নাহ। এড়িয়ে যাবো কেন?
কোথায় ছিলে কাল রাতে বললে না যে!
বললাম তো ছিলাম!
কোথায়? কোনও বন্ধুর বাড়ি?
না।
কোনও আড্ডায়?
না।
তবে?
রুদ্র চপু করে থাকে, তার মৌনতা ক্রমে অসহ্য হয়ে আমাকে মর্মন্তুদ বেদনায় মন্থর করে। শ্বাস-কষ্ট হতে থাকে। রুদ্র তুমি বলে ফেলো, বলে ফেললে আমার কষ্ট যাবে। কিন্তু সে কি যায়! সে তো আরও বাড়ে। রুদ্র বলে সে নারায়ণ গঞ্জ ছিল। নারায়ণ গঞ্জ কেন, কোনও বন্ধু থাকে ওখানে? না। কেন গিয়েছো তবে? কার সঙ্গে গিয়েছো? একা। কার কাছে? কারও কাছে নয়। কোথায় ছিলে রাতে? টানবাজারে। রুদ্রর ভাষাহীন দুটো চোখ আমার চোখে পড়ে থাকে। হৃদপিণ্ডের ধুকপুক শব্দ শুনি। নারায়ণগঞ্জের টানবাজার দেশের সবচেয়ে বড় পতিতালয়, রুদ্র কি আমাকে বলতে চায় সে গেছে টানবাজার পতিতালয়ে রাত কাটাতে! না রুদ্র তুমি আর যা কিছুই বল, এ কথাটি বোলো না। ওখানে সারারাত তুমি কোনও চায়ের দোকানে, মদের দোকানে অথবা রাস্তায় ফুটপাতে গাছের তলে সারারাত শুয়েছিলে, এরকম কিছু বল। আমার চোখে আকুতি। কিন্তু রুদ্র বলে, টানবাজারে সে রাত কাটিয়েছে এক পতিতার ঘরে। আমার চোখে আকুলতা, পতিতা তো মানুষই রুদ্র, তোমার মায়ের মত, বোনের মত। বল যে তোমার ক্ষিদে পেয়েছে বলে পতিতাটি তোমাকে খেতে দিয়েছে, এত ঘুম পাচ্ছিল নেশা করে যে তুমি খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লে। বল যে সারারাত বেঘোরে ঘুমিয়ে তুমি উঠে এসেছো। বল যে স্পর্শ করনি অন্য কারও শরীর। সেই যে কথা দিয়েছিলে স্পর্শ করবে না, বল যে তুমি তোমার কথা রেখেছো। বল যে কেবল এ ঠোঁটেই তুমি কেবল চুমু খাও, অন্য ঠোঁটে নয়। বল অন্য কোনও শরীরের জন্য তুমি তৃষ্ণাতর্ হও না। রুদ্র আমার চোখের ভাষা পড়তে পারে না, পতিতার সঙ্গে তার যৌনসম্পর্কের কথা বলে । আমার দিকে এক জগত অন্ধকার ছুঁড়ে দিয়ে বলে যায়। আমি স্তব্ধ বসে থাকি। শ্বাসের জন্য কোনও হাওয়া পাই না। সাজানো ঘরটি দেখি, রুদ্রকে দেখি, আমার সংসার দেখি। ভেঙে যাওয়া বিশ্বাস অল্প অল্প করে জোড়া দিয়ে জীবন শুরু করেছিলাম আবার। হায় জীবন! যেন এ সংসার নয়, আস্ত একটি শ্মশান। শ্মশান জুড়ে মৃত মানুষের মত শুয়ে থাকি। আমি পুড়ছি, পুড়ে ছাই হচ্ছি। কিন্তু একটি শক্তি আমি হঠাৎই অর্জন করি নিজের ভেতর। সেই শক্তি আমাকে দাউ দাউ আগুন থেকে টেনে সরায়, আমার অস্তিত্বের অবশিষ্টটুকু বাঁচায়। পতিতার শরীর থেকে আনা রসগন্ধ ধুয়ে ফেলা রুদ্র লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। দুপুরে খেয়ে খানিকক্ষণ ঘুমোয় সে, এ তার স্বভাব। ঘুমিয়ে উঠে বিকেলে বাইরে বেরোবে। রাতে পেট ভরে মদ খাবে। রাতে হাতের কাছে আমি থাকলে আমার শরীরে, তা না হলে অন্য যে কোনও নারী- শরীরে উপগত হবে। রুদ্রর প্রতিদিনকার জীবনে কোনও এক বিন্দু এদিক ওদিক হবে না। একরত্তি না। আমার জন্য তার স্বভাবের এতটুকু বদল হবে না। নিজেকে ধিক্কার দিই। সেই ফুলশয্যার রাতেই তো তাকে আমার ত্যাগ করা উচিত ছিল, কি দরকার ছিল এতগুলো বছর এই প্রেম বয়ে বেড়ানো! একবার যে মানুষ বিশ্বাস ভাঙে, সে সবসময়ই ভাঙে। ভাঙাই তার স্বভাব। ভাঙাই তার নেশা।
নিরুত্তাপ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করি, তালাক দিতে হলে কি করতে হয়?
ভাঙা গলায় বলে রুদ্র, উকিলের কাছে যেতে হয়, কি কারণ সম্পর্কে ভাঙার, এসব বলতে হয়। নানান ঝামেলা। লক্ষ করি, আগের বারের মত আমি কাঁদছি না। এক ফোঁটা জল নেই চোখে। স্তব্ধতার ভেতর থেকে একটি পাথুরে কন্ঠ, উকিলের বাড়ি কোথায় বল, যাব আমি, আজই। কেবল আমি কেন, তুমিও চল। তুমিতো বেশ ভাল করেই জানো আমাদের এই সম্পর্কটির কোনও অর্থ নেই। সুতরাং এ আমার আর রাগ করে তোমাকে ত্যাগ করা নয়। চল দুজনই কাজটি করি। সম্পর্কটি ছিন্ন করি। আর বিশ্বাস কর, আমার একেবারেই মনে হচ্ছে না যে তুমি অন্য মেয়ের সঙ্গে শুয়েছো বলে আমাদের সম্পর্কে শেষ হওয়া উচিত। সম্পর্কটি শেষ হওয়া উচিত, তুমি আমাকে ভাল বাসো না বলে।
ভাল তোমাকে আমি বাসি। রুদ্র জোর দিয়ে বলে।
যে ভালবাসায় বিশ্বাস নেই!
বিশ্বাস আমি তোমাকে করি।
তুমি কর আমাকে। কিন্তু আমার বিশ্বাসের কথা ভেবেছো? আমার জায়গায় তুমি হলে কি করতে? বিশ্বাস না থাকলে কি ভালবাসা যায়!
শিল্পের মানুষদের একটু এরকম হয়ই। শিল্পের মানুষেরা সমাজের সব নিয়ম কানুন মেনে চলে না। তোমার তা বোঝা উচিত। আমি শিল্পের মানুষ জেনেই তো আমাকে বিয়ে করেছো। তবে আর এত প্রশ্ন করো কেন?
সমাজের নিয়ম কানুনের কথা হচ্ছে না। ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে জরুরি যে জিনিস, সেই বিশ্বাসের কথা হচ্ছে।
আমি হেসে উঠি। হাসতে হাসতে বলি, শিল্পের মানুষ হলে সাত খুন মাপ তাই না! শিল্পের মানুষ বলে যা কিছু করার স্বাধীনতা তোমার আছে। শিল্পের মানুষ না হলে বুঝি নেই!আমিও তো কবিতা লিখি, তাই বলে আমিও তাই তাই করতে পারব যা তুমি কর? নাকি আমার সেই স্বাধীনতা নেই যেহেতু আমি ভাল কবিতা লিখি না? যেহেতু তুমি ভাল লেখো, তুমি পারো! নাকি তুমি পুরুষ হয়েছো বলে পারো। আমি মেয়ে বলে আমার সে স্বাধীনতা থাকতে নেই?
রুদ্র চপু করে থাকে। অনেকক্ষণ সে চেয়ে থাকে জানালায়, একটি উঁচু দেয়াল ছাড়া আর কিছু নেই সামনে। শাদা চুনকাম করা একটি দেয়াল শুধু আমি রুদ্রর চোখে চেয়ে থাকি। অনেককক্ষণ ওভাবেই দেয়ালে চেয়ে থেকে সে বলে, শেষবারের মত ক্ষমা করতে পারো না?