ধীরে ধীরে বাংলাদেশের সিনেমা খারাপ হতে শুরু করলো, সিনে-পত্রিকা পড়ারও চল উঠে গেল। আমরা যারা মাঝে মধ্যে লিখতাম ওসবে, অন্য পত্র পত্রিকায় বা লিটল ম্যাগাজিনে লিখতে শুরু করলাম। একসময় আমি নিজেই কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা করতে শুরু করেছিলাম, নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে প্রকাশও করতাম। ছোটদা বিজ্ঞাপন জোগাড় করে দিত, প্রেস জোগাড় করে দিত। যখন ঢাকায় চলে গেল বিমানে চাকরি নিয়ে, একবার ঢাকা থেকেও সেঁজুতি ছাপিয়ে দিয়েছিল। ছোটদার হাজার রকম বিষয়ে আগ্রহ ছিল। কোনওদিন এমন কিছু পাইনি, যা নিয়ে ছোটদা কোনও আগ্রহ দেখায়নি। ছোটদা সেই দুষ্প্রাপ্য ধরনের মানুষ, জুতো সেলাই থেকে যে চন্ডিপাঠ পর্যন্ত করতে জানতো। ছোটদা একসময় একটা নাটকের দলে নাম লিখিয়েছিল। ছোটদার কল্যাণেই একবার চমৎকার এক নাটক করে ফেলেছিলাম ময়মনসিংহ শহরের টাউন হল মঞ্চে। ছোটদাকে নাটকের একটা স্ক্রিপ্ট দিলাম, পছন্দ হলো তার, আর তার পরই শুরু হল এক পোড়োবাড়িতে কলা কুশলী নিয়ে নাটকের মহড়া। আমার ওই আঠারো বছর বয়সে রীতিমত নাটকের পরিচালক হয়ে উঠেছিলাম। নাটকটা খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। বেশ অনেকগুলো শো হয়েছিল টাউন হলে। রাতে রাতে আমরা বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে নাটকের রিহার্সেলে যেতাম। ছোটদার অ্যাডভেঞ্চার আমাকে নিশ্চিতই প্রভাবিত করেছিল। সেই তখন থেকেই তো শিল্পের জগতে হাঁটি হাঁটি পা পা করে ঢুকছি আমি।
মাঝখানে অনেক বছর কেটে গেছে। দেশ থেকে আমাকে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। বাবা মারা যাওয়ার পর বাবার অঢেল সহায় সম্পত্তি ছোটদা আর বড়দা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়ায়, বোনদের কোনও ভাগ না দেওয়ায় আমি খুব রাগ করেছিলাম। তারপরও ছোটদাকে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছি আমেরিকার নানা শহরে। লাস ভেগাস, এ্যাণ্ড ক্যানিয়ন, ওয়াসিংটন ডিসি। আমি যখন হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেলোশিপ করছি, ছোটদা এসেছিল, তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছি বিখ্যাত হারভার্ড। এরও আগে আমি যখন জার্মানিতে, সুইডেনে, ছোটদা গিয়েছিল দেখা করতে। তখন। ছোটদাই ছিল আমার হারিয়ে যাওয়া দেশ। ছোটদা এমন একটা মানুষ যার ওপর খুব বেশিদিন রাগ করে থাকা যায় না, নাকি আমি এমন একজন মানুষ যে বেশিদিন কারও ওপর রাগ করে থাকতে পারি না, জানি না। সম্ভবত ছোটদাই, যার ওপর রাগ করে থাকা যায় না। যার ওপর সেই শৈশব থেকেই আমরা কেউ রাগ করে থাকিনি। অল্প বয়সে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে সেই যে সংসার চালাবার স্ট্রাগল করে যাচ্ছিল, আমরা সবাই ছোটদার সেই স্ট্রাগল চোখের সামনে দেখেছি বলেই হয়তো। কিছু কিছু মানুষ আছে সংসারে, যারা হরদম ভুলভাল কাজ করছে, ওলোটপালোট করে দিচ্ছে সবকিছু, কিন্তু তাদের জন্য মায়া জীবনে কখনও ফুরোয় না। অভিমান হয়, রাগ হয়। কিন্তু মায়াটা কোথাও না কোথাও থেকে যায়। ছোটদা নিজের জীবন এবং জগত নিয়ে ব্যস্ত। থাকতো। ভাই বোন বাবা মার সঙ্গে সময় কাটানোর সময় তার কখনও খুব বেশি হয়নি। অভিযোগের আমার শেষ নেই। তবে ছোটদার কাছে আমি অনেক কিছুর জন্য কৃতজ্ঞও বটে। ভারত সরকার যখন আমাকে তাড়িয়ে দিল দেশ থেকে, আমি না হয় দুর দেশে গিয়ে বেঁচেছি, কিন্তু আমার পোষা বেড়ালটিকে তো দূর দেশে কেউ ঢুকতে দেবে না। ভারতবর্ষে ওকে লালন পালন করার কেউ ছিল না। ওকে অগত্যা পাঠিয়ে দিই ঢাকায়, আমার ফ্ল্যাটে। ওখানে ছোটদাই ওকে খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিল আড়াই বছর। পরে যখন বেড়ালটাকে ফেরত চেয়েছি, ছোটদার খুব মন খারাপ, বলেছিল, মানুষটা ছিল, চলে গেলে কষ্ট হবে না বুঝি?
এর মধ্যে হঠাৎ একদিন ফোন। কী! ছোটদা দিল্লি আসবে। রুটিন টেস্ট করতে গিয়ে দেখা গেছে লিভারে হেমানজিওমা। হেমানজিওমা কোনও ক্ষতিকর কিছু নয়। তারপরও একটা দ্বিতীয় মত ভারত থেকে কে না নিতে চায়। ছোটদা খুব স্বাস্থ্য সচেতন ছেলে। চিরকালই ফিট। আমার চুল পেকে সাদা হয়ে গেল। ছোটদার চুল পাকা টাকার ব্যাপার নেই। ছোটদার সঙ্গে কোথাও বেরোলে আমাকে লোকে জিজ্ঞেস করতো ও আমার ছোট ভাই কি না। কী আর বলবো, আমার চেয়ে ন বছরের বড় ছোটদাকে আমার চেয়ে বয়সে ছোট ভাবা হচ্ছে। আসলে মিথ্যে নয়, ছোটদার বয়স হলেও ত্বকে কোনও ভাঁজ পড়েনি। চুল খুব কম পেকেছে। বিয়ার খেলেও হুঁড়ি বাড়েনি, চিরকাল ওই স্লিমই রয়ে গেছে। কিছুদিন আগে শুনেছি লাখ টাকা খরচ করে একটা ট্রেডমিল কিনেছে। এক ঘণ্টা করে প্রতিদিন হাঁটে। আমরা সবাই জানতাম আমাদের চার ভাই বোনের মধ্যে ছোটদার স্বাস্থ্যই সবচেয়ে ভালো। খামোকা কি সুন্দরী বিদুষী মেয়েরা টুপ টুপ করে প্রেমে পড়তো ছোটদার! যে কোনও বয়সের যে কোনও পেশার মেয়েই ছোটদার প্রেমে পড়ে যেতো দুদিনেই। কিছু একটা ছিল ছোটদার মধ্যে, জানি না ওই শিশুর মতো হাসিটিই কিনা।
ছোটদা এল দিল্লিতে। লিভার হাসপাতালে আমি আগেই কথা বলে রেখেছিলাম। যে রাতে এল, তার পরদিন সকাল নটায় ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাৎ ডাক্তার ওই একই কথা বললেন, হেমানজিওমা অনেকের থাকে, এ নিয়ে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। তারপরও তিনি কিছু পরীক্ষা করতে দিলেন। লিভারের এমআরআই যখন প্রায় শেষ হয়ে আসছে, তখন ডাই এর দরকার হলো। আমার বুক কাঁপল প্রথম। ডাই-এর দরকার কেন হবে। এমআরআইএর ডাক্তারের মত, কিছু যেন পাওয়া যাচ্ছে প্যানক্রিয়াসে। রক্ত পরীক্ষা করতে দিল ওইদিনই। পরদিন অজ্ঞান করে এণ্ডোসকপি করা হলো। আমাকে দেখানো হল ভেতরের অবস্থা। ডাক্তার বললেন, প্যানক্রিয়াস ক্যানসার। অত ছোট নয়, কিছুটা এগিয়েছে, অ্যাডভান্সড, রক্তের একটা নালীর গা ছুঁয়েছে। মা মারা গেছেন কোলন ক্যানসারে মাকে না হয় সারাজীবন হেলাফেলা করা হয়েছে। জ্বলা পোড়া খাবার খেতে হয়েছে মাকে, ক্যানসার হওয়ার আগে পলিপের উপসর্গ দেখা দিলেও মাকে কেউ ডা ক্তারের কাছে নিয়ে যায়নি। কিন্তু ছোটদার কেন হবে ক্যানসার! সে তো ঘন ঘন ডাক্তা রের কাছে যেতো, বছর বছর রুটিন টেস্ট করতো! যে রোগটার নাম মুখে নিতেও ভয় হয়, সে রোগ ছোটদার শরীরে! জগত ঘুরতে শুরু করলো চরকির মতো। আমি আর কিছুতেই মন দিতে পারলাম না। মার মৃত্যুশোক আজও কাটিয়ে উঠতে পারিনি, কিছুদিন আগে চোখের জলে ভেসে ভেসে পুরো একটা বই লিখেছি মাকে মনে করে। আর এখন কিনা ছোটদার ক্যানসার যন্ত্রণা চোখের সামনে দেখতে হবে। অবাক হয়ে দেখি, ছোটদা এই ক্যানসারকে দিব্যি মেনে নিয়ে, যেন এ গ্যাস্ট্রিক আলসার জাতীয় কোনও রোগ, পুরো উদ্যমে চিকিৎসা করতে শুরু করলো। কোনও চোখের জল নেই, দীর্ঘশ্বাস নেই, কিচ্ছু নেই। ঘন্টার পর ঘন্টা কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে থাকা নেই। হতাশায় ডুবতে ডুবতে অবশ হয়ে যাওয়া নেই। বেড়াতে যাচ্ছে গাড়ি চালিয়ে। খাচ্ছে। গল্প করছে। ছোটদার জায়গায় আমি হলে আমি এত সব পারতাম না। কেঁদে কেটে হাল ছেড়ে দিয়ে কোনও গহীন অরণ্যে গিয়ে একা বসে থাকতাম।