ভারতবর্ষের এই একাকী থাকিয়া কাজ করিবার ব্রতকে যদি আমরা প্রত্যেকে গ্রহণ করি, তবে এবারকার নববর্ষ আশিস্বর্ষণে ও কল্যাণশস্যে পরিপূর্ণ হইবে। দল বাঁধিবার, টাকা জুটাইবার ও সংকল্পকে স্ফীত করিবার জন্য সুচিরকাল অপেক্ষা না করিয়া যে যেখানে, আপনার গ্রামে, প্রান্তরে, পল্লীতে, গৃহে, স্থিরশান্তচিত্তে, ধৈর্যের সহিত, সন্তোষের সহিত, পুণ্যকর্ম, মঙ্গলকর্ম সাধন করিতে আরম্ভ করি; আড়ম্বরের অভাবে ক্ষুব্ধ না হইয়া, দরিদ্র আয়োজনে কুন্ঠিত না হইয়া, দেশীয় ভাবে লজ্জিত না হইয়া, কুটিরে থাকিয়া, মাটিতে বসিয়া, উত্তরীয় পরিয়া সহজভাবে কর্মে প্রবৃত্ত হই; ধর্মের সহিত কর্মকে, কর্মের সহিত শান্তিকে জড়িত করিয়া রাখি– চাতকপক্ষীর ন্যায় বিদেশীর করতালিবর্ষণের দিকে উর্ধ্বমুখে তাকাইয়া না থাকি–তবে ভারতবর্ষের ভিতরকার যথার্থ বলে আমরা বলী হইব। বাহির হইতে আঘাত পাইতে পারি, বল; পাইতে পারি না; নিজের বল ছাড়া বল নাই। ভারতবর্ষ যেখানে নিজবলে প্রবল সেই স্থানটি আমরা যদি আবিষ্কার ও অধিকার করিতে পারি, তবে মুহূর্তে আমাদের সমস্ত লজ্জা অপসারিত হইয়া যাইবে।
ভারতবর্ষ ছোটো-বড়ো স্ত্রী-পুরুষ সকলকেই মর্যাদা দান করিয়াছে। এবং সে মর্যাদাকে দুরাকাঙক্ষার দ্বারা লভ্য করে নাই। বিদেশীরা বাহির হইতে ইহা দেখিতে পায় না। যে ব্যক্তি যে পৈতৃক কর্মের মধ্যে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, যে কর্ম যাহার পক্ষে সুলভতম, তাহা পালনেই তাহার গৌরব; তাহা হইতে ভ্রষ্ট হইলেই তাহার অমর্যাদা। এই মর্যাদা মনুষ্যত্বকে ধারণ করিয়া রাখিবার একমাত্র উপায়। পৃথিবীতে অবস্থার অসাম্য থাকিবেই, -উচ্চ অবস্থা অতি অল্প লোকেরই ভাগ্যে ঘটে; বাকি সকলেই যদি অবস্থাপন্ন লোকের সহিত ভাগ্য তুলনা করিয়া মনে মনে অমর্যাদা অনুভব করে, তবে তাহারা আপন দীনতায় যথার্থই ক্ষুদ্র হইয়া পড়ে। বিলাতের শ্রমজীবী প্রাণপণে কাজ করে বটে, কিন্তু সেই কাজে তাহাকে মর্যাদার আবরণ দেয় না। সে নিজের কাছে হীন বলিয়া যথার্থই হীন হইয়া পড়ে। এইরূপে য়ুরোপের পনেরো-আনা লোক দীনতায় ঈর্ষায় ব্যর্থপ্রয়াসে অস্থির। য়ুরোপীয় ভ্রমণকারী, নিজেদের দরিদ্র ও নিম্নশ্রেণীয়দের হিসাবে আমাদের দরিদ্র ও নিম্নশ্রেণীয়দের বিচার করে–ভাবে, তাহাদের দুঃখ ও অপমান ইহাদের মধ্যেও আছে। কিন্তু তাহা একেবারেই নাই। ভারতবর্ষে কর্মবিভেদ শ্রেণীবিভেদ সুনির্দিষ্ট বলিয়াই, উচ্চশ্রেণীয়েরা নিজের স্বাতন্ত্র্যরক্ষার জন্য নিম্নশ্রেণীকে লাঞ্ছিত করিয়া বহিষ্কৃত করে না। ব্রাহ্মণের ছেলেরও বাগ্দিদাদা আছে। গণ্ডিটুকু অবিতর্কে রক্ষিত হয় বলিয়াই পরস্পরের মধ্যে যাতায়াত, মানুষে-মানুষে হৃদয়ের সম্বন্ধ বাধাহীন হইয়া উঠে–বড়োদের আত্মীয়তার ভার ছোটোদের হাড়গোড় একেবারে পিষিয়া ফেলে না। পৃথিবীতে যদি ছোটোবড়োর অসাম্য অবশ্যম্ভাবীই হয়, যদি স্বভাবতই সর্বত্রই সকলপ্রকার ছোটোর সংখ্যাই অধিক ও বড়োর সংখ্যাই স্বল্প হয়, তবে সমাজের এই অধিকাংশকেই অমর্যাদার লজ্জা হইতে রক্ষা করিবার জন্য ভারতবর্ষ যে উপায় বাহির করিয়াছে তাহারই শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করিতে হইবে।
য়ুরোপে এই অমর্যাদার প্রভাব এতদূর ব্যাপ্ত হইয়াছে যে, সেখানে একদল আধুনিক স্ত্রীলোক,স্ত্রীলোক হইয়াছে বলিয়াই লজ্জাবোধ করে। গর্ভধারণ করা, স্বামী-সন্তানের সেবা করা, তাহারা কুন্ঠার বিষয় জ্ঞান করে। মানুষ বড়ো, কর্মবিশেষ বড়ো নহে; মনুষ্যত্ব রক্ষা করিয়া যে কর্মই করা যায় তাহাতে অপমান নাই; দারিদ্র্য লজ্জাকর নহে, সেবা লজ্জাকর নহে, হাতের কাজ লজ্জাকর নহে–সকল কর্মে, সকল অবস্থাতেই সহজে মাথা তুলিয়া রাখা যায়, এ ভাব য়ুরোপে স্থান পায় না। সেইজন্য সক্ষম অক্ষম সকলেই সর্বশ্রেষ্ঠ হইবার জন্য সমাজে প্রভূত নিস্ফলতা, অন্তহীন বৃথাকর্ম ও আত্মঘাতী উদ্যমের সৃষ্টি করিতে থাকে। ঘর ঝাঁট দেওয়া, জল আনা, বাটনা বাটা, আত্মীয়-অতিথি সকলের সেবাশেষে নিজে আহার করা, ইহা য়ুরোপের চক্ষে অত্যাচার ও অপমান, কিন্তু আমাদের পক্ষে ইহা গৃহলক্ষ্মীর উন্নত অধিকার–ইহাতেই তাহার পুণ্য, তাহার সম্মান। বিলাতে এই-সমস্ত কাজে যাহারা প্রত্যহ রত থাকে, শুনিতে পাই, তাহারা ইতরভাব প্রাপ্ত হইয়া শ্রীভ্রষ্ট হয়। কারণ, কাজকে ছোটো জানিয়া তাহা করিতে বাধ্য হইলে, মানুষ নিজে ছোটো হয়। আমাদের লক্ষ্মীগণ যতই সেবার কর্মে ব্রতী হন, তুচ্ছ কর্মসকলকে পুণ্যকর্ম বলিয়া সম্পন্ন করেন, অসামান্যতাহীন স্বামীকে দেবতা বলিয়া ভক্তি করেন,ততই তাঁহারা শ্রীসৌন্দর্যে পবিত্রতায় মণ্ডিত হইয়া উঠেন–তাঁহাদের পুণ্যজ্যোতিতে চতুর্দিক হইতে ইতরতা অভিভূত হইয়া পলায়ন করে।
য়ুরোপ এই কথা বলেন যে, সকল মানুষেরই সব হইবার অধিকার আছে–এই ধারণাতেই মানুষের গৌরব। কিন্তু বস্তুতই সকলের সব হইবার অধিকার নাই, এই অতি সত্যকথাটি সবিনয়ে গোড়াতেই মানিয়া লওয়া ভালো। বিনয়ের সহিত মানিয়া লইলে তাহার পরে আর কোনো অগৌরব নাই। রামের বাড়িতে শ্যামের কোনো অধিকার নাই, এ কথা স্থিরনিশ্চিত বলিয়াই রামের বাড়িতে কর্তৃত্ব করিতে না পারিলেও শ্যামের তাহাতে লেশমাত্র লজ্জার বিষয় থাকে না। কিন্তু শ্যামের যদি এমন পাগলামি মাথায় জোটে যে, সে মনে করে, রামের বাড়িতে একাধিপত্য করাই তাহার উচিত এবং সেই বৃথাচেষ্টায় সে বারংবার বিড়ম্বিত হইতে থাকে, তবেই তাহার প্রত্যহ অপমান ও দুঃখের সীমা থাকে না। আমাদের দেশে স্বস্থানের নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সকলেই আপনার নিশ্চিত অধিকারটুকুর মর্যাদা ও শান্তি লাভ করে বলিয়াই,ছোটো সুযোগ পাইলেই বড়োকে খেদাইয়া যায় না, এবং বড়োও ছোটোকে সর্বদা সর্বপ্রযত্নে খেদাইয়া রাখে না।