দ না হলে গায়েব করে দেয় লোকদের।

–মানে?

–মানে মেরে ফেলে। ইঙ্গিত দিলেন, শুধু মৌলবাদী নয়, ক্যাডাররাও আমাকে মেরে ফেলতে পারে।

কয়েক ঘণ্টা কথোপকথনের পরও যখন তিনি দেখলেন, আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল, আমি দেশ ছাড়বো না, কারণ দেশ ছাড়ার পক্ষে যত যুক্তিই তিনি দেখাচ্ছেন, আমি মানছি না, তখন তিনি ক্রুদ্ধ স্বরেই কথা বললেন আমার সঙ্গে। তাঁকে আর চেনা যায় না তখন। মনে হয় না আমার তিনি দীর্ঘকালের চেনা। আমাকে স্নেহ করেন তিনি। ভালোবাসেন তিনি।

মানুষ দেখলে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে কতটুকু তার মুখ আর কতটা মুখোশ!

বিকেলে গাড়ি দাঁড়িয়েছিল তার জন্য। সোজা তিনি বিমান বন্দরে যাবেন কিন্তু আগে কেন বললেন, যে ভ’বাবুর সঙ্গে দেখা করে তারপর যাবেন বিমান বন্দরে! তা তো নিশ্চয়ই তিনি করছেন না। কেন বললেন, দুদিন আগে এসেছেন দিল্লিতে। তার সঙ্গে তো

কোনো লাগেজ ব্যাগেজ নেই। ভুল করে বলেও ফেলেছিলেন যে আজ প্লেনে বসে পত্রিকা পড়েছেন তিনি, কলকাতার পত্রিকা। কলকাতা থেকেই তাহলে সেদিন সকালেই তিনি রওনা হয়েছেন। দেশের একজন বিশাল ব্যক্তি আরেক বিশাল ব্যক্তির কাছ থেকে রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে সাহায্য চেয়েছেন। একটা আদেশ নির্দেশ না মানা মেয়েকে আদেশ মানতে বাধ্য করতে।

আমার চারপাশের মানুষগুলোকে আমি চিনতে পারি না।

১১ মার্চ

এই সনাতন সেনগুপ্তই একদিন মদনজিৎ সিংকে লেখা আমার একটি চিঠির কপি আমাকে দেখিয়ে কী ভীষণ দুর্ব্যবহারই না করেছিলেন। বলেছিলেন, এইসব কী ছড়াচ্ছেন আপনি সারা পৃথিবীতে? যে সরকার আপনাকে নিরাপত্তা দিচ্ছে, সেই সরকারের বিরুদ্ধে বলে বেড়াচ্ছেন? আপনি জানেন কী অন্যায় আপনি করছেন, কী শাস্তি আপনার হতে পারে? এইসব বন্ধ করুন। আমি বলেছিলাম, সরকারের বিরুদ্ধে আমি কোনও কথা লিখিনি। আমি শুধু আমার অবস্থার কথা লিখেছি। সনাতন সেনগুপ্ত চেঁচিয়েই যাচ্ছিলেন। একটা সময় তাকে মনে হচ্ছিল মেশিন বুঝি। ঘাড়ের কাছে কোথাও সুইচ আছে অন/অফ করার। কেউ সুইচটাকে অন করে দিয়েছে। একই বাক্য, শব্দ বারবার আওড়াচ্ছিলেন।

মন্ত্রণালয়ে আমি লিখিত অনুরোধ করেছিলাম, বিশেষ করে ফেব্রুয়ারিতে রেসিডেন্স পারমিটের মেয়াদ বাড়ানোর পর, যে, আমাকে কিছুটা অন্তত স্বাধীনতা দেওয়া হোক, এই দিল্লিতেই নিজের মতো করে থাকার অধিকার, যতদিন কলকাতায় ফিরে যেতে না পারছি। দেহরক্ষী যদি থাকে থাকবে, কলকাতায় যেমন ছিল। আমি কোথায় যাবো না যাবো, কার সঙ্গে দেখা করবো না করবো, আমার সিদ্ধান্ত। এর উত্তর সনাতন সেনগুপ্ত আমাকে জানিয়েছিলেন, গম্ভীর গলায় একদিন স্ট্যাটাস কুও।

–মানে?

–মানে যেমন আছেন, তেমন থাকতে হবে।

–কোনও পরিবর্তন নেই?

–না।

–কতদিন এভাবে?

–অনির্দিষ্টকালের জন্য।

একটা জিনিস আমার মনে হয়, সচিবরা মন্ত্রীদের আদেশ পালন করেন বটে, তবে মন্ত্রীদের সব কাজকেই তারা পছন্দ করেন না। করলে সনাতন সেনগুপ্ত বলতেন না, যে, যা-ই হোক, যা কিছুই ঘটুক, যা কিছুই বলি আপনাকে, সচিব সনাতন সেনগুপ্ত হয়ে নয়, আজ মানুষ সনাতন সেনগুপ্ত আপনাকে বলছি, আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি। আপনাকে নিয়ে গর্ব হয় আমার। আপনার সততা আর সাহসের সামনে, আপনার ব্যক্তিত্বের সামনে ক’জন দাঁড়াতে পারবে? আপনি আমার স্যালুট নিন।

১২ মার্চ

নানাভাবে কায়দা করে এটা অন্তত বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, এ দেশে থাকতে হলে এভাবেই বন্দি জীবন আমাকে যাপন করতে হবে। এরকমই বন্দি, আমি কোথাও বেরোতে পারবো না, কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। আমার কোনো সামাজিক জীবন থাকবে না। আমাকে একটা ঘরে পুরোপুরি বন্দি থাকতে হবে। যদি ডাক্তার দেখানোর খুব প্রয়োজন পড়ে, সেটার ব্যবস্থা সরকার করবে। এবং এই জীবন পছন্দ না হলে, বলে দিয়েছেন, নিজের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিজেকেই করে নিতে হবে।

আমাকে নাকি যে জায়গাটায় আমি আছি, তার থেকে সরানো হবে। সরিয়ে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে, তা বলা হয়নি। কোনো গুহায়। বা কোনো নির্জন পাহাড়ে। আমার ফোন নেট কেড়ে নেওয়া হবে কি? হতে পারে। আমি এখন সরকারের হেফাজতে অথবা হাতের মুঠোয়। আমাকে নিয়ে তারা যা খুশি করতে পারেন। কিন্তু কতদিন এইভাবে আমি বাঁচতে পারবো। মানুষ কি এইভাবে পারে! কেউ পারে! রাজনীতিকরা হয়তো পারেন। আমি রাজনীতির সাতেপাঁচে নেই, দেশের ক্ষমতা নিয়ে আমি দুশ্চিন্তা করছি না কোনও। স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করেছি জীবন ভর, আজ আমার জীবনটিকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনও স্বাধীনতা আমার নেই। আজ দীর্ঘ সাতমাস যাবৎ সরকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। বুঝি, টের পাই, অনুভব করি, যে, দেশটিতে বাস করা শেষ অবদি আমার আর সম্ভব হবে না। কেন আমি অপেক্ষা করছি কোনোদিন ক্ষমতাবানদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে বলে? শুভবুদ্ধির উদয় হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে আঁচ করা যায়। কিছুই তো আঁচ করতে পারি না। আমাকে এভাবে একটা ঘরের মধ্যে ফেলে রাখতে, এভাবে শেকলে বেঁধে রাখতে কারও তো কোনো অসুবিধে নেই। অসুবিধে আমার। আমার অসুবিধে যেন হয়, তা অনেকে মনে প্রাণে চাইছে। বাইরের মানুষ নানারকম ভেবে নিচ্ছে। ভেবে নিচ্ছে যে হয়তো নিরাপত্তার জন্য এভাবেই ঘরবন্দি করতে হয়। কজন মানুষের মনে প্রশ্নের উদয় হয়, কার সময় আছে প্রশ্ন। করার? যদি সময় থাকেই, ক’জনের সাহস আছে চ্যালেঞ্জ করার।

আমি একা হয়ে যাচ্ছি। বাইরে যে আন্দোলন প্রতিবাদ হচ্ছিল, সব স্তিমিত হয়ে গেছে। যে যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত। এই এত বড় পৃথিবী, আমি এই পৃথিবীর সন্তান। একটু পছন্দের জায়গায় যে কটা বছর বেঁচে থাকবো নিজের মতো করে, মানুষের সেবা করে, মানুষের উপকার করে, সে অধিকার নেই আমার।

ওদিক থেকে পশ্চিম থেকে আমাকে ডাকা হচ্ছে। আমি যাচ্ছি না। ওসব দেশে বাস করার কথা ভাবলে আমার গায়ে জ্বর চলে আসে। ওদিকে গণতন্ত্র, ওদিকে বাক স্বাধীনতা, ওদিকে মুক্তবুদ্ধি, মানবাধিকার, ওদিকে সুস্থতা, সমতা, ওদিকে নিশ্চিতি, নিরাপত্তা, ওদিকে যুক্তিবাদ, ওদিকে জীবন। এদিকে দারিদ্র, এদিকে দূষণ, দুঃশাসন, এদিকে সন্ত্রাস, নিরাপত্তাহীনতা, পরাধীনতা, এদিকে নির্যাতন, এদিকে ধর্মান্ধতা, জড়বুদ্ধি। এদিকে বৈষম্য, এদিকে আতংক, অনিশ্চয়তা, মৃত্যু।

আমি কোনদিকে যাবো? জগৎ বলছে ওদিকে যাও, বাঁচো। ওদিকে সহমর্মিতা, স্বর্ণপদক, এদিকে অবজ্ঞা, এদিকে অপমান।

আমি এদিকটাকেই বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু এদিকের রাজনীতির কাছে আমার স্বপ্ন পরাজিত হল।

১৩ মার্চ

অনেকদিন হল। সাত মাস। চার মাস গৃহবন্দি ছিলাম কলকাতায়। তিন মাস এই দিল্লিতে। যখন কলকাতা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, নভেম্বরের ২২ তারিখে, গিয়ে পড়লাম জয়পুরে, আর জয়পুর থেকে তাড়ানো হল ২৩ নভেম্বরে। যে অচ্ছুৎকে কোনও রাজ্য আর নিচ্ছে না, তাকে কেন্দ্র নিল। ভেবেছিলাম ভালোবেসে নিয়েছে বুঝি। ভ যখন ফোনে বলেছিলেন কাপড়চোপড় কিনে দেবে, বই টই নিয়ে নিন, কী রকম যেন পিতার কণ্ঠস্বর বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু কাপড়চোপড়, বইপত্রেরই বা দরকার কেন, বুঝে পাইনি। সোজা কলকাতায় পাঠিয়ে দেবেন, তা নয়তো, ঝামেলা করছেন কেন। ঝামেলা কেন করেছিলেন, তখন না বুঝলেও এখন বুঝি। রাজনীতিকদের রাজনীতি বুঝতে বুঝতে আমার প্রায় তিনমাস সময় নিল। সম্ভবত তুলনায় কমই সময় নিয়েছে আমার অপরিপক মস্তিষ্ক। অবশ্য আমার মস্তিষ্ক যে সব কিছু ধরতে পেরেছে তা নয়, অন্যের মস্তিষ্ক যেসব রাজনীতি বোঝে ভালো, তারা আমার ঢের আগে ধরেছে। তারা সোজা বলেছে, তোমাকে এভাবে রাখা হয়েছে, যেন তুমি, অতিষ্ঠ হয়ে একদিন দেশ ছেড়ে চলে যাও।

সুয়েনস এলো সুইডেন থেকে, ওকে আমার সঙ্গে থাকতে দিল না, দেখাও খুব একটা করতে দেয়নি। তারপরও ওর সঙ্গে দেখা করতে দেবার পেছনে হয়তো উদ্দেশ্য ছিল। সুয়েনসন নিশ্চয়ই আমার প্রেমিক, আমার এই হাল দেখে, নিশ্চয়ই বলবে এ দেশ ছাড়তে। উদ্দেশ্য সফল হয়নি, সুয়েনসন আমাকে বরং উল্টো বুঝিয়েছে। দ্বিতীয় যে বন্ধুকে দেখা করতে দিয়েছিল, সে অশেষ সান্যাল। অশেষ কলকাতা থেকে আমার কিছু জিনিস সুটকেসে করে নিয়ে এসেছিল, তাই অশেষকে দেওয়া হয়েছে দেখা করতে। সুটকেসের ঘটনা না থাকলে দেখা করতে দেওয়া হত না। আর্জি জানিয়ে রাখতে হয়েছিল অনেক আগে। সুয়েনসনের বেলায় তো লিখিত চিঠি পাঠাতে হয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। ভ’কে ফোনেও বলেছিলাম যে আমার এক বিদেশি বন্ধু আসছে, আমার কাছে থাকবে কদিন। উনি নাম লিখে নিলেন বন্ধুর। কিন্তু ওকে আমার কাছে আসার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এই দু’জন ছাড়া আর যাদের সঙ্গে দেখা করানো হয়েছে, তা তাদের লোক। এম এ বেবি। সিপিএমের লোক। তপন রায় চৌধুরী। ভ’ বাবু পাঠিয়েছেন। আমাকে দেশ ছাড়ার জন্য বোঝাতে। দু দুবার এসেছেন তপন রায় চৌধুরী। প্রথমবার যখন এলেন, তখন মনে হয়েছিল বুঝি ভালোবেসে এসেছেন। তিনি যে ভ’বাবুর পাঠানো দূত, তা দ্বিতীয়বার আসার পর বুঝেছি। খুব আহত হয়েছি। এত ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি, আর তিনি কিনা আমাকে বলতে এসেছেন, যেন দেশ ছাড়ি। বাক স্বাধীনতা নিয়ে, নির্যাতিত লেখকের অধিকার নিয়ে নিজে লেখক হয়েও, বুদ্ধিজীবী হয়েও ভাবলেন না কিছু! কিছু কিছু জিনিস যে কী অসম্ভব। বিশ্বাস হতে চায় না। ওদিকে এনামুল কবীর নামের এক দীর্ঘদিনের বন্ধুও দেখি ব্যবহার অন্যরকম করছেন। পুরো পাল্টে গেছেন। তাঁকে বুদ্ধবাবু বলেছেন আমাকে বোঝাতে, যেন চলে যাই এ দেশ ছেড়ে। যে ক’জন ছিলেন সঙ্গে, যাঁদের থাকার কথা ছিল পাশে, তাঁরাও ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছেন।

এই তিন মাস ধরে এক অজ্ঞাতবাসে আমাকে রাখা হয়েছে। আমার ইচ্ছে অনুযায়ী আমাকে এক পা কোথাও বেরোতে দেওয়া হয় না। আমাকে কারও সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয় না। কী কারণ এর? একটিই কারণ, আমাকে শাস্তি দেওয়া। আমাকে কষ্ট দেওয়া। আমাকে বোঝানো যে তোমাকে আমরা চাইনা। মানুষ কী করে বাঁচবে সমাজ ছাড়া। কী করে বাঁচবে বন্ধু ছাড়া। কী করে স্বাধীনতাহীনতায়, কতদিন! একদিন না একদিন আমি তো অতিষ্ঠ হবই। একদিন তো আমি বলবোই আমি আর পারছি না। আমাকে তালাবন্ধ করে রাখতে কারও তো কোনও অসুবিধে হচ্ছে না, হবেও না। হবে আমার। আমি তো মানুষ। কোনও অপরাধ না করে কতদিন এই কঠোর কঠিন শাস্তি মাথা পেতে নেব আমি! আমাকে এভাবে বছরের পর বছর রেখে দিতে সরকারের কোনও অসুবিধে নেই। বাইরে দু’একটা লোক প্রতিবাদ করবে। কিন্তু কতদিনই বা প্রতিবাদ করবে! লেখালেখি এর মধ্যেই অনেক কমে গেছে। টেলিভিশনের শিরোনাম থেকে খসে গেছে বিষয়টি। এখন আলোচনা অন্য কিছু নিয়ে হচ্ছে। তসলিমা কোথায় আছে কেউ জানে না। কোথাও হয়তো আছে। সরকারের হেফাজতে খুব কি আর খারাপ থাকবে?

সরকারের হেফাজতে কেমন থাকা যায়, তা হেফাজতে যতদিন না থাকার অভিজ্ঞতা হয়, ততদিন বোঝা যাবে না, বোঝানোও যাবে না। সরকার যখন তোমাকে হেফাজতে রাখে দেশের সীমান্ত পার করার জন্য, তখন সেই হেফাজতটি খুব ভয়ংকর হয়। প্রতি মুহূর্তে বুলডোজার চলতে থাকে মনের ওপর। মনকে ভেঙে গুঁড়ো করে দেওয়ার সব আয়োজন রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতের মুঠোয়।

এখন আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, আমাকে তাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে অনেকে। আমাকে ভীষণ আতংকের মধ্যে রাখার ভীষণই চেষ্টা চলছে। রেসিডেন্স পারমিট এর মেয়াদ বাড়ানোর আগেই যেন দেশ ছাড়ি, তার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছিল। ফরাসি প্রেসিডেন্ট সারকোজি এলেন এ দেশে, আসার আগে সারকোজির দল থেকে সিমোন দ্য বোভোয়া পুরস্কারটি আমার হাতে দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। যেই না ইচ্ছে প্রকাশ, অমনি জানিয়ে দেওয়া হল, অসম্ভব, ওকে ভারতের মাটিতে তো পুরস্কার দিতে পারবে না। যে দেশের মানুষ পুরস্কার পাচ্ছে, এবং যারা দিচ্ছে পুরস্কার, তাদের দেশে পুরস্কার অনুষ্ঠান করো। হয় বাংলাদেশে যাও, নয়তো ফ্রান্সে যাও। ফরাসি সরকার মাথা পেতে মেনে নিলেন ভারতের প্রস্তাব। আমাকে ফ্রান্সে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। আমন্ত্রণ জানানোর আগে একবার ফরাসি দেশের মতো বিরাট দেশের সরকার এইটুকু বুঝতে পারলেন না যে, নিরাপত্তার যে কারণটা দেখানো হচ্ছে, তা মিথ্যে। হয়তো বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু আমার পক্ষে লড়ার চেয়ে জরুরি ভারতের মতো বিরাট দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করা। আমার বিবৃতি দিতে হল, যে, পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান প্যারিসে হয়ে গেছে অনেক আগেই, ৯ জানুয়ারি, প্যারিসে। আমার ফরাসি প্রকাশক সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে আমার পুরস্কার গ্রহণ করেছেন। আমার বক্তৃতাও পড়ে দিয়েছেন। পুরস্কারের মানপত্রটি আমার প্রকাশকের কাছ থেকে আনার জন্য আমার ভারত থেকে প্যারিসে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। আমার প্রকাশক দিব্যি কুরিয়ার করে দিতে পারেন সেটি আমার কলকাতার ঠিকানায়। আমাকে তাড়ানোর জন্য সত্যিই মরিয়া হয়ে উঠেছে সরকার।

১৪ মার্চ

কোথায় আছি? এই প্রশ্নের উত্তর, আমার বিশ্বাস, কেউ বিশ্বাস করবে না যে, আমি জানি না। না বিশ্বাস করলেও এটা ঠিক যে, আমি জানি না। আমি কেমন আছি-র উত্তরও আমার কাছে ওই একই, জানি না। মাঝে মাঝে টের পাই না নিজের অস্তিত্ব। বেঁচে আছি নাকি মরে আছি, বুঝি না। আমার ভেতরের আমিটিকে এখন আমি আর স্পর্শ করতে পারি না। একটা অনুভূতিহীন জড়বস্তুর মতো, একটা প্রায় মৃত মানুষের মতো পড়ে থাকি। সারাদিন একটা ঘরে। সারারাত একটা ঘরে। মৃত্যু এসে প্রায়ই খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। কাঁধে হাত রাখে। হ্যাঁ এইরকম ভাবে আজকাল আমি বেঁচে আছি। এর শুরু হঠাৎ সেদিন, কলকাতা থেকে আমাকে উৎখাতের পর নয়, দীর্ঘদিন ধরে, একটু একটু করে আমাকে পান করানো হচ্ছে বিষ, ভেতরে আলগোছে জলজ্যান্ত মৃত্যুকে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমার ভেতরের আমিটিকে, সাহসী, প্রত্যয়ী, আপোসহীন, দুরন্ত, দুর্বিনীত আমিটিকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আমি টের পাচ্ছি, কিন্তু সমস্ত শক্তি দিয়েও আমি ক্ষমতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে পারি না। আমি নিজে লোকবলহীন একটি কণ্ঠস্বর শুধু। আমার পাশে যারাদাঁড়ায়, অন্ধকার ঘনিয়ে এলে তাদের মুখ আর দেখা যায় না।

নিজেকে জিজ্ঞেস করছি, কী অপরাধ আমি করেছি? কেন আজ আমি এখানে, যেখানে আমি। এটা কি কোনও জীবন হল? আমি চৌকাঠ ডিঙোতে পারবো না, এবং কেউই আমার নাগাল পাবে না! কী অপরাধ আমি করেছি যে আমাকে লোকচক্ষুর আড়ালে জীবন কাটাতে হচ্ছে, থাকতে হচ্ছে অন্তরীণ! কী অপরাধের শাস্তি আমাকে দিচ্ছে এই সমাজ, এই দেশ, এই জগৎ! নিজের মনের কথা লিখেছিলাম, নিজের বিশ্বাসের কথা লিখেছিলাম কাগজে। কাগজেই লিখেছিলাম, কারও গায়ে পাথর ছুঁড়ে কিছু বলিনি, কারও মুন্ডু কেটেও কিছু কোনওদিন লিখিনি। কিন্তু তারপরও আমি অপরাধী। আমার নিজের মত অনেকের মতের চেয়ে ভিন্ন ছিল বলে আমাকে শাস্তি পেতে হচ্ছে। একটা যুগ ছিল, রাজার অবাধ্য হলে শূলে চড়ানো হত। দেশসুদ্ধ লোক দেখতো, শূলে চড়া মানুষটির কষ্ট। আমাকেও তো অনেকটা নতুন যুগের শূলে চড়ানো হল। দেশসুদ্ধ লোক কি দেখছে না আমার যন্ত্রণা? যেখছে না কী ভয়াবহ যন্ত্রণা হলে, নিজের ভেতরে নিজের মৃত্যু কতটা হলে, আশাভঙ্গ আর হতাশা কতটা চরম হলে, কতটা ভয়ংকর হলে নিজের বিশ্বাসের কথা মানুষ ফিরিয়ে নেয়, নিতে পারে! কতটা অপমানিত হলে, কতটা ব্রাত্য হলে, কতটা পিষ্ট হলে, কতটা রক্তাক্ত হলে আমি বলতে পেরেছি, আমার ওই বাক্যগুলো তোমরা বাদ দিয়ে দাও, বাদ দিয়ে যদি তোমাদের আরাম হয় হোক, বাদ না দিলে তোমরা কেউই আমাকে বাঁচতে দেবে না জানি, তোমাদের রাজনীতি, তোমাদের ধর্ম, তোমাদের হিংস্রতা, তোমাদের বীভৎসতা নারকীয় উল্লাসে আমার রক্ত পান করবে, করতেই থাকবে যতক্ষণ না শেষ বিন্দু রক্ত আমার শেষ হয়। উড়িয়ে দাও ওই নিষিদ্ধ শব্দগুলো, উড়িয়ে দাও থোকা থোকা সত্য। শব্দ তো নিতান্তই নিরীহ। সত্য তো নিরস্ত্র। মসি চিরকালই হেরে গেছে অসির কাছে। চারদিকে অসির আস্ফালন। আমার মতো সামান্য মানুষ তাবড় তাবড় শক্তির বিরুদ্ধে কী করে পেরে উঠবো! আমি তো অসত্য জানি না।

আমার শুধু সম্বল ভালোবাসা। মানুষের জন্য ভালোবাসা। ভালোবেসে চেয়েছি মানুষ দীপ্ত হোক, দৃপ্ত হোক। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তোক শ্রদ্ধার স্নেহের। ঘৃণা উবে যাক। যেভাবে ঘৃণা করে মানুষ আমার শব্দ বাক্য উড়িয়ে দিতে চায়, তেমন চেয়েছি মানুষকে ভালোবেসে বেসে মানুষের ভেতরের ঘৃণাকে উড়িয়ে দিতে। সম্ভবত অবিশ্বাস, ঘৃণা, নিষ্ঠুরতা, নিষ্পেষণ, নিপীড়ন এসব না থাকলে জগৎ চলবে না। জগৎকে চলতে দিতে হবে, নিজের যাত্রাভঙ্গ করেও। আমি তো অতি ক্ষুদ্র তুচ্ছ এক প্রাণী। এমন এক প্রাণীকে জগৎ থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিলে জগতের কিছু যাবে আসবে না। সেটা জানি। ভেবেছিলাম বাংলার বুঝি যাবে আসবে। বাংলা বুঝি ঘুরে দাঁড়াবে। যে বাংলাকে এত ভালোবাসি, সেই বাংলাও মুখ ঘুরিয়ে নিল।

ওপার বাংলা থেকে নির্বাসনদন্ড পেয়ে পৃথিবীর পথে পথে অনাথের মতো ঘুরেছি অনেক বছর। যেই না এপার বাংলায় ঠাঁই পেলাম, দীর্ঘ বছরের অপেক্ষার ক্লান্তি ঝেড়ে শান্তিতে স্বস্তিতে আমার জন্ম জন্ম চেনা বাংলায় জীবন শুরু করলাম, যতদিন বেঁচে থাকি বাংলার নদীমাঠক্ষেতে ঘুরে, বাংলার রোদেজলে ভিজে, বাংলার রূপরসগন্ধে লীন হব। যে বাংলায় পৌঁছোবো বলে হাজার বছর ধরে অমসৃণ পথে হেঁটে হেঁটে নিজেকে রক্তাক্ত করেছি, সেই বাংলা মুখ ঘুরিয়ে নিল। এ কথা আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে বাংলায় আমার ঠাই নেই। বাংলার মেয়ের, যার বাহিরে অন্তরে কেবলই বাংলা, বাংলা ভাষা বাংলা সংস্কৃতি যার প্রাণ, তার ঠাই নেই বাংলায়।

এই দেশের অতিথি আমি, আমার সংযত হয়ে কথা বলতে হবে। আমি কারও অনুভূতিতে আঘাত দিতে এ দেশে আসিনি। সম্ভবত আমি আঘাত পেতে এসেছি। নিজের দেশে আঘাত পেয়েছি, অন্য যে সব দেশে বাস করেছি, আঘাত পেতে পেতে শেষ সম্বল এই ভারতবর্ষে এসেছি আঘাত পেতেই। তারপরও আপনারা আমার অপরাধ নেবেন না, আমি চারদিকে শুনছি যে, এখানে যে রাজনীতি চলে, সে রাজনীতির নাম নাকি ভোটের রাজনীতি, শুনছি যে এদেশে সেকুলার হওয়া মানে নাকি মুসলিম মৌলবাদীর পক্ষ নেওয়া। আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না এসব। আমি শুনতে চাই না এসব। তারপরও চারদিকে তাই দেখছি, পড়ছি, শুনছি। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে নাকচোখমুখ বন্ধ করে বসে থাকি। ধীরে ধীরে মৃত্যু যেভাবে আমার দুঃসহ একাকীত্বের নির্বাসনে এসে ঘাপটি মেরে বসে থাকে, তার সঙ্গে বরং প্রাণের কথা বলি। প্রাণের কথা বলার আমার তো নেই কেউ আর।

আমি বাংলাকে হারিয়েছি। যে বাংলাকে আঁকড়ে ধরে আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম, যে বাংলার মাটি কামড়ে আমি পড়েছিলাম, সেই বাংলা থেকে আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া, মায়ের কোল থেকে শিশুকে ছিনিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার মতো। আমি আমার মাকে, যে মা আমাকে জন্ম দিয়েছিল, হারিয়েছি। নিজের মাকে যেদিন হারিয়েছিলাম, সেদিনের কষ্টের চেয়ে আজকের কষ্ট তো কিছু কম নয়। আমার মা খুব চাইতেন যেন একদিন দেশের মেয়ে দেশে ফিরি। দেশে ফিরতে আমি পারিনি। কলকাতায় পাকাঁপাকিভাবে বসবাস শুরু করার পর মাকে মনে মনে বলেছিলাম, ”মা তুমি দুঃখ কোরো না, নিজের দেশেই ফিরেছি, এপার ওপার অত কী বিচার করতে আছে।

মাকে বলা হয়নি আর, মুখ ফুটে আমি বলতে পারিনি, যে, আমার এখন উদ্বাস্তু জীবন। বলতে পারিনি, মা বলে যার মাটিতে মাথা রেখেছিলাম, ঘাড়ধাক্কা দিয়ে সে আমাকে বের করে দিয়েছে। বললে আমার নিরীহ মা-টি বড় কষ্ট পাবেন। তাই মাকেও বলি না, মনে মনেও বলি না। বরং নিজেকেই এখন বোঝাবার চেষ্টা করছি এই বলে যে, অপরাধ নিশ্চয়ই আমি করেছি, অপরাধ না করলে কেন আমার এমন কঠিন নির্বাসনদন্ড হবে! সত্য বলাটাই কি অপরাধ নয় এই অসত্যের যুগে? কিন্তু সত্য তো আরও মানুষ বলছে, তাদের তো এত দুর্ভোগ পোহাতে হয় না? আমাকে হয় কেন এত পোহাতে? আমি মেয়ে বলেই সম্ভবত। মেয়েদের আক্রমণ করার মতো সহজ কাজ আর কী আছে।

আমি জানি মানুষ আমাকে নির্বাসনদন্ড দেয়নি। যদি জনগণের মত নেওয়া হত, জানি অধিকাংশই চাইতেন আমি বাংলায় বাস করি। কিন্তু গণমানুষের মতে কি আর গণতন্ত্র চলে। গণতন্ত্র চালায় শাসকেরা, শাসকের সুবিধে যেভাবে হয়, সেভাবে। আমি সামান্য মানুষ। নিজের মতো করে বাস করি, নিজের বিশ্বাসের কথা নিজের মতো করে লিখি। কারও অনিষ্ট করি না। কাউকে ঠকাই না। মিথ্যে বলি না। কোনও অসততা আজ অবদি করিনি। আমার মতো সাধারণ লেখক, যে রাজনীতির সাতেপাঁচে নেই, রাজনীতি যে বোঝে না, তার ওপর যে রাজনৈতিক অত্যাচার হল, তাকে যেভাবে খুঁটি করা হল রাজনীতির, তাতে সত্যিই কোনও দলের কোনও ভোটের লাভ হবে কিনা জানি না, তবে আমার ক্ষতি হল ভীষণ। মৌলবাদী শক্তি, যে শক্তির বিরুদ্ধে আমি অনেককাল লড়ছি, তাকে অনেক বেশি শক্তিমান করা হল।

এই আমার প্রিয় ভারত, যে ভারতে বসে আমি মানবতন্ত্র, মানবাধিকার আর নারীর অধিকারের কথা বলছি, সেই ভারতে আমি যখন আমার বিশ্বাস এবং আদর্শের কারণে আক্রান্ত হই, তখন কোনও রাজনৈতিক শক্তি আমার পক্ষে একটি শব্দ উচ্চারণ করে না, কোনও অরাজনৈতিক দল, কোনও নারীবাদী সংস্থা, কোনও বড় মানবাধিকার সংগঠন আমার পাশে দাঁড়ায় না, আমার ওপর আক্রমণের নিন্দা করে না। এই ভারতবর্ষকে আমি চিনি না। তবে এ ঠিক, মানুষ এককভাবে বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিবাদ করছেন, লেখক সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীরা লিখছেন, আমার লেখা পড়ে বা না পড়ে, কী লিখি না লিখি না জেনেই মত প্রকাশের পক্ষেই মত প্রকাশ করছেন। কিন্তু যখনই মানুষ সংগঠিত, তখনই মুখে কুলুপ। ভারতবর্ষের নতুন এই চেহারা দেখে আমি আতঙ্কিত। এটা কি আসলে নতুন চেহারা, নাকি এই চেহারাটাই ভারতবর্ষের আসল। আমি সেই বালিকাবয়স থেকে ভারতবর্ষকে মহান বলেই ভেবেছি। আমার সেই স্বপ্নের ভারতবর্ষ, দৃঢ়, দীপ্ত এবং দৃপ্ত, স্বপ্নের সেই ভারতবর্ষকে কোনও একদিন দেখবো এবং গৌরব করবো বলেই হয়তো আরও বেশি করে বেঁচে থাকতে চাই। আততায়ীকে বলতে চাই অপেক্ষা করতে। সেদিন আমি নিজেই আমার আততায়ীকে আমন্ত্রণ জানাবো, মরতে কোনও দ্বিধা হবে না, যেদিন দেখবো অন্যায়ের এবং অন্ধত্বের বিরুদ্ধে রুখে উঠতে জানে ভারতবর্ষ। আমি আর ক’দিন বেঁচে থাকবো, ভারতবর্ষকে তো বেঁচে থাকতে হবে হাজার বছর।

১৫ মার্চ

চোখ দেখানো হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, রেটিনোপাথি। তাহলে কি চোখ নষ্ট হওয়ার পথে! পথে, তবে যদি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, ও আর এগোবে না। দীর্ঘকাল রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে এই-ই হয়। কিন্তু এই অজ্ঞাতবাসে, এই অস্থির অনিশ্চয়তায় আমি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবো না। আমাকে কোনও ডাক্তারের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে দেওয়া হয় না। অন্তত যে বাঙালি বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সঙ্গে ফোনে কথা বলতাম দিল্লিতে, সেই ডাক্তারও ভয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন কথা বলা। একটা ভয়ংকর ভুতুড়ে পরিবেশ চারদিকে। যেন আমি পৃথিবী নামের গ্রহের অনেক অনেক দূরে অন্য কোনও গ্রহে। যেন আমাকে বন্দি করা হয়েছে, আমি ঠিক এই গ্রহের কারও মতো নই বলে আমাকে মহা বিপজ্জনক কিছু একটা ভাবা হচ্ছে। এই বাড়িতে নিরন্তর মানসিক চাপে আমার রক্তচাপ কোনওদিন নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস হয় না।

একটি সিদ্ধান্ত নিই। কেন এই সিদ্ধান্তটি আমি নিচ্ছি, তা দ্রুত একটি কাগজে আমি এক দুই তিন নম্বর দিয়ে লিখে ফেলি। যে কথাই টগবগ করে ফুটছে, লিখি। লিখি, যেন আজ আমার মৃত্যু হলেও মানুষ, পৃথিবীর যে ক’জন মানুষই আমাকে লেখক হিসেবে শ্রদ্ধা করেছে, ভালোবেসেছে, তারা জানতে পায়। যেন কিছুই অজানা থেকে না যায়।

এই মৃত্যু কুঠুরি থেকে আমাকে বেরোতে হবে। আমি আগে একে ‘অত্যাচারের কক্ষ বলতাম। ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছি, এ আসলে মৃত্যু কুঠুরি। ডাক্তাররা যেখানে ভেবেছিলেন এবং বলেছিলেন রক্তচাপ স্বাভাবিক করার জন্য হাসপাতালে আরও দীর্ঘদিন থাকা অত্যন্ত জরুরি, আমাকে থাকতে দেওয়া হয়নি, হাসপাতালের কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিট থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে সুস্থ না হওয়া রোগী। আমি কখন হাসপাতাল ত্যাগ করবো, সেই সিদ্ধান্ত ডাক্তার নেন না, প্রভু নেন। ডাক্তার যেদিন বললেন আরও হয়তো এক বাদু’সপ্তাহ থাকতে হতে পারে হাসপাতালে, তার পরদিনই আমাকে হাসপাতাল ত্যাগ করতে হয়েছে। পত্রিকায় আমার হাসপাতালে থাকার খবর ছাপা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে। মোবাইল ফোন আমার কাছ থেকে নিয়ে নেন প্রভু।

এই অজ্ঞাতবাসে আমার জন্য কোনও ডাক্তার আসতে পারবে না, আমিও এখান। থেকে কোনও ডাক্তারের কাছে যেতে পারবো না। আবার কোনও ডাক্তারের সঙ্গে ফোনেও কথা বলতে পারবো না। অনেকবার চেয়েছি ডাক্তারদের ফোন নম্বর। বড় ছোট কোনও ডাক্তারের ফোন নম্বর আমাকে দেওয়া হয়নি। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় ডাক্তারদের ফোন নম্বর যখন চেয়েছিলাম জরুরি হলে ফোন করবো বলে, বলেছেন, আমাকে ফোন নম্বর দেওয়ার ব্যাপারে নিষেধ আছে। যা কিছুই আমি জানতে চাই আমার স্বাস্থ্যের ব্যাপারে, জানাতে হবে সরকারি অফিসারদের, তাঁরা ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমার প্রশ্নোত্তর জানাবেন। ডাক্তার বলেছিলেন, দুশ্চিন্তা হচ্ছে আমার রক্তচাপ বাড়ার মূল কারণ। আমি যেন দুশ্চিন্তা মুক্ত থাকি। এখানে, এই অবস্থায়, এই বাড়িতে, দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার আমার কোনও উপায় নেই।

রক্তচাপ অনিয়ন্ত্রিত থাকার কারণে ধীরে ধীরে হৃদপিণ্ডের দেয়াল শক্ত হয়ে উঠছে, চোখেও অসুখ দেখা দিচ্ছে। এরপর একদিন দুম করে হৃদপিণ্ড, চোখ, কিডনি সব নষ্ট হয়ে যাবে। আমি মরে পড়ে থাকবো নিরাপদ বাড়িটিতে। এই অজ্ঞাতবাসের আগে আমার রক্তচাপ সবসময় নিয়ন্ত্রণে ছিল। আমার শরীরের ভেতরের কোনও কিছুতে কোনও রক্তচাপ জনিত অসুবিধে দেখা দেয়নি। চোখের ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরে আমি জানিয়ে দিই, আমার সিদ্ধান্তটি, আমি ভারত ছাড়বো। প্রভুকে অনুরোধ করেছি, ভারত ছাড়ার আগে আমাকে একদিনের জন্য হলেও কলকাতা যেতে হবে, একদিনের জন্য না দিলেও অন্তত কয়েক ঘণ্টা থাকার অনুমতি দিন, আমাকে আমার জরুরি জিনিসপত্র ইত্যাদি নিয়ে আসার জন্য। এবং একা পড়ে থাকা বাড়িটির দায়িত্বও তো কাউকে দিতে হবে। প্রভু রাজি হননি। প্রভুর দোষ নয়, প্রভু বলেছেন তিনি জানিয়েছিলেন ওপরে, ওপরওয়ালারা রাজি নন।

১৭ মার্চ

অত বড় সরকারের সঙ্গে পিরবো কী করে আমি! আমি ক্ষুদ্র তুচ্ছ মানুষ। তারপরও মনে হয়, ঠেকিয়ে তো ছিলাম সাড়ে সাত মাস! যুদ্ধ তো করেছি সাড়ে সাত মাস! শুধু মৃত্যু চাইনি বলে বেরিয়ে যাচ্ছি। বেঁচে থাকলে দেখা হবে। দেখা তো হবেই ভারতবর্ষ। যতই তুমি আমাকে দলে পিষে মারো না কেন! যতই তুমি আমাকে নিশ্চিহ্ন করো না কেন! যতই তুমি আমাকে নিঃশেষ করো না কেন? ভালোবাসি তোমাকে ভারতবর্ষ।

১০. ‘হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা অন্য কোন্ খানে!’

শেষ অবধি ভারত আমাকে ত্যাগ করতেই হল। সিদ্ধান্তটি আমি নিজেই নিই। নিতে হয়। এ ছাড়া, সত্যি বলতে কী, আমার উপায় ছিল না। আমার রক্তচাপ উদ্বাহু নৃত্য করে যাচ্ছে। মুহূর্তে কমছে, মুহূর্তে বাড়ছে। দুশ্চিন্তার ওপরও কিছু আর নির্ভর করছে না। রক্তচাপ কমানোর ওষুধ, আর যার রক্তচাপই কমাক, আমার রক্তচাপ কমাতে পারছে না। কিডনি আর চোখ পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন ডাক্তার। চোখের ডাক্তারের কাছে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল। পরীক্ষা করে ডাক্তার বলে দিলেন, রেটিনোপ্যাথি ধরেছে চোখে। তার মানে চোখ আমার নষ্ট হওয়ার পথে।

রক্তচাপ যতবারই পরীক্ষা করছি, ততবারই অদ্ভুত সব রক্তচাপ দেখতে পাচ্ছি। আর যাকেই বিশ্বাস করা যায়, এই চাপকে করা যায় না। অন্য যে কোনো লোক কবেই মরে যেতো এই চাপে। আমি কী করে বেঁচে থাকি জানি না। রক্তচাপ দাবিয়ে রাখার ব্যবস্থা হয় বটে, তবে বছর পার হওয়ার পর যে ভয়ংকর সংবাদটি আমাকে নিউইয়র্কের রক্তচাপ বিশেষজ্ঞরা দিয়েছেন, তা হল, আমার রক্তচাপের চরিত্র এখন এমনই দাঁড়িয়ে গেছে, সে কখনও কোনো ওষুধে বশ মানবে না, সে তার নিজের খুশি মতো, যখন ইচ্ছে আকাশে উঠবে, যখন ইচ্ছে পাতালে ঝাঁপ দেবে। এমন রক্তচাপ নিয়েই আমাকে বাঁচতে হবে, যতদিন বাঁচি। নৃত্য যদি রক্ত একবার শিখে যায়, সে নৃত্য তার থামে না কিছুতেই। আমার রক্ত নৃত্য শিখেছে নিরাপদ বাড়ির চাপে আর তিন তিনটে ভুল ওষুধে।

পৃথিবীতে দুটো বাড়িকেই আমি বাড়ি বলে মনে করি, অথবা আমার বাড়ি বলে ভাবতে পারি। এক ঢাকায় শান্তিনগরের বাড়ি। দুই কলকাতার বাড়ি। যদিও কলকাতার বাড়িটি ভাড়া বাড়ি, কিন্তু বাড়িটির ভাড়া আমি দিয়েছি, অন্য কেউ নয়। আমার সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব ওখানেই। আর ওই দুটো বাড়িতেই আমার প্রবেশ নিষেধ। আমি শুধু ঢাকা বা কলকাতা শহরের আমার বাড়িতে নয়, যে দেশে ওই শহরগুলো, সেই দেশগুলোতেও যেতে পারবো না, আমি নিষিদ্ধ। পশ্চিমের দেশে আমার নির্বাসন জীবন শুরু হয়। এই নির্বাসন সারা জীবনের, নাকি ক্ষণিকের, কিছুই আমার জানা নেই। অনিশ্চয়তার কাঁধে ভর দিয়ে আমাকে হাঁটতে হয়। কতদূর হাঁটতে পারবো, তাও আমার জানা নেই। দেশে দেশে ঘুরি ফিরি।

ভারত সরকার বিজনেস ক্লাস টিকিট দিয়েছে সুইডেনে যাওয়ার। ওয়ান ওয়ে টিকিট। পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজস্থান যাওয়ার টিকিট দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ওই টিকিটও ছিল ওয়ান ওয়ে টিকিট। কলকাতা টু জয়পুর। ভারত সরকার থেকেও দেওয়া হল, দিল্লি টুস্টকহোম। তবে ভারত সরকার থেকে বিদেয়টা অনেকটা ঘটা করেই হয়েছে। অনেকটা বাড়ির অতিথিকে পোলাও মাংস খাইয়ে বিদেয় জানানোর মতো। অথবা অনেকটা ফাঁসির আসামীকে যেমন ফাঁসির আগে যা চাওয়া হয়, তাই দেওয়া হয়, তেমন। যাওয়ার দিন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হবে, এ কথা শুনে কলকাতা থেকে বন্ধুরা এসেছিল দেখা করতে। রীতিমত পাঁচ তারা হোটেলে ওদের সঙ্গে দেখা করানোর ব্যবস্থা হল। গভীর রাতে ফ্লাইট। ডিনার করো বন্ধুদের সঙ্গে। যত ইচ্ছে খাও। দুতিন ঘণ্টার জন্য বরাদ্দ হল তাজ হোটেলের একটা সুইট। যে রাতে আমার ভারত ছাড়তে হবে, সে রাতে সেই তাজ হোটেলেই ডিনার করতে হবে কলকাতার বন্ধুদের সঙ্গে। রুম সার্ভিসকে যা খুশি তাই অর্ডার করতে পারি। কেবল তাই নয়, ওই বন্ধুদের সবাইকে হোটেলে রাখা, খাওয়ানো, সবই দেওয়া হল সরকার থেকে। সবই হচ্ছে আমার ভারত ছাড়ার উপহার। প্রভু নিজেই এসব করলেন। আমি আবদার করিনি কিছুর। বরং বলেছি এত খরচ করার দরকার নেই। ওরা নিজেরা এসেছে, নিজেরাই নিজেদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে নেবে। কিন্তু কে শোনে আমার কথা! অনেকটা মিশন সাকসেসফুল হওয়ার মহোৎসবের মতো লাগছিল সবকিছু। তবে জানি না সরকারের কে কী ভেবেছিলেন, আমি কিন্তু শরীর সুস্থ করার উদ্দেশেই যাচ্ছিলাম। রক্তচাপে কোনো অসুবিধে না দেখলে আমি হাজার বছর থেকে যেতে পারতাম। হ্যাঁ ওই বন্দি অবস্থাতেই। অন্যায় না করে শাস্তি পেতে থাকলে পালিয়ে না গিয়ে বরং ওই শাস্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা আর বাক স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই করা, সে জীবন ভর লড়াই করতে হলেও করার পক্ষপাতী আমি। মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছেগুলো খুব পুরোনো শোনায়, যে আদর্শের কথা বলি তা এখন অচল, মানুষ ঠিক বোঝে না কী বলছি, যেন সেই চল্লিশ বা পঞ্চাশ দশকের কোনো অশরীরী কেউ এসে কিছু বলছে। গোলগোল চোখ করে লোকে তাকায়। অনেকে ভাবে, আমার নিশ্চয়ই আসলে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে, না হলে নিজের কথা না ভেবে অন্যের কথা ভাবছি কেন, নিশ্চয়ই কোনো ফায়দা। লোটার উদ্দেশে অন্যের জন্য দরদ দেখাচ্ছি, তলে তলে অন্য প্ল্যান।

আমি তখন ভীষণ ক্লান্ত। এ আমার এক ধরনের হেরে যাওয়াও বটে। ভারত কখনও ছাড়বো, এ আমি কোনোদিন ভাবিনি। কিন্তু আগে তো বাঁচতে হবে। তারপর তো কোন দেশে যাপন করবোজীবন, সেই প্রশ্ন। ভারত আর বাংলাদেশ বাদ দিলে বাকি দুনিয়া আমার কাছে এক, সবই বিদেশ। সুইডেনে যাওয়ার উদ্দেশ্য, ও দেশে আমার চিকিৎসার সুবিধে। ও দেশের যারা নাগরিক, বা যারা বাস করে ওদেশে, সবাই পায় রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে ইওরোপ আমেরিকায় চিকিৎসা করা! ও সত্যিকার রাজা বাদশা ছাড়া আর কেউ পারবে না। সুইডেনে নেমেই দেখি সুইডিশ পেন ক্লাবের মারিয়া, মাইব্রিট, আর সিসিলিয়াভিকম, সুইডেনের সংসদ সদস্য, আমাকে নেবার জন্য এসেছে। আমার থাকার ব্যবস্থাও করে রেখেছে। সংস্কৃতি দপ্তর থেকে আমাকে একটা গ্রান্ট বা স্কলারশিপ দেওয়া হয়েছে। উপসালা শহরে একটা অ্যাপার্টমেন্ট দেওয়া হবে আমাকে। সুয়েনসন এসেছিলো বিমান বন্দরে। কিন্তু ওর বাড়িতে যেতে গেলে বাধা আসে। কী রকম সব সাজানো মনে হয় সব। সিসিলিয়া তার গাড়িতে করে উপসালা নিয়ে গেল। জানা নেই শোনা নেই, অথচ ব্যবহার করছে যেন আমি তার কতকালের আপন। আমার জন্য তার উপচে ওঠা আবেগ আমাকে বড় বিব্রত করে। উপসালা শহরের এক হোটেলে রাখা হল আমাকে, সঙ্গে মাইব্রিট রইলো। এত দিন পর আমার মানসিক অবস্থাও বোধহয় অদ্ভুত হয়ে গেছে। পুলিশ আমকে ঘিরে রাখছে না, কিন্তু আমার খবরাখবর রাখছে। এ জানার পরও পুলিশ বেষ্টিত না হয়ে রাস্তায় বেরোতে ভয় পাচ্ছিলাম। এ কলকাতা নয়, দিল্লি নয়, এ উপসালা, তারপরও। দীর্ঘদিন ভারতে আমাকে কুঁকড়ে থাকতে হয়েছে ভয়ে, এই বুঝি কেউ মেরে ফেলতে আসছে। মৌলবাদী আজকাল পৃথিবীর সব জায়গায়। দিন দিন এমন হচ্ছে, কোনো দেশ বা শহর নেই যেখানে ওদের চিহ্ন নেই। সুইডিশ এক শিল্পী কুকুরের ছবিতে মোহাম্মদের মুখ বসিয়ে দেওয়ার পর তার ওপরও হামলা হয়েছে। তাকেই এখন লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। আমি আর মাইব্রিট দুজন বেরোলাম রাতে বাইরে খেতে। খেতে তো যেতেই হবে। আমার হাঁটার মধ্যে আমি লক্ষ করি আড়ষ্টতা। এদিক ওদিক তাকাই, কেউ আবার চিনে ফিলছে না তো আমাকে! যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই রাত হয়। অনেকটা সেরকম। সুইডিশ লোকেরা আমাকে সম্ভাষণ জানাচ্ছে। কেউ দৌড়ে এসে ফুলও দিল। কী কারণ হঠাৎ আমাকে এভাবে চেনার! গা ছমছম করে।

সিসিলিয়াই উপসালা হাসপাতালের ডাক্তারকে বলে দেয় আমার শরীরের সব পরীক্ষা করতে। চোখ, হৃদপিণ্ড, রক্তচাপ সব। সব দেখে ডাক্তার বললেন, কোথাও কোনও অসুবিধে নেই। সব ঠিক আছে। রক্তচাপের ওষুধ বরং কমিয়ে দিলেন।

সুয়েনসনের বাড়িতে আমার কাপড়চোপড় কমপিউটার জিনিসপত্র। কলকাতায় সংসার করছিলাম বটে, কিন্তু সুইডেন থেকে এত বছরের ব্যবহার করা সবকিছু সরানো হয়নি। সুইডেন থেকে সরেছিলাম, জিনিসপত্র অনেক রয়ে গেছে। সুটকেসে তেইশ কিলো করে কত আর কী নেওয়া যায়। সুয়েনসনের বাড়ি ভর্তি এখনও আমারই জিনিসপত্র। এভাবে উপসালা শহরের হোটেলে থাকার কোনো মানে হয় না। দ্বিতীয় রাতে সুয়েনসন দিয়ে যায় বটে ইন্টারনেট ব্যবহারের ডিভাইস, কিন্তু তৃতীয় রাতেই সুয়েনসনের সঙ্গে রওনা হই তার উপলাস ভিয়েসবির বাড়িতে। আমার স্টাডি ঠিক সেভাবেই আছে, যেভাবে শেষবার রেখে গিয়েছিলাম। পপকর্ন মাটিতে যেভাবে যে জায়গায় পড়েছিলো, এখনও সেখানেই আছে। চায়ের কাপ যে কটা ছিল টেবিলে, যেভাবে ছিল, সেভাবেই আছে, শুধু কাপের অবশিষ্ট চা শুকিয়ে চিহ্ন রেখে গেছে। পুরো বাড়ি পরিষ্কার করলেও সুয়েনসন কোনোদিন আমার ও ঘরটা পরিষ্কার করবে না। যদি হাজার বছর আমি না আসি, হাজার বছর এ ঘর এভাবেই থাকবে। অথচ আমি যখন ঘর দোর সাফ করি, তার স্টাডি বাদ দিয়ে সাফ করিনি কোনোদিন। পুরুষের চরিত্রে ভয়ংকর এক হিংসে কিলবিল করে। বাড়িটিতে বহু বছর থাকার কারণে বাড়িটি খুব চেনা, নিজের বাড়ি বলেই মনে হয়। নিশ্চিন্তে নির্ভাবনায় স্টাডিতে কাটাতে থাকি দিন রাত, আগে যেমন কাটাতাম।

ওদিকে উপসালার স্কলারশিপ দেওয়ার খবর ঘোষণা হয়ে গেছে। সুইডেন ছাড়িয়ে এ খবর ছড়িয়ে গেছে অন্য দেশে। সুয়েনসনের ব্যবহার দিন দুই হয়তো ভালো থাকে, এরপর যে কে সেই। আমাকে সঙ্গ দিতে থাকে মাইব্রিট। একদিন ও আমাকে টেনে নিয়ে যায় উপসালায়, স্কলারশিপের বাড়িখানা দেখতে। একজনের বাস করার জন্য খুব মন্দ নয়, তবে সে বাস অবশ্যই দীর্ঘ দিনের জন্য নয়। ক্ষণিকের অতিথি হতে চাই না আর। অনেক হয়েছি, এ দেশ ও দেশ অনেক তো হল। আমি ক্লান্ত। কোথাও বাকি জীবনের জন্য কাটাতে পারি, যেন সব ছেড়ে ছুঁড়ে আবার কোথাও ছুটতে না হয়। বাড়িটি উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই। জায়গা সুন্দর। দু’পা এগোলেই অরণ্য-মত কিছু। কিন্তু ভেতরে হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা! সিসিলিয়া বলছে, উপসালা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে ফেলোশিপ দেবে, স্কলারশিপটি গ্রহণ করার জন্য নানা কায়দায় আমাকে উৎসাহ দেওয়া হয়। তারপরও আমার ‘হেথা নয়, হেথা নয়’ কাটে না। সুইডেনেই যদি থাকতে হয়, তবে এই বাড়িই বা কেন, সুয়েনসনের বাড়িতেই থাকতে পারি, অথবা সুয়েনসনের বাড়িতে যদি ভালো না লাগে, নিজের জন্য কোনো বাড়ি ভাড়া নিতে পারি, যে বাড়ি ছ’মাস বা এক বছর পর ছেড়ে দিতে হবে না। সিসিলিয়া জোঁকের মতো লেগে থাকে আমার গায়ে। তাঁর বাড়িতে নেমন্তন্ন করলো শুধু আমাকে নয়, আমার বন্ধু বান্ধবকেও। প্রথম মনে হয়েছিল, চমৎকার মেয়ে। কর্মঠ, বুদ্ধিমতী, আন্তরিক। তাই হতো, যদি না আমাকে প্রেস কনফারেন্সের জন্য অমন চেপে না ধরতো। নিজে, পেন ক্লাবের সদস্যদের দিয়ে, এমনকী তার সেক্রেটারিকে দিয়েও আমাকে প্রেস কনফারেন্সে রাজি করাতে মরিয়া হয়ে উঠলো। আমি প্রথম থেকেই বলেছি, আমি কোনো প্রেসের সঙ্গে কথা বলবো না। আমি দুনিয়াকে জানাতে চাই না আমি কোথায় আছি। কারণ স্কলারশিপটা আমাকে দেওয়া হয়েছে, এ খবর রাষ্ট্র করা মানে সবাইকে ঢাড়া পিটিয়ে একরকম জানিয়ে দেওয়া হল এই আমার ঠিকানা। সরকারি এই স্কলারশিপের বাড়িটা কোথায়, কারও দুমিনিট লাগবে না বের করতে। আমি এত ঝুঁকি নিতে পারবো না জীবনের। কিন্তু কে শোনে আমার কথা, সিসিলিয়া বারবারই বলতে লাগলো, না জানালে উপসালার স্কলারশিপ যে আমাকে দিয়ে উদ্বোধন হল, তা লোকে জানবে না। দেশের জন্য, এমনকী উপসালার জন্য এ বড় খবর যে, উপসালা শহর এখন থেকে পৃথিবীর নির্যাতিত লেখক শিল্পীদের পাশে দাঁড়াবে, বাক স্বাধীনতার পক্ষে লড়াই করবে। একদিন দুপুরে তাঁর বাড়িতেই আমাকে কিছুতেই যখন প্রেস কনফারেন্সে রাজি করাতে পারলো না, হাল ছেড়ে দিয়ে চলে গেল মিটিং আছে বলে। সেই মিটিংটা যে তার সেই প্রেস কনফারেন্সে যাওয়া ছিল, তা বুঝলাম পরদিন, যেদিন সারা পৃথিবীর কাগজে দেখলাম ছাপা হয়েছে, সিসিলিয়া ভিকস্ট্রম-এর উদ্যোগে উপসালা শহরে আমাকে স্কলারশিপ দেওয়া হচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। নামের কী আশ্চর্য মোহ! ক্ষমতার জন্য সে কী ভীষণ পিপাসা! যত ভালো কাজে নাম বাড়বে, তত তার সিঁড়ি মসৃণ হবে ওপরে ওঠার। মনে মনে বলি, গুডবাই উপসালা, গুডবাই সিসিলিয়া।

চলে যাই ফ্রান্সের দক্ষিণে, মদনজিৎ সিং ডাকছেন আমায়। মদনজিৎ সিংএর বাড়িটি সত্যি বলতে কী সত্যিকার সাগরসৈকতে। সামনে নীল ভূমধ্যসাগর, পেছনে পাহাড়। এক টিলায় তার প্রাসাদ। ঘর থেকেই দেখা যায় আদিগন্ত নীলজল আর শোনা যায় পাড়ের ঢেউ ভাঙার শব্দ। সমুদ্রে সাদা সাদা নৌকো ভাসছে, পাখিরা উড়ছে, খোলা নীল আকাশ। যত না মুগ্ধ হই প্রকৃতির সৌন্দর্যে, তার চেয়ে বেশি মুগ্ধ হই মদনজিৎ সিংকে দেখে। সাতাশি বছর বয়স, আদ্যোপান্ত নাস্তিক। আশি বছর বয়সে দু’শ মিলিয়ন ডলার পেয়েছিলেন, অকাতরে ঢেলে দিয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ার সেবায়। দক্ষিণ এশিয়ার ছেলে মেয়েদের বৃত্তি দেওয়া হবে কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনে পয়সায় পড়ার জন্য। যেন দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন ধর্ম বর্ণ ভাষা সংস্কৃতির ছাত্র ছাত্রীরা একসঙ্গে পড়তে গিয়ে নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারে। মদনজিৎ সিং স্বপ্নবান মানুষ। ঠিক যে স্বপ্ন আমি দেখি, একই স্বপ্ন তিনি দেখেন। এত আন্তরিক মানবিক মানুষ তিনি, এমন মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে যদি বেশি হতে আরো, পৃথিবী সুন্দর হতো আরও। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী সহ যাকে যাকে চেনেন, সবাইকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন আমাকে বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করে ভালোয় ভালোয় কলকাতা পাঠাতে। মৌলবাদীর কাছে হেরে যাওয়া ভারতের মতো দেশকে মানায় না। উপদেশ দিয়ে তিনি অনেককে চিঠি লেখেন। জানি না ক’জন মানেন তার উপদেশ। একসময় ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। প্রচুর বই লিখেছেন, ছবি এঁকেছেন। এখনো লিখে চলেছেন বই। এই বয়সেও। তার সব কথা আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি। অর্থহীন নয় তাঁর একটি বাক্যও।

পর পর অনেক কিছু ঘটতে থাকে। প্যারিসে আমাকে দেওয়া হচ্ছে সিমোন দ্য বুভোয়ার পুরস্কার। পুরস্কার নেবোপররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবাধিকার মন্ত্রীর হাত থেকে। তখন একের পর এক ফরাসি সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার দিতে হচ্ছে। এখানে এমনই হয়, একটা বই বের হলো, তো বই-প্রকাশক টিভিরেডিওদৈনিকসাপ্তাহিকে লেখকের সাক্ষাৎকার নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। সবার বেলায় এমন ঘটে না। যার কিছুনাম ডাক আছে, প্রচার মাধ্যম তার প্রতিই আগ্রহ দেখায়। প্রকাশক তড়িঘড়ি করে একটা বই করেছে, বইটির ফরাসি নামের বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘আমার কারাগার থেকে। তড়িঘড়িই বলবো। সেই আমি দিল্লিতে গৃহবন্দি অবস্থায় থাকাকালীন প্রকাশক তাড়া দিলেন, ‘কিছু লেখো, অথবা ওখানে বসে যা লিখেছো, তাই দাও। আমি বলেছি, লেখার মধ্যে কিছু কবিতা, আর টুকরো টুকরো কিছু ভাবনার কথা। বললেন, ”যা লিখেছে পাঠিয়ে দাও, আমি বই করবো’। আমি অনেকবার বলেছি, ‘বই হওয়ার মতো কিছু লিখিনি। আত্মজীবনী আমি তো লিখছিই। লেখা শেষ হলে নিশ্চয়ই তোমাকে পাঠাবো’। আবারও বললেন, ”যা লিখেছে তাই নিয়েই ছোটমতো একটা বই করবো, ঠিক বই নয়, সংকলন মতো। আমি খুব ভালো করে জানি, কিছু কবিতা আর দুটো মনের কথা দিয়ে আস্ত একটা বই বের করলে পাঠক ঠকানো হবে, আর কিছু নয়। এমনিতে ধুমধাম করে ফতোয়া ফতোয়া আওয়াজ দিয়ে লজ্জা বের করার পর পাঠক নিশ্চয়ই আকাশ থেকে পড়েছে, এই বইয়ের জন্য ফতোয়া জারি হওয়ার কারণ কেউ কিছু খুঁজে পায়নি। যে বই, বা আমার যেসব লেখার কারণে সত্যিকার ফতোয়া জারি হয়েছিল, সেসব হয় ছাপানোই হয়নি, নয়তো ছাপানো হলেও ফতোয়া ফতোয়া বলে কোনও লম্ফঝম্ফও হয়নি। নতুন বইটিই সবার হাতে হাতে, সাক্ষাৎকার দিতে হচ্ছে সবখানে। সকাল থেকে রাত অবদি ব্যস্ত। লমন্দ এ পুরো পাতা সাক্ষাৎকার। কানাডা থেকে চলে এসেছেন মাইক বাক স্বাধীনতার ওপর তথ্যচিত্র বানাচ্ছেন, এমপায়ার অব দ্য ওয়ার্ড, ধারাবর্ণনা করছেন হিস্টরি অব রিডিংএর লেখক আলবার্তো ম্যাংগুয়েল। ওখানে আমার কথা ও কাহিনী থাকছে। সাত সকালে রেডিওতে ছোটো, দশটা থেকে সাংবাদিক আসতে শুরু হয়। রাত্তিরে টিভি থেকে ফেরা। ঘটা করে পুরস্কার অনুষ্ঠান হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। সিমোন দ্য বোভোয়া পুরস্কার আমাকে দিয়েই শুরু হল ফ্রান্সে। কেবল আমি নই, আমার সঙ্গে আছে আয়ান হিরসি আলি। দু’জনে এই পুরস্কারটা পেয়েছি। তবে ও আগেই নিয়ে গেছে ওর ভাগ, আমার ভাগটা নিতে হল পরে।

এরপর আবার আমন্ত্রণ প্যারিসে। এবার প্যারিস সিটি কাউন্সিল আমাকে সম্মানীয় নাগরিক করবে। সিটি হলে বা টাউন হলে বা হোটেল দ্য ভিলে নেওয়া হল আমাকে। মেয়র উপহার দিলেন দামি, কথা বললেন চমৎকার, তোমাকে শুধু নামকাওয়াস্তে নাগরিকত্ব দেওয়া হচ্ছে না, সত্যি সত্যিই নাগরিক হিসেবে তুমি প্যারিসে থাকো, তাই আমরা চাইছি। মেয়র যখন আমাকে প্যারিসের নাগরিক কেন করা উচিত এক এক করে সিটি কাউন্সিলের অ্যাসেম্বলিতে বলছিলেন, বলা শেষ হলে, ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের একশ আশি জন সদস্যই দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে মেয়রের প্রস্তাব সমর্থন করলেন। দেখা করতে বেলজিয়াম থেকে আইরিন চলে এলো। স্টিভ মারা যাওয়ার পর আইরিন অনেকটাই বদলে গেছে। ছোঁক ছোঁকটা বেড়েছে। মাথা ঠিক রাখার মুঠো মুঠো ওষুধ আগেও যেমন খেতো, এখনও খাচ্ছে। তবে এখন যেন পরিমাণটা আরও বেশি। বেলজিয়ামের গেন্ট শহরে থাকছে,যার বাড়িতে থাকছে, তার দুর্নাম করেই যাচ্ছে তো করেই যাচ্ছে। ও জায়গা তার পোযাচ্ছে না, টাকা পয়সার অভাব, বয়স বিচ্ছিরি রকম বেড়ে গেছে, স্টিভের রেকর্ডগুলো এখনও বিক্রি করতে পারছে না, ইত্যাদি। কী জানি কেন, আইরিনের নিরন্তর অভিযোগ একসময় বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। স্টিভের অসুস্থতার সময় স্টিভের বন্ধুদের সঙ্গে এমনকী আমার সঙ্গেও কী অসভ্যের মতো ব্যবহার করতো, সেসব মনে পড়ে। যে মানুষটা মারা যাচ্ছে, তাকে চোখের দেখাও দেখতে দেয়নি শেষদিকে। স্টিভকে নিজের সম্পত্তি ঠাউরেছিলো। স্টিভের অসুখ হওয়াটা আইরিনের এত অসহ্য লাগতো যে অসুস্থ স্টিভের সঙ্গেও ভালো ব্যবহার করতো না। সেই ভয়াবহ প্রতাপশালী আইরিন এখন শিশুর মতো হয়ে গেছে। মেয়র ডিনার পার্টি দিচ্ছেন আমার সম্মানে, গোঁ ধরেছে সেখানে যাবে। আমি আপত্তি করিনি। আইরিনের জন্য আবার মায়াও হয়। আমার নাগরিকত্ব পাওয়া ও আমার পাশে থেকে দেখতে পেলো বলে খুশিতে লাফায়। আইরিনকে আমি অনেকবার ক্ষমা করেছি, জানে ও। অনেকবার নিজের ভুল সে স্বীকার করেছে। আইরিনের দুঃসময়ে পাশে আমি দাঁড়িয়েছি অনেক। অনেককাল ওকে জানি। মায়া হয় যখন ওষুধ খেয়ে ওকে সামাজিক হতে হয়, মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়, আত্মহত্যা করার আগ্রহ দূর করতে হয়। আবারও প্যারিসে আমন্ত্রণ, যারা ফরাসি সরকারের মানবাধিকার পুরস্কার পেয়েছে, তাদের সবাইকে নিয়ে উৎসব হচ্ছে। সেই উৎসবে সামিল হলাম। এক ডিনারে ক্যাথারিন দনোভকে দেখে সে যে কী ভালো লাগে! একসময়ের ডাকসাইটে ফরাসি অভিনেত্রী। সত্যি বলতে কী, সিনেমাজগতে ক্যাথারিনকেই আমার সবচেয়ে রূপসী বলে মনে হয়। সেই সত্তর/আশির দশকের চলচ্চিত্রগুলো এখনও মুগ্ধ হয়ে দেখি! এদিকে আবার আরেক আমন্ত্রণ, আমাকে বোর্ড মেম্বার হতে হবে ‘ফাউণ্ডেশন ফর উইমেন’-এর। বিরাট এক বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান পিপিআর শুরু করছে সারা পৃথিবীর মেয়েদের সাহায্য করার জন্য এই ফাউণ্ডেশন। ফাউণ্ডেশনে থাকবে স্টেলা ম্যাককার্টনি, ওয়ারিশ দুরি, এবং আরও কয়েকজন। বড় বড় সব লোক। বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার নির্যাতিত নিপীড়িত মেয়েদের অবস্থার উন্নতি করার জন্য কাজ করবো সবাই। প্রচণ্ড উৎসাহ পাই এ কাজে।

এরকমই একটা সময় আমার মন উদাস। ভারতের রেসিডেন্স পারমিট ফুরোবার আগে গিয়েছিলাম দিল্লিতে। ঢুকতে দিয়েছে, এক বন্ধুর খালি বাড়িতে থাকতেও দিয়েছে কয়েকদিন। শত শত পুলিশ ঘিরে রেখেছে বাড়িকে, আমাকে। কিন্তু যাওয়ার পর পরই রেসিডেন্স পারমিট ছ’মাসের জন্য বাড়িয়ে আমাকে বিদেয় করে দেওয়া হয়েছে। আমি থাকবো না ভারতে, এ কথাটি ওদের মাথায় হাত দিয়ে বললে, নিজের বুকে হাত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করলে তবেই আমাকে ‘ভারতে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। মুচলেকা দিতে বলা হয়েছে, দিতে বাধ্য হয়েছি। ছমাস পরেও গিয়ে দেখি সিদ্ধান্ত পাল্টায়নি। ওই একই, রেসিডেন্স পারমিট দেবো, তবে এক শর্তে, পারমিট পাওয়ার তিন দিনের মধ্যে চলে যাও। ভারত যদি থাকতেই না দেয়, যেতেই না দেয় কলকাতায়, আমাকে তো কোথাও না কোথাও থাকতে হবে, এরকম কিছুদিন সুইডেনে সুয়েনসনের বাড়িতে, কিছুদিন নিউইয়র্কে ইয়াসমিনের বাড়িতে, কিছুদিন প্যারিসের হোটেলে হোক না সে ফাঁইভ স্টার হোটেল, কিছুদিন মদনজিৎ সিংএর প্রাসাদে –এভাবে জীবন ঠিক যাপন করা যায় না। সুয়েনসনের বাড়িতে কিছুদিন থাকা যায়, দীর্ঘদিন থাকা যায় না। প্যারিসের আমি সম্মানীয় নাগরিক, মেয়রও বলেছেন প্যারিসে যেন থাকি। তবে প্যারিসেই থাকি না কেন। অনেকে বলেছে, ফরাসি সরকারের কত কত বাড়ি পড়ে আছে, দিতেই পারে একটি। তা কি সত্যি আমাকে দিতে পারে, ফরাসি কত লোক রাস্তায় জীবন যাপন করে, আর আমি কে যে আমাকে একটা বাড়ি দিতে হবে। শুধু লমন্দ নয়, অন্যান্য পত্রিকাও ভারত থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর আমার গৃহহীন অবস্থার কথাই লিখেছে। প্যারিসের মেয়র বাট্রণ্ড দোলানয়ে দিলেন ছ’মাসের জন্য স্কলারশিপ, শিল্পীদের থাকার জায়গায় আমার জন্য ঘর হবে, মাসে মাসে হাত-খরচের টাকা হবে। লেখক শিল্পী সাহিত্যিকের সঙ্গে প্যারিসের মধ্যিখানে সেইন নদীর ধারে এক বাড়িতে থাকা আমাকে পুলকিত না করলেও আমার ফরাসি বন্ধুদের করে। হৈহুল্লোড় করে কিছু বন্ধু লেখক ধুমধাম করে খেয়েও গেল, তুমুল আড্ডা দিয়ে গেল আমার জন্য বরাদ্দ ঘরটিতে। অনেকটা উদ্বোধনের মতো। তবে ঘরে, সত্যিকার অর্থে আমার থাকা হয়নি, চলে গেছি নিউইয়র্কে, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে আমাকে ফেলোশিপ দেওয়া হয়েছে।

নিউইয়র্কে থাকতে শুরু করি, তবে ছুটতে হয় আরও অনেক দেশে। সুইডেনে আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন, স্পেনের বিলবাওয়ে সেন্সরসিপের বিরুদ্ধে সেমিনার, সানফ্রান্সসিস্কোতে কবিতা উৎসব, বীট-কবিরা যেখানে কবিতা পড়তেন, সেখানে কবিতা পড়া, সেই নর্থ বিচ,সেই সিটি লাইটস, সেই বিসুভিয়াস! ইতালিতে কবিতা উৎসব, লুক্সেমবার্গেও তাই, আমস্টারডামে মুক্তচিন্তা বিষয়ে অনুষ্ঠান, ভিয়েনায় জগতে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করার · মূল্যবান আলোচনা অনুষ্ঠান। ইওরোপিয়ান পার্লামেন্ট থেকে শাখারভ পুরস্কারের পঁচিশ বছর পূর্তি। বেলজিয়ামের লোভেইন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডক্টরেট কিছু না কিছু আছেই। কিছু না কিছু থাকেই। ঘরে বসে নিশ্চিন্তে লেখালেখি করার জো নেই। অথবা এ একধরনের ঘরে বসে থাকার একঘয়েমি থেকে মুক্তি।

তবে নিউইয়র্কে যে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বিষয় করে সাহিত্য উৎসব হচ্ছে, তাতে কেউ আমাকে আমন্ত্রণ জানায় না। ভিন্ন মত প্রকাশ করার অপরাধে যে লেখককে এত কাল ধরে এত ভয়ংকর জীবন যাপন করতে হচ্ছে–যাকে এই কদিন আগে ছেড়ে আসতে হচ্ছে ভারতের মতো বিরাট একটা গণতান্ত্রিক দেশ তাকে ডাকা হয়নি, ডাকা হয়েছে অগুনতি অজ্ঞাত অখ্যাত লেখকদের। আমেরিকান পেন ক্লাব সাহিত্য উৎসবের আয়োজন করেছে। আমেরিকার এই লেখক সংগঠন কি আমাকে চেনে না? খুব চেনে। এ খবর কি জানে না যে এখন আমি নিউ ইয়র্কে। না জানার কোনো কারণ নেই। তবে কেন অন্য লেখকরা আজ তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলছে, কিন্তু তাদের চেয়েও অনেক বেশি অত্যাচারিত হওয়ার পরও আমি বলার অধিকার পাচ্ছি না। ভারতে আমার লেখার। কারণে মুসলিম মৌলবাদীর হামলা, আমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বের করে দেওয়া, দিল্লিতে অজ্ঞাতবাসে আমাকে রাখা, অবশেষে আমার ভারত ছাড়তে বাধ্য হওয়া এসব অন্য কেউ যদিও না জানে, পেন এর সভাপতি তো জানেন নিশ্চয়ই। সভাপতি সালমান রুশদি। তবে কি সালমান রুশদি সভাপতি বলেই এ শহরে আমি উপস্থিত থেকেও আন্তর্জাতিক মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে সেমিনারে আমি আমন্ত্রিত হতে পারি না! কী অপরাধ আমার। সেই যে কতকাল আগে জার্মানির ডাস্পিগাল পত্রিকায় ‘মৌলবাদীদের কাছে সালমান রুশদির ক্ষমা ভিক্ষে চাওয়া উচিত হয়নি’ বলেছিলাম বলে? সত্য কথা শুনে তখন রেগে আগুন হয়েছিলেন জানি, রাগ যে এত কাল পুষে রেখেছেন তা কে জানবে!

ইয়াসমিনের বাড়িতে থাকছিলাম। ভালোবাসা কিছুতেই রাজি নয় আমি ও বাড়িতে থাকি। ও আস্ত একটা বাস্তবজ্ঞানবর্জিত অদ্ভুত মানুষে পরিণত হয়েছে। হাত পা ছুরি দিয়ে কাটছে। কেন? তার বয়ফ্রেন্ড নেই, নিশ্চয়ই সে কুৎসিত, তা না হলে সবার বয়ফ্রেণ্ড থাকে, তার নেই কেন! ইয়াসমিনকে অনেক বলেছি ওকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিতে। ইয়াসমিন রাগে ফেটে পড়ে সাইকিয়াট্রিস্টের নাম শুনলে! তার মেয়ের কেন মাথা নষ্ট হতে যাবে। তার মেয়ে কি পাগল নাকি! অ্যানাল ফিশারে অনেকদিন ভুগে ওটাই ওর হয়ে উঠেছিল অবসেশন, এখন ভালোবাসা অবসেশন। ভালোবাসা ঘরের রানী, আর তার বাপ মা তার চাকর বাকর। এই ধরনের একটা রোলপ্লে চলে ইয়াসমিনের বাড়িতে। অসুস্থ পরিবেশ, জানি। আমি নিজের জন্য হন্যে হয়ে একটা অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজি। অ্যাপার্টমেন্ট পাওয়া কি আর চাট্টিখানি কথা। ক্রেডিট হিস্টরি লাগবে, যেটি নেই আমার। কত উপার্জন করি বছরে তার একটা প্রমাণপত্র দেখাতে হবে। যদি লক্ষ ডলার বছরে না উপার্জন করি, কেউ আমাকে বাড়ি ভাড়া দেবে না। তারপরও খুঁজি। শেষ পর্যন্ত ভাড়া নিই বটে না থাকা-টুইন-টাওয়ারের কাছে, হাডসন নদীর প্রায় পাড়ে, একজন গ্যারেন্টর জাদুর মতো যোগাড় হয়েছিল বলে। আমি যদি বাড়ি ভাড়া নেওয়ার শর্তগুলো পূরণ করতে না পারি, তবে আমাকে তার আশ্রয় নিতে হবে, যার ক্ষমতা আছে ওই শর্ত পূরণ করার। গ্যারেন্টর পাওয়াটা অমাবস্যার চাঁদ পাওয়ার মতো। যে দীর্ঘ বছর ধরে আমাকে চেনে একজন সৎ মানুষ হিসেবে, সে পিছিয়ে গেল, এগিয়ে এলো এমন একজন মানুষ, যার সঙ্গে আমার জানা নেই শোনা নেই, কিছু নেই। পৃথিবী বড়ই বিচিত্র।

ছ’মাস অন্তর অন্তর ভারতে ঢোকার অনুমতি জোটে রেসিডেন্স পারমিটের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য, তবে ভারতে থাকার জন্য আবেদন করলে কিন্তু ওই একই নিয়ম চলে। ‘তুমি কথা দাও তুমি ভারতে থাকবে না, তাহলে তোমাকে ভারতে থাকার ভিসা দেবো’। বাইরের কেউ জানে না এসব কথা। কাউকে জানানো চলবে না। বছরের পর বছর কলকাতার তালাবন্ধ বাড়ির ভাড়া দিতে হচ্ছে। যখন হাড়ে মজ্জায় বুঝেছি, কলকাতায় আমাকে কিছুতেই যেতে দেওয়া হবে না, কলকাতার বাড়ির জিনিসপত্র সব পাঠিয়ে দিতে বললাম বন্ধুদের। সরকার থেকেই ও বাড়ি খালি করে জিনিসপত্র দিল্লি আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিলো, এনে নাকি দিল্লির সরকারি গুদামে রেখে দেবে। গুদামে বন্দি করতে আমি রাজি হইনি। বন্দিদশা আমার সয় না। আমি নিজেই আনিয়েছি। নিজে আনা মানে, টাকা দিয়েছি, কলকাতার বন্ধুরা ওখান থেকে বাহক ডেকে সব বাক্সবন্দি করে পাঠিয়ে দিয়েছে। সরকারকে আমার জিনিসপত্র টানাটানি করার বিশাল দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছি। তবে কিছু বাড়তি আসবাব দিল্লির সরকরি গুদামে রাখা হয়েছিল, দু’বছর পর ফেরতও নিয়েছি। এই রাখার জন্য কোনও খরচ নেয়নি সরকার। দাদাদিল্লি এলো একবার, কলকাতা থেকে মিনুকে আনিয়ে নিলাম। মিনু উড়োজাহাজে করে এলো কলকাতা থেকে দিল্লি। আবার যখন আমার ভারত ছাড়ার ঘণ্টা বাজলো, মিনুকে দাদার সঙ্গে পাঠিয়ে দিলাম শান্তিনগরে, আমার ঢাকার বাড়িতে। এ ছাড়া উপায় ছিল না। দিল্লিতে মিনুকে রাখার অনেক চেষ্টা করেছি। বেড়াল ভালোবাসে এমন লোকের সঙ্গেও কথা বলেছি, পশুপাখি রক্ষা সংস্থার সঙ্গেও যোগাযোগ করেছি, কিন্তু লাভ হয়নি। ছ’মাস নাকি খাঁচায় বন্দি করে রাখবে বেড়াল! আবারও উড়লো মিনু। এবার ভারত থেকে ভারতের বাইরে। তবে যেহেতু ও মানুষ নয়, ওকে খাঁচায় বন্দি হয়ে উড়তে হয়। মানুষ বাস করে অদৃশ্য খাঁচায়। মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেছে খাঁচায়। মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী আজও কোথাও কোনও খাঁচায় বন্দি হতে চায় না। আবারও আমাকে সব ফেলে চলে যেতে হল। আবারও বিদায় বলতে হল ভারতকে। আবারও অনিশ্চয়তার পথে আমার পা।

মদনজিৎ সিংএর চিঠির জবাব ভারতের প্রধানমন্ত্রী একবার দিয়েছিলেন, বড় ভালো সেই চিঠি, ভারতীয় উপমহাদেশের অন্য কোনো দেশের অন্য কোনো প্রধানমন্ত্রীও যদি লিখতে পারতেন এমন চিঠি!

Dear Shri Madanjeet Singh,

I read your letter with great interest. Let me share you that many of us here share the sense of anguish you feel at Taslima Nasreen’s plight. It is most unfortunate that someone like her should be the target of extremist elements. Actions of this kind, though by a small minority tend to undermine our secular credentials and damage our image as an inclusive society.

You may rest assured, however that we shall never deviate our age-old tra ditions and principles. Right through the ages we have offered sanctuary and a

home to anyone who has sought our help. We have always shown compassion to those who have been persecuted. His Holiness the Dalai Lama is one shin ing example. We are unhappy at the turn of events in the case of Ms Taslima Nasreen, but in her case also we have honourned our ancient pledge. I can’t say how pleased I am that you have offered her a place to stay in Paris, till such time as she finds it convenient to return to India,

Taslima has been a victim of the politics of hate that a small section of ex tremists within our country are now pursuing. Her preference was to stay in Kolkata, but the West Bengal Government apprehended that this might lead to a law and order situation in the State. I cannot say whether this apprehension is valid, but we nevertheless welcomed her here in Delhi. Taslima misses being in Kolkata, however.

It is not correct to say that while in Delhi she was kept in solitary confine ment in a small room. Certain restrictions on her movements had to be im posed based on perceptions of the threat to her personal security. Otherwise she had relative freedom of movement. The restrictions that were imposed, no doubt, weighed heavily on her mind, and I can understand her predicament. External Affair Minister, Mr. Pranab Mukherjee, and senior officials did meet her from time to time to assuage many of her concerns.

She left for Sweden on her own volition, and not because we asked her. She will always be welcome in India as our guest. Her personal security, however, remains a matter of concern and we will need to take precautions to ensure her protection as long as she is our guest. We can try and see whether she could go back to Kolkata where she feels comfortable, but for this we would need the cooperation of the West Bengal Government.

India’s glorious traditions of welcoming people irrespective of caste and creed, community and religion will continue, whatever be the odds. The atmo sphere of hate being perpetrated by a small segment within the country will not prevent us from persisting with this tradition. We recognize Taslima Nasreen’s right to remain in a country of her choice, viz., India in this case. She should also have the option to choose whichever city of state she chooses.

Thope you would try to make her understand this You should also try to per suade her to realize that whatever was done while she was in India was dictated by the necessity to ensure her safety and security.

With regards,
Yours sincerely
Manmohan Singh.

এই চিঠি মদনজিৎ সিংকে গর্বিত করে, আমাকে তো করেই। আমি আশায় আশায় থাকি, অন্তত বাংলাদেশে যদি না-ই সম্ভব হয়, ভারতে বাস করতে পারবো আমি। কিন্তু ওই চিঠির পরও আমি দিল্লিতে থাকতে পারিনি দু’বছর।

২০১০ এর ফেব্রুয়ারিতে ইউরোপের ফরাসি জার্মান আর্তে টেলিভিশন ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানানো শুরু করেছে আমাকে নিয়ে। রেসিডেন্স পারমিটের মেয়াদ বাড়াতে আবারও দিল্লি যেতে হয় আমাকে। আর্তে টেলিভিশনের লোকেরা আগেই এসে বসে ছিল। এক ঘণ্টার একটা ছবি বানাতে ওরা মিলিয়ন ইউরো খরচ করছে। কত জায়গায় যে আমার পিছু নিল। লিওঁ, দিল্লি, নিউইয়র্ক। নিজেরা গেল কলকাতায়, ঢাকায়, ময়মনসিংহে, শুধু আমার ফেলে আসা স্মৃতির খুঁদ কুড়ো খুঁজে পেতে। ওরা অপেক্ষা করছিলো আমার রেসিডেন্স পারমিটের মেয়াদ এবার বাড়ানো হয় কি না দেখতে, সম্ভবত এ কারণেই করছিলো যে মেয়াদ বাড়বে না, আমাকে পাততাড়ি গুটোতে হবে, আর ওরা ক্যামেরায় চমৎকার ধরে রাখতে পারবে ‘ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলো। আর আমাকে আর থাকতে দেওয়া হবে না ভারতে, প্রতিবারই এই সংশয়ই কাজ করে। এবার রেসিডেন্স পারমিটের মেয়াদ আমার বাড়ানো হয় বটে, তবে একটি চিঠি সঙ্গে দেওয়া হয়। চিঠিতে লেখা, এবারই শেষ আমাকে থাকার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে, কারণ পাঁচ বছর পূর্ণ হয়ে গেছে। এরপর থেকে আমাকে আর ভারতের ভেতর থেকে ভিসা দেওয়া হবে না। যদি নিতান্তই ভারত ভ্রমণ করতে চাই, তবে বিদেশের ভারতীয় দূতাবাসে আমাকে দরখাস্ত দিতে হবে। এর চেয়ে ভয়ংকর কোনও চিঠি আমি আর হাতে পাইনি জীবনে। দু’বছরে এই প্রথম রেসিডেন্স পারমিট দেবার বেলায় কোনো শর্ত দেওয়া হয়নি আমাকে, ভারত ছাড়তে বলা হয়নি। জানি না কী করবো আমি। কোথায় যাবো, কার কাছে যাবো। কাকে বোঝাবো আমি! ভারতীয় যাকেই বলি, হ্যাঁ করে তাকিয়ে থাকে আমার মুখের দিকে। আমি বুঝি রেসিডেন্স পারমিট, এক্সটেনসন, ইমিগ্রেশন ল’ –এসব সম্পর্কে কেউ খুব একটা জানে না।

মার্চে কর্ণাটকে ভীষণ দাঙ্গা শুরু হল আমার একটা লেখা নিয়ে। কর্ণাটকের এক পত্রিকা আমার বোরখা নিয়ে একটা লেখা নিজেরাই ছাপিয়ে দিয়েছিল। আমার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। লেখাটা ২০০৬ সালের। আউটলুক নামের একটি ইংরেজি ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল লেখাটা। কেউ কেউ বললো, এ দাঙ্গাটির পেছনেও রাজনীতি কাজ করেছে। বিজেপি কর্ণাটকে ক্ষমতায়, তাই কংগ্রেসের এক নেতা দাঙ্গা বাধিয়ে কর্ণাটক সরকারকে বিপদে ফেলতে চেয়েছে। আমি তো একা মানুষ। আমার বিরুদ্ধে পথে নামলে, ফতোয়া দিলে, আমাকে মেরে ফেলতে চাইলে কে বাধা দেবে, কে দাঁড়াবে! এমন যার কেউ নেই কিছু নেইকেই মনে পড়ে দাঙ্গা বাধাবার বেলায়, ফতোয়া দেওয়ার বেলায়। আমার লেখাটায় ছিল, কোরানেও যদি লেখা থাকে বোরখা পরার কথা, তারপরও মেয়েদের বোরখা পরা উচিত নয়। বোরখার পক্ষের লোকেরা নেমে গেছে রাস্তায়। টেলিভিশনে দেখাতে থাকে কর্ণাটকের রাস্তাঘাট, পনেরো হাজার বোরখার পক্ষের মানুষ রাস্তায়, এক শহর থেকে আরেক শহরে ছড়িয়ে যাচ্ছে উন্মত্ত লোকে। বাস ট্রাক দোকান পাট যা সামনে পাচ্ছে তাই পোড়ানো হচ্ছে। আমার রক্তচাপ বেড়ে জানিনা কোন আকাশে উঠেছিল। হাত পা ঠাণ্ডা হতে শুরু করে। এ রকম ভয়াবহ দাঙ্গা আমার লেখাকে কেন্দ্র করে, যে কোনো সময় কোনো উন্মাদ ধর্মান্ধ আমাকে খুন করতে আসবে, আর যদি খুন না-ই হই, ভারতের। পাট বুঝি উঠলোই এবার। ঘরের বাতি নিবিয়ে দিয়ে, টেলিভিশন বন্ধ করে আমি শুয়ে পড়ি। এক্ষুণি না ঘুমোলে লম্ফ ঝম্ফ করা রক্তচাপ আমার হৃদপিণ্ড আচমকা অচল করে দেবে। প্রাণপণে শান্ত করতে চাই মন। আমি শুধু জানিয়ে দিয়েছি পিটিআইএর পল্লবকে, কর্ণাটকের পত্রিকায় আমি কোনও লেখা পাঠাইনি।

মন ভালো হয়ে যায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বিবৃতিতে। টেলিভিশনে বললেন, এই দাঙ্গার পেছনে তসলিমার কোনো ভূমিকা নেই। পত্রিকার লোকেরা লেখকের বিনাঅনুমতিতে লেখা প্রকাশ করেছে। এ পত্রিকার লোকদেরই দুষ্ট পরিকল্পনা। পত্রিকা অফিস ভাংচুর হল। যদিও মন ভালো হয়, আমাকে বাঁচিয়েছেন বলে, কিন্তু ভাবি, মত প্রকাশের স্বাধীনতার তবে হবে কী! কপি রাইট লংঘন করা ছাড়া আর কোনো অপরাধ নেই পত্রিকা সম্পাদকের। ভিন্ন মত প্রকাশের অধিকার থাকবে না কেন! দোষ তো ওই রাস্তার গুণ্ডাদের, যারা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে শহর, কারণ ভিন্ন কোনো মত তারা সইবে না।

আমাকে চলে যেতে হয় অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে। গ্লোবাল এথিস্ট কনভেনশনে। কর্ণাটকের দাঙ্গার কথা উল্লেখ করি ওখানে। ধর্ম মুক্ত বিজ্ঞান-বিশ্বাসী মানুষদের মধ্যেই আমি সবচেয়ে আরাম বোধ করি, যেন তারাই আমার সমাজ, আমার সত্যিকার স্বদেশ। আড়াই হাজার ধর্মমুক্ত মানুষ ইওরোপ আমেরিকা আর অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছে। বাঘা বাঘা বক্তা সব। রিচার্ড ডকিন্স, পিজি মেয়ার্স, এসি গারলেইং। সবার মধ্যে আমিই একমাত্র পেয়েছি স্ট্যান্ডিং অভেশন। সবার দাঁড়িয়ে হাততালি। খুব বড় সম্মান। এত বড় সম্মানে আমার মন ভালো হয়ে যাওয়ার কথা। অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়া সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য ধরেছে, না কাউকে দিইনি সাক্ষাৎকার, ইমেইলের উত্তরও দিইনি। রাস্তায় উদাস হাঁটি, মানুষ দেখি। পেঙ্গুইনের মিছিল দেখতে দৌড়োই। ইস্কুলের বান্ধবী মমতা থাকে সিডনিতে, উড়ে এলো একদিন দেখা করতে। দেখা হয়নি। আমি তখনও পেঙ্গুইনে। আরও গ্লোবাল কনভেনশনে ডাক পড়ে। যাইনি। ডেনমার্কে যাওয়ার জন্য টিকিটও হয়ে গিয়েছিলো। ইচ্ছে করেনি। ঘরে বেড়াল আছে, ওকে আদর করি কোলে নিয়ে, কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। আকাশে আকাশে জীবনের অনেকটা বছর কাটিয়েছি। আকাশ-জীবন থেকে এবার একটু মুক্তি চাই। ঘর আমাকে ভীষণ টানে। কতকাল ঘর জোটে না।

আবারও নিউইয়র্ক, আমার সেই ২৩তলার মিলিয়ন ডলার ভিউ’ অ্যাপার্টমেন্টে। দেয়াল জুড়ে কাঁচের জানালা। যত পারো দেখ খোলা আকাশ আর নদী। নদীতে নানা রকম ঢেউ, আকাশে নানা রকম রং। সত্যিকার নিরাপদ বাড়ি, নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলোশিপ শেষ হওয়ার পরও অপার সম্ভাবনা –কানেকটিকাট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি, উড্রোউইলসন ফেলোহিসেবে বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো, ব্রডওয়ে মিউজিকাল, লিংকন সেন্টারের অনুষ্ঠান, নারীবাদীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, সব সম্ভাবনা, সব সমর্থন ছেড়ে, ইয়াসমিন,সুহৃদ যে দুজন আমার জীবনের একমাত্র আত্মীয় তাদেরও ছেড়ে, নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের রবার্ট কুইন, দীর্ঘকালের বন্ধু ওয়ারেন অ্যালেন স্মিথ, মেরেডিথ ট্যাক্স সবাইকে ছেড়ে, সুন্দর এই প্রকৃতি ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই ভারতে, যে ভারত আমাকে চিঠি দিয়েছে যে আর আমার ভিসা বাড়ানো হবে না। এ আমি মেনে নিচ্ছি না। বিদেশের কোনও ভারতীয় দূতাবাস ভারত সরকারের আদেশ ছাড়া আমাকে ভিসা দেবে না। সরকারই যদি সে আদেশ দেওয়ার হর্তাকর্তা, তবে আর ভারতের বাইরে থেকে ভিসা নিতে হবে কেন, ভেতর থেকেই তো নেওয়া সম্ভব। আর সয় না ভেতর বাহির। যে করেই হোক নিশ্চিন্তিবাস চাই জীবনে। অনেক তো হল। অকাতরে ছেড়ে আসতে পারি সব। জীবনে এক দেশ ছেড়ে আরেক দেশে গেছি অনেক। এক শহর ছেড়ে আরেক শহরে। এভাবেই এক ঠিকানার আশায় আশায় জীবন ফুরোয় আমার।

আগস্ট মাস অবদি আমার থাকার অনুমতি দিল্লিতে, ভিসা আমি বাইরে থেকে চাইবো না। একবার যদি আমার ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যায়, আমি আর নতুন কোনো ভিসা পাবো না। এ অনেকটা বাংলাদেশ বা পশ্চিমবঙ্গ থেকে যেমন বলা হয়েছিলো, তুমি যাও দেশের বাইরে, দু একদিন বা দু তিন মাস পর ফিরে এসো, তেমন সেই ফিরে আসা কোনওদিন আর হয়নি। সব বিদেয় ফিরে আসার জন্য নয়। অনেক বিদেয়-এর পর দরজা চিরতরে ভেতর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

শুনেছি বিদেশি কিছু লেখকও বিবৃতি দিয়েছেন আমার ভারত বাসের অধিকার নিয়ে। ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছেন আমাকে যেন ভারতে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। একদিন সুইডিশ দূতাবাসে গেছি নতুন পাসপোর্ট করতে, কারণ অতি ভ্রমণে পাসপোর্ট সিলে সিলে একাকার, এক বিন্দু জায়গা নেই ভিসার সিলের। ওই দূতাবাসেই শুনলাম দিল্লির কয়েকটি বিদেশি দূতাবাস থেকে লোক যাচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কারও সঙ্গে দেখা করতে, আমাকে যেন থাকতে দেওয়া হয় দিল্লিতে, এই আবেদন নিয়ে। মন ভালো হয়ে ওঠে। কোনও ভালো খবর পেলে লোকে বলে, ‘তাহলে বলতে হয় ঈশ্বর আছেন’, আমি তা বলি না, আমি বলি, তাহলে ভালো মানুষ পৃথিবীতে এখনো আছেন। এখনও মানুষ আছেন, যাঁরা মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন, এখনও তবে পৃথিবীটা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়নি। তারা ঠিক কারা আমি জানি না, যারা আমাকে ভারত ছাড়া করার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, যারা আমাকে ছ’মাস নয়, পুরো এক বছরের ভিসা দিয়েছেন, এবং প্রতি বছর দিয়ে যাবেন। মন কৃতজ্ঞতায় ভরে যায় আড়ালের সেই মানববাদী, মত প্রকাশে বিশ্বাসী মানুষের প্রতি। আমি ভারতের নাগরিক নই, আমাকে যদি থাকতে না দেওয়া হত, কার কী বলার ছিল, আমাকে যদি ভিসা একেবারেই না দেওয়া হত, ভিসা পাওয়ার কোনো ক্ষমতাই তো আমার ছিল না। আমাকে যদি নিরাপত্তা না দেওয়া হত, কী-ই বা করার থাকতো আমার! মোদ্দা কথা, কিছুই না। আমি অতি নিরীহ প্রাণী, লেখার জোর ছাড়া আর সত্য কথা বলার জোর ছাড়া আর কিছুর জোর নেই আমার। এই পুরুষতান্ত্রিক পৃথিবীতে নারীর অধিকারের জন্য লেখার মাধ্যমে লড়াই চালিয়ে যাওয়া বড় সেকেলে জিনিস। বেশির ভাগ নারী পুরুষ নারীবাদ বিষয়টিকেই ভালো চোখে দেখে না। তারা বিশ্বাস করে সমাজে নারী পুরুষের সমতা পুরোপুরিই প্রতিষ্ঠিত, শুধু গোটা কয় বর্বর অশিক্ষিত লোক কদাচিৎ নারীকে অসম্মান করে।

ভারতবাসের শর্তহীনঅনুমতি শেষ অবদি জোটেবটে ২০১০ সালের শেষে, তবেইতিমধ্যেই আমি উপমহাদেশের সাহিত্য জগতে নিষিদ্ধ একটি নাম। কোনও বাংলা পত্রিকায় আমার লেখা ছাপা হয় না। বাংলাদেশের কথা বাদই দিলাম, ওরা বন্ধ করেছে সতেরো বছর আগে। পশ্চিমবঙ্গ অনুসরণ করেছে বাংলাদেশের পদাঙ্ক। দৈনিক স্টেটসম্যান বন্ধ করে দিয়েছে আমার লেখা ছাপানো, যদিও আমার লেখা ভীষণই জনপ্রিয় ছিল। আনন্দবাজার, দেশ, প্রতিদিন, রোববার ইত্যাদি ম্যাগাজিন এবং পত্রিকায় আমি নিষিদ্ধ নাম। রোববারের সম্পাদক ঋতুপর্ণ ঘোষ খুব ঘোষণা দিয়ে আমার লেখা ছাপাতে শুরু করেছিল। একটি লেখা ছাপা হওয়ার পর বন্ধ করে দিল ছাপানো। ওপর থেকে শুনেছি নির্দেশ আসে আমাকে বাতিল করার। এরপর দিল্লির ‘জনসত্তা’ নামের একটি হিন্দি দৈনিকে লিখতে শুরু করলাম, কর্ণাটকে আমার লেখা নিয়ে দাঙ্গা হওয়ার পর সেখানেও বন্ধ করে দেওয়া হল কিছুদিন পর। সবাই পিছিয়ে যায়। সবার কাছেই ওপর থেকে আদেশ আসে আমাকে বন্ধ করার। বই ছাপানোও বন্ধ করেছে প্রায় সব প্রকাশক। কারণ কি এই যে আমার বই বিক্রি হয় না, বা দৈনিকে সাপ্তাহিকে আমার লেখা কেউ পড়ে না? মোটেও তা নয়। লেখা ছাপালে কাগজ বেশি বিক্রি হয়, বই ছাপালে বই বেস্ট সেলার হয়। বোম্বের বিখ্যাত ‘ব্যাগ ফিল্মস’ আমার ‘ফরাসি প্রেমিক’ উপন্যাসের ফিল্ম রাইটস কিনেও ছবি বানায়নি। নামি পরিচালক মহেশ ভাট আমাকে নিয়ে ছবি বানাচ্ছেন, চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করেছেন ঘোষণা দিয়েও চুপ হয়ে যান। ইউটিভির মতো বড় প্রডাকশান কোম্পানিকেও আমার ওপর ছবি বানানো শুরু করেও অজ্ঞাত কারণে বন্ধ করে দিতে হয়। কলকাতায় আমার গল্প নিয়ে মেগাসিরিয়ালের একশ এপিসোড সুটিং করার পরও টেলিভিশনে প্রচার করা বন্ধ করে দিতে হয়। সম্প্রতি কলকাতার তিনজন পরিচালক আমার জীবন এবং আমার উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র। নির্মাণের সব পাকা কথা হয়ে যাওয়ার পর, চুক্তিপত্রে সই নিয়ে যাওয়ার পরও ছবি বানানো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলেন। একটা কালো হাত আমার সমস্ত কিছুর ওপর থাবা বসাচ্ছে। একটা অদৃশ্য হাত। একটা ভুতুড়ে হাত। আমার শিরদাঁড়ায় ঠাণ্ডা ভয় বইতে থাকে। কণ্ঠদেশ চেপে ধরে আমাকে মেরে ফেলবে না তো হঠাৎ একদিন!

শুধু লেখাই বন্ধ হয়নি, বেশিরভাগ বন্ধুও যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। ভারতবর্ষে আমি একা। একটি বিন্দুর মতো একা। কোনো লেখক বিনা দোষে এমন নিষিদ্ধ হয়েছে। পৃথিবীর কোথাও? হয়তা গ্যালিলিও হয়েছিলেন প্রায় চারশ’ বছর আগে। মাঝে মাঝে আমার অবাক লাগে ভাবতে আমি বাস করছি একুশ শতকের পৃথিবীতে।

দিল্লিতে থাকার স্বপ্ন তো কোনোদিন আমি দেখিনি। কলকাতায় বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতির মধ্যে যতদিন না যেতে পারি, বা বাংলাদেশে, আমার দেশে, যতদিন না যেতে পারি, আমি শান্তি পাবোনা। এ ঠিক আমার ব্যক্তিগত বাসের জন্য নয়। হয়তো অধিকার পেলে আমি বাংলায় বাসও করবো না। কিন্তু বাস করার অধিকারের জন্য চেঁচিয়ে যাবো।

বাকস্বাধীনতার জন্য এ আমার লড়াই। যেসব দেশ আমাকে তাড়িয়েছে মৌলবাদীর মতের চেয়ে ভিন্ন কোনো মত তারা সইবে না বলে, সে দেশ বা সে অঞ্চলে আমার প্রবেশাধিকার যদি না হয়, তবে সে দেশ মৌলবাদীদের অসহিষ্ণুতাকে জয়ী করে তুলবে। এ আমার একার সুখ স্বস্তির চেয়ে বড় কিছু। যদিও লড়াই করছি আমি, একটি বিন্দুর মতো একা আমি, কিন্তু এ ছোট কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য মোটেই নয়, আরও বড় স্বার্থে। আমি হয়েছি, হয়েছি, পৃথিবীর আর কোনোমানুষই যেন নিজের মত প্রকাশের কারণে কোনওদিন নির্বাসন, নিষেধাজ্ঞা, নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদির শিকার না হয়।

দিল্লিতে ধু ধু নিঃসঙ্গতা। শুধু বেড়ালটিই সঙ্গ দেয়। এই একটি প্রাণীর গোটা জীবন আমার ওপর নির্ভরশীল। আর কারও জীবন সম্পূর্ণ আমার ওপর নির্ভর করছে না। একে দিল্লিতে রেখে আমাকে প্রতি মাসেই বিদেশ ভ্রমণ করতে হয়। আসলে যে অনুষ্ঠানগুলোয় অংশ না নিলে চলে না সেগুলোতেই যাই। বাকিগুলো ফিরিয়ে দিই। বেলজিয়ামের বিশ্ববিদ্যালয় ডক্টরেট দেবে, প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ও দেবে ডক্টরেট, পশ্চিমের অনেকগুলো সিটি সাম্মানিক নাগরিকত্ব দেবে, ইওরোপিয়ান পার্লামেন্টে বক্তৃতা করতে হবে মানবাধিকার নিয়ে, নরওয়েতে হিউম্যানিস্ট কংগ্রেস। যেতেই হয়। যতটা কম সময় থাকা সম্ভব, ততটা সময় থেকেই উড়ে আসি। ঘন ঘন ফিরে আসি বেড়ালের কাছে। ও একা আছে বলে। কী অসাধারণ এক ভালোবাসা গড়ে উঠেছে আমাদের মধ্যে। কে বলেছে, বেড়ালরা খুব স্বার্থপর, কাউকে ভালোবাসে না। মিনু ঠিক ভালো বাসে। ভীষণই বাসে। আর কেউ না বুঝুক, আমি বুঝি। ওর সঙ্গে দিন রাত ওই ভালোবাসা নিয়েই নিভৃতে কথা হয়। ভারতের ধনী লোকেরা কুকুর পোষে, কিন্তু বেড়াল নয়। বেড়ালে ভয়। বেড়ালে কুসংস্কার। বেড়াল দেখাশোনা করার তাই কেউ নেই দিল্লিতে। কলকাতাতেও ছিল না। কিন্তু কাউকে কাউকে শিখিয়ে পড়িয়ে তবেই ওদের কাছে বেড়াল রেখে যেতাম। দিল্লিতে কাউকে শেখাবো, সে সুযোগও নেই। বর্ধমান থেকে জয়প্রকাশ আগরওয়াল আসেন আমার অনুপস্থিতির দিনগুলোতে বেড়ালের দেখাশোনা করতে। কিন্তু বেড়ালের সঙ্গে তার কেবল তিক্ত সম্পর্কই গড়ে ওঠে। বেড়াল নিয়ে যত কুসংস্কার আছে ভারতে, তার বেশির ভাগই হয়তো তিনি বিশ্বাস করেন। দিল্লির কাউকে বেড়াল দেখাশোনা করার কথা বলা হয় না। দিল্লির কারও সঙ্গে পরিচয় নেই এমন নয়। কিন্তু পরিচয়গুলো বন্ধু বা বন্ধুমতো কোনো সম্পর্কে গড়াতে যা যা হওয়া উচিত তা হয়ে ওঠে না। আমারই আলস্য নাকি ওদের, কে জানে। কলকাতায় আমার এই আলস্য নিয়েই বন্ধু এবং বন্ধুমতো অনেকে গড়ে উঠেছিলো। ক্রমশ এক-ঘরের মানুষ হয়ে উঠি, চাই বা না চাই। জগতের মধ্যে আরেক জগৎ। আমার একার নিভৃত জগৎ।

ভারতীয় উপমহাদেশে জন্ম আমার। অথচ এখানেই মুখ খোলা নিষেধ, আমাকে মুখ খুলতে হয় ইওরোপ আর আমেরিকায়। ওখানেই আমি আমার বিশ্বাসের কথা বলতে পারি। ওখানেই আজ্ঞা আলোচনা মত প্রকাশ। অবশ্য সব ধর্ম নিয়ে পশ্চিমের আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলোতেও আজকাল নির্ভয়ে আর নির্বিঘ্নে নিজের মত প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

বক্তৃতার সময় আমার নিরাপত্তার জন্য পুলিশ থাকে, হয় মঞ্চে, নয়তো মঞ্চের ঠিক নিচে। পৃথিবী ক্রমশ অনিরাপদ হয়ে উঠছে। অসহিষ্ণু মানুষ আজকাল পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত বিচরণ করছে। শুধু একবারই আমি পশ্চিমের মেইনস্ট্রিম সোসাইটির বাইরের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম, সেদিন মঞ্চ থেকে নেমে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম আমি। আমেরিকার প্রবাসী বাঙালি হিন্দুরা প্রতি বছর বঙ্গ সম্মেলনের আয়োজন করে, সেই সম্মেলনের মঞ্চ থেকে। বঙ্গ সম্মেলনে আমার যাওয়ার কোনও ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু আয়োজকদের অতি অনুরোধে রাজি হয়েছিলাম। আর যখন কি না আমেরিকার বিদেশ নীতির, বিশেষ করে যত্রতত্র যুদ্ধ বাধানোর নিন্দে করে কবিতা পড়ছিলাম, ম্যাডিসন স্কোয়ারের পনেরো হাজার বাঙালির মধ্যে একটি প্রভুভক্ত, যুদ্ধপ্রেমী অংশ হৈ চৈ করে আমাকে থামিয়ে দিল। হ্যাঁ, মুশকিল সেসব জায়গায় হয়ই, যেসব জায়গায় আমার একমাত্র পরিচয় ‘ইসলামবিরোধী’, এবং আমার ‘ইসলাম বিরোধিতা’র গল্পই তারা চায় শুনতে। কিন্তু যদি জানে যে আমি আসলে আরও অনেক কিছুর বিরোধী, মুসলমানরা যে যুদ্ধে মরছে, সেই যুদ্ধেরও বিরোধী, তখনই শুনি দূর হ, দুর হআওয়াজ। যখনই পৃথিবীকে সুন্দর করার স্বপ্ন নিয়ে মানবতার বিরুদ্ধে ঘটতে থাকা সব কিছুরই সমালোচনা করছি, তখনই ক্ষুদ্র মানুষের সঙ্গে সংঘাত ঘটে। ক্ষুদ্র মানুষের ভিড় থেকে দূরে সরি, সরতে সরতে বুঝি আমি একঘরে, আমি আলাদা, আমি একা, আমাকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছে অন্যরা। বড় মানুষ আছে পৃথিবীতে তবে তাদের সঙ্গে হয় আমার দেখা হয় না, অথবা দেখা হয়, তবে খুব কম হয়।

এদিকে ভিকিলিকস খবর ফাঁস করলো আমার বিষয়ে। ভারতের আমেরিকান দূতাবাস থেকে আমেরিকার সরকারের কাছে পাঠানো তথ্য ফাঁস হয়ে যাচ্ছে আজকাল। Author Taslima Nasreen; Pawn In Political web নামে ২৮ নভেম্বর ২০০৭ তারিখে পাঠানো তারের দুটো টুকরো এমন

11. (SBU) After Nandigram, Nasreen represented a convenient foil for both the CPM and fundamentalist Muslim leaders in Kolkata. From their actions (or lack thereof), it is clear

NEW DELHI 00005119 003 OF 003

India’s main political parties could not care less about Nasreen or her writ ing beyond how their parties’ reactions to events play to voters. Not wanting to offend the Muslim vote bank, neither Congress nor CPM has officially support ed an extension of Nasreen’s visa. Both parties want the situation to go away. The BJP will ensure that will not happen by raising the issue in Parliament to bat ter both the CPM and Congress and to burnish their own tarnished secular cre dentials. The BJP has seized the high ground and will milk the controversy for all its worth. For Taslima, the last week has been chaotic, but will no doubt provide ample material for her next book. As for the CPM, the public are increasingly aware that their lofty rhetoric about looking out for the little guy rings hollow, since they have stooped recently not only to kill peasants at Nandigram but to abandon a female author in order to pander to vote banks. Surely they could have found space for one woman in a teeming city of 16 million? MULFORD.

12. (SBU) Comment: Even though few in the Indian Muslim community are familiar with Nasreen’s work, there is a general sense amongst the Indian Mus lims community that her writings have somehow insulted or disparaged Islam. The Muslim groups’ public opposition is a reflection of this unhappiness with Nasreen. There are also politics at play. The Communist Party of India Marx ist (CPM) had originally driven Nasreen out of Kolkata to divert attention from the CPM’s central role in the Nandigram violence, as well as to win favor from Muslims who were the main victims of the Nandigram brutality (ref E). The Muslim groups have put pressure once again on the UPA government to act more decisively on Nasreen. Vote bank politics has been an important factor in the Nasreen controversy. India’s political parties are ready to use any tar get of opportunity available to pander to voting groups in preparation for the next national election, due before May 2009. The UPA’s hot-cold response in the Nasreen affair illustrates that the Congress Party, the original and still most prolific practitioner of vote bank pandering, is attempting to juggle its national image and the Muslim vote. End Comment. MULFORD

আর ওদিকে বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জয় গোস্বামী কবিতার বই ২০০৭”আমার শ্যামশ্রী ইচ্ছে, স্বাগতা ইচ্ছেগুলি’ তো উৎসর্গ করলেনই আমাকে, আমাদের সময়ের উজ্জ্বল ফলক তসলিমা নাসরিনকে’ লিখে, একটি কবিতাও লিখলেন, ‘আমাদের কাউকে যদি তোমার লড়াই লড়তে হত?/দূরে দূরে, নিরাপদ আশ্রয়ে দাঁড়িয়ে/আমরা তোমার কত দোষ খুঁজে বার করলাম/আগুনের সামনে গিয়ে দেখলাম না আঙুলটি বাড়িয়ে/জানলায় দড়ির মই ঝোলানোই ছিল, কিন্তু তুমি/ বেরিয়ে আসার কোনো সুযোগ নিলে না/জ্বলন্ত বাড়ির মধ্যে থেকে যাওয়াটাই বেছে নিলে/ তোমার যুদ্ধের কাছে/আমার জীবন কিছু নয়। এখন আমার পিঠে ঠেকেছে দেওয়াল/এরপর বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে/আমার জীবনটি ওই ধানক্ষেতে ফেলে দিয়ে যাবে/নায়েব, গোমস্তা, লাঠিয়াল/না, আমি তোমার মতো/ ঘুরে পাল্টা লড়তে পারবো না/এমনকী অবস্থানটুকু/জানাতে যাবো না কাউকে পতাকা নাড়িয়ে/যদি বন্ধু মনে করো, শুধু এ শুভেচ্ছাটুকু দাও, সাহসিকা/অন্তত ঘাড় গুঁজে যেন মরতে পারি একা একা স্বধর্মে দাঁড়িয়ে।

২০০৭/২০০৮ সালে অনেকেই কবিতা লিখেছিলেন। বেশ কিছু বই আর ম্যাগাজিন বেরিয়েছিলো আমাকে কলকাতা ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মানুষের প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গল্প কবিতা ছাপিয়ে। মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন, দেওয়ালে পোস্টার সেঁটেছিলেন, আন্দোলন করেছিলেন, অনশন করেছিলেন। প্রতি বছর ২২ নভেম্বর তারিখে আমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বের করে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অনুষ্ঠান হয়। ধীরে ধীরে সেসব ফিকে হয়ে এলো। পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন হল। সিপিএম-এর চৌত্রিশ বছর শাসন গেল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক বিজয় হল। কিন্তু দু’একজন কাছের মানুষ ছাড়া কেউ আর আমার প্রসঙ্গ তোলে না। যেন আমি বলে কিছু আর বেঁচে নেই কোথাও। আমার আর বাংলায় ফেরা জরুরি। নয়। যেন এক বাঙালি লেখককে বাংলা থেকে নির্বাসনদণ্ড দেওয়ার ঘটনাটি ইতিহাসের পাতা থেকে দিব্যি মুছে দেওয়া গেল।

কোটি কোটি বছর আগে জন্ম নেওয়া বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোটি কোটি নক্ষত্র আর গ্রহের ভিড়ে পৃথিবী নামক গ্রহের অস্তিত্বই ক্ষণস্থায়ী, এই গ্রহে মানুষ নামের প্রজাতির বিচরণ আর এর নির্মূল হয়ে যাওয়ার ঘটনাও নিতান্তই তুচ্ছ ঘটনা। মানুষের গোটা ইতিহাসও হয়তো কিছুই না, কিছুই না, কিছুই না। ব্রহ্মাণ্ডে কে আর কোথায় আছে মানুষের ইতিহাস খুঁড়ে .দেখতে যাবে। এখনও বেঁচে আছি বিরুদ্ধ স্রোতে, এই তো বেশি।

Exit mobile version