Site icon BnBoi.Com

আওরঙ্গজেব : ব্যক্তি ও কল্পকথা – অড্রি ট্রুসকে

আওরঙ্গজেব : ব্যক্তি ও কল্পকথা

আওরঙ্গজেব : ব্যক্তি ও কল্পকথা – অড্রি ট্রুসকে
অনুবাদ – মোহাম্মদ হাসান শরীফ

প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০২০

বাংলা সংস্করণ উৎসর্গ
আব্বাকে, তিনিই আমাকে প্রথম বাদশাহ আওরঙ্গজেব সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন ।

অনুবাদকের কথা

এ বইটি পড়ার সময় শৈশবে শোনা একটি গল্প (‘কিস্সা’) মনে পড়েছিল। গল্পকার প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসে বলেছিলেন, “বাদশাহ আওরঙ্গজেব ছিলেন ‘জিন্দা পীর।’ ভণ্ড পীরদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। বাদশাহি পেয়েই তিনি বাহিনী নিয়ে ছুটে গেলেন কে আসল আর কে নকল পীর তা নির্ধারণ করতে। প্রতিটি মাজারের ফটকে গিয়ে তিনবার সালাম দিলেন। মাজারের প্রধান পীরের সমাধি থেকে সালামের জবাব না এলেই তিনি শ্রমিকদের হুকুম দিতেন সেটি ভেঙ্গে ফেলতে। এভাবে মাজার ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে তিনি এগিয়ে চললেন। সামনে পড়ল খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির (র.) মাজার। তিনি সেখানে গিয়েও সালাম দিলেন। প্রথমবার সালামের জবাব না পেয়ে দ্বিতীয়বার দিলেন। জবাব পেলেন না। এরপর তৃতীয়বার দিলেন। তখনো জবাব পেলেন না। তখন শ্রমিকদের বললেন, ভাঙ্গো ।

শ্রমিকরা শাবল হাতে যেই মাজারের প্রাচীরে আঘাত দিতে গেছে, সাথে সাথে সমাধি থেকে প্রচণ্ড শব্দ বের হলো : ‘থামো।’

সবাই চমকে গেল ।

বাদশাহ তখন বললেন, ‘আমি তো আপনাকে সালাম দিয়েছিলাম । আপনি জবাব দেননি।’

কবরের ভেতর থেকে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (র.) বললেন, ‘প্রথমবার তুমি যখন সালাম দিয়েছিলে, তখন আমি ওজু করছিলাম। দ্বিতীয়বার যখন সালাম দিয়েছ, তখন নামাজে দাঁড়িয়েছিলাম। আর তৃতীয়বার সালামের সময় আমি মুনাজাত করছিলাম । এজন্যই তোমার সালামের জবাব দিতে পারিনি ।’

বাদশাহ আওরঙ্গজেব অনুতপ্ত হলেন, ক্ষমা চাইলেন ।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতিও তাকে ক্ষমা করলেন। তবে বললেন, তুমি মাজারগুলো ভেঙ্গে ঠিক করোনি। যাদের মাজার ভেঙ্গেছ, তারা আমার কাছে নালিশ নিয়ে এসেছিল । তুমি সব মাজার আবার মেরামত করে দেবে।

বাদশাহ সাথে সাথে রাজি হলেন। এ জন্যই ভারতের সব মাজারে দুটি তারিখ খোদাই করা আছে। একটিতে নির্মাণের সময়, আরেকটি বাদশাহ আওরঙ্গজেবের সংস্কারের তারিখ।”

কাহিনীটি আমার মনে গেঁথে ছিল । এ ধরনের লোক সম্পর্কে আগ্রহ থাকাই স্বাভাবিক। ফলে বইটি যখন অনুবাদ করার প্রস্তাব এলো, সাথে সাথে গ্রহণ করেছি। পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। ফলে অনুবাদটি পরিশ্রমের কাজ মনে হয়নি, শেখার একটি পর্ব বিবেচনা করেছি।

আওরঙ্গজেব প্রবল বৈপরীত্যপূর্ণ ও ধাঁধাময় এক ব্যক্তিত্ব। অনেকে তাকেই মোগল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য দায়ী করেন। অথচ তিনিই মোগল সাম্রাজ্যকে সর্বোচ্চ মাত্রায় সম্প্রসারিত করেছিলেন। আওঙ্গজেবকে হিন্দুবিদ্বেষী মনে করা হয়। অথচ তার আমলেই হিন্দুরা মোগল মসনবে সর্বোচ্চ সংখ্যায় নিয়োগ পেয়েছিল। তাকে খাঁটি মুসলিম মনে করা হয়। অথচ তার আমলেই ইসলামি অনেক অনুষ্ঠানের ওপরও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। তিনি বিশ্বের বৃহত্তম মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন, অথচ নিজের কবরের জন্য অচিহ্নিত একটি স্থান বেছে নিয়েছিলেন ।

লেখক জানিয়েছেন, এই জীবনী রচনা করা হয়েছে ঐতিহাসিক ব্যক্তি ও সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগির সম্পর্কে আমাদের মধ্যে বিরাজমান খুবই হালকা জ্ঞানের গভীরতা বাড়ানোর জন্য। বইটি পড়লে সত্যিই আমাদের জ্ঞান বাড়বে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আওরঙ্গজেব সম্পর্কে জানার আগ্রহ নতুন করে বাড়বে।

এ গ্রন্থটি একটি রাজনৈতিক প্রপাগান্ডাকে গুঁড়িয়ে দেওয়া পরিমিত, অতিরঞ্জনহীন ভাষ্য। এ বই প্রমাণ করে যে আওরঙ্গজেব এমন মানুষ ছিলেন যিনি অবশ্যই অনেক ভুল করেছেন, তবে এমন কেউ তিনি নন যার নিন্দা করতে হবে অন্ধভাবে।

উপমহাদেশের ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি নিয়ে যারা ভাবেন, তাদের জন্য এটি একটি অমূল্য গ্রন্থ। বিশেষ করে বর্তমান ভারতে আওরঙ্গজেবকে নিয়ে তীব্র সমালোচনা চলতে থাকায় তাকে জানার গুরুত্ব বেড়ে গেছে। বইটি বড় নয়। ছোট্ট পরিসরের মধ্যেই কেবল আওরঙ্গজেববেই নয়, মোগল ইতিহাসকেই তুলে আনা হয়েছে। আওরঙ্গজেব হয়ে ওঠেছেন মোগল ইতিহাসের মধ্যমণি

মুখবন্ধ

এ বইটির লেখা সূচনা হয়েছিল একটি টুইটার বার্তার মাধ্যমে। আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল যে মোগল সম্রাটদের কোনো একজনের ওপর একটি সহজবোধ্য গ্রন্থ লিখব কিনা। আলোচনা শিগগিরই ইমেইলে স্থানান্তরিত হলো, আমি বিষয় হিসেবে বেছে নিলাম আওরঙ্গজেব আলমগিরকে। এই বই সামাজিক মাধ্যমের মাধ্যমে প্রথম সূত্রবদ্ধ হওয়াই ছিল যথার্থ। কারণ আধুনিক ভারতকে ছেয়ে ফেলা আওরঙ্গজেব জ্বর প্রায়ই টুইটার ও ফেসবুকের মতো ফ্লাটফর্মে সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করে। এই সংক্ষিপ্ত জীবনীতে আমি লোকরঞ্জক সংস্কৃতিতে আওরঙ্গজেব নিয়ে প্রকম্পমান ও অব্যাহত উপস্থিতির জবাব দিয়েছি। অবশ্য একজন ইতিহাসবিদের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, আওরঙ্গজেব হলেন প্রথম ও প্রধানতম মোগল সম্রাট যার সম্পর্কে বেশির ভাগ লোক জানে দুঃখজনকভাবে কম। এই বই তার সব জটিলতা নিয়েই ঐতিহাসিক আওরঙ্গজেবকে পরিচিত করার চেষ্টা করা হয়েছে বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠীর কাছে

তথ্যপ্রবাহ ও সহজ পাঠের জন্য বইটি পাদটীকা ছাড়াই উপস্থাপন করা হয়েছে। আওরঙ্গজেবের জীবন ও শাসন কৌশল এমনিতেই জটিল বিষয়, এতে পাদটীকা যোগ করা হলে তা আরেকটি বাধা হিসেবে আবির্ভূত হবে। যেসব পাঠক আমার সূত্রগুলো জানতে আগ্রহী, তারা সেগুলো পাবেন জীবনমূলক প্রবন্ধ ও নোটের অংশে। পুনশ্চ তাদের কাছে ভালো লাগবে যারা ইতিহাসবিদেরা কিভাবে অতীত নিয়ে চিন্তা করেন এবং প্রাক-আধুনিক সূত্রগুলো বিশ্লেষণ করেন তা জানতে আগ্রহী ।

১. আওরঙ্গজেবের পরিচিতি

অবিস্মরণীয় আওরঙ্গজেব

আমি এসেছি অচেনা মানুষ হিসেবে, চলেও যাব অচেনা মানুষের মতো ।
–মৃত্যুর প্রাক্কালে আওরঙ্গজেবের লেখা চিঠি

মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৭০৭ সালে ৮৮ বছরের পরিণত বয়সে যখন জীবনের পেছন দিকে তাকিয়েছিলেন, তখন তিনি ব্যর্থতাই দেখতে পেয়েছিলেন।

মৃত্যুশয্যা থেকে আওরঙ্গজেব ছেলেদের কাছে বেশ কিছু মর্মভেদী চিঠি লিখেছিলেন। এসব লেখায় তার অধার্মিকতার জন্য আল্লাহ তাকে শাস্তি দিতে পারেন, এমনসহ নানা ভয়ানক শঙ্কা প্রতিফলিত হয়েছে। তবে সর্বোপরি, বাদশাহ হিসেবে তার ভুলগুলো নিয়ে আর্তনাদই করেছেন বেশি। সবচেয়ে ছোট ছেলে কাম বকশের কাছে লেখা চিঠিতে তার মৃত্যুর পর অফিসার ও সেনাবাহিনীর প্রতি খারাপ আচরণ করা হবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তৃতীয় ছেলে আযম শাহের কাছে অনেক গভীর সংশয়ের কথা স্বীকার করেছিলেন : ‘শাসন করা ও জনগণকে রক্ষার গুণ আমার মধ্যে একেবারেই ছিল না। আমার মূল্যবান জীবনটা বৃথাই গেল। খোদা এখানেই আছেন, কিন্তু আমার নিষ্প্রভ চোখ তার উজ্জ্বল দীপ্ত দেখতে পারছে না।’

আওরঙ্গজেব ১৫ কোটির বেশি লোকের ওপর ৪৯ বছর শাসনকাজ পরিচালনা করেছেন। তিনি মোগল সাম্রাজ্যকে সর্বোচ্চ সীমায় সম্প্রসারিত করেছিলেন, মানব ইতিহাসে তিনিই প্রথমবারের মতো ভারতীয় উপমহাদেশের বেশির ভাগ এলাকাকে একটি একক রাজকীয় শাসনের অধীনে এনেছিলেন। আইনগত বিধিবিধানের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগে তিনি স্থায়ী অবদান রেখে গেছেন, সব ধরনের লোক ও ধর্মীয় গ্রুপের সদস্য তার কাছে ন্যায়বিচার পেয়েছে বলে তার সুখ্যাতি রয়েছে। খুবই সম্ভব যে তিনি ছিলেন তার আমলের সবচেয়ে ধনী লোক, তার কোষাগার ছিল পরিপূর্ণ। তাতে ছিল উপচে পড়া হীরা, মানিক, মুক্তা, স্বর্ণ। এমনকি জৌলুষপূর্ণ কোহিনূর হীরাও ছিল তার কাছে। তবে এসব অর্জনও শেষ দিনগুলোতে নিজের রাজনৈতিক অসম্পূর্ণতা সম্পর্কে তার উৎকণ্ঠা প্রশমিত করতে পারেনি ।

আযম শাহ ও কাম বকশ- উভয়ের কাছে আওরঙ্গজেব তার ধর্মীয় ত্রুটিগুলোর কথাও স্বীকার করে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে তাকে শিগগিরই কঠিন ঐশী বিচারের মুখে পড়তে হতে পারে। নিবেদিতপ্রাণ মুসলিম হিসেবে চিন্তা করেছেন যে এই জীবন ও পরকালে তিনি ‘আল্লাহর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথই বেছে নিয়েছিলেন।’ তিনি বোঝাহীনভাবে এই দুনিয়ায় এলেও পাপের বোঝা নিয়ে পরকালে যাচ্ছেন বলে ধারণা তার মধ্যে প্রবেশ করেছিল । আযমকে তিনি শেষ যে চিঠিটি লিখেছিলেন তাতে স্মৃতিকাতরতা, দীর্ঘ অলঙ্কৃত বাক্যে তিনবার বিদায়সম্ভাষণ করেছিলেন : ‘বিদায়, বিদায়, বিদায় ।

আওরঙ্গজেব তিন শতাধিক বছর আগে, ১৭০৭ সালের শীতকালে, এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তাকে সমাহিত করা হয় মহারাষ্ট্রের খুলদাবাদের সাধারণ, ছাদ ও প্রাচীরহীন একটি খোলা কবরে। দিল্লিতে হুমায়ূনের লাল বেলেপাথরের বিশাল সমাধিসৌধ বা আগ্রায় শাহ জাহানের জাঁকজমকপূর্ণ তাজ মহলে অপরিমিত ব্যয়ে নির্মিত বিশ্রামাগারের বিপরীতে আওরঙ্গজেবের কবরটি তাকে স্মরণ করার মতো কোনো তাগিদ সৃষ্টি করেনি। আওরঙ্গজেবের ইচ্ছানুযায়ী একটি সুফি দরগার মধ্যে সমতল ও চিহ্নহীন স্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। কয়েক শ’ বছরের ব্যাপ্তিতে এতে মার্বেলের মেঝ হয়েছে, মার্বেলের রেলিং লাগানো হয়েছে, শনাক্তকারী ফলকও সংযোজন করা হয়েছে। অবশ্য, এসব অলঙ্করণ সত্ত্বেও আওরঙ্গজেবের সমাধির সাদামাটা অবস্থা তার পূর্বসূরীদের সমাধিস্থল ও জাগতিক কীর্তিগাঁথা জোরালোভাবে প্রকাশকারী পাথরের ব্লকগুলোর প্রবল বিপরীত কথাই জানায় ।

আওরঙ্গজেব হয়তো বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দুনিয়া তাকে ছেড়ে দিতে রাজি নয়। একুশ শতকের ভারত ও পাকিস্তানের জনসাধারণের স্মৃতিতে তিনি স্পন্দমান একটি চরিত্র। ভারতে লোকজন তার আমল নিয়ে উত্তপ্তভাবে বিতর্কে নিয়োজিত হয়, প্রায়ই হিন্দুদের প্রতি জঘন্য নির্যাতন করার জন্য তার নিন্দা করে। আওরঙ্গজেব নিজের কৃতকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুললেও বর্তমান ভারতের অনেকেই সংশয়হীনভাবে মনে করে যে তিনি ছিলেন উগ্র গোঁড়া, তরবারির জোরে শাসন করতেন, পেছনে রেখে গেছেন হিন্দু অশ্রুধারা। আধুনিক ভারতের অবয়ব থেকে আওরঙ্গজেবকে মুছে ফেলার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রয়াসগুলো (দিল্লিতে আওরঙ্গজেব সড়কের নাম পরিবর্তন করা এমনই একটি কাজ) এই সম্রাট ও ভারতের ইসলামি অতীতবিষয়ক বিতর্কে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছে। কাছের পাকিস্তানে আওরঙ্গজেব স্রেফ কিছুটা ভালো অবস্থায় আছেন। সেখানে অনেকে ভারতীয় ধারার আলোকে মনে করে যে আওরঙ্গজেব সুস্পষ্টভাবে গোঁড়া ছিলেন। তবে অন্যরা তাকে অতীত কালের মুসলিম সত্যনিষ্ঠ শাসকদের একজন মনে করে। এসব আধুনিক ধারণায় ইতিহাসের বক্তব্য থাকে খুবই সামান্য ।

আরো ভালোভাবে বলা যায়, আওরঙ্গজেব-সম্পর্কিত মিথ্যা তথ্য ও নিন্দাবাদ একুশ শতকের দক্ষিণ এশিয়াকে ছেয়ে ফেলায় লোকটি নিজে একটি হেঁয়ালি হিসেবেই রয়ে গেছেন।

আওরঙ্গজেব ছিলেন বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত মোগল সাম্রাজ্যের ষষ্ট শাসক । উপমহাদেশের বাইরের দুনিয়ায় বর্তমানে খুব কমই মোগলদের কথা স্মরণ করা হয়, কিন্তু তাদের আমলে তারা ছিলেন তীব্র মোহিনী শক্তিসম্পন্ন, সম্ভ্রম জাগানিয়া। ১৬০০ সাল নাগাদ মোগল সাম্রাজ্যের জনসংখ্যা ছিল পুরো ইউরোপের চেয়ে বেশি, সারা পৃথিবীতে মোগলদের সম্পদের কোনো তুলনা ছিল না। এক রক্তাক্ত উত্তরাধিকারের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে আওরঙ্গজেব ক্ষমতায় আসেন ১৬৫৮ সালে ৷ এই লড়াইয়ে তার দুই ভাই মারা যান, একজন বার্মায় পালিয়ে যান এবং তার পিতা কারারুদ্ধ হন। আওরঙ্গজেব নিজের নাম রাখেন ‘বিশ্বজয়ী’ (আলমগীর), তার ৪৯ বছরের রাজত্বকালে একটার পর একটা রাজ্য দখল করে নামকরণকে যথার্থ প্রতিপন্ন করেছেন ।

জীবদ্দশাতেও আওরঙ্গজেব জগতব্যাপী কল্পনামানসে ধরা পড়ে ছিলেন। ১৬৭৫ সালে ওই সময়ের ইংল্যান্ডের রাজকবি জন ড্রাইডেন বিদ্যমান মোগল সার্বভৌমত্ব নিয়ে বীরোচিত ট্রাজেডি আওরেঙ্গ-জেব লিখেছিলেন । আর ইউরোপিয়ান পর্যটকেরা ভারত সফর করেছেন ক্রমবর্ধমান হারে, তাদের অনেকেই খ্যাতিমান আওরঙ্গজেব আলমগীরের সাথে সাক্ষাত প্রার্থনা করেছেন। ব্রিটিশ, ডাচ, পর্তুগিজ ও ফরাসি বণিকেরা উপমহাদেশের পকেটগুলোতে কার্যক্রম পরিচালনা করত, মোগলদের সাথে বাণিজ্য চুক্তি করার প্রয়াস চালাত । অবশ্য মোগলদের দৃষ্টিতে ইউরোপিয়ানরা ছিল চুনো পুঁটি। পূর্বসূরিদের মতো আওরঙ্গজেবের মনেও দৃঢ় বিশ্বাস গেঁথে ছিল যে তিনি বিশ্ব ইতিহাসের বৃহত্তম সাম্রাজ্যগুলোর একটি পরিচালনা করছেন। এই সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল ৩.২ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার (আধুনিক ভারতের প্রায় সমান) এবং এর সম্পদ, সমৃদ্ধি ও ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য ছিল সম্মানের পাত্র।

গত কয়েক দশক ধরে অন্যান্য মোগল শাসক ইতিহাসবিদদের ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করলেও আওরঙ্গজেব শিকার হয়েছেন অবহেলার। এ সম্রাটের জীবনকে তুলে ধরার কাজটি, তার সম্পর্কে আমরা বিস্ময়করভাবেই কম জানি, কোনোভাবেই সহজ নয়। আওরঙ্গজেব ছিলেন জটিল শাসক। ক্ষমতা, ন্যায়বিচার, ধর্মপ্রীতি ও মোগল সাম্রাজ্যের দায়ভারসহ নানা সাঙ্ঘর্ষিক আকাঙ্ক্ষা ও উদ্দীপনার সমাবেশে গড়ে ওঠেছিল তার জীবন। যেকোনো পরিস্থিতিতেই এ ধরনের লোক হবেন দুরূহ ঐতিহাসিক বিষয়। তার সময় ও আমাদের নিজেদের সময়ের মধ্যকার সাংস্কৃতিক জ্ঞানের বিপুল পার্থক্যের বিষয়টি বিবেচনা করা হলে তা যে কত কঠিন হতে পারে, তা বোঝাই যাচ্ছে ।

বর্তমান সময়ে স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করে এমন উত্তপ্ত ও ফুটন্ত ইতিহাসও আওরঙ্গজেব। অবশ্য, আওরঙ্গজেবকে নিয়ে প্রচলিত লোকরঞ্জক ভাষ্যগুলোতে বাস্তব অস্তিত্বের চেয়ে বানোয়াট কাহিনীই রয়েছে বেশি। আওরঙ্গজেবকে ঘিরে থাকা কল্পকথার ধূম্রজাল ভেদ করতে পারলে আমরা সম্ভবত সপ্তদশ শতকের ভারতের এককভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বটিকে আবিষ্কার করতে পারব। বর্তমান ছাড়া অতীতে যাওয়ার অন্য কোনো পথ না থাকায় আমি প্রথমে আমাদের সময়ে কল্পিত আওরঙ্গজেবের দিকেই নজর ফেরাব। আমি তারপর দুইভাবে তথা তার সময়ের ফসল হিসেবে এবং যে যুগে তিনি বাস করেছিলেন ওই কালকে অবয়ব দানকারী সম্রাট হিসেবে তাকে বিশ্লেষণ করব ।

খলনায়ক আওরঙ্গজেবের কল্পকথা

তথাকথিত ‘গ্র্যান্ড মোগলদের’ শেষ ব্যক্তি আওরঙ্গজেব চেষ্টা করেছিলেন ঘড়ির কাঁটা উল্টা দিকে ঘোরাতে। তা করতে গিয়ে তিনি ঘড়িটি বন্ধ করে ফেলেন, এটি ভেঙ্গে যায় ।
–জওহেরলাল নেহরু

আওরঙ্গজেবের জন্য ২০১৫ সালটি ছিল খারাপ। প্রায় পুরো বছর ধরেই এই মোগল সম্রাটের নামে থাকা দিল্লির একটি প্রধান রাস্তার নাম বদল করা নিয়ে বিতর্ক চলে । স্থানীয় একটি শিখ গ্রুপ প্রথম বিষয়টি উত্থাপন করে। নাম বদলের যুক্তি হিসেবে বলা হয় যে আওরঙ্গজেব ছিলেন ‘ভারতের অসহিষ্ণু অমানবিক নৃশংস অপরাধের অন্যতম স্বৈরাচারী উৎপীড়নকারী শাসক।’ হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সাথে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্য সাথে সাথে এই স্রোতে যোগ দিয়ে তাদের ভাষায় দিল্লির ইতিহাসের অন্যতম বেদনাদায়ক অধ্যায়টিকে নিশ্চিহ্ন করার কিংবা অন্তত নগরীর রাস্তা থেকে এই উৎপীড়ক শাসকের নাম মুছে ফেলার আহ্বান জানান। নয়া দিল্লির কর্মকর্তারা এই দাবির কাছে নতি স্বীকার করে ২০১৫ সালের আগস্টের শেষ দিকে ভারতের একাদশ রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম সড়ক নামে নতুন নামকরণ করেন। এক সপ্তাহ পর রাতের অন্ধকারে নগরকর্মীরা চুপি চুপি রাস্তার সাইনগুলো থেকে আওরঙ্গজেবের নাম মুছে ফেলে।

অবশ্য এ ধরনের প্রয়াসের ফলে আওরঙ্গজেব সম্পর্কে সমাজ-বিস্তৃত স্মৃতিবিলোপ না ঘটে বরং জনসাধারণের মনে আবার তাকে জাগিয়ে তোলে । এর মাত্র এক মাস পর ২০১৫ সালের অক্টোবরে শিব সেনার এক এমপির একটি টেপ প্রকাশিত হয়। এতে তাকে এক সরকারি কর্মকর্তার প্রতি আওরঙ্গজেব কি আওলাদ (আওরঙ্গজেবের বংশধর) এবং আরো কিছু গালিগালাজ প্রয়োগ করতে দেখা যায়। ভারতীয় মুসলিমদের লক্ষ্য করে প্রয়োগ করা এ ধরনের বাক্য বাবর কি আওলাদ (বাবরের বংশধর) পরিভাষার প্রতিফলন ঘটায়। বিশেষ করে ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে ও ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে হিন্দুত্ববাদী দাঙ্গাবাজদের অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার আগ দিয়ে এর ব্যবহার বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাবরের স্থানে আওরঙ্গজেব হলো কেন?

বিভেদকারী হিন্দু জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী অত্যাচারী মুসলিম বিজয়ী হিসেবে বাবর ও আওরঙ্গজেব অনেক দিক থেকে বিনিময়যোগ্য। এই দিক থেকে আওরঙ্গজেব ভারতের অতীতের ধিক্কারজনক ঘটনাবলীর সাথে জড়িত ‘গোঁড়া মুসলিমদের’ পুরো শ্রেণির প্রতিনিধি এবং এ কারণে ভারতের বর্তমান সময়ে অনাকাঙ্ক্ষিত। আওরঙ্গজেবকে সবচেয়ে ধার্মিক মোগল বাদশাহ হিসেবে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করাটাও কাকতালীয় বিষয় নয়। এ কারণে আওরঙ্গজেব অতীত ও বর্তমান উভয় সময়ের উদ্দীপ্ত মুসলিম সমগ্রের (যারা তাদের ধার্মিকতা দিয়ে ভারতীয় সমাজে হুমকি সৃষ্টি করেছিল) আদর্শ প্রতিনিধিত্বকারী। এই তত্ত্ব অনুযায়ী ভারতীয় ও হিন্দু সংস্কৃতি একটি একক, সমতল অবস্থানে মিশে যায়, যেখানে অন্য ধর্মীয় গ্রুপগুলোর জন্য শ্বাস ফেলার অবকাশ থাকে সামান্যই ।

ভারতের তীব্র সমালোচিত শাসকদের মধ্যেও আওরঙ্গজেবের বিশেষ, অনাকাঙ্ক্ষিত স্থান রয়েছে। এমনকি যারা বিজেপি ও সমমনা হিন্দু জাতীয়তাবাদী গ্রুপগুলোর ভাবাবেগের সাথে একমত নয়, এমন সাধারণ অভিমতেও নির্মম ইসলামি উৎপীড়ক (যাদের কাছে ভারতের সবকিছু, বিশেষ করে হিন্দু মাত্রই ঘৃণিত) হিসেবে আওরঙ্গজেবকে বিদ্রূপ করা হয়ে থাকে। সীমান্তের ওপাড়ে পাকিস্তানেও অনেকে বদ আওরঙ্গজেবের ভাষ্যটি অনুমোদন করে, এমনকি তাকে দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান দুর্দশার জন্য দায়ী মনে করা হয়। পাকিস্তানি নাট্যকার শহিদ নাদিমের বক্তব্য এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন : ‘আওরঙ্গজেব যখন [তার ভাই] দারাশিকোর ওপর বিজয়ী হলেন, তখনই [ভারতবর্ষ) বিভক্তির বীজ রোপিত হয়েছিল।’ অনেক লোক অনুমোদন না করলে এ ধরনের কষ্টকল্পিত অভিমত ফালতু হিসেবে পরিগণিত হতো।

এই পাকিস্তানি নাট্যকারের দৃষ্টিভঙ্গির নজির পাওয়া যায় আধুনিক ভারতের প্রতিষ্ঠাতা জওহের লাল নেহরুর রচনাবলীতে। জওহের লাল নেহরু কোনোভাবেই আওরঙ্গজেবের অনুরাগী ছিলেন না। ১৯৪৬ সালে প্রথম প্রকাশিত ডিসকোভারি অব ইন্ডিয়ায় নেহরু বিস্তারিতভাবে আওরঙ্গজেবের অন্তর্নিহিত খুঁতগুলো তুলে ধরেন, ‘গোঁড়া ও কঠোর বিশুদ্ধবাদী’ হিসেবে তার নিন্দা করেন । তিনি ঘড়ির কাঁটা উল্টা দিকে চালানো ও মোগল সাম্রাজ্যের ধ্বংসকারী বিপজ্জনক পূর্বানুবৃত্তিকারী হিসেবে ষষ্ট মোগল সম্রাটের সমালোচনা করেছেন । সম্ভবত নেহরুর সবচেয়ে কঠিন আঘাত ছিল আওরঙ্গজেবের মুসলিম পরিচিতির ওপর। তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন যে আওরঙ্গজেব বাড়াবাড়ি রকমের মুসলিম হওয়ায় সফল ভারতীয় রাজা হতে পারেননিঃ ‘আওরঙ্গজেব যখন [আগেকার মোগল শাসকদের সমন্বয়বাদের] বিরোধিতা ও একে দমন করা শুরু করেন এবং ভারতীয় শাসক হিসেবে নয়, বরং মুসলিম হিসেবেই কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকেন, তখন মোগল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে শুরু করে। নেহরুর মতে, ইসলামের প্রতি আওরঙ্গজেবের দৃঢ়ভাবে অনুরক্ত থাকাটাই তার ভারতবর্ষ শাসন করার সক্ষমতা নষ্ট করে দিয়েছিল।

আওরঙ্গজেব বিপজ্জনকভাবে ধার্মিক ছিলেন এবং এ কারণেই তিনি খারাপ সম্রাট ছিলেন- এমন ধারণা কেবল নেহরুই পোষণ করতেন, তা নয়। নেহরুর সমসাময়িক আরো অনেকেই এ ধরনের মতবাদ সমর্থন করেছেন। এদের অন্যতম ছিলেন বিশ শতকে আওরঙ্গজেবের ইতিহাস রচনাকারী যদুনাথ সরকার। ব্রিটিশ উপনিবেশিক চিন্তাবিদেরা আরো অনেক আগে থেকেই মোগলদেরকে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত করে আসছিলেন। তাদের অভিযোগের মধ্যে ছিল মোগলরা কামুক, উৎপীড়ক ও মুসলিম। আলেকজান্ডার ডো ১৭৭২ সালেই মোগল শাসন সম্পর্কে এক আলোচনায় মন্তব্য করেছিলেন যে ‘মোহাম্মদের ধর্ম অদ্ভূতভাবে স্বৈরতন্ত্রের সাথে খাপ খেয়ে যায়, এবং প্রাচ্যের এ ধরনের সরকারের টিকে থাকার কারণগুলোর সাথেই তা সম্পর্কিত।’ ভারতে ব্রিটিশ শাসনের জন্য ব্রিটিশদের কাছে সমস্যাটির এই সমাধান যে প্রয়োজনীয় ছিল, তা স্পষ্ট। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতারা উপনিবেশিক যুক্তির শেষ ধাপটি প্রত্যাখ্যান করলেও অনেকেই কোনো বাছবিচার না করেই প্রথম অংশটি গ্রহণ করে নেন। পাঠ্যবই ও গণমাধ্যমের মাধ্যমে এসব ধারণা সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, কয়েকটি প্রজন্ম ধরে আওরঙ্গজেব ধর্মীয় উগ্রবাদে তাড়িত উৎপীড়ক শাসক ছিলেন, এমন উপনিবেশিক ধারণা গলধঃকরণ করে তা বমনও করছে।

কয়েক শ’ বছর ধরে একেবারে হালকা প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে অনেক ভাষ্যকার দুষ্ট, গোঁড়া আওরঙ্গজেবের কল্পকথা প্রচার করেছেন। আওরঙ্গজেব সম্পর্কে অনেক ভ্রান্ত ধারণা এখনো লোকরঞ্জক স্মৃতিতে বিরাজ করছে। এসব ভ্রান্ত ধারণার মধ্যে রয়েছে তিনি লাখ লাখ হিন্দুকে হত্যা করেছেন, হাজার হাজার মন্দির ধ্বংস করেছেন। সাধারণভাবে বিশ্বাস করা এসব ‘তথ্য’ ঐতিহাসিক প্রমাণে না টিকলেও কোনো কোনো পণ্ডিত, সাধারণত খারাপ উদ্দেশ্যে, এ ধরনের আষাঢ়ে গল্পের একটি কথিত ভিত্তি প্রদান করার চেষ্টা করেছেন। অবশ্য, আরো বেশি দেখা যায় আওরঙ্গজেবকে নিয়ে আগে উল্লেখ করা সমালোচনাগুলো টিকিয়ে রাখার নির্লজ্জ লক্ষ্য হাসিলের জন্য সুবিধাজনক কিছু নির্বাচিত ঘটনার পক্ষপাতপূর্ণ ব্যবহার। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সমালোচকেরা সুর তোলেন যে আওরঙ্গজেব অমুক অমুক মন্দির ভেঙ্গেছেন। কিন্তু তারা এ কথা স্বীকার করেন না যে তিনি অনেক হিন্দু মন্দির রক্ষা করার জন্য অসংখ্য আদেশ জারি করেছেন, ব্রাহ্মণদের বৃত্তি ও ভূমি মঞ্জুর করেছেন। তারা হলি উদযাপনে তার কড়াকড়ি আরোপের নিন্দা করেন একথা উল্লেখ ছাড়াই যে তিনি মোহাররম ও ঈদের অনুষ্ঠানও কাট-ছাঁট করেছেন। তারা বেমালুম চেপে যান যে স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে তিনি হিন্দু সন্ন্যাসীদের সাথে পরামর্শ করতেন, আগের যেকোনো মোগল শাসকের চেয়ে তিনি অনেক বেশি সংখ্যক হিন্দুকে তার প্রশাসনে নিয়োগ করেছিলেন। আওরঙ্গজেবের শাসন-সংশ্লিষ্ট অনেক কম উল্লেখ করা তবে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর সাথে এই শাসককে নিয়ে ধর্মভিত্তিক ঘৃণায় চালিত কাল্পনিক চরিত্রকে সমন্বিত করার কাজটি আমরা করতে পারি না।

তবে কোনোভাবেই কেউ বলবে না যে আওরঙ্গজেব ত্রুটিহীন ছিলেন। আধুনিক গণতান্ত্রিক, সার্বজনীন মূল্যবোধ ও মানবাধিকার মানদণ্ড পূরণ করতে না-পারা আওরঙ্গজেবের অনেক পদক্ষেপ খুঁজে বের করা কঠিন নয়। রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যের প্রাক-আধুনিক বিশ্বে শাসনকাজ পরিচালনা করেছিলেন আওরঙ্গজেব। সহিংসতা, রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও অন্য সবকিছুই ওই সময় ও তিনি যে স্থানে বাস করেছিলেন তার সাথে শর্তসাপেক্ষ। আওরঙ্গজেবের সমসাময়িকদের মধ্যে ছিলেন ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় চার্লস, ফ্রান্সের চতুর্দশ লুই, উসমানিয়া সাম্রাজ্যের সুলতান দ্বিতীয় সোলায়মান। কেউ জোর দিয়ে বলতে পারবে না যে এসব ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব বর্তমান সময়ের রীতিনীতি অনুযায়ী ‘সুশাসক’ ছিলেন। কারণ অতীতকে বর্তমানের মানদণ্ডের সাথে তুলনা করার কোনো মানে হয় না । ঐতিহাসিক সমীক্ষার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু ।

ইতিহাসবিদেরা বিশেষ সময় ও স্থানের ফসল হিসেবে তাদের নিজস্ব অবস্থার আলোকে ওই ব্যক্তিদের উপলব্ধি করতে চান, তাদের কর্মপন্থা ও প্রভাবের ব্যাখ্যা করেন। যাদের নিয়ে আমরা সমীক্ষা চালাচ্ছি, তাদেরকে অপরাধ মুক্ত করার কোনো প্রয়োজন আমাদের নেই এবং তাদেরকে পছন্দ করার কোনো দরকারও নেই আমাদের। তবে আমরা অভিমত প্রকাশ করা থেকে যথেষ্ট সময় বিরত থাকার চেষ্টা করেছি এ কারণে যে যাতে আওরঙ্গজেবকে নিয়ে থাকা কল্পকথা আড়ালে ম্লান হয়ে যায় এবং আরো বোধগম্য ও বিশ্বাসযোগ্য কথা বলার অবকাশ সৃষ্টি হয় ।

মানুষ আওরঙ্গজেবকে ফিরে পাওয়া

সার্বভৌম ক্ষমতার ভিত্তির স্থিতিশীলতা নির্ভর করে ন্যায়বিচারের (আদালত) ওপর।
–শাসকদের সম্পর্কে প্রচলিত সাধারণ বাণী, আওরঙ্গজেবের সমর্থিত

হিন্দুস্তানের শাসক হিসেবে আওরঙ্গজেব তার জীবনকে বিন্যস্ত করেছিলেন কিছু প্রধান আদর্শ ও বদ্ধমূল ধারণার আলোকে। তিনি হতে চেয়েছিলেন ন্যায়পরায়ণ রাজা, ভালো মুসলিম, মোগল সংস্কৃতি ও প্রথা রক্ষাকারী। আওরঙ্গজেব একইসাথে একটি সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্রেরও প্রধান ছিলেন, প্রায়ই সহিংসতা প্রয়োগ করে উপমহাদেশ ও এর অধিবাসীদের ওপর রাজকীয় কর্তৃত্ব সম্প্রসারণ করার প্রয়াস চালাতেন। আওরঙ্গজেব সম্পর্কে আমার ভাষ্যটি সর্বোপরি ন্যায়বিচারসহ এসব সার মূল্যবোধ অনুসরণে তার চেষ্টা, এবং রূঢ় ক্ষমতা কব্জা করার জন্য যেসব আদর্শ তিনি বিসর্জন দিয়েছেন, সেইসব উদাহরণ কেন্দ্র করে প্রণীত 1

ন্যায়বিচার সম্পর্কে আওরঙ্গজেবের ভাষ্য বৃহত্তর ইসলামি ঐতিহ্যের রঙে গভীরভাবে রঞ্জিত, এর বেশির ভাগের সাথে ধর্মতত্ত্বের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই । ন্যায়বিচার-সম্পর্কিত প্রাক-আধুনিক ‘ইসলামি’ আদর্শ ব্যাপকভাবেই ইসলাম পূর্ববর্তী পারস্য ও গ্রিক দর্শন থেকে গৃহীত। এই ভাষ্যে জিহাদ ও জিজিয়ার (যথাক্রমে ধর্মযুদ্ধ ও ব্যক্তির ওপর আরোপিত কর) মতো বিভেদকারী ধারণাগুলো আখলাক ও আদবের (যথাক্রমে রাজনৈতিক আচরণ ও নৈতিক মূল্যবোধ) মতো আদর্শগত ধারণার চেয়ে অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ। আওরঙ্গজেব তার রাজকীয় পূর্বসূরীদের মাধ্যমেও প্রভাবিত হয়েছিলেন, নিজেকে পূর্ববর্তী মোগল রাজাদের অনুকরণে গড়ে তুলেছিলেন। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ন্যায়বিচার-সম্পর্কে আওরঙ্গজেবের আদর্শ বর্তমান সময়ে সাধারণভাবে গৃহীত আদর্শের সাথে মেলে না। কিন্তু তা খুব বড় বিষয় নয়। সমসাময়িক মানদণ্ডে আওরঙ্গজেবকে বিচার করার বদলে আমি চেয়েছি তার জীবন ও শাসন সম্পর্কে ঐতিহাসিক ভাষ্য নির্মাণ করতে এবং কয়েক শ’ বছর ধরে আমাদের মেনে নেওয়া ভুল তথ্যের নিচে চাপা পড়ে থাকা এই ব্যক্তি ও রাজাকে উদ্ধার করতে।

ন্যায়বিচার, ধর্মানুরাগ ও মোগল রাষ্ট্রের প্রতি আওরঙ্গজেবের ভক্তি ফারসি ইতিহাস গ্রন্থরাজি, বাদশাহর চিঠিপত্র ও সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকজুড়ে থাকা অন্য প্রাথমিক দলিল-দস্তাবেজগুলোতে বারবার উল্লেখ করা বিষয়। আওরঙ্গজেব সম্পর্কে আমার ভাষ্যের মূল কাঠামো এসেছে এসব ফারসি রচনাবলীর সমালোচনামূলক পাঠ থেকে। এছাড়াও হিন্দি, সংস্কৃত, ও অন্যান্য ভাষায় (আরো জানার জন্য এই বইয়ের শেষ দিকে থাকা জীবনীমূলক প্রবন্ধ ও পুনশ্চ : মধ্য যুগের ফারসি সাহিত্য পাঠ নিয়ে নোট অধ্যায় দেখুন) গবেষণাও রয়েছে। আওরঙ্গজেবের আদর্শগুলো- বিশেষ করে তার ন্যায়বিচার, মূল্যবোধ ও যথার্থ ইসলামি আচরণবিষয়ক ধারণাগুলো- বর্তমানে এগুলো সাধারণভাবে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, তা থেকে অনেক ভিন্ন। তবে তিনি ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন কিনা তা আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। বরং আমি জানতে চাই, আওরঙ্গজেব ন্যায়পরায়ণ শাসক বলতে কী বুঝতেন এবং তা কিভাবে হিন্দুস্তানের সম্রাট হিসেবে তার বিশ্ব-সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মপন্থা গড়ে দিয়েছিল ।

বোধগম্যভাবেই আওরঙ্গজেব তার নিজস্ব পরিভাষাতেই একটি প্রতিশ্রুতিশীল উদ্যোগ, তবে বর্তমান সময় পর্যন্ত তা করার চেষ্টা হয়েছে সামান্যই। এই বই মধ্য যুগের ভারতবর্ষে আওরঙ্গজেবের প্রভাব এবং ইন্দো মুসলিম ইতিহাসের মধ্যে তার গুরুত্বপূর্ণ স্থানটি আরো ভালোভাবে বুঝতে আমাদের সহায়তা করবে। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জোরালো বাস্তব ঐতিহাসিক বক্তব্য বর্তমানের (যা আওরঙ্গজেবকে এমনভাবে উপস্থাপন করে যা তিনি কখনোই ছিলেন না) আবেগকে প্রশমিত করতে পারে। এটিও বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক যে আওরঙ্গজেবকে নিয়ে বর্তমান বিকৃতির মধ্যে আমার সুপারিশ করা মধ্যবর্তী ভূমিকার ভিত্তি চিন্তাশীল ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত। এর বিপরীতে, আগেকার চিন্তাবিদেরা আওরঙ্গবের উত্তপ্ত লোকরঞ্জক ভাবমূর্তি প্রশমিত করতে দুটি ভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করেছিলেন। কিন্তু রক্ষণাত্মক হওয়ায় উভয়টিই ব্যর্থ

হয়েছে।

প্রথম ব্যর্থ কৌশলে স্বীকার করে নিতে হয়েছিল যে আওরঙ্গজেব ছিলেন ধর্মীয় স্বৈরশাসক, আবার সেইসাথে প্রধানত আকবর ও দারাশিকোর মতো ‘প্রচলিত মতবাদবিরুদ্ধ মুসলিম’ মোগল ব্যক্তিত্বদের চেয়ে ভিন্ন। এই যুক্তিতে বলা হয়, গোঁড়া আওরঙ্গজেবের তুলনায় আকবর ও দারা অনেক বেশি হিন্দু ধ্যান-ধারণা আত্মস্থ করেছিলেন। আর এভাবেই তারা উপমহাদেশের গ্রহণযোগ্য শাসক হওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিমাণে ‘ভারতীয়তে’ পরিণত হয়েছিলেন। এই চিন্তাধারায় আওরঙ্গজেবকে পুনঃবিবেচনা বা পুনঃমূল্যায়ন করা হয় না। এর বদলে তৃতীয় মোগল সম্রাট ও আওরঙ্গজেবের দাদার বাবা আকবরের নির্মিত কথিত সহিষ্ণুতার সংস্কৃতি ধ্বংস করা ও আওরঙ্গজেবের বড় ভাই দারা শুকোহর কাছ থেকে মোগল রাজমুকুট ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য তাকে কলঙ্কিত করা হয়। অবশ্য, মনে করা হয় যে ইতিহাসের মহা পথ-পরিক্রমায় আদর্শমূলক ভারতীয় মুসলিমদের সমন্বয়বাদী উত্তরাধিকারে ভারসাম্য রক্ষাকারী হিসেবে কাজ করেছে আওরঙ্গজেবের সাম্প্রদায়িকতাবাদ । এই চিন্তাধারা এমনকি হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রাথমিক প্রচারক ভি ডি সাভারকারের মতো লোকজনও লালন করেন। দিল্লির আওরঙ্গজেব রোডের নাম বদল নিয়ে বিতর্কের সময় এই যুক্তি অনুসরণ করেই সেটির নতুন নাম দারা শুকোহ রোড রাখার প্রস্তাবও এসেছিল।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, আওরঙ্গজেবের মতো আকবর ও দারা শুকোহ উভয়েই তাদের নিয়ে লোকরঞ্জক খ্যাতিতে যা বলা হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল ছিলেন। আওরঙ্গজেবের সাথে ভারসাম্য করার জন্য আকবর ও দারাকে সামনে আনতে গিয়ে এসব লোক সম্পর্কে নতুন কিছু শিখতে আমরা ব্যর্থ হই, তাদের মুসলমানিত্ব অনুযায়ী মোগল বাদশাহদের মান নির্ণয় করার কাজে নিজেদের শৃঙ্খলিত করে ফেলি। এই তুলনা করতে গিয়ে আমরা এই ধারণা পোষণ করে বিরাট ভুল করে বসি যে ভারতবর্ষের ইতিহাস, তথা ইন্দো-মুসলিম অতীতের সবকিছুই ধর্মবিষয়ক। আওরঙ্গজেব মুসলিম ছিলেন। তবে তার আধুনিক অনুসারীরা বা সমর্থকেরা তাকে যে ধরনের মুসলমান হিসেবে বিবেচনা করে, তেমন ছিলেন না তিনি। অধিকন্তু, আওরঙ্গজেবকে তার বিশ্বাসের মধ্যে খর্ব করা যায় না। অতীতের কাছে সৎ থাকার জন্য আমাদের যুবরাজ ও সম্রাট হিসেবে তার পূর্ণতর ছবিটি পুনরুদ্ধার করতে হবে।

আক্রমণে ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে কেউ কেউ যুক্তি দেন যে আমরা খুবই কঠোরভাবে আওরঙ্গজেবকে বিচার করছি। সম্ভবত ভারতের সবচেয়ে ঘৃণ্য মুসলিম বদমাসটি আসলে ততটা জঘন্য ছিলেন না?

এই যুক্তির ভিত্তি নিহিত রয়েছে আওরঙ্গজেবের আমল সম্পর্কে ভ্রান্ত ব্যাখ্যা সংশোধন এবং মোটামুটিভাবে সঠিক হলেও যেসব বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, সেগুলো উপস্থাপনের ওপর। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, লোকরঞ্জক বিশ্বাসের বিপরীতে আওরঙ্গজেব কখনো বড় মাত্রার এমন কোনো ধর্মান্তর কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেননি যাতে অমুসলিমদেরকে ইসলাম বা তরবারির কোনো একটিকে গ্রহণ করে নিতে হয়েছিল। আওরঙ্গজেব কখনোই হাজার হাজার হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেননি (খুব সম্ভবত সংখ্যাটি কয়েক ডজনে সীমিত থাকতে পারে)। তিনি হিন্দুদের পাইকারিভাবে হত্যার মতো জঘন্য কোনো কাজ করেননি। বস্তুত, তিনি তার সরকারের সর্বোচ্চ অবস্থানে হিন্দুদের বসিয়েছিলেন। তিনি হিন্দু ধর্মীয় গ্রুপগুলোর স্বার্থ সুরক্ষিত রেখেছিলেন, এমনকি ব্রাহ্মণদের হয়রানি বন্ধ করার জন্য স্বধর্মী মুসলিমদের নির্দেশ পর্যন্ত দিয়েছিলেন। তিনি তার সব প্রজার জন্য নিরাপদ রাস্তা ও মৌলিক আইন-শৃঙ্খলার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছিলেন।

সব ঘটনার সঠিক বিবরণ দেওয়া ইতিহাসবিদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত বিষয়, এবং এটুকু সত্য : আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে আওরঙ্গজেব ছিলেন তার সমসাময়িক খ্যাতির তুলনায় অন্যের প্রতি অনেক কম অকল্যাণকামী। তবে আওরঙ্গজেব পুরোপুরি জঘন্য ব্যক্তি ছিলেন না, কেবল এমন কথার ফুলঝুড়ি দিয়েই আমরা আওরঙ্গজেব সম্পর্কে লোকরঞ্জক নিন্দাগুলোর ঊর্ধ্বে উঠতে পারব না। আরো সমস্যার বিষয় হলো, আমরা ভারতবর্ষের জটিল অতীত সম্পর্কে ন্যায়বিচার করতে ব্যর্থ হই। আওরঙ্গজেব কি একুশ শতকের স্পর্শকাতরতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিলেন? এমন প্রশ্নের চেয়ে উপনিবেশ-পূর্ব ভারতবর্ষে অর্ধশত বর্ষ শাসনকারী ও রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে দেওয়া লোকটি সম্পর্কে অনেক বেশি কথা বলার আছে। আমাদেরকে অবশ্যই তাড়াহুড়া করে আওরঙ্গজেবের বিচার করার প্রবল, আধুনিক প্রবৃত্তি দমন করে বরং এই প্রভাবশালী বাদশাহর কর্ম ও আদর্শগুলোকে প্রথমে পুনরুদ্ধার করতে হবে।

আমাদের প্রয়োজন আওরঙ্গজেব সম্পর্কে নতুন ভাষ্য। আমি এখানে এ ধরনের একটি বক্তব্যই উপস্থাপন করছি।

আমার ভাষ্যে আওরঙ্গজেবের জীবন ও শাসনকাল সম্পর্কে বর্তমানে স্বল্প পরিচিত অনেক বক্তব্য অন্তর্ভুক্ত করে এর মাধ্যমে বিভ্রান্তির শিকার এক বাদশাহ-সম্পর্কে অতি-প্রয়োজনীয় ঐতিহাসিক গভীরতা যোগ করেছে। এতে আওরঙ্গজেবের কথিত ‘সবচেয়ে খারাপ’ বিষয়গুলো তথা তার মন্দির অবমাননা, কূটিল রাজনৈতিক বুদ্ধি, সহিংস পন্থা, কিছু ধর্মীয় সম্প্রদায়কে নির্যাতন করার মতো অভিযোগের জবাব দেওয়া হলেও এগুলোতেই বইটি সীমাবদ্ধ নয়। যদি কেবল আওরঙ্গজেব সম্পর্কে কুৎসা রটনাকারীদের বিভ্রান্তিকর তথ্য ও সন্দেহজনক দাবিগুলো মোকাবিলা করা হয়, তবে তা হবে একটি ফাঁকা কাজ। কারণ এটি ইতিহাসের মূল নির্দেশিকা তথা ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের তাদের নিজস্ব পরিভাষার ভিত্তিতে উপলব্ধি করার কাজটি বাস্তবায়ন করা হবে না ।

এই পার্থক্যের- রক্ষণাত্মকভাবে চিন্তা করা বনাম ঐতিহাসিকভাবে চিন্তা করা- একটি ভালো উদাহরণ হলো হিন্দুদের প্রতি আওরঙ্গজেবের আচরণ। লোকরঞ্জক ধারণায় আওরঙ্গজেবকে সব হিন্দুর প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ ও সবভাবে তাদেরকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন বলে কল্পনা করা হয়। কিন্তু দায়িত্বশীল ইতিহাসবিদ বিজ্ঞচিতভাবে বলতে পারেন যে পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে আওরঙ্গজেব সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে হিন্দুদের সাথে আচরণ করেছিলেন। মোগল রাষ্ট্র ও বিশেষ হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রায়ই সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হতো এবং এতে অনেক সময় স্পর্শকাতর ধর্মীয় বিষয়ও থাকত। কিন্তু অনেক হিন্দুই আওরঙ্গজেবের ভারতবর্ষে সহিষ্ণুতা ও সুরক্ষা লাভ করেছিল। আওরঙ্গজেবের শাসন নিয়ে চিন্তা করার সময় নির্ভুল হলেও এ ঐতিহাসিক সংশোধনটি হিন্দুদের ব্যাপারে সাধারণ কোনো ধারা গ্রহণ ফলপ্রসূ পথ কিনা সেই মৌলিক প্রশ্নটি বিবেচনা করতে পারেনি।

বাস্তবে আওরঙ্গজেব তার সাম্রাজ্যে হিন্দুদের ব্যাপারে সার্বজনীন কোনো এজেন্ডা অনুসরণ করেননি। ওই আমলে ‘হিন্দুরা’ সাধারণত নিজেদের ওই পরিভাষায় পরিচিত করত না, তারা বরং আঞ্চলিক, সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী পরিচয়ে (যেমন রাজপুত, মারাঠা, ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব ইত্যাদি) পরিচিত করত। অনেক বিশেষজ্ঞ উল্লেখ করেছেন, ‘হিন্দু’ শব্দটি সংস্কৃত নয়, বরং ফারসি। আর এ শব্দটি ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলে সাধারণভাবে স্ব-উল্লেখে ব্যবহৃত হয়েছিল । মোগলরাও ‘হিন্দুদের’ বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যকার পার্থক্যকে গুরুত্ব দিত। উদাহরণ হিসেবে মোহাব্বত খানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি ১৬৭০-এর দশকে অল্প সময়ের জন্য দাক্ষিণাত্যে মোগল অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি এমনকি মারাঠাদের (তারা দৃশ্যত এই ঘটনায় ‘হিন্দু’ হিসেবে বিবেচিত হয়নি) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময় মোগল আভিজাত্যের মধ্যে ‘রাজপুত ও হিন্দুদের’ অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আওরঙ্গজেবের আমলে একটি ব্লক হিসেবে মোগল-হিন্দু সম্পর্ককে মূল্যায়ন করার বদলে আমরা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে তথা বিশেষ গ্রুপ ও পদক্ষেপকে আলাদা আলাদাভাবে বিবেচনা করব। এর ফলে পাঠকেরা এখানে হিন্দুদের প্রতি আওরঙ্গজেবের আচরণ নিয়ে আলাদা কোনো অংশের দেখা পাবে না, বরং মোগল রাষ্ট্রের পক্ষে নিয়োজিত হিন্দু অভিজাত, ব্রাহ্মণ নেতা এবং সশস্ত্র মারাঠা বিরোধিতারীদের নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা দেখতে পাবে!

আমাদের সময়ের সীমাবদ্ধকরণ, সাম্প্রদায়িক পরিভাষার ঊর্ধ্বে আমরা যদি ওঠতে পারি, এবং এর বদলে সপ্তদশ শতকের মোগল বিশ্বকে পুনরুদ্ধারের প্রবল প্রয়াস চালাই, তবে আওরঙ্গজেবের এক চমকপ্রদ ছবির আবির্ভাব ঘটবে। এই আওরঙ্গজেব ছিলেন ভারতবর্ষের সম্রাট। তিনি সারা জীবন সাধনা করেছেন মোগল সাম্রাজ্য রক্ষা ও সম্প্রসারিত করার, রাজনৈতিক শক্তি লাভ করার এবং ন্যায়বিচারবিষয়ক তার নিজস্ব ধারণার আলোকে শাসন করার ।

আওরঙ্গজেবের জীবন সম্পর্কে কিছু মৌলিক তথ্যের ব্যাপারে ইতিহাসবিদেরা একমত। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৬১৮ সালের শরতে। ১৬৫৮ সালে ৩৯ বছর বয়সে তার প্রথম রাজ্যাভিষেক হয়েছিল। তিনি ১৬৮১ সালে পুরো রাজদরবার নিয়ে দাক্ষিণাত্য অভিযানে বের হয়েছিলেন। ওই সময় তার বয়স ছিল ৬০-এর কোঠার মাঝামাঝিতে। এরপর তিনি বিজাপুর, গোলকোন্ডা ও এমনকি তামিল নাড়ুর অংশবিশেষও জয় করেছিলেন। তিনি ৮৮ বছর বয়সে ১৭০৭ সালে পরলোকগমন করেন । তবে আমরা তথ্যগুলোকে কিভাবে একসাথে করে সাজাব, তার আলোকে আওরঙ্গজেব সম্পর্কে আকর্ষণীয় সবকিছু বের হয়ে আসে। অন্য কথায় বলা যায়, আর এই ভাষ্যই আসল জিনিস ।

আওরঙ্গজেব সম্পর্কে আমার ভাষ্য একইসাথে সম্রাট হিসেবে তার জীবনে গভীরতা ও ব্যাপকতা অনুসন্ধান করেছে। এগুলো কিছুটা কালক্রমানুনিকভাবে ও কিছুটা বিষয়ভিত্তিক সাজানো হয়েছে। শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আওরঙ্গজেবের জীবনকে অনুসরণ করতে গিয়ে আমরা মোগল রাজত্ব, নৈতিক আচরণ, রাজনীতি সম্পর্কে তার ধারণা গঠনকারী প্রধান শক্তিগুলো উপলব্ধি করতে পারি, সময়ের পরিক্রমায় এসব শক্তি কিভাবে বিবর্তিত হয়েছে, তাও দেখতে পাই। সিংহাসনে থাকাকালীন কিছু ঘটনা ও পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আমরা আওরঙ্গজেব সম্পর্কে আরো গভীর মূল্যায়ন ও তার ঐতিহাসিক নীতির ফলাফল সম্পর্কে জানতে পারি ।

আমি আওরঙ্গজেবের জীবনের প্রথম চার দশক তথা তার তারুণ্য আমল দিয়ে শুরু করব। এ সময়ই তিনি বিশেষ করে ভাইদের বিরুদ্ধে আসন্ন উত্তরাধিকার লড়াইয়ে বিপুলভাবে জয়ী হওয়ার অবস্থান সৃষ্টি করেছিলেন। দুই বছরের রক্তাক্ত সংগ্রামের পর আওরঙ্গজেব সিংহাসন নিশ্চিত করেন, অল্প সময়ের মধ্যেই তার নিজের প্রয়োজনের (তার প্রায় ৫০ বছরের শাসনকালে প্রকাশিত প্রকল্প) সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ক্ষমতাসীন সংস্কৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে শুরু করেন। আওরঙ্গজেবের শাসনের তিনটি বিষয় তার শাসন কৌশল ও ন্যায়বিচার-সম্পর্কিত ধারণা পেতে আমাদের সহায়তা করে। এগুলো হচ্ছে : সাম্রাজ্যিক আমলাতন্ত্র, একজন নৈতিক নেতা হিসেবে আওরঙ্গজেবের নিজেকে মূল্যায়ন এবং হিন্দু ও জৈন মন্দির সম্পর্কে তার নীতি। এগুলো আওরঙ্গজেবের শাসনকালের সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়গুলোর সাথে সম্পৃক্ত এবং স্বল্প জানা ঘটনাগুলো সামনে নিয়ে আসে। সর্বোপরি, এসব অধ্যায় প্রায়ই একটিমাত্র চশমা দিয়ে দিয়ে বিকৃতভাবে উপস্থাপিত একজন বাদশাহ-সম্পর্কে ঐতিহাসিক গভীরতা যোগ করে। আমি এর পর আওরঙ্গজেবের জীবনের শেষ দিকের বর্ণনা দেব। এসবের মধ্যে রয়েছে দাক্ষিণাত্যে তার শেষ দশকগুলোর সংগ্রাম ও মৃত্যু। অষ্টাদশ শতকে মোগল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য তাকে যেসব কারণে অভিযুক্ত করা হয়, সেগুলোর ওপরও আমি আলোকপাত করব।

ব্যাপক গবেষণার ওপর ভিত্তি করে আমি প্রস্তাব করছি যে আমরা রাজপুরুষ হিসেবে আওরঙ্গজেবকে (তিনি রাজপরিবারের গতিশীলতার জালে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। এটি তার প্রথম দিকের জীবন গড়ে দিয়েছিল এবং পরে তাকে এমন এক ভারতবর্ষীয় সম্রাটে পরিণত করেছিল, যিনি ভূখণ্ড, রাজনৈতিক শক্তি ও বিশেষভাবে ন্যায়বিচারের প্রতি ক্ষুধিত ছিলেন) সফলভাবে দেখতে পাব!

২. যুবরাজ আমল

ভারতবর্ষীয় যুবরাজের শৈশব

আশা করা যায়, তার শুভাগমন এই শ্বাশত রাজবংশের জন্য সৌভাগ্যময় আর শুভ প্রমাণিত হবে ।
–নাতি আওরঙ্গজেবের জন্মের পর জাহাঙ্গীরের শুভেচ্ছা

দাদা জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে গুজরাতের দোহাদে ১৬১৮ সালের ৩ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন আওরঙ্গজেব। এর কয়েক সপ্তাহ পর আওরঙ্গজেবের বাবা যুবরাজ খুররম (পরে শাহ জাহান নামে পরিচিত) জন্ম-উৎসবের আয়োজন করেন। এ সময় তিনি সদ্য জন্ম নেওয়া তার ছেলেকে গর্বের সাথে প্রদর্শন করেন, রাজকোষাগারে বিপুল পরিমাণে মণি-মানিক্য ও কয়েক ডজন হাতি পাঠিয়ে দেন। তবে এ ধরনের সুপ্রশন্ন সূচনা সত্ত্বেও বাবার আনুকূল্য নিশ্চিত করাটা আওরঙ্গজেবের জন্য সহজ হয়নি।

আওরঙ্গজেব ছিলেন শাহ জাহানের তৃতীয় ছেলে। তার বড় দুই ভাই হলেন দারা শুকোহ ও শাহ সুজা। এক বছর পর শাহ জাহানের চতুর্থ ছেলে মুরাদের জন্ম হয়। চারজনই ছিলেন আপন ভাই, শাহ জাহানের প্রিয় স্ত্রী মোমতাজের ছেলে। অন্য ভাইদের মতো আওরঙ্গজেবও নানা বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাহিত্যিক ঐতিহ্যে পরিব্যপ্ত রাজকীয় শিক্ষালাভ করেন ।

পাঠ্যক্রম অনুযায়ী আওরঙ্গজেব কোরআন ও হাদিস, ধর্মীয় জীবনীসহ ইসলামি ধর্মীয় পুস্তকাদি অধ্যায়ন করেন। তিনি তুর্কি সাহিত্যও পাঠ করেন, ক্যালিগ্রাফির শিল্প-সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করেন। মোগলদের রাজকীয় শিক্ষাব্যবস্থায় ফারসি ক্লাসিক, বিশেষ করে সাদি, নাসিরউদ্দিন তুসি ও হাফিজের মতো বর্তমানেও অত্যন্ত প্রিয় মহান কবি ও পণ্ডিতদের রচনাবলী বেশ গুরুত্ব পেত। গুঞ্জন রয়েছে যে আওরঙ্গজেবের বিশেষ প্রিয় গ্রন্থ ছিল রুমির মসনবি। এসব ফারসি সাহিত্য মোগল রাজপুরুষদের নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে দিত, বিশেষ করে ন্যায়বিচার, আদব, আখলাক ও রাজত্ব সম্পর্কে তাদের ধারণা বিকশিত করত ।

আওরঙ্গজেবকে সম্ভবত মহাভারত ও রামায়ণের মতো সংস্কৃতি গ্রন্থরাজির ফারসি অনুবাদের সাথেও ভালোভাবে পরিচিত করানো হয়েছিল। এসব অনুবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন আওরঙ্গজেবের দাদার বাবা আকবর। আমরা জানি যে আকবর তার এক ছেলের কাছে রাজকীয় শিক্ষার জন্য মহাভারত উপকারী বলে সুপারিশ করেছিলেন। শৈশব থেকেই আওরঙ্গজেব অনর্গল হিন্দি বলতে পারতেন। মোগল পরিবারের চতুর্থ প্রজন্ম হিসেবে তিনি এই দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তিনি হিন্দি সাহিত্যবিষয়ক নিবন্ধগ্রন্থে দক্ষ ছিলেন, তা ছিল সম্ভবত তার আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণেরই অংশবিশেষ। এমনকি প্রাক-আধুনিক হিন্দির সাহিত্যিক বাহন ব্রজ ভাষায় তিনি মৌলিক রচনাও করেছেন বলে বলা হয়ে থাকে। মোগল রাজকীয় পাঠ্যক্রমে তরবারি, ছোরা, গাদা বন্দুক, সামরিক কৌশল ও প্রশাসনিক দক্ষতার মতো বাস্তব অনুশীলনও অন্তর্ভুক্ত ছিল ।

শিক্ষার বাইরে মোগল রাজপুরুষের শৈশবের অনুষঙ্গ ছিল ভাইদের মধ্যকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা, আওরঙ্গজেবের বেড়ে ওঠাও ব্যতিক্রম ছিল না।

অল্প বয়স থেকেই শাহ জাহানের চার ছেলে মোগল সিংহাসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত ছিলেন। মোগলরা মধ্য এশিয়ার উত্তরাধিকার প্রথা অনুসরণ করত। এই প্রথায় পরিবারের সব পুরুষ সদস্যই রাজনৈতিক ক্ষমতা দাবি করতে পারত, বয়স এখানে অপ্রাসঙ্গিক বিবেচিত হতো। আকবর প্রতিদ্বন্দ্বিতা কমিয়ে আনেন বৈধ উত্তরাধিকারের তালিকা কেবল ছেলেদের মধ্যে আবদ্ধ রেখে (এর ফলে ভাতিজা ও ছেলে কাজিনরা বাদ পড়ে যায়)। প্রথম সন্তানই উত্তরাধিকারী হবে, এমন আইন না থাকায় শাহ জাহানের দীপ্তিময় ময়ুর সিংহাসন একদিন আওরঙ্গজেবের অধিকারে আসতেই পারে, যদি তিনি তার দাবিদার ভাইদের পেছনে ফেলে দিতে পারেন। অবশ্য শৈশবেই ভাইদের থেকে আওরঙ্গজেব যে আলাদা তা প্রমাণ করার সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন খুবই সামান্য ।

শাহ জাহান প্রকাশ্যে তার বড় ছেলের প্রতি আনুকূল্য প্রদর্শন করতেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দারা শুকোহর প্রথম বিয়ের অনুষ্ঠানটি মোগল ইতিহাসের অন্য সব আয়োজন ছাপিয়ে যায়। এতে খরচ হয়েছিল ৩২ লাখ রুপি। আর কোনো বিয়েতে এত অর্থ ব্যয় হয়নি। ১৬৩৩ সালে রাজপরিবার এত জৌলুসময় আয়োজন করেছিল, যা আজও বিস্ময় সৃষ্টি করে। ইউরোপিয়ান পর্যবেক্ষক পিটার মান্ডের মতে, সম্ভ্রম-জাগানিয়া আতশবাজির প্রদর্শন আগ্রার আকাশে আধা মাইল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। শাহ জাহানের শাসনকাল সম্পর্কে সরকারি কার্যবিবরণী পাদশাহনামায় ওই বিবাহ অনুষ্ঠানের চিত্র শোভিত হয়ে আছে। গ্রন্থটি বর্তমানে সংরক্ষিত রয়েছে ইংল্যান্ডের উইন্ডসর ক্যাসলে। স্পন্দমান দৃশ্যাবলীতে রাজকীয় সঙ্গীতজ্ঞ, উপহারবাহক, শুভাকাঙ্ক্ষী ও কর্মকর্তাদের নিয়ে গড়া বিশাল জনস্রোতকে বর্ণাঢ্য সাজে শাহ জাহানের প্রিয় ছেলের সম্মানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ওই সময় আওরঙ্গজেবের বয়স ছিল ১৪ বছর। অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত ছিলেন বলেই জানা যায়। কিন্তু বিবাহ অনুষ্ঠান নিয়ে পাদশাহনামায় যেসব ছবি রয়েছে, তাতে স্থান পাওয়ার মতো উপযুক্ত বিবেচিত হননি তিনি ।

দারা শুকোহর বিয়ের কয়েক মাস পর আওরঙ্গজেব তার বাবার নজরে পড়ার একটি বিরল সুযোগ লাভ করেন। রাজকীয় প্রিয় বিনোদন হাতির লড়াইয়ের আয়োজন করতে বলেছিলেন শাহ জাহান। সুধাকর ও সুরত সুন্দর (মোগল হাতিদের নাম প্রায়ই হিন্দিতে রাখা হতো) মুখোমুখি হলো। খুব কাছ থেকে লড়াই দেখার জন্য বাদশাহ ও তার তিন বড় ছেলে লড়াই ঘোড়ার পিঠে কাছাকাছিই অবস্থান করছিলেন। হঠাৎ করেই সুধাকর পাশবিক রোষে আওরঙ্গজেবকে আক্রমণ করে বসে। আওরঙ্গজেব হাতির মাথায় বর্শা বিদ্ধ করেন। এতে হাতিটি আরো ক্ষেপে যায়। সুধাকর তখন আওরঙ্গজেবের ঘোড়াটিতে কাবু করে, ফলে তিনি মাটিতে পড়ে যান। অন্যরা সাহায্য করার চেষ্টা করেন। সুজা ও রাজা জয় সিং (যথাক্রমে আওরঙ্গজেবের ভাই ও প্রখ্যাত রাজপুত) অস্ত্র হাতে এগিয়ে আসেন, আতশবাজি নিক্ষেপ করে হাতিকে লক্ষ্যচ্যুত করার চেষ্টা করে প্রহরীরা। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। কেবল সুরত সুন্দরই আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে সুধাকরকে ফিরিয়ে আবার লড়াইয়ে মত্ত করতে সক্ষম হয় ।

উল্লেখ্য, এই জীবন-মরণ লড়াইয়ে দারা শুকোহকে কোথাও দেখা যায়নি। এই ঘটনার লিখিত বিবরণে তার ভূমিকার কোনো কথা নেই, আর টিকে থাকা ছবিতে দারাকে পেছনে ওঁত পেতে থাকতে দেখা যায়, তিনি তখন ক্ষতি ও গৌরব উভয় থেকেই নিরাপদ দূরত্বে ছিলেন।

ফারসি কবিতার মাধ্যমে আওরঙ্গজেবের সাহসিকতা স্মরণীয় করে রেখেছেন শাহ জাহানের রাজকবি আবু তালেব কালিম। তিনি চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন কিভাবে আওরঙ্গজেবের বর্শা বিদ্যুৎ গতিতে সুধাকরের মাথায় আঘাত করেছিলেন। তারপর যুবরাজের বর্শার আঘাতে হাতির মনকে বিষিয়ে পাগল করে দিলো।’ আওরঙ্গজেবের সাহসিকতার প্রশংসা করেন শাহ জাহান, অন্তত এক মুহূর্তের জন্য হলেও তিনি তার নিজের ছবি দেখেছিলেন তার ছেলের মধ্যে। শাহ জাহানের দরবারি ইতিহাস লেখকেরা একমত হয়ে আওরঙ্গজেবের ভয়হীন এই কৃতিত্বের সাথে ১৬১০ সালে শাহ জাহানের সাথে ক্রুদ্ধ এক সিংহের মোকাবিলার তুলনা করেন। ওই ঘটনা দেখেছিলেন শাহ জাহানের বাবা জাহাঙ্গীর।

কয়েক বছর পর সাম্রাজ্য পরিচালনায় সহায়তা করার জন্য আওরঙ্গজেবকে দরবার থেকে দূরে পাঠিয়ে দেন শাহ জাহান। তখন আওরঙ্গজেবের বয়স মাত্র ১৬ বছর। ১৬৩৫ থেকে ১৬৫৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২২ বছর ধরে আওরঙ্গজেব মোগল সাম্রাজ্য চষে বেড়ান; বলখ, বুন্দেলখন্ড ও কান্দাহারে লড়াই করেন; গুজরাত, মুলতান ও দাক্ষিণাত্য পরিচালনা করেন ।

যুবরাজ এসবের মধ্যেও উপভোগের জন্য সময় বের করে নিতেন, হিরাবাই জৈনাবাদির সাথে ঝড়ো রোমান্সে মেতে ওঠার সময়ও বের করে নিয়েছিলেন। ১৬৫৩ সালে আওরঙ্গজেব বুরহানপুরে তার মামার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে গাছ থেকে আম পাড়ার খেলায় মত্ত হিরাবাইকে দেখে তার প্রেমে বিভোর হয়ে পড়েন। মেয়েটি ছিলেন গায়িকা ও নর্তকী। দুজনে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হন । গুঞ্জন রয়েছে যে আওরঙ্গজেব এই তরুণীর এতটাই অনুগত হয়ে পড়েছিলেন যে তিনি এমনকি সারা জীবনের জন্য মদ্যপান না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন (প্রথম ফোঁটা মদ আওরঙ্গজেবের ঠোঁট দিয়ে যাওয়ার আগেই তিনি থামিয়ে দিয়েছিলেন)। কিন্তু হায়, হিরাবাই এক বছরের কম সময়ের মধ্যে মারা যান, তাকে আওরঙ্গাবাদে সমাহিত করা হয়। এ ধরনের চমকপ্রদ মুহূর্ত সত্ত্বেও আওরঙ্গজেব তার প্রাপ্তবয়স্ক রাজপুরুষালী আমলে রাষ্ট্রীয় কাজেই বেশির ভাগ সময় ব্যয় করেছেন।

রাজপরিবার থেকে আওরঙ্গজেবের দূরে থাকাও তাকে তার বাবার হৃদয়কে স্নেহসিক্ত করতে পারেনি। তিনি তার ২২ বছরের এই সময়কালে খুব কমই রাজদরবারে এসেছেন। বিশেষ বিশেষ ঘটনায়, যেমন ১৬৩৭ সালে তার প্রথম বিয়ের সময় এসেছিলেন। প্রশাসনিক ও সামরিক অভিযান- উভয় দিক থেকেই নিজেকে দক্ষ প্রমাণ করেছিলেন আওরঙ্গজেব। তবে প্রায়ই দিল্লির সিদ্ধান্তে হতাশ হতেন। দৃশ্যত তার সাফল্য ক্ষুণ্ণ করার জন্যই এমনটা করা হতো। উদহারণ হিসেবে ১৬৫০-এর দশকের ঘটনা বলা যায়। দাক্ষিণাত্যে তার কয়েকটি প্রায় জয়ের মুহূর্তে তাকে বাধ্য করা হয় প্রত্যাহারের জন্য। দারা শুকোহর তাগিদে এই আদেশ জারি করেছিলেন শাহ জাহান ।

আওরঙ্গজেব তার ২০ ও ৩০-এর কোঠার বয়সকালে যখন যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেকে প্রমাণ করছিলেন, প্রশাসনিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছিলেন, দুর্ধর্ষ খ্যাতি অর্জন করছিলেন, তখন দারা শুকোহ রাজদরবারে আয়েসী জীবনযাপন করছিলেন। শাহ জাহানের বড় ছেলে পরিচিত ছিলেন দার্শনিক আগ্রহের জন্য, হিন্দু ও মুসলিম সাধু-সন্ন্যাসীদের সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায় দিন কাটাত তার। কাগজে-কলমে দারা সবসময়ই আওরঙ্গজেবের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। বড় ভাই মোগল মনসব ব্যবস্থায় (এতে রাষ্ট্রের সব কর্মকর্তা সম্পৃক্ত ছিলেন) ছিলেন উচ্চতর পদবির অধিকারী। শাহ জাহান তাকেই সিংহাসনে আসীন দেখতে চান বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হতো। কিন্তু দারা কেন্দ্রীয় রাজদরবারের অত্যন্ত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের বাইরে থাকা প্রকৃত দুনিয়ার অভিজ্ঞতার অভাবে ছিলেন। আর এটিই পরে মারাত্মক অসুবিধা হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল ।

লোকরঞ্জক স্মৃতিতে প্রায়ই দারা শুকোহর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়, ভারতীয় ইতিহাসের বড় ‘কী হতো যদি’ বিবেচনা করা হয় তাকে। ‘ধর্মান্ধ’ আওরঙ্গজেবের বদলে ষষ্ট মোগল বাদশাহ যদি হতেন ‘উদার’ দারা, তবে কী হতো? ইতিহাস কি ভিন্ন দিকে মোড় নিত? সাম্প্রতিক সময়েও অনেকে শহিদ নাদিমের দারা নাটকে উদ্দীপ্ত হয়ে প্রশ্ন করেন, বাদশাহ হলে কি দারা ১৯৪৭ সালের ভারতবর্ষের নৃশংস বিভক্তি অনেক আগেই নাকচ করতে পারতেন? অযাচিত নস্টালজিয়া সরিয়ে রাখা রেখে বলা যায়, বাস্তবতা হলো এই যে জয়ী হতে বা মোগল সাম্রাজ্য শাসন করার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছিল না দারার। হিন্দুস্তানের মুকুটের জন্য চার ভাইয়ের মধ্যকার অনিবার্য মোকাবিলায় দারার অসুস্থ বাদশাহকে সাথে রাখাটা আওরঙ্গজেবের জোট, কৌশলগত দক্ষতা, 3 মোগল সাম্রাজ্য কয়েক দশক ধরে ঘুরে ঘুরে যে রাজনৈতিক বিচক্ষণতা অর্জন করেছিলেন, তার সাথে পাল্লা দেওয়ার মতো ছিল না ।

বিশ্ব জয় করলেন আওরঙ্গজেব

ইয়া তখত ইয়া তাঁবুত
হয় সিংহাসন নয়তো কবর
–মোগল রাজত্বের একটি মন্ত্র

শাহ জাহান ১৬৫৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক সকালে জেগে মারাত্মক অসুস্থতা বোধ করলেন, প্রাসাদের বারান্দায় প্রজাদের সামনে হাজির হওয়ার দৈনন্দিন কাজটিও করতে পারলেন না। তিনি ওই দিনের দরবারও বাতিল করে দিলেন। শাহ জাহান এক সপ্তাহেরও বেশি সময় জনসাধারণের সামনে উপস্থিত হতে পারলেন না। ফলে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেল। বাদশাহর অসুস্থ হওয়ার খবর তীব্র বেগে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। দোকানদারেরা আতঙ্কিত হলো, লুটপাট বেড়ে গেল। শাহ জাহানের চার ছেলে মনে করলেন, তাদের বাবা মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। ফলে তারা ক্ষমতার এই শূন্যতার সুযোগ গ্রহণ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন। প্রচলিত মোগল প্রথা অনুযায়ী, ছলে-বলে-কলে-কৌশলে যিনি জয়ী হবেন, তিনিই হবেন হিন্দুস্তানের পরবর্তী সম্রাট ।

সঙ্ঘাত বন্ধ হতে লাগল প্রায় দুই বছর এবং আওরঙ্গজেব অবিসংবাদিত বিজয়ী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। সিংহাসনে উত্তরণের পরিক্রমায় আওরঙ্গজেব তার তিন ভাই- দারা শুকোহ, শাহ সুজা ও মুরাদ- ও বাবা শাহ জাহানকে পরাভূত করেছিলেন। ১৬৬০-এর দশকের শেষ দিকে পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের বিরোধ নিষ্পত্তি করার প্রক্রিয়ায় আওরঙ্গজেব তার দুই ভাইকে মৃত্যুদণ্ড দেন, আরেকজনকে ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করেন, বাবাকে (তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই সুস্থ হয়ে ওঠেছিলেন) আটকিয়ে রাখেন আগ্রার লাল কেল্লায়। অবিভক্ত মোগল সাম্রাজ্য শাসন করার জন্য একমাত্র আওরঙ্গজেবই এই সহিংসতা থেকে অক্ষতভাবে বের হয়ে আসতে পেরেছিলেন!

ইউরোপিয়ান পর্যটকেরা মোগল রাজপরিবারকে নিমজ্জিত করা নৃশংস, রক্তাক্ত উত্তরাধিকার লড়াইয়ে আতঙ্কিত হয়েছিলেন। কয়েক দশক পর মোগল ভারত সফরকারী ইতালির জেমেলি ক্যারেরি পারিবারিক দ্বন্দ্বকে ‘অপ্রাকৃতিক যুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। আওরঙ্গজেবের শাসনকালের শেষ দিকে সুরাতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চ্যাপলিন জন অভিংটন ‘এ ধরনের বর্বর আত্মদানের’ নিন্দা করেছেন, বিষয়টিকে ‘অমানবিক’ হিসেবে অভিহিত করে সমাপ্তি টেনেছেন। ফ্রান্সিস বার্নিয়ার ও নিকোলাও মানুচির মতো অন্যান্য ইউরোপিয়ান পর্যটন লেখক এসব ঘটনা নিয়ে জালিয়াতপূর্ণ ও বিভীষিকাময় দমবন্ধ করা বক্তব্য দিয়েছেন, চার ভাইয়ের, বিশেষ করে আওরঙ্গজেবের ‘আধিপত্য বিস্তারের লোলুপতা’ নিয়ে কথা বলেছেন। ভারতীয় পর্যবেক্ষকেরাও এই ঘটনা উল্লেখ করেছেন, তবে তারা ঘটনায় অনেক কম আশ্চর্য হয়েছেন, অন্তত শুরুতে এর নির্মমতা সম্পর্কে কম সরব ছিলেন।

মোগল রাজকীয় ব্যবস্থা দীর্ঘ দিন ধরেই সুস্পষ্টভাবে ফরাসি বাক্য ইয়া তকত ইয়া তাঁবুত (হয় সিংহাসন নয়তো কবর) নীতিতে পরিচালিত হতো। শাহ জাহান তার দুই ভাইকে (১৬২২ সালে খসরু ও ১৬২৮ সালে শাহরিয়ার) খুন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি দুই ভাতিজা ও দুই কাজিনকে মৃত্যুদণ্ড দেন ১৬২৮ সালে সিংহাসন দখল করার পর। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি সাক্ষী দিচ্ছে যে শাহ জাহানের বাবা জাহাঙ্গীর দায়ী ছিলেন জাহাঙ্গীরের ছোট ভাই দানিয়েলের মৃত্যুর জন্য। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে দানিয়েল মারা গিয়েছিলেন বিষাক্ত মদ পানে। এমনকি বাবর ও হুমায়ূনের মতো মোগল শাসনের প্রাথমিক যুগেও ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাই, বাবার বিরুদ্ধে ছেলের সহিংস সঙ্ঘাত দেখা গেছে।

অবশ্য আওরঙ্গজেব ও তার ভাইদের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে লড়াই প্রত্যাশিত থাকলেও সময় বা সঙ্ঘাতের ফলাফল পূর্বনির্ধারিত ছিল না।

শাহ জাহান ১৬৫৭ সালে ছিলেন ৬৫ বছর বয়স্ক। তখনই তার আগের অন্য চার মোগল সম্রাটের চেয়ে তিনি অনেক বেশি দিন জীবিত ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার অসুস্থতা ছিল আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত। কী কারণে শাহ জাহান মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিলেন, সে ব্যাপারে পর্যবেক্ষকেরা একমত নন। ইতালির ভ্রমণকারী নিকোলি মানুচি তার বিশেষ রংচং মাখানো কায়দায় দাবি করেছেন যে অসংবৃত এই শাসক অতিরিক্ত মাত্রায় যৌন শক্তি বর্ধক ওষুধ গ্রহণ করেছিলেন। মানুচির স্বদেশী ক্যারেরিও উপসংহার টেনেছেন এই বলে যে অসম্ভব আবেগের বশবতী শাহ জাহান একজন বুড়ো মানুষের স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে অনেক বেশি যৌনতায় মজে গিয়েছিলেন। তবে বাস্তবে তার অসুস্থতার মূল কারণ হতে পারে মুত্রথলি বা আন্ত্রিক কোনো রোগ। যে কারণেই তিনি অসুস্থ হয়ে থাকুন না কেন, এর ফলেই উত্তরাধিকার লড়াই শুরু হয়েছিল, তবে চার যুবরাজের মধ্যকার সঙ্ঘাতের ভিত্তি আরো অনেক আগেই প্রস্তুত হয়েছিল।

আওরঙ্গজেব ১৬৫০-এর দশকের প্রথম দিকে দারা শুকোহর বিরোধিতার লক্ষ্যে শাহ সুজা ও মুরাদের সাথে গোপন মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিন ছোট ভাই জানতেন যে তাদের বাবা তার বড় ছেলেকেই পছন্দ করছেন এবং দারাও হয়তো একই সময় তার ভাইদের খুন করার নিজস্ব পরিকল্পনা প্রণয়ন করছিলেন। সেই ১৬৫২ সালের দিকেও সমসাময়িক একটি ফরাসি ভাষ্যে দারাকে ‘তার ভাইদের রক্ত পান করতে তৃষ্ণার্ত নেকড়ে’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। উত্তরাধিকার যুদ্ধ চলাকালে বলা হয়ে থাকে, শাহ জাহানের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়ে আওরঙ্গজেব আবারো দারার খুনে প্রবৃত্তির কথা বিশেষ করে আওরঙ্গজেবের নির্দোষ রক্ত নিতে তার ব্যগ্রতার কথা জানিয়েছিলেন। তবে সময়ের পরিক্রমায় দেখা যায়, ভ্রাতৃহত্যার কাজটি করেছিলেন আওরঙ্গজেবই ।

শাহ জাহানের অসুস্থতার সময় দিল্লির দরবারে উপস্থিতি ছিলেন একমাত্র দারা শুকোহ। তার ভাইয়েরা তখন সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো নিয়ন্ত্ৰণ করছিলেন। পূর্বে শাহ সুজা নিয়ন্ত্রণ করতেন বাংলা, পশ্চিমে মুরাদ পরিচালনা করতেন গুজরাত, আর দক্ষিণে আওরঙ্গজেব নিয়োজিত ছিলেন দাক্ষিণাত্যে। ভাইদের কাছে সংবাদপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টায় দারা চরদের আটকিয়ে ও রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। শাহ জাহানের অসুস্থতার খবর শুনেই তিন ছোট ভাই দারার ক্ষমতা গ্রহণ, তাদের খুন করার ষড়যন্ত্র ও তাদের বাবাকে বন্দী করা নিয়ে গুজব দিয়ে তাদের কান ভারী করে ফেললেন । চার মাত্রিক প্রতিযোগিতা দানা বেঁধে ওঠার প্রেক্ষাপটে সাম্রাজ্যের অভিজাতেরাও পক্ষাবলম্বন করেন। শাহ সুজা ও মুরাদ ছিলেন প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী, উভয়ের হাতে ছিল বিপুল সমর্থন। তবে মূল প্রতিযোগিতা হয়েছিল দারা ও আওরঙ্গজেবের মধ্যে। বেশির ভাগ মোগল অভিজাত এই দুজনের কোনো একজনকে সমর্থন করতেন। রাজপরিবারের নারীরাও মোগল উত্তরাধিকার লড়াইয়ে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন। শাহ জাহানের তিন মেয়ে তাদের প্রিয়জনকে সিংহাসনের বসানোর জন্য বাছাই করে নেন। বড় মেয়ে জাহানারা সমর্থন করতেন দারা শুকোহকে, মেজ মেয়ে রোশানারা সমর্থন করতেন আওরঙ্গজেবকে। আর সবার ছোট মেয়ে গৌহারারা ছিলেন মুরাদের পক্ষে। দারার বিরুদ্ধে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মুরাদের সাথে শিথিল মিত্রতায় আবদ্ধ হন আওরঙ্গজেব ।

বাবার মৃত্যু নিয়ে ভুল খবর বিশ্বাস করে ১৬৫৭ সালের ডিসেম্বরে মুরাদ নিজেকে বাদশাহ ঘোষণা করেন, গুজরাতে অভিষেক অনুষ্ঠানও আয়োজন করলেন। আওরঙ্গজেবের কাছে আগেভাগে মুরাদের নিজেকে সম্রাট ঘোষণার চেয়েও বেশি হুমকিপূর্ণ ছিল মোগল সাম্রাজ্যের অন্যতম সম্পদশালী রাজ্য গুজরাতে মুরাদের শক্তিশালী অবস্থান ও তার হাতে থাকা বিপুলসংখ্যক সৈন্য । ছোট ভাইকে মিষ্টি কথায় তুষ্ট করে গুজরাত থেকে বের করার জন্য আওরঙ্গজেব তাকে প্রতিশ্রুতি দেন (তিনি সম্ভবত এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার কোনো ইচ্ছা তিনি পোষণ করেননি) : আওরঙ্গজেব ওয়াদা করেন যে দারা শুকোহ ও শাহ সুজাকে পরাজিত করার পর তিনি মোগল সাম্রাজ্যের উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাংশ মুরাদের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেবেন। ইতিহাসবিদ ঈশ্বরদাস জানান যে আওরঙ্গজেব এমনকি তার ভাইকে একটি ফরাসি প্রবাদবাক্যের উদ্ধৃতিও দেন : দুই হৃদয় একসাথে হলে চিড়ে যায় পর্বত।’ এই কপটতায় কাজ হয়। গুজরাত থেকে বের হয়ে আসেন মুরাদ। আওরঙ্গজেবের বাহিনীর সাথে তার বাহিনী মিলে ১৬৫৮ সালের এপ্রিলে উজ্জায়িনির কাছে ধারমতে রাজকীয় বাহিনীকে পরাজিত করে। দুই ভাইয়ের পরবর্তী গন্তব্য ছিল দিল্লি। তখন তাদের লক্ষ্য মোগল সাম্রাজ্যের কেন্দ্র জয় করা।

আওরঙ্গজেব ও মুরাদের যৌথ বাহিনী ১৬৫৮ সালের মে মাসের এক প্রচণ্ড উত্তপ্ত দিনে আগ্রার ঠিক পূর্ব প্রান্তে দারা শুকোহর ৫০ হাজার সদস্যের শক্তিশালী বাহিনীর মুখোমুখি হয়। সামুগড়ের লড়াই (ছবি ১) হিসেবে বর্তমানে পরিচিত এই প্রচণ্ড সঙ্ঘাতই মোগল উত্তরাধিকার সঙ্কটের ফয়সালাসূচক মুহূর্ত বিবেচিত হয়। সংঘর্ষের আগের দিন আওরঙ্গজেব তার ও মুরাদের বাহিনীকে বিশ্রামে রাখেন। আর দারার সৈন্যরা ভারী যুদ্ধসাজে প্রচণ্ড রোদে তাদের শত্রুর বাহিনীর প্রতীক্ষায় থাকে। তাদের শক্তি ক্ষয় হয়, দারার সেনাবাহিনীর অনেকে গরমেই কাবু হয়ে পড়ে, তাদের শেষ করার জন্য শত্রুর আঘাতের প্রয়োজন পড়েনি ।

পরের দিন ভোরে শুরু হলো যুদ্ধ, উভয় পক্ষই গোলন্দাজ বাহিনী, অশ্বারোহী বাহিনী, তীরন্দাজ, যুদ্ধ হাতি বাহিনী ও পদাতিক বাহিনীতে সুসজ্জিত ছিল। আওরঙ্গজেব ও দারা উভয়ে নিজ নিজ হাতিতে সওয়ার হয়ে তাদের বাহিনীর শীর্ষে অবস্থান করছিলেন। তাদের বাহিনী প্রবল যুদ্ধ করছিল, আঠার শতকের এক ইতিহাসবিদের ভাষায় ‘যুদ্ধের তীব্র শব্দ ওই সন্ত্রাস-জর্জরিত ময়দানের ওপরে ওঠে গিয়েছিল।’ দিনের শেষভাগে আওরঙ্গজেবের সৈন্যরা দারা শুকোহকে বহনকারী যুদ্ধহাতিকে লক্ষ্য করে কামানের গোলা ও রকেট নিক্ষেপ করার মতো অবস্থানে অগ্রসর হয়ে পড়ে। জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কায় দারা হাতি থেকে নেমে ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যান। তিনি পেছনে রেখে যান একটি বিশৃঙ্খল ও মনোবল হারা বাহিনী। এই বাহিনী অল্প সময়ের মধ্যেই পর্যুদস্ত হয় ।

দারা শুকোহ আগ্রায় পালিয়ে যান, সেখানে লাল কিল্লায় শাহ জাহান আয়েসে অবস্থান করছিলেন। দারা এরপর দিল্লি হয়ে লাহোরে আত্মগোপন করেন। বড় ভাই যখন বন্দী হওয়া থেকে রক্ষা পেতে ছুটছেন, তখন আওরঙ্গজেব ও মুরাদ আগ্রার লাল কিল্লার দিকে অগ্রসর হন। শাহ জাহান তখন সুস্থ হয়ে ওঠলেও ছিলেন নামমাত্র সম্রাট।

শাহ জাহান চেষ্টা করেছিলেন আওরঙ্গজেবের সাথে সাক্ষাত করার। তিনি এমনকি ইউসুফ নবী ও ইয়াকুব নবীর কয়েক বছরের বিচ্ছেদের পর মিলন হওয়া নিয়ে পবিত্র কোরআনে থাকা ঘটনার উদ্ধৃতিও দেন। তিনি চাচ্ছিলেন ছেলেকে মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে তার সাথে সাক্ষাত করতে। প্রতারিত হওয়ার শঙ্কায় আওরঙ্গজেব তা প্রত্যাখ্যান করেন। এর বদলে ১৬৫৮ সালের জুনের শুরুতে তিনি ও মুরাদ আগ্রা দুর্গ অবরোধ করে এর পানি সরবরাহ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেন। শাহ জাহান ছিলেন দুর্গের ভেতরে। কয়েক দিন পর তিনি দুর্গের ফটক খুলে দিয়ে তার কোষাগার, অস্ত্রভাণ্ডার ও নিজেকে তার ছোট দুই ছেলের কাছে উন্মুক্ত করে দেন। বড় মেয়ে জাহানারাকে মধ্যস্ততাকারী হিসেবে ব্যবহার করে শেষ চাল হিসেবে শাহ জাহান সাম্রাজ্যকে পাঁচ ভাগে ভাগ করার একটি প্রস্তাবে রাজি করানোর চেষ্টা করেছিলেন আওরঙ্গজেবকে। তিনি তিন ভাইকে সাম্রাজ্যের তিন অংশ এবং আওরঙ্গজেবের বড় ছেলে মোহাম্মদ সুলতানকে (মৃত্যু ১৬৭৬) একটি অংশ প্রদান করার প্রস্তাব করেন। শাহ জাহানের অবশিষ্ট সমর্থকদের অনেকে দ্রুততার সাথে আওরঙ্গজেবের বিজয়কে মেনে নেন। এমনকি তাদের অবরোধ সম্পন্ন করার আগেই তারা তার প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেছিলেন ।

কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আওরঙ্গজেব ও মুরাদের মধ্যে টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়। মুরাদ তার সৈন্যদের বেতন বাড়িয়ে দেন, দ্রুত পদোন্নতির প্রতিশ্রুতি দেন, আনুগত্য বদল করার জন্য আওরঙ্গজেবের সৈন্যদের অনেককে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। বড় ভাইয়ের তাগিদ সত্ত্বেও দারা শুকোহর পিছু ধাওয়ার ব্যাপারে গড়িমশি করতে থাকেন মুরাদ। তিনি এমনকি আওরঙ্গজেবের সাথে বৈঠকও এড়িয়ে যান। আওরঙ্গজেব তখন সিদ্ধান্ত নেন যে মুরাদ তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছেন ।

আওরঙ্গজেব ১৬৫৮ সালের গ্রীস্মে ছোট ভাইকে তার সাথে ব্যক্তিগত সাক্ষাতে প্রলুব্ধ করতে অসুস্থতার ভান করেন। খাওয়া দাওয়ার পর মুরাদ বিশ্রাম নিতে রাজি হয়ে নিরস্ত্র হন। এই কাহিনীর পরবর্তীকালের সংস্করণগুলোতে বলা হয় যে মুরাদ মদ্য পান করেন (আর আওরঙ্গজেব সংযত ছিলেন) বা মর্দনকারীদের দক্ষ হাতের কারসাজিতে আয়েসের জগতে চলে যান, তরুণ যুবরাজের চিন্তাভাবনা বিনাশ করে দেওয়া ভোগে লিপ্ত হন, তাকে গভীরভাবে অবচেতন করে ফেলা হয়। প্রতিরক্ষাহীন হওয়া মাত্র আওরঙ্গজেবের সৈন্যরা মুরাদকে গ্রেফতার করে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে ফেলে। ছোট ভাইয়ের ২০ হাজার সদস্যের বাহিনীকে আত্মস্ত করে নিতে বিলম্ব করেননি আওরঙ্গজেব।

হিন্দুস্তানের সম্রাট

উৎসব যখন খোদ বেহেশতের মতো সজ্জিত হয়, তখন আকাশও তাদের আসন ছেড়ে নৃত্য করে ।

-–কাফি খানের উদ্ধৃতি। আওরঙ্গজেবের প্রথম অভিষেকের বর্ণনা এভাবেই দিয়েছেন আঠার শতকের এই ইতিহাসবিদ

মুরাদ কারারুদ্ধ, শাহ জাহান বন্দী, দারা পলাতক- এমন অবস্থায় প্রথম অভিষেক অনুষ্ঠান আয়োজন করতে যথেষ্ট বেশি সময়ই নিয়েছিলেন আওরঙ্গজেব। ১৬৫৮ সালের ৩১ জুলাই জ্যোতিষীদের কাছে শুভ বলে বিবেচিত দিনটিতে দিল্লির শালিমার গার্ডেন্সে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করে আলমগীর (বিশ্বজয়ী) রাজকীয় পদবি গ্রহণ করেন তিনি ।

আওরঙ্গজেব মোগল প্রথা অনুসরণ করে সঙ্গীতের আয়োজন করার নির্দেশ দেন, উপহার বণ্টন করেন। তবে নিজের নামে মুদ্রা প্রচলন ও জুমার নামাজে খুতবা প্রদানের রীতি অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকেন। স্বল্প পরিসরের অনুষ্ঠান হলেও এর মাধ্যমেই আওরঙ্গজেব যুগের সূচনা ঘটে। কয়েক বছর পর আঁকা প্রথম অভিষেক অনুষ্ঠানের ছবিতে একইসাথে সরলতা ও উদ্দীপনার সমাবেশ দৃষ্টিগোচর হয়। ছবিতে কালো দাড়িতে তরুণ আওরঙ্গজেব হাঁটু ভাজ করে রয়েছেন। রাজদরবার সফরকারী পরবর্তীকালের লোকজন তার উঁচু নাসিকা ও জলপাই রঙের যে ত্বকের বর্ণনা দিয়েছে, এই ছবিতে তাকে তেমনই দেখা যায়। ছবিতে তিনি সোজা হয়ে বসে ছিলেন, শেষ বয়সে তার কাঁধ ঝুঁকে পড়ার যেসব চিত্র দেখা যায়, তা এতে অনুপস্থিত। ছবিতে আর মাত্র দুটি মানুষ দৃশ্যমান। এতে অনুষ্ঠানটি যে সংক্ষিপ্ত ছিল, তার ইঙ্গিত মেলে। অখণ্ড মোগল সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধ, মানসম্পন্ন শাসনের উচ্চাশায় আঁকা ছবিতে বেহেশতি অনুমোদনের চিহ্ন হিসেবে উপরে কালো মেঘ ভেদ করে সদ্য মুকুট পরা সম্রাটের ওপর আলোর ঝরনাধারা নেমে আসতে দেখা যায় (ছবি-২)।

প্রাথমিক অভিষেকের পর আওরঙ্গজেব তার তখনো মুক্ত থাকা দুই ভাই দারা শুকোহ ও শাহ সুজাকে বাগে আনার কাজ শুরু করলেন ।

আওরঙ্গজেব কয়েক মাস ধরে দারাকে অনুসরণ করে গেলেন। তাকে তিনি প্রথমে লাহোরে শনাক্ত করেন, তারপর তাকে মুলতানে তাড়িয়ে নেন, পরে আরো দক্ষিণে সিন্ধু নদ পথে এগিয়ে চলেন। ধরা পড়া এড়ানোর জন্য দারা শুকোহ তার ক্রমশ ছোট হতে থাকা বাহিনীকে দুর্গম এলাকা দিয়ে পরিচালিত করেন, কখনো বিশুদ্ধ পানির ধারা এড়িয়ে জঙ্গল কেটে সফর করতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত তিনি গুজরাতে তার পথচলার সমাপ্তি টানেন, তত দিনে অনেক সমর্থকই তার সাথে ছিল না। ১৬৫৮ সালের সেপ্টেম্বরে দারাকে ধরার কাজটি তার অনুগত কর্মকর্তাদের হাতে ন্যস্ত করে আওরঙ্গজেব দিল্লির দিকে যাত্রা শুরু করেন শাহ সুজাকে সামাল দেওয়ার জন্য ।

শাহ সুজা আগের বছরটি অত্যন্ত ব্যস্ত কাটিয়েছিলেন। ১৬৫৭ সালে শাহ জাহানের অসুস্থতার খবর পেয়ে তিনি নিজেকে বাদশাহ ঘোষণা করে জাঁকজমকপূর্ণ আবুল ফৌজ (বিজয়ের পিতা) নাসরুদ্দিন (বিশ্বাসের রক্ষক) মোহাম্মদ তৃতীয় তৈমুর দ্বিতীয় আলেকজান্ডার শাহ সুজা বাহাদুর গাজি পদবি ধারণ করেন। তবে শাহ সুজার মোগল সাম্রাজ্য শাসন করার স্বপ্ন স্বল্পস্থায়ী হয়েছিল। ১৬৫৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে (ওই বছরের মে মাসে সামুগড়ের যুদ্ধের আগে, যেখানে আওরঙ্গজেব ও মুরাদের যৌথ বাহিনী দারা শুকোহর বাহিনীকে হারিয়েছিল) শাহ সুজা যুদ্ধে নামেন দারা শুকোহর বাহিনীর বিরুদ্ধে। বেনারাসের কাছে হওয়া ওই যুদ্ধে দারার বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন তার ছেলে সোলায়মান শুকোহ । যুদ্ধে শাহ সুজা শোচনীয়ভাবে পর্যুদস্ত হন । এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুদ্ধক্ষেত্রে এত রক্ত ঝড়েছিল যে ঘাসগুলো টিউলিপ ফুলের রঙ ধারণ করেছিল। ১৬৫৮ সালের মে মাসে সুজাকে এক চিঠি লিখে আওরঙ্গজেব জানালেন, তিনি যদি সম্রাট ঘোষণা থেকে সরে আসেন, তবে তার ওপর আওরঙ্গজেব সাম্রাজ্যের পূর্ব অংশের শাসনভার ন্যস্ত করবেন। সুজা প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেন।

আওরঙ্গজেব ও শাহ সুজা ১৬৫৯ সালের জানুয়ারিতে এলাহাবাদের উত্তর পশ্চিম দিকে খাজওয়ায় যুদ্ধে নামলেন। শেষ মুহূর্তে শাহ জাহানের সাবেক অনুগত রাজপুত যশোবন্ত সিং দল ত্যাগ করা সত্ত্বেও সুজার চেয়ে আওরঙ্গজেবের বাহিনী ছিল অনেক বড়, ২:১। কিন্তু তবুও তীব্র লড়াই হয়। জানা যায়, একপর্যায়ে আওরঙ্গজেব তার হাতির পাগুলো বেঁধে ফেলার হুকুম দেন প্রাণিটির পলায়ন রোধ করার জন্য। আওরঙ্গজেবের দৃঢ়তা তার লোকদের মনোবল চাঙ্গা করে, তারা সুজার বাহিনীকে পরাজিত করে। সুজা পালিয়ে যান। পরের দেড় বছর ধরে আওরঙ্গজেবের বাহিনী ক্রমাগত সুজাকে তাড়িয়ে বেড়াতে থাকে, শেষ পর্যন্ত তাকে ভারতবর্ষই ত্যাগ করতে বাধ্য করে। ১৬৬০ সালের মে মাসে শাহ সুজা তার পরিবার নিয়ে নৌপথে ঢাকা ছাড়েন। তারা বার্মায় যান। সেখানে তারা আরাকানের শাসকের হাতে মারা পড়েন। আরাকানের শাসক সম্ভবত আশঙ্কা করেছিলেন যে মোগল যুবরাজ অভ্যুত্থান করতে পারেন। তবে এসব ঘটনার সত্যতা ও সুজার মৃত্যু নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে।

এদিকে ভারতবর্ষে উত্তরাধিকার লড়াইয়ের শেষ বড় যুদ্ধটি হয় ১৬৫৯ সালের মার্চের তিন দিন। দারা ২০ হাজার লোকের একটি বাহিনী (এদের বেশির ভাগ গুজরাত থেকে সংগ্রহ করা) গঠন করে আজমিরের বাইরে পাহাড়ে পাহাড়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি আশা করেছিলেন, এই বন্ধুর এলাকা, পরিখা ও প্রতিরক্ষা প্রাচীর তার সৈন্য স্বল্পতা কাটাতে সহায়ক হবে। আওরঙ্গজেব গোলন্দাজ বাহিনী দিয়ে লড়াই শুরু করেন। দুদিন ধরে এই আক্রমণ শানানো হয়। ফলে পুরো এলাকা ঘন ধোয়ায় ঢেকে যায় ৷ আওরঙ্গজেবের দরবারি ইতিহাসবিদের ভাষায়, ‘বারুদের ধোয়া বজ্রসহ প্রবল মেঘের মতো যুদ্ধক্ষেত্র অন্ধকার করে ফেলে। এমনভাবে স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হলো, ভূমি জ্বলে ওঠল যে মনে হলো পরশ পাথরের শক্তি দেখছি আমরা।’ আওরঙ্গজেব তৃতীয় দিনে দারার একটি অংশের দিকে আক্রমণ কেন্দ্ৰীভূত করলেন। রাজকীয় বাহিনীর বেশির ভাগ অংশ সামনাসামনি যুদ্ধ করলেও একটি অংশ গোপনে পেছনে চলে গিয়েছিল। তারাই যুদ্ধকে আওরঙ্গজেবের অনুকূলে নিয়ে আসে। সেনাবাহিনীর পেছনে অবস্থান নিয়ে নিজের বাহিনীর কচুকাটা অবস্থা দেখে আবারো জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যান দারা ।

তিন মাস ধরে পালিয়ে বেড়ালেন দারা। তারপর ভুল করে মালিক জিওয়ান নামের এক আফগান গোত্রপতির আশ্রয় কামনা করলেন। কয়েক বছর আগে তিনি শাহ জাহানের কাছে করুণা ভিক্ষা করে এই লোকের জীবন রক্ষা করেছিলেন। কিন্তু ভাবাবেগে আক্রান্ত না হয়ে মালিক জিওয়ান দ্রুত দারাকে গ্রেফতার করে আওরঙ্গজেবের বন্দী হিসেবে তাকে দিল্লি পাঠিয়ে দেন ।

জীবন ও মৃত্যু

একজন সম্রাটকে কোমলতা ও কঠোরতার মাঝামাঝি অবস্থান গ্রহণ করতে হয় ৷
–আওরঙ্গজেব

আওরঙ্গজেব প্রথমবারের মতো নিজেকে মোগল সাম্রাজ্যের বাদশাহ হিসেবে ঘোষণা করার প্রায় এক বছর পর ১৬৫৯ সালের ১৫ জুন তার দ্বিতীয় অভিষেক অনুষ্ঠান উদযাপন করেন। এবার মোগল সম্পদের বিপুল জৌলুস প্রদর্শিত হয় । গায়কদের দল আওরঙ্গজেবের বিশালত্ব ঘোষণা করে, সঙ্গীতজ্ঞরা মনি-মানিক্য উপহার লাভ করেন, আর এত পরিমাণ কাপড় ব্যবহৃত হয় যে ‘সাত মহাদেশের বণিকেরা বিপুল পরিমাণে লাভবান হয়।’ এবার মুদ্রা প্রচলন করা হয়, আওরঙ্গজেব আলমগীরের (বিশ্বজয়ী সিংহাসন উজ্জ্বলকারী) নামে খুতবা পাঠ করা হয়।

এখন ৪০ বছর বয়স্ক আওরঙ্গজেব তার ক্ষমতা লাভের দুই বছরের দ্বন্দ্বের ফলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিরসন করতে নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। প্রথমে দারা শুকোহর বিষয়টি ফয়সালা করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ছিলেন সাবেক সম্ভাব্য উত্তরসূরী ও উত্তরসূরীর লড়াইয়ে আওরঙ্গজেবের সবচেয়ে প্রবল শত্রু ।

দারা শুকোহ ১৬৫৯ সালের গ্রীষ্মকালের শেষ দিকে বন্দী হিসেবে দিল্লি পৌঁছেন। আওরঙ্গজেব তাকে ও তার ১৪ বছর বয়স্ক ছেলে সিপহর শুকোহকে ছেঁড়া কাপড় পরিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরানোর নির্দেশ দেন। পরাজিত দু’জনকে খোলা, রোগাক্রান্ত হাতির পিঠে চড়ানো হয়। সেপ্টেম্বরের ঝলসানো রোদে এমন করুণ দৃশ্য দেখা কঠিন ছিল। তাদের পেছনে উপস্থিত ছিল এক সৈনিক। তারা যাতে পালানোর বেপরোয়া কোনো চেষ্টা না করেন, সেটা জানাতেই সে ছিল তৈরী। অবশ্য, মোগল প্রজারা আগেও এ ধরনের মর্যাদাহানিকর প্রদর্শনী দেখেছে। দারা বছর দেড়েক আগে শাহ সুজার পক্ষের কয়েকজনকে আগ্রায় অবমাননাকরভাবে ঘুরিয়ে ছিলেন। কিন্তু মোগল যুবরাজদের সাথে এমন অমর্যাদাপূর্ণ আচরণ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। ফ্রাসোয়াঁ বার্নিয়ার বলেছেন যে সমবেত লোকজন দারা শুকোহ ও তার কিশোর ছেলের প্রকাশ্য অবমাননার এই দৃশ্য দেখে গুটিয়ে গিয়ে ছিল ।

পরের দিন আওরঙ্গজেবের সরাসরি নির্দেশ দারা শুকোহর শিরোশ্ছেদ করা হয়। কোনো কোনো সূত্র উল্লেখ করেছে যে মৃত্যুদণ্ডাদেশের যৌক্তিকতা প্ৰতিপন্ন করতে দারার ইসলাম থেকে কথিত মুরতাদ হওয়ার কথা উল্লেখ করেছিলেন আওরঙ্গজেব। তবে অন্যরা কেবল মৃত্যুদণ্ডাদেশের কথাই উল্লেখ করেন। এর কয়েক বছর পর পূর্ববর্তী একটি খুনের বদলার অজুহাতে মুরাদকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এতে মনে হয়, যত ঠুনকো অজুহাতই হোক না কেন, ভাইদের হত্যা করার বিষয়টি যৌক্তিক করতে চেয়েছিলেন আওরঙ্গজেব। সম্ভবত ন্যায়বিচারভিত্তিক শাসন পরিচালনাকারী রাজার জন্য এ ধরনের ব্যাখ্যা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তবে দারার দুই ছেলের বড় জন তথা সোলায়মান শুকোহর জন্য কোনো যুক্তি দেওয়ার দরকার মনে করেননি আওরঙ্গজেব। ১৬৬১ সালে তার জন্য অতিরিক্ত মাত্রায় আফিম পানি দেওয়ার নির্দেশ দেন তিনি ।

আওরঙ্গজেবের খুনে পদক্ষেপগুলো আধুনিক পাঠকের কাছে সন্দেহাতীতভাবে কঠোর মনে হতে পারে। তবে তার ভাইয়েরাও ভিন্ন কোনো পদ্ধতি গ্রহণ করতেন না। মানুচি বিষয়টি ধরে রাখতে পেরেছিলেন। তিনি লিখেছেন, মৃত্যুর দিন দারা শুকোহকে আওরঙ্গজেব জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাদের ভূমিকা বিপরীত হলে তিনি কী করতেন? দেয়ালের লিখন দেখতে পেয়ে দারা বিদ্রূপ করে বলেছিলেন যে তিনি আওরঙ্গজেবের লাশ চার টুকরা করে দিল্লির চার প্রধান ফটকে ঝুলিয়ে রাখতেন। তুলনামূলকভাবে আওরঙ্গজেব সংযমের পরিচয়ই দিয়েছিলেন। তিনি দারা শুকোহর লাশ দিল্লির হুমায়ূনের সমাধিতে কবর দেওয়ার নির্দেশ দেন। দারা সেখানেই বিশ্রামে রয়েছেন।

কঠিন মোগল নজির অনুসরণ করার পর আওরঙ্গজেব করুণা প্রদর্শন করেন, এমনকি দারা শুকোহ ও অন্য ভাইদের বেশির ভাগ সাবেক সমর্থকের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করেন, এমনকি তাদের যোগ্যতার মূল্যায়নও করেন। তিনি প্রতিহিংসার পথ অবলম্বন না করে তার ভাইদের সৈন্য ও প্রধান উপদেষ্টাদের তার নিজের সেনাবাহিনী ও প্রশাসনে নিয়ে আসেন। ধনী গুজরাতি জৈন বণিক শান্তিদাসের কাছ থেকে মুরাদ যে ঋণ গ্রহণ করেছিলেন, তিনি তা পরিশোধ করেন। ১৬৭০ এর দশকে আওরঙ্গজেব এমনকি তার মেয়ে জুবেদাতুন্নিসাকে দারা শুকোহর ছোট ছেলে সিপিহর শুকোহর সাথে বিয়ে দেন এবং তার ছেলে যুবরাজ আকবরের সাথে সোলায়মান শুকোহর মেয়ের বিয়ে দেন। দারার মাত্র কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মীর প্রতি কোনো দয়া প্রদর্শন করা হয়নি। এদের একজন হলেন সারমাদ। আর্মেনিয়ান ইহুদি সন্ন্যাসী সারমাদ উদ্ভট আচরণের জন্য পরিচিত ছিলেন। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে দারা শুকোহই সিংহাসনে আসীন হবেন। আওরঙ্গজেব ১৬৬১ সালে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন।

দারা শুকোহর সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের ওপর আওরঙ্গজেব অনেক বেশি শানিত আক্রমণ চালিয়েছিলেন। ১৬৪৯-এর দশক ও ১৬৫০-এর দশকে শাহ জাহানের দরবারে অবস্থানকালে দারা শুকোহ ধর্ম, সাহিত্য ও আধ্যাত্মিক সাধনায় প্রচুর সময় ব্যয় করেছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণদের একটি দলকে ৫০টি উপনিষদ ফারসি ভাষায় অনুবাদ করার নির্দেশ দেন। এই অনুবাদ পরে ফ্রান্সে পাওয়া গিয়েছিল। এর মাধ্যমেই সংস্কৃত সাহিত্য সম্পর্কে অবগত হয়েছিল ইউরোপ। পাঞ্জাবি আধ্যাত্মিক নেতা বাবা লালের সাথে তার দার্শনিক কথোপকথন হয়েছিল। দারা ফারসিতে গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘দুই সাগরের মোহনা’ রচনা করেন। এতে তিনি দেখিয়েছেন যে হিন্দুধর্ম ও ইসলামধর্ম একই লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হয়েছে। গবেষণা গ্রন্থটি সমুদ্রসঙ্গম নামে সংস্কৃতে অনুবাদ হয়েছে ।

সাবেক সম্ভাব্য উত্তরসূরী হিসেবে স্বীকৃত ব্যক্তিটির হিন্দু দর্শনের, বিশেষ করে সংস্কৃত সাহিত্যের প্রতি প্রবল আগ্রহের কারণেই আওরঙ্গজেব এর সুস্পষ্ট বিরোধিতায় অবতীর্ণ হন। তিনি দারা শুকোহর আন্তঃসাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেন, বেনারসের ব্রাহ্মণ কবিন্দ্রচার্য সরস্বতীর রাজকীয় বৃত্তি বাতিল করে দিয়ে শাহ জাহান ও সংস্কৃত সাংস্কৃতিক বিশ্বের মধ্যকার দীর্ঘ দিনের সম্পর্কের ইতি ঘটান। বৃত্তি আবার চালুর জন্য চেষ্টা করেছিলেন কবিন্দ্রচার্য। কিন্তু সফল হতে পারেননি। এসবের মাধ্যমে বড় ভাইয়ের সাংস্কৃতিক অনুরাগ থেকে নিজেকে আলাদা করতে চেয়েছেন আওরঙ্গজেব।

শাহ জাহানের অস্পষ্ট উপস্থিতি যে প্রশ্ন সৃষ্টি করেছিল, সে তুলনায় দারা শুকোহ ও তার কীর্তি সামাল দেওয়া ছিল নিতান্তই তুচ্ছ বিষয়। আওরঙ্গজেব যখন সিংহাসনে বসেন, তত দিনে শাহ জাহান সুস্থ হয়ে গেছেন। মূলত, আওরঙ্গজেব তার বাবাকে আগ্রার লাল কেল্লায় বন্দী করে রেখেছিলেন। অনেকে মর্জিমতো ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে তাজমহল দেখানোর লোভ দেখিয়ে তাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে চাবি ফেলে দেওয়া হয়েছিল। পঞ্চম মোগল বাদশাহ তার জীবনের শেষ সাড়ে সাত বছর গৃহবন্দী অবস্থায় কাটিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে তাকে সঙ্গ দিতেন তার বড় মেয়ে জাহানারা। অনেকে শাহ জাহানকে সিংহাসনচ্যুত করা ও বন্দী করার তীব্র নিন্দা করে। তবে তার কারাবন্দী বাবার ট্রাজেডি তার শাসনের প্রথম দিকে তার জন্য জ্বালাতন সৃষ্টিকারী সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছিলেন ।

সিংহাসনের জন্য ভাইদের মধ্যে লড়াই মোগলদের মধ্যে গ্রহণযোগ্য রীতি হিসেবে বিদ্যমান থাকলেও ক্ষমতাসীন বাবাকে ক্ষমতাচ্যুত করা খারাপ কাজ বিবেচিত হতো । প্রধান কাজি (মুসলিম বিচারপতি) বিষয়টিকে এত কঠোরভাবে নিয়েছিলেন যে তিনি রাজকীয় ক্রোধের ঝুঁকি নিয়েই শাহ জাহানের জীবিতকালে আওরঙ্গজেবের সিংহাসন আরোহণকে অনুমোদন করতে অস্বীকৃতি জানান। আওরঙ্গজেব তাকে বরখাস্ত করে ওই পদে আরো নমনীয় আবদুল ওয়াহাবকে নিযুক্ত করেন ।

ভারতবর্ষের বাইরেও শাহ জাহানের প্রতি আওরঙ্গজেবের নৃশংসতা নানা জটিলতার সৃষ্টি করে। মক্কার শরিফ আওরঙ্গজেবকে হিন্দুস্তানের যথার্থ শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানান, এমনকি তিনি শাহ জাহানের প্রতি অসদাচরণ করার কারণে কয়েক বছর পর্যন্ত আওরঙ্গজেবের আর্থিক উপহার গ্রহণ করেননি। আওরঙ্গজেবের রাজকীয় পদবি ‘আলমগীর’ (বিশ্বজয়ী) নিয়ে বিদ্রূপ করে সাফাভি রাজা শাহ সোলায়মান (শাসনকাল ১৬৬৬-৯৪) এক তিক্ত পত্র লিখেন। নিজেকে ভুলভাবে বিশ্বজয়ী (আলম-গিরি) হিসেবে অভিহিত করার জন্য আওরঙ্গজেবের সমালোচনা করে শাহ সোলায়মান বলেন, তিনি তো কেবল তার বাবাকে জয় (পিদর-গিরি) করেছেন। আওরঙ্গজেব তার ন্যায়বিচারের অবস্থান প্রতিপন্ন করার জন্য সিংহাসনে আরোহণের সময় অনেক ধরনের কর (কয়েকটি সূত্র মোট ৮০টির কথা জানিয়েছে) মওকুফ করে দিয়েছিলেন। তবে আওরঙ্গজেব তার বাবাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন বলে যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়, তার জবাবে তিনি যা বলেছিলেন তা ছিল ডাহা অসত্য ঘোষণা। তিনি সাফাভি রাজা শাহ সোলায়মানকে (ভুলভাবে) জানিয়েছিলেন যে শাহ জাহান স্বেচ্ছায় অবসরগ্রহণ করে আওরঙ্গজেবকে মুকুট প্রদান করেছেন ।

পিতার সাথে অন্যায় আচরণের বিষয়টি কোনোভাবেই সামাল দিতে পারেননি আওরঙ্গজেব। এই ঝঞ্ঝাটময় সূচনা তার পুরো শাসনকালে সমস্যা সৃষ্টি করে গেছে, এমনকি তার ধর্মানুরাগেও প্রভাব ফেলেছে বলে আমরা দেখতে পাব। প্রথম দিকের এই ঘটনাও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আওরঙ্গজেবের প্রতিশ্রুতিকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে, অবশ্য তা উচ্চাকাঙ্ক্ষায় সীমিত হয়ে পড়েছে। দীর্ঘ শাসনকালে আওরঙ্গজেব তার নীতি ও তার রাজনীতির মধ্যে নানা সঙ্ঘাতময় অবস্থার মুখে পড়েছেন, খুব কমই নীতি জয়ী হয়েছে।

সূচনায় আওরঙ্গজেবের ঝামেলায় ও সমস্যায় থাকলেও ১৭০৭ সালে মৃত্যু পর্যন্ত ৪৯ বছর মোগল সাম্রাজ্য শাসন করেছেন। তিনি প্রায়ই বিদ্রোহের মুখে পড়েছেন। তবে এমন অবস্থায় সব মোগল শাসকই পড়েছিলেন। তিনি ছিলেন ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম বাদশাহ ।

৩. আওরঙ্গজেব শাসনকালের মহা পথ-পরিক্রমা

সম্প্রসারণ ও ন্যায়বিচার

আমি আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে শ্রেষ্ঠ বিজয়ীরা সবসময় শ্রেষ্ঠ রাজা হন না। দুনিয়ার জাতিগুলো প্রায়ই স্রেফ অসভ্য বর্বরদের অধীনস্ত হয়, সবচেয়ে বিপুল বিজয়ও মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ভেঙে খান খান হয়ে যায়। সে-ই সত্যিকারের রাজা, যার জীবনের প্রধান কাজ হয় সাম্যের সাথে তার প্রজাদের শাসন করা ।
-–আওরঙ্গজেব, সদ্য সিংহাসনচ্যুত শাহ জাহানকে লেখা পত্ৰ

আওরঙ্গজেব একটি সম্পদশালী, সমৃদ্ধশীল ও সম্প্রসারণমুখী সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। তার বাবা শাহ জাহানের আমলে মোগল রাষ্ট্রের রাজস্ব বেড়েছিল। শাহ জাহান খ্যাতিমান ছিলেন নির্মাণ প্রকল্পের জন্যও। তিনি আগ্রার তাজ মহল ও দিল্লিতে শাহজাহানাবাদ নির্মাণে অর্থের ব্যবস্থা করেছিলেন । আর আওরঙ্গজেবের কৃতিত্ব ছিল রাজকীয় সীমান্ত সম্প্রসারণে ।

শাসনকালজুড়ে আওরঙ্গজেব একের পর এক বিদ্রোহ দমন করেছেন, ঠাণ্ডা মাথায় সম্প্রসারণ যুদ্ধ করেছেন, নির্দয় অবরোধ তদারকি করেছেন। তিনি বিশেষ করে তার রাজত্বের প্রথম ভাগে (১৬৫৮-৮১) মোগল সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ ও সুসংহতকরণে কূটনীতির প্রয়োগ করে প্রায়ই খুশি থাকতেন। তবে মোগল এলাকা আরো বড় করতে শক্তিপ্রয়োগ করতে দ্বিধা করেননি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৬০-এর দশকে মোগল রাজ্যের প্রতি মারাঠা হুমকি দমন করার জন্য মারাঠা নেতা শিবাজিকে রাজকীয় চাকরিতে যোগদান করতে প্রলুব্ধ করেছিলেন। ওই প্রয়াস ব্যর্থ হওয়ার পর আওরঙ্গজেব সহিংস হয়ে ওঠেন, বাকি জীবন মারাঠাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। এতে তিনি সীমিত সফলতা পেয়েছিলেন। মোগল কব্জা থেকে যারা শিবাজিকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল বলে তার মনে হয়েছিল, তাদেরকেও তিনি শাস্তি দিয়েছেন, বেনারাস ও মথুরার মন্দির ধ্বংস করেছেন ।

আওরঙ্গজেব তার শাসনকালের প্রথমার্ধে মোগল সাম্রাজ্যের অখণ্ডতার প্রতি আরো অনেক সশস্ত্র হুমকির মুখোমুখি হয়েছিলেন। তিনি এসবের প্রতি সামান্যই কোমলতা প্রদর্শন করেছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মোগল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেওয়ার জন্য ১৬৭৫ সালে তিনি শিখ গুরু তেগ বাহাদুরের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। রাঠোর ও সিসোদিয়া রাজপুতেরা ১৬৭০-এর দশকের শেষ দিকে বিদ্রোহ করেছিল। আওরঙ্গজেব উভয় গ্রুপকে দমন করে রাজকীয় পতাকাতলে আনার জন্য সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সাথে আপসকারী পরিবার সদস্যদের বিরুদ্ধেও আওরঙ্গজেব কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আওরঙ্গজেবের ছেলে যুবরাজ আকবর ১৬৮১ সালে বিদ্রোহ করলে তাকে ধাওয়া করা হয়। বাবার ক্রোধ থেকে রক্ষা পেতে তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই ইরানে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। সেখানেই তিনি ১৭০৪ সালে মারা যান ।

আওরঙ্গজেব ১৬৮১ সালে তার পুরো রাজদরবার নিয়ে দক্ষিণ দিকে রওনা হন। এটি ছিল নজিরবিহীন পদক্ষেপ। তার লক্ষ্য ছিল দাক্ষিণাত্যকে রাজকীয় কর্তৃত্বের আওতায় নিয়ে আসা। আকবরের আমল থেকেই দাক্ষিণাত্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে যাচ্ছিল মোগলেরা। কোনো কোনো সম্রাট দক্ষিণ দিকে আক্রমণ চালিয়েছিলেন, কিন্তু আওরঙ্গজেব প্রথম সম্রাট হিসেবে দাক্ষিণাত্যের বেশির ভাগ অংশে মোগল শক্তি সম্প্রসারণ করেন।

আওরঙ্গজেব তার শাসনকালের দ্বিতীয়ার্ধ (১৬৮১-১৭০৭) দক্ষিণ ভারতে ব্যয় করে মোগল সাম্রাজ্যকে সর্বোচ্চ সীমায় সম্প্রসারিত করেন। তিনি ১৬৮০ এর দশকে বিজাপুর ও গোলকোন্ডা অবরোধ করেন, উভয় সালতানাতকে তার অধীনে আনার ব্যবস্থা করেন। ১৬৯০ ও ১৭০০-এর দশকে তিনি মারাঠাদের বজ্রমুষ্টি থেকে তামিল নাড়ু ও দক্ষিণে অনেক পাহাড়ি দুর্গ দখল করেন। অবশ্য এসব কাজে তিনি প্রবল প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে থাকেন। ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেব যখন মারা যান, তত দিনে মোগল সাম্রাজ্যের জনসংখ্যা সমসাময়িক ইউরোপের দ্বিগুণ হয়ে গেছে, মোগল ভৌগোলিক এলাকা সর্বকালের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেছে ।

যুদ্ধ ও শক্তির প্রতি সংকল্পবদ্ধ থাকার দিক থেকে আওরঙ্গজেব তার পূর্বপুরুষদের চেয়ে সামান্যই ভিন্ন ছিলেন। তবে তিনি ব্যাপক আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন, উল্লেখযোগ্য সফলতা প্রদর্শন করেছিলেন। ঐক্যবদ্ধ মোগল সাম্রাজ্য সমুন্নত রাখার গুরুভার ও সম্ভব হলে এর সীমান্তগুলো সম্প্রসারণ করার দায়িত্ব আওরঙ্গজেবের কাঁধের ওপর ভারী বোঝা চাপিয়ে তার মধ্যে আগ্রাসী সামরিক উদ্যোগ গ্রহণের মানসিকতা গড়ে তুলেছিলেন। তবে মোগল সিংহাসনে বসার মধ্যে কেবল রক্তপাত ঘটানো ও মানচিত্র ক্রমাগত বড় করার চেয়েও বেশি কিছু সম্পৃক্ত ছিল। আওরঙ্গজেবের মধ্যে জাগতিক শক্তির জন্য তার আকাঙ্ক্ষার সাথে ছিল ন্যায়বিচার (আদল) নিশ্চিত করার ধারণা ।

অনেক সময় আওরঙ্গজেব নিজেকে ভূখণ্ডগত নিয়ন্ত্রণকারীর মতো নয়, বরং তাদের চেয়ে ঊর্ধ্বে থাকা পক্ষপাতহীন, নৈতিক শাসক দাবি করতেন। সম্প্রসারণবাদী একটি রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে এ ধরনের দাবি বিস্ময়করই। একবার দাক্ষিণাত্য ও বাঙলায় অকার্যকরভাবে সৈন্য মোতায়েনের জন্য সদ্য সম্রাট হওয়া আওরঙ্গজেবের সমালোচনা করেছিলেন শাহ জাহান। এর জবাবে আওরঙ্গজেব বলেছিলেন যে দক্ষ বিজয়ীরা সবসময় দক্ষ শাসক হয় না। দক্ষ শাসকেরা প্রধানত ন্যায়পরায়ণ শাসনের দিকেই নজর দেন ।

সমসাময়িক অনেক দলিল-দস্তাবেজে ন্যায়বিচারের প্রতি আওরঙ্গজেবের ঘোষিত ভক্তির জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায়। উদাহরণ হিসেবে ইতালির পর্যটক নিকোলাও মানুচির কথা বলা যেতে পারে। তিনি কোনোভাবেই আওরঙ্গজেবের প্রতি ইতিবাচক ছিলেন না। সেই তিনিও বাদশাহ সম্পর্কে বলেছেন : ‘তিনি বিষণ্ন মেজাজের, সবসময় কোনো না কোনো কাজে নিয়োজিত থাকেন, ন্যায়বিচার করতে আগ্রহী থাকেন, সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে চান।’ হিন্দু জ্যোতিষী ঈশ্বরদাস ১৬৬৩ সালে সংস্কৃত ভাষায় আওরঙ্গজেব সম্পর্কে লিখেছেন। তিনি বাদশাহকে ধর্মপরায়ণ (ধর্মায়া) হিসেবে অভিহিত করে এমনকি উল্লেখ করেছেন যে তার করনীতি ন্যায়সঙ্গত (বিধিত)।

সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে আওরঙ্গজেবের সামগ্রিক মূল্যবোধ ছিল ন্যায়বিচার নিয়ে তার বদ্ধমূল ধারণার ওপর নির্ভরশীল, যদিও চাতুর্যপূর্ণ রাজনীতি ও ক্ষমতার অতৃপ্ত তৃষ্ণা নিবারণের জন্য বেশ বড় মাত্রার কৌশল তাতে জড়িয়ে ছিল। এ কারণে আমরা যদি আওরঙ্গজেবের জীবন ও শাসন সম্পর্কে কোনো কিছু (হিন্দুস্থানের বাদশাহ হওয়ার জন্য তার ভাইদের পদদলিত করা, হিন্দু মন্দিরের প্রতি তার আচরণ ও সুফি মাজারে তার সমাধি হওয়া নিয়ে তার ধারণা) বুঝতে চাই তবে আমাদেরকে অবশ্যই একজন কার্যকর, সাম্যবাদী নেতার অর্থ তিনি কী চিন্তা করেছিলেন, তা পুনঃনির্মাণ করতে হবে। এ দিক থেকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ওই ব্যাপারগুলোর ওপর আলোকপাত করা, যেখানে আওরঙ্গজেব মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচারবিষয়ক তার নিজের আদর্শের বিরুদ্ধেই গেছেন। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে বিবেচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে তার বাবাকে উৎখাত করা ও দাক্ষিণাত্যের মুসলিম রাজ্যগুলোর বিরুদ্ধে নৃশংস যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া। বাস্তব রাজনীতিতে তাড়িত হয়ে গৃহীত পদক্ষেপগুলো নিয়ে আওরঙ্গজেব প্রায়ই ঝামেলায় পড়ে যেতেন। তার অস্বস্তি ন্যায়পরায়ণ শাসনের প্রতি তার প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে গভীরতা ও সীমারেখা উভয়ের ইঙ্গিতই দেয়।

মহান মোগল ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী

হিন্দুস্তান অঞ্চলে রুটির এই সামান্য টুকরাটি [তথা মোগল সাম্রাজ্য] হলো মহামান্বিত তৈমুর ও আকবরের উদার উপহার ।
-–আওরঙ্গজেব, নাতি বিদার বখতকে লেখা চিঠিতে

একটি সাম্রাজ্যের পাশাপাশি আওরঙ্গজেব এমন একটি বর্ণাঢ্য মোগল অতীতের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন যাতে ছিল সমৃদ্ধ অনুকরণীয় আদর্শ ও ভয়ানক দায়িত্ববোধ। একজন মহান রাজা কিভাবে হওয়া যায়, তার উদাহরণ দিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ রাজকীয় পূর্বপুরুষদের নাম উল্লেখ করেছেন তার লেখালেখিতে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, জীবনের শেষ দিকে লেখা এক চিঠিতে আওরঙ্গজেব তার নাতিদেরকে উপদেশ দিয়েছিলেন যে মোগল সাম্রাজ্য হলো তৈমুর ও আকবরের উপহার, পরবর্তী প্রজন্মগুলোর দায়িত্ব হলো এর সামগ্রিক গৌরব সমুন্নত রাখা ।

পূর্বসূরীদের মাধ্যমে আওরঙ্গজেব একটি বিশাল, নানা মাত্রিক সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। কয়েক দশক ধরে মোগল বাদশাহরা চমকপ্রদ ভবনরাজি নির্মাণ করেছিলেন, কবি-পণ্ডিতদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, পাণ্ডুলিপির জন্য বিশাল বিশাল পাঠাগার তৈরী করেছেন, চিত্রকর ও শিল্পীদের সহায়তা করেছেন। এসব শিল্প, বুদ্ধিবৃত্তিক ও স্থাপত্য ধারার অনেকগুলোকে স্থায়িত্ব দিয়েছেন আওরঙ্গজেব, আবার কোনো কোনোটিকে বাতিল করেছেন, পরিমার্জিত করেছেন। তিনি কখনো তার মোগল উত্তরাধিকারকে লঙ্ঘন করেননি, তবে তার নিজস্ব স্বতন্ত্র সৃষ্টিতে পরিশীলিত করেছেন ।

শুরুতে শাহ জাহান ও অন্যান্য মোগল সম্রাটের অনুসরণ করা সাংস্কৃতিক ও দরবারি কার্যক্রম কঠোরভাবে অনুসরণ করেছিলেন আওরঙ্গজেব ।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাদশাহ হিসেবে প্রথম কয়েক বছর সময়কালের মধ্যে আওরঙ্গজেব তার প্রথম স্ত্রী দিলরাস বানু বেগমের জন্য আওরঙ্গবাদে একটি স্মারক সমাধি নির্মাণ করেন। তার এই স্ত্রী ১৬৫৭ সালে পঞ্চম সন্তান জন্মদানকালে প্রসবজনিত জটিলতায় পরলোকগমন করেছিলেন। উজ্জ্বল শ্বেতশুভ্র এ সমাধি ক্ষেত্রটি বিবি কা মাকরাবা (রানির সমাধি) নামে পরিচিত। এটি ছিল শাহ জাহানের তাজ মহলের দৃশ্যমান অনুকরণ। অবশ্য আকারে ছিল অর্ধেক এবং বাইরের দিকে মার্বেল পাথর না দিয়ে প্রলেপ দিয়ে অলঙ্কৃত করা হয়েছিল। বর্তমানে এর নাম গরিবের তাজ। আওরঙ্গজেব এখানে স্বীকৃত মানসম্পন্ন মোগল সমাধি দিয়ে স্ত্রীকে সম্মানিত করার স্বপ্নাবিভাবের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি।

আওরঙ্গজেব তার প্রথম ১০ বছরের শাসনকালে হিন্দু রীতিনীতি থেকে উদ্ভূত অনেক মোগল রাজকীয় প্রথা বহাল রেখেছিলেন। তার রাজকীয় চেহারার দর্শন তথা শুভ দৃষ্টিপাত দিতে তিনি প্রতিদিন সকালে ঝরোকা প্রাসাদের জানালায় দৃশ্যমান হতেন। চান্দ্র ও সৌর জন্মদিনে তিনি প্রকাশ্যে সোনা ও রুপা দিয়ে ওজন করিয়ে তা গরিবদের মধ্যে বিতরণ করে দিতেন। আকবরের আমল থেকে এ হিন্দু প্রথাটি মোগলরা অনুসরণ করত ৷

হিন্দু ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন আওরঙ্গজেব। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তিনি ১৬৬১ সালে মহান্ত আনন্দ নাথকে একটি চিঠি লিখে যোগ শাস্ত্রানুসারে তাকে একটি ওষুধ লিখে দিতে বলেছিলেন। ১৬৬০-এর দশকে তিনি পাঞ্জাবে একটি গ্রামে আনন্দ নাথের ভূসম্পত্তি বাড়িয়ে দেন। এ ধরনের যোগাযোগ জাহাঙ্গীরের হিন্দু যোগী যদরূপের সাথে বৈঠক ও আকবরের মথুরার বৈষ্ণব সম্প্রদায়কে ভূমিদানের মতোই ।

কয়েক বছর পর্যন্ত আওরঙ্গজেবের বিনোদনমূলক কার্যক্রম তার পূর্বপুরুষদের মতোই ছিল। মোগল সম্রাটদের প্রিয় অবকাশকেন্দ্র কাশ্মিরে তিনি গ্রীস্মকালটি কাটাতেন, সঙ্গীত উপভোগ করতেন। ওই আমলের স্বল্প-উদ্ধৃত তবে গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসবিদ বখওয়ার খানের ভাষ্যানুযায়ী, বাদশাহ সঙ্গীত কলার ওপর বিশেষজ্ঞ জ্ঞান রাখতেন। ফকিরুল্লাহর ১৬৬৬ সালের সঙ্গীত গবেষণা গ্রন্থ রাগ দর্পণে আওরঙ্গজেবের প্রিয় শিল্পী ও বাদ্যকারদের তালিকা দেওয়া হয়েছে।

শাসনকালের দ্বিতীয় দশকে আওরঙ্গজেব তার রাজকীয় আচরণ বদলাতে শুরু করেন। হিন্দু উৎস থেকে আসা অনেক রাজকীয় প্রথা তিনি বাতিল করেন, সঙ্গীতের মতো কিছু কিছু ব্যবস্থার ওপর থেকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করে নেন। তিনি সরকারি দরবারি ইতিহাসবিদের পদটিই বিলুপ্ত করে দেন। আওরঙ্গজেবের দরবারের কঠোরতর নীতিপরায়ণ পরিবেশের কারণেই এমনটা হয়েছিল। তবে মোগল সাম্রাজ্যের অন্যান্য স্থানে এসব পরিবর্তন সামান্যই অনুভূত হয়েছিল ।

আওরঙ্গজেব ১৬৬৮ সাল পর্যন্ত দরবারি ইতিহাসলেখক মোহাম্মদ কাজিমকে পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন। মোগল পাঠাগার ও সরকারি নথিপত্রে প্রবেশগম্যতা ভোগ করতেন কাজিম। মোগল সম্রাটেরা সবসময় দরবারি ইতিহাসবিদ নিয়োগ করেননি। বাবর ও জাহাঙ্গীর নিজেরাই তাদের স্মৃতিকথা লিখেছেন, হুমায়ূনের রাজত্ব সম্পর্কে বেশির ভাগ ইতিহাস লেখা হয়েছে তার মৃত্যুর পর। তবে আকবর ও শাহ জাহান সাধারণ নিয়ম হিসেবে বেতনভোগী ইতিহাসবিদ নিয়োগ করেছিলেন। পূর্ববর্তী মোগল সম্রাটদের মধ্যে এ দুজনই ছিলেন তর্কসাপেক্ষে আওরঙ্গজেবের কাছে প্রধান দুই দৃষ্টান্ত । মোহাম্মদ কাজিমের আলমগিরনামা (আওরঙ্গজেব আলমগিরের ইতিহাস) হাতে পাওয়ার পর এই রীতি থেকে বের হয়ে আসেন আওরঙ্গজেব। এ গ্রন্থটি আওরঙ্গজেবের প্রথম ১০ বছরের ইতিহাস। এরপর কাজিমকে অন্য দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়।

দরবারি ইতিহাসলেখকের প্রতি কেন বিরূপ হয়েছিলেন আওরঙ্গজেব তা এখনো অস্পষ্ট রয়ে গেছে। তার হঠাৎ করে সরকারি ইতিহাসের প্রতি বিরূপ হওয়ার কারণ নির্ণয়ে অনেক গবেষক প্রয়াস চালিয়েছেন। তারা নানা কারণ অনুমান করেছেন। এসবের মধ্যে রয়েছে বাদশাহর অতিমাত্রায় ধার্মিক হয়ে পড়ার ফলে ধর্মতত্ত্ব ছাড়া অন্য সব বইয়ের প্রতি বিতৃষ্ণ হওয়া, রাজকোষাগার খালি হয়ে যাওয়া। রাজদরবারে এর পরবর্তী সময়ের ঘটনাপ্রবাহের দিকে নজর দেওয়া হলে এসব যুক্তি টেকে না। ঘটনা যা-ই হোক না কেন, আওরঙ্গজেব আর কোনো ইতিহাসবিদকে নিয়োগ করেননি, তবে তিনি ইতিহাস লেখার ওপর নিষেধাজ্ঞাও জারি করেননি। যদিও পরবর্তীকালের ইতিহাস লেখকদের ভ্রান্ত পাঠের কারণে ২০ শতকের অনেক ইতিহাসবিদ আওরঙ্গজেব নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। অনেক মোগল কর্মকর্তা আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর সময়ে বা এর সামান্য পরপরই ফারসি ভাষায় ইতিহাস লিখেছেন। এগুলো আজও আমাদের কাছে রয়েছে।

আওরঙ্গজেব ১৬৬০-এর দশকে অনেক দরবারি সৌজন্যবিধিতে পরিবর্তন করেছেন। ১৬৬৯ সালে তিনি দৈনন্দিন দর্শনে হাজির হওয়ার প্রথা বাতিল করেন । প্রায় একই সময়ে তিনি সোনা ও রুপা দিয়ে জন্মদিনে ওজন করার প্রথা রদ করেন বলে জানা যায়। তিনি দরবারের অনেক অনুষ্ঠান থেকে সঙ্গীতজ্ঞদের সরিয়ে নেন, তাদেরকে অন্য দায়িত্বে নিয়োজিত করেন। মজার ব্যাপার হলো, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের বেতন বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

এসব পরিবর্তনের অনেকগুলো হয়তো সাধারণ রাষ্ট্রনায়কোচিত জ্ঞান থেকে করা হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে ঝারোকা জানালায় প্রতিদিন আবির্ভূত হওয়ার কথা বলা যায়। অনাকাঙ্ক্ষিত রাজকীয় উত্তেজনা এড়াতেই এই প্রথা থেকে সরে আসেন আওরঙ্গজেব। ১৬৫৭ সালে শাহ জাহান অসুস্থ হয়ে পড়লে তার অসুস্থতার খবর চাপা দিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি, কারণ তিনি ঝারোকায় হঠাৎ করেই অনুপস্থিত হয়ে পড়েছিলেন । শাহ জাহান বিছানায় ছিলেন মাত্র ১০ দিন। কিন্তু এই সময়ের মধ্যেই মোগল রাজপুত্রদের মধ্যে সঙ্ঘাতের চাকা ঘুরতে শুরু করে দিয়েছিল ।

অবশ্য আওরঙ্গজেব তার শাসনকালের ১০ বছর পূর্তির সময়কালের দিকে যেসব পরিবর্তন করেছিলেন, সবই বিচক্ষণ ছিল, তা বলা যায় না। উদাহরণ হিসেবে সঙ্গীতের কথা বলা যেতে পারে। এটা সম্ভবত করা হয়েছিল ব্যক্তিগত কারণে। তিনি এ থেকে হয়তো বাস্তব উপকার পাচ্ছিলেন না, এবং ব্যক্তিগত রুচির বিষয়টিও এতে ছিল। মূল্যবান ধাতু দিয়ে ওজন করানোর প্রথার ব্যাপারেও একই ধরনের মনোভাব পোষণ করে থাকতে পারেন। অবশ্য শেষ জীবনে তিনি এ ব্যাপারে তার মন পরিবর্তন করেছিলেন। আওরঙ্গজেব তার নাতি বিদার বখতের জন্য ওজন পরিমাপ প্রথা অনুসরণের সুপারিশ করেছিলেন, সম্ভবত নিজের জন্যও তা শুরু করেছিলেন। এ ব্যাপারে ১৬৯০ সালে ইউরোপিয়ান পর্যটক জন অভিঙ্গটনের একটি প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। আওরঙ্গজেবের মধ্যে সঙ্গীতের প্রতি তার প্রথম বয়সের উদ্দীপনা আর ফিরে না এলেও শেষ জীবনে তিনি কিন্তু এটিকে যথার্থ রাজকীয় প্রথা বলে অভিহিত করে তার ছেলেকে উপভোগ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তারপরও ১৬৬৯ সালের দিকে আওরঙ্গজেব হিন্দু মূল থেকে প্রাপ্ত অনেক প্রথাসহ মোগল সংস্কৃতির সুপরিচিত অনেক অনুষ্ঠান রাজদরবার থেকে উঠিয়ে দেওয়ায় এর সামগ্রিক পরিবর্তনের নিট প্রভাব অস্বীকার করা যায় না ।

দ্বিতীয়ত, এবং সম্ভবত অভাবিত বিষয় হলো এই যে আওরঙ্গজেবের নতুন নীতির ফলে প্রতিভাধর ব্যক্তিরা তার ছেলে ও মোগল অভিজাতদের দরবারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আওরঙ্গজেব নিজে সঙ্গীত থেকে বিরত থাকলেও তার কয়েকজন ছেলে উৎসাহভরে সঙ্গীতজ্ঞ ও সঙ্গীত শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ক্যাথেরিন স্কফিল্ড উল্লেখ করেছেন যে আওরঙ্গজেবের আমলে সঙ্গীতের ওপর এত বেশি ইন্দো-ফারসি আকর গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল, যা পূর্ববর্তী ৫০০ বছরের ভারতবর্ষের ইতিহাসেও হয়নি। চিত্রকলার ব্যাপারেও একই কথা বলা যেতে পারে। সমসাময়িক প্রমাণে দেখা যায়, ১৬৬০-এর দশকের পর আওরঙ্গজেব চিত্রশিল্পীদের নিয়মিত তহবিল প্রদান করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সম্রাটের বৃদ্ধ বয়সের অনেক ছবি এখনো টিকে আছে। বর্ষীয়ান আওরঙ্গজেবের ছবিগুলো খুব সম্ভবত যুবরাজদের দরবার থেকে এসেছে। এসব দরবারে চিত্রকলা শিল্প বিকশিত হচ্ছিল। এই আমলে ফারসি কবিতাও সমৃদ্ধ হয়েছিল। আর আওরঙ্গজেবের নিজের মেয়ে জেবুন্নিসা ছিলেন প্রখ্যাত কবি। তিনি মাখফি (আড়ালে থাকা ব্যক্তি) ছদ্মনামে লিখতেন ।

সংস্কৃত পণ্ডিতদের দিক থেকে আওরঙ্গজেবের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ফলেও প্রতিভাগুলো উপ-রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকদের কাছে ছড়িয়ে পড়ে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৫০-এর দশকের শেষ দিকে আওরঙ্গজেবের নির্দেশে বৃত্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার পর কবিন্দ্রাচার্য মোগল অভিজাত দানিশমন্দ খানের দরবারে নিয়োগ লাভ করেন। পরে তিনি ফরাসি পর্যটক ফ্রাসোয়াঁ বার্নিয়ারকে সহায়তা করেছিলেন। আওরঙ্গজেবের মামা শায়েস্তা খান সংস্কৃত বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃত-সম্পর্কিত প্রকল্পগুলোর উল্লেখযোগ্য পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বাঙলার গভর্নরের দায়িত্ব পালনকালে তিনি আকবরের আমলে অনূদিত মহাভারতের ফরাসি পাণ্ডুলিপির সূচিপত্র তৈরী করার নির্দেশ দেন বসন্ত রাইকে। শায়েস্তা খান নিজে সংস্কৃত কবিতা রচনা করেছিলেন। তার কবিতাগুলো রসকল্পক্রমে সংরক্ষিত রয়েছে। আর সংস্কৃত কবিরা কখনো আওরঙ্গজেবকে স্বীকৃতি দিতে বিরাম দেননি। উদাহরণ হিসেবে দেবদত্তের কথা বলা যেতে পারে। তিনি ছিলেন গুজরাতি নারীদের প্রেমবিলাস নিয়ে লেখা গুজারিশতাকামের লেখক। এই গ্রন্থের সূচনায় তিনি আওরঙ্গজেব ও তার ছেলে আযম শাহের কথা উল্লেখ করেছেন।

আওরঙ্গজেবের দরবার ১৬৬৯ সাল থেকে ভিন্ন মনোভাব পোষণ করতে থাকে, কিছু কিছু ব্যাপারে কম কম উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। তবে তারপরও শাহ জাহানের আমলে থাকা মোগল সংস্কৃতির অনেক কিছু অব্যাহত থাকার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এসবের মধ্যে রয়েছে আদালতের শাস্ত্রাচার ও রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা ।

ইউরোপিয়ান পর্যটকেরা আওরঙ্গজেবের দরবারের আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। দরবার পরিচালিত হতো কঠোর বিধিবিধান ও আদেশের মাধ্যমে। সম্রাট আসন গ্রহণ করতেন একটু উঁচু মঞ্চে, দিল্লিতে থাকলে বসতেন ময়ূর সিংহাসনে। এতে যত মনি-মানিক্য ছিল, তা দরবারের দর্শকেরা গুণেও শেষ করতে পারত না। সম্রাট নিজে সিল্কের পোশাক পরতেন, সোনায় মোড়ানো পাগড়ি মাথায় দিতেন, মুক্তা ও রত্নপাথরের ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতেন। মোগল ক্রমপরম্পরা নিজেদের অবস্থান অনুযায়ী অভিজাতেরা দাঁড়াতেন, এই উজ্জ্বল ঝলমলে প্রদর্শনীতে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন । মেঝগুলোতে থাকত মহামূল্যবান কার্পেট, দেয়ালে দেয়ালে শোভা পেত পর্দা । রাজকীয় বাদকদল (নওবাত) আওরঙ্গজেবের সঙ্গীত-বিধিনিষেধের বাইরে ছিল। তারা সদা-প্রস্তুত থাকত। এই বিলাসবহুল পরিবেশে আওরঙ্গজেব উপহার প্রদান করতেন, গ্রহণ করতেন, পর্যটক ও অভিজাতদের স্বাগত জানাতেন, সরকারি কার্যক্রম পরিচালনা করতেন ।

আওরঙ্গজেবের স্বকীয় আগ্রহে পূর্ববর্তী মোগল সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে ১৬৭০-এর দশকে কয়েকটি বিশালাকার রাজকীয় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাজদরবারে আলেমরা বিশাল বুদ্ধিবৃত্তিক প্রকল্প ফতোয়া-ই আলমগিরি সম্পন্ন করেন। আট বছর পরিশ্রমের পর হানাফি মাজহাবের শাস্ত্রাচার অনুযায়ী ১৬৭৫ সালে এর রচনার কাজ শেষ হয়। এই সঙ্কলন কাজটি করার সময় মাঝে মাঝে এমনকি জোরে করা পাঠ আওরঙ্গজেব শুনতেন, মাঝে মাঝে সংশোধনের কথা বলতেন। এর পর থেকে সাম্রাজ্যজুড়ে বিচারকেরা এই বই থেকে উদ্ধৃতি দিতেন। বইটি আরবিতে লিখিত হলেও এর পরপরই তা ফারসিতে অনূদিত হয়। এ বইতে আওরঙ্গজেবের ধর্মভক্তি প্রতিফলিত হয়েছে। ন্যায়বিচারের প্রতি আওরঙ্গজেবের আগ্রহ পরিষ্কার আইনি বিধান প্রণয়নে উদ্বুদ্ধ করে থাকতে পারে। অবশ্য আকবর থেকে পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণার প্রতি বৃহত্তর মোগল ধারাবাহিকতা আওরঙ্গজেবের মাধ্যমে অব্যাহত থাকে। পূর্বপুরুষদের মতো আওরঙ্গজেবও বিশাল একটি রাজকীয় পাঠাগারের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন, এমনকি তার পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের জন্য ১০ লাখ রুপি পর্যন্ত ব্যয় করেছিলেন ।

আওরঙ্গজেব ১৬৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে লাহোরের বিশাল বাদশাহি মসজিদের (চিত্র ৩) নির্মাণকাজে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। দিলরাসের গরিবের তাজের বিপরীতে এখানে শাহ জাহানের সৃজনী ক্ষমতার সমকক্ষ হন আওরঙ্গজেব। আওরঙ্গজেবের কৃতিত্বগাঁথা এই মসজিদে ফুলের মটিফ, মার্বেল পাথর ও বাঁকানো কার্নিশসহ চমকপ্রদ ছোঁয়া ছিল। নির্মাণের সময় বাদশাহি মসজিদ ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় মসজিদ। এখানে ৬০ হাজার মুসুল্লি একসাথে নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদটি এখনো দর্শনার্থীদের বিস্মিত করে। সময়ের পরিক্রমায় এবং ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে শিখ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা রণজিৎ সিংয়ের গোলন্দাজ ভাণ্ডার হিসেবে ব্যবহারের ফলে ভবনটি কিছু ক্ষতির শিকার হয়েছিল। বর্তমানে এটি আবারো মসজিদ হিসেবে বিরাজ করছে। এর প্রগাঢ় সৌন্দর্য দর্শকদের মধ্যে সম্ভ্রমের উদ্রেক করে, মোগল নান্দনিক রুচিবোধের কথা মনে করিয়ে দেয়।

আওরঙ্গজেব ১৬৭৯ সালে দিল্লি ত্যাগ করেন, আর কখনো উত্তর ভারতে ফিরে আসেননি। ১৬৮১ সাল থেকে তিনি দাক্ষিণাত্যের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন, বিরামহীনভাবে অভিযানে নিয়োজিত ছিলেন বিশাল অস্থায়ী লাল তাঁবুতে বাস করে। আওরঙ্গজেবের পূর্বপুরুষেরা প্রায়ই তাঁবুতে (মোগল রাজকীয় চিহ্ন লাল রঙের) বাস করতেন, এখানেও আওরঙ্গজেব উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ঐতিহ্য অনুসরণ করেছেন। মোগল জীবনযাত্রা যাযাবর শেকড়ে ফিরে যাওয়ায় আওরঙ্গজেব অতুচ্চ মোগল সংস্কৃতির অনেক স্বকীয় বৈশিষ্ট্যসহ তার নিজের অগ্রাধিকার ও রুচির ওপর জোর দিয়েছেন।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অর্ধ শতকজুড়ে শাসনকালে আওরঙ্গজেব প্রতিদিন এবং কখনো কখনো দিনে দুবার করেও দরবার ডাকতেন। তিনি ন্যায়বিচার করা নিয়ে গর্ব করতেন, অনেক সময় আবেদনকারীর জবাব নিজে লিখতেন। তিনি জ্যোতিষীদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। এটি ছিল মোগল রাজকীয় কার্যক্রমের অন্যতম অনুষঙ্গ। এমনকি আঠার শতকেও তা অব্যাহত ছিল। ১৬৯০-এর দশকে ভারতবর্ষ সফরকারী ইতালির পর্যটক গেমেলি ক্যারেরি লিখেছেন যে ‘সম্রাট [আওরঙ্গজেব] তার জ্যোতিষীদের পরামর্শ ছাড়া কোনো কাজই করেন না।’ ১৭০৭ সালে মৃত্যুর সামান্য আগে এক জ্যোতিষী সুপারিশ করেন যে জ্বর ভালো করার জন্য সম্রাটকে একটি হাতি ও একটি হীরা দান করতে হবে। হাতি দান করার হিন্দু ও ফারসি রীতি অনুসরণ করার পরামর্শটি অযৌক্তিক বিবেচনা করে প্রত্যাখ্যান করেন আওরঙ্গজেব । তবে তিনি গরিবদের মধ্যে ৪০০০ রুপি দান করেন। উল্লেখ্য, ৪৯ বছরের শাসনকালজুড়ে এ ধরনের জ্যোতিষী সম্রাটের কাছে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে ।

আরো সাধারণভাবে বলা যায়, আওরঙ্গজেব জীবনের শেষ দিকে তার শাসনের অনেক আগে থেকেই মোগল রাজকীয় জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হওয়া হিন্দু আদর্শ, ধর্মগ্রন্থ ও সংস্কৃতি থেকে কোনোভাবেই দূরে ছিলেন না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৯০-এর দশকে চন্দ্রমান নামের এক কবি রামায়ণের ফরাসি ভাষ্য নারগিসিস্তান (নার্সিসাস উদ্যান) আওরঙ্গজেবকে উৎসর্গ করেন। ১৭০৫ সালে অমর সিং একই কাজ করে তার গদ্য ফারসি রামায়ণ (অমর প্রকাশ নামে) আওরঙ্গজেবকে উৎসর্গ করেন। আকবর প্রথম ফারসি রামায়ণের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। এটি দুই মহান সংস্কৃত মহাকাব্যের অন্যতম ও ষোড়শ শতকের শেষ দিকের এই সময়কালে ছিল অনেক হিন্দুর কাছে প্রধান ধর্মতাত্ত্বিক গ্রন্থ। পরের শত বছরে কবিরা অসংখ্য স্বতন্ত্র ফারসি রামায়ণ রচনা করেন, এগুলোর কিছু কিছু ক্ষমতায় থাকা মোগল সম্রাটদের উৎসর্গ করেন। এমনকি রাজত্বের শেষ দিকেও আওরজঙ্গজেব মোগল রাজত্ব ও রামের মহাকাব্যিক কাহিনীর মধ্যকার কথিত সম্পৃক্ততার অবসান ঘটিয়ে মোগল সাংস্কৃতিক প্রথা থেকে খুব বেশি দূরে সরে যাননি ।

8. হিন্দুস্তানের শাসক

তার বিশাল সাম্রাজ্য সুরক্ষা করা

শাহ জাহান সপ্তাহে এক দিন দরবার আয়োজনে অভ্যস্ত ছিলেন এবং সত্যনিষ্ঠতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও ঈশ্বরের প্রতি ভক্তিময় ছিলেন, কারোরই তার কাছে অভিযোগ জানানোর প্রয়োজন হতো না। এখন আওরঙ্গজেব দিনে দুবার দরবারের আয়োজন করেন এবং অভিযোগের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছে।
–ভীমসেন স্যাক্সেনা, আওরঙ্গজেব প্রশাসনের হিন্দু সদস্য, ফারসিতে লিখিত

আওরঙ্গজেব একটি বিশাল সাম্রাজ্যের তত্ত্বাবধান করতেন। ফলে একটি বিরাট আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল। তিনি সাম্রাজ্যের বেশির ভাগ অংশে নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন না, বরং নিজের শাসনামলের প্রথমার্ধের বেশির ভাগ সময় দিল্লিতে ও শেষার্ধ প্রধানত দাক্ষিণাত্য অভিযানে ব্যয় করেছেন। মোগল সাম্রাজ্য পরিচালনার দৈনন্দিন কাজের দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের কাঁধে। অবশ্য ন্যায়বিচারের প্রতি নাছোড়বান্দা মনোভাবের কারণে আওরঙ্গজেবের শারীরিক দূরত্ব তাকে অনেক প্রশাসনিক কার্যক্রমে ব্যক্তিগতভাবে সম্পৃক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারত না ।

আওরঙ্গজেব বিপুলসংখ্যক নিউজ বুলেটিনের (আখবারাত, যুবরাজদের দরবারগুলোর খবরাখবর নিয়ে এগুলো প্রতিদিন তার কাছে আসত। এতে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের কার্যক্রম ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর তথ্য থাকত) মাধ্যমে তার রাজ্যের সব প্রান্তের ঘটনাবলী সম্পর্কে অবগত থাকতেন। ওই সময়ের সব নেতাই এ ধরনের সংবাদ বুলেটিনের ওপর নির্ভর করতেন। এসব বুলেটিন আওরঙ্গজেবের দরবারে কী ঘটছে, সে সম্পর্কিত তথ্যও তার শত্রু ও মিত্র সবাইকে অবগত করত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ডাচ দূত হার্বার্ট ডি জ্যাগার জানিয়েছেন, ১৬৭৭ সালে শিবাজি সংবাদ প্রতিবেদন দিয়ে এত ব্যস্ত থাকতেন যে তিনি বৈঠক করার সময় পর্যন্ত বের করতে সমস্যায় পড়তেন ।

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও মোগল রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের আচরণ-সম্পর্কিত প্রতিবেদন শুনতেও অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন আওরঙ্গজেব। এসব ক্ষেত্র প্রায়ই অতি বিশাল সাম্রাজ্যটি শাসন করার আওরঙ্গজেবের প্রয়াসের ত্রুটিগুলো প্রকাশ করে দিত।

আওরঙ্গজেব মোগল ভূখণ্ড জুড়ে মৌলিক নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করতেন। তিনি বারবার তার ছেলে ও গুরুত্বপূর্ণ অভিজাতদেরকে রাস্তাঘাটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নিয়ে লিখতেন, সাধারণ প্রজাদের বিরুদ্ধে চুরি ও অন্যান্য অপরাধ প্রতিরোধ করতে না পারার জন্য তাদের তিরস্কার করতেন। অবশ্য, আওরঙ্গজেবের প্রয়াস সত্ত্বেও আইন-শৃঙ্খলা সমস্যা জটিল হয়েছিল মোগল ভারতে, তার রাজত্বের শেষ দিকে সম্ভবত আরো অবনতি ঘটেছিল। এই পর্যায়ে মোগল বাহিনী শিথিলভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, কয়েক দশকের সঙ্ঘাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। অনেক নতুন সৈনিকের মধ্যে মোগল স্বার্থের প্রতি আনুগত্য ছিল দুর্বল। ১৬৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইতালির গেমেলি ক্যারেরি অভিযোগ করেছিলেন যে মোগল ভারত চোরদের থেকে পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে পারে না, যেমনটা পারে সমসাময়িক সাফাভি ও উসমানিয়া সাম্রাজ্য । আওরঙ্গজেব নিজে আর্তনাদ করে বলেছেন যে বুরহানপুর ও আহমদাবাদের মতো বড় বড় নগরীতে পর্যটকদের ওপর ডাকাতি হয়। এতে বোঝা যায়, পল্লী এলাকায় আরো সাংঘাতিক হামলা হতো ।

আওরঙ্গজেবকে মিশ্র মানসম্পন্ন তার রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতেও হিমশিম খেয়েছিলেন। মোগল প্রশাসকেরা নিয়মিত ঘুষ নিতেন, আওরঙ্গজেব যদিও এ ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমনকি অষ্টাদশ শতকের একটি ইন্দো-ফারসি গ্রন্থের ভাষ্যানুযায়ী খাবলে ধরা ও টেনে আনার জন্য প্রধান কাজি (এই সুবাদে তিনি ছিলেন সাম্রাজ্যের নৈতিক নির্দেশনাদাতা) আবদুল ওয়াহাবের ‘হাতটি ছিল দীর্ঘ, তিনি বিপুল অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন।’ দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসকেরা আওরঙ্গজেবকে হতাশ করেছিলেন, বাদশাহ তাদের অন্যায় পন্থার সমালোচনা করতেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নাতি বিদার বখতকে লেখা এক চিঠিতে কয়েকজন দুর্নীতিগ্রস্ত অভিজাত ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে তাকে উপদেশ দেন : “শান্তি অনুপস্থিতি থাকলে সার্বভৌমত্ব থাকতে পারে না।’ তবে সম্রাট তার লোকদের প্রতি ক্ষমশীলতাও প্রদর্শন করতেন। তিনি রাজকীয় কর্মকর্তাদের কঠোরভাবে তিরস্কার করার জন্য তার ছেলেদের ধমক দিতেন, এবং অনেক সময় শাস্তি পরিবর্তন করে দিতেন ।

আওরঙ্গজেবের ক্ষমতাশীলতা অনেক সময়ই তার পরিবার সদস্যের প্রতি সম্প্রসারিত হতো না। রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বিরোধিতাকারীদের তিনি শাস্তি দিতেন, এমনকি স্রেফ ভুল করলেও নিস্তার মিলত না। উত্তরাধিকার লড়াইয়ের সময় এই বিষাদময় প্রবণতা ব্যাপকভাবে দেখা গেছে, তবে তার পুরো আমলে তা অব্যাহত থাকে ।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মামা শায়েস্তা খানকে আওরঙ্গজেব দক্ষিণে পাঠিয়েছিলেন ১৬৫৯ সালে শিবাজির সামরিক বিরোধিতা প্রতিরোধ করতে। শিবাজি তখন দাক্ষিণাত্যে মোগল স্বার্থের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছিলেন। শায়েস্তা খান পুনেতে সুন্দর সুন্দর ভবন ও উদ্যান নির্মাণ করেছিলেন, পুরো অঞ্চলের সমৃদ্ধি নিয়ে এসেছিলেন। খাদ্যের দাম কম থাকে, শায়েস্তা খানের বদান্যতায় লোকজন উপকৃত হয়। পুনেতে শায়েস্তা খানও আয়েসী ও বিলাসী জীবনযাপন করছিলেন, মেয়ের বাগদানের মতো অনুষ্ঠান আয়োজন করছিলেন। কিন্তু এসব করতে গিয়ে তিনি তার প্রধান লক্ষ্য তথা শিবাজিকে দমন করার গুরুত্বপূর্ণ কাজটির কথাই ভুলে গিয়েছিলেন।

শিবাজি কিন্তু শায়েস্তা খানকে ভোলেননি। তিনি ১৬৬৩ সালের বসন্তে তার প্রাসাদে গুপ্তহামলা চালান। মাত্র কয়েক ডজন লোক নিয়ে রাতের অন্ধকারে শিবাজি চুপি চুপি প্রাসাদে ঢুকে পড়েন। মারাঠারা হঠাৎ করে শায়েস্তা খানের শয়নকক্ষে প্রবেশ করে। তিনি নিজেকে রক্ষা করতে পারলেও তার একটি আঙুল কাটা পড়ে। তিনি তার পরিবারকেও রক্ষা করতে পারেননি। তার কয়েকজন স্ত্রী শেষ হয়ে যায়। শিবাজি ও তার লোকজন চলে আসার আগে শায়েস্তা খানের ছেলেকে হত্যা করেন বলে অনেক সূত্র জানিয়েছে। তারা তাকেই শায়েস্তা খান মনে করে তার বিছানায় তাকে হত্যা করে। এই লজ্জাজনক পরাজয়ের কথা শুনে আওরঙ্গজেব তার মামাকে মোগল সাম্রাজ্যের শাস্তিমূলক বদলির স্থান হিসেবে পরিচিত বাঙলায় পাঠিয়ে দেন। এমনকি তাকে পূর্ব দিকে গমনপথে ভাগ্নের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতকারের সুযোগ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।

কয়েক দশক পর আরো কম নাটকীয় তবে বর্ণাঢ্য ঘটনায় আওরঙ্গজেব তার ছেলে আযম শাহকে তিরষ্কার করেন সুরাত মহাসড়কে ডাকাতি বন্ধ করতে ব্যর্থতার কারণে। আযম শাহ প্রতিবাদ করে বলেন যে এলাকাটি তার নয়, বরং অন্য এক কর্মকর্তার আওতাধীন। জবাবে আওরঙ্গজেব তার ছেলের মনসব মর্যাদা হ্রাস করে উল্লেখ করেন, ‘যদি কোনো যুবরাজের বদলে অন্য কোনো কর্মকর্তার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকত বিষয়টি, তবে তদন্তের পর এই নির্দেশ জারি করা হতো। যুবরাজের জন্য তদন্ত ছাড়াই শাস্তি।’

আওরঙ্গজেব তার চতুর্থ ছেলে যুবরাজ আকবরের বিদ্রোহের সময় আরো কঠোর হয়েছিলেন। ১৬৮১ সালে রাজস্থানে রাঠোর ও সিসোদিয়াদের বিদ্রোহ দমন করার জন্য পাঠানোর পর আকবর বিদ্রোহ করে নিজেকে বাদশাহ ঘোষণা করেন। তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই তার রাজপুত মিত্রদের সমর্থন হারিয়ে শিবাজির ছেলে ও ওই পর্যায়ে আওরঙ্গজেবের চরম শত্রু শম্ভুজির দরবারে পালিয়ে যান। কয়েক বছর পর ১৬৮৭ সালে আওরঙ্গজেব তার ছেলেকে ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করেন। যুবরাজ আকবর পারস্যে আত্মগোপন করেন, সেখানেই ১৭০৪ সালে ইন্তিকাল করেন ।

আওরঙ্গজেব তার সাম্রাজ্যে রাজপুত শাসকদের মতো আরো কিছু বিদ্রোহের মুখে পড়েছিলেন। রাজপুতেরা দীর্ঘ সময় মোগলদের অধীনে কাজ করেছিল, তবে আকবরের আমলে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় প্রথম একীভূত হওয়ার পর থেকে বিদ্রোহ করা যেন প্রথাই হয়ে পড়েছিল।

আওরঙ্গজেবের আমলে একটি অবাক করা ঘটনা ছিল ১৬৭৯-৮১ সময়কালে মারওয়ার ও মেবারের রাজপুত পরিবারগুলোর বিদ্রোহ। এ ঘটনাটি দুই রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন ফলাফল দেখা দেয়। ১৬৭৮ সালের ডিসেম্বরে যশোবন্ত সিং রাঠোর মারা গেলে ঝামেলার সূত্রপাত ঘটে। ওই সময় আওরঙ্গজেব দক্ষিণ পশ্চিম রাজস্থানের রাঠোর রাজ্যের উত্তরাধিকারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেন। আওরঙ্গজেবের হস্তক্ষেপকে রাঠোরের রাজপরিবার, বিশেষ করে মারওয়ারের দুই নাবালক রাজপুত্রকে সাম্রাজ্যের দরবারে লালন-পালন করা নিয়ে তার পরামর্শ ও যোধপুর দখল করার জন্য তার সৈন্য পাঠানোর সিদ্ধান্তকে ভালোভাবে নেয়নি। প্রতিবেশী মেবারের সিসোদিয়া রাজপুতদের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি হয় যে একই ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে তাদের বেলাতেও। তারা তখন মারওয়ারের সাথে জোট গঠন করে।

আগেই বলা হয়েছে, রাঠোর-সিসোদিয়া যৌথ বিদ্রোহ দমন করার জন্য ছেলে যুবরাজ আকবরকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন আওরঙ্গজেব। আকবর এতে সফল হন। কিন্তু রাঠোর ও সিসোদিয়াদের কাছ থেকে প্রকাশ্য সমর্থন লাভ করে সুযোগ পেয়েছেন মনে করে তিনি ১৬৮১ সালের জানুয়ারির প্রথম দিকে রাজস্থানের নাদোলে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেন। রাজকীয় চাপে যুবরাজ আকবর বিদ্রোহ আরো দক্ষিণে নিয়ে যান। এদিকে আওরঙ্গজেবের আরেক ছেলে আযম শাহ ১৬৮১ সালের জুনে রাজপুতদের সাথে কূটনৈতিক নিষ্পত্তির জন্য আলোচনা করেন। এর ফলে ১৬৮১ সালের জুন মাসে রাজসমুদ্র নামে একটি চুক্তি হয়। এটি চুক্তি মেবার ও মোগল সাম্রাজ্যের মধ্যে এটা স্থায়ী ও ফলপ্রসূ শান্তির পথ দেখায়। তবে মারওয়ারে কয়েক বছর ধরে বিদ্রোহ দেখা যায়। এর কারণ ছিল প্রত্যক্ষ রাজকীয় নিয়ন্ত্রণ নিয়ে হতাশা ।

এই পুরো ঘটনাকে আধুনিক ইতিহাসবিদেরা ‘রাজপুত বিদ্রোহ’ এবং মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে হিন্দু বৈরিতা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। এই সাম্প্রদায়িক পাঠ ভুল প্রমাণিত হয় রাঠোর ও সিসোদিয়া উভয়ের মুসলিম যুবরাজ আকবরকে সমর্থন করার সিদ্ধান্তে, রাজসমুদ্র চুক্তির ব্যাপারে তাদের ভিন্ন প্রতিক্রিয়ার কথা না-ই বা উল্লেখ করা হলো। মেবার আওরঙ্গজেবের সাথে চুক্তিটি গ্রহণ করেছিল, আর মারওয়ার অব্যাহতভাবে মোগল জোয়াল থেকে মুক্তি পাওয়ার সংগ্রাম করেছে। এই ঘটনা আসলে একটি ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, কয়েক শ’ বছর ধরে মোগল শাসনের বিরুদ্ধে হিন্দু ও মুসলিমেরা আরো যেসব বিদ্রোহ করেছিল সেগুলোর মতোই ।

আওরঙ্গজেব রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার হুমকি নিরসনে সবসময় কূটনীতির আশ্রয় গ্রহণ করতেন না। আর যেসব ব্যক্তি সম্রাটকে চ্যালেঞ্জ করতেন, তারা প্রায়ই নিজেদেরকে তার সহিংসতার সামর্থ্য এবং এমনকি অনেক সময় নৃশংসতার শিকার হতে দেখতে পেতেন ।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কয়েক বছর যুদ্ধের পর ১৬৮৯ সালে মোগল বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের পর বন্দী হিসেবে আনা শিবাজির ছেলে শম্ভূজি কোনো ধরনের করুণা লাভ করেননি। শম্ভুজি ও তার ব্রাহ্মণ উপদেষ্টা কবি কলাশকে প্রকাশ্যে অপদস্থ করার জন্য তাদেরকে ভাঁড়ের টুপি পরতে বাধ্য করতে এবং উটে করে দরবারে নিয়ে আসতে আদেশ দেন আওরঙ্গজেব । তারপর তিনি কাঁটা দিয়ে শম্ভুজির চোখ দুটি উপড়ে ফেলতে বলেন। এক ইতিহাসবিদ কাব্যে বিষয়টি বর্ণনা করেছেন, ‘তার কাঁধ আর তার মাথাটির ভার বহন করতে পারছিল না।’ কোনো কোনো ইতিহাসে বলা হয়েছে যে শম্ভুজি ও কবি কলাশের লাশ কুকুরদের সামনে নিক্ষেপ করা হয়, আর তাদের মাথা খড়ে ভর্তি করে দাক্ষিণাত্যের নগরীগুলোতে ঘুরিয়ে অবশেষে দিল্লির কোনো একটি ফটকে ঝুলিয়ে রাখা হয় ।

তবে আদর্শ রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে কিছু ধরনের নৃশংসতাসহ সহিংস পন্থা অবলম্বনের দিক থেকে ওই সময় আওরঙ্গজেব প্রথাবিরুদ্ধ ছিলেন, এমন নয়। আওরঙ্গজেবের কাছে সহিংসতা কেবল অনুমোদনযোগ্যই ছিল না, তা প্রয়োজনীয় ছিল এবং তা যদি মোগল সাম্রাজ্যের স্থিতিশীলতা ও সহযোগিতা উৎসাহিত করে থাকে, তবে তা যৌক্তিকও ছিল। অবশ্য রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগের দিক থেকে ওই সময়ের মানুষ হিসেবে আওরঙ্গজেব তার ভূমিকা পালন করেছেন, এই যুক্তি তাকে পরবর্তী প্রজন্মগুলোর তীব্র সমালোচনা থেকে রক্ষা করতে পারেনি। আওরঙ্গজেবের সহিংসতার একটি একটি মর্মভেদী উদাহরণ হলো নবম শিখ নেতা তেগ বাহাদুর। বর্তমান সময়ের অনেক অস্বস্তির সাথে এ ঘটনাটি সম্পর্কিত।

পাঞ্জাবে উত্তেজনা সৃষ্টির কারণে মোগল সাম্রাজ্য ১৬৭৫ সালে তেগ বাহাদুরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। অনেক শিখ তাদের ধর্মের আদি সময়টিকে কিভাবে বিবেচনা করে, এই ঘটনা তার অন্যতম বিষয়। অথচ মোগল দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ছিল স্রেফ একটি গতানুগতিক কাজ। আওরঙ্গজেবের আমলের কোনো ফারসি গ্রন্থে এই মৃত্যুদণ্ডের উল্লেখ নেই। এতে মনে হয়, মোগলদের কাছে এটিকে বিশেষ কোনো ঘটনা বিবেচিত হয়নি। পরবর্তীকালের ফারসি সূত্রগুলো নানা সাংঘর্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এমনকি কোথায় তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল, তা নিয়েও পরস্পরবিরোধী তথ্য উপস্থাপন করা হয় । মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার স্থান হিসেবে কেউ দাক্ষিণাত্য, কেউ লাহোরের কথা বলেছেন । আর শিখ দলিল-দস্তাবেজে দিল্লিতে হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল বলে বলা হয়ে থাকে। শিখ নথিপত্রে অনেক পরের এবং সেগুলোতেও ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায় । আধুনিক পাঠ্যপুস্তকগুলোতে বারবার উল্লেখ করা লোকরঞ্জক কাহিনীতে বলা হয় যে তেগ বাহাদুর কাশ্মিরি ব্রাহ্মণদের বাধ্যতামূলক ধর্মান্তরের প্রতিবাদ করছিলেন। অথচ মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে আদিতম নথি-পত্রে এ ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলে না ।

বিষয়টি অনেকটাই পরিষ্কার হয় ফারসি ও শিখ উভয় সূত্রগুলোতে : আওঙ্গেজেবের দৃষ্টিতে তেগ বাহাদুর মোগল রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বিরোধিতা করেছিলেন সামরিকভাবে এবং এর ফলে তার মৃত্যুদণ্ড ছিল যৌক্তিক পদক্ষেপ । তার ধর্মীয় মর্যাদা রাষ্ট্রের শত্রুদের মৃত্যুদণ্ডসহ শাস্তি প্রদান করার ব্যাপারে আওরঙ্গজেব প্রশাসনের সর্বব্যপ্ত প্রতিশ্রুতি লঘু করতে কিছুই করেনি। আর তেগ বাহাদুরের ভাইয়ের ছেলে ও সপ্তম শিখ গুরু হর রাইয়ের উত্তরাধিকার লড়াইয়ে দারা শুকোহর প্রতি সমর্থন দিয়েছিলেন বলে যে গুঞ্জন রয়েছে, তাও এতে সহায়ক হয়নি। একই সময় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেওয়া অন্যান্য ধর্মীয় গ্রুপের (যেমন সাতনামি) প্রতিও একই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল।

মূল্যবান হিন্দু অভিজাত

হে সম্রাট দুনিয়া আপনার হুকুমে চলুক;
শুকরিয়া আর সালাম ঝরুক ঠোঁট থেকে;
আপনার আত্মা যেহেতু সব মানুষকে রক্ষা করছে,
তাই আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, ঈশ্বর আপনাকে রক্ষা করুন!
-–চন্দর ভান ব্রাহ্মণ, আওঙ্গজেবের অধীনে কর্মরত এই হিন্দু কবির রচনার মাধ্যম ছিল ফারসি

আওরঙ্গজেবের বিশাল আমলাতন্ত্রে হিন্দুরা ভালো অবস্থায় ছিল, তারা চাকরি ও পদোন্নতির সুযোগ পেয়েছিল। আকবরের আমল থেকে রাজপুত ও অন্য হিন্দুরা মোগল প্রশাসনের পূর্ণ সদস্য হয়ে পড়েছিল। তারা তাদের মুসলিম প্রতিপক্ষদের মতো মনসব নামে পরিচিত আনুষ্ঠানিক পদবি (এটিই ছিল রাজকীয় পদপরম্পরায় তাদের মর্যাদা) পেত। তারা সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের জন্য লড়াই করত। মোগল অভিজাতদের মধ্যে মুসলিমেরা সংখ্যায় বেশি হলেও হিন্দুরাও মর্যাদাসূচক অবস্থায় এগিয়ে আসছিল, তারাও অতি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করত। আওরঙ্গজেবও মোগল আমলাতন্ত্রে হিন্দুদের একীভূত করার জন্য বাস্তববাদী কৌশল গ্রহণ করেছিলেন, বিশেষ করে দাক্ষিণাত্যে অভিযান চালানোর সময় তিনি হৃদয়, মন ও ভূখণ্ড জয় করতে চেয়েছিলেন। তবে অনেক ক্ষেত্রে তিনি তার রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের ধর্মের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন। তিনি তাদের প্রশাসনিক দক্ষতার দিকেই নজর দিতেন।

শাহ জাহানের ছেলেদের উত্তরাধিকার যুদ্ধের (১৬৫৭-৫৯) সময় মোগল প্রশাসনের হিন্দু সদস্যদের সমর্থন আওরঙ্গজেব বনাম দারার প্রতি সমর্থনে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। রাজপুতদের বেশির ভাগ সমর্থন করেছিল দারাকে, আর মারাঠারা (মধ্য সপ্তদশ শতক থেকে তারা পরাক্রান্ত হয়ে ওঠেছিল) সমর্থন দিচ্ছিল আওরঙ্গজেবকে। তবে সার্বিকভাবে ২১ জন উচ্চ পদস্থ হিন্দু অভিজাত (অর্থাৎ যারা এক হাজার বা তার চেয়ে বেশি মনসবধারী ছিলেন) আওরঙ্গজেবের পক্ষে লড়াই করেছেন, আর ২৪ জন ছিলেন দারার সমর্থক। অন্য কথায় বলা যায়, আওরঙ্গজেব ও দারার শুকোহ প্রায় সমান হারে হিন্দু অভিজাতদের সমর্থন পেয়েছিলেন ।

হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে মোগল অভিজাতদের অনেক সদস্যের দৃষ্টিকোণ থেকে সিংহাসনে আরোহণের ক্ষেত্রে আওরঙ্গজেব ছিলেন চৌকষ বাজি। কবি চন্দর ভান ব্রাহ্মণের মতো মোগল দরবারের অন্যান্য হিন্দু সদস্যের কাছে আওরঙ্গজেবের বিজয় ছিল গ্রহণযোগ্য ঘটনা, কারণ এতে মোগল রাষ্ট্রের মূলনীতি বদলায়নি ।

প্রত্যাশা মতো, আওরঙ্গজেবের সিংহাসনে আরোহণের সূচনায় মোগল প্রশাসনে হিন্দুদের অংশে সামান্যই পরিবর্তন হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আকবরের আমলে সব মোগল অভিজাতের মধ্যে হিন্দুরা ছিল ২২.৫ ভাগ। শাহ জাহানের আমলে ও আওরঙ্গজেবের শাসনকালের প্রথম ২১ বছর শাসনকালে (১৬৫৮-৭৯) তা ২১.৬ ভাগেই থাকে। তবে ১৬৭৯ থেকে ১৭০৭ সময়কালে আওরঙ্গজেব মোগলদের অভিজাত পর্যায়ে হিন্দু অংশগ্রহণ বাড়িয়ে প্রায় ৫০ ভাগ করেন। মোগল অভিজাতের মধ্যে হিন্দু বাড়ে ৩১.৬ ভাগ । দাক্ষিণাত্যজুড়ে সম্প্রসারণশীল মোগল সার্বভৌমত্বের কৌশলগত বিষয় হিসেবে এই নাটকীয় বৃদ্ধি মারাঠাদের ব্যাপক অন্তঃপ্রবাহকে ফুটিয়ে তুলেছে।

সংখ্যা ছাড়াও রাজা রঘুনাথের কাহিনীর মতো স্বতন্ত্র ঘটনাগুলোও আওরঙ্গজেবের ভারতবর্ষে মূল্যবান হিন্দু অভিজাতদের কথা ধরে রেখেছে।

রাজা রঘুনাথ মাত্র পাঁচ বছর সম্রাটের সেবা করেছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন আওরঙ্গজেবের সবচেয়ে প্রিয়ভাজন রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা। শাহ জাহানের আমলে অর্থমন্ত্রী হিসেবে রাজকীয় ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন রঘুনাথ। সমুগড়ে দারা শুকোহকে আওরঙ্গজেব পর্যুদস্থ করার পর একদল প্রশাসকের সাথে রঘুনাথও আওরঙ্গজেবের আনুগত্য স্বীকার করেন। রঘুনাথকে আওরঙ্গজেব তার দিওয়ান (সাম্রাজ্যের মুখ্য অর্থমন্ত্রী) হিসেবে নিয়োগ করেন। এই উচ্চ মর্যাদা এক শ’ বছর আগে সম্রাট আকবরের মুখ্য অর্থমন্ত্রী হিসেবে টোডর মলকে নিয়োগ করার কথাই মনে করিয়ে দেয়। আওরঙ্গজেব তার দ্বিতীয় অভিষেকের সময় তার হিন্দু দিওয়ানকে রাজা পদবি প্রদান করেন, মনসব আড়াই হাজার করার মাধ্যমে তাকে সম্মানিত করা হয়। তারপর থেকে রঘুনাথ দক্ষ হাতে সাম্রাজ্যের কোষাগার পরিচালনা করেন ।

কয়েক বছরের মধ্যে দরবারে রঘুনাথের প্রভাব এমনকি তার দফতরের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ার তাকে সাম্রাজ্যের ভারপ্রাপ্ত উজিড় হিসেবে অভিহিত করেছেন। চন্দর ভান এই মূল্যায়নের সাথে একমত পোষণ করেছেন, প্রশংসা করে রঘুনাথকে ‘হিন্দুস্তানের জ্ঞানী লোকবিষয়ক গ্রন্থের প্রচ্ছদপট’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। রঘুনাথের জীবনের অবসান ঘটে ১৬৬৩ সালে। তিনি তখন মোগলদের প্রিয় অবকাশ যাপন কেন্দ্র কাশ্মিরের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করছিলেন আওরঙ্গজেবের সঙ্গী হয়ে । অবশ্য আওরঙ্গজেব তার প্রিয় হিন্দু দিওয়ানকে ভোলেননি ।

এমনকি কয়েক দশক পর বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুর সময়ও আওরঙ্গজেব তার কথা মনে করেছেন, তার প্রথম অর্থ কর্মকর্তার প্রতি স্মৃতিকাতরতা প্রকাশ করেছেন । শেষ বয়সে অন্যান্য প্রশাসকের কাছে লিখা চিঠিতে দক্ষ সরকার পরিচালনায় রঘুনাথের উপদেশমালার উদ্ধৃতি দিয়েছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উজিড় আসাদ খানকে লেখা চিঠিতে রঘুনাথের প্রাজ্ঞ বাণী উল্লেখ করেছেন আওরঙ্গজেব : সরকারি কাজের দায়িত্ব কোনো লোভী লোকের কাছে নয়, বরং খুবই অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও কর্মদক্ষ লোকের ওপর ন্যস্ত করা উচিত।’ মৃত্যুর ৪০ বছর পরও রঘুনাথ তার পৃষ্ঠপোষকের মনে বিশাল আকারে বিরাজ করছিলেন, এবং তা কেবল আর্থিক বিষয়েই নয়, বরং সাধারণভাবে মোগল রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি ও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রেও। মোগল সাম্রাজ্যের মহান কর্মকর্তা হিসেবে সজীব স্মৃতির কাছে রঘুনাথের ধর্মীয় পরিচিতি আওরঙ্গজেবের কাছে ছিল অপ্রাসঙ্গিক ।

আওরঙ্গজেব তার শাসনকালের দ্বিতীয় অংশে প্রতিরোধের মুখেও অনেক বেশি হারে রাজকীয় আমলাতন্ত্রে হিন্দুদের নিয়োগ করেছিলেন।

আমি আগেই উল্লেখ করেছি, ১৬৭৯-১৭০৭ সময়কালের মধ্যে মোগল কর্মকর্তাদের মধ্যে হিন্দুদের প্রতিনিধিত্ব অর্ধেক বেড়ে গিয়েছিল। হিন্দু অভিজাতের এই বৃদ্ধি নিয়ে অনেক কর্মকর্তা আপত্তি উত্থাপন করেছিলেন। উদাহরণ হিসেবে ভীমসেন সাক্সেনার নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এই হিন্দু সৈনিক কয়েক দশক আওরঙ্গজেবের অধীনে কাজ করেছিলেন। পরে তিনি ফারসিতে ইতিহাস রচনা করেছিলেন। তিনি সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, ‘ওই সময়ের রেওয়াজ ছিল যে [পদোন্নতির জন্য] হিন্দুদের নাম কখনো সুপারিশ করা হতো না।’ খুবই সম্ভব যে মারাঠাদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে অভিজাতদের মধ্যকার নির্দিষ্ট কিছু গ্রুপ অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিল। ওই পর্যায়ে মোগল অভিজাতদের মধ্যে মারাঠারা রাজপুতদের ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এর ফলেই হিন্দু কর্মকর্তাদের হ্রাস করার (যদি ব্যর্থও হয়ে থাকে) চেষ্টা হয়েছিল ।

পরের দিকেও আওরঙ্গজেব জোরালোভাবে বলে যাচ্ছিলেন যে মোগল চাকরির জন্য ধর্মীয় লিটমাস টেস্টের প্রয়োজন নেই। একবার বুখারা থেকে আগত এক মুসলিম (তিনি ১৬৮০-এর দশকের শেষ দিকে মোগল চাকরিতে প্রবেশ করেছিলেন) এই যুক্তিতে ইরানিদের রাজকীয় চাকরিতে পদোন্নতি দেওয়া বন্ধ করতে সম্রাটের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন যে তারা সুন্নি নয়, শিয়া। আওরঙ্গজেব এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে অভিমত প্রকাশ করেন যে “দুনিয়াদারির বিষয়ের সাথে ধর্মের সম্পর্ক কী? গোঁড়ামি দিয়ে প্রশাসনিক কাজে হস্তক্ষেপ করার যুক্তি কী আছে? ‘কারণ তোমার জন্য তোমার ধর্ম, আমার জন্য আমারটি।’ এই শাসন [তোমার প্রস্তাবিত] যদি প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে আমার কর্তব্য হবে সব (হিন্দু) রাজা ও তাদের অনুসারীদের একেবারে নিশ্চিহ্ন করা। বিজ্ঞ লোকেরা সক্ষম কর্মকর্তাদেরকে দায়িত্ব থেকে অপসারণ নাকচ করে।”

শিবাজি ও আওরঙ্গজেব

দিল্লি থেকে সুবেদারগিরি করাটা পতিতাকে প্রলুব্ধ করার মতো । তার সৌন্দর্য দেখে, কে না তাকে কামনা না করে থাকতে পারে?
তার ছলাকলা তো বিশ্ব জয় করার ।
সে যার পানেই তাকাবে, তাকে সে সাথে সাথে কর্পদহীন করে ফেলবে।
ভুষণ বলে, তার সাহচর্যে সময় ব্যয় করায় কোনোই লাভ নেই ।
-–ভূষণ ত্রিপাঠী, হিন্দু কবি, তিনি কাজ করতেন শিবাজির সাথে, ১৬৭৩

আওরঙ্গজেবের সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডার বিরোধিতা করে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন শিবাজি ভোঁসলে। মারাঠা যোদ্ধা শিবাজি শেষ পর্যন্ত নিজের শক্তিতে রাজা হয়েছিলেন। মোগল সম্রাট কয়েক দশক ধরে সাম্রাজ্যের শক্ত ঘাঁটিগুলোতে শিবাজির ধ্বংস সৃষ্টিকারী হামলা দমন করার, অনেকটাই অসফলভাবে, চেষ্টা করেছিলেন ।

আওরঙ্গজেব সিংহাসনে আরোহণের আগে থেকেই শিবাজি ছিলেন একটি কাঁটা। শিবাজি ১৬৫০-এর দশকটি ব্যয় করেছিলেন পশ্চিম দাক্ষিণাত্যের পাহাড়ি এলাকায় (আধুনিক কালের পুনের কাছে) একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠায়। তিনি প্রথম সরাসরি আওরঙ্গজেবের বিরোধিতা করেন ১৬৫৭ সালে। এ সময় শাহ জাহানের নির্দেশে যুবরাজ আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্য অভিযানে নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু মোগল সিংহাসন লাভের লড়াইয়ের জন্য আওরঙ্গজেব যখন মধ্য ভারতে চলে গেলেন, তখন শিবাজি তার এলাকা বাড়ানোর সুযোগটি গ্রহণ করেছিলেন।

শিবাজি ১৬৬০-এর দশকে ছিলেন ১০ হাজার অশ্বারোহী ও ৫০ হাজার পদাতিক সৈন্যের অধিকারী। তিনি তার বাহিনীকে হয়ে মোগল লক্ষ্যবস্তুগুলোতে মোতায়েন করলেন। শিবাজি ছিলেন গেরিলা যুদ্ধ ও হামলায় পারদর্শী। ক্ষিপ্র অভিযানে বিপুলাকার মোগল সেনাবাহিনীর তুলনায় তার বাহিনী ছিল দক্ষ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে ১৬৬৩ সালের এপ্রিলে তিনি মাত্র কয়েক ডজন লোক নিয়ে আওরঙ্গজেবের মামা শায়েস্তা খানের বাড়িতে প্রবেশ করে তার কয়েকজন স্ত্রী ও তার ছেলেকে হত্যা করেন। ১৬৬৪ সালের জানুয়ারিতে সুরাত হামলা করেন শিবাজি। এটি ছিল পশ্চিম উপকূলের অন্যতম ব্যস্ত বন্দর। এর জনসংখ্যা ছিল দুই লাখ। শিবাজি কয়েক দিন ধরে নগরীতে লুটপাট চালান। এ সময় মোগল গভর্নর ভয়ে কাছের এক দুর্গে লুকিয়ে ছিলেন ।

এ ধরনের বিপর্যয় অসহ্যকর মনে হওয়ায় ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার লঙ্ঘনের কারণে ১৬৬৫ সালের প্রথম দিকে শিবজিকে পাকড়াও করার জন্য মির্জা রাজা জয় সিংকে নির্দেশ দেন আওরঙ্গজেব। জয় সিং ছিলেন কাজওয়াহা রাজপুত ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী। যে কয়েকজন রাজপুত উত্তরাধিকার লড়াইয়ে আওরঙ্গজেবকে সমর্থন করেছিলেন, তাদের অন্যতম ছিলেন তিনি। জয় সিংয়ের দুই মাস ধরে পুরান্দার পাহাড়ের দুর্গ অবরোধের পর শিবাজি আত্মসমর্পণ করেন। তিনি মোগল রাষ্ট্রের জায়গিরদার হয়ে জমি, দুর্গ সমর্পণ করতে, খাজনা দিতে, মোগলদের জন্য যুদ্ধ করতে রাজি হন। শিবাজি যখন বশ্যতাস্বীকার ও সহযোগিতা করতে সম্মতি প্রদর্শন করছিলেন, আসলে তখনই মোগলদের প্রতি তার বিরোধিতা সবেমাত্র শুরু হয়।

শিবাজি ১৬৬৬ সালের মে মাসে সাক্ষাত করতে আগ্রায় আওরঙ্গজেবের দরবারে যান। সম্প্রতি তিনি শত্রু থেকে অভিজাতে পরিণত হয়েছিলেন। প্রত্যাশা মতোই তিনি মোগল সম্রাটকে নজরানা দেন, আনুগত্যসূচক নতজানুও হন । কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই সম্পর্ক তিক্ততায় গড়ায়। দুজনের মধ্যে মুখোমুখি সাক্ষাতের এটিই একমাত্র লিখিত ঘটনা। তবে তখন কী ঘটেছিল, তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে ব্যাপক মতানৈক্য দেখা যায়। তবে বেশির ভাগের অভিমত হলো, কিছুটা কল্পিত উপেক্ষায় শিবাজি কষ্ট পেয়েছিলেন। সেটা হতে পারে সম্রাট তার গুরুত্ব স্বীকার না করায় কিংবা তাকে নিম্ন মর্যাদার অভিজাতদের মধ্যে দাঁড়াতে বলায়। এর ফলে প্রকাশ্য দরবারেই বিরোধ দেখা দেয়। কাফি খান নামের এক ইতিহাসবিদ উল্লেখ করেছেন, শিবাজি ‘আহত পশুর মতো’ চিৎকার করতে করতে ভূমিতে পতিত হলেন। আরেক ইতিহাসবিদ ভীমসেন স্যাক্সেনা বলেছেন, তিনি ‘অর্থহীন প্রলাপ বকছিলেন, ফালতু জিনিস নিয়ে কথা বলছিলেন, মনে হচ্ছিল যেন তিনি পাগলামিতে আক্রান্ত হয়েছেন।’ সৌজন্যবিধিতে এ ধরনের লঙ্ঘন বরদাস্ত করেননি আওরঙ্গজেব। ফলে শিবাজিকে পাহারায় দরবার থেকে বাইরে নিয়ে গৃহবন্দী করা হয়।

শিবাজি তার ক্রোধপ্রকাশের অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই আগ্রা থেকে তার ৯ বছরের ছেলে শম্ভুজিকে নিয়ে পালিয়ে যান। খুব সম্ভবত, বের হওয়ার জন্য প্রহরীদের ঘুষ দিয়েছিলেন শিবাজি। তবে কাল্পনিক অনেক কাহিনীতে বলা হয় যে ব্রাহ্মণদের দান করার জন্য আনা বিশাল বিশাল ঝুড়িতে করে পালিয়ে গিয়েছিলেন শিবাজি। মোগল ভূখণ্ড থেকে বের হওয়ার আগে পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ সন্ন্যাসীর বেশ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। এক ইতিহাসবিদ বলেছেন, তার ছেলেও একই পোশাক গ্রহণ করেছিলেন। তবে একটি বর্ণনায় দেখা যায়, ভ্রমণের সময় যাতে তাকে চেনা না যায়, সেজন্য তিনি ব্রাহ্মণের স্ত্রীর ছদ্মবেশ গ্রহণ করেছিলেন। কয়েক বছর আগে সমর্পণ করা দুর্গগুলো পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে শিবাজি ১৬৬৯ সালে নতুন করে হামলা চালানোর মাধ্যমে মোগল কর্তৃত্ব অস্বীকার করার কথা ঘোষণা করেন ।

শিবাজির সাথে সম্পর্ক যে কারণেই নষ্ট হয়ে থাকুক না কেন, মোদ্দা কথা হলো, আওরঙ্গজেব তাকে মোগল পতাকার নিচে সামিল করতে পারেননি। আপাত দৃষ্টিতে এই ব্যর্থতাকে ধাঁধা মনে হতে পারে। কারণ, রাজপুতেরা কয়েক প্রজন্ম ধরেই মোগল আভিজাত্যে একীভূত হওয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচকভাবে সাড়া দিচ্ছিল। অবশ্য, এই উদাহরণ সব হিন্দু সম্মিলিতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মতপার্থক্যগুলো দেখতে তথা আওরঙ্গজেবের আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনায় শিবাজি কেন বেঁকে বসলেন, তার ব্যাখ্যা করতে বাধা দেয়। ওই সময়ের অনেক রাজপুত শিবাজিকে মনে করত অসভ্য ভুঁইফোড়, মোগল পরিভাষায় যার আদবে ঘাটিত ছিল। বস্তুত বেশির ভাগ রাজপুতের তুলনায় ফারসি দরবারি আদব কায়দায় পিছিয়ে ছিলেন শিবাজি। তার বাবা বিজাপুরের আদিল শাহি রাজবংশের অভিজাত হলেও তিনি শৈশব কাটিয়েছিলেন তার মা জিজাবাইয়ের কাছে। সেখানে দরবারি জীবন ছিল অনুপস্থিত। সম্ভবত এই অবস্থার কারণে (এ দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে তার দক্ষতাকে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে না) শিবাজির পক্ষে মোগল অভিজাত হিসেবে তার ভূমিকায় মানিয়ে নিতে পারেননি, যেমনটা পেরেছিলেন অনেক রাজপুত। শিবাজি বরং আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রেই অবতীর্ণ হওয়াকেই গ্রহণ করে নিয়েছিলেন ।

শিবাজির বিদ্রোহে প্রত্যাবর্তন মোগলদের জন্য বিপর্যয়কর হয়েছিল। ১৬৭০ থেকে শিবাজি সুরাত ও অন্যান্য স্থান বারবার লুটপাট করেন। পরের চার বছর তিনি মহারাষ্ট্রে খানদেশ, বেরার ও বেগলানের মতো মোগল ঘাঁটিগুলোতে অভিযান পরিচালনা করেন, মোগল ও বিজাপুরি উভয় বাহিনীর বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এই সময়ে আওরঙ্গজেব সাম্রাজ্যের উত্তর-পশ্চিম পাবর্ত্য এলাকায় পাঠান গোত্রগুলোর বিদ্রোহ দমনে নিয়োজিত ছিলেন।

আওরঙ্গজেব ১৬৭৪ সালের জুনে ব্যক্তিগতভাবে যখন খাইবার পাসের কাছে পার্বত্য এলাকায় আফ্রিদি গোত্রের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, তখন শিবাজি নিজেকে রাজা তথা ছত্রপতি ঘোষণা করেন। তার এই স্বাধীন মারাঠা রাজ্য ওয়েস্টার্ন ঘাট ও কোনকান উপকূলের অংশবিশেষজুড়ে বিস্তৃত ছিল। শিবাজি পরের ছয় বছর ব্যয় করেন মারাঠা এলাকা সম্প্রসারণে । তিনি সংস্কৃতভিত্তিক রাজনৈতিক রীতিনীতির মাধ্যমে ইন্দো-ফারসি আদব কায়দার পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৭৭ সালে তিনি রাজাবিবাহারকোষ (রাজকীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর শব্দকোষ) নামে পরিচিত একটি সংস্কৃত গ্রন্থের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এতে ১৫০০ ইন্দো-ফারসি প্রশাসনিক পরিভাষার সংস্কৃত প্রতিশব্দ স্থান পেয়েছিল। এ ধরনের গ্রন্থ গবেষণাসুলভ মনে হলেও এটি মোগল শাসক সংস্কৃতি দমনে তার প্রয়াস সফল করতে সহায়ক হয়েছিল। শিবাজির শাসনকালের শেষ দিকে মারাঠা সরকারি নথিপত্রে সংস্কৃত পরিভাষা ব্যাপকভাবে বেড়ে ছিল ।

শিবাজি ১৬৭৮ সাল থেকে একের পর এক রোগে আক্রান্ত হতে থাকেন । দুই বছর পর ১৬৮০ সালে তিনি বিছানায় পরলোকগমন করেন। শিবাজির মৃত্যু নিয়ে অনেক গুজব প্রচলিত রয়েছে। এর একটি হলো তার দ্বিতীয় স্ত্রী সূর্যবাই তাকে বিষ প্রয়োগ করেছিলেন শম্ভুজির বদলে তার ১০ বছর বয়স্ক ছেলে রাজারামকে সিংহাসনে বসানোর জন্য। শম্ভুজি ছিলেন তার বাবার প্রথম স্ত্রীর সন্তান। বিষ প্রয়োগের কাহিনী সম্ভবত সত্য নয়। তবে রাজারাম ও শম্ভুজির মধ্যে সংক্ষিপ্ত উত্তরাধিকার লড়াই হয়েছিল। এতে শম্ভুজি জয়ী হয়ে বাবার উত্তরসূরি হিসেবে দাক্ষিণাত্যে মোগল স্বার্থের বিরুদ্ধে উৎপাত অব্যাহত রেখেছিলেন ।

শিবাজি ও আওরঙ্গজেব যদিও মাত্র একবার মুখোমুখি হয়েছিলেন (১৬৬৬ সালে দরবারে) তারা একে অপরকে তাচ্ছিল্য করতেন। শিবজির অন্যতম রাজকবি ভূষণ সম্রাট আওরঙ্গজেবকে কুম্ভকর্ণ হিসেবে অভিহিত করেছেন। রামায়ণে এই নামে একটি বিপুলাকায়, অতিভোজী দানব চরিত্র আছে। আওরঙ্গজেব ‘পার্বত্য মুষিক’ বলতেন শিবাজিকে। মোগল সূত্রগুলো গালিগালাজ করে তাকে বলত শিব, সম্মানসূচক জি কখনো যোগ করা হতো না। আওরঙ্গজেবের আমলের অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকের এক ইতিহাসবিদ শিবাজির মৃত্যুর তারিখটি লিপিবদ্ধ করেছেন বেশ রূঢ়ভাবে : ‘কাফিরটি দোজখে গেল।’ (কাফির বিজাহান্নাম রাফত)।

মোগল-মারাঠা সঙ্ঘাত দানা বেঁধেছিল কৌশলগত, পরিবর্তনশীল মিত্ৰতা দাবিকারি পাশবিক শক্তি লাভের আকাঙ্ক্ষা থেকে । শিবাজি বিজাপুর, গোলকোন্ডা এবং প্রয়োজনীয় সময়ে মোগলসহ (অনেক ক্ষেত্রে দক্ষিণ ভারতে হিন্দু শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে) অনেক ইসলামি রাষ্ট্রের সাথে মিত্রতা করেছেন। শিবাজি তার সেনাবাহিনীতে মুসলিমদের স্বাগত জানাতেন; তার বেতনভুক কাজি (মুসলিম বিচারক) ছিল, তার শীর্ষ কমান্ডারদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন মুসলিম। মোগল মিত্রতা ও রাজকীয় বাহিনীও ছিল বৈচিত্র্যময়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, পুরান্দারে শিবাজিকে অবরোধ করার জন্য আওরঙ্গজেব পাঠিয়েছিলেন জয় সিং নামের এক হিন্দুকে। রাজপুত ও মোগল শাসনের বিরোধিতাকারী মারাঠারা নিজেদেরকে ‘মুসলিম’ স্বৈরতন্ত্র প্রতিরোধকারী ‘হিন্দু’ হিসেবে পরিচয় দানের আধুনিক ধারণাটি নিছকই আধুনিক কালের। মোগল বা মারাঠা কোনো পক্ষের লেখকেরাই (বিশেষ করে মারাঠারা) এই সঙ্ঘাতকে ধর্মীয় যুদ্ধের আবহে আখ্যায়িত করতে কোনোভাবেই কুণ্ঠিত ছিলেন না। তবে বাস্তবে রাজনৈতিক ক্ষমতার তৃষ্ণা থেকেই আওরঙ্গজেবের শাসনের বিরোধিতা ও মোগল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল।

৫. নীতিপরায়ণ মানব ও নেতা

ধর্মভক্তি ও ক্ষমতা

সম্রাট [আওরঙ্গজেব] একটি দোয়া লিখে সেটিকে [বন্যার] পানিতে নিক্ষেপ করলেন। সাথে সাথেই পানি কমতে শুরু করল। খোদাভক্ত সম্রাটের দোয়া খোদা কবুল করলেন, দুনিয়া আবারো শান্ত হলো ।
–ভীমসেন স্যাক্সেনা, আওরঙ্গজেব বাহিনীর এক হিন্দু সৈনিক, লিখেছেন ফারসিতে

অন্য সব মোগল শাসকের মতোই আওরঙ্গজেব মুসলিম হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, জীবনজুড়ে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ধর্মের অনুশীলন করেছেন। অনেক আগে মারা যাওয়া সম্রাটদের মনের ভাবনা সম্পর্কে জানা অসম্ভব। তবে তাদের কর্মের ওপর ভিত্তি করে মনে হতে পারে যে আওরঙ্গজেব তার পূর্বসূরিদের চেয়ে বেশি ধার্মিক ছিলেন। তিনি তার পূর্বপুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি নিয়মিত নামাজ পড়তেন। আর মদ্যপান ও আফিম থেকে বিরত ছিলেন। এই দুটি নেশায় মোগল পরিবারের অনেক পুরুষ সদস্য মারা গেছেন। ১৬৬০ এর দশকে আওরঙ্গজেব কোরআনে হাফেজ হন। শেষ বয়সে তিনি নামাজের টুপি সেলাই করতেন, নিজ হাতে পবিত্র কোরআনের অনুলিপি প্রস্তুত করতেন। এসব কাজ তিনি করতেন ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ।

তবে আওরঙ্গজেব ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনোভাবেই বিশুদ্ধবাদী ছিল না । বরং তিনি সারা জীবন প্রখ্যাত হিন্দু ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের সাথে পরামর্শ করেছিলেন, যেমনটি করেছিলেন তার পূর্বসূরি মোগল সম্রাটেরা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৮০-এর দশকে আওরঙ্গজেব বৈরাগী হিন্দু শিব মঙ্গলদাস মহারাজের সাথে ধর্মীয় আলোচনা করেন, ওই সন্ন্যাসীকে বিপুল উপহার প্রদান করেন। সম্রাটের সাথে ইসলামি সুফি সম্প্রদায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এটিও ছিল দীর্ঘ দিন ধরে অনুসরণ করা মোগল ঐতিহ্য। এর প্রমাণ পাওয়া যায় মহারাষ্ট্রের একটি চিশতি দরগায় তার কবর হওয়ার মধ্যে। একটি ছবিতে দুই ছেলেকে নিয়ে রাজস্থানের আজমিরে মইনুদ্দিন চিশতির (মৃত্যু ১২৩৬) দরগায় যেতে দেখা যায় আওরঙ্গজেবকে। ছবিটি সম্ভবত ১৬৮০ সালের দিকের (চিত্র ৫)। ইসলাম সম্পর্কে আওরঙ্গজেবের বিশ্বাসের মধ্যে অনেক তাবিজ-কবজের বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত ছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একবার যুদ্ধের সময় তিনি দোয়া-দরুদ লিখে সেগুলো রাষ্ট্রের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া ঝান্ডা ও পতাকায় গেঁথে দিয়েছিলেন।

আওরঙ্গজেব প্রায়ই তার নিজের ও অন্যদের কল্যাণের জন্য প্রকাশ্যে তার ধর্মভক্তি প্রকাশ করতেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যুদ্ধ পতাকায় দোয়া দরুদ লিখে সেলাই করার কথা বলা যায়। তিনি কাজটি করতেন তার ও তার সৈন্যদের দৃষ্টিতে জয় নিশ্চিত করার জন্য। সম্রাট একবার দোয়া লিখে বন্যার পানিতে নিক্ষেপ করেছিলেন। ভীমসেন স্যাক্সেনার ভাষায় এতে পানি হ্রাস পেয়েছিল। আরেক ইতিহাসবিদ লিখেছেন, যুদ্ধের মধ্যেই তিনি তার ধর্মনুরাগ প্রকাশ করার লক্ষ্যে নামাজ পড়ার জন্য ঘোড়া থেকে নেমে গিয়েছিলেন। তিনি কাজটি করেছিলেন তার সৈন্যদের এই আত্মবিশ্বাস বাড়াতে যে আল্লাহ তাদের পক্ষে আছেন। আওরঙ্গজেব হতে চাইতেন ভালো মুসলিম এবং তা অন্যদের দেখাতেও চাইতেন ।

মুসলিম শাসক হিসেবে আওরঙ্গজেবের ধর্মীয় আদর্শ দাবি করত যে তিনি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবেন, তার নাগরিকদের সুরক্ষা দেবেন। তিনি তার নাতি আজিমুশ্বানের কাছে লেখা এক পত্রে লিখেছেন : ‘তুমি ইহকাল ও পরকালের সুখের উৎস হিসেবে প্রজাদের সুরক্ষা প্রদানকে বিবেচনা করতে পারো।’ তবে ইসলামের সাথে তার প্রকাশ্য সম্পর্ক নিয়ে সম্রাট বারবার সমস্যায় পড়তেন । দুটির মধ্যে সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হলে আওরঙ্গজেব সাধারণত রাষ্ট্রীয় স্বার্থের বেদীতে ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা বলি দিতেন, যদিও এ ধরনের সিদ্ধান্ত তার বুকে ভারী বোঝা হয়ে থাকত ।

পিতাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ও তাকে অর্ধ দশকেরও বেশি সময় আটকে রেখে ইসলামি বিধান লঙ্ঘন করেছিলেন আওরঙ্গজেব। আমি আগেই বলেছি, মক্কার শরিফ এই রায় স্পষ্টভাবে দেন। তিনি আওরঙ্গজেবের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে জানিয়ে দেন যে শাহ জাহান জীবিত থাকা পর্যন্ত হিন্দুস্তানের বৈধ শাসক হিসেবে তাকে স্বীকৃতি দেবেন না। মক্কার শরিফের মন পরিবর্তনের চেষ্টায় কখনো বিরাম দেননি আওরঙ্গজেব। এতে মনে হয়, মুসলিম ধর্মীয় নেতাদের অনুমোদনের অভাব মোগল সম্রাটকে অস্বস্তিতে ফেলেছিল। ১৬৬৬ সালে শাহ জাহান ইন্তিকাল করলে সমস্যাটির আপনা-আপনি সমাধান হয়। তবে এর মধ্যবর্তী সাড়ে সাত বছরের ইসলামি নীতিমালার লঙ্ঘনের জন্য আওরঙ্গজেবকে অত্যন্ত চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল।

এর কয়েক দশক পর এক ইউরোপিয়ান পর্যটক অভিমত প্রকাশ করেছেন যে আওরঙ্গজেবের মদ্যপানসহ ‘কঠোর সংযম’ ছিল তার পিতার প্রতি করা তার আগেকার পাপের প্রায়শ্চিত্ত। এই সূক্ষ্ম যোগসূত্র নির্ভুল হোক বা না হোক, খুব সম্ভবত অবৈধ মুসলিম রাজা হিসেবে আওরঙ্গজেবকে চিহ্নিত করার কারণেই তিনি আরো নিবেদিতপ্রাণ মুসলিমে পরিণত হতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। ঐকান্তিকতার সাথে পবিত্র কোরআন মুখস্ত করা, পবিত্র কোরআনের অনুলিপি তৈরী করাসহ তার আরো সুস্পষ্ট ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হওয়ার ঘটনা ঘটে তার সিংহাসনে আরোহণের পর। এখানে, আওরঙ্গজেবের ধার্মিকতা রাষ্ট্রীয় নীতিতে তেমন প্রভাব ফেলেনি যেভাবে তার রাজকীয় অভিজ্ঞতা তার ধার্মিক জীবনে পরিবর্তনকে উদ্দীপ্ত করেছিল।

তার শাসন পরিক্রমার ধারায় ইসলামি ধর্মীয় আদর্শ ও মোগল রাষ্ট্রীয় স্বার্থের মধ্যে আরো নানা সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হয়েছিল। প্রায় সব ক্ষেত্রেই আওরঙ্গজেব রাষ্ট্রীয় স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিতেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৮৬ সালের বিজাপুর অভিযানকালে বিজাপুরের ধর্মবিদদের একটি দল আওরঙ্গজেবের কাছে গিয়ে এই যুক্তিতে অবরোধ তুলে নিতে বলেন যে একই মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা অন্যায়। আওরঙ্গজেব অনড় থাকেন, তিনি বিজাপুরের পতন না হওয়া পর্যন্ত তার নৃশংস কৌশল কঠোরভাবে প্রয়োগ করেন। সম্রাট তারপর বিজাপুরি প্রাসাদের কিছু দেয়ালচিত্র মুছে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন এটা বোঝাতে যে মোগল ধর্মীয় রাষ্ট্রের কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ছবিগুলো পৌত্তলিকতাবিষয়ক!

তিনি যখন মনে করতেন, কোনো কাজ সাম্রাজ্যের স্বার্থ পূরণ করবে তখন আওরঙ্গজেব এমনকি আগে অনুমোদিত ইসলামি নীতিমালার সাথেও আপস করতেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৭০০ সালে মারাঠা শক্ত ঘাঁটি সাতারা দুর্গ অবরোধের সময় মোগল সৈন্যরা ৯ হিন্দু ও চার মুসলিমকে আটক করে। আওরঙ্গজেবের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রণীত আইনি গ্রন্থ ফতোয়া-ই-আলমগিরি অনুযায়ী এক মোগল বিচারক চার মুসলিমকে তিন বছর করে কারাদণ্ড ও ইসলাম গ্রহণ করার শর্তে হিন্দুদেরকে মুক্তির রায় দেন। এই সাজা ছিল বেশ নমনীয়। এতে অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়ায় আওরঙ্গজেব ওই বিচারককে ‘অন্যভাবে রায় দিতে বলেন, যাতে রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া না হয়।’ সূর্যোদয়ের আগেই বিদ্রোহী সবার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

ইসলামের প্রাজ্ঞ ব্যক্তিবর্গ তথা আলেম সমাজ আওরঙ্গজেবের প্রয়োজন অনুযায়ী ধর্মীয় বিবেকজনিত দ্বিধা ত্যাগ করার আগ্রহের ব্যাপার নিয়ে অন্ধ হয়ে থাকেনি পূর্ববর্তী মোগল শাসকদের মতো আওরঙ্গজেবও তার পুরো রাজত্বকালে আলেমদের, বিশেষ করে কাজি হিসেবে তাদের ভূমিকার সাথে সঙ্ঘাতে জড়িয়েছেন। সিংহাসন দখল করেই তিনি প্রধান কাজি হিসেবে আবদুল ওয়াহাবের নাম ঘোষণা করেন। এর কারণ হলো, তার পূর্ববর্তী প্রধান কাজি পিতাকে ক্ষমতাচ্যুত করার আওরঙ্গজেবের পাপ এড়িয়ে যাননি। কয়েক দশক পর আবদুল ওয়াহাবের ছেলে (তিনিও ছিলেন কাজি) শায়খুল ইসলামের সাথে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এই কাজি ইসলামি দেশ বিজাপুর ও গোলকুন্ডা দখল ও অনেক মুসলিমকে হত্যার বিষয়টি অনুমোদন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। শায়খুল ইসলাম অল্প সময়ের মধ্যেই পদত্যাগ করে হজে চলে যান। রাজকীয় নিয়মের সাথে সামঞ্জস্য নিয়ে চলতে অস্বীকৃতিকারী ব্যক্তিকে অপসারণ করার জন্য এটি ছিল মোগলদের দীর্ঘ দিন ধরে অনুসরণ করা ব্যবস্থা।

আকবরের আমল থেকেই মোগল শক্তির মধ্যে ভারসাম্য বিধানে অন্যতম উপাদান ছিল আলেম সমাজ। আকবর এই সম্প্রদায়ের অধিকতর কঠোর সদস্যদের বিদ্রূপ করতেন, কয়েকজন সোচ্চার ব্যক্তিকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন। আকবরের অনুকরণে আওরঙ্গজেবও তার সিংহাসন আরোহণের বিরোধিতাকারী শাহ জাহানের প্রধান কাজির মতো আলেম সমাজের সমস্যা সৃষ্টিকারী সদস্যদের অসন্তুষ্ট করার ঊর্ধ্বে ছিলেন না। তবে সম্ভব হলে আলেমদের প্রশান্ত রাখার জন্য আওরঙ্গজেব তাদের সাথে নমনীয় আচরণ করতেন, বিশেষ করে তাদের জন্য আয়ের ব্যবস্থা করে দিতেন ।

আওরঙ্গজেব ফতোয়া-ই-আলমগিরি লেখার জন্য অনেক জ্ঞানী মুসলিমকে অর্থ প্রদান করেছিলেন। ১৬৬৭ থেকে ১৬৭৯ সালের সময়কালে এটি রচনা করা হয়েছিল। আওরঙ্গজেবের আমলে আলেমরা জনসাধারণের নৈতিক চরিত্র সংশোধনের দায়িত্বেও ছিলেন, জিজিয়ার কর তারাই আদায় করতেন । ১৬৭৯ সালের শুরুতে আওরঙ্গজেব তার সাম্রাজ্যে সামরিক সেবা না দেওয়ার বিপরীতে জিজিয়া কর আরোপ করেন। রাজপুত ও মারাঠা রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা, ব্রাহ্মণ ধর্মীয় নেতাদের এই কর থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। তবে সাধারণ জৈন, শিখ ও অন্যান্য অমুসলিমের জন্য তা প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়। জিজিয়া কর মোগল সাম্রাজ্যে প্রায় ১০০ বছর বাতিল ছিল। আওরঙ্গজেবের এটি পুনঃজীবিত করার একটি কারণ ছিল এর সংগ্রহের দায়িত্বে আলেমদের নিয়োজিত করার জন্য। তাত্ত্বিকভাবে জিজিয়ার ফলে আলেমদের মধ্যে বিশেষ করে যারা যথার্থ ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে মোগল সাম্রাজ্যকে চিহ্নিত করে সম্রাটদের ধর্মীয় আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহে ভুগতেন তাদের মধ্যে আওরঙ্গজেবের খ্যাতি বাড়াতেও সহায়ক হয়েছিল।

আওরঙ্গজেবের অনেক অভিজাত (এদের মধ্যে ছিলেন অনেক প্রখ্যাত মুসলিম ও রাজপরিবারের সদস্য, যেমন আওরঙ্গজেবের বড় বোন জাহানারা ) দুর্বল প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত হিসেবে জিজিয়া নিয়ে তীব্র বিদ্রূপ করেছিলেন। এই কর অনেক হিন্দুকেও কষ্ট দেয়। আওরঙ্গজেবকে লেখা এক কঠোর সমালোচনামূলক পত্রে (এটি হয় শিবাজি কিংবা ১৬৫২-১৬৮২ সাল পর্যন্ত মেবার শাসনকারী রাজপুত শাসক রানা রাজ সিং লিখেছিলেন) জিজিয়াকে ফালতু হিসেবে অভিহিত করেছিলেন এই যুক্তিতে যে এটি আকবরের আমল থেকে মোগল নীতির ভিত্তি হিসেবে বিরাজমান সুলেহ কুল (সবার জন্য শান্তি) ধারণার পরিপন্থী।

বাস্তবে, জিজিয়া পুনঃবহাল শক্তিশালী আলেমদের ওপর আওরঙ্গজেবের নিয়ন্ত্রণ বাড়ায়নি। সমসাময়িক অনেক ঘটনায় জিজিয়া সংগ্রহে অনিয়মের চিত্র পাওয়া যায়। সংগৃহীত অর্থের একটি বড় অংশই লোভী সংগ্রহকারীদের পকেট থেকে বের হয়নি। এ ধরনের চুরি বন্ধ করতে অক্ষম ছিলেন আওরঙ্গজেব।

নৈতিক তদারকি

রাজা হলেন গরিবের রাখাল, এমনকি যদি তিনি তার মহিমা দিয়ে তাদের ভীতও করেন।
রাখালের জন্য ভেড়া থাকে না। ভেড়ার সেবা করার জন্যই রাখালের অস্তিত্ব থাকে ।
–সাদি, গুলিস্তাঁ

আওরঙ্গজেবের তার আদর্শের সাথে আপস করতে ইচ্ছুক থাকলেও বাদশাহ তার প্রজাদের প্রতি পিতৃমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গির বাধ্যবাধকতাকে সমর্থন করতেন । তিনি মনে করতেন যে তার সাম্রাজ্যে বসবাসকারী সবার কেবল দৈহিকই নয়, তাদের নৈতিক কল্যাণের দায়িত্বও তার। সে অনুযায়ী তিনি তার সাম্রাজ্যে বসবাসকারীদের নৈতিক জীবনযাপন করতে তাদেরকে উৎসাহিত, এবং এমনকি জবরদস্তিও করতেন ।

আওরঙ্গজেব নিজেকে নীতিপরায়ণ নেতা হিসেবে উপস্থাপনের লক্ষ্যে ন্যায়বিচার ও নৈতিকতাবিষয়ক ইসলামি আদর্শ সামনে আনতেন। তার পিতৃসুলভ প্রবণতা গড়ে ওঠেছিল সাদির গুলিস্তাঁর (গোলাপ উদ্যান) মতো ফারসি নীতিবাদী গ্রন্থাবলীতে পাওয়া রাজাদের দুঃখদায়ক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এসব সতর্ক রাজা শাসন করতেন ভালোই, তবে ধারণা করা হতো, তাদের বেশির ভাগই ছিলেন সবচেয়ে পাপাচারপূর্ণ স্বৈরাচার। উল্লেখ্য, আওরঙ্গজেব হিন্দু ও মুসলিম সবারই কার্যক্রমে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে তিনি ধর্ম নির্বিশেষে সব প্রজার জন্য একই ধরনের আচরণবিধি প্রণয়ন করেছিলেন। কিছু ঘটনায় দেখা যায়, তিনি একটি ধর্মীয় গ্রুপের নির্দিষ্ট ইস্যুগুলোর সমাধান করছেন, যদিও তিনি কার্যত সবার জন্য প্রযোজ্য নীতিই তাতে প্রয়োগ করছেন।

মোগল ভারতে বসবাসকারীদের মধ্যে নীতিপরায়ণতা প্রচারের জন্য আওরঙ্গজেব যেসব সবচেয়ে সাধারণ ধরনের রাষ্ট্রীয় নীতি প্রয়োগ করেছিলেন, সেগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল নানা নিষেধাজ্ঞা ও বিধিনিষেধ! আওরঙ্গজেব তার রাজত্বের বিভিন্ন পর্যায়ে অ্যালকোহল, আফিম, পতিতাবৃত্তি, জুয়া, উস্কানি সৃষ্টিকারী ধর্মীয় লেখালেখি, ধর্মীয় উৎসব সার্বজনীনভাবে উদযাপনসহ বিভিন্ন পাপাচার সীমিত বা নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। মুহতাসিবদের (সেন্সর) দায়িত্ব ছিল নৈতিক বিধিমালা প্রয়োগ করা, প্রতিটি নগরীতে আলেমদের অনেকে এই কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এ ধরনের বিধিনিষেধের যৌক্তিকতা ও লক্ষ্য ছিল অভিন্ন : জনসাধারণ ও ব্যক্তির জীবনবিধান। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সাথে সংশ্লিষ্ট মৌলিক উদ্বেগগুলোও অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ আরোপের উদ্দীপনা সৃষ্টি করত। এগুলোই তাত্ত্বিকভাবে নীতিপরায়ণ ও নিরাপদ রাজ্য হিসেবে মোগল ভারতকে তৈরীতে হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল। আওরঙ্গজেব দৃঢ়ভাবে এই মনোভাব পোষণ করতেন যে নৈতিকতা হলো রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ও শাসিতদের কল্যাণ সুরক্ষিত রাখার শাসকের বৃহত্তর কর্তব্যের আওতাভুক্ত বিষয়।

আওরঙ্গজেব তার পুরো সাম্রাজ্যে অ্যালকোহল পান হ্রাস করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তার আমলে যেসব উল্লেখযোগ্য নীতি ভয়াবহভাবে ব্যর্থ হয়েছে, তার মধ্যে এটি একটি। অ্যালকোহলকে ব্যাপকভাবে অনৈস্লামিক হিসেবে নিন্দা করা হতো, মোগল সম্রাটেরা অ্যালকোহল পানে নিরুৎসাহিত করার জন্য ধর্মীয় নীতির আলোকে সোচ্চার ছিলেন। উদাহরণ হিসেবে জৈন সন্ন্যাসী শান্তিচন্দ্রের কথা বলা যায়। তিনি ১৫৯০ সালের দিকে আকবরের ‘অ্যালকোহল নিষিদ্ধ করা’ নিয়ে আলোচনা করে বলেছিলেন যে ‘এটি সার্বজনীনভাবে নিষিদ্ধ হওয়া উচিত।’ জাহাঙ্গীরও অ্যালকোহল নিষিদ্ধ করেছিলেন (যদিও তিনি ছিলেন পুরো মাত্রায় মদ্যপ)। এই নিষেধাজ্ঞা বারবার আরোপ করায় মনে হচ্ছে নিষেধাজ্ঞা ছিল অকার্যকর।

বিফল হওয়ার আশঙ্কা সত্ত্বেও আওরঙ্গজেব তার পূর্বপুরুষদের অনুকরণ করে মদ ও তাড়ি বিক্রি সীমিত করার চেষ্টা করেন। ফরাসি পর্যটক ফ্রাসোয়া বার্নিয়ারের সাক্ষ্য অনুযায়ী মদ ছিল ‘জেন্টিল ও মোহামেতান [হিন্দু ও মুসলিম] উভয় আইনেই নিষিদ্ধ,’ এবং দিল্লিতে তা সহজলভ্য ছিল না। তবে সাধারণভাবে, আওরঙ্গজেবের ভারতবর্ষে অ্যালকোহল গলধঃকরণ ছিল ব্যাপক অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে আওরঙ্গজেবের দরবারে ইংরেজ রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম নরিস সাক্ষ্য দিয়েছেন, আসাদ খান (১৬৭৬ থেকে ১৭০৭ সময়কালে প্রধান উজিড়) ও অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তার কাছে ‘কড়া মদের চেয়ে প্রিয় আর কিছু নেই এবং হাতের কাছে পেলে তারা প্রতিদিন তা পান করেন। সে অনুযায়ী, আসাদ খানের কাছে কিছু মদ ও পছন্দের পানপাত্র (যা দিয়ে কড়া পানি’ গলধঃকরণ করা যাবে) পাঠিয়ে তাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন ।

আওরঙ্গজেব ব্যক্তিগতভাবে অ্যালকোহল পান করতে অস্বীকৃতি জানালেও তিনি জানতেন, তার কর্মকর্তাদের মধ্যে খুব কম লোকই তার উদাহরণ অনুসরণ করেন। গালগল্প ও অতিরঞ্জনের প্রকট দুর্বলতাসম্পন্ন নিকোলি মানুচি লিখেছেন যে আওরঙ্গজেব একবার উত্তেজিতভাবে অভিমত প্রকাশ করেন যে হিন্দুস্তানে মাত্র দুজন মদ পান করেন না। এদের একজন হলেন তিনি ও অন্যজন হলেন প্রধান কাজি আবদুল ওয়াহাব। তবে মানুচি গোপনীয়তা ফাঁস করে তার পাঠকদের জানিয়েছেন : ‘কিন্তু আবদুল ওয়াহাবের ব্যাপারে [আওরঙ্গজেব] ভুল ছিলেন। কারণ আমি তাকে প্রতিদিন এক বোতল করে স্পিরিট (ভিনো) পাঠাতাম। তিনি তা পান করতেন গোপনে, যাতে সম্রাট তা বুঝতে না পারেন। ‘

আওরঙ্গজেবের জারি করা অন্যান্য নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ছিল আফিম উৎপাদন ও ব্যবহারের হ্রাস করা । এগুলোও একই ধরনের ব্যর্থ পরিণতি বরণ করে।

আওরঙ্গজেব অনেক ধর্মীয় ছুটির সার্বজনীন উদযাপন সীমিত করেন। এসব বিধিনিষেধ সব ধর্মের লোকজনকেই প্রভাবিত করেছিল। কারণ আওঙ্গজেব তার সাম্রাজ্যের সব প্রধান ধর্মের উৎসব নিয়ন্ত্রিত করেছিলেন এবং আজকের দিনের অনেক ভারতীয়ের মতো তখনও ভারতীয়রা একের পবিত্র দিনগুলো অন্যরাও পালন করত।

আওরঙ্গজেব তার শাসনকালের অষ্টম বছরে ফারসি নববর্ষ নওরোজ, মুসলিমদের ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আজহা ‘বড় ধরনের জাঁকজমকভাবে পালনের’ ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন। একই সময় তিনি হিন্দুদের হলি ও দিওয়ালি এবং মুসলিমদের মোহররম উদযাপনের সাথে সম্পৃক্ত হইচই হ্রাস করার চেষ্টা করেন। আওরঙ্গজেবের এসব হুকুম জারি করার আংশিক কারণ ছিল এই যে তার কাছে হইচয়ের বাড়াবাড়ি বিতৃষ্ণাকর মনে হয়েছিল । জননিরাপত্তার বিষয়গুলোও সম্ভবত তার এই উদ্যোগ গ্রহণের পেছনে কাজ করেছিল।

মধ্য যুগের ভারতবর্ষে ধর্মীয় উৎসবগুলো প্রায়ই পরিণত হতো বিপজ্জনক বিষয়ে। উদাহরণ হিসেবে ভীমসেন স্যাক্সেনার কথা বলা যায়। তিনি মহারাষ্ট্রের ত্রিমবাকে প্রতি ১২ বছর পরপর হওয়া একটি বিশাল উৎসবের কথা বলেছেন (তিনি সম্ভবত কুম্ভ মেলার কথা উল্লেখ করেছেন)। সন্ন্যাসীদের সশস্ত্র দলগুলো এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে জড়ো হয়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করত। এতে অনেকে হতাহত হতো। ভারতবর্ষ সফরকারী ফরাসি পর্যটক জ্যাঁ ডি থেভেনট বলেছেন, ১৬৬৬-৬৭ সময়কালে গোলকোন্ডায় মোহররম উদযাপন (তাতে হিন্দু ও মুসলিম উভয়ে অংশ নিত) এতই উন্মাদনাপূর্ণ হয়ে পড়েছিল যে সহিংসতা হওয়াটাই সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। ১৬৬৯ সালে বুরহানপুরে মোহররম উৎসবের সময় ৫০ জন নিহত ও ১০০ জন আহত হয় । মোগল ভারতবর্ষে চুরি ও অন্যান্য অপরাধও ব্যাপকভাবে হতো ধর্মীয় উৎসবের সময়। যেমন গুজরাতের হলি উৎসবকারীদের বিশাল আগুন জ্বালানোর জন্য কাঠ চুরি করার প্রবণতা ছিল। আওরঙ্গজেব ১৬৬০-এর দশকের মাঝামাঝিতে এই প্রথা দমন করার জন্য তার কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। একইসময় তিনি হলি ও দিওয়ালি উভয় উৎসবে অশ্লীল ভাষা ব্যবহারের বিরুদ্ধে নির্দেশও দিয়েছিলেন ।

আওরঙ্গজেব ধর্মীয় উৎসবগুলোতে প্রচুর মদ্য পান করে উন্মাদ হওয়া ও অবৈধ আচরণ করা হ্রাস করেছিলেন, তবে এ ধরনের উৎসব পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। বস্তুত, শাসনকালের প্রথম দিকে ইতোপূর্বে হিন্দু উৎসবগুলোর ওপর আরোপ করা কর হ্রাস করে এসব উৎসবকে উৎসাহিত করেছিলেন। বিপুলসংখ্যক উদাহরণে দেখা যায়, আওরঙ্গজেবের পুরো শাসনকালে লোকজন সার্বজনীন অবকাশ যাপনের সময়গুলোতে অংশগ্রহণ অব্যাহত রেখেছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৯০-এর দশকের শেষ দিকেও অনেক ইউরোপিয়ান পর্যটক ও হিন্দু লেখক হলি উদযাপনের কথা লিখেছেন। এমনকি আওরঙ্গজেবের নিজের সন্তানেরা পর্যন্ত অমুসলিম ধর্মীয় উৎসবগুলোতে অংশ নিত। আওরঙ্গজেব তার জীবনের শেষ দিকে লেখা এক চিঠিতে তার ছেলে মোয়াজ্জেমকে নওরোজ উৎসবে অংশগ্রহণ করার জন্য কঠোর শাস্তি দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব এই প্রাচীন প্রথাকে কিংবদন্তীপ্রতীম হিন্দু শাসক বিক্রমাদিত্যের অভিষেক উদযাপন স্মারকও মনে করতেন ।

নৈতিক আচরণ উন্নয়নের এজেন্ডার অংশ হিসেবে আওরঙ্গজেব চেষ্টা করেছিলেন তার প্রজাদের, বিশেষ করে মুসলিমদের মধ্যে ধর্মতাত্ত্বিক ঝোঁক গড়ে তুলতে । সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত করাবিষয়ক তার কথিত এজেন্ডা নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়ে থাকেন আওরঙ্গজেব। কিন্তু বাস্তবে আওরঙ্গজেবের সরকার কখনো হিন্দুদের বা অন্য কোনো ধর্মের লোকদের মধ্যে ব্যাপক ধর্মান্তরের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। তবে কেউ কেউ ইসলাম গ্রহণ করার তাগিদ অনুভব করেছিল।

ইসলামে ধর্মান্তরের ফলে অনেকে মোগল ক্রমপরম্পরার উচ্চতর ধাপে উঠতে পারত, জিজিয়া কর আদায়কারীসহ মুসলিমদের জন্য নির্ধারিত অনেক চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হতো। অবশ্য, ধর্মান্তরের ফলে লোকজনকে আওরঙ্গজেবের অনুসন্ধানের আওতায়ও নিয়ে আসত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৯৯ সালে এক চিঠিতে দুই ব্যক্তির নিন্দা করেন এ কারণে যে তারা ‘তাদের ইসলামে ধর্মান্তর নিয়ে দম্ভ করছে এবং সম্রাটের বিরুদ্ধে কথা বলছে। আওরঙ্গজেব তাদেরকে ‘অধার্মিক লোক’ (বেদিন) হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আন্তরিকতা না থাকায় উভয়কেই কারারুদ্ধ করার আদেশ দেন তিনি |

সার্বিকভাবে আওরঙ্গজেবের ভারতবর্ষে খুব কম হিন্দুই ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। রাজদরবারে আসা নিয়মিত বুলেটিনগুলোতে অতি সামান্য সংখ্যক ধর্মান্তরের খবর আসত, অনেক সময় সম্পর্কিত ব্যক্তিদের নামও থাকত, এদেরও বেশির ভাগ ছিল নিম্ন পর্যায়ের রাষ্ট্রীয় কর্মী।

আওরঙ্গজেব অবশ্য মুসলিম প্রজাদের ব্যাপারে অনেক বেশি সক্রিয় ছিলেন। তিনি তাদের ধর্মের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছেন বেশি, বিশেষ করে আহমদ সরহিন্দির (মৃত্যু ১৬২৪) নির্বাচিত কিছু লেখার ওপর সেন্সরশিপ আরোপ করেছিলেন। সরসিন্দি ছিলেন সুফি নকশবন্দি তরিকার সদস্য। তিনি তার তীব্র বিতর্কমূলক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিত ছিলেন। তার ওই দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিমদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ বাড়িয়ে দিয়েছিল। সরহিন্দি জাহাঙ্গীরের রাজত্বের শেষ দিকে ইন্তিকাল করলেও তার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে শাহ জাহানের শাসনকালে। তার গ্রন্থ কোনো কোনো মাদরাসা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, অনেকে ক্রমবর্ধমান হারে তাকে মুজাহিদ (সংস্কারক), এমনকি নবি হিসেবেও বিবেচনা করতে থাকে। সমসাময়িক ইউরোপিয়ান শক্তিগুলো যেভাবে গ্রন্থরাজি সেন্সর করত, সে তুলনায় আনুষ্ঠানিক হাতিয়ারের অভাব ছিল মোগল সাম্রাজ্যে। কিন্তু আওরঙ্গজেব ১৬৮০-এর দশকে সরহিন্দিকে আলাদা করে রাখেন, তার কিছু ধর্মতাত্ত্বিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ রচনা নিষিদ্ধ করেন।

অনেক সময় আওরঙ্গজেব নির্দিষ্ট কিছু মুসলিম গ্রুপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। এসব গ্রুপের মতবাদ ইসলাম সম্পর্কে তার ভাষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৪০-এর দশকে আওরঙ্গজেব তখনো ছিলেন গুজরাত পরিচালনার দায়িত্বে থাকা যুবরাজ, আহমদাবাদের মোগল সৈন্যরা মাহদাবি সম্প্রদায়ের (সহস্রাব্দবাদী এই সম্প্রদায় পনের শতকের শেষ দিকে ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত হয়) কয়েক ডজন সদস্যকে হত্যা করে। মাহদাবিদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ছিল। সম্ভবত এ কারণেও তাদের প্রতি এ ধরনের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। এর ৪০ বছর পর, তখন তারা তাদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলেছে, মাহদাবিদের একটি প্রতিনিধিদল রাজদরবারে আওরঙ্গজেব ও প্রধান কাজিকে বোঝাতে সক্ষম হন যে তারা নিরীহ, মূলধারার মুসলিম!

আওরঙ্গজেব বিচ্যুত বিবেচিত অরাজনৈতিক মুসলিম সম্প্রদায়গুলোর ওপরও চড়াও হয়েছিলেন। যুবরাজ থাকার সময় তিনি শিয়া সম্প্রদায়ের শাখা ইসমাইলি বোহরাদের লক্ষ্যবস্তু করেছিলেন। তিনি তাদের এক নেতাকে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব তার পুরো রাজত্বকালে ইসমাইলি বোহরাদের হয়রানি করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তিনি তার শাসনকালের অষ্টম বছরে বোহরা মসজিদগুলোতে সুন্নিদের মতোই দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার নির্দেশ দেন। তিনি কয়েক দশক পরও রাজকীয় বাহিনীর সৈন্যরা এই সম্প্রদায়ের সদস্যদের মাঝে মাঝেই গ্রেফতার করত।

পূর্ববর্তী মোগল শাসকদের মতো আওরঙ্গজেবও জনকল্যাণের নামে কোন কোন জিনিসের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে এবং ব্যক্তিগত অভিরুচির ব্যাপার হিসেবে কোনগুলোকে ছাড় দেওয়া হবে সে ব্যাপারে সতর্ক সীমারেখা টেনেছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সঙ্গীতও ব্যক্তিগত অভিরুচির বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। সাধারণভাবে মনে করা হয়ে থাকে, আওরঙ্গজেব তার পুরো সাম্রাজ্যে সঙ্গীত নিষিদ্ধ করেছিলেন। এ ভুল ধারণাটির অপনোদন করেছেন ক্যাথেরিন স্কোফিল্ডের মতো বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু তা সত্ত্বেও লোকরঞ্জক ধারণার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হয়নি। আওরঙ্গজেব তার নিজের দরবারে সামান্য কিছু ধরনের সঙ্গীত সীমিত করেছিলেন।

সম্ভবত আরো মজার ব্যাপার হলো, আওরঙ্গজেব কখনো তার আমলে অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যঙ্গমূলক কবিতা নিষিদ্ধ করেননি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শেষ বয়সে সরকারি কর্মকর্তা কামগর খানের দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে জনৈক কবি আদি রসাত্মক একটি কবিতা রচনা করেছিলেন। অপমানিত কামগর খান এতে বাদশাহের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। আওরঙ্গজেব জবাবে বলেন, ‘এই কবি আমাকে নিয়েও [ব্যঙ্গ কবিতা রচনা করতে ছাড়েনি। আর এর বিপরীতে আমি তার পারিশ্রমিক বাড়িয়ে দিয়েছি, যাতে [এজন্য হলেও] আর সে এ কাজ না করে, কিন্তু এর পরও সে [ব্যঙ্গ] রচনা কমায়নি।’ আওরঙ্গজেব তখন আবেদনটি খারিজ করে কামগর খানকে উপদেশ দেন, ‘আমাদের উচিত হবে আমাদের সংবেদনশীলতা অবদমিত করে সম্প্রীতিতে বসবাস করা।’

৬. হিন্দু সম্প্রদায়ের তত্ত্বাবধায়ক

মন্দিরের রক্ষক

[ইলোরা] হলো সত্যিকারের, অতিলৌকিক শিল্পীর [অর্থাৎ খোদা] নিপুণ হাতে গড়া বিস্ময় –ইলোরার হিন্দু, জৈন ও বৌদ্ধ মন্দিরগুলো সম্পর্কে আওরঙ্গজেবের ভাষ্য

আওরঙ্গজেবের সাম্রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে ছিল অসংখ্য হিন্দু ও জৈন মন্দির। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি সুরক্ষা পাওয়ার দাবিদার ছিল, এবং আওরঙ্গজেব সাধারণভাবে সেগুলোর সমৃদ্ধির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। আবার মোগল দৃষ্টিকোণ থেকে ওই কল্যাণকামী ধারণা বাতিল হতে পারত যদি নির্দিষ্ট মন্দির বা সেগুলোর সাথে সম্পৃক্তরা রাজকীয় স্বার্থের পরিপন্থী কাজ করত। এই নীতির আলোকে সম্রাট আওরঙ্গজেব তার পুরো শাসনকালে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়া মন্দির ধ্বংস ও অবমাননা করেছেন ।

আধুনিক অনেক লোক কিছু মন্দিরের ক্ষতি করার আওরঙ্গজেবের নির্দেশগুলোকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে বৃহত্তর প্রতিহিংসার প্রতিফলন হিসেবে দেখে থাকে। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির মূলে রয়েছে উপনিবেশ আমলের গবেষণা ৷ এই গবেষণায় সময়োত্তীর্ণ হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতিকে ব্রিটিশ ভাগ করে জয় করার কৌশলের আলোকে উপস্থাপন করা হয়। বর্তমানে অনেক ওয়েবসাইটে হিন্দুদের বিরুদ্ধে আওরঙ্গজেবের ‘নৃশংসতার’ তালিকা তুলে ধরে (ভাসা ভাসা তথ্য উপস্থাপন এসব সাইটের অন্যতম বৈশিষ্ট্য) সাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় ইন্ধন দিয়ে থাকে। আওরঙ্গজেব হিন্দুদের প্রতি ঘৃণা থেকে কতটি মন্দির ধ্বংস করেছিলেন, তার প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিস্তর মতভেদ রয়েছে। সবচেয়ে চোখ ধাঁধানো ব্যাপার হলো, আওরঙ্গজেব তার সাম্রাজ্যে হাজার হাজার মন্দির গণনা করলেও বাস্তবে তিনি সর্বোচ্চ মাত্র গুটি কতেক মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। এই অসমঞ্জস্যতা অর্থপূর্ণ মনে হবে না যদি এই বদ্ধমূল ধারণা পোষণ করা হয় যে আওরঙ্গজেব ছিলেন ভারতকে হিন্দু উপাসনা স্থান শূন্য করার একনিষ্ঠ এজেন্ডায় পরিচালিত ব্যঙ্গচিত্র ধর্মান্ধ। তবে আওরঙ্গজেবের ঐতিহাসিকভাবে যুক্তিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই ব্যাখ্যা করতে হবে, কেন তিনি যত হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছিলেন, তার চেয়ে বেশি মন্দির তিনি সুরক্ষিত রেখেছিলেন।

আওরঙ্গজেব আসলে অমুসলিম ধর্মীয় নেতা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষার ব্যবস্থা করার ইসলামি আইন অনুসরণ করেছিলেন। অষ্টম শতক থেকে ইন্দো মুসলিম শাসকেরা হিন্দুদেরকে জিম্মি তথা ইসলামি আইনে সংরক্ষিত শ্রেণি গণ্য করতেন। এর ফলে হিন্দুরা বিশেষ কিছু অধিকার ও রাষ্ট্রীয় রক্ষাকবচের অধিকারী হতো। অবশ্য, হিন্দু ও জৈন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে আওরঙ্গজেব ইসলামি আইনের সীমারেখা ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। বরং আওরঙ্গজেবের কাছে মন্দির সুরক্ষিত রাখা ও মাঝে মাঝে ধ্বংস করার কাজটি মোগল সাম্রাজ্যজুড়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার কারণ হিসেবে ব্যবহৃত হতো ।

আওরঙ্গজেবের ন্যায়বিচারের ধারণার মধ্যে ধর্মীয় স্বাধীনতার নির্দিষ্ট কিছু ব্যবস্থাও ছিল। এ কারণেই তিনি হিন্দু উপাসনার বেশির ভাগ স্থানকে সুরক্ষিত রেখেছিলেন। সাধারণভাবে মোগল শাসকেরা প্রজাদেরকে তাদের নিজস্ব ধর্মীয় ধারণা ও প্রবণতা অনুসরণ করার জন্য বিপুল আনুকূল্য প্রদর্শন করতেন। এটি ছিল ওই আমলে অনেক ইউরোপিয়ান দেশের কঠোর বিধানের সম্পূর্ণ বিপরীত 1 ওইসব দেশে শাসকদের ধর্মই অনুসরণ করতে হতো প্রজাদের। অবশ্য, রাষ্ট্রীয় স্বার্থ মোগল ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতায় চাপ সৃষ্টি করত। আর আওরঙ্গজেবও তার মনে হওয়া বিদ্রোহ বা অনৈতিক আচরণের ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও নেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর আঘাত হানতে দ্বিধা করতেন না। তবে এ ধরনের উদ্বেগ না থাকলে সব ভারতীয়ের প্রতি সমান আচরণ করার ব্যাপারে নিজের বিশ্বাসই আওরঙ্গজেবকে মন্দিরের প্রতি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে দিতে উদ্বুদ্ধ করত।

মেবারের হিন্দু রাজপুত শাসক রানা জয় সিংয়ের কাছে ১৬৫৪ সালে পাঠানো এক রাজাদেশে (ফারসিতে নিশান) আওরঙ্গজেব মন্দির ও অন্যান্য অমুসলিম ধর্মীয় স্থাপনার প্রতি একজন ভালো রাজার আচরণ সম্পর্কে একটি রূপরেখা দিয়েছেন। এতে তিনি লিখেছেন : ‘মহান রাজারা খোদার ছায়া হওয়ায় খোদার দরবারের স্তম্ভ এসব উচ্চ মর্যাদার লোকের নজর নিবেদিত থাকে এই কাজে যাতে : বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন ধর্মের (মাজাহিব) লোকজন শান্তির ছায়াতলে বাস করতে পারে, সমৃদ্ধিতে তাদের দিন গুজরান করতে পারে, কেউ যেন অন্যদের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে না পারে।’ আদব দুরস্ত ফরাসির মনোরম রীতি থেকে সরে এসে আমরা আওরঙ্গজেবের বক্তব্য হিসেবে যা পাই তা হলো : রাজারা হলো দুনিয়াতে আল্লাহর প্রতিনিধি এবং এ কারণে ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে শাস্তি নিশ্চিত করার দায়িত্ব রয়েছে তাদের।

ওই একই রাজাদেশে ‘গোঁড়ামির (তাসুর) আশ্রয় নেওয়া’ সব রাজার নিন্দা করেছেন এ কারণে যে ওই শাসক ‘খোদার সমৃদ্ধ সৃষ্টিকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছেন এবং ঐশী ভিত্তিকে ধ্বংস করছেন।’ সিংহাসনে আসীন হলে আওরঙ্গজেব এ ধরনের অনৈপ্লামিক ব্যবস্থার দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে এর বদলে নিজের ‘পূর্বসূরিদের শ্রদ্ধামূলক রীতি ও প্রতিষ্ঠিত বিধান’ অনুসরণ করে ‘চার কোণযুক্ত বসতিময় বিশ্বকে দীপ্তিময়’ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেবের দৃষ্টিতে ইসলামি শিক্ষা ও মোগল ঐতিহ্য তাকে হিন্দু মন্দির, তীর্থযাত্রীদের তীর্থস্থান ও সাধু পুরুষদের রক্ষা করতে বাধ্য করেছে।

আওরঙ্গজেব মোগল সাম্রাজ্যে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা পরিচর্যা করার ব্যাপারে তার রাজকীয় প্রতিশ্রুতির প্রতি বিশ্বস্ততা থাকার জন্য ৪৯টি বছর পেয়েছিলেন এবং তিনি শুরু করেছিলেন দৃঢ়ভাবে। সম্রাট হিসেবে আওরঙ্গজেবের প্রথম দিকের একটি কাজ ছিল বেনারসের স্থানীয় মোগল কর্মকর্তাদের এই রাজকীয় নির্দেশ (ফরমান) প্রদান যে স্থানীয় মন্দিরগুলোর কার্যক্রমে যেন কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ না হয়। ১৬৫৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আওরঙ্গজেব লিখেন যে তিনি জানতে পেরেছেন যে ‘কিছু লোক বিদ্বেষপরায়ণতা ও তিক্ততার কারণে বেনারস ও কাছের কয়েকটি এলাকায় সেখানকার প্রাচীন মন্দিরগুলোর দায়িত্বে থাকা একদল ব্রাহ্মণসহ হিন্দু অধিবাসীদের হয়রানি করছে।’ সম্রাট এরপর কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন : ‘ব্রাহ্মণ বা অন্য হিন্দুরা যাতে তাদের ঐতিহ্যবাহী এলাকায় অবস্থান করে সাম্রাজ্যের ধারাবাহিকতার জন্য দোয়া করতে পারে, সেজন্য তোমাকে অবশ্যই নজর রাখতে হবে সেখানে তাদেরকে কেউ যেন অন্যায়ভাবে হয়রানি করতে না পারে।’

মন্দির ও সেগুলোর তত্ত্বাবধায়কদের রক্ষার জন্য আওরঙ্গজেবের ১৬৫৯ সালের বেনারস ফরমানের শেষ অংশটি তার লেখা অনেক রাজকীয় আদেশের সাধারণ ধ্রুববাক্যে পরিণত হয়। তিনি তাতে বলেছিলেন, তাদেরকে তাদের মতো করে রাখতে হবে, যাতে মোগল সাম্রাজ্যের দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য ব্রাহ্মণরা দোয়া করতে পারে।

রাজ্য শাসনকালের পুরো সময়জুড়ে আওরঙ্গজেবের অবিচ্ছেদ্য নীতি ছিল হিন্দু ধর্মের প্রতিষ্ঠান ও তাদের নেতাদের কল্যাণ নিশ্চিত করা। তিনি অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ থেকে মন্দিরগুলোকে রক্ষা করার জন্য, হিন্দু সম্প্রদায়কে ভূমি মঞ্জুর করার জন্য এবং হিন্দু আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বদের বৃত্তি প্রদান করার জন্য অনেক নির্দেশ জারি করেছিলেন।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শাসনকালের নবম বছরে গৌহাটির উমানন্দ মন্দিরকে পূর্ববর্তী ভূমিদান ও রাজস্ব সংগ্রহের অধিকার বহাল রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করে একটি ফরমান জারি করেন। ১৬৮০ সালে তিনি নির্দেশ দেন যে বেনারসে গঙ্গার তীরে বসবাসকারী হিন্দু সন্ন্যাসী ভগবন্ত গোসাহঁকে যেন হয়রানিমুক্তভাবে থাকতে দেওয়া হয়। ১৬৮৭ সালে তিনি বেনারসের একটি ঘাটে থাকা কিছু ফাঁকা স্থান (ঘটনাক্রমে ওই জমি ছিল একটি মসজিদের কাছে) রামজীবন গোসাইঁকে দেওয়ার নির্দেশ দেন, যাতে তিনি ‘ধার্মিক ব্রাহ্মণ ও পবিত্র দরবেশদের’ জন্য ঘর তুলতে পারেন। ১৬৯১ সালে বালাজি মন্দিরকে সহায়তার লক্ষ্যে চিত্রকূটের মহন্ত বালক দাস নিবানিকে আটটি গ্রাম ও বেশ ভালো পরিমাণ করমুক্ত ভূমি মঞ্জুর করেন আওরঙ্গজেব। ১৬৮৮ সালে মধ্য ভারতের পূর্ব খানদেশে নেক ভট্টের ছেলে রং ভট্ট নামের এক ব্রাহ্মণকে তিনি করমুক্ত ভূমি মঞ্জুর করেন। তালিকাটি বেশ বড় এবং এতে এলাহাবাদ, বৃন্দাবন, বিহার ও অন্যান্য স্থানে মন্দির ও ব্যক্তিদের নাম রয়েছে।

হিন্দু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অনুকূলে মঞ্জুরি প্রদান করার পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য বহাল রাখেন আওরঙ্গজেব। এই ধারাবাহিকতা ফুটে ওঠে জঙ্গম নামের এক শৈব গ্রুপের সাথে তার আচরণে। গ্রুপটি আকবরের আমল থেকে মোগল আদেশ থেকে উপকৃত হয়ে আসছিল। আকবরই ১৫৬৪ সাল থেকে ভূমিতে তাদের আইনত অধিকার নিশ্চিত করেন। এ গ্রুপটি আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে বেশ কিছু ফরমান লাভ করেন। এসবের ভিত্তিতে তারা অন্যায়ভাবে বাজেয়াপ্ত হওয়া ভূমি ফিরে পায় (১৬৬৭), স্থানীয় মুসলিমদের বাধা থেকে সুরক্ষা প্রাপ্তি ঘটে (১৬৭২) ও অবৈধভাবে ধার্য কর ফেরত পেয়ে যায় (১৬৭৪)। এসব পদক্ষেপে নিশ্চিত হওয়া যায় যে ধার্মিক ব্যক্তিরা তাদের ধর্মীয় কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারতেন। আর তা ছিল আওরঙ্গেেজবর ন্যায়বিচার অন্তঃদৃষ্টির একটি অনুষঙ্গ ।

আওরঙ্গজেব জৈন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিও একই ধরনের অনুকূল নীতি বাস্তবায়ন করেছেন। এখানেও আকবরের উদাহরণ অনুসরণ করে ১৬৫০ এর দশকের শেষ দিকে শত্রুঞ্জয়, গিরনার ও মাউন্ট আবুতে (তিনটি স্থানই ছিল জৈন তীর্থযাত্রীদের গন্তব্য) ভূমি মঞ্জুর করেন। তিনি সম্ভবত ১৬৮১ সালের আগে কোনো একসময় জৈন সন্ন্যাসী লাল বিজয়কে একটি আখড়া (পশাল) এবং ১৬৭৯ সালে একটি বিশ্রামাগার (উপাশ্রয়) মঞ্জুর করেন। ১৭০৩ সালের দিকে আওরঙ্গজেব জনৈক জৈন ধর্মীয় নেতা জিনা চন্দ্র সুরিকে হয়রানি থেকে রক্ষা করার নির্দেশ জারি করেন। এ ধরনের নির্দেশনার ফলে এই সময়কালের জৈন সাহিত্যে সম্রাটের উচ্ছ্বসিত প্রশংসার কারণ বুঝতে পারি। একটি স্থানে বলা হয়েছে, ‘আওরঙ্গজেব শাহ সাহসী ও শক্তিশালী রাজা’ (মারদানো আওর মহাবলী আওরঙ্গশাহি নারান্দা)।

আওরঙ্গজেব ১৬৭২ সালে হিন্দুদের দেওয়া সব ভূমি ফিরিয়ে নেওয়া ও এ ধরনের সব বন্দোবস্তু কেবল মুসলিমদের জন্য নির্ধারিত করার একটি আদেশ জারি করেন। সম্ভবত আলেমদের দাবির প্রতি এটি ছিল একটি ছাড়। এই নির্দেশ কঠোরভাবে পালন করা হলে তা হতে পারত হিন্দু ও জৈন সম্প্রদায়ের জন্য বড় ধরনের আঘাত। কিন্তু ঐতিহাসিক প্রমাণ বলে ভিন্ন কথা।

ভূমি দানের নতুন নীতি বিশেষ করে সাম্রাজ্যের দূর প্রত্যন্ত এলাকায় বাস্তবায়ন করা হয়নি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলার মোগল কর্মকর্তারা ১৬৭২ সালের নির্দেশ জারির আগে হিন্দুদেরকে যত ভূমি বন্দোবস্তু দিয়েছিলেন, পরে দিয়েছিলেন তার চেয়ে বেশি। স্বতন্ত্র ঘটনাগুলোর প্রাচুর্যও ইঙ্গিত দেয় যে ভূমি ফিরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ ছিল কাগজে-কলমে, বাস্তবে নয়। উদাহরণ হিসেবে গুজরাতের কথা বলা যেতে পারে। আওরঙ্গজেবের শাসনকালের শেষ দিকে চিকিৎসকদের একটি পারসি পারিবার ১৭০২ সালের আগে পাওয়া ভূমি মঞ্জুরের নিশ্চয়তাপত্র পেয়েছিল। একইভাবে আগেই অন্যান্য অঞ্চলের যে বিপুলসংখ্যক উদাহরণ আমি উল্লেখ করেছি, তাতে ওই নীতির সীমিত বাস্তবায়নের ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রমাণের ভিত্তিতে আধুনিক অনেক ইতিহাসবিদ মনে করছেন যে ১৬৭২ সালের নির্দেশটি কার্যত সাম্রাজ্যের কোথাও বাস্তবায়িত হয়নি, পাঞ্জাবের মতো কিছু নির্দিষ্ট এলাকা ছাড়া তা ‘কাগজপত্রেই থেকে যায় ৷

আরো অনেক সময় হিন্দু মন্দিরগুলোর প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আওরঙ্গজেব। উদাহরণ হিসেবে আগেই উল্লেখ করা ১৬৫৯ সালের বেনারস নির্দেশের কথা বলা যায়। এতে আওরঙ্গজেব জানিয়েছেন, ইসলামি আইনের বিধান অনুযায়ী, ‘প্রাচীন কোনো মন্দির ভাঙ্গা যাবে না।’ তবে এতে আরো যোগ করা হয়েছে, ‘নতুন কোনো মন্দির নির্মাণ করা যাবে না।’ রিচার্ড ইটন উল্লেখ করেছেন, এটি বেনারসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল, আওরঙ্গজেবের শাসনকালে সাম্রাজ্যের অন্যত্র অসংখ্য মন্দির নির্মিত হয়েছে। কিন্তু তবুও এ নির্দেশটি ছিল আগেকার মোগল নীতির থেকে সরে যাওয়া। উল্লেখ্য, এ নীতিটি আওরঙ্গজেবের হিন্দু মন্দির রক্ষার জটিলতা (এবং সেইসাথে সীমা) প্রকাশ করে।

মন্দির ধ্বংসকারী

কোনো প্রাচীন মূর্তির মন্দির ভেঙ্গে ফেলা বৈধ নয় এবং প্রাচীন কাল থেকে প্রথা হিসেবে চালু থাকা সরোবরে প্রক্ষালন নিষিদ্ধ করাও দায়িত্ব আপনার নয় ৷
–ভবিষ্যত দিল্লির সুলতান সিকান্দার লোদির (শাসনকাল ১৪৮৯-১৫১৭) প্রতি মুফতিদের উপদেশ

মোগল সাম্রাজ্যজুড়ে থাকা লাখ লাখ মন্দিরের সবগুলো না হলেও বেশির ভাগই আওরঙ্গজেবের আমলের শেষ সময় পর্যন্ত টিকে ছিল।

আওরঙ্গজেবের নির্দেশে ঠিক কতটি মন্দির ধ্বংস বা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তা কেউ জানে না, আমরা কখনো জানতেও পারব না। আওরঙ্গজেবের শাসনকালে মন্দির ধ্বংসের নিশ্চিত সংখ্যা মাত্র এক ডজনের সামান্য কিছু বেশি বলে উল্লেখ করেছেন এ বিষয়ক শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞ রিচার্ড ইটন। আর এগুলোর মধ্যে সরাসরি সম্রাটের নির্দেশে ধ্বংস করা হয়েছে আরো কম । অন্যান্য বিশেষজ্ঞ ইটনের উল্লেখ না করা আরো কয়েকটি মন্দির ধ্বংসের কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ১৬৫৯ ও ১৭০৬ সালে সোমনাথ মন্দির ধ্বংস-সংক্রান্ত দুটি নির্দেশ (দ্বিতীয় নির্দেশটির অস্তিত্ব থাকার অর্থ হচ্ছে, প্রথম নির্দেশটি বাস্তবায়িত হয়নি)। আওরঙ্গজেব নিজেও মন্দির অপবিত্রকরণ তদারকি করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৪৫ সালে তিনি জৈন বণিক শান্তিদাসের নির্মিত আহমদাবাদের চিন্তামনি পার্শ্বনাথ মন্দিরে মিরহাব (মুসলিমদের মসজিদে নামাজের নির্দেশসূচক) তোলার নির্দেশ দেন। কিন্তু এমনকি এ ধরনের ক্ষেত্রেও ইটন উদ্ধৃতি হলো, ‘প্রায় সবসময়ই প্ৰমাণ অতিরঞ্জিত, অসম্পূর্ণ ও এমনকি সাংঘর্ষিক।’ এমন প্রেক্ষাপটে বলা যায়, আমরা যতগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারি, আওরঙ্গজেবের আমলে সম্ভবত তার চেয়ে বেশি মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিল (হয়তো মোটে কয়েক ডজন?), কিন্তু এখানে আমরা অজ্ঞাত অতীতের ওপর টেনে দেওয়া কালো পর্দার মুখোমুখি হই ।

অবশ্য, ক্ষীণ যে কয়েকটি রশ্মি আছে, তার আলো থেকে আমরা ধরে নিতে পারি যে আওরঙ্গজেবের ভারতবর্ষে মন্দির ধ্বংস ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক কম। উদাহরণ হিসেবে সাকি মস্তাইদ খানের মাসির-ই আলমগিরে (আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর সামান্য পরে লিখিত ফারসি ভাষায় ইতিহাসপুঞ্জি) ১৬৭০ সালে মথুরার কেশব দেব মন্দির গুঁড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশের কথা বলা যেতে পারে। এটিকে দৃশ্যত একেবারে ভিত্তিহীন বিরল ও অসম্ভব ঘটনা’ হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। সার্বিকভাবে মাসির-ই আলমগিরি হলো ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা আওরঙ্গজেবের শাসনকাল। এখানে অনেক সময় লেখকের অভিরুচি অনুযায়ী তথ্য পরিবর্তন করা হয়েছে। এই প্রবণতার মানে হলো এই যে এ গ্রন্থটি (এটি ইতিহাস নয়, বরং বাগাড়ম্বড়তার শিল্পকর্ম) থেকে উদ্ধৃতি দেওয়ার সময় চরম সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। মাসির-ই আলমগিরিতে আওরঙ্গজেবের হাতে ভাঙ্গা মন্দিরের সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানোর বিষয়টি প্রমাণিত। এতে এমন সব গাল-গল্প উল্লেখ করা হয়েছে যেসব ঘটা অস্বাভাবিক ও অপ্রত্যাশিত ।

উপনিবেশ-পূর্ব আমলের ভারতবর্ষে মন্দির ভাঙ্গার ব্যাপারটি ইটনের মতে, “সংখ্যার খেলায় কাটাকাটিতে মেতে ওঠা’ একটি পণ্ডশ্রম। আওরঙ্গজেব কেন সুনির্দিষ্ট কিছু হিন্দু মন্দিরকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিলেন, আর বিশালসংখ্যক মন্দিরকে স্পর্শ করার বাইরে রেখেছিলেন. তা নিয়ে যুক্তি পুনঃগঠনের জন্য আমরা আরো দৃঢ় ভিত্তির ওপর অবস্থান করছি।

রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের কারণেই নির্দিষ্ট হিন্দু মন্দিরগুলোর ওপর হামলা চালাতে প্ররোচিত হয়েছিলেন আওরঙ্গজেব। আওরঙ্গজেব ১৬৬৯ সালে বেনারসের বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারপর ১৬৭০ সালে কেশব দেব মন্দির গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। উভয় ক্ষেত্রেই আওরঙ্গজেব মন্দিরের সাথে সম্পৃক্তদেরকে তাদের রাজনৈতিক ভুল পদক্ষেপের শাস্তি দিতে চেয়েছিলেন এবং মোগল রাষ্ট্রের প্রতি তাদের ভবিষ্যতের আনুগত্য নিশ্চিত করতে চেয়েছেন ।

ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক কারণে ধ্বংস করার ধারণাটি আধুনিক অনেক লোকের কাছে অগ্রহণযোগ্য বিবেচিত হলেও প্রাক-আধুনিক ভারতবর্ষে ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে এ ধরনের জোরালো রেখা টানা ছিল না। বরং এর বিপরীতে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ই মন্দিরকে ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক পদক্ষেপের সাথে সম্পর্কিত মনে করত। সম্ভবত ষোড়শ শতকে লিখিত সংস্কৃত গ্রন্থ বৃহতসংহিতায় সতর্ক করা হয়েছে যে ‘দৃশ্যমান কারণ ছাড়া যদি কোনো শিবলিঙ্গ, ছবি বা মন্দির ভেঙ্গে যায়, সরে যায়, ঘাম নির্গত হয়, কাঁদে, কথা বলে বা অন্য কিছু করে, তবে ওই রাজা ও তার রাজ্য ভেঙে পড়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হচ্ছে।’ ধর্মীয় প্রতিমার রাজনৈতিক শক্তি থাকার এই বক্তব্যের আলোকে হিন্দু রাজারা সপ্তম শতক থেকে একে অন্যের মন্দিরগুলো লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতেন, নিয়মিতভাবে দুর্গা, গনেশ, বিষ্ণু ইত্যাদি দেব-দেবীর মূর্তি লুটপাট করতেন, ভেঙে ফেলতেন। তারা নিয়মিতভাবে একে অপরের মন্দিরগুলো ধ্বংস করতেন। কোনো কোনো হিন্দু রাজা এ ধরনের কাজকে উদযাপন ও স্মরণে রাখার জন্য সংস্কৃত কবিতা রচনা করতেন। আওরঙ্গজেবের মতো ইন্দো-মুসলিম শাসকেরা এর আলোকে শাস্তিমূলক রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ হিসেবে হিন্দু মন্দিরগুলোকে বৈধ লক্ষ্যবস্তু বিবেচনা করতেন।

আওরঙ্গজেব ১৬৬৯ সালে বেনারসের বিশ্বনাথের মন্দিরের বড় অংশ ভেঙ্গে ফেলেন। আকবরের আমলে রাজা মানসিং মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন । অনেকে মনে করেন, মানসিংহের নাতির ছেলে জয় সিং ১৬৬৬ সালে মোগল দরবার থেকে শিবাজি ও তার ছেলে শম্ভুজিকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন। এই জয় সিংই এর আগে পুরান্দারে শিবাজির বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়েছিলেন । এছাড়া ১৬৬৯ সালে বিশ্বনাথ মন্দিরের সাথে সম্পর্কিত বেনারসের অনেক জমিদারদের মধ্যে একটি বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। তাদের অনেকেও শিবাজির পলায়নের সাথে জড়িত ছিলেন।

আওরঙ্গজেব ১৬৭০ সালে মাথুরার কেশব দেব মন্দিরটি নিশ্চিহ্ন করার নির্দেশ দেন। ১৬১৮ সালে বীর সিং বুন্দেলার নির্মিত এ মন্দিরটি ভাঙ্গার পেছনেও ছিল রাজনৈতিক কারণ। মাথুরার ব্রাহ্মণরা সম্ভবত ১৬৬৬ সালে শিবাজির আগ্রা থেকে চলে যেতে সহায়তা করেছিলেন। অধিকন্তু কেশব দেব মন্দিরটির পৃষ্ঠপোষকতা করতেন সিংহাসনে আওরঙ্গজেবের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দারা শুকোহ। আরো কাছাকাছি সময়ে, তথা ১৬৬৯ ও ১৬৭০ সালে ওই অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া জাট বিদ্রোহে মোগলদের ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। পরে বছরগুলোতে যোধপুর, খান্দেলা ও অন্যান্য অঞ্চলে একই কারণে মন্দির ধ্বংস করার নির্দেশ দেন আওরঙ্গজেব ।

বিশ্বনাথ ও কেশব দেব মন্দিরের উভয়স্থানেই মসজিদ নির্মিত হয়, তবে তা ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে। বিধ্বস্ত মন্দিরটির প্রাচীরের কিছু অংশ ভবনটির সাথে একীভূত করে নির্মিত জ্ঞানবাপি মসজিদটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে। এই পুনঃব্যবহারের কারণ সম্ভবত এটি মোগল কর্তৃত্ব বিরোধিতার ভয়ঙ্কর পরিণাম সম্পর্কে ধর্মীয় আবরণে দেওয়া একটি বিবৃতি। ব্যবহার করায় সুবিধা থাকাও সম্ভবত পুনঃব্যবহারের একটি কারণ। জ্ঞানবাপি মসজিদটি আওরঙ্গজেবের আমলে নির্মিত হলেও এর পৃষ্ঠপোষকের নাম জানা যায় না, কাঠামোটির কথাও মোগল নথিপত্রে নেই ।

মাথুরার কেশব দেবের মন্দিরের স্থানে নির্মিত মসজিদটির পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন আওরঙ্গজেব। জাট বিদ্রোহের সময়কার মোগল কমান্ডার ও মাথুরার প্রধান মসজিদের পৃষ্ঠপোষক আবদুল নবি খানের মৃত্যুর ঘটনার মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। আবদুল নবির মৃত্যুর (এতে মাথুরার মসজিদগুলোর পৃষ্ঠপোষতা হ্রাস পেয়েছিল) মাত্র আট মাস পর কেশব দেব মন্দিরটি ধ্বংস করা হয়।

আমরা মোগল মন্দির ধ্বংস নিয়ে রাজনীতি পুনঃনির্মাণ করতে পারলেও মধ্য যুগের পর্যবেক্ষকেরা, যদি করেও থাকেন, খুব কমই কখনো কিছু স্থানে হামলার বাস্তব রাজনৈতিক যুক্তির ওপর জোর দিয়েছিলেন। অনেক হিন্দু ও জৈন চিন্তাবিদ মন্দির ধ্বংসকে কলি যুগ বা বর্তমান সময়ের আবির্ভাব হিসেবে দেখেছেন। মন্দির ধ্বংসের বর্ণনা করার সময় মুসলিম লেখকেরা সাধারণভাবে জিহাদ বা অন্য কোনো ধর্মভিত্তিক ধারণা তুলে ধরেছেন। ইসলামি প্রবণতাটির মূল সম্ভবত নিহিত রয়েছে এই ধারণায় যে ইসলামি আইনে সরকারের স্বার্থে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিসাধন অনুমোদন করে না। ফলে ইসলাম বিস্তারের যুক্তি উপস্থাপন ছিল ওই কাজের যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করা। এই যুক্তি সাংস্কৃতিকভাবে যথাযথ হলেও আওরঙ্গজেবের ভারতবর্ষে মন্দির ধ্বংসের ঐতিহাসিকভাবে ব্যাপকভিত্তিক ব্যাখ্যা দিতে পারে না।

আওরঙ্গজেব কেন কিছু মন্দির ধ্বংস করলেন এবং অন্যগুলো একেবারে অক্ষত রেখে দিলেন তার ব্যাখ্যা ইতিহাসের আলোকে কলি যুগ ও জিহাদ তত্ত্ব দিতে না পারলেও বিকল্প ধর্মীয় কারণও বিরাজ করতে দেখা যায়। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর ইতিহাস রচনাকারী মুস্তাইদ খান বলেছেন যে ১৬৬৯ সালে আওরঙ্গজেব জানতে পারেন যে ‘থাট্টা, মুলতান ও বেনারসের কিছু বিচ্যুৎ ব্রাহ্মণ তাদের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভ্রান্ত বই পড়াচ্ছেন। তাদের কাছ থেকে ভ্রষ্ট শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য দূর দূরান্ত থেকে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোকজন সেখানে যাচ্ছে।’ মাথুরার কেশব দেব মন্দিরের ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য হতে পারে। সেই জাহাঙ্গীরের আমলেও এ মন্দিরটির দিকে মুসলিমরা আকৃষ্ট হয়েছিল।

মোগল বাদশাহদের কয়েকটি প্রজন্ম নির্দিষ্ট কিছু ধর্মীয় আচরণ, বিশেষ করে মোগলদের দৃষ্টিতে অপেক্ষাকৃত কম মার্জিত হওয়ার সুযোগ গ্রহণকারী ভ্রান্ত ব্রাহ্মণদের দমন করার চেষ্টা করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আকবর নিম্নবর্ণের লোকদের কাছে হিন্দু গ্রন্থগুলোর ভুলভাবে উপস্থাপনের জন্য ব্রাহ্মণদের দায়ী করেছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন যে সংস্কৃত পুস্তকগুলো ফারসিতে অনুবাদ করা হলে (তার দৃষ্টিতে) এসব ঔদ্ধত্যপূর্ণ নেতা তাদের পথ সংশোধন করতে উদ্দীপ্ত হবেন ।

আওরঙ্গজেবও সাধারণ হিন্দুদের প্রতারিত করার লক্ষ্যে ব্রাহ্মণদের নিজেদের ধর্ম সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করতেন, এবং সম্ভবত বিশেষভাবে আতঙ্কিত ছিলেন এই ভেবে যে, মুসলিমরা ভণ্ড লোকদের খপ্পরে পড়ে যাচ্ছে। এ ধরনের প্রতারণার মাধ্যমে ব্রাহ্মণরা আর্থিকভাবেও লাভবান হতেন। ফরাসি পর্যটক জ্যাঁ ডি থেভেনট অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে বেনারসে ব্রাহ্মণদের সংখ্যা অনেক এবং তারা বিপুলসংখ্যক লোককে টেনে আনা বড় বড় অনুষ্ঠান থেকে ‘লাভবান হওয়ার পথ খোঁজে। এ ধরনের ক্ষেত্রে মোগল রাজকীয় বাধ্যবাধকতা ছিল তাদের প্রজাদেরকে প্রতারিত হওয়া প্রতিরোধ করার জন্য দায়িত্বশীল ভূমিকা গ্রহণ। বেনারস ও অন্যান্য স্থানের বেশির ভাগ মন্দিরে ভ্রান্ত কার্যকলাপ হয় কিনা তার অনুসন্ধান করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন আওরঙ্গজেব। তবে বিশ্বনাথ ও কেশব দেব মন্দিরের ক্ষেত্রে তার মনে হয়েছিল, ধ্বংস করাই হবে যথাযথ ।

আওরঙ্গজেবের লক্ষ্যবস্তু হওয়া বেশির ভাগ মন্দির ছিল উত্তর ভারতে। গুটিকতেক ব্যতিক্রম ছাড়া আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের কোনো মন্দির ধ্বংস করেননি। অথচ এখানেই তার জীবনের শেষ তিন দশক মোগল সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের কাজে তার সেনাবাহিনী নিয়োজিত ছিল। মধ্য ও দক্ষিণ ভারতে অসংখ্য মন্দির ভেঙ্গে ফেলা সম্ভব ছিল। কারণ মোগলরা এসব এলাকায় তাদের সামরিক শক্তি দুর্গ ও অন্যান্য সামরিক লক্ষ্যবস্তুগুলোর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেছিল। কিন্তু আওরঙ্গজেব মোগল সাম্রাজ্যে নতুন নতুন এলাকা সফলভাবে একীভূত করার সাথে মন্দির ভাঙ্গাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে বিবেচনা করেননি।

এমনকি আওরঙ্গজেব যখন দক্ষিণ দিকে মোগল শাসন সম্প্রসারণের পথে ব্যাপক প্রতিরোধের মুখে পড়েছিলেন, তখনো তিনি প্রয়োজনের আলোকে অন্যান্য কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে, আওরঙ্গজেব ও তার কর্মকর্তারা মনে করতেন যে মন্দির ভাঙ্গা হলো চরম পদক্ষেপ, তাই এর ব্যবহার করতে হবে খুবই কম!

৭. শেষ সময়

দাক্ষিণাত্য বিজয়

আমি এই দুনিয়ার মানুষদেরকে খুবই লোভী দেখেছি, আওরঙ্গজেব আলমগিরের মতো সম্রাট একেবারে বিনা কারণে এত ব্যাকুলতা ও আবেগ নিয়ে দুর্গ দখল করেন যে মনে হয় তিনি ব্যক্তিগতভাবে কিছু পাথরের স্তূপের জন্য হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটছেন ।
–হিন্দু সৈনিক ভীমসেন স্যাক্সেনার ফারসি স্মৃতিকথা, ১৭০৭

যদি কোনো দরবেশ অর্ধেক রুটি খান, তবে তিনি বাকিটা দেবেন কোনো গরিবকে।
রাজা কোনো পুরো ভূখণ্ড জয় করলেও তিনি আরেকটির জন্য ব্যাগ্র হয়ে ওঠেন।
–সাদি, গুলিস্তাঁ

আওরঙ্গজেব ১৬৮০-এর দশকের প্রথম দিকে দিল্লির ময়ূর সিংহাসন পেছনে ফেলে দাক্ষিণাত্যের দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি দাক্ষিণাত্যে মোগল সম্প্রসারণ অভিযানে একের পর এক কমান্ডারকে পরিচালনা করছিলেন, কিন্তু কোনো কিছুতেই কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাননি। দাক্ষিণাত্যের প্রতি মোগলদের আকর্ষণ ছিল সেই আকবরের আমল থেকে, আগের শতকে তারা ওই এলাকায় অনেকগুলো সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছিল। কিন্তু আওরঙ্গজেব দক্ষিণ ভারত জয় করার জন্য নজিরবিহীন সম্পদ নিয়োজিত করেছিলেন, নিজেও জীবনের শেষ দশকগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে কাটিয়েছেন ।

আওরঙ্গজেব তার সব জীবিত ছেলে (যুবরাজ আকবর ছাড়া, তিনি ছিলেন বিদ্রোহী) ও হেরেমসহ বিপুলসংখ্যক সহকর্মী নিয়ে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে গেলেন। চলমান তাঁবু শিবিরের সাথে নিশ্চিতভাবেই ভ্রাম্যমান বাজার, সেনাবাহিনী, আমলাতান্ত্রিক কর্মকর্তা ও চাকর-বাকরের দল ছিল। কয়েক মাস পথ চলার পর কাফেলা দাক্ষিণাত্যে পৌঁছে, বিজয়ের দিকে দৃষ্টি ফেললেন আওরঙ্গজেব ।

মোগল সম্রাটেরা অনেক সময়ই চলমান অবস্থায় থাকতেন, আওরঙ্গজেব সম্রাটের সাথে রাজধানী নিয়ে চলাচল করার মহান মোগল ঐতিহ্য অনুসরণ করেছিলেন। তবে আওরঙ্গজেবের পদক্ষেপে অভিনবত্ব যা ছিল তা এই যে তিনি রাজধানী স্থায়ীভাবে দক্ষিণ দিকে সরিয়ে নেন। তার অনুপস্থিতিতে ও জনসংখ্যা বেশ কমে যাওয়ায় অনেকের কাছে দিল্লি পরিণত হয় ভুতুরে নগরীতে। লাল কেল্লার কক্ষগুলো ধূলিমলিন হয়ে সফরকারী দূতদের যাওয়ার অনুপযুক্ত বিবেচিত হয় ।

ভূখণ্ডগত সম্প্রসারণের পরিভাষায় আওরঙ্গজেব তার দাক্ষিণাত্য অভিযানে নজিরবিহীন সাফল্য লাভ করেন। উপমহাদেশের দক্ষিণাংশজুড়ে মোগল নিয়ন্ত্ৰণ সম্প্রসারণের জন্য তিনি সামরিক ও কূটনীতি উভয় সম্পদই ব্যবহার করেন । কিন্তু আওরঙ্গজেব জীবিত কালেই দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধগুলো অপ্রত্যাশিতভাবে ইঙ্গিত দিতে থাকে যে মোগল সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত ভালো নয়। আওরঙ্গজেবের শেষ দশকগুলোর নির্মম আক্রমণ ও সীমাহীন অবরোধ ছিল কৃত্রিমভাবে সাফল্যপূর্ণ, তবে চূড়ান্তভাবে ফাঁপা ।

দাক্ষিণাত্যে আওরঙ্গজেবের অনেক বিজয়ের মধ্যে বিজাপুর ও গোলকোন্ডা জয় ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, অবশ্য তা ছিল বেশ ব্যয়বহুলও ।

আওরঙ্গজেব ১৬৮৫ সলে বিজাপুর অবরোধ করেন। এটি ১৪৮৯ সাল থেকে আদিল শাহি রাজবংশের মাধ্যমে শাসিত হতো, তাদের সেনাবাহিনীতে সদস্য ছিল ৮০ হাজার। বিজাপুরের শাসক সিকান্দারকে তার ৩০ হাজার লোকসহ নগরীর সুরক্ষিত প্রাচীরগুলোর অভ্যন্তরে ১৫ মাস ধরে আটকে ফেলা হয়। ক্ষুধায় উভয় পক্ষের অনেক লোক মারা যায়, কিন্তু সিকান্দার আদিল শাহ আত্মসমর্পণ করার আগে পর্যন্ত মোগলরা অবরোধ প্রত্যাহার করেনি। পরাজিত শাসক ১৬৮৬ সালে আওরঙ্গজেবের কাছে এসে মোগল সার্বভৌমত্ব গ্রহণ করার ব্যাপারে তার ইঙ্গিত নিশ্চিত করতে ভূমিতে নত হন ।

কুতুব শাহি রাজবংশ নিয়ন্ত্রণ করত গোলকোন্ডা। ১৫১৮ সালের দিক এই রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের মাধ্যমে পরের বছরই মোগল বাহিনীর কাছে এর পতন ঘটে। মোগলরা প্রথমে কুতুব শাহি সেনাবাহিনীর বেশির ভাগ অংশকে গোলকোন্ডা দুর্গে তাড়িয়ে তারপর অবরোধ আরোপ করে (চিত্র ৬)। মোগল সেনাবাহিনী আট মাস ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে। এ সময় তারা কুতুব শাহি বাহিনীকে খাদ্য, পানি ও শক্তিবৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত করে। এ ধরনের বঞ্চনা আর সহ্য করতে না পেরে এক কর্মকর্তা এক রাতে ফটক সামান্য খুলে চলে যাওয়ার জন্য আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে ঘুষ নেন। মোগল বাহিনী দ্রুততার সাথে তাতে প্রবেশ করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কুতুব শাহি রাজ্য গ্রহণ করে, এর বিখ্যাত হিরার খনিগুলো মোগল পতাকার অধীনে নিয়ে আসে ।

গোলকোন্ডার পর আওরঙ্গজেবের কাছে প্রধান বিরোধী হিসেবে টিকে থাকে কেবল মারাঠারা। মারাঠা নেতারা ১৬৯৮ সালে মোগলদের কাছে তামিল নাড়ুর দুর্গ জিনজি (গিনগি) খোয়ায়। ১৬৯৯ থেকে ১৭০৬ সাল পর্যন্ত আওরঙ্গজেবের বাহিনী মারাঠাদের এক ডজন দুর্গে আক্রমণ চালায়, মোগল সীমান্ত বৃদ্ধি পায়, প্রায় পুরো উপমহাদেশ তাদের হাতে চলে আসে। সামগ্রিকভাবে আওরঙ্গজেব চারটি নতুন মোগল প্রদেশ যুক্ত করেন, যা সম্মিলিতভাবে ছিল পুরো মোগল সাম্রাজ্যের এক চতুর্থাংশের চেয়ে বেশি। তবে এই মোগল দখলদারিত্ব হয়েছিল স্বল্পস্থায়ী। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর কয়েক দশকের মধ্যেই মোগলরা দাক্ষিণাত্যে তাদের সব অর্জন খুইয়ে ফেলে; সাম্রাজ্য সঙ্কুচিত হয়ে আসতে থাকে ।

এমনকি আওরঙ্গজেবের জীবনকালেও দাক্ষিণাত্যে সামরিক অভিযানে মোগল রাষ্ট্রের জন্য বড় বড় সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। অব্যাহত সঙ্ঘাতে কোষাগার খালি হয়ে পড়ছিল, অনেক অভিজাত সদস্যের ইচ্ছা নষ্ট হয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে রাজপুত ও উত্তর ভারতের অন্যান্য এলাকার মানুষ দক্ষিণ ভারতে দশকের পর দশক ধরে কাটাতে বিরক্ত হয়ে পড়েছিল। এলাকাটি ছিল তাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে, সেখানকার জলবায়ু, সংস্কৃতি ও জনসাধারণকে নিজের মনে করত না তারা। উদাহরণ হিসেবে উত্তর প্রদেশের কায়স্থ বর্ণের ভীমসেন স্যাক্সেনার কথা বলা যেতে পারে। তার পরিবার কয়েক প্রজন্ম ধরে মোগলদের অধীনে কাজ করেছে। তিনিও খোলামেলাভাবে সফর ও পরিবার থেকে দীর্ঘ সময় আলাদা থাকার কষ্টের কথা বলেছেন । তিনি দক্ষিণ ভারতীয়দের প্রতি তার প্রতি বিতৃষ্ণা প্রকাশ করে তাদেরকে পুরোপুরি বিদেশী লোক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ১৬৯০-এর দশকের মধ্যভাগে দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধগুলো সম্পর্কে ভীমসেন যা লিখেছেন তাতে আধুনিককালের দৃষ্টিতে বেশ আপত্তিকর মনে হবে। তিনি দক্ষিণের হিন্দুদের সম্পর্কে লিখেছেন : ‘তারা কালো বর্ণের, বাজে গড়নের ও কুৎসিত চেহারার। আগে দেখা হয়নি, এমন কারো সাথে যদি রাতের অন্ধকারে সাক্ষাত হয়, তবে সে হয়তো ভয়েই মরে যাবে।’ এ ধরনের লোকদের মুখোমুখি হওয়াকে তারা বিরক্তিকর মনে করত, অনেকে ভাবত যে মোগল চাকরি আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছে।

অন্য মোগল কর্মকর্তাদের কাছে অবশ্য দক্ষিণের জীবন সহ্যকর বলেই মনে হয়েছিল। তবে মোগল মনসব ব্যবস্থা নিজের ভারেই ভেঙে পড়ে ছিল। অভিজাতদেরকে আয়ের উৎস ভূমি পাওয়ার (জায়গির) জন্য প্রায়ই তাদেরকে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হতো। ইতোমধ্যেই মোগল রাষ্ট্র তার কাছ থেকে যে নির্দিষ্ট সংখ্যক সৈন্য পাওয়ার প্রত্যাশা করত, ওই সব সৈন্যের বেতনের জন্য যে সম্পদ ব্যয় করতে হতো, তা এমন অবস্থায় তাদের কাছে থাকত না। বিশ্বাসঘাতকতা করা ও দলত্যাগ ছিল সাধারণ ঘটনা ।

জিনজি অবরোধের সময়কার অস্থিরতা এমন কিছু ইঙ্গিত দিয়েছিল যা দাক্ষিণাত্যের বছরগুলোতে অনেক মোগল সৈন্য ও অভিজাতকে হঠাৎ করে অভিভূত করে ফেলেছিল। আওরঙ্গজেব ১৬৯৮ সালে জিনজি দখল করেন, তবে তা হয়েছিল আট বছর অবরোধের পর। এত দীর্ঘ অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি যুক্তিগ্রাহ্য করা কঠিন। পর্যবেক্ষকেরা এজন্য কমান্ডার জুলফিকার খানকে দায়ী করেন। তাদের মতে, এই কমান্ডার দায়িত্ব পালনে প্রতিশ্রুতিশীল ছিলেন না। এ নিয়ে অনেক গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। এর একটি ছিল এই যে তিনি জিনজি নিয়ন্ত্রণকারী মারাঠাদের সাথে গোপন আঁতাত করেছিলেন । তাছাড়া তিনি হতশ্রী কান্দহার অভিযানেও যেতে না চাওয়ায় বিজয় সম্পন্ন করার কাজে সময়ক্ষেপণ করছিলেন। কারণ, এর পরই তাকে সেখানে পাঠানো হবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। যাই হোক না কেন, একটি অবরোধ অপ্রয়োজনীয়ভাবে দীর্ঘায়িত হওয়ায় মনে হচ্ছে যে সেনাবাহিনীর নৈতিক শক্তি ও রাজকীয় কর্তৃত্ব শিথিল হয়ে যাওয়া ।

আওরঙ্গজেবের লোকজন দোদুল্যমান হয়ে পড়লেও বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে অভিযানও বাড়াচ্ছিলেন আওরঙ্গজেব। সম্রাট তার জীবনের ৬০, ৭০ ও ৮০-এর দশকগুলো দাক্ষিণাত্যে কাটানোর পাশাপাশি প্রায়ই ব্যক্তিগতভাবে যুদ্ধ ও অবরোধ তদারকি করতেন। ভীমসেনের ভাষায়, খুব একটা ইতিবাচকভাবে নয়, ‘[আওরঙ্গজেব] ব্যক্তিগতভাবে কিছু পাথরের স্তূপের জন্য হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটছেন।’ আওরঙ্গজেব তার ক্রমবর্ধমান তৎপরতার মাধ্যমে সাফল্য লাভ করছিলেন, সুস্থ বা অসুস্থ থাকুন, সৈন্যদল পরিচালনার নির্দেশ দিয়েই যাচ্ছিলেন। তিনি এক প্রশাসককে লিখেছেন, ‘যতক্ষণ এই নশ্বর জীবনের একটি শ্বাসও বাকি থাকবে, ততক্ষণ শ্রম আর কাজ থেকে মুক্তি নেই।’ অফিসারেরা পছন্দ না করলেও দাক্ষিণাত্যে বাস করাটা সম্রাট নিজে উপভোগ করতেন। আগের যুবরাজ আমলে তিনি তার বাবাকে দাক্ষিণাত্যের টাটকা বাতাস, মিষ্টি পানি আর ব্যাপক চাষাবাদের প্রশংসা করে লিখেছিলেন ।

দাক্ষিণাত্যে আওরঙ্গজেবের অনেক কার্যক্রমের জন্য মানুষের জীবন ও জীবিকার দিক থেকে উচ্চ মূল্য দিতে হয়েছে। মোগল ও মারাঠা উভয়েই গ্রাম এলাকা জ্বালিয়ে দিয়েছিল, কোনো কোনো এলাকায় দুর্ভিক্ষ নেমে এসেছিল । মোগল অবরোধের ফলে অনেক এলাকায় বিপুলসংখ্যক প্রাণহানি ঘটত, আবার এর পর নেমে আসত রোগ-বালাই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৬৯০ সালে পাঁচ বছর আগের তুলনায় বিজাপুরের জনসংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসে। এখানেও মোগল আক্রমণের পরপরই কলেরার বিস্তার ঘটে। করুণা লাভের জন্য আকুল আবেদনে সম্প্রসারণ অভিযান পরিত্যক্ত করা বা তার কৌশলে পরিবর্তন ঘটত না। অবশ্য কোনো কোনো সময় সামান্য স্বস্তির ব্যবস্থা করা হতো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভয়াবহভাবে আক্রান্ত এলাকায় তিনি কর মওকুফ করে দিতেন, খরার কারণে ১৬৮৮-৮৯ সময়কালে হায়দরাবাদের জিজিয়া বাতিল করেছিলেন, দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধের ক্ষতির কারণে ১৭০৪ সালে পুরো দাক্ষিণাত্যের জিজিয়া কর থেকে রেহাই দিয়েছিলেন। মোগল ও মারাঠা সঙ্ঘাতের ফলে যে কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, এসব পদক্ষেপ তাতে সামান্যই স্বস্তি সৃষ্টি করতে পারত ৷

আওরঙ্গজেব ছিলেন সম্রাট। ফলে তার সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের জন্য বিশেষ কোনো কারণ দেখানোর প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু তারপরও বৃদ্ধ বয়সে ও অনেক মোগল কর্মকর্তার আরো যৌক্তিক বিবেচনাকে অগ্রাহ্য করে আওরঙ্গজেব কেন এ ধরনের আগ্রাসী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, সে প্রশ্ন জাগতেই পারে। সামনাসামনি যুদ্ধে মোগলদের সমকক্ষ না হওয়া সত্ত্বেও রাজকীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে ক্ষিপ্র, আকস্মিক ও গেরিলা কৌশল অবলম্বন করে অনেক বেশি কার্যকারিতার পরিচয় দেওয়া মারাঠা যোদ্ধাদের অব্যাহত প্রতিরোধে কি আওরঙ্গজেব হতাশ হয়েছিলেন? আওরঙ্গজেব কি বিশ্বাস করতেন যে আরো ভূখণ্ড মোগল রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে সহায়ক হবে? কিভাবে সরে আসতে হবে, তা না জানার কারণেই কি তিনি দক্ষিণ ভারত জয়ের জন্য তার জীবনের এতটা অংশ নিবেদন করেছিলেন? কারণ যাই হোক না কেন, মনে হচ্ছে, আরো বেশি বেশি ভূখণ্ড জয়ের নেশায় নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলেন আওরঙ্গজেব ।

মৃত্যুন্মুখ রাজা

এই দুনিয়ার যন্ত্রণা তো খুবই ভয়াবহ, আর আমি স্রেফ একটা কোমল কলি–
আমি কিভাবে সূর্যঘড়িতে মরুভূমির সব বালি ঢেলে দেব?
–আওরঙ্গজেব

আওরঙ্গজেব তার শেষ বয়সের বড় একটি অংশ যুদ্ধক্ষেত্রে কাটালেও নিজের জীবন ও মোগল রাষ্ট্রের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তাভাবনা করার মতো সময় বের করতে পেরেছিলেন। সম্রাট দাক্ষিণাত্য দিয়ে পথ চলার সময় (ক্রমবর্ধমান হারে তাকে বহন করে নেওয়া হচ্ছিল, চিত্র ৭) জেনারেল, রাজকীয় কর্মকর্তা ও পরিবার সদস্যদের কাছে পত্র লিখতেন। এসব নথিপত্র তার অন্তঃদৃষ্টি ও নিজের জীবনের ব্যাপারে অনুশোচনা, ভারতবর্ষের ইতিহাসে তার স্থান, মোগল সাম্রাজ্যের বিশাল অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছে।

আওরঙ্গজেবের শেষ বয়সের কিছু উদ্বেগ ছিল দুনিয়াবি ও চরমভাবে মানবীয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তিনি বারবার তার অন্যতম প্রিয় ফল আম নিয়ে লিখেছেন। মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের আমল থেকেই মোগলরা আম ভালোবাসত। তিনি তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘আম যখন ভালো, তখন সত্যিই ভালো।’ আওরঙ্গজেব তার ছেলে ও কর্মকর্তাদের ঝুড়ি ঝুড়ি আম পাঠাতে বলতেন, তারা তা করলে তিনি তাদের প্রশংসা করতেন। আওরঙ্গজেব অপরিচিত প্রজাতির আমের নাম রাখতেন সংস্কৃত শব্দভাণ্ডার থেকে উৎপত্তি হওয়া হিন্দি শব্দে, যেমন সুধারস, রসনাবিলাস ইত্যাদি। হাতে আসা আমের চালান নষ্ট হয়ে গেলে তিনি অসন্তুষ্ট হতেন।

আওরঙ্গজেব তার যৌবনকালের কথাও স্মরণ করতেন, পরিবারের সাথে তার দিনগুলো ছিল অনেক সুখের ছিল বলে মনে করতেন। যুবরাজ আযমকে লেখা ১৭০০ সালের এক চিঠিতে তার ছেলের শৈশবের স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছেন। রাজকীয় ঢোলের শব্দ নকল করে আযম হিন্দি শব্দে বাবা সম্বোধন করে চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘বাবাজি, ধুন, ধুন।’ শেষ বয়সে আওরঙ্গজেব বিশেষভাবে উদয়পুরির (তার সবচেয়ে ছোট ছেলে কাম বকশের মা । আশ্চর্যজনক ঘটনা হলো, তিনি ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ) সঙ্গ উপভোগ করতেন। মৃত্যুশয্যায় কাম বকশকে লেখা এক চিঠিতে আওঙ্গজেব বলেন যে অসুস্থতা সময় উদয়পুরি তার সাথে আছেন এবং মৃত্যুর পর তিনিও অল্প সময়ের মধ্যে তার সঙ্গী হবেন। উদয়পুরি মারা যান ১৭০৭ সালে, আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর কয়েক মাস পর ৷

শেষ বছরগুলোতে আওরঙ্গজেব প্রায়ই পেছনের সময়ে ফিরলেও সামনের দিকে তাকাতেন এবং যা দেখতেন তা অপছন্দ করতেন ।

আওরঙ্গজেব তার সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত নিয়ে আশঙ্কায় ছিলেন। এর পেছনে যুক্তিগ্রাহ্য কারণও ছিল। মোগল সাম্রাজ্যকে চেপে ধরা আর্থিক ও প্রশাসনিক ভয়াবহ সমস্যা ছাড়াও এ ধরনের জটিলতা কাটানোর মতো সক্ষমতাসম্পন্ন কাউকে আশপাশে দেখতে পাননি তিনি ।

মৃত্যুর সময় আওঙ্গেজেবের তিন ছেলে জীবিত ছিলেন (অপর দুজন বাবার আগেই মারা গিয়েছিলেন)। এদের কাউকেই তিনি রাজা হওয়ার উপযুক্ত মনে করতেন না। উদাহরণ হিসেবে অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে মোয়াজ্জেমকে লেখা একটি চিঠির কথা বলা যায়। এতে কান্দাহার জয় করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য তার তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি তাকে তিক্ত ভাষায় গালাগাল করে বলেন, ‘অপদার্থ ছেলের চেয়ে মেয়েও অনেক ভালো।’ তিনি এরপর মোয়াজ্জেমকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘এরপর তুমি কিভাবে এই দুনিয়ায় তোমার প্রতিদ্বন্দ্বীকে এবং সর্বোচ্চ পবিত্র মহামান্বিত খোদাকে মুখ দেখাবে?”

আওরঙ্গজেব বুঝতে পারেননি যে মোগল সিংহাসনে আরোহণের জন্য তার ছেলেদের দুর্বল প্রস্তুতির জন্য অনেকাংশে দায়ী তিনিই। ইতিহাসবিদ মনিস ফারুকি বিস্তারিতভাবে লিখেছেন কিভাবে আওরঙ্গজেব রাজকীয় অন্দরমহলে হস্তক্ষেপ করে মোগল রাজপুত্রদের শৃঙ্খলিত করে রেখে ছিলেন, যুবরাজদের স্বায়ত্তশাসন খর্ব করেছিলেন। ১৭০০-এর দিক থেকে আওরঙ্গজেব ছেলেদের বিপরীতে নাতিদের বেশি আনুকূল্য প্রদান করতে থাকেন, এটিও ছেলেদের অবস্থান আরো নাজুক করেছিল। অনেক সময় আওরঙ্গজেব যুবরাজদের চেয়ে অভিজাতদের অগ্রাধিকার দিতেন। যেমন ১৬৯৩ সালে জিনজিতে মারাঠা শাসক রাজারামের সাথে অবৈধ আলোচনা শুরু করার পর আওরঙ্গজেব তার সর্বকনিষ্ঠ ছেলে কাম বকশকে গ্রেফতার করার দায়মুক্তি সুযোগ দিয়েছিলেন তার প্রধান উজিড় আসাদ খান ও সামরিক কমান্ডার জুলফিকার খানকে। আওরঙ্গজেবের তাৎপর্যপূর্ণ শেষ ইচ্ছায় তিনি মোগল সাম্রাজ্যকে তিন ছেলের মধ্যে ভাগ করে দেন, আসাদ খানসহ কয়েকজনকে স্থায়িত্ব দিয়ে বিশেষ কর্মকর্তা নিয়োগ করেন ৷

মোগল যুবরাজদের প্রজন্মগুলো বিশাল নেটওয়ার্ক নির্মাণ করতেন, এটিই নতুন নতুন গ্রুপকে মোগল পতাকাতলে নিয়ে আসত, অবিভক্ত সাম্রাজ্যের মুকুটের জন্য যুবরাজদের লড়াই করতে সক্ষম করে তুলত। সংক্ষেপে বলা যায়, উত্তরাধিকার লড়াইই মোগল রাষ্ট্রকে নতুন জীবন দিত, প্রাণবন্ত করে তুলত। আওরঙ্গজেব মোগল যুবরাজদের দন্তনখরহীন করে ফেলেছিলেন। ফলে যখন সময় এলো, তখন তারা আর যুদ্ধ করতে বা শাসন করতে সক্ষম হননি ।

আওরঙ্গজেব তার ছেলেদের নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে কিভাবে মোগল রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতি করেছেন, সে ব্যাপারে অন্ধ থাকলেও মোগল রাষ্ট্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি বুঝতে পেরেছিলেন। শেষ বয়সে ছেলে ও নাতিদের কাছে লেখা চিঠিপত্রে আওরঙ্গজেব মোগল সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে তার ব্যাপক অন্তঃদৃষ্টি প্রকাশ করেছেন।

আওরঙ্গজেব ১৬৯১-পরবর্তী সময়ে আযম শাহের বড় ছেলে, তার নাতি বিদার বখতকে লেখা এক চিঠিতে কিভাবে সর্বোত্তমভাবে জীবনযাপন ও শাসন করা যায়, সে ব্যাপারে নিজের কর্মপন্থা তুলে ধরে উপদেশ দেন। তিনি শুরু করেন এই সুপারিশ দিয়ে যে পানি সামনে রেখে ফজরের নামাজ পড়তে ও কোরআন তেলায়াত করতে হবে, তারপর ওই পানি পান করতে হবে। এতে করে রোগ ও বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। বিদার বকশকে তার পরবর্তী পরামর্শ ছিল আকবরের আমল থেকে প্রচলিত একটি মোগল প্রথা অনুসরণ করার। এতে নিজেকে বিভিন্ন সামগ্রী দিয়ে ওজন করা হতো। আওরঙ্গজেব এটিকে হিন্দু প্রথা বিবেচনা করা সত্ত্বেও লিখেছেন, ‘যদিও সোনা, রুপা, তামা, শস্য, তেল ও অন্যান্য সামগ্রী দিয়ে কারো পুরো দেহের ওজন করা আমাদের পূর্বপুরুষদের দেশের বা এখানকার [ভারতবর্ষ] মুসলিমদের প্রথা নয়, কিন্তু এই ব্যবস্থার ফলে অনেক অভাবগ্রস্ত ও গরিব মানুষ বিপুলভাবে উপকৃত হয়।’ চিঠিতে সম্রাট তার নাতিকে বলেন যে শাহ জাহান বছরে দুবার নিজেকে ওজন করাতেন। তবে তিনি বিদার বকশকে পরামর্শ দেন, তিনি যেন বছরে ১৪ বার এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। আমরা দেখেছি, আওরঙ্গজেব তার শাসনকালের প্রথম দশকে নিজের ওজন করার প্রথা অনুসরণ করলেও পরে তা বাদ দেন (তবে শেষ বয়সে তিনি সম্ভবত আবার তা চালু করেছিলেন। এমন মত দিয়েছেন চ্যাপলিন জন ওভিঙ্গটন)। আওরঙ্গজেব হিন্দুভিত্তিক ওজন করা প্রথাটিকে ভারতীয় মোগল ঐতিহ্যের অংশ বিবেচনা করেছিলেন, এমনকি যদিও ব্যক্তিগতভাবে নিজে তা থেকে দূরে ছিলেন ।

একইভাবে আওরঙ্গজেব শেষ দিকে তার ছেলে আযম শাহকে লেখা এক চিঠিতে শাহ জাহানের সঙ্গীত উপভোগকে অনুমোদন করে বলেছিলেন, এটি যথার্থ রাজকাজ। উল্লেখ্য, তিনি এর কয়েক দশক আগেই এটি পরিত্যাগ করেছিলেন। মোগল বাদশাহ হওয়ার জন্য আরো অনেক পথ ছিল। শেষ বয়সের চিঠিতে আওরঙ্গজেব সমন্বয়বাদকে অনুমোদন করেছিলেন যা ছিল তার রক্তধারার অংশ, এটিই ছিল প্রবল বিরোধিতার মুখে সাম্রাজ্যের টিকে থাকা নিশ্চিতকারী বিপুল শক্তি ।

আওরঙ্গজেব ১৭০৭ সালের প্রথম দিকে মধ্য ভারতের আহমদনগরে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন। তার ইচ্ছানুযায়ী তাকে খুলদাবাদে সুফি দরবেশ জয়নুদ্দিন শিরাজির (মৃত্যু ১৩৬৯) মাজারে অচিহ্নিত এক কবরে সমাহিত করা হয়। আপনিও এখন ওই কবর দেখতে যেতে পারেন, যদিও সেখানে ছোট, উন্মুক্ত স্থানে দেখার তেমন কিছুই নেই। হুমায়ূন, আকবর ও শাহ জাহানের জাঁকালো সমাধিসৌধের তুলনায় এই মাজারে বছরে খুব কম পর্যটকই যায় ।

আওরঙ্গজেবের সাদামাটা কবরটি তার জটিল জীবনের একেবারে বিপরীত বিষয়। আওরঙ্গজেব তার ধার্মিকতার ওপর গুরুত্বারোপ করার জন্যই কবরের স্থান হিসেবে এই গাম্ভীর্যতা ও পারিপার্শ্বিকতা বাছাই করেছিলেন । বস্তুত আওরঙ্গজেব তার জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ক্রমবর্ধমান হারে ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। অবশ্য সম্রাটের আধুনিক সমালোচকেরা বিষয়টি যেভাবে কল্পনা করে, তিনি তা করেছিলেন তার চেয়ে ভিন্নভাবে। অন্যদের প্রতি ধর্মীয় উগ্রতাপূর্ণ আচরণ করার বদলে আওরঙ্গজেবের ধর্মভক্তি প্রকাশিত হয়েছিল তার অন্তঃমুখী উদ্বেগে যা তিনি করেছিলেন খোদার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। তিনি তার শেষ বয়সের চিঠিপত্রে প্রায়ই হাশরের ময়দানের কথা উল্লেখ করতেন, পরবর্তী দুনিয়ায় প্রবেশ করতে উদ্যত এক অচেনা লোক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন।

ইসলামের সাথে এই বহুরূপী সম্রাটের সম্পর্ক ছিল জটিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ধর্মের গণ্ডিতে আটকে রাখার মতো ছিলেন না তিনি। বস্তুত, আওরঙ্গজেব সম্পর্কে সাদামাটা বিষয়াদি রয়েছে সামান্যই। আওরঙ্গজেব ছিলেন ক্ষমতা, নিজস্ব ধরনের ন্যায়বিচার ও সম্প্রসারণে নিবেদিতপ্রাণ এক সম্রাট। তিনি ছিলেন দারুণ মেধাসম্পন্ন শাসক, সেইসাথে অনেক ভুলও করেছেন। তিনি মোগল সাম্রাজ্যকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সম্প্রসারিত করেছিলেন, এবং সম্ভবত এটি ভাঙার অবস্থায়ও নিয়ে গিয়েছিলেন। কোনো একক বৈশিষ্ট্য বা পদক্ষেপে আওরঙ্গজেব আলমগিরকে আবদ্ধ করা যায় না। তিনি প্রায় ৫০ বছর মোগল সিংহাসনকে অলংকৃত করেছিলেন, জনসাধারণের কল্পনাশক্তিকে অনেক দূর পর্যন্ত বিমোহিত করেছেন।

৮. আওরঙ্গজেবের উত্তরাধিকার

আওরঙ্গজেবের পর

স্রষ্টা ছাড়া আর কারো নেই ভবিষ্যতের জ্ঞান;
যদি কেউ বলে সে তা জানে, তবে তাকে বিশ্বাস করো না!
–বাবা মুসাফির (মৃত্যু ১৭১৪) নকশবন্দিয়া সুফি দরবেশ, আওরঙ্গজেবের ছেলেদের মধ্যকার উত্তরাধিকার লড়াই নিয়ে মন্তব্য

আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর কয়েক দশকের মধ্যে মোগল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে । আওরঙ্গজেব-পরবর্তী সময়ে মোগলদের পতন যত দ্রুত বা সামগ্রিক হয়েছিল বলে যে ধারণা দেওয়া হয়ে থাকে, সাম্প্রতিক সময়ের গবেষণাগুলোতে দেখা যাচ্ছে, বিষয়টি মোটেই তেমন ছিল না। তবে এমনকি অতি সূক্ষ্ম তারতম্যকে অনুমোদন করা হলেও বলতে হবে, আওরঙ্গজেবের পর মোগল সাম্রাজ্যের ক্রমাগত পতন বেশ অবাক করা ।

সম্রাটের তিন জীবিত ছেলে একে অপরের বিরুদ্ধে উত্তারাধিকার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তার দ্বিতীয় ছেলে মোয়াজ্জেম যুদ্ধে অপর দু’জনকে- আযম ও কাম বখশ- হত্যা করেন। তিনি বাহাদুর শাহ নাম ধারণ করে মোগল সিংহাসনে আরোহণ করেন। আপাত দৃষ্টিতে সবকিছুই স্বাভাবিক বলে মনে হতে থাকে। উত্তরাধিকার লড়াই ছিল প্রত্যাশিত এবং তা সাধারণত মোগল শক্তিকে নতুন করে উজ্জীবিত করত। কিন্তু এবার এই পরবর্তী ধাপে তা না হয়ে বরং মোগল সাম্রাজ্যে গভীরভাবে শিকড় গেড়ে থাকা সমস্যাগুলো বিপর্যয় সৃষ্টি করে ।

আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে মোগল রাষ্ট্রের অখণ্ডতার প্রতি চলমান অনেক হুমকি উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছিলেন বাহাদুর শাহ। উত্তরে জাট ও শিখেরা সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, দক্ষিণে মারাঠারা ফুঁসছিল, অকার্যকর করের ফলে কোষাগার ফাঁকা হয়ে পড়ছিল, রাজপুতেরা বিদ্রোহ করছিল। বাহাদুর শাহের সিংহাসনে আরোহণের পর এসব সমস্যার আরো অবনতি ঘটে। কারণ মোগল কর্তৃত্বের প্রতি নতুন করে চ্যালেঞ্জ জানাতে অনেকেই রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বাহাদুর শাহ তার বাবার মতো ছিলেন না। তিনি মোগল সার্বভৌমত্বের বিরোধিতায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন ।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মারওয়ারের রাঠোর রাজপুত পরিবার (তারা ৩০ বছর আগে আওরঙ্গজেবের সময় ব্যর্থ বিদ্রোহ করেছিল) আবারো চেষ্টা করে মোগল নিয়ন্ত্রণ ছুঁড়ে ফেলে দিতে। রাঠোরের শাসক অজিত সিং যোধপুর থেকে মোগল বাহিনীতে বিতাড়িত করেন, এমনকি নগরীতে রাজকীয় দখলদারিত্বের সময় নির্মাণ করা মসজিদগুলো পর্যন্ত ধ্বংস করেন। বাহাদুর শাহ যোধপুর পুনর্দখল করেন। কিন্তু অজিত সিং অল্প সময়ের মধ্যেই মারওয়ারের জন্য বর্ধিত স্বাধীনতা লাভ করেন। এর অন্যতম কারণ ছিল বাহাদুর শাহ তখন পাঞ্জাবে শিখ-নেতৃত্বাধীন একটি বিদ্রোহের দিকে মনোযোগ সরিয়ে নিয়েছিলেন। এটিও ছিল আওরঙ্গজেবের আমল থেকে রয়ে যাওয়া আরেকটি অস্থিরতা।

বাহাদুর শাহ মারা যান ১৭১২ সালে, তার বাবার মৃত্যুর মাত্র পাঁচ বছর পর। এরপর মোগল সাম্রাজ্য দ্রুত গতিতে ভেঙে পড়ে। ১৭১২ থেকে ১৭১৯ সাল পর্যন্ত সাত বছরে অল্প ব্যবধানে উত্তরসূরি হিসেবে শাসন করেছিলেন চারজন। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর ১৩ বছরের মধ্যে পাঁচজন বাদশাহ মোগল সিংহাসনে বসেছিলেন, অথচ আগের ১৫০ বছরে রাজত্ব করেছিলেন মাত্র চারজন। বস্তুত, এ ধরনের অস্থিতিশীলতার কারণে মোগল রাজপরিবার অভিজাতদের ওপর থেকে কর্তৃত্ব হারিয়ে ধারাবাহিক কর আদায়সহ রাষ্ট্র পরিচালনার স্বাভাবিক কার্যক্রম পর্যন্ত চালাতে পারছিল না। রাজকীয় প্রশাসনে দুর্নীতি ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়, অনেক এলাকা মোগল রাষ্ট্র থেকে আলাদা হয়ে পড়ে ।

ইরানি যুদ্ধবাজ নেতা নাদির শাহ ১৭৩৯ সালে দিল্লি লুণ্ঠন করেন, মোগল গর্ব হিসেবে টিকে থাকা সবকিছু পদদলিত করেন। নাদির শাহ মোগল সম্রাট মোহাম্মদ শাহকে পণবন্দী করে রাখেন, আর তার সৈন্যরা দিল্লিবাসীর ওপর গণহত্যা চালায়, এর বিপুল সম্পদরাশির কোষাগার লুণ্ঠন করে। দুই মাস পর নাদির শাহ ইরান ফিরে যাওয়ার সময় সাথে করে ময়ূর সিংহাসন ও কোহিনূর হীরাসহ মোগল সার্বভৌমত্বের মহামূল্যবান প্রতাঁকের অনেক কিছু নিয়ে যান। হামলার অল্প সময় পর চিত্রিত নাদির শাহের একটি ছবিতে তাকে ভারী অলংকার, আক্ষরিকভাবেই লুণ্ঠিত মোগল সম্পদে সজ্জিত অবস্থায় দেখা যায় । নাদির শাহের হামলার পর মোগল সাম্রাজ্য সত্যিকার অর্থে আর আগের অবস্থায় ফিরতে পারেনি। ওই সময়ের এক মুসলিম বুদ্ধিজীবী বিষয়টিকে বলেছেন এভাবে : ‘দিল্লির সালতানাত হয়ে পড়েছেন শিশুর খেলনা ।’

ঊনিশ শতকের মধ্যভাগ নাগাদ মোগল সাম্রাজ্য নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল। তারপর ১৮৫৮ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পর ব্রিটিশরা একটি আদালত কক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে মোগল সাম্রাজ্যের পতন ঘোষণা করে। তবে ওই পর্যায় পর্যন্ত ‘সাম্রাজ্য’ ছিল কেবল নামে। ১৭৫০-এর দশকের শেষ দিক থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভূমির মালিকানা, সেনাবাহিনী ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতাসহ সত্যিকারের সার্বভৌমত্বের প্রায় সব বিষয় করায়ত্ত করে ইতোমধ্যেই ক্ষয়ে পড়া মোগল সাম্রাজ্য আরো নিঃশেষ করে ফেলেছিল। সর্বশেষ বাদশাহর আগের জন্য তথা দ্বিতীয় আকবর শাহ (শাসনকাল ১৮০৬-৩৭) জীবন্ত জাদুঘর প্রদর্শন সামগ্রীতে পরিণত হয়েছিলেন, ব্যয়ভার মেটানোর জন্য দরবারে বিদেশী পর্যটকদের দর্শনদানের বিনিময়ে ফি গ্রহণ করতেন ।

কোন কারণে মোগল শক্তির পতন হলো বা ঠিক কখন মোগল সাম্রাজ্য মেরামতের অযোগ্য হয়ে ভেঙে পড়তে শুরু করল তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে বেশির ভাগ ইতিহাসবিদ মনে করেন, আওরঙ্গজেব আংশিকভাবে হলেও দায়ী। এটি একটি অদ্ভূত যুক্তি। কারণ আওরঙ্গজেবই মোগল সাম্রাজ্যকে ভৌগোলিকভাবে সর্বোচ্চ অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে আওরঙ্গজেবের সাফল্য হয়তো তার বিনাশও ছিল। তিনি সম্ভবত মোগল সাম্রাজ্যকে খুব বেশি দূর পর্যন্ত বিস্তৃত করে ফেলেছিলেন। ফলে সম্প্রসারণশীল রাজকীয় সম্পদ শিথিল হয়ে আসছিল, পুরো ব্যবস্থাই ভেঙে পড়ার মুখে পড়ে গিয়েছিল ।

আরো সংশয়পূর্ণ বিষয় হচ্ছে, কেউ কেউ উপস্থাপন করেছেন যে আওরঙ্গজেবের কঠোর নীতিপরায়ণতাই ছিল মরণ আঘাত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আওরঙ্গজেবের ওপর বিশ শতকের সবচেয়ে বেশি গবেষণামূলক কাজ করেছেন যে যদুনাথ সরকার, তিনি তার নিজস্ব নাটকীয় কায়দায় এভাবে বলেছেন, ‘[আওরঙ্গজেবের আমলে] মোগল আল হেলাল পূর্ণিমার চাঁদের পূর্ণতা পায় এবং তারপর দৃশ্যমানভাবেই ক্রমশ ক্ষীণজ্যোতি হতে শুরু করে।’ যদুনাথ সরকার তার পাঁচ খণ্ডের হিস্টরি অব আওরঙ্গজেবসহ এই সম্রাটকে নিয়ে লেখা অনেক গ্রন্থে আওরঙ্গজেবের দর্শন ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি তার শেষ বৃহৎ গ্রন্থটি শুরু করেছেন এই বলে যে ‘আওরঙ্গজেবের জীবন হলো একটি দীর্ঘ ট্রাজেডি, অদৃশ্যমান অপ্রতিরোধ্য ভাগ্যের বিরুদ্ধে এক ব্যক্তির ব্যর্থ সংগ্রামের কাহিনী, যুগের শক্তিতে কিভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী মানবীয় উদ্যোগ ব্যর্থ হতে পারে তার উপাখ্যান।’ যদুনাথ সরকারের কাছে আওরঙ্গজেব ছিলেন ট্রাজিক ব্যক্তিত্ব। অধিকন্তু, অন্যান্য উপনিবেশিক-আমলের চিন্তাবিদের মতো যদুনাথ সরকারও আওরঙ্গজেবকে মনে করতেন ধর্মান্ধ (এবং সে কারণেই ‘মোগল আল হেলাল’)। তিনি মনে করেছিলেন, ইসলামের একটি বিশেষ ধারার প্রতি তার নিবেদিতপ্রাণ থাকার কারণে সাম্রাজ্যে চরম বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছিল।

বর্তমান সময়ের খুব কম ইতিহাসবিদই যদুনাথ সরকারের মোগল সাম্রাজ্যের পতনের ধর্মভিত্তিক ব্যাখ্যাকে গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করছেন। কিন্তু তবুও সাধারণ মানুষের মধ্যে এটি লোকরঞ্জক বিষয়ই হয়ে রয়েছে। এর আংশিক কারণ, এটি আখ্যানগত সমস্যা, ঐতিহাসিক নয়। নীতিবাদী গল্পকথনে কোনো শক্তিশালী, সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের পতনের জন্য কোনো ব্যক্তিকে দায়ী করার মধ্যে মানবীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণের আবেদন রয়েছে। মুসলিম দুরাত্মারা বর্তমান সময়ে বিশেষভাবে চটকদার জিনিস, এটিই ধার্মিক আওরঙ্গজেবকে আকর্ষণীয় বলির পাঠায় পরিণত করেছে। এর বিপরীতে, আধুনিক ইতিহাসবিদেরা একগুচ্ছ সামাজিক, রাজস্ব, প্রশাসনিক কারণ উল্লেখ করেছেন, যা মোগল শক্তিকে দুর্বল করে ফেলেছিল। এ ধরনের পরিব্যাপ্ত, পদ্ধতিভিত্তিক ব্যাখ্যা ইতিহাসের জন্য উপাদেয় হলেও বাজারের গল্পকথকদের জন্য মুখরোচক নয় ।

খোলামেলাভাবে বলা যায়, আওরঙ্গজেব-পরবর্তী মোগল ভারতবর্ষ সম্পর্কে আমরা খুবই কম জানি। আমরা তার শাসনকালের সাথে সম্পর্কিত অনেক বিষয়ের ব্যাপারে এখনো অন্ধকারে রয়ে গেছি। মোগল রাষ্ট্র ফাঁপায় পরিণত করতে তার ভূমিকার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হলে এসব প্রাসঙ্গিক বিষয় জানা দরকার। তবে আওরঙ্গজেব দূর দৃষ্টিতে দেখতে পেয়েছিলেন যে তিনি একটি তিক্ত উত্তরাধিকার রেখে যাচ্ছেন। তিনি শেষ বয়সে লেখা তার চিঠিপত্রে প্রায়ই মোগল সাম্রাজ্যের সামনে অন্ধকার দিন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যদিও সাম্রাজ্যের পতনমুখ গতি বদলে দিতে নিজেকে ক্ষমতাহীন দেখতে পেয়েছিলেন।

মোগল সাম্রাজ্যের পতনের সূচনার জন্য আওরঙ্গজেবকে সম্ভাব্য দায়ী করার বিষয়টি সরিয়ে রেখে আমরা কিভাবে এই জটিল, অনেক সময় সাংঘর্ষিক চরিত্রের সম্রাটের দীর্ঘ, অসম শাসনকালকে মূল্যায়ন করতে পারি? আধুনিক মানদণ্ডের আলোকে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সহিষ্ণুতা নিয়ে আওরঙ্গজেবের সমালোচনা করার মধ্যে অন্তঃদৃষ্টির অবকাশ থাকে সামান্যই । কিন্তু তার সময়ের অন্যান্য শাসকের সাথে, বিশেষ করে পূর্ববর্তী মোগল সম্রাটদের সাথে তিনি কিভাবে তুলনীয় তা আরো ফলপ্রসূভাবে জানতে চাইতে পারি ।

আওরঙ্গজেব তার পূর্ববর্তী যেকোনো মোগল সম্রাটের চেয়ে, অন্তত অনেক মোগল প্রথার প্রতিষ্ঠাতা আকবরের পর থেকে, অনেক বেশি মোগল রীতিনীতি ভেঙেছেন। কিন্তু কিছু শিল্পকলার ওপর থেকে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা হ্রাস করা, দাক্ষিণাত্যে সরে যাওয়া, জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তনের মতো অনেক পরিবর্তন সাধন সত্ত্বেও আওরঙ্গজেব মোগল প্রশাসনিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচির দিক থেকে বিপুলভাবে ধারাবাহিকতাই রক্ষা করে গেছেন। তিনি আকবরের মতো আন্তঃসংস্কৃতির পথিকৃত ছিলেন না (হয়তো ভারত সম্রাজ্যের ষষ্ট শাসক হিসেবে তিনি এর প্রয়োজন আছে বলেই মনে করতেন না)। কিন্তু আওরঙ্গজেব ফতোয়া-ই-আলমগিরির মতো বিশাল মাত্রার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রকল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন, কয়েকটি ফারসি রামায়ণ তাকে উৎসর্গ করা হয়েছে। শাহ জাহানের সমমানের মহান নির্মাতা ছিলেন না আওরঙ্গজেব, কিন্তু তবুও যদি লাহোরের বাদশাহি মসজিদ বিবেচনা করা হয়, তবে তিনি খুব পিছিয়েও থাকবেন না। বর্তমানে বেশির ভাগ লোক যেমনটা মনে করে, তার চেয়েও মোগল পূর্বসূরীদের সাথে অনেক বেশি সমরূপ ছিলেন তিনি।

আওরঙ্গজেব তারপরও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন, বিশেষ করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতি তার গতানুগতিক উদ্বেগ ও তার সামরিক নৈপূণ্যের দিক থেকে। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, পূর্ববর্তী মোগল শাসকেরাও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। এক্ষেত্রে জাহাঙ্গীরের কথা বলা যেতে পারে । যে কেউ যাতে সম্রাটের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে, সেজন্য জাহাঙ্গীর আগ্রা দুর্গ থেকে নদীর কিনারা পর্যন্ত ৬০টি ঘণ্টা-সংবলিত একটি বিশাল ‘ন্যায়বিচারের শিকল’ ঝোলানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেবের কাছে ন্যায়বিচার ছিল অনেক কম প্রদর্শনীর বিষয়। তিনি অসৎ প্রশাসকদের দমন করা ও নিরাপদে ধর্মীয় উৎসবের নিশ্চয়তা দানকেই বুঝতেন ন্যায়বিচার। অবশ্য সম্রাটের ইচ্ছা সত্ত্বেও আওরঙ্গজেবের প্রশাসন দুর্নীতির মতো জঘন্য কাজ করত। অধিকন্তু, আওরঙ্গজেব তার সারা জীবনে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলেও মধ্য যুগের অন্য অনেক রাজার মতো তিনিও বারবার চির অতৃপ্ত রাজনৈতিক শক্তির জন্য তার ঘোষিত মূল্যবোধের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন।

আওরঙ্গজেব ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে দারুণ দক্ষ সামরিক কৌশলবিদ । তিনিই সম্ভবত ছিলেন মোগল ধারায় সবচেয়ে সুদক্ষ জেনারেল। তিনি দীর্ঘস্থায়ী উত্তরাধিকার লড়াইয়ের মাধ্যমে ময়ূর সিংহাসন জয় করেছিলেন। কয়েক প্ৰজন্ম ধরে মোগলদের কাম্য দাক্ষিণাত্য তিনি জয় করেছিলেন। কিন্তু তারপরও প্রবীণ আওরঙ্গজেব যেকোনোভাবেই হোক না কেন, দক্ষিণ ভারতে তার পথ হারিয়েছিলেন, লক্ষ্যহীনভাবে দুর্গগুলো দখল করছিলেন, বৃদ্ধ বাদশাহ ও দুর্বল যুবরাজদের কাছ থেকে সুযোগ গ্রহণে ইচ্ছুক প্রশাসকদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান হারে নির্বিষ হয়ে ওঠেছিলেন।

আওরঙ্গজেবের শাসনকাল যদি ২০ বছর সংক্ষিপ্ত হতো, জাহাঙ্গীর (তিনি শাসন করেছিলেন ২২ বছর) বা শাহ জাহানের (তিনি শাসন করেছিলেন ৩০ বছর) কাছাকাছি সময় পর্যন্ত শাসন করতেন, তবে আধুনিক ইতিহাসবিদেরা হয়তো তাকে ভিন্নভাবে বিচার করতেন। কিন্তু আওরঙ্গজেবের শেষ দশকগুলোতে ছেলেদের শৃঙ্খলিত করা, ক্রমবর্ধমান হারে স্ফীত হয়ে ওঠা প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল থাকা, বাজে পরামর্শপুষ্ট যুদ্ধে নিয়োজিত হওয়া ছিল তার জট পাকানো উত্তরাধিকারের বিশাল অংশ। ফলে আমাদের জন্য রেখে যাওয়া হয়েছে বিপুল উচ্চাভিলাষ ও মোগল ভারতের বাস্তবতার মধ্যে অপূরণীয় ব্যবধানে জর্জরিত একজন জটিল মানুষ ও রাজার মিশ্রণ মূল্যায়ন ।

আওরঙ্গজেবকে শৃঙ্খলমুক্ত করা

সময়, পরিস্থিতি, ইতিহাস আমাকে যা বানিয়েছে, আমি অবশ্যই তাই, তবে তারপর আমি তার চেয়েও বেশি কিছু। আমরা সবাইই তাই ।
–জেমস ব্যান্ডউইন, আমেরিকান লেখক, ১৯৫৫

আওরঙ্গজেবের লোকরঞ্জক স্মৃতির সাথে ঐতিহাসিক সম্রাটের রয়েছে স্রেফ ঝাপসা সাদৃশ্য। এই অমিল থাকার বিষয়টি স্বীকার করে নেওয়া দুটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। একটি কারণ হলো উত্তপ্ত সাম্প্রদায়িক ধারণার প্রশমন করা এবং অপরটি হলো ঐতিহাসিক গবেষণাকে শৃঙ্খলমুক্ত করা ।

আওরঙ্গজেবের লোকরঞ্জক খ্যাতির ফলে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই মোগল অতীত নিয়ে রাজনৈতিক ইন্ধনযুক্ত ভাষ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আগেই বলা হয়েছে, আওরঙ্গজেবের দুই ভাষ্যই (ধর্মান্ধ আওরঙ্গজেব ও ধার্মিক আওরঙ্গজেব) প্রকাশ্য ধারায় পরিণত হয়েছে। ধর্মান্ধ আওরঙ্গজেবের চিত্রটি বিশেষভাবে বিভ্রান্তিকর ও ধ্বংসকারী। এতে হিন্দু ও হিন্দুবাদকে ধ্বংস করতে আগ্রহী উগ্র আওরঙ্গজেবের চিত্র আঁকা হয়। মুসলিমবিরোধী ভাবাবেগ বাড়াতে ও ভারতীয় মুসলিমদেরকে বিপজ্জনক বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিত্রিত করতে ভারতের রাজনীতিবিদ ও অন্যরা এই ধারণা প্রচার করে। আওরঙ্গজেবকে বিশুদ্ধ মুসলিম (উর্দু কবি মোহাম্মদ ইকবাল, মৃত্যু ১৯৩৮, তাকে ‘ভারতের মূর্তি গৃহে ইব্রাহিম’ হিসেবে অবহিত করেছিলেন) হিসেবে চিত্রিত করাও সমস্যাসঙ্কুল। এভাবে উপস্থাপনের ফলে এই ধারণা সৃষ্টি করে যে মুসলিমরা প্রধানত তাদের বিশ্বাসের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত হয়, আর ইসলাম হলো মৌলিকভাবে হিন্দু ধর্মের চেয়ে আলাদা। ভারতবর্ষের জন্য এই ধারণার অর্থ হলো এই যে মুসলিমেরা পুরোপুরি ভারতীয় হতে পারে না, আর পাকিস্তানে তারা ধারণা দেয় যে সব মূল্যবান নাগরিককে অবশ্যই ইসলামের সংকীর্ণ ধরনের সংজ্ঞায় থাকতে হবে।

আওরঙ্গজেবকে নিয়ে প্রচলিত লোকরঞ্জক ধারণা কেন বাতিল করার জরুরি, তার দ্বিতীয় কারণ হলো, যাতে আমরা তাকে ইতিহাসের পরিভাষায় বুঝতে পারি। আওরঙ্গজেব ছিলেন তার সময়ের মানুষ, আমাদের সময়ের নয়। আমি যুক্তি দিয়েছি যে আওরঙ্গজেব ন্যায়বিচার নিয়ে তার আদর্শের আলোকে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, নিজের রাজনৈতিক ও নৈতিক আচরণের (আদব ও আখলাক) প্ৰতি দায়বদ্ধ ছিলেন, রাজনৈতিক প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ করেছেন। আওরঙ্গজেবের বিশ্ববীক্ষা তার নিজের ধর্মভক্তি ও উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া মোগল সংস্কৃতির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল। হিন্দু-মুসলিম সঙ্ঘাত (আধুনিক সময় এ ধারণাটিতে আচ্ছন্ন) তার স্বার্থের অনুকূলে ছিল না, বরং তিনি তার ধারণার আলোকে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, মোগল ঐতিহ্য সমুন্নত রাখা এবং উপমহাদেশজুড়ে তার মুষ্ঠি সম্প্রসারণ করার দিকে নজর দিয়েছিলেন।

কিন্তু তারপরও আওরঙ্গজেব সহজে সংক্ষিপ্ত করাকে প্রতিহত করেন। তিনি ছিলেন প্রবল বৈপরীত্যপূর্ণ ও ধাঁধাময় এক ব্যক্তিত্ব। আওরঙ্গজেব নিয়ম অনুসরণে পুরোপুরি আচ্ছন্ন ছিলেন। এমনকি রাস্তাঘাটের নিরাপত্তা নিয়েও সর্বক্ষণ অস্থির থাকতেন। কিন্তু বাবাকে বন্দী করা ছাড়া তার কাছে আর কোনো উপায় দেখতে পাননি, অবশ্য এই কারণে এশিয়ার একটি বড় অংশে তিনি সমালোচিত হয়েছেন। তিনি দারা শুকোহসহ তার পরিবার সদস্যদের হত্যা করতে কিংবা শত্রুদের টুকরা টুকরা করে কাটতেও (এই যেমন শম্ভুজির ক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থেই) দ্বিধা করেননি। আবার তিনি নিজ হাতে টুপি সেলাই করতেন, ধার্মিক জীবনযাপন করার আকাঙ্ক্ষা লালন করতেন। খারাপ প্রশাসক, পচা আম, অপদার্থ ছেলেদের প্রতি ক্রুদ্ধ হতেন তিনি। তিনি ছিলেন সঙ্গীতের সমঝদার, এমনকি গায়িকা হিরাবাইয়ের প্রেমেও পড়েছিলেন। কিন্তু মধ্যবয়সের শুরুতে তিনি নিজেকে সঙ্গীত শিল্পের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও শেষ বয়সে আরেক সঙ্গীতশিল্পী উদয়পুরির সঙ্গ উপভোগ করতেন। তিনি বিশ্বের বৃহত্তম মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন, অথচ নিজের কবরের জন্য অচিহ্নিত একটি স্থান বেছে নিয়েছিলেন। তিনি মোগল সাম্রাজ্যকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মাত্রায় সম্প্রসারিত করলেও নিজেকে চরম ব্যর্থ মনে করতেন ।

আওরঙ্গজেব ছিলেন রহস্যময় সম্রাট। অধিকন্তু, আওরঙ্গজেবের শাসনকাল সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত ইতিহাসবিদ কাফি খান তাকে পারস্য ঐতিহ্যের কিংবদন্তিপ্রতীম শাসক জামশিদের সাথে তুলনা করে বলেছেন, ‘জামশিদের সমমানের একজন শাসকের ৫০ বছরের শাসনকালের প্রধান ঘটনাগুলোর সারাংশ টানার চেষ্টা সাগর থেকে এক কলস পানি নেওয়ার মতো।’ এই উৎসুক্য সৃষ্টিকারী সম্রাট এবং যে সাম্রাজ্য তিনি শাসন করেছেন, সে সম্পর্কে অনেক কথা বলা এখনো বাকি রয়ে গেছে। কল্পকথার আওরঙ্গজেবের আবরণটি পরিষ্কার করার পরই আমরা কেবল মধ্য যুগের ভারতবর্ষের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সম্রাট আওরঙ্গজেবের মুগ্ধতা সৃষ্টিকারী ধাঁধার মুখোমুখি হতে পারি ।

পুনশ্চ : মধ্য যুগের ফারসি সাহিত্য পাঠ নিয়ে নোট

আওরঙ্গজেবের জীবন ও রাজত্ব বিশাল বিস্তৃত নথিপত্রে বিন্যস্ত হয়ে রয়েছে। ইতিহাস, রাজকীয় আদেশ, খবর প্রতিবেদন, চিঠিপত্র, ভ্রমণকাহিনী ও অন্যান্য দলিল-দস্তাবেজে (এগুলো মূলত লেখা হয়েছে ফারসি ভাষায়) মধ্য যুগের ভারতবর্ষীয় এ সম্রাটকে নিয়ে লিখিত ভাষ্যের বিশাল ভাণ্ডার সৃষ্টি করেছে। তবে ইতিহাসবিদেরা এই প্রাচুর্যপূর্ণ আর্কাইভের সুষ্ঠু ব্যবহার করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন।

আওঙ্গজেব সম্পর্কিত অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ও ইতিহাসে ইতিহাসবিদদের প্রবেশগম্যতার অভাব রয়েছে। অসংখ্য নথিপত্র কখনো ছাপা সংস্করণের মুখ না দেখে পাণ্ডুলিপির লাইব্রেরিগুলোতে অবহেলিতভাবে পড়ে আছে। দক্ষিণ এশিয়া ও ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব লাইব্রেরিতে যাওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞদের বিপুল সময় ও অর্থের প্রয়োজন হয়। আবার অনেক স্থান ফটোগ্রাফির ওপর এমন বিধিনিষেধ রয়েছে যে সেগুলোর আর্কাইভ সামগ্রীর সত্যিকারের ব্যবহার প্রায় অসম্ভব। এছাড়া ভাষাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ । আওরঙ্গজেব সাম্রাজ্যের সরকারি প্রশাসনিক ভাষা ফারসি হওয়ায় এ ভাষাতেই মোগলদের বেশির ভাগ ইতিহাস লেখা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান ভারতে এটি বিদেশী ভাষা । অনেক ইতিহাসবিদের মূল ফারসি পাণ্ডুলিপিগুলো বাদ দিয়ে এর বদলে ইংরেজি অনুবাদের ওপর নির্ভর করার কারণ প্রয়োজনের তাগিদ ও এগুলোর প্রাপ্তি সহজলভ্য হওয়া। এই দৃষ্টিভঙ্গি লাইব্রেরি সামগ্রীর ব্যবহার ব্যাপকভাবে হ্রাস করে। আবার মোগল পাণ্ডুলিপিগুলোর অনেক অনুবাদের মান প্রশ্নবোধক। ভুল অনুবাদ ও সংক্ষিপ্তকরণ রয়েছে ভয়াবহ মাত্রায়। ভুল বা বিভ্রান্তিকর অনুবাদের কিছু কিছু বেশ সুবিধাজনকভাবেই অনুবাদকদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যবহৃত হয়েছে। বিশেষ করে উপনিবেশ যুগের অনুবাদগুলোর কথা বিশেষভাবে বলা যায়। এসব অনুবাদে ইন্দো-মুসলিম সম্রাটদের সবচেয়ে খারাপভাবে উপস্থাপন করতে চাওয়া হয়েছিল যাতে তাদের তুলনায় ব্রিটিশদেরকে শ্রেষ্ঠ মনে হয়। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ইলিয়ট ও ডসনের হিস্টরি অব ইন্ডিয়া, অ্যাস টোল্ড বাই ইটস ওন হিস্টোরিয়ান্স। এসব বই ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ সম্পর্কে জানার বিশাল উৎস হলেও মোগল ভারতবর্ষ সম্পর্কে ভ্রান্ত চিত্র উপস্থাপন করে ।

এমনকি বিশেষজ্ঞরা আওরঙ্গজেব আমলের নথিপত্র দেখার ও পাঠের যদি সুযোগ পানও তখন বড় ধরনের বাধা হিসেবে সামনে আসে এসবের ব্যাখ্যা। কাফি খান (মুন্তাখাব আল-লুবাব) ও মুসতাইদ খানের (মাসির-ই আলমগির মতো আওরঙ্গজেব শাসনকালবিষয়ক তথাকথিত প্রধান প্রধান ইতিহাসবিদের অনেকে লিখেছেন আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর অনেক পরে এবং তারা কয়েক দশক আগে সংঘটিত ঘটনাগুলো পুনঃগঠনের জন্য স্মৃতিকথা ও জনশ্রুতির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করেছেন। এ ধরনের ব্যবস্থার ফলে অগোচরে অনিচ্ছাকৃত ভুল তাদের রচনায় প্রবেশ করেছে। প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্যের সন্ধান পাওয়া গেলে এসব গ্রন্থকে তুলনা করে ভুলগুলো শনাক্ত করা যায়। এমনকি রাজাদেশ ও চিঠিপত্রসহ যেসব নথিপত্র অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য মনে হয়, সেগুলোও প্রায়ই ঘটনাটি সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর চিত্র সৃষ্টি করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অনেক নির্দেশ কখনো কার্যকর করা হয়নি ।

অধিকন্তু, মধ্য যুগের অনেক লেখক যথার্থ তথ্য প্রাপ্তি নিয়ে আচ্ছন্নতায় থাকতেন না। বরং এর বিপরীতে আওরঙ্গজেবের আমলে ইতিহাসবিদদের মধ্যে আদর্শ কৌশল ছিল অতীতকে ভ্রমাত্মকভাবে উপস্থাপন করা। এসব ইতিহাসবিদ তারিখ (ফারসি ঘরানার ইতিহাস রচনা) লেখার সময় অতীতকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরার মতোই বাধিত থাকতেন সাহিত্যিক লক্ষ্য হাসিলের জন্য। সাহিত্যিক প্রয়োজনের আলোকে ইতিহাস পরিবর্তন করা ছাড়াও কাফি খানের মতো লেখকেরা ব্যাপক বাগাড়ম্বড়তার আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের এ কৌশল আমাদেরকে তাদের পক্ষপাতিত্বের কথা প্রকাশ করলেও বিশেষ রাজকীয় সিদ্ধান্তটি গ্রহণের নেপথ্য কারণটি অন্ধকারে রেখে দিয়েছেন। অবশ্য এ ধরনের স্তরে স্তরে থাকা অংশগুলো প্রাক-আধুনিক ঐতিহাসিক ভাষ্যগুলোকে বাতিল করে দেয় না। তবে মোগল ইতিহাস দায়িত্বশীলতার সাথে পুনঃনির্মাণের জন্য আমাদেরকে এসব তথ্যের সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক উভয় মান বিচার করে সতর্কতার সাথে ব্যবহার করতে হবে ।

বেশির ভাগ আধুনিক ইতিহাসবিদ ফারসি-মাধ্যমের মোগল ইতিহাসের সাথে ইউরোপিয়ান ভ্রমণকাহিনী, হিন্দি ও অন্যান্য স্থানীয় ভাষার রচনাবলী ও (সাধারণভাবে সবচেয়ে কম) সংস্কৃত গ্রন্থরাজিসহ অন্যান্য ভাষার প্রাক-আধুনিক গ্রন্থরাজিকে পরিপূরক হিসেবে গ্রহণ করেন। এসব গ্রন্থে প্রায়ই কল্পনা ও বাস্তবতার মিশ্রণ দেখা যাওয়ায় এগুলোও একই ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে। ইউরোপিয়ান ভ্রমণকাহিনীগুলোর প্রতি বিশেষ মনোযোগ লাভ করে, কারণ মোগল সাম্রাজ্যবিষয়ক অনেক বিশেষজ্ঞ এখনো বুঝতে পারছেন না এসব রচনা আসলে বাস্তব তথ্যের সাদাসিধে বর্ণনা নয়, বরং এগুলো বিশেষ শ্রেণির পাঠকদের (এবং প্রায়ই পুঁজিবাদী বাজার) সামনে রেখে প্রণীত কৌশলী ভাষ্য ।

আধুনিক ইতিহাসবিদেরা ইতিহাসের বই-পত্রগুলো পাঠ করেন কঠোরতার সাথে। এর মানে হলো, আমরা এসব বই-পত্রকে সেগুলোর বৃহত্তর সামাজিক ও সাহিত্যিক প্রেক্ষাপটে স্থাপন করি, গুরুত্ব বিচার করি, প্রমাণ মূল্যায়ন করি, একটি পাণ্ডুলিপিকে অন্যটির সাথে তুলনা করি। ইতিহাসবিদেরা পেইন্টিংস, ভবনরাজি, মুদ্রার মতো প্রমাণগুলোও বিবেচনা করেন। চূড়ান্তভাবে, ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব, প্রতিষ্ঠান বা ঘটনার ব্যাখ্যা করার জন্য ইতিহাসবিদেরা একটি নিয়মসম্মতভাবে ধারাবাহিক ভাষ্য নির্মাণের জন্য প্রাথমিক নথিপত্রগুলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বিবেচনা করেন। ইতিহাস নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করার ব্যাপক অবকাশ আছে, তবে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রায়ই হয় গঠনমূলক। কিন্তু আওরঙ্গজেবের ঐতিহাসিক নথিপত্রগুলো সংগ্রহ, আত্মস্ত করা ও বোধগম্য করার প্রক্রিয়া খুব সহজ নয়।

জীবনীমূলক প্রবন্ধ

আওরঙ্গজেবের এই জীবনীগ্রন্থের ভিত্তি হলো প্রাক-আধুনিক ও আধুনিক উভয় সময়ের পূর্ববর্তী বিশেষজ্ঞদের রচনাবলী। এরপর আমার বিবেচনায় আনা গ্রন্থগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি। আমি একই সাথে আওরঙ্গজেব অধ্যয়নের সময়কার গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রগুলোর কয়েকটি সম্পর্কে সারসংক্ষেপও দিয়েছি। আমি পাণ্ডুলিপির আর্কাইভগুলো খুব কমই ব্যবহার করেছি, আমার প্রাথমিক নথিপত্র নিয়ে গবেষণা প্রধানত ছাপানো সংস্করণের ওপর নির্ভরশীল ছিল। উদ্ধৃতি ও অন্যান্য বিশেষ তথ্যের জন্য আগ্রহী পাঠকেরা এই অংশের পর থাকা নোটের ওপর নজর বুলাতে পারেন।

আমি আগেই উল্লেখ করেছি, ফারসি ইতিহাসগুলো– আওরঙ্গজেব আলমগিরবিষয়ক আমাদের বিপুল ঐতিহাসিক সম্পদরাশির মূল কাঠামো গঠন করেছে। আওরঙ্গজেবের প্রাথমিক জীবনের প্রধান প্রধান ঘটনা শাহ জাহান আমলের ইতিহাসগুলোতে নথিবদ্ধ হয়ে আছে। এসবের মধ্যে আমি এই গ্রন্থে আব্দুল হামিদ লাহোরির পাদশাহনামা, ইনায়েত খানের শাহজাহাননামা, মোহাম্মদ সালিহ খামবুর আমল-ই-সালিহ, তাবাতাবাইয়ের শাহজাহাননামা থেকেও তথ্য সংগ্রহ করেছি।

আওরঙ্গজেবের আমলে অনেক লোক ইতিহাস রচনা করেছেন। মোহাম্মদ কাজিমের আলমগিরনামা, সম্পাদনা খাদিম হোসাইন ও আবদুল হাই (কলকাতা, ১৮৬৮), আওরঙ্গজেবের শাসনকালের প্রথম ১০ বছরের তথ্য দেয়। এটিই ওই সময়ের একমাত্র সরকারি রাজকীয় ইতিহাস। বখতওয়ার খানের (মৃত্যু ১৬৮৫) মিরাত আল-আলম একটি সার্বজনীন ইতিহাস, যা আওরঙ্গজেব আমলের প্রথম দশকের ঘটনাবলীতে সমৃদ্ধ। সাজিদা আলভি তার পার্সপেকটিভস অন মোগল ইন্ডিয়া গ্রন্থে (করাচি, ২০১২) উল্লেখ করেছেন, বখতওয়ার খানের বইটি এখন খুবই কম পাঠ করা হয়, কিন্তু এ বইয়ে আলমগিরনামায় না পাওয়া অনেক তথ্যের সন্ধান মেলে। আকিল রাজি খানের (মৃত্যু ১৬৯৬/৭) ওয়াকিয়াত-ই আলমগিরি হলো উত্তরাধিকার যুদ্ধের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ভাষ্য। আমি মৌলভি জাফর হাসানের সংস্করণটি (দিল্লি, ১৯৪৬ ) ব্যবহার করেছি। এছাড়া হাতিম খানের আলমগিরনামা, মোহাম্মদ মাসুমের তারিখ-ই শাহ শুজাই, আবুল ফজল মামুরির তারিখ-ই আওরঙ্গজেবের মতো অপ্রকাশিত ফারসি ইতিহাস গ্রন্থ রয়েছে। আমি এ বইটি লেখার কাজে এসব গ্রন্থের সহায়তা নিতে পারিনি ।

আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর কয়েক দশকের মধ্যে লেখকেরা অনেক ইতিহাস রচনা করেছেন। কাফি খানের মুন্তাখাব আল-লুবাব (আনুমানিক ১৭৩০) ও সাকি মুস্তাইদ খানের মাইসির-ই আলমগির (১৭১০) অনেক ইতিহাসবিদের কাছে খুবই প্রিয়। এর আংশিক কারণ বই দুটির মইনুল হক (করাচি ১৯৭৫) ও যদুনাথ সরকারের (কলকাতা, ১৯৪৭) ইংরেজি সংস্করণ পাওয়া যায়। এছাড়া বই দুটিতে আওরঙ্গজেবের পুরো আমলের তথ্য থাকার কারণেও জনপ্রিয় পরবর্তীকালে লেখা হওয়ায় এবং আওরঙ্গজেবের নীতিপরায়ণ প্রকাশ্য ভাবমূর্তির ওপর জোর দেওয়া বাগাড়ম্বড়াতার কারণে বই দুটির ব্যাপারে আমি একদিকে যেমন সতর্ককতা অবলম্বন করেছি, অন্য দিকে অন্যান্য সূত্রের সাথে তুলনা করেছি। আমি কাফি খানের ইলিয়ট ও ডাওসনের অনুবাদের সাথে ভিন্ন মত প্রকাশ করছি। জনপ্রিয়তার কারণে আমি যদুনাথ সরকারের মাইসির-ই আলমগিরির অনুবাদের কথা উল্লেখ করেছি। তবে পাঠকদের সতর্ক থাকতে হবে যে যদুনাথের অনুবাদটি অসম্পূর্ণ, এতে ভুল রয়েছে (এই অনুবাদ নিয়ে আরো কিছু তথ্যের জন্য টিলম্যান কুলকের ‘অ্যা মোগল মুনসি অ্যাট ওয়ার্ক’ ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট, পিএইচডি থিসিস, ২০১৬], ১০-১৫, ২০-২২ দেখা যেতে পারে)।

ভীমসেন স্যাক্সেনার তারিখ-ই দিলখুশা দাক্ষিণাত্যের ঘটনাবলীর একটি অমূল্য ভাষ্য। আমি একটি ব্রিটিশ লাইব্রেরি পাণ্ডুলিপির (অর, ২৩) সাথে যদুনাথ সরকারের অনুবাদ তুলনা করেছি এবং কয়েকটি পৃষ্ঠার পুনঃঅনুবাদ করেছি। নগর ব্রাহ্মণ ও যোধপুরের মোগল বেসামরিক কর্মকর্তা ঈশ্বরদাস লিখেছেন ফুতুহাত-ই আলমগিরি, আনুমানিক ১৭০০ সালে (যদুনাথ সরকার ভুল করে সালটি উল্লেখ করেছেন ১৭৩০)। ফুতুহাতে (ভাদোদারা, ১৯৯৫) নিশ্চিতভাবেই কিছু ঐতিহাসিক ভুল আছে, তবে তা সত্ত্বেও এমন কিছু বিবরণ আছে, যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। স্বল্প ব্যবহৃত মিরাত-ই-আহমদি (১৭৫৪) গ্রন্থে আওরঙ্গজেবের গুজরাত আমলের কথা বলা হয়েছে। শাহ নওয়াজ খানের মাইসির আল-উমারা, সম্পাদনা আবদুর রাহিম ও মির্জা আশরাফ আলী (কলকাতা, ১৮৮৮-৯১), ১৭৮০ সাল পর্যন্ত মোগল অভিজাতদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত দেয়। এছাড়া রয়েছে এইচ বেভারিজ ও বেনী প্রাসাদ (পাটনা, ১৯৭৯) অনূদিত মাইসির আল-উমারাও।

ফারসি ভাষার ইতিহাস ছাড়াও আমি ভূষণের শিবরাজভূষণের (অনুবাদের জন্য অ্যালিসন বাচকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি) মতো বইগুলোসহ সীমিত পরিসরে হিন্দি সাহিত্য ব্যবহার করেছি। আমি জ্ঞান চন্দ্রের সহযোগিতায় জৈন ভাষায় লিখিত বই দেখিছি (এই বিষয়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো মোহাম্মদ আকরাম লারি আজাদের রিলিজিয়ন অ্যান্ড পলিটিক্স ইন ইন্ডিয়া (দিল্লি, ১৯৯০], ২৩৪-৩৭)। আমি সহায়তার মাধ্যমে শিখ সামগ্রীও কিছুটা ব্যবহার করেছি। আওরঙ্গজেবের জীবনের আরো ব্যাপকভিত্তিক জীবনী রচনার জন্য অন্যান্য হিন্দি গ্রন্থ বিশেষ করে রাজপুত দরবারের গ্রন্থগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া লক্ষ্মীপতির অবদুল্লাকরিত ও নৃপতিনিতিগরবিতাভৃত্তের মতো সংস্কৃত সামগ্রীর সহায়তাও গ্রহণ করা যায়। এগুলোতে আওরঙ্গজেবের মৃত্যু পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাগুলো রয়েছে ।

ইতিহাসবিদদের জন্য ইউরোপিয়ান ভ্রমণকাহিনীগুলো আওরঙ্গজেবের ভারতবর্ষ সম্পর্কে অনেক আগে থেকেই নির্ভরযোগ্য উৎস। বিশেষ করে নিকোলাও মানুচির স্টোরিয়া ডি মোগর, (অনুবাদ উইলিয়াম আরভিন, লন্ডন, ১৯০৭-০৮), ফ্রাসোয়া বার্নিয়ারের ট্রাভেলস ইন দি মোগল আম্পায়ার (অনুবাদ আর্চিবল্ড কনস্টাবল ও ভিনসেন্ট স্মিথ, অক্সফোর্ড, ১৯১৪) ও জ্যা-বাস্তাইজ টাভারনিয়ারের ভয়েজ (অনুবাদ ভি. বল, লন্ডন, ১৮৮৯)-এর কথা বিশেষভাবে বলা যেতে পারে। এখানে আমি জেমেলি ক্যারেরি, পিটার মুন্ডি, উইলিয়াম নরিস, জন অভিঙ্গটন ও জ্যা ডি থেভেনটের মতো কিছুটা কম জনপ্রিয় ভাষ্যের উদ্ধৃতি দিয়েছি। বিদেশী পর্যটকেরা মোগলদের নিয়ে বড় ধরনের অন্তঃদৃষ্টি তুলে ধরেছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা প্রায়ই কোনো কারণ ছাড়াই ভারতীয় নথিপত্রের চেয়ে ইউরোপিয়ান গ্রন্থগুলোর ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন, ইউরোপিয়ান পর্যটকেরা কিভাবে কল্পকাহিনী ও বাস্তবতার মধ্যে গোলকধাঁধার সৃষ্টি করেছেন তা না বুঝেই

আমি আওরঙ্গজেবের চিঠিপত্রের মাধ্যমে তাকেই তার সম্পর্কে কিছুটা বলার সুযোগ দিয়েছি। এসব চিঠিপত্র ওই সময়ের অনেক মোগল ইতিহাসে তাকে যেভাবে চিত্রিত করা হয়েছে সেই ছবির চেয়ে ভিন্ন ব্যক্তি হিসেবে তাকে উপস্থাপন করে। আওরঙ্গজেব অনেক চিঠি লিখেছিলেন ফারসি ভাষাতে, সম্ভবত দুই হাজার এখনো টিকে আছে। এগুলো নিয়ে বেশ কয়েকটি সঙ্কলন প্রকাশিত হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে আদব-ই আলমগিরি, কালিমাত-ই তাইবিয়াত, রাকাইম-ই কারিম ও রুকাত-ই আলমগিরি (আমি ব্যাপকভাবে বিলিমোরিয়ার ইংরেজি অনুবাদ ব্যবহার করেছি, তবে মূল ফারসি ভাষার কাছাকাছি ভাষ্যই প্রয়োগ করেছি। আমি দস্তার আল-আমল আগাহি ও আহকামই-আলমগিরির (এটি আর যদুনাথ সরকারের অ্যানিকডোটেস অব আওরঙ্গজেব নামে প্রকাশিত গ্রন্থটি এক নয়) মতো অপ্রকাশিত সঙ্কলন ব্যবহার করিনি। যদুনাথ সরকারের অ্যানিকডোটেস (কলকাতা, ১৯১৭) প্রলুব্ধ সৃষ্টিকারী গ্রন্থ, এতে আওরঙ্গজেব সম্পর্কে টুকরা টুকরা অনেক রসাল কাহিনী আছে। এতে অবশ্য অনেক ভুল তথ্যও রয়েছে। যদুনাথ সরকারও তা স্বীকার করেছেন, কিছু কিছু পাদটীকায় কয়েকটি ঘটনার সত্য ভাষ্যও উল্লেখ করেছেন। আমি যদুনাথ সরকারের অ্যানিকডোটেস সতর্কতার সাথে ব্যবহার করেছি, আওরঙ্গজেবের কথিত দ্বিতীয় উইল (দেখুন, অ্যানিডোটেস, ৫১-৫৫) এবং এ জাতীয় অনেক সম্ভাব্য বানোয়াট ভাষ্য পুরোপুরি বাদ দিয়েছি।

আওরঙ্গজেবের বক্তব্য ফরমান (রাজকীয় আদেশ) আকারে এবং সেগুলোর রাজোচিত সমান্তরাল নিশান আকারেও আমাদের কাছে এসেছে। আমি হিন্দু মন্দির ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ব্যাপারে বিশেষভাবে নির্ভর করেছি জ্ঞান চন্দ্রের আওরঙ্গজেবের ফরমানবিষয়ক প্রবন্ধগুলোর ওপর। এ ব্যাপারে এস এ আই তিরমিজির মোগল ডকুমেন্টস (দিল্লি, ১৯৯৫)-এর ওপর নজর বুলিয়েছি।

আওরঙ্গজেবের আমলের সংবাদ প্রতিবেদনগুলো (আখবারাত) এখনো অনেক আর্কাইভে টিকে আছে। অবশ্য এই গ্রন্থে সেগুলোর সীমিত ব্যবহার হয়েছে। আমি অন্যান্য বিশেষজ্ঞের প্রতিবেদনের মাধ্যমেই সেগুলোর সাথে পরিচিত হয়েছি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মনিষ ফারুকি তার প্রিন্সেস অব দি মোগল এম্পায়ারে (ক্যাম্ব্রিজ, ২০১২) আখবারাত-ই দারবার-ই মাওলা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন। এটি আছে কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব ইন্ডিয়ায় ৷

আওরঙ্গজেবের ওপর মাধ্যমিক সাহিত্য বিপুল, তবে যতটা ধারণা করা যেতে পারে, তার চেয়েও ভাসা ভাসা। ঊনিশ শতকে মন্টস্টুয়ার্ট ইলফিনস্টোন (১৮৪১) ও স্ট্যানলি লেন-পুলের (১৮৯৩) রচিত আওরঙ্গজেবের জীবনী ছাপা থাকলেও তা সেকেলে হয়ে পড়েছে। আমি এখানে এ জাতীয় গ্রন্থের ওপর নির্ভর করিনি। আত্ম-প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার (১৮৭০-১৯৫৮) বিশ শতকে আওরঙ্গজেবের ওপর সবচেয়ে বেশি গবেষণামূলক কাজ করেছেন । তিনি আওরঙ্গজেবের আমলের অনেক ইতিহাস ও চিঠিপত্র সঙ্কলন ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন, আওরঙ্গজেবের ওপর অনেক বই প্রকাশ করেছেন। এসবের মধ্যে রয়েছে অমূল্য পাঁচ খণ্ডের হিস্টরি অব আওরঙ্গজেব (১৯১২-২৪)। দীর্ঘ সময় ধরে তিনিই ছিলেন আওরঙ্গজেবের ওপর শেষ কথা। যদুনাথ সরকারের সর্বাত্মক প্রয়াসের পরের কয়েক দশকে তুলনামূলকভাবে অনেক কম সংখ্যক বিশেষজ্ঞ এই বাদশাহকে নিয়ে লিখেছেন। বিশেষজ্ঞরা ধীরে ধীরে আওরঙ্গজেবকে অধ্যায়নে ফিরে গেছেন, যদুনাথ সরকার যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তারা বাদশাহকে দেখতে পেয়েছেন ভিন্নভাবে। আমরা সবাই যদুনাথ সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ হলেও তার বিশ্লেষণ ব্যাপকভাবে সাম্প্রদায়িকতাপূর্ণ এবং অনেক সময় তাতে ঐতিহাসিক বস্তুনিষ্ঠতার অভাব দেখা যায়। যারা যদুনাথ সরকারের পদ্ধতি ও কৃতিত্ব নিয়ে চিন্তা করতে চান, তাদের উচিত হবে দিপেশ চক্রবর্তীর দি কলিং অব হিস্টরি : স্যার যদুনাথ সরকার অ্যান্ড হিস এম্পায়ার অব ট্রুথ (শিকাগো, ২০১৫) বিবেচনা করা।

আরো সাম্প্রতিক সময়ে আওরঙ্গজেবের ওপর গবেষণা বেড়েছে, আমি এই রচনায় তা গ্রহণ করেছি। আমি ওপরে যেসব বিশেষজ্ঞের নাম উল্লেখ করেছি, তার বাইরে নিম্নোক্তদের লেখা ছিল বিশেষভাবে ফলপ্রসূ : এম আতাহার আলী, সতীশ চন্দ্র, এস এম আজিজুদ্দিন হোসাইন, ইরফান হাবিব, হারবান্স মুখিয়া ও জন রিচার্ডস। আরো অনেক বিশেষজ্ঞ আওরঙ্গজেবের শাসকালের বিশেষ বিষয় সম্পর্কে লিখেছেন। আমার লেখায় তাদের তথ্য ব্যবহার করেছি। এসবের মধ্যে রয়েছেন : ক্যাথেরিন অ্যাশর (স্থাপত্য), রিচার্ড ইটন (মন্দির অবমাননা),

লুই ফেঞ্চ (শিখদের সাথে সম্পর্ক), ইউহানান ফ্রিডম্যান (সরহিন্দি নিষিদ্ধকরণ), যশ গোম্যান্স (যুদ্ধ ও দাক্ষিণাত্যের বছরগুলো), স্টুয়ার্ট গর্ডন (মোগল-মারাঠা সঙ্ঘাত), বি এন গোস্বামী (হিন্দু সন্ন্যাসী), জে এস গ্রেওয়াল (ফতোয়া-ই আলমগিরি), রবার্ট হ্যাঁলিসে (রাজপুতদের সাথে সম্পর্ক), শালিন জৈন (জৈনদের সাথে সম্পর্ক), হেইদি পাওয়েলস (কেশব দেব মন্দির), ক্যাথেরিন বাটলার স্কোফিল্ড (নি ব্রাউন, সঙ্গীত) ও তাইমিয়া জামান (ভীমসেন স্যাক্সেনা)। বিনয় লালের ওয়েবসাইটটি (Manas; http://www.sscnet.wcla.edu/southasia/) আওরঙ্গজেবের শাসনকালের বেশির ভাগ বিতর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত, সহজবোধ্য প্রবন্ধ রয়েছে। মোগল ইতিহাসের বেশ কিছু পর্যালোচনায় বৃহত্তর মোগল প্রকল্পে আওরঙ্গজেবের খাপ খাওয়ানোর বিষয়টি দেখানো হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে মাইকেল এইচ ফিশার, অ্যা শর্ট হিস্টরি অব দি মোগল এম্পায়ার (লন্ডন, ২০১৬), জন এফ রিচার্ডস, দি মোগল এম্পায়ার (ক্যাম্ব্রিজ, ১৯৯৩), ফ্রান্সিস রবিনসন, দি মোগল এম্পেস অ্যান্ড দি ইসলামিক ডাইনাস্টিকস অব ইন্ডিয়া, ইরান অ্যান্ড সেন্ট্রাল এশিয়া, ১২০৬-১৯২৫ (নিউ ইয়র্ক, ২০০৭)।

এ বইটি লেখার সময় সুপ্রিয়া গান্ধী (দারা শুকোহ), ইয়াল রাইস (পেইন্টিং) ও বেশ কয়েকজন সহকর্মীর অপ্রকাশিত ও প্রকাশিতব্য গ্রন্থ থেকে সহায়তা গ্রহণ করার সুবিধা পেয়েছি। এছাড়া সুইজারল্যান্ডের জুরিখে ২০১৪ ইউরোপিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর সাউথ-এশিয়ান স্টাডিজ কনফারেন্সে হেইদি পাওয়েলসের আয়োজিত আওরঙ্গজেববিষয়ক প্যানেলের অনেক লেখকের রচনাও দেখেছি। বর্তমান সময়ে আওরঙ্গজেব একটি নতুন করে সৃষ্টি হওয়া ব্যাপক আগ্রহের বিষয়। অনেক বিশেষজ্ঞ শিগগিরই তার ওপর অনেক মাধ্যমিক পর্যায়ের সামগ্রী উপহার দিতে চলেছেন ।

আওরঙ্গজেববিষয়ক নথিপত্রের ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিয়ে বলা শেষ দুটি কথা হলো যথাক্রমে প্রাচুর্যতা ও স্বল্পতা। আওরঙ্গজেব ইতোমধ্যেই সম্ভবত সবচেয়ে প্রামাণিক মোগল সম্রাটে পরিণত হয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও আখবারাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ অনেক নথিপত্রে প্রবেশগম্যতা গবেষকদের জন্য কঠিন। তাছাড়া আওরঙ্গজেববিষয়ক নতুন নতুন সামগ্রী নিয়মিত আত্মপ্রকাশ করছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সম্রাটের একটি তরবারি ২০১১ সালে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাবার্ড থেকে চাঞ্চল্যকরভাবে বের হয়েছে। বেসরকারি বাজারে প্ৰামাণিক সামগ্রী আত্মপ্রকাশ করছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৪ সালে ক্রিস্টিসে আওরঙ্গজেবের ইস্যু করা একটি ফরমান ২৭,৫০০ পাউন্ডে বিক্রি হয়েছে। আওরঙ্গজেবের ওপর যারা গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে চান, তাদের নথিপত্রের অভাবে ভুগতে হবে না ।

অবশ্য সৌখিন পাঠক ও গবেষক উভয়কেই ঐতিহাসিক প্রমাণ ও নিয়মসম্মত ঐতিহাসিক দাবির প্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। যেসব ব্যক্তি হিন্দু-মুসলিম সঙ্ঘাতের সন্দেহমূলক আধুনিক পরিভাষায় আওরঙ্গজেবের কথিত বর্বরতার ‘প্রমাণ’ উত্থাপন করার দাবি করে থাকেন, তারা প্রায়ই জাল নথিপত্র ও নির্লজ্জ ভুল অনুবাদসহ বিদ্বেষপ্রসূত মিথ্যাচার করছেন। যারা আওরঙ্গজেবের নিন্দা করেন, তাদের অনেকেরই ইতিহাসের নিয়মানুবর্তিতা সম্পর্কে কোনো প্রশিক্ষণ নেই, এমনকি প্রাক-আধুনিক ফারসি ইতিহাস কিভাবে পড়তে হয়, সে সম্পর্কে মৌলিক দক্ষতা পর্যন্ত নেই। লোকরঞ্জক পরিমণ্ডলে বন্যার মতো ছেয়ে যাওয়া আওরঙ্গজেব-সম্পর্কিত সাম্প্রদায়িক ভাষ্য নিয়ে সংশয়প্রবণ হতে হবে। এই জীবনী রচনা করা হয়েছে ঐতিহাসিক ব্যক্তি ও সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগির সম্পর্কে আমাদের মধ্যে বিরাজমান খুবই হালকা জ্ঞানের গভীরতা বাড়ানোর জন্য ।

কৃতজ্ঞতাস্বীকার

আমি এই সংক্ষিপ্ত বইয়ে অনেক ঋণের কৃতিজ্ঞতাস্বীকার করছি। অনেকেই তাদের অপ্রকাশিত গ্রন্থের তথ্য আমাকে জানিয়েছেন, ছবি দিয়ে সাহায্য করেছেন, এই বইয়ের প্রাথমিক পাণ্ডুলিপি পাঠ করেছেন। তাদেরকে উচ্ছ্বসিতভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আর সব মতামত, যুক্তি ও ভ্রান্তি কেবল আমার একার।

ভারতীয় ইতিহাসের অন্যতম ঘৃণিত ব্যক্তি আওরঙ্গজেবকে নিয়ে লেখালেখি করা কোনো তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নয়। এ ব্যাপারে আমি বিশেষ ঋণ স্বীকার করছি। আমি বইটি লিখব কিনা তা নিয়ে যখন দ্বিধায় ছিলাম, তখন যারা আমাকে উপদেশ দিয়েছিলেন, তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি আপনি জানেন, কে আপনি আর আমি খুবই কৃতজ্ঞ ।

আওরঙ্গজেবের জীবন ও শাসনকালের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহ

১৬১৮ : জন্ম

১৬৩৩ : পাগলা হাতির মোকাবিলা

১৬৩৪ : প্রাপ্ত বয়স পূর্তি উদযাপন

১৬৩৭ : প্রথম বিয়ে

১৬৫৩-৫৪ : শিল্পী হিরাবাইয়ের সাথে রোমান্স

১৬৫৭ : প্রথম স্ত্রী দিলরাস বানু বেগমের ইন্তিকাল

১৬৫৭ : শাহজাহানের অসুস্থ হয়ে পড়া, উত্তরাধিকার লড়াই শুরু

১৬৫৭ : সম্রাট হিসেবে প্রথম অভিষেক অনুষ্ঠান

১৬৫৮ : সম্রাট হিসেবে দ্বিতীয় অভিষেক অনুষ্ঠান

১৬৫৯ : দারা শিকোহর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর

১৬৬১ : মুরাদ বকসের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর

১৬৬৩ : রাজা রঘুনাথের মৃত্যু

১৬৬৬ : শাহজাহানের ইন্তিকাল

১৬৬৬ : মোগল দরবার থেকে শিবাজির পলায়ন

১৬৬৭ : ফতোয়া-ই-আলমগিরির রচনা শুরু

১৬৬৯ : সম্রাটের ঝরোকা দর্শন প্রথা বাতিল

১৬৬৯ : বেনারসের বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস

১৬৭৩-৭৪ : লাহোরে বাদশাহি মসজিদের নির্মাণকাজ সমাপ্ত

১৬৭৫ : তেজ বাহাদুরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর

১৬৭৯-৮০ : রাঠোর-সিসোদিয়া বিদ্ৰোহ

১৬৭৯ : জিজিয়া কর পুনঃপ্রবর্তন

১৬৭৯ : মোগল অভিজাতদের মধ্যে হিন্দু প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি শুরু

১৬৮০ : শিবাজির মৃত্যু

১৬৮১ : যুবরাজ আকবরের বিদ্রোহ

১৬৮১ : আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য যাত্রা

১৬৮৫-৮৬ : বিজাপুর অবরোধ

১৬৮৭ : গোলকোন্ডার পতন

১৬৮৯ : শম্ভুজির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর

১৯৯৮ : জিনজির (গিনগি) পতন

১৭০৪ : নির্বাসনে যুবরাজ আকবরের মৃত্যু

১৭০৪ : দাক্ষিণাত্যে জিজিয়া করে ছাড়

১৭০৫ : অমর সিংয়ের ফারসি রামায়ণ আওরঙ্গজেবকে উৎসর্গ

১৭০৭ : আওরঙ্গজেবের ইন্তিকাল

Exit mobile version