Site icon BnBoi.Com

জাফর ইকবালের বিশেষ রচনা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

জাফর ইকবালের বিশেষ রচনা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

অন্য রকম ফেব্রুয়ারি

এই ফেব্রুয়ারিটা অন্য রকম। প্রতিবছর আমি ফেব্রুয়ারি মাসটার জন্য আলাদাভাবে অপেক্ষা করি। সারা বছর লেখালেখি করার সময় পাই না। তাই ক্যালেন্ডারে যখন দেখতে পাই ফেব্রুয়ারি মাস আসি আসি করছে, তখন আমি নাক-মুখ গুঁজে লিখতে বসি। ফেব্রুয়ারি মাস আসতে আসতে লেখালেখি শেষ করে বইমেলার জন্য অপেক্ষা করি। যদি ঢাকা শহরে থাকতাম, তাহলে নিশ্চয়ই প্রতিদিন বইমেলায় হাজির হতাম, কিন্তু সেটি আমার ভাগ্যে নেই। ছুটিছাটায় যাই, বই দেখি, বইপাগল মানুষ দেখি। ভারি ভালো লাগে!

একটি একটি করে দিন কাটে। আমি তখন একুশে ফেব্রুয়ারির জন্য অপেক্ষা করি। একুশে ফেব্রুয়ারি, কী অসাধারণ একটি দিন! একসময় সেটা ছিল শোকের দিন; এখন এটি শোকের দিন নয়, এটি ভালোবাসার দিন। মাতৃভূমির জন্য ভালোবাসা, মাতৃভাষার জন্য ভালোবাসা। এই ভালোবাসা এখন শুধু আমাদের জন্য নয়, এখন সেটা সারা পৃথিবীর সব মানুষের মাতৃভাষার জন্য ভালোবাসা।

এই দিনে সম্ভব হলে আমি ঢাকায় চলে আসি। ভোরবেলা আমি শহীদ মিনারের পাশে মানুষের যে ঢল নামে, সেই ঢলের পেছনে গিয়ে দাঁড়াই। গভীর রাত থেকে শত শত নয়, হাজার হাজার মানুষ এসে ভিড় করে। যত মানুষ, আমার তত আনন্দ। আমি শহীদ মিনার যতটা দেখতে যাই, তার চেয়ে বেশি যাই মানুষ দেখতে। বাবা শিশুপুত্রটিকে ঘাড়ে নিয়ে এসেছে, কিশোরী মেয়েটি এসেছে মায়ের হাত ধরে, তরুণীটি এসেছে তার ভালোবাসার তরুণের সঙ্গে। সবার হাতে ফুল, গালে বাংলা বর্ণমালা। কী অপূর্ব একটি দৃশ্য! একটু একটু করে মানুষগুলো এগিয়ে যায়, আর আমি তাদের পেছনে পেছনে হাঁটি। মানুষের ভিড়ে অনেক সময় শহীদ মিনারের কাছে যেতে পারি না। তখন কোনো একজন তেজি তরুণের হাতে ফুলগুলো দিয়ে বলি, আমার হয়ে ফুলগুলো শহীদ মিনারে দিয়ে দিয়ো। সে ঘাড় নেড়ে রাজি হয়।

আমি তখন মানুষের মুখ দেখতে দেখতে ঘুরে বেড়াই। একটি দেশ তো শুধু দেশের মাটি নয়, দেশ হচ্ছে দেশের মানুষ। একুশে ফেব্রুয়ারিতে সেই দেশের মানুষ দেশের জন্য ভালোবাসা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়। আমি সেই মানুষগুলোকে দেখতে দেখতে নিজের ভেতরে একধরনের শক্তি অনুভব করি। নতুন একধরনের আত্মবিশ্বাস জন্ম নেয়। আমি বুঝতে পারি, এই দেশে কখনো কোনো অন্ধকার শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মানুষগুলো আলাদা করে কিছু করে না; তার পরও আমি অবাক হয়ে দেখি, তাদের ভেতরে কী এক আশ্চর্য শক্তি লুকিয়ে থাকে। সেই শক্তির ভেতরে থেকে আমি নিজের ভেতরে শক্তি খুঁজে পাই। সে জন্য প্রতিবছর আমি আলাদাভাবে ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য অপেক্ষা করি।

এই বছর ফেব্রুয়ারি মাসটা অন্য রকম। এই বছর আমার শুধু একটি একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে না, আমি যে কারণে একুশে ফেব্রুয়ারির জন্য অপেক্ষা করি, এই বছর প্রতিটি দিনই সে রকম। প্রতিদিন চারপাশে ঘর থেকে বের হওয়া মানুষ। কেউ যখন দেশকে ভালোবেসে ঘর থেকে বের হয়, সেই মানুষগুলো হয় অন্য রকম। প্রথমে ছিল কমবয়সী তরুণ-তরুণী, তারপর এসেছে বৃদ্ধ-যুবা। এসেছে শিশু-কিশোর। তারা ঘুরে-ফিরে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে, আমরা বাঙালি। তারা ঘোষণা দিয়েছে, যারা এই দেশ চায়নি, তাদের এ দেশে স্থান নেই। পৃথিবীর নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডে যারা অংশ নিয়েছে, তাদের তারা শুধু বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চায় না, বিচার করে শাস্তি দিয়ে দেশকে কলঙ্কমুক্ত করতে চায়। তারুণ্যের এত বড় জোয়ার কি আগে কখনো দেখেছে এ দেশের মানুষ? দেখেছে পৃথিবীর মানুষ?

সে জন্য এই ফেব্রুয়ারিটা অন্য রকম। এই দেশের তরুণেরা আমাদের বায়ান্ন দিয়েছিল, ঊনসত্তর দিয়েছিল। বুকের রক্ত দিয়ে একাত্তর দিয়েছিল। এখন তারা ২০১৩ দেবে?

আমরা অপেক্ষা করে আছি।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো
অমর একুশে ২০১৩ বিশেষ সংখ্যা
ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৩

আমাদের গণিত অলিম্পিয়াড

ছোট থাকতে আমাদের শেখানো হয়েছিল, ‘রোগই সংক্রামক স্বাস্থ্য নহে’। যার অর্থ খারাপ বিষয়গুলোই একজন থেকে অন্যরা শেখে, ভালোগুলো শেখে না। বড় হয়ে আবিষ্কার করেছি, আসলে কথাটা সত্যি না—ভালো বিষয়গুলোই একে অন্যের কাছ থেকে শেখে। যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে আমাদের গণিত অলিম্পিয়াড! প্রথম যখন শুরু করা হয়েছিল তখন সবার ভেতরেই একটা দুশ্চিন্তা ছিল, এখন সেই দুশ্চিন্তা নেই। এর ভালো বিষয়গুলো সবাই শিখে গেছে, একজনকে দেখে অন্যজন শিখছে। শুধু তা-ই নয়, গণিতের সঙ্গে সঙ্গে দেশে এখন বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড, ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াড, পদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়াড, রসায়ন অলিম্পিয়াড, প্রাণরসায়ন অলিম্পিয়াড, ভাষা অলিম্পিয়াড, জ্যোতির্বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড এমনকি দাবা অলিম্পিয়াড পর্যন্ত আছে। দেখা যাচ্ছে, স্বাস্থ্যই সংক্রামক রোগ নহে! মজার ব্যাপার হচ্ছে, নামে অলিম্পিয়াড হলেও আসলে এগুলো হচ্ছে উৎসব। এই উৎসবে ছোট ছোট ছেলেমেয়ের আনন্দে ছোটাছুটি দেখে মনে হয়, আহা রে! ছোট থাকতে আমাদের জন্য যদি কেউ এগুলো করত, কী মজাই না হতো!

গণিত অলিম্পিয়াড প্রথম যখন শুরু করেছিলাম তখন এর নাম কী হবে, সেটা নিয়ে আমাদের একটু মাথা ঘামাতে হয়েছিল। সেই ছোটবেলা থেকে আমরা বিষয়টাকে ‘অঙ্ক’ বলে আসছি—অঙ্ক বই, অঙ্ক ক্লাস, অঙ্ক স্যার, অঙ্ক পরীক্ষা—গণিত তো কখনো বলিনি। কিন্তু শুদ্ধ করে বললে তো এটাকে গণিত বলতে হবে—অঙ্ক বললে তো হবে না। তাই যা থাকে কপালে বলে আমরা ‘গণিত’ শব্দটাই বেছে নিয়েছিলাম। এত দিন পর দেখা যাচ্ছে, গণিত শব্দটা কী সুন্দর আমাদের মনে গেঁথে গেছে! বরং অঙ্ক বললেই জানি কেমন কেমন লাগে।

যখন এটা লিখছি, তখন শাহবাগে তরুণ প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বিস্ময়কর একটা আন্দোলন শুরু করেছে। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা সেই চত্বর স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল। কী বিচিত্র মনোমুগ্ধকর প্রাণবন্ত আর তেজি সেই সব স্লোগান। সেটা দেখে আমার মাথায় নতুন একটা আইডিয়া এসেছে, এ দেশে গণিত অলিম্পিয়াডের মতো ‘স্লোগান অলিম্পিয়াড’ শুরু করে দিলে কেমন হয়!

সহসভাপতি: বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো
ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৩

 একটি পুরোন লেখার নতুন পাঠ : কত দীর্ঘ এই লংমার্চ


তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটি যখন ঠিক করেছিলো যে তারা বিবিয়ানা লংমার্চ করবে তখনই আমার খুব ইচ্ছে হয়েছিলো যে সেটাতে যোগ দিই, কিন্তু আজকাল এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গেছি যে দৈনন্দিন রুটিন থেকে আট আটটি দিন বের করে ফেলা খু্ব সহজ ব্যাপার নয়। তাই ঠিক করে রেখেছিলাম লংমার্চ করে সবাই যখন বিবিয়ানা এলাকায় পৌঁছুবে তখন অন্তত সেখানে গিয়ে আমার কৃতজ্ঞতাটুকু প্রকাশ করে আসবো।

লংমার্চ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে আমি খবরের কাগজে তাদের অগ্রগতি লক্ষ করতে শুরু করেছিলাম এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনটি খুব গুরুত্বপূর্ণ জিনি আবিষ্কার করলাম। সেগুলো হচ্ছে- ক) এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের কোনো মাথাব্যথা নেই, খ) সমর্থন দিয়েছে শুধু বামদলগুলো, গ) সংবাদপত্র ও প্রচারমাধ্যমগুলো পুরো লংমার্চটিকে একটা গুরুত্বহীন ব্যাপার হিসেবে বিবেচনা করেছে।

আমাদের দেশের এধরনের একমাত্র সম্পদ রক্ষা করার যে প্রচেষ্টা তা আমাদের কাছে একেবারেই গুরুত্বহীন নয়। তাই তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটি যখন তেরোই মার্চ বিবিয়ানা এলাকায় পৌঁছেছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষক মিলে তাদের সঙ্গে আমাদের একাত্মতা প্রকাশ করতে গিয়েছিলাম। সিলেট শহর থেকে ঘন্টা খানেক বাসে গিয়ে শেরপুরে পৌঁছে দেখি পথের পাশে একটা ছোট মঞ্চ করা হয়েছে। মঞ্চে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা বসে আছেন। ওপরে একটা সামিয়ানা টানা আছে। আমার দেখে খুব ভালো লাগল যে যারা বসে আছে তাদের বিশেরভাগই তরুণ তরুণী। এরকম একটি ব্যাপারে আমাদের নতুন প্রজন্ম উৎসাহ দেখাচ্ছে সেটি খুব আশার কথা বলে মনে হলো।

আমরা পৌঁছা মাত্রই কিছু বোঝার আগে আমাকে এবং আমাদের প্রাক্তন উপাচার্য মোঃ হাবীবুর রহমানকে মঞ্চে তুলে দেয়া হলো। সবাই কাঠফাটা রৌদ্রে বসে আছে তার মাঝে আমরা ছায়াতে বসে আছি ভেবে একটু অপরাধবোধে ভুগছিলাম। আশেপাশে যারা এসেছেন, যাদের অনেক নাম শূনেছি, কখনো চোখে দেখিনি তাদের সঙ্গে পরিচয় করছি ঠিক তখন শুনতে পেলাম একজন আমার নাম ঘোষণা করে বলে দিয়েছেন যে, আমি এখন বক্তৃতা দেব। আমরা যে কোনো বিষয়ে পঞ্চাশ মিনিট কথা বলতে পারি (আমাদের ক্লাসগুলো পঞ্চাশ মিনিটের মাঝে মাঝে কোনোরকম প্রস্তুতি ছাড়াই ক্লাস নিয়ে ফেলতে হয়)। কিন্তু আজকের এটি অন্য একটি ব্যাপার। এটি একটি জনসভা, যারা বসে আছে তারা মুহুর্মুহু স্লোগান দিচ্ছে আমি কিছু বলতে চাইলে সেটি স্লোগানের উত্তেজনা ছাপিয়ে বলতে হবে। আমার আগে আরে দু চারজন বক্তৃতা দিয়ে ফেললে তাদের কথা শুনে কিছু একটা বলা যেত। আমার সে সুযোগও নেই। কাজেই বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়ে আমি অন্য কিছু চেষ্টা না করে মনের কথাগুলোই বললাম, দেশের প্রতি গভীল মমতায় যারা সুদূর ঢাকা থেকে ৩০০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে এখানে এসেছেন তাদের প্রতি আমার পক্ষ থেকে এবং দেশের মানুষের পক্ষ থেকে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। লংমার্চ শুরু হবার পর জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী লংমার্চের উদ্যোগক্তাদের আবেগ দিয়ে তাড়িত বলে উপহাস করেছিলেন। আমি শ্রোতাদের বললাম দেশের জন্য ভালোবাসার যে আবেগ সেটিকে নিয়ে উপহাস করা যায় না- বাঙালীর বুকের ভেতর এই গভীর আবেগ আছে বলে উনিশ‌র শ একাত্তর সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিলো। জ্বালানী প্রতিম্ত্রীর যে বক্তব্যটি আমার সবচেয়ে বেশি খারাপ লেগেছিল সেটি হচ্ছে তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটির সদস্যরা নাকি গ্যাস সম্পর্কে কিছুই জানে না। আমি তার প্রতিবাদ করে বললাম জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী সত্যিই যদি তাদের এতটা তাচ্ছিল্য করেন তাহলে তার উচিত তেল-গ্যস রক্ষা জাতীয় কমিটির যে কোন একজন সদস্যের সঙ্গে জাতীয় টেলিভিশনে সরাসরি বিতর্কে যোগ দেওয়া। দেশের মানুষ দেখুক কে এসম্পর্কে বেশি জানে। দেশের জন্য কার মমতা বেশি।

আমি ভালো বক্তা নই। অন্যরা আমার থেকে অনেক সুন্দর করে বক্তৃতা দিলেন। আমি খুব আনন্দের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম তাদের বেশ কয়েকজন টেলিভিশনে সরাসরি বিতর্কের বিষয়টি গ্রহণ করে সেটিকে একটা সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ হিসেবে সরকারের কাছে ছুড়ে দিলেন। (লংসার্চ শেষ করে জাতীয় তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটি এই চ্যালেঞ্জের কথা ভোলেননি সংবাদ সম্মেলন করে তারা মন্ত্রী, আমলা, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, মার্কির রাষ্ট্রদূত এবং তাদের যে কোন অর্থনীতিবিদকে সরাসরি বিতর্কে আহ্বান জানিয়েছিলেন। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে দেখার জন্য অপেক্ষা করছি এই বিতর্কে অংশ নেবার মতো কোনো নৈতিক জোর আদৌ তাদের আছে কিনা।)

সভা শেষে সবাই বিবিয়ানার পথে রওনা দিয়েছে। গ্রামের মেঠাপথে সবাই মিছিল করে হাঁটছে। ব্যানার আর পোস্টার, বিশাল ফাঁকা প্রান্তরের মাঝ দিয়ে আঁকাবাকা সড়ক কুশিয়ারা নদীর তীর ঘেঁষে চলে গেছে। আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি মানুষের সেই মিছিল অন্তত কয়েক কিলোমিটার লম্বা। গ্রামের মানুষজন রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে, বউঝিরা গাছের আড়াল থেকে উকি দিচ্ছে, কোথাও হাত তালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে, পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছোটছোট শিশুরা পিছু পিছু ছোটাছুটি করছে। তাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে হঠাৎ একী উত্তেজনা।

বড় কোনো মিছিলে হাঁটার আমার বিশেষ কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এমনিতে হাঁটতে বের হলে ক্লান্ত হলে ছায়ায় বসে বিশ্রাম নেওয়া যায়। কিন্তু এখানে বিশ্রাম নেবার উপায় নেই। সবাই যে ছন্দে হাটছে আমাদেরও সেই ছন্দে হাঁটতে হবে। গ্রামের পথে হাঁটতে গেলে কতটুকু হাঁটা হয়েছে তা বের কর খুব মুশকিল। কোনো এক বিচিত্র কারণে আমাদের গ্রামের মানুষ দুরত্বকে মাইল-কিলোমিটারে প্রকাশ করতে পারে না। তবে আমার পকেটে একটা জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম-উপগ্রহের সিগন্যাল ব্যবহার করে অবস্থান বের করার একটি যন্ত্র ছিলো।) সেটার হিসাব অনুযায়ী ঠিক সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার হাঁটার পর পুলিশ আমাদের থামিয়ে দিলো। মিছিলটি পুলিশের বেষ্টনী ভেঙে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করল না, কাছাকাছি একটা স্কুলের মাঠে একত্র হয়ে মুহুর্মুহু স্লোগানের মাঝে তাদের ঘোষণাপত্র পাঠ করলো। আমি খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার ফিরে আসতে শুরু করলাম। অন্যরা আট দিনে হেটেছে তিনশ কিলোমিটার। আমরা একদিনে হেটেছি মাত্র এগারো কিলোমিটার। কিন্তৃ তাতে আমার মনে হতে লাগল আমরা বুঝি বিশাল একটা কাজ করে ফেলেছি।

২.
ঘরকনো মানুষ বলে একরকম দক্ষযজ্ঞ মানুষ থেকে আমি দূরে থাকি, তবে গ্যাস রপ্তানীর ব্যপারটি এই দেশের জন্য এমন ভয়ংকর একটি ষড়যন্ত্র যে এখন আর ঘরে বসে থাকার সুযোগ নেই। আমার ধারণা সরকার যদি এটি বন্ধ না করে তাহলে আগে হোক পরে হোক সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে আসবে। ব্যক্তিগতভাবে লংমার্চের শেষ অংশটুকুতে থাকতে পারা আমার জন্য খুব চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা ছিলো।

আমাদের দেশের সংবাদপত্র পড়ে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটা থেকে আমি বলতে পারি সংবাদপত্রের খবর হিসেবে এই লংমার্চটুকু অত্যন্ত একটা চমৎকার বিষয় ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যপার এই পুরো ব্যাপারটি নিয়ে সংবাদপত্রগুলো ছিল একেবারেই নিস্পৃহ। কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ সেই রঙিন এবং উদ্দীপ্ত তারুণ্যের মিছিলের ছবিটি বেশিরভাগ পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়নি। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারি না ডেইলি স্টারের মতো সম্ভান্ত একটি পত্রিকা এই ঘটনার সংবাদটুকুও ছাপেনি।

ব্যাপারটি আমায় খুব ভাবনায় ফেলেছে। সংবাদপত্রের কর্মচারী এবং সাংবাতিকরা নিশ্চয়ই আমার মতো সাধারণ মানুষ, কিন্তু সংবাদপত্রের মালিকরা নিশ্চয়ই বিত্তশালী মানুষ। সাধারণ মানুষ আর বিত্তশালী মানুষের স্বার্থ নিশ্চয়ই এক নয়। আমি নিশ্চিত বিবিয়ানা লংমার্চের এই বিশাল জাতীয় একটি ঘটনাকে বাংলাদেশের মানুষের চোখের আড়ালে সরিয়ে রাখার ব্যাপারটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়- এর নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। যারা খবরের কাগজের মালিক, বিশাল যাদের অর্থবিত্ত, কোনো না কোনোভাবে নিশ্চয়ই এই গ্যাস বিক্রির ব্যাপারটির সঙ্গে, এ সম্পর্কে দেশের মানুষের সচেতনতার সঙ্গে তাদের একটা সম্পর্ক আছে। কাজেই ভবিষ্যতেও নিশ্চয়ই গ্যাস রপ্তানীর ব্যাপারে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের কথা সম্ভবত সংবাদমাধ্যমগুলোতে সেভাবে প্রচার করা হবে না। যারা গ্যাস রক্ষার জন্য পথে নামবেন, তাদের সম্ভবত একটা দুরুহ পথ অতিক্রম করতে হবে, সেই পথে সংবাদপত্রের সাহায্য তারা তেমন পাবে না। জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী সম্ভবত সেটি আগে থেকেই জানেন, পুরো ব্যাপারটি নিয়ে তাই বুঝি এত তাচ্ছিল্য।

৩.
বিবিয়ানা লংমার্চে যোগ দিয়ে আরো কয়েকটি ব্যাপার নিয়ে আমি এক ধরনের নস্টালজিয়া অনুভব করেছি। আমাদের চারপাশে ছাত্র রাজনীতির কলুষিত রূপটি দেখে আমাদের সবার মন বিষিয়ে গেছে। ছাত্ররা যখন তাদের তারুণ্যের শক্তি ব্যয় করে কেন্টিনে ‍‌‌ফাও খাওয়ার জন্য, বিকশাওয়ালার থেকে চাদা তোলার জন্য বা ছিনতাই করা ভাগাভাগি করতে মারামারি করার জন্য তখন লজ্জায় আমাদের মাথা হেট হয়ে যায়। কিন্তু এই লংমার্চে এসে আমি অসংখ্য তরুণ তরুণিকে দেখেছি যারা নিশ্চয়ই এই দেশে নানা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। দেশের সম্পদ রক্ষার করার জন্য নিজেদের রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে শক্তি পেয়ে তারা তিনশ কিলোমিটার হেটে চলে এসেছে। আদর্শের পথ ধরে চলে আসার সুশৃংখল একটি দল। আমাদের ছাত্রজীবনে আমরা যেরকমটি দেখেছিলাম। সেটি দেখে আমি এক ধরনের নস্টালজিয়া বোধ করেছি। দেশের পড়াশুনার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য আমি অনেকবার ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছি। কিন্তু লংমার্চে এসে আত্মত্যাগী, পরিশ্রমী, সুশৃংখল দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধ থাকা এই ছাত্রছাত্রীদের দেখে মনে হয়েছে আমরা কি আবার ষাট এবং সত্তরের দশকের আদর্শবান তেজস্বী ছাত্রছাত্রীদের ফিরে পেতে পারি না।

৪.
গ্যাস বিক্রিয় একটা অযৌক্তিক প্রস্তাব তুলে সারাদেশে একটা বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। আমার মনে হয় প্রস্তাবটি যে কত অর্থহীন সেটা বোঝার জন্য সবারই কয়েকটি সংখ্যার কথা জানা উচিত। প্রথম সংখ্যাটি হচ্ছে এক হাজার কোটি। বর্তমান প্রস্তাব অনুযায়ী গ্যাস রপ্তানী করা হলে বাংলাদেশ বছরে এক হাজার কোটি টাকা পাবে। আমরা যারা গুণে গুণে টাকা খরচ করি, দরদাম করে রিকশায় উঠি তাদের কাছে এক হাজার কোটি টাকা অনেক বেশি মনে হতে পারে কিন্তু একটা দেশের জন্য এক হাজার কোটি টাকা ক্ষুদ্র একটি সংখ্যা। সংখ্যাটি কত ছোট বোঝানোর জন্য মনে করিয়ে দেয়া যায় যে, বাংলাদেশে বছরে বিদ্যুৎ আর গ্যাসই চুরি হয় (system loss) এক হাজার একশ কোটি টাকার। সরকার যদি শুধু তার দায়িত্ব পালন করে বিদ্যু আর গ্যাস চুরি বন্ধ করতে পারে তাহলেই বছরে গ্যাস রপ্তানীর এক হাজার কোটি টাকা উঠে গিয়েও একশ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত থাকবে। এরকম একটা অবস্থায় যে কাজটি করা উচিত সেটি না করে কেন দেশকে সর্বশান্ত করার একটা ষড়যন্ত্র করতে শুরু করে দেব?

গ্যাস বিক্রি করে যে এক হাজার কোটি টাকার লোভ দেখানো হচ্ছে সেটা যে অত্যান্ত ক্ষুদ্র একাট সংখ্যা সেটা বোঝানোর জন্য সবাইকে আরো মনে করিয়ে দেওয়া যায় যে আমাদের সামরিক আর অন্যান্য অনুৎপাদনশীল খাতে বছরে খরচ হয় প্রায় পনের হাজার কোটি টাকা-সেখানে যদি দশ ভাগের এক ভাগও বাচানো যায় তাহলেই গ্যাস বিক্রির দেড় গুণ টাকা উঠে আসে। শুধু তাই নয়, এদেশে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার কোটি কালো টাকা তৈরী হয়। সরকার যদি শুধু ভালো ভালো বক্তৃতা না দিয়ে এই কালো টাকার শতকরা দুইভাগও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তাহলেই গ্যাস রপ্তানীর সমান টাকা পাওয়া যাবে। আমি অর্থনীতিবিদ নই- এই সংখ্যাগুলো নিয়েছি ডিসেম্বরের আট তারিখে এলজিইডি ভবনে পঠিত ড. আবুল বারাকাতের প্রবন্ধ থেকে। সেখানে এর চাইতেও চমকপ্রদ তথ্য আছে। দেশের সাধারণ মানুষের সেগুলো জানা খুব দরকার। গ্যাস বিক্রি, গ্যাস বিক্রি বলে সরকার হঠাৎ করে যেভাবে ক্ষেপে উঠেছে সেটা দেখে অনেকের ধারণা হতে পারে ব্যাপারটি বুঝি আমাদের দেশের জন্য একটা বিশাল ব্যাপার।এটি করে টাকায় টাকায় দেশ সয়লাব হয়ে যাবে- আসলে সেটি একেবারেই সত্যি নয়। টাকার পরিমাণটি কম-এত কম যে সেটা নিয়ে আদৌ কেউ মাথা ঘামাচ্ছে সেটাই হচ্ছে আমাদের বিষ্ময় ও সন্দেহের কারণ। তার চাইতেও বড় কথা বাংলাদেশের সঙ্গে বিদেশী কোম্পানিগুলোর যে চুক্তি করা হয়েছে, সেখানে পাইপ লাইন দিয়ে গ্যাস বিক্রি করার কথা লেখা নেই। তাহলে হঠাৎ করে তাদের চুক্তি বাইরে একটা সুবিধা দেয়ার জন্য সবাই উঠেপড়ে লেগেছে কেন?

আমরা ঘরপোড়া গরু- তাই সিদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পাই। অতীতে বিদেশী কোম্পানীদের খুশি করার জন্য আমাদের দেশের স্বার্থ পুরোপুরি বিসর্জন দেওয়ার এতগুলো উদাহরণ দেখেছি (সিমিটার, মাগুড়ছড়া, কাফকো) এবং এ ব্যাপারে সকল সরকারই একরকম। তাই আমরা এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে আছি। অতীতে উদাহরণ দেখে বলে দেয়া যায় এই সরকার যদি গ্যাস বিক্রির এই চক্রান্ত সত্যি সত্যি কোনোভাবে কাজে লাগিয়ে ফেলে তাহলে ভবিষ্যতে নতুন কোনো ষড়যন্ত্র হবে না সেটি কে বলতে পারে? আজ থেকে চার পাচ বছর পরে হয়তো বিদেশী তেল কোম্পানির ধুরন্ধর আইনজীবীদের কৌশলী শব্দচয়নের কারণে আমরা গ্যাস বিক্রির কোনো টাকা তো পাবই না; বরং নিজেদের পকেটের ভর্তুকি দিয়ে সেই গ্যাস দিল্লিতে পৌছে দিয়ে আসতে হচ্ছে।

৫.
আমাদের সংবিধান বলেছে বাংলাদেশের এই গ্যাস সম্পদের মালিক দেশের মানুষ, সেই হিসেবে গ্যাস সম্পদে আমারও নিজের একটা মালিকানা আছে। মানুষের বাড়িঘর জমিজিরাত এরকম নানা ধরনের সহায়সম্পদ থাকে। আমার সেরকম কিছু নেই, বলা যেতে পারে গ্যাসের মালিকানায় আমার অংশটুকুই হচ্ছে আমার একমাত্র স্থাবর সম্পত্তি। রাস্তার টোকাইশিশু, রিকশাওয়ালা এবং গ্রামের চাষীরও তাতে সমান অধিকার এবং মাননীয় জ্বালানী প্রতিমন্ত্রীরও তার অংশের বাইরে এক সিএফটি গ্যাস বেশি নেই। সে সম্পদটি আমার সেটি যদি আর কেউ বিক্রি করে দেওয়ার কথা বলে তাহলে আমাদের ক্ষুব্ধ হওয়ার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। রাস্তা দিয়ে হেটে যাবার সময় একজন দুর্বৃত্ত যদি আমার মানিব্যাগ ছিনতাই করে নেয়, তার সঙ্গে এই গ্যাস বিক্রি করার মৌলিক পার্থক্য নেই। এর মালিক আমরা এবং আমরা অনুমতি দেইনি। কাজেই এই গ্যাস বিক্রি করা হবে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে বিক্রি করা। পাইপ লাইন বসিয়ে গ্যাস বিক্রির কথা নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল না। কাজেই এই সরকারের গ্যাস বিক্রি করার কোনো নৈতিক বা আইনগত অধিকার নেই। কিছু ভাড়াটিয়া বিশেষঞ্জের কথায় তারা গ্যাস বিক্রি করতে পারবে না। একান্তই যদি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাহলে তারা গণভোটের ব্যবস্থা করবে। যতদিন এই গণভোটের ব্যবস্থা না করা হচ্ছে অনুগ্রহ করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত না নেয়া হবে বুদ্ধিমানের কাজ এবং গ্যাস বিক্রি করার পরিকল্পণাটি পুরোপুরি পরিত্যাগ করা হবে দেশপ্রেমিকের কাজ। গ্যাস বিক্রি বন্ধ করতে একটি দীর্ঘ লংমার্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন আমরা সবাই জানতে চাই কত দীর্ঘ এই বিবিয়ানা লংমার্চ।

প্রথম আলো, ৬ এপ্রিল, ২০০২

একাত্তরের দ্বিতীয় পাঠ

আজকাল চিঠি লেখালেখি খুব কমে এসেছে- চিঠি লিখে যে কথাটি জানাতে হবে টেলিফোন করে অনেক তাড়াতাড়ি সে কথাটি জানিয়ে দেয়া যায়। এস.এম.এস কিংবা ই-মেইল আছে, ফেসবুক আছে, তাই কে আর এতো সময় নিয়ে চিঠি পাঠাবে। আমার ধারণা আমি সম্ভবত এই দেশে অল্প কয়েকজন সৌভাগ্যবান মানুষের একজন, যে এখনও নিয়মিত চিঠি পাই! আমার চিঠিগুলো খুব মজার হয় কারণ তার বেশিরভাগই লেখে ছোটো ছোট ছেলেমেয়েরা।

প্রজন্ম চত্বরের গণজাগরণ শুরু হবার পর চিঠিগুলোকে মোটামুটি দুই ভাবে ভাগ করা যায়। একভাগ লিখছে যারা শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে আসতে পারছে তারা, অন্যভাগে রয়েছে যারা আসতে পারছে না তারা। যারা আসতে পারছে না, তাদেরকেও আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়; একভাগে রয়েছে যারা ঢাকার বাইরে থাকে তারা- অন্যভাগে রয়েছে সবচেয়ে ক্ষুব্ধ অংশটুকু। তারা ঢাকায় থাকে, ইচ্ছে করলেই তারা শাহবাগ আসতে পারে, কিন্তু তাদের মা-বাবা আত্মীয়স্বজন তাদের আসতে অনুমতি দিচ্ছে না! আমার কাছে তারা লম্বা চিঠি লিখে সেই দুঃখের কাহিনী জানায়।

বাচ্চাদের চিঠিগুলোতে নানা প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় তথ্য থাকে এবং নানা ধরনের গল্প থাকে। একজন লিখেছে, তার পরিচিত একজন রাজাকার টাইপের আত্মীয় আছে, সে শাহবাগে যাচ্ছে শুনে সেই রাজাকার টাইপ আত্মীয় মুখ কালো করে বলেছে- “দেশটাকে দুইভাগ করে এখন গৃহযুদ্ধ শুরু করে দেয়ার ব্যবস্থা।” বাচ্চাটি তখন আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে হাতে কিল দিয়ে বলেছে, “কী মজা! এইটাই তো চাই! মুক্তিযুদ্ধ করতে পারি নাই- এখন যুদ্ধ করবো!” তার কথা শুনে রাজাকার টাইপ আত্মীয়ের মুখের ভাব কেমন হয়েছে সেটাও সে অনেক মজা করে বর্ণনা করেছে।

সত্যি সত্যি এই দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে আর এই দেশের কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা দেশদ্রোহী রাজাকারদের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করে দেবে আমি মোটেও সেজন্যে অপেক্ষা করে নেই। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বড়ো হয়েছি তারা জানি- একটা যুদ্ধে যে রকম সাহস বীরত্ব আর অর্জন থাকে, তার পাশাপাশি থাকে ভয়াবহ নৃশংসতা, দুঃখ-কষ্ট আর হাহাকার। আমরা সবসময় সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থণা করি এই দেশের মাটিতে আর কখনও যেনো কাউকে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে না হয়।
কিন্তু এই কথাটি কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, ছোটো ছেলেমেয়েদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই ছেলেমানুষী উচ্ছ্বাস দেখে একটি বিষয় বোঝা যায়, তারা মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন, মুক্তিযুদ্বের আদর্শকে সত্যিকারভাবে অনুভব করতে পেরেছে। এই দেশে প্রায় সত্তর ভাগ হচ্ছে তরুণ, এই তরুণ প্রজন্ম যদি মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নকে ধারণ করতে পারে তাহলে এই দেশে যে পুণ্জিভূত শক্তি রয়েছে সেই শক্তিকে অস্বীকার করার ক্ষমতা কার আছে? এই দেশকে নিয়ে আর যে-ই দুর্ভাবনা করুক আমি করি না।

তবে একটি সত্য কেউ অস্বীকার করবে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই সেই যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য জামাত শিবির যে তান্ডব শুরু করেছে, এই দেশের নতুন প্রজন্ম কখনো সেই তান্ডব দেখেনি। তাদের অনেকে উপলব্ধি করতে শুরু করেছে একাত্তরের নৃশংসতা কেমন ছিলো। এটি হচ্ছে সেই রাজনৈতিক দল যেটি একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আজ্ঞাবহ হয়ে এই দেশে গণহত্যায় অংশ নিয়েছিলো। সে সময়ে তাদের নৃশংসতা কতো ভয়াবহ ছিলো এখন অনেকে সেটা আঁচ করা শুরু করেছে। আমরা কি কখনো কল্পনা করেচিলাম যে আমরা টেলিভিশনে দেখবো একজন পুলিশের মাথা থেঁতলে দেয়া হচ্ছে? গাড়ির ভেতরে মানুষকে রেখে সেই গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে? ককটেল মেরে স্কুলের শিশুকে পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে? একাত্তরের যে বিভীষিকাটি আবার নতুন করে আমাদের হতবাক করে দিচ্ছে সেটি হচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, মন্দির পুড়িয়ে দেয়া। আমরা কি কখনও কল্পনা করেছিলাম যুদ্ধাপরাধীর বিচার বন্ধ করার জন্য তারা দেশের এই জনগোষ্ঠীকে নির্যাতন করার পথ বেছে নেবে? একটি দিনও যায় না যখন আমরা দেখি না এই দেশের কোথাও না কোথাও একটি মন্দিরে আগুন দেয়া হচ্ছে না।

এই সবকিছুর পাশাপাশি আমরা দেখেছি ধর্মের অপব্যবহার। খবরের কাগজে কাবাঘরকে নিয়ে মিথ্যাচার করা হয়, চাঁদে যুদ্ধাপরাধীর ছবি দেখা হয়, বিশাল গণ-আন্দোলনকে ভুল দিকে ঠেলে দেয়ার জন্য নাস্তিক-আস্তিক প্রসঙ্গ তুলে আনা হয়। একজন ধর্মভীরু মানুষ কখনোই ধর্মকে এভাবে ব্যবহার করতে পারে না- কিন্তু একাত্তরে যেভাবে ধর্মের নাবে এদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা হয়েছিলো ঠিক একইভাবে এই দেশে সেই একই গোষ্ঠী এই নতুন প্রজন্মের বিরোধিতা করার জন্য তাদের সকল শক্তি নিয়ে পথে নেমেছে।

আমরা এই মিথ্যাচার, অন্যায়, অবিচার, নৃশংসতা, বিভীষিকা, সাম্প্রদায়িকতায় অভ্যস্ত নই। আমি জানি, এই দেশের মানুষ, নতুন প্রজন্ম কখনও কখনও আতঙ্কিত হয়ে যাচ্ছে, কখনও কখনও হতাশাগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম যে রকম একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে অনুপ্রেরণা পায়া, তাদেরকে ঠিক একইভাবে এই দুঃসময়ে আবার একাত্তরের কাছে ফিরে যেতে হবে। তাদেরকে মনে রাখতে হবে, একাত্তর থেকে বড়ো দুঃসময় এ দেশে কখনও আসেনি, অপ্রস্তুত একটি জাতিকে যুদ্ধের মাঝে ঠেলে দেয়া হয়েছে। পাকিস্তান মিলিটারি গণহত্যা করে যাচ্ছে। রাজাকার, আল-বদর তাদের সাহায্য করছে, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে, এক কোটি মানুষ পাশের দেশের শরণার্থী হয়ে গেছে, নারীদের উপর অত্যাচার হচ্ছে, বাইরের পৃথিবী চুপচাপ দেখছে, চীন-আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষে, মুসলিম দেশগুলো পাকিস্তানের পক্ষে- কতো দীর্ঘদিন যুদ্ধ হচ্ছে কেউ জানে না, ভয়ঙ্কর অনিশ্চিত একটা ভবিষ্যৎ। সেই ভয়ঙ্কর দুঃসময়ও এ দেশের মানুষ হতাশায় নিমজ্জিত হয়নি, জীবনের সবচেয়ে বড়ো ত্যাগ স্বীকার করে তারা রুখে দাঁড়িয়েছিলো। আমাদের নতুন প্রজন্মকে একাত্তরের সেই শিক্ষাটি নিতে হবে, কিছুতেই হতাশ হওয়া যাবে না। দেশদ্রোহী ধর্মান্ধদের অপপ্রচারের বিভ্যান্ত হওয়া যাবে না। তাদেরকে নিজেদের উপর আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে- একাত্তরের ভয়ঙ্কর দুঃসময়েও যদি এদেশের মানুষ নিজের জীবন বাজি রেখে রুখে দাঁড়াতে পারে, তাহলে এই নতুন প্রজন্ম কেনো পারবে না?
নতুন প্রজন্ম দেশপ্রেমের প্রথম পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে পাস করেছে- আমাদের দেখিয়েছে তারা মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ের ভেতর লালন করে। অপপ্রচার, আতঙ্ক, সাম্প্রদাবিকতা, নৃশংসতা, বিভীষিকার কালো ছায়ার মাঝে হতাশাগ্রস্ত না হয়ে আশাবাদী হয়ে থাকার দ্বিতীয় পরীক্ষাটিতেও তাদের পাশ করতে হবে।

এই দেশটি আমাদের। যে স্বপ্ন নিয়ে এই দেশটির জন্ম হয়েছিলো, নতুন প্রজন্মকেই আমাদের সেই দেশ উপহার দিতে হবে।

৭ বৈশাখ, ১৪২০
২০ এপ্রিল, ২০১৩

গণজাগরণ মঞ্চের মুখপত্র “গণজাগরণ” এর প্রথম সংখ্যা
মে ০৩, ২০১৩

কোকাকোলা

যখন আমি ক্লাশ থ্রীতে পড়ি তখন একদিন খবরের কাগজ খুলে দেখি তার মাঝখানে আস্ত পৃষ্ঠা জুড়ে একটা বিজ্ঞাপন। কাগজে বিশাল একটা বোতলের ছবি তার উপড়ে বড় বড় লেখা “কোকাকোলা”। বিজ্ঞাপনটা দেখে জিনিসটা কি ঠিক বোঝা গেল না কিন্তু কয়েকদিনের মাঝে বন্ধুদের থেকে খোঁজ পেলাম যে এটা একটা খাবার জিনিস। বোতলের মাঝে কালচে রংয়ের এক ধরণের তরল পদার্থ থাকে এবং সেটা খেলে নাকি খানিক্ষণ পর একটা ঢেকুর ওঠে এবং তখন নাকি নাক মুখ আর কান দিয়ে আগুনের হলকার মত ঝাঁঝ বের হয়ে আসে। নাক মুখ আর কান দিয়ে ঝাঁঝ বের করার জন্যে কেন মানুষ খামোখা কালচে একটা তরল পদার্থ খাবে আমরা সেটা বুঝতে পারলাম না।

আরো কয়েকদিন পর কোকাকোলা সম্পর্কে আরও খোজ খবর এল। জিনিসটা নাকি একধরনের পানীয় এবং এটা খেতে খারাপ নয়। এক দুজন বন্ধু সেটা খেয়ে এসেছে এবং আমাদের কাছে তারা কোকাককোলার স্বাদ গন্ধ বর্ণ এবং বিশেষ করে তার ঝাঁঝালো ঢেকুরের একটা রোমহর্ষক বর্ণনা দিল। আমাদের মাঝে আবার একজন ছিল নামাজী। সে আমাদের সম্পূর্ণ নূতন খবর এনে দিল। সে জানাল যে তার কাছে পাকা খবর রয়েছে যে কোকাকোলায় নেশার করার জন্যে মদ মিশিয়ে দেয়া হয়। কাজেই কেউ যদি কোকাকোলা খায় তাকে সোজাসুজি দোজখে যেতে হবে। তার পরিচিত একজন নাকি তিন বোতল কোকাকোলা খেয়ে পুরোপুরি মাতাল হয়ে গিয়েছিল, লোকজন দেখেছে প্যান্ট খুলে মাথায় বেঁধে সে চৌরাস্তায় হাঁটাহাটি করছে।

কথাটা সত্যি না মিথ্যা সেটা নিয়ে ভীষণ উত্তেজনা। আমরা দুই দলে ভাগ হয়ে গেলাম, একদল কোকাকোলার পক্ষে আরেকদল কোকাকোলার বিপক্ষে। দিনরাত আমরা কোকাকোলা নিয়ে আলোচনা করি। শহরে বড় বড় কোকাকোলার গাড়ি এসেছে, সেটা দিয়ে দোকানে দোকানে কোকাকোলা দেওয়া হচ্ছে। আমরা ঘুরে ঘুরে কোকাকোলার বোতল দেখে আসি। বোতল ক্যাপ দিয়ে সীল করা থাকে। বোতল খুলে সেগুলি ফেলে দেওয়া হয়। আমরা সেগুলি কুড়িয়ে এনে নানাকাজে ব্যবহার করি। একটা ক্যাপের সাথে রাবার ব্যান্ড, বোতাম আর গিট দেওয়া সুতো দিয়ে এক ধরনের যন্ত্র তৈরী করা যায়, সেটা টান দিলে ক্যাট ক্যাট করে শব্দ হয়। আমাদের সবার কাছে এরকম দুই চারটা যন্ত্র রয়েছে কর্কশ ক্যাট ক্যাট শব্দের কারণে কেউ আমাদের ধারে কাছে আসতে পারে না। এর মাঝে আমাদের আরেক বন্ধু খবর আনল যে কোকাকোলা যদি বরফের মত ঠান্ডা করে খাওয়া যায় তাহলে নাকি একটু পরে পরে ঢেকুর ঊঠতে থাকে এবং সেই ঢেকুরের ঝাঁঝ হয় অনেক বেশী এবং মনে হতে থাকে নাক মুখ দিয়ে আগুন বের হয়ে আসছে। শুধুমাত্র যাদের বুকের পাটা অনেক বেশী তারাই যেন বরফ ঠান্ডা কোকাকোলা খাওয়ার চেষ্টা করে কারণ ব্যাপারটা নাকি সাক্ষাৎ মৃত্যুর আলামত। কোকাকোলা সম্পর্কে আরো খবরাখবর আসে, এটা নাকি এসিডের মত যেটাকে স্পর্শ করে সেটা গলিয়ে ফেলে। একজন মুখে কোকাককোলা নিয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিল সকালকে উঠে দেখে সব দাঁত গলে গিয়েছে মুখে শুধু মাড়ি।
স্কুলের বাইরেও চারিদিকে শুধু কোকাকোলার গল্প। দেওয়ালে দেওয়ালে পোস্টার, রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিশাল সাইনবোর্ড, এরকম একটা জিনিস ছাড়া কিভাবে আমরা এতদিন বেঁচে ছিলাম আমরা এখন চিন্তাও করতে পারি না।

এরকম সময়ে আমাদের ক্লাশে একদিন পরীক্ষা। পড়াশোনার ব্যাপারটা তখন আমার কাছে সহজ, পরীক্ষায় অন্যদের অনেক আগেই আমার লেখালেখি শেষ হয়ে যায়। সেদিনও তাই হল। সময় শেষ হবার অনেক আগেই আমার লেখালেখি শেষ, চুপচাপ খাতা নিয়ে বসে থেকে বিরক্ত হয়ে গেলাম। সময় কাটানোর জন্যে পরীক্ষার খাতার সামনে যে ফাঁকা জায়গাটা আছে সেখানে একটা বিশাল কোকাকোলার বোতলের ছবি আঁকলাম। বোতলে কোকাকোলা এবং তার মাঝে থেকে বুদবুদ বের হচ্ছে। অন্যপাশে একজন মানুষকে আঁকলাম, তার মুখে হাসি সে একটা কোকাকোলার বোতল নিয়ে ঢক ঢক করে খাচ্ছে। দুইটা ছবির মাঝখানে বড় বড় করে লিখলা, “কোকাকোলা পান করুন”। দরদ দিয়ে আঁকা ছবি, ভারী চমৎকার হল দেখতে, আমার পাশে যে বসে ছিল সেও আমার শিল্প-কর্ম দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল।
কয়েকদিন পরে পরীক্ষার খাতা ফেরৎ দেওয়া হচ্ছে। স্যারের খাতা দেওয়ার একটা নিয়ম আছে। প্রথমে ফেরৎ দেন সবচেয়ে বেশী যে নম্বর পেয়েছে তার খাতাটা, তারপর যে তার থেকে একটু কম, তারপর যে তার থেকে আরেকটু কম। সাধারণতঃ প্রথম দুই দিন জনের মাঝেই আমার খাতাটা থাকে কিন্তু এবারে ব্যতিক্রম ঘটল আমি প্রথম দু দিনজনের মাঝে খাতা ফেরৎ পেলাম না। পরীক্ষা যখন দিয়েছিলাম তখন মনে হয়েছিল পরীক্ষাটা ভালই দিয়েছি কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে নিশ্চয়ই কিছু একটা ভুল করে ফেলেছি। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বসে রইলাম স্যার ভাল খাতা দেওয়া শেষ করে মাঝারী খাতা দেওয়া শুরু করলেন তারপর মাঝারী খাতা শেষ করে যারা ক্লাসে এসে উদাস মুখে বাইরে তাকিয়ে বসে থাকে তাদের খাতা দেওয়া শুরু করলেন কিন্তু তবু আমার খাতার দেখা নেই। পরীক্ষায় ফেল করে ফেলেছি এরকম তো হতে পারে না। কিন্তু একটা বড় গোলমাল হয়েছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই; তবে গোলমালটা কোথায় হয়েছে কিছুতেই ধরতে পারলাম না। হঠাৎ করে আমার পেটের ভিতরে পাক খেতে শুরু করল।

সব খাতা ফেরৎ দেওয়া হয়েছে, স্যারের হাতে এখন একটি মাত্র খাতা এবং স্যার সেই খাতাটা ফেরৎ না দিয়ে হাতে ধরে আছেন। স্যার হঠাৎ টেবিলে থাবা দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, “এখন তোদেরকে একটা জিনিস দেখাব, সবাই দেখ”।

স্যারের গলা শুনে সবাই সামনে তাকাল। স্যার তখন আমাকে ডাকলেন। আমি স্যারের দিকে এগিয়ে গেলাম, কাছাকাছি পৌছাতেই খপ করে আমার কানটা ধরে ফেললেন, তারপর সেটা ধরে রেখেই স্যার পরীক্ষার খাতাটা খুলে সারা ক্লাশকে দেখালেন পরীক্ষার খাতার উপরে আমার বিশাল শিল্পকর্ম। কোকাকোলার বোতল এবং হাস্যমুখী একজন মানুষ এবং বড় বড় করে লেখা “কোকাকোলা পান করুন।” ছবিটি দেখে সারা ক্লাশে একটা বিষ্ময়ধ্বনী উঠল আর স্যার আমার কান ধরে একটা ঝাঁকুনী দিয়ে বললেন, “আমার সাথে মশকরা? কোকাকোলা পান করুন?”

ক্লাশের ছেলেরা এবারে খুব আনন্দ পেল, কেউ শাস্তি পেলে সাধারণতঃ আনন্দ হয় না কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার, স্যার খুব রেগে যাওয়ার ভাণ করে আছেন কিন্তু আসলে যে বেশী রাগেন নি সেটা বুঝতে পারো বাকী নেই। ছেলেমেয়েরা হাত তালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করলা। স্যার আরেক বার কান টেনে হাতে খাতাটা দিয়ে বললেন, “নে, ভাগ”।
একজন জিজ্ঞেস করল, “কত পেয়েছে, স্যার?”
“পেয়েছে সবচেয়ে বেশী। কিন্তু বেশী পেলেই কি মশকরা করবে নাকি? তাও পরীক্ষার খাতায়?”
এতদিন পর এখনো আমি বুঝতে পারি না যদি অন্য সব জায়গায় কোকাককোলার বিজ্ঞাপন দেওয়া যায় তাহলে পরীক্ষার খাতায় তার একটা বিজ্ঞাপন দিলে ক্ষতি কি?

বই: আধ ডজন স্কুল
প্রকাশকাল: বই মেলা ১৯৯৬
প্রকাশ করেছে: শিখা প্রকাশনী

গ্লানিমুক্তির ডিসেম্বর

ডিসেম্বর মাসটি চমত্কার একটি মাস। এই মাসে শীতের একটা আমেজ পাওয়া যায়, বাগানে বাগানে রঙিন মৌসুমি ফুল ফুটতে শুরু করে, বাজারে শীতের সবজি উঠতে শুরু করে, বাচ্চাদের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে তাদের আনন্দ শুরু হয়, বিদেশ থেকে আপনজনেরা দেশে বেড়াতে চলে আসে, নানা ধরনের দেশি-বিদেশি কনফারেন্স শুরু হয়-কিন্তু এর কোনোটাই ডিসেম্বর মাসটিকে আলাদা করে দেখার কারণ নয়! ডিসেম্বর মাসটি চমত্কার একটি মাস, এর কারণ, এটি আমাদের বিজয়ের মাস। এই মাসে রাজাকাররা গর্তে ঢুকে থাকে-এই মাসে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের আলাদাভাবে স্মরণ করি। এই মাসে মন্ত্রী না হয়েও আমরা গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগিয়ে ফেলি। আমাদের মধ্যে যারা একাত্তরের ভেতর দিয়ে এসেছি, তারা বিজয় দিবসের কথা স্মরণ করে এখনো এক ধরনের শিহরণ অনুভব করি।
মনে হচ্ছে, এই ডিসেম্বর মাসে আরও একটা বিষয় যোগ হবে-এই মাসে বহু বছর পর আমরা পৃথিবীর একটা নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞের বিচার শেষ করে গ্লানিমুক্ত হতে পারব। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডটা অনেক দিক থেকেই ছিল অবিশ্বাস্য। এই দেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না। খুব সংগত কারণে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী অসংখ্যবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে চেয়েছে; কিন্তু সাহস পায়নি। অথচ বাংলাদেশের জন্মের সাড়ে তিন বছরের মাথায় বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর কিছু অফিসার তাঁকে হত্যা করার দুঃসাহস দেখিয়েছিল-এটি এখনো বিশ্বাস করা যায় না। পৃথিবীর ইতিহাসে রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করার উদাহরণ খুব কম নেই। যুক্তরাষ্ট্রের লিংকন কেনেডি থেকে শুরু করে মিসরের আনোয়ার সাদাত, পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টো বা ভারতের ইন্দিরা গান্ধী-ইতিহাসের পাতা ওল্টালেই আমরা এ রকম অনেক উদাহরণ পেয়ে যাব। কিন্তু শুধু বঙ্গবন্ধু নয়, তাঁর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পরিবারের সবাইকে হত্যা করার মতো নৃশংস ঘটনা ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে? নববিবাহিত বধূ কিংবা ১০ বছরের শিশুসন্তান? এই হত্যাকাণ্ডের সময় ঠিক কী ঘটেছিল বহুদিন সাধারণ মানুষ সেটি জানতে পারেনি। বিচার প্রক্রিয়ার কারণে সেই হত্যাকাণ্ডের খুঁটিনাটি আবার নতুন করে প্রকাশ পেয়েছে। আমার ধারণা, যাঁরা সেই বর্ণনাগুলো পড়েছেন, তাঁদের অনেকেই ‘মানুষ’ প্রজাতির ওপর থেকেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন।
শুধু যে বঙ্গবন্ধু আর তাঁর পরিবারের সবাইকে হত্যা করেছিল তা নয়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আত্মীয়তা থাকার কারণে শেখ মণি এবং আবদুর রব সেরনিয়াবাতের পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে হত্যা করেছিল। সেনাবাহিনীর যে কর্মকর্তাকে সব মৃতদেহ সমাহিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তাঁর লেখা তালিকাটি পড়লে এখনো শিউরে উঠতে হয়। সেই দীর্ঘ তালিকায় বঙ্গবন্ধু, শেখ নাসের, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের পরিবারের সবার নামের সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে একাধিক অজ্ঞাত পরিচয় ১০/১২ বছরের বালক কিংবা ‘১০ বছর বয়সী একটি ফুটফুটে বালিকা’-এর কথা। আমার খুব জানার ইচ্ছে করে, তারা কারা!
১৫ আগস্টের হত্যার মাঝে ছিল এক ধরনের পাশবিক নৃশংসতা। এর পরের হত্যাকাণ্ড, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ঠান্ডা মাথায় একটা সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র। নভেম্বরের ৩ তারিখ জেলখানায় বেছে বেছে সেই নেতাদের হত্যা করা হলো, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধারণ করে বাংলাদেশকে সামনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখতেন। জেলখানায় বন্দীদের হত্যা করার মতো নৃশংস ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই, কিন্তু সেটি করা হয়েছিল, কারণ, এই খুনিচক্র তো শুধু পাশবিক আনন্দের জন্য খুন করেনি, তারা খুন করেছিল বাংলাদেশকে তার আদর্শ থেকে চিরদিনের জন্য লক্ষ্যচ্যুত করতে।
বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের সবাইকে হত্যা করার নৃশংস ঘটনার পর সবাই হয়তো ভেবেছিল বর্বরতার সমাপ্তি হয়েছে। কিন্তু এই দেশের মানুষ শিউরে উঠে আবিষ্কার করল, সেই বর্বরতা শেষ হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। তার ৪১ দিন পর ২৬ সেপ্টেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমদ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ নামে পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম একটি দলিল প্রকাশ করলেন, যে দলিলে পরিষ্কার করে লেখা হলো, যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, তাঁর স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূদের হত্যা করেছে, শিশু রাসেলকে হত্যা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে এই দেশে কোনো মামলা করা যাবে না। পৃথিবীর নৃশংসতম খুনিরা শুধু খুনি নয়, তারা এই দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষ-এই দেশের কোনো আইন তাদের স্পর্শ করতে পারবে না। ব্যাপারটি এখানেই শেষ হলো না, ১৯৭৯ সালে সামরিক আইনের অধীনে নির্বাচন করে জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হয় আর ১৯৭৯ সালের এপ্রিলের ৯ তারিখ কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ পঞ্চম সংশোধনী নামে আমাদের সংবিধানে স্থান করে নিল! এটি আমাদের সেই সংবিধান, যে সংবিধানটি এই দেশের মুক্তিযোদ্ধারা বুকের রক্ত দিয়ে যুদ্ধ করে অর্জন করেছিল। যে বঙ্গবন্ধু এই সংবিধানটি এই দেশকে উপহার দিয়েছিলেন, সেই সংবিধানে ঘোষণা করা হলো, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের এই দেশের মাটিতে বিচার করা যাবে না। এর চেয়ে উত্কট নিষ্ঠুরতার উদাহরণ কি এই পৃথিবীতে আছে?
বঙ্গবন্ধুর খুনিরা তখন দেশ-বিদেশে সগৌরবে তাদের হত্যাকাণ্ডের কথা ঘোষণা করে বেড়াচ্ছে। বহুদিন পর এই দেশের মানুষ টেলিভিশনে সেটি দেখেছে, যারা দেখেনি তারা ইন্টারনেটের ইউটিউবে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী (নধহমধনধহফযঁ শরষষবৎ) লিখে খোঁজ করলেই সেটা পেয়ে যাবে। সেই হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততা কতটুকু ছিল, তাদের নিজের মুখে দেশের মানুষ, পৃথিবীর মানুষ শুনতে পারবে।
তার পর একদিন নয়, দুই দিন নয়, এক বছর নয়, দুই বছর নয়, ২১ বছর কেটে গেছে। জিয়াউর রহমানের সরকার, এরশাদের সরকার এবং খালেদার সরকার সেই খুনিদের টানা ২১ বছর বুক আগলে রক্ষা করেছে, দেশ-বিদেশে কূটনীতিকের চাকরি দিয়েছে, তাদের পদোন্নতি হয়েছে, সগর্বে তারা পৃথিবী চষে বেড়িয়েছে। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সেই ইনডেমনিটি বিলটিকে আমাদের সংবিধান থেকে অপসারণ করে প্রথমবার খুনিদের আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে আনার ব্যবস্থা করেছে। খুনিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেই বিচারকাজ শেষ হতে সময় লেগেছে ১৩ বছর।
মামলা করা যায়নি একুশ বছর, মামলা করার পর বিচারকাজ শেষ হতে সময় লেগেছে ১৩ বছর। এর মাঝে বিচারকদের নিয়োগ দেওয়া হয়নি, যাঁরা আছেন তাঁদের অনেকে বিব্রত হয়েছেন এবং সেগুলো দেখে আমরা শুধু বিব্রত হইনি, ক্ষুব্ধ হয়েছি এবং ক্রুদ্ধ হয়েছি। তার পরেও দেশের মানুষ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছে। একটা ট্রাইব্যুনাল তৈরি করে ঝটপট বিচার করে খুনিদের ঝুলিয়ে প্রতিশোধের তীব্র আনন্দটুকু সহজেই পাওয়া যেত; কিন্তু সেটি করা হয়নি। এটি আমাদের দেশের বিশাল একটি অর্জন। আমরা এখন মাথা তুলে বলতে পারি, এই দেশের মাটিতে আমরা খুনিদের বিচার করে দেশকে, দেশের মানুষকে গ্লানিমুক্ত করেছি।
আত্মস্বীকৃত খুনিদের দম্ভোক্তিগুলো আমরা অসংখ্যবার শুনেছি, নতুন প্রজন্ম ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন আরও অনেক সহজে শুনতে পারে। বিচারকাজ চলার সময় আবিষ্কার করেছি, প্রাণ বাঁচানোর জন্য এখন তারা সব দায়দায়িত্ব অস্বীকার করে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করছে, তখন আমরা না চাইলেও আমাদের ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে। আমি চাই, যখন তাদের গলায় জল্লাদেরা ফাঁসির দড়িটি পরাবে, তখন অন্তত একবারও যেন তাদের সামনে শিশু রাসেল এবং ১০/১২ বছরের নাম না জানা সেই বালক বা ফুটফুটে বালিকাদের চেহারাটা ভেসে ওঠে।

২.
আমি আশা করছি, বর্তমান সরকার আত্মতুষ্টির সঙ্গে সঙ্গে ১৯৭৫ সালের সেই সময়টুকুর কথা একবার ভাববে। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা সেই হত্যাকাণ্ড ঘটানোর দুঃসাহস পেয়েছিল কারণ, তখন দেশটি ভালো চলছিল না। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, অর্থনীতি বলে কিছু নেই, খাবার নেই, দুর্ভিক্ষ, বাকশাল, রক্ষী বাহিনী-সব মিলিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ ছিল হতাশ এবং ক্ষুব্ধ। এত দিন পর আমরা জানি এর অনেকটুকু ছিল দেশ এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফল, অনেকটুকুর ওপর কারও হাত ছিল না সেটি আমাদের দুর্ভাগ্য-কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারকে স্বীকার করতেই হবে, একটা বড় অংশ ছিল তাদের ভুলভ্রান্তি এবং অন্যায়-অবিচার। বঙ্গবন্ধুর দলের মানুষের অপকর্মের দায়ভারই নিতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে আর তাঁর পরিবারের মানুষকে। যদি সেই সময় আওয়ামী লীগের অনেক সমর্থক আর কর্মীরা দেশটাকে এ রকম নৈরাজ্যকর একটা জায়গায় ঠেলে না দিত, এই খুনিরা তাহলে এত বড় একটা ঘটনা ঘটানোর দুঃসাহস পেত না।
আওয়ামী লীগ আবার দেশ শাসনের দায়িত্বটুকু পেয়েছে, দেশের মানুষ অনেক বড় স্বপ্ন দেখে তাদের ক্ষমতায় এনেছে। প্রতি মুহূর্তে তাদের জিজ্ঞেস করতে হবে, আমার দলের মানুষ কি এই দেশের সাধারণ মানুষের মন বিষিয়ে দিচ্ছে? দলের মানুষ ছোট একটা লাভ করার জন্য কি পুরো দেশটাকে বিশাল একটা বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে?
আমি পুরো দেশের খবর জানি না, খবরের কাগজে অত্যন্ত খণ্ডিত একটা ছবি দেখি সেটা থেকে অনুমান করার চেষ্টা করি। সব সময় অনুমান সঠিক হয় না। কিছুদিন আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সংগঠন বাউল সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। কোনো একটা কারণে ছাত্রলীগের ছেলেরা সেখানে হামলা করে স্টেজ ভেঙে চেয়ার-টেবিল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সাউন্ড সিস্টেম নষ্ট করে দিয়েছিল। বাংলাদেশের সব খবরের কাগজে খবরটা ছবিসহ ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। যে খবরটা ছাপা হয়নি সেটা হচ্ছে, তার পরেও সবাই মিলে অত্যন্ত চমত্কারভাবে দুই দিনের সেই বাউল সম্মেলন অনুষ্ঠানটি উদ্যাপন করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের বাইরের সবাই সেটি উপভোগ করেছে। কাজেই, খবরের কাগজ থেকে আমরা যে তথ্যগুলো পাই সেগুলো খণ্ডিত, সেগুলো পূর্ণাঙ্গ নয়।
কিন্তু যে বিষয়গুলো আমি নিজের চোখে দেখি, সেগুলো খণ্ডিত নয়, সেগুলো পূর্ণাঙ্গ। কাজেই, আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের চোখে দেখেছি, এখানে ছাত্রলীগের ছেলেরা নিজেদের ভেতর মারামারি করছে, একদল আরেক দলের ওপর হামলা করছে। সেই হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করছে, ধর্মঘট ডেকে লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, নিজেরা নিজেদের কুপিয়ে আহত করে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ইন্টারনেট ব্রাউজ করার সবচেয়ে সুন্দর ল্যাবরেটরিটি ভেঙে গুঁড়ো করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। আমি অন্তত এই একটা ঘটনার কথা বলতে পারি, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সুন্দর ডিজিটাল পরিবেশটি তারা অবলীলায় ধ্বংস করে দিয়েছে। (আমার এত মন খারাপ হয়েছিল যে আমি সেটি কখনো দেখতে যাইনি। বিশ্ববিদ্যালয় নিজের খরচে সেটি আবার ঠিক করে দিয়েছে।) শুধু যে দল বেঁধে এ রকম হাঙ্গামা হচ্ছে তা নয়, নীতিহীন নেতা তৈরি হচ্ছে, তারা মাস্তানি করছে, ছাত্রীদের অসম্মান করছে।
আমি জানি, আওয়ামী লীগের বড় নেতারা এই পুরো ব্যাপারটাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলবেন, সমগ্র দেশের বিশাল কর্মকান্ডের তুলনায় এটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র বিষয়! কিন্তু এই ছোট ছোট অসংখ্য ক্ষুদ্র বিষয় যখন একত্র হয়, তখন সেটি আর ক্ষুদ্র বিষয় থাকবে না। যখন দেশের মানুষ একদিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলবে, ‘ধুর! এদেরকে দিয়ে কিছু হবে না। সবই আসলে এক মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ!’ তখন তাদের বুঝতে হবে, একটা খুব ভয়ংকর ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে। আমরা নিজের চোখে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট দেখেছি। তাই আমরা কোনোভাবেই হতাশ এবং ক্ষুব্ধ দেশবাসী দেখতে চাই না।
শুধু যে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অসহিষ্ণু ছাত্রলীগ- যুবলীগের তাণ্ডব হচ্ছে তা নয়, আরও বড় বড় ব্যাপারও ঘটছে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অত্যন্ত দক্ষ এবং কার্যকর ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। তিনি সত্ এবং নীতিবান মানুষ ছিলেন কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা তাঁর জীবনকে অতিষ্ঠ করে দিয়ে তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করিয়েছে। আমি যতদূর জানি, পদত্যাগ পত্রে তিনি স্পষ্ট করে সেই কথা লিখে দিয়েছেন। শুধু যে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম ঘটনা ঘটেছে তা নয়, পাবনা বিশ্ববিদ্যালয়েও সেই একই ঘটনা ঘটেছে, ভাইস চ্যান্সেলরকে সরে যেতে হয়েছে। আমি দেশের অন্য অনেক কিছু না বুঝতে পারি, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে কী হয় আর কী না হয় সেই জিনিসটা বুঝতে পারি। তাই আমি খুব স্পষ্ট ভাষায় বলতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে কাজগুলো ঘটছে, সেগুলো কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এগুলো যে শুধু অনৈতিক তা নয়, এগুলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য ভয়ংকর ক্ষতিকর। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে সঠিক মানুষকে নিয়োগ না দিয়ে দলীয় অপদার্থ মানুষদের জোর করে ঢুকিয়ে দিলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়টি আর কোনো দিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। অন্যরা শুনছে কী না জানি না, আমরা কিন্তু এই দেশের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্যুঘণ্টা শুনতে শুরু করেছি।
আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে, তাদের অনেক বড় কাজ করার সুযোগ আছে। কিন্তু অত্যন্ত সংকীর্ণ দলীয় কিছু বিষয়ে নাক গলিয়ে তারা যেন কোনোভাবেই সাধারণ মানুষের মন বিষিয়ে না দেয়। এই অতি সাধারণ বিষয় বোঝার জন্য কি রকেটবিজ্ঞানী হতে হয়?

৩.
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যখনই বড় কিছু ঘটে, তখন ছাত্র-শিক্ষক সবাই আমাদের লাইব্রেরির সিঁড়িতে এসে জড়ো হয়েছি। একজন-দুজন কিছু বলে অন্যরা শোনে। ১৯ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণার পর অনেকটা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ছাত্র-শিক্ষকেরা সেখানে উপস্থিতি হয়েছে। ছাত্ররা কথা বলেছে, শিক্ষকেরা কথা বলেছে। বক্তব্যের বিষয়বস্তু মোটামুটি এক, আমরা কলঙ্কমুক্ত হয়েছি, একই ধারাবাহিকতায় জেলহত্যা মামলার বিচার করে দ্বিতীয়বার কলঙ্কমুক্ত হব। আমাকে যখন কথা বলতে দিয়েছে, আমি তখন আরও একটি কথা যুক্ত করেছি, বলেছি, আজ যেমন এখানে এসেছি, ঠিক সেরকম কিছুদিনের ভেতর আবার এখানে এসে আমরা ঘোষণা করতে চাই, ‘যুদ্ধাপরাধীর বিচার করে পুরো জাতি আজ কলঙ্কমুক্ত হলো।’
সরকার আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা যুদ্ধাপরাধীর বিচার করবে, আমরা সরকারের সেই প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস করেছি। আমরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছি সেই প্রক্রিয়াটি শুরু হওয়ার জন্য। এটি ডিসেম্বর মাস, এটি বিজয়ের মাস। এই মাসে এই দেশের সবাই যেন নতুন করে ঘোষণা করে যে এই দেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীর বিচার আমরা করবই করব।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করে আমরা প্রথমবার অনুভব করেছি গ্লানিমুক্তির অনুভূতিটি কী রকম। যুদ্ধাপরাধীর বিচার করে আমরা নতুন করে আবার সেই গ্লানি আর কলঙ্ক ধুয়ে-মুছে ফেলতে চাই।
নতুন প্রজন্মের চোখের দিকে তাকিয়ে তখন আমরা স্পষ্ট করে বলতে পারব, বাঙালি বীরের জাতি-এই জাতির ইতিহাসে কোনো গ্লানি নেই, কোনো কলঙ্ক নেই।

চলচ্চিত্রের নতুন প্রজন্ম তৈরি করছি

শুরু হলো ‘ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসব’। চিলড্রেন’স ফিল্ম সোসাইটি বাংলাদেশের উদ্যোগে আয়োজন করা হয়েছে এই উৎসব। সংগঠনটির সভাপতি মুহম্মদ জাফর ইকবাল। উৎসব নিয়ে প্রথম আলোকে দেয়া সাক্ষাৎকার।

> আপনি এখন ঢাকায়?
>> হ্যাঁ, আজ (শনিবার) বিকেলে ‘ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসব’ উদ্বোধন হচ্ছে। এই অনুষ্ঠানে থাকব।

> এই উৎসব নিয়ে ছোটদের আগ্রহ কেমন মনে হচ্ছে?
>> এই উৎসবের জন্য শিশু-কিশোরেরা আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে। আমরা তাদের দেখানোর জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ভালো ভালো চলচ্চিত্র নিয়ে আসি। আর ছোটরা কিন্তু ভালো যেকোনো কিছু গ্রহণ করে। আমরা এই উৎসবে ছোটদের সেসব ভালো চলচ্চিত্র দেখাব।

> ছোটদের কিন্তু টিভির প্রতি একটা আকর্ষণ রয়েছে।
>> টিভি আর চলচ্চিত্র কিন্তু এক জিনিস নয়। চলচ্চিত্র অনেক বড় মাধ্যম। চলচ্চিত্রের আলাদা একটা জগৎ আছে। এটা তাদের বোঝাতে হবে। আমি বলব, এই উৎসব তাদের বিশ্বের ভালো ভালো সব চলচ্চিত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে।
টিভিতে তো এখন অসংখ্য অনুষ্ঠান তৈরি হচ্ছে… কিন্তু তার মধ্যে ছোটদের জন্য কয়টা হচ্ছে? এই যে প্রতিবছর ঈদের সময় টিভি চ্যানেলগুলো টানা কয়েক দিন নানা ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার করে, তার মধ্যে ছোটদের জন্য তেমন কিছুই থাকে না। ছোটরা সব সময়ই অবহেলিত।

> ছোটদের জন্য চলচ্চিত্র তৈরির ব্যাপারে আমাদের নির্মাতারা কতটা আগ্রহী?
>> আগ্রহটা হবে কীভাবে। কাজলের দিনরাত্রি ছবিটি তৈরি করেছেন সজল খালেদ। ওর সঙ্গে কথা হলো। ছবিটি তৈরির জন্য সরকারের কাছ থেকে ও যে অনুদান পেয়েছে, এরপর ছবির কাজ শেষ করার জন্য তাঁর গাড়ি আর স্ত্রীর গহনা বিক্রি করতে হয়েছে। এভাবে সম্ভব? শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যাপারে আরও ভালোভাবে সহযোগিতা করার জন্য আমি সরকারকে অনুরোধ করছি।

> আপনার দৃষ্টিতে এই উৎসব আয়োজন কতটা ফলপ্রসূ?
>> ছোটদের জন্য এই ‘আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসব’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা শুধু বিনোদনের জন্য এই উৎসব আয়োজন করছি না, আমরা একদিকে যেমন তাদের ভালো চলচ্চিত্র দেখার ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলছি, তেমনি তাদের চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যাপারেও উদ্বুদ্ধ করছি। এই উৎসবে ছোটদের নির্মিত চলচ্চিত্র নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়। তাদের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণের ওপর কর্মশালার আয়োজন করা হয়। আমরা চলচ্চিত্রের নতুন একটি প্রজন্ম তৈরি করছি। ৮-১০ বছর পর আমরা যে নির্মাতাদের দেখব, আশা করছি তাদের বেশির ভাগই হবে এই উৎসবে অংশ নেওয়া ছেলেমেয়েরা।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো
জানুয়ারি ২০, ২০১৩

জাতি গ্লানিমুক্ত হোক

সূর্যকে ঘিরে পৃথিবীর আবর্তনের বিষয়টি বিবেচনা করলে নববর্ষের দিনটি অন্য যেকোনো দিন থেকে কোনোভাবেই আলাদা কোনো দিন নয় (আনন্দের উচ্ছ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মাঝেমধ্যে গভীর রাতে পুলিশ ডাকতে হয়, তবে সেটা অন্য ব্যাপার!)। অন্য বছরের কথা জানি না, কিন্তু আমরা চাইলে এ বছরটাকে আলাদাভাবে পালন করতে পারি, আমরা সবাই মিলে ঘোষণা করতে পারি, ২০১০ সালটি হবে গ্লানিমুক্তির বছর, যুদ্ধাপরাধীর বিচারের বছর।
নতুন প্রজন্মের যে প্রশ্নগুলোর উত্তর আমরা কখনো ভালো করে দিতে পারিনি, তার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন ছিল এ প্রশ্নটি—পৃথিবীর সব দেশে যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়, আমরা কেন আমাদের যুদ্ধাপরাধীর বিচার করতে পারি না? এ দেশে তারা কেন বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়? কেন তারা বড় গলায় কথা বলে?

ব্যাপারটি আমরা যতভাবেই ব্যাখ্যা আর বিশ্লেষণ করি, প্রশ্নটি কিন্তু থেকে যায়। যুক্তিতর্ক, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ দিয়ে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়, শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে এ প্রশ্নটিকেই অর্থহীন করে দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ খোলা নেই। সে অঙ্গীকার করে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে। তারা যুদ্ধাপরাধীর বিচার করবে এবং আমরা আবার নতুন প্রজন্মের চোখের দিকে তাকিয়ে বলব, কে বলেছে এই দেশে যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয় না। এই দেখো, আমরা তাদের বিচার শেষ করেছি, সেই মুহূর্তটির জন্য আমরা গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি।
আমরা শুনতে পাচ্ছি কি না জানি না, কিন্তু এ দেশের যুদ্ধাপরাধীরা কিন্তু তাদের মৃত্যুঘণ্টা শুনতে শুরু করেছে। ডুবন্ত মানুষ যেভাবে খড়কুটো আঁকড়ে ধরে, এ দেশের যুদ্ধাপরাধীরা ঠিক সেভাবে তাদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য শেষ আশ্রয়টুকু আঁকড়ে ধরেছে। নিজের কানে শুনে, নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হতে চায় না যে এ দেশের যুদ্ধাপরাধীদের শেষ আশ্রয় হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধ, শেষ সহায় হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১-এ যে মুক্তিযোদ্ধাদের তারা বলে এসেছে দুষ্কৃতকারী, ভারতের দালাল, ইসলামের দুশমন, বেইমান, গাদ্দার, যাদের তারা আক্ষরিক অর্থে এ দেশের মাটিতে জবাই করেছে; হঠাত্ করে সেই মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দেখাতে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। যে মুক্তিযুদ্ধে তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পদলেহী হয়ে অস্ত্র হাতে এ দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, এখন তারা যে শুধু সেই যুদ্ধকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করছে তা নয়, তারা দাবি করছে, সেই মুক্তিযুদ্ধকে তারা সহায়তা করেছে! এর চেয়ে বড় মিথ্যাচার এ দেশের মানুষ কি কখনো শুনেছে? কখনো শুনবে? যারা বলছে, তারা নিজেরাও তো সেই কথা একবারের জন্যও বিশ্বাস করে না। তাহলে তারা কেন সেটি বলছে?
আমরা সবাই জানি, তারা এই কথাগুলো বলছে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য, সংগঠনটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। তাদের নিজের দলের তরুণ প্রজন্মকে ধরে রাখার জন্য। যে রাজনৈতিক দল রাজাকার হয়ে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পদলেহন করে নিজের মা-বোনকে তাদের হাতে তুলে দেয়, বদর বাহিনী হয়ে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করে, কোন তরুণ সেই রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে ছুটে যাবে? সত্যিকারের বিচারের আলো ঘৃণার আগুনে ধিকি ধিকি করে জ্বলতে থাকার কষ্ট থেকে তাদের মুক্তি নেই। বিচারে কী হবে, আমরা জানি না, কিন্তু এ দেশের মানুষ তাদের কোনো দিন ক্ষমা করবে না, সেই কথাটি যুদ্ধাপরাধীদের থেকে ভালো করে আর কেউ জানে না!

আমার ধারণা, যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবিটুকু উচ্চারণ করেই আমরা এই নতুন বছরকে গ্রহণ করব। এ বছরেই আমরা সত্যিকার অর্থে গ্লানিমুক্ত হব।

 নববর্ষের শপথ

পৃথিবীর আহ্নিক গতির জন্যে দিন রাত হয়, বার্ষিক গতির জন্য ঋতু পরিবর্তন হয় সেই হিসেবে ইংরেজী নববর্ষের দিনটি অন্য যে কোনো একটা দিনের মত, তার আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্যই নেই।

তারপরও শুধুমাত্র নববর্ষের দিন বলে এই দিনটিকে আমরা আলাদাভাবে দেখতে পছন্দ করি। রাত বারোটা বাজার সাথে সাথে আমরা বিকট চেচামেচি করি, পরিচিতি অপরিচিত সবাইকে “হ্যাপি নিউ ইয়ার” বলে ব্যতিব্যস্ত করে তুলি।

ঘড়ির কাঁটা পেছানোর জন্য ঠিক রাত বারোটা বেছে নেওয়ার কারণে এইবার আমাদের এক ঘণ্টার মাঝে দুই দুইবার নববর্ষ পালনের সুযোগ এসেছিল।

কিন্তু বেরসিক সাংবাদিকদের কারণে সরকার সতর্ক হয়ে ঘড়ির কাঁটা পেছানোর জন্য রাত বারোটা বেছে না নিয়ে এগারোটা উনপঞ্চাশ বেছে নিয়েছে।

যার অর্থ আমরা নববর্ষের এক মিনিটের ভেতর চলে এসে আবার এক লাফে এক ঘন্টা পিছিয়ে যাবো! দুই দুই বার নববর্ষ পালন করার ঐতিহাসিক সুযোগটা আর পাব না।

একবারই হোক আর দু’বারই হোক নববর্ষ দিনটাকে আলাদা ভাবে দেখার জন্য আমরা সব সময়েই নতুন বছরে নতুন কিছু করার পরিকল্পনা করি।

ছাত্রছাত্রীরা সময়মত হোমওয়ার্ক করার পরিকল্পনা করে, গৃহিনীরা হিন্দী সিরিয়াল না দেখার প্রতিজ্ঞা করে, বয়স্ক মানুষেরা সিগারেট ছেড়ে দেবার যোগাড়যন্ত্র করে। প্রথম সপ্তাহ দু’য়েক সবাই তাদের প্রতিজ্ঞায় অটল থাকে, তারপর কীভাবে কীভাবে জানি ঠিক আগের অবস্থায় চলে আসে।

তবে আমাদের জন্য এই নববর্ষটা একটা চমৎকার সুযোগ নিয়ে এসেছে। হোমওয়ার্ক, হিন্দী সিরিয়াল কিংবা সিগারেট সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত থেকেও ভালো সিদ্ধান্ত আমরা নিতে পারি – সেটা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি করা।

এই সরকার যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, জাতীয় সংসদে সেই সংক্রান্ত একটা সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। খবরের কাগজে দেখেছি বিচারের জন্য ভবন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারি, মার্চে ট্রাইবুনাল গঠন হবে, তদন্ত করার জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ হবে।

বিষয়টি যত দ্রুত হওয়ার কথা ছিল, তত দ্রুত হচ্ছে না সেটা সত্যি কথা। ভেতরে অন্য কিছু হচ্ছে কি না আমরা সেটাও জানি না। একাত্তরে যে দেশগুলো এই দেশের যুদ্ধাপরাধীদের সাথে সাথে ছিল তাদের অনেক এখনো তাদের সাথে আছে।

যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করার জন্য তারা নতুন কোনো পায়তারা শুরু করলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু সকল বাধা আর প্রতিবন্ধকতা দূর করার একটা মাত্র উপায় হচ্ছে দেশের সকল মানুষ একতাবদ্ধ হয়ে এই বিচারের দাবিটি জোরালো বা স্পষ্ট উচ্চারণ করা।

আর এই দাবি উচ্চারণ করার জন্য নববর্ষের মুহূর্তটি থেকে চমৎকার সময় আর কী হতে পারে?

মা, তোর বদনখানি মলিন হলে…

বছর দুয়েক আগের কথা, আমি একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছি। বাংলাদেশের যে কয়টি সংগঠন আছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সংগঠনগুলোর একটি—তাদের বিশাল আয়োজন (সংগঠনটিকে প্রকাশ্যে লজ্জা দিতে চাই না বলে নাম উল্লেখ করলাম না)। অনুষ্ঠান শুরু হবে জাতীয় সংগীত দিয়ে, তাই মঞ্চে কয়েকজন উঠেছেন সেটি গাওয়ার জন্য। আমরা দর্শকেরা উঠে দাঁড়িয়েছি। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সংগীতটি গাওয়া শুরু হলো এবং দুই লাইন গাওয়ার পরই আমি বুঝতে পারলাম, মঞ্চে যারা গিয়ে দাঁড়িয়েছে, তারা কেউ দেশের জাতীয় সংগীতটি জানে না। সবাই ধরে নিয়েছে, অন্য একজন জানে এবং তার সঙ্গে গলা মেলাবে, কিন্তু ঘটনাক্রমে একজনও গানের কথাগুলো জানে না। মঞ্চে দাঁড়িয়ে সেই গায়কেরা কতটুকু লজ্জা পেয়েছে আমি জানি না, কিন্তু আমি লজ্জায় ম্রিয়মাণ হয়ে গেলাম। শুধু লজ্জা নয়, আমি ভয়ংকর একটি ধাক্কা খেলাম—তাহলে কি আমাদের দেশে একটি তরুণ প্রজন্ম বড় হচ্ছে, যারা দেশের জাতীয় সংগীতটি জানে না?
শুধু তরুণ প্রজন্ম নয়, আমার ধারণা, আমাদের অনেক বড় মানুষও জাতীয় সংগীতটি জানেন না। তার একটা রাষ্ট্রীয় প্রমাণ পেয়েছিলাম জোট সরকারের আমলে। ২০০৩ সালের অক্টোবর মাসে কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের ৪৯তম সম্মেলনের শুরুতে জাতীয় সংগীতটি শুরু না হতেই থেমে গিয়েছিল।
একাধিকবার চেষ্টা করেও যখন সেটি বাজানো সম্ভব হয়নি, তখন সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া একজন সাংসদকে সেটা গাইতে বলেছিলেন। সেই সাংসদ পুরোটুকু জানতেন না, একটুখানি গেয়ে হাল ছেড়ে দিলেন। যদি সবাই পুরো জাতীয় সংগীতটুকু সঠিকভাবে গাইতে পারত, তাহলে এই যান্ত্রিক গোলযোগটাই একটা মধুর ব্যাপার হতে পারত। প্রধানমন্ত্রী সবাইকে বলতে পারতেন, ‘আসুন, আমরা সবাই মিলে জাতীয় সংগীত গেয়ে ফেলি।’ মঞ্চে দাঁড়িয়ে সবাই মিলে মাথা দুলিয়ে গলা ফাটিয়ে জাতীয় সংগীত গাইতে পারতেন—হয়তো একটু বেসুরোভাবেই, কিন্তু আমাদের জাতীয় সংগীতের কথাগুলো এত সুন্দর যে বেসুরো হলেই কী এমন ক্ষতি হতো? কিন্তু সেটা হয়নি, পৃথিবীর ৪৬টা দেশের সামনে আমরা নিজেদের বেইজ্জতি করে ছেড়েছিলাম (সেই সম্মেলনের অবশ্যি আরও অনেক ইতিহাস আছে, অনেক দেশের জাতীয় পতাকাও উল্টো করে টাঙানো হয়েছিল, সেই দেশের প্রতিনিধির অনেকে নিজেরা তাঁদের পতাকা নামিয়ে সোজা করে নিয়েছিলেন!)।
আমি যখন টের পেয়েছি যে একটা আশঙ্কা আছে, আমাদের স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা সবাই সঠিকভাবে জতীয় সংগীত গাইতে পারে না, তখন থেকে কোনো অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত গাওয়া হলেই আমি তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করি, কতজন গাইছে। আমি লক্ষ করেছি, খুব কমসংখ্যক ছেলেমেয়ে কণ্ঠ দেয়। তারা জাতীয় সংগীতটি জানে না, সে জন্য গাইছে না, নাকি সবার সঙ্গে গাওয়ার প্রয়োজন আছে সেটি অনুভব করে না—সেটি কখনো নিশ্চিত হতে পারিনি।
এ রকম সময়ে আমাদের স্কুলের পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত যেসব বিকৃতি আছে, সেগুলো সংশোধন করার জন্য একটা কমিটি করা হলো এবং ঘটনাক্রমে সেখানে আমাকেও রাখা হয়েছে। সবাই মিলে যখন বিকৃতিগুলো সংশোধন করছি, তখন আমি আবিষ্কার করলাম, প্রাইমারি স্কুলের বাংলা বইয়ের শুরুতেই আমাদের জতীয় সংগীতটি দেওয়া হয়েছে। একটি ছোট বাচ্চার জন্য জাতীয় সংগীতটি শিখে ফেলার এটাই হচ্ছে মোক্ষম সময়—কাজেই এটা খুবই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আমার আরও একটি বিষয় মনে হলো—আমাদের সংবিধানে জাতীয় সংগীতের জায়গায় লেখা আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সংগীত আমার সোনার বাংলা-র প্রথম দশ চরণ’ এবং পাঠ্যবইয়ে সেই দশ লাইন তুলে দেওয়া আছে। কিন্তু সংগীতটি যখন গাওয়া হয়, তখন কিন্তু হুবহু এভাবে গাওয়া হয় না। কোনো লাইন বা লাইনের অংশ দ্বিতীয়বার গাওয়া হয়, কোনো লাইন মাঝখানে ছেড়ে দিয়ে আবার শুরু করা হয় এবং যারা গায়ক বা গায়িকা, তারা সেগুলো জানেন—আমাদের মতো সাধারণ মানুষ সেগুলো জানি না। কাজেই আমার মনে হলো, আমাদের ছেলেমেয়েদের সংবিধানে উল্লেখ করা জাতীয় সংগীতের সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে গাওয়া হয়, সেটাও জানিয়ে দেওয়া উচিত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি সংশোধন কমিটির অন্য সদস্যদের কাছে আমি যখন সেই প্রস্তাবটি করেছি, তখন তাঁরা সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। তাই গত দুই বছরের প্রাথমিক স্কুলের পাঠ্যবইয়ে আমাদের জাতীয় সংগীতের নিচে নতুন একটি বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। সেটা হচ্ছে, ‘গাওয়ার জন্য জাতীয় সংগীতের পূর্ণ পাঠ’। সেটি আমি এই লেখার সঙ্গে যুক্ত করে দিচ্ছি। আমার ইচ্ছা, যাঁরা এখনো আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির জাতীয় সংগীতটি (যেটি পৃথিবীর মধুরতম একটি সংগীত) জানেন না, তাঁরা এই অংশটি কেটে তাঁদের পকেটে বা ব্যাগে রাখবেন। প্রতিদিন সময় করে এক-দুইবার করে পড়বেন, দেখতে দেখতে তাঁরা আমাদের জাতীয় সংগীতটি ঠিক যেভাবে গাওয়ার কথা, সেটি তাঁরা শিখে যাবেন।
কথাগুলো শিখে যাওয়ার পর বাকি থাকল সুর। এ ব্যাপারে আমি একেবারে অজ্ঞ, আমার যে গলায় কোনো সুর নেই, শুধু তা-ই নয়, আমার কানেও কোনো সুর নেই। আমার সংগীতজ্ঞ বন্ধুরা যখন সুরের সূক্ষ্ম তারতম্য নিয়ে কথা বলেন, তখন আমি একধরনের বিস্ময় নিয়ে তাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকি! ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি একসময় ছিল শুধু একটি রবীন্দ্রসংগীত, যখন সেটাকে আমরা আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে ঠিক করেছি, তখন সেটি শুধু গায়ক-গায়িকাদের জন্য থাকেনি—আমাদের সবার জন্য হয়ে গেছে। এখন এটি শুধু অল্প কিছু গায়ক-গায়িকা গাইবেন না, এ দেশের ছেলে-বুড়ো, পুরুষ-মহিলা, সাংসদ-মন্ত্রী, পুলিশ-মিলিটারি—সবাই গাইবে। যার গলায় সুর আছে সে যে রকম গাইবে, ঠিক সে রকম যার গলায় সুর নেই সেও গাইবে। তাই এর সুরটিকে সহজ করে নেওয়া হয়েছিল।
আমি ইন্টারনেটে বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদিত জাতীয় সংগীত খুঁজেছি, সঠিকভাবে খোঁজা হয়েছে কি না জানি না, তবে খুঁজে পাইনি। আমার গায়ক বন্ধুরা আমাকে বলেছেন, বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদিত জাতীয় সংগীতের যন্ত্রসংগীত রূপ আছে, তবে মূল গানটি নেই। আমার বিশ্বাস হতে চায় না, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না, এ রকম অনেক কিছুই পৃথিবীতে আছে, তাই আমার নিজের বিশ্বাস-অবিশ্বাসকে খুব বেশি গুরুত্ব দিই না। ইন্টারনেটের ইউটিউবে যন্ত্রসংগীত এবং জাতীয় সংগীত দুটিই খুঁজে পাওয়া যায়, কিন্তু সেটি কোনো একজনের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা, রাষ্ট্রীয় কিছু নয়। আমার গায়ক বন্ধুদের সাহায্য নিয়ে আমি ছায়ানটের একটি সিডির সন্ধান পেয়েছি, যেটিতে লেখা আছে, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত সুর’—আমার মনে হয়, সেটাকেই রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশের মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেওয়া উচিত। কিছুদিন আগে ‘জাগরণের গান’ হিসেবে বেশ কটি দেশাত্মবোধক গান প্রকাশ করা হয়েছে, এর প্রথমটিতেও আমাদের জাতীয় সংগীত আছে—যেটি এখন ইচ্ছে করলেই সংগ্রহ করা যায়।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা জাতীয় সংগীত গায়—আমি আবিষ্কার করেছি, তাদের গলায় অপূর্ব সুর, কিন্তু কথাগুলো সঠিক নয়। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, আমি তাদের কাছে ‘গাওয়ার জন্য জাতীয় সংগীতের পূর্ণ পাঠ’ ধরিয়ে দেওয়ার পরও তারা নিজেদের মতো করে জাতীয় সংগীতটি গাইতে পছন্দ করে। যার অর্থ, তারা যেখান থেকে শিখে এসেছে, সেখানেই অনেক যত্ন করে তাদেরকে এভাবে শেখানো হয়েছে—তারা চেষ্টা করেও তার বাইরে যেতে পারে না। আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রজ্ঞাপনে স্পষ্ট করে লেখা আছে, সাধারণ মানুষের অনুষ্ঠানে যখনই জাতীয় সংগীত গাওয়া হবে, তখন পুরোটুকু গাইতে হবে। তার পরও দেখি, অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অর্ধেক গেয়ে শেষ করে দেওয়া হয়। খুব সহজ ভাষায় বলা যায়, স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরেও জাতীয় সংগীত নিয়ে আমাদের মধ্যে একটা বিশৃঙ্খলা ও অনিয়ম আছে। আমার ধারণা, এটা ঠিক করা দরকার।
আমি যখন ক্লাস থ্রি-ফোরের ছাত্র, তখন আমাদের স্কুলে কিছু মানুষ এসে স্কুলের ছাত্র আর শিক্ষকদের পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। দুর্বোধ্য ভাষার সেই জাতীয় সংগীতটি আমাদের প্রতিদিন গাইতে হতো এবং সেটি একসময় আমাদের মস্তিষ্কে পাকাপাকিভাবে স্থান করে নিয়েছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে আমার খুব খারাপ লাগত যে পাকিস্তানের জাতীয় সংগীতটি আমার মস্তিষ্কে জায়গা দখল করে বসে আছে এবং চেষ্টা করেও আমি সেটা আমার মাথা থেকে সরাতে পারি না—আমি সেটা ভুলে যেতে পারি না! তবে খুবই আনন্দের ব্যাপার, ইদানীং আমি পরীক্ষা করে দেখেছি, ছেলেবেলায় শেখা অনেক কবিতা আমার মুখস্থ আছে, কিন্তু পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ আমার মস্তিষ্ক থেকে বিদায় নিয়েছে—আমি চেষ্টা করেও এখন সেটা মনে করতে পারি না।
তবে এ ঘটনা থেকে আমি একটা জিনিস বুঝতে পেরেছি, একটা ছোট শিশুকে শিশু অবস্থায় জাতীয় সংগীত শিখিয়ে দেওয়া হলে সারা জীবন সে সেটি মনে রাখবে। কাজেই আমাদের রাষ্ট্রের দায়িত্ব, প্রতিটি স্কুলের এক-দুজন শিক্ষককে সঠিক কথা আর সুরে জাতীয় সংগীতটি শিখিয়ে দেওয়া এবং তাদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া, স্কুলের সব ছাত্রছাত্রীকে প্রতিদিন সেটি গেয়ে তাদের দিনটি শুরু করানো। দেশের বড় করপোরেশনগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে কিছু কাজ করার কথা—তারাও সাহায্য করতে পারে।
আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি শুধু একটি গান—আমাদের কাছে সেটি আরও অনেক কিছু। ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তানি মিলিটারি পৃথিবীর ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিল—পরদিন সারা পৃথিবীর রেডিওতে সেই খবরটি প্রচারিত হয়েছে। আকাশবাণী কলকাতা থেকে পরদিন এই খবরটি প্রচার করেছিল খুব সংক্ষিপ্তভাবে দুই-এক লাইনে—তারপর ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি প্রচার করেছিল। একবার-দুইবার নয়, অসংখ্যবার। সেই গানের কথা ও সুর আমাদের রক্তের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল—আমরা তখন কেউ জানতাম না, কত রক্ত দিয়ে আমরা আমাদের স্বাধীনতাটুকু অর্জন করতে পারব। আমাদের প্রজন্মের কাছে এই জাতীয় সংগীতটি শুধু একটি সংগীত নয়—এটি অনেক কিছু। এখন পর্যন্ত একবারও হয়নি, যখন কেউ এই গানটি গেয়েছে এবং তার কথাগুলো শুনে আমার চোখ ভিজে আসেনি।

২.
ফুটবল ওয়ার্ল্ড কাপ আমি দুই চোখে দেখতে পারি না। কিন্তু ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ আমার অসম্ভব প্রিয়। কেউ যেন মনে না করে, আমি একজন খাঁটি বোদ্ধা। ফুটবল শারীরিক খেলা, একজন খেলোয়াড় ক্রমাগত আরেকজন খেলোয়াড়ের গায়ে গা লাগিয়ে হুটোপুটি করেন বলে আমার ‘সুকুমার’ মনোবৃত্তি আহত হয়—তাই এই খেলাটি আমি দেখতে পারি না। সেই তুলনায় ক্রিকেট ভদ্র মানুষের খেলা, একজন খেলোয়াড় আরেকজন খেলোয়াড়কে স্পর্শ না করে খেলে যান, তাই আমি খেলাটি পছন্দ করি—আসলে সে রকম কিছু নয়। ফুটবলের ওয়ার্ল্ড কাপ আমি দুই চোখে দেখতে পারি না, কারণ সেই সময়টাতে আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম দেশটাতে বিদেশের পতাকা আকাশে উড়তে থাকে এবং দেখে মনে হয়, পুরো দেশটাকে বুঝি বিদেশিরা দখল করে ফেলেছে। জাতীয় পতাকা মোটেও এক টুকরো কাপড় নয়—এটা অনেক বড় রাষ্ট্রীয় ব্যাপার, ইচ্ছে করলেই একটা দেশে অন্য দেশের পতাকা তোলা যায় না। বিশেষ প্রয়োজনে যদি অন্য দেশের পতাকা তুলতে হয়, তাহলে তার আগে অনেক নিয়মকানুন মানতে হয়—অন্য দেশের পতাকা থেকে উঁচুতে নিজের দেশের পতাকাটি টাঙাতে হয়। আমি দেখেছি, আমাদের রাষ্ট্র সেই কথাগুলো কাউকে মনে করিয়ে দেয় না। দেশের মানুষ পুরোপুরি নির্বোধের মতো নিজের দেশকে অপমান করতে থাকে, কেউ সেটা নিয়ে মাথা ঘামায় না।
আমি ক্রিকেটের ওয়ার্ল্ড কাপ অসম্ভব ভালোবাসি, কারণ এই সময়টাতে সারা দেশের মানুষ লাল-সবুজ রঙের খেলায় মেতে ওঠে। এই খেলায় আমার নিজের দেশ খেলছে এবং আমরা ক্রমাগত ‘বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ’ করে চিৎকার করছি। দেশকে ভালোবাসার আর দেশকে নিয়ে গর্ব করার একটা সুযোগ করে দেয় এই ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেট খেলা। যাঁরা ক্রিকেট বোদ্ধা, তাঁরা খেলার প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করেন, আমি পারি না। আমি খেলা দেখতে পারি, যখন সেই খেলায় বাংলাদেশ জিততে থাকে, শুধু তখন! বাংলাদেশ যদি কখনো কোনো খেলায় হেরে যায়, তখন দুঃখে আমার বুক ভেঙে যায়, মনে হয় হাউমাউ করে কাঁদি।
এই দেশের মানুষেরা আজকাল লাল-সবুজ রঙের কাপড় পরে, মাথায় ফেটি বাঁধে। লাল-সবুজ আমাদের জাতীয় পতাকার রং। মার্চ মাস আসছে, আমাদের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে অসংখ্য জাতীয় পতাকা তৈরি হবে এবং আকাশে ওড়ানো হবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধ কর্নার’ বলে লাইব্রেরিতে একটি অংশকে আলাদা করে রাখা হয়েছে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রকাশিত যত বই, যত তথ্য—সবকিছু সংগ্রহ করা হচ্ছে। তার দেয়ালে ঝোলানোর জন্য আমি সবচেয়ে বড় জাতীয় পতাকাটি কিনে এনেছিলাম। সেটি ঝোলানোর সময় মেপে আমি আবিষ্কার করলাম, সেটি সঠিক মাপে তৈরি নয়। পুরোটি কেটে আমাকে নতুন করে জাতীয় পতাকা তৈরি করতে হয়েছে। এখন আমি চোখ খোলা রেখে তাকাই এবং একধরনের দুঃখ মেশানো বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করি যে বাংলাদেশে জাতীয় পতাকা নিয়েও একধরনের বিশৃঙ্খলা চলছে। যে কেউ যেকোনো মাপে জাতীয় পতাকা তৈরি করে বাজারে বিক্রি করছে, কেউ তাকে থামাচ্ছে না। জাতীয় পতাকার লাল-সবুজ রংটি সঠিক—এ ছাড়া আর কিছু সঠিক নয়। একটি সবুজ আয়তক্ষেত্রে মোটামুটি আকারের একটা লাল বৃত্ত বসিয়ে দিলেই সেটা জাতীয় পতাকা হয়ে যায় না। কিন্তু সেটাই এ দেশে ঘটছে।
অথচ জাতীয় পতাকার মাপটি মোটেও কঠিন নয়। দশ এবং ছয় এই দুটি সংখ্যা মনে রাখলেই জাতীয় পতাকার পুরো মাপটি মনে রাখা সম্ভব। জাতীয় পতাকার দৈর্ঘ্য যদি দশ ফুট হয়, তাহলে তার প্রস্থ হবে ছয় ফুট। এখন আমার জানা দরকার, লাল বৃত্তের সাইজ, দশ থেকে ছয় বিয়োগ দিলেই সেটা বের হয়ে যাবে, অর্থাৎ বৃত্তের ব্যাস হচ্ছে চার ফুট। বৃত্তটি যদি আয়তক্ষেত্রের ঠিক মাঝখানে বসানো হতো, তাহলে আর কিছুই জানতে হতো না—কিন্তু আমাদের জাতীয় পতাকার লাল বৃত্তটি পতাকা টাঙানোর দণ্ডটির দিকে একটু সরে এসেছে। কতটুকু সরে এসেছে, সেটা অনেকভাবে বের করা যায়, সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি এ রকম। বাঁ-দিকে পতাকার খুঁটি থাকলে ডান দিকে এক ফুট কাপড় ভাঁজ করে আয়তক্ষেত্রটি নয় ফুট বাই ছয় ফুট করে ফেলতে হবে। এখন বৃত্তটি বসাতে হবে এই নয় ফুট বাই ছয় ফুট আয়তক্ষেত্রের ঠিক মাঝখানে। দশ ফুট বাই ছয় ফুট সাইজের জাতীয় পতাকা না করে কেউ যদি পাঁচ ফুট বাই তিন ফুট বা আরও ছোট করতে চায়, তাহলে ঠিক একই মাপে সবকিছু কমিয়ে আনতে হবে।
আমার ইচ্ছা, রাষ্ট্র এই বিষয়গুলোতে একটুখানি নজর দিক। যে ফেরিওয়ালা জাতীয় পতাকা বিক্রি করছে, তাকে বাধ্য করুক সঠিক মাপের জাতীয় পতাকা তৈরি করতে। স্কুলের বাচ্চাদের উৎসাহ দিক লাল-সবুজ কাগজ কেটে সঠিক মাপের জাতীয় পতাকা তৈরি করতে। একটি দেশ স্বাধীন হওয়ার চল্লিশ বছর পরও আমরা সঠিক জাতীয় পতাকা খুঁজে পাব না—এটা হতে পারে না।
জাতীয় পতাকা নিয়ে আমাদের একটা চমৎকার বিষয় আছে, যেটা অন্য দেশগুলোর নেই। সেটা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন জাতীয় পতাকা। সেই পতাকার মাঝখানে সোনালি রং দিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্রটি বসানো ছিল। প্রথম দিন যখন আমি এই মানচিত্র দেখেছিলাম, তখন আমার বুকের ভেতর যেভাবে রক্ত ছলাৎ করে উঠেছিল, আমি এখনো সেটি অনুভব করতে পারি। মুক্তিযুদ্ধের সেই পতাকাটি একটু পরিবর্তন করে এখন আমরা আমাদের নতুন জাতীয় পতাকা পেয়েছি—কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সেই পতাকাটি কিন্তু হারিয়ে যায়নি। আমরা কিন্তু সেই পতাকাটিকে আমাদের হূদয়ের ভেতরে স্থান করে দিয়েছি। আমার খুব ভালো লাগে যখন দেখি, তরুণ প্রজন্ম এখনো মুক্তিযুদ্ধের পতাকাটিও সমান মমতায় নিজের কাছে রাখছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধ কর্নারে জাতীয় পতাকার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পতাকাটিও আমরা গভীর মমতায় ঝুলিয়ে রেখেছি।
গাড়িতে পতাকা লাগানোর একটি ব্যাপার আছে—শুধু মন্ত্রীরা গাড়িতে পতাকা লাগাতে পারেন। এই বিষয়টি আমি ভালো বুঝতে পারি না। জাতীয় সংগীত এবং জাতীয় পতাকার ওপরে দেশের জনগণের সবার একধরনের অধিকার আছে। জাতীয় পতাকাটিকে যথাযথ সম্মান দেখানো হলে যেকোনো মানুষের সেটি ব্যবহার করার অধিকার থাকার কথা ছিল। বিজয় দিবস কিংবা স্বাধীনতা দিবসে অনেকেই গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগিয়ে নেন, আমি দেখেছি, পুলিশ তাদের থামিয়ে পতাকা খুলে ফেলতে বাধ্য করছে! মুক্তিযুদ্ধের পতাকাটি লাগালে নিশ্চয়ই পুলিশ কিছু বলতে পারবে না।

৩.
আমাদের জাতীয় জীবনে একটি চরম লজ্জা, দুঃখ, অপমান, ক্ষোভ, ক্রোধ ও বেদনার ইতিহাস আছে। সেটি হচ্ছে, জোট সরকারের আমলে পূর্ব পাকিস্তান আলবদর বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মতিউর রহমান নিজামী এবং পূর্ব পাকিস্তান আলবদর বাহিনীর কেন্দ্রীয় সংগঠক আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের মন্ত্রী হয়ে যাওয়া। যারা এই দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে, তারা সেই দেশের জাতীয় পতাকাটি তাদের গাড়িতে লাগিয়ে এই দেশের মাটিতে ঘুরে বেড়িয়েছে—আমরা বস্ফািরিত চোখে সেটা তাকিয়ে দেখেছি। আমার মাতৃভূমির এর চেয়ে বড় অপমান আর কখনো হয়নি। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের কথা দিয়ে এ দেশের সব মানুষ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছে, ‘মা, তোর বদনখানি মলিন হলে,/ ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি’!
আমার মায়ের বদনখানি মলিন হয়েছে—যুদ্ধাপরাধীর বিচার করে আমার মায়ের বদনে আবার হাসি ফোটাতে হবে। দেশের প্রতিটি মানুষ কিন্তু নিঃশ্বাস বন্ধ করে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে।
সরকারের সেটি মনে আছে তো?

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১১

মানুষের ভালোবাসা অসাধারণ বিষয়

মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের ৫৯তম জন্মদিন উপলক্ষে ২৩ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন সিরাজুল ইসলাম আবেদ

> উচ্চ শিক্ষার জন্য পাড়ি জমালেন যুক্তরাষ্ট্রে। পড়াশোনা শেষে কর্মজীবনেও প্রবেশ করলেন সেখানেই। কিন্তু ১৯৯৪ সালে দেশে ফিরে এসে শুরু করলেন নতুন জীবন কোনো বিশেষ স্বপ্ন বা বোধ দ্বারা তাড়িত হয়েছিলেন কি?
>> অনেকেই আমাকে এই প্রশ্নটি করে এবং আমার মনে হয় আমি কাউকেই বিষয়টি বোঝাতে পারি না। ‘কোনো বিশেষ স্বপ্নবোধ দ্বারা তাড়িত হয়ে’ আমি দেশে ফিরে আসিনি, আমি দেশে ফিরে এসেছি কারণ এটা আমার দেশ। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। একজন মানুষের মা যদি সাদাসিধে অশিক্ষিতা বৃদ্ধা একজন মহিলা হয়, তখন মানুষটি কিন্তু ফিটফাট সুন্দরী কমবয়সী একজন মহিলা খুঁজে বের করে না মা ডাকার জন্য! যখন মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করে সেই সাদাসিধে অশিক্ষিতা বৃদ্ধা মহিলার কাছে গিয়েই তার পায়ের কাছে বসে থাকে। এখানেও তাই, যুক্তরাষ্ট্রের হাইফাই পরিবেশে যত ভালো ভালো বিষয়ই থাকুক সেটা তো আমার দেশ নয়। আমার যদি আকাশ কালো করে আসা মেঘ, ঝমঝম বৃষ্টি, ব্যাঙের ডাক আর কালো শ্যামলা মানুষ দেখার ইচ্ছা করে, আমি কী করব?
কাজেই আবার একবার বোঝানোর চেষ্টা করি, আমি কোনো বড় উদ্দেশ্য বা স্বপ্ন নিয়ে দেশে ফিরে আসিনি। নিজের দেশে থাকার জন্য ফিরে এসেছি। অত্যন্ত চমৎকার একটা জীবনের লোভে নিজের দেশে থাকার আনন্দটুকু হারাতে আমি রাজি নই। আমি এত বেশি বোকা না।

> দেশে ফিরে নিজের স্বপ্ন পূরণে কতটা এগোলেন?
>> যেহেতু স্বপ্ন নিয়ে আসিনি তাই স্বপ্ন পূরণ বিষয়টি আসে না। তবে দেশে ফিরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে করতে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, দিন চলতে চলতে নতুন নতুন পরিকল্পনা মাথায় এসেছে কিছু কিছু বাস্তবায়িত হয়েছে, কিছু হয়নি! সবাইকে নিয়ে এখন নতুন নতুন স্বপ্ন দেখি কিছু পূরণ হবে, কিছু হবে না। এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার করে বলে দেওয়া দরকার, স্বপ্ন পূরণ হতেই হবে সেটা কিন্তু সত্যি নয়। স্বপ্ন দেখতে হয় আর সেটার জন্য কাজ করতে হয় সেটা হচ্ছে সত্যি।

> স্বাধীনতার ৪০ বছর পর আমাদের অর্জন নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে, হতাশাও কম নেই। এমন বাস্তবতাতেও আমরা যতটুকু দেখি, আপনি অসম্ভব আশাবাদী একজন মানুষ। এবং যে তারুণ্যকে কেউ কেউ সমাজের ঘুণে ধরা অংশ হিসেবে দেখতে চান আপনার পদচারণা সেই তারুণ্যকে কেন্দ্র করে লেখালেখি বা কর্মকাণ্ড সব সময় তাদের সঙ্গে কেন?
>> আমি আলাদাভাবে যুক্তিহীন বারাবাড়ি আশাবাদী মানুষ সেটি সত্যি নয় আমি যে জীবনের ভেতর দিয়ে এসেছি সেখানে অন্য রকম কিছু হওয়াটাই অস্বাভাবিক। ১৯৭১ সালে তাড়া খাওয়া পশুর মতো ছুটে বেড়িয়েছি, একটি দিন শেষ হওয়ার পর অন্য একটা দিন শুরু হবে কি-না জানতাম না! যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর উদ্বাস্তুর মতো ঘুরে বেড়িয়েছি, রক্ষীবাহিনী বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর রাস্তায় রাত কাটিয়েছি, পরের বেলা কোথা থেকে খাবার আসবে জানতাম না, এমন দিন গিয়েছে যে, বাসায় একটা শার্ট, সেটা পরে কখনও বড় ভাই বাইরে গেছে, সে ফিরে এলে সেই শার্ট পরে আমি বাইরে গেছি। আমাদের খুব সৌভাগ্য যে, আমরা একটা অসাধারণ মা পেয়েছি, যিনি আমাদের পুরো পরিবারটাকে ধরে রেখেছেন এবং আমরা টিকে গেছি। এই দেশে সেই দুঃসময়ে অসংখ্য পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। সেই ভয়ঙ্কর পরিবেশে আমি কিংবা আমরা যারা বেঁচে এসেছি তাদের কে ভয় দেখাবে? কে হতাশ করবে? সব বুড়ো মানুষই তারুণ্যকে ঘুণে ধরা বলে। এখন যারা তরুণদের গালাগাল করেন তারা যখন কম বয়সী ছিলেন তখন তাদের বাবা-চাচারা তাদের গালাগাল করেছেন! কাজেই এগুলোকে আমি সিরিয়াসলি নিই না। আমি বিশ্বাস করি, সবার ভেতরেই একজন ভালো মানুষ থাকে, তাকে ঠিকভাবে স্পর্শ করলেই সে বের হয়ে আসে।
আমার ‘পদচারণা’ বা কর্মকাণ্ড সব সময় তারুণ্যকে কেন্দ্র করে, কারণ আমার সেটাই ভালো লাগে। একজন বুড়ো মানুষকে নতুন করে কিন্তু শেখানো যায় না কিন্তু কম বয়সী তরুণরা কিন্তু নতুন কিছু শিখতে রাজি আছে। স্বপ্ন দেখতে রাজি আছে।

> তরুণদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আপনাকে দাঁড়াতে হয়েছে; দাঁড়িয়েছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতেও হুমকি-ধমকিও শুনতে হয়েছে, নিজেকে কখনও বিপন্ন মনে হয়েছে কি?
>> না, নিজেকে কখনই বিপন্ন মনে হয়নি, প্রশ্নই ওঠে না। যখনই দুঃসময় এসেছে তখন চারপাশে আরও বেশি মানুষ এসে আরও নতুনভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। আজকাল ইন্টারনেটে তরুণরা অনেক বেশি সময় কাটায় আমি শুনেছি সেখানে কেউ যখন আমার বিরুদ্ধে [কিংবা আমার পরিবারের বিরুদ্ধে] একটা কুৎসিত কথা বলে তখন অসংখ্য তরুণ সেটাকে তাদের মতো করে প্রতিবাদ করে। মানুষের ভালোবাসা একটি অসাধারণ বিষয়, আমি সেই ভালোবাসাটুকু অনুভব করতে পারি। আমি সব সময় সৃষ্টিকর্তাকে বলি তিনি যেন আমাকে সেই শক্তিটুকু দেন যেন আমি কখনও কারও ভালোবাসার অমর্যাদা না করি।

> এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসা যাক মাত্র ৭ বছর বয়সে সায়েন্স ফিকশন লেখা দিয়ে শুরু করে ছিলেন লেখালেখি?
>> মনে হয় এটা জেনেটিক। বাবা লিখতেন, মা লেখেন, ভাইয়েরা লেখে, বোনেরাও লেখে, এখন তাদের ছেলেমেয়েরাও লেখে! আমরা বইয়ের মাঝে বড় হয়েছি, কাজেই বই পড়তে পড়তে লেখার ইচ্ছে করবে সেটাই স্বাভাবিক। পরিবারে সেটা নিয়ে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে তাই লেখালেখি করেছি। সত্যি কথা বলতে কী, লেখালেখি না করাটাই হয়তো অস্বাভাবিক হতো।
তবে লেখালেখি করে লেখক হিসেবে পরিচিতি হবে সেটা কখনোই মাথায় ছিল না, লেখালেখি করেছি মনের আনন্দে!

> দীপু নাম্বার টু’র দীপু বা কাজলের দিনরাত্রির কাজল কিংবা আমি তপু’র তপুর মধ্যে মুহম্মদ জাফর ইকবালের কৈশোরকে দেখার সুযোগ কতটুকু?
>> কিশোর উপন্যাসের প্রায় সবগুলোতেই আমার [কিংবা আমার প্রজন্মের] কৈশোরের ছাপ পাওয়া যেতে পারে। তবে ‘কাজলের দিনরাত্রি’ বা ‘আমি তপু’ একটু ব্যতিক্রম এই বই দুটির চরিত্রগুলোর যে জটিলতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে আমার জীবনে কখনোই সেই জটিলতা ছিল না!

> কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রাখছেন, সে সময় শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। আপনার বাবা যুদ্ধে গেলেন, আপনি গেলেন না?
>> আমার বাবা যে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে অস্ত্র হাতে পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন তা নয়। পুলিশ অফিসার ছিলেন, সেই হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন, যার জন্য পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে।
আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে অনেক চেষ্টা করেছিলাম, পারিনি। সবার কপালে সবকিছু থাকে না, আমার কপালে এটা ছিল না। সৃষ্টিকর্তা আমার সব ইচ্ছা পূরণ করেছেন, এটা করেননি, কেন করেননি জানি না! [কে জানত পাকিস্তানিরা এত ভীরু, কাপুরুষ আর দুর্বল যে, মাত্র নয় মাসে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাবে!]

> মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশ, ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে নতুন এক রাষ্ট্রের পথচলা এবং আপনি বিশ্ববিদ্যালয় পুড়ূয়া এক শহীদ পরিবারের সন্তান সে দিনের সংগ্রামটা বলবেন কি?
>> সেটি ছিল খুব কঠিন সময়, খানিকটা আগেই বলেছি। তখন বুঝতে পারিনি, এখন যখন পেছন ফিরে তাকাই তখন মাঝে মধ্যে অবিশ্বাস্য মনে হয় যে, কেমন করে আমরা টিকে ছিলাম। দুঃখ কষ্ট ঝামেলা দুর্বলতার কথা বলতে ভালো লাগে না, তাই সেগুলো আবার না বললাম। কিন্তু কেউ যেন মনে না করে সময়টুকু শুধু দুঃসময় ছিল একই সঙ্গে সেটি ছিল আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের মাথা তুলে দাঁড়ানোর সময়। ‘গেরিলা’ নামে যে অসাধারণ ছায়াছবিটি নাসিরুদ্দীন ইউসুফ তৈরি করেছেন তিনি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। নাসিরুদ্দীন ইউসুফের পরিচালিত, সেলিম আল দীনের লেখা নাটকে আমিও অভিনয় করেছিলাম, যেটি টিএসসিতে মঞ্চস্থ হয়েছিল। নির্মলেন্দু গুণের কবিতার বই প্রেমাংশুর রক্ত চাই প্রকাশিত হলো, আমরা মুগ্ধ হয়ে সেই কবিতাগুলো পড়তাম। শাহাদত চৌধুরীর সম্পাদিত বিচিত্রা তখন একমাত্র সাময়িকী কী আধুনিক পত্রিকা! আমার লেখা প্রথম ছোটগল্প ‘ছেলেমানুষী’ প্রকাশিত হলো গর্বে মাটিতে আমার পা পড়ে না। গান, কবিতা, ছোটগল্প, নাটক, বিজ্ঞান সবকিছু নিয়ে সত্যিকারের রেনেসাঁ।

> পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন কলাম বা নিবন্ধে সমাজ এবং রাজনীতি সচেতন একজন প্রগতিশীল জাফর ইকবালকে আমরা পাই। এসব বিষয়কে উপজীব্য করে ঔপন্যাসিক হিসেবে আপনাকে আমরা পাই না…।
>> পাবেন না! ছোট বাচ্চারা আমাকে খুন করে ফেলবে। তারা আমাকে বলেছে সবাই বড়দের জন্য লেখে, খবরদার আপনি বড়দের জন্য লিখতে পারবেন না। আমাদের দেশের সাহিত্যিকদের জন্য আমি অবশ্য একটু দুঃখ অনুভব করি, খুবই সীমিত কিছু বিষয়ে আরও সীমিত প্রকাশ ভঙ্গিতে তাদের লিখতে হয়। এই মুহূর্তে পৃথিবীর অন্য সাহিত্যিকরা যেভাবে লিখতে পারেন, তাদের যে অবিশ্বাস্য স্বাধীনতা আছে, আমাদের লেখকদের তার বিন্দুমাত্র নেই।

> আপনাদের বেড়ে ওঠা এবং বর্তমান প্রজন্মের বেড়ে ওঠা পরিবার, সমাজ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমস্যা কোথায়, যে কারণে একটা পর্যায়ে এসে তাদের অনেককেই হতাশায় পেয়ে বসছে?
>> তাই নাকি? আমি তো জানি না! যদি সত্যিই হয়ে থাকে তাহলে সম্ভবত সেটা একটা ফ্যাশন। আমি যখন ট্রেনে করে আসি এবং জানালা দিয়ে মাথা বের করে একটা কিশোর কিংবা কিশোরীকে কলা, ঝালমুড়ি, চিনা বাদাম, কিংবা খবরের কাগজ বিক্রি করতে দেখি, তাদের মাঝে বিন্দুমাত্র হতাশা দেখতে পাই না, তারা রীতিমতো যুদ্ধ করে যাচ্ছে। ভোরবেলা যখন গামেন্টের মেয়েরা হাসতে হাসতে কথা বলতে বলতে কাজ করতে যায়, তখনও আমি তাদের মাঝে কোনো হতাশা দেখি না। তারা কিন্তু সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
‘হতাশা’ নামের এই ‘বিলাসী’ শব্দটি শুধু সেই তরুণদের, যারা পরিবার সমাজ আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সব সুযোগ পেয়েছে। আমি এই দলটিকে নিয়ে সময় নষ্ট করতে চাই না। শত ঝামেলার মাঝে থেকেও যারা কখনও হতাশ হয় না, তারা হচ্ছে সমাজের আসল শক্তি_ আমি আসলে তাদের মুখ চেয়ে থাকি, তাদের জন্য কাজ করি।

> লিখলেন ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’। মাত্র ২২ পৃষ্ঠায় এত বড় একটা ক্যানভাসকে ধারণ! ভেতরের গল্পটা বলবেন?
>> ভেতরের গল্পটা সহজ। জোট সরকারের আমলের একটা শ্বাসরুদ্ধকর সময়, মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করার, অবমাননা করার সব রকম চেষ্টা চলছে। আমরা সমমনা বেশকিছু মানুষ বসেছি কী করা যায় সেটা নিয়ে কথা বলতে। অনেক সুন্দর সুন্দর পরিকল্পনা এসেছে, আমি তার মাঝে বললাম, আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। নতুন প্রজন্ম যদি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটুকু জানে তাহলে তারা দেশের জন্য যে ভালোবাসা অনুভব করবে সেটি আর অন্য কোনোভাবে সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটুকু হবে ছোট, যেন এক কাপ চা খেতে খেতে পড়ে ফেলতে পারবে, বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে পড়ে ফেলতে পারবে কিংবা দুই ক্লাসের মাঝখানে পড়ে ফেলতে পারবে। প্রতিটি লাইনের রেফারেন্স থাকবে যেন কেউ এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে। ইতিহাসটি হবে এক ফর্মার নিউজপ্রিন্টের হ্যান্ডবিলের মতো, পড়ে ফেলে দিলেও ক্ষতি নেই। মূল্য হবে খুব কম যেন পয়সা খরচ না হয়!
যারা উপস্থিত ছিলেন তারা আমার প্রস্তাবটি লুফে নিলেন, কিন্তু নিউজপ্রিন্টের হ্যান্ডবিল করতে রাজি হলেন না সেটা যেন সংগ্রহ করে রাখে সেই রূপটি দেবেন বলে ঠিক করলেন। সেই ঘরটিতে একটি কম বয়সী বাচ্চা মেয়ে ছিল, সে ইতস্তত করে বলল, ‘যদি সেই ইতিহাসটি জাফর ইকবাল স্যার লেখেন তাহলে আমাদের বয়সী ছেলেমেয়েরাও সেটা পড়ে ফেলবে।’ তার কথাটা মেনে নিয়ে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো।
এই হচ্ছে ইতিহাস। এটা লিখতে আমাকে যে পরিশ্রম করতে হয়েছে সেই পরিশ্রম করে দশটা সায়েন্স ফিকশন লেখা যেত। শেষ পর্যন্ত এক ফর্মার মাঝে আটকানো যায়নি, একটু বড় হয়ে গেছে!

> বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাওয়ার পর একাডেমী মাঠেই তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন ভালো লাগছে কিন্তু একই সঙ্গে খারাপ লাগাও আছে। আহমদ ছফাকেই এ পুরস্কার দেওয়া হয়নি? এ ব্যাপারে বলবেন?
>> তার মতো এত বড় লেখক পাননি, কিন্তু আমার মতো একজন পাতি লেখক পেয়ে গেল সেটা খুব লজ্জার বিষয়। বাংলা একাডেমীর পুরস্কার পাওয়ার পর প্রতি বছরই এই পুরস্কারের মনোনয়ন দেওয়ার জন্য আমার কাছে চিঠি পাঠানো হয়। মরণোত্তর পুরস্কার দেওয়ার প্রথা চালু করে আহমদ ছফাকে পুরস্কার দেওয়ার জন্য আমি অনেকবার প্রস্তাব দিয়েছি, আমার প্রস্তাবকে কেউ গুরুত্ব দেয়নি। আমার পুরস্কারের ব্যাপারে একটা মজার তথ্য আছে। আমাকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে ‘ভাষা ও সাহিত্যে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের’ জন্য। আমি যখন পুরস্কার পেয়েছি, তখন আমি মাত্র দুটি পাতলা জিলজিলে বিজ্ঞানের বই লিখেছি, এর জন্য কাউকে এত বড় পুরস্কার দেওয়া ঠিক নয়। আমার খুব লজ্জা লেগেছে, তাই এখন প্রতি বছরই বিজ্ঞানের ওপর লিখতে চেষ্টা করি যেন পুরস্কারটা হালাল হয়।
আরও একটা বিষয় হয়তো বলা যায়, আগে জানতাম না এখন টের পেয়েছি পুরস্কার পাওয়ার জন্য অনেক লেখক নিজেরাই অনেক ধরাধরি করেন, সেটা দেখে আমার খুব অস্বস্তি হয়। অনেক বড় লেখক যেহেতু এই পুরস্কার পাননি তাই এই পুরস্কার না পাওয়াটাই তো অনেক সময় সম্মানজনক।
> আমরা অনেক কিছুতেই প্রভাবিত হই_ ব্যক্তি, বিষয়, ঘটনা। আপনার জীবনে তেমন কিছু আছে কি?
>> অবশ্যই আছে, অনেক কিছুই আছে। সেই ঘটনাগুলো আমি আমার লেখালেখিতে উল্লেখও করেছি। যেহেতু এই মুহূর্তে লেখালেখি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সেই বিষয়েই বলি।
জাহানারা ইমাম নিউইয়র্ক গেছেন, আমার তার সঙ্গে খুব পরিচিত হওয়ার শখ। আমি তাই খুব কুণ্ঠিতভাবে তার কাছে গিয়ে বললাম, ‘আপনি আমাকে চিনবেন না, আমার বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের খুব বড় লেখক, আমি তার ছোটভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল।’
জাহানারা ইমাম আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি তোমাকেও চিনি। আমি তোমার সায়েন্স ফিকশন কপোট্রনিক সুখ দুঃখ পরেছি’ তারপর আমার লেখালেখি নিয়ে খুব দয়ার্দ্র কিছু কথা বললেন। শুনে আমি একেবারে হকচকিয়ে গেলাম।
আমি তখন আমেরিকায় থাকি। দুই-চারটা বই দেশে ছাপা হয়েছে, সেগুলো আমার হাত পর্যন্ত পেঁৗছায় না, দেখতে কেমন, পড়তে কেমন জানি না। কেউ পড়ছে কি-না তাও জানি না। জাহানারা ইমামের কথা শুনে আমার ভেতরে ম্যাজিকের মতো কিছু একটা ঘটে গেল, আমার মনে হলো তার মতো একজন মানুষ যদি আগ্রহ নিয়ে আমার বই পড়ে থাকেন তাহলে এখন থেকে আমি নিয়মিতভাবে লিখব।
সেই থেকে আমি নিয়মিতভাবে লিখে আসছি। সব দায়দায়িত্ব শহীদ জননী জাহানারা ইমামের।

> নিজের কোন পরিচয় ভালো লাগে?
>> শিক্ষক।

> আপনার নিজের রচনার মধ্যে কোনগুলো আপনার প্রিয়?
>> আমি ঠিক জানি না এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব কি-না! আমার স্মৃতি খুব দুর্বল, তাই আগে কী লিখেছি মনে থাকে না। [খুব আশঙ্কা আছে, আগে লেখা কোনো একটা কাহিনী আবার লিখে ফেলব!] কিছুদিন আগে হঠাৎ করে আমার পুরনো একটা বই পড়তে পড়তে মনে হলো, ‘আরে, ভালোই তো লিখেছিলাম!’ কাজেই বলা যেতে পারে, যে লেখালেখিগুলো আমি ভুলে গেছি সেগুলো যথেষ্ঠ প্রিয়।

> নিজের লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
>> আমাদের বাচ্চাদের বিজ্ঞান এবং গণিতের পাঠ্যবইগুলোর ভাষা খুবই কটমটে বিজ্ঞানের সহজ বিষয়গুলোও জটিল করে লেখা হয়। আমার দুটি ইচ্ছা এবং পরিকল্পনার একটি হচ্ছে তাদের জন্য সহজ ভাষায় বিজ্ঞানের বইগুলো লিখে দেওয়া। [কাজ শুরু করেছি!]

> পরিণত পাঠকদের জন্য লিখতে আপনার দ্বিধা কেন?
>> আমার কোনো দ্বিধা নেই, ভয় আছে। ছোট বাচ্চারা তাহলে আমাকে খুন করে ফেলবে। তারা যদি আমাকে অনুমতি দেয় তাহলে মুক্তিযুদ্ধের ওপর আমার একটা বড় উপন্যাস লেখার ইচ্ছা আছে। এটি হচ্ছে আমার জীবনের দ্বিতীয় ইচ্ছা। এটা যদি শেষ করতে পারি তাহলে আমি মনে করব আমার দায়িত্বের একটা ধাপ শেষ হলো। তখন পরের ধাপ নিয়ে কাজ শুরু করব।

> আপনার প্রিয় লেখক কারা?
>> এই প্রশ্নেরও মনে হয় উত্তর নেই। লেখকদের নাম বলে শেষ করা যাবে না। কোনো কোনো লেখক হয়তো শৈশবে বা কৈশোরে খুব প্রিয় ছিলেন, এখন বড় হয় গেছি বলে তার লেখা পড়ি না, কিন্তু আমার প্রিয় লেখকের তালিকায় অবশ্যই তার নাম থাকতে হবে। আবার এই মুহূর্তে যে লেখকের লেখা খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ছি তার নামটিও থাকতে হবে, কাজেই তালিকাটি শেষ করতে পারব না। তবে প্রিয় কবির বেলায় কাজটি খুব সহজ। আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ। আগে সবসময় আমার ব্যাকপেকে তার একটা বই থাকত, এখন আমি আমার ই-বুক রিড়ারে তার বই রাখি! [যারা ই-বুক রিডার বলতে কী বোঝায় জানেন না তাদের জন্য বলছি : পৃথিবীতে বই প্রকাশনার যুগে একটা বিপ্লব ঘটেছে, মানুষ আজকাল কাগজের বই না পড়ে ই-বুক রিডারে বই পড়া শুরু করেছে। এর মাঝে সেটা প্রায় বইয়ের মতো হয়ে গেছে, একটু অভ্যাস হয়ে গেলে কোনো সমস্যাই হয় না। শরহফষব একটি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ড, তাদের ই-বুক রিডার থেকে যে কোনো সময় যে কোনো বই কিনে এক মিনিটের মাঝে পড়তে শুরু করা যায়। আগে বই কিনে রাখতাম পরে পড়ব বলে, পড়া হতো না। এখন বই কিনি আর পড়ি। কী মজা!]

> কোন কোন লেখকের লেখায় অনুপ্রাণিত হয়েছেন?
>> যার লেখাই পড়ে আনন্দ পেয়েছি তার লেখাতেই অনুপ্রাণিত হয়েছি। একটি বই যদি আলাদা করে উল্লেখ করতে হয় তাহলে সেটা মার্ক টোয়েনের লেখা টম সয়ার। কৈশোরে সেই বই পড়ে আমার মাথা ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল সেই থেকে আমি তার মতো করে লেখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

> সমকালের পক্ষ থেকে আপনাকে ৫৯তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
>> দিলেন তো মনে করিয়ে। মনে ছিল না ভালোই ছিলাম! এই বয়সে কে জন্মদিনের কথা মনে করতে চায়?

সূত্র: দৈনিক সমকাল
ডিসেম্বর ২৩, ২০১১

মায়েদের জন্য ভালোবাসা

বহু বছর আগে আমি যখন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম তখন আমার ছেলেমেয়েরা খুব ছোট। তারা তাদের স্কুলটাকে খুব পছন্দ করত। তার কারণ সেখানে লেখাপড়া ছাড়া আরও অনেক কিছু হতো। যে রকম মে মাস এলেই স্কুলের সব বাচ্চা খুব উৎসাহ নিয়ে তাদের মায়েদের জন্য কোনো একটা উপহার তৈরি করা শুরু করত। মে মাসের ১১ তারিখ ‘মা দিবস’। সেদিন বাচ্চারা রীতিমতো হইচই করে মায়ের হাতে সেটা তুলে দিত! (বাবা দিবস মনে হয় ষড়যন্ত্র করে জুন মাসে রাখা হয়েছে−তত দিনে স্কুল ছুটি হয়ে যায় বাবার জন্য আর উপহার তৈরি হয় না!)

ব্যাপারটাতে খানিকটা ছেলেমানুষি আছে, কিন্তু আমার মনে হয়, এই ছেলেমানুষিটুকু খুবই দরকার। ছাগল বা গরুর বাচ্চা জন্ন হওয়ার পরই তিড়িং-বিড়িং করে লাফাতে থাকে, কিন্তু মানুষের বাচ্চার মতো অসহায় হয়ে আর কেউ জন্ন নেয় না। মায়েরা সেই অসহায় বাচ্চাকে বুকে ধরে মানুষ করেন বলে পৃথিবীতে এখন ছয় বিলিয়ন মানুষ! (এই ছয় বিলিয়ন মানুষের মধ্যে একজনও নেই যাকে কোনো একজন মা পেটে ধরেননি!) পৃথিবীর এই সভ্যতার একেবারে গোড়ার ব্যাপারটা হচ্ছে সন্তানের জন্য ভালোবাসা। অন্যসব ভালোবাসা থেকে এই ভালোবাসা অনেক বেশি খাঁটি আর গভীর এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কাব্যগাথা তৈরি হয়েছে মায়েদের নিয়ে। কোনো কিছুর জন্য আমাদের ভালোবাসা গভীর হলে কোনো না কোনোভাবে সেখানে আমরা ‘মা’ কথাটি জুড়ে দিই। তাই নিজের দেশকে বলি মাতৃভুমি, মুখের ভাষাকে বলি মাতৃভাষা! নিজেদের সভ্য হিসেবে পরিচয় দিতে হলে সবার আগে দেখি মায়েদের আমরা কতটুকু সম্মান করি, সেই ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি মায়ের পায়ের নিচে হচ্ছে বেহেশত!

নারী উন্নয়ন নীতিমালা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ করে আমাদের কিছু আলেম-ওলামা বলে বসেছেন, আমি যদি পুরুষ মানুষ হয়ে থাকি তাহলে আমার মা যেহেতু একজন মহিলা তিনি আমার থেকে নিচু স্তরের মানুষ। পত্রিকায় ছাপা হওয়া সেই খবর আমাকে কয়েকবার পড়তে হয়েছে বিশ্বাস করার জন্য যে সত্যিই এই কথাগুলো আলেম-ওলামারা বলেছেন। আলেম-ওলামাদের এ রকম একটা কথা বলার কোনো পরিকল্পনা ছিল না, আমাদের চারজন উপদেষ্টা নারী উন্নয়ন নীতিমালাটি এই আলেম-ওলামাদের হাতে তুলে দিয়ে তাঁরা যেন এই কথাগুলো বলতে পারেন তার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তাঁরা শুধু এই কথাটি বলেননি, ধর্মের দোহাই দিয়ে নারী উন্নয়ননীতির এমন সব পরিবর্তনের কথা বলেছেন যে সেই পরিবর্তন করা হলে এই নারী উন্নয়ননীতিকে আর ‘নারী উন্নয়ন নীতি’ বলা যাবে না, এটাকে ‘পুরুষের ঔদ্ধত্যের নীতি’ বা এই ধরনের নতুন কোনো একটা নাম দিয়ে চালাতে হবে।

যেসব মানুষ নারীদের সম্পর্কে অসম্মানজনক কথা বলছেন তাঁরা যদি এই পৃথিবীর জ্ঞান-বিজ্ঞানের একটু খবর রাখতেন তাহলে তাঁরা মুখ ফুটে এ ধরনের কথা বলতে সাহস পেতেন না। পৃথিবীতে টিকে থাকাটা যদি কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে থাকে তাহলে নারীদের তুলনায় পুরুষেরা রীতিমতো বিপদগ্রস্ত গোষ্ঠী! বিজ্ঞানের এমন একটা পর্যায় এখন এসেছে যে প্রায় রুটিন মাফিক স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্লোন করা শুরু হয়েছে। নানা রকম আইন-কানুন করে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে, তা না হলে মানুষের ক্লোন করা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। যখন ক্লোন করা ডাল-ভাতের মতো হয়ে যাবে, তখন পৃথিবীর মেয়েরা যদি কোনো কারণে বিরক্ত হয়ে পুরুষদের পরিত্যাগ করে তাহলে এক প্রজন্ন পরই পৃথিবীতে আর কোনো পুরুষ থাকবে না, মেয়েরা কিন্তু নিজেদের ক্লোন করে দিব্যি পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে!

নারী বড় না পুরুষ বড়−স্কুলের ছেলেমেয়েদের মতো আমি মোটেও সেই বিতর্ক শুরু করতে যাচ্ছি না! যে জিনিসটা আমাদের মনে রাখতে হবে সেটা হচ্ছে নারী আর পুরুষ ভিন্ন দুটি প্রজাতি নয়−দুজনই মানুষ। পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে দুজনেরই একই অধিকার কেউ যদি বলে একজনের অধিকার বেশি অন্যের অধিকার কম তাহলে তার থেকে অন্যায় কথা আর কিছু হতে পারে না। মানুষ হয়ে অন্য মানুষকে তার অধিকার না দেওয়ার মতো বড় অপরাধ আর কী হতে পারে?

২.
১৯৯৭ সালে প্রথমবার জাতীয় নারী উন্নয়ননীতি ঘোষণা করা হয়েছিল। নারী আর পুরুষের মধ্যে পার্থক্য দুর করে জাতীয় জীবনে তাদের মোটামুটি এক জায়গায় নিয়ে আসার বিভিন্ন কৌশল এই নারী উন্নয়ননীতিতে ছিল। সেই নারী উন্নয়ননীতিটি সে সময়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, সংস্থা, নারী অধিকার সংগঠন এবং নানা ধরনের বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনের মাঝে আলাপ-আলোচনার সুযোগ ছিল বলে সবার মধ্যে এক ধরনের প্রত্যাশা ছিল। সেই নারীনীতিতে উত্তরাধিকারের বেলাতেও নারী এবং পুরুষের সমান অধিকারের কথাও বলা হয়েছিল। (মজার ব্যাপার হচ্ছে−এখন প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার করে ইসলামি দলগুলো নারী উন্নয়ননীতির নামে একটা হাঙ্গামা শুরু করলেও তখন সে রকম কিছু করেছিল বলে মনে পড়ে না!)

’৯৭-এর নারী উন্নয়ননীতি এই দেশের মানুষ বেশি দিন দেখতে পায়নি। কারণ জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর এক দিন রাতের অন্ধকারে সেই নারীনীতি পরিবর্তন করে ফেলা হলো! বলা হয়ে থাকে সেই পরিবর্তনটুকু করেছে জোট সরকারের শরিক জামায়াতে ইসলামী এবং সেই পরিবর্তনের কথা প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কিংবা আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ দুরে, মহিলা আর শিশু বিষয়কমন্ত্রী খুরশিদ জাহান হকও জানতেন না! পুরোপুরি জামায়াতে ইসলামী কায়দায় পরিবর্তনগুলো করার কারণে সেই দলিলটি তখন আর ‘নারী উন্নয়ননীতি’ থাকল না, বরং হয়ে গেল ‘নারী ঠেকাও নীতি’। পরিবর্তন করা হয়েছিল ২০০৪ সালের মে মাসের মাঝামাঝি, দেশের মানুষ সেটা জানতে পারল ২০০৫ সালের প্রথম দিকে! জানামাত্রই সঙ্গে সঙ্গে সবাই এই নারী ঠেকাও নীতি প্রত্যাখ্যান করে সবাই ১৯৯৭ সালের নারী উন্নয়ননীতি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি করতে শুরু করল।

শেষ পর্যন্ত এই বছর বিশ্ব নারী দিবসে প্রধান উপদেষ্টা নারী উন্নয়ননীতি ২০০৮ ঘোষণা করলেন। উত্তরাধিকারের কথাটি নেই, তবুও সবাই প্রাথমিকভাবে একটু সতর্ক হয়ে সেটাকে স্বাগত জানাল, কারণ এর মধ্যে কিছু নতুন বিষয় এসেছে (যেমন−পাঁচ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি, জাতীয় সংসদে বর্ধিত আসনের পরিবর্তে এক-তৃতীয়াংশ আসনে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচন, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কোটা বাড়ানো ইত্যাদি)! বলা যেতে পারে, এটা ১৯৯৭ সালের নারী উন্নয়ননীতির পুনর্বিন্যাস।

এ পর্যন্ত ঠিক ছিল, কিন্তু এর পরে যা ঘটল তার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিল না! ধর্ম ব্যবসায়ী দলগুলো রুটিনমাফিক তাদের চেঁচামেচি শুরু করে দিল এবং সঙ্গে সঙ্গে সরকারের চরজন উপদেষ্টা এই নারীনীতি পর্যালোচনা করার জন্য এমন একটা কমিটির হাতে তুলে দিলেন, যাঁরা আজীবন প্রগতিশীল কাজের বিরোধিতা করে এসেছেন, আজীবন নারীদের সব ধরনের উন্নয়নে বাধা দিয়ে এসেছেন। ‘আলেম-ওলামা’দের এই কমিটিতে কোনো মহিলা নেই। বাংলাদেশে ১৪ কোটি মানুষের মধ্যে সাত কোটি মহিলা−এই সাত কোটি মহিলার মধ্যে একজন মহিলাও নেই, যিনি ধর্ম সম্পর্কে জানেন? যিনি এই আলেম-ওলামাদের সঙ্গে বসে ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এটা পর্যালোচনা করতে পারেন? নারী উন্নয়ননীতি−কিন্তু সেটা পর্যালোচনা করবে কিছু নারীবিদ্বেষী পুরুষ, এটা কোন ধরনের যুক্তি? সবচেয়ে মজার কথা হচ্ছে, এই নারী উন্নয়ননীতিতে কিন্তু এ ধরনের ব্যাপার যেন না ঘটে সেটা নিয়েও সতর্ক করে দেওয়া আছে। ৩.৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘স্থানীয় বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোনো ধর্মের, কোনো অনুশাসনের ভুল ব্যাখ্যার ভিত্তিতে নারীস্বার্থের পরিপন্থী এবং প্রচলিত আইনবিরোধী কোনো বক্তব্য বা অনুরূপ কাজ করা বা কোনো উদ্যোগ না নেওয়া’। অথচ ঠিক এ কাজটিই করা হলো, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে নারীস্বার্থের পরিপন্থী একটা উদ্যোগ নেওয়ার জন্য কিছু আলেম-ওলামাকে সুযোগ করে দেওয়া হলো−এর চেয়ে উৎকট রসিকতা আর কী হতে পারে?
বর্তমান সরকার বিচ্ছিন্ন কয়েকজন মানুষের সরকার−আমরা আগেও দেখেছি, হঠাৎ করে উপদেষ্টাদের চাকরি চলে যায়! এ রকম অবস্থায় অন্য কিছু না হোক নিজের চাকরির জন্য মায়ার কারণেও তো তাঁদের আরও একটু সতর্ক থাকার কথা−তাঁরা কোন যুক্তিতে এ রকম দায়িত্বহীন একটা কাজ করলেন? সে জন্য তাঁদের কি কখনো দেশের মানুষ ক্ষমা করবে?

৩.
জাতীয় নারী উন্নয়ননীতি ২০০৮ আসলে খুব ছোট একটা দলিল−সুচিপত্রটুকু ছেড়ে দিলে মাত্র ১৯ পৃষ্ঠা। সব মিলিয়ে এখানে পাঁচটা অধ্যায়। কোন অধ্যায় কী নিয়ে সেটা সহজে বোঝা যায় না, কারণ অধ্যায়গুলোর কোনো শিরোনাম নেই; ভেতরের বিষয়গুলো দেখে অনুমান করে নিতে হয়। প্রথম অধ্যায়টি হচ্ছে ভুমিকা, সুচনা পর্ব ও পূর্ব ইতিহাস। দ্বিতীয় অধ্যায় হচ্ছে উন্নয়ননীতির লক্ষ্য। আমার কাছে যে কপিটি আছে সেটা দেখে মনে হলো, এত গুরুত্বপূর্ণ একটা দলিল, কিন্তু এর পরিবেশনাটুকু একটু অগোছালো। এ অধ্যায়ের ১৯টি লক্ষ্যের ক্রমিকসংখ্যাগুলো দেখে বোঝা যায়, নারী উন্নয়ননীতির অন্যান্য অংশের সঙ্গে মিল রেখে এর ক্রমিকসংখ্যা হওয়া উচিত ছিল ২.১ থেকে ২.১৯, কিন্তু লেখা হয়েছে ১.১ থেকে ১.১৯। ফলে এ দলিলটিতে ১.১ থেকে ১.৬ ধারা রয়েছে দুবার এবং বর্ণনা করছে দুটি ভিন্ন বিষয়। তৃতীয় অধ্যায়টি হচ্ছে নারী উন্নয়ননীতির একেবারে মূল বিষয়টি−দ্বিতীয় অধ্যায়ে যে লক্ষ্যগুলো ঠিক করা হয়েছিল সেগুলো বস্তবায়ন করার জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় তার তালিকা। নারী উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সব বিষয়ই সেখানে আছে, যেমন বলা আছে বৈষম্য কিংবা নির্যাতন কীভাবে দুর করা যাবে। কীভাবে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক অধিকার দেওয়া যাবে এবং সবশেষে শিক্ষা-দীক্ষা প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি দিয়ে জীবনের মান বাড়াতে হবে।

এই দলিলের চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায় হচ্ছে এই উন্নয়ননীতির বাস্তবায়নের কৌশল, কর্মপরিকল্পনা, অর্থায়ন−এসব বিষয় নিয়ে।

এই নারী উন্নয়ন নীতিমালাটি পড়ার সময় ঘুণাক্ষরেও কারও মনে হবে না যে এখানে বিরোধিতা করার মতো একটি অক্ষরও আছে। মজার ব্যাপার যে ‘আলেম-ওলামারা’ তার পরও এই নারী উন্নয়ন নীতিমালা বিরোধিতা করার মাল-মসলা পেয়ে গেছেন। এটি একেবারে অবিশ্বাস্য, যে বিষয়গুলো আমরা সভ্য মানুষের পরিচয় হিসেবে দেখি তাঁরা সেই বিষয়গুলোরই বিরোধিতা করেছেন, আর সবচেয়ে ভয়ের কথা তাঁরা সেটা করছেন ধর্মের নাম দিয়ে। মোটামুটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এই দেশের যেসব সত্যিকারের ধর্মপ্রাণ মানুষ আছেন তাঁরা এই আলেম-ওলামাদের প্রতিক্রিয়া দেখে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেছেন, তাঁরা কখনো কল্পনাও করেননি তাঁদের ধর্মকে এ রকমভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব!

কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যায়, এই আলেম-ওলামারা বাচ্চার পরিচয় দেওয়ার বেলায় বাবার নাম দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মায়ের নাম দেওয়ার বিরুদ্ধে! যে মা নয় মাস তাঁর সন্তানকে পেটে ধরে জন্ন দেন, বুক আগলে রক্ষা করেন, সেই মায়ের নাম সন্তানের পরিচয় দেওয়ার সময় লেখা যাবে না−এ রকম কথা কি কোনো সভ্য মানুষ মুখ দিয়ে উচ্চারণ করতে পারেন!

সারা পৃথিবী অনেক চেষ্টা করে বাল্যবিবাহ থেকে সরে আসার চেষ্টা করছে। এর কী ভয়াবহ ফল হতে পারে সেটি একটা ছোট বাচ্চাও জানে (খবরের কাগজে দেখেছি স্কুলের বান্ধবীকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে খবর পেয়ে ক্লাসের অন্য সবাই মিলে সেটাকে ঠেকিয়ে দিয়েছে)। আমাদের কপাল−এই দেশের আলেম-ওলামারা সেটা জানেন না, তাঁরা বাল্যবিবাহের বিরোধিতা করতে নারাজ! বাইরের জগৎ যখন এই কথা শুনবে তখন আমরা মুখ দেখাব কেমন করে?

আলেম-ওলামারা এই নারী উন্নয়ননীতির যে ধারাগুলোর বিরোধিতা করেছেন, সেগুলো দেখে এই দেশের নারীরা একটু মুচকি হাসতেও পারেন! সম্ভবত, তাঁরা নারীদের রীতিমতো ভয় পান, মনে হয় নারীদের ক্ষমতায়ন হয়ে যাবে এই বিষয়টি তাঁদের কাছে রীতিমতো আতঙ্কের একটা বিষয়! তারা যেন কোনোভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা না পেয়ে যায়, অর্থনৈতিকভাবে মুক্ত না হয়ে যায়, সম্পদের অধিকার না পেয়ে যায় সেটাই তাঁদের একমাত্র দুর্ভাবনা। তাঁরা কোটা প্রথারও বিরুদ্ধে, কারণ তাহলে মেয়েরা তাদের ক্ষমতায়নে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে−কিন্তু সেই কথাটা তাঁদের মুখ ফুটে বলার সাহস নেই! তাঁরা বলেন, ‘কোটা প্রথা নারীর জন্য অমর্যাদাকর।’ মজার কথা হচ্ছে তারা কিন্তু সরাসরি ঘোষণা দিয়েছেন, নারীর মর্যাদা পুরুষ থেকে কম−এই ঘোষণায় তাদের যে অমর্যাদা করা হলো সেই কথাটি একবারও তাঁদের মাথায় আসেনি!

৪.
এই দেশের সাত কোটি মানুষ হচ্ছে মহিলা। যারা নারী উন্নয়ননীতির বিরোধিতা করছেন তাঁদের মনে রাখতে হবে তাঁরা এই দেশের এক-দুজন নয় সাত কোটি মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করার সর্বনাশা খেলায় মেতে উঠেছেন। জেনে হোক না জেনে হোক তাঁদের কর্মকান্ড দিয়ে তাঁরা বাংলাদেশের মেয়েদের মনে ধর্ম নিয়ে একটা প্রশ্ন তৈরি করে দিচ্ছেন। এই মেয়েদের অনেকেই দেখেছে তারা নিজেদের কর্মক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। অনেক ক্ষেত্রে তারা তাদের ওপরে, তাহলে কেন তাদের পুরুষের নিচে স্থান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে, সেটা তারা কিছুতেই বুঝতে পারছে না। তাঁরা যে ধর্মের কথা বলে মেয়েদের ঘরের ভেতর আটকে রাখতে চাইছেন, সেই ধর্মের যে তাঁরা অনেক বড় একটা ক্ষতি করার চেষ্টা করছেন, সেটা কি তাঁরা জানেন?
নারী উন্নয়ননীতি আসলে মোটেও শুধু নারীদের ব্যাপার নয়। এটা আমাদের সবার ব্যাপার, তাই নারী উন্নয়নের জন্য শুধু নারী আর নারী সংগঠনের সদস্যরা কথা বলবেন সেটাও হতে পারে না। যখন দেখব নারীদের অধিকার দেওয়া হচ্ছে না তখন বুঝতে হবে আমাদের কারও অধিকার দেওয়া হচ্ছে না। সেই অধিকার আদায় করার জন্য শুধু নারীদের নয় আমাদেরও পথে নামতে হবে।

আমাদের দেশের নারীদের সংগ্রামের এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এই নারী উন্নয়ননীতি নিয়ে যদি আবার সংগ্রাম করতে হয় তাহলে সেই সংগ্রামে শুধু নারীরা থাকবে না, সেখানে পুরুষেরাও থাকবে।

শুধু মায়েরা থাকবে না, মায়ের পাশে সন্তানেরাও থাকবে। বিশ্ব মা দিবসে বাংলাদেশের সব মায়ের জন্য ভালোবাসা এবং ভালোবাসা।

যারা এসএসসি দিয়েছে…

আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যাপারটি হচ্ছে এসএসসি পরীক্ষা। আমি আমার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ভুলে বসে আছি, কিন্তু এসএসসি পরীক্ষার দিনগুলোর কথা এখনো ভুলিনি! পরীক্ষা না যেটুকু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সব খবরের কাগজে হাস্যোজ্জ্বল ছেলেমেয়েদের ছবি ছাপা হবে, তারা একজন আরেকজনকে জড়াজড়ি করে ধরে, দুই আঙুল দিয়ে ‘ভি’ তৈরি করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে—দেখেই আমাদের মন ভালো হয়ে যায়। ছেলেমেয়েদের হাসিগুলো আমাদের মুখে ফুটে ওঠে, মনে হয়, তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে একটু আদর করে দিয়ে আসি।
যেদিন এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়, তার পরদিন খবরের কাগজটির পৃষ্ঠা ওল্টানোর সময় আমার বুক দুরু দুরু করতে থাকে। প্রথম পৃষ্ঠায় ছেলেমেয়েদের হাস্যোজ্জ্বল মুখের ছবির পাশাপাশি আরও একটি ব্যাপার ঘটে, সেটি হচ্ছে আশাভঙ্গের বেদনা। সেই খবরগুলো খবরের কাগজে আসে না, আমরা তাই জানতে পারি না। আশাভঙ্গের কারণে কোনো ছেলে বা মেয়ে যখন ভয়ানক কিছু করে ফেলে, তখন সেটি খবরের কাগজে চলে আসে, সেগুলো দেখে আমার বুক ভেঙে যেতে চায়, নিজেদের অপরাধী মনে হয়। বেশ কয়েক বছর আগে খবরের কাগজে ফুটফুটে একটি মেয়ের ছবি দিয়ে তার বাবা-মায়েরা একটা বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে ছিলেন। এসএসসির রেজাল্ট হওয়ার পর মেয়েটি মন খারাপ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে, বাবা-মা কাতর-কণ্ঠে সেই মেয়েটিকে বাড়ি ফিরে আসার জন্য অনুনয় করছেন। বিজ্ঞাপনটি কেটে সেটি আমি অনেক দিন পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি, মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে, ফোন করে বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করি মেয়েটি ফিরে এসেছে কি না। শেষ পর্যন্ত সাহস করে ফোন করতে পারিনি, যদি শুনি তাঁরা বলেন মেয়েটি আর ফিরে আসেনি, চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে, তখন আমি কী করব।
কখনো কখনো আরও ভয়ংকর ব্যাপার ঘটে, পরীক্ষার রেজাল্ট হওয়ার পর একটি ছেলে বা মেয়ে আশাহত হয়ে আত্মহত্যা করে ফেলে। কী সর্বনাশ! আমি তখন নিঃশ্বাস বন্ধ করে সেই খবরটির দিকে তাকিয়ে থাকি, নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারি না। এবার এসএসসি পরীক্ষা চলার সময় হঠাৎ আমার কাছে একটি এসএমএস এসেছে, সেখানে লেখা পদার্থবিজ্ঞানের প্রশ্ন কঠিন হয়েছে, পরীক্ষা খারাপ হওয়ার জন্য একজন আত্মহত্যা করেছে।
সবার নিশ্চয়ই মনে আছে, মাঝখানে একটা সময় গেছে যখন প্রতিদিনই কেউ না কেউ আত্মহত্যা করছে—সবাই কম বয়সী মেয়ে। বাবা-মা বৈশাখী মেলায় নিয়ে যাননি বলে আত্মহত্যা, মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে আত্মহত্যা, বখাটে ছেলে রাস্তায় টিটকারি দিয়েছে বলে আত্মহত্যা, ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে মন কষাকষি হয়েছে বলে আত্মহত্যা। আমরা প্রতিদিন খবরের কাগজ খুলে দেখি আর চমকে চমকে উঠি।
আমার কাছে বিষয়টা অনেক বেশি বেদনাদায়ক ছিল, কারণ ঠিক সেই সময় আমার একজন ছাত্রী গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শাওয়ারের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেছিল। একেবারে ফার্স্ট ইয়ারের ফার্স্ট সেমিস্টারের বাচ্চা একটি মেয়ে। হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল। নিজের হাতে নিজের জীবনটা নেওয়ার ৩০ মিনিট আগেও সে জানত না, এ রকম ভয়ংকর একটা কাণ্ড সে করে ফেলবে। গভীর রাতে টেলিফোনে খবর পেয়ে মেয়েদের হোস্টেলে গিয়ে আমার প্রিয় মেয়েটির প্রাণহীন নিথর দেহটিকে বাথরুমের শাওয়ারের সঙ্গে ঝুলতে থাকার দৃশ্যটি যে কী ভয়ংকর রকম হূদয়বিদারক, সেটি অন্য কেউ বুঝতে পারবে না। শুধু মনে হয়, আহা, মেয়েটি গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলে যাওয়ার আগে যদি শুধু একবার আমাকে ফোন করে বলত, স্যার আমার বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে, রাগে-দুঃখে-অপমানে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে—তাহলে হয়তো আমি এই বাচ্চা মেয়েটিকে বলতে পারতাম, তোমার জীবন তোমার একার নয়। তোমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তোমার আপনজনের জীবন—স্বার্থপরের মতো নিজের জীবনটুকু নিয়ে তোমার আপনজনকে তুমি কষ্ট দিতে পারো না! তাকে আমি আরও অনেক কিছু বলতে পারতাম, আগে আমার কাছে যখন লেখাপড়ার কথা বলতে এসেছে, তখন আমি তাকে যেভাবে উৎসাহ দিয়েছি, তার থেকে একশ গুণ বেশি উৎসাহ দিতে পারতাম। কিন্তু বাচ্চা মেয়েটি আমার সঙ্গে কথা বলেনি, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কথা বলেনি, বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলেনি, মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শাওয়ার থেকে ঝুলে পড়েছে।
আমি এখনো ক্লাস নেওয়ার সময় ভুল করে তার রোল নম্বর ডেকে ফেলি, তখন মনে পড়ে এই রোল নম্বর থেকে আমার ছাত্রীটি আর কখনো উত্তর দেবে না। একজন শিক্ষকের জীবনে এর চেয়ে দুঃখের ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না।

২.
টিন-এজ বয়সটা খুব জটিল একটা সময়। আমরা সবাই সেই সময়টা পার হয়ে এসেছি এবং আমাদের সবারই নিশ্চয়ই সেই সময়টার কথা মনে আছে। পরিচিত পৃথিবীটা তখন অন্য রকম মনে হতো—তখন বুকের ভেতর থাকত তীব্র আবেগ। সহজ বিষয়টাকে মনে হয় জটিল, জটিল বিষয়টাকে মনে হয় দুর্বোধ্য। শরীরে নতুন নতুন হরমোন খেলা করতে শুরু করেছে, সেই হরমোন আমাদের চিন্তার জগৎকে পাল্টে দিচ্ছে। আমরা সবাই সেই জটিল সময়টা পার হয়ে আসতে পেরেছি, কারণ আমাদের চারপাশে থাকত পরিবারের আপনজন। মনের কথা বলার জন্য থাকত বন্ধুবান্ধব, কাজকর্মে ব্যস্ত থাকার জন্য থাকত লেখাপড়ার দায়িত্ব, শরীরের প্রাণশক্তি বের করার জন্য থাকত খেলার মাঠ। টিন-এজ সময়ের সেই জটিল মাইনফিল্ডে সাবধানে পা ফেলে ফেলে আমরা বের হয়ে এসেছি।
সবাই বের হতে পারে না, জটিল ধাঁধায় আটকা পড়ে যায়। সারা পৃথিবীর পরিসংখ্যান নিয়ে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করে টিন-এজ ছেলেমেয়েরা। আমাদের বাংলাদেশের কোনো পরিসংখ্যান আমি খুঁজে পাইনি, কিন্তু পৃথিবীর পরিসংখ্যান অনুযায়ী এটি হচ্ছে এই বয়সী ছেলেমেয়েদের অপমৃত্যুর বড় কারণগুলোর একটি। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখে—এই বয়সী ছেলেমেয়েদের জীবনটাকে সহজ করার জন্য তাদের অনেক রকম পরিকল্পনা থাকে—আমাদের সে রকম কিছু নেই, আমরা শুধু কমন সেন্স দিয়ে এগুলো সমাধান করার চেষ্টা করি। আমি যখন বাংলাদেশে প্রথম এসে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছি, তখন একজন ছাত্রের খোঁজ পেলাম যে একাধিকবার ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। আমি তাকে ডেকে পাঠিয়েছি, তার সঙ্গে কথা বলেছি। সে তখন মাথা নিচু করে কাতর-কণ্ঠে বলেছে, ‘আমি জানি না স্যার, আমি কী করব, আমার মাঝেমধ্যেই আত্মহত্যা করার ইচ্ছে করে।’ আমি তাকে বলেছি, এর পরের বার যখনই ইচ্ছে করবে, আমার সঙ্গে দেখা করবে। ছাত্রটি মাঝেমধ্যেই আসত, অপরাধীর মতো বলত তার আত্মহত্যা করার ইচ্ছে করছে। আমি তখন তার সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলতাম, উৎসাহ দিতাম—জটিল একটা পৃথিবী যে আসলে সহজ, আনন্দময় একটা জীবন তাকে দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতাম। শেষ পর্যন্ত ছাত্রটি লেখাপড়া শেষ করে বিদেশে স্থায়ী হয়েছে। ফুটফুটে একটা মেয়েকে বিয়ে করে সুখে ঘর-সংসার করছে।
আমি মনোবিশেষজ্ঞ নই, আমি শুধু কমন সেন্স দিয়ে বুঝতে পারি টিন-এজ বয়সের জটিল একটা সময় যদি একটু স্নেহ-মমতা দিয়ে পার করিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে পরের জীবনটা হয় অনেক সহজ।
সে জন্য এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার দিন আমার বুক ধুকপুক করতে থাকে। আমি জানি, এদিন যখন লাখ লাখ ছেলেমেয়ে সাফল্যের আনন্দে উদ্ভাসিত হবে, ঠিক তখন অসংখ্য ছেলেমেয়ে আশাভঙ্গের কষ্টে কাতর হবে। এদের সবাই যে নিজের কারণে এই আশাভঙ্গের বেদনাটুকু পাবে তা নয়—অনেক সময়ই সেটি হবে নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আমার সহকর্মীর একটি মেয়ে যখন পরীক্ষায় খুব ভালো একটা ফল আশা করছে, তখন আবিষ্কার করল সম্পূর্ণ বিচিত্র একটা কারণে খুব ভালো পরীক্ষা দেওয়া একটা বিষয়ে তাকে ফেল দেখাচ্ছে। আঘাতে মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে যায়—আমরা এ রকম কথাবার্তা শুনেছি, সেবার আমি নিজের চোখে দেখলাম। মেয়েটি শুধু যে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল তা নয়, তার শরীরের সব অনুভূতিও থেমে গেল। ঘুমের ওষুধ দিয়েও তাকে ঘুম পাড়ানো যায় না, ভয়াবহ একটি অবস্থা। পরিবারের সবার স্নেহ-মমতা-ভালোবাসায় তাকে শেষ পর্যন্ত সুস্থ করে তোলা হয়েছিল। পরের বার পরীক্ষা দিয়ে চমৎকার রেজাল্ট করে এখন সে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।
সবাই আমার সহকর্মীর মেয়েটির মতো সৌভাগ্যবান নয় যে একটা দুর্ঘটনার পর সে গভীর ভালোবাসা এবং মমতায় সেখান থেকে বের হয়ে আসতে পারবে। অনেক সময়ই দেখা যায়, অভিভাবক বা আত্মীয়স্বজন আশ্চর্য রকম নিষ্ঠুর। একটি ছেলে বা মেয়ে পরীক্ষায় তার পছন্দের ফল না পেয়ে যখন গভীর আশাভঙ্গের বেদনায় কাতর হয়ে আছে, তখন তাকে তার চারপাশের মানুষ থেকে গালাগাল শুনতে হয়, অভিশাপ শুনতে হয়। টিন-এজ বয়সের সেই জটিল মনোজগতে এটি যে কী ভয়ংকর একটা ব্যাপার হতে পারে, সেটা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। এই দেশের সব অভিভাবকের কাছে তাই আমার কাতর-অনুরোধ, এসএসসি পরীক্ষায় আপনার ছেলে বা মেয়ের ফল যদি আশানুরূপ না হয়, তাহলে তাদের ওপর রেগে উঠবেন না। তাদের সান্ত্বনা দিন, সাহস দিন, তাদের পাশে এসে দাঁড়ান।

৩.
আমাকে মাঝেমধ্যেই নানা রকম অনুষ্ঠানে যেতে হয়, সেই অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ অনুষ্ঠান হচ্ছে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান। সেখানে কয়েক হাজার ছেলেমেয়ে থাকে এবং সবাই পুরস্কার পায়। সেখান থেকে কেউ মন খারাপ করে যায় না।
সব অনুষ্ঠান এত সুন্দর নয়—অনেক অনুষ্ঠানেই প্রতিযোগিতা হয় এবং প্রতিযোগিতা হলেই সেখানে হাতে গোনা কয়েকজন বিজয়ী থাকে। যারা বিজয়ী হতে পারে না, আমি তাদের মনের কষ্টটা বুঝতে পারি। কারণ আমি ছেলেবেলায় অসংখ্যবার এই গ্লানি সহ্য করেছি। তাই এ ধরনের অনুষ্ঠানে গেলে আমি আমার সময়টুকু ব্যয় করি তাদের বোঝাতে যে বিজয়ী হতে না পারা অগৌরবের কিছু নয়। প্রতিযোগিতা একটা ছেলেমানুষি প্রক্রিয়া—পৃথিবীর বড় কাজ প্রতিযোগিতা দিয়ে হয় না, পৃথিবীর সব মহৎ কাজ হয় সহযোগিতা দিয়ে। তাই ছোটখাটো ব্যর্থতায় কোনো গ্লানি নেই, এটা হচ্ছে জীবনের পথচলার অভিজ্ঞতা। সবাইকে এর ভেতর দিয়ে যেতে হবে!
আমি খবর পেয়েছি, অনেক বাচ্চা-কাচ্চাও খবরের কাগজে ছাপা হওয়া আমার কলামগুলো পড়ে ফেলে! (কটমটে নীরস কলাম পড়ে সম্ভবত খানিকক্ষণ আমার মুণ্ডুপাতও করে।) অনুমান করছি, অনেক কম বয়সী ছেলে এই কলামটিও পড়ে ফেলবে। আমি শিরোনামটি এমনভাবে লিখেছি যেন যারা এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে, তারা এটি পড়ে ফেলে।
যাদের পরীক্ষার ফল ভালো হয়েছে তাদের অভিনন্দন। আমি নিশ্চিত তাদের পরিবার হইচই করে মিষ্টি কিনে আনবে—পাড়াপড়শি সবাইকে সেই মিষ্টি দেওয়া হবে। সেই মিষ্টি মুখে না দিয়েই আমি এখনই তার মিষ্টি স্বাদ অনুভব করতে পারছি। তাদের ভবিষ্যৎ জীবনটা হোক আনন্দময়, হোক সৃজনশীল। দোয়া করি তাদের যেন প্রাইভেট পড়তে না হয়, তাদের কোচিং করতে না হয়, জীবনে কখনো যেন তাদের গাইড বই স্পর্শ করে হাতকে অপবিত্র করতে না হয়। দোয়া করি, তারা বড় হয়ে এই দেশের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিক।
যাদের পরীক্ষার ফল মনমতো হয়নি কিংবা আপাতদৃষ্টিতে বলা যায় খুব খারাপই হয়েছে, আমার এই লেখাটি তাদের জন্য। আমি তাদের মনে করিয়ে দিতে চাই, তাদের এই আশাভঙ্গের সবচেয়ে বড় কারণ আমাদের এই পচা শিক্ষাব্যবস্থা। ১০ বছর লেখাপড়া করার পর যদি কেউ শূন্য হাতে বাড়ি ফিরে আসে, তাহলে তার দায়ভার তার একা নেওয়ার কথা নয়। সবাই মিলে এই দেশের লেখাপড়া ঠিক করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। কাজ হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসে যেটা হয়নি, এই প্রথমবার সেগুলো হচ্ছে। (এই দেশের অসম্ভব বড় সৌভাগ্য যে তারা একজন সত্যিকারের শিক্ষামন্ত্রী পেয়েছে, যিনি দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কথা জানেন। সেটাকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছেন। তাকে অনেক জ্বালা-যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে, সেটাও আমরা জানি। কিন্তু তাঁর ভয় পাওয়ার কিছু নেই, দেশের মানুষ তাঁর সঙ্গে আছে।) ভবিষ্যতের ছেলেমেয়েদের যেন এক শিক্ষাব্যবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে না হয়, সেটাই আমাদের স্বপ্ন।
যাদের পরীক্ষার ফল ভালো হয়নি, তাদের নিশ্চয়ই মন খারাপ হবে—সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মন খারাপ করে তারা যেন হতাশ হয়ে না যায়। পৃথিবীটা বিশাল, তার চেয়েও বিশাল হচ্ছে মানুষের জীবন। সেই বিশাল জীবনের সঙ্গে তুলনা করলে এসএসসি পরীক্ষাটা খুব ছোট একটা ঘটনা!
কাজেই বিশাল জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য এই ছোট ঘটনার কথা ভুলে নতুন উৎসাহে তাদের জীবন শুরু করতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে—এই বয়সটাই অন্য রকম, এই বয়সটাতে সবকিছুকেই একশ গুণ বড় মনে হয়। আনন্দকে একশ গুণ বড় করে দেখায় দোষ নেই।
কিন্তু দুঃখ-কষ্ট-হতাশাকে একশ গুণ বড় করে দেখা যাবে না। সামনের জীবনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হলে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১৪, ২০১০

 যুদ্ধাপরাধীর বিচার

ডিসেম্বর মাসটি একটি অন্যরকম মাস। আটত্রিশ বছর পরেও আমার মনে হয় এই বুঝি সেদিনের ঘটনা। বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করার আগেই শুনতে পেয়েছিলাম আলবদর বাহিনীর ঠাণ্ডামাথায় বুদ্ধিজীবী হত্যার খবর। শুনেও বিশ্বাস হতে চায় না_ আমাদের পরিচিত শিক্ষকদের খুন করেছে আলবদর বাহিনী_ খবরের কাগজে যখন বদর বাহিনীর খুনীদের নাম ছাপা হয়েছে সেখানেও আছে আমার পরিচিত সহপাঠী, জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্য। ১৪ ডিসেম্বর তারিখটি তাই বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে আলাদা করে রাখা আছে, তার দুদিন পরেই বিজয় দিবস। শোক আর আনন্দ পাশাপশি, দুদিন এদিক ওদিক।

একাত্তর সালে কতজন মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। আমরা অনুমান করে নিই সংখ্যাটি ত্রিশ লাখ। যাদের হত্যা করা হয়েছে, যারা যুদ্ধের মারা গেছে, শরণাথর্ী শিবিরে রোগে শোকে যারা মারা গেছে তাদের সবার সংখ্যা যোগ করলে প্রকৃত সংখ্যাটি আরও বেশি হতে পারে। আমি জানি এই প্রজন্মের কাছে সেটা অবিশ্বাস্য মনে হয়, কিন্তু আমরা যারা একাত্তরের ভেতর দিয়ে এসেছি শুধু তারাই জানি মৃতু্য তখন কী একটা সহজ বিষয় ছিল! নয় মাসে ত্রিশ লাখ লোক মারা গেলে দৈনিক হাজার দশেক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে_ সেই হিসেবে একাত্তরের নয় মাসের প্রতিটি দিনই কিন্তু একটি শহীদ দিবস, একটি শোক দিবস। যখন আমরা এই দেশের প্রত্যেকটি বধ্যভূমিকে চিহ্নিত করে সঠিক ইতিহাসটি লিপিবদ্ধ করব তখন সবার কাছে সেটি আরও অনেক স্পষ্ট হবে।

একাত্তর সালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এত দক্ষতার সাথে সাধারণ মানুষদের হত্যা করতে পেরেছিল কারণ তারা তাদের পাশে পেয়েছিল এই দেশের কিছু পদলেহী বিশ্বাসঘাতক। রাজাকার-আলবদর নামে তাদের পরিচয় আর এই শব্দগুলোর চাইতে ঘৃণিত কোন শব্দ এই দেশে আর কখনো জন্ম নেবে বলে মনে হয় না। সেই কুখ্যাত বদর বাহিনীর প্রধানের নাম ছিল মতিউর রহমান নিজামী_ সেদিন হঠাৎ করে খবরের কাগজে তার একটা বক্তব্য চোখে পড়ল। বক্তব্যটি এরকম : যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলে এই সরকার আসলে দেশকে ইসলামহীন করার পাঁয়তারা করছে!

মতিউর রহমান নিজামী না হয়ে অন্য যে কোন মানুষ হলে এই কথাটি পড়ে আমি তার জন্য এক ধরনের মায়া অনুভব করতাম_ কারণ দেশ পৃথিবী সমাজ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র কোন ধারণা না থাকলেই শুধু একজন মানুষ এরকম মন্তব্য করতে পারে। ডুবে যাওয়া মানুষের খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো একটি ঘটনা প্রাক্তন বদর বাহিনীর প্রধান এখনও বিশ্বাস করে ‘ইসলাম গেলো’ ‘ইসলাম গেলো’ রব তুললেই সব মানুষ বুঝি হাতে নাঙ্গা তলোয়ার নিয়ে তার পিছনে এসে দাঁড়াবে_ বিষয়টি আর সেরকম নেই। উনিশ শ’ একাত্তর সালের পর প্রায় চার দশক পার হয়ে গেছে তার মাঝে সম্ভাব্য সবরকম সরকার আমরা দেখেছি। “মিলিটারি+তত্ত্বাবধায়ক” এই হাইব্রিড সরকারটি আমাদের দেখা বাকি ছিল। ২০০৭-২০০৮ এ আমরা সেটাও দেখে ফেলেছি। এই নানা ধরনের সরকারের আমলে নানা ধরনের শাসন হয়েছে যার বৈচিত্র্যের কোন শেষ নেই, দেশের মানুষ তার খুটিনাটি সবকিছু ভাল করে বুঝেছে কী না জানি না, কিন্তু অন্তত একটা জিনিস বুঝেছে যে এই দেশের মাটিতে তাদের ধর্ম কর্ম করতে কোন সরকার কখনও বাধা দেয়নি। মুসলমান না হয়ে অন্য ধর্মের হলে তাদের ভোগান্তি হয়নি সেটি সত্যি নয়_ কিন্তু কোন মুসলমান ধর্ম পালন করতে পারেনি সেই কথাটি কেউ বলবে না। এই দেশে ইসলাম কখনও ধ্বংস হয়নি।

কাজেই বদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর মুখ থেকে যখন উচ্চারিত হয় যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার ছলে দেশকে ইসলামহীন করে দেয়া হচ্ছে তখন সবাই কথাটি ভাল করে বুঝতে চায়। যুদ্ধাপরাধীর বিচার করে ইসলামকে ধ্বংস করা না বলে যদি বলা হতো যে জামায়াতে ইসলামী নামক রাজনৈতিক দলটিকে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে তাহলে অনেক মানুষই হয়তো কথাটিকে গুরুত্ব দিত। সম্ভবত তাদের দাবি যে এই দেশে তারা ইসলাম ধর্মের এজেন্সি নিয়েছে এবং এই দলটি ধ্বংস হলে ইসলামও ধ্বংস হয়ে যাবে! কারণ উনিশ শ’ একাত্তর সালের যুদ্ধাপরাধের সবচেয়ে বড় অপরাধীদের মধ্যে রয়েছে এই দলটির প্রবীণ নেতারা। বিচার কাজ শুরু হওয়া মাত্রই তাদের অতীত ইতিহাস একটি একটি করে বের হয়ে আসবে। আমাদের দেশে এখন রয়েছে অত্যন্ত ক্ষমতাশীল চৌকস একটি সংবাদ মাধ্যম, কাজেই অতীতের সেই নৃশংস ঘটনাগুলো চোখের পলকে এই দেশের মানুষ, পৃথিবীর মানুষ নতুন করে জানতে পারবে। কাজেই এটি সত্যি কথা_ জামায়াতে ইসলামী নামক দলটি মহাবিপদের মধ্যে আছে, সত্যি সত্যি তাদের ধ্বংস হবার সম্ভাবনা আছে।

বিচারের রায় কী হবে আমরা কেউ জানি না, কিন্তু অন্তত একটি জিনিস জানি, এই বিচার প্রক্রিয়া চলার সময় এই যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের রাজনৈতিক দলের জন্যে মানুষের ভেতর নূতন করে যে ঘৃণার জন্ম হবে সেটি হবে বিচারের রায় থেকেও অনেক শক্তিশালী একটি ব্যাপার।

একটা রাজনৈতিক দল চালাতে হলে সেখানে নতুন প্রজন্মকে যোগ দিতে হয়। পুরাতন নেতারা অবসর নেয়ার পর নতুন নেতারা তাদের স্থান দখল করে নিতে থাকে।

প্রাক্তন বদর বাহিনীর দল জামায়াতে ইসলামীতে সেটি কেমন করে ঘটে দেখার জন্যে আমি অনেক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। যে দলটি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে বাংলাদেশকে টুঁটি চেপে হত্যা করতে চেয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছে, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে, সেই দলটিতে এই দেশের নতুন প্রজন্ম আর যোগ দেবে আমার সেই বিশ্বাস নেই। এই দেশের তরুণ সমাজ এত বড় বেইমান নয়।

এই দেশের তরুণ প্রজন্মকে আমি চিনি। অতীতে তাদের ধোঁকা দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের দলে টেনে নেয়া গেছে ভবিষ্যতে আর নেয়া যাবে না।

আধুনিক পৃথিবীতে সব ধরনের দল টিকে থাকতে পারে কিন্তু যুদ্ধাপরাধীর দল টিকে থাকতে পারে না। পৃথিবীর কোথাও টিকে নেই।

 যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে থাকতে হবে

যুদ্ধাপরাধের বিচার সরকার শুধু একা করছে না, আমরাও করছি। তাই এ ব্যাপারে সরকারকে সাহায্য করতে হবে। প্রতিমুহূর্তে এই একটি ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে থাকতে হবে। অন্য জায়গায় বিরোধিতা করতে পারি। সরকার যখন দুর্নীতি করবে, ভুল করবে; আমরা সক্রিয়ভাবে প্রতিবাদ করব। যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে সরকারকে ক্রমাগত সাহায্য করতে হবে।’

নিজের ৬০তম জন্মদিনে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও জনপ্রিয় লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে এভাবেই নিজের মত জানালেন। একই সঙ্গে জানলেন, এই বিচারকাজের ফলাফলের জন্য তিনি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে রাজি আছেন।

জনপ্রিয় লেখক ও শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবালের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে আজ সকাল ১০টার দিকে প্রথম আলোর সাংবাদিক গিয়েছিলেন। সেই আলাপচারিতা তুলে ধরা হলো প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য—

প্রথম আলো: এই জন্মদিনে মায়ের সঙ্গে কী কথা হয়েছে?
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: আমাদের সব ভাইবোনের জন্মদিন হয় নভেম্বর, নইলে ডিসেম্বর। আমাদের বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ এ বছরই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এবার তাই কেউই জন্মদিনের কোনো অনুষ্ঠান করছেন না। মায়ের সঙ্গে এখনো কথা হয়নি। দিনের কোনো একসময় কথা হবে। এ বছর জন্মদিন এলেই আমাদের মন খারাপ হয়, আমাদের মধ্যে কেউ একজন নেই।

প্রথম আলো: বাংলাদেশে বিজ্ঞান, গণিত, তথ্যপ্রযুক্তিকে জনপ্রিয় করতে আপনি সচেষ্ট। এ ব্যাপারে আপনার চাওয়া?
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: অনেক বেশি চাওয়া, না অল্প? অনেক বেশি হলে, বাংলাদেশ এমন দেশ হবে যে ছোট ছোট দেশগুলোকে সাহায্য করবে। এখন যে বড় বড় দেশগুলো আছে, তারা একে অন্যকে দখল করে, অত্যাচার করে, সর্বনাশ করে ছেড়ে দেয়। বাংলাদেশ যেন তেমন দেশ না হয়, বাংলাদেশ যেন দায়িত্ব নেয়।
আর অল্প হলে, বাংলাদেশের সব ছেলেমেয়ে যেন পড়াশোনা করে। সকালে বাইরে তাকালে যেন দেখতে না হয় তারা ফুল বিক্রি করছে, পপকর্ন বিক্রি করছে, ইট ভাঙছে। সব বাচ্চা যেন স্কুলে যায়। তাহলে বাংলাদেশকে নিয়ে আলাদাভাবে চিন্তা করতে হবে না। তারা নিজেরাই নিজেদের সমস্যার সমাধান করবে।

প্রথম আলো: শিশু ও তরুণদের আদর্শ আপনি। তরুণ প্রজন্ম নিয়ে আপনার স্বপ্ন?
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: তাদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখি। তারা দেশকে এত ভালোবাসে। এ নিয়ে আমাদের আলাদা করে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। আমি মনে করি, তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়। আমি সব সময় বলি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ো। তাহলে দেশকে ভালোবাসবে। তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানে, দেশকে ভালোবাসে।
রামুর বৌদ্ধবিহারে হামলার ঘটনার পর ভেবেছিলাম, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক ছেলেমেয়ে বিশালভাবে আন্দোলন করবে, রাগ-ক্ষোভ প্রকাশ করবে। বিষয়টা তাদের মাথায় রাখতে হবে। বিশ্বজিৎকে কুপিয়ে মারার ঘটনায় অনেকে প্রতিবাদ করছে না। ছাত্রলীগ সরকারি দল, কাজেই ভয় করছে। প্রতিবাদ করলে না জানি কী হয়। তরুণদের সত্য কথা সাহসের সঙ্গে বলতে হবে।

প্রথম আলো: শিশু ও তরুণদের জন্য আপনার পরামর্শ?
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: আমি পরামর্শ দিতে পছন্দ করি না। আমি চাই, শিশুরা আনন্দময় পরিবেশে পড়ুক। যারা স্কুলে যায় তারা কোচিং বন্ধ করুক। তারা যেন গাইড বই না পড়ে। তারা শিক্ষকদের বাধ্য করুক, স্কুলকে আনন্দময় করার জন্য। সবাইকে বলব, অনেক বেশি বই পড়তে। ছেলে বা মেয়ে কী শিখল, তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরি সে কল্পনা করতে পারে কি না। একটি বই পড়লে অনেক কিছু কল্পনা করতে পারা যায়। আরেকটি কথা বলব, তারা যেন টেলিভিশন কম দেখে। এতে কল্পনাশক্তি কমে যায়।
সবাই বই পড়ো। যত বেশি বই পড়বে, তত বেশি সৃজনশীলতা বাড়বে, দেশ, পৃথিবী ও সমাজকে অনেক বেশি দিতে পারবে।

প্রথম আলো: যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে আপনার প্রচেষ্টা ছিল, এখনো আছে। শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে আপনি কি যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়ার গতি নিয়ে সন্তুষ্ট?
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: বিষয়টা অনেক জটিল। যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া থামানোর জন্য, যাদের বিচার করা হচ্ছে, তাদের দল জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সংগঠনগুলো যেভাবে লেগেছে, যেভাবে সারা পৃথিবীতে টাকা-পয়সা খরচ করছে; আমাদের সবার যে দাবি, সেটি কঠিন করে দিচ্ছে। প্রমাণ পাই কীভাবে? যখন দেখি মার্কিন রাষ্ট্রদূত এসে এমন কথা বলেন, যে কথাগুলো শুনলে মনে হয় তিনি আমাদের দেশের ইতিহাস কিছু জানেন না বা যুদ্ধাপরাধের বিচার হোক সেটা চান না। শুধু তিনি নন, অন্যদের সঙ্গেও কথা বলেছি, বিশেষ করে বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে। তাঁদের কথা শুনলে আমার খুব বিরক্ত লাগে। ১৯৭১ সালে আমাদের দেশে যখন ঘটনাগুলো ঘটেছিল, তাঁরা একটি কথাও বলেননি। আমেরিকা, চীন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো পাকিস্তানের সঙ্গে ছিল। লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে, একটিবারের জন্যও তারা নিন্দাসূচক কথা বলেনি।
এত দিন পর আমরা যখন বিচারকাজ শুরু করেছি, তখন বিচারপ্রক্রিয়াকে ব্যাহত করার জন্য, কঠিন করার জন্য, বন্ধ করার জন্য তারা সাহায্য করা শুরু করেছে। আমরা যদি সরকারকে শুধু বলি, তুমি কেন বিচার তাড়াতাড়ি করছ না? মনে রাখতে হবে, বিচার শুধু সরকার একা করছে না, আমরাও করছি। এ কাজে সরকারকে সাহায্য করতে হবে। প্রতিমুহূর্তে এই একটি ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে থাকতে হবে। অন্য জায়গায় বিরোধিতা করতে পারি। সরকার যখন দুর্নীতি করবে, ভুল করবে; আমরা সক্রিয়ভাবে প্রতিবাদ করব। যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে সরকারকে ক্রমাগত সাহায্য করতে হবে। যুদ্ধাপরাধের বিচার আরও তাড়াতাড়ি করতে পারলে খুশি হতাম। তবে জানি, কাজটা তাদের জন্য কত কঠিন হচ্ছে। তাই আমি ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে রাজি আছি।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো
ডিসেম্বর ২৩, ২০১২

শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের মহাসমাবেশে তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে বক্তব্য

আজ আমি এসেছি তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইবার জন্য! আমি পত্রিকায় লিখেছি যে এই নতুন জেনারেশন খালি ফেসবুকে লাইক দেয়, এরা আর কিছু করে না। আমি লিখেছি, এরা খালি ব্লগ করে, এরা আর কিছু করে না, এরা রাস্তায় নামে না। তোমরা আমাকে ভুল প্রমাণিত করেছ।

এই দেখো এখানে ব্লগাররা আছে, এই ব্লগাররা সারা পৃথিবীতে যেটা হয়নি, সেটা ঘটিয়ে দিয়েছে।

তোমাদের কাছে ক্ষমা চাই! আমাকে ক্ষমা করেছ সবাই? আজকের মতো আনন্দের দিন আমি আমার জীবনে কোনো দিন পাই নাই!! ২০১৩ সাল ১৯৭১ হয়ে গিয়েছে!! তোমরা যারা ১৯৭১ দেখো নাই, সুযোগ পেয়েছ ২০১৩ সালকে আবার ১৯৭১ হিসেবে দেখার জন্য।

বাংলাদেশের মতো সুন্দর দেশ পৃথিবীতে নাই! ওপরে তাকাও কী সুন্দর আকাশ!! তাকাও কত সুন্দর গাছ!!

একজন আরেকজনের দিকে তাকাও, কত সুন্দর মানুষ!! তোমাদের মতো সুন্দর মানুষ পৃথিবীতে নাই।

আমরা অনেক সৌভাগ্যবান! যখন যেটা দরকার, সেটা পেয়েছি। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুকে পেয়েছি। যখন যুদ্ধের সময় হয়েছে, তাজউদ্দীন আহমদ আমাদের যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্ম হয়েছে, তারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে। এখন তোমাদের দরকার, তোমাদের জন্ম হয়েছে।

জাহানারা ইমাম এখানে আন্দোলন করেছিলেন, জাহানারা ইমামের ছবি আছে। আমি শিওর, উনি ওপর থেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন আর আনন্দে হাসছেন!! ৩০ লাখ শহীদ ওপরে আছে, তারা আমাদের দিকে দেখছে আর বলছে, ‘থ্যাংক ইউ’, ‘থ্যাংক ইউ’—তোমাদের ধন্যবাদ!

একটা সময় ছিল যেখানে হানাদার বলতে হতো, পাকিস্তান বলা যেত না। টেলিভিশনে রাজাকার কথাটা মানুষের মুখ থেকে বলা যেত না। তখন হুমায়ূন আহমেদ টিয়া পাখির মুখ দিয়ে বলেছিল, ‘তুই রাজাকার’!! আমি বলব, তোমরা বলবে, হুমায়ূন আহমেদ ওপর থেকে দেখছে। হুমায়ুন আহমদ দেখো—

কাদের মোল্লা! কাদের মোল্লা!
(জনতা—তুই রাজাকার! তুই রাজাকার!)

সাঈদী! সাঈদী!
(জনতা—তুই রাজাকার! তুই রাজাকার!)

সাকা চৌধুরী! সাকা চৌধুরী!
(জনতা—তুই রাজাকার! তুই রাজাকার!)

কামারুজ্জামান! কামারুজ্জামান!
(জনতা—তুই রাজাকার! তুই রাজাকার!)

নিজামী! নিজামী!
(জনতা—তুই রাজাকার! তুই রাজাকার!)

গোলাম আযম! গোলাম আযম!
(জনতা—তুই রাজাকার! তুই রাজাকার!)

বাংলাদেশে যত শহীদ হয়েছিল, তাঁরা সবাই এখন ওপর থেকে তাকিয়ে আমাদের দেখছে, আর বলছে—
এই বাংলাদেশকে আর কেউ কোনো দিন পদানত করতে পারবে না!

তোমাদের আমি অনুরোধ করি—
যখন লেখাপড়ার কথা তখন লেখাপড়া করবে। যখন গান গাওয়ার কথা তখন গান গাইবে। যখন কবিতা লেখার কথা কবিতা লিখবে। ছবি আঁকার কথা ছবি আঁকবে। ভাস্কর্য বসানোর কথা ভাস্কর্য বসাবে। প্রেম করার কথা প্রেম করবে।
বাংলাদেশকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দেশে তৈরি করবে। নোবেল প্রাইজ আনবে। যখন রাস্তায় নামার দরকার পড়বে তখন রাস্তায় নামবে।

তোমাদের কাছে সারা বাংলাদেশ কৃতজ্ঞ। যত শহীদ আছে সবাই কৃতজ্ঞ, আমরা সবাই কৃতজ্ঞ। ধন্যবাদ সবাইকে।
ব্লগারদের আলাদাভাবে ধন্যবাদ! তারা যেটা করেছে তার কোনো তুলনা নাই। সবাইকে ধন্যবাদ!!

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো
মে ০৪, ২০১৩

 শিক্ষা সফর

ইউনিভার্সিটিতে আমরা যখন পড়াশোনা করেছি, তখন লেখাপড়া ছিল একটু পুরনো ধাঁচের। তিন বছর পড়ার পর অনার্স পরীক্ষা শুরু হতো। সেটা শেষ করার পর এক বছরের মাস্টার্স। আমরা যে বছর পাস করেছি, সেই বছর থেকে মাস্টার্সের জন্য নতুন একটা বিভাগ খোলা হলো। সেটার নাম থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স।

এটা মোটামুটি আধুনিক একটা বিভাগ। আমেরিকান কায়দায় দুটি সেমিস্টার। দুই সেমিস্টারে পাঁচটি পাঁচটি করে ১০টি আধুনিক কোর্স। আমরা প্রথমদিকের ১০ জন – ছয়জন ছেলে ও চারজন মেয়ে খুব আগ্রহ নিয়ে এই আধুনিক বিভাগে ভর্তি হয়ে গেলাম। বাকি ছেলেমেয়েরা পুরনো বিভাগে রয়ে গেল।

এক বিভাগের ছেলেমেয়েদের দুই ভাগে ভাগ করলে যা হয়, তা-ই হলো। দুই ভাগের মাঝে একটা অদৃশ্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। তারা দলে ভারী, পুরো ডিপার্টমেন্টই তাদের। আমাদের মাত্র একজন শিক্ষক, নিজেদের ক্লাসরুম নেই, ল্যাব নেই, বসার জায়গা নেই, খানিকটা উদ্বাস্তুর মতো ঘুরে বেড়াই। পুরোনো বন্ধুবান্ধবরা কখনো আমাদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করে, কখনো হিংসা করে।

আমার নিজের সমস্যা একটু অন্য রকম, সারা জীবন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এসেছি। যখনই সম্ভব হয়েছে পার্সেন্টেজ দিয়ে সটকে পড়েছি। বড় ক্লাস, কেউ টের পায়নি। ছোট ক্লাসে সেটা করা যায় না, হাতেগোনা ১০ জন মাত্র ছাত্রছাত্রী, স্যারেরা সবার মুখ চেনেন, পালানোর উপায় নেই। আমি মুখ কালো করে ক্লাস করি। নতুন বিভাগ, স্যারদের খুব উত্সাহ, আমরা নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ পাই না।

এর মাঝে নিঃশ্বাস নেওয়ার একটু সময় হলো। শীতের শুরুতে ঠিক করা হলো, আমরা শিক্ষা সফরে যাব। নামেই শিক্ষা সফর – এর মাঝে শিক্ষার কিছু নেই। কদিন সবাই মিলে কক্সবাজার, রাঙামাটি এ রকম মনোরম জায়গায় ঘুরে বেড়ানো। শিক্ষা সফরে যাওয়ার জন্য সব বিভাগ ইউনিভার্সিটি থেকে টাকা পেয়েছে, সবার জন্য সমান টাকা এবং আমরা হঠাত্‍ করে আবিষ্কার করলাম, অন্যান্য বিভাগে ৫০-৬০ জন যে টাকা পেয়েছে, আমাদের মাত্র ১০ জনে সেই টাকা। আমরা মোটামুটি রাজার হালে ঘুরে বেড়াতে পারব।

তবে একটি সমস্যা এবং সেটি গুরুতর। আমরা সব ছেলেমেয়ে মিলে যেতে চাই, সঙ্গে একজন দায়িত্বশীল শিক্ষক না থাকলে মেয়েদের বাবা-মায়েরা যত বড় শিক্ষা সফরই হোক, সেখানে যেতে দেবেন না। আমাদের এই নতুন থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স বিভাগের শিক্ষক মাত্র একজন এবং তিনি তখন বিদেশে। আমাদের সঙ্গে যাওয়ার কেউ নেই! আমরা শুকনো মুখে কয়েকজন স্যারের কাছে আমাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য অনুনয়-বিনয় করলাম এবং তাদের মাঝখান থেকে একজন স্যার রাজি হয়ে গেলেন!

সদ্য বিদেশ থেকে এসেছেন স্যার। অত্যন্ত আধুনিক মানুষ। এখনো বিয়ে থা করেননি কিন্তু খুব দায়িত্বশীল। আমরা মহা খুশি। একদিন মহা উত্সাহে কক্সবাজার বেড়াতে বের হলাম। নির্দিষ্ট সময়ে সবাই কমলাপুর স্টেশনে হাজির হয়েছি, ফাস্র্ট ক্লাসের টিকিট কেনা হয়েছে। শেষ মুহূর্তে একজন মেয়ে বাদ পড়েছে, অন্য তিনজনের বাবা-মা তাদের তুলে দিতে এসেছেন। বাবা-মায়েরা স্যারকে বললেন, ‘আপনি একটু এদের দেখে রাখবেন।’
স্যার বললেন, ‘অবশ্যই দেখে রাখব।’
বাবা-মায়েরা বললেন, ‘আজকালকার ছেলেদের কোনো বিশ্বাস নেই, সঙ্গে আপনি যাচ্ছেন বলে এদের যেতে দিচ্ছি।’
স্যার বললেন, ‘আপনারা কোনো চিন্তা করবেন না। আমি আছি।’

আমরা ট্রেনে ওঠলাম, গার্ড হুইসেল দিল এবং আমাদের আনন্দভ্রমণ শুরু হলো। শুরুতেই একটা ছোট সমস্যা দেখা দিল, স্যার সদ্য বিদেশ থেকে এসেছেন, কিছুতেই যেখানে খুশি সেখানে কিছু ফেলতে দেবেন না! কলা খাওয়ার পর কলার ছিলকে, ডাব খাওয়ার পর ডাবের খোসা, বিস্কুট খাওয়ার পর বিস্কুটের প্যাকেট ময়লার ঝুড়িতে ফেলতে হবে। সমস্যা হচ্ছে, কোথাও ময়লার ঝুড়ি নেই। তাই স্যার নিয়মমাফিক আমাদের হাতে বর্জ্য পদার্থ তুলে দিতে লাগলেন এবং ময়লার ঝুড়িতে ফেলে আসার ভান করে আমরা এদিক-সেদিক ছুড়ে ফেলতে লাগলাম।

প্রথম চট্টগ্রাম শহর, সেখান থেকে রাঙামাটি, আমরা মহানন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছি। স্যারের বাবা খুব বড় সরকারি কর্মকর্তা। আমাদের জন্য সব ব্যবস্থা করে রাখছেন। কাজেই যেখানেই যাই সেখানে গাড়ি, ট্রলার, গেস্টহাউস, খাবার-দাবার সব রেডি থাকে। আমরা রাজার হালে থাকি। রাঙামাটিতে বিশাল হ্রদের টলটলে নীল পানি, সেখানে সাঁতার কেটে বালুবেলায় শুয়ে থাকি। স্যার ট্রলারের গলুইয়ে বসে কবিতা লিখেন, সব মিলিয়ে চমত্কার সময় কাটছে।

শিক্ষা সফরের বড় অংশটি রেখেছি কক্সবাজারের জন্য। তাই যেদিন রাতে কক্সবাজার পৌঁছেছি আমাদের আনন্দ আর ধরে না। হোটেলে জিনিসপত্র রেখে তখনই বের হয়ে গেলাম, ঝাউবনের এক ধরনের উদাসী বাতাসের শব্দ, সমুদ্রের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে, নির্জন বালুবেলা, জ্যোত্স্নার আলোতে রহস্যময় পরিবেশ – এক কথায় আমরা ব্যাকুল হয়ে গেলাম। আমাদের ভেতর একজন এর মাঝে গাঁজা খাওয়ার অভ্যাস করেছে, সে গাঁজা টেনে আরও ব্যাকুল হয়ে গেল। এই চমত্কার সমুদ্রতটে আমরা পাঁচ-ছয় দিন কাটাবচিন্তা করেই আমাদের মন পুলকিত হতে থাকে।

আমাদের স্ফূর্তি দেখে খোদা মুচকি হাসলেন। পরদিন সকালে দেখলাম, স্যার ব্যস্ত হয়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন, খুব গম্ভীর হয়ে কিছু টেলিফোন করে আমাদের সবাইকে ডাকলেন। আমরা চিন্তিতভাবে স্যারকে ঘিরে দাঁড়ালাম, স্যার বললেন, ‘একটা বড় সমস্যা হয়ে গেছে।’
আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী সমস্যা?’
‘বলতে পারো একধরনের ইমার্জেন্সি।’
আমরা শুকনো গলায় বললাম, ‘কী ইমার্জেন্সি!’
স্যার বললেন, ‘সেটা তোমাদের বলতে পারব না, কিন্তু আমাকে এক্ষুনি ফিরে যেতে হবে।’
আমরা মাথায় হাত দিয়ে বললাম, ‘সর্বনাশ! তাহলে আমাদের শিক্ষা সফরের কী হবে?’
স্যার বললেন, ‘আমি খুব দুঃখিত। আমাকে যেতেই হবে।’
‘আপনি চলে গেলে আমরা থাকি কেমন করে? সঙ্গে মেয়েরা আছে।’
একজন বলল, ‘গার্জিয়ানরা আপনি আছেন বলে মেয়েদের আসতে দিয়েছে।’
স্যার বললেন, ‘আমাকে ছাড়া তোমরা থাকতে চাইলে থাকো। কিন্তু আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে।’

স্যার নিজের ব্যাগ গোছাতে শুরু করলেন। আমরা বিশাল লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেরা কথা বলতে থাকি। মেয়েদের একজন বলল, ‘আমরা বড় হয়েছি না? স্যার ছাড়া থাকি, সমস্যা কোথায়?’
আমরা হাতে কিল দিয়ে বললাম, ‘সমস্যা কোথায়?’ একজন একটু ইতস্তত করছিল, তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলাম।

স্যার একটু পরেই প্লেন ধরে ঢাকা রওনা হয়ে গেলেন। এখন শিক্ষকবিহীন আমরা নয়জন ছেলেমেয়ে। স্যার থাকার সময় আনন্দ-স্ফূর্তি একটু রয়েসয়ে করতে হতো, এখন আমাদের লাগাম ছাড়া স্ফূর্তি করতে শুরু করলাম। বালুর মাঝে গর্ত করে সারা শরীর পুঁতে রেখে শুধু মাথাটা বের করে রেখেছি। জিবে কামড় দিয়ে পড়ে থাকি, লোকজন চমকে ওঠে। বালুবেলায় একটা মুণ্ডু পড়ে থাকতে দেখে চমকে ওঠে। সমুদ্রের পানিতে লাফাঝাঁপি করার আনন্দ অন্য রকম, একজন চ্যাংদোলা শব্দটার অর্থ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করায় সবাই মিলে তাকে ধরে চ্যাংদোলা করে সমুদ্রের পানিতে ফেলে দিলাম। গভীর রাতে আমরা কাঁধে লাকড়ি আর খাবার নিয়ে বালুবেলায় চলে যেতাম, আগুন জ্বালিয়ে শরীর গরম করে বেসুরো গলায় গান গাইতাম। কম বয়সে আনন্দ করার জন্য যা করার কথা, তার কিছুই বাকি থাকল না।

শেষ পর্যন্ত কোনো রকম দুর্ঘটনা ছাড়াই শিক্ষা সফর শেষ করে আমরা ফিরে আসতে শুরু করেছি। প্রথমে বাসে করে চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে ঢাকায়। যতই ঢাকার কাছে আসছি, আমাদের ভেতর ততই এক ধরনের দুশ্চিন্তা চেপে বসছে। কমলাপুর স্টেশনে মেয়েদের বাবা-মায়েরা তাদের নিতে আসবেন, যখন দেখবেন স্যার নেই, তাদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাবে। কমবয়সী ছেলেমেয়েরা কোনো অভিভাবক ছাড়া কক্সবাজারে ঘুরে বেড়িয়েছে, বাবা-মায়েরা সেটাকে মোটেও ভালো চোখে দেখবেন না। মেয়ে তিনজনকে বিশেষ দুশ্চিন্তিত দেখা গেল। বাবা-মায়েরা তাদের বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দেবেন।

ট্রেন টঙ্গী এসে থেমেছে, আর কয়েক স্টেশন পরেই কমলাপুর। এমন সময় আমাদের বগির দরজায় টুক-টুক শব্দ। দরজা খুলতেই দেখি, স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা আনন্দে চিত্কার করে উঠলাম, ‘স্যার আপনি?’
স্যার মৃদু হাসলেন, বললেন, ‘কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।’
আমরা বললাম, ‘বলব না, স্যার।’

ট্রেন এসে কমলাপুর থামল। মেয়েদের নেওয়ার জন্য তাদের বাবা-মায়েরা এসেছেন। স্যার আমাদের সবাইকে নিয়ে ট্রেন থেকে নামলেন। বাবা-মায়েরা এগিয়ে এসে বললেন, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। সবাইকে সুস্থ শরীরে ফিরিয়ে এনেছেন।’
স্যার কোনো কথা না বলে মৃদু হাসলেন। আরেকজন বললেন, ‘ছেলেমেয়েরা যা পাজি, নিশ্চয়ই আপনাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে।’
স্যার এবারও মৃদু হাসলেন।
‘আপনার মতো এ রকম দায়িত্বশীল মানুষ সঙ্গে ছিলেন বলে যেতে দিয়েছিলাম, তা না হলে কি যেতে দিই?’
স্যার আবার একটু মৃদু হাসলেন।
আমরাও হাসলাম, আমাদের হাসি অবশ্য আরও অনেক বিস্তৃত হলো।

সাক্ষাৎকার – সমকাল ‘কালের খেয়া’ থেকে (ডিসেম্বর ১৯, ২০১১)

 

১. উচ্চ শিক্ষার জন্য পাড়ি জমালেন যুক্তরাষ্ট্রে। পড়াশোনা শেষে কর্মজীবনেও প্রবেশ করলেন সেখানেই। কিন্তু ১৯৯৪ সালে দেশে ফিরে এসে শুরু করলেন নতুন জীবন_ কোনো বিশেষ স্বপ্ন বা বোধ দ্বারা তাড়িত হয়েছিলেন কি?

* অনেকেই আমাকে এই প্রশ্নটি করে এবং আমার মনে হয় আমি কাউকেই বিষয়টি বোঝাতে পারি না। ‘কোনো বিশেষ স্বপ্নবোধ দ্বারা তাড়িত হয়ে’ আমি দেশে ফিরে আসিনি, আমি দেশে ফিরে এসেছি কারণ এটা আমার দেশ। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। একজন মানুষের মা যদি সাদাসিধে অশিক্ষিতা বৃদ্ধা একজন মহিলা হয়, তখন মানুষটি কিন্তু ফিটফাট সুন্দরী কমবয়সী একজন মহিলা খুঁজে বের করে না মা ডাকার জন্য! যখন মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করে সেই সাদাসিধে অশিক্ষিতা বৃদ্ধা মহিলার কাছে গিয়েই তার পায়ের কাছে বসে থাকে। এখানেও তাই, যুক্তরাষ্ট্রের হাইফাই পরিবেশে যত ভালো ভালো বিষয়ই থাকুক সেটা তো আমার দেশ নয়। আমার যদি আকাশ কালো করে আসা মেঘ, ঝমঝম বৃষ্টি, ব্যাঙের ডাক আর কালো শ্যামলা মানুষ দেখার ইচ্ছা করে, আমি কী করব?
কাজেই আবার একবার বোঝানোর চেষ্টা করি, আমি কোনো বড় উদ্দেশ্য বা স্বপ্ন নিয়ে দেশে ফিরে আসিনি। নিজের দেশে থাকার জন্য ফিরে এসেছি। অত্যন্ত চমৎকার একটা জীবনের লোভে নিজের দেশে থাকার আনন্দটুকু হারাতে আমি রাজি নই। আমি এত বেশি বোকা না।

২. সে স্বপ্ন পূরণে কতটা এগোলেন?

* যেহেতু স্বপ্ন নিয়ে আসিনি তাই স্বপ্ন পূরণ বিষয়টি আসে না। তবে দেশে ফিরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে করতে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, দিন চলতে চলতে নতুন নতুন পরিকল্পনা মাথায় এসেছে কিছু কিছু বাস্তবায়িত হয়েছে, কিছু হয়নি! সবাইকে নিয়ে এখন নতুন নতুন স্বপ্ন দেখি কিছু পূরণ হবে, কিছু হবে না।
এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার করে বলে দেওয়া দরকার, স্বপ্ন পূরণ হতেই হবে সেটা কিন্তু সত্যি নয়। স্বপ্ন দেখতে হয় আর সেটার জন্য কাজ করতে হয় সেটা হচ্ছে সত্যি।

৩. স্বাধীনতার ৪০ বছর পর আমাদের অর্জন নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে, হতাশাও কম নেই। এমন বাস্তবতাতেও আমরা যতটুকু দেখি, আপনি অসম্ভব আশাবাদী একজন মানুষ। এবং যে তারুণ্যকে কেউ কেউ সমাজের ঘুণে ধরা অংশ হিসেবে দেখতে চান আপনার পদচারণা সেই তারুণ্যকে কেন্দ্র করে_ লেখালেখি বা কর্মকাণ্ড সব সময় তাদের সঙ্গে কেন?

আমি আলাদাভাবে যুক্তিহীন বারাবাড়ি আশাবাদী মানুষ সেটি সত্যি নয়_ আমি যে জীবনের ভেতর দিয়ে এসেছি সেখানে অন্য রকম কিছু হওয়াটাই অস্বাভাবিক। ১৯৭১ সালে তাড়া খাওয়া পশুর মতো ছুটে বেড়িয়েছি, একটি দিন শেষ হওয়ার পর অন্য একটা দিন শুরু হবে কি-না জানতাম না! যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর উদ্বাস্তুর মতো ঘুরে বেড়িয়েছি, রক্ষীবাহিনী বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর রাস্তায় রাত কাটিয়েছি, পরের বেলা কোথা থেকে খাবার আসবে জানতাম না, এমন দিন গিয়েছে যে, বাসায় একটা শার্ট, সেটা পরে কখনও বড় ভাই বাইরে গেছে, সে ফিরে এলে সেই শার্ট পরে আমি বাইরে গেছি। আমাদের খুব সৌভাগ্য যে, আমরা একটা অসাধারণ মা পেয়েছি, যিনি আমাদের পুরো পরিবারটাকে ধরে রেখেছেন এবং আমরা টিকে গেছি। এই দেশে সেই দুঃসময়ে অসংখ্য পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। সেই ভয়ঙ্কর পরিবেশে আমি কিংবা আমরা যারা বেঁচে এসেছি তাদের কে ভয় দেখাবে? কে হতাশ করবে?
সব বুড়ো মানুষই তারুণ্যকে ঘুণে ধরা বলে। এখন যারা তরুণদের গালাগাল করেন তারা যখন কম বয়সী ছিলেন তখন তাদের বাবা-চাচারা তাদের গালাগাল করেছেন! কাজেই এগুলোকে আমি সিরিয়াসলি নিই না। আমি বিশ্বাস করি, সবার ভেতরেই একজন ভালো মানুষ থাকে, তাকে ঠিকভাবে স্পর্শ করলেই সে বের হয়ে আসে।
আমার ‘পদচারণা’ বা কর্মকাণ্ড সব সময় তারুণ্যকে কেন্দ্র করে, কারণ আমার সেটাই ভালো লাগে। একজন বুড়ো মানুষকে নতুন করে কিন্তু শেখানো যায় না_ কিন্তু কম বয়সী তরুণরা কিন্তু নতুন কিছু শিখতে রাজি আছে। স্বপ্ন দেখতে রাজি আছে।

৪. তরুণদের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আপনাকে দাঁড়াতে হয়েছে; দাঁড়িয়েছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতেও_ হুমকি-ধমকিও শুনতে হয়েছে, নিজেকে কখনও বিপন্ন মনে হয়েছে কি?

* না, নিজেকে কখনই বিপন্ন মনে হয়নি, প্রশ্নই ওঠে না। যখনই দুঃসময় এসেছে তখন চারপাশে আরও বেশি মানুষ এসে আরও নতুনভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। আজকাল ইন্টারনেটে তরুণরা অনেক বেশি সময় কাটায়_ আমি শুনেছি সেখানে কেউ যখন আমার বিরুদ্ধে [কিংবা আমার পরিবারের বিরুদ্ধে] একটা কুৎসিত কথা বলে তখন অসংখ্য তরুণ সেটাকে তাদের মতো করে প্রতিবাদ করে। মানুষের ভালোবাসা একটি অসাধারণ বিষয়, আমি সেই ভালোবাসাটুকু অনুভব করতে পারি। আমি সব সময় সৃষ্টিকর্তাকে বলি তিনি যেন আমাকে সেই শক্তিটুকু দেন যেন আমি কখনও কারও ভালোবাসার অমর্যাদা না করি।

৫. এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসা যাক- মাত্র ৭ বছর বয়সে সায়েন্স ফিকশন লেখা দিয়ে শুরু করে ছিলেন লেখালেখি পর্ব। সেখক হওয়ার ইচ্ছেটা এলো কিভাবে?

* মনে হয় এটা জেনেটিক। বাবা লিখতেন, মা লেখেন, ভাইয়েরা লেখে, বোনেরাও লেখে, এখন তাদের ছেলেমেয়েরাও লেখে! আমরা বইয়ের মাঝে বড় হয়েছি, কাজেই বই পড়তে পড়তে লেখার ইচ্ছে করবে সেটাই স্বাভাবিক। পরিবারে সেটা নিয়ে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে তাই লেখালেখি করেছি। সত্যি কথা বলতে কী, লেখালেখি না করাটাই হয়তো অস্বাভাবিক হতো। তবে লেখালেখি করে লেখক হিসেবে পরিচিতি হবে সেটা কখনোই মাথায় ছিল না, লেখালেখি করেছি মনের আনন্দে!

৬. দীপু নাম্বার টু’র দীপু বা কাজলের দিনরাত্রির কাজল কিংবা আমি তপু’র তপুর মধ্যে মুহম্মদ জাফর ইকবালের কৈশোরকে দেখার সুযোগ কতটুকু?

* কিশোর উপন্যাসের প্রায় সবগুলোতেই আমার [কিংবা আমার প্রজন্মের] কৈশোরের ছাপ পাওয়া যেতে পারে। তবে ‘কাজলের দিনরাত্রি’ বা ‘আমি তপু’ একটু ব্যতিক্রম_ এই বই দুটির চরিত্রগুলোর যে জটিলতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে আমার জীবনে কখনোই সেই জটিলতা ছিল না!

৭. কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রাখছেন, সে সময় শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। আপনার বাবা যুদ্ধে গেলেন, আপনি গেলেন না?

* আমার বাবা যে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে অস্ত্র হাতে পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন তা নয়। পুলিশ অফিসার ছিলেন, সেই হিসেবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন, যার জন্য পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে অনেক চেষ্টা করেছিলাম, পারিনি। সবার কপালে সবকিছু থাকে না, আমার কপালে এটা ছিল না। সৃষ্টিকর্তা আমার সব ইচ্ছা পূরণ করেছেন, এটা করেননি, কেন করেননি জানি না! [কে জানত পাকিস্তানিরা এত ভীরু, কাপুরুষ আর দুর্বল যে, মাত্র নয় মাসে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাবে!]

৮. মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশ, ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে নতুন এক রাষ্ট্রের পথচলা এবং আপনি বিশ্ববিদ্যালয় পুড়ূয়া এক শহীদ পরিবারের সন্তান_ সে দিনের সংগ্রামটা বলবেন কি?

* সেটি ছিল খুব কঠিন সময়, খানিকটা আগেই বলেছি। তখন বুঝতে পারিনি, এখন যখন পেছন ফিরে তাকাই তখন মাঝে মধ্যে অবিশ্বাস্য মনে হয় যে, কেমন করে আমরা টিকে ছিলাম। দুঃখ কষ্ট ঝামেলা দুর্বলতার কথা বলতে ভালো লাগে না, তাই সেগুলো আবার না বললাম। কিন্তু কেউ যেন মনে না করে সময়টুকু শুধু দুঃসময় ছিল_ একই সঙ্গে সেটি ছিল আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের মাথা তুলে দাঁড়ানোর সময়। ‘গেরিলা’ নামে যে অসাধারণ ছায়াছবিটি নাসিরুদ্দীন ইউসুফ তৈরি করেছেন তিনি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। নাসিরুদ্দীন ইউসুফের পরিচালিত, সেলিম আল দীনের লেখা নাটকে আমিও অভিনয় করেছিলাম, যেটি টিএসসিতে মঞ্চস্থ হয়েছিল। নির্মলেন্দু গুণের কবিতার বই প্রেমাংশুর রক্ত চাই প্রকাশিত হলো, আমরা মুগ্ধ হয়ে সেই কবিতাগুলো পড়তাম। শাহাদত চৌধুরীর সম্পাদিত বিচিত্রা তখন একমাত্র সাময়িকী_ কী আধুনিক পত্রিকা! আমার লেখা প্রথম ছোটগল্প ‘ছেলেমানুষী’ প্রকাশিত হলো_ গর্বে মাটিতে আমার পা পড়ে না। গান, কবিতা, ছোটগল্প, নাটক, বিজ্ঞান সবকিছু নিয়ে সত্যিকারের রেনেসাঁ।

৯. পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন কলাম বা নিবন্ধে সমাজ এবং রাজনীতি সচেতন একজন প্রগতিশীল জাফর ইকবালকে আমরা পাই। এসব বিষয়কে উপজীব্য করে ঔপন্যাসিক হিসেবে আপনাকে আমরা পাই না…।

* পাবেন না! ছোট বাচ্চারা আমাকে খুন করে ফেলবে। তারা আমাকে বলেছে সবাই বড়দের জন্য লেখে, খবরদার আপনি বড়দের জন্য লিখতে পারবেন না। আমাদের দেশের সাহিত্যিকদের জন্য আমি অবশ্য একটু দুঃখ অনুভব করি, খুবই সীমিত কিছু বিষয়ে আরও সীমিত প্রকাশ ভঙ্গিতে তাদের লিখতে হয়। এই মুহূর্তে পৃথিবীর অন্য সাহিত্যিকরা যেভাবে লিখতে পারেন, তাদের যে অবিশ্বাস্য স্বাধীনতা আছে, আমাদের লেখকদের তার বিন্দুমাত্র নেই।

১০. বর্তমান প্রজন্ম মেধাবী, অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। তবে, আপনাদের বেড়ে ওঠা এবং বর্তমান প্রজন্মের বেড়ে ওঠা- পরিবার, সমাজ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমস্যা কোথায় যে কারণে একটা পর্যায়ে এসে তাদের অনেককেই হতাশায় পেয়ে বসছে আর এগোতে পারছে না?

* তাই নাকি? আমি তো জানি না! যদি সত্যিই হয়ে থাকে তাহলে সম্ভবত সেটা একটা ফ্যাশন। আমি যখন ট্রেনে করে আসি এবং জানালা দিয়ে মাথা বের করে একটা কিশোর কিংবা কিশোরীকে কলা, ঝালমুড়ি, চিনা বাদাম, কিংবা খবরের কাগজ বিক্রি করতে দেখি, তাদের মাঝে বিন্দুমাত্র হতাশা দেখতে পাই না, তারা রীতিমতো যুদ্ধ করে যাচ্ছে। ভোরবেলা যখন গামেন্টের মেয়েরা হাসতে হাসতে কথা বলতে বলতে কাজ করতে যায়, তখনও আমি তাদের মাঝে কোনো হতাশা দেখি না। তারা কিন্তু সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
‘হতাশা’ নামের এই ‘বিলাসী’ শব্দটি শুধু সেই তরুণদের, যারা পরিবার সমাজ আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সব সুযোগ পেয়েছে। আমি এই দলটিকে নিয়ে সময় নষ্ট করতে চাই না। শত ঝামেলার মাঝে থেকেও যারা কখনও হতাশ হয় না, তারা হচ্ছে সমাজের আসল শক্তি_ আমি আসলে তাদের মুখ চেয়ে থাকি, তাদের জন্য কাজ করি।

১১. প্রচুর সায়েন্স ফিকশন, কিশোর উপন্যাস, গল্প, এমন কি ভূতের গল্পও লিখেছেন, এরপর আপনাকে আমরা দেখি ইতিহাসকার হিসাবে। লিখলেন ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’। মাত্র ২২ পৃষ্ঠায় এত বড় একটা ক্যানভাসকে ধারণ! ভেতরের গল্পটা বলবেন?

* ভেতরের গল্পটা সহজ। জোট সরকারের আমলের একটা শ্বাসরুদ্ধকর সময়, মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করার, অবমাননা করার সব রকম চেষ্টা চলছে। আমরা সমমনা বেশকিছু মানুষ বসেছি কী করা যায় সেটা নিয়ে কথা বলতে। অনেক সুন্দর সুন্দর পরিকল্পনা এসেছে, আমি তার মাঝে বললাম, আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। নতুন প্রজন্ম যদি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটুকু জানে তাহলে তারা দেশের জন্য যে ভালোবাসা অনুভব করবে সেটি আর অন্য কোনোভাবে সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটুকু হবে ছোট, যেন এক কাপ চা খেতে খেতে পড়ে ফেলতে পারবে, বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে পড়ে ফেলতে পারবে কিংবা দুই ক্লাসের মাঝখানে পড়ে ফেলতে পারবে। প্রতিটি লাইনের রেফারেন্স থাকবে যেন কেউ এর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে। ইতিহাসটি হবে এক ফর্মার নিউজপ্রিন্টের হ্যান্ডবিলের মতো, পড়ে ফেলে দিলেও ক্ষতি নেই। মূল্য হবে খুব কম যেন পয়সা খরচ না হয়!
যারা উপস্থিত ছিলেন তারা আমার প্রস্তাবটি লুফে নিলেন, কিন্তু নিউজপ্রিন্টের হ্যান্ডবিল করতে রাজি হলেন না সেটা যেন সংগ্রহ করে রাখে সেই রূপটি দেবেন বলে ঠিক করলেন। সেই ঘরটিতে একটি কম বয়সী বাচ্চা মেয়ে ছিল, সে ইতস্তত করে বলল, ‘যদি সেই ইতিহাসটি জাফর ইকবাল স্যার লেখেন তাহলে আমাদের বয়সী ছেলেমেয়েরাও সেটা পড়ে ফেলবে।’ তার কথাটা মেনে নিয়ে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো।
এই হচ্ছে ইতিহাস। এটা লিখতে আমাকে যে পরিশ্রম করতে হয়েছে সেই পরিশ্রম করে দশটা সায়েন্স ফিকশন লেখা যেত। শেষ পর্যন্ত এক ফর্মার মাঝে আটকানো যায়নি, একটু বড় হয়ে গেছে!

১২. বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাওয়ার পর একাডেমি মাঠেই তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন- ভালো লাগছে কিন্তু একই সঙ্গে খারাপ লাগাও আছে। আহমদ শরীফ স্যারকেই এ পুরস্কার দেওয়া হয়নি? এ ব্যাপারে বলবেন?

* আমি আহমদ শরীফ বলিনি, যতদূর মনে আছে আহমদ ছফা বলেছিলাম। তার মতো এত বড় লেখক পাননি, কিন্তু আমার মতো একজন পাতি লেখক পেয়ে গেল সেটা খুব লজ্জার বিষয়। বাংলা একাডেমীর পুরস্কার পাওয়ার পর প্রতি বছরই এই পুরস্কারের মনোনয়ন দেওয়ার জন্য আমার কাছে চিঠি পাঠানো হয়। মরণোত্তর পুরস্কার দেওয়ার প্রথা চালু করে আহমদ ছফাকে পুরস্কার দেওয়ার জন্য আমি অনেকবার প্রস্তাব দিয়েছি, আমার প্রস্তাবকে কেউ গুরুত্ব দেয়নি।
আমার পুরস্কারের ব্যাপারে একটা মজার তথ্য আছে। আমাকে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে ‘ভাষা ও সাহিত্যে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের’ জন্য। আমি যখন পুরস্কার পেয়েছি, তখন আমি মাত্র দুটি পাতলা জিলজিলে বিজ্ঞানের বই লিখেছি, এর জন্য কাউকে এত বড় পুরস্কার দেওয়া ঠিক নয়। আমার খুব লজ্জা লেগেছে, তাই এখন প্রতি বছরই বিজ্ঞানের ওপর লিখতে চেষ্টা করি যেন পুরস্কারটা হালাল হয়।
আরও একটা বিষয় হয়তো বলা যায়, আগে জানতাম না এখন টের পেয়েছি পুরস্কার পাওয়ার জন্য অনেক লেখক নিজেরাই অনেক ধরাধরি করেন, সেটা দেখে আমার খুব অস্বস্তি হয়। অনেক বড় লেখক যেহেতু এই পুরস্কার পাননি তাই এই পুরস্কার না পাওয়াটাই তো অনেক সময় সম্মানজনক।

১৩. আমরা অনেক কিছুতেই প্রভাবিত হই_ ব্যক্তি, বিষয়, ঘটনা। আপনার জীবনে তেমন কিছু আছে কি?

* অবশ্যই আছে, অনেক কিছুই আছে। সেই ঘটনাগুলো আমি আমার লেখালেখিতে উল্লেখও করেছি। যেহেতু এই মুহূর্তে লেখালেখি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সেই বিষয়েই বলি।
জাহানারা ইমাম নিউইয়র্ক গেছেন, আমার তার সঙ্গে খুব পরিচিত হওয়ার শখ। আমি তাই খুব কুণ্ঠিতভাবে তার কাছে গিয়ে বললাম, ‘আপনি আমাকে চিনবেন না, আমার বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের খুব বড় লেখক, আমি তার ছোটভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল।’
জাহানারা ইমাম আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি তোমাকেও চিনি। আমি তোমার সায়েন্স ফিকশন কপোট্রনিক সুখ দুঃখ পরেছি’ তারপর আমার লেখালেখি নিয়ে খুব দয়ার্দ্র কিছু কথা বললেন। শুনে আমি একেবারে হকচকিয়ে গেলাম।
আমি তখন আমেরিকায় থাকি। দুই-চারটা বই দেশে ছাপা হয়েছে, সেগুলো আমার হাত পর্যন্ত পৌঁছায় না, দেখতে কেমন, পড়তে কেমন জানি না। কেউ পড়ছে কি-না তাও জানি না। জাহানারা ইমামের কথা শুনে আমার ভেতরে ম্যাজিকের মতো কিছু একটা ঘটে গেল, আমার মনে হলো তার মতো একজন মানুষ যদি আগ্রহ নিয়ে আমার বই পড়ে থাকেন তাহলে এখন থেকে আমি নিয়মিতভাবে লিখব।
সেই থেকে আমি নিয়মিতভাবে লিখে আসছি। সব দায়দায়িত্ব শহীদ জননী জাহানারা ইমামের।

১৪. পরিবারের বাইরেও আপনার অনেক পরিচয়- শিক্ষক, লেখক, তথ্য প্রযুক্তিবিদ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংগঠক-সক্রিয় কর্মী। কোন কোন পরিচয়টা দিতে আপনার ভালো লাগে?

* শিক্ষক।

১৫. আপনার নিজের রচনার মধ্যে কোনগুলো আপনার প্রিয়?

* আমি ঠিক জানি না এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব কি-না! আমার স্মৃতি খুব দুর্বল, তাই আগে কী লিখেছি মনে থাকে না। [খুব আশঙ্কা আছে, আগে লেখা কোনো একটা কাহিনী আবার লিখে ফেলব!] কিছুদিন আগে হঠাৎ করে আমার পুরনো একটা বই পড়তে পড়তে মনে হলো, ‘আরে, ভালোই তো লিখেছিলাম!’
কাজেই বলা যেতে পারে, যে লেখালেখিগুলো আমি ভুলে গেছি সেগুলো যথেষ্ঠ প্রিয়।

১৬. নিজের লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

* আমাদের বাচ্চাদের বিজ্ঞান এবং গণিতের পাঠ্যবইগুলোর ভাষা খুবই কটমটে বিজ্ঞানের সহজ বিষয়গুলোও জটিল করে লেখা হয়। আমার দুটি ইচ্ছা এবং পরিকল্পনার একটি হচ্ছে তাদের জন্য সহজ ভাষায় বিজ্ঞানের বইগুলো লিখে দেওয়া। [কাজ শুরু করেছি!]

১৭. আপনি যতই বলুন না কেন, আপনি শুধু কিশোরদের জন্য লিখে থাকেন; তারপরও বড়দের জন্য লেখা ‘একজন দুর্বল মানুষ’ কিংবা ‘রঙিন চশমা’ ইত্যাদি গ্রন্থে আমরা পরিণত বয়স্ক পাঠকের রচয়িতাকেই পাই। পরিণত পাঠকদের জন্য লিখতে আপনার দ্বিধা কেন?

* আমার কোনো দ্বিধা নেই, ভয় আছে। ছোট বাচ্চারা তাহলে আমাকে খুন করে ফেলবে। তারা যদি আমাকে অনুমতি দেয় তাহলে মুক্তিযুদ্ধের ওপর আমার একটা বড় উপন্যাস লেখার ইচ্ছা আছে। এটি হচ্ছে আমার জীবনের দ্বিতীয় ইচ্ছা। এটা যদি শেষ করতে পারি তাহলে আমি মনে করব আমার দায়িত্বের একটা ধাপ শেষ হলো। তখন পরের ধাপ নিয়ে কাজ শুরু করব।

১৮. আপনার প্রিয় লেখক কারা?

* এই প্রশ্নেরও মনে হয় উত্তর নেই। লেখকদের নাম বলে শেষ করা যাবে না। কোনো কোনো লেখক হয়তো শৈশবে বা কৈশোরে খুব প্রিয় ছিলেন, এখন বড় হয় গেছি বলে তার লেখা পড়ি না, কিন্তু আমার প্রিয় লেখকের তালিকায় অবশ্যই তার নাম থাকতে হবে। আবার এই মুহূর্তে যে লেখকের লেখা খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ছি তার নামটিও থাকতে হবে, কাজেই তালিকাটি শেষ করতে পারব না।
তবে প্রিয় কবির বেলায় কাজটি খুব সহজ। আমার প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ। আগে সবসময় আমার ব্যাকপেকে তার একটা বই থাকত, এখন আমি আমার Kindle ই-বুক রিডারে তার বই রাখি! [যারা Kindle ই-বুক রিডার বলতে কী বোঝায় জানেন না তাদের জন্য বলছি : পৃথিবীতে বই প্রকাশনার যুগে একটা বিপ্লব ঘটেছে, মানুষ আজকাল কাগজের বই না পড়ে ই-বুক রিডারে বই পড়া শুরু করেছে। এর মাঝে সেটা প্রায় বইয়ের মতো হয়ে গেছে, একটু অভ্যাস হয়ে গেলে কোনো সমস্যাই হয় না। শরহফষব একটি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ড, তাদের ই-বুক রিডার থেকে যে কোনো সময় যে কোনো বই কিনে এক মিনিটের মাঝে পড়তে শুরু করা যায়। আগে বই কিনে রাখতাম পরে পড়ব বলে, পড়া হতো না। এখন বই কিনি আর পড়ি। কী মজা!]

১৯. কোন কোন লেখকের লেখায় অনুপ্রাণিত হয়েছেন?

* যার লেখাই পড়ে আনন্দ পেয়েছি তার লেখাতেই অনুপ্রাণিত হয়েছি। একটি বই যদি আলাদা করে উল্লেখ করতে হয় তাহলে সেটা মার্ক টোয়েনের লেখা টম সয়ার। কৈশোরে সেই বই পড়ে আমার মাথা ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল_ সেই থেকে আমি তার মতো করে লেখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

২০. সমকালের পক্ষ থেকে আপনাকে ৫৯তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

* দিলেন তো মনে করিয়ে। মনে ছিল না ভালোই ছিলাম! এই বয়সে কে জন্মদিনের কথা মনে করতে চায়?

সাদাসিধে কথা

আজকাল নিজেকে কেমন জানি গাধা-গাধা মনে হয়। প্রতিদিন খুব মনোযোগ দিয়ে কয়েকটা পত্রিকা পড়ি, কিন্তু তবু কিছু বুঝি না। একে-ওকে জিজ্ঞেস করি দেখি, তারাও কিছু বোঝেন না, মাথা চুলকান। দু-একজন মাঝেমধ্যে নিচু গলায় ভেতরের খবর দেওয়ার চেষ্টা করেন, সেগুলো আসলেই ভেতরের খবর নাকি উর্বর মস্তিষ্কেকর তৈরি করা গুজব সেটাও বুঝি না। পত্রিকায় দেখি, হইচই করে বড় বড় রাঘব বোয়াল দুর্বৃত্ত ধরা হয়। কারও বিরুদ্ধে মামলা হয়, কারও বিরুদ্ধে হয় না। কারও কারও বেলায় চার্জশিট হয়, কারও কারও হয় না। কারও আবার জামিন হয় না, আবার কারও বেলায় একসঙ্গে এক ডজন-হাফ ডজন মামলার জামিন হয়ে যায়। বিচার বিভাগকে আলাদা করা হয়েছে, কিন্তু দেখি সরকার যখন যা চায় বিচার বিভাগ ঠিক তখন তা করে দেয়। টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে বয়স্ক মুক্তিযোদ্ধার পিঠে লাথি মারলেও কিছু হয় না, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাসের পর মাস জেলে আটকে রাখা হয়। বামঘেঁষা চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের ঝটপট ক্রসফায়ারে মেরে ফেলা হয়, কিন্তু জঙ্গি মৌলবাদী চরমপন্থীদের কখনো ক্রসফায়ারে ফেলা হয় না। দেশের সব প্রতিষ্ঠানের কিছু না কিছু দুর্বৃত্তদের ধরা হয়েছে, কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে জোট সরকারের দুর্বৃত্তরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঠিক যখন মাত্র তিন মাস বাকি তখন শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য উপদেষ্টারা সবাইকে ডাকাডাকি করছেন। অথচ গত দুটো বছর আমরা মাথা কুটেছি, কাগজে একটা স্বাক্ষর দিয়েই কত কিছু করে ফেলা যেত, কেউ আমাদের কথা শোনেনি!
সবকিছু মিলিয়ে আমি কী হতাশ হব না আশান্বিত হব, দুঃখ পাব না রাগ হব তাও বুঝতে পারছি না। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে সব সময়ই আশাবাদী মানুষ−আমার সব সময়ই কৌতুকের সেই বাচ্চা ছেলেটির কথা মনে হয়! এই ছেলেটি সব সময়ই সবকিছু নিয়ে এত খুশি হয়ে যেত যে তার বাবা-মা খানিকটা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। ছেলেটি যখন বড় হবে, দেখবে জীবন বড় কঠিন, সেখানে পদে পদে বাধা, তখন আশাভঙ্গের কারণে হতাশায় ডুবে যাবে। বাবা-মা তাই ঠিক করল শৈশবেই ছেলেটিকে জীবনের রূঢ় বাস্তবতার কিছু শিক্ষা দিতে হবে। শুরু করল তার ঘরটিতে ঘোড়ার গোবর ফেলে রেখে। এই গোবর পরিষ্ককার করতে করতে ছেলেটির জীবনে নিশ্চয়ই কঠিন জীবনের খানিকটা অভিজ্ঞতা হবে। বাবা-মা আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে ঘরের ভেতর গোবর দেখে ছেলেটা কী করে সেটা দেখার জন্য। স্কুল থেকে এসে নিজের ঘরে ঢুকে ঘোড়ার গোবর দেখেই ছেলেটার মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে যায়। সে আনন্দে চিৎকার করতে করতে সারা বাসায় ছোটাছুটি করতে থাকে। হতভম্ব বাবা-মা তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে?’ ছেলেটা বলল, ‘আমার ঘরের ভেতর ঘোড়ার গোবর। তার মানে চমৎকার একটা টাট্টু ঘোড়া এই বাসার ভেতরে কোথাও লুকিয়ে আছে।’
কাজেই আমিও দেশের এখানে-সেখানে ঘোড়ার গোবর দেখেও হতাশ হই না, চোখ খুলে ঘোড়াটাকে খুঁজতে থাকি। মাঝেমধ্যে যখন খুব বিভ্রান্ত হয়ে যাই তখন আমি ১/১১-এর রাতের কথাটি মনে করি, তখন সঙ্গে সঙ্গে আমার মন ভালো হয়ে যায়।
সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলোর কথা কি মনে আছে? জামায়াত-বিএনপির দুঃশাসনের পাঁচ বছর মাত্র পার হয়েছে, লুন্ঠন কত প্রকার ও কী কী এ দেশের মানুষ স্বচক্ষে সেটি মাত্র দেখে শেষ করেছে। একই সঙ্গে দেখছে হাওয়া ভবনকে ঘিরে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমান আর তাঁর বিশাল দুর্বৃত্ত বাহিনীর উত্থান। পাশাপাশি ধর্মকে ব্যবহার করে সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন। স্বাধীনতাবিরোধীদের আস্কালন মুক্তবুদ্ধির মানুষের ওপর অত্যাচার, ইতিহাস বিকৃতি। ধর্মোন্নত্ত মৌলবাদীদের হাতে ধরে গড়ে তোলা হচ্ছে, অস্ত্রের চালান, জঙ্গিদের বোমা হামলা, গ্রেনেড হামলা করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শেষ করে দেওয়া, প্রশাসনের নির্বিচার দলীয়করণ। জিনিসপত্রের দাম−জামায়াত-বিএনপি সরকারের কিছুতেই কিছু আসে যায় না। কারণ, পরের নির্বাচনে জিতে আসার নীলনকশা তৈরি হয়ে আছে।
একটা নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আমরা যখন সেই ভয়ঙ্কর দুঃশাসন থেকে মুক্তি চাইছি, তখন আমরা সবিস্নয়ে আবিষ্ককার করেছি নির্বাচন কমিশনে কিছু ভাঁড় বসে আছে। শুধু কি নির্বাচন কমিশনে, অফিসের দারোয়ান থেকে দেশের রাষ্ট্রপতি সবই দলীয় মানুষ। সংবিধানকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে রাষ্ট্রপতি নিজেই প্রধান উপদেষ্টা হয়ে গেলেন। সেই ভয়ঙ্কর সময়ের কথা মনে আছে? আমার মনে আছে, ছোট বাচ্চারা আমার কাছে ফোন করে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করেছিল, তাদের একটাই প্রশ্ন, এখন কী হবে?
পর্দার আড়ালে কী হয়েছে আমরা সেগুলো ভাসা-ভাসা জানি। স্পষ্টভাবে যেটা জানি সেটা হচ্ছে, সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ একটা দায়িত্ব পালন করল, হঠাৎ রাষ্ট্রপতি টেলিভিশনে স্বীকার করে নিলেন, নির্বাচন নিয়ে ভয়ঙ্কর একটা ষড়যন্ত্র হচ্ছিল, সেটা বন্ধ করা হয়েছে।
আমরা সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। যখনই আমার মনমেজাজ একটু খারাপ থাকে, তখন আমি সেই সময়টার কথা চিন্তা করি। ২২ জানুয়ারির সেই প্রহসনের নির্বাচনটি যদি জামায়াত-বিএনপি সরকার করে ফেলতে পারত, তাহলে কী অবস্থা হতো কেউ কল্পনা করতে পারে? এখন আর যাই হোক তারা ফাঁকা মাঠে গোল দিতে পারবে না, রীতিমতো প্রতিপক্ষের সঙ্গে খেলে গোল দিতে হবে। আমরা সেই খেলা দেখার জন্য অপেক্ষা করে আছি।

২.
তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছরের জন্য ক্ষমতায় থাকবে বলে জানি। দুই বছর দীর্ঘ সময়−দুই বছরে অনেক কিছু করা যায়। যেহেতু পুরো সময়টাতেই জরুরি অবস্থা, তাই অনেক কিছু তারা জোর করেও করে ফেলতে পারে। এই দুই বছর সময়টা তারা ঠিক করে ব্যবহার করেছে কি না ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেবে। আমি শুধু তাদের একটি বিষয় নিয়ে কথা বলব।
বিষয়টি হচ্ছে এ দেশের শিক্ষা। এ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। জোট সরকারের আমলে অন্য সব প্রতিষ্ঠানের মতো সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দুর্নীতিতে একেবারে আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তদন্ত কমিটিকে পাঠানো হলো−তাঁরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েও এসেছিলেন। তাঁরা ছিলেন জোট সরকারের নিয়োগ পাওয়া সদস্য, তাই তাঁরা সেই তদন্তে এসে নিজের দলের মানুষদের রক্ষা করে বিশাল প্রতিবেদন দাখিল করলেন! আমার খুব শখ ছিল সেই প্রতিবেদনটি দেখার, কিন্তু সেটা কোনো দিন প্রকাশ করা হয়নি। কেন প্রকাশ করা হবে না? আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কী দুর্নীতি হয়, আর তাদের অন্য দুর্নীতিবাজেরা কীভাবে রক্ষা করে সেটা দেশের মানুষ কেন জানতে পারবে না?
দেশের অন্য সব প্রতিষ্ঠানে কিছু না কিছু পরিবর্তন হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবর্তন হয়নি। জোট সরকারের আমলের প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় চালিয়ে গেছে, তাদের দলীয় প্রভোস্ট, তাদের দলীয় প্রক্টর, হলে হলে তাদের দলীয় ছাত্র। শিক্ষক নিয়োগের বেলায় তাদের দলীয় শিক্ষক। দলীয় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার সময় দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় মানুষেরা কীভাবে অবলীলায় মিথ্যা কথা লেখেন সে রকম কিছু কাগজপত্র আমার কাছে আছে, আমি সেগুলো মাঝেমধ্যে দেখি, কী করব বুঝতে পারি না। দলীয় বিবেচনায় প্রভোস্টরা কীভাবে ছাত্রদের হলে সিট দেন তার প্রমাণও আছে, কিন্তু সেই অভিযোগগুলো করার কোনো জায়গা নেই। জোট সরকার দেশকে শাসন করেছে পাঁচ বছর, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শাসন করেছে সাত বছর−এ জন্য ইতিহাস এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ক্ষমা করলেও আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের কখনো ক্ষমা করব না।
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার শিক্ষার ব্যাপারটা কখনোই বুঝতে পারেনি। ১০ জন উপদেষ্টার ভেতরে কোনো শিক্ষক নেই। কেন নেই আমরা সেটা অনুমান করতে পারি, এই উপদেষ্টা ‘সেনা সমর্থিত’ (যার অর্থ কাউকে পরিষ্ককার করে বুঝিয়ে দিতে হবে না!) তাঁদের শিক্ষকদের জন্য কোনো সম্মানবাধ নেই; যদি থাকত তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গত বছর জেলে ঢুকিয়ে হেনস্তা করার সাহস পেতেন না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে শিক্ষার ব্যাপারটা বোঝেনি তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল এবং সেখানে জিপিএ ফাইভের প্লাবন! সত্যি সত্যি যদি আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা এভাবে জিপিএ ফাইভ পেয়ে যেত, তাহলে আমার থেকে বেশি খুুশি কেউ হতো না। কিন্তু আমি খুব ভালোভাবে জানি, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এমন কিছু ঘটেনি, যার জন্য এভাবে জিপিএ ফাইভের প্লাবন শুরু হয়ে যাবে। তাই সেই ফলাফল দেখে আমি খুশি না হয়ে খুব দুশ্চিন্তিত হয়েছিলাম। কারণ, এটা ঘটেছে সম্পুর্ণ অন্য কারণে, প্রশ্নপত্র সোজা করে করা হয়েছে, পরীক্ষকদের বলা হয়েছে উদারভাবে মার্কস দিতে। দুশ্চিন্তার কারণ সেটি নয়, কারণ হচ্ছে আমাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেটাকে শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের সাফল্য হিসেবে বড় গলায় প্রচার করেছে। এটি সাফল্য নয়, এটি হচ্ছে শিক্ষার মান এক ধাপ নিচে নামিয়ে দেওয়া−এই সত্য কথাটি তো দেশের সব মানুষ জানে, তাহলে কেন এই প্রচারণা?
এসএসসির রেজাল্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি বলেছিলাম, এটি মাত্র শুরু, এইচএসসির রেজাল্ট হওয়ার পর আমরা আসল মজা দেখতে পাব। আমি তার মাঝে খবর পেয়েছি, এইচএসসি পরীক্ষায় বেশি বেশি মার্কস দেওয়ার জন্য পরীক্ষকদের ওপর প্রবল চাপ দেওয়া শুরু হয়েছে। সত্যি সত্যি তাই হলো, এইচএসসি পরীক্ষাতে আবার সেই জিপিএ ফাইভের প্লাবন। এবার ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেল। কারণ, দেখা গেল এই পরীক্ষায় ছেলেমেয়েরা বাংলার চেয়ে ইংরেজিতে বেশি ভালো করেছে! পরীক্ষার ফলাফল যদি সত্যি হয়, তাহলে এ দেশের ছেলেমেয়েরা যতটুকু বাংলা জানে, তার থেকে বেশি ইংরেজি জানে! কে এই কথা বিশ্বাস করবে? এ দেশের ছেলেমেয়েরা ১২ বছর ইংরেজি পড়ে, তার পরও শুদ্ধ ইংরেজিতে একটা এসএমএস পাঠাতে পারে একেবারে হাতে গোনা কয়েকজন। তাই তারা ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লেখার একটা বিচিত্র পদ্ধতি আবিষ্ককার করে বসে আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসব কোনো কিছু বিশ্লেষণ করল না, বুক ফুলিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়নের সাফল্যের কৃতিত্বটুকু নিয়ে নিল?
যখন শিক্ষার মান কমিয়ে এনে সেটাকে ইতিবাচক একটা বিষয় বলে কৃতিত্ব দাবি করা হয়, তখন আমি খুব দুশ্চিন্তিত হয়ে যাই। শুধু যে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ আর মাধ্যমিক স্কুল নিয়ে সমস্যা, তা নয়। প্রাইমারি স্কুলেও সমস্যা−হঠাৎ জানতে পেরেছি, পরীক্ষামূলকভাবে কয়েক হাজার স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব ব্র্যাকের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষকেরা আন্দোলন শুরু করলেন। তারপর কী হলো আমরা কিছুই জানতে পারলাম না। রাষ্ট্রীয়ভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, অথচ দেশের সব মানুষকে এ ব্যাপারে অন্ধকারে রাখা হলে কেমন করে হবে?
দেশের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নে কোনো শর্টকাট নেই, এটা করতে হলে শুরু করতে হবে শিক্ষকদের দিয়ে। মানসম্মত শিক্ষকদের মানসম্মত বেতন আর সম্মান দিয়ে এর শুরু করা যায়, এটি না করে অন্য যে পরিকল্পনাই করা হোক তার কোনোটি কাজ করবে না। সারা পৃথিবীর সবচেয়ে পরীক্ষিত এই সত্যটি গ্রহণ করতে এত ভয় কেন? এত সংকোচ কেন? এত অনাগ্রহ কেন?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় শেষ হয়ে আসছে, তাদের প্রগ্রেস রিপোর্টের অনেক বিষয়ে তারা হয়তো জিপিএ ফাইভ পাবে, অনেক ক্ষেত্রে পাবে না। আমি শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের অবদানের জন্য পাস মার্ক দিতে পারলাম না। তিন মাসের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এ বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয় না−দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অবশ্যই দিতে হয় এবং খুব কম করে হলেও পাস করতে হয়।

৩.
এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাজনীতিতে একটা বিশাল ওলট-পালট শুরু হয়ে গেছে। রাজনীতিবিদদের গালাগাল করা একটা ফ্যাশনের মতো হয়ে যাওয়ায় আমি সেটা আর করতে চাই না। বিশেষ করে এই দেশ সামরিক বাহিনী আর রাজনীতিবিদ প্রায় সমান সমান সময় শাসন করেছে, দেশের এই অবস্থার জন্য গালাগাল শুধু রাজনীতিবিদদের শুনতে হবে কেন? সবচেয়ে বড় কথা, রাজনীতিতে যত না তৃণমূল রাজনৈতিক নেতা, তার থেকে অনেক বেশি ব্যবসায়ী, সাবেক আমলা আর সাবেক সেনা কর্মকর্তা। যেসব রাজনৈতিক নেতা সারা জীবন পথেঘাটে ঘুরে ঘুরে মানুষের সঙ্গে মিশে মিশে রাজনীতি করে এসেছেন, তাঁরা যখন দেখেন কোনো একজন মালদার ব্যবসায়ী কিংবা আমলা কিংবা সাবেক সেনা কর্মকর্তা হঠাৎ উড়ে এসে তাঁর এলাকায় জুড়ে বসেছেন তখন তাঁরা নিশ্চয়ই একধরনের হতাশা অনুভব করেন। আমার যদি সুযোগ থাকত, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোকে বলতাম, তারা যেন তৃণমূল পর্যায়ে থেকে উঠে আসা জননেতাদের নির্বাচনের সুযোগ দেয়। ব্যবসায়ী-আমলা আর সাবেক সেনা কর্মকর্তা গাছেরটাও খেয়েছেন, এখন নিচেরটা কুড়ানোর প্রয়োজন কী? তাঁরা অন্যভাবে দেশ সেবার সুযোগ পাবেন।
তবে আমি একটা বিষয় নিয়ে সব সময়ই একধরনের বিভ্রান্তি অনুভব করে এসেছি। কোন রাজনৈতিক দলের ভেতরে কোন ধরনের কোন্দল, কে কাকে কনুই দিয়ে গুঁতো দিয়ে সরিয়ে জায়গা করে নিচ্ছেন, কে কতটুকু চাটুকারিতা করে করে কাছে চলে আসছেন এ খবরগুলো প্রতি মুহুর্তে আমাকে খবরের কাগজে পড়তে হয়−যারা টেলিভিশন দেখে তাদের নিশ্চয়ই সেটা দেখতে হয়, শুনতে হয়। আমাদের সাধারণ নাগরিকদের কি রাজনৈতিক দলগুলোর পারিবারিক কলহ শোনার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন আছে? আমি যে জিনিসগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর মুখে শুনতে চাই, সেগুলো একটিবারও কেন শুনতে পাই না? দেশের মানুষকে তারা কী দেবে, সেটি কেন তারা বলে না?
প্রথমেই আমি জানতে চাইব দ্রব্যমূল্য নিয়ে তারা কী ভাবছে। তারা কী জানে এ দেশের কত লাখ মানুষ হঠাৎ গরিব হয়ে গেছে? কত পরিবার খবরের কাগজ পড়া বন্ধ করে দিয়েছে? এই ঈদে কত লাখ শিশু নতুন কাপড় কিনতে পারেনি? কত লাখ মা সন্তানের প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে নিজে অভুক্ত থেকেছেন? আমরা পরিষ্ককারভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে শুনতে চাই, তারা সংসদে গিয়ে নিজেদের জন্য বিনা শুল্কে গাড়ি আমদানি করার সিদ্ধান্ত নেবে, নাকি এ দেশের মানুষের জন্য কিছু করবে? যদি কিছু করার পরিকল্পনা থাকে, সেটি কীভাবে করবে? কত তাড়াতাড়ি করবে?
আমি কঠিনভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের এই দুর্ভাগা দেশের ৯০ ভাগ সমস্যা মিটিয়ে দেওয়া সম্ভব শুধু শিক্ষাব্যবস্থাটাকে ঠিক করে দিয়ে। আমরা পরিষ্ককারভাবে জানতে চাই, এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থাটাকে ঠিক করে দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা আছে কি না। তারা বাজেটের কত অংশ এখানে দেবে। বাংলা মাধ্যম, মাদ্রাসা আর ইংরেজি মাধ্যম নামে আমরা মধ্যবিত্ত, দরিদ্র আর বড়লোকের যে তিনটি ধারা তৈরি করেছি সেটাকে একত্র করার কোনো পরিকল্পনা আছে কি না। মেধাবী ছাত্রদের আবার বিজ্ঞানমুখী করবে কি না। শিক্ষকদের সম্মানজনক বেতন দেবে কি না। গাইড বই নিষিদ্ধ করে দেবে কি না। ছাত্রছাত্রীদের প্রাইভেট কোচিংয়ের পীড়ন থেকে মুক্তি দিয়ে আনন্দময় স্কুলে ফিরিয়ে আনবে কি না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি করবে কি না।
আমাদের দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি তিন ধরনের মানুষ−চাষি, পোশাককর্মী আর প্রবাসী শ্রমিক। যাদের শ্রমে এ দেশ চলছে আমরা জানতে চাইব, সেই তিন শ্রেণীর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর আলাদা কোনো পরিকল্পনা আছে কি না। সারের জন্য, সেচের জন্য চাষিরা মাথা কুটে মরবে কি না। তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার সুযোগ থাকবে কি না। পোশাক কারখানার মেয়েদের সম্মানজনক বেতন দেওয়া হচ্ছে কি না। তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে কি না। ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার সুযোগ আছে কি না। প্রবাসী শ্রমিকদের বিদেশে নিরাপদ জীবন যাপনের সুযোগ আছে কিনা। দেশে এলে তাদের ভ্রমণের বিষয়গুলো সহজ করে দেওয়া হচ্ছে কি না। তাদের কষ্টের অর্জনে এ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় তাদের সেই প্রাপ্য সম্মানটুকু দেওয়া হচ্ছে কি না।
আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জানতে চাইব, তারা আমাদের ইলেকট্রিসিটি দেবে কি না। দিলে কতটুকু দেবে! কবে দেবে? কীভাবে দেবে? আমরা জানতে চাইব, গ্যাস-তেল-কয়লা নিয়ে তাদের কী পরিকল্পনা? সব সময়ই আমাদের আতঙ্কে থাকতে হয়, এই বুঝি কোনো এক ষড়যন্ত্রে আমাদের সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের এই উদ্বেগ থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করা হবে কি না।
পরিবেশ দুষণে বাংলাদেশের বড় অংশ ভবিষ্যতে পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা শোনা যায়। আমরা শুনতে চাই, এ নিয়ে রাজনৈতিক দল কী ভাবছে? তারা কীভাবে এ সমস্যার সমাধান করবে।
আমরা জানতে চাই, এ দেশে সব ধর্মের সব জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ পাশাপাশি সমান অধিকার নিয়ে থাকতে পারবে কি না। আমরা জানতে চাইব, নির্বাচনে জেতার পর এ দেশে আবার নতুন করে হতভাগিনী পূর্ণিমাদের হাহাকারে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হবে কি না। আমরা জানতে চাইব, এ দেশটিকে ধর্মান্ধ মানুষের দেশে পাল্টে দেওয়া হবে কি না। দেশের হাজার বছরের সংস্কৃতিকে ধর্মের নামে জলাঞ্জলি দেওয়া হবে কি না। আমরা জানতে চাইব, এ দেশকে আধুনিক সেক্যুলার দেশ হিসেবে গড়ে তোলা হবে কি না।
আমরা কী জানতে চাই তার তালিকা দীর্ঘ−আমি শুধু অল্প কয়েকটি কথা উল্লেখ করেছি−সব এখানে লিখতে পারব বলে মনে হয় না। তবে একটা বিষয় আমরা সব রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে জানতে চাইব। সেটা হচ্ছে, তারা ক্ষমতায় এলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে কি না। যদি করে, তাহলে কেমন করে করবে? কত দিনের ভেতর করবে?
যে রাজনৈতিক দল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার অঙ্গীকার দেবে না, সেই রাজনৈতিক দলের আর যাই থাকুক এ দেশের মাটিতে থাকার অধিকার নেই, এ দেশের বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার অধিকার নেই।

ডিজিটাল টাইম’ এবং ঘোড়ার মৃতদেহ

এই বছর জুন মাসের ১৯ তারিখ বাংলাদেশে ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা এগিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এ ধরনের একটা কাজ করা হবে এ রকম কানাঘুষা হচ্ছিল, আমার ধারণা ছিল এত বড় একটা ব্যাপার—সেটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হবে, দেশের জ্ঞানী-গুণী মানুষেরা বলবেন, এটা নেহায়েত এক ধরনের খামখেয়ালিপনা—সোজা কথায় পাগলামো। তখন আর এই সিদ্ধান্তটা নেওয়া হবে না। দেশ যখন রাজা-বাদশাহরা শাসন করতেন তখন তাঁরা এ রকম খামখেয়ালিপনা করতেন—কথা নেই বার্তা নেই তাঁরা পুরো রাজধানী এক শহর থেকে অন্য শহরে নিয়ে যেতেন। রাজা-বাদশাহদের সেই খামখেয়ালি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেউ টুঁ শব্দটি করত না, কার ঘাড়ে দুটি মাথা আছে যে, এর প্রতিবাদ করে নিজের গর্দানটি হারাবে? আমি ভেবেছিলাম, এখন তো রাজা-বাদশাহদের আমল নয়—এখন গণতান্ত্রিক সরকার, এ রকম একটা সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই কিছু খামখেয়ালি মানুষ নিয়ে ফেলবে না।
কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, আমি অবাক হয়ে দেখলাম, দেশের ইলেকট্রিসিটি বাঁচানোর কথা বলে হুট করে একদিন ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা এগিয়ে দেওয়া হলো! আমি দুর্বলভাবে পত্রিকায় একটা লেখা লিখেছিলাম—কিন্তু কার সময় আছে আমাদের মতো মানুষের লেখা পড়ার কিংবা সেই লেখা বিবেচনা করার? আজকে আবার লিখতে বসেছি, আগের বার যখন লিখেছিলাম তখন নিজের ভেতর যে অনুভূতিটা ছিল সেটা ছিল খানিকটা হতাশার। এখন যখন লিখছি তখন আমার ভেতরকার অনুভূতিটা রীতিমতো ক্রোধের অনুভূতি। আস্ত একটা দেশের মানুষকে প্রতারণা করা হলে যেটুকু ক্রোধান্বিত হওয়ার কথা আমি এই মুহূর্তে ঠিক সে রকম ক্রোধান্বিত। ‘ডে লাইট সেভিং’ এর কথা বলে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এখন বলা হচ্ছে, এটা বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সময় নির্ধারণের পদ্ধতির বাইরে ঠেলে দিয়ে পাকাপাকিভাবে এক ঘণ্টা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এর চেয়ে বড় প্রতারণা আর কী হতে পারে?
যে সব দেশে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে নেওয়া হয় এবং পিছিয়ে নেওয়া হয় আমি সে রকম একটি দেশে প্রায় ১৮ বছর ছিলাম। কাজেই এই ব্যাপারটি কী আমি সেটা খুব ভালো করে জানি। আমার ধারণা, কেন এই ধরনের বিচিত্র একটা কাজ করা হয় সে ব্যাপারে এ দেশের বেশির ভাগ মানুষের ধারণা ছিল না। কাজেই হুট করে যখন এটা করা হলো, তখন সবাই নিশ্চয়ই আকাশ থেকে পড়েছে। ইলেকট্রিসিটি বাঁচানোর একটা খোঁড়া যুক্তি দিয়ে ঘটনাটা ঘটানো হয়েছিল, তাই অনেক পত্র-পত্রিকাও এর পক্ষে সম্পাদকীয় লিখে ফেলেছিল, আমি আবিষ্কার করেছিলাম এর বিরুদ্ধে কথা বলার মানুষ বলতে গেলে কেউ ছিল না।
আমার ধারণা ছিল, ব্যাপারটা ঘটার পর দেশে এমন একটা গোলমাল লেগে যাবে যে, সরকার সঙ্গে সঙ্গে টের পাবে কাজটা খুব বড় ধরনের বোকামি হয়েছে। (আমার মাঝে মাঝে জানার ইচ্ছা করে, সরকারটা কে বা কী! এটা কী একটা বিমূর্ত ব্যাপার, যারা অদৃশ্য থেকে দেশের বড় বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, কিন্তু কে ঘটনাটা ঘটিয়েছে সেটা কী কেউ জানতে পারবে না?) যাই হোক, আমি সবিস্ময়ে লক্ষ করলাম, দেশে কোনো বড় ধরনের গোলমাল হলো না, সবাই ব্যাপারটা বেশ সহজেই মেনে নিল। বলতে দ্বিধা নেই, আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম।
দেশে কেন বড় ধরনের কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না, সেটা বুঝেছি অনেক পরে। আমার পরিচিত একজন হঠাত্ খুব বড় ধরনের ঝামেলায় পড়েছে, রীতিমতো পুলিশের হস্তক্ষেপ করিয়ে তাকে ঝামেলামুক্ত করা হয়েছে। মানুষটি সবিস্তারে যখন আমার কাছে ঘটনাটি বর্ণনা করছে, তখন তাকে আমি মাঝপথে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘রাত তখন কয়টা?’
মানুষটি বলল, ‘আসল টাইম ১০টা। ডিজিটাল টাইম ১১টা।’
আমি তখন সবিস্ময়ে আবিষ্কার করলাম, এ দেশের অনেক মানুষ ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টা গ্রহণ করেনি। তারা এখনো সেটাকে সরকারের এক ধরনের খামখেয়ালি কাণ্ড হিসেবে ধরে নিয়ে ‘আসল টাইমে’ তাদের জীবন চালিয়ে যাচ্ছে! শুধু তাই নয়, তারা সরকারের হুট করে ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা এগিয়ে দেওয়ার ফলে তৈরি হওয়া এই নতুন সময়টার নাম দিয়েছে ‘ডিজিটাল টাইম’—যদিও ডিজিটাল প্রযুক্তি বলতে যা বোঝায় তার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
এই সরকার নির্বাচনে জিতে দেশ চালানোর দায়িত্ব পেয়েছে দেশের কমবয়সী ভোটারদের ভোটে, তারা মেনিফেস্টোর দুটি বিষয়কে খুব আগ্রহের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল, একটা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীর বিচার, দ্বিতীয়টি হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশের অঙ্গীকার। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কথাটা খুব সুন্দর দুই শব্দে বুঝিয়ে দেওয়া যায় যে, আমরা আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর একটা দেশ গড়তে চাইছি। শব্দটি অত্যন্ত ইতিবাচক, শব্দটির মাঝে একটা স্বপ্ন লুকিয়ে আছে।
‘ডিজিটাল টাইম’ শব্দটিতে কোনো স্বপ্ন লুকিয়ে নেই, এটা একটা টিটকারি! এটা একটা রসিকতা। সরকারের চমত্কার একটা স্বপ্নকে টিটকারিতে পরিণত করার সুযোগ যাঁরা করে দিয়েছেন তাদের কী জিজ্ঞেস করা যায়, তাঁরা কার বুদ্ধিতে এটা করেছেন?

২.
সরকার যখন প্রথম ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল তখন আমরা সতর্ক করে দেওয়ার জন্য বলেছিলাম কাজটি বুদ্ধিমানের মতো হয়নি। কারণ যদি কখনো গ্রীষ্মকালে এক ঘণ্টা সময় এগিয়ে নেওয়া হয় তাহলে শীতকালে এটা আবার এক ঘণ্টা পিছিয়ে নিতে হয়। মার্কিন যুক্তিরাষ্ট্র বা ইউরোপের মতো দেশ সেটা করতে পারে, আমাদের মতো দেশের জন্য সেটা এত সহজ নয়, বছরে দুবার করে এই হাঙ্গামা করার মতো ক্ষমতা আমাদের দেশের নেই। কাজেই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে এ রকম ঝামেলার মাঝে না যাওয়া। সরকার তার পরেও এই ঝামেলাটা নিজের ঘাড়ে তুলে নিল, আমরা এটা সহ্য করেছি এবং এতদিন নিঃশ্বাস বন্ধ করে সহ্য করে আছি যে, শীতকালে ঘড়ির কাঁটা আবার এক ঘণ্টা পিছিয়ে নেওয়ার সময় সরকার বুঝতে পারবে কাজটা বুদ্ধিমানের মতো হয়নি। তারপর ভবিষ্যতে আর এ ঝামেলায় পড়তে চাইবে না।
ঠিক যখন ঘড়ির কাঁটা আবার পিছিয়ে নেওয়ার সময় হলো, তখন হঠাত্ করে একদিন রাতের বেলা আমার টেলিফোন বাজতে থাকে, ফোন ধরতেই শুনতে পেলাম, বিবিসি থেকে একজন আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, ‘আপনি কী জানেন সরকার ঠিক করেছে তারা ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে নেবে না?’ আমি আকাশ থেকে পড়লাম, নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না! ঘড়ির কাঁটা নাড়াচাড়া করার পেছনে তবু এক ধরনের যুক্তি আছে, কিন্তু ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা এগিয়ে নিয়ে আর কোনোদিন সেটা পিছিয়ে না আনাটা স্রেফ এক ধরনের পাগলামি, তুঘলক খান বা কালিগুলারা এগুলো করত—তাই বলে একটা গণতান্ত্রিক সরকার? তারা কী জানে যে, এ ব্যাপারটা হঠাত্ করে ঘোষণা করাতে এই শুক্রবারটিকে শনিবার বলে বিবেচনা করার মতো? কিংবা ২০০৯ সালের পর ২০১০ সাল না এসে ২০১১ সাল আসবে—এ রকম একটা ঘোষণা দেওয়ার মতো? বিবিসির প্রতিবেদক আমাকে বললেন, ‘আপনি কী জ্বালানি উপদেষ্টার বক্তব্যটা শুনতে চান?’
আমি শুনতে চাইলাম, তখন তাঁরা আমাকে সেটা শোনালেন। আমাদের জ্বালানি উপদেষ্টা বললেন, ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে না আনার কারণে যে সব সমস্যা হবে, সেই সমস্যার সমাধান করা হবে অফিস-আদালত বা স্কুলের সময়সূচি এক ঘণ্টা পিছিয়ে দিয়ে! রসিকতাটা কী কেউ ধরতে পেরেছেন? ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা এগিয়ে নেয়া হলো, সেই সমস্যাটা মেটানোর জন্য অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজের সময়সূচিও এক ঘণ্টা পরিবর্তন করা হলো! যদি সময়সূচি পরিবর্তন করেই সমস্যায় সমাধান করতে হবে তাহলে সেই গ্রীষ্মকালে অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজের সময়সূচি পরিবর্তন করে দেওয়া হলো না কেন? তাহলে তো ঘড়ির কাঁটা পরিবর্তন করতে হতো না। এটা হুবহু হবুচন্দ্র রাজার গল্পের মতো—পা দুটো ঢেকে ফেললেই পায়ে ধুলো-মাটি লাগে না! পাকে ধুলো-বালি থেকে রক্ষা করার জন্য সারা পৃথিবীকে চামড়া দিয়ে ঢাকতে হয় না। ঠিক সে রকম অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজের সময়সূচিকে পরিবর্তন করলেই ইলেকট্রিসিটির খরচ কমানো যায়—সে জন্য সারা দেশের সব ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা এগিয়ে দিতে হয় না।
বিবিসির প্রতিবেদক এ ব্যাপারে আমার মন্তব্য জানতে চেয়েছিলেন, আমার যতদূর মনে পড়ে আমি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ গলায় কিছু কথা বলেছিলাম, একাধিকবার ‘উন্মাদ’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলাম। ধারণা করছি, বিবিসির মতো সম্ভ্রান্ত প্রতিষ্ঠান আমার ক্রুদ্ধ চিত্কারকে কাটছাঁট করে সেটাকে ভদ্র একটা রূপ দিয়ে প্রচার করেছিল।

৩.
এতক্ষণ ছিল ভূমিকা, এবার আসল কথায় আসি! পৃথিবীর বড় বড় মনীষী মিলে সারা পৃথিবীর মাঝে একটা সমন্বয় করেছেন, সেটাকে নানাভাবে ভাগ করেছেন। একটা ভাগের নাম দ্রাঘিমাংশ। পৃথিবীটা গোলাকার, গোলাকার বৃত্তের কেন্দ্রে মোট কোণের পরিমাণ ৩৬০ ডিগ্রি। ৩৬০ ডিগ্রি হচ্ছে চারটি সমকোণ, প্রত্যেকটি সমকোণ হচ্ছে ৯০ ডিগ্রি, কাজেই পৃথিবীর ওপর চারটি সমকোণের ওপর দিয়ে চারটি দ্রাঘিমারেখা চলে গেছে। ০ ডিগ্রির দ্রাঘিমারেখাটা গেছে গ্রিনিচের ওপর দিয়ে, (সে জন্য আমরা কথায় কথায় বলি গ্রিনিচের সময়!) এর পরের সমকোণটি হচ্ছে ৯০ ডিগ্রি, আমাদের দেশের অনেকেই হয়তো জানেন না, এই ৯০ ডিগ্রি দ্রাঘিমারেখাটি ঠিক বাংলাদেশের ওপর দিয়ে চলে গেছে। (আমার একটা জিপিএস আছে আমি সেটা দিয়ে এই ৯০ ডিগ্রি দ্রাঘিমারেখা খুঁজে বের করেছি—যতবার আমি সেটা অতিক্রম করি, আমি আনন্দের একটা শব্দ করি। মানিকগঞ্জের চৌরাস্তার মোড় থেকে উত্তর-দক্ষিণে যে রাস্তাটা গেছে সেটা প্রায় ৯০ ডিগ্রি দ্রাঘিমারেখা দিয়ে গেছে!)
৯০ ডিগ্রি দ্রাঘিমারেখার একটা খুব বড় গুরুত্ব আছে—সেটা হচ্ছে গ্রিনিচের সময় থেকে এর পার্থক্য হচ্ছে কাঁটায় কাঁটায় ছয় ঘণ্টা। ভারত, পাকিস্তান বা মিয়ানামার তাদের ঘড়ি একটু এদিক-সেদিক করতে পারে, তাতে পৃথিবীর সৌন্দর্যের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। কিন্তু যে দেশের ওপর দিয়ে ৯০ ডিগ্রি দ্রাঘিমারেখাটি গেছে সেই দেশ যদি তাদের সময়টি গ্রিনিচের সময় থেকে ঠিক ছয় ঘণ্টা পরে নির্ধারণ না করে তাহলে তারা যে কাজটি করবে সেটা আমার চোখে একটা অনেক বড় অপরাধ। পৃথিবীর বড় বড় মনীষী মিলে সারা পৃথিবীকে একটা নিয়মনীতির মাঝে এনেছেন, কয়েকজন খামখেয়ালি মানুষ মিলে আমাদের দেশকে সারা পৃথিবীর নিয়মনীতি থেকে সরিয়ে উদ্ভট একটা জায়গায় নিয়ে যাবেন, সেটা কোনোমতে মেনে নেয়া যায় না।
যাঁরা এ সিদ্ধান্তগুলো নেন, তাদের কাছে আমি হাত জোড় করে অনুরোধ করি, এ দেশের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের বড় বড় প্রফেসরকে ডেকে একটিবার তাদের সঙ্গে কথা বলে নিন। তাদের জিজ্ঞেস করে দেখুন ৯০ ডিগ্রি দ্রাঘিমারেখা যে দেশের ওপর দিয়ে গেছে গ্রিনিচ সময় থেকে সাত ঘণ্টা পরে সময় নির্ধারণ করার কোনো নৈতিক অধিকার সেই দেশের আছে কি না। আমরা স্কুলের বাচ্চাদের শেখাই ২৪ ঘণ্টা সময়টি কেমন করে সারা পৃথিবীতে ভাগ করে দেয়া হয়েছে, খুব জোর গলায় বলি, প্রতি ৯০ ডিগ্রি হচ্ছে ছয় ঘণ্টা সময়। আমাদের কিছু খামখেয়ালি মানুষের কারণে আমরা আমাদের স্কুলের বাচ্চাদের এই বিষয়টি আর বলতে পারছি না!

৪.
আমি যে প্রফেসরের সঙ্গে পিএইচডি করেছি তিনি আমাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস শিখিয়েছিলেন। তার একটি হচ্ছে, ‘যদি কোনো কিছু কাজ করে তাহলে সেটা ঠিক করার চেষ্টা করো না!’ অনেকেই হয়তো জেনে থাকবেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির আবেদন প্রক্রিয়াটি এবার আমরা মোবাইল টেলিফোনের এসএমএস দিয়ে করে ফেলেছি। এটা করার জন্য যে ডেটাবেস তৈরি করা হয়েছিল, সেটা আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যখন দেখতে পেলাম ঠিক ঠিক কাজ করছে তারপর আমরা একবারও সেটাতে হাত দিইনি! কেউ কেউ সেটাকে আরেকটু সংস্কার করার প্রস্তাব দিচ্ছিলেন, আমি সেটা করতে দিইনি—আমি আমার প্রফেসরের আপ্তবাক্য স্মরণ রেখেছি যেটা কাজ করছে সেটাকে ঠিক করার চেষ্টা করতে হয় না। আমার ধারণা, সে কারণে আমরা একটিবারও কোনো সমস্যায় পড়িনি।
আমার প্রফেসর আমাকে আরেকটা জিনিস শিখিয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘তুমি তোমার ঘোড়াকে নিয়ে কেরদানি করতে চাও কর—আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু সেই কেরদানি করতে গিয়ে যদি তোমার ঘোড়া মারা যায় তাহলে খবরদার ঘোড়ার মৃতদেহ নিয়ে টানাহেঁচড়া করবে না—দ্রুত সেটাকে মাটিতে পুঁতে ফেলবে।’
ঘড়ির কাঁটা নিয়ে যারা কেরদানি করেছেন তাদের জানতে হবে ঘড়ির কাঁটা নামক এ ঘোড়াটা মারা গেছে। এর মৃতদেহটি নিয়ে টানাহেঁচড়া করে কোনো লাভ নেই—এখন এটাকে মাটিতে পুঁতে ফেলার সময় হয়েছে।
যদি সেটা না করা হয়, তাহলে সেটা পচে-গলে সেখান থেকে দুর্গন্ধ ছড়াবে, আর কোনো লাভ হবে না।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: লেখক। অধ্যাপক শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ০৯-১১-২০০৯

Exit mobile version