সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পূর্বে হঠাৎ দেখা গেল মেঠো রাস্তার ধুলো উড়িয়ে বিরাট দল আশ্রমের দিকে এগিয়ে আসছে। সঙ্গে এক ছল্পর হীন গরুর গাড়ি, তার উপর পাশ ফিরে শুয়ে আছে সেই বাঘ।
আশ্রমসুদ্ধ সবাই ভেঙ্গে পড়ল বাঘ দেখবার জন্যে। হাসপাতালের সামনে গরুর গাড়ি থেকে মৃত বাঘকে নামান হল, দেখা গেল বাঘের গলাটা ভোজালী দিয়ে এপাশ ওপাশ কাটা। আর নরভূপদার দুই কঁধ বাঘের থাবার আঁচড়ে ক্ষত-বিক্ষত।
কুকুর-মারা বন্দুকের গুলিতে বাঘ মরবে কেন। একটা গুলী ছুড়তেই বাঘ ঝাঁপিয়ে পড়ল নরভূপদার উপর। নরভূপদা দুই বলিষ্ঠ হাতে সেই যে বাঘের গলা টিপে ধরলেন আর ছাড়লেন না। অন্য ছেলেরা প্রাণের দায়ে বাঘের মাজা লক্ষ করে সমানে চালালেন লাঠি আর হকিস্টিক, যতক্ষণ, বাঘের শিরদাঁড়াটা না ভাঙ্গল। বাঘ একটু ঘায়েল হতেই নরভূপদা চিৎকার করে বললেন, ভোজালিটা দাও। কোমর থেকে ভোজালিটা টেনে বার করে ওর হাতে দিতেই তা চালিয়ে দিলেন বাঘের কণ্ঠনালীর উপর।
আমরা সবাই বাঘের চারিদিক ঘিরে বাঘে মানুষের লড়াইয়ের লোমহর্ষক কাহিনী উদগ্রীব হয়ে শুনছি, এমন সময় একটা মাংস কাটা ছুরি হাতে সুধাকান্তদা সেখানে এসে হাজির। বললেন—বাঘের ছাল ছাড়িয়ে সামনের পায়ের রান থেকে মাংস চাই। বাঘ মানুষের মাংস খায়, আজ আমি বাঘের মাংস খাব।
সুধাকান্তদার এই উদ্ভট সংকল্প শুনে কে একজন বলে উঠলেন বাঘের মাংস খেলে মানুষ পাগল হয়ে যায়।
সুধাকান্তদা তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন-বাঘের মাংস খেলে পাগল ভাল হয়ে যায়।
সুধাকান্তদার নানারকম পাগলামী খেয়ালের জন্য শান্তিনিকেতনে সবাই ওঁকে পাগল বলেই ঠাট্টা করত।
সেই রাত্রেই সুধাকান্তদা প্রচুর পেঁয়াজ রসুন সহযোগে বাঘের মাংস রান্না করেছিলেন, কিন্তু একটুকরো মুখে দিয়েই ফেলে দিতে হয়েছিল। বাঘের মাংস যে এতটা তেতো হবে তা তিনি আগে বুঝতে পারেন নি।
গল্পের এখানেই বৈঠকের একজন বললেন–ওরেফ ফাদার! এ হেন বড় সুধাকান্তর ছোট ভাই নিশিকান্ত। তাহলে ব্যাপারটা বুঝুন। ইঁদুরের মাংস দিয়ে যার শুরু তার শেষটা কোথায় একবার অনুমান করুন।
আমি বললাম–এ আর কি শুনলেন। নিশিকান্তর বাদুড়ের মাংস খাওয়ার গল্পটা তা হলে বলি। আমার সহপাঠী বর্মী ছেলে টুনাং নিশিকান্তর মাংস খাওয়ার উৎসাহ দেখে বললে, বর্মা দেশে বাদুড়ের মাংস নাকি খুব প্রিয় খাদ্য। যাঁহাতক শোনা-নিশিকান্তরও রোখ চেপে গেল সে-ও বাদুড়ের মাংস খেয়ে দেখবে। এখন বাদুড় কোথায় পাওয়া যায়? অবশেষে টুনা এসে খবর দিল, নীল কুঠিয়াল চীপ সাহেবের পরিত্যক্ত কুঠির বাগানে সন্ধ্যের পর নাকি ঝাঁকে-ঝাকে বাদুড় বসে। চীপ সাহেবের কুঠি ছিল শ্রীনিকেতন থেকে মাইল দুই উত্তরে বল্লভপুর গ্রামের কাছে। শ্রীনিকেতনে তখন এক জাপানী সপরিবারে থাকতেন, নাম তার কাসাহারা। হনুমান নিকেতনের চাষের ফসল নষ্ট করত বলে এলমহাস্ট সাহেব তাকে একটা বন্দুক দিয়েছিলেন। টুনাং কাসাহারাকে পটিয়ে-পাটিয়ে বন্দুক যোগাড় করে সন্ধ্যার আগেই সাইকেলে চেপে চলে গেল চীপ সাহেবের কুঠি।
আমরা মাংস রান্নার যাবতীয় মালমশলা সংগ্রহ করে টুনাং-এর জন্য অপেক্ষা করছি, এমন সময় টুনাং সাইকেলের ব্যাণ্ডেল-এ একজোড়া বাদুড় ঝুলিয়ে এসে হাজির। রান্না হল বটে কিন্তু খাওয়া গেল না। যা আঁশটে গন্ধ!
নিশিকান্ত দমবার পাত্র নয়। বললে-ভিনিগারে একরাত ভিজিয়ে রাখতে পারলে গন্ধ মারতে পারতুম। ঠিক আছে। আরেকদিন হবে।
আমাদের উৎসাহ অবশ্য সেদিনই ধামাচাপা পড়ল।
নিশিকান্তর পাল্লায় পড়ে নাজেহাল হবার দৃষ্টান্ত একাধিক। তার মধ্যে দুটি গল্প আপনাদের শোনাই।
১৯৩০ সালের কথা। আমি তখন শান্তিনিকেতন কলেজে ফাস্ট ইয়ারে পড়ি, নিশিকান্তর কবিখ্যাতি তখন শান্তিনিকেতনের চৌহদ্দি পেরিয়ে কলকাতার পরিচয় বিচিত্রা পত্রিকার মাধ্যমে বাংলাদেশেও ছড়িয়েছে। সে তখন শান্তিনিকেতন কলাভবনের ছাত্র। কবিতা লেখার মত ছবি আঁকাতেও সে ট্রাডিশন ভেঙেচুরে নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তন্ময়।
শান্তিনিকেতনে তখন পূজোর ছুটি, সকাল-সন্ধ্যেয় শীতের আমেজ তখন সবে শুরু। একদিন সকালে একটা হলদে আলোয়ান মুড়ি দিয়ে নিশিকান্ত আমার বাড়ি এসে বললে—সাগর, চটপট একটা আলোয়ান গায়ে দিয়ে বেরিয়ে আয়। আমার সঙ্গে চল্।
কোথায় যেতে হবে, কী হয়েছে, শীত না পড়া সত্ত্বেও আলোয়ান গায়ে দিতে হবে কেন, এসব প্রশ্ন করা বৃথা। সঙ্গে যেতে হবে যখন তখন যেতেই হবে। আমার ছিল একটা লাল রঙের আলোয়ান, তাই গায়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
পথে যেতে যেতে নিশিকান্ত বললে—উত্তরায়ণের পশ্চিম দিকের ভুট্টা খেতে বড় বড় ভুট্টা হয়েছে। চল পেড়ে আনি, ভেজে খাওয়া যাবে।
প্রস্তাবটা আমার কাছে খুব মনঃপূত হল না। চিন্তিত হয়ে বললামবাগানের মালীরা ঘোরাফেরা করে। তাছাড়া
এক ধমক দিয়ে নিশিকান্ত বললে—ওসব তোকে ভাবতে হবে না। আমি সব খোঁজ নিয়েছি। সকালে মালীরা উত্তরায়ণের পুব দিকের গোলাপ বাগানে থাকে। তোর যদি এতই ভয়, তুই চলে যা। আমি একাই যাব। তারপর যখন উনুনে সাঁতলে গাওয়া ঘি মাখিয়ে কঁচা লঙ্কা দিরে খাব তখন চাইতে আসিস।
পৌরুষে ঘা লাগল। নিশিকান্ত আমাকে এতই ভীতু মনে করবে? তাছাড়া ভুট্টা খাবার বর্ণনাটাও ততক্ষণে রসনাকে বসিয়ে তুলেছে। দ্বিরুক্তি করে ওর সঙ্গেই পা চালালাম।
উত্তরায়ণের পশ্চিম দিকের তারের বেড়া টপকে দুটি হলদে আর লাল আলোয়ান বিরাট ভুট্টা খেতের মধ্যে মিলিয়ে গেল। গোটা তিন চার কচি ভুট্টা পেড়ে আলোয়ানের মধ্যে লুকিয়ে খেত থেকে বেরিয়েই দেখি উত্তরায়ণের উড়িয়া খাস চাকর নাথু, পান দোক্তা খাওয়া কালো দাঁত বার করে হাসছে।