Site icon BnBoi.Com

ভারতবর্ষ – প্রমথ চৌধুরী

ভারতবর্ষ - প্রমথ চৌধুরী

অনু-হিন্দুস্থান

অনু-হিন্দুস্থান
[কোনো পারিবারিক সমিতিতে পঠিত]

হে সমিতির কুমারগণ, আমাদের দেশের লোকের বিশ্বাস যে হিন্দুস্থানের বাইরে হিন্দুর আর স্থান নেই। এ বিশ্বাস সর্বসাধারণ। শিক্ষিত অশিক্ষিত সকলেরই ধারণা যে, হিন্দুধর্ম ও হিন্দুজাতি আছে শুধু জিয়োগ্রাফিতে—যাকে বলে ভারতবর্ষ তারই চতুঃসীমার মধ্যে।

আমরা সকলেই দেখতে পাই, ভারতবর্ষের পশ্চিমে রয়েছে মুসলমান, উত্তরেও তাই, পূর্বে বৌদ্ধ, আর দক্ষিণে সমুদ্র। আর সমুদ্রের ওপারে যদি কোনো দেশ থাকে তো সে দেশে হিন্দুজাত কখনো যায় নি; আর যদি কখনো গিয়ে থাকে তো তখনই তাদের হিন্দুত্ব মারা গিয়েছে। কেননা একালে হিন্দুজাতির সমুদ্রযাত্রার অর্থ তার গঙ্গাযাত্রা।

এ ধারণা শিক্ষিতলোকসামান্য হলেও, অশিক্ষিত ধারণা। ইংরেজি শিক্ষার চশমা পরলে আমাদের বর্তমান জাতীয় দৈন্য ও হীনতা সম্বন্ধে আমাদের চোখ যেমন ফোটে, আমাদের জাতীয় পূর্বগৌরব ও ঐশ্বর্য সম্বন্ধে আমরা তেমনি অন্ধ হই। আমাদের নতুন শিক্ষা এসেছে পশ্চিম থেকে। এর ফলে আমরা পূর্ব সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ–পূর্বকাল সম্বন্ধেও, পূর্বদিক সম্বন্ধেও। ভারতবর্ষের পূর্বকালের হিস্টরির সঙ্গে আমাদের যদি কিছুমাত্র পরিচয় থাকত তা হলে আমরা জানতুম যে, ভারতবর্ষের পূর্বের অনেক দেশেও অনেককাল ধরে হিন্দুধর্ম ও হিন্দু,জাতি রাজত্ব করেছে। আজকাল অনেকে যাকে ভারতবর্ষের অতীত বলে চালিয়ে দিতে চান, তা কোনো দেশেরই অতীত নয়, ভারতবর্ষের তো নয়ই। বেশির ভাগ লোকের মতে ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ যেমন ইউরোপের বর্তমান, জনকতক লোকের মতে ভারতবর্ষের অতীতও তেমনি ইউরোপের বর্তমান। আমাদের কল্পনার দৌড়ও বিলেত পর্যন্ত।

আমাদের শাস্ত্রকাররা বলেন লোকের নাম থেকে দেশের নাম হয়, দেশের নাম থেকে লোকের নাম হয় না। যথা, আর্যরা বাস করতেন বলেই আধখানা ভারতবর্ষের নাম হয়েছিল আর্যবর্ত; আর আর্যরা যদি অপর কোনো দেশে গিয়ে বাস করেন, তা হলে সে দেশের নামও হবে আর্যাবর্ত। এই হিসেবে ভারতবর্ষ ও চীনের ভিতর যে-সব দেশ আছে, সে-সব ভূভাগকে উপ-হিন্দুস্থান বলা অন্যায় নয়। যাক সেসব পরোনো কথা। তোমরা শুনে আশ্চর্য হবে যে, আজও এশিয়ার এক কোণে এমন একটি দেশ আছে, যেখানকার ষোলো-আনা অধিবাসী আজও হিন্দু। সেই দেশটির সঙ্গে তোমাদের চেনাপরিচয় করিয়ে দিতে চাই। সে পরিচয় করিয়ে দিতে বেশিক্ষণ লাগবে না। মাপে ও ম্যাপে ভারতবর্ষ যেমন বড়ো, সে দেশটি তেমনি ছোটো। ভারতবর্ষের তুলনায় সেটি তালের তুলনায় তিল যদ্রুপ, তদ্রুপ। এমন-কি, মানচিত্রেও সে দেশটি হঠাৎ কারো চোখে পড়ে না; অনেক খুঁজেপেতে সেটিকে বার করতে হয়। সেকালের উপ-হিন্দুস্থানের দক্ষিণে ম্যাপের গায়ে যে কতকগুলো কালির ছিটেফোঁটা দেখা যায়, তারই এক বিন্দু হচ্ছে এই বর্তমান অন-হিন্দুস্থান।

ও দেশের হিস্টরি তোমরা না জান, তার নাম তোমরা নিশ্চয়ই শুনেছ। এর নাম বলিদ্বীপ এবং এটি হচ্ছে যবদ্বীপ থেকে ভাঙা এক টুকরো খণ্ডদ্বীপ। ম্যাপে দেখতে পাওয়া যায় যে, জাভা সমুদ্রের মধ্যে পশ্চিমে মাথা করে পুর্বে পা ছড়িয়ে অনন্তশয্যায় শুয়ে রয়েছে; আর তার পায়ের গোঁড়ায় পুটলি পাকিয়ে জড়োসড়ো হয়ে রয়েছে–বলি। এ দুটি দ্বীপকে যদি খাড়া করে তোলা যায়—অর্থাৎ তাদের মাথা যদি পশ্চিম থেকে উত্তরে ফিরিয়ে দেওয়া যায়, আর পা পর্ব থেকে দক্ষিণে–তা হলে ভারতবর্ষের নীচে লঙ্কা যেমন দেখায়, জাভার নীচে বলিও তেমনি দেখাবে। এ কথাটা এখানে বলে রাখছি এইজন্যে যে, সিংহলের পূর্ব-ইতিহাস যেমন ভারতবর্ষের পূর্ব-ইতিহাসের একটা ছেঁড়াপাতা মাত্র, বলির ইতিহাসও তেমনি জাভার ইতিহাসের একটি ছিন্নপত্র।

জাভা ও বলির মধ্যে যে সমুদ্রের ব্যবধান আছে, সে অতি সামান্য। সে শাখাসমুদ্রটুকু মাইল দেড়েকের বেশি চওড়া নয়, অর্থাৎ চাঁদপুরের নীচে মেঘনার তুল্য। বলিদ্বীপ কতটা লম্বা আর কতটা চওড়া তা শুনলে তোমরা হাসবে। বলি দৈঘ্যে ৯৩ মাইল ও প্রস্থে মোটে ৫০ মাইল; তাও আবার সমস্তটা সমতলভূমি নয়। এই ছোট্ট দেশের মধ্যে বহুসংখ্যক হ্রদ আছে, আর সে-সব হ্রদ এত গভীর যে, তাদের অতলস্পর্শী বললেও অত্যুক্তি হয় না। তার উপর একটি একটানা পর্বতশ্রেণীর দ্বারা দেশটি দু ভাগে বিভক্ত। দেশ ছোটো, কিন্তু তার পর্বত যেমন লম্বা তেমনি উঁচু; অর্থাৎ ও হচ্ছে একরকম বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি। সে পর্বতের উচ্চতা কোথায়ও সাড়ে তিন হাজার ফুটের কম নয়, কোথাও-বা তা দশ হাজার ফট পর্যন্ত মাথা তুলেছে। এ পর্বত বলিদেশকে উত্তরাপথ ও দক্ষিণাপথে ভাগ করেছে–ভারতবর্ষের নকলে।

তোমরা হয়তো মনে ভাববে যে এই দেশেরই ইংরেজি নাম হচ্ছে লিলিপুট, কিন্তু তা নয়। গালিভার লিলিপুট-দেশের লোকের যে বর্ণনা করেছেন, তার সঙ্গে বলির অধিবাসীর চেহারার কোনো মিল নেই। এরা আকারে জাভার লোকের চেয়ে ঢের বেশি দীর্ঘাকৃতি ও বলিষ্ঠ। দেশ ছোটো হলে সেখানকার মানুষ যে বড়ো হয়, তা অন্যত্রও দেখা যায়। ইউরোপের ভিতর ইংলণ্ড সবচেয়ে ছোটো দেশ; কিন্তু এ দেশের মতো বড়োলোক ও-ভূভাগে অন্য কুত্রাপি মেলে না। অপর পক্ষে, অতি ক্ষুদ্র লোকের সাক্ষাৎ শুধু মহাদেশেই মেলে। বামনের জাত শুধু আফ্রিকাতেই আছে। গালিভার বলিদ্বীপে না গেলেও সিন্ধুবাদ যে সে দেশে গিয়েছিলেন তার প্রমাণ, যে বৃদ্ধ ভদ্রলোক তার কাঁধে ভর করেছিলেন, তিনি ছিলেন বলীয়ান।

বলির লোক শুধু বলিষ্ঠ নয়, অত্যন্ত কমিষ্ঠ। চাষবাসে তারা অতিশয় দক্ষ। তারা হাল-চালনা ছাড়া হাতের আরো অনেক কাজ করে। তারা চমৎকার কাপড় বোনে ও চমৎকার অস্ত্র বানায়। তাদের তুল্য তাঁতি ও কামার জাভায় পাওয়া যায় না। অন্ন বস্ত্র ও অস্ত্রের সংস্থান যে দেশে আছে, সে দেশে একালের আদর্শ সভ্যতার কোন উপকরণ নেই? আর শৌখিন অশনসনের ব্যবস্থাতেও বলি বঞ্চিত নয়। সে দেশে কফি জন্মায় আর তামাক জন্মায়। আর এ দুই তারা পান করে; একটা তাতিয়ে জল করে, আর-একটা পুড়িয়ে ধোঁয়া করে—যেমন আমরা করি। বলির লোক রেশমের কাপড়ও বোনে আর তা রঙাবার জন্য নীলের চাষও করে। সোনা দিয়ে তারা গহনা গড়ায় ও জরি বানায়। গহনা গড়তে ও জরির কাজ করতে তারা অদ্বিতীয় ওস্তাদ।

বলির ভাষা জাভার ভাষারই অনুরূপ। তবে ইতালির ভাষার সঙ্গে ফরাসি ভাষার যে প্রভেদ, যবীয় ভাষার সঙ্গে বলীয় ভাষার সেই প্রভেদ। এ দেশের সাহিত্যের ভাষার নাম ‘কবি’, ‘সাধু’ নয়। পাঁচশো বৎসর পূর্বে জাভার সাহিত্য কবি-ভাষাতেই লেখা হত। এ ভাষার অনেক শব্দ সংস্কৃত। এ যুগে জাভার লোক তাদের সাহিত্যের ভাষা বড়ো-একটা বুঝতে পারে না—কিন্তু বলির লোকের কাছে কবি মৃত নয়। চারশো বৎসর আগে জাভার লোক সব মুসলমান হয়ে যায়। সম্ভবত সেইজন্য তারা তাদের পূর্ব কবি-ভাষা ভুলে গিয়েছে; আর বলির লোক আজও হিন্দু, রয়েছে বলে কবির পঠনপাঠন সে দেশে আজও চলছে।

জাভার যথার্থ নাম যে যবদ্বীপ, তা তোমরা সবাই জান। সংস্কৃত যব শব্দের অন্তস্থ য আরবদেশের মুসলমানদের মুখে বর্গীয় জ-এ ও ব ভ-এ পরিণত হয়ে তদুপরি অকার আকার হয়ে জাভা রূপ ধারণ করেছে।

এই সংস্কৃত নাম থেকেই আন্দাজ করা যায় যে, পুরাকালে ও-দ্বীপের নামকরণ করেছিল হিন্দুরা। এখন তোমরা জিজ্ঞাসা করতে পার, কবে হিন্দুরা এ দ্বীপ আবিষ্কার করে। এর উত্তর দেওয়া অসম্ভব। তবে যেকালে এ দেশে রামায়ণ লেখা হয়, সেকালে যবদ্বীপ যে হিন্দুদের কাছে উক্ত নামেই পরিচিত ছিল তার প্রমাণ রামায়ণেই আছে। আর সে বড়ো কম দিনের কথা নয়। তোমরা সবাই জান যে, রামায়ণ রাম জন্মাবার ষাট হাজার বৎসর আগে লেখা হয়েছিল; আর রাম জন্মেছিলেন ত্রেতা যুগে।

শ্রীমৎ হনুমানকে যখন দেশদেশান্তরে সীতাকে অন্বেষণ করতে আদেশ দেওয়া হয়, তখন তাকে বলা হয়—

গিরিভির্যে চ গম্যন্তে প্লবনেন প্লবেন চ।
রত্নবন্তং যবদ্বীপং সপ্তরাজ্যোপশোভিতম।।
সুবৰ্ণরূপ্যকং চৈব সুবর্ণাকরমণ্ডিতম।
যবদ্বীপমতিক্রম্য শিশিরো নাম পর্বতঃ।
দিবং স্পৃশতি শৃঙ্গেন দেবদানবসেবিতঃ।

এ যবদ্বীপ যে বর্তমান জাভা, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা সেখানে যেতে হত প্লবনেন প্লবেন চ-অর্থাৎ হয় লাফিয়ে, নয় সাঁতরে, নয় ভেলায় চড়ে। কিষ্কিন্ধ্যা থেকে লঙ্কায় এক লম্ফে যাওয়া সোজা, কারণ এক লম্ফে তা যাওয়া যায়। কিন্তু মাদ্রাজ থেকে বলি যেতে হলে অসম্ভব হাই জাম্প ও লং জাম্প একসঙ্গে দুই চাই। আর বঙ্গ-উপসাগর তো ইংলিশ চ্যানেল নয় যে, সাঁতরে পার হওয়া যায়। সুতরাং ও দেশে ভেলায় চড়েই যেতে হত। যবদ্বীপ রত্নবন্ত ও সোনারূপোর দেশ আর সোনার খনিতে মণ্ডিত। কোনো কোনো ইউরোপীয় পণ্ডিত বলেন, এ দেশ জাভা নয়, সুমাত্রা। কেননা সোনার খনি জাভায় নেই ও কোনো কালে ছিল না–ছিল ও আছে শুধু সুমাত্রায়। অপর আর-এক দল বলেন যে, যবদ্বীপ জাভাই, সুমাত্রা নয়। কিন্তু আসল কথা এই যে, সেকালে হিন্দুদের কাছে জাভা ও সুমাত্রা উভয় দ্বীপই যবদ্বীপ বলে পরিচিত ছিল। সুমাত্রা পরে স্বর্ণদ্বীপ সুবর্ণদ্বীপ প্রভৃতি নাম ধারণ করে। সুমাত্রা নাম পুরোনো নয়। স্বর্ণদ্বীপে সমুদ্র বলে একটি নগর ছিল। সেই সমুদ্রই আরবি জবানে রুপান্তরিত হয়ে সুমাত্রা হয়েছে, এবং এই নতুন নামেই ও-দ্বীপ ইউরোপীয়দের কাছে পরিচিত, আর একালের জিয়োগ্রাফিতে প্রসিদ্ধ।

ইউরোপীয় পণ্ডিতরা বলেন যে, প্রাচীন হিন্দুদের ভূগোলের জ্ঞানের দৌড় ঐ যবদ্বীপ পর্যন্ত ছিল। তার পূর্বে যে আর-কোনো দেশ আছে, তা তাঁরা জানতেন না। তাই তাঁরা যবদ্বীপ অতিক্রম করে যে শিশির-পর্বতের উল্লেখ করেছেন, সে পর্বত তাঁদের ষোলো-আনা মনগড়া। আমি প্রথমত ইউরোপীয় নই, দ্বিতীয়ত পণ্ডিত নই; সুতরাং তাঁদের কথা আমি নতমস্তকে মেনে নিতে বাধ্য নই।

যবদ্বীপ অতিক্রম করে যে দ্বীপটি পাওয়া যায়, তার নাম বলিদ্বীপ; এবং তার অন্তরে যে পর্বত আছে, সে পর্বতকে শিশির বলা ছেরেফ কবিকল্পনা নয়। কেননা যার এক-একটি শৃঙ্গ দশ হাজার ফটের চেয়েও উঁচু, সে পর্বতকে কিছুতেই গ্রীষ্মপর্বত বলা যায় না, যদি কিছু বলতে হয় তো শিশির বলাই সংগত। শুনতে পাই উক্ত দ্বীপপুঞ্জ চিরবসন্তের দেশ। সুতরাং সে দেশের পাহাড়ে শীত হবারই কথা। আর সে পর্বত দেবদানব-সেবিত বলবার অর্থ সেখানে মানুষের বসতি নেই। হনুমানকে সীতার খোঁজে আরো অনেক স্থানে যেতে বলা হয়েছিল। কিন্তু সে-সব দেশ যে রূপকথার দেশ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যে দেশে মানুষের কান হাতির কানের মতো বড়ো, ও যে দেশে মানুষের কান উটের কানের মতো ছোটো, আর যে দেশে মানুষের পা দুটো নয়, একটা মাত্র, অথচ সেই এক পায়ে তারা খুব ফুর্তি করে চলে, সে-সব দেশেও হনুমানকে ভ্রাম্যমাণ হবার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এ-সব দেশের কোনো নাম বলা হয় নি। এর থেকেই স্পষ্ট প্রমাণ হয় যে, যে-সব দেশের নাম হিন্দুরা জানত না, সেই-সব দেশ সম্বন্ধে তাদের কল্পনা খেলত। যে দেশের নাম তারা জানত, সে দেশের রূপও তারা চিনত।

সে যাই হোক, বলিদ্বীপের নাম যখন সংস্কৃত, তখন সে নামকরণ যে হিন্দুরাই করেছিলেন, সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেই। আর খৃস্টজন্মের পূর্বেও যে হিন্দুরা বলিদ্বীপে উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন, তারও কিছু কিঞ্চিৎ প্রমাণ আছে।

এই দ্বীপপুঞ্জে উপনিবেশ-স্থাপন হিন্দুজাতির ইতিহাসের একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। সে ইতিহাস আমি আজ তোমাদের শোনাব না; কারণ সে মস্ত লম্বা ইতিহাস। হিন্দু জাতির মহা গৌরবের কথা এই যে, হিন্দুরা এই দ্বীপবাসী অসভ্য জাতদের সভ্য করে তুলেছিলেন। এ দেশের লোক পূর্বে যে কিরকম যোর অসভ্য ও ভীষণপ্রকৃতির লোক ছিল, তা রামায়ণে দ্বীপবাসীদের বর্ণনা থেকেই অনুমান করা যায়। তারা ছিল ‘আমমীনাশনাঃ’ অর্থাৎ তারা কাঁচা মাছ খেত। তাতে কিছু যায় আসে না; কেননা সুসভ্য জাপানিরা আজও তাই খায়। বাল্মীকি শুনেছিলেন যে, তারা ‘অন্তর্জলচরা ঘোরা নরব্যাঘ্রাঃ’। নরশার্দূল অবশ্য আমরা বীরপুরুষদেরই বলি, কিন্তু নরব্যাঘ্র বলতে বীরপুরুষ বোঝায় না, বোঝায় সেই জাতীয় পুরুষদের, যারা ‘অক্ষয়া বলবন্ত পুরুষা পুরুষাদকা’–ইংরেজিতে যাকে বলে ক্যানিবলস। এই হেমাঙ্গ কিরাতের দল ছিল সব ক্যালিবনের দাদা ক্যানিবল।

শ্রীবিজয়রাজ্যের অর্থাৎ সুমাত্রার ইতিহাস-লেখক জনৈক ফরাসি পণ্ডিত বলেছেন যে আমরা পুরোনো দলিলপত্র থেকে প্রমাণ পেয়েছি যে, ভারত-মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জ পুরাকালে এক নব সভ্যতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। যেমন কম্বোজের (ক্যাম্বোডিয়া) ও চম্পার (আনাম-কোচিনচায়না) তেমনি এ দেশেরও Alma Mater ভারতবর্ষ বহুকাল পূর্বে তার দেবতা, তার শিল্পকলা, তার ভাষা, তার সাহিত্য, সংক্ষেপে তার সভ্যতার সকল মহামূল্য উপকরণ এই দ্বীপবাসীদের সানন্দে দান করেছিল, এবং সহস্র বৎসরের অধিককাল ধরে এই দ্বীপবাসীরা সমগ্র হিন্দু-সভ্যতা ভক্তিভরে শিক্ষা ও আয়ত্ত করে তাদের হিন্দুগুরুদের গৌরবান্বিত করেছিল।

একটি সভ্য জাতি একটি অসভ্য জাতিকে নিজের ধর্ম আর্ট ও সাহিত্যের চেয়ে বড়ো আর কোন মহামুল্য বস্তু দান করতে পারে!

প্রসিদ্ধ চীন-পরিব্রাজক ই-চিং খৃস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে ভারতবর্ষ থেকে স্বদেশে ফেরবার পথে সুমাত্রার অন্তর্গত শ্রীবিজয়রাজ্যে কিছুকাল বাস করেন। তিনি তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে লিখে গিয়েছেন যে—

শ্রীবিজয়ের বৌদ্ধ-পণ্ডিতরা ভারতবর্ষের মধ্যদেশের পণ্ডিতদের মত সমগ্ৰ সংস্কৃত শাস্ত্র চর্চা করেন, ও তাঁদের ক্রিয়াকলাপ আচার-বিচার মধ্যদেশের ক্রিয়াকলাপ আচার-বিচারের সম্পূর্ণ অনুরূপ। সুতরাং ভবিষ্যতে চীন-পরিব্রাজকরা যেন প্রথমে শ্রীবিজয়ে এসে সংস্কৃত শিক্ষা করেন পরে ভারতবর্ষে যান।

আমরা যেমন আগে গোলদিঘির পণ্ডিতদের কাছে ইংরেজি শিক্ষা করে পরে বিলেত যাই।

ই-চিংয়ের পরামর্শ অনুসারে তাঁর পরবর্তী বহু চীনদেশীয় পরিব্রাজক সংস্কৃত সাহিত্য শিক্ষা করবার জন্য যবদ্বীপ ও শ্রীবিজয়ে গিয়েছিলেন। এখানে একটি কথা বলে রাখি। যবদ্বীপে প্রথমত হিন্দুধর্ম প্রচলিত ছিল, পরে সে দেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হয়। কিন্তু যবদ্বীপে এ দুই ধর্ম পৃথক ছিল না, দুয়ে মিলে একই ধর্ম হয়। বুদ্ধ সে দেশে শিববুদ্ধ নামেই পরিচিত। এ দেশে বুদ্ধদেব বিষ্ণর অবতার হিসেবেই গণ্য; কিন্তু সে দেশে শিবে ও বুদ্ধে সমান হয়ে গিয়েছিল। সেকালে হিন্দুরা যে অপর দেশের লোককে সভ্য করেছিল, এ কথা বিশ্বাস করা দূরে থাক, এ যুগের আমরা তা কল্পনাও করতে পারি নে; কারণ এখন অপর দেশের লোক আমাদের সভ্য করছে, আর তাদের সভ্যতা আমরা সকল তনু মন ধন দিয়ে মুখস্থ করতে এতই ব্যস্ত যে, ভারতবর্ষ যে এককালে সভ্য ছিল সে কথা আমাদের মনে স্থান পায় না, পায় শুধু মুখে।

সুতরাং ভারতবর্ষের কোন প্রদেশের লোক যবদ্বীপে গিয়ে বসতি করে, এ প্রশ্ন তোমাদের মনে উদয় হওয়া নিতান্ত স্বাভাবিক। এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে প্রমাণের চেয়ে অনুমানের উপর বেশি নির্ভর করতে হয়; অর্থাৎ অন্ধকারে ঢিল মারতে হয়। ঐতিহাসিকরা সে ঢিল দেদার মেরেছেন, কিন্তু তার একটাও যে ঠিক লোকের গায়ে গিয়ে পড়েছে, এমন কথা জোর করে বলা যায় না।

তবে এটুকু ভরসা করে বলা যায় যে, তারা আর যে জাতই হোক, মাদ্রাজি নয়। যে উত্তরাপথের লোক দক্ষিণাপথকে সভ্য করেছে, খুব সম্ভবত তারাই ঐ দ্বীপবাসীদেরও সভ্য করেছে। যবদ্বীপে যে মহাভারতের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, তা উত্তরাপথে যে মহাভারত প্রচলিত ছিল, তারই অনুবাদ।

কোথায় ভারতবর্ষের উত্তরাপথ আর কোথায় মহাসাগর, সুতরাং তাঁরা কোন বন্দর থেকে মহাসমুদ্রে অবতরণ করলেন? খুব সম্ভবত তাঁরা মসলিপত্তনে গিয়ে জাহাজে চড়েছিলেন। আর গুজরাটের Broach নগর থেকে মসলিপত্তন পর্যন্ত যে একটি স্থলপথ ছিল, তারও প্রমাণ আছে। সুতরাং এরূপ অনুমান করা অসংগত নয় যে, আর্যাবর্তের আর্যরাই এই সভ্যতা-প্রচারকার্যে ব্রতী হয়েছিলেন। মন, বলেছেন যে, আর্যদের আচারই একমাত্র সাধু আচার, অতএব তা ‘শিক্ষেরন, পৃথিব্যাং সর্বমানবাঃ’। এ কথার ভিতর মস্ত একটা গর্ব আছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি আছে উদারতা আর মহত্ত্ব। দক্ষিণাপথের তামিলরাও সুমাত্রা জয় করতে গিয়েছিল, কিন্তু সে বহুকাল পরে—খৃস্টীয় দশম ও একাদশ শতাব্দীতে। তাদের উদ্দেশ্য কিন্তু ছিল শ্রীবিজয়রাজ্য বিজয় করে তাকে শ্রীভ্রষ্ট করা। বলিদ্বীপের কথা বলতে গিয়ে যবদ্বীপের বিষয় দু কথা বলোম এইজন্য যে, সেকালের যবদ্বীপের হিন্দুধর্ম একালে বলিদ্বীপে মজুত রয়েছে।

রামায়ণের যুগে যবদ্বীপ সপ্তরাজ্যে উপশোভিত ছিল; কিন্তু খৃস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে সে দেশে তিনটি মাত্র রাজ্য ছিল। খৃস্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে যবদ্বীপের হিন্দুরাজ্যের যখন ধংস হয় ও সে দেশের লোকে মুসলমানধর্ম অবলম্বন করে, তখন এক দল লোক স্বধর্ম রক্ষা করবার জন্য যবদ্বীপ থেকে পালিয়ে বলিদ্বীপে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। এদেরই বংশধরেরা এখন বলির অধিবাসী। আর এই ক্ষুদ্র দ্বীপবাসীরাই আজ পর্যন্ত তাদের স্বধর্ম ও স্বরাজ্য দুই রক্ষা করে আসছে। হিন্দু হলেই পরাধীন হতে হবে, বিধির যে এমন-কোনো নিয়ম নেই, তার তিলমাত্র প্রমাণ ঐ দেশেই আছে। বলিদ্বীপ স্বাধীন, কিন্তু যে হিসাবে জাপান স্বাধীন সে হিসাবে নয়; যে হিসাবে নেপাল স্বাধীন সেই হিসাবে, এবং একই কারণে হিন্দুস্থানের ইতিহাসের ধারা এই যে, সে দেশ প্রথমে মুসলমানের অধীন হয়, ও পরে খৃস্টানের। নেপাল ও বলি আগে মুসলমানের অধীন হয় নি, কাজেই তা আজ খৃস্টানের অধীন হয় নি।

বলিদ্বীপ একরত্তি দেশ হলেও কোনো একটি রাজার রাজ্য নয়, এই একশো মাইল লম্বা ও পঞ্চাশ মাইল চওড়া দেশ অট রাজ্যে উপশোভিত। আর এই আটটি ভাগের আটটি পৃথক রাজা আছে। এর থেকেই বুঝতে পারছ, এ দেশে যা আছে তা পুরোমাত্রায় হিন্দুরাজ্য। ভারতবর্ষও হিন্দুযুগে হাজার পৃথক রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এ দেশে যে দু জন একচ্ছত্র রাজত্ব করে গিয়েছেন, তাঁরা হিন্দু নন। অশোক ছিলেন বৌদ্ধ, আর আকবর মোগল। এক রাজ্যের প্রজা না হলে এক দেশের লোক যে এক নেশন হতে পারে না, এ হচ্ছে ইউরোপের হাল মত। হিন্দুরা প্রাচীন যুগে যদি এক নেশন হয়ে থাকে তো সে এক ধর্মের বন্ধনে। অষ্ট রাজ্যে বিভক্ত হলেও বলির অধিবাসীরা এক নেশন—এক ধর্মাবলম্বী বলে। ইউরোপে একালে নেশন গড়ে রাজায়; আর এ দেশে সেকালে গড়ত দেবতায়। পশ্চিমের সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে রাজনীতি, আর পূর্বের সবচেয়ে বড়ো কথা ছিল ধর্মনীতি।

যেমন রাজ্যের ব্যবস্থায়, তেমনি সমাজেও তারা পুরো হিন্দু। তারা এক জাতি হলেও পাঁচ জাতে বিভক্ত। এ পাঁচ জাত হচ্ছে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র ও চণ্ডাল। এ পাঁচ জাত পরস্পর বিবাহাদি করে না। পূর্বে অসবর্ণ বিবাহের শাস্তি ছিল প্রাণদণ্ড। গীতায় ভয় দেখিয়েছে যে, এ করলে ও হবে, ও হলে তা হবে, আর তা হলেই হবে বর্ণসংকর, তার পরেই প্রলয়। বলির হিন্দুসমাজ বোধ হয় গীতার মতেই চলে। আর প্রাণদণ্ডটাও বোধ হয় দেওয়া হত গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় অনুসারে। যদি কোনো ঘাতক কারো প্রাণ বধ করতে ইতস্তত করত তা হলে তাকে সম্ভবত বলা হত–

ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্ত্বা উত্তিষ্ঠ পরন্তপঃ।

আমরা সকলেই যখন ব্রহ্ম তখন কে কাকে মারে, আর কেই-বা মরে। কিন্তু এতটা নির্জলা হিঁদুয়ানি এ যুগে চলে না। কারণ এ যুগের লোকের যখন-তখন মরতে ঘোর আপত্তি আছে, কিন্তু যাকে-তাকে বিয়ে করতে আপত্তি নেই। তাই এখন নিয়ম হয়েছে যে, অসবর্ণ বিবাহ করলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যার বর্ণ নিম্ন, অপর পক্ষও সেই বর্ণভূত হয়ে যাবে। অর্থাৎ জাতিভেদের কাঠামো বজায় থাকবে, কিন্তু লোকের এক বর্ণ ত্যাগ করে আর-এক বর্ণে ভর্তি হবার স্বাধীনতাও থাকবে। স্কুলের ছেলেরা যেমন পড়া মুখস্থ না দিতে পারলে উপরের ক্লাস থেকে নীচের ক্লাসে নেমে যায়, বলির লোকেরাও তেমনি অসবর্ণ বিবাহের ফলে উলটো প্রমোশন পায়।

কিছুদিন পূর্বে বলিদ্বীপে সতীদাহ প্রচলিত ছিল। কিন্তু এখন সে প্রথা উঠে গিয়েছে। এখন সতী যায় শুধু রাজার ঝি-বৌরা। এর কারণ বোধ হয় রাজারা অবলাদের আঁচল না ধরে স্বর্গেও যেতে পারে না। সে যাই হোক, এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, বেন্টিক সাহেব এ দেশে না এলেও এতদিনে হিন্দুসমাজে সতীদাহ প্রথা উঠে যেত, ছেরেপ কালের গুণে।

বিবাহের পর আসে অবশ্য আহারের কথা। বলীয়ানরা কি খায় তা জানি নে, কিন্তু তারা গো-মাংস ভক্ষণ করে না, এমন-কি, বলিদ্বীপে গোহত্যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তারা কিন্তু শুয়োর নিত্য খায়, তবে তাতে তাদের হিন্দুত্ব নষ্ট হয় না। সে দেশে সকল বরাহই বন্যবরাহ, কারণ দেশটাই হচ্ছে বুনো দেশ।

তাদের ধর্মবিশ্বাসের পরিচয় দু কথায় দিই। ভারতবর্ষের সব দেবতা বলিবীপে গিয়ে জুটেছেন। এমন-কি, কার্তিক সমুদ্রলঙ্ঘন করেছেন ময়ুরে চড়ে, আর গণেশ ইঁদুরে চড়ে। ইঁদুর যে পিঁপড়ের মতো চমৎকার সাঁতার কাটতে পারে, তা বোধ হয় তোমরা সবাই জান, কারণ ছেলেরা চিরকালই মেয়েদের কাছে শুনে আসছে যে, পিঁপড়ে খেলে সাঁতার শেখা যায়।

কিন্তু সেখানকার মহাদেব হচ্ছেন কাল, আর মহাদেবী দুর্গা। বলিদ্বীপের দুর্গাপূজা নৈমিত্তিক নয়, নিত্য। বলিদ্বীপের অধিবাসীরা বৌদ্ধও নয়, বৈষ্ণবও নয়। ওসব ধর্ম গ্রহণ করলে তাদের প্রধান ব্যাবসা-অস্ত্রের ব্যাবসা—যে মারা যায়। আর বাকি থাকে শুধু বস্ত্রের ব্যাবসা। একমাত্র বস্ত্রের সাহায্যে স্বরাজ হয়তো লাভ করা যেতে পারে, কিন্তু রক্ষা করা যায় না।

বলিদ্বীপের অধিবাসীদের আচার-ব্যবহার, দেবদেবতার সংক্ষেপে যে পরিচয় দিলাম, তার থেকেই বুঝতে পারছ তারা যে হিন্দু, সে বিষয়ে আর সন্দেহ নেই। এমন-কি, যে-সব ইউরোপীয়ের সে দেশের সঙ্গে পরিচয় আছে, তাঁরা বলেন যে তাদের যদি কেউ অহিন্দু বলে, তা হলে তারা অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠে।

বলিদ্বীপে যখন ব্রাহ্মণ আছে, তখন সে দেশে নিশ্চয় পণ্ডিতও আছে। এই পণ্ডিতদের নাম পেদণ্ড। বলির পণ্ডিতরা সংস্কৃত পণ্ডিতের অপভ্রংশ না হয়ে কি করে যে ইংরেজি pedantএর অপভ্রংশ হল, সে রহস্য আমি উদঘাটিত করতে পারি নে। তবে নামে বড়ো কিছু আসে যায় না। আমাদের দেশের পাণ্ডা, বিলেতের পেডাণ্ট ও বলির পেদণ্ড, সবাই একজাত; তিনজনই সমান মূর্খ। কৃত্তিবাসের রামায়ণে হনুমানকে বলা হয়েছে যে–

সর্বশাস্ত্র পড়ে বেটা হলি হতমূর্খ।

ইউরোপের পণ্ডিতেরা সর্বশাস্ত্র পড়ে পেডাণ্ট হয়, বলিদ্বীপের পণ্ডিতরা কোনো শাস্ত্র না পড়েই পেদণ্ড হয়; পূর্ব পশ্চিমের ভিতর এই যা প্রভেদ। আমরা পূর্ব, সুতরাং ‘অন্ত’ হবার চাইতে ‘অণ্ড’ হবার দিকেই আমাদের ঝোঁক বেশি।

এই কারণে আমার বলিদ্বীপে যাবার ভয়ংকর লোভ হয়, উক্ত দ্বীপে পেদণ্ডদের সঙ্গে শালোচনা করবার জন্য। এ দেশের পেদণ্ডদের কাছে শাস্যালোচনা ঢের শুনেছি, কিন্তু বলিদ্বীপের পেদণ্ডদের কাছে অনেক নূতন কথা শুনতে পাব বলে আশা আছে। সম্ভবত সে সবই পুরোনো কথা, কিন্তু এত পুরোনো যে, আমার কাছে তা সম্পূর্ণ নন বলে মনে হবে।

দুঃখের বিষয়, বলিদ্বীপে যাবার বল এ বয়েসে আমার আর নেই। কারণ সে দেশে যেতে হয় প্লবেন প্লবনেন চ। আশা করি, তোমরা যখন মানুষ হবে, তখন তোমরা কেউ কেউ ও-দেশে একবার হাওয়া বদলাতে যাবে, বিদেশে হিন্দু-সভ্যতার নয়, হিন্দু-অসভ্যতার নিদর্শন দেখতে। আমরা বিলেতি পলিটিকাল সভ্যতা যেরূপ তেড়ে মুখস্থ করছি, তাতে আশা করতে পারি যে তোমরা যখন বড়ো হবে, তখন এ দেশের শিক্ষিত লোক এই স্থিরসিদ্ধান্তে উপনীত হবে যে, হিন্দু-সভ্যতা অতি মারাত্মক অসভ্যতা। আর পূর্বে যে তা সংক্রামক ছিল, তার পরিচয় ঐ-সব দেশেই পাবে। ভবিষ্যতে তোমাদের হিন্দুধর্মের প্রতি যদি কিছুমাত্র মায়া নাও থাকে, তবু এথনলজির উপর মায়া তত বাড়বে। আর বলিদ্বীপের পেদণ্ডদের কাছে ও-বিজ্ঞানের সরু মোটা অনেক তত্ত্ব উদ্ধার করতে পারবে। পৃথিবীতে অসভ্য লোক না থাকলে এথনলজি অ্যানগ্রপলজি প্রভৃতি বিজ্ঞানের জন্ম হত না; যেমন পৃথিবীতে রোগ না থাকলে চিকিৎসাবিজ্ঞান জন্মাত না। সুতরাং আশা করি, আর কোনো কারণে না হোক, বিজ্ঞানের খাতিরেও বলীয়ানরা আর কিছুদিন তাদের অসভ্যতা রক্ষা করে বেঁচে থাকবে। তবে তাদের পাশে রয়েছে ওলন্দাজরা। তারা ইতিমধ্যে তাদের সভ্য না করে তোলে। আর ওলন্দাজি সভ্যতা আত্মসাৎ করতে পারলেই তার আমাদেরই মতো সভ্য হয়ে উঠবে। ইংরেজি সভ্যতার সঙ্গে ওলন্দাজি সভ্যতার শুধু সেইটুকু প্রভেদ, হুইসকি ও জিনএর ভিতর যে প্রভেদ। আসলে ওই এক। ও-দুয়ের নেশাই সমান ধরে। আর তার ফলে কারো দুর্বল দেহকে সবল করে না, শুধু সকলের সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত করে।

সে যাই হোক, এই ক্ষুদ্র দ্বীপ সম্বন্ধে তোমাদের কাছে এতক্ষণ ধরে যে বক্তৃতা করলাম, তার উদ্দেশ্য তোমাদের দ্বীপান্তর-গমনের প্রবৃত্তি উদ্রেক করা নয়, আমাদের পূর্ব-ইতিহাস সম্বন্ধে তোমাদের কৌতূহল উদ্রেক করা। নিজের দেশের অতীত সম্বন্ধে অজ্ঞ হওয়ায় কোনো লাভ নেই, কারণ যার অতীত অন্ধকার তার ভবিষ্যতও তাই-অর্থাৎ সেই জাতের, যার অতীত বলে একটা কাল ছিল।

বৈশাখ ১৩৩৪

ভারতবর্ষ সভ্য কি না

ভারতবর্ষ সভ্য কি না

সেকালে ভারতবর্ষ ছিল মীমাংসার যুগ, একালে হয়েছে সমস্যার। এ কথা যে সত্য, এতগুলো কমিশনই তার প্রমাণ। এই আজকের দিনে পাঁচ-পাঁচটা কমিশনের প্রসাদে পাঁচ-পাঁচটা সমস্যা রাজদরবারে টাঙানো রয়েছে; যথা : ১ চাকরির সমস্যা, ২ স্বরাজের সমস্যা, ৩ অরাজকতার সমস্যা, ৪ শিল্পের সমস্যা, ৫ শিক্ষার সমস্যা; তার উপর আবার এসে জুটেছে বিয়ের সমস্যা।

এর পর জন্ম মৃত্যু বাদে দুনিয়ার আর কোন সমস্যা বাকি রইল? ও-দুটির যে কোনো সমস্যা নেই, তার কারণ ও-দুটিই হচ্ছে রহস্য। তবে এ দেশে জন্মটা বড়ো রহস্য না মৃত্যুটা বড়ো, এ বিষয়ে একটা তর্ক অবশ্য উঠতে পারে। কিন্তু ওঠে না এইজন্য যে, তার মীমাংসাও স্পষ্ট। আমাদের পক্ষে ও-দুইই সমান।

এ যুগ সমস্যার যুগ, বিশেষ করে এই কারণে যে, এ যুগে অধিকারীভেদ নেই। জীবন, তা সে ব্যক্তিগতই হোক আর জাতিগতই থোক, চিরকালই একটা সমস্যা; কিন্তু সেকালে এ সমস্যা নিয়ে মাথা কাত দু-চার জন; আর একালে কোনো বিষয়ে একটা সমস্যা উঠলে আমরা সকলে মিলে তার মীমাংসা করতে বাধ্য। যেকালে সকলের সকল বিষয়ে মত দেবার অধিকার আছে, সেকালে কোনো বিষয়েই কারো চুপ করে থাকবার অধিকার নেই। যদি বল, যার নিজের একটা মত গড়বার সামর্থ্য নেই, এক কথায় যার মত বলে কোনো পদার্থই নেই, সে সে-পদার্থ দান করে কি করে। তার উত্তর, মনের ঘরে যার শূন্য আছে, সে শুন্যই দিতে পারে; শুধু যে দিতে পারে তাই নয়, দেশের ও দশের মঙ্গলের জন্য তার পক্ষে তা দেওয়া একান্ত কর্তব্য। একের পিছনে শুন্য বসালে তা যে দশগুণ বেড়ে যায়, এ কথা কে না জানে। সুতরাং যার হোক একটা মতের পিছনে আমরা যদি ক্রমান্বয়ে শনা বসিয়ে যাই, তা হলে সঙ্গে সঙ্গে তার দশগুণ করে মূল্য বেড়ে যাবে।

সত্য কথা বলতে গেলে, রাজনৈতিকপ্রমুখ বিষয়ে অধিকাংশ লোকের পক্ষে কোনোরূপ মত না থাকাটাই শ্রেয়। সকলেরই যদি একটা-না-একটা স্বমত থাকে, তা হলে নানা মতের সৃষ্টি হয়; অপর পক্ষে অধিকাংশ লোক মতশূন্য হলে যা সৃষ্টি হয়, তার নাম লোকমত। আর, এ কথা বলা বাহুল্য যে, একালে লোকমতই হচ্ছে একমাত্র কেজো মত, কেননা ও-মতের অভাবে হয় কোনো বিলই পাস হয় না, নয় সকল বিলই পাস হয়।

এর কারণও খুঁজে বার করতে হবে না। নানা মত পরস্পরের সঙ্গে কাটাকাটি গিয়ে বাকি থাকে শুধু শন্য, আর শনন্য শন্যে যোগ দিলে দাঁড়ায় গিয়ে বিরাট একে। এই সত্যই যে সার সত্য, তার প্রমাণ দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক, দরকম অদ্বৈতবাদের মধ্যে সমান পাওয়া যায়।

 

২.

উপরে যে-সব সমস্যার ফদ দেওয়া গেছে, তার উপর সম্প্রতি আর-একটি সমস্যা এসে জটেছে, যার বিশেষত্ব হচ্ছে এই যে, তার কোনো মীমাংসা নেই অথচ অনেক তর্ক আছে।

সমস্যাটা হচ্ছে এই যে, ভারতবর্ষ সভ্য কি না। দেখতে পাচ্ছেন সমস্যাটা কত ঘোরতর, কত গুরতর। এ সমস্যা অবশ্য রাজনৈতিকও নয়, সামাজিকও নয়, কিন্তু সকলপ্রকার রাজনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যা ওরই অন্তর্ভূত।

যদি জিজ্ঞাসা করেন, যার মীমাংসা নেই, এমন সমস্যা ওঠে কেন। তার উত্তর একজনে এর পর্বমীমাংসা করে দিয়েছেন বলেই আর পাঁচজনে তার উত্তরমীমাংসা করতে বদ্ধপরিকর হয়েছে। ফলে, ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে একটা বিষম তর্কে।

উইলিয়ম আর্চার নামক জনৈক ধনধর ইংরেজি লেখক এবং প্রবীণ ভাবক, ভারতের নানা দেশ পর্যটন করে অবশেষে উপনীত হয়েছেন এই সিদ্ধান্তে যে, ভারতবাসীরা হচ্ছে অসভ্য জাতিদের মধ্যে সবচাইতে সভ্য এবং সভ্য জাতিদের মধ্যে সবচাইতে অসভ্য।

অমনি আমরা অস্থির হয়ে উঠেছি।

এ কথায় কিন্তু বিচলিত হবার কোনো কারণ আমি দেখতে পাই নে। উইলিয়ম আচারের মত যদি সত্য বলেই ধরে নেওয়া যায়, তাতেই বা ক্ষতি কি। আমরা যদি সভ্যতার মধ্যপথ অবলম্বন করে থাকি, তা হলে তো আমরা আরিস্টটলের মতে ঠিক পথই ধরেছি, বৌদ্ধ মতেও তাই। আর সেকেলে দর্শন যদি বাতিল হয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে বলি হেগেলের মতেও দাঁড়ায় এই যে, সভ্যতা (thesis) + অসভ্যতা (antithesis) = সভ্যাসভ্যতা (synthesis); অর্থাৎ আমাদের সভ্যাসভ্যতাটা হচ্ছে synthetic civilization। অতএব সর্বশ্রেষ্ঠ। বেশি অসভ্য হওয়া যে ভালো নয়, সে তো পুরানো সত্য; আর বেশি সভ্য হওয়াও যে মারাত্মক, এই নতুন সত্য তো ইউরোপে হাতে-হাতে প্রমাণ হয়ে গেল। এক দিকে সভ্যতা আর-এক দিকে অসভ্যতা, এই দুই চাপের ভিতর পড়াটা অবশ্য সুখের অবস্থা নয়; কিন্তু আমাদের বর্তমান অবস্থা যে সুখের অবস্থা, এমন কথা আর যেই বলক, আমরা তো কখনো বলি নে।

আর-এক কথা, কি সভ্যতা কি অসভ্যতা এ দুয়ের কোনোটিরই ভিতর মানুষের শান্তি নেই–না দেহের না মনের। যারা নিজেদের অসভ্য বলে জানে, তারা সভ্য হবার জন্য লালায়িত হয়; আর যারা নিজেদের সভ্য বলে জানে, তারা স্বাভাবিক হবার জন্য লালায়িত হয়। পুরাকালে ভারতবর্ষ যখন অতিসভ্য হল, তখন ভারতবাসী সভ্যতার শিকলি কেটে বনে যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল; এবং একই অবস্থায় একই কারণে গ্রীকরা হল ফিলজফর আর রোমানরা খান। তার পর যখন নব রোমক-খস্টান-সভ্যতা পুরোপুরি গড়ে উঠল, তখন রসো সকলকে পরামর্শ দিলেন আবার প্রকৃতির কাছে ফিরে যেতে— অমনি দেশসদ্ধ লোক মেতে উঠল। অপর পক্ষে যাদের জ্ঞান তারা অসভ্য, তারা যে সভ্য হবার জন্য আঁকুবাঁকু করে তার প্রমাণ কি আর উদাহরণের অপেক্ষা রাখে। অতএব এ কথা নিয়ে বলা যায় যে, শান্তি যদি কোথাও থাকে তো সভ্যতা আর অসভ্যতার মিলনক্ষেত্রে; কেননা ও-ক্ষেত্রে অসভ্যতা সভ্যতার এবং সভ্যতা অসভ্যতার তেজ বিলকু ও বেমালুম মেরে দেয়। সুতরাং একাধারে সভ্য এবং অসভ্য হওয়াটাই বুদ্ধিমান জাতের কাজ; আর আমাদের মাথায় যে মগজ নেই, এমন কথা উইলিয়ম আর্চারও বলেন না।

আমার এ-সব কথা যতই যুক্তিযুক্ত হোক-না কেন, আমার মত কেউ গ্রাহ্য করবেন। কেননা এক দল প্রমাণ করতে যেমন ব্যস্ত যে আমরা অতি-সভ্য, আর-এক দল প্রমাণ করতে তেমনি ব্যস্ত যে আমরা অতি-অসভ্য। সুতরাং এ দুই দলকে কেউ ঠেকাতে পারবে না; তাঁরা তর্ক করবেনই, শুধু উইলিয়ম আচারের সঙ্গে নয়, পরস্পরের সঙ্গেও।

এ উভয়কেই আমি বলি, খিরো ভব। আমরা যে অসভ্য, এ প্রমাণ করবারই বা সার্থকতা কি। আর আমরা যে সভ্য, এ প্রমাণ করবারই বা সার্থকতা কি। কেউ যদি প্রমাণ করে দেয় যে আমরা অসভ্য, তা হলেই কি আমাদের অস্তিত্ব লোপ পাবে, না, আমাদের জীবনের সকল সমস্যা উড়ে যাবে? তা অবশ্য কখনোই হবে না, উপরন্তু আর-একটা সমস্যা বাড়বে, সে হচ্ছে সভ্য হবার মহাসমস্যা।

অপর পক্ষে আমরা যদি প্রমাণ করে দিই যে আমরা সভ্য, তা হলেই কি আমাদের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ হয়ে উঠবে, না, আমাদের জীবনের সকল সমস্যার চড়ান্ত মীমাংসা হয়ে যাবে? তা অবশ্য কখনোই হবে না। কেননা নিজের সার্টিফিকেট নিজের কোনো কাজে লাগে না, ব্যক্তির পক্ষেও নয় জাতির পক্ষেও নয়। তা ছাড়া নিজের দরখাস্তের বলে, এ ক্ষেত্রে পরের কাছ থেকে ভালো সার্টিফিকেট আমরা কিছুতেই আদায় করতে পারব না। সভ্যতা সম্বন্ধে প্রতি জাত নিজেকে সোহহং মনে করে, কিন্তু অপর কোনো জাতকে তত্ত্বমসি বলতে প্রস্তুত নয়। তবে প্রাচীন সভ্যতার সম্বন্ধে এ কথা অবশ্য খাটে না। প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সভ্যতার সুখ্যাতি যে ইউরোপের মুখে আর ধরে না, এ কথা কে না জানে। তার কারণ এই যে, যে সভ্যতা মরে ভূত হয়ে গেছে, উঁচুগলায় তার গুণগান করবার ভিতর কোনো বিপদ নেই; কেননা কোনো জ্যান্ত সভ্যতার উপর ও-সব মরা সভ্যতার কোনো দাবি নেই। প্রাচীন ও মত সভ্যতা কোনো বতমান সভ্যতার কাছ থেকে কিছু আদায় করতে পারে না, কিন্তু বর্তমান সভ্যতা তার কাছ থেকে ঢের আদায় করে, এবং তার নন খায় বলেই তার গুণে গায়। ভারতবর্ষের সভ্যতা গ্রীস-রোমের সভ্যতার মতো প্রাচীন হলেও প্ৰশস্য নয়; কেননা তা মত নয়, জীবিত। এ সভ্যতার অমার্জনীয় অপরাধ এই যে, তা আজও বেচে আছে, এবং বহুকাল বেচে আছে বলে আরো বহুকাল বেচে থাকতে চায়; তাই তার দাবির আর অন্ত নেই। এ সভ্যতার সপক্ষে ইউরোপের সাটিফিকেট বার করা অসম্ভব। আর যদিই বা করা যায়, তাতেই বা কি লাভ? আমাদের জাতীয় সমস্যার আশ মীমাংসা ততটা নির্ভর করবে না আমাদের প্রাচীন সভ্যতা কিংবা অসভ্যতার উপর যতটা নির্ভর করবে ইউরোপের বর্তমান সভ্যতা কিবা অসভ্যতার উপর।

যদি কেউ বলেন যে, ইউরোপের খাতিরে নয়, সত্যের খাতিরে আমরা প্রমাণ করতে চাই যে, ভারতবর্ষ সভ্যতার উত্তরে আমার বক্তব্য এই যে, ও চেষ্টায় উলটো উৎপত্তি হবারই সম্ভাবনা বেশি। মানুষ যেমন মুখের জোরে নিজেকে অপরের চাইতে বেশি ভদ্র প্রমাণ করতে গিয়ে শুধু অভদ্রতারই পরিচয় দেয়, জাতিও তেমনি নিজেকে অপরের চাইতে বেশি সভ্য প্রমাণ করতে গিয়ে শুধু অসভ্যতারই পরিচয় দেয়। এর প্রথম কারণ, সভ্যতা প্রমাণ করতে হয় হাতে-কলমে, কাগজে-কলমে নয়; কেননা ও-বস্তু আত্মপ্রতিষ্ঠিত হয় যুক্তির বলে নয়, কর্মের ফলে। এর দ্বিতীয় কারণ, মানুষ সভ্য হলেও মানুষই থাকে; সভ্য মানবেরও সত্তার মূলে রয়েছে আদিম মানব। সুতরাং মানুষ যখন অবিবাসী লোকের সম্মুখে নিজেকে সভ্যমানব বলে খাড়া করতে যায়, তখন প্রায়ই দেখা যায় যে, ও-ক্ষেত্রে যাকে খাড়া করা হয় সে হচ্ছে আদিম মানব; কেননা এরকম কাজ মানুষে এক রাগের মাথায় ছাড়া আর-কোনো অবস্থায় করে না। প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা থাকলে মানুষে যে এ কাজ করে না, তার কারণ ও-কাজ করা হয় অনাবশ্যক, নয় নিরর্থক। সভ্যতা বলে যদি মানবসমাজে কোনোএক বস্তু থাকে, তা হলে সভ্যসমাজ মাত্রেই তার সঙ্গে পরিচিত। যা প্রত্যক্ষ, তার অস্তিত্ব প্রমাণ অনাবশ্যক। আর অসভ্যের কাছে তার অস্তিত্ব প্রমাণ করতে যাওয়া বিড়ম্বনা, কেননা কোনো প্রমাণ-প্রয়োগের দ্বারা অসভ্যের কাছে সভ্যতাকে প্রত্যক্ষ করে তোলা যাবে না।

মতান্তরে সভ্যতা এক বস্তু নয়, কিন্তু দেশভেদে ও কালভেদে সভ্যতা হরেক রকমের হয়ে থাকে। সভ্যতার ভিতরও বিশিষ্টতা আছে, এবং সভ্যতায় আর সভ্যতায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে পার্থক্য এত বেশি যে, তাদের মিলন কস্মিনকালেও হবে না। এ মতের চরম বাণী হচ্ছে কিপলিঙের এই কথা

The East is East and the West is West, and never the twain shall meet. এ কথা দেশে-বিদেশে অনেকে বেদবাক্য বলে গ্রাহ্য করেছেন, কিন্তু আমার কাছে বরাবর তা নিরর্থক প্রলাপ বলেই মনে হয়েছে, কেননা ও-কথার অর্থ আমি কখনো বুঝতে পারি নি। সম্প্রতি বটিশ সভ্যতার একটি অগ্রগণ্য মুখপত্রে তার ব্যাখ্যা দেখে নিশ্চিন্ত হলুম। SPECTATOR লিখেছেন, কিপলিঙের ও-কথার সাদা অর্থ হচ্ছে।

Black is black and white is white.

এ ব্যাখ্যা যে অতি বিশদ, সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু সেইসঙ্গে এ বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই যে, প্লেটের বৃটিশ সভ্যতার পরিচয় দিতে গিয়ে শুধু বৃটিশ অসভ্যতারই পরিচয় দিয়েছেন। এর পর নিজের সভ্যতার বিশিষ্টতার ব্যাখ্যান করতে সকলেরই ভয় পাওয়া উচিত।

কোনো সভ্যতার বিশিষ্টতার প্রতি বিশেষ করে নজর দেওয়াতেও বিপদ আছে। ও অবস্থায় বিশিষ্টতাকেই সভ্যতা বলে মানুষের সহজে ভুল হয়। অপর সমাজের সঙ্গে নিজের সমাজ যে অংশে বিভিন্ন, সেই অংশকেই নিজের সভ্যতার প্রধান অঙ্গ বলে অহংকার করবার লোভ যায়। শুধু তাই নয়, তখন সেই অঙ্গকেই যেন-তেনপ্রকারেণ রক্ষা করবার জন্য মানুষ বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে; আর তার ফলে যদি সমাজের সকল অঙ্গ পঙ্গু হয়ে যায়, তাতেও সমাজ তার নিজের গোঁ ছাড়ে না। উদাহরণ স্বরূপ, এই প্যাটেল-বিলের বিপক্ষ দলের কথাই ধরা যাক-না। এরা বলেন, জাতিভেদ-প্রথা যখন হিন্দুসমাজ ছাড়া অপর কোনো সভ্যসমাজে নেই, তখন হিন্দুসভ্যতার ভিত্তিই হচ্ছে জাতিভেদ-প্রথা। অতএব হিন্দুসভ্যতার বিশিষ্টতা, অর্থাৎ জাতিভেদ-প্রথা, বজায় রাখতেই হবে, তার জন্য যদি হিন্দু,জাতি ধলাশায়ী হয়, তাতেও কোনো ক্ষতি নেই। এ কথা বলাও যা, আর স্পেক্টেটরের কথায় সায় দেওয়াও তাই। স্পেক্টেটরের এ মত শুধু একমাত্র বর্ণভেদের উপরই প্রতিষ্ঠিত। ওরকম ঢেরা-সই দেওয়াতে বর্ণ ধর্মজ্ঞানের পরিচয় দেওয়া যেতে পারে কিন্তু বর্ণজ্ঞানের পরিচয় দেওয়া হয় না, ধর্মজ্ঞানেরও নয়। জাতিভেদ-প্রথা হিন্দুসমাজের গোঁড়ার কথা হলেও হিন্দুসভ্যতার শেষ কথা নাও হতে পারে।

সভ্যতার অবশ্য নানা রূপ, বিশেষ্য ও বিশেষণ আছে; কিন্তু তার ক্রিয়া এক, এবং সে ক্রিয়া হচ্ছে মানবজীবনের মুখ্য ক্রিয়া, to be। এ কথায় অবশ্য তারা আপত্তি করবেন, যাঁদের বিশ্বাস মানবপ্রকৃতির মূল ধাতু হচ্ছে to have। কিন্তু এঁরা ভুলে যান যে, জীবনে কিছু পেতে হলে তার আগে কিছু হতে হয়। এক সভ্যতার সঙ্গে আর-এক সভ্যতার গড়নের পার্থক্য ঘটে শুধু বাহ্যবস্তুর আনকল্যে এবং প্রতিকলতায়। এ পার্থক্য প্রাচীনকালে যেমন স্থূল ছিল, বর্তমানে তেমনি সক্ষম হয়ে আসছে; তার প্রথম কারণ, একালে এক জাতির সঙ্গে আর-এক জাতির দেশের ও সেইসঙ্গে দেহের এবং মনেরও ব্যবধান কমে আসছে। আর তার দ্বিতীয় কারণ এই যে, বর্তমানে মানুষ বস্তুজগতের ততটা অধীন নয়, বস্তুজগৎ মানুষের যতটা অধীন। জাতিতে জাতিতে মনের ও ব্যবহারের পার্থক্য কমে আসছে বলে এ ভয় পাবার দরকার নেই যে, মানবজীবন বৈচিত্র্যহীন হয়ে পড়বে। জাতিতে জাতিতে প্রভেদ যেমন কমে আসছে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে প্রভেদ তেমনি বেড়ে চলেছে। এক কথায় বিশিষ্টতা এখন জাতিকে ত্যাগ করে ব্যক্তিকে আশ্রয় করেছে। আমার বিশ্বাস, ভবিষ্যতের মানবসভ্যতা এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের গুণে অপূর্ব বৈচিত্র্য লাভ করবে এবং এই বিচিত্রতাই হবে তার বিশিষ্টতা। অন্তত আমাদের সভ্যতার জন্যে সে ভাবনা নেই। ভারতবর্ষ যদি একদেশ হিসেবে ধরা যায়, তা হলে সে দেশের সভ্যতা যুগপৎ হরবোলা ও বহুরূপী হতে বাধ্য।

ভবিষ্যতে যা হবার সম্ভাবনা তা নাও হতে পারে; কিন্তু অতীতে যা হয়ে গেছে তা যে হয়ে গেছে তার আর সন্দেহ নেই। এবং প্রতি প্রাচীন সভ্যতার যে একটা বিশেষ রূপ ও বিশেষ ধর্ম আছে, সে কথাও অস্বীকার করা অসম্ভব। অথচ এ-সকল সভ্যতার সামাজিক ব্যবহার এবং মনোভাবের মিলও বড়ো কম নয়। পণ্ডিত ব্যক্তিদের মতে গ্রীক রোমান এবং হিন্দু সভ্যতার ভিতর ঠিক ততখানি মিল আছে গ্রীক লাটিন ও সংস্কৃত ভাষার ভিতর যতখানি মিল আছে; এবং সে মিল প্রথমত কম নয়, দ্বিতীয়ত তা ধাতুগত। যদিচ আমি পণ্ডিত নই, তবও এ মত গ্রাহ্য করতে আমি কিছুমাত্র কুণ্ঠিত নই। তার কারণ, আমার বিশ্বাস, সকল সভ্যতারই ধাতু এক, প্রত্যয় শুধু; আলাদা। সে যাই হোক, যে-ক’টি প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, সে সবগুলিই, আমার মনে হয়, একজাতীয়, অর্থাৎ আমার কাছে তার প্রতিটি হচ্ছে এক-একখানি কাব্য। কাব্যে-কাব্যে যে প্রভেদ থাকে এদের পরস্পরের ভিতর সেই প্রভেদ মাত্র আছে। আমার মতে গ্রীক সভ্যতা হচ্ছে নাটক, রোমান সভ্যতা মহাকাব্য, ইহদি সভ্যতা লিরিক এবং অর্বাচীন যুগের ইতালীয় সভ্যতা সনেট; আর ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতা হচ্ছে রূপকথা। সভ্যতার সঙ্গে কাব্যের তুলনা দেওয়ায় যদি কেউ আপত্তি করেন, তা হলে বলি, ও তুলনা একটা খামখেয়ালির ব্যাপার নয়। আমরা প্রাচীন সভ্যতার যে-সব মতি গড়ি-হয় পুজা করবার জন্য, নয় মনের ঘর সাজাবার জন্য-অতীত শুধু তার উপাদান জোগায়, তাও আবার অতি স্বল্পমাত্রায়; সেই উপাদানকে আমাদের কল্পনাশক্তি গড়ন ও রূপ দেয়, এবং সেই রূপকে আমরা আমাদের হৃদয়রাগে রঞ্জিত করি। কাব্যরচনার পদ্ধতিও ঐ।

সত্য কথা এই যে, সভ্যতা হচ্ছে একটা আর্ট এবং সম্ভবত সবচাইতে বড়ো আর্ট। কেননা এ হচ্ছে জীবনকে বরপ করে তোলবার আর্ট, আর বাদবাকি যত-কিছু, শিল্পকলা আছে, সে সবই এই মহা আর্ট হতে উদ্ভূত এবং তার কর্তৃকই পরিপুষ্ট।

এ কথা অবশ্য বৈজ্ঞানিকেরা এবং দার্শনিকেরা মানবেন না; কেননা বৈজ্ঞানিকের বিশ্বাস, সভ্যতা জন্মে মাটির গুণে; আর দার্শনিকের বিশ্বাস, ও-বস্তু পড়ে আকাশ থেকে। এদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, কাব্যের জন্মদাতা যেমন কবি, সভ্যতার জন্মদাতাও তেমনি মানুষ। এ বস্তুর তত্ত্ব বিজ্ঞান-দর্শন কখনো আবিষ্কার করতে পারবে না, কেননা ও হচ্ছে জীবনের একটি postulate, জ্ঞানের axiom নয়। অর্থাৎ মানুষের মন ছাড়া সভ্যতার অস্তিত্ব আর কোথাও নেই।

সে যাই হোক, এ ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের সভ্যতার বিশিষ্টতা প্রমাণ করবার কোনোই প্রয়োজন নেই। উইলিয়ম আর্চার প্রতি সে বিশিষ্টতা সম্পূর্ণ মানেন; আমাদের উপর তাঁদের রাগ এই যে, আমরা আমাদের প্রাচীনতা ত্যাগ করে নবীন হবার চেষ্টা করছি। ফলে আমাদের সমাজ এখন হয়েছে প্রবীণ-নবীন ওরফে সভ্যাসভ্য। East এবং West যে ভারতবর্ষে meet করেছে, এই হচ্ছে আমাদের অপরাধ; কেননা এই মিলনের ফলে কতকগুলি দুরন্ত সমস্যা জন্মলাভ করেছে। কিন্তু তার জন্য দায়ী কি আমরা?

পূর্বাপর সভ্যতার এই মিলন ও মিশ্রণ যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার নয়, তার প্রমাণ ইউরোপের বর্তমান সভ্যতাও তো প্রবীণ-নবীন, ইউরোপীয় পণ্ডিতমণ্ডলী যার নাম দিয়েছেন antico-modern। বর্তমান ইউরোপীয়েরা যে-অংশে ও যেপরিমাণে জ্ঞানে গ্রীক কর্মে রোমান ও ভক্তিতে ইহদি, সেই অংশে ও সেই পরিমাণে তারা সভ্য, এবং বাদবাকি অংশে তারা হচ্ছে শুধু সাদা মানুষ।

যদি বর্তমান ইউরোপীয় সভ্যতা অ্যান্টিকো-মডান হতে পারে, তো ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ সভ্যতা কেন যে অ্যান্টিকো-মডার্ন হতে পারবে না, তা আমার বুদ্ধির অগম্য। তবে এ ক্ষেত্রে ইউরোপের সঙ্গে ভারতবর্ষের একটু প্রভেদ আছে। ইউরোপ তার নবীন সভ্যতার গায়ে প্রাচীন সভ্যতার কলম বসিয়েছে, অপর পক্ষে ভারতবর্ষ তার প্রাচীন সভ্যতার গায়ে নবীন সভ্যতার কলম বসাচ্ছে। ফল কোনটায় ভালো ফলবে, সে কথা বলতে পারে শুধু বৃক্ষায়ুর্বেদীরা। তবে সহজ বুদ্ধিতে তো মনে হয় যে, নূতনের ঘাড়ে পুরাতনকে ভর করতে দেওয়ার চাইতে নূতনকে পুরাতনের কোলে স্থান দেওয়াই বেশি স্বাভাবিক।

সুতরাং আমরা সভ্য কি অসভ্য, সে বিষয়ে আমাদের মাথা বকাবার দরকার নেই, কেননা এখন আমাদের মীমাংসা করতে হবে অন্য সমস্যার। প্রথমে যে-ক’টি সমস্যার উল্লেখ করেছি, তার মধ্যে যে তিনটি বিল-আকার ধারণ করেছে তাদের সম্বন্ধেও বেশি কিছু ভাববার নেই, কেননা এ কথা নিশ্চিত যে, রাউলাট-বিল পাস হবে প্যাটেল-বিল হবে না, এবং রিফর্ম-বিল পাস হবে ও হবে না। যে দুটি বাকি থাকল, শিক্ষা ও শিল্প, সে দুটিই হচ্ছে এ যুগের আসল সমস্যা; কারণ এ দুটির মীমাংসার ভার অনেকটা আমাদের হাতে, এবং এ দুটির আমরা যদি সুমীমাংসা করতে পারি তা হলে আমরা সভ্য কি না, সে প্রশ্ন আর উঠবে না।

ফাগুন ১৩২৫

ভারতবর্ষের ঐক্য

ভারতবর্ষের ঐক্য

শ্ৰীযুক্ত রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় উপরোক্ত নামে পুস্তিকা-আকারে ইংরেজি ভাষায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। যাঁরা দিবারাত্র জাতীয় ঐক্যের স্বপ্ন দেখেন তাঁদের পক্ষে, অর্থাৎ শিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রেরই পক্ষে, এই ক্ষুদ্র পুস্তকের আলোচ্য বিষয়ের যথেষ্ট মূল্য আছে।

স্বদেশ কিংবা স্বজাতির নাম উল্লেখ করবামাত্রই এক দলের লোক আমাদের মুখ-ছোপ দিয়ে বলেন, ও-সব কথা উচ্চারণ করবার তোমাদের অধিকার নেই, কেননা ভারতবর্ষ বলে কোনো-একটা বিশেষ দেশ নেই এবং ভারতবাসী বলে কোনো-একটা বিশেষ জাতি নেই। ভারতবর্ষের অর্থ হচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এবং পরপর-অসংযত নানা খণ্ড দেশ এবং ভারতবাসীর অর্থ হচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরপর-সম্পর্কহীন নানা ভিন্ন জাতি।

ভারতবর্ষ যে একটি প্রকাণ্ড মহাদেশ, এ সত্য আবিষ্কার করবার জন্য পায়ে হেঁটে তীর্থ পর্যটন করবার দরকার নেই। একবার এ দেশের মানচিত্রখানির উপর চোখ বুলিয়ে গেলেই আমাদের শ্রান্তি বোধ হয়, এবং শরীর না হোক মা অবসন্ন হয়ে পড়ে। এবং ভারতবর্ষের জনসংখ্যা যে অগণ্য, আর এই কোটি কোটি লোক যে জাতি ধর্ম ও ভাষায় শত শত ভাগে বিভক্ত, এ সত্য আবিষ্কার করবার জন্যও সেন্সস রিপোর্ট গড়বার আবশ্যক নেই; চোখ-কান খোলা থাকলেই তা আমাদের কাছে নিত্যপ্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে।

আমাদের জীবনের যে ঐক্য নেই, এ কথাও যেমন সত্য–আমাদের মনে যে ঐক্যের আশা আছে, সে কথাও তেমনি সত্য। এক-ভারতবর্ষ হচ্ছে এ যুগের শিক্ষিত লোকের ইউটোপিয়া, সংস্কৃত ভাষায় যাকে বলে গন্ধর্বপুরী। সে পুরী আকাশে ঝোলে এবং সকলের নিকট তা প্রত্যক্ষ নয়। কিন্তু যিনি একবার সে পুরীর মর্মরপ্রাচীর মণিময়তেরণ রজতসৌধ ও কনকচড়ার সাক্ষাৎলাভ করেছেন, তিনি আকাশরাজ্য হতে আর চোখ ফেরাতে পারেন না। এক কথায় তিনি ভারতবর্ষের একতার দিবাস্বপ্ন দেখতে বাধ্য। অনেকের মতে দিবাঘন দেখাটা নিন্দনীয়, কেননা ও ব্যাপারে শুধু অলীকের সাধনা করা হয়। মানুষে কিন্তু বাস্তবজগতের অজ্ঞতাবশত নয়, তার প্রতি অসন্তোষবশতই, চোখ-চেয়ে ঘন দেখে; সে ঘরে মূল মানবহৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত। এবং ইতিহাস এ সত্যের সাক্ষ্য দেয় যে, আজকের কল্পনারাজ্য কখনো কখনো কালকের বাস্তবজগতে পরিণত হয়, অর্থাৎ দিবাধন কখনো কখনো ফলে। সুতরাং ভারতবর্ষের ঐক্যসাধন জাতীয় জীবনের লক্ষ্য কবে তোলা অনেকের পক্ষে স্বাভাবিক এবং সকলের পক্ষেই আবশাক। সমগ্র সমাজের বিশেষ-একটা-কোনো লক্ষ্য না থাকায় দিন দিন আমাদের সামাজিক জীবন নিজীব এবং ব্যক্তিগত জীবন সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। পূর্বে যে ঐক্যের কথা বলা গেল, তা অবশ্য আইডিয়াল ইউনিটি; এবং অধিকাংশ শিক্ষিত লোকের মনে এক ভারতবর্ষ একটি বিরাট আইডিয়াল-রূপেই বিরাজ করছে। আমাদের বাঞ্ছিত ইউটোপিয়া ভবিষ্যতের অঙ্কস্থ রয়েছে।

কিন্তু এই আইডিয়ালকে দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত দিক থেকে নিত্যই আক্রমণ সহ্য করতে হয়। এক দিকে ইংরেজি সংবাদপত্র, অপর দিকে বাংলা সংবাদপত্র এই আইডিয়ালটিকে নিতান্ত উপহাসের পদার্থ মনে করেন; উভয়েই শিক্ষিত সম্প্রদায়ের উপর বিদ্রূপবাণ বর্ষণ করেন। কাগজওয়ালাদের মতে এই মনোভাবটি বিদেশী-শিক্ষালন্ধ, এবং সেইজন্যই স্বদেশী-ভিত্তিহীন; কেননা ভারতবর্ষের অতীতের সঙ্গে তার কোনো যোগ নেই। ইংরেজি সংবাদপত্রের মতে ভারতবর্ষের সভ্যতার মূল এক নয়, বহ; এবং যা গোঁড়া হতেই পৃথক, তার আর কোনোরূপ মিলন সম্ভব নয়। কুকুর আর বেড়াল নিয়ে এক-সমাজ গড়ে তোলা যায় না; ও দুই শ্রেণীর জীব শুধু গহস্বামীর চাবুকের ভয়ে একসঙ্গে ঘর করতে পারে। অপর পক্ষে বাংলা সংবাদপত্রের মতে হিন্দুসমাজের বিশেষত্বই এই যে, তা বিভক্ত। এ সমাজ শতরঞ্জের ঘরের মতো ছক-কাটা। এবং কার কোন ছক, তাও অতি সুনির্দিষ্ট। এই সমাজের ঘরে কে সিধে চলবে, কে কোনাকুনি চলবে, কে এক পা চলবে, আর কে আড়াই পা চলবে, তারও বাঁধাবাঁধি নিয়ম আছে। এর নাম হচ্ছে বর্ণশ্রমধর্ম। নিজের নিজের গণ্ডির ভিতর অবস্থিতি করে নিজের নিজের চাল রক্ষা করাই হচ্ছে ভারতবাসীর সনাতন ধর্ম। সুতরাং যাঁরা সেই দাবার ঘরের রেখাগুলি মুছে দিয়ে সমগ্র সমাজকে একঘরে করতে চান, তাঁরা দেশের শত্র। শিক্ষিত সম্প্রদায় যে ঐক্য চান তা ভারতবর্ষের ধাতে নেই, সুতরাং জাতির উন্নতির যে ব্যবস্থা তারা করতে চান, তাতে শুধু সামাজিক অরাজকতার সৃষ্টি করা হবে। সমাজের সুনির্দিষ্ট গণ্ডিগুলি তুলে দিলে সমাজতরী কোনাকুনি চ’লে তীরে আটকে যাবে, এবং সমাজের ঘোড়া আড়াই পা’র পরিবর্তে চার পা তুলে ছুটবে। এ অবশ্য মহা বিপদের কথা। সুতরাং ভারতবর্ষের অতীতে এই ঐক্যের আইডিয়ালের ভিত্তি আছে কি না, সেটা খুঁজে দেখা দরকার। এই কারণেই সম্ভবত রাধাকুমুদবাবু দু হাজার বৎসরের ইতিহাস খুড়ে সেই ভিত বার করবার চেষ্টা করেছেন, যার উপরে সেই কাম্যবস্তুকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে। এ যে অতি, সাধু উদ্দেশ্য সে বিষয়ে বোধ হয় দ্বিমত নেই।

 

২.

রাধাকুমুদবাবু জাতীয় জীবনের ঐক্যের মূল যে প্রাচীন যুগের সামাজিক জীবনে আবিষ্কার করতে চেষ্টা করেছেন, তার জন্য তিনি আমার নিকট বিশেষ ধন্যবাদার্হ। অনেকে, দেখতে পাই, এই ঐক্যের সন্ধান, ঐতিহাসিক সত্যে নয়, দার্শনিক তথ্যে লাভ করেন। এ শ্রেণীর লোকের মতে সমগ্র ভারতবর্ষ এক ব্রহ্মপুত্রে গ্রথিত; কেননা অদ্বৈতবাদে সকল অনৈক্য তিরস্কৃত হয়। কিন্তু যে সমস্যা নিয়ে আমরা নিজেদের বিব্রত করে তুলেছি, তার মীমাংসা বেদান্তদর্শনে করা হয় নি; বরং ঐ দর্শন থেকেই অনুমান করা অসংগত হবে না যে, প্রাচীন যুগে জাতীয় জীবনে কোনো ঐক্য ছিল না। মানবজীবনের সঙ্গে মানবমনের যোগ অতি ঘনিষ্ঠ। কাব্যের মতো দর্শনও জীবনবৃক্ষের ফল; তবে এ ফল এত সক্ষম বতে ভর করে এত উচ্চে ফুটে ওঠে যে, হঠাৎ দেখতে তা আকাশকুসুম বলে ভ্রম হয়। আমার বিশ্বাস, একটি ক্ষুদ্র দেশের এক রাজার শাসনাধীন জাতির মন একেশ্বরবাদের অনুকল। ঐরূপ জাতির পক্ষে বিশ্বকে একটি দেশ হিসেবে এবং ভগবানকে তার অদ্বিতীয় শাসনও পালনকর্তা হিসেবে দেখা স্বাভাবিক এবং সহজ। অপর পক্ষে যে মহাদেশ নানা রাজ্যে বিভক্ত এবং বহু রাজা-উপরাজার শাসনাধীন, সে দেশের লোকের পক্ষে আকাশদেশে বহু দেবতা এবং উপদেবতার অস্তিত্ব কল্পনা করাও তেমনি স্বাভাবিক। সাধারণত মানুষে মর্তের ভিত্তির উপরেই স্বর্গের প্রতিষ্ঠা করে। যে দেশের পূর্বপক্ষ একেশ্বরবাদী সে দেশের উত্তরপক্ষ নাস্তিক, এবং যে দেশের পূর্বপক্ষ বহুদেবতাবাদী সে দেশের উত্তরপক্ষ অদ্বৈতবাদী। অদ্বৈতবাদী বহুর ভিতর এক দেখেন না, কিন্তু বহুকে মায়া বলে তার অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। সুতরাং উত্তরমীমাংসার সার কথা— ‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা’–এই অর্ধ শ্লোকে যে বলা হয়েছে, তার আর সন্দেহ নেই। এই কারণেই বেদান্তদর্শন সাংখ্যদর্শনের প্রধান বিরোধী। অথচ এ কথা অস্বীকার করবার জো নেই যে, সংখ্যা বাদ দিলে অবশিষ্ট থাকে শুধু শূন্য। সুতরাং মায়াবাদ যে ভাষান্তরে শূন্যবাদ এবং শংকর যে প্রচ্ছন্নবৌদ্ধ–এই প্রাচীন অভিযোগের মূলে কতকটা সত্য আছে। যে একাত্মজ্ঞান কর্ম শূন্যতার উপর প্রতিষ্ঠিত, সে জ্ঞানের চর্চায় আত্মার যতটা চর্চা করা হয়, বিশ্বমানবের সঙ্গে আত্মীয়তার চর্চা ততটা করা হয় না। আরণ্যক-ধর্ম যে সামাজিক, এ কথা শুধু ইংরেজি-শিক্ষিত নাগরিকেবাই বলতে পারেন। সমাজ ত্যাগ করাই যে সন্ন্যাসের প্রথম সাধনা, এ কথা বিস্মৃত হবার ভিতর যথেষ্ট আরাম আছে।

সোহহং হচ্ছে ইনভিভিডুয়ালিজমের চরম উক্তি। সুতরাং বেদান্তমত আমাদের মনোজগৎকে যে পরিমাণে উদার ও মুক্ত করে দিয়েছে, আমাদের ব্যাবহারিক জীবনকে সেই পরিমাণে বদ্ধ ও সংকীর্ণ করে ফেলেছে। বেদান্তের দর্পণে প্রাচীন যুগের সামাজিক মন প্রতিফলিত হয় নি, প্রতিহত হয়েছে। বেদান্তদর্শন সামাজিক জীবনের প্রকাশ নয়, প্রতিবাদ। অদ্বৈতবাদ হচ্ছে সংকীর্ণ কর্মের বিরুদ্ধে উদার মনের প্রতিবাদ, সীমার বিরুচ্ছে অসীনের প্রতিবাদ, বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে আত্মজ্ঞানের প্রতিবাদ। এক কথায় জড়ের বিরুদ্ধে আমার প্রতিবা। সমাজের দিক থেকে দেখলে জীবের এই ঘরাটন শুধু বিরাট অহংকার মাত্র। সুতরাং যে সূত্রে একালের লোকেরা জাতিকে একতার বন্ধনে আবদ্ধ করতে চান তা ব্রহ্মসূত্র নয়, কিন্তু তার অপেক্ষা ঢের স্থূল জীবনসূত্র।

কেন যে পুরাকালে অদ্বৈতবাদীরা কৌপীনকমণ্ডল, ধারণ করে বনে যেতেন, তার প্রকৃত মর্ম উপলদ্ধি না করতে পারায় একালের অদ্বৈতবাদীরা চোগাচাপকান পরে আপিসে যান।, উভয়ের ভিতর মিল এইটুকু যে, একজন হচ্ছেন উদাসী আর-একজন শুধু উদাসীন–পরের সম্বন্ধে।

রাধাকুমুদবাবুর প্রবন্ধের প্রধান মর্যাদা এই যে, তিনি ভারতের আত্মজ্ঞানের ভিত্তি অতীতের জীবনক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়াসী হয়েছেন। তবে কতদূর কৃতকার্য হয়েছেন সেইটেই বিচার্য। ভবিষ্যতের শুন্যদেশে যা-খুশি-তাই স্থাপনা করবার যে স্বাধীনতা মানুষের আছে, অতীত সম্বন্ধে তা নেই। ভবিষ্যতে সবই সম্ভব হতে পারে, কিন্তু অতীতে যা হয়ে গেছে তার আর একচুলও বদল হতে পারে না। কল্পনার প্রকৃত লীলাভূমি ভূত নয়, ভবিষ্যৎ। আকাশে আশার গোলাপ ফুল অথবা নৈরাশ্যের সরষের ফল দেখবার অধিকার আমাদের সকলেরই আছে; কিন্তু অতীত ফলের নয়, মূলের দেশ। যে মূল আমরা খুঁজে বার করতে চাই তা সেখানে পাই তো ভালোই; না পাই তো, না পাই।

 

৩.

জীবের অহংজ্ঞান যেমন একটি দেহ আশ্রয় করে থাকে জাতির অহংজ্ঞানও তেমনি একটি দেশ আশ্রয় করে থাকে। মানুষের যেমন দেহাত্মজ্ঞান তার সকল বিশিষ্টতার মূল, জাতির পক্ষেও তেমনি দেশাত্মজ্ঞান তার সকল বিশিষ্টতার মূল। ভারতবাসীর মনে এই দেশাত্মজ্ঞান যে অতি প্রাচীনকালে জন্মলাভ করেছিল, রাধাকুমুদবাবু নানারূপ প্রমাণপ্রয়োগের বলে তাই প্রতিপন্ন করতে চেষ্টা করেছেন।

ভারতবর্ষ মহাদেশ হলেও যে একদেশ এবং ভারতবাসীদের যে সেটি স্বদেশ, এ সত্যটি অন্তত দু হাজার বৎসর পূর্বে আবিষ্কৃত হয়েছিল।

উত্তরে অলঙ্ঘ্য পর্বতের প্রাকার, এবং পশ্চিম দক্ষিণ ও পূর্বে দুর্লঙ্ঘ্য সাগরের পরিখা যে ভারতবর্ষকে অন্যান্য সকল ভূভাগ হতে বিশেষরূপে পৃথক ও স্বতন্ত্র করে রেখেছে, এ হচ্ছে প্রত্যক্ষসত্য। তার পর, এ দেশ অসংখ্যযোজনবিস্তৃত হলেও সমতল; এত সমতল যে, সমগ্র ভারতবর্ষকে একক্ষেত্র বললেও অত্যুক্তি হয় না। বিন্ধ্যাচল সম্ভবত এ মহাদেশকে দুটি চিরবিচ্ছিন্ন খণ্ডদেশে বিভক্ত করতে পারত, যদি অগস্ত্যের আদেশে সে চিরদিনের জন্য নতশির হয়ে থাকতে বাধ্য না হত। রাধাকুমুদবাবু দেখিয়েছেন যে, এই স্বদেশজ্ঞান ভারতবাসীর পক্ষে কেবলমাত্র শুষ্ক জ্ঞান নয়, কিন্তু তাদের আত্যন্তিক প্রীতি ও ভক্তির সঙ্গে জড়িত। ভারতবাসীর পক্ষে ভারতবর্ষ হচ্ছে পূণ্যভূমি। সে দেশের প্রতি ক্ষেত্র ধর্মক্ষেত্র, প্রতি নদী তীর্থ, প্রতি পর্বত দেবতাত্মা। কিন্তু এই ভক্তিভাব আর্য মনোভাব কি না, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। বেদ হতে পঞ্চনদের আবাহনস্বরূপ একটিমাত্র শ্লোক উদধৃত করে রাধাকুমুদবাবু প্রমাণ করতে চান যে, ঋষিদের মনে এই একদেশীয়তার ভাব সর্বপ্রথমে উদয় হয়েছিল। কিন্তু সেই বৈদিক মনোভাব যে ক্ৰমে বৃদ্ধি এবং বিস্তার লাভ করে শেষে লৌকিক মনোভাবে পরিণত হয়েছিল, তার কোনো প্রমাণ নেই। আমার বিশ্বাস, বৈদিক ধর্ম নয়, লৌকিক ধর্মই ভারতবর্ষকে পূণ্যভূমি করে তুলেছে। ভারতবর্ষের আদিম অধিবাসীদের ধর্ম হচ্ছে লৌকিক ধর্ম, বিদেশী বিজেতা আর্যদের ধর্ম হচ্ছে বৈদিক ধর্ম। ভারতবর্ষের মাটি ও ভারতবর্ষের জলই হচ্ছে লৌকিক ধর্মের প্রধান উপাদান। সে ধর্ম আকাশ থেকে পড়ে নি, মাটি থেকে উঠেছে। ভারতবর্ষের জনগণ চিরদিন কৃষিজীবী। যে ত্রিকোণ পৃথিবী তাদের চিরদিন অন্নদান করে সেই হচ্ছে অন্নদা এবং যে জল তাদের শস্যক্ষেত্রে রসসঞ্চার করে সেই হচ্ছে প্রাণদা। তাই ভারতবর্ষের অসংখ্য লৌকিক দেবতা সেই অন্নদার বিকাশ। সীতার মতো এ-সকল দেবতা হলমুখে ধরণী হতে উত্থিত হয়েছে। তাই এ দেশের প্রতিমা মাটির দেহ ধারণ করে এবং জলে তার বিসর্জন হয়। ‘তোমারি প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে’ এ কথা মোটেই বৈদিক মনোভাবের পরিচায়ক নয়। কেননা, পঞ্চনদবাসী আর্যেরা মন্দিরও গড়াতেন না, প্রতিমাও পুজা করতেন না। এই দেশভক্তি পৌরাণিক সাহিত্যে অতি পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। তার কারণ, বৈদিক যুগ ও পৌরাণিক যুগের মধ্যে যে বৌদ্ধ যুগ ছিল সেই যুগেই এই দেশজ্ঞান ও স্বদেশপ্রীতি ভারতবর্ষময় ব্যাস্ত হয়ে পড়েছিল। বৌদ্ধধর্ম অবৈদিক ধর্ম, এবং সার্বজনীন বলে তা সার্বভৌম ধর্ম। অপর পক্ষে বৈদিক ধর্ম আর্যদের গৃহধর্ম, বড়োজোর কুলধর্ম। সমগ্র দেশকে একাত্ম করবার ক্ষমতা সে ধর্মের ছিল না। যেমন অসুরদের সঙ্গে যুদ্ধে সুরেরা এক ঈশানকোণ ব্যতীত আর-সকল দিকেই পরাস্ত হয়েছিলেন, তেমনি সম্ভবত ইন্দ্র চন্দ্র বায়ু বরুণ প্রভৃতি বৈদিক দেবতারা দেশজ দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধে এক গৃহকোণ ব্যতীত আর সর্বত্রই পরাস্ত হয়েছিলেন। অন্তত আকাশের দেবতারা যে মাটির দেবতাদের সঙ্গে সন্ধিস্থাপন করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তার প্রমাণ পৌরাণিক হিন্দুধর্ম। বৈদিক ও লৌকিক মনোভাবের মিশ্রণে এই নবধর্মভাবের জন্ম। আর্যরা যে কস্মিনকালেও সমগ্র ভারতবর্ষকে একদেশ বলে স্বীকার করতে চান নি, তার প্রমাণ স্মৃতিশাস্ত্রে পাওয়া যায়। বৌদ্ধধর্মের অধঃপতন এবং ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরভ্যুদয়ের সময় মনুসংহিতা লিখিত হয়। এই সংহিতাকারের মতে ব্রহ্মাবর্ত-এবং আর্যাবর্ত-বহির্ভূত সমগ্র ভারতবর্ষ হচ্ছে ঘৃণ্য ম্লেচ্ছদেশ। মনুর টীকাকার মেধাতিধি বলেন যে, দেশের ম্লেচ্ছত্বদোষ কিংবা আর্যগুণ নেই। যে দেশে বেদবিহিত ক্রিয়াকর্মনিরত আর্যেরা বাস করেন, সেই হচ্ছে আর্যভূমি, বাদবাকি সব ম্লেচ্ছদেশ। আর্যদের এই স্বজাতিজ্ঞান সমগ্র ভারতবর্ষের স্বদেশজ্ঞানের প্রতিকূল ছিল। পঞ্চনদের পঞ্চনদীর উল্লেখ করে তর্পণের মন্ত্র উচ্চারণপক বৈদিক ঋষিরা যে গণ্ডূষ করতেন, সে কতকটা সেই ভাবে, যে ভাবে একালে বিলাতি আর্যেরা মহোৎসবের ভোজনাতে The Land we live inএর নামোচ্চারণ করে সুরার আচমন করেন। প্রাচীন আর্যজাতির মনে দেশপ্রীতির চাইতে আত্মপ্রীতি ঢের বেশি প্রবল ছিল। দেশের স্বাতন্ত্র রক্ষা নয়, নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষাই ছিল তাঁদের স্বধর্ম। রাধাকুমুদবাবু এমন-কোনো বিরুদ্ধপ্রমাণ দেখাতে পারেন নি, যাতে করে আমার এই ধারণা পরিবর্তিত হতে পারে।

 

৪.

ইংরেজ যে সর্বপ্রথমে ভারতবর্ষের মানচিত্র লালবর্ণে চিত্রিত করেছেন, তা নয়। আজ দু হাজার বৎসরেরও পূর্বে আশোকও একবার ঐ মানচিত্র গেরুয়ারঙে রঞ্জিত করেছিলেন। এ কথা শিক্ষিত লোকমাত্রেরই জানা না থাক, শোনা আছে। যা সপরিচিত তার আর নতুন করে আবিষ্কার করা চলে না, সুতরাং রাধাকুমুদবাবু প্রাচীন ভারতের একরাস্ট্রীয়তার মূল বৈদিক সাহিত্যে অনুসন্ধান করেছেন, তাঁর পুস্তিকার মৌলিকতা এইখানেই। সুতরাং তিনি অনুসন্ধানের ফলে যে নূতন সত্য আবিষ্কার করেছেন, তা বিনাপরীক্ষায় গ্রাহ্য করা যায় না।

শাস্ত্রকারেরা বেদকে স্মৃতির মূল বলে উল্লেখ করেছেন, কিন্তু বেদ যে শূদ্ররীতি কিংবা বৌদ্ধনীতির মূল, এ কথা তারা কখনো মুখে আনেন নি; বরং বৌদ্ধচার্যেরা যখন বেদের কোনো উৎসন্ন শাখা থেকে বৌদ্ধধর্ম উদ্ভূত হয়েছে এই দাবি করতেন, তখন বৈদিক ব্রাহ্মণেরা কানে হাত দিতেন। অথচ এ কথা অস্বীকার করবার জো নেই যে, ইতিহাস যে প্রাচীন সাম্রাজ্যের পরিচয় দেয় তা বৌদ্ধযুগে ব্রাত্যদেশে শূদ্রভূপতি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মগধের নন্দবংশও শূদ্রবংশ, মৌর্যবংশও শূদ্রবংশ ছিল। এবং অশোক সমগ্র ভারতবর্ষে শুধু রাজচক্র নয় ধর্মচক্রেরও স্থাপনা করে সসাগরা বসুন্ধরার সার্বভৌম চক্রবর্তীর পদে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। সুতরাং একরাষ্ট্রীয়তার মূল বৈদিক মনে পাওয়া যাবে কি না সে বিষয়ে স্বতই সন্দেহ উপস্থিত হয়।

বৌদ্ধযুগের পূর্বে কোনো একরাটের পরিচয় ইতিহাস দেয় না। কিন্তু ইতিহাসের পশ্চাতে কিংবদন্তি আছে; সেই কিংবদন্তির সাহায্যে, দেশের বিশেষকোনো ঘটনা না হোক, জাতির বিশেষ মনোভাবের পরিচয় আমরা পেতে পারি। রাধাকুমুদবাবু ব্রাহ্মণ এবং শ্রৌত সূত্র প্রভৃতি নানা বৈদিক গ্ৰন্থ থেকে রাজনীতি সম্বন্ধে আর্যজাতির মনোভাব উদ্ধার করবার চেষ্টা করেছেন।

রাধাকুমুদবাবুর দাখিলি বৈদিক দলিলগুলির কোনো তারিখ নেই, সুতরাং তার সবগুলি যে মাগধসাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার পূর্বে লিখিত হয়েছিল, তা বলা যায় না। অতএব কোনো বিশেষ ব্রাহ্মণগ্রন্থ বৈদিক সাহিত্যের অন্তর্ভুত হলেও তার প্রতি বাক্য যে বৈদিক মনোভাবের পরিচয় দেয় এ কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে না। ওরূপ দলিলের বলে তর্কিত বিষয়ের চুড়ান্ত নিষ্পত্তি করা অসম্ভব, বিশেষত যখন তাঁর সংগৃহীত দলিল তাঁর মতের বিরুদ্ধেই সাক্ষ্য দেয়। রাধাকুমুদবাবুর প্রধান দলিল হচ্ছে ঐতরেয় ব্রাহ্মণ। ঐ গ্রন্থেই তিনি সাম্রাজ্য শব্দের সাক্ষাৎ পেয়েছেন, এবং সেই শব্দই হচ্ছে তাঁর মতের মূলভিত্তি। উক্ত ব্রাহ্মণের একখানি বাংলা অনুবাদ আছে; তারই সাহায্যে রাধাকুমুদবাবুর মত যাচাই করে নেওয়া যেতে পারে। সম্রাট কাকে বলে, তার পরিচয় ঐ ব্রাহ্মণে এইরূপ আছে—

পূর্ব দিকে প্রাচ্যগণের যে-সকল রাজা আছেন তাঁহারা দেবগণের ঐ বিধান অনুসারে সাম্রাজ্যের জন্য অভিষিক্ত হন, অভিষেকের পর তাঁহারা সম্রাট নামে অভিহিত হন। (ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, ৩৮শ অধ্যায়)

রাধাকুমুদবাবু বলেন যে, এ স্থলে মাগধসাম্রাজ্যের উল্লেখ করা হয়েছে। যদি তাঁর উক্ত অনুমান গ্রাহ্য হয় তা হলে প্রাচীন ভারতসাম্রাজ্যের বৈদিক ভিত্তি ঐ এক কথাতেই নষ্ট হয়ে যায়।

ঐতরেয় ব্রাহ্মণে নানারূপ রাজ্যের উল্লেখ আছে, যথা : রাজ্য, সাম্রাজ্য, ভৌজ্য, স্বারাজ্য, বৈরাজ্য, পারমেষ্ঠ্য রাজ্য, মাহারাজ্য ইত্যাদি। রাধাকুমুদবাবু প্রমাণ করতে চান যে, ঐ-সকল নাম উচ্চনীচহিসাবে একরাটের অধীন ভিন্ন ভিন্ন রাজপদ নির্দেশ করে। কিন্তু ঐ ব্রাহ্মণগ্রন্থেই প্রমাণ আছে যে, ঐ-সকল নাম হচ্ছে পৃথক পৃথক দেশের ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যের নাম। তার সকল দেশই পঞ্চনদের বহির্ভূত, কোনো কোনো দেশ ভারতবর্ষেরও বহির্ভুত, এবং বিশেষ করে একটি দেশ পৃথিবীর বহিভূত। যথা–

পূর্ব দিকে প্রাচ্যগণের রাজ্য সম্রাট, দক্ষিণ দিকে সত্ত্বৎগণের রাজা ভোজী; পশ্চিম দিকে নীচ্য ও অপাচ্যদিগের রাজা স্বরাট; উত্তর দিকে হিমবানের ওপারে যে উত্তরকুরু ও উত্তরমদ্র জনপদ আছে, তাহারা দেবগণের ঐ বিধানানুসারে বৈরাজ্যের জন্য অভিষিক্ত হয়, অভিষেকের পরে তাহারা বিরাট নামে অভিহিত হয়। মধ্যমদেশে সবশ উশীনরগণের ও কুরপাঞ্চালগণের যে-সকল রাজা আছেন তাঁহারা রাজা নামে অভিহিত হন। এবং ঊর্ধ্বদেশে (অন্তরীক্ষে) ইন্দ্র পরমেষ্ঠ্য লাভ করিয়াছিলেন।

উপরোক্ত উদধৃত বাক্যগলি থেকে দেখা যায় যে, দেশভেদ অনুসারে সে যুগের রাজাদের নামভেদ হয়েছিল, পদমর্যাদা অনুসারে নয়। উক্ত ব্রাহ্মণে একরাট শব্দও ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু সে একরাট, একসঙ্গে স্বরাট্‌ বিরাট্‌ সম্রাট, সব রাট্‌ হতে পারতেন; অর্থাৎ তিনি স্বদেশ বিদেশ এবং আকাশদেশের রাজা হতে পারতেন। বলা বাহুল্য, এরূপ একরাটের নিকট ভারতবর্ষের একরাষ্ট্রীয়তার সন্ধান নিতে যাওয়া বৃথা।

আসল কথা এই যে, রাজনীতি অর্থে আমরা যা বুঝি ও চাণক্য যা বুঝতেন, ব্রাহ্মণগ্রন্থে তার নামগন্ধও নেই। বাজপেয় রাজসূয় অশ্বমেধ পুনরভিষেক ঐন্দ্রমহাভিষেক–এ-সব হচ্ছে যজ্ঞ। এবং এসকল যজ্ঞের উদ্দেশ্য রাজ্যস্থাপনা নয়, পুরোহিতকে ভূরি দান করানো এবং ঐরূপ যজ্ঞ দ্বারা যজমানের অভ্যুদয় সাধিত হতে পারে, তাই প্রমাণ করা। রাধাকুমুদবাবু তাঁর পুস্তিকাতে পুরাকালে যাঁরা একরাট-পদে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন তাঁদের নামের একটি লম্বা ফর্দ ঐতরেয় ব্রাহ্মণ হতে তুলেছিলেন। সম্ভবত তিনি উক্ত রাজাগণের সার্বভৌম সাম্রাজ্যলাভ ঐতিহাসিক ঘটনা বলে মনে করেন, কিন্তু আমরা তা পারি নে। কারণ উক্ত ব্রাহ্মণের মতে ঐন্দ্রমহাভিষেকের বলেই প্রাচীন রাজারা ঐ ইন্দ্রবাঞ্ছিত পদ লাভ করেছিলেন। মন্ত্রবলে এবং যজ্ঞফলে তাদৃশ বিশ্বাস না থাকার দরুন আমরা উক্ত রাজযজমানদের ঐরূপ আত্যন্তিক অভ্যুদয় এবং রাজপুরোহিতদের তদনুরূপ দক্ষিণালাভের ইতিহাসে যথেষ্ট আস্থা স্থাপন করতে পারি নে। রাধাকুমুদবাবু নামের ফর্দের পাশাপাশি যদি দানের ফর্দটি তুলে দিতেন, তা হলে পাঠকমাত্রেই ঐতরেয় ব্রাহ্মণের কথা কতদূর প্রামাণিক তা সহজেই বুঝতে পারতেন। ঐন্দ্রমহাভিষেক উপলক্ষে দান করা হত–

বদ্ধ শতকোটি গাভীর মধ্যে প্রতিদিন মাধ্যন্দিন সবনে দুই দুই সহস্র। আটাশি হাজার পুষ্ঠবাহনযোগ্য শ্বেত অশ্ব। এদেশ ওদেশ হইতে আনীত নিষ্ককণ্ঠী আঢ্য দুহিতার মধ্যে দশ সহস্র।

এরূপ দানের দাতা দুর্লভ হলেও গ্রহীতা আরো বেশি দুর্লভ। এত গোরু, এত ঘোড়া এত বনিতা রাখি কোথায় আর খাওয়াই কি, এ প্রশ্ন বোধ হয় দরিদ্র ব্রাহ্মণের মনে উদিত হত। ব্রাহ্মণগ্রন্থ এই সত্যেরই পরিচয় দেয় যে, সে যুগে এমন বহু ক্ষত্রিয় ছিলেন যাঁদের নিজেদের কোষবৃদ্ধি এবং অধিকারবৃদ্ধির প্রতি লোভ ছিল, এবং তাঁরা ব্রাহ্মণদের তন্তরমন্তরজাদুতে বিশ্বাস করতেন। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে যে সাম্রাজ্যের উল্লেখ আছে তা বিয়ের বাহুবল বুদ্ধিবল ও চরিত্রবল দ্বারা নয়, ব্রাহ্মণের মন্ত্রবলের দ্বারা লাভ করবার বস্তু। কারণ শত্রুনাশের জন্য তাঁদের যুদ্ধ করা আবশ্যক হত না, ব্ৰহ্ম-পরিমর-কর্ম প্রভৃতি অভিচারের দ্বারাই সে কামনা সিদ্ধ হত। এই অতীত সাহিত্যের ভিত্তির উপর যদি ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ ঐক্যের প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তা হলে আমাদের মনোজগতের গন্ধর্বপুরী চিরকাল আকাশেই ঝলবে।

আমরা ইউরোপীয় সভ্যতার নূতন মদ নিত্যই সংস্কৃত সাহিত্যের পুরোনো বোতলে ঢালছি। আমরা স্পেন্সরের বিলেতি মদ শংকরের বোতলে ঢালি Comte কঁতের ফরাসি মদ মনুর বোতলে ঢালি, এবং তাই যুগসঞ্চিত সোমরস বলে পান করে তৃপ্তিও লাভ করি মোহও প্রাপ্ত হই। কিন্তু এই ঢালাঢলি এবং ঢলাঢলিরও একটা সীমা আছে। বিস্‌মার্কের জর্মান মদ ব্রাহ্মণের যজ্ঞের চমসে ঢালতে গেলে আমরা সে সীমা পেরিয়ে যাই। ও-হাতায় এ-জিনিস কিছুতেই ধরবে না। ইংরেজি শিক্ষার প্রসাদে আমরা ব্রাহ্মণসাহিত্যের আধিদৈবিক ব্যাপার -সকলের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যার চেষ্টা করতে পারি, এবং চাই কি তাতে কৃতকার্যও হতে পারি; কিন্তু শুধু ইংরেজি শিক্ষা নয় তদুপরি ইংরেজি ভাষার সাহায্যেও তার ‘আধিরাষ্ট্রিক’ ব্যাখ্যা করতে পারি নে।

 

৫.

এতদিন প্রাচীন ভারতের নাম উল্লেখ করবামাত্রই বর্ণাশ্রমধর্ম, ধ্যান-ধারণা নিদিধ্যাসন–এই-সকল কথাই আমাদের স্মরণপথে উদিত হত, এবং বঙ্গ সাহিত্যে তারই গুণকীর্তন করে আমরা যশ ও খ্যাতি লাভ করতুম। ইমপরিয়লিজম নামক আহেলবিলাতি পদার্থ পুরাকালে এদেশে ছিল, এরূপ কথা পূর্বে কেউ বললে তার উপর আমরা খড়্গহস্ত হয়ে উঠতুম, কেননা ওরূপ কথা আমাদের দেশভক্তিতে আঘাত করত। বৈরাগ্যের দেশ ঐহিক ঐশ্বর্যের স্পর্শে কলুষিত হয়ে ওঠে। কিন্তু আজ যে নবদেশভক্তি ঐ ইমপীরিয়লিজমের উপর এত ঝুকেছে, তার একমাত্র কারণ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের আবিষ্কার। উক্ত গ্রন্থ থেকেই আমরা এই জ্ঞান লাভ করেছি যে, ইউরোপীয় রাজনীতির যা শেষ কথা ভারতবর্ষের রাজনীতির তাই প্রথম কথা। এই সত্যের সাক্ষাৎকার লাভ করে আমাদের চোখ এতই ঝলসে গেছে যে, আমরা সকল তন্ত্রে সকল মাত্রে ঐ সাম্রাজ্যেরই প্রতিরূপ দেখছি। এরূপ হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু আমাদের চোখ যখন আবার প্রকৃতিস্থ হবে তখন আমরা এই প্রাচীন ইমপীরিয়লিজমকেও খুঁটিয়ে দেখতে পারব এবং কৌটিল্যকেও জেরা করতে শিখব। ইতিমধ্যে এই কথাটি আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, চন্দ্রগুপ্ত রাজনীতির ক্ষেত্রে যে মহাভারত রচনা করেছিলেন কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র শুধু তারই ভাষ্য। যে মনোভাবের উপর সে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সে মনোভাব বৈদিক নয়, সম্ভব আর্যও নয়। মন, প্রভৃতি ধর্মশাস্ত্রের সঙ্গে তুলনা করে দেখলে দেখতে পাওয়া যায় যে, উক্ত অর্থশাস্ত্রকারের মানসিক প্রকৃতি এবং ধর্মশাস্ত্রকারদের প্রকৃতি এক নয়। সে পার্থক্য যে কোথায় ও কতখানি তা আমি একটিমাত্র উদাহরণের সাহায্যে দেখিয়ে দেব।

সংস্কৃত ভাষায় ধর্ম শব্দের অর্থ law, এবং শাস্ত্রকারদের মতে ল-এর মূল হচ্ছে বেদ স্মৃতি সদাচার ও আত্মতুষ্টি। রাজশাসন অর্থাৎ লেজিসলেশন যে ধর্মের মূল হতে পারে, এ কথা ধর্মশাস্ত্রে স্বীকৃত হয় নি। রাজা ধর্মের রক্ষক, স্রষ্টা নন। অপর পক্ষে কৌটিল্যের মতে রাজশাসন সকল ধর্মের উপরে। এ কথা বৈদিক ব্রাহ্মণ কখনোই মেনে নেন নি, কেননা তাঁদের মতে ধর্মের মূল হচ্ছে বেদ; অতএব ধর্ম অপৌরুষেয়। তার পরে আসে স্মৃতি, অর্থাৎ আর্যঋষিদের স্মৃতি; তার পর সদাচার, অর্থাৎ আর্যদের কুলাচার; তার পর আত্মতুষ্টি, অর্থাৎ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের আত্মতুষ্টি। এক কথায় ধর্মশাস্ত্রের মতে ‘পারম্পর্ষক্রমাগত’ আর্য-আচারই একমাত্র এবং সমগ্র ল। যাঁরা এরূপ মনোভাব পোষণ করতেন, তাঁরা চন্দ্রগুপ্ত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এবং চাণক্য কর্তৃক ব্যাখ্যাত রাজনীতি কখনোই স্বচ্ছন্দমনে গ্রাহ্য করতেন না। সম্ভবত এই কারণেই চাণক্য নিজে ব্রাহ্মণ হলেও সংস্কৃত সাহিত্যে হিংসা প্রতিহিংসা ক্রোধ দ্বেষ ক্রূরতা ও কুটিলতার অবতার-স্বরূপ বর্ণিত হয়েছেন, এবং একই কারণে ব্রাহ্মণসমাজে তাঁর অনাদৃত গ্রন্থ লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। বৌদ্ধধর্ম এবং সেইসঙ্গে মৌর্য সাম্রাজ্যের অধঃপতনের সকল কারণ আমরা অবগত নই। যখন সে ইতিহাস আবিষ্কৃত হবে, তখন সম্ভবত আমরা দেখতে পাব যে, এ ধংসব্যাপারে বৈদিক ব্রাহ্মণের যথেষ্ট হাত ছিল।

এ কথা বোধ হয় নির্ভয়ে বলা যেতে পারে যে, ভারতবাসী আর্যদের কৃতিত্ব সাম্রাজ্যগঠনে নয়, সমাজগঠনে; এবং তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় শিল্পে-বাণিজ্যে নয়, চিন্তার রাজ্যে। শাস্ত্রের ভাষায় বলতে হলে ‘পৃথিবীর সর্বমানব’কে আর্য-আচার শিক্ষা দেওয়া এবং সেই আচারের সাহায্যে সমগ্র ভারতবাসীকে একসমাজভুক্ত করাই ছিল তাঁদের জীবনের ব্রত। তার ফলে, হিন্দুসমাজের যা-কিছু গঠন আছে তা আর্যদের গুণে, এবং যা-কিছু জড়তা আছে তাও তাঁদের দোষে। এই বিরাট সমাজের ভিতর নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ও প্রভুত্ব রক্ষা করবার জন্য তাঁরা যে দুর্গ গঠন করেছিলেন, তাই আজ আমাদের কারাগার হয়েছে। দর্শনে বিজ্ঞানে কাব্যে অলংকারে অভিধানে ব্যাকরণে তাঁদের অপূর্ব কীর্তি, যে ভাষার তুলনা জগতে নেই সেই সংস্কৃত ভাষায়, অক্ষয় হয়ে রয়েছে। এ দেশের প্রাচীন আর্যেরা যে সাম্রাজ্যের চাইতে সমাজকে, এবং সমাজের চাইতেও মানুষের আত্মাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন, তার জন্য সমাজের লজ্জিত হবার কোনো কারণ নেই; কারণ বর্তমানে ইউরোপের মনেও এ ধারণা হয়েছে যে, political problemsএর অপেক্ষা social problemsএর মূল্য কিছু কম নয়। এবং শাসনযন্ত্রের চাইতে মানুষের মুল্য ঢের বেশি।

আষাঢ় ১৩২১

ভারতবর্ষের জিয়োগ্রাফি

ভারতবর্ষের জিয়োগ্রাফি
[একটি পারিবারিক সমিতিতে পঠিত]

হে সমিতির কুমার ও কুমারী-গণ, তোমাদের সমিতির কর্ণধার ভারতবর্ষের জিয়োগ্রাফির সঙ্গে তোমাদের দু কথায় পরিচয় করিয়ে দেবার ভার আমার উপর ন্যস্ত করেছেন। জিয়োগ্রাফি বিজ্ঞানের অন্তর্ভুত, সাহিত্যের নয়; আর এ কথা সবাই জানে যে, আমি সাহিত্যিক হলেও হতে পারি, কিন্তু বৈজ্ঞানিক নই। তবে যে আমি এ অনুরোধ রক্ষা করবার জন্য উদ্যত হয়েছি, তার কারণ অনধিকারচর্চা করবার কু অভ্যাস ও দুঃসাহস দুই আমার আছে।

কিন্তু প্রথমেই এক মুশকিলে পড়েছি। সকল বিজ্ঞানের মতো জিয়োগ্রাফিরও একটা বিশেষ পরিভাষা আছে। সে পরিভাষা মূলত ইংরেজি। এ বিষয়ে বাংলা ভাষায় যে পরিভাষা আছে, তা হয় সংস্কৃত নয় ইংরেজির অনুবাদ। সে-সব সংস্কৃত কথার অর্থ বুঝতে হলে তাদের আবার মনে মনে ইংরেজি ভাষায় উলটে অনুবাদ করে নিতে হয়। একটি উদাহরণ দিই। অন্তরীপ ও cape, এ দুটি কথাই বাঙালির কাছে সমান অপরিচিত। এ দুয়ের মধ্যে সম্ভবত কেপ শব্দটিই তোমরা স্কুলঘরে বেশি বার শুনেছ, অতএব তোমাদের কাছে বেশি পরিচিত। অপর পক্ষে উত্তমাশা অন্তরীপ বললে আমরা ভাবতে বসে যাই, জিনিসটা কি। আর ততক্ষণ চিন্তার দায় থেকে অব্যাহতি পাই নে, যতক্ষণ না কেউ বলে দেয় যে, ও হচ্ছে কেপ অব গুড হোপ-এর বাংলা নাম। আর শঙ্গ-অন্তরীপ (কেপ হর্ন) শুনলে তো আমরা অগাধ জলে পড়ি। আর সে জলে পড়লে আর উদ্ধার নেই, কারণ সে জল বরফ জল।

আমাদের পরিভাষার দশা যখন এরূপ মারাত্মক, তখন আমি যতদূর সম্ভব পরিভাষা পরিত্যাগ করে আমার কথা ভাষায় বলতে চেষ্টা করব। যেখানে অগত্যা পরিভাষা ব্যবহার করতে বাধ্য হব, সেখানে ইংরেজি শব্দই ব্যবহার করব। এ প্রস্তাব শুনে আমার হাতে বাংলা ভাষার জাত মারা যাবে ভেবে তোমরা ভীত হোয়ো না। ইংরেজি বিজ্ঞানের পরিভাষাও ইংরেজি নয়, গ্রীক। আর গ্রীক সভ্যতার বয়েস আড়াই হাজার বৎসর। সুতরাং তার পাশে অমাদের ভাষার আভিজাত্য একেবারে নষ্ট হবে না। ভারতবর্ষের সভ্যতার সঙ্গে গ্রীক, সভ্যতার আর-কোনো বিষয়ে মিল থাকুক, বয়েসে মিল আছে।

 

ভূমণ্ডল

প্রথমেই আমি তোমাদের কাছে পৃথিবী নামক গোলকটির কিঞ্চিৎ পরিচয় দেব। এ গোলকটি ক্ষিতি আর অপ-মাটি আর জল—এই দুই ভূতে গড়া! আর এ গোলকের বহিঃপষ্ঠের চার ভাগের তিন ভাগ হচ্ছে জল, আর এক ভাগ স্থল।

আমরা অবশ্য পৃথিবী বলতে প্রধানত মাটিই বুঝি। তার প্রমাণ আমরা একে ভূমণ্ডল বলি। এর কারণ আমরা ভূচর জীব, অর্থাৎ মাটির উপর বাস করি। জলচর জীবদের যদি শুধু জল-পিপাসা নয়, সেইসঙ্গে জ্ঞান-পিপাসা থাকত ও সেইসঙ্গে তাদের জ্ঞান তরল ভাষায় ব্যক্ত করবার ক্ষমতা থাকত, তা হলে তারা জিয়োগ্রাফি না রচনা করে রচনা করত হাইড্রোগ্রাফি। আর তারা কবিতা লিখত ‘আমার জন্মজলের’ উপর। আর আমরা যাকে বলি মধুর রস, তার নাম তারা দিত লবণ রস। এর থেকেই দেখতে পাচ্ছ যে, আমাদের কল্পনা আশা আকাঙক্ষা কতটা মাটিগত, অর্থাৎ আমরা মনে-প্রাণে কতটা জিয়োগ্রাফির অধীন।

 

পৃথিবীর ভাগ

এখন শোনো, মাটি কিন্তু একলন্ত ভাবে নেই, খণ্ড খণ্ড ভাবে আছে। প্রাচীন শাস্ত্রকাররা বলেন যে, মেদিনী সপ্তদ্বীপ আকারে ব্যক্ত হয়েছে।

এই দ্বীপ শব্দটার অর্থ তোমরা সবাই জান। যার চারি দিকে জল আর মাঝখানে থল, তাকেই আমরা বলি দ্বীপ। এ হিসাবে আজকের দিনে পৃথিবীতে সাতটি নয়, অসংখ্য দ্বীপ আছে। সমুদ্রের মধ্যে থেকে অসংখ্য ছোটোবড়ো দ্বীপ মাথা তুলে রয়েছে।

সুতরাং এ স্থলে সপ্তদ্বীপ অর্থে সাতটি মহাদ্বীপ বুঝতে হবে। এই মহাদ্বীপকে আমরা একালে মহাদেশ বলি। আজকের দিনে আমরা পৃথিবীকে চারটি মহাদেশে ভাগ করি, যথা : ইউরোপ এশিয়া আফ্রিকা ও আমেরিকা; অস্ট্রেলিয়াকে আমরা আজও মহাদ্বীপ বলেই জানি, মহাদেশ বলে মানি নে।

মহাদেশ বলতে যদি মহাদ্বীপ বোঝায়, তা হলে পৃথিবীতে চারটি নয় তিনটি মাত্র মহাদ্বীপ আছে : প্রথম ইউরেশিয়া, দ্বিতীয় আফ্রিকা, তৃতীয় আমেরিকা। শ্লোবের প্রতি একবার দৃষ্টিপাত করলেই দেখতে পাবে যে, গোটা ইউরোপ ও গোটা এশিয়ার ভিতর কোথাও জলের ব্যবধান নেই। এ দুই দেশের জমি একলপ্ত। আর এই আদি মহাদেশটি হচ্ছে একটি প্রকাণ্ড দ্বীপ। এর উত্তরে আকীটক সী, দক্ষিণে ইন্ডিয়ান ওশন, পশ্চিমে অ্যাটলান্টিক ও পূর্বে প্যাসিফিক ওশন; আর আফ্রিকার উত্তরে ও পশ্চিমে অ্যাটলান্টিক এবং দক্ষিণে ও পূর্বে ইন্ডিয়ান ওশন। আর আমেরিকার পশ্চিমে প্যাসিফিক, পূর্বে অ্যাটলান্টিক, উত্তরে উত্তর-আর্কটিক ও দক্ষিণে দক্ষিণ-আর্কটিক সাগর। ইউরেশিয়ার সঙ্গে অপর দুটি মহাদেশের গড়নেরও একটা স্পষ্ট প্রভেদ আছে। ইউরেশিয়ার বিস্তার পব হতে পশ্চিমে, অপর দুটির উত্তর হতে দক্ষিণে। অর্থাৎ ইউরেশিয়া লম্বার চাইতে চওড়ায় বেশি। আফ্রিকা ও আমেরিকা চওড়ার চাইতে লম্বায় বেশি। এই আকারভেদ এক দেশের সঙ্গে অপর দেশের অনেক প্রভেদ ঘটিয়েছে।

তোমরা সবাই জান যে ইউরেশিয়া ও আফ্রিকাকে আমরা প্রাচীন পৃথিবী বলি ও আমেরিকাকে নবীন। এর প্রধান কারণ প্রাচীন পৃথিবীর লোক পাঁচশো বৎসর পূর্বে আমেরিকার অস্তিত্বের কথা জানত না। অতএব, এ নাম শুধু লৌকিক, বৈজ্ঞানিক হিসেবে ঠিক নয়। তা ছাড়া, অনেক বিষয়ে এই নতুন পৃথিবী প্রাচীন পৃথিবীর ঠিক উলটো। বিলাতে (গ্রীনউইচ) যখন দিনপর, আমেরিকায় (নিউ অরলিনস) তখন রাতদুপুর। কেন এরকম হয়, সে কথা আর আজ বলব না; কারণ তা বোঝাতে হলে আমাকে মাটি থেকে আকাশে উঠতে হবে। এ ব্যাপারের ব্যাখ্যার ভিতর শুধু পৃথিবী নয়, সচন্দ্রকেও টেনে আনতে হবে। কেননা জিয়োগ্রাফি কতক হিসেবে অ্যাস,ট্রনমির অন্তর্ভূত। আর অ্যাসষ্ট্রনমি তোমরাও জান না, আমিও জানি নে।

 

উত্তরখণ্ড দক্ষিণখণ্ড

আর-একটি কথা শোনো। আমাদের শাস্ত্রকারদের মতে এই বিশ্ব আদিতে ছিল ব্ৰহ্মাণ্ড নামে একটি অণ্ড। পরে ভগবান সেই অণ্ডকে দ্বিখণ্ড করে তার ঊর্ধ্বখণ্ড দিয়ে স্বর্গ ও অধঃখণ্ড দিয়ে পৃথিবী রচনা করেন, আর এ দুয়ের মধ্যে আকাশ সৃষ্টি করেন। কিন্তু একালে আমরা পৃথিবীকে আধখানা ডিমের সঙ্গে তুলনা করি নে; আমরা বলি পৃথিবীর চেহারা ঠিক একটি কমলালেবুর মততা।

সেই কমলালেবুটিকে যদি ঠিক মাঝখানে কাট, তা হলে এই কাটা জায়গাটার নাম হবে ইকোয়েটর; তার উপরের আধখানার নাম হবে উত্তর হেমিসফিয়ার, আর নীচের অংশটির নাম হবে দক্ষিণ হেমিসফিয়ার। পৃথিবীর এই দুই খণ্ডের চরিত্র কোনো কোনো বিষয়ে ঠিক পরস্পরের বিপরীত। যথা উত্তরাখণ্ডে যখন গ্রীষ্মকাল, দক্ষিণাখণ্ডে তখন শীতকাল। তার পর এই দুই খণ্ডের গড়নেও ঢের প্রভেদ আছে। দক্ষিণাখণ্ডে যতখানি মাটি আছে, উত্তরাখণ্ডে প্রায় তার দ্বিগুণ আছে। এর থেকে অনুমান করতে পার যে, উত্তরাখণ্ডের জলবায়ুর সঙ্গে দক্ষিণাখণ্ডের জলবায়ুর বিশেষ প্রভেদ আছে। আর জলবায়ুর প্রভেদ থেকেই ভৌগোলিক হিসেবে এক দেশের সঙ্গে অপর দেশের প্রভেদ হয়। তোমরা সবাই জান যে, জল ও বায়, খির পদার্থ নয়-ও দুইই চঞ্চল, ও দুয়েরই স্রোত আছে। অপ ও মরতের স্রোতের মূল কারণ হচ্ছে সূর্যের তেজ; কিন্তু ক্ষিতি এই দুই স্রোতকে বাধা দিয়ে তাদের গতি ফিরিয়ে দিতে পারে। সুতরাং পৃথিবীর যে খণ্ডে বেশি পরিমাণ মাটি আছে, সে খণ্ডের জলবায়ুর গতি, যে খণ্ডে জল বেশি, সে দেশ হতে বিভিন্ন।

 

ইউরেশিয়া

এখন ইউরেশিয়ার বিশেষত্ব এই যে, এ মহাদেশটি সম্পূর্ণ পৃথিবীর উত্তরখণ্ডের অন্তর্ভূত। অপর পক্ষে আমেরিকা ও আফ্রিকার কতক অংশ উত্তরখণ্ডে ও কতক অংশ দক্ষিণখণ্ডে অবস্থিত। এর ফলে আমরা যাকে সভ্যতা বলি, সে বহু ত্যিপতেজমরদ,ব্যোমের কৃপায় ইউরেশিয়াতেই জন্মলাভ করেছে। আমেরিকা ও আফ্রিকা সভ্যতার জন্মভূমি নয়। ও দুই মহাদেশে যে সভ্যতার আমরা সাক্ষাৎ পাই, সে সভ্যতা ইউরেশিয়া হতে আমদানি। সমগ্র আমেরিকা ও আফ্রিকার উত্তরদক্ষিণ ভাগ তো ইউরোপের উপনিবেশ। আর পুরাকালে আফ্রিকার যে অংশে সভ্যতা প্রথম দেখা দেয়, সেই ইজিপ্ট উত্তরাখণ্ডের অন্তর্ভূত ও এশিয়ার সংলগ্ন। সুতরাং এ অনুমান করা অসংগত হবে না যে, সে সভ্যতার জন্মভূমি হচ্ছে এশিয়া, আর সেকালে ইজিপ্ট ছিল এশিয়ার একটি উপনিবেশ।

এর থেকে তোমরা বুঝতে পারবে যে, কোনো দেশের ইতিহাস বুঝতে হলে সে দেশের জিয়োগ্রাফিও আমাদের জানা চাই। এ যুগের মানুষ জিয়োগ্রাফির দশ অধীন না হলেও আদিতে যে বিশেষ অধীন ছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ভারতবর্ষের ইতিহাস জানতে আমরা সবাই উৎসুক। সে ইতিহাস ভারতবর্ষের জমির উপরেই গড়ে উঠেছে, সেইজন্যই সেই জমির সঙ্গে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে আমি উদ্যত হয়েছি। এখন এই-ক’টি কথা তোমরা মনে রেখো যে, এ পৃথিবী সৌরমণ্ডলের অন্তর্ভূত ও তার সঙ্গে নানারূপ যোগসূত্রে আবদ্ধ। তার পর এই পৃথিবীর উত্তরাখণ্ডে ইউরেশিয়া অবস্থিত। আর এই মহাদেশের যে অংশকে আমরা এশিয়া বলি, ভারতবর্ষ তারই একটি ভূভাগ। আর এই ভূভাগের রূপগুণ বর্ণনা করাই এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য। প্রথমে সৌরমণ্ডল থেকে পৃথিবীকে ছাড়িয়ে নিয়ে, তার পর পৃথিবী থেকে তার উত্তরাখণ্ডকে ছাড়িয়ে নিয়ে, তার পর তার উত্তরাখণ্ড থেকে ইউরেশিয়াকে ছাড়িয়ে নিয়ে, তার পর ইউরেশিয়া থেকে এশিয়াকে পৃথক করে নিয়ে, তার পর এশিয়া থেকে অপরাপর দেশকে বাদ দিলে তবে আমরা ভারতবর্ষ পাই। এ দেশ অপরাপর দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন না হলেও বিভিন্ন। সুতরাং একে একটি স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে ধরে নিয়ে তার বর্ণনা করা যায়। আমি পূর্বে বলেছি যে, বিদেশের সামান্য জ্ঞান না থাকলে স্বদেশেরও বিশেষ জ্ঞান লাভ করা যায় না। এ কথা সত্য। কিন্তু অপর পক্ষে এ কথাও সমান সত্য যে, স্বদেশের বিশেষ জ্ঞান না থাকলে বিদেশের সামান্য জ্ঞান লাভ করা কঠিন। ও ক্ষেত্রে আমরা নাম শিখি, কিন্তু দেশ চিনতে শিখি নে। এই কারণে আজকাল এক শ্রেণীর বৈজ্ঞানিক বলেন যে, প্রথমে বাড়ির জিয়োগ্রাফি শিখে, তার পর দেশের জিয়োগ্রাফি শেখাই কর্তব্য। কারণ ছোটোর জ্ঞান থেকেই মানুষকে বড়োর জ্ঞানে অগ্রসর হতে হয়, ঘর থেকেই বাইরে যেতে হয়। আমি যে এ প্রবন্ধে তার উলটো পদ্ধতি অবলম্বন করেছি, বড়ো থেকে ছোটোতে, বাইরে থেকে ঘরে আসছি, তার প্রথম কারণ আমি বৈজ্ঞানিক নই-সাহিত্যিক; আর তার দ্বিতীয় কারণ, আমি তোমাদের মনে এই সত্যটি বসিয়ে দিতে চাই যে, ভারতবর্ষ একটা সৃষ্টিছাড়া দেশ নয়।

 

এশিয়া

এশিয়া ব’লে ইউরোপ থেকে কোনো পথক, মহাদেশ নেই, এ কথা তোমাদের পূর্বেই বলেছি। কিন্তু বহুকাল থেকে মানুষ এই এক মহাদেশকে দুই মহাদেশ বলে আসছে। ভৌগোলিক হিসাবে না হোক, লৌকিক মতে এশিয়া একটি স্বতন্ত্র মহাদেশ বলে যখন গ্রাহ্য, তখন এ ভূভাগকে একটি পথক, মহাদেশ বলে মেনে নেওয়া যাক।

ভারতবর্ষ এই মহাদেশের অন্তর্ভূত, অতএব এশিয়ার চেহারাটা একনজর দেখে নেওয়া যাক।

এ যুগের জাপানের একজন বড়ো কলাবিদ ও সাহিত্যিক কাকুজো ওকাকুরা, তার The Ideals of the East নামক গ্রশের আদিতেই বলেছেন যে, Asia is one। এ কথাটা Eastএর ideal হতে পারে, কিন্তু বস্তুগত্যা সত্য নয়।

ভৌগোলিক হিসেবে এশিয়া চারটি উপমহাদেশে (সাব-কন্টিনেন্ট) বিভক্ত। কি হিসেবে এশিয়াকে চার ভাগে বিভক্ত করা হয়, তা এখন শোনো।

মনুভাষ্যকার মেধাতিথি বলেছেন যে–

জগৎ সরিৎ সমুদ্ৰা শৈলাদ্যাত্মকম্‌

অর্থাৎ এ জগৎ নদী সমুদ্র ও পাহাড় দিয়ে গড়া। জগৎ সম্বন্ধে এ কথাটা যে কতদূর সত্য, তা বলতে পারি নে—তবে একেবারে যে বাজে নয়, তার প্রমাণ চন্দ্র উপগ্রহে পাহাড় আছে, মার্স গ্রহে নদী আছে এবং সম্ভবত অপর কোনো গ্রহে সমুদ্রও থাকতে পারে। সে যাই হোক, পৃথিবী সম্বন্ধে মেধাতিথির উক্তি যে সম্প সত্য সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

আর, এই তিন বস্তুই পৃথিবীকে নানাদেশে বিভক্ত করে রেখেছে।

সমুদ্রের ব্যবধানেই যে মহাদেশ হয়, তার কারণ সমুদ্র আগে ছিল অলঘ্য আর এখন হয়েছে দুর্লঙ্ঘ্য। শৈলমালা সমুদ্রের চাইতে কিছু, কম অঘ্য বা দল নয়। সুতরাং পর্বতের ব্যবধানও এক ভূভাগকে অপর ভূভাগ থেকে পৃথক করে রাখে।

কালিদাস বলেছেন যে–

অস্ত্যুত্তরস্যাং দিশি দেবতাত্মা হিমালয়ো নাম নগাধিরাজঃ।
পূর্বাপরৌ তোয়নিধী বগাহ্য স্থিতঃ পৃথিব্যা ইব মানদণ্ড।

ভারতবর্ষের উত্তরে স্থিত যে পর্বতশ্রেণীর স্বদেশী অংশকে আমরা হিমালয় বলি, তা অবশ্য এশিয়ার পূর্ব ও পশ্চিম সমুদ্রে অবগাহন করছে না। কিন্তু হিমালয় বলতে আমরা যদি সেই শৈলমালা বুঝি, যে পর্বতশ্রেণী সমগ্র এশিয়ার মেরুদণ্ড, আর যাকে এ যুগের ভৌগোলিকরা সেন্ট্রাল মাউনটেনস আখ্যা দিয়েছেনহলে আমরা কালিদাসের উক্তি সত্য বলে স্বীকার করতে বাধ্য। এ নগাধিরাজ সত্য সত্যই এশিয়ার পূর্ব ও পশ্চিম তোয়নিধিতে অবগাহন করে অবস্থিতি কমছে। পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর ও পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত এ পর্বতশ্রেণী বিস্তৃত। আর পৃথিবী বলতে যদি আমরা শুধু প্রাচীন পৃথিবী বুঝি, তা হলে তো কালিদাসের উক্তি অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়। কারণ এশিয়ার এই সেন্ট্রাল মাউন, টেনস হচ্ছে প্রাচীন পৃথিবীর মিড-ওঅলড মাউনটেনএরই অংশ। তার পর এ সমগ্র পর্বতশ্রেণীকে হিমালয় বলা যেতে পারে; কেননা এ পর্বতের অধিকাংশই চিরহিমের আলয়।

এই হিমালয়, ভাষান্তরে সেন্ট্রাল মাউনটেনসএর মতো বিরাট প্রাচীর পৃথিবীর আর কোনো মহাদেশকে দু ভাগে বিভক্ত করে নি। এ প্রাচীরের উত্তরদেশকে এশিয়ার উত্তরাপথ এবং দক্ষিণদেশকে দক্ষিণাপথ বলা যেতে পারে। এই প্রাচীর যে কত উঁচু তা তো তোমরা সবাই জান। এই ভারতবর্ষের উত্তরেই এর পাঁচটি শৃঙ্গ আছে, যার প্রতিটির উচ্চতা হচ্ছে পঁচিশ হাজার ফুটের চাইতেও বেশি। কাশ্মীরে নাংঘা পর্বত উঁচুতে ২৬,৬২১ ফুট, তিব্বতে নন্দাদেবী ২৫,৬৪৫, নেপালে ধবলগিরি ২৬,৭৯৯ ফুট, এভারেস্ট ২৯,০০২, কিনচিনজঙ্গা ২৮,১৪৬। এখন এ পর্বত প্রস্থে কত বড়ো তা শোনো।–

ভারতবর্ষের পশ্চিমে যে দেশ আছে, সে দেশকে আমরা ইরান বলি; আর উত্তরপশ্চিমে যে দেশ আছে, তাকে তুরান বলি। ইরান ও তুরানে এই পর্বত কোথাও চারশো মাইল, কোথাও আটশো মাইল চওড়া। এ মহাপর্বতের অনেক শাখাপ্রশাখা আছে। তাদের মিলনভূমি হচ্ছে পামির অধিত্যকা। এ অধিত্যকাও প্রায় চৌদ্দ হাজার ফুট উঁচু। এই পামিরের উত্তরে এ পর্বতের প্রস্থ হচ্ছে বারোশশা মাইল, এবং এর সঙ্গে এ পর্বতের নিদাংশ অর্থাৎ উপত্যকাগুলি যদি যোগ দেওয়া যায়, তা হলে এ ব্যবধানের প্রস্থ হয় দু হাজার মাইল—অর্থাৎ হিমালয় হতে কন্যাকুমারিকা যতদূর ততদূর। এর থেকে দেখতে পাচ্ছ যে, এশিয়ার উত্তরাপথ ও দক্ষিণাপথকে এক দেশ বলা কতদূর সংগত।।

এই কারণে এশিয়ার উত্তরাখণ্ডকে একটি উপমহাদেশ বলা হয় আর তার দক্ষিণাপথের পশ্চিম ভাগকে দ্বিতীয়, পূর্ব ভাগকে তৃতীয়, তার মধ্য ভাগকে চতুর্থ উপমহাদেশ বলা যায়।

এই মধ্যদেশই ভারতবর্ষ। ভূমধ্য পর্বত থেকে এই চারটি উপমহাদেশ ঢাল হয়ে সমুদ্রের দিকে নেমে এসেছে। ফলে উত্তর ভাগের সকল নদী উত্তরবাহিনী, ও তারা সব গিয়ে পড়ে আর্কটিক সমুদ্রে; পশ্চিম ভাগের জল গড়িয়ে পড়ে ভূমধ্যসাগরে, পর্ব ভাগের জল প্রশান্ত-মহাসাগরে ও মধ্যদেশের জল ভারত-মহাসাগরে। মধ্য এশিয়া পর্বতময়। আর এ পর্বত অর্ধেক এশিয়া জুড়ে বসে আছে। আর তার চার পাশের চার ভাগের প্রকৃতি ও চরিত্র সম্পূর্ণ বিভিন্ন। উত্তরদেশ অর্থাৎ সাইবিরিয়া সমতল ভূমি কিন্তু জলবায়ুর গুণে মানুষের বাসের পক্ষে অনুকল নয়। পশ্চিম একে পাহাড়ে, উপরন্তু নির্জলা দেশ। সে দেশের জমিতে ফসল একরকম হয় না বললেই চলে। ইরান-তুরানের অধিকাংশ লোক গৃহস্থ নয়, তারা অন্নের সন্ধানে তাঁবু ঘাড়ে করে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ায়। বাকি দুটি ভূভাগ, ভারতবর্ষ ও চীনদেশ, মানুষের বাসের পক্ষে সম্পূর্ণ উপযোগী। এ দুটি দেশ মুখ্যত সমতল ভূমি, আর সে ভূমি কর্ষণ করে অন্নবস্ত্র দুই লাভ করা যায়; অতএব এ দুই দেশের লোকই গহস্থ হয়েছে। আর শাস্ত্রে বলে, মানুষের সকল আশ্রম গার্হস্থ্যআশ্রমেরই বিকল্প মাত্র।

এশিয়াকে ত্যাগ করবার পূর্বে সে মহাদেশ সম্বন্ধে আর-একটি কথা বলছি, যা শুনে তোমরা একটু চমকে যাবে। এ মহাদেশের ম্যাপে একটি দেশ ভুলক্রমে ঢুকে পড়েছে, যেটি ভৌগোলিক হিসেবে এশিয়ার নয়, আফ্রিকার অঙ্গ। সে দেশের নাম আরবদেশ। এই আরবদেশ প্রকৃতপক্ষে আফ্রিকার সাহারা মরুভূমিরই একটি অংশ। তোমরা বোধ হয় জান যে, মরুভূমির একটি ধর্ম হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশকে আক্রমণ করা। হাওয়ায় তার তপ্ত বালি উড়ে এসে পার্শ্ববর্তী দেশকে চাপা দেয়। তার স্পর্শে গাছপালা-তৃণপুষ্প সবই মারা যায়। মরুভূমির শুধু বালুকা নয়, তার বায়ুও সমান মারাত্মক। যে দেশের উপর দিয়ে সে বাতাস বয়ে যায়, সে দেশের রস-কষ একেবারে শুকিয়ে যায়। সাহারার এই নিজস্ব বাতাসের নাম ট্রেড উইন্‌ড্‌স। এবার গ্লোবের দিকে তাকিয়ে দেখলেই দেখতে পাবে যে, এই ট্রেড উইন্‌ড্‌স চলার পথটি হচ্ছে আগাগোড়া পোড়ামাটি।

সাহারা মরুভূমি আরবদেশের ভিতর দিয়ে এসে প্রথমে পারস্যের দক্ষিণ ভাগকে, তার পর আরো এগিয়ে ভারতবর্ষের সিন্ধুদেশকে আক্রমণ করে। ফলে, আরব থেকে সিন্ধুদেশ পর্যন্ত সমস্ত ভূভাগকে মরুভূমিতে পরিণত করেছে। এ আক্রমণে বাধা দিয়েছে রাজপুতানা। রাজপুতানার চিরগৌরব এই যে, এই রাজপুতানাই হিন্দুস্থানকে এই ক্রমবর্ধমান আফ্রিকার মরুভূমির কবল থেকে রক্ষা করেছে।

এই আরবদেশ যে ভুলক্রমে এশিয়ার ম্যাপে ঢুকে গেছে, তার কারণ কেবলমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী মানচিত্রকাররা লোহিত-সমুদ্রকে আফ্রিকা ও এশিয়ার মধ্যে পরিখা বলে ধরে নিয়েছিলেন। একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যায়, এ সমুদ্রও আসলে মরুভূমি। এর উপরে যেটুকু জল আছে, তা ভারত-মহাসাগরের দান।

ভারতবর্ষকে যদি এশিয়াখণ্ডের একটি উপমহাদেশ না বলে একটি স্বতন্ত্র মহাদেশ বলা যায়, তা হলেও কথাটা অসংগত হয় না।

ভারতবর্ষ মাপে ১৫,০০,০০০ বর্গমাইল। এক চীন ব্যতীত এত বড়ো দেশ এশিয়ায় আর কোথাও নেই। এশিয়ার রুশিয়া ম্যাপে দেখতে প্রকাণ্ড দেশ; কিন্তু এর দক্ষিণাংশে এত বড়ো বড়ো হ্রদ মরুভূমি তৃণকান্তার ও পর্বত আছে যে, সে অংশটিকে একটি দেশ বলা যায় না। কারণ সে ভূভাগ মানুষের বাসের অযোগ্য। আর এর উত্তরাংশের জমি সমতল হলেও আজও জমাট মাটি হয়ে ওঠে নি। এ দেশে গাছপালা অতি বিরল, যে দুটি-চারটি আছে তারা সব বামন। এরকম দেশ যে কৃষিকার্যের জন্য অনুপযোগী, সে কথা বলাই বাহুল্য। ফলে সাইবিরিয়া একরকম জনশূন্য বললেই হয়।

ভারতবর্ষ যে আকারে বিপুল, শুধু তাই নয়। এ দেশ এশিয়ার অপরাপর দেশ থেকে একরকম সম্পূর্ণ বিভিন্ন বললেও অত্যুক্তি হয় না।

এর উত্তরে হিমালয়ের গগনস্পর্শী প্রাচীর; আর তিন দিকে ভারত-মহাসাগরের অতলস্পর্শী পরিখা। তোমরা ভেব না যে আমি ভুল করছি। আরব-সাগর বঙ্গউপসাগর প্রতি নাম আমিও জানি; কিন্তু ও-সব সাগর-উপসাগর ভারত-মহাসাগরেরই অংশ মাত্র। ভারতবর্ষ তার উত্তরপশ্চিম ও উত্তরপূর্বে কোণে শুধু অপর দেশের সঙ্গে সংলগ্ন। তার উত্তরপশ্চিমে আফগানিস্থান, এবং উত্তরপূর্বে ব্রহ্মদেশ। কিন্তু এ দুই দিকেই আবার অতি দুর্গম পর্বতের ব্যবধান আছে। যে পর্বতশ্রেণী আফগানিস্থান ও বেলুচিস্তানকে হিন্দুখান থেকে পথক করে রেখেছে, সে পর্বতশ্রেণীর অবশ্য দুটি দয়োর আছে—খাইবার পাস ও বোলান পাস-যার ভিতর দিয়ে এ দুই দেশে মানুষে যাতায়াত করতে পারে। কিন্তু ব্রহ্মদেশে যাবার পথ আজও বঙ্গোপসাগরের জলপথ।

দেখতে পাচ্ছ স্বয়ং প্রকৃতিই ভারতবর্ষকে একটি স্বতন্ত্র মহাদেশ করে গড়েছেন।

এখন দেখা যাক, এই সমগ্র দেশটার আকার কিরকম। আমাদের পূর্বপুরুষেরা সমগ্র পৃথিবীকে ত্রিকোণ বলতেন। সম্ভবত পৃথিবী বলতে তাঁরা ভারতবর্ষ বুঝতেন। কেননা ভারতবর্ষ সত্যসত্যই ত্রিকোণ।

মানুষে যতক্ষণ জ্যামিতির কোনো মূর্তির সঙ্গে কোনো দেশকে মেলাতে না পারে, ততক্ষণ তার মনস্তুষ্টি হয় না; যদিও জ্যামিতির কোনো আকারের সঙ্গে কোনো দেশই হবহ, মিলে যায় না। পৃথিবীকে আমরা বলি গোলাকার। কথাটা মোটামুটি সত্য। কিন্তু জ্যামিতির বৃত্তের উত্তরদক্ষিণ চাপা নয়। ইউক্লিডের তৃতীয় অধ্যায়ে কমলালেবুর কোনো স্থান নেই। এই কথাটা মনে রাখলে, মহাভারতে ভারতবর্ষকে যে একটি সমভুজ ত্রিকোণ দেশ বলা হয়েছে, সে উক্তিকে গ্রাহ্য করে নিতে আমাদের কোনো আপত্তি হওয়া উচিত নয়।

পৃথিবীতে এমন কোনোই দেশ নেই, যা সম্পূর্ণ একাকার। ভারতবর্ষও একাকার নয়। অর্থাৎ ভারতবর্ষকেও নানা খণ্ডে বিভক্ত করা যায়। এখানে একটি কথা বলে রাখি। রাজ্যের ভাগের সঙ্গে ভৌগোলিক ভাগের বিশেষ কোনো সম্বন্ধ নেই। অর্ধেক পৃথিবী আজ ব্রিটিশরাজের অধীন; কিন্তু তাই বলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ক্যানেডা অস্ট্রেলিয়া ও ভারতবর্ষকে পাগল ছাড়া আর-কেউ এক দেশ বলবে না। আমি যে ভাগের কথা বলছি, সে ভৌগোলিক ভাগ।

আমাদের শাস্ত্রে ভারতবর্ষকে নানা ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। পুরাণকারদের মতে ভারতবর্ষ নবখণ্ড। বরাহমিহির প্রতি গণিতশাস্ত্রীরা পৌরাণিকদের সঙ্গে একমত, যদিচ এ দুয়ের বর্ণিত নবখণ্ডের মিল নেই। মহাভারতের মতে এ দেশ চার খণ্ডে বিভক্ত। চারিটি equilateral triangleএর সমষ্টি হচ্ছে ভারতবর্ষ নামক বড়ো cquilateral triangle। জ্যামিতির হিসেব থেকে যদিও এ বর্ণনা সত্যের কাছ ঘেঁষে যায়, কিন্তু ভৌগোলিক হিসেব থেকে অনেক দূরে থাকে। সে যাই হোক, সংস্কৃত সাহিত্যে আর-একরকম ভাগের উল্লেখ আছে। ভারতবর্ষ মোটামুটি দু ভাগে বিভক্ত। একটি ভাগের নাম উত্তরাপথ, অপরটির দক্ষিণাপথ। এই লৌকিক ভাগটিই প্রকৃতপক্ষে বৈজ্ঞানিক। উত্তরাপথ ভৌগোলিক হিসেবে দক্ষিণাপথ থেকে বিচ্ছিন্ন ও বিভিন্ন।

হিমালয় যেমন সমস্ত এশিয়ার মেরুদণ্ড, বিন্ধ্যপর্বত তেমনি ভারতবর্ষের মেরুদণ্ড। এ খলে আমি সাতপরা ও আরাবলি পর্বতকে বিধ্য নামে অভিহিত করছি। উত্তরে হিমালয় ও দক্ষিণে বিন্ধ্যপর্বতের মধ্যের দেশকে উত্তরাপথ বলা যায়, আর দক্ষিণে বিন্ধ্যপর্বত থেকে ভারত-মহাসাগরের মধ্যবর্তী দেশকে দক্ষিণাপথ বলা যায়। কিন্তু তোমরা ম্যাপের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেই দেখতে পাবে, আরাবলি পর্বতের পশ্চিমে ও রাজমহলের পূর্বেও অনেকখানি জমি পড়ে রয়েছে। এই পশ্চিম অংশের নাম পাঞ্জাব ও সিন্ধুদেশ, আর পর্ব অংশের নাম বঙ্গদেশ ও আসাম। এ দুটিকেও উত্তরাপথের অন্তর্ভূত করে নিতে হবে।

 

উত্তরাপথ

প্রথম জিনিস যা চোখে পড়ে সে হচ্ছে এই যে, এই বিস্তৃত ভূভাগের ভিতর কোনোরূপ পাহাড়পবত নেই, সমস্ত উত্তরাপথ সমতলভূমি। এর ভিতর এক জায়গায় শুধু একটু অপেক্ষাকৃত উঁচু জমি আছে। পাঞ্জাব ও হিন্দুস্থানের মিলনস্থল হচ্ছে সেই উচ্চভাগ। উত্তরাপথের এই জায়গাটার গড়ন কাছিমের পিঠের মতো। ফলে এ স্থানের পশ্চিমের যত নদী সব পশ্চিমবাহিনী ও পূর্বের যত নদী সব পূর্ববাহিনী।

এই পশ্চিম ভাগের নদী পাঁচটির নাম ঝিলম চেনাব রাবি বিয়াস ও সৎলেজ। এ পাঁচটিরও জন্মভূমি হচ্ছে হিমালয়, আর এ পাঁচটিই পথিমধ্যে এ-ওর সঙ্গে মিলিত হয়ে শেষটা ভারতবর্ষের সবচাইতে পশ্চিমের নদী সিন্ধুনদের সঙ্গে মিশে সমুদ্রে গিয়ে পড়েছে। তোমরা বোধ হয় জান যে, পাহাড় থেকে নদী যে মাটি কেটে নিয়ে আসে, সেই মাটি দিয়েই সমতলভূমি তৈরি হয়। এই পঞ্চনদের কৃপায় পঞ্চনদ-দেশ ওরফে পাঞ্জাব তৈরি হয়েছে। আর এই দেশটাকে ইণ্ডাস ভ্যালি বলা হয়। কারণ সিন্ধুই হচ্ছে এই পঞ্চনদের ভিতর মহানদ।

উত্তরাপথের পূর্ব ভাগের প্রধান নদীগুলির নাম যমুনা গঙ্গা গোমতী গোগরা গণ্ডক ও কুশি। এ-সকল নদীরই উৎপত্তি হিমালয়ে, আর এদের মধ্যে সর্বপ্রধান হচ্ছে গঙ্গা। অপর পাঁচটি একে একে গঙ্গায় মিশে গিয়েছে। সিন্ধুনদের সঙ্গে গঙ্গার একটি বিশেষ প্রভেদ আছে। সিন্ধুনদ তার আগাগোড়া জল হিমালয়ের কাছ থেকে পায়। গঙ্গা কিন্তু কিছু জল বিন্ধ্যপর্বতের কাছ থেকেও পায়। চম্বাল ও শোণ এই দুই নদীরই জন্মভূমি হচ্ছে বিন্ধ্যপর্বত। আর এই দুই নদীই উত্তরবাহিনী হয়ে এসে গঙ্গায় পড়েছে। সংস্কৃত ভাষায় জলের আর-এক নাম জীবন। গঙ্গাই হচ্ছে উত্তরাপথের জীবন। ও দেশের বুকের ভিতর দিয়ে গগা যদি রক্তের মতো বয়ে না যেত, তা হলে উত্তরাপথের প্রাণবিয়োগ হত। এই গাঙ্গেয় দেশই হচ্ছে প্রকৃত হিন্দুস্থান।

আরাবলি পর্বতের পশ্চিমে ও দক্ষিণে হচ্ছে মরভূমি। সিন্ধুনদ দক্ষিণাংশে এই মরভূমির ভিতর দিয়ে বয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়েছে। এই সিন্ধুনদীর দু পাশের দেশের নাম সিন্ধুদেশ।

বিন্ধ্যপর্বতের একরকম গা ঘেঁষে পূর্বে অনেক দূর এসে গগা রাজমহলের কাছে পর্বতের বাধা হতে অব্যাহতি লাভ করে দক্ষিণবাহিনী হয়ে সমুদ্রের অভিমুখে যাত্রা করেছেন। তার পর দক্ষিণে অনেক দূর এসে গোয়ালন্দের নিকট ব্ৰহ্মপুত্রের সহিত মিলিত হয়েছেন। এই ব্রহ্মপুত্রেরও জন্মস্থান হিমালয়। ব্রহ্মপুত্র লখনউয়ের উত্তরে হিমালয় থেকে বেরিয়ে পূর্বমুখে বহুদূর পর্যন্ত হিমালয়ের ভিতর দিয়েই প্রবাহিত হয়ে ভুটানের পূর্বে এসে দক্ষিণবাহিনী হয়ে গঙ্গার সঙ্গে মিশে গেছেন। তার পর এই মিলিত গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র আরো দক্ষিণে এসে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়ে সমুদ্রে এসে পড়লেন। মেঘনার জন্মভূমি হচ্ছে গারো-লসাই পর্বত। এই তিন নদীতে মিলে বাংলাদেশ গড়েছে।

উত্তরাপথের পশ্চিমদেশ সিন্ধুদেশ যেমন শুখনো, তার পূর্বদেশ বাংলা তেমনি ভিজে। সিন্ধুদেশের সক্কর নামক স্থানের মতো গরম জায়গা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নেই। তার পাশে রোড়ী নামক স্থানে গত বারো বৎসরে মোটে ছ পশলা বৃষ্টি হয়েছে। অপর পক্ষে বাংলার মতো ভিজে দেশও ভারতবর্ষে আর দ্বিতীয় নেই।

 

দক্ষিণাপথ

এখন দক্ষিণাপথে যাওয়া যাক।

এ ভূভাগ সম্বন্ধে প্রথম বক্তব্য হচ্ছে এই যে, এটি উত্তরাপথ থেকে একরকম বিচ্ছিন্ন।

অগস্ত্যমুনি বিন্ধ্যপর্বতের মাথা নিচু করে দিয়েছিলেন, কিন্তু সে মাথাকে ভূলণ্ঠিত করতে পারেন নি। ফলে এই দুই ভাগের ভিতর যাতায়াতের সুগম পথ নেই। উত্তরাপথ থেকে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে এমন কোনো নদী নেই, সুতরাং এ দুই দেশের ভিতর জলপথ নেই। গঙ্গানদী বিন্ধ্যপর্বতকে প্রদক্ষিণ করে ও সিন্ধুনদ সে পর্বতকে বাঁয়ে ফেলে রেখে তার পর সমুদ্রে এসে পড়েছে।

তার পর এ দুয়ের ভিতর কোনো স্থলপথও নেই। এক রেলের গাড়ি ছাড়া আর কোনোরকম গাড়ি-গোরুর ঘোড়ার কি উটের-বিন্ধ্যপর্বতের এক পাশ থেকে অপর পাশে যেতে পারে না।

মানুষে পায়ে হেঁটে যখন হিমালয় পার হয়ে যায়, তখন বিন্ধ্যপর্বত অবশ্য তার চলাচলের পথ বন্ধ করতে পারে নি। মানুষের অগম্য স্থান ভূ-ভারতে নেই, কিন্তু দুর্গম স্থান আছে। এই বিন্ধ্য অতিক্রম করবার পথ সেকালে অত্যন্ত দুর্গম ছিল। রামচন্দ্র পায়ে হেঁটে বিন্ধ্যপর্বত পার হয়ে দক্ষিণাপথে গিয়েছিলেন, কিন্তু ফিরতি বেলায় তিনি বিমানে চড়ে লঙ্কা থেকে অযোধ্যায় প্রত্যাগমন করাই বেশি আরামজনক অতএব সুযুক্তির কাজ মনে করেছিলেন।

সেকালে বিন্ধ্যপর্বত প্রদক্ষিণ করে আসবারও বিশেষ অসুবিধা ছিল। আরাবলি পর্বতের পশ্চিম দিয়ে আসতে হলে মরুভূমি অতিক্রম করে আসতে হত। অপর পক্ষে রাজমহলের পূর্ব দিয়ে বাংলায় এসে সমুদ্রের ধার দিয়ে মাদ্রাজ পৌঁছতে অনেক দিন নয়, অনেক বছর লাগত। এক, রাজা ও সন্ন্যাসী ছাড়া ওরকম দেশভ্রমণ বোধ হয় সেকালে অপর কেউ করত না। সমগ্র ভারতবর্ষকে এ ভাবে প্রদক্ষিণ করতেন রাজা দিগ্‌ বিজয়ে বহির্গত হয়ে, আর সন্ন্যাসী তীর্থভ্রমণে।

এই বিন্ধ্যপর্বতের ভিতর একটি ফাঁক আছে–খাণ্ডেয়া নামক স্থানে। এলাহাবাদ থেকে বম্বে যাবার রেলপথ এই খাণ্ডোয়ার ফাঁক দিয়েই যায়। এবং সেকালে এই দুয়োর দিয়েই বোধ হয় উত্তরাপথের লোক দক্ষিণাপথে প্রবেশ করত। ভারতবর্ষের মধ্যে দক্ষিণাপথ হচ্ছে একটি বড়ো কৌটোর মধ্যে আর-একটি ছোটো কৌটো।

দক্ষিণাপথ উত্তরাপথ থেকে শুধু বিচ্ছিন্ন নয়, বিভিন্ন আকৃতিতেও, প্রকৃতিতেও।

উত্তরাপথকে একটি চতুর্ভুজ হিসেবে ধরা যায়, কিন্তু দক্ষিণাপথ হচ্ছে একটি স্পষ্ট ত্রিভুজ। একটি উলটো পিরামিড, যার base হচ্ছে বিধ্য, আর apex কুমারিকা অন্তরীপ। এর উভয় পাশই পাহাড় দিয়ে বাঁধানো। পশ্চিম দিকের পর্বতের নাম পশ্চিমঘাট, পর্ব দিকের পর্বঘাট। এই দুই পর্বত এসে মিলিত হয়েছে, কুমারিকা অন্তরীপের একটু উত্তরে। এর দক্ষিণে যে জায়গাটুকু আছে, তার পূর্বে আর পাহাড় নেই, কিন্তু পশ্চিমে আছে কারডামম হিলস।

উত্তরাপথ হচ্ছে সমতলভূমি কিন্তু দক্ষিণাপথ মালভূমি। অর্থাৎ ইরান দেশের মতো এ দেশও হচ্ছে পর্বতের উপত্যকা; শুধু ইরানের উপত্যকা হচ্ছে প্রায় তিন হাজার ফুট উঁচু, ও দক্ষিণাপথের হাজার ফিট। সুতরাং এ পিরামিডকে পাথরেগড়া বলা যেতে পারে। এ ভূভাগে সমতলভূমি আছে শুধু পশ্চিমঘাটের পশ্চিমে ও সমুদ্রের উপকূলে, যে দেশকে আমরা মালাবার দেশ বলি; ও পর্বসমুদ্রের উপকূলে, যে দেশকে আমরা করমণ্ডল বলি। দক্ষিণাপথের অন্তরেও কিছু কিছু সমতলভূমি আছে, তার পরিচয় পরে দেব।

এই মালাবার দেশটি অতি সংকীর্ণ, করমণ্ডল অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত। যদি একটি বিমানে চড়ে দূর থেকে দেখা যায় তো দেখা যাবে যে, দক্ষিণাপথের পশ্চিম পাড় বেজায় মাথা উঁচু করে রয়েছে, পশ্চিমঘাট যেন সমুদ্র থেকে ঝাঁপিয়ে উঠেছে আর করমণ্ডল একেবারে সমুদ্রের সঙ্গে বেমালুম মিশে গেছে। এ অংশের তালীবন যেন সমুদ্র থেকেই উদভূত হয়েছে। কালিদাস যে বলেছেন–

দূরাদয়শ্চক্রনিভস্য তন্বী তমালতালীবনরাজিনীলা।
আভাতি বেলা লবণাম্বুরাশেঃ ধারানিবন্ধেব কলঙ্করেখা ৷৷

সে বেলা হচ্ছে করমণ্ডল কোস্‌ট্‌।

দক্ষিণাপথের উত্তরে দুটি অপর নদী আছে, নর্মদা ও তাপ্তি। নর্মদা বিন্ধ্যপর্বতের উপত্যকার ভিতর দিয়ে, ও তাপ্তি সাতপরা-পর্বতের দক্ষিণ পাদদেশ ঘেঁষে পশ্চিমবাহিনী হয়ে গালফ অব ক্যাম্বেতে পড়ছে।

এ দুই নদী মানুষের বিশেষ কোনো কাজে লাগে না। এ নদী দুটি মানুষের যাতায়াতের জলপথ নয়। তার পর এদের পলিতে কোনো সমতল দেশ গড়ে ওঠে নি। এরা দুটিতে মিলে সাগরসংগমের মুখে খালি একটুখানি মাটি তৈরি করেছে।

এ দেশের দক্ষিণের নদী-ক’টি সবই পূর্ববাহিনী। প্রথম গোদাবরী, দ্বিতীয় কৃষ্ণা, তৃতীয় কাবেরী। এই তিনটি নদীরই জন্মভূমি হচ্ছে পশ্চিমঘাট, আর এ তিনটিই এসে পড়ছে বঙ্গ-উপসাগরে।

এই তিনটি নদীর উভয় কূলে অল্পস্বল্প সমভূমি আছে, যেখানে ফসল জন্মায়। এই তিনটি নদীর হাতে করমণ্ডল দেশ গড়ে উঠেছে। দক্ষিণাপথের ভিতর থেকে মালাবার ও কোন যাবার কোনো পথ থাকত না, যদি না পশ্চিমঘাটের ভিতর তিনটি ফাঁক থাকত—উত্তরে থালঘাট ও বোরঘাট, দক্ষিণে পালঘাট। এইখানেই কোইম্বাটোর নামক শহর। এই কোইম্বাটোরের দুয়োরই দক্ষিণাপথের অন্তরের সঙ্গে তার পশ্চিম উপকূলের যোগরক্ষা করেছে। দক্ষিণাপথ ও বাংলার ভিতর আর দুটি দেশ আছে—উত্তরে সেন্ট্রাল প্রভিনসেস ও দক্ষিণে উড়িষ্যা।

সেন্ট্রাল প্রভিনসেস পাহাড় ও জঙ্গলে ভরা। উড়িষ্যার অনেকটাই সমভূমি। মহানদী এই সমভূমি গড়েছে। এ দুটি দেশ সম্ভবত কখনোই দক্ষিণাভুক্ত হয় নি বলে একে উত্তরাপথের ভিতর টেনে আনা যায়। আজকাল আমরা যাকে বথে প্রেসিডেন্সি ও ম্যাড্রাস প্রেসিডেন্সি বলি, সে দুই এই দক্ষিণাপথেরই অন্তর্ভূত। শাধ, সিদেশটি ববের গভর্নরের অধীন হলেও দক্ষিণাপথের অন্তর্ভূত নয়।

ভারতবর্ষের উত্তরে হিমালয়ের উপরে চারিটি দেশ আছে, যেগলি ভারতবর্ষের অন্তর্ভূত। পশ্চিমে কাশ্মীর, তার পূর্বে নেপাল, তার পূর্বে সিকিম ও পূর্বপ্রান্তে ভুটান।

কাশ্মীরের লোকের ভাষা সংস্কৃতের অপভ্রংশ, নেপালের গুর্খাদেরও তাই; অপর পক্ষে সিকিম-ভুটানের ভাষা চীনবংশীয়। এই নেপালেই পশ্চিম ও দক্ষিণ থেকে আগত আর্যজাতি এবং পূর্ব ও উত্তর থেকে আগত চীনজাতি মিলেমিশে একজাতি হয়ে গিয়েছে। এ দেশে শুধু দুই জাতির নয়, দুই সভ্যতারও মিলন ঘটেছে। তাই নেপালে বৌদ্ধধর্ম ও হিন্দুধর্ম পাশাপাশি বাস করছে। কাশ্মীরে অবশ্য হিন্দুধর্ম ও মুসলমানধর্ম পাশাপাশি বাস করছে, কিন্তু এই দুই ধর্ম পরস্পরের অশ্য। ফলে উভয় ধর্মই নিজের স্বাতন্ত্র্য সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে। অপর পক্ষে নেপালের বৌদ্ধধর্মকে হিন্দুধর্মের বিকার অথবা নেপালের হিন্দুধর্মকে বৌদ্ধধর্মের বিকার বললেও অত্যুক্তি হয় না। সিকিম-ভুটানের সংস্রব আসলে বাংলাদেশের সঙ্গে। শুনতে পাই, বাংলার লোকের দেহে চীনের রক্ত আছে। সেইসঙ্গে বাঙালির মনেও কিঞ্চিৎ চৈনিক ধর্ম আছে কি না বলতে পারি নে।

দেশের পণ্ডিতলোক-সব আজকাল বেদের পুনরুদ্ধারের জন্য ভারতবর্ষের উত্তরপশ্চিম দেশে মহা খোঁড়াখুঁড়ি আরম্ভ করেছেন। বেদ উদ্ধারের পর আমাদের পণ্ডিতরা যদি তন্ত্রের সন্ধানে বেরোন, তা হলে, আমার বিশ্বাস, তাঁদের উত্তরপশ্চিম দেশকে গজভুক্ত কপিখবৎ ত্যাগ করে ভারতবর্ষের উত্তরপূর্বে আসতে হবে। তখন রিসার্চ ওঅক-এর পীঠস্থান হবে প্রথমে ভূটান, পরে সিকিম। তন্ত্রশাস্ত্রের পথি খললেই পাতায় পাতায় মহাচীনের সাক্ষালাভ ঘটে। সে যাই হোক, ভারতবর্ষের পশ্চিমে ইরান ও উত্তরে তুরানের মতো তার পূর্বে মহাচীনকেও পুরাতত্ত্ববিৎ ভাষাতত্ত্ববিং ও নতত্ত্ববিত্রা উপেক্ষা করতে পারেন না। সম্প্রতি অবগত হয়েছি যে, পণ্ডিতরা আজকাল Tarim দেশ নিয়েই উঠে-পড়ে লেগেছেন। Tarim অবশ্য চীন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুত তুর্কস্থানে। সুতরাং আশা করা যায় যে, তাঁরা খোটান থেকে ভুটানে অচিরে নেবে পড়বেন।

 

ভারতবর্ষের প্রকৃতি

এতক্ষণে তোমরা ভারতবর্ষ নামক মহাদেশ, আর তার অন্তর্ভুত খণ্ড দেশগুলির আকৃতির মোটামুটি পরিচয় পেলে। এখন, তার প্রকৃতির পরিচয় সংক্ষেপে দেওয়া যাক।

প্রথমত ভারতবর্ষ হচ্ছে গ্রীষ্মপ্রধান দেশ। তবে উত্তরাপথের সঙ্গে দক্ষিণপথের এ বিষয়েও একটু প্রভেদ আছে। তোমরা বোধ হয় লোবে লক্ষ্য করেছ যে পিপের গায়ে লোহার পঞ্জার বাঁধনের মতো কতকগুলি কালো কালো রেখা এই গোলকটির দেহ বেষ্টন করে আছে। এই রেখাগুলির ভিতর দুটি রেখায় একটু বিশেষত্ব আছে। সে দুটি একটানা নয়, কাটা কাটা। এ উভয়ের মধ্যে ইকোয়েটরর উত্তরে যে রেখাঁটি আছে, সেটির নাম ট্রীপক অব ক্যানসার; আর ইকোয়েটরএর দক্ষিণে যেটি আছে, তার নাম ট্রপিক অব ক্যাপ্রিকর্ন।

সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর কি যোগাযোগ আছে, তাই দেখাবার জন্য এ দুটি রেখা আঁকা হয়েছে। এই রেখাঙ্কিত জায়গাতেই সূর্যের কিরণ পৃথিবীর উপর ঠিক খাড়া হয়ে পড়ে, অপর সব স্থানে তেরচা ভাবে। এই ট্রপিক অব ক্যানসারের উত্তরদেশ শীতের দেশ, আর ট্রপিক অব ক্যাপ্রিকর্নের দক্ষিণদেশও শীতের দেশ।

আর এই রেখাদ্বয়ের মধ্যের দেশ সব দারুণ গরম দেশ। ভারতবর্ষের উত্তরাপথ, প্রায় সমস্তটাই ট্রপিক অব ক্যানসারের উত্তরে, ও দক্ষিণাপথ আগাগোড়া তার দক্ষিণে। ফলে দক্ষিণাপথে শীতঋতু বলে কোনো ঋতু নেই। জনৈক ইংরেজ বলেছেন যে, দক্ষিণাপথ হচ্ছে Nine months hot and three months hotter। কথাটা কিপলিঙের মুখ থেকে বেরোলেও মিথ্যে নয়। উত্তরাপথে কিন্তু শীতগ্রীষ্ম দুই বেশি। দক্ষিণাপথে গ্রীষ্মকালে গরম যে উত্তরাপথের মতো অসহ্য হয় না, তার কারণ দক্ষিণাপথ উত্তরাপথের চাইতে প্রথমত উঁচু, দ্বিতীয়ত তার তিন দিক সমুদ্রে ঘেরা।

 

মাটি

তার পর ভারতবর্ষের এ দুই ভূভাগের মাটিও এক জাতের নয়, এবং তাদের গণাগণও পথক। মানুষের পৃথিবীর সঙ্গে কারবার প্রধানত মাটি নিয়ে। গাছপালা তৃণ শস্য সব মাটিতেই জন্মায়। এবং অনেক পণ্ডিতের মতে সব জীবজন্তুর ন্যায় মানুষের আদিমাতা হচ্ছে ভূমি। এ মতে যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁরা কোন জমিতে কে জন্মেছে তার থেকেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও নিকৃষ্টত্ব নির্ণয় করেন।

এ সত্ত্বেও আমাদের জানা উচিত যে, মাটি হচ্ছে পৃথিবীর চামড়া মাত্র। ও চামড়ার নীচে পাথর আছে, যে পাথর থেকে কিছুই জন্মায় না।–জীবজন্তুও নয়, গাছপালাও নয়। মা-বসুন্ধরা আসলে পাষাণী।

এই মাটিও পাথরের বিকার মাত্র। অর্থাৎ পাথরকে ভেঙে মাটি তৈরি করতে হয়। পাথরকে চূর্ণ করা হচ্ছে জল আর বাতাসের কাজ।

নদনদী পাহাড় থেকে বেরোয়, পাহাড় ভেঙে। আর তারা যে চূর্ণপাষাণ বয়ে নিয়ে আসে, তাই দিয়ে যে মাটি গড়ে, সেই মাটিকে আমরা পলিমাটি বলি। সেই মাটিই প্রধানত গাছপালার জন্মভূমি। আর সমগ্র উত্তরাপথ প্রায় এই মাটিতেই তৈরি।

আমরা ভারতবর্ষকে উপদ্বীপ, পেনিনসুলা বলি; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষের ত্রিকোণ দক্ষিণাংশই একটি উপদ্বীপ। এ অংশ অতি পুরাকালে একটি দ্বীপ মাত্র ছিল। হিমালয় ও বিন্ধ্যপর্বতের মধ্যের দেশ তখন জলমগ্ন ছিল। তার পর সেই জলমগ্ন দেশ যখন হিমালয়ের নদনদীর কৃপায় উত্তরাপথ হয়ে উঠল, তখন তার দক্ষিণ দ্বীপ উত্তরাপথের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভারতবর্ষ নামক মহাদেশ সৃষ্টি করল। দক্ষিণাপথ উত্তরাপথের চাইতে ঢের প্রাচীন দেশ। তোমরা যখন জিয়োলজি পড়বে, তখন এ দেশের বয়সের গাছপাথরের অথবা গাছপাথরের বয়সের হিসেব পাবে।

দক্ষিণাপথের বেশির ভাগ মাটি নদনদীর দান নয়। আগ্নেয়গিরি হতে যে গলা পাথরের (লাভা) উদগম হয়েছে, তাই চুর্ণ হয়ে হয়েছে দক্ষিণাপথের মাটি। উত্তরাপথ বরুণদেবতার সৃষ্টি, দক্ষিণাপথ অগ্নিদেবতার। এ দুই মাটি এক জাতেরও নয়, এ দুয়ের ধর্মও এক নয়।

এ দুই দেশের জলবায়ুও বিভিন্ন। মেঘ আসে সমুদ্র থেকে, আর পবনদেবই মেঘকে উড়িয়ে নিয়ে আসেন। সুতরাং কোন দেশে কত বৃষ্টি হয় তা নির্ভর করে কোন দেশে কোন দিক থেকে কি বাতাস বয়, তার উপর। তোমাদের পূর্বে বলেছি যে, সিন্ধুদেশ হচ্ছে অনাবৃষ্টির ও আসাম অতিবৃষ্টির দেশ। এর মধ্যবর্তী দেশ অল্পবন্টির দেশ। অপর পক্ষে দক্ষিণাপথের পশ্চিম উপকূল অতিবৃষ্টির দেশ, ও তার পূর্বে অংশই অনাবৃষ্টির দেশ।

যে বায়ুকে আমরা মনসুন নামে আখ্যাত করি, তার চলবার পথ হচ্ছে ভারতবর্ষের দক্ষিণপশ্চিম কোণ থেকে উত্তরপূর্বে কোণে। এ বাতাস মালাবার দেশকে জলে ভাসিয়ে দেয়। আবার বাংলায় ঢোকার পর এর গতি হয় দক্ষিণপূর্ব থেকে উত্তরপশ্চিমে। এই বাতাস বাংলা ও আসামের গায়ে প্রচুর জল ঢেলে দিয়ে তার পর উত্তরাপথের অন্তরে গিয়ে প্রবেশ করে। গ্রীষ্মঋতুর অবসানেই এ দেশে বর্ষাঋতু দেখা দেয়। মনসুন কিন্তু পঞ্চনদ পর্যন্ত ঠেলে উঠতে পারে না। এজন্য বাংলায় যখন বৃষ্টি হয়, পাঞ্জাব তখন শুখনো। পাঞ্জাবে শীতকালই বর্ষাকাল।

ভারতবর্ষের লোক শতকরা নব্বই জন হচ্ছে কৃষিজীবী। এই কারণে ভারতবর্ষ নাগরিক দেশ নয়, গ্রাম্য দেশ। এ দেশে সাত লক্ষ পঞ্চাশ হাজার গ্রাম আছে, আর পঁচাত্তরটি নগর নেই। নগরেও একরকম সভ্যতার সৃষ্টি হয়, যেমন হয়েছিল পুরাকালে গ্রীসের আথেন্স ও ইতালির রোম নগরীতে। আর সেই সভ্যতাই কতক অংশে বর্তমান ইউরোপের মনের উপর প্রভুত্ব করছে। এই শহরে মনোভাব থেকে নিষ্কৃতি না পেলে মানুষের মন ভারতবর্ষ ও চীনদেশের সভ্যতার প্রতি অনুকূল হয় না। এই কারণেই ইউরোপের সাধারণ লোক ও বর্তমান ভারতবর্ষের অসাধারণ লোকে–অর্থাৎ যারা শিক্ষা-দীক্ষার প্রভাবে বিলেতের সাধারণ লোকের শামিল হয়ে গিয়েছে, তারা ভারতবর্ষের সভ্যতাকে অসভ্যতা মনে করে।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন যে, ইউরোপীয় সভ্যতা জন্মলাভ করেছে শহরে ও সেইখানেই লালিত-পালিত হয়েছে; অপর পক্ষে ভারতবর্ষের সভ্যতা জন্মগ্রহণ করেছে বনে, অর্থাৎ ঋষির আশ্রমে, ও সেইখানেই লালিত-পালিত হয়েছে।

এ দেশ যদি ঋষিক্ষেত্র হয়, তার কারণ এ দেশ মূলে কৃষিক্ষেত্র। বন গ্রামেরই অপর পৃষ্ঠা। আশ্রম মাটির নয়, মনেরই কৃষিক্ষেত্র।

আজকাল অনেক ইংরেজশিক্ষিত সদাশয় লোক ভিলেজ অরগ্যানিজেশন করবার জন্য অতিশয় ব্যাকুল হয়ে পড়েছেন। কিন্তু মানুষ কৃষিকর্মের জন্য যুগ যুগ ধরে যে অরগ্যানিজেশন করেছে, তারই নাম কি ভিলেজ নয়? ভিলেজ জিনিসটে শুধু অরগ্যানাইজড নয়, কালবশে প্রতি গ্রাম এক-একটি অরগ্যানিজম হয়ে উঠেছে। অরগ্যানিজমকে অরগ্যানাইজ করবার প্রবৃত্তিটি যেমন উচ্চ, তেমনি নিরর্থক। অরগ্যানিজমও ব্যাধিগ্রস্ত হয়; যদি আমাদের দেশের গ্রামসমূহ তাই হয়ে থাকে, তা হলে তাদের ব্যাধিমুক্ত করবার জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন। কিন্তু চিকিৎসার নাম অরগ্যানিজেশন নয়; অরগ্যানাইজ্‌ মানুষে করে শুধু কলকারখানা। যে ভূভাগকে ভগবান চাষের দেশ করে গড়েছেন, তাকে আমরা পাঁচজনে কলকারখানার দেশ তৈরি করতে পারব না, তা চাষার মুখের গ্রাস কেড়ে টাটা কোম্পানির লোহার কলের পেট যতই ভরাই নে কেন। ভারতবর্ষ কখনো বিলেত হবে না। মনে ভেবো না যে আমি ধান ভানতে শিবের গীত গাইতে শুরু করেছি। পুরাণকাররা বলেছেন যে, ভারতবর্ষ হচ্ছে আসলে কর্মভূমি, আর এ দেশ সেই কর্মের ভূমি যে কর্ম দেবদানবরা করতে পারেন না। এ কর্ম হচ্ছে কৃষিকর্ম। আর এইটিই হচ্ছে, ভারতবর্ষের জিয়োগ্রাফির গোঁড়ার কথা আর অন্তরের কথা। আর এই ভিত্তির উপরেই ভারতবাসীর মনপ্রাণ গড়ে উঠেছে। এ সত্য উপেক্ষা করলে সেকালের ধর্মশাস্ত্রেও অধিকার জন্মাবে না, একালের অর্থশাস্ত্রেও অধিকার জন্মাবে না। আর তখন তোমরা ধর্ম বলতে বুঝবে অর্থ, আর অর্থ বলতে বুঝবে ধর্ম; যেমন আজকালকার পলিটিশিয়ানরা বোঝেন।

 

উদ্ভিদ

মানুষের জীবন উদ্ভিদের জীবনের অধীন। উদ্ভিদের কাছ থেকে যে আমরা শুধু অন্ন পাই তাই নয়, বস্ত্রও পাই। ভারতবর্ষের বক্ষলতা তৃণশস্য আমাদের এই দুই জিনিসই জোগায়। উত্তরাপথ প্রধানত আমাদের দেয় অন্ন, আর দক্ষিণাপথ বস্ত্র।

উত্তরাপথের পশ্চিমাংশ রুটির দেশ, পূর্বাংশ ভাতের দেশ। প্রথমত ধান জন্মায় অতিবৃষ্টির দেশে, ও গম জন্মায় অল্পবৃষ্টি এমন-কি, অনাবৃষ্টির দেশে। তার পর ধানের জন্য চাই নরম মাটি, ও গমের জন্য শক্ত মাটি। বাংলার মাটিও নরম আর এখানে বৃষ্টিও হয় বেশি, তাই বাংলা হচ্ছে আসলে ধানের দেশ। পাঞ্জাবে বৃষ্টি কম ও মাটি শক্ত, তাই পাঞ্জাবের প্রধান ফসল হচ্ছে গম। সিন্ধুদেশেও আজকাল দেদার গম জন্মাচ্ছে। অনেক উদ্ভিদের মাথায়ও জল ঢালতে হয়, গোঁড়ায়ও জল দিতে হয়। বৃষ্টির জলে স্নান না করতে পেলে ধান বাঁচে না। কিন্তু খেজুর গাছের মাথায় এক ফোঁটাও জল দিতে হয় না। গোঁড়ায় রস পেলে ও গাছ তেড়ে বেড়ে ওঠে। এ কারণ সাহারা মরুভূমি ও আরবদেশই আসলে খেজুরের দেশ। ও দুই মরভূমির ভিতর যেখানে একটু জল আছে, সেইখানেই চমৎকার খেজুর জন্মায়। জানোয়ারের ভিতর যেমন উট, গাছের ভিতর তেমনি খেজুর-মরুভূমিরই জীব। গমের মাথায়ও বারিবর্ষণ করবার দরকার নেই। মরুভূমির ভিতর নালা কেটে যদি জল নিয়ে যাওয়া যায়, তা হলেই সেখানে গম জন্মায় ও প্রচুর পরিমাণে জন্মায়। শস্যের যে শুধু পিপাসা আছে তাই নয়, খিদেও আছে। মাটির ভিতর যে রাসায়নিক পদার্থ ওরফে সার থাকে, তাই হচ্ছে শস্যের প্রধান খাদ্য। যে দেশে বেশি বৃষ্টি হয়, সে দেশের মাটি থেকে অনেক সময়ে এই সার ধুয়ে যায়। মরভূমির অন্তরে কিন্তু এ সার সঞ্চিত থাকে। সেখানে অভাব শুধু জলের। তাই মরভূমির অন্তরে জল ঢোকাতে পারলেই যে-সব শস্যের শুধু গোঁড়ায় জল চাই সে-সব শস্য প্রভূত পরিমাণে জন্মায়। সিন্ধুনদ থেকে খাল কেটে জল নিয়ে গিয়ে সিন্ধুদেশকে এখন শস্যশ্যামলা করে তোলা হয়েছে।

দক্ষিণাপথের ভিতরকার মাটি আগ্নেয়গিরি থেকে উদগত পাথর-ভাঙা মাটি। এ মাটিতে খাবার জিনিস তেমন জন্মায় না। আর দক্ষিণাপথের অপর মাটিও অতি নিরেস মাটি, তাতে ধান জন্মায় না, গমও জন্মায় না; জন্মায় শুধু বাজরি আর জোয়ারি, আর তারই রুটি খেয়েই এ দেশের লোক জীবনধারণ করে। এ দু ভাগের দুটি অংশ কিন্তু খুব উর্বর, পশ্চিমে মালাবার ও পূর্বে করমণ্ডল উপকূল। মালাবার নারিকেল গাছের দেশ, আর করমণ্ডল তাল গাছের। তা ছাড়া এই দেশে শস্যও প্রচুর জন্মায়। তবুও দক্ষিণাপথ নিজের দেশেরই খোরাক জুগিয়ে উঠতে পারে না; দেশে-বিদেশে অন্ন বিতরণ করা তো তার পক্ষে অসম্ভব।

কিন্তু এই দক্ষিণাপথের আর-একটি সম্পদ আছে। আগ্নেয়গিরির পাথর-ভাঙা মাটিকে ব্ল্যাক কটন সয়েল বলা হয়, কারণ ও-মাটির রঙ কালো ও তাতে কার্পাস জন্মায়। এ দেশে এত কার্পাস জন্মায় যে দক্ষিণাপথ শুধু সমগ্র ভারতবর্ষকে নয়, দেশ-বিদেশকে তুলো জোগায়। বাংলা যেমন ধানের দেশ, পাঞ্জাব যেমন গমের দেশ, দক্ষিণাপথ তেমনি মুখ্যত তুলোর দেশ। এ দেশ শুধু কাপাসের দেশ নয়, শিমুলেরও দেশ। অতি গোদাবরীতীরে বিশাল শাল্মলীতর-এ কথাটা শুধু গল্পের কথা নয়। দক্ষিণাপথের তুল্য বিশাল শাল্মলীতর, পৃথিবীর অন্য দেশে বিরল।

এই থেকে দেখতে পাচ্ছ যে ভারতবর্ষ, কি অন্ন কি বস্তু, কিছুরই জন্য অপর কোনো দেশের মুখাপেক্ষী নয়। আজকাল কেউ কেউ বাংলাদেশে কাপাসের চাষ করতে চান। এ চেষ্টা দক্ষিণাপথে ধানের চাষ চালাবার অনুরূপ। এ ইচ্ছা অবশ্য অতি সদিচ্ছা, কিন্তু এ ইচ্ছা জিয়োগ্রাফির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। সমগ্র ভারতবর্ষকে ঢেলে সাজাবার মহৎ বাধা হচ্ছে ভারতবর্ষের প্রকৃতি।

 

ভারতবর্ষের ঐক্য

ভারতবর্ষের জিয়োগ্রাফির পরিচয় দিতে হলে বোধ হয় এক বৎসর কাল লাগে। আমি আমার বরাদ্দ এক ঘণ্টার ভিতর সে দেশের আকৃতি ও প্রকৃতির মোটামুটি পরিচয় দিতে চেষ্টা করেছি। তাতে তোমাদের তরুণ জ্ঞানপিপাসা কতদূর মিটেছে বলতে পারি নে। যদি না মিটে থাকে তো আমার বক্তব্য এই যে— যত্নে কৃতে যদি ন সিধ্যতি কোহত্র দোষঃ।

এখন এই কথাটি তোমাদের বলতে চাই যে, এই সমগ্র দেশটি একদেশ। পৃথিবীতে আর যে-সব দেশ একদেশ বলে গণ্য, সে-সব ছোটো ছোটো দেশ। এক মহাচীন ব্যতীত অপর কোথাও এত বড়ো দেশ একদেশ বলে গণ্য হয় নি।

প্রথমত, এদেশের চতুঃসীমা এ দেশকে যেমন পরিচ্ছিন্ন করেছে, অন্য কোনো দেশকে তেমন করে নি। চীনদেশে এর তুল্য স্বাভাবিক সীমানা নেই, তাই চীনেরা তাদের দেশ প্রাচীর দিয়ে ঘিরতে চেষ্টা করেছিল, পাশাপাশি অন্যান্য দেশ থেকে স্বদেশকে পৃথক করবার জন্য। এ চেষ্টা অবশ্য ব্যর্থ হয়েছে।

হিমালয়ই হচ্ছে ভারতবর্ষের জিয়োগ্রাফির সবচেয়ে বড়ো জিনিস। পৃথিবীর আর-কোনো দেশের অত বড়ো প্রাচীর নেই। তার পর ঐ হিমালয়ই সত্যসত্য ভারতবর্ষের ভাগ্যবিধাতা ও জলবায়ুর নিয়ন্তা। হিমালয়ের জলই হচ্ছে উত্তরাপথের প্রাণ। আর হিমালয়ই সমগ্র ভারতবর্ষের বায়ুর চলাচল নিয়ন্ত্রিত করে। এর ফলে প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষ এমন উর্বর, এমন মানুষের বাসোপযোগী দেশ হয়েছে। তার পর ভারতবর্ষের অন্তরে কোনো সমদ্র কিংবা হ্রদ নেই, আর তার মধ্যস্থ একমাত্র পর্বতশ্রেণী বিন্ধ্যশ্রেণী এত উচ্চ নয় যে, ভারতবর্ষের উত্তর-দক্ষিণকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পারে। তার পর এই একদেশ এত বৈচিত্র্যপূর্ণ যে, এক হিসেবে একে পৃথিবীর সংক্ষিপ্তসার বলা যেতে পারে।

ভারতবর্য মহাদেশটি অতি সুরক্ষিত দেশ। প্রকৃতি নিজ হাতেই এ দুর্গের পর্বতের প্রাকার ও সাগরের পরিখা গড়ে দিয়েছেন। তবে এ দেশ এশিয়ার অপরাপর দেশ হতে বিচ্ছিন্ন হলেও তাদের সঙ্গে একেবারে যোগাযোগশন্য নয়। পূর্বেই বলেছি যে, উত্তরাপথের পশ্চিমে দুটি প্রবেশদ্বার আছে—উত্তরে খাইবার পাস ও দক্ষিণে বোলান পাস। অতীতে এই দুই রন্ধ্র দিয়ে ইরানি তুরানি শক হূন যবন বাহ্লিক মোগল পাঠান প্রভৃতি জাতিরা এ দেশে প্রবেশ করেছে, কিন্তু সহজে নয়। খাইবার পাস দিয়ে ঢুকলে পাঞ্জাবের পঞ্চনদ পার হয়ে এসে গঙ্গাযমুনার দেশে পৌঁছতে হত, আর বোলান পাস দিয়ে এলে বিদেশীদের বুকে মরুভূমি ঠেকত।

ভারতবর্ষের অন্তরে প্রবেশ করবার আসল দ্বার হচ্ছে দিল্লি নামক শহর। কারণ সেখানে মরভূমি ও আরাবলি পর্বত শেষ হয়ে শস্যশ্যামল সমভূমি আরম্ভ হয়েছে। সেই মিলনস্থানেই মোগল-পাঠানরা দিল্লি নগর প্রতিষ্ঠিত করেছে। আর্যদের ইন্দ্রপ্রস্থ নগরও এইখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর, দিল্লির উপকণ্ঠেই ভারতবর্ষের সর্ব প্রধান রণক্ষেত্র। কুরুক্ষেত্র থানেশ্বর পাণিপথ এ-সবই প্রায় এক জায়গায়। পুরাকালে দিল্লির গেট না ভেঙে কোনো বিদেশী জাতি ভারতবর্ষের ভিতর প্রবেশ করতে পারে নি। ফলে যে-সকল জাত ও-দ্বার খুলতে পারে নি তারা হয় দেশে ফিরে গিয়েছে, নয় সিন্ধু ও পঞ্চনদ-দেশ অধিকার করে বসেছে।

ভারতবর্ষের সমুদ্রকূলেও দু-চারটি ছাড়া আর প্রবেশদ্বার ছিল না, আর সে-কটি বন্দর দক্ষিণাপথের পশ্চিম উপকূলে; উত্তরে ভৃগুকচ্ছ ও সুরপারগ এবং দক্ষিণে কালিকট ও কোচিন।

এই-ক’টি দ্বার দিয়েই ইউরোপীয় জাতিরা জাহাজে করে সমুদ্র পার হয়ে এ দেশে প্রবেশ করেছে। পোর্তুগিজ ওলন্দাজ ইংরেজ ও ফরাসিরা এই পথ দিয়েই ভারতবর্ষে ঢুকেছে। ভারতবর্ষে প্রবেশ করবার স্থলপথ এখন বন্ধ। খাইবার পাস এবং বোলান পাস এই দুই দুয়োরই এখন দুর্গ দিয়ে সুরক্ষিত; কিন্তু জলপথ এখন পশ্চিম দক্ষিণ ও পূর্ব তিন দিকে খোলা। এখন ভারতবর্ষের সঙ্গে এশিয়ার যোগ ছিন্ন হয়েছে, তার পরিবর্তে নূতন যোগ স্থাপিত হয়েছে ইউরোপের সঙ্গে; সে যোগ অবশ্য দৈহিক নয়, মানসিক।

এই এক ঘণ্টা ধরে তোমাদের কাছে ভারতবর্ষের যে মোটামুটি বর্ণনা করলাম, সে বর্ণনার ভিতর থেকে তার একটা অঙ্গ বাদ পড়ে গেল। দেশের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। সুতরাং ভারতবাসীদের কথা বাদ দিয়ে ভারতবর্ষের জিয়োগ্রাফির বর্ণনা পূর্ণাঙ্গ হয় না। তবে-যে ভারতবর্ষের নানা দেশের নানা জাতীয় লোকের রূপগণের পরিচয় দিতে চেষ্টামাত্র করি নি, তার কারণ সে পরিচয় দেওয়া আমার পক্ষে অসাধ্য। অ্যানথ্রপলজি নামক বিজ্ঞান আমি জানি নে, আর সে বিজ্ঞানেরও এ বিষয়ে বিশেষ কোনো জ্ঞান নেই। অ্যানথ্রপলজি এ বিষয়ে সত্য খুঁজছে, কিন্তু আজও তার সাক্ষাৎ পায় নি। আজ এক অ্যানথ্রপলজিস্ট যা বলেন, কাল অপর অ্যানথ্রপলজিস্ট তার খণ্ডন করেন। সুতরাং ও-শাস্ত্রের মনগড়া কথা সব তোমাদের নিয়ে কোনো লাভ নেই; বরং সে-সব কথা শোনায় তোমাদের ক্ষতি আছে। বিজ্ঞানের নাম শুনলেই আমরা অজ্ঞান হই। অর্থাৎ ঐ নামে যে-সব কথা চলে, সে-সব কথাকে এ যুগে বেদবাক্য বলে মেনে নিই। আমাদের মতো বয়স্ক লোক দেরই যখন মনের চরিত্র এহেন, তখন তোমাদের পক্ষে এ-সব অনিশ্চিত বিজ্ঞানের সুনিশ্চিত কথা শোনায় ভয়ের কারণ আছে। তোমাদের মন স্বভাবতই বিশ্বাসপ্রবণ। বিজ্ঞানের কথা ছেড়ে দাও, খবরের কাগজের কথাতেও তোমরা বিশ্বাস কর। বুজরুক শব্দটার মানে শুনতে পাই জ্ঞানী। বুজরুক নামক জ্ঞান নিয়েই কাগজওয়ালাদের কারবার। আর নিত্য দেখতে পাই যে, সেই বুজরুকি কথা তোমাদের নরম মনে এমনই বসে যায় যে, সে কালির ছাপ অনেকের মনে চিরজীবন থেকে যায়। সুতরাং ভারতবর্ষের নৃতত্ত্ব অথবা জাতিতত্ত্ব নিয়ে তোমাদের সব মনকে ব্যস্ত করবার কোনো প্রয়োজন নেই।

ভারতবর্ষের সকল লোক যে এক জাতির নোক নয়, এ সত্য তো সকলের কাছেই প্রত্যক্ষ। এ দেশে বিভিন্ন প্রদেশের লোকের রূপের ও বর্ণের ভিতর কতটা স্পষ্ট প্রভেদ আছে তা সকলেরই চোখে পড়ে। এর থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে, তাদের প্রকৃতিও বিভিন্ন। আমি পূর্বে তোমাদের বলেছি যে, পৃথিবীর জিয়োগ্রাফিকাল ভাগ ও পলিটিকাল ভাগ এক নয়। এ দেশের যে পলিটিকাল হিসেবে এক জাত হতে পারে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক হিসেবে এক জাত নয়। জিয়োগ্রাফির ভাগের হিসেবে তাদের জাতেরও স্পষ্ট ভাগ আছে। পলিটিক্সের হিসেবে কাশ্মীরি পণ্ডিত অবশ্য তামিল নাইডুর সহোদর, কিন্তু জিয়োগ্রাফির হিসেবে এরা পরস্পরকে কিছুতেই দেশকা ভাই বলতে পারেন না। আজ আমি তোমাদের কাছে যতদূর সংক্ষেপে পারি ভারতবর্ষের বর্তমান জিয়োগ্রাফির বর্ণনা করলুম; বারান্তরে তোমাদের ভারতবর্ষের প্রাচীন জিয়োগ্রাফি ও প্রাচীন ভারতবর্ষের জিয়োগ্রাফির কথা শোনাব। পুরাকালেও স্বদেশের জিয়োগ্রাফি জানবার কৌতূহল লোকের ছিল, এবং এ বিষয়ে যেটকু জ্ঞান তারা সংগ্রহ করেছিলেন তা তাঁরা লিখে রেখে গিয়েছেন; আর তার থেকেই জানা যায় যে, কালক্রমে ভারতবর্ষের জিয়োগ্রাফির কিঞ্চিৎ পরিবর্তন ঘটেছে।

তোমাদের ভরসা দিচ্ছি যে, সে বর্ণনা এ বর্ণনার চেয়ে ঢের ছোটো হবে, আর আশা করি ঢের বেশি সরস হবে। যে-সব দেশের, যে-সব শহরে, যে-পাহাড়ে, যে-সব নদীর নাম আমরা রামায়ণ-মহারতে পড়ি, তারা কোথায় ছিল আর তাদের ভিতর কোনটি, স্বনামে না হোক, স্বরূপে বিরাজ করছে, সে-সব ক নেতে তোমাদের নিশ্চয়ই ভালো লাগবে। সেকালের ভারতের পরিচয় দিতে আমাকে কষ্ট করতে হবে, কিন্তু শুনতে তোমাদের কোনো কষ্ট হবে না।

মাঘ ১৩৩২

Exit mobile version