আমার চ্যান্স দিন, স্যার, আমি আপনার কাগজের তরে কামালের আমল করে ছাড়ব। ও! আপনি বুঝি আরবি ভাষা আমার চেয়েও বেশি মিসান্ডারস্টেন্ড করেন। কামালের স্যুপারলেটিভ আমল- যেমন কবীর-এর অবর, হামিদ-এর আহমদ! বাঁদরের বোধহয় আবৃদ নইলে হারাম ব্র্যান্ডি-পানি দেবে কেন?
***
শ্রীবিমলকে না নিলেও আপনি যে মিত্তির একটি নিতেনই– সে আমি জানি। মুখুয্যে “কুটিল” অতি বন্দ্যো বটে সাদা, অপিচ ঘোষ বংশ মহাবংশ, বোস বটে সাদা, মিত্তির “কুটিল” অতি দত্ত মহারাজা।
এ কম্মটি ভালোই করেছেন। সর্বশেষে দেখছি নমস্য বদ্যিও জুটিয়েছেন। কবিগুরুর দক্ষিণ-হস্তের সাক্ষাৎ প্রতীক আপনাদের কাগজের মেরুদণ্ড গড়ে দিচ্ছেন।… হা হা পাবলিসিটি করতে জানতেন না, বদ্যি সন্তান শ্ৰীম।
***
তবু বলছি, আমাকে নিলে ভালো করতেন!
‘কালি ও কলম’ ফাল্গুন ১৩৭৫
.
এষাস্য পরমা গতি?
সত্যেরে দেখিব আমি জ্যোতির্ময় রূপে;
আমার চরম মোক্ষ, আমি গন্ধ ধূপে
ভস্ম হব পরি লয়ে সে দীপ্ত তিলক
অগ্নিতে আছেন যিনি, জলে বিশ্বলোক–
অন্তস্তলে, ওষধিতে, বনস্পতি মাঝে
মম সত্তাবীণা যেন তারি স্পর্শে বাজে ॥
সে যুগ অতীত হল। তার পর ঋষি
কহিলেন, এ জীবন অন্ধ অমানিশি।
সত্য বাক্য, সত্য চিন্তা, তথা সত্য কর্ম
ত্রিরত্ন তোমার হোক– সঙ্, বুদ্ধ ধর্ম
দীপ্যমান সর্বলোকে অন্ধ তমোনাশা
ঈশ্বরের দাস্য ত্যজ, ত্যজ শূন্যে আশা।
বুদ্ধ-জীন ক্ষত্রিয়ের অমিতাভ ভাষা।
তাপিত শূদ্রের বুকে এনেছিল আশা ॥
অতিক্রমি আরবের দুস্তর মরুরে
ভারতে শ্যাম-সুধা-পঞ্চনদ ক্রোড়ে
আশ্রয় লভিল যবে নব সত্যদূত
বক্ষেতে বাহুতে তার এক ধর্ম পূত
একেশ্বর। প্রণমিয়া এ ভূমিরে।
–যে দেশ ত্যজিয়া এল নাহি চাহি ফিরে–
কহিল, “সত্যেরে আমি যে সুন্দর রূপে
লভিয়াছি, তবু শুভ্র পাষাণের স্তূপে
করিব প্রকাশ আমি। এস সর্বজন,
জাতিবর্ণ নাহি হেথা। মুক্ত এ প্রাঙ্গণ
আচণ্ডাল তরে। শুনি সে উদাত্ত বাণী
শান্ত হল অভিযান, যুদ্ধে হানাহানি ॥
তার পর? তার পর লজ্জা, ঘৃণা, পাপ,
অপমান; প্রকাশিল অন্তহীন শাপ ॥
যুগক্ষাত্র তেজে তার পাপ-প্রক্ষালন
চেষ্টা হল ব্যর্থ যবে। করিল বরণ
ভেদ-মন্ত্র ছিদ্রান্বেষী, পরম্পরাঘাত,
হইল বিজয়টিকা– সে অভিসম্পাত ॥
দীর্ঘ রাত্রি অবসানে অরুণ আলোতে
মেলি সুপ্ত আঁখি দেখি চলে মুক্তস্রোতে
নাগরিক বৃদ্ধ ক্ষুদ্র; জনপদে জাগে
দীন-দুঃখী, পাপী-তাপী। তারি পুরোভাগে
মোহনের সাথে চলে যে ছিল নির্ভয়
মহাপুরুষের নামে দিতে পরিচয়,
আজাদি মোতিরমালা চিত্ত কেড়ে লয়
সরোজিনী পঙ্কে ফোটে– জয় জয় জয়!
চক্রনেমি আবর্তন পূর্ণ হল ভেবে
কৃতজ্ঞ হৃদয় নিয়ে প্রণমিনু দেবে।
হায়রে বিদীর্ণ ভাল, হারে অর্বাচীন
চক্রনেমি আবর্তিল; কিন্তু হল লীন
সম্মুখের সুখস্বর্গ। কি অভিসম্পাতে
ভাগ্যচক্র প্রবেশিল সেই অন্ধরাতে ॥
ভূতনাথ গিরিশৃঙ্গে উভয়ে প্রয়াণ
নববীজমন্ত্র লাগি। নাহি অসম্মান!
নাহি অসম্মান তাহে। হেথা নাগরিক
দ্বি-ধা হয়ে তর্ক করে দীর্ণে দিগ্বিদিক!
কৌলীন্য বিচারের তাই কী জাত্যাভিমান!
দম্ভ কিবা?– কে পড়িছে বেশি স্টেটসম্যান।
[আনন্দবাজার পত্রিকা ২৮.৭.১৯৪৫]
.
গাঁধী-ঘাট
আজ যদি রাষ্ট্রসংঘ ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সংগীত শুনতে চান, তা হলে আমাদের কোনও দুর্ভাবনা নেই। আমাদের উচ্চাঙ্গ সংগীত কী সে বিষয়ে আমাদের মনে কোনও সন্দেহ নেই, এবং সে সংগীত, সর্বাঙ্গসুন্দর করে কে কে গাইতে পারবেন সে বিষয়েও আমাদের মনে অত্যধিক দ্বিধা নেই। তার কারণ আমাদের সংগীত এখনও জীবন্ত– তার ঐতিহ্য কখনও ছিন্নসূত্র হয়নি।
কিন্তু স্থাপত্যের বেলা আমাদের মস্তকে বজ্রাঘাত হয়। এককালে ভারতবর্ষে যে অত্যন্ত নয়নাভিরাম ভবন অট্টালিকা ছিল সে বিষয়ে আমরা নিঃসন্দেহ– সংস্কৃত কাব্য নাটক শিল্প-শাস্ত্রে তার ভূরিভূরি বর্ণনা পাওয়া যায় কিন্তু ঠিক কী করে সেগুলো আবার নির্মাণ করা যায়, সে সম্বন্ধে আমাদের কারও মনে কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই। মোগল-পাঠান বাদশারা ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে বুখারাস-মরকন্দ ইরানের শিল্পকলা মিশিয়ে এদেশে বিস্তর ইমারত গড়েছিলেন, কিন্তু তার প্রধান নিদর্শন পাওয়া যায় মসজিদ, কবর ও দুর্গ নির্মাণে। আজকের দিনে এসব ইমারতের আমাদের প্রয়োজন নেই, কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গৃহনির্মাণ করতে গিয়ে আমরা তাজমহল বা জুমা-মসজিদের দ্বারস্থ হতে পারিনে।
ইংরেজ যখন নয়াদিল্লি গড়তে বসল তখন যে এ সমস্যা তার সামনে একেবারেই উপস্থিত হয়নি তা নয়। ঠিক সেই সময়েই রসজ্ঞ হ্যাভেল সায়েব ভারতীয় শিল্পকলা সম্বন্ধে একখানা প্রামাণিক পুস্তক প্রকাশিত করেন। তার শেষ পরিচ্ছেদে তিনি ভারতীয় ইংরেজ বড়কর্তাদের সাবধান করে দেন, তারা যেন নয়াদিল্লিতে শিব দিয়ে বাঁদর না গড়েন। হ্যাভেল স্পষ্ট ভাষায় ইংরেজ স্থপতি-ইঞ্জিনিয়ারদের বলে দেন, ভারতবর্ষের স্থাপত্য-ঐতিহ্যের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া তোমাদের কর্ম নয়। যে শহরে দিওয়ান-ই-খাস, জুমা মসজিদ, কুতবৃমিনার রয়েছে, সেখানে ভারতীয় স্থপতিকে বাদ দিয়ে কোনও কিছু সৃষ্টিকার্য করার দম্ভ কর না।
কিন্তু হ্যাভেল যখন দেখতে পেলেন যে ইংরেজের স্বাধিকার-প্রমত্ততা তাকে সম্পূর্ণ বধির করে ফেলেছে, তখন তিনি ইংল্যান্ডের গণমান্য ইংরেজদের তরফ থেকে একখানা স্মারকলিপি তখনকার দিনে সেক্রেটারি অব স্টেটকে পাঠান। যতদূর মনে পড়ছে, সে স্মারকলিপিতে বার্নার্ড শ এবং এচ. জি. ওয়েলসের নামও ছিল।