Site icon BnBoi.Com

প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ – ইমদাদুল হক মিলন

Imdadul Haq Milan

০১. হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে যেদিন পরিচয় হলো

হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে যেদিন পরিচয় হলো সেদিন আমার মাথা ন্যাড়া।

জীবনে দুবার ন্যাড়া হওয়ার কথা আমার মনে আছে। একবার একাত্তরের মাঝামাঝি, আরেকবার তিরাশির শুরুর দিকে। দুবারই মন ভালো ছিল না।

একাত্তরে আমি এসএসসি ক্যান্ডিডেট। আমাদের বয়সী ছেলেরাও মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছে। এ কারণে বাবা আমাকে বাড়ি থেকে বেরোতে নিষেধ করে দিলেন। দুঃখে। আমি ন্যাড়া হয়ে গেলাম। ন্যাড়া মাথা নিয়ে রাস্তায় বেরোতে লজা করবে, ফলে বাড়ি থেকে বেরোনো হবে না।

সত্যি তা-ই হয়েছিল। ন্যাড়া মাথার কারণে একাত্তরের সময় অনেক দিন আমি বাড়ি থেকেই বেরোই নি। তিরাশি সালে সেই স্মৃতি মনে করেই ন্যাড়া হয়েছিলাম।

আমার তখন রুজি-রোজগার নেই।

একাশির অক্টোবরে জার্মানি থেকে ফিরে রোববার পত্রিকায় জয়েন করেছি। ইত্তেফাক-এর সামনে দিন-দুপুরে ট্রাকের তলায় এক পথচারীকে থেতলে যেতে দেখে রোববার-এ একটা রিপোর্ট লিখলাম, সেই রিপোর্টে বিশেষ একটি মন্তব্য করায় চাকরি চলে গেল। তারপর বন্ধুদের সঙ্গে দোয়েল নামে একটা অ্যাডফার্ম করলাম। এক-দেড় বছরের মাথায় সেটাও বন্ধ হয়ে গেল।

তত দিনে বিয়ে করে ফেলেছি। কিন্তু পকেটে দশটি টাকাও নেই। এ অবস্থায় সিদ্ধান্ত নিলাম, সমরেশ বসু হয়ে যাব। লিখে জীবন ধারণ করব। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে সে যে কী কঠিন কাজ, আজকের কোনো তরুণ লেখক ভাবতেই পারবেন না।

তখন একটা গল্প লিখে পঞ্চাশ-এক শ টাকা পাই। ঈদ সংখ্যার উপন্যাসের জন্য পাঁচ শ-এক হাজার। তাও পেতে সময় লাগে তিন-চার মাস। লেখার জায়গায়ও কম। এত পত্রপত্রিকা তখন ছিল না। দৈনিক পত্রিকায় উপন্যাস ছাপার নিয়ম ছিল না।

কঠিন সময়।

দু-চারটা বই ততদিনে বেরিয়েছে, সেগুলোর অবস্থাও ভালো না। পাবলিশাররা টাকাই দিতে চায় না। একটা বিখ্যাত প্রকাশন সংস্থা তো অভাবী লেখক দেখে ষোল শ টাকায় আমার দুটি বইয়ের গ্ৰন্থস্বত্বই কিনে নিয়েছিল। প্রথম প্রকাশিত বইয়ের জন্য আমি কোনো টাকাই পাই নি। এ অবস্থায় লিখে জীবন ধারণ! সত্যি, সাহস ছিল আমার!

সেইসব দিনের কথা ভাবলে এখনো বুক কাঁপে।

যা হোক, লিখে জীবন ধারণ মানে প্রতিদিন দিস্তা দিস্তা লেখা। লেখার জন্য সময় দেওয়া এবং ঘরে থাকা। কিন্তু সারা দিন ঘরে আমার মন বসবে কেমন করে! যখন-তখন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা না দিলে আমার পেটের ভাত হজম হয় না। তখনই একাত্তরের ন্যাড়া হওয়ার স্মৃতি মনে এসেছিল। ন্যাড়া হয়ে গেলাম। ন্যাড়া মাথা নিয়ে সারা দিন ঘরে বসে উন্মাদের মতো লিখি। লেখার কষ্ট দেখে জ্যোৎস্না একদিন আমার ন্যাড়া মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেছিল, সাধ্য থাকলে তোমার লেখাগুলো আমি লিখে দিতাম।

সেবারের বাংলা একাডেমী বইমেলায় তিন-চারটা বই বেরোলো। কালোঘোড়া, তাহারা ইত্যাদি। বইয়ের বিক্রি বাড়াবার জন্য লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে ন্যাড়া মাথা নিয়েই মেলায় যাই। আমার অবস্থা যে বেশ ভালো তা বোঝাবার জন্য জার্মানি থেকে আনা জিনস-কেডস আর একেক দিন একেকটা শার্ট পরি। জ্যোৎস্নার মোটা ধরনের একটা সোনার চেন পরে রাখি গলায়। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমার অবস্থা তখন উপরে ফিটফাট, ভিতরে সদরঘাট। পকেটে সিগ্রেট খাওয়ার পয়সা পর্যন্ত থাকে না।

বইমেলায় এক বিকেলে নওরোজ কিতাবিস্তানে বসে আছি। প্রতিষ্ঠানটি তখনো ভাগ হয় নি। আমার তাহারা বইটি হাতে নিয়ে চশমা পরা, রোগা, দেখলেই মেধাবী এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন মনে হয়, এমন একজন মানুষ সামনে এসে দাঁড়ালেন। অটোগ্রাফ।

মুখের দিকে তাকিয়ে দিশেহারা হয়ে গেলাম। নিজের অজান্তে উঠে দাঁড়ালাম। মুখটি আমার চেনা। ছবি দেখেছি। হুমায়ূন আহমেদ।

তখন পর্যন্ত খান ব্রাদার্স থেকে তাঁর তিনটি বই বেরিয়েছে। নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার আর বাংলাদেশের প্রথম সায়েন্স ফিকশন তোমাদের জন্য ভালবাসা। তিনটি বইয়ের কোনো-একটির ব্যাক কাভারে পাসপোর্ট সাইজের ছবিও আছে। আর কে না জানে, স্বাধীনতার পর পর নন্দিত নরকে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাস। আহমদ শরীফ, শওকত আলী, আহমদ ছফা-এই সব শ্ৰদ্ধেয় মানুষ উপন্যাসটির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সনাতন পাঠক ছদ্মনামের আড়ালে বসে তখনই বিখ্যাত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় দেশ পত্রিকায় নন্দিত নরকের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন।

তিয়াত্তর-চুয়াত্তর সালের কথা। আমি জগন্নাথ কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ি। লেখার পোকা মাত্র মাথায় ঢুকেছে। আমার বন্ধু কামালের বন্ধু হচ্ছে খান ব্রাদার্সের মালিকের ছেলে ফেরদৌস। তার কাছ থেকে নন্দিত নরকে এবং শঙ্খনীল কারাগার জোগাড় করে আনল কামাল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই বই পড়লাম আমরা। পড়ে মুগ্ধ এবং বিস্মিত!

এমন লেখাও হয়! এত সহজ-সরল ভাষায়, এমন ভঙ্গিমায়, মধ্যবিত্ত জীবনের সামান্য ঘটনাকে এমন অসামান্য করে তোলা যায়!

সেই প্রথম হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে একটা ঘোর তৈরি হলো আমার। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশ, কত নতুন নতুন লেখক লিখতে শুরু করেছেন, এমনকি আমাদের প্ৰবীণ লেখকরাও নতুন লেখকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লিখছেন, কিন্তু বেশির ভাগ লেখকেরই লেখা আমি বুঝতে পারি না। ভাষার কারুকার্যে অযথাই জটিল। গল্পে গল্প খুঁজে পাওয়া যায় না। কায়দা-সর্বস্ব।

এ অবস্থায় দু-তিন বছরের মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে আরও দু-তিনটি লেখা পড়লাম হুমায়ূন আহমেদের। জনাক্তক কিংবা এ ধরনের কোনো একটি লিটল ম্যাগাজিনে পড়লাম নিশিকাব্য নামে এক আশ্চৰ্য সুন্দর গল্প। বাংলাবাজার থেকে জোনাকী নামে উল্টোরথ টাইপের একটি সিনেমা পত্রিকা বেরোত, সেই পত্রিকার কোনো-এক বিশেষ সংখ্যায় পড়লাম সূর্যের দিন।

এই সূর্যের দিনই পরে শ্যামল ছায়া নামে বই হয়। যদিও সূর্যের দিন নামে পরে অন্য আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদ।

যা হোক বিচিত্রার ঈদ সংখ্যায় সে সময় উপন্যাস লিখলেন হুমায়ূন আহমেদ। নির্বািসন। বুক হু হু করা এক প্রেমের উপন্যাস। তারও পর লিখলেন অন্যদিন। এইসব লেখা পড়ে আমি বুঝে গেলাম, লেখা এমনই হওয়া উচিত। সাদামাটা নিজস্ব ভাষায়, নিজের মতো করে জীবনের কথা বলে যাওয়া, যা প্রত্যেক মানুষকে আলোড়িত করবে, দ্রুত পৌঁছাবে পাঠকের কাছে। বলতে দ্বিধা নেই, লেখায় সরলতার মন্ত্র আমি হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকেই পেয়েছিলাম।

কিন্তু বইমেলার সেই বিকেলের আগে তাঁকে কখনো চোখে দেখি নি। শুনেছি তিনি ছয় বছর ধরে আমেরিকায়, পলিমার কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করছেন। এদিকে বাজারে সম্ভবত চারটি মাত্র বই-নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, তোমাদের জন্য ভালবাসা আর নির্বাসন। সেই চারটি বইয়ের কল্যাণেই বিরাশি সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়ে গেছেন। পরে শুনেছি, আমেরিকায় বসে তিনি যখন বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাওয়ার কথা শুনলেন, শুনে তাঁর শিক্ষককে দিলেন খবরটা, আমেরিকান শিক্ষক হতভম্ব। তুমি কেমিস্ট্রির লোক, লিটারেচারে একাডেমী অ্যাওয়ার্ড পাও কী করে?

সেই শিক্ষক কি জানতেন, কালক্রমে বাংলা সাহিত্যের রসায়ন সম্পূর্ণ চলে আসবে হুমায়ূন আহমেদের হাতে! সাহিত্যের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদ। তিনি অবলীলায় ছেড়ে আসবেন!

মনে আছে, তিরাশির বইমেলায় খান ব্রাদার্স থেকে বেরিয়েছে তাঁর অন্যদিন উন্যাসটি। মাঝখানে ছয় বছর লেখালেখি করেন নি, তবু অন্যদিন খুব ভালো বিক্রি হচ্ছে। এ অবস্থায় তিনি এসেছেন আমার অটোগ্রাফ নিতে। একজন স্বপ্নের মানুষ এসে দাঁড়িয়ে আছেন সামনে। কিসের অটোগ্রাফ, আমি তাঁর পা ধরে সালাম করব কি না ভাবছি। কোনারকমে শুধু বলেছি, হুমায়ুন ভাই, আপনাকে আমি চিনি। তিনি বললেন, আমি আমেরিকায় বসে খবর পেয়েছি বাংলাদেশে ইমদাদুল হক মিলন নামে একটি ছেলে গল্প-উপন্যাস লিখে জনপ্রিয় হয়েছে। তুমি কী লেখ আমার একটু বোঝা দরকার।

সেদিনই সন্ধ্যার পর আমাকে তিনি তার ফ্ল্যাটে নিয়ে গেলেন। শ্যামলীতে এখন যেখানে শামসুর রাহমানের বাড়ি তার পেছন দিকে খোলা মতো মাঠ পেরিয়ে একটা বাড়ি। সেই বাড়ির দোতলা কিংবা তিনতলায় হুমায়ুন ভাইয়ের ফ্ল্যাট। খালান্মা, শাহিন, মানে আজকের বিখ্যাত সম্পাদক-কাটুনিস্ট এবং লেখক আহসান হাবিব, ছোটবোন, ভাবি, ফুটফুটে নোভা, শিলা, বিপাশা। বিপাশা তখন ভাবির কোলে। আর রফিকের মা নামে একজন বুয়া ছিল। পরবর্তী সময়ে এই বুয়াটির বহু মজার মজার আচরণ হুমায়ুন ভাইয়ের বিভিন্ন নাটকে হাসির উপাদান হয়ে এসেছে।

সেদিন আমার সঙ্গে আরও দুজন মানুষ গিয়েছিলেন হুমায়ূন ভাইয়ের ফ্ল্যাটে। দৈনিক বাংলার সালেহ চৌধুরী আর বাংলাদেশের প্রথম গ্রান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ।

সালেহ চৌধুরীকে হুমায়ূন ভাই ডাকতেন নানাজি, আর নিয়াজ মোরশেদের দাবার তিনি ভক্ত। নিয়াজের জন্য ভালো রান্নাবান্না হয়েছিল বাসায়। গুলতেকিনে ভাবি বেশ বড় সাইজের আস্ত একখানা ইলিশ মাছ ভেজে খুবই লোভনীয় ভঙ্গিতে সাজিয়ে রেখেছেন ট্রেতে। ইলিশটির ওপর ভাজা পেঁয়াজ ছড়ানো, চারপাশে চাক চাক করে কাটা টমেটো, শস্যা। ভাত-পোলাও দুটোই আছে, মাছ, মুরগি, সবজি, মিষ্টি-সব মিলিয়ে টেবিলভর্তি খাবার। নানাজি এবং নিয়াজ মোরশেদকে ভাবি চিনতেন। হুমায়ুন ভাই ভাবির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। ভাবি তাঁর স্বভাবসুলভ হাসিমুখে আমার দিকে তাকালেন, একটু বুঝি অবাকও হলেন। ন্যাড়া মাথা, গলায় সোনার চেন, পরনে জিনস-কেডস, এ কেমন লেখক!

সেই সন্ধ্যায় সেই যে হুমায়ূন আহমেদ পরিবারের সঙ্গে আমি মিশে গেলাম, আজও সে রকম মিলেমিশেই আছি। আমাদের কোথাও কোনো গ্যাপ হয় নি।

হুমায়ূন ভাই তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটির কেমিস্ট্রির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। ইউনিভার্সিটির কাজ সেরে শ্যামলীর ফ্ল্যাটে ফিরে যান, বিকেলবেলা আসেন ইউনিভার্সিটি টিচার্স ক্লাবে। সালেহ চৌধুরী আসেন, হুমায়ুন আজাদ আসেন, আমিও যাই। চা, সিগ্রেট, শিঙাড়া আর গল্পগুজব চলে।

সালেহ চৌধুরী গল্প শুরু করলে সহজে থামেন না। শুরুর আগেই হুমায়ুন আজাদ বলেন, কাহিনিটা কি খুব দীর্ঘ? দুজনের ছোটখাটো খুনসুটিও লাগে কোনো কোনো দিন। হুমায়ূন ভাই আর আমি চুপচাপ বসে থাকি।

হুমায়ুন ভাই চেয়ারে বসেন দু পা তুলে, আসনপিঁড়ি করে। সেই ভঙ্গিতে বসে মাথা নিচু করে চুপচাপ সিগ্রেট টানেন। তখন কথা বলতেন খুব কম। শুনতেন বেশি। আর আমি শুধু তাঁকে খেয়াল করি। পরিচয়ের দিন থেকে ব্যক্তি, মানুষটাকেও তাঁর লেখার মতোই নেশা ধরানো মনে হচ্ছিল আমার। আস্তে-ধীরে হুমায়ূন নেশায় আচ্ছন্ন হচ্ছিলাম আমি।

এ সময় হুমায়ূন ভাইয়ের একবার জন্ডিস হলো। পেঁপে নিয়ে আমি তাকে দেখতে গেছি। জন্ডিসভরা শরীর নিয়েও এমন মজাদার আড্ডা দিলেন তিনি, আমি হতভম্ব। সেদিন প্রথম টের পেলাম, হুমায়ূন আহমেদ পুরনো হতে জানেন না, তিনি প্রতিদিন নতুন। এমন ঠাট্টাপ্রিয় মানুষ আমি আর দেখি নি। অবলীলাক্রমে নিজেকে নিয়েও ভয়ানক ঠাট্টা করতে পারেন। আর অসম্ভব মেধাবী, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন, আগাগোড়া যুক্তিবাদী, সম্পূর্ণ স্মার্ট এবং ভয়াবহ শিক্ষিত। জানেন না এমন বিষয় পৃথিবীতে কম আছে। অদ্ভুত সব বিষয়ে আসক্তি। হিপনোটিজম শেখার জন্য আমেরিকা থেকে দুবার নোবেল প্রাইজ পাওয়া প্রফেসর ফাইনম্যানের বই আনলেন। অন্যদিন সম্পাদক মাজহারুল ইসলামকে হিপনোটাইজ করে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। ভূত, বিজ্ঞান, ধর্ম, ম্যাজিক, মানুষ আর মানুষের মনোজগৎ, সাহিত্য, গান, নাটক, সিনেমা, দাবা আর শিশু—এসব একত্রে ককটেল করলে যে জিনিসটা দাঁড়ায়, সেই জিনিসের নাম হুমায়ূন আহমেদ।

প্ৰচণ্ড শীতে নুহাশপল্লীতে শুটিং করতে এসেছে একটি গ্ৰাম্য মেয়ে। মা গেছে মেয়েটির জন্য শীতবস্ত্ৰ জোগাড় করতে। পাতলা জামা পরা মেয়েটি ঠকঠক করে শীতে কাঁপছে। আগুন জ্বেলে তার চারপাশে লোকজন নিয়ে বসে আছেন হুমায়ুন ভাই। মেয়েটিকে খেয়াল করছেন। আগুনের পাশে আসতে মেয়েটি একটু লজ্জা পাচ্ছে, কারণ এখানকার কাউকে সে চেনে না। এর পরও শীত সহ্য করতে না পেরে আস্তে ধীরে আগুনের পাশে এসে দাঁড়ায়। সেই তাপেও তার শীত মানে না। হুমায়ূন ভাই উঠে গিয়ে নিজের কম্বল এনে দেন মেয়েটিকে। তারপর জিজ্ঞেস করেন, তুমি চেন আমাকে? মেয়েটি তাঁর মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে বলে, মনে হয় আপনে হুমায়ূন আহমেদ। আপনেরে আমি চিনছি।

যখন মাথায় যা আসে। সেই কাজ না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তি নেই হুমায়ূন ভাইয়ের। মনে হলো নুহাশপল্লীতে একটা অ্যাকুরিয়াম থাকা দরকার। বিশাল এক অ্যাকুরিয়াম বসালেন সুইমিংপুলের পাশে। বিদেশি নানা ধরনের মাছের সঙ্গে দুটো দেশি সরপুটি, কয়েকটা ট্যাংড়া, ছোট সাইজের গোটা চারেক ফলি ছাড়লেন। আমরা গেছি নুহাশপল্লীতে, আর্কেটক্ট করিম ভাই গেছেন সস্ত্রীক, তাঁর বছর দু-আড়াইয়ের ছেলে রিয়াদকে নিয়ে অ্যাকুরিয়ামের পাশে গিয়ে বসে রইলেন হুমায়ূন ভাই। রিশাদ তাঁকে ডাকে হাদা, তিনিও রিশাদকে ডাকেন হাদা। দুজনে এমন ভঙ্গিতে গল্প জুড়ে দিল, দেখে করিম ভাই বললেন, দুটো শিশু গল্প করছে।

অনেক বছর আগের কথা! অবসর এবং প্রতীক প্ৰকাশনীর মালিক আলমগীর রহমান তখন গেণ্ডারিয়ার বাড়িতে থাকেন। তাঁর একমাত্র পুত্র প্রতীকের জন্মদিন। বেশ বড় আয়োজন করেছেন আলমগীর ভাই। বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হলেন হুমায়ুন ভাই, মুখে ভয়ংকর এক মুখোশ।

মাজহারের বছর দেড়েকের ছেলে অমিয় যখন-তখন এসে ওঠে হুমায়ুন ভাইয়ের কোলে। অমিয়র একমাত্র নেশা মোবাইল ফোন। মোবাইল দেখলে সে ধরবেই। যার যত মোবাইল হাতের কাছে পান, শিশুর ভঙ্গিতে অমিয়কে তা ধরিয়ে দেন হুমায়ূন ভাই।

শিশুদের সঙ্গে মেশার সময় তিনি শিশু হয়ে যান। এত মনোযোগ দেন শিশুদের দিকে, ভাবা যায় না। আর অসম্ভব আড্ডাপ্রিয়। একা বলতে গেলে চলতেই পারেন। না, দলবল লাগে। কেউ দাওয়াত করলেও একা যান না। দলবল নিয়ে যাওয়া যাবে না। এমন জায়গায় যাবেনই না। ঠান্ডা খাবার খেতে পারেন না, মাকড়সায় প্রচণ্ড ভয়, হঠাৎ করে রেগে যান। রাগ থাকে। অল্প কিছুক্ষণ। কিন্তু সেই অল্প কিছুক্ষণের ঠেলা সামলাতে জান বেরিয়ে যায়। যার ওপর রাগেন তার সর্বোচ্চ শান্তি কান ধরে উঠবস।

দুটো মাত্র গাল ব্যবহার করেন রাগের সময়, ফাজিল কোথাকার আর খেতাপুড়ি। কৃপণতা বলতে গেলে কিছু নেই। দুই হাতে খরচা করেন। ভালো রান্না না হলে খেতে পারেন না। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো খাদ্যরসিক। খান অল্প কিন্তু আয়োজন রাজকীয়। হঠাৎ করে চার হাজার টাকা দিয়ে একটা চিতল মাছ কিনে ফেললেন। ভাবিকে দিয়ে রান্না করিয়ে প্ৰিয়বন্ধুদের ডাকলেন। যত প্রিয় মানুষই হোক, তার বাড়িতে দাওয়াত খেতে গিয়ে যদি দেখেন রান্না খারাপ হয়েছে, মুখের ওপর বলে দেবেন। ভণিতা বলে কোনো কিছু হুমায়ূন ভাইয়ের নেই। সত্য কথা তিনি বলবেনই, কে কী ভাবল তোয়াক্কা করেন না। আপাতদৃষ্টিতে রুক্ষ, কাঠখোট্টা এবং প্রচণ্ড অহংকারী।

নুহাশের আগে তাঁর একটি ছেলে হয়ে মারা যায়, শুনে আমি গেছি দেখা করতে। তখন শহীদুল্লাহ্ হলের হাউস টিউটর তিনি। আমাকে দেখে খুবই বিরক্ত হয়ে বললেন, চলে যাও, আমার ভালো লাগছে না। কিন্তু চোখে পানি ছিল না তাঁর। অথচ নিজের লেখা পড়ে আমি তাকে কাঁদতে দেখেছি। নাটকের স্ক্রিপ্ট পড়তে পড়তে চোখ মুছছেন, কান্নায় বুজে আসছে গলা।

০২. অদ্ভুত একটা স্বপ্ন

অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম একরাতে।

কোথাও বেশ একটা জনকোলাহল। অনেক সুন্দরী নারী। সম্ভবত কোথাও কোনো সাহিত্য সম্মেলন হচ্ছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখতে পেলাম আসরের মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন। গান-গল্পে মুখর হয়ে আছে। অনুষ্ঠান।

একসময় সুনীল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমাকে এক্ষুনি ছুটতে হবে। প্লেন ধরতে হবে।

তিনি কিছুক্ষণের জন্য উধাও হয়ে গেলেন। তারপর পোশাক বদলে একটা ব্যাগ হাতে বেরিয়ে এলেন। ব্যাগটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, আমার পেছন পেছন এসো।

একটা সময় দেখি কিছুতেই আমি আর তাঁর নাগাল পাচ্ছি না। তিনি আমাকে অনেকটা পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছেন। হাঁটা বাদ দিয়ে তাকে ধরার জন্য আমি ছুটিছি। সামনে একটা জলাশয়। সুনীলকে দেখি জলাশয়ের ওপারে। একবারও পেছন ফিরে তাকাচ্ছেন না, মাঝারি মানের মোটা শরীর নিয়ে হনহন করে হেঁটে যাচ্ছেন। আমি জলাশয় পেরিয়ে তাকে ধরার চেষ্টা করছি, পারছিই না।

এটুকুই স্বপ্ন। কী অর্থ ওই স্বপ্নের কে জানে।

তবে সুনীলদা আমাকে ফেলে নিউইয়র্কের লাগোর্ডিয়া বিমানবন্দর থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসে চলে গিয়েছিলেন। সেবার হুমায়ুন ভাইও ছিলেন। নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের মুক্তধারা বিখ্যাত প্ৰতিষ্ঠান। মুক্তধারার কর্ণধার বিশ্বজিৎ সাহা বইমেলার আয়োজন করেছিলেন। বাংলাদেশ থেকে অতিথি হিসেবে গিয়েছিলাম হুমায়ূন আহমেদ আর আমি। কলকাতা থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আর সমরেশ মজুমদার। হুমায়ূন ভাই দল ছাড়া চলতে পারেন না। অন্যদিন গ্রুপের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম আছেন আমাদের সঙ্গে, হুমায়ূন ভাইয়ের অতিপ্রিয় বন্ধু আর্কিটেক্ট আবু করিম আছেন। অন্যদিন গ্রুপের কমলও ছিলেন।

এই ঘটনা বলার আগে একটু পেছন ফিরি। হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে বলি।

হুমায়ূন আহমেদ কোনো কিছু লুকাতে জানেন না, আড়াল করতে জানেন না। তিনি তাস খেলেন মাটিতে ফেলে। সবাই দেখতে পায় তাঁর হাতের তাস। সম্পূর্ণ নিজের মতো একটি জীবন তিনি যাপন করেন। যা ভালো লাগে, বিশ্বাস করেন, তা-ই করেন। কোনো কাজ করার আগে বন্ধুদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ-আলোচনা করেন, প্রত্যেকের মতামত নেন; কিন্তু করেন সেটাই, নিজে যেটা ভালো মনে করেন।

সেন্ট মার্টিনস দ্বীপে বেড়াতে গিয়ে ভাবলেন, এ রকম দ্বীপে একটা বাংলোবাড়ি করলে কেমন হয়? জায়গা কিনে বাড়ি করে ফেললেন। তাঁর সেই বাড়ি ইতিহাস হয়ে গেল। দেশের সব মানুষ জানে।

বাবা ফয়েজুর রহমান আহমেদ একাত্তরের বীর শহীদ, বাংলাদেশ সরকার তাঁর নামে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে, আর হুমায়ূন আহমেদ তাঁর পিতার স্মরণে ৭০ লাখ টাকা ব্যয় করে নিজ গ্রামে একটা স্কুল করেছেন। সেই স্কুলের ডিজাইন ও পরিবেশ স্কটল্যান্ডের মতো।

তাঁর নুহাশপল্লী এখন আপন মহিমায় বিখ্যাত। বহু লোক দেখতে যায়। ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডে হোতাপাড়ার পশ্চিমে ঢুকে গেছে যে সড়ক, সেই সড়কের নাম নুহাশপল্লী সড়ক। মোটকথা, হুমায়ূন আহমেদ যা করেছেন, তা-ই ইতিহাস হয়ে গেছে। জীবনে যা চেয়েছেন তিনি, পেয়েছেন তার চেয়ে বহুগুণ বেশি।

শাহাদৎ চৌধুরী সম্পাদিত একসময়কার বিখ্যাত সাপ্তাহিক বিচিত্রাই তাঁকে নিয়ে পাঁচ-ছয়বার কাভার ক্টোরি করেছে, রোববার, পৃণর্মা, অন্যদিন তো করেছেই, আরও কত পত্রিকা যে করেছে।

তাঁর একক বইমেলা হয়েছে বাংলাদেশের বহু জায়গায়, নিউইয়র্কে, ফ্রাংকফুর্টে। নিজের তৈরি ছবির ফেস্টিভ্যাল হয়েছে জাপানে। জাপানের বিখ্যাত টেলিভিশন এনএইচকে তাঁকে নিয়ে ১৭ মিনিটের ডকুমেন্টারি করেছে–হু ইজ হু ইন এশিয়া।

শাহরিয়ার কবির, অভিনেতা মাহফুজ আহমেদ তাঁকে নিয়ে বই লিখেছেন। কোথাও কেউ নেই নাটকে বাকের ভাইয়ের যাতে ফাঁসি না হয়, সে জন্য মিছিল বেরিয়েছে ঢাকার রাস্তায়, পোস্টারিং হয়েছে। আসাদুজ্জামান নূরের মতো জনপ্রিয় অভিনেতা, এখন আওয়ামী লীগের বিখ্যাত নেতা এবং সংসদ সদস্য চাপা পড়ে গেছেন বাকের ভাইয়ের আড়ালে। এখনো লোকে তাঁকে বাকের ভাই বলেই চেনে। নাটকটির শেষ পর্ব যেদিন প্রচারিত হয়, সেদিন হুমায়ুন ভাই বাড়িতে থাকতে পারেন নি। বাকেরের যাতে ফাঁসি না হয়, সে জন্য হাজার হাজার লোক এসে দাঁড়িয়েছিল তার বাড়ির সামনে।

যেখানে হাত দিয়েছেন হুমায়ূন ভাই, সোনা ফলেছে। ব্যর্থতা বলে কোনো জিনিস হুমায়ূন আহমেদের ধারে কাছেও ভিড়তে পারে নি কখনো।

টিভি নাটক লিখতে এসে সম্পূর্ণ নতুন এবং নিজস্ব একটি ধারা তৈরি করে দিলেন তিনি। হুমায়ূন আহমেদের নাটক শুধুই হুমায়ূন আহমেদের নাটক, অন্য কারও সঙ্গে মেলে না, অন্য কেউ তাঁর মতো লিখতেও পারেন না। এইসব দিনরাত্রি থেকে শুরু হলো। বহুব্রীহি, আয়োময়, কোথাও কেউ নেই—আরও কত তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয় নাটক!

সিনেমা করলেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণী আবার হলে ফিরল। প্ৰথম ছবিতেই আট-দশটি ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড। অসাধারণ কিছু গান লিখলেন, যেমন—এক যে ছিল সোনার কন্যা মেঘবরণ কেশ, ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ। দুর্দান্ত কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্র তৈরি করলেন, যেমন-হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো কুদ্দুস বয়াতির পেছনে ৪০-৫০টি শিশু ছুটছে। প্রাথমিক শিক্ষা কাৰ্যক্রমের বিজ্ঞাপন। তাঁর প্রায় প্রতিটি ধারাবাহিকের জনপ্রিয় চরিত্রদের নিয়ে বিজ্ঞাপন হয়েছে।

একটি নাটকে রাধারমণের গান ব্যবহার করলেন, আইজ পাশা খেলিব রে শ্যাম। গানটি জনপ্রিয়তায় রেকর্ড করল। সিনেমা-নাটকে ব্যবহার করে হাছন রাজার গানকে নতুন করে জনপ্রিয় করালেন তিনি।

তাঁর গল্প পড়ে রমাপদ চৌধুরী বলেন, বিশ্বের যে-কোনো ভাষার ভালো গল্পগুলোর সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের গল্প তুলনীয়। তিনিই একমাত্র বাঙালি লেখক, যিনি সাত বছর ধরে দেশ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় উপন্যাস লিখেছেন। এই সৌভাগ্য আর কোনো বাঙালি লেখকের হয় নি।

আর তার বইয়ের বিক্রি?

অনেক বছর ধরে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদ সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। তাঁর কোনো কোনো বই ৮০-৯০ হাজার কপিও বিক্রি হয়েছে। টাকার বস্তা নিয়ে প্রকাশকরা তার বাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। একসঙ্গে ৫০ লাখ টাকা অগ্রিম দেন কোনো প্ৰকাশক। তাঁর বই না পেয়ে হতাশায় ডায়াবেটিস হয়ে যায় প্রকাশকের। গাড়ি, ফ্ল্যাট হয়ে যায় পর পর কয়েক বছর বইমেলায় তাঁর একটি করে বই পাওয়া ভাগ্যবান প্ৰকাশকের। বইমেলায় যে স্টলে বসেন। তিনি, ভিড় ঠেকাতে সেখানে আট-দশজন পুলিশ লাগে। আড়াই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে তাঁর অটোগ্রাফ নিতেও ক্লান্ত হয় না পাঠক। তাঁর সঙ্গে এক দিনের জন্য আড্ডা দিতে নুহাশপল্লীতে কলকাতা থেকে ছুটে আসেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বাড়িতে দেখা করতে আসেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, নুহাশ পদক দিতে তিনি ডাকেন সমরেশ মজুমদারকে।

কিশোর-তরুণ-তরুণী তো আছেই, অনেক শ্ৰদ্ধেয় ও বয়স্ক ভদ্রলোকও তাঁর ভক্ত, পেছন, পেছন ঘুরছেন আর স্যার স্যার করছেন। অভিনেতা-অভিনেত্রী, পাঠকপ্ৰকাশক এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাছে তিনি স্যার। নিজ গ্রামে তিনি পীর সাহেব। লোকে তাকে তেমন করে মানে।

ভাবতে বিস্ময় লাগে, পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি মাপের রোগা-পটকা একজন মানুষ কোন মন্ত্রবলে এমন আকাশছোঁয়া হয়ে ওঠেন, কী করে হয়ে ওঠেন কিংবদন্তি!

তাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলে ঘোর লেগে যায়। আমি আমার ঘোর কাটাতে আবার পেছন ফিরে তাকাই। হুমায়ুন ভাইয়ের আরও পেছনে ফেলে আসা জীবনটা দেখি।

শ্যামলীর বাসা ছেড়ে হুমায়ূন ভাই এরপর আজিমপুরে চলে এলেন। নিউমার্কেটের দক্ষিণ পাশ দিয়ে সোজা পশ্চিমে বিডিআর গেট, সেই গেটের বাঁ দিকের রাস্তা দিয়ে খানিক এগিয়ে হাতের ডানদিকে একটা রাস্তা ঢুকে গেছে, রাস্তার একপাশে একটা ডোবা আর কয়েকটা কবর, তার উল্টো পাশের বাড়িটির তিনতলায় ফ্ল্যাট।

তত দিনে জয়যাত্রা শুরু হয়ে গেছে তার। ঈদ সংখ্যাগুলোতে একটার পর একটা উপন্যাস লিখছেন, বইয়ের পর বই বেরোচ্ছে, প্রতিদিনই বিস্ময়করভাবে বাড়ছে বইয়ের বিক্রি। প্রকাশকদের আসা-যাওয়া শুরু হয়ে গেছে। হুমায়ূন ভাইও প্রায়ই যাচ্ছেন বাংলাবাজারে। নওরোজ কিতাবিস্তানে ইফতেখার রসুল জর্জের ওখানে আড্ডা হয়। প্ৰায় নিয়মিত আসেন হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ।

কখনো বিউটি বুক হাউস, কখনো স্টুডেন্ট ওয়েজ। আমি যাই। দু-চার দিন পর পরই হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়। কোনো কোনো দিন দুপুরবেলা আমাকে তিনি সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে যান। দুপুরে তাঁর ওখানে খেয়ে বিকেলবেলা ইউনিভার্সিটি ক্লাবে আডা দিতে যাই।

এ সময় টেলিভিশনে শুরু হলো তার দেশমাতানো ধারাবাহিক এইসব দিনরাত্রি। নাটকটির পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান। মুস্তাফিজ ভাই তখন আজিমপুর স্টাফ কোয়ার্টারে থাকেন। আমাকে নিয়ে হুমায়ূন ভাই প্রায়ই তাঁর ওখানে যান, স্ক্রিপ্ট নিয়ে কথা হয়। কোনো কোনো দিন টিভি ভবনে রেকর্ডিংয়েও যাই আমি।

সেই সময় নিজেদের গ্রামে বাবার নামে একটা পাঠাগার করলেন হুমায়ুন ভাই। নির্মলেন্দু গুণ, হুমায়ুন আজাদ এবং আমাকে নিয়ে গেলেন উদ্বোধন করাতে। ফেরার দিন রাতে ময়মনসিংহ শহরে নির্মলেন্দু গুণের বাসায় থাকলাম। উহ, সারাটা রাত নির্মলেন্দু গুণ আর হুমায়ুন আজাদ যে কী ঝগড়া করলেন! ঝগড়ার শ্রোতা আমি আর হুমায়ূন আহমেদ।

০৩. অন্য রকম একটি প্রসঙ্গ

এবার অন্য রকম একটি প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলি। তারপর আবার হুমায়ূন আহমেদের পেছনের জীবনের দিকে ফিরব।

হুমায়ুন ভাইয়ের যে-কোনো লেখাই গভীর আগ্রহ ও আনন্দ নিয়ে পড়ি। আমার ধারণা, তার এমন কোনো লেখা নেই, যা আমি পড়ি নি।

বছর তিনেক আগের কথা, তখন অপেক্ষা করে থাকতাম তার বলপয়েন্ট লেখাটির জন্য। সাপ্তাহিক ২০০০-এ প্রতিসপ্তাহে বেরোচ্ছে বিলপয়েন্ট। এত স্বাদু রচনা, পড়তে শুরু করলে কখন শেষ হয়ে যায় টেরই পাই না। শেষ হওয়ার পর বিরক্ত লাগে। কেন মাত্র দেড়-দুই পৃষ্ঠা করে লিখছেন তিনি? কেন এই লেখা আরও বড় করে লিখছেন না?

এর মধ্যে একটি পর্বে দেখলাম আমাকে নিয়ে দু-তিনটি প্যারা লিখেছেন। পড়ে সন্ধ্যাবেলা তাকে ফোন করলাম। তিনি বিক্রমপুর থেকে ফোন ধরলেন। বিক্রমপুরের দীঘিরপার এলাকায় নাটকের শুটিং করতে গেছেন। গ্রামটির নাম কামাড়খাড়া।

এই গ্রামের পাশের গ্রাম বাণীখাড়ায় ছিল শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়দের বাড়ি। এলাকাটি আমার বিশেষ পরিচিত। ওই গ্রামে আমার এক দাদার বাড়ি। অর্থাৎ বাবার ফুফাতো চাচার বাড়ি। কিশোর বয়সে বহুবার সেই বাড়িতে গেছি। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির নাম রাজতরেখা।

হুমায়ূন ভাই ওই এলাকায় শুটিং করছেন আর সেদিনই অনেক দিন পর তাঁর সঙ্গে আমার কথা হচ্ছে ভেবে ভালো লাগল। আমাকে নিয়ে তিনি লিখেছেন সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য ফোন করেছিলাম। কথায় কথায় বললাম, বলপয়েন্ট লেখাটিকে মনে হচ্ছে কলম ছেড়ে দেওয়া লেখা। কোনো পরিকল্পনা নেই, মাথায় এলোমেলোভাবে আছে স্মৃতিগুলো। কোন স্মৃতি আগের, কোনটি পরের—কোনো হিসাব নেই, কলাম যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, লেখাও এগোচ্ছে সেইভাবে। বলপয়েন্টের মূল আকর্ষণ এই জায়গায়।

কিন্তু যে কথা বলার জন্য হুমায়ুন ভাইকে ফোন করেছিলাম সেই কথাটাই বলা হলো না। এখন বলি। হূমায়ূন ভাই, আপনি লিখেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর সমরেশ মজুমদার ঢাকায় এসেছেন। সন্ধ্যাবেল পার্টি হচ্ছে কোথাও। ঢাকার লেখকশিল্পীরা অনেকেই আছেন সেখানে। পানাহার হইহল্লা আডা চলছে। সেই আড্ডায় আমি সুনীল-সমরেশকে সমানে তুমি তুমি করে যাচ্ছি।

এখানটায় একটুখানি গণ্ডগোল আছে।

আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে কখনো তুমি বলি না। তাঁকে আপনি করেই বলি। সুনীলদা আপনি, বলি।

সমরেশ মজুমদারকে তুমি করে বলি।

পেছনে একটা ঘটনা আছে। ৯২-৯৩ সালে সমরেশ মজুমদার প্রথম ঢাকায় এলেন। ফেব্রুয়ারির বইমেলা চলছে বাংলা একাডেমীতে। সমরেশকে ঢাকায় এনেছেন পার্ল পাবলিকেশন্সের আলতাফ হোসেন। আপনার-আমার দুজনের প্রিয় মিনু ভাই।

মিনু ভাই অকালে চলে গেছেন। এই মুহূর্তে তাঁর কথা খুব মনে পড়ছে। মিনু ভাই ঠোঁটকাটা লোক ছিলেন, হঠাৎ রেগে যেতেন; কিন্তু মনটা খুব ভালো ছিল!

একবার তাঁর বিদেশে থাকা এক আত্মীয় খুবই সুন্দর পিংক কালারের বেশ দামি একটা টি-শার্ট গিফট করেছেন মিনু ভাইকে। মিনু ভাই সেটা নিয়ে আমার গেণ্ডারিয়ার বাসায় গিয়ে হাজির। ওই টি-শার্টে নাকি আমাকে খুব মানাবে। বহুদিন মিনু ভাইয়ের দেওয়া সেই টি-শার্ট পরে আমি ঘুরে বেড়িয়েছি। ফেব্রুয়ারি বইমেলায় মিনু ভাইকে একটা বই দেব বলে অনেক দিন ঘুরিয়েছিলাম, সে কথা মনে করে আজ অনুতপ্ত হচ্ছি।

তো, সমরেশ ঢাকায় এসে মিনু ভাইয়ের সঙ্গেই আছেন। বাংলা একাডেমীতে মিনু ভাইয়ের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তখনো বাংলাদেশের পাঠক সমরেশকে সেভাবে চেনে না। আমি হাঁটতে হাঁটতে গেছি মিনু ভাইয়ের স্টলের সামনে। মিনু ভাই সমরেশের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

সমরেশের লেখা সম্পর্কে আমার কিছু ধারণা ছিল। তাঁর বহু লেখা আমি পড়েছি। বিশেষ করে উত্তরাধিকার উপন্যাসটি আমাকে মুগ্ধ করেছিল।

পরিচয়ের মুহূর্তেই সমরেশ যেটা করলেন, আমার কাঁধে একটা হাত দিলেন, দিয়ে বেশ একটা দাদাসুলভ ভঙ্গিতে কলকাতার ভাষায় বললেন, তা কী লিখছ আজকাল?

আচরণ এবং প্রশ্নে আন্তরিকতার অভাব ছিল না। কিন্তু আমার মনের ভেতর খুঁটি করে একটা শব্দ হলো। বয়সে ছোট ইত্যাদি ভেবে কি তিনি আমাকে তুমি করে বলছেন? নাকি লেখকসুলভ কোনো ভাব! লেখকদের তো নানা ধরনের ভাবচক্কর থাকে।

আমার মাথায় দুষ্ট একটা পোকা কামড় দিল। তাহলে আমিও সমরেশের সঙ্গে গলায় বললাম, তা, তুমি কী লিখছ?

সমরেশ কিন্তু ব্যাপারটা সহজভাবেই নিলেন। ওই বিকেলেই আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আমি সমরেশকে তুমি করেই বলতে লাগলাম। সঙ্গে দাটা লাগিয়ে দিলাম।

কিন্তু হুমায়ুন ভাই, আপনি এই তুমি তুমিটা একদমই পছন্দ করছিলেন না। একদিন খুবই বিরক্ত হয়ে কথাটা আমাকে বলেছিলেন। যখন আমি ঘটনাটা বললাম, শুনে আপনি খুব মজা পেয়েছিলেন। তবে তারপর দু-একবার সমরেশদাকে আমি আপনি করে বলার চেষ্টা করেছি, ব্যাপারটা তিনি স্বাভাবিকভাবে নেন নি। মাইন্ড করেছেন।

২০০৯-এর এপ্রিলে কলকাতায় গেছি। সমরেশদার সঙ্গে দেখা। বললাম, কেমন আছেন, সমরেশদা?

সমরেশদা গম্ভীর গলায় বললেন, তুমি কিন্তু আমাকে তুমি করে বলতে!

এবার অন্য প্ৰসঙ্গ।

মনে আছে, হুমায়ূন ভাইয়ের আজিমপুরের ফ্ল্যাটের মুহম্মদ জাফর ইকবালের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। তখন তিনি আমেরিকায় থাকেন। ছুটিতে দেশে এসেছেন। আমি মুহম্মদ জাফর ইকবালেরও ভক্ত পাঠক। যত দূর জানি, তখন পর্যন্ত তাঁর দুটি মাত্র বই বেরিয়েছে। মুক্তধারা থেকে কপোট্রনিক সুব দুঃখ, শিশু একাডেমী থেকে দিপু নাম্বার টু। কপোট্রনিক সুখ দুঃখ গল্পটি বিচিত্রায় ছাপা হয়েছিল এবং আজকের অনেক পাঠকই জানেন না, হুমায়ূন ভাইয়ের নন্দিত নরকের প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন দুজন শিল্পী—মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও শামিম সিকদার।

হুমায়ূন আহমেদরা তিন ভাইই বিখ্যাত, তিন ভাইই লেখক। জনপ্রিয়তায় হুমায়ুন ভাইয়ের পরই জাফর ভাই। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কাছে মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতো প্ৰিয় লেখক আর কেউ নেই। শিক্ষক হিসেবে দারুণ জনপ্রিয় তিনি। স্কুল-কলেজের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের আদর্শ, অসম্ভব সাহসী এবং সৎমানুষ। যে কজন মানুষের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে আমাদের সময়, মুহম্মদ জাফর ইকবাল তাঁদের একজন।

আর আহসান হাবীব উন্মাদ পত্রিকার সম্পাদক, দুর্দান্ত কার্টুন আঁকেন, রম্য লেখায় তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। তাঁর জোকসের বইয়ের যে বিক্রি বইমেলায় আমি দেখেছি, বিস্ময়কর!

এই পরিবারের আরেকজন মানুষের আমি খুব ভক্ত, হুমায়ূন ভাইয়ের মা। সারা দিন বই পড়েন, সাহিত্য নিয়ে ভাবেন। নূরজাহান প্রথম পর্ব পড়ে আমাকে বললেন, দ্বিতীয় পর্ব বেরোলে আমাকে দিয়ো। দ্বিতীয় পর্ব বেরোতে সাত বছর লাগল। এই সাত বছরে যতবার দেখা হয়েছে, ততবারই তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, বেরোয় নি?

বই বেরোনোর পর প্রথম কপিটি আমি তাকে পৌঁছে দিয়ে এসেছি। শেষ পর্ব হুমায়ূন ভাই মাকে কিনে দিয়েছিলেন, বইটা পৌঁছে দিতে আমার কয়েকটা দিন দেরি হয়েছিল বলে।

আজিমপুরের সেই ফ্ল্যাট ছেড়ে হুমায়ূন ভাই তারপর এসে উঠলেন শহীদুল্লাহ হলের হাউস টিউটরের কোয়ার্টারে। তত দিনে অনিন্দ্য পাবলিশার্স নামের একটি প্রকাশনা সংস্থা বেশ জাঁকজমক করে এসেছে প্রকাশনায়। হুমায়ূন ভাইয়ের অমানুষ, আমার কালাকাল—এইসব বইনিয়ে শুরু করল। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই অনিন্দ্যর স্বত্বাধিকারী নাজমুল হক একদিন একটা মিষ্টির প্যাকেট আর একটা নতুন সাদা ডাইহাটসু গাড়ি নিয়ে হুমায়ুন ভাইয়ের বাড়িতে এসে হাজির। গাড়িটা আপনার জন্য। রয়ালটি থেকে অ্যাডজাস্ট হবে।

ঘটনাটি অবিশ্বাস্য। বাংলাদেশের কোনো লেখকের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা আগে বা পরে আজ পর্যন্ত আর ঘটে নি।

সেই সময় দৈনিক বাংলার সাহিত্য পাতায় মৌনব্রত নামে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখেছিলেন হুমায়ুন ভাই। ধারাবাহিকভাবে লেখা তাঁর বেশির ভাগ উপন্যাসই শেষ পর্যন্ত শেষ হয় না। মৌনব্রতীও শেষ হলো না। পরে এই লেখাটি নাম বদলে বই করলেন তিনি। জনম জনম। উপন্যাসটি যারা পড়েছেন তারা স্বীকার করবেন, জনম জনম এক অসাধারণ উপন্যাস। পরে নিরন্তর নামে আবু সায়িদ ছবি করেছেন। নায়িকা শাবনূর।

আমি হুমায়ূন আহমেদের প্রায় সব উপন্যাস পড়েছি। বহু ভালো উপন্যাস লিখেছেন তিনি। কতগুলোর নাম বলব! নন্দিত নরকে ও শঙ্খনীল কারাগার-এ দুটো উপন্যাস তো ইতিহাস! তারপর নির্বাসন, সূর্যের দিন, অন্ধকারের গান, চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক, গৌরিপুর জংশন, শ্রাবণ মেঘের দিন, কবি, উনিশ শো একাত্তর, ফেরা, জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাইস্কুল, আগুনের পরশমণি, কোথাও কেউ নেই, রুমাল, শুভ্ৰ, লীলাবতী, মধ্যাহ্ন, জোছনা ও জননীর গল্প, মাভাল হাওয়া, বাদশা নামদার-আরও কত উপন্যাস!

তাঁর লেখার একনিষ্ঠ পাঠক ও ভক্ত ছিলেন বাংলাদেশের খুব বড় একজন শিক্ষিত মানুষ, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। বেশ কয়েকবার হুমায়ুন ভাই আমাকে রাজ্জাক স্যারের ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারে নিয়ে গেছেন। মনে আছে, রাজ্জাক স্যার নিজ হাতে পাঙাস মাছের ডিম রান্না করে আমাদের দুজনকে একদিন খাইয়েছিলেন। তাঁর মুখে কী যে প্রশংসা শুনেছি হুমায়ূন ভাইয়ের একেকটি লেখার!

একবার বইমেলায় আবু হেনা মুস্তাফা কামাল বললেন, হুমায়ূন মধ্যবিত্তের নাড়ি স্পর্শ করেছে। তাঁর চোখ গল্পটি পড়ে সংবাদ-এ দুর্দান্ত একটি লেখা লিখলেন। সৈয়দ শামসুল হক চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক উপন্যাসটি পড়ে আহমদ ছফা আমাকে বলেছিলেন, অসাধারণ লেখা! মাত্র কয়েকটি আঁচড়ে বাংলাদেশের চেহারা ফুটিয়ে তুলেছে হুমায়ূন। ফরহাদ মযহার বলেছিলেন, হুমায়ূনের গল্পগুলোর কোনো তুলনা হয় না। নির্মলেন্দু গুণ মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর জলিল সাহেবের পিটিসন গল্পটি পড়ে। কলকাতার জিজ্ঞাসা পত্রিকায় হুমায়ূন ভাইয়ের ১৯৭১ গল্পটি ছাপা হলো। আমার সামনে সেই গল্পের এমন প্রশংসা করলেন আল মাহমুদ, হুমায়ূন ভাই লজ্জা পেয়ে গেলেন।

এ রকম কত ঘটনার কথা লিখব!

একই হাতে কত রকমের লেখা যে লিখেছেন হুমায়ূন ভাই। বাংলা ভাষায় সায়েন্স ফিকশনের জনক তিনি। প্ৰথম সার্থক সায়েন্স ফিকশন লিখেছেন, সায়েন্স ফিকশনকে জনপ্রিয় করেছেন। এখন তাঁর অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশনও ভীষণ জনপ্রিয়।

ভূতের গল্পে হুমায়ূন আহমেদের কোনো জুড়ি নেই। তাঁর মতো এত ভালো ভূতের গল্প বাংলা ভাষার আর কোনো লেখক লেখেন নি। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ছায়াসঙ্গী গল্পটির কথা। রহস্য, ফ্যান্টাসি, থ্রিলার আর অদ্ভুত অদ্ভুত বিষয়ের লেখা। দেবী, নিশীথিনী লিখে আরেকটা জগৎ তৈরি করলেন। অন্য ভুবন লিখে আরেকটি জগৎ তৈরি করলেন। আয়নাঘর, পোকা, ভয়-কত লেখার কথা বলব!

সিলেটের একটি মেয়ে-হিমুর সঙ্গেও আমার একবার দেখা হয়েছিল।

সব মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদ একটি নেশার নাম, হুমায়ূন আহমেদ একটি প্রতিষ্ঠান।

শিশু-কিশোরদের লেখা, রূপকথা—কোথায় তার হাতের পরশ পড়ে নি? আর যেখানে পড়েছে, সেখানেই সোনা ফলেছে।

বাংলা ভাষায় তাঁর প্ৰিয় লেখক রবীন্দ্রনাথ। ঘন্টার পর ঘন্টা রবীন্দ্ৰনাথের কবিতা মুখস্ত বলে যেতে পারেন। বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, মানিক, সতীনাথ ভাদুড়ীর উপন্যাস-গল্প তাঁর প্রিয়। জন স্টাইনবেক, স্টিফান কিং তাঁর প্রিয়। সারাক্ষণ লেখা নিয়ে ভাবছেন। লেখার ব্যাপারে অসম্ভব খুঁতখুঁতে। মনমতো না হলে সেই লেখা কিছুতেই লিখবেন না। মাথা ভর্তি নতুন নতুন আইডিয়া। সবার মধ্যে থেকেও, তুমুল আড্ডার মধ্যে থেকেও কোন ফাঁকে যেন একা হয়ে যান, লেখার জগতে চলে যান। যখন-তখন লিখতে পারেন। লেখেন মেঝেতে বসে, লেখার জন্য চেয়ার-টেবিল দরকার হয় না। লেখার মতোই অসম্ভব আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে গল্প বলতে পারেন, বাস্তবের সঙ্গে কোথায় যে মিশেল দেবেন। কল্পনা, তিনি নিজে ছাড়া কেউ তা বুঝতে পারবে না। কখনো তিনি নিজেই মিসির আলী, কখনো হিমু।

সব মিলিয়ে এক বিস্ময়কর মানুষ।

কাউকে মা-বাবা ডাকতে পারেন না। নিজের শ্বশুর-শাশুড়িকেও কখনো মা কিংবা বাবা বলে ডাকেন না। কাউকে দুঃখ দিতে চাইলে বেশ ভালোভাবেই তা দিতে পারেন।

নিজের নাটকে একবার এক বিশাল নাট্যব্যক্তিত্বের অভিনয় দেখে এত বিরক্ত হলেন, বললেন, এটা কি অভিনয়? আরে, আপনি তো অভিনয়ই জানেন না।

একবার তাঁর নুহাশপল্লীতে নাটকের রেকর্ডিংয়ে এসে সন্ধ্যার পর কয়েকজন অভিনেতা-অভিনেত্রী অন্য একটি ঘরে বসে হুমায়ূন আহমেদের তুমুল নিন্দামন্দ করছেন। তিনি তো আর তা জানেন না, খুবই উৎফুল্ল ভঙ্গিতে সেই ঘরের দিকে যাচ্ছেন। ঘরের কাছে গিয়েই শোনেন, এই অবস্থা। বাইরে দাঁড়িয়ে খানিক ওসব শুনে মন খারাপ করে ফিরে এলেন। সেইসব অভিনেতা-অভিনেত্রীকে বুঝতে দিলেন না কিছু। আবার পেটে কথাও রাখতে পারেন না। যদি বন্ধুদের কেউ কোনো গোপন কথা বলে বলল, কাউকে বলবেন না, সেটাই সবার আগে বলে ফেলবেন। পাগলের সাঁকো নাড়ানোর মতো।

০৪. ভালো ছাত্র হয়ে ওঠার গল্প

হুমায়ূন আহমেদের ভালো ছাত্র হয়ে ওঠার গল্পটা বলি।

গল্প না, ঘটনা। গল্পে কল্পনা থাকে, ঘটনায় থাকে সত্যতা। ছেলেবেলায় পড়াশোনায় খুবই খারাপ ছিলেন তিনি। আসলে পড়াশোনায় তাঁর মন বসত না। একেবারেই মনোযোগী ছিলেন না লেখাপড়ায়। স্কুলের পরীক্ষাগুলোয় টেনেটুনে, কায়ক্লেশে পাসটা করতেন।

বাবার বদলির চাকরি। একেকবার একেক জেলায়। চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ছেন। সে বছর পাসই করতে পারলেন না। ডাহা ফেল। ফেল করা মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরবেন কী করে! ক্লাস টিচার বড়ুয়া স্যার। তাঁর কাছে গিয়ে কান্নাকাটি শুরু করলেন। ছাত্রের কান্না দেখে বড়ুয়া স্যারের হৃদয় দ্রবীভূত হলো। তিনি বিশেষ বিবেচনায় ক্লাস সেভেনে তুলে দিলেন। ওপরের ক্লাসে উঠে যেই কে সেই! অবস্থা আগের মতোই। পড়ায় মন বসে না।

মন বসল ক্লাস এইটে ওঠার পর।

স্কুল থেকে তখন খুবই সুস্বাদু, ভালো টিফিন দেওয়া হতো। সেই টিফিনের জন্য ব্যাপক লোভ ছিল বালক হুমায়ুন আহমেদের। এখানে ব্র্যাকেটে আরেকটা কথা বলে রাখি। হুমায়ূন আহমেদের ডাকনাম বাচ্চু। কবি শামসুর রাহমানেরও ডাকনাম ছিল বাচ্চু। পরে দুজনের কেউ এই নাম কখনো ব্যবহার করেন নি। কাউকে বলতেনও না।

যা হোক, ক্লাস এইটো বৃত্তি পরীক্ষা হবে। ক্লাসের ভালো ছাত্রদের সিলেক্ট করা হয়েছে বৃত্তি পরীক্ষার জন্য। যারা সিলেক্ট হয়েছে, স্কুলে তাদের মহাসমাদর। স্যাররা খাতির করছেন, ছাত্ররা খাতির করছে। তাদের যত্ন-আত্তির অভাব নেই। যেহেতু বৃত্তি পরীক্ষা দিতে হবে, সেহেতু ফাইনাল পরীক্ষাও তাদের দিতে হবে না। আর যেটা সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘটনা সেটা হলো, ভালো ছাত্রদের টিফিন দেওয়া হবে ডাবল। সাধারণ ছাত্ররা যে টিফিন পাবে, ওরা পাবে তার দ্বিগুণ।

এই টিফিনের লোভটা ঢুকল হুমায়ূন আহমেদের মাথায়। যেমন করে হোক বৃত্তি পরীক্ষা তাঁকে দিতেই হবে। বৃত্তি পরীক্ষায় সিলেক্ট হলেই ডাবল টিফিন। তিনি ক্লাস টিচারের কাছে গিয়ে, হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়, ঘ্যানরঘ্যানর শুরু করলাম। রোজই স্যারকে ধরি আর করুণ মুখ করে কাঁদো কঁদো গলায় বলি, স্যার, আমি বৃত্তি পরীক্ষা দেব।

প্রথম দিন ক্লাসের খারাপ ছাত্রগুলোর একটি বৃত্তি পরীক্ষা দিতে চাইছে শুনে স্যার আকাশ থেকে পড়লেন। বলিস কী, তুই দিবি বৃত্তি পরীক্ষা!

জি স্যার।

আরে তুই তো ক্লাস সিক্সে ফেল করেছিলি। সেভেন থেকে এইটে উঠেছিস তাও দুটো না তিনটে সাবজেক্ট ফেল।

তাও আমি স্যার বৃত্তি পরীক্ষা দেব।

যা যা ভাগ।

স্যার ধমক দিয়ে বিদায় করলেন।

পরদিন আবার সেই ঘ্যানঘ্যাননি, স্যার, আমি বৃত্তি পরীক্ষা দেব।

আজ স্যার বিরক্ত হলেন আরও বেশি। পারলে মেরে ক্লাস থেকে বের করে দেন। হুমায়ূন আহমেদের করুণ কঁদো কাদো মুখ দেখে মারলেন না। আগের দিনের মতোই ধমক দিয়ে থামালেন।

কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ থামার জিনিস না। চান্স পেলেই স্যারকে ধরছেন, আমি বৃত্তি পরীক্ষা দেব, স্যার। আপনি ব্যবস্থা করে দিন।

একই ঘ্যানঘ্যাননি রোজ শুনতে শুনতে স্যার একদিন মহা বিরক্ত হয়ে বললেন, আয় আমার সঙ্গে।

নিয়ে গেলেন হেডস্যারের রুমে, স্যার, এই ছেলেটা বৃত্তি পরীক্ষা দিতে চায়।

হেডস্যার অবাক, বলেন কী!

জি স্যার।

আরে ও তো সব সাবজেক্ট পাসই করতে পারে না, ও কী বৃত্তি পরীক্ষা দেবে? স্কুলের মান-ইজ্জত থাকবে না।

সারা জীবনই হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে বিচিত্র সব মানুষের দেখা হয়েছে। ওই স্যারটিও কিঞ্চিৎ বিচিত্র চরিত্রেরই ছিলেন। হেডস্যারকে বললেন, তার পরও আপনি স্যার ওকে কনসিডার করেন। দেখা যাক কী হয়।

সেই শিক্ষকের নাম আমার মনে পড়ছে না। হুমায়ূন ভাই বলেছিলেন, ভু্লে গেছি। স্মৃতি আজকাল কিছুটা প্রতারণাও করছে।

তো, ক্লাস টিচারের কথা শুনে হেডস্যার হতভম্ব, এসব আপনি কী বলছেন? এটা কী করে সম্ভব? স্কুলের মান-ইজ্জত সব যাবে।

শেষ পর্যন্ত ওই স্যারের কারণেই হেডস্যার কনসিন্ডার করলেন। ক্লাস এইটের একটি খারাপ ছাত্রও বৃত্তি পরীক্ষা দেবে এমন ঘটনা চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুলে কখনো ঘটে নি।

হুমায়ূন আহমেদ দারুণ খুশি। আরে, কিসের বৃত্তি পরীক্ষা, টিফিন ডাবল পাওয়া যাবে এটাই হচ্ছে আসল ঘটনা।

পরদিন থেকে ভালো ছাত্রদের মতো ডাবল টিফিন পেতে লাগলেন। কিন্তু কপাল খারাপ, চার-পাঁচ দিনের মাথায় জলবসন্ত হয়ে গেল। জলবসন্ত নিয়ে স্কুলে যাওয়া যায় না, বাড়িতে শুয়ে থাকতে হয়। রাতের বেলা তো বটেই, দিনের বেলাও মশারি টানিয়ে রাখতে হয়। মাথার কাছে নিমের একটা ডাল রাখা হয়েছে। ডাল ভর্তি পাতা। নিমপাতা জলবসন্তের মহৌষধ। শরীর অবিরাম চুলকায়। তখন নিমপাতা শরীরে বুলিয়ে দিলে আরাম হয়।

কিন্তু মশারির তলার জীবন লেখকের ভালো লাগে না। ভাইবোনরা কেউ তাঁর সামনে আসেই না। জলবসন্ত ছোয়াচে রোগ। কাছে এলেই বা ছুলেই হবে। বাবা চাকরি নিয়ে ব্যস্ত, মা সংসার নিয়ে। বালক হুমায়ূন আহমেদ মশারির তলায় একা একা ছটফট করেন। সময় আর কাটে না। ওদিকে বৃত্তি পরীক্ষার মাস দেড়-দুয়েক বাকি।

একদিন মনে হলো, আচ্ছা, ক্লাসের বইগুলো একটু পড়ে দেখি তো। কিছু হোক আর না হোক, সময়টা তো কাটবে।

জলবসন্ত ভরা শরীরে মশারির তলায় সময় কাটানোর জন্য ক্লাসের বইগুলো পড়তে শুরু করলেন, অঙ্কগুলো একা একাই করতে লাগলেন। লেখাপড়ার আশ্চর্য এক নেশা ধরে গেল। ধীরে ধীরে জলবসন্ত সারল। বৃত্তি পরীক্ষার দিন এসে গেল। পরীক্ষা দিলেন। ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেলেন। স্কুলের ভালো ছাত্র যারা তাঁর সঙ্গে পরীক্ষা দিয়েছিল, তারা কেউ তাঁর ধারে কাছেও নেই। সবাইকে পেছনে ফেলে হুমায়ূন আহমেদ নাম্বার ওয়ান!

শুরু হলো হুমায়ূন আহমেদের ভালো ছাত্রের জীবন। এসএসসিতে স্ট্যান্ড করলেন, এইচএসসিতে স্ট্যান্ড করলেন। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হলেন, তুখোড় রেজাল্ট। ডক্টরেট করতে গেলেন আমেরিকার নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটিতে। অলথ্রু এ ক্যাটাগরির স্টুডেন্ট। শিক্ষকতার জীবন শুরু করলেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার। অধ্যাপক হয়ে ডক্টর হুমায়ূন আহমেদ শিক্ষকতা ছেড়ে দিলেন। তত দিনে সাহিত্যজগতে তিনি কিংবদন্তি হয়ে গেছেন।

কিন্তু ক্লাসের খারাপ ছাত্রটি বৃত্তি পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো করেছে, স্কুলে হৈচৈ পড়ে গেছে। সেই টিচার পারলে হুমায়ূন আহমেদকে কোলে নিয়ে হেডস্যারের রুমে চলে যান। ছাত্রের ভালো রেজাল্টের গৌরবে স্কুলে তাঁর পজিশনও হাই হয়ে গেছে।

ক্লাস নাইনে ঘটল আরেক ঘটনা।

জেনারেল ম্যাথের টিচার হুমায়ূন আহমেদের খাতা দেখতে দেখতে এতটাই মুগ্ধ হয়ে গেছেন, ১০০ নম্বরের জায়গায় ১১০ নম্বর দিয়ে দিয়েছেন।

হেডস্যার অঙ্কের টিচারকে ডেকে পাঠালেন। এটা আপনি কী করেছেন? ১০০ নম্বরের জায়গায় ১১০? অঙ্কের টিচার খেপে গেলেন। ছেলেটা অঙ্কে এত ভালো, আমার ইচ্ছা আমি তাকে ১০০-র মধ্যে ১১০ দিয়েছি। আপনার কোনো অসুবিধা আছে?

হেডস্যার হতভম্ব। এ দেখি অদ্ভূত চরিত্ৰ!

নিশ্চয় জীবনের এসব অভিজ্ঞতা থেকেই হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস-গল্প-নাটকে অদ্ভুত সব চরিত্রের সমাবেশ ঘটান। তাঁর অভিজ্ঞতা এবং দেখার ভঙ্গি অন্য কারও সঙ্গে মেলে না।

এসব ঘটনা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আড্ডায় হুমায়ূন ভাই মজা করে বলেছেন। আমি আমার স্মৃতি থেকে লিখছি।

হুমায়ূন ভাইয়ের ভয় পাওয়া নিয়ে এবার নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি।

১৯৮৫-৮৬ সালের কথা। বিটিভিতে চলছে হুমায়ূন আহমেদের দেশ-কাঁপানো ধারাবাহিক এইসব দিনরাত্রি। প্রযোজক মুস্তাফিজুর রহমান। সেই নাটক নিয়ে চারদিকে চলছে তুমুল আলোচনা। নাটকের ছোট্ট মেয়ে টুনি, তার ব্লাড ক্যান্সার। দর্শক আতঙ্কে আছে টুনির মৃত্যু নিয়ে। ওই প্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশনের কোনো ধারাবাহিক নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় পোস্ট এডিটরিয়াল পর্যন্ত লেখা হলো। টুনিকে যেন মেরে ফেলা না হয়। কোনো কোনো সাপ্তাহিক পত্রিকা কাভার স্টোরি করেছে।

নাটক যখন তুঙ্গে, তখন এক সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে হুমায়ূন ভাই গেছেন মুস্তাফিজ ভাইয়ের ফ্ল্যাটে। তিনি তখন নিউমার্কেটের দক্ষিণ দিককার সরকারি কোয়াটারে থাকেন। প্রায়ই আমাকে নিয়ে হুমায়ূন ভাই তাঁর ফ্ল্যাটে যান। খাওয়াদাওয়া, গল্পআড্ডা আর নাটক নিয়ে নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা। আড্ডা শেষ করে হুমায়ূন ভাই ফিরে যান। তাঁর আজিমপুরের বাসায়, আমি চলে যাই গেণ্ডারিয়ায়।

ও রকম এক সন্ধ্যার ঘটনা।

সিঁড়ি ভেঙে আমরা দুজন মুস্তাফিজ ভাইয়ের ফ্ল্যাটের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছি। সরকারি পুরনো আমলের ফ্ল্যাট। দরজাগুলো পুরনো। দরজার মাথার ওপর পুরনো আমলের কলিংবেলের সুইচ। সিঁড়িতে টিমটিম করে জুলছে অল্প পাওয়ারের একটা বাম্ব। হুমায়ূন ভাই আনমনা ভঙ্গিতে কলিংবেলের সুইচে হাত দিতে গিয়েই উরে বাবা রে বলে একলাফে সরে এলেন।

আমি কিছুই বুঝতে পারি নি। ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। প্রথমে মনে হলো পুরনো কলিংবেল, তারফারে লিকটিক হয়ে আছে কি না! হুমায়ূন ভাই কি ইলেকট্রিক শক খেলেন।

খুবই নার্ভাস ভঙ্গিতে তার হাত ধরলাম। কী হলো, হুমায়ূন ভাই?

তিনি কোনোরকমে বললেন, মাকড়সা।

মাকড়সা?

হ্যাঁ।

তিনি রীতিমতো কাঁপছেন। তাকিয়ে দেখি, কলিং সুইচের ওখানে মাঝারি সাইজের একটা মাকড়সা।

মাকড়সাকে এ রকম ভয়?

সত্যি তা-ই। হুমায়ূন ভাই সবচেয়ে ভয় পান মাকড়সা। তাঁর ভাইবোনরাও কেউ কেউ মাকড়সাকে খুবই ভয় পান।

সেদিন মাকড়সার ভয়ে মুস্তাফিজ ভাইয়ের ফ্ল্যাটে তিনি আর স্বাভাবিক হতে পারলেন না। দ্রুত আড্ডা শেষ করে আমরা ফিরে এলাম।

আমরা তখন প্রায়ই বাংলাবাজারে পাবলিশার্সদের ওখানে গিয়ে চা-বিস্কুট খাই আর আড্ডা দিই। রয়ালটির টাকা পয়সার জন্যও যাই কোনো কোনো দিন। আমার অবস্থা তখন খুবই খারাপ। হূমায়ুন ভাই ইউনিভার্সিটির টিচার। তাঁর একটা বঁধা রোজগার আছে। আমার নেই কিছুই! হুমায়ূন ভাইয়ের কাছ থেকে পঞ্চাশ-একশ টাকা ধারও নিই। সেই ধার কোনোদিন শোধ করি না।

একদিন দুপুরের দিকে বাংলাবাজার থেকে রিকশায় করে যাচ্ছি। তার শহীদুল্লাহ হলের কোয়ার্টারে। বাহাদুর শাহ পার্কের ওখানে দেখি এক পাখিওয়ালা খাচায় করে মুনিয়া পাখি বিক্রি করছে। আমরা রয়ালটির কিছু টাকা পেয়েছি। খাচাসহ হুমায়ূন ভাই তিন জোড়া মুনিয়া পাখি কিনে ফেললেন।

ঢাকায় তখন ট্রাফিক জ্যাম বলতে কিছু নেই। আমরা রিকশায় করে ইউনিভার্সিটি এলাকার দিকে যাচ্ছি। যেতে যেতে দুজনে মিলে একটা বিজনেসের প্ল্যান করে ফেললাম।

আমাদের সেই ব্যবসার প্ল্যান ইত্যাদির কথা পরে বলব।

 ০৫. ভোরের কাগজ-এর সাহিত্য পাতা

ভোরের কাগজ-এর সাহিত্য পাতায় হুমায়ূন আহমেদ ধারাবাহিকভাবে লিখতে শুরু করেছিলেন তার মনোজগৎ আচ্ছন্ন করে থাকা মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস জোছনা ও জননীর গল্প।

অনেক বছর আগের কথা।

হুমায়ূন আহমেদ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। বিশাল ক্যানভাসের উপন্যাসটি লেখার জন্য স্ত্রী আরও কয়েক বছর আগে তাঁকে ৫০০ পৃষ্ঠার একটি খাতা উপহার দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বছরের ছুটি নিয়ে জোছনা ও জননীর গল্প লিখতে শুরু করেন হুমায়ূন আহমেদ। কিন্তু কয়েক কিস্তি লিখে লেখা বন্ধ করে দেন। নীলগঞ্জ হাই স্কুলের আরবি শিক্ষক মাওলানা ইরতাজউদ্দিন কাশেমপুরী কমলাপুর রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে আছেন। এই লাইনটি দিয়ে উপন্যাস শুরু হয়ে কিছুদূর এগোয়, তারপর আর খবর নেই। লেখা বন্ধ।

পত্রিকার সম্পাদক একটু ফাঁপরে পড়েন। তারপর কিছুদিনের গ্যাপে আবার শুরু হয় লেখা, কয়েক কিস্তির পর আবার বন্ধ। ঈদসংখ্যার লেখা, বইমেলার লেখা, নাটক, সিনেমা-সবই লিখছেন হুমায়ূন আহমেদ, শুধু জোছনা ও জননীর গল্প লিখছেন না।

কেন?

তাঁর লাখ লাখ পাঠকের মতো তামার মনেও প্রশ্নটি ঘুরঘুর করে। দুইবারে লেখা কয়েক কিস্তি পড়ে অস্থির হয়ে আছি। কবে শেষ হবে এই উপন্যাস? কবে পুরোটা পড়া যাবে? দেখা হলে জিজ্ঞেস করি। তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মজা করেন। জোছনা ও জননীর পল্প প্ৰসঙ্গ এড়িয়ে যান। সময় কাটে সময়ের মতো। হৃদয়ে দুৰ্যোগ নামে লেখকের। সিঙ্গাপুরে গিয়ে বাইপাস করান। অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার আগমুহূর্তে, অ্যানেসথেশিয়ার কল্যাণে অবচেতন হওয়ার মুহূর্তে তাঁর মনে পড়ে, একটি কাজ বাকি রয়ে গেল , জোছনা ও জননীর গল্প লেখা। মাতৃভূমির ঋণ শোধ করা হলো না।

ফিরে এসে লেখা শুরু করেন।

এবার আর কিস্তি কিস্তি নয়, কোনো পত্রিকায় ধারাবাহিক নয়, সরাসরি লেখা শেষ করা, বই বের করা। পরম করুণাময়কে ধন্যবাদ যে এবার আর তিনি থেমে যান নি, লেখা শেষ করেছেন।

২০০৪ সালের কথা। জোছনা ও জননীর গল্প এখন পাঠকের হাতে হাতে। বাংলা একাডেমী বইমেলার মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি। ৪০০ টাকা দামের বইটির চার-পাঁচটি সংস্করণ হয়ে গেছে সপ্তাহখানেকের মধ্যে। প্রকাশক অন্যপ্রকাশ।

বইমেলায় অন্যপ্রকাশের স্টলে জোছনা ও জননীর গল্প-র জন্য দীর্ঘ লাইন ধরতে দেখেছি পাঠককে। কোনো কোনো দিন বাঁধাইয়ের কারণে বই থাকত না স্টলে। ইস্, সে সময় যে কী হাহাকার পাঠকের! এসব দৃশ্য চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না। একজন লেখক যে কী ধরনের জাদুকরী প্রভাব বিস্তার করতে পারেন পাঠকের মনে, হুমায়ূন আহমেদ তার একমাত্র উদাহরণ : বাংলা ভাষার কোনো লেখকের ক্ষেত্রে এ রকম ঘটে নি।

হুমায়ূন আহমেদের পাঠকরা জানেন, লেখায় এক ধরনের ঘোর তৈরি করেন তিনি, এক ধরনের মায়া বিস্তার করেন। একবার তাঁর লেখার ভেতর ঢোকার অর্থ হচ্ছে, সেই মায়ার জগতে বন্দি হওয়া। পড়া শেষ হওয়ার পরও ঘোর সহজে কাটতে চায় না। পাঠক আচ্ছন্ন থাকে অনেক দিন।

জোছনা ও জননীর গল্প পড়ে এখনো আচ্ছন্ন হয়ে আছি আমি।

তবে লেখায় শুধু যে পাঠককেই আচ্ছন্ন করেন হুমায়ূন আহমেদ তা নয়, তিনি নিজেও আচ্ছন্ন হন। লেখার সময় তাঁর নিজের মধ্যেও তৈরি হয় আশ্চর্য রকমের এক ঘোর। জোছনা ও জননীর গল্প লেখার সময় তাঁকে এ রকম ঘোরে পড়তে দেখেছি আমি। দিনভর মাথা নিচু করে লিখছেন, চা খাচ্ছেন, সিগারেট খাচ্ছেন, প্রািফ দেখছেন, লেখা বদলাচ্ছেন, কাটাকাটি করছেন আর পড়ছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলা-ইংরেজিতে লেখা হেন বই নেই, হেন পত্রপত্রিকা নেই, যা না পড়েছেন। সন্ধ্যার পর সাধারণত লেখেন না। তিনি, বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা দেন। সেই আড্ডার সময়ও লক্ষ করেছি, সবার সঙ্গে থেকেও কোন ফাঁকে তিনি যেন একা হয়ে গেছেন। তাঁর মন চলে গেছে। উনিশ শ একাত্তরে। মনে মনে জোছনা ও জননীর গল্পের পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলো সাজাচ্ছেন তিনি। নিজের মধ্যে প্রবল ঘোর তৈরি না হলে তিন-চার মাসের মধ্যে ৪৯৩ পৃষ্ঠার এ রকম একটি মহৎ উপন্যাস লিখে শেষ করা যায় না। সঙ্গে আছে ছয় পৃষ্ঠার চমৎকার একটি ভূমিকা। আর ব্যাপক পড়াশোনার কথা তো আগেই বললাম।

এতক্ষণে পাঠক সংগত কারণেই আশা করবেন, উপন্যাসটির ভালো-মন্দ নিয়ে আমি কিছু কথা বলব, কিছু সমালোচনা করব, উপন্যাসটির দোষ-ত্রুটি ধরব, অমুক জায়গায় তমুক হলে ভালো হতো, ওই চরিত্রটি যেন হঠাৎই শেষ হয়ে গেছে, অমুক অমুক তথ্যে গণ্ডগোল আছে ইত্যাদি। সবিনয়ে বলি, ওটি আমার কাজ নয়। ওই কাজটি করবেন গবেষক-সমালোচকরা। আমি গবেষক কিংবা সমালোচক নই। যদিও জোছনা ও জননীর গল্প-র পূর্বকথায় ব্যাপারটি পরিষ্কার করে দিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ।

 

জোছনা ও জননীর গল্প কোনো ইতিহাসের বই নয়, এটি একটি উপন্যাস। তার পরও ইতিহাসের খুব কাছাকাছি থাকার চেষ্টা আমি করেছি। সেখানেও ভুলভ্রান্তি হতে পারে। হওয়াটা স্বাভাবিক। উপন্যাস যেহেতু কোনো আসমানি কিতাব নয়, এসব ভুলভ্রান্তি দূর করার উপায় আছে।

উপন্যাসে চরিত্র হিসেবে সেই সময়ের অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু মানুষ এনেছি। এই স্বাধীনতা একজন ঔপন্যাসিকের আছে। গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের চরিত্র ফুটিয়ে তোলায় কোনো ভুল যদি করে থাকি, তার জন্য আগেভাগেই ক্ষমা চাচ্ছি। অতি বিনয়ের সঙ্গে সেই বিখ্যাত উক্তি মনে করিয়ে দিচ্ছি—একজন লেখক যা লিখবেন সেটাই সত্যি।

সেই সত্য যা রূচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নহে।
কবি, তব মনোভূমি রামের জনম স্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।

উপন্যাসে বর্ণিত প্রায় সব ঘটনাই সত্য। কিছু নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা, কিছু অন্যের অভিজ্ঞতা থেকে ধার নেওয়া। প্রকাশিত হওয়ার আগেই এ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি অনেককে পড়িয়েছি। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখে নি (এই প্রজন্মের পাঠকের কথা বলছি), তারা পড়ার পর বলেছে, উপন্যাসের অনেক ঘটনাই তাদের কাছে কাল্পনিক বলে মনে হচ্ছে, এ রকমও কি হয়?

তাদের কাছে আমার একটাই কথা, সে বড় অদ্ভুত সময় ছিল। স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের মিশ্র এক জগৎ-সবই বাস্তব আবার সবই অবাস্তব। আমি সেই ভয়ংকর সুন্দর সুররিয়েলিষ্টিক সময় পার করে এসেছি। তার খানিকটাও যদি ধরে থাকতে পারি, তাহলেই আমার মানবজীবন ধন্য।

 

খানিকটা নয়, প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ, আপনি প্রায় সবখানিই ধরেছেন। জোছনা ও জননীর গল্প লিখে আপনি আপনার লেখকজীবন পূর্ণ করেছেন। এ রকম একটি উপন্যাস লেখার পর একজন লেখকের আর কিছু চাওয়ার থাকে না।

হুমায়ূন আহমেদের অন্যান্য লেখার সঙ্গে জোছনা ও জননীর গল্প একেবারেই মেলে না। এ একেবারেই অন্য ধাচের রচনা। অতি সরল এবং আশ্চর্য রকমের নিরাসক্ত, ঘরোয়া ভাষায় পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে গেছেন তিনি। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ—এই তিনটি কালকে কখন যে একাকার করে দিয়েছেন গল্পের ভেতর, কখন যে পাঠককে নিয়ে গেছেন স্বপ্নে, কখন ফিরিয়ে এনেছেন বাস্তবে—টেরই পাওয়া যায় না। উপন্যাস রচনার কোনো প্রচলিত রীতি তিনি মানেনই নি। যেভাবে লিখে আনন্দ পেয়েছেন, যেভাবে পাঠককে বোঝাতে পেরেছেন—গল্প সেভাবেই এগিয়ে নিয়ে গেছেন। যেখানে যে তথ্যের প্রয়োজন, নির্বিকারভাবে তা ব্যবহার করেছেন, ফুটনোটে উল্লেখ করেছেন তথ্যসূত্র। কোথাও কোথাও মুক্তিযুদ্ধের দলিল প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা তুলে দিয়েছেন। অর্থাৎ যখন যেখানে যা প্রয়োজন, যেমন করে সাজালে উপন্যাসটি পূর্ণাঙ্গ হবে তা-ই করেছেন। বহুটুকরোটাকরা গল্প, ঘটনা, চরিত্র আর ইতিহাসের উপাদানকে মহৎ শিল্পীর ভঙ্গিতে জোড়া দিয়ে দিয়ে যে সময়কে তিনি সম্পূর্ণ তুলে ধরেছেন, সেই সময়ের নাম উনিশ শ একাত্তর। ফলে এই উপন্যাস একাধারে আমাদের সবচেয়ে গৌরবময় সময়ের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস এবং মূল্যবান দলিলও। হুমায়ূন আহমেদ শুধু উপন্যাসই লেখেননি, মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার ইতিহাস লেখার মহৎ দায়িত্বটিও পালন করেছেন।

এই উপন্যাসে চরিত্র হয়ে এসেছেন মওলানা ভাসানী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, ইন্দিরা গান্ধী, ইয়াহিয়া খান, ভুট্টো, টিক্কা খান, অর্থাৎ সেই সময়কার সব শ্ৰদ্ধেয় ও নিন্দিত মানুষ। ভারতীয় বাহিনীর চরিত্ররা এসেছেন যে যাঁর ভূমিকায়। মুক্তিযোদ্ধারা এসেছেন, রাজাকাররা এসেছে, শর্ষিনা পীর সাহেব এসেছেন, আর এসেছে যারা দেশের নানা স্তরের নানা রকম মানুষ। ছোট, বড় এবং ঐতিহাসিক এত চরিত্রের সমাহার। আর কোনো বাংলা উপন্যাসে এভাবে এসেছে কি না, এত সার্থকভাবে চরিত্রগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে কি না আমার জানা নেই।

আজকের দুই নেত্রীর সেই সময়কার অবস্থার কথা এসেছে, শেখ জামালের কথা এসেছে, শেখ হাসিনার ছেলে জয়ের জন্মের কথা এসেছে। এত সহজ ও সাবলীলভাবে এসেছে, পড়ে পাঠকের মনে হবে, আরে এইসব মানুষের কথা এভাবেও লেখা যায়!

 

ইরতাজউদ্দিন তখন মওলানা সাহেবকে চিনলেন- ইনি মওলানা ভাসানী! পত্রিকায় কত ছবি দেখেছেন। এই প্রথম সামনাসামনি দেখা।

ইরতাজউদ্দিন তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন। মওলানা ভাসানী তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, ঘুম ভালো হয়েছে? যেন কত দিনের চেনা মানুষ।

ইরতাজউদ্দিন বিনয়ের সঙ্গে বললেন, জি।

আপনার ঘুমের ব্যাঘাত করেছি, কিছু মনে করবেন না।

ইরতাজউদ্দিন আরও লজ্জার মধ্যে পড়ে গেছেন। এ রকম একজন বিখ্যাত মানুষের সামনে ইজিচেয়ারে শুয়ে থাকা যায় না। তিনি উঠে দাড়ালেন।

 

এই ইরতাজউদ্দিন হুমায়ূন আহমেদের এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। পরাধীন দেশে জুমার নামাজ হয় না, জুমার নামাজ পড়াতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। এ কারণে ক্যাপ্টেন বাসেত তাঁকে নীলগঞ্জ স্কুল এবং বাজারে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় প্রদক্ষিণ করায়।

 

বাজারে ছোট্ট একটা ঘটনা ঘটল। দরজির দোকানের এক দরজি একটা চাদর দিয়ে ছুটে এসে ইরতাজউদ্দিনকে ঢেকে দিয়ে জড়িয়ে ধরে থাকল। ঘটনা এতই দ্রুত ঘটল যে সঙ্গের মিলিটারিরা বাধা দেবার সময় পেল না।

ইরতাজউদ্দিন এবং দরজিকে মাগরেবের নামাজের পর সোহাগী নদীর পাড়ে নিয়ে গুলি করা হলো। মৃত্যুর আগে আগে ইরতাজউদ্দিন পরম নির্ভরতার সঙ্গে আল্লাহপাকের কাছে উঁচু গলায় শেষ প্রার্থনা করলেন, হে আল্লাহপাক, যে মানুষটা জীবনের মায়া তুচ্ছ করে আমাকে লজ্জার হাত থেকে বাচাতে চেয়েছিল, তুমি তার প্রতি দয়া করো। তুমি তার প্রতি তোমার রহমতের দরজা খুলে দাও।

পরদিন প্রবল বৃষ্টিতে জীবনের মায়া ত্যাগ করে নীলগঞ্জ হাই স্কুলের হেডমাস্টার মনসুর সাহেব। আর তাঁর পাগল স্ত্রী আসিয়া সোহাগী নদীর পাড় থেকে ইরতাজউদিনের লাশ টেনে আনার সময় এলাকার কোনো বাঙালি নয়, রেলুচ রেজিমেন্টের সিপাহি আসলাম খাঁ তাদের সঙ্গে হাত মেলায়।

 

কলমের সামান্য আঁচড়ে আঁকা আসলাম খাঁ চরিত্রটির মাধ্যমে লেখক বোঝালেন, পাকিস্তান আর্মিতেও দু-একজন হৃদয়বান মানুষ ছিলেন।

 

শেখ সাহেব হেসে ফেলে বললেন, তুই তো তোর গোপন কথা সবই বলে ফেললি। তুই আইবির লোক, তুই তোর পরিচয় গোপন রাখবি না?

আমি সরকারের হুকুমে আসলেও ডিউটি করি আপনার। আমি খেয়াল রাখি, যেন কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করতে না পারে।

আমার ডিউটি করিস কী জন্যে?

কারণ আপনিই সরকার।

শেখ মুজিব এই কথায় খুবই তৃপ্তি পেলেন। মোবারক হোসেনের কাধে হাত রেখে বললেন, তুই আমার জন্যে কী করতে পারবি?

আপনি যা করতে বলবেন, করতে পারব। যদি বলেন, ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়, আমি পড়ব।

তোর নাম কী?

মোবারক হোসেন। পুলিশ ইন্সপেক্টর।

দেশের বাড়ি কোথায়?

কিশোরগঞ্জ।

ভালো জায়গায় জন্ম। বীর সখিনার দেশ।

ছেলেমেয়ে কী?

তিন মেয়ে, এক ছেলে। তিন মেয়ের নাম-মরিয়ম, মাসুমা, মাফরুহা আর ছেলের নাম ইয়াহিয়া।

কী বলিস তুই? ছেলের নাম ইয়াহিয়া?

আমার দাদিজান রেখেছেন। নবীর নামে নাম।

আয় আমার সঙ্গে।

স্যার, কোথায় যাব?

তোকে নিয়ে বাড়ির ছাদে উঠব। তারপর তোকে হুকুম দেবী ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়তে। দেখি হুকুম তামিল করতে পারিস কি না।

মোবারক হোসেন শান্ত গলায় বললেন, স্যার, চলেন।

শেখ মুজিব মোবারক হোসেনকে নিয়ে দোতলায় এলেন। তিনি তাঁর স্ত্রীকে বললেন, এই, আমাদের দুজনকে নাশতা দাও।  এ হলো আমার এক ছেলে।

 

অতি সামান্য এক ঘটনায়, মাত্র কয়েক লাইনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্রের প্রধান দিকটি নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুললেন হুমায়ূন আহমেদ। মানুষের প্রতি এই মহান নেতার তীব্ৰ ভালোবাসা, অন্যদিকে তার জন্য সাধারণ মানুষের ভালোবাসা। জীবন দিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার।

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের চরিত্রটি এল এভাবে :

 

তাঁর চোখ কালো চশমায় ঢাকা। গায়ে ধবধবে সাদা হাফহাতা গেঞ্জি। বসেছেন ঋজু ভঙ্গিতে। বাঁ হাতের কজিতে পরা ঘড়ির বেল্ট সামান্য বড় হয়ে যাওয়ায় হাত নাড়ানোর সময় ঘড়ি উঠানামা করছে। এতে তিনি সামান্য বিরক্ত, তবে বিরক্তি বোঝার উপায় নেই। যে চোখ মানবিক আবেগ প্ৰকাশ করে, সেই চোখ তিনি বেশির ভাগ সময় কালো চশমায় ঢেকে রাখতে ভালোবাসেন। মানুষটার চারপাশে এক ধরনের রহস্য আছে।

তাঁর নাম জিয়াউর রহমান।

মেজর জিয়া এস ফোর্সের অধিনায়ক কে এম শফিউল্লাহ এবং কে ফোর্সের অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফের সঙ্গে এক বৈঠকেও খোলাখুলি নিজের এই মত প্ৰকাশ করেন। তার কথা হলো—গেরিলা ধরনের এই যুদ্ধে আমাদের সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কের প্রয়োজন নেই। আমাদের দরকার কমান্ড কাউন্সিল। সবচেয়ে বড় কথা, সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত কেউ সেনাবাহিনীর প্রধান হতে পারেন না।

 

জোছনা ও জননীর গল্পতে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কথা লেখা হয়েছে। এইভাবে :

নিয়াজীর ফোপানো একটু থামতেই জেনারেল নাগরা তার পাশে দাঁড়ানো মানুষটির সঙ্গে নিয়াজীর পরিচয় করিয়ে দিলেন। শান্ত গলায় হাসি হাসি মুখে বললেন, এই হচ্ছে সেই টাইগার সিদ্দিকী।

জেনারেল নিয়াজী, জেনারেল জামশেদ অবাক হয়ে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকলেন কাদের সিদ্দিকীর দিকে। তাদের স্তম্ভিত ভাব কাটতে সময় লাগল। একসময় নিয়াজী করমর্দনের জন্যে তার হাত বাড়িয়ে দিলেন কদের সিদ্দিকীর দিকে।

কাদের সিদ্দিকী হাত বাড়ালেন না। তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইংরেজিতে বললেন, নারী এবং শিশু হত্যাকারীদের সঙ্গে আমি করমর্দন করি না।

 

এ রকম বহু স্মরণীয় উদ্ধৃতি তুলে ধরতে ইচ্ছা করছে। কত চরিত্র, কত ঘটনার কথা মনে পড়ছে! শাহেদ, আসমানী, জোহর, মোবারক, গৌরাঙ্গ, নাইমুল, মরিয়ম, শাহ কলিম, রুনি, বি হ্যাপি স্যার, ধীরেন্দ্র রায়চৌধুরী ও কংকন। আর অতি ছোট চরিত্র হারুন মাঝি, যে ছিল একজন ডাকাত।

একটি উত্তাল সময় কীভাবে দেশের প্রায় প্রতিটি মানুষকে ঠেলে দিয়েছিল স্বাধীনতার দিকে, কীভাবে দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজীবিত হয়ে মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছিল মানুষ, এই উপন্যাসের পাতায় পাতায় ছড়ানো আছে সেই কথা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের, বিভিন্ন স্তরের মানুষ, কখনো একজন ঠেলাগাড়িওয়ালা, কখনো হুমায়ূন আহমেদের নিজ পরিবার, মা-বাবা, ভাইবোন, পাঙ্খাপুলার রশিদ, নানা স্তরের নানা মানুষ, কারও সঙ্গে কারও হয়তো কোনো সম্পর্ক নেই, আবার সবাই যেন সবার সঙ্গে যুক্ত। যে সুতায় সব মানুষকে একত্রে গেঁথে জোছনা ও জননীর গল্প নামের এই মহৎ মালাটি হুমায়ূন আহমেদ গেঁথেছেন, সেই মালার নাম উনিশ শ একাত্তরের বাংলাদেশ। উপন্যাসটি পড়তে পড়তে একাত্তরের প্রকৃত ইতিহাস পাওয়া যাবে-ক্ৰোধে, আবেগে, ঘূণায়, মমতায় এবং চোখের জলে ভাসবে মানুষ।

 

তারও অনেক পরে ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে বাড়ির সামনে দাড়ি-গোফ ভর্তি এক যুবক এসে দাঁড়াল। গম্ভীর গলায় বলল, সিঁড়িতে যে মেয়েটি বসে আছে, তাকে কি আমি চিনি? দীর্ঘকায় এই যুবক দুহাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মরিয়ম চিৎকার করে বলল, মা, দেখো কে এসেছে! মাগো, দেখো কে এসেছে!

মরিয়ম যুবকটিকে জড়িয়ে ধরে আছে। যুবকের বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলছে—আহা, এইভাবে সবার সামনে আমাকে ধরে আছ কেন? আমাকে ছাড় তো। আমার লজ্জা লাগে। নাইমুল কিন্তু তার স্ত্রীকে ধরে ছিল না। তার হাত এখনো প্রসারিত। কঠিন হাতে নাইমুলকে জড়িয়ে ধরেছিল মরিয়ম নিজেই।

পাঠক, মহান বিজয় দিবসে যে গল্প শেষ হবে, সেই গল্প আনন্দময় হওয়া উচিত বলেই আমি এ রকম একটা সমাপ্তি তৈরি করেছি। বাস্তবের সমাপ্তি এ রকম ছিল না। নাইমুল কথা রাখে নি। সে ফিরে আসতে পারে নি তার স্ত্রীর কাছে। বাংলার বিশাল প্ৰান্তরের কোথাও তার কবর হয়েছে। কেউ জানে না কোথায়। এই দেশের ঠিকানাবিহীন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার কবরের মধ্যে তারটাও আছে, তাতে কিছু যায়-আসে না। বাংলার মাটি পরম আদরে তার বীর সন্তানকে ধারণ করেছে। জোছনা রাতে সে তার বীর সন্তানদের কবরে অপূর্ব নকশা তৈরি করে। গভীর বেদনায় বলে, আহা রে! আহা রে!

 

হুমায়ূন আহমেদের জোছনা ও জননীর গল্প শুধু উপন্যাস নয়, উপন্যাসের চেয়ে বেশি কিছু। এ হচ্ছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত এক মহাকাব্য। এত সার্থক ও সুন্দরভাবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আর কিছু রচিত হয় নি। বাঙালির ঘরে ঘরে এই গ্ৰন্থ অত্যন্ত যত্নে ও মায়ায় রক্ষিত হবে। কোনো কোনো জোছনা রাতে বাংলার গ্রাম-প্রান্তরের দাওয়ায় বসে একজন তাঁর উদাত্ত গলায় পড়োবেন এই উপন্যাসের একেকটি অধ্যায়, আর তার চারপাশ ঘিরে বসে থাকা শ্রোতারা চোখের জলে ভাসবেন। এই উপন্যাস তাদের ফিরিয়ে নেবে স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের সেই মিশ্র সময়ে-উনিশ শ একাত্তরে।

০৬. জোছনা ও জননীর গল্প-র প্রকাশনা উৎসব

জোছনা ও জননীর গল্প-র প্রকাশনা উৎসব হবে।

হুমায়ূন ভাই সাধারণত প্রকাশনা উৎসব ইত্যাদি এড়িয়ে চলেন। এ বইটি নিয়ে তাঁর একটু বিশেষ মায়া আছে। মাজহারের প্রস্তাবে তিনি রাজি হলেন।

২০০৪ সালের কথা।

ফেব্রুয়ারি বইমেলা চলছে। মেলার মধ্যেই আয়োজন করা হলো। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এক বিকেলে অনুষ্ঠান। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তিনি এলেন। কোনো বিশেষ অতিথি বা সভাপতি—এসব নেই। পাঁচজন বড়মাপের মানুষ বইটি নিয়ে কথা বলবেন। শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আনিসুজ্জামান, মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করবেন আসাদুজ্জামান নূর।

এক দিন আগে হঠাৎ করে মত বদলালেন হুমায়ূন ভাই। মাজহারকে বললেন, উপন্যাস নিয়ে অনুষ্ঠান, এই অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হবেন একজন লেখক। দায়িত্বটা তিনি আমাকে দিলেন। আলোচনা শেষে মোহিনী চৌধুরী রচিত সেই বিখ্যাত গান—

মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্ৰাণ হলো বলিদান
লেখা আছে অশ্রুজালে…

খালি গলায় গেয়ে শোনালেন শাওন। হুমায়ূন ভাইকে দেখি উইংসের আড়ালে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো কাঁদছেন। কান্নার কারণ সেই মুহুর্তে তিনি চলে গিয়েছিলেন ১৯৭১-এ। সেই ভয়ংকর সময়ের কথা ভেবে তিনি কাঁদছিলেন।

এই আবেগপ্রবণ শিশুর মতো মানুষটিই আবার খোঁচাখুঁচির ওস্তাদ, মজা করার ওস্তাদ। প্রিয় মানুষজনকে খুঁচিয়ে আনন্দ পান।

তাঁর মুখ থেকে শোনা একটি ঘটনার কথা বলি। পিএইচডি করে আমেরিকা থেকে ফিরেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আগের চাকরিতে ঢুকেছেন। হুমায়ূন আজাদের সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব। তিনি খুবই সিরিয়াস টাইপের মানুষ। ইংরেজি সাহিত্যের এক সেমিনারে নিয়ে গেছেন হুমায়ূন আহমেদকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংবদন্তিতুল্য ইংরেজির অধ্যাপক, আমি তাঁর নামটা বলছি না, তিনি বক্তৃতা করছেন। হুমায়ূন আহমেদ ভদ্রলোককে চেনেন এবং তাঁর সম্পর্কে জানেন সবই। তবু তাঁর বক্তৃতা শুনে একটু মজা করতে চাইলেন। ভদ্রলোক বক্তৃতা শেষ করে স্টেজ থেকে নেমে আসার পর হুমায়ূন আহমেদ তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। হাসিমুখে বললেন, স্যার, আপনার চিবিয়ে চিবিয়ে বলা ইংরেজি আমার ভালো লেগেছে।

সেই ভদ্রলোক ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে এতই পস, জীবনে এ ধরনের কথা বোধ হয় শোনেনই নি। হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ হুমায়ূন আহমেদের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আপনি একটা কাজ করুন, আমার বক্তৃতার দু-একটি বাক্য না চিবিয়ে উচ্চারণ করুন তো।

হুমায়ুন আজাদ গিয়েছিলেন ওয়াশরুমে। সেখান থেকে এসে পরিস্থিতি সামাল দিলেন। ইংরেজির অধ্যাপককে বললেন, স্যার, ও তো আমাদের হুমায়ূন আহমেদ।

ভদ্রলোক হুমায়ূন ভাইকে চিনতে পারেন নি। নাম শুনে রাগ-বিরক্তি ভুলে গেলেন। হাসিমুখে বললেন, আরে, আমি তো আপনার লেখার ভক্ত।

এক বন্ধুর বাসায় দাওয়াত খেতে গেছেন। বন্ধুপত্নী অতিযত্নে রান্নাবান্না করেছেন। বহু আইটেম। সঙ্গে আমি এবং আমাদের আরও দু-একজন বন্ধু আছেন। হুমায়ূন ভাই যা যা পছন্দ করেন, ওসবেরই আয়োজন করেছেন তিনি। বন্ধুপত্নীর রান্না তেমন সুবিধার না। তবু ভদ্রমহিলা তার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। খাওয়াদাওয়া শেষ করে হুমায়ূন ভাই নির্বিকার গলায় বললেন, এত বাজে রান্না জীবনে খাই নি।

আমাকে একবার বললেন, তোমাদের মাওয়ার ওদিককার পদ্মায় ভালো রিঠা মাছ পাওয়া যায়। তোমার বউকে বলে আমাকে রান্না করে পাঠাতে।

মাওয়া থেকে রিঠা মাছ আনালাম। আমার স্ত্রী রান্না করে পাঠালেন। হুমায়ূন ভাই খেলেন, আমার স্ত্রীকে নিজের উপন্যাস সংকলন অটোগ্রাফ দিয়ে পাঠালেন। পরদিন হঠাৎ আমাকে বললেন, রিঠা মাছটা মরা ছিল।

আমি বিস্মিত। রিঠা মাছ মরা ছিল না জ্যান্ত, এটা বোঝা বেশ কঠিন। কারণ মাছটা আনার পর আমি একপলক দেখেছিলাম। একদম তাজা এবং জ্যান্ত মনে হয়েছে। রিঠা খুবই শক্ত প্ৰাণের মাছ, দু-চার ঘণ্টায় মরে না, ভালো রকম তাজা থাকে।

আমার খটকা লাগল। বাসায় এসে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, রিঠা মাছটা জ্যান্ত ছিল না?

সে বলল, না, আনতে আনতে মরে গিয়েছিল। তবে তাজা ছিল, ফ্রেশ ছিল।

আমি আরেকটা ধাক্কা খেলাম। একজন মানুষ কতটা খাদ্যসচেতন হলে এটা বোঝা সম্ভব!

আমাদের যেবার তিনি কুতুবপুরে নিয়ে গেলেন, ৮৫/৮৬ সালের কথা। তাঁর বাবার নামে করা পাঠাগার উদ্বোধন। ওই যেবার হুমায়ুন আজাদ আর নির্মলেন্দু গুণ রাতভর ঝগড়া করলেন, সেবারের কথা। হুমায়ূন ভাইয়ের চাচা খুবই সমাদর করেছিলেন আমাদের, চমৎকার খাওয়াদাওয়ার আয়োজন ছিল। আমরা ফিরছিলাম ট্রেনে করে। ট্রেনের খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন হুমায়ূন ভাই, আমি তাঁর পাশে। মুগ্ধ গলায় বললাম, চাচা খুবই সমাদর করলেন আমাদের। ভালো খাইয়েছেন।

হুমায়ূন ভাই গম্ভীর গলায় বললেন, হুঁ, দেড় হাজার টাকার একটা বিলও ধরিয়ে দিয়েছেন।

তখনকার দিনে দেড় হাজার টাকা অনেক টাকা।

রাতের বেলা তাঁর অতিপ্রিয় একজনের ভাইয়ের বিয়েতে যেতে হবে। হুমায়ূন ভাই দলবল ছাড়া চলতে পারেন না। আমরা সবাই রেডি। কিন্তু হুমায়ূন ভাইয়ের তেমন ইচ্ছা নেই যাওয়ার। তাঁর ইচ্ছা নিজের ফ্ল্যাটে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেবেন।

সেটা সম্ভব না। যেতেই হবে।

আমরা রওনা দিলাম। অনেক রাতে। বিয়েশাদির খাওয়াদাওয়া শেষ। আমরা যাওয়ার পর নতুন করে অ্যারেঞ্জ করা হলো। খেতে শুরু করেছি। হুমায়ূন ভাই একবার মাত্র সামান্য বিরানি মুখে দিয়েই প্রচণ্ড রেগে গেলেন। হাতের ধাক্কায় প্লেট সরিয়ে প্রিয় মানুষটিকে বললেন, তুমি জানো না, আমি ঠান্ডা খাবার খাই না?

খাবার তেমন ঠান্ডা ছিল না, তবু তিনি রাগলেন। এই রাগটা আসলে ওই রাগ, যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না; প্ৰকাশ করলেন অন্যভাবে। আর খেলেনই না। উঠে চলে এলেন। তার সঙ্গে আমাদেরও খাওয়া হলো না।

গেণ্ডারিয়ায় আমাদের বন্ধু আলমগীর রহমানের বাড়িতে বহু বছর আগে আমরা খুব আডা দিতাম। আলমগীর ভাইয়ের স্ত্রী ঝরনা ভাবির রান্নার কোনো তুলনা হয় না। আলমগীর ভাই নিজেও খুব ভালো রান্না করেন। আমরা বিকেলবেলা আড্ডা দিতে বসি! রাতের বেলা তার ওখানে খেয়ে যে যার বাড়ি ফিরি। ও রকম এক বিকেলবেলা হুমায়ূন ভাই এসে বললেন, আমি একটা সেলুনে চুল কাটাতে গিয়েছিলাম, ন্যাকের লোম কাটার কথা বলে নাপিত আমার নাকে কাঁচি ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আমি খুবই বিরক্ত হয়েছি। চুল না। কাটিয়েই চলে আসছি। আলমগীর, একজন নাপিত ডেকে আনান, আমি আপনার এই বারান্দায় বসে চুল কাটাবো।

০৭. অসুস্থতার কথা লিখতে চাই না

চুয়াডাঙ্গা থেকে এক ভদ্রমহিলা ফোন করলেন, হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আপনার লেখাটা নিয়মিত পড়ছি। তিনি এখন কেমন আছেন এ কথা। আপনি একবারও লিখছেন না। আমরা জানতে চাই তিনি কেমন আছেন।

আমি বিনীতভাবে বললাম, আমি তাঁর অসুস্থতার কথা লিখতে চাই না। আমার  কলম সায় দেয় না। তবে তাঁর অসুস্থতার কথা, তিনি এখন কেমন আছেন এসব দুচার দিন পর পর সব কাগজেই লেখা হচ্ছে।

ভদ্রমহিলা একটু নাছোড় ধরনের। বললেন, আপনি কবে কীভাবে তাঁর অসুস্থতার কথা জানলেন?

আমার বলতে ভালো লাগছিল না। ব্যস্ততার ভান করে ফোন রেখে দিলাম। আজ এই লেখা লিখতে বসে মনে হচ্ছে, সেই ভদ্রমহিলার মতো হয়তো অনেক পাঠকের জানার আগ্রহ, আমি কীভাবে হুমায়ূন আহমেদের অসুস্থতার কথা জানলাম।

ঘটনাটা বলি।

আমার বহু বছরের পুরনো বন্ধু আলমগীর রহমান। বাংলাদেশের অত্যন্ত রুচিশীল ও বিখ্যাত প্ৰকাশন সংস্থা প্রতীক আর অবসরের স্বত্বাধিকারী। একসময় চমৎকার গল্প লিখতেন, সাংবাদিকতা করতেন। তারপর এলেন প্রকাশনায়। খুবই বন্ধুবৎসল মেজাজি মানুষ আলমগীর ভাই।

হঠাৎ একদিন তাঁর ফোন, মিলন, আপনি হুমায়ুনের সঙ্গে দেখা করেন।

আমি অবাক। হুমায়ূন ভাই সিঙ্গাপুর থেকে ফিরেছেন?

হ্যাঁ। শাশুড়ির পায়ের চিকিৎসার জন্য গিয়েছিল। নিজের চেকআপও করিয়ে আসছে। আপনি দেখা করেন। তিন দিন পর হুমায়ূন আমেরিকায় যাচ্ছে।

আমি ছিলাম গাড়িতে। অফিসে যাচ্ছিলাম। আলমগীর ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, জরুরি কিছু?

বলতে পারব না। আপনি দেখা করেন।

আমি একটু চিন্তিত হলাম। ব্যাপারটা কী?

ফোন করলাম মাজহারকে। কী খবর, মাজহার? আলমগীর ভাই ফোন করে বললেন…

হ্যাঁ। আপনি স্যারের সঙ্গে দেখা করেন।

ব্যাপারটা কী?

মাজহার বিষন্ন গলায় বললেন, খারাপ খবর আছে।

কী হয়েছে?

হুমায়ূন ভাইয়ের কোলন ক্যান্সার ধরা পড়েছে।

আমি যেন পরিষ্কার বুঝতে পারলাম না কথাটা। কী? কী ধরা পড়েছে?

কোলন ক্যান্সার।

প্ৰথমে দিশেহারা হলাম, তারপর স্তব্ধ। কথা বলতে পারছি না।

মাজহার বললেন, সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পর ভাবি বললেন, আসছ যখন, তোমার চেকআপটিাও করিয়ে নাও। চেকআপ করাতে গিয়ে ধরা পড়েছে। ওখানে চিকিৎসা করাতে রাজি হন নি। পরশুর পরদিন নিউইয়র্কে যাচ্ছেন। আমিও যাচ্ছি। সঙ্গে। মেমোরিয়াল স্লোয়ান ক্যাটারিং ক্যান্সার হাসপাতালে চিকিৎসা হবে। এই হাসপাতালে সোনিয়া গান্ধীরও ক্যান্সারের চিকিৎসা হয়েছে। পৃথিবী-বিখ্যাত হাসপাতাল।

মাজহার বলে যাচ্ছেন। কিন্তু আমার কানে যেন ঢুকছে না কিছুই। মৃতের মতো অফিসে এলাম। কোনো কাজে মনই বসল না। প্ৰায় সারাটা দিন আমার রুমের সোফায় শুয়ে রইলাম। রাতের বেলা একটু আগেভাগেই অফিস থেকে বেরিয়ে গেলাম দখিন হাওয়ায়। গিয়ে দেখি, হুমায়ূন ভাই যে জায়গাটায় বসে লেখালেখি করেন, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেন, সেখানে তাঁর পাশে বসে আছেন জুয়েল আইচ। কিছুক্ষণ পর আলমগীর ভাই এলেন, মাজহার এলেন। আমাকে দেখে সব সময়কার মতো হুমায়ূন ভাই বললেন, আসো, মিলন। বসে।

আমি তাঁর পাশে বসলাম। তিনি শুরু করলেন তাঁর রসিকতা, শোনো মিলন, সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথে আমার আর আমার মায়ের বাইপাস হয়েছিল। একইরুমে পাশাপাশি বেড়ে রাখা হয়েছিল মা-ছেলেকে। এরকম ইতিহাস ওই হাসপাতালে নেই। মায়ের পাওয়া গিয়েছিল। ৯টি ব্লক, ছেলের ১১টি। এবার ওই হাসপাতালে চকআপে গেছি। ডাক্তার চেকআপ করে বললেন, অমুক রুমে যাও। গেলাম। আরেক ডাক্তার চেকআপ করে বললেন, আরে, তোমার তো ক্যান্সার। বললেন এমন ভঙ্গিতে, যেন ক্যান্সার কোনো রোগই না। সর্দি-কাশির মতো সামান্য কিছু।

আমার এমনিতেই সারা দিন ধরে মন খারাপ। হুমায়ূন ভাইয়ের রসিকতায় হাসার চেষ্টা করছি, হাসতে পারছি না। জুয়েল আইচের মুখে সব সময় হাসি লেগেই আছে। তিনি আমার দিকে তাকালেন, কিন্তু সবসময়কার মতো প্ৰাণ খুলে হাসতে পারলেন না। আমি মাথা নিচু করে হুমায়ূন ভাইয়ের পাশে বসে আছি। খানিক পর শাওন এসে বসল। পাশে। সে খুবই উচ্ছল, প্রাণবন্ত; একপলক তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি, ভেতরের গভীর কষ্ট অতিকষ্টে চেপে সে উচ্ছল থাকার চেষ্টা করছে। আমার চোখ ভরে আসছিল কান্নায়, গোপনে চেপে রাখছিলাম চোখের পানি।

হুমায়ূন ভাই নানা রকম কথা বলে যাচ্ছিলেন, তাঁর চিরাচরিত রসিকতাও করছিলেন। আমি না থাকলে তো তোমার অনেক সুবিধা। তুমি তখন একচ্ছত্র রাজত্ব করবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

শাওন উচ্ছল গলায় বলল, না না, মিলন আংকেলকে একক রাজত্ব করতে দেওয়া যাবে না। হুমায়ূন আহমেদ কমপক্ষে আরও ২০ বছর আছে।

প্রিয় পাঠক, আপনাদের কারও কারও মনে হতে পারে শাওন আমাকে কেন মিলন ভাই না বলে মিলন অ্যাংকেল বলছে। আসলে আমাদের কয়েকজনের ক্ষেত্রে শাওন তার অভ্যাসটা বদলাতে পারে নি। যেমন—আসাদুজ্জামান নূর কিংবা আলমগীর রহমান কিংবা আমি। আমি শাওনকে চিনি ওর শিশু বয়স থেকে। বিটিভির নতুন কুড়ির সময় থেকে। শাওনের গুণের পরিচয় তখন থেকেই জানি। ওর অসাধারণ অভিনয়ের কথা, অসাধারণ গায়কি প্রতিভার কথা, এমনকি টিভি নাটক পরিচালনার কথা সবাই জানে। আমি তার আরেকটা বড় প্রতিভার কথাও জানি। শাওন খুবই উচ্চমানের একজন নৃত্যশিল্পী। এখন আলোকিত করছে হুমায়ূন আহমেদের জীবন, একসময় আলোকিত করেছিল নতুন কুঁড়ি প্ৰতিযোগিতা।

কথায় কথায় কত কথা যে আসে!

শাওনকে নিয়ে একটা ঘটনার কথা বলি।

নুহাশপল্লীতে হুমায়ূন ভাইয়ের নাটকের শুটিং ছিল। আমি আর ইফতেখার নামে হুমায়ূন ভাইয়ের এক বন্ধু গেছি তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতে। নাটকের নায়িকা শাওন। পরদিন ইউনিভার্সিটিতে তার জরুরি ক্লাস। বিকেলবেলা ফিরতে হবে। আমি আর ইফতেখার ভাই যে মাইক্রোবাসে ফিরব, শাওনও সেই মাইক্রোবাসে আমাদের সঙ্গে রওনা দিল। রাস্তায় হঠাৎ আমি শাওনকে বললাম, শাওন একটু পুরনো দিনের হিন্দি গান শোনাও না। দু-চার লাইন যা পারো।

ধারণা ছিল, শাওন এই জেনারেশানের মেয়ে, ও কি আর পুরনো দিনের হিন্দি গান পুরোপুরি জানে কোনোটা? হয়তো দু-চার লাইন গাইতে পারবে।

শাওন আমার ধারণা তছনছ করে দিল। একটার পর একটা পুরনো দিনের হিন্দি গান গাইতে লাগল। সামসাদ বেগম, নূরজাহান, লতা মুঙ্গেশকর, গীতা দত্ত, এমনকি মোহাম্মদ রফি, মুকেশের গানও। এমন নিখুঁত সুরে, একটি শব্দও ভুল না করে একের পর এক গেয়ে গেল। শাওন একটা করে গান শুরু করে, আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে তার মুখের দিকে তাকাই।

নুহাশপল্লী থেকে ঢাকা, সারাটা পথ পুরনো দিনের হিন্দি গান গেয়ে শোনাল শাওন। ওর গান শুনতে শুনতে আমি চলে গেলাম। আমার ছেলেবেলায়, কৈশোরকালে। সেই সময়কার আমার পুরান ঢাকার জীবনে, যেখানে চায়ের দোকানে দিনরাত বাজত এসব গান। গ্রামোফোনে, রেডিওতে। বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠানেও বাজত।

বাংলার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মুম্বাইতে (তখনকার বোম্বাই) গিয়ে হয়েছিলেন হেমন্তকুমার। হিন্দি গান গেয়ে নাগিন ছবির সুর করে ভারতবর্ষ মাত করে দিলেন। সেদিন শাওন শেষ গানটা গেয়েছিল হেমন্তকুমারের আয় আপনা দিল তো আওয়ারা।

০৮. বিজনেস প্ল্যান

হুমায়ূন ভাই আর আমি যে একবার বিজনেস প্ল্যান করেছিলাম, সেই ঘটনা বলি।

১৯৮৫ সালের কথা। হুমায়ূন ভাই থাকতেন আজিমপুর কবরস্থানের পশ্চিমউত্তর দিককার গলির ভেতর তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে। আমি গেণ্ডারিয়ায়। হুমায়ূন ভাইয়ের তো ঢাকা ইউনিভার্সিটির চাকরি আছে, তখন তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। আমি একেবারেই বেকার। বাড়ি থেকে বিতাড়িত। থাকি কলুটোলার একটি বাসায়। চারদিকে ইটের দেয়াল, মাথার ওপর টিনের চাল। আমার স্ত্রী লজ্জায় ওই বাসায় আসেন না। তিনি থাকেন কাছেই তাদের তিনতলা বাড়িতে।

বিতাড়িত হওয়ার পর শাশুড়ি আমাকেও তাদের বাড়িতে থাকতে বলেছিলেন। ব্যৰ্থ লোকদের অহংকার তীব্ৰ হয়। আমার পকেট দশটা টাকাও নেই। তবু শ্বশুরবাড়িতে না থেকে বারো শ না পনেরো শ টাকা দিয়ে যেন ওই টিনশেড ভাড়া নিয়েছি। শ্বশুরবাড়ির কাছেই।

এই বাসায় আমাকে একদিন দেখতে এসেছিলেন কবি রফিক আজাদ। আমার শোচনীয় অবস্থা দেখে নানা ধরনের জ্ঞান দিয়ে চলে গেলেন। লেখকদের জীবন এ রকমই হয়… ইত্যাদি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদাহরণও দিলেন।

আমার কি আর ওসব কথায় মন ভালো হয়!

মন ভালো করার জন্য দু-একদিন পরপরই হুমায়ূন ভাইয়ের কাছে যাই। দুপুরে তাঁর ফ্ল্যাটে খাই, বিকেলে আড্ডা দিতে যাই ইউনিভার্সিটি ক্লাবে। দু-একদিন হুমায়ুন আজাদের বাসায়। শামসুর রাহমান, সালেহ চৌধুরী, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ আর এই অধম, আমরা ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসির এক ভদ্রলোকের ধানমণ্ডির ফ্ল্যাটেও আড্ডা দিতে যাই কোনো কোনো সন্ধ্যায়। অর্থাৎ আমার খুবই এলোমেলো জীবন।

এর আগে ও পরে আমি বেশ কয়েকবার ছোটখাটো নানা রকম ব্যবসা-বাণিজ্য করার চেষ্টা করেছি। শুরু করার পর সেইসব ব্যবসায় লালবাতি জুলে যেতে একদম সময় লাগে নি। আমার ধারণা, আমার মতো ব্যৰ্থ ব্যবসায়ী এই পৃথিবীতে আর একজনও নেই। যদি কখনো আত্মজীবনী লিখি তাহলে একটা চ্যাপ্টারের শিরোনাম হবে আমার ব্যৰ্থ ব্যবসায়ী জীবন।

যা হোক, ওই টিনশেডের বাসায় এক গরমের দুপুরে বসে ঘামে ভিজতে ভিজতে সিদ্ধান্ত নিলাম, লিখেই রুজি-রোজগারের চেষ্টা করব। এ ছাড়া আমি অন্য কোনো কাজ জানি না। ৭৭ সালের শেষদিকে সাপ্তাহিক রোববার পত্রিকায় ঢুকেছিলাম জুনিয়র রিপোর্টার হিসেবে। পুলিশ নিয়ে রিপোর্ট লেখার কারণে চাকরি চলে গিয়েছিল।

এসব কথা আগেও কোথাও কোথাও লিখেছি।

কিন্তু লিখে জীবনধারণের সিদ্ধান্তটা তখন ছিল প্রায় আত্মঘাতী। পত্রপত্রিকা বলতে গেলে হাতে গোনা দু-চারটা। একটা গল্প লিখলে পাওয়া যায় বড়জোর ২০ টাকা। তাও সে টাকা তুলতে বাসভাড়া, রিকশাভাড়া চলে যায় অর্ধেকের বেশি।

বিটিভি একমাত্র টিভি চ্যানেল। তিন মাসে ছয় মাসে একটা নাটক লেখার সুযোগ মেলে। তাও নানা প্রকার ধরাধরি, তদবির। শেষ পর্যন্ত নাটক প্রচারিত হলে টাকা পাওয়া যায় শ চারেক।

পাবলিশাররা বই ছাপলে সেই বই কায়ক্লেশে পাঁচ-সাত শ-এক হাজার বিক্রি হয় বছরে। রয়্যালিটি যেটুকু পাওয়া যায় তাতে মাসখানেক চলা মুশকিল।

এ অবস্থায় ও-রকম সিদ্ধান্ত।

তবে সিদ্ধান্ত মোতাবেক কাজ আমি শুরু করলাম। আজানের সময় ঘুম থেকে উঠে লিখতে বসি। টানা ১১টা ১২টা পর্যন্ত লিখি। এক ফাঁকে গরিব মানুষের দিনদরিদ্র নাশতাটা সেরে নিই। তারপর যাই বাংলাবাজারে, প্ৰকাশকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরি। কোথাও কোথাও বসে আড্ডা দিই। দুপুরে কেউ কেউ খাওয়ায়। যেদিন ও রকম হয় সেদিন আর বাড়ি ফিরি না। একবারে আড্ডা-ফাডা দিয়ে রাতে ফিরি।

হুমায়ূন ভাইও তখন দু-একদিন পরপরই বাংলাবাজারে আসেন। বিউটি বুক হাউস, স্টুডেন্ট ওয়েজ আর নওরোজ কিতাবিস্তানে বসে আড্ডা দিই, চা-সিগ্রেট খাই।

ও রকম একদিনের ঘটনা।

আমরা দুজনই এক প্রকাশকের কাছ থেকে কিছু টাকা পেয়েছি। দুপুরের দিকে হুমায়ূন ভাই বললেন, চলে আমার বাসায়।

আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি। চলুন।

বাংলাবাজার থেকে রিকশা নিলাম। যাব আজিমপুর। তখনো বাংলাদেশের প্রকাশনা জগৎ আধুনিক হয় নি। আমাদের বইপত্র তৈরি হয়। হ্যান্ড কম্পোজে, প্রচ্ছদ তৈরি হয়। হাতে তৈরি ব্লকে। অফিসেটে প্রচ্ছদ ছাপার কথা তখনো ভাবতে পারেন না অনেক প্ৰকাশক।

আমার প্রথম বই ভালোবাসার গল্প ছিল ১২ ফর্মার। দাম ছিল ৭ টাকা। আমি রয়্যালটি পেয়েছিলাম ৪০০ টাকা। হুমায়ূন ভাইয়ের নন্দিত নরকের দাম ছিল সাড়ে তিন টাকা।

তখন বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা হলে বাংলাবাজার এলাকার কোনো গলির ভেতর একটা রুম ভাড়া নিয়ে কম্পোজ সেকশন করা যেত। সিসা দিয়ে তৈরি টাইপ সাজানো থাকে একধরনের কাঠের ছোট ছোট খোপওয়ালা পাত্রে। সামনে টুল নিয়ে বসে একটা একটা করে টাইপ তুলে পাণ্ডুলিপি অনুযায়ী লাইনগুলো তৈরি করে কম্পোজিটর, পৃষ্ঠা তৈরি করে। একেক খোপে একেক অক্ষরের টাইপ। ১৬ পৃষ্ঠা তৈরি হলে এক ফর্মা। ভারী একটা তক্তার ওপর ওই টাইপের দুটো করে পৃষ্ঠা। মোট আটটি ও-রকম কাঠের তক্তা চলে যায় মেশিনে। অর্থাৎ একটা ফর্মা।

এভাবে ছাপা হয় বই।

যারা বই ছাপার কাজ করে, ও-রকম প্রেসগুলোরও অনেকেরই থাকে কম্পোজ সেকশন। ওসব ক্ষেত্রে ইনভেস্টমেন্টটা বেশি। আর মেশিন ছাড়া শুধু কম্পোজ সেকশন ছোটখাটোভাবে করেও অল্প পুঁজিতে ব্যবসা করে কেউ কেউ।

ও রকম কম্পোজ সেকশনের একটা সমস্যা হলো কম্পোজিটরীরা অনেকেই সিসায় তৈরি টাইপ চুরি করে নিয়ে সের দরে বিক্রি করে ফেলে। পার্টনারশিপে যারা কম্পোজ সেকশন করে তারা নিজেরাও এক পাটনার আরেক পার্টনারের অজান্তে টাইপ চুরি করে। বিক্রি করলেই তো ক্যাশ টাকা।

একটা বিজনেস করি।

হুমায়ূন ভাই সিগ্রেট টান দিয়ে বললেন, কী বিজনেস?

একটা কম্পোজ সেকশন করি।

হ্যাঁ। করা যায়। ভালো আইডিয়া।

কত টাকা লাগবে?

একেকজনে দশ-পনেরো হাজার করে দিলে হয়ে যাবে।

সেটা দেওয়া যাবে।

তাহলে চলেন শুরু করি।

তোমার টাকা রেডি আছে?

আরে না। দশ টাকাও নেই।

তাহলে?

ধার করতে হবে।

সেটা না হয় করলে, তবে আমার একটা শর্ত আছে।

কী শর্ত?

হুমায়ূন ভাই আমার মুখের দিকে তাকালেন। চুরি করে টাইপ বিক্রির অধিকার সমান থাকতে হবে।

আমি হাসতে হাসতে রিকশা থেকে প্রায় ছিটকে পড়ি।

আমাদের ব্যবসার ওখানেই যবনিকাপাত।

০৯. পেপারব্যাকে উপন্যাস

পেপারব্যাকে উপন্যাস লেখার জন্য সিগারেটের প্যাকেটের ভেতর দিককার সাদা অংশে হুমায়ূন ভাই লিখলেন, ১০০০ (এক হাজার) টাকা বুঝিয়া পাইলাম। উপন্যাস লেখার জন্য ওটাই তাঁর জীবনের প্রথম অগ্ৰিম নেওয়া। হাতের কাছে কাগজ ছিল না বলে সিগারেটের প্যাকেট ছিঁড়ে তার পেছন দিকে লেখা হলো। এই ঘটনা ঘটল মুনতাসীর মামুনের বাসায়, মগবাজারের ইস্পাহানি কলোনিতে।

সেই বাসা বা বাড়িটি বোধহয় এখনো মামুন ভাই রেখে দিয়েছেন। ইস্পাহানি কলোনির ভেতরে যাঁরা ঢুকেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই দেখেছেন গাছপালায় ঘেরা, সামনে সবুজ ঘাসের লন, হলুদ একতলা পুরনো ধরনের স্টাফ কোয়ার্টার করেছিল ইস্পাহানি কর্তৃপক্ষ। স্নিগ্ধ নির্জন সুন্দর পরিবেশ। ও রকম কোয়ার্টারে সেই সময় থাকতেন মামুন ভাই। এখনো কোয়ার্টারটি তাঁর আছে, তবে তিনি ওখানে থাকেন না। প্রতিটি রুম ভর্তি বই। শুনেছি তিনি অনেক সময় লেখালেখির কাজ করতে যান ওখানে।

১৯৮৫ সাল। ২০-২২ দিন ধরে সংবাদপত্রে কর্মবিরতি চলছে। আলমগীর রহমান কাজ করেন। সাপ্তাহিক বিচিত্রা-য়। সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী। শাহরিয়ার কবির, মাহফুজউল্লাহ, রেজোয়ান সিদ্দিকী কাজ করেন। মুনতাসীর মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক অথবা সহকারী অধ্যাপক। তার পরও বিচিত্রার সঙ্গে যুক্ত। নিয়মিত লেখালেখি করেন বিচিত্ৰায়। সংবাদপত্রে কর্মবিরতি চলে বলে অফিসে বসে চা-সিগারেট খেয়ে সময় কাটে সবার।

শাহাদত চৌধুরীর মাথাভর্তি নানা রকম আইডিয়া। আলমগীর রহমানকে বললেন, কাজী আনোয়ার হোসেনের সেবা প্ৰকাশনীর মতো করে বাংলাদেশের লেখকদের মৌলিক উপন্যাস বের করুন।

আলমগীর ভাই রাজি হয়ে গেলেন। কারণ তার রক্তের সঙ্গে প্ৰকাশনা। বাবা আবদুস সোবহান বিশাল প্রকাশক। পাকিস্তান বুক করপোরেশন, স্বাধীনতার পর হলো বাংলাদেশ বুক করপোরেশন, আলমগীর ভাইয়ের বাবা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখনো সেই প্রতিষ্ঠান আগের মতোই সুনাম নিয়ে চলছে। বাবা বেঁচে থাকতেই আলমগীর ভাইয়ের বড় ভাই খলিলুর রহমান যুক্ত হয়েছিলেন সেই ব্যবসার সঙ্গে। এখনো তিনিই দেখছেন প্রতিষ্ঠানটি।

স্বাধীনতার দু-এক বছর আগে আলমগীর ভাইও মাঝেমধ্যে গিয়ে বসতেন পাটুয়াটুলীর পাকিস্তান বুক করপোরেশনে। পাঠ্য বই, রেফারেন্স বই প্রকাশ করত প্রতিষ্ঠানটি। আলমগীর ভাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কিছু মৌলিক বই প্রকাশ করবেন। কারণ তখন তার মাথায় সাহিত্যের পোকা ঘোরাঘুরি করছে। নিজে গল্প লেখেন। কামাল বিন মাহতাব সম্পাদিত ছোটগল্পের বিখ্যাত মাসিক পত্রিকা ছোটগল্পতে নিয়মিত তার গল্প ছাপা হয়। দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতায় ছাপা হয়। বিএ পরীক্ষা দিয়েছেন কিন্তু ওই বয়সেই তাঁর আড্ডার সঙ্গী শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদ। গেণ্ডারিয়ায় পুরনো আমলের বিশাল জমিদারবাড়ির মতো বাড়ি আলমগীর ভাইদের। কাছাকাছি থাকেন হায়াৎ মামুদ। হায়াৎ ভাইয়ের ছোট ভাই তাঁর বন্ধু। একসময় হায়াৎ ভাইও বন্ধু হয়ে গেলেন।

আবদুল মান্নান সৈয়দ তখন সিলেটের এমসি কলেজে বাংলার প্রভাষক। প্ৰবন্ধ, কবিতা, গল্প-সবই লেখেন। আলমগীর ভাই সিলেটে গিয়ে হাজির হলেন। মান্নান সৈয়দের প্রবন্ধের বই ছাপবেন। মান্নান ভাই বললেন, প্ৰবন্ধ না, আমার একটা গল্পের বই ছাপুন।

আলমগীর ভাই রাজি হলেন। মান্নান সৈয়দের গল্পগ্রন্থ সত্যের মতো বদমাসএর পাণ্ডুলিপি নিয়ে ঢাকায় এলেন। অতি যত্নে ছাপা হলো বই। সরকার সেই বই বাজেয়াপ্ত করল। নিষিদ্ধ হয়ে গেল সত্যের মতো বদমাস। আলমগীর ভাই হতাশ হয়ে এমএ পড়তে চলে গেলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবশ্য এই ফাঁকে হায়াৎ মামুদের বইও ছাপা হয়েছিল তাদের প্রকাশনা সংস্থা থেকে।

রাজশাহীর পাট চুকিয়ে পড়াশোনা শেষ করে স্বাধীনতার পর সাংবাদিকতা শুরু করলেন আলমগীর ভাই। ১৯৮৫ সালে এসে আবার প্রকাশক হয়ে গেলেন শাহাদত চৌধুরীর বুদ্ধিতে। মুনতাসীর মামুনের বাসায় বসলেন তারা। আমিও ছিলাম সেই বিকেলে তাদের সঙ্গে। প্ৰকাশনার নাম ঠিক হলো অবসর। লেখক তালিকায় আমিও আছি। তবে প্রথম বইটি লিখবেন হুমায়ূন আহমেদ। এক হাজার টাকা অগ্রিম দেওয়া হলো তাঁকে। হুমায়ূন ভাই লিখলেন তাঁর আদিভৌতিক বিষয়ের উপন্যাস দেবী। পেপারব্যাক সংস্করণ বেরোল।

এক বইতেই বাজিমাত। সংস্করণের পর সংস্করণ হতে লাগল। পরে হার্ড বাইন্ডিংয়েও বেরোল দেবী। এ পর্যন্ত বোধহয় এক লাখ কপির ওপর বিক্রি হয়েছে। স্টেজ নাটক হয়েছে।

ওই উপন্যাসেই প্রথম মিসির আলী নামের একটি চরিত্র এল, যে চরিত্র এখন বাঙালি পাঠকের মুখে মুখে। মিসির আলীকে নিয়ে বহু উপন্যাস পরবর্তী সময়ে লিখেছেন হুমায়ূন ভাই। তাঁর দুটি জনপ্রিয় চরিত্রের একটি হিমু অন্যটি মিসির আলী।

দেবীর পর হুমায়ূন ভাই লিখলেন নিশিথিনী। সেই উপন্যাসও জনপ্রিয়তার রেকর্ড গড়ল। আলমগীর ভাইয়ের অবসর বিশালভাবে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর তিনি করলেন প্রতীক। হুমায়ূন ভাইয়ের বহু বইয়ের প্রকাশক তিনি। খণ্ডে খণ্ডে ছাপছেন হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসসমগ্র। ১০-১২ খণ্ড বোধহয় বেরিয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশের রুচিশীল প্রকাশনার অন্যতম অবসর ও প্রতীক। বিভিন্ন বিষয়ের অসাধারণ সব বই ছাপছেন আলমগীর ভাই। আন্তর্জাতিক মানের রান্নার বই আছে অনেক।

রান্নার বই প্রকাশের ক্ষেত্রে অন্যপ্রকাশও বড় ভূমিকা রেখেছে। অসাধারণ সব রান্নার বই প্রকাশ করেছে তারা। আর প্রডাকশন এত চমৎকার, হাতে নিলে মনেই হয় না। বাংলাদেশ থেকে এ ধরনের বই প্ৰকাশ পেতে পারে।

হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে অন্যপ্রকাশের সম্পর্ক তৈরির ঘটনাটা বলি। তার আগে বোধহয় আমার নিজের কথাও কিছু বলা দরকার, অর্থাৎ অন্যপ্রকাশের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হলো কীভাবে।

সেটা হয়েছিল হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে অন্যপ্রকাশের সম্পর্কের আগে। বোধ হয় ১৯৯০-৯১ সাল। নানা ধরনের দুঃখদৈন্য কাটিয়ে আমি একটু একটু করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। সেই টিনশেডের বাসা থেকে গেণ্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী রোডের চারতলার ওপর ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে উঠেছি। ছয়-সাত শ বর্গফুটের ফ্ল্যাট হবে। পাশের ফ্ল্যাটটি আরও ছোট। কাকলি প্রকাশনীর সেলিম ভাই থাকতেন।

কাকলিও খুব বড় প্রকাশনা সংস্থা এখন। সেলিম ভাই উত্তরায় ছয় তলা বাড়ি করেছেন। ওই অতটুকু ফ্ল্যাট ছেড়ে একসময় তিনি চলে গেলেন। সাহস করে ওই ফ্ল্যাটটাও আমি ভাড়া নিলাম। দুটি অতি ক্ষুদ্র কক্ষ। একটায় আমার বসার ব্যবস্থা, আরেকটায় লেখার টেবিল-চেয়ার, বুকশেলফ। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ওখানে বসে লিখি। পাশের ফ্ল্যাট থেকে চা-নাশতা পাঠান স্ত্রী। আমার কাছে কেউ এলে তারাও ওখানটায়ই বসেন।

আমার ওই ছোট্ট ফ্ল্যাটে বহুবার গেছেন হুমায়ূন ভাই। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এলেন একবার, সমরেশ মজুমদার এলেন দু-তিনবার, রফিক আজাদ, সৈয়দ শামসুল হকসহ অনেকেই।

এক দুপুরে কলিংবেল বাজল। দরজা খুলে দেখি আবু ইসহাক দাঁড়িয়ে আছেন। দেখে আমার মনে হয়েছিল দৃশ্যটা বাস্তব, না আমি স্বপ্ন দেখছি!

এত বড় একজন লেখক আমার ফ্ল্যাটে!

আবু ইসহাক সাহেবের হাতে একটা বই। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস পদ্মার পলিদ্বীপ। বইটি তিনি আমাকে উপহার দেওয়ার জন্য বাংলাবাজার থেকে ঠিকানা জোগাড় করে আমার ফ্ল্যাটে এসেছেন।

সেটি আমার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন।

পদ্মার পলিদ্বীপ-এর প্রথম নাম ছিল মুখর মাটি। ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমীর উত্তরাধিকার পত্রিকায় মুখর মাটি নামে ছাপা হচ্ছিল। পাশাপাশি ছাপা হচ্ছিল। আমার প্রথম উপন্যাস যাবজীবন। পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন। রফিক আজাদ। বই করার সময় প্রচুর ঘষামাজা করেছেন ইসহাক সাহেব, নাম বদলেছেন। বাংলাদেশের নদী আর চরের জীবন নিয়ে পদ্মার পলিদ্বীপ-এর মতো উপন্যাস আর একটিও লেখা হয় নি। এ এক কালজয়ী উপন্যাস।

আমার ওই ফ্ল্যাটে একদিন এলেন চার যুবক। তাদের সঙ্গে পরিচয় বাংলা একাডেমীর বইমেলায়। পজিট্রন নামে একটি প্রকাশনা করেছেন। এখন অন্যদিন নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা করবেন এবং প্রকাশনা করবেন। বাংলা একাডেমীতে পরিচয়ের সময়ই আমার বই ছাপার আগ্রহ প্ৰকাশ করলেন। তখনো তাদের প্রত্যেকের নাম জানা হয় নি। যেদিন আমার ফ্ল্যাটে এলেন, নাম জানলাম চারজনেরই মাজহারুল ইসলাম, মাসুম রহমান, সিরাজুল কবির চৌধুরী (এই যুবকের ডাকনাম কমল) আর আবদুল্লাহ্ নাসের। তারা আমার বইয়ের জন্য এসেছেন।

চা খেতে খেতে মাজহার আচমকা একটা পলিথিনের শপিং ব্যাগ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এখানে দুই লাখ টাকা আছে। একুশে ফেব্রুয়ারি বইমেলায় আপনার একটা বই চাই।

আমি কী করব খানিকক্ষণ বুঝতেই পারলাম না। সেদিনকার আগে দুই লাখ টাকা আমি একসঙ্গে কখনো চোখেই দেখি নি। একটা বইয়ের জন্য এত টাকা অগ্ৰিম! এই টাকা দিয়ে কী করব বুঝতেই পারছিলাম না।

মাজহারদের সেই টাকায় আমার জীবন ঘুরতে শুরু করেছিল। হুমায়ূন ভাইয়ের ক্ষেত্রে আরও বড় ঘটনা ঘটালেন এই চার যুবক। হুমায়ূন ভাইয়ের কাছে গিয়ে হাজির একদিন-স্যার, আমরা আপনার একটা বই করব?

হুমায়ূন ভাইয়ের তত দিনে অনেক প্রকাশক। ঈদসংখ্যার লেখা, বইমেলার লেখা, নাটক লিখছেন বিটিভিতে (তখনো স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো আসে নি)। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা। অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ। এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বললেন, একটা বইয়ের জন্য আমাকে ১০ লাখ টাকা অগ্রিম দিতে হবে।

তারা একটু চমকালেন, চিন্তিত হলেন। সম্ভবত ৯৭-৯৮ সালের কথা। কোনো কথা না দিয়ে বেরিয়ে এলেন। হুমায়ূন ভাই ভাবলেন, যাক ঝামেলা গেছে।

হুমায়ূন ভাই তখন সিনেমা তৈরির পরিকল্পনা করছেন। বিজয়নগরের ওদিকে একটা অফিস নিয়েছেন। মাজহাররা চারজন পরদিন সেই অফিসে গিয়ে হাজির। একজনের হাতে বাজার করার চটের বড় একটা ব্যাগ। হুমায়ূন ভাইয়ের সামনে গিয়ে ব্যাগটা উপুড় করে দিলেন- স্যার, এই যে ১০ লাখ টাকা। বই দেবেন কবে?

তার পরের ইতিহাস আর বলার দরকার নেই। এখন অন্যপ্ৰকাশ বিশাল ব্যাপার। হূমায়ুন ভাইয়ের প্রধান প্রকাশক। বাংলা একাডেমী বইমেলায় অন্যপ্রকাশের স্টলের সামনে পৌঁছতে ২০ মিনিট থেকে আধা ঘণ্টা সময় লাগে, এমন লাইন। শুধু হুমায়ূন ভাইয়ের বইয়ের জন্য।

আমি একবার বলেছিলাম, হুমায়ূন ভাইয়ের কারণে বাংলা একাডেমীর বইমেলা একদিকে কাত হয়ে গেছে। শুনে তসলিমা নাসরিন খুব হেসেছিলেন।

১০. পদ্মা গোমতী

পদ্মা গোমতী বেশ নামকরা সংগঠন।

বাংলাদেশ এবং আগরতলা মিলিয়ে কার্যক্রম চলে সংগঠনের। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পদ্মা গোমতীর সভাপতি ড. আনিসুজ্জামান আর আগরতলার হচ্ছেন অনিল ভট্টাচার্য। এই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ত্রিপুরা দৰ্পণ পত্রিকার সম্পাদক সমীরণ দত্ত, কবি রাতুল দেববর্মণ প্রমুখ।

রাতুল দেববর্মণ বিখ্যাত দেববর্মণ পরিবারের লোক। শচীন দেববর্মণ ও রাহুল দেববর্মণ আলোকিত করেছেন যে পরিবার। শচীনকর্তার স্ত্রী মীরা দেববর্মণও কম বিখ্যাত নন। কী অসাধারণ সব গান লিখেছেন! আর শচীনকর্তার গানের কথা না-ই বা বললাম। বাংলা গানে সম্পূর্ণ আলাদা একটি ঘরানা সৃষ্টি করেছেন তিনি। সুরের মায়ায় এবং কষ্ঠের জাদুতে শচীন কর্তা বাঙালি সংগীতপ্রেমীদের হৃদয়ে চিরকালীন জায়গা করে নিয়েছেন। বাঙাল মুলুক ছাড়িয়ে বোম্বেতে (আজকের মুম্বাই) পাড়ি জমালেন। হিন্দি গানের জগতেও হয়ে উঠলেন কিংবদন্তি। এমন সব বিখ্যাত ও হিট ছবির সুর করলেন, উপমহাদেশ মাতিয়ে দিলেন। লতা মুঙ্গেশকর, মোহাম্মদ রফি, কিশোরকুমার-আরও কত কত গায়ক তাঁর সুর করা গান গেয়ে জগৎ জয় করলেন! শচীন দেববর্মণের সুর করা বহু হিন্দি ছবি থেকে দুটোর কথা বলি। একটি ছবির নাম অমর প্রেম। অভিনয় করলেন রাজেশ খান্না ও শর্মিলা ঠাকুর। কিশোরকুমার তাঁর অসাধারণ কণ্ঠে গাইলেন হৃদয় তোলপাড় করা গান। মূল গল্প বাংলা সাহিত্যের তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের একজন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কী অসাধারণ প্রেমের গল্প, কী অসাধারণ প্রেমের ছবি!

আরেকটি ছবির নাম গাইড। ভারতীয় ইংরেজি ভাষার লেখক আর কে নারায়ণের গল্প, অভিনয় করলেন দেব আনন্দ ও ওয়াহিদা রেহমান। গানগুলোর কোনো তুলনা হয় না। দুটো ছবিতেই শচীনকর্তা নিজের কণ্ঠ সামান্য একটু ব্যবহার করলেন। অমর প্রেম-এর গানটির একটি লাইন আমার মনে পড়ছে, ও মাইয়ারে…। গাইড-এ দু-তিন লাইনে তিনি গেয়েছিলেন গ্রামবাংলার বিখ্যাত সেই গান–

আল্লাহ মেঘ দে পানি দে
ছায়া দে রে তুই

শচীন দেববর্মণ হিন্দিতে করলেন—

মেঘ দে পানি দে
ছায়া দে রে তু রামা মেঘ দে

এখনো কানে লেগে আছে সেই সুর।

তাঁর একটি বিখ্যাত গান (আসলে বিখ্যাত বিখ্যাত বারবার বলা ঠিক হচ্ছে না। শচীনকর্তার সব গানই বিখ্যাত)

বাজে তাকদুম তাকদুম বাজে
বাজে ভাঙা ঢোল

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এই গানের লাইন বদলে তিনি গাইলেন–

বাজে তাকদুম তাকদুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল
সব ভুলে যাই তাও ভুলি না বাংলামায়ের কোল।

আমার বহুদিনের শখ ছিল একবার আগরতলায় যাব, শচীনকর্তার বাড়িটা দেখে আসব। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অনেকখানি সংগঠিত হয়েছিল আগরতলায়। শরণার্থী ক্যাম্প হয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং নিয়েছিল। লক্ষ লক্ষ বাঙালি ১৯৭১-এ আশ্রয় নিয়েছিলেন আগরতলায়। আগরতলাটা একবার দেখতেই হবে।

২০০৫ সালে সেই সুযোগ হলো।

পদ্মা গোমতী সংগঠন আমন্ত্রণ জানাল হুমায়ূন আহমেদকে। তাঁর সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক শফি আহমেদ, প্ৰকাশক আলমগীর রহমান, মাজহারুল ইসলাম এবং আমাকে।

হুমায়ূন ভাই দলবল ছাড়া চলতে পারেন না। তাঁর প্রিয় বন্ধু আর্কিটেক্ট আবু করিমকে নিলেন সপরিবারে; অন্যপ্রকাশের মাজহার, কমল আর নাসের সন্ত্রীক। মাজহারের বড় ছেলে অমিয় তখন খুব ছোট। শাওন তখনো মা হন নি।

বেশ বড় রকমের একটা বহর আমরা রওনা দিলাম। কমলাপুর থেকে বাসে করে আখাউড়া। বর্ডারের বাংলাদেশ অংশের কর্মকর্তারা খুবই খাতির করে চা-নাশতা খাওয়ালেন আমাদের। তারপর বর্ডার ক্রস করলাম। ওপারে দেখি রাতুল দেববর্মণের সঙ্গে অনিল ভট্টাচাৰ্য, সমীরণ দত্ত আর আমাদের শফি ভাই। তিনি দুদিন আগেই আগরতলায় পৌঁছে গেছেন। আমাদের এগিয়ে নিতে আসছেন বর্ডারে।

শফি আহমেদের আমি বিশেষ ভক্ত। বিচ্ছিন্নভাবে তার লেখা পড়েছি। বেশির ভাগই প্ৰবন্ধ। মুগ্ধ হলাম যে বই পড়ে, সেই বইয়ের নাম মুক্তো। জন স্টাইনবেকের পার্ল-এর অনুবাদ। এত স্বচ্ছ সুন্দর প্রাঞ্জল অনুবাদ আমি কমই পড়েছি। আর শফি ভাই এত ভালো মানুষ, এত হাসিমুখের মানুষ, কী বলব।

হুমায়ূন ভাইও তাঁকে খুব পছন্দ করেন। নিজের পছন্দের মানুষদের নানাভাবে খুঁচিয়ে আনন্দ পান। তিনি, অদ্ভুত অদ্ভুত নামে ডেকে আনন্দ পান। শফি ভাই ভগবান কৃষ্ণের রংটি পেয়েছেন। হুমায়ূন ভাই তাঁকে ডাকেন। কালো বুদ্ধিজীবী।

আমি সাহিত্য নিয়ে কঠিন কঠিন চিন্তাভাবনা করি, হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম দিককার কথা। তখন মুগ্ধ হয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়ছি। সাহিত্যের আলোচনা উঠলেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়ে কথা বলি। হুমায়ূন ভাই বইমেলায় আমাকে তার ফেরা উপন্যাসটি উপহার দিলেন। অটোগ্রাফের জায়গায় লিখলেন আমাদের মানিকবাবুকে।

রবীন্দ্রনাথকে মাথায় তুলে রেখেছিলেন আগরতলার মহারাজরা। এই সেই আগরতলা, এখানে বসবাস করতেন শচীন দেববর্মণ। এই সেই আগরতলা, আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় গৌরব মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাসংগ্রামে যে আগরতলার অবদান ইতিহাসের পাতা উজ্জ্বল করে থাকবে।

আগরতলায় তখন একটা বইমেলা চলছে।

বিকেলবেলা সদলবলে বইমেলায় গেলাম আমরা। বিশাল এলাকাজুড়ে বইমেলা। আমাদের বাংলা একাডেমী বইমেলার মতো ভিড় ধাক্কাধাব্ধি নেই। লোকজন কম। ঘুরে ঘুরে বইপত্র দেখছে, কিনছে।

একদিন বইমেলার স্টেজে উঠলাম। আমরা। বাংলাদেশি লেখক প্রকাশক। হুমায়ূন ভাই তাঁর স্বভাবসুলভ মজার ভঙ্গিতে বক্তৃতা দিলেন।

আমাদের দিনগুলো কাটছিল। এদিক-ওদিক ঘুরে। বড় একটা মাইক্রোবাস দেওয়া হয়েছে ঘুরে বেড়ানোর জন্য। গাইড আছে সঙ্গে। আমরা এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়িয়ে দিন কাটাচ্ছি। দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখছি।

প্রথম দিন বেড়িয়ে ফেরার পর মাইক্রোবাসের ড্রাইভারকে এক শ রুপি অফার করলেন হুমায়ূন ভাই। লোকটি অবাক। কিসের টাকা, দাদা?

আপনি চা-টা খাবেন। না না, টাকা আমি নেব না।

কেন?

এই ডিউটি করার জন্য সরকার আমাকে মাইনে দিচ্ছে। আমি আপনার টাকা নেব কেন?

আমরা হতভম্ব!

আগরতলার নীরমহল খুব বিখ্যাত পৰ্যটনকেন্দ্ৰ। চারদিকে পানি, মাঝখানে জমিদারবাড়ি। সেটাই এখন পর্যটনকেন্দ্র। স্পিডবোটে করে যেতে হয়। একটা রাত ওখানে কাটালাম আমরা।

আগরতলায় আমার সঙ্গে অদ্ভুত এক মজা করলেন হুমায়ূন ভাই। এমন লজ্জার মধ্যে ফেললেন আমাকে, আমি একেবারে চুপসে গেলাম।

ঘটনা হলো কী, পদ্মা গোমতী থেকে আমাদের সংবর্ধনা দেওয়া হচ্ছে একটি হলে। সন্ধ্যার পর বেশ ভালো আয়োজন করা হয়েছে। রাতুল দেববর্মণ, অনিল ভট্টাচাৰ্য, সমীরণ দত্ত বক্তব্য দিলেন। একে একে আমাদের উত্তরীয় পরানো হলো। আগরতলার কিছু সুধীজন আর আমাদের পুরো দল।

মাজহারের ছেলে অমিয় তখন আড়াই-তিন বছরের। ওই বয়সী শিশু যেমন হয় তেমনই। চঞ্চল, ছটফটে। এই এদিকে ছুটছে, এই ওদিকে ছুটছে। মাজহারের স্ত্রী স্বর্ণা চমৎকার মেয়ে। সে আপ্ৰাণ চেষ্টা করছে ছেলেকে সামলাতে। দুরন্ত শিশুটির সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। শিশুটি তো আর সাহিত্য কিংবা হুমায়ূন আহমেদ বোঝে না, আগরতলা কিংবা পদ্মা গোমতী বোঝে না, সে তার মতো কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ কিছু ভাবছেও না, মনেও করছে না।

হুমায়ূন ভাই খেয়াল করছিলেন অমিয়র দুরন্তাপনা। আমি তাঁর পাশে বসে আছি। আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন, একটা কাজ করব নাকি?

কী?

অমিয়কে একটা থাপ্পড় লাগিয়ে দেব নাকি? (একেবারেই মজা করা অর্থে। কোনো শিশুর গায়ে হুমায়ূন আহমেদ হাত তুলবেন, ভাবাই যায় না)

আমি থতমত খেয়ে হুমায়ূন ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম। কী বলছেন, হুমায়ূন ভাই!

তার মানে তুমি থাপ্পড় মারতে না করছ?

আরে!

ওই পর্যন্তই। অনুষ্ঠান শেষ হলো। খাওয়াদাওয়া শেষ হলো। আমরা আড্ডা দিতে বসছি, হুমায়ূন ভাই গম্ভীর গলায় মাজহারকে ডাকলেন। শোনো মাজহার, একটা কথা তোমাকে না বলে পারছি না।

মাজহার তটস্থ। কী কথা স্যার?

গোপন কথা। বলা উচিত না। তবু বলছি। এইটুকু একটা শিশু, তার ব্যাপারে… মানে আমি অমিয়র কথা বলছি।

কী হয়েছে স্যার?

মিলন তোমার ছেলেকে থাপ্পড় মারতে চেয়েছে।

আমি আকাশ থেকে পড়লাম। হায় হায়, বলে কী? নিজে ওরকম একটা প্ল্যান করে এখন আমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন সব!

আমার মুখে আর কথা জোটে না। কী বলবো?

দলের সবাই এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। স্বর্ণা একপলক আমার দিকে তাকিয়ে মুখ নিচু করেছে। মাজহার স্বাভাবিক কারণেই গম্ভীর।

আমি কীভাবে তাদেরকে বোঝাবো ঘটনা পুরো উল্টো। একটা সময়ে অবশ্য সবাই বুঝে গেল এটা হুমায়ূন ভাইয়ের রসিকতা। তবে তারপর যে কদিন আমরা আগরতলায় ছিলাম সে কদিন তো বটেই, ঢাকায় ফিরেও হুমায়ূন ভাই মাঝে মাঝে বলতেন, তোমার ছেলেকে থাপ্পড় মারতে চাইলো মিলন, আর তুমি তাকে কিছুই বললে না মাজহার!

অমিয় এখন বড় হয়েছে। মাজহার-স্বর্ণার সংসার উজ্জ্বল করে আরেকজন অমিয় এসেছে। এখনও অমিয়ার দিকে তাকালে আগরতলার সেই ঘটনা আমার মনে পড়ে। যতদিন বেঁচে থাকবো, অমিয়কে দেখলেই ঘটনাটা আমার মনে পড়বে।

 

সেদিনকার সেই অনুষ্ঠানে খালি গলায় চমৎকার দুতিনটা গান গেয়েছিল শাওন। আমরা তো আগে থেকেই শাওনের গানে মুগ্ধ, আগরতলার সুধীজনেরাও মুগ্ধ হয়েছিলেন।

আগরতলায় শচীন দেববর্মণের বাড়ি আমরা দেখেছিলাম, বইমেলা যেখানে হচ্ছিল সেই সড়কটির নাম শচীন দেববর্মণ সড়ক। এক নির্জন দুপুরে সেই সড়কের দিকে তাকিয়ে আমার মনে পড়ছিল, তুমি যে গিয়াছো বকুল বিছানো পথে।

১১. এই লেখাটুকু হুমায়ূন আহমেদের

কিছুদিন হলো আমার জীবনচর্যায় নতুন সমস্যা যুক্ত হয়েছে। সন্ধ্যা মিলাবার আগেই সিরিয়াস মুখভঙ্গি করে তিন-চারজন আমার বাসায় উপস্থিত হচ্ছে। আমার মায়ের শোবার ঘরটিতে ঢুকে যাচ্ছে। নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে এসি ছেড়ে দিচ্ছে। গলা উঁচিয়ে চা-নাশতার কথা বলছে। এই ফাঁকে একজন ক্যাসেট রেকর্ডার রেডি করছে। অন্য একজন ক্যামেরায় ফিল্ম ভরছে। তৃতীয়জন কাগজ-কলম নিয়ে প্রস্তুত। চতুৰ্থজন ব্যস্ত হয়ে মোবাইলে টেলিফোন করছে ইমদাদুল হক মিলনকে। ঔপন্যাসিক চলে এলেই কর্মকাণ্ড শুরু হবে। ঔপন্যাসিক আমার ইন্টারভিউ নেবেন।

ইমদাদুল হক মিলনের সমস্যা কী আমি জানি না। ইদানীং সে সবার ইন্টারভিউ নিয়ে বেড়াচ্ছে। টিভি খুললেই দেখা যায়। সে কারও-না-কারও ইন্টারভিউ নিচ্ছে। পত্রিকার পাতাতেও দেখছি অনেকেই তার প্রশ্নবাণে জর্জরিত। কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সস্ত্রীক বেড়াতে এসেছিলেন। তারাও রক্ষা পান নি। তিন দিন ধরে ক্রমাগত তাদের ইন্টারভিউ হলো। আমার দখিন হাওয়ার বাসাতেই হলো।

মিলন জানেও না ইন্টারভিউ নিতে নিতে তার গলার স্বরেও কিছু পরিবর্তন হয়েছে। চোখের দৃষ্টিও অন্যরকম। এখন তার চোখে শুধু প্রশ্ন খেলা করে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কেন এই ফাঁদে পা দিলাম? সন্ধ্যাটা আগে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ভালোই কাটত। এখন ক্যাসেট প্লেয়ার মুখের সামনে ধরে মিলন বসে থাকে। সামান্য বুকে এসে প্রশ্ন করে—

ইমদাদুল হক মিলন : আপনার সাম্প্রতিক উপন্যাস লীলাবতী দিয়েই শুরু করছি। এটা পড়ে মনে হয়েছে, প্রধান চরিত্র হচ্ছে সিদ্দিকুর রহমান। এই উপন্যাসটির নাম সিদ্দিকুর রহমান বা সিদ্দিকুর রহমানের জীবন এ রকম হতে পারত। অনিল বাগচীর একদিন নামে আপনার একটা বই আছে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের নামেই যদি নামকরণ করেন, তাহলে উপন্যাসটির নাম লীলাবতী কেন?

হুমায়ূন আহমেদ : আমি তো মনে করি যে, লীলাবতী উপন্যাসে যে কটি চরিত্র এসেছে, প্রতিটিই প্রধান চরিত্র।

[ভুল উত্তর। উপন্যাসের সব চরিত্রই প্রধান হতে পারে না। ঔপন্যাসিক মিলন অবশ্যই এটা জানে। কিন্তু সে এমন ভাব করল যেন সে আমার উত্তর গ্রহণ করেছে। সে দ্বিতীয় প্রশ্ন করল–]

ইমদাদুল হক মিলন : তাহলে লীলাবতী নামটি কেন রাখলেন?

[প্ৰবল ইচ্ছা হলো বলি–আমার ইচ্ছা। তোমার কী? এই জাতীয় উত্তর দেওয়া যায় না। অনেক পাঠক পড়বে। জ্ঞানগর্ভ কিছু বলা দরকার। জ্ঞানগর্ভ কিছু মাথায় আসছে না। কী করি? উপন্যাসের নাম নিয়ে মিলনের মাথাব্যথার কারণটাও ধরতে পারছি না। আমি বললাম–]

হুমায়ূন আহমেদ : উপন্যাসের নাম হিসেবে লীলাবতী নামে যে মাধুর্য আছে সিদ্দিকুর রহমান নামে কি সে মাধুৰ্য আছে?

ইমদাদুল হক মিলন : অবশ্যই এটা একটা সুন্দর নাম।

[মিলন মুখে বলল, এটা একটা সুন্দর নাম; কিন্তু তার চেহারা দেখে মনে হলো সে আমার কথাবার্তায় পুরোপুরি সন্তুষ্ট না। তার চেহারায় প্রশ্নবোধক চিহ্ন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। তখন আমার মনে হলো-আচ্ছা মিলন কি ভাবছে আমি লীলাবতী নামটি বাণিজ্যিক কারণে রেখেছি? তাই যদি হয় তাহলে তো নামকরণের ব্যাপারটি ভালোমতো ব্যাখ্যা করা দরকার। বইয়ের ফ্ল্যাপে এই ব্যাখ্যা আছে। আমি পরিষ্কার বলেছি-ভারতীয় গণিতজ্ঞ ভাস্করাচার্যের কন্যার নাম লীলাবতী। এই নামটির প্রতি আমার অস্বাভাবিক দুর্বলতা আছে। তবে আমি এত ব্যাখ্যায় গেলাম না, সরাসরি মূল বিষয়ে চলে গেলাম–]

হুমায়ূন আহমেদ : মিলন, তুমি যদি মনে করো আমি লীলাবতী নামটি দিয়েছি বাণিজ্যিক চিন্তাভাবনায়, তাহলে ভুল করবে। আমার ভালো লেগেছে, তাই এই নাম দিয়েছি। বইয়ের নামের কারণে কিছু বই বেশি বিক্রি হবে—এটা নিয়ে আমার প্ৰকাশক মাথা ঘামাতে পারে। আমি ঘামাই না।

[আমার কঠিন কথায় মিলন একটু থমকে গেল এবং অতি দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল–]

ইমদাদুল হক মিলন : আপনার উপন্যাসের ক্ষেত্রে নাম কোনো ফ্যাক্টর না। আপনি মন্দ্রসপ্তক নামে একটি বই লিখেছিলেন। এই শব্দটির অর্থও অনেকে জানেন না। আপনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটি নাটক লিখেছিলেন-আয়োময়। এই শব্দের সঙ্গে বেশির ভাগ বাঙালি পরিচিত নন। আপনার লেখার ক্ষেত্রে নাম কোনো ফ্যাক্টর না। ওইভাবে আমি ভাবি নি।

হুমায়ূন আহমেদ : তার পরও কিন্তু ফ্যাক্টর থাকে, মিলন। আমি দেখেছি। অন্যপ্রকাশ আমার দুটি বই বাসর ও সৌরভ প্ৰকাশ করেছে। তুমি দেখবে, বাসর-এর বিক্রি হয়েছে অনেক বেশি। বাসর, নামটি হয়তো মানুষকে আকর্ষণ করেছে অনেক বেশি, দেখি তো কী আছে। বইটিতে। সৌরভ কিন্তু ততটা আকর্ষণ করে নি। সৌরভ উপন্যাসটির নাম যদি বাসর দিতাম এবং বাসর উপন্যাসটির নাম সৌরভ দিতাম। তাহলেও একই ঘটনা ঘটত।

ইমদাদুল হক মিলন : (বিজয়ীর ভঙ্গিতে) তাহলে তো আপনি স্বীকারই করলেন যে, নামের একটি বাণিজ্যিক ব্যাপার আছে।

হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ স্বীকার করলাম। তবে বইয়ের নাম দেওয়ার সময় বাণিজ্যিক ব্যাপারটা আমার মাথায় কখনো থাকে না। যদি থাকত তাহলে সৌরভ উপন্যাসটির নাম দিতাম গোপন বাসর। হা হা হা।

[বুদ্ধিমান পাঠক সম্প্রদায়, আপনারা কি লক্ষ করছেন-মিলন আমাকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নিল যে নামের একটা বাণিজ্যিক ব্যাপার আছে। এখন আমার কি উচিত না আরও সাবধানে তার প্রশ্নের জবাব দেওয়া? কে জানে সে হয়তো এমন অনেক কিছু আমার মুখ দিয়ে বলিয়ে নেবে, যা আমার মনের কথা না। কাজেই Attention, সাবধান। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ব্যাপারে সাবধান। মিলন গভীর জলের পাঙ্গাশ মাছ। আমার মতো অল্প পানির তেলাপিয়া না।]

ইমদাদুল হক মিলন : আপনি প্রচুর ভূতের গল্প লিখেছেন। অবিস্মরণীয় কিছু ভূতের গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। বৃহন্নলা, দেবী, নিশিথিনী, অন্যভুবন—এই যে লেখাগুলো, এগুলোর মধ্যে আপনি আদিভৌতিক এবং রহস্যময়তার ব্যাপারগুলো সব সময়ই এনেছেন। পাশাপাশি আপনি আবার বলেছেন যে, বিজ্ঞানের ছাত্রদের এই বিষয়ে বিশ্বাস থাকা ঠিক না। আপনি যখন এই লেখাগুলো লেখেন, তখন কি বিজ্ঞানের ব্যাপারটি মাথায় রেখে লিখেছিলেন?

[মিলন কোন দিকে যাবে বুঝতে পারছি। সে আবারও আমাকে দিয়ে স্বীকার করাবে যে আমি নিজেকে কনট্রাডিক্ট করছি। একই সঙ্গে বিজ্ঞানের কথা বলছি আবার ভূত-প্রেতের কথা বলছি। অতি সাবধানে এখন উত্তর দিতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় প্রশ্নগুলো পাশ কাটিয়ে যাওয়া।]

হুমায়ূন আহমেদ : বিজ্ঞান তো থাকবেই। কিন্তু সব ব্যাখ্যা কি বিজ্ঞান দিতে পারছে? মহাবিশ্বের শুরু হলো বিগ ব্যাং (Big Bank) থেকে। তার আগে কী ছিল?

[মিলন ভুলবার মানুষ না। সে এই বিষয়ে দ্বিতীয় প্রশ্ন করল। আমাকে ঠেলা ধাক্কা দিয়ে খাদে ফেলতে চাচ্ছে…]

ইমদাদুল হক মিলন : বিভিন্ন সময়ে অনেক আড্ডায় আপনি প্রচুর ভৌতিক গল্প বলেন। আপনাকে আমরা যত দূর জানি, আপনি একজন যুক্তিবাদী মানুষ, অযৌক্তিক কোনো কিছুকে আপনার প্রশ্ৰয় দেওয়ার কথা না। তাহলে..?

হুমায়ূন আহমেদ : আমার চরিত্রের একটি অংশ হিমু, আরেক অংশ মিসির আলী। হিমু তো যুক্তিহীন জগতের মানুষ।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনার কথা শুনে মনে হয়, আপনার মধ্যে একসঙ্গে অনেকগুলো মানুষ বসবাস করে।

হুমায়ূন আহমেদ; শুধু আমার মধ্যে কেন, সবার মধ্যেই বাস করে। মিলন! তোমার মধ্যে কি বাস করে না? A man has many faces. শুধু জন্তুর একটাই Face থাকে। মানুষ জন্তু না।

[মোটামুটি জ্ঞানগর্ভ উত্তর দেওয়া হলো। আমি খুশি। মিলনকে তেমন খুশি মনে হচ্ছে না।]

ইমদাদুল হক মিলন : তাহলে আপনাকে একটি প্রশ্ন করি, মানুষ হিসেবে আপনি নিজেকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন এবং নিজেকে কোন স্তরের মনে করেন?

হুমায়ূন আহমেদ; মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমি খুবই উঁচু স্তরের। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি খুবই নিচুস্তরের একজন মানুষ।

ইমদাদুল হক মিলন : কী কী কারণে এমন মনে হয়?

হুমায়ূন আহমেদ : কখনো কখনো আমি এমন সব কাজ করি যে মনটা খুবই খারাপ হয়, তখন মনে হয় এই কাজটা কীভাবে করলাম? কেন করলাম?

ইমদাদুল হক মিলন : এটা কি রিসেন্ট কোনো ঘটনায় আপনার মনে হয়েছে! আপনার দ্বিতীয় বিয়ের ঘটনায় বা.

[ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় যদি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের ব্যবস্থা থাকত। তাহলে এ পর্যায়ে ব্যং করে একটা শব্দ হতো এবং টেনশন মিউজিক শুরু হতো।]

ইমদাদুল হক মিলন : প্রশ্নের জবাব দিতে না চাইলে দিতে হবে না।

হুমায়ূন আহমেদ: আমি যখন ইন্টারভিউ দিতে রাজি হয়েছি, তখন তোমার সব প্রশ্নেরই উত্তর দেব। মানুষ হিসেবে আমি কখনো নিজেকে অতি উঁচুস্তরের ভাবি আবার কখনো নিচুস্তরের ভাবি অনেক আগে থেকেই। দ্বিতীয় বিয়ের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনি বহু দিন ধরে টিভিতে, পত্র-পত্রিকায়, এমনকি কোনো অনুষ্ঠানেও যান না, এর কারণ কী? আপনি কি এগুলো অ্যাভয়েড করতে চান? আপনি বলছেন সব কিছু পরিষ্কার বলতে চান, কিন্তু আপনি তো বলেন না।

হুমায়ূন আহমেদ : শোনো, এ ধরনের প্রোগ্রামে যাওয়া বাদ দিয়েছি অনেক দিন হলো। একটা সময় ছিল, লেখালেখি জীবনের শুরুর কথা বলছি, যখন আগ্ৰহ নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাওয়া-আসা করতাম। পত্রিকার অফিসে বসে থাকতাম। বাংলাবাজারের প্রকাশকদের শোরুমে সময় কাটাতাম। ওই সময়টা পার হয়ে এসেছি। আমার বয়সও হয়েছে। এসব ভালো লাগে না। ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগে বেশির ভাগ সময়। তা ছাড়া হয়েছে কী, মানুষ তো গাছের মতো। গাছ কী করে? শিকড় বসায়। প্রতিটি মানুষেরই শিকড় আছে। আমার দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত যে শিকড় আছে, সেগুলো ছিঁড়ে গেছে। আমি ফর ফাইভ ইয়ারস বাইরে বাইরে ঘুরেছি। কখনো মায়ের কাছে থেকেছি, কখনো হোটেলে থেকেছি, কখনো উত্তরায় একটি বাসা ভাড়া করে থেকেছি, কখনো বন্ধুর বাসায় থেকেছি, দখিন হাওয়ায় থেকেছি। যখন দখিন হাওয়ায় থাকতে শুরু করলাম। তখনো সমস্যা। সপ্তাহের তিন দিন থাকি দখিন হাওয়ায়, চার দিন থাকি গাজীপুরে। প্রায়ই রাতে আমার ঘুমটা ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে গেলে মনে হয়, আমি এখন কোথায়? ঢাকায় না। গাজীপুরে? একজন মানুষের শিকড় যখন ছিঁড়ে যায়, তখন তাকে অস্থিরতা পেয়ে বসে। এই অস্থিরতার জন্যই বাইরে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। মনে হয়, নিজের মতো থাকি। ঘরে বসে থাকি, ছবি দেখি, গান শুনি। আমি এই বয়সে এসে এ রকম একটা সময় পার করছি। গর্তজীবী হওয়ার পেছনে এটাও হয়তো কারণ।

এখন নতুন শিকড় গজাচ্ছে। অস্থিরতা কমে আসছে। গর্ত থেকে বেরোতে শুরু করেছি। তোমাকে দীর্ঘ ইন্টারভিউ দিতে যে রাজি হলাম। এটা কি তা প্রমাণ করে না?

ইমদাদুল হক মিলন : আপনাকে অনেকে রুক্ষ মানুষ মনে করে, ভয় পায়। কিন্তু আপনার লেখা যারা পড়েছে তারা জানে যে, আপনি অসম্ভব মমতাবান একজন মানুষ। মানুষকে আপনি পছন্দ করেন।

হুমায়ূন আহমেদ : লেখা পড়ে তো একজন মানুষকে বিচার করা যায় না।

ইমদাদুল হক মিলন : অবশ্যই করা যায়। কেন যাবে না? একজনের লেখা পড়ে আমরা কি বুঝতে পারব না, সে কোন ধরনের মানুষ এবং এটা আপনার তো বিশ্বাস করার কথা। একজন লেখক জীবনের নানা রকম কথা তাঁর লেখার বিভিন্ন চরিত্রের মধ্য দিয়ে বলেন।

হুমায়ূন আহমেদ : হেমিংওয়ের লেখা পড়ে আমরা কখনোই বুঝতে পারি না যে, হেমিংওয়ে নিজেকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারেন। তিনি অসম্ভব জীবনবাদী একজন লেখক। তাঁর লেখা পড়ে যদি তাঁকে আমরা বিচার করতে যাই, তাহলে কিন্তু আমরা একটা ধাক্কা খাব। মায়কোভস্কি পড়ে কখনোই বুঝতে পারব না যে, মায়কোভস্কি আত্মহত্যা করার মানুষ। আমরা কাওয়াবাতা পড়ে কখনো বুঝতে পারব না যে, কাওয়াবাতা হারিকির করে নিজেকে মেরে ফেলবেন। এঁরা প্রত্যেকেই জীবনবাদী লেখক। জীবনবাদী লেখকদের পরিণতি দেখা গেল ভয়ংকর। তার মানে কী? তার মানে কী দাঁড়ায়? লেখকরা কি সত্যি সত্যি তাদের লেখায় নিজেকে প্ৰতিফলিত করেন? নাকি তাদের শুদ্ধ কল্পনাকে প্ৰতিফলিত করেন?

ইমদাদুল হক মিলন : ঘুরে ফিরে লীলাবতীর প্রসঙ্গটায় আবার আসি। আপনার এ লেখাটা এমন আচ্ছন্ন করেছে আমাকে, এর আগে জোছনা ও জননীর গল্প পড়ে এমন আচ্ছন্ন হয়েছিলাম। লীলাবতীতে মাসুদ নামের একটি ছেলে গোপনে এক সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছে, পরীবানু যার নাম, আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই। সে চরিত্রটা আবার আত্মহত্যা করল। আপনি মানুষকে এত নির্মমভাবে মেরে ফেলেন কেন আপনার লেখায়?

হুমায়ূন আহমেদ; আমাদের জগতটা কিন্তু খুব নির্মম। এ জগতে মানুষ যখন মরে যায়, খুব স্বাভাবিকভাবেই সে মরে যায়। সৃষ্টিকর্তাও কিন্তু নির্মম। এই যে সুনামিতে দেড় লক্ষ দুই লক্ষ লোক মারা গেল, তিনি নির্মম বলেই তো এত লোক মারা গেল। এই নির্মমতােটা কিন্তু আমাদের মধ্যেও আছে। কথা নেই বার্তা নেই একজন গলায় দড়ি দিচ্ছে, হঠাৎ করে একজন ঘুমের বড়ি খেয়ে নিচ্ছে। যে ঘুমের বড়িটা খাচ্ছে, সে কিন্তু খুব আয়োজন করে খাচ্ছে তা না। মনে হলো খেয়ে নিল। জীবনানন্দের সেই বিখ্যাত কবিতা, শোনা গেল লাশকাটা ঘরে নিয়ে গেছে তারে/ কাল রাতে—ফাল্গুনের রাতের আঁধারে/ যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ/ মরিবার হলো তার সাধ/..বধু শুয়ে ছিল পাশে—শিশুটিও ছিল/প্রেম ছিল, আশা ছিল/ জ্যোৎস্নায়,-তবু সে দেখিল কোন ভূত/ ঘুম ভেঙে গেল তার? অথবা হয় নি তো ঘুম বহুকাল/ লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার/ এই ঘুম চেয়েছিল বুঝি/ রক্তফেনা-মাখা মুখে/ মড়কের ইদুরের মতো ঘাড় গুজি/ আঁধার গুজির বুকে ঘুমায় এবার;/ কোনোদিন জাগিবেএলজি আর/ কোনোদিন জাগিবে না আর/ জাগিবার গাঢ় বেদনার/ অবিরাম-অবিরাম ভার/ সহিবে না আর। [এই পর্যায়ে আমি জীবনানন্দ দাশের দীর্ঘ কবিতার প্রায় সবটাই চোখ বন্ধ করে আবৃত্তি করলাম। কারণ? আশপাশের সবাইকে জানান দেওয়া যে, আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কবিতা মুখস্থ বলতে পারি। মিলনকে সামান্য ভড়কে দেওয়ার ইচ্ছাও যে ছিল না, তা না।]

ইমদাদুল হক মিলন : এই লীলাবতী উপন্যাসটা আপনি জীবনানন্দকে উৎসর্গ করেছেন। উৎসর্গের ভাষাটা হচ্ছে এ রকম—তিনি জীবিত, আপনি কবির উদ্দেশে বলছেন, কবি, আমি কখনো গদ্যকার হতে চাই নি। আমি আপনার মতো একজন হতে চেয়েছি। হায়, এত প্ৰতিভা আমাকে দেওয়া হয় নি।

হুমায়ূন আহমেদ : জীবনানন্দ দাশের কবিতা যখন পড়ি, তখন মনে হয় কবি যেন পাশেই আছেন। আমি যখন গভীর আগ্রহ নিয়ে তার কবিতাটি পাঠ করছি তিনি সেটা শুনতে পাচ্ছেন। রবীন্দ্ৰনাথের ক্ষেত্রেও আমার এই ব্যাপারটি ঘটে। যখন রবীন্দ্ৰসাহিত্য পড়ি, তখন মনে হয়, তিনি বুঝি আশপাশেই আছেন। অল্প কিছুদিন আগে বিভূতিভূষণের কিন্নরদল গল্পটি পড়ছিলাম…

ইমদাদুল হক মিলন : হ্যাঁ। এটা আপনার খুব প্রিয় একটা গল্প…

হুমায়ূন আহমেদ : আমি যখন গল্পটি পড়ছি, তখন আমার মনে হলো, তিনি আমার পাশেই আছেন। গল্পটি পড়ে আমি আনন্দ পাচ্ছি এবং সেই আনন্দটা তিনি বুঝতে পারছেন। এটা আমার ছেলেমানুষি হতে পারে। কিন্তু এই অনুভূতিটা আমার প্রায়ই হয়। যেকোনো ভালো লেখা পড়ার সময়ই আমার মনে হয় লেখক আমার পাশে আছেন।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনার লেখা পড়তে পড়তে আমার মনে হয়, ধরেন আপনি লিখছেন, কিন্তু এর পরে কোন লাইনটা লিখবেন আপনি জানেন না?

হুমায়ূন আহমেদ : কিছু কিছু লেখক আছেন, যারা প্রতিটি লাইন খুবই চিন্তাভাবনা করে লেখেন। আবার একধরনের লেখক আছেন, স্বতঃস্ফূর্ত লেখক। মাথায় যেটা আসবে সেটা লিখবো। আমার লেখার ওপর খুব একটা কস্ট্রোল আছে—তা না, কন্ট্রোল আছে হালকা, আমার মনে হয় যে আমার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে লেখাটা বেশি কাজ করে। কিন্তু আমি যখন জোছনা ও জননীর গল্প লিখেছি তখন কোন লাইনের পর কোন লাইন লিখব। আমি জানি। আমি যখন মিসির আলী লিখি তখন কিন্তু আমি জানি এই লাইনটার পরে আমি কোন লাইন লিখব। সায়েন্স ফিকশন লেখার সময় আমি জানি কোন লাইনটা লিখব। ওই বাকি লেখাগুলোর সময় আমার আর কন্ট্রোল থাকে না।

ইমদাদুল হক মিলন : লীলাবতী লেখার সময় জানতেন?

হুমায়ূন আহমেদ : না।

ইমদাদুল হক মিলন; লীলাবতীর একটা ছোট চরিত্রের কথা বলি, চঞ্চলী, সে রমিলার বোন। রমিলা মাঝে মাঝে বলে আমি পানিতে ডুবে গেলাম। আমার বোন আমার জন্য ঝাঁপ দিল, আমি উঠে গেলাম। কিন্তু সে আর উঠল না। সে এখন সব সময় আমার সঙ্গে থাকে। মাগো, এই জন্য আমি তোমার সঙ্গে ঢাকায় যাব না। এই যে চরিত্রটা, আপনি জেনেই লিখেছেন নাকি হঠাৎ?

হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ হঠাৎ,. হঠাৎ করেই মাথায় এসেছে, আবার হঠাৎ করেই চলে গেছে। চলে গেছে। যখন এটা নিয়ে পরে আর মাথা ঘামাই নি। যেমন দীঘির জলে একটা মাছের লেজ ভেসে উঠল। জলে ঘাই দিয়ে তলিয়ে গেল।

ইমদাদুল হক মিলন : এটি ১৩৫৭ সালের পটভূমিতে লেখা উপন্যাস, এখানে আনিস চরিত্রটা কতটুকু যৌক্তিক বলে মনে হয়েছে?

[বুঝতে পারছি মিলন এখন প্রমাণ করার চেষ্টা করবে যে, আনিস চরিত্রটি যৌক্তিক না। আমাকে এই মুহূর্তে কঠিন অবস্থানে যেতে হবে। দেরি করা যাবে না।]

হুমায়ূন আহমেদ : (কঠিন গলা) মিলন যথেষ্ট হয়েছে। রেকর্ডার বন্ধ করা। চা খাও। আজকের মতো এখানেই ইতি।

[মিলন রেকর্ডার বন্ধ করল। আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। হাত বাড়িয়ে আমার ডান হাত শক্ত করে চেপে ধরল। অনেক দিন আগের একটি স্মৃতি আমার মনে পড়ল। তখন শ্যামলীর এক ভাড়া বাড়িতে থাকি। আমার হয়েছে ভয়াবহ জন্ডিস। মিলন প্রচুর ফলমূল নিয়ে আমাকে দেখতে এসেছে। তার মাথাটা পরিষ্কার করে কামানো। তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। সে আমার বিছানার পাশে বসল। শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরল। মুখে কিছুই বলল না। এভাবে সে বসে থাকল। দীর্ঘ সময়। ভাব প্রকাশের ব্যাপারটা লেখকদের চেয়ে ভালো কেউ জানেন না। কিন্তু গভীর আবেগের সময় যে তারা কিছুই বলেন না—এই তথ্য কি সবাই জানে?

অনেক বছর আগে আমার হাত চেপে ধরে মিলন যে আবেগ প্রকাশ করেছিল, আজও সে তাই করল। হাত সে ধরে আছে ধরেই আছে, কিছুতেই ছাড়ছে না। আমি এত ভাগ্যবান কেন? মানুষের এত ভালোবাসা কেন আমার জন্য? আমার ঘর ভর্তি চাঁদের আলো। এই আলো আমি কোথায় রাখব?]

১২.০১ হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার

ইমদাদুল হক মিলন : আপনার মনে হয় নি যে লীলাবতী উপন্যাসের শেষটা আপনি খুব দ্রুত করেছেন? শেষটা আরেকটু বিস্তৃত হতে পারত?

হুমায়ূন আহমেদ : আমার বেশির ভাগ উপন্যাসে আমি শেষের দিকে এসে তাড়াহুড়া করি। কেন করি তোমাকে ব্যাখ্যা করি—তুমি তো লেখক মানুষ, তুমি বুঝবে। লেখক যখন লেখালেখি করেন, লেখার আগে থেকে পুরো উপন্যাসটা তাঁর মাথার ভেতর ঢোকে। আমি একটা ৫০০ পৃষ্ঠার উপন্যাস লিখলাম, ৫০০টা পৃষ্ঠা কিন্তু আমি তখন মাথার ভেতর নিয়ে বাস করছি। তখন একটা চেষ্টা থাকে, কত তাড়াতাড়ি আমি জিনিসটাকে মাথা থেকে নামিয়ে দেব। আমি প্রবল চাপ নিয়ে হাঁটাহাঁটি করি, একই সঙ্গে আমার মাথার ভেতর ৫০০ পৃষ্ঠার উপন্যাস হাঁটাহাঁটি করে। উপন্যাসের চরিত্রগুলো কুটুরকুটুর করে নিজেদের মধ্যে কথা বলে, ব্যাপারটা একই সঙ্গে আনন্দের ও প্রচণ্ড চাপের। আমার মনে হয়, একজন গর্ভবতী মা। ৯ মাস গৰ্ভধারণের পর সন্তানের জন্ম দিয়ে যে আনন্দ-তৃপ্তি-স্বস্তিটা পান, একজন লেখক ঠিক সেই স্বস্তিটা পান। সেই স্বস্তিটার জন্য আমার তাড়াহুড়া। আল্লাহপাক হয়তো এ কারণেই

ইমদাদুল হক মিলন : আবার লীলাবতী প্রসঙ্গে আসি। মাসুদের স্ত্রীর যখন বাচ্চা হবে, সে বাড়িতে থাকল, তার বাচ্চা হচ্ছে না। তার শাশুড়ি আগেই বলেছিল, তার যমজ বাচ্চা হবে। একটা ছেলে, একটা মেয়ে। তারপর নৌকা করে সে যাচ্ছে, ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে, সেখানে তার যমজ বাচ্চা হলো। এই যে এটুকু রহস্য, তাকে আপনি ঝড়-জলের মধ্যে কেন নিয়ে এলেন? রহস্যটা কী? এই কষ্টটা সে তো বাড়িতেও পেতে পারত?

হুমায়ূন আহমেদ : নৌকায় পরীবানুকে নিয়ে, তাকে ঝড়বৃষ্টির হাতে ছেড়ে দিয়ে যে টেনশন তৈরি হয়েছে, পরীবানুকে বাড়িতে রেখে দিলে তা হতো না।

ইমদাদুল হক মিলন : আমি সাহিত্যের যেটুকু বুঝি, তাতে জানি যে আপনি খুব বড় একজন লেখক। অন্য ভাষায় অন্য দেশে জন্মালে হয়তো আপনি আরও ভাগ্যবান হতেন। দুর্ভাগ্য আপনার, আপনি এই ভাষার, এই দেশে জন্মে গেছেন। আপনার কী মনে হয়, বাংলা ভাষার প্রেক্ষাপটে ঔপন্যাসিক হিসেবে আপনার অবস্থানটা কোথায়?

হুমায়ূন আহমেদ: আমার অবস্থান আমাকেই ঠিক করতে হবে? মিলন, শোনো, আমি সাহিত্যের ছাত্র না। আমি কেমিষ্ট্রির ছাত্র। সাহিত্যের বিষয়ে আমার যে জ্ঞান, সেটা হচ্ছে বই পড়ে। এক জীবনে প্রচুর বই পড়েছি। আমাদের সময় তো রেডিও, টিভি—এসব ছিল না; আমাদের একমাত্র জিনিস ছিল গল্পের বই। বিশাল বিশাল উপন্যাস, যেটা আমাদের অল্পবয়সীদের পড়তে দেওয়া হতো না। যেমন ধরো, কড়ি দিয়ে কিনলাম, খাটের নিচে ঢুকে অন্ধকারে পড়ে শেষ করেছি। আমার সাহিত্য সম্পর্কে যা জ্ঞান আছে, ওই খাটের নিচে ঢুকে বই পড়ে। এমন একজনকে কি সাহিত্যে তার অবস্থান বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক?

ইমদাদুল হক মিলন : হুমায়ূন ভাই, আমি জানতে চাইছিলাম যে আপনি এত বড় একজন লেখক, বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে আপনার নিজের অবস্থানটা কোথায়?

হুমায়ূন আহমেদ : প্রশ্নের উত্তর নিয়েই ছাড়বে? আমার অবস্থান ঠিক হবে আমার মৃত্যুর পর। তোমরা সবাই মিলেই ঠিক করবে। এই সময়ে আমি বর্তমানের একজন জনপ্রিয় লেখক। এর বেশি কিছু না।

ইমদাদুল হক মিলন : এখানে একটা কথা বলি, যে অবস্থায় হেমিংওয়ে তাঁর জীবদ্দশায় পপুলার, জীবদ্দশায় মার্কেজ পপুলার, জন স্টাইনবেক পপুলার, তাঁদের মতো লেখক সারা পৃথিবীতে বিরল আর আমাদের সাহিত্যে শরৎচন্দ্ৰ জনপ্রিয়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুল—এঁরা জনপ্রিয়। এখন এসব লেখকের জনপ্রিয়তার পার্থক্য আছে। আমি বাংলা ভাষায় জনপ্রিয়তার কথা বললে তারাশঙ্করকে বলব। তার সময়ে তার মতো জনপ্রিয় আর কেউ নেই। জনপ্রিয়তার কথা বললে আপনাকে তো কেউ রোমেনা আফাজের সঙ্গে তুলনা করে না, আপনাকে তুলনা করলে তারাশঙ্করের সঙ্গে তুলনা করে, শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তার সঙ্গে করে।

হুমায়ূন আহমেদ : মিলন, শোনো, বাংলাদেশে সাহিত্যের থার্মোমিটার হলেন সাহিত্যের অধ্যাপকরা। এ দেশে পাঠকদের ভালোলাগা-মন্দলাগা গ্রাহ্য হয় না। সাহিত্যের অধ্যাপকদের থার্মোমিটারে কী উঠছে, সেটাই গ্রাহ্য। সাহিত্যের থার্মোমিটার বলছে, আমি একজন জনপ্রিয় লেখক। এর বেশি কিছু না। কাজেই এটাই সত্য। আমার মৃত্যুর পর নতুন সত্য আসতে পারে, আবার নাও পারে। না এলে নাই। সাহিত্যের অধ্যাপকরা সাহিত্য মাপার নানা যন্ত্রপাতি—থার্মোমিটার, ল্যাকটোমিটার নিয়ে বসে থাকুক। আমি বসে থাকব বলপয়েন্ট নিয়ে। মিলন, ল্যাকটোমিটার কী জানো তো? ল্যাকটোমিটার দিয়ে দুধের ঘনত্ব মাপা হয়। সাহিত্যের সমালোচকদের হাতেও কিন্তু সাহিত্যের ঘনত্ব মাপার ল্যাকটোমিটার আছে। হা হা হা।

বাংলাদেশের একজন সাহিত্যবোদ্ধা আমার উপন্যাসগুলোর জন্য একটা নাম বের করেছিলেন, সেটা তোমার মনে আছে? অপন্যাস।

ভাগ্যিস তার পরই কলকাতার দেশ পত্রিকা আমার অপন্যাস ছাপতে শুরু করল। আমাদের দেশের সাহিত্যবোদ্ধাদের কাছে ওই পত্রিকাটি হিসাবের পত্রিকা।

ইমদাদুল হক মিলন : হ্যাঁ। এটা বাংলা ভাষার কোনো লেখকের ক্ষেত্রে ঘটে নি। প্রতিবছর শারদীয় সংখ্যায় বাংলা ভাষার কোনো লেখকের উপন্যাস ছাপা হওয়া দেশ-এর ইতিহাসে নেই।

হুমায়ূন আহমেদ : থাকুক ওই প্রসঙ্গ। শারদীয় দেশ আমার উপন্যাস ছেপেছে বলে আমি জাতে উঠে গেছি, এটা আমি মনে করি না। আমি লেখালেখি আমার আনন্দের জন্য করি, জাতে ওঠার জন্য করি না। জাতিচ্যুত হওয়ার জন্যও করি না।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনি তো প্ৰচণ্ড আত্ম-অহংকারী লোক!

হুমায়ূন আহমেদ : আমি চোখমুখ শক্ত করে থাকি বলে আমাকে অহংকারী মনে হয়। তবে কিছু অহংকার আছে। সেই অহংকার নিজেকে ভালো মানুষ ভাবার অহংকার। এর বেশি না।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনার প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলা ভাষার খুব বড় ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বইটি নিয়ে দেশ পত্রিকায় লিখলেন। ওটা একটা অসাধারণ রচনা। আমার এখনো মনে আছে। আপনার বইয়ের ভূমিকা লিখলেন আহমদ শরীফ এবং বাংলাদেশের যত বুদ্ধিজীবী আছেন সবাই আপনার প্রশংসা করেছিলেন এই লেখার জন্য। এরপর ড. আনিসুজ্জামান আপনার বইয়ের ভূমিকা লিখে দিলেন। শামসুর রাহমান আপনার লেখার ব্যাপক প্রশংসা করে লিখেছেন এবং বাংলা ভাষার খুব বড় লেখক আমি মনে করি তাকে, জানি না। আপনি আমার সঙ্গে একমত হবেন কি না-তাঁর নাম রমাপদ চৌধুরী, তিনি আপনার লেখা সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত চিঠিপত্র লিখেছিলেন এবং তাঁর সঙ্গে আমার একবার কথাও হয়েছিল কলকাতায়। সব কিছু মিলিয়ে আপনার এ ধারণাটা কেন হলো যে এ দেশের দু-একজন কী বললেন না বললেন তার ওপর আপনাকে নির্ভর করতে হবে বা আপনি খুব আশান্বিত হবেন তাদের কথায়?

হুমায়ূন আহমেদ : মিলন, আমি যে সময়ের কথা বলেছি, সে সময়…।

ইমদাদুল হক মিলন : না, তার আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বা আহমদ শরীফের মতো লেখকরা আপনাকে নিয়ে লিখেছেন। শওকত আলী আপনাকে নিয়ে লিখেছেন।

হুমায়ূন আহমেদ : মানুষের মন খারাপ হয় না? কত আগ্রহ, কত আনন্দ নিয়ে লিখি! কত না বিনিদ্র রজনীর লেখাকে অপন্যাস বলা হচ্ছে, একথা মনে লাগবে না? লেখকরা তো আবেগের সমুদ্রেই লালিত-পালিত।

ইমদাদুল হক মিলন : জনপ্রিয় লেখকের কনসেপ্টটা আসলে কী আপনার কাছে? আপনি আমাকে একটু পরিষ্কার করে বলেন তো…।

হুমায়ূন আহমেদ : তুমি দেখি এক জনপ্রিয় নিয়ে ঘটঘট করেই যাচ্ছ? ব্যাপারটা কী? জনপ্ৰিয় লেখকের কনসেপ্ট একটাই–বহু লোক তাঁর বই পড়ছে।

ইমদাদুল হক মিলন : এখন বহু লোক তো মার্কেজের বইও পড়ছে, তারাশঙ্করের বইও পড়ছে, হুমায়ূন আহমেদের বইও পড়ছে, আবার এদিকে রোমেনা আফাজ বা এজাতীয় লেখকের বইও পড়ছে। সে ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কী রকম দাঁড়ায়?

হুমায়ূন আহমেদ : শোনো মিলন, এত প্যাচালের মধ্যে যেতে চাইছি না। এখন আমার কাছে জনপ্রিয় শব্দটা খুব প্রিয়। ইমদাদুল হক মিলন : প্ৰিয় শব্দ? হুমায়ূন আহমেদ : কারণ জনপ্রিয় শব্দটার প্রথম শব্দ হলো জন, যেখানে জনতা আছে, সেখানে সেই শব্দটাকে আমি ক্ষুদ্র করে দেখব, আমি ওই রকম লোকই না। আমাদের হেমন্তের গান শুনতে ভালো লাগে না?

ইমদাদুল হক মিলন : হ্যাঁ। অবশ্যই।

হুমায়ূন আহমেদ : কত দরদি একজন গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়! এখন বহু লোক তার গান শোনে বলে কি তিনি ছোট হয়ে গেছেন?

ইমদাদুল হক মিলন : না, এখানে কি হুমায়ূন ভাই আপনার মনে হয় জনপ্রিয়তার দুটি ভাগ আছে? ধরেন যে অর্থে মার্কেজ বা তারাশঙ্কর জনপ্রিয়, যে অর্থে আপনি জনপ্রিয়, সেই অর্থে ফুটপাতের চটিবই লেখা একজন জনপ্রিয় লেখক, এ বিষয়ে আপনার ব্যাখ্যাটা কী?

হুমায়ূন আহমেদ : আসলে ব্যাপার হলো, জনতার কোন অংশ বইটি পড়ছে।

ইমদাদুল হক মিলন : আমি সেটাই জানতে চাইছি। আমি বিষয়টা একটু ক্লিয়ার করে দিই। আপনাকে। ধরেন হেমিংওয়ে বা মার্কেজের জনপ্রিয়তা, তারাশঙ্কর বা বিভূতিভূষণের যে জনপ্রিয়তা আর ওদিকে নীহারঞ্জন গুপ্ত। আপনার জায়গাটা কোথায় আসলে?

হুমায়ূন আহমেদ : ভালো যন্ত্রণায় পড়লাম তো। মিলন, শোনো, একটা সময় ছিল, যখন এইসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আমি মাথা ঘামাতাম। এখন মাথা ঘামাই না। এখন মনে হয়, তোমাদের যা ইচ্ছা তোমরা বলো, আমার উপন্যাসকে অপন্যাস বলো, আমার কিছু যায়-আসে না। আমার প্রধান কাজ হচ্ছে লেখালেখি করে যাওয়া, এ কাজটি আমি যদি আমার মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত করে যেতে পারি, আমি মনে করব, এটা আমার জন্য যথেষ্ট। এবং আমি খুবই ভাগ্যবান লেখক যে আমি আমার বইগুলো অনেককেই পড়াতে পারছি। একটা প্রত্যন্ত গ্রামের কোনো বাড়িতে ঢুকে যখন দেখি ওই বাড়িতে চার-পাঁচটা বই আছে, এর মধ্যে একটা নিয়ামুল কোরআন আছে, একটা বিষাদসিন্ধু আছে আর একটা হুমায়ূন আহমেদের বই—আমার যে কী আনন্দ হয়! চোখে পানি এসে যাওয়ার মতো আনন্দ।

১৩. হুমায়ূন আহমেদের কলকাতার লেখকবন্ধুরা

হুমায়ূন আহমেদ কলকাতার এক হোটেলে উঠেছেন।

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় খবর পেয়েছেন। হোটেলে ফোন করে হুমায়ূন ভাইকে বলেছেন, দেখা করতে আসবেন।

হুমায়ূন ভাই সেদিন দুপুরের পরই সময় দিয়েছেন।

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা সম্পর্কে হুমায়ূন ভাইয়ের তেমন ধারণা ছিল না। পরে ঢাকায়, তার দখিন হাওয়ার ফ্ল্যাটের আড্ডায় ঘটনাটি বলতে বলতে হঠাৎই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের দু-চারটা লেখার কথা বলো তো? আমি শ্যামলদার লেখার ভক্ত। ঢাকা কলকাতায় অনেকবার তার সঙ্গে আড্ডা হয়েছে। আমি তাঁর কিছু অসাধারণ লেখার কথা বললাম, কুবেরের বিষয় আশয় ঈশ্বরীতলার রুপোকথা স্বর্গের আগের স্টেশান হাওয়া গাড়ি শাহজাদা দারশুকো এইসব উপন্যাস আর দুতিনটি গল্পের কথা বললাম। যেমন চন্দশ্বেসরের মাচান তলায় পরী গত জন্মের রাস্তা। আর তাঁর বাংলাসাহিত্যে একেবারেই নতুন ধরনের গদ্যভাষার কথাও বললাম।

হুমায়ূন ভাই শুনলেন তারপর ঘটনাটা বললেন।

হুমায়ূন আহমেদ যে অসাধারণ জাদুকরী ভঙ্গিতে লিখতেন, গল্পও করতেন ঠিক সেই ভঙ্গিতে। তিনি কথা বলবার সময় আমরা মুগ্ধ বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে থাকতাম। সেই সন্ধ্যায়ও আছি। তো শ্যামলদা দুপুরের পর পর হুমায়ূন ভাইয়ের হোটেলে এলেন। রুমে বসে চা খেতে খেতে গল্প হচ্ছে দুই লেখকের। শ্যামলদাকে যারা চেনেন যারা তাঁর লেখা পড়েছেন তাঁরা জানেন, তার রসোবোধ চমৎকার। আর হুমায়ূন আহমেদের রসোবোধের তুলনাই হয় না।

কথায় কথায় শ্যামলদা একসময় বললেন, আমার দাঁতগুলো দেখেছেন হুমায়ূন? কী চকচক করছে! আসলে ফলস দাঁত লাগিয়েছি। এই দাঁতের মুশকিল হলো একটাই, চুমু খেতে অসুবিধা!

হুমায়ূন ভাই সিগ্রেট টানতে টানতে নির্বিকার গলায় বললেন, দাঁত খুলে নেবেন। নিজের খুলতে অসুবিধা হলে প্রেমিকাকে বলবেন মাঝারি সাইজের একটা চড় মারতে, দাঁত আপনা আপনি খুলে বেরিয়ে আসবে।

হুমায়ূন আহমেদের রসোবোধে শ্যামলদা মুগ্ধ।

তারপুর হুমায়ূন ভাই তাঁর অতি বিনয়ী ভঙ্গিতে, হাসিমুখে বললেন, আপনি একবার সন্তোষকুমার ঘোষকে চড় মেরেছিলেন। চড় খেয়ে আনন্দবাজার পত্রিকার চাকরি ছাড়লেন। আমি সেই স্মৃতি মনে রেখে চড়ের কথাটা বললাম। কিছু মনে করবেন না।

কলকাতার লেখকদের মধ্যে হুমায়ূন ভাইর প্রথম যোগাযোগ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ৭০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল হুমায়ূন ভাইর প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরকে। স্বাধীনতার পর ৭২ সালের শুরুর দিকে সেই উপন্যাসের একটি কপি কেমন কেমন করে গিয়ে পড়ল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে। নন্দিত নরকে তখন আমাদের লেখক বুদ্ধিজীবী মহলে ব্যাপক আলোচিত। বইয়ের ভূমিকা স্বপ্রণোদিত হয়ে লিখেছেন মনীষী আহমদ শরীফ। শওকত আলী প্রমুখ লেখকরা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আলোচনা লিখছেন। বাংলাসাহিত্যে একেবারে নতুন স্বাদ নিয়ে এসেছেন হুমায়ূন আহমেদ। অতি সাদামাটা সরল ভাষায় মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার গল্প এর আগে এভাবে কোনো লেখক লিখতে পারেন নি।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখন দেশ সাপ্তাহিকে সনাতন পাঠক নামে বইপত্রের আলোচনা এবং লেখক বিষয়ক নানারকম খুটিনাটি বিষয় নিয়ে কলাম লেখেন। অন্যদিকে কৃত্তিবাস বের করেন বন্ধুদের নিয়ে।

নন্দিত নরকে নিয়ে তিনি একটি লেখা লিখলেন। তার সেই লেখার মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পাঠক জানতে পারলেন বাংলাদেশের এক তরুণ তুখোড় ঔপন্যাসিকের কথা, কালক্রমে যিনি কিংবদন্তি হয়ে উঠলেন।

হুমায়ূন ভাই বোধহয় তারপরই সুনীলদাকে চিঠি লিখেছিলেন। পত্র যোগাযোগ তাদের মধ্যে ছিল। ধীরে ধীরে সেই যোগাযোগ গভীর হলো। সুনীলদা ঢাকায় এলেই হুমায়ূন ভাইর ফ্ল্যাটে আসেন। সাহিত্যের আড্ডা আর গানে, আমাদের তুমুল হৈহল্লায় সময় কাটে। কখনো কখনো স্বাতীন্দিও (স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী) থাকেন।

একবার পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের লেখকদের নিয়ে একটা সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে কলকাতায়। বাংলাদেশ থেকে সেমিনারে আমন্ত্রিত হয়ে গেছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং হুমায়ূন আহমেদ। অনুষ্ঠানের সভাপতি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তার লেখার মতোই অতি সিরিয়াস একটা বক্তৃতা দিলেন। প্রেমের গল্প উপন্যাস যারা লেখেন, হালকা চালের পাঠকমন জয় করা যাঁরা লেখক তাদেরকে খুব একচোট নিলেন। আকার ইঙ্গিতে হুমায়ূন আহমেদকেও একটু ধরলেন, একটু তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলেন।

হুমায়ূন আহমেদের মতো বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ আমি জীবনে দেখি নি। তিনি মুহূর্তেই বুঝলেন ব্যাপারটা। লজ্জা পেলেন, মাথা নিচু করে বসে রইলেন। সুনীলদা ব্যাপারটা খেয়াল করলেন। সভাপতির বক্তব্য দিতে উঠে তিনি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বক্তব্য বিভিন্ন যুক্তিতে খণ্ডন করলেন, প্রেমের গল্প কবিতা উপন্যাস নিয়ে এমন কিছু কথা বললেন, পৃথিবীর বিখ্যাত সব লেখকের প্রেম বিষয়ক লেখার উদ্ধৃতি দিলেন, হুমায়ূন ভাইয়ের মন ভালো হয়ে গেল। আর কে না জানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো পাঠক বাঙালি লেখকদের মধ্যে বিরল। সারা পৃথিবীর সাহিত্য তিনি ভেজে খেয়েছেন।

তারপর আরেকটা কাজ করলেন সুনীলদা।

তখন হুমায়ূন ভাইকে তিনি আপনি করে বলতেন। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর বললেন, হুমায়ূন, আমাদের একটা আড্ডাখানা আছে, নাম বুধসন্ধ্যা। প্রতি বুধবার সন্ধ্যায় আমরা ওখানটায় বসে আড্ডা দিই, গান গল্প করি। কবিতা গল্প পড়ি। কাল বুধসন্ধ্যার একটা গল্প পাঠের আসর আছে। আপনি গল্প পড়বেন।

পরদিন বুধসন্ধ্যায় গল্প পড়লেন হুমায়ূন ভাই। গল্পের নাম আনন্দ বেদনার কাব্য। পড়া শুরু করার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই স্তব্ধ হয়ে গেল হলরুম। একটা সময়ে দেখা গেল শ্রোতারা অনেকেই চোখ মুচছেন।

হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন এ রকম জাদুকর। লিখে মানুষ কাঁদাতে আর হাসাতে তাঁর তুলনা তিনি নিজে।

কলকাতার দুজন লেখকের খুব প্রিয় জায়গা ঢাকা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার। ঢাকায় এলে হুমায়ূন ভাইর ফ্ল্যাটে তাঁরা আসবেনই, নুহাশপল্লীতে গিয়ে একটা রাত হলেও থাকবেন। দুজনেই এত ভালোবাসেন হুমায়ূন আহমেদকে, লেখক হিসেবে এত শ্রদ্ধা করেন, ভাবা যায় না। বড় লেখকের পাশাপাশি এই দুজন মানুষ হিসেবেও বড়, হুমায়ূন আহমেদের মতোই। হুমায়ূন ভাই লেখক হিসেবে যে মাপের, মানুষ হিসেবেও সেই মাপেরই। তাঁর হৃদয় ছিল শরীরের তুলনায় কোটিগুণ বড়।

আরেকজন বড় লেখক হুমায়ূন আহমেদের লেখা এবং ব্যক্তি হুমায়ূনকে খুবই ভালোবাসেন। তিনি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। হুমায়ূন ভাই শীর্ষেন্দুর লেখা যেমন পছন্দ করতেন, মানুষটিকেও পছন্দ করতেন। ঢাকায় এলে হুমায়ূন ভাইর সঙ্গে দেখা শীর্ষেন্দুদা করতেনই। এক দুঘণ্টা গল্প করতেন। ঐশ্বরিক জগতের গল্প, ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের গল্প।

শীর্ষেন্দুদার জীবনযাপন অন্যরকম। এক ধরনের স্বাত্ত্বিক জীবনযাপন করেন তিনি। লেখেন অসাধারণ। এখনো মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমরা তাঁর লেখা পড়ি।

হুমায়ূন ভাই বেশি পছন্দ করতেন। শীর্ষেন্দুদার কিশোরদের লেখাগুলো। ঢাকার বহু অনুষ্ঠানে শীর্ষেন্দুদার বক্তৃতা শুনেছি আমি। সেইসব বক্তৃতায় হুমায়ূন আহমেদের লেখার উচ্ছ্বসিত প্ৰশংসা করতেন তিনি।

এবার সমরেশ মজুমদারের কথা বলি।

নব্বই দশকের শুরুর দিকে প্রথম ঢাকায় এলেন সমরেশদা। ততদিনে তিনি বাংলাভাষার জনপ্ৰিয়তম লেখকদের একজন। উক্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ এই ট্রিলজি জনপ্রিয়তার আগের অনেক রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। আমরা আবিষ্ট হয়ে আছি সেই ট্রিলজির মায়ায়। তারপর তিনি লিখলেন দুই পর্বের সাতকাহন। এই উপন্যাস আরও একধাপ এগিয়ে নিল তাকে। তার আগে সমরেশদার প্রথম উপন্যাস দৌড়, এই আমি রেণু আর দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর দুর্দান্ত একেকটা গল্প পড়ে পাঠক মন্ত্ৰমুগ্ধ হয়ে আছে।

সমরেশদা ঢাকায় এলেন পার্ল পাবলিকেশন্সের স্বত্বাধিকারী আলতাফ হোসেনের আমন্ত্রণে। আলতাফ সাহেবের ডাকনাম মিনু। আমরা ডাকতাম মিনুভাই। অতি বড় হৃদয়ের অসাধারণ মানুষ।

আহা, কত ভালো ভালো মানুষ আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন। মিনুভাইও অকালে চলে গেলেন।

হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে সমরেশদার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন মিনুভাই। আমার পরিচয়ও মিনুভাইর মাধ্যমেই। পরিচয়ের প্রথম দিন থেকেই আমি সমরেশদাকে তুমি বলি। গভীর ভালোবাসা থেকেই বলি। যেমন বলি, বেলাল চৌধুরী, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, রবিউল হুসাইনকে।

সমরেশদাকে আমার এই তুমি বলাটা একদমই পছন্দ করতেন না হুমায়ূন ভাই। এই নিয়ে আমাকে একদিন মৃদু বকাঝকা করলেন। ২০০৮ সালের কথা। তখন আমি আনন্দবাজার পত্রিকা-র আমন্ত্রণে কলকাতায় যাচ্ছি। মৈত্রী ট্ৰেন উদ্বোধন হবে, সেই অনুষ্ঠানে। একসঙ্গে দুটো ট্রেন রওনা দেবে। একটা কলকাতা থেকে, একটা ঢাকা থেকে। আনন্দবাজার পত্রিকা ঠিক করেছে। কলকাতা থেকে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় যাবেন ঢাকায়, যেতে যেতে একটা লেখা লিখবেন, আর ঢাকা থেকে আমি আসব, আসার পথে একটা লেখা লিখব, পরদিন আনন্দবাজার পত্রিকা-র ফাস্টপেজে দুজনের রেলভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা লেখা হবে।

আগের রাতে গেছি হুমায়ূন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি সব শুনে বললেন, যাচ্ছ ভালো কথা কিন্তু সমরেশদার সঙ্গে দেখা হলে কিছুতেই তাঁকে আর তুমি করে বলবে না।

কলকাতায় যাব আর সমরেশদার সঙ্গে দেখা হবে না, এটা হতেই পারে না।

এক অনুষ্ঠানে দেখা হলো। লেখকদের কলকাতার স্মৃতি নিয়ে অনুষ্ঠান। নামকরা অনেক লেখক সেই অনুষ্ঠানে। আমাকে নিয়ে গেছেন ছড়াকার দীপ মুখোপাধ্যায়। গিয়ে আমি মুগ্ধ। সুনীল শীর্ষেন্দু সমরেশ নবনীতা দেবসেন এ রকম অনেকে। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক পবিত্র মুখোপাধ্যায়। সমরেশদার একটু তাড়া ছিল। তিনি তাঁর বক্তব্য শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমে এলেন। আমি তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কেমন আছেন, সমরেশদা?

সমরেশদা গম্ভীর হয়ে গেলেন। তুমি কিন্তু আমাকে তুমি করে বলতে? আজি আপনি আপনি করছো কেন?

আমি আর বলার চান্স পেলাম না, হুমায়ূন ভাইয়ের ভয়ে বলছি।

হায় রে, আমার সেই শাসন করার মানুষটি নেই।

কলকাতায় হুমায়ূন ভাইকে ব্যাপকভাবে পরিচিত করাবার কাজটি করেছিলেন সমরেশদা। দেশ পত্রিকায় পর পর আট বছর হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ছাপা হয়েছে। দেশ পত্রিকার সম্পাদককে হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে বুঝিয়ে ছিলেন সমরেশদা। আমার ক্ষেত্রেও একই কাজ করেছিলেন। দেশ পুজো সংখ্যা প্রতিবছর ছেপে যাচ্ছিল হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস, আর আনন্দলোক ছাপিছিল আমার উপন্যাস। আমাদের দুজনকে কী যে ভালোবাসেন তিনি।

সমরেশদা, তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা নেই আমার। মৃত্যু মুহূর্ত পর্যন্ত তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব আমি। আমাদেরকে কলকাতায় পরিচিত করাবার জন্য তুমি দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে আমাদের নিয়ে লিখেছিলে, সাপ্তাহিক বর্তমান পত্রিকায় অনেকগুলো লেখা লিখেছিলে। খুব কম লেখকই অন্য লেখকের জন্য এই কাজ করেন। তুমি লেখক হিসেবে হিমালয়ের মতো, মানুষ হিসেবেও। জনপ্রিয়তায় আকাশ স্পর্শ করা লেখক হুমায়ূন আহমেদ চলে যাওয়ার পর তোমাকে আমি ফোন করেছিলাম। ফোনের একদিকে আমি কাঁদছি, আরেকদিকে তুমি। হুমায়ূন আহমেদের জন্য তোমার ভালোবাসা অক্ষয় হোক।

আরেকজন লেখকের কথা বলে এই লেখা শেষ করি।

তাঁর নাম রমাপদ চৌধুরী। খুবই গুরুগম্ভীর মানুষ। আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরিয় পাতা দেখেন। সমরেশদা হুমায়ূন ভাইকে নিয়ে গেছেন তাঁর কাছে। পরিচয় করিয়ে দিলেন। হুমায়ূন ভাই রমাপদ চৌধুরীর লেখা পছন্দ করেন। আমাকে বহুবার তাঁর দ্বীপের নাম টিয়া রঙ বইটির কথা বলেছেন। পরিচয় হলো ঠিকই কিন্তু রমাপদ চৌধুরী তাঁর স্বভাবগত কারণেই তেমন কথাবার্তা বললেন না। হুমায়ূন ভাই তাঁর গল্পসমগ্র বইটি রমাপদ চৌধুরীকে উপহার দিয়ে এলেন।

মাসখানেক পর রমাপদ চৌধুরীর একটা চিঠি এল হুমায়ূন ভাইয়ের কাছে। তিনি লিখেছেন, আমি আপনার গল্পগুলো পড়ে মুগ্ধ এবং বিস্মিত হয়েছি। আপনার বহু গল্প বাংলাসাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ হিসেবে গণ্য হবে। আপনি একজন বিশাল মাপের লেখক।

হায় রে, আমাদের সেই বিশাল মাপের লেখক নেই। আমাদেরকে দরিদ্র করে তিনি চলে গেছেন। এই বেদনা আমরা কোথায় রাখব!

১৪. হুমায়ূন আহমেদের অন্যরকম সাক্ষাৎকার

মিলন : হুমায়ূন আহমেদ, আপনি কেমন আছেন?

হুমায়ূন আহমেদ : বেঁচে আছি।

মিলন : বেশির ভাগ মানুষকে যদি এ প্রশ্নটা করা হয়, তারা বলেন, ভালো আছি। অথবা এই আছি আর কী। কেউ কেউ কোনো কোনো সমস্যার কথা বলেন। আর আপনি শুধু বলেন, বেঁচে আছি। এ রকম বলার কারণ কী?

হুমায়ূন আহমেদ : বাংলাদেশে আমি অনেক মৃত মানুষকে জীবিত ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াতে দেখি। এঁদের আত্মা মরে গেছে। তারা তা জানেন না। তাদের যদি প্রশ্ন করা হয় কেমন আছেন, তাঁরা হাসিমুখে বলেন, ভালো আছি।

মিলন : আপনি এত বড় লেখক, বড় লেখকদের বাড়িভর্তি বই থাকবে, এমনই আমরা আশা করি। আপনার ফ্ল্যাটে তেমন বই দেখছি না কেন? আপনার এই ফ্ল্যাটের সেলফে বইয়ের সংখ্যা কত?

হুমায়ূন আহমেদ : এই মুহূর্তে আমার ফ্ল্যাটে বই আছে বারো শ তেত্রিশ। এটা আমার লেখালেখির বারান্দা। যেসব বই লেখালেখিতে প্রয়োজন সেই বই-ই শুধু এখানে আছে। আমার নিজের লেখা বই একটিও নেই। তবে ঢাকার বাইরে নুহাশপল্লীর লাইব্রেরিতে অনেক বই আছে। দশ হাজারের বেশি বই আছে আমার গ্রামের শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ স্কুলে। একটা কথা, লেখক হতে হলেই বিশাল লাইব্রেরি থাকতে হবে, তা না। প্ৰকাণ্ড লাইব্রেরির মালিকরা কেউই লেখক না।

মিলন : কয়েক বছর ধরে আপনি ছবি আঁকছেন। অনেক ছবিই এর মধ্যে এঁকেছেন। ছবি আঁকার ব্যাপারটি আপনার মধ্যে কীভাবে এল?

হুমায়ূন আহমেদ : আমার সব ভাইবোনই শখের পেইন্টার। এটা বোধহয় জিনের কোনো ব্যাপার। তবে আমার বাবা-মা কাউকেই কখনো ছবি আঁকতে দেখি fà |

মিলন : ছেলেবেলায় বা বড় হয়ে ওঠার পর লেখালেখি শুরু করলেন। কিন্তু ছবি আঁকতে শুরু করলেন অনেকটা বয়সে.।

হুমায়ূন আহমেদ : Even an old dog can learn few new tricks.

মিলন : যারা ছবি আঁকেন, তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছবির প্রদর্শনী করা। কখনো কখনো পত্রপত্রিকায় নিজের আঁকা ছবি ছাপাবার ব্যবস্থা করা। অর্থাৎ প্রচারের একটা লক্ষ্য থাকে। আপনার সে রকম কিছুই আমাদের চোখে পড়ে নি কেন?

হুমায়ূন আহমেদ : আমি খুবই নিম্নমানের পেইন্টার। আমার আঁকা ছবি বন্ধুবান্ধবকে দেখানো যায়। এর বাইরে না। নিজের সীমাবদ্ধতা আমি জানি।

মিলন : ম্যাজিকে আপনার গভীর উৎসাহ। ম্যাজিকের বই পড়া, ম্যাজিক প্র্যাকটিস করা-এ ব্যাপারটি নিয়ে মেতে থাকতে আপনি খুব পছন্দ করেন। ম্যাজিকের প্রতি আপনার এই আকর্ষণ কীভাবে জাগল?

হুমায়ূন আহমেদ : ম্যাজিক মুন্সি লেখায় আমার ম্যাজিকের প্রতি আগ্রহের কারণ ব্যাখ্যা করেছি। আর কিছু বলতে ইচ্ছা করছে না। একই কথা বারবার বলা ক্লান্তিকর ব্যাপার।

মিলন : এ পর্যন্ত শ খানেক গান আপনি লিখেছেন। আপনার লেখা কোনো কোনো গান আকাশচুম্বী জনপ্রিয়। যেমন—এক যে ছিল সোনার কন্যা, ও আমার উড়াল পঙ্খী রে। আপনি সেভাবে কখনো কবিতা চর্চা করেন নি। গান লেখার ব্যাপারটিতে কেমন করে জড়ালেন?

হুমায়ূন আহমেদ : বেশির ভাগ গানই প্রয়োজনের তাগিদে লেখা। যেমন ছবির জন্য গান দরকার, অন্য কারও কাছে না গিয়ে নিজেই লিখলাম। গানে আমার ভূমিকার চেয়ে সুরকার এবং গায়ক-গায়িকার ভূমিকা প্রধান। পত্রিকার পোস্টএডিটরিয়ালেও সুন্দর সুর বসালে এবং ভালো কাউকে দিয়ে গাওয়ালে সুন্দর গান হবে।

মিলন : আপনি কয়েকটি দুর্দান্ত বিজ্ঞাপন চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। বিজ্ঞাপন চিত্রের স্ক্রিপ্ট করেছিলেন। এ কাজগুলো এখন আর করছেন না কেন?

হুমায়ূন আহমেদ : বিজ্ঞাপন তো নিজের আগ্রহে কেউ করে না। অন্যের আগ্রহে করা হয়। কেউ আমাকে এখন আর বিজ্ঞাপন বানাতে ডাকে না।

মিলন : একবার ঈদে দেশ টিভির জন্য আপনি একটি অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করেছেন। অনুষ্ঠানটির পরিচালকও ছিলেন আপনি। পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ নন, আমরা কথা বলতে চাইছি উপস্থাপক হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে। এ বিষয়ে তিনি কী বলেন?

হুমায়ূন আহমেদ : নুহাশপল্লীর নিতান্ত ঘরোয়া অনুষ্ঠানে উপস্থাপনটা গৌণ। নিজের ঘরে কথা বলার মতো। তবে জীবনের প্রথম উপস্থাপনাটা কিন্তু জাপানে। বাংলাদেশ থেকে বিশাল একদল নিয়ে গিয়েছি। উপস্থাপক নিয়ে যাই নি, কাজেই বাধ্য হয়ে উপস্থাপনা।

মিলন : ভবিষ্যতে আপনি কি উপস্থাপনা করবেন? সবকিছুই তো করলেন, এটা বাদ থাকবে কেন?

হুমায়ূন আহমেদ : আমার চেহারা খারাপ, কণ্ঠস্বর খারাপ, ভাষা আঞ্চলিকতা দোষে দুষ্ট। এইসব ক্রটি নিয়ে লেখক হওয়া যায়, উপস্থাপক হওয়া যায় না।

মিলন : আপনি কিছু অবিস্মরণীয় ভূতের গল্প লিখেছেন। আমরা মনে করি, সেইসব গল্প বাংলা সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হবে। ভূত নিয়ে আপনার নিজের ভাবনাটা কী রকম? আপনি ভুতে বিশ্বাস করেন?

হুমায়ূন আহমেদ; ভূত বিশ্বাস করি না, কিন্তু ভয় নামক অনুভূতিটি বিশ্বাস করি। আমার কাজ ভয় নিয়ে, ভূত একটা উপলক্ষ মাত্র।

মিলন : আপনার লাইব্রেরি ভর্তি বিজ্ঞানের বই। বিজ্ঞান বিষয়ে কিছু বলুন।

হুমায়ূন আহমেদ : বিজ্ঞান আমাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করত। মনের ভেতর সবসময় অতৃপ্তির হাহাকার, কবে মানুষ সব জানতে পারবে?

মিলন : ধর্ম নিয়ে আপনার ব্যাপক পড়াশোনা। নানা রকমের ধর্মীয় বই আপনি পড়ছেন। আপনার ধর্মভাবনা কী রকম?

হুমায়ূন আহমেদ : আমি অত্যন্ত গোড়া মুসলিম পরিবার থেকে এসেছি। উৎসাহের শুরুটা সেখানে। আমি প্ৰচণ্ড আস্তিক, তবে… পরের উত্তর দেব না।

মিলন : আপনি একজন বৃক্ষপ্রেমী মানুষ। বৃক্ষের প্রতি আপনার আকর্ষণ এবং মমত্ববোধের কথা আমরা জানি। থা নামে আপনি একটি বইও লিখেছেন। বৃক্ষের প্রতি আপনার এই আকর্ষণ কীভাবে জাগল?

হুমায়ূন আহমেদ : লোকমান হেকিম গাছের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। আমি কথা বলতে পারি না, তবে গাছের অনুভূতি সামান্য হলেও ধরতে পারি। হয়তোবা এ কারণেই।

মিলন : আপনি খান খুব কম। কিন্তু আপনি একজন রসনাবিলাসী মানুষ। আপনার বইয়ের কোনো কোনো তাকভর্তি শুধুই রান্নার বই। রান্না বিষয়ে আপনার এত আগ্ৰহ কেন?

হুমায়ূন আহমেদ : কম খেলেও ভালো খেতে পছন্দ করি। রান্না যে-কোনো জাতির সংস্কৃতির একটা বড় অংশ। বিভিন্ন দেশের রান্নার বই পড়ি ওই দেশ সম্পর্কে ভালোমতো জানার জন্য।

মিলন : আপনি একসময় বন্ধুবান্ধব নিয়ে বাংলাদেশ প্রায় চষে বেড়িয়েছেন। বেড়াবার নেশাই ছিল আপনার। বিদেশেও অনেক বেড়িয়েছেন। এখনো কি সেভাবে বেড়ান?

হুমায়ূন আহমেদ : গর্তজীবী হয়ে গেছি। নিজেকে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করার মধ্যেও কিন্তু আনন্দ আছে। জনতার মধ্যে যেমন আছে নির্জনতা, আবার নির্জনতার মধ্যেও আছে জনতা।

মিলন : লেখকরা সাধারণত একা থাকতে পছন্দ করেন। একাকী ঘুরে বেড়ানো বা নিজের জন্য ভাবনার সময় বের করা। কিন্তু আপনি সেভাবে একা কখনো থাকেন না। চারপাশে আড্ডা, বন্ধুবান্ধব, হইচই পছন্দ করেন। তাহলে আপনার ভাবনার সময়টা কখন?

হুমায়ূন আহমেদ : যে-কোনো মানুষ একগাদা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গল্প করতে করতেও নিজের একান্ত ভাবনা ভাবতে পারে। আমি তা-ই করি।

মিলন : একজন মানুষ এত কাজ একা কী করে করে?

হুমায়ূন আহমেদ : আমি অনেক দিন থেকেই বেকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি। বেকারের হাতে থাকে অফুরন্ত সময়।

মিলন : আগামী দিনের জন্য আপনার কাজের পরিকল্পনা কী?

হুমায়ূন আহমেদ : আমি বাস করি বর্তমানে। ভবিষ্যতে না। কাজেই কোনো পরিকল্পনা নেই।

মিলন : আনন্দ-এ ব্যাপারটিকে আপনি কীভাবে দেখোন?

হুমায়ূন আহমেদ : ১৯৭১ সালে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে আসার পর বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহূর্তই আমার জন্য আনন্দের। শাওনের সঙ্গে যখন ঝগড়া করি তখনো আনন্দ পাই। মনে হয় বেঁচে আছি বলেই তো ঝগড়া করতে পারছি। আমি যে আপনি কেমন আছেন প্রশ্নের উত্তরে বেঁচে আছি বলি, এটাও একটা কারণ। জীবন পরম করুণাময়ের অতি পবিত্র এক উপহার। এই উপহার নিয়ে নিরানন্দে থাকার কোনো উপায় নেই।

১৫. প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ

বাবার মৃত্যুর পর আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।

চার দিন কথা বলতে পারি নি। নিঃশব্দে চোখের জলে ভেসেছি। ১৯৭১ সালের কথা। সেই ঘটনার ৪১ বছর পর গতরাত (বৃহস্পতিবার, ১৯ জুলাই) থেকে আমি বলতে গেলে বাকরুদ্ধই হয়ে আছি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর টিভি চ্যানেলগুলো থেকে অবিরাম ফোন এসেছে, কত বন্ধুবান্ধব, প্রিয়জন ফোন করেছেন, ফোন ধরার পরই গলা বন্ধ হয়ে এসেছে। চোখের জলে গাল ভাসতে শুরু করেছে।

হুমায়ূন ভাই নেই, এই বেদনা আমি নিতে পারছি না। গত কয়েক দিন নানা রকমের খবর রটছিল। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, টিভি চ্যানেল প্রচার করছিল তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন। কালের কণ্ঠে সংকটাপন্ন শব্দটা লিখতে আমি মানা করলাম। এই শব্দ আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। বুধবার সন্ধ্যায় আমেরিকায় ফোন করে মাজহারের কাছে খবর নিয়েছি। তিনি বলেছেন, অবস্থার সামান্য উন্নতি দেখা যাচ্ছে। শুনে চাপ ধরা বুক খানিকটা হালকা হলো। বৃহস্পতিবার বাসায় ফিরছি, রাত ৯টার দিকে নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ ফোন করলেন। কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা। হুমায়ুনের খবর কী, বলো তো? মন খারাপ করা সব কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছি।

রাত ১১টার দিকে ফরিদুর রেজা সাগর ফোন করে বললেন, যখন তখন অশুভ সংবাদটা আসবে। মন শক্ত করো।

ঘণ্টাখানেক পর সেই সংবাদ এলো। টেলিভিশন স্ক্রলে উঠতে লাগল, নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ…

এর পর থেকে আমার চারপাশে শুধুই হুমায়ূন আহমেদ। মাথা শূন্য হয়ে গেল, বুক ফাঁকা হয়ে গেল। চোখজুড়ে শুধুই হুমায়ূন আহমেদের প্রিয়মুখ। কত দিনের কত ঘটনা মনে এলো, আমাদের কত স্মৃতি, কত আনন্দ-বেদনার দিন। যে বেলভ্যু হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ফেললেন, ১০-১২ বছর আগে আমরা কয়েকজন তাকে সেই হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। তার হার্টের সমস্যা। এনজিওগ্রাম করাবেন। আর্কিটেক্ট করিম ভাই, অন্যপ্রকাশের মাজহার, কমল আর আমিম, গেলাম তার সঙ্গে।

যাওয়ার দিন সন্ধ্যাবেলাটার কথা আমার মনে আছে। আমরা সবাই ব্যাগ সুটকেস নিয়ে তাঁর দখিন হাওয়ার ফ্ল্যাটে। হুমায়ূন ভাই দলামোচড়া করে দু-তিনটা শার্ট-প্যান্ট ভরলেন একটা ব্যাগে, পাসপোর্ট-টিকিট হাতে নিলেন, ব্যাগ কাঁধে বুলিয়ে বললেন, চলো।

আমি অবাক। আপনি আমেরিকায় যাচ্ছেন, না কুতুবপুর?

নিউইয়র্কে তখন একটা বইমেলারও আয়োজন করেছিল মুক্তধারার বিশ্বজিৎসাহা। কলকাতা থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর সমরেশ মজুমদার গেছেন। হুমায়ূন ভাই আর আমিও অতিথি। একই হোটেলে উঠেছি সবাই। কী যে আনন্দে কাটল কয়েকটা দিন! এনজিওগ্রাম করানো হলো হুমায়ূন ভাইয়ের। এক রাত হাসপাতালে থাকতে হবে। কিন্তু ওই একটা রাত একা হাসপাতালে থাকবেন তিনি, এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। শিশুর মতো ছটফট করতে লাগলেন, চঞ্চল হয়ে গেলেন। আমরা নানা রকমভাবে প্ৰবোধ দিয়ে তাঁকে একটা রাত বেলভ্যুতে রাখতে পেরেছিলাম।

চারপাশে বন্ধুবান্ধব ছাড়া তিনি থাকতেই পারতেন না। একা চলাফেরা করতে পারতেন না। তিনি চলতেন সমাটের মতো। চারপাশে আমরা কয়েকজন তার পারিষদ।

হুমায়ূন ভাই, যে জগতে আপনি চলে গেলেন, সেখানে একা একা। আপনি কেমন করে থাকবেন? সেখানে তো আপনার পাশে আপনার মা নেই, শাওন নেই, নিষাদনিনিত নেই, মাজহার নেই, আমরা কেউ নেই।

আমার ৫০তম জন্মদিনে আমাকে নিয়ে প্ৰথম আলো-তে একটা লেখা লিখলেন হুমায়ূন ভাই, কী কথা তাহার সাথে। (এই নামে এনটিভিতে আমি তখন একটা প্রোগ্রাম করতাম। হুমায়ূন ভাইকে নিতে চেয়েছি, তিনি যান নি। শাওনকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।) তাঁর স্বভাব ছিল যে-কোনো লেখা লিখলেই সন্ধ্যার পর বন্ধুবান্ধব নিয়ে বসে সেই লেখা পড়ে শোনাতেন। ওই লেখাটাও পড়তে লাগলেন। আমি বসে আছি তাঁর পাশে। আলমগীর রহমান, মাজহার, আর্কিটেক্ট করিম-আমরা মুগ্ধ হচ্ছি। তাঁর লেখায়। আমার মুখে শোনা আমার কিশোর বয়সের এক দুর্দিনের বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি। সেই অংশটুকু পড়তে পড়তে আমাকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো কাঁদতে লাগলেন।

কী গভীর ভালো তিনি আমাকে বেসেছেন, আমি ছাড়া কেউ তা জানে না।

কালের কণ্ঠে তিনি বহু লেখা লিখেছেন। শুরু থেকেই। আমি গিয়ে জোর করে তাঁর লেখা নিয়ে আসতাম। একদিন বললেন, দেড়-দুই বছরে কালের কণ্ঠে যত লেখা লিখলাম, জীবনে কোনো পত্রিকায় এত অল্প সময়ে এত লেখা আমি লিখি নি। কেন লিখেছি জানো? তোমার জন্য।

আগরতলায় বেড়াতে গিয়ে পুরনো একটা মন্দির দেখতে গিয়েছি আমরা। পুরোদল। জনা ১০-১২ লোক। সেই মন্দিরের সামনে আদূরে ছেলে যেমন করে অনেক সময় পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বাবাকে, ঠিক সেভাবে দুই হাতে আমি তাঁকে জড়িয়ে ধরলাম। দুজনেরই গভীর আনন্দিত হাসিমুখ। মাজহার ছবি তুললেন। হুমায়ূন ভাই হাসতে হাসতে বললেন, মনে হলো আমার একটা পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের ছেলে আছে।

আমার বয়স তখন পঁয়তাল্লিশ।

ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য তিনি নিউইয়র্কে চলে যাওয়ার পর কালের কণ্ঠের সাহিত্য ম্যাগাজিন শিলালিপিতে তাকে নিয়ে আমি একটা ধারাবাহিক লেখা শুরু করলাম। হুমায়ূন আহমেদ এবং হুমায়ূন আহমেদ। একটু নতুন আঙ্গিকে লেখা। আমার স্মৃতিচারণা আর তাঁর ইন্টারভিউ। এই ইন্টারভিউটা অন্যদিন পত্রিকায় একসময় ছাপা হয়েছিল। সেটাকেই নতুন আঙ্গিকে পরিবেশন করা। ১৩ পর্বে লেখাটা শেষ হলো।

নিউইয়র্কে বসে হুমায়ূন ভাই একটু রাগলেন। আমাকে নিয়ে একটা লেখা লিখলেন, মিলন কেন দুষ্ট। সেই লেখায় আমাকে মৃদু বকাঝকাও করলেন। তাঁর সম্মানে কালের কণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠায় লেখাটা আমি ছেপে দিলাম।

কিছুদিন আগে দুই সপ্তাহের জন্য তিনি দেশে এসেছিলেন। উঠেছিলেন তাঁর প্রিয় নুহাশপল্লীতে। সেখান থেকে এলেন ধানমণ্ডির দখিন হাওয়ায়। এক রাতে দেখা করতে গেছি। তিনি তাঁর অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমটায় চেয়ারে বসে আছেন। শাওন আছে পাশে, মাজহার আছে। একপাশে বসে আছেন স্থপতি ও লেখক শাকুর মজিদ। আলমগীর রহমান এলেন, মাজহারের স্ত্রী স্বর্ণা এলো। আমি বসে আছি হুমায়ূন ভাইয়ের পায়ের কাছে। তাঁর মুখটা আর আগের মতো নেই। কালো হয়ে গেছে। মাথার চুল গেছে অনেকটা পাতলা হয়ে। আর শরীরও কেমন যেন ভারী মনে হলো আমার।

ওজন কি একটু বেড়েছে?

দু-চার কথার পর হঠাৎ তিনি আমার মাথায় হাত রাখলেন, গভীর মায়াবী গলায় বললেন, ওই লেখাটার জন্য মন খারাপ করেছিলে? বললেন এমন করে, আমি তাঁর হাত ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম।

হুমায়ূন ভাই, বৃহস্পতিবার রাত থেকে আপনার জন্য শুধু আমি নই, পুরো বাংলাদেশ কাঁদছে। অমিত হাবিবের কথা আপনার মনে আছে। সংবাদপত্ৰজগতের অত্যন্ত মেধাবী যুবক। মাত্ৰ এক রাতে কয়েক ঘণ্টা আপনার সঙ্গে আড্ডা দিয়েছিল অমিত। আমিই তাকে আপনার কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। রাত ১টার দিকে ফোন করে অমিত কাঁদতে লাগল। ফোনের একদিকে আমি কাঁদি, আরেক দিকে অমিত। বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ আপনাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছে। যে আপনার কাছে গেছে, সে তো বটেই, দূর থেকে যারা আপনাকে দেখেছে, আপনার লেখা পড়েছে, নাটক-সিনেমা দেখেছে, আপনার লেখা গানগুলো শুনেছে, তারা যেমন ভালো আপনাকে বেসেছে, পৃথিবীর খুব কম মানুষের ভাগ্যেই এ রকম ভালোবাসা জোটে। আপনি চলে গেছেন, বাংলাদেশ আজ চোখের জলে ভাসছে। আমাদের চারদিক অনেকটাই অন্ধকার। শ্রাবণ দিনে আপনি চলে গেলেন। আর আমাদের আকাশ ছেয়ে গেল শ্রাবণ মেঘে। এই মেঘ চোখের জলের বৃষ্টি হয়ে ঝরছে।

হুমায়ূন ভাই, আপনার মনে আছে, একদিন নুহাশপল্লীতে ঢোকার মুখে, গেটের বাইরের দিকটায় দুপুরের নির্জনতায় আপনি ও আমি হাঁটছিলাম। আমাদের পায়ের কাছে ফুটে আছে কিছু সাদা রঙের ছোট ছোট বুনোফুল। তেমন গন্ধ নেই। আপনি হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলেন, এগুলো কী ফুল, বলো তো?

প্রথমে আমি চিনতে পারলাম না। আপনি বললেন, বিভূতিভূষণ এই ফুলের কথা অনেকবার লিখেছেন।

বুঝে গেলাম। ভাঁটফুল।

আপনার নুহাশপল্লী গেটের কাছে বছর বছর ফুটতে থাকবে ভাঁটফুল, নুহাশপল্লীর সবুজ মাঠ আরও সবুজ হবে বর্ষার বৃষ্টিতে, আপনার ওষুধি বাগান হয়ে উঠবে বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ। নুহাশপল্লীর ফুলের ঝোপ রঙিন হবে বসন্তকালে, গাছপালায় বইবে চৈতালী হাওয়া, আপনার পুকুরের জলে শ্বাস ফেলতে উঠবে। মাছেরা, পাখিরা মুখর হবে সকাল-দুপুর-সন্ধ্যায়। গভীর রাতে দূরে ডাকতে থাকবে দুরন্ত কোকিলেরা। শিউলি ফুলের মতো জ্যোৎস্নায় ফুটফুট করবে আপনার তৈরি করা এক টুকরো পৃথিবী। শ্রাবণ দিনের বৃষ্টি আপনার শোকে কাতর হবে, নুহাশ পল্লীর মাঠ ভাসবে চোখের জলে, ফুলেরা ভুলে যাবে গন্ধ ছড়াতে, মুখর পাখিরা স্তব্ধ হবে, জ্যোৎস্না রাত স্নান হবে। দুরন্ত কোকিল আর ডাকতে চাইবে না। আমাদের বইমেলাগুলো মিীয়মাণ হয়ে যাবে, প্রকাশকরা হারাবেন উদ্দীপনা। ঈদসংখ্যাগুলো হারাবে জৌলুস। টেলিভিশন পর্দা আলোকিত হবে না। আপনার নতুন নাটকে। মাইক্রোবাস ভরে আমরা আর আড্ডা দিতে যাব না। নুহাশ পল্লীতে, দখিন হাওয়া মুখর হবে না হাসি-আনন্দে। আমরা নিঃস্ব হয়ে গেলাম।

আপনার সর্বশেষ উপন্যাস দেয়াল ১৬০ পৃষ্ঠার মতো লিখে ড. আনিসুজ্জামান, ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও আমাকে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। আমাদের মতামত জেনে লেখা শেষ করবেন। আপনার লেখা দেয়াল উপন্যাসের ওই ১৬০ পৃষ্ঠার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হচ্ছে লিখতেই লিখতেই যেন উঠে চলে গেলেন। আপনি। টেবিলে অসহায় ভঙ্গিতে পড়ে আছে আপনার কলম আর সাদা কাগজ।

সাদা কাগজ, তোমাকে কে বোঝাবে হুমায়ূন আহমেদ চলে যান নি। এই তো বাঙালি পাঠকের বুকসেলফগুলোতে রয়ে গেছেন তিনি, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে রয়ে গেছেন, বাংলাদেশের সিনেমায় রয়ে গেছেন। তাঁর গান রয়ে গেছে সুবীর নন্দী, শাওন আর অন্যান্য শিল্পীর কণ্ঠে। আর তিনি রয়ে গেছেন বাঙালি জাতির অন্তরে।

যে অপার্থিব জগতে আপনি আছেন, সেখানে ভালো থাকুন, আনন্দে থাকুন হুমায়ূন ভাই। পরম করুণাময় আপনাকে গভীর শান্তিতে রাখুক।

Exit mobile version