মি. মন্টেগু তখন উঠিয়া নিজামের, তাঁহার প্রধানমন্ত্রী সার আলি ইমাম সাহেবের ও তাঁহার বেগম সাহেবার স্বাস্থ্য কামনা করিয়া …নিজাম যে গত যুদ্ধের সময় লোক-লশকর গোলাগুলি দিয়া ইংরাজের ইজ্জত রক্ষা করেন, তজ্জন্য খুব গরমাগরম কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। যদিও ভারতের অবস্থা এখন জটপাকানো জটার মতোই জটিলতাপূর্ণ, তবুও তাঁহার আশা আছে, এ-সব জট খুলিয়া যাইবে, এবং ইংরাজ ও ভারতীয়দের মধ্যে একটা নূতন যুগের নব প্রেরণার আজানুলম্বিত বাহুর আবির্ভাব হইয়া পরস্পরকে নিবিড় প্রেমে জড়াজড়ি করিয়া কষিয়া বাঁধিবে!
ইহার উপরে আর আমাদের কথা নাই! এ যেন একেবারে ‘দুধকে দুধ, জলকে জল!’
সবাই তো নিজের নিজের মনের মতন কথাগুলি দিব্যি আওড়াইয়া গেলেন, কিন্তু যাহাদের জন্য এত নাড়ির টান ইঁহাদের, তাহাদের কেমন লাগিল বা লাগিবে সেটা কি ভাবিয়া দেখিয়াছেন? রাজতন্ত্র, স্বেচ্ছাতন্ত্র বা আমলাতন্ত্রের মজাই হইতেছে এই যে, কর্তারা কেবল নিজের দিকটাই দেখেন। নিজেদের সুখ-সুবিধাটাই তাঁহাদের লক্ষ্য – বাকি সব চুলোয় যাক, তাঁহাদের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নাই!
সার আলি ইমাম এখন লাট হইবার আশায় কত রকম ঢলানই ঢলাইবেন, এবং কর্তাদের মনস্তুষ্টির জন্য কত রকমেই না পুচ্ছ নাড়িয়া নিজের কৃতজ্ঞতা ও প্রভুভক্তি জানাইবেন, কিন্তু সে আশা কি সফল হইবে শেষ পর্যন্ত? ভারতের বিনা-জবাবদিহির লাট-মসনদে বসা লইয়াও তিনি যাঁহার নিঃস্বার্থ ত্যাগ দেখিয়া বিনাইয়া-বিনাইয়া গুণ ব্যাখ্যা করিলেন বা খোত্বা পড়িলেন, তিনিই কি না তাঁহার মুখের উপর এমন অপমানটা করিয়া বসিলেন, “না ভাই, না এতে আমার স্বার্থত্যাগের কোনো সুগন্ধই নাই – আমি বুদ্ধদেব নই; ত্রিশ কোটি মানুষ-মেষের রাখাল, পঞ্চাশটি হাজার করে টাকা মাসোহারা (যা দিয়া ইংলণ্ডে দু-পাঁচটা লয়েড জর্জ কিনতে পাওয়া যায়), এ কী ভাই সবই ফাঁকি , স লভ্য কি গেছ ভুলে?” লর্ড রিডিং সাংঘাতিক লোক, তাই খাঁটি সত্যকথা (তা যত বড়োই অপ্রিয় হউক না) একেবারে মুখের উপর চাঁচাছোলা ভাষায় বলিয়া দিয়াছেন! এঁদের কাছে বাবা ঢাক-ঢাক গুড়-গুড় নাই, সোজা কথা। সোজাসুজি বলিয়া দেওয়া, – ব্যস! ইহাতে তুমি রাগো, তো ঘরে বেশি করিয়া ভাত খাইবে! এ তো আর এদেশি রাজা-মহারাজ নন যে, দুটো চাটুবাক্যের আঁচ দিয়াই তাঁহাদিগকে ননীর মতন গলাইয়া ফেলিবে!
সার আলি ইমামকে শুধু জিজ্ঞেস করি, আমাদের গায়ের দাগগুলো কী এমন করিয়া মাখন ডলিলেই এত শীঘ্র মিলাইয়া যাইবে? –
‘সেথা যে বহে নদী নিরবধি সে ভোলেনি,
তারই যে স্রোতে আঁকাবাঁকা বাঁকা চোখা বাণী,
এখনও গুঁতোর রেখা আছে লেখা পিঠের কূলে! –
আজই জী সবি ফাঁকি, সেকথা কী গেছ ভুলে?’
লোকমান্য তিলকের মৃত্যুতে বেদনাতুর কলিকাতার দৃশ্য
আজ মনে পড়ে সেই দিন আর সেই ক্ষণ – বিকাল আড়াইটা যখন কলিকাতার সারা বিক্ষুব্ধ জনসংঘ টাউনহলের খিলাফত-আন্দোলন-সভায় তাহাদের বুকভরা বেদনা লইয়া সম্রাটের সম্রাট বিশ্বপিতার দরবারে তাহাদের আর্ত-প্রার্থনা নিবেদন করিতেছিল, আর পুত্রহীনা জননীর মতো সারা আকাশ জুড়িয়া কাহার আকুল-ধারা ব্যাকুলবেগে ঝরিতেছিল! সহসা নিদারুণ অশনিপাতের মতো আকাশ বাতাস মন্থন করিয়া গভীর আর্তনাদ উঠিল, – ‘তিলক আর নাই!’ আমাদের জননী জন্মভূমির বীরবাহু, বড়ো স্নেহের সন্তান – ‘তিলক আর নাই!’ হিন্দুস্থান কাঁপিয়া উঠিল – কাঁপিতে কাঁপিতে মূর্ছিত হইয়া পড়িল। ওরে, আজ যে তাহার বুকে তাহারই হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা ধসিয়া পড়িল! হিন্দুস্থানের আকাশে বাতাসে কোন্ প্রিয়তম-পুত্রহারা অভাগি মাতার মর্মবিদারী কাতরানি আর বুকচাপড়ানি রণিয়া রণিয়া গুমরিয়া ফিরিতে লাগিল, ‘হায় মেরি ফর্জন্দ (হায় আমার সন্তান) – আহ্ মেরি বেটা!’ এই আর্ত কান্নার রেশ যখন কলিকাতায় আসিয়া প্রতিধ্বনি তুলিল, তখনকার অবস্থা বর্ণনা করিবার ক্ষমতা আমাদের নাই। এত মর্মভেদী কান্না প্রকাশের ভাষা নাই – ভাষা নাই! মহাবাহু মহাপুরুষ অগ্রজের মৃত্যুতে কনিষ্ঠ ভ্রাতারা যেমন প্রাণ ভরিয়া গলা-ধরাধরি করিয়া ফোঁপাইয়া ফোঁপাইয়া কাঁদে, সেদিন দিনশেষে ব্যাকুল বৃষ্টিধারা মধ্যে দাঁড়াইয়া আমরা তেমনি করিয়া কাঁদিয়াছি! হিন্দু-মুসলমান, – মারোয়ারি, বাঙালি, হিন্দুস্থানি – কোনো ভেদাভেদ ছিল না, কোনো জাতবিচার ছিল না, – তখন শুধু মনে হইতেছিল, আজ এই মহাগগনতলে দাঁড়াইয়া আমরা একই ব্যথায় ব্যথিত বেদনাতুর মানবাত্মা, দুটি স্নেহহারা ছোটো ভাই! এখানে ভেদ নাই! – ভেদ নাই! সেদিন আমাদের সে-কান্না দেখিয়া মহাশূন্য স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছে – ঝাঁঝরা আকাশের ঝরা থামিয়া গিয়াছে, – শুধু সে-কার মেঘ-ভরা বেদনাপ্লুত অপলক দৃষ্টি আমাদের নাঙ্গা শিরে স্তব্ধ আনত হইয়া চাহিয়া থাকিয়াছে! তাই মনে হইতেছিল, বুঝি সারা বিশ্বের বুকের স্পন্দন থামিয়া গিয়াছে! এই স্তম্ভিত নিস্তব্ধতাকে ব্যথা দিয়া সহসা লক্ষ কণ্ঠের ছিন্ন-ক্রন্দন কারবালা-মাতমের (কারবালা শোকোচ্ছ্বাস) মতো মোচড় খাইয়া উঠিল, ‘হায় তিলক!’ ওরে, এ কোন্ অসহনীয় ক্রন্দন? হায়, কাহার এ রুক্ষ কণ্ঠের শ্রান্ত রোদন? – মনে পড়ে, সমস্ত বড়োবাজার ছাপাইয়া হ্যারিসন রোডের সমস্ত স্থান ব্যাপিয়া রোরুদ্যমান লক্ষ লক্ষ লোক – মাড়োয়ারি, বাঙালি, হিন্দু-মুসলমান, বৃদ্ধ, যুবক, শিশু, কন্যা – শুধু বুক চাপড়াইতেছে, ‘হায় তিলকজি! আহ্ তিলকজি!’ মৃত্যুর অমাভরা শত শত কৃষ্ণ পতাকা পশ্চিমা-ঝঞ্ঝায় থরথর করিয়া কাঁপিতেছে, আর তাহারই নিম্নে মাল্য-চন্দন বিভূষিত বিগত তিলকের জীবন্ত প্রতিমূর্তি! তাহাই কাঁধে করিয়া অযুত লোক চলিয়াছে জাহ্নবীর জলে বিসর্জন দিতে। বাড়ির বারান্দায় জানালায় থাকিয়া আমাদের মাতা-ভগিনীগণ এই পুণ্যাত্মার আলেখ্যের উপর তাঁহাদের পূত অশ্রুরাশি ঢালিয়া ভাসাইয়া দিতেছিলেন। বলিলাম, ধন্য ভাই তুমি! এমনই মরণ, সুখের মরণ, সার্থক মরণ যেন আমরা সবাই মরতে পারি! তোমার চিরবিদায়ের দিনে এই শেষ আশিস-বাণী করিয়া যাও ভাই, এমনই প্রার্থিত মহামৃত্যু যেন এই দুর্ভাগ্য ভারতবাসীর প্রত্যেকেরই হয়!…..ওরে ভাই, আজ যে ভারতের একটি স্তম্ভ ভাঙিয়া পড়িল! এ পড়-পড় ভারতকে রক্ষা করিতে এই মুক্ত জাহ্নবীতটে দাঁড়াইয়া, আয় ভাই, আমরা হিন্দু-মুসলমান কাঁধ দিই! নহিলে এ ভগ্নসৌধ যে আমাদেরই শিরে পড়িবে ভাই! আজ বড়ো ভাইকে হারাইয়া, এই একই বেদনাকে কেন্দ্র করিয়া, একই লক্ষ্যে দৃষ্টি রাখিয়া যেন আমরা পরস্পরকে গাঢ় আলিঙ্গন করি! মনে রাখিও ভাই, আজ মশানে দাঁড়াইয়া এ স্বার্থের মিলন নয়, এ-মিলন পবিত্র, স্বর্গীয়! ওই দেখ, এ-মিলনে দেবদূতরা তোমাদের নাঙ্গা-শিরে পুষ্পবৃষ্টি করিতেছেন। মায়ের চোখের জলেও হাসি ছলছল করিতেছে!
শ্যাম রাখি না কুল রাখি
বিহারের শাসনকর্তা লর্ড সিংহ বাহাদুর ভয়ানক মুশকিলে পড়িয়া গিয়াছেন। ঠিক যেন সাপে ছুঁচো গেলা গোছ। ছাড়িতেও পারেন না, গিলিতেও পারেন না। সহযোগিতা বর্জন আন্দোলন বিহারে যেরকম জোরে চলিতেছে, সেরূপ আর কোথাও নয়। মহাত্মা গান্ধিও এই লইয়া সেদিন ‘ইয়ং ইণ্ডিয়ায়’ বিহারের জোর প্রশংসা করিয়াছেন। এই ব্যাপারে বিহার গবর্নমেন্ট দস্তুর মতো বেসামাল হইয়াছেন বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। কেননা ইহার ছোটো শাসন-কর্তারা রাগের বা ভয়ের চোটে যখন তখন যা-তা করিয়া বসিতেছেন। সেদিন পুরুলিয়ায় ডেপুটি কমিশনার উকিলদিগকে ধমকাইতে গিয়া অপ্রতিভের একশেষ হইয়াছেন। তার পর মহকুমায়-মহকুমায়, জেলায়-জেলায় ম্যাজিস্ট্রেটগণ যে রকম সৃষ্টিছাড়া হুকুম জারি করিতেছেন, তাহা দেখিয়া বুঝা যায় যে, বাস্তবিকই এবার তাঁহারা চটিয়াছেন। মদের উপকারিতা লইয়া যে সরকারি ইস্তাহার জারি হইয়াছিল, তাহার কেলেঙ্কারি আর বলিলাম না। লর্ড সিংহ বাহাদুর বড়ো অসময়ে লাট ও শাসনকর্তা হইয়াছেন। এখন তিনি দেশের লোকের মন জোগাইয়া চলিতে পারেন না, আবার তাঁহার অধীন বিলিতি শাসনকর্তাদিগকেও জোর করিয়া কিছু বলিতে পারেন না, পাছে তাঁহারা তাঁহার বিরুদ্ধে ধর্মঘট করিয়া বসেন! দেশের লোক এখন যাহা চায়, তাও যদি আবার তিনি বিনা বাধায় চলিতে দেন, তাহা হইলে তো আবার তাঁহাকে একদিনেই পাততাড়ি গুটাইতে হয়।