জেনারেল জারফ! সর্বচৈতন্য কেন্দ্রীভূত করে, গভীরতম মনোযোগের সঙ্গে তিনি এগিয়ে আসছিলেন। প্রায় ঠিক গাছটার সামনে তিনি দাঁড়ালেন, তার পর মাটিতে হাটু গেড়ে জমিটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। কিছুমাত্র চিন্তা না করে রেনসফর্ডের প্রথম রোখ চেপেছিল নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ার কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সে লক্ষ করল জেনারেলের ডানহাতে ধাতুর তৈরি কী একটা বন্ধু ছোট্ট একটি অটোম্যাটিক পিস্তল।
শিকারি কয়েকবার মাথা নাড়লেন, যেন তিনি ধন্ধে পড়েছেন। তার পর সটান খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে কে থেকে তার কালো একটা সিগারেট বের করলেন; তার তীব্র সুগন্ধ ভেসে উঠে রেনসফর্ডের নাকে পৌঁছল।
রেনসফর্ড দম বন্ধ করে রইল!
জেনারেলের চোখ তখন মাটি ছেড়ে, ইঞ্চি ইঞ্চি করে গাছের গুঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠছে। রেনসফর্ড বরফের মতো জমে গিয়েছে, তার সবকটা মাংসপেশি লাফিয়ে পড়ার জন্য টনটন করছে। কিন্তু যে ডালটার উপর রেনসফর্ড শুয়েছিল ঠিক সেখানে পৌঁছবার পূর্বে শিকারির তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থেমে গেল। তার রোদেপোড়া মুখে দেখা দিল স্মিত হাস্য। যেন অতিশয় সুচিন্তিতভাবে তিনি ধুয়োর একটি রিং উপরের দিকে উড়িয়ে দিলেন, তার পর গাছটার দিকে পিছন ফিরে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে যে পথ দিয়ে এসেছিলেন সেই পথেই ফিরে চললেন। ঘাসপাতার উপর তার শিকারের বুটের খসখস শব্দ ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হতে লাগল।
ফুসফুসের ভিতরে রেফর্ভের বন্ধ প্রশ্বাস উগ্র বিস্ফোরণের মতো ফেটে বেরুল। তার মনে প্রথম যে চিন্তার উদয় হল সেটা তাকে ক্লিষ্ট, অবশ করে দিল। শিকার যেটুকু সামান্যতম চিহ্ন রেখে যেতে বাধ্য হয় জেনারেল সেই খেই ধরে রাতের অন্ধকারে বনের ভিতর এগুতে জানেন; তিনি ভুতুড়ে শক্তি ধরেন। সামান্যতম দৈববশে কাক তার শিকার এবার দেখতে অক্ষম হয়েছেন।
রেনসফর্ডের দ্বিতীয় চিন্তা বীভৎসতর রূপে উদয় হল। সে কুচিন্তা তার সর্বসত্তার ভিতর মরণের হিমের কাঁপন তুলে দিল। জেনারেল মৃদুহাস্য করলেন কেন? তিনি ফিরে চলে গেলেন কেন?
তার সুস্থ বিচার-বুদ্ধি তাকে যে কথা বলছিল রেনসফর্ড সে সত্য বিশ্বাস করতে চাইল না– অথচ ঠিক সেই সময় প্রভাত-সূর্য যেরকম কুয়াশা ভেদ করে বেরিয়ে এসেছিল সে সত্য ঠিক ওইরকমই প্রত্যক্ষ। জেনারেল তার সঙ্গে শিকার-খেলা খেলছেন! আরেকদিনের শিকার-খেলার জন্য জেনারেল তাকে বাঁচিয়ে রাখছেন! কসাকই বেড়াল; সে ইঁদুর। মৃত্যুর আতঙ্ক তার পরিপূর্ণ অর্থ নিয়ে এই প্রথম রেন্সফর্ডের কাছে আত্মপ্রকাশ করল।
আমি আত্মকর্তৃত্ব হারাব না, কিছুতেই না।
সে গাছ থেকে পিছলে নেমে আবার ঘন বনের ভিতর ঢুকল। তার মুখ তার দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় কঠিন এবং সে তার মস্তিষ্কযন্ত্র সবলে পূর্ণোদ্যমে কাজে লাগিয়ে দিল। প্রায় তিনশো গজ দূরে সে বিরাট একটা মরাগাছের গুঁড়ির সামনে দাঁড়াল। সেটা বিপজ্জনকভাবে পড়-পড় হয়ে একটা ছোট জ্যান্ত গাছের উপর হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। রেনসফর্ড তার খাবারের ব্যাগ মাটিতে ফেলে দিয়ে খাপ থেকে শিকারের ছোরা বের করে পূর্ণোদ্যমে কাজে লেগে গেল।
অনেকক্ষণ পরে কর্ম সমাপ্ত হল। শ-ফুট খানেক দূরে একটা শুকনো কাঠের গুঁড়ি পড়ে ছিল। রেনসফর্ড তার আড়ালে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। তাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। বেড়ালটা ওই তো আবার আসছে, ইঁদুরের সঙ্গে খেলবে বলে!
ডালকুত্তার মতো দ্বিধাহীন প্রত্যয় নিয়ে জেনারেল জার আসছেন রেনসফর্ডের খেই ধরে ধরে। তার সদসন্ধানী কালো চোখকে কিছুই এড়িয়ে যেতে পারে না– একটিমাত্র তেলে যাওয়া ঘাসের পাতা না, বেঁকে যাওয়া ছোট্ট ডালের টুকরোটি না, শ্যাওলার উপর ক্ষীণতম চিহ্নটি না থোক না সে যতই ক্ষীণ। সন্ধান খুঁজে খুঁজে এগুতে গিয়ে জেনারেল এতই নিমগ্ন ছিলেন যে রেনসফর্ড তার জন্য যে জিনিসটি তৈরি করেছিল সেটা না দেখার পূর্বেই তার উপরে এসে পড়লেন। তার পা পড়ল সামনে-এগিয়ে-পড়া একটা ঝোঁপের উপর– এইটেই রেন্সফর্ডের পাতা ফাঁদের হ্যাঁন্ডিল। কিন্তু তার পা ওইটে ছোঁয়ামাত্রই জেনারেলের চৈতন্যে বিপদের পূর্বাভাস চমক মারল—-সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিপ্র বানরের মতো তিনি তৃরিত বেগে পিছনের দিকে লাফ দিলেন। কিন্তু যতখানি ক্ষিপ্র হওয়ার প্রয়োজন ছিল ঠিক ততখানি হননি; কাটা জ্যান্ত গাছের উপর সন্তর্পণে রাখা মরা গাছটা মড়মড়িয়ে পড়ার সময় জেনারেলের ঘাড়ের উপর মারল ট্যারচা ঘা। জেনারেলের ক্ষিপ্ত বিদ্যুৎগতি না থাকলে তিনি গাছের তলায় নিঃসন্দেহে গুঁড়িয়ে যেতেন। টাল খেয়ে তিনি টলতে লাগলেন বটে কিন্তু মাটিতে পড়লেন না; এবং পিস্তলটিও হস্তচ্যুত হল না। সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জখমি ঘাড়টাতে হাত ঘষতে লাগলেন। রেনসফর্ডের বুকটাকে সেই ভীতি আবার পাকড়ে ধরেছে; সে শুনতে পেল জেনারেলের ব্যঙ্গ-হাস্য জঙ্গলের ভিতর খলখলিয়ে উঠছে।
তিনি যেন ডেকে বললেন, রেনসফর্ড, আপনি যদি আমার কণ্ঠস্বরের পাল্লার ভিতরে থাকেন এবং আমার বিশ্বাস আছেন, তবে আপনাকে আমার অভিনন্দন জানাই। মালয় দেশের মানুষ ধরার ফাঁদ খুব বেশি লোক বানাতে জানে না। কিন্তু আমার কপাল ভালো যে, আমিও মালাক্কাতে শিকার করেছি। আপনি সত্যি এখন আমার কাছে চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠছেন। আমি এখন আমার জখমটাকে পট্টি বাধতে চললুম; জখমটা সামান্যই। কিন্তু আমি ফিরে আসছি। আমি ফিরে আসছি।