ঢাকা বিভাগ হইতে প্রত্যাগমন-পরে দীনবন্ধু “নবীন তপস্বিনী” প্রণয়ন করেন। উহা কৃষ্ণনগরে মুদ্রিত হয়। ঐ মুদ্রাযন্ত্রটি দীনবন্ধু প্রভৃতি কয়েক জন কৃতবিদ্যের উদ্যোগে স্থাপিত হইয়াছিল, কিন্তু স্থায়ী হয় নাই।
দীনবন্ধু নদীয়া বিভাগ হইতে পুনর্বার ঢাকা বিভাগে প্রেরিত হয়েন। আবার ফিরিয়া আসিয়া উড়িষ্যা বিভাগে প্রেরিত হয়েন। পুনর্বার নদীয়া বিভাগে আইসেন। কৃষ্ণনগরেই তিনি অধিক কাল অবস্থিতি করিয়াছিলেন। সেখানে একটি বাড়ী কিনিয়াছিলেন। সন ১৮৬৯ সালের শেষে বা সন ১৮৭০ সালের প্রথমে তিনি কৃষ্ণনগর পরিত্যাগ করিয়া, কলিকাতায় সুপরনিউমররি ইন্স্পেক্টিং পোষ্টমাষ্টার নিযুক্ত হইয়া আইসেন। পোষ্টমাষ্টার জেনেরলের সাহায্যই এ পদের কার্য। দীনবন্ধুর সাহায্যে পোষ্ট আপিসের কার্য কয় বৎসর অতি সুচারুরূপে সম্পাদিত হইতে লাগিল। ১৮৭১ সালে দীনবন্ধু লুশাই যুদ্ধের ডাকের বন্দোবস্ত করিবার জন্য কাছাড় গমন করেন। তথায় সেই গুরুতর কার্য সম্পন্ন করিয়া অল্পকালমধ্যে প্রত্যাগমন করেন।
কলিকাতায় অবস্থিতি কালে, তিনি “রায় বাহাদুর” উপাধি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। এই উপাধি যিনি প্রাপ্ত হয়েন, তিনি আপনাকে কত দূর কৃতার্থ মনে করেন বলিতে পারি না। দীনবন্ধুর অদৃষ্টে ঐ পুরস্কার ভিন্ন আর কিছু ঘটে নাই। কেন না, দীনবন্ধু বাঙ্গালি-কুলে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি প্রথম শ্রেণীর বেতন পাইতেন বটে, কিন্তু কালসাহায্যে প্রথম শ্রেণীর বেতন চতুষ্পদ জন্তুদিগেরও প্রাপ্য হইয়া থাকে। পৃথিবীর সর্বত্রই প্রথমশ্রেণীভুক্ত গর্দভ দেখা যায়।
দীনবন্ধু এবং সূর্যনারায়ণ এই দুই জন পোষ্টাল বিভাগের কর্মচারীদিগের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুদক্ষ বলিয়া গণ্য ছিলেন। সূর্যনারায়ণ বাবু আসামের কার্যের গুরু ভার লইয়া তথায় অবস্থিতি করিতেন ; অন্য যেখানে কোন কঠিন কার্য পড়িত, দীনবন্ধু সেইখানেই প্রেরিত হইতেন। এইরূপ কার্যে ঢাকা, উড়িষ্যা, উত্তর, পশ্চিম, দারজিলিঙ্গ, কাছাড় প্রভৃতি স্থানে সর্বদা যাইতেন। এইরূপে, তিনি বাঙ্গালা ও উড়িষ্যার প্রায় সর্ব স্থানেই গমন করিয়াছিলেন, বেহারেরও অনেক স্থান দেখিয়াছিলেন। পোষ্টাল বিভাগের যে পরিশ্রমের ভাগ তাহা তাঁহার ছিল, পুরস্কারের ভাগ অন্যের কপালে ঘটিল।
দীনবন্ধুর যেরূপ কার্যদক্ষতা এবং বহুদর্শিতা ছিল, তাহাতে তিনি যদি বাঙ্গালী না হইতেন, তাহা হইলে মৃত্যুর অনেক দিন পূর্বেই তিনি পোষ্টমাষ্টার জেনেরল হইতেন, এবং কালে ডাইরেক্টর জেনেরল হইতে পারিতেন। কিন্তু যেমন শতবার ধৌত করিলে অঙ্গারের মালিন্য যায় না, তেমনি কাহারও কাহারও কাছে সহস্র গুণ থাকিলেও কৃষ্ণবর্ণের দোষ যায় না। Charity যেমন সহস্র দোষ ঢাকিয়া রাখে, কৃষ্ণচর্মে তেমনি সহস্র গুণ ঢাকিয়া রাখে।
পুরস্কার দূরে থাকুক, শেষাবস্থায় দীনবন্ধু অনেক লাঞ্ছনা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। পোষ্টমাষ্টার জেনেরল এবং ডাইরেক্টর জেনেরলে বিবাদ উপস্থিত হইল। দীনবন্ধুর অপরাধ, তিনি পোষ্টমাষ্টার জেনেরলের সাহায্য করিতেন। এজন্য তিনি কার্যান্তরে নিযুক্ত হইলেন। প্রথম কিছু দিন রেলওয়ের কার্যে নিযুক্ত হইয়াছিলেন। তাহার পরে হাবড়া ডিবিজনে নিযুক্ত হয়েন। সেই শেষ পরিবর্তন।
শ্রমাধিক্যে অনেক দিন হইতে দীনবন্ধু উৎকটরোগাক্রান্ত হইয়াছিলেন। কেহ কেহ বলেন, বহুমূত্র রোগ প্রায় সাংঘাতিক হয়। সে কথা সত্য কি না বলা যায় না, কিন্তু ইদানীং মনে করিয়াছিলাম যে, দীনবন্ধু বুঝি রোগের হাত হইতে মুক্তি পাইবেন। রোগাক্রান্ত হইয়া অবধি দীনবন্ধু অতি সাবধান, এবং অবিহিতাচারবর্জিত হইয়াছিলেন। অতি অল্প পরিমাণে অহিফেন সেবন আরম্ভ করিয়াছিলেন। তাহাতে রোগের কিঞ্চিৎ উপশম হইয়াছে বলিতেন। পরে সন ১২৮০ সালের আশ্বিন মাসে অকস্মাৎ বিস্ফোটককর্তৃক আক্রান্ত হইয়া শয্যাগত হইলেন। তাঁহার মৃত্যুর বৃত্তান্ত সকলে অবগত আছেন। বিস্তারিত লেখার আবশ্যক নাই। লিখিতেও পারি না। যদি মনুষ্যের প্রার্থনা সফল হইবার সম্ভাবনা থাকিত, তবে প্রার্থনা করিতাম যে, এরূপ সুহৃদের মৃত্যুর কথা কাহাকেও যেন লিখিতে না হয়।
নবীন তপস্বিনীর পর “বিয়েপাগলা বুড়ো” প্রচার হয়। দীনবন্ধুর অনেকগুলিন গ্রন্থ প্রকৃত-ঘটনা-মূলক এবং অনেক জীবিত ব্যক্তির চরিত্র তাঁহার প্রণীত চরিত্রে অনুকৃত হইয়াছে। “নীল-দর্পণে”র অনেকগুলি ঘটনা প্রকৃত ; “নবীন তপস্বিনী”র বড় রাণী ছোট রাণীর বৃত্তান্ত প্রকৃত। “সধবার একাদশী”র প্রায় সকল নায়ক-নায়িকাগুলিন জীবিত ব্যক্তির প্রতিকৃতি ; তদ্বর্ণিত ঘটনাগুলির মধ্যে কিয়দংশ প্রকৃত ঘটনা, “জামাই-বারিকে”র দুই স্ত্রীর বৃত্তান্ত প্রকৃত। “বিয়েপাগলা বুড়ো”ও জীবিত ব্যক্তিকে লক্ষ্য করিয়া লিখিত হইয়াছিল।
প্রকৃত ঘটনা, জীবিত ব্যক্তির চরিত্র প্রাচীন উপন্যাস, ইংরেজি গ্রন্থ এবং “প্রচলিত খোসগল্প” হইতে সারাদান করিয়া দীনবন্ধু তাঁহার অপূর্ব চিত্তরঞ্জক নাটক সকলের সৃষ্টি করিতেন। নবীন তপস্বিনীতে ইহার উত্তম দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। রাজা রমণীমোহনের বৃত্তান্ত কতক প্রকৃত। হোঁদলকুঁৎকুঁতের ব্যাপারে প্রাচীন-উপন্যাসমূলক ; “জলধর” “জগদম্বা” “Merry Wives of Windsor” হইতে নীত।
বাঙ্গালি-পাঠক-মধ্যে নিতান্ত অশিক্ষিত অনেক আছেন। তাঁহারা ভাবিবেন, যদি দীনবন্ধুর গ্রন্থের মূল প্রাচীন উপন্যাসে, ইংরেজি গ্রন্থে বা প্রচলিত গল্পে আছে, তবে আর তাঁহার গ্রন্থের প্রশংসা কি? তাঁহারা ভাবিবেন, আমি দীনবন্ধুর অপ্রশংসা করিতেছি। এ সম্প্রদায়ের পাঠকদিগকে কোন কথা বুঝাইয়া বলিতে আমি অনিচ্ছুক, কেন না, জলে আলিপনা সম্ভবে না। সেক্ষপীয়রের প্রায় এমন নাটক নাই যাহা কোন প্রাচীনতর-গ্রন্থমূলক নহে। স্কটের অনেকগুলি উপন্যাস প্রাচীন কথা বা প্রাচীন-গ্রন্থমূলক। মহাভারত রামায়ণের অনুকরণ। ইনিদ্, ইলিয়দের অনুকরণ। ইহার মধ্যে কোন্ গ্রন্থ অপ্রশংসনীয়?
“সধবার একাদশী” “বিয়ে পাগলা বুড়ো”র পরে প্রকাশিত হইয়াছিল, কিন্তু উহা তৎপূর্বে লিখিত হইয়াছিল। সধবার একাদশীর যেমন অসাধারণ গুণ আছে, তেমনি অনেক অসাধারণ দোষও আছে। এই প্রহসন বিশুদ্ধ রুচির অনুমোদিত নহে, এই জন্য আমি দীনবন্ধুকে বিশেষ অনুরোধ করিয়াছিলাম যে ইহার বিশেষ পরিবর্তন ব্যাতীত প্রচার না হয়। কিছুদিন মাত্র এ অনুরোধ রক্ষা হইয়াছিল। অনেকে বলিবেন, এ অনুরোধ রক্ষা হয় নাই ভালই হইয়াছে আমরা “নিমচাঁদ”কে দেখিতে পাইয়াছি। অনেকে ইহার বিপরীত বলিবেন।
“লীলাবতী” বিশেষ যত্নের সহিত রচিত, এবং দীনবন্ধুর অন্যান্য নাটকাপেক্ষা ইহাতে দোষ অল্প। এই সময়কে দীনবন্ধুর কবিত্বসূর্যের মধ্যাহ্নকাল বলা যাইতে পারে। ইহার পর হইতে কিঞ্চিৎ তেজঃক্ষতি দেখা যায়। এরূপ উদাহরণ অনেক পাওয়া যায়। স্কট প্রথমে পদ্যগ্রন্থ লিখিতে আরম্ভ করেন। প্রথম তিনখানি কাব্য অত্যুৎকৃষ্ট হয়, “Lady of the Lake” নামক কাব্যের পর আর তেমন হইল না। দেখিয়া, স্কট পদ্য লেখা ত্যাগ করিলেন, গদ্যকাব্য লিখিতে আরম্ভ করিলেন, গদ্যকাব্য-লেখক বলিয়া স্কটের যে যশ, তাহার মূল প্রথম পনের বা ষোলখানি নবেল। “Kenilworth” নামক গ্রন্থের পর স্কটের আর কোন উপন্যাস প্রথম শ্রেণীতে স্থান পাইবার যোগ্য হয় নাই। মধ্যাহ্নের প্রখর রৌদ্রের সঙ্গে সন্ধ্যাকালীন ক্ষীণালোকের যে সম্বন্ধ, “Ivanhoe” এবং “Kenilworth” প্রভৃতির সঙ্গে স্কটের শেষ দুইখানি গদ্য-কাব্যের সেই সম্বন্ধ।
“লীলাবতী”র পর দীনবন্ধুর লেখনী কিছুকাল বিশ্রাম লাভ করিয়াছিল। সেই বিশ্রামের পর “সুরধুনী কাব্য” “জামাই-বারিক” এবং “দ্বাদশ কবিতা” অতি শীঘ্র প্রকাশিত হয়। “সুরধুনী কাব্য” অনেক দিন পূর্বে লিখিত হইয়াছিল। ইহার কিয়দংশ “বিয়েপাগলা বুড়ো”রও পূর্বে লিখিত হইয়াছিল। ইহাও প্রচার না হয়, আমি এমত অনুরোধ করিয়াছিলাম,—আমার বিবেচনায় ইহা দীনবন্ধুর লেখনীর যোগ্য হয় নাই। বোধ হয়, অন্যান্য বন্ধুগণও এইরূপ অনুরোধ করিয়াছিলেন। এইজন্য ইহা অনেক দিন অপ্রকাশ ছিল।