Site icon BnBoi.Com

রচনাবলি ৯ (নবম খণ্ড) – সৈয়দ মুজতবা আলী

রচনাবলি ৯ (নবম খণ্ড) – সৈয়দ মুজতবা আলী

বিবিধ – ৯

০১.

যারা ভালো করে পৃথিবীর ইতিহাস পড়েছেন তারা খাঁটি খবর দিতে পারবেন; আমি সামান্য যেটুকু পড়েছি তার থেকে আমার দৃঢ় প্রত্যয় হয়েছে মহাত্মাজির মতো মহাপুরুষ এ পৃথিবীতে দ্বিতীয় জন্মাননি।

বুদ্ধদেবকে কোনও ব্যাপক রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয়নি; খ্রিস্টের সামনে যে রাজনৈতিক সমস্যা এসে পড়েছিল (ইহুদিদের পরাধীনতা) তিনি তার সম্পূর্ণ সমাধান করেননি; শ্রীকৃষ্ণ এবং মুহম্মদ অন্যায়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র গ্রহণ করার আদেশ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

এই চার মহাপুরুষকেই কোটি কোটি লোক শত শত বছর ধরে স্বীকার করে নিয়ে জীবনযাত্রার পথ খুঁজে পেয়েছে; কিন্তু আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, মহাত্মাজি যে বুদ্ধ এবং খ্রিস্টের অহিংস পন্থা নিয়ে কৃষ্ণ এবং মুহম্মদের মতো রাজনৈতিক সফলতা লাভ করেছিলেন এ জিনিস পৃথিবীতে পূর্বে কখনও হয়নি। প্রেম দিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে হিংসার ওপর জয়ী হওয়া যায় এ কথা পৃথিবী বহু পূর্বেই মেনে নিয়েছিল, কিন্তু অস্ত্রধারণ না করে রাজনীতির ক্ষেত্রেও যে জয়ী হওয়া যায় সেই অবিশ্বাস্য সত্য প্রমাণ করে গিয়েছেন মহাত্মাজি। আমার ভয় হয়, একদিন হয়তো পৃথিবী বিশ্বাস করতেই রাজি হবে না যে, মহাত্মাজির প্রেম ইংরেজের বর্বর সৈন্যবলকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়েছিল। অবিশ্বাসী মানুষ আজ স্বীকার করে না যিশু মৃতকে প্রাণ দিয়েছিলেন; পাঁচশো বছর পরের অবিশ্বাসী দুটোকেই হয়তো এক পর্যায়ে ফেলবে।

***

পাঠক হয়তো জিগ্যেস করবেন, মহাত্মাজি রাজনৈতিক ছিলেন; তিনি কোনও নবীন ধর্ম প্রচার করে যাননি, তবে কেন তাঁকে ধর্মগুরুদের সঙ্গে তুলনা করি।

নবীন ধর্ম কেন সৃষ্ট হয় তার সব কটা কারণ বের করা শক্ত কিন্তু একটি জিনিস আমি লক্ষ্য করেছি। কি বুদ্ধ কি খ্রিস্ট সকলকেই তাদের আপন আপন যুগের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করে নিতে হয়েছিল। এ বিষয়ে পিথৌরার চর্চা বড়ই অগভীর– সে কথা পাঠককে আবার জানিয়ে রাখছি।

বুদ্ধদেবের সময় উত্তর ভারতবর্ষের বনবাদাড় প্রায় সাফ হয়ে গিয়েছে এবং ফলে আশ্রমবাসীগণ নিরাশ্রয় হয়ে পড়েছিলেন। সংঘ নির্মাণ করে তাদের অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা বুদ্ধদেবকে করে নিতে হয়েছিল। আমার ভাণ্ডার আছে ভরে, তোমা সবাকার ঘরে ঘরে— অর্থাৎ যৌথ পদ্ধতিতে বিরাট প্রতিষ্ঠান (সংঘ) নির্মাণ ভারতে এই প্রথম। দ্বিতীয়ত, তখন প্রদেশে প্রদেশে এত মারামারি হানাহানি যে, ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো করে প্রসার পাচ্ছিল না। শ্ৰমণগণ এসব উপেক্ষা করে শান্তির বাণী নিয়ে সর্বত্র গমনাগমন করার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের অনেক অন্তরায় দূর হয়। তাই শ্ৰেষ্ঠীরা সবসময়ই সংঘের সাহায্যের জন্য অকাতরে অর্থ দিয়েছেন।

খ্রিস্ট ইহুদিদের স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন। তবে তার পন্থা ছিল ইহুদিদের নৈতিক বলে এতখানি বলীয়ান করে দেওয়া যাতে করে পরাধীনতার নাগপাশ নিজের থেকে ছিন্ন হয়ে যায়। অরবিন্দ ঘোষও পণ্ডিচেরিতে এই মার্গেরই অনুসন্ধান করেছিলেন।

কুরুক্ষেত্রের শ্রীকৃষ্ণ যে শুধু কুরু-পাণ্ডবের যোগসূত্র স্থাপনা করার জন্য কূটনৈতিক দূত তাই নন, শেষ পর্যন্ত তিনি পাণ্ডববাহিনীর প্রধান সেনাপতির পদও গ্রহণ করেছিলেন।

মুহম্মদের প্রধান কর্ম ছিল আরবের যুযুধান, ছিন্নবিচ্ছিন্ন বেদুইন উপজাতিগুলোকে এক করে শক্তিশালী জাতি গঠন করা।

মহাত্মাজিকে সবাই রাজনৈতিক হিসেবে মেনে নিয়েছেন, কিন্তু পৃথিবীর মহাপুরুষদের সঙ্গে তুলনা করলে তাকে ধর্মগুরু বলে স্বীকার করে নিলেই ঠিক হবে।

***

প্রশ্ন উঠতে পারে, তাই যদি হয়, তবে মহাত্মাজি কোনও নবীন ধর্ম প্রবর্তন করে গেলেন না কেন?

সে তো খ্রিস্টও করে যাননি। খ্রিস্ট-তিরোধানের বহু বছর পর পর্যন্তও তাঁর অনুচরগণ বুঝতে পারেননি যে তারা এক নবীন ধর্মের প্রদীপ হাতে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। রামমোহন, নানকও দেখা দিয়েছিলেন ধর্ম-সংস্কারকরূপে, তাঁরা বীজ রোপণ করে গিয়েছিলেন– শাখাপ্রশাখায় পল্লবিত হল নবীন ধর্ম পরবর্তী যুগে।

মহাত্মাজির নবীন– অথচ সনাতন ধর্ম প্রবর্তিত হতে সময় লাগবে।

সেই ধর্মং শরণং গচ্ছামি!

***

গল্প শুনেছি এক গুরু যখন বুঝতে পারলেন তার এক নতুন শিষ্য একদম গবেট, তখন তাকে উপদেশ দিলেন বিদ্যাচর্চা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোনও পন্থা অবলম্বন করতে। শিষ্য প্রণাম করে বিদায় নিল।

বহু বছর পরে গুরু যাচ্ছিলেন ভিন গাঁয়ের ভিতর। একটি আধাচেনা লোক এসে নিজের পরিচয় দিয়ে গুরুকে আপন বাড়িতে নিয়ে গেল। সেই গবেট শিষ্য। গুরু তার যত্ন-পরিচর্যায় খুশি হয়ে শুধালেন, তা বাবাজি আজকাল কী করো?

শিষ্য সবিনয়ে বলল, টোল খুলেছি।

গুরুর মস্তকে এটম বোমাঘাত। খানিকক্ষণ পরে সামলে নিয়ে শুধালেন, তা কী পড়াও?

শিষ্য বলল, আজ্ঞে সব কিছুই; তবে ব্যাকরণটা পড়াইনে।

গুরু আরও আশ্চর্য হয়ে বললেন, সে কী কথা? আমার যতদূর মনে পড়ছে তুমি তো ব্যাকরণটাই একটুখানি বুঝতে।

শিষ্য বললে, আজ্ঞে, তাই ওটা পড়াতে একটুখানি বাধো-বাধো ঠেকে।

***

রায় পির্থেীরা যে সর্ববাবদে এই শিষ্যটির মতো, সে কথা আর লুকিয়ে রেখে লাভ কী? এই দেখুন না, দিনের পর দিন সে সম্ভব-অসম্ভব কত বিষয়ে কত তত্ত্ব কথাই না বেহায়া বেশরমের মতো লিখে যাচ্ছে। কারণ? কারণ আর কী? সর্ববিষয়ে যার চৌকশ অজ্ঞতা তার আর ভাবনা কি?

কিন্তু প্রশ্ন, গবেট শিষ্য কিঞ্চিৎ ব্যাকরণ জানত বলে ওই বিষয়ে পড়াতে তার বাধোবাধো ঠেকত। পিথৌরার কি সেরকম কোনওকিছু আছে?

সেই তো বেদনা, সুশীল পাঠক, সেই তো ব্যথা।

মা সরস্বতী সম্বন্ধে কোনও কিছু লিখতে বড় বাধো-বাধো ঠেকে। চতুর্দিকে গণ্ডা গণ্ডা সরস্বতী পূজা হয়ে গেল। আমি গা-ঢাকা দিয়ে, কিংবা পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি।

আর কোনও দেবতার সেবা করার মতো সুবুদ্ধি আমার হয়নি– প্রথমজীবনে মা সরস্বতীই আমার স্কন্ধে ভর করেছিলেন, আর আমি হতভাগা তার সেবাটা কায়মনোবাক্যে করিনি বলে আজ আমার সবকিছু ভণ্ডুল বরবাদ হয়ে গিয়েছে। এখন মা সরস্বতীর দিকে মুখ তুলে তাকাতেও ভয় করে। হায়, দেবীর দয়া পির্থেীরার প্রতি হয়েছিল, কিন্তু মৃর্থ তাঁকে অবহেলা করে আজ এই নিদারুণ অবস্থায় পড়েছে। —–রায় পিথৌরা

.

০২.

দিল্লির বিখ্যাত সাধু নিজামউদ্দীন আওলিয়ার প্রখ্যাত সখা এবং শিষ্য কবি আমির খুসরৌর জন্মোৎসব কয়েক দিন হল আরম্ভ হয়েছে। আমির খুসরৌর কবর নিজামউদ্দীনের দরগার ভিতরেই– এবং সে দরগা হুমায়ুনের কবরের ঠিক সামনেই। (এ দর্গায় আরও বহু বিখ্যাত ব্যক্তির কবর আছে।)

খুসরৌর পিতা ইরানের বখ (সংস্কৃত বহীকম– ভারতীয় কোনও কোনও নৃপতি বখ পর্যন্ত রাজ্যবিস্তার করেছিলেন বলে কিংবদন্তি আছে) থেকে ভারতবর্ষে আসেন। পুত্র খুসরৌ কবিরূপে দিল্লির বাদশাহদের কাছে প্রচুর সম্মান পান।

ফারসি তখন বহুদেশের রাষ্ট্রভাষা। উত্তর ভারতবর্ষ (ফার্সি এদেশের ভাষা নয়), আফগানিস্তান (সে দেশেরও দেশজ ভাষা পশতু), তুর্কিস্তান (তারও ভাষা চুগতাই) এবং খাস ইরানে তখন ফার্সির জয়-জয়কার। এমনকি বাঙলা দেশের এক স্বাধীন নৃপ হাফিজকে বাঙলা দেশে নিমন্ত্রণ করেছিলেন।

খুসরৌ ফার্সিতে অত্যুত্তম কাব্য সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন। ভারতের বাইরে, বিশেষ করে কাবুল-কান্দাহার এবং সমরকন্দ-বোখারা খুসরৌকে এখনও মাথার মণি করে রেখেছে।

আলাউদ্দীন খিলজী, তার ছেলে খিজর খান; বাদশা গিয়াসউদ্দীন তুগলুক, তাঁর ছেলে বাদশা মুহম্মদ তুগলুক (ইংরেজ ঐতিহাসিকদের পাগলা রাজা) এরা সবাই খুসরৌকে খিলাত ইনাম দিয়ে বিস্তর সম্মান দেখিয়েছেন।

গুজরাতের রাজা কর্ণের মেয়ে যখন দিল্লি এলেন তখন তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে রাজকুমার খিজর খান তাকে বিয়ে করেন। ইংরেজের মুখে শুনেছি, বিয়ে নাকি প্রেমের গোরস্তান, অর্থাৎ বিয়ে হওয়ার পরই নাকি সর্বপ্রকারের রোমানস্ হাওয়া হয়ে যায়। এখানে হল ঠিক তার উল্টো। এদের ভিতর যে প্রেম হল সে প্রেম পাঠান-মোগল হারেমের গতানুগতিক বস্তু নয়– তাই অনুপ্রাণিত হয়ে খুসরৌ তাঁদের প্রেমকাহিনী কাব্যে অজর অমর করে দিলেন। সেই কাব্যের নাম ইশকিয়া–বাঙলা ভ্রমণের সময় সম্রাট আকবর সেই কাব্য শুনে বার বার প্রশংসা করেছিলেন। কর্ণের মেয়ের নাম দেবতাদেবী। শুনেছি, বাঙলায় নাকি দেবলাদেবী নাটক বহুদিন ধরে অভিনীত হয়েছে।

গিয়াসউদ্দীন তুগলুক নিজামউদ্দীনকে দু চোখে দেখতে পারতেন না। সে কাহিনী দৃষ্টিপাতে সালঙ্কার বর্ণিত হয়েছে- দিল্লি দূর অস্ত! কিন্তু গিয়াস নিজামের মিত্র খুসরৌকে রাজসম্মান দিয়েছিলেন। খুসরৌ বড় বিপদে পড়েছিলেন, একদিকে সখার ওপর বাদশাহি জুলুম, অন্যদিকে তিনি পাচ্ছেন রাজসম্মান।

মুহম্মদ তুগলক রাজা হওয়ার পর তাবৎ মুশকিল আসান হয়ে গেল। ঠিক মনে নেই (পোড়ার শহর দিল্লি একখানা বই পাইনে যে অর্ধবিস্মৃত সামান্য জ্ঞানটুকু ঝালিয়ে নেব), বোধহয় খুসরৌ বাদশা মুহম্মদের লাইব্রেরিয়ান ছিলেন।

সে এক অপূর্ব যুগ গেছে। সাধক নিজামউদ্দীন, সুপণ্ডিত বাদশা মুহম্মদ তুগলুক, ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বরনী এবং সভাকবি আমির খুসরৌ।

প্রথম দেহত্যাগ করলেন শেখ-উল-মশাইখ নিজামউদ্দীন আওলিয়া, তার পর তাঁর প্রিয়সখা আমির খুসরৌ, তার পর বাদশা মুহম্মদ শাহ তুগলুক এবং সর্বশেষে জিয়া বরনী।

ইংরেজ আমাদের কত ভুল শিখিয়েছে। তার-ই একটা, এসব গুণীরা ফার্সিতে লিখতেন বলে এঁরা এদেশকে ভালোবাসতেন না। বটে? সরোজিনী নাইডু ইংরেজিতে লিখতেন, তাই তিনি ভারতবর্ষকে ভালোবাসতেন না!

খুসরৌ মাতৃভূমি ভারতবর্ষ ভালোবাসতেন এবং সে ভূমির অশেষ গুণকীর্তন করে গিয়েছেন।

এবং দূরদৃষ্টি ছিল বলে তিনি যেটুকু দেশজ হিন্দি জানতেন (হিন্দিরও তখন শৈশবাবস্থা) তাই দিয়ে হিন্দিতে কবিতা লিখে গিয়েছেন।

শুধু তাই নয়, ফার্সি এবং হিন্দি মিলিয়ে তিনি উর্দুর গোড়াপত্তন করে গিয়েছেন– জানতেন একদিন সে ভাষা রূপ নেবেই নেবে।

আবার বিপদে পড়লুম; হাতের কাছে বই নেই, তাই চেক আপ করতে পারছিনে– পণ্ডিত পাঠক অপরাধ নেবেন না– যেটুকু মনে আছে, নিবেদন করছি–

হিন্দু বাচ্চেরা ব নিগরু আজ হুসন্ ধরত হৈ
দর ওকতে সুখ জদ মুহ ফুল ঝরত হৈ
গুফতম কে বি আ আজ লবেৎ বোসে বিগরিম–
গুফত আরে রাম! ধরম নষ্ট করত হৈ!
হিন্দু বামা কী অপূর্ব সৌন্দর্যই না ধারণ করে,
কথা বলার সময় মুখ থেকে যেন ফুল ঝরে।
বললুম, আয় তোর ঠোঁটে চুমো খাব
বললে, আরে রাম! ধর্ম নষ্ট করত হৈ! –রায় পিথৌরা

.

০৩.

দিল্লির দুর্গাপূজা দেখবার মতো জিনিস। আমরা বুড়ো হয়ে গিয়েছি, কিন্তু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সমাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মতাত্ত্বিক তথ্য সংগ্রহ করবার মতো বয়স, সময় এবং উৎসাহ যাদের আছে তারা যদি এখানে পূজার সময় গোটা তিনেক রোদ মেরে যান তবে নব হুতোম লিখে পৌরজনকে বিস্তর মধু পান করাতে পারবেন।

সবকিছু দেখিনি, যা দেখলুম তাতে খুশিই হয়েছি। রুচিবাগীরা বলেন, এরকম টাকার শ্রাদ্ধ, বাজে থিয়েটার এবং থিয়েটারকে টেক্কা দেবার জন্য কলকাতা থেকে বাঙলা ফিল আনানো; এরা যদি ট্যাক্সি করে মীরাট থেকে কলাগাছ আনালো তবে ওরা প্লেনে করে কলকাতা থেকে মাল্য যোগাড় করালে; এসব অপব্যয় আড়াআড়ি নিতান্ত অর্থহীন, মূল্যহীন এবং এদের চাপে পড়ে দেবীপূজার মাহাত্ম্য গাম্ভীর্য সমস্তই নির্মমভাবে ব্যর্থ হয়।

বহু স্থানে রুচিবাগীশদের সঙ্গে আমি একমত– একথা অস্বীকার করে মহানবমীর দিনে আমি মহাপাতক হতে চাইনে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একথাও বলব যে, যাদের রুচি আছে, যারা দেবী-পূজার প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত কী কী করতে হয় সে সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা ধরেন, তারা যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকেন, তবে দিল্লি শহরের ঐতিহ্য-বিস্মৃত যুবক-যুবতীরা এমন কী অলৌকিক কর্ম সমাধান করতে পারবে? এদের অনেকেই পুব, পশ্চিম কোনও বাঙলায় কখনও যায়নি, বাঙলায় দুর্গাপূজার রূপ এরা কখনও দেখেনি– এদের দেখাবে কে, শেখাবে কে?

কিন্তু এদের উৎসাহ-উদ্দীপনা খাঁটি বাঙালির চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। হাঁসকে যেমন জলে ছেড়ে দিলে সে তৎক্ষণাৎ সাঁতার কাটতে আরম্ভ করে, বাঙালিকে তেমনি পৃথিবীর যে কোনওখানেই ছেড়ে দাও না কেন, বাঁশ, খড়, মাটি, রঙ যোগাড় করে ভালো-মন্দ একটি প্রতিমা বানিয়ে বসবেই বসবে, ঢাক-ঢোল সানাইয়ের অভাবে ট্যাম্বুরিন ক্লারিনেট দিয়ে কাজ চালিয়ে নেবেই নেবে।

আমার চোখে পড়ে এই উৎসাহটাই। তার বর্তমান গতি বা রূপ দেখে আমি নিরাশ হইনে। যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ নিরাশ হবার কোনও কারণই আমি দেখতে পাইনে।

***

দিল্লির যেসব ছেলে-ছোকরারা দেহলি প্রান্তে পড়ে এবং আমাকে যারা ব্যক্তিগত জীবনে কিছুটা মানে, তাদের উদ্দেশে আমি দু একটি কথা বলতে চাই।

দুর্গাপূজার প্রধান উদ্দেশ্য শক্তির সন্ধান, শক্তির সাধনা। এ শক্তি শারীরিক মানসিক নৈতিক সর্বপ্রকারের পার্থিব আধ্যাত্মিক শক্তি ছাড়িয়ে গিয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বশক্তির আধার। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্তরালে যেসব শক্তি আছে যাদের সন্ধান করতে গিয়ে আমাদের বাক্ এবং চিত্ত বার বার ফিরে আসে সেগুলোও ওই মূল শক্তির ভিতর সমাহিত। মানুষ যখন ধ্যানলোকে তার শারীরিক মানসিক সর্বপ্রকারের সংকীর্ণ সীমা অতিক্রম করে ব্রহ্মের সঙ্গে মিলিত হয় তখন সে শক্তি পায় সেই মূল শক্তি থেকে, আবার ক্ষুদ্রতম কীটাণুকীট যখন তার সামান্যতম প্রয়াসে নিযুক্ত হয় তখনও এই বিশ্বশক্তি তাকে অনুপ্রাণিত করে। এ শক্তির বাইরে কোনও কিছু নেই– সবকিছুই এরই ভিতরে।

শান্তির সাধনা করো আর সংগ্রামের সাধনাই করো, এই শক্তি ছাড়া অন্য পন্থা নেই।

এই জ্ঞানের মাধ্যমে আমরা জড়জগতের সৃষ্টিশক্তির অনেক সন্ধান পেয়েছি এবং শক্তির দ্বারাই আমাদের সভ্যতা গড়ে তুলেছি। শক্তিকে কেউ অস্বীকার করে না, এ শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ালে যে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে নিষ্পেষিত হতে হয় সে তত্ত্ব সকলেরই জানা। ঠিক তেমনি আমাদের মনের ভিতরে-বাইরে নানা ধরনের শক্তি আছে যার সন্ধান কেউ অল্পবিস্তর পেয়েছে, কেউ সাধনার জোরে বেশি পেয়েছে।

এঞ্জিনের শক্তির সামনে আমি দাঁড়াইনে, কিন্তু নৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও যে তদ্দণ্ডেই আমার বৃহত্তর মৃত্যু সে কথা আমরা ভেবে দেখিনে। তার প্রধান কারণ আমরা সে শক্তির স্বরূপ চিনিনে– সে শক্তি তো চোখ দিয়ে দেখা যায় না, হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায় না। এই নৈতিক শক্তির স্বরূপ মহাত্মা গাঁধী তাঁর সর্বসত্তা দিয়ে চিনতে পেরেছিলেন এবং সেই শক্তি-অশ্ব যখন তিনি তাঁর স্বরাজরথে পার্থসারথির মতো সংযোজনা করলেন তখন ইংরেজকে পরাজয় স্বীকার করতে হল।

এ শক্তি সকলেই কাজে খাটাতে পারবে সে আশা দুরাশা। পার্থসারথি হওয়া মহামানবের কর্ম কিন্তু এ শক্তিকে চিনতে পারা ততখানি কঠিন নয়। সামান্যতম পদাতিকও কৃষ্ণের রথ দেখে চিনতে পারে এবং পথ ছেড়ে সরে দাঁড়ায়। এ তত্ত্ব নেতিবাচক কিন্তু এর কমে বেঁচে থাকা অসম্ভব। তাই এর সন্ধান আমাদের অহরহ করতে হবে। নৈতিক ভুবনে শক্তিশালী হই আর না-ই হই, শক্তিমানকে যেন অন্তত চিনতে পারি।

***

এসব শক্তি ছাড়িয়ে যে বিশ্বশক্তি, যে বিশ্ব-ভাণ্ডার থেকে সর্বশক্তি উচ্ছ্বসিত হয় তার সন্ধানে মানুষ এখনও খুব বেশি অগ্রসর হতে পারেনি। কী করলে সেই শক্তি-স্রোতে আমি শরীর ভাসিয়ে দিয়ে সুধাপারাবারে পৌঁছব তার সন্ধান পেয়েছেন অতি অল্প পুরুষই। এ-যুগে তাই শ্রীঅরবিন্দ ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক ইতিহাসে স্বর্ণসিংহাসনে বিরাজ করছেন। সকলেই জানেন, তিনি কতবার বলেছেন, শক্তিরূপা মাতাকে আরাধনা না করে আধ্যাত্মিক জগতে গত্যন্তর নেই।

দুর্গাপূজার দিনে বাঙালি এ সত্য সর্বান্তঃকরণে স্বীকার করে। কিন্তু বাদবাকি ৩৬৪ দিন? তখন বাঙালি আবার সেই নির্জীব শক্তিহীন বাঙালি?

তাই শক্তিপূজা শুধু কয়েকটি দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়— বছরের প্রতিদিন শক্তিকে স্মরণ করতে হয়, তাঁর সাধনা করতে হয়। –রায় পির্থেীরা

.

০৪.

প্রভাত মুখুয্যের রত্নদীপ যখন মাসিকে ধারাবাহিক হয়ে বেরোয়– আজ পিছন পানে তাকিয়ে মনে হয় সে যেন বহু যুগের কথা– তখন কী উৎসাহে বাঙালি জনসাধারণ এবং রুচিসম্পন্ন পাঠকেরাও সে-বই পড়েছিলেন! মফঃস্বলের শহরের ডাকঘরে যখন সে মাসিক আসত তখন তার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। আমাদের শহরে তো নিয়ম ছিল, পোস্ট মাস্টার মহাশয়ের মাসিকখানা পোস্টাপিসের সম্মুখের কালীবাড়িতে নিয়ে গিয়ে কাউকে দিয়ে চেঁচিয়ে পড়ানো– আমরা সবাই কুণ্ডুলি পাকিয়ে সেই শাস্ত্ৰ-পাঠ শুনতুম।

খ্যাতনামা, সুরুচিবান এবং শক্তিশালী বাঙালি লেখক কর্তৃক এই প্রথম এবং বলতে গেলে শেষ রগরগে বা সেনশনাল নভেল।

এখনও বহু লোকের বিশ্বাস রগরগে উপন্যাস লেখা অতিশয় অপকর্ম– পাঁচকড়ি দেনরাধম এবং দীনেন্দ্রকুমার রায় কুলোক। আমি এ দলে নেই কিন্তু সে আলোচনা আরেক দিন হবে।

কোনান ডয়েল সত্যকার পণ্ডিত লোক ছিলেন এবং তাঁর একটি অসাধারণ গুণের কথা বহু লোকের অজানা যে তিনি ইংলন্ডের মৃত কি জীবিত যে কোনও সাহিত্যাচার্যের রচনাভঙ্গি, শৈলী এবং ভাষা অনায়াসে অনুকরণ করতে পারতেন। এডগার ওয়ালেসও সুসাহিত্যিক ছিলেন– ইংলন্ডের যে কোনও সাহিত্যসভা তাঁর আশীর্বাদ কিংবা উপস্থিতি পেলে কৃতাৰ্থৰ্মন্য হতেন।

সাহিত্যে রগরগে উপন্যাসেরও বিশেষ স্থান আছে। তবে একথা ভুললে চলবে না, শুষ্ক ইতিহাসকে সরস, সজীব, সার্থক সাহিত্য করতে হলে যে রকম সুসাহিত্যিকের প্রয়োজন, রগরগে উপন্যাসের বেলাতেও তাই। গুপ্তধন রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কেউ লিখতে পারতেন না, গোস্ট অব ক্যান্টারভিল লেখা অস্কার ওয়াইলডেই সম্ভবে।

প্রভাত মুখুয্যে যখন রত্নদীপ লেখেন তখন তিনি খ্যাতনামা লেখক। শুধু যে তিনি তখন রবীন্দ্রনাথ, চারু বন্দ্যোপাধ্যায়, মণি গাঙ্গুলী, সত্যেন দত্তের শ্রদ্ধা এবং সাহচর্য পেয়েছিলেন তা-ই নয়, ঋষিকল্প দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত তাঁর একটি গল্প পড়ে মুগ্ধ হয়ে আপন দর্শন-দ্বিরদ-দ-স্তম্ভ থেকে নেমে এসে সেই গল্প নিয়ে একটি চমৎকার আলোচনা করেন। সে আলোচনা পড়লে বাঙালি এখনও উপকৃত হবে।

সেই প্রভাত মুখোপাধ্যায় সুসাহিত্যিক-খ্যাতির শিখরে বসে লিখলেন, রত্নদীপ— রগরগে উপন্যাস!

কিন্তু হলে কী হয়–উপন্যাসখানা পড়বার সময় ক্ষণে ক্ষণে সর্বাঙ্গে রোমাঞ্চ এবং শিহরণ হলেও পরিষ্কার ধরা পড়ে মুখোপাধ্যায়ের আসল কৃতিত্ব কোথায়? প্রবঞ্চক যেদিন বউরাণীকে। ভালোবেসে এক নতুন মানুষ হয়ে জন্ম নিল, তখন তার নবজন্মের কাহিনী, তার ভিতরকার ন্যায়-অন্যায়ের দ্বন্দ্ব এবং সর্বশেষে তার নির্ভয়, পরিপূর্ণ স্বার্থত্যাগ-আত্মবিসর্জন প্রভাত মুখোপাধ্যায় বিশ্লেষণ এবং বর্ণন করেছেন এদেশে মনস্তাত্ত্বিক নভেল প্রচলিত হওয়ার বহু পূর্বেশক্তিশালী সাহিত্যিকের জোরদার কলম দিয়ে। আমার মনে হয় সে যুগে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কেউ ওরকম অপরের হৃদয়মনের গভীর অতলে ঢুকে এরকম রত্নদীপ তুলে আনতে পারতেন না।

তাই রত্নদীপ নিছক রগরগে উপন্যাস নয় (তা হলেও আমার মত অনেকের ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত আপত্তি নেই), রত্নদীপ সুসাহিত্য।

***

সেই রত্নদীপ তার আলো-ছায়া ফেলেছে দেহলি-প্রান্তের রুপালি পর্দায়। তবে সে দীপ হিন্দি ভাষার ঘিউ দিয়ে জ্বালানো– হেথাকার বাঙালির এই যা আফসোস।

বয়স হয়েছে; বায়স্কোপ– সিনেমা-মুভি-পিকচার-টকি কথাগুলো এখনও রপ্ত হল না– যেতে দেখলে নাতি-নাতনিরা হাসাহাসি করবে তাই যেতে হয় গা-ঢাকা দিয়ে টাপে-টোপে। দিল্লিতে আমাকে অন্য কেউ বড় একটা চেনে না– অখ্যাত হওয়ার এই একটা মস্ত সুবিধে।

গিয়ে ভালোই করেছিলুম। ছবিখানা অত্যুত্তম না হলেও উত্তম হয়েছে। বেশিরভাগ ছবি আজকাল এতই খারাপ যে, বায়স্কোপে বসে অনেক জোয়ানরাই ঘুমোয় প্রাপ্তবয়স্কদের তো কথাই নেই; এ ছবি ঘুমের দাওয়াইরূপে সেবন করা যায় না। বেশ খাড়া হয়ে বসে দেখতে হয়।

আর ছবির নায়ক অভিনয়ে পাউল মনির পর্যায়ে উঠেছেন– অবশ্য শেষ পর্যন্ত তিনি মুনির মতো বিভিন্ন চরিত্রে একই কৃতিত্ব দেখাতে পারবেন কি না, সে কথা এখনও বলা যায় না বলেই আমার মনে হল। জমিদারবাড়িতে ঢোকার পর নায়ক সবসুদ্ধ হয়তো এক ডজন কথাও বলেছেন কি না সন্দেহ, অথচ এই কথা না-বলার টেকনিকেই তাঁর অভিনয় চরম খোলতাই পেয়েছে। সিনেমা-মৌতাতিরা এ লোকটির ওপর নজর রাখবেন।

বউরাণীও ভালো অভিনয় করেছেন, তবে মাঝে মাঝে মনে হয়েছে তার বস্তৃতান্ত্রিক অভিনয়ে যতখানি দখল, ব্যঞ্জনার ভিতরে গোপন থেকেও আত্মপ্রকাশ করার পদ্ধতি তিনি ততটা ভালো করে আয়ত্ত করতে পারেননি। সেদিক দিয়ে তার সহচরী সুচতুরা। তবে একথাও বলব, বউরাণী দর্শকের চিত্তজয় করতে সমর্থ হয়েছেন।

যতদূর মনে পড়ছে, মূল পুস্তকে বউরাণী লাজুক এবং অতিশয় স্বল্পভাষী। নায়ক কথা বলে না, নায়িকাও স্বল্পভাষী। উপন্যাসে এ জিনিস চলে, ফিলমে চালানো মুশকিল সায়লেন্ট ফিমে এই একটা মস্ত সুবিধে ছিল– তাই বোধহয় বউরাণীকে কিঞ্চিৎ এগ্রেসিভ করে গড়া হয়েছে।

আমার ভালো লাগেনি প্রধান পরিচারিকা আর জমিদার-মাতার অভিনয়। বড় বাড়াবাড়ি বলে মনে হল; তবে শুনেছি এ দেশের অধিকাংশ দর্শকই নাকি বাড়াবাড়ি (ইংরেজিতে যাকে বলে হ্যাঁম্ অ্যাকটিং) পছন্দ করেন।

আগাগোড়া নাটকেই বিস্তর ফাইন টাচেস আছে। তার জন্য প্রসার ডিরেক্টর কাকে প্রশংসা করতে হবে জানিনে। বাঙলা ছবি এ বাবদে এখন ভারতীয় অন্যান্য ছবির চেয়ে অনেক দূরে এগিয়ে আছে।

গোঁফ পরচুলা কিন্তু এখন খারাপ। ক্লোজ-আপের সময় চোখে পীড়া দেয়। শুনেছি, কোনও এক ফিলমে ক্রাইটের দাড়ি-গোঁফের প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা করে গঁদ দিয়ে সাঁটা হয়েছিল– অতখানি না করেও দাড়িগোঁফ আরও অনেক স্বাভাবিক করা যায়।

কিন্তু এসব খুঁটিনাটি। রবিবাবু বলেছেন,

দোষ গাইতে চাই যদি তো তাল করা
যায় বিন্দুকে;
মোটের উপর শিলঙ ভালোই যাই না
বলুক নিন্দুকে।

এ ছবি মোটের উপর নয়, খণ্ডেও ভালো। প্রিমিয়ের-রাত্রে দেবকীবাবু রিগেলে উপস্থিত ছিলেন। –রায় পিথৌরা

.

সপ্তপর্ণী

কয়েক দিন হল আনন্দবাজার পত্রিকার দোল সংখ্যা বেরিয়েছে। শ্ৰীযুত প্রবোধচন্দ্র সেন এ কাগজে বাংলা সাহিত্যের অতীত ও ভবিষ্যৎ শীর্ষক একটি সুচিন্তিত এবং বহু তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছেন। হিন্দি-ইংরেজি বনাম বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে যারা কৌতূহলী তাঁদের সকলকে আমি এই প্রবন্ধটি পড়তে অনুরোধ করি- তারা লাভবান হবেন।

আমার আলোচনায় জানা-অজানাতে প্রবোধচন্দ্রের অনেক যুক্তি এসে গিয়েছে এবং আসবে। প্রবোধচন্দ্র না হয়ে অন্য কোনও কাঁচা লেখক হলে আমি আমার লেখাতে পদে পদে তার উদ্ধৃতির ঋণস্বীকার করতুম– কিন্তু এর বেলা সেটার প্রয়োজন নেই, কারণ প্রবোধবাবু লব্ধপ্রতিষ্ঠ পণ্ডিত, তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য বাঙলা ভাষা যেন তার ন্যায্য হক পায় এবং সেই হক সপ্রমাণ করার জন্য কে তাঁর লেখা থেকে কতখানি সাহায্য পেল, সে সম্বন্ধে তিনি সম্পূর্ণ উদাসীন। এবং আমার বিশ্বাস, দরকার হলে তিনিও অন্য লেখকের রচনা থেকে যুক্তি-তর্ক আহরণ করতে কুণ্ঠিত হবেন না। আমার লেখা তাঁকে সাহায্য না-ই করল।

প্রাচ্যে যেসব বড় আন্দোলন হয়ে গিয়েছে, সেসব আন্দোলন শুধু যে তার জন্মভূমিতেই সফল হয়েছে তাই নয়, তার ঢেউ পশ্চিমকেও তার সুপ্তিতে জাগরণ এনে দিয়েছে, সেসব আন্দোলনকে আমরা সচরাচর ধর্মের পর্যায়ে ফেলে নবধর্মের অভ্যুদয় নাম দিয়ে থাকি। ভারতবর্ষে তাই বৌদ্ধ ও জৈনদের দুই বৃহৎ আন্দোলনকে আমরা ধর্মের আখ্যা দিয়েছি; সেমিতি ভূমিতে ঠিক ওইরকমই দুই মহাপুরুষকে কেন্দ্র করে দুটি জোরালো আন্দোলন সৃষ্ট হয় সেগুলোর নাম খ্রিস্টধর্ম এবং ইসলাম।

আজকের দিনে ধর্ম বলতে আমরা প্রধানত বুঝি, মানুষের সঙ্গে ভগবানের সম্পর্ক। পূজা-অর্চনা কিংবা কৃজ্রসাধন-ধ্যানাদি করে কী করে ভগবানকে পাওয়া যায়, ধর্ম সেই পন্থা দেখিয়ে দেয়, এই আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু একটুখানি ধর্মের ইতিহাস অধ্যয়ন করলেই দেখতে পাবেন, ভগবানকে পাওয়ার জন্য ধর্ম যতখানি মাথা ঘামিয়েছে তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি চেষ্টা করেছে মানুষে মানুষের সম্পর্ক সভ্যতর করার জন্য। ধর্ম চেষ্টা করেছে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য কমাতে, অন্ধআতুরের আশ্রয় নির্মাণ করাতে– এককথায় এমন এক নবীন সমাজ গড়ে তুলতে, যেখানে মানুষ মাৎস্যন্যায় বর্জন করে, একে অন্যের। সহযোগিতায় আপন আপন শক্তির সম্পূর্ণ বিকাশ করতে পারে। বৌদ্ধ এবং জৈনধর্ম এইসব কাজেই মনোযোগ করেছে বেশি– ভগবানের সান্নিধ্য এবং তাঁর সাহায্য সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে।

বিত্তশালী এবং পণ্ডিতের সংখ্যা সংসারে সবসময়েই কম ছিল বলে বড় আন্দোলনকারী মাত্রই এদের উপেক্ষা করে জনগণকে কাছে আনতে- এমনকি ক্ষেপিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন আপ্রাণ। এবং তাই তাঁরা বিত্তশালী এবং পণ্ডিতের ভাষা উপেক্ষা করে যে ভাষায় কথা বলেছেন, সেটা জনগণের ভাষা। তথাগতের ভাষা তকালীন গ্রাম্য ভাষা পালি এবং মহাবীরের ভাষা অর্ধ-মাগধী। খ্রিস্টের ভাষা হিব্রুর গ্রাম্য সংস্করণ আরামেয়িক এবং মুহম্মদের ভাষা আরবি। আরবি সে যুগে এতই অনাদৃত ছিল যে আরবেরাই আশ্চর্য হল, এ ভাষায় আল্লা তাঁর কুরান প্রকাশ (অবতরণ = নাজিল) করলেন কেন? তার-ই উত্তর কুরানে রয়েছে :

আল্লা স্পষ্ট ভাষায় বলছেন, আরব পয়গম্বর যে আরবি ভাষায় কুরান অবতরণের আধার হবেন সেই তো স্বাভাবিক এবং অন্য যে কোনও ভাষায় (এবং সে যুগে হিব্রু ছিল পণ্ডিতের ভাষা– রায় পিথৌরা) সে কুরান পাঠানো হলে মক্কার লোক নিশ্চয়ই বলত, আমরা তো এর অর্থ বুঝতে পারছিনে।

গণ-আন্দোলনে সবচেয়ে বড় কথা– আপামর জনসাধারণ যেন বক্তার বক্তব্য স্পষ্ট বুঝতে পারে।

তাই মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের চতুর্দিকে যে আন্দোলন গড়ে উঠল, তার ভাষা বাঙলা, তুকারামের ভাষা মারাঠি (তিনি ব্যঙ্গ করে বলেছেন, সংস্কৃতই কেবল সাধুভাষা? তবে কি মারাঠি চোরের ভাষা), কবীরের ভাষা সে সময়ে প্রচলিত বৈধ হিন্দি এবং তিনিও বলেছেন, সংস্কৃত কূপজল (তার জন্য ব্যাকরণের দড়িলোটার প্রয়োজন), কিন্তু ভাষা (অর্থাৎ চলতি ভাষা) বহুৎ নীর যখন খুশি ঝাঁপ দাও, শান্ত হবে শরীর। রামমোহন, দয়ানন্দ আপন আপন মাতৃভাষায় তাদের বাণী প্রচার করেছিলেন, আর শ্রীরামকৃষ্ণ যে বাঙলা ব্যবহার করে গিয়েছেন, তার চেয়ে সোজা সরল বাঙলা আজ পর্যন্ত কে বলতে পেরেছেন? এমনকি বিদ্যাসাগর মহাশয়ও তার বিপক্ষ দলকে উপদেশ দিয়েছিলেন সংস্কৃতে না লিখে বাঙলায় উত্তর দিতে। তিনি নিজেও সংস্কৃতে লেখেননি, যদিও তিনি সংস্কৃত জানতেন আর সকলের চেয়ে বেশি।

আমার মনে হয়, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের পতনের অন্যতম কারণ সেদিনই জন্ম নিল, যেদিন বৌদ্ধ ও জৈন পণ্ডিতেরা দেশজ ভাষা ত্যাগ করে সংস্কৃতে শাস্ত্রালোচনা আরম্ভ করলেন। দেশের সঙ্গে যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল, ওদিকে সংস্কৃত শাস্ত্রচর্চা করাতে ব্রাহ্মণদের ঐতিহ্য ঢের ঢের বেশি– বৌদ্ধ জৈনদের হার মানতে হল।

পৃথিবীজুড়ে আরও বহু বিরাট আন্দোলন হয়ে গিয়েছে– পণ্ডিতি ভাষাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, মাতৃভাষার ওপর পরিপূর্ণ নির্ভর করে।

এইবারে নিবেদন, ইতিহাস আলোচনা করে দেখান তো, পৃথিবীর কোথায় কোন্ মহান এবং বিরাট আন্দোলন হয়েছে জনগণের কথা এবং বোধ্য ভাষা বর্জন করে?

এ তত্ত্ব এতই সরল যে, এটাকে প্রমাণ করা কঠিন। স্বতঃসিদ্ধ জিনিস প্রমাণ করতে গেলেই প্রাণ কণ্ঠাগত হন।

আটঘাট বেঁধে পূর্বেই প্রমাণ করেছি এসব আন্দোলন নিছক ধর্মান্দোলন (অর্থাৎ আত্মা-পরমাত্মাজনিত) নয়– এদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অংশ অনেক বেশি গুরুত্বব্যঞ্জক।

তাই ভারতবর্ষ এখন যে নবীন রাষ্ট্র নির্মাণের চেষ্টা করছে, তার সঙ্গে এইসব আন্দোলনের পার্থক্য অতি সামান্য এবং তুচ্ছ। এই যে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা করা হয়েছে, তার সাফল্যের বৃহদংশ নির্ভর করবে জনগণের সহযোগিতার ওপর– এ কথা পরিকল্পনার কর্তাব্যক্তিরা বহুবার স্বীকার করেছেন এবং ক্রমেই বুঝতে পারছেন, উপর থেকে পরিকল্পনা চাপিয়ে কোনও দেশকে উন্নত করা যায় না যদি না নিচের থেকে, জনগণের হৃদয়মন থেকে সাড়া না আসে, সহযোগিতা জেগে না ওঠে।

আমাদের সর্বপ্রচেষ্টা, সর্বঅর্থব্যয়, সর্বসাধন, সম্পূর্ণ নিষ্ফল হবে যদি আমরা আমাদের সর্বপরিকল্পনা সর্বপ্রচেষ্টা জনগণের বোধ্য ভাষায় তাদের সম্মুখে প্রকাশ না করি। এ বিষয়ে আমার মনে কণামাত্র সন্দেহ নেই।

আমি জানি, ভারতবর্ষ এগিয়ে যাবেই, কেউ ঠেকাতে পারবে না। শুধু যারা অন্তহীনকাল ধরে ইংরেজির সেবা করতে চান, তারা ভারতের অগ্রগামী গতিবেগ মন্থর করে দেবেন মাত্র।

এ বিশ্বাস না থাকলে আমি বার বার নানা কথা এবং একাধিকবার একই কথা বলে বলে আপনাদের বিরক্তি ও ধৈর্যচ্যুতির কারণ হতুম না। –রায় পিথৌরা

.

তোমার আসন পাতব কোথায়?

মিশরের লোক নিশ্চয়ই বাঙলা পড়তে পারে, অন্তত মিশরস্থ ভারতের রাষ্ট্রদূত এ. এ. এ. ফৈজি সাহেব পারেন, এবং সত্যযুগ কাগজখানারও কিছুটা কাটতি কাইরোতে আছে। তা না হলে এ অলৌকিক ঘটনা ঘটল কী প্রকারে?

মিশর থেকে খবর এসেছে, ফৈজি সাহেবের উদ্যোগে কাইরোতে একটি মিশর-ভারত সংস্কৃতি-সঙ্ স্থাপিত হয়েছে। এই জাতীয় সঙ্ প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অধম কোনও প্রকারের প্রস্তাব করেননি বটে কিন্তু স্মৃতি-বিলাস পাঠকের স্মরণ থাকতে পারে, মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে অধম রুদ্ধ-বাতায়ন এবং খোলা-জানালায় লিখনে কিছুটা ওকালতি করেছিল।

ভুবন-ব্যাপী রাজনৈতিক অরাজকতার মাঝখানে আমার নস্য-প্রমাণ লিখন দুটি এরকম ঝটপট ফল দেবে সে আশা আমি কস্মিনকালেও করিনি। তার শতাংশের একাংশও মনে মনে পোষণ করলে আমি আজই চিনির অনটন সম্বন্ধে গণ্ডদশেক প্রবন্ধ লিখতুম। তাই আমার এ কেরামতিটা কাকতালীয় বলে স্বীকার করে নেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত বলে বিবেচনা করলুম।

ফৈজি সাহেবকে পূর্ব-ভারতের লোক চেনে না। ইনি বোম্বাইবাসী এবং বোম্বাইয়ের ইসলামিক রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা। উৎকৃষ্ট আরবি জানেন এবং বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি-বিভাগ এরই আদেশ-উপদেশ অনুসারে চলে। শিয়াদের ইসমাইলিয়া সম্প্রদায় সম্বন্ধে তিনি বিস্তর গবেষণা করেছেন এবং অন্যান্য নানা বিষয়ে ইনি সুপণ্ডিত। চিন্তা-জগতে ইনি প্রগতিশীল, এবং চোস্ত আদব-কায়দা জানেন বলে ইনি রাষ্ট্রদূত বা ইচি হওয়ার উপযুক্ত।

কেউ যদি সঙ্কীর্ণমনা, প্রাদেশিক বাঙালি বলে আমার প্রতি কটুবাক্য প্রয়োগ না করেন তবে অবশ্য নিবেদন করব, আমাদের খুদাবখশ অথবা আব্দুল্লা সুহ্রাওয়ার্দীর তুলনায় ইনি এমন কিছু ভয়ঙ্কর গুণী নন। আজ আব্দুল্লা বেঁচে থাকলে তিনিই যে এ কর্মের সর্বোত্তম অধিকারী হতেন সে-বিষয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু থাক্ এসব কথা, বাঙালি হিন্দুই যখন আজ বাঙলার বাইরে কোথাও কল্কে পায় না তখন আর মুসলমানের জন্য কোন্ কারবালায় কান্না জুড়ব? আব্দুল্লা অবশ্য কোনও অবস্থাতেই ফিরে আসবেন না, কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য সুধীও আছেন।

সংস্কৃতিকেন্দ্রের পত্তন উপলক্ষে মিশরের পক্ষ থেকে দু জন পণ্ডিত বক্তৃতা দেন। তার একজন অল-অজহর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গুরু বা শেখ।

সিদনা (সম্মানিত) শেখ যে অজহরের পক্ষ থেকে এ-উৎসবে যোগদান করেছেন সে বড় আনন্দের বিষয়। অজহর পৃথিবীর সবচেয়ে বুড়া বিশ্ববিদ্যালয়– তার বয়স এক হাজার সাতের কাছাকাছি। ইয়োরোপের তাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়– তা সে অক্সফোর্ডই হোক আর প্যারিসই হোক–অজহরের হাঁটুর বয়সী এবং গোড়ার দিকে এদের সকলেই অজহরের নকল করত। ইবনে রুশদের (দার্শনিক আডেরস) যেসব বই অজহরে পড়ানো হত তারই লাতিন তর্জমা নিয়ে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন পড়ানো আরম্ভ হয়। অক্সফোর্ড-কেম্ব্রিজের ছেলেরা যে গাউন পরে সেটি প্রথম থেকেই চালু করা হয় অজহরের অনুকরণে।

মক্কা যেরকম মুসলিম-জাহানের ধর্মকেন্দ্র, অজহর ঠিক সেইরকম মুসলিম-জাহানের শিক্ষাকেন্দ্র। অজহরের সিদনা শেখ যে বাণী বলেন, যে ফতোয়া দেন (এ-স্থলে ফতোয়া আমি শব্দার্থে অর্থাৎ বিধান অনুশাসন অর্থে ব্যবহার করছি) তামাম পৃথিবীর মুসলমান সে ফতোয়া পালন করার চেষ্টা করে। মিশরের প্রধানমন্ত্রীর তো কথাই নেই, স্বয়ং রাজা পর্যন্ত এঁকে সমঝে চলেন।

সিদনা শেখ কেন্দ্রের উন্নতিকল্পে নানা প্রস্তাব পেশ করে কামনা জানিয়েছেন, মিশর-ভারতে যেন ছাত্র ও শিক্ষক বিনিময় হয়। ভারত সম্বন্ধে মিশরের কৌতূহল প্রচুর তাই তিনি ভরসা রাখেন এইসব শিক্ষক ও ছাত্র ভারতবর্ষ থেকে ফিরে গিয়ে আরবি ভাষায় ভারতবর্ষ সম্বন্ধে কেতাব লিখে মিশরবাসীর জ্ঞান বাড়াতে সমর্থ হবেন।

উত্তম প্রস্তাব, এ সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নেই। বরঞ্চ আমরা কিঞ্চিৎ আরবি জানি বলে মিশর সম্বন্ধে আপন মুখে ঝাল খেতে পারি, কিন্তু মিশরের লোক না জানে ইংরেজি, না জানে ভারতীয় কোনও ভাষা। তাই ভারত সম্বন্ধে মিশরের জ্ঞান এতদিন পর্যন্ত ইংরেজের কুৎসা নিন্দার ওপর নির্ভর করেছে। আজ যদি সিদনা শেখের প্রস্তাব হাড়-মাংস নিয়ে শরীর ধারণ করে তবে আমি উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করব।

কিন্তু প্রশ্ন, যেসব ছাত্র-শিক্ষক এদেশে আসবেন তারা অধ্যয়ন করবেন কোথায়?

কলকাতা, বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ে? কাশী, ভট্টপল্লির চতুষ্পঠীতে? দেওবন্দ, রামপুরের মাদ্রাসায়? এঁরাই তো আমাদের ত্রিশরণ।

দেওবন্দ, রামপুর গিয়ে যে এদের মোক্ষলাভ হবে না সে-কথা বিনাবাক্য ব্যয়েই স্বীকার করে নিতে পারি। তার কারণ দেওবন্দ রামপুর পড়ায় অজহরেরই নিসাব বা পঠনবস্তু বেশ কিছুটা জল ঢেলে, মিশ্রির শরবৎ বানিয়ে। তাতে যে ভেজাল নেই সে কথাও হলপ করে বলা যায় না। তুলনা দিয়ে কথাটা বললে আমার বক্তব্য ঈষৎ খোলসা হবে। আজ যদি অক্সফোর্ডের ইংরেজ ছেলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য, ইংলন্ডের ইতিহাস পড়তে আসে তবে যে পরিস্থিতিটা হবে তার সঙ্গেই মিশরের বিদ্যার্থীর দেওবন্দ গমনের তুলনা হতে পারে।

তবে কি তারা ভট্টপল্লিতে যাবেন?

মুশকিল! ভট্টপল্লির জীবন ও মিশরীয় মুসলমানের চলা-বসাতেই এত পার্থক্য রয়েছে যে একে অন্যকে বরদাস্ত করতে করতেই তাদের উভয়পক্ষের বেশ কয়েক বছর কেটে যাবে বহিরাগতের শাস্ত্রাধিকার আছে কি নেই, সে প্রশ্ন না-ই বা তুললুম।

অথচ ভট্টপল্লি-দেওবন্দই তো ভারতীয় ঐতিহ্যের সন্তান। তা তারা আজ যত নির্জীবই হোন না কেন, যত অনাদৃত অবহেলিতই হোন না কেন।

তবে কি তারা কলকাতা, বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ে দাখিল হবেন। ত্রাহি মধুসূদন, তওবা, তওবা। ভারতীয় ঐতিহ্যের কোন মণি-মাণিক্য সঞ্চিত আছেন এইসব দো-আঁসলা, অকালপকু, কেরানি-প্রসবিনী বিদ্যায়তনের শ্বেত-সমাধির মাঝখানে? ভারতীয় সাহিত্য এখানে সপত্নী-পুত্রের সম্মান পায়, ভারতীয় সঙ্গীত, স্থাপত্য, চিত্র, নাট্য এখানে বন্ধ্যা পাণ্ডিত্যের কচকচানির বিষয়বস্তু, শেক্সপিয়ার-মিল্টনের ভূত এ গোরে প্রেতের মতন নাকিসুরে কথা কয়, অর্থশাস্ত্রের মিসিং লিঙ্ক মার্শাল টাউসিগ এখানকার শাখা-প্রশাখার শাখা-মৃগ, এখানকার ইতিহাসদেবী স্মিথের, অতিবৃদ্ধা, লোলচৰ্মা রক্ষিতা এবং এখানকার দর্শন অধ্যয়ন সত্যই অমাযামিনীর অন্ধকার গৃহে অন্ধ কর্তৃক অনুপস্থিত অসিত মার্জারের অনুসন্ধান এবং মার্জারটি সে-গৃহে কস্মিনকালে প্রবেশও করেনি।

তবে কি অতিথিকে চাল-চিনি বাড়ন্ত বলে ফিরতি নৌকার সন্ধান করতে বলব? তা-ও তো পারিনে।

তাই বলি স্বাগতম, স্বাগতম–যে সামান্য আরবি জানি তাই দিয়ে বলি অহলান ওয়া সহলান। –ওমর খৈয়াম

.

গণভাষা

রাষ্ট্রভাষার স্বরূপ কী হবে এবং তার সম্প্রসারণ কতদূর, সে-কথা আলোচনা করার পূর্বে স্বাধীনতা লাভের ফলে ভারতবর্ষে যে নতুন বাতাবরণের সৃষ্টি হয়েছে সেটা ভালো করে বুঝতে হবে।

ইংরেজ জাতি পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে কিন্তু তার কেন্দ্র ইংলন্ডে। ইংরেজের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য, বৈদগ্ধ্যের উন্নতি অনেকখানি নির্ভর করে জগৎ-জোড়া ইংরেজের ওপর; তাই ইংরেজের প্রয়োজন তার রাজত্বের সর্বদূর ভূখণ্ড এবং তার শাসকের সঙ্গে যেন ইংলন্ডের যোগসূত্র অবিচ্ছিন্ন থাকে। এই যোগসূত্রের নাম ইংরেজি ভাষা এবং এটাকে ইংরেজ কিছুতেই ছিঁড়তে দেয় না। তাতে করে যে ভূখণ্ডে সে রাজত্ব করছে তার আপন ভাষার সর্বনাশ হোক, সে দেশের বৈদগ্ধ্য উচ্ছন্নে যাক ইংরেজের কোনও আপত্তি নেই।

এ তত্ত্বটা আমরা ঠিক ঠিক বুঝতে পারিনি, কারণ, ইংরেজ যখন এদেশে আসে তখন ভারতবর্ষের রাষ্ট্রভাষা ছিল ফার্সি। সে ভাষা সমূলে উৎপাটন করে ইংরেজ এদেশে ইংরেজি চালায়। কিন্তু তাতে আমাদের কিছুমাত্র ক্ষতি হয়নি, কারণ ফার্সি এদেশের আপন ভাষা নয়, ইংরেজির মতো সে-ও বিদেশি। এমনকি আর কিছুদিন গেলে ফার্সি হয়তো নিজের থেকেই হিন্দুস্তানির জন্য রাষ্ট্রভাষার আসন ছেড়ে দিত।

ইংরেজি ভাষার সাহায্য ছাড়া ইংরেজ এ দেশটাকে ব্যাপকভাবে শোষণ করতে পারবে না বলেই সে এদেশে ইংরেজি চালিয়েছিল এবং গোড়ার দিকে এদেশে প্রাদেশিক ভাষাগুলো ইংরেজি থেকে বিস্তর মাল-মশলা আহরণ করে সমৃদ্ধিশালী হয়েছিল সে বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই। তার পর একটা জায়গায় এসে সবকটা প্রাদেশিক ভাষা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। এই বাঙলা ভাষার কথাই ধরুন। আমরা এখনও নভেল, ছোটগল্প, আর দু চারখানা মামুলি প্রবন্ধ নিয়েই মাতামাতি করি। বিজ্ঞান, দর্শন, অলঙ্কার, অর্থশাস্ত্র, ফলিতবিজ্ঞান সম্বন্ধে কুচিৎ কখনও একখানা বই লেখা হয় এবং তার প্রথম সংস্করণ ফুরোতে দশ মাস লাগে, হয়তো-বা কখনও একদম ফুরোয়ই না।

তার কারণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা হচ্ছে ইংরেজিতে এবং ইংরেজির ভূত ঘাড় থেকে না নামা পর্যন্ত রোগী আর কোনও ভাষায় কথা কইবে না।

তুলনা দিয়ে বক্তব্যটা আরও খোলসা করি। লাতিন ভাষা যতদিন ইউরোপীয় গুণীজ্ঞানীর বিদ্যা-চৰ্চার ভাষা ছিল, ততদিন ফরাসি-জর্মন কোনও ভাষাই ব্যাপকার্থে সমৃদ্ধিশালী হতে পারেনি। তার পর লুথারের প্রটেস্টান্ট সর্ষের ঠেলায় যখন লাতিন ভূত ইউরোপের ঘাড় থেকে নামল তখন ফরাসি এসে চাপল জর্মন এবং রুশের স্কন্ধে– স্বয়ং ফ্রেডরিক দি গ্রেট জর্মনে না লিখে কাব্য রচনা করেছিলেন ফরাসি ভাষায় (এবং সে কাব্য এমন ওঁচা যে বিখ্যাত জর্মন কবি হাইনরিশ হাইনে বলেছেন, জর্মন সাহিত্যে ফ্রেডরিকের সবচেয়ে বড় অবদান- তিনি জর্মন ভাষায় কিছু রচনা করেননি)।

এই ফরাসিকে না খেদানো পর্যন্ত জর্মন ও রুশ সাহিত্য কোনও প্রকারের উন্নতি করতে পারেনি।

এইবার গোড়ার কথায় ফিরে যাই। ইংরেজের মতো ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের এমন কোনও কু-মতলব নেই যে কেন্দ্র তাবত ভারত শোষণ করে খাবেন। যুক্তপ্রদেশের দোবেজি পড়েজি হিন্দি ভাষার জোরে ভারতময় দাবড়ে বেড়াবেন ও মতলব নিয়ে হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা করা হচ্ছে না। পণ্ডিতজি ভালো হিন্দি জানেন না, তিনি জানেন অতি উত্তম উর্দু, এবং সর্দারজির হিন্দি শুনেও কোনও দোবেজি পড়েজি ঈর্ষাতুর হবেন না। তাই হিন্দি দিয়ে যদি ভারতবর্ষ শোষণ করতে হয় তবে এদের বেতন দিয়ে বাড়ি পাঠাতে হবে।

আমাদের আদর্শ হচ্ছে ভারতবর্ষকে শক্তিশালী রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলার। তার জন্য প্রত্যেক প্রাদেশিক ভাষাকে বলশালী হতে হবে। বলশালী হতে হলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা প্রত্যেক প্রদেশকে আপন ভাষায় করতে হবে। ইংরেজি সে পথে অন্তরায় হয়ে আসর জমিয়ে বসেছিল, আজ যদি ইংরেজির শূন্য আসনটি হিন্দি দখল করে বসে তবে আমরা যে আবছায়ায় ছিলুম সেই আবছায়ায়ই থাকব।

এই জিনিসটিই আরেক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে।

ইংরেজ প্রত্যেক প্রদেশেই কয়েক হাজার বা কয়েক লক্ষ লোককে ইংরেজি শিখিয়ে আপন রাজত্ব চালিয়ে নিত। ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের এই কয়েক লক্ষ লোকের কয়েকজন ইংরেজির মাধ্যমে একজোট হয়ে কিছুকাল পরে কংগ্রেস তৈরি করে স্বাধীনতার জন্য ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন। ইংরেজ তাতে কিছুমাত্র বিচলিত হল না, কারণ সে বিলক্ষণ জানত এসব লেকচার দেশের জনসাধারণ কিছুই বুঝতে পারে না বলে পোলিটিশিয়ানরা ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরামের মতো শুধুই তড়পাচ্ছেন। যখনই দরকার হবে এঁদের ওপর চোটপাট করে এঁদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া যাবে। কিন্তু যখন সর্দারজি গুজরাতি ভাষায় বরদলৈএতে আগুন ছড়াতে আরম্ভ করলেন তখন ইংরেজ প্রমাদ গুনল। যে গণ-আন্দোলনের ফলে ভারতবর্ষ শেষটায় স্বরাজ পেল তার অধিকাংশ বক্তাই আপন। মাতৃভাষার মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

স্বাধীনতালাভ কর্ম সমাধান হয়েছে। সেটা অপেক্ষাকৃত সরল কর্ম। কঠিনতর কর্ম হচ্ছে। দেশ থেকে দুঃখ-দারিদ্র্য দূর করে শিক্ষাবিস্তার করা, স্বাস্থ্যের উন্নতি করা। এইখানে এসে রাষ্ট্রভাষামত্ত স্বৈরতন্ত্রীরা করেন প্রথম ভুল। তারা ভাবেন রাষ্ট্র নির্মাণে জনসাধারণের আর কোনও সহযোগিতার প্রয়োজন নেই। কাজেই ইংরেজির শূন্য আসনে যদি হিন্দি এসে গেঁট হয়ে চেপে বসে তা হলে কোনও ক্ষতি তো হবেই না, বরং ইংরেজেরই মতো তাঁরা বেধড়ক রাজত্ব চালাতে পারবেন।

অর্থাৎ ইংরেজের আমলে যা হয়েছিল তারই পুনরাবৃত্তি হবে। একদল লোক হিন্দি শিখবেন, বড় বড় নোকরি করবেন, বহিরাগত হিন্দিভাষিদের সাথে কাঁধ মিলিয়ে এক নতুন অভিজাত সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করবেন, আর বাদবাকি চাষাভূষো আমরা পাঁচজন আবছায়া থেকে তিমিরে নিমজ্জিত হব।

তাই দেখতে হবে রাষ্ট্র গঠনের সর্বপ্রচেষ্টার সঙ্গে যেন আপামর জনসাধারণ সংযুক্ত থাকে। এবং সে জিনিস মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য কোনও মাধ্যমের দ্বারা সফল করা সম্ভবপর হয় না। রাষ্ট্রভাষার উৎকট সমর্থনকারীরা বলবেন, মাতৃভাষায় লেখা হলেই কি সব মানুষ এইসব রাষ্ট্র নির্মাণের কুটিলতম প্রচেষ্টার কথা বুঝতে পারবে?

উত্তরে বলি, সকলে পারবে না, কিন্তু অসংখ্য লোক পারবে।

আমরা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রে শিক্ষাব্যবস্থার যে স্বপ্ন দেখছি তাতে দেশের শতকরা নব্বই জন মাইনর, মেট্রিক পর্যন্ত পড়বে। এবং সে মাইনর মেট্রিকের শিক্ষাদান অনেক বেশি উন্নত পর্যায়ের হবে। ইংরেজি বা হিন্দির জন্য তারা প্রাণপাত করবে না বলে (অবশ্য স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রভাষা হিন্দি অপশনাল হিসেবে পড়বার ব্যবস্থা সবসময়ই রাখতে হবে আজ যেমন কেউ শেখে সংস্কৃত, কেউ শেখে ফার্সি) তারা অতি উত্তম বাংলা শিখবে এবং ইংলন্ড, ফ্রান্স, চীন, ইরানে যেরকম সাধারণ লোক মাতৃভাষায় লেখা দেশের শ্রেষ্ঠ পুস্তক পড়তে পারে, এরাও ঠিক তেমনি দেশের উন্নততম জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। দেশের তাবত লোকেই যে উত্তম উত্তম পুস্তক পড়বে সে কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয় কারণ সকলেই জানেন জ্ঞানতৃষ্ণা কোনও বিশেষ শ্রেণি বা সমাজের মধ্যে নিবদ্ধ নয়, এমনকি উচ্চশিক্ষা পাওয়া না পাওয়ার ওপরও সে জিনিস সম্পূর্ণ নির্ভর করে না। কত বি.এ. এম.এ. পরীক্ষা পাসের পর চেক্ বই ছাড়া অন্য কোনও বইয়ের সন্ধানে সময় নষ্ট করে না, আর কত মাইনরের ছেলে গোগ্রাসে যা পায় তাই গেলে– তাই মাতৃভাষা দেশের সংগঠন কর্মের মাধ্যমে হলে যে কোনও তত্ত্বানুসন্ধিৎসু অল্প চেষ্টাতেই দেশের সর্বোত্তম প্রচেষ্টার সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারে। এর সত্যতা সপ্রমাণ হয় আরেকটি তথ্য থেকে ইউরোপের বহু সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক, আবিষ্কর্তা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন না করেও যশস্বী সৃষ্টিকার হতে সমর্থ হয়েছেন।

জিনিসটা এতই সরল যে প্রবাদরূপে বলা যেতে পারে,–

গণভাষার সাহায্য ভিন্ন গণরাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না।

জয় হিন্দি, কিন্তু রাষ্ট্রভাষা হিন্দি যেন সে পথে অন্তরায় না হয়। — ওমর খৈয়াম

.

জনমত

ইংরেজ এ-দেশ দখল করে শান্তি এনেছিল বলে প্রাচীনদের অনেকেই ইংরেজের প্রশংসা করতেন। খুনখারাবির সময় আর্তৰ্জন প্রথম কোম্পানির দোহাই দিয়ে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করত আর ছোরা তবুও এগিয়ে এলে মহারানীর দোহাই কাড়ত। সাক্ষ্য দেবার সময় আর পাঁচজন বলত লোকটা এমনি পাষণ্ড, ধর্মাবতার, যে সে মহারানীর দোহাই পর্যন্ত অমান্যি করে গেল।

তার পর এই শান্তির সুযোগ নিয়ে ইংরেজ এদেশে ব্যাপকভাবে ব্যবসা চালিয়ে আমাদের শিল্প-বাণিজ্য পয়মাল করে দিল। প্রাচীনদের অনেকেই তখন বুঝতে পারলেন, স্বর্গরাজ্যে যাবার জন্য ইংরেজ এসব পরোপকার করেনি। স্পষ্ট দেখা গেল স্বর্গরাজ্যের গাইড-বুক মথিলিখিত সুসমাচার ইংরেজ অফিসার পড়ে না। পাদ্রিদের মারফতে বিলিয়ে দেয় এদেশের গায়ে গায়ে।

তাই যখন আরম্ভ হল অনটন, বস্ত্রাভাব, দুর্ভিক্ষ তখন দেশের লোক ইংরেজকে গালাগাল দিতে আরম্ভ করল। অসহিষ্ণুজন বোমা মারল, বিচক্ষণজন তার চেয়েও মারাত্মক বৈষ্ণবপ্রেমের হাতিয়ার আবিষ্কার করলেন।

কিন্তু ততমধ্যে আমাদের অভ্যাস খারাপ হয়ে গিয়েছে। সব জিনিসেই ইংরেজকে দোষ দিয়ে আমরা বিমলানন্দ উপভোগ করতে আরম্ভ করে দিয়েছি। তাজমহলে ফাটল দেখা দিলে ইংরেজের দোষ, বন্যা হলে ইংরেজের দোষ, বৃষ্টি না হলেও ইংরেজের দোষ, আর ভূমিকম্প হলে তো আলবৎ ইংরেজের দোষ, ওই যে ব্যাটাদের আলীপুরে খাসা যন্ত্রপাতি রয়েছে তাই দিয়ে ভূমিকম্পের দিনক্ষ্যাণ আগের থেকে বাৎলে দিল না কেন? ওদের কম্ম বুঝি আপন জাহাজের তদারকি করা আর ডানপিটেদের গৌরীশঙ্কর চড়ার সময় অষ্টপ্রহর বুলেটিন ঝাড়া!

এ বদ অভ্যাসটার জন্য অবশ্যি বেবাক দোষ দিশি লোকের ঘাড়ে চাপানো যায় না। ইংরেজের কুলগুরু গ্রিকরাই বলে গিয়েছেন, দাসের বিবেক থাকতে পাবে না, দাসের স্কন্ধে দায়িতুবোধ চাপানো যায় না–দাসের পাপ-পুণ্যের জন্য প্রভু দায়ী। তাই মহাপ্রভুর আপন কর্তব্য-নির্ধারণের সময় আমাদের মতামত কী তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। কোন্ রাস্তায় কটা ডাস্টবিন থাকবে তাই নিয়ে অবশ্যি মাঝে মাঝে সার্কুলার জারি করে আমাদের পরম আপ্যায়িত করেছেন এবং এই অভ্যাসের বশবর্তী হয়েই ক্রিস সায়েব লড়াইয়ের বাজারে স্বরাজ দেবার অর্থে বুঝেছিলেন আমাদের আপন লেটারহেড় ছাপাবার অধিকার হয়ে যাবে, কোন্ খ্যাংরায় কটা কাঠি থাকবে সে বিবেচনার হক্ক আমাদের ওপর বর্তাবে। আমাদের অনেকেই তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে বগল বাজিয়েছিলেন, পণ্ডিচেরি থেকে পর্যন্ত উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করবার ফরমান এসেছিল।

যাক এসব কথা– সেসব দিন গেছে।

ইতোমধ্যে স্বরাজটা ধপ করে চালকুমড়োর মতো উঠোনে পড়েছে আর তাই নিয়ে যে কামড়াকামড়ি লেগেছে– থাক, বাকিটা আর বলব না– এখন আর জেলে গিয়ে ভাঙাবার মতো কোনও ক্যাশ সার্টিফিকেট পাওয়া যায় না। কিন্তু আমাদের বদ অভ্যাসটা গেল না, কিছু একটা বানচাল হলেই আমরা বলি কংগ্রেস দায়ী, ছেলেটা চাকরি না পেলে কংগ্রেসের দোষ, বউটা বাজা বেরোলে কংগ্রেসের নাক কাটো।

বেবাক ভুলে গিয়েছি যে আমরা স্বাধীন, এবং যেহেতু চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী রাজ-চক্রবর্তী নন তাই দেশের জনসাধারণ কংগ্রেসরাজের ভালো-মন্দ সবকিছুরই জন্য অংশত দায়ী।

তার অর্থ, জনগণের যেমন সর্ববিষয়ে দায়িত্ব আছে তেমনি কংগ্রেসকেও জনমত উপেক্ষা করে ফতোয়া জাহির হাতিয়ার বাহির করলে চলবে না। কংগ্রেস হয়তো উত্তরে বলবেন, জনমত না কচু! যে-দেশের দু আনা লোক ভালো করে খবরের কাগজ পড়তে পারে না, সে দেশে আবার জনমত! ইংরেজকে তাড়াবার জন্য আজেবাজে সক্কলেরই প্রয়োজন হয়েছিল বলে তারাই সব এখন রাজত্বের কর্ণধার হয়ে যাবে নাকি? বুনো শুয়ার খেদাবার জন্য যে মাচান তৈরি করা হয়েছিল সেইটে এখন রাজসিংহাসন হয়ে যাবে নাকি?

প্রশ্নটা একেবারে ন-সিকে ভুয়ো নয়, কারণ আমাদের জনগণের কার্যকলাপ সেদিন শেয়ালদায় দেখা গেল, নিত্যি নিত্যি শোফার ঠ্যাঙানোতে, খেলার মাঠের দাবড়ানোতে দেখতে পাই। জনমত যদি জনকর্মের মতোই হয় তবে তাকেই-বা কুইট ইন্ডিয়ার বখরাদার করা হবে না কেন?

কবুল। কিন্তু প্রশ্ন এবং এই আমার শেষ প্রশ্ন– কংগ্রেস যখন গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন। তখন সুস্থ জনমত গঠন করার দায়িত্ব কি কংগ্রেসেরই নয়?

ইংরেজ জনমত গঠন করতে চায়নি বিদেশি রাজা কস্মিনকালেও জনমত গঠন করে না। কাজেই ইংরেজের কথা বাদ দিন।

হিটলারও তো জনমত গঠন করেননি। তবুও তো তিনি জার্মানিকে শক্তিশালী রাষ্ট্ররূপে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।

খাঁটি কথা। হিটলারের পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী ফ্রনিঙের আমলে জার্মান রাষ্ট্রে জনমত ছিল প্রচুর এবং রাষ্ট্র ছিল কম-জোর। এবং পার্টির প্রাচুর্য থেকে যদি জনমতের প্রসার স্বীকার করতে হয় তবে ব্রুনিঙের জার্মানির সামনে দণ্ডবৎ হয়ে প্রণাম করতে হয়। ১৯৩২ সালে জার্মানিতে সবসুদ্ধ সাতাশখানা পার্টি প্রতি গণনির্বাচনে ঝামেলা লাগাত।

হিটলার যে জনমত গড়েননি তার জন্য তাঁকে খেসারতিও দিতে হয়েছিল। সেই খেসারতির ধাক্কা সামলাবার ভার পড়েছিল গ্যোবেলসের ওপর। জার্মানির নিষ্পেষিত জনমত ছিল যুদ্ধের বিরুদ্ধে। গ্যোবেলস সায়েবের প্রপাগান্ডার চাবুক মরা-ঘোড়াকে খাড়া করেও খাড়া করতে পারল না। অর্থাৎ অস্ত্রবলে, ব্লিৎসক্ৰিগের ফলে জার্মানি লড়াই জিতেও শেষ পর্যন্ত হার মানলো।

স্ট্যালিনও জনমত চাননি কিন্তু তিনি হিটলারের চেয়ে বহুৎ বেশি হুঁশিয়ার। আর হাজার হোক রুশিয়ার ধনবন্টন পদ্ধতি জার্মানির চেয়ে অনেক বেশি সাম্যবাদী এবং গণতান্ত্রিক যদিও জার্মান মজুরের বিত্তসম্বল রুশ মজুরের চেয়ে অনেক বেশি। তা সে যা-ই হোক, লড়াই লেগে যাওয়ার পর স্ট্যালিনকেও রুশ জনমতের দর্গায় গোটাকয়েক মুরগি জবাই করে পীরকে জাগ্রত করতে হয়েছিল। কথাটা নিছক তুলনা নয়, কারণ সবাই জানেন, স্ট্যালিন বহু গির্জার দরজা খুলে দিলেন, হোলি রাশিয়ার নাম নিয়ে বিস্তর দোহাই-কিরা কাটলেন, জাপান হেরে যাওয়ার পর বললেন, এতদিন বাদে আমরা পোর্ট আর্থারের প্রতিশোধ নিতে পারলুম। আমরা কারা? জারিস্ট রাশিয়া? স্ট্যালিনিস্ট রাশিয়া? একই কথা!

মুসোলিনিও ইতালিকে শক্তিশালী করেছিলেন জনমতের কণ্ঠরুদ্ধ করে। কিন্তু লড়াই লেগে যাওয়ার পর তিনি যুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে পারলেন না। কারণ তাঁর গোয়ালে কোন গ্যোবেলস বাধা ছিল না। তাই যুদ্ধের মাঝামাঝিই ইতালির সর্বত্র দেখা যেত মুসোলিনি-বৈরী জনমতের নোটিশ লাগানো রয়েছে, যুদ্ধে যোগ দিয়ে ভারতবর্ষ দেখে নাও! অর্থাৎ লড়াইয়ে যোগ দিলে তোমাকে লিবিয়ায় যেতে হবে। সেখানে লড়াইয়ে হেরে ইংরেজের হাতে ধরা পড়বে। ইংরেজ তোমাকে ভারতবর্ষের বন্দিশিবিরে পাঠিয়ে দেবে। ব্যস! ফোকটে ভারতবর্ষ দেখা হয়ে গেল। আর ভারতবর্ষ দেখবার নামে ইতালির লোক অজ্ঞান।

মোদ্দা কথা তা হলে এই; জনমতের টুটি চেপে ধরলে দেশটাকে ঝটপট শক্তিশালী করা যায় কিন্তু যখন মার আসে তখন আর সামলানো যায় না। এই তত্ত্বটিই পূর্ববঙ্গের একটি প্রবাদে শুনেছি :

একলা ঘরের বউ-ঝি খেতে বড় সুখ।
মারতে গেলে ধরবে কে? ঐ বড় দুখ।

অর্থাৎ যে বাড়িতে শ্বশুর, ভাশুর, দেবর নেই সে বাড়ির একা বউ মনের আনন্দে যা খুশি রান্না করে খায়, কিন্তু যখন কিল মারার গোসাই সোয়ামি বউকে ঠ্যাঙাতে আরম্ভ করেন তখন তাঁকে ঠেকাবার জন্য শ্বশুর-ভাশুর কেউ নেই– এই হল বেদনা।

কিন্তু আমরা ভারতবাসী একান্নপরিবারে বিশ্বাস করি। তাই আমাদের বিশ্বাস কংগ্রেসও জনমত গড়ে তুলতে চাইবেন।

চান আর না-ই চান, আপনি-আমি তো আর চুপ করে বসে থাকতে পারিনে। কী করা যায়?

প্রথমত শিক্ষার ভিতর দিয়ে, অর্থাৎ স্কুল-কলেজে শিক্ষার বিষয়বস্তু এবং পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন করে।

কিন্তু ততদিন কি জনমত তে-ঠ্যাঙা রেস রান করবে?

না। খবরের কাগজ রয়েছে। এ যুগসন্ধিক্ষণে সত্যযুগাকাক্ষী খবরের কাগজ মাত্রেরই দায়িত্ব অসীম।

–ওমর খৈয়াম

.

রাষ্ট্রভাষা

গল্পটা অতি পুরনো তাই আরেকবার বললে ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না।

চাটুয্যে এসেছেন শ্রাদ্ধের নেমন্তন্নে স্মোকিং জ্যাকেট পরে। আনকোরা ইভনিং স্যুট। হালে বিলেত থেকে ফিরেছেন তাই।

বাঙ্গালাতেই কথাবার্তা হচ্ছিল। চাটুয্যে বললেন, কিছু মনে করবেন না, আমি বাঙলাটা তেমন ভালো বলতে পারিনে। সবাই চুপ। শেষটায় মুখুয্যে বললেন, তাই তো বড় বিপদে ফেললে হে চাটুয্যে, ইংরিজিটাও জানেন না, কী করা যায় বলো।

অর্থাৎ দু নৌকোয় পা দিলে মধ্যিখানে পড়ে যাবার সম্ভাবনাই বেশি।

কিংবা বলতে পারেন, এ সংসারের অধিকাংশ লোকই একটার বেশি ভাষা শিখতে পারে না (সাহিত্যিকরা বলবেন, একটা ভাষাই-বা কটা লোকে ঠিকঠিক শিখতে পারে বলো, কিন্তু এখানে উচ্চাঙ্গ বঙ্গভাষা নিয়ে রঙ্গরসের কথা হচ্ছে না)। এবং তাই নিয়ে এ পৃথিবীর গুরু সম্প্রদায়ের ভিতর শিরঃপীড়ার অন্ত নাই। আমেরিকা, ইংলন্ড, ফ্রান্স যে কোনও দেশ-মহাদেশের শিক্ষা বাবদীয় মাসিক পত্রিকা খুললেই দেখতে পাবেন সেই প্রাচীন সমস্যা নিয়ে পুনরপি আলোচনা : সেকেন্ড ল্যাগুইজ শেখানো কী প্রকারে সফল করা যায়?

আমেরিকায় লক্ষ লক্ষ ডলার খরচা করে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়েকে ফরাসি, জর্মন শেখানো হয়, ইংলন্ডেও তাই, ছেলেমেয়েরা লেটার পেয়ে পরীক্ষা পাসও দেয় কিন্তু গর্বান্ধ বাপ-মায়েরও অন্ধত্ব ঘুচে যায় যখন দেখেন ছেলে ক্যালে বন্দরে পোর্টারকে ফরাসি ভাষায় সামান্য প্রশ্নটুকু জিগ্যেস করতে পারছে না, পারিসের ট্রেন ছাড়বে কটায়, কোন প্ল্যাটফর্ম থেকে। দেখেন, ছেলের প্রশ্ন শুনে ফরাসি পোর্টার প্রথমটায় মাথা চুলকোয়, তার পর মুখ থেকে পাইপটা নামায়, তার পর হঠাৎ তার মাথায় কী একটা খেয়াল খেলে যাওয়ায় চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তার পর আর এক বেরাদর পোর্টারকে চেঁচিয়ে বলে, হে জ্যা, ভিয়ানিসি, ভোয়ালা আঁ মসিয়ো কি পার্ল আংলো–অর্থাৎ হেই জন, এদিকে আয়, এক ভদ্রলোক হেথায় ইংরেজি বলছেন। বাপ-মার চক্ষুস্থির, ছেলের মুখ চুন। কিন্তু কেলেঙ্কারিটার শেষ এইখানেই নয়। জ্যাঁ আসবে, ইংরেজি বলবে এবং সে ইংরেজি বাপ-ব্যাটা কেউই বুঝবে না।

হামেশাই এ ব্যাপার দুনিয়ার সর্বত্র হচ্ছে। প্যারিসে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন; ফিটফাট ভদ্রলোক, লম্বা দাড়ি অধ্যাপক, পাততাড়ি বগলে স্কুলের ছোকরা সবাইকে বুজুর বলে জোর করে দাঁড় করাচ্ছেন, অতিশয় কমনীয় নমনীয় ইংরেজিতে কিংবা আপনার অতি নিজস্ব মেড ইন ইন্ডিয়া (কিংবা ইংলন্ড) মার্কা ফরাসিতে জিগ্যেস করছেন, প্লাস দ্য লা মাদলেন। কোথায়? ফলম? সর্বং শূন্যং!

কিংবা হাম্বুর্গে। ইংরেজি ছাড়ুন, ফরাসি ছাড়ুন, জর্মন ছাড়ুন। যা ইচ্ছে তাই, কিংবা যাচ্ছেতাই। ইয়া, ইয়া, ইয়েস, ইয়েস, নো, নো, আন্দারস্তেন্দ নৎ। সরি, সরি গুদ মর্নিং! হয়ে গেল আপনার পায়ে হাঁটার অভিযান। মনে মনে কানমলা খেয়ে প্রতিজ্ঞা করলেন, আর ট্রামবাসে পায়ে হেঁটে ইয়ার্কি মারা নয়, এখন থেকে শুধু ট্যাক্সি, যেখানে যাবার যাব আর আসব, কারও সঙ্গে স্পিকটি নট।

অথবা আরেকটি গল্প নিন। আমার বক্তব্য আরও খোলসা হয়ে যাবে। এক ফরাসি দোকানের সামনে বড় বড় হরফে লেখা, ইংলিশ স্পোকেন। তাই দেখে আপনার-আমার মতো ভাষা বাবদে একংজিহ্ব (মনোগ্নট) জনৈক ইংরেজ সেই দোকানে ঢুকে গড়গড় করে ইংরেজি বলে কী একটা কিনতে চাইল। দোকানদার উত্তর দেয় যেন ফরাসিতে। ইংরেজ শুধায়, ফরাসি কও কেন? ইংরেজি বলতে পারো না? সাইনবোর্ডে লিখে রাখোনি ইংলিশ স্পোকেন? সাইনবোর্ডের দিকে আঙুল দিয়ে দেখানোতে দোকানদার মামলাটার আন্দেশা করতে পারল। অনেক ধস্তাধস্তি, বহুৎ হোঁচট খেয়ে ফরাসি-ইংরেজিতে আইরিশ স্টু বানিয়ে যা বললে তার অর্থ, ঠিকই তো, ইংলিশ এখানে বলা হয়। আমাদের খদ্দেররা ইংরেজি বলেন, আমরা কিন্তু ফরাসিই বলে থাকি। দোকানদারকে দোষ দিয়ে কী হবে, সে তো আর লেখেনি, উই স্পিক ইংলিশ, সে লিখেছে, ইংলিশ স্পোকেন।

গল্পটি শুনে আমি অবিশ্বাসীর বিজ্ঞ হাসি হেসেছিলুম। পরে ভেবে দেখলুম, এতে অবিশ্বাসের কিছুই নেই। কোথাও যদি পুলিশ সাইনবোর্ড লাগায় সাবধান, এখানে মালপত্র চুরি যায় আর তার পরও যদি আপনার মাল চুরি যায় আপনি কি তবে পুলিশকে গিয়ে ধরবেন যে তারাই মাল চুরি করেছে? (পুলিশের কাছে মাফ চেয়েই বলছি, ভারতবর্ষের কথা আলাদা, আমি অন্যান্য বর্বর দেশের কথা ভাবছি)।

শিরোনামায় বলেছি রাষ্ট্রভাষা। আপনি ঘড়েল পাঠক। নিশ্চয় এতক্ষণে ধরে ফেলেছেন আমার নলটা কোনদিকে চলেছে। হিন্দি রাষ্ট্রভাষা হয়ে গিয়েছে। সহি বাৎ। আমার তাতে কোনও আপত্তি নেই। একটা কেন, পঞ্চাশটা রাষ্ট্রভাষা চালান, আমি বড়ম্বরে সায় দেব। আমি তো আর কেন্দ্রে গিয়ে নোবাবির সন্ধান করব না, কিংবা মন্ত্রণাসভায় লম্বা লম্বা ভাষণ ঝাড়বো না যে হিন্দি রাষ্ট্রভাষার নোকরি পেয়ে গিয়েছেন শুনে বৈধব্য দুঃখে হবিষ্যান্নি আরম্ভ করব?

রাষ্ট্রভাষার যে প্রয়োজন আজ সেটা উপস্থিত না হয় মেনেই নিলুম এবং হিন্দি রাষ্ট্রভাষা হয়েছে তাতে আমার আপত্তি নেই। আমার শুধু সবিনয় নিবেদন, যেসব প্রদেশে হিন্দি প্রচারিত নয়, যেমন ধরুন বাঙলা, কিংবা অন্ধ্র, কিংবা তামিলনাড়ু সেসব দেশের লোককে জোর করে হিন্দির কলমা পড়াতে যাবেন না, কারণ পূর্বেই নিবেদন করেছি, দুটো ভাষা শিখতে পারে অল্প লোকেই।

উত্তরে আপনি বলবেন, কেন, মশায়, আমাদের অনেকেই তো ইংরেজি-বাঙলা দু ভাষাতেই খাসা বক্তৃতা ঝাড়তে পারেন!

আমি বলব, ইংরেজিতে আমরা বক্তৃতা দিয়েছি আপসে অর্থাৎ আপনজনের ভিতরে। দহরম মহরম বোঝাতে গিয়ে ফ্যামিলি ওয়ে বলেছি, ট্রেন মিস করার উল্লেখ করতে গিয়ে মিস ক্যারেজ বলেছি তাতে কোনও ব্যাকরণ অশুদ্ধ হয়ে যায়নি। কারণ, যে দু চারটি ইংরেজ সভাস্থলে উপস্থিত থাকতেন তারা নানা প্রকারের পিজিন ইংলিশ শুনে শুনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন; আমাদের ইংরেজি নিয়ে মস্করামো করতেন না। কিন্তু লালাজি দুবেজি পড়েজিরা, আমাদের টোটি-ফোটি হিন্দি শুনে তুষ্ণীভাব অবলম্বন করবেন, না মুখ ফিরিয়ে একটুখানি ফিক করে হেসে নেবেন ঠিক এঁচে উঠতে পারছি নে। লক্ষ্ণৌ দেহলি কি হিন্দি, সাহেব, বড়ি ঠাটকি হিন্দি,– মজাককি বাৎ নহি!

বিলক্ষণ, বিলক্ষণ। মোটেই মজাক করছিনে। যে মন্ত্রণাসভায় দেশের দশের ধনপ্রাণ নিয়ে আলোচনা হবে সেখানে মস্করা করতে যাবে কে?

তাই বারান্তরে আলোচনা করার বাসনা রইল, যেসব দেশে বহু ভাষা প্রচলিত সেসব দেশ এ সমস্যা সমাধান করেছে কী প্রকারে। ততদিনের জন্য জয় হিন্দ এবং

জয় হিন্দ। — ওমর খৈয়াম

.

ত্রিবেণী

ভারত ও এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক দৃঢ় করিবার উদ্দেশ্যে ভারতের শিক্ষাসচিব মৌলানা আবুল কালাম আজাদের সভাপতিত্বে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক প্রতিনিধি, ভারতের বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতী ও মুসলিম নেতৃবৃন্দের এক সম্মেলন হয়। এই সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের সহিত সাংস্কৃতিক সহযোগিতা রক্ষাকল্পে একটি ভারতীয় পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হইয়াছে।

এ খবর পড়ে বিদগ্ধজন মাত্রই আনন্দিত হবেন এবং আমার বিশ্বাস বাঙালি এ আহ্বানে সাড়া দেবে সবচেয়ে বেশি কাজ করার সুযোগ পাবে কি না, সেকথা তুলে এই মঙ্গলের দিনে দ্বন্দ্ব-কলহের সূত্রপাত করতে চাইনে। বাঙালি কেন এ আহ্বানে সবচেয়ে বেশি সাড়া দেবে সেকথা আরেক দিন হবে উপস্থিত ভারতবর্ষই কেন এ প্রকারের সাংস্কৃতিক যোগাযোগের চক্রবর্তী হবে, সে আলোচনা করা যাক।

প্রাচ্যলোকে তিনটি ভূখণ্ড পৃথিবীতে যশ অর্জন করেছে। আরব-ভূমিতে দুটি ধর্মের অভ্যুদয় হয়। খ্রিস্টধর্ম ও ইসলাম এবং এ দুটি ধর্ম যে প্রাচীনতম ইহুদি ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তারও বিকাশ হয়েছে আরব-ভূমির অন্যতম কেন্দ্র জেরুজালেমে।

দ্বিতীয় ভূখণ্ড ভারতবর্ষ। এখানে সনাতন, বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ।

তৃতীয় ভূখণ্ড চীন (এবং জাপানকে নিয়ে মঙ্গোলভূমি) কনফুসীয়, লায়োসে প্রচলিত পন্থাকে ধর্ম বলা যায় কি না, সে সম্বন্ধে সন্দেহ আছে, কিন্তু আমরা এখানে যে ব্যাপক অর্থে ধর্ম শব্দটি ব্যবহার করছি, তার প্রধান উদ্দেশ্য ধর্মকে সর্বপ্রকারের সংস্কৃতি ও বৈদগ্ধ্যের প্রস্থানভূমিরূপে অবলোকন করা।

সর্বশেষে আরেকটি ধর্মের উল্লেখ করা প্রয়োজন। আরব ও ভারতবর্ষের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডের বল্খ (সংস্কৃত বহিক) নগরে জরথুস্ত্র আপন ধর্ম প্রচার করেন ও ইরানি আর্য রাজা শুশতাশ্মকে এই নবধর্মে দীক্ষিত করেন।

ভৌগোলিক দৃষ্টিবিন্দু থেকে দেখতে গেলে ভারতবর্ষ প্রথম ও তৃতীয় ভূখণ্ডের মধ্যবর্তী একদিকে বল (ইরান) ও আরবভূমি, অন্যদিকে চীন-জাপানের মঙ্গোলভূমি এবং সে যে শুধু মধ্যবর্তী তাই নয়– সর্ব বৈদগ্ধের চক্রবর্তীও বটে।

মুসলমান ধর্ম জন্ম নিল আরবভূমিতে, ইরানে সে ধর্ম সুফি মতবাদের সহায়তায় পুষ্ট হল, কিন্তু ভারতবর্ষে এসে মুসলিম বৈদগ্ধ্য যে বিকাশ ও পরিণতি পেল তার সঙ্গে কটি মুসলিম দেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে? মিশরের ইবনেতুলুন মসজিদ অতি রমণীয়, জেরুজালেমের ওমর মসজিদ এবং মসজিদ-উল-আকসা স্থাপত্যের গর্বরূপ, বুখারা-সমরকন্দও চেঙ্গিস তিমুরের কীর্তি বক্ষে ধারণ করেছে, কিন্তু তৎসত্ত্বেও এ পৃথিবীর কে না জানে তাজমহলের বাড়া ইমারত পৃথিবীর আর কোথাও নেই।

শুধু তা-ই নয়। এ ইমারত গড়ে উঠল আর্য ও সেমিতি সংস্কৃতির অভূতপূর্ব সহযোগিতার ফলে। তাজের চারু-কারুকার্য অস্মদেশীয়, কিন্তু স্থাপত্য-পরিকল্পনা যাবনিক এরকম কথা পণ্ডিতেরা বলেন, আমরাও (অর্থাৎ অর্বাচীনরা) অস্বীকার করি না, কিন্তু ভারতবর্ষের ক-জন দর্শক তাজ দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হওয়ার সময় এ সম্বন্ধে সচেতন?

সেইটেই সবচেয়ে বড় কথা এবং সেইটেই আমাদের সবচেয়ে বড় গর্ব। কোনও ইংরেজ বা মার্কিন যখন তাজের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে তখন কোনও হিন্দু তো একথা বলে না, আমাকে শোনাচ্ছ কেন? আমার এতে গর্ব করবার কী আছে? ও জিনিস তো মুসলমানের তৈরি– যাবনিক, ম্লেচ্ছদুষ্ট! (আজ পর্যন্ত এমন মুসলমানও দেখিনি যিনি রবীন্দ্রনাথের প্রশংসা শুনে কানে আঙুল দিয়ে বলেছেন, তওবা, উনি তো হিন্দু!)।

পৃথিবীতে বহু সাধক জন্মেছেন, কিন্তু বিশ্বমৈত্রী প্রচার করাতে যারা দেশ-বিদেশে সম্মান পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর কবীর, নানক, দাদু, পল্টদাস এবং অন্যান্য অর্ধশিক্ষিত অশিক্ষিত আউল বাউল সম্প্রদায়। কবীরের চেয়ে বড় সাধক জন্মাননি একথা বলা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু তাঁর সাধনার ধন যখন বিশ্বজন সমক্ষে স্বপ্রকাশ হল তখন সত্যান্বেষীরা বিস্ময় মেনে এই কথাই জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এই অশিক্ষিত সাধক সর্বধর্ম সমন্বয়ের সন্ধান পেল কোথায়? হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-জরথুস্ত্রি সব ধর্মকে পক্ষপাতহীন সহৃদয়তায় গ্রহণ করতে হলে যে ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক, দার্শনিক পরিপ্রেক্ষিতের প্রয়োজন এ লোক সে দিব্যদৃষ্টি পেল কী করে?

এষাস্য পরমাগতি, এখোস্য পরম সম্পদ, ইহাই পরম গতি, ইহাই পরম সম্পদ, এ সম্পদ ভারতবর্ষ পেল কী করে?

সাধনার ক্ষেত্রে, সংস্কৃতির জগতে ভারতবর্ষ একদিন যে দিব্যদষ্টি পেয়েছিল, যার ফলে তার কাছে আত্ম-পর এক হয়ে গিয়েছিল, যার কৃপায় সর্বসংস্কারমুক্ত হয়ে সে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু মঙ্গল, যা কিছু সত্য অনায়াসে গ্রহণ করতে পেরেছিল, আজও সে সম্পদ ভারতবাসীর অবচেতন মনে সুষুপ্ত। সে সত্যযুগ পশ্চাতে ছিল, সে সত্যযুগ সম্মুখেও রয়েছে। আজাদ সাহেবের অদ্যকার প্রচেষ্টাই আমাদের মন সর্বপ্রকার সংশয় থেকে মুক্ত করতে পেরেছে।

এ ভারতভূমিতে যেরকম ইসলাম এসে তার বিকাশ পেল, জরথুস্ত্র ধর্মও এ ভূমিতে এসে আশ্রয় নিল। ঠিক তেমনি একদা এদেশ থেকে বিশ্বজয়ে বেরিয়েছিল বৌদ্ধধর্ম। চীন-জাপানে সে ধর্ম কী বিকাশ, কী পরিণতি লাভ করেছিল তার সন্ধান মাত্র কিছুদিন হল আমরা আরম্ভ করেছি। আত্মম্ভরিতা আমাদের উদ্দেশ্য নয়, তবু বলি যে জিনিস ভারতবর্ষ গ্রহণ করেছে সে সম্বন্ধে সে সচেতন– ইসলামের ভারতীয় ইতিহাস তাই সে অম্লাধিক জানে, কিন্তু যে জিনিস সে বিশ্বজগৎকে দিয়েছে, সে সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ অচেতন।

তাই বলি, ভারতবর্ষ পূর্বদিকে বাহু প্রসারিত করে দিয়েছে, পশ্চিমদিকে বাহু প্রসারিত করে নিয়েছে। সম্বিতে হোক্, অবচেতন অবস্থায়ই হোক, দুয়েরই সঙ্গে তার যোগাযোগ। চীন তো আরবকে চেনে না, আরবও চীনকে চেনে না।

সমস্ত প্রাচ্যের দৃঢ়ভূমি তাই ভারতবর্ষ।

— ওমর খৈয়াম

.

এ-পার গঙ্গা ও-পার গঙ্গা

নদীর এপার যখন নিশ্বাস ছেড়ে বলে ও-পারের মতো সুখ এ-পারে নেই আর ও-পারও যখন ঠিক একই কথা বলে তখন বিচক্ষণ জন বিশেষ বিচলিত হন না। কিন্তু পুব পারের প্রজারা যদি বলে পশ্চিম পারে রামরাজত্ব এবং পশ্চিম পারের প্রজারা যদি বলে পুবের জমিদার শিবতুল্য লোক এবং তদুপরি যদি দুই জমিদারের ভিতর মনের মিল না থাকে তা হলে উভয় পারের জমিদারবাড়িতে সামাল সামাল রব পড়ে যায়। রামের তখন ভয়, পাছে শিব উস্কানি দিয়ে তার জমিদারিতে প্রজা-বিদ্রোহ মাতিয়ে তোলেন, এবং শিব আগের থেকেই আপন প্রজার কিছু কিছু বকেয়া খাজনা মকুব করে দিয়ে শিবতুল্য হওয়ার চেষ্টা করেন। এ-হাল বাবতে বাঙালি মাত্রই ওকিবহাল।

কাজেই জর্মনির পূর্ব-পশ্চিম দু পারের অবস্থা বুঝতে বাঙালিকে কিছুমাত্র বেগ পেতে হয় না। উপরের তুলনাটি পেশ করা মাত্রই বিচক্ষণ জন যেমন টে শুনলেই বুঝতে পারেন টেংরার হাইস্কুলের হেডমাস্টারের মাথার টাকের কথা হচ্ছে ঠিক তেমনি বাঙালি মাত্রই রগড়ের আশায় উফুল্ল হয়ে ওঠে।

পশ্চিম জর্মনির ইংরেজ-মার্কিন-ফরাসি বড়কর্তারা বিনিদ্র যামিনী যাপন করছেন পাছে রায়তরা রাতারাতি রাতুল রুশের উস্কানিতে লাল হয়ে ওঠে, ওদিকে স্তালিনও যে পূর্ব জর্মনির দিল-দরিয়ায় গোসল করবার হেকমত খুঁজে পাচ্ছে না সেটাও লাল হরপেই মাঝে মাঝে ফুটে উঠছে।

এ সমস্যার গর্ভদান করেছিলেন লড়াই শেষ হওয়ার পূর্বে রজোভেল্ট, স্তালিন এবং চার্চিল তিন হুজুরে মিলে। জর্মনিকে দু টুকরো করে কমজোর করার মতলব তিন গাঁও বুড়োতেই করেছিলেন। বেবাক ভুলে গিয়েছিলেন যে, হিটলার একদা জর্মনির মন পেয়েছিলেন অর্ধচ্যুত রাইনল্যান্ডকে সম্পূর্ণ আপন করার জিগির তুলে, জর্মনিকে পাগল করে তুলেছিলেন খণ্ডিত সারল্যান্ডকে ফিরে পাওয়ার লোভ দেখিয়ে এবং শেষটায় ক্ষেপিয়ে তুলেছিলেন পরহস্তগত সুডেটেনল্যান্ড ও ডানৎসিখ কেড়ে নেবার কড়া মদ খাইয়ে। অর্থাৎ জর্মনির সামান্যতম টুকরো তার জাতির অঙ্গ থেকে কেটে ফেললেই জর্মনির সমস্ত শরীর– অর্থাৎ তার পূর্ণাঙ্গ জাতীয়তাবোধ ছিন্ন অঙ্গের জন্য প্রথমটায় ব্যাকুল হয়, তার পর নানা কল-কৌশলে গায়ে গত্তি লাগিয়ে নিয়ে শেষটায় চতুর্দিকে ডাণ্ডা বুলোতে থাকে। তখন তার আর শক্ৰমিত্র জ্ঞান থাকে না। ইংলন্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, রুশিয়া, কাউকে তখন সে বাদ দিয়ে কথা কয় না। এ হিড়িকে তিন মাতব্বরই যে কী রকম বেধড়ক মার খেয়েছেন তা তাদের গা চ্যাটাস চ্যাটাস শব্দ থেকে আমরা পর্যন্ত স্পষ্ট বুঝতে পারছি।

সোজা বাংলায় বলতে গেলে দাঁড়ায় : বিচ্ছেদের ফল বেদনা এবং তার থেকে জন্ম নেয় নিবিড়তম একাত্মবোধ। এই আমাদের যক্ষের ব্যাপারটাই বিবেচনা করে দেখুন না। একটুখানি ভেডুয়াগোছ ছিল বলে লোকটাকে কুবের গাঁয়ের বার করে দিলেন। বেচারি তখন হাউমাউ করে যে কান্নাকাটি করেছিল তারই নাম মেঘদূত। খাসা কাব্যি, কেউ অস্বীকার করবেন না। অথচ দেখুন, কুবের যদি ছোরার বউ-হ্যাংলামোটা একটুখানি বরদাস্ত করে নিতেন তা হলে সে আরামে খেয়েদেয়ে দু পয়সা লোকটার ছিল তো বটে– ঢেঁকুর তুলে তুলে আর আণ্ডা-বাচ্চা পয়দা করে বাকি জীবন কাটিয়ে দিত।

অবশ্য যক্ষটি অম্মদেশীয় অর্থাৎ গান্ধীপন্থি অহিংস। জর্মন হলে কী করত বলা যায় না। হয়তো ভি ওয়ান, ভি টু নিয়ে কুবেরের পেছনে তাড়া লাগাত আর কুবেরও হয়তো এটমবমের সন্ধানে মন্বন্তরব্যাপী তপস্যায় বসে যেতেন।

পাঠক বলবেন, চার্চিল তো আর মেঘদূত পড়েননি, এ তত্ত্বটা জানবেন কী করে? আলবৎ জানা উচিত। কারণ ইংরেজিতেই প্রবাদ রয়েছে অ্যাবসেন্স মেক্স হার্ট ফন্ডার। আমার বিশ্বাস চার্চিল এ প্রবাদটি জেনেশুনেই বিরহের ব্যবস্থাটা করেছিলেন। কারণ ইংরেজ আর কিছু জানুক আর না-ই জানুক, পয়সার কদরটা খুব ভালো রকমেই জানে। তাই তাদের ভিতর এ প্রবাদেরও বাড়া আরেকটা প্রবাদ আছে এবং সেটা জানে অতি অল্প ঘড়েলই– সেটা হচ্ছে, প্রেজেন্টস ফন্ডার স্টিল।

অর্থাৎ প্রেজেনস নয় প্রেজেন্টস। সাড়িডা, বালাডা কিন্যা বিবির মন যোগাও।

আমার বিশ্বাস চার্চিল যখন জর্মনিকে বৈষ্ণবার্থে খণ্ডিতা করতে রাজি হয়েছিলেন তখনই প্রেজেন্টসের কৌশলটা মনে মনে এঁচে নিয়েছিলেন। তাঁর মতলব ছিল কৃষ্ণকে কোনও গতিকে রাধার কাছ থেকে মথুরায় সরিয়ে নিয়ে রুক্মিণী-সত্যভামার ভেট দেওয়া। আমার বিশ্বাস তাই ইংরেজ এত সাত-তাড়াতাড়ি জর্মনিতে আবার খানা-দানা পাঠাতে আরম্ভ করেছে। (যুদ্ধ যখন লাগে তখন আমার এক জর্মন বন্ধুর দুই মেয়ের বয়স ছিল এক আর তিন। বন্ধু মাসখানেক হল একখানি চিঠিতে আমাকে লিখেছেন, যুদ্ধের সময় তো দক্ষিণ আমেরিকা থেকে কলা আসা বন্ধ ছিল। কাল প্রথম বাজারে কলা উঠেছে। আমার মেয়ে দুটি ছবিতে দেখা জিনিস নিজের চোখে দেখে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল। পদ্মার ও-পারে আমরা বলি, জর্মনিকে আবার কলা মূলাড়া দেওয়া হচ্ছে।

এবং সবচেয়ে বড় সওগাত মার্কিন-ইংরেজ-ফরাসি তিন মহাজন পশ্চিম জর্মনিকে দিয়ে ফেলেছেন সেটা হচ্ছে স্বরাষ্ট্রাধিকার। পশ্চিম জর্মনির কাজ-চালানো-গোছ একটা কনসটিটুশান তৈরি হয়ে গিয়েছে, গণনির্বাচন সমাপ্ত হয়েছে এবং হের আডেনাওয়ার এ অঞ্চলের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।

কিন্তু মার্কিন-ইংরেজ-ফরাসি বড়কর্তারা স্তালিনকে ফাঁকি দিয়েছেন। কথা ছিল কোনও কর্তাই আপন হিস্যার জর্মনিকে স্বরাজ দেবে না– স্বরাজ যদি দিতেই হয় তবে সবাই একজোট হয়ে পূর্ণাবয়ব জর্মনিকে পূর্ণাঙ্গ স্বরাজ দেবেন। মা-ই-ফ ঝপ করে আপন হিস্যায় স্বরাজ দিয়ে অর্থাৎ প্রজাস্বত্ব আইন চালু করে দিয়ে ওপারের জমিদার শিববাবুকে বেবাক বোকা বানিয়ে দিয়েছেন।

প্যাঁচটা মন্দ নয়। কারণ নব-রাষ্ট্রপতি হের আডেনাওয়ার প্রথম বক্তৃতাতেই ও-পারের জমিদারের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। অবশ্য হিটলার যেরকম ভাষায় সুডেটেন চেয়েছিলেন ঠিক সে ভাষায় নয়– অতি মোলায়েম কণ্ঠে, কিন্তু আমরা এসব গলা চিনি, টে বললেই বুঝতে পারি টেংরার হাই স্কুলের ইত্যাদি।

অবশ্য চেম্বারলিনের মতো স্তালিনের ছাতা-বগলে ছুটোছুটি, ওড়াউড়ি করতে এখনও ঢের দেরি।

কিন্তু তাঁকেও এপিজমেন্ট করতে হচ্ছে। পূর্ব-জর্মনিকেও স্বরাজ দিতে হয়েছে।

এখন কে কত দিতে পারে? সুকুমার রায়ের মতো আমরা বলি লাগ, লাগ, লাগ–অর্থাৎ নিলামটা লেগে যাক, দর চড়ুক, বেচারি জর্মনির দু মুঠো অন্ন জুটুক, গায়ে গত্তি লাগুক।

–ওমর খৈয়াম

.

ধর্মং শরণং?

নদীতে স্নান করলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে, দেশভ্রমণ করলে কুসংস্কার ও সঙ্কীর্ণতা থেকে মানুষ মুক্তি পায়, বস্ত্রদান ছত্রদান করলে দেশের শিল্প উন্নতিলাভ করে, মন্দির-মসজিদ গড়লে দেশের চারুকলা সমৃদ্ধিলাভ করে, তাই গঙ্গাস্নানে পুণ্য, তীর্থযাত্রায় ধর্মলাভ, দানে মোক্ষ আর উপাসনালয় নির্মাণে যে পুণ্য-ধর্ম-মোক্ষ তিনেরই সম্মেলন সে বিষয়ে এককালে কারও মনে কোনও সন্দেহ ছিল না।

অর্থাৎ যা কিছু মানুষের পক্ষে মঙ্গলদায়ক এককালে তাকেই ধর্ম নাম দিয়ে সাধুসজ্জন এবং সমাজপতিরা জনগণের মন উদ্বুদ্ধ করতেন। এখনও অশিক্ষিত লোক ধর্মের দোহাই না দিলে কোনও প্রকারের সামাজিক উন্নতির চেষ্টা করে না, এখনও বহু লোক শরীর অসুস্থ হলে ডাক্তার না ডেকে মন্ত্রতন্ত্রের আশ্রয় নেয়। দাওয়াই-দেনে-ওয়ালা সন্ন্যাসী ফকিরের বিধান এখনও মানে বহু লোক, বিধানের বিধানকে উপেক্ষা করে। এ নিয়ে মনস্তাপ করলে শিক্ষিত সম্প্রদায় বলেন, শিক্ষা বিস্তার ছাড়া অন্য কোনও উপায়ে মানুষের মন ধর্মের মোহ থেকে মুক্ত করা যাবে না। স্বাস্থ্যরক্ষা, সমাজসংস্কার, শিল্পকলার বিস্তার এখন ডাক্তার, অর্থবিদ নন্দনজ্ঞদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে–এরা সব স্পেশালিস্ট ধর্ম এখন শুধু তাদেরই জন্য যারা পরলোকের জন্য ইহলোক ত্যাগ করতে প্রস্তুত। শিক্ষাবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ এ তত্ত্বটা বুঝতে পেরে রাজনীতি অর্থনীতি থেকে ধর্মকে গলাধাক্কা দিয়ে বিদায় করে দেবে। যেমন ইউরোপ করেছে।

কিন্তু প্রশ্ন ইউরোপ সত্যিই কি রাজনীতি থেকে ধর্ম বাদ দিয়ে ফেলেছে?

হিটলার যখন সোশ্যালিস্টদের সাবাড় করলেন, কম্যুনিস্টদের ভিটে-মাটি উচ্ছন্ন। করলেন, ধনপতিদের কলুর বলদের মতো খাটালেন, শ্রমিকদের ইউনিয়ন পয়মাল করে দিলেন, ইহুদিদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করলেন, তখন নাৎসিরা নিশ্চিন্ত হয়ে ভাবল, এখন রাস্তা সাফ, লন্ডন-মস্কো পৌঁছতে এখন আর কোনই বাধা নেই। ঠিক তখনই বিদ্রোহ দেখা দিল এমন এক দলের মাঝখানে যাঁদের সবাই কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অফিসের কারবারি নামে পরিচিত হতেন। এঁরা সব ক্রিশ্চান পুরোহিতের দল, এবং এদের নির্ভীক আচরণ দেখে জর্মনির বহু আস্তিক বহু নাস্তিক বিস্ময় মানলেন, এবং আস্তে আস্তে তাদেরই চারপাশে ভিড় জমাতে লাগলেন। ১৯২৯ সালে হিটলার যখন সামান্য মন্ত্রীত্ব পেলেই বর্তে যেতেন তখন আমি গির্জাঘরে অনায়াসে বসবার জায়গা পেতুম, ১৯৩৮ সালে যখন চেম্বারলেন তাঁর কথায় কথায় বাঁদরনাচ নাচতে শুরু করেছেন তখন গির্জাঘরের ভিড়ের ঠেলায় আমি বহু রবিবার দরজা পর্যন্ত পৌঁছে নিরাশ হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছি। ১৯২৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়োলজি বিভাগ ছাত্রাভাবে অক্কা পায় পায়, ১৯৩৮ সালে ওই বিভাগই বক্তৃতা আলোচনায় গমগম করছে। হিটলারের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জর্মনির নাস্তিকরা তখন পর্যন্ত পাদ্রি-পুরুতের সঙ্গে দহরম মহরম আরম্ভ করেছে। এঁরা তখন যে সাহস দেখিয়েছিলেন জর্মনির লোক আজও তা ভুলতে পারেনি। এই মাত্র সেদিন পশ্চিম জর্মনির ব্রিটিশ এলাব যে গণ-নির্বাচন হয়ে গেল তাতে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে এক ধর্মের নামে গড়া রাজনৈতিক দল। জর্মনির খবর কাগজ পড়ে মনে হয়, সাধারণ জর্মন আর যেন নির্জলা রাজনৈতিকদের হাতে সবকিছু তুলে দিতে রাজি নয়। যে দলে দু চারজন পাদ্রি-পুরুত আছেন সে দলকে স্বীকার করে জর্মনি যেন তাদের আগেকার সাহসের পুরস্কার দিতে চায়।

ইটালিতেও তাই। কমরেড তল্লাত্তির মতো সর্বজনমান্য কম্যুনিস্ট নেতা পৃথিবীর অল্প দেশেই আছেন। ইটালির গত গণভোটে তার অবশ্যম্ভাবী জয় ঠেকাবার জন্য স্বয়ং পোপকে ভোট-মারে নাবতে হল। তল্লাত্তিও তখন প্রমাদ গণলেন। কমিউনিস্ট পার্টি জনসাধারণকে সন্তুষ্ট করার জন্য ইস্তাহারে জাহির করলেন, কমিউনিস্টরা জয়লাভ করলে পাদ্রি-পুরুতের টাকা-পয়সায় হাত দেবে না, গির্জা মনাস্টেরির (সংঘ) যুগ যুগ সঞ্চিত চাষা-মজুরের রক্তে রাঙা ধনদৌলত যেমন আছে তেমনি থাকবে। অর্থাৎ ধর্মকে তার অর্থ থেকে বঞ্চিত করা হবে না। তবু তাত্তিকে হার মানতে হল। আর এখন তো ভ্যাটিকান এবং মার্শাল প্লান একই জিনিস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

স্বয়ং স্তালিন লড়াইয়ের সময় পাদ্রি সম্প্রদায়কে ডেকে এনে বহু গির্জাঘর ফেরত দিলেন। শুনেছি কোনও কোনও গির্জাঘরে নাকি হোলি রাশার নামে পুজোপার্বণও হয়েছিল। নাম ভুলে গিয়েছি কিন্তু তখন এক বড় পাদ্রি সায়েবকে নিয়ে রুশিয়া বিস্তর মাতামাতি করেছিল। যুদ্ধের পর আমেরিকার ধনতন্ত্রে ফাটল ধরাবার জন্য কোনও কোনও মার্কিন পুরোতকে রুশ সাড়ম্বর নিমন্ত্রণ, আদর, আপ্যায়নও করেছিল।

ফ্রান্সের মতো নাস্তিক দেশে ক্যাথলিকদের এখনও কতখানি শক্তি সে-কথা আর বুঝিয়ে বলতে হবে না।

প্যালেস্টাইনে নবনির্মিত ইহুদিরাজ্য চোখের সামনে গড়ে উঠল যেহোভার নামে শপথ করে করে। ইহুদিরা শুয়োরের মাংস খায় না–শাস্ত্রে বারণ- ইসরায়েল রাজ্যে এই শূকর মাংস নিষিদ্ধ। অথচ এ রাজ্যের কর্ণধারগণের শতকরা নব্বইজন যখন ইউরোপে ছিলেন তখন ভুলেও সিনাগগে (ইহুদি ভজনালয়) যেতেন না, গবগব করে শুয়োরের মাংস গিলতেন প্রশস্ত দিবালোকে, হোটেল রেস্তোরাঁর বারান্দায় বসে।

এবং এই প্যালেস্টাইনের প্রতিবেশী মিশরে রাজনৈতিক আন্দোলন করে কে? ইংরেজকে খেদাবার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে কারা? অজহর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা। আমরা এদেশে টোল বা মাদ্রাসা বলতে যা বুঝি অজহর ঠিক সেই জিনিস। সেখানে ধর্মচর্চা হয়, সেখানকার ভূগোল পাঁচশো বছরের পুরনো, সেখানে অর্থনীতি এমনকি রাজনীতিও পড়ানো হয় না। অথচ এই অজহরের ছাত্রেরাই ট্রাম পোড়ায়, বাস জ্বালায়, আর মোকা পেলে ইংরেজকে ঠ্যাঙায়। এদের দমাবার জন্য দিনসাতেক হল নতুন আইন পাস করা হয়েছে। এবং আশ্চর্যের বিষয়, মিশরের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়টি ধর্মচর্চা করে না, ট্রামবাস পোড়াতেও চায় না, তারা আছে সরকারকে খুশি করে চাকরি পাবার তালে।

ট্রান্সজর্ডানের আমিরের তাগদ তিনি মহাপুরুষের বংশধর, তিনি রাজা এবং ধর্মগুরু দুই-ই বটেন।

ইবনে সউদের তাগদ তিনি মক্কা-নশীন তাই। মুসলিম জাহানের কেন্দ্র মক্কাশরীফ।

ইরান আফগানিস্তানের মোল্লা সম্প্রদায় এখনও সমাজচক্রবর্তী।

***

ধর্ম রাজনীতিতে প্রবেশ করবে কি না, করা উচিত কি না সে বিষয়ে ব্যক্তিগতভাবে আমি কিছু বলতে চাইনে। কারণ আমার মতের কোনও মূল্য নেই। আমি শুধু এইটুকু দেখিয়েই সন্তুষ্ট যে ধর্মকে গেট আউট বললেই সে সুড়সুড় করে বেরিয়ে যায় না। এবং তাই যদি সত্য হয় তবে ধর্মকে কী প্রকারে জনপদ-কল্যাণে নিযুক্ত করা যায় সেইটে সাদা চোখে ভালো করে তলিয়ে দেখতে হবে। এবং তলিয়ে দেখতে হলে ঈষৎ ধর্মচর্চার প্রয়োজন। সেটা কী প্রকারে করা যায় সেই হল সমস্যা। ধর্ম বলতেই যারা অজ্ঞান তাঁদের হাতে তো আর সবকিছু ছেড়ে দেওয়া যায় না।

–ওমর খৈয়াম

.

কাঠ-বেরালি?

স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের কথা এ সপ্তাহে আমরা বার বার স্মরণ করেছি; দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা জনারণ্যের মাঝখানে বক্তৃতামঞ্চের উপর থেকে তাদের উদ্দেশে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেছেন। স্বাধীনতার যে দেউল নির্মিত হল তার অনির্বাণ আরতির চিরন্তন প্রদীপ হয়ে রইল তাদের স্মৃতি।

সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু এ-বেদনাটাও বুকে বাজে যে, বহু অখ্যাত অজ্ঞাত দেশবাসীর নাম আমরা এ উপলক্ষে পাঁচজনকে শোনাতে পারলুম না। তারা এমন কিছু কীর্তি রেখে যেতে পারেননি যার জন্য আমরা তাদের নাম আড়ম্বর করে স্মৃতিফলকে উত্তীর্ণ করতে পারি। অথচ আপনি আমি পাঁচজন নগণ্য লোকের চেনা-শোনার ভিতরেও এরকম ধরনের দু চারটি দেশসেবী ছিলেন।

তাঁর নাম শান্তিলাল খুশহালচন্দ শাহ। বাড়ি মহাত্মাজির দেশে, অর্থাৎ কাঠিওয়াড়ে–প্রাচীন সৌরাষ্ট্রে। রোগা-পটকা লোকটি দৈর্ঘ্যে পাঁচ ফুট হয় কি না-হয়। অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে এ-দিক ও-দিক ধাক্কা খেয়ে খেয়ে পৌঁছলেন শান্তিনিকেতনে সেখান থেকে গেলেন বন্ শহরে (অধুনা পশ্চিম জর্মনির রাজধানী) সংস্কৃতে ডক্টরেট নেবার জন্য। অধ্যাপক কিফেল (পুরাণ সম্বন্ধে ইন্ডিশে কসমগণি নামে একখানা বিরাট গ্রন্থ ইনি লিখেছেন, বিখ্যাত প্রাচ্য বিদ্যামহার্ণব অধ্যাপক য়াকোবির ইনি শিষ্য) ছোকরাকে পেয়ে ভারি খুশি।

কী মতলব তা জানার পূর্বে খামকা তর্ক করে অস্ট্রেলিয়ান শয়তানকে হুঁশিয়ার করে দেওয়াটা বিচক্ষণের কর্ম হবে না।

ভেবেছিলুম, শাহ খবরদারিটা শুনে অস্ট্রেলিয়ানকে ঠ্যাঙাবার জন্য তার ভাঙা মোটর-সাইকেল করে তদণ্ডেই বন শহর চষতে আরম্ভ করে দেবে। আদপেই না, ঠাণ্ডা হয়ে সব কথা শুনল, মিটমিটিয়ে একটুখানি হাসল।

শুধালুম, দেশে ফিরে না যেতে পারলে দেশ-সেবা করবে কী করে? তাই একটু সমঝে-বুঝে বক্তৃতাটা দিলে হয় না?

শাহ মিটমিটিয়ে হাসল।

বক্তৃতার দিন আমরা সদলবলে উপস্থিত– দেখি অস্ট্রেলিয়াও এসেছে।

সাড়ে ছ-ফুটি জর্মনদের মধ্যিখানে পাঁচফুটি শাহকে বামনাবতারের মতো দেখাচ্ছিল।

ভারতবর্ষের নানা প্রকার ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক গবেষণা করার পর শাহ নামল ইংরেজ রাজত্বের আমলে। প্রথমে আলোচনা করল সে-আমলের সর্বাঙ্গীণ দুঃখ-দৈন্য, মহামারী-দুর্ভিক্ষের, আস্তে আস্তে ফুটিয়ে তুলতে লাগল তার জন্য যে দায়ী তার বিকট বীভৎস নগ্ন ছবি এবং সর্বশেষে করল হুঙ্কারের পর হুঙ্কার দিয়ে এমিল জোলার আই একুজ (I accuse) কায়দায় ইংরেজের চতুর্দশ পুরুষের শ্রাদ্ধ।

কর্ণপটবিদারক করতালির মাঝখানে শাহ আসন গ্রহণ করল।

করতালির প্রতি নমস্কার করতে উঠে শাহ বলল, এই সামান্য নগণ্য বক্তৃতা সম্পর্কে আমার আরেকটি বক্তব্য আছে।

তার পর অতি শান্তকণ্ঠে অস্ট্রেলিয়ান হুমকির একটা সবিস্তর বয়ান দিয়ে বলল, আমি কে, আর আমার কতটুকুই-বা শক্তি? সেই সামান্য সত্তাটুকুকেও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সইতে পারে না বলে এই সুদূর বন্ শহরের নিভৃত কোণেও সে চোখ রাঙায়, মার লাগাবে বলে ভয় দেখায়। কিন্তু আমার দেহ ক্ষুদ্র, ভয়ও সেই অনুপাতে ক্ষুদ্র।

পাঁচফুটি শাহ সেদিন জর্মনদের কাছ থেকে বাদ-‘শাহী’ কদর পেয়েছিল।

***

আমি দেশে ফিরে এলুম। কিছুদিন পরে শুনলুম, কোথাও থেকে একটা বৃত্তি যোগাড় করে শাহ বন্ শহরের মেডিকাল কলেজে ঢুকেছে। সংস্কৃতে ডক্টরেট নেওয়ার পর পরিণত বয়সে ডাক্তারি পড়া আরম্ভ করা– তা-ও আবার জর্মন মেডিকাল কলেজে! চারটিখানি কথা নয়।

তার পর শুনলুম, শাহ ডাক্তারি পাস করে জর্মন ফৌজে ডাক্তার হয়ে ঢুকেছে। তখন বুঝলুম, কেন সে এত মেহনত করে ডাক্তারি শিখল। সুভাষচন্দ্র যেরকম জাপানের সাহায্য নিয়ে ইংরেজকে পর্যুদস্ত করতে চেয়েছিলেন, আমাদের নগণ্য শাহ তেমনি জর্মন ফৌজে ঢুকেছিল সেই মতলব নিয়ে। পাঁচফুটি শাহ তো অন্য কোনও উপায়ে জর্মন ফৌজে ঢুকতে পারত না।

তার পর নাকি শাহ স্তালিনগ্রাদের দিকে জর্মন ফৌজের সঙ্গে যায়– এটা অবশ্য উড়ো খবর। শাহের জীবনের এ পর্বটা জানবার কৌতূহল সকলেরই হওয়ার কথা, কিন্তু অনেক অনুসন্ধান করেও আমি এ বিষয়ে কোনও তথ্য যোগাড় করতে পারিনি।

শাহের সর্বশেষ খবর পাই লড়াই শেষ হওয়ার বছরখানেক পরে। জর্মনিতে তখন যেসব ভারতীয় আটকা পড়ে আছেন তার একটা ফিরিস্তি ইংরেজ সরকার প্রকাশ করে। সে ফিরিস্তিতে শাহের নাম ছিল।

তার পর শাহের আর কোনও খবর পাইনি।

–প্রিয়দর্শী

.

মিজো সমস্যা : সরকার

ফিজোর ভাই মিজো না হলেও খুব যে নিকট-আত্মীয় সন্দেহ নেই। বললেন, লোকসভার একজন কংগ্রেসি সদস্য সংসদের কেন্দ্রীয় হলঘরে। উপস্থিত একজন সদস্য অতিশয় উত্মা প্রকাশপূর্বক বর্ণনা করতে লাগলেন কেন্দ্রীয় সরকার ও আসামের রাজ্য-সরকারের মনোভাব। এবং এক জায়গায় এসে উনি অতি নিপুণভাবে যে বিশেষণটি প্রয়োগ করলেন এই দুই সরকারের বিষয়ে, সেই শব্দটি জরগদব।

একদা নাগা-নেতা ফিজোকে নিয়েও ছিল এই জরপাব ভাব; এবার মিজোদের বেলায়ও দেখা গেল ওই একই ভাব। সশস্ত্র অভ্যুত্থানে যারা দেশের বাইরে চলে যেতে চায় তাদের নিন্দা করেন না এমন রাজনৈতিক নেতা ভারতে খুব বিরল। কিন্তু এবার অনেকে (তাদের ভিতর সরকারি দলের নেতারাও আছেন) প্রশ্ন করতে আরম্ভ করেছেন কেন্দ্রীয় ও আসাম রাজ্য-সরকারের সেই ঢিমে-তেতালা জমিদারি চালের, যার জন্য আজ সম্ভব হয়েছে মিজো বিদ্রোহ।

কেন্দ্রীয় সরকার, বিশেষত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আসাম সরকার জানতেন যে, চরমপন্থী মিজোরা অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করছে ১৯৬৩ থেকে, এবং যারা অস্ত্র যোগাড় করে তারা একদিন অস্ত্র নিয়ে দাঁড়াবে, তা-ও জানতেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নন্দজি নিজে বললেন লোকসভায় যে, অস্ত্রাদি এসেছে পাকিস্তান থেকে, এবং মিজোদের অনেককে সামরিক শিক্ষাও দিয়েছে পাকিস্তান। এটা সরকার জানেন আজ অনেকদিন। তা সত্ত্বেও না হয়েছে চেষ্টা অস্ত্র-আনার পথ বন্ধ করার, না হয়েছে চেষ্টা চরমপন্থি নেতাদের গ্রেপ্তার করার, না হয়েছে চেষ্টা অস্ত্রের গোপন গুদাম খুঁজে বের করার। এও যদি জরপাব না হয় তো কে আর হবে?

শুধু তাই কি? এই চরমপন্থী শ্রেষ্ঠ নেতা হল লালডেংগা, ও তার দক্ষিণহস্ত হল লালনুমাউইয়া, মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের যথাক্রমে সভাপতি ও উপ-সভাপতি। এরা, ও আরও অনেকে চট্টগ্রাম দিয়ে যেত পাকিস্তানে। এবং যেত বেড়াবার জন্য নয়। অবশেষে ১৯৬৩-র ১৭ ডিসেম্বর এই দু জনকেই গ্রেপ্তার করা হয় বেআইনিভাবে পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কী জানি কেন, কিছুকাল পর দুজনকেই ছেড়ে দেওয়া হয়। তার জন্য দায়ী আসাম সরকার।

আজ থেকে প্রায় বছর চার-পাঁচেক আগে কেন্দ্রীয় সরকারকে দেওয়া হয়েছিল গোপন সামরিক রিপোর্ট ভারতের ওইসমস্ত পাহাড়ি সীমান্ত নিয়ে, এবং তাতে নাগা-মিজো পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের উল্লেখও ছিল।

মুখ্যমন্ত্রী শ্রীচালিহার নাকি চমৎকার যুক্তি। তাঁর প্রাক্তন সহযোগী ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ সাহেব বললেন লোকসভায় যে, মুখ্যমন্ত্রী অতিরিক্ত কোনও নিরাপত্তা বাহিনী পাঠালেন না মিজো অঞ্চলে এই ভয়ে যে, তাতে মিজোরা অসন্তুষ্ট হবে, এবং হয়তো তাদের বিদ্রোহের দিন ঘনিয়ে আনবে। এমন যুক্তি কোনও মুখ্যমন্ত্রী দিতে পারেন, অবিশ্বাস্য। কিন্তু বাস্তবে তাই হয়েছে। আইজলে মাত্র ছিল এক ব্যাটালিয়ন আসাম রাইফেলস্। হালফিলে পাঠানো হয়েছে আর একটি মাত্র ব্যাটালিয়ন। সশস্ত্র মিজোদের সামনাসামনি করতে, অথবা বিদ্রোহ দমন করতে এই দুই ব্যাটালিয়ন কিছুই না। যদি কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত বাহিনী পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেনই তা হলে ওই সময়ে আরও বেশি কেন পাঠানো হল না? আমাদের সৈন্যবাহিনীর ঘাটিই-বা নেই কেন? ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি এত কম ছিল যে, অতিরিক্ত রাস্তাঘাট তৈরির চেষ্টাও হয়নি।

অসীম অবহেলা যেমন নিরাপত্তার দিকে তেমনি রাজনৈতিক দিকে। লালডেংগা প্রমুখ মিজো নেতারা ১৯৬০ ও আগে থেকে অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চলনেতাদের সঙ্গে মিলে কাজ করছিল। ১৯৫৫-৫৬ থেকে তারা দাবি তুলেছে, সমস্ত পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে আলাদা রাজ্য গড়ার। স্বাধীন রাষ্ট্রের নয়, ভারতের ভিতরে থেকে আলাদা রাজ্য গড়ার। কে শোনে? আসাম সরকার ও তাঁর কর্মচারীদের ঔদ্ধত্যের ফলে ক্রমশ নাগারা গেল বিগড়ে। তাঁদের শাসক-মনোভাব শেষে অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চলেও আনল অসন্তুষ্টি। গোড়ায় ছিল পাহাড়ি মানুষদের একটা অনুভব যে, তারা আসামের ভিতরে থেকে আসামের কর্তৃত্বধীনে নিজেদের মতো জীবনযাপন করতে পারবে না। ১৯৬০-এর ভাষা বিল, বাঙালি বিতাড়ন আন্দোলন, ১৯৬১-এর কাছাড়ে পুলিশি তাণ্ডব সব মিলে ঠেলে দিল পার্বত্য নেতাদের সম্পূর্ণ বিরোধী স্থানে।

তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সঙ্গে এদের প্রতিনিধিরা সাক্ষাৎ করতে থাকেন ১৯৬০-এর নভেম্বর (২৪-২৬) থেকে। লালডেংগারা সেই বছরই বেরিয়ে চলে গেল সর্বদলীয় নেতা সম্মেলন থেকে। তখন থেকে মিজোরা চলল আলাদা পথে। এমনকি নরমপন্থী দলের নেতা থাংলুরা মশায়ও কংগ্রেস দল থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন ২৭ এপ্রিল, ১৯৬১। তাঁকেই আবার কংগ্রেস পাঠালো রাজ্যসভায়। মিজোরা ছিল দু মুখো। এক মুখে ছিল স্বায়ত্তশাসন অর্জনের কথা, অন্য মুখে ছিল সার্বভৌম রাষ্ট্র স্থাপনের কথা। আমাদের সরকার প্রথম মুখের কৌশলে ধরা দিলেন।

অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চল-নেতারা (খাসি, গারো, মিকির ইত্যাদি) নিজেদের দাবি নামিয়ে আনল। নেফা থেকে গারো পাহাড় অবধি এক রাজ্য আর চায় না। তারা শুধু চাইল, নেহরু ফরমুলা মতে, পুরোপুরি স্বায়ত্তশাসন আসাম রাজ্যের অভ্যন্তরে। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী চালিহাও সম্মত হলেন (১-১-৬৪)। তা সত্ত্বেও আজ দু বছর গড়িয়ে গেল, কিছুই হল না।

সরকারের না আছে সামরিক দূরদৃষ্টি, না আছে রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি। দৃষ্টিই নেই, তা কি। দূরের কি কাছের! ফল : (১) মিজো বিদ্রোহ। (২) অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চলে তার প্রভাব, যার ফলে অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চল শুধু স্বায়ত্তশাসনে সন্তুষ্ট না থেকে হয়তো দাবি আরম্ভ করবে ভারতীয় রাষ্ট্রস্থ রাজ্যপদ লাভের।

— দারাশিকো।

সত্যপীরের কলমে

লাক্ষাদ্বীপ

বহু বত্সর পূর্বে আমি মাদ্রাজ শহরে এক বন্ধুর বাড়িতে বাস করতুম। তখন চিনি বড় রেশনড় ছিল। যে-ঘরের বারান্দায় বসেছিলুম সেখানে বন্ধুপত্নী কাগজে মোড়া চিনি একটা বোয়ামে রেখে কাগজটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন। সেই কাগজের টুকরোটা হাওয়ায় ভেসে ভেসে এসে আমার পায়ের কাছে ঠেকল। আমার চোখ গেল যে, কাগজটাতে আরবি হরফে কী যেন লেখা। আশ্চর্য। এই মাদ্রাজ শহরে চিনির দোকানে আরবি কাগজ এল কোথা থেকে? কৌতূহল হল। কাগজটি তুলে ধরে পড়বার চেষ্টা দিলুম। তখন দেখি আরবি হরফে যেসব ভাষা লেখা হয় এটা তার কোনওটাই নয়, আরবি নয়, ফারসি নয়, উর্দু নয়, সিন্ধি নয় (সিন্ধি আরবি হরফে লেখা হয়), কিছুই নয়। তুর্কি ভাষা আমি জানি না। কিন্তু তুর্কি ভাষা এই মাদ্রাজে এসে পৌঁছবে কী প্রকারে? একটি পাতার তো ব্যাপার; ধৈর্য সহকারে পড়ে যেতে লাগলাম এবং দ্বিতীয় পৃষ্ঠার শেষ শব্দটি দেখি মুদরায়ে অর্থাৎ মদুরা। তা হলে ইটি ভারতীয় ভাষা। তখন ছিন্ন পত্রখানা ফের সযত্নে পড়ে দেখি, খাস আরবি শব্দের সঙ্গে মিশে আছে মালায়লাম ও তামিল শব্দও। হঠাৎ মাথায় খেলল, এটি তা হলে মপলাদের ভাষা। এরা আরব ও মালয়ালমের বর্ণসঙ্কর। পরের দিন বন্ধু যখন কর্মস্থলে গেলেন তখন ছিন্ন পত্রটি তার হাতে দিয়ে আমার অনুমানটি কনফার্ম করিয়ে নিলুম। এবং অনুসন্ধান করে আরও জানলুম, লাক্ষাদ্বীপকে নিয়ে যে দ্বীপপুঞ্জ গঠিত সেগুলোর ভাষাও নাকি মোটামুটি ওই একই।

হালে শ্রীযুক্তা ইন্দিরা গান্ধী এই দ্বীপপুঞ্জটির সফরে গিয়েছিলেন। আমি আশা করেছিলুম, এই সুবাদে আমাদের দেশের ওই অংশটি সম্বন্ধে অনেক-কিছু জানতে পাব। তা জেনেছি নিশ্চয়– এঁদের বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে অনেক সাংবাদিক সবিস্তর বর্ণনা দিয়েছেন, কিন্তু আমার কৌতূহল ছিল এঁদের প্রাচীন ইতিহাস জানবার। সে-বাবদে যে তিমিরে সে তিমিরেই রয়ে গেলুম।

প্রথম প্রশ্ন লাক্ষাদ্বীপ কথাটার অর্থ কী? ইংরেজিতে বানান করা হয় Laccadive এবং এর শেষাংশ দীব যে দ্বীপ সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আরবি ভাষায় প অক্ষরটি নেই বলে সে স্থলে ব বা ওয়া (অর্থাৎ ইংরেজি v অক্ষর) ব্যবহৃত হয় : তাই দীব বা দীও নিশ্চয়ই দ্বীপ। কিন্তু প্রশ্ন লাক্ষা শব্দের অর্থ কী? পণ্ডিতেরা বলেন, ওটা সংস্কৃত লক্ষ (১,০০,০০০) থেকে এসেছে। অথচ লাক্ষাদ্বীপপুঞ্জে দ্বীপের সংখ্যা মাত্র চোদ্দটি। এমনকি এই দ্বীপপুঞ্জের সংলগ্ন, মাত্র আশি মাইল দূরে অবস্থিত মালদ্বীপের (এ-এলাকা ভারতের অংশ নয়।)

চতুর্দিকে যে দ্বীপপুঞ্জ আছে তার সংখ্যাও তিন শো (এর মধ্যে মাত্র সতেরোটিতে লোকাবাস আছে এবং এদের ভাষা আরবি মিশ্রিত সিংহলি)। এই তিনশো এবং লাক্ষাদ্বীপে চৌদ্দটি (বসতি আছে সাকুল্যে তা হলে বাইশটি দ্বীপে) নিলেও তাকে লক্ষ সংখ্যায় পরিবর্তিত করতে হলে এদেরকে হাজার হাজার ডবল প্রমোশন দিতে হয়। তবে কি না, কি হিন্দু পুরাণকার কি মুসলমান পর্যটক ঐতিহাসিক গণনা করার (শুমার করার) সময় বেশকিছুটা কল্পনাশক্তির আশ্রয় নিয়ে ১০০ বা ১০০০-র পিছনে গোটা তিনেক শূন্য বসিয়ে দিতে কার্পণ্য করতেন না। এরই একটি উদাহরণ পাওয়া যায় বাঙলা দেশের কেচ্ছাসাহিত্যে : লোক মরে লক্ষ লক্ষ, কাতারে কাতার। শুমার করিয়া দেখি আড়াই হাজার। তবু এ কবিটির কিঞ্চিৎ বিবেক-বুদ্ধি ছিল। উৎসাহের তোড়ে প্রথম ছত্রে লক্ষ লক্ষ বলে শেষটায় মাথা ঠাণ্ডা করে বললেন, না, পরে গুনে দেখি, আড়াই হাজার। অতএব আড়াই হাজার যদি লক্ষ লক্ষ হতে পারে তবে তিনশো দ্বীপকে মাত্র এক লক্ষে পরিণত করতে আর তেমন কি ভয়ঙ্কর অসুবিস্তে! তদুপরি মূল পাণ্ডুলিপির কপি করার সময় নকলনবিসরা শূন্য সংখ্যা বাড়াতে ছিলেন বড়ই উদারচিত্ত।

এতসব যুক্তি থাকা সত্ত্বেও আমি অতিশয় সভয়ে একটি নিতান্ত এমেচারি (ফোক ইটিমলজি) শব্দতাত্ত্বিক গবেষণা পেশ করি।

লাক্ষা শব্দের অর্থ গালা। পলাশ প্রভৃতি বৃক্ষের শাখায় পুঞ্জীভূত কীট-বিশেষের দেহজ রস হইতে ইহা উৎপন্ন হয় (হরিচরণ)। এর রঙ লাল। হিন্দিতে এর নাম লাক এবং ইংরেজি ল্যাক এর থেকে এসেছে।… লাক্ষাদ্বীপপুঞ্জ নির্মিত হয়েছে এক প্রকারের কীটের রস থেকে। এর নাম প্রবাল এবং এর রঙ লাল গোলাপি, সাদা ইত্যাদি হয়। কিন্তু প্রবাল বলতে সংস্কৃতে সর্বপ্রথম অর্থ : অঙ্কুর, কিসলয়, নবপল্লব– অতএব বৃক্ষের সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে।

তাই আমার মনে সন্দেহ জাগে সেই প্রাচীন যুগে যখন লাক্ষাদ্বীপের নামকরণ হয় (এবং আর্যরা ওই প্রথম প্রবালদ্বীপ, কোরাল আইল্যান্ড-এর সংস্পর্শে আসেন। তখন তারা হয়তো লক্ষ সংখ্যার কথা ভাবেননি, তাঁরা এর নামকরণ করেছিলেন লাক্ষার সঙ্গে এর জন্মগত, বর্ণগত, রসাগত রূপ দেখে।

.

সিন্ধুপারে

লাক্ষা দ্বীপ নিয়ে বড্ড বেশি তুলকালাম করার কোনওই প্রয়োজন থাকত না, যদি না তার সঙ্গে ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস বিজড়িত থাকত।

প্রথম প্রশ্ন : পশ্চিমদিকে ভারতীয়রা কতখানি রাজত্ব বিস্তার করেছিল? কোন কোন জায়গায় তারা কলোনি নির্মাণ করেছিল?

আমার সীমাবদ্ধ ইতিহাস ভূগোল জ্ঞান বলে, পশ্চিম দিকে, ভারতের দক্ষিণতম প্রান্ত কন্যাকুমারী থেকে প্রায় দু হাজার মাইল দূরে, আদন বন্দরের প্রায় ছ শো মাইল পুব দিকে সোকোত্রা দ্বীপে। ম্যাপ খুললেই দেখা যায়, এ-দ্বীপ যার অধিকারে থাকে সে তাবৎ লোহিত সাগর, আরব সমুদ্র এবং পার্সিয়ান গালফের ওপরও আধিপত্য করতে পারে।

এই সোকোত্রা দ্বীপের গ্রিক নাম দিয়োকরিদে এবং পণ্ডিতেরা বলেন এ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত দ্বীপ-সুখাধার থেকে। মনে হয়, ভারতবর্ষের পশ্চিম প্রান্ত থেকে নৌকোয় বেরিয়ে, দু হাজার মাইল ঝড়ঝার সঙ্গে লড়াই করতে করতে যে কোনও জায়গায় পৌঁছলেই মানুষ সেটাকে সুখাধার বলবেই বলবে। কিন্তু এ-দ্বীপের পরিষ্কার ইতিহাস জানবার তো উপায় নেই। প্রাচীন গ্রিক ভৌগোলিকেরা বলছেন, এ দ্বীপে বাস করত ভারতীয়, গ্রিক ও আরব বণিকরা। পরবর্তী যুগের ঐতিহাসিকরা বলছেন, এটা তখন ভারতীয় বম্বেটেদের থানা। তারা তখন আরব ব্যবসায়ী জাহাজ লুটপাট করত।

মনে বড় আনন্দ হল। এদানির অহিংসা অহিংসা শুনে শুনে প্রাণ অতিষ্ঠ। আমরাও যে একদা বম্বেটে ছিলুম সেটা শুনে চিত্তে পুলক জাগল। বম্বেটেগিরি হয়তো পুণ্যপন্থা নয়, কিন্তু এ-কথা তো সত্য যেদিন থেকে আমরা সমুদ্রযাত্রা বন্ধ করে দিলুম সেইদিন থেকেই ভারতের দুঃখ দৈন্য, অভাব দারিদ্র্য আরম্ভ হল।

সোকোত্রা দ্বীপকে মিশরিরা নাম দিয়েছিল সুগন্ধের সারিভূমি–অর্থাৎ সারি কেটে কেটে যেখানে সুগন্ধ দ্রব্যের চাষ হয়। এবং এখন সেখানে ঘৃতকুমারী (মুসব্বর), মস্তকি (MyTh), গুগগুল এবং আরও কী একটা উৎপাদিত হয়। মামি তৈরি করার জন্য মিশরীয়দের অনেক কিছুর প্রয়োজন হত। এবং খুশবাইয়ের প্রতি ওদের এখনও খুবই শখ। খ্রিস্টপূর্ব হাজার বছর আগে রচিত রাজা সুলেমানের গীতে বিস্তর সুগন্ধের উল্লেখ আছে। এদের অধিকাংশই যেত ভারত, সিংহল, ইন্দোনেশিয়া এবং সোকোত্রা থেকে। এবং এই সোকোত্রাই ছিল ভারত ও আরব বণিকদের পণ্যদ্রব্য বিনিময়ের মিলনভূমি। আরবদের মারফতে সেসব গন্ধদ্রব্য বিলেত পর্যন্ত পৌঁছত। তাই শেকসপিয়র ভেবেছিলেন এসব গন্ধদ্রব্য বুঝি আরব দেশেই জন্মায়– লেডি মেকবেথ বলছেন, অল দি পারফিউমজ অব আরাবিয়া উইল নট সুইটেন দিস লিটিল হ্যান্ড। এই গন্ধের ব্যবসা তখন খুবই লাভজনক ছিল। এবং কাঠিয়াওয়াড়ের গন্ধবণিকরা এর একটা বড় হিস্যা পেতেন। মহাত্মা গান্ধীর জন্মবার্ষিকীতে এই সুবাদে স্মরণ যেতে পারে যে তিনি জাতে গন্ধবণিক– সেই গন্ধ থেকে তাঁর পরিবারের নাম গাঁধী।

ভারতীয় বণিকরা লাক্ষাদ্বীপ বা মালদ্বীপ থেকে তাদের শেষ রসদ এবং সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস জল নিয়ে এখান থেকে পাগের নৌকায় করে দু হাজার মাইলের পাড়ি দিতেন।

***

সচরাচর বলা হয়, আরব নাবিকরাই প্রথম মৌসুমি বায়ু আবিষ্কার করে। আমি কিন্তু ভিন্ন মত পোষণ করি। আমার ধারণা, ভারতীয়রাই প্রথম লক্ষ করে যে শীতকালে বাতাস পশ্চিমবাগে বয়। তারই সুবিধে নিয়ে পাল তুলে দিয়ে পণ্যসম্ভার নিয়ে তারা যেত সোকোত্রা। ফিরে আসত গ্রীস্মারম্ভে যখন সোকোত্রা থেকে পুব বাগে বাতাস বয়। ভারতীয় নাবিক যদি কোস্টাল সেলিংই (পাড় ঘেঁষে ঘেঁষে) করবে তবে তো তারা সিন্ধুদেশ, বেলুচিস্তান, ইরানের পাড় ঘেঁষে ঘেঁষে দক্ষিণ আরবিস্তানে পৌঁছে যেত। অর্থাৎ আদন বন্দরের কাছাকাছি। সেখান থেকে আবার ছ শো মাইল পুব বাগে সোকোত্ৰা আসবে কেন?

তার পর কর্তারা সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ করে দিলেন।

সে-কথা আরেকদিন হবে।

.

প্রাচ্য বিদ্যাবিশারদ

সঠিক বাঙলা অনুবাদ করা হল কি না তাই নিয়ে অনেকেরই মনে ন্যায্য সন্দেহ হতে পারে। ইংরেজিতে একে বলে অল ইনডিয়া অরিনটাল কনফারেন্স। আমার এতদিন বিশ্বাস ছিল এর নাম অল ইনডিয়া অরিএনটালিসটস কনফারেন্স দুটো নামই আমার কাছে কেমন যেন সামান্য বেখাপ্পা ঠেকে। অল ইনডিয়াই যদি হবে তবে তার সঙ্গে অরিএনটাল জোড়া যায় কী প্রকারে পক্ষান্তরে দ্বিতীয় নাম অল ইনডিয়া অরিএনটালিসটসও কেমন যেন মনে সাড়া জাগায় না। অরিএনটালিসট বলতে বোঝায়, অরিএনট সম্বন্ধে যিনি বিজ্ঞ পণ্ডিত। কিন্তু রূঢ়ার্থে বোঝায়, যেসব ইউরোপীয় পণ্ডিত অরিএনট নিয়ে চর্চা করেন। এই নিয়ে যখন আমি আমার এক দর্শনে সুপণ্ডিতা বান্ধবীর সঙ্গে আলোচনা করছি তখন তিনি বললেন, হ্যাঁ, কেমন যেন ঠিক মনে হয় না। মাকসমলার অরিএনটালিসট আবার রাধাকৃষ্ণনও অরিএনটালিসট? আমার মনে হল, তার মনে ধোকা জেগেছে, দু জনার মাহাত্ম কি একই? রাধাকৃষ্ণন তার আপন দেশের জ্ঞানবিজ্ঞানদর্শনের চর্চা করছেন, সে তো স্বাভাবিক। কিন্তু ওই যে সাত সমুদ্রের ওপারের মাকসমুলার ভারতের জ্ঞানবিজ্ঞানদর্শনের চর্চা করলেন– এ দু জনাতে তো একটা পার্থক্য আছে। তুলনা দিয়ে বলি, আপনি ভারতীয়, তাই আপনি স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিলেন। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সাতসমুদ্রের ওপারের পুণ্যশ্লোকা এ্যানি বেসানত, দীনবন্ধু এ্যানড্রজ যখন এ-আন্দোলনে যোগ দিলেন, সে দুটো কি একই?

যদ্যপি জর্মন ভাষা কাঠখোট্টা তবু প্রাচী = অরিএনট এবং প্রতীচী = অকসিডেনট নিয়ে কথা বলতে গেলে ওরা ওই দু ভূখণ্ডের জন্য দুটি বড়ই সুন্দর নাম দেয়। এই প্রাচ্যভূমিকে বলে মরগেন লানট = ভোরের দেশ সূর্যোদয়ের দেশ–জর্মন ভাষায় মরগেন শব্দের অর্থ সকাল ভোর। তাই তারা সকালবেলা কারও সঙ্গে দেখা হলে বলে গুটেন মরগেন। = গুড মরনিং। পক্ষান্তরে তাদের নিজের দেশ তথা ইউরোপকে বলে আবেনট লানট অর্থাৎ সূর্যাস্তের দেশ। তাই বিকেলবেলা সন্ধেবেলা, এমনকি রাত্রেও দেখা হলে বলে গুটেন আবেনট।

খুব সম্ভব এই কারণেই ভারতবর্ষের প্রতি জর্মন পণ্ডিতদের একটা বিনয় ভাব-শ্রদ্ধা আছে। ইংরেজি-ফরাসি-ডাচদের সে শ্রদ্ধা নেই। কারণ তারা প্রাচ্যভূমি এশিয়াতে রাজত্ব করত। তাই এনারা যখন ইউরোপের কোনও অরিএনটালিসটস কনফারএনসে যান তখন কেমন যেন মুরুব্বিয়ানা করেন। ভাবটা এই, তারা যে ভারতের ব্যাপারে ইনটরেসট দেখাচ্ছেন সেটা যেন, অনেকটা মুনিব তার চাকরের বউবাচ্চার সম্বন্ধে পলাইট বাট ডিসটেনট খবর নিচ্ছেন (পাছে না দু টাকা খসাতে হয়)।

এই মুরুব্বিয়ানাটা আমাকে ঈষৎ পীড়িত করে। হপ্তা তিনেক পরে পূর্বে আমি বলেছিলাম আমি অত সহজে অপমানিত হই না। ইতোমধ্যে খান আবদুল গফফার বাদশাহ মিঞা বলেছেন, ভারত যে রাবাতে গিয়েছিল সেটা অনুচিত হয়নি। কিন্তু পত্রান্তরে জনৈক সম্পাদক অতিশয় দ্র ভাষায় সঙ্গে সঙ্গে বলেছেন, কিন্তু সকলেই এ মত পোষণ না-ও করতে পারেন (নট এভরিবডি শেয়ারজ ইট) এবং এই আনন্দবাজারেই জনৈক পত্রলেখক আমার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কঠোর আপত্তি জানান। ধর্ম সাক্ষী করে বলছি, এঁদের বিরুদ্ধে আমার কোনও ফরিয়াদ নেই। কে কোন আচরণে অপমানিত হবেন না হবেন সেটা তার স্পর্শকাতরতার ওপর নির্ভর করে। এরা স্পর্শকাতর। কিন্তু আমার গায়ে গণ্ডারের চামড়া। মরক্কো লেদার তার তুলনায় ধূলিপরিমাণ লস্যি লস্যি।

মূল বক্তব্যে ফিরে আসি।

ইউরোপীয়রা বিশেষ করে ইংরেজ-ফরাসি-ডাচ যদি আমাদের প্রতি মেহেরবানি দেখায় তবে আমরাই-বা তাদের প্রতি মেহেরবানি দেখাব না কেন?

অতএব আমি প্রস্তাব করি এই ভারতবর্ষে যেন অকসিডেনটালিসট কনফারেন্স নির্মিত হয়। ইউরোপের ইংরেজ ফরাসি ডাচ অরিএনটালিসটরা যেরকম আমাদের সতীদাহ, বহুবিবাহ নিয়ে আলোচনা করেন, আমরা ওই কনফারেনসে সাহেবদের কল গার্ল, কিলার প্রফুমো ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করব। কিন্তু বিপদ এই : আমাদের ভারতীয় সভ্যতা যায় নিদেন খ্রি.পূ. দু হাজার বছর পূর্বে। ইউরোপীয়দের সত্যতা মেরে কেটে ছ-শো বছর পূর্বে। যতই প্রাচীন সভ্যতা হয়, তত তাকেই আঘাত করা যায় বেশি। বুড়ো-ঠাকুরদাকে গাট্টা মারা খুবই সহজ।

এই প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করার জন্য আমি সুপণ্ডিত শ্রীযুক্ত নীরদ সি চৌধুরীর নাম প্রস্তাব করি। ইউরোপীয় কাণ্ডকারখানা উনি বিলক্ষণ বিচক্ষণরূপে জানেন। তদুপরি তিনি সংস্কৃত ভাষা এবং ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে উত্তমরূপে সুপরিচিত। সেয়ানা পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, তিনি সপ্তাহের পর সপ্তাহ শুধুমাত্র ইউরোপীয় গুণীজ্ঞানীরই উদ্ধৃতি দেন।

.

পুনরপি প্রাচ্য

আর রসিকতা না। এবারে আমাকে সিরিয়স হতে হবে। স্বৰ্গত প্রমথ চৌধুরীও প্রতি বছরে এই শপথ নিতেন এবং সে-লিখিত শপথের কালি শুকোতে না-শুকোতেই সেটি পরমানন্দে ভঙ্গ করতেন। আমি সেই মহাজনপন্থাই অবলম্বন করছি।

প্রাচ্যবিদ্যা সম্মেলনে কী-সব সমস্যা কী-সব বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা হয়েছে তার কিছু কিছু বিবরণ খবরের কাগজে বেরিয়েছে এবং কয়েকদিন পূর্বে হিন্দুস্থান স্ট্যানডারডের সম্পাদক মহাশয় সে সম্বন্ধে একটি সুচিন্তিত তথা সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছেন। কিন্তু যেসব বিষয়বস্তু কনফারেনসে আলোচিত হয়নি সে-সংবাদ জানব কী প্রকারে? তাই আমার মনে দুটি সমস্যা জেগেছে। এ-দুটি নতুন নয়। আমার জীবনে প্রথম এবং শেষ প্রাচ্যবিদ্যাসম্মেলনে আমি যাই তিরুঅনন্তপুরমে বরদা সরকারের প্রতিভূরূপে ত্রিশ দশকের মাঝামাঝি। সেই থেকে।

প্রথম : এই যে গত কয়েক শতাব্দী ধরে ইউরোপীয়রা এশিয়াতে রাজ্য বিস্তার করতে চেয়েছিলেন– ইংরেজ ফরাসি অস্ট্রিয়ান ডাচ পর্তুগিজ ইত্যাদি ইত্যাদি– এদের মহাফেজখানাতে (আর্কাইভে) বিস্তর দলিলপত্র রয়েছে। এগুলোর সাহায্য বিনা ভারতের গত কয়েক শতাব্দীর ইতিহাস সর্বাঙ্গসুন্দর হয় না। কিন্তু এসব দলিলদস্তাবেজ নিয়ে গবেষণা করে সেগুলোকে প্রকাশিত করাতে স্বভাবতই আজ এদের আর কোনও ইনটরেস্ট নেই। যতদূর মনে পড়ে, একমাত্র ডাচ সরকারই বছর কয়েক পূর্বে এ-কর্ম করার জন্য ভারতীয়দের আমন্ত্রণ জানান এবং দুটি ভালো স্কলারশিপ দিতে চান। এর ফল কী হয়েছে জানিনে। অতএব এসব ভিন্ন ভিন্ন দেশের মহাফেজখানার অমূল্য দলিলদস্তাবেজ নিয়ে গবেষণা করার দায়িত্ব আমাদেরই ভারতীয়দের। … এছাড়া এদের আরকাইভে আছে ভারতীয় ভাষার ব্যাকরণ, অভিধান, পাঠ্যপুস্তক, অনুবাদ ইত্যাদি। সেগুলোও মহামূল্যবান। কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ—না কী যেন নাম– অনেকেই জানেন।

দ্বিতীয় : এবং এইটেই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা। নমস্য প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণবরা তো অগাধ গবেষণা করেছেন, যথা মহাভারত রামায়ণের প্রামাণিক পাঠ প্রকাশ করেছেন, করছেন এবং অন্যান্য শাস্ত্রাদির জন্যও ওই পদ্ধতিতে তৎপর। এ কর্মের প্রশংসা অজ্ঞ বিজ্ঞ তাবজ্জন করবেন। কিন্তু প্রশ্ন, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি যে প্রতিদিন ভারতীয়দের ইনটরেট কমে যাচ্ছে, সেটা ঠেকানো যায় কী প্রকারে? অর্থাৎ সংস্কৃত সাহিত্যের উত্তম উত্তম ধন মূল সংস্কৃতে যত না হোক, অনুবাদ মারফত কোন পদ্ধতিতে সাধারণজনের সামনে আকর্ষণীয়রূপে দিতে পারি? এক কথায় সংস্কৃত, অর্ধমাগধী, পালি, প্রাকৃত, সান্ধ্য ইত্যাদিতে লিখিত প্রকৃত হীরাজওহর পপুলারাইজ করি কী প্রকারে? তারা যে কলচরড পাল প্ল্যাসটিক চায়। এবং এটা না করতে পারলে যে প্রাচ্যবিদ্যা তথা প্রাচ্যবিদ্বজ্জনের মহতী বিনষ্টি হবে সে-বিষয়ে অন্তত আমার মনে কণামাত্র সন্দেহ নেই। কারণ, তুলনা দিয়ে বলি; জনগণ যেন দেশ-গাছের শিকড়, বিদ্বজ্জন ফুল। শিকড় যদি শুকিয়ে যায় তবে ফুলের, ফলের তো কথাই নেই, মরণ অনিবার্য।… যেমন আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের নাভিশ্বাসের সময়ে আমাদের চৈতন্য হল এবং আমরা এখন সেটিকে পপুলারাইজ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা দিচ্ছি।

ইউরোপীয়দের ওই একই সমস্যা। আমরা যেমন সংস্কৃতাদি একাধিক সাহিত্যের ওপর এতকাল নির্ভর করে এসেছি, তারা করে দুটি সাহিত্যের ওপর– গ্রিক এবং লাতিন। এবং চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে এ-ভাষাগুলোর পড়ুয়া দিন দিন কমে যাচ্ছে। বিলেতের কোনও এক বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রিক-লাতিন শেখার জন্য প্রতি বছর পাঁচটি এমনই দিলদরাজ বৃত্তি দেয় যে, যে কোনও বৃত্তিধারী সে-অর্থে হস্টেলের খাইখরচা দিয়ে উত্তম বেশাদি পুস্তকাদি ক্রয় করার পর একাংশ দরিদ্র পিতামাতাকে পাঠাতে পারে। তথাপি, কাগজে পড়েছি, বছর তিনেক পূর্বে সেই পাঁচটি বৃত্তির জন্য মাত্র তিনটি ছাত্র দরখাস্ত পাঠায়!! বছর পঞ্চাশেক পূর্বে আসত দুশো!!

এবং এহ বাহ্য। জনসাধারণও গ্রিক-লাতিন সাহিত্যের অমূল্য অমূল্য সম্পদও ইংরেজি ফরাসি জর্মন অনুবাদে যথা যার দেশ– পড়তে চায় না। এই ইউরোপের বিদ্বজ্জন এসব সম্পদের নবীন নবীন অনুবাদ করেছেন দেশোপযোগী কালোপযোগী করে। এমনকি বাইবেলেরও।

আমাদের প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণবরা এ-বিষয়ে কী করছেন?

আমার মনে হয় কবি কালিদাস বাঙালি। প্রমাণ? একমাত্র বাঙালিই যে-ডালে বসে আছে সেটা কাটে। কালিদাসও তাই করতেন। অতঃ কালিদাস বাঙালি। প্রাচ্যজ্ঞরা ডালটা কাটছেন বটে কিন্তু ডালটা যে শিকল্লেখিত রসাভাবে শুষ্ক হয়ে ভেঙে পড়ছে সেদিকে খেয়াল নেই।

.

সিলেটি সাগা

০১.

অ ডুরা! কুনার সাবরে আরক কটরা ছালন দেও।

অতিশয় বিশুদ্ধ সিলেটি উচ্চারণে বাক্যটি উচ্চারিত হল। আমি অবশ্য তার জন্য প্রস্তুত ছিলুম। যদ্যপিদেশ : লন্ডনের টিলবারি ডক; কাল : ১৯৩১; পাত্র : রেস্তোরাঁর মালিক। সে আমলে খাঁটি বিলিতি হোটেল-রেস্তোরাঁতে যে অখাদ্য নির্মিত হত সেটা হটেনটটীয় পর্যায়ের। কথায় বলে, ওট নামক বস্তুটি স্কটল্যান্ডে খায় মানুষ, ইংলন্ডে খায় ঘোড়া। কিন্তু ওই আমলে লন্ডনের পোশাকি খানাও স্টকল্যান্ডের ঘোড়া পর্যন্ত খেতে রাজি হত না– এই আমার বিশ্বাস। তাই আমি লন্ডনের লাঞ্চকে বলতুম লাঞ্ছনা আর সাপারকে বলতুম Suffer!

রবীন্দ্রনাথ লন্ডনে এসেছেন শুনে তাকে প্রণাম জানিয়ে যখন রাস্তায় নেমেছি তখন হঠাৎ এক সিলেটি দোস্তের সঙ্গে মোলাকাত। আলিঙ্গন কুশলাদির পর দোস্ত শুধাল, অত রোগা কেন? একে দুর্দান্ত শীত, তদুপরি লন্ডনের গুষ্টির-পিণ্ডি-চটকানো রান্না। সংক্ষেপে বলল, চল। এতদিন পরে সব ঘটনা আর মনে নেই তবে বাসে করে যে অনেকখানি পথ যেতে হয়েছিল সেটা স্পষ্ট মনে আছে। মোকামে পৌঁছে ভালো করে বেয়ারিং পাবার পূর্বেই দেখি, একটি ছোটখাটো রেস্তোরাঁর মাঝখানে আমি দাঁড়িয়ে এবং কানে গেল পূর্বোক্ত অ ডুরা– ইত্যাদি, যার অর্থ, ও ভোরা, কোণের সাহেবকে আরেক বাটি ঝোল দাও।

হালে কাগজে পড়লুম, বিলেতে যেসব পাক-ভারতের রেস্তোরাঁ আছে তার শতকরা ৮০ ভাগ সিলেটিরা চালায়। অবশ্য ওই চল্লিশ বছর পূর্বে বিলেতে অত ঝাঁকে ঝাঁকে পাক ভারতীয় রেস্তোরাঁ ছিল না; তবে সে-রাত্রেই জানতে পাই, যে-কয়টি আছে পনেরো আনা সিলেটিদের। এমনকি লন্ডনের নামকরা হতচ্ছাড়া তালু-পোড়া দামের এক ভারতীয় রেস্তোরাঁর শেফও সিলেটি।

ইতোমধ্যে দোস্ত শশাঙ্কমোহন অটলালার (হোটেলওয়ালার) সঙ্গে বে-এক্তেয়ার গালগল্প জুড়ে দিয়েছেন– আহা, যেন বহু যুগের ওপার হতে লঙ লসট ভ্রাতৃদ্বয়ের পুনর্মিলন। শশাঙ্ক আমাকে অটলালার পাশের একটা টেবিলের কাছে বসবার ইঙ্গিত দিয়ে আবার তার ভ্যাচর ভ্যাচরে ফিরে গেল। একটা দরজা খুলে যেতে দেখি বেরিয়ে এল একটি প্রাপ্তবয়স্কা মেম। হাতের ট্রের উপর রাইস, কারি, ডাল, ভাজাভুজি। আমাদের দিকে নজর যেতেই মৃদুহাস্য করে গুড ইভনিং বলে বয়সের তুলনায় অতি স্মার্ট পদক্ষেপে গটগট করে প্রথম অন্যান্য খদ্দেরদের রাইসকার্যাদি দিয়ে সর্বশেষে কোণের সাহেবের টেবিলের উপর তার ছালনের কট্রা রাখল। ইনিই তা হলে ডোরা।… জনা আষ্টেক খালাসি পরম পরিতৃপ্তি সহকারে সশব্দে, ছুরি-কাটার তোয়াক্কা না করে খেয়ে চলেছে। আরও দু জন গোরা একান্তে বসে ওই খাদ্যই রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করছে। ডোরা ফিরে আসতে অটলালা তার ক্যাশ ছেড়ে এল। আমরা চারজন এক টেবিলে বসলুম। অটলালা সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমরা তো বেশি পদ রাঁধি না– আমাদের গাহক তো সবই খালাসি, দু একজন গোরা মাঝেমধ্যে। কিন্তু আপনারা অতদূর থেকে মেহেরবানি করে এসেছেন। ভালোমন্দ কিছু করতে হয়। আমাদের আপত্তি না শুনে দুজনা রান্নাঘরে চলে গেল। শশাঙ্ক বলল, আশ্চর্য, কুড়ি বছর হয়ে গেল এই আম্বরউল্লা এ-দেশে আছে, তবু একবর্ণ ইংরেজি শিখতে পারেনি। ওদিকে ওর বউ ভোরা দিব্যি সিলেটি বলতে পারে। খালাসি গোরা সব খদ্দের ও-ই সামলায়। তবে ওর ইংরেজি বোঝাটাও চাট্টিখানি কথা নয়। একদম খাস খানদানি কনি। আমি শুধালুম, বিয়েটা– মানে সিলেটি খালাসি আর লন্ডনি মেমেতে হল কী প্রকারে? কেন হবে না? তুমি কি ভেবেছ ডোরা কোনও অক্সফড ডন-এর মেয়ে এবং কেমব্রিজের রেঙলার? আর হ কথাই যদি কই, তবে বলি, সামাজিক পদমর্যাদায় আম্বর মিয়া তার মাদামের চেয়ে ঢের ঢের সরেস। মিয়া চাষির ছেলে আর ডোরা মুচির মেয়ে। অবশ্য ভোরার মতো লক্ষ্মী মেয়ে শতকে গোটেক। আমাদের যে কী আদর করে, পরে দেখতে পাবে। আর এমন সময় আম্বর মিয়া সহাস্য আস্যে প্রত্যাবর্তন করে বলল, আমাদের সুখদুঃখের কথাতে মাঝে মাঝে বাধা পড়বে, স্যর। ডোরাই খদ্দেরদের কাছ থেকে হিসেবের কড়ি তোলে। এখন রাঁধছে। ওটা আমাকে সামলাতে হবে। আমি ভয় পেয়ে মনে মনে বললুম, মেমের হাতের রান্নায় আবার সেই লাঞ্ছনা আবার সেই সাফার! আমরা তো গাঁটের রোক্কা সিক্কা ঝেড়ে হেথায় পৌঁছলুম, আর ওই হতভাগ্য লন্ডনি লাঞ্ছনা-সাফার কোত্থেকে বাস-ভাড়া জোগাড় করে আমাদের পিছনে ধাওয়া করল? প্রকাশ্যে রোস্টোমোস্টো রাঁধবে নাকি?

হেসে বলল, তা-ও কি কখনও হয়, স্যর। রাঁধবে খাঁটি সিলেটি রান্না।

শিখল কার কাছ থেকে?

আমার কাছ থেকে সামান্যই, কিন্তু আমার গাহক খালাসি-ভাইদের ভিতর প্রায়ই বাঢ়িয়া বাঢ়িয়া বাবুর্চি থাকেন। তাঁদের কাছ থেকে সিলেটের পোশাকি খানা থেকে মামুলি ঝোল-ভাত সবকিছু শিখে নিয়েছে। এমন সময় কোণের গোরা রান্নাঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে সামান্য গলা চড়িয়ে বলল, ও মিসিস উল্লা আজকের কারিটাতে একদম ঝাল নেই। দুটো গ্রিন চিলি– সরি– সে তো,এই গড ড্যাম দেশে নেই। তা হলে একটু টাবাস্কো চিলি সস্ দাও না। বলে কী ব্যাটা! ডোরা যখন রাইস-কারি নিয়ে যাচ্ছিল, তখন সে-কারির কটকটে লাল রঙ দেখে আঁতকে উঠে আমার মতো খাস সিলটাও মনস্থির করেছিল ওই বস্তু কম মেকদারে খেতে হবে– চাটনির মতো, আ লা চাটনি। আর এ-গোরা হট, হট, ডবল হট মাদ্রাজি আচার দিয়ে তার ঝোলের ঝাল বাড়াল।… একে একে, দুয়ে তিনে সব খদ্দের কড়ি গুনে চলে গেল। আমার চোখে একটুখানি ধাঁধার ভাব দেখে বলল, ঠিক ধরেছেন, স্যর। সক্কলের জেবে কি আর রেস্ত থাকে? ইনশাল্লা, দিয়ে দেবে কোনও এক খেপে। আর নাই বা দিলে।

আমরা খেয়েছিলুম, বেগুন-ভাজা, মুড়িঘন্ট, মটরপোলাও, মাছ ভাজা, মুরগি কারি– বাকি মনে নেই। অসম্ভব সুন্দর রান্না। কিন্তু আর শুধোবেন না। আহারাদির আলোচনা আরম্ভ হলে আমার আর কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। রাতও তখন অনেক। মোকা পেয়ে শশাঙ্ককে কানে। কানে বললুম, বিল?

চোক্কোরো। ও-কথা তুললে আম্মর-উল্লা ভ্যাক করে কেঁদে ফেলবে।

শুধু কি তাই! বিদায় নেবার সময় ডোরা দোস্ত শশাঙ্কের হাতে তুলে দিল একটা বাস্কেট। পথে নেমে সেটাকে প্রিয়ার গণ্ডদেশে হাত বুলোবার মতো আদর করতে করতে বলল, তিন দিনের দু বেলার আহারাদি হে দোস্তো দু জনার তিনজনারও হতে পারে।

.

০২.

ঠিক কোন সময়ে হিন্দুরা সমদ্রযাত্রা বন্ধ করেন ঠিক বলা যায় না। তবে এর ফল যে বিষময় হয়েছিল সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এই চট্টগ্রাম এবং সিলেটের (সিলেট সমুদ্রতীরবর্তী নয়, কিন্তু সিলেটে বিরাট বিরাট হাওর থাকায় মাঝিরা অন্ধকারে তারা দেখে নৌকা চালাতে পারে– লিন্ডসে সাহেব গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে কম্পাসের সাহায্যে একাধিক হাওর পেরিয়ে চাল-ভর্তি মহাজনি নৌকা মাদ্রাজ পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন এবং সি-সিকনেস তাদের হয় না) লক্ষ লক্ষ ব্যবসায়ী মাঝিমাল্লা অন্নহীন হয়ে যায়। এর পর আরব বণিকরা সমুদ্রপথে চট্টগ্রামে ব্যবসা করতে এলে এরা প্রধানত পেটের দায়ে মুসলমান হয়ে গোড়ার দিকে আরব জাহাজে খালাসির চাকরি নিয়ে পূর্বে ইন্দোনেশিয়া ও পশ্চিমে জেদ্দা, সুয়েজ বন্দর অবধি পাড়ি দেয়। কিছুদিনের মধ্যেই চট্টগ্রামের সদাগর সম্প্রদায় আপন আপন পালের জাহাজ নির্মাণ করে বর্মা মালয়ের সঙ্গে ব্যবসা চালাতে থাকে এবং এ শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত ইংরেজের কলের জাহাজের সঙ্গে পাল্লা দেয়।

প্রধানত সিলেট, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালির মাঝিমাল্লা চাষাভূষোই গোড়ার দিকে ইউরোপীয় জাহাজে কাজ নেয় এবং এদের খালাসি বলা হত (এ স্থলেই উল্লেখ করি সংখ্যায় প্রায় আশি হাজারের মতো যেসব সিলেটি বর্তমানে ইংলন্ডে কলকারখানায় কাজ করে শুনেছি সিলেটিদের তুলনায় পুব পাকের অন্যান্য জেলার লোকসংখ্যা নগণ্য দেশের সিলেটবাসীরা এদের নাম দিয়েছেন লন্ডনি, যদিও এদের বড় আড্ডা বোধহয় নটিংহামে)। বহু বছর ধরে খালাসিরা ডাঙায় বাসা বেঁধে কলকারখানায় ঢোকেনি। কিন্তু বেশ কিছু সংখ্যক সিলেটি কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রে কলকারখানায় ঢুকে প্রচুর পয়সা কামিয়ে দেশে ফিরত– ওখানে চিরতরে বাসভূমি নির্মাণ করত না।

খালাসিবৃত্তি থেকে কবে কী করে এরা দক্ষিণ ও মধ্য ইংলন্ডের কলকারখানায় ঢুকে পড়ে লন্ডনি খেতাব পায় তার কোনও লিখিত বিবরণ আমি পড়িনি। তবে আমার মনে হয়, ১৯২৯-৩৩-এর পূর্বে নয়, কারণ এ সময়ে ইউরোপ-আমেরিকার কারখানাকর্মীদের ভিতর প্রচুরতম বেকারি। এর পরে প্রধানত যুদ্ধের সময় বিস্তর সস্তা লেবারের প্রয়োজন হল। আজ যে আপনি-আমি লন্ডন-নটিংহামের যে কোনও দ্বিতীয় শ্রেণির ইংরেজি রেস্তোরাঁতেও পাটনা রাইস এবং কারি পাচ্ছি তার গোড়াপত্তন হয় ওই সময় (পাটনা রাইস বলে বটে, কিন্তু সেটা দেরাদুন, বাসমতি সবকিছুই হতে পারে। বহু গবেষণা করে সন্ধান পেলুম কোম্পানির আমলে এ-দেশ থেকে যে-চাল বিলেত যেত সেটা প্রধানত সংগ্রহ করা হত পাটনার আড়তে যে-হরেক প্রদেশের চাল জড়ো হয়েছে তার থেকে; তাই এর অমনিবাস নাম হয়ে যায় পাটনা রাইস) সৈন্যদের এবং লন্ডনিদের ক্ষুধা নিবারণের জন্য। আজ এদেশ থেকে প্রতিদিন মণ মণ চাল, ডাল, শুঁটকি, মসলা ইত্যাদি তো যাচ্ছেই, তার ওপর হাজার হাজার বোতল আম, নেবু, জলপাইয়ের আচার। গত বছর সিলেটে এক বিরাট আচার ফ্যাকটরি দেখে আমি স্তম্ভিত। পরে সে কারখানার অমায়িক মালিকের সঙ্গে দেখা হলে তিনি বললেন, যা তৈরি হয় তার প্রায় বেবাক মাল চলে যায় লন্ডনিদের খেদমতে। চাহিদাও বেড়ে চলেছে। আমি পেরে উঠছি না। অবশ্য আমি জানতুম, মালদার ম্যাংগো স্লাইজ এবং মিষ্টি-টক (সুইট-সাওয়ার) আমের আচারের এক বৃহৎ অংশ লন্ডনিদের তরেই যায়। কারণ সিলেটের আম জঘন্য। তার থেকে ভালো আচার হয় না– স্লাইস মাথায় থাকুন। অবশ্য সিলেট থেকে সর্বোকৃষ্ট আনারস-স্লাইস বিলেত যায়। মার্কিন হাইনস ফিফটি সেভনের (বা অন্য সংখ্যাও হতে পারে) মতো সিলেটি আচার কারখানা ৪৭ রকমের আচার, স্লাইস ইত্যাদি তৈরি করে। বুঝুন, যে সিলেটি দেশে ভাত, লাল লঙ্কা পেষা, আর কিস্যুৎ নিতান্তই মেহেরবান হলে একটি কাঁচা প্যাজ খেত– তা-ও দুবেলা নয় এবং সে-ও পেট ভরে নয়– সে কি না আজ সিলেটের জমিদার-ছেলেরও যা জোটে না বিলেতে বসে তাই খায়। এস্তেক পান-তক। পান যায়। প্লেনে। তাই নাকি একটা খিলির দাম সি পেন্স থেকে এক শিলিং

সিলেটিরা বিলেতে চাকরি পায় কেন? কাগজে নিশ্চয়ই পড়েছেন, সাদা আর কালো মজুরে সেখানে নিত্য লড়াই। আমি এ-বিষয়ে সরেজমিন তদন্ত-তাবাশ করিনি। যা শুনেছি, তাই বলছি : (১) কালোরা– বিশেষ করে সিলেটিরা কম মাইনেতে কাজ করতে রাজি; নিগ্রোরা মদ খায়, জুয়া খেলে বলে তাদের খাই বেশি। (২) দুই শিফটে এবং রবিবারেও কাজ করতে রাজি নিগ্রোরা খ্রিস্টান, রবিবারে সাবাৎ মানে। (৩) ইউনিয়ন এড়িয়ে চলে, স্ট্রাইক করতে চায় না। (৪) রাতভর মদ খেয়ে পরের দিন বেহুশ হয়ে পড়ে থাকে না বলে কাজকর্মে কামাই দেয় কম।

এই সিলেটিরা অনেকেই মেম বিয়ে করে ওদের একটা দু আঁসলা সমাজ গড়ে তুলেছে এবং ঘটকালি করে এই মেমেরা নবাগত সিলেটিকে তাদের বোন-ভাগ্নী বিয়ে দেবার জন্য। বোন-ভাগ্নীও লন্ডনির বউয়ের কাছ থেকে জেনে গিয়েছে (১) সিলেটি মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বউকে ঠ্যাঙায় না, (২) ঘোড়ার রেস, কুকুরের রেস, এমনকি কড়ি খর্চা করে ফুটবল খেলা দেখতে যায় না, মদে পয়সা ওড়ায় না এবং কোনওপ্রকারের জুয়োও খেলে না বলে বউ স্বচ্ছন্দে সংসার চালাবার জন্য স্বামীর মাইনের একটা বড় হিস্যে পায়। বিয়ের পূর্বে বা পরে সে অন্য মেয়ের সঙ্গে পরকীয়া করে না– সে তো ধলা মেম পেয়েই খুশ! এ দুটো সেকুরিটি পৃথিবীর সর্বত্রই রমণীমাত্রই খোঁজে। এবং কেউ কেউ তৃতীয় সেকুরিটিও দিতে পারে– আপন পয়সায় কোনও নিজস্ব কটেজ। আমার পরিচিত এক চৌধুরীর ছেলে তো নটিংহামে তিনখানা চেন, হোটেল-রেস্তোরাঁর মালিক (আজকাল সিলেটি মুসলমানদের উচ্চশ্রেণির লোকও নানা ধান্দায় লন্ডনি হচ্ছেন)। তিনি তো অনায়াসে তৃতীয় সেকুরিটি দিতে পারেন। এছাড়া ছোটখাটো আরও অনেক আরাম-আয়েস আছে। বাচ্চা রাত্রে কেঁদে খাস-সায়েব মজুরের ঘুম ভাঙালে সে ধমক দিয়ে বউকে বাচ্চাসহ রান্নাঘরে খেদায়; লন্ডনি গায়ে পড়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ঠাণ্ডা করে। দেশে ছেলেবেলা থেকেই সে কত ভাতিজা ভাতিজি ঠাণ্ডা করেছে।… পাব-এ যায় না বলে প্রায়ই তার ফুরসত থাকে এবং বউকে প্রেম। করে বলে প্র্যাম-এ করে বাচ্চাকে হাওয়াভি খাওয়ায়।

.

০৩.

অ ভাই, জলদি আও, বেটিয়ে ডাকে।

একদম ন সিকে খাঁটি সিলেটি উচ্চারণ। অবশ্য আমি খুব-একটা হকচকিয়ে উঠিনি, কারণ ঢাকার অ্যার-পরুটে হরহামেশাই সিলেটি উচ্চারণ শোনা যায়। কিন্তু যে প্রৌঢ় লোকটি এই মধুর আহ্বান শোনালেন, তার পরনে দেখি উত্তম বিলিতি কাট-এ অত্যুত্তম ১০০% বিলিতি উলের নেভি ব্লু স্যুট। ওদিকে গলকম্বল মানমুনিয়া চাপদাড়ি। যাকে ডাকছিলেন তারও ওই বেশ, তবে বয়সে যুবক। কিন্তু ওই বেটিয়ে ডাকে অর্থাৎ মেয়েছেলে ডাকছে–এর বিগলিতার্থটা কী? তখন অ্যার-পরূটের প্রধান লাউজে ঢুকে দেখি একপাল লোক; প্রায় সক্কলেরই পরনে একই ধরনের নেভি ব্লু স্যুট। বুঝে গেলুম এরা লনডনি। বাড়িতে এসে দাদাকে তাবৎ হালত বয়ান করলুম। দাদা বলল, লনডনিরা ঈদের পরবে প্লেন চার্টার করে দেশে যায়। সে ঢাউস প্লেন সিলেটে নামতে পারে না বলে ঢাকা অবধি এসে থেমে যায়। তার পর সাধারণ সারভিসে আপন আপন মোকামে যায়। শ্রীমঙ্গল, শমসের নগরের মতো ছোট ছোট জায়গায়ও প্রধানত এদেরই জন্য অ্যার স্ট্রিপ করা হয়েছে। আর ওই যে চাপদাড়ি-ওলা লোকটাকে দেখলি সে খুব সম্ভব লনডনিদের বিলেতের মসজিদের ইমাম। এ-ই এদের বিলেত থেকে আপন আপন মোকাম অবধি দেখ-ভাল করে পৌঁছিয়ে দেয়। এদেরই একজন বোধহয় ছিটকে পড়েছিল; ইতোমধ্যে তরুণী এনাউনসার মাইকে বলেছে সিলেটগামী প্লেন এখখুনি ছাড়বে। তাই ইমাম হাঁকছিল, বেটিয়ে ডাকে, জলদি আও। সিলেটি মাত্রই জানেন, সে-ভাষায় বেটি ঠিক দুহিতা বা মেয়েছেলে নয়। বরঞ্চ মেয়েমানুষ এমনকি মাগি অর্থেও ধরে। পশ্চিমবঙ্গে যখন কেউ বলে বেটির কাণ্ড দেখ! তখন যে অর্থ ধরে। এখন পাঠক বুঝুন, সেই খাবসুরৎ তরুণীকে বেটি বললে কোন রস সৃষ্ট হয়।

লনডনিরা প্রতি বছর সিলেটে কত টাকা পাঠায় তার হিসাব কেউ দিতে পারে না। কারণ এরা কালোবাজারে খুব ভালো রেট পায় বলে এদের পাঠানো টাকার খুব বড় একটা হিস্যের কোনও সন্ধানই কেউ জানে না। শুনেছি কোনও এক বিশেষ সম্প্রদায়ের লোক কালোবাজারে লন্ডনিদের কাছ থেকে পাউন্ড কিনে তাদের নারায়ণগঞ্জস্থ আপন পাট গুদাম জুট মিলকে কোড-এ হুকুম দেয়। অমুক সিলেটিকে অত টাকা পাঠাবে। আরও শুনেছি, তার পর ওই পাউন্ড দিয়ে বিলিতি জিনিস কিনে, কিছুটা আইনত, বেশিরভাগ কালোয় প্রাচ্যে পাচার করে।

কত টাকা লনডনিরা পাঠায় তার হিসাব না জানা থাকলেও সিলেট জেলাতে সে টাকার সুদূরপ্রসারী গভীর প্রভাব সর্ব সিলেটির চোখে যেন ঘুষি মেরে আপন মাহাত্ম অহরহ প্রচার করে। সস্তা সেকেনহ্যানড বিদেশি ট্রানজিসটার, পারকার কলম, ক্যামেরা ইত্যাদির কথা বাদ দিচ্ছি– একমাত্র সিলেট শহরেই নাকি গণ্ডা দুই সরকার কর্তৃক স্বীকৃত ট্রাভেল এজেন্সি আছে– কল্পনা করতে পারেন এ-জিনিস বর্ধমানে? মহকুমা শহরের কথা বাদ দিন, বড় বড় থানায় বিশেষত যেসব পকেটে লনডনিদের আদি নিবাস পর্যন্ত বড় বড় ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ আপিস খোলা হয়েছে। আর ডাকঘরের তো কথাই নেই। যে-ডাকঘরে দিনে তিনখানা চিঠিও আসে কি না, সেখানে আসে পাঁচশো-হাজার টাকার মনিঅরডার। কিন্তু এহ বাহ্য। যে সিলেট শহরের বন্দর-বাজারে মাছের কখনও অভাব হয়নি সেই বাজারে দর আগুন এবং শৌখিন মাছ বিরল। আমার এক মুরুব্বি বললেন, আসবে কোত্থেকে? লন্ডনির পাঠানো টাকাতে এখন গাঁয়ের লোক মাছ খায়। জেলে তকলিফ বরদাস্ত করে শহরে আসবে কেন। বললে প্রত্যয় যাবে কি, পাঁচখানা গাঁয়ের মাঝখানে যে-হাট, সেটা এই কয়েক বছর আগে পর্যন্ত বসত সপ্তাহে একদিন একবেলা। এখন বসে রোজ, প্রতিদিন, দু বেলা।

এটা আবার কনফারম করল আমার এক বোন। গাঁয়ের জমিদারবাড়িতে তার বিয়ে হয়েছে এবং লন্ডনিরা যখন দেশে আসে তখন প্রায়ই ব্যাঙ্কের চিঠিপত্রাদি পড়াবার জন্য জমিদারবাড়িতে আসে। বোন বলল, এক লন্ডনি দেশে এসেছে ঈদ করতে। মাছ কিনতে গেছে ভিন গাঁয়ের হাটে। একটা ভালো মাছ দেখে দাম শুধাল। জেলে বলল ওটা বিক্রি হয়ে গিয়েছে। সেটা কিনেছে ওই গাঁয়েরই এক লন্ডনি, এবং দুই গাঁয়ে দারুণ আড়াআড়ি। ভিন গায়ের লন্ডনির এক দোস্ত প্রথম লন্ডনিকে খোঁচা দিয়ে যা বলল তার অর্থ তোমাদের গায়ে এ-মাছ খাবার মতো রেস্ত আছে কার? প্রথম লন্ডনি বড় নিরীহ, কোনও উত্তর দিল না। কিন্তু তার গায়ের সঙ্গী-সাথীরা চটে গিয়ে তাকে বলল, আল্লার কসম, এই, এই মাছটাই তোকে কিনতে হবে। তখন মাছ চড়ল নিলামে। দশ, বিশ, শ, দু শো চড়চড় করে চড়ে গেল। কবিগুরুর ভাষা একটু বদলালে দাঁড়ায়,

দশ মাষা দিব আমি
কহিলা লনডন-ধামী,
বিশ মাষা অন্য জনে কয়।
দোঁহে কহে দেহো দেহো,
হার নাহি মানে কেহ–
মূল্য বেড়ে ওঠে ক্রমাগত।

আমার বোনটি অতিরঞ্জনে অভ্যস্ত নয়। শেষটায় বলল, আখেরে মাছটা বিক্রি হল এক হাজার এক টাকা মূল্যে। কিনল প্রথম লন্ডনি। এবং আশ্চর্য নগদ টাকা তার ওয়াকিটের পকেট থেকেই বের করল। তার পর বিজয়ী মাছটাকে নিয়ে প্রসেশন করে গ্রামে এসে আপন গাঁ প্রদক্ষিণ করল। বিস্তর জিন্দাবাদ জিগিরের পর মাছটাকে ব্লেড দিয়ে প্রায় ডাকটিকিটের সাইজে টুকরো টুকরো করে গায়ের সব্বাইকে বিলোলো। এখন এরা হাটে গিয়ে দেমাক করে, আজার টেকি (হাজার টাকা দামের) মাছ খাই আমরা।

কিন্তু এহ বাহ্য। সমাজবিদের কান খাড়া হবে শেষ তত্ত্ব এবং তথ্যটি শুনে। লন্ডনি যত টাকা নিয়েই গ্রামে ফিরুক না কেন, জমিদার মিরাশদারের (যদ্যপি এখন আর জমিদারি নেই) বৈঠকখানায় শব্দার্থে এখনও তারা কলকে পায় না। অথচ তারা জাতে উঠতে চায়। তাই তারা হন্যে হয়ে উঠেছে সদরে, মহকুমা টাউনে বাড়ি কিনতে। সেখানে কে কার খোঁজ নেয়? এক বা দু পুরুষে সবাই ভুলে যাবে তাদের উৎপত্তি, পেশা, জন্মস্থল। ফলে সিলেট শহরে যে-বাড়ির দাম পাঁচ বছর আগে ছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা, এখন লন্ডনি দেড় লাখ হাঁকছে। একাধিক পেনশনার ভাবছেন সিলেটের বাড়ি বিক্রি করে ওই টাকা দিয়ে ঢাকাতে ওইরকম বাড়িই যখন পাব (সিলেট জেলার বাইরে লন্ডনি বাড়ি চায় না) তখন ছেলে-নাতির পড়াশুনোর সুবিধের জন্য ক্যাপিটালে বাস করার আরও সুবিধে সেখানেই যাই না কেন? যিনি আমাকে এ-ব্যাপারটির কথা বললেন, তিনি প্রাগুক্ত ওই মছলী-কহানীও জানতেন। শেষ করলেন এই বলে– আগে প্রবাদ ছিল মাছ খাবি তো ইলিশ, লাং ধরবি তো পুলিশ, এখন হয়েছে মাছ খাবি ন মণী, লাং ধরবি লন্ডনি। কিন্তু এটা চালু হবে না। লন্ডনিরা সচ্চরিত্র।

.

০৪.

এই পর্যায়ের কীর্তনকাহিনী (সাগা)-র কালি ভালো করে শুকোবার পূর্বেই দেখি হঠাৎ আমি সিলেটিদের মাঝখানে। তবে খাস সিলেটে নয়, লন্ডনে। এবং বিরাট লন্ডনের সব কটা সিলেটি রেস্তোরাঁ চষতে হলে পুরো পাক্কা ছটি মাস লাগার কথা।

প্রথম যেটিতে গেলুম, সেটা নিতান্তই যোগাযোগের ফলে। লন্ডনে যে অ্যারপর্টে নাবলুম সেখান থেকে খাস লন্ডন নিদেন ত্রিশ মাইল দূরে। তিনজন পরিচিতের ঠিকানা নোটবুকে টোকা ছিল। এক সহৃদয় ইংরেজকে সে-তিনটে দেখিয়ে শুধালুম, সবচেয়ে কাছে পড়ে কোনটা। এক ঝলক দৃষ্টি হেনেই বলল, গঙ্গা রেস্তোরাঁ। তাই সই। গেল বছরে যখন ওর মালিক পঁচিশ বছর লন্ডনে কাটিয়ে বাপ-মাকে দেখতে দেশে আসে তখন আমাকে জোর নিমন্ত্রণ জানিয়ে বলে, তার রেস্তোরাঁ আছে, ফ্ল্যাট আছে; আমি যদি দয়া করে পদধূলি– হেঁ হেঁ হেঁ হেঁ।

কোথায় কী? আমি ভেবেছিলুম, সেই যে চল্লিশ বছর পূর্বেকার টিলবারি ডকের সিলেটি রেস্তোরাঁ- যার কাহিনী আপনাদের শুনিয়েছি সেই ধরনের গরিবগুরবোর অটলই (হোটেলের সিলেটি উচ্চারণ; তবে সিলেটিতে এ্যাকসেন্ট আছে বলে সেটা পড়বে অ-র ওপর) হবে। তবে কি না, নিতান্ত মহারানির আপন নগরের মধ্যিখানে থানা গেড়েছে যখন, তবে হয়তো দেয়াল ছাদে দু এক পলস্তরা পাউডার-রুজ মাখিয়ে নিয়েছে।

কোথায় কী? পরিপাটি ছিমছাম পশ, শিক্। বাদবাকি সবকিছু পর্যবেক্ষণ করার পূর্বেই দূর থেকে মালিক (অটলালা = হোটেলওয়ালা) আমাকে দেখতে পেয়েই ছুটে এসেছে। আউকা, আউকা; বউকা বউকা (আসুন, আসুন; বসুন, বসুন)। তার পর দিল ছুট রেস্তোরাঁর গর্ভগৃহের দিকে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য বউকে নিয়ে আসতে।

টেবিল-ক্লথ, ন্যাপকিন মুরমুরে পয়লা নম্বরি আইরিশ লিনেনের, ফুলদানিতে যেন বাগান থেকে সদ্য তোলা, শিশির-ভেজা গোলাপ, ছুরি কাঁটা তথা যাবতীয় কাটলারি যেন মোগল আমলের খাঁটি রুপোর, আর গেলাস-বৌল এমনই স্বচ্ছ যে ভয় হল যে দুর্যোধনের মতো স্ফটিককে জল ভেবে, আমিও এগুলোর দু একটা দেখতে না পেয়ে ভেঙে ফেলি!

ডানদিকে কাচে ঘেরা একটি চৌকো কুঠরি। ভিতরে সারি সারি শেলফে সাজানো দুনিয়ার খাসা খাসা মদ্যাদি। বোতলের আকার-প্রকার রঙ-লেবেল দেখেই বোঝা যায়। কুঠরির। মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটি খাপসুরৎ জোয়ান ছোকরা ন্যাপকিন দিয়ে ওয়াইন শ্যামপেন; বিয়ার-মাগ সাফসুতরো করছিল এবং মাঝে মাঝে আমার দিকে আড়নয়নে তাকাচ্ছিল। ছোকরার মুখের আদল, দেহের গঠন সিলেটির মতো। কিন্তু রঙটা? গোরাদের মতো ফর্সা নয়, আবার সিলেটির মতো শ্যাম-হলদেও নয়। সমাধান কিন্তু সহজ। গলা বাড়িয়ে সিলেটিতে শুধোলুম, ভাই সাহেব, আপনার দেশ কোথায়?

গোটা কয়েক গেলাস ভেঙে ফেলেছিল আর কি! গলার আওয়াজ হোঁচট খেতে খেতে, খাবি খেয়ে খেয়ে, পড়িমরি হয়ে বলল, জি, জি, জি; আমি সিলেটের ফেচুগঞ্জের।… এখানে যারা কাজ-কাম করে সবাই সিলেটি। (আমরা মারওয়াড়িদের দোষ দিই; তারা শুধু দেশের ভাইয়াদেরই চাকরি দেয়। সমস্যাটার সমাধান এখনও করতে পারিনি।)

ইতোমধ্যে মালিক এসে গেছেন। তাঁর গৃহিণীর– মেমসাহেবার প্রথম কথা কটি শুনেই আমার মনে সন্দেহ হল, যদিও এর ইংরেজি উচ্চারণ উত্তম– অন্তত আমার চেয়ে ভালো– তবু ইনি বোধহয় কন্টিনেনটাল। ভারি মিষ্টি স্বভাবের, লাজুক, স্বল্পভাষী রমণী। মালিকের মাথায় হঠাৎ কী যেন আচমকা ভাবোদয় হল। বলল, আপনি তো একদা জর্মনিতে পড়াশুনো করেছিলেন; এখনও নাকি ওই দেশের ভাষা বলতে পারেন। ইনি (বউয়ের দিকে তাকিয়ে) খাঁটি জর্মন।।

এ্যাতক্ষ্যাণ ব্যাললেই হত। মেমও সঙ্গে সঙ্গে জর্মন বলতে আরম্ভ করল। ওর উচ্চারণ থেকে মনে হল সে ভুরুটেবের্গ প্রদেশের মেয়ে।

সোমদেবের চরম কৃপাই বলতে হবে! যে প্লেনে জরমনি থেকে লন্ডন এসেছিলুম সেটাতে ওই ভরটেমূবের্গ প্রদেশের মোলায়েম ওয়াইন সস্তায় বিক্রি হচ্ছিল। লন্ডনে পৌঁছে শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ডেরা পাব তা তো জানিনে। যদি-স্যাৎ কাজে লেগে যায়। তাই এক বোতল কিনে নিয়েছিলুম। আর যাবে কোথা! এক কোণে উঁই করে রাখা লাগেজ থেকে বোতলটি বের করে ম্যাডামের সামনে রেখে বললুম, এই নিন। সুম ভোল জাইন, আ ভত্র সতেহিয়ার ইজ টু ইউ –এসব তান্ত্রিক মন্ত্রের অর্থ আমি এখনও সঠিক জানিনে। তবে মোটামুটি দাঁড়ায় ইটি পান করে আপনার স্বাস্থ্যের উন্নতি হোক, আপনার সর্বমঙ্গল হোক ইত্যাদি। উভয় পক্ষ উভয়ের একই মঙ্গল কামনা করেন। মদ্যপান করে স্বাস্থ্যের উন্নতি হয় কি না জানিনে গত যুদ্ধে ফ্রানস হেরে যাওয়ার পর প্রেসিডেন্ট পেতা যখন প্রথম বক্তৃতা দেন, তখন তিনি বলেন, অত্যধিক মদ্যপান হেতু ফরাসি সেপাই ঠিকমতো লড়তে পারেনি– কিন্তু এটাই রেওয়াজ এবং ম্যাডামের চোখ ছল ছল করে উঠল। কোথাকার কোন ইন্ডিয়ান– তার দেশের জিনিস, এ স্থলে প্রতীক বলতে হবে, এনেছে। এটা কি কম কথা! ভাবুন, আপনি নিউজিল্যান্ড বা ওসলোতে। সেখানে কেউ নিয়ে এল আপনার জন্য পাটিসাপটা ক্ষীরের মালপো দেদো সন্দেশ! তদুপরি সে বাঙালি নয়।

ইতোমধ্যে দুটি একটি করে খদ্দের আসতে আরম্ভ করেছে। তার থেকে বুঝলুম, রাত হয়ে আসছে। আমার কাছে আশ্চর্য বোধ হয় যে আমরা সূর্যচন্দ্র দেখে সময়টা কী এবং তার চেয়েও বড় কথা মানুষের আচরণ তার কাজ-কারবার স্থির করি। যেমন সূর্য অস্ত যাচ্ছেন; অতএব এখন রাস্তার ভিড় কমতির দিকে। আর বিলেতে জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলেন রাস্তায় প্রচণ্ড ভিড়। নিশ্চয়ই লাঞ্চের সময়, অতএব দুপুর।

ক্রমে ক্রমে রেস্তোরাঁ ভর্তি হয়ে গেল। কিন্তু কী আশ্চর্য! সব গোরার পাল। একটি মাত্র ইন্ডিয়ান নেই। চল্লিশ বছর পূর্বে টিলবারির রেস্তোরাঁয় দেখেছিলুম বেশিরভাগ সিলেটি খদ্দের; মাত্র দু একটি গোরা। এখানে দেখি স লাল হো গিয়া।

মালিক ওয়ারলডু এটুলাসের মতো বিরাট একখানা মেনু এগিয়ে দিয়ে বলল, কী খাবেন, হুকুম দিন। আমি বললুম, প্লেনে বিস্তর ঝাঁকুনি খেয়েছি আর কী খাব, কও। বমি করেছে বেশ কয়েকজন। তুমি-আমি নিতান্ত সিলেটের লোক। জন্ম থেকে হাওর-বিলে নৌকা ভিতরে-বাইরে নাগরদোলার দোল খেয়ে শিলঙ যাবার সময় আচমকা পাহাড়ি মোড়, হেয়ার পিন টার্ন হজম করে করে সি সিক অ্যার সিক, ল্যান্ড সিক হইনে। কিন্তু এবারে আমো কাবু। গা গুলোচ্ছে, বমি না করলেই রক্ষে। প্লেনে ওঠার আগে যা-সব খেয়েছিলুম সেগুলো যেন রিটার্ন টিকিট নিয়ে গিয়েছিল; এখন ফিরি ফিরি করছে। উপস্থিত থাক। বরঞ্চ খাটের পাশে দু খানা স্যানউইচ রেখে দিয়ো। ক্ষিদে পেলে খেয়ে নেব।

মেনুটার ওপর চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিলুম, খেয়াল না করে, মালিককে ভদ্রতা দেখাবার জন্য, আলতো আলতো ভাবে। বিরিয়ানি, কোর্মা, কালিয়া, কাবাব, কোফতা, চিকেনকারি গয়রহ গয়রহ। এ তো ডালভাত কিন্তু শব্দার্থে বলছি না। আই মিন, এগুলো তো এরকম ফ্যাশনেবল রেস্তোরাঁতে থাকবেই। ইংরেজিতে যাকে বলে মাসুটস। কিন্তু কী একটা মামুলি আইটেমের দাম দেখতে গিয়ে আমি যেন আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারলুম না। বলে কী? দশ শিলিং! মানে? দশ টাকা। তখন মেনুর ডান দিকে তাকিয়ে দেখি, সব মালেরই প্রায় ওই দাম। অর্থাৎ, দু পদী আহারাদির জন্য আপনার খসে যাবে পৌন্ড খানিক। পনরো, বিশ, পঁচিশ টাকা! ও! তাই ইন্ডিয়ানরা আসেনি। ওদের বেশিরভাগই তো ছাত্রসম্প্রদায়। ওদের জেবে অত রেস্ত কোথায়?… মনে পড়ল, চল্লিশ বছর পূর্বে ছ পেনিতে (পাঁচ আনাতে)। রাইসকারি পাওয়া যেত টিলবারি ডক্‌-এ।

পরে খবর নিয়ে শুনলুম, গঙ্গার ভাও মোটেই আক্রা নয়। এটাই নর্মাল। এমনকি, ওই পাড়ার চীনা, হাঙ্গেরিয়ান, স্প্যানিশ রেস্তোরাঁতে আহারাদি আরও আক্রা। আর এর পর খাস বিলিতি ডাঙর ডাঙর রেস্তোরাঁতে কী ভাও, সেটা শুধোবার মতো হিম্মত আমার জিগর কলিজায় ছিল না, সেটা আমার হাফ-সিঙ্গল-চা, দুটো-ফলস্ পিনেওলা বেরাদর পাঠক নিশ্চয়ই দিব্য-দৃষ্টিতে দেখে ফেলেছেন।

কিন্তু এহ বাহ্য। কোন দেশে কোন বস্তুর কী দর, বিভিন্ন দেশের রেস্তোরাঁর তুলনাত্মক দরদাম সম্বন্ধে ডকটেরেট থিসিস লিখে ধৈর্যশীল পাঠককে, এ-অধম নিপীড়িত করতে সাতিশয় অনিচ্ছুক! তবে কেন?

সেটা পরে হবে।

.

নটিংহাম

০১.

আমাদের ছেলেবেলায় ঘটি-বাঙালে রেষারেষি ঠাট্টা-মশকরা ছিল ঢের ঢের বেশি। একটা মশকরা আমার মনে পড়ল নটিংহাম যাবার ট্রেনে বসে। বাঙালের সঙ্গে (বাঙাল সাথে বলে এবং গদ্যেও লেখে সাথে; রবীন্দ্রনাথ শেষ বয়সে সেটা কিঞ্চিৎ অনিচ্ছায় স্বীকার করে নেন) লিলুয়া স্টেশনে দেখা এক ঘটির। বাঙাল শুধাল, কোথায় চললেন দাদা? ঘটি বলল, চললুম, দাদা, পশ্চিমে। গায়ে এটুখানি গত্তি লাগিয়ে আসি। বাঙাল আমেজ করল, দাদা বুঝি হিলি দিল্লি বিজয় করতে চললেন। কারণ সে যখন প্রথম দেশ ছেড়ে শেয়ালদায় নামে তখন গান রচেছিল।

লাম্যা ইশটিশানে
গাড়ির থনে।
মনে মনে আমেজ করি
আইলাম বুঝি আলী মিয়ার রঙ-মহলে
ঢাহা (ঢাকা) জেলায় বশ্যাল (বরিশাল) ছাড়ি ॥

তার তরে বরিশাল ছেড়ে ঢাকা যাওয়াটাই একটা মস্ত কসরত। এবং শেয়ালদা আসাটা তো রীতিমতো গামার সঙ্গে লড়াই দেওয়া!… অবশেষে ধরা পড়ল ঘটি দাদা যাচ্ছেন লিলুয়া।

সবই পরিপ্রেক্ষিতের ব্যাপার। লন্ডন থেকে নটিংহাম সোয়া শো মাইল হয় কি না হয়। আমাদের কাছে লস্যি। অথচ লন্ডনের ইংরেজ দোস্তেরা যেভাবে আমাকে ওখানে যেতে নিরুৎসাহ করেছিলেন তার থেকে মনে হল ওরা ও-মুলুককে প্রায় দুশমনের পুরী বলে ধরে নিয়েছেন। একাধিক জন বললেন, ওখানে– অপরাধ নিয়ো না এই এই, অর্থাৎ সেখানে ইন্ডিয়ানদের ঠ্যাঙানো হচ্ছে। আমি বললুম, যেতে যখন হবেই তখন অত ভেবে কী হবে। তদুপরি আমাদের পোয়েট টেগোর বলছেন–

মৃত্যুকে যে এড়িয়ে চলে মৃত্যু তারেই টানে
মৃত্যু যারা বুক পেতে লয় বাঁচতে তারাই জানে ॥

ট্রেনে বসে চিন্তা করে দেখি, আমি নটিংহাম সম্বন্ধে যা জানি সে ধর্তব্যের মধ্যেই নয়। (১) আমার একজন আত্মীয় সেখানে আছেন। আমার আপন আত্মীয় হলে না গেলেও চলত কিন্তু তিনি আমার ছোট বোনের দেবর। তিনি আবার তালেবর লোক। আমি যখন হামবুর্গে তখন কী করে কোথায় থেকে খবর পেয়ে তিনি নটিংহাম থেকে আমাকে ট্রাঙ্ক-কল করে সাতিশয় অনুরোধ জানালেন আমি যদিস্যাৎ ইংলন্ডে যাই তবে অতি অবশ্য আমাকে নটিংহাম যেতেই হবে, যেতেই হবে– তিন সত্যি। (২) ছেলেবেলায় রবিনহুডের কেচ্ছা পড়েছিলুম। তার কর্মস্থল ছিল নটিংহাম। পাশে ছিল শারউড বন। সেইটেই ছিল তাঁর স্থায়ী আস্তানা।… এদানির কলকাতার ছেলেছোকরারা আর রবিনহুডের কাহিনী তেমন একটা পড়ে না। কলকাতার গলিতে গলিতে এন্তের রবিনহুড। তবে অতি সামান্য একটা তফাৎ রয়েছে। রবিনহুড নাকি ডাকাতি করে যে-কড়ি কামাতো সেটা গরিব-দুঃখীদের বিলিয়ে দিত। অদ্যকার কলকাতার রবিনহুডরা চাঁদার নামে, হ্যাঁনত্যানার নামে যে-টাকা, প্রায়-ডাকাতি করে কামান, সেটা ঠিক ঠিক কোন জায়গায় যায়, এ-মূর্খ সে-বাবদে বিশেষজ্ঞ নয়। ঈশ্বর সুকুমার রায় তার একটি কবিতাতে, উপবেশন কী করে করতে হয়, সে সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে বলেছেন,

তবে দেখো, খাদ্য দিতে অতিথির থালে
দৈবাৎ না পড়ে যেন কভু নিজ গালে।

বাকিটা বলার কোনও প্রয়োজন নেই। চালাক মাত্রই মূর্খকে কথা বলতে দেয়। আমি বিশ্বাস করি, যদল্লং তন্মিষ্টং। (৩) আমাদের যেরকম বিদ্রোহী কবি শ্ৰীযুত নজরুল ইসলাম, ইংরেজের বিদ্রোহী কবি বায়রন। এবং তার বাস্তুভিটে নটিংহামের অতি কাছে। ইংরেজ সরকার তার মৃতদেহ বড় বড় মহৎ মহৎ কবির সঙ্গে লন্ডনে গোর দিতে চায়নি বলে তাঁকে গোর দেওয়া হয় তার বাস্তুভিটের গোরস্তানে।

নটিঙম! নটিঙম!! নটিঙম!!! কলরব চিৎকার।

আরেকটু হলেই পৌঁছে যেতুম নর্থ পোলে। প্রফেটরা বার বার বলেছেন, নিজেকে চিনতে শেখ। আত্মচিন্তা কর। তা আপনারা যত খুশি আত্মচিন্তা করুন। কিন্তু রেলগাড়িতে না। কহাঁ কহাঁ মুল্লুকে পৌঁছে, দু ডবল ভাড়া, জরিমানা দিয়ে মোকামে ফিরবেন বরঞ্চ সেইটেই চিন্তা করুন।

.

০২.

তনু, দেহ, শরীর, বপু, কলেবর, কোনটা ঠিক মধ্যিখানে বলা ভার। আমার আত্মীয় যিনি আমাকে নটিঙাম স্টেশনে রিসিভ করতে এলেন তিনি ওই মধ্যিখানে। বাইরে বেরিয়ে দেখি, তার ঢাউস মোটরগাড়ি। বাড়ি যাবার সময় অলস-নয়নে এদিক-ওদিক তাকালুম। ইংরেজ বিদেশে যদি বিশেষ কোনও নতুন চিজ না দেখতে পায় তবে বলে নাথিং টু রাইট হোম এবাউট। অর্থাৎ এমন কিছু দেখিনি যা চিঠিতে লিখে বাড়ির লোককে তাক লাগানো যায়। আমার হল তাই। এ জায়গায় লক্ষ করলুম, পর পর দুটো দোকানে যেন কিছু ভারতীয় সামান আসবাব আছে। শুধোলুম, এ দোকানগুলো কাদের? চৌধুরী বললেন, এক শিখ ভদ্রলোকের। বেশ দু পয়সা কামান। বড়লোক বলা যেতে পারে। চৌধুরীর বাড়ি পৌঁছে দেখি তিনিও কিছু কম যান না। তেতলা বাড়িতে বাস করেন। তিনটেই তার। তার পর গেলুম তাঁর রেস্তোরাঁ দেখতে। সে-ও এলাহি ব্যাপার; উপরের তলা নিচের তলা দু তলা নিয়ে পেল্লাই কাণ্ড।

কিন্তু এসব কথা অন্য দিন হবে।…. খবরের কাগজে পাঠক হয়তো লক্ষ করে থাকবেন যে ইংলন্ডের বর্তমান সরকার আইন পাস করতে যাচ্ছেন, এখন থেকে ওঁদের দেশে চলে যেতে হলে কমনওয়েলথ নাগরিক– যেমন ভারতীয়-পাকিস্তানি এবং পাক্কা বিদেশি– যেমন ফরাসি-জরমন– আর কোনও তফাৎ রইল না। বিগলিতাৰ্থ : ভারত-পাকিস্তানির পক্ষে এখন ও-দেশে গিয়ে দু পয়সা কামানো প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে। আত্মাভিমানী পাঠক হয়তো ঈষৎ রাগত কণ্ঠে শুধোবেন, কী দরকার রে বাপু, বিদেশে গিয়ে এরকম হ্যাংলামো করার? কিন্তু আমি বিলক্ষণ অবগত আছি, আজ ওই বাংলা দেশেই হাজার হাজার ছেলে এবং মেয়েও আছে যারা বিলেত, বিলেত কেন হটেনটটের মুলুকেও যেতে রাজি আছে পেটের ভাতের তরে। এতে অভিমান করার কী আছে?…কিন্তু সেই কথায় ফিরে যাই। নটিঙামে গিয়েছিলুম গেল বছরের সেপ্টেম্বর মাসে। সেখানে গিয়ে শুনি, ওরা ইতোমধ্যে জেনে গিয়েছে, নতুন কনজারভেটিভ সরকার কোন তালে আছেন। বিশেষ করে সিলেটিরা আমাকে তাদের দুশ্চিন্তার কথা শোনাতে গিয়ে বলল, দেশ থেকে নতুন লোক যে আর আসতে পারবে না, শুধু তাই নয়, হুজুর। দেশে যাওয়া-আসা যে প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে। আমাদের বেশিরভাগেরই বউ-বাচ্চা তো ওখানে। আমি বললুম, আচ্ছা, এখানে তো ভারতের লোকও রয়েছে। তাদের সঙ্গে পরামিশ-সুপারিশ করে দেখেছ? উভয় পক্ষের বিপদ তো একই। উত্তরে যা বলল সেটা, পাঠক একটু মন দিয়ে শুনুন। বলল, হুজুর ওদের সঙ্গে আমাদের ঠিক বনে না। ওদের বেশির ভাগই শিখ। ওরা হিন্দুস্থানি বলেই যে আমাদের সঙ্গে বনে না সেটা ঠিক না বিশ্বাস করুন হুজুর। আপনিও তো হিন্দুস্থানি। আপনাকে তা হলে এসব দরদ জানাই কেন? ছুটিছাটায় যখন লন্ডন যাই, তখন পুব-পশ্চিম দুই বাংলার লোকের সঙ্গেই দেখ-ভাল মোলাকাত-মহব্বত হয়– হিন্দু-মুসলমান দুই-ই। তারার লগে কথা কইতে কুনু অসুবিস্তা অয় না, তারা আমরার দুশকো (দুঃখ) বুঝে, আমরাও তারার দুশকো বুঝি। আর এই শিখদের সঙ্গে আমাদের আরেকটা ডাঙর ফারাক আছে। এরা এদেশেই বসতি গড়তে চায়, দেশে ফিরে যেতে চায় না। তাই তারা দেশের গাঁয়ে টাকাকড়ি পাঠায় না। আর আমাদের পনেরো আনা দেশে ফিরে যেতে চায়। তাই আমরা দেশে টাকা পাঠাই– যাতে করে দেশের ভাই-বেরাদর সুখে থাকে, পুরনো বাড়ি ঘরদোর মেরামতিতে রাখে, নয়া উমদা বাড়ি বানায়। আর দেশে টাকা পাঠানোতেও বিস্তর মুশকিল। ব্যাংকের মারফতে পাঠালে দেশের লোক পাবে কম, কালোবাজারে।

বাকিটা আমি শুনিনি।… আমি মনে মনে ভাবছিলুম (১) বাঙালি বাঙালিতে কী প্রণয়! (২) বাঙালি দেশকে বড়ই ভালোবাসে। এই নটিঙামের বাঙালি মুসলমান তার প্রাণ-জিগর কলিজা পড়ে আছে সিলেটে।

.

হাওর

বাংলাদেশের প্রথম ইতিহাস লেখেন জনৈক মোল্লা নাথন, নাথতু। বইখানার নাম বহার-ই স্তানই-গায়েবি অর্থাৎ অজানা চিরবসন্ত ভূমি– ফারসিতে লেখা। নাথু মিঞা দিল্লির লোক। ভাগীরথী পার না হওয়া পর্যন্ত তিনি এমন কোনও দ্যাশ দেখেননি যেখানে ঘোরতর গ্রীষ্মকালেও ঘাস সবুজ থাকে। তাই কেতাবের নাম দিয়েছিলেন চির বসন্ত ভূমি। মিঞা সাহেব এসেছিলেন বাংলা দেশে জাহাঙ্গিরের রাজ সেনানীর সঙ্গে শেষ পাঠান রাজা ওসমানকে পরাজিত করার জন্যে। জাহাঙ্গিরের পিতা আকবর বাদশাহ পুরো বাংলা দেশ জয় করতে পারেননি। তার একমাত্র কারণ মোগলরা শুকনো দেশের লোক; নৌযুদ্ধ কারে কয় জানে না। জাহাঙ্গিরের প্রধান সেনাপতি বেশিরভাগ ভয় দেখিয়ে কিছুটা ঘুষ দিয়ে কয়েকটি মীরজাফর যোগাড় করে নৌযুদ্ধ খানিকটা শিখল। তার পর তারা ওসমানের পিছনে ধাওয়া করল। ওসমানের প্রধান দুর্বলতা ছিল যে তার কাছে যেসব কামান বন্দুক ছিল, সেগুলো মোগলদের তুলনায় নিকৃষ্টতর। তদুপরি জাহাঙ্গিরের সেনাপতি যে প্রচুর সৈন্যদল নিয়ে এসেছিলেন তার সামনে দাঁড়ানো ওসমানের পক্ষে প্রায় অসম্ভব ছিল।

ওই সময়ে বাদশাহ জাহাঙ্গির চিঠি লিখলেন ওসমানকে : আত্মসমর্পণ করো। ওসমান অতি সংযত ভদ্র ভাষায় উত্তর দিলেন, যার মর্মার্থ, আপনি দিল্লীশ্বর, আপনার দেশ দেশব্যাপী বিরাট রাজত্ব। আমি তো তার তুলনায় সামান্য একটি চিড়িয়া। কিন্তু সামান্যতম পাখিটিও স্বাধীনভাবে থাকতে চায়।…. ওসমান জানতেন মোগলরা এতদিনে বেশ কিছুটা নৌ-যুদ্ধ শিখে নিয়েছে। তদুপরি সেটা শীতকাল (ইয়াহিয়া খানের কপাল ভালো যে শেখ মুজিবের সঙ্গে তার ঝগড়াটা চরমে পৌঁছায় মার্চ মাসে; বর্ষা নামলেই চিত্তির। তাই তিনি তিলব্যাজ না সয়ে মারলেন তাঁর হাতুড়ি ওই মোকাতেই)। তাই তিনি স্থির করলেন মোগলদের নিয়ে যেতে হবে সিলেটে। সেখানে যেসব হাওর আছে তার প্রধান ভাগ শীতকালে শুকোয় না। কারণ বৃষ্টির জন্য প্রসিদ্ধতম স্থল চেরাপুজি। তার কুল্লে পানি নেবে আসে সিলেট জেলায়, ডাউঁকি হয়ে জইন্তা হয়ে অসংখ্য নদনদী খাল নালা দিয়ে। এই সব হাওরে সামান্যতম ঝড় উঠলে ওই দেশেরই বহু কিশোর তরুণ তক বমি করতে থাকে– অর্থাৎ বাংলা কথায় সি-সিক হয় (পাঠকের স্মরণ থাকতে পারে ডিডে ল্যান্ডিঙের সমর প্রচুর সৈন্য নরমান্ডির বেলাভূমিতে নেমে সেখানে শুয়ে পড়ে। বমি করতে করতে তাদের পেটে তখন আর কিছু ছিল না যে লড়াই করে করে জর্মনদের ঘাঁটি দখল করে।

নেপোলিয়ন বলেছিলেন, এন আর্মি মার্চেজ অন ইটস স্টমাক। অন্যার্থে। কিন্তু এস্থলে এটা প্রযোজ্য)। এবং ঢাকা থেকে সিলেটের হাওর অবধি এক্কেবারে ফ্ল্যাট। সিলেট পৌঁছলেই আরম্ভ হয় টিলা, কোনও কোনও টিলাকে পাহাড়ও বলা যেতে পারে। ঘন বন জঙ্গল এবং প্রচুর সুপুরিগাছ।… ওসমান তাই পৌঁছলেন সিলেটে। রিয়ার গার্ড একশন করতে করতে। অর্থাৎ তিনটে সুপুরিগাছ জড়িয়ে বেঁধে তার সর্বোচ্চতম প্রান্তে একটা কাঠের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে সেখানে কামান তুলে নিয়ে দুশমনের উপর কামান দাগতে দাগতে। মিয়াদের তখন তাজ্জব নয়া অভিজ্ঞতা হল। করে করে ওসমান সিলেট জেলার প্রায় আধখানা পেরিয়ে মিয়াদের নিয়ে গেলেন, আজ ম্যাপে যেখানে মৌলবি বাজার, তার তিন মাইল দূরে দুল্লভমপুরে (অধুনা নাম দুর্লভপুর)। তারই পরে হাইল হাওর। ওসমান ও তার সৈন্যদল হাওরের হাঁটুজলে পায়ে হেঁটে ওপারে চলে গেলেন। তিনি জানতেন, মোগলরা এ অঞ্চলে কখনও আসেনি। তারা জানে না কোন জায়গায় হাঁটুজল আর কোন কোন জায়গায় অথৈ জল। মোগলরা এপারে দাঁড়িয়ে। তার পর শুভলগ্নে ওসমান ওপার থেকে হাওর পেরিয়ে আক্রমণ করলেন– মোগল সৈন্যদের। তারা লড়েছিল প্রাণপণ। কিন্তু পরাজয় অনিবার্য বুঝতে পেরে তারা পালাতে আরম্ভ করল। এমন সময় হাতির-পিঠে-বসা অগ্রগামী ওসমানের চোখে এসে ঢুকলো একটা উটকো তীর। মাহুত ভয় পেয়ে হাতি ঘোরাল। ওসমান বুঝতে পেরে চেঁচাচ্ছেন, এগিয়ে চল চল। ওদিকে মোগল সৈন্যদের ভিতর বিজয়ধ্বনি আরম্ভ হয়েছে ওসমান পালাচ্ছে, ওসমান পালাচ্ছে। মোগলরাই জয়ী হল। সে এক করুণ কাহিনী। সুযোগ পেলে আরেকদিন সবিস্তর বলব।

কিন্তু আমি জালা জালা পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটছি কেন? যারা বাংলা দেশ থেকে আসছেন, তাঁরাই বলছেন গেল সাড়ে-দুই মাস ধরে সবচেয়ে মোক্ষম লড়াই দিয়েছে সিলেটের লোক। তাদের কী সুবিধে টিলাবন হাওর– অর্থাৎ তেরা– পূর্বেই বলেছি।

ওসমান যুদ্ধে হারেন শীতকালে মার্চ মাসে। এবারে দেখি ঘন বরষায় তারা হাওরের কী সুযোগ নেয়।

এপিলোগ : আকবর বাদশাহ মারা যান আমাশাতে। বাংলা বিজয় অভিযানে বেহারে! সে আবার আমাশা! ঢাকার আমাশা অলিম্পিক। পিণ্ডির জাঁদরেল যে এই বর্ষায় ঢাকায় আসছেন, তার যদি ভালো-মন্দ কিছু একটা হয়ে যায়। সম্পাদক মহাশয়, আপনি সহৃদয় লোক। তাই আপনাকে অনুরোধ করছি, পিণ্ডির খান সাহেবকে জানিয়ে দিতে, প্রতিদিন দুটো এনটেরো ভায়োফর্ম এবং এক বড়ি ত্রিফলাকস, তদভাবে ইসপগুল তিনি যেন সেবন করেন। যদি তিনি এ যাত্রায় নিস্তার পান তবে ইতিহাস হয়তো আপনার প্রতি কটুকাটব্য করবে! সাধু সাবধান।

.

মহাভারত

পয়লা ফেব্রুয়ারি দিবস, কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির বার্ষিক সম্মেলনে লাটসাহেব শ্ৰীযুত শান্তিস্বরূপ ধাওন যা বলেন তার বিগলিতাৰ্থ– আমি তিনখানা খবরের কাগজের রিপোর্টের ওপর নির্ভর করে আমার নিবেদন জানাচ্ছি- এতাবৎ ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা মহাভারতের তথা ভারতীয় সভ্যতার ব্যাখ্যা (ইন্টারপ্রিট) করেছেন তাঁদের পশ্চিমী দৃষ্টিভঙ্গি দৃষ্টিকোণ দৃষ্টিবিন্দু (উয়েসটার্ন আইজ) দিয়ে। এখন আমাদের ভারতীয়দের উচিত, ভারতীয় সভ্যতা (শ্ৰীযুত ধাওন সভ্যতার–সিভলিজেশন-এর সঙ্গে কালচার বলেছিলেন কি না সেটা খবরের কাগজ উল্লেখ করেনি। এটা গুরুত্বব্যঞ্জক। কারণ যে কোন একটা জাতি, দেশ, নেশন অতিশয় সিভিলাইজড না হয়েও কালচার, বৈদগ্ধ্যের উচ্চাসন গ্রহণ করতে পারে। আমি ধরে নিচ্ছি শ্ৰীযুত ধাওন দুটোই বলতে চেয়েছেন। ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করা।

এ অতি উত্তম প্রস্তাব সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আমাদের অজানা নয় যে, যবে থেকে ইংরেজ আপন স্বার্থের জন্য ভারতবর্ষে এসেছে সেই থেকেই এ দেশের নিন্দাবাদ করেছে। গোড়ার দিকে মৃদুকণ্ঠে, মোলায়েম মোলায়েম ভাবে। পরে যখন বণিকের মানদণ্ড পুরোপাক্কা রাজদণ্ডে পরিণত হল তখন ভারত বাবদে তার অন্যতম প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল বিশ্বজনের সামনে সপ্রমাণ করা : ভারতবর্ষ অতিশয় অশিক্ষিত, অসভ্য, অনলচরড দেশ এবং এ দেশকে সভ্য ভদ্র সত্যধর্মে –খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার জন্য ইংরেজ নিতান্ত পরোপকারার্থে, প্রতি খ্রিস্টজনের যা কর্তব্য, অর্থাৎ বর্বরদের সভ্য করার জন্য এ দেশে এসেছে, এবং এই পাষণ্ড, নেমকহারাম দুশমনের কলকাতা শহরের জলাভূমির আমাশা, নানাবিধ জ্বর রোগে সাতিশয় ক্লেশ ভুঞ্জিয়া সদ্যপ্রভুর পদপ্রান্তে আপন আত্মা নিবেদন করছে, সেক্রিফাইস করছে, এক কথায় মার্টার বা শহিদ হয়েছে। এই যে ইংরেজের দম্ভোলিদম্ভ- এরই ঘৃণ্য ভণ্ডনাম হোয়াইট মেনস বার্ডেন। তদর্থ, গড ধবলাঙ্গদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন, সে যেন শ্যামাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, রক্তাঙ্গ (রেড ইন্ডিয়ান), পীতাঙ্গ পৃথিবীর কুল্লে জাতকে শিক্ষিত সভ্য করার গুরুভার (বার্ডেন) আপন স্কন্ধে তুলে নেয়। এ বার্ডেন বইতে গিয়ে ইংরেজাদি শ্বেতাঙ্গদের কী পরিমাণ মুনাফা হয়েছে সে তত্ত্ব আমরা হাড়ে হাড়ে জানি। থ্রি মেন ইন এ বোট-এর প্রখ্যাত রসাচার্য ভারতপ্রেমী লেখক জরৌম কে জরৌম এই বার্ডেন ভণ্ডামিকে তীব্রতর ভাষায় ব্যঙ্গ করে এই শতকের গোড়ায় একটি প্রবন্ধ লেখেন : হোয়াইট মেনস বার্ডেন– হোয়াই শুড ইট বি সো হেভি? কিংবা ওই ধরনের। তিনি নানা প্রকারের ঠাট্টামশকরা ব্যঙ্গবিদ্রূপ সারার পর বক্রোক্তি করেন, হোয়াইট মেনস বার্ডেন বইতে গিয়ে আমরা যে আত্মত্যাগ, পরার্থে প্রাণ দান করলুম তাতে করে আমাদের কী ফায়দা হয়েছে? এই নেমকহারাম ইন্ডিয়ানরা (বলা বাহুল্য, ইংরেজের আত্মত্যাগ, ভারতীয়ের নেমকহারামি জরৌম আগাপাশতলা উল্টো বুঝলি রামার্থে নিয়েছেন। যদি আমাদের বার্ডেন বওয়ার মূল্য না বুঝে এখন নিজের বার্ডেন নিজেই বইতে চায় (ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তখন জোরদার জরৌম তার প্রতি অনুরাগী) তবে ফেলে দে না, বাবা, ওই মূর্খদের স্কন্ধে ওদের আপন বার্ডেন। চলে আয় ওদেশ ছেড়ে। বয়ে গেছে আমাদের।

এ তো গেল। ওদিকে আরেক শিরঃপীড়া। ইংরেজের বাক্যরীতিতেই বলি, সে একাই তো বেলাভূমিতে একমাত্র উপলখণ্ড নয়। আরও মেলা চিড়িয়া রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় কেবল অতি সামান্য একটা কারণে একটু মুশকিল বাধল। সেটা হচ্ছে এই যে, পৃথিবীর অন্য দেশগুলোকে ভূতে পায়নি।

এস্থলে দেখা ইতোমধ্যে ইউরোপের অন্যান্য জাত ভারতের অনেক অনেক উত্তম উত্তম। গ্রন্থ- অবশ্য অধিকাংশ অনুবাদে পড়ে ফেলেছে। দারাশিকুহকৃত উপনিষদের ফারসি অনুবাদ কিংবা তার আদেশে কৃত অনুবাদ (মুজমা-ই-বহরেন–দ্বিসিন্ধু মিলন) লাতিনে অনূদিত হয়েছে। ইংরেজ পড়ল বিপদে। উপনিষদ হিন্দু ধর্মগ্রন্থ। তার ফারসি অনুবাদ করল এক মুসলমান। তার লাতিন অনুবাদ করল এক খ্রিস্টান পাদ্রি এবং তার উচ্ছ্বসিত প্রশস্তি গাইল সেদিনকার– সর্বোত্তম বললেও অত্যুক্তি করা হয় না– সর্বসংস্কারমুক্ত, ধর্ম-নিরপেক্ষ দার্শনিক শোপেনহাওয়ার।

ইতোমধ্যে, শেক্সপিয়রের সঙ্গে সঙ্গে যার নাম অনেকেই করে থাকেন সেই কবি গ্যোটে শকুন্তলা নাট্যকে প্রশংসা প্রশংসায় স্বর্গে তুলে দিয়েছেন– না, ভুল বললুম,–তিনি বললেন, এই নাট্যেই স্বর্গ এবং পৃথিবী সম্মিলিত হয়েছে।

ইংরেজ জাত ঘড়েলস্য ঘড়েল। সে সুর পালটাল। অবশ্য আমার বক্তব্য এ-নয়, যে নিরপেক্ষ প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব কোনও ইংরেজ কস্মিনকালেই ছিল না। কিন্তু কে পরোয়া করে তাদের?

তাই আজ যখন প্রশ্ন উঠেছে, মহাভারত কাল্পনিক না ঐতিহাসিক তখন ইংরেজ পণ্ডিতেরই বরাত দেওয়া প্রকৃষ্টতম পন্থা। উওশবর্ন হপকিনস তার একাধিক প্রামাণিক গ্রন্থে বলেছেন (যে কারণে, অধমের জানা মতে, ধর্ম বিষয়ে সর্বোৎকৃষ্ট এনসাইক্লোপিডিয়ায় তিনি মহাভারত সম্বন্ধে প্রামাণিক প্রবন্ধ রচনা করার জন্য সম্মানিত আমন্ত্রণ পান), নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে মহাভারত কাব্যে কোনও সত্যকার সংঘর্ষ প্রতিবিম্বিত হয়েছে– ইট (মহাভারত) অনডাউটেডলি রিফলেটস সম্ রিয়েল কনটেসট। পুনরপি তিনি বলেছেন, সত্য ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে আমরা যদি পুরাণে উল্লিখিত রাজবংশসমূহের তালিকা (লিস্টস) মহাভারতের সঙ্গে মিলিয়ে দেখি তবে পাই যে মহাভারতের নানা প্রকারের কিংবদন্তির পশ্চাতে সত্য ইতিহাস বিম্বিত হয়েছে। স্বর্গত গিরীন্দ্রশেখর ঠিক এই মতটিই তার প্রামাণিক গ্রন্থে সপ্রমাণ করেছেন; এ-পত্রিকার সম্পাদকীয় স্তম্ভে তার উল্লেখ হয়েছে।

সব থাক, সব যাক্। পাঠক, তোমার কমনসেনস কী বলে? কোনও কিছু ঘটেনি, কোনও কিছু হয়নি, এ যেন হাওয়ার-কোমরে দড়ি বাধা!

ঠিক তেমনি, খোঁড়াখুঁড়ি করে কিছু পাওয়া যায়নি বলে সব ঝট হ্যায়? তবে একটি ছোটিসি চুটকিলা পেশ করি। এক রেড ইন্ডিয়ান বলল তার দেশে খোঁড়াখুঁড়ির ফলে বেরিয়েছে প্রাগৈতিহাসিক যুগের টেলিগ্রাফের তার। অতএব সে-যুগেই তারা টেলিগ্রাফি জানত। উত্তরে এসকিমো বলল, তার দেশে খোঁড়াখুঁড়ি করে কোনও প্রকারের তার পাওয়া যায়নি। অতএব তারা বেতার ওয়্যারলেস ব্যবহার করত।

কিন্তু আমার শিরঃপীড়া ভিন্ন। মহাভারতের মতো কোনও গ্রন্থই বার বার পুনর্বার আমি পড়িনি। অথচ প্রতিবার নব নব সমস্যা দেখা দেয়। সে কথা আর এক দিন হবে।

.

৫৭০-১৯৭০/১৪০০ বছর হজরত
মুহম্মদ (দ.)-এর চতুর্দশ জন্মশতবার্ষিকী

হজরতের জন্মদিন নিয়ে বিস্তর আলোচনা, সবিস্তর তর্কাতর্কি মোটামুটি এই চোদ্দশো বছর ধরে চলছে, এবং চলবেও।

আজ ৪ জ্যৈষ্ঠ, ১৮ মে, শুক্লপক্ষের দ্বাদশী। আরবি চান্দ্রমাসের গণনায় আজ রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ। দ্বাদশ শব্দের ফারসি : দোওয়াজদহম। দো = দ্ব = দুই; দহম = দশম = দশ। অর্থাৎ দ্বিদশ। বলা হয়, হজরত মুহম্মদ এইদিন জন্মগ্রহণ করেন। তাই চান্দ্রমাস রবিউল আউয়াল-এর বারো তারিখকে বলা হয় ফহ্-ই-দো ওয়াজদহম্। দোওয়াজদহম্ শব্দের অর্থ এইমাত্র নিবেদন করেছি। ফহ্ শব্দের অর্থ জয়। এই আরবি শব্দটি আমাদের সম্পূর্ণ অজানা নয়। শিখেরা গুরুজিকি ফতেহ জয়ধ্বনি করেন; বাদশা আকবর নির্মিত ফতেহপুর সিক্রি অনেকেই দেখেছেন।

কবি মরহুম গোলাম মোস্তফা তাঁর বিশ্বনবী গ্রন্থে এই মত পোষণ করেছেন।

পক্ষান্তরে সুপণ্ডিত মরহুম মাওলানা মোহম্মদ আকরম খান তাঁর মোস্তফাচরিত গ্রন্থে বিস্তর গবেষণার পর সিদ্ধান্ত করেছেন, হজরতের জন্ম হয়, ৯ রবিউল আউয়াল; ১২ নয়।

কিন্তু বাঙলা দেশের জনসাধারণ, তথা উভয় বাঙলার সরকার মেনে নিয়েছেন যে হজরতের জন্ম হয় ১২ তারিখে। কিন্তু সেটা চাঁদ দৃশ্যমান হবার ওপর নির্ভর করছে। কাজেই কেউ কেউ ১৮ মে, অন্যেরা ১৯ মে হজরতের জন্মদিবস (ঈদ-ই-মিলাদ-উন-নবি; ঈদ = আনন্দদিবস, মিলাদ = জন্মক্ষণ ও-ল-দ ধাতুর অর্থ জন্ম দেওয়া, তার থেকে মওলিদ, মিলাদ, মওলু অনেক শব্দই প্রায় একই অর্থে এসেছে, এমনকি আরবের খ্রিস্টানরা বড়দিনকে বলে ঈদ, উল মিলাদ তাই পাঠক নির্ভয়ে আজকের পরবকে মিলাদ শরিফ–শরিফ = উচ্চ, সম্মানিত, ভদ্র মওলুদ শরিফ, ঈদ-ই মিলাদ যা খুশি বলতে পারেন। কিংবা পূর্বোল্লিখিত আরবি-ফার্সির সংমিশ্রণে ফ-ই-দোওয়াদহও বলতে পারেন।

নবী, পয়গম্বর, রসুল ইত্যাদি শব্দ একই ব্যক্তি, অর্থাৎ হজরতকে বোঝায়।

হজরতের জন্মদিন নিয়ে দেশের জনসাধারণ যা মেনে নিয়েছেন আমরাও তাই মেনে নিলুম। এখন প্রশ্ন তাঁর জন্ম কোন বৎসরে?

কেউ বলেন ৫৬০ খ্রিস্টাব্দ, কেউ বলেন ৫৬৯ খ্রিস্টাব্দ, কেউ বলেন ৫৭০ খ্রিস্টাব্দ।

মোদ্দা কথা এই : যখন কোনও মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেন তখন তো মানুষ জানে না, তিনি একদিন মহাপুরুষ রূপে আত্মপ্রকাশ করবেন। তদুপরি হজরত জন্মগ্রহণ করেন বিত্তহীন অনাথের গৃহে। সে-কালে মক্কা শহরে লেখাপড়ার খুব একটা চর্চা ছিল না (হজরতকে লেখাপড়া শেখাবার কোনও চেষ্টা তাঁর বাল্যবয়সে করা হয়নি; বস্তুত তিনি নিরক্ষর ছিলেন)– কে লিখে রাখবে তার জন্মদিন?

এটা শুধু হজরতের বেলায়ই নয়। বুদ্ধদেব, মহাবীর, জরথুস্ত্র, খ্রিস্ট এঁদের সকলেরই জন্মদিবস এমনকি জন্মবছর নিয়েও পণ্ডিতেরা আদৌ একমত নন।

হজরতের পরলোকগমন দিবস সম্বন্ধে কোনও মতানৈক্য নেই। তিনি মরধাম ত্যাগ করেন ৭ জুন, ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে। এবং হিজরি তারিখ অনুযায়ী ১২ রবিউল আউয়াল। অর্থাৎ তার জন্মদিন এবং মৃত্যুদিন একই দিবসে। এতে ভক্ত মুসলমান মাত্রই আল্লাহতালার অদৃশ্য অঙ্গুলিসংকেত দেখতে পান।

পূর্বেই নিবেদন করেছি হজরতের জন্মবৎসর ৫৬০, ৫৬৯, ৫৭০ বলা হয়। আমরা ছেলেবেলা থেকেই স্কুলে পড়েছি ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে। সেই জনমতই আমরা আবার মেনে নিলুম। এখন যাচ্ছে ১৯৭০। তা হলে এই বৎসর, এই মাসে, এই দিনে ইজরতের ১৪০০ জন্মদিন। তাই বহু মুসলমান এদিনটিকে বিশেষ সম্মান দেখাচ্ছেন। কিন্তু এখানে কিঞ্চিৎ মতভেদের সম্ভাবনা রয়ে গিয়েছে। মুসলমানদের বৎসর গণনা চন্দ্র নিয়ে। চান্দ্র বৎসর সৌর বৎসরের চেয়ে হ্রস্বতর। তদুপরি গণনাতে আরেকটা অসুবিধা আছে। মুসলমানদের বৎসর হিজরি, গণনা আরম্ভ হয় জুলাই ১৬, ৬২২ খ্রিস্টাব্দ। কিন্তু তার পূর্বে আরবরা বৎসর গণনা করত সৌর বৎসরে। হিসাব তাই কঠিনতর হয়ে যায়। এবং সর্বশেষ বিপদ, যে খ্রিস্টান ক্যালেন্ডার নিয়ে আমরা সন তারিখ গণনা করি তারও পরিবর্তন সংস্কার একাধিকবার হয়েছে।

অতএব এসব হিসাব আপনার-আমার মতো সাধারণ জনের কর্ম নয়। আমরা সরল বিশ্বাসী। স্কুলে পড়েছি ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে হজরত মুহম্মদের জন্ম হয়। আজ তার জন্মদিন। এবং উপস্থিত ১৯৭০। অতএব আজ তার ১৪০০ বৎসরের জন্মদিন। আজ আনন্দের দিন। ঈদের দিন। মুসলমান হিন্দু, খ্রিস্টান, জৈন, (মারওয়াড়ি) সক্কলকে মিষ্টান্ন বিতরণ করতে হয়।*

[*এই সামান্য লেখনটি লেখার উদ্দেশ্য : বহু হিন্দু এবং অনেক মুসলমান হজরতের জন্মদিন, পরলোকদিবস সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল নন বলে মনে মনে সঙ্কোচ বোধ করেন। পণ্ডিতরাই যে বিষয়ে মনস্থির করতে পারেননি, সে স্থলে আমাদের অযথা কুণ্ঠিত হওয়ার কোনও কারণ নেই।]

.

ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই

০১.

হিন্দু-মুসলমান সমস্যা ভারতবর্ষের সর্বত্র যে রূপে প্রকাশ পায়, বাংলাদেশে সে রূপ গ্রহণ করে না। উত্তর ভারতের অন্যত্র হিন্দুরা হিন্দি বলেন পড়েন, মুসলমানরা উর্দুর সঙ্গে যুক্ত। তেজবাহাদুর সপ্রু ও পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু জাতীয় উর্দু ভাষাভাষী হিন্দুর সংখ্যা ক্রমেই কমিয়া আসিতেছে। এককালে বিহারে বহু মুসলমান হিন্দি শিখিতেন; শুনিতে পাই, তাঁহারাও নাকি হিন্দি বর্জন আরম্ভ করিয়াছেন।

কিন্তু বাংলাদেশের অধিবাসী– তিনি হিন্দুই হউন আর মুসলমান হউন বাংলা বলেন ও পড়েন। কাজেই ভাষার কল্যাণে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান একে অন্যকে চিনিবার সুযোগ পায়। মিশরে কপ্ট-রা ক্রিশ্চান ও বাদবাকি বাসিন্দা আরব মুসলমান। কিন্তু উভয়ের ভাষা এক বলিয়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মিলনের সুবিধা হইয়াছে। প্যালেস্টাইনে নবাগত ইহুদিরা হয় ইউরোপীয় কোনও ভাষা বলে নতুবা মৃতপ্রায় ইয়েডিশ ভাষাতে। কলহ লাগিয়াই আছে।

বাঙালি মুসলমান বাঙালি হিন্দুর কৃষ্টি-সভ্যতা সাধারণ বাঙালি হিন্দু যতটুকু (পরিতাপের বিষয় সে ধূলপরিমাণে) জানেন ইচ্ছা করিলেই ততটুকু অক্লেশে জানিতে পারেন ও অনেকেই জানেন। সাধারণ বাঙালি হিন্দু যেটুকু বেদ-উপনিষদ, রামায়ণ-মহাভারত, পুরাণ-ভাগবত, ষড়দর্শন, কাব্য-নাটক পড়েন, তাহা বাঙলা অনুবাদে ও বাদবাকি বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্ব রামপ্রসাদী, পরমহংসদেবের রচনামৃত তো মূল বাঙলাতেই আছে। ফলিত-গলিত জ্যোতিষের জন্য বিরাট পঞ্জিকা আছে। বলিতে কি, গ্রামাঞ্চলে পঞ্জিকা বেদ-উপনিষদ গীতাকে হার মানাইয়াছে। আশ্চর্য হইবারই বা কী আছে? ভবানীকে যখন মহাকাল এক বসরকালের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ করিয়া শুধু ওই বৎসরেরই ফলাফল নিবেদন করেন, তখন তাহাকে উপেক্ষা করিবে কোন নাস্তিক? আমরাও করি না। বস্তুত সরকারি আবহাওয়া দপ্তরের ভবিষ্যদ্বাণী অপেক্ষা ক্ষণা দেবীর উপর অন্তত আমার বিশ্বাস ভরসা বেশি।

সে যাহাই হউক। আসল কথা এই যে, অনুবাদ সাহিত্যে বাঙলা এখন এতটা সমৃদ্ধ হইয়াছে যে, তাহা দ্বারা সাধারণ বাঙালি নিজেকে দেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত রাখিতে পারেন। বাঙালি মুসলমানও এই সাহিত্য হইতে অনেক কিছু পারেন। উপায় নাই। এইসব অনুবাদ, মূল বৈষ্ণব পদাবলি, মেঘনাদ বধ কাব্য, কৃষ্ণচরিত্র ইত্যাদি বাদ দিলে প্রাক্ রবীন্দ্র সাহিত্যে রইল কী?

এখন প্রশ্ন, বাঙালি হিন্দু-মুসলমানদের অথবা হিন্দুর দ্বারা লিখিত মুসলমানি সাহিত্যের কতটা খবর রাখিয়াছেন ও রাখিতেছেন?

বাঙালি-হিন্দু মুসলমানদের দ্বারা লিখিত পুস্তক যে পড়েন না বা কম পড়েন, তার জন্য তাহাকে সম্পূর্ণ দোষ দেওয়া যায় না। কারণ মুসলমানদের ভিতর শক্তিমান লেখক বড় কম। একবার ভাবিয়া দেখিলেই হয় যে, আজ যদি কোনও মুসলমান শরত্ববুর মতো সরল ভাষায় মুসলমান চাষি ও মধ্যবিত্ত জীবনের ছবি আঁকেন, তবে কোন হিন্দু না পড়িয়া থাকিতে পারিবেন? আরব্যোপন্যাসের বাঙলা তর্জমা এখনও হাজার হাজার বিক্রয় হয় যদিও তর্জমাগুলো অতি জঘন্য ও মূল আরবি হইতে একখানাও এযাবৎ হয় নাই। আবু সঈদ আইয়ুবের লেখা কোন বিদগ্ধ বাঙালি অবহেলা করেন? কিন্তু তিনি সৌন্দর্যতত্ত্ব সম্বন্ধে প্রবন্ধ লেখেন; মুসলমান জীবন অঙ্কিত করা বা মুসলমানি কৃষ্টি বা সভ্যতার আলোচনা তিনি করেন না। বাঙালি কবীরকে কে না চিনে?

মুসলমানদের উচিত কোরান, হদিস, ফিকাহ, মহাপুরুষ মুহম্মদের জীবনী (ইবনে হিশামের উপর প্রতিষ্ঠিত) মুসলিম স্থপতি শিল্পকলা ইতিহাস (বিশেষ করিয়া ইবনে খলুদন), দর্শন কালাম ইত্যাদি ইত্যাদি কত বলিব সম্বন্ধে প্রামাণিক, উৎকৃষ্ট সরল সস্তা কেতাব লেখা। লজ্জার বিষয় যে, ফারসিতে লিখা বাঙলার ভূগোল ইতিহাস বাহার-ই-স্তানে গাঙ্গবীর বাঙলা তর্জমা এখনও কেহ করেন নাই।

শুনিতে পাই কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ইসলামিক কালচর বিভাগ আছে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু অধ্যাপকেরা নানারকম পুস্তক প্রবন্ধ বাঙলায় লিখিয়া বিশ্ববিদ্যালয় নাম সার্থক করেন। মুসলমান অধ্যাপকেরা কি লেখেন? লিখিলে কি উজবেকিস্তানের ভাষায় লেখেন?

মুসলমানদের গাফিলি ও হিন্দুদের উপেক্ষা আমাদের সম্মিলিত সাহিত্যসৃষ্টির অন্তরায় হইয়াছে। দুইজন একই ভাষায় বলেন; কিন্তু একই বই পড়েন না। কিমাশ্চর্যমতঃপরম!

গুরুজনদের মুখে শুনিয়াছি গিরিশবাবুর কোরানের তর্জমা এককালে নাকি বহু হিন্দু পড়িতেন এবং তখন নাকি সে তর্জমার কদর হিন্দুদের মধ্যেই বেশি ছিল; কারণ মুসলমানরা তখনও মনস্থির করিতে পারেন নাই যে, কোরানের বাংলা অনুবাদ করা শাস্ত্রসম্মত কি না।

পরবর্তী যুগে মীর মশারফ হুসেন সাহেবের বিষাদসিন্ধু বহু হিন্দু পড়িয়া চোখের জল ফেলিয়াছেন (পুস্তকখানা প্রামাণিক ধর্মগ্রন্থ নহে; অনেকটা পুরাণ জাতীয়, বিস্তর অবিশ্বাস্য অলৌকিক ঘটনায় পরিপূর্ণ)। ইতোমধ্যে রবীন্দ্রনাথ লালন ফকিরের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করিলেন। পরবর্তী যুগে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন দত্ত, চারু বন্দ্যোপাধ্যায়, মণি গঙ্গোপাধ্যায় আরবি-ফারসি শব্দযোগে তাহাদের লেখায় কিঞ্চিৎ মুসলমানি আবহাওয়ার সৃষ্টি করিয়াছিলেন। শরৎ চট্টোপাধ্যায়ের উদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ইঁহারা লোকপ্রিয়তা হারাইলেন। তার পর আসিলেন নজরুল ইসলাম। সাধারণ বাঙালি হিন্দু তখন প্রথম জানিতে পারিলেন যে, মুসলমানরাও কবিতা লিখিতে পারেন; এমনকি উক্তৃষ্ট কবিতাও লিখিতে পারেন। কাজী সাহেবের কবিতার ব্যঞ্জন বুঝিবার জন্য প্রচুর হিন্দু তখন মুসলমান বন্ধুদের শহীদ কথার অর্থ, ইউসুফ কে, কানান কোথায় জিজ্ঞাসা করিয়াছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় কাজী সাহেব তাহার ধূমকেতু কাগজে মুসলমান সমাজের পঙ্কিল দিকটা যত না আক্রমণ করিলেন, তাহার অপেক্ষা বহু কম করিলেন ইসলামের সুন্দর ও মঙ্গলের দিকের বর্ণনা। ইতোমধ্যে মৌলানা আকরম খান প্রমুখ মুসলমান লেখকেরা ইসলাম ও তৎসম্বন্ধীয় নানা পুস্তক লিখিতেন। খুব কম হিন্দুই সেগুলো পড়িয়াছেন। এখনও মাসিক মোহাম্মদীতে ভালো ভালো প্রবন্ধ বাহির হয়, কিন্তু সাধারণ হিন্দু মোহাম্মদী কিনেন না; বিশেষত পদ্মার এপারে। সুখের বিষয়, মৌলবি মনসুরউদ্দীনের হারামণিতে সংগৃহীত মুসলমানি আউল-বাউল-মুরশিদিয়া গীত হিন্দু-মুসলমান শুণীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ লইয়া সঞ্চয়নখানি প্রকাশিত হয়।

.

০২.

সর্বজাতি-ধর্মবর্ণ মিলিত হইয়া ভারতবর্ষ স্বাধীনতা অর্জন করিবে ও সেই সম্মিলিত শক্তি পৃথিবীর মধ্যে স্থায়ী আসন লইয়া সত্য ও ধর্মের পথে চলিবে, কংগ্রেসের ইহাই মূলমন্ত্র। এ মন্ত্রে কংগ্রেস কখনও বিশ্বাস হারাইবে না, ও আজ যদি কোনও বিশেষ বর্ণকে নির্যাতন করিয়া অথবা কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের স্বার্থকে বলি দিয়া কংগ্রেস স্বরাজ পাইবার সম্ভাবনা দেখিতে পান, তবুও তাহা গ্রহণীয় মনে করিবে না।

উপস্থিত ভারতবর্ষের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় হিন্দু-মুসলমান সমস্যা ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি করিয়াছে। রাজনৈতিক চিন্তাধারায় বলিতেছি, কারণ আপামর জনসাধারণ এই সমস্যা দ্বারা কতটা বিক্ষুব্ধ হইয়াছে তাহার পরিমাণ দ্বিধাহীনরূপে আমাদের কাছে এখনও প্রকাশ পায় নাই।

মুসলমানদের কোনও কোনও নেতা বলেন, আমাদের ধর্ম পৃথক, আমাদের আদর্শ পৃথক, আমাদের অনুভূতির জগৎ পৃথক, আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা সব কিছুই পৃথক, এক কথায় আমরা আলাদা জাতি বা নেশান।

কংগ্রেস ইহা স্বীকার করেন না; বহু মুসলমানও করেন না। প্রায় সকল বিদেশি মুসলমানও ইহা অস্বীকার করিয়াছেন। বিশেষ করিয়া তুর্কি মুসলমানেরা। তাবৎ প্রাচ্যশক্তিরই বাসনা যে, ভারতবর্ষের সর্বজাতি মিলনের ফলে উপজাতি মহতী শক্তিই প্রাচ্য তথা বিশ্বের মঙ্গল আনয়ন করিবে।

হিন্দু-মুসলমান দুই পৃথক নেশন কি না তাহা দুই দৃষ্টিবিন্দু হইতে দেখা যাইতে পারে। এক, হিন্দু-মুসলমানের উপস্থিত চিন্তা অনুভূতি ও জীবনধারার পার্থক্যের হিসাবনিকাশ করিয়া মীমাংসা করা, তাহারা দুই পৃথক নেশন কি না; অথবা (দুই) ঐতিহাসিক দৃষ্টি দিয়া সিংহাবলোকন করা, অর্থাৎ ইতিহাস কি এই সাক্ষ্য দেয় যে অতীতে ভারতবর্ষের মুসলমানরা হিন্দু ও অন্যান্য জাতির সাহায্য-বর্জিত স্বকীয় বিশেষ কৃষ্টি, ঐতিহ্য সৃষ্টি করিয়া আপন নেশনত্ব উপভোগ করিতেছিলেন; আপন ভুবনে বাস করিতেছিলেন? ইংরেজ যেরকম আজ এই দেশে দুই শত বৎসর কাটাইয়াও আপন ভাষায় কথা বলে; আপন আহার করে ও করিবার সময় দেশের হ্যাম-বেকনের স্মরণে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে; আপন সঙ্গীত দেশের লোকের কর্ণকুহর প্রপীড়িত করিয়া উচ্চৈঃস্বরে গায়, এদেশের প্রখর আলো উপেক্ষা করিয়া নির্বিকার চিত্তে তাহার অন্ধকার দেশের মানানসই তীব্র বর্ণযুক্ত ওয়েলপেন্টিং দ্বারা এদেশের প্রাচীর প্রলেপন করে, অবকাশ পাইলেই ঊর্ধ্বশ্বাসে কালবিলম্ব না করিয়া হোম ছোটে, নয়াদিল্লিতে শিরঃপীড়া ও হৃদিত্রাস সঞ্চার স্থাপিত সৃষ্টি করে; নগরীর যত্রতত্র বেমক্কা মানুষকে ঘোড়ায় বসাইয়া প্রতিমূর্তি নির্মাণ করে; যতদূর সম্ভব আপন কাস্ট ক্লব করিয়া দেশের সামাজিক জীবন হইতে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখে; ও বিশেষ প্রাত্যহিক নিত্যকর্ম এমনভাবে করে যে, তদ্দর্শনে তাবৎ ভারতবাসী, কি হিন্দু, কি মুসলমান, কি শিখ সকলেই সচকিত হয়। নিন্দা করিতেছি না– পার্থক্য দেখাইতেছি মাত্র।

স্বীয় উক্তিতে মুসলমানরা নিজেকে যত পৃথকই ভাবেন না কেন, স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছি যে, তাহারা সায়েবদের মতো পাণ্ডববর্জিত পার্থক্য ধরেন না।

পার্থক্য আছে এবং অঙ্গাঙ্গী বিজড়িত সম্মিলিত সাহিত্য-কাব্য-ধর্ম প্রচেষ্টাও আছে। প্রথম ঐতিহাসিক দৃষ্টি দ্বারা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে এই দুইটির বিচার করা কর্তব্য। তৎপর দ্রষ্টব্য, ইতিহাস আমাদের ভবিষ্যৎ সর্বাঙ্গীণ মিলনের জন্য কোন আনন্দলোকের দিকে দিঙনির্ণয় করে।

ধর্মে দেখা যায় হিন্দু-মুসলমানে পার্থক্য আছে–অনৈক্য আছে কি না, তাহা পরে বিচার্য। ধর্মবিশ্বাসে হিন্দুর মতো উদার জাতি পৃথিবীতে আর নাই। হিন্দু বহু দেবতা মানিতে পারে না-ও মানিতে পারে; উপনিষদের আত্মন ব্রহ্ম একাত্মানুভূমিতে তাহার মোক্ষের সাধন করিতে পারে, না-ও পারে, গীতার পরমপুরুষকে উপেক্ষা করিয়া বৃন্দাবনের রসরাজকে হৃদয়আসনে বসাইতে পারে, না-ও পারে, সর্বভূতে দেবীকে শান্তিরূপে দেখিতে পারে, না-ও পারে; পূর্বজন্ম পরজন্ম মানিতে পারে নতুবা স্বৰ্গনরকে বিশ্বাস করিতে পারে অথবা উভয়ের সম্মিলনও করিতে পারে। এক কথায় হিন্দুর ধর্মবিশ্বাস কয়েকটি বিশেষ সজ্ঞাবদ্ধ সংকীর্ণ তত্ত্ব বা তথ্যে গণ্ডিবদ্ধ নহে। কিন্তু তবু আমরা অনায়াসে দৈনন্দিন জীবনে জানি কাহার ধর্মবিশ্বাস হিন্দুর ন্যায়, কাহার নহে।

মুসলমানরা ধর্মবিশ্বাসে কঠোর নিয়মের বশবর্তী। আল্লা এক কি বহু সে সম্বন্ধে কোনও মুসলমান আলোচনা করিতে সম্মত হইবেন না, মহাপুরুষ মুহম্মদ যে সর্বশেষ নবী (Prophet) সে বিষয়ে কোনও মুসলমানের সন্দেহ করিবার উপায় নাই। মৃত্যুর পর বিচার ও স্বর্গ অথবা নরক, এই তাহার নিঃসন্দেহ বিচার। ইহার যে কোনও একটি সিদ্ধান্তে বিন্দুমাত্র সন্দেহ প্রকাশ করিলে সে ধর্মচ্যুত বা কাফির হইয়া যায়।

ফল এই দাঁড়ায় যে, ধর্মসিদ্ধান্ত লইয়া পণ্ডিত যখন জ্ঞান সঞ্চয়ার্থে মৌলানার সঙ্গে তর্ক করিতে চাহেন, তখন তিনি কবুল জবাব দেন। (মৌলানার ঔদার্য অন্য স্থলে– তাহার আলোচনা অন্য প্রসঙ্গে হইবে।)

ইহাই একমাত্র কারণ, কেন মুসলমান আগমনের পরবর্তী সংস্কৃত সাহিত্যে মুসলমান ধর্মদর্শনের প্রভাব, চিহ্ন-নিশানা কিঞ্চিৎ মাত্র নাই। প্রক্ষিপ্ত অল্লোপনিষদ শুধু সাধারণ নিয়মের দিকে রূঢ় অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া আমাদের পরিতাপ বাড়াইয়া দেয়। অন্যদিকে মুসলমানদের ধর্মদর্শন আলোচনা এই ষড়দর্শনের দেশে এই মধুর ধর্মের দেশে নির্বিকার চিত্তে আপনার ঐতিহ্যানুসরণ করিল, অবহেলা করিয়া কী বিত্ত হারাইল বুঝিল না।

দুনিয়ার এই দুই বিরাট ধর্ম সাতশো বৎসর পাশাপাশি কালযাপন করিল অথচ একে অন্যকে সমৃদ্ধ করিল না– এ যেন জলের মধ্যে মীন তৃষ্ণায় কাতর রহিল!

কিন্তু পার্থক্য সত্ত্বেও ঐক্য আছে। খ্রিস্টধর্ম তাহার নাম দিয়াই খ্রিস্টের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। ইসলাম তাহার অত্যন্ত সরল অর্থের দিকে পুনঃপুন অঙ্গুলি নির্দেশ করে। সে অর্থ সকলেই জানেন। তাঁহাকে স্বীকার করিয়া স্পেন হইতে জাভা পর্যন্ত বহুমানব যুগে যুগে আত্মার শান্তি পাইয়াছে–ইসলাম অর্থাৎ শান্তির ধর্ম।

হিন্দুরাও সর্ব তর্ক, সর্ব আলোচনা, সর্ব পূজা, সর্ব উপাসনার পর বলেন শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ। নতমস্তকে বলেন, পৃথিবীতে শান্তি হউক, অন্তরীক্ষে শান্তি হউক; মুসলমানেরা বলেন ইহলোকে (দুনিয়া) শান্তি হউক, পরলোকে (আখিরা) শান্তি হউক।

তরবারির জোরে ইসলাম প্রচারিত হইয়াছিল এই হিংস্র নিন্দা ভারতবর্ষে প্রচার করে একদল দুষ্ট স্বার্থান্বেষী। সে আলোচনা অবান্তর বলিয়াই বারান্তরে।

হিন্দু-মুসলমানে সম্পূর্ণ, অখণ্ড মিলন হইয়াছিল অন্যান্য বহু প্রচেষ্টায়; সেগুলি ধর্ম ও দর্শন অপেক্ষা হীন তো নহে। বরঞ্চ কেহ কেহ বলেন, মানবসমাজে অধিকতর প্রয়োজনীয় বিশেষত অদ্যকার যুগে। ভাষা নির্মাণ, সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, স্থপতি, নৃত্য, বাদ্যযন্ত্র রাজনীতি অর্থনীতি বসনভূষণ, উদ্যাননির্মাণ, আমোদ-আহ্লাদ কত বলিব। এই সব প্রচেষ্টার পুণ্য, পূর্ণ ইতিহাস কেন, আংশিক ইতিবৃত্তও হয় নাই। যেদিন হইবে সেদিন সেই সুদর্শন পূর্ণাঙ্গ দেবশিশুকে হিন্দু-মুসলমান কর্তন করিতে চাহিবে এ বিশ্বাস আমাদের কিছুতেই হয় না।

আসল কথাটির পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন। সেটি এই : হিন্দুর ধর্মবিশ্বাস কয়েকটি বিশেষ সংজ্ঞাবদ্ধ সংকীর্ণ তত্ত্ব বা তথ্যে গণ্ডিবদ্ধ নহে বলিয়া তিনি সে বিষয়ে আলোচনা করিতে প্রস্তৃত। মুসলমানের দ্বিধাহীন একমত বলিয়া তিনি অসম্মত। ফলে উভয় ধর্মের শাস্ত্রীয় সংমিশ্রণ হয় নাই।

তবুও হয়তো কিঞ্চিৎ হইত যদি সামাজিক ক্ষেত্রে উভয়ে মিলিত হইতে পারিতেন। সামাজিক ব্যাপারে মুসলমান উদার। হিন্দুর সঙ্গে এক গৃহে বসবাস করিতে মুসলমানের কোনও আপত্তি নাই, একই পাকের ভাত, ডাল, মাছ, কাসুন্দি সকাল-সন্ধ্যা পরমানন্দে খায়– প্রশ্ন করে না কে রন্ধন করিয়াছে– একই সরোবরে স্নান করে, একই যানে ভ্রমণ করে এবং রুগণ হইলে বৈদ্যরাজকে ডাকা সম্পর্কে তাহার সম্পূর্ণ স্বরাজ। মৃত্যুর পর তাহাকে শ্মশানে গোর দিলেও তাহার ধর্মচ্যুতি হয় না।

অর্থাৎ মুসলমান বলে, শাস্ত্রচর্চা করিতে অসম্মত বটি, কিন্তু আইস একসঙ্গে বসবাস করি। হিন্দু বলে, বসবাস করিতে পারিব না, কিন্তু শাস্ত্রালোচনা করিতে প্রস্তুত। এক কথায় হিন্দু যেখানে উদার মুসলমান সেখানে সংকীর্ণ ও মুসলমান যেখানে উদার হিন্দু সেখানে সংকীর্ণ। অর্থাৎ উভয়ের জন্য বারোয়ারি চাঁদোয়া অথবা সর্বজনীন চন্দ্রাতপ নাই।

(দোষাদুষির কথা হইতেছে না। আমরা ইতিহাসের যে শিখরে দাঁড়াইয়া দিকনির্ণয়ের চেষ্টা করিতেছি, সেখানে হিন্দু-মুসলমানের স্বার্থ এমনি বিজড়িত যে, একে অন্যকে ধাক্কাধাক্কি করিলে উভয়েরই পতন ও অস্থিভঙ্গের সমূহ বিপদ অবশ্যম্ভাবী।)

উপরোল্লিখিত রোগনির্ণয় সাধারণ মোটামুটিভাবে করা হইল। কিন্তু ইহার ব্যত্যয়ও আছে ও সেই সম্পর্কে প্রথম বক্তব্য যে, উপরোল্লিখিত রোগ মৌলানা ও শাস্ত্ৰীমণ্ডলীর। দেশের হিন্দু মুসলমান জনসাধারণ শাস্ত্র লইয়া অত্যধিক শিরঃপীড়ায় ব্যতিব্যস্ত হয় না; পক্ষান্তরে অর্থনৈতিক চাপে পড়িয়া একে অন্যের সঙ্গে মিলিতে ও এমনকি বসবাস করিতেও বাধ্য হয় কিন্তু সে-প্রসঙ্গ এখনও উত্থাপিত করিবার সময় হয় নাই। দ্বিতীয় এই যে, শাস্ত্রালোচনা করিবার ঔদার্য শাস্ত্রীর আছে সন্দেহ নাই কিন্তু ভারতবর্ষে ট্রেড সিক্রেট জাতীয় একটি নিন্দনীয় ঐতিহ্য অর্ধ-পণ্ডিতদের ভিতরে আছে। যোগ ও তন্ত্র শিক্ষা করিতে যাঁহারাই চেষ্টা করিয়াছেন– হিন্দু-মুসলমান যিনিই হউন– তাঁহারাই জানেন যে, গুণীরা জ্ঞানদানে কী পরিমাণ পরাজুখ। ফলিত-জ্যোতিষ, আয়ুর্বেদ, প্রতিমা-নির্মাণ, সঙ্গীত জাতীয় অন্যান্য প্রত্যক্ষ ও প্রয়োজনীয় বিদ্যার কথা বাদই দিলাম। অবশ্য একটি কারণও আছে, তাহাকে শাস্ত্রাধিকার বলে। অপকূ পাত্রে যোগের ন্যায় অত্যুষ্ণ ঘৃত রাখিলে যে সে সহ্য করিতে পারিবে না তাহাতে আর কী সন্দেহ? কিন্তু ভুক্তভোগী মাত্রই অকপটচিত্তে স্বীকার করিবেন যে এই শাস্ত্রাধিকার লইয়া অর্ধদগ্ধ পণ্ডিতেরা– সত্যকার বিদগ্ধেরা নহেন অনেক সময় মাত্রাজ্ঞান হারাইয়াছেন ও যোগ্য ব্যক্তিকেও প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন।

গজনির বিখ্যাত মহমুদের সভাপণ্ডিত গুণীজন দ্বারা মহমুদ অপেক্ষা অধিক সমাদৃত অল-বিরুনি তাঁহার ভারতবর্ষ পুস্তকে এই লইয়া পুনঃপুন পরিতাপ করিয়াছেন। কিন্তু তাহার ধৈর্য ও জ্ঞানতৃষ্ণার প্রশংসা করিতে হয় ও যেসব পণ্ডিতের সঙ্গে তাঁহার যোগাযোগ হইয়াছিল, তাহাদের কয়েকজনকে তসলিম করিতে হয় যে, তাঁহারা অকৃপণভাবে জ্ঞানদান করিয়াছিলেন। না হইলে অল-বিরুনি ষড়দর্শন, রামায়ণ-মহাভারত, পুরাণ জ্যোতিষ ইত্যাদি নানা বিষয়ে লিখিতেন কী প্রকারে? (এই প্রসঙ্গ হয়তো পুনর্বার উত্থাপিত হইবে না, তাই একটি জিনিসের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার লোভ সম্বরণ করিতে পারিলাম না; অল-বিরুনি তাহার পুস্তকে মহাভারতের যে পর্ববিভাগ ও তাহাদের শিরোনামা দিয়াছেন, সেগুলির সঙ্গে অদ্যকার প্রচলিত মহাভারতের বিস্তর অনৈক্য দৃষ্ট হয়। এ বিষয় লইয়া কোনও গবেষণা এযাবৎ আমার দৃষ্টিগোচর হয় নাই বলিয়া গুণীজনের সহৃদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করিতেছি। Sachau-এর India নামক ইংরেজি অনুবাদ দ্রষ্টব্য।)

দুই ধর্মের চরম নিষ্পত্তি সম্মিলিত করিয়া হিন্দু-মুসলমানকে উচ্চাঙ্গ সাধনার ক্ষেত্রে মিলিত করিবার আর একটি প্রক্ষিপ্ত উদাহরণ দৃষ্ট হয়। সে উদাহরণটি এমনি ছন্নছাড়া, যূথভ্রষ্ট যে, বিশ্বাস হয় না এমন সাধনা সে-যুগে কী করিয়া সম্ভব হইল।

প্রাতঃস্মরণীয় রাজকুমার দারাশিকুহর কথা স্মরণ করিতেছি। কী অপূর্ব পাণ্ডিত্য ও অসাধারণ উপলব্ধির সম্মেলনে তাহার মুজম-ই বহরেন বা দ্বিসিন্ধুমিলন সৃষ্ট হইল। ১৮২০-৩০-এর সময় রাজা রামমোহন উপনিষদকে লোকচক্ষুর সম্মুখে আনিয়া ভারতে প্রখ্যাত হইলেন। তিনি ব্রাহ্মণসন্তান– কার্যটি তাঁহার পক্ষে অসম্ভব নয়। কিন্তু তাহার প্রায় দুইশো বৎসর পূর্বে পৃথিবীর সর্বাধিক বিলাসব্যসান মোগল রাজপরিবারের ফারসি-ভাষাভাষী সুকুমার রাজকুমার যৌবনের প্রারম্ভে কী করিয়া সংস্কৃতের বিরাট ভাণ্ডার হইতে এই অক্ষয়, অনাদৃত খনিটি কোন যোগবলে আবিষ্কার করিলেন? ব্রাহ্মণপণ্ডিত রাখিয়া তাহার অনুবাদ ফারসিতে করাইলেন পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন শাস্ত্রী মহাশয়ের নিকট হইতে শুনিয়াছি মূল পাণ্ডুলিপিতে নাকি দারার স্বহস্তে কৃত শুদ্ধি সম্মার্জন মার্জিনে আছে। সেই ফারসি তর্জমা জেসুইয়ট দ্য পেরো লাতিনে অনুবাদ করেন এবং সেই অনুবাদ জানি না কী করিয়া জর্মন দার্শনিক শোপেনহাওয়ারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কান্টের দেশের লোক, প্লেটোর ঐতিহ্যে সঞ্জীবিত, হেগেলের সমসাময়িক এই দর্শনার্ণনের জর্মন কর্ণধার বলিলেন, উপনিষদ আমার জীবনে শান্তি আনয়ন করিয়াছে। তার পর জর্মনি ও পরে ইউরোপে হুলস্থুল পড়িয়া গেল। উপনিষেদের খেই ধরিয়া নানা পণ্ডিত নানা সংস্কৃত জৰ্মনে তর্জমা করিলেন– সর্বত্র ভারতীয় বিদ্যা ছড়াইয়া পড়িল। কিন্তু সেকথা আজ থাক। অনুসন্ধিৎসু এই লোমহর্ষক লুপ্তগৌরব প্রত্যর্পণকারিণী কাহিনী জর্মন পণ্ডিত বিন্টারনিৎস (Winternitz) ও শ্রীযুক্ত রাধাকৃষ্ণণের ঈস্টার্ন আইডিয়ালিজম্ ও বেস্টার্ন থট পুস্তকে পাইবেন।

দারাশিকুহ’র দ্বিসিঙ্কুমিলনে তিনি ইসলামের সাধনামণি সুফিতত্ত্ব ও হিন্দু দর্শনের চিন্তামণি বেদান্ত তাহার জ্ঞানকাঞ্চনাঙ্গুরীয়তে একাসনে বসিয়া যে রশ্মিধারার সম্মেলন করিলেন, হায়, তাহা দেশের তমসান্ধকারকে বিদ্ধ করিতে সমর্থ হইল না।

কিয়ৎকাল পরেই প্রলয় প্রদোষে মোগলের উষ্ণীষশীর্ষ প্রস্ফুরিত হইতে লাগিল, শবলুব্ধ গৃধীদের বীভৎস চিল্কারের মধ্যে যোগাঙ্গুরীয় কোন অন্ধকারে বিস্মৃত বিলুপ্ত হইল।

পুনর্বার ক্ষীণচেষ্টা দেখা গেল– সুভাষচন্দ্র তাহার পুস্তকে সে প্রচেষ্টার উল্লেখ করিয়াছেন কিন্তু তখন বিদেশি আসিয়াছে। সেই কথার উল্লেখ করিয়া একদিন লিখিয়াছিলাম।

তার পর? তার পর লজ্জা ঘৃণা পাপ
অপমান; প্রকাশিল অন্তহীন শাপ

হিন্দু-মুসলমান ক্ষত্রিয়েরা যখন ১৮৫৭ সালে পুনরায় সম্মিলিত হইয়া সফল হইলেন না তখন তাহাই উদ্দেশ করিয়া লিখিয়াছিলাম।

যুগ ক্ষাত্রতেজে তার পাপ প্রক্ষালন
চেষ্টা হল ব্যর্থ যবে। করিল বরণ
ভেদমন্ত্র ছিদ্রান্বেষী পরম্পরাঘাত
হইল বিজয়টিকা সে অভিসম্পাত।

.

ভাই ভাই ঠাই ঠাঁই
না
ভাই ভাই এক ঠাঁই?

ভারতীয় কৃষ্টি ও সভ্যতা সম্যক হৃদয়ঙ্গম করিবার চেষ্টা সর্বপ্রথম করেন অল-বিরুনি ও পরবর্তী যুগে হিন্দু-মুসলিম উভয় সাধনার যে চরম উৎকর্ষ বেদান্ত ও সুফি মতবাদে বিদ্যমান, তাহাদের মিলন ঘটাইবার চেষ্টা করেন রাজকুমার দারাশিকুহ। আমরা বারান্তরে তাহার উল্লেখ করিয়াছি।

এক্ষণে যে স্থলে উপস্থিত হইয়াছি সেখানে প্রশ্ন ওঠে, আর কি ভাই ভাই ঠাই ঠাই বলা চলে, না এখন বরঞ্চ বলিব ভাই ভাই এক ঠাই?

এই সম্পর্কে একটি উদাহরণ নিবেদন করি।

খ্রিস্টানরা যেরকম এদেশে সিরিয়ন ক্যাথলিকবাদ, রোমান ক্যাথলিকবাদ এবং প্রোটেস্টান্ট ধর্মের নানা চার্চ বা মতবাদ স্ব স্ব ধর্মবিশ্বাসানুযায়ী প্রচলিত করিবার চেষ্টা করেন, মুসলমানরাও সেইরূপ সুন্নি, শিয়া ও অন্যান্য নানারকম মজহব (Seeds) প্রচলন করার চেষ্টা করেন। ভারতবর্ষে পাঠান রাজত্ব সর্বত্র পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হইবার বহু পূর্বে মুসলিম অবৈতনিক মিশনারিরা এদেশে স্ব স্ব ধর্মমত প্রচার করিবার প্রয়াস করেন ও বেশিরভাগ সমুদ্রযোগে ভারতবর্ষের পশ্চিম উপকূলে, অর্থাৎ সিন্ধু দেশ হইতে কেপ কমরিণ পর্যন্ত কর্মস্থল বিস্তৃত করেন।

যাহারা ফিটজিরাল্ড কৃত ওমর খৈয়ামের ইংরেজি অনুবাদের উপক্রমণিকাটি মনোযোগ দিয়া পড়িয়াছেন তাহাদের স্মরণ থাকিবে যে, ওমর খৈয়ামের বন্ধু হিসাবে আরেকটি লোকের নাম তাহাতে উল্লেখ করা হইয়াছে– সে নাম হাসন বিন্ সব্বার। এই হাসন সব্বা স্বধর্ম ও স্বাধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করিবার মানসে পারস্যে এক ভয়ঙ্কর গুপ্তঘাতকদের প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন; সেই ঘাতকদের নাম হশিশিয়ুন এবং হশিশিয়ুনরা ক্রুসেডের নাইটদের মধ্যে এমনই আতঙ্কের সৃষ্টি করে যে, সেই হশিশিয়ুন শব্দ ল্যাটিনের ভিতর দিয়া ইতালির assassino হইয়া, ফরাসি assassin-এ রূপান্তরিত হইয়া ইংরেজিতে সেই বানানেই প্রচলিত আছে। হানন সব্বা পারস্যে আপন কর্মভূমি সীমাবদ্ধ করেন নাই। বিদেশে স্বমত সুপ্রতিষ্ঠিত করিবার বাসনায় গুজরাটে তিনি মিশনারি প্রেরণ করেন। তাঁহাদেরই একজন লোহানা রাজপুতদিগের মধ্যে অ্যাসাসিনদের শিয়া ধর্ম প্রচার করেন। ইহারা বর্তমানে পশ্চিম ভারতে খোঁজা সম্প্রদায় নামে সুপরিচিত। কলিকাতার রাধাবাজারে ইঁহাদের কাহারও কাহারও কাপড়ের দোকান আছে।

এস্থলে শিয়া-সুন্নি মতবাদ লইয়া আলোচনা করা নিষ্প্রয়োজন। ততোধিক নিষ্প্রয়োজন শিয়াদের বিভিন্ন সম্প্রদায় ও তাহাদের পার্থক্য লইয়া বাক্যব্যয় করা। শুধু এইটুকু বলা প্রয়োজন যে, হাসন সব্বার মতবাদী খোঁজা মুসলমানরা উত্তর ভারতের শিয়া হইতে ভিন্ন; উত্তর ভারতের শিয়ারা ইসনা আশারি অর্থাৎ বারোজন শুরুতে বিশ্বাস করেন, খোঁজারা ইসমাইলি অর্থাৎ ইসমাইলকে শেষ প্রধান গুরু হিসাবে বিশ্বাস করেন। অনুসন্ধিৎসু পাঠক এই সব বিভিন্ন মতবাদের আংশিক ইতিহাস এনসাইক্লোপিডিয়া অব রিলিজিয়ন অ্যান্ড এথিকস এবং পূর্ব ইতিহাস এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলামে পাইবেন।

লোহানা রাজপুতরা বৈষ্ণব ধর্মে বিশ্বাস করিতেন ও সম্ভবত পঞ্চরাত্র সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন (Schrader-এর আজিয়ার হইতে প্রকাশিত পাথরাত্র সিস্টেম দ্রষ্টব্য)। কিন্তু বৈষ্ণব যে ছিলেন সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই–কারণ তাঁহারা বিষ্ণুর দশ অবতারে বিশ্বাস করিতেন।

অদ্যকার খোঁজাদের মধ্যে কুরান শরিফের প্রচলন নাই। তাঁহাদের ধর্মগ্রন্থগুলি আংশিক কচ্ছের উপভাষায় ও আংশিক গুজরাতিতে লেখা। সেগুলি গিনান। (সংস্কৃত জ্ঞান) নামে প্রচলিত ও তাহাদের মধ্যে দশাবতার পুস্তক বা গিনান সর্বাধিক সম্মান পায়। লোহানা রাজপুতদিগকে যে মিশনারি ইসমাইলি শিয়া মতবাদে দীক্ষিত করেন সেই নুর-সৎ-গুর (নুর আরবি শব্দ রশ্মি অর্থে ও সৎগুর সৎগুরু হইতে) দশাবতারের প্রণেতা। খোঁজারা সাধারণ মুসলমানদের মসজিদে যান না, তাহাদের স্বতন্ত্র জমাতখানা বা সম্মেলন গৃহে জমায়েত হন। বিশেষ পর্ব উপলক্ষে দশাবতার পঠন হয়, প্রথম নয় অবতার মৎস্য, কূর্ম, বরাহ ইত্যাদি তাঁহারা উপবিষ্ট হইয়া শ্রবণ করেন; কিন্তু দশমাবতারের কাহিনী আরম্ভ হইলে তাহারা দণ্ডায়মান হন।

এই দশমাবতার লইয়া বৈষ্ণব ও খোঁজার পার্থক্য। বৈষ্ণবমতে দশমাবতার কল্কি, খোঁজামতে দশমাবতার বহুকাল হইল মক্কায় জন্মগ্রহণ করিয়াছেন– তিনি মহাপুরুষ মুহম্মদের জামাতা হজরত আলি। (পাঠককে এইস্থলে স্মরণ করাইয়া দেই যে, গোঁড়া শিয়ারা আলিকে মহাপুরুষ মুহম্মদ অপেক্ষা সম্মান প্রদর্শন করে ও আদালুসের ইবনে হাজমের মতে এমন শিয়াও আছেন যাঁহারা বলেন, দেবদূত = ফিরিস্তা জিবরাইল = Gabriel ভ্রমবশত কুরান শরিফ হজরত আলিকে না দিয়া হজরত মুহম্মদকে দিয়া ফেলেন!!! এবং আরও বিশ্বাস করেন যে, হজরত আলির মৃত্যুর পর তাঁহার আত্মা তাঁহার পুত্র হাসন তৎপর তাঁহার ভ্রাতা হুসেন, তৎপর জয়ন উল-আবেদিন তৎপর তাঁহার পুত্র হইয়া বংশানুক্রমে চলিতে চলিতে বর্তমান জীবিত ইমাম বা গুরুতে বিরাজমান বর্তমান গুরুর নাম পরে উল্লেখ করিব।

খোজারা অর্ধ-কচ্ছী-উপভাষা ও অর্ধ-গুজরাতিতে উপাসনা করেন– তাহাকে নামাজ বলিলে ভুল বোঝানো হইবে। রমজান মাসে খোঁজারা উপবাস করেন না। হজ করিতে মক্কায় যান না– বর্তমান ইমাম বা গুরু দর্শনে হজের পুণ্যসঞ্চয় বলিয়া বিশ্বাস করেন। গরিব দুঃখীকে জকাত বা ধৰ্মাদেশানুযায়ী ভিক্ষা দেন না, সে অর্থ গুরু দ্বারা প্রচলিত প্রতিষ্ঠানকে দেন। খোজারা পাঁচবারের পরিবর্তে তিনবার উপাসনা করেন এবং সুন্নি ও শিয়া মত হইতে তাঁহাদের ধর্মবিশ্বাসে অন্যান্য বহু অনৈক্য দৃষ্ট হয়।

খোজাদের গিনান বা ধর্মগ্রন্থগুলি পড়িলে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, অ্যাসাসিন মিশনারিরা হিন্দু এবং শিয়া মতবাদের সম্মেলনে এক নতুন ধর্ম সৃষ্টি করিয়া তাহাতে তাবৎ ভারতীয়দিগকে দীক্ষিত করিতে চেষ্টা করেন। এই দৃষ্টান্তটি বিশেষ উল্লেখ করিলাম কারণ ইহা শিয়াদের পক্ষ হইতে করা হইয়াছিল। ইহার পর ভাষা নির্মাণে কাব্য সৃষ্টিতে বিভিন্ন রসবস্তু সম্মেলনে যেসব প্রচেষ্টা হইয়াছিল তাহা অধিকাংশ সুন্নিদের দ্বারা।

গুজরাতে মতিয়া সম্প্রদায়ও বিবাহের সম্বন্ধে ব্রাহ্মণকে নিমন্ত্রণ করেন; কিন্তু মৃত্যুর পর শব কবরস্থ করিবার জন্য মোল্লার কাছে আরজি পেশ করেন। পশ্চিম উপকূলে এইরূপ নানা সংমিশ্রণের চিহ্ন সর্বত্র পাওয়া যায়।

এইসব চেষ্টার ফলেই ১৭৫০ সালে লিখিত গুজরাতের ফারসি ইতিহাস মিরাত-ই অহমদিতে দেখা যায় যে, হিন্দু-মুসলমানে সাম্প্রদায়িক কলহ তখন প্রায় শেষ হইয়া গিয়াছে। লেখক আলি মুহম্মদ খান তাহার হাজার পাতার (মুদ্রিত) পুস্তকে যে দুই একটি কলহের উদাহরণ দিয়াছেন সেগুলি তিনি সাধারণ নিয়মের ব্যত্যয় রূপেই উদ্ধৃত করিয়াছেন।

খোজাদের বর্তমান গুরু হিজ হাইনেস দি আগা খান।

.

ভাই ভাই এক ঠাঁই

০১.

বারান্তরে হিন্দু-মুসলিম শাস্ত্রীয় মিলনের ফলে উপজাত খোঁজা মতবাদের উল্লেখ করিয়াছিলাম। এক্ষণে যেস্থলে উপস্থিত হইয়াছি, তাহার সম্মুখে মিলনের সুধা-শ্যামলিমদিগ্‌দিগন্ত বিস্তৃত– তাহার পুণ্য পরিক্রমা আরম্ভ করিব, এমন সময় একটি অতি আধুনিক ঘটনার দিকে আমাদের চিত্ত আকৃষ্ট হইয়াছে। কালানুপূর্বের ধারাবাহিকতার প্রতি অত্যধিক নিষ্ঠা প্রদর্শন না করিয়া অসময়ে প্রসঙ্গটির অবতারণা করিব, কারণ বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিবিন্দু হইতে অসাময়িক হইলেও অবান্তর নহে।

গত মঙ্গল-শুক্রবারে*[* ১৯৪৫ সালের নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ।] যখন কলিকাতার ছাত্রসমাজ ও বহু বাঙালি-অবাঙালি স্বৈরতন্ত্রের প্রতিবাদ করিয়া আন্তরিক বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন, তখন অনেকেই হয়তো আশা করিবার সাহস রাখেন নাই যে, মুসলমানেরা, বিশেষত মুসলমান ছাত্রসমাজ ইহাতে যোগদান করিবেন। আমরা নিম্নলিখিত সম্পাদকীয় স্তম্ভটি পাঠকের গোচর করিতেছি।

A large number of Muslim students participated in the recent disorders in Calcutta. One of them lost his life, and many received injuries, serious and light. The student of the Islamia College went on strike in sym pathy with their Hindu fellow students and in protest against the firing and lathi charge by the police. The vice-president of the College Union presided over a huge meeting which passed appropriate resolutions. Large numbers of Muslims, other than students, also took part in the demonstrations. Many non-Muslims wonder why these Muslims have taken this attitude. The answer is not difficult to find. It is the Muslim way, the result of over 13 centuries of teaching expressed in the practice of the precepts laid down in the holy Quran and the traditions of the prophet Muhammad : Love your neighbours, side with him that is weak, oppressed or ill-used, serve Allah by serving his creatures; the true Muslim is represented in his two little things, his heart and his tongue.

এতদিন ধরিয়া আমরা ঠিক এই কথাটিই বলিবার চেষ্টা করিতেছিলাম। সর্বধর্মের মূলতত্ত্ব সমান, আমরা সকলে একথা স্বীকার করি; কিন্তু আচার-ব্যবহারে অশন-বসনে সেই তত্ত্বগুলি যখন প্রকাশ পায়, তখন অনেক সময় এমন বিকৃত রূপ ধারণ করিয়া পীড়াদায়ক হইয়া উঠে যে, তখন মানুষ শুধু সেই মানুষগুলির আচরণের নহে তাহাদের ধর্মের উপরও দোষারোপ করিতে থাকে। সবিস্তর নিবেদন করি :

ইংরেজরা এদেশে খ্রিস্টধর্ম আনয়ন করেন। খ্রিস্টধর্ম মৈত্রী ও ক্ষমার ধর্ম। কিন্তু দেড়শত বৎসর খ্রিস্টধর্ম প্রচারের পরও এদেশে দেখি, দিশি খ্রিস্টানের স্বতন্ত্র ধর্মালয়, শ্বেত খ্রিস্টানের স্বতন্ত্র ধর্মালয়, আহার-বিহার সামাজিক গণ্ডি স্বতন্ত্র, এমনকি মৃত্যুর পাণ্ডুহস্ত স্পর্শেও কৃষ্ণ-খ্রিস্ট ধবল হয় না; তাহার জন্য স্বতন্ত্র গোরস্তান। ইংরেজ শাসকের স্বৈরতন্ত্র মুসলমান শাসকের এখতেয়ারি অপেক্ষা সর্বাংশে অধিক, চর্মদাহে মর্মদাহে তাহা বার বার অনুভব করিয়াছি ও করিতেছি। কিন্তু তাহাদের সর্বপ্রকার সাহায্য সত্ত্বেও খ্রিস্টধর্মের ন্যায় উদার ধর্ম, এদেশে সসম্মানে বরিত ও নন্দিত হইল না। ধর্মপিপাসু মন বার বার শুধায়, ক্রটি কোনখানে? হয়তো যাহারা বাহকরূপে আসিয়াছিলেন, তাঁহারা ধর্মের সত্য সেবক ছিলেন না।

তাই বলি এদেশের মুসলমান ধার্মিক। ব্যাপক অর্থে ধার্মিক। তিনি আরব-তুর্ক-মোগল বিজেতাদের জন্য স্বতন্ত্র ধর্মাগার, ভোজনাগার, অনন্ত-শয্যাগার নির্মাণ করেন নাই। তিনি স্বধর্ম পালন করিয়া হিন্দুর প্রতিবাসী হইয়াছেন। বিদেশি-শকট-যুগ যখন হিন্দু-মুসলিমের যুগ্ম-স্কন্ধকে চরম মর্দনে প্রপীড়িত করিল, তখন বর্ণ-ধর্ম ভুলিয়া দুই নিরীহ বলীর্বদ যুগ্ম-পদাঘাতে শকটারোহীকে সচেতন করিয়া দিল।

উপরোদ্ধৃত সম্পাদকীয় স্তম্ভের লেখক ইসলামের মূলনীতি হৃদয় দিয়া অনুভব করিয়াছেন, সজোর লেখনী সঞ্চালনে প্রকাশ করিয়াছেন।

We do not blame the action of the students, for that matter, the action of the other Muslims who took part in the demonstrations; but it is the students in particular whom we are addressing. We commend their action and admire it, Furthermore, we thoroughly under stand the noble motives which have actuated them.

এ সত্য মুসলমানদের কথা! এ সত্য মানুষের কথা! ধর্মের কথা ন্যায়ের কথা! এই ভাই কোন ভিন্ন ঠাই যাইবে?

কিন্তু,

The Muslim students know fully well that their life and future are in jeopardy in a country where though a hundred million, the Muslim are in a minority. They realise the designs against them as Muslims.

মুসলমানদের ভীত হইবার কারণ আছে কি না সে প্রশ্ন আমরা কেন জিজ্ঞাসা করিব? কারণ লেখক নিজেই ভীত হন নাই– ভীত হইয়া স্বধর্মীয়দিগকে গণঅভিযান হইতে পশ্চাৎপদ হইতে বলেন নাই; নিজেই বলিতেছেন :

Still they have not hesitated to plunge into the fury, why? It is the Muslim way. Their hearts told them the I. N. A. trial was unjust. The lathi charges were brutal, the firing absolutely unjustified. It was their bound en duty to sympathise. Their hearts, brimful with the sublime teachings of Islam made them translate their sympathy into action. Some of them fell, side by side, with those who, perhaps not in person, represented the terrible menace to Islam and Muslim in India.

It was the Muslim way, most nobly expressed.

আমেন। তথাস্তু!

আমাদের তো বলিবার আর কিছুই নাই। সাহস পাইলাম, ভরসা পাইলাম, যে দিন স্বাধীনতা সংগ্রামের শঙ্খধ্বনি ভারতবর্ষ প্রকম্পিত করিবে, সেদিন তাহার রুদ্রমন-চেষ্টা পুনর্বার ক্রুর বুধ-শুক্র রূপ ধারণ করিবে, সেই শুভদিনে প্রতিবাসী যখন প্রতিবাসীর দিকে হস্ত প্রসারণ করিবে সেদিন তরুণ মুসলিম, প্রবীণ মুসলিম মুসলিম-ওয়ে মুসলিম-পন্থায় দৃঢ় পদক্ষেপে অগ্রসর হইবে– তাহার বিরুদ্ধে কি design কি menace ভুক্ষেপ মাত্র করিবে না।

.

০২.

এতদিন যাবৎ হিন্দু-মুসলমান কৃষ্টির যেসব স্থলে যোগ হয় নাই তাহারই উল্লেখ করিতেছিলাম। দেখিলাম সাতশত বৎসর ধরিয়া ভট্টাচার্য টোলে সংস্কৃত ঐ তিহ্য সঞ্জীবিত রাখিলেন, কিন্তু ইসলামের নিকট হইতে কোনও ঋণ গ্রহণ করিলেন না; মৌলানা আরবি-ফারসি জ্ঞানচর্চা করিলেন, কিন্তু ভট্টাচার্যের দ্বারস্থ হইবার প্রয়োজন বোধ করিলেন না।

অর্থাৎ শাস্ত্রীয় হিন্দুধর্ম, মুসলমান ধর্ম, হিন্দু দর্শন, মুসলমান দর্শন একে অন্যকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া জীবিত রহিল।

কিন্তু ইহাই কি শেষ কথা? ভারতবর্ষের কোটি কোটি হিন্দু-মুসলমান চাষা মজুর শতকরা কয়জন ইহাদের মুখের দিকে চাহিয়া জীবনযাপন করিয়াছে, তাহাদের সুখ-দুঃখ, আশা-আদর্শ একে অন্যের সাহায্য লইয়া তাহারা কি পণ্ডিত-মৌলবিকে উপেক্ষা করিয়া প্রকাশ করে নাই? ভট্টাচার্য তাঁহার দেবোত্তর জমি ও মৌলানা ওয়াকফদত্ত সম্পত্তি উপভোগ করিতেন, উভয়ের উপর এমন কোনও অর্থনৈতিক চাপ ছিল না যে বাধ্য হইয়া একে অন্যের দ্বারস্থ হন। কিন্তু মুসলমান চাষা তো দম্ভ করিতে পারে নাই যে হিন্দু জেলেকে সে ধান বেচিবে না, হিন্দু জোলা তো এ অহংকার করিতে পারে নাই যে মুসলমানকে কাপড় না বেচিয়াও তাহার দিন গুজরান হইবে।

শাস্ত্রী ও মৌলানা যেসব কারণবশত সর্বজনীন চন্দ্রাতপতলে একত্র হইতে পারিলেন না, সেসব কারণ তো চাষামজুরের জীবনে প্রযোজ্য নহে। ব্রহ্ম এক কি বহু, সগুণ কি নিগুণ– তাহা লইয়া সে হয়তো অবসর সময়ে কিছু কিছু চিন্তা করে, কিন্তু এসব তো তাহার কাছে জীবনমরণ সমস্যা নহে– এমন নহে যে, ওই সম্পর্কে কলহ করিয়া একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রাখিবে না। তাহার উপর অর্থনৈতিক চাপ নির্মম চাপ, যাহাকে বলে অন্নচিন্তা চমৎকারা। তাই দেখিতে পাই মোল্লা-মৌলবির বারণ সত্ত্বেও মুসলমান চাষা জানিয়া-শুনিয়া হিন্দুকে বলির জন্য পাঠা বিক্রয় করে, পয়সা রোজগারের জন্য বিসর্জনে ঢোল বাজায়; হিন্দু গয়লা মুসলমান কসাইকে এঁড়ে বাছুর বিক্রয় করে। এই কোটি কোটি হিন্দু-মুসলমান শব্দার্থে পাশাপাশি বাস করিয়াছে। একে অন্যের সুখ-দুঃখের ভাগ লইয়াছে। আশা-আকাঙ্ক্ষার সন্ধান পাইয়াছে। সেসব কি তাহারা ধর্মে, লোকসাহিত্যে, গানে, ছবিতে প্রকাশ করে নাই? যদি করিয়া থাকে তবে তাহা পুস্তকাবদ্ধ নস্যসিক্ত শাস্ত্রালোচনা, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ধর্ম ও দর্শনালোচনা অপেক্ষা অনেক সত্য, অনেক জীবন্ত। লক্ষ কণ্ঠে গীত কবীরের ধর্মসঙ্গীত, ষড়দর্শন ও ইলমুলকালাম হইতে লক্ষগুণে নমস্য।

হিন্দু-মুসলমান জনসাধারণের যুগ্ম চেষ্টায় ভারতবর্ষে গত সাতশত-আটশত বত্সর ধরিয়া যে-কৃষ্টি যে-সভ্যতা নির্মিত হইয়াছে তাহা পৃথিবীর ইতিহাসে অপূর্ব। কি ধর্মে, কি ভাষা নির্মাণে, কি সাহিত্য-সৃষ্টিতে, কি সঙ্গীতে, কি নৃত্যে, কি বিলাস-সামগ্রী নির্মাণে, তৈজসপত্রে– কত বলিব? ইহারা যে প্রাণশক্তির পরিচয় দিয়াছে, দানে-গ্রহণে যে অকৃপণতা দেখাইয়াছে তাহা আবার বিশেষ জোর দিয়া বলি– সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসে অপূর্ব, সমগ্র জগতের কল্পনার অতীত। ভারতের হিন্দু-মুসলমান যাহা করিতে সক্ষম হইয়াছে তাহা পৃথিবীর কোনও দুই ধর্ম কস্মিনকালেও করিতে পারে নাই। এই প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত কথা তোলা অনুচিত, কিন্তু যে-বিষয়ে অধম গত পঁচিশ বৎসর সমস্ত শক্তি নিয়োগ করিয়াছে তাহার সম্যক মূল্য বুঝিবার জন্য সে দেশে-বিদেশে সর্বত্র সর্বপ্রকার লোকসঙ্গীত ও অন্যান্য জনপদকলা আকণ্ঠ পান করিয়াছে, আকর্ণ-বিস্ফারিত চক্ষে দেখিয়াছে। সহৃদয় পাঠক ক্ষমা করিবেন, কিন্তু অধর্মের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাজনিত দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের দেশের লোকসঙ্গীতের কাছে ইউরোপের তথা অন্যান্য প্রাচ্যদেশের (চীনের কথা বলিতে পারি না) কোনও লোকসঙ্গীত দাঁড়াইতে পারে না, না, না।

অতএব আমাদের কর্তব্য এই আটশত বৎসরের সর্বপ্রকারের জনপদ-প্রচেষ্টা খুঁটিয়া খুঁটিয়া চিরিয়া চিরিয়া পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান করা, লিপিবদ্ধ করা, কলের গানে রেকর্ড করা, ইতিহাস লেখা ও সর্বশেষে তাহাকে অর্থনৈতিক রাজনৈতিক দৃষ্টিবিন্দু হইতে পর্যবেক্ষণ করিয়া স্কুলে-কলেজে পড়ানো।

আবার বলিতেছি স্কুল-কলেজে পড়ানো। ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অর্থনৈতিক স্থপতি যদি সুপ্রতিষ্ঠিত করিতে হয় তবে ইহাই হইবে তাহার সুদৃঢ়, অচল-অটল ভিত্তি। শিখর, মিনার কে নির্মাণ করিবেন, কোন দর্শন, কোন শাস্ত্রীয় ধর্ম দিয়া– সে আলোচনা পরে হইবে।

কিন্তু যে কর্মটির প্রতি সহৃদয় পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করিলাম তাহা তো একজন, শতজন, হাজারজনের অক্লান্ত পরিশ্রমেরও বাহিরে। এত লোকসঙ্গীত, স্থপতি, চিত্র, সঙ্গীত, নৃত্য ভারতের গ্রামে গ্রামে গৃহে গৃহে সর্বত্র হজ্যোতি হইয়া মৃতপ্রায়, তাহাকে সংগ্রহ করিবার জন্য নেতৃত্ব করিবেন কে?

আমাদের পরম সৌভাগ্য, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ আমাদিগকে পথ দেখাইয়া গিয়াছেন। বিশ্বের সর্বত্র রাজাধিরাজের সম্মান পাইয়াও এই কবি লালন ফকিরকে উপেক্ষা করেন নাই, হাসন রাজার গান গাহিয়া বিদগ্ধ দার্শনিকমণ্ডলীর সম্মুখে অবতরণ করিলেন।

মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমীন,
কানেতে করিল পয়দা মুসলমানি দীন
নাকে পয়দা করিয়াছে খুশবয় বদবয়
আমা হইতে সব উৎপত্তি হাসন রাজায় কয়।

(কাশীতে প্রদত্ত দার্শনিক সম্মেলনে রবীন্দ্রনাথের অভিভাষণ দ্রষ্টব্য)।

পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেনের দৃষ্টি এদিকে পূর্বে আকৃষ্ট হইয়াছিল। রবীন্দ্রনাথের সহৃদয় উৎসাহে তিনি এই কর্মে আরও মনোযোগ করিলেন, বহু অমূল্য লুপ্তধন সঞ্চয় করিলেন। দেশের লোক তাহা প্রকাশের অপেক্ষায় রহিয়াছে। ভগবান তাঁহাকে দীর্ঘজীবন দান করুন।

ভারতবর্ষের লোকসংগীত লইয়া চর্চা করিতে হইলে উত্তর-ভারতীয় অনেকগুলি ভাষা উপভাষার পণ্ডিত হইতে হয় ও এইসব সঙ্গীতের পশ্চাতে যে সংস্কৃত ও ফারসিতে লিখিত ও গীত ভক্তি-সুফি-বেদান্ত-যোগবাদ রহিয়াছে তাহার সম্যক জ্ঞানের প্রয়োজন।

অধমের নাই। বাহির হইতে যেটুকু সামান্য দেখিয়াছি তাহাই নিবেদন করিবার চেষ্টা করিব। সহৃদয় পাঠককে সাবধান করিয়া দিতেছি, আলোচনা অতি অসম্পূর্ণ ও দোষত্রুটিতে কণ্টকিত থাকিবে। এবং ইতোমধ্যে অন্য কেহ যদি আলোচনাটি আরম্ভ করেন তবে অধম তাঁহাকে সশ্রদ্ধ নমস্কার নিবেদন করিয়া পরমানন্দে শ্রোতার আসনে গিয়া বসিবে।

.

০৩.

পূর্বের প্রবন্ধে সামান্য আভাস দিয়াছিলাম যে, ভারতবর্ষীয় লোকসঙ্গীতের মূল্য ও তাৎপর্য সম্যক হৃদয়ঙ্গম করিতে হইলে বেদান্ত, যোগ, ভক্তিবাদ ও সুফিতত্ত্ব সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ জ্ঞান থাকার প্রয়োজন।

সুফিবাদ (ভক্তি, যোগ ও mysticism-এর সমন্বয়) ভারতবর্ষে আসে পারস্য হইতে ও এদেশের দর্শন ও ভক্তিরস ইহাকে পরিপুষ্ট করে। কিন্তু এ সম্বন্ধে আলোচনা করিবার পূর্বে আরেকটি বিষয়ের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্য আকর্ষণ করিব।

১৯১৮-র যুদ্ধে যখন ফ্রান্স ও জর্মনি ক্লান্ত, তখন পণ্ডিত-মহলে দ্বিতীয় যুদ্ধ আরম্ভ হইল। সে যুদ্ধ সুফিবাদ লইয়া। একদিকে ফ্রান্সের বিখ্যাত পণ্ডিত মাসিনা, অন্যদিকে জর্মনির তদপেক্ষা বিখ্যাত পণ্ডিত গড়ৎসিহার ও তস্য শিষ্য হতেন। মাসিনো পক্ষ বলিলেন, ইরানের সুফিবাদের উপর ভারতবর্ষীয় কোনও প্রভাব পড়ে নাই, যেটুকু পড়িয়াছে তাহা সুফিবাদ ভারতবর্ষে আসিবার পর। অন্যপক্ষ নানা প্রকার যুক্তিতর্ক দলিলদস্তাবেজ দ্বারা সপ্রমাণ করিবার চেষ্টা করিলেন যে, ভারতবর্ষে আগমনের পূর্বেই অর্থাৎ ইরানের বর্ধিষ্ণু সুফিবাদ বেদান্ত ও যোগরস পুনঃপুন পান করিয়াছে।

তর্কটি পাত্ৰাধার তৈলজাতীয় আপেক্ষিক, নিরর্থক নহে। সুফিবাদ অনুসন্ধান করিলে যদি সপ্রমাণ হয় যে, ভারতবর্ষীয় দর্শনের লাঞ্ছন তাহার উপর রহিয়াছে তাহা হইলে সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি গম্ভীর ঐতিহাসিক তত্ত্ব সপ্রমাণ হয়, সেটি এই যে, ভারতীয় ধর্ম ও দর্শন এককালে ইরান পর্যন্ত ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ছিল।

এ সন্দেহ বহু পূর্বেই কোনও কোনও পণ্ডিত করিয়াছেন। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম দর্শন যে ইরান নহে, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত হইয়াছিল, সে সন্দেহ প্রথম জাগে পণ্ডিতমণ্ডলীর মনে, যখন তাঁহারা বাইবেলের প্রাচীন ও নবীন মালিকের (Old and New Testaments) তুলনাত্মক আলোচনা আরম্ভ করেন। ইহুদিদের প্রাচীন মাঙ্গলিকের যে হিংস্র নীতি ক্ষণে ক্ষণে আমাদিগকে পীড়া দেয়, সেইরূপ খ্রিস্টের ক্ষমা ও দয়ার নীতি নবীন মাঙ্গলিকে আমাদিগকে পুনঃপুন আনন্দ ও সাহস দেয় (একদিকে An eye for an eye, and a tooth for a tooth 3 DALINCA Love the neighbour, offer the left cheek ইত্যাদি তুলনা করুন)। পণ্ডিতমণ্ডলী জিজ্ঞাসা করিলেন খ্রিস্ট কী করিয়া শান্তি ও মৈত্রীর বাণী এ হিংস্র পরিবেষ্টনীর মধ্যে হৃদয়ঙ্গম করিতে সমর্থ হইলেন ও প্রচার করিবার দুঃসাহস সঞ্চয় করিলেন? তবে কি কোনও বৌদ্ধশ্রমণের সঙ্গে তাহার যোগাযোগ হইয়াছিল? বিশেষত তাহার যৌবন কোথায় কী প্রকারে যাপিত হইয়াছিল সে সম্বন্ধে বাইবেল যখন নীরব।

এ প্রশ্নের সমাধান অদ্যাপি হয় নাই, কখনও হইবে এ আশাও আমার নাই। কিন্তু সে সমস্যা উপস্থিত তুলিবার প্রয়োজন আমার নাই– সে বড় জটিল ও এস্থলে অবান্তর।

তবে একথা আমরা জানি যে, বৌদ্ধশ্রমণেরা ইরান, আরব পর্যন্ত পৌঁছিয়াছিলেন ও সেই তত্ত্ব জানি বলিয়া যখন সুফিবাদে মাঝে মাঝে এমন চিন্তাধারার সন্ধান পাই, যাহা অবিমিশ্র সনাতন ইসলামে নাই, অথচ শূন্যবাদের অত্যন্ত পাশ দিয়া বহিতেছে, তখন মন স্বতঃই প্রশ্ন করে, তবে কি উভয়ের কোথাও যোগ আছে?

মাসিন্নো ও হর্তেনে এই তর্ক চলিয়াছিল বহু বৎসর ধরিয়া। পৃথিবীর বিদগ্ধজন সে তর্ক অনুসরণ করিয়া যে কী আনন্দ লাভ করিয়াছিলেন তাহা তাহারা কখনও বিস্মৃত হইবেন না। হর্তেন স্বীয় মত সমর্থন করিবার জন্য শেষ পর্যন্ত একখানা পূর্ণাঙ্গ অভিধান লিখিলেন, তাহাতে সুফিবাদের সঙ্গে বেদান্ত শব্দে শব্দে মিলাইয়া বলিলেন, এরকম সাদৃশ্য যেস্থলে বর্তমান, সেখানে প্রভাব মানিতেই হইবে।

এ তর্কও কখনও শেষ হইবে না। কারণ একথা ভুলিলে চলিবে না, মানবাত্মা যখন কর্ম ও জ্ঞানযোগে তাহার তৃষ্ণা নিবৃত্ত করিতে পারে না, তখন সে ভক্তির সন্ধান করে। মানব যখন দুঃখ-যন্ত্রণায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়, তখন অকস্মাৎ তাহারই গভীর অন্তস্তল হইতে এবং জ্যোতির্ময় পুরুষ তাঁহাকে রহস্যময় ইঙ্গিত করেন। চিত্তবৃত্তি নিরোধ করিয়া মানুষ তখন সেই জ্যোতির্ময় পুরুষে সর্বচৈতন্য সংযোগ করে। তাহাই যোগ।

বহু ক্যাথলিক সাধু যোগী ছিলেন অথচ তাঁহারা ভারতের যোগশাস্ত্রের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। যুগে যুগে পৃথিবীর সর্বত্র উপযুক্ত সোপান আরোহণ দৃষ্ট হয়। কর্ম জ্ঞান ও তৎপর ভক্তি। আর যোগ তো অহরহ রহিয়াছে। ঘোর সংসারীও যখন অর্থশোক ভুলিবার চেষ্টা করে, তখন সে যোগের প্রথম সোপানে আরোহণ করিয়াছে। শুধু দ্বিতীয় সোপানে সে যাইবার চেষ্টা করে না– হিরন্ময় পাত্র দেখিয়াই সে সন্তুষ্ট তাহাকে উন্মোচন করিয়া চরম সত্য দর্শন করিবার প্রয়াস তাহার নাই।

যোগ পৃথিবীর সর্বত্রই ছিল ও এখনও আছে। কিন্তু ভারতবর্ষে যোগকে বিশ্লেষণ করিয়া যেরূপ সর্বজনগম্য করা হইয়াছে, তাহাকে যুক্তিতর্ক ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ দর্শন করা হইয়াছে, সেরকম আর কোথাও করা হয় নাই একমাত্র ইরান ছাড়া। সুফিরা ভারতবর্ষীয় যোগীর ন্যায় অন্তর্লোকে সোপানের পর সোপান অধিরোহণ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণনা করিয়াছেন। এক সুফি অন্য সুফির অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করিয়া অগ্রসর হইয়াছেন।

ফলে কখনও নির্গুণ ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মবোধে বিলীন হইয়াছেন (ফানা), কখনও ভক্তিরসে আপ্লুত হইয়া সেই একাত্মবোধ রসস্বরূপে প্রকাশ করিয়াছেন :

মন্ তু শুদম, তু মন্ শুদি,
মন তন্ শুদম, তু জাঁ শুদি।
তা কমি ন গোয়েদ বাদ আজ ইন।
মন জিগরম তু দিগরী ॥

আমি তুমি হইলাম, তুমি আমি হইলে,
আমি দেহ হইলাম, তুমি প্রাণ,
ইহার পর আর যেন কেহ না বলে,
আমি ভিন্ন এবং তুমি ভিন্ন।

ইহাই তো সত্য ধর্ম। এ মন্ত্র ব্রহ্মে বিলুপ্তির মন্ত্র এবং এ মন্ত্র বিবাহের মন্ত্র। খ্রিস্টসাধু যিশুকে বিবাহ করে, চার্চকে বিবাহ করে, শ্ৰমণ সঙ্ঘকে বিবাহ করে আর আমাদের মতো সাধারণ মানুষ প্রিয়াকে এই মন্ত্রে বরণ করিয়া সংসারপথে চলিবার শক্তি পায়।

.

০৪.

মুসলমান ধর্মপ্রচারকগণ এদেশে সুফি বা ইরানি ভক্তিমার্গ প্রচার করিলে পর হিন্দু-মুসলমান জনসাধারণের সম্মিলিত আধ্যাত্মিক সাধনার ফলে যেসব সাধক মধুরকণ্ঠে আত্মার রহস্য-লোকের অভিজ্ঞতার গান গাহিলেন তাহার সঙ্গে আমাদের সকলেরই অল্পাধিক পরিচয় আছে। কবীরের নাম শোনেন নাই এমন লোক কম ও যাঁহারাই ভারতীয় কৃষ্টির সত্য, বহুমুখী প্রতিভার প্রতি সিংহাবলোকন করিয়াছেন, তাঁহারাই অন্যান্য নানা সাধকের ভজন দোহার সঙ্গে সুপরিচিত।

উত্তর ভারতে যেসব সাধক জনগণের হৃদয়মন ভক্তিরসে প্লাবিত করিয়া গিয়াছেন তাহাদের আংশিক পরিচয় মাত্র দিতে হইলেও বহু বৃহৎ গ্রন্থের প্রয়োজন। সংবাদপত্রের বিক্ষিপ্ত স্তম্ভের উপর সে বিপুল সৌধনির্মাণ করা সম্ভবপর নহে। অনুসন্ধিৎসু ও রসজ্ঞ পাঠক সে সৌধের সন্ধান পাইবেন শ্রীযুক্ত ক্ষিতিমোহন সেনের দাদু পুস্তকের ভূমিকায়, পুস্তকাকারে প্রকাশিত তাহার স্টেফান নির্মলেন্দু বক্তৃতায়।

উত্তর ভারতে এই সাধনার দ্বারা পূর্ব ভারতে প্রকাশ হয় আউল, বাউল, মুর্শিদিয়া, সাঁই, জারিগানের ভিতর দিয়া। সেসব গীতের সঙ্কলন এযাবৎ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে করা হয় নাই। দুইজন গুণী এই কর্মে লিপ্ত আছেন ও রসিকজনের সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা সঞ্চয় করিয়াছেন। রাজশাহী কলেজের অধ্যাপক মৌলবি মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন ও শ্রীহট্টের মৌলবি আশরাফ হোসেন বহু পরিশ্রম করিয়া নানা সঙ্কলন প্রকাশ করিয়াছেন। (এই মহান ব্রতে আত্মনিয়োগ করিয়া দ্বিতীয়োক্ত মহাশয় কয়েক মাস পূর্বে আসাম সরকারের নিকট হইতে যে কী উকট প্রতিদান পাইয়াছেন সে সম্বন্ধে আরেকদিন আলোচনা করিবার বাসনা রহিল)।

লালন ফকির, শীতালং শাহ, রাধারমণ, গোলাম হুসেন শাহ, হাসন রাজা, ভেলা শাহ, সৈয়দ জহরুল হোসেন, সৈয়দ শাহ নূর প্রভৃতি সাধক-মণ্ডলীর পরিচয় এইসব সঙ্কলনে পাওয়া যায়। আধ্যাত্মিক জগতে হঁহাদের অধিকার, দৈনন্দিন জীবনের নিম্নতম কঠিন কঠোর অভিজ্ঞতা হইতে আত্মার উচ্চতম রহস্যলোকের প্রতি ঘঁহাদের অভিযান যে কী পরম বিস্ময়জনক, লোমহর্ষক তাহা বর্ণনা করিবার মতো অভিজ্ঞতা তো আমার নাই। গ্রহচন্দ্রে, তারায় তারায় অনন্তের যে সুগম্ভীর বীণাধ্বনি প্লাবন মন্ত্রে মুখরিত, রুদ্রের ত্রিকাল ত্রিকোলস্পর্শী দক্ষিণ হস্তে যে রুদ্রাক্ষ জন্মমৃত্যু সৃষ্টিপ্রলয়ের অন্তহীন চক্রে ঘূর্ণায়মান তাহারই স্পন্দন নমস্য সাধকেরা অনাবিল চৈতন্যগোষ্পদে শতরাগে বিম্বিত করিয়া প্রত্যক্ষ দর্শন করিয়াছেন। পুনরাবৃত্তি করি, প্রত্যক্ষ দর্শন করিয়াছেন, উপনিষদের ঋষি যে প্রকারে দর্শন করিয়াছিলেন, মুতালিজা সুফি পঞ্চেন্দ্রিয়ের অতীত যে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যোগে পরমাত্মাকে দর্শন করিয়াছিলেন।

সে রহস্যলোকের ব্যঞ্জনা সাধকেরা দিয়াছেন মধুর কণ্ঠে, ছন্দগানে। রসিকজন শ্রবণমাত্র ভাবরসে আপ্লুত হইয়াছেন। নীরস গদ্যে অরসিকজন তাহার ব্যাখ্যা করিতে গিয়া কেন। বিড়ম্বিত হইবে?

আমাদের পক্ষে শুধু সম্ভব সাধকগণের রসস্রোতধারার ভৌগোলিক উৎপত্তিস্থলের অনুসন্ধান করা। কোন পর্বত-কন্দরে তাহার উৎপত্তি, কোন দেশে প্রদেশের উপর দিয়া তাহার গতি, কোন মহাসমুদ্রে তাহার নিবৃত্তি সে অনুসন্ধান ভূগোল আলোচনার ন্যায়; তাহাতে জ্ঞানবৃদ্ধি হয়, রসাস্বাদনের প্রত্যক্ষ আনন্দ তাহাতে হয় না। গঙ্গার উৎপত্তি-নিলয় জানিয়া তাপিত দেহে গঙ্গাবগাহনজনিত স্নেহসিক্ত শান্তিলাভ হয় না, পুণ্যলাভ তো সুদূরপরাহত।

রসিকজন এই অন্ধের হস্তীদর্শনের ন্যায় বিড়ম্বনাকে লক্ষ করিয়াই বলিয়াছেন,

ফুলের বনে কে ঢুকেছে সোনার জহুরি
নিকষে ঘষয়ে কমল, আ মরি, আ মরি।

স্মৃতিশক্তি ক্ষীণ হইয়া গিয়াছে, তৎসত্ত্বেও মনে পড়িতেছে, পরমহংসদেবও বলিয়াছেন, মদ শুকিলেই নেশা হয় না, চাখিলে নেশা হয় না, এমনকি সর্বাঙ্গে মাখিলেও নেশা হয় না, নেশা করিতে হইলে মদ খাইতে হয়। অর্থাৎ সে রসসায়রে নিমজ্জিত হইতে হয়, পারে দাঁড়াইয়া সে অমৃতের রাসায়নিক বিশ্লেষণ করা পণ্ডিতের পণ্ডশ্রম। তাই বাউল বলিয়াছেন,

যে জন ডুবল, সখী, তার কী আছে বাকি গো?

তখন তো তাহার আর দুঃখ-যন্ত্রণা নাই, সে তো জন্ম-মৃত্যুর অতীত। রাজসিক কবি শ্রীমধুসূদন পর্যন্ত বলিয়াছেন :

মক্ষিকাও গলে না গো সে অমৃত হ্রদে

সৈয়দ শাহনূর গাহিয়াছেন :

রসিক দেখে প্রেম করিয়া যার দিলেতে ফানা,
অরসিকে প্রেম করিলে চোখ থাকিতে কানা।
ওজুদে মজুদ করি লীলার কারখানা,
সৈয়দ শাহনূর কইন দেখলে তনু ফানা ॥

যিনি ব্রহ্মানন্দে আত্মনিলয় (ফানা) করিতে সমর্থ হইয়াছেন, একমাত্র সে-ই রসিকের সঙ্গে প্রেম করিবে। তদভাবে তুমি চক্ষুষ্মন অন্ধ। এই দেহেই (ওজুদ) লীলার কারখানা মজুত। তাহা যদি দেখিতে পারো তবেই তুমি দেহের বন্ধন হইতে মুক্তিলাভ (ফানা) করিবে।

(শব্দতাত্ত্বিক লক্ষ করিবেন ভাষার দিক দিয়াও এই চৌপদী রুবাইয়াৎটি হিন্দু-মুসলিম আধ্যাত্মিক সাধনার কী অপূর্ব সংমিশ্রণে গঠিত– রসিক, প্রেম, লীলা শুদ্ধ সংস্কৃত, চোখ কানা বাঙলা; ফানা ওজুদ মজুদ শুদ্ধ আরবি; কারখানা ফারসি কইন বাঙাল।)

অরসিক, অপ্রেমিককে এইসব সাধক কখনও করজোড়ে নিবেদন করিয়াছেন যেন ভৌগোলিক শব্দতাত্ত্বিক তর্কবিতর্ক করিয়া রসভঙ্গ না করেন, কখনও নিরুপায় হইয়া কাতরকণ্ঠে দিব্যিদিলাসা দিয়াছেন। তাই ক্ষমাভিক্ষা করিয়া অদ্যকার সভার রসভঙ্গ করি, কবিগুরু কৰ্তক নন্দিত সেই হাসন রাজার গীতি সংকলন হাসন-উদাসের সর্বপ্রথম গীতিটি উদ্ধৃত করিয়া এবং তৎপূর্বে এইমাত্র নিবেদন করি যে, সাধারণত বাউলরা পরমাত্মা মহাপুরুষ ও গুরুর বন্দনা সমাপ্ত করিয়া রস সৃষ্টি আরম্ভ করেন। কিন্তু হাসন রাজা অপ্রেমিক, রবাহুতের আগমন ভয়ে আল্লা-রসুল বন্দনার পূর্বেই বলিতেছেন,

আমি করিয়ে মানা, অপ্রেমিকে গান আমার শুনবে না।
কিরা দেই, কসম দেই, আমার বই হাতে নিবে না।
বারে বারে করি মানা বই আমার পড়বে না।
প্রেমের প্রেমিক যে জনা এ সংসারে হবে না।
অপ্রেমিকে গান শুনলে কিছুমাত্র বুঝবে না।
কানার হাতে সোনা দিলে লাল-ধলা চিনবে না।
হাসনরাজায় কসম দেয়, আর দেয় মানা।
আমার গান শুনবে না, যার প্রেম নাই জানা ॥

.

সাক্ষরকে নিরক্ষরতা হইতে রক্ষা করিবার পন্থা

০১.

জনসাধারণের শিক্ষাবিস্তার সমস্যা লইয়া যাহারা তথ্য সংগ্রহ করেন তাঁহাদের মুখে শুনিয়াছি যে, উনবিংশ শতকের প্রথম ভাগে ভারতবর্ষে শতকরা দশজন লিখিতে পড়িতে পারিত ও আজ নাকি দশের পরিবর্তে বারোয় দাঁড়াইয়াছে। স্পষ্টই বোঝা যাইতেছে, শিক্ষাবিস্তারের কর্মটি সদাশয় সরকার সুচারুরূপে সম্পন্ন করেন নাই। কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের কর্তব্য রহিয়াছে। স্বরাজপ্রাপ্তি আমরা যেমন সদাশয় সরকারের হাতে সম্পূর্ণ ছাড়িয়া দেই নাই, ঠিক সেইরূপে শিক্ষাবিস্তার সমস্যায় আমাদেরও ভাবিবার ও করিবার আছে। শিক্ষানবিশরাও বলেন যে, আমাদের মতো অর্ধশিক্ষিত লোকের সাহায্য পাইলেও নাকি নিরক্ষর দেশকে সাক্ষর করার পথ সুগম হইবে।

সমস্যার জটিল গ্রন্থি এই যে যদিও প্রতি বৎসর বহু বালক পাঠশালা-পাস করিয়া বাহির হয়, অর্থাৎ সাক্ষর হইয়া সামান্য লেখা-পড়া করিতে শিখে, তবুও কয়েক বৎসর পরেই দেখা যায় যে, ইহারা সম্পূর্ণ নিরক্ষর হইয়া গিয়াছে। কারণ অনুসন্ধান করিলে দেখা যায় যে, পাঠশালা-পাসের পর পড়িবার মতো কোনওই পুস্তক তাহারা পায় না। আমার এক স্কুল সাব ইন্সপেক্টর বন্ধুর মুখে শুনিয়াছি যে কৈবর্ত, নমঃশুদ্র ও মুসলমান জেলেদের ছেলেরা যত শীঘ্র পুনরায় নিরক্ষর হয়, অপেক্ষাকৃত দ্ৰশ্রেণিতে ততটা নয়। তাহার মতে কারণ বোধহয় এই যে, তথাকথিত নিম্নশ্রেণির হিন্দুর বাড়িতে রামায়ণ-মহাভারতের প্রচলন কম ও মুসলমানদের জন্য বাঙলায় সরল কোনও ধর্মপুস্তক নাই।

মধ্য ইউরোপের তুলনায় বল্কান শিক্ষায় পশ্চাৎপদ। বন্ধানের গ্রামাঞ্চলে অনুসন্ধান করিয়া আমিও ঠিক এই তত্ত্বই আবিষ্কার করি। বন্ধানের গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের লেখাপড়ার সঙ্গে যোগ তাহাদের উপাসনা পুস্তিকার মধ্যবর্তিকায়। পাঠকের অবগতির জন্য নিবেদন করি যে, ক্যাথলিক ক্রিশ্চানরা শাস্ত্রাধিকারে বিশ্বাস করেন। গ্রামের পাদ্রি সাহেবের অনুমতি বিনা যে কেহ বাইবেল পড়িতে পারে না, তাহাদের জন্য বরাদ্দ উপাসনা পুস্তিকা বা প্রেয়ার বুক, যেমন শূদ্র স্ত্রীলোককে বেদাভ্যাস করিতে আমাদের দেশেও নিষেধ ছিল। তাহাদের জন্য রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত, চৈতন্যচরিতামৃত পদাবলি।

প্রত্যেক ক্যাথলিকের একখানা উপাসনা পুস্তিকা অতি অবশ্য থাকে। গ্রামের বুড়ি উপন্যাস পড়ে না, খবরের কাগজ পড়ে না, এমনকি চিঠিপত্র লিখিবার প্রয়োজনও তাহার হয় না। কিন্তু প্রতিদিন সে উপাসনা পুস্তিকা হইতে কিছু না কিছু পড়ে ও রোববারে গির্জায় বেশ খানিকটা অধ্যয়ন করে।

প্রোটেসট্যান্ট দেশগুলোতে বাইবেল পড়া হয়। এই উপাসনা পুস্তিকা ও বাইবেল ইউরোপের কোটি কোটি লোককে পুনরায় নিরক্ষর হইবার পথে জোড়াকাটা।

আমাদের উচিত রামায়ণ-মহাভারতের আরও সস্তা সংস্করণ প্রকাশ করা ও সম্ভব হইলে পাঠশালা পাস-করার সঙ্গে তথাকথিত নিম্নশ্রেণির প্রত্যেক বালককে একখণ্ড রামায়ণ অথবা মহাভারত বিনামূল্যে দেওয়া। আমি কৃত্তিবাসের রামায়ণ ও কাশীরামের মহাভারতের প্রতিই ইঙ্গিত করিতেছি।

কিন্তু প্রশ্ন, তাহাতে লাভ কী? ধর্মচর্চা (?) তো আমরা বিস্তর করিয়াছি, আর না হয় নাই করিলাম। তবে কি দেশের লোককে নিরক্ষরতা হইতে আটকাইবার অন্য কোনও উপায় নাই, অথবা ধর্মপুস্তকের উপর আরও কিছু দেওয়া যায় না।

যায়। এবং সেই উদ্দেশ্যেই খবরের কাগজের শরণাপন্ন হইয়াছি। এই খবরের কাগজই তাহার উপায়।

রামায়ণ-মহাভারত সস্তায় অথবা বিনামূল্যে বিতরণ করিবার মতো অর্থ কোনও গৌরী সেনই দিতে রাজি হইবেন না। কিন্তু তিন দিনের বাসি খবরের কাগজ বিলাইয়া দিতে অনেকেই সম্মত হইবেন। আমাদের কল্পনাটি এইরূপ–প্রথমত বড় ও ছোট শহরে যুবক ও বালক লইয়া একটি প্রতিষ্ঠান করিতে হইবে। ইহাদের কাজ হইবে বাসি দৈনিক সাপ্তাহিক (ও পরে মাসিক) কাগজ জড়ো করা। পরে সেগুলি ডাকযোগে প্রতি পাঠশালায় পাঠানো। যেসব ছেলেরা পাঠশালা-পাস করিয়াছে, বিশেষ তাহাদেরই নিজের নামে দৈনিক ও সাপ্তাহিক পাঠাইতে হইবে। ইহাতে ডাকখরচা লাগিবে। উপস্থিত সে পয়সা তুলিতে হইবে, কিন্তু আমার বিশ্বাস অন্ধরা যেরকম বিনা ডাকখরচায় পড়িবার জিনিস পান, ঠিক সেইরকম যথারীতি আন্দোলন করিলে ও বিশেষত যদি প্রথম দিকে পয়সা খরচ করিয়া কাগজ বিতরণ করিয়া সপ্রমাণ করা যায় যে, পরিকল্পনা বিশেষ প্রাথমিক কেন্দ্রে সফল হইয়াছে, তাহা হইলে ডাকখরচও লাগিবে না।

রোজই যে কাগজ পাঠাইতে হইবে, এমন কোনও কথা নাই। প্রথম দিকে সপ্তাহে একবার অথবা দুইবার পাঠাইলেই চলিবে।

কিন্তু সংবাদপত্র ইহারা পড়িবে কি? এইখানেই আসল মুশকিল। কাজেই দ্বিতীয়ত, পাঠশালার শেষ শ্রেণিতে ছেলেদের পত্রিকা পাঠ শিখাইতে হইবে। গোড়ার দিকে শিক্ষক তাহাদিগকে বিশেষ করিয়া ছেলেদের জন্য যেসব লেখা বাহির হয়, তাহা পড়াইবেন। পরে নানারকম দেশি খবর, খেলার বর্ণনা, জিনিসপত্রের বাজার দর, আইন-আদালতের চাঞ্চল্যকর মামলা, সাহিত্যিক প্রবন্ধ, যুদ্ধের খবর, সম্পাদকীয় আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ইত্যাদি ইত্যাদি।

যাহারা নৈশ স্কুল চালান প্রথম দিকে তাঁহারা এই প্রচেষ্টা করিলে ভালো হয়। পরে

তৃতীয়ত, গুরু ট্রেনিং স্কুলে শিক্ষকদের শিখাইতে হইবে কী করিয়া খবরের কাগজ পড়িতে ও পড়াইতে হয়। ইহার জন্যও আন্দোলনের প্রয়োজন হইবে।

আমি অতি সংক্ষেপে খসড়াটি নিবেদন করিলাম। আমার বিশ্বাস, খবরের কাগজ পড়িবার শখ সৃষ্টি করা কঠিন কাজ নহে। আর কিছুটা সুখ পাইলেই বালক সপ্তাহে দুইবার দুইখানা কাগজ স্বনামে পাইবার গর্বে নিশ্চয় পড়িবে।

আমাদের সবচেয়ে বড় লাভ হইবে যে, গণআন্দোলনের জন্য আমরা গ্রামবাসীকে প্রস্তুত করিতে পারিব।

পরিকল্পনাটির স্বপক্ষে বিপক্ষে নানা যুক্তিতর্ক আমরা অনেকদিন যাবৎ ভাবিয়াছি ও আমি নিজে বাড়ির চাকরদের কাগজ পড়িতে শিখাইবার চেষ্টা করিয়া সফল হইয়াছি। পাঠকবর্গ এ সম্বন্ধে অনুসন্ধিৎসা প্রকাশ করিলে পরিকল্পনাটি আরও বিস্তৃতভাবে আলোচনা করিতে পারিব।

.

০২.

বিপদ এই যে, চতুর্দিক হইতে রাশি রাশি খবর রোজ খবরের কাগজের অফিসে উপস্থিত হইতেছে, অথচ কাগজের অনটন। অর্থাৎ খবর আছে, কাগজ নাই। কাজেই খবর-কাগজ সমাসটি সিদ্ধ হয় কী প্রকারে? এদিকে আবার দেশহিতৈষীরা নিরক্ষরতা দূর করিবার অন্যান্য উপায় জানিতে চাহিতেছেন। বিষয়টি গভীর-আলোচনার দিক দিয়া দেখিতে গেলে ত্রৈমাসিকের উপযুক্ত; অথচ খবরের কাগজের ভিতর দিয়া হাজার হাজার লোককে সমস্যাটি না জানাইলে প্রতিকারের সম্ভাবনাও নাই।

পণ্ডিতেরা একবাক্যে স্বীকার করিয়াছেন যে, চীন যে জনসাধারণের শিক্ষা-প্রসার ব্যাপারে এত পশ্চাৎপদ তাহার প্রধান কারণ চীনভাষার কাঠিন্য। সে ভাষার বর্ণমালা নাই। প্রত্যেকটি শব্দ একটি বর্ণ। শব্দটি যদি না জানা থাকে তবে উচ্চারণ পর্যন্ত করিবার উপায় নাই; কারণ উচ্চারণ তো করি বর্ণে বর্ণ জুড়িয়া। প্রত্যেকটি শব্দই যখন বর্ণ তখন হাজার হাজার বর্ণনা শিখিয়া চীনা পড়িবার বা লিখিবার উপায় নাই। ৪৭টি স্বরব্যঞ্জন শিখিতে ও শিখাইতে গিয়া আমরা হিমসিম খাইয়া যাই। চীনা সাক্ষররা কী করিয়া হাজার হাজার ও পণ্ডিতেরা কী করিয়া লক্ষ লক্ষ বর্ণ শিখেন সে এক সমস্যার বিষয়। শুনিয়াছি চৌদ্দ বছরের বাঙালি ছেলে যে পরিমাণ বাঙলা জানে ততটুকু চীনা শিখিতে গিয়া নাকি সাধারণ চৈনিকের বয়স ত্রিশে গিয়া দাঁড়ায়। শুধু একটি কথা নিশ্চয়তার সঙ্গে উল্লেখ করিতে পারি। পুনা ফার্গুসন কলেজের অধ্যাপক শ্ৰীযুত বাসুদেব গোখলে (বিখ্যাত গোখলের আত্মীয়) শান্তিনিকেতনে ১৯২৪ সালে চীনা শিখিতে আরম্ভ করেন; পরে জর্মনিতে ডক্টরেট পান। ভদ্রলোক এখনও চীনা ভাষার অক্টোপাস-পাস হইতে বাহির হইতে পারেন নাই। ইতোমধ্যে তাহার সতীর্থরা ফরাসি, জর্মন, ইতালিয়ন নানা ভাষা শিখিয়া বসিয়াছেন। শ্ৰীযুত গোখলের পাণ্ডিত্যে সন্দেহ করিবার কারণ অবশ্য নাই; চীনা ছাত্র এদেশে আসিয়া তাহাকে গুরু স্বীকার করিয়া তাহার নিকট চীনা বৌদ্ধশাস্ত্র পালিশাস্ত্রের সঙ্গে মিশাইয়া পড়িতে শিখে।

সকলেই একবাক্যে স্বীকার করিয়াছেন যে, নতুন বর্ণমালা না চালাইলে চীনের জনসাধারণ কখনও সাক্ষর হইতে পারিবে না। জাপানিদের বর্ণমালা আছে।

বাঙলা বর্ণমালা সংস্কৃত নিয়মে চলে বলিয়া তাহার শ্রেণিবিভাগ সরল ও যুক্তিযুক্ত। ইংরেজি ও অন্যান্য সেমিটিক বর্ণমালার সঙ্গে তুলনা করিলে তথ্যটি স্পষ্ট হইবে। কিন্তু, এইখানেই সমস্যার জগদ্দল কিন্তু উপস্থিত লেখা ও পড়ার সময় বাঙলা বর্ণমালা যে কী অপূর্ব কাঠিন্য সৃষ্টি করে তাহা আমরা ভাবিয়াও দেখি না। দুইটি ইকার কেন, দুইটি উকার কেন উচ্চারণে যখন কোনও প্রভেদ নাই তখন মনে রাখি কী করিয়া, কই যখন লেখা যায় তখন কৈর কী প্রয়োজন? বউ যখন লেখা যায় তখন বৌকে বরণ করিবার কী দরকার? গিআ, গিএর পরিবর্তে কেন গিয়া গিয়ে? এইসব প্রশ্ন শিশুমনকে বিক্ষুব্ধ করে ও সে সমস্ত ব্যাপারটার কোনও হদিস পায় না। কারণ সংস্কৃতে তার হদিস আছে, বাঙলা লিখন-পঠনে নাই। দ্বিতীয়ত অযৌক্তিকতা; কা লিখিতে আকার জুড়ি পশ্চাতে, কিন্তু ইকার জুড়ি অগ্রভাগে, আর ঈকার জুড়ি পশ্চাতে, দুটি উকার জুড়ি নিচে। সর্বাপেক্ষা মারাত্মক ওকার ও ঔকার। প্রথম? লাগাই, তার পর লাগই । ছোট ছেলেকে নিশ্চয়ই পড়িতে শুনিয়াছেন ঘ একারে ঘে; উঁহু ঘ আকারে আ, উঁহু ঘে? ঘা? তখন তাহার মনে পড়ে ওকারের কথা; বলে ঘো ঘোড়া। ঔকার তো আরও চমৎকার। আকার ইকার উ-কার, ঋকার সব কয়টি হয় আগে, নয় পশ্চাতে লাগাইলে যে কী আপত্তি ছিল, তাহা আমি বহু গবেষণা করিয়াও স্থির করিতে পারি নাই। শিশুর পক্ষে সরল হইত, বয়স্ককে পুনর্নিরক্ষরতা হইতে রক্ষা করিত। ইংরেজিতে ব্যাপারটা কানুনমাফিক ও সরল।

তবুও শিশুরা সাধারণত সামলাইয়া লয়, কিন্তু যুক্তাক্ষরে আসিয়া তাহাদের বানচাল হয়।

আমার সব-ইনসপেকটর বন্ধুটি বলিয়াছেন যে, অনুসন্ধান করিলে দেখা যায় কৈবর্ত জেলের ছেলে বেশিরভাগ পাঠশালা পালায় যুক্তাক্ষরের যুগে, দ্বিতীয় ভাগ পড়িবার সময়। যুক্তাক্ষর হইয়াছিল সংস্কৃত বানানের অনুসরণে। নিয়ম এই, কোনও ব্যঞ্জন যদি একা দাঁড়ায় তবে ধরিয়া লইতে হইবে তাহার সঙ্গে অ স্বর যুক্ত আছে। তাহা কর-ভতে তিনটি অ যোগ দিয়া পড়ি। কিন্তু যদি কোনও ব্যঞ্জন স্বরের সাহায্য ছাড়া দাঁড়াইতে চাহে, তবে তাহাকে পরের ব্যঞ্জনের সঙ্গে জুড়িয়া দিতে হইবে– অন্যথায় পূর্ব নিয়মানুসারে অকার লাগিয়া যাইবে। তাই সন্তপ্ত বলিতে তাহার ন আধা অর্থাৎ হসন্ত, প আধা অর্থাৎ হসন্ত। উত্তম প্রস্তাব, কিন্তু বিপদ এই যে, যুক্তাক্ষর হওয়া মাত্রই অনেকেই এমন। চেহারা বদলায় যে, তাহাদিগকে চিনে তখন কার সাধ্য– লাইনো টাইপের অর্থাৎ আনন্দবাজারের ছাপার কথা হইতেছে না, প্রচলিত ছাপা ও লেখার কথাই বলিতেছি। দ্বিতীয় বিপদ, এই আইন সংস্কৃতে অতি প্রাঞ্জলভাবে চলে বটে, বাঙলায় চলে না। লিখিতেছি রামকে অর্থাৎ রা+ম+অ+কে অর্থাৎ রামোকে (কারণ ব্যঞ্জন একা দাঁড়াইলে অ বর্ণ যুক্ত হইবে– অ ছাপায় আলাদা বুঝাইবার উপায় নাই বলিয়া ওকার ব্যবহার। করিয়াছি), অথচ পড়িতেছি এমনভাবে যে ম ও ক যুক্তাক্ষরে লেখা উচিত; যথা রামুকে। সরব নার যে উচ্চারণ করি তাহাতে তো লেখা উচিত সর্ব না; যাক সের যে উচ্চারণ করি তাহাতে লেখা উচিত যাক্ষে অথবা যাক্সে। কখন জাগলি-কখন জাগ্নি; কাঁপলেই=কপ্লেই ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু সর্বাপেক্ষা মারাত্মক ব্যাপার এই যে, লিখিতেছি সূক্ষ্ম, বলিতেছি শুকখ; লিখিতেছি আত্মা বলিতেছি আত্তা; লিখিতেছি উর্ধ, বলিতেছি উর্দো বা উর্ধো–দ ব অথবা ধ ব বৃথাই লেখা হইতেছে। শিশু যখন পড়ে স+উ-ক+ষ+ম, সে উচ্চারণ করিতে চাহে শুদ্ধ সংস্কৃতে যেরকম করা হয়–সূকষম। কিন্তু বেচারাকে চোখের জলে নাকের জলে শুদ্ধ উচ্চারণ লিখিতে হয়। সংস্কৃতে যাহা যুক্তিযুক্ত, বাঙলাতে তাহা খামখেয়ালি।

তাই দেখা গিয়াছে, দ্বিতীয় ভাগ হইতে বেশিরভাগ ছেলে যুক্তাক্ষরের ধাক্কা সহিতে না পারিয়া অক্কা পায়। তাই দেখা গিয়াছে, বয়স্ক সাক্ষর বহুদিন লেখাপড়া চর্চা না করিয়া পুনরায় পড়িতে বা লিখিতে যায়, তখন সেই এককালীন সাক্ষর টক্কর খায় যুক্তাক্ষরে।

আমাদের লিখন ও উচ্চারণের বৈষম্য এত বিকট যে, ইহাই নিরক্ষরতা ও সাক্ষরের নিরক্ষরতায় পুনরায় ফিরিয়া যাওয়ার দ্বিতীয় প্রধান কারণ।

কিন্তু উপায় কী?

অদ্যকার লেখা শেষ করিবার পূর্বে একটি কথা না বলিয়া শান্তি পাইতেছি না। যখন গড়িমসি করিতেছিলাম, এ বিষয় লইয়া আর আলোচনা করিব কি না, তখন হঠাৎ দেখি সোমবারের আনন্দমেলায় একটি বালক– বালক মাত্র– বলিতেছে যে, সে নিরক্ষরকে সাক্ষর করা সম্বন্ধে প্রবন্ধ পাঠ করিয়া কাজে লাগাইবার চেষ্টা করিতেছে।

ভগবানকে অজস্র ধন্যবাদ, আমার শ্রম সার্থক হইয়াছে। বালকটিকে আমার আশীর্বাদ, সে আমাকে মনের জোর দিয়াছে।

.

০৩.

গত আগস্ট*[* ১৯৪৬-এর আগস্ট মাস।] মাসে উপযুক্ত শিরোনামায় দুইটি রচনা নিবেদন করিয়াছিলাম। সত্যপীরের বয়স যখন অতি অল্প, তাহার বালসুলভ চপলতা কেহই লক্ষ করিবে না, এই ভরসায় উপযুক্ত বিষয় লইয়া তখন অত্যধিক বাক্যাড়ম্বর করি নাই। কিন্তু বাঙলা দেশে সহৃদয় পাঠকের অভাব নাই। তাহারা লেখা দুইটি পড়িয়া এযাবৎ অধমকে বহু পত্রাঘাত করিয়াছেন। তুলসীদাসের চৌপদীটি মনে পড়িল :

জো বালক কহে তোতরী বাতা
সুনত মুদিত নেন পিতু অরু মাতা
হসিহহি কূর কুটিল কুবিচারী
জো পরদোষভূষণধারী

বালক যখন আধ আধ কথা বলে, তখন পিতা এবং মাতা মুদ্রিত নয়নে (সন্তোষ সহকারে) সে বাক্য শ্রবণ করেন, কিন্তু কুরকুটিল কুবিচারীরা শুনিয়া হাসে তাহারা তো পরদোষ ভূষণধারী।

(তুলসীজীর রামায়ণখানা হাতের কাছে নাই; সদাশয় সরকারের ন্যায় দুর্ভিক্ষের সময় সঞ্চিত পচা চাউল অর্থাৎ আমার ক্ষীণ স্মৃতিভাণ্ডার হইতে চৌপদীটি ছাড়িলাম– হাজরা লেনের শ্রীমতী ঘোষের সহযোগের উপর নির্ভর করিয়া)।

সহৃদয় পাঠকেরা মুদিত নেন শুনিয়া এখন মুক্তকণ্ঠে আমাকে বহুতর প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়াছেন।

আমি বলিয়াছিলাম–

প্রথমত বড় ও ছোট শহরের যুবক ও বালক লইয়া একটি প্রতিষ্ঠান করিতে হইবে। ইহাদের কাজ হইবে বাসি দৈনিক, সাপ্তাহিক (ও পরে) মাসিক কাগজ জড়ো করা। পরে সেগুলি ডাকযোগে প্রতি পাঠশালায় পাঠানো। যেসব ছেলেরা পাঠশালা পাস করিয়াছে, বিশেষ করিয়া তাহাদের নিজের নামে দৈনিক ও সাপ্তাহিক পাঠাইতে হইবে। ইহাতে ডাক-খরচা লাগিবে। উপস্থিত সে পয়সা তুলিতে হইবে কিন্তু আমার বিশ্বাস, অন্ধেরা যেরকম বিনা ডাক-খরচায় পড়িবার জিনিস পান, ঠিক সেই রকমই যথারীতি আন্দোলন করিলে, ও বিশেষত যদি প্রথম দিকে পয়সা খরচ করিয়া কাগজ বিতরণ করিয়া সপ্রমাণ করা যায় যে, পরিকল্পনাটি বিশেষ প্রাথমিক কেন্দ্রে সফল হইয়াছে– ডাক-খরচাও লাগিবে না।

দ্বিতীয়ত, পাঠশালার শেষ শ্রেণিতে ছেলেদিগকে পত্রিকা পাঠ শিখাইতে হইবে। গোড়ার দিকে শিক্ষক তাহাদিগকে বিশেষ করিয়া ছেলেদের জন্য যেসব লেখা বাহির হয় (আনন্দমেলা জাতীয়) তাহা পড়াইবেন। পরে নানারকম দেশি খবর ইত্যাদি ইত্যাদি।

খবরের কাগজের মাধুকরী করা ও তৎপর বণ্টনকর্ম সম্বন্ধে সবিস্তার আলোচনা কেহ কেহ চাহিয়াছেন।

প্রথমেই নিবেদন করি যে, এইপ্রকার সম্পূর্ণ নবীন প্রচেষ্টা আরম্ভ করিবার পূর্বে আটঘাট বাঁধিয়া ফুলগুফে কোনও স্কিম বা প্ল্যান করা ঠিক হইবে না। শহর ও গ্রামের বাতাবরণ বিভিন্ন, কাজেই একই প্ল্যান দুই জায়গায় বলবৎ হইবে না। দ্বিতীয়ত, প্রথম প্রচেষ্টা ডিনেমিক, চলিষ্ণু বা প্রাণবন্ত হইবে অর্থাৎ কাজ করিতে করিতে ভুলত্রুটি সংশোধন করিয়া, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিয়া, উনিশ-বিশ ফেরফার করিয়া অগ্রসর হইতে হইবে। সহৃদয় পাঠক যদি কিছু মনে না করেন, তবে বলি যে, আমাদের দেশে সর্বপ্রচেষ্টায় আমরা বিলাতি ফিটফাট তৈয়ারি মডেল খুঁজিয়া তাহার অনুকরণ চেষ্টা করি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, আমাদের ট্রেন-জাহাজ, আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলন, আমাদের নৃত্যগীতের পুনরুজ্জীবন-প্রচেষ্টা ইস্তেক জাতীয় সঙ্গীত শুনিবার সময় দণ্ডায়মান হওয়া সর্বত্রই অনুকরণ-প্রচেষ্টা, মডেল খোঁজা-বাতাবরণের সঙ্গে মিলাইয়া দেশের অভাব-অভিযোগ সম্বন্ধে সচেতন থাকিয়া চলিষ্ণ ক্রমবর্ধমান শিশু-প্রচেষ্টাকে বলিষ্ণু করিতে শিখি না। আমাকে দোষ দিবেন না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি অক্সফোর্ড-কেম্ব্রিজের কীরকম অন্ধানুকরণ করে তাহা দৰ্শাইয়া স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এই মর্মে অনেকগুলি মর্মন্তুদ সত্য বলিয়াছিলেন।

আমার মনে হয়, উপযুক্ত বাক্যটি স্মরণ রাখিয়া কর্মক্ষেত্রে অবতরণ করা প্রশস্ত।

প্রথমত, কর্মী যুবকগণ মিলিত হইবেন ও কে কে বাসি কাগজ দিতে সম্মত হইবেন তাহার ফর্দ প্রস্তুত করিয়া যে খবরের কাগজ সরবরাহ করে তাহারই দ্বারা তাহাকে কিঞ্চিৎ অর্থ দিয়া কাগজ জমায়েত করিতে হইবে।

দ্বিতীয়ত, স্কুল সব-ইন্সপেক্টর মহোদয়কে আক্রমণ করা। অতি সবিনয়ে তাঁহার সম্মুখে প্ল্যানটি উপস্থিত করিতে হইবে– অতি সবিনয় অতি সভয়। তিনি সাহায্য করিতে প্রস্তুত হইলে অর্ধেক কেল্লা ফতেহ। তাঁহার সহযোগিতায় যে যে পাঠশালায় প্রধানশিক্ষক শুধু বেতন কমাইয়াই (সে কত অল্প আমি জানি, কাজেই ব্যঙ্গ করিতেছি না) সন্তুষ্ট নহেন তাহার ফর্দ করিতে হইবে।

তৃতীয়ত, তাহাদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া শহরে একটি সভা করিয়া বিষয়টি আলোচনা করিতে হইবে।

তখন যে কর্মপদ্ধতি স্থির করা হইবে তাহাতে যত ভুলচুকই থাকুক তাহাই ঠিক। অধমের পদ্ধতির প্রতি তখন যেন কোনও অহেতুক করুণা না দেখানো হয়।

সন্তর্পণে ঝোপ দেখিয়া কোপ মারিতে হইবে, অর্থাৎ তীক্ষ্ণ ট্যাক্ট সহযোগে মাস্টার মহাশয়ের সদয় সহযোগ না পাইলে সব গুড় মাটি হইয়া যাইবে।

যদি সব-ইন্সপেক্টর মহোদয়ের সাহায্য না পাওয়া যায়, তবে বোর্ডের চেয়ার-ভাইস-চেয়ারম্যান তদভাবে কোনও মুরুব্বি মেম্বরের সাহায্য লইয়া কাজ করা যাইতে পারে। কিন্তু আমি নিজে সব-ইন্সপেক্টর মহোদয়গণের প্রতি অবিচল শ্রদ্ধা রাখি। যে সব-ইন্সপেক্টর মহোদয়কে স্মরণ করিয়া প্রথম প্রবন্ধ লিখিয়া ছিলাম, তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, এ বিষয়ে আপ্রাণ সাহায্য করিবেন ও আমার অন্ধ বিশ্বাস, তাঁহার মতো জীবন্ত কর্মী বাঙলা দেশে আরও আছেন।

কাহারও সাহায্য না পাইলেও কাজ আরম্ভ করা যায় শুদ্ধ গুরুমহাশয়কে যদি দলে টানা সম্ভবপর হয়। তিনি রাজি হইলে বাকি সবকিছুই সরল।

যাহারা নৈশ বিদ্যালয় চালান তাহাদের পক্ষে কর্মটি তো সরলই।

এতটা কাজ আগাইলে পর কর্মীরা যদি আমাকে পত্র লিখিয়া সুবিধা-অসুবিধার কথা জানান, তবে আমি তাহাদিগকে সোজা উত্তর দিব ও সম্ভব হইলে দুর্বল শরীর সত্ত্বেও সরেজমিন উপস্থিত হইয়া যেটুকু সামান্য সাহায্য সম্ভব তাহা নিবেদন করিব।

কী পড়াইতে হইবে, কোন কায়দা পড়াইতে হইবে, সে আলোচনা বারান্তরে করিব। ইতোমধ্যে এই শীতকালই কাজ আরম্ভ করার পক্ষে প্রশস্ত।

সর্বশেষে আমাদের কাগজের আনন্দমেলা হইতে কিছু উদ্ধৃত করিতেছি।

কামাখ্যাচরণ ভট্টাচার্য (১৪৪১৬) দর্শনা মণিমেলা, নদীয়া গত ১৭ আগস্টের আনন্দবাজারে সত্যপীরের লেখা নিরক্ষরদের অক্ষর পরিচয় করানোর যে প্রবন্ধ বেরিয়েছিল তা তুমি পড়েছ জেনে খুশি হলাম। মণিমেলার অন্যান্য বন্ধুরা ওই লেখাটি পড়ে এদেশের নিরক্ষরতা দূর করবার সহজ কতকগুলি পন্থা ধরে কাজ করার চেষ্টা করবে, এ বিশ্বাস আমি রাখি।

বালক কাজে ঝাপাইয়া পড়িল, তবে আমরা অতশত দুর্ভাবনা করি কেন।

.

উচ্চারণ

০১.

প্রবাদ আছে, বঙ্গদেশে সংস্কৃত উচ্চারণ এককালে এমনই বিকৃত হইয়া পড়িয়াছিল যে, মহারাজা আদিশূর কানাকুজ হইতে শ্রীহর্ষ, ভট্টনারায়ণ (কেহ কেহ বলেন ক্ষিতীশ, মেধাতিথি) ইত্যাদি পাঁচজন ব্রাহ্মণকে এদেশে নিমন্ত্রণ করিয়া আনয়ন করেন। তাহারা এদেশের লোককে শুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণ কতটা শিখাইতে সমর্থ হইয়াছিলেন জানিবার উপায় নাই। ইহার পর আমাদের জানামতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এদেশে আবার সেই চেষ্টা করেন। কিন্তু তাহার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।

ইতোমধ্যে শত শত বছর ধরিয়া বহু বাঙালি বিদ্যার্থী কাশীতে সংস্কৃত শিখিয়া আসিয়াছেন, কিন্তু তাহাদের উচ্চারণও এদেশে প্রভাব বিস্তার করিতে পারে নাই। এমনকি কাশী-প্রত্যাবৃত্ত কোনও কোনও বাঙালি পণ্ডিতকে আমরা খাঁটি বাংলা উচ্চারণে সংস্কৃত পড়িতে শুনিয়াছি। সন্দেহ হইতেছে খাস কাশীতেও বাঙালি চালিত টোলে বাংলা কায়দায় সংস্কৃত উচ্চারণ শিখানো হয়।

বাংলা কায়দায় সংস্কৃত উচ্চারণ ব্যাপারটা যে কতদূর মারাত্মক তাহা একটি সামান্য উদাহরণ হইতেই পাঠক বুঝিতে পারিবেন। প্রায় পঁচিশ বছর পূর্বে ইতালির খ্যাতনামা সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত অধ্যাপক তুচ্চি কলকাতার তকালীন এক বিখ্যাত পণ্ডিতের সঙ্গে শাস্ত্রালোচনা করিতেছিলেন। কথায় কথায় পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ ঋষি যাজ্ঞবন্ধ্যের নাম উচ্চারণ করেন। বাঙালি যে কায়দায় করে, সেই কায়দায়ই করিলেন, অনেকটা জাগেগাঁবোল্কোর ন্যায়। তুচ্চি তো কিছুতেই বুঝিতে পারেন না। কাহার কথা হইতেছে। পণ্ডিতের চক্ষুস্থির যে তুচ্চির মতো লোক যাজ্ঞবন্ধ্যের নাম শোনেন নাই। তুষ্টি প্রত্যাশা করিতেছেন যাজ্ঞবন্ধ্যের শুদ্ধ উচ্চারণ অনেকটা Yajnyavalkya-র ন্যায়, শুনিতেছেন Jaggonbolkol. বুঝিবেন কী প্রকারে যে একই ব্যক্তি!

বাঙালির সংস্কৃত উচ্চারণ এতই কর্ণপীড়াদায়ক যে, আমাদের পরিচিত দুইটি পশ্চিম ভারতীয় ছাত্রকে বাধ্য হইয়া কলকাতা কলেজে সংস্কৃত অধ্যয়ন ত্যাগ করিতে হইল। পরশুরামের গল্পেীজী মেঘনাদবধকাব্য উচ্চারণ করিলে আমাদের কর্ণে যে পীড়ার সঞ্চার হইবে, আমাদের সংস্কৃত উচ্চারণ পশ্চিম ও উত্তর ভারতীয়দের সেই রকমই পীড়া দেয়।

বাঙালি সংস্কৃত ব্যঞ্জনের ঞ, ণ, য, অন্তস্থ ব, ষ, স উচ্চারণ করিতে পারে না ও যুক্তাক্ষরের (আত্মা, যক্ষ ইত্যাদি) উচ্চারণে অনেকগুলি ভুল করে। স্বরবর্ণের অ, ঐ, ঔ ভুল উচ্চারণ করে ও সর্বাপেক্ষা মারাত্মক এই যে স্বরের উচ্চারণে দীর্ঘশ্বরের প্রতি ক্ষেপমাত্র করে না। তাহাতে বিশেষ করিয়া মন্দাক্রান্তা পড়িলে মনে হয় ভগবানের অপার করুণা যে, কালিদাস জীবিত নাই।

বাঙালি যখন আরবি উচ্চারণ করে, তখন এই মারাত্মক অবস্থার পুনরাবৃত্তি হয়। বাঙালি (কি হিন্দু কি মুসলমান) আরবি বর্ণমালার সে, হে, জাল, স্বাদ, দ্বাদ, তৃয়, জয়, আইন, গাইন, কাফ, হামজা, অর্থাৎ বর্ণমালার ৪, ৬, ৯, ১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২১ ও ২৯ ভুল উচ্চারণ করে ও সংস্কৃতে হ্রস্ব-দীর্ঘ যেমন অবহেলা করিত, সেইরকমই আরবিতেও স্বরের হ্রস্ব-দীর্ঘের কোনও পার্থক্য করে না। কিন্তু শুধু কোরান পাঠের জন্য এক শ্রেণির বিশেষজ্ঞ আছেন। তাহাদিগকে কারী বলে; দ্রাবিড়ে যেমন সামবেদ গাহিবার জন্য এক শ্রেণির বিশেষ আইয়ার– আয়ঙ্গার ব্রাহ্মণ আছেন। বাঙালি কারীরা দীর্ঘ-হ্রস্ব মানেন ও ব্যঞ্জনে শুধু ৪, ৯, ১৫-তে ভুল করেন।

আমরা সংস্কৃত উচ্চারণে ভুল করি তাহার প্রধান কারণ, আমরা আর্য-সভ্যতার শেষ সীমা প্রান্তে বাস করি। (আর্য-সভ্যতা বাঙলা ছাড়াইয়া বর্মায় যাইতে পারে নাই ও বালি-জাভায় বিকশিত হইল বটে, কিন্তু প্রাণধারণ করিতে পারিল না)। আমাদের ধমনিতে আর্য-রক্ত অতি কম বলিয়াই আর্য উচ্চারণ করিতে অক্ষম হই। আমরা যে আরবি উচ্চারণ করিতে পারি না, তাহাও ঠিক সেই কারণেই। আরবি সেমিতি ভাষা, তাহার যেসব কঠিন উচ্চারণ মুখের নানা গোপন কোণ হইতে বহির্গত হয়, তাহা বাল্যকাল হইতে না শুনিলে আয়ত্ত করা প্রায় অসম্ভব।

গত শুক্রবারে রেডিয়োতে কোরান পাঠ ও শনিবারে সংস্কৃত শাস্ত্র পাঠ ও উভয়ের বাঙলা অনুবাদ ও টিপ্পনী শুনিয়া উপরোল্লিখিত চিন্তাধারা মনের ভিতর তরঙ্গ খেলিয়া গেল। রেডিয়োর কোরান পাঠ মুসলমানদের কাছে আদর পাইয়াছে কি না জানি না, কিন্তু তাহারা যে কান দিয়া শুনেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এক বৃহৎ মুসলমান পরিবারে লক্ষ করিয়াছি, বুড়া কর্তারা রেডিয়োটা দুই চক্ষে দেখিতে পারেন না, দুই কানে শুনিতে পারেন না। তাহাদের বিশ্বাস ইসলামে সঙ্গীত অসিদ্ধ ও ওই যন্ত্রটি সেইসব শয়তানি জিনিস লইয়া কারবার করে, ছোকরাদের বিগড়াইয়া দেয়। অথচ শুক্রবার সকালবেলা দেখি গুঁড়িগুড়ি রেডিওঘরের দিকে চলিয়াছেন তাবৎ বুড়াবুড়িরা। আধ ঘণ্টা পূর্ব হইতে কলকাতা ছাড়া অন্য কোনও বেতারকেন্দ্রে রেডিয়ো জুড়িবার উপায় নাই। তার পর মুদ্রিত চক্ষে ভক্তিরসে পরিপূর্ণ হৃদয়ে অতি নীরবে কোরান পাঠ শ্রবণ করেন। অনুবাদ ও টিপ্পনী কেহ শোনেন, কেহ শোনেন না।

এই সব বৃদ্ধ-বৃদ্ধার প্রতি কলকাতা কেন্দ্রের কর্তব্য আছে।

যে কারী সাহেব কোরান পাঠ করিলেন, তাহার উচ্চারণ সাধারণ বাঙালি কারী অপেক্ষা ভালো সন্দেহ নাই। তাঁহার দীর্ঘ-হ্রস্ব দুরস্ত, তাঁহার আইন কাফ হে ঠিক, কিন্তু তাঁর সে জাল ও দ্বাদ (4, ৯, ১৫) বারে বারে দুঃখ দেয়, বিশেষ করিয়া সে ও জাল, কারণ ইজা (যখন) ও সুম্মা (তৎপর) দুইটি কথা আরবিতে এবং সর্বভাষাতেই ঘন ঘন আসে।

কারী সাহেবের বাঙলা উচ্চারণে আরবির গন্ধ পাওয়া যায়– পাদ্রি সাহেবের বাঙলাতে যেরকম ইংরেজি গন্ধ আমাদিগকে পীড়িত করে আমরা বাঙলায় বলি যখন (যখোন), কারী সাহেব বলেন, য্যখ্যন যেন য ও খ-র ভিতরে আরবি আকার বা জবর রহিয়াছে।

শাস্ত্র যিনি পাঠ করিলেন তাহার উচ্চারণ সাধারণ বাঙালি অপেক্ষা শতগুণে ভালো সন্দেহ নাই কিন্তু কোনও মারাঠি বা যুক্তপ্রদেশীয় পণ্ডিত সে উচ্চারণের প্রশংসা করিবেন না। তাহার প্রধান কারণ যে শাস্ত্ৰ-পাঠকের হ্রস্ব-দীর্ঘ যথেষ্ট পরিমাণে হ্রস্ব ও যথেষ্ট পরিমাণে দীর্ঘ নহে। হ্রস্ব-দীর্ঘে তিনি এত সামান্য পৃথক করেন যে, বানান জানা সত্ত্বেও কানে ঠিক ঠিক বাজে না। তাঁহার বাঙলা উচ্চারণও পণ্ডিতি অনেকটা কথক-ঠাকুরদের মতো।

দুইজনেরই অনুবাদ ও টীকা নৈরাশ্যজনক। প্রভু ইসা (খ্রিস্ট) ও হাওয়ারিগণের বর্ণনা বাঙলার মুসলমান কী প্রকারে বুঝিবে, তাহাতে যদি বেশ কিছুদিন ধরিয়া প্যালেস্টাইনের ইতিহাস ও ভূগোল না শোনানো হয়। সকলেই তো শূন্যে ঝুলিতে থাকিবেন ও শাস্ত্র শোনা হইবে বটে, কিন্তু বোঝা বা আলোচনা তো হইবে না।

শাস্ত্ৰ-পাঠক যে ঊর্ধ্বশ্বাসে অনুবাদ ও টীকা করিয়া গেলেন তাহাতে আমার মতো মূর্খ কিছুই বুঝিতে পারিল না। টোলে কৃতবিদ্য ছাত্রকে যে ধরনে দ্রুতগতিতে টীকা শোনানো হয়, ইহার অনেকটা তাই। সাধারণ বাঙালি ধৰ্মতৃষিতকে আরও সরল, আরও সহজ করিয়া না বুঝাইলে টীকাদান পণ্ডশ্রম হইবে।

কারী সাহেব ও শাস্ত্রী মহাশয়ের নিন্দা করা আমাদের উদ্দেশ্য নহে; আমরা জানি তাহারা যে কোনও মসজিদ-মাদ্রাসা, যে কোনও টোল-চতুম্পাঠীতে সম্মান ও আদর পাইবেন– আমরাও দিব। কিন্তু অল ইন্ডিয়া রেডিওর উচিত আরও ভালো আরও উত্তম, এক কথায় সর্বোত্তম কারী সর্বোত্তম শাস্ত্ৰপাঠক আনয়ন করা। ইংরেজিতে বলে, সর্বোত্তম উত্তমের শত্রু।

তাবৎ বাঙলা ও কিছু কিছু বিহার উড়িষ্যা আসামকে সপ্তাহের পর সপ্তাহ যে উচ্চারণ পরিবেশন করা হয় তাহার জন্য রেডিওকর্তার দায়িত্বজ্ঞান ও বিবেকবুদ্ধি অনেক বেশি হওয়া উচিত ও তাহাদিগকে অনেক পরিশ্রম করিয়া সর্বোত্তম কারী-শাস্ত্রী সন্ধান করা উচিত। অথবা অর্থব্যয় করিয়া উপযুক্ত লোক প্রস্তুত করা উচিত।

শুনিয়াছি মিশরের কারী রেফাৎ রমজান মাসে কোরান পাঠের জন্য ১৩০০ টাকা পারিশ্রমিক পান; কাইরো কলকাতা অপেক্ষা ধর্মপ্রাণ একথা কে বলিবে?

সর্বশেষে বক্তব্য, পাঠক যেন না ভাবেন, মন্দ উচ্চারণে আমরাই একা। আর্যসভ্যতার অন্য প্রান্ত অর্থাৎ ইংলন্ডের অবস্থাও তাই। সেখানে বড় বড় পণ্ডিতদের লাতিন উচ্চারণ শুনিলে কানে আঙুল দিতে হয়। তবে ইংলন্ডে উচ্চারণ শুদ্ধ করিবার জন্য জোর আন্দোলন চলিতেছে, এদেশে–থাক সে কথা।

.

০২.

উচ্চারণ সম্বন্ধে আলোচনায় যোগ দিয়াছেন শ্ৰীযুত মুখোপাধ্যায়, কাব্য ব্যাকরণস্মৃতিতীর্থ, সাহিত্যশাস্ত্রী, ভূতপূর্ব অধ্যাপক, সংস্কৃত কলেজ। পাঠক বুঝিতে পারিতেছেন, এহেন পণ্ডিতের সঙ্গে উচ্চারণ সম্বন্ধে আমি আলোচনা করিতে পারি, কিন্তু তর্ক করিবার মতো যুগ্ম মস্তক স্কন্ধে নাই। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে শাস্ত্রী মহাশয়ের শেষ বাক্য আমাদের মতের সঙ্গে মিলিয়া গিয়াছে বলিয়া তর্কাতর্কির বিশেষ প্রয়োজন হইবে না। তাঁহার শেষ বাক্য সকল কথার পর তবুও স্বীকার্য যে, বাঙালির সংস্কৃত উচ্চারণ ত্রুটিপূর্ণ, কিন্তু তাহার পূর্বে সকল কথার মাঝখানে শাস্ত্রী মহাশয় এমন কথাও তুলিয়াছেন যেখানে অধম কিঞ্চিৎ প্রগলভতা প্রকাশ করিবে। শাস্ত্রী মহাশয় এবং অন্যান্য সহৃদয় পত্রপ্রেরকও দর্শাইয়াছেন যে, অবাঙালি সংস্কৃত পণ্ডিত ষ ও খতে পার্থক্য রাখেন না। কিন্তু তাহা হইতে কী সপ্রমাণ হয় ঠিক পরিষ্কারভাবে বুঝাইয়া বলেন নাই। ব্যঞ্জনায় বুঝিতেছি শাস্ত্রী মহাশয়ের বলার উদ্দেশ্য যে, যেহেতুক অবাঙালি পণ্ডিতও ঠিক ঠিক উচ্চারণ করিতে পারেন না, তবে বাঙালিরই-বা দোষ কী?

ইহার উত্তরে বক্তব্য এই যে, মারাঠি, দ্রাবিড় ও কাশীর পণ্ডিত যখন সংস্কৃত উচ্চারণ করেন, তখন প্রাদেশিক বৈশিষ্ট্যবশত কিছু কিছু পার্থক্য তাহাদের উচ্চারণের মধ্যে থাকে। ওইসব পণ্ডিতের একে অন্যের উচ্চারণে যে পার্থক্য তাহা যেন একইরঙের পৃথক পৃথক ফিকা ভাব অথবা গাঢ়। বাঙালির উচ্চারণ যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন রঙ। দক্ষিণের আইয়ার হয়তো যতটা দীর্ঘ করিলেন, উত্তরে কাশীবাসী হয়তো ততটা করিলেন না। এবং শেষ পর্যন্ত বাঙালি যে অত্যন্ত পৃথক কিছু উচ্চারণ করে তাহা এই তথ্য হইতে সপ্রমাণ হয় যে, আইয়ার, নষুদ্ৰী, চিতপাবন, দেশ, করাঢ় (এমনকি মহারাষ্ট্রের দেশস্থ ও ঔপনিবেশিক দ্রাবিড়স্থ), উদীচী, ভার্গব, নাগর ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়গণ ও তাঁহাদের শিষ্য ব্রাহ্মণগণও একে অন্যের উচ্চারণের পার্থক্য লইয়া ঈষৎ আলোচনা করিয়া একটি সাধারণ রূপ বা নর্ম (norm) স্বীকার করেন, কিন্তু বাঙালির উচ্চারণ যে সম্পূর্ণ পৃথক এবং পরস্পর-বিরোধিতায় কণ্টকাকীর্ণ সে সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ প্রকাশ করেন না।

(ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে উচ্চারণের পার্থক্য হয় প্রধানত দীর্ঘস্বরের দৈর্ঘ্য, হ্রস্বস্বরের হ্রস্বতা, ঝ, ৯, ও ষ লইয়া। সব কয়টির আলোচনা এক কলমে ধরাইবার মতো কলমের জোর অধমের নাই। উপস্থিত য লইয়া আলোচনা করিব, পরে প্রয়োজন হইলে অন্যান্যগুলির হইবে। ষ যে খ নয় সে বিষয়ে তর্ক করিবার কোনও প্রয়োজন নাই। কিন্তু ষ-এর উচ্চারণ কেন খ হইল তাহার আলোচনা করিলে মূল ষ-এর কিঞ্চিৎ নির্দেশ পাওয়া যায়। প্রথম দ্রষ্টব্য ষ স্থলে বিদেশি পণ্ডিত যখন খ বলেন, তখন তাহারা দুই দলে বিভক্ত; কেহ কেহ উচ্চারণ করেন পরিষ্কার খ অর্থাৎ ক বর্গের মহাপ্রাণ খ এবং কেহ কেহ উচ্চারণ করেন ঘর্ষণজাত আরবির খ— কাবুলিরা যেরকম খবর বলে, স্কচরা যেরকম লখ LOCH বলে, জর্মনরা যেরকম BACH বলে। এই দ্বিতীয় খ উচ্চারিত হয় পণ্ডিত যখন ষ-কে শ হইতে পৃথক করিবার জন্য অত্যধিক উল্কণ্ঠিত হইয়া জিহ্বা মূর্ধা হইতে সরাইয়া আরও পশ্চাৎ দিকে ঠেলেন। এই কারণেই আর্যভাষা পশতুতেও তাহা দেখা যায়– কেহ বলে পশুতু, কেহ বলে পখতু, কেহ বলে পেশাওয়ার, কেহ বলে পেখাওয়ার। এই কারণে জর্মনে Becher-এর ch ষ-এর মতো, অথচ Bach-এর ch আরবি খ-এর ন্যায়। ষ-কে এইজাতীয় খ করা অবশ্য ভুল, আমি মাত্র কারণটি ও নজিরগুলো দেখাইলাম। কিন্তু ষ-এর আসল শুদ্ধ উচ্চারণ সম্বন্ধে মতানৈক্য হওয়া অনুচিত। অত্যধিক উল্কণ্ঠিত (উভয়ার্থে) না হইয়া মুখগহ্বরের যে স্থল অর্থাৎ মূর্ধা হইতে ট, ঠ, ড, ঢ ও পরে ওই স্থলে য বলিলে মূর্ধণ্য য বাহির হইবে।)

বাঙালির সংস্কৃত উচ্চারণের কৈফিয়ৎ দিয়াছেন হিন্দুস্থান পার্ক হইতে শ্রীআচার্য। তাহার বক্তব্য কোনও ভাষা আয়ত্ত করিতে হইলে তার সাহিত্য, ব্যাকরণ এবং ধ্বনিতত্ত্বে পারদর্শী হওয়া বাঞ্ছনীয় সন্দেহ নাই। আমাদের মতের সঙ্গে আচার্য মহাশয়ের মতে মিলিল কিন্তু তিনি বলিতেছেন—

কিন্তু জাতীয় অভ্যাসের প্রতিকুলতা নিবন্ধন যদি সেই ভাষার উচ্চারণে অসম্পূর্ণতা থাকিয়া যায়, তাহাতে কোনও পণ্ডিত ব্যক্তির লজ্জা পাওয়ার কোনও কারণ আছে বলিয়া মনে করি না।

আচার্য মহাশয় তাহার চিঠিতে নিজের কোনও উপাধির উল্লেখ করেন নাই, অথচ পত্রখানি গভীর, পাণ্ডিত্যে পূর্ণ। তাই প্রতিবাদ করিতে সাহস পাইতেছি না, অথচ উপরের নীতিটি এতই বিপজ্জনক যে, নিতান্ত অনিচ্ছায় করিতেছি। কারণ যদি এই নীতিই অনুসরণ করিতে হয়, তবে বলিতে হইবে যেহেতু আমরা বাঙালি, আমাদের জাতীয় অভ্যাসের প্রতিকূল হয় তাই আমরা F ও ফয়ের তফাৎ করিব না, th-এর শুদ্ধ উচ্চারণ শিখিব না, কুরান বঙ্গীয় ইসলামি কায়দায় পড়িব, মন্দাক্রান্তার দীর্ঘ না মানিয়া উদয়াস্ত কালিদাসকে জবাই করিব। এই নীতি আরও অনুসরণ করিয়া বলিব, আমরা বাঙালি, বাঙলা ভাষার লিঙ্গ নাই, সংস্কৃত লিখিবার সময় লিঙ্গভেদ করিব না। দ্বিবচন মানিব না; হিন্দি বলিবার সময় একঠো, দুইঠো করিব, গাড়ি আতা হৈ বলিব– এক কথায় জাতীয় অভ্যাসের দোহাই দিয়া বিজাতীয় কোনও ভাষাই তাহার স্বরূপে গ্রহণ করিব না; সুকুমার রায়ের হ য ব র ল-য়ের দর্জির ৩২ ইঞ্চি ফিতা দিয়া মাপিলে যেমন সবকিছু ৩২ ইঞ্চি হইয়া যাইত। আমাদের জাতীয় অভ্যাসের বকযন্ত্রে চোলাই করা সর্ব উচ্চারণ শুদ্ধ একহল হইয়া বাহির হইবে তাহার বর্ণগন্ধ থাকিবে না।

লজ্জা বা শ্লাঘার কথা হইতেছে না; অভ্যাসটি বাঞ্ছনীয়। বেদমন্ত্র ঠিক কী প্রকারে উচ্চারিত হইত জানি না, কিন্তু চেষ্টা তো করিতে হইবে জানিবার জন্য। সেই চেষ্টাতেই তো

পণ্ডিতে ও আমাদের মতো সাধারণ লোকের তফাৎ। যুক্তপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মদ্র, গুর্জর পার্থক্য সত্ত্বেও একটি (norm) মানিয়া লইয়াছেন, নিরপেক্ষ ইউরোপীয় পণ্ডিতগণও সেটি স্বীকার করিয়া লইয়াছেন– তবে আমাদের কর্তব্য কী?

আচার্য মহাশয় ভুল উচ্চারণ চাহেন না, কিন্তু তাঁহার মতো পণ্ডিত যদি সে উচ্চারণের সপক্ষে এককাড়ি অজুহাত দেন, তবে আমাদের মতো সরল লোক জাতীয় অভ্যাসের তাকিয়ায় ঠেসান দিয়া আরামে নিদ্রা যাইব– এই আমার ভয়।

এস্থলে বলিয়া রাখা ভালো যে, যদিচ জাভার মুসলমান ও মক্কার মুসলমান এক রকম উচ্চারণে কোরান পড়েন না, তবু জাভার মুসলমান হামেহাল চেষ্টা করেন নর্মের (norm) দিকে অগ্রসর হইবার। পূর্ব বাঙলার মুসলমানদের আরবি উচ্চারণ খারাপ, কিন্তু জাতীয় অভ্যাসের বিরুদ্ধে জেহাদ হামেসা চালু রাখেন বলিয়া তাহাদের আরবি উচ্চারণ বাঙালির সংস্কৃত উচ্চারণ অপেক্ষা নর্মের (norm-এর) অনেক কাছে।

আচার্য মহাশয় দূরদৃষ্টি ও অভিজ্ঞতাজাত অন্যান্য মনোরম তথ্যও বলিয়াছেন। সেগুলি পণ্ডিত-অপণ্ডিত সকলেরই জানা উচিত। সুবিধামতো সেগুলি পাঠকের সম্মুখে উপস্থিত করিব।

অন্যান্য চিঠিও পাইয়াছি, লেখকদের ধন্যবাদ। এ মূর্খকে জ্ঞানদান করিবার জন্য তাহাদের প্রচেষ্টা কৃতজ্ঞ হৃদয়ে বার বার স্বীকার করি।

.

পরাজিত জর্মনি

০১.

জর্মনি হারিয়া গিয়াছে। দুঃস্বপ্ন কাটিয়াছে। সমর-নেতারা যুদ্ধের দুশ্চিন্তা ত্যাগ করিয়া আবার কুচকাওয়াজের সত্যযুগে ফিরিয়া যাইবার তালে পা ফেলিবার চেষ্টায় আছেন।

কিন্তু রাজনৈতিকদের দুশ্চিন্তার অবসান হইল না। বরঞ্চ এতদিন যে মাথাব্যথা শুদ্ধ সামরিক মাথাকে গরম করিয়া রাখিয়াছিল সে আজ রাজনৈতিকদের আহার ও নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটাইতেছে। সমস্যাটা এই, পরাজিত জর্মনিকে লইয়া কী করা যায়।

১৯১৮ সালে এ সমস্যা ছিল না। নিবীর্য রুশ তখন নিজের গৃহসমস্যা লইয়া ব্যস্ত। জর্মনি সম্বন্ধে সে তখন সম্পূর্ণ উদাসীন। ১৯৪৫ সালে অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। রুশ জর্মনিকে লইয়া কী ভেল্কিবাজি খেলিবে, তাহা মিত্রশক্তির কর্তারা ঠিক আঁটিয়া উঠিতে পারিতেছেন না। অথচ দাবা খেলায় অন্য পক্ষের চালের জন্য যেরকম অবিচলিত চিত্তে বসিয়া থাকা যায় এস্থলে তাহা সম্ভবপর নয়।

জর্মনিকে মিত্রপক্ষের কোন চণ্ডীমণ্ডপের সম্মুখে বলি দিবেন আর রুশরা কোন দর্গায় সিন্নি চড়াইবেন সে বিষয়ে আমাদের দুর্ভাবনা নাই। কারণ প্রসাদ আমরা পাইব না, পাইবার ইচ্ছাও রাখি না। কিন্তু ঠিক এই কারণেই আমাদের এ বিষয়ে কিছু বলা নিতান্ত অশোভনীয় হইবে না। জর্মনি সম্বন্ধেই এযাবৎ যে কেতাবপত্র বাহির হইয়াছে ও হইতেছে, খবরের কাগজে যে বত্রিশভাজার পরিবেশন হইতেছে তাহা হইতে ইহাই প্রমাণ হয়– সকলেরই কিছু-না-কিছু স্বার্থ আছে। আমরা নিঃস্বার্থ, আমাদের মতামতে তাই কিঞ্চিৎ নিরপেক্ষতা থাকিবে, আর কিছু না থাকুক।

গোড়াতেই বলিয়া রাখা ভালো যে, জর্মনি বিশেষ করিয়া পরাজিত জৰ্মনি আমাদের শত্রু নয়, মিত্রও নয়। তবে নাৎসিদের আমরা চিরকালই অপছন্দ করিয়াছি। তাহার অন্যতম কারণ নাৎসিরা গায়ে পড়িয়া বহুবার ভারতবর্ষ ও তাহার সভ্যতার প্রতি কটুক্তি করিয়াছে। তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ রজেনবের্গ সাহেবের বিংশ শতাব্দীর মিথ নামক কেতাবে বিস্তর পাওয়া যায়। রজেনবের্গ সাহেবের পরিচয় বিশদভাবে দিবার প্রয়োজন নাই। হিটলার তাঁহাকে জর্মনির আধ্যাত্মিক গুরু (গাইসটস ফুরার) বলিয়া স্বীকার করিয়াছিলেন।

রজেনবের্গ সাহেব প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিয়াছেন যে, পৃথিবীর সভ্যতা ও কৃষ্টিতে বৃহত্তম দান করিয়াছে, (ক) আর্যরা, (খ) আর্যদের মধ্যে আর্যতম আর্য হইলেন নীল চোখওয়ালা, সোনালি চুলওয়ালা নর্দিক জর্মনরা।

প্রথম তথ্য সম্বন্ধে রজেনবের্গ সাহেবের মনে কোনও সন্দেহ নাই, কারণ রজেনবের্গের বহু পূর্বে ভিয়েনার খ্যাতনামা পণ্ডিত লেওপল্ড ফন শ্লোডার বহু যুক্তি-তর্ক দ্বারা প্রায় সপ্রমাণ করিয়া গিয়াছেন যে, আর্যরা সেমাইট (ইহুদি ও আরব) ও মঙ্গলীয়দের চেয়ে বহু গুণে শ্রেষ্ঠ।

কিন্তু নর্দিক জর্মনরাই যে সর্বোকৃষ্ট আর্য এ বিষয়ে রজেনবের্গের মনে ধোকা ছিল। কারণ আর্যসভ্যতা লইয়া যাহারা লম্ফঝম্ফ করেন তাহাদের প্রথমেই খবর লইতে হয় আর্যের ইতিহাস কোথায় পাওয়া যায়। আর সে অনুসন্ধান করিতে গেলেই স্বেচ্ছায় হউক, অনিচ্ছায় হউক, ভারতবর্ষের আর্যদের দ্বারস্থ হইতে হয়। কারণ ইউরোপীয় আর্যদের মাথার মণি গ্রিক সভ্যতার গোড়াপত্তনের পূর্বেই অন্তত তিনখানা বেদের মন্ত্র রচনা শেষ হইয়া গিয়াছে, উপনিষদের ঋষি সক্রেটিসের পরম বৃদ্ধ পিতামহের ন্যায় বয়সে ও জ্ঞানে। কাজেই ভারতবর্ষীয় আর্যরা যদি আর্য জাতির ঠিকুজিকুষ্ঠি লইয়া বসিয়া থাকে তবে নর্দিকদের কী গতি হয়। রজেনবের্গ বলিলেন যে, ভারতবর্ষীয় আর্যদের এই বিষয়ে কৌলীন্য আছে সন্দেহ নাই, কিন্তু অদ্যকার ভারতবর্ষীয়রা সে আর্য নয়। ইহারা জারজ, এখনও গঙ্গাস্নান করিয়া ইহারা নিজেদের বর্ণসংকর পাপের ক্ষালন করিবার চেষ্টায় সর্বদাই রত। গঙ্গাস্নানের কী অপূর্ব অর্থ নিরূপণ ও সঙ্গে সঙ্গে নর্দিক কৌলীন্যের কী আশ্চর্য কুতুবমিনার নির্মাণ!

একথা আমরা আজ আর তুলিব না যে নর্দিক অর্যে বর্ণসংকর আছে কি না ও থাকিলে কী পরিমাণ। আমাদের বক্তব্য যে, রজেনবের্গ প্রমুখ নাৎসিরা যে আর্যামির বন্যায় জর্মন জাতকে ভাসাইয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন তাহা আমাদের অজানা নহে। এ বন্যা আমাদের দেশেও এককালে বহিয়াছিল ও পরবর্তী যুগে আমাদের রাজনীতিকে গণ্ডিভূত করিবার চেষ্টা করিয়াছিল। এ বিষয়ে পূজনীয় দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১২৯৭ সনে কী বলিয়াছিলেন উদ্ধৃত করিতেছি। রজেনবের্গের তখনও জন্ম হয় নাই।

ম্যাকসমুলার ভট্টের অভ্যুদয়ের পূর্বে আর্য বলিয়া যে একটি শব্দ অভিধানে আছে তাহা তাঁহারা (অর্থাৎ আর্যামির পাণ্ডারা) জানিতেন কি না সন্দেহ। তাহার পর ম্যাকমুলার যখন উঠিয়া দাঁড়াইয়া পৃথিবীময় আর্যমন্ত্রের বীজ ছড়াইতে আরম্ভ করিলেন তখন তাহার দুই-এক রত্তি ছিটা তাঁহাদের কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইবামাত্র সেই মুহূর্ত হইতে তাঁহাদের মানসক্ষেত্রে আর্যামির অঙ্কুর গজাইতে আরম্ভ করিল। বিলাত হইতে আর্যমন্ত্রের আমদানি হইল– আর আমাদের দেশশুদ্ধ সমস্ত কৃতবিদ্য যুবক আর্য আর্য বলিয়া ক্ষেপিয়া উঠিলেন; তাহাদের সহস্র কণ্ঠে উদ্গীত আর্য নামের চিৎকার-ধ্বনিতে ইয়ং বেঙ্গলের গাত্রে থর থর কম্প উপস্থিত হইল। ব্রাহ্মণদের ব্রাহ্মণদেব দানোয়া-পাওয়া শবদেহের ন্যায় মৃত্যুশয্যা হইতে সহসা গাত্রোখান করিয়া পৈতা মাজিতে বসিয়া গেলেন এবং ফিরে-ফির্তি কোমর বাঁধিয়া সন্ধ্যা-গায়ত্রী মুখস্থ করিতে আরম্ভ করিলেন।

আমরা যেরূপ একদিন পৈতা মাজিতে ও সন্ধ্যা-গায়ত্রী মুখস্থ করিতে বসিয়া গিয়াছিলাম, রজেনবের্গ সাহেবও সেইরকম নর্দিক নীল চোখকে নীলতর ও সোনালি চুলকে সোনালিতর করার চেষ্টায় মশগুল হইলেন। আমরা যেরকম ভুলিয়াছিলাম যে

কর্তব্যমাচরন কার্যমকর্তব্যমনাচরন।
তিষ্ঠতি প্রকৃতাচারে স বা আর্য ইতি স্মৃতঃ।

অর্থাৎ কর্তব্য আচরণ করিয়া এবং অকর্তব্য অনাচরণ করিয়া যিনি প্রকৃত আচারে দৃঢ়নিষ্ঠ হন তিনি আর্য শব্দের বাচ্য।

রজেনবের্গ প্রমুখ নাৎসিরাও এই মহাবাক্য ভুলিলেন।

আমরা একদিন ভুলিয়াছিলাম বলিয়া আমাদের রাজনীতি সেদিন সম্প্রদায়মুক্ত হইতে পারে নাই। পরবর্তী যুগে আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলন আর্যামির হাত হইতে নিষ্কৃতি পায়। এই আবহাওয়ায় আমাদের নাভিশ্বাস উঠে বলিয়াই জিন্না সাহেব যখন বলেন, কংগ্রেস হিন্দু প্রতিষ্ঠান, তখন আমরা আপত্তি জানাই। সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানগুলি স্ব স্ব আর্যামি লইয়া থাকুন; কিন্তু সাম্প্রদায়িক দম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত নাৎসি আন্দোলনের ভাগ্যচক্রগতি দেখিয়া যেন পদক্ষেপ করেন।

নাৎসিদের এই দম্ভের চরম প্রকাশ হইল পৃথিবী জয়ের বাসনায়। তাহার পূর্বে জর্মনি জয়ের কার্যে তাহারা নিযুক্ত হইলেন। ইহুদিদের নির্যাতন; নাৎসি সাম্প্রদায়িকতায় যাহারা বিশ্বাস করেন না তাঁহাদের উৎপীড়ন, এমনকি জ্ঞান-বিজ্ঞানের মন্দির হইতে হাইনে, আইনস্টাইন, মানি প্রভৃতি মৃত জীবিত মনষীদের বহিষ্করণ।

বিচক্ষণ জর্মনরা যে ইহার বিরুদ্ধে কিছু বলে নাই এমন নহে। শুধু বিচক্ষণেরাই যে নাৎসি-দর্শনের প্রতিবাদ করিয়াছিলেন তাহা নহে, জর্মনির জনসাধারণও তাহাদের ব্যঙ্গোক্তি আড়ালে অন্তরালে অনেকখানি প্রকাশ করিয়াছিল। একটি ধাঁধার ভিতর দিয়া সে ব্যঙ্গোক্তি, তাহারা বিদেশিদের কাছে প্রকাশ করিত ও তাহাদের নাৎসি তন্ত্রজ্ঞানের পরীক্ষা লইত।

ধাঁধাটি এই—

প্রশ্ন : আদর্শ আর্য কে?

উত্তর : তাহার জন্ম হইবে ফুরারের দেশে, সে বীর প্রস্থে হইবেন গ্যোরিঙের ন্যায়, দৈর্ঘ্যে গ্যোবেলসের ন্যায়, নামে রজেনবের্গের ন্যায়, কার্যক্ষেত্রে ফন রিবেট্রপের ন্যায়। (সকলেই জানেন হিটলারের জন্মভূমি জর্মনি নয়, গ্যোরিঙ ও গ্যোবেলসের একজন মোটা একজন বেঁটে; রজেনবের্গের নামে আছে ইহুদি নামের বোটকা গন্ধ ও রিবেট্রপ শৌকি।)।

তবু স্বীকার করিতে হইবে যে, আর্যামি জর্মনিতে ব্যাপকভাবে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল; পরে সে আর্যামির দম্ভ চেকোশ্লোভাকিয়া, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি প্রভৃতি বিজিত দেশে, এমনকি ইতালির ন্যায় মিত্ররাজ্যে (কাউন্ট চানোর অধুনাপ্রকাশিত রোজনামচা দ্রষ্টব্য) তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি করিয়াছিল। আজ যে রুশেরা বন্ধানে অনেকটা সুবিধা পাইতেছে, তাহার কারণ এই নহে যে বল্কানরা সকলেই ভাবে যে, রুশ তাহাদের পরম মিত্র, বরঞ্চ যুক্তিধারা অনেকটা এইরকম : শত্রুর শত্রু মিত্র না-ও হইতে পারে, কিন্তু মিত্রবৎ।

জর্মনির নাৎসি কর্তারা কী রাজরাজেশ্বরের হালে দিন কাটাইতেন, সে সকলেই জানেন। গাঁজার নেশাটা করিলেন কর্তারা, মাথাধরাটা পাইল জনসাধারণ। তাহারা প্রাণ দিল রুশিয়ার দুস্তর প্রান্তরে ক্ষুধায় শীতকষ্টে অথবা রুশনগরদ্বারে, রাস্তায় গলিতে গুলিতে বিস্ফোটকে; অথবা নরমাদিতে সামনে মিত্রশক্তির ট্যাঙ্ক, কামান, উপরে বোমারু, পিছনে ফরাসি গেরিল্লা মাতা বসুন্ধরা তাহাদের আবেদন শুনিবার পূর্বেই বোমারু জাহাজ মাতার বক্ষস্থল বিদীর্ণ করিয়া দিতেছিল, কিন্তু হায়রে, সেখানেও আশ্রয় কোথায়?

দেশের কথায় বলে, খেলেন দই রমাকান্ত বিকারের বেলা গোবর্ধন। আজ সমস্ত জৰ্মনি জুড়িয়া যে বিকার ও ভবিষ্যতে যে কী সান্নিপাতিক জ্বর হইবে, তাহার কল্পনা করাও আমাদের পক্ষে শক্ত। ইংরেজ, আমেরিকান, রুশ ত্রিদোষ হইয়া জর্মনির গোবর্ধনগুলিকে কোন শ্মশানযাত্রায় লইয়া যাইতেছেন, তাহার খবর কে রাখে।

এতদিন খবর পাইতেছিলাম যে, রমাকান্তগুলিকে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা হইতেছে ও তাহারা যে বিকার হইতে নিষ্কৃতি পাইবে এমন নহে। তাহাদের জন্য বিশেষ গারদ, বিশেষ বিচার, এমনকি বিশেষ হাড়িকাঠও নির্মিত হইতেছে। ফাঁসি অথবা গুলির কর্ম নয়, খাস জর্মন কায়দায় তাহাদিগকে গিলোটিনে গলা দিতে হইবে। আমরা শোক প্রকাশ করিতেছি না, আনন্দিতও হইতেছি না। আমরা ভারতবাসী; কর্মফলে বিশ্বাস করি। দই খাইলে বিকার হইবেই। কিন্তু ইতোমধ্যে হঠাৎ একটি খবর পাইয়া আমরা স্তম্ভিত হইলাম। খবরটি এই জেবিক-হলস্টাইনে নাকি প্রায় সোয়ালক্ষ জর্মন সৈন্য ও অফিসারকে জিয়াইয়া রাখা হইয়াছে। তাহাদের নিরস্ত্র করা হয় নাই। পাছে বিশ্বসুদ্ধ লোক খবর পাইয়া আঁতকাইয়া উঠে, তাই অত্যন্ত সান্ত্বনাপূর্ণ এই খবরটিও সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া হইয়াছে যে, তাহাদের রসদ মাত্র দশ রোদ চালাইবার মতো। যে অঞ্চলে এই নোনা ইলিশরা বিরাজ করিতেছেন, সেখানে তাঁহারা সর্বময় কর্তা, এমনকি সে অঞ্চলে যদি তাঁহাদের খানাপিনার অসুবিধা হয়, তবে পার্শ্ববর্তী জর্মনিও সম্ভবত ডেনমার্ক হইতে আহারাদি যোগাড় করিতে পারিবেন। হেমলেটি ভাষায় বলি, ইহারা যে পাঁড় নাৎসি, সেকথা জানাইবার জন্য দৈববাণীর প্রয়োজন নাই।

সঙ্গে সঙ্গে এই খবরও পাইলাম যে, প্রায় ৪৫ মিলিয়ন পাউন্ড খরচা করিয়া (প্রতি বৎসরে না প্রতি তিন বৎসর এ কথাটা রয়টার কাজের হিড়িকে ঘুলাইয়া ফেলিয়াছেন) একটি পাকাঁপোক্ত পোলিশ বাহিনী ইংলন্ডে মজুদ রাখা হইয়াছে। ইহারাও জনবুল মার্কা ষাঁড় লাল রঙের কট্টর দুশমন।

এই যে ইংলন্ডের হাঁড়িতে জিয়ানো যশোরে কই, জেবিক-হলস্টাইনে জমানো পদ্মার নোনা ইলিশ, ইঁহারা লাগিবেন কোন কর্মে কোন পরবে? নতুন রাজনীতির জন্মদিনের দাওয়াতে, না ইউরোপের দ্বিতীয় কাঁপালিক শ্রদ্ধবাসরের ভোজে?

.

০২.

পেটুক ছেলেকে যা কিছু করিতে বলা হউক না কেন, সে আহারাদির আলোচনায় ঠিক পৌঁছিবে। এমনকি একং দশঙের মতো রসকসহীন জিনিস মুখস্থ করিতে বলিলেও সে ঠিক লুচি-মণ্ডায় পৌঁছিবে। কায়দাটা দেখার মতো : একং, দশং, শতং, সহস্র, অযুত; লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাগ (মাঘ) ছেলেপিলে, জ্বর, সর্দি, কাশি; গয়া, বৃন্দাবন, পুরী, রসগোল্লা, সন্দেশ, মিহিদানা, লেডিকিনি ইত্যাদি ইত্যাদি।

গন্তব্যস্থানে পৌঁছিয়াছে, তাহাকে সেখান হইতে নড়ায় কাহার সাধ্য।

ইংরেজ, ফরাসির দৃঢ় বিশ্বাস যে জমনি পেটুক ছেলের মতো। তাহাকে যে কোনও কায়দার সরকার দাও না কেন, সে রাজতন্ত্রই হউক আর গণতন্ত্রই হউক, জর্মনরা ঠিক স্বৈরতন্ত্র ও কুচকাওয়াজতন্ত্রে পৌঁছিবেই। য়ুকার ও রূঢ়ের ধনপতিরা মিলিয়া পৃথিবী জয়ের প্ল্যান আঁটিবেই। ফন পাপেন ও টুসেনে বন্ধুত্ব হইবেই ও পৃথিবী জয়ের জন্য বিদেশি, টুথব্রাশ-গোপওয়ালা, নিরক্ষর উজবুকেরও যদি প্রয়োজন হয় তাহাও সই– যদি সে উজবুক ঠিক ঠিক বক্তৃতা ঝাড়িয়া টেবিল ফাটাইতে পারে ও শান্তিপ্রিয় দেশি-বিদেশির মাথাও এলোপাতাড়ি ফাটাইতে পারে। ইংরেজ-ফরাসি বলে, দেখ না, ১৯১৮-১৯ সালে আমরা জর্মনিকে কীরকম সরেস একখানা বাইমার রিপাবলিক দিয়াছিলাম; কিন্তু সেই একং দশং পড়িতে গিয়া তাহারা ঠিক নাৎসি গুণ্ডামিতে পৌঁছিল। ইহাদের বিশ্বাস নাই, ইহাদের রোম রোম মে বদমায়েশি।

পরাজিত জর্মনিকে লইয়া সমস্যাটা তাহা হইলে এই, তাহাকে স্বাধীনভাবে ছাড়িয়া দেওয়া যায় কি না। যদি না দেওয়া যায় তবে পিটুনি পুলিশ দিয়া তাহাকে আদবকায়দা শিখাইতে হইবে।

১৯৩৯ সালে আমার এক জর্মন বন্ধু আমাকে বলিয়াছিলেন : লড়াই শীঘ্রই লাগিবে। আমরা যদি জিতি, তবে দুনিয়ার রাজত্ব আমাদের হাতে আসিবে আর যদি হারি তাহা হইলেও। কারণ আমাদের পরাজয় অর্থই রাশিয়ার জয়। আমরা তখন লাল হইয়া যাইব। আমাদের প্রতিনিধিরা মস্কোতে যাইবে, সেখানে ভোঁতা রাশিয়ানদের তিন দিনে কাবু করিয়া তামাম ইউএসএসআর আমাদের প্রতিনিধিরাই চালাইবে। রাশিয়ানরা বর্ণবিচার। করেন না, তাহাদের বীজমন্ত্র সর্বোত্তম ব্যক্তি বড়কর্তা হইবে, হউক না সে জর্জিয়ন। যেরকম মুসলমানরা একদিন বলিত, সর্বোত্তম ব্যক্তি খলিফা হইবে, হউক না সে হাবসি। কাজেই কিছুদিনের ভিতরই দেখিতে পাইবে এক জর্মন ক্রেমলিনে বসিয়া দুনিয়া চালাইতেছে। হ্যাঁ, তামাম দুনিয়াটা, কারণ জর্মনি ইউএসএসআরের গুষ্টিতে যদি ঢোকে, তবে বাদবাকি ইউরোপ তিন দিনেই তার খপ্পরে পড়িবে। ইংরেজ, মার্কিন কেউ ঠেকাইতে পারিবে না। তার পর পটপট করিয়া চীন, ভারতবর্ষ, ইরান, ইরাক, মিশর। তার পর? তার পর আর কী? এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা এক অখণ্ড রাজ্য হইলে আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়াকে একঘরে করিয়া তিন দিনের ভিতর সমাজের সামনে নাকে খত দেওয়াইব। দেখিবে সব লাল হো জায়েগা, তবে রঞ্জিতি মর্মে নহে।

শুনিয়া বলিয়াছিলাম, তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। তোমার কথাই যদি ফলে, তবে আমরা ভারতবাসীরাই দুনিয়ার রাজত্ব করিব। ভারতবাসীও না, আমরা বাঙালিরাই ক্রেমলিনে বসিয়া নিয়ে নদীর ইলিশ মাছ খাইব ও দুনিয়ার রাজত্ব করিব।

বন্ধু বলিলেন, সে কী কথা? তোমরা বাঙালিরা এমন কী গুণে গুণবান?

আমি বলিলাম, বিলক্ষণ, আমরা লড়াই করিয়া দেশের স্বাধীনতা জিতিতে না পারি, কিন্তু মস্কোর কৌন্সিল-ঘরে আমাদের বক্তৃতা জলতরঙ্গ রুধিবে কে, হরে মুরারে।

কিন্তু সেকথা উপস্থিত ধামাচাপা থাকুক; গোঁফে তেল দিবার সময় এখনও হয় নাই।

আমার জর্মন বন্ধুর যুক্তিতে মার্কিনিংরাজ বিশ্বাস করে। তাহাদের মাথায় ঢুকিয়াছে যে, জর্মন জিঙ্গো যেরকম পাগলা হিটলারকে কার্য উদ্ধারের জন্য দলে নিয়াছিল, জাতধর্ম, কৌলীন্য আভিজাত্য বিসর্জন দিয়া, ঠিক সেইরকম তাহারা লাল হইয়া স্টালিনকে হিটলারের তখতে বসাইয়া দুনিয়ার বাদশাহি করিবে অর্থাৎ নাৎসি গুণ্ডামির বদলে স্টালিনি গুণ্ডামি চালাইবে। দুই গুণ্ডামিই মার্কিনিংরাজের পক্ষে মারাত্মক, মহতী বিনষ্টি। সেই মহাপ্রলয় হইতে রক্ষা পাইবার একমাত্র উপায় জর্মন জিঙ্গোকে বোঝানো যে, তাহারা লাল হইয়া কেন মস্কো দরবারে কুর্নিশ দিতে যাইবে। মার্কিনিংরাজ সাহায্য করিতে প্রস্তুত, জিঙ্গোরা লাল রক্তস্রোতের উপর ভরাপালে মস্কো পৌঁছিবে রাজবেশে। উপস্থিত কোনওগতিকে রুশকে ঠেকাইয়া রাখ; জর্মনি যেন মনের দুঃখে লাল গেরুয়া। পরিয়া বিবাগী হইয়া মস্কো তপোবনে চলিয়া না যায়। অর্থাৎ সেই অতি প্রাচীন চেম্বেরলিন নীতি যতক্ষণ রুশে-জর্মনে লড়াই চলে আমাদের পৌষ মাস, দুই দুশমনে মিলিলেই আমাদের সর্বনাশ।

যদি বলা হয়, এক কাজ করো না কেন, নাৎসিদের শক্তি সম্পূর্ণ বিনষ্ট করিয়া রাজ্যশাসন দেশের জনগণের হাতে ছাড়িয়া দাও। তাহারা যে লাল হইয়া যাইবেই, এ স্বতঃসিদ্ধ পাইলে কোথায়?

মার্কিনিংরাজ বিজ্ঞের ন্যায় মৃদুহাস্য করিয়া বলে, ইতিহাস পড়ো। বাইমার রিপাবলিক যখন জর্মন জনগণকে ভেট দেওয়া হইল তখন তাহারা করিল কী? কোথায় না বাদশাহি মসলন্দে বসিয়া শাহেনশাহিগিরি করিবে তাহা নয়, সেই কাইজারকে তাহার জমিদারির আমদানি কিস্তি খিলাপ না করিয়া হামেহাল পাঠাইল– এদিকে নিজে খাইতে পায় না। মুচি-মেথরকে বলা হইল, রাজা তো হইতে পারিবে না, সিংহাসন নাই, প্রেসিডেন্ট হ, তা নয়, ডাকিয়া আনিল সেই যুঙ্কার পালের গোদা হিন্ডেনবুর্গটিকে। তার পর সেই পাগলা জগাইকে। সে ব্যাটা কালাপাহাড় জাতে অস্ট্রিয়ান হইল জার্মান। মোদ্দা কথা এই, জর্মন আপামর জনসাধারণ যা, যুঙ্কারও তা, নাৎসিও তা। সব শিয়ালের এক রা। বরঞ্চ কট্টর নাৎসিরা ভালো। শক্তির উপাসক। জাতবর্ণহীন স্টালিনি নেড়া-নেড়িদের বিরুদ্ধে ইহাদের কোনও না কোনও দিন শভিনিজম-কারণ খাওয়াইয়া লড়ানো যাইবে। আপামর জনসাধারণ তো কাছাখোলা, লাল গেরুয়া পরিয়া ধেই ধেই করিয়া স্টালিনি সংকীর্তন নাচিবার গাইবার জন্য তৈয়ার হইয়া আছে। তাই জেবিক-হলস্টাইনে নাৎসি জিয়াও আর গোরাদের কড়া বারণ করিয়া দাও যেন জর্মন জনগণের সঙ্গে রাখি না বাঁধে (নন-ফ্রেটারনাইজেশন)। গোরাদেরই-বা বিশ্বাস কী? দুষ্টলোকে বলিতে আরম্ভ করিয়াছে, তাহাদেরও নাকি গোলাপি আমেজ লাগিয়াছে।

ঠিক এইখানটায় মার্কিনিংরাজের সঙ্গে আমার মত মিলে না। আমার বিশ্বাস, জর্মন জনসাধারণ আপন মুক্তি আপন ঐতিহ্যের ভিতর দিয়া খুঁজিয়া পাইতে চায়। স্টালিন-দত্ত গুরুমন্ত্র জপিয়া নয়। আমার মনে আছে ১৯৩২ সালে যখন জর্মনিতে নাৎসি-কম্যুনিস্টে জোর সঁড়ের লড়াই চলিতেছিল তখন নাৎসিরা পথেঘাটে একে অন্যকে অভিবাদন করিত হাইল হিটলার বলিয়া, কম্যুনিস্টরা হাইল মস্কো বলিয়া। গুণীদের বলিতে শুনিয়াছি এই মস্কো-মার্কা বিদেশি ভদকা জর্মন বিয়ার ঐতিহ্য-গর্বিত জনসাধারণ আদপেই পছন্দ করিত না। কে জানে হয়তো এই কথা স্মরণ করিয়াই রুশরা আজ বার্লিনাঞ্চলে জোর করিয়া জর্মনদের হাইল মস্কো বলাইতেছে না। অবান্তর হইলেও একটি কথা বলিবার লোভ হইতেছে। আমাদের দেশি কম্যুনিস্টরা কিন্তু মস্কোবাগে না তাকাইয়া কোনও কর্মই করেন না, কোনও বাক্যই বলেন না। স্টালিন যদি জর্মনির সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন তা-ও ভালো, যদি লড়েন তা-ও ভালো, যদি ফিনল্যান্ডের কান মলেন তা-ও ভালো, যদি ফি কমুনিস্টদের তত্ত্বতাবাশ না করিয়া পাসিকিভির সঙ্গে দোস্তি করেন তাও ভালো, ইরান তেল দিল না বলিয়া যদি তাকে ধমক দেন তবে তা-ও ভালো, গ্রিক দেশসেবীদের গাছে চড়াইয়া যদি মই কাড়িয়া লন তবে তা-ও ভালো। কারণ বাতুশকা (ছোট বাপা) স্টালিন সর্ব-বিশারদ, ভগবানের (রাম রাম!) ন্যায় সর্বজ্ঞ। বিরিঞ্চিবাবার ন্যায় তিনি চন্দ্রসূর্য ওয়েল না করিলে আকাশ পাতালের বন্দোবস্ত ভণ্ডুল হইয়া যাইবার নিদারুণ সম্ভাবনা। অতএব হাইল মস্কো। আমাদের এ ধর্ম পছন্দ হয় না। আতাতুর্ক পছন্দ করিতেন না বলিয়াই নব্যতুর্কের স্কন্ধ মক্কাবাগ হইতে ফিরাইয়া আঙ্কারাবাগে স্কু টাইট করিয়া দিয়াছিলেন।

কথা হইতেছিল যে, জর্মন জনসাধারণ আপন মুক্তি আপন ঐতিহ্যের ভিতর দিয়া খুঁজিয়া লইতে চায়। তাই যদি হয় তবে বাইমার রিপাবলিকের বানচাল হইল কী করিয়া?

.

০৩.

সোশ্যাল ডিমোক্রেটদের হাতে রাজ্যচালনার ভার সমর্পণ করাই যে প্রশস্ত ইহা বিচক্ষণ ব্যক্তি মাত্রই স্বীকার করিবেন। তাহার কারণ আমরা পূর্বেই নিবেদন করিয়াছি। বাইমার রিপাবলিককে সাফল্যমণ্ডিত করিবার আপ্রাণ চেষ্টা করিয়াছিলেন সোশ্যাল ডিমোক্রেটরা। জর্মনির খ্যাতনামা পণ্ডিত অধ্যাপক, গুণীজ্ঞানী–এক কথায় যাহারা জর্মনির গর্বশ্বরূপ, তাহারা প্রায় সকলেই ছিলেন বাইমারের পিছনে, সোশ্যাল ডিমোক্রেটরূপে। আমরা বিশেষ করিয়া ইহাদের চিনিতাম, কারণ ইহাদের ভিতর আর্যামি গোঁড়ামি ভণ্ডামি ছিল না।

জর্মনির দুর্দিনে সোশ্যাল ডিমোক্রেটরা আপামর জনসাধারণকে এক পতাকার নিচে সম্মেলিত করিয়া ইনফ্লেশন, বেকারি, নাস্তিক্য, উচ্ছলতা হইতে রক্ষা করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। পৃথিবী জয় করার উদ্দেশ্যে নতুন সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করার স্বপ্ন তাহারা দেখেন নাই। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় তাঁহারা বলিয়াছিলেন, মানবসংসারে ভালো লোকের দেয়ালি উত্সব চলিতেছে, প্রত্যেক জাতি আপন প্রদীপ উঁচু করিয়া তুলিলে তবে সে উৎসব সমাধা হইবে। পৃথিবীর শান্তি ও মঙ্গল তাহারা কামনা করিয়াছিলেন বলিয়া ঠিক ওই সময়ে (১৯২০) রবীন্দ্রনাথকে তাঁহারা বিপুল সম্বর্ধনা করিয়াছিলেন। জর্মন জনসাধারণ তখন রবীন্দ্রনাথের বাণীতে নিজের মূক আদর্শ প্রকাশ করিয়াছিল। কে না জানে ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিশ্বপ্রেমের কবি, শান্তির প্রতীক, পদদলিতের পরিত্রাণ।

তথাপি ইংরেজ-ফরাসির ভয় ছিল যে সময়কালে সোশ্যাল ডিমোক্রেটরা বলশিদের সঙ্গে যোগদান করিবে। তাই যখন দেশের শিল্প-বাণিজ্যের উদ্ধার করিবার জন্য সোশ্যাল ডিমোক্রেটরা ইংরেজ-ফরাসি ধনপতিদের সাহায্য চাহিল তাহারা সাফ জবাব দিল। ফলে বেকারি বাড়িল, ব্রনিভ হাল সামলাইতে পারিলেন না। তার পর ফন পাপেন; শ্লাইশার গর্ভাঙ্কের ভিতর দিয়া নাৎসি যবনিকা পতন। ইংরেজের কথা ফলিল না, সোশ্যাল ডিমোক্রেটরা কম্যুনিস্টদের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও নাৎসি অবিচারের বিরুদ্ধে ধর্মঘট করিতে রাজি হইলেন না।

***

সোশ্যাল ডিমক্রেটরাই যে দেশের মেরুদণ্ড তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ এই যে, রুশেরা তাহাদের অধিকৃত অঞ্চলে ইহাদেরই প্রধান শক্তি স্বীকার করিয়া নিয়াছে। ইহাদেরই সঙ্গে আছেন ক্রিশ্চান ডেমোক্রেটিক পার্টি ও লিবারেল ডিমোক্রেটিক পার্টি। কম্যুনিস্টরাও আছেন, ও বেশ জোর আছেন তাহাতে কোনও সন্দেহ নাই এবং ভিতরে ভিতরে রুশ সরকার যে তাহাদেরই সবচেয়ে বেশি সাহায্য করিবে তাহাতেও বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু রুশরা জানে যে, সোশ্যাল ডেমোক্রেটরা যদি বাঁকিয়া বসিয়া থাকে, তবে কম্যুনিস্টরা শুধু গায়ের জোরে তাহাদের প্রোগ্রাম চালু করিতে পারিবে না। স্পষ্ট বোঝা যাইতেছে যে, রুশের চাল হইল সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের নটমঞ্চের সম্মুখে রাখিয়া দেশের প্রথম দুর্দিনের ধাক্কা তাহাদের দিয়া সহানো। রুশদের যথেষ্ট সাহায্য না পাইয়া যখন ব্যনিভ সরকারের মতো তাহাদের পার্টি-নৌকা বানচাল হইবে তখন কম্যুনিস্টরা আসরে নামিয়া দেশোদ্ধার করিবেন, অর্থাৎ গোটা রুশাধিকৃত অঞ্চলকে ইউএসএস আরের অঙ্গীভূত করিবেন। সে বিপদকালে সোশ্যাল ডিমোক্রেটরা যে কোনও কট্টর লাল-বিরোধী দর্গায় ধরনা দিবে তাহার উপায় নেই, কারণ রুশরা কট্টরদের নির্মমভাবে বিলোপ করিয়াছে ও করিতেছে। রুশরা জানে যে, উপস্থিত সোশাল ডিমোক্রেটদের লোকচক্ষে অপমানিত করার প্রয়োজন তাই তাহাদের সভামঞ্চে আনিবার পূর্বে বেশ করিয়া মুসোলিনি-কায়দায় জোলাপ দেওয়া হইতেছে।

অস্ট্রিয়ায় রুশরা যে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করিয়াছে তাহাতেও ওই চাল। বিস্তর সোশ্যাল ডিমোক্রেটদের হরেক রঙের পোর্টফোলিও দেওয়া হইয়াছে, কিন্তু পুলিশ, অর্থ, প্রোপাগান্ডা অভ্যন্তরীণ মন্ত্রীর হাতে ও তিনি কম্যুনিস্ট। অর্থনৈতিক দিক দিয়াও রুশের বালাই কম। যে অঞ্চল দখল করিয়া বসিয়াছে সেখানে খানা-পিনা আছে, তাহার উপর উক্রাইন আছে। সে অঞ্চলের সমস্ত কলকারখানা সরাইয়া রাশিয়ায় লইয়া গেলেও ইহাদের অন্তত অস্থিচর্মসার করিয়া রাখিতে কোনও বিশেষ অসুবিধা হইবে না।

***

মার্কিন-ইংরেজ কিন্তু কিছুতেই মনস্থির করিতে পারিতেছেন না। কর্তাদের বুদ্ধির বহর কতটুকু তাহা নিম্ন খবরটুকু হইতে বিলক্ষণ বোঝা গেল।

জর্মনির কলকজা যদি কাড়িয়া লই (অর্থাৎ ডিসইনডাসট্রিয়ালাইজ) তবে তাহারা না খাইয়া মরিবে, আর যদি না কাড়ি তবে চর্বচোষ্য লালিত হইয়া পুনর্বার মস্তকোত্তোলন করিয়া আমাদিগকে প্রহার করিবে।

এই তথ্যটুকু কি বিজ্ঞের ন্যায় প্রচার করা হইল! ঘোড়াকে দানাপানি না দিলে সে মরিবে, তাহাতে আর নতুন কথা কী? আর দিলে সে গাড়ি টানিতে পারিবে (অর্থাৎ গায়ের জোরে রুশকে ঠেকাইতে পারিবে, কিন্তু মাঝে মাঝে তোমাকে লাথিও মারিবে। গাড়ি যদি চালাইতে চাও, তবে তেজি ঘোড়া কিঞ্চিৎ দুরন্তপনা তো করিবেই। তুমি ভালো লাগাম কেনো না কেন?

দ্বিতীয় উদাহরণ পণ্য!

কাঠের অভাব হইয়াছে বলিয়া বার্লিনের যেসব অঞ্চলে ইংরেজ-মার্কিন প্রবেশ করিয়াছে, সেখান হইতে স্টালিনি সাইনবোর্ড সরানো হইয়াছে। খদ্দের যখন অশ্ব-বিক্রেতাকে বলিল, বাড়ি গিয়া দেখিলাম, তোমার ঘোড়া খোঁড়া, তখন সে বলিল, আপনার বাড়ি তো বাজারের উত্তর দিকে, ওদিকে চলিলে আমার ঘোড়া খোঁড়া হয়ই! খদ্দের বলিল, তোমার যুক্তিটা তোমার ঘোড়ার মতোই খোঁড়া।

তৃতীয় উদাহরণ,

কোনও কোনও জর্মন মেয়ে ইংরেজ সিপাহিদের নিকট হইতে চকলেট লইয়া চম্পট দেয়। আশ্চর্য! কিন্তু আমাদের এতদিন বিশ্বাস ছিল যে, সবদেশের মেয়েরাই এরকম করে। আর মেয়েদেরই-বা দোষ দেই কেন? তোমাদের সন্তুষ্টিকরণ (এপিজমেন্ট) অস্ট্রিয়া-চেকোশ্লোভাকিয়া চকলেট পকেটস্থ করিয়া হিটলার তো এই সেদিন তোমাদের বিশেষ অঙ্গুলি প্রদর্শন করিয়াছিল। রাজনৈতিক স্মৃতিশক্তি ক্ষীণ হয়, কিন্তু এতটা ক্ষীণ।

অধিকৃত জর্মনি চালনা সম্বন্ধে নিম্নলিখিত খবর হইতে বোঝা যায়, বরঞ্চ বলা উচিত বোঝা যায় না ইংরেজ-মার্কিনের নীতি কী।

কম্যুনিস্টরা রাজ্যশাসনে কোথাও নাই। বেভেরিয়া ও নিম্নরাইনে দক্ষিণপন্থি ক্যাথলিকরা সর্বময় কর্তা। হামবুর্গ ও হানোফারে পার্টিমতামতহীন বণিক ও দক্ষিণপন্থি আমলারা গুছাইয়া লইতেছেন, যদিও অন্য কেউ কেউ বখরা পাইতেছেন। হেস্মে ও মধ্য রাইনে সোশ্যাল ডেমোক্রেটরা রাজ্য-চালনার পুরোভাগে ও উত্তরপন্থি ক্যাথলিকদের আওতায় বেস্টফালিয়েন ও ওল্ডেনবুর্গে কিছুটা রাজত্ব করিতেছেন। তদুপরি বড় বড় নগরে ইহারাই মেয়র হইয়া বসিয়াছেন।

উৎকৃষ্ট প্রস্তাব। এ রকম পঁচিশ জায়গায় বত্রিশভাজা করিবার কী প্রয়োজন? এরকম দো-আঁসলা, তিন-আঁসলা জানোয়ার পয়দা করিবার এক্সপেরিমেন্ট কেন? ইংলন্ডে একবার টার্কি ও হেন (মুরগি) পক্ষীতে সংমিশ্রণ করাইয়া যখন টার্কিন পাখি পয়দা করা হয়, তখন ফ্রান্স বলিয়াছিল, আমেরিকার এক আস্তাবলে গাধা ও একখানা ভাঙা বাইসিক্ল একসঙ্গে রাখার ফলে ফোর্ড গাড়ির জন্ম হয়েছিল। সাধু সাবধান!

তাই বলিতেছি যে, প্রকৃষ্টতম পন্থা, সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের শুধু রাজ্য সমর্পণ করাই নয়, তাঁহাদের সম্পূর্ণ দ্বিধাহীন সাহায্যদান। রুশরা যেমন তাহাদের অধিকৃত অঞ্চলে সোশ্যাল ডেমোক্রেটদের বোকা বানাইতে চাহে, তোমরা তেমনি তাহাদের সফলতার পথে লইয়া চল। জর্মন বড় জাত্যাভিমানী, পারতপক্ষে সে কখনও তাহার জাতীয়তাবোধ ত্যাগ করিতে চাহে না। তাহার দৃঢ় বিশ্বাস, তাহার মুক্তির পথ তাহারই ঐতিহ্যের তাহারই বৈদগ্ধ্যের ভিতর দিয়া। সে বলশির ধামাধরা হইতে চাহে না, তোমাদের গোলাম হইতে চাহে না। তাহাদের যদি স্বাধীনভাবে স্বচ্ছন্দে জীবনযাপন করিতে দাও তবে সে সকল শত্রুকে রোধ করিয়া শান্ত জীবনযাপন করিবেই। সোশ্যাল ডেমোক্রেটরা শান্তি চায়।

আর শেষ কথা তো এই যে, স্বায়ত্তশাসনে সর্বজাতির অধিকার। সোশ্যাল ডেমোক্রেটরা জর্মনজাতির যাহা শ্রেষ্ঠ, যাহা বরণীয় তাহারই প্রতীক।

.

প্যালেস্টাইন

০১.

গোড়ার দিকে ইহুদি-আরবে প্যালেস্টাইন সম্পর্কে তর্ক উপস্থিত হইলেই প্রথম প্রশ্ন এই উঠিত, সে দেশটা কাহার। ইহুদিরা বলিত, এই পবিত্র দেশ আমাদের পিতৃভূমি, মুসা (মোজেস) আমাদিগকে এই দেশে পথ দেখাইয়া আনেন; আমাদের গর্বস্থল রাজা সুলেমন (সলমন), দায়ূদ (ডেভিড) এই দেশে রাজত্ব করিয়াছেন, আমাদের প্রপিতামহ ইব্রাহীমের (আব্রাহামের) কবর এই মাটিতে। এই দেশ আমাদের পুণ্যভূমি, এখন এ দেশকে আমাদের কর্মভূমিতে পরিণত করিতে চাহি। (সত্যেন দত্তের তীর্থসলিলে রাজা সুলেমন ও দায়ুদের গীতি দ্রষ্টব্য)।

উত্তরে আরব বলে, তোমাদের মতো আমরাও সেমিটি, যেসব মহাপুরুষদের নাম করিলে তাহারা আমাদেরও পূর্বপুরুষ। তাঁহাদের গোর আমাদের তীর্থস্থল-দরগাহ। ইহাদের মহৎ কার্যকলাপ কোরানে বর্ণিত হইয়াছে। উপরন্তু জেরুজালেম (বয়ত উল-মুদ্দস পবিত্রালয়) আমাদিগের কাছে মক্কার পরেই সম্মানিত। কিন্তু এসব ধর্ম-সম্বন্ধীয় হার্দিক আলোচনা উপস্থিত স্থগিত রাখো। আসল কথাটা এই, তোমাদের স্বাধীনতা লোপ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই (খ্রিস্টের বহুপূর্বে) তোমরা এ দেশ ত্যাগ করিতে আরম্ভ কর; খ্রিস্টের পর তোমাদের অধিকাংশ জাতভাই খ্রিস্টান হইয়া যায়– তাহারা আজ আমাদের দলে, পরবর্তী যুগে তাহাদিগের অধিকাংশ আবার মুসলমান হইয়া যায় এবং সর্বশেষে ক্রুসেডের আমলে যখন যুদ্ধ, অরাজকতা, ও অনাসৃষ্টির ফলে দেশটা উচ্ছন্ন গেল, তখন তোমরা সকলেই পোড়া দেশকে ছাড়িয়া কারবারে পয়সা করিবার জন্য পৃথিবীর সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িলে। আমরা এই দেশের মাটিকে ভালোবাসিতাম সেই মাটিকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া আটশত বৎসর কাটাইলাম, এখন পয়সার জোর হইয়াছে বলিয়া আমাদিগকে ভিটা-ছাড়া করিতে চাও? তোমাদের বেশভূষা বিজাতীয়, তোমাদের আচার-ব্যবহার এদেশের প্রাচীন ইহুদি পন্থানুযায়ী নহে (অর্থাৎ যে কয়টি ইহুদি দুর্দিনে। এদেশ ত্যাগ করিয়া যান নাই, তাঁহাদের আচার-ব্যবহারের সঙ্গে আমাদের আজ মিলে বেশি), তোমরা বার্লিন-প্যারিসের নৈতিক চরিত্র ও দুষ্ট রোগ সঙ্গে আনিয়াছ, আর সর্বশেষ কথা, আমাদের দুশমন ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে তোমরা বন্ধুত্ব করিয়াছ।

এই তর্কাতর্কি আমি ছয় মাসকাল উদয়াস্ত শুনিয়াছি–লিখিতে গেলে একখানা ছোটখাটো বই লেখা যায়। কিন্তু এসব তর্ক আজকাল কম হয়।

১৪-১৮ যুদ্ধের সময় ইংরেজ প্যালেস্টাইনের আরবকে কথা দেয় তখন যেখানে ইহুদির সংখ্যা নগণ্য যে, তোমরা যদি তুর্কির হইয়া না লড়ো তবে যুদ্ধের পর তোমাদিগকে স্বরাজ (সেলফ ডিটারমিনেশন) দিব। সঙ্গে সঙ্গে আরবদের অজানাতে, প্রধানত মার্কিন ইহুদিদিগকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইল যে, তাহারা যদি কাইজারকে অর্থসাহায্য করা বন্ধ করিয়া সেই অর্থ ইংরেজকে দেয় ও বিশ্ব-ইহুদি (ওয়ার্লড জিউয়ারি) অন্যান্য সাহায্য প্রদান করে, তবে যুদ্ধের পর ইহুদিদিগকে প্যালেস্টাইনে ন্যাশনাল হোম নির্মাণ করিতে দেওয়া হইবে। (ন্যাশনাল হোম কথাটার বাঙলা আর করিলাম না, ইংরেজিতেই তাহার অর্থ কী, সে লইয়া বাগবিতণ্ডার অন্ত নাই। নিরক্ষর আরব ইংরেজির এক বর্ণ বোঝে না, কিন্তু ন্যাশনাল হোম যে ন্যাশনাল স্টেট নয় সে কথা বুঝাইতে তাহার তৎপরতার অন্ত নাই। বারে বারে আরবি কথাতে শুধু চারিটি ইংরেজি শব্দ শুনিতে পাওয়া যায়, ন্যাশনাল হোম আর ন্যাশনাল স্টেটআমি।  যদি ন্যাশনাল হোমের অনুবাদ জাতীয় ভবন বা জাতীয় সদন দিয়া করি, তবে ইহুদিরা আমাকে খুন করবে, আরবরা আমাকে খয়রাতি দিবে।)

যুদ্ধের পর যখন ন্যাশনাল হোমের খবরটা বাহির হইল, তখন আরবরা হুঙ্কার দিয়া উঠিল। অতিকষ্টে তাহাদিগকে বুঝান হইল যে, এ বস্তুটি অত্যন্ত নিরীহ তেঁড়া সাপ। জনকয়েক ইহুদি প্যালেস্টাইনে বসবাস করিবার জন্য আসিতেছে, বিস্তর পয়সা সঙ্গে আনিবে, নিজের খাইবে পরিবে, ধর্মচর্চা করিবে, কলচর করিবে, আরবের আপত্তি করিবার কী আছে? ২৬ সেপ্টেম্বরে (৪৫) প্রকাশিত বাইৎসমান সাহেবের এই মর্মে বুলি যে, ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে জুইশ মেজরিটি ও জুইশ স্টেট চায়। সেকথা তখনকার দিনের ইংরেজ সরকার মানেন নাই- লেবার পার্টি লাকি প্রভৃতি ইহুদিদের প্রতাপে আজ মানেন।

সে যাহাই হউক, যুদ্ধাবসানে যখন এইসব আলোচনা হইতেছে, তখন হঠাৎ দেখা গেল যে, যেসব ইংরেজ সৈন্য আরবদের সহায়তায়, লরেন্সের ধূর্তামিতে, জেরুজালেমে একটি বুলেটমাত্র খরচ না করিয়া প্রবেশ করিয়াছিল, তাহারা সেখানে থাকিবার পাকাপাকি বন্দোবস্ত করিতেছে।

পৃথিবীর ইতিহাসে ইহা এক স্মরণীয় ও অভিনব বস্তু। ১৯১৪ সালের পূর্বে কোনও রাজা গায়ের জোরে বা অন্য কোনও কায়দায় কোনও দেশ জয় করিলে সে-রাজা দুনিয়ার লোককে ডাকিয়া বলিতেন না যে, তোমরা সকলে আমাকে আশীর্বাদ করিয়া রাজ্যটি সোনার থালাতে করিয়া তুলিয়া দাও, আমি গ্রহণ করিয়া তোমাদিগকে কৃতার্থম্মন্য করিব। এ কায়দাটা আবিষ্কার করিলেন ইংরেজ ও ফরাসি সাম্রাজ্যবাদীরা। লিগ অব নেশনস গড়িয়া তামাম দুনিয়ার দেশপতিদের ডাকিয়া বলা হইল যে, তাহারা যেন ইংরেজকে রাজনৈতিক পূতজলে বাপ্তিস্ম করিয়া প্যালেস্টাইন, ইরাক, মিশরের মেনডেটরি প্রভু বা অছি নিযুক্ত করে। বিশ্বজন যেন স্বস্তিবচন ঝাড়িয়া বলে, তুমি ন্যায়ত ধৰ্মত আইনত দেশটা পাইলে। পৃথিবীর নৈতিক ইতিহাসের ক্রমবিকাশ লইয়া যাহারা নাড়াচাড়া করেন, তাহারা যেন এই পর্যায়ে নতুন পরিচ্ছেদ পাড়েন।

অছি কথাটি শুনিলে আমাদের মতো প্রাচীনপন্থিদের ধর্মপিতা সমাসটি মনে পড়ে। তুর্কি ভাষায় অছি অর্থ জ্যেষ্ঠভ্রাতা। নাবালক শিশুর জন্য যখন অছি নিযুক্ত করা হয় তখন এই কথা অছিকে মানিয়া লইতে হয় যে, সে নিঃস্বার্থভাবে শিশুর তত্ত্বাবধান করিবে। আইনকানুন ভালো জানি না, তবে শুনিয়াছি যে, অছি নিয়োগের পূর্বে দেখিতে হয় যে, ওই শিশুর স্বার্থে যেন অছির লোভ না থাকে– থাকিলে অমিত্ব রদ-বাতিল। লিগের কর্তারা স্বকায়দায় এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করিতে বিস্মৃত হইলেন। ইংরেজ তখন বলেন নাই। কিন্তু হালে পরিষ্কার বুঝাইয়া দিয়াছেন যে, প্যালেস্টাইন আইসা পাক আর রহিম নিক, সেখানে ইংরেজ স্বার্থ বরাবর অচল-অটুট থাকিবে– সেখানে বিমানঘাঁটি, পল্টন-গোয়াল থাকিবেই। লিগ-কর্তারা শুধু তম্বি করিয়া অছিদের বলিয়াছিলেন যে, তাহাদিগকে কয়েক বৎসর অন্তর অন্তর শাসিত দেশের কার্য-প্রতিবেদন পেশ করিতে হইবে। সে ব্যঙ্গ-নাট্যের কথা আরেক দিন স্মরণ করাইয়া দিবেন। আসল কথা, বিশেষ লক্ষমান প্রাণীকে মোড়শোপচারে কদলীবৃক্ষের অছি নিযুক্ত করা হইল।

সেই অছিত্বের আওতায় তার পর উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম হইতে ঝাঁকে ঝাঁকে ইহুদি বুলবুলির পাল আসিয়া আরবের গমক্ষেতে পড়িল। কিন্তু ছেলে ঘুমাইল না, পাড়া জুড়াইল না। আরবরা এক হাতে ঠেকায় ইংরেজকে, আরেক হাতে মারে ইহুদিকে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও প্রশ্ন ঠেকাইতে পারিল না। খাজনা দেব কিসে? শ্মশান হইতে মশান হইতে ঝোড়ো হাওয়ায় হা হা করিয়া তখন উত্তর আসিল, আবু দিয়া, ইজ্জত দিয়া, ইমান দিয়া, বুকের রক্ত দিয়া। (কর্তার ভূত, লিপিকা, রবীন্দ্রনাথ)

কিন্তু সে সমস্যা অর্থনৈতিক। বুলবুলিরা কি সঙ্গে কিছুই আনে নাই? তাহার আলোচনা আরেকদিন হইবে।

.

০২.

ইহুদিদের পক্ষে যাহারা যুক্তিতর্ক উপস্থিত করেন, তাঁহাদের প্রধান সাফাই এই যে, ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে আসিবার সময় প্রচুর অর্থ সঙ্গে আনিয়াছে ও এখনও মাসে মাসে সমস্ত পৃথিবীর ইহুদি ধনপতিরা সে দেশে টাকা-পয়সা ও অন্যান্য নানা তৈজসপত্র পাঠাইতেছেন।

কথাটা সম্পূর্ণ সত্য। কিন্তু তলাইয়া দেখিবার মতো। উপনিষদের ঋষি বলেন, হিরন্ময় পাত্র মধ্যে সত্য লুক্কায়িত আছেন। অধিকাংশ লোক সেই পাত্র দেখিয়াই আনন্দে আত্মহারা হয়, বলে না, হে পূষণ, পাত্রটি উন্মোচন করিয়া দেখাও ভিতরে কী আছে।

শ্রীহট্ট বা উত্তর আসামের ভিতর দিয়া যাইবার সময় দেখিবেন, দুই দিকে ঘন সবুজ টিলার গায়ে গায়ে সারি সারি, কাটাছটা, সযত্নে বর্ধিত চায়ের গাছ। মাঝে মাঝে সরস সতেজ গোলমোহরের গাছ, শ্যামাঙ্গী কুলি মেয়েরা কাজ করিতেছে, দূরে ছবির মতো সুন্দর কলকারখানা, ঝকঝকে তকতকে সায়েবদের বাঙলো, ক্লব হৌস, গলফ লিনক। এমনকি দূর হইতে কুলিদের ব্যারাকগুলি পর্যন্ত সুন্দর দেখায়।

ইংরেজ আমাদের চোখে আঙুল দিয়া বলে, দেখ, দেশের ধনদৌলত কীরকম বাড়াইয়াছি।

ইহুদিরা যে অর্থ আনিল, তাহা দিয়া চাষের অনুপযুক্ত কোনও কোনও জলাভূমির জলকর্দম নিকাশ করিয়া সোনা ফলাইয়াছে। কিন্তু আসামের চা-বাগিচায় ও এইসব স্বর্ণভূমিতে পার্থক্য এই যে, যদি আসামের চা-বাগানে কুলিরা এক বেলা খাইবার মতো পয়সা রোজগার করিতে পারে, প্যালেস্টাইনের স্বর্ণভূমিতে আরব চাষা-মজুরকে কাজ করিতে দেওয়া হয় না। ট্রাক্টর পাঠাইয়াছে মার্কিন ইহুদিরা, চালাইতেছে জর্মন ইহুদিরা, ফসল কাটিতেছে পোল ইহুদিরা, বাজারে লইয়া যাইতেছে অস্ট্রিয়ান ইহুদিরা। আরব অপাঙক্তেয়। কিন্তু তাহারা আপত্তি-ওজর জানায় না, বলে, নিষ্কর্মা জমি যদি কাজে লাগাইতে পারো, তাহলে আমার আপত্তি কী?

কিন্তু মার খায় যখন ইহুদি সেই ফসল, সেই জাফা কমলালেবু বাজারে ছাড়ে। ইহুদি ক্ষেতখামার করিয়াছে, জাতভাই মার্কিন ধনপতিদের অফুরন্ত পয়সায়। জায়োনিস্টদের চাপে ও কিছুটা স্বেচ্ছায় তাহারা আরও পঞ্চাশ বৎসর ধরিয়া পুঁজি ঢালিতে প্রস্তুত। সে টাকার প্রতি প্যালেস্টাইনি ইহুদির বিশেষ দয়ামায়া নাই টাকাটা তো দিতেছেন গৌরী সেন। কাজেই ফসল নেবু বিক্রয় করিয়া যাহাই উঠে তাহাই তাহার লাভ। প্রচুর অর্থ ব্যয় করিয়া যে জমি প্রস্তুত করা হইয়াছে, ফ্যাশেনবল ইহুদি মজুরকে বিস্তর অর্থ দিয়া যে ফসল ফলানো হইয়াছে, তাহা দিয়া লাভ করিতে হইলে বাজারের দর অপেক্ষা তাহার দর হইবে চারিগুণ, ছয়গুণ বেশি। সে দর তো ইহুদি কখনও পাইবে না, কাজেই বাজার দর অপেক্ষা আরও দুই পয়সা সস্তা করিয়া আরব চাষিকে ঘায়েল করিতে ক্ষতি কী?

আপাতদৃষ্টিতে মনে হইবে অর্থের অপব্যয়, কিন্তু দূরদৃষ্টি দ্বারা জায়োনিস্ট দল হৃদয়ঙ্গম করিয়াছে, ইহাই প্রশস্ততম পন্থা। বাজারে যদি আরব চাষিকে ক্রমাগত বৎসরের পর বৎসর ফসল কম দরে বেচিয়া কাবু করা যায় তবে সে আর জমি আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকিবে কয়দিন? পেট ভরিতে হইবে তো? বাবু যখন মনস্থির করিয়াছেন জমিটা লইবেনই, তখন উপেন ঘ্যান ঘ্যান করিয়া বাবুর পয়সা নষ্ট করেন ক্যান!

নিরুপায় হইয়া আরব জলের দরে ইহুদিকে জমি বেচিয়া আণ্ডাবাচ্চাসহ জেরুজালেম শহরে উপস্থিত হয়– দুর্ভিক্ষপীড়িত নরনারী যেমন কলিকাতায় উপস্থিত হইয়াছিল–ভাবে সেখানে গেলে রোজগারের ধান্দা জুটিবে। সেখানেও সেই অবস্থা। মার্কিন পুঁজির জোরে ইহুদি দোকানিরা আরব ব্যবসায়ীকে ঘায়েল করিতেছে আরও অল্পায়াসে, আরও কম খরচায়।

ইহুদিরা বলে, আরব চাষিরা জমি বেচে স্বেচ্ছায়, আপন খুশিতে, জমির বাজারদর কী তাহার তত্ত্ব-তাবাশ, তদ্বির-তদন্ত করিয়া। সত্যই তো আমরাও পাট বেচি স্বেচ্ছায় বাজারদর জানিয়া শুনিয়া, আমরাও ৩২-৩৩ সালে অধিকাংশ স্থলে ধান বেচিয়াছিলাম বহাল তবিয়তে, খুশমর্জিতে। দুনিয়ার তাবৎ পাট আমাদের, তবু পাটের চাষি না খাইয়া মরে! ৩২-৩৩ সালে আঠারো আনা ফসল ফলাইয়াও চাষি না খাইয়া মরিল!

আরেক বিপদ, প্যালেস্টাইনে প্রজাস্বত্ব আইন নাই। আরব, তথা তুর্কি জমিদার মহাপ্রভুরা কাইরো, প্যারিসের বিলাস-বাসরের সর্দার। তালুকের পর তালুক বিক্রয় করিতেছেন পরমানন্দে, দুই পয়সা বেশি পাইয়া। যে জমিদার দেশে থাকে না, গরিব চাষার বেদনা সে বুঝিবে কী করিয়া, দরদ আসিবে কোথা হইতে? তার পর আরবদিগকে পুলিশের জোরে ভিটাজমি-ছাড়া করা হয়, যে মাটি তাহারা চাষ করিয়াছে বারো শত বৎসর ধরিয়া।

এতদ্বেশীয় সদাশয় সরকারও ব্যাপকভাবে এমন কর্মটি করেন নাই। তবু সাঁওতাল প্রজা বিদ্রোহের করুণ কাহিনী যাহারা জানেন তাহাদের কাছে অবস্থাটা সরলই প্রতীয়মান হইবে।

তাই আরব লিগ, পিপলস্ পার্টি সকলেই একবাক্যে কাতর ক্রন্দন অনুনয়-বিনয় করিতেছে, আইন করা হউক ইহুদি যেন আরবের জমি কিনিতে না পারে। সর্বশেষে ভয় দেখাইয়াছে।

ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে এক অদ্ভুত অভিনব অর্থনৈতিক করর্দো সানিতের (আরব ঠেকাইয়া রাখিবার বেড়া) সৃষ্টি করিয়াছে। আরব মজুরকে ডাকে নিতান্ত কালেভদ্রে অত্যন্ত মুশকিলে পড়িলে, জিনিসপত্র কিনে ছয়গুণ মূল্যে জাতিভাইয়ের কাছ থেকে, বেচে আরবকে, আরবের হোটেলে যায় না, আরব কোম্পানির বাসে চড়ে না, সমস্ত টেল আভিভ শহরে (প্যালেস্টাইনের ইহুদিদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্রীয় শহর) দশটি আরব খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। অর্থাৎ বিদেশ হইতে যে লক্ষ লক্ষ পৌন্ড ডলার মাসে মাসে অকৃপণভাবে প্যালেস্টাইনে ঢুকিতেছে, সে অর্থ ইহুদিদিগের ভিতরই চক্রবৎ পরিবর্তন্তে। যেটুকু বাহিরে যায়, সে আরবের জমি কিনিতে ও গলা-কাটা কারবারে আরবের ব্যবসা বাণিজ্য নষ্ট করিতে। সেই টাকাটাও সুচ হইয়া ঢোকে, মুষল হইয়া বাহির হয়। আরবরা প্রায়ই ইহুদিদিগকে বলে, বিদেশের পুঁজি না লইয়া আসো না একবার পাল্লা দিতে। আমরা যেরকম গরিব অবস্থায় সস্তায় কমলালেবু ফলাইতে পারি, তোমরা বাবুরা পারিবে? শুধু রুটি আর পেঁয়াজ খাইয়া কতদিন বাঁচিবে?

অথচ যে অজস্র অর্থ আসিতেছে তাহা দিয়া ব্যাপকভাবে শিল্পপ্রতিষ্ঠান করিবার উপায় নাই- কাঁচামালের অভাবে। ভারতবর্ষে কাঁচামাল আছে, তাহার বহু পুঁজি লন্ডন, নিউইয়র্কে পড়িয়া আছে, তবুও দুর্বোধ্য কারণে আমরা কারখানা-কারবার করিতে পারিতেছি না। ঠিক সেই দুর্বোধ্য কারণেই ইহুদিদিগকে প্যালেস্টাইনে ব্যাপকভাবে কলকারখানা করিতে যাহারা দিতে চায় না, মধ্যপ্রাচ্যে আজ তাহাদেরই প্রতাপ।

প্যালেস্টাইনে ধন বাড়িয়াছে, কিন্তু সে-ধন আরবের শ্যাম নহে, তাহার শূল।

বারান্তরে অদ্যকার পরিস্থিতি লইয়া আলোচনা করিব।

.

নেটিভ স্টেট

স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে নেটিভ শব্দটা ব্যবহার করিয়াছি, লেটিব বলিলে আরও ভালো হইত। কারণ নেটিভ বলিতে যাহা কিছু মন্দ, যাহা কিছু বীভৎস, যাহা কিছু পাশবিক ইঙ্গ-বঙ্গে বোঝায় ও বোঝানো উচিত তাহা বেশিরভাগ নেটিভ স্টেটে বর্তমান।

বাঙালির উপর বিধাতার বহু অভিসম্পাত বর্ষিয়াছে; একমাত্র নেটিভ স্টেটরূপী গোদের উপর বিষফোঁড়া হইতে আমরা রক্ষা পাইয়াছি। যে দুইটি স্টেট আমরা চিনি তাহাদের সঙ্গে আমাদের শ্রদ্ধার প্রীতির বন্ধন আছে। কবিগুরুকে যখন বাঙলা দেশও চিনিত না, তখন ত্রিপুরার মহারাজ বিশেষ দূত পাঠাইয়া কিশোর কবিকে জয়মাল্যে বিভূষিত করিয়াছিলেন ও পরবর্তী যুগে তিনি ও তাঁহার পুত্র-পৌত্রগণ শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম ও বিশ্বভারতাঁকে বহুপ্রকারে সাহায্য করিয়াছেন। শুধু তাহাই নহে, রাজপুত্র রাজপরিজন শান্তিনিকেতনে কবিগুরুর পদপ্রান্তে শিক্ষালাভ করিয়াছেন ও দেশে-বিদেশে কবিকে সেবা করিয়া ধন্য হইয়াছেন।

কুচবিহারও প্রাতঃস্মরণীয় কেশবচন্দ্রের আত্মীয়তা লাভ করিয়া কৌলীন্যপ্রাপ্ত হইয়াছেন। ইদানীং কুচবিহারে যে গুণ্ডামি হইয়া গেল তাহা লইয়া দেশে আন্দোলন হইয়াছে ও হওয়া উচিত কিন্তু পশ্চিম ভারতে নিত্য নিত্য যে কাণ্ড হয় তাহা শুনিলে বাঙালির চক্ষু স্থির হইয়া যাইবে।

প্রথমত কোনও নেটিভ স্টেটে কোনওপ্রকার স্বায়ত্তশাসন নাই। কোনও কোনও অত্যন্ত প্রগতিশীল রাজ্যে ধারা সভা থাকে। সে সভার প্রধান কর্ম রাজাকে সদুপদেশ দেওয়া। সে ধারাসভার সভাপতি স্টেটের দেওয়ান বা প্রধানমন্ত্রী। রাজা সাধারণত স্টেটের বাহিরে দেশের কোনও বড় শহরে বা ইউরোপের বিলাস-ব্যসনে মগ্ন–আমাদের জমিদাররা যেরূপ কলিকাতায় নানা সৎ কর্মে লিপ্ত থাকেন– প্রধানমন্ত্রী সর্বেসর্বা। তিনি সভাপতি। তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া, তাঁহারই নিন্দা করিবার বুকের পাটা থাকে কয়জনের? রসিক-জনেরা তাই ধারাসভার নাম দিয়াছেন রাধা সভা। রাধা যেরকম শাশুড়ি-ননদির ভয়ে চোখের জল ফেলিতেও সাহস করিতেন না, হঁহাদের সেই অবস্থা।

আমাদের জমিদারেরা যেরকম নায়েব-ডাকিনীর হাতে প্রজাপুত্র সমর্পণ করিয়া আরামে দূরে থাকেন, নেটিভ স্টেটেও তাই। শুধু নায়েবের অত্যাচারের সীমা আছে, কারণ হাজার হউক পুলিশ আছে, ম্যাজিস্ট্রেট আছে। তাহাদিগকে সবসময় রীতিমতো ওয়েলিং না করার ফলে মাঝে মাঝে কল বিগড়াইয়া যায়। নেটিভ স্টেটে সে ভয় নাই। পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট দেওয়ানের অতিভক্ত বাহন।

দেওয়ান যত বেশি টাকা তুলিতে পারেন, মহারাজ তত খুশি। তিনি দেশে-বিদেশে যে ভূতের খপরে তেল ঢালিতেছেন সে ভূতের তৃষ্ণার শেষ নাই। দরিদ্র প্রজার রক্ত চুষিয়া, হাড় পিষিয়া, মেরুদণ্ড চূর্ণ করিয়া তৈল বাহির করিতেছেন দেওয়ান। আত্মীয়-স্বজন ইয়ার-বক্সি হুঙ্কার দিয়া বিদ্রোহীকে কাবু করিতেছেন; কন্ট্রাক্টে, একচেটিয়া কারবারে অন্যান্য শত উপায়ে উদরপূর্তি করিতেছেন। সিংহাসনে উপবিষ্ট মহারাজা সিংহের অংশ পাইতেছেন। যে দেওয়ান যত বেশি শোষণ করিতে পারে সেই তত কর্মদক্ষ।

প্রজার নৈতিক চরিত্র যে তাহাতে কী পরিমাণ অধঃপাতে যায় বুঝানো অসম্ভব। যেখানে প্রভু স্বৈরাচারী, স্বাধিকারপ্রমত্ত সেখানে মানুষের বাঁচিবার উপায় কী থাকিতে পারে? একমাত্র পদলেহন ছাড়া তাহার অন্য কোনও পন্থা তো জানা নাই। বোম্বাই শহরে যদি দেখেন কেহ অতিরিক্ত বিনয় ভদ্রতা ও সৌজন্য প্রকাশ করিতেছে তবে প্রশ্ন করিলে খুব সম্ভব জানিবেন যে, ভদ্রলোক নেটিভ স্টেটের লোক।

ধর্মসাক্ষী, আমরা কাহারও মনে আঘাত দিতে চাহি না কিন্তু সত্য নিরূপণে অপ্রিয় কথাও বলিতে হয় আমরা নাচার।

আর যদি মহারাজা দেশে থাকেন তবে ব্যাপার আরও পেল্লাই। দেশি-বিদেশি সায়েবসুবোতে সরকারি অতিথিশালা গমগম করিতেছে। নর্তকী আসিয়াছে, বাঈজী আসিয়াছে, গণিকা আসিয়াছে। হাজার মুরগি বাড়াইয়া বলিতেছি না– হাজার মুরগি কাটিয়া তাহারই নির্যাস দিয়া বিশেষ জুস তৈয়ারি হইতেছে– বহুতর ডাক্তার কবিরাজ হাকিম ডাকা হইয়াছে, তাহার বহুতর ইনজেকশন-টনিক, অরিষ্ট-আসব-প্রাণ-মোদক, হালুয়াতরওগণ লইয়া উপস্থিত। বর্দোবার্গেন্তি হইতে আরম্ভ করিয়া জাহাঙ্গির-বাদশাহি ডবল ডেস্টিলড আরক, আফিঙ সবকিছু প্রস্তুত। সে কী বীভৎস শিবহীন দক্ষয়ক্ষ! দেশের অন্যান্য সরকারি কাজকর্ম বন্ধ। উদয়াস্ত বলিব না, অস্তোদয় দেওয়ান সাহেব প্রাসাদে চৰ্কিবাজির মতো তুর্কিনাচ নাচিতেছেন।

কোনও কোনও মহারাজা স্বরাজ্যে ফিরিলেই অরাজকতা আরম্ভ হয়। কলির কী বিচিত্র গতি! যেসব কাণ্ড তখন হয় তাহার বিবরণ খবরের কাগজে ছাপানো অসম্ভব। শুধু ডাক্তারি পুস্তকে তাহার বর্ণনা দেওয়া চলে। লজ্জাহীন উচ্ছল তাণ্ডব নৃত্য তখন যে কী চরমে উঠিতে পারে তাহার বর্ণনা সত্যপীর যতই সত্যপ্রিয় হউন না কেন, দিতে অক্ষম। সদাশয় সরকার বাহাদুরের কাছে এসব কীর্তি অজানা নহে।

এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে, কোনও কোনও স্টেটে সর্ব-সাকুল্য আয়ের অর্ধাপেক্ষা বেশি ব্যয় হয় মেহমানদারি খাতায় অর্থাৎ এইসব ভূতের যজ্ঞে।

আমার একটি রাজপুত শিষ্যের বিবাহ উৎসবে আমাকে যাইতে হইয়াছিল। যাহা দেখিয়াছিলাম ও শুনিয়াছিলাম তাহা অবর্ণনীয়।

দেশের আপামর জনসাধারণের সঙ্গে অবশ্য এইসব অশ্লীলতার যোগ বিশেষ নাই। কিন্তু আরেকটি জিনিস লক্ষ করিয়া আমি সর্বদা মর্মাহত হইয়াছি। নেটিভ স্টেটের বালক-বালিকা ছাত্রছাত্রীদের দাস্যভাব।

এক অতি সম্ভ্রান্ত স্টেটে দেওয়ানের নাতি স্কুলের ছাত্র-মাস্টারের উপর ঠাকুরদাদার অপেক্ষাও কঠিন ডাণ্ডা চালাইত। মাস্টারদের ঘরের পাশে তাহার জন্য বিশেষ বসিবার জায়গা, সেইখানে সেই শাখামৃগ তাহার ইয়ার-বক্সীদের লইয়া অঙ্গদের রায়বার বসাইত। আর কী দাপট! হেডমাস্টারকে শাসায় ঠাকুরদাদাকে বলিয়া তাহাকে আন্দামান অর্থাৎ রাজধানী হইতে দূরে গগ্রামে বদলি করাইবে। মাস্টার বৃদ্ধ– পেনশন-পেয়ালায় চুম্বন দিব-দিব করিতেছেন, ফস্কাইলেই সর্বনাশ। সবকিছু নীরবে সহিয়া যাইতেন।

স্কুল হইতে ছেলেমেয়ে বাছাই করিয়া রাজবাড়িতে রাজপুত্র রাজকন্যাগণের সঙ্গে পড়িবার জন্য লইয়া যাওয়ার রীতি কোনও কোনও স্টেটে আছে।

রাজা বিদেশে, কাজেই সে স্কুলের বড়া শয়তান যুবরাজের সেখানে সপত্নহীন রাজত্ব। কারণ রাজা ছাড়া যুবরাজকে তম্বি কে করিতে পারে? আর সকলেই দিন শুনিতেছেন, যুবরাজ কবে রাজা হইয়া তাহাদিগকে বড় বড় তঙ্কার নোকরি দিবেন। কাজেই যুবরাজের শিক্ষা অগ্রসর হইতেছে না, অন্য ছেলেমেয়েদের কী সাহস যে-পাঠ যুবরাজ পড়িতে পারেন না তাহা তাহারা পড়িতে পারার দম্ভ করিবে! বাপ-মা ছেলেদের বিশেষ করিয়া বলিয়া দেন যেন তাহারা ওই সব লেখাপড়ার মতো অবান্তর বাহ্যবস্তুর প্রতি মনোযোগ না করে সারবস্তু, যেন যুবরাজকে খুশি রাখা হয়। তিনি বড় হইয়া তাহাদের প্রতি নেকনজর দিলে তাহাদের তখন ভূগোল-ইতিহাসের কী প্রয়োজন? আর লেখাপড়ার ফপরদালালি করিয়া যদি এখন তাহাকে চটায় তবে পরে তাহাদিগকে রক্ষা করিবে কোন জ্যামিতি, কোন ব্যাকরণ? স্মরণ তো রাখিতে হইবে এযুগে চাণক্য প্রবচনের প্রথমার্ধ স্বদেশে পূজ্যতে রাজা খাটে কিন্তু বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে আর খাটে না।

যুবরাজ বড় হইলে এইসব অকাল-কুষ্মন্ত্রে উজির নাজির কোটাল হয়। তাহাদের না আছে শিক্ষা, না আছে শীল। কুলীনের যে নবধা কুললক্ষণ, সেসব তাবৎ কয়টির সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি যদি কোনও ব্যক্তিতে পান তবে বুঝিবেন, তিনি নেটিভ স্টেটের রাজার বাঁদর নাচের পুচ্ছহীন মর্কট, অর্থাৎ সেখানকার হোমরা-চোমরা অথবা বড় কর্মচারী।

কোনও কোনও খবরের কাগজে দেখিলাম, নেটিভ স্টেটগুলিকে মধ্যযুগের সামন্ত রাজ্যের সঙ্গে তুলনা করিয়াছে। তাহাতে মধ্যযুগের সামন্ত রাজ্যের প্রজাদের প্রতি অবিচার করা হইয়াছে। আমি পশ্চিম ভারতের যেটুকু ইতিহাস পড়িয়াছি তাহাতে দেখিয়াছি যে, মধ্যযুগে কোনও রাজা কাণ্ডজ্ঞানহীন উচ্ছলতায় মত্ত হইলে প্রজা বিদ্রোহী হইয়া রাজাকে তাড়াইয়াছে, অথবা অন্য সামন্ত রাজা প্রজাদের অসন্তোষের খবর পাইয়া সে রাজ্য আক্রমণ করিয়া নিজ রাজ্য বৃদ্ধি করিয়াছেন অথবা দিগ্বিজয়ী বলিয়া খ্যাত হইয়াছেন। এখন প্রজাবিদ্রোহেরও উপায় নাই। নানারকম ট্রিটির জোরে মহারাজ বহিঃশক্তি আহ্বান করিয়া দুই মিনিটেই সব বিদ্রোহ ঠাণ্ডা করিয়া দিতে পারেন। প্রজারা কর্মে মগ্ন বলদের মতো একদিকে খায় রাজার মার, অন্যদিকে খায় ট্রিটির মার।

তবু মাঝে মাঝে যখন অত্যাচার অসহ্য হয় তখন অনেক সুবিধাবাদী মকুবির জয়জয়কার আরম্ভ হয়। তাহারই একজনের সঙ্গে আমার বোম্বায়ে আলাপ হয়। তাঁহার পেশা নাকি জর্নালিজম। শুধাইলাম, মহাশয় কোন কাগজে লেখেন? বলিলেন, আজ্ঞে, কোনও কাগজেই লিখি না, না লিখিয়া পয়সা কামাই। আমি বলিলাম, সে কী মহাশয়, কালিদাসের নাই তাই খাচ্ছ ব্যাপার নাকি? বলিলেন, অনেকটা তাই; নেটিভ স্টেটে ফ্রেশ কেলেঙ্কারির খবর পাওয়া মাত্রই সেখানে উপস্থিত হইয়া নানা তদ্বির-তদন্ত করিয়া রাজা বা দেওয়ানের বিপক্ষে প্রমাণ সংগ্রহ করি। তার পর দেওয়ানকে বলি, কত ওগরাবে কও। দেওয়ান বেশ টু পাইস দেয়– অবশ্য অবস্থা বুঝিয়া ব্যবস্থা। তাই আর কেচ্ছাটা লেখার প্রয়োজন হয় না। আর লিখিয়াই-বা হইবে কী? ফি কলম কুড়ি টাকা তো? তাহাতে আমার এক সন্ধ্যার ইয়ের খরচটাই উঠিবে না। জিজ্ঞাসা করিলাম, কিন্তু যাহাদের নানা ভরসা দিয়া প্রমাণ সংগ্রহ করিলেন, সে প্রমাণ দেওয়ানকে যে সমঝাইয়া দিলেন, তাহাদের কী? পাষণ্ড কী বলিল জানেন? আণ্ডা না ভাঙিয়া কি আর মামলেট হয়!

কোনও কোনও নেটিভ স্টেটে প্রজামণ্ডল আছে– শুনিলাম কুচবিহারে নাই। প্ৰজামণ্ডল কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হইয়া স্টেটের প্রজাবর্গের উন্নতির চেষ্টা করেন, অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন, ধারা সভায় প্রবেশ করেন ও ব্রিটিশ ভারতে ব্যাপক রাজনৈতিক আন্দোলন আরম্ভ হইলে যোগদান করেন। লক্ষ করিয়াছি, যে স্টেটে অবিচার কম সেখানে কংগ্রেসের সঙ্গে যোগ দেওয়া আন্দোলনে জোর কম থাকে। ব্রিটিশ ভারতে আমরা বিদেশি রাজের বিরুদ্ধে যে জোর পাই, ভালো স্টেটে প্রজারা সে জোর পাইবে কোথা হইতে? মন্দ স্টেটে আন্দোলন ভালো চলে, কারণ রাজা বা দেওয়ান তখন বিদেশি শাসনের প্রতীক হইয়া দাঁড়ান।

পশ্চিম ভারতের কংগ্রেস কর্মীরা প্রজামণ্ডলগুলির সঙ্গে সর্বদা যোগসূত্র রক্ষা করেন। পূর্ব ভারতে আমাদের অন্তত খবর রাখা উচিত না হইলে অখণ্ড সম্পূর্ণ ভারতবর্ষের প্রতি রাজনৈতিক সিংহাবলোকন চক্রবালে পরিব্যাপ্ত হয় না।

কোনও কোনও স্টেটে মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠানও আছেন; কর্মীরা মুসলিম স্বার্থ রক্ষা করিবার প্রয়াস করেন। খুব দরকার হয় না, কারণ দেশি স্টেটে হিন্দু-মুসলমানের দলাদলি কম।

এই একটিমাত্র গুণ দেশি রাজ্যে আছে। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা সেখানে হয় না। কারণ হিন্দু-মুসলমানকে লড়াইয়া সেখানে রাজার কোনও ফায়দা নাই। কোনও কোনও স্টেটে হিন্দু-মুসলমানের হৃদ্যতা দেখিয়া ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ লইয়া মনে মনে সুখস্বর্গ গড়িয়াছি।

উত্তম রাজা যে দেশি রাজ্যে কুত্রাচ নাই, এমন নহে। বরোদার ভূতপূর্ব মহারাজ স্বর্গীয় সয়াজি রাওয়ের মতো প্রজাপালক দেশে-বিদেশে অতি অল্পই জন্মিয়াছেন। কিন্তু তিনিও তো বাল্যকাল কাটাইয়াছিলেন রাখাল ছেলেদের সঙ্গে। তিনি রাজা ছিলেন, কিন্তু কখনও যুবরাজ ছিলেন না–দত্তক পুত্ররূপে রাজা হন। দুই-একটি জনপ্রিয় রাজা যদি-বা স্টেটে জন্মান তবু তাঁহাদের জন্য নেটিভ স্টেট রূপ জঞ্জাল রাখিবার প্রয়োজন নাই।

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাপ্রসূত দৃঢ় বিশ্বাস, স্বাধীন ভারতে দেশি রাজ্যের স্থান নাই।

.

ধবলদম্ভ

জর্জিক জাহাজে সেদিন ভারতীয়দের প্রতি যে অদ্ভুত ব্যবহার করা হইল তাহা ধবলদম্ভের, স্বাধিকার প্রমত্ততার বিকৃত রূপ। এই সম্পর্কে আমার আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়িল। সে অনেক দিনের কথা; কিন্তু বহু ভারতীয় বিদেশে যান, ঘটনাটি মনে রাখিলে তাহারা উপকৃত হইবেন।

১৯২৮ সালে প্রচণ্ড শীত কাবুলে প্রচণ্ডতর হইয়া পড়িয়াছিল। সেই সময় আমানউল্লা বাচ্চা-ই-সকাওর হস্তে পরাজিত হইয়া রাতারাতি কাবুল ত্যাগ করিয়া কান্দাহার চলিয়া যান। বাচ্চা তখনও শহরে প্রবেশ করেন নাই। সেখানে তখন নির্মম বীভৎস অরাজকতা চলিয়াছে। রাজা নাই; পুলিশ, মিলিটারি প্রাণরক্ষার্থে উর্দি ছাড়িয়া আত্মগোপন করিয়াছে। শহরে রাস্তায় রাস্তায় প্রকাশ্য লুটতরাজ, খুন-খারাবি চলিয়াছে। বাচ্চার অগ্রগামী সৈন্যরাই প্রধান দস্যু, তাহাদের সঙ্ঘবদ্ধ অত্যাচার রুদ্ধ করিবার মতো কোনও প্রতিষ্ঠান তখন কাবুলে ছিল না।

দোকান-পাট বন্ধ। রাস্তায় বাহির হইবার উপায় নাই। ওভারকোটের লোভে যে কোনও দস্যু আপনাকে গুলি করিতে প্রস্তুত। চাহিলে পর দিলে গুলি করার রেওয়াজ আফগান দস্যুদের মধ্যে প্রচলিত নাই।

খাস কাবুলিরা এরকম বিদ্রোহ ও লুটতরাজ ব্যাপারে অভ্যস্ত। বিশৃঙ্খলতার গন্ধ পাইবা মাত্রই তাহারা বছর দুইয়ের খোরাক বাড়িতে যোগাড় করিয়া রাখে। বিপদে পড়িলেন বিদেশি অধ্যাপক ও শিক্ষকেরা। ইহারা সকলেই কাবুলে নবাগত– কাবুলি কায়দা জানেন না। আহারাদি সঞ্চয় করিয়া রাখেন নাই। পক্ষাধিককাল যাইতে না যাইতেই তাহাদের নিরস্তু একাদশী আরম্ভ হইল– কারণ কলের জল পর্যন্ত বন্ধ হইয়া গিয়াছে।

বাচ্চা সিংহাসনে আরোহণ করিয়া প্রথম সৎকর্ম করিলেন অধ্যাপক শিক্ষকদের বরখাস্ত করিয়া। প্রাপ্য বেতনও তাঁহাদিগে দেওয়া হইল না। সে-যুগে কাবুলে কোনও ব্যাংক ছিল না বলিয়া অধ্যাপক-শিক্ষকেরা সঞ্চিত অর্থ পেশাওয়ার বা লাহোরের ব্যাংকে রাখিতেন। তাঁহারা তখন কপর্দকহীন; সে দুর্দিনে ধারই-বা দিবে কে? কাবুলের সঙ্গে তখন বহির্জগতের কোনও যোগাযোগ নাই।

পরিস্থিতি আলোচনা করিবার জন্য ফরাসি, জর্মন ও ভারতীয় শিক্ষকেরা একত্র হইয়া জিরগা করিলেন। তখন প্রথম অসুবিধা হইল ভাষা লইয়া। সকলে জানেন এমন কোনও ভাষা খুঁজিয়া পাওয়া গেল না। সে সভায় মাত্র একজন বাঙালি ছিলেন। তিনি ফারসি ফরাসি জর্মন তিনটি ভাষাই জানিতেন বলিয়া তাঁহাকেই সভাপতি করা হইল। সভায় স্থির হইল যে, যেহেতু অধ্যাপকেরাই সর্বাধিক বিপদে পড়িয়াছেন, তাঁহাদিগের জন্য যদি সদাশয় ব্রিটিশ লিগেশন কোনও উপায় অনুসন্ধান করিয়া দেন, তবে তাহারা কৃতাৰ্থৰ্ম্মন্য হইবেন। এই মর্মে ডেপুটেশন পাঠানো স্থির হইল।

লিগেশন হইতে উত্তর আসিল ফরাসি-জর্মনরা যেন স্ব স্ব লিগেশনের দৌত্যে নিজ নিজ অসুবিধা পেশ করেন। ভারতীয়দের সঙ্গে দেখা করিতে লিগেশনকর্তা হিজ এসেলেন্সি লেফটেনান্ট-কর্নেল শ্রীযুক্ত সর ফ্রান্সিস হমফ্রিস রাজি আছেন।

ইতোমধ্যে সর ফ্রান্সিস বাচ্চার সঙ্গে আলাপ করিয়া পেশাওয়ার হইতে কাবুলে রোজ একখানা, দুইখানা হাওয়াই জাহাজ আনাইবাবু সন্দোবস্ত দিয়া ফেলিয়াছেন। ফরাসি জর্মন ইতালীয়দের সেই জাহাজগুলিতে করিয়া ভারতে পাঠানো আরম্ভ হইয়া গিয়াছে।

ডেপুটেশন নিবেদন করিল যে, ভারতীয় শিক্ষকেরা উপবাসে প্রায় মরিবার উপক্রম। ভারতে যাইবার অন্য সব পন্থা যখন রুদ্ধ তখন সায়েব যদি তাহাদিগকে হিন্দুস্থান পাঠাইবার বন্দোবস্ত করিয়া দেন ইত্যাদি ইত্যাদি। সায়েব বলিলেন, দেখুন কাবুলের ব্রিটিশ লিগেশন লন্ডনস্থ ব্রিটিশ সরকারের সিন জেমস (অথবা ওই জাতীয় অন্য কিছু বিজাতীয়) কোর্টের মুখপাত্র (Representative)। ভারতীয়েরা হক্কের জোরে (as a matter of right) আমাদিগের নিকট হইতে কোনও সাহায্য দাবি করিতে পারেন না। মেহেরবানি-রূপে (as a matter of favour) চাহিতে পারেন।

ডেপুটেশনের বাঙালি মুখপাত্রটি বলিলেন, সে কী কথা সায়েব, এই যে হাওয়াই জাহাজ আসিতেছে সেগুলি তো ইন্ডিয়ান আর্মির পয়সায় কেনা, পাইলট মেকানিক ভারতীয় তনখা খায়, যে জায়গায় গিয়া জাহাজ খানা লইবে সে-ও তো ভারতের জমি। তুমি আবার পরের ধনে পোদ্দারি না হউক, পরের জাহাজে কাপ্তেনি কেন করিতেছ! অবশ্য একথা তিনি জিজ্ঞাসা করেন নাই।

চোর বরঞ্চ ধর্মের কাহিনী শোনে না হইলে বাল্মীকি উদ্ধার পাইতেন না কিন্তু ধবলদম্ভ হড়াঈর দ্বিরদরদস্তম্ভে গম্ভীর হইয়া বসিয়া রহিলেন। বাঙালিটি তখন লক্ষ করিলেন যে, ডেপুটেশনের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে চিত্তচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হইয়াছে। তখন তিনি গাত্রোত্থান করিয়া বলিলেন, সাহেব, এই যে হক আর মেহেরবানি লইয়া কথা বলিলাম, তাহা নিতান্ত আমার ব্যক্তিগত মতামত। এখন জীবনমরণ সমস্যা। ডেপুটেশনের অন্যান্য সদস্যগণের সঙ্গে আলোচনা করিয়া কর্তব্য স্থির করুন। সদস্যগণ একবাক্যে সায় দিলেন যে, হ মেহেরবানি লইয়া কথা-কাটাকাটি করা বাতুলতা। আত্মানাং সততং রক্ষে দারৈরপি ধনৈরপি।

বাঙালিটি বলিলেন, বিলক্ষণ, কিন্তু সায়েব, আমি ভারতে, স্বদেশে মেহেরবানিরূপে যাইব না, যদি যাই, যাইব হক্কের জোরে। বন্ধুগণ, নমস্কার, সায়েব, সেলাম।

সন্ধ্যাকালেই ভদ্রলোক খবর পাইলেন যে, তাহার নাম ভারত প্রত্যাগমনকামীদের নির্ঘণ্ট হইতে নাকচ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। খবরটি দিলেন ভদ্রলোকটির বন্ধু, ব্রিটিশ লিগেশনের অরিয়েন্টাল সেক্রেটারি, খান বাহাদুর শেখ মহবুব আলী খান, বন্ধুভাবে, সরকারি খবর হিসাবে নয়। তার পর সেইসব জাহাজে করিয়া ফরাসি গেল, জর্মন গেল, ইতালি গেল, তুর্ক গেল, ইরানি গেল, ব্রিটিশ লিগেশনের মেয়েরা গেলেন। তার পর সর্বশেষে ভারতীয় মেয়েদের খোঁজ পড়িল। তাঁহাদের অনেকেই পুরুষ অভিভাবক ছাড়া হাওয়াই জাহাজে চড়িয়া পেশোয়ার যাইবার হিম্মত পান না– কেহ কেহ গেলেন, কেহ কেহ রহিলেন। ভদ্রলোকটি রীতিমতো জোর-জবরদস্তি করিয়া রবীন্দ্রনাথের শিষ্য, (পরে) শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক স্বর্গীয় মৌলানা জিয়াউদ্দিনের স্ত্রীকে হাওয়াই জাহাজে তুলিয়া দিয়া আসিলেন। তার পর অতি সর্বশেষে ভারতীয় পুরুষদের পালা আসিল। কিন্তু ভদ্রলোকটির নামে তো ঢেরা পড়িয়াছে; তিনি পেটে কিল মারিয়া কাবুলের মাটি কামড়াইয়া পড়িয়া রহিলেন।

এদিকে ভারতবর্ষে ভদ্রলোকের পিতা-পুত্রের কোনও খবর না পাইয়া আহারনিদ্রা ত্যাগ করিয়াছেন ও টেলিগ্রাফ অফিসে থানা বাঁধিয়াছেন। দিল্লি-সিমলা যেখানে যাহাকে চিনিতেন, অহরহ তার করিতেছেন, আমার পুত্রের কী খবর? আসামের বর্তমান রাজস্বসচিব (?) মৌলবি আবদুল মতীন চৌধুরীও একখানা তার পাইলেন। সেইদিনই সর ডেনিস ব্রের সঙ্গে তাঁহার দেখা। ভোট সংক্রান্ত কী একটা ব্যাপারে সর ডেনিস মতীন সাহেবের কাছে যান। তিনি বলিলেন, তোমরা যে কাগজে ছাপাইতেছ ভারতীয়দের আনা হইতেছে, অমুকের খবর কী?

সর ডেনিস কাবুলে বেতার পাঠাইলেন সর ফ্রান্সিসকে, অমুককে তার-পাঠ পাঠাও। সাইমন কমিশন তখন আসিব-আসিব করিতেছে অথবা আসিয়াছে। সর ডেনিস সেন্ট্রাল এসেমব্লির সদস্যকে সস্তায় খুশ করিতে কেন নারাজ হইবেন। কোনও ভারতীয়কে বাঁচাইবার জন্য ওই একটিমাত্র বেতার সেই সময় ভারতবর্ষ হইতে কাবুল যায়! পেশাওয়ার সরকার ও কাবুলের ব্রিটিশ লিগেশনে বেতার চলিত, বলা বাহুল্য যে, সে-বেতারের সুবিধা ভারতীয়দের দেওয়া হয় নাই। কাবুলে বসিয়া ভদ্রলোক অবশ্য এসব খবর পান নাই।

সে-বেতার লিগেশনে কী অলৌকিক কাণ্ড বা তিলিসমাত করিল তাহা স্থানাভাবে বাদ দিলাম। পরদিন ভদ্রলোক খবর পাইলেন, তাহার জন্য আগামীকল্যের হাওয়াই জাহাজে একটি স্থান রিজার্ভ করা হইয়াছে। ফেবার না রাইট তাহার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি আর হইল না।

সর্বস্ব কাবুলদস্যদের জিম্মায় ফেলিয়া মাত্র দশ সের (অথবা পৌন্ড) লগেজ লইয়া ভদ্রলোক হাওয়াই জাহাজে করিয়া পেশাওয়ার ফিরিলেন। বিমানঘাঁটিতে সর ফ্রান্সিস করমর্দন করিয়া বলিলেন, আমরা ভারতীয়দের যথাসাধ্য সাহায্য করিবার চেষ্টা করিয়াছি, আশা করি, আপনি ভারতবর্ষে ফিরিয়া সব কথা বলিবেন।

ভদ্রলোকটি বলিলেন, নিশ্চয়ই সব কথাই বলিব। দেশে ফিরিয়া তিনি জমিয়ত-উল উলেমার নেতা মৌলানা হুসেন আহমদ মদনীকে আদ্যোপান্ত বলেন। আন্দোলনও হইয়াছিল কিন্তু কোনও ফল হয় নাই। লিগেশন-কর্তা প্রমোশন পাইয়া ইরাক না কোথায় চলিয়া গেলেন।

বর্ণনা শেষ করিয়া ভদ্রলোকটি বলিলেন, কিন্তু আমার চরম শিক্ষা হইয়া গেল। কাবুল গিয়াছিলাম টাকা রোজগার করিয়া ইউরোপে পড়িতে যাইবার জন্য। কোন দেশে যাইব বহুদিন মনস্থির করিতে পারি নাই। এই ঘটনার পর নির্ঘ মনে ইংলন্ড বর্জন করিলাম। পড়িতে গেলাম অন্য দেশে ও ফরাসি জাহাজে।

.

চতুরঙ্গ

পুব বাংলা যখন পাকিস্তানের অংশরূপে স্বাধীন হল তখন ওই অঞ্চলের লোক সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারেননি, তাঁহাদের সাহিত্য সৃষ্টি কৃষ্টি গবেষণা কোন পথে চলবে। অখণ্ড পাকিস্তান নির্মাণের সহায়তা করার জন্য তারা উর্দু ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযুক্ত হবেন, না, যে বাংলা ঐতিহ্য উভয় বাংলা অনুকরণ করছে সেই পন্থা অবলম্বন করবেন? একটু সময় লাগল।

(১) ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার বর্ধমান হাউসে–বাংলা অ্যাকাডেমি। কিছুদিন পরেই তাঁদের প্রথম ত্রৈমাসিক বেরুল। দুই বাংলাতে তখনও পুস্তকাদি অনায়াসে গমনাগমন করত। প্রথম সংখ্যা এ-বাংলায় পৌঁছনোমাত্রই তার আলোচনা দেশ পত্রিকায় বেরোয়। এ-বাংলা তাকে সানন্দ অভিনন্দন জানায়। আজ যদি দুষ্টজন বলে, পশ্চিম বাংলার রাজনৈতিকরা বাংলা দেশের লোকজনকে অখণ্ড পাকিস্তান ধ্বংস করার জন্য যাবতীয় কারসাজি করছে, তবে অকুণ্ঠ ভাষায় বলব, যখন আমরা দেশ মারফত ওই ত্রৈমাসিককে স্বাগত জানাই তখন আমাদের ভিতর কেউই রাজনৈতিক ছিলেন না। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তান সরকার তাঁদের পেটুয়া কিছু কিছু বাঙালি মোল্লা মুন্‌সিকে অ্যাকাডেমিতে ছলে-বলে ঢুকিয়ে দিলেন। তাঁরা বললেন, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র। কিন্তু বাংলা ভাষায় ইসলামের উত্তম উত্তম আরবি ধর্মগ্রন্থের অনুবাদ নেই। অতএব আমাদের প্রথম কর্ম কুরান-শরিফের বাংলা অনুবাদ করা। সভাপতি বললেন, সে কী? আমারই জানা-মতে অন্তত পাঁচখানা বাংলা অনুবাদ রয়েছে। মোল্লারা : তা হলে হদিসের (কুরান-শরিফের পরেই হদিস আসে) অনুবাদ করা যাক। আসলে মোল্লারা চান ওই মোকায় বেশ দু পয়সা কামাতে। আর এদিকে বেচারি অ্যাকাডেমি সবে জন্ম নিয়েছে। অজাতশত্রু হতে চায়। স্বীকার করে নিল। সে কর্ম এখনও সমাপ্ত হয়নি। কারণ সমাপ্ত হলেই তো কড়ি বন্ধ হয়ে যাবে। (এ টেকনিক আমাদের এ দেশের ডাঙর ডাঙর আপিসাররাও জানেন।) বাঙলা অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যান আমাকে বললেন, এ যাবৎ তেনারা আশি হাজার টাকা গ্যাটস্থ করেছেন। এই মোল্লাদের অনেকেই এখন খানকে সাহায্য করছেন– মীরজাফররূপে।

(২) কেন্দ্র বাংলা উন্নয়ন বোর্ড।

আপনারা বাঙালদের যত মূর্খ ভাবেন তারা অতখানি মূর্খ নয়। তারা তখন অন্য প্যাঁচ কষল। তারা কেন্দ্রীয় সরকারকে জানাল, আমাদের পাঠশালা স্কুলে যেসব টেকস্ট বই পড়ানো হচ্ছে সেগুলো বড়ই অনৈসলামিক ভাবাপন্ন। অতএব সেগুলো নাকচ করে দিয়ে নয়া নয়া কেতাব লেখা হোক। গাড়োল রাওলপিণ্ডি সে ফাঁদে পা দিল। তখন সৃষ্ট হল কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু ইয়া আল্লা ইয়া রাসুল! কোথায় না তারা প্রস্তাবিত কর্মে লিপ্ত হবে, না তারা লেগে গেল বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের পরিপূর্ণ পদ্য-গদ্য রচনা সম্পূর্ণাকারে প্রকাশ করতে। আমার মনে হয়, তখনই তারা ভিতরে ভিতরে আপন অজান্তে জেনে গেছে, ঝঞ্ঝা আসন্ন, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে একটা দফারফা করতেই হবে। অতএব বিদ্রোহী কবি কাজীই আমাদের ভরসা। কী সুন্দর তিন ভলুম এ্যাবৎ বেরিয়েছে। যিনি সম্পাদনা করেছেন তার নাম বলব না। পাছে না টিক্কা খানের লোক তাকে গুলি করে মারে। (টিক্কা অর্থ টুকরো–ফারসিতে বলে টিক্কা টিক্কা মি কুন –তোকে টুকরো টুকরো করব। আমরা যেরকম তিনকড়ি, এককড়ি, ফকির নফর নাম দিই যাতে করে যম তাকে না নেয়।)

(৩) এশিয়াটিক সোসাইটি অব্ ইস্ট পাকিস্তান স্থাপিত হল। (ঠিক কী নাম বলতে পারছিনে।) এতেও পশ্চিম পাকের খানরা চটে গেলেন। কারণ বাঙালরা তখন বগুড়ার মহাস্থানগড়, কুমিল্লার ময়নামতি-লালমাই (এই ময়নামতি অঞ্চলেই এখন লড়াই চলছে) যেসব স্থলে বৌদ্ধবিহার স্থাপিত ছিল, যে সবের বর্ণনা চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং দিয়েছেন, সেই নিয়ে তারা লেকচর দিচ্ছে, সেমিনার করছে। তোবা, তোবা।

(৪) এবং এসবের বহু পূর্বেই আবদুল হাই, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃতের প্রধানতম অধ্যাপক, তাঁর সাংস্কৃতিক ত্রৈমাসিক বের করে যাচ্ছেন। এবং তিনি প্রকাশ করলেন তাঁর ওই পত্রিকায় আমাদের পশ্চিম বাংলার হরেন পাল মহাশয়ের অভিধান।

এই চতুরঙ্গে বাঙাল দেশ তার আপন পথে এগিয়ে যাচ্ছিল রাজনীতিকে উপেক্ষা করে। এমন সময় ইয়াহিয়া খান মারলেন ওই প্রগতির উপর থাপ্পড়। এর উত্তরে আমরা শুধু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে পারি।

বাহুর দম্ভ, রাহুর মতো,
একটু সময় পেলে
নিত্যকালের সূর্যকে
সে এক-গরাসে গেলে।
নিমেষ পরেই উগরে দিয়ে
মেলায় ছায়ার মতো,
সূর্যদেবের গায়ে কোথাও
রয় না কোনও ক্ষত।
বারে বারে সহস্রবার হয়েছে এই খেলা,
নতুন বাহু ভাবে
তবু হবে না মোর বেলা
কাণ্ড দেখে পশুপক্ষী।
ফুকরে ওঠে ভয়ে,
অনন্তদেব শান্ত থাকেন
ক্ষণিক অপচয়ে।

.

হ-য-ব-র-ল

০১.

তথাকথিত পণ্ডিতেরা বলেন, আসাম দেশ অসমান বলিয়া ইহার নাম আসাম। অথচ আদি বাসিন্দাদের নাম অহম। ইহাদের নামেই দেশের নাম হওয়া উচিত অহম দেশ। প্রকৃত তত্ত্ব এই যে, আসাম হইতে অহম হয় নাই, অহম হইতে আসাম হইয়াছে। ফোক ফিললজিস্ট অর্থাৎ গাঁওবুড়ো শব্দতাত্ত্বিক মনে মনে তর্ক করিয়াছেন যে, যেহেতু শুদ্ধ বাঙলার সেপার পূর্ব বঙ্গে হেপার, সাগর হাওর, সরিষা হইরা হয়, অতএব উল্টা হিসাবও চলে– অর্থাৎ স যখন হ হইতে পারে তখন হ-ও স হইতে পারে। এই নীতি চালাইলে যে হাসানো আর শাসানো একই ক্রিয়া হইয়া দাঁড়ায়, গাঁওবুড়ারা তাহা খেয়াল করিলেন না। স্থির করিলেন অহমই অসম; তার পর অসম হইতে আসাম হইল। তখন তথাকথিত পণ্ডিতেরা আসিয়া সমাধান করিলেন, এই দেশ অসমান বলিয়া ইহার নাম আসাম।

গাঁওবুড়াদের মূর্খ বলিলে আমাদের অন্যায় হইবে। উল্টাপুরাণ যে সর্বত্র চলে না– এ জ্ঞান এখনও বহু নাগরিকের হয় নাই। সায়েবরা হ্যাটকোট পরেন অতএব হাটকোট পরিলেই সায়েব হইয়া যাইব গায়িকা সুন্দরী কাননবালা লম্বা হাতা জামা পরেন অতএব লম্বা হাতা জামা পরিলে গায়িকা ও সুন্দরী হওয়া যায় এই ভুল যুক্তিজনিত আচার তো হাটে-ঘাটে ট্রামে-বাসে সর্বত্র দেখা যায়।

***

এই আসাম হইতে প্রত্যাগত এক বন্ধু বলিলেন যে, এতদিন আসামে যে তিন দলে রাজনৈতিক রেষারেষি চলিত তাহার সঙ্গে এখন চতুর্থ দল আসিয়া জুটিয়াছে। এই তিন দলের প্রথম দল আসামি বা অসমিয়া (উচ্চারণ অহমিয়া); ইঁহারা আসামি ভাষায় কথাবার্তা বলেন। আসামি ভাষা ও বাংলায় পার্থক্য ওড়িয়া বাঙলা অপেক্ষাও কম; আসামিদের গায়ে আর্য ও অহম রক্তের সংমিশ্রণ, যেরকম বাঙালির ধমনিতে আর্য ও মঙ্গোল দ্রাবিড় রক্তের সংমিশ্রণ। দ্বিতীয় দল শ্রীহট্ট, কাছাড়, গোয়ালপাড়ার অধিবাসী বাঙালি। ইঁহারা মূলত বাঙলা দেশেরই লোক, ইহাদের বাসভূমি বাঙলা দেশ হইতে কর্তন করিয়া আসামে জুড়িয়া দেওয়া হইয়াছে এবং ইহাদের অনেকেই চাহেন যে, ওইসব জিলাগুলো যেন পুনর্বার বাঙলা দেশে ফিরাইয়া লওয়া হয়। তৃতীয় দল বিশুদ্ধ অহম। ইঁহারা আসামের আদিম বাসিন্দা, হঁহাদের অনেকেই আর্যরক্ত দ্বারা অশুদ্ধ বা শুদ্ধ–যাহাই বলুন–না হইয়া আপন আভিজাত্য রক্ষা করিয়াছেন। চতুর্থ দল নতুন আসিয়া জায়গা চাহিতেছেন, ইঁহারা গারো, লুসাই, কুকি, নাগা, আবর, মিশমি ইত্যাদি পার্বত্য জাতি। ইঁহারা আসামের আদিমতম বাসিন্দা এবং আসামের রাজনৈতিক যজ্ঞশালায় উঁহারা এতদিন অপাঙক্তেয় ছিলেন।

***

যতদূর মনে পড়িতেছে ১৯৩২ সালে কাছাড় লর্ড বেনটিঙ্কের সময় ইংরেজ কর্তৃক অধিকৃত হয়। তাহার পর একশত বৎসর কাটিয়াছে। ধীরে ধীরে ইংরেজ গারো, লুসাই, নাগা অঞ্চলে আপন ডেরা ফেলিয়া ফেলিয়া দখল বাড়াইয়া চলিয়াছেন। ইহাদের জন্য ইংরেজ সরকার কী উপকার করিয়াছেন তাহার ইতিহাস লিখিবার সময় আজও হয় নাই। মোগল পাঠানরা ইহাদের রাজত্ব দখল করেন নাই, ইহাদের প্রতি কোনও দায়িত্ব তাঁহাদের ছিল না। কিন্তু ইংরেজ সরকারকে একদিন উভয়ার্থে আসামি ঐতিহাসিক গবেষণার কাঠগড়ায় দাঁড়াইয়া স্বপক্ষ সমর্থন করিতে হইবে।

মধ্য আফ্রিকার বনেজঙ্গলে হস্তীদন্ত-ব্যবসায়ী মুসলমান ইসলাম প্রচার করেন, বেতনভোগী ইউরোপীয় মিশনারিরা খ্রিস্টধর্ম প্রচার করেন। নিগ্রো মুসলমানদের কথা আজ থাক, কিন্তু খ্রিস্টান নিগ্রোদের কী অবস্থা হইয়াছে তাহা বার্নার্ড শর কৃষ্ণার ব্রহ্মান্বেষণ পুস্তকে পাইবেন। অসভ্য সুরা-অনভ্যস্ত জনগণের ভিতর মদ্য চালাইলে কী নিদারুণ কুফল হয় ও সেই সুযোগ লইয়া বিবেকধর্মহীন পুঁজিপতিরা তাহাদের কী অনিষ্ট করে, তাহা আঁদ্রে জিদের বেলজিয়ম কঙ্গো পুস্তকে পাঠক পাইবেন। ও অন্যান্য নিরপেক্ষ লেখকের অধুনা-খ্যাতিপ্রাপ্ত ফরাসি ডাকার অঞ্চলের বর্ণনায় পাইবেন।

***

খ্রিস্টান মিশনারিরা লুসাই, গারো, খাসিয়া ও নাগা অঞ্চলে প্রবেশ করেন। সরকারের কতটা সাহায্য পান ঠিক বলিতে পারি না, কিন্তু অনুমান করি ভারতবর্ষে ও পৃথিবীর অন্যত্র মিশনারিরা সচরাচর যে সাহায্য লাভ করেন, তাহাই পাইয়াছিলেন। অধুনা মুসলমানরা খাসিয়া পাহাড়ে ইসলাম প্রচারে লিপ্ত হইয়াছেন ও ব্রাহ্মরা কিয়ঙ্কাল ওইস্থলে ধর্মপ্রচারের পর কয়েকটি পরিবারকে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত করেন। তুলনামূলক ধর্ম সম্বন্ধীয় আলোচনা বারান্তরে হইবে; উপস্থিত শুধু এইটুকু বলিতে চাই যে, যে কোনও মানুষ যে কোনও ধর্ম গ্রহণ করুক আপত্তি নাই, কিন্তু যে ধর্মান্তর গ্রহণে সাহায্য করে সে যেন ঠিক এইটুকু বোঝে যে, ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে তাহাকে সে অর্থনৈতিক, সামাজিক, বেশভূষা, আহার-বিহার সংক্রান্ত, দেশের অবস্থার সঙ্গে খাপ না খাওয়া, ছন্নছাড়া কোনও নতুন ক্ষতিকর পরিবেষ্টনীতে যেন টানিয়া লইয়া না যায়।

বাঙালি মুসলমান আরব বেদুইনের ন্যায় কাবাব-গোস্ত খায় না, রাইফেল লইয়া দল বাঁধিয়া হানাহানি করে না, কিন্তু এক জর্মন নৃতত্ত্ববিদ খ্রিস্টান নাগাদের নতুন সামাজিক জীবনের সঙ্গে বসবাস করিয়া তাহাদের প্রচুর নিন্দা করিয়াছেন। কোনও কোনও পার্বত্য অঞ্চলে স্বচক্ষে কড়া মদের মাতলামি দেখিয়াছি ও বিশ্বস্তসূত্রে শুনিয়াছি কোনও কোনও অঞ্চলে গোপন বেশ্যাবৃত্তি আরম্ভ হইয়াছে।

কিন্তু সর্বাপেক্ষা মারাত্মক ভয়, এইসব খ্রিস্টানরা যেন আসামের চা-বাগিচার খ্রিস্টান ম্যানেজারদের সঙ্গে জুটিয়া এক নতুন ক্রিশ্চান লিগ নির্মাণ না করে। ট্রাইবেল লিগ হউক, আমরা তাহার মঙ্গল কামনা করিব, কিন্তু ক্রিশ্চান লিগ করিলে পার্বত্য জাতিরা আখেরে ক্ষতিগ্রস্ত হইবে।

.

০২.

উচ্চারণ সম্বন্ধে আর বাক্যবিনাস করিব না, এই প্রতিজ্ঞা করিলাম। কিন্তু তৎপূর্বে শেষবারের মতো একখানি চিঠি হইতে কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত করিব। হাজরা লেন হইতে শ্রীমতি ঘোষ লিখিতেছেন :

আমার ধারণা, অল্প একটু চেষ্টা করলেই বাঙালির সংস্কৃত উচ্চারণ বিশুদ্ধতায় যে কোনও ভারতীয় পণ্ডিতের সমকক্ষ হতে পারবে। প্রমাণস্বরূপ একটা উদাহরণ দিতে পারি– যদিও সেটি এত তুচ্ছ যে বলতে সংকুচিত হচ্ছি। পাঞ্জাবি অধ্যাপকটির ক্লাসে আমরা যে কয়টি ছাত্রী ছিলাম, তাহাদের মধ্যে তিনি বাঙালির উচ্চারণে কখনও কোনও ভুল তো ধরেনইনি; এমনকি সময়ে সময়ে একটু বেশি প্রশংসা করতেন। (লেখিকা দিল্লি কলেজে পড়িতেন।)

সর্বশেষ লেখিকার বক্তব্য–

যদি কলকাতার স্কুলগুলোর সংস্কৃত শিক্ষকেরা এ বিষয়ে একটু অবহিত হন, তা হলে বোধহয় কিছু সুফল পাওয়া যেতে পারে।

সবিস্তার মন্তব্য অনাবশ্যক। শুদ্ধ উচ্চারণ শিক্ষা যদি সত্যই কঠিন না হয়, তাহা হইলে এই স্থলে উচ্চারণ সম্বন্ধে আলোচনা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বন্ধ করা যাইতে পারে।

***

আমরা যখন সংস্কৃত শিখি, আরবি-ফারসি শিখি, তখন আমাদের উদ্দেশ্য এই নহে যে, সংস্কৃত অথবা আরবিতে সাহিত্যসৃষ্টি করিব। আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য উৎকৃষ্ট সাহিত্য পড়িয়া হৃদয়মনকে সংস্কৃত ও ধনবন্ত করা। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ওইসব সাহিত্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়া, উহাদের পরশমণি দ্বারা যাচাই করিয়া করিয়া মাতৃভাষায় উৎকৃষ্ট সাহিত্য রচনা করা। উদাহরণরূপে বলিতে পারি যে, রবীন্দ্রনাথ সংস্কৃত না জানিলে যৌবন বেদনা রসে উচ্ছল আমার দিনগুলি কবিতাটি লিখিতে পারিতেন না, প্রমথ চৌধুরী উত্তম ফরাসি ও বিশেষত আনাতোল ফ্রাঁস না পড়িলে কখনও বাংলাতে নতুন শৈলী প্রবর্তন করিতে পারিতেন না।

ইংরেজি, ফরাসি, জর্মন সাহিত্য আজ এত সমৃদ্ধ যে গ্রিক-লাতিনের জ্ঞান না থাকিলেও ইহাদের যে কোনও ভাষাভাষী মাতৃভাষার সাতজন ভালো লেখকের শৈলী মিশ্রণ করিয়া নতুন সৃষ্টি করিতে পারে; বিষয়বস্তু অনুসারে গড়িয়া পিটিয়া নতুন ঢং তৈয়ারি করিতে পারে। কিন্তু বাঙলাভাষা এখনও অত্যন্ত অপকু, সাহিত্য বড়ই দরিদ্র।

সংস্কৃতই যে জানিতে হইবে এমন কোনও কথা নহে। ইংরেজি ফরাসি বা আরবি যে কোনও সাহিত্যের সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠ যোগ থাকিলেই ভাষা ও সাহিত্যের মাপকাঠি পাওয়া যায়।

আধুনিক বঙ্গসাহিত্য না পড়িলে মনে হয় অধিকাংশ লেখকেরা যেন শুধু বাঙলার পুঁজিই ভাঙাইয়া খাইতেছেন। কিন্তু এককালে তো এরকম ছিল না। বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, সকলেই যে শুধু সংস্কৃতে পণ্ডিত ছিলেন তাহা নহে, তাহারা সকলেই ইংরেজি বেশ ভালো করিয়া জানিতেন।

ভারতচন্দ্র ফারসি ও সংস্কৃত দুই ভাষাই জানিতেন, এবং কী প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ যে তাহার আয়ত্তাধীন ছিল ও মোগল বিলাসের যে কী সন্ধান তিনি রাখিতেন তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ হইতে প্রকাশিত ভারতচন্দ্র গ্রন্থাবলীর প্রথম খণ্ড ১৭/১৮ পৃষ্ঠা পশ্য।

(এস্থলে সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করি, সাধারণ বাঙালি পাঠক এই দুই পৃষ্ঠায় উল্লিখিত তাবৎ আরবি শব্দ বুঝেন? না ইহাদের অর্থ দ্বিতীয় খণ্ডে প্রকাশিত হইবে– আমার কাছে দ্বিতীয় খণ্ড নাই।)।

যে কবি অত্যন্ত সহজ সরল অনুভূতি গীতিকাব্যে প্রকাশ করিতে চাহেন তাহার জন্য হয়তো সংস্কৃতের প্রয়োজন নাই। চণ্ডীদাসের সংস্কৃত জানিবার প্রয়োজন নাই; জসীম উদ্দীন চসার শেক্সপিয়র পড়িয়াছেন কি না সে প্রশ্ন অবান্তর।

যাহারা জটিল নভেল লেখেন ও উপন্যাস রচনা করেন তাঁহাদের সম্বন্ধেই উপরের মন্তব্যগুলি করিলাম।

.

০৩.

আমরা সাধারণত যখন ইউরোপে বা ইউরোপীয় সভ্যতা সম্বন্ধে মতামত প্রকাশ করি, তখন প্রায়ই ভুলিয়া যাই যে ইউরোপ সম্বন্ধে আমাদের প্রায় সকল জ্ঞান ইংরেজি পুস্তক হইতে সঙ্কলিত এবং ইংরেজিতে যেসব ফরাসি-জর্মন ইত্যাদি গ্রন্থ অনূদিত হয়, সেগুলি প্রায়শ ইংরেজ মনকে দোলা দিয়াছে বলিয়াই ওই ভাষাতে রূপান্তরিত হইয়াছে। অর্থাৎ বহুস্থলে সেগুলি খাস ফরাসি-জর্মন নহে, ইংরেজকে খুশি করিতে পারিয়াছে, ঈষৎ ইংরেজ-ভাবাপন্ন বলিয়া।

অথচ ইংরেজ ও ফরাসি যে কী ভীষণ দুই পৃথক জাত সে সম্বন্ধে অন্তহীন আলোচনা চলিতে পারে। সাহিত্যের দিক দিয়া দেখিতে গেলে নির্ভয়ে বলা যায় ফরাসি সাহিত্য ইংরেজি হইতে বিশেষ কিছু গ্রহণ করে নাই, কিন্তু ইংরেজি পদে পদে ফরাসির হাত ধরিয়া চলিয়াছে। তামাম ফরাসি ভাষাতে একশতটি ইংরেজি শব্দ খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না; ইংরেজিতে শুধু ফরাসি শব্দ নহে, গোটা বাক্য বিস্তরে বিস্তরে আছে। ইংরেজের পোশাকি রান্না বলিয়া কোনও বস্তু নাই– দ্র খাবারের মেনু মাত্রই আগাগোড়া ফরাসিতে লেখা। এমনকি ভিয়েনার ভিনার মিসেল পর্যন্ত ইংরেজি মেনুতে ফরাসির মধ্যস্থতায় এসূকেলপ দ্য ভ্য আ লা ভিয়েনেয়াজ রূপে পৌঁছিয়াছে।

ইংরেজি সঙ্গীত বলিয়া কোনও বস্তু নাই– যাহা কিছু তাহার শতকরা ৯৯ ভাগ জর্মন-ফরাসি-ইতালীয়-রুশ। তামাম বৎসর চালু থাকে এরকম অপেরাগৃহ একটিও লন্ডনে নাই; উত্তম অপেরা শুনিতে হইলে ড্রেসডেন যাও, মুনিক যাও, বন্ যাও, ভিয়েনা যাও, প্যারিস যাও।

ইংরেজ মেয়ে ফ্রক ব্লাউজ কিনিতে প্যারিস যায়, ছবি আঁকা শিখিতে প্যারিস যায়, ভাষা শিখিতে প্যারিস যায়, উৎকৃষ্ট খাদ্য ও মদ্য আস্বাদ করিতে প্যারিস যায়, বোতল বোতল বর্দো-বার্গন্ডি-শ্যাম্পেন খরিদ করিয়া নৌকা বোঝাই করিয়া ইংলন্ডে লইয়া যায়– ফরাসি স্কচ-হুঁইস্কি খাইতেছে আর মারোয়াড়ি পাঠার কালিয়া খাইতেছে– একই কথা।

ফরাসি ইংরেজকে বলে চরুয়া অর্থাৎ চরের বাসিন্দা অর্থাৎ খানদানহীন ঔপনিবেশিক। পদ্মার পারের জমিদার পদ্মার চর-বাসিন্দাকে যেরকম অবহেলা করে, ভাবে– চর আজ আছে কাল নাই– খানদানের বনিয়াদ গড়িবে কী প্রকারে, ফরাসি ইংরেজ সম্বন্ধে সেইরকম ভাবে। চ্যানেল পার হইয়া তাহাকে লন্ডন যাইতে হইলে, তাহার মস্তকে সহস্র বজ্রাঘাত হয়।

উপযুক্ত মন্তব্যগুলি করার উদ্দেশ্য এই যে, আমরা যেন ইউরোপের তাবৎ কর্মকীর্তি ইংরেজের জমার খাতায় লিখিয়া তাহাকে অহেতুক ভক্তি না দেখাই। দ্বিতীয়ত, ফরাসি ও জর্মন পড়াইবার ব্যাপক ব্যবস্থা যেন এদেশের স্কুল-কলেজে করা হয়। আমাদের মনে হয় কলকাতার ছেলেরা এককালে যেটুকু ফরাসি-জর্মন শিখিত এখন যেন সেইটুকুও শিখিতেছে না।

আমাদের স্কুল-কলেজে কী বিকট আনাড়ি কায়দায় ভাষা শিখানো হয় তাহার বিস্তৃত আলোচনা আরেকদিন করিবার বাসনা রহিল। উপস্থিত শুধু বলি চারি বৎসর স্কুলে ও চারি বৎসর কলেজে সংস্কৃত অথবা ফারসি পড়ার পরও ছাত্র ওইসব ভাষাতে সড়গড় হয় না এমন অদ্ভুত ব্যাপার আমি কোনও সভ্য দেশে দেখি নাই শুনি নাই।

.

০৪.

এক প্রসিদ্ধ আরব লেখকের স্বগত পড়িতেছিলাম।

ধনীরা বলে, অর্থোপার্জন করা কঠিন, জ্ঞানার্জনের অপেক্ষাও কঠিন। পণ্ডিতেরা বলেন, জ্ঞানার্জন অর্থোপার্জনের অপেক্ষা কঠিন; অতএব জ্ঞানীরা ধনীর চেয়ে শক্তিমান ও মহৎ। আমি বিস্তর বিবেচনা করিয়া এই সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়াছি যে, আমরা– অর্থাৎ জ্ঞানীরা যদি কখনও অর্থ পাই, তবে সে অর্থ ব্যয় করিতে সক্ষম এবং অনেক সময় ধনীদের চেয়েও সৎপথে অর্থ ব্যয় করি, কিন্তু ধনীরা যখন আমাদের সম্পদ অর্থাৎ পুস্তকরাজি পায়, তখন সেগুলির ব্যবহার বিলকুল করিতে পারে না। অতএব সপ্রমাণ হইল জ্ঞানীরা ধনীর চেয়ে শক্তিমান।

বিবেচনা করিয়া দেখিলাম, আরব লেখকের কথাটি অক্ষরে অক্ষরে সত্য।

গত শনি, রবি, সোমবারে বোম্বাই বাজারে যে তুমুল কাণ্ড দেখিলাম, তাহাতে সন্দেহের কোনও অবকাশ আর রহিল না।

একশত হইতে উপরের নোট আর যত্রযত্র ভাঙানো যাইবে না খবর প্রকাশ হওয়া মাত্র কালোবাজারিদের হৃদকম্প উপস্থিত হইল। ফালতু ট্যাক্স হইতে আত্মত্রাণ করিবার জন্য ব্যবসায়ীরা বিস্তারে বিস্তরে একশত, এক হাজার টাকার নোট গৃহে লোহার সিন্দুকে জমায়েত করিয়া রাখিয়াছিল, সে টাকা লইয়া তাহারা করিবে কী?

তখন কালোবাজারিরা ছুটিল ব্যাংকারদের কাছে। দয়া করিয়া, ঘুষ লইয়া নোটগুলি লও, হিসাবে দেখাও যে বহুদিন ধরিয়া এই নোটগুলি তোমাদের ব্যাংকে জমা ছিল। আমরা বাঁচি। ব্যাংকারদের জেলের ভয় আছে; কাজেই পন্থা বন্ধ।

কেহ ছুটিল সোনার বাজারে। সে বাজারে এমনি হিড়িক লাগিল যে, দাম হুশ হুশ করিয়া গগনস্পর্শী হইতে লাগিল। কর্তারা সোনার বাজার বন্ধ করিয়া দিলেন।

কেহ ছুটিল তাড়া তাড়া নোট পকেটে করিয়া শরাবের দোকানে। এক টাকার মদ খাইয়া একশত টাকার নোট ভাঙাইবার চেষ্টা করে। আমি গিয়াছিলাম এক বোতল সোডা খাইতে, দোকানি সোড়া দিবার পূর্বে সন্তর্পণে কানে কানে প্রশ্নবাণে প্রাণ হানে, একশত টাকার নোট নয় তো স্যার? ভাঙানি নাই।

বিস্ময় মানিলাম। প্রায় ছয় মাস হইল আমার মতো কারবারি-বুদ্ধি-বিবর্জিত মূর্খও বিলাতি মাসিকে পড়িয়াছিল যে, ইংলন্ডে কালোবাজারের ফাঁপানো পয়সাকে কাবুতে আনিবার জন্য দশ পৌন্ড নোটের উপর কড়া আইন চালানো হইয়াছে। সেই মাসিক কি এদেশের কারবারিরা পড়ে নাই। পড়িয়া থাকিলে ছোট নোটে ভাঙাইয়া রাখিলেই পারিত।

আরব ঠিকই বলিয়াছিলেন, ধনীরা পুস্তক (এমনকি মাসিক কাগজও) পড়িতে জানে না।

.

০৫.

বাঙলা ভাষায় একখানা অতি উপাদেয়, গ্রন্থ আছে। বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণচরিত্রের কথা স্মরণ করিতেছি। কী অসাধারণ পরিশ্রম, কী অপূর্ব বিশ্লেষণ, অবিমিশ্র যুক্তিতর্কের কী অদ্ভুত ক্রমবিকাশ এই পুস্তকে আছে, তাহা বর্ণনা করিয়া শেষ করা যায় না। ভাষা ও শৈলী সম্বন্ধে শুধু এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, যুক্তিতর্কপূর্ণ রচনায় এই ভাষাকেই আজ পর্যন্ত কেহই পরাজিত করিতে পারেন নাই। অনেকের মতে বাংলা গদ্য রচনায় কৃষ্ণচরিত্রের পর উল্লেখযোগ্য কোনও উন্নতি হয় নাই।

আরেকটি বিষয় লক্ষ করিয়া বিস্ময় মানিতে হয়। বঙ্কিম কয়েক জর্মন পণ্ডিতের নাম এই পুস্তকে উল্লেখ করিয়াছেন এবং সেই যুগে প্রত্যেকের নামের শুদ্ধ উচ্চারণ জৰ্মনে কী সে খবর লইয়া বাঙলায় বানান করিয়াছেন। আমরা নির্বিকার চিত্তে নিত্য নিত্য জওহরলাল, প্যাটেল, মালব্য লিখি, পটোডির নওয়াব ও ভিনু মনকদের কথা আর তুলিলাম না।

সে কথা থাকুক। কিন্তু বঙ্কিমের পুস্তকখানা বাঙলায় লেখা, বাঙলা লিপিতে। যদি পুস্তকখানা দেবনাগরী অক্ষরে লিখিত হইত, তবে বহু অবাঙালি অনায়াসে ইহা পড়িয়া উপকৃত হইতে পারিতেন।

পাঠক পত্রপাঠ শুধাইবেন বাঙলা, হিন্দি, গুজরাতি, মারাঠিতে কি এতই সাদৃশ্য যে শুধু ভিন্ন লিপি বলিয়া, এক প্রদেশের লোক অন্য প্রদেশের রচনা পড়িতে পারে না?

দৃষ্টান্ত স্বরূপ নিম্নলিখিত রচনাটি পাঠ করুন।

ব্যায়ামচর্চা ভারত অতি পুরনি কালরে পরা প্রচলিত; অসমতো নতুন নহয়। অহোম রাজা সকলর দিনত অসমত ব্যায়ামর খুব আদর আছিল। বিশেষকৈ মহারাজ রুদ্ৰসিংহর দিনত ইয়ার প্রসার বেচী হয়। তেঁও অসমর জাতীয় উৎসব আদিত ব্যায়ামর দৃশ্য দেখুবার নিয়ম করিছিল।

একখানা আসামি পুস্তিকা হইতে এই কয়টি পঙক্তি তুলিয়া দিলাম: ইহার বাংলা অনুবাদ করিয়া সহৃদয় সরল পাঠককে অপমানিত করিতে চাহি না। যে লিপিতে লেখা হইয়াছে অক্ষরে অক্ষরে সেইরকম তুলিয়া দিলাম; কেবলমাত্র বক্তব্য যে র অক্ষর আসামিতে ক অক্ষরের পেট কাটিয়া করা হয় এবং ওয়া উচ্চারণ প্রকাশ করিতে হইলে ব অক্ষরের উপরে একটি হসন্ত জাতীয় চিহ্ন ব্যবহৃত হয়।

এই কয়টি পঙক্তিই যদি কোনও বিজাতীয় লিপিতে লেখা হইত, তবে এ ভাষা যে না। শিখিয়াও পড়া যায়, সে তত্তটুকু শিখিতে আমাদের মতো অনভিজ্ঞের এক যুগ কাটিয়া যাইত।

পুনরায় দেখুন :

ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক উন্নতি রাজনৈতিক স্বাধীনতার উপর নির্ভর করে বাক্যটি হিন্দিতে ভারতবর্ষকী অর্থনৈতিক উন্নতি রাজনৈতিক স্বাধীনতা পর নির্ভর করতি হৈ, এবং গুজরাতিতে ভারতবর্ষনী অর্থনৈতিক উন্নতি রাজনৈতিক স্বাধীনতা পর নির্ভর করে ছে বলিলে বিশেষ ভুল হয় না কিন্তু যেহেতু গুজরাতি ও হিন্দি ভিন্ন লিপিতে লেখা হয়, আমরা এইসব ভাষা দূরে রাখি; ওইসব ভাষা-ভাষীরাও একে অন্যের মধ্যে তাহাই করেন।

এই বাক্যটিই ফরাসিতে বলি :

le progres economique de l Indedepend sur son Independance politique.

লিপি একই, অর্থাৎ ইংরেজি; কাজেই ভাষাশিক্ষা ব্যাপারে অতি অথর্ব ইংরেজও তাড়াতাড়িতে ফরাসি শিখিতে পারে।

তাহা হইলেই প্রশ্ন, তাবৎ ভারতবর্ষে একই লিপি প্রচলিত হইলে ভালো হয় কি না?

তাহা হইলে পুনরায় প্রশ্ন– শান্তিনিকেতন হইতে শ্ৰীযুত সেন মহোদয় জিজ্ঞাসা করিতেছেন তাবৎ পৃথিবীর জন্য একই লিপি হইলে ভালো হয় কি না? অর্থাৎ লাতিন লিপি যে লিপিতে লাতিন, ইংরেজি, ফরাসি, ইতালীয়, স্পেনীয়, পর্তুগিজ, তুর্কি ও অধিকাংশ জর্মন পুস্তক লেখা হয়।

***

এই সম্পর্কে আরেকটি কথা মনে পড়িল। প্রথম যৌবনে এক গুরুর কাছে শিক্ষালাভ করার চেষ্টা করি। সেই প্রাতঃস্মরণীয় গুরু অন্ততপক্ষে একশতটি ভাষা জানিতেন ও খুব সম্ভব একশত হইতে দুই শতের মধ্যেই ঠিক হিসাব পড়ে। এবং প্রত্যেকটি ভাষাই সাধারণ গ্র্যাজুয়েট যতটা সংস্কৃত বা ফারসি জানে তাহা অপেক্ষা বেশি জানিতেন। সাধারণ এ্যাডুয়েট আট বৎসর সংস্কৃত অধ্যয়ন করে। সেই হিসাবে গুরুর বয়স অন্ততপক্ষে ১৫০ x ৮ = ১২০০ বৎসর হওয়া উচিত ছিল; যদি তিন-তিনটি ভাষা একসঙ্গে শিখিয়া থাকেন, তবে তাঁহার বয়স ৪০০ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু গুরু বিরিঞ্চি বাবা নহেন ও ৬০ বৎসর বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন। এবং শেষের দশ বৎসর খুব সম্ভব কোনও নতুন ভাষা শিখেন নাই।

তবেই প্রশ্ন এই অলৌকিক কাণ্ড কী প্রকারে সম্ভবপর হইল?

স্বীকার করি শুরু ভাষার জহুরি ছিলেন ও ভাষা শিখিতে তাহার উৎসাহের অন্ত ছিল না। কিন্তু তবু আমার বিশ্বাস ভালো শুরু পাইলে, অর্থাৎ শিক্ষাপদ্ধতি উত্তম হইলে অল্পায়াসে এক ডজন ভাষা দশ বত্সরে শিখা যায়। শিক্ষাপদ্ধতির সঙ্গে আরেকটি জিনিসের প্রয়োজন, তাহা নিষ্ঠা। এবং তৃতীয়ত কণ্ঠস্থ করা অপ্রয়োজনীয়– এই অদ্ভুত বিজাতীয় অনৈসর্গিক পাণ্ডববর্জিত ধারণা মস্তিষ্ক হইতে সম্পূর্ণরূপে নিষ্কাষণ করা।

***

আরেকটি প্রশ্ন। প্যারিস লিখিব, না পারি? ফরাসিস লিখিব, না ফরাসি, না ফ্রেঞ্চ; বেৰ্লিন না বার্লিন; এ্যাক্সেলা শাপেল না আখেন (প্রথমটি ফরাসি উচ্চারণ ও আন্তর্জাতিক ভাষায় ইহাই চলে, কিন্তু দ্বিতীয়টি জর্মন ও শহরটি জর্মনিতে অবস্থিত? মস্কভা, না মস্কৌ, না মস্কো; শ্যাম না সিরিয়া যিশু, না য়েশু, না জীসস? ১৮৭০-৮০ খ্রিস্টাব্দে এইসব সমস্যা সমাধান করিবার জন্য কলকাতায় একটি কমিটি নির্মিত হয়, তাহার রিপোর্ট এযাবৎ দেখি নাই। কোনও পাঠক দেখিয়াছেন কী?

.

০৬.

ভর্তৃহরি বলিয়াছেন, প্রিয়ভাষীজনকে ধনহীন মনে করা দুর্জনের লক্ষণ। কিন্তু প্রিয়ভাষণেরও তো একটি সীমা থাকার প্রয়োজন। আমরা স্থির করিয়াছি বিলাতি কমিশন না আসা পর্যন্ত টু শব্দটি পর্যন্ত করিয়া রাজনৈতিক আবহাওয়া অহেতুক উষ্ণ করিব না, বিলাতি কর্তাদের গরমে কষ্ট হইতে পারে। কিন্তু এই সুযোগে অ্যাটলি সাহেবের প্রিয়ভাষণ যে অলঙ্কারের উপর অলঙ্কার পরিধান করিতেছে, তাহাতে সন্দেহ হইতেছে– বধূটি খুব সম্ভব কুরূপা। তবু গুরুজনেরা বলিতেছেন, বিশ্বাসে কৃষ্ণ মিলয়। হইতে পারে; কিন্তু কন্যাকর্তাকে বিশ্বাস করিয়া সুরূপা বধূলাভের আশা নগণ্য বলিয়াই কনে দেখার প্রথা এদেশে প্রচলিত।

সে যাহাই হউক, সর্বশেষ উপমা শুনিলাম নিউইয়র্কের কোনও এক খবরের কাগজের লন্ডনস্থ সংবাদদাতার নিকট হইতে। তিনি মনে মনে এক নদীর ছবি আঁকিয়াছেন, তাহার একপারে অ্যাটলি সাহেব, হাতে নাকি বহুমূল্য স্বরাজ; অন্য পারে তাবৎ ভারতীয়। সংবাদদাতা বলিতেছেন, শুধু কংগ্রেস, শুধু লীগ, শুধু রাজসংঘ, শুধু হরিজন সন্তরণ করিয়া উত্তীর্ণ হইলেই হইবে না; সকলকে একযোগে একসঙ্গে সে বৈতরণী পার হইতে হইবে।

বাল্যবয়সে বিস্তর ভারতীয় বিস্তর নদী সাঁতরাইয়া পার হয়, এবারেও চেষ্টা করিবে; কিন্তু প্রশ্ন– কে কে জলে নামিবেন? কংগ্রেস তো নামিবেনই, সায়েবের হাতে যখন স্বরাজ রহিয়াছে, লীগ নামিবেন কি? কারণ সংবাদদাতা বলিয়াছেন, সায়েবের হাতে স্বরাজ, পাকিস্তান আছে কি না বলেন নাই। না হয় লীগও নামিলেন; কিন্তু রাজারা তো কখনও সাঁতার কাটেন না। প্রজাদের পৃষ্ঠে বসিয়া যে যাইবেন তাহারও কোনও উপায় নাই; কারণ প্রথমত প্রজাদের সে-সন্তরণে যোগ দিবার কোনও প্রস্তাবই হয় নাই, দ্বিতীয়ত তাহারা সরেজমিন উপস্থিত থাকিলে মণিটির হিস্যা পাইবার জন্য চেল্লাচেল্লি করিবে, হয়তো-বা সাকুল্য মণিলাভের তালে থাকিবে। কাজেই মনে হইতেছে রাজারা দুইশত বৎসরের প্রাচীন খানদানি বাতরোগের অর্থাৎ সরকারের সঙ্গে কৃত সনাতন সন্ধিশর্তের দোহাই দিয়া পাড়ে দাঁড়াইয়া রহিবেন অথবা শূন্যে হাত-পা ছুড়িয়া সাঁতারের ভান করিবেন। হরিজন নামিতে পারেন, কারণ কূপ অপবিত্র হইতে পারে, মা-গঙ্গার সে ভয় নাই।

কিন্তু একযোগে সাঁতার কাটিতে হইবে। বয়নাক্কাটা বিবেচনা করুন। রুশ বাদ দিলে তামাম ইউরোপ ভারতের চেয়ে ক্ষুদ্র, তবু তথাকার কর্তারা সাঁতার কাটিবার সময় একে অন্যের গলা এমনি টিপিয়া ধরেন, যাহাকে বলে মহাযুদ্ধ। আর শুধু তাহাই নহে। পৃথিবীর আপামর জনসাধারণকে সেই নদীতে নামানো চাই, কি অস্ট্রেলিয়া, কি আমেরিকা, কি ভারত–কাহারও রেহাই নাই। এই এক জন্মেই দুইটি দক্ষযজ্ঞ দেখিলাম। তাহারই এক ছাগ-মুণ্ড তম্বি করিয়া বলিতেছেন, একযোগে সাঁতরাও।

না হয় সঁতরাইলাম, কিন্তু তথাপি প্রশ্ন ক্রিপস-নদীতে যে হাঙর-কুমির আমাদের পা কামড়াইয়া সবকিছু ভণ্ডুল করিয়া দিয়াছিলেন তাঁহারা ইতোমধ্যে বৈষ্ণব হইয়া গিয়াছেন কি?

সর্বশেষ প্রশ্ন, সায়েবের হস্ত মুষ্টিবদ্ধ। এ যেন ফোকা ধোকা খেলা। আমরা সকলে একযোগে হাঙ্গর-কুমির এড়াইয়া নদী পার হইয়া একবাক্যে চিৎকার করিয়া বলিব, আমরা ফোকা চাই অথবা ধোকা চাই, তখন সায়েব হস্তানন্মাচন করিবেন।

তখন আমাকে দোষ দিবেন না।

Exit mobile version