১৯৩০ সালের কথা। আমি তখন শান্তিনিকেতন কলেজে প্রথম শ্রেণীর ছাত্র। যে-সব পিরিয়ডে ক্লাস থাকত না, আমরা এসে জড়ো হতাম লাইব্রেরীর রীডিং রুম-এ, কলকাতা থেকে সদ্য-আসা মাসিক পত্রিকাগুলি ছিল আমাদের প্রধান আকর্ষণ। প্রবাসী, ভারতবর্ষ, বসুমতী, মানসী ও মর্মবাণী, বিচিত্রা তো ছিলই, সেই সঙ্গে ছিল প্রগতি কল্লোল কালিকলম উত্তরা। যে-বয়েসে সাহিত্যের বাতিক সংক্রামক ব্যাধির মত অল্প-বিস্তর সব মানুষকেই আক্রমণ করে, আমার তখন সেই বয়েস। প্রবীণ ও নবীন পত্রিকাগুলিতে প্রকাশিত গল্প-উপন্যাস পড়ে ফেলা ছিল আমাদের নেশা। বিশেষ করে তরুণ কোন সাহিত্যিকের লেখায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গীর স্বাদ পেলে তো আর কথাই নেই। শুধু নিজে পড়ে তৃপ্তি হত না। আর পাঁচজনকে পড়ানো চাই, তারপর শুরু হত তাই নিয়ে তুমুল আলোচনা।
আরেকটা নেশা আমাদের ছিল, সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচিত হবার নেশা। কলকাতা থেকে মাঝে-মাঝে সাহিত্যিকরা আসতেন রবীন্দ্রনাথের কাছে, কিন্তু সংখ্যায় নিতান্তই অল্প। যারাই আসতেন, খবর পেলেই আমরা তাদের আশেপাশে ঘুরঘুর করতাম পরিচয় লাভের আশায়। আমাদের কৌতূহল ছিল লেখকদের কাছ থেকে জানার-কি ভাবে তারা গল্প লেখেন; দিনে কয় ঘণ্টা লেখেন, কতদিন লাগে একটা গল্প লিখে শেষ করতে ইত্যাদি। এই সময়ে হঠাৎ লাইব্রেরি রুম-এ নতুন কি একটা পত্রিকার পাতা ওল্টাতে গিয়ে একটা গল্পের নাম পড়ে চমকে উঠলাম। কলঙ্কিত সম্পর্ক। লেখকের নামটা সেকেলে, জগদীশ গুপ্ত। আগে এর কোন লেখা পড়েছি বলে মনে করতে পারলাম না। তবু নামের আকর্ষণে গল্পটা আদ্যোপান্ত পড়ে ফেলে হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলাম এই লেখকের লেখা আর কোন্ পত্রিকায় পাওয়া যায়। এমন নেশা ভদ্রলোক ধরিয়ে দিলেন যে, ওঁর লেখা গল্প উপন্যাস যেখানে পাই পড়ে ফেলি।
একদিন লাইব্রেরির নতুন বইয়ের তালিকায় জগদীশ গুপ্তর নোমন্থন বইয়ের নামটা দেখেই ছুটলাম লাইব্রেরিয়ান প্রভাতদার কাছে, রবীন্দ্রজীবনীকার শ্ৰীযুক্ত প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়।
লাইব্রেরিতে তখন একটা নিয়ম ছিল—সব বই সব ছাত্রকে পড়তে দেওয়া হত না। বিশেষ করে অশ্লীলতা দোষে কলঙ্কিত বাংলা বইগুলি আমাদের দৃষ্টির আড্ডালে সযত্নে রক্ষিত হত। নতুন বই এলেই প্রভাতদা সর্বাগ্রে তা পড়ে দেখতেন এবং তিনিই স্থির করতেন সে-বই ছাত্রদের হাতে দেওয়া যাবে কি না। তার ফলে আজকের দিনের একাধিক খ্যাতিমান ঔপন্যাসিকের সেদিনের লেখা আলোড়ন সৃষ্টিকারী উপন্যাস-পাঠের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। পরবর্তী জীবনে কলকাতায় এসে সেই সব উপন্যাস সংগ্রহ করে পড়তে গিয়ে পানসে লেগেছে।
প্রভাতদার কাছে ঝোমন্থন বইটা চাইতেই দেরাজ থেকে বার করে দিয়ে বললেন–এ বই তুই পড়তে পারিস। বড় ভালো লিখেছে রে। হাসিও যেমন, অশ্রুও তেমনি।
বইখানা পড়ে লেখককে দেখার প্রবল কৌতূহল দেখা দিল। দুদিন পরে বইটা ফেরত দিতে গিয়ে প্রভাতদাকে বললাম-এই লেখক কি কখনও শান্তিনিকেতনে আসেন না?
প্রভাতদা বললেন–কেন বল তো?
–আলাপ করার বড় ইচ্ছে।
–যে কোনদিন গেলেই তো পারিস।
অবাক হয়ে গেলাম প্রভাতদার কথা শুনে। শান্তিনিকেতনে হেন লোক নেই যাকে আমি চিনি না বা জানি না। আমাদের কোনও মাস্টার মশাই কি তাহলে ছদ্মনামে লিখছেন! পদবীটা যখন গুপ্ত, হলেও হতে পারে।
প্রভাতদাকে অনুনয়ের সঙ্গে বললাম-আপনি যখন জানেন লেখকটি কে তখন আমাকে বলতেই হবে।
প্রভাতদা বললেন—কেন বলব না। বোলপুরে আদালতে কাজ করেন। মুহুরীর কাজ। থাকেনও আদালতের কাছেই। যে-কোন রবিবার সকালে চলে যা। আদালতের কাছে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই বাড়িটা দেখিয়ে দেবে।
শান্তিনিকেতনে রবিবার কখনও ছুটি থাকে না, ছুটি থাকে বুধবারে। অথচ রবিবার দিন না গেলে জগদীশ গুপ্তর দেখা পাওয়া সম্ভব নয়।
এক শীতের রবিবার সকালে একটা সাইকেল যোগাড় করে চলে গেলাম বোলপুরে। স্টেশনের ডান দিকের রাস্তা ধরে আধ মাইল পথ দক্ষিণে এগোলেই আদালত। আদালতের এক চৌকিদারকে জিজ্ঞেস করতেই বাড়ির হদিস পেয়ে গেলাম। বাড়িটার সামনে একটা প্রশস্ত উঠোন। সেই উঠোনে বোলপুরী মোড়ায় রোদে পিঠ দিয়ে বসে আছেন এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক, একমনে একটা বই পড়ছেন। গায়ে ছাই রঙের তুষের আলোয়ান জড়ানো।
সাইকেলটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে রেখে আস্তে আস্তে ভদ্রলোকের কাছে এসে দাঁড়ালাম। কোনদিকে খেয়াল নেই, একমনে একটা মোটা ইংরেজী বই পড়ে চলেছেন। সন্তর্পণে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছি, কি বই পড়ছেন দেখার আগ্রহ। আমার ছায়াটা দীর্ঘায়িত হয়ে বইটার উপর পড়তেই চমকে তাকালেন আমার দিকে। অপ্রস্তুত হয়ে বললাম—আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, আপনিই তো লেখক জগদীশ গুপ্ত?
আমার কথা শুনেই শিশুর মত সরল হাসি সারা মুখে-চোখে ফুটে উঠল। নিকেলের ফ্রেমের চশমার ভিতরে করুণাঘন দুটি চোখের দৃষ্টি আমার উপর নিবদ্ধ রেখে মোড়া থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ঝুলেপড়া গোপের ফাঁকে সরল হাসিটি উকি-ঝুকি মারছে। সস্নেহে আমার কাধে হাত রেখে বললেন–আমিই জগদীশ গুপ্ত। তবে লেখক কিনা, সে বিষয়ে নিজেরই যথেষ্ট সংশয় আছে। তা আমার কাছে কি প্রয়োজন?
আমি বললাম-আমি শান্তিনিকেতনের ছাত্র। আপনার সঙ্গে আলাপ করবার জন্যেই এসেছি।
অবাক হয়ে জগদীশবাবু বললেন—সে কি কথা। সমুদ্রের স্বাদ তুমি পেয়েছ, হেজে-মজে যাওয়া ডোবায় তুমি কি পাবে। বোসো, আমি এখুনি আসছি।