Site icon BnBoi.Com

সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস – আহমদ ছফা

সাম্প্রতিক বিবেচনা : বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস - আহমদ ছফা

পরিবর্ধিত সংস্করণের ভুমিকাঃ সাম্প্রতিক বিবেচনা

সাম্প্রতিক বিবেচনা : বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (প্রবন্ধ) – আহমদ ছফা

উৎসর্গ – আততায়ীর গুলিতে নিহত
কবি হুমায়ুন কবির-এর
স্মৃতির উদ্দেশ্যে

পরিবর্ধিত সংস্করণের ভুমিকাঃ সাম্প্রতিক বিবেচনা

‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ রচনাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো উনিশশো বাহাত্তর সালে। এখন উনিশশো সাতানব্বই। এরই মধ্যে পঁচিশ বছর পেরিয়ে গেছে। যখন লেখাটি প্রকাশিত হয় আমার বয়স বড়জোর আটাশ। বিগত পঁচিশ বছরে এই লেখাটির অনেকগুলো সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরবর্তী সময়ে তৎকালীন পরিবেশ পরিস্থিতি স্নায়ুতন্ত্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করে আমাকে এই লেখাটি লিখতে বাধ্য করেছিলো। দৈনিক গনকন্ঠ পত্রিকায় সতেরোটি কিস্তিতে আমি লেখাটা লিখি। পরে বই আকারে প্রকাশ করি। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ার পর লেখাটি নানা লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। বিশেষ করে রাজনীতি সচেতন তরুণদের কাছে লেখাটি আশাতীত জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই পুস্তকে প্রকাশিত নানা মন্তব্য পাঠকদের মধ্যে এতো সাড়া জাগিয়ে তুলেছিলো, সেকালে যাঁরা তরুণ ছিলেন তাঁদের কারো সাথে দেখা সাক্ষাত হয়ে গেলে এই বইটির বিশেষ পংক্তি তাঁরা এখনো আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে থাকেন।

এই রচনাটি লেখার পূর্বে বিশষ ভাবনা চিন্তা করার সুযোগ আমি পাইনি। স্বতঃস্ফুর্ত আবেগে বেবাক রচনাটি লিখে ফেলেছিলাম। লেখার সময় কখনো মনে হয়নি, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আশয় নিয়ে আমি সিরিয়াস একটা পর্যালোচনা হাজির করতে প্রবৃত্ত হয়েছি। যেহেতু এ লেখাটি লিখতে আমাকে কোনো বেগই পেতে হয়নি, তাই কি লিখলাম এ নিয়ে আমি বিশেষ মাথা ঘামাবার প্রয়োজনও বোধ করিনি। আমার অন্যান্য রচনার পেছনে যে শ্রম অভিনিবেশ এবং যত্ন আমাকে বিনিয়োগ করতে হয়েছে, তার ভগ্নাংশও এই রচনার পেছনে ব্যয় করতে হয়নি। তাই এ লেখার সঙ্গে আমার প্রাণের অনুভূতির সংযোগ অতোটা নিবিড় নয়। যদি লোক সমাজে বিশেষভাবে আলোচিত না হতো, হয়তো এই রচনাটির কথা আমিও ভুলে যেতে পারতাম। সৃষ্টিশীল আবেগের সঙ্গে সম্পর্ক রহিত হলেও এই রচনায় আমি এমন কিছু মতামত প্রকাশ করেছিলাম, সমাজ এবং রাজনীতি সচেতন মানুষ, সেগুলোর গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন। এই বইয়ের পাঠকেরাই আমাকে বারংবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, এ বইটি যেহেতু আমার কলম থেকে বেরিয়েছে সুতরাং গ্রন্থ প্রকাশিত মতামতের দায়দায়িত্বও আমাকে বহন করতে হবে। এখানে আমি সবিনয়ে নিবেদন করতে চাই, আমার সাধ্যমতো সেই দায়দায়িত্ব আমি বহন করছি।

মাঝে মাঝে এমন চিন্তাও আমার মনে আসে, লেখাটি যদি না লিখতাম, হয়তো আমার জীবন অন্য রকম হতে পারতো। এই লেখাটির জন্যই আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত শ্ৰেণীভূক্ত এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর রোষ আমাকে পেছন থেকে অভিশাপের মতো তাড়া করছে। অদ্যাবধি আমি জীবনে স্বস্তি কি বস্তু তার সন্ধান পাইনি। আগামীতে কোনোদিন পাবো, সে ভরসাও করিনে। তথাপি এই রচনাটি লেখার জন্য এক ধরনের গর্ব অনুভব করি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরবর্তী বছরগুলোতে অবিচার, অনাচার নির্যাতন, রাষ্ট্রশক্তির সক্রিয় হস্তক্ষেপ যখন সামাজিক বিবেকের করুদ্ধ করে ফেলেছিলো, স্বৈরাচারের প্রবল প্রতাপে উদ্ধত অন্যায় যখন ন্যায়ের বসন পরে অসহায় সমাজের ওপর দ্রুকুটি নিক্ষেপ করেছিলো, রাজরোষের ভয়ে বিবেকবান মানুষ মুক হতবিহ্বল চণ্ড শাসনের সেই নিষ্ঠুর পরিস্থিতিতে আমি জ্বলে উঠতে পেরেছিলাম। এটা অহঙ্কারে স্ফীত হয়ে ওঠার মতো কিছু না হলেও নিতান্ত সামান্য বিষয় মনে করিনে। প্রতিটি দ্রোহ, প্রতিটি প্রতিবাদ, তার শাস্তির দিক যেমন আছে তেমন পুরস্কারেরও একটা ব্যাপার এতে রয়েছে। শাস্তির কথাটা বলেছি। এখন পুরস্কারের কথা বলি। ন্যায়ের পক্ষে যারা কথা বলে, কাজ করে মানবহৃদয়ের স্বতঃস্ফূর্ত সম্মানবোধ তাদের অভিমুখে ধাবিত হয়। এই ছিপছিপে গ্রন্থটি রচনা করার কারণে তরুনতরো প্রজন্মের মনে আমি একটা স্থান করে নিতে পেরেছিলাম। এই লেখাটা নিয়ে পঁচিশ বছর আগে যেভাবে আলোচনা হতো, এখনো নানা জায়গায় সেরকম আলোচনা হতে দেখি। সেই জিনিশটাকেই আমি পুরস্কার বলে ধরে নিয়েছি।

‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ প্রকাশিত হওয়ার পর যখন সকলে লেখাটির তারিফ করতে থাকেন, আমাদের দেশের কৃতবিদ্য লোকদের কেউ কেউ আগ্রহী হয়ে প্রতিবাদী বই পুস্তক লিখতে আরম্ভ করেন। সেগুলো যদি যথার্থ দ্রোহ এবং প্রতিবাদ ধারণ করতে পারতো তাহলে আমিই সবচেয়ে বেশী সন্তোষ বোধ করতে পারতাম। অন্ততঃ মনে করতে পারতাম আমি নেহায়েত অরণ্যে রোদন করিনি। আমার উত্তাপিত কণ্ঠস্বরে সাড়া দেয়ার লোক পাওয়া গেছে। আমি একা নই। কিন্তু আমাকে নিদারুণভাবে হতাশ হতে হয়েছে। এই ভদ্রলোকদের রচনাসমূহে বাকচাতুর্য আছে, কিন্তু প্রতিবাদের আগুন নেই। পণ্ডিতদের এই ধরনের ভাবের ঘরে চুরি করার কসরত দেখ দেখে আমি প্রায় স্থির সিদ্ধান্ত উপনীত হয়েছি, সম্মানের কাঙ্গাল মানুষেরা কি ধরনের সামাজিক উৎপাতের কারণ হতে পারেন। সম্পূর্ণ নিরাসক্ত দৃষ্টিতে যখন আমি বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাসের সঙ্গে পরবর্তীকালে পণ্ডিতদের প্রকাশিত পুস্তকগুলোর তুলনা করি, কেনো জানি আমার সেগুলোকে তাজা বোমার পাশে সার সার ভেজা পটকার মতো মনে হতে থাকে। বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস রচনাটির প্রতি আমার অন্য এক বিশেষ কারণে একটা বিরক্তি বোধ রয়েছে। যথেষ্ট না হলেও সাহিত্যের নানা শাখায় অবশ্যই কিছু দাহিকাশক্তিসম্পন্ন রচনা আমি লিখেছি । এই সকল রচনায় আমার মনন, মেধা এবং শ্রমের অধিকাংশ ব্যয় করেছি। কিন্তু মানুষ অনেক সময়ে আমার সাহিত্যকর্ম বলতে একমাত্র এই ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাসে’র উল্লেখ করে থাকেন। যদিও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারিনি, এই জিনিশটি আমাকে খুবই আহত করে। আমি নিজেকেই প্রশ্ন করেছি, লোকে ওই লেখাটার কথা বলে কেনো? আমার অন্যান্য রচনার কি কোনো সাহিত্য মূল্য নেই। আমার অন্যান্য রচনাকে আড়াল করে রাখার জন্য এই বইটির প্রতি একটা চাপা নালিশ সবসময়ই পুষে আসছিলাম।

.

০২.

এই লেখার শুরুতেই জানিয়েছি ‘বুদ্ধিবৃত্তির নুতন বিন্যাস’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো উনিশশো বাহাত্তর সালে। এখন সাতানব্বই। মাঝখানে সিকি শতাব্দীর ব্যাবধান। তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে কোনো রকমের পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া লেখা একটি রচনা এই পঁচিশ বছর পরেও কতোটা প্রসঙ্গিক হতে পারে, বইটি পাঠ করতে গিয়ে নতুন করে টের পেলাম । বিশ্বাসই হতে চায় না যে রচনাটি আমি লিখেছিলাম। এই গ্রন্থে যে সকল মতামত প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো বাহাত্তর সালে যতোটা প্রাসঙ্গিক এবং সত্য ছিলো, এই সাতানব্বই সালে তাদের তাৎপর্য ক্ষুণ্ণ না হয়ে বরং অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মুখ্যতঃ সে কারণেই নতুন একটি সংস্করণ প্রকাশের প্রক্কালে নতুন একটি ভুমিকা লেখার প্রয়োজন অস্বীকার করতে পারিনি।

সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে জাতীয় মধ্যেশ্রেণীভূক্ত বুদ্ধিজীবীরা সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা এই রাষ্ট্রীয় চতুঃস্তম্ভের জয়ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে ফেলেছিলেন। রেডিও টেলিভিশনে তোষামোদ, চাটুকারিতা, নিলজ্জ আত্মপ্রচার মানুষের সুস্থ কাণ্ডজ্ঞানকে এক রকম মুছে ফেলতে উদ্যত হয়েছিলো । সন্ত্রাস, গুম, খুন, ছিনতাই, দস্যুতা, মুনাফাখখারি, কালোবাজারী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্বিচার হত্যা এগুলো একান্তই নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিলো । মানুষের হনন প্রবত্তি, লোভ রিরংসার এরকম নির্লজ্জ আত্মপ্রকাশের সিংহ দুয়ার খুলে দেয়ার ব্যাপারে তৎকালীন সরকার মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলো। এই ধরনের একটি মাৎস্যন্যায় পরিস্থিতিতে বুদ্ধিজীবীদের অবশ্যই একটি পালনীয় ভূমিকা ছিলো, একটা দায়িত্ব ছিলো। কিন্তু তারা সেদিন তাদের ওপর আরোপিত দায়িত্ব কর্তব্য বিস্মৃত হয়ে যাবতীয় অমানবিক কর্মকাণ্ডে সরকারের মদদ দিয়ে নিজেদের আখের গুছাবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন।

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে সামগ্রীক পরিস্থিতির এরকম অবনতির বহুবিধ গভীরতরো কারণ নিশ্চয়ই বর্তমান ছিলো এবং সেগুলোর উৎসও ছিলো জাতীয় রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির ধারাবাহিক ইতিহাসের গভীরে প্রোথিত। আমি চারদিকে যা ঘটছে খোলা চোখে দেখে প্রতিক্রিয়াগ্রস্ত হয়ে আমার শঙ্কা, সন্দেহ এবং ক্ষোভের অভিব্যক্তি ছাপার হরফে প্রকাশ করেছিলাম। আমি যা লিখেছিলাম, তার একটা বাক্যও আমাকে গবেষণা করে আবিষ্কার করতে হয়নি। আমার চারপাশে যা ঘটছে দেখে, চারপাশের মানুষের মুখের কথা শুনে আমার বয়ানটুকু তৈরি করেছিলাম। আমার মনে হয়েছিলো এ অবস্থা চলতে পারে না, এই মিথ্যার পাহাড় এক সময়ে ধ্বসে পড়তে বাধ্য। আমি এই বইটিতে যে সকল সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলাম, তার প্রতিটি বাক্য অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে।

শেখ মুজিবুর রহমান বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পথ পরিহার করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা আরোপ করলেন এবং সর্বময় ক্ষমতার কর্তা হয়ে বসলেন। সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ এই চারটি প্রতীতিকে জাতীয় মূলনীতি হিসেবে নির্ধারণ করলেন বটে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সেগুলো একদলীয়, আরো সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে এক ব্যক্তির শাসন ত্ৰাসনের হাতিয়ারে পরিণত হলো। তার মর্মান্তিক পরিণতি এই হলো যে, শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নিহত হতে হলো। রাষ্ট্রক্ষমতা বেসামরিক একনায়কের হাত থেকে সামরিক একনায়কের হাতে হস্তান্তরিত হলো। একের পর এক সমর নায়কেরা সমাজের পাতাল প্রদেশ থেকে পশ্চাদপদ ধ্যান ধারণা, ধর্মান্ধতা শুধু জাগিয়ে তুলে ক্ষান্ত হননি, সেগুলোর আইনগত স্বীকৃতি দান করে আমাদের জাতীয় জীবনের গন্তব্য অধিকতরো ধোয়াটে এবং কুয়াশাচ্ছন্ন করে তুলেছেন। স্বাধীনতার শুরু থেকেই বুদ্ধিজীবীরা একজোট হয়ে শেখ মুজিবের অগণতান্ত্রিক একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে যদি রুখে দাঁড়াতেন তাহলে আমাদের জাতিকে এতোটা পথ পশ্চাত প্রত্যাবর্তন করতে হতো না। যে কোনো দেশের বুদ্ধিজীবীরা যদি রাষ্ট্রযন্ত্রের অনাচার অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে অসম্মত হন সেই দেশটির দুর্দশার অন্ত থাকে না। বাংলাদেশ সেই রকম একটি দুর্দশাগ্রস্থ দেশ। এই দুর্দশা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উদ্যোগ, কোনো প্রয়াস কোথাও পরিদৃশ্যমান নয়।

বর্তমানে সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা যে ভূমিকাটি পালন করছে, তা কিছুতেই বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত সময়সীমার মধ্যে আওয়ামী বাকশালী বুদ্ধিজীবীরা যে কাপুরুষোচিত ভূমিকা পালন করছে, তার চাইতে বেশী আলাদা নয়। তাঁদের কথাবার্তা শুনে মনে হয় বাহাত্তর তেয়াত্তর সাল থেকে টাইম মেশিনে চড়ে তাঁরা এই সাতানব্বই সালে পদার্পণ করেছেন। বাহাত্তর সালে তারা যেভাবে যে ভাষায় অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলতেন বাঙালী সংস্কৃতির কথা বলতেন, বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রতি অঙ্গীকার প্রকাশ করতেন; এই সাতানব্বই সালেও তাঁরা একই ভাষায় সেই পুরোনো বুলি গুলো উচ্চারণ করে যাচ্ছেন। পরিবর্তন যেটুকু হয়েছে তাঁদের কণ্ঠস্বর এখন অধিকতরো দ্বিধা এবং জড়িমাহীন। অনেকটা স্বৈরাচারী অবস্থানে দাঁড়িয়ে তাঁরা এই প্রত্যয়সমূহ উচ্চরণ করে যাচ্ছেন। সাজানো মঞ্চে দাঁড়িয়ে মাইনেভোগী নটনটীর মতো সেই পুরোনো কথা বলে যাচ্ছেন তাদের কণ্ঠস্বর থেকে অভব কিংবা উপলব্ধির কোনো তড়িৎ সঞ্চারিত হয় না। তাঁদের উচ্চারণ থেকে কোনো গাঢ় প্রত্যয়ের দীপ্তি জনমানসে বিকীরিত হয় না।

বাংলাদেশের মধ্যশ্রেণীভূক্ত এই ভাড়াখাটা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সকলের না হলেও কারো কারো অল্পস্বল্প শৈল্পিক অঙ্গীকার এবং সামাজিক সুকৃতি ছিলো। কিন্তু শাসক দলের চালকলা খেকো বামুনের ভূমিকা পালন করতে গিয়ে তাদের সমস্ত অঙ্গীকার এবং সুকৃতি প্রায় নিঃশেষ করে ফেলেছেন। বর্তমানে তাদের অবস্থা অনেকটা জয় জয় করিয়া বাড়ে রাজার ব্রাহ্মণের মতো । সরকারী বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ একসময়ে শিল্পকলার নানা বিষয়ে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন। সরকারী সুবিধার বলয়ে প্রবেশ করার পর সর্বত্র তাদের কণ্ঠস্বর ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো। প্রদর্শন করার যতোগুলো মাধ্যম আছে সবখানে তাদের পবিত্র মুখমণ্ডল আলো করে জ্বলতে থাকলো। সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় অমৃতবর্ষী বাণী ছড়িয়ে দিতে লেগে গেলেন। সরকারী প্রচারযন্ত্রের অংশে পরিণত হওয়ার পর এই সকল সৃষ্টিশীল মানুষ সম্পূর্ণরূপে সুকুমার অনুভূতি এবং কল্পনাশক্তি রহিত রোবটে পরিণত হয়েছেন। তাদের অবস্থা দলীয় ক্যাডারের চাইতে অধিক শোচনীয়। কারণ ক্যাডারের কাজ চিন্তা করা নয়, নেতা বা দলের হুকুম তামিল করা। কিন্তু একজন বুদ্ধিজীবীকে চিন্তা করতে হয়। কিন্তু চিন্তার বদলে যদি তিনি চিন্তা করার ভান করেন পরিণতি ভয়ঙ্কর হতে বাধ্য। তাই সরকারী বুদ্ধিজীবীরা যখন বলেন আমরা বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিকাশ সাধন করছি, তাদের এই উচ্চারণগুলো সত্য বলে মেনে নেয়ার কোনো যুক্তি নিজেরাও দাঁড় করাতে পারবেন না। সরকারী সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন বলেই যত্রতত্র তারা তোতা পাখির মতো এ বুলিগুলো উচ্চারণ করছেন। তাদের রচনার মধ্যেই মানসিক বন্ধ্যাত্বের চিহ্ন যে কেউ খুঁজে বের করতে পারেন। তারা যখন মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কথা বলেন শুনে মনে হবে, আবাহনী মোহামেডান টীমের ভাড়া করা বিদেশী খেলোয়াড়দের মতো, তাঁদেরও ভাড়া করে আনা হয়েছে। তারা যখন বাঙালী জাতীয়তাবাদের কথা বলেন শুনে মনে হবে, টেক্সট বই থেকে কথাগুলো মুখস্ত করে হাজেরান মজলিশের শ্রোতাদের সামনে বমি করে দিচ্ছেন। তারা যখন মৌলবাদের বিরুদ্ধে হুঙ্কার তোলেন, সেটাকে গোদা পায়ের লাথির সঙ্গে তুলনা করা যায়। হুঙ্কার দিয়ে কি মৌলবাদ প্রতিরোধ সম্ভব? তাদের মধ্যে স্বচ্ছ চিন্তা কোথায়? চিন্তার সমর্থনহীন ঢোলা উচ্চারণ এবং শোরগোল কি মৌলবাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিষেধক বিবেচিত হতে পারে? এই সকল বুদ্ধিজীবীদের অতীত অত্যন্ত ঘৃণ্য এবং কলঙ্কিত। পাকিস্তান আমল থেকেই রাষ্ট্রশক্তির সহায়তায় তাঁরা ননী মাখন লুট করে এসছেন। তাদের আতীত দিনের কর্মকাণ্ড ঘেঁটে আসল পরিচয় উদ্ঘাটন করা হলে যে কেউ বুঝতে পারবেন তারা কিছুতেই আমাদের জনগণের বন্ধু হতে পারেন না। তাদের উচ্চ কণ্ঠ চিৎকারের মধ্য দিয়ে নির্লজ্জ সুবিধাবাদ ছাড়া অন্য কোনো প্রত্যয়ই ধ্বনিত হয় না। বাহাত্তর সালে তারা যা করেছেন, অধিক জোরের সঙ্গে তার পুনরাবৃত্তি করে চলেছেন মাত্র।

বাহাত্তর সাল আর ছিয়ানব্বই সাল এক নয়। বাহাত্তর সালে প্রতিক্রিয়ার শক্তি ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলো। মৌলবাদের অবস্থান ছিলো তখন টলটলায়মান। এখন প্রতিক্রিয়ার শক্তি অনেক বেশি সুসংহত এবং সংগঠিত। মৌলবাদ অক্টোপাশের মতো ক্রমাগতভাবে আমাদের সমাজকে চারপাশ থেকে বেষ্টন করে ফেলছে। যারা মৌলবাদী তারা শতকরা একশো ভাগ মৌলবাদী। কিন্তু যারা প্রগতিশীল বলে দাবী করে থাকেন তাদের কেউ কেউ দশ ভাগ প্রগতিশীল, পঞ্চাশ ভাগ সুবিধাবাদী, পনেরো ভাগ কাপুরুষ, পাঁচ ভাগ একেবারে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন। এই রকমের একটি সমীকরণের মধ্যে ফেললে বর্তমান সরকার দলীয় বুদ্ধিজীবীদের চিহ্নিত করা সম্ভব। দিনে দিনে প্রতিক্রিয়ার শক্তি যে হারে সংহত হচ্ছে এবং মৌলবাদের প্রতাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তথাকথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা তার বিরুদ্ধে কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধই রচনা করতে পারেননি। আমাদের জনগণ তাদেরকে চরিত্রহীন, ভ্রষ্ট সুযোগ সন্ধানী এবং আগ্রাসী শক্তির সহায়ক হিসেবে এরই মধ্যে চিহ্নিত করে ফেলেছেন। মুখে তারা যাই বলুন না কেনো, আমাদের জনগণকে মুক্তির দিগন্তে পরিচালিত করার কোনো অনুপ্রেরণা তারা দিতে পারেন না যেমন তেমনি আমাদের জাতিকে আপন মেরুদণ্ডের ওপর থিতু হয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবার কোনো কর্মপন্থার নির্দেশ করতেও তারা সত্যি সত্যি অক্ষম। সরকার সমর্থক বুদ্ধিজীবীরাই দেশের একমাত্র বুদ্ধিজীবী নন। যে সকল বুদ্ধিজীবী প্রধান বিরোধীদলটির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে মাঠে ময়দানে হুঙ্কার তুলেছেন, যখন তখন যে কোনো উপলক্ষে জমায়েত হচ্ছেন, ভাগে কম পড়ার বেদনাই চীৎকার করে তারা প্রকাশ করে থাকেন। তাদের মনন এবং চিন্তা পদ্ধতি আরো সেকেলে, আরো ভয়ানক। সরকারী বুদ্ধিজীবীদের সামনের দিকে তাকানোর সাহস নেই। কিন্তু এই সকল বুদ্ধিজীবীদের চোখ এবং পা দুই-ই পেছনের দিকে ফেরানো। এক কথায় রাষ্ট্রযন্ত্রের এপাশে ওপাশে যে সমস্ত বুদ্ধিজীবীর অবস্থান তারা জাতি এবং সমাজকে কিছু দেন না, বরং গবাদি পশুর গায়ের এটুলি পোকার মতো সমাজের মানুষের রক্তপান করে নিজেরা মোটা তাজা হতে থাকেন।

দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল এবং ছদ্মবেশী প্রগতিশীল এই উভয় গোষ্ঠীকে পরাজিত করতে না পারলে আমাদের দেশে প্রগতিশীল সংস্কৃতি এবং রাজনীতির উত্থান অসম্ভব। আমাদের দেশের প্রগতিশীল রাজনীতির যে অবস্থা তার সঙ্গে খাটে শোয়া মুমূর্ষ রোগীর তুলনা করা চলে। যার অস্তিত্ব আছে বলে শোনা যায়, কিন্তু তার নড়াচড়া নেই। বামপন্থী রাজনীতির এই করুণ পলায়মান এবং জরাজীর্ণ দশা আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বাঙ্গীন দুর্ভাগ্যেরই ইঙ্গিত নির্দেশ করে। সুতরাং বর্তমান অবস্থা থেকে প্রগতিশীল রাজনীতি এবং সংস্কৃতিকে উঠে আসতে হলে ছদ্মবেশী প্রগতিশীল এবং মৌলবাদী উভয় গোষ্ঠিকেই পরাজিত করতে হবে। কিন্তু কাজটি সহজ নয়। এই সময়ের মধ্যে আমাদের সমাজ অনেক জটিল হয়ে পড়েছে, বিরাজমান রাজনীতি, অর্থনৈতিক সংগঠন, রাষ্ট্রের চেহারা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য,ধর্মীয় সামাজিক বদ্ধমত এবং সংস্কারের অনেক কিছু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে সংগ্রামের গতিপথটি ছকিয়ে নিতে হবে। যে সকল বিষয় পঁচিশ বছর আগে স্পর্শ করার প্রয়োজন বোধ করিনি, নতুন একটি সংস্করণ প্রকাশ করার সময় সে বিষয়গুলো নতুন করে শনাক্ত করার চেষ্টা করছি।

.

০৩.

‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাসে’ তৎকালীন রাজনীতির ভালো মন্দ সম্পর্কে কোনো আলোচনাই করা হয়নি। কারণ এ ব্যাপারে আমার মনে সংশয় ছিলো। সেই পরিবেশ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের চরিত্র আলোচনার সুযোগও ছিলো না। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির চরিত্র কি হবে জন্মলগ্নে তার একটি পরিচয় নির্ণয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিলো। সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্ম নিরপেক্ষতা এ চারটি মূলনীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছিলো। বাংলাদেশের তৎকালীন সমাজের বাস্তব অবস্থা এবং রাষ্ট্রীয় আদর্শের ফাঁকা বুলির মধ্যে পার্থক্যের পরিমাণ এতো অধিক ছিলো যে এক বছর সময়ের মধ্যেই আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছিলো, এ জিনিশ চলবে না, চালানো যাবে না। একটা বিপত্তি ঘনিয়ে আসছে। বাতাসে আমি তার গন্ধ শুঁকেছিলাম। কার্যকারণ সম্পর্ক বিচারের অবকাশ হয়নি। একজন লেখক হিসেবে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে এই সমূহ সর্বনাশের সংকেত আমার মনে জ্বলে উঠেছিলো।

পরবর্তীতে অল্পদিন না যেতেই দেখা গেলো শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধান পরিবর্তন করে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর স্থলে রাষ্ট্রপতি হয়ে বসলেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের পন্থা পরিহার করে একদলীয় শাসন কায়েম করলেন। তারপর মুজিবের শাসন তিন বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই তিনি সপরিবারে মর্মান্তিকভাবে নিহত হলেন। একজন বা একাধিক ব্যক্তির হত্যার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের পরিচয় পাল্টে যাওয়ার দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে অধিক নেই । অথচ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেই ব্যাপারটিই ঘটেছে। সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার এই প্রত্যয় দুটো সংবিধান থেকে ঝরে পড়লো। বেশ কিছুদিন সামরিক শাসন চালু থাকার পর জিয়াউর রহমান যখন পুনরায় বহুদলীয় সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করলেন, সংবিধানের শিরোভাগে বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম এসে স্থান করে নিলো। রাষ্ট্রের চরিত্রের আমূল পরিবর্তন ঘটে গেলো। জিয়াউর রহমনের পর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এসে ইসলাম ধর্মকে বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে বসলেন।

মুজিব পরবর্তী বাংলাদেশের শাসকবৃন্দ ঘোষণা দিয়ে রাষ্ট্রীয় সংবিধানের মধ্যে যেমন পরিবর্তন এনেছেন, তেমনি রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প-বাণিজ্যের প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা এগুলো ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেয়ার প্রক্রিয়া চালু করেন। জিয়াউর রহমান তার শাসনামলে শিল্প প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির হাতে ছেড়ে দেয়ার প্রক্রিয়াটি শুরু করেন। এরশাদের আমলে এসে সেই প্রক্রিয়াটিই অত্যন্ত জোরে-শোরে অনুসৃত হতে থাকে। সামরিক শাসক এরশাদের পতনের পর জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে খালেদা এলেন। খালেদাকে পরাজিত করে হাসিনা। এই বারংবার ক্ষমতার হাত বদলের মধ্যেও রাষ্ট্রীয় পুঁজি ব্যক্তির হাতে স্থানান্তরের প্রক্রিয়াটি প্রতিটি নতুন সরকারের আমলে অধিকতরো বেগবান হয়েছে। বর্তমান শেখ হাসিনার আমলেও যে অল্পস্বল্প পুঁজির নিয়ন্ত্রণভার সরকারের হাতে আছে, ব্যাংক-বীমা ইত্যাকার যে প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক খোদ সরকার, সেগুলো ব্যক্তি মালিকদের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আই এমএফ, বিশ্বব্যাংক এই সমস্ত আন্ত র্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান নিরন্তর চাপ প্রয়োগ করে আসছে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির আসল স্বরূপ নিয়ে যে বিতর্ক সাম্প্রতিককালে কতিপয় জাতীয় প্রতীককে ঘিরে ঘনীভূত হয়েছে মোটা দাগে সেগুলো এরকম। জাতি হিসেবে বাংলাদেশীদের পরিচয় কি হবে? বাঙালী না বাংলাদেশী? বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের পরিচয় মুসলমান না বাঙালী? বাংলাদেশীরা জয়বাংলা বলবে না বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বলবে, শেখ মুজিবুর রহমান যার নেতৃত্বে বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সংগ্রাম ধাপে ধাপে বিকশিত হয়ে স্বাধীনতা সগ্রামে রূপ লাভ করেছে, কোন পরিচয়ে তাকে চিহ্নিত করা হবে? তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রের স্থপতি? নাকি বাঙালী জাতির জনকের অভিধায় চিহ্নিত হবেন? বর্তমান বাংলাদেশের দুটি প্রধান দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জতীয়তাবাদী দল এই সমস্ত প্রতাঁকের মধ্যেই তাদের অন্তর্গত বৈপরীত্য এবং মতাদর্শগত বিরোধ সন্ধান করছে । যে প্রতীকগুলো নিয়ে দুটি প্রধান দলের মধ্যে বিরোধ বিসংবাদ চলছে, সেই প্রতীকগুলোর ভাবার্থ এবং গভীর ব্যঞ্জনা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে খতিয়ে দেখলে কোনো বৈপরীত্য আবিষ্কার করা সত্যি সত্যি অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। আমরা বাঙালী একথা যেমন সত্য, তেমনি আমাদের বাংলাদেশী পরিচয়ও মিথ্যা নয়। সংখ্যাধিক জনগোষ্ঠীর মুসলমানিত্বের পরিচয় বাঙালীত্বের পরিচয় খারিজ করে না। জয় বাংলা এবং জিন্দাবাদ শব্দটির মধ্যে অর্থগত কোনো বিরোধ না থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের সময় জয়বাংলা শব্দবন্ধটি একটি বিশেষ তাৎপর্য লাভ করেছিলো, সেকথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। যেহেতু আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের মূল নেতৃত্বের দাবীদার, সেই সুবাদে জয়বাংলা শব্দবন্ধটি তাঁরা একচেটিয়াভাবে ব্যবহার করে থাকেন। অন্য কোনো ব্যক্তিবর্গ যদি আওয়ামী লীগ বিরোধী একটি রাজনৈতিক সংগঠন দাঁড় করিয়ে জয়বাংলা শব্দটিকে ব্যবহার করতে থাকেন, আওয়ামী লীগের তরফ থেকে আপত্তি উত্থাপন করার কোনো কারণ কি থাকতে পারে? যদি বাংলা ভাষার শব্দ হওয়ার কারণে জিন্দাবাদের বদলে জয় বাংলার গ্রহণযোগ্যতা অধিক হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে, আওয়ামী লীগ শব্দবন্ধটিও বাংলা নয়। আওয়ামী শব্দটি উর্দু এবং লীগ শব্দটি ইংরেজী । তারপরে শেখ মুজিবুর রহমানের কথা ধরা যাক। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি না বাঙালী জাতির জনক? মুজিবকে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে মেনে নিলে কারো কোনো বিতর্কের অবকাশ থাকে না। কিন্তু তাঁকে বাঙালী জাতির জনক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে আরো একটি প্যাচালো বিতর্কের জন্ম দেয়া হয় মাত্র। বাংলাদেশের বাইরে ভারতের নানা জায়গায় বাঙালীরা বসবাস করে থাকেন। তারা শেখ মুজিবকে বাঙালী জাতির জনক হিসেবে মেনে নিতে স্বীকৃত হবেন না। প্রকৃত অর্থে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ভূখণ্ডটিই স্বাধীন হয়েছে। তাকে যদি জাতির জনক হিসেবে মেনেও নিতে হয়, বাংলাদেশী জাতির জনক বলাই অধিকতররা সঙ্গত। তাই যদি হয়, তাহলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার দাবীই প্রকারান্তরে স্বীকার করা হয় নাকি? বাংলাদেশী বলে কোনো জাতি যেমন নেই, তেমনি কোনো পিতাও থাকতে পারে না।

উনিশশো একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশে যে নতুন একটি রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছে তার ভেতরের যে সংকট তার সঙ্গে সাম্প্রতিক কালে দুটি প্রধান দলের মধ্যে যে প্রতীকী বিরোধ চলছে তার সম্পর্ক নিতান্তই ক্ষীণ। আসলে যাহা জল তাহাই পানি। বাংলার হিন্দুরা পানিকে জল বলে। আর বাংলার মুসলমানেরা জলকে পানি বলে। আবার বাংলার বাইরে হিন্দু মুসলমান সবাই জলকে পানিই বলে থাকে। পানি শব্দটি সংস্কৃত থেকে এসেছে। জল বাংলা শব্দ। জল পানির মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। তারপরেও দীর্ঘদিন পর্যন্ত বাংলার হিন্দু মুসলমানের বিরোধ জল অথবা পানি শব্দ দুটো উচ্চারণের মধ্য দিয়েই প্রতীকী ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। সংকটের আসল এলাকাকে পাশ কাটিয়ে প্রতাঁকের মধ্যে বিরোধ আবিষ্কার করার প্রবণতার কারণ বীজ বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্য প্রক্রিয়ার মধ্যেই অনুসন্ধান করতে হবে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দান করার কৃতিত্ব দাবী করে থাকে। দলটির এ দাবী একটুকুও অসঙ্গত নয়। তা সত্ত্বেও এ কথাটি অসত্য নয় যে সমস্ত নেতা আওয়ামী লীগের জন্ম প্রক্রিয়াটি সূচীত করেছিলেন, তাঁরা সকলেই পাকিস্ত নি আন্দোলনের নেতৃত্বদান করেছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রধান স্থপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং শেখ মুজিবুর রহমান এই তিন ব্যক্তিত্ব পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় প্রণিধানযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের কাছ থেকে ন্যায্য অংশ আদায় করার দাবীতে তারাই আবার আওয়ামী লীগ সংগঠনটি দাঁড় করিয়েছেন। আপোষ আলোচনার মাধ্যমে ন্যায্য দাবী আদায় করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিলো বলে, আওয়ামী লীগকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠমো থেকে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করার দায়িত্ব স্বীকার করে নিতে হয়েছে।

নির্মোহভাবে দৃষ্টিপাত করলে একটা বিষয় সকলের চোখে স্পষ্টভাবে ধরা পড়বে। আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের রাজনীতির মধ্যে যে সকল চিন্তা চেতনা ক্রিয়াশীল সেগুলোকে অতীতের পাকিস্তানী রাজনীতির জের কিংবা সম্প্রসারণ বলে অভিহিত করলে খুব বেশি অন্যায় হবে না। মুসলিম লীগের বীজতলা থেকেই আওয়ামী লীগের জন্ম এবং দলটি মুসলিম লীগের রাজনীতির বেসামরিক ঐতিহ্যের ধারক বাহক। যতদিন পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে একটি মধ্য শ্রেণীর বিকাশ হয়নি, আওয়ামী লীগের সমর্থন এবং আনুগত্য কম্পাসের কাঁটার মতো পশ্চিমের দিকে হেলে থাকতো। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর উত্তরাধিকার ধারণ করছে একথা বললেও খুব একটা মিথ্যা বলা হয় না। যদিও এরই মধ্যে দলটিতে অনেক নতুন উপাদান সংযোজিত হয়েছে, তথাপি জন্ম প্রক্রিয়ার সেই প্রাথমিক বোধগুলো এখনো সক্রিয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল যে উৎস থেকে জন্ম লাভ করেছে, সেই একই উৎস থেকে জাতীয় পার্টিরও উদ্ভব। তারতম্যের পরিমাণ নির্ভর করছে অন্যান্য সামাজিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ওপর। বাংলাদেশটির দুর্ভাগ্য হলো এই যে, দেশটির প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে বিপুল পরিমাণ অতীতের দায়ভার বহন করতে হচ্ছে। অতীতের ভূত কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে বর্তমানের নিরিখে কর্মকাণ্ড নির্ধারণ করার কোনো লক্ষণ পরিদৃশ্যমান হচ্ছে না। অতীতের ধারাবাহিকতার সূত্র ধরেই তারা দেশটা শাসন করতে চান। তাই প্রধান দুটো রাজনৈতিক দলের আচরণের মধ্যে ভারত এবং পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য এতোটা প্রাধান্য বিস্তার করে থাকে, তার মধ্যে বাংলাদেশ কততটা উপস্থিত সেই জিনিশটিই দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশের যে একটি আত্মা আছে, তা আবিষ্কার করতে সক্ষম নয়। সে কারণে সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসগত বিভেদ পাশ কাটিয়ে শব্দ বা শব্দবন্ধ নিয়ে কলহ করে সময় যাপন করে থাকেন।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি জন্মাবার পেছনে ধারণাগত একটা ভ্রান্তি অদ্যাবধি প্রবলভাবে বিরাজমান। বলা হয়ে থাকে ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতর থেকে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার দাবীতে এই রাষ্ট্রটির উত্থান হয়েছে। মুহম্মদ আলী জিন্নাহ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির জন্য সুনিশ্চিত করেছিলেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি মুসলমান হিন্দু দুটি আলাদা জাতি, এই প্রত্যয়টি খারিজ করে দিয়ে জন্ম লাভ করেছে। শুধু এটুকু যদি বলা হয় সম্পূর্ণ সত্য বলা হয় না। একটু ইতিহাসের পেছনে যাওয়া প্রয়োজন। এক সময়ে ভারতবর্ষের হিন্দু এবং মুসলমান একটি রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে বসবাস করতে সম্মত হয়নি বলেই ভারত এবং পাকিস্তান দুটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম সম্ভাবিত হয়েছে। মুহম্মদ আলী জিন্নাহ দাবী করেছিলেন, ভারতের মুসলমানেরা নিজেরাই আলাদা একটি জাতি। সুতরাং একটি স্বতন্ত্র বাসভূমি পাকিস্তান প্রয়োজন। অন্যদিকে মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু এবং মাওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ নেতা দাবী করেছিলেন, ভারতের সব সম্প্রদায়ের জনগণ মিলেই একটি জাতি। সুতরাং ভারতকে হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভাগ করা কখনো উচিত হবে না। তারপরেও দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতকে বিভক্ত করা হয়েছিলো এবং মুসলমানদের একটি স্বতন্ত্র বাসভূমির দাবী পাকিস্তানকে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। সিকি শতাব্দীর মধ্যেই পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি জন্ম নিলো । জিন্নাহ সাহেবের দ্বিজাতিতত্ত্ব সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা হয়ে গেলো। কথাটি এতোই দিবালোকের মতো সত্য যে, এ নিয়ে আর কোনো তর্ক চলতে পারে না।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতের কংগ্রেস দলীয় তাত্ত্বিকেরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এই মতাদর্শগত ভিত্তিটির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তাঁদের প্রচার প্রোপাগাণ্ডার ধরনটি থেকে একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে বেরিয়ে এসেছিলো। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস সকল ভারতীয় জনগণের এক জাতিত্বের যে দাবী তুলে ধরেছিলো, বাংলাদেশের জন্মের মধ্য দিয়ে সেই জিনিশটিই আবার নতুন করে প্রমাণিত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলটির অনুসারী শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের বেশিরভাগই বাংলাদেশের জন্মকে মুহম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের ভ্রম সংশোধন বলে ব্যাখ্যা করে আসছেন। কিন্তু এই ব্যাখ্যাটির মধ্যে একটা শুভঙ্করের ফাঁক বরাবরই থেকে যাচ্ছে। অবশ্যই প্রশ্ন করা প্রয়োজন, ভারতের হিন্দু মুসলমান দুটি জাতি আলাদা এটা যেমন সত্য নয়, তেমনি সত্য নয় ভারতের সবজাতি মিলে একজাতি। কংগ্রেস তাত্ত্বিক এবং তাঁদের বাংলাদেশী সাগরেদদের ব্যাখ্যা মেনে নিলে বাংলাদেশের একটা রাষ্ট্রিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। ভারতের মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়াই বাংলাদেশের রাষ্ট্রিক নিয়তি। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই অবচেতনে হলেও এই ব্যাখ্যাটি সত্য বলে মনে করে থাকেন। তাই তাঁদের মধ্যে এমন একটা ভারতমুখীনতা লক্ষ্য করা যায়, যার অর্থ পরিষ্কার এ রকম দাঁড়াবে-বাংলাদেশ রাষ্ট্র একটি খণ্ডকালীন অস্তিত্ব মাত্র।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ভারতবর্ষের মানচিত্রে বারবার অদলবলদ ঘটেছে। যদি আরেকবার ঘটে তাতে বাধা কোথায়? একই রকম ভাঙচুর বাংলার মানচিত্রেও ঘটেছে। আরেকবার যে ঘটবে না, সে কথা জোর করে বলার উপায় কি? কিন্তু প্রশ্নটা একটু ঘুরিয়ে করলে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম জবাব শোনার জন্য তৈরি থাকতে হবে। ভারতের বাঙালী, পাঞ্জাবী, উড়িয়া, বিহারী, কাশ্মীরি, আসামী সকলে মিলে কি একটা জাতি? ভারতীয় যে অধিজাতিত্বের ধারণা বৃটিশ বিদায়ের প্রাক্কালে তৈরি করা হয়েছিলো, সেটা কি এখন ধোপে টেকে? পাঞ্জাব, কাশ্মির, আসাম, নাগাল্যাণ্ড, অরুণাচল এই সকল রাজ্যে একসার অগ্নিগিরির মতো স্বাধীনতা এবং স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে জনগণের সংগ্রাম যেভাবে প্রচণ্ড রোষে ফেটে পড়েছে, সেটা কি সমস্ত ভারতীয় জনগণের এক জাতিত্বের প্রতি আনুগত্যের পরিচায়ক? ভারতের রাষ্ট্র নায়কেরাও আত্মবিশ্বাস সহকারে ভবিষ্যদ্বাণী করতে অক্ষম, ভারত একজাতি হিসেবে চিরকাল অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারবে।

ওপরের আলোচনা থেকে একটি সত্য বেরিয়ে আসে। ভারতবর্ষ শুধুমাত্র হিন্দু মুসলমান দু’জাতির দেশ যেমন নয়, তেমনি একজাতির দেশও নয়। বহু জাতি, বহু ভাষা, বহু বর্ণ, বহু ধর্ম, অঞ্চল এবং নানা জনগোষ্ঠীর আবাসভূমি হিসেবে ইতিহাসের শুরু থেকেই তার অস্তিত্ব রক্ষা করে আসছে। বৃটিশ বিদায়ের প্রাক্কালে দুর্বলতরো জাতি, সম্প্রদায় এবং জনগোষ্ঠীগুলো তাদের দাবী উধ্বে তুলে ধরতে পারেনি বলেই একটি জগদ্দল রাষ্ট্রের বোঝা তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে সবাইকে ধারণ করা সম্ভব হচ্ছে না, কাঠামোতেই টান লাগছে।

উনিশশো বাহান্ন থেকে শুরু করে একাত্তর পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশের যতোগুলো আন্দোলন হয়েছে, যতো ধরনের গণসংগ্রাম রচনা করেছে তার একটা ইতিবাচক প্রভাব ভারতের নির্যাতিত অঞ্চল এবং জনগোষ্ঠীর ওপর অনিবার্যভাবে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের উনিশশো বাহান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের পরে আসাম, অন্ধ্র ইত্যাদি অঞ্চলে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম ভারতের পাঞ্জাব এবং কাশ্মিরের মতো বিচ্ছিন্নতাকামী রাজ্যসমূহের জনগণের ভারত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এসে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র। প্রতিষ্ঠার সগ্রামে প্রেরণার উৎস হিসেবে ক্রিয়াশীল ভূমিকা পালন করেছে।

একটা বিষয় শুরু থেকেই পরিষ্কার করে নেয়া প্রয়োজন। নানা অপূর্ণতা ও সীমাদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সংজ্ঞা অনুসারে ভারত উপমহাদেশের মধ্যে বাংলাদেশ সব চাইতে আধুনিক রাষ্ট্র। ভাষাভিত্তিক জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশের উত্থান আধুনিক ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে সব চাইতে অভিনব ঘটনা। বাংলাদেশ জাতি রাষ্ট্রের আদর্শ উর্ধ্বে তুলে ধরে তাবত ভারত উপমহাদেশের অবহেলিত অঞ্চল এবং জনগোষ্ঠীর ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে এবং দিনে দিনে সে প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উত্থান স্বীকার না করে যারা শুধুমাত্র জিন্নাহ সাহেবের দ্বিজাতিতত্ত্বের ভ্রম সংশোধনকেই বাংলাদেশের জন্মের কারণ মনে করেন; জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে এমন একটা ভ্রান্তির মধ্যে নিজেদের নিক্ষেপ করেন, চূড়ান্ত বিচারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেই একটা খণ্ডকালীন ব্যাপার বলে মেনে নিতে তারা কদাচিত দৃষ্টভঙ্গীগত বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হতে পারেন। বাংলাদেশ ভাষাভিত্তিক জাতি রাষ্ট্রের গন্ত ব্যটি দ্বৰ্থহীনভাবে আমাদের জনগোষ্ঠীর মনে অনপনেয়ভাবে গেঁথে দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ লেখাটির একটি বিশেষ পর্যায়ে প্রান্তিক জাতিসমূহের ওপর যে নির্যাতন নিপীড়ন চলে আসছে তার একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা আমি হাজির করেছিলাম। সাম্প্রতিক বিবেচনা যখন তৈরি করছি উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের সগ্রাম একদিকে যেমন একটি দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধের আকার পেয়েছে, তেমনি অন্যদিকে শক্তিশালী প্রতিবেশীর আগ্রাসী তৎপরতার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। শুরুতে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকার স্বীকার না করার মনোভাব থেকেই এই সঙ্কটের জন্ম হয়েছে। আসলে আমাদের নিপীড়িত জনগণের জীবনের যে মূল সঙ্কট, উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্কট তার চাইতে খুব একটা বিচ্ছিন্ন নয়। তাদের বিশেষ বিশেষ অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতিদানের মাধ্যমে তাঁদের আস্থা অর্জন করার এখনই প্রকৃষ্ট সময়। বিলম্বে অনর্থপাত ঘটে যেতে পারে।

.

০৪.

অর্থনীতি রাজনীতির মূল চালিকা শক্তি। রাজনীতির চেহারাটি কি দাঁড়াবে নেপথ্যে অর্থনীতিই নির্ধারণ করে দেয়। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতির দিকচিহ্নহীনতা এবং গণবিরোধী চরিত্র সেটাকে বাংলাদেশের অচলবন্ধ্যা অর্থনীতির যথার্থ প্রতিফলন বললে খুব বেশি বলা হয় না। অনড় স্থবির গতিহীন অর্থনীতিই রাজনীতিতে ক্রমাগত সংঘাত ডেকে আনছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এমন একটা দুষ্টচক্রের মধ্যে আটকা পড়ে আছে, সেখান থেকে উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা পরিদৃশ্যমান নয়।

বাংলাদেশের জনগণ মূখ্যতঃ অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করার তাগিদেই মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকগোষ্ঠী পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানকে উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহার করে আসছিলো। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করে পাকিস্তানের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে বিস্তর। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের অর্থনীতিতে উন্নয়নের কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করা হয়নি। এখানকার আদিম কৃষিনির্ভর অর্থনীতির কোনো রূপান্তর ঘটানো হয়নি একথা যেমন সত্য, তেমন পূর্বাঞ্চলের কৃষিপণ্যের থেকে মুনাফা অর্জন করে পশ্চিমারা তাদের অঞ্চলে সম্পদের পাহাড় গড়েছে তাও সত্য। এখানে কলকারখানা স্থাপন করা হয়নি, শিল্পবাণিজ্য বিকশিত করে তোলার সুচিন্তিত পদক্ষেপ কখনো গ্রহণ করা হয়নি। একটি কৃষিভিত্তিক অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যে একটি পরিকল্পিত উন্নয়ন পরিকাঠামো প্রয়োজন, সে ব্যাপারে একেবারেই নজর দেয়া হয়নি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অল্পস্বল্প যে শিল্প কারখানা গড়ে তোলা হয়েছিলো, সেগুলোর মালিক ছিলেন পশ্চিমারা। পূর্বাঞ্চলের সস্তা কাঁচামাল এবং শ্রমিকের স্বল্প মজুরীর ওপর নির্ভর করে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতিরা নিজেদের সহজ মুনাফা আয় করার তাগিদেই এই অঞ্চলে কিছু কিছু শিল্পকারখানা স্থাপন করেছিলেন। এই সব শিল্পকারখানার লভ্যাংশ এই অঞ্চলে বিনিয়োজিত না হয়ে পশ্চিমে চলে যেতো। পাকিস্তানের বাইশটি প্রধান পুঁজিপতি পরিবারের মধ্যে মাত্র একটিই ছিলো পূর্বাঞ্চলে। পাকিস্তানে যে পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ এবং সাহায্য পশ্চিমের ধনী দেশগুলো থেকে আসতো, তার সিংহভাগ ব্যয় করা হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। সুফল যেটুকু, ভোগ করতো পশ্চিমারা। পূর্ব পাকিস্তানকে বইতে হতো বৈদেশিক ঋণের দায়ভাগ। তঙ্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিমাদের এই অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে প্রতিবাদ করেছেন, আন্দোলন করেছেন। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তাদের ন্যায্য হিস্যা আদায় করা যখন অসম্ভব বলে মনে হয়েছে, তখনই পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বতন্ত্র একটা অর্থনীতি নির্মাণের কর্মসূচী গ্রহণ করে রাজনৈতিক সংগ্রামে নেমেছেন। মূলতঃ আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচী ছিলো পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের একটা স্বতন্ত্র অর্থনীতি নির্মাণের দলিল। পশ্চিমারা বরাবরই এই ন্যায্য অধিকারের দাবীকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ষড়যন্ত্র বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে। সত্তরের নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ছয় দফার পক্ষে আওয়ামী লীগকে ভোটের মাধ্যমে নিরঙ্কুশভাবে বিজয়ী করলেও পশ্চিমারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজি হয়নি। অধিকন্তু পশ্চিমা সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতিরোধের ব্যুহ চুরমার করে ফেলার জন্য রাতের অন্ধকারে তৎকালীন নিরীহ নিরস্ত্র জনগণের ওপর আক্রমণ চালিয়ে বসেছে। পাকিস্তানী সৈন্যদের হামলার ফলে পাকিস্তানের ঐক্য রক্ষা করার শেষ সম্ভবনাটির অবসান ঘটলো এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণকে একটি অসম যুদ্ধ ঘাড়ে করে নিতে হলো।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশের সঠিক বিশ্লেষণের জন্য পেছনের ইতিহাসটুকু জানা অবশ্যই প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জন হওয়ার পরে যে রাষ্ট্রটি বাংলাদেশে আত্মপ্রকাশ করলো, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে সমাজতন্ত্রকেও সে রাষ্ট্রের একটা মূল স্তম্ভ বলে ঘোষণা করা হলো। বাংলাদেশে একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সৃষ্টি করার পূর্বশর্তসমূহ হাজির ছিলো না। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান শক্তি আওয়ামী লীগ তেমন দলও ছিলো না। তথাপি আওয়ামী লীগ সরকার সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় প্রধান নীতিমালার একটি হিসেবে ঘোষণা দিলো এবং একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করতে হলো।

সমাজতান্ত্রিক সমাজে উৎপাদনের উপকরণসমূহের ওপর ব্যক্তি মালিকানার দখল থাকে না, সেগুলো সামাজিক মালিকানার ওপর ছেড়ে দিতে হয়। বাংলাদেশে উল্লেখ করার মতো বৃহদায়তন শিল্প কারখানা ছিলো না, যেগুলোও বা ছিলো, মালিক ছিলো অবাঙালী পশ্চিমা পুঁজিপতিরা। তারা দেশ ছেড়ে কলকারখানা ফেলে পাকিস্তানে চলে গেছেন। উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখার জন্য বাধ্য হয়েই সরকারকে এই শিল্পকারখানাসমূহের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়। শেখ সাহেব অনুপস্থিত পশ্চিমা মালিকদের শিল্পকারখানা অধিগ্রহণের কর্মটিকে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ বলে ঘোষণা দিলেন। বিষয়টির ব্যাপকতা প্রমাণ করার জন্য বাঙালী মালিকের কিছু কিছু কলকারখানার দায়িত্বও সরকার গ্রহণ করলেন। আওয়ামী লীগ সরকার দলীয়ভাবে বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিদের হাতে এই সমস্ত কলকারখানার দায়িত্ব নিয়োজিত করলেন। রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা ছাড়া তাদের শিল্পকারখানা চালানোর কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা কিংবা যোগ্যতার বালাই ছিলো না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিরা শিল্পকারখানার মধ্যে কোনো রকম শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার বদলে অধিকতররা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করলেন। তাদের নামে অভিযোগ উত্থাপিত হতে আরম্ভ হলো, তারা কারখানার যন্ত্রাংশ বেঁচে দিচ্ছেন, কাঁচামাল পাচার করে ফেলছেন। তার নীট ফল এই দাঁড়ালো যে উৎপাদন কিছুতেই পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলো না। কোথাও পরিচালনার ক্রটিতে, কোথাও কাঁচামালের অভাবে কল কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে আরম্ভ করলো। রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে অর্থ ধার করে শ্রমিকদের মাইনে মাসের পর মাস পরিশোধ করতে হলো। এই সময়টা ছিলো শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর সরকারের জন্য কঠোর অগ্নিপরীক্ষার কাল। আওয়ামী লীগ সরকার অনুপস্থিত মালিকদের শিল্পকারখানা অধিগ্রহণ করেছেন, না করেও উপায় ছিলো না। কিন্তু এই ব্যবস্থাটাকে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ বলে ঘোষণা করে অর্থনৈতিক নৈরাজ্যের সবগুলো অর্গল খুলে দেয়া হলো। সত্য বটে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার দল আওয়ামী লীগের পক্ষে সমাজতন্ত্রের দাবী উপেক্ষা করে একটা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির পন্থা কবুল করে নেওয়া একটুখানি ঝুঁকির কাজ হতো। তারপরেও লুটপাট দুর্নীতি বন্ধ করে একটি স্বচ্ছ ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করা তাঁর পক্ষে অসভব হতো না। তিনি ভুল পথ অনুসরণ করলেন। কোনো রকমের সহায়ক ভিত্তি না থাকা সত্বেও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেন। সমাজতন্ত্র তো প্রতিষ্ঠা করা গেলো না। তৈরি করে ফেলেন একটা নৈরাজ্যতন্ত্র। জাতীয় অর্থনীতির মধ্যে যে ধরনেরই হোক একটা শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা না গেলে, অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলা এবং নৈরাজ্য আসতে বাধ্য। জাতীয় অর্থনীতির মধ্যে একটা শৃঙ্খলা সৃষ্টি না হলে অর্থনৈতিক জীবন বিপর্যস্থ হয়ে পড়ে। সমাজে কালোবাজারী, মুনাফাখখারী, চোরাচালানী ইত্যাকার যতো ধরনের সামাজিক অপরাধ আছে সবগুলো প্রাধান্য বিস্তার করে জাতীয় অর্থনীতির টুটি চেপে ধরে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে দেখা গেলো সারা দেশে একটা লুটপাটের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, লাইসেন্স পারমিট সংগ্রহ করার বেলায় রাজনৈতিক ক্ষমতার বিস্তর অপব্যবহার হতে থাকলো। সরকারী ছত্রচ্ছায়ায় একদল মানুষ রাতারাতি অঢেল টাকার মালিক হয়ে উঠলেন। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ তাঁরা কেউ স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা বাণিজ্য কিংবা শিল্প কারখানার মাধ্যমে আয় করেন নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে এই অঞ্চলে মাত্র একজন কোটিপতির অস্তিত্ব ছিলো। বর্তমানে কোটিপতির সংখ্যা হাজার হাজার। একটি ছোটো দরিদ্র দেশে এই পরিমাণ ধনিকের উত্থান, সেটা নির্লজ্জ লুণ্ঠনের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে। কি পরিমাণ লুণ্ঠনের সুযোগ পেলে মাত্র বিশ হাজার টাকার পরিমাণ সম্পদের মালিক একশো কোটি টাকার মালিক হতে পারে, বাংলাদেশ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

শেখ মুজিবুর রহমানের রাজত্বকালে এই কোটিপতিদের জন্ম। জিয়াউর রহমান তাঁদের লালন করেছেন এবং বাড়িয়ে তুলেছেন। এরশাদ সমাজ জীবনে তাদের আইনগত বৈধতা দিয়েছেন। হাল আমল পর্যন্ত এসে তারা গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রটা তাঁদের কব্জার মধ্যে এনে ফেলেছেন। তাঁদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন ছাড়া কোনো সরকার টিকে থাকতে পারে না। তাদের সক্রিয় মদদ ছাড়া কোনো দল সরকার গঠন করতে পারে না। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ছোটোখাটো দলের সভা কিংবা শোভাযাত্রার জন্যও তাঁদের চাঁদার ওপর নির্ভর করতে হয়।

আমাদের সমাজে এই নব্য নবাবেরা অঢেল টাকার মালিক। ভোগ উপভোগের সমস্ত উপকরণ তাদের এখতিয়ারে। কিন্তু জাতীয় বুর্জোয়া তাদের কিছুতেই বলা যাবে না। বুর্জোয়া চরিত্রের মধ্যে অন্য অনেক দোষ যাই থাকুক তাদের সেন্স অব বিলঙ্গিং অর্থাৎ এটা আমার নিজের জাতি, এই জাতির উন্নতি অবনতির সঙ্গে সরাসরি আমার ভাগ্যও জড়িত, এই বোধ তাদের নেই। আমাদের দেশে যে সকল মানুষ হঠাৎ ধনী হয়ে উঠেছে জাতীয় বুর্জোয়াদের অঙ্গীকার তাদের কাছ থেকে আশা করা দূরাশার শামিল। মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলাই তাদের একমাত্র অভীষ্ট। আমাদের জাতীয় মধ্যশ্রেণীটি দু’ভাবে দেশের মানুষকে শোষণ করে। একদিকে দেশে উৎপাদিত কাঁচামাল বিদেশে রপ্তানি করে দেশের মানুষকে শোষণ করে। অন্যদিকে বিদেশের উৎপন্ন পণ্য দেশে আমদানী করে একইভাবে শোষণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে। দেশের চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে কলকারখানার প্রতিষ্ঠা করে জাতিকে স্বনির্ভর এবং বেকার জনগণের কর্মসংস্থানের কোনো দায়িত্ব তারা আদৌ বোধ করে না। তাদের বিকাশ আমাদের জাতীয় জীবনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। একটি সুড়ঙ্গ পথের ভেতর দিয়ে হেঁটে জাতির শিরোভাগে অবস্থান গ্রহণ করে তারা জাতির অগ্রগতির পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে। এই জাতীয় টাকাঅলা মানুষেরা যদি সত্যিকার অর্থে জাতীয় বুর্জোয়ার স্থান দখল করতে পারতো, একদিক থেকে দেশের জন্য সেটা মঙ্গলকর হতো। বুর্জোয়ারা রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান গ্রহণ করতে এটা ঠিক, কিন্তু সমান্তরালে কৃষক, শ্রমিক এবং নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর রাজনীতি আপনিই বিকশিত হয়ে উঠতো। জাতীয় মধ্যশ্রেণীভূক্ত এই সমস্ত মানুষ বাংলাদেশের রাজনীতির মেরুকরণ ঠেকিয়ে রেখেছে। এই কাঠামোহীন অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে যে বুদ্ধিজীবী শ্ৰেণীটি নতুন রাষ্ট্রযন্ত্রের নাটবল্ট ঘোরাবার দায়িত্ব পেয়ে গিয়েছিলেন, দ্রুত ধনী হওয়ার মানসিকতা তাঁদেরও চরিত্রলক্ষণ হয়ে দাঁড়ালো। পরোক্ষে তারাও লুণ্ঠণের অর্থনীতির ফায়দা তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সরকারী আমলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবীসহ সাদা পোষাকের পেশাজীবীদের বেশিরভাগেরই চরিত্র থেকে মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা একেবারেই বিদায় নিলো। এই ধরনের একটি লোভ লাভের সার্বিক পরিস্থিতিতে বুদ্ধিজীবীরা কখনো ঋজু শিরদাঁড়ার অধিকারী হতে পারেন না। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা যে বেশিরভাগ চরিত্রভ্রষ্ট তার মূল কারণ লুণ্ঠণের অর্থনীতির মধ্যেই নিহিত।

এই দেশে কৃষক শ্রেণীর রাজনীতির একটা গৌরবজনক ঐতিহ্য ছিলো। শ্রমিক শ্রেণীর রাজনীতিরও বেগবান একটা ধারা ছিলো। অতীতে ক্ষমতার পালাবদলে তারা বড়ো বড়ো ভূমিকা পালন করেছেন। এই দেশেরে অন্যূন সত্তর শতাংশ মানুষ কৃষক। জনসংখ্যার বিচারে জাতীয় রাজনীতিতে তাদের কোনো ভূমিকার কথা দূরে থাকুক, সক্রিয় উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায় না। বেবাক রাজনীতি নিলামে কেনা পণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষক শ্রমিক নির্যাতিত জনগোষ্ঠী তাদের পছন্দ মতো প্রতিনিধি সংসদে পাঠানোর কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। যারা চড়া দাম দিয়ে ভোট কিনে নিতে পারে, যারা গুণ্ডা এবং মাস্তান লাগিয়ে পুলিং বুথ দখল করে নিতে পারে, নির্বাচনে তারাই অনিবার্যভাবে জয়লাভ করে। কৃষক এবং নির্যাতিত মানুষ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে ভোট দিয়ে থাকেন। ভোট দিতে বিরত থাকলেও তাদের ভোট আকাশ থেকে ফেরেশতা এসে দিয়ে যায়। দরিদ্র মানুষেরা ভোট দিতে পারেন কিন্তু নিজেদের মনোনীত ব্যক্তিকে নির্বাচিত করে সংসদে পাঠাবার অধিকার তাদের নেই। আগুনের ছবি আগুনের মতো দেখালেও তার দাহিকাশক্তি থাকে না। বাংলাদেশে বর্তমানে যে গণতন্ত্র চালু আছে, সেই জিনিশটি তৃণমূল থেকে উঠে আসেনি। পশ্চিমা শক্তিগুলো দুনিয়া জোড়া গণতন্ত্রের খবরদারীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, তারাই এখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটি চালু রেখেছে। কমিউনিজমের পতনের আগে তারা সেনা ছাউনির ওপর নির্ভর করতো। হালফিল তাদের গণতন্ত্রের চর্চার ওপর অত্যধিক জোর প্রয়োগ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।

বাংলাদেশে যে গণতন্ত্র চালু আছে সেটা যে গণতন্ত্রের প্রহসন, পাশ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিম বাংলার সঙ্গে তুলনা করলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। বিগত রাজ্যসভা নির্বাচনে কালু ডোম নামে বর্ধমান জেলার এক প্রার্থী সর্বভারতে পরিচিত এক কংগ্রেস প্রার্থীকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছেন। কালু ডোম নামটিতেই তার পেশাগত পরিচয় পাওয়া যায়। এরকম বাংলাদেশে কল্পনা করাও কি সম্ভব? পেশাজীবী মানুষ তাদের মনোমতো প্রতিনিধিকে সংসদে পাঠাবার কথা কি চিন্তাও করতে পারেন? বাংলাদেশের সংসদে নানা দল থেকে যে সকল সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন, তার শতকরা ষাট ভাগই স্থায়ীভাবে ঢাকা এবং বিশ ভাগ জেলা সদরে বসবাস করেন। তাঁদের শরীরে শ্রমঘামের কোনো গন্ধ নেই। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আশা আকাঙ্খর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশে যে গণতন্ত্রটি চালু আছে তার মাধ্যমে আসল জনগণের শত্রুরা নির্বাচনে জিতে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর বুকের ওপর সওয়ার হয়ে রক্ত শোষণ করার আইনগত বৈধতাই অর্জন করে।

ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনের লড়াইয়ে জেতার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে এলে দলে দলে যে দলটি জিতবে তার পক্ষপুটে আশ্রয় গ্রহণ করে। দেখা যাবে আজকে যে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচনে লড়ছে, গত নির্বাচনে সে একই ব্যক্তি জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলো। জাতীয়তাবাদী দল থেকে জাতীয় পার্টিতে যাওয়া, জাতীয় পার্টি থেকে আওয়ামী লীগে আসা এগুলো নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় রাজনীতিতে আদর্শবাদের ক্ষীণতম ছোঁয়াটুকুও আর অবশিষ্ট নেই। রাজনৈতিক সুবিধাবাদই গোটা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের নিয়ামক শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থটাই সেখানে প্রধান। দেশের জনগণের ভালো মন্দের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য কৃষক শ্রমিক ব্যাপক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের প্রয়োজন হয় না। এ থেকে প্রমাণিত হয় গণতন্ত্রের শেকড় এখানে কতো দুর্বল। শুধু ছাত্ররা একটি সরকারের পতন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক জনগোষ্ঠীর অংশ গ্রহণ ছাড়াই শুধুমাত্র আমলা এবং এনজিও কর্তারা আরেকটি পতন ঘটাতে পেছপা হবে না।

মুৎসুদ্দি শ্রেণীর হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি থাকায় গণতন্ত্র এখানে প্রাতিষ্ঠানিকতা লাভ করতে পারছে না। সমাজের তৃণমূল অবধি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রসারিত হতে পারছে না। এই মুৎসুদ্দি শ্রেণী অনড় অটল হয়ে সমাজের পথ রুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের প্রভাব খর্ব করতে না পারলে যে কোনো ধরনের ইতিবাচক রাজনৈতিক উত্তরণের আশা সুদূর পরাহত থেকে যাবে।

.

০৫.

বাঙালী সংস্কৃতি থেকে প্রাণরস আহরণ করে জাতীয়তার বোধটি পুষ্ট এবং বিকশিত হয়েছে। তথাপি বাংলাদেশের সংস্কৃতির আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। কতিপয় জটিল সংকট সংস্কৃতি চর্চার পথটিকে কন্টকাকীর্ণ করে রেখেছে। বাংলাদেশের সংখ্যাধিক জনগণের মানস সংকটেরই প্রতিফলন ঘটছে সংস্কৃতিতে।

বাংলাদেশ নামে যে ভূখণ্ডটিতে আমাদের বসবাস, পঁচিশ বছর আগে সেই দেশটি ধর্মতান্ত্রিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ ছিলো। তারও আগে দেশটি পশ্চিম বাংলার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে সংযুক্ত ছিলো। বৃটিশ শাসনের অন্যূন দুশো বছর কাল সময় বাংলা প্রদেশ বৃটিশ ভারতের একটি স্বতন্ত্র শাসন ইউনিট হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিলো। বৃটিশ বিদায়ের প্রাক মুহূর্তে ভারতের হিন্দু এবং মুসলমান একটি সংযুক্ত রাষ্ট্রে বসবাস করতে সম্মত হয়নি বলেই বৃটিশ-ভারতকে ভারত এবং পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করতে হয়েছে। বাংলা প্রদেশের হিন্দু মুসলমান নেতৃবৃন্দের একাংশ বাংলার ভাঙ্গন ঠেকাবার চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি। সর্বভারতীয় রাজনীতির প্রবল টান অগ্রাহ্য করে বাংলা তার স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রক্ষা করতে সক্ষম হয়নি। হিন্দুপ্রধান পশ্চিমবঙ্গ ভারত ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত হয়েছে এবং মুসলিম প্রধান পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল হিসেবে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রিক অস্তিত্বের মধ্যেই অবস্থান তৈরি করেছে। পাকিস্তান ঘোষিতভাবেই ছিলো ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র। পাকিস্তান সৃষ্টির অল্পকালের মধ্যেই পূর্বাঞ্চলের লোকদের বোধোদয় হতে থাকে যে ধর্মতান্ত্রিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অধিকার কিছুই সুনিশ্চিত নয়। উনিশশো বাহান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সর্বপ্রথম তাঁদের সংগঠিত প্রতিবাদটি জন্ম নেয়। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানী জাতীয়তার বোধটি খারিজ করে বাঙালী জাতীয়তার বোধটি আঁকড়ে ধরে অগ্রসর হতে আরম্ভ করে। এই অগ্রযাত্রার পথটি সরল এবং একরৈখিক নিশ্চয়ই ছিলো না। অনেক দ্বিধা এবং দোদুল্যমানতা তাতে ছিলো। শেষ পর্যন্ত উনিশশো একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয়তার সগ্রাম এই পর্যায়ে একটা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে।

মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রিক কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়ার সময় যে সমস্ত বোধ এবং উপলব্ধি সক্রিয় ছিলো, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার পর দেখা গেলো সে সমস্ত বোধ এবং উপলব্ধিগুলোকে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করার কাজটি সত্যি সত্যি দুরূহ। বাংলাদেশে ভাষা ভিত্তিক যে জাতীয় রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হয়েছে তার সাংস্কৃতিক চেহারার একটি নির্দিষ্ট আকার দান করার প্রশ্নটা যখন উঠলো, তখনই প্রকৃত সংকটটা আত্মপ্রকাশ করলো। বাংলাদেশে যে নতুন রাষ্ট্রসত্তাটি জন্ম নিয়েছে, তার যে দাবী সেটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এই অঞ্চলের সংখ্যাগুরু অধিবাসী মুসলমান। শুধুমাত্র ধর্মের বন্ধনকে মান্য করে দেড় হাজার মাইল দূরবর্তী একটি অঞ্চলের মানুষদের সঙ্গে এক রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাস সম্ভব নয় বলেই নতুন একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছে এবং রাষ্ট্র গঠনের উপাদান হিসেবে ধর্মের স্থান থাকতে পারে, সেই প্রত্যয়টা খারিজ করে দিয়েছে। তারপরেও একটা প্রশ্ন মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে। এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠী যাদের বেশির ভাগ দরিদ্র এবং নিরক্ষর, তাদের জন্য নতুন সমাজের প্রয়োজনে ধর্মের অভিভাবকত্বহীন একটা সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিত সৃষ্টির পাশাপাশি বাংলাদেশের সকল ধর্মের এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য একটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল নির্মাণ করার চ্যালেঞ্জটা যখন সামনে এলো, দেখা গেলো বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের তার সম্মুখীন হওয়ার ক্ষমতা, প্রস্তুতি, মেধা এবং মানসিকতা কোনোটাই নেই। যুদ্ধোত্তর বালাদেশে একটি সাংস্কৃতিক রেনেসার প্রয়োজন সবচাইতে অধিক ছিলো। একটি সর্বব্যাপ্ত জাগরণ, নতুন মানসিক বোধের উদ্বোধন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক একটি উত্থানের ঢেউ লেগে শিল্প, সংস্কৃতি এবং সাহিত্যের কোনো শাখা হৃদ্য, সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারেনি। পাকিস্তান আমলে যে সকল ব্যক্তি, পাকিস্তান সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের ভেতর থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতা করে জাতীয় আন্দোলনের প্রতি কখনো ক্ষীণ, কখনো জোড়ালো সমর্থন ব্যক্ত করার চেষ্টা করতেন, স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় তারা একটা নিরাপদ অবস্থান পেয়ে গেলেন। দেশটির সংস্কৃতির অভিভাবক নতুন ব্রাহ্মণের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়ে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রশক্তির সহায়তায় আত্মতুষ্টি এবং তোষামোদের এমন পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে আরম্ভ করলেন, বাঙালী জনগোষ্ঠীর মুক্তি সংগ্রামের তরঙ্গ তার মধ্যে ধ্বনিত হয়ে উঠলো না। কৃষক, মজুর, দরিদ্র জনগোষ্ঠী যারা মুক্তিযুদ্ধে সর্বাধিক আত্মত্যাগ করেছে, তাদের আশা আকাঙ্ক্ষার কোনো চিহ্নই তাঁদের চিন্তা চেতনায় স্থান করে নিতে পারেনি। তারাও বাঙালীর রাষ্ট্র, বাঙালী জনগণের কথা বলতেন, কিন্তু সেগুলো বিমূর্ত ধারণার অধিক কিছু ছিলো না। বাস্তবে যে বাঙালী জনগণ প্রাণ দিয়ে, রক্ত দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম সম্ভাবিত করেছে, সেই হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রীষ্টান জনগণকে এক সূত্রে বেঁধে একটি সমৃদ্ধ জাতি গড়ে তোলার স্বপ্ন কখনো তাদের মনে সঞ্চারিত হয়নি।

যে সাংস্কৃতিক নেতৃশ্রেণীটি বাংলাদেশ আমলে জাতির শিরোভাগে চলে এসেছিলো, পাকিস্তান আমলে পাকিস্তান সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যেই তাদের বিকাশ এবং সংবৃদ্ধি। তাদের অবস্থান টিকিয়ে রাখার জন্য তারা পাকিস্তানি শাসকদের সহযোগিতা করতেন, আবার বাঙালি জনগণের উত্থানের সম্ভাবনা দেখে, নিজেদের বাঙালিত্বের পরিচয়টাও তুলে ধরতে চেষ্টা করতেন। এই শ্রেণীর মানসিক দোলাচল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লোকেরা যখন বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির অভিভাবক হয়ে বসলেন, দেখা গেলো তাদের সৃষ্টিশক্তি অবসিত হয়ে গেছে, নতুন কিছু সৃষ্টি করার ক্ষমতা তাদের নেই।

রাজনীতির ক্ষেত্রে যে জিনিশটি ঘটেছে, দেখা গেলো সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে আরম্ভ করেছে। পশ্চিম বাংলা থেকে যে সকল মুসলমান বুদ্ধিজীবী জিন্নাহ্ সাহেবের দ্বিজাতিতত্ত্ব মেনে নিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সৃষ্টির আশায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে এসেছিলেন, তাদেরই একটা অংশ আচকান শেরোয়ানী পাল্টে গলায় খদ্দর ঝুলিয়ে তারস্বরে নিজেদের বাঙালী বলে জাহির করতে আরম্ভ করলেন। তাঁদের এই উচ্চারণগুলো ছিলো মেকি ভড়ং সর্বস্ব, একটি নতুন জাতির বিকাশ সম্ভাবিত করার জন্য তাদের পালনীয় কোনো ভূমিকা ছিলো না। জনগণের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করার বদলে তাঁরা বিভেদের বীজই বপন করলেন।

উনিশশো পঁচাত্তর সালে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর দেখা গেলো, একাত্তরের পরাজিত শক্তিসমূহ আবার মাথা তুলতে আরম্ভ করেছে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং প্রেসিডেন্ট এরশাদ এই সমস্ত শক্তিকে পাতাল প্রদেশ থেকে টেনে তুলে আমাদের সমাজ জীবনে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলেন। মুক্তিযুদ্ধের অর্জনসমূহ একে একে ধুলোয় গড়াগড়ি খেতে লাগলো। সমস্ত পরিবেশটা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে বিষিয়ে তোলা হলো। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহের প্রতাপ অধিকতরো বিস্তৃত হয়ে পড়লো। সংস্কৃতির গতিপথটার মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য নিত্যনতুন কৌশলের উদ্ভাবন করা হতে থাকলো। বাঙালীত্বের বিপরীতে মুসলমান পরিচয়টা খুঁচিয়ে বের করার জন্য তাদের চেষ্টার অন্ত রইলো না। মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ লক্ষ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে যে দেশটি জন্ম নিয়েছে তার প্রকৃত পরিচয় মুছে দিয়ে দেশটিকে আবার নতুন পাকিস্তানে পরিণত করার সর্বাত্মক পাঁয়তারা করতে থাকলো। সমাজের ওপর হতে তলা পর্যন্ত সর্বত্র পশ্চাদপদ ধারণা রাজ্যপাট বিস্তার করতে আরম্ভ করলো।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হত্যা করে যদি একদলীয় শাসন কায়েম করে না বসতো স্বৈরাচারী শক্তি সমাজের ওপর জেঁকে বসে মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত অর্জন, সমস্ত প্রতিশ্রুতি হাওয়ায় মিশিয়ে দিতে পারতো না। যে জনগণ মুক্তিযুদ্ধ করে দেশটিকে স্বাধীন করেছে, সে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে সর্বনাশের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিলো আওয়ামী লীগ। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগকেও তার বলি হতে হয়েছে।

আওয়ামী লীগের পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থিত বুদ্ধিজীবীরা স্বৈরশাসনের পেছনে এমন কোনো সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ, এমন কোনো ভাবাদর্শিক জাগরণ রচনা করতে পারেননি, যাতে করে সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শের সার্থক প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। সাম্প্রদায়িক শক্তির সহায়তায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসতে হয়েছে এবং সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শের সঙ্গে আপোষও তাদের করতে হয়েছে। সরকার সমর্থিত বুদ্ধিজীবীরা সেই একাত্তর সালের পরবর্তী সময়ের মতো উচ্চকণ্ঠে অসাম্প্রদায়িকতা, বাঙালী জাতীয়তাবাদ এই সকল প্রত্যয়ের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করছেন। তাদের অবস্থানগত স্ববিরোধিতা একটা দৃষ্টান্ত তুলে ধরলেই সকলের দৃষ্টিতে উজ্জ্বলভাবে ধরা পড়বে। তাঁরা ইনকিলাব পত্রিকা যে সাম্প্রদায়িকতা প্রচার করছে, তার বিরুদ্ধে জেহাদ করতে প্রস্তুত, কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদ কর্তৃক আরোপিত রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে একটি কথাও উচ্চারণ করেন না। সেনাবাহিনী কর্তৃক ধ্বংসপ্রাপ্ত গুলিস্তান রমনা কালীবাড়ি পুননির্মাণের ন্যায়সঙ্গত দাবী যখন হিন্দু সম্প্রদায় থেকে উত্থাপিত হয়, তারা অতিরিক্ত দার্শনিক হয়ে ওঠেন। অর্থাৎ এটাকে এমন একটা দুরূহ দার্শনিক সমস্যা মনে করেন, হঠাৎ করে জবাব দেয়ার কিছু নেই এমন মনে করে থাকেন। (অর্পিত) শত্রুসম্পত্তি আইন বাতিল করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পূর্ণ নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার দাবী যখন ওঠে, এগুলো তাঁদের বিজ্ঞ মস্তকে স্থান পাবার উপযুক্ত বিষয় মনে করেন না।

দোদেল বান্দা কলমা চোর, না পায় শ্মশান, না পায় গোর। এঁদের অবস্থা অনেকটা সেরকম। এঁরা একটা সরকারকে সমর্থন করছেন, কিন্তু তার পেছনে নিজেদের ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠা ছাড়া অন্য কোনো মূল্যবোধ কাজ করছে সে কথা নিজেরাও মনে করেন না। সত্যিকার অসাম্প্রদায়িক হওয়ার বদলে ছদ্মবেশী অসাম্প্রদায়িক সাজার পরিণাম কতো ভয়াবহ হতে পারে আমাদের হাড়ে হাড়ে টের পেতে হয়েছে। সরকারী দলের বুদ্ধিজীবীরা যে সুবিধাবাদী অবস্থানটিতে দাঁড়িয়ে জাতীয়তাবাদের অভিভাবক এবং অসাম্প্রদায়িক শক্তির প্রতিভূ বলে নিজেদের পরিচিত করতে চেষ্টা করছেন, সেই জায়গাটি ভয়ঙ্কর নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। সাম্প্রদায়িক শক্তি বাহাত্তরের পরবর্তী সময়ের চাইতেও অনেক সংগঠিত এবং পরিকল্পিতভাবে তাদের জায়গাটি কেড়ে নিতে ছুটে আসছে। সে শক্তিকে প্রতিরোধ করার কোনো ক্ষমতা তাঁদের নেই, তাঁদের সততা নেই। তাদের বিশ্বাস এবং প্রত্যয়ের কোনো বালাই নেই। অতীতে তা আমাদের জাতিকে ভুল পথে চালিত করেছেন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সুফলটুকু ভোগ করছেন।

বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক এবং প্রতিশীল শক্তির সংগ্রাম অধিকতররা জটিল ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। ত সল সাম্প্রদায়িক এবং নকল প্রগতিশীল সুবিধাবাদীদের যুগপদভাবে পরাস্ত করতে না পারলে বাংলাদেশের জনগণের সংস্কৃতির উত্থান অসম্ভব। কাজটি সত্যি সত্যিই কঠিন।

.

০৬.

উনিশশো একাত্তর সালে দক্ষিণপন্থী শক্তিসমূহ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার সবগুলো ধর্মভিত্তিক দল নিষিদ্ধ করে এবং তাদের কার্যকলাপ বেআইনী বলে চিহ্নিত করে। তার ফলে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক লীগ, নেজামে ইসলামী, জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ এই সকল দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলের প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা বন্ধ হওয়ার ফলে, তারা গোপনে তাঁদের কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে আরম্ভ করেন। যেহেতু প্রকাশ্যে তাদের সভা ও সমাবেশ এবং শোভাযাত্রা করার অধিকার ছিলো না, তাই তারা ধর্মীয় এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কাঁধে ভর করেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতার সেই পংক্তিটা আছে না, নিন্দাকে রসনা হতে দিলে নির্বাসন, গভীর জটিল মূল অন্তরে প্রসারে–বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সেই জিনিশটি ঘটতে আরম্ভ করলো।

তারা মসজিদ এবং মাদ্রাসাসমূহকে তাদের কর্মতৎপরতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ব্যবহার করতে থাকলেন। ওয়াজ মাহফিল, ধর্মীয় জলসা, নবীর জন্ম মৃত্যু তারিখে দশ পনেরো দিন ব্যাপী সিরাত অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে থাকলেন। পাকিস্তান যতোদিন টিকে ছিলো সমাজের ভেতর থেকে এই ধরনের ধর্মীয় জিগীর কখনো উখিত হতে দেখা যায় নি। অথচ ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার পর এই সকল প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় করে তোলা হয়েছে। সেই সময়ে বাংলাদেশে কোনো মানুষের ধনপ্রাণের নিশ্চয়তা নেই। একদিকে চলছে রাজনৈতিক নিষ্পেষণ অপরদিকে সরকারী সন্ত্রাসের মোকাবেলা করার জন্য চরমপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো পাল্টা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের আয়োজন করে যাচ্ছিলো। দেশে দুর্ভিক্ষ, অনাহারে মানুষ মারা যাচ্ছে। এই ধরনের একটা সংকটজনক সময়সন্ধিতে দেশের প্রতিষ্ঠিত সরকার কোনো ক্ষেত্রেই বিশেষ যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারছে না। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সরকার ইচ্ছা করলেও হয়তো অধিক কিছু করতে পারতেন না। নানা ধরনের সমস্যার ভারে তাঁদের হিমশিম খেতে হচ্ছিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো দেশের সাধারণ মানুষ সরকারের স্বচ্ছতার ব্যাপারে আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন। তার কারণও ছিলো। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় একদল মানুষ রাতারাতি ধনী হয়ে উঠলো। তারা দোকান, বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এসকল দখল করতে থাকলো।

এই ধরনের কুয়াশাচ্ছন্ন একটা পরিবেশে পাকিস্তানের সমর্থক গোষ্ঠী মুসলিম বাংলা গঠন করার জন্য তৎপরতা চালিয়ে যেতে আরম্ভ করলেন। এখানে সেখানে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের অনুষ্ঠান হতে থাকলো। যে সমস্ত বুদ্ধিজীবী সরকারী নীতি এবং আদর্শের সমর্থক ছিলেন সমাজের তৃণমূল থেকে উখিত সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ করার কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান তারা গ্রহণ করতে পারেননি। দেশের বিবেকবান মানুষের কাছে তাদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা অবশিষ্ট ছিলো না। মুসলিম বাংলার সমর্থকরা মসজিদ, মাদ্রাসা এবং ধর্মীয় সভাগুলোতে ফিসফিস করে বলতে আরম্ভ করলেন, ভারত পাকিস্তানকে হটিয়ে গোটা বাংলাদেশটা দখল করে বসেছে। এই দেশে মুসলমানদের ধন, প্রাণ, ঈমান কিছুই নিরাপদ নয়। শতত ধারায় এই ধরনের নেপথ্যে প্রচারের কারণে সমাজের ভেতর থেকে ঘূর্ণিহাওয়ার মতো সাম্প্রদায়িক মনোভাব জাগ্রত হয়ে জনমানসে জীবাণুর মতো প্রভাব বিস্তার করতে আরম্ভ করলো।

দক্ষিণপন্থী ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে, অনেকগুলোই সাইনবোর্ড সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য যে দলটি দায়ী সেই পাকিস্তান মুসলিম লীগ উনিশশো চুয়াল্লোর নির্বাচনে সেই যে ধরাশায়ী হয় আর কখনো কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। জেনারেল আয়ুব মুসলিম লীগের একটি অংশকে নতুন জীবন দান করতে চেষ্টা করেছিলেন। আয়ুবের পতনের সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম লীগ শুধুমাত্র একটা নিপ্রাণ অস্তিত্বে পরিণত হয়। এই দলগুলোর মধ্যে একমাত্র জামায়াতে ইসলামীই ছিলো ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন। পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার জন্য জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরাই সবচাইতে বেশি সচেষ্ট ছিলেন। তাঁরা সর্বতোপায়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগীতা করেছেন। রাজাকার আলবদর, আলসামস্ ইত্যাদি যে সকল সন্ত্রাস সহায়ক বাহিনী যুদ্ধকালে সৃষ্টি করা হয়েছিলো, তার সিংহভাগই এসেছে জামায়াতে ইসলামী দলটি থেকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পন করার পর জামায়াতে ইসলামীর অধিকাংশ কর্মীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়। কিছু অল্প সংখ্যক অপরাধীই ধরা পড়ে। এই অপরাধীদের অনেকেই নগদ অর্থের বিনিময়ে সরকারের লোকদের কাছ থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। বেশ কিছু অংশ নানা কৌশল অবলম্বন করে সৌদী আরব, কুয়েত, ইরান ইত্যাদি মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশে চলে যায়। এক পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আজমও পাকিস্তান থেকে সৌদি আরবে চলে আসেন। মধ্য প্রাচ্যের দেশসমূহে, বিশেষ করে সৌদি আরব এবং কুয়েতে এই সকল পলাতক জামায়াত সদস্য নিজেদের সংগঠিত করে সঘবদ্ধভাবে জোরালো প্রচার চালাতে আরম্ভ করেন। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য লন্ডন অফিসটি ব্যবহার করতে থাকেন। তারা মধ্যপ্রাচ্যের সকলশ্রেণীর মানুষদের বোঝাতে থাকেন যে বাংলাদেশে ইসলাম সত্যি সত্যি বিপন্ন। ভারতের হিন্দুরা বাংলাদেশ দখল করে ফেলেছে। বাংলাদেশে অনেকগুণ বেশি ইসলামকে জীবিত রাখতে হলে সেখানে গ্রামে গঞ্জে সর্বত্র মসজিদ এবং মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। কেনোনা মসজিদ এবং মাদ্রাসাই ইসলামকে টিকিয়ে রাখার একমাত্র গ্যারান্টি।

মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ তাঁদের কথা বিশ্বাস করেছেন। মসজিদ মাদ্রাসা এবং অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য প্রচুর অর্থ সাহায্য করেছেন। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা অর্থে বাংলাদেশের শহর বন্দর থেকে শুরু করে একেবারে নির্জন গ্রামে পর্যন্ত অনেক মসজিদ মাদ্রাসা নির্মাণ করা হয়েছে। একটা পরিসংখ্যান নিলে জানা যাবে পাকিস্তান বিগত পঁচিশ বছরে যতো পরিমাণে মসজিদ মাদ্রাসা তৈরি হয়নি, বাংলাদেশ আমলে পঁচিশ বছর সময়ের মধ্যে তার চাইতে অনেকগুণ বেশি মসজিদ মাদ্রাসা তৈরি হয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশে এমন কোনো গ্রাম খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে, যেখানে একটি মাদ্রাসা নেই। বর্তমানে মাদ্রাসা গ্রাম সমাজের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদে কোনো প্রার্থীকে বিজয়ী হতে হলেও মাদ্রাসার সমর্থন লাভ জরুরী হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের শহরগুলোতে তারা পরিকল্পনা করে এমন কতিপয় মসজিদ নির্মাণ করেছেন যার সঙ্গে এক একটি সুপার মার্কেট সংযুক্ত রয়েছে। এই সব মার্কেট থেকে ভাড়া ইত্যাদি বাবদে যে অর্থ আদায় হয় তার এক ভগ্নাংশ মাত্র মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে ব্যয় করা হয়। বাকী বিপুল পরিমাণ অর্থ ধর্মীয় রাজনীতির পেছনে ব্যয়িত হয়। মসজিদ ছাড়া তারা ক্লিনিক, হাসপাতাল, ব্যাংক এবং আরো নানা রকম বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান করে, দেশের ভেতর থেকেই একটা আয়ের উৎস সৃষ্টি করে ফেলেছেন। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি একটা শক্ত আর্থিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে বলেই মাসে মাসে মাসোহারা দিয়ে বিপুল সংখ্যক কর্মী এবং প্রচারক পোষা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয় না। রাজনৈতিকভাবে সমাজে আশানুরূপ অগ্রগতি না হলেও সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে তারা শক্তি সগ্রহ করে একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করে ফেলেছেন, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

মুজিব সরকারের আমলে শিক্ষা সংস্কারের কথা উঠলেও জনমত বিপক্ষে যায় এই আশঙ্কায় তিনি মাদ্রাসা শিক্ষায় হাত দিতে সাহসী হয়ে উঠতে পারেননি। জিয়ার আমলে এই মাদ্রাসাসমূহকে সরকারের সমর্থন ক্ষেত্রে পরিণত করার একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এরশাদ আমলে মাদ্রাসাসমূহের মধ্যে ধর্মীয় রাজনীতি ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টার ক্রটি করা হয়নি। খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে মাদ্রাসাসমূহ যে পরিমাণ সরকারী অনুদান পেয়েছে, তা মাধ্যমিক স্কুলগুলোর জন্য বরাদ্দ অর্থের চাইতে বেশি।

এই সমস্ত কারণ ছাড়াও বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা গাঢ়মূল হওয়ার একাধিক আন্তর্জাতিক কারণ বর্তমান। আফগানিস্তান, আলজিরিয়া, ইরান, মিশর এই সকল মুসলিম দেশে মৌলবাদের উত্থান বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বহুলাংশে প্রভাবিত করেছে। বাংলাদেশ মুসলমান প্রধান দেশ হওয়ায় মুসলিম জগতের চলমান ঘটনা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে পারে না। কিছু না কিছু প্রভাব আবশ্যই পড়ে। আরো একটি বিষয় অবশ্যই স্পষ্ট করা প্রয়োজন। সোভিয়েত রাশিয়ার ভাঙ্গন, ক্যুনিজমের ভরাডুবি এবং সোভিয়েত মধ্য এশিয়ায় একগুচ্ছ মুসলিম রাষ্ট্রের আকস্মিক আবির্ভাবের কারণে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো পৃথিবীতে তাদের প্রভূত্বমূলক আধিপত্য অক্ষুণ্ণ রাখার ব্যাপারে নতুন করে চিন্তা ভাবনা করতে আরম্ভ করেছে। পশ্চিমা তাত্ত্বিকেরা বলেছেন, আগামীতে পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে যদি অন্য কোনো শক্তির সংঘাত বাধে তাহলে প্রথম সংঘাতটি বাধবে ইসলামের সঙ্গে এবং দ্বিতীয় সংঘাতটি হতে পারে কনফুসীয়পন্থী চীনের সঙ্গে। পশ্চিমা শক্তিগুলো ইসলাম ধর্মের প্রতিরোধ ক্ষমতা খর্ব করার জন্য দুনিয়া জোড়া নানা কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছে। মুখ্যতঃ আত্মরক্ষার প্রয়োজনে মুসলিম দেশগুলোতে এক ধরনের ধর্মীয় পুনরুত্থান জেগে উঠছে, বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। এই সামাজিক রূপান্তরটা এতো চুপিসারে, নীরবে ঘটছে যে, কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে তার প্রভাব অস্বীকার করা অসম্ভব নয়। ঘোষিতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকেও উনিশশো ছিয়ানব্বই সালে এই সাম্প্রদায়িক প্রভাবের কিছু কিছু স্বীকার করে নিয়ে ক্ষমতায় আসতে হয়েছে।

হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সশস্ত্র হামলার মুখে ঘরবাড়ি দেশ ফেলে প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে ভারতে পলায়ন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। নয় মাস পর দেশে ফিরে দেখেন তাদের ঘরবাড়ি অবশিষ্ট নেই। তাদের দোকানপাট, জমিজমা, পুকুর এমনকি ভিটেমাটি পর্যন্ত সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের দখলে চলে গেছে। এই দখলদার সংখ্যাগুরুদের মধ্যে সকলে পাকিস্তান ভক্ত নয়, সরকার সমর্থক দেশপ্রেমিক জনগণেরও অভাব নেই। বেশিরভাগ হিন্দুকে তাদের ঘরবাড়ি এবং অন্যান্য অস্থাবর সম্পত্তি যা কিছু হাতের কাছে ছিলো সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই নয় মাসে তার সবটাই নিঃশেষ করে ফেলতে হয়েছে। সম্পূর্ণ কপর্দকহীন অবস্থায় ঘরবাড়ি আবার নতুন করে গড়ে তোলার কাজে মন দিলেন। তাঁদের হাতে কোনো সহায় সম্পদ নেই। সরকার তাদের পুনর্বাসনের কাজে কোনোরকম সহযোগিতার হস্ত সম্প্রসারিত করলেন না। সংখ্যাগুরু প্রতিবেশীর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহানুভূতি পর্যন্ত তারা পেলেন না। তথাপি তাদের মনে একটা সান্ত্বনা ছিলো। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তারা অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা সহ্য করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তারা আর দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক নন। রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক বিষয়ের সর্বক্ষেত্রে সংখ্যাগুরুদের মতো তাদের সমান অধিকার। ঘরবাড়ি তৈরি করে থিতু হয়ে বসার পরে তারা যখন অধিকার বোধটা ব্যবহার করতে চাইলেন, তারা কল্পনাও করতে পারেননি এই স্বাধীন বাংলাদেশেও তাদের জন্য মর্মান্তিক আঘাতটা অপেক্ষা করছিলো। স্বাধীনতার এক বছর না যেতেই পাকিস্তান আমলের চাইতেও জোরালো সাম্প্রদায়িকতার মুখোমুখি তাদের দাঁড়াতে হলো। স্বাধীনতার পর প্রথম দুর্গোৎসবটাতেই তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। নরায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম এবং বরিশালের নানা জায়গায় দুর্গাপ্রতিমা ভেঙ্গে ফেলে হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মাচরণে বাধা দেয়া হলো। ভারত বিরোধিতা এবং হিন্দু বিরোধিতা এক হয়ে গেলো। বাংলাদেশে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ভেদ বুদ্ধি যে স্বাধীনতা উত্তরকালে নতুন করে নতুনভাবে জাগ্রত হয়ে সাম্প্রদায়িক দূরত্বের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা এক রকম প্রায় দুঃসাধ্য করে তুলেছে, তার জন্য আরো কতিপয় বিষয় পর্যালোচনার প্রয়োজন।

উনিশশো পঁয়ষট্টি সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় আয়ুব খান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঘর বাড়িসহ পরিত্যক্ত সম্পত্তিকে এক অর্ডিন্যান্স বলে শত্রু সম্পত্তি বলে ঘোষণা করেছিলেন। হিন্দু সম্প্রদায় পাকিস্তান আমল থেকেই এই নাগরিক অধিকারবিরোধী আইনের প্রতিবাদ করে আসছিলো, কিন্তু ফলোদয় হয়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা আশা করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে এই আইনের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে। শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার এই আইনের নামটা পরিবর্তন করে শত্রু সম্পত্তির স্থলে অর্পিত সম্পত্তি রাখলেন, কিন্তু কার্যকারিতা একই রকম থেকে গেলো। শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি ছিলেন তাঁদের এক রকম ভরসাস্থল, তার এই ধরনের সংবেদনহীনতা হিন্দুদের চূড়ান্তভাবে হতাশ করলো। উনিশশো একাত্তর সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী রমনার বহু পুরোনো কালীবাড়ি ধ্বংস করে। ওই একাত্তর সালেই সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান আন্তর্জাতিক চাপে বাধ্য হয়ে রমনা কালীবাড়ি পুননির্মাণের টেন্ডার আহবান করেছিলেন এরকম শোনা যায়। যাহোক বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে রমনার কালীমন্দির পুনঃনির্মাণ করার অনুমতি পাননি। শেখ মুজিবুর বোধকরি তাদের বলেছিলেন, ওই নাজুক সময়ে মন্দির নির্মাণের অনুমতি দিলে তাঁর সরকারের বিপদ হতে পারে। এইভাবে খোদ মুজিব শাসনামলেই তাদের একটার পর একটা আশাভঙ্গ ঘটতে থাকে।

উনিশশো পচাত্তর সালে শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর পুরো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটিই পাল্টে গেলো। পাকিস্তানপন্থী শক্তির ক্ষমতা দখল করার পর হিন্দুরা অধিকতরো অসহায় এবং জাতীয় জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করতে থাকেন। তারপরে জিয়াউর রহমানের আমলে এসে সংবিধানের যখন পরিবর্তন করা হলো, হিন্দু সমাজের হতাশা ঘনীভূত আকার ধারণ করলো। তাদের মনোভাব দাঁড়ালো এ রকম, বাপ, পিতামহের এই দেশটিতে আমাদের কোনো অধিকার নেই। এই দেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমাদের চূড়ান্ত রকম আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। তথাপি আমাদের সামাজিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়ের পাশাপাশি আমাদের বসবাস করতে হয়। আমাদের পুকুরের মাছ, ক্ষেতের ধান, বাগানের তরিতরকারী ঐ সম্প্রদায়ের লোকেরা এসে যখন জোর করে কেটে নিয়ে যায়, আমরা কোনো প্রতিবাদ করতে পারিনে। আমরা বিচার পাইনে, পুলিশ আমাদের কথা শুনে না, আইন আদালত করলে অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়ে। আমরা স্কুলে কলেজে ছেলেমেয়ে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত এবং নিরাপদ বোধ করতে পারিনে। আমাদেরকে চাকরি বাকরি দেয়ার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বৈষম্যের নীতি অনুসরণ করা হয়। আমরা কারবার তেজারত করে জীবন ধারণ করবো, সেরকমও ভরসা পাইনে। এই দেশটিতে থেকে আমাদের কী লাভ হবে। দলে দলে হিন্দুরা দেশত্যাগ করতে আরম্ভ করলেন।

বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ প্রবল হয়ে উঠছিলো, তার প্রভাব যে হিন্দুদের ওপর পড়েনি সে কথাও বলা যাবে না। চিত্তরঞ্জন সুতারের নেতৃত্বে স্বাধীন বঙ্গভূমি আন্দোলন নামে একটি আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিলো। সুতার বাবুর দাবী ছিলো বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী তিনটি জেলা হিন্দু জনসাধারণের বসবাসের জন্য আলাদা করে দেয়া হোক। হিন্দু মৌলবাদী শক্তি চিত্তরঞ্জন সুতারকে দিয়ে এ আন্দোলনটি সৃষ্টি করিয়েছিলো। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও বাংলাদেশ সরকারকে বিব্রত করার জন্য বঙ্গভূমি আন্দোলনকে উস্কে দিয়েছে। এরশাদ ক্ষমতায় এসে সংসদে আইন পাশ করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর কিছুই অবশিষ্ট নেই। দেশত্যাগের মাত্রা অধিক হারে বেড়ে গেলো। নানা রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংগঠন ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালো বটে, কিন্তু আইনটি রদ করা সম্ভব হলো না। উনিশশো ছিয়ানব্বই সালে হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে অধিকতররা গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের ক্ষমতা লাভের পরও দেখা যাচ্ছে আইনটি যথাযোগ্য বহাল রয়েছে।

উনিশশো একানব্বই সালে ভারতে বিজেপির নেতৃত্বে হিন্দু মৌলবাদীরা মোগল সম্রাট বাবর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি ষোড়শ শতাব্দীর মসজিদ ভেঙ্গে ফেলে, ওই জায়গায় শ্রীরামচন্দ্রের নামে একটি মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে। তার প্রতিবাদে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে গ্রাম গঞ্জ সর্বত্র হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রদায়িক মুসলমানেরা হামলা শুরু করেন। হিন্দুদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগানো হয়, তাদের দোকান পাট ভেঙ্গে ফেলা হয়, তাদের মন্দির ও দেবালয় শয়ে শয়ে ধ্বংস করা হয়। খালেদা জিয়ার সরকার দাঙ্গা প্রতিরোধ করার কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করলেন না। অপর প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ব্যপক মুসলমানের কাছে অপ্রিয় হওয়ার ভয়ে হিন্দুদের পাশে এসে দাঁড়াতে পারলেন না। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা দেশ ভাগ হওয়ার পর থেকে অনেকবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হয়েছেন। উনিশশো একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতাও তাদের সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু উনিশশো একানব্বই সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসজনিত নিষ্ঠুরতার সঙ্গে অন্য কোনো নিষ্ঠুরতার তুলনা চলে না। তারা চূড়ান্ত অসহায়তা সহকারে প্রত্যক্ষ করতে বাধ্য হলেন, কী প্রচণ্ড আক্রোশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের ওপর আক্রমণ করতে পারে। তারা মর্মে মর্মে অনুভব করলেন, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ওপর সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের আক্রোশ, সময় বিশেষে তা সাইক্লোন, সমুদ্র প্লাবন কিংবা বিধ্বংসী ভূমিকম্পের চাইতেও মারাত্মক হতে পারে।

এই সমস্ত ঘটনার অভিঘাত হিন্দু সম্প্রদায়ের সংবেদনাকে এতোটা আহত করেছে, তারা বাংলাদেশে নির্ভর করার মতো কোনো অবলম্বনই খুঁজে পেলেন না। কোন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ সমর্থক বিচারপতি দেবেশ ভট্টাচার্যের মতো মানুষকে ভোরের কাগজে প্রবন্ধ লিখে হিন্দুদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচন দাবী করতে হয়, তা অনুমান করতে কষ্ট হয়না। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের প্রতি অবিশ্বাস, সংশয় এবং আতঙ্কের কারণে বাংলাদেশের হিন্দুরা অপর দুটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় খ্রীষ্টান এবং বৌদ্ধদের নিয়ে হিন্দু বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এই সংগঠনের পেছনের উদ্দেশ্য যতোই মহৎ হোক না কেননা, বাস্তবে তার কর্মকাণ্ড সাম্প্রদায়িক খাতেই প্রবাহিত হচ্ছে একথা বললে অত্যুক্তি করা হবে না। তারপরেও এই ধরনের সংগঠনের যৌক্তিকতা অস্বীকার করা যায় না। মুসলমানেরা যদি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে পারে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থেকে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অত্যাচারের শিকার হওয়ার চাইতে সাম্প্রদায়িকভাবে সংগঠিত প্রতিবাদ রচনা করা অনেক পুরুষোচিত কাজ।

তারপরেও একটা কথা থেকে যায়। সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মধ্যবর্তী দূরত্ব যদি ক্রমাগত বাড়তে থাকে, এই দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত কোন পরিণতির দিকে ধাবিত হবে, সেই জিনিশটি কল্পনা করলেও আতঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না। বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেও সাম্প্রদায়িকতার একটা বিষাক্ত স্রোত সাপের মতো এঁকে বেঁকে প্রবাহিত হয়ে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। এই প্রক্রিয়াটি ক্রমশঃ বলবান হয়ে উঠেছে। দুঃখের বিষয় বাংলাদেশের অবস্থানটি যদি নেপালের মতো হতো আমাদের দুশ্চিন্তা করার বিশেষ কারণ থাকতো না। নেপাল পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র হওয়া সত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের মধ্যে নেপালের জনগণই সবচাইতে ভারত বিরোধী তা এক জরিপে প্রমাণিত হয়েছে। সুদীর্ঘকালের ঐতিহাসিক সংলগ্নতার কারণে ভারত বাংলাদেশ, হিন্দু মুসলমান এই সম্পর্কের ধরনগুলো সরল এবং একমাত্রিক নয়। সেই কারণে ভারত বিরোধিতা এবং হিন্দু বিরোধিতা এক হয়ে দাঁড়ায়। আবার অনায়াসে হিন্দু বিরোধিতাও ভারত বিরোধিতায় রূপান্তরিত হতে পারে। মুসলিম দেশগুলোতে উখিত মৌলবাদের প্রভাব যেমন মুসলিম জনগোষ্ঠীর একাংশকে প্রভাবিত করছে, তেমনি ভারতবর্ষের সজ্ঞা পরিবারভূক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর অনুসৃত মৌলবাদ হিন্দু সমাজের একাংশকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করছে। মুসলিম মৌলবাদের পাশাপাশি হিন্দু মৌলবাদও সমাজের গভীরে শেকড় বিস্তার করছে। হিন্দুরা যেহেতু সংখ্যালঘু এবং সামাজিকভাবে নির্যাতিত, মৌলবাদের প্রতি তাঁদের ঝুঁকে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল।

কতিপয় দৃষ্টান্ত তুলে ধরলে বিষয়টার গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠবে। দেখা গেলো এক সুপ্রভাতে স্বামী বিবেকানন্দের একটি মূর্তি তৈরি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন জগন্নাথ হল কর্তৃপক্ষ। স্বামী বিবেকানন্দের অন্য অনেক পরিচয় যাই থাকুক, তাঁর ধর্মীয় পরিচয়টাই তাঁর অন্যবিধ পরিচয়কে ছাপিয়ে উঠেছে। ঘোষিতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিবেকানন্দের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয় না। কিন্তু এখানে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে উম্মোচন করা হলো, তখনই মুসলিম শিক্ষকদের কেউ কেউ অগ্রণী হয়ে প্রস্তাব তুললেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং ফজলুল হক মুসলিম হল নতুন করে নামকরণ করা হোক। আরেক শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম পাল্টানোর প্রস্তাব করলেন। প্রতিটি ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। দুই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের মধ্যে একটিও অপ্রিয় বাক্য বিনিময় ছাড়া একটি সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায় থেকে কতো দূরে সরে যাচ্ছে, এই সকল ঘটনার মধ্যে তার প্রমাণ মেলে।

পাকিস্তান আমলে জগন্নাথ হল ছিলো শিক্ষা সংস্কৃতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সব চাইতে অগ্রসর ছাত্রাবাস। এই হলটি প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে বিবেচিত হতো। সাম্প্রতিককালে পূজা পার্বণ ধর্মীয় উৎসব এই হলে এতো অধিক পরিমাণে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, দেখে অনুমান করতে কষ্ট হয় না সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আতঙ্ক কতো অধিক পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের তরুণদের অন্যবিধ সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ অসম্ভব হয়ে উঠেছে বলেই, তারা অধিক হারে ধর্মকর্মের দিকে মনোযোগী হয়ে উঠছে। হ্যাঁ একটা কথা অবশ্য উঠতে পারে, ভারতের বিজেপির প্রভাবের কারণেই এসব ঘটছে। বাংলাদেশের মুসলমান ছাত্ররা যদি মাদ্রাসায় আফগানিস্তানের তালেবানদের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য গোপনে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারে, তাহলে হিন্দু ছাত্রদের অনুরূপ কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার অধিকার কেনো থাকবে না। যুক্তির পিঠে যুক্তি দিয়ে, কথার খেলা অনেক করা যায়। কিন্তু তাতে আসল সংকটের কোনো হেরফের হবে না।

একটা কথা খুব স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করা প্রয়োজন। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা পলিটিক্যাল ডিমোরালাইজেশনের প্রক্রিয়া অনেকদিন আগে থেকে শুরু হয়েছে। সেটা এখন এমন একটা আকার ধারণ করেছে, সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু কারো পক্ষে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার অবকাশ নেই। পলিটিক্যাল ডিমোরালাইজেশন গ্যাংগ্রিনের মতো, সমাজ দেহের যে কোনো অংশে এর বিষক্রিয়া শুরু হলে অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য। সংখ্যালঘুকে আশ্রিত ভেবে করুণা করা, কিংবা ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করা উভয়ই ন্যায়তঃ স্বাধীন মানুষের নাগরিক সত্তার বিরুদ্ধে অপরাধ। ভারত উপমহাদেশের বিভক্তি, পাকিস্তানের জন্ম, পাকিস্তানের ভাঙন আমাদের ইতিহাসের এই সকল ঘটনা একযোগে ভারত পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের মধ্যে এই পলিটিক্যাল ডিমোরালাইজেশনের জন্ম দিয়েছে। অনুকূল পরিস্থিতিতে সেই ক্ষত শুকিয়ে আসতে থাকে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তাতে পুঁজ রক্তের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ যে মূলচিন্তার উপর দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে সেই বোধ যদি পূর্ণ দৈর্ঘ্যে বিকশিত হতে পারতো, সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুর ফারাক অবশ্যই কমে আসতো। যে সমস্ত সরকার বাংলাদেশ শাসন করেছে বা এখনো করছে, তারা সোচ্চার মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক হোক বা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি কৌশলগত আনুগত্য প্রদর্শন করুক, কমবেশি সকলে এই অপরাধে অপরাধী। তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত মর্মবাণীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। নির্যাতিত মানুষ যেখানে জন্মগত অধিকার ভোগ করতে পারে না, যেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সমাজে অবস্থানগতভাবেই নির্যাতিত, তাই অন্য সকল নির্যাতিত মানুষের সংগ্রামের সঙ্গে নিজেদের সংগ্রাম জড়িত না করলে সম্প্রদায়গতভাবে তাদের মুক্তি অর্জন অসম্ভব। একমাত্র নির্যাতিত মানবগোষ্ঠীর সম্মিলিত সংগ্রামই সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুর ফারাক রেখা মুছে দিতে পারে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির বয়স পঁচিশ বছর। কিন্তু বাংলাদেশী সমাজের বয়স হাজার হাজার বছর। সামাজিক সংকটগুলো সামাজিকভাবেই আমাদের সমাধান করতে হবে। সমাজের সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর বিবেকবান দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষদের একটা সত্য অনুধাবন করার সময় এসেছে, আমাদের সকলকে দেশে পাশাপাশি বসবাস করতে হবে। ভালোবাসা দিয়ে এবং ভালোবাসা পেয়ে বেঁচে থাকার একটা মিলিত কৌশল আমাদেরই উদ্ভাবন করতে হবে। অবশ্যই সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের দায়দায়িত্ব এতে অনেক বেশি।

.

০৭.

বাংলাদেশী রাজনীতি সংস্কৃতির যা কিছু উজ্জ্বল অংশ তার সিংহভাগই বামপন্থী রাজনীতির অবদান। ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে বামপন্থী রাজনীতির উত্তাপ থেকেই বাঙালী সংস্কৃতির নবজন্ম ঘটেছে। সামন্ত সংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত একটি নতুনতরো সংস্কৃতির উন্মেষ বিকাশ লালনে বামপন্থী সংস্কৃতি সেবীদের যে বিরাট সাফল্য এবং ত্যাগ; তিলতিল করে সংস্কৃতির আসল চেহারাটি ফুটিয়ে তোলার কাজে বামপন্থী সংস্কৃতি কর্মীরা যে শ্রম, মেধা এবং যত্ন ব্যয় করেছেন, সে কাহিনী এখনো প্রায় বিস্মৃতিতে বিলীন হতে চলেছে। তাদের সাফল্যের পরিমাণ হয়তো আশানুরূপ ছিলো না। কিন্তু সূচনাটি করেছিলেন এবং অনেকদিন পর্যন্ত সংস্কৃতিকে লালন করেছেন। সংস্কৃতিতে উত্তাপ, লাবণ্য এবং গতি সঞ্চার করার ব্যাপারে বামপন্থী সংস্কৃতি কর্মীরা অনেক কিছু দিয়েছেন। সেই সব মহান আবদানের কথা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করার প্রয়োজন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।

বামপন্থী রাজনৈতিক সংগ্রাম থেকেই বাংলাদেশের জাতীয়তার বোধটি প্রথম অঙ্কুরিত এবং মুকলিত হয়। বাঙালী জাতীয়তার প্রাথমিক সোপানগুলো বামপন্থী রাজনীতির নেতা কর্মীরাই নির্মাণ করেছিলেন। সে জন্য তাদের জেল, জুলুম, অত্যাচার নির্যাতন কম সহ্য করতে হয়নি। সেই সময়ে আওয়ামী লীগ দলটির কাছ থেকেও তাঁদের কম নিগ্রহ ভোগ করতে হয়নি। পাকিস্তানের সংহতি বিনাশকারী, বিদেশী গুপ্তচর ইসলামের শত্রু এই ধরনের অভিযোগ বামপন্থী রাজনীতির নেতা এবং কর্মীদের বিরুদ্ধে হামেশাই উচ্চারিত হতো। এসব লাঞ্ছনা সহ্য করেও বামপন্থী রাজনীতির নেতা এবং কর্মীরা ধর্মতান্ত্রিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোর ভেতরেই একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের ভ্রুণ রোপন করতে পেরেছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা যেটুকু সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করেন, তার পেছনে রয়েছে বামপন্থী রাজনীতির বিপুল পরিমাণ অবদান। বামপন্থী রাজনীতিই শ্রমিক, কৃষক, নিম্নবিত্ত সমস্ত নির্যাতিত মানুষকে অধিকার আদায়ের স্বপ্ন দেখিয়েছে, সংগঠিত করেছে এবং আন্দোলনে টেনে নিয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য বামপন্থী আন্দোলন এখন রাজনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ উত্থানরহিত।

বামপন্থী রাজনীতির মুমূর্ষ অবস্থা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্যকে তমশাচ্ছন্ন করে রেখেছে। এই দেশটির সত্তর ভাগ মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে বসবাস করে। অথচ এই দেশটির রাজনৈতিক ক্ষমতা যারা নিয়ন্ত্রণ করে, তার মধ্যে এই বিপুল পরিমাণ জনসংখ্যার কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। বাংলাদেশের কৃষক শ্রমিক নিম্নবিত্ত মানুষ গুটিকয় মানুষের শোষণ পীড়নের শিকারে পরিণত হয়ে আসছে। তারা এমন কোনো রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলতে পারেন নি, যার সাহায্যে তারা নিজেদের ভাগ্য গড়ে তোলার সুযোগ পান।

মধ্যশ্রেণীভূক্ত রাজনৈতিক দলগুলো বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগোষ্ঠীকে শোষণের মাধ্যমেই নিজেদের অবস্থান টিকিয়ে রেখেছে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গী অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ। তারা দেশে শিল্পকারখানা তৈরি করে দেশের বেকার সমস্যা সমাধান করতে পারেন না। অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করতেও তারা অক্ষম। বাংলার ঘুণেধরা গ্রাম সমাজের কাঠামোর পরিবর্তন করে নতুন সমাজ সৃষ্টি করার পরিকল্পনা তাদের নেই। সংখ্যাধিক জনগোষ্ঠীর প্রাণপ্রিয় দাবী খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষাব্যবস্থা এসবের ব্যবস্থা তারা করেন না। আমাদের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে বিপুল পরিমাণ সৃজনী ক্ষমতা রয়েছে, সেটাকে মুক্তি দিয়ে দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণও তাঁদের অভীষ্ট হতে পারে না। তারা নিজেদের শাসন শোষণের মাধ্যমে জরাজীর্ণ সমাজ ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে গোটা সমাজটাকে এমন একটা কারাগার বানিয়ে রাখতে চান, যাতে করে মানুষ তার অধিকার কখনো ভোগ করতে না পারে। শাসকশ্রেণী সমাজের ওপর তাদের অপ্রতিহত শোষণ ব্যবস্থা কায়েম রাখার জন্য বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তাবেদারী করে এবং আগ্রাসী শক্তির সঙ্গে হাত মেলাতেও কুণ্ঠিত হন না। এই সমাজে শ্রমিক কৃষক মেহনতি সমাজের স্বার্থরক্ষা করতে পারে এমন বলিষ্ঠ আন্দোলন সমাজের অভ্যন্তর থেকে জেগে উঠতে পারছে না। আমাদের রাজনৈতিক জীবনে বামপন্থী রাজনীতির প্রভাব খুবই সামান্য। বামপন্থী রাজনীতির মধ্যে কোনো ঐক্য নেই। তারা অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল উপদলে বিভক্ত। দেশের প্রকৃত বাস্তব পরিস্থিতি বিচার বিশ্লেষণের বদলে অপ্রয়োজনীয় মতাদর্শগত বিতর্কে তাদের সময় কাটে। বাংলাদেশের বামপন্থী দলগুলোর পক্ষে সাধারণ নির্বাচনে প্রার্থী দেয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে। কোনো রকমে প্রার্থী দাঁড় করাতে পারলেও সে সকল প্রার্থী নির্বাচনে এমন শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়, তাদের জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয়। তাদেরকেও মধ্যশ্রেণীভূক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর মতো ধনিকদের চাঁদার ওপর নির্ভর করতে হয়। এক কথায় বাংলাদেশে বামপন্থী রাজনীতি সর্বপ্রকার উত্থানশক্তি হারিয়ে বসেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বামপন্থীদের কোনো অবস্থান না থাকার কারণে বেবাক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দক্ষিণপন্থী কক্ষপথে ঢুকে পড়েছে। এই দুষ্টচক্রের ভেতর থেকে টেনে বের করতে না পারার কারণে গোটা রাজনীতিটাই পচে উঠেছে।

বামপন্থী রাজনীতির এই দৈন্যদশা সমস্ত দেশপ্রেমিক এবং মুক্তিকামী মানুষের দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন একটা সময় ছিলো, যখন বামপন্থী রাজনীতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সকলের সামনে পরিদৃশ্যমান হয়ে উঠেছিলো। সকলে বামপন্থী রাজনীতির ভবিষ্যতের মধ্যেই দেশের ভবিষ্যৎ দেখতেন। এখন তাদের অতীত দিনের স্মৃতির কথা স্মরণ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। বাংলাদেশের শহর বন্দর গ্রাম গঞ্জের হাজার হাজার কর্মী যারা দেশ এবং জাতির সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য সব রকমের আত্মত্যাগ করতে কুণ্ঠিত হননি। এই সমস্ত ত্যাগী এবং নিষ্কলঙ্ক কর্মীরা এখন সকলের করুণার পাত্রে পরিণত হয়েছেন। রাজনীতি, কালোবাজারী, লুঠেরা, চোরাচালানি-এক কথায় সমাজের যতো খারাপ মানুষ আছে, তাঁদের স্থায়ী পেশায় রূপান্তরিত হয়েছে। রাজনীতিতে সৎ মানুষের অবস্থান বহুকাল পূর্বেই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, চিহ্নিত অপরাধী, মাফিয়াচক্রের হাতে দেশের কোটি কোটি মানুষের ভাগ্য বন্দী হয়ে আছে। এই অবস্থাটি যদি দীর্ঘদিন এভাবে চলতে থাকে, এই সমাজ মানুষের বসবাসের সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়ে পড়বে।

এই পরিস্থিতির অবসান ঘটানোর জন্য দেশের কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের একটি রাজনৈতিক উত্থান অবশ্যম্ভাবী। পরিতাপের বিষয় হলো কৃষক, শ্রমিক, বিত্তহীন এবং নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনের সঙ্কট পূর্বের তুলনায় বহুগুণ বেড়েছে। অথচ তাদের প্রতিবাদ করার কোনো উপায় নেই। তাদের দাবীর কাছে শোষকশ্রেণীগুলেকে নতি স্বীকারে বাধ্য করতে পারে, এমন কোনো সংগঠন নেই। ইতিহাস ঘাটলে এমন বহু প্রমাণ পাওয়া যাবে বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণ অতীতে এরকম উত্থানশক্তিহীন ছিলো না। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র এবং নিম্নবিত্ত মানুষের সম্মিলিত আন্দোলনের তোড়ে ভূতপূর্ব পাকিস্তানের জঙ্গী লাট আয়ুব খানকে পর্যন্ত পরাজয়ে স্বীকার করতে হয়েছে। অথচ বর্তমান সময়ে দরিদ্র মানুষের একজন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পর্যন্ত নির্বাচিত করার ক্ষমতা নেই।

বামপন্থী রাজনীতির বর্তমান স্থবিরতার কারণগুলো অনুসন্ধান করতে হলে আমাদের পেছনের দিকে না তাকিয়ে গত্যন্তর নেই। বামপন্থী রাজনীতির মধ্যে যে উজ্জ্বল সম্ভাবনা মূর্তিমান হয়ে উঠেছিলো, তা অনেকের মধ্যেই আশাবাদ জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলো। সকলে আশা করেছিলেন বামপন্থী রাজনীতিই দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে। বামপন্থী রাজনীতির প্রবল প্রবাহে স্তরের পর স্তর বালু সঞ্চিত হয়ে মূল স্রোতধারাটিই রুদ্ধ করে ফেলেছে। বিভ্রন্তি বিচ্যুতির সে বালুরাশি খনন করে বামপন্থী রাজনীতির গতিমুখটি উন্মুক্ত করে দেয়ার জন্য অতীতের বিচ্যুতি এবং বিভ্রান্তিগুলোর দিকে অত্যন্ত নির্মোহ দৃষ্টিতে তাকানো অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে।

উনিশশো পঁয়ষট্টি সালের পূর্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, শ্রমিক ইউনিয়ন এবং কৃষক সমিতি যখন অবিভক্ত ছিলো, সে সময়টাই ছিলো বামপন্থী রাজনীতির স্বর্ণযুগ। সমাজের ভেতর থেকে সেই সময়ে যে শক্তিপুঞ্জ জাগ্রত হয়ে উঠেছিলো সকলে আশা করতেন, হয়তো সেদিনের বেশি দেরী নেই, যখন এই সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে এই দেশে জনগণের কল্যাণমূখী একটা সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন মতাদর্শগত কারণে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। দুনিয়ার কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাচ্চা নেতা কে চীন না সোভিয়েত ইউনিয়ন, তা নিয়ে মতদ্বৈধতা দেখা দেয়। কমিউনিস্ট আন্দোলন দ্বিধাবিভক্ত হয়। একদিকে চীন, অন্যদিকে রাশিয়া। তার প্রভাব আমাদের দেশেও পড়ে। কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কৃষক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়ন এই সকল সংগঠন চীন রাশিয়ার প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। এই চীন-সোভিয়েত বিরোধের কারণে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের বামপন্থী আন্দোলনের ওপর প্রথম আঘাতটা আসে।

তারপরে ভারত আর চীনের মধ্যে যখন সীমান্ত যুদ্ধ সংগঠিত হয়, আমাদের দেশের বামপন্থী আন্দোলনে আরো একটা বিভক্তি নেমে আসে। বেশিরভাগ হিন্দু সম্প্রদায় থেকে আগত নেতা এবং কর্মী সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতি সমর্থন দিতে থাকেন। অন্যদিকে মুসলিম সমাজ থেকে আগত বেশিরভাগ নেতা এবং কর্মী চীনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন। এই সময়ের হিন্দু কমিউনিস্ট এবং মুসলমান কমিউনিস্ট শব্দ দুটি সমাজে ব্যাপকভাবে চালু হয়ে যায়। বামপন্থী আন্দোলনের মধ্যে এই যে বিভক্তি ঘটলো, তার পেছনে আমাদের দেশের আভ্যন্তরীন পরিস্থিতির চাইতে আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রভাবই সর্বাধিক সক্রিয় ছিলো।

উনিশশো পঁয়ষট্টি সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যখন ছয় দফা কর্মসূচীর মাধ্যমে বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটি সামনে নিয়ে আসেন, মস্কো সমর্থক রাজনীতির অনুসারীরা পারস্পরিক বিবাদে রত ছিলেন। কিন্তু দুটি দলই ছয় দফা কর্মসূচীর নিন্দা করতে ছাড়লেন না। সে সময়ে রাশিয়া ভারত এবং পাকিস্তান মিলিয়ে চীন বিরোধী একটা ব্লক করার প্রস্তাব দিয়েছিলো। মূখ্যতঃ সে কারণে মস্কোপন্থী সংগঠনগুলো নিখিল পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব রক্ষার প্রতি অধিক যত্নবান হলেন। পরিতাপের বিষয় এই যে মস্কোপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ উনিশশো চুয়ান্ন সালে ‘হোয়াট ইজ অটোনমি’ পুস্তি কাটি লিখে প্রকারান্তরে তৎকালীন পূর্ব বাংলার জাতি সত্তার প্রশ্নটি তুলে ধরেছিলেন। উনিশশো পঁয়ষট্টি সালের পর আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের স্বার্থটা বড়ো করে দেখার কারণে তার লেখা পুস্তিকাটি অধ্যাপক সাহেব বেমালুম ভুলে যেতে পেরেছিলেন।

সেই সময়ে মওলানা ভাসানীর ছত্রচ্ছায়ায় বেইজিংপন্থী রাজনীতি পরিচালিত হচ্ছিলো। ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে চীন পাকিস্তানের অবস্থানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলো বলে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। চীনপন্থী রাজনীতির অনুসারীরা আদর্শগত কারণে চীনের প্রতি অনুগত ছিলেন। চীনের নেতৃবৃন্দ তাদের অনুসারীদের বোঝাতে সক্ষম হলেন যে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের বিরোধিতা করলে পাকিস্তানের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন বাধাগ্রস্থ হবে। সুতরাং চীনপন্থীদের মধ্যে আয়ুবের বিরোধিতা না করার একটা মনোভাব স্পষ্ট হয়ে উঠে। বরঞ্চ তারা শেখ মুজিবের ছয় দফার বিরোধিতা করতে আরম্ভ করেন এবং ছয়দফার মধ্যে সিআইএ-এর ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে যান।

মস্কো এবং বেইজিংপন্থী রাজনৈতিক দল দুটো যখন পারস্পরিক বাদবিসংবাদে মত্ত সেই সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফার প্রতি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের উঠতি মধ্যবিত্ত সমর্থন দিয়ে বসে আছে। শহর বন্দর গ্রাম গঞ্জ সর্বত্র ছয় দফার সমর্থনে প্রবল গণজোয়ারের সৃষ্টি হলো। বাঙালী জাতীয়তাবাদের অপ্রতিহত জয়যাত্রা দেখে মস্কোপন্থী রাজনীতির অনুসারীরা যখন আওয়ামী লীগের কাছে দাবী জানালেন যে আন্দোলনে তাঁদেরও অংশীদার করা হোক, শেখ সাহেব এক বাক্যে জানিয়ে দিলেন, দলের সাইনবোর্ড পাল্টে আওয়ামী লীগে চলে আসুন। বাঙালী জাতীয়তাবাদের যে উত্তাল উত্থান পঁয়ষট্টি পরবর্তী রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে জেগে উঠেছিলো বামপন্থী রাজনীতি তার নেতৃত্ব থেকে সম্পূর্ণরূপে বাদ পড়ে গেলো । অথচ এটা অবিসংবাদিত সত্য যে বাঙালী জাতীয়তার বিকাশের প্রাথমিক সোপানগুলো, বামপন্থী রাজনীতির নেতা এবং কর্মীরাই নির্মাণ করেছিলেন।

নকশাল বাড়ি আন্দোলনের স্থপতি কমরেড চারু মজুমদার পশ্চিম বাংলার কমিউনিস্ট রাজনীতিতে একটা নতুন চমক সৃষ্টি করলেন। তাঁর শ্ৰেণীশত্রু খতমের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চীনপন্থী রাজনীতির একাংশকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। আবদুল হক এবং মোহম্মদ তোঁয়াহা, মওলানা ভাসানীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের একটা দল তৈরি করেন। পাকিস্তান সেনা বাহিনীর দখলদারিত্বের সময়ে কমরেড আবদুল হক পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব টিকিয়ে রাখার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। মোহাম্মদ তোঁয়াহা এবং সুখেন্দু দস্তিদার হকের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে দেশের অভ্যন্তরে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নেতা আব্দুল মতিন, আলাউদ্দিন, অধ্যাপক অহিদুর রহমান প্রমূর্খ উত্তরবঙ্গের আত্রাই অঞ্চলে সশস্ত্র যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দখলদারিত্বের সময়েই চীনপন্থী রাজনীতির ভেতর থেকে সুদক্ষ সংগঠক সিরাজ শিকদারের আবির্ভাব। তিনি স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা কায়েম করার দাবীতে একাধিক সশস্ত্র সংগ্রামে সফল নেতৃত্ব দান করেন। সিরাজ শিকদারের রাজনৈতিক আন্দোলনের ধারাটি কিছুকাল সক্রিয় ছিলো। তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ওই ধারাটির অবসান রচিত হয়। রণো এবং মেননের অনুসারীরা আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে নরসিংদীর গ্রামে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ করেছেন। সংক্ষেপে এই-ই হলো চীনপন্থী রাজনীতির অনুসারীদের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের অবস্থানগত একটা খতিয়ান।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়া একটা মস্তবড়ো সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলো। মুখ্যতঃ রাশিয়ার চাপের কারণেই বাংলাদেশের সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতির মধ্যে সমাজতন্ত্র স্থান দখল করে নিতে পেরেছিলো। সোভিয়েতপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, ছাত্র ইউনিয়ন, শ্রমিক ইউনিয়ন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, মহিলা সংগঠন ও কৃষক সংগঠন মিলিয়ে সমাজে তাদের একটা বড়ো রকমের অবস্থান ছিলো। তারা যদি ইচ্ছা করতেন, বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পক্ষে কোনো বাধা ছিলো না। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ার নির্দেশে তাদের এক দলীয় শাসন ব্যবস্থা মেনে নিতে হলো। এই ঘটনাটি তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উভয়কে এমন একটা অন্ধকার গহ্বরে নিক্ষেপ করে, সেখান থেকে অদ্যাবধি কারো পুরোপুরি উঠে আসা সম্ভব হয়নি। সেদিন যদি কোনো রকমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটি চালু রাখা যেতো, বাংলাদেশে একের পর এক স্বৈরশাসন জন্ম নিতে পারতো না। দৃশ্যতঃ বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু করা হলেও দেশটিকে বিগত দিনের দায়ভাগ অদ্যাবধি বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

বাম রাজনীতির সর্বশেষ তরঙ্গটি জেগে উঠেছিলো আওয়ামী লীগ সংগঠনটিরই ভেতর থেকে। আওয়ামী লীগের নিরাপোষ লড়াকু তরুণ যারা আওয়ামী লীগকে পাকিস্তানের সঙ্গে কোনোরকম আপোষ করতে দেয়নি, স্বাধীনতার পর তারাই আওয়ামী লীগ থেকে ছিটকে বেড়িয়ে এসে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল সংক্ষেপে জাসদ গঠন করে। জাসদ দলটিকে বামধারার রাজনীতির সঙ্গে এক করে দেখা বোধকরি ঠিক হবে না। আওয়ামী তরুণ র‍্যাডিক্যাল অংশ থেকেই জাসদের সৃষ্টি। বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবী উচ্চারণ করলেও অধিকসংখ্যক তরুণের তারুণ্যই ছিলো তাদের প্রাণশক্তি। দলটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছিলো বলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেই ছিলো তার প্রবল ক্ষোভ। আওয়ামী লীগকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় আসার উগ্র আকাঙ্ক্ষার কারণে কোনো সুচিন্তিত রাজনৈতিক দর্শন দলটির চালিকা শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি। একের পর এক আত্মঘাতী উদ্যমের মধ্যে দলটি শক্তি ক্ষয় করতে থাকে। শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পর সামরিক শাসন যখন চেপে বসে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা এবং কর্মীর মধ্যে একের পর এক বিভ্রান্তি জন্ম নিতে আরম্ভ করে। শেখ মুজিবের মৃত্যুর দেড় দশকের মধ্যেই দলটি অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। জাসদের অপমৃত্যু বাংলাদেশের রাজনীতির সব চাইতে করুণ সংবাদ। এই দলটির ছত্রখান হয়ে যাওয়ার মধ্যে একটি যুগের একটি প্রজন্মের বিপ্লবী আকাক্ষার অবসান ঘটে।

.

০৮.

বাংলাদেশের রাষ্ট্রসত্তাকে ঘিরে যে সকল বিতর্ক জন্ম নিয়েছে, আসলে সেগুলো পাকিস্তান রাষ্ট্রেরই উত্তরাধিকার। অর্থাৎ হিন্দু মুসলমান এবং অপরাপর জাতি মিলে একটি জাতি না দুটি জাতি না অনেক জাতি। বৃটিশ ভারতে এ সমস্যাটার সমাধান হয়নি, তাই ভারতকে দু’টুকরো করতে হয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে জাতীয়তার সংকটটির নিরসন হয়নি বলেই পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি করতে হয়েছে। দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশেও সেই মৌলিক সংকটটি নানান ছদ্মবেশ ধারণ করে জাতীয়তা সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশেষ বিশেষ সময় আসে, যখন ধর্ম, সংস্কৃতি এবং জাতীয়তার প্রশ্নে বিভাজন রেখাগুলো বড়ো বড়ো ফাটলের জন্ম দেয়। বাংলদেশ রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য এটাকে বলা যাবে না। কিন্তু একথা তো সত্যি একটা শেকলের জোর কতো তার দুর্বল কড়াটির প্রতিরোধ ক্ষমতার মধ্যেই প্রমাণ মিলে ।

ভারতের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা কী দেখতে পাই? বৃটিশ বিদায়ের প্রাক্কালে সমস্ত ভারতীয়রা মিলে একটা জাতি, তার ভিত্তিতেই ভারতীয় ইউনিয়নের সৃষ্টি হয়েছিলো। সেই জায়গাটিতে ভারত কি স্থির থাকতে পারছে? বিকাশমান জাতীয়তার ধারণাগুলো ভারত অস্বীকার করতে পারছে না, নতুন নতুন জাতীয়তার ধারণাগুলোর সঙ্গে ফেডারেল রাষ্ট্রকাঠামোর সংঘাত লেগেই আছে। খুব শ্লথগতিতে হলেও ভারতকে এই বহু জাতীয়তার অভিমুখে অগ্রসর হতে হচ্ছে। ভারতে যে ব্যাপারটি বিবর্তন, রূপান্তর এবং ক্রমাগত পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটছে, সেই একই জিনিস পাকিস্তানে আচমকা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ঘটে গেছে। এই ঘটনার সঙ্গে সীজারিয়ান অপারেশনের তুলনা করা যায়।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়ায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে পাকিস্তান মুসলিম লীগেরই ধারাবাহিক বিবর্তনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ জন্ম নিয়েছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে তার চিন্তা-চেতনায় অনেক নতুন মৌল উপাদানের সংযোজন হয়েছে। কিন্তু তারপরেও একটা জিজ্ঞাসা এখানে প্রধান হয়ে দেখা দেয়। যে সামাজিক শক্তিগুলো ভারত রাষ্ট্রকে এক জাতীয়তার মধ্যে বহু জাতীয় অবস্থানের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সেই সামাজিক শক্তিগুলোর প্রতিনিধিত্ব করছে কিনা। উত্তর হবে খুব সম্ভবতো ‘না’। বামপন্থী আন্দোলনের সার্বিক উত্থানই বাংলাদেশের বিবাদমান সম্প্রদায়, জাতি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব, সংঘাত কমিয়ে আনতে সক্ষম। মনে রাখা প্রয়োজন শোষিত শ্ৰেণীগুলোর নেতৃত্বে রাষ্ট্রের চরিত্রের মধ্যে পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। সংবিধানে পঞ্চাশ পাতা লিখেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং প্রান্তিক জাতিগুলোর অধিকার দেয়া যাবে না। বামপন্থী রাজনীতির সার্বিক উত্থান ছাড়া এই দেশটির মুক্তি সম্ভব নয়। বামপন্থী আন্দোলনের বিকাশের ধারাটি পর্যালোচনা করে যে সকল বাঁকে বিভক্তি, বিভ্রান্তি, বিচ্যুতি আন্দোলনের গতিবেগকে দুর্বল করেছে, ভুল পথে পরিচালিত করেছে, ঠাণ্ডা মাথায় সেগুলো চিহ্নিত করে বামপন্থার বিকাশের নতুন সম্ভাবনাগুলো খুঁজে বের করার এখনই প্রকৃষ্ট সময়।

যেসকল কারণে বামপন্থী রাজনীতি এদেশের প্রধান রাজনৈতিক ধারা হয়ে উঠতে পারে নি সেগুলোরও একটা খতিয়ান করা প্রয়োজন। প্রথমতঃ জাতিসত্তার প্রশ্নটি পাশ কাটিয়ে বামপন্থী রাজনীতি বিপ্লবের প্রশ্নটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলো এবং তাই-বামপন্থী রাজনীতি জাতীয় নেতৃত্বে অবস্থান হারিয়েছে। দ্বিতীয়তঃ আন্তর্জাতিক রাজনীতির মতাদর্শগত দ্বন্দ্বটি আমাদের দেশের বামপন্থী দলগুলো যতোটা বড়ো করে দেখেছে, আমাদের দেশের শোষিত জনগণের প্রশ্নটি তাঁদের চোখে সে তুলনায় গৌণ হয়ে দেখা দিয়েছে। তৃতীয়তঃ অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটা মৌলিক উন্নয়ন কৌশলের সঙ্গে রাজনৈতিক আন্দোলনের সংযোগ সাধন করে পরিবর্তনকামী শক্তিগুলো একটা জঙ্গী ঐক্যমোর্চায় টেনে আনার ব্যাপারে তারা বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। চতুর্থতঃ আমাদের শোষিত জনগণের সামগ্রিক স্বার্থটির প্রতি দৃষ্টি না দেয়ার কারণে বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে মধ্যশ্রেণীভূক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর কনিষ্ঠ অংশীদার হওয়ার প্রবণতা জনগণের মধ্যে তাদের গ্রহণযোগ্যতা অসম্ভব করে তুলেছে। পঞ্চমতঃ মেহনতি জনগণের সংস্কৃতির বিকাশ সাধনের ক্ষেত্রে তাদের পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতা সামন্ত সংস্কৃতির রিক্তাবশেষকে টিকিয়ে রাখতে বিশেষ সাহায্য করেছে, যা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সহযোগীতায় বারবার আমাদের সংস্কৃতির গতিধারার সুষ্ঠু বিকাশ প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেছে। ষষ্ঠতঃ। বৃহত্তরো জনগোষ্ঠীর মানস চৈতন্যের শুশ্রূষা করে তার মান উন্নত এবং বোধ উপলব্ধিতে নতুন সমাজের ভ্রণ গ্রহণ করার পরিবেশ সৃষ্টি না করে অনুভূতিকে আহত করার প্রবণতা বৃহত্তরো জনগণকে বামপন্থার প্রতি বিমুখ করে তুলেছে। সপ্তমতঃ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং প্রান্তিক জাতিসমূহের নিরাপত্তা এবং জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণের অধিকারের প্রতি যথেষ্ট অঙ্গীকারসম্পন্ন না হওয়ার কারণে, তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি জন্ম দিয়েছে। অষ্টমতঃ বামপন্থী রাজনৈতিক দল এবং নেতৃবৃন্দ সমস্ত জাতির নেতৃত্ব দেয়ার বদলে সমাজে বিশেষ বিশেষ অংশকেই কর্মক্ষেত্র মনে করেন বলে তারা একটি পলায়নবাদী, পরাজিত মানসিকতার শিকারে পরিণত হয়েছেন। সে কারণে বামপন্থী রাজনীতিকে আমাদের রাজনীতির প্রধান ধারা হিসেবে তারা চিন্তা করতেও সক্ষম নন। নবমতঃ বিশ্বপরিসরে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর পতন আদর্শিকভাবে আমাদের বামপন্থী দলগুলোর নেতা এবং কর্মীদের হতবিহ্বল হরে ফেলেছে। তাই তারা আমাদের শোষিত জনগণের উত্থান ক্ষমতার প্রতি আস্থা স্থাপন করতে পারেন না। দশমতঃ বাজার অর্থনীতির জয়যাত্রা বামপন্থী বুদ্ধিজীবী এবং অর্থনীতিবিদদের একাংশকে মোহাবিষ্ট করে ফেলেছে। তারা জনগণের শ্রমনির্ভর অর্থনৈতিক বিকাশের পথ পরিহার করে বাজারের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান করছেন। তাদের এ দৃষ্টিভঙ্গী সঠিক নয়। বিকল্প অর্থনৈতিক যুক্তি নির্মাণে বামপন্থী অর্থনীতিবিদদের মধ্যে কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে না। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফএ সকল আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ধনী দেশগুলোর স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রেক্ষিতটি তারা উপেক্ষা করে থাকেন। একাদশতম কারণ হিসেবে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহের জনউদ্যোগ এবং সামাজিক সংহতি বিনষ্ট করার বিষয়টি উল্লেখ করতে চাই। আমাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির এ পর্যায়ে হয়তো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহকে অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহ যেভাবে সরকারের উত্থানপতনে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেছে, তাদের এ ক্ষতিকারক ভূমিকার বিরুদ্ধে সম্মিলিত সামাজিক প্রতিরোধ প্রয়োজন। তারাই বামপন্থার বিকাশের প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে উঠবে।

আহমদ ছফা
১৫ আগস্ট ১৯৯৭
উত্থানপর্ব কার্যালয়
ইহা, ৭১ আজিজ সুপার মার্কেট
শাহাবাগ, ঢাকা-১০০০।

.

প্রথম সংস্করণের ভূমিকা

‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ এর লেখক আহমদ ছফা বাঙলাদেশের মধ্য শ্রেণীভূক্ত বুদ্ধিজীবীদের কতকগুলো চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং তাঁদের বিশিষ্ট মানসিকতার বিবর্তনের ধারা এই প্রবন্ধ সংকলনটিতে কিছুটা আলোচনা করেছেন। এই আলোচনাকে মূলতঃ বাঙলাদেশের মধ্য শ্রেণীভূক্ত বুদ্ধিজীবীদেরই একজনের স্বশ্রেণীর বিরুদ্ধে একটা নিঃশঙ্ক সমালোচনা বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সুবিধাবাদের একটা ঝোঁক যে তাঁদের একটা শ্ৰেণীগত বৈশিষ্ট্য এ বিষয়ে এই তরুণ লেখকের যে কিছুমাত্র সংশয় নেই সেটা তাঁর লেখায় প্রতিটি ছত্রে সুস্পষ্ট, কিন্তু তবু তিনি স্বদেশের বুদ্ধিজীবীদের ব্যাপক সুবিধাবাদিতায় নিদারুণভাবে বিক্ষুব্ধ। তার এই বিক্ষোভের কারণ একদিকে মধ্যশ্রেণীভূক্ত বুদ্ধিজীবীদের একাংশ যে সুবিধাবাদের সাধারণ আবহাওয়ার মধ্যে থেকেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরোপুরি এবং অনেক ক্ষেত্রে আংশিকভাবে সুবিধাবাদ উত্তীর্ণ হতে সক্ষম, এই ধারণার প্রতি তাঁর গভীর আস্থা এবং অন্যদিকে বাঙলাদেশের এই শ্ৰেণীভূক্ত বুদ্ধিজীবীদের বাস্তব কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে একটা সামগ্রিক ও দিগন্তপ্রসারী সুবিধাবাদের অবাধ রাজত্ব। বুদ্ধিজীবীদের সাধারণ সুবিধাবাদের পাশাপাশি তাদের একাংশের সুবিধাবাদ উত্তীর্ণতার যে সন্ধান তিনি করেছেন সেই সন্ধানের ক্ষেত্রে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। এই ব্যর্থতার মধ্যে তার বিভিন্ন বিক্ষুব্ধ মন্তব্যের মর্মকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে এবং সে চেষ্টা করলে বর্তমান বাঙলাদেশে যে ব্যাপক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংকট শ্রমিক, কৃষক ও নিম্ন মধ্যশ্রেণীভূক্ত জনগণের জীবনকে বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত করছে তারও কতকগুলো মূলসূত্রের সন্ধান এ প্রবন্ধগুলোর মধ্যে পাওয়া যাবে।

বাঙলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আহমদ ছফা শ্রেণী বিশ্লেষণের কোনো চেষ্টা করেননি। কিন্তু দেশের সাংস্কৃতিক বিকাশ সাধারণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতির সাথে ওতপ্রোত যোগসূত্রে আবদ্ধ একথা তিনি স্বীকার করেছেন। এবং এই স্বীকৃতির ওপরই শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গীর প্রাথমিক ভিত্তি। কোন লেখক যদি নিশ্চল সততা এবং নিরবচ্ছিন্ন অধ্যবসায়কে অবলম্বন করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনের সাথে সাংস্কৃতিক জীবন এবং সংস্কৃতি চর্চার যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করেন তাহলে সংস্কৃতি চর্চাকে তিনি শেষ পর্যন্ত একটা শ্রেণীগত কর্মকাণ্ড বলে সিদ্ধান্ত করতে দ্বিধাবোধ করবেন না এবং নিজের বিশ্লেষণকে আরও সুষ্ঠু ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর উদ্দেশ্যে আলোচনাকে সামগ্রিকভাবে শ্রেণী বিশ্লেষণের ওপর দাঁড় করাবেন । আহমদ ছফা এই সংকলনের প্রবন্ধগুলিতে আলোচিত বিষয়সমূহের ক্ষেত্রে যেহেতু মোটামুটিভাবে সঠিক ভিত্তির ওপরই দাঁড়িয়েছেন সেজন্য এটা আশা করা অবাস্তব হবে না যে ভবিষ্যতে তিনি তার সমালোচনার ক্ষেত্রে শ্রেণী বিশ্লেষণের ওপর যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করবেন।

বর্তমান বাঙলাদেশের মধ্যে শ্রেণীভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের, বিশেষতঃ ‘লব্ধ-প্রতিষ্ঠ’ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যে নির্লজ্জতা, ভণ্ডামী, কাপুরুষতা এবং সুবিধাবাদ আজ দোর্দণ্ডপ্রতাপ তা শুধু বুদ্ধিজীবীদের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নেই। এই প্রবণতা বস্তুত পক্ষে রাজনৈতিক জীবন থেকে রস সংগ্রহ করেই আজ দিকে দিকে অংকুর থেকে পরিণত হচ্ছে মহীরুহে। তথাকথিত সংস্কৃতি চর্চার নামে যে কদর্য বেহায়াপনা, এবং আত্মসেবা এদেশের ‘লব্ধপ্রতিষ্ঠ’ বুদ্ধিজীবীরা আজ করে চলছেন সে বেহায়াপনা এবং আত্মসেবা রাজনীতিবিদদের বেহায়াপনা এবং আত্মসেবার সাথে অবিচ্ছিন্ন। সামগ্রিকভাবে এদেশের সাম্রাজ্যবাদকবলিত বুর্জোয়াশ্রেণী আজ যে শাসন ও শোষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে জনস্বার্থ পদদলিত করে নিজেদের শ্ৰেণীস্বার্থ পুষ্ট করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে, তারই একটা সুস্পষ্ট চিত্র মধ্যশ্রেণীভুক্ত এই বুদ্ধিজীবীদের সংস্কৃতি চর্চার মধ্যে পাওয়া যায়।

লেনিন বলেছেন, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চাকে যারা শ্ৰেণীনিরপেক্ষ বলে কলাকৈবল্যবাদ প্রচার করে তারা নির্মম ভণ্ড ব্যতীত আর কিছুই নয়। তাই যারা এক্ষেত্রে কলাকৈবল্যবাদের কথা বলে তারা আসলে শোষকশ্রেণীর সাহিত্য-সংস্কৃতি, তাদের কাব্যচর্চা ইত্যাদির সঠিক শ্রেণীচরিত্রকে শোষিতশ্রেণীর চোখের আড়াল করার উদ্দেশ্যেই তা বলে থাকে। কিন্তু তবু কোন ক্ষেত্রে আমরা দেখি শোষকশ্রেণীভূক্ত এই সমস্ত সংস্কৃতিসেবীদেরকে নিজেদের মুখোস অনেকখানি ছিঁড়ে ফেলতে, নির্লজ্জ এবং নগ্নভাবে শাসকশ্রেণী অর্থাৎ তাদের নিজেদেরই শ্রেণীর বড়ো তরফের ভাড়া খাটতে। আমাদের দেশেও আমরা পাকিস্তানী আমলে, বিশেষতঃ সামরিক শাসনের আমলে, তা দেখেছি। অনেকে ভেবেছিলেন যে, পূর্ব বাঙলায় একটা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে এই অবস্থার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটবে। কিন্তু তাদের সে আশা ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতা উদ্ভূত বিক্ষোভই আহমদ ছফার প্রবন্ধের ছত্রে ছত্রে। তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন রাষ্ট্রে এই ভাড়াখাটা সংস্কৃতিসেবীদের স্বদেশ প্রেম ও আত্মপ্রেম ন্যাক্কারজনকভাবে একাকার হতে দেখে তিনি অনেকখানি উত্তেজিত হয়েই এই সংকলনে স্থানপ্রাপ্ত প্রবন্ধগুলি রচনা করেছেন।

কিন্তু একটি জিনিশ এখানে উল্লেখ না করলে এই ভূমিকা বহুলাংশে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কথাটি হলোঃ মধ্যশ্রেণীভূক্ত হোমরা-চোমরা ব্যক্তিদের এবং তরুণ ও ছাত্র সম্প্রদায়ের এক ব্যাপক অংশের উপরোক্ত চরিত্র লক্ষণসমূহকে একেবারে সার্বজনীন মনে করা আজকের এই বাঙলাদেশেও অসঙ্গত। আমরা জানি আমাদের দেশের হাজার হাজার মধ্যশ্রেণীভূক্ত যুবক ও ছাত্র কিভাবে স্বদেশকে ভালবেসে, স্বদেশের স্বাধীনতা ও স্বাধিকারকে অর্জন ও সমুন্নত রাখার জন্যে সবকিছু বিসর্জন দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত থেকেছেন, প্রয়োজনে তা বিসর্জন দিয়েছেন। একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও তারা নিজেদের আত্মসম্মান বিসর্জন দেননি। মধ্যশ্রেণীভূক্ত এই তরুণদের মধ্যে আজ অনেকেই নতুনভাবে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামকে সংগঠিত করার কাজে নিজেদেরকে উৎসর্গ করতে উন্মুখ । অনেকে একাজে ইতিমধ্যেই নিযুক্ত। যে কোন দেশেই বিপ্লবের প্রাথমিক স্তরে শ্রমিক কৃষকের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চেতনাকে উচ্চস্তরে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এঁদের ভূমিকা অনস্বীকার্য । শুধু তাই নয়। এঁদের এই প্রাথমিক ভূমিকা ব্যতীত কোন দেশে আজ পর্যন্ত কোন বিপ্লব উপযুক্তভাবে সংগঠিত ও সফল হয় নি।

বাঙলাদেশে আজ সাহিত্য ও কাব্যচর্চা এবং সংস্কৃতি ক্ষেত্রে ওপর তলায় সুবিধাবাদের যে নৈরাজ্য দেখা দিচ্ছে সেটা ওপর তলারই ব্যাপার। সামগ্রিক বিচারে তার গুরুত্ব তেমন বেশি নয়। রাজনৈতিক সংগ্রামের তুফানে এই সমস্ত সংস্কৃতি সেবীরা অতীতের মতো ভবিষ্যতেও খড় কুটোর মতো উড়ে যাবে। তাই আজ ওপর তলার এই সমস্ত ভাড়াখাটা সংস্কৃতি সেবীদের সমালোচনার প্রয়োজন অনস্বীকার্য হলেও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সমালোচনা এবং সংস্কৃতি চর্চার মূল উদ্দেশ্য হতে হবে, যে সমস্ত নূতন ও তরুণরা সম্পত্তি সংগ্রহের ঝোঁক অতিক্রম করে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গীতে সংস্কৃতি চর্চা করতে, রাজনীতি সংগঠিত করতে এগিয়ে আসছেন তাঁদের সহায়তা করা। তাঁদের উম্মেষ ও কর্মক্ষেত্রকে সাহায্য ও প্রসারিত করা ।

আহমদ ছফাও তাঁর এই সংকলনটির শেষে এই ধরনেরই একটা কথা বলেছেন। আশা করা যায় তিনি তার ভবিষ্যৎ রচনা সমূহের মধ্যে শ্রেণীভূক্ত প্রগতিশীল লেখকদের কর্মকাণ্ডের প্রতিই নিজের দৃষ্টিকে অধিকতরো নিবন্ধ রাখবেন।

বদরুদ্দীন উমর
৩/১২/৭২

.

লেখকের কথা

আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যখন রক্ত দিয়েই চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছি। চারদিকে এতো অন্যায়, অবিচার এতো মূঢ়তা এবং কাপুরুষতা ওঁৎ পেতে আছে যে। এ ধরনের পরিবেশে নিতান্ত সহজে বোঝা যায় এমন সহজ কথাও চেঁচিয়ে না বললে কেউ কানে তোলেনা। এই স্বল্প পরিসর গ্রন্থে যা বলেছি সব আমার কথা নয়। হামেশাই যা আলোচিত হতে শুনেছি তাই-ই একটু জোর দিয়ে সাজিয়ে গুজিয়ে বলবার চেষ্টা করেছি। তাও সবসময় পেরেছি তেমন দাবী করতে পারবো না। সৎসাহসকে অনেকে জ্যাঠামী এবং হঠকারিতা বলে মনে করে থাকেন, কিন্তু আমি মনে করি সৎসাহস হলো অনেক দূরবর্তী সম্ভাবনা যথাযথভাবে দেখতে পারার ক্ষমতা। এই ক্ষুদ্র গ্রন্থের যাবতীয় তত্ত্ব এবং তথ্য আমি কোথাও না কোথাও থেকে আহরণ করেছি, কেবল উচ্চকণ্ঠে উচ্চারণ করার সাহসটুকুই আমার ব্যক্তিগত বিনিয়োগ। দৈনিক গণকণ্ঠে যখন লেখাটা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিলো অনেকে প্রশংসা করেছেন, অনেকে নিন্দা করেছেন! নিন্দা প্রশংসার প্রত্যক্ষ কারণ বলে যা মনে করি, অসংকোচে আমাদের সংস্কৃতির কতিপয় প্রখ্যাত অমানুষের নাম সাকিন উল্লেখ করতে পেরেছিলাম। কুৎসার প্রতি মানব সাধারণের মমতা তো সুবিদিত। বই আকারে বের করার সময় নামগুলো ছেটে দিলাম। সুযোগ সন্ধানীরা অল্প বিস্তর চিরকাল থাকে। মোটাবুদ্ধি, ভোঁতা অনুভূতি, পুরো চামড়াই তাদের টিকে থাকার মূলধন। তার বাইরেও দেশের মানুষের হয়ে, অকৃত্রিমভাবে কিছু অনুভব করতে চেষ্টা করেছি। কবি আল-মাহমুদ ব্যক্তিগতভাবে যত্ন নিয়ে লেখাটা দৈনিক ‘গণকণ্ঠে’র জন্য আমাকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন, তার কাছে এবং ‘গণকণ্ঠে’র বন্ধুদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ । শ্রদ্ধেয় বদরুদ্দীন উমর সদয় হয়ে ভূমিকা লিখে দিয়েছেন। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে বইটি বের করতে হয়েছে এবং আমি একেবারে আনাড়ি প্রুফ রিডার বলে অনেকগুলো মারাত্মক মুদ্রণ প্রমাদ রয়ে গেলো।

বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস

বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাঙলাদেশের সমাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না।

আগে বৃদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানী ছিলেন, বিশ্বাসের কারণে নয়-প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালী হয়েছেন-সেও ঠেলায় পড়ে। কলাবরেটরদের মধ্যে এমন অনেকে আছে, যারা অন্ধভাবে হলেও ইসলাম পাকিস্তান ইত্যাদিতে সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে। আবার স্বাধীন বাঙলাদেশে চতুঃস্তম্ভের জয়ধ্বনি দিচ্ছেন, এমন অনেক বুদ্ধিজীবী রয়েছেন, যারা সারা জীবন কোনো কিছুতে যদি নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতে পেরেছেন-সে বস্তুটির নাম সুবিধাবাদ।

মামুলীভাবে বলা হয়ে থাকে, বুদ্ধিজীবীরা তো সুবিধাবাদীই। সুতরাং তাদের কোন কর্ম নিয়ে হৈ চৈ করা পণ্ডশ্রম। সুবিধাবাদই বুদ্ধিজীবীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কথাটা যদি সর্বাংশে সত্য হয়ে থাকে, তা হলে ধরে নিতে হবে সমাজে ন্যায়-অন্যায়, ভালোমন্দ, সত্যি-মিথ্যে উচিত-অনুচিতের মধ্যে কোনোও প্রভেদ নেই।

একটা সমাজের একটা বিরাট পরিবর্তনের পূর্বাহ্নে বুদ্ধিজীবীদের কি ভূমিকা গ্রহণ করা উচিত? বাঙলাদেশের আজকের যারা নামকরা বুদ্ধিজীবী, তারা কি আদৌ তাদের ভূমিকা পালন করেছিলেন? প্রমাণ হাতের কাছেই রয়েছে। বাঙলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা কিছু কিছু পোষাকী ভূমিকা পালন করেছেন, এ কথা স্বীকার করতেই হবে। যেমন রবীন্দ্র সঙ্গীত, রবীন্দ্র সাহিত্যের ওপর হামলা, বর্ণমালা সংস্কার প্রচেষ্টার প্রশ্নে বাঙলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা এককাট্টা হয়ে সামরিক সরকারের আরোপিত সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। এটা একদিক-এ দিকটাকে আমরা পোষাকী বলেছি। কারণ জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এতো অধিক হারে প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছিলেন, বুদ্ধিজীবীদের চুপ করে থাকার কোন উপায় ছিলো না। তারা প্রতিবাদ করেছেন, কিন্তু প্রতিবাদ করার কারণে দুয়েকজন ব্যতিক্রম ছাড়া কাউকে চাকুরী হারাতে হয়েছে অথবা জেলে যেতে হয়েছে এমন কোনো মানুষের নাম আজও জানার সৌভাগ্য হয়নি। অথচ শিল্প, সংস্কৃতি এবং সমাজের এমন অনেক গভীর, বিকট হাঁ করা প্রশ্ন ছিলো, যে সকল বিষয়ে একজন কি দু’জন ব্যতীত কোন প্রতিষ্ঠাবান বুদ্ধিজীবীই উচ্চবাচ্য করেননি। কেন এমন হলো; জবাবে সেই প্রথম কথাই এসে পড়ে। বুদ্ধিজীবীরা সুবিধাবাদী, ঝড়-ঝঞ্জা, বিপদ-আপদ এড়িয়ে চলাই স্বভাব । তাদের নিষ্ক্রিয়তার জন্যে দোষ দিয়ে লাভ নেই । সচরাচর এমনই হয়ে থাকে।

সেই সময়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কি রকম ছিলো? খুব বেশি কথা নয় স্মৃতিতে এখনো তাজা রয়েছে। সামরিক সরকার গণতান্ত্রিক অধিকার কালো থলিতে পুরেছে, প্রতিদিন ধর পাকড় চলেছে, প্রতি মাসে গুলি চলেছে, প্রতি বছরেই জনগণের রুদ্ররোষ উথলে উথলে উঠেছে। এ সবের মধ্যে আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা কোন জাতীয় সম্ভাবনা আঁচ করতে পারেন নি। বাঙলাদেশ যে স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াবে, আমাদের কোনো সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের কল্পনায় আভাসিত হয়নি। দু’যুগ, এক যুগ, ছ’যুগ, দু’বছর এমনকি এক বছর আগের লেখা কোনো বইতে বাঙলাদেশ যে স্বাধীন হতে পারবে, তার ছিটেফোঁটা উল্লেখও দেখতে পাচ্ছিনে।

বাঙলাদেশের জনগণই বাঙলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি। ঘটনা ঘটেছে ঘটনার নিয়মে। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তার কোনো তীক্ষ্ণ প্রতিক্রিয়া হয়নি। বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সগ্রামে বুদ্ধিজীবীদের দানই নগণ্য। বলতে গেলে বুদ্ধিজীবীদের সচেতন দিক নির্দেশনা ব্যতিরেকেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছে। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে একটা কথা আছে না, বাঙলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ক্ষেত্রে তা আরো একবার সত্যে পরিণত হয়েছে। আসল ঘটনা ঘটে যাবার পর সকলে আপনাপন গর্ত থেকে শেয়ালের মতো বেরিয়ে সমস্বরে জয়ধ্বনি তুলছেন। চিন্তাশীলতার লক্ষণই তো হলো সমাজের নানামুখী স্রোতের গতিধারা অনুধাবন করে একটা সামঞ্জস্য বিধান করার প্রচেষ্টা। বাঙ্গালী জনগণের চেতনার ঘনত্ব অনুধাবন করতে বাঙলাদেশের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবৃন্দ কি সত্যি সত্যি অক্ষম ছিলেন? যদি তা না হয় গোটা বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে এমন একটি অভূতপূর্ব ঘটনা অনতিবিলম্বে ঘটতে যাচ্ছে, অন্ততঃ তার জলছবিটিও কোনো সাংস্কৃতিক প্রয়াসের মধ্যে ছায়াপাত করলো না কেনো? ঘটনা ঘটলে তারপর চিন্তা করতে বসবে–সকলের ক্ষেত্রে এ কেমন করে সত্য হয়? আমাদের দেশে আগাম চিন্তা করতে পারে এমন কোন মানুষ কি ছিলোই না? সংস্কৃতি বাস্তব রাজনীতিকে পথ দেখিয়ে থাকেথ-তা কি আমাদের দেশে মিথ্যে হয়ে গেলো?

এই সকল বিষয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চিন্তা করার সময় এসেছে। কেননা, চিন্তা কাজের সূক্ষ শরীর। আমাদের সমাজ একটি পরিবর্তনের মুখোমুখী এসে দাঁড়িয়েছে। সমাজের খোল নলচে দুই-ই বদলে নতুন সমাজ সৃজন করার জোরালো দাবী সমাজের মর্মমূল থেকেই তীব্রবেগে স্কুরিত হয়েছে। এই সৃজন প্রক্রিয়াতে বেগ এবং পূর্ণাঙ্গতা দান করতে হলে, রাজনীতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাত্রেও প্রয়োজন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

বাঙলাদেশের মানুষ সমৃদ্ধিশালী, সুখী একটি মানব সমাজ, একটি তৃপ্তি ধারার সভ্যতা নির্মান একটি বলবন্ত ফলবন্ত সংস্কৃতির অধিকারী হওয়ার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ । এই নতুন সমাজের দুটি দিক। এক রাজনীতি, দুই সংস্কৃতি। একে অপরের পরিপূরক। একে অপরের থেকে চলার পথের গতি এবং প্রাণরস আহরণ করে। রাজনীতিতে যেমন, তেমনি সাংস্কৃতিক সংগ্রামের প্রথম ধাপ হলো অতীতের সংস্কৃতি প্রবাহ বিচার বিশ্লেষণ করে তার হাঁ ও না’এর দিক চিহ্নিত করা এবং প্রাণের ইশারাটুকুতে গতিময়তা দান করা।

বাঙলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা অতীতে তাদের সামাজিক ভূমিকা যথাযথ পালন করতে পারেননি। একথা সত্যি। সেজন্য তাদের এক তরফা দোষারোপ করলে কোনো লাভ হওয়ার কথা নয়। কোনো সমাজে কোনো বিশেষ ব্যক্তি যদি তার সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে না পারেন তার জন্য সে ব্যক্তি এবং সে সমাজ উভয়েই দায়ী। কারণ, ধরে নিতে হবে সে সমাজের এমন কোনো ক্ষমতা নেই, যার বলে ব্যক্তিকে দায়িত্ব পালনে বাধ্য করতে পারে অথবা ব্যক্তির মনে এমন অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করতে অপারগ, যার ফলে ব্যক্তি আপনা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে সামাজিক দায়িত্ব পালন করে। বাঙলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা প্রাক-স্বাধীনতা কালে তাদের সামাজিক দায়িত্ব পালন করেন নিতা অত্যন্ত নিন্দনীয়; কিন্তু কেন পারেননি, কারণগুলো নির্মোহভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে ।

.

পাকিস্তান আমলের গোড়া থেকেই শুরু করা যাক। পাকিস্তান হওয়ার পরপরই এদেশে একটা সাংস্কৃতিক ‘এলিট শ্রেণী সৃষ্টি হতে থাকে। দুনিয়ার বুকে পাকিস্তান একটা বিসংগত রাষ্ট্র-এই রাষ্ট্রের সরকারী দর্শনও বিসংগত। ইসলাম, মুসলিম জাতীয়তা, ইসলামী রাষ্ট্র এসব গালভরা মনোহর মিথ্যে বুলিই ছিলো পাকিস্তানবাদী বুদ্ধিজীবীদের অত্যন্ত আদরের জিনিস। তারা এসব কপচাতেন এ কারণে নয় যে, সত্যি সত্যি এগুলোর প্রতি কোন মমতা ছিলো–কিংবা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতেন। রাষ্ট্রীয় দর্শন আওড়ালে, প্রশংসা করলে পয়সা পাওয়া যেতো। তাই তাঁরা দরাজ গলায় অমন একনিষ্ঠভাবে রাষ্টীয় দর্শনের গুণ বাখান করতেন। গল্প, উপন্যাস, কাব্য, ইতিহাস এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ শ্রেণী থেকে প্রাইমারী স্কুলের নিম্নতম শ্রেণীর পাঠ্য পুস্ত ক পর্যন্ত তাদের পক্ষাঘাতদুষ্ট মনোভঙ্গীর অক্ষয় রাজত্ব। প্রতিবাদ করার কেউ ছিলো না। প্রতিবাদ করলে উপোষ করতে হতো, প্রতিবাদ করলে জেলে যেতে হতো। শুধুমাত্র রাষ্টীয় দর্শনকে সত্য প্রতিপন্ন করার জন্যে অনেক খ্যাতনামা পণ্ডিত ব্যক্তি এবং বিদগ্ধ জন কতো আকাজ কুকাজ করেছেন একটা দৃষ্টান্ত দিলেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে। বাঙলা সাহিত্যের একটি ইতিহাস লেখা হয়েছিলো এবং ইতিহাসটি ছাত্র ছাত্রীদের এখনো পড়ানো হয়। তাতে অনেক স্থলেই প্রকৃত ইতিহাসকে হত্যা করা হয়েছে। সবচে’ আশ্চর্যের হলো ইতিহাসকারদ্বয় জেনেশুনেই সত্যকে হত্যা করেছেন। বর্তমান সময়ে বইটির নতুন সংস্করণ প্রকাশ করার ইচ্ছে গ্রন্থকারদের থাকার কথা নয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তো বইটি পাঠ্য করার কোনো প্রশ্নই উঠেনা। পাকিস্তান সৃষ্টির গোড়ার দিকে ইসলামী রাষ্ট্র নামের ব্যঞ্জনায় কেউ মোহিত হয়ে, কেউ বাধ্য হয়ে, কেউ প্রতিপত্তির কারণে, কেউ লোভে পড়ে, রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির একটি পরিমণ্ডল সৃষ্টি করেছিলো। এই রকম একটা আবহাওয়া পাকিস্তানবাদী বুদ্ধিজীবীরা সৃষ্টি করেছিলো বলেই পশ্চিমারা অতো সহজে কোনো রকমের আগ পাছ চিন্তা না করে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালিয়ে দেবার দুঃসাহস করেছিলো। তার ফল অজানা নয় কারো । যা বিনা কথাতে পাওয়া উচিত, তার জন্য রক্ত দিতে হলো। শুরু থেকেই একটা জিনিশ পরিষ্কার আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমাদের দেশের জনসাধারণ ভুল করেননি এবং খুব কমই বিভ্রান্ত হয়েছেন। যখনই কোনো সরকারী সিদ্ধান্ত তাদের স্বার্থের এবং বাস্তব জীবন ধারার বিপক্ষে গেছে তারা কোমর বেঁধে পৌরুষের সাথে প্রতিবাদ করেছেন। জনগণের চিন্তাধারায় অগ্রসরমানতা এবং পরিচ্ছন্নতা দেয়ার মতো কোনো সাংস্কৃতিক প্রয়াস হয়নি বললেই চলে। এখানে একটা কথা বলে দেয়া প্রয়োজন। ভাষার প্রশ্নে আমাদের দেশের কোনো পণ্ডিত বাঙলা ভাষার স্বপক্ষে মতামত রেখেছিলেন, কিন্তু তা এত ক্ষীণ অস্পষ্ট এবং সংশয়াচ্ছন্ন যে, জনগণের মধ্যে তার খুব সামান্যই প্রতিক্রিয়া হয়েছে। সুতরাং যা ঘটবার ঘটে গেলো। ছাত্র তরুণেরা প্রাণ দিলো–দেশে আগুন জ্বলে উঠলো। আর কবি সাহিত্যিকেরা শোক সভায় সভাপতির আসন দখল করলেন প্রবন্ধে-কবিতায় এক কলসী করে অশ্রু বিসর্জন করলেন।

উনিশশো বাহান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারীর ভাষা আন্দোলনের পর পর এ দেশের সংস্কৃতির একটা পট পরিবর্তন আসন্ন হয়ে উঠেছিলো। এই সময়ে আমরা অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কতিপয় স্পর্ধিত তরুণের আবির্ভাব লক্ষ্য করি। তাদের দেখবার চোখ, চিন্তা করার ভঙ্গী, বিচার করার পদ্ধতি পাকিস্তানবাদী বুদ্ধিজীবী ও শিল্প সাহিত্যের মুরুব্বীদের চাইতে সম্পূর্ণ আলাদা। ধর্মের জং ধরা খোলস প্রাণশক্তির তোড়ে ফাটিয়ে ফেলার যে স্পর্ধিত স্পৃহা তাদের মধ্যে দেখা গেছে তা প্রশংসা করার মতো। কিন্তু ঝিলিক দেয়াটাই সার। আজকের দিনে বাঙলাদেশের শিল্প সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, তাদেরকে পরিণত চিন্তার অধিকারী এবং স্থিতধী দিকদ্রষ্টা হিসেবে দেখতে পাওয়াটা খুবই প্রত্যাশিত ছিলো। কিন্তু বাস্তবের সংঘাতে জাতির সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বাঙলাদেশে সংস্কৃতির যে নতুন সম্ভাবনা মূর্ত হয়ে উঠেছিলো, যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গেই তার গতিবেগ মন্দা হয়ে আসে। সে সুবাদে পাকিস্তানের প্রবক্তা বুদ্ধিজীবীরা, শিল্পী-সাহিত্যিকবৃন্দ তাদের টলটলায়মান আসনগুলোতে নড়েচড়ে শক্ত হয়ে জেঁকে বসেন। গোটা বাঙলাদেশে তারা অর্ধ বর্বরসুলভ চিন্তাচেতনা চাপিয়ে দিতে থাকলেন। এ ব্যাপারে সে সময়কার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকেও দায়ী না করে উপায় নেই। রাজনীতির উত্থান-পতনে, জয়পরাজয়ে সংস্কৃতির যে কোনো ভূমিকা থাকতে পারে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আদপেই সে ব্যাপারে কোনো ধারণা ছিলো মনে হয় না। রাজনৈতিক দলগুলোর সাধারণ কর্মীদের সাংস্কৃতিক চেতনাহীনতা, ইতিহাস ভূগোলের জ্ঞানের অভাবের দরুণ তারা নেতৃমোহে তাড়িত হয়েছেন এবং নেতারা ডন কুইকসোটে পরিণত হয়েছিলেন। একটি সমাজে সর্বাঙ্গীন গতির নাম রাজনীতি এবং সংস্কৃতি রাজনীতির রস রক্ত, এই বোধে কোন রাজনৈতিক দল কিংবা লোকমান্য নেতার মন সিঞ্চিত হয়েছে, তেমন কোন দল বা ব্যক্তিত্বের নাম আজো জানা হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কৃতি বিমুখতা, কর্মীদের চেতনাহীনতা, সংস্কৃতি এবং রাজনীতিকে দুটি আলাদা আলাদা ক্ষেত্র বলে চিহ্নিত করলো । ফরাসী লেখক আলফাস দোঁদের একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে। ফরাসীরা যুদ্ধে মার খেয়েছে, গল্পের নায়ক খুবই আশাহত হয়ে পড়েছে, আরেকজন তাকে উপদেশ দিচ্ছে ফরাসী সাহিত্য পড়ার। তার মানে ফরাসী সাহিত্যের মধ্যে এমন কিছু প্রাণদায়িনী উপকরণ রয়েছে, যার প্রভাবে নায়ক যুদ্ধে পরাজয়ের হতাশা কাটিয়ে উঠতে পারবে। পুরোপুরি না হোক,

আংশিকভাবেও যদি আমাদের জাতি এই মনোভঙ্গী আয়ত্ব করতে না পারে, তাহলে বলতে হয় আমাদের বর্বর-দশা এখনো কাটেনি। ভাষা আন্দোলনের পরে বাঙ্গালী সংস্কৃতির চর্চা হতো পোকায় কাটা প্রাচীন কাব্য অনুগত ছাত্রদের ফিসফিস করে পড়ানোর মধ্যে, অবসরভোগী চাকুরেদের অলস বিশ্রাম্ভালাপে, মেদবহুল বাঙলার অধ্যাপকের রেডিও টকের বাগবিস্তারে এবং রবীন্দ্রবিলাসী মহিলাদের পূর্ণিমা বাসর রচনায়। কখনো কখনো দুয়েকটি ব্যতিক্রমী পত্র পত্রিকা চোখে পড়তো। গোটা দেশের বিচারে তা আর কতো।

রাজনীতি আর সংস্কৃতি আলাদা হয়ে পড়লেও বাঙলাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতি এমনভাবে প্রাণ স্পন্দনহীন হয়ে থাকার কথা ছিলো না। যেটুকু প্রাণের লক্ষণ ছিলো মার্কিন ডলার একেবারে থেতলে দিয়ে গেলো। মার্কিন দূতাবাস বাঙলাদেশের অধ্যাপক, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিকদের চড়া দাম দিয়ে কিনে নিয়ে গেলো। যে লেখক একটা গল্পের বই কিংবা উপন্যাস প্রকাশ করে বছরে দু’শো টাকা আয় করবার ভরসা করতে পারতেন না, সেই একই লেখক মার্কিন বইয়ের সের মাপা অনুবাদ করে মাসে আড়াই হাজার কামাতে লাগলেন। মার্কিন দূতাবাস বেছে বেছে সমাজতন্ত্রীদের বিরোধী প্রোপাগাণ্ডা বই-ই অনুবাদ করাতো। এ পর্যন্ত মার্কিনীরা হাজার হাজার বই অনুবাদ করিয়েছে। তার মধ্যে আঙ্গুলে গুণে বলা যাবে–কটি সৎ সাহিত্য। সে কটিও অনুবাদ করিয়েছে পাছে লোকে মনে করে মার্কিনীরা কেবল প্রোপাগাণ্ডাই অনুবাদ করায়। বাঙলাদেশের যে সমস্ত কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং সমালোচকের নাম এখন হামেশা শোনা যায়, তাদের শতকরা আশি ভাগই মার্কিনী প্রচারের অনুবাদ করেছেন। এটা খুবই দুঃখের কথা যে আমাদের সংস্কৃতির যারা শ্রদ্ধেয় লোক বলে খ্যাত অনেকেই মার্কিনী অর্থের বিনিময়ে মানসিক দাসত্ব করেছেন এবং তা আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতি ও গণ সংগ্রামের বিপক্ষে গেছে। আমেরিকান দূতাবাসের সহজ টাকা না পেলে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা মানসিক সগ্রামে প্রবৃত্ত হতেন। তা আমাদের শিল্প-সাহিত্যে নতুন সম্ভাবনার ক্ষেত্র উম্মোচন করতো। আর অনূদিত বইগুলো মার্কিনীরা জ্ঞান বিতরণের ছল করে স্কুলে-কলেজে এবং সাধারণ পাঠাগারসমূহে বিনামূল্যে অথবা নামমাত্র মূল্যে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমাদের গণ সংগ্রাম বিরোধী বই অধিক পাঠের ফলে আমাদের জনগণের চেতনা, চিন্তা বিভ্রান্ত ও বিপথগামী হয়েছে।

তালিকা যদি ক্ষুদ্র হতো নাম উল্লেখ করতামঃ কোন্ খ্যতনামা কবি, কোন্ নামী অধ্যাপক আমেরিকার টাকায় দেশের বিরোধিতা করলেন! কোনো রকমের দ্বিধা না করেই বলে দেয়া যায়, দু’চারজন বাদে আজকের বাঙলাদেশের নামকরা শিক্ষক সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের বেশীর ভাগই জীবনের একসময়ে না এক সময়ে মার্কিন প্রচার অনুবাদ করেছেন। এমন নজীর আমাদের আছে, কেউ কেউ দুর্নামের ভয়ে নিজের নামের বদলে মেয়ের স্বামী, ছেটো ভাই এবং অর্ধাঙ্গিনীর নাম পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন।

বাঙলাদেশের রাজনৈতিক দল এবং নেতৃবৃন্দের দৃষ্টির সঙ্কীর্ণতা ও দূরদর্শীতার অভাবের দরুণ ধীরে ধীরে সংস্কৃতি এবং রাজনীতি একে অপরের পরিপূরক না হয়ে দুটি আলাদা জলঅচল কুঠুরীতে পরিণত হলো। রাজনীতি হলো মানুষ ফাঁকি দিয়ে ভোটে জেতা, ক্ষমতা দখলের অস্ত্র আর সংস্কৃতি সম্পূর্ণরূপে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মাষ্টারদের, উড়নচণ্ডী কবি সাহিত্যিকদের বিলাসের, চিত্তবিনোদনের উপায় হয়ে দেখা দিলো। এই সময়ে জঙ্গীলাট আয়ুব খান ক্ষমতা দখল করলেন।

তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দিয়ে মৌলিক গণতন্ত্রী শ্রেণী সৃষ্টি করলেন, সৃষ্টি করলেন আমলা এবং টাউট শ্ৰেণী। আয়ুবের সিংহাসন ধরে ঝুলে থাকা এই শ্রেণী সমূহের পাশাপাশি বুদ্ধিজীবীদেরও একটা শ্রেণী একনায়ক নিজের প্রয়োজনে সৃষ্টি করে নিলেন। আয়ুব খানের রাজত্বে বুদ্ধিজীবীরা একটা আলাদা শ্রেণী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। সামাজিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বুদ্ধিজীবীরা সম্পূর্ণ একটা শ্রেণী হিসেবে মাথা তুলেছে তা নয়-জঙ্গীলাট নিজের প্রয়োজনে বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ে কারবার করেন এমন মানুষদের মধ্যে মাথামোটাদের বেছে নিয়ে আলাদা একটা শ্রেণী দাঁড় করালেন।

শিক্ষকদের মধ্যে, সাংবাদিকদের মধ্যে, সাহিত্যিকদের মধ্যে তিনি সুবিধাভোগী কতিপয় মানুষ বাছাই করলেন। তাঁদের বাড়ী, গাড়ী, অধিক মাইনে, বিদেশ ভ্রমণ এবং পারিতোষিকের সুযোগ-সুবিধে করে দিলেন। হিসেব করলে দেখা যাবে, যে সময়ে দেশের সাধারণ মানুষের অবস্থা নিকৃষ্টতম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, সেই সময়েই এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী অঢেল সরকারী সুযোগ সুবিধা হাতিয়ে রাতারাতি চেকনাইওয়ালা হয়ে উঠেছেন। আয়ুব রাজত্বে দুর্নীতিবাজ মৌলিক গণতন্ত্রী দেশের জনগণের স্বার্থের বিনিময়ে পোষা যেমন রেয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, তেমনি এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের পুষে সাংস্কৃতিক উজ্জীবন বন্ধ করাও একটা প্রথায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। সাংবাদিকতা, সাহিত্য এবং শিক্ষকতার ক্ষেত্রে আয়ুব খান এমন কতিপয় চেকন-মোটা পদ্ধতি অবলম্বন করলেন, যার ফলে অধিকাংশ চক্ষুষ্মন ব্যক্তি চড়া দামে আত্ম বিক্রয় করতে বাধ্য অথবা প্রলুব্ধ হলেন।

সাংবাদিকতার কথাই ধরা যাক। সাংবাদিকদের টাকা দিয়ে হাত করার জন্যে আয়ুব খান প্রেস ট্রাস্ট, ফিচার সিণ্ডিকেট ইত্যাদির জন্ম দিলেন। অন্যান্য দৈনিক কাগজে যে পরিমাণ মাইনে দেয়া হয়, তার দুগুণ তিনগুণ মাইনে প্রেস ট্রাস্টের পত্রিকার কর্মচারীদের দিতে থাকলেন। জঙ্গীলাট বেশী মাইনে দিতে রাজী হয়েছিলেন এ কারণে যে, টাকা দিয়ে তিনি ধারালো কলমগুলো কিনে নিতে পারবেন। দেশের মানুষের আস্থা ছিলো যাদের সাংবাদিক সততায়, যারা লেখক এবং কবি হিসেবে, বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে সমাজের শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন, তারাই কিনা হয়ে গেলেন আয়ুব খানের মিলিটারী গেজেটের কেরানী। সেদিন অধিক পয়সার লোভে যারা আয়ুব খানের দালালী করেছিলেন, আয়ুব খানের আয়ুবনামা অনুবাদ করেছিলেন, তারা আজ কি করে, কিসের বলে স্বাধীন বাঙলাদেশে রাতারাতি মস্ত দেশপ্রেমিকে পরিণত হলেন ভাববার বিষয়। একটা কথা বললে শত্রুতার মতো শোনাবে–কিন্তু আসলে সত্যি। প্রেস ট্রাস্টের একটি বাঙলা পত্রিকা জটিল এবং সূক্ষ পদ্ধতিতে বাঙলাদেশের কবি সাহিত্যিকদের বুদ্ধিবৃত্তিক সতোর যে ক্ষতি করেছে, তার জুড়ি নেই। প্রেস ট্রাস্টের অপর পত্রিকাটিও ক্ষতি করেছে। কিন্তু ইংরেজী হওয়ায় বাঙলাদেশের সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার অল্প সুযোগই পেয়েছে সে তুলনায়। বাঙলা পত্রিকাটিতে অধিক মাইনের লোভে এমন কতিপয় লোক আয়ুব রাজত্বের শুরুর দিকে আত্মবিক্রয় করলেন, যারা সুন্দর বাঙলা লিখতে পারেন, সাংবাদিকতায় যাদের হাত পেকেছে, কবি-গল্পকার-প্রাবন্ধিক এবং বামপন্থী রাজনীতি ঘেঁষা বলে যারা আগেই খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তরুণ অনতিপ্রবীণ, প্রবীণ সকলে আয়ুব খানের সামরিক গেজেটে যোগ দিয়ে একনায়কের জয়ধ্বনি করতে লাগলেন। তার ফল হলো, তরুণ এবং কিশোরেরা কোনো রকমের সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক নেতৃত্ব থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত হলেন। পত্রিকায় যে আকর্ষণীয় সাহিত্য বিভাগ চালু করা হয়েছিলো আসলে ওটা ছিলো সাহিত্যের কসাইখানা। কারণ সাহিত্যে জাতীয় অভাব অভিযোগের কথা, সামাজিক দুর্নীতির কথা আসা চাই-ই। কিন্তু দৈনিক পত্রিকাটি একটা পর্যায়ে বক্তব্যহীন কিন্তু রঙচঙে রচনাই ছাপতেন। দেশের অভাব অভিযোগের দিক থেকে তরুণদের দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখার জন্য এই মনোরম ফাঁদ পেতেছিলেন, তাতে করে ঐ পত্রিকার হোমড়া চোমড়া গোছের লোকেরা অপরাধ বোধ লাঘবের এক ধরণের আত্মতৃপ্তি বোধ করতেন।

আয়ুব খানের উদ্ভাবিত পদ্ধতি সৎ সাংবাদিকতাকে আরো নানা দিক দিয়ে ব্যাহত করেছে। বিশেষ করে পত্রিকাটির নাম করলাম এ কারণে যে, পত্রিকাটিতে আমাদের দেশের বেশ ক’জন প্রতিভাবান মানুষ চাকুরী নিয়েছিলেন। তাঁদের রচনা, রচনারীতি, চিন্তাধারা এবং প্রগতিশীল ভূমিকার প্রতি আমাদের দেশের জনগণ শ্রদ্ধান্বিত ছিলেন। কিন্তু তারা প্রতিভা এবং যোগ্যতা দিয়ে খান সাহেবের দালালীই করেছিলেন। প্রতিভাহীন ব্যক্তির ক্ষতি করার ক্ষমতা অল্প। প্রতিভাবান ব্যক্তি বুদ্ধি খাঁটিয়ে ইচ্ছে করলে খৈ খাওয়ার জন্য ধানের গোলায় আগুন লাগাতে পারে। পত্রিকাটির বেলায়ও তেমনটি হয়েছে।

অন্যান্য সাংবাদিকদেরও আয়ুব খান নানা পদ্ধতিতে উৎকোচ দিয়ে বশীভূত করেছেন। সাংবাদিকদের জন্য বাড়ী, জমি, গাড়ী এই সব কিছুর ব্যবস্থা আয়ুব রাজত্বেই হয়েছে। সাংবাদিকদের বাড়ী হবে না, গাড়ী থাকবে না–তেমন কথা বলা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। বলতে চাইছি আয়ুব রাজত্বে সাংবাদিকদের মধ্যে হঠাৎ এমন একটা গাড়ীওয়ালা, বাড়ীওয়ালা, পয়সাওয়ালা সাংবাদিক শ্রেণী গজিয়ে উঠলো–যাদের এই আকস্মিক সমৃদ্ধির কারণে জনগণের দুর্দশা বেড়েছে। যে সমাজে জনগণের মাথাপিছু আয় এক পয়সা বাড়েনা–সে সমাজে যদি সাংবাদিকেরা রাতারাতি বড়োলোক হয়ে উঠেন, তাহলে কথাটা কি এই দাঁড়ায় না–তারাও জনগণের ওপর শোষণের কাজে সাহায্য করে আসছেন। প্রেস ট্রাস্টের অন্তর্ভূক্ত সাংবাদিকদের নয় শুধু অনেক সময় চৌকষ বিরোধী দলীয় পত্রিকার সাংবাদিকদেরও পয়সা দিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে প্রতিবাদের ধার ভেঁতা করে দিয়েছিলো। মোট কথা আয়ুব রাজত্বে মুষ্টিমেয় সাংবাদিকদের নিয়ে একটা সুবিধাভোগী শ্রেণী পুরোপুরি সৃষ্টি হয়েছিলো। তারা আয়ুব খানের দালালী করেছেন, সৎ সাংবাদিকতার ক্ষতি করেছেন, প্রদেশের সংবাদপত্র শিল্পের প্রসারে পরোক্ষে বাধা দিয়েছেন এবং সংখ্যাধিক সাংবাদিকের মতামতের স্বাধীনতা এবং রুজী রোজগারের স্বাধীনতায় ছলে-বলে-কলে-কৌশলে হস্তক্ষেপ করার কাজে সামারিক সরকারের সহায়তা করেছেন। কারণ, যেভাবেই হোক না কেননা, যারা অত্যাচারী সামরিক সরকারের সহায়তা করেছেন এবং তা করে টাকাকড়ির মালিক হয়েছেন, তাঁরা যে গণতন্ত্র এবং দেশের মানুষের ক্ষতি করেছেন, তা আর নতুন করে বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। কেউ কেউ বলে থাকেন গোবেচারা শিক্ষকদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। বেচারারা অবস্থার শিকার । চমৎকার যুক্তি। কিন্তু এই গোবেচারারাই পেছনে একটা শক্ত খুঁটি পেলে করতে পারেন না হেন কর্ম নেই। গত তেইশ বছরের একটা হিসেব কষে দেখানো যেতে পারে। শিক্ষকেরা স্কুল কলেজ পাঠ্য টেক্সট বইতে কি পরিমাণ মিথ্যে লিখেছেন, প্রকৃত ঐতিহাসিক তথ্যের বিকৃতি কিভাবে সাধন করেছেন, কিভাবে জাতীয় চেতনার ধারাকে বিপথগামী করেছেন; তা অল্প কথায় শেষ করার নয়। সব শিক্ষক সম্পর্কে বলছিনে, যাদের সম্পর্কে বলছি, তাদের কাছ থেকে জাতি সুষ্ঠু কৃষ্টি-কালচার ভিত্তিক ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আশ্রয়ী শিক্ষা পদ্ধতি আশা করেছিলো। কিন্তু তারা তা করেননি এবং এই না করার জন্য লাভবান হয়েছেন।

আয়ুব খান শিক্ষকদের মধ্যেও একটা শ্রেণী গড়ে তুলেছিলেন। এই বিশেষ শ্ৰেণীটিকে নানা উপায়ে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে একান্ত অনুগত রেখেছিলেন। আমাদের দেশের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষক যেভাবে রাজার হালে থাকেন তার সঙ্গে আশেপাশের উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশের শিক্ষকদের বাস্তব অবস্থার তুলনা করে দেখলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। যেদেশে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকেরা একবেলা খেতে পাননা, বেসরকারী স্কুলের শিক্ষকেরা বেতন পান না, সে দেশে এক শ্রেণীর কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিভাবে বাড়ী-গাড়ীর মালিক হতে পারেন? বাড়ী থাকাটা খারাপ নয়, কিন্তু যে টাকা দিয়ে ওসব করা হয়েছে, সে টাকা অর্জনের পদ্ধতিটাই সামগ্রিকভাবে শিক্ষক সমাজ এবং দেশের জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী। সাধারণ অর্থে যাদের আমরা কলাবরেটর বলি এঁরা তা নন। এঁরা ভিন্নভাবে সামরিক সরকারের সহায়তা করেছেন। কলাবরেটর শিক্ষকদের সাক্ষাৎ প্লেগের সঙ্গে যদি তুলনা করা যায়, এই ধরণের শিক্ষকদের বলা উচিত ক্ষয় রোগ। এই রোগ দিনে দিনে একটু একটু করে জীবনী শক্তি ক্ষয় করে একদিন হৃদপিন্ড আক্রমণ করে বসে। এখনও এই শ্রেণীটির হাতেই শিক্ষার দায় পুরোপুরি ন্যস্ত রয়েছে।

.

কবি, সাহিত্যিক, লেখকেরা গর্ভিণী নারীর মতো। তারা জাতির গড়ে ওঠার, বেড়ে ওঠার বেঁচে থাকার জ্বণকণা অন্তর্লোকে ধারণ করে থাকেন। জাতীয় জীবনে যা ঘটে গেছে অতীতে, তাঁরা ভাবের আবেশে সামনের দিকে আঙ্গুলি নির্দেশ করে বলে ফেলেন– এই-ই হতে যাচ্ছে এবং এই-ই হবে। কিন্তু বাঙলাদেশের তেমন কবি, সাহিত্যিক, তেমন উপন্যাস লিখিয়ে কিংবা গাল্পিক কি আছেন? নেই। আমাদের যে ক’জন নামকরা কবি কিংবা সাহিত্যিক আছেন, তাঁদের বেশির ভাগের প্রতি মানুষ খুব শ্রদ্ধেয় মনোভাব পোষণ করে না। বাংলাদেশের আজকের দিনে লেখকেরা কবিরা সামাজিক দিক দিয়ে বোধ হয় সম্মানহীন জীব। তারা পত্রিকার রবিবাসরীয় সংখ্যার যোগানদার, রেডিও টেলিভিশনের অঙ্গসজ্জা এবং বিকৃত রুচিহীন নিরস পাঠ্যপুস্তক প্রণেতার অধিক কিছু নন। লেখক-কবি একটা জাতির সংগ্রাম, সাধনা চিত্তসম্পদ আবেগে ধারণ করেন এবং চেতনায় লালন করেন। কিন্তু বাঙলাদেশের লেখকদের ক্ষেত্রে তা সত্য হয়নি। বাঙলাদেশের লেখকেরা সামাজিক দায়িত্ব পালন করেননি–তাই সমাজও লেখককে শ্রদ্ধা করে না। সমাজে লেখকদের কোন ইমেজ নেই বললেই চলে।

অথচ বাহান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের পর পর দেশের জাগ্রতচিত্ত লেখক কবিদের প্রতি অত্যন্ত ভরসার দৃষ্টিতে তাকাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলো। গণতন্ত্রের অপঘাত মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সে প্রক্রিয়াটি গোড়াতেই বন্ধ হয়ে যায়। এই সুযোগে পাকিস্তানবাদী বুদ্ধিজীবীরাই সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ আসনগুলো অধিকার করে বসলেন। সরকারী আনুকুল্য পেয়ে তারা দেশের সংস্কৃতিকে বয় বেয়ারার মতো ইঙ্গিতে যে দিকে ইচ্ছে চালাতে লাগলেন। বাহান্ন সালের রক্ত থেকে যাদের জন্ম, সে সকল তরুণেরাও এসে সুযোগ সুবিধার জন্য এই পাকিস্তানবাদী সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে হাত মেলালেন। মোটের ওপর লেখার ব্যাপারটিই সুযোগ দেয়া এবং সুযোগ গ্রহণ করার কাজ হয়ে দাঁড়ালো। আয়ুব খান এসে এই সমস্ত নতুন পুরোনো লোকদের নিয়ে লেখক সংঘ বানালেন।

লেখক সংঘ মানে লেখকেরা কি ভাববেন, কি চিন্তা করবেন, কি লিখবেন, কিভাবে লিখবেন জঙ্গীলাট নির্দিষ্ট করে দেবেন। তিনি যা বলবেন–এঁরা তা লিখবেন। বিনিময়ে লেখকদের দেয়া হলো অঢেল সুযোগ-সুবিধা। তাদের জন্য আদমজী পুরস্কার, ঘন ঘন বিদেশ যাওয়া ইত্যাদির ব্যবস্থা করলেন। সেদিন বাঙলাদেশে একজন লেখকও লেখকের সুস্থ এবং স্বাধীন মননশীলতার বিরোধী এই প্রতিষ্ঠান স্থাপনের বিরুদ্ধে ট্যু শব্দটি করেননি। বরং সকলে বগল বাজিয়ে আপনা থেকেই এগিয়ে এসে অংশ গ্রহণ করেছেন। খ্যাতনামা পশ্চিমা দালালদের কথা বলে লাভ নেই। যারা কমিউনিস্ট, সর্বহারার আন্দোলনে বিশ্বাসী বলে পরিচিত ছিলেন, তাঁদেরও অনেককে দেখা গেছে ধনপতিদের হাত থেকে অর্থ পুরস্কার গ্রহণ করতে পেরে জীবন ধন্য মনে করেছেন। চিহ্নিত প্রতিক্রিয়াশীলরা তো প্রতিক্রিয়াশীল-সরকারের সহযোগীতা করতো সেটা জানা কথা। কিন্তু তথাকথিত প্রগতিশীল এবং কমিউনিস্টদেরও দেখা গেছে কার্যত জঙ্গীলাটের সহায়তা করতে। আদমজী পুরস্কার, দাউদ পুরস্কার, ন্যাশনাল ব্যাংক এবং হাবীব ব্যাংক পুরস্কার যারা গ্রহণ করেছেন, সে তালিকাটা আমাদের সামনে খোলা রয়েছে। তাতে এমন ক’জন মানুষের নাম রয়েছে, যাদেরকে এক শ্রেণীর মানুষ দেবতার মতো ভক্তি শ্রদ্ধা করেন। আজকের বাঙলাদেশের যে সকল খ্যাতিমান কবি-সাহিত্যিক আছেন, তাদের বেশির ভাগই একভাবে না একভাবে সামরিক সরকারের সহযোগিতা করেছেন। এঁদের সকলে কি আয়ুব খানের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেননি? শ্রমিকরাজ প্রতিষ্ঠার জন্য এঁদের কেউ কেউ জীবনপাত করেছেন বলে শোনা যায়–আদমজী, দাউদের দেয়া পুরস্কার গ্রহণ করে কোন শ্রেণীর রাজত্ব প্রতিষ্ঠার কথা তারা কামনা করেছিলেন? তাহলে দেখা যাচ্ছে বাঙলাদেশে সৎ-লেখক ও সৎ-বুদ্ধিজীবী ছিলেন না বললেই চলে। মুখে সর্বহারার রাজনীতি কিন্তু কাজের বেলায় বাঙ্গালী সংস্কৃতিরও বিরোধিতা করেছেন অনেকে।

বি, এন, আর-কে দোষ দেয়া হয়ে থাকে–দোষ দেয়া হয় শুধু হাসান জামানকেই। কিন্তু বি, এন, আর-এ যাননি কোন লেখক? সকলেই টাকা নিয়েছেন–আবার জনগণের সঙ্গে সুর মিলিয়ে সকলেই বি, এন, আর-এর গোষ্ঠী উদ্ধার করেছেন। চমৎকার রসিকতা। বাঙলাদেশের সমস্ত নামকরা কবি-সাহিত্যিক যারা সোনার বাঙলা নামে কেঁদে-কুটে বড় বড় পদ দখল করে বসেছেন–তাদের শতকরা নিরানব্বই ভাগই যে অকাণ্ড কুকাণ্ড করেছেন তার ভুরি ভুরি প্রমাণ হাজির করা যায়।

লেখক সংঘ, বি, এন, আর, রেডিও টেলিভিশন ইত্যাদির মাধ্যমে কতিপয় ব্যক্তি যে শুধু নষ্ট হয়েছে তা নয়–এ সবের মাধ্যমে আয়ুব খান একটি যুগের বিবেককে হত্যা করেছে, চিন্তাকে কলুষিত করেছে। তরুণ সমাজের সামনে শ্রদ্ধা করার মতো কোন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ছিলোনা–এখনো নেই। কাউকে শ্রদ্ধা করতে না পারা যে কতো বড়ো অভিশাপ একমাত্র ভূক্তভোগীই উপলব্ধি করতে পারেন। রেডিও, টেলিভিশন, লেখক সংঘ, প্রেট্রাস্ট ইত্যাদি আলাদা আলাদা প্রতিষ্ঠান হলেও এ সবের মধ্যে একটা যোগসূত্র ছিলো।

আমাদের কবি-সাহিত্যিকেরা আমাদের সমাজের সবচেয়ে নোংড়া মানুষ। তারা দেশকে যে হারে ফাঁকি দিয়েছেন কোনো কালোবাজারীর সঙ্গে তার তুলনা হয় না। তাঁদের ছদ্ম আদর্শবাদিতার সঙ্গে গণিকাদের সতীপনার তুলনা করা যায়। কে না জানে পাকিস্তান-ভারত যে যুদ্ধ হয়েছিলো তা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ! সেই যুদ্ধে অনেকটা আসোয়ান ড্যামের টাকা খরচ হয়েছিলো বলা হয়ে থাকে। এই আসোয়ান ড্যাম ভালো করে তৈরি করার টাকা ঋণ না পেয়ে প্রেসিডেন্ট নাসের রাতারাতি মার্কিন ব্লক থেকে সোভিয়েত ব্লকে চলে গিয়েছিলেন। এমনি একটা যুদ্ধকে নিন্দা করার মতো একজন কবি, একজন লেখক ছিলেন না। অথচ পশ্চিম বঙ্গে এই যুদ্ধের প্রতি সমর্থন দেননি বলে প্রায় আশিজন বুদ্ধিজীবীকে কারাবরণ করতে হয়েছিলো। আমাদের কবিরা, আমাদের লেখকেরা কি করেছেন? ভারতকে বাক্যবাণে হারিয়ে দেওয়ার জন্য কষে হিন্দু নিন্দা করেছেন। খুবই বুক ফুলিয়ে গদগদ ভাষায় বলেছেন, দুনিয়াতে মুসলমানেরাই আসল জাতি! ভাগ্যের কি পরিহাস, সে কবি-সাহিত্যিকেরা এখন ভারতীয় পণ্ডিতদের সার্টিফিকেট এনে বাঙলাদেশে আসন পোক্ত করার জন্য কোলকাতা ছুট দেন। আগে যে বইগুলো লিখেছেন কোন রকমে গুম করে ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ থেকে রু করেছেন–এবার অসাম্প্রদায়িকতার কেতাব লিখবেন।

বুঝতে কষ্ট হয় না আমাদের লেখকেরা কেন কল্পনা করতে পারেন নি, কেন স্বপ্ন দেখতে পারেন নি যে, বাঙলাদেশ দু’এক বছরে স্বাধীন হবে। কল্পনা করা এবং স্বপ্ন দেখাতো আসল মস্তিষ্কের কাজ। আমাদের তারা বাস্তব কাজে ব্যস্ত ছিলেন–সেটি টাকা রোজগারের কাজ তাও বাঙলাদেশকে বেচে দিয়ে। ভুল হয়ে গেছে। সুতরাং পত্র পাঠ ক্ষমা করে দিন। অসাম্প্রদায়িকতার জয়গান গেয়ে আরো দুয়েক দাও মারতে দিন। ধন্য বাঙলাদেশের লেখক।

.

বাঙলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা বাঙলাদেশের গণমুক্তি সংগ্রামে কি আবদান রেখেছেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে যে সকল কবি সাহিত্যিক কোলকাতা গিয়েছিলেন এবং ফিরে এসে মুক্তিসংগ্রামী হিসেবে সকলের সামনে পরিচয় দিয়ে থাকেন, তাদের সেখানকার কাজকর্মের ধারা সম্পর্কে কিঞ্চিত আলোকপাত করা প্রয়োজন। বাঙলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা কোলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ তথা সমগ্র ভারতের বুদ্ধিজীবীদের সামনে যে পরিচয় রেখে এসেছেন তা আমাদের জাতির চূড়ান্ত লজ্জা এবং কলঙ্কের বিষয়। সকলের সম্পর্কে বলছিনে। বেশির ভাগ বুদ্ধিজীবীই কে কার চাইতে লোভী এবং গবেট তা প্রমাণ করার জন্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন।

জাতির এতোবড়ো সংকটের মুহূর্তে কোলকাতা প্রবাসী কবি সাহিত্যিকেরা আমাদের শরণার্থী জনগণের সঙ্গে কোনোরকমের একাত্ম বোধ করার তাগিদ আদৌ অনুভব করেননি। তাদের বেশির ভাগের বক্তৃতায়, কথায়, লেখায় জনগণের সঙ্গে এক সারিতে নেমে আসার আবেগ বিকীরিত হয়নি। এই বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানী সৈন্যদের দখলদার বাঙলাদেশে থাকলে বেয়নেটের গুতোর চোটে এবং লোভের বশবতী হয়ে যে ভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন করতেন, একইভাবে বাঙলাদেশকে সমর্থন করেছেন। ঘটনাচক্রে তাদের কোলকাতা যেয়ে কয়েক মাস উদ্বেগে কাটাতে হয়েছিলো–মুক্তি সংগ্রামী বলে পরিচয় দেয়ার তাৎপর্য এটুকুই–বেশি কিছু নয়।

এই সময়ে বাঙলাদেশের জনগণ যারা পাকিস্তানী সৈন্যদের অত্যাচারে চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে, নিহত আত্মীয় পরিজনের স্মৃতি বুকে নিয়ে, সর্বহারা অবস্থায় ত্রিপুরা, মেঘালয় এবং পশ্চিম বাংলার নগর জনপদে জীবন্ত প্রেতের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিলো–ভারতীয় এবং বিদেশী সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক আর বিশ্বের মানববাদী মানুষ যাদের প্রাণ রক্ষা করার জন্যে পথে নেমে এসেছিলেন, বাঙলাদেশের লেখক-সাহিত্যিক কি তাদের এই দুর্গত অবস্থার প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে একটি কথাও বলতে পেরেছেন? দেখে শুনে আমাদের ধারণা হয়েছিলো, বাঙলাদেশের লেখক সাহিত্যিকদের হৃদপিণ্ডগুলো প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি। সেই সময়ে বিভিন্ন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের যে অসহনীয় অবস্থা ছিল তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। প্রতিদিন সীমান্ত পেরিয়ে মুক্তিযযাদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোতে হাজার হাজার স্বাধীনতা প্রেমিক কিশোর, যুবক এসে সমবেত হচ্ছেন। কিন্তু শিবিরে অতো লোককে স্থান দেবার ব্যবস্থা নেই। বাধ্য হয়ে তরুণেরা, যাদের বেশির ভাগই স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, গাছতলায় রাত কাটাচ্ছেন, রোদে পুড়ছেন এবং বৃষ্টিতে ভিজছেন। কারো কারো অসুখ-বিসুখ হচ্ছে। শরণার্থী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থার সঙ্গে বুদ্ধিজীবীদের তুলনা করা যাক। বুদ্ধিজীবীরা তখন কি করছেন? দিল্লী-হিল্লী ঘুরে বেড়াচ্ছেন, বাঙলাদেশের গণহত্যার নাটকীয় বর্ণনা দিয়ে নিজেদের রুটি রুজির ব্যবস্থাটা পাকাঁপোক্ত করে নিচ্ছেন, বিদেশ থেকে আসা সাহায্যের অর্থ নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করছেন। শিক্ষক-সাংবাদিক-সাহিত্যিক এবং উকিল-মোেজার যারাই গিয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশ এইভাবেই কোলকাতা থেকে মুক্তি সংগ্রাম করেছেন।

আমাদের বুদ্ধিজীবীদের একটি বিশেষ মানসিকতা দেখে পশ্চিম বাংলার লোকেরা বিস্ময়ে হতবাক হয়েছেন। বিদেশ থেকে যে সাহায্য এসেছে তাও উদারসাৎ করেছেন তারাই। অথচ সাহায্যের যাদের দরকার সব চাইতে বেশি তারাই বঞ্চিত হয়েছেন। কোলকাতা শহরেও বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের একটি সুবিধাববাগী শ্রেণী হিসেবে দাঁড় করাতে পেরেছিলেন। বিদেশ থেকে শিক্ষকদের দেয়ার জন্য টাকা-পয়সা সাহায্য এসেছে, সে সাহায্য পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের কতিপয় শিক্ষক। প্রাইমারী স্কুল এবং কলেজের শিক্ষকদের কাছে সে সাহায্য পৌঁছায়নি বললেই চলে। ঢেঁকি যে মক্কা গেলেও ধান ভানে বাঙলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের দেখে আমাদের সে ধারণা অধিকতরো সুদৃঢ় হয়েছে। কোলকাতার পত্র-পত্রিকাগুলোতে বাঙলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের সম্বন্ধে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, পড়লে যে কোন স্বাধীনতাকামী আত্মবিশ্বাসী মানুষের মাথা আপনা থেকেই হেট হয়ে আসার কথা। আসল পরিসংখ্যান রিপোর্ট আগে প্রকাশিত হয়নি। তবু বলতে হয়, আনুমানিক তিরিশ লাখের মৃত্যু, প্রায় এক কোটি মানুষের দেশ ত্যাগ এবং দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ছ’কোটির মতো মানুষের বন্দীদশা দেখে বুদ্ধিজীবীরা কোন রকম বিচলিত হয়েছিলেন বলে, একটুও মনে হয় না। যদি তাই হতো তা হলে কি করে বাঙলাদেশের সাংবাদিকেরা কলকাতার কাগজে মনগড়া কাহিনী রচনা করেন? কি করে লেখকেরা সভা-সমিতিতে এন্তার মিথ্যা কথার তুবড়ি ছোটান– তাও আবার এমন মিথ্যা যার সঙ্গে স্বাধীনতা সগ্রামের সামান্যতম সংযোগও নেই।

বাঙলাদেশের অনেক সাহিত্যিক সাংবাদিক মুখে স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করেছেন, কিন্তু করেছেন উল্টো। সকলের সম্পর্কে আমরা বলছিনে। কোলকাতাতে যেয়ে যারা সুযোগ লুট এবং টাকা ভাগাভাগি করার চক্র-উপচক্র সৃষ্টি করেছিলেন, তাদের কথাই বলছি এবং তাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ। একশ্রেণীর শিক্ষক এবং সাহিত্যিক ভারতে যেয়ে আমেরিকার টাকায় আরামে দিন কাটিয়েছেন। অথচ সে সময়ে মার্কিন অস্ত্রে এদেশের মানুষকে পাকিস্তানী সৈন্যরা পশুর মতো হত্যা করছে। তারা কি করে এই সময়ে মার্কিন অর্থ গ্রহণ করতে পারলেন, তার রহস্য এখনো অজানা থেকে গেছে। যদি এমন হয় যে, মানবতার খাতিরে মার্কিনীরা এ টাকা দিয়েছিলো, তাহলে সে টাকা উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক এবং প্রাথমিক শিক্ষকেরা পেলেন না কেনো? কয়েকজন ভাগ্যবান শিক্ষক, সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক মিলে সে টাকা আত্মসাৎ করলেন কেনো? বিপদ তো সকলের জন্যেই। তাই যদি হয়, অন্যান্য শিক্ষক এবং সাংবাদিকরা বাদ পড়ে গেলেন কি করে? কোনো কোনো শিক্ষক, সাংবাদিক তো প্রত্যক্ষভাবে বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছেন।

বাঙলাদেশের কিছু কিছু অধ্যাপক এবং সাহিত্যিকের কথা জানি যারা কোলকাতা গিয়ে রাতারাতি ছদ্মনাম গ্রহণ করেছিলেন। পাকিস্তানী সৈন্য তাঁদের কোলকাতায় যেয়ে খুন করবে সেরকম কোনো সম্ভাবনা ছিলো না। তবু তারা ছদ্মনাম নিয়েছিলেন। এর প্রয়োজনটা ছিলো কি? প্রয়োজন ছিলো বৈকি। তা দু’ধরনের। এক, তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন না যে বাঙলাদেশ সত্যি স্বাধীন হবে। যদি শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান টিকেই যায়, আর তাঁদের যদি দেশে ফিরে আসতে হয়, বলতে পারবেন তারা পাকিস্তান সরকারের বিপক্ষে কিছু করেন নি। দুই নম্বর হলো, ছদ্মনামে সত্যি মিথ্যে গল্প ফেঁদে ভারতীয় জনগণের সহানুভূতি আকর্ষণ করার যে সুযোগ পেয়েছিলেন, তার সদ্ব্যবহার। যেহেতু ছদ্মনামে লিখেছেন তাই দেশের কেউ তাঁদের কোনো কার্যকলাপের প্রতি চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন না। যারা এরকম দুর্বলচিত্তের এবং যুদ্ধের সময়ে এই দোদুল্যমানতার পরিচয় দিয়েছেন, স্বাধীন বাঙলাদেশে এসে মুক্তি সংগ্রামী হিসেবে কিভাবে দাপট দেখান এবং সরকার কোন যুক্তিতে তাদের টেনে তুলে উঁচুপদে বসালেন? এ ধরণের অপকর্ম শুধু লেখক-সাহিত্যিক-সাংবাদিকরা করেছেন এবং অন্যরা একেবারে খাঁটি ছিলেন সে কথা কিছুতেই সত্যি নয়। রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত লোকেরা যা করেছেন ঠিকমতো প্রকাশ পেলে লোম দাঁড়িয়ে যাবে। তা প্রকাশ করার দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর।

.

বাঙলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মনন-রীতি এবং চিন্তন পদ্ধতির মধ্যে, আমাদের কবি সাহিত্যিকদের রচনায় একটা বিরাট গুণগত পরিবর্তন খুবই প্রত্যাশিত ছিলো। সমগ্র বাঙ্গালী জাতির লিখিত ইতিহাসে বাঙলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মতো তাৎপর্যবহ কোনো ঘটনা নেই। এই-ই প্রথম বাঙ্গালী জাতি একটি রাষ্টের জন্ম দিয়েছে। সে রাষ্ট্রের আঙ্গিক এবং প্রকরণ যাই হোক না কেননা, বাঙলার ঐতিহাসিক অহং-এর এই অ্যুদয় যে সম্পূর্ণ অভিনব ঘটনা, তার গুরুত্ব কিছুতেই ছোটো করে দেখার উপায় নেই। একটি নবীন রাষ্ট্রসত্তা হিসেবে বাঙলাদেশের পরিচিতি চিহ্ন তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শিক্ষকদের, সাংবাদিকদের, কবি-সাহিত্যিকদের চিন্তাধারার মধ্যে একটা ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দেয়া উচিত ছিলো। কিন্তু তারা সে দাবী মিটাতে পারছেন না।

আমাদের রেডিও-টেলিভিশনে যাদের চেহারা দেখি, কণ্ঠস্বর শুনি, আমাদের কাগজগুলোতে, সাময়িকী পৃষ্ঠায় যে সব রচনা প্রকাশিত হয়, দেখে মনে হয়, কোনোরকমে মুখরক্ষা করতে পারলেই যেনো সকলে বেঁচে যান। যে নতুন কাল সামনে এসেছে, সে কালের অন্তর্বাণী কি তা উপলব্ধি করে জনসাধারণের সামনে এঁরা যথাযথ ভাবে উপস্থিত করতে পারছেন না। তাঁদের কুঁকড়ে যাওয়া মানসিক প্রত্যঙ্গগুলো নবযুগের আহবানে সাড়া দিতে পারছে না। তাই তারা জোরে চীৎকার করছেন এবং চীকারের অন্তরালে তাদের চিন্তাশূণ্যতা এবং মানসিক বন্ধ্যাত্ব ঢেকে রাখার অন্তহীন কসরত করে যাচ্ছেন। এই ভদ্রলোকদের, ইংরেজীতে যাকে বলে ‘ভালগার’ তা ছাড়া কিছু মনে করার উপায় নেই। কাগজগুলো খুললেই দেখা যাবে লেখক-কবিরা সকলে পরামর্শ করে কলস কলস অশ্রু বিসর্জন করছেন, যেনো স্বাধীনতা উত্তর বাঙলাদেশে লম্বা টানে বিলাপ করাটাই সবচেয়ে করণীয় কাজ। বিলাপ একটি জীবন্ত সম্ভাবনাময় জাতির সব চাইতে বড়ো শক্ত। কারণ, যে জীবন্ত, তার অতীতের ক্ষয় ক্ষতি নিয়ে খেদ করার খুব একটা বেশী সময় নেই। অতীতের চাইতে তার কাছে ভবিষ্যণ্টাই মূখ্য। আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের হালফিল প্রকাশিত রচনায় ভবিষ্যতের ইশারাটি কোথায়? কাগজ-গুলোতে স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কিত যে সকল রচনা প্রকাশিত হচ্ছে তাতে, স্বাধীনতা সগ্রামের মূখ্য বৈশিষ্ট্যটি ফুটিয়ে তোলার বদলে স্থূলতাকে ফাঁপিয়ে ফুলিয়ে রঙ চড়িয়ে বর্ণনা করা হচ্ছে। এই ধরণের রচনার সার্থকতা কোথায়? রেডিও টেলিভিশনে প্রতিদিন নয়া শিক্ষা, নয়া সংস্কৃতির নামে যে সকল ভদ্রলোক তারস্বরে চীকার করে রুচী পীড়িত করেছেন, তার দরকারটাই বা কি? সভা-সমিতিতে প্রতি মাসে যে সকল পণ্ডিত মাথা চুলকে চতুঃস্তম্ভের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করছেন এবং জাতিকে, তরুণ সমাজকে হেদায়াত করে যাচ্ছেন, তাঁদের কথা শুনে কারই বা মনে ভাবান্তর আসে? কেই বা এই আত্মরতিপরায়ন পণ্ডিতদের কথায় বিশ্বাস করে? না করাটা খুবই স্বাভাবিক। কেননা এক বছর আগেও এই সকল ভদ্রলোক প্রকাশ্যে গণসংগ্রামের বিরোধিতা করেছেন। এই লেখক-কবিদের বেশীর ভাগই সংহতির নামে গদগদ হয়ে যেতেন। আর, সি, ডি, ট্যুর ইত্যাদির সুযোগ গ্রহণ করার জন্য দরকার হলে পশ্চিমা হুজুরদের জুতো পালিশ করে দিতেন। তারাই আবার প্রকাশ্যে মাঠে নেমে চীকার করে বলছেন, পাকিস্তানী দস্যুরা নিপাত যাক, তারা আমাদের তিরিশ লাখ নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে, মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছে ইত্যাদি। সেই যে ষোলোই ডিসেম্বরের পর থেকে বলতে শুরু করেছেন এখনো সমানে বলেই চলেছেন। আমাদের মহারথীদের একটিই বৈশিষ্ট্য, তারা যা করেন, প্রকাশ্যেই করেন। পাকিস্তানীরা তো নিপাত গেছে, তিরিশ লাখ মানুষ তো মেরেই ফেলেছে এবং আপনারা বেঁচে যখন আছেন, সে মরা মানুষের নামে মরা কান্না কেঁদে কি আর লাভ? যারা বেঁচে আছে তাদের কথাটি একবার ভেবে দেখুন দেখি। মরলে তো সকল সমস্যা চুকে বুকে যায়, কিন্তু বেঁচে থাকার হাজার লেঠা। কিন্তু আমাদের বুদ্ধিজীবীরা বাঙলাদেশের এই জীবিত মানুষদের সম্বন্ধে কোনও ভাবনা-চিন্তা করতে রাজী নন। কেননা তা করলে ঘাড়ে অনেক দায়-দায়িত্ব এসে পড়ে, অনেক ঝুঁকি গ্রহণ করতে হবে। চাই কি কর্তৃপক্ষের শত্রুও হতে হবে। সুতরাং কার বা গোয়ালে কে দেয় ধোয়া। এতে করে হচ্ছে কি? কিছু সংখ্যক পাকিস্তানী বাঙলাদেশের শুধু নিজেদের অস্তিত্বই টিকিয়ে রাখছেন না–একই সঙ্গে নতুন চিন্তা, নতুন কল্পনা এবং বুদ্ধিবৃত্তির নতুন প্রকরণেরও বিরোধিতা করে যাচ্ছেন। বাঙলাদেশের সাম্প্রতিক জনযুদ্ধের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক আদর্শের বদলে আরেকটি রাজেৈনতিক আদর্শ, এক ধরণের রাষ্ট্রের পরিবর্তে আরেক ধরণের রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়েছে। তার প্রভাব আমাদের সংস্কৃতিতে আসতে বাধ্য। পাকিস্তানী সংস্কৃতির স্থলে নতুন প্রাণবন্ত এবং সৃজনশীল বাঙ্গালী সংস্কৃতির মহীরুহে শত শত নতুন মুকুল মেলবে। এটা প্রত্যাশা করা একটুও অস্বাভাবিক নয়। যদি তা বাস্তবে পরিণত না হয়, তাহলে আমরা কোনও দিন মনে প্রাণে স্বাধীন জাতি হিসেবে মাথা তুলতে পারবো না। একটি যুদ্ধোত্তর সমাজের নানা অসুবিধা, অপূর্ণতা, উত্তেজনা এবং ভুল বুঝাবুঝির মধ্যেও নতুন সংস্কৃতির বুনিয়াদটি ভেতর থেকে সৃজিত হচ্ছে কি না তার প্রতি দৃষ্টি রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন। দুঃখের বিষয় আমাদের যারা সুধীজন বলে কথিত, তাদের চিন্তা স্বপ্নের যে ছায়াপাত–লেখায়, গল্পে, বক্তৃতায় দেখতে পাচ্ছি, তাতে নতুন সমাজের অঙ্কুরটি নেই। আমাদের প্রবীণ এবং অনতি প্রবীণেরা একেবারে বেমালুম ফেল মেরে যাচ্ছেন। আমাদের সমাজের যে নতুনতরো মানব সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন, যে নতুনতরো মূল্যবোধের অঙ্কুরণ করার কথা এবং দৃষ্টিতে নতুন ভঙ্গী আসার কথা, তার লক্ষণগুলো ক্রমশঃ সুদূরে বিলীয়মান হচ্ছে। চারদিকে চিন্তা শূন্যতার নৈরাজ্য এবং চাটুকারিতার চক-চকানি। এরই মধ্যে আমাদের সৃজনশীলতা রেশমের ফাঁসে আটকা পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়, বাঙলা একাডেমী, সরকারী পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন এসব আবার প্রতিক্রিয়ার দুর্গ হয়ে উঠেছে এবং এই চক্র দিনে দিনে শক্তিশালী হচ্ছে। এর মধ্যে পড়ে তরুণদের কল্পনা, বুদ্ধিবৃত্তি, চিন্তা প্রতিদিন কলুষিত হচ্ছে।

.

পাকিস্তান আমলে বুদ্ধিজীবীদের যে একটি সামাজিক প্রেক্ষাপট ছিলো, তা এখন ভেঙ্গে গেছে। যে সমাজ ব্যবস্থায় এক ধরণের রবার স্ট্যাম্প মার্কা বুদ্ধিজীবীর সৃষ্টি, যাতে বুদ্ধিজীবীরা কি ভাববেন, কি বলবেন, কি লিখবেন, উপর থেকে বলে দেয়া হতো, পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে এবং সে সকল বুদ্ধিজীবীদের অবস্থা দাঁড়িয়েছে খাঁচার টিয়ে বাইরের উন্মুক্ত আকাশে এলে যেমন হয় সেরকম। বর্তমান মুহূর্তে আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীরাই হচ্ছেন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত শ্ৰেণী। এঁরা চিরদিন হুকুম তামিল করতেই অভ্যস্ত। প্রবৃত্তিগত কারণে তারা ফ্যাসিস্ট সরকারকেই কামনা করবেন। কেননা একমাত্র ফ্যাসিস্ট সরকারই কিছু সংখ্যক বুদ্ধিজীবী সম্মান শিরোপা দিয়ে পুষে থাকে। অল্পসংখ্যক বাছাই করা লোককে দিয়ে নিজেদের প্রচার প্রোপাগাণ্ডা করিয়ে গোটা দেশের জনসমাজের স্বাধীন চিন্তা এবং প্রাণস্পন্দন রুদ্ধ করেই ফ্যাসিবাদ সমাজে শক্ত হয়ে বসে। চিন্তাশূন্যতা এবং কল্পনাশূন্য আস্ফালনই হলো ফ্যাসিবাদের চারিত্র্য লক্ষণ।

আমাদের সমাজ এখন একটি দোলাচলের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। জনগণ সত্যি সত্যি গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জন করতে পারে এবং সমাজের প্রাচীন সম্পদ সম্পর্ক ভেঙ্গে দিয়ে সমাজে অধিকাংশের কল্যাণমুখী শোষণহীন নয়া ধন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। আবার একটি বিশেষ শ্রেণী গালভরা চটকদার শ্লোগানে জনগণকে বিভ্রান্ত করে ক্ষমতায় গাট হয়ে বসে পাকিস্তানী একনায়কদের অনুকরণে চিন্তার স্বাধীনতা, জীবিকার স্বাধীনতা, কল্পনার স্বাধীনতা, এক কথায় দেশের নামে, জাতির নামে সমস্ত মানবিক স্বাধীনতা হরণ করতে পারে। ইতিহাসে এই ধরণের ঘটনা অনেক ঘটেছে। ঘটনাচক্রে বাঙলাদেশেও যদি তেমন ঘটে যায়, খুব বেশী অবাক বা বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এই ধরণের পরিস্থিতিতে পাকিস্তানী আমলের বুদ্ধিজীবীরা এই ফ্যাসিবাদেরই সহায়তা করবেন। তার কিছু কিছু লক্ষণ এরই মধ্যে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। গোটা দেশের জনসমষ্টির প্রায় সিকি-শতাব্দীর সংগ্রামে এদের কোনো অবদান নেই। এঁরা পাকিস্তানীদেরই সহায়তা করেছেন এবং পাকিস্তানী কর্তারা চিন্তাভাবনার যে মূল্যমান স্থির করে দিয়েছিলেন, তাকেই চরম এবং পরম জ্ঞান করেছেন। যে কোন কারণেই হোক, পাকিস্তানী বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সমর্থন করলেও তাদের দাস্য মনোভাবের কোনোও পরিবর্তন হয়নি। আবার এই দেশে যখন ফ্যাসিবাদ শক্তিশালী হয়ে উঠবে, তারাই আবার ফ্যাসিবাদের ঘোর সমর্থক হয়ে দাঁড়াবে। অবশ্য ইতিহাস এক সময় প্রমাণ করবে পাকিস্তানী আমলের বুদ্ধিজীবীবৃন্দ এবং তাদের শিষ্য সাগরেদরাই হলেন বাঙ্গালী জাতি, বাঙ্গালী সংস্কৃতির শত্রু।

বর্তমান সরকার গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি ঘোষণা করেছেন। এসবকে সংস্কৃতি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার জন্য যে সকল মানুষ ভাড়া করে এনেছেন, এবং তাঁদের অতীত জীবনের রচনা পাঠ করে বলে দেয়া যায়, এঁদের বুদ্ধি একনায়কের সেবা ছাড়া আর কোনো কিছুতেই খেলেনা। সাম্প্রদায়িক মানুষকে দিয়ে অসাম্প্রদায়িকতা প্রচার এবং চিন্তাভাবনার দিক দিয়ে আদিম স্থূল মানুষদের দিয়ে প্রাগ্রসর সমাজদর্শন সমাজতন্ত্রের আদর্শ প্রচারের ব্যাপারটা রেলগাড়ীতে গরুর গাড়ীর চাকা লাগানোর মতো হাস্যকর প্রয়াসের মতো কি কেমন বিদঘুঁটে ঠেকে না? বর্তমান নেতৃত্বের একটি বিরাট দুর্বলতা হলো, তারা, যে সকল রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ করেছেন বলে ঘোষণা করেছেন, কাজে খাটানোর মতো কোনো সাংস্কৃতিক এলিট সৃষ্টি করতে পারেন নি। সেজন্য পাকিস্তানী বুদ্ধিজীবীদের ভাড়া করে আনতে হচ্ছে। আর পাকিস্তানী বুদ্ধিজীবীরা সরকারী যন্ত্রের হাল ধরেই নিজেদের পূর্ব সংস্কার এবং অভ্যাস অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় যন্ত্র চালনা করবেন। সম্প্রতি সরকারী, আধা সরকারী এবং স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহে তার লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নয়া শিক্ষানীতির রূপরেখা নির্ধারণ করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। শিক্ষকেরা উঁচুপদে চড়বার জন্য কর্তার তোষামোদ এমনকি ছাত্রদেরকেও খুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছেন। পত্রিকাগুলো সেই পাকিস্তান আমলের মতো নোংড়া প্রচারপত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। বেতার এবং টেলিভিশন স্কুল রুচীহীন লোকদের আখড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোথাও সমাজতান্ত্রিক সমাজ সৃজনের তাগিদ, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রগতিশীল চাহিদা কোনোও দাম পাচ্ছে না। কর্তার তোষামোদ, ধরতাই বুলি কপচানো, দলাদলি, অবদমিত সাম্প্রদায়িকতা, পদের মোহ এসব প্রতিটি সরকারী প্রতিষ্ঠানের এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।

আগের মতো দেশ এবং দেশের মানুষের চালাবার দায়িত্ব আল্লাহর কাঁধে ছেড়ে দিয়ে এরা নিরাপদ নিশ্চিন্তে জীবন অতিবাহিত করছেন। অবস্থা যদি এরকমভাবে চলতে থাকে তাহলে দেশে ফ্যাসিবাদ শক্ত হয়ে বসবে তা সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

সরকার দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলছেন, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন কিন্তু কিভাবে। শিক্ষা এবং সংস্কৃতি তো সমাজ সৃজনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। সেই শিক্ষা এবং সংস্কৃতির রূপায়নের জন্যে যে সকল মানুষ আমদানী করছেন, তাঁদের বেশির ভাগই তো আয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানের প্রিয় অফিসার। এঁদের দিয়ে সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা এবং সংস্কৃতি সৃজন কামারকে দিয়ে সোনার গয়না গড়ানোর মতোই অবাস্তব। এ ধরণের মানুষ দিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলে সরকার কি শিব গড়তে বানর গড়বেন না? সরকার তো সব নয়। জনগণ না চাইলে এই সরকার নয়, কোনো সরকারই তো টিকতে পারে না। দেশের মানুষই দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ করবে এই শেষ কথা। দেশের মানুষের হয়ে যারা ভাববেন, কাজ করবেন, তাঁদের চিন্তা পদ্ধতি কেমন হওয়া উচিত?

.

বাঙলাদেশে এখন একটি রেনেসাঁর সময়। কিন্তু নানামুখী ঘটনা এবং সামাজিক শক্তিগুলোর ঘাত প্রতিঘাতে একটি জাতির শিল্প সংস্কৃতিতে নতুনতরো অধ্যায় সংযোজন এবং বিজ্ঞানে দীক্ষা গ্রহণ নানা কারণে বিলম্বিত হতে পারে। কেননা পাকা বীজও পাথরে পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। তবু একটি রেনেসাঁ যে আসন্ন এ দেশে তার সম্ভাবনাগুলো কি কি সংক্ষেপে আলোচনা করা মোটেই অসম্ভব নয়। একটি সমাজ যখন উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় যে, তার প্রতিষ্ঠিত বিচার-আচার, সংস্কার, বিশ্বাস, রীতিনীতি, আইনকানুন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাস্তব জীবনের চাহিদা মেটাতে মোটেই সক্ষম হচ্ছে না, তখন সেই বিশেষ সমাজের বেঁচে থাকার তাগিদে জীবনকে সমৃদ্ধ এবং গরীয়ান করার প্রেরণায় সম্পূর্ণ নতুনভাবে, নয়া দৃষ্টিকোণ থেকে সবকিছু বিচার করতে হয়। নতুন চিন্তার অস্ত্রে সজ্জিত নতুন মানুষ জন্ম গ্রহণ করে। তারা। পুরোনো সমাজের সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেঙ্গে চুরে নতুন যুগের প্রয়োজন মতো নতুনভাবে ঢালাই করে। তখন সমাজে মানুষের সম্পর্কের ধরণটা একেবারেই বদলে যায়।

মধ্যযুগের ইউরোপে এমনটি ঘটেছে। কতিপয় মানুষ যখন উপলব্ধি করলেন, যাজকেরা যা বলেন অর্থাৎ রাজা আল্লাহ্র ছায়া, নারী নরকের দ্বার, মানুষের রক্তমাংসের দাবী শয়তানের প্ররোচনা, মনের প্রশ্নশীলতা নয়, বাইবেলের বাণীর প্রতি অন্ধ আনুগত্যই সৎ জীবন যাপনের প্রকৃষ্ট উপায়; এ সবের পেছনে কোনো বাস্তব সত্যের সমর্থন নেই, তখন থেকে তাঁরা মানব জীবনকে জাগতিক সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে চিন্তা করলেন, ছবি আঁকলেন, রাজনৈতিক সন্দর্ভ রচনা করলেন, কবিতা লিখলেন। দ্য ভিঞ্চির ছবি, শেক্সপীয়রের কাব্য, বেকনের দর্শন, হবস, লক প্রমুখের রাজনৈতিক সন্দর্ভ মূলতঃ অর্গলবদ্ধ মানব চিন্তা চেতনার নানামুখী বহিঃপ্রকাশ। ইউরোপীয় মানসের এই বন্ধনমুক্তি, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার ফলিত রূপ মহান ফরাসী বিপ্লব। ফরাসী বিপ্লবের ফলে রাজা বিতাড়িত হলো, মানুষে মানুষে সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্ব অন্ততঃ তত্ত্বগতভাবে হলেও স্বীকৃত হলো। ইউরোপীয় চিত্তের নবতররা সৃজনশীলতা বস্তুবীক্ষা এবং প্রকৃতি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আরো একটি বিপ্লবের সূচনা করে। সেটি ইংল্যান্ত্রে শিল্প বিপ্লব। এই বিপ্লবের ফলে প্রাচীন পৃথিবীর চেহারা সম্পূর্ণ বদলে গেলো। শিল্প বিপ্লব, ফরাসী বিপ্লব এবং পরবর্তীকালের রুশ বিপ্লব ইউরোপীয় রেনেসার প্রত্যক্ষ এবং দূরবর্তী ফসল।

বলা হয়ে থাকে উনবিংশ শতাব্দীর তৎকালীন বাঙলাদেশেও একটা রেনেসাঁর সূত্রপাত হয়েছিলো। প্রতিটি রেনেসাঁর একটি সামাজিক পশ্চাদভূমি থাকে। সমাজের একটি শ্রেণী আপনা থেকে উদ্যোগী হয়েই রেনেসাঁর বীজ ধারণ করে, বহন করে এবং লালন করে। সে শ্ৰেণীটি মানব চেতনার নতুন দিক নির্দেশ করতে প্রয়াসী হয়, এ কারণে যে, তার মধ্যে দিয়েই সে বিশেষ শ্রেণীটির জাগতিক আকাক্ষা স্ফুর্তি লাভ করে। উনবিংশ শতাব্দীর তৎকালীন বাঙলাদেশে ইংরেজ রাজত্ব স্থাপনের ফলে লাভবান হয়েছিলো যে শ্ৰেণীটি, তার বিত্ত, বৈভব এবং সামাজিক মান মর্যাদা সবই বিদেশী রাজত্বের কারণে এবং এই শ্ৰেণীটিই ইউরোপীয় রেনেসাঁর মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করে। তারাই নতুন মানব ধর্ম প্রচার করলো। নতুন সাহিত্য রচনায় ব্রতী হলো এবং নতুন ভাবে সমাজকে ঢালাই করতে উদ্যোগী হলো। তাঁদের প্রচেষ্টা পুরোপুরি ফলবতী হয়নি। কারণ, বৃটিশ সাম্রাজ্যের লৌহ কাঠামো মেনে নিয়েই তাদেরকে চিন্তা করতে হয়েছে, কাজ করতে হয়েছে। শিল্প সাহিত্যে তাঁদের অনেকেই অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করতে পেরেছেন একথা সত্যি। কিন্তু সামাজিকভাবে তাদের প্রচারিত মতবাদ খুব বেশী প্রসার লাভ করেছে একথা জোর করে বলার উপায় নেই। ইউরোপের ফরাসী বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী এবং স্বাধীনতার আদর্শ সমাজের উঁচুবিত্তের গণ্ডি পেরিয়ে ক্বচিৎ কখনো নীচুতলা স্পর্শ করতে পেরেছে। তাই দেখা যাবে, উনবিংশ শতাব্দীর রেনেসাঁর প্রভাবে বাঙলাদেশে কতিপয় বিশ্ববিশ্রুত মনীষার জন্ম হলেও তারা সমাজের সাধারণ মানুষকে খুব কমই প্রভাবিত করতে পেরেছেন। সেকালে সাম্রাজ্যরক্ষার খুঁটি হিসেবে যে শ্ৰেণীটি সৃষ্টি করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন, যারা রক্ত মাংসে নেটিভ এবং মর্জি মেজাজে বৃটিশ, সেই ইংরেজী শিক্ষিত শ্রেণীর স্তর অতিক্রম করে সমাজের প্রাকৃতজনের কাজে উনবিংশ শতাব্দীর মনীষীবৃন্দের কোনো প্রভাব পড়েনি। হিন্দু-মুসলমান বৌদ্ধ, খৃষ্টান প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষের মনে তাদের ভাবধারা সমানভাবে প্রেরণা জাগানোর কথা দূরে থাকুক, শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের সমানুষকেও জ্ঞানের ভোজে, অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আহবান করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। তাই উনবিংশ শতাব্দীর যে রেনেসাঁ তার মৌলিক উপাদান পুরোপুরি ধর্ম বহির্ভূত হলেও তার চেহারাটি ধর্মীয় এবং আকারটি সাম্প্রদায়িক। সুতরাং বাঙলার উনবিংশ শতাব্দীর রেনেসাঁকে বাঙালী বর্ণ হিন্দুদের নব জাগরণ বলা নানাদিক দিয়েই যুক্তিসঙ্গত। রামমোহন রায়ের শিষ্যদের মধ্যে কেউ নিম্ন বর্ণের হিন্দু ছিলেন সত্যিসত্যি, সে রকম কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। বিদ্যাসাগরের শিক্ষা বিস্তার এবং সমাজ সংস্কার প্রয়াস তার আপন গরি মধ্যেই সীমিত ছিলো। শিল্প সংস্কৃতি, সাহিত্য-বিজ্ঞানে, রাজনীতিতে এ পর্যন্ত বর্ণ হিন্দুদের বাদ দিয়ে নীচুস্তর থেকে কোনো উল্লেখ্য ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হয়নি। উনবিংশ শতাব্দীর এমনকি বিংশ শতাব্দীর শিল্পী, সাহিত্যিক, দার্শনিক বৈজ্ঞানিকদের জগত জোড়া খ্যাতি প্রতিপত্তি যেনো সমুদ্র তরঙ্গের শীর্ষে ফরফরাসের মতো। নীচের দিকে আলোকিত করার কোন ক্ষমতা নেই। রেনেসাঁর ভাব তরঙ্গের বেগ বহুকাল আগেই ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু অতীতের মোহ এখনো বাঙলার ও অংশের মানুষ কাটিয়ে উঠতে পারেননি। অতীত এবং বর্তমানের দ্বন্দ্বে অতীত যদি মহীয়ান হয় এবং বর্তমান যদি হয় সমস্যা সঙ্কুল, সহজ বিশ্বাসী মানুষেরা অতীতের ধ্যানেই দিন অতিবাহিত করে। বৃটিশ যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিজ প্রয়োজনে সৃষ্টি করে দিয়ে গেছে, তাদের চিন্তন পদ্ধতি, অভ্যাস, মনন ইত্যাদির ছাপ এখনও বাঙলার মানুষের মনে রয়ে গেছে, একটুও রঙছুট হয়নি। একটা সংগ্রাম করে যদি সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন সাধন করতে পারতেন, অন্ততঃ তেমন আশাও যদি থাকতো, তাহলেও বাঙলার শিল্প, সংস্কৃতি এবং সাহিত্য থেকে অনুকরণ করবার মতো, শ্রদ্ধা করার মতো কিছু পেতাম। কিন্তু তা হবার নয়।

সূর্য পূর্ব দিকেই উদিত হয়। বাঙলার এই পূর্ব অংশেই আর একটা রেনেসাঁ সম্ভাবিত হয়ে উঠেছে। উনবিংশ শতাব্দীর তুলনায় তার ব্যাপ্তি এবং গভীরতা অনেক বেশী হওয়ার কথা। রেনেসাঁরও তো সামগ্রীর প্রয়োজন। তা বাঙলাদেশে বেশ কিছুদিন থেকেই অধিক হারে সঞ্চিত হয়ে আসছে। আইডিয়ার সঙ্গে বাস্তবের সঙ্গতি না থাকলে বিকাশ বিকলাঙ্গ হতে বাধ্য। উনিশ শতকে বৃটিশের দৌলতে ধনবান, প্রতিষ্ঠাবান এবং জ্ঞানবান একদল মানুষ চাইতেন সমাজে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্তার হোক, মানুষে মানুষে সহজ সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত হোক। কিন্তু বৃটিশ তা চাইতো না এবং তারা ছিলেন একভাবে না একভাবে বৃটিশ সরকারের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু বাঙলাদেশের সবমানুষের মধ্যে জ্ঞানের বিস্তার এখন অপরিহার্য সামাজিক প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জ্ঞান এবং যুক্তির আলোকে এযাবতকাল ধরে ধর্মীয় কুসংস্কার এবং সমাজের প্রাণহীন আচার সংস্কারগুলো কখনো বিচার করা হয়নি। এইবার সময় এসেছে। কামাল পাশার তুরস্কের মতো বাঙলাদেশেও অনেকগুলো মজ্জাগত ধর্মীয় সংস্কার জোর করে পিটিয়ে তাড়াতে হবে। শুধু হিন্দু মুসলমানে সৌভ্রাতৃত্ব নয়, গারো, হাজং, চাকমা, মগ যে সকল অধিবাসী আছেন, যে সকল উর্দুভাষী থেকে যাবেন তাদেরকে পুরোপুরি মানবিক মর্যাদা দিতে হবে। মানুষকে সত্যিকারভাবে মর্যাদা না দিয়ে মানুষের কোনো শ্রদ্ধেয় সমাজ সৃজন সম্ভব নয়।

বৃটিশ সৃষ্ট হিন্দু মধ্যবিত্ত বাবু কালচার অথবা আলীগড় প্রভাবিত মুসলিম মধ্যবিত্ত মানসিকতায় কিংবা প্রতীচ্যের দুষ্ট প্রভাবে দূষিত মানসিকতায় আমাদের সময়ে যে নতুন মানবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত তা প্রতিফলিত হওয়ার কথা নয়। অথচ এই নতুন সমাজের, নতুন মানবিক সম্বন্ধের প্রকৃতি বিশ্লেষণই হচ্ছে বাঙলাদেশে নতুন একটি বিজ্ঞাননিষ্ঠ মহীয়ান সংস্কৃতি সৃজনের গোড়ার দিকের কাজ। যারা এখন সংস্কৃতির অভিভাবক তাদের দিয়ে এ হবে না। প্রথমতঃ তারা ভয় পাবেন, দ্বিতীয়তঃ বিরোধিতা করবেন। ভয় পাবেন এ কারণে যে, তারা নতুন করে চিন্তন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে পারবেন না, তাই জাতির কাঙ্খিত পরিবর্তন যদি অন্য কারো হাত দিয়ে আসে প্রাণপণে বিরোধিতা করবেন। যখন প্রয়োজন হবে ফ্যাসিবাদের সহায়তা করবেন। যারা বাঙলাদেশে সর্ব মানবের জীবনের মঙ্গলের মতো একটি প্রাণোচ্ছল সংস্কৃতি কামনা করেন, তাঁদের রাজনীতি এবং সংস্কৃতিকে পিঠেপিঠি ভাই-বোনের মতো দেখা ছাড়া উপায় নেই। কেননা রাজনীতিতে যদি ফ্যাসিবাদ শিকড় গেড়ে বসে, সাংস্কৃতিক অগ্রসরণের প্রশ্নই উঠেনা। সাংস্কৃতিক অগ্রগতি ছাড়া কোনো রাজনৈতিক অগ্রগতি নেই। রাজনীতি সুন্দরভাবে, সুস্থভাবে অপরের সঙ্গে ভ্রাতৃ সম্পর্ক স্থাপন করে বাঁচার সগ্রাম।

এই যুদ্ধ আমাদের দেশের জীবনে সুগভীর প্রভাব ফেলেছে। অন্যান্য দেশে যেমনটি হয়ে থাকে আমাদের দেশে যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া শুরু থেকেই প্রত্যক্ষভাবে অনুভূত হয়নি। তার কারণ এই যুদ্ধের জন্য আমাদের জনগণের ঠিক মানসিক এবং সামরিক প্রস্তুতি ছিলো না, যদিও জনগণ অবচেতনে অনুভব করছিলেন, একটি যুদ্ধ ছাড়া আমাদের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান নেই। তার মানে একটি জনগোষ্ঠীর যুদ্ধ করে স্বাধীনতা আদায় করার জন্য যে ঐক্য এবং একাগ্রতা প্রয়োজন তা আমাদের জনগণ অর্জন করতে পেরেছিলেন। তা না হলে সুদীর্ঘ নয়মাস কাল সময় সংগ্রাম চালিয়ে বিজয় অর্জন করা কিছুতেই সম্ভব হতো না। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি মারাত্মক দুর্বল দিক হলো, আমরা দেশের মাটিতে লড়াই করে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পারিনি। আমাদেরকে বিদেশে আশ্রয় নিতে হয়েছে এবং বিদেশী সাহায্য গ্রহণ করতে হয়েছে। অন্যান্য স্বাধীনতাকামী দেশ যেভাবে বিদেশী সাহায্য গ্রহণ করে তার সঙ্গে আমাদের বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণের অনেকটা গুণগত পার্থক্য রয়েছে। একথা স্মরণে রেখেই আমরা প্রসঙ্গের অবতারণা করছি।

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের যতোই দুর্বলতা থাকুক, তার উজ্জ্বল দিকটিই প্রধান। আমাদের জনগণ স্বাধীনতা চেয়েছিলেন, সংগ্রাম করেছেন, এবং পেয়েছেন। এটি প্রথম কথা। কিন্তু দ্বিতীয় একটি কথাও আছে, কিসের জন্য স্বাধীনতা, কাদের জন্য স্বাধীনতা? এই দ্বিতীয় প্রশ্নটির সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির প্রশ্ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সে যা হোক, এই যুদ্ধ আমাদের অনেকগুলো সংস্কার, বিশ্বাস এবং মূল চিন্তার গোড়া ঘেঁষে কোপ বসিয়েছে। আমরা দেখেছি আমাদের সমাজের অনেক প্রতিষ্ঠাবান এবং সমাজদরদী বলে খ্যাত লোক চরম মুহূর্তে আমাদের গণসগ্রামের বিরোধিতা করেছেন। এই প্রতিষ্ঠাবান লোকগুলোই পাকিস্তানের নামে আমাদের গোটা সমাজটাকে শাসন করে আসছিলো। তারা সব সময় বলতো, যা করছে সব আমাদের জনগণের কল্যাণের জন্য। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যেমন হয়েছে, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও হয়েছে। তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণাত্বক দৃষ্টি দিয়ে দেখলে নজরে না পড়ার কথা নয়, কিছু সংখ্যক মানুষ রাজনীতিতে সংগ্রামীদের কাতারে ছিলেন। অথচ তাদের মন মানসিকতা, শ্রেণীভিত্তিক লোভ এসবের কোনও পরিবর্তন হয়নি। তাই তারা স্বাধীনতাউত্তর পর্বে সমাজতন্ত্র ইত্যাদির শ্লোগান দিয়ে প্রকৃত সমাজতন্ত্র এবং জনগণের প্রকৃত দাবীর বিরোধিতাই করেছেন। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও এরকমটি ঘটছে। কিছু সংখ্যক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব যাদের মন মানস পাকিস্তানী সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে গঠিত হয়েছে এবং নতুন সাংস্কৃতিক দিগন্তের উম্মোচনের বিদ্যাবুদ্ধি, সদিচ্ছা এসবের কোনটিই নেই, তারাই আমাদের সংস্কৃতির চালক হয়ে বসেছেন। তারা নতুন বাঙ্গালী সংস্কৃতির কথা বলেই নতুন বাঙ্গালী সংস্কৃতির বিরোধিতা করছেন। নতুন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সৃজনের দায়িত্ব যাদের হাতে, তারা এই সংস্কৃতির মোড়লদের মানসিক সন্নিহিতি কিসের সঙ্গে, সে সম্পর্কে ওয়াকেবহাল হওয়া সবিশেষ প্রয়োজন। কোন ধরণের রাজনৈতিক পদ্ধতি এঁদেরকে টিকিয়ে রেখেছে, সে রাজনীতির চরিত্রটি ভালভাবে জেনে রাখা উচিত। জানা, বোঝা এবং উপলব্ধিতে ফাঁক রেখে সত্যিকারের কল্যাণধর্মী কোনো কিছু করা সম্ভব নয়।

এখন সকলেই উপলব্ধি করেছেন, উনিশশো সাতচল্লিশের দেশ বিভাগ একটা প্রকাণ্ড রাজনৈতিক ভ্রান্তি। মুহম্মদ আলী জিন্নাহ বা তার পূর্বের নেতা বাল গঙ্গাধর তিলকের দ্বিজাতিতত্ত্ব আসলে মন গড়া জিনিশ। বাস্তবের সঙ্গে তার কোনও সংযোগ নেই। তবু বাঙলার মুসলমান পাকিস্তান চেয়েছিলো তার একটি সাক্ষাৎ কারণ তো নিশ্চয়ই ছিলো। বাঙলার মুসলমানেরা হিন্দু ভূস্বামী এবং বর্ণহিন্দু শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অনুকম্পার পাত্রে পরিণত হবেন বলে আশঙ্কা করেছিলেন। তাই বাঙলার মুসলিম সম্প্রদায় পশ্চিমা সন্তানদের সঙ্গে আঁতাত গড়ে পাকিস্তান দাবী তুলেছিলেন। চব্বিশ বছর পর দেখা গেলো, যে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের দাবীতে পাকিস্তানের সৃষ্টি, সেই জিনিশটিই আগাগোড়া ভিত্তিহীন। বাঙলাদেশের জনগণের মন মানস যে উপাদানে গঠিত হয়েছে তা হিন্দুর হোক, মুসলমানের হোক, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ এবং আদিবাসী যে সম্প্রদায়েরই হোক না কোনা তাই-ই আমাদের বাঙলার সংস্কৃতি। বাঙলাদেশে সংস্কৃতির এই রূপরেখাঁটি আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পরেই আভাসিত হয়ে উঠেছে। এই সংস্কৃতিতে বিভাগপূর্ব আমলের বাঙালী সংস্কৃতি বলতে যা কিছু বোঝাতো তার অনেক কিছু থাকলেও এ সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিশ। বিপ্লবের অর্থ তো ধ্বংস নয়, পুনর্গঠন। বাঙলাদেশের সংস্কৃতিতে বাঙলার মনীষীবৃন্দের চিন্তা চেতনার স্থান নিশ্চয়ই আছে। সে সঙ্গে গ্রাম বাঙলার মানুষের সুখ-দুঃখ যা এক সময়ে প্রায় অশিক্ষিত হিন্দু-মুসলমান কবিয়ালের মুখে ময়মনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ গীতিকার আকারে নিঃসৃত হয়েছে, মনসামঙ্গল ইত্যাদি কাব্যে আকারিত হয়েছে, প্রাণের আকুতি-বেদনা-আকাঙ্খ ভাটিয়ালী, জারী সারী; এ সকল গানে ফেটে পরেছে–তাও আছে। কোনো রাজ শক্তির বা রাষ্ট্রশক্তির পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি বলে তা তুচ্ছ বা ফেলনা নয়। আমাদের জীবন থেকে এসব উঠে এসেছে বলেই এখনো তাজা, সজীব এবং হৃদস্পন্দনে ভরপুর। জনগণের এই আবেগের ঘরে আমাদের নাড়া দিতে হবে এবং জীবনের এই আগুনকেই যুগের সমস্যা, সংগ্রামের খড়কুটোতে সহস্র শিখায় জ্বালিয়ে তুলতে হবে। এই কাজটি যতো সুচারুরূপে এবং যতো কম সময়ে করা যায় ততোই পূর্ণাঙ্গ এবং একটি সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি শীগগির সৃজিত হবে।

এখন কথা দাঁড়াচ্ছে, বাঙলাদেশে কি সমাজতন্ত্র সত্যি এসে গেছে? কানাঘুষো চলছে বটে কিন্তু সমাজতন্ত্র আসেনি। আসবে কি? হাঁ; আসতে পারে, যদি জনগণ দাবী করে। আমাদের দেশের জনগণ একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে তাদের আত্মনির্ভরতা এবং সংঘ শক্তি দিয়ে প্রমাণ করেছে অসম্ভবকে সম্ভব করা যায় একথাটি বুঝে ফেলেছেন। তাদের শক্তি সম্বন্ধে সচেতনতাও অনেকগুণে বেড়েছে। তারা জানেন, তারা সম্মিলিতভাবে শক্তি প্রয়োগ করে জীবনকে অনেকদূর সুখী এবং সমৃদ্ধ করে তুলতে পারেন। এই শক্তিসচেতন জনগণকে বিপথে পরিচালিত করাও খুব সহজ। সামাজিক দাবী উপেক্ষা করে ব্যক্তি, গোষ্ঠীদল আপনাপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য উঠেপড়ে লেগে যেতে পারে। পথে ঘাটে প্রায়ই মানুষকে বলতে শোনা যায়, অমুক ছাত্রনেতার অতো খানি বাড়ি, অমুক নেতার অতো টাকা ইত্যাদি। এটা এখন একটি সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা নেতা, উপনেতা এমন কি যুব নেতাও নয় তারাও উচ্চাকাক্ষী হয়ে পড়েছে। তাদেরও গাড়ি চাই, বাড়ি চাই। কেউ দেবে না, আইন সাহায্য করবে না, কিন্তু তারা লুঠ করবে, হাইজ্যাক করবে, জোরে দখল করবে। তাদের মোক্ষম যুক্তি দেশের উন্নতির জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামে তারা অংশ গ্রহণ করেছে। দেশের উন্নতি যদি না হয় ভাগ্যবানদের অনুসরণে নিজেদের অবস্থার উন্নতি সাধনের অধিকার তাদের নিশ্চয়ই রয়েছে। বিশেষত হাতে যখন অস্ত্রপাতি আছে, পরোয়াটা কিসের। রাজনৈতিক দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে, আমাদের সমাজে এক ধরনের নৈরাজ্য চলছে। এই অবস্থার উপশম যদি না করা যায়, তাহলে সমাজতন্ত্র আসবে না এবং সাধারণ মানুষও কোনো দিন তাদের অধিকার আদায় করতে পারবে না ।

সংস্কৃতি ক্ষেত্রেও এই ধরণের নৈরাজ্যের হাওয়ার অনুপ্রবেশ ঘটছে। যোগ্যতা থাক না থাক, কাজ কিছু হোক না হোক, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সাংস্কৃতিক কর্মীরাও আশাতীতভাবে উচ্চাকাক্ষী হয়ে পড়েছে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পর যেমন কলেজের আরবী ফারসী অধিকাংশ শিক্ষক রাতারাতি অধ্যক্ষ বনে গিয়েছিলেন, এখনও সেরকম কিছু লোক প্রবল উচ্চাকাঙ্ক্ষায় তাড়িত হচ্ছেন। তাদের একমাত্র যোগ্যতা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁদের গড়মিল নেই এবং তারা বাঙালী অর্থাৎ কলাবরেটর বলে প্রত্যক্ষ কোন প্রমাণ নেই। একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছিনে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একটি বিভাগে কোনো একজন শিক্ষক প্রফেসর মনোনীত না হওয়ায় ক্ষেপে গিয়ে তার সমর্থক অনুগত ছাত্ররা নির্বাচক মণ্ডলীর বাড়ি গিয়ে হামলা করেছেন বলে কাগজে সংবাদ পড়েছি। একজন ব্যক্তি শিক্ষক হিসেবে কতোদূর অযোগ্য হলে, নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ছাত্রদের ব্যবহার করতে পারেন, তা অনুমান করা মোটেই দুষ্কর নয়। শিক্ষকেরা নিজেদের পদবৃদ্ধির জন্য যদি এতোদূর উৎসাহিত হয়ে পড়েন এবং ছাত্রদের ব্যবহার করে থাকেন, দেখা যাবে প্রত্যেক শিক্ষকের কিছু কিছু সমর্থক ছাত্র রয়েছে এবং শিক্ষকেরাও ছাত্রদের দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে তুলবেন। শিক্ষকেরা যদি এই করে সময় এবং শক্তি ব্যয় করেন, নতুন সংস্কৃতি এবং শিক্ষানীতি যা বর্তমান বাঙলাদেশের অপরিহার্য সামাজিক দাবী তার কি হবে? দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য বিভাগের শিক্ষকেরাও শিক্ষক এই পদ বৃদ্ধির খেলায় অবতীর্ণ হবেন এবং তা কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়বে। সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাই যদি না হয়, সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা সংস্কৃতি তো হাওয়া ফুড়ে জন্মাতে পারে না।

.

তেইশ চব্বিশ বছর বড়ো কম সময় নয়। এই সিকি শতাব্দী পরিমাণ সময়ের মধ্যে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির ভিত্তিটি স্থাপিত হওয়া উচিত ছিলো। বাঙলাদেশের সাহিত্যে দু’তিনটি কবিতার বই, দু’তিনটি উপন্যাস, দু’তিনটি প্রবন্ধের সংকলন, দুটি কি তিনটি উল্লেখ করবার মতো নাটক বা অ-নাটক এই-ই তো আমাদের মোটামোটি মানস ফসল। এই সাহিত্য নিয়ে বিশ্বের দরবারে হাজির হওয়া দূরে থাকুক, সামগ্রিক বাঙলা সাহিত্যের উৎকর্ষের নিরিখে এ আর এমন কি! কালজয়ী এবং দেশজয়ী হওয়ার স্পর্ধা রাখে এমন কোনো সাহিত্য এদেশে রচিত হয়নি। তবু বাঙলা ভাষাভাষী জগতে বাঙলাদেশের সাহিত্যের যে একটি বিশেষ স্থান আছে আমরা মনে করছি, তার কারণ আমরা অত্যধিক অযৌক্তিক আশাবাদী এবং বিচার বোধ বর্জিত। লাভ ক্ষতি খতিয়ে দেখার ক্ষমতা আমাদের খুবই সামান্য। কেউ যখন আমাদের পিঠ চাপড়ায়, তখন মহানন্দে আমাদের দেশের গর্জনকারী চতুস্পদ জন্তুটির মতো লেজ নাড়তে থাকি। অপরের স্তোকবাক্যে মোহিত হয়ে দন্ত ব্যাদান করে এরকম ভাবখানা করি যেনো সত্যি সত্যি বাঙলাদেশের নির্মাণ বুদ্ধি, স্বপ্ন, কল্পনা সংঘাত সব আমাদের জীবনে ধারণা করেছি। আদতে এসব কি সত্যি? যে কোনও দেশের চব্বিশ বছরের সাংস্কৃতিক প্রয়াসের সাথে আমাদের তুলনা করে দেখতে পারি। এই চব্বিশ বছরে ক’টি বিজ্ঞানের মৌলিক আবিষ্কার এদেশে হয়েছে! পদার্থ বিদ্যা, রসায়ন বিদ্যা এবং শরীরবিদ্যা, প্রযুক্তি এবং গবেষণার দিক দিয়ে কতোদূর উৎকর্ষ অর্জন করেছে? কখানি গবেষণাসমৃদ্ধ ইতিহাস লেখা হয়েছে! সমাজতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি এসব বিষয়ে আমাদের মাটি, এবং সমাজ সম্পদ নিয়ে কোনো বই মাতৃভাষা বাঙলায় নয় ইংরেজীতেও প্রকাশ পেয়েছে কি? বিশটি বিষয় মিলিয়েও একগণ্ডার অধিক আমাদের পণ্ডিতদের লেখা ভালো বই এ দেশে কিংবা বিদেশে প্রকাশিত হয়নি। অথচ এসব বিষয়ে সুদক্ষ পণ্ডিত বানাবার জন্য বছরে প্রচুর টাকা খরচ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। ফি মাসে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ থেকে শিক্ষার্থীরা বিদেশে যাচ্ছেন এবং বিদেশ থেকে ফি মাসেই পণ্ডিতেরা কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি স্কুলগুলোতেও বিলেত, আমেরিকা ফেরতাদের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু তার নগদ ফল হয়েছে এই যে, বিলেত, আমেরিকা ফেরতাদের দৌরাত্মে সমাজে টেকা একরকম দায় হয়ে পড়েছে। এই বিলেত, আমেরিকা ফেরত পণ্ডিতেরা বিলেত, আমেরিকার কথা স্মরণ করে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলেন। স্বদেশের মাটির দিকে তাদের দৃষ্টি কদাচিৎ আকৃষ্ট হয়। সলিড কিছু করার বদলে বিলেতী বিদ্যের গুমর দেখাতেই তারা অত্যন্ত আনন্দ পেয়ে থাকেন। বিলেতে যেয়ে আমাদের সাহিত্য এবং ইতিহাস নিয়ে গবেষণাগ্রন্থ রচনা করেছেন এমন দু’তিনখানা বই নেড়েচেড়ে দেখবার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে। দেখে শুনে ধারণা জন্মে গেছে যে ও ধরণের বই ঢাকার পাবলিক লাইব্রেরীর ভিরের মধ্যে বসে চা সিগ্রেট খেয়ে আড্ডা গুলতানি মেরে তিন কি সাড়ে তিন মাস সময়ের মধ্যে অনায়াসে লিখে দেয়া যায় । কিন্তু এসকল মহাগ্রন্থ রচনা করতে আমাদের পণ্ডিতেরা বিলেত যেয়ে তিন তিন বছর কাটিয়েছেন এবং দেশে ফিরে আর তিন তিন বছর বিলেতের গল্প করে কাটাচ্ছেন। কি অপূর্ব বিদ্যা, বিলেতী ডিগ্রীর কি চোখ ধাঁধানো ঔজ্জ্বল্য। আমাদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ওদের দায়িত্বে ছেড়ে দিয়ে আমরা মনে করছি, পড়াশুনা ইত্যাদির কাজ ভালোভাবেই চলছে। প্রকৃত ভালোটা তখনই চোখে পড়ে, যখন গোটা দেশের সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ, অপকর্ষের দিকে তাকাই। দেশ দেশের হিসেবে চলে, সমাজের দারিদ্র্য বেড়েছে, সমাজের অজ্ঞতা দিনে দিনে পাষাণের মতো কঠিন আকার ধারণ করছে। সবল দুর্বলকে অত্যাচার করছে। আর আমাদের পণ্ডিত মহাশয়েরা পরস্পরের পিঠ চুলকে, খুনসুটি দিয়ে দিব্যি আরামে দিন কাটাচ্ছেন। আর শাসক পরিবর্তনের সময়ে নিজেরা সদল বলে জয়ধ্বনি দিয়ে বলেন, আমরাও আছি তোমার সাথে। এই সাথে থাকার কাজটি তখন থেকেই শুরু হয়, যখন সিংসনে চড়ার সময় আসে। আমাদের দেশের পণ্ডিতদের এই ন্যাক্কারজনক ভূমিকার প্রতি ঘৃণা করাটাও অনেক সময় মনে হয় পণ্ডশ্রম। জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত অন্যান্য বিষয়গুলোর চর্চা যেহেতু এখনো আদিম পর্যায়ে রয়ে গেছে, তাই সংস্কৃতি বলতে সাধারণ্যে একটি ধারণা জন্মে গেছে। তারা সংস্কৃতি বলতে মনে করতে আরম্ভ করেছেন ক’টি কবিতা, কটি গল্প, উপন্যাস, ভাওয়াইয়া গান, নজরুল গীতি এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত । জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়গুলোর কোনো স্থান যেনো আমাদের সংস্কৃতিতে নেই। আমাদের দেশে তাই সংস্কৃতিবান বলতে সেই শ্ৰেণীটিকেই বোঝায়, যারা শুধু কবিতা লিখার আজীবন ব্যর্থ প্রয়াস করেন, গল্প লিখতে যেয়ে মার খান, বাজে উপন্যাস লিখেন। এসবের সঙ্গে আরো দুটো গুণ থাকা চাই। প্রভুভক্তি এবং মার্জিতি। পৃথিবীর যাবতীয় জিনিসের বদল হয় প্রাকৃতিক নিয়মে আর আমাদের দেশের পণ্ডিতদের প্রভু বদল হয় ক্ষমতার নিয়মে।

বিদ্যা, বুদ্ধি এবং জ্ঞানের ভূমিকা কি সে বিষয়ে নিবিড়ভাবে চিন্তাভাবনা করেন, এরকম আধা ডজন মানুষও আমাদের দেশে নেই। এই না থাকাটা যে কাতোটুকু না থাকা একটু চিন্তা করলেই উপলব্ধি করা যায়। যদি আধা ডজন তেমন মানুষও থাকতেন বাঙলাদেশে সুস্থভাবে জ্ঞান এবং বিদ্যা চর্চার একটা আবেষ্টনী রচনা এতোদিনে হয়ে যেতো। সুস্থ জ্ঞানচর্চার একটা ক্ষেত্র যদি তৈরি হতো, তাহলে বর্বরেরা পদ্মার চর দখল করার মতো লাঠি বাগিয়ে হৈ হৈ করে ছুটে আসতে পারতো না। এতোদিনেও জগতের জ্ঞান-বিজ্ঞান ভাবকল্পনার ক্ষেত্রে আমরা এমন অসহায়, এমন কাঙ্গাল থেকে যেতাম না । আমাদের দেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান পড়ানো হয়, কিন্তু বিজ্ঞানের প্রকৃত লক্ষ্য কি সে সম্পর্কে বিজ্ঞানের শিক্ষকেরাই শেষ পর্যন্ত অনবহিত থেকে যান । বাঙলাদেশের সেরা বিজ্ঞানী বলে কথিত মানুষটি যখন শুধুই অর্থের জন্য নিম্নশ্রেণীর দীনিয়াত বই লেখেন, দেখেশুনে হতবাক না হয়ে উপায় থাকে না। শ্রেষ্ঠ লোকটিই যখন এরকম, কম শ্রেষ্ঠরা কি রকম খুব সহজে বুঝে নেয়া যায়। যে বিজ্ঞানের আবিষ্কারের বলে মানুষের জীবন সুন্দর, স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠছে, সমাজ উন্নত হচ্ছে তেমনি বিজ্ঞান চর্চা আমাদের দেশে কই? আমাদের দেশে আবিষ্কার কই? আর বিজ্ঞানীও বা কোথায়? বস্তুত এই দেশে ধর্মান্ধ মোল্লা এবং বিজ্ঞানীর মধ্যে খুব তফাৎ নেই।

সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস, রাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি বিষয়ের জ্ঞানের সংগে আমাদের দেশের মানুষের জীবনের বাস্তব যোগাযোগটা কোথায়? যদি বাস্তব যোগাযোগ নাই-ই থাকে তা হলে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসকল বিষয় পড়ানো এবং সেজন্য বিদেশে লোক পাঠিয়ে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করার সার্থকতাটা কোথায়? জ্ঞানকে যদি জীবনে প্রয়োগ করা গেলো না, সে জ্ঞানের চর্চা করে কি লাভ? সমাজ কেননা সাদা হাতির মতো এই পতিদের পুষবে, কেনো দুধ-ঘি খাইয়ে তাদের মোটা তাজা করবে? পণ্ডিতেরা পণ্ডিতদের জায়গায় অনড় স্থির থাকবেন । আমাদের দেশের পরম উপকারী জন্তুটির মতো মনের সুখে জাবর কাটবেন এবং নতুন প্রভু পেলেই প্রভু বদলের আনন্দে চীৎকার করে উঠবেন । আর সমাজের দুঃখ দুর্দশা বাড়বে এ তো হতে পারে না। এক সময়ে সমাজের চক্ষুষ্মন মানুষদের এই পণ্ডিতদের প্রতি তাকাতে হয়, নইলে সমূহ ধ্বংস অনিবার্য । জ্ঞান মানব জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ। পণ্ডিতদের প্রভাবে আমাদের সমাজে নানান বিষয়ে প্রকৃত জ্ঞানের বিকাশ হচ্ছে কিনা সেটিই দেখতে হবে। সমাজে পণ্ডিতের প্রয়োজন নেই একথা সত্যি হতে পারে না। তবে এমন পণ্ডিত প্রয়োজন যাদের প্রভাবে গোটা দেশের চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠবে, বহুকালের স্থবির জীবন ভেতর থেকে নড়ে উঠবে। তাদের শিক্ষাপদ্ধতি মানুষে মানুষে ভেদাভেদের প্রাচীরে শানানো আঘাত করবে, মানবিক বৃত্তিগুলোর উৎকর্ষ সাধন করবে, সুন্দরের বোধকে জাগ্রত, প্রাণবন্ত করে তুলবে, জড়কে পোষ মানাতে শেখাবে। শুধুমাত্র ভাষা এবং সাহিত্যকে আশ্রয় করে এসব হওয়া সম্ভব নয়। জীবনের অন্যান্য বিষয় এবং অন্যান্য মানব বিদ্যার উৎকর্ষ সাধিত না হলে সাহিত্যের উন্নতি হবে এমন আশা করা সুদুরপরাহত। সাহিত্য তো সমাজবদ্ধ জীবনের নানা চিকন মোটা প্রকাশ, আমরা আশা করবো কোত্থেকে?

আমাদের সামাজিক এই যুবদ্ধ স্থবিরতাকে নানান দিক থেকে জ্ঞানবিজ্ঞানের সাহায্যে আলোকিত আঘাত করতে হবে। সে পথেই আমাদের সমাজে একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব সূচিত হবে। উন্নততরো সাংস্কৃতিক বিপ্লব উন্নততরো রাজনৈতিক বিপ্লবের জন্ম দেবে। সুন্দর সমাজই রাজনৈতিক বিপ্লবের প্রাণ কথা। একটা পর্যায়ে আমাদের দেশে রাজনৈতিক কর্মীদের সাংস্কৃতিক কর্মীর ভূমিকা পালন করতে হবে এবং বিভিন্ন বিষয়ে সাংস্কৃতিক কর্মীদের রাজনীতি সচেতন হতে হবে। সমাজকে সুন্দর করা রাজনীতি এবং সংস্কৃতির যৌথ দায়িত্ব।

.

‘বিদ্রোহহীন জীবন বাঙ্গালীর আত্ম অস্তিত্বের অস্বীকৃতি।‘ বাঙ্গালী বারে বারে বিদ্রোহ করেছে কিন্তু লিখিত ইতিহাসের কোনও পর্বে বিদ্রোহকে জাতিগত খাতে প্রবাহিত করে দীর্ঘদিনের জন্য একটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম যেমন দিতে পারেনি বাঙালী, তেমনি পুরোপুরি বিদেশী, বিজাতির অধীনতার বন্ধনও মেনে নিতে পারেনি। প্রতিটি বিদেশাগত চিত্তস্রোতের সঙ্গে সংঘাতে বাঙালী জনগণের মজ্জাগত শৌর্য ফণা মেলেছে এবং সৃজনশীলতা উল্লস্ফিত হয়ে উঠেছে। বাঙ্গালীর প্রথম প্রামাণ্য ছন্দোবন্ধ বাণী বৈদিক নৈয়ায়িক ব্রাহ্মণদের ধর্মীয় বদ্ধমতের বিরুদ্ধে সহজিয়া সিদ্ধাচার্যদের নতুন জীবনবোধের প্রেরণাময় ধ্বনি। তেমনি সামাজিক বিদ্রোহ মুখিয়ে তুলেছে বৈষ্ণব গীতিকার প্রেমময় আর্তি। ময়মনসিংহ গীতিকা, মঙ্গল কাব্য সর্বত্র বিদ্রোহ এক সমাজ আদর্শের বদলে আরেক সমাজ আদর্শ প্রতিষ্ঠার বিদ্রোহ তাবৎ বাঙ্গালীর শিল্প সৃজনলোকে রক্তবাহী শিরার মতো প্রসারিত।

আধুনিক বাঙলা সংস্কৃতি বলতে যা বোঝায়, তাতো পুরোপুরি প্রতিবাদেরই সংস্কৃতি। রামমোহন, বিদ্যাসাগর ডিরোজিও, মাইকেল, দেবেন্দ্রনাথ, কেশব সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে কাজী নজরুল ইসলাম, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য পর্যন্ত সকলে প্রচলিত সমাজ ধর্ম এবং লোকাঁচারের বিরোধিতা করেছেন একদিকে, অন্যদিকে কেউ স্পষ্টভাবে, কেউ আভাষে-ইঙ্গিতে আরেকটি মহত্তরো, সুন্দরতরো সমাজের ছবি শিল্পরূপে ফুটিয়ে তুলেছেন। বাঙলার গৌরবময় সাহিত্য স্রষ্টাদের সৃষ্টি থেকে যদি সামাজিক বিদ্রোহ, নতুন মানবিক মূল্যমান প্রতিষ্ঠার বিদ্রোহ আলাদা করে ফেলা হয় তাহলে কি বাঙলাভাষা বিশ্বের সমৃদ্ধ ভাববাহী ভাষাপুঞ্জের আসন থেকে রাতরাতি প্রাদেশিক ভাষা হয়ে দাঁড়ায় না? রামমোহনের ধর্মীয় এবং সামাজিক মতবাদ ছাড়া তাঁর সাহিত্যের কতোটুকু মূল্য? বিদ্যাসাগরের সৃষ্টিকর্ম থেকে তার বৈপ্লবিক চিন্তাধারা ঘেঁকে আলাদা করে যদি ফেলা হয়, তাহলে তো তিনি টোলের ব্রাহ্মণ পণ্ডিত হয়ে দাঁড়ান। রামমোহনের ধর্মীয় এবং সামাজিক বিপ্লব বাদ দিলে অমন সূর্য সঙ্কাশ প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথের গর্ব বাঙ্গালী কিভাবে করতো? ভারতের জাতীয় আন্দালনের জান দেয়া নেয়ার মহৎ খেলা এবং রুশ বিপ্লবের অভিনব জঙ্গী মানবতার ডাকাতিয়া বাঁশীর ডাকেই তো কাজী নজরুলের কণ্ঠ নিনাদিত হয়েছে। তার

কবিতায় যে তীব্র আবেগ বিচ্ছুরিত হয়েছে, যে কুল ছাপানো ভালোবাসা লহরিত হয়েছে। তা কি প্রচলিত সমাজকে ভেঙ্গেচুরে নতুন করে বানানোর, নতুন মানব সম্বন্ধ রচনার ঐকান্তিক হাদ্য প্রয়াস নয়?

বাঙলা সাহিত্য প্রতিবাদের, প্রতিরোধের, বিদ্রোহের সাহিত্য। কিন্তু সে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, বিদ্রোহ পূর্ণাঙ্গ নয়। সে দোষ বাঙালী সমাজের। বাঙালী সমাজে বাঙলার মহত্তর মানবদের চিন্তাভাবনা মাত্র আংশিকভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইংরেজ রাজত্বের কারণেই এমনটি হয়েছে। বাঙালী মুসলমান সমাজে পার্শ্ববর্তী ভ্রাতৃসম্প্রদায়ের মতো তেমন মনীষী পুরুষের জন্ম হয়নি, যিনি চিন্তাভাবনার বলে আপন সম্প্রদায়ের মানুষকে অগ্রগামী করতে পেরেছেন। মনীষী না জন্মাবার সামাজিক এবং রাজনৈতিক কারণ নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু তার আলোচনার স্থান এ নয় । সে যা হোক, আধুনিক চিন্তাসমৃদ্ধ বিরাট কোনো পুরুষের অভিভাবকত্বের অভাবে বাঙালী সমাজের ভেতর থেকে ধর্মীয় ডগমা বা বদ্ধমত এবং সামাজিক আচারের জঞ্জাল ভেদ করে কোনো বিরাট মানুষ প্রবল প্রাণশক্তির তোড়ে মাথা তুলতে পারেনি। তার ফল দাঁড়িয়েছে ধর্মীয় বদ্ধমত এবং সামাজিক সংস্কারের কোলঘেঁষা অন্ধকার সামাজিকভাবে কাটিয়ে ওঠা এখনো সম্ভবপর হয়নি। এখনো সকলে ধর্মীয় ভাব অনুভাব এবং অনুশাসনকে অন্ধভাবে মেনে চলেন অথবা যারা একটু উন্নাসিক, নিজেদেরকে সমাজের প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন বলে ভাবতে শিখেন। নিজেকে আলাদা ভাবলে কি সত্যি সত্যি আলাদা হওয়া যায়? কোন মানুষ আপন ছায়ার অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারে, কোন মানুষ আপন সমাজের ওপর নির্ভরহীন হয়ে বাঁচতে পারে? মানুষ সব সময়ে সামাজিক জীব, তার যা কিছু উন্নতি, অগ্রগতি, সুখ-সমৃদ্ধি সব সমাজেই সম্ভব। কিন্তু বাঙালী মুসলমান সমাজের কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে অনেক দিন সে বোধ আসেনি। যে সকল কবি-সাহিত্যিক অল্পবিস্তর সামাজিক ভাবনায় ভাবিত হয়েছিলেন, তারা সমাজকে তেরশ বছর পিছিয়ে নিতে চেষ্টা করেছিলেন। ভূতের পা পেছন দিকে, তাই তাদের দ্বারা বাঙ্গালী মুসলমান সমাজের কোনোও লাভ হয়নি। ধর্মের আওতাভূক্ত, বিধি, আচার, সংস্কার বিশ্বাস, রীতি-নীতি, নিয়ম-কানুন এসব অস্বাস্থ্যকর জেনেও কোনো লেখক শৈল্পিকভাবে বা বিজ্ঞোচিত অথবা মানববাচিতভাবে এ সবকে চ্যালেঞ্জ করেননি। যেখানে পুরোনো বিশ্বাস, পুরোনো মূল্যবোধের প্রতি সজ্ঞান মেধাবী চ্যালেঞ্জ নেই, সেখানে মহত্তররা সৃষ্টির সম্ভাবনা কোথায়? যে যুথবন্ধ প্রথায় প্রশস্তি রচনা করে, সে তো দাসত্ব করে, তার অন্তরাত্মা পরাধীন। এই পরাধীন অন্তর থেকে কেমন করে স্বাধীন চিন্তা যা মহত্তরো সৃষ্টির শোণিত, উচ্ছিত হবে? আবার সমাজকে পিঠ দিয়ে একা আনমনে নিজের ভাবনা চিন্তা নাড়াচাড়া করার মধ্যেও ব্যক্তির সাধনার পূর্ণতার অভিলাষ কোথায়? পূর্ণতার সাধনা যেখানে নেই, সেখানে ব্যক্তির একান্ত অন্তরঙ্গ, আবেগ কিভাবে খেলা করে? এখনো পর্যন্ত কোনো বাঙালী মুসলমান লেখক তার সমাজের প্রাণহীন আচার পদ্ধতি, মূঢ়তা, স্কুল বিশ্বাস এসবকে চ্যালেঞ্জ করেননি। রাজনৈতিক উপন্যাস কেউ কেউ লিখেছেন, লিখতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু আমাদের দেশে প্রচলিত অর্থে রাজনীতি বলতে যা বোঝায়, তাতো এক ধরণের ক্ষমতালোভী মানুষের ক্ষমতা দখলের ফন্দী মাত্র। তার বেশী কিছু নয়। রাজনীতি মানব সমাজের সর্বাঙ্গীন পরিণতি নির্ধারণের নিয়তি, যারা রাজনীতি করেন তারা বিশ্বাস করলেও লেখকেরা, কবিরা, সাহিত্যিকেরা রাজনীতি এবং সংস্কৃতির কোন মানসিক মেলবন্ধন সাধনা করতে পারেননি বললেই চলে। অথচ মোস্ত ফা কামাল পাশার তুর্কীতে এই রাজনীতিই ধর্মীয় জাড্য, সামাজিক কূ-রীতি খেদিয়ে তাড়িয়েছে। সে-তো অনেকদিন আগের কথা। তুর্কীতে অনেকদিন আগে যা হয়েছে আমাদের দেশে এখন হওয়া সম্ভব নয় কেনো? এই প্রতিবাদের অভাবে আমাদের সমাজের জ্ঞানী গুণী মানুষকেও অন্ধ তামসিকতাসম্পন্ন মানুষদের দাস হয়ে থাকতে হয়। যে দু’একজন মাঝে মাঝে প্রতিবাদ করেন তারা বাঁচাল। তাদের সঙ্গে সে শল্য চিকিৎসকের তুলনা করা যায়, যে রোগ দূর করার বদলে রোগী মারে। মনুষ্যত্বের প্রতি শ্রদ্ধাহীন এবং মানুষের প্রতি মমতাহীন কবি, সাহিত্যিক কিংবা সমাজসংস্কারক কারো কোনো দাম নেই।

সমাজের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান। সুতরাং মুসলমান সমাজ থেকে আগত জ্ঞানবান, বিবেকবান, চিন্তাশীলদেরই দায়িত্ব সামাজিক অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার এবং বিবেকহীনতার বিরুদ্ধে তীব্র, তীক্ষ্ণ এবং সপ্রেম বিদ্রোহের আওয়াজ তোলা । মানুষের মন দিয়েই মনের পরিবর্তন সম্ভব। বাহ্যিক সমস্ত প্রচেষ্টা মনের জাগরণ, চৈতন্যের উদ্বোধন ছাড়া ব্যর্থ হতে বাধ্য। কেউ কেউ বলেন, ধন বন্টনের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলে ওসব থাকবে না। কিন্তু সাম্য প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই তো সর্বপ্রথম সংস্কারমুক্তির প্রয়োজন। ধর্মীয় সংস্কার এমন জিনিশ যা সোজা জিনিসকে বাঁকা দেখতে বাধ্য করে। এই বাঁকা দেখতে বাধ্য হয়েছিলো বলেই ভারত দ্বি-খণ্ডিত হয়েছে। অনেকে এই কথাটি সহজে বুঝতে চান না বলেই হিন্দু কমিউনিস্ট এবং মুসলমান কমিউনিস্ট শব্দ দুটি আমাদের সমাজে চালু হয়েছে।

এই বাঙলাদেশে যেখানে শতকরা আশিজন মানুষ মুসলমান-আশিজনের মধ্যে উনসত্তর জন সংস্কারান্ধ, সেই সমাজে আজকে যদি একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব সাধনের প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়, তার চেহারা কি হবে? ধর্মীয় সমস্ত অনুশাসনের অনেকগুলো কি রদ করতে হবে না? যদি তাই হয়, জোর করে সে সব কি সম্ভব? জ্ঞানের সাহায্যে নিষ্কলঙ্ক মানবতার বাণী প্রচার করে তার কি একটা ক্ষেত্র রচনা করতে হবে না? সে কাজ শিল্পীর, সে কাজ কবির, সে দায়িত্ব ঔপন্যাসিকের। শুধু মুসলমান সমাজ কেনো, হিন্দু সমাজে কি কুসংস্কার নেই? গোটা সমাজদেহে কি বর্ণাশ্রম ধর্ম জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে নেই? হিন্দু সম্প্রদায় থেকে আগত চিন্তাশীল মানুষদের এসবের বিরুদ্ধে ধ্বনি তোলা প্রয়োজন। একইভাবে সাঁওতাল, মগ, গারো, হাজং সকল ধর্মের সকল বর্ণের মানুষের মধ্যে একটা প্রীতির সঞ্চার করা এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে, যার প্রভাবে প্রত্যেক সমাজ ভেতর থেকেই সম্প্রদায়গত বদ্ধমতের আবরণ ঠেলে ফেলে দিতে পারবে। এক ধর্ম, এক সম্প্রদায়ের অনাচারের বিরুদ্ধে অন্য সমাজের মানুষের কিছু না বলাও আরেক ধরণের সাম্প্রদায়িকতা। কেননা যে ভাবেই হোক না কেনো যা যে কোনো মানুষের চিন্তা চেতনাকে আবদ্ধ করে রাখে তাকে শোধরাবার চেষ্টা না করা, নিজের জ্ঞান থাকলে সে জ্ঞানের অংশভাগী না করাও মানুষের প্রতি আরেক ধরনের কপটতা। কিন্তু বিপ্লবে কপটতার স্থান নেই। আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থা যে রকম তাতে শুরুতেই এক ধর্মের, এক সম্প্রদায়ের মানুষ অন্যকে উপযাচক হয়ে উপদেশ দিতে গেলে লাভের চাইতে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশী। বাঙলাদেশের মানুষ ধর্মীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সগ্রাম করেছে, তার কাঠামো ভেঙ্গে ফেলেছে। এখন সকল সম্প্রদায়ের মানুষ মিলে বাঙলাদেশে ধর্মের বদ্ধমতগুলো উড়িয়ে দিতে পারলে মানুষে মানুষে অন্তরের মিলনটা সহজ এবং স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। মানুষ শুধু মানুষ এই পরিচয়ে চিহ্নিত করার সর্বাঙ্গীন প্রয়াসটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মূল কথা। আমাদের দেশে সে প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছে। যারা বুঝতে চায় না, তারা মূঢ়, দৃষ্টিহীন এবং মানবোচিত প্রেমহীন।

.

আমাদের সমাজের এখন একটি প্রচণ্ড ওলটপালট অবস্থা। একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের স্বাভাবিক পরিণতি এবং একটি নতুন সমাজ সৃজনের পূর্বশর্ত যদি একে ধরে নেয়া হয়, তাহলে দোষের কিছু নেই। কিন্তু সমস্ত বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে, সমস্ত ভাঙন থেকে সুশৃঙ্খল পরিবেশ বেরিয়ে আসে, ভাঙনের মুখে নতুন চর, নাবাল জমি জাগে একথা তো সত্যি নয়। নৈরাজ্য নৈরাজ্যকেই ডেকে নিয়ে আসে। স্বাধীনতার পর পর একটি শ্রেণীর বদলে আরেক শ্রেণী স্বাভাবিকভাবে জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করার জন্য, ক্ষমতা অপ্রতিহত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। আমাদের উৎপাদন প্রক্রিয়া, বন্টন পদ্ধতি, যাবতীয় সামাজিক সম্বন্ধ, বৈদেশিক সম্পর্কের মধ্যেই এই শ্রেণীর বৃদ্ধির উপাদান রয়েছে। এই শ্রেণী যদি তার সপক্ষে যা কিছু আছে, সব কিছুকে ব্যবহার করে গ্যাট হয়ে বসে আমাদের জনগণের কিচ্ছু হবে না। তথাকথিত প্রতিটি জাতীয় সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিটি জাতি যা লাভ করে থাকে, যেমন জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সরকার, তার বেশী পাবেন না। কঠোর বাস্তবের শিক্ষা এই, সুস্থ মানুষ অকারণে কিছু করে না। আমাদের দেশের শ্রমিক-কৃষক নিম্নবিত্ত মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে এই তিন বস্তুর জন্য অংশ গ্রহণ করেছিলেন-এটা কিছুতেই সত্য হতে পারে না। তাদের এই সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করার পেছনে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কারণ বর্তমান ছিলো। রাজনীতিকে জনগণের সর্বাঙ্গীন ভাগ্যের নিয়তি যারা মনে করেন, তাদের কর্তব্য হবে এই বিশৃঙ্খলা, এ অসন্তোষকে সঠিকভাবে প্রবাহিত করিয়ে জনগণের মধ্যে চারিয়ে দিয়ে তাদের সুপ্ত শক্তির বিকাশ সাধন করে স্বাদেশিক এবং বৈদেশিক উভয় অর্থে শোষণহীন একটি সমাজ গঠনের জন্য শরীর এবং মনের দিক থেকে পরিপূর্ণভাবে তৈরি করে তোলা। তা যদি না হয়, তাহলে অপর সম্ভাবনাটিই কার্যে পরিণত হতে খুব বেশী সময়ের প্রয়োজন হবে না।

বাঙলাদেশের বর্তমান সামাজিক নৈরাজ্য সংস্কৃতি চিন্তায়ও প্রভাব বিস্তার করেছে। অনেক চিন্তাশীল মানুষ এখন চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ঠুটো জগন্নাথ হয়ে বসে আছেন। তাঁরা কিছু বলতে চান না। যারা প্রতিক্রিয়াশীল তাদের কথা বলছিনে। তারা তো সব সময়ে নিজের স্বার্থের কথা ভাবেন-এটা একটুও বিচিত্র কিছু নয়। কিন্তু যারা সত্য স্বাধীনতার পূজারী, যারা মনুষকে ভালোবাসেন, যারা নিজের দেশ, জাতি এবং দেশের মানুষকে ভালোবাসেন, তাঁরাও কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছেন। কারণ, কোনটা ন্যায়, কোনটা অন্যায় এ সময়ে চেনা অনেকটা কঠিন। তাই ভালো কথা বললেও তার প্রতিক্রিয়া খারাপ হবে মনে করে চুপ থাকা শ্রেয় মনে করেছেন। এঁরা প্রকারান্তরে এই নৈরাজ্যের শক্তির কাছেই আত্মসমর্পন করেছেন। তাঁদের মনোভাব মারাত্মক। কেননা, রোগ যখন প্রবল, জোরালো ওষুধের প্রয়োজন তখন বেশী। যখন পারিপার্শ্বিকার কারণে স্থির চিন্তা করা একরকম অসম্ভব, তখনই স্থির চিন্তা করার সময়। নৌকা যখন ঝড়ে পড়ে, তখনই দৃঢ়ভাবে হাল ধরে ঠাণ্ডা মাথায় তীর লক্ষ্য করে বাইতে হয়। নচেত যে বিপদের মধ্যে তরী দুলছে, সে বিপদেই গ্রাসিত হবার সম্ভাবনা অত্যধিক।

আমাদের প্রবীণ সংস্কৃতি বিশারদরা তাঁদের অভিজ্ঞতার দোহাই পেড়ে বিপদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে চান। যারা এ বিপদকে সোজাসোজি চ্যালেঞ্জ করতে চান, তাদেরকে হঠকারী ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে সম্ভাব্য সকল উপায়ে বিরোধিতা করছেন। যে ক্ষেত্রে তারা সরকারী কর্মচারী, পদস্থ অফিসার সরকারের আইন দেখিয়ে চিন্তার স্রোত, জীবনের উল্লাস এবং কল্পনার দাবীকে লৌহ শৃঙ্খলে আটক করে রাখতে চাইছেন-এই সময়েই তরুণদের বিদ্রোহ করার সময়, ভবিষ্যতের সুন্দর স্বপ্নের দিকে দৃষ্টি রেখে নৈরাজ্যের আওতা থেকে বেরিয়ে পড়ার সময়। প্রবীণ পদস্থ ভদ্রলোকেরা যে অভিজ্ঞতার দোহাই দিয়ে চোখ রাঙাচ্ছেন, সে তাদের সুদীর্ঘ জীবনের দাসত্বের অভিজ্ঞতা। এই মানসিকভাবে দাস সংস্কৃতিজীবীদের হাতে এতোকাল আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতির ভার ন্যস্ত ছিলো বলেই আমাদের শিক্ষা, আমাদের সংস্কৃতিতে জাতীয় মানসের আশা আকাঙ্খ প্রতিফলিত হয়নি।

এই নৈরাজ্য, এই বিশৃঙ্খলা কিছুতেই আমাদের সমাজের শেষ কথা নয়। এই নৈরাজ্যের মধ্যেই মহত্তরো সম্ভাবনার ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে। এই ভাঙনের কুলেই আভাসিত হবে নতুনের। আমাদের সমাজ যে ভাঙছে, আমাদের চিন্তাতে যে ঘূর্ণিস্রোত সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে মহত্তরো সামাজিক সম্ভাবনা যারা দেখতে চান না তাদের চিন্তা কিছুতেই সঠিক চিন্তা হতে পারে না। আমাদের দেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়-এই শান্তিপ্রিয় মানুষগুলো ক্ষেপে উঠেছেন। তাদের পেটে ভাত নেই, পরনে কাপড় নেই, শরীরে স্বাস্থ্য নেই, রোগের ওষুধ নেই, জীবন এবং জীবিকার নিশ্চয়তা নেই। এ সবের দাবীতে তারা ক্ষেপে উঠেছেন। সে সমস্তের ব্যবস্থা করা হোক, তারা আপনা থেকেই ঠাণ্ডা হয়ে যাবেন। যদি বলা হয় আমাদের মতো গরীব দেশে এতোসবের একসঙ্গে নিশ্চয়তা বিধান করা এতো সহজ নয়। তাহলে কথা দাঁড়াচ্ছে, এদেরকে তুমি নিশ্চয়তা দিতে পারছে না, কিন্তু নিশ্চিতভাবে একটা শ্রেণী কি ভাবে আরো ধনী হয়ে যাচ্ছে। এই ধনী হওয়ার নিশ্চয়তা তারা পেলো কোথায়? ধনীদের টাকা কার ব্যাংকে জমা থাকে? ধনীদের কলকারখানায় কারা পাহারা দেয়, কারা খাটে? বিচারে ধনীদের কারা জিতিয়ে দেয়? যদি বলো আগে থেকে এমন হয়ে এসেছে, বৃটিশ আমলে এমনও এমন ছিলো, এখনো এমন চলছে, করার কিছু নেই। এ তোমার মনগড়া কথা। বৃটিশ আমলে বৃটিশ গভর্ণর ছিলো, পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানী একনায়ক ছিলো, আর আমাদের আমলে আমরা তোমাকে জিম্মাদার করেছি এবং করছি এই জন্যে যে বৃটিশ আমলের সমাজটাকে তুমি ভেঙ্গে ফেলবে, পাকিস্তান আমলে সৃষ্ট আমলাতান্ত্রিকতার কাঠামোটা সম্পূর্ণ বদলে দেবে। তা না করে তুমি যদি সেই বৃটিশ এবং পাকিস্তানী আমলের প্রভূদের মতো ব্যবহার করো, তাদের সৃষ্ট আমলা এবং অনুচরদের নিজের চারদিকে বডি গার্ড রাখো অথবা নিজে একদল অনুরূপ বানিয়ে নাও এবং কারণ অনুসন্ধান না করে উপযুক্ত সামাজিক প্রতিবিধান করার বদলে নিজেই হুঙ্কার ছাড়তে থাকো এবং নৈরাজ্যের শক্তি বাড়িয়ে তোলো–সেটা আমার জাতির সর্বাঙ্গীণ বিকাশের পক্ষে ক্ষতিকর, একথা দ্বৰ্থহীন ভাষাতে ঘোষণা করবো।

রাজনৈতিক সংগ্রামকে স্বাভাবিক পরিণতির দিকে এগিয়ে নেয়ার প্রয়োজনের সঙ্গে সংস্কৃতির সগ্রামকেও এগিয়ে নিতে হবে। সুস্থ রাজনৈতিক সংগ্রাম ছাড়া সুস্থ সংস্কৃতি কখনো আশা করা যায় না। সুস্থ সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে যারা আশা রাখেন তাদের গৌণ কাজ হওয়া উচিত রাজনৈতিক সংগ্রামকে বিকশিত হতে সাহায্য করা। আমাদের দেশে অনেক প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বর্তমানে বক্তব্যহীন হয়ে পড়েছেন, তার কারণ হালের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে চরম এবং পরম মনে করেছেন। সে সঙ্গে তাঁদের শাসন পদ্ধতিকেও মনের দিক থেকে সমর্থন করতে পারছেন না। তা করলে তারা বিবেকের কাছে আপরাধী হয়ে পড়েন। বিকল্প কোনো রাজনীতির কথা চিন্তা করতে পারেন না। যেহেতু তাদের অনেকেরই আমাদের দেশের জনগণের উপর বিশ্বাস এবং আস্থা খুবই স্বল্প। আসলে তাদের নিজেদের উপরই বিশ্বাস নেই। এই আত্মবিশ্বাসের অভাবেই তারা ইচ্ছার বশেই হোক বা অনিচ্ছায় হোক সামরিক সরকার দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছেন। এখনও ব্যবহৃত হতে পেলে বেঁচে যান।

কিন্তু এ ভিন্ন সময়। আমাদের দেশের প্রতিটি শ্রমিক, প্রতিটি কৃষক নিজের শক্তির মহিমা বুঝেছে। সে হাতে কলমে বুঝেছে তার বন্দুক নিক্ষিপ্ত একটি বুলেটের সঠিক আঘাতে একজন পাকিস্তানী সৈন্য মরেছে। তেমনি আমাদের দেশের প্রতিটি তরুণ দেশপ্রেমিক উপলব্ধি করেছেন তাদের চিন্তা ও কল্পনার বিস্ফোরণের মধ্যেই একটি পুরোনো, সমাজ ধ্বসে যাচ্ছে, একটি নতুন সমাজ সৃজিত হচ্ছে। এই নতুন সমাজে সৃজনের পদ্ধতি থেকেই আমাদের দেশে আসবে নতুন সাহিত্যিক, নতুন কালের কবি, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক। উদ্ভব হবে ঝলমলে সব সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের ।

.

দেশটা যেনো আমাদের নয়। অন্য কেউ অদৃশ্যভাবে এই দেশ শাসন করে। ঠিক রাজনৈতিক অর্থে বলছিনে। ভিন্ন ভিন্ন দেশের রুচি সংস্কৃতির দাসত্ব করি আমরা মনে মনে। অপরের খুশী এবং পছন্দের মাপে আমরা গড়ে উঠি। আমাদের কোনো বিষয়ে জাতীয় কোনো দৃষ্টিভঙ্গী নেই। জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গীর অর্থে অন্ধ এবং অহংপুষ্ট স্বাদেশীকতাসর্বস্ব মনোভাবের কথা বলা আমাদের উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই নয়। সভ্যতার মূলকথা যা-জীবন জড়বস্তুকে শাসন করে, পোষ মানায়। আমাদের প্রতিবেশীদের উপকরণ সংগ্রহ করে এই দেশে একটি সভ্যতা সৃজন করতে পারবো, এই বিশ্বাসে বলীয়ান মানুষের সংখ্যা আমাদের দেশে খুবই বিরল। তাই বিদেশ থেকে বৈদেশিক অর্থ সাহায্যেরে দিকে হাপিত্যেশ করে বসে থাকি যেমন, তেমনি বিদেশী জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প সংস্কৃতির সুফলটুকু ভোগ করেই আমরা মনে করি সুসভ্য হয়ে গেলাম। বিলাত দেশটা যে সত্যি সত্যি মাটির–ঠেকে না শিখলে গোটা জীবনে অজ্ঞই থেকে যেতে হয়।

জ্ঞান সার্বজনীন। কিন্তু দেশে দেশে তার বিকাশ এবং প্রয়োগ বিধি একেক রকম। কিন্তু এই বোধটা আমাদের নেই, কেননা আমাদের অনুভূতিশক্তি খুবই ভোতা। তাই আমাদের শহুরে স্থাপত্যের দিকে তাকালে এক নিমিষে মনে পড়ে যায় একেক খণ্ড বিলেত আমেরিকা আমাদের দেশে উড়ে এসে জুড়ে বসে গোটা দেশের উত্থান শক্তি রহিত করে রেখেছে। বিলেত আমেরিকায় স্থাপত্য কলা খারাপ কিংবা অবিকশিত বলার ইচ্ছে আদৌ আমাদের নেই। বরং আমরা বলতে চাই, ওসব দেশে স্থাপত্য কলার প্রভূত উন্নতি হয়েছে, কিন্তু উন্নত স্থাপত্যের অনুকরণ করার মধ্যে আমাদের প্রকৌশলীদের মৌলিক শক্তির পরিচয় নেই। আমরা যে অনেক অনেক পশ্চাদপদ তার প্রমাণ আমাদের সাধনা থেকে কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, আধুনিক কোনো দার্শনিক সূত্র, সমাজতাত্বিক গবেষণা কিংবা অন্য কোনো রকমের কলা বা জ্ঞানের উদ্ভব হয়নি-অদুর ভবিষ্যতে যে হবে তার কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।

আমাদের এই দেশে মজার কথা হলো, যাদের এসব বিষয়ে ভাবার দায়িত্ব তাঁরাই মানসিকভাবে বিদেশের দাস হয়ে পড়েন। বিদেশের ভালো কিছু গ্রহণ করার মধ্যে কোনো যে দোষ আছে, তেমন কথা বলছিনে। কিন্তু বিদেশী সব কিছু আমরা দাসের মতো গ্রহণ করবো, না স্বাধীন মানুষের মতো গ্রহণ করবো পুরোপুরি নির্ভর করছে। আমাদের ইচ্ছার উপর। আমাদের ইচ্ছাটাও দেখতে হবে। এটি ব্যক্তিগত ইচ্ছা কি সামাজিক ইচ্ছা, তার চারিত্র্য নির্ধারণ করাও প্রয়োজন। কোনো লোক রসায়ন বিদ্যায় জ্ঞান লাভ করতে চাইলে জ্ঞান লাভ করতে পারেন। সে জন্য রসায়ন শাস্ত্রের গ্রন্থাদি পড়তে হবে। সেগুলো বাঙলা ভাষাতে নেই। সে জন্য তাঁকে ইংরেজী, ফরাসী, জার্মান শিখতে হবে । এদেশে গবেষণাগার এবং উপযুক্ত শিক্ষক নেই। সে জন্য তাকে সেসব দেশে যেতে হবে। কিন্তু একটা জাতির যদি হাজার হাজার রসায়নবিদের প্রয়োজন পড়ে তাহলে সকলকে প্রতিবছর জার্মানীতে, ফ্রান্সে, আমেরিকায়, রাশিয়ায় পাঠানো অসম্ভব। সে জ্ঞান–যাতে বিদেশীরা সাফল্য লাভ করেছেন, যে কোনো মূল্যে, যে কোনো শ্রমে, যে কোনো ত্যাগে এবং তিতিক্ষায় বাঙলা ভাষায় নিয়ে আসতে হবে, বাঙলাদেশে গবেষক এবং গবেষণাগার সৃষ্টি করতেই হবে। এই পদ্ধতিতেই জ্ঞানের সামাজিকীকরণ করা হয়। এ পর্যন্ত এদিক দিয়ে আমাদের দেশ এক পা-ও অগ্রসর হয়নি।

আমাদের অর্থনীতির পণ্ডিতেরা হার্ভার্ড থেকে যে অর্থনীতি শিখে আসেন তার প্রয়োগ আমাদের দেশে সম্ভব নয়। অক্সফোর্ড থেকে যে সমাজতত্ত্বের পাঠ নিয়ে আসেন বাঙলাদেশে তা অনেকটা মূল্যহীন। হার্ভার্ড-অক্সফোর্ডের শিক্ষা-দীক্ষা, গবেষণা ইত্যাদি অনেকটা ইংরেজ মার্কিন সমাজের অভিজ্ঞতা, উদ্দেশ্য শক্তি এবং বাস্তবতা দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। বাঙলাদেশে তা প্রয়োগ করা নানা কারণে অসম্ভব হয়ে পড়ে। তার ফলেই আমাদের পণ্ডিতেরা অনেক সময় বিদেশী বিদ্যার ভারবাহী পশুতে পরিণত হয়ে যান। যে বিদ্যার ফলিত প্রয়োগ নেই বা প্রয়োগের ক্ষেত্র অন্বেষণের ব্যাকুলতা নেই সে শিক্ষিত মানুষও এক ধরণের ভারবাহী পশু।

আমাদের দেশে অনেকদিন থেকে এ চলে আসছে এবং এখনো চলছে। তার কারণ এই শিক্ষিত শ্ৰেণীটিই নানাদিক দিয়ে নিয়ন্ত্রিত করেছে আমাদের সমাজকে। তারাই রাজনীতির হর্তাকর্তা, তারাই জাতির ভাগ্য বিধাতা। নিজেরা বহাল তবিয়তে বেঁচে থেকে সমস্ত দেশের মানুষ মরুক, বাঁচুক, জাহান্নামে যাক কিংবা অশিক্ষিত থেকে যাক তাদের কিছু আসে যায় না। আপন পাওনাগণ্ডা পেলেই তারা খুশী । এই সন্তুষ্ট শ্রেণীর অবিমৃষ্যতার দরুণই পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসন এতো দীর্ঘকাল স্থায়ী হতে পেরেছে। জ্ঞানই শক্তি-এ অনুভূতি তাদের মন মানসে কদাচিৎ জেগেছে। তারা উপনিবেশবাদ বা সাম্রাজ্যবাদের লেজুর ছিলেন, তাদের মাধ্যমেই বিদেশী শোষকেরা এ দেশের মানুষকে শোষণ করতো এবং তারা নিজেরাও প্রত্যক্ষভাবে শোষণ করতেন। তাদের নিজেদের প্রয়োজন মতো জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সংস্কৃতি সবকিছুর উদ্ভব হতে পারে।

আমাদের মন মানস এতো দীর্ঘকাল ধরে দাসত্ব করেছে যে, তার হদিস আমরা নিজেরাও জানিনে। অসংখ্য বিদেশী জিনিশের মধ্যে কোনটা আমাদের জন্য উপযুক্ত, কোনটা অনুপযুক্ত, কোনটা প্রয়োজন, কোনটা অপ্রয়োজন, কোনটা খেতে ভালো হবে, কোনটা খেলে খারাপ হবে, কোনটা করা উচিত, কোনটা করা উচিত নয় সে ব্যাপারে আমাদের ধারণা করার শক্তিও নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা জ্ঞানকে কতোদূর সার্বজনীন করবো, প্রযুক্তি বিদ্যার কি পরিমাণ প্রসার ঘটাবো এবং ফলিত বিজ্ঞানের বিকাশ কতোদূর নিশ্চিত করবো তার উপরেই নির্ভর করছে আমাদের স্বাধীনতার ভাবষ্যৎ। এসব যদি করা অসম্ভব হয়ে পড়ে তাহলে নামে স্বাধীন হলেও কার্যত আমাদের দাস থেকেই যেতে হবে। অপরের বাধাধরা চিন্তার মধ্যে আমাদের আবর্তিত হতে হবে । আমাদের নিজস্ব রুচী নিজস্ব সংস্কৃতির যে নির্দিষ্ট কোনো আকার আছে, তা কোনদিন দৃশ্যমান করে তুলতে পারবো না। বাঙালী সংস্কৃতি বলতে যদি আদ্যিকালের কোম সমাজের চিন্তা-চেতনায় আচ্ছন্ন থাকি বা তা আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করি তাহলে আমরা সভ্য মানুষ হিসেবে স্বীকৃত হতে পারবো না। ইতিহাসের ধারায় বাঙালী আজ যেখানে এসে পৌঁছেছে সব কিছুকে স্বীকার করে নিয়ে, মেনে নিয়ে এই বৈজ্ঞানিক যুগে পৃথিবীর অপরাপর দেশের সঙ্গে তাল রেখে আমাদের মাটি জলহাওয়া যে আমাদের চরিত্রকে একটি নির্দিষ্ট ধাচে তৈরি করেছে, সেটি ফুটিয়ে তুলতে পারাটাই হবে আমাদের যথার্থ মৌলিকতার স্ফুরণ। এবং সেটাই হবে আমাদের যথার্থ বাঙ্গালীয়ানা।

আজ এই দাস্য মনোভাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তা নইলে আমাদের স্বাধীনতা মিথ্যা হয়ে যাবে। কিন্তু এই মানসিক দাসত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কাজটা হৈ হৈ করে হওয়ার কথা নয়। এতে প্রয়োজন সুন্দরতম ধৈর্য, মহত্তম সাহস, তীক্ষ্ণতম মেধা এবং প্রচণ্ড কুলছাপানো ভালোবাসা, যার স্পর্শে আমাদের জনগণের কুঁকড়ে যাওয়া মানসিক প্রত্যঙ্গে আশা-আকাঙ্খ জাগবে এবং সাহস ফণা মেলবে।

.

আমাদের সমাজের দিকে তাকালে একই সঙ্গে লজ্জা, ঘৃণা, এবং অসহায়তা বোধ না করে উপায় নেই। এই যুগে মানুষ চাদে গেছে, সমুদ্রের তলায় ডুবেছে, ক্ষ্যাপা নদীর মাজায় বন্ধনী পরিয়ে ঊষর মরুভূমিকে শষ্য শ্যামলা করেছে। নিপ্রাণ কঠিন আবরণ উপড়ে ফেলে দিয়ে তুষার ঢাকা অঞ্চলে সোনালী গমের ক্ষেত বধুয়ার আঁচলের মতো দুলছে। মানুষের কতো কীর্তি, কতো সম্মিলিত প্রয়াস, কতো অসাধ্য সাধনের কাহিনী আমরা শুনে পাশ ফিরে ঘুমোই। অথচ আমরাও মানুষ । আমাদেরও হাত পা মাথা সব আছে। আমরাও সমাজে বাস করি। আমাদের রাষ্ট্র আছে, সরকার আছে। তবু আমাদের মানুষ হয়েও পশুর মতো জীবন কাটাতে হয়। আমরা গতর খাঁটিয়ে উৎপাদন করতে পারিনে, মাথা খেলিয়ে আবিষ্কার করতে পারিনে, বুক প্রসারিত করে ভাবতে পারিনে। আমাদের এই দেশে আমরা হাত-পা যুক্ত মানুষ হয়েও বিকলাঙ্গ। চোখের সামনে আমাদের কতো কিছু ঘটে যাচ্ছে, কতো নতুন নতুন আবিষ্কারে সমৃদ্ধ হচ্ছে জ্ঞান বিজ্ঞানের ভাণ্ডার, সন্ধানীর স্বচ্ছ দৃষ্টিতে বিজুলীর রেখার মতো কতো তত্ত্ব এবং তথ্য ঝিলিক দিয়ে ধরা পড়ছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই বিরাট যজ্ঞে আমাদের কোন স্থান নেই। সমাজ ভেঙে সমাজ গড়ার এই মহান শক্তিমন্ত ক্রীড়ায় আমরা নীরব দর্শকও নই। নতুন সংগ্রামী মানবতার ললাটে বিজয় মুকুট পরাবার কাজে এক পা এগুই তিন পা পিছিয়ে যাই।

আমাদের সমাজে দৈব এবং দুর্দৈব রাজত্ব করছে। প্রবল পক্ষ দুর্বল পক্ষের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে। গোটা দেশব্যাপী বিচারের বাণী নীরবে নিভৃত অশ্রুপাত করছে। দয়া, মানবতা, প্রেম, করুণা এসব শব্দ এখন অন্তর্নিহিত ব্যাঞ্জনা হারিয়ে ফেলেছে। শঠতা, মিথ্যাচার এবং প্রবঞ্চনা এদেশের রাজনৈতিক আন্দালনের মূলধন। তামসিক প্রবৃত্তির পরিচর‍্যা এদেশে ধর্মীয় কর্তব্যের অঙ্গীভূত বিষয়। সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা এদেশের নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রবল পক্ষের স্থূল অসহিষ্ণু সাম্প্রদায়িকতা এবং দুর্বল পক্ষের নিষ্ক্রিয় বিদেশে সহানুভূতি যাঞ্চাকারী সাম্প্রদায়িকতা এবং দেশের ঐতিহ্যিক সম্পত্তি । আবার প্রবল পক্ষ এবং দুর্বল পক্ষ, হিন্দু-মুসলমান দুই-ই মিলে দুর্বলতরো পক্ষ মগ, হাজং, গারো, চাকমা প্রভৃতি সব উপজাতিদের বুকের ওপর চেপে বসে আছে । আমাদের এই দেশে ধর্মের নামে ধর্মধ্বাজীরা রায়ট করে। জ্ঞানের নামে পণ্ডিত নামধারী মানুষেরা চাতুরী করে, সত্য, সুন্দর এবং মঙ্গলের নামে কবি-সাহিত্যিক এবং চিন্তাশীল মানুষরা চাতুরালী করে। রাজনীতির নামে লোক ঠকায়। কুসংস্কার মানুষের মনে মনে বন রচনা করেছে। কাঁপালিক প্রবৃত্তির গোঁড়ায় জল ঢেলে, সার দিয়ে রাজনীতির সেনাপতিবৃন্দ খেয়া ঘাট পার হবার জন্য নিত্যনতুন চকচকে কৌশল রচনা করেন। হয়তো তারা নির্বাচনের খেয়া খুব ধুমধাম করে পার হয়ে যাবেন। কিন্তু তারপর? তারপরও তো বাঙলাদেশে মানুষ থাকবে। সে মানুষদের কি হবে? যাদের দেখে প্রাচীন যুগে চর্যাপদের কবি বলেছিলেন, হাড়িতে ভাত নেই, তাই নিত্য উপবাস করতে হয় এবং মধ্যযুগে চণ্ডী-মঙ্গলের কবি বলেছেন, “শিশু কাঁদে ওদনের তরে, বাঙলাদেশে প্রাচীন ও মধ্যযুগ যুগপৎভাবে অবস্থান করছে। এখনো হাড়িতে ভাত থাকে না, গেরস্থ নিত্যি উপোষ দেয়, এখনো শিশু এক ফোঁটা দুধের জন্য আছালি পিছালি করে। সেই চাষা, সেই লাঙ্গল, সেই বলদ, সেই সংস্কার, ক্ষুধা, সেই, রোগ, সেই অভাব, দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর বাঙলাদেশের ললাটের অক্ষয় লিখনের মতো অটুট হয়ে আছে। সব পর্যায়ক্রমে একের পর এক দর্শন দিয়ে যায়। বন্যা, জলোচ্ছাস এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ঝড়-ঝঞ্জ ঘরদোর তছনছ করে ফেলে। বনের পশুরাও অনেক দ্র জীবন যাপন করে। তারপরেও বাঙলাদেশের মানুষ বেঁচে থাকে। তাদের জীবনী শক্তি এতো শক্ত। বাঙলাদেশের নারী সমাজের কথা কয়ে লাভ নেই। ঊনবিংশ শতাব্দীর মনীষীবৃন্দ বাঙলাদেশের নারীদের দুঃখ–দুর্দশার কথা স্মরণ করে চোখের জল ফেলেছিলেন। এখন চোখের জলও ফুরিয়ে গেছে। তবু সে সহিষ্ণুতায় বাঙালী নারীর স্বামী পুত্রের সংসার রক্ষা করে, সন্তান ধারণ করে এবং রোগ শোক মারীর আক্রমণ এড়িয়ে বাঁচিয়ে রাখে সন্তান তা পারমাণবিক বিদ্যার চাইতেও দুরূহ এবং জাটিল সাধনার বলেই সম্ভব। নারীমুক্তি, নারী জাগরণ, নারী আন্দোলন ইত্যাদি সব শব্দ কিষাণের কুটিরে, জেলে, তাঁতী, ছুতোর, কামারের ভেঙ্গে পড়া আটচালায় কেমন ইংরেজী শোনায় না?

অনেকগুলো অভুক্ত সন্তান যে রকম করে জননীর স্তনের বোটা আকর্ষণ করে মারা মারি কামড়া-কামড়ি করে কিন্তু কারো পেট ভরে না, তেমনি আদ্যিকালের উৎপাদন পদ্ধতি অনুসারে আদ্যিকালের যন্ত্রপাতি নিয়ে কোটি কোটি মানুষ জমির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। কারো ক্ষুধা মেটে না। এতো মানুষের পেটের ভাত যোগাবার ক্ষমতা জমির নেই। তাই মানুষ আত্ম-ধ্বংসী কলহে রত হয়। কিন্তু মানুষ যাবে কোথায়? আমাদের দেশে কল নেই, কারখানা নেই, বিশ্বজোড়া আমাদের কারবার তেজারতি কিছু নেই। অদূর ভবিষ্যতে যে হবে তার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই আমাদের জাতীয় পেশা ভিক্ষা। ফরেন এডে’র দিকে আমরা হা-পিত্যেশ করে চেয়ে থাকি। বিদেশী সাহায্য খেয়ে খেয়ে আমাদের হজম শক্তি অনেক গুণ বেড়ে গেছে। এক দেশের ভিক্ষা নেয়ার পর আরেক দেশের দিকে হাত বাড়িয়ে বাঙালী কাঙালী প্রবাদের সার্থকতা প্রমাণ করি। সেই বিদেশী সাহায্য আমাদের দেশের অতি খাওয়া লোকেরা উদরসাৎ করে, অভূক্তদের কাছে পৌঁছায় না। আমাদের জাতীয় মুলধন হতাশা। বেশী খাওয়া এবং একেবারে না খাওয়ার হতাশার পীড়নে আমাদের সমাজ উত্থান শক্তিহীন। আমাদের সমাজে অফুরন্ত শক্তি এবং অনন্ত সম্ভাবনার আধার অমৃতের পুত্র, অমৃতের সহোদর মানুষের জীবনই সবচাইতে ঘৃণিত, অবহেলিত এবং অনিশ্চিত। সর্বক্ষেত্রে জীবন লাঞ্ছিত, অপমানিত এবং নিগৃহীত হচ্ছে। পৃথিবীর কোনো দেশে মানুষ এমনি করে তারই ভাই মানুষের হাতে মার খায়? মার খেয়ে সহ্য করে? পৃথিবীর কোনো দেশে মানুষ শুভবুদ্ধির প্রতি এমন কঠিন ব্যঙ্গবিদ্রুেপের বাণ নিক্ষেপ করে? পৃথিবীর কোনো দেশে মানুষের অধিকার মানুষ এমনি করে হরন করে? পৃথিবীর কোনো দেশে মানুষের ভবিষ্যতের আশার মুকুল এমনি করে ঝরে যায়? অকাল জীবনতরু মরে যায়? কল্পনার পাখি পাখা অচল হয়? যদি কোনো দেশে হয় সে আমাদের দেশ-আমাদের প্রিয় কবি কল্পচোখে যার রূপ দেখে গান বেঁধেছেন সোনার বাঙলা… । দুনিয়ার সব কিছুর অদল বদল হয়ে গেছে। দেশে দেশে পালা বদলের পালা সূচিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের সোনার বাঙলা বালুচরে আটকে পড়া নায়ের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। রাজা এসেছে, রাজা গিয়েছে। কতো আন্দোলন গতিবেগ সঞ্চয় করে জলস্তম্ভের মতো ফুলে ফুলে উঠলো । কতো নেতা এলেন গেলেন, কতো আশা উদ্যম, স্বপ্ন-সাধনার অপচয় হলো কিন্তু মানুষের ভাগ্য ফিরলোনা-এমনি দেশে আমরা বাস করি। রাগে দুঃখে, ক্ষোভে, অপমানে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হয়। অন্যায়ের ওপর ভিত্তি করে শাসকদল টিকে থাকে আবার অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেই বিরোধী দল ক্ষমতা দখল করে। যতোই ভাবি অসংখ্য মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে মুষ্টিমেয় মানুষের এই ছিনিমিনি খেলা তার বুঝি কোন অবসান নেই ।

শেষ পর্যন্ত কি ভিখারীই থেকে যাবো? আমরা কি রাজনীতিতে প্রজ্ঞা এবং ভালোবাসার বদলে ফাঁকিবাজিই করে যাবো? সরকারের নামে নির্যাতনেই চলবে এদেশে? বিজ্ঞানের নামে বিদেশের সেকেন্ডহ্যান্ড যন্ত্রপাতি বিক্রয়ের ক্যানভাসার সৃষ্টি হবে? সামাজিকতার নামে তামসিক বৃত্তির চর্চা করবো? সাহিত্যের নামে বাজে কথার আড়ত বানাবো? লোকহিতের নামে জুয়াচুরি করবো? এক অদ্ভুত দেশে আমরা বাস করি। যে দেশে মানুষের সাবালক মস্তিষ্কের ফসল বিজ্ঞান এসেছে অনেকদিন আগে। কিন্তু মানুষের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনতে আমাদের দেশে ব্যর্থ হয়েছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞান এসেছে বিলাসের উপকরণ হিসেবে, শোষণের হাতিয়ার হিসেবে। আমাদের দেশের জীবন সুখী এবং সুন্দর করার বদলে হতশ্রী এবং হতাশায় ভরিয়ে তুলেছে। আধুনিক মানববাদী শিক্ষা আমাদের দেশে এসেছে আমলা সৃষ্টির ফুস মন্তর হয়ে। পৃথিবীর অতগ্রসর সামাজিক বিপ্লব এবং রাজনৈতিক সংগ্রামের আগ্নেয় চেতনা আমাদের দেশের ঘাটে এসে তুকতাক বশীকরণ বিদ্যার আকার ধারণ করেছে।

সবচে’ আশ্চর্যের বিষয় আমাদের জ্ঞানীগুণীজন কবি সাহিত্যিক শিক্ষক সাংবাদিকদের মন এসবে মোটেই খোঁচায় না। প্রতিটি সরকারের আমলে সকলে তাকে ঠুকে বলেন খোদার দুনিয়ার এই অংশ আপনার সুশাসনে বহাল তবিয়তে চলছে। সমাজের তলা পর্যন্ত অবলোকন করে সারবান কিছু বলেছেন, বা লিখেছেন এমন মানুষ আমাদের সমাজে নেই বললেই চলে। যাদের ভাবার দায়িত্ব, তাদের ভাবনা যন্ত্র বিকল। প্রয়োজন কতোদূর, ঘা কতোবড়ো সে বিষয়ে কোনো অনুভূতি নেই। একটি জাতি তার প্রয়োজন, অপ্রয়োজন, অজ্ঞতা, মূর্খতা ইত্যাদি নিয়ে ভাবতেই যদি না পারে তার কিসের গণতন্ত্র? গালভরা নাম দিলে তো আর সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না। ভিক্ষাজীবী, পুঁজিবাদ, ভিক্ষাজীবী পরাধীনতা আর ভিক্ষা নির্ভর সমাজতন্ত্রে পার্থক্যটা কোথায়? সমাজতন্ত্রের মূল কথা মানুষকে ভেতর থেকে আত্মশক্তিতে আস্থাশীল করা, সৃজনী শক্তিতে এবং সহযোগীতায় বিশ্বাস করা। মানুষের সৃষ্ট সমস্ত কৃত্রিম বিভেদকে গুঁড়িয়ে ফেলে মানুষে মানুষে মিলনের পথ প্রশস্ত করা; সর্বপ্রকার দাসত্ব থেকে মানুষী সত্তা যা সভ্যতার প্রাণবস্তু তাকে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন এবং আপন ক্ষেত্রে স্থিত করা। বাঙলাদেশে সে প্রক্রিয়াটি কি শুরু হয়েছে? বেতার টেলিভিশন সংবাদপত্রে বলা হচ্ছে হাঁ শুরু হয়েছে। কিন্তু তাও অন্যান্য দেশের অন্ধ অনুকরণ করে বলা হচ্ছে। তার সঙ্গে বাস্তবের কোনো সংযোগ নেই।

সমাজতন্ত্রের কবি কই? ভাবুক কই? চিত্রকর কোথায়? কোথায় মানুষে মানুষে ভেদাভেদ বিনাশকারী কুসুমসদৃশ কোমল বজ্ৰাদপি কঠোর মানবপ্রেমিক সংগ্রামী? কোথায় আত্মপর ভেদহীন জ্ঞানমিশ্রিত কর্মীর বাহিনী? এসব কিছুই নেই-তবু সংবিধানের ঘোষণাতে সমাজতন্ত্র এসে যাবে–সে ভারী আজব কথা। আজকের এই পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের মানুষদের একটি মাত্র কর্তব্য হওয়া উচিত। সে যেখানে যে দেশকে ভালোবাসে, সংস্কৃতি ভালোবাসে, মানুষ ভালোবাসে, জ্ঞান ভালোবাসে; সকলে মিলে জ্ঞানের ভবিষ্যৎ, মানুষের সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ এবং দেশের ভবিষ্যৎ সুন্দরভাবে রচনা করার কাজে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। কতগুলো বিষয়ে নিশ্চিত ধারণা নেয়া প্রয়োজন। জ্ঞান মানবজীবনকে সুন্দর করে বলেই আকাঙ্খিত। সংস্কৃতিতে জীবনের আশা-আকাঙ্খর স্পন্দন বাজে বলেই বরণীয়। একটা দেশের আধারেই জ্ঞানের প্রসার, সাংস্কৃতিক অগ্রগতি, মানুষের উন্নতি হতে পারে। আন্তর্জাতিক ভিত্তিতেও সে সবের কল্পনা করা যায় । কিন্তু এ পর্যন্ত পৃথিবীর লিখিত ইতিহাসে আন্ত র্জাতিক প্রচেষ্টায় এ জাতীয় প্রমাণ মেলে না। আন্তর্জাতিক সাহায্যের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করে আমাদের ভাগ্য বদলানো সম্ভব নয়। আমাদের দাঁড়াতে হবে নিজের মেরুদণ্ডের ওপর, তাকাতে হবে, নিজেদের দিকে, অনুসরণ করতে হবে নিজেদের সৃজনী শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে দেশের মানুষকে, জাগাতে হবে ঘুমন্ত শক্তি এবং প্রতিভাকে । বড়ো জোড় বিদেশ থেকে প্রেরণা পেতে পারি, দৃষ্টান্তে উৎসাহিত হতে পারি, কিছু উপকরণও আনতে পারি। আমাদের দেশে আমরাই সব। যা কিছু করার আমরাই করবো।

.

সমস্ত কিছুর একটা ভিত্তি, একটা অবলম্বন প্রয়োজন। বাঙলাদেশে যে নতুন সংস্কৃতির রূপরেখা আভাসিত হয়ে উঠেছে, সম্পূর্ণ ঐতিহাসিক প্রয়োজনে বাঙলাদেশের জনগণের নতুন একটি সংস্কৃতি ক্ষেত্রের দিগন্ত উন্মোচন অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে-তার বস্তুভিত্তি কি? সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন এবং অন্যান্য সুকুমার কলা অনুকুল পরিবেশ না পেলে গড়ে উঠতে পারে না। আশা করতে দোষ নেই, বাঙলাদেশে অনতিবিলম্বে তেমন একটা পরিবেশ তৈরি হবে। কঠোর বাস্তবের দিকে না তাকিয়ে শুধুমাত্র আশাবাদ দিয়ে কোথাও কিছু ভালো কাজ হয়েছে তেমন প্রমাণ নেই। আমাদেরও বাস্তব অবস্থার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করার প্রয়োজন এসেছে। অন্যভাবে বলতে গেলে এরকম দাঁড়ায়, বাস্তব অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, সোজাসুজি না তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।

সংস্কৃতির বাহন পত্রপত্রিকা এবং নানা রকমের সাময়িকী । আজকে বাঙলাদেশে বলতে গেলে কোনো পত্র পত্রিকা নেই যাতে তীব্র জীবনাবেগ, গভীর প্রাণস্পন্দন, পরিণত চিন্তা কিংবা জনগণের কল্যাণ ভাবনার কোনো চিহ্ন ধারণ করে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়। তার ফলশ্রুতি এই হয়েছে, আমাদের এই দেশে মতামতের, ভাবের, অনুভূতির এবং জ্ঞানের চলাচল প্রক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে রুদ্ধ হয়ে পড়েছে। পণ্ডিত সমাজ একেবারে সমাজের সঙ্গে বাস্তব সংযোগহীন হয়ে পড়েছে। আর পরিণত বুদ্ধি, জীবনের অভিজ্ঞতা এবং প্রগাঢ় জ্ঞানের অভিভাবকত্বে যে নতুন চিন্তার উম্মেষ হয়, প্রবীণের সস্নেহ প্রশ্রয়ে, ঋদ্ধ সমালোচনায় তরুণ তার সাধনার যে সার্থকতা অনুভব করে, তা একেবারেই হচ্ছে না। পণ্ডিতেরা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন, তরুণরা কোনো একটা লক্ষ্য ঠিক করতে পারছেন না বলে অনেক ক্ষেত্রে দিকভ্রান্ত হয়ে পড়েন। কর্তব্যাকর্তব্য নির্ধারণ করতে পারেন না। আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে অনেকগুলো সাময়িকপত্র থাকলে পণ্ডিতেরা কিছুতেই বিচ্ছিন্ন থাকতে পারতেন না। তাদেরকে নেমে আসতে হতো, নানান বিতর্কের সম্মুখীন হতে হতো, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক নানা প্রশ্নে মতামত রাখতে হতো। পণ্ডিতবর্গের মতামতের ওপর নির্ভর করে গোটা সমাজে তর্কের তুফান ছুটতো। জাতির মানসূহদে ঢেউয়ের পর ঢেউ খেলে যেতো। এই দ্বন্দ্বে আমাদের সংস্কৃতির ভারজীর্ণ অংশ খসে পড়তো। শুধু প্রাণটুকু তরুণদের মনপ্রাণ লালিয়ে তুলতো। তারা কল্যাণের, সুন্দরের, সত্যের পথে হেলায় দুরূহ সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে পারতেন।

পাকিস্তান আমলে ঔপনিবেশিক সরকার চাইতো না বাঙলাদেশের পত্র-পত্রিকার প্রসার হোক, বাঙালী সৃজনশীল কর্মে আত্মনিয়োগ করুক। তা করলে ভয় ছিলো, বাঙালী শিল্প-বিজ্ঞানে, সাহিত্য-ইতিহাসে তার জাতির মানস যাত্রার ভঙ্গীটির সঙ্গে পরিচিত হলে একদিন স্বাধীনতা ঘোষণা করবে। এই আশঙ্কাবশত তারা বাঙালীর সাংস্কৃতিক বিকাশ নানান দিকে ঠেকিয়ে রেখেছিলো। সেই কারণে পাকিস্তানী আমলে উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিধর্মী কোনো সাময়িক পত্রের জন্ম হয়নি। সমকাল জাতীয় যে দু’য়েকটা সাময়িক পত্রের দান এদেশের সংস্কৃতির বিকাশে স্মরণীয় তাও কোনো দিন পাকিস্তানী সরকারের আরোপিত বিধিনিষেধের পরিপন্থী কোনো চিন্তা ভাবনা করতে পারেনি।

উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় কি তৃতীয় পাদ পর্যন্ত বাঙলার সব রকমের অগ্রগতির বিষয় স্নিগ্ধ মস্তিষ্কে বিচার বিবেচনা করলে দেখতে পাবো বহতা নদীর মতো একটা না একটা সাময়িকপত্র জনমতকে শিক্ষিত করছে, নতুন চিন্তাধারার বিকাশ সাধন করছে, নতুন প্রতিভা সৃজন করছে। বাঙলার সংস্কৃতির, রাজনীতির, সাহিত্য-বিজ্ঞানের যারা বরেণ্য পুরুষ বলে আমরা মনে করি, এই সকল সাময়িক পত্র না থাকলে তাদের কারো জন্ম হতো না, সে কথা বলাই বাহুল্য। উনবিংশ শতাব্দীর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, ‘সংবাদ প্রভাক’, ‘বঙ্গ দর্শন’, ‘প্রবাসী’ থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের ‘কল্লোল’, ‘পরিচয়’, প্রভৃতি পত্র-পত্রিকা বাদ দিলে দেখতে পাবো, যাদের দানে বাঙালী সমাজ উর্বরা হয়েছে, সমৃদ্ধ হয়েছে বাঙলা সাহিত্য, রাজনীতিতে এসেছে বেগ, এই সাময়িক পত্র পত্রিকাগুলোর পেছনে না তাকালে তাদের জন্ম সম্ভব হতো না।

সাময়িক পত্রপত্রিকা বহতা নদীর মতো আর সামাজিক ভাবে শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শনের আলোচনা আলো-বাতাসের মতোই প্রয়োজনীয়। পৃথিবীর সব দেশেই দেখা গেছে নতুন যুগের সূচনা হওয়ার সময়ে, নতুন চিন্তাধারা বিকাশ লাভ করার সময়ে, নতুন সমাজ নির্মাণ করার প্রাক্কালে সমমনা মানুষেরা পরস্পর মিলিত হয়ে, একে অপরের গুণাবলীর তারিফ করেছেন, দোষ দেখিয়ে দিচ্ছেন, পারস্পরিক সহযোগীতার ক্ষেত্র প্রশস্ত করছেন, একই লক্ষ্যে কাজ করার ভিত্তিভূমি প্রতিষ্ঠা করছেন। অন্যান্য দেশের কথা বাদ দিয়ে বাঙ্গালী সমাজের উনবিংশ শতাব্দীর কথাই ধরা যাক। রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠিত ‘আত্মীয় সভা থেকে ব্রাহ্ম ধর্মের সূত্রপাত। এই ব্রাহ্ম ধর্মের সংবৃদ্ধির কারণ ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারে প্রতিষ্ঠিত ‘হিন্দু মেলায়’ই উত্তরকালে নানাবিধ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়ে ভারতের জাতীয় আন্দোলনের রূপ এবং আকার পেয়েছে। এমনকি বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময়েও বাঙলাদেশের জেলায় জেলায় নানা সাংস্কৃতিক সম্মেলন হতো। সে সব সম্মেলনে নানা জাতীয় সমস্যার বিষয় অত্যন্ত আন্তরিকতা সহকারে হিতৈষণার বাণী গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়তো। সারা দেশে জ্ঞান বিদ্যা চর্চার একটা হাওয়া আপনা থেকেই সৃষ্টি হতো।

কিন্তু আমাদের বাঙলাদেশে সে রকম কোনো কিছুই করা হয়নি। মাঝে মধ্যে কবিদের সম্মেলন সাহিত্যিকদের অনুষ্ঠানের সংবাদ কাগজে দেখা যায়। সেগুলো ব্যয়বহুল হোটেলে অথবা জনগণের দুরধিগম্য অন্য কোনো স্থানে। এই জাতীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে লেখক সাহিত্যিকেরা সমাজে প্রমাণ করতে চান তারাও দামী লোক। কিন্তু যে মনোবৃত্তির কারণে গোটা দেশ এবং দেশের মানুষের দিকে পিঠ দিয়ে এই ধরনের সভার আয়োজন করা হয় তা অত্যন্ত সংকীর্ণ, তাই নিন্দনীয়। যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে কাগমারীতে একটা সাহিত্য সম্মেলনের কথা শুনেছি। এই সুদীর্ঘ সময়ের পরিসরে আর ঐ জাতীয় সভা বা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়নি।

তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ পড়বেন কি পড়বেন না, বর্ণমালার সংস্কার হবে কি হবে না ইত্যাদি বিষয়েও পণ্ডিতজনেরা খুব ক্ষুদ্র আকারে হলেও নিজেরা একত্রিত হয়েছেন, মতামত রেখেছেন এবং গোটা জাতির কাছে এই গ্রহণ বর্জনের কথা স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু এই ধরণের অনুষ্ঠানগুলো আত্মরক্ষামূলক, আত্মবিকাশের কিছু নেই । সামরিক সরকারকে খুশী করার জন্য সরকারী উদ্যোগে অনেক সভা-সমিতি হয়েছে, সেগুলোতে আমাদের সংস্কৃতির বিরোধী ব্যক্তিবৃন্দই বক্তা এবং সভাপতির আসন অলংকৃত করেছেন। জনগণ ওসব উদ্যোগ আয়োজনকে সব সময়ে ঘৃণার চোখেই দেখেছেন।

বাঙলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে উচিত ছিলো নানা বিষয়ে অনেকগুলো সাময়িক পত্রের আত্মপ্রকাশ। কিন্তু তা হচ্ছে না, বিনিময়ে কোলকাতার পত্র পত্রিকা এসে আমাদের বাজার ছেয়ে ফেলেছে। আমরা কোলকাতার পত্র পত্রিকা আসার বিরোধী নই । কিন্তু কোলকাতার পত্র পত্রিকার আমাদের বাজারে এই একাধিপত্য মারাত্মক। তার দুটি কারণ। প্রথমতঃ কোলকাতার পত্র-পত্রিকাগুলোতে যে ধরনের চিন্তা চেতনার প্রকাশ পায় এবং যে ধরনের সমাজ আদর্শের ছবি তুলে ধরে, সে ধরনের সমাজ আমাদের জনগণের স্বার্থ বিরোধী। তাই এক ভাষা-ভাষী অঞ্চল হলেও আমাদের সমস্যা এবং পশ্চিম বাঙলার সমস্যার ধরনটি এক নয়। দ্বিতীয়তঃ ওদেশের সব পত্র পত্রিকা ব্যাপক হারে আমাদের দেশে আসতে থাকলে আমাদের দেশে সাময়িক পত্রের জন্ম এবং বিকাশ অনেক কারণে বিঘ্নিত হবে। আমাদের প্রতিভাবান এবং প্রতিশ্রুতিবান লেখক সাহিত্যিকেরা পূর্বসংস্কারের বশে কোলকাতার কাগজে লেখা প্রকাশ করবেন এবং কোলকাতার কাগজগুলো বাজার রাখার কারণ কিছুসংখ্যক লেখকের লেখা প্রকাশ করবেন। তার ফল দাঁড়াবে আমাদের দেশে চিন্তাসমৃদ্ধ, সৃষ্টিধর্মী কাগজের প্রকাশ বিলম্বিত হবে। আমাদের সব সমস্যা তো আর কোলকাতার কাগজে আলোচিত হতে পারে না, কারণ কোলকাতার নিজস্ব সমস্যা রয়েছে। আমাদের সাময়িকী আমাদের নিজেদের জন্ম দিতে হবে এবং আমাদের লেখক নিজেদের সৃষ্টি করতেই হবে। প্রথম দিকে হয়তো আমাদের লেখকেরা অপূর্ণ থেকে যাবেন। প্রচেষ্টা আন্তরিক এবং শক্তিমন্ত হলে সে অভাব কাটিয়ে উঠতে পারবে। নবজন্মের সময় সবদেশে তো এমন হয়েছে।

কিন্তু কোলকাতার সঙ্গে ভাবের আদান প্রদান, মতের বিনিময় পুরোপুরি চালু রাখা প্রয়োজন। সঙ্গে সঙ্গে কোলকাতার যে সমস্ত কাগজ যেমন ‘দেশ’, ‘আনন্দ বাজার’, ‘অমৃতবাজার’, ‘যুগান্তর’, ‘জলসা’ ইত্যাদি আমাদের দেশে ব্যাপক হারে চলছে, সেগুলোর দিকে সন্দেহের চোখে না তাকিয়ে উপায় নেই। কেননা সে সকল কাগজের একমাত্র লক্ষ্য কাটতি । টাকা উপার্জন ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু আমাদের দেশে একটি নতুন সমাজ আদর্শ, একটি নতুন সংস্কৃতি সৃজনের প্রয়োজন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। শুধু লোকরঞ্জনের অভিপ্রায়ে যে সকল কাগজ, সেগুলো বেশী পড়লে আমাদের জনগণের চেতনা থিতিয়ে যাবে। একইভাবে বিদেশী যে সকল যৌন পত্র পত্রিকা, হালকা গোয়েন্দা বই আমাদের দেশে আসে সেগুলোর প্রসারও রোধ করতে হবে। ভাবতে অবাক লাগে বিজ্ঞানের জার্নাল, দর্শনের বই আমাদের বই বিক্রেতারা আনে না, আনে নোংরা বই।

সরকারের ওপর নির্ভর করে বিশেষ লাভ হবে মনে হচ্ছেনা। কারণ সরকার ইতিমধ্যে যে সকল নীতি নির্ধারণ করেছেন, তাতে নতুন চিন্তার প্রসারের স্থান নেই বললেই চলে। সরকার এমনভাবে প্রেস-ট্রাস্টের কাগজগুলো, রেডিও-টেলিভিশন এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহ নিয়ন্ত্রণ করছেন তাতে স্বাধীন চিন্তা যা সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান শিল্প-সাহিত্যের প্রাণবস্তু তার কোনো স্থান নেই। সুতরাং সে সকল পত্র পত্রিকা থেকে জাতির জন্য মঙ্গলকর কিছু বেরিয়ে আসতে আশা করা অবান্তর। তেমনি সরকারী উদ্যোগে যে সকল সাহিত্য সভার অনুষ্ঠান হচ্ছে, তাতে নতুন সংস্কৃতি সৃজনের উত্তাপ বিকীরণের বদলে তোষামোদ এবং আমলাতান্ত্রিকতাই প্রধান্য পাচ্ছে। কিন্তু সরকার তো আর দেশ নয়। এ সরকার খারাপ করলে টিকতে পারবেন না। জনগণ নতুন সরকার আনবেন। সুতরাং জনগণেরই দায়িত্ব সাময়িক পত্র প্রকাশ এবং ঘন ঘন সাংস্কৃতিক সম্মেলন, ঘরোয়া বৈঠক ইত্যাদির অনুষ্ঠান করে সাহিত্যের উন্নতি সাধন করা এবং সংস্কৃতির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করা।

.

আমরা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবার চেষ্টা করছি। আমাদের সবদিকে উদ্ভাবনী শক্তির উদ্বোধনের বদলে আমরা অপরের অনুকরণ করে আত্মপ্রবঞ্চনা করছি। ভালো জিনিশ অনুকরণ করার মধ্যে দোষের কিছু নেই, কিন্তু অন্ধ অনুকরণটা কি কখনো ভালো? যে সমাজে আমাদের পিতৃপুরুষেরা জীবন অতিবাহিত করেছেন, যে সমাজে পাকিস্তানী একনায়কোরা চুটিয়ে রাজত্ব করেছে তার কাঠামোটা তো ভেঙ্গে গেছে। যে মূল চিন্তার উপর আমাদের সমাজকে জোর করে স্থিত রাখা হয়েছিলো তা ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। এখন আমাদের নতুন মূল চিন্তা সৃষ্টি করার এবং সে অনুসারে গোটা সমাজকে ঢালাই করার সময়। এখন কথা দাঁড়ালো যে নতুন সমাজ সৃজনের তাগিদ সমাজের গভীর থেকে সঞ্চারিত হয়েছে, গণমানুষের জীবনের দাবী যাকে প্রায় অবশ্যকরণীয়ের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে এবং যা বাঙলাদেশের ঐতিহাসিক অহং বা হিষ্ট্রিক ইগোর’ অভ্যুদয়ের শামিল তার দিকে মনোযোগ দেবো না কি বিদেশের দিকে তাকিয়ে তাদের সাফল্যে আত্মহারা হয়ে আনন্দে বগল বাজাবো, সেটা স্থির করা আমাদের মৌলিক এবং প্রাথমিক কর্তব্য। রাশিয়া আমেরিকার মানুষ চাদে গেছে, রাশিয়ার শ্রমিকরা জারতন্ত্রের উচ্ছেদ সাধন করে মেহনতী মানুষের নেতৃত্বে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী সমাজ নির্মাণ করেছে। তেমনি করেছে অপরাপর সমাজতন্ত্রী দেশের মানুষ। এসব সংবাদে আমাদের জন্য শুভ সংবাদ বয়ে এনেছে। মানুষ আত্মবিশ্বাসে উদ্ভাবনী শক্তির ব্যবহার করতে পারলে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে, গ্রহান্তরেও যাত্রা করতে পারে। যারা চাদে গেছে তারাও মানুষ-আমাদেরই স্বজাতি। তাদের বিজয়ে আনন্দিত হওয়ার অর্থ হলো, যেহেতু আমরাও মানুষ, চেষ্টা করলে হয়তো আমরাও কোনো দিন দুরুহ সাধনায় সিদ্ধি লাভ করতে পারবো। তেমনি শ্রমিক শ্রেণীর বিজয়ে আমরা আনন্দিত হই এই কারণে, আমাদের মতো যে সব দেশে দৈব দুর্দৈব রাজত্ব করতো, মুষ্টিমেয় মানুষ সমাজের অধিকাংশ মানুষকে শাসন এবং শোষণ করতো, জনগন তাদের দুঃখ দুর্দশাকে বিধিলিপি মনে করে অপমান আর লাঞ্চনা সহ্য করতো, তারা এক যোগে দাঁড়িয়ে শোষক শ্রেণীর হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে নিজেরাই মালিক হয়েছে সব কিছুর এবং সে সঙ্গে শোষক শ্রেণীর পোষিত বিশ্বাস সংস্কার সব ঝেটিয়ে তাড়িয়ে মানুষের বাস্তব জীবনের সাথে সম্পর্কিত বিশ্বাস এবং ধারনাকে সমাজের মর্মকেন্দ্রে স্থান দিয়েছে। এই দৃষ্টান্তে আমাদের আনন্দিত এবং উৎসাহিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ আমাদের দেশের মানুষ যদি চায় তারাও অনুরূপ আরেকটি বিল্পব আমাদের দেশে সম্পন্ন করতে পারে। যেহেতু সামাজিক বিপ্লব সমাজ বিজ্ঞানের এবং রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি বিষয়, নিপীড়িত শ্রেণী যদি বিপ্লব সাধন করতে চায়, তাহলে অবশ্যই ধারাবাহিকভাবে বিপ্লবের শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। আমাদের দেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের কর্তব্য হওয়া উচিৎ আমাদের জনগনের মধ্যে ইতিহাসের এই গতিধারাটির বোধ চাড়িয়ে দেয়া এবং যে সকল সংস্কার বিশ্বাস ইতিহাসের স্বাভাবিক গতি পথে বাধা রচনা করে, সে সকল প্রতিবন্ধক অতিক্রম করবে কি করে, তার বিষয়ে ওকেফহাল করা। মানুষের বোধকে উন্নত করা, রুচিকে পরিশীলিত করা, সংগ্রামী মানবতার প্রতি মানুষকে শ্রদ্ধাশীল এবং কায়িক মানসিক শ্রমের প্রতি যত্নশীল করে তোলাই এ পর্যয়ে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কাজ।

অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশের কোনো কোনো বুদ্ধিজীবীকে বলা হয় আমেরিকার মানুষ, কাউকে রাশিয়ার, কেউ চীনের কেউ ভারতের এবং কেউবা পাকিস্ত নের। এদের অনেকের সম্বন্ধে পরিস্কার ভাষায় বলে দেয়া যায় দালাল। শুধু অর্থের জন্যই বিদেশী শক্তির দালালি করে। কিন্তু সকলে এই হীন অর্থে দালাল নন। যদি বা দালালি করেন, সে সম্বন্ধে নিজেরাও বিশেষ সচেতন নন। কারণ তাঁরা মানুষের মুক্তির আদর্শে বিশ্বাসী। স্কুল লোভের কারণে বিদেশী শক্তির হয়ে কাজ করেন, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।

তাঁদের অনেকে অন্ধভাবে চীন, রাশিয়া প্রভৃতির দেশের সব কিছুকে এ কারণে সমর্থন করেন যে, ওসব দেশে সমাজ এমন করে ঢালাই করে ফেলেছে জনগন, সেখানে মানুষে মানুষে সমতার আদর্শ অনেকাংশে বাস্তবায়িত হয়েছে। এই মুগ্ধতাই তাঁদের অন্ধতার কারণ। সেখানে মানুষে মানুষে সমতার আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একথা সত্য, কিন্তু তাতেও ভেবে দেখলে আমাদের পুলকিত হওয়ার খুব বেশী প্রয়োজন নেই। কারণ আমাদের কাছে সব চেয়ে যেটা প্রত্যক্ষ, যেটা খাঁটি সে হলো, আমাদের দেশ এবং দেশের মানুষ। এই দেশ বহির্ভূত মানসিক আনুগত্যের চাইতে ক্ষতিকর আর কিছু নেই। একটি দৃষ্টান্ত দিলে, বিষয়টি পরিষ্কার হবে। খিলাফত আন্দেলনের সময়ে ভারতবর্ষের মুসলমানেরা এককাট্টা হয়ে বৃটিশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলো তুর্কীর খলিফার রাজত্ব রক্ষা করার দাবিতে। সেই দিক দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে, গোটা খেলাফতের ব্যাপারটাই ছিলো অবৈজ্ঞানিক, দেশ বহির্ভূত এবং না ধর্মী আন্দেলন। কার্য কালে দেখা গেলো খালিফাঁকে খেদিয়ে দেশের বের করে দিয়ে মুস্তাফা কামাল পাশা এক নবযুগের সূচনা করলেন। সে সময়ে মুগ্ধদৃষ্টিতে মুসলমানেরা যেমন ওসমানীয় সাম্রাজ্যের রাজধানীর দিকে তাকিয়ে থাকতেন, তেমনি ভাবে প্রগতিশীল বলে কথিত বুদ্ধিজীবীরা সমাজতান্ত্রিক দেশসমুহের রাজধানীগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকেন। যদিও এই দুই মোহমুগ্ধতার মধ্যে কিছুটা গুণগত পার্থক্য রযেছে।

অনেকে ভেবে দেখতে রাজি নন যে, সমাজতান্ত্রিক দেশসমুহের সমাজতন্ত্রের প্রচারের চাইতে আরো বেশী কিছু সমস্যা রয়েছে। তাদের খেয়ে পরে বাঁচতে হয়, গৃহ এবং বহিঃ শত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে হয়, অপরের সঙ্গে কারবার তেজারতী করতে হয় এবং তদুপরি তাদের পররাষ্ট্র নীতি বলে একটা যে জিনিশ আছে সে বিষয়ে আদৌ ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ করেন না। আজকের সেভিয়েত রাশিয়া এবং চীনের পররাষ্ট্র নীতির কথাই ধরা যাক। দুটি দেশের বর্তমান পররাষ্ট্র নীতির মধ্যে এমন অনেক কিছু রয়েছে যার সঙ্গে জারদের এবং চীনা সম্রাটদের অনুসৃত নীতির সঙ্গে মিল বর্তমান। তাদের আমরা যতোদূর সমাজতন্ত্রের প্রসার প্রচারের বন্ধু মনে করি, আসলে তাঁরা ততোটা নয়। গভীরভাবে বিচার করলে দেখা যাবে ও সমস্ত দেশ জাতীয় স্বার্থকেই সব সময়ে প্রধান্য দিয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের কতিপয় বুদ্ধিজীবী এ বিষয়টি বুঝতে চান না,বড় লোকেরা গরীব অহঙ্কারী আত্মীয়ের মতো, তাঁরা সমাজতান্ত্রিক দেশের সমর্থক সে গর্বে দেশের মাটিতে পা ফেলেন না। এঁদের জন্য দুঃখ করা যায়, করুণা করা যায় । কিন্তু ওই বিদেশাভিমুখিতা যদি ব্যাপক হয় তাহলে আমাদের দেশের সমাজ পরিবর্তনের কাজটি বিলম্বিত হবে। তাই সমাজতান্ত্রিক দেশের যে সংস্কৃতি তা সে সকল দেশের সমাজ বাস্তবতার ফসল। তারা সমাজ ভেঙ্গে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠা করে নতুন সংস্কৃতির সৃষ্টি করেছে। প্রতিটি সমাজের মানুষকেই তার নিজের সমাজ পরিবর্তন করে গড়তে হয় নিজেদের সংস্কৃতি। যা কিছু আমরা রক্ত দিয়ে, প্রাণ দিয়ে, চিন্তা দিয়ে, স্বপ্ন দিয়ে সৃষ্টি করিনি, তাতে আমাদের অধিকার নেই। এই সংস্কৃতিতে অধিকারবোধটি গভীর নয় বলেই আমাদের দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী নিজের দেশের ইতিহাসের বদলে চীন-রাশিয়ার ইতিহাস মুখস্ত করে। আসলে এটাও একটা পলায়নী মনোবৃত্তি, এই পলায়নী মনোবৃত্তি থেকেই রাজনীতি সংস্কৃতিতে লেজুরবৃত্তির জন্ম। আগে আমরা লেজ না মাথা সেটিই ঠিক করতে হবে। মহামতি লেনিন শ্রমিক শ্রেণীর বন্ধু কথাটি সত্য। কিন্তু জার্মানীর মানুষের তো তা দিয়ে কোনো লাভ হয়নি। জার্মানীতে হিটলার এসে বসেছিলো, জার্মানীর শ্রমিকরা কিছুই করতে পারেনি। কারণ জার্মানীর শ্রমিক শ্রেণী, জার্মানীর রাজনৈতিক আন্দোলন, জার্মান লেনিন সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে। তেমনি আমাদেরও চীনা লুসুন কিংবা রাশিয়ান গর্কী দিয়ে চলবেনা। আমাদের চাই নিজেদের মানুষ, আমাদের গণ সংগ্রামের উত্তাপ থেকে জন্ম হবে যাদের ।

.

আমাদের দেশে একটি রেনেসাঁর লক্ষণ জীবনের নানা ক্ষেত্রে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে! কি সংস্কৃতি চিন্তায়, কি রাজনীতিতে এমন কতিপয় লক্ষণ এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ফুটে বেরিয়েছে, পূর্বের যুগে তা ছিলো সুপ্ত, চিন্তাবিদদের চিন্তা এবং স্বাপ্নিকদের স্বপ্নের বিষয়। যেহেতু পুরনো সমাজের গর্ভ থেকে একটা নতুন সমাজ জন্ম নেয়ার বেদনা এখন তীক্ষ্ণভাবে অনুভূত হচ্ছে, তাই নতুন এবং পুরনোর মধ্যে সংঘাতটাও তীব্র আকার ধারণ করেছে। এই সংঘাত শুধুমাত্র পাকিস্তানী সংস্কৃতি এবং পাকিস্তানী আমলের সমাজের সঙ্গে প্রাদেশিক বাঙ্গালী সংস্কৃতি এবং কৃষিভিত্তিক অনগ্রসর বাঙ্গালী সমাজের মধ্যে সীমিত নয়। আবহমান কালের ঐতিহ্যভিত্তিক স্থবির প্রায় বাঙ্গালী সমাজ এবং সংস্কৃতির সঙ্গে আন্তর্জাতিকতা অভিমুখী বাঙ্গালী সমাজ সংস্কৃতির সংঘাতটাও বড়ো বেশী মুখিয়ে উঠেছে। শেষোক্ত সংঘাতটাকে বাঙ্গালী জনগণের মুক্তি সংগ্রামই সুনির্দিষ্ট আকার দান করেছে এবং সঞ্চারিত করেছে তাতে বেগ আর আবেগ। নিজেদের কিছুকে অস্বীকার না করে বিশ্বের যা কিছু মহীয়ান, গরীয়ান তা গ্রহণ করা এবং একই সঙ্গে নিজেদের যা কিছু অস্বাস্থ্যকর এবং জীবন বিরোধী মনে হবে, বর্জন করার মধ্যেই আমাদের জাতীয় রেনেসাঁর ভবিষ্যৎ সংগুপ্ত রয়েছে।

রেনেসাঁর মূলকথা মানুষের জীবন সম্পর্কিত সমস্ত বিষয়ের নতুন মূল্যায়ন এবং বাস্ত বতা সম্মত উপায়ে কি ব্যক্তিক জীবনে, কি সামাজিক জীবনে স্বীকার করে নেয়া। এই কাজটিতেই প্রয়োজন জ্ঞানের। যখনই আমাদের সমাজে স্বীকৃতি পাবে-জ্ঞানই শক্তি, তখনই আমাদের দেশে সম্ভাবিত হয়ে উঠবে একটি রেনেসাঁ। সমাজের মুখ্য অংশে জ্ঞানের শাসন প্রবর্তিত হওয়ার পূর্ব শর্ত একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক পদ্ধতি ব্যক্তির অন্ত জীবনের মহিমা এবং তার ব্যক্তিত্বের অনন্যতা স্বীকার করবে। একই সঙ্গে সামাজিক জীবনের দাবির প্রতি সচেতন থাকবে। এই ধরনের একটি রাজনৈতিক পদ্ধতি সৃষ্টি করার কাজ সহজসাধ্য নয়-বিশেষতঃ আমাদের এই দেশে। তার কারণ, আমাদের মানুষ অশিক্ষিত এবং কুশিক্ষিত, কুসংস্কারে তাদের চিন্তা-চেতনা আবদ্ধ। দেবতা পুজোর মতো ব্যক্তি পুজোয় তারা অভ্যস্ত, সাম্প্রদায়িকভাবে ছাড়া অনেক চিন্তাও করতে পারেন না। সুতরাং এই দেশে মামুলী অর্থে যাকে আমরা রাজনীতি বলি, তাই দিয়ে মানুষের চরিত্রের আমূল সংস্কার সাধন করে একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক পদ্ধতি নির্মাণ করার কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব নয়। ইজমের’ পর ইজম’ আসতে পারে। থিয়োরী আর থিয়োরীর জঙ্গলে মানুষের চিন্তা ভাবনা দিকচিহ্নহীন হয়ে পড়তে পারে। কিন্তু মানুষের স্বভাব এবং চিন্তাধারা পরিবর্তন হবে না। মানুষের চিত্তবৃত্তির উন্নতি সাধন না করে, তার বুদ্ধিবৃত্তিতে পরিশীলন না এনে, জ্ঞানের আগুন বুকে না জ্বালিয়ে তাকে একটা সমাজ ভেঙ্গে আরেকটা সমাজ নির্মাণের কাজে ঠেলে দেয়াও একধরণের জবরদস্তি । শেষ পর্যন্ত জবরদস্তি পশুর সমাজে চললেও মানুষের সমাজে চলে না। আজকে যে সকল রাজনৈতিক দল বোধবুদ্ধিহীন উপায়ে মানুষকে বিপ্লবের মায়া কাননের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে, তারা হয়তো মিথ্যা বলছে অথবা সমাজে জবরদস্তির রাজত্ব কায়েম করতে চাইছে। দুটোই যে ব্যর্থ হবে, ব্যর্থ হতে বাধ্য, সে কথা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।

সামাজিক বিপ্লবের পূর্ব শর্ত সমাজের মুখ্য অংশে জ্ঞানের শাসন প্রতিষ্ঠিত করা। মানুষ তার পূর্বপুরুষ মানুষের কাছে যা কিছু পেয়েছে, তার মধ্যে জ্ঞানই সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদএই জ্ঞান প্রয়োগ করে তার যৌহ জীবন কিভাবে সে চালাবে এরকম চিন্তা এবং কর্মে সে যদি উদ্দীপিত হয়ে না উঠে তাহলে কেন সে বিপ্লব করতে যাবে? মানুষ কি কখনো স্বেচ্ছায় সন্ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টির কাজে অংশ গ্রহণ করতে পারে? কিন্তু মানুষের প্রচেষ্টা এবং চিত্ত সড়েও অনেক সময় নিজেদের শক্তি ও দুর্বলতা কোথায় জানতে পারে না। লোকচরিত্রের রহস্য বুঝতে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে থাকে। তাই তারা ভাবে এক, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে হয়ে যায় ভিন্ন, করতে চায় একরকম, কিন্তু হয়ে যায় অন্য রকম। তাই প্রতিটি সামাজিক বিপ্লবকে সুষ্ঠুভাবে প্রবাহিত করার জন্য মানুষের মননশীলতার পরিবর্তন সাধন সম্ভব নয়, তাই প্রতিটি রাজনৈতিক বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে একটা মানসবিপ্লবেরও প্রয়োজন অনিবার্য হয়ে পড়ে। বাঙলাদেশে বর্তমানে যে মানন বিপ্লবের প্রয়োজন অমোঘ হয়ে উঠেছে, তার রূপটি কি হবে সে বিষয়ে একটা প্রাথমিক ধারণা নেয়া অবাস্তব হবে না আশা করি; পাকিস্তানী আমলে পাকিস্তানী শাসকেরা ইসলাম, মুসলমান কোরআন এবং হাদিসের নামে এমন কতিপয় ধারণা চালু করেছিলো, যেগুলোর পেছনে কোনো বাস্তব সত্যের স্বীকৃতি নেই! পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাতারাতি যে ধারণাগুলোও চলে যায়নি। রঞ্চ অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মানুষের মনের মধ্যে তার শিকড়ও অনেকদূর বিস্তৃত। সে ধারণাগুলোর অযৌক্তিকতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখাতে হবে। সেগুলো যে জীবন বিরোধী, সভ্যতা বিরোধী-আমাদের জনগণের সামনে তা প্রমাণ করতে হবে। পাকিস্তানীদের দ্বারা প্রবর্তিত সমস্ত ধারণা অবৈজ্ঞানিক, সমস্ত আইন-কানুন পদ্ধতি তৎকালীন পূর্ব বাংলাকে উপনিবেশ রাখার জন্যই প্রয়োগ করেছে এবং যা মানুষের মনে গভীর ছাপ রেখেছে, তার অশুভ প্রভাব থেকে মানুষের মন এবং চেতনাকে সৃষ্টিশীল উপায়ে মুক্ত করতে হবে। আবার যারা সনাতন বাংগালীয়ানার বড়াই করেন, কোম জীবনের গুণগান করেন, অনগ্রসর সামন্তভিত্তিক কৃষি সভ্যতার ঢিলে-ঢালা মন্থর জীবনের মূল্য চিন্তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তারাও বাঙ্গালী সমাজ ও সংস্কৃতির গতিকে পশ্চাদমূখী করতে চান। তার অর্থ হলো, বাংগালীর ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করা, বাঙলাদেশও যে ভূগোলের একটা চিহ্নিত অংশ সে সত্যের অপলাপ করা, বাঙলার জনগণ যে পৃথিবীর জনগণের একটা ভগ্নাংশ, এই দিবালোকের মতো সত্যকে অস্বীকার করা। বস্তুতঃ আমাদের মন-মানসে বর্তমানে দুই ধরণের অন্ধতা বর্তমান। এই পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক আরোপিত অন্ধতা, অন্যটা স্বেচ্ছা অন্ধতা। আমাদের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী এরকম বুঝিয়ে থাকেন যে বাঙলা ভাষা এবং সংস্কৃতির উৎকর্ষ যা হওয়ার বৃটিশ আমলে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথের সাধনায় হয়ে গেছে, বাঙলা সাহিত্যের যতোটুকু শ্রীবৃদ্ধি পশ্চিম বাঙলায় হয়েছে, তার বাইরে একচুল অগ্রসর হওয়ার সামর্থ্যও নেই। তারা ঠিক একথা স্পষ্টভাবে বলেন না, কিন্তু যে মানসিকতা দিয়ে তাঁরা রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল, বিদ্যাসাগর এবং সংস্কৃতির অত্যন্ত বরেণ্য পুরুষদের বিচার করেন, তা অনেকটা এই রকম। এই অর্থহীন অতীতচারিতা ভবিষ্যৎ থেকে আমাদের দৃষ্টি অতীতের দিকে নিয়ে যায় এবং শাসকশ্রেণী গদী রক্ষার কারণে এই অতীতচারিতাকেই অধিক মূল্য দিয়ে থাকে। তার দুটি কারণ। একদিকে আত্মপ্রসাদ অনুভব করতে পারে–জাতীয় সংস্কৃতির চর্চা করছি, অন্যদিকে শাসন ত্রাসনও অব্যাহত রাখা যায়।

বাঙলাদেশের নাড়ীর স্পন্দনে আজ যা ধ্বনিত হচ্ছে, তার সুরটি আন্তর্জাতিক। তার নিজের যা আছে তাই নিয়ে বিশ্বের সামনে তাকে দাঁড়াতে হবে। তাতে পাকিস্তানী সমাজ বা বাঙলার কৃষিনির্ভর সামন্ত সমাজের কোনো স্থান যদি থাকে, থাকবে স্মৃতি হিসেবে, কখনও তা প্রধান ধারা নয়। তার প্রধান ধারাটি হবে এ দেশীয় হয়েও আন্ত দেশীয়, বাঙলাদেশের মানুষের হয়েও হবে সর্ব মানুষের। এই ধারাটি এখন প্রমত্তা পদ্মার মতো ফুলে ফুলে উঠার কথা-এবং এই ধারাসোতে অবগাহিত হয়ে বাঙলার এই অংশে জন্ম নেবে নতুনকালের রবীন্দ্রনাথ, নতুন কালের বিদ্যাসাগর, নতুন কালের জগদীশচন্দ্র বসু এবং নতুন কালের নজরুল ইসলাম ।

Exit mobile version