Site icon BnBoi.Com

আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

আমার প্রতিবাদের ভাষা – তসলিমা নাসরিন

অনুভূতিতে আঘাত না করে সমাজ বদলানো যায় না

অনুভূতিতে আঘাত করতেই হবে, বিশেষ করে ধর্মানুভূতিতে। এ ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। সমাজকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখলে চলবে না। সমাজকে এগোতে হবে। যারা সমাজটাকে যেমন আছে তেমন রাখতে চায়, তারা সবরকম অগ্রসরতাকে রোধ করে। অন্য কোনও অনুভূতিতে আঘাত লাগলে মানুষ এত বীভৎস বর্বর হয়ে ওঠে না, যত হয়ে ওঠে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলে। ধর্মীয় অনুভূতিকে এত গুরুত্ব কেন দেওয়া হচ্ছে। অনেকে বলে, যেহেতু ধার্মিকের সংখ্যাটা দুনিয়াতে বেশি। প্রায়ই শুনি দেড় বিলিয়ন লোকের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়াটা ঠিক নয়। বুঝি যে, মানুষের সংখ্যাটাকে খুব বড় করে দেখা হয়। ব্যাপারটা যেন এরকম, সংখ্যায় কম হলে তাদের ধর্মানভুতিতে আঘাত দেওয়া যেতে পারে, সংখ্যায় বেশি হলে দেওয়া উচিত নয়। দেড় বিলিয়ন না হয়ে দেড়শ বা দেড় হাজার হলে ঠিক ছিল কি?

অনেকে যারা বাংলাদেশের ব্লগার হত্যার বিরুদ্ধে, তারা ব্লগারদের পক্ষ নিতে গিয়ে হামেশাই বলছেন, ব্লগাররা মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেননি। তাহলে কি তারাও ধর্মান্ধদের মতো মনে করেন ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়া অন্যায়? মুশকিলটা ঠিক এই জায়গায়। লক্ষ্য করেছি, এটা মেনে নিতে প্রগতিশীলদেরও অসুবিধে হচ্ছে যে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়াটা অন্যায় নয়।

মানুষের অনুভূতিতে আঘাত লাগাটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কেউ যদি বলে, তার অনুভূতিতে কোনও রকম আঘাত সে চায় না, সুতরাং কারও অধিকার নেই তার অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার! নিশ্চিতভাবেই সে বাস্তবতা সম্পর্কে জ্ঞান রাখে না। তাছাড়া, অনুভূতিতে কোনওরকম আঘাত ছাড়াই পুরো জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাওয়ার দাবি অত্যন্ত অন্যায় দাবি। আমরা এমন মানুষ কখনও পাবো না, যার কোনও অনুভূতিতে আজ অবধি কোনও আঘাত লাগেনি। মানুষের ভিন্ন ভিন্ন মত। মানুষের সঙ্গে ওঠা বসা এবং চলাফেরা করলে আমাদের অনুভূতি সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি শতবার আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে। এভাবেই আমরা জীবন যাপন করি। ধরা যাক, ক যদি বলে সে সমাজবাদি দলের আদর্শে বিশ্বাস করে, এবং খ যদি উত্তরে বলে, সমাজবাদি এক নেতার চরিত্রের ঠিক নেই বা সমাজবাদির আদর্শ কোনও আদর্শই নয়, তাহলে কি ক দাবি করবে যে খ তার রাজনৈতিক অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে? এবং এই নিয়ে কোর্ট কাছারি করবে, জবাই চাপাতি করবে? ক আসলেই খ-এর রাজনৈতিক অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে। প্রশ্ন হলো, তাতে হলোটা কি? মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করলে অনুভুতির ওপর আঘাত নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। মাথা ঘামালে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলতে কিছুর অস্তিত্ব থাকে না। মত প্রকাশের স্বাধীনতার অস্তিত্ব থাকতেই হবে যদি গণতন্ত্রের অস্তিত্ব থাকে।

আগেই বলেছি, অন্য কোনও অনুভূতি আঘাত প্রাপ্ত হলে এত অঘটন ঘটে না, যত অঘটন ঘটে ধর্মীয় অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হলে। ধর্মীয় অনুভূতিকে কেন আমাদের বিশেষভাবে সমীহ করতে হয়? যেহেতু ধর্মের গল্পগুলো সত্যি নাকি প্রচুর লোক এই ধর্মটাকে ভালোবাসে, সে কারণে? ধর্মের গল্পগুলোকে যারা সত্যি বলে মানে, তাদের অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হতেই পারে ধর্মের গল্পগুলোকে যারা সত্যি বলে মানে না, তাদের দ্বারা। তবে আর সব অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হলে তারা যেভাবে শুশ্রূষা করে, ধর্মানুভূতিও আঘাত প্রাপ্ত হলে ঠিক এভাবেই শুশ্রূষা করতে হবে।

অনুভূতির রাজনীতি অনেককাল ধরে চলছে। ধর্মানুভূতির সঙ্গে সংঘাত লাগছে গণতন্ত্রের, শুভবুদ্ধির, জ্ঞানের, বিজ্ঞানের, নারীর অধিকারের, মানবাধিকারের, সমানাধিকারের। এখন দেখতে হবে আমরা কোন পক্ষ নিতে চাই। ধর্মানুভূতি রক্ষা করতে চাই নাকি গণতন্ত্র, শুভবুদ্ধি, জ্ঞান, বিজ্ঞান, নারীর অধিকার, মানবাধিকার, সমানাধিকার ইত্যাদি রক্ষা করতে চাই?

ধর্মানুভূতি নিয়ে রাজনীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এখন। এর সমাধান কিন্তু ধর্মানুভূতিতে আঘাত না করে হবে না। বরং উল্টো। ধর্মানুভূতিতে ক্রমাগত আঘাত করে যেতে হবে। আগের চেয়ে অনেক বেশি। ক্রমাগত আঘাতের ফলেই এই আঘাত গা সওয়া হবে। ধর্মানুভূতিকে নিয়ে ধর্ম ব্যবসা এক্ষুণি বন্ধ না করলে অসৎ ধর্মব্যবসায়ীরা সমাজের যেটুকু বাকি আছে ধ্বংস হওয়ার, সেটুকুও ধ্বংস করবে।

পৃথিবীর কোথাও নারীবিদ্বেষীদের অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও মানবাধিকারবিরোধী লোকদের অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও গণতন্ত্র বিরোধী লোকদের অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও ধর্মান্ধদের অনুভূতিকে আঘাত না দিয়ে বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও মানুষের ধর্মানুভূতিকে ক্রমাগত আঘাত না দিয়ে ধর্মানুভূতির নামে ধর্ম ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব হবে না। এইসব পুরোনো পচা নিয়ম দূর করে সমাজ বদলাতে হলে ধর্মানুভূতিতে আঘাত করা অত্যন্ত জরুরি।

নাস্তিক ব্লগারদের পক্ষ নিতে চাইলে ওরা কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেনি, এটা বলাটা ঠিক নয়। বরং বলা উচিত, ওরা মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে, কারণ আঘাতটা জরুরি ছিল। ধর্মান্ধরা চাইছে নাস্তিক শব্দটিকে এখন গালি হিসেবে ব্যবহার করতে। নাস্তিক শব্দটি যদি গালি হয়, আস্তিকও কিন্তু গালি।

গালি যত ইচ্ছে দাও। কিন্তু ভায়োলেন্স বন্ধ করো। আইডিওলজির বিরুদ্ধে যুদ্ধ আহিডিওলজি দিয়েই হতে হবে। বিজ্ঞানের সঙ্গে সংঘাত ধর্মের চিরকালের। বিজ্ঞানীরা, বিজ্ঞান যে মানে না, তাদের ধারালো ছুরি শানিয়ে কোপাতে যায় না। কিন্তু ধার্মিকরা, ধর্ম যে মানে না তাদের কোপাতে যায়। কোপানোর বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে প্রতিবাদ না হলে কোপানো চলতে থাকবে। আজ বিজ্ঞানীদের, মুক্তমনাদের কোপাবে, কাল হিজাব না পরলে, নামাজ না পড়লে, রোজা না করলে কোপাবে। পৃথিবীতে মুসলমান ছাড়া আর কোনও সম্প্রদায় নেই যারা নিজেদের কোপাচ্ছে, জবাই করছে, বোমা ছুড়ছে, উড়িয়ে দিচ্ছে।

অভিজিৎ

কেন অভিজিৎ গেল দেশে! সম্ভবত ফেসবুকে দেওয়া হুমকিকে বড় কোনও হুমকি বলে মনে করেনি। আমাকেও তো ফেসবুকে-টুইটারে ইমেইলে হত্যার হুমকি দেয় লোকেরা। আমি তো গা করি না। তাঁর বাবাও বলেছিল দেশে না যেতে দেশে না যেতে তো আমাকেও কত লোকে বলে, তারপরও তো আমি মনে করি, যে করেই হোক দেশে যাবোই আমি। অভিজিৎএর জায়গায় আমি হলে আমি হয়তো ঠিক তাই করতাম, অভিজিৎ যা করেছে। আমাকে যদি দেশে ঢুকতে দিত সরকার, বইমেলায় আমি ঠিক ঠিক যেতাম, বিশেষ করে সে বইমেলায় যদি আমার দুটো নতুন বই বের হয়ে থাকে। একজন লেখকের জন্য বইমেলায় ঘুরে বেড়ানো, বইয়ে অটোগ্রাফ দেওয়া, পাঠকের সঙ্গে মত বিনিময় করা যে কী ভীষণ আনন্দের, তা সব লেখকই জানেন।

এখন আমি জানি, দেশে যদি বাস করতাম আমি, বা দেশে যদি কখনও বেড়াতেই যেতাম, আমাকে ঠিক ওভাবে অনেক আগেই কুপিয়ে মেরে ফেলতো ওরা, যেভাবে অভিজিৎকে মেরেছে। আশি নব্বইএর দশকে বড় বড় মুফতি, ইমাম, মাদ্রাসায় পড়া মাতব্বর গোছের লোকেরা ফতোয়া দিত, মানুষের মাথার দাম ঘোষণা করতো। লক্ষ লোক মিছিল করতো, লং মার্চ করতো। আজকাল ফেসবুকে ইউনিভার্সিটির ছেলেরা মেরে ফেলার হুমকি দেয়। যাকে হুমকি দেয়, তাকে ঠিক ঠিক একদিন পেছন থেকে অতর্কিতে আক্রমণ করে, ধারালো চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মারে। চোখে পড়ার মতো এই বদলটাই সম্ভবত বাংলাদেশে গত কবছরে হয়েছে।

অভিজিতের নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখার পর দেশে ফেরার আমার যে দুর্দমনীয় ইচ্ছে ছিল, সেটি মরে পড়ে রয়েছে উপুড় হয়ে, যেভাবে অভিজিৎ পড়ে ছিল নিজের রক্তের ওপর। একুশ বছর আমি দেশে নেই, এ কারণে নিরন্তর বয়ে বেড়িয়েছি এক দুঃখের বোঝা। দুঃখগুলো এখন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ভাগ্যিস আমাকে দেশে ঢুকতে দেয়নি বাংলাদেশের কোনও সরকারই। ঢুকতে দিলে আমি দেশে ফিরতাম। আগে না জানলেও এখন বেশ জানি যে দেশে ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যে আমার নিজের রক্তের ওপর উপুড় হয়ে মরে থাকতে হতো আমাকে, কোপানো মস্তিষ্কের টুকরো ভেসে থাকতো রক্তে।

ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা একদিনে বাড়েনি বাংলাদেশে। উনসত্তরের গণআন্দোলন দেখেছি, একাত্তরের যুদ্ধ দেখেছি, মৌলবাদের লম্ফ ঝম্ফ দেখিনি। আশির দশকে ধর্মের এবং ধর্মের মহাপুরুষদের নিন্দা করে আমার যেসব কলাম ছাপা হত বাংলাদেশের জাতীয় পত্রিকায়, তা আজ কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। হ্যাঁ, সেসব কলামে ধর্ম নিয়ে আমার ভিন্নমত ছিল। আজ ভিন্নমতের কোনও স্থান বাংলাদেশের সমাজে নেই। মানুষ কী খাবে, কী পান করবে, কী গান শুনবে, কী ছবি আঁকবে, কী ভাববে, কী পড়বে, কী লিখবে, কী বলবে, কোথায় যাবে, কোথায় যাবে না, কী পোশাক পরবে, কার সঙ্গে মিশবে, কার সঙ্গে শোবে –তা বলে দেওয়ার লোক বাড়ছে। মনস্টার বাড়ছে। তাদের আদেশ অমান্য করলে রাজপথে নিজের রক্তের ওপর উপুড় হয়ে মরে পড়ে থাকতে হবে।

আমার মনে হয়, বাংলাদেশের প্রগতিশীল মানুষেরা যদি ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের শক্ত হাতে দমন করতো, তাহলে ওদের এত বাড় বাড়তো না। কী করে ভুলবো নব্বইয়ের শুরুর দিকে কী ঘটেছিল। আমার মাথার মূল্য ধার্য করা হচ্ছে, আমার ফাঁসির জন্য সারা দেশ জুড়ে মৌলবাদীরা তাণ্ডব করছে, ইসলামী ঐক্যজোট মরিয়া হয়ে উঠছে আমাকে হত্যা করার জন্য, মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে সরকার আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে, মামলা করছে, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হচ্ছে–কোনও লেখকের ওপর দেশজুড়ে অমন ভয়ংকর দুর্যোগ এর আগে আসেনি। প্রগতিশীলরা তখন বেশির ভাগই মুখ বন্ধ করে ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল বেরিয়েছে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে, কিন্তু কেউ আমার নাম উচ্চারণ করেনি। করবে কেন? নাস্তিক নারীবাদীর বিরুদ্ধে শুধু যে মৌলবাদীরাই নয়, মৌলবাদীবিরোধীরাও। পুরুষতন্ত্রবিরোধী নাস্তিক নারীবাদীদের মত প্রকাশের অধিকারে বাংলাদেশের মৌলবাদী গোষ্ঠী এবং মৌলবাদবিরোধী ধার্মিক গোষ্ঠী কোনও গোষ্ঠীই বিশ্বাস করে না। দেশসুদ্ধ লোকের সামনে আমাকে আমার দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল, এবং একুশ বছর হয়ে গেল, দেশে আজও পা রাখতে দেওয়া হয়নি। এর কোনও প্রতিবাদ সত্যিকার অর্থে হয়নি। প্রতিবাদ একা আমিই নিরলস করে গেছি। আজও করি। নিজের জন্য নয়, দেশটার জন্য করি। কারণ আমি জানি, অন্যায়ের প্রতিবাদ না করলে অন্যায়টা বড় হতে হতে অজগরের মতো হয়ে যায় আর যাকে সামনে পায়। তাকেই গিলে খায়।

মৌলবাদীদের সঙ্গে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে দেশের তথাকথিত প্রগতিশীলরা আমার বিরুদ্ধে গত দুদশক ধরে মিথ্যে অপবাদ রটিয়েছে পত্র-পত্রিকায়। প্রগতিশীল নামে খ্যাত সুবিধেবাদীগুলো চুপচাপ দেখে গেছে মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগবে এই ছুতোয় সরকার একের পর এক আমার বই নিষিদ্ধ করেছে। কোনও কোনও সময় তো নিজেরাই আদালতে গিয়ে বই নিষিদ্ধ করেছে। নারীবাদী সমিতির নির্বোধ নারীরা আমাকে দোষ দিয়েছে আমি নাকি মৌলবাদীদের উত্থানের কারণ। তাদের এটুকু বোঝার ক্ষমতা হয়নি যে আমার লেখার কারণে মৌলবাদের উত্থান হয়নি। মৌলবাদের উত্থানের পেছনে অনেক কারণের মধ্যে একটি কারণ তাদের মৌনতা এবং আপোস। মৌলবাদীরা আমাকে চায়নি, সুতরাং ওদের খুশি করার জন্য, ওদের জিতিয়ে দেওয়ার জন্য সরকার আমাকে তাড়িয়েছে। জনগণ তা মাথা পেতে মেনে নিয়েছে। এই তো ছিল ঘটনা! মৌলবাদীরা কি আর তারপর হাত গুটিয়ে গুহায় বসে থেকেছে? তারা যা ইচ্ছে তাই করার সবুজ সংকেত পেয়ে গেছে। তাই মহাউৎসাহে নেমে পড়লো একের পর এক বাক স্বাধীনতা হরণে। মুক্তচিন্তার মানুষের ওপর ক্রমাগত আঘাত আসতে লাগলো, আসলে লাগলো খুনের হুমকি, বীভৎস শারীরিক আক্রমণ, খুনের চেষ্টা, খুন।

আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, সেদিন যদি আমার ওপর মৌলবাদী আর সরকারী নির্যাতনকে রোধ করা হতো, তবে মৌলবাদীর পেশিতে হয়তো এত শক্তি আসতো না, তাদের আত্মবিশ্বাস এত ভয়ংকরভাবে বাড়তো না। যদি আমার নির্বাসনকে সেদিন বন্ধ করা যেতো, তবে মৌলবাদী অপশক্তিকে অন্তত বুঝিয়ে দেওয়া যেতো, তাদের জয় অনিবার্য নয়।

ধর্মান্ধ বর্বরদের সঙ্গে বছরের পর বছর আপোস করতে থাকলে শেষ অবধি এই দাঁড়ায়। সমাজটা পচে গলে নষ্ট হয়ে যায়। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের অবস্থা আজ পচা গলা। আশির দশকের মাঝামাঝি প্রেসিডেন্ট এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নিয়ে এলো, যদিও কেউ তাকে রাষ্ট্রধর্ম আনার জন্য অনুরোধ বা আবদার করেনি। সেই থেকে ইসলামের জয়জয়কার শুরু হয়ে গেল সমাজে। ইসলামি ব্যাংক, ইসলামি ইস্কুল, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি নার্সিং হোম, ইসলামি হাসপাতাল… সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে গেল ইসলাম, প্রবেশ করে গেল ভিনদেশি পোশাক এবং আচার আচরণ। নানা ধর্মের লোক যেখানে বাস করে, সেখানে তুমি কোনও একটা ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম বানাতে পারো না। বানালে সেই ধর্মটি অন্য ধর্মের চেয়ে গুরুত্ব বেশি পায়। এবং সেই ধর্মের মানুষেরা অন্য ধর্মের মানুষদের চেয়েও বেশি প্রাধান্য পায়, গণতন্ত্র বা সমানাধিকার বলে কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আসার পর থেকে অমুসলিম সংখ্যা কমতে কমতে, মুসলিম সংখ্যাকে আট থেকে নয়ের ঘরেও পৌঁছে দিয়েছে। এভাবে চললে ১০০ ভাগ মুসলিমের দেশ হয়ে উঠতে খুব বেশি সময় নেবে না বাংলাদেশ। ১০০ ভাগ মুসলিমের দেশ হওয়ার আভাসটা এরকমই দেখতে পাচ্ছি। অমুসলিমরা বিদেয় হলে কি মুসলিমারা সুখে শান্তিতে বসবাস করবে? আমার কিন্তু তা মনে হয় না। যত বেশি মুসলমান, তত বেশি মৃত্যু। সুন্নিরা শিয়া মারছে, নাস্তিক মারছে, আহমদিয়া মারছে; শিয়ারা সুন্নি মারছে, কাফের মারছে। তাদের হাতে শুধু তরবারির ঝনঝনানি। আইসিসরাই দেখিয়ে দিচ্ছে, খাঁটি মুসলমানের দেশ বলতে ঠিক কী বোঝায়। খাঁটি মুসলমানের দেশে ধর্মনিরপেক্ষ জিনিসটা, সত্যি বলতে কী, চলে না।

ধর্মনিরপেক্ষ জিনিসটায় আজকাল আমি বিশ্বাস করি না। কারণ আমি মনে করি না সব ধর্ম সমান। ইসলাম আর বৌদ্ধ ধর্মকে আমি সমান বলে মনে করি না। ইহুদি আর জৈন ধমকেও নয়। বর্বরতাগুলো একেক ধর্মে একেকরকম। তবে নিরপেক্ষ কী করে হবে মানুষ? যদি দুই বর্বরের মধ্যে এক বর্বরের পাশে আমাকে দাঁড়াতেই হয়, তবে তুলনায় কম বর্বরের পাশেই দাঁড়াবো। তাই নয় কি? যেহেতু ধর্মগুলো বর্বরতার দিক দিয়ে বা উদারতার দিক দিয়ে সমান নয়, তাই সকল ধর্মের প্রতি সবারই সমান শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং সকল ধর্মের প্রতি নিরপেক্ষ থাকাও সম্ভব নয়। বরং সকল মানুষকে, সে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান, ইহুদি, জৈন, শিখ, নাস্তিক যা ই হোক– সমান চোখে দেখাটা সম্ভব হতে পারে। আমি মনে করি মানুষ হিসেবে প্রত্যেকের অধিকার সমান হওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার বদলে বিশ্বাসী-নিরপেক্ষতা অথবা এরকম একটি শব্দ আমাদের ব্যবহার করা উচিত। যে কোনও ধর্মে এবং ধর্মহীনতায় বিশ্বাসীদের আমি নিরপেক্ষ ভাবেই দেখি যতক্ষণ না তারা কোনও অপরাধ করছে।

কে মেরেছে অভিজিৎকে? ফারাবি? খুনীরা কি ফেসবুকে বলে বেড়ায় আমি খুন করব? আইসিসএর রাজ্যে বলে। কিন্তু এখনো তো বাংলাদেশ পুরোপুরি আইসিস রাজ্য হয়ে ওঠেনি। আমার মনে হয় ফারাবীর চেয়েও ভয়ংকর জিহাদী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অভিজিৎকে হত্যা করেছে। যে ই করুক, খুনী ধরা পড়ুক চাই। খুনীর শাস্তি হোক চাই। আমি বরাবরই মুত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে। কিন্তু ইদানীং প্রায়ই আমার মনে হয়, আইসিসরা, বোকো হারামরা, আল শাবাবরা, আর বাংলাদেশে রাজিব হায়দার, হুমায়ুন আজাদ আর অভিজিৎ রায়ের খুনীদের মৃত্যুদণ্ড হলে আমি অখুশী হবো না।

খুনীদের যে শাস্তিই হোক, অভিজিৎ আর ফিরে আসবে না। বাঙালিকে মানুষ বানাবার স্বপ্ন আর সে দেখবে না। একজন প্রতিভাবান বাঙালিকে, যে দেশ আর দশের জন্য খুব জরুরি কাজ করছিল, বাঙালিরাই মেরে ফেললো। টিএসসির সামনে যে ফুটপাতে অভিজিৎকে খুন করা হয়েছে, তার রক্তের ওপর মস্তিষ্কের কাটা টুকরো আর তার চশমাটা ভাসছিল ঠিক যে জায়গাটায়, সে জায়গায় একটা মনুমেন্ট গড়া হোক। মুক্তমনা মনুমেন্ট। মানুষ খুব দ্রুত অতীতকে ভুলে যায়। মনুমেন্টটা থাকলে ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারবে না। মনুমেন্টটাই এ দেশের মানুষকে প্রতিদিন মনে করিয়ে দেবে যে ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, কুসংস্কার, নারীবিদ্বেষ, বৈষম্য ইত্যাদিকে পরাজিত করে মুক্তচিন্তা, বিজ্ঞানমনস্কতা, সমতা, বাক স্বাধীনতা যদি সামনে না এগোয়, তবে অচিরেই জাতি হিসেবে বাঙালির মুখ থুবড়ে পড়ে মৃত্যু ঘটবে।

অভিজিৎকে কেন মরতে হলো

কেন অভিজিৎ গেল দেশে! সম্ভবত ফেসবুকে দেওয়া হুমকিকে বড় কোনও হুমকি বলে মনে করেনি। আমাকেও তো ফেসবুকে-টুইটারে-ইমেইলে হত্যার হুমকি দেয়। লোকেরা। আমি তো গা করি না। তাঁর বাবাও বলেছিল দেশে না যেতে। দেশে না যেতে তো আমাকেও কত লোকে বলে, তারপরও তো আমি মনে করি, যে করেই হোক দেশে যাবোই আমি। অভিজিৎএর জায়গায় আমি হলে আমি হয়তো ঠিক তা-ই তা-ই করতাম, অভিজিৎ যা যা করেছে। আমাকে যদি দেশে ঢুকতে দিত সরকার, বইমেলায় আমি ঠিক ঠিক যেতাম, বিশেষ করে সে বইমেলায় যদি আমার দুটো নতুন বই বের হয়ে থাকে। একজন লেখকের জন্য বইমেলায় ঘুরে বেড়ানো, বইয়ে অটোগ্রাফ দেওয়া, পাঠকের সঙ্গে মত বিনিময় করা যে কী ভীষণ আনন্দের, তা সব লেখকই জানেন।

এখন আমি জানি, দেশে যদি বাস করতাম আমি, বা দেশে যদি কখনও বেড়াতেই যেতাম, আমাকে ঠিক এভাবে অনেক আগেই কুপিয়ে মেরে ফেলতো ওরা, যেভাবে অভিজিৎকে মেরেছে। আশি নব্বই এর দশকে বড় বড় মুফতি, ইমাম, মাদ্রাসায় পড়া মাতব্বর গোছের লোকেরা ফতোয়া দিত, মানুষের মাথার দাম ঘোষণা করতো। লক্ষ লোক মিছিল করতো, লং মার্চ করতো। আজকাল ফেসবুকে ইউনিভার্সিটির ছেলেরা মেরে ফেলার হুমকি দেয়। যাকে হুমকি দেয়, তাকে ঠিক ঠিক একদিন পেছন থেকে অতর্কিতে আক্রমণ করে, ধারালো চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মারে। চোখে পড়ার মতো এই বদলটাই সম্ভবত বাংলাদেশে গত কবছরে হয়েছে।

অভিজিতের নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখার পর দেশে ফেরার আমার যে দুর্দমনীয় ইচ্ছে ছিল, সেটি মরে পড়ে রয়েছে উপুড় হয়ে, যেভাবে অভিজিৎ পড়ে ছিল নিজের রক্তের ওপর। একুশ বছর আমি দেশে নেই, এ কারণে নিরন্তর বয়ে বেড়িয়েছি এক দুঃখের বোঝা। দুঃখগুলো এখন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ভাগ্যিস আমাকে দেশে ঢুকতে দেয়নি বাংলাদেশের কোনও সরকারই। ঢুকতে দিলে আমি দেশে ফিরতাম। আগে না জানলেও এখন বেশ জানি যে দেশে ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যে আমার নিজের রক্তের ওপর উপুড় হয়ে মরে থাকতে হতো আমাকে, কোপানো মস্তিষ্কের টুকরো ভেসে থাকতো রক্তে।

ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা একদিনে বাড়েনি বাংলাদেশে। উনসত্তরের গণআন্দোলন দেখেছি, একাত্তরের যুদ্ধ দেখেছি, মৌলবাদের লম্ফ ঝম্ফ দেখিনি। আশির দশকে ধর্মের এবং ধর্মের মহাপুরুষদের নিন্দা করে আমার যেসব কলাম ছাপা হত বাংলাদেশের জাতীয় পত্রিকায়, তা আজ কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। হ্যাঁ, সেসব কলামে ধর্ম নিয়ে আমার ভিন্নমত ছিল। আজ ভিন্নমতের কোনও স্থান বাংলাদেশের সমাজে নেই। মানুষ কী খাবে, কী পান করবে, কী গান শুনবে, কী ছবি আঁকবে, কী ভাববে, কী পড়বে, কী লিখবে, কী বলবে, কোথায় যাবে, কোথায় যাবে না, কী পোশাক পরবে, কার সঙ্গে মিশবে, কার সঙ্গে শোবে –তা বলে দেওয়ার লোক বাড়ছে। মনস্টার বাড়ছে। তাদের আদেশ অমান্য করলে রাজপথে নিজের রক্তের ওপর উপুড় হয়ে মরে পড়ে থাকতে হবে।

আমার মনে হয়, বাংলাদেশের প্রগতিশীল মানুষেরা যদি ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের শক্ত হাতে দমন করতো, তাহলে ওদের এত বাড় বাড়তো না। কী করে ভুলবো নব্বইয়ের শুরুর দিকে কী ঘটেছিল। আমার মাথার মূল্য ধার্য করা হচ্ছে, আমার ফাঁসির জন্য সারা দেশ জুড়ে মৌলবাদীরা তাণ্ডব করছে, ইসলামী ঐক্যজোট মরিয়া হয়ে উঠছে আমাকে হত্যা করার জন্য, মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে সরকার আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে, মামলা করছে, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হচ্ছে–কোনও লেখকের ওপর দেশজুড়ে অমন ভয়ংকর দুর্যোগ এর আগে আসেনি। প্রগতিশীলরা তখন বেশির ভাগই মুখ বন্ধ করে ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল। বেরিয়েছে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে, কিন্তু কেউ আমার নাম উচ্চারণ করেনি। করবে কেন? নাস্তিক নারীবাদীর বিরুদ্ধে শুধু যে মৌলবাদীরাই নয়, মৌলবাদীবিরোধীরাও। পুরুষতন্ত্রবিরোধী নাস্তিক নারীবাদীদের মত প্রকাশের অধিকারে বাংলাদেশের মৌলবাদী গোষ্ঠী এবং মৌলবাদবিরোধী ধার্মিক গোষ্ঠী কোনও গোষ্ঠীই বিশ্বাস করে না। দেশসুদ্ধ লোকের সামনে আমাকে আমার দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল, এবং একুশ বছর হয়ে গেল, দেশে আজও পা রাখতে দেওয়া হয়নি। এর কোনও প্রতিবাদ সত্যিকার অর্থে হয়নি। প্রতিবাদ একা আমিই নিরলস করে গেছি। আজও করি। নিজের জন্য নয়, দেশটার জন্য করি। কারণ আমি জানি, অন্যায়ের প্রতিবাদ না করলে অন্যায়টা বড় হতে হতে অজগরের মতো হয়ে যায় আর যাকে সামনে পায়। তাকেই গিলে খায়।

৮০

মৌলবাদীদের সঙ্গে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে দেশের তথাকথিত প্রগতিশীলরা আমার বিরুদ্ধে গত দুদশক ধরে মিথ্যে অপবাদ রটিয়েছে পত্র-পত্রিকায়। প্রগতিশীল নামে খ্যাত সুবিধেবাদীগুলো চুপচাপ দেখে গেছে মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগবে এই ছুতোয় সরকার একের পর এক আমার বই নিষিদ্ধ করেছে। কোনও কোনও সময় তো নিজেরাই আদালতে গিয়ে বই নিষিদ্ধ করেছে। নারীবাদী সমিতির নির্বোধ নারীরা আমাকে দোষ দিয়েছে আমি নাকি মৌলবাদীদের উত্থানের কারণ। তাদের এটুকু বোঝার ক্ষমতা হয়নি যে আমার লেখার কারণে মৌলবাদের উত্থান হয়নি। মৌলবাদের উত্থানের পেছনে অনেক কারণের মধ্যে একটি কারণ তাদের মৌনতা এবং আপোস। মৌলবাদীরা আমাকে চায়নি, সুতরাং ওদের খুশি করার জন্য, ওদের জিতিয়ে দেওয়ার জন্য সরকার আমাকে তাড়িয়েছে। জনগণ তা মাথা পেতে মেনে নিয়েছে। এই তো ছিল ঘটনা! মৌলবাদীরা কি আর তারপর হাত গুটিয়ে গুহায় বসে থেকেছে? তারা যা ইচ্ছে তাই করার সবুজ সংকেত পেয়ে গেছে। তাই মহাউৎসাহে নেমে পড়লো একের পর এক বাক-স্বাধীনতা হরণে। মুক্তচিন্তার মানুষের ওপর ক্রমাগত আঘাত আসতে লাগলো, আসলে লাগলো খুনের হুমকি, বীভৎস শারীরিক আক্রমণ, খুনের চেষ্টা, খুন।

আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, সেদিন যদি আমার ওপর মৌলবাদী আর সরকারী নির্যাতনকে রোধ করা হতো, তবে মৌলবাদীর পেশিতে হয়তো এত শক্তি আসতো না, তাদের আত্মবিশ্বাস এত ভয়ংকরভাবে বাড়তো না। যদি আমার নির্বাসনকে সেদিন বন্ধ করা যেতো, তবে মৌলবাদী অপশক্তিকে অন্তত বুঝিয়ে দেওয়া যেতো, তাদের জয় অনিবার্য নয়।

ধর্মান্ধ বর্বরদের সঙ্গে বছরের পর বছর আপোস করতে থাকলে শেষ অবধি এই দাঁড়ায়। সমাজটা পচে গলে নষ্ট হয়ে যায়। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের অবস্থা আজ পচা গলা। আশির দশকের মাঝামাঝি প্রেসিডেন্ট এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নিয়ে এলো, যদিও কেউ তাকে রাষ্ট্রধর্ম আনার জন্য অনুরোধ বাআবদার করেনি। সেই থেকে ইসলামের জয়জয়কার শুরু হয়ে গেল সমাজে। ইসলামি ব্যাংক, ইসলামি ইস্কুল, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি নার্সিং হোম, ইসলামি হাসপাতাল….. সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে গেল ইসলাম, প্রবেশ করে গেল ভিনদেশি পোশাক এবং আচার আচরণ। নানা ধর্মের লোক যেখানে বাস করে, সেখানে তুমি কোনও একটা ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম বানাতে পারো না। বানালে সেই ধর্মটি অন্য ধর্মের চেয়ে গুরুত্ব বেশি পায়। এবং সেই ধর্মের মানুষেরা অন্য ধর্মের মানুষদের চেয়েও বেশি প্রাধান্য পায়, গণতন্ত্র বা সমানাধিকার বলে বলে কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আসার পর থেকে অমুসলিম সংখ্যা কমতে কমতে, মুসলিম সংখ্যাকে আট থেকে নয়ের ঘরেও পৌঁছে দিয়েছে। এভাবে চললে ১০০ ভাগ মুসলিমের দেশ হয়ে উঠতে খুব বেশি সময় নেবে না বাংলাদেশ। ১০০ ভাগ মুসলিমের দেশ হওয়ার আভাসটা এরকমই দেখতে পাচ্ছি। অমুসলিমরা বিদেয় হলে কি মুসলিমারা সুখে শান্তিতে বসবাস করবে? আমার কিন্তু তা মনে হয় না। যত বেশি মুসলমান, তত বেশি মৃত্যু। সুন্নিরা শিয়া মারছে, নাস্তিক মারছে, আহমদিয়া মারছে; শিয়ারা সুন্নি মারছে, কাফের মারছে। তাদের হাতে শুধু তরবারির ঝনঝনানি। আইসিসরাই দেখিয়ে দিচ্ছে, খাঁটি মুসলমানের দেশ বলতে ঠিক কী বোঝায়। খাঁটি মুসলমানের দেশে ধর্মনিরপেক্ষ জিনিসটা, সত্যি বলতে কী, চলে না।

ধর্মনিরপেক্ষ জিনিসটায় আজকাল আমি বিশ্বাস করি না। কারণ আমি মনে করি না সব ধর্ম সমান। ইসলাম আর বৌদ্ধ ধর্মকে আমি সমান বলে মনে করিনা। ইহুদি আর জৈন ধমর্কেও নয়। বর্বরতাগুলো একেক ধর্মে একেকরকম। তবে নিরপেক্ষ কী করে হবে মানুষ? যদি দুই বর্বরের মধ্যে এক বর্বরের পাশে আমাকে দাঁড়াতেই হয়, তবে তুলনায় কম বর্বরের পাশেই দাঁড়াবো। তাই নয় কি? যেহেতু ধর্মগুলো বর্বরতার দিক দিয়ে বা উদারতার দিক দিয়ে সমান নয়, তাই সকল ধর্মের প্রতি সবারই সমান শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং সকল ধর্মের প্রতি নিরপেক্ষ থাকাও সম্ভব নয়। বরং সকল মানুষকে, সে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান, ইহুদি, জৈন, শিখ, নাস্তিক যাই হোক– সমান চোখে দেখাটা সম্ভব হতে পারে। আমি মনে করি মানুষ হিসেবে প্রত্যেকের অধিকার সমান হওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার বদলে বিশ্বাসী-নিরপেক্ষতা অথবা এরকম একটি শব্দ আমাদের ব্যবহার করা উচিত। যে কোনও ধর্মে এবং ধর্মহীনতায় বিশ্বাসীদের আমি নিরপেক্ষ ভাবেই দেখি যতক্ষণ না তারা কোনও অপরাধ করছে।

কে মেরেছে অভিজিৎকে? ফারাবি? খুনীরা কি ফেসবুকে বলে বেড়ায় আমি খুন করব? আইসিসএর রাজ্যে বলে। কিন্তু এখনো তো বাংলাদেশ পুরোপুরি আইসিস রাজ্য হয়ে ওঠেনি। আমার মনে হয় ফারাবীর চেয়েও ভয়ংকর জিহাদী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অভিজিৎকে হত্যা করেছে। যে-ই করুক, খুনী ধরা পড়ক চাই। খুনীর শাস্তি হোক চাই। আমি বরাবরই মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে। কিন্তু ইদানীং প্রায়ই আমার মনে হয়, আইসিসরা, বোকো হারামরা, আল শাবাবরা, আর বাংলাদেশে রাজিব হায়দার, হুমায়ুন আজাদ আর অভিজিৎ রায়ের খুনীদের মৃত্যুদণ্ড হলে আমি অখুশী হবো না।

খুনীদের যে শাস্তিই হোক, অভিজিৎ আর ফিরে আসবে না। বাঙালিকে মানুষ বানাবার স্বপ্ন আর সে দেখবে না। একজন প্রতিভাবান বাঙালিকে, যে দেশ আর দশের জন্য খুব জরুরি কাজ করছিল, বাঙালিরাই মেরে ফেললো। টিএসসির সামনে যে ফুটপাতে অভিজিৎকে খুন করা হয়েছে, তার রক্তের ওপর মস্তিষ্কের কাটা টুকরো আর তার চশমাটা ভাসছিল ঠিক যে জায়গাটায়, সে জায়গায় একটা মনুমেন্ট গড়া হোক। মুক্তমনা মনুমেন্ট। মানুষ খুব দ্রুত অতীতকে ভুলে যায়। মনুমেন্টটা থাকলে ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারবে না। মনুমেন্টটাই এ দেশের মানুষকে প্রতিদিন মনে করিয়ে দেবে যে ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, কুসংস্কার, নারীবিদ্বেষ, বৈষম্য ইত্যাদিকে পরাজিত করে মুক্তচিন্তা, বিজ্ঞানমনস্কতা, সমতা, বাক স্বাধীনতা যদি সামনে না এগোয়, তবে অচিরেই জাতি হিসেবে বাঙালির মুখ থুবড়ে পড়ে মৃত্যু ঘটবে।

অভিজিৎকে যেভাবে চিনি

অভিজিএর সঙ্গে আমার পরিচয় আজ থেকে পনেরো-ষোলো বছর আগে। অভিজিৎ তখন সিঙ্গাপুরে থাকতেন। বেশ কয়েকদিনের আলাপে এবং ওঁর বেশ কিছু ব্লগ পড়ে আমি বুঝি যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, বিবর্তন, দর্শন, ধর্ম, কুসংস্কার নিয়ে অভিজিৎ আর আমার বিশ্বাসের মধ্যে কোনও অমিল নেই। আমরা মূলত একই আদর্শের মানুষ। অভিজিৎ আমার লেখা বই আগেই পড়েছেন, সুতরাং নারীবাদ, মানববাদ এবং অস্তিত্ববাদে আমার বিশ্বাসের কথা তিনি জানতেন। মুক্তমনা নামে সবে একটা ব্লগ খুলছেন তখন। মুক্তমনার জন্মটা একেবারে আমার চোখের সামনে। মুক্তচিন্তায় আর যুক্তিবাদে বিশ্বাসী যে কোনও মানুষই তাঁদের মত প্রকাশ করতে পারবেন মুক্তমনায়। এর চেয়ে চমৎকার ঘটনা আর কী হতে পারে, বিশেষ করে আমার কাছে, যার বাক স্বাধীনতা প্রায় নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের প্রকাশকরা তখন আমার বই ছাপানো বন্ধ করে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে আজ বই বেরোয় তো বাংলাদেশে পরদিন সে বই নিষিদ্ধ হয়ে যায়। দেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর থেকেই দেশের সমস্ত পত্রপত্রিকা আমার লেখা ছাপানোও বন্ধ করে দিয়েছে। তারা কি আমাকে ভুলে গিয়েছে, না, ভুলে যায়নি, ভুলে গেলে আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতেও ভুলে যেত, ওটি কিন্তু ভোলেনি। আমার মত অন্য অনেকের মতের চেয়ে ভিন্ন। এ কারণে আমাকে নিরন্তর পোহাতে হয়েছে দুর্ভোগ। অভিজিৎএর মুক্তমনা আমার মত প্রকাশের জন্য ছিল খুব প্রয়োজনীয় প্ল্যাটফর্ম। যে কথা আমি কোথাও বলতে পারিনি, সবসময় জানতাম সে কথা বলার জন্য একটি মাত্র জায়গা যদি কোথাও থাকে, সে মুক্তমনা। বিস্মিত আমি লক্ষ্য করি, আমি একা নই। অভিজিৎও একা নন। আমাদের মতের সঙ্গে আরও অনেক সাহসী উজ্জ্বল তরুণ-তরুণী একমত। সবাই বাঙালি। বেশির ভাগই বাঙালি মুসলিম পরিবারের, কিন্তু ধর্মমুক্ত। আমি যে কী ভীষণ উত্তেজিত এবং উচ্ছ্বসিত ছিলাম মুক্তমনা নিয়ে। প্রগতিশীল কারও সঙ্গে দেখা হলে মুক্তমনা পড়তে অনুরোধ করতাম। পৃথিবীর অনেক মানুষের অনেক মতই অন্য অনেকের মতের চেয়ে ভিন্ন। বিভিন্ন বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের বিভিন্ন মত প্রকাশ, আর একই সঙ্গে বিভিন্ন মত নিয়ে আলোচনা চলতে লাগলো মুক্তমনায়। মুক্তমনা দিন দিন সমৃদ্ধ হতে থাকে। বিস্তৃত হতে থাকে। একটা অশিক্ষিত মৌলবাদী মানুষের দেশ আমার দেশ–এই ভাবনাটি আমাকে মাথা নত করিয়েছিলো, অভিজিএর মুক্তমনা আমার নতমস্তক উঁচু করিয়েছে। ওই মুক্তমনার ব্লগগুলো, বিজ্ঞান আর দর্শন নিয়ে আলোচনাগুলো মানুষকে পড়তে দিয়ে আমি বলতে পেরেছি, আমার দেশেও শিক্ষিত সচেতন মানুষ আছেন, বুদ্ধিজীবী,বিজ্ঞানী আছেন, দার্শনিক আছেন, ধর্মমুক্ত, কুসংস্কারমুক্ত, চিন্তক, ভাবুক আছেন। ওই সময় ইংরেজিতে লেখা হতো ব্লগ। পরে বাংলা শুরু হয়েছি। ধীরে ধীরে লক্ষ্য করেছি, বাঙালি ছাড়াও ভিনভাষী বিজ্ঞানমনস্ক নিরীশ্বরবাদী আসছেন মুক্তমনায়।

অভিজিৎ রায় বয়সে আমার চেয়ে প্রায় আট-ন বছরের ছোট। কিন্তু স্নেহ নয়, ওঁকে আমি সবসময় শ্রদ্ধা করেছি। বিজ্ঞানের এবং দর্শনের যে সব কঠিন জটিল খুঁটিনাটি সাধারণের পাঠযোগ্য করে অভিজিৎ একের পর এক বই লিখে গেছেন, আমার পক্ষে সেসব লেখা কখনই সম্ভব হতো না। অভিজিৎ রায়ের মতো ধৈর্য আর ধীশক্তি আমার নেই। ওঁর সঙ্গে কখনও আমার সামনাসামনি দেখা হয়নি। কিন্তু কখনও মনে হয়নি দেখা হয়নি। বিশ্বাসে কোনও দুরত্ব না থাকলে বসবাসের জায়গার দুরত্বটাকে ঠিক দুরত্ব বলে কখনও মনে হয় না। এই তো গত বছরের ডিসেম্বরে যখন ফোনে কথা হলো, আমি তখন নিউইয়র্কে। অভিজিৎ অনেকক্ষণ নানা বিষয়ে কথা বলার পর বললেন জর্জিয়ায় ওঁর বাড়িতে বেড়াতে যেতে। কয়েকদিনের জন্য একবার সত্যি যাবো, কথা দিয়েছিলাম। অভিজিৎ আর তাঁর স্ত্রী কন্যার সঙ্গে জমিয়ে আড়া হবে ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম এ বছরের গ্রীষ্মে নয়তো শরতে। অভিজিৎএর সঙ্গে যে আমার কখনও আর দেখা হবে না, অভিজিৎ যে এই পৃথিবীতে আর মাত্র মাস তিনেকও নেই, তা কি আমি জানতাম! তা কি আমার চরম দুঃস্বপ্নের মধ্যেও ছিল! অভিজিৎএর সঙ্গে দেখা না হলেও ওঁর বাবা অজয় রায়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। আমার কলকাতার বাড়িতে গিয়েছিলেন তিনি, তাও প্রায় দশ বছর হয়ে গেল। সজ্জন, সচেতন, উদার, আদর্শবান শিক্ষাবিদ মানুষটির স্নেহ এবং সমর্থন আমি অনেককাল থেকে পাচ্ছিলাম। আমার যে কোনও দুর্যোগে দুঃসময়ে তিনি পাশে দাঁড়াতেন। আমার জন্য দুশ্চিন্তা করতেন। আমাকে না আবার হাতের কাছে পেলে কুপিয়ে মেরে ফেলে। হিংস্র বর্বর মৌলবাদীর দল! মৌলবাদীর দল মেরেছে কুপিয়ে, তবে আমাকে নয়, হাতের কাছে পেয়েছে ওরা আমার চেয়েও বেশি প্রতিভাবান, আমার চেয়েও বেশি জ্ঞানী যুক্তিবাদী অভিজিৎ রায়কে, অজয় রায়ের হীরের টুকরো ছেলেকে।

এখনও আমারকাছে এ অবিশ্বাস্য একটি ঘটনা যে অভিজিৎ নেই। তাঁকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে মেরেছে ইসলামী মৌলবাদীরা। আমি ওদের দুর্বৃত্ত বলছি না, ইসলামী মৌলবাদী বলছি। জেনেবুঝেই বলছি। ইসলামী সন্ত্রাসীরাই অভিজিৎকে দুবছর যাবৎ খুন করার হুমকি দিচ্ছিল ফেইসবুকে। ওদের অ্যাকাউন্ট ব্লকও করা হয়নি, এদের গ্রেফতারও করা হয়নি। বরং নাস্তিকদের অ্যাকাউন্ট ঘন ঘন উধাও করে দেওয়া হয়, চরম হেনস্থাও করা হয়। চাইলে খুনীদের নাড়িনক্ষত্র বের করে ফেলা সরকারের জন্য কঠিন নয়। সরকারকে তো চাইতে হবে। প্রধানমন্ত্রীও জনসমক্ষে এই বীভৎস মৃত্যু নিয়ে একটি শব্দ উচ্চারণ করলেন না। হয়তো অভিজিৎএর খুনীদের কোনও শাস্তি হবে না, যেমন হয়নি রাজিব, হুমায়ুন হত্যার খুনীদের। বাংলাদেশের এই নোংরা রাজনীতিকে আমি ঘৃণা করি। আমি ঘৃণা করি বাংলাদেশের নোংরা কুৎসিত রাজনীতিকে।

কোটি মানুষের ভিড়ে অন্ধকারে অভিজিৎ ছিলেন আলো হাতে দাঁড়িয়ে। অভিজিৎ বিদেশে থাকতেন বটে, কিন্তু তিনি বাংলায় বই লিখতেন, ব্লগ লিখতেন, ফেইসবুক লিখতেন। অশিক্ষিত আর অজ্ঞানকে জ্ঞান দিতেন, শিক্ষিত করতেন। লিখেছেন আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে, অবিশ্বাসের দর্শন, শূন্য থেকে মহাবিশ্ব, স্বতন্ত্র ভাবনার মতো অনেক মূল্যবান গ্রন্থ। অভিজিৎ রায় বাংলা আর বাঙালির জন্য ছিলেন অমূল্য সম্পদ। বাংলাদেশের ধর্মান্ধদের সেকথা বোঝার কোনও কথা নয়। কিন্তু সরকারের বোঝা উচিত ছিল। সরকারের উচিত ছিল অভিজিৎএর জন্য কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। অভিজিৎ এবার দেশে গেছেন তাঁর মাকে দেখতে, বইমেলায় ঘুরতে, নিজের দুটো বইএর মোড়ক উন্মোচনে অংশ নিতে। যে কোনও বাঙালি লেখককের জন্য বাংলা বইমেলার আকর্ষণ অদম্য। আমি দুই বাংলা থেকেই বিতাড়িত এক বাঙালি লেখক, দুই বাংলার কোনও বইমেলায় যাওয়ার কোনও অধিকার আমার নেই। আমি বুঝি আমি কী হারাচ্ছি। বাংলার দুর্ভাগা কূপমণ্ডুকরা তাদের অমূল্য সম্পদকে শুধু পায়ে ঠেললোই না, কুপিয়ে মেরে ফেললো। শুনেছি মুসলিম মৌলবাদীরা নাকি বলেছে, অভিজিৎ হিন্দু ছিল, মুসলমানের ধর্ম নিয়ে নিন্দা করেছিল, মরেছে, বেশ হয়েছে। আবার ভারতের কিছু হিন্দু মৌলবাদী বলছে, ঢাকার রাস্তা ভিজেছে আজ হিন্দুর রক্তে। মুসলিমরা মেরে ফেলেছে অভিজিৎ রায় নামের এক হিন্দুকে। ভুল সংশোধনটা এখনই হয়ে যাক। অভিজিৎ রায় হিন্দু ছিলেন না। হিন্দু ছিলেন না অভিজিৎ। অভিজিৎ হিন্দু ছিলেন না। অভিজিৎ রায় হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করতেন না। অভিজিৎ ছিলেন সকল ধর্মমুক্ত বিশুদ্ধ পবিত্র মানুষ, মানববাদী। আমি যেমন মুসলমান নই, আমি যেমন ধর্মমুক্ত, মানববাদী।

পৃথিবীকে সুস্থ সুন্দর বাসযোগ্য করার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন অভিজিৎ রায়। এরকম নিঃস্বার্থ সবাই হয় না, হতে পারে না। একদিন অভিজিৎ আমার কাছে আসিফ মহীউদ্দিনের ওপর যা যা লিখেছি, সব চাইলেন। তিনি অনেকের লেখা জড়ো করে, অনেকের উদ্ধৃতি দিয়ে, অনেকের সই নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। পৃথিবীর সব মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী মানববাদী সংগঠনগুলোকে আসিফের ব্যাপারে জানিয়েছিলেন অভিজিৎ, অনুরোধ করেছিলেন আসিফকে মৌলবাদীর কবল থেকে বাঁচিয়ে আনার জন্য। আসিফের ওপর মৌলবাদী আর সরকারী হামলার পর আমি ইংরেজিতে এবং বাংলায় কিছু ব্লগ লিখেছিলাম ওর সমর্থনে। আসিফকে বাঁচানোর জন্য আমি আর কী করেছি, অভিজিৎ করেছেন শতগুণ। আসিফ আজ অনিশ্চয়তা, অনিরাপত্তা, হত্যার হুমকি আর মৃত্যুর ঝুঁকি থেকে বেরিয়ে একটি নিরাপদ দেশে বাস করছে, সেখানে বসে ও নিশ্চিন্তে ভাবতে পারছে, লিখতে পারছে, এর পেছনে অভিজিৎএর অবদান সম্ভবত প্রায় সবটুকুই। আসিফ বেঁচেছে। অভিজিৎ নিজেকে বাঁচাতে পারেননি। আমরাও পারিনি অভিজিৎকে বাঁচাতে। কিছু কিছু মানুষ আছেন যাঁরা অন্যকে বাঁচানোর জন্য পৃথিবীতে বেঁচে থাকেন, নিজেকে বাঁচানোর জন্য নয়। অভিজিৎ রায় ছিলেন সেরকম দুর্লভ একজন মানুষ।

অসম্মান

একটি মেয়েকে গাছের সঙ্গে বেঁধে পেটানো হচ্ছে। এই দৃশ্যটি কিছুদিন আগে বাংলাদেশের কোনও এক পত্রিকায় দেখি। মেয়েটি গ্রামের কোনও অশিক্ষিত মেয়ে নয়। নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী। নাম ববিতা। তো, এমন একটি শিক্ষিত মেয়েকে কারা জনসমক্ষে পেটাচ্ছে! পেটাচ্ছে তার শ্বশুরবাড়ির লোক। পেটানোর লোকদের লিস্টটা বেশ লম্বা। পেটাচ্ছে স্বামী শফিকুল, ভাসুর হাসান শেখ, শ্বশুর ছালাম শেখ, শাশুড়ি জিরিন আক্তার, চাচাশ্বশুর কালাম শেখ, প্রতিবেশী নান্নু শেখ ও পদ্মবিলা গ্রামের আজিজুর রহমান আরজুসহ আরও অনেকে। একটা একুশ বছর বয়সী মেয়েকে এতগুলো পুরুষ বাঁশ দিয়ে পেটালো। কী ভয়ংকর কাণ্ড। মেয়েটির মরে যাওয়ার কথা। মরেনি, তবে হাসপাতালে।

ঘটনা যতটুকু শুনেছি, তা হলো, ববিতার সঙ্গে শফিকুল নামের এক সেনার পরিচয়, প্রেম, এবং বেশ কয়েক বছর পর দুজনের গোপনে বিয়েও হয়। এরপর যখন প্রশ্ন ওঠে ববিতার শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার, তখন থেকেই শফিকুল তাকে আর স্ত্রী বলে স্বীকৃতি দেয়নি। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে অপমানিত আর নির্যাতিত হয়ে ফিরে এসেছে ববিতা। একসময় অতিষ্ঠ হয়ে স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করে সে। শেষ অবধি কী হয়! ববিতাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে আত্মীয় স্বজন ডেকে গাছের সঙ্গে বেঁধে পেটায় শফিকুল। শফিকুলের নাকি এক স্ত্রী আছে। ববিতার সঙ্গে তার কখনও বিয়ে হয়েছে বলে সে স্বীকার করে না।

এরকম ঘটনা অনেক ঘটে বাংলাদেশের সর্বত্র। ঘরের ভেতর বধূ নির্যাতন প্রতিদিনই হচ্ছে। বধুকে হত্যা করা হচ্ছে। খুনকে আত্মহত্যা বলে প্রচার করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বাজারের মধ্যে নিয়ে হাজার লোককে দেখিয়ে মেয়েদের অপকর্মের শাস্তি দেয় পুরুষরা। পুরো উলঙ্গ করে গ্রাম জুড়ে তাদের হাঁটানো হয়। এসবের পরও দেখি দোষীরা শাস্তি পায় না। আমি তো বলবো নড়াইলে বধূনির্যাতনের কারণে যেভাবে স্বামী আর শ্বশুর-ভাসুরদের পুলিশ ধরে নিয়ে গেলো, সেভাবে অত শীঘ্র অন্য কোনও বধূরা সুবিচার পায় না। বধূ নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর আইন থাকা অত্যন্ত জরুরি। ভারতে ৪৯৮(এ) নামে এক আইন আছে, যেখানে মেয়েরা অভিযোগ করা মাত্র অত্যাচারী স্বামী শ্বশুরদের গ্রেফতার করা হয়। জামিন পাওয়া ওই আইনে সহজ নয়।

বাংলাদেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের পুরুষের সম্পত্তি বলে ভাবা হয়। সে কারণে সব পুরুষ মিলে একটা মেয়েকে নির্যাতন করতে দ্বিধা করে না। ববিতা সাহসী মেয়ে, সাহসী মেয়ে বলেই সে আদালতের সাহায্য চেয়েছে। বেশির ভাগ মেয়েই আদালতে যেতে চায় না। ওখানে মেয়েদের ভোগান্তি তো কম নয়! উকিলরাই অসম্মান করে। স্বামীর বাড়ি থেকে হুমকি আসে। তাছাড়া গাঁটের পয়সা প্রচুর যায়। ববিতার পাশে সমাজের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যেন দাঁড়ায়। ববিতাকে দেখে যেন আরও মেয়েরা সাহস অর্জন করে। অপরাধীদের ক্ষমা করে দেওয়ার অভ্যেসটা মেয়েদের এবার ত্যাগ করতে হবে।

মেয়েদের এই শ্বশুরবাড়ি থাকার নিয়মটা যে কবে শেষ হবে। ছেলে মেয়ে বিয়ে করবে, তো ছেলের বাপের বাড়িতে কেন মেয়েকে বাস করতে হবে। দুজনে মিলে আলাদা থাকার ব্যবস্থা চালু হওয়া উচিত। শ্বশুরবাড়ির সকলের সেবাযত্ন করার ভার মেয়ের ওপর পড়ে। এ তো সেকালের বউ আনার নাম করে বাড়িতে দাসি আনার মতো। মেয়েদের সমানাধিকারের কথা যদি ওঠেই, স্বামীর হাত ধরে একটা পরনির্ভর বস্তুর মতো শ্বশুরবাড়ি কেন বাস করতে যাবে মেয়েরা? তোমরা বিয়ে করেছো, তোমরা এইবার নিজেদের সংসার শুরু করবে। আলাদা বাড়িতে সংসার সাজাবে। শ্বশুরবাড়িতে না বাস করেও কিন্তু আত্মীয় স্বজন সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখা যায়। আসলে দুরে থাকলেই সেই সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো থাকে। স্ত্রী দাসি নয়। স্ত্রী একসঙ্গে জীবন কাটানোর সঙ্গী, বান্ধবী, প্রেমিকা। কজন ঠিক এভাবে ভাবে? এভাবে ভাবে না বলেই স্ত্রীকে দাসী হিসেবে এবং সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে বাড়িতে রেখে দেওয়া হয়। আর বাইরে বান্ধবী বা প্রেমিকা যোগাড় করে নেয় পুরুষেরা।

এইসব নিয়ম কবে দূর হবে মাঝে মাঝে ভাবি। কোনও লক্ষণ দেখি না দুর হওয়ার। মেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছে, টাকা পয়সা উপার্জন করছে, কিন্তু স্বনির্ভর হচ্ছে না, সচেতন হচ্ছে না। সত্যি কথা, হতে দেওয়া হচ্ছে না। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা পুরুষের ভেতর থেকে তো দুর হচ্ছে না, মেয়েদের ভেতর থেকেও দুর হচ্ছে না। মেয়েরা হাজার বছর ধরে যে নিয়মের মধ্যে বংশ পরম্পরায় বেড়ে উঠেছে, সেই নিয়মের বাইরে যাওয়ার সাধ্য তাদের নেই। বাইরে গেলে যে অসম্মান, যে গ্লানি, যে দুর্ভোগ তাদের পোহাতে হয়, তা পোহানোর শক্তি সবার থাকে না। সেই শক্তি যেন মেয়েদের না থাকে, তেমন করেই মেয়েদের বড় করা হয়।

নড়াইলের মেয়ে ববিতা যেন কোনও অবস্থাতেই শফিকূলকে স্বামী হিসেবে মেনে না নেয়। এই অবিবেচক প্রতারক লোকটির সঙ্গে যেন সংসার না করে, এর সঙ্গে যেন কোনও সন্তান না নেয়। জীবনে কোনও ভালো পুরুষের দেখা যদি মেলে, তবেই যেন তার সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়। যদি না পায় ভালো কোনও হৃদয়বান পুরুষ, তবে যেন একা থাকে। যেন স্বনির্ভর হয়। নিজের পায়ে দাঁড়ায়। মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। অবশ্য নিজের পায়ে দাঁড়ানোটাও নারী বিদ্বেষী সমাজে খুব সহজ নয়। নারী বিদ্বেষী পুরুষরা কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের হেনস্থার চূড়ান্ত করে। সহজ নয় কাজটিই নারীদের করতে হবে। কারণ স্বনির্ভর না হলে, যে পরনির্ভর জীবন তাদের জুটবে, সেটা আরও কঠিন, আরও ভয়ংকর। নারীদের পদে পদে কণ্টক। নারীর পথ কখনও কোনওদিন মসৃণ ছিল না।

পুরুষরা যে সমাজ বানিয়েছে, তা নারীকে অসম্মান করার জন্য। ববিতার অসম্মান আমরা চোখে দেখেছি। সাধারণত ঘরের দরজা বন্ধ করে মেয়েদের খুঁটিতে বেঁধে এভাবেই স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির লোকরা নির্যাতন করে। রান্নাঘরে ঢুকিয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয় শরীরে। লোকে যেন মনে করে রান্না করার সময় দুর্ঘটনা ঘটেছে। গলা টিপে মেরে ফেলে মৃত শরীর ঝুলিয়ে দেয় কড়িকাঠে নয়তো সিলিং ফ্যানে। ববিতার স্বামী শ্বশুররা ববিতাকে বাড়ির বাইরে নিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে মেরেছে বলে এ খবর জানাজানি হয়েছে। ফটো তুলে পত্রিকায় দিয়েছে বলে আরও জানাজানি হয়েছে। জানাজানি হয়েছে বলেই কিছু লোক প্রতিবাদ করছে। তা না হলে নড়াইলের লোকরাও মুখ বুজেই থাকতো। মেয়েরা অন্যায় করলে শাস্তি তো পুরুষরাই দেবে। এরকমই তো নিয়ম। শফিকুল নিজেকে ববিতার স্বামী হিসেবে না মানলেও নির্যাতন করার অধিকার রাখে বলেই বিশ্বাস করে। অধিকার পুরুষ হিসেবেই রাখে। পুরুষরা এই সমাজে নারীর অভিভাবক, এবং মালিক। সে কারণেই শফিকূলের পাড়াপড়শিরাও এসেই ববিতা-নির্যাতনে অংশ নিয়েছে।

মাঝেমাঝে ভাবলে গাশিউরে ওঠে, কী করে এই নারীবিদ্বেষী সমাজে আমি বেড়ে উঠেছি, স্বনির্ভর হয়েছি, আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচেছি। তা কি আর সহজ ছিলো? শিক্ষিত পরিবারে জন্ম নিয়েও, স্বনির্ভর হয়েও, আমার পথচলা সহজ হয়নি বাংলাদেশে। পদে পদে বাধা ছিল। আমিই যদি অত বাধার মুখোমুখি হই, তবে অন্যরা কতো বড় বাধার সামনে পড়ে তা অনুমান করতে পারি। প্রতিটি সিঁড়ি নারীকে ভাঙতে হয়, যে সিঁড়িগুলোর প্রতিটিই এক একটি মৃত্যুফাঁদ। পুরুষের সিঁড়ি পুরুষরা বানিয়েছে তরতর করে উঠে যাওয়ার জন্য। এমনি বৈষম্যের পৃথিবীতে বাস করি আমরা। পুরুষদের বড় ভালোবেসে বাস করি। পুরুষদের বড় আপন ভেবে বাস করি। পুরুষদের তৈরি এই বৈষম্য নিয়ে প্রশ্ন করলে আমাদের পুরুষবিদ্বেষী বলে গালি দেয় পুরুষরা। আমরা এই গালিকে ভীষণ ভয় পাই। তাই হাসিমুখে বরণ করি পুরুষের দেওয়া সকল নির্যাতন। আমাদের তো সহিষ্ণ হতে হবে। পুরুষরা অনেক আগেই বলে দিয়েছে আমদের হতে হবে ধরিত্রীর মতো সহিষ্ণ। আমরা তা ই হতে চেষ্টা করি। আর যদি ববিতার মতো অবাধ্য হই, তবে তো সমাজের সবাই মিলে আমাদের বাঁশ দিয়ে পেটাবে। সে কি আমরা জানি না? ববিতার ঘটনা আমাদের সবার জীবনেই ঘটে। একটু অন্যরকম করে ঘটে, এই যা।

অসহিষ্ণুতা

অন্যের মত, আদর্শ, বিশ্বাস, ব্যবহার যারা মানতে আগ্রহী নয়, তাদেরই অসহিষ্ণু বলি আমরা। ইদানীং শিক্ষিত শহুরে লোকরা ভারতে অসহিষ্ণতা বাড়ছে কি না এ নিয়ে বিতর্কে মেতেছেন। বেশির ভাগ লোকই এই বিতর্কের কথা না জেনে, যেমন অসহিষ্ণ তেমনই থেকে যাচ্ছেন। এখনও নারীর প্রতি পুরুষ অসহিষ্ণু। এখনও গরিবের প্রতি ধনী অসহিষ্ণু। এখনও এক ধর্মের লোক আরেক ধর্মের লোকদের প্রতি, এক রাজনৈতিক বিশ্বাসের মানুষ আরেক রাজনৈতিক বিশ্বাসের মানুষের প্রতি অসহিষ্ণু। খুন খারাবি করলেই সে অসহিষ্ণ, তা না হলে নয়, তা তো নয়। যারা গোমাংস খাওয়ার অপরাধে মুসলমানদের খুন করেছে, হিন্দু ধর্মের বা কুসংস্কারের নিন্দা করেছিলেন বলে কালবুরগিকে যারা খুন করেছে, তারা শুধু অসহিষ্ণু নয়, তারা বর্বর, ধর্মান্ধ খুনী, ক্রিমিনাল।

লেখক বুদ্ধিজীবীদের অনেকে তাঁদের পুরস্কার ফিরিয়ে দিচ্ছেন। প্রতিবাদের এ এক নতুন রূপ। যে যেভাবে প্রতিবাদ করতে পছন্দ করেন, সেভাবে করছেন। অনেকে বলছেন, রুশদির বই যখন নিষিদ্ধ করা হলো, তাঁকে যখন কলকাতায় বা জয়পুর লিট ফেস্টে যেতে দেওয়া হলো না, অথবা তসলিমাকে যখন হায়দারাবাদে আক্রমণ করা হলো, তাঁকে যখন কলকাতা থেকে বা ভারত থেকে বের করে দেওয়া হলো, তখন কোথায় ছিল ওই লেখক বুদ্ধিজীবীদের চেতনা? তখন কেন পুরস্কার ফেরত দেননি ওঁরা? মোদ্দা কথা, মুসলিম মৌলবাদীরা অন্যায় করলে তার প্রতিবাদ আপনারা করেন না, কেবল হিন্দু মৌলবাদীরা অন্যায় করলেই প্রতিবাদ করেন? যদি করেনই, আপত্তি কেন? আমি সব ধর্মীয় মৌলবাদের বিপক্ষে দাঁড়াই। কেউ যদি তা না করতে চান, যদি কেউ মনে করেন, একটি ধর্মের মৌলবাদের বিপক্ষেই তিনি দাঁড়াবেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে আমি যাবো কেন, যদি আমি মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি? বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের লেখক বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের দেশের মুসলিম মৌলবাদীদের বিপক্ষে লড়েন, হিন্দু বা ক্রিশ্চান মৌলবাদীদের বিপক্ষে নয়। নিরীহ সংখ্যালঘুর প্রতি সব দেশের বুদ্ধিজীবীদের সহানুভুতি কাজ করে। তবে ঠিক এভাবে সব দেশের সব সংখ্যালঘুকে বিচার করা চলে না। পাকিস্তানের সংখ্যালঘু হিন্দু বা ক্রিশ্চান এবং ভারতের সংখ্যালঘু ক্রিশ্চান বা মুসলমান একই রকম নিরীহ নয়, একইভাবে তারা নির্যাতিতও হয় না। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়েও মৌলবাদী থিকথিক করছে, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মৌলবাদীর চেয়ে তারাও কম যায় না। বাংলাদেশে এখনও হিন্দু মৌলবাদীরা শাস্ত্র মতে চলার পক্ষপাতী, নারীর সমানাধিকারের পক্ষে যে কোনও আইনের তারা ঘোর বিরোধী। ভারতেও একই হাল। সংখ্যালঘু মুসলমান কোরানের আইনে চলবে, সভ্য আইন নৈব নৈব চ।

অসহিষ্ণুতা নিয়ে কত কাণ্ডই না হচ্ছে। আমির খান বললেন তাঁর স্ত্রী নাকি ভারত ছাড়ার কথা উঠিয়েছেন। বাহ, অমনি শুরু হয়ে গেল আমিরের বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক। শিবসেনার কেউ কেউ তো ঘোষণা করে দিল আমির খানের গালে যে চড় মারতে পারবে, তাকে এক লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। শুনে আমার মনে পড়লোদুহাজার চার সালে কলকাতার টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম ঘোষণা করেছিল, আমার মুখে চুনকালি দিতে পারলে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার। শুধু টাকার অংকটায় আর সময়টায় পার্থক্য, তাছাড়া সব তো এক।

তারপরও আমি হিন্দু আর মুসলিম সন্ত্রাসীদের এক কাতারে রাখি না। সারা বিশ্বে আজ মুসলিম সন্ত্রাসীরা যে কাণ্ড করে বেড়াচ্ছে, তার তুলনায় হিন্দু সন্ত্রাসীরাকিছুই করছে না। আইসিস, বোকো হারাম, আল শাবাব, আল কায়দা, লস্করই তৈবা, হিজবুল্লাহ, হিজবুত তাহিরি এসবের কাছাকাছি আসতে পারবে কোনও আরএসএস, শিবসেনার দল। যেভাবে ওরা গলা কাটছে মানুষের, যে ভাবে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে, হিন্দু সন্ত্রাসীদের পক্ষে তা কোনওকালেই সম্ভব নয়। সেদিন একজন বললো, হিন্দুরা যদি মুসলিমদের মতো গলা কাটার সুযোগ পেতো, গলা কাটতো। সুযোগ পাচ্ছে না বলে করছে না।

আমির খানের বিরুদ্ধে যে কাণ্ডগুলো হচ্ছে, তাতেই প্রমাণ হচ্ছে সমাজের অসহিষ্ণুতা নিয়ে আমির খানের আশংকা একেবারেই অমূলক ছিল না। আমির খানের নিন্দুকরাই আমির খানের কথার সত্যতা প্রমাণ করছে। একবার মনে হয় আমির খান যা-ই বলুন, তাঁর মতো তারকার কখনও ভারতবর্ষ ছেড়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি আসবে না। আবার এও মনে হয়, মকবুল ফিদা হোসেনের মতো তারকার যদি সেই পরিস্থিতি আসতে পারে, আমির খানেরও আসতে পারে। দেশকে ভালোবাসেন বলেই আমির খান দেশে কোনও অরাজকতা চান না। আমিও এ দেশকে ভালোবাসি বলে চাই এ দেশে নারী পুরুষের সমতা থাকুক, অন্যায় অত্যাচার দারিদ্র বৈষম্য দূর হোক, ধর্মান্ধতা কুসংস্কার ঘুচে যাক, বাক স্বাধীনতা মুক্তি পাক, মানুষ সভ্য হোক, বিজ্ঞানমনস্ক হোক। যখন এ দেশে ঘটতে থাকা মন্দ বিভৎস ঘটনার সমালোচনা করি, এদেশি কিছু জাতীয়তাবাদী আমাকে গালি দিয়ে অনুযোগ করে, এ দেশের নিন্দা করছি আমি। কী করে বোঝাই, দেশটার ভালো চাই বলে সমোলোচনা করি, যেন মন্দ বিভৎস ঘটনা আর কখনও না ঘটে। ওই জাতীয়বাদীরা মনে করে, মন্দ বিভৎস ঘটনাগুলো কার্পেটের তলায় রেখে চোখ বুজে জোরে সোরে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে ফেললেই দেশকে ভালোবাসা হয়ে গেলো। দেশকে আমি ওদের চেয়ে অন্যভাবে ভালোবাসি। ক্ষতকে আড়াল করে নয়, ক্ষতের চিকিৎসা করে শরীরে সুস্থতা আনার পক্ষে আমি।

আমির খানকে একজন প্রশ্ন করেছে, মুম্বই হঠাৎ তাঁর কাছে হঠাৎ অনিরাপদ জায়গা হয়ে পড়ছে কেন! এত যে মুসলমানদের বোমাবাজি হলো মুম্বইয়ে, সন্ত্রাসী হামলা হলো, তখন তো আমির খান অনিরাপদ বোধ করেননি! হ্যাঁ, একেবারেই ফেলে দেওয়ার মতো কথা নয়! কিন্তু হয়তো আমির খান তখনও অনিরাপদ বোধ করেছিলেন। হয়তো প্রকাশ করেননি। হয়তো অনেকে মনে করেন, মুসলিম মৌলবাদীদের গালাগালি দেওয়ার চেয়ে হিন্দু মৌলবাদীদের গালিগালি দেওয়া নিরাপদ। এ কিন্তু একদিক থেকে প্রমাণ করে হিন্দু মৌলবাদীরা মুসলিম মৌলবাদীদের মতো ভয়ংকর নয়।

সব সমাজেই অসহিষ্ণু লোক থাকে। আমেরিকা ইউরোপেও আছে, এশিয়া আফ্রিকাতেও আছে। ভারতবর্ষকে অসহিষ্ণু আখ্যা না দিয়ে বরং অসহিষ্ণু মানুষকে অসহিষ্ণ আখ্যা দেওয়া উচিত। ভারতবর্ষের সংবিধান এবং আইন কোনওরকম অসহিষ্ণুতাকে উৎসাহ দেয় বলে আমি করি না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, যতদূর জানি, হিন্দু কট্টরপন্থীদের কোনও অসভ্য কার্যকলাপে হাততালি দেননি। কেউ কেউ বলছেন, দাদরি হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করে তাঁর উচিত ছিল আখলাকের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করা। নরেন্দ্র দাভোলকার বা গোবিন্দ পানসারেকেও তো মেরে ফেলা হয়েছে তাদের ধর্মান্ধতা আর কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলনের জন্য। অসহিষ্ণুতা তো এই সরকারের আমলেই প্রথম নয়, সব সরকারের আমলেই ঘটেছে, তখন তো সমাজ অসহিষ্ণু হয়ে যাচ্ছে, দেশ রসাতলে গেলো এরকম হাহাকার শুরু হয়নি! আসলে সত্যি বলতে কী, দেশ এবং মানুষ ধীরে ধীরে আগের চেয়ে অনেক বেশি সভ্য হচ্ছে। বর্বরতার পরিমাণ আগে অনেক বেশি ছিল এখনকার চেয়ে। এখন ধর্ণ হলে, খুন হলে, আমরা জেনে যাই। কোথাও কোনও অসহিষ্ণুতা ঘটলে মুহূর্তে ছড়িয়ে যায় খবর। এখন মানুষ জানে যে মেয়েদের পেটানো বা ন্যাংটো করে বাজারে ঘোরানো, বা ধর্ষণ করা বা প্রাণে মেরে ফেলা অন্যায়। ক্যাশিশুদের জ্যান্ত পুঁতে ফেললে মানুষ এখন ছি ছি করে। একসময় এসব কাজকে উচিত কাজ বলেই ভাবতো লোকেরা। একসময় ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচার স্বাভাবিক ছিল, এখন ওগুলো নিন্দার বিষয়। শূদ্রকে শূদ্র বলে ঘাড়ধাক্কা দেওয়াটা চোখে লাগতো না। এখন লাগে। এখন মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি মানবাধিকারে, নারীর অধিকারে, সমতা আর সমানাধিকারে বিশ্বাস করে। দীর্ঘকাল যাবৎ যে মুক্তলুদ্ধির চর্চা চলেছে সমাজে, এ তারই ফল।

ভারতবর্যে, শুধু ভারতবর্ষেই নয়, সারা পৃথিবীতেই লড়াই চলছে। এই লড়াইটা কিন্তু বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে নয়, এই লড়াই দুটো মতবাদের মধ্যে, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মৌলবাদ। লড়াইটা বিজ্ঞানমনস্কতা আর ধর্মান্ধতার মধ্যে, যুক্তিবাদিতা আর কুসংস্কারের মধ্যে, জ্ঞান আর অজ্ঞানতার মধ্যে, সচেতনতা আর অচেতনতার মধ্যে, স্বাধীনতা আর পরাধীনতার মধ্যে। এই লড়াইয়ে আমি জানি, আমি কোন পক্ষ। বিপক্ষের মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে আমি, কিন্তু তার মতকে মেনেও নিতে চাই না, শ্রদ্ধাও করতে চাই না। তার মানে এই নয় যে ভোরবেলায় বিপক্ষের কেউ যখন মর্নিং ওয়াকে বেরোবে, আমি তাকে গুলি করে মারবো বা সে যখন ফুটপাতে হাঁটতে থাকবে, তাকে আমি চাপাতি চালিয়ে খুন করবো। না, কারও মত আমার অপছন্দ হলে তাকে আমি চুমু খাবো না, তার গালে আমি চড়ও দেবো না। আমি লিখবো। লিখে আমি আমার মত প্রকাশ করি। কারও যদি আমার লেখা পছন্দ না হয়, লিখে আমার লেখার প্রতিবাদ করতে পারেন, আমার মতের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিতে পারেন, কিন্তু আমাকে মারতে আসতে পারেন না। বাক স্বাধীনতার এই শর্তটি আজকাল অনেকেই জানেন। জানলেও কিছু কিছু ধর্মীয় মৌলবাদী সন্ত্রাসী এই শর্তটি মোটেও মানতে চান না।

লক্ষ করছি হিন্দু মৌলবাদীদের একটা ভয়, হিন্দু ধর্ম আর সংস্কৃতি বুঝি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ভয় মুসলিম মৌলবাদই বা ইসলামই এর বিলুপ্তির কারণ। সুতরাং ধর্ম টিকিয়ে রাখার জন্য মুসলিম মৌলবাদীরা যে পদ্ধতি অনুসরণ করছে, তারাও তাই করছে। তারাও যুক্তিবাদীদের, বিধর্মীদের, অবিশ্বাসীদের হত্যা করতে শুরু করেছে।

এভাবে কি ধর্মটিকে থাকে? পৃথিবীতে শত শত ধর্ম ছিল। এখন তারা বেশির ভাগই বিলুপ্ত। কোথায় আজ অলিমাপিয়া পাহাড়ের সেই ডাক সাইটে গ্রীক দেবতারা, কোথায় শক্তিশালী রোমানদের নামীদামী ঈশ্বর? কোথায় মিশরীয় ফারাওদের ঈশ্বর? সব আজ ইতিহাস। ইসলাম, ক্রিস্টান ধর্ম, ইহুদি ধর্ম, বৌদ্ধ বা হিন্দু ধর্মও একসময় ইতিহাস হবে। যুগোপযোগি নতুন ধর্ম আসবে অথবা যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞানমনস্কতায় মানুষের বিশ্বাস বাড়বে।

ভারতবর্ষে অসহিষ্ণুতা নিয়ে বিতর্কে একটুখানি যা লাভের লাভ হয়েছে তা হলো প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, আশির দশকে রুশদির বই নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল। অসহিষ্ণুতা যে শুধু ধর্মীয় মৌলবাদীদের মধ্যে তা নয়, রাজনীতিকদের মধ্যেও প্রচও। পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার আমার বই নিষিদ্ধ করেছিলেন, আমাকে রাজ্য থেকে বের করে দিয়েছেন,তৃণমূল সরকার কলকাতা বইমেলায় আমার বই উদ্বোধনের অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করেছে, টিভির জন্য লেখা আমার মেগা সিরিয়াল দেখাতেই দেয়নি। সবই মুসলিম মৌলবাদীদের তোষণ করার জন্য এবং মুসলমানের ভোট পাওয়ার জন্য। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, চিদাম্বরমের মতো পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ও কি তাঁদের ভুল স্বীকার করবেন? না, তাঁরা ভুল স্বীকার করবেন না। ভুলটাই আজকের রাজনীতিকদের কাছে বাস্তবতা, যে বাস্তবতা ছাড়া, তাঁরা বিশ্বাস করেন, ভোটে জেতা সম্ভব নয়।

এভাবেই চলবে ভারতবর্ষ, যেভাবে চলছে। এভাবেই চলবে পৃথিবী। অশিক্ষা, জড়তা আর মুখর্ত চলবে শিক্ষা আর সচেতনতার পাশাপাশি। ধর্মান্ধ আর রাজনীতিক নিজেদের স্বার্থ দেখবে, সমাজটাকে অন্ধকারেই ফেলে রাখবে, শুধু সুস্থ সচেতন মানুষই সমাজ পাল্টাবে। হাতে গোণা কিছু মানুষই সমাজ পাল্টায়। চিরকাল তাই হয়েছে।

মানুষ মূলত অসহিষ্ণু। মানুষ ভালোবাসতে যেমন জানে, ঘৃণা করতেও জানে। আজ বিতর্ক হোক, বিতর্ক ছাড়া সমাজ এগোয় না। অসহিষ্ণুতার পক্ষে বিপক্ষে যা হচ্ছে, তা বেশ লাগছে। শুধু ভায়োলেন্সটা যেন না হয়। ভায়োলেন্সটা বা বর্বরতাটা মানুষের রক্তে। রক্ত থেকে এই জিনিসটা বিয়ে করতে পারলে মানুষের জয় নিশ্চিত।

 অ্যাসেম্বলি

একবার আমাকে ফ্রান্সের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে বা ফ্রেঞ্চ পার্লামেন্টে ওয়ার্ল্ড রিফিউজি ডে বা বিশ্ব শরণার্থি দিবসে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ডাকা হয়েছিল। ওই আমার প্রথম ফ্রান্সের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে ঢোকা। সেদিন পার্লামেন্টের কাণ্ড দেখে আমি তো অবাক। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কেউ চেঁচিয়ে বলেন স্পিকার আসছেন। তারপর ঝলমলে পোশাক পরা চেঁচানো লোকটি স্পিকারকে নিয়ে টয় সোলজারের মতো হেঁটে হেঁটে পার্লামেন্টে প্রবেশ করেন, হাতে মোটাসোটা একটা সোনার লাঠি। স্পিকার যখন বেরোন, তখনও একই রকম চেঁচিয়ে লোকটি বলেন, স্পিকার কক্ষ ত্যাগ করছেন। ফ্রান্স কত কিছু চুরমার করে দিল, কত নিয়ম ভেঙে দিল, কত সংস্কার পুড়িয়ে দিল, বড় বড় সিংহাসন গুঁড়িয়ে দিল,রাজা রানিকে মেরে ফেললো,আর আজও পার্লামেন্টের এই চেঁচানো বন্ধ করতে পারলো না!

দুটো ছবি এখানে। একটিতে আমি, ফ্রেঞ্চ পার্লামেন্টে, আমার পেছনে স্পিকার, আমার সামনে বিশ্বের নামী পলিটিক্যাল রিফিউজিবৃন্দ। দ্বিতীয় ছবিটি, অন্য সময় ওই একই কক্ষ।

আইসিস

ইজরাইল আর আমেরিকা আইসিসকে গড়েছে? ইজরাইল আর আমেরিকাকে তাদের অন্যায় আর নির্বুদ্ধিতার জন্য যত খুশি গালাগালি দাও। কিন্তু আইসিসের প্রতি সহানুভূতি দেখিও না। আইসিস নিরীহ মানুষদের খুন করছে। এই খুন ওরা নিজেদের বুদ্ধিতেই করছে। ইজরাইল আর আমেরিকা নয়, ওদের খুন করার প্রেরণা দিচ্ছে ওদের ধর্ম। ইজরাইল আর আমেরিকা আইসিসকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য না করলেও, খুন করার ট্রেনিং না দিলেও, ওরা খুন করতো। বাংলাদেশের ইসলামী-খুনীদের ইজরাইল। আর আমেরিকা খুন করতে শেখাচ্ছে না। চাপাতির সাপ্লাই ইজরাইল বা আমেরিকা থেকে আসছে না। ইসলামী-খুনীরা পাথর ছুঁড়ে মেয়েদের হত্যা করে, ওই পাথর ইজরাইল বা আমেরিকা থেকে আসে না। সুইসাইড ভেস্টগুলোও নিশ্চয়ই আসে না।

আচ্ছা এত প্ল্যান করে ওরা নিরীহ মানুষ হত্যা করে কেন? প্ল্যান করে যে দেশের সরকারের ওপর রাগ, সে দেশের সরকারকে মারার চেষ্টা করলেই তো পারে।

আমার দুঃখিনী বর্ণমালা

পৃথিবীর প্রায় পঁচিশ কোটি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে, বাঙালির জন্য এটি খুব বড় গৌরব। কিন্তু বাঙালি কি নিজের ভাষা নিয়ে সত্যিই গৌরবান্বিত? যে ভাষাটিকে ভালবেসে বাহান্ন সালে রাজপথে নেমেছিল অগণন বাঙালি, যে ভাষাটির জন্য মমতা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন এনেছিল এবং যে আকাশচারী স্বপ্নটিই দীর্ঘ নমাস যুদ্ধের পর হাতের মুঠোয় এসেছিল, বাঙালি কি গৌরব করে সেই স্বপ্নময় ভাষাটির জন্য? আমার মনে হয় না। পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক করুণ, ওখানে কান পাতলে ইংরেজি, হিন্দি শোনা যায়, বাংলা নয়। যেন বাংলা অচ্ছ্যুতের ভাষা। এ ভাষায় কথা বললে জাতে ওঠা যায় না, জাতে ওঠার প্রথম শর্ত নিজের ভাষা বাংলাটি ত্যাগ করা। হায় দুর্ভাগা জাতি। একটি বাংলা রাষ্ট্র হয়েও পশ্চিমবঙ্গের অফিস-আদালত সব কিছুর কাজ ইংরেজিতে হয়, দোকাঁপাটের সাইনবোর্ড হাতেগোনা বাংলা, বাদবাকি হয় ইংরেজি নয় হিন্দি। ছেলেমেয়েরা ইংরেজি স্কুলে লেখাপড়া করছে, ইংরেজি, হিন্দি ছাড়া নাকি ভবিষ্যৎ নেই। ভালো চাকরি করতে চলে যাচ্ছে বোম্বে-ব্যাঙ্গালুরু। অবাঙালি যারা পশ্চিমবঙ্গে কাজ করতে আসে, তারা সারা জীবন ওখানে থেকে যেতে পারে এক অক্ষর বাংলা না জেনে। ভিন ভাষার চাপে পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষার প্রাণ যায়-যায়। ভাষার প্রাণটি বাঁচাতে রাস্তায় নামছেন ওখানকার কিছু সচেতন বাঙালি। আন্দোলন করেও যে খুব কিছু লাভ হয়েছে বা হচ্ছে তা আমার মনে হয় না। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা বলেন, বাংলা টিকে থাকবে বাংলাদেশেই। বাংলাদেশে বাঙালির সংখ্যা বেশি, এটি কোনও দেশের ছোট্ট দারিদ্র প্রদেশ নয় যে, বাংলা রক্ষায় কোনও অশান্তি হবে। কিন্তু বাংলাদেশেই কি বাংলা রক্ষা হচ্ছে? বাংলা ভাষাকে ভালবাসে কজন? সারা দেশে কচুরিপানার মতো গজিয়ে উঠছে ইংরেজি ইস্কুল। বাচ্চাকে ইংরেজি ইস্কুলে পড়ানোর জন্য বাবা-মা আকূল। বাচ্চার মুখে বাংলা ছড়া শোনার চেয়ে ইংরেজি রাইম শুনতে তাদের আগ্রহ বেশি। বাংলা বলতে গিয়ে অযথা কিছু ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা একধরনের বাতিক বাঙালির। ইংরেজি বলতে যে জানে, তাকেই ধারণা করা হয়, শিক্ষিত। বিদ্যা জাহির করতে গেলে ইংরেজি ছাড়া উপায় নেই বলে অধিকাংশ লোকের বিশ্বাস। তো এই যখন অবস্থা তখন কী করে বলি যে, বাঙালি গৌরব করে নিজের ভাষাটি নিয়ে? অনেকে বলে অনেক ইংরেজি শব্দের বাংলা নেই, তাই নাকি ইংরেজি শব্দের এমন যথেচ্ছ ব্যবহার। বাংলা পরিভাষিকগণ, আমি ঠিক বুঝি না কী করছেন ওই আকাদেমিতে বসে? অতলান্তিকের ওপর ছোট্ট একটি দ্বীপ, আইসল্যান্ড নাম, মাত্র তিন লক্ষ লোকের বাস, সে দেশের ভাষাটির মধ্যেও কোনও রকম ইংরেজি শব্দ ঢুকতে দেয়া হয় না। প্রযুক্তি সম্পর্কিত প্রচুর ইংরেজি শব্দ এখন দ্রুত ছড়াচ্ছে বিশ্বময়, কিন্তু আইসল্যান্ডের মতো ছোট্ট দেশটিতেও ওই সব শব্দকে শব্দান্তরিত করা হয়। ভাষাকে ভালবাসলে এই করতে হয়।

আমি ভাষার ব্যাপারে খুব সংকীর্ণ নই, এক ভাষায় অন্য ভাষার শব্দ ঢুকে ভাষাকে সমৃদ্ধ করে এ আমি মানি, কিন্তু সেই সঙ্গে নিজের ভাষারও পরিচর্যার প্রয়োজন আছে। নিজের স্বকীয়তা এবং নিজের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের জন্য, এ বিশ্বাস আমার গভীর। ইংরেজি ভাষাটি পৃথিবীর একটি বড় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ভাষা, ঔপনিবেশিকতার কারণে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ভাষাটি ভ্রমণ করেছে। কেবল ভ্রমণ নয়, এই ভাষাটি বহু জাতির ওপর চাপিয়ে দিয়ে বহু ভাষার মৃত্যু ঘটিয়েছে নির্দয় সাম্রাজ্যবাদীরা। ভাষাটি আজ সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মতো সর্বত্র অনুপ্রবেশ করছে, বৈধ এবং অবৈধ দুইরকম উপায়েই। এতে ভাঙন লাগছে পৃথিবীর অনেক ভাষায়। ভাঙন সম্ভবত আমাদের অঞ্চলেই প্রকট। ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের কথ্য ভাষা এখন জগাখিচুড়ি ছাড়া আর কিছু নয়। আমি যখন কোনও বাঙালির সঙ্গে কথা বলি, আমার বিদেশি বন্ধুরা অবাক তাকিয়ে থাকে আমার দিকে, প্রশ্ন করে, তুমি এত ইংরজি শব্দ ব্যবহার করছ কেন? যে শব্দগুলো ব্যবহার করছ, ওই শব্দগুলো কি তোমার ভাষায় নেই? তোমার ভাষা কি এমনই দরিদ্র? লজ্জায় মাথা নোয়াতে হয় আমাকে। এ লজ্জা আমার। পৃথিবীর অন্য কোনও দেশের কেউ নিজের ভাষায় যখন কথা বলে, অহেতুক কোনও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে না, এক হতদরিদ্র আমরা ছাড়া। ঔপনিবেশিক শক্তি ভারতবর্ষ থেকে বিদায় নিয়েছে, ভারতবর্ষের মানুষই কেবল আজও ধরে রেখেছে প্রভুভক্তির চিহ্ন। এই প্রভুভক্তি এমনই ভয়ংকর যে, দৈনন্দিন প্রতিটি কর্মকান্ডে আমাদের নিজস্বতা বিশেষ কিছু অবশিষ্ট থাকে না, অনুকরণপ্রিয়তা আমাদের এমনই প্রকট যে, আমাদের পোশাক, আমাদের ভাষা, আমাদের খাদ্য, আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি বিসর্জন দিতে আমাদের এতটুকু অনুতাপ হয় না। মিরা নায়ারের মনসুন ওয়েডিং ছবিটি ভারতবর্ষের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারের লোকেরা দিনে যদি একশোটি শব্দ উচ্চারণ করে, তার আশিটিই যে ইংরেজি, তাঁর একটি চমৎকার উদাহরণ।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমি বিভিন্ন পন্ডিত ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছি, একটিও ইংরেজি বা ভিনদেশি শব্দ না জেনে তাঁরা কেবল নিজের দেশেই পন্ডিত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত কেবল নিজের মাতৃভাষাটি জেনেই। অনেক মানুষই বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজের মেধা ও দক্ষতার কারণে বিখ্যাত হয়েছেন, অমর হয়েও রয়েছেন।

অর্থনৈতিক দারিদ্র্য বিরাজ করায় বাংলা ভাষাটি কোনও মূল্যবান ভাষা হিসেবে বিশ্বের বাজারে স্থান পায় না। জাপানি ভাষা আজ পশ্চিমি দেশের বাজারে প্রয়োজনীয়। একটি ভাষা, বড় বড় রেস্তোরাঁর মেনুতে যে ভাষাটি দ্বিতীয় স্থান দখল করে, সেটি জাপানি, বড় হোটেলে, দোকানপাটেও তাই, একজন জাপানি জানা দোভাষীকে চাকরি দেওয়া হয়। এর কারণ জাপানিরা পশ্চিমি দেশ ভ্রমণ করতে যায় অঢেল টাকা নিয়ে। বাংলা ভাষাটি বিশ্বের দ্রব্য বাজারে যদি স্থান না পায়, ক্ষতি কী, মানুষের অন্তরে তো স্থান পেতে পারে। আর সে স্থান নিশ্চিত করতে গেলে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির মান আরও উন্নত করা চাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সত্যজিৎ রায়ের সাহিত্য ও শিল্পকর্ম অনেক বিদেশিকে বাংলা ভাষার প্রতি আকৃষ্ট করেছে, অনেকে বাংলা ভাষা শিখেছে। ফরাসি সাহিত্যে আকৃষ্ট হয়ে মূল ভাষায় ফরাসি সাহিত্য পাঠ করার জন্য পৃথিবীতে প্রচুর লোক ফরাসি ভাষা শিখছে। ইদানীং ডেনমার্কের কিছু পরিচালক তাক লাগিয়ে দেওয়া চলচ্চিত্র তৈরি করছেন বলে অনেকের আকর্ষণ ডেনিশ ভাষাটির প্রতি, ছোট্ট একটি ভাষা, মাত্র পঞ্চাশ লক্ষ লোক এ ভাষায় কথা বলে, তবুও। অন্যান্য ভাষা জানার অর্থ এই নয় যে নিজের ভাষাকে হেলা করা। হেলার ফল কখনও কোন কালেই ভাল হয় না। ভাষা নিজের পরিচয়, নিজের পরিচয়টিই যদি লজ্জাজনক হয়, তবে নিজের অস্তিত্বই একটি মস্ত লজ্জা। যত ছোট, যত দরিদ্রই নিজের ভাষা হোক, ভাষাকে ভালবাসলে নিজের কাছে নিজে তো বটেই, অন্যের কাছেও বড় হওয়া যায়। আমি বাংলাদেশে দেখছি, বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা লুকিয়ে তথাকথিত পুস্তকি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার আপ্রাণ চেষ্টা চলে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে। আমি মনে করি মুখের যে কোনোও ভাই শুদ্ধ।অশুদ্ধ ভাষা বলে কোনও ভাষা নেই পৃথিবীতে।

জার্মানির দক্ষিণে বাভারিয়া অঞ্চলে একধরনের জার্মান বলে লোকেরা যা ঠিক জার্মান নয়। তারা নিজেদের সেই জার্মান-মিশেল ভাষাটি নিয়ে ভীষণ রকম গর্বিত। ভাষা নিয়ে গৌরব করা যদি না যায়, তবে মনে এমনই হীনম্মন্যতা বাসা বাঁধে যে মেরুদন্ড সোজা করে একজন ব্যক্তি দুপায়ে ভর করে দাঁড়াতেও কুণ্ঠিত হয়। ব্যক্তি থেকে গোষ্ঠী, গোষ্ঠী থেকে জাতি, জাতি থেকে দেশ সবই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ময়মনসিংহের বেড়ে ওঠা মেয়ে হয়েও একসময় আমি ময়মনসিংহের আঞ্চলিকতা যথাসম্ভব আড়াল করে কলকাতাইয়া উচ্চারণে বাংলা বলতে চেষ্টা করতাম, যেহেতু ওটিকে শুদ্ধ বলে মনে করা হয়। শুদ্ধের চর্চা করতে কে না চায়! কিন্তু ইউরোপে বহু বছর কাটিয়ে নিজ দেশের আঞ্চলিক ভাষার প্রতি মানুষের ভালোবাসা এবং মমতা এবং এটির সৌন্দর্য দেখার পর আমার ভেতরের সেই লুকোনো প্রবণতা সম্পূর্ণ লুপ্ত, শুদ্ধের সংজ্ঞাটিও একই রকম লুপ্ত, আমি এখন মহানন্দে খাঁটি ময়মনসিংহি ভাষায়। যে-কোনও বাঙালির সঙ্গে কথা বলি। আইলাম, খাইবাম, যাইবাম-এর অনাবিল সৌন্দর্য আমি আগে এত করে উপলব্ধি করিনি, এখন যেমন করি।

আমার রিস্টওয়াচটা খুঁইজা পাইতেছি না, একজন লোক আমারে ইনভাইট করছে, আমার তো টাইম চইলা যাবে। যে তিনটি ইংরেজি শব্দ এখানে ব্যবহার হচ্ছে, সেই তিনটি শব্দের যে কোনও বাংলা শব্দ নেই, তা নয়, আছে এবং সে শব্দগুলো যে অচল হয়ে গেছে তাও নয়, রীতিমতো সচল শব্দ, কিন্তু তারপরও ব্যবহার করা হচ্ছে না, কী কারণ এর? কোনও কারণ নেই। বাঙালির বেশির ভাগ কথা ও কাজের পেছনে অনেক সময় কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। অকারণে বিস্তর কথা বলে বাঙালি, অকারণে বিস্তর কাজও করে। রাগারাগি, দলাদলি, খুনোখুনি নানা রকম কাজ। যুক্তিহীন কাজ। ভাষার প্রতি আবেগ ফেব্রুয়ারি এলে বাঙালির মনে উথলে ওঠে, এ কথা ঠিক, কিন্তু সারা বছর ভাষাটিকে ভাল না বাসলে এক মাসের ভালবাসায় আর যার লাভ হোক, ভাষার কোনও লাভ হয় না। দেশকে না ভালবাসলে ভাষাকে ভালবাসা যায় না। আর ভাষাকে ভাল না বাসলে নিজেকে ভালবাসা যায় না, নিজেকে ভাল না বাসলে অন্যকে ভালবাসা যায় না। অন্যকে ভাল না বাসলে মানুষে-মানুষে সৌহার্দ্য ও প্রীতি যা একটি সুস্থ দেশের জন্য প্রয়োজন, তা বিনষ্ট হতে সময় নেয় না। অন্যের গোলামি করা আর অন্যকে ভালবাসা দুটো দুজিনিস।

রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন। সেটি অন্য রকম করে বলতে ইচ্ছে হয়, বাঙালি যদি মানুষ হতে চায়, তাকে আগে বাঙালি হতে হবে। দেশ ও জাতিকে, জাতির ভাষাকে সংস্কৃতিকে ভালবেসে রফিক-সালাম বরকতের উত্তরসূরিরা, বাংলাদেশ নামের দেশটি পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের দেশ হিসেবে চিরকাল যেন সম্মানিত হয়, সেরকম একটি ব্যবস্থা করবেন, এ কেবল আশা নয় আমার, স্বপ্নও।

আমি কোথায় এখন?

ভারত থেকে প্রায়ই আমিইউরোপ অথবা আমেরিকায় যাই, সাধারণতবিভিন্ন অনুষ্ঠানে নারীর অধিকার বা মানবাধিকার নিয়ে বক্তৃতা করতে। ইউরোপ এবং আমেরিকার বিভিন্ন সরকার, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন আমাকে বক্তৃতার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছে আজ বাইশ বছর। যেখানেই বাস করি না কেন, বক্তৃতার জন্য আমাকে যেতে হয় বিভিন্ন দেশে। ভারতীয় উপমহাদেশের কোনও পত্রিকায় আমার বক্তৃতা করা, আমার সম্মান অর্জন, মানবাধিকার পুরস্কার পাওয়া, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট পাওয়া, এসব নিয়ে কিছু কখনও লেখেনি। লিখেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায়, কটা পুরুষের সঙ্গে আমি শুয়েছি, মোট কজনকে বিয়ে করেছি, এবং কত লোক আমাকে ঘৃণা করে, এবং মৌলবাদীরা কী করে আমাকে প্যাদানি দিচ্ছে, আমার দিকে লোহার চেয়ার ছুঁড়ে মারছে, রাজ্য কী করে আমার বই নিষিদ্ধ করেছে, কী করে রাজ্য থেকে আমাকে তাড়িয়েছে, এসব। আমার নামের আগে জুড়ে দেয় একটি শব্দ বিতর্কিত। এই শব্দটি জুড়তে জুড়তে এখন এটিকে তারা আমার নামের অংশ বলেই সম্ভবত ভাবে। এই বিতর্কিত বিশেষণটি তারাইতিবাচক নয়, ব্যবহার করে নেতিবাচক অর্থে। দুই বাংলা আমাকে শুধু তাড়িয়ে শান্ত হয়নি, আমাকে বানিয়েছে আস্ত একটা নিষিদ্ধ নাম, আপাদমস্তক নিষিদ্ধ লেখক। ভারত থেকে আমি এখন আমেরিকায় এসেছি, এর মানে কিন্তু এই নয় যে আমি জন্মের মতো ছেড়ে এসেছি ভারত। ভারতে এখনও আমার সবকিছু, সমস্ত জরুরি জিনিসপত্র। আমি শুধু ছোট একটা সুটকেসে নিয়ে আমেরিকায় এসেছি, সঙ্গে এনেছি আমার নিত্যসঙ্গী ল্যাপটপ আর আইপ্যাড। আর আমার এক জোড়া রিডিং গ্লাস। দেশের বাইরে যেখানেই যাই, এগুলো নিয়েই যাই।

বাংলাদেশ আমাকে তাড়িয়েছে। আমার বই নিষিদ্ধ করেছে। নারীবিদ্বেষী মৌলবাদীর দল আর নারীবিদ্বেষী তথাকথিত প্রগতিশীলের দল দুদলই দুযুগ ধরে আমার পেছনে –আমাকে অপমান করতে, অপদস্থ করতে, অবাধে আমার কুৎসা রটাতে ব্যস্ত। ইউরোপ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেছিলাম। বাংলাকে ভালোবেসে কী অসম্ভব অসম্ভব কাগুই না করেছি। সেখানেও ওই একই ঘটনা ঘটলো, রাজনীতিক, নারীবিদ্বেষী মৌলবাদীর দল, আর এক দল সেকুলার নামধারী কাপুরুষ আমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠলো। আমাকে গৃহবন্দি করেছিল ভারত সরকার। ভারত ছাড়তে বাধ্য করেছিল দুহাজার আট সালে। তারপরও ফিরে ফিরে গেছি ভারতে। আশ্রয় ভিক্ষে চাইনি। আশ্রয়ের দাবি জানিয়েছি। গণতন্ত্রের কাছে দাবি। একটি সেক্যুলার রাষ্ট্রের কাছে দাবি। মানবাধিকারের পক্ষে লড়াই করা একজন লেখক হিসেবে দাবি। দিল্লি ছাড়া আর কোথাও যাওয়া নিষেধ, তারপরও ওই দিল্লিতেই থেকেছি। কেন দিল্লিতে পড়ে আছি, কেউ প্রশ্ন করলে বলতাম, যেহেতু এখানকার গাছগুলো চিনি। দিল্লি আমার জন্য সম্পূর্ণ নতুন একটি শহর, নতুন চারদিক। তারপরও রয়েছি দিল্লিতে, কারণ গোটা ভারতবর্ষে ওই ছোট শহরটি ছাড়া আর কোনও শহর ছিল না আমার থাকার। ওই শহরটি ত্যাগ করা মানে গোটা একটি উপমহাদেশ ত্যাগ করা। আমার ভারত-বাসের অনুমতি আর না পাওয়া মানে আমার জন্য উপমহাদেশের দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়া। এবারই তো নতুন সরকার এসে ভারত বাসের অনুমতিকে এক বছর থেকে কমিয়ে দুমাসে এনেছিল। শুধু যুদ্ধ করে বেঁচে আছি। নিজের আদর্শের জন্য যুদ্ধ। যেখানে বাস করতে ইচ্ছে করে, সেখানে বাস করার স্বাধীনতা চাই বা অধিকার চাই। পৃথিবীর সর্বত্র বাক স্বাধীনতা চাই। আমি স্বাধীনভাবে আমার মত প্রকাশ করবো, সে কারণে আমাকে জেল খাটতে হবে না, আমার ফাঁসি হবে না, আমার পিঠে চাবুক চালানো হবে না, আমাকে দুররা মারা হবে না, আমাকে পাথর ছোঁড়া হবে না, আমাকে নির্বাসনে যেতে হবে না। এই নিশ্চয়তা চাই। শুধু আমার জন্য নয়। সবার জন্য।

আমার অধিকাংশ পাঠকের বাস উপমহাদেশে। সে কারণে পাঠকের কাছাকাছি রয়েছি, ভাষার কাছাকাছি রয়েছি, আমার পোষা বেড়ালের কাছাকাছি রয়েছি, যে মেয়েদের কথা লিখি, যে নির্যাতিত মানুষের কথা লিখি, তাদের কাছাকাছি রয়েছি। তাদের কাছাকাছি আমাকে তো থাকতেই হবে যতদিন বাঁচি। আমি তো ভাসমান এক মানুষ। আমার পায়ের তলায় মাটি নেই। আমার কোনও শহর নেই, গ্রাম নেই, দেশ নেই। এক শহর থেকে আরেক শহরে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে আজ একুশ বছর যাবৎ কেবল ভেসে যাচ্ছি। এই ভাসমান মানুষটিই মানুষের মত প্রকাশের অধিকারের জন্য, নারীর সমানাধিকারের জন্য, দেশে-দেশের কাঁটাতার উপড়ে ফেলার জন্য, মানুষের যেখানে খুশি সেখানে যাওয়ার এবং বসবাসের স্বাধীনতার জন্য, মানবতার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, লাথিঝাঁটা খেয়ে, গালি খেয়ে, ঘৃণা পেয়ে, ফতোয়া সয়ে, নির্যাতন সয়ে লড়াই করে যাচ্ছি।

আমেরিকায় আসার পেছনে এবার আমার উদ্দেশ্য সেকুলার হিউম্যানিস্ট কনফারেন্সে নাস্তিক ব্লগাররা কী রকম মৃত্যুভয়ে গুটিয়ে আছে, সে সম্পর্ক বলা। তাদের প্রাণে বাঁচানোর জন্য ইউরোপ-আমেরিকার সরকার এবং সংগঠনের কাছে আবেদন করা। যে ফাণ্ড তৈরি করা হচ্ছে আমার জন্য, সেটি মূলত যাবে দেশের প্রতিভাবান নাস্তিক ব্লগারদের দেশ থেকে বিদেশে আসা এবং বিদেশে বসবাসের খরচে। আমার নিজের নিরাপত্তা? অনেক তো হলো বাঁচা। এবার মাথায় কোপ খেলে, বা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হলে এমন কোনও সর্বনাশ হবে না কারও। গত একুশ বছর কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করেনি আমি কোথায় আছি, কেমন আছি। আমি ভালো আছি কি না। আমি বেঁচে আছি কি না। আজ হঠাৎ আমি ভারত ছেড়ে কেন চলে গেলাম। জানতে চাইছে সবাই। ভারতে থাকাকালীন মুখ ফুটে ভারতের রাজনীতি, ভারতের মেয়েদের অসহায়ত্ব, ভারতের গরিবদের দুরবস্থা, কোনও সামাজিক অব্যবস্থা, কোনও ধর্ম, কোনও পুরুষতন্ত্র, কোনও কুসংস্কার নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করলে জাতীয়তাবাদী, ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, পুরুষতান্ত্রিক লোকেরা আমাকে ধমক দিতো, গালি দিত, বলতো ভারত ছাড়তে, বাংলাদেশে চলে যেতে, কী জঘন্য অপমানই না করতো। বাংলাদেশ একটা গরিব দেশ বলে, বাংলাদেশে আমার জন্ম হয়েছে বলে তারা ভারতীয়রা তুই তোকারি করে কথা বলতো। পৃথিবীর সব দেশকে আপন ভাবলে, নিজের দেশ ভাবলে, দেশ আর দেশের মানুষের ভালো চাইলে, বিশেষ করে যেচে, আগ বাড়িয়ে ভালো করতে চাইলে অনেক কষ্ট পেতে হয়। বিদেশী, বাইরের লোক, আমাদের দেশের ব্যাপারে নাক গলাবে না, ইত্যাদি কটুক্তি শুনতে হয়। অনেকে ধারণা করে আমার নিশ্চয়ই কোনও বদ অভিসন্ধি আছে। তা না হলে অন্য দেশের মেয়েরা ধর্ষিতা হলে আমার কী, ডমেস্টিক ভায়োলেন্স বাড়লে আমি উদ্বিগ্ন কেন, এ তো আর আমার দেশ নয়! আমি আপন ভাবলেও আমাকে আপন ভাবার লোক আমি খুব কমই পেয়েছি। আমার কথা পছন্দ না হলে আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে, আমাকে লাথি মেরে ভারত থেকে তাড়াবে। প্রায় প্রতিদিন শুনেছি এমন হুমকি। একদিকে মুসলিম মৌলবাদীদের আক্রমণ। আরেকদিকে নারীবিদ্বেষী, কট্টর ডানপন্থী, হিন্দুত্ববাদীর আক্রমণ। আর যাদের থাকার কথা আমার পাশে, যে বামপন্থী সেকুলার দলের, তারা আমার বই নিষিদ্ধ করে, আমাকে রাজ্য থেকে তাড়ায়, আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটায়। তারা মিথ্যে দোষ দেয়, তাদের সহজ সমীকরণ এই, আমি যেহেতু ইসলামী মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি, আমি তবে নিশ্চয়ই হিন্দুত্ববাদীদের বন্ধু। ভারতের সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ উদারপন্থী মুক্তচিন্তকদের মধ্যে একটা বড় অংশই ভণ্ড। একটা বড় অংশই নারীবিরোধী।

এদের বাইরেও অনেক মানুষ আছে, যারা ভালোবাসে, যারা শ্রদ্ধা করে। হাটে, মাঠে, ঘাটে কত মানুষ দৌড়ে এসেছে অটোগ্রাফ নিতে, কত মানুষ ছবি তুলতে, জড়িয়ে ধরতে, একটু হাত স্পর্শ করতে, একটু কাঁদতে, একটুখানি পায়ের ধুলো নিতে। ওই ভালোবাসা আমাকে টানে। ওই ভালোবাসার কাছে আমি ফিরে যাবোই। ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই আমার কাছে বড় নয়। আমার সবজিওয়ালা জয়ন্ত আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকে, আমার মাছওয়ালা গোবিন্দ আর বনমালী আমার জন্য অপেক্ষা করে। অপেক্ষা করে শাড়ির দোকানের মজুমদার। অপেক্ষা করে আছে মিনু বেড়াল, অসংখ্য চেনা অচেনা শুভাকাঙ্ক্ষী।

অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর ঘাড়ের কাছটায় চাপাতির একখানা কোপ আজ বসে কাল বসে এইরকম একটি বিচ্ছিরি কিছু অনুভূত হচ্ছিল। বার বার পেছন ফিরে দেখছিলাম কেউ অনুসরণ করছে কি না। ওটা আমেরিকায় এসে এ কদিনে খানিকটা গেছে। সম্পূর্ণ চলে যেতে খানিকটা সময় নেবে। নব্বইয়ের শুরুতে আমি লক্ষ লক্ষ মৌলবাদীদের মিছিল আর সভা দেখেছি, যেখানে আমার ফাঁসির দাবিতে দেশকে অনেকদিন পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছিল। ওই মৌলবাদীদের সুযোগ্য পুত্ররা আজ সন্ত্রাসী, আজ তারা চাপাতি চালানো খুনী। আমার দিকে নজর তাদের নতুন নয়।

.

পৃথিবীটাকে দেশ বলে আজও ভাবি। আমি ইউরোপের নাগরিক অনেককাল। আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা অনেককাল। এসব জায়গায় বাস না করে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমি বাংলায় বাস করতে চেয়েছি। এখনও চাই। যতদিন বাংলা শাসন করবে মুখ লোকেরা, জঙ্গীদের সঙ্গীরা, ততদিন আমার প্রবেশাধিকার নেই বাংলায়। এই প্রবেশাধিকার ফেরত চাই। পৃথিবীটায় যতদিন বাঁচি যেখানে খুশি সেখানে যাওয়ার, যেখানে ইচ্ছে করে সেখানে বাস করার অধিকার পেতে চাই। যেন চাইলে আমেরিকায়, যেন এস্কিমোদের দেশে গ্রীনল্যাণ্ডে, যেন আফ্রিকার যে কোনও দেশে, অস্ট্রেলিয়ায়, ইউরোপ বা এশিয়ার যেখানে খুশি সেখানে বাস করার অধিকার পেতে পারি। শুধু আমি নই। পৃথিবীর সবাই।

জানি আমার স্বপ্নগুলো মানুষ পায়ে মাড়িয়ে যাবে। সে যাক। আমার কিছু যায় আসে না। আমি স্বপ্ন রচনা করে যাবোই।

 ইলিশ কোরবানি

শুনেছি একটা ইলিশ নাকি ষোলো হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে ঢাকায়। পয়লা বৈশাখে ইলিশ খেতে হবে যে করেই হোক, তাই যে দামই হাঁকছে ইলিশওয়ালা, সে দামেই কিনছে বাঙালি। বাঙালি না বলে ধনী বাঙালি বলাই ভালো। পয়লা বৈশাখ ইলিশ ছাড়া কী করে উৎযাপন হবে। কোরবানির ঈদের আগে চড়া দামে গরু কিনে লোকেরা যেমন চারদিকে বলে বেড়ায় কত টাকায় কিনেছে গরু, এও ঠিক তেমন, ইলিশ কিনে সবাইকে শোনাচ্ছে কত টাকায় ইলিশটা কিনেছে। যত বেশি দাম, তত বেশি ইজ্জত। পয়লা বৈশাখে গরু-খাসির বদলে ইলিশ কোরবানি দেয় মানুষ। পয়লা বৈশাখটা কি ধীরে ধীরে একটুখানি কোরবানির ঈদের মতো হয়ে উঠছে। কী ভালোই না হবে বাংলা নববর্ষ যদি কোরবানির ঈদের মতো বড় উৎসব হয়ে ওঠে। ধর্মীয় উৎসবের চেয়ে নববর্ষের উৎসব নিশ্চয়ই ঢের ভালো।

তবে যেভাবেই পালন করুক, পয়লা বৈশাখটা পালন করুক বাঙালিরা। বাংলা ক্যালেণ্ডারের উৎপত্তির সঙ্গে বাংলা বা বাঙালির কতটুকু কী জড়িত সে নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে বাংলা ক্যালেণ্ডারকে যেহেতু বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে, বাঙালিরা আর ক্যাচাল না করে এর বারো মাসের তেরো পার্বণ উত্যাপন করুক ঘটা করে।

বাঙালির বাঙালিত্ব তো প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে। ভাষাটাই যাবো যাবো করছে। এই ভাষা গরিব লোকের ভাষা, এই ভাষা দাদু-দিদিমার ভাষা, ঠাকুম্মা- ঠাকুর্দার ভাষা। সত্যিই এখনকার ছেলেমেয়েদের জন্য বাংলাটা নেহাত প্রাচীন লোকদের ভাষা, চাষোভুযোদের ভাষা।

মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হোক ঢাকা শহরে, প্রতি পয়লা বৈশাখে। কুটির শিল্পের মেলা হোক। মানুষ কাঁচা লংকা আর পান্তা ভাত খাক। কেউ কেউ টিপ্পনি কাটে, বছরের একদিন পান্তা খেয়ে কী লাভ, বাকি দিনগুলোয় তো মোগলাই খাচ্ছে। আমার বক্তব্য, বছরে একদিনই উৎসব করুক। একদিন বৃদ্ধ থেকে শিশু সবাই দেখুক, তাদের সংস্কৃতিটা ঠিক কী। একদিন দেখুক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, শাড়ি ধূতি, নাচ গান, আল্পনা, কাগজের হাতি ঘোড়া। একদিন বাংলায় কথা বলুক, একদিনের জন্য হলেও শত ভাগ বাঙালি হোক।

একদিনের জন্য হলেও উৎসবটা করা জরুরি, কারণ সামনে এমন দিন আসছে, এই একটা দিনও হয়তো আর বাঙালির উৎসবের জন্য জুটবে না। এখনই ইসলামি মৌলবাদীরা হুমকি দিচ্ছে, পয়লা বৈশাখ যেন পালন না করা হয়। একবার তো রমনার বটমূলে ছায়ানটের গানের দিকে গ্রেনেড ছুঁড়েছিল ওরা। এরপর বলা যায় না হয়তো পয়লা বৈশাখের উৎসব যারা করবে, তাদের দিন দুপুরে জবাই করে ফেলে রাখবে রাস্তায়। যারা আরবের সংস্কৃতিকে গায়ের জোরে ঘরে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজেদের বাঙালি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করছে, তারা খুব ভয়ংকর, তারা আজ বাংলাদেশে বিশাল ক্ষমতার অধিকারী। তাদের এক হাতে অস্ত্র, আরেক হাতে টাকা। তাদের মাথার ওপর সরকারি আশির্বাদের হাত।

সূতরাং পয়লা বৈশাখের উৎসব বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আগে যত পারুক উৎসব করে নিক বাঙালি। যত পারুক বাংলা গান গেয়ে নিক। যত পারুক নেচে নিক। যত পারুক ঢাক ঢোল বাজিয়ে নিক। যত পারুক মুড়ি মুড়কির মেলা করে নিক। কবে আবার কাকে হিজাব বোরখা আর টুপি জোব্বার আড়ালে চলে যেতে হয় কে জানে।

সত্যি বলছি, খুব দাম দিয়ে মানুষ ইলিশ কিনছে বলে আমার ভালো লাগছে। মানুষ গর্ব করে বলুক, তারা বাঙালি। বন্ধুদের ডেকে ডেকে দেখাক, আত্মীয় পড়শিদের দেখাক সদ্য কেনা রূপোলি রূপোলি ইলিশ। পয়লা বৈশাখের পেছনে যত টাকা যায়, যাক। বাঙালিকে সারাবছর বাঙালিত্ব বিসর্জন দিতে হয়, একদিন অন্তত বাঙালিত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য তারা মরিয়া হয়ে উঠুক। যত হুমকিই আসুক, যত শত্রুই থাকুক বাঙালির আশেপাশে, তবুও যেন অকুতোভয়ের মতো পালন করে যায় বছরের একদিনের এই উৎসব।

ইহুদিরা আজও নিজের সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রেখেছে। নিজভূমি থেকে নির্বাসিত হয়ে ওরা হাজার হাজার বছর কাটিয়েছে বিদেশ বিভূঁইয়ে, ভিন্ন সংস্কৃতির দেশে, সংখ্যালঘু হয়ে, নিরন্তর অপমান সয়ে। চরম প্রতিকূলতার মধ্যে কী করে এতকাল তারা বেঁচে ছিল, এই বিস্ময় জাগায়। এতদিনে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কথা তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, সব। কিন্তু না, সবই টিকে আছে। কারণ হাজার বছর ধরে ঘরে ঘরে নিজেদের ভাষা আর সংস্কৃতির চর্চা চালু রেখেছিল বলেই টিকে আছে। যে করেই হোক টিকিয়ে রাখবে এই প্রতিজ্ঞা করেছিলো বলেই টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে।

ইহুদি পারলে বাঙালি পারবে না কেন! নিশ্চয়ই পারবে, যদি নিজের ভাষা আর সংস্কৃতিকে ইহুদিদের মতো ভালবাসে। এখানেই আমার সংশয়, আমার মনে হয়। বাঙালি তাদের সংস্কৃতিকে সত্যিকার ভালোবাসে না। বাসে না বলেই অত সহজে আরবের এবং ইংরেজের সংস্কৃতি বাংলাকে দখল করে নিতে পেরেছে। এই অবাঙালির দেশে আমি কী করে কাটাবো আমার পয়লা বৈশাখ!পদ্মার ইলিশ কোথায় পাবো, রমনার বটমূলে গানই বা কী করে শুনতে যাবো! আমি না হয় দূর থেকেই সবার আনন্দ দেখলাম। না হয় দূর থেকেই গানের সুর শুনলাম। কাছে যাওয়া আমার না-ই হলো। সবার কি আর সব হয়!

ইসলামী ইনকুইজেশন

নির হোসেন অনন্ত বিজয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, একসঙ্গে যুক্তি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিল নামে এক সংগঠন গড়েছিলেন সিলেটে। অনন্তর মতো মনিরও ব্লগ লিখতেন মুক্তমনায়। অনন্ত বিজয় আর মনির দুজনকেই ইসলামী সন্ত্রাসীরা হুমকি দিতো ফোনে। অনন্তর জন্য তারপরও একটা ব্যবস্থা হয়েছিলো। সুইডেনের লেখক-কবিদের সংগঠন পেন থেকে একটা আমন্ত্রণ পত্র যোগাড় হয়েছিল। মনির অনন্তর সঙ্গে ঢাকায় গিয়েছিলো যেদিন সুইডেনের ভিসার জন্য আবেদন করেন অনন্ত, ১২ এপ্রিল তারিখে সুইডেনের দূতাবাস অনন্তর সাক্ষাৎকার নেয়, ২২ এপ্রিল তারিখে জানিয়ে দেয়, তারা অনন্তকে ভিসা দেবে না। সিলেটে ফিরে আসার পর ১২ মে তারিখে অনন্তকে দিন দুপুরে কুপিয়ে মেরে ফেলে ইসলামী জঙ্গিরা। অনন্তকে খুন করার পর মনিরকে ফোনে হুমকি দিচ্ছে। অচেনা কণ্ঠ বলছে, রেডি হয়ে যা। নেক্সট তুই। কেউ আবার কোনও কথা না বলে ফোনে কোরানের সুরা বাজাচ্ছে। মনির সিলেটের একটা কলেজে বাংলা পড়াতেন। এখন চাকরি বাকরি সব ফেলে। সিলেট ছেড়েছেন মনির। ঢাকায় বন্ধুর বাড়িতে লুকিয়ে আছেন। ঘর থেকে কোথাও বের হচ্ছেন না। চেষ্টা করছেন দেশের বাইরে চলে যাওয়ার। যোগাযোগ করছেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে। ভিসা এখনও জুটছে না। সিদ্ধার্থ ধরও হুমকি পাচ্ছেন। কিছুদিন আগে আমেরিকার দূতাবাস থেকে ঘুরে এসেছেন। ভিসা পাননি। নিলয় নীল আর সন্ন্যাসী রতনের বাড়িতে তল্লাশি চলেছে, ওঁরা পালিয়ে গেছেন অচেনা গ্রামে। সম্ভবত চেহারা বদলে নিয়েছেন। দাড়ি রাখছেন। বেশভুষা নাম ধাম। সব বদলে ফেলেছেন। ভিসা না পেলে মনিরও চলে যাবেন গহীন গ্রামে। যেখানে কেউ তাঁকে চিনতে পারবে না। শহরে আছেন অনন্য আজাদ, তিনিও দেশ ছাড়তে চাইছেন। মাথায় হেলমেট পরে ঘর থেকে বেরোন। অতর্কিতে কোপাতে এলে যেন হেলমেটের কারণে মাথাটা বাঁচে। কোপ খেয়েও আসিফ মহীউদ্দিন প্রাণে বেঁচেছিলেন, মোটা শীতের কাপড় পরা ছিল বলে। মুক্তচিন্তক ব্লগারদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। আতংক। মোহাম্মদ ইসলামের মতো দেশের অনেক মুক্তচিন্তক ব্লগার লেখালেখি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। ইউরোপ-আমেরিকায় বাস করছেন যাঁরা, তাঁরাই শুধু নির্ভয়ে লিখতে পারছেন। মসিউর রহমান (মরহুম আল্লামা শয়তান)এর নাম ৮৪ জনের তালিকায়, হাসিনার সরকার তাঁকে জেলেও রেখেছিলো কয়েকমাস। সঙ্গে ছিলেন আসিফ মহীউদ্দিন আর সুব্রত শুভ। আসিফ আর সুব্রত দেশ ছেড়েছেন। মসিউর রহমান এখনও সুযোগ পাননি দেশ ছাড়ার। এখনও ফেসবুকে লিখছেন। তবে ধার কমিয়ে দিয়েছেন লেখায়। তাতে কি ক্ষমা পাবেন? ধর্মান্ধদের অভিধানে দয়া মায়া ক্ষমা এসব নেই।

সবাই ভাবছে কোপ এবার তাকেই খেতে হবে। প্রায় প্রতিমাসেই একজনকে কুপিয়ে মারা হচ্ছে। হুমকি পেয়ে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করতে গেছেন কিছু ব্লগার, পুলিশ রিপোর্ট নিচ্ছে না, সোজা বলে দিচ্ছে, বাঁচতে চাইলে দেশ থেকে পালাও। খুনীদের গ্রেফতার করছে না পুলিশ, কেন করছে না জিজ্ঞেস করলে বলছে, ওপরের নির্দেশ নেই। কুপিয়ে মারার জন্য সন্ত্রাসীরা নতুন তালিকা বানিয়েছে। ৮৪ জনের পুরোনো তালিকায় ওয়াশিকুর ছিলেন না। ওই তালিকায় মনির এবং অন্যান্য যাঁরা হুমকি পাচ্ছেন এখন, তাঁরা নেই। পুরোনো তালিকায় ছিলেন নাস্তিকের ধর্মকথা। চাপাতি চালানো খুনীরা তাঁরও পিছু নিয়েছে। শুধু ফেসবুক ব্লগারদের নয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শফিউল ইসলামকে সেদিন কুপিয়ে মেরে ফেললো ইসলামী সন্ত্রাসীরা। শফিউল ইসলাম তাঁর ক্লাসের ছাত্রীদের বোরখা পরে আসতে বারণ করেছিলেন, বলেছিলেন মুখ ঢাকা থাকলে পড়াতে অসুবিধে হয়। পরের দিন ইসলামী সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে মেরে ফেলেছে শফিউল ইসলামকে।

শেখ হাসিনা অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান আর অনন্ত বিজয় দাসের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর একটি বিবৃতিও দেননি। শুনেছি তিনি পরের নির্বাচনে জেতার জন্য মৌলবাদী পটাচ্ছেন। মুক্তমনা ব্লগারদের নিরাপত্তা তো দেবেনই না, খুনীদের বিরুদ্ধেও কোনও ব্যবস্থা নেবেন না। এই দুঃসহ অবস্থায় দেশ ত্যাগ করা ছাড়া ওঁদের আর কোনও উপায় নেই। আপাতত বাঁচুক। দেশের অবস্থা ভালো হলে না হয় ফিবে দেশে। কিন্তু মৌলবাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতা শাহরিয়ার কবির চান না ব্লগাররা দেশ ছাড়ুক। তিনি বলছেন, দেশ ছেড়ে লাভ কিছু হবে না, লাভ হবে জামাতে ইসলামিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে। জামাতে ইসলামি নিষিদ্ধ হওয়া উচিত, কিন্তু নিষিদ্ধ হলে সন্ত্রাসীরা নাস্তিকদের খুন করবে না, এ হলফ করে কে বলতে পারে? এতকাল যাবৎ জামাতে ইসলামির বাইরেও লক্ষ লক্ষ মৌলবাদী-সন্ত্রাসীর জন্ম হয়েছে, তারা জামাতের চেয়েও বেশি ভয়ংকর। তারা আইসিস-আলকায়দার নির্দেশে চলে। শাহরিয়ার কবির বললেন তাঁর হাতে পিস্তল আছে, এবং তিনি একা বাইরে বেরোন না। শাহরিয়ার কবির না হয় লাইসেন্স সহ পিস্তল যোগাড় করতে পারেন। কিন্তু অল্প বয়সী নাস্তিক ব্লগাররা পিস্তল কোত্থেকে যোগাড় করবে, লাইসেন্সই বা তাদের কে দেবে? যে সরকার তাদের কোনও দেহরক্ষী দেয় না, সে সরকার তো লাইসেন্স দেবে না। কিছুদিন আগে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়েছে। যে দল খুন করে এসে গোটা দেশকে জানিয়ে দিচ্ছে তারা খুন করেছে, তারপরও তাদের টিকিটি পর্যন্ত স্পর্শ করছে। না সরকার। তাদের নিষিদ্ধ করলেই কী, বা না করলেই কী!

হুমকি আমিও পাচ্ছিলাম। ঢাকার গোয়েন্দা রিপোর্ট বলেছে, আমাকে খুন করার জন্য আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের দুতিনটে স্লিপার সেলকে নাকি পাঠানো হচ্ছে। দিল্লিতে। আমি কি তাই পালিয়ে আমেরিকা চলে এসেছি? পালিয়ে আসার মানুষ তো কোনওদিনই ছিলাম না। বাংলাদেশে বাস করছিলাম যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ আমার ফাঁসি চাওয়ার জন্য মিছিল করতো। দেশ থেকে তাড়ানো হয়েছিল আমাকে। পশ্চিমবঙ্গে আমার বিরোধী মৌলবাদীর সংখ্যা নেহাত কম ছিল না, বাংলাদেশি সন্ত্রাসীদেরও বেশ যাতায়াত ছিল, সেই পশ্চিমবঙ্গে থেকে আমি বেরোইনি, আমাকে বের করে দেওয়া হয়েছে। নিরাপদ জায়গা ফেলে আমি তো সারা জীবন অনিরাপদ জায়গাতেই বাস করেছি, শুধু নির্যাতিত মানুষদের, যাদের নিয়ে লিখি, তাদের পাশে থাকার জন্য। আমি এসেছি আমেরিকায়, কাজ করছি আমেরিকার সেকুলার মানববাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে, আমেরিকার সরকারকে বলে যেন বাংলাদেশের মুক্তমনা ব্লগারদের ভিসার ব্যবস্থা করে, এবং এখানেই তাদের স্থায়ী বসবাসের সুযোগ করে দেয়। সবচেয়ে ভালো হতো ওরা যদি দেশে নিরাপত্তা পেতে। কিন্তু মুশকিল হলো সরকার মৃত্যুর হুমকি পাওয়া কোনও নাস্তিককে নিরাপত্তা দেবে না। নাস্তিকদের মৃত্যুতে সহানুভূতিও দেখাবে না। এতে যদি আবার সরকারকে নাস্তিক বলে মনে হয়। তাহলে সব্বনাশ। ভোট তো পাবে না ধর্মান্ধদের।

নিজের সুবিধের জন্য, নিজের বাঁচার জন্য, আজ অবধি কোনওদিন কিছু করিনি আমি। লক্ষ লক্ষ মৌলবাদীরা যখন দেশ জুড়ে তাণ্ডব করছিলো, আমার ফাঁসি চাইছিল, আমি দেশ ছাড়িনি, সরকার আমাকে তাড়িয়েছে। আজ একুশ বছর নির্বাসনে, সারা পৃথিবীতে আমার নিজের কোনও ঘর নেই। দিল্লিতে অন্যের বাড়িতে থাকি। যে কোনও দিন পাততাড়ি গুটোতে বললে গুটোতে হবে। আক্ষরিক অর্থে গৃহহীন যাকে বলে, সে আমিই। প্রায় কুড়ি বছর আগে যখন চারদিকে আমার নাম ডাক, ইসলামী মৌলবাদীরা হাতের নাগালে পেলে কাঁচা খেয়ে ফেলবে, এই খবর যখন বিশ্বের সর্বত্র প্রচার হচ্ছে, ইউরোপের সরকার, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান থেকে আমাকে জিজ্ঞেস করা হতো, তোমাকে কী করে সাহায্য করতে পারি বলো। আমি সবাইকেই বলেছি, ব্যক্তি আমাকে সাহায্য করতে হবে না। বাংলাদেশের মেয়েদের সাহায্য করো। আমাকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছে বলে কিছু দাতা দেশ বলেছিলো তারা বাংলাদেশকে দান দেওয়া বন্ধ করে দেবে কিনা। আমি বলেছি, ও কাজটি কখনও করো না। বাংলাদেশের দরিদ্র মেয়েরা তোমাদের সাহায্য পেলে খেয়ে পরে বাঁচবে, শিক্ষিত আর স্বনির্ভর হতে পারবে। না, নিজের জন্য আজও ভাবছি না। আমার জন্য যে ফাগু তোলা হচ্ছে আমেরিকায়, তা খরচ করা হবে দেশের মুক্তমনা ব্লগারদের আমেরিকায় আসার আর থাকার খরচে।

আমার ভয় হচ্ছে, যুক্তিবাদী মুক্তমনা লেখকদের আবার ছুট্টি হয়ে যাচ্ছে না তো! দেশে কমপিউটার বন্ধ। বিদেশে পালিয়ে এসে জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত হয়ে উঠবে। লেখালেখি হয়তো আর হবে না অনেকের। ধর্মান্ধতা এবং কুসংস্কার থেকে সমাজকে মুক্ত করার কাজে কেউ আর হয়তো আগের মতো এগিয়ে আসবে না। সবাই তো আর আমার মতো নয়। যুগ যুগ ধরে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভাসমান জীবন কাটিয়ে হলেও, জীবনের ঝুঁকি নিয়েও, ফতোয়া সয়ে, নির্যাতন সয়ে, ঘাড়ধাক্কা, অন্যায়, অপমান, নিষেধাজ্ঞা, ঘৃণা সয়েও মানবাধিকারের জন্য, নারীর সমানাধিকারের জন্য, বাক স্বাধীনতার জন্য, সহিষ্ণুতার জন্য, সমতার জন্য, যা হয় হোক, লড়াই করে যাবে!

সমাজ যেভাবে আছে, সেভাবেই যদি থাকে, ঘটে বুদ্ধি আছে এমন কাউকেও চাপাতির হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব নয়। সমাজকে বদলাতে হলে ধর্মান্ধদের অনুভূতিতে আঘাত করাটা খুব জরুরি, বিশেষ করে ধর্মানুভূতিতে। অন্য কোনও অনুভূতিতে আঘাত লাগলে মানুষ এত বীভৎস-বর্বর হয়ে ওঠে না, কেবল ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলেই হিতাহিত জ্ঞান হারায়। যারা বাংলাদেশের ব্লগার হত্যার বিরুদ্ধে, তারা অনেকই ব্লগারদের পক্ষ নিতে গিয়ে বলছেন যে ওরা কারও ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয়নি। তাহলে কি তারাও ধর্মান্ধদের মতো মনে করেন ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়া অন্যায়? মুশকিলটা ঠিক এই জায়গায়। লক্ষ্য করেছি, এটা মেনে নিতে গণ্যমান্য মনীষীদেরও অসুবিধে হচ্ছে যে, মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়াটা অন্যায় নয়।

এমন কে আছে যার কোনও অনুভূতিতে আজ অবধি কোনও আঘাত লাগেনি। অনুভূতিতে কোনওরকম আঘাত ছাড়াই পুরো জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাওয়ার দাবি অত্যন্ত অন্যায় দাবি। সব মানুষের মত এক নয়। মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা করলে অনুভূতি একবার কেন, বাবার আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে। মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করলে অনুভূতির ওপর আঘাত নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। মত প্রকাশের স্বাধীনতার অস্তিত্ব থাকতেই হবে যদি গণতন্ত্রের অস্তিত্ব রাখতে হয়।

ধর্মানুভূতির রাজনীতি অনেককাল ধরে চলছে। ধর্মানুভূতির সঙ্গে সংঘাত লাগছে গণতন্ত্রের, শুভবুদ্ধির, জ্ঞজ্ঞানের, বিজ্ঞানের, নারীর অধিকারের, মানবাধিকারের, সমানাধিকারের। যে কোনও একটি পক্ষ আমাদের নিতেই হবে। আমরা ধর্মানুভূতি রক্ষা করতে চাই নাকি গণতন্ত্র, শুভবুদ্ধি, জ্ঞান, বিজ্ঞান, নারীর অধিকার, মানবাধিকার, সমানাধিকার ইত্যাদি রক্ষা করতে চাই?

ধর্মানুভূতি নিয়ে রাজনীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এখন। এর সমাধান কিন্তু ধর্মানুভূতিতে আঘাত না করা নয়। বরং উল্টো। ধর্মানুভূতিতে ক্রমাগত আঘাত করে যেতে হবে। মুহুর্মুহু আঘাতের ফলেই এই আঘাত গা সওয়া হবে। ধর্মানুভূতিকে নিয়ে ধর্ম ব্যবসা এক্ষুণি বন্ধ না করলে অসং ধর্মব্যবসায়ীরা সমাজের যেটুকু বাকি আছে ধ্বংস হওয়ার সেটুকুও ধ্বংস করবে।

পৃথিবীর কোথাও নারীবিদ্বেষীদের অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও মানবাধিকারবিরোধী লোকদের অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও গণতন্ত্র বিরোধী লোকদের অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও ধর্মান্ধদের অনুভূতিকে আঘাত না দিয়ে বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও মানুষের ধর্মানুভূতিকে ক্রমাগত আঘাত না দিয়ে ধর্মানুভূতির নামে ধর্মব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব হবে না, ধর্মীয় সন্ত্রাস বন্ধ করা সম্ভব হবে না, ইসলামি ইউকুইজেশন বন্ধ করা সম্ভব হবে না।

নাস্তিক ব্লগারদের পক্ষ নিতে চাইলে ওরা কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেনি, এটা বলাটা ঠিক নয়। বরং বলা উচিত, ওরা মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে, কারণ আঘাতটা জরুরি ছিল। বিজ্ঞানের সঙ্গে সংঘাত ধর্মের চিরকালের। বিজ্ঞানীরা, বিজ্ঞান যে মানে না, তাদের ধারালো ছুরি শানিয়ে কোপাতে যায় না। কিন্তু ধার্মিকরা, ধর্ম যে মানে না তাদের কোপাতে যায়। এ মহানবীর আদর্শ। তিনি এভাবে কুপিয়ে বিধর্মী মারতেন, অবিশ্বাসীদের মারতেন। তাঁর অনুসারীদের এভাবেই মারতে শিখিয়ে গেছেন তিনি। এই একবিংশ শতাব্দিতে চৌদ্দশ বছর আগের বর্বরতাকে প্রশ্রয় দেবো না আমরা। কোপানোর বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে প্রতিবাদ না হলে কোপানো চলতে থাকবে। আজ বিজ্ঞানীদের, মুক্তমনাদের কোপাবে, কাল হিজাব না পরলে, নামাজ না পড়লে, রোজা না করলে কোপাবে।

 ইসলামী খুনী

নব্বই দশকের শুরুর দিকে, খালেদা জিয়ার আমলে, তিন ইসলামী খুনী আমার মাথার মূল্য ঘোষণা করেছিল। কেউ যদি আমার মুণ্ডু কেটে নিয়ে যায়, তারা নাকি বড় অংকের টাকা দেবে। দেশের এক নাগরিককে খুন করার ইন্ধন জোগানোর জন্য ওই তিন ইসলামী খুনীর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। বরং বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ নিজেদের পার্টিতে ওদের ঢুকিয়েছিলো, ইলেকশনেও দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল, এমপি টেমপিও বোধহয় বানিয়েছিল।

এক মৌলবী ওয়াজ করছিল সেদিন, তার শিষ্যদের বলছিল ইসলামের সমালোচনা যারাই করবে, তাদের যেন এরা টুগরো টুগরো করে কেটে ফেলা হয়। লোকটির কি কোনও শাস্তি হবে? লোকটিকে কি গ্রেফতার করা হবে? শাসানো হবে? না। কারণ, দেশের প্রধানমন্ত্রী এই লোকটির মতোই বিশ্বাস করেন ইসলামের সমালোচকদের টুগরো টুগরো করেই কেটে ফেলা উচিত। তাই ওদের যখন এরা কেটে ফেলে, তখন প্রধানমন্ত্রী তাঁর মৌনতা দিয়ে বুঝিয়ে দেন যে এই কেটে ফেল্লায় তাঁর সম্মতি রয়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয় ১৪০০ বছর আগেও বোধহয় ইসলামী খুনীদের এখনকার মতো এত রমরমা অবস্থা ছিল না।

ইহা বোমা নহে

আহমদ মোহাম্মদ রাতারাতি সেলেব্রিটি হয়ে উঠেছে। সারা বিশ্ব থেকে ১৪ বছর বয়সী আহমদের জন্য পাঠানো হচ্ছে সহানুভূতি, সমর্থন, অভিনন্দন, আর অগাধ ভালোবাসা। এর কারণ নিশ্চয়ই মানুষের অপরাধবোধ। আহমদ যা নয়, তাকে তাই ভাবা হয়েছিল, সন্ত্রাসী নয়, কিন্তু সন্ত্রাসী ভাবা হয়েছিল, সে কারণেই অপরাধবোধ। ঘড়ি বানিয়েছিল, যেটিকে বোমা ভেবেছে তার শিক্ষক, পুলিশ ডেকেছে, পুলিশ এসে হাতকড়া পরিয়ে ছেলেটিকে থানায় নিয়ে গেছে, একটি নিরপরাধ কিশোরের বিরুদ্ধে অন্যায় আচরণ করা হয়েছে,– অপরাধবোধ সে কারণে। থানা থেকে জিজ্ঞাসাবাদের পর আহমদকে ছেড়েও দেওয়া হয়েছে, তারপরও মানুষের অপরাধবোধ কমেনি। উদারপন্থীরা ভাবছেন, যদিও মুসলমানদের বেশির ভাগ লোকই ভালো লোক, তারপরও গোটা মুসলমান সম্প্রদায়কে মানুষ ভয় পায়, সন্দেহের চোখে দেখে, সন্ত্রাসী বলে মনে করে। এ কারণেই একটা অস্বস্তির কাঁটা বিঁধে রয়েছে উদারপন্থীদের মনে। এ কথা তো সত্য, মুসলমানদের মধ্যে কেউ কেউ সন্ত্রাসী, সকলেই নয়। ঠিক যেমন ক্রিশ্চানদের মধ্যে, ইহুদিদের মধ্যে, হিন্দুদের মধ্যে কেউ কেউ সন্ত্রাসী, সকলেই নয়। এই সত্যটা সবারই জানা নেই, তাই উদারপন্থীদের লজ্জা, তাই অপরাধবোধ।

কত কত নিরপরাধ মানুষকে অন্যায়ভাবে হাতকড়া পরানো হচ্ছে প্রতিদিন,জেলবন্দি করা হচ্ছে,যাবজ্জীবন দেওয়া হচ্ছে। আমরা কজনকে সেলেব্রিটি বানাই! কিন্তু থানায় নিয়ে কিছুক্ষণ রাখার কারণেই নিরপরাধ আহমদ মোহাম্মদকে আমরা সেলেব্রিটি বানিয়েছি। থানায় নিয়ে কত কালো বাদামী লোককেই তো রাখা হয়, কিন্তু তারা তো সেলেব্রিটি হয় না, আহমদ মোহাম্মদ কেন সেলেব্রিটি হয়? তার কারণ আহমদ মুসলিম ছেলে। আহমদ যদি ক্রিশ্চান হতো, অথবা ইহুদি হতো অথবা হিন্দু হতো তাহলে কি সারা পৃথিবীর ভালো মানুষগুলো আমেরিকার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এত প্রতিবাদ করতো, বা আহমদকে এত সমর্থন করতো? আমার কিন্তু মনে হয় না। আহমদ মুসলিম বলেই করেছে।

ইসলাম কিন্তু কোনও বর্ণ নয় বা রেস নয়। মুসলিমরা সাদা হলুদ বাদামি কালো যে কোনও বর্ণের হতে পারে। যে কোনও জাতিই তারা হতে পারে। ইসলাম কেবলই এক ধর্ম। খ্রিস্টান ধর্ম যেমন এর উৎপত্তিস্থল থেকে ভ্রমণ করেছে নানা অঞ্চলে, ইসলামও তেমন। আহমদকে যারা অপছন্দ করে বা ভয় পায়, তাদের বর্ণবাদী বলার চেয়ে মুসলিম-ভীতু বলাটাই হয়তো ঠিক। (মুসলিম বিদ্বেষী বলার চেয়ে মুসলিমদের যারা ভয় পায় তাদের মুসলিম ভীতু বললাম, ইংরেজিতে মুসলিমফোবিয়াও বলতে পারি। ইংরেজিতে একটি শব্দ খুব প্রচলিত, ইসলামোফোবিয়া। এই শব্দটিতে ভয়ের চেয়ে ঘৃণার ইঙ্গিতই বেশি দেওয়া হয়। ইস্কুল শিক্ষক এবং পুলিশ যারা আহমদকে হেনস্থা করেছে তারা মুসলিমদের নিয়ে তাদের ভয় থেকে করেছে, বর্ণবাদ থেকে নয়।

সাদা বর্ণবাদীরা সম্ভবত অনেকেই মুসলিম বিদ্বেষী।কিন্তু কেন তারা হিন্দু বিদ্বেষী, বৌদ্ধ বিদ্বেষী, জৈন বিদ্বেষী, শিখ বিদ্বেষী না হয়ে মুসলিম বিদ্বেষী? এর কি কোনও কারণ আছে নাকি একেবারেই নেই? আমরা কি বলতে পারবো, যে তারা এমনি এমনি মুসলিম বিদ্বেষী হয়ে গেছে? কিছু কি কারণ নেই এর পেছনে? খুব বেশি দিন তো হয়নি টুইন টাওয়ার উড়ে গেলো চোখের সামনে, খুব বেশিদিনও হয়নি দুটো কচি ছেলে ব্যাগে প্রেসারকুকার-বোমা নিয়ে বস্টন ম্যারাথনের ভিড়ের মধ্যে ফোঁটালো, কিছু মানুষ মারা গেল, কিছু হাত-পা হারালো। ইদানীং খবরে প্রায় প্রতিদিনই শুনছি আইসিস বা ইসলামিক স্টেট মানুষকে জবাই করছে, শত শত মানুষকে নীল ডাউন করিয়ে মাথায় গুলি করছে। শিশু আর কিশোরীদের অপহরণ করছে, ধর্ষণ করছে। দেখছি ইসলামের নামে বোকো হারাম কী করে মানুষ মারছে, আর মেয়েদের ধর্ষণ করছে, বাজারে বিক্রি করছে। আল-শাবাব কী করে গুলি চালাচ্ছে, অবলীলায় শত শত মানুষ মারছে। বর্বরতা, নৃশংসতা, ভয়াবহতা এরা ইসলামের নামেই করছে। ইজরাইলের রাস্তাঘাটে, বাসে ট্রেনে গায়ে বোমা বাঁধা মুসলমানরা কিছু ইহুদি মারবে বলে নিজেকে উড়িয়ে দিতেও দ্বিধা করেনি। ডেনিস কার্টুনের কারণে দেশে দেশে আগুন জ্বালিয়েছে মুসলমান জঙ্গীরা। ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগেছে এই অভিযোগ করে ক্রিস্টানদের ফাঁসাচ্ছে পাকিস্তানী মুসলিমরা। ইসলামের সমালোচনা করেছে এই অজুহাতে বাংলাদেশের ব্লগারদের কুপিয়ে মারছে মুসলমান মৌলবাদীরা। এইসব খবর কারও অজানা নয়। সে কারণে তারা সম্ভবত মুসলমানদের ভয় পায়, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে। এ কী স্বাভাবিক নয়? এ কারণেই হয়ত এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি একটু ভালোভাবেই চেক করে মুসলমান নামের মানুষদের। এ কারণেই হয়তো মুসলমান নামের মানুষদের হাতে ঘড়ি অথচ ঘড়ির মতো দেখতে নয় কিছু একটা দেখলে পুলিশ ডাকে। আমেরিকার বাচ্চারা বন্দুক হাতে নিয়ে ইস্কুলে ঢুকে মানুষ মারে। বহুবার এরকম ঘটনা ঘটেছে। আমি নিশ্চিত, টেক্সাসের ওই ইস্কুলেও যদি আমেরিকার কোনও সাদা ছাত্র খেলনা রাইফেল বা খেলনা পিস্তল নিয়ে ঢুকতো, সবাই তটস্থ হয়ে পিস্তলটি সত্যিকারের পিস্তল কি না তা যাচাই করতে পুলিশ ডাকতো। কারণ এ রকম ঘটনা ঘটেছে আগে।

মুসলিমদের সন্দেহ করা যাবে না, এ কেমন কথা? মুসলিমদের সন্দেহ করলেই বা ইসলামের সমালোচনাকরলেই, নতুন একটা গালি বানানো হয়েছে, ইসলামোফোবিয়া, সেটি তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়। এই গালির ভয়ে মানুষ মুখ বুজে থাকে। আমি মনে করি, ইসলামোফোবিয়া শব্দটি বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অত্যন্ত অশ্লীল একটি শব্দ। এই শব্দটি যত দ্রুত বিলুপ্ত হবে, তত ভালো। এই শব্দটিকে অক্ষত রেখে বাক স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন চালানো সম্ভব নয়। ইহুদিদের বাইহুদিদের ধর্মের বিরুদ্ধে কোনও সমালোচনা করলেই এন্টি-সেমেটিক বলে গালি দেওয়া হয়, এই গালিও বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে একটি গালি। এটিরও বিলুপ্তি প্রয়োজন। নিরাপত্তার কারণে সব ধর্মের, সব জাতের, সব ভাষার, সব রঙের মানুষদের ব্যাপারেই সতর্ক থাকতে হবে। তবে কিছু মানুষের ক্ষেত্রে একটু বেশি সতর্ক থাকা উচিত। ব্যক্তিগতভাবে একজন মুসলমান সর্বগুণে গুণান্বিত হতে পারে, কিন্তু সে কথা তো বাইরের সবার জানার কথা নয়, সমষ্টিগতভাবে মগজধোলাই হচ্ছে কিনা তার খবর সবার তো জানা নেই। যেমন জানা ছিল না ফুটফুটে দুই জারনায়েভ ভাই ভেতরে ভেতরে মগজধোলাই হয়েছে। ব্যাকপ্যাকে যদি প্রেসারকুকার বোমা থাকতে পারে, পেন্সিল বাক্সে ঘড়ি-বোমা থাকতে পারে, এ যে কেউ ভাবতে পারে। আমি ওদের ভাবনাটার মধ্যে কোনও দোষ দেখি না। সবাইকে আমরা সমানভাবে বিশ্বাস করি না, করা উচিত নয় বলেই করি না। আমাদের চিন্তাশক্তি, বুদ্ধি বিবেচনা যুক্তি খাঁটিয়ে আমরা মানুষকে বিচার করি, কারও ওপর আস্থা রাখি, কারও ওপর রাখি না।

আহমদ মোহাম্মদকে ওবামা ডেকেছেন, সমর্থন জানিয়েছেন বাঘা বাঘা সব লোক। আহমদ কতটা বুদ্ধিমান জানি না। ও বড় হয়ে কত বড় বিজ্ঞানী হবে তা জানি না, তবে শুনেছি ও ঘড়ির বিভিন্ন পার্টস কিনে এনে জোড়া দিয়েছে মাত্র। তবে যা কিছুই করুক, যেভাবেই যা বানাক, তাকে আমি ধন্যবাদ দিই সে যে বোমা না বানিয়ে। ঘড়ি বানানোর চেষ্টা করেছে। আমেরিকার অনেক মুসলিম কিশোরই আইসিসে যোগ দিয়েছে, ইরাকে আর সিরিয়ায় গিয়ে জঙ্গীদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে মানুষ মারছে। অনেক শিশু-কিশোরকে জঙ্গীরা খুন করতে শেখাচ্ছে। অনেকে জঙ্গীদের আকারে ইঙ্গিতে অথবা প্রকাশ্যে সমর্থনও করছে। আইসিসের পোশাক না পরে আহমদ নাসার টিশার্ট পরেছে, সে কারণে কৃতজ্ঞতা জানাই তাকে। আমরা আহমদকে উৎসাহ দেবো যেন সে বিজ্ঞানমনস্ক হয়, শিক্ষিত হয়, সচেতন হয়। কিন্তু অনুগ্রহ করে কেন আহমদকে সন্দেহ করা হলো, সে মুসলমান বলেই সন্দেহ করা হলো, সাদারা সবাই রেসিস্ট, আমেরিকানরা মুসলিম-বিদ্বেষী বলে ন্যাকামো না করাই ভালো। মুসলমানকে কেন সন্ত্রাসী বলে সন্দেহ করা হয়, তা না জানলে জেনে নিন মুসলমানদের সন্ত্রাসের ইতিহাস। গর্ত খুঁড়ে পুরোনো কাহিনী বের করতে হবে না। যা ঘটছে চারদিকে এখন, তা জানলেই যথেষ্ট।

সন্ত্রাসী যে কোনও ধর্মের, যে কোনও বর্ণের মানুষই হতে পারে। তবে ধর্মের নামে হলেই গোটা ধর্মীয় গোষ্ঠীর ওপরও সন্দেহের চোখ পড়ে। এ আমাদের বুঝতে হবে এবং এই সন্দেহ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে মুসলিমদের উচিত ধর্মের নামে যারা জিহাদ করছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, নিজেদের ধর্মান্ধতা থেকে মুক্ত করা, বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত করা। মুসলিম জঙ্গিরা মুসলিমদের যতটা ক্ষতি করেছে, ততটা ক্ষতি অন্য কোনও শ এ যাবৎ করেনি।

ঈদ

মুসলমানদের জন্য পবিত্র দিন। ঈদের নামাজ তো সুপার পবিত্র। আর ঈদের নামাজেই কিনা বোমা মেরেছে মুসলিম সন্ত্রাসীরা যারা নিজেদের সবচেয়ে খাঁটি মুসলমান বলে দাবি করে! নাইজেরিয়ায় নিহত, ইরাকে নিহত, সৌদি আরবেও নিহত। এখন কথা হলো, ধার্মিকেরা যদি ঈদের দিন নামাজ পড়তে থাকে, তাহলে কী উদ্দেশে আরেক দল ধর্মপ্রাণ ওদের লক্ষ্য করে বোমা ছোড়ে, ওদের খুন করে? ইসলাম ধর্ম শান্তির ধর্ম–কিন্তু চারদিকের কোথাও শান্তি তো দেখি না। এই ধর্ম নিয়ে বর্বরতা কম হচ্ছে না। প্রতিটি মুসলিম দেশে কোনও না কোনও অশান্তি লেগেই আছে।

ঈদের নামাজ নিষিদ্ধ

আইসিসের কাণ্ড। তারাঈদের নামাজ নিষিদ্ধ করেছে ইরাকের মসুলে। বলেছে, ঈদের নামাজের সঙ্গে ইসলামের কোনও সম্পর্ক নেই। উপবাসের পর খাওয়া-দাওয়ার আর দল বেঁধে প্রার্থনার উৎসব এক কাফেররাই করতো। পুরোনো কালের মুসলিমরা ঈদের নামাজ পড়তো না। মসুলের কারও অধিকার নেই ঈদের নামাজ পড়ার। কেউ যদি নামাজ পড়তে যায়, তাদের নাকি মেরে ফেলা হবে। এই ইরাকে বসে বসে কী কাণ্ডই না করেছে আইসিসের সশস্ত্র লোকগুলো! বুলডোজার দিয়ে, ডিনামাইট দিয়ে, কুড়োল দিয়ে, শাবল দিয়ে ভেঙেছে মুসলমানের মাজারগুলো, শিয়াদের মসজিদগুলো, হাজার বছরের পুরোনো শিল্পকর্ম, মিউজিয়াম।

আইসিস কি একসময় নামাজ জিনিসটাকেই নিষিদ্ধ করবে? কারণ নামাজটা তো ইসলাম আসার আগে বিধর্মীরা পড়তো! ইহুদিদের আর কপ্টিক ক্রিশ্চানদের প্রার্থনা রুকু সেজদাসহ নামাজের মতোই। আইসিস তো মাজার, এমনকি কাবা শরিফ, রওজা শরিফ সব ভেঙে ফেলার কথাও বলছে। এগুলোও নাকি একধরনের মুর্তি পুজো। অনেকে মনে করে, ১৪০০ বছর আগের খাঁটি ইসলাম ধর্মকেই আইসিস অবিকৃত অবস্থায় পালন করছে। আইসিস সেনারা, অনেককে বলতে শুনেছি, পয়গম্বরের যোগ্য উত্তরসূরি।

বিধর্মীদের সংস্কৃতি যদি আইসিস ইসলাম থেকে বাদ দিতে শুরু করে, তাহলে শেষ অবধি কী থাকবে অবশিষ্ট ইসলামে? আইসিস তো এও বলতে পারে, এখন থেকে শুয়োর খাওয়া হালাল, কারণ আরবদেশে শুয়োর খাওয়া হারাম ছিল বিধর্মীদের মধ্যে। এখন থেকে খৎনা করা হারাম, কারণ বিধর্মীরা অর্থাৎ ইহুদিরা খনা করতো। কাফেরদের, বিধর্মীদের, অমুসলিমদের, অবিশ্বাসীদের গল্প আদম হাওয়ার গল্প। ইসলাম শুরু হওয়ার হাজার বছর আগেই এই গল্প লেখা হয়েছে। তাহলে এই গল্পটিকেও আনৈসলামিক বলে বাদ দেওয়া যায়? এভাবে নুহ নবীর গল্প, আবিল। কাবিলের গল্প, এবং আরও অনেক গল্পকে ইসলামের গল্প নয় বলে সরিয়ে রাখতে হয়। ওসব গল্প ইসলামের অনেক আগের, তাহলে ওসবও ডিলিট করে দিতে হয়। বাহাত্তর জন হুরি এবং হাতে গোনা কিছু গল্প ছাড়া সবই তো প্রায় হয় পেগানদের, নয় ইহুদি নাছারাদের গল্প। ইসলাম শুধু অন্য সংস্কৃতি থেকে নয়, ধর্ম গ্রহণ করেছে অন্য ধর্ম থেকে। সব ধারগুলো আজ ফেরত দিলে কি ইসলাম আর ইসলাম থাকবে? আইসিস যদি এভাবে চলতে থাকে যেভাবে চলছে, তাহলে খুব শীঘ্র ইসলাম বলে সম্ভবত কিছুরই আর অস্তিত্ব থাকবে না।

একবিংশ শতাব্দীতে সপ্তম শতাব্দীর সংস্কৃতি আনতে চাওয়া কি বৃদ্ধির কথা! মানুষ পেছনে যাবে নাকি সামনে এগোবে! মানুষ আর কতটা পেছোবে! পিছু হঠতে হঠতে দেয়ালে ঢুকে গেছে পিঠ। যখন নারীর স্বাধীনতা পাওয়ার কথা, মানবাধিকার লজ্বন না হওয়ার কথা, দারিদ্র ঘুচে যাওয়ার কথা, যখন সবারই বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার কথা, যখন মানুষের আরও মানবিক হওয়ার কথা, আলোকিত হওয়ার কথা, তখন লোক ধর্ম ধর্ম করে মাতম করছে, ফিরতে চাইছে অন্ধকার যুগে। আইসিস ছাড়াও অন্ধকারের উপাসনা করার লোক এই পৃথিবীতে আরও আছে।

ভাবছি মসুলের মানুষের কথা। ঈদের নামাজ পড়তে গেলে তাদের আজ খুন হয়ে যেতে হবে। ধর্মকর্ম করার অধিকারও মানবাধিকারের অংশ। আমি নিজে ধর্মে বিশ্বাস করি না, কিন্তু মানুষের ধর্মে বিশ্বাস করার অধিকারের জন্য আমি লড়ি। মসুলের মানুষ যদি ঈদের নামাজ পড়তে চায়, তবে সেই অধিকার তাদের থাকা উচিত। একই রকম কারও কারও যদি ধর্মে বিশ্বাস না করতে ইচ্ছে হয়, ধর্মের সমালোচনা করতে ইচ্ছে হয়, সেই অধিকারও তাদের থাকা উচিত। কিন্তু জোর করে ধর্মকর্ম করতে বাধা দেওয়া আর ধর্মের সমালোচনা করতে বাধা দেওয়া– দুটোরই বিরুদ্ধে আমি। স্বাধীনতায়। বিশ্বাস করলে বাক স্বাধীনতা আর ধর্ম বিশ্বাসের স্বাধীনতা দুটোতেই বিশ্বাস করতে হয়। স্বাধীনতায় আমি গভীরভাবে এবং বড় অকপটভাবে বিশ্বাস করি। স্বাধীনতাহীন জীবন বড় দুঃসহ।

মাঝে মাঝে ভাবি পৃথিবীর এত সহস্র কোটি মুসলিম আইসিসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কেন করে না? কেন অনেকে সব জেনেশুনে আইসিসে যোগ দেয়? আইসিসের আদর্শে তবে কি তারা সত্যিই বিশ্বাস করে নাকি মানুষের মাথা লক্ষ্য করে গুলি করার আর ধারলো ছোরা দিয়ে মানুষের মুণ্ডু কাটার আনন্দ তারা উপভোগ করতে চায়, নাকি অল্প বয়সী মেয়েদের অবাধে ধর্ষণ করার আর অগুনতি যৌন দাসীকে ভোগ করার মজা পেতে চায়? এছাড়া যে আইসিস নামাজ নিষিদ্ধ করে, যে আইসিস মসজিদ গুঁড়ো করে, ইউনুস নবীর কবর ভাঙে, কাবা ভেঙে ফেলার স্বপ্ন দেখে, ইসলামের এতকালের পবিত্র সৌধ যারা উড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের প্রতি মুসলিম যুব সমাজের এত কেন আকর্ষণ?

আইসিসকে দমানোর চেষ্টা চলছে। মধ্যপ্রাচ্যের বড় শক্তি সৌদী আরব নিজেকে বাঁচানোর স্বার্থেই আইসিসকে নিশ্চিহ্ন করবে। আবার সৌদি আরবের ভেতরের অনেক খাঁটি ইসলামপন্থীদের টাকায় আইসিস শক্তশালী হতে থাকবে। আর আমরা দুর থেকে দেখতে থাকবো হত্যাযজ্ঞ। নিরীহ মানুষ বলি হতে থাকবে আর আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে থাকবো আর অপেক্ষা করতে থাকবো মানুষের শুভবুদ্ধির। শুভবুদ্ধি সবার উদয় হয় না, হবেও না। কিন্তু আমাদের অপেক্ষা ফুরোবে না।

অপেক্ষা ছাড়া নিরীহ মানুষের আছেই বা কী।

তবে এই কথা জোর দিয়ে বলতে পারি, এক আইসিস গেলে আরও আইসিস আসবে। আইসিস তাদের নৃশংসতা দেখিয়েছে পৃথিবীকে। এই নৃশংসার চর্চা আরও বহুকাল চলবে, যতদিন না মানুষ ধর্মকে গৌণ করতে পারে আর মানবতাকে মুখ্য করতে পারে। মানবতাকে মুখ্য করার শিক্ষাটা ধর্মশিক্ষার বাইরের শিক্ষা, সভ্যতার, সমতার, সমানাধিকারের শিক্ষা। আইসিস তৈরি হওয়া সহজ, আইসিসের বিপরীত আদর্শে মানুষকে দিক্ষিত করা সহজ নয়। আইসিসের আদর্শে খুন ধর্ষণ লুটতরাজ আর ভায়োলেন্স। আইসিসের বিপরীত আদর্শে আছে শান্তি। শান্তি প্রতিষ্ঠা করা কোনওকালেই কোনও গোষ্ঠীতেই সহজ ছিল না, সহজ নয়।

এই কঠিন কাজটিই আমাদের করতে হবে।

উইকিপিডিয়া

আমার উইকিপিডিয়া পেইজে লেখে কারা? সেই আদিকালে আমার ওপর একটা পেইজ খোলা হয়েছিল। কে খুলেছিল কে জানে। আজগুবি তথ্য থাকতো। ওসব তথ্য চোখে পড়লে দ্রুত সরিয়ে নিতাম চোখ। অনেক বছর পর নিজে একবার সঠিক তথ্য দিয়ে উইকিপিডিয়ার ভুল সংশোধন করলাম। করলে কী হবে, পরদিনই আবার সঠিক তথ্য পুরোটাই মুছে দিয়ে ভুল তথ্য এসে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেল। আবারও সংশোধন করলাম। ওই একই অবস্থা। এরপর তৃতীয় বার সংশোধন করতে গেলে উইকিপিডিয়ার সিকিউরিটি গার্ড ফার্ড এসে আমাকে রীতিমত ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। সম্ভবত আমার নামটাই ওদের খাতায় সাইবার ক্রিমিনাল হিসেবে লেখা হয়ে গেছে। উইকিপিডিয়াকে আমি একটা চিঠিও পাঠিয়েছিলাম। লিখেছিলাম এই যে আমার সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়ে বসে আছো অথচ আমাকে দিচ্ছে না সংশোধন করতে! এ কেমন বিচার! খুব তো ভাব ধরছো সব জানো সব বোঝো, তবে আমাকে চিনতে পারছো না কেন! কেন জানো না যে যাকে নিয়ে এই পেইজ, সে স্বয়ং আমি! নাহ, আমার কথা কারও কানে পৌঁছয়নি। এরপর আশা ছেড়ে দিয়েছি। যারা আমার সম্পর্কে লেখে উইকিপিডিয়াতে, তারা বেশির ভাগ না জেনে অথবা ভুল জেনে লেখে। ভুলভাল খবর যেসব বেরোয় পত্রপত্রিকায়, ওগুলোর উদ্ধৃতি দিয়ে লেখে। যার যা খুশি লেখে লিখুক। ও আমি দেখবোও না, পড়বোও না, শুনবোও না। মাঝে মাঝে ভাবি, আমি সাত খণ্ডে আমার আত্মজীবনী লিখেছি। এত বড় আত্মজীবনী খুব কম লেখকই লিখেছেন। আত্মজীবনীতে পুরো জীবনের কথাই লিখেছি আমি, অর্ধেক জীবনের নয়। কিছু গোপন করিনি। কিছু মিথ্যে লিখিনি। এই যে এতকাল ধরে আমার আত্মজীবনী পড়ছে লোকে, বছরের পর বছর ধরে ওসব ছাপা হচ্ছে, ফুরোচ্ছে, আবার ছাপা হচ্ছে। এসবের পাঠকেরা কোথায়? তারা কেন উইকিপিডিয়ার ভুল সংশোধন করছে না? তারা তো অন্তত জানে আমার জীবনের খুঁটিনাটি সব!

আজ হঠাৎ বাংলা উইকিপিডিয়ায় চোখ পড়লো। এ তো আরও অখাদ্য। চোখ বুলিয়ে দেখি আমার নাম নাকি ছিল নাসরিন জাহান তসলিমা, আমি নাকি কবিতা টবিতা লেখার সময় তসলিমা নাসরিন নাম দিয়েছি নিজের। আমার মা নাকি আমার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী। তারপর আমার হরেক রকম স্বামীর প্রসঙ্গ তো আছেই।

নকলবাজদের তো অভাব নেই। তারা কোথায়? তারা তো আমার ওয়েবসাইট, ফ্রিথট ব্লগইত্যাদি থেকেও আমার সম্পর্কে সঠিক তথ্য কপি পেস্ট করে উইকিপিড়িয়ায় দিতে পারে। নাকি সঠিক তথ্যে মজা নেই। মজা ভুল আর মিথ্যে তথ্যে? আমার মনে হয়, আমার সম্পর্কে এতকাল ধরে মৌলবাদী আর নারীবিদ্বেষী লোকেরা যে সব অপপ্রচার চালিয়েছে, ওগুলো সত্য তথ্য বলে একরকম প্রতিষ্ঠিতই হয়ে গেছে। মানুষের মস্তিষ্কেই ঢুকে বসে আছে ওসব। মানুষের মস্তিষ্ক এমন এক জিনিস, যেখানে ঢুকিয়ে দেওয়া সহজ, বের করা মোটেও সহজ নয়।

উপহার

বাংলাদেশের অবস্থা বোঝার জন্য বোধহয় এই ইনফোটুকুই যথেষ্ট। কী ঘটেছে। বলি। আজ সকালে এক তোড়া গোলাপ আর একটা চকলেট কেক এলো কুরিয়ারে। বিকেলে আসছে একটা দেওয়াল ঘড়ি। পাঠিয়েছে বাংলাদেশ থেকে আমার ছোটভাই মতো একজন। ফেসবুকেও আছে সে। একটু আগে ফোন করলো। আমি ধন্যবাদ জানালাম। বললো ঢাকা থেকে অনলাইনে অর্ডার করে এসব সে আমার জন্মদিনে উপহার পাঠিয়েছে।

আমি বললাম, আমি কি ফেবুকে তোমার এই সুইট সারপ্রাইজের কথা জানাবো?

ও বললো, জানান, তবে আমার নামটা দেবেন না আপা।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন নাম দেবো না, অসুবিধে কী?

ও বললো, আমার গলাটা কেটে ফেলে রেখে যাবে সন্ত্রাসীরা।

দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। দেশটা তাহলে নষ্ট হতে আর বাকি নেই।

এই সময়

১. ভালোই তো। স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্রতিবাদটি বেশ চমৎকার। প্রথম যেদিন দেখেছিলাম, বেশ ফুরফুরে লেগেছিল। প্রায় তিরিশ বছর যাবৎ অনেকটা একা একাই ট্যাবু ভেঙে চলেছি। তাই কাউকে ট্যাবু ভাঙতে দেখলে বেশ শান্তি পাই। স্যানিটারি ন্যাপকিনকে প্রতিবাদের মাধ্যম করা এই প্রথম নয়, আগেও করা হয়েছে। চার্লি নামে এক মেয়ে গতবছর একটা টুইট করেছিলেন, টুইটটা এরকম: মেয়েদের পিরিয়ডকে যেরকম ঘেন্না করে পুরুষেরা, ধর্ষণকেও যদি একইরকম ঘেন্না করতো! এই টুইট দেখে এলোনে নামের এক জার্মান শিল্পী এমনি উত্তেজিত ছিলেন যে সে চার্লির ওই টুইটের কথাগুলো চল্লিশটা স্যানিটারি ন্যাপকিনের ওপর লিখে তাঁর শহরের দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে দিয়েছিলেন। টুইটের ওই কথা ছাড়াও নিজ থেকে আরও লিখেছিলেন, পুরুষরা মেয়েদের শরীরকে ধর্ষণ করে, পোশাককে নয়। এসবের জন্য এলোনে নিন্দিত নন্দিত দুই-ই হয়েছেন। এলোনে বলেছেন, মানুষকে একটু নাড়া খাওয়ানোর জন্য তিনি ইচ্ছে করেই স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেছিলেন। সেক্সিজম যে প্রতিদিনকার সমস্যা তা তাঁর মনে হয়েছে সবাইকে জানানো দরকার। এলোনে টের পেয়েছেন, পিরিয়ডকে ধর্ষণের সঙ্গে মিলিয়ে দিলে লোকদের বেশ অস্বস্তি হয়। ওই অস্বস্তি দিতে পারাটাই সাকসেস। এলোনে প্রথম স্যানিটারি প্যাড়কে শিল্পের পর্যায়ে তোলেননি। এর আগে ট্রেসি এমিন নামের একজন শিল্পী প্রেগনেন্সি টেস্টের পাশে একটা জারে পুরোনো ব্যবহৃত ট্যাম্পুন রেখেছিলেন। ওটাই ছিল ওর আর্ট। ওই আর্টটার নাম ছিল পেনটিংএর ইতিহাস-১। চিলির একজন আর্টিস্ট পাঁচ বছর ধরে জমানো পিরিয়ডের রক্তের একটা প্রদর্শনী করেছিলেন। প্রদর্শনীটা দেখে একজন মন্তব্য করেছিলেন, পুরুষের রক্ত উৎযাপন হয়, কারণ এ রক্ত সাহসের, আর আমাদের মেয়েদের রক্তকেই চিরকাল লজ্জার বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। চাবুকের মতো গায়ে লাগে এই সত্যটা।

ভারতের জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে স্যানিটারি প্যাডের প্রতিবাদ। যাদবপুরে এসে থামলে চলবে না। প্রতিবাদকে সারা উপমহাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। প্রতিবাদের এই ভাষাটি সার্থক এই কারণে যে, এই ভাষাটি ভদ্রলোকদের পছন্দ হচ্ছে না। ওদের পছন্দের ভাষা দিয়ে ওদের পছন্দের পুরুষতন্ত্রের প্রতিবাদ করলে প্রতিবাদটায় জোর থাকে না। যে ভাষা এতকাল ব্যবহৃত হয়েছে, সেই ম্যাড়ম্যাড়ে ভাষা পাল্টে আরও তীব্র, তীক্ষ্ণ ভাষা ব্যবহারের সময় এসেছে। নিষিদ্ধ রক্তমাখা কাপড় পতাকার মতো উড়িয়ে প্রতিবাদ হোক পুরুষতন্ত্রের, নারীবিদ্বেষের। পুরুষের শেখানো ভাষায়, পুরুষের দেখানো পথে এতকাল মেয়েরা হেঁটেছে, এবার নিজেদের মতো করে হাঁটুক।

নারীর না হয়ে ঋতুস্রাব যদি পুরুষের হতো, তবে কিন্তু ঋতুস্রাবের রক্ত নিয়ে সমাজে লজ্জা করার কিছু থাকতো না। বরং পুরুষের ওই রক্তকে পবিত্র বলে ঘোষণা করা হতো, ওদের রক্তকে পুজোও করা হতো, ওদের স্যানিটারি প্যাডকে ওরা অত্যন্ত গৌরবের সঙ্গে প্রদর্শন করতো। নারীর ঋতুস্রাবের রক্তকে পুরুষেরা এতকাল ঘৃণা করেছে, এই রক্তকে অপবিত্র বলেছে, আজ নারীরাই তাদের রক্তকে পবিত্র বলে ঘোষণা করুক। এই পবিত্র রক্ত দিয়ে লিখে রাখুক যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে তাদের গর্জে ওঠার কাহিনী।

২.ছাত্র রাজনীতির ভাষা খুব একটা বদলাচ্ছে বলবো না। তবে কিছুটা তো বদলানোর চেষ্টা হচ্ছে। ছাত্র আন্দোলন এখনও নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়নি। মাঝে মাঝে দুএকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের ওপর যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ হচ্ছে, এই যা। ছাত্রছাত্রী উভয়ে মিলে প্রতিবাদ করছে। কিন্তু এই প্রতিবাদে যোগ না দেওয়া ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যাও কিন্তু প্রচুর। এটুকু প্রতিবাদ, এটুকু রুখে ওঠা যথেষ্ট নয়। এই প্রতিবাদ ছড়িয়ে দিতে হবে সর্বত্র। নারী-আন্দোলনকে নারীদের নিজস্ব আন্দোলন ভাবাটা ঠিক নয়। নারীর সমস্যা সমাজের সমস্যা। সমাজের সমস্যার সমাধান করতে সমাজের সবার অংশগ্রহণ জরুরি। সামাজিকভাবে না হলে, রাজনৈতিকভাবে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। ছাত্ররা সমাজের সচেতন শ্রেণী। এই শ্রেণী যদি নারীর মানবাধিকার লঙ্নের প্রতিবাদ না করে, তবে করবে কে? নারীর সমানাধিকারের প্রয়োজনীয়তাকে অবজ্ঞা করে যে রাজনীতি, সে রাজনীতি কোনোমতেই সুস্থ রাজনীতি নয়।

৩. স্যানিটারি ন্যাপকিন সাঁটিয়ে আন্দোলন করাটা, আমি মনে করি, অভিনব এবং নান্দনিক। আগেই বলেছি নারীবিদ্বেষীদের গায়ে এই আন্দোলনটা জ্বালা ধরাচ্ছে বলে এই আন্দোলনটার সফল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। পুরুষেরা যখন জামা খুলে বুকে পিঠে গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক লিখে মিছিলে হাঁটে, মানুষ মুগ্ধ হয়, কবিরা তাদের নিয়ে কাব্য লেখেন, শিল্পী ছবি আঁকেন, চিত্রপরিচালক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, চারদিকে তাদের জনপ্রিয়তা হৈরৈ করে বাড়ে। আর ফেমেন গোষ্ঠীর যে মেয়েরা খোলা বুকে-পিঠে একই জিনিস লিখে রাস্তায় হাঁটে, পুলিশ দৌড়ে এসে চ্যাংদোলা করে তাদের সবকটাকে তুলে থানায় নিয়ে যায়। স্লোগান লেখা পুরুষের খোলা শরীর গৌরবের, আর স্লোগান লেখা নারীর খোলা শরীর লজ্জার,ঘৃণার,সংকোচের! খোলা বুকে ফেমেনের যে প্রতিবাদ, তাকে নান্দনিক বলবে না সমাজের ভদ্রলোকরা। ফেমেনের প্রতিবাদ ভদ্রলোকদের অস্বস্তি দেয়। অস্বস্তি দেয় বলেই নারীর সমস্যা নিয়ে ফেমেনের প্রতিবাদগুলো সাড়া ফেলেছে, মানুষ উঠে বসেছে, সমস্যাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছে, সচেতন হচ্ছে।

যারা অভিযোগ করছে স্যানিটারি ন্যাপকিন সাঁটিয়ে আন্দোলন করাটা নান্দনিক নয়, তাদের বলছি– যৌনহেনস্থা নান্দনিক নয়, ধর্ষণ নান্দনিক নয়, ডমেস্টিক ভায়োলেন্স নান্দনিক নয়, তবে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদটাকে কেন নান্দনিক হতে হবে?

এই সব সমালোচক ভদ্রলোক সমাজে আগেও ছিল, এখনও আছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে এদের সংখ্যাটা অনেক বেশি। এদের মূল্য দেওয়ার আদৌ কোনও প্রয়োজন নেই। এরা মেয়েদের নিতান্তই যৌন সামগ্রী ছাড়া আর কিছু বলে ভাবতে পারে না। এরা যত শীঘ বিলুপ্ত হয়, তত শীঘ্র আসবে সমাজের মঙ্গল।

৪. যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে যাদবপুরের আন্দোলন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের জানাচ্ছি আমার সংগ্রামী অভিনন্দন। সারা দেশে কন্যাশিশু হত্যা, বাল্য বিবাহ, পণপ্রথা, বধূনির্যাতন, বধূহত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, খুন, ঘৃণা, ইত্যাদির শিকার হচ্ছে মেয়েরা। মেয়েদের নিরাপত্তা কোথাও নেই, ঘরে নেই, রাস্তা ঘাটে নেই, এমনকী সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠেও নেই। যে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুসংস্কার, অন্ধত্ব, বৈষম্য থেকে মুক্ত হওয়ার কথা, নারী-পুরুষের সমানাধিকার বিষয়ে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জ্ঞান দেয়, শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে, সচেতন করে, আলোকিত করে — সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থা ঘটে, এর চেয়ে লজ্জা আর কী আছে। সবচেয়ে সুস্থ, শিক্ষিত, সচেতন, চরিত্রবান, আদর্শবান নাগরিক তো আশা করি আছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই! নারী-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীকেই সরব হতে হবে। প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেই সত্যিকার শিক্ষিত হওয়া হয় না। নারীকে যারা যৌনবস্তু ঠাওরায়, তাদের আদৌ শিক্ষিত বলে গণ্য করা উচিত নয়।

৫. স্যানিটারি প্যাড নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা হয় না। দোকান থেকে প্যাড কিনলে দোকানী নিজ দায়িত্বে বাদামি কাগজের ঠোঙায় প্যাড ঢুকিয়ে দেয়, যেন বাইরে থেকে কেউ বুঝতে না পারে এটা স্যানিটারি প্যাড। যারা ঋতুস্রাবকে নোংরা আর অপবিত্র বলে, তারাই স্যানিটারি প্যাড নিয়ে নাক সিঁটকাবে। তাই তো স্বাভাবিক। স্যানিটারি প্যাড নিয়ে আজ আলোচনা শুরু হয়েছে, আলোচনা হতে হতেই একসময় এ নিয়ে আলোচনাটা স্বাভাবিক হয়ে আসবে।

ধর্ষণ আর যৌনতা নিয়ে আজকাল আলাপ আলোচনা হয়। কিন্তু আগে এ দুটো বিষয় নিয়ে আলাচনা হওয়ার জো ছিল না। দুটোই ছিল ট্যাবু সাবজেক্ট। বেড়ালের গলায় ঘন্টা বেঁধেছে কেউ। আলোচনা অল্প সল্প শুরু করেছে। এখন এটি অল্পে সল্পে সীমাবদ্ধ নেই।

৬. যাদবপুরের আন্দোলন যদি রাজ্য সরকার ভালো চোখে না দেখে, তাহলে বুঝতে হবে রাজ্য সরকার নারীর অধিকারকে ভালো চোখে দেখে না। পুরুষতন্ত্র এমনই ভয়ংকর ক্ষমতাধর যে নারীকেও বাধ্য করে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা গ্রহণ করতে। বদ-পুরুষের মতো অনেক নারীও ধর্ষণের জন্য দোষ দেয় ধর্ষিতাকে। যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাটাকে অন্যায় বলে ধরে নেয় যাদবপুরের প্রশাসন, তবে বুঝতে হবে ওই প্রশাসন আজ নারীবিদ্বেষীদের দখলে। চারদিকে শুধু সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত, সত্যিকার শিক্ষিত মানুষের বড় অভাব। এখন তরুণদের ওপর ভরসা। ওরাই জীর্ণ পুরাতনকে বিয়ে করবে।

৭. আমার আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ডে আমি আমার শৈশবের কথা লিখেছি। ১৮ বছর আগের লেখা বই আমার মেয়েবেলা। এখনও মানুষ পড়ছে। এখনও পাঠকের কাছে এই বইটি খুব প্রিয়। যে কথা বলতে হয়না, সে কথা আমি বলেছি। বলাটা উচিত বলেই বলেছি। না বলার পেছনে কোনও যুক্তি দেখিনি বলেই বলেছি। লোকে নিন্দা করবে, ছিঃ ছিঃ করবে, তা নিয়ে দুর্ভাবনায় পড়ার মানুষ আমি নই। আমার মেয়েবেলা পড়ে প্রচুর মেয়ে আমাকে বলেছে, তাদের জীবনেও ওই ঘটনাগুলো ঘটেছে যা আমার জীবনে ঘটেছে। পার্থক্য শুধু এই, আমি মুখ ফুটে বলেছি, তারা বলতে পারেনি। আমি না হয় অনেক মেয়ের হয়েই লিখলাম। লেখা পড়ে ওদের অনেক নির্ভার লাগে। ওরাও সাহস সঞ্চয় করে, ওরাও আমার মতো করে বলতে চেষ্টা করে, বলে, ঘুরে দাঁড়ায়। এভাবেই সমাজের পরিবর্তন হয়। ঢাক ঢোল পিটিয়ে। পরিবর্তন চাই বললেই পরিবর্তন চলে আসে না। পরিবর্তনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়। হাজার বছরের পুরুষতান্ত্রিক সংস্কারকে অস্বীকার করতে বুকের পাটা লাগে। সেই বুকের পাটাটা অর্জন করা সহজ নয়।

আমার ঋতুমতী হওয়ার কাহিনী বর্ণনা করেছি বলে, অথবা কিভাবে যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছি আমি, সেই গল্পটা দ্বিধাহীন বলেছি বলে যারা আমার নিনে করেছে, যারা আমার সত্য বলাটা অপছন্দ করেছে তাদের আমি বড় করুণার চোখে দেখি, তাদের ক্ষুদ্রতার সঙ্গে আমি কোনওকালেই আপোস করি না। ওইসব লেখাতে বাংলাদেশে আমার মেয়েবেলা বইটি হাসিনা সরকার অশ্লীলতার দোষ দিয়ে নিষিদ্ধ করেছে ১৯৯৯ সালে। বইটি আজও ও দেশে নিষিদ্ধ। ছোটলোকরা তো বলেই বেড়িয়েছে, আমি বেশ্যা। বেশ্যা না হলে, তারা বিশ্বাস করে না, নিজের ওপর যৌন হেনস্থার বর্ণনা এত নির্লজ্জ ভাবে কোনও ভদ্রঘরের মেয়ে দিতে পারে। অনেক বড় বড় লেখক পর্যন্ত বলেছেন, তোমার মেয়েবেলাটা ভালোই লিখেছিলে, তবে ওই যৌনতার বর্ণনাটা দেওয়ার দরকার ছিল না। ওটা ভালগার। হ্যাঁ আমি তোমাদের বদমাইশির কথা লিখলে সেটা ভালগার, আমি আমার শরীরের কথা লিখলে সেটা অশ্লীল। আর তোমরা যখন নারীর শরীরের বর্ণনা দাও, যৌন সঙ্গমের বর্ণনা দাও, সেটা শিল্প। নারীর শরীর নিয়ে পুরুষরা লিখলেই আর্ট, আর নারীরা লিখলেই অশ্লীলতা, বেশ্যাদের মতো কাজ। এই নষ্ট সমাজ থেকে এর চেয়ে ভালো কিছু হয়তো আশা করাও যায় না।

মেয়েরা যদি পুরুষের শেখানো ভাষায় না লেখে, কী বলবে-কতটুকু বলবে কোথায় সীমা টানবে— এই রুলটা না মানে, তবে পুরুষতান্ত্রিক লোকদের বড় রাগ হয়। এই সমাজে যে মেয়েরা নারীবিরোধীদের গায়ে রাগ না ধরাতে পারে, যে মেয়েরা নারীবিরোধীদের কাছ থেকে নষ্ট, স্লাট, বেশ্যা ইত্যাদি আখ্যা না পায় — সেই মেয়েদের নিয়ে খুব বেশি আশা করার নেই।

নারীবিরোধী সমাজের সঙ্গে আপোস যারা করে না, যারা অবাধ্য, যারা নিয়ম ভাঙে, তারাই সমাজ পাল্টায়। তারাই বিবর্তন ঘটায়। আমি তাদেরই স্যালুট করি।

৮. রূপী কৌরের ঋতুস্রাবের রক্তমাখা ছবিটা দুর্দান্ত। দিপিকা পাড়ুকোনের মাই চয়েজ ভিডিওটাও অসাধারণ। মেয়েরা শেষ অবধি কথা বলছে। যাদবপুরেও মেয়েরা জেগে উঠেছে। মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখতে হলে এই জাগরণটার ভীষণ প্রয়োজন। মানুষ-প্রজাতির এক দল তার নিজের প্রজাতিকে কেবল ভিন্ন লিঙ্গ হওয়ার কারণে নির্যাতন করছে, বঞ্চিত করছে, লাঞ্ছিত করছে, হেনস্থা করছে, এবং হাজার হাজার বছর ধরে এটা চলছে; গায়ের জোরে, পেশির জোরে, অশিক্ষা আর কুশিক্ষার জোরে চলছে –ভাবলে শিউরে উঠি। আরও হাজার বছর আগেই উচিত ছিল এই জাগরণের। নারী পুরুষকে এক মিছিলে হাঁটতে হবে সমানাধিকারের দাবিতে। আমরা পেশি দিয়ে সমাজ চালাই না, বুদ্ধি দিয়ে চালাই। সুতরাং যার পেশির জোর বেশি, সে বেশি মুল্যবান, যার পেশির জোর কম, সে কম মুল্যবান–এভাবে ভাবাটা হাস্যকর। নারী তার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পেলে নারীর চেয়ে পুরুষই বেশি উপকৃত হবে। সঙ্গিনী হিসেবে শিক্ষিত স্বনির্ভর সমকক্ষ নারীকে পাওয়া আর দাসি বাঁদিকে পাওয়ার মধ্যে বিরাট পার্থক্য।

নারী-পুরুষের বৈষম্য ঘোচানোর দায় নারীর একার নয়। এ বৈষম্য ঘোচানোর দায় সব মানুষের। যে মানুষেরা সচেতন, যে মানুষেরা চেঁচালে, চেষ্টা করলে বৈষম্য ঘোচে, দায়িত্বটা তাদেরই নিতে হবে। নারী-পুরুষের বৈষম্য যতদিন থাকবে ততদিন মানবজাতিকে সভ্য জাতি বলার কোনও যুক্তি নেই। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই নারীবিরোধী পুরুষরা পুরুষরক্ষা সংগঠন, পুরুষাধিকার সংস্থা ইত্যাদি গড়ে তুলেছে। এসব সংগঠন নারীবিরোধিতা, নারীবিদ্বেষ, নারীঘৃণা প্রচার করতে সারাক্ষণই ব্যস্ত। আমার খুব ভালো লাগে, যখন দেখি পুরুষরা নারীর অধিকারের পক্ষে মিছিলে নামছে। এই পুরুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়, কিন্তু এই সংখ্যাটা বাড়ুক, চাই। এই সংখ্যাটা বাড়লেই সমাজে পরিবর্তন আসবে। যে পুরুষরা নারীকে ধর্ষণ করে, খুন করে, তারা আজ প্রতিজ্ঞা করুক আজ থেকে কোনও নারীকে তারা ধর্ষণ করবে না বা খুন করবে না। যে পুরুষরা নারী নির্যাতনে বেশ হাত পাকিয়েছে, তারা আজ প্রতিজ্ঞা করুক নারী নির্যাতন আর করবে না। যে পুরুষেরা যৌন হেনস্থা করে, তারা আজ থেকে বন্ধ করুক যৌন হেনস্থা। আজ থেকে সংসারের যাবতীয় কাজ, নিজেদের সন্তান-পালন, নিজেরা মিলেজুল করুক। আজ থেকে বাইরের দুনিয়ার কাজ নারী-পুরুষ উভয়ে করুক, স্বনির্ভর আর পরনির্ভরের সংসারের বদলে সংসার হয়ে উঠুক দুজন স্বনির্ভর মানুষের সংসার। আজ থেকে নারী আর পুরুষের সমতা আসুক সংবিধানে, রাষ্ট্রে, আইনে, সমাজে, পরিবারে, অফিসে, আদালতে, রাস্তা-ঘাটে, বাসে, ট্রেনে, জাহাজে, লঞ্চে সর্বত্র। নারী-পুরুষের মধ্যে গড়ে উঠুক সত্যিকারের বন্ধুতা। প্রভু-দাসির সম্পর্কটা, উঁচু নিচুর সম্পর্কটা সম্পূর্ণ নির্মূল হোক।

একটি মৃত্যু

কত ছেলেকে রাস্তায় পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। কত ছেলে মার খেয়ে খেয়ে বেঁচে থাকে। কত মেয়েকে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়। কত মেয়েকে প্রতিদিন স্বামীর অত্যাচার সইতে হয়! তাদের খবর কজন রাখে!

আমরা তো জানিই যে মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলে মানুষ। মানুষের এই হত্যাযজ্ঞ কি কেউ থামাতে পেরেছে আজ অবধি? মানুষ তো মানুষকে পেটাচ্ছে, চিল ছুড়ছে, হয়রানি করছে, এসব দেখে অভ্যস্ত, এসব নৃশংসতা দেখে সবাই যে যার মতো বাড়ি চলে যায়, সংসার করে। ফুটপাতের মৃতদেহ ডিঙিয়ে সকালে আপিসের দিকে হাঁটে। কারও সময় নেই থমকে দাঁড়িয়ে থাকার, অথবা প্রতিবাদ করার। মানুষ দল বেঁধে দেখে যখন কোনও মেয়েকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হয়। মানুষ হাততালি দেয় যখন কাউকে উলঙ্গ করে গ্রাম জুড়ে হাঁটানো হয়। এ কি মানুষের আজকের স্বভাব? আদিকালে মানুষকে শুলে চড়ানো, ফাঁসিকাষ্ঠে চড়ানো, ক্রশবিদ্ধ করা– সবই জনতার সামনে হতো। জনতা হাততালি দিত, হাসতো, ঘৃণা ছুঁড়ে দিতো অত্যাচারিত নির্যাতিত অসহায় মানুষগুলোকে লক্ষ্য করে। এ আমাদের মানুষজাতির বৈশিষ্ট্য।

কিছুদিন আগে বাংলাদেশের এক গ্রামে রাজন নামের একটা গরিব ছেলেকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে কিছু লোক। পেটানোর দৃশ্য অনেকে দেখেছে। দেখেছে আর হেসেছে। পিটিয়ে মেরে ফেলার ভিডিও ওরা ফেসবুকেও দিয়েছে। এই যে দিন-দুপুরে একটা ছেলেকে মেরে ফেলা হলো, কেউ কি বাঁচাতে এসেছিল? কেউ আসেনি। রাজন নাকি কী চুরি করেছিল, তাই পেটানো হয়েছিল। আমি কিন্তু একথা বলতে চাইছি না। যে রাজনকে গরিব করেছে এই সমাজ, দোষটা সমাজের। চুরি না হয় করেছে রাজন, তাই বলে তাকে মেরে ফেলতে হবে?। আমি শুধু বলতে চাইছি, মানুষ নামক জাতটার জন্য বর্বরতা নৃশংসতা নিষ্ঠুরতা হিংস্রতা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। দুর্বলকে মেরে ফেলে। মানুষের মতো কাজই করেছে ওরা। সবল-মানুষ দুর্বল-মানুষকে মারে। ধনী-মানুষ গরিব মানুষকে মারে। পুরুষ মানুষ মেয়ে মানুষকে মারে। নানা কায়দায় মানুষ মানুষকে মারে। প্রতিদিন মারে। কেবল রক্ত গড়ালেই আর শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হলেই কি মৃত্যু ঘটে? অনেকে মার খেতে খেতে মৃতবৎ বেঁচে থাকে।

গোটা জগত জুড়ে মারামারি চলছে। কিছু মানুষ মারামারি ঠেকাতে রূপকথার আশ্রয় নেয়, ঈশ্বরের ভয় দেখিয়ে মানুষকে শান্ত করে। কিছু মানুষ আইন বানিয়েছে, শাস্তির ভয় দেখিয়ে মানুষের রক্তপিপাসা কমায়। কিছু শুভবুদ্ধির মানুষ ইস্কুল খুলেছে, মানুষকে খুনী না হওয়ার পরামর্শ দেয়। আজ যদি মানুষ জানে ঈশ্বর,ভগবান বা আল্লাহ বলে কিছু নেই, যদি জানে দেশে কোনও শাস্তির আইন নেই, মানুষ হত্যা করতে তারা আজই ঝাঁপিয়ে পড়বে। রক্তে ভেসে যাবে পৃথিবী। আমি বলতে চাইছি, মানুষ মূলত বর্বর, মূলত ভয়ংকর দানব। বলতে চাইছি, মানুষ অত্যন্ত নৃশংস বীভৎস প্রজাতি। হাতে গোনা কিছু শুভবুদ্ধির মানুষ সাধারণ মানুষকে পরামর্শ দেয় স্বভাব চরিত্র বদলাতে, নৃশংসতা বন্ধ করতে। এ অনেকটা সাপকে ছোবল না দেওয়ার পরামর্শ দেওয়ার মতো।

কেউ কেউ বলছে রাজনকে কামরুল নামের এক লোক যৌন নির্যাতন করতে চেয়েছিল, কিন্তু রাজন রাজি হয়নি বলে চুরির অপবাদ দিয়ে ওকে মেরেছে। কামরুল কয়েক লাখ টাকা পুলিশকে ঘুষ দিয়ে পালিয়ে যায় সৌদি আরবে। সৌদি আরবে তাকে ধরা হয়েছে। ধরা হয়েছে সম্ভবত মিডিয়া সরব ছিল বলে। তা না হলে কজন পালিয়ে যাওয়া ধর্ষক বা খুনীকে এভাবে ধরা হয়।

একবার আমি সচক্ষে দেখেছিলাম বাসের এক পকেটমারকে কী করে পিটিয়েছিল। বাসের যাত্রীরা। কারও পকেট থেকে দুটাকা চুরি করেছিল গরিব পকেটমার ছেলেটি। খবরটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাসের কিছু যাত্রী ঝাঁপিয়ে পড়লো ছেলেটার ওপর। বাসের বাকি যাত্রীরা কী কারণে ছেলেটাকে মারছে না জেনেই আক্রমণে অংশ নেয়। কী ভীষণ আক্রোশ। পারলে ছেলেটাকে প্রাণে মেরে ফেলে। অন্যকে মারায় যে এত আনন্দ তা না দেখলে বিশ্বাস হতো না। মেরে ছেলেটার হাড়গোড় ভেঙেছিল। রক্ত বেরোচ্ছিল ছেলেটার নাক মুখ দিয়ে। তারপরও ওরা থামেনি। থামানোর চেষ্টা করে দেখেছি, আমিও মার খাচ্ছি। পৃথিবীর আর কোনও প্রাণী নিজেদের এভাবে অত্যাচার করে বলে আমার জানা নেই। মানুষই সম্ভবত একমাত্র প্রজাতি যে অন্য প্রজাতিকে শুধু নয়, নিজ প্রজাতিকেও নির্যাতন করে।

রাজনকে মারার ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছে বলে রাজনের হত্যার বিরুদ্ধে আন্দোলন তীব্র হচ্ছে। যদি প্রতিটি অত্যাচারের, নির্যাতনের, ধর্ষণের, হত্যার ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করা হয়? মানুষ কি সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হবে রাজনের মৃত্যুতে যেরকম সরব হয়েছে? এই প্রশ্নটি আমি ফেসবুকেই করেছিলাম। উত্তর যা এলো,তা দেখে আমি থ। ধর্ষণের ভিডিও পোস্ট করলে ধর্ষিতার প্রতি মায়া হওয়া আর ধর্ষকের বিরুদ্ধে রুখে ওঠার বদলে বরং এই ধর্ষণটাকে মানুষ নাকি উপভোগ করবে। পর্ন ছবিগুলো অনেকটা ধর্ষণের মতোই। আজকাল পর্ন ছবির বিজ্ঞাপনেও বলা হয় যে ভায়োলেন্স আছে, রেপ আছে, মেয়েদের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া আছে। শুধু ধর্ষণই কি উপভোগ করবে, হয়তো অত্যাচার আর খুনও উপভোগ করবে। কেউ কাউকে মারছে, এই দৃশ্য দেখতে তো মানুষের চিরকালই খুব ভালো লাগে। তাই তো ভায়োলেন্সের আর যুদ্ধের চলচ্চিত্র এত জনপ্রিয়।

কদিন পর রাজনকে মানুষ ভুলে যাবে। তার খুনীর কোনও বিচার হয়েছে কী না কেউ খবরও নেবে না। নতুন রাজনরা মরবে। মানুষ হয়তো জানবেও না। খুনীরা আর অত্যাচারীরা পার পেয়ে যাবে, যেমন পার পেয়ে যায়। গরিব মরলে বেশিরভাগ সময় মানুষ কোনও প্রতিবাদ করে না। গরিবের অপঘাতে মৃত্যুকে অস্বাভাবিক বলে কারও মনে হয় না। হঠাৎ হঠাৎ ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটে। রাজন হত্যার বিচার চাওয়াটা ব্যতিক্রম।

মানুষকে মানুষ হলেই চলবে না, শুভবুদ্ধির মানুষ হতে হবে। তা না হলে মানুষ নামক প্রজাতির মধ্যে বর্বর আর হিংস্র মানুষ ছাড়া আর কেউই রইবে না।

এলোমেলো

একটা জিনিস আমি প্রায়ই খুব মিস করি। দরজায় হঠাৎ কারও কড়া নাড়া।

সেকালে এই কড়া নাড়াটা ছিল। যে কোনও দিন, যে কোনও সময়, যে কেউ প্রতিবেশী, আত্মীয় বা বন্ধু কড়া নাড়তো দরজায়। চা নাস্তা হতো, লাঞ্চ ডিনারও হতো। ঘরে দুধ চিনি না থাকলে পাশের বাড়ি থেকে ধার করে আনা হতো। সেকালে মোবাইল ছিল না, ল্যাণ্ড ফোনেরও ব্যবহার ছিল না খুব। অ্যাপোয়েন্টমেন্টের ব্যাপার ছিল না। এভাবেই দেখা হতো মানুষের। এভাবেই হঠাৎ দরজায় কড়া নেড়ে।

এখন সবকিছুই খুব ভালো। খুব গোছানো। সাজানো। এতে আমাদের স্বস্তি হয়, আমাদের সময় বাঁচে। এখন আমি জানি কখন কার সঙ্গে কবে কোথায় আমার দেখা হবে। কোনও চমক নেই। অপ্রত্যাশিত কিছু নেই। কিন্তু কেন জানি না, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সবকিছু আবার উল্টে দিই। আগের মতো এলোমেলো করে দিই।

এস

লুক্সেমবার্গের এস শহর সেদিন আমাকে সাম্মানিক নাগরিকত্ব দিল। যে শহর নিয়ে আমি কোনওদিন ভাবিনি, যে শহরে বাস করার জন্য আমি কাঁদিনি,সে শহর দিয়েছে সর্বোচ্চ সম্মান। আর যে সব শহরকে আমার শহর বলে বিশ্বাস করি, সেসব শহর থেকে পেয়েছি সর্বোচ্চ অসম্মান। গোটা ব্যাপারটাই কী রকম যেন রূপকথা রূপকথা লাগে।

এসব কী হচ্ছে দেশে?

দেশের খবর নিতে গেলেই আজকাল দেখছি মসজিদের ইমামরা শিশু ধর্ষণ করছে। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে মসজিদের ইমাম মসজিদের ভেতরেই এক শিশুকে ধর্ষণ করেছে। সাতকানিয়ায় এক মসজিদের মুয়াজ্জিন ধর্ষণ করেছে আট বছর বয়সী এক শিশুকে। সিলেটের মৌলভীবাজারে এক মাদ্রাসা প্রিন্সিপাল নবম শ্রেণীর ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে। আগে আমরা ভাবতাম মসজিদ মাদ্রাসার মৌলভীদের বিজ্ঞানবোধ না থাকলেও নীতিবোধ থাকে। এখন দেখছি সেটিও নেই। মাদ্রাসার হুজুরদের, মসজিদের ইমামদের সৎ এবং আদর্শবান মানুষ হিসেবে সমাজের লোকরা ভেবে আসছে বহুকাল। বাবা মারা নির্দ্বিধায় নিজেদের সন্তানকে সঁপে দেন ওদের হাতে। ওরা অসহায় নিরীহ শিশুদের ধর্ষণ করতে দুবার ভাবে না। শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার করে নিশ্চিন্তে নির্ভাবনায়। অনুমান করতে পারি কতটা বর্বর হলে, কতটা কুৎসিত হলে, কতটা নৃশংস হলে শিশু ধর্ষণে উদ্যোগী হয় পুরুষরা! অথচ ওরা নাকি দিনরাত আল্লাহর নাম জপে, আল্লাহর কালাম পড়ে, আল্লাহর সেবায় নিয়োজিত। আল্লাহ কি শিশু ধর্ষণ পছন্দ করেন? আল্লাহ কি ওই ইমামদের উপদেশ দিয়েছেন শিশুদের ধর্ষণ করার জন্য? আমার তো ভয় কখন ওরা বলে বসে আল্লাহ বলেছেন ধর্ষণ করতে। কিছুদিন আগে আইসিসের জঙ্গীরা বললো, আল্লাহকে ধন্যবাদ আমাদের বিধর্মী মেয়েদের ধর্ষণ করতে দেওয়ার জন্য।

কী যুগ এসেছে? আল্লাহর কালাম পড়া আল্লাহ নাম জপা পরহেজগার মুসলমানদের হাতে এখন ধারালো চাপাতি, তাদের হাতে এখন পিস্তল, রাইফেল, তাদের হাতে অস্ত্র, মারণাস্ত্র। কিছুদিন আগে খবরে পড়লাম, আইসিস নাকি এক বছরের মধ্যে পাকিস্তানের কাছ থেকে পারমাণবিক বোমা কিনছে। যেভাবে সিরিয়া আর ইরাকের প্রাচীন ঐতিহ্য আর ইতিহাস ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে, সেভাবেই পৃথিবীটাকে পারমাণবিক বোমা মেরে উড়িয়ে দেবে ওরা। মানুষ খুন করতে করতে, যা পাচ্ছে হাতের কাছে সব ধ্বংস করতে করতে, ধ্বংসের নেশায় পেয়েছে এদের। এরা যতদিন বাঁচে ততদিন ধ্বংস করবে, আর ধর্ষণ করবে। বোকা হারাম তো অগুনতি শিশুকে ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছে। ধর্ষণ এরা ধর্মের নামেই করছে। ধর্ম কি ধর্ষণের কথা বলে? উত্তরে বেশির ভাগ মানুষ বলবে, না। তবে ধর্ষণের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক না থাকলেও, ধর্ষণের সঙ্গে নারীবিদ্বেষের সম্পর্ক আছে, এ ব্যাপারে কোনও দ্বিধা নেই। নারীবিদ্বেষের সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক কিন্তু পুরুষ রচিত ধর্মগুলোর, কেউ স্বীকার করুক বা না করুক।

বাংলাদেশে সেদিন ধরা পড়েছে কোকাকোলা কোম্পানির আইটি প্রধান আমিনুল ইসলাম বেগ। পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, লোকটি প্রকৌশলীর আড়ালে একজন দুর্ধর্ষ জঙ্গি নেতা। জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মোজাহেদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) বর্তমান সমম্বয়ক হিসেবে কাজ করছেন। কোকাকোলা কোম্পানির চাকরি তার ওপরের লেবাস। প্রকৃতপক্ষে তিনি বাংলাদেশের জঙ্গি জেএমবি ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইসিসের বাংলাদেশের সমন্বয়কারী। একদল আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণদের দিয়ে জিহাদ করানোর উদ্দেশ্যে তিনি কাজ করছিলেন। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে ইরাক ও সিরিয়ায় পাঠিয়েছেন। আরও যারা যেতে ইচ্ছুক তাদের পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পাশাপাশি বাংলাদেশেও ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠায় জিহাদ করার জন্য আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণদের উদ্বুদ্ধ করছেন। অবাক লাগে, ধর্মান্ধতা আর কুসংস্কার দূর করার জন্য বিজ্ঞানশিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলি, অথচ সবচেয়ে বেশি যারা ধর্মান্ধ-জিহাদি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে, তারা বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত লোক। বিজ্ঞানশিক্ষা এরা কোনও ভালো কাজে খাটায় না। যদি আদৌ খাটায়, তবে ধ্বংস করার জন্য, নির্মাণ করার জন্য নয়। আইসিসের গণহত্যা কেউ রোধ করতে পারছে না। সিরিয়ার পালমিরা অঞ্চলটি দখল করার পর ৪০০ জনকে ওরা হত্যা করেছে, যাদের বেশির ভাগই নারী আর শিশু। ওরা আল্লাহর দোহাই দিয়ে নারী আর শিশুকে ধর্ষণ করছে, হত্যা করছে। আর আমরা গোটা বিশ্ব মুখ বুজে দেখছি ওদের ধর্ষণযজ্ঞ, হত্যাযজ্ঞ।

বাংলাদেশ আজও প্রতিভাবান ব্লগারদের যারা খুন করেছে, তাদের গ্রেফতার করতে পারেনি। শাস্তি দেওয়া দুরের কথা। এদিকে আবার আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। অন্তত এতদিনে একটা ভালো কাজ করেছে সরকার। অবশ্য নিষিদ্ধ করে কী ছাই হবে যদি না খুনীদের গ্রেফতার করা না হয়। একটি নিষিদ্ধ দলের লোক যুক্তিবাদীদের জবাই করে চলে যাবে, দিনে দুপুরে গর্দানে কোপ মেরে চলে যাবে, পুলিশ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে, ওপরের নির্দেশ না এলে খুনীকে ধরবে না। এরকম যদি নিয়ম হয়, তবে আনসারুল্লাহর নিষিদ্ধ হওয়া না হওয়ায় নিশ্চয়ই কিছু যায় আসে না।

সেদিন শুনি গরুধর্ষণ হয়েছে। নারী ধর্ষণ, কিশোরী ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণের পাশাপাশি গরুধর্ষণ চলছে। নিরীহ পশুপ্রাণীদেরও বাদ দেয় না পুরুষরা। নীতি আদর্শ সমস্তই লোপ পেয়েছে! যত বেশি ধর্ম বাড়ছে দেশে, তত বেশি অনাচার বাড়ছে। অথচ আমরা এরকমই শিখেছি ছোটবেলা থেকে, যত বেশি ধর্ম বাড়বে, তত বেশি অনাচার কমবে। আমি হিসেব মেলাতে পারি না। ধর্ম কি তবে মন্দ লোকরাই বেশি পালন করে? নাকি মন্দ কাজ করার জন্য ওপরে একটা ধার্মিকের লেবাস লাগানো হয়, যেন কারও সন্দেহভাজন হতে না হয়? আমার তো মনে হয়, ধার্মিকের লেবাস দেখলেই আজকাল ধর্ষক আর খুনী বলে অনেকের সন্দেহ হয়।

আমার নানা, আমার মা ছিলেন ধার্মিক। ধর্মের অর্থ তাঁরা বুঝতেন কারও অনিষ্ট না করা, কাউকে কষ্ট না দেওয়া, বরং অন্যের দুঃখ-কষ্টে পাশে দাঁড়ানো, অন্যের অভাব দূর করা। ছোটবেলায় ওঁদের মতো অনেক ধার্মিকের দেখা আমি পেয়েছি। কিন্তু এ বেলায় এসব কী দেখছি দেশে? আগে ধর্ম মানে মানুষ বুঝতো সহিষ্ণুতা, উদারতা, মানবতা। আর এখন ধর্ম মানে হিজাব, হিংস্রতা, রমজান মাসে বিশাল খানাপিনা, ঈদে গরু জবাইএর ধুম, ধর্ম মানে এখন মানুষ কুপিয়ে মারা, দিন দুপুরে গরুর মতো জবাই করে ফেলে রাখা। ভাগ্যিস আমার নানা বেঁচে নেই, মাও বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে ধর্মের এই রূপ দেখে ওরা নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেতেন। আসলে ধর্ম যেমন ছিল, তেমনই আছে। মানুষ পাল্টেছে। বর্বর লোকরা ধর্মকে বর্ম হিসেবে রেখে যত বীভৎস হতে পারে হচ্ছে।

ধর্মকে আবার মানবিক করার সময় এসেছে। মসজিদের খুতবায়, মাদ্রাসার ক্লাসঘরে মগজধোলাই হচ্ছে কি না লক্ষ্য রাখতে হবে। ব্যাঙের ছাতার মতো মসজিদ নির্মাণ করা উচিত নয়। এগুলোকেই ধর্ষকরা অতঃপর ব্যবহার করতে শুরু করবে ধর্ষণের নিরাপদ জায়গা হিসেবে, যেহেতু মানুষ মসজিদে কোনও অপবিত্র কাজ হয় না বলেই ধারণা করে। ইমামদের, মাদ্রাসার শিক্ষকদের চোখে চোখে রাখতে হবে যেন তারা ছেলেদের জঙ্গি হিসেবে তৈরি না করে, যেন শিশুদের ধর্ষণ না করে। ধর্ম করতে এসে অধর্ম করলে চলবে কেন!

ইমাম ছাড়াও অন্য পুরুষরা অহরহই ধর্ষণ করছে। ইমাম জাতও পুরুষের জাত। কিন্তু ইমামের গুরুত্বটা অনেক। ইমামকে দেখে শেখে পুরুষরা। ইমামের পেছনে দাঁড়িয়ে পুরুষরা নামাজ পড়ে। ইমামের কথা এবং কাজকে তারা মান্য করে, ইমামের উপদেশ পরামর্শ মতো জীবন যাপন করে। সুতরাং ইমাম যদি ধর্ষক হয়, তবে সমাজের পুরুষরা তার কাছ থেকে ধর্ষক হওয়ার প্রেরণা পাবে। সুতরাং ইমামদের চরিত্র নষ্ট হলে চলবে না। ইমামদের গতিবিধি নজর রাখার ব্যবস্থা না হলে সমূহ বিপদ।

দেশে দিন দিন দুঃসংবাদের পাহাড় গড়ে উঠছে। কী ভালোই না হতো যদি দেশটি থেকে ধর্ষণের খবর না আসতো। সেদিন একটা গারো মেয়েকে গণধর্ষণ করা হলো বাংলাদেশে। বাসের ভেতর। ভারত থেকে ভালো অনেক কিছু তো শেখার আছে। শিখলো শিখলো গণধর্ষণটাই শিখলো? যে লোকগুলো মেয়েটাকে ধর্ষণ করেছে, ওদের জিজ্ঞেস করুন, ওরা ধর্মে বিশ্বাস করে কি না, সবাই, আমি নিশ্চিত, বলবে, করে। আল্লাহকে মানে? বলবে, মানে। তোমরা কি নাস্তিক? জিজ্ঞেস করুন। ওরা খুঁসে উঠবে। এত বড় অসম্মান। আমাদের নাস্তিক বললো? ওরা তীব্র প্রতিবাদ করবে, বলবে যে ওরা আস্তিক। মাঝে মাঝে মনে হয়, নাস্তিক হওয়ার পথই বোধহয় সহিষ্ণ হওয়ার, উদার হওয়ার, মানবিক হওয়ার সঠিক পথ।

ও আমার দেশের মাটি

একসময় এই গানটি বেশ গাইতাম, ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি। এই গানগুলো আর গাই না আমি। কারণ গানগুলোর কথা এখন আমি আর বিশ্বাস করি না। কথাগুলোয় প্রচুর ভুল। শুধু আবেগ দিয়ে মিথ্যেকে সত্য করা যায় না। সত্যকেও মিথ্যে করা যায় না। বাংলাদেশ সকল দেশের সেরা দেশ নয়। বরং বার বার প্রমাণ করছে পৃথিবীর আর সব দেশের চেয়ে প্রায় সবদিক থেকেই পিছিয়ে আছে দেশটি। এই দেশটি নিয়ে কোনও শিক্ষিত-সচেতন মানুষ গর্ব করবে না। দেশটিতে দারিদ্র, প্রতারণা, অন্যায়, অত্যাচার, বৈষম্য, নির্যাতন একেবারে রমরমা। তাই তো দেখি বাংলাদেশের ভেতর ভারতের ১১১টি ছিটমহল থেকে ৯৭৯ জন লোক ভারতে যেতে চাইছে, আর ভারতের ভেতর বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল থেকে কেউ বাংলাদেশে ফিরতে চাইছে না। এই ঘটনা থেকেই আমরা অনুমান করতে পারি বাংলাদেশের প্রতি কারও আশা নেই, কারও সত্যিকার ভালোবাসা নেই, কেউ বিশ্বাস করে না দেশটিকে, কারও সামান্য আস্থা নেই দেশটির ওপর। এই দেশটি থেকে বছর বছর অমুসলিমরা চলে যাচ্ছে নিরাপদ কোনও দেশে। হিন্দুর সংখ্যা কমতে কমতে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দেশটিতে ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, অশিক্ষা, অসচেতনতা এত তীব্র যে কেউ দেশটিতে আর বাস করতে চায় না। সুযোগ পেলে সবাই চলে যেতে যায় দেশের বাইরে। আজ যদি সীমান্তে কোনও কাঁটাতারের বেড়া না থাকতো, বা দেশ থেকে ভিসার নিয়ম উঠে যেতো, আমার বিশ্বাস দেশসুদ্ধ লোক দেশ ছাড়তো। দেশটা শুকনো পড়ে থাকতো সুদূর মরুভূমির মতো।

ভারতভাগের সময় পাকিস্তান থেকে হিন্দু যত গেছে ভারতে, ভারত থেকে মুসলমান তত আসেনি পাকিস্তানে। ইস্কুল কলেজ একরকম খালি হয়ে গিয়েছিল দেশভাগের পর। শিক্ষক নেই। বেশির ভাগ ছাত্র নেই। হিন্দুরা ছিল মুসলমানদের চেয়ে বরাবরাই বেশি শিক্ষিত। তাদের অধিকাংশই দেশ ছাড়ার পর মুখতার ভারে মুখ থুবড়ে পড়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। দেশভাগের পর মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ যদিও দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে বলেছেন, হিন্দু-মুসলমানকে এক জাতি হিসেবে ঘোষণা করেছেন, তারপরও বারবার দাঙ্গা লেগেছে দেশে। পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুরা বার বার দেশত্যাগ করেছে। পাকিস্তানকে হঠিয়ে যে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছিল একাত্তরে, সেটি নিয়ে মানুষ স্বপ্ন দেখেছিল আবার। সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেছে কয়েক বছরে। দেশত্যাগ শুরু হয়েছে আবার। সব আশার প্রাচীর চুরচুর করে ভেঙে পড়েছে। দেশে অরাজকতা এত তীব্র যে বাংলাদেশ ত্যাগ করে ভারতে আজকাল শুধু হিন্দু যাচ্ছে না, মুসলমানও যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে, আসামে, আজ বাংলাদেশের মুসলমানের ভিড়। ভারতবর্ষের প্রায় সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে তারা। শুধু সামান্য অন্নবস্ত্রবাসস্থানের জন্য, জীবনের সামান্য নিরাপত্তার জন্য, সামান্য স্বস্তির জন্য ভারতে বসত গড়েছে। ভারতেই শুধু নয়, বাংলাদেশ ছাড়া প্রায় যে কোনও দেশেই, এমন কী অন্য কোনও গরিব দেশেও তাদের বাস করতে আপত্তি নেই। ইওরোপ-আমেরিকায় পাড়ি জমানোর জন্য সবাই এক পায়ে খাড়া। আগে গলা কাটা পাসপোর্ট হাতে নিয়ে, জীবনের বিশাল ঝুঁকি নিয়ে। হলেও, মানুষ দেশ ছাড়তো। দেশে থেকে কিচ্ছু হবে না, দেশে কিছু নেই সেই যে কতকাল আগে বলা শুরু করেছিল মানুষ, এখনও বলছে। দেশ নিয়ে হতাশার শেষ আজও হয়নি। আর সব দুর্যোগই কাটে, নড়বড়ে দেশও শক্ত পায়ে দাঁড়াতে শেখে, বাংলাদেশই শুধু পারে না, বাংলাদেশের দুর্যোগই শুধু কাটে না।

কিছুদিন আগে দেশের প্রগতিশীল ব্লগারদের সঙ্গে কথা বলেছি তাদের নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে। প্রত্যেকে, হ্যাঁ প্রত্যেকে দেশ ছাড়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে আমার লেখালেখির জন্য ফতোয়া জারি করেছিল ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীরা। আমার মাথার মূল্য ধার্য করেছিল ওরা। লক্ষ লক্ষ লোকের মিছিল হতো আমার বিরুদ্ধে, লং মার্চ হতো। সারা শহরে এক লক্ষ বিষাক্ত সাপ ছেড়ে দেবে বলে সাপুড়েরাও আমার ফাঁসির দাবিতে সাপ হাতে নিয়ে মিছিল করেছে। সুইসাইড স্কোয়াড় গঠন করা হয়েছিল আমাকে হত্যা করার জন্য। সরকার আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। অন্ধকারে আত্মগোপন করে থাকতে আমি বাধ্য হয়েছি। ওই ভয়াবহ দুঃসময়েও আমি দেশ ত্যাগ করার মতো দুঃস্বপ্ন দেখিনি। আর দেশের দুঃসময় এখন কত ভয়ংকর, কত বীভৎস হলে সব ব্লগাররা বাঁচার জন্য দেশ ত্যাগ করতে চাইছে! এই দুঃসময় অনুমান করাও বোধহয় আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

ব্লগারদের অনেকে এখন ইওরোপ আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়েছে। দেশ থেকে প্রগতিশীল আর শিক্ষিত-সচেতন মানুষগুলো উধাও হয়ে যাচ্ছে। অভিমানে, ক্ষোভে, ভয়ে, হতাশায় দেশের প্রতিভা আজ দেশের বাইরে পাড়ি দিচ্ছে। দেশ কি জানে দেশের কতটুকু সর্বনাশ হচ্ছে দিনদিন?

সরকার কিন্তু চাইলেই এই ক্ষতি রুখতে পারতো। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর তো একটিই কাজ, কী করে ছলে বলে কৌশলে গদিতে বসে আরাম করা যায়, লুঠতরাজ করা যায়, ধর্মান্ধদের আরও ধর্মান্ধ করা যায়, অচেতনকে আরও অচেতন করা যায়, অসৎকে আরও অসৎ করা যায়, প্রতারককে আরও বড় প্রতারক বানানো যায়। সরকারের চরিত্র এখনও যেমন ছিল তেমনই। সামান্যও শুধরায়নি কেউ। ধর্ম যেমন ধর্মান্ধ পেযে, দল তেমন দলান্ধ পোষে। রাজনৈতিক দলে এবং ধর্মে আজকাল খুব একটা তফাত দেখি না। ধর্মগুলো দিন দিন রাজনৈতিক হয়ে উঠছে। আর, রাজনৈতিক দলগুলো দিন দিন ধর্মীয় হয়ে উঠছে। ধর্ম টিকিয়ে রাখছে রাজনীতিকে। রাজনীতি টিকিয়ে রাখছে ধর্মকে। চমৎকার বন্ধুত্ব তাদের। শুধু বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ।

দেশটির ভবিষ্যত কী মাঝে মাঝে ভাবি। দেশে কারা বাস করবে শেষ অবধি? বেশির ভাগ ধনীরা আমেরিকায় চলে যায়। মধ্যবিত্তরা এশিয়া বাইওরোপের কোনও দেশে। গরিবরা যায় ভারতে। শুধু সেই ধনীরাই দেশে বাস করছে, যারা দেশটাকে প্রাণভরে লুঠ করতে পারছে। শুধু সেই দরিদ্ররাই দেশে বাস করছে, যারা কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছে না দেশ ছাড়ার। শুধু সেই মধ্যবিত্তরাই দেশে বাস করছে, যারা নিজেরা ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। এই বেশির ভাগের চিত্র। বাকি যারা দেশকে ভালোবেসে দেশে বাস করে, তাদের সংখ্যাটা ক্রমাগত কমে আসছে, সংখ্যাটা শূন্যে এসে ঠেকলেও আমি অবাক হবো না।

ইওরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে পৌঁছে প্রগতিশীল ব্লগাররা এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। জানিনা তারা কতদিন আর বাংলায় ব্লগ লিখবে! দেশ থেকে সহস্র মাইল দুরে বসে দেশের কথা লেখার উৎসাহ হয়তো একদিন হারিয়ে ফেলবে। সভ্য দেশগুলো দেশের প্রতিভাবান নাগরিকদের মাথায় তুলে রাখে। বাংলাদেশ তাদের চূড়ান্ত অসম্মান করলো। তাদের হারালো বাংলাদেশ। দেশের সম্পদকে পায়ে ঠেলছে দুর্ভাগা দেশ।

বাংলাদেশকে দেশ বলে ডাকতে আমার আর রুচি হয় না। দেশ মানে আমি নিরাপত্তা বুঝি। যে মাটিতে আমার নিরাপত্তা নেই, সে মাটি আমার দেশ নয়। বাংলাদেশ আসলে কাদের দেশ হয়ে উঠছে? বাংলাদেশ জেনেবুঝে এক পাল অশিক্ষিত, মুখ, নারীবিদ্বেষী, ধর্মান্ধদের দেশ হয়ে উঠছে। আমার লজ্জা হয়। হলে কী হবে, সরকারের তো হয় না।

 ওরা আটজন

পশ্চিমবঙ্গের এবং বাংলাদেশের যে কজন মানুষ আমাকে তাঁদের অফুরন্ত শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, স্নেহ এবং সমর্থন দিয়েছেন, আমার সুসময়ে শুধু নয়, আমার দুঃসময়েও পাশে ছিলেন, আছেন, তাঁরা অন্নদাশংকর রায়, শিবনারায়ণ রায়, অম্লান দত্ত, নিখিল সরকার, শামসুর রাহমান, শামীম সিকদার, চূর্ণী গাঙ্গুলী। ওঁরাই আমার আত্মীয়, আমার স্বজন, আমার বন্ধু, আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। আজ ওঁদের অনেকেই বেঁচে নেই। ওঁদের মতো মানুষ আরও জন্মাক। পৃথিবীটা সুন্দর হোক আরও।

অন্নদাশংকর রায়

আমাকে খুব ভালোবাসতেন অন্নদাশংকর রায়। আমি যখন বাংলাদেশে আক্রমণের শিকার হচ্ছি, তখন থেকেই তিনি আমাকে নিয়ে অনেক বলেছেন, অনেক লিখেছেন। একবার তো ঘোষণা করলেন, আমি যেন সঙ্গে পিস্তল রাখি নিজের নিরাপত্তার জন্য।

ইউরোপের নির্বাসন জীবন থেকে যখনই কলকাতায় যেতাম, চাইতেন সবার আগে তাঁর বাড়িতে যাই। দুপুরের খাবার নিয়ে বসে থাকতেন, একসঙ্গে খাবেন। কত কথা যে বলতেন, কত কথা যে শুনতে চাইতেন। শুনতে চাইতেন বেশি।

একবার তিনি আমার সাক্ষাৎকার নিলেন। সেই সাক্ষাৎকারটা পুরো রেকর্ড করে নিয়ে এক ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছাপিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারটা নিয়ে ভীষণ উত্তেজিত ছিলেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি তখন বাড়ির বাইরে কোথাও যান না। তাঁকে কোলে করে এনে চেয়ারে বসাতে হয়, কোলে করে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিতে হয়। অথচ আশ্চর্য, ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের অডিটোরিয়ামে আমার মেয়েবেলার প্রকাশনা উৎসবে সভাপতিত্ব করতে দিব্যি চলে এলেন। আমাকে ভালোবাসেন বলেই তিনি অনুষ্ঠানে আসতে রাজি হয়েছিলেন।

ওখানেই তিনি তাঁর সেই বিখ্যাত ভাষণটি দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ তসলিমার মা, পশ্চিমবঙ্গ তসলিমার মাসি। মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি হয়না, কিন্তু তসলিমার বেলায় মনে হচ্ছে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি..। আমি তাঁর এই স্নেহ ভালোবাসার মর্যাদা ঠিক ঠিক দিতে পারিনি। বিদেশ থেকে কলকাতার কত কারও জন্য কত উপহার নিয়ে আসতাম। প্রতিবার ভুলে যেতাম অন্নদাশংকর রায়ের কথা। আমি কলকাতায় এসেছি শুনেই তিনি খবর পাঠাতেন, একবার যেন দেখা করতে যাই। অপেক্ষা করতেন আমার জন্য। আমি ব্যস্ত হয়ে পড়তাম তরুণ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায়। একবার খুব অল্প সময়ের জন্য তাঁর বাড়ি গেলাম, কথা দিয়ে এলাম দুদিন পর যাবো। দুদিন পর এলো। যথারীতি ভুলে গেলাম যেতে। তার পরদিন গিয়ে দেখি তিনি অচেতন অবস্থায় শুয়ে আছেন বিছানায়। আমি যে এসেছি দেখতে পেলেন না।

নার্স বললেন আমি আসবো বলে আগের দিন সারাদিন ভালো কাপড় চোপড় পরে ড্রইং রুমের চেয়ারে বসে ছিলেন। নার্স অনেকবার বিছানায় নিয়ে আসতে চেয়েছেন, রাজি হননি। বলেছেন, আজ তসলিমা আসবে। নার্স বলেছিলেন, রাত হয়ে গেছে, আর হয়তো আসবে না। তারপরও তিনি নড়েননি চেয়ার থেকে। বলেছেন, না না ও আসবেই। কথা যখন দিয়েছে আসবেই।

পরদিনের ওই অচেতন অবস্থা থেকে আর ফেরেননি অন্নদাশংকর রায়। খবর পাই, মারা গিয়েছেন। নিজেকে সেই থেকে আর ক্ষমা করতে পারিনি।

.

শিবনারায়ণ রায়

শিবনারায়ণ রায়ের সঙ্গে আমার পরিচয় বিরানব্বই সালে। সেই বিরানব্বইএর পর থেকে আমার জীবনে কত ফতোয়া, কত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস,কত নির্বাসন, কত নির্যাতন এলো, তিনি কখনও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেননি। লেখক সাহিত্যিক, সহযাত্রী, সহমর্মী, এমনকী আত্মীয় বন্ধুও সুদূর নির্বাসনে পড়ে থাকা একাকী আমাকে নিজেদের নানা ব্যস্ততায় ভুলে থেকেছেন। বছরের পর বছর কারও কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি। কিন্তু শিবনারায়ণ রায় তাঁর অপরিসীম স্নেহ থেকে আমাকে কোনওদিনের জন্য বঞ্চিত করেননি। যেখানেই ছিলাম, দেশে বা বিদেশে, তাঁর চিঠি পেতাম। প্রতিটি চিঠি কী অসম্ভব প্রেরণার চিঠি! সবসময় বলতেন, যেন লিখি, যেন হেরে না যাই, যেন ভেঙে না পড়ি। বলতেন, নির্বাসনে পৃথিবীর অনেক লেখককে কাটাতে হয়েছে, কারাগারে বসে সংগ্রামী লেখকরা উদ্যম হারাননি, লেখার জন্য খাতা কলম থাকতো

, মনে মনে লিখতেন। শিবনারায়ণ রায় মনে করতেন, সমাজে আমার একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা আছে, আমি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছি, যে কাজ করার সাহস এবং সততা সবার থাকে না।

তিরানব্বই সালে আমার ঢাকার বাড়িতে তিনি ছিলেন কদিন। প্যারিসেও আমাকে তিনি দেখতে গিয়েছিলেন দুহাজার সালে। তাঁর দুটি ফুসফুসের একটি নষ্ট ছিল বহুদিন। কিন্তু নিজের শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে অভিযোগ করতে কখনও শুনিনি।

শিবনারায়ণ রায় নাস্তিক ছিলেন জীবনভর। তিনি তাই মরণোত্তর দেহদান করে গেছেন। অনেক কপট নাস্তিকদের দেখেছি গোপনে গোপনে ধর্মের আচার অনুষ্ঠান সারতে। শিবনারায়ণ রায়ের মধ্যে কোনও কপটতা ছিল না।

আমার কলকাতার বাড়িতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করেছেন একটিও অর্থহীন কথা না বলে। তিনি সাহিত্য, সংস্কৃতি,দর্শন, বিজ্ঞান, মানববাদ, মানবতা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করতে পছন্দ করতেন। মানুষ চিন্তা করুক, চাইতেন। নিজে বিশ্বাস করতেন মুক্তচিন্তায়। চিন্তার চর্চা যে বাংলাদেশে হচ্ছে না, তা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করতেন। লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশ বলতে তিনি দুই বাংলাকে বোঝাতেন।

তাঁর প্রজ্ঞা, তাঁর প্রতিভা, তাঁর প্রত্যয়, তাঁর পান্ডিত আমাকে চিরকালই মুগ্ধ করেছে। কলকাতা থেকে আমাকে বিতাড়নের পর শিবনারায়ণ রায়কে দেখেছি বড় বিপন্ন বোধ করতে। আমাকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি কীভাবে কী করতে পারেন তা নিয়ে খুব ভাবতেন। পত্রিকায় প্রতিবাদ লিখেছেন, সভায় ভাষণ দিয়েছেন। কিন্তু এতে তিনি জানেন কোনও কাজ হয় না। বড় করুণ কণ্ঠে, বড় অসহায়। স্বরে বারবার বলেছেন, ওদের আমি চিঠি লিখতে পারি, কিন্তু আমার কথা তো ওরা শুনবে না!

বাঙালি সমাজে মনীষী আর কজনই রইলো! আমরা দীন ও দরিদ্র হয়ে পড়ছি দিনদিন। মনীষীদের আর্তি কারও কানে পৌঁছোয় না। মনীষীরা বড় নিঃসঙ্গ বেঁচে থাকেন। র‍্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট শিবনারায়ণ রায়ের যুক্তিবাদ এবং মানবতন্ত্রের সঙ্গে আমার মতের একফোঁটা কখনও বিরোধ ছিল না। একটা সময়ে মত বিরোধ দেখা দিল যখন তিনি পতিতাপ্রথার পক্ষে দুবারের আন্দোলনে শরিক হলেন, এবং আমি যেহেতু বরাবরই পুরুষতান্ত্রিকতার সবচেয়ে বীভৎস প্রথাটি নির্মুল হোক চাই, পতিতাপ্রথার পক্ষে তাঁর কোনও যুক্তিই আমি মেনে নিইনি। এই মত-বিরোধ সত্ত্বেও আমাদের সম্পর্ক একটি দিনের জন্যও এতটুকু নষ্ট হয়নি। পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক আগের মতোই অটুট ছিল। আমার আশংকা, শিবনারায়ণ রায় না হয়ে অন্য কেউ হলে সম্পর্কে হয়তো সামান্য হলেও চিড় ধরতো। তিনি ক্ষুদ্রতা সংকীর্ণতা, হিংসে দ্বেষএর সীমানা ছাড়িয়ে অনেক ওপরে ওঠা মানুষ ছিলেন। তিনি যে কোনও মতকে, সে মত তাঁর মত থেকে ভিন্ন হলেও, যদি যথেষ্ট যুক্তি থাকে সে মতের পক্ষে, গুরুত্ব দিতেন।

ক্ষমতার পেছনে, বড় বড় প্রতিষ্ঠানের পেছনে, নামের জন্য, অর্থের জন্য, সম্মানের জন্য কোনওদিন নিজের সত্তা বিকিয়ে দেননি তিনি। যতদিন বেঁচেছিলেন, নিজের নীতি আর আদর্শ নিয়ে মাথা উঁচু করেই ছিলেন।

শিবনারায়ণ রায়ের মতো অকুতোভয় মানুষ আমি কমই দেখেছি। জোর গলায় প্রতিবাদ করতেন, যা হয় হোক। কাউকে ছেড়ে কথা কইতেন না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে যারা রা-শব্দ খুব করে না, যারা গা বাঁচিয়ে চলে, তারা আজ প্রখ্যাত। আর শিবনারায়ণ রায় ছিলেন পেছনে অন্ধকারে। কলকাতার বাড়িটাও তাঁকে ছেড়ে দিতে হয়েছিল। শান্তিনিকেতন থেকে ট্রেনে চড়ে কলকাতায় এসে ছোটখাটো আলোচনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। যেদিন শেষ কথা হলো, মৃত্যুর তিন দিন আগে, বললেন হাওড়া স্টেশনের ভিড়ে তাঁর কিছুটা অসুবিধে হয় হাঁটতে। বললাম, কেউ যেন সঙ্গে থাকে এমন ব্যবস্থা কি করা যায় না?, শিবনারায়ণ রায় কারও সাহায্য নিয়ে বা কারও কাঁধে ভর দিয়ে চলতে রাজি নন। অনেকদিন আগে কেউ একজন তাঁকে একটা লাঠি উপহার দিয়েছিল হাঁটার জন্য, ওটিও কোনওদিন তিনি ব্যবহার করেননি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি নিজের পায়েই হেঁটেছেন।

.

অম্লান দত্ত

আমি তখন ঢাকায় থাকি। আমার কোনও একটি বই পড়ার পর আমার ঢাকার ঠিকানায় একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন অম্লান দত্ত। চিঠিতেই আমাদের অনেকদিন যোগাযোগ ছিল। তারপর একদিন ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে প্রথম তাঁর বক্তৃতা শুনে ভীষণ মুগ্ধ হই। অনুষ্ঠানের কোনও বক্তাই অম্লান দত্তের মতো এত অল্প কথায়, এত স্পষ্ট ভাষায়, আসল কথাটা এবং খাঁটি কথাটা এত চমৎকার বলতে পারেননি। আমি সেদিন ছুটে গিয়েছি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। জীবন ও জগতের অনেক কিছু নিয়ে সেদিন আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। মৃদুভাষী ছিলেন, সবার তর্ক বিতর্ক, মত ভিন্নমত শুনতেন, তারপর শেষ মন্তব্যটি করতেন, যেটির পর কারও কোনও কথা বলার দরকার হয় না। যখন নির্বাসন জীবন যাপন করছি, তিনি আমার বার্লিনের বাড়িতে কিছুদিনের জন্য আমার আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। তাঁকে তখন আরও কাছ থেকে জানার সৌভাগ্য হয়। তাঁর নীতি এবং আদর্শের সামনে, তাঁর নির্লোভ নির্মোহ জীবনের সামনে, তাঁর সততা এবং সারল্যের সামনে শ্রদ্ধায় বারবার আমি মাথা নত করেছি।

অম্লান দত্তের যে অসাধারণ গুণ আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে, তা হল নিজে ঈশ্বরবিশ্বাসী হয়েও আমার মতো নাস্তিকের কথা বলার স্বাধীনতার পক্ষে তিনি শুধু মত দেননি, আমাকে সমর্থন করে তিনি লিখেছেন, বলেছেন, সরব হয়েছেন সবখানে। সহিষ্ণুতার পক্ষে তিনি তাঁর মত প্রকাশ করে গেছেন সারা জীবন। পশ্চিমের নির্বাসন জীবন থেকে যখনই আমি কলকাতা আসার সুযোগ পেয়েছি, প্রতিবারই অম্লান দত্ত আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। প্রতিবারই আমাদের গল্প হয়েছে দীর্ঘক্ষণ, জীবন আর জগতের গল্প। বিজ্ঞান, ধর্ম, সাহিত্য, শিল্প, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি– যে কোনও বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে মন খুলে কথা বলা যেত, যে কোনও জটিল প্রশ্নের সহজ এবং সত্য উত্তর তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যেত। নির্বাসন জীবনে দেশ হারানোর বেদনায় যেন নুয়ে না থাকি; শুধু হা হুতাশ করে, চোখের জল ফেলে সময় নষ্ট না করে যেন আরও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করি, আরও জ্ঞান যেন আহরণ করি, বলতেন। আমার সাফল্য তাঁকে আনন্দ দিত, আমার বেদনায় মুষড়ে পড়তেন।

কলকাতায় বাস করার সময় তাঁর বাড়িতে গিয়েছি অনেক। বয়স হয়েছে, একা থাকেন, এ কারণে তাঁকে সাংসারিক কিছু সাহায্য করতে চেয়েছি, তিনি কারও কোনও সাহায্য নেননি। কারও দেওয়া কোনও উপহার তিনি নেননি। জীবনের যেসব জিনিসকে এ যুগে আমরা অতীব প্রয়োজনীয় বলে মনে করি, এবং যেসব ছাড়া বাঁচা অসম্ভব বলে। ভাবি, সেসব ছাড়াই অম্লান দত্ত বেঁচে থাকতেন। তাঁর কোনও অভাববোধ ছিলো না। একবার মানববাদের ওপর একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দুজন দিল্লিতে গিয়েছিলাম,গান্ধী আশ্রমের অতিথিশালায় ছিলাম, হাড় কাঁপানো শীতে আমি কাবু হয়ে যাচ্ছিলাম। তিনি আমার দেখভাল করছিলেন। মাঝে মাঝে শিশুর মতো রাগ করতেন। রাগ পড়ে গেলে আবার শিশুর মতোই অমলিন হাসতেন। কলকাতায় আমার সাত নম্বর রাউডন স্ট্রিটের বাড়িতে তিনি প্রায়ই আসতেন। যেদিনই তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি, এসেছেন, একদিন। শুধু নিজেই ছুটে এসেছিলেন আমার আমন্ত্রণ ছাড়াই। হায়দারাবাদে আমার ওপর আক্রমণ হওয়ার পর দিন। উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ তাঁর মুখে স্থির হয়ে বসে ছিল। তাঁর বোধহয়। এই ভেবে কষ্ট হত যে, মানুষ তার যুক্তি বুদ্ধি বিবেক বিসর্জন দিয়ে যেভাবে বেঁচে আছে, সেটার নাম সত্যিকার বেঁচে থাকা নয়।

কলকাতা থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আমাকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর যখনই আমার ওপর কোনও প্রতিবাদ সভার অনুষ্ঠান হয়েছে, অম্লান দত্ত গিয়েছেন। বাক স্বাধীনতার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। তাঁকে কখনও ক্লান্ত মনে হয়নি এসবে। বরং যত অসুস্থতাই থাকুক, আদর্শের জন্য তিনি সব ভুলে উঠে দাঁড়িয়েছেন, যখন এই কলকাতা শহরেই, অনেক লেখক, কবি, শিল্পী, আমার বিপদ দেখে আলগোছে কেটে পড়েছেন।

.

নিখিল সরকার

একসময় নিখিল সরকার হয়ে উঠেছিলেন একই সঙ্গে আমার মা বাবা ভাইবোন, আত্মীয় স্বজন আর বন্ধু বান্ধব। হোঁচট খেলে তুলে ধরছেন। হাঁটতে সাহায্য করছেন। নির্বাসন অসহ্য লাগলে বলছেন, আমি একা নই, আরও অনেক লেখক নির্বাসন জীবন যাপন করেছেন। আমি যেন হতাশ না হয়ে দুচোখ খুলে জগৎটা দেখি, যেন লেখাপড়ায় মন দিই। উপদেশ দিয়েই যাচ্ছেন, ক্লান্তিহীন। চিঠি লিখছেন যেখানেই ডেরা বাঁধি সেখানেই। আমিও নানান দেশ থেকে ফোন করছি নিখিল সরকারকে। খুঁটিনাটি সবকিছু জানাচ্ছি। কোনও কারণে একটা দিনের জন্যও নিখিলদার সঙ্গে সম্পর্ক আমার নষ্ট হয়নি। নিখিল সরকার আমাকে বই পাঠাতে বলতেন। ভারতে পাওয়া যায় না এমন সব দুষ্প্রাপ্য বই। বইগুলো বিদেশের বিভিন্ন বইয়ের দোকান থেকে কিনে পাঠাতাম নিখিলদাকে। ভাবতাম, এসব বই কজন লোক পড়ে আজকাল। এত জ্ঞানের বই! সত্যি বলতে কী, জগতের এত বিষয়ে এত জ্ঞান খুব বেশি মানুষের আমি দেখিনি। এমন পণ্ডিত লোক কজন আছে উপমহাদেশে! যে কোনও বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলেই আমি লক্ষ্য করেছি, তিনি বিশাল এক জ্ঞানের সমুদ্র। কত কিছু যে শিখেছি নিখিল সরকারের কাছে! নিখিল সরকার আমার শুধু বন্ধুই ছিলেন না, শিক্ষকও ছিলেন।

নিখিল সরকার যে বছর চলে গেলেন, সে বছরই আমি কলকাতায় বাস করতে শুরু করেছি। শহরটায় অনেকগুলো বছর কাটিয়েছি, শুন্য শহরটায়, খা খা করা শহরটায়। এই শহর থেকেও আমাকে তিনবছর পর তাড়িয়ে দেওয়া হল, ঠিক বাংলাদেশ থেকে যেমন তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। নিখিল সরকার বেঁচে থাকলে প্রতিবাদ করতেন এই অন্যায়ের। একজন লেখক তার লেখালেখির কারণে আর কত যুগ রাজনৈতিক, সামাজিক, সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক আঘাত পেতেই থাকবে!

নিখিল সরকার চলে যাওয়ার পর শিবনারায়ণ রায় চলে গেলেন। অম্লান দত্তও গেলেন। আমার জগৎ এখন বড় ফাঁকা। কলকাতা নিশ্চয়ই খুব ফাঁকা এখন। মানুষ আছে, মনীষী নেই। কলকাতায় হয়তো আমাকে এ জীবনে কখনও ঢুকতে দেওয়া হবে না। তবে যেখানেই থাকি পৃথিবীর, নিখিল সরকার মনে রয়ে যাবেন, যতদিন বাঁচি ততদিন। আমি তো ঋণী তাঁর কাছে। আমার মার কাছে আমি ঋণী, বাবার কাছেও ঋণী। নিখিল সরকারের কাছেও। কিছু কিছু ঋণ কখনও শোধ হয় না।

.

শামসুর রাহমান

দেশে থাকাকালীন শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমার খুব সখ্য ছিল। এই একটি মানুষই ছিলেন বাংলাদেশের সাহিত্য জগতে যাঁকে আমার মনে হতো সরল সহজ ভালোমানুষ। হৃদয় দিয়ে লিখতেন। প্রচণ্ড আবেগ ছিল। রেগে গেলে চিৎকার করতেন। দুঃখ পেলে কাঁদতেন। চোখে জল দেখেছি তাঁর। যখন প্যারিসে দেখা হয়েছিল ২০০০ সালে, বিদেয় নেওয়ার সময় জড়িয়ে ধরেছিলেন আমাকে। চলে আসতে আসতে পেছন ফিরে দেখেছিলাম চোখ মুছছেন। দেশে ফিরে গিয়ে আমাকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন। ধিক্কার দিয়েছিলেন দেশের সরকার আর ধর্মীয় মৌলবাদীদের। তিনি হয়তো জানতে ও দেখাই আমার সঙ্গে তাঁর শেষ দেখা।

শামসুর রাহমান নেই। আর কেউ তাঁর মতো অত বড় বৃক্ষ হতে পারেনি। চারদিকে শুধু তৃণ।

.

প্রশান্ত রায়

প্রশান্ত রায় ইস্কুল কলেজের ক্রিম ছাত্র। সব ছেড়েছুঁড়ে নকশাল করতে একসময় মাঠে নেমেছিলেন। গ্রামের এক জোতদারকে প্রাণে মেরে ফেলার আদেশ পান, বড় বড় নকশাল নেতার সে আদেশ তিনি মানতে পারেননি। খুনের রাজনীতি তিনি করবেন। না বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন। কত নকশাল নেতা পচে গেছেন। প্রশান্ত রায় কিন্তু আগের মতোই আছেন। সমাজতন্ত্রে আজও গভীর বিশ্বাস তাঁর। আজও তিনি নিজের আদর্শ থেকে এক চুল নড়েননি। মেরুদণ্ড তেমনই দঢ়। বাড়িতে আজও কোনও রঙিন। টেলিভিশন নেই, কোনও রেফ্রিজারেটর নেই, কোনও এসি নেই, কোনও মাইক্রোওয়েভ নেই, ওয়াশিং মেশিন নেই। গাড়ি তো নেইই। তিনি বলেন, ভারতবর্যের অধিকাংশ লোকের যা নেই, তা আমার থাকবে না। প্রশান্ত রায় আমার লেখা খুব পছন্দ করেন। কারণ, আমার লেখায় মানুষের মধ্যে সমতা আর সমানাধিকারের কথা থাকে। আমার জীবন সংগ্রাম দেখে তিনি অভিভূত। তাই তাঁর পিপলস বুক সোসাইটি থেকে আমার সাত খণ্ড আত্মজীবনী প্রকাশ করেছেন। আমরা পরস্পরকে মাঝে মাঝে কমরেড বলেও সম্বোধন করি।

.

শামীম সিকদার

শামীম সিকদারের দাদা সিরাজ সিকদার,সর্বহারা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। সর্বহারা পার্টি অনেকটা নকশাল পার্টির মতো, নিষিদ্ধ ছিল। শেখ মুজিবের আমলে সিরাজ সিকদারকে মেরে ফেলা হয়েছিল। শামীম সিকদার অসাধারণ মানুষ। ছোটবেলায়। সাইকেল চালাতেন। কোনও এক ছেলে তারা ওড়না টান মেরে নিয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে আর ওড়না পরেননি, সালোয়ার কামিজও পরেননি। সেই থেকে প্যান্ট সার্ট। কে কী বললো না বললো, তার কোনওদিন ধার ধারেননি। যা ইচ্ছে হয়েছে, করেছেন। ঢাকার আর্ট কলেজে পড়াশোনা করেছেন। ভাস্কর্য ডিপার্টমেন্টের মাস্টার হয়েছেন। কিছু পুরুষ-মাস্টার তাঁকে আর্ট কলেজ থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য আন্দোলন করেছিলেন একসময়। শামীম সিকদার মোটেও দমে যাননি। মাথা উঁচু করে ফাইট করেছেন। ফাইটার ছিলেন। প্রয়োজনে পকেটে পিস্তল নিয়ে চলতেন। নাম কিন্তু ওই পুরুষ-মাস্টারদের হয়নি। হয়েছে শামীম সিকদারের। ঢাকা শহরে তাঁর বিশাল বিশাল ভাস্কর্য শোভা পাচ্ছে স্বাপার্জিত স্বাধীনতা, স্বাধীনতা সংগ্রাম ইত্যাদি। সিগারেট খেতেন। তবে কখনও আড়ালে নয়। সবার সামনে খেতেন। আমি যদি ডাকাবুকো মেয়ে হই, আমার চেয়ে শত গুণ বেশি ডাকাবুকো শামীম সিকদার, এবং আমার আগের জেনারেশনের মেয়ে, যখন সমাজ আরও রক্ষণশীল ছিলো। কৈশোরে শামীম সিকদারের জীবন পড়ে চমকিত হতাম। সেই শামীম সিকদার আমার বিরুদ্ধে মৌলবাদীদের ফতোয়া ঘোষণা হওয়ার পর ঢাকার রাস্তায় আমার পক্ষে ব্যানার নিয়ে হেঁটেছেন। এবং তাঁরও চেয়ে বড় কথা, নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। আমাকে তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে, যখন আমার বিরুদ্ধে ১৯৯৪ সালে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। সরকার আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল আর লক্ষ লক্ষ মৌলবাদী আমাকে হত্যা করার জন্য সারা দেশে মিছিল মিটিং করেছিলো। সেই দুঃসময়ে যখন বন্ধুরাই সরে গিয়েছিল, এগিয়ে এসেছিলেন তিনি। শুধু শুধু বসে বসে দুঃশ্চিন্তা করার বদলে আমাকে কাগজ কলম দিয়েছেন লেখার জন্য, ইজেল, ক্যানভাস আর রং তুলি দিয়েছিলেন ছবি আঁকার জন্য। অনেক রাত পর্যন্ত আমার সঙ্গে কথা বলতেন। দুমাস অনেকের বাড়িতে আমাকে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিলো, সবাই একটা সময় বেঁধে দিয়েছিলেন কদিন থাকতে পারবো তার। কিন্তু শামীম সিকদারই বাঁধেননি সময়, যতদিন প্রয়োজন ততদিন থাকার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। শামীম সিকদারই কাউকে ভয় পাননি। পকেটে অস্ত্র নিয়ে তিনি কোর্টেও চলে যেতে চেয়েছিলেন যেদিন জামিনের জন্য আমার যাওয়ার কথা ছিল। এই একটা মানুষ আমার জীবনে আমি দেখেছি, যে মানুষ কাউকে ভয় পাননা, পাছে লোকে কিছু বলের ভয় তো তার কোনওদিন ছিলই না, যে মানুষ মাথা উঁচু করে চিরকাল চলেছেন এবং আমাকেও চলতে শিখিয়েছেন।

 কবিতা

সম্ভবত ১৯৯১ অথবা ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। বইমেলায় বিদ্যাপ্রকাশের স্টলে আমি দাঁড়িয়ে আছি। হুমায়ুন আজাদ এলেন আমার সঙ্গে কথা বলতে। বললেন, আপনার যে ইংরেজি অনুবাদের বইটা বেরিয়েছে, এতে আপনার প্রাপ্তি কবিতাটার অনুবাদ নেই কেন? ওই কবিতাটি তো খুব ভালো কবিতা!

আমি তাজ্জব।

বললাম, আপনি তো কিছুদিন আগে বলেছেন আমার কবিতা নাকি বালকরা পড়তে পারে, আপনি নন! আপনি কি সত্যিই আমার প্রাপ্তি কবিতাটা পড়েছেন? কিন্তু আপনি তো বালক নন!–

হুমায়ুন আজাদ হাসলেন।

তাঁর ওই হাসিটা বড় অদ্ভুত ছিল। তিনি ওই হাসিটা হাসতেন যখন বাংলাদেশের কবিদের অকবি বলতেন আর ঔপন্যাসিকদের অপন্যাসিক বলতেন। অবশ্য নিজের ব্যাপারে তাঁর আস্থা এবং অহংকার খুব বেশি ছিল।

সেবার আমার বিরুদ্ধে বইমেলায় মিছিল হয়েছিল। আমার বই পোড়ানো হয়েছিল। আমার কোন কবিতা নাকি কাদের ভালো লাগেনি। বাংলা একাডেমির পরিচালক আমাকে বলেছিলেন মেলা থেকে চলে যেতে। পুলিশের একটা ভ্যানে করে আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বলে দিয়েছিলেন মেলায় যেন আর না আসি। সব স্টল থেকে আমার কবিতার সব বই সরিয়ে ফেলা হয়েছিল।

কবিতার জন্য কী ভয়ংকর ভয়ংকর কাণ্ড ঘটতে পারে!

কবিতা

তিরিশোর্ধ্ব শরীরখানা কাঁপে,
তরবারি কি আছে যুবক তরবারির খাপে।

–এই ছোট্ট কবিতাটি আমার একটি কবিতার বইয়ে ছিল। যে বছর সেই কবিতার বইটি বেরিয়েছে, সে বছর এক পাল যুবক ঢাকার বইমেলায় আমাকে দেখলেই কবিতার লাইনদুটো জোরে জোরে বলতো। যৌনতা নিয়ে কবিতা লিখলে কোনও পুরুষ-কবিকে কি কখনও অপদস্থ হতে হয়েছে কোথাও? আমি শুনিনি।

‘আমার খুব ইচ্ছে দশ পাঁচ টাকায় ছেলে কিনতে ..’– কোনও এক কবিতায় এরকম একটা লাইন ছিল। এক পাল ছেলে এসে আমাকে একদিন বললো, বইমেলার ভেতরেই, আমাকে কিনুন। যতই বলি এ কবিতা, এ কোনও ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন নয়, তারা শোনে না। কোনও পুরুষ-কবি যদি তার কোনও কবিতায় লিখতো আমার খুব ইচ্ছে দশ পাঁচ টাকায় মেয়ে কিনতে.., তাহলে কি তাকে হেনস্থা হতে হতো আমার মতো?

আমি যে কবিতাই লিখি, যে প্রবন্ধই লিখি, যে গল্প উপন্যাসই লিখি, লোকে ভাবে আমি আমার ব্যক্তিগত জীবনের কথা লিখেছি। কোনও পুরুষ-কবিকে বা লেখককে তার লেখার জন্য কৈফিয়ত এভাবে দিতে হয় না, যেভাবে আমাকে এবং আরও অনেক মেয়ে-কবিকে দিতে হয়। কোনও পুরুষ যদি কোনও কবিতায় এমনও লেখে মেয়েটাকে দলামোচা করে চুমু খাবো, স্তন খামচে ধরবো, দীর্ঘ সঙ্গম করবো, তার পর শেষ রাতের দিকে মেয়েটাকে গলা টিপে মেরে ফেলবো– কেউ কিন্তু এটিকে কবিতা ছাড়া কবির ব্যক্তিগত ঘোষণা বলে ভাববে না। বরং পাঠকরা ওই ভায়োলেন্সের ভেতরেই কাব্য আবিষ্কার করবে, যে কাব্যের সঙ্গে তারা বড় কোনও ইউরোপ বা আমেরিকার কবির কবিতার সাদৃশ্য খুঁজে পাবে।

কল্পনার রাজ্য

প্রচুর লোকের ধারণা, ইসলামের সমালোচনা করলে পশ্চিমের দেশ থেকে বেশ ইনাম, মেলে। মুখগুলো তাদের কল্পনার রাজ্যে বাস করে। সত্য কথা হলো, ইসলামের সমালোচনা করলে তোমার কোথাও ঠাঁই নেই। মুসলিম সন্ত্রাসীরা তোমাকে জবাই করবে, মৌলবাদীরা তোমার মাথার মূল্য ঘোষণা করবে, মুসলিম সরকার তোমাকে জেলে পুরবে, ইওরোপ আমেরিকা তোমাকে অবজ্ঞা করবে। তুমি একা হয়ে যাবে। সম্পূর্ণ একা। একঘরে। হাতে গোণা কিছু অসহায় নাস্তিক কালে ভদ্রে তোমার খোঁজ নেবে। নাও নিতে পারে।

পশ্চিমের দেশে কদর পায় আদর পায় ফুল পায় ফুল পায় তারা, যারা বলে, ইসলামী মৌলবাদ খারাপ কিন্তু ইসলাম ভালো; যারা বলে, মৌলবাদীরা বা সন্ত্রাসীরা যে ইসলাম চর্চা করছে, সেটা সহি ইসলাম নয়; যারা বলে, মৌলবাদীরা বা সন্ত্রাসীরা কোরানের যে ব্যাখ্যা দিচ্ছে, তা ভুল ব্যাখ্যা। সে কারণে পশ্চিমে মালালা হিরো, কারণ মালালা বলে বেড়ায়, ইসলামী মৌলবাদ খারাপ কিন্তু ইসলাম ভালো। সে কারণে পশ্চিমে তসলিমা জিরো, কারণ তসলিমা বলে বেড়ায়, ইসলামে আর ইসলামী মৌলবাদে কোনও তফাৎ নেই, ফারাক নেই।

পশ্চিমের দেশগুলো মডারেট মুসলমানদের পছন্দ করে, ইসলাম-নিন্দুক নাস্তিকদের মোটেও পছন্দ করে না। বরং যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে। ওরা মনে করে ইসলামে পরিবর্তন আসতে হবে ভেতর থেকে, অন্য সব ধর্মে যেভাবে এসেছে। বিশ্বাস করে, ইসলামের বাইরে দাঁড়িয়ে নাস্তিকরা চেঁচালে কোনও লাভ তো হবেই না, বরং ক্ষতি হতে পারে। তাই আমরা, মুসলমান পরিবারের নাস্তিক সন্তানেরা, বাতিলের খাতায়। আমাদের নিয়ে পশ্চিমের রাজনীতিক, দার্শনিক, ভাবুক, বুদ্ধিজীবী, সমাজবিদ, নৃতত্ত্ববিদ, পূর্ব বিশারদ, ধর্ম বিশারদদের কোনও উৎসাহ নেই।

কল্পনার রাজ্যে বাস করা মুখরা কিন্তু যতদিন বাঁচবে, বলেই যাবে যে ইসলামের বিরুদ্ধে লিখলে পশ্চিমের ইনাম পাওয়া যায়। পশ্চিমের তো আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, ইসলাম বিরোধী কাউকে ইনাম দিয়ে নিজের সর্বনাশ করবে! আসলে, সত্যিটা হলো, ইসলামের স্তুতি গাইলে শুধু পুবে নয়, পশ্চিমেও ইনাম মেলে।

বেশির ভাগ মুসলমানের ধারণা, আমেরিকা মুসলমান-বিরোধী, কারণ মুসলমানের দেশ আফগানিস্তানে আর ইরাকে বোমা ফেলেছে আমেরিকা, আর সেই বোমায় নিহত হয়েছে লক্ষ লক্ষ মুসলমান। ইজরাইলকে অস্ত্র শস্ত্র দিচ্ছে আমেরিকা, যে ইজরাইল ফিলিস্তিনি মুসলমানদের মেরে সাফ করে দিচ্ছে। সুতরাং ইসলামের নীতি রীতি নিয়ে প্রশ্ন করলে বা ইসলামে অবিশ্বাস করলে আমেরিকার ইহুদি নাসারারা ওত পেতে থাকে আলিঙ্গন করার জন্য, হীরে মুক্তোয় ডলারে পাউণ্ডে ইউরোয় ডুবিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু এটা যে সম্পূর্ণ মিথ্যে, তা তাদের কে বোঝাবে। আমেরিকার কোনও সরকার কি ইসলামের নিন্দা করেছেন? কোনও সরকার কি কোনও চিহ্নিত ইসলাম বিরোধীর সঙ্গে দেখা করেছেন? এরকম আমি শুনিনি, দেখিওনি। বরং আমেরিকার সরকার সেইসব মডারেট মুসলিমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, যাঁরা বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম। আমেরিকার সব প্রেসিডেন্টই ঘোর নিশ্চিন্তে বলেছেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম, কিছু বিপথগামী লোক শুধু অশান্তি সৃষ্টি করছে। আমেরিকার কোনও সরকারই কোনও ইসলাম বিরোধীর সঙ্গে না প্রকাশ্যে না গোপনে কোনও সম্পর্ক রেখেছেন। তাঁরা অনেকেই নিজেরা ধর্মে বিশ্বাস করেন। এবং অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসীর সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগটা সে কারণেই ভালো।

রাজনৈতিক শরণার্থীদের উন্নতমানের জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিত করে, এমন একটি দেশে আমি রাজনৈতিক শরণার্থী ছিলাম। কিন্তু সরকারের কাছে থেকে কোনও টাকা পয়সা আমি পাইনি। চাইওনি। বই বিক্রির রয়্যালটি কিছু পেতাম, ওতেই কষ্টেসৃষ্টে বাঁচার চেষ্টা করেছিলাম। আজ পর্যন্ত এই যে এত দেশে বাস করেছি, কোনও সরকারের কাছ থেকে কানা কড়ি সাহায্য আমি পাইনি কিন্তু। সরকারি বা বেসরকারি কোনও সংস্থা আগ বাড়িয়ে আমাকে সাহায্য করতে চায়নি। আমি ইসলামের সমালোচনা করি জানার পরও কোনও বাড়তি আগ্রহ কেউ দেখায়নি। অথবা ইসলামের সমালোচনা করি জানার পরই বাড়তি আগ্রহ তো দেখায়ইনি, স্বাভাবিক আগ্রহও দেখায়নি। যদি পশ্চিমের দেশগুলো ইসলাম বিরোধী হতো, তাহলে আমাকে লুফে নিতো। লুফে হয়তো আমাকে নিতো, যদি আমি ইসলামের প্রশংসা করতাম, এবং মুসলিম মৌলবাদী এবং সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লিখতাম। সালমান রুশদি জনপ্রিয়, কিন্তু ইসলাম বিরোধী লেখা লিখে উনি জনপ্রিয় নন। বাক স্বাধীনতার পক্ষের যে লোকেরা তাঁকে সমর্থন জানিয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই কিন্তু রুশদির বইগুলোর মধ্যে সেটানিক ভার্সেসকে খুব উন্নতমানের উপন্যাস বলে মনে করেন না। পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে চরম ডানপন্থীর সংখ্যা কম, ইসলাম এবং মুসলিমদের প্রতি তাঁদের প্রবল সহানুভূতি এবং সহমর্মিতা।

ইওরোপ আর আমেরিকা যদি ইসলাম বিরোধী হতো, তাহলে এত বিপুল পরিমাণ মুসলিম অভিবাসী ওসব দেশে বাস করতে পারতো না। মুসলিমরা যে মানবাধিকার ভোগ করে ইওরোপ আর আমেরিকায়, তা পৃথিবীর অন্য কোথাও ভোগ করতে পারে না, মুসলিম দেশগুলোতে তো প্রশ্নই ওঠে না। আজ মুসলিমদের মানবাধিকার রক্ষায় সবচেয়ে বেশি যাঁরা এগিয়ে আসেন, তাঁরা পশ্চিমের বুদ্ধিজীবী, পশ্চিমীদের তৈরি হিউমেন রাইটস ওয়াচ, এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, এরকম শত শত সংগঠন। অবৈধ অভিবাসীরা যখন আইনের তাড়া খায়, আশ্রয় নেয় গির্জায় না, এসব গির্জা মুসলিমদের ক্রিশ্চান হওয়ার কোনও শর্ত না দিয়েই আশ্রয় দেয়। এই অভিবাসীদের অনেকেই পায়ের নিচে মাটির ছোঁয়া পেতে না পেতেই পশ্চিমেরই বিরোধিতায় নিজেকে উৎসর্গ করে। পশ্চিমের পুলিশই গাড়ি ঘোড়া সরিয়ে পশ্চিমের বিরোধিতায় ওদের সামিল হতে দেয়, ওদের নিরাপত্তাও একশ ভাগ নিশ্চিত করে। মুসলিমদের জন্য স্বর্গরাজ্য পাশ্চাত্য। বিশ্বাস হয় না? ওদের জিজ্ঞেস করুন। উত্তর আমেরিকার কোনও অঞ্চল থেকে, বা সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যাণ্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যাণ্ড থেকে ওরা সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, সিরিয়া, জর্দান, মিশর, কুয়েত, কাতার, পাকিস্তান, আফগানিস্তানে বাস করতে চায় কি না। যত বড় ধর্মপ্রাণই হোক না কেন, যতই বিধর্মীদের গালাগালি করুক না কেন, যতই শরিয়া আইনকে শ্রেষ্ঠ আইন বলে বলে রাস্তায় নামুক না কেন, বিধর্মীদের মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে, কিছুতেই শরিয়া আইনের দেশে, ইসলামের দেশে, মুসলিম প্রধান কোনও দেশে বাস করতে চাইবে না।

কীরকম যেন ভয় ভয় লাগে

সভ্য পৃথিবীতে নাস্তিক, ব্লগার, মুক্তমনা হওয়া খুব গৌরবের বিষয়। মানুষ তাঁদের শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। যাদের পরিচিতি আছে, তাদের দেখার জন্য ভিড় হয়, তাদের অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। পৃথিবীর অসভ্য জায়গাগুলোয় নাস্তিক, ব্লগার, মুক্তমনাদের নিয়ে গৌরব করা হয় না। কারণ অসভ্য লোকরা জানেনা, নাস্তিক, ব্লগার, মুক্তমনা মানে কী। অসভ্য লোকদের কাছে যে মানুষই প্রগতিশীল, যে মানুষই ব্লগ লেখে, যে মানুষই মুক্তচিন্তায় বিশ্বাস করে–সে মানুষই নাস্তিক। এবং অসভ্য লোকরা এও বিশ্বাস করে, নাস্তিকদের মেরে ফেলার মতো ভালো কাজ আর হয় না। এই অসভ্য লোকদের সভ্য করার উপায় কী! এদের সভ্য করার জন্য আজ প্রায় তিরিশ বছর আগে লেখালেখি শুরু করেছিলাম, তিরিশ বছর পর দেখলাম, অসভ্যরা আরও অসভ্য হয়েছে। আমার একার লেখালেখি দিয়ে তো আর গোটা দেশের অসভ্যকে সভ্য করা সম্ভব নয়। আরও লেখক যদি লিখতেন, রাজনীতিকরা যদি বলতেন, সরকার যদি পদক্ষেপ নিতেন অসভ্যকে সভ্য করার, মুক্তবুদ্ধির মানুষরা মিলেজুলে পারতেন কিন্তু দেশটাকে বদলে দেবার। সেই কবে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কী ভেবে স্বাধীন হলো, আর কোথায় এসে দাঁড়ালো দেশ!

দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর পুত্র সজীব জয়, যিনি তাঁর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা, ঘোষণা করে দিয়েছেন, নাস্তিকদের পাশে তাঁরা প্রকাশ্যে দাঁড়াবেন না। প্রশ্ন ওঠে, নাস্তিকরা তো দেশের নাগরিক, তাদের পাশে দাঁড়াবেন না তো কাদের পাশে দাঁড়াবেন? উত্তর খুব সহজ। দাঁড়াবেন আস্তিকের পাশে। ভাবছিলাম, নাস্তিক শব্দটি এত ঘৃণিত শব্দ হলো কবে থেকে? সবাই নাস্তিক থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে চায়। এমনকী যে সরকারের দায়িত্ব, ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ ভাষা অঞ্চল বিশ্বাস নির্বিশেষে সব মানুষকে সমান ভাবা, সেই সরকারও পক্ষপাতিত্ব করছে।

নির্যাতিত সংখ্যালঘু যুক্তিবাদীদের পাশে দাঁড়াবেন না সরকার। বিনা দোষে তাদের হত্যা করা হলেও তিনি বলবেন না যে হত্যা করাটা অন্যায়। তিনি হত্যাকারীদের শাস্তির ব্যাপারে আগ্রহ দেখাবেন না। অন্য যে সব হত্যাকাণ্ড ঘটছে দেশে, যেমন, পেট্রোল বোমা মেরে যে মানুষগুলোকে মারা হল, সে নিয়ে হাসিনা তো দিব্যি বিবৃতি দিয়েছেন। এক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করবেন, আরেক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করবেন না। কী ভয়ংকর এই দেশ! নাস্তিকদের সঙ্গে কোনও ওঠা বসা আছে, সেটা প্রচার হোক, চান না হাসিনা। কারণ তাঁর ভয়, ধর্মান্ধদের ভোট যদি আবার এই ফাঁকে ফসকে যায়।

বাংলাদেশ সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কোনও ধর্ম থাকে না। বাংলাদেশের একটি ধর্ম আছে। যতদিন না রাষ্ট্রধর্মটি বিদেয় নিচ্ছে, যতদিন না নাস্তিক শব্দটি আস্তিক শব্দটির মতো একই রকম গ্রহণযোগ্য হচ্ছে, ততদিন বাংলাদেশকে সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা যায় না। বাংলাদেশে নাস্তিক শব্দটি গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মুক্তমনা শব্দটিও আজ গালি। দেশ কত দুর্ভাগা হলে বিজ্ঞানমনস্ক নাস্তিকদের আজ ঘৃণা করে দেশের জনগণ। বিজ্ঞান আর ধর্মের সংঘাত চিরকালের। তবে, বিজ্ঞানের জয় অবশ্যম্ভাবি। এর একটিই কারণ, বিজ্ঞান সত্য। সত্যকে মিথ্যের ছাই দিয়ে বেশিদিন গোপন করে রাখা যায় না। আজ যে প্রতিভাবান তরুণ মানববাদীদের খুন করা হচ্ছে বাংলাদেশে, দেশটাকে সুষ্ঠুভাবে গড়তে হলে, দেশটাকে ধর্মান্ধতা আর বর্বরতা মুক্ত করতে হলে এদের মতো মানুষেরই দরকার হবে এই দেশের। দরকার হবে আরও অনেক অভিজিতের, অনন্তর, রাজিবের, ওয়াশিকুরের। এ ছাড়া উপায় নেই।

শুনেছি লেখক-অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রধানমন্ত্রীর পুত্র যে নাস্তিকদের হত্যাকাণ্ডের প্রকাশ্যে নিন্দা করতে চাননি, সে বিষয়ে বলেছেন যে এসব মন্তব্য মৌলবাদীদের জন্য গ্রিন সিগন্যাল। জাফর ইকবাল কোনও ভুল কথা বলেননি। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাঁর বিরুদ্ধে সিলেট শহরে মিছিল শুরু করে দিয়েছে, মৌলবাদী দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে মিছিল করছে আওয়ামী লীগ। শুনেছি আওয়ামী নেতারা নাকি চট্টগ্রামেও মধ্যযুগীয় ১৩ দফা দেয়া হেফাজতের আমীর শফির কাছ থেকে নিয়মিত দোয়া নিতে যান। নতুন মেয়রও দোয়া নিয়ে এসেছেন। বিশ্বাস হয় না এসব কথা। এখনও আওয়ামী লীগকে মানুষ সেকুলার দল বলে ভাবে, এখনও বিশ্বাস করে মৌলবাদীর প্রতিপক্ষ হিসেবে একটি দলই আছে বাংলাদেশে। কিন্তু যা ঘটছে বাস্তবে, তা দেখলে মনে হয়, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাতে ইসলামি– এসব দলে মূলত কোনও পার্থক্য নেই।

আজকাল মাঝে মাঝেই আমার মনে হয়, দেশ নিয়ে আশা করার আর কিছু নেই। রাজনৈতিক দলগুলো দেশটাকে একটা ইসলামী মৌলবাদী আর সন্ত্রাসীর দেশ বানাবে। জনগণ চুপচাপ বসে বসে দেশের এই সর্বনাশ দেখবে। অবশ্য সবাই একে সর্বনাশ বলে ভাবছে না। যে হারে সমাজে ধর্মান্ধতা বাড়ছে, তাতে মনে হয়, বেশির ভাগ জনতাই দেশটাকে দারুল ইসলাম বানাতে চায়। যে বুদ্ধিজীবীরা বিজ্ঞানমনস্ক, ধর্মমুক্ত, মানববাদী, যাঁরা অন্যায় আর অরাজকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস দেখিয়েছেন, তাঁদের অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এক এক করে হত্যা করা হচ্ছে। এই বর্বর হত্যাকারীরা কখনও শাস্তি পাবে না। কারণ হত্যাকারীরা ধর্মব্যাবসায়ী রাজনীতিকদের ঘরের লোক। এই রাজনীতিকরা অন্ধে, ধর্মান্ধে, কূপমণ্ডুকে, কবন্ধে, অশিক্ষিতে, অসভ্যে, খুনীতে, ধর্যকে দেশটা ভরে রাখার স্বপ্ন দেখছে।

বাংলাদেশকে একসময় বিশ্বের মানুষ জানতো বছর বছর বন্যা হওয়ার দেশ হিসেবে। এখন জানছে মাসে মাসে নাস্তিক হতার দেশ হিসেবে। প্রথমটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়। দ্বিতীয়টি মানুষের তৈরি। বাংলাদেশের নতুন পরিচয়টি প্রথম পরিচয়ের থেকে ভয়ংকর। মানুষের ধর্মানুভূতিকে ব্যবহার করে ভোটে জেতার কৌশল বন্ধ না করলে এক এক করে আরও প্রতিভাবান মানুষের রক্তে ভাসবে রাজপথ। একসময় শেখ মুজিবুর রহমান ডাক দিয়েছিলেন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যারা বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করছিলো তাদের হাত থেকে দেশ বাঁচাতে, আজ সেই শেখ মুজিবুরের কন্যা শেখ হাসিনার ছায়াতলে বাস করছে সেই জঙ্গীসেনারা যারা দেশের বুদ্ধিজীবী হত্যা করছে। শেখ মুজিব রুখে উঠেছিলেন। শেষ হাসিনা রুখে ওঠা দূরের কথা, তাদের বরং সাহারা দিচ্ছেন। সজীব জয়ও দিচ্ছে খুনীদের সাহারা। লজ্জা হয় না আর, বরং ভয় হয়।

কুপমন্ডুক

১৬ই ডিসেম্বর

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নমাস যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছিল বাংলাদেশ, এক নদী রক্ত পেরিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। বেশ রোমাঞ্চকর বটে। ৪৪ বছর আগের কথা। মনে হয় এই সেদিনের ঘটনা।

ভারত ভাগ করা হয়েছিল কারণ ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা নাকি সংখ্যালঘু মুসলমানদের ঠিক সহ্য করতে পারে না, এই সমস্যার সমাধান হলো, পাকিস্তান নামের একটি দেশ বানিয়ে ফেলা, যেখানে মুসলমানরা সুখে শান্তিতে বাস করতে পারে। ভারত ভাগ হয়ে অবশ্য লাভ কিছু হয়নি। মুসলমানরাই মুসলমানদের অত্যাচার করতে শুরু করলো। বাঙালি মুসলমানের ওপর অবাঙালি মুসলমান ঝাঁপিয়ে পড়লো। শেষ অবধি আবারও দুটুকরো হলো ভূখণ্ড।

কথা ছিল বাংলাদেশ নামের নতুন দেশটি পাকিস্তান থেকে আলাদা হবে, ধর্মনিরপেক্ষ হবে, গণতান্ত্রিক হবে, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান মুসলমান সবাই সুখে শান্তিতে বাস করবে। কিন্তু সে আর হচ্ছে কই! দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুকাল পরই শুরু হয়ে গেছে অশান্তি। দেশটা এখন আক্ষরিক অর্থে ভাগ না হলেও আদর্শের কারণে ভাগ হয়ে গেছে, এক দিকে আছে মুসলমান মৌলবাদী-সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, আরেক দিকে আছে ধর্মনিরপেক্ষ উদারপন্থী মানুষ। দুই দলে লড়াই হচ্ছে। একে বাংলাদেশ আর বাংলাস্তানের লড়াইও বলা চলে। বাংলাস্তানের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে অস্ত্র। তারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর মতো অস্ত্র হাতে ঘন ঘন ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র মানুষের ওপর, তাদের নির্বাচারে হত্যা করে, যে হত্যার কোনও বিচার হয় না।

অধিকাংশ ভারতীয় দাবি করে একাত্তরের যুদ্ধটা ছিল ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধ, যে যুদ্ধে ভারত জিতেছে। বেচারা বাঙালি গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তবে ও দিয়ে যুদ্ধে জেতা হতো না। সাততাড়াতাড়ি বাংলাদেশ নামের একটি দেশ জন্ম নিয়েছে বটে, জন্ম নিয়েই স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ইত্যাদি শব্দ উচচারণ করতে শিখেছে বটে, তবে এগুলোর অর্থ এখনও দেশটি জানে না। যেদিন জানবে, যেদিন বিশ্বাস করবে, চর্চা করবে এগুলোর, সেদিন স্মৃতিসৌধে পতাকা ওড়ালে তাকে বিদঘুঁটে দেখাবে না। আমি বিজয় দিবস পালন করি না, কারণ পাকিস্তান আর বাংলাদেশের মধ্যে আমি কোনও পার্থক্য দেখতে পাই না। পাকিস্তানেও মুক্তচিন্তকদের ওপর নির্যাতন চলে, বাংলাদেশেও তাই। কেউ মানুক আর নামানুক, আমি মনে করি, বিজয় দিবস পালন করার যোগ্যতা বাংলাদেশ সেদিনই সত্যিকার অর্জন করবে যেদিন দেশের মুক্তচিন্তকদের খুন হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পারবে এবং নির্বাসিত সব মুক্তচিন্তককে দেশে ফিরিয়ে নিতে পারবে। তার আগ অবধি বিজয় দিবসের উৎযাপন নিতান্তই ন্যাকামো ছাড়া কিছু নয়।

ন্যাকামোই চলছে অনেকগুলো বছর। লোক দেখানো বিজয় দিবস। লোক দেখানো একুশে ফেব্রুয়ারি। এসব আর কতদিন চলবে! আত্মা বলে যদি কিছু সত্যিকার থাকতো, তাহলে ওই শহিদদের আত্মা কষ্ট পেতো, ওই মৃত মৃক্তিযোদ্ধাদের আত্মা কষ্ট পেতো।

আত্মায় আমার বিশ্বাস নেই, ধর্মে আমার বিশ্বাস নেই। আমার মানুষে বিশ্বাস, ভালো কাজে, ভালো চিন্তায় বিশ্বাস। আমার প্রাণে বিশ্বাস, নিষ্ঠায় বিশ্বাস। সাম্যে, সমতায় আর সমানাধিকারে বিশ্বাস। আমার কি তবে অধিকার নেই বাংলাদেশে বাস করার? আজ একুশ বছর আমি নির্বাসিত জীবন যাপন করছি। না, স্বেচ্ছায় নয়, বাধ্য হয়ে। দেশ ত্যাগ করতে আমাকে বাধ্য করেছে দেশের সরকার। দেশের দরজাও এখন আমার জন্য বন্ধ। আমি কি কাউকে খুন করেছিলাম? কারও কিছু লুঠ করেছিলাম। আমি ছিলাম ডাক্তার এবং লেখক। ডাক্তার এবং লেখক হিসেবে মানুষের সেবা করেছি। দেশ এবং দশের মঙ্গলের জন্য পরিশ্রম করেছি, মানুষ যেন মানুষ হয়, তাদের যেন শুভবুদ্ধির উদয় হয়, সে কারণে নিরলস লিখেছি। আমার এই ত্যাগের পুরস্কার আমাকে এখন ভোগ করত হচ্ছে। হ্যাঁ একুশ বছর আমি নির্বাসিত। একুশ বছরে দেশের সংজ্ঞা আমার কাছে পাল্টে গেছে। দেশ বলতে এখন আমি মানুষ বুঝি। যে মানুষ ভালোবাসে, যে মানুষ সবার মত প্রকাশের অধিকারে বিশ্বাস করে, ধর্ম এবং কুসংস্কার থেকে যে মানুষ মুক্ত, সে মানুষই আমার স্বদেশ।

পৃথিবীর মানচিত্র এঁকেছেন মূলত রাজনীতিকরা। আমরা যদি মানচিত্র আঁকার অধিকার পেতাম, তাহলে মানচিত্রটা অন্যরকম হতো। ধর্মের কারণে মানচিত্রের অদল বদল হতো না। ধর্মের কারণে দেশ ভাগ হওয়ার মতো গ্লানি আর কিছুতে নেই। যুদ্ধ করা, দেশ ভাগ করা, এসব এখন আর উৎ্যাপনেরও হয়তো বিষয় নয়। পৃথিবীটা ক্রমশ কি ছোট হয়ে আসছে না? মানুষ আন্তর্জাতিক ভাষায় কথা বলতে শিখছে, আন্তর্জাতিক পোশাক পরতে শিখছে, খাবার খেতে শিখছে। ভাষা ও সংস্কৃতির কারণেও নিজেদের আলাদা করার কোনও কারণ আর নেই। রাজনীতিকরা যে ভাগটা করেছে নিজেদের স্বার্থে, সেই ভাগটা আমাদের এখন মুছে দেওয়ার পালা, কাঁটাতার সরিয়ে দেওয়ার পালা, দেওয়াল ভেঙে দেওয়ার পালা। দেশগুলোকে না ভেঙে বরং এক করে দেওয়ার সময় এখন।

হিংসে, দ্বেষ, খুনোখুনির ইচ্ছেটা মানুষের ভেতরে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। একে আমরা যতটা পারি শান্ত রাখি। একে পুরোপুরি শান্ত রাখতে পারলেই আমরা এক করতে পারবো পৃথিবী। এশিয়া আফ্রিকা ইউরোপ আর আমেরিকার ভৌগোলিক দুরত্ব যা আছে তা থাকবেই, কিন্তু মানুষের মধ্যে মানসিক দূরত্ব অনেকটাই ঘুচে যাবে। ধনী আর দরিদ্রের ফারাকটাও কমে কমে শূন্যের দিকে যাবে। ভাষা আর সংস্কৃতি ভিন্ন হতেই পারে, কিন্তু ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, মৌলবাদ, সন্ত্রাস, অপশিক্ষা, শিক্ষাকে সবাই মিলেই দুর করতে হবে। এগুলো যেন আবার কারও সংস্কৃতির অংশ না হয়ে দাঁড়ায়। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর এক কোণে সন্ত্রাস জন্ম নিলে আরেক কোণে তা পাচার হবেই। ভালো জিনিস যেমন বিশ্বময় ছড়িয়ে যায়, খারাপ জিনিসও ছড়িয়ে যায়। তথ্য আর প্রযুক্তির যুগ এ যুগ। এই তথ্য আর প্রযুক্তিই পৃথিবীকে এক করার জন্য বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

মুসলমান মুসলমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে একাত্তরে। যুদ্ধটি শিয়া-সুন্নির যুদ্ধ নয়, সুন্নি-আহমদিয়া বা কাদিয়ানির যুদ্ধ নয়, ও ছিল সুন্নিতে সুন্নিতে যুদ্ধ। এমনটি খুব বেশি দেখা যায় না। যে ভাষা আর সংস্কৃতিকে বাঁচানোর জন্য একাত্তরে বীর বাঙালির অধিকাংশ সুন্নি মুসলমান হয়েও সুন্নি মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলো, সেই ভাষারই লেখক আমি, সেই সেলার সংস্কৃতির পক্ষেই আমি কলম ধরেছিলাম। আজ আমার জীবন বিপন্ন। শাসকরা কতটা নির্বোধ হলে, কতটা স্বৈরাচারী হলে, কতটা দেশদ্রোহী হলে, কতটা মানবাধিকারবিরোধী হলে, কতটা গণতন্ত্রবিদ্বেষী হলে, কতটা একনায়কতান্ত্রিক হলে নারীর অধিকারের পক্ষে এবং ধর্মীয় মৌলবাদের বিপক্ষে যে মানুষটি অনড় দাঁড়িয়েছিল, তাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে দেশ থেকে বের করে দেয়, আর আলিঙ্গন করে মৌলবাদী সন্ত্রাসী অপশক্তিকে। একুশ বছরেও সরকার নিজেকে শোধরায়নি। তাই এখনও দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের এক এক করে দেশ ছাড়তে বাধ্য করছে।

বাংলাদেশকে দেশ বলতে আজকাল আমার বাধে। দেশ মানে আমি নিরাপত্তা বুঝি। যে মাটিতে মানুষের নিরাপত্তা নেই, যে মাটিতে লেখক শিল্পী বুদ্ধিজীবীদের কথা বলার স্বাধীনতা নেই, সেই মাটিকে আমি আমার দেশ বলতে চাই না। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হওয়া সহজ, দেশ হওয়া সহজ নয়। ঠিক যেমন মানুষের মতো দেখতে হওয়া সহজ, মানুষ হওয়া সহজ নয়।

কোকো, খালেদা আর দেশের দগ্ধ সন্তানেরা

মা হলেই যে সন্তানের প্রতি দরদ থাকে, তা আমার মনে হয় না। বিশেষ করে ক্ষমতার স্বাদ একবার যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা মাতৃত্বের স্বাদের চেয়েও ক্ষমতার স্বাদটাকেই বেশি উপভোগ করেন। খালেদা জিয়াকে যদি বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী হতে চান নাকি ছেলে ফেরত চান? আমার বিশ্বাস, তিনি প্রধানমন্ত্রীত্বটাকে বেছে নেবেন। বলবেন, দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ করছেন। আসলে দায়িত্ববোধটোধ নয়, সবই ক্ষমতার লোভ। একবার গদিতে বসলে সেই গদি আর ছাড়তে ইচ্ছে করে না। গরিব দেশের গদির আরাম বড় আরাম কিনা! সভ্য,শিক্ষিত দেশের গদিতে এত আরাম নেই। এত দুর্নীতি, এত অরাজকতা, এত সন্ত্রাস করার সুযোগ ওসব দেশে নেই। মন্ত্রী হলেই সামনে পেছনে নিরাপত্তার বহর থাকারও নিয়ম নেই, যদি না মৃত্যুর হুমকি থাকে। যা খুশি তাই করার অবকাশ নেই। খালেদা জিয়া দীর্ঘ বছর যা খুশি তাই করেছেন। এখনও করে যাচ্ছেন। অসংখ্য চাটুকার, অসংখ্য আদেশ পালনকারী এক পায়ে এখনও খাড়া। প্রধানমন্ত্রী না হলেও বিরোধীদলের নেত্রী তো! তাঁর আদেশে বা উপদেশে, পরামর্শে বা প্ররোচনায় তাঁর দলের এবং ধর্মান্ধ শিবিরের ছেলেরা বাসে, ট্রাক, লঞ্চে আগুনবোমা ছুড়ছে। মানুষ ঝলসে যাচ্ছে, জ্বলে যাচ্ছে, পুড়ে যাচ্ছে, মরে যাচ্ছে। বোমা বানাতে ব্যস্ত খালেদার ছেলেরা। এরাই খালেদার সত্যিকার ছেলে, যারা তাঁকে গদিতে বসানোর জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বোমা বানাচ্ছে, বোমা ফেটে হাত উড়ে যাচ্ছে, পা উড়ে যাচ্ছে, এমনকী প্রাণ পর্যন্ত উড়ে যাচ্ছে, তারপরও বানাচ্ছে। বোমা ছুঁড়তে গিয়ে ধরা পড়ছে, পুলিশের মার খাচ্ছে, জেলে যাচ্ছে, ভুগছে, জেল থেকে বেরিয়ে আবার বোমা ছুড়বে এরা। এরা খালেদাকে গদিতে বসাতে চায়, কারণ খালেদা গদিতে বসলে এদের বিস্তর সুবিধে। এরা খালেদাকে দিয়ে দেশের আরও সর্বনাশ করতে পারে। গণতন্ত্র, মুক্তচিন্তা, বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে লড়তে পারে। ধর্মের আইন আনতে পারে। ধর্মের নামে মেয়েদের পাথর ছুঁড়ে হত্যা করতে পারে। মেয়েদের হিজাব পরতে বাধ্য করতে পারে। মেয়েদের শিক্ষা দীক্ষা, চাকরি ব্যবসা বন্ধ করে দিতে পারে। মেয়েদের বিরুদ্ধে যাবতীয় অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার মহা সমারোহে চালু করে দিতে পারে। ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করলে মানুষকে নির্দ্বিধায় জবাই করে রাস্তায়। ফেলে রাখতে পারে। বিজ্ঞান শিক্ষা বন্ধ করে, দেশ ছেয়ে ফেলতে পারে মসজিদে আর মাদ্রাসায়। খালেদা ক্ষমতায় এলে তারা একএকজন হাসতে হাসতে বনে যেতে পারে আইসিস, বোকো হারাম বা আল কায়দার জঙ্গী। ত্রাস সৃষ্টি করবে, আগুনে দগ্ধ করবে মানুষ, বাড়িঘর, দোকানপাট, অফিস আদালত, গোটা দেশ। খালেদা প্রতিবাদ করবেন না। বরং মায়ের আদরে কোলে তুলে নেবেন তাঁর এই সন্তানদের। গদি যারা নিশ্চিত করে, তারাই তো সত্যিকার সন্তান। এরাই খালেদার কোকো।

কোকোর জন্য দেশের মানুষ শোক করছে কেন! অন্যকে ঠকিয়ে যে লোক নিজের পকেটে পয়সা ভরেছে, দুর্নীতি যাদের রোজগারের উৎস, তারা গত হলে আমাদের দুঃখ না করে স্বস্তি পাওয়া উচিত নয় কি? শুনেছি কোকোর ভাই তারেক দেশের অনেক মানুষের টাকা লুট করেছে। অনেক মানুষকে পথে বসিয়ে দিয়েছে, অনেক মানুষের সর্বনাশ করেছে। এসব দেশদ্রোহী দুর্নীতিবাজ কুলাঙ্গার মরলে দেশের কেন কিছু যাবে আসবে! খালেদা কি কখনও তাঁর পুত্রদের বাধা দিয়েছেন? কখনও কি ওদের সৎ পথে টাকা রোজগারের উপদেশ দিয়েছেন। বলেছেন চরিত্র বদলাতে, মানুষ হতে? আমার মনে হয় না। খালেদা নীতির কথা মুখে বলেন, নিজের জীবনে তা মানেন না। তিনি কি তাঁর দলের বা শিবিরের ছেলেদের বোমা বানাতে, বা বোমা ছুঁড়তে নিষেধ করেছেন? এই যে চোখের সামনে মানুষকে আগুনে ঝলসে দেওয়া হচ্ছে, পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, তিনি কি কেঁদেছেন কারও জন্য? তিনি কি অনুশোচনা করেছেন, দুঃখ করেছেন, বন্ধ করেছেন হত্যাযজ্ঞ? করেননি। কারণ তিনি ভেবেছেন এভাবেই মানুষ থেকে শুরু করে যা কিছু আছে সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সর্বনাশ করলেই তাঁর পক্ষে ক্ষমতায় আসা সম্ভব। খালেদা তার ছেলে কোকোর মৃত্যুর জন্য দুঃখ করবেন না। গদির আরামের কাছে স্বজন তুচ্ছ। বরং কোকোর মৃত্যুকে তিনি রাজনীতিতে ব্যবহার করতে চাইবেন। এ থেকে ফায়দা লুটতে চাইবেন। তাঁর স্বামীর মৃত্যুকে ব্যবহার করে তিনি আজ তিনি। এই মৃত্যুর কারণেই দীর্ঘ বছর রাজত্ব করেছেন তিনি। স্বামীর মৃত্যু না হলে কোনওরকম যোগ্যতা ছাড়া সর্বোচ্চ ক্ষমতা অর্জন করা তাঁর জন্য অকল্পনীয় ছিল। স্বামীর মৃত্যু নিয়ে যিনি রাজনীতি করতে পারেন, তিনি পুত্রের মৃত্যু নিয়ে করবেন না কেন।! দুটো মৃত্যু আলাদা, জানি। কোকো দেশের প্রেসিডেন্টও ছিল না, তকে কেউ মেরেও ফেলেনি। কিন্তু হোক না ভিন্ন। মৃত্যু বলে কথা। দেশের সাধারণ জনগণ মৃত্যু দেখলে বড় নরম হয়ে ওঠে, দোষ ত্রুটি সব ক্ষমা করে দেয়। অবশ্য মৃত্যুটা কার হচ্ছে দেখতে হবে। যদি ক্ষমতাবান কারও মৃত্যু হয়, মানুষ চোখের জল। ফেলবে। গরিবের মৃত্যুর দিকে খুব বেশি কেউ ফিরে তাকায় না।

যে মানুষগুলো আগুনবোমায় মারা গেছে, তাদের বেশির ভাগই গরিব। গরিব মরলে ধনীদের কিছু যায় আসে না। ওই গরিব ছেলে গুলোও কারও না কারও সন্তান। ওই ছেলেগুলোর রোজগারেই হয়তো সংসার চলতো। অনেকেই নির্ভর ছিল ওদের ওপর। ওদের মৃত্যুতে অনেকগুলো পরিবারের সর্বনাশ হয়েছে। আমি ওদের মৃত্যুতে শোক করছি। কোকোর মৃত্যুতে কারও কোনও সর্বনাশ হয়নি। তার মায়ের তো নয়ই। তার মা রাণী মাতা। রাণী মাতা পুত্রের উপার্জনের ওপর নির্ভর করেন না। পুত্ৰ অলে সম্পদ রেখে গেছে যা দিয়ে পুত্রের স্ত্রী সন্তানেরা আমোদে আহ্লাদে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। ওদিকে হাসপাতালে কাতরাচ্ছে শতাধিক দগ্ধ সন্তান। জ্বলে যাওয়া পুড়ে যাওয়া মানুষগুলো আর ফিরে পাবে না তাদের আগের জীবন। হয়তো পঙ্গু হয়ে বাকি জীবন বেঁচে থাকতে হবে। এদের এই পরিণতির জন্য দায়ি কে?দায়ি কোকোর মা। কোকোর মা এভাবেই অসহায় নিরাপরাধ মানুষকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে পঙ্গু করে মেরে গদি দখল করতে চান। রাণী মাতাদের নিজের জন্য ছাড়া আর কারও জন্য মমতা থাকে না।

খালেদা নিজের আরাম আয়েশ ছাড়া, নিজের পেটের ছেলেদের নষ্ট বানানো ছাড়া, দেশের লক্ষ লক্ষ ছেলেদের বিভ্রান্ত করে, বিপথে নিয়ে বোমাবাজ, ধর্মবাজ বানানো ছাড়া, খুনি আর সন্ত্রাসী বানানো ছাড়া ভালো কী কাজটা করেছেন, শুনি? এদেরই পিঠের ওপর চড়ে তিনি ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে উঠতে চান। মানুষকে সভ্য শিক্ষিত করা, সচেতন করা, বোধবুদ্ধিসম্পন্ন দায়িত্ববান মানুষ করা, মানুষের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করা, সবার বাক স্বাধীনতাকে সম্মান করা, সমাজকে দারিদ্র, বৈষম্য, ধর্মান্ধতা, আর কুসংস্কার থেকে মুক্ত করা –এসব তার এজেন্ডা নয়। এসবের তিনি বোঝেনই বা কী! কেবল ভাষণ দিতে শিখেছেন। জনগণকে বোকা বানাবার ভাষণ। তাঁর স্বামীও যে কাজটি করতেন।

 কোথায় আছি

ভাইরাসের মতো খবরটা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে, আমি ভারত ছেড়ে চলে গিয়েছি আমেরিকায়। কেন? আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের খুনীরা যারা অভিজিৎ ওয়াশিকুর-অনন্তকে কুপিয়ে মেরেছে, তারা আমাকেও মেরে ফেলবে এই ভয়ে। এতই যদি আমার ভয়, তাহলে ইউরোপের নাগরিক হয়েও, আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়েও কেন বাংলাদেশে ফেরত যাওয়ার জন্য এত চেষ্টা করেছি, আর, কেনই বা বছরের পর বছর ভারতে শুধু থাকিইনি, থাকার জন্য যুদ্ধও করেছি? এ দুটো দেশেই তো জীবনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি, এ দুটো দেশেই আমার বিরুদ্ধে মিছিল হয়েছে, আমার ওপর শারীরিক আক্রমণ হয়েছে, আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি হয়েছে, আমার মাথার দাম ঘোষিত হয়েছে, এ দুটো দেশেই ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীরা আমাকে মেরে ফেলার জন্য ওত পেতে থাকে। এতকাল পর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে থাকায় অভ্যস্ত আমি ভয় পেয়ে পালাবো? পালিয়ে যাওয়ার মানুষ তো কোনওদিনই ছিলাম না। নিরাপদ জায়গা ফেলে আমি তো সারা জীবন অনিরাপদ জায়গাতেই জেনেশুনে বাস করেছি, শুধু নির্যাতিত মানুষদের, যাদের কথা লিখি, তাদের পাশে থাকার জন্য। নিজের সুবিধের জন্য, নিজের বাঁচার জন্য, আজ অবধি কিছু তো করিনি।

আজ একুশ বছর নির্বাসনে। অনেক আগে, যখন আমার খুব নাম ডাক, ইসলামী মৌলবাদীরা হাতের নাগালে পেলে আমাকে জবাই করবে– খবরটি বিশ্বের সর্বত্র প্রচার হচ্ছে, ইউরোপের সরকার, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান থেকে আমাকে জিজ্ঞেস করা হতো, তোমাকে কী করে সাহায্য করতে পারি বলো। আমি সবাইকেই বলেছি, আমাকে নয়, বাংলাদেশের গরিব মেয়েদের সাহায্য করো। আমাকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছে বলে কিছু দাতা দেশ বলেছিলো তারা বাংলাদেশকে দান দেওয়া বন্ধ করে দেবে। আমি বলেছি, ও কাজটি কখনও করো না। বাংলাদেশের দরিদ্র মেয়েরা তোমাদের সাহায্য পেলে খেয়ে পরে বাঁচবে, শিক্ষিত আর স্বনির্ভর হওয়ার সুযোগ পাবে।

না, নিজের জন্য আজও ভাবছি না। এবার আমার আমেরিকায় আসার কিছু কারণের মধ্যে একটি বড় কারণ, সেকুলার হিউম্যানিস্ট কনফারেন্সে বাংলাদেশের নিরীশ্বরবাদী লেখকরা কী রকম মৃত্যুভয়ে গুটিয়ে আছে, সে সম্পর্ক বলা, তাদের প্রাণে বাঁচানোর জন্য ইউরোপ-আমেরিকার সরকার এবং সংগঠনের কাছে আবেদন করা। আর এখানে যে ফাণ্ড তৈরি করা হচ্ছে আমার জন্য, সেটি মুলত যাবে দেশ থেকে ওই লেখকদের বিদেশে নিয়ে আসা এবং বিদেশে তাদের থাকাখাওয়ার খরচে।

নব্বইয়ের শুরুতে লক্ষ লক্ষ মৌলবাদীর মিছিল দেখেছি, যে মিছিলে আমার ফাঁসির দাবি উঠতো। ওই মৌলবাদীদের সুযোগ্য পুত্ররা আজ দেশের প্রতিভাবান লেখকদের জবাই করে, নয়তো পেছন থেকে ঘাড়ে কোপ বসায়। আমি তাদের পুরোনো শত্রু। ঢাকা থেকে দিল্লি তো খুব দুরে নয়। সন্ত্রাসীরা পশ্চিমবঙ্গেই বোমা বানানোর কারখানা তৈরি করতে পারে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে চাপাতি চালানোর ট্রেনিংটাও হয়তো পশ্চিমবঙ্গের কোনও শহরেই করছে। ওদিকে বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের হিটলিস্টে এখন এক ঝাঁক উজ্জ্বল লেখক, যারা ধর্মে নয়, বিজ্ঞানে বিশ্বাসী, শরিয়ায় নয়, নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাসী। লেখকরা আজ ভয়ে লেখালেখি বন্ধ করে দিয়েছে, ঘরের কোনে লুকিয়ে রয়েছে, ভয়ে দেশ ছাড়তে চাইছে, মাথায় হেলমেট পরে বাইরে বেরোচ্ছে, কেউ কেউ শহর থেকে চলে গেছে অচেনা গ্রামে, চেহারা বদলে মিশে গেছে মানুষের ভিড়ে।

সবাই ভাবছে কোপ এবার তাকেই খেতে হবে। প্রায় প্রতিমাসেই একজনকে কুপিয়ে মারা হচ্ছে। হুমকি পেয়ে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করতে গেছেন কিছু লেখক, পুলিশ রিপোর্ট নিচ্ছে না, সোজা বলে দিচ্ছে, বাঁচতে চাইলে দেশ থেকে পালাও। খুনীদের গ্রেফতার করছে না পুলিশ, কেন করছে না জিজ্ঞেস করলে বলছে, ওপরের নির্দেশ নেই। শুধু লেখক বা ব্লগারদের নয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শফিউল ইসলামকে কুপিয়ে মেরে ফেলেছে সন্ত্রাসীরা। তাঁর দোষ, তিনি তাঁর ক্লাসের ছাত্রীদের বোরখা পরে আসতে বারণ করেছিলেন, বলেছিলেন মুখ ঢাকা থাকলে পড়াতে অসুবিধে হয়।

সমাজ যেভাবে আছে, সেভাবেই যদি থাকে, ঘটে বুদ্ধি আছে এমন কাউকেও চাপাতির হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব নয়। সমাজকে বদলাতে হলে ধর্মান্ধদের ধর্মনুভূতিতে আঘাত করাটা খুব জরুরি। অন্য কোনও অনুভূতিতে আঘাত লাগলে মানুষ এত বীভৎস বর্বর হয়ে ওঠে না, কেবল ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগলেই হিতাহিত জ্ঞান হারায়। যারা বাংলাদেশের ব্লগার হত্যার বিরুদ্ধে, তারা অনেকই ব্লগারদের পক্ষ নিতে গিয়ে বলছেন যে ব্লগাররা কারও ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেয়নি। তাহলে কি ধর্মান্ধদের মতো তারাও মনে করেন ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়া অন্যায়? মুশকিলটা ঠিক এই জায়গায়। লক্ষ্য করেছি, এটা মেনে নিতে গণ্যমান্য মনীষীদেরও অসুবিধে হচ্ছে যে, মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়াটা অন্যায় নয়।

অনুভূতিতে কোনওরকম আঘাত ছাড়াই পুরো জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাওয়ার দাবি অত্যন্ত অন্যায় দাবি। সব মানুষের মত এক নয়। মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা করলে অনুভূতি একবার কেন, বারবার আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে। মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করলে অনুভূতির ওপর আঘাত নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। মত প্রকাশের স্বাধীনতার অস্তিত্ব থাকতেই হবে যদি গণতন্ত্রের অস্তিত্ব রাখতে হয়।

ধর্মানুভূতির রাজনীতি অনেককাল ধরে চলছে। ধর্মানুভূতির সঙ্গে সংঘাত লাগছে গণতন্ত্রের, শুভবুদ্ধির, জ্ঞানের, বিজ্ঞানের, নারীর অধিকারের, মানবাধিকারের, সমানাধিকারের। যে কোনও একটি পক্ষ আমাদের নিতেই হবে। আমরা ধর্মানুভূতি রক্ষা করতে চাই নাকি গণতন্ত্র, শুভবুদ্ধি, জ্ঞান, বিজ্ঞান, নারীর অধিকার, মানবাধিকার, সমানাধিকার ইত্যাদি রক্ষা করতে চাই?

পৃথিবীর কোথাও নারীবিদ্বেষীদের অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও মানবাধিকারবিরোধী লোকদের অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও গণতন্ত্র বিরোধী লোকদের অনুভূতিতে আঘাত না দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও ধর্মান্ধদের অনুভূতিকে আঘাত না দিয়ে বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পৃথিবীর কোথাও মানুষের ধর্মানুভূতিকে ক্রমাগত আঘাত না দিয়ে ধর্মানুভূতির নামে ধর্ম ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব হবে না, ধর্মীয় সন্ত্রাস বন্ধ করা সম্ভব হবে না।

একবিংশ শতাব্দিতে চৌদ্দশ বছর আগের বর্বরতাকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। কোপানোর বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে প্রতিবাদ না হলে কোপানো চলতে থাকবে। আজ বিজ্ঞানীদের, মুক্তমনাদের কোপাবে, কাল হিজাব না পরলে, নামাজ না পড়লে, রোজা না করলে কোপাবে।

সেক্লার সংগঠনটি তাদের ফাণ্ড রেইজিংএর চিঠিটি বিলি করার পরই সমস্যা হয়েছে। বিশ্বের সব প্রচার মাধ্যমের কাছে আমি আমেরিকায় এসেছির চেয়ে বড় খবর আমি ভারত ছেড়েছি। আমার ভারত ছাড়ার খবরটা যারাই ছড়িয়েছে, একটু বাড়িবাড়ি করেই ছড়িয়েছে। চিঠিতে লেখাছিল নাআমি তল্পিতল্পানিয়ে জন্মের মতো ভারত ছাড়ছি। ভারত ছেড়ে কোথায় যাবো? এখনও তো ভারতেই পড়ে আছে আমার বাড়িভর্তি বইখাতা, কাপড়চোপড়, অযুত-নিযুত জিনিসপত্তর, পোষা বেড়াল। দিল্লি থেকে বেরিয়েছি ছোট একটা সুটকেসে দুটো জিনস, দুটো শর্টস, আর কটা টিশার্ট নিয়ে। ল্যাপটপ, আইপ্যাড তো হাতে থাকেই, সে যেখানেই যাই। ভারত ছাড়ার খবরটা নিঃসন্দেহে কোনও সুখবর নয়। আমার কোনও সুখবর কি কখনও কোথাও প্রকাশ হয়েছে। এই যে দীর্ঘ বাইশ বছর ইউরোপ আর আমেরিকার বিভিন্ন সরকার, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মানবাধিকার সংগঠন, নারীবাদী দল আমাকে বক্তৃতার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, একটা সুস্থ সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন নিয়ে নিজের সময়, শ্রম, অর্থকড়ি, বিদ্যেবৃদ্ধি সব ঢেলে দিচ্ছি, এই যে এত সভ্য দেশ থেকে এত সম্মান পেয়েছি, এত পুরস্কার, এত ডক্টরেট উপমহাদেশের কোথাও কেউ কি খবর করেছে? কখনও করেনি, শুধু লিখে গেছে কটা পুরুষের সঙ্গে শুয়েছি, কটা বিয়ে করেছি, কোন দেশ আমাকে তাড়িয়েছে, কোন রাজ্য আমাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়েছে, কত লোক আমাকে ঘৃণা করে, কত লোক আমার লেখা পছন্দ করে না, আমাকে লক্ষ করে লোহার চেয়ার ছুঁড়ে মারা হয়, রাজ্য আমার বই নিষিদ্ধ করে, টিভিতে আমার মেগাসিরিয়াল দেখাতে আপত্তি করে, এসব। আমার নামের আগে জুড়ে দেয় একটি শব্দ, বিতর্কিত। শব্দটি জুড়তে জুড়তে এখন এটিকে তারা আমার নামের অংশ বলেই সম্ভবত ভাবে। বিতর্কিত বিশেষণটি আমার ক্ষেত্রে নেতিবাচক অর্থেই ব্যবহার করা হয়। দুই বাংলাআমাকে শুধু তাড়িয়ে শান্ত হয়নি, সবরকম চেষ্টা করেছে, যেন আমি হয়ে উঠি একটা নিষিদ্ধ নাম, একটা নিষিদ্ধ লেখক।

এতকাল কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করেনি আমি কোথায় আছি বা আমি বেঁচে আছি কি না। আজ হঠাৎ আমি ভারত ছাড়লাম কেন জানতে চাইছে। ভারতের মৌলবাদী তোষণ রাজনীতি, মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা, গরিবের অসহায়তা, সামাজিক অব্যবস্থা, ধর্ম, জাতপাত, পুরুষতন্ত্র, কুসংস্কার ইত্যাদি নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করলে কট্টর জাতীয়তাবাদী, ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন পুরুষতান্ত্রিক নারীবিরোধীরা আমাকে নোংরা নোংরা গালি দিয়েছে, ধমকে ভারত ছাড়তে বলেছে, বলেছে বাংলাদেশে ফেরত যেতে। পৃথিবীর সব দেশকে আপন ভাবলে, দেশ আর দেশের মানুষের ভালো চাইলে, অনেক কষ্ট পেতে হয়। রিফুজি, বেগার, ইউ বাংলাদেশি, আমাদের দেশের কোনও ব্যাপারে নাক গলাবি না– এসব গালি অনেক শুনেছি। অনেক ধারণা করে আমার নিশ্চয়ই কোনও বদ মতলব আছে, তা না হলে অন্য দেশের মেয়েরা ধর্ষিতা হলে আমি এত রাগ করি কেন, কন্যাশিশুদের পুতে ফেলা হলে আমি এত রুখে উঠি কেন, নারী নির্যাতন বাড়লে আমি উদ্বিগ্ন কেন, এ দেশ তো আর আমার দেশ নয়! আমি আপন ভাবলেও আমাকে আপন ভাবার লোক আমি খুব কমই পেয়েছি। আমার কথা পছন্দ না হলে আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে, আমাকে লাথি মেরে ভারত থেকে তাড়াবে। প্রায়ই শুনি এমন হুমকি। একদিকে মুসলিম মৌলবাদীদের আক্রমণ। আরেকদিকে নারীবিদ্বেষী, কট্টর ডানপন্থী, কুসংস্কারের ডিপো, উগ্র হিন্দুত্ববাদীর আক্রমণ। যাদের থাকার কথা আমার পাশে, যে বামপন্থী সেকুলার দলের, তারা আমার বই নিষিদ্ধ করে, আমাকে রাজ্য থেকে তাড়ায়, আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটায়। তারা মিথ্যে দোষ দেয়, তাদের সরল সমীকরণ, আমি যেহেতু ইসলামী মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করি, আমি তবে নিশ্চয়ই হিন্দুত্ববাদীদের বন্ধু, নিশ্চয়ই ক্রিশ্চান অথবা ইহুদি মৌলবাদীদের বন্ধু। ভারতের উদারপন্থী সেকুলারদের মধ্যে একটা বড় অংশই ভণ্ড। শুধু ভারতবর্ষে বধূহত্যা হলেই নয়, সোমালিয়ার মেয়েদের যৌনাঙ্গ ছেদন হলেও, ইতালির মেয়েদের গর্ভপাতে বাধা দেওয়া হলেও, সৌদি আরবে মেয়েদের বোরখা পরতে বাধ্য করা হলেও আমি প্রতিবাদ করি। বাংলাদেশে হিন্দুরা অত্যাচারিত হলেই নয়, গুজরাতে বা ফিলিস্তিনে মুসলমানরা, পাকিস্তানে ক্রিশ্চানরা অত্যাচারিত হলেও প্রতিবাদ করি। তা সেকুলারদের অজানা নয়। তারপরও আমাকে ব্রাত্য করতে এরা দ্বিধা করেনি।

এদের বাইরেও মানুষ আছে, যারা ভালোবাসে। ভারতবর্ষের কত কত শহরে কত কত মানুষ দৌড়ে আসে সই নিতে,, ছবি তুলতে, জড়িয়ে ধরতে, একটু হাত স্পর্শ করতে, একটু কাঁদতে, একটুখানি পায়ের ধুলো নিতে। ওই ভালোবাসার কাছে আমি একদিন ফিরে যাবোই। আমার সবজিওয়ালা জয়ন্ত আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকে, আমার মাছওয়ালা বনমালী আমার জন্য অপেক্ষা করে। অপেক্ষা করে শাড়ির দোকানের মজুমদার। অপেক্ষা করে আছে অসংখ্য চেনা অচেনা শুভাকাঙ্খী। ওই ভালোবাসাই আমার সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা।

 কোরবানির ঈদ

কোরবানির ঈদে গরু ছাগল জবাই করতে করতে হাত পাকে। পরে পাকা হাতে মানুষ জবাইটা ভালো জমে। জবাইয়ের জবের অভাব নেই। সিরিয়ায় গিয়ে আইসিসে যোগ দাও, যত খুশি জবাই করো। তা না হলে বাংলাদেশ তো আছেই। যত ব্লগার বাড়ছে, তত জব বাড়ছে। আল্লাহর নামে ধরো আর কাটো।

এবারের ঈদে মুসলমানের বাচ্চারা সবাই চাপাতি হাতে নেবে। আল্লাহু আকবর বলে গরু ছাগল জবাই করবে। একেকটা জবাইয়ে একেকটা নেকি। আল্লাহ তায়ালা জবাই খুব পছন্দ করেন।

খাওয়াদাওয়া

খাবার দাবারের বেলায়, লক্ষ করেছি, বাংলাদেশের চেয়ে পশ্চিমবঙ্গের লোকের গ্রাম্যতা বেশি। পশ্চিমবঙ্গ থেকে একবার দুবন্ধু এলো আমার বাড়িতে, সাতদিন থাকবে। আমি ভাত ডাল শাক সবজি মাছ মাংস রাঁধলাম দুপুরে। খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে বেড়াতে বেরোলো। রাতে ফিরে এলে ডিনার খেতে বসেছি একসঙ্গে। ভেটকি মাছ দেখে একজন বললো, কী ব্যাপার, দুপুরে ভেটকি বেঁধেছো, রাতেও ভেটকি বেঁধেছো?

–রাতে রাঁধিনি।

–রাতে রাঁধোনি? কিন্তু এইতো ভেটকি। এটা ভেটকি না?

–হ্যাঁ এটা ভেটকি। কিন্তু এটা দুপুরে যে রেঁধেছিলাম, সেটাই।

–বলছো কী? দুপুরের ভেটকি?

–হ্যাঁ। ভেটকি তো শেষ হয়নি। অনেকটাই ছিল। নতুন করে রাঁধবো কেন? এগুলোই খাবো এখন।

–কিন্তু এগুলো তো দুপুরে খেয়েছি।

–হ্যাঁ, যা বাকি ছিল, সেগুলো ফ্রিজে রেখেছিলাম, মাইক্রোওয়েভে এখন গরম করে দিয়েছি।

-মানে?

–মানে হলো আমি যখন রাঁধি তখন বেশি করেই রাঁধি, যেন পরে আবার খাওয়া যায়।

–কিন্তু আমরা তো বাসি খাবার খাই না।

–বাসি হতে যাবে কেন? ফ্রিজে ছিল।

–ফ্রিজের খাবার তো আমরা খাই না।

–তোমাদের বাড়িতে তো ফ্রিজ আছে। ফ্রিজে খাবার রাখো না? ফ্রিজটা তবে কী কাজে লাগাও?

— জল টল রাখি।

–ব্যস?

–ব্যস।

–আর আমি তো একদিন রান্না করে সব ফ্রিজে তুলে রাখি। একটু একটু করে সাতদিন খাই।

–হোয়াট?

–বলছি, একদিন রান্না করে সাতদিন খাই। কারণ রান্না ছাড়াও তো আরও কাজ আছে। সে সব করতে হবে না? বেলায় বেলায় রাঁধতে হবে কে বললো?

–তাই তো জানি।

–আমি আবার তা জানি না। রেফ্রিজারেটারে আমি খুব ভালো ভাবে খাবার রাখি। নষ্ট হয়না। এখানে গরমকালে তিনদিন খেতে পারি। আর শীতকালে পাঁচদিন। বিদেশে ঠাণ্ডার দেশে তো একদিন রান্না করে আরও বেশিদিন খাই।

চোখ কপালে তোলে বন্ধুরা।

ওদের শেষ অবধি রাজি করাতে পেরেছি, একবার রাঁধলে একবেলা নয়, দুবেলা খাবে। কিন্তু আজ বেঁধে কাল খাওয়াটা বা পরশু খাওয়াটা মানেনি। আমাকে প্রতিদিন রাঁধতে হয়েছে। কোনওদিন যদি রাঁধতে না পারি, ওদের রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেছি। আগের দিনের খাবার দিইনি। আগের দিনের খাবারগুলো শুধু আমি খেয়েছি।

রেফ্রিজারেটরের ব্যবহার জানে না বেশির ভাগ লোক। ফ্রিজারেও কাঁচা মাছ মাংস রাখে না খুব। কিন্তু ফ্যাশনের আরামবাগ ফ্রোজেন চিকেন বাজারে এলে সেটা কেনার ধুম পড়ে যায়। তখন ফ্রেশ চিকেন ভালো লাগে না। জ্যান্ত মুরগি বাজারে রেখে দোকানের ফ্রিজার থেকে চিকেন কিনে এনে রান্না করে খায় আর আহা কী স্বাদ আহা কী স্বাদ বলে। বড়লোকরা পছন্দ করে বলে মধ্যবিত্তরাও ওই চিকেনে স্বাদটা দ্রুত পেয়ে যায়।

একবার কলকাতার যদুবাজার থেকে আমি পাঙ্গাস মাছ এনেছিলাম। বন্ধুদের নেমন্তন্ন করেছি। বন্ধুরা অন্য যা যা খাবার ছিল, খেলো, পাঙ্গাস মাছের নাম শুনে ছিটকে সরে গেলো। ও মাছ খাবে না, কারণ ও মাছ আগে খায়নি অথবা ও মাছের নাম শোনেনি। অচেনা কোনও খাদ্য চেখে দেখতে কেউ রাজি নয়। সবই হতে হবে চেনা। জন্ম থেকে খেয়ে এসেছে, এমন চেনা।

একবার চিতল মাছের মুইঠ্যা বানিয়েছিলাম। মুইঠ্যা ওই আমি প্রথম বানিয়েছি। এবং আশ্চর্য ভালো হয়েছিল সেই মুইঠ্যা। মুইঠ্যা খেতে বন্ধুরা এলো। সবাই কাড়াকাড়ি করে খেয়ে হাত চাটতে লাগলো। সক্কলে বললো, এমন সুস্বাদু মুইঠ্যা তারা তাদের জীবনে খায়নি কোনওদিন। এটা তাদের লাইফের বেস্ট মুইঠ্যা। মুইঠ্যার প্রশংসা চললো আরও কয়েক ঘণ্টা। তারপর, সবাই যখন যাবে, তখনই কথা প্রসঙ্গে বললাম, যদুবাজার থেকে কিনেছিলাম চিতল মাছটা। বিশাল ছিল মাছটা। পেটিগুলো বেঁধেছি। আর মুইঠ্যার জন্য কাঁটামুক্ত মাছ সরিয়ে রেখেছিলাম। কতদিন ভেবেছি মুইঠ্যা বানাবো। আর হয়ে ওঠেনি। প্রতি মাসেই ভাবি এ মাসেই নামাবো মাছটা ফ্রিজার থেকে। ফ্রিজারের এত তলায় পড়ে গিয়েছিল যে ওই প্যাকেটটা খুব চোখে পড়তো না। ছমাস পরে বের করেছি।

বন্ধুদের চোখ কপালে। অস্ফুট স্বরে বললো, কী বললে?

আমি বললাম, ছমাস।যে মাছটা দিয়ে মুইঠ্যা বানিয়েছি সে মাছটা ছমাস ফ্রিজারে ছিল।

–ছমাস এই মুইঠ্যার মাছ ফ্রিজারে ছিল? ভাঙা গলায় একজন জিজ্ঞেস করলো।

–হ্যাঁ। বললাম।

একেকজন বমি করে দেয় অবস্থা। দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে ওয়াক ওয়াক করতে লাগলো। কেউ বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। আর এসব শুনতে পারছে না। কারও মাথা ধরলো। মুখ চোখ বিবর্ণ।

(ওহ আর একটা কথা তো বলাই হয়নি। পুরুষগুলো তো চামচে করে খাবার নিতে পারে না নিজের থালায়। পড়ে যায়। কারণ নিয়ে তারা অভ্যস্ত হয়। যখন তারা খেতে বসে, তাদের মা বা তাদের বউ, পাশে দাঁড়িয়ে বেড়ে দেয়। কলকাতার শিক্ষিত ঘরেও এই দৃশ্য দেখতে হয়েছে আমাকে। আমার বাড়িতে এলে, প্রথমেই সোজা বলে দিই, এখানে কেউ খাবার বেড়ে দেবে না আপনাদের, নিজেদের তুলে খেতে হবে। আর আমার বাড়িতে পুরুষের আগে খাওয়া আর মেয়েদের পরে খাওয়ার কুৎসিত নিয়মটা নেই।)

নর্থ বিচ এলাকার আনাচ-কানাচে কবিতা পড়ার অন্য এক আনন্দ আছে। যেন জ্যাক কেরুয়াক, অ্যালেন গিন্সবার্গ, লোরেন্স ফারলিংগেটির আমরাই উত্তরসূরি। জ্যাক কেরুয়াক অ্যালিতে ছিল একদিন আমার কবিতা পড়া। কবিতা উৎসবের আয়োজক জ্যাক হিরশম্যান সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আমি কবিতা পড়বো আমার মাতৃভাষায়, আমেরিকার কোনও কবি আমার কবিতার ইংরেজি অনুবাদ পড়ে শোনাবেন। আমাদের বড় অনুষ্ঠানটা হয় সানফ্রান্সিসকোর প্যালেস অব ফাইন আর্টসে। ওই প্যালেসে অডিটোরিয়ামের বাইরে কবিদের কবিতার বইও বিক্রি হয়েছে। আমার বইও ছিল, তবে কবিতার বই নয়, গদ্যের বই। ফাঁক পেয়ে একদিন বিটনিকদের মিউজিয়াম ঘুরে এসেছি। যেন স্বপ্নপুরী। অ্যালেন গিন্সবার্গের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে প্যারিসে। জানি না কেন, গিন্সবার্গের চেয়ে বেশি জ্যাক কেরুয়াক আমাকে টানে।

খুন

কেউ কেউ বলছে এত যে ব্লগার লেখক প্রকাশককে কুপিয়ে মারা হচ্ছে দেশে, হাসিনা মোটেও উদ্বিগ্ন নন, খুনীদের ধরা, বিচার করা, এসব তিনি, সত্যি কথা বলতে কী, চান না। মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের অখুশী করলে যদি আবার তাঁর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে, কেউ যদি তাকে নাস্তিক ভেবে বসে, তাঁকে যদি গদি হারাতে হয়! হাসিনার নাকি টনক নড়বে তাঁর পুত্রধন জয়কে যদি কুপিয়ে হত্যা করে ইসলামী খুনীরা। তাহলেই নাকি তিনি খুনের বিচার চেয়ে কাঁদবেন। তাহলেই নাকি তিনি ইসলামী খুনীদের শায়েস্তা করবেন।

আমার কিন্তু তা মনে হয় না। ক্ষমতার লোভ যাকে একবার পেয়ে বসেছে, তার কাছে পুত্রকন্যা স্বামীস্ত্রী মাবাপ সবই তুচ্ছ। জয়কে, যথেষ্ট ধর্মপ্রাণ না হওয়ার কারণে, অভিজিৎ রায়ের মতো, ওয়াশিকুর বাবুর মতো, অনন্ত বিজয় দাশের মতো, নিলয় নীলের মতো, ফয়সাল আরেফিন দীপনের মতো নৃশংসভাবে, হাসিনার চোখের সামনে, কুপিয়ে হত্যা করলেও হাসিনা ওদের বিচার চাইবেন না, ওদের শাস্তি হোক চাইবেন না। ভয়ে চাইবেন না, চাইলে যদি ইসলামী মৌলবাদী সন্ত্রাসী খুনীরা হাসিনাকে সমর্থন না করে, তিনি যদি ক্ষমতাচ্যুত হন। ক্ষমতার লোভটা রক্তপিপাসুদের রক্তের লোভের মতো। ও না হলে তাদের চলে না। গোটা দেশকে রক্তের নদীতে ভাসিয়ে দিতে আপত্তি নেই। পুত্রকন্যাদের রক্ত পান করতে বললেও হয়তো আপত্তি থাকবে না।

গরবাচেভ

২০০৮ সালে বিখ্যাত গ্লাসনস্ত এবং পেরেস্রোইকার স্থপতি মিখাইল গরবাচেভ আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ইতালির বোসকো মারেঙ্গোতে, ওয়ার্ল্ড পলিটিক্যাল ফোরামের অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করতে। আমার বিষয় ছিল নারীর সমানাধিকার। আমি টেবিলের এইপাশে, ওইপাশে বসে মন দিয়ে আমার বক্তব্য শুনেছেন গরবাচেভ। কানে অনুবাদের হেডফোন লাগিয়ে শুনেছেন। সাইমালটেনিয়াস অনুবাদ ছিল। বক্তৃতা শেষ হলে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বুড়ো আঙুল উঁচু করলেন। তারপর দেখলাম। উনি নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। ভাবলাম হয়তো কোনও জরুরি কাজে কোথাও যাচ্ছেন। আশ্চর্য, উনি লম্বা টেবিলটার কিনার দিয়ে হেঁটে হেঁটে আমার কাছে পোঁছুলেন। আমি তাঁর গন্তব্য! আমাকে ভীষণ চমকে দিয়ে আলিঙ্গন করলেন আমাকে, শুদ্ধ ইংরেজিতে বললেন, খুব ভালো বলেছে, সবার চেয়ে ভালো হয়েছে তোমার বক্তব্য। দি বেস্ট যাকে বলে। আমি বিস্মিত, মুগ্ধ, অপ্রস্তুত, অপ্রতিভ। এরপর উনি ফিরে গেলেন নিজের চেয়ারে। ফিরে মাইক্রোফোন টেনে নিয়ে রাশান ভাষায় বলতে শুরু করলেন আমি যা বলেছি তা কেন তিনি মনে করেন অতি প্রয়োজনীয়, কেন আমার পাশে সবার দাঁড়ানো উচিত। প্রায় পনেরো মিনিট বললেন। আমি থ।

 গরিবের গ্রেনেড

সেদিন আলোচনা হচ্ছিল কিছু ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে। প্রসঙ্গ বাংলাদেশ। আজকাল বাংলাদেশের কথা ওঠা মানে পেট্রোল বোমার কথা ওঠা। পেট্রোল বোমায়। এ পর্যন্ত প্রচুর লোক নিহত, প্রচুর আহত। তুমি বাড়ি থেকে বের হলে, কিন্তু তুমি জানো না তুমি বাড়ি ফিরতে পারবে কি না। তুমি যখন বাইরে, বাসে চড়ছো, গাড়িতে চড়ছো, রাস্তায় হাঁটছো, আচমকা কোনও এক পেট্রোল বোমা উড়ে এসে তোমার গায়ে পড়তে পারে এবং তোমাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারে। তুমি নিশ্চিত নও পেট্রোল বোমা তোমার গায়ে পড়বে না বা তুমি পুড়বে না বা তুমি মরবে না।

বাড়ি থেকে বেরোনো মানে যদি যে কোনও সময় মরে যাওয়া হয়, তবে বাড়ি থেকে বেরোনোই হয়তো উচিত নয়। সবাইকে সিঁটিয়ে থাকতে হবে ভয়ে, জীবন স্থবির করে দিয়ে ঘরবন্দি বসে থাকতে হবে অনির্দিষ্টকাল। কিন্তু ঘরবন্দি হলে চাকরি খোয়াতে হয়, ব্যবসা লাটে ওঠে, কারো কারো জন্য তো দুবেলা অন্নের সংস্থানই হয় না! এ অনেকটা দুটো মৃত্যুর মধ্যে একটিকে বেছে নিতে বলা। যে বাসের কনডাক্টরটা সেদিন পুড়ে মরলো, তার কি ঘরবার না হলে চলতো? কানাডা থেকে দেশে ফিরেছেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক, আমার অনুরাগী পাঠক, দিল্লিতে এসে আমার সঙ্গে দেখা করার খুব ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন, পারলেন না। একদিন আমাকে খুব দুঃখিত কণ্ঠে জানিয়ে। দিলেন, বাসে উঠতে ভয় পাচ্ছেন তিনি। দেশটায় নাকি আগুন জ্বলছে।

খালেদা জানেন সব। জানেন মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়েও বাইরে বেরোবে। হয়তো মরবো না এই বিশ্বাস নিয়ে লোকে বেরোবে। কারণ ঘরে বসে থাকলে মানুষের চলবে না। দেশজুড়ে বিষম এক আতঙ্ক তৈরি করতে চাইছেন খালেদা। ছেলেমেয়েদের মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে দেবেন না। হরতাল ডেকে বসলেন পরীক্ষার দিন। নিজের ক্ষমতা ছাড়া আর কাউকে বা আর কিছুকে তিনি কি কখনও মূল্য দিয়েছেন? আমার জানা মতে, দেননি।

তুমি বাসে চড়ছো, বাজারে যাচ্ছো, ভাগ্য ভালো হলে বেঁচে যাবে, তা না হলে আজই আগুনে জ্বলে পুড়ে তোমাকে মরতে হবে। এত নিরাপত্তাহীনতা স্বদেশে থাকে না, থাকে শত্রুর দেশে, অথবা যুদ্ধ চলছে এমন দেশে। ফিনল্যাণ্ডের লোকেরা তিরিশের দশকের শেষদিকে পেট্রোল বোমা বানিয়েছিল রাশিয়ার লোকদের মারার জন্য। পেট্রোল বোমাকে ওরা বলতো, মলোটভ ককটেল। একে গরিবের গ্রেনেড়ও বলা হয়। এই পেট্রোল বোমা ফিনল্যাণ্ডের যুদ্ধে আর স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধে ব্যবহার

হয়েছিল। আর এতকাল পর উক্রেইনে গতবছর এর সামান্য ব্যবহার দেখা যায়। যুদ্ধ ছাড়া এই বোমা কেউ ব্যবহার করেনি। যুদ্ধ নেই, অথচ বাংলাদেশে এই বোমা ব্যবহৃত হচ্ছে। যুদ্ধ নেই, অথচ শুরু হয়েছে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। এ থেকেই শুরু হয়ে যেতে পারে বিচ্ছিরি গৃহযুদ্ধ। গৃহযুদ্ধ শুরু হোক বা না হোক, ধর্মনিরপেক্ষতা আর ধর্মান্ধতার মধ্যে চিরকালের যে লড়াই, সেটি তো রয়েই যাবে। ধর্মান্ধরা এখন আগুন হাতে নিয়েছে। এ আগুন জেহাদের আগুন। নরকের আগুনের চেয়েও এর বীভৎসতা বেশি।

রাষ্ট্রদূতেরা পেট্রোল বোমা বন্ধ করা নিয়ে কথা বলেছেন দুই নেত্রীর সঙ্গে। বিরোধীদলের নেত্রীকে অনুরোধ জানানো হয়েছে, ঘণ্টার পর ঘন্টা তাঁকে বোঝানো হয়েছে ভায়োলেন্সবিহীন আন্দোলনে যাওয়ার জন্য। বলা হয়েছে, আপনার লক্ষ লক্ষ কর্মী মাঠে নামুক, মিছিল করুক, সভা করুক, অবরোধ করুক, কিন্তু খালি হাতে করুক, হাতে কোনও বোমা, কোনও বন্দুক না নিয়ে করুক। না, খালেদা রাজি নন। তিনি কোনো ভায়োলেন্সবিহীন অবরোধে রাজি নন। তিনি ভায়োলেন্স দেখতে চান, মৃত্যু দেখতে চান, রাজপথ রক্তে ভেজাতে চান। রক্ত ছাড়া তাঁর কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে তিনি নাকি পৌঁছোতে পারবেন না। অগত্যা ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূতদের হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হয়েছে। কারও কথাই তিনি শুনবেন না। মানুষ আগুনে পুড়ে মরছে– এতে তাঁর কিছু যায় আসে না। ইরাক-সিরিয়ার সন্ত্রাসী দল আইসিসও তো সেদিন জ্যান্ত পোড়ালো জর্দানের পাইলটকে। জেনে শুনে খালেদাও পোড়াচ্ছেন। কী পার্থক্য দুই দলে?

যাত্রীবাহী বাসে ট্রাকে লঞ্চে পেট্রোল বোমা ছোঁড়া হচ্ছে, বা নিরপরাধ মানুষকে গুলি করে মারা হচ্ছে, এসব খবর যখন কানে আসে, আমি প্রশ্ন করি, যদি সরকারের ওপর এত রাগ বিরোধী দলের, বিরোধী দলের সঙ্গী ধর্মীয় দল জামাতে ইসলামী আর ছাত্র শিবিরের, তবে তারা অরাজনৈতিক দরিদ্র নিরীহ নিরপরাধ লোকদের মেরে ফেলছে কেন, কেন সরকারের কোনও মন্ত্রী বা কোনও রাজনীতিকের বাড়িতে, বা অফিসে, বা গাড়িতে বোমা ছুড়ছে না? সরকারের পতন চাও, তবে পেট্রোল বোমা সরকারের দিকে তাক করো, সাধারণ মানুষের দিকে তাক করছে কেন? সাধারণ মানুষকে মারা সোজা, জানি। কিন্তু কঠিন কাজটাই তো কঠিন সময়ে করতে হয়, অন্তত চেষ্টা তো করো। সরকারকে না মারলে সরকারের পতন কী করে হবে? সত্যি বলতে কী, গরিব মরলে কারও কিছু যায় আসে। না সরকারের, না বিরোধী দলের, না জনগণের।

কিছুদিন পর ইউরোপীয় সংসদ থেকে মানবাধিকার নিয়ে কথা বলতে বিশেষজ্ঞরা আসবেন। তাঁরা মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলের নেত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন। নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে পুড়িয়ে কেবল বিরোধীদলের নেত্রী জনগণের মানবাধিকার লন করছেন তা নয়, প্রধানমন্ত্রীও লম্ফন করছেন মানবাধিকার। মত প্রকাশের অধিকার অন্যতম মানবাধিকার। আর সেটিই নিয়ত পদদলিত হচ্ছে। বাক স্বাধীনতার বিরোধী আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারাটি বহাল তবিয়তে এখনও বিরাজ করছে। ইন্টারনেটে এমন কোনও কথা কেউ যদি লেখে, যা সরকারের পছন্দ নয়, তবেই হাতকড়া পরিয়ে জেলে নিয়ে যাবে পুলিশ। তাছাড়া মুক্তচিন্তকদের নির্যাতন করার জন্য বাংলাদেশ ফৌজদারি আইনের ২৯৫ ধারা তো আছেই। এইসব দুষ্ট আইন বাতিল করা তো হচ্ছেই না বরং নির্বিচারে ব্যবহার করা হচ্ছে, তার মানে এই আইনগুলো রক্ষা করা হচ্ছে দুষ্ট কাজ করার জন্য। বাংলাদেশের সব সরকারই দুষ্ট কাজে ভীষণই পারদর্শী। এই সরকারকে সংখ্যালঘুদের পক্ষের সরকার ভাবা হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি মন্দির আক্রমণ হচ্ছে, সরস্বতীর একশ মূর্তি ভেঙে ফেলা হলো সেদিন, হিন্দুরা আওয়ামী আমলেও দেশত্যাগ করছে। আমি তো আশার কিছু দেখি না কোথাও। কেবল হতাশায় বসতি।

মানুষ কতটা অসহায় হলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশে বাস করে। কতটা অসহায় হলে বাসে পেট্রোলবোমা পড়তে পারে জেনেও বাসে চড়ে। কতটা অসহায় হলে রাজনীতিকদের সব অনাচার অত্যাচার সহ্য করেও, অবর্ণনীয় দুর্ভোগের দিন কাটাতে কাটাতেও স্বপ্ন দেখে দিন বদলের!

বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে কথা বলে এইটুকু টের পেয়েছি, বাংলাদেশকে তাঁরা গণতান্ত্রিক দেশ বলে মনে করেন না। জানি না, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে ঠিক কী তন্ত্র বলে তাঁরা মনে করেন। তবে আমার কথা বলি, যে দেশে জনগণের নিরাপত্তা নেই, সে দেশকে দেশ বলতে আমার বাধে, গণতন্ত্র বলতে তো আরও বাধে। গণতন্ত্র মানে কিন্তু শুধু ভোটাভুটি নয়, গণতন্ত্র মানে সবার কথা বলার অধিকার, সবার সমান অধিকার, সবার নিরাপত্তার অধিকার।

গার্হস্থ্য

লেখালেখি নিয়ে আমার চূড়ান্ত ব্যস্ততা। তারপরও আমি নিজে বাজার করি, রান্না করি। অতিথি এলে বারো পদের খাবার একা আমিই রাঁধি। কাজে সাহায্য করার যে মেয়েটি আসে চার ঘণ্টার জন্য, সে শাক সবজি পেঁয়াজ রসুন কেটে দিলো,ব্যস এটুকুই। মেয়েটি মূলত যে কাজগুলো করে, তা হলো, বাসন মাজা, ঘর ঝাড়ু দেওয়া, ঘর মোছা। মেয়েটি না এলে আমি ওসব নিজেই করি। তাছাড়া কাপড় কাঁচার মেশিনটা আমিই চালাই। গাছে আমিই জল দিই। আমি বলতে চাইছি, আমি পারি ঘরের কাজকম্ম করতে। কোনও কাজে আমার অনীহা নেই। আমি নিজেই তো টয়লেট পরিষ্কার করি। কারণ টয়লেট পরিষ্কার করতে সাহায্যকারীরা রাজি নয়। যেটা বলার জন্য এত সব বলছি, সেটা হলো, ভারত এবং বাংলাদেশের বন্ধুরা যারা আমার কাছে আসে, থাকে, তাদের দেখেছি, তারা ঘরের কোনও কাজে হাত দিতে চায় না, তারা কিছু করতে অভ্যস্ত নয়। জুসটাও ঢেলে খেতে জানে না। আমি যখন তাদের জন্য রান্না করি, তারা ড্রইংরুমে বসে থাকে। আমি যখন বাসন মাজি, ঘর ঝাড়ু দিই, তারা দুরে বসে বসে দেখে। পুরোই হ্যাঁন্ডিক্যাড। তাদের কাজ হল, বসে থাকা, আর গল্প করা অথবা অনর্থক শুয়ে থাকা। তারা ঘরের কাজগুলো আমার সঙ্গে ভাগ করে করে না, তার কারণ কিন্তু এই নয় যে তারা আমাকে ভালোবাসে না, তারা করে না কারণ কিছু করতে তারা জানে না, করতে শেখেনি, করে অভ্যেস নেই। শেখার এবং করার কোনও ইচ্ছে তাদের নেই। যদি কিছু করতে বলি, যদি বলি তোমার বিছানার চাদরটা চেঞ্জ করো, বা বালিশে নতুন ওয়াড় লাগাও, তাদের মুখ ভার হয়ে যায়, ঘরের কোনও কাজ করাকে তারা ইনসাল্ট বলে মনে করে। যদি ভারত এবং বাংলাদেশের মানুষই আমার বাড়িতে থাকতো,যারা ইউরোপ বা আমেরিকায় কয়েক বছর হলেও থেকেছে, তাহলে কিন্তু তারা আমার মতো সবকিছুই করতে জানতো। আমি একা ঘরের সব কাজ করছি দেখলে তারাও কিছু কাজ ভাগ করে নিত। নিতে লজ্জা করতো না। অথবা বাসনগুলো মেজে দাও বললে তারা গাল ফুলোতো না।

এই উপমহাদেশের উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্ত ছেলেমেয়েগুলো পাশ্চাত্যের দেশগুলোয় কয়েক বছর করে থেকে এলে ভালো মানুষ হতে পারতো। কাজ ভাগ করে করা, কোনও কাজকে ঘৃণা না করা, মানুষকে সম্মান করা– এসব খুব জরুরি। মুশকিল হলো, জরুরি ব্যাপারগুলোকে মোটেও তারা জরুরি বলে মনে করে না। নিজেদের দেশে তারা গরিব লোক সবসময়ই পেয়ে যাবে, যারা সংসারের সব কাজ করে দেবে। সুতরাং তাদের খামোকা বসে থাকা আর শুয়ে থাকাটা তারা যতদিন বেঁচে থাকে, চালিয়ে নিতে পারবে। আমি বলছি না তারা সব আলসে লোক। তারা কিন্তু বাইরে কাজ করছে, চাকরি বাকরি করছে। কিন্তু ঘরের কাজগুলো তাদের কাজ নয়, ঘরের কাজগুলো চাকর বাকরের কাজ, এটা তাদের মস্তিষ্কে জন্মের পরই ঢুকে বসে আছে। প্রয়োজনে এই কাজগুলো যে নিজেও করা যায়, এতে যে কোনও লজ্জা নেই– এ সম্পর্কে তাদের কোনও ধারণাই নেই।

গুন্টার গ্রাস

গুন্টার গ্রাসের সঙ্গে আমার দুবার দেখা হয়েছিল। প্রথমবার চেক রিপাবলিকের প্রাগে, এক সাহিত্য সম্মেলনে। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে। আর দ্বিতীয়বার, বার্লিনে। পূর্ব বার্লিনে। যখন তিনি তাঁর বই থেকে পড়তে এসেছিলেন। তখন আমি বার্লিনেই থাকি। এই ছবিটা প্রাগের সম্মেলনে যখন দুজন কথা বলছিলাম।

মনে আছে,তিনি যখন পাঠ করতে এসেছিলেন তাঁর নতুন বেরোনো আইন ওয়েটিস ফেল্ড (একটা প্রশস্ত মাঠ) থেকে, আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল অডিটোরিয়ামের বাইরে। অনেকক্ষণ কথা বললেন আমার সঙ্গে। টিভি ক্যামেরগুলো প্রজাপতির মতো উড়ে চলে এলো আমাদের দেখে। এতে আমাদের কিছু যায় আসেনি। আমরা কথা বলে যাচ্ছিলাম, উনি বললেন, তোমার ফতোয়ার মতো সিরিয়াস না হলেও আমার ওপর জারি করা ফতোয়া কিন্তু একেবারেই ফেলনা নয়। তাঁর ওই বইটা নিয়ে তখন জার্মানিতে তোলপাড়। ডাস স্পিগাল পত্রিকার প্রচ্ছদ ছাপানো হয়েছিলো বিখ্যাত পুস্তক সমালোচক মারচেল গ্রাসের বইটাকে ছিঁড়ে দু টুকরো করে ফেলেছেন। বাক স্বাধীনতার প্রশ্নে ডাস স্পিগালের ভূমিকা নিয়েও তখন আলোচনা তুঙ্গে। গ্রাস তাঁর বইয়ে দুই জার্মানি এক হওয়ার বিরুদ্ধে লিখেছেন। গ্রাস নিজে বামপন্থী আদর্শের মানুষ। তিনি পুঁজিবাদের কাছে পূর্ব জার্মানির হেরে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেননি। তিনি মনে করেন, পূর্ব জার্মানিকে স্রেফ কিনে নিয়েছে পশ্চিম জার্মানি। খুব স্বাভাবিকভাবেই যারা বার্লিন দেয়াল ভাঙার পক্ষে ছিলো, গ্রাসের তীব্র সমালোচনা করেছিল। ফতোয়া, সমালোচনা, নিন্দা নিয়ে আরও কিছুক্ষণ রসিকতা করলেন গ্রাস। তবে দুজনের একান্ত আড্ডাটা শেষ করলাম এই বলে, যে, লোকে যাই বলুক, যা কিছুই ঘটুক, যতো ফতোয়াই দেওয়া হোক, যত ঘৃণাই আমাদের করা হোক, আমাদের যা বলতে ইচ্ছে করে, তা আমরা বলে যাবো, আমরা যা বিশ্বাস করি, তা আমরা লিখে যাবো।

সেদিন গুন্টার গ্রাসের পাঠ মন দিয়ে শুনেছিলাম। আমি কি জার্মান জানি। জানি, তারপরও শুনেছি। হাজার হাজার মানুষ শুনেছে, দাঁড়িয়ে, বসে। তিল ধারণের জায়গা ছিল না। কী আশ্চর্য। মানুষ তাঁর সঙ্গে একমত নয়, কিন্তু মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে। কেউ চিৎকার করে উঠছে না, কেউ গালি দিচ্ছে না, কেউ সামান্য শব্দ করছে। না। পিন পতন নিস্তব্ধতার মধ্যে তিনি বই থেকে পাঠ করলেন। কতক্ষণ? দুঘণ্টা? হ্যাঁ দুঘন্টাই। আমার মতো অস্থির মানুষও একটিও জার্মান শব্দ না বুঝে দুঘণ্টা বসে রইলাম। আসে কিছু কিছু সময় মানুষের জীবনে, যখন চারপাশের সব কিছু অনুভব করা যায়, ভাষা বোঝার দরকার হয় না।

গুন্টার গ্রাস আজ মারা গেছেন। বয়স হয়েছিল ৮৭। ভালো যে নোবেল কমিটি এত বড় লেখককে নোবেল প্রাইজটা দিয়েছিলেন। নোবেল না পেলেও গুন্টার গ্রাস গুন্টার গ্রাসই থাকতেন, নোবেল কমিটিকে লজ্জায় মাথা হেঁট করতে হতো।

গুন্টার গ্রাসের অতুলনীয় প্রতিভাকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু আজও জানি না তিনি কেন এত দীর্ঘদিন লুকিয়ে ছিলেন যে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর এসএস ছিলেন।

গুলাম আলী

গুলাম আলির বোম্বে প্রোগ্রাম বাতিল, পুনে প্রোগ্রাম বাতিল। বাতিল করার পেছনে কে? হিন্দু মৌলবাদী দল শিব সেনা। কেন? পাকিস্তানিরা ভারতীয়দের মারছে, সুতরাং ওদের টেররিজম বন্ধ না হলে ওদের কেউ এদেশে গাইতে পারবে না। আমার কথা,গুলাম আলি গায়ক মানুষ, ওর দোষটা কী, ও তো ভারতে বোমা মারতে আসিনি, বেচারা গান গাইতে এসেছে। কেউ কেউ বললো গুলাম আলি হিন্দুদের কাফের বলেছে। আমার কথা যা ইচ্ছে তাই বলুক, সাংস্কৃতিক আদান প্রদান বাড়লে দুদেশের সম্পর্ক ভালো হবে, একদিন মারামারিটাও বন্ধ হবে। কে শোনে কার কথা। টুইটারে আমাকে তো শিবসেনার ভক্তরা বললো, তুই অত গুলামের হয়ে লড়ছিস কেন, ভারতকে হিন্দু সৌদি বলছিস তো, ভারত থেকে তুইও বেরিয়ে যা।

আমি না হয় বেরিয়ে গেলাম। কিন্তু অন্যায় দেখলে কথা তো আমি কইবোই। পৃথিবীটাকেই যখন আমার নিজের একটা গ্রাম মনে করি, ছায়াপথটাকে রাজ্য, আর ইউনিভার্সটাকে দেশ, তখন কোথাও গড়বড় হলে আমি চিল্লাবো না তো কে চিল্লাবে!

হঠাৎ শুনি পশ্চিমবাংলার মমতা বিবি গুলাম আলিকে কলকাতায় গাইতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। এক শিল্পীকে লাথি মারো, আরেক শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানাও। কারণটা কী? কারণটা হলো উর্দুভাষী অশিক্ষিত কূপমণ্ডুক ইমামের দল, যাদের টাকা পয়সা দিয়ে, যা ইচ্ছে তাই করার ক্ষমতা দিয়ে পুষছেন তিনি তারা তাদের অশিক্ষত শিষ্যদের বলে দেবে বিবিকে ভোট দিও, ভোট-পাগল বিবি ইমামদের খুশি করতে তাই গুলাম আলিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ইমামরা পাকিস্তানি মুসলিম গুলাম আলিকে পেয়ে আহ্লাদে আটখানা হবে, কারণ মনে মনে পাকিস্তানই তো তাদের আসল স্বদেশ, মুসলিম ভ্রাতৃত্বই তো তাদের আসল ভ্রাতৃত্ব!

তসলিমার বই উদ্বোধন বন্ধ করো, তসলিমার মেগা সিরিয়াল বন্ধ করো, তসলিমার এন্ট্রি বন্ধ করো রাজ্যে, তসলিমার লেখা যেন কেউ না ছাপায় মিডিয়াকে সাবধান করে দাও, তসলিমার বই যেন কেউ প্রকাশ না করে পাবলিশারদের হুমকি দিয়ে দাও, তসলিমার গল্প নিয়ে ফিচার ফিল্ম কেউ যেন না বানায় টালিগঞ্জে জানিয়ে দাও –এসব কাজ মমতা বিবি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই করে গেছেন। কেন তসলিমার প্রতি তাঁর এত ঘৃণা? তসলিমার ৪০টা বইয়ের তো লক্ষ লক্ষ পাঠক পশ্চিমবাংলায়, তবে? তাকে ভালোবাসার, শ্রদ্ধা করার লোকেরও তো অভাব নেই, তবে? মুশকিলটা হলো, তাঁর পেয়ারের ইমামরা তসলিমাকে ঘৃণা করে। ইমামরা ঘৃণা করে কারণ ইসলাম ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করেছিল তসলিমা, কারণ মেয়েদের অধিকারের দাবি করেছিল তসলিমা। মমতা বিবি মুসলিম মৌলবাদীদের গুলাম সেজেছেন। মৌলবাদীরা কাউকে ঘৃণা করলে তিনিও তাকে ঘৃণা করেন। নিজের বোধবুদ্ধি গঙ্গার জলে অনেক আগেই বিসর্জন দিয়েছেন। তসলিমাকে পারলে চাপাতি দিয়ে কোপাবেন তিনি।

আজ গুলাম আলিকে কোনও কারণে কলকাতার মুসলিম মৌলবাদীরা পছন্দ না করলে গুলাম আলিকেও মমতা বিবি নিষিদ্ধ করবেন কলকাতায়। চ্যালেঞ্জ।

গৃহকর্মীদের নির্যাতন করছে গৃহকর্ত্রীরা!

কিছু কিছু তথ্য শুনলে আঁতকে উঠি, যেমন বাংলাদেশের গৃহকর্মীদের গড় বেতন ৫১০ টাকা। শুধু ঢাকা আর চট্টগ্রাম শহরে গৃহকর্মীর সংখ্যা কুড়ি লাখ, এদের মধ্যে ৮৩ শতাংশ নারী, অনেকে শিশু। যৌন নির্যাতনের শিকার শতকরা ১৬.৬৭। ২০০১ থেকে ২০১০- এই দশ বছরে নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে ৩৯৮ জন গৃহকর্মী, আহত হয়েছে ২৯৯ জন। আমার মনে হয়, নির্যাতনের শিকার আর ধর্ষণের শিকার আরও বেশি গৃহকর্মী। সঠিক সংখ্যাটি হয়তো লুকিয়ে রাখা হচ্ছে। তারপরও ভালো তো কিছু লোক আছে দুনিয়ায়, ভালো সংগঠনও আছে। তারা গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, গৃহশ্রমিকদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি ও শ্রম আইনে তাদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছে। জানি না আদৌ গৃহকর্মীরা তাদের প্রাপ্য সেই অধিকার পাবে কি না।

গৃহকর্মীদের ওপর অত্যাচার গরিবের ওপর ধনীর অত্যাচার। গৃহকর্মীরা যেহেতু সাধারণত নারী, তাই গৃহকর্মীদের বিরুদ্ধে যে নির্যাতন চলে, তা নারী নির্যাতনের অংশও, গার্হস্থ্য হিংস্রতার বা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের অংশও। সমতার সমাজ যতদিন না গড়ে উঠবে, যতদিন না ধনী আর গরীবের মাঝে ফারাকটা কমবে, ততদিন নির্যাতন চলবে। তবে গৃহকর্মীরা এখন সংখ্যায় অগুনতি নয় বলে তাদের অবস্থার উন্নতি চোখে পড়ে। ছোটবেলায় দেখতাম, চাইলেই আশেপাশের বস্তি থেকে কাজের মেয়ে জোগাড় করে আনা যায়। সেইসব মেয়েকে দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করানো হতো। মশলা বাটা,পানি টানা,কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা। বিনিময়ে হয়তো শুধু দুবেলা ভাত জুটতো। আমাদের বাড়িতে কাজ করতো অল্প বয়সী কিছু মেয়ে। ওরাও হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে পেতো সামান্য কটা টাকা। মণি নামের এক কিশোরী কাজ করতো, ওর মাইনে ছিল মাসে পাঁচ টাকা। ভোর থেকে মধ্যরাত মুখ বুজে কাজ করতো। এদিক ওদিক তাকাবার অবকাশ ছিল না। ওরা প্রায়ই মার খেতো। মার খাওয়াটা ওদের জন্য খুব স্বাভাবিক ছিল। শুধু চড় থাপ্পড় নয়, রীতিমত লাঠিসোটার মার। মার খেয়েও মেয়েরা থাকতো বাড়িতে। দারিদ্র মানুষকে কত যে আপোস করতে শেখায়, কত যে নির্মমতা মানুষ মেনে নিতে বাধ্য হয়!

একটা বড় পরিবর্তন এলো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি যখন বাংলাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজাতে শুরু করলো। মেয়েরা দলে দলে যোগ দিতে শুরু করেছে গার্মেন্টসে, বস্তি থেকে মেয়েদের চাইলেই তুলে আনা সম্ভব নয়। সেসময় বেতন খানিক বাড়লো মেয়েদের। গৃহকর্মী বা গৃহশ্রমিক যাই ওদের ডাকুক, মনে মনে এখনও শিক্ষিত লোকরাও ওদের চাকর চাকরানি বলেই ডাকে। গৃহকর্তা আর গৃহকর্মীর মধ্যে যে সম্পর্ক, তা আক্ষরিক অর্থে প্রভু আর দাসদাসীর সম্পর্ক। প্রায়ই শুনি গৃহকর্ত্রীরা নাকি গৃহকর্মীদের অত্যাচার করে। মেরে হাড়গোড় ভাঙছে, এমনকী প্রাণেও মেরে ফেলছে। এত ভয়ানক কাণ্ড মানুষ কী করে ঘটাতে পারে! নারীরা মমতাময়ী, মায়াময়ী, দয়াময়ী, এসবই জানতো মানুষ। তবে ভায়োলেন্সে এত পারদর্শীই বা নারী কেন! ভায়োলেন্স নারী করলেই সেটা অবশ্য চোখে পড়ে। গৃহকর্তারা চাকরবাকরকে কী ভীষণভাবে পেটালো, কীভাবে ধর্ষণ করলো, সেটা নিয়ে খুব একটা ছি ছি শুনি না।

ভায়োলেন্স নারী পুরুষ উভয়েই করতে জানে। তবে নারীর সুযোগ হয় না বলে পুরুষের তুলনায় কম ভায়োলেন্স করে। সুযোগ পেলে নারীও ভায়োলেন্স করে। সুযোগটা নারীরা পায় ঘরে, কাজের মেয়ের ওপর। সেই সুযোগের সদব্যবহার করতে তারা দ্বিধা করে না। স্বামীরা অন্যায় করলে তারা স্বামীকে পেটাতে পারে না, সমাজের দশটা অত্যাচারী পুরুষকে তারা মারধোর করতে পারে না, কারণ এই সমাজে নারীরা পুরুষের অধীনে বাস করতে বাধ্য হয়। গৃহকর্ত্রীরা চাকরদের গায়ে তত হাত তোলে। না, যত তোলে চাকরানীদের গায়ে। কারণ হায়ারারকিতে চাকরানীরা চাকরদের চেয়ে। নিচে। সবচেয়ে নিচে যে, সবচেয়ে অসহায় আর নিরাপত্তাহীন যে, সবচেয়ে দরিদ্র যে, তাকেই নির্যাতন করছে নারীরা। এই নারীদের অধিকাংশই পরনির্ভর, পরের টাকায় অর্থাৎ স্বামীর টাকায় চলছে, এই নারীরাও পুরুষতান্ত্রিক সমাজ দ্বারা নির্যাতিত, এই নারীরাও নারী হয়ে জন্ম নেওয়ার অপরাধে নিজের প্রাপ্য সব অধিকার এবং স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত। এই নারীদের অনেকেই সংসারের দেখভাল করার নামে সংসারে যে শ্রমিকটি সবচেয়ে বেশি শ্রম দিচ্ছে, তাকেই ভায়োলেন্সের শিকার করছে। অত্যাচারিতও সুযোগ পেলে অন্যের ওপর অত্যাচার করে। দরিদ্র-পুরুষ ধনী-পুরুষ দ্বারা অত্যাচারিত হয়, এই অত্যাচারিত দরিদ্র-পুরুষও যদি কাউকে অত্যাচার করে, সে দরিদ্র নারী। দরিদ্র নারীরা দুবার অত্যাচারিত হচ্ছে, একবার ধনী নারীপুরুষ দ্বারা, আরেকবার দরিদ্র পুরুষ দ্বারা।

বাংলাদেশে আমি একুশ বছর নেই। ইউরোপের নির্বাসিত জীবনে একবার একটা মেয়েকে চাকরি দিয়েছিলাম। আমি তখন পশ্চিম বার্লিনে থাকি। বার্লিন ওয়াল ধসে পড়ার পরের কথা বলছি। পূর্ব বার্লিনের একটা জার্মান মেয়েকে মোটা টাকা মাইনের চাকরি দিয়েছিলাম। তিন বা চার ঘণ্টার জন্য আমার বাড়িতে আসতো। বাসন মাজতো, ঘর পরিষ্কার করতো, রান্না করতো, কাপড় ধুতো, ইস্ত্রি করতো। আমি সোফায় বসে চা খেতে খেতে অথবা বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ওর কাজ দেখতাম। আর ওর জীবনের গল্প শুনতাম। ভীষণ আলসে হয়ে উঠেছিলাম অথবা একা একা সংসারের কাজ করতে আর ভালো লাগছিল না। তাই কাজের মেয়ে রাখার ইচ্ছেটা হয়েছিল। বেশিদিন পোষাতে পারিনি ওই কাজের মেয়ে। ইউরোপ আমেরিকায় কাড়ি কাড়ি টাকা ব্যাংকে না থাকলে চাকরবাকর রাখা যায় না।

এরপর কলকাতায় রেখেছি কাজের মেয়ে, দিল্লিতেও রেখেছি। অফিসে চাকরি দেওয়ার মতো করে চাকরি দিতে হয়। দীর্ঘদিন পাশ্চাত্যে থেকে স্বভাবের বদলও ঘটেছে। কাজ যারা করছে ঘরে, তাদেরকে মানুষ বলে ভাবতে শিখেছি, সহকর্মীর মতো শ্রদ্ধা করতে শিখেছি, ভালো মাইনে দিতে শিখেছি, তাদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে খাওয়া, এক সোফায় বসে টেলিভিশন দেখা, এক বিছানায় তাদের শুতে দেওয়া– সবই নিশ্চিন্তে নিঃসঙ্কোচে করি। যেটা ভারতের প্রায় কাউকেই করতে দেখি না। ইচ্ছে করলেই তো মানুষ দরিদ্রের প্রতি সদয় হতে পারে, নিজের ঘৃণ্য দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলাতে পারে, অন্যের দারিদ্র ঘোচাতে সাহায্য করতে পারে, সমমর্মী হতে পারে। ইচ্ছেটাই মানুষ করছে না। বিশেষ করে ধনীরা আর ধনীদের যে শ্রেণী অনুকরণ করতে পছন্দ করে, সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণী।

তবে দয়া মায়া মমতা যাকাত ছদগা ভিক্ষে ইত্যাদি ঢেলে অগাধ দারিদ্র ঘোচানো যায় না। দরিদ্রের প্রতি ঘৃণা যে সমাজে, সে সমাজে ব্যাঙের ছাতার মতো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বা গ্রামীণ ব্যাংক তৈরি করেও মানুষের দারিদ্র সম্পূর্ণ ঘোচানো যাচ্ছে না বলেই মনে হচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি দুর্নীতি, লোভ, হিংসেকে অতিক্রম। করার উপায়ও জানা উচিত। কেউ ধনী হবে, কেউ দরিদ্র থেকে যাবে, এটাকে নিয়ম না ভেবে– দরিদ্র আর ধনীর মাঝখানের ব্যবধানটাকে কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে সবাইকে। রাজনীতিকরা, ধনীদের যাদের ভুরি ভুরি আছে, তাদের ঠেলে খাওয়াচ্ছেন। দরিদ্ররা অভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে। ঈশ্বর তাদের অভাবে ডুবিয়ে ঈমান পরীক্ষা করছেন, এরকম একটা হাস্যকর কথা প্রায়ই শুনি। ধনীরা এবং শাসকরা সে কারণে ঈশ্বর এবং ধর্মকে ব্যাবহার করেন গরিবদের শান্ত এবং সন্তুষ্ট রাখার জন্য। তা না হলে প্রলেতারিয়েত বিপ্লব ঘটে গেলে তো মুশকিল।

নারীরা কাজের মেয়েকে নির্যাতন করছে। সমাজের এক নির্যাতিত শ্রেণী সমাজের আরেক নির্যাতিত শ্রেণীকে নির্যাতন করছে। এই ছোট নির্যাতন আমাদের চোখে পড়ে, আর বড় নির্যাতন, যেটি ক্ষমতাশালীরা করে, দরিদ্রকে আজীবন দরিদ্র করে রাখার রাজনীতি, সমতার সমাজকে ধারে কাছে ভিড়তে না দেওয়ার ষড়যন্ত্র, — সেটি খুব বেশি কারওর চোখে পড়ে না।

 গোমাংস নিষিদ্ধ

 

কী করতে যে দেশটা ভাগ হয়েছিল! কোনও দেশই তো পুরোপুরি হিন্দুর দেশ বা মুসলমানের দেশ হতে পারেনি। মাঝখান থেকে খুনোখুনিটা বাড়ছে। বাংলাদেশে নামকরা হিন্দু হও, টিকে যাবে। মহাদেব সাহা, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, নির্মলেন্দু গুণ, সৌম্য সরকার, মুন্নী সাহা –এরা সেলেব্রিটি হিন্দু। এঁদের দেশ ছাড়ার দরকার কখনও হবে না। কিছু মুসলমান ভারতেও খুব নামীদামী। বলিউডের শাহরুখ খান, সালমান খান, আমীর খান তো আছেনই, রাজনীতি, সাহিত্য শিল্পের জগতেও মুসলমানরা সেলেব্রিটি। এ আর রহমানের কথাই ধরা যাক। ভারতীয়রা তাঁদের নিয়ে গর্বিত। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ হিন্দুরা ভুগছে, ভারতের সাধারণ মুসলমানরাও মাঝে মাঝে ভোগে। কিছুদিন আগে ইখলাক নামের এক লোককে যে মেরে ফেলা হলো গোমাংস খেয়েছে বলে, তা নিয়ে এখন ভারত ভীষণরকম দুভাগে ভাগ হয়ে আছে। একদল বামঘেঁষা, উদারপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষ, আরেকদল কট্টর ডানপন্থী, ধর্মান্ধ, মৌলবাদী, মুসলিম বিরোধী। এই দুই দলে পত্র পত্রিকায়, টিভিতে, ব্লগে, টুইটার ফেসবুকে গালাগালি চুলোচুলি করছে। ঝাঁকে ঝাঁকে সাহিত্যিকরা তাঁদের পুরস্কার ফেরত দিচ্ছেন। ডানপন্থীরা এই পুরস্কার ফেরত দেওয়া মোটেও পছন্দ করছে না। এখন তো বিজ্ঞানীরাও, চলচ্চিত্র পরিচালকরাও তাঁদের জাতীয় পুরস্কার ফেরত দেবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা তাঁদের মতো প্রতিবাদ করছেন। অনেক কট্টর ডানপন্থী লোক, শিল্পী সাহিত্যিক যারা পুরস্কার ফিরিয়ে দিচ্ছেন, তাঁদের গালমন্দ করছে। এই বলে দোষ দিচ্ছে যে অন্যায় তো আগেও ঘটেছে, মুসলমান মৌলবাদীরা সালমান রুশদি বা তসলিমা নাসরিনের ওপর যখন আক্রমণ করেছে, তখন কোথায় ছিলেন আপনারা? তখন কেন আপনাদের পুরস্কার ফিরিয়ে দেননি। তখন পুরস্কার ফেরত দেননি বলে এখন দিতে পারবেন না, এ আমি মানি না। তখন প্রতিবাদ করেননি বলে এখন প্রতিবাদ করবেন না, তা ঠিক নয়। তখন না হয় বিবেক জাগেনি, এখন জেগেছে। যখনই জাগুক, জাগাটাই জরুরি। এতে রাজনীতির গন্ধ পাচ্ছে অনেকে। রাজনীতি কোথায় নেই! শিল্পী সাহিত্যিকদের রাজনৈতিক সচেতনতা থাকতে নেই, কে বলেছে?

আমি কিন্তু এসব বিতর্কের সাতেও নেই, পাঁচেও নেই। কিন্তু মত জানতে চাইলে ঝট করে সেদিন নিজের মত জানিয়ে দিয়েছি। আমার কথা, দেশে গোমাংসের জন্য মরতে হচ্ছে, এমন খারাপ দিন আগে কখনও দেখিনি। ভারতে প্রায় দশ বছর আমি বাস করেছি। কখনো গোমাংস কিনিনি। খাসির মাংস, ভেড়ার মাংস, মুরগির মাংসই কেনা হয়েছে। কবুতরের আর হাঁসের মাংস কিনতে চেষ্টা করেছিলাম, পাইনি কোথাও। এদেশে গোমাংসের দুটো গল্প আছে আমার। প্রথম গল্পটি আশির দশকে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছি। উনি আমার কাছে আবদার করলেন, গোমাংস খাবেন। গোমাংস বাংলাদেশ থেকে আনতে হবে। আমাকে কথা দিতে হলো, ফের যখন আসবো কলকাতায় বেড়াতে, গোমাংস নিয়ে আসবো। নিয়ে এসেছিলাম। তিনি খুশিতে উঠোনময় নেচেছিলেন। দ্বিতীয় গল্পটি দুহাজার পাঁচের দিকে। তখন আমি কলকাতায় থাকি, আমার এক বন্ধু সুমিতাভ ঘোষালের শখ হলো সে গরুর মাংস খায়নি কখনও, খাবে। আমি যদি রান্না করে দিই, তবেই সে তার স্বপ্ন পুরন করতে পারবে। একবার সে এক কিলো গরুর মাংস পার্ক সার্কাসের কোনও এক মুসলিম দোকান থেকে কিনে আমার বাড়িতে এলো। মাংসগুলো দেখে খুব ভালো কোয়ালিটির মাংস বলে আমার মনে হলো না। সুমিতাভের আবদারে আমার সেদিন রান্না করতে হয়েছিল গরুর মাংস। তবে বাড়ির কাজের মেয়েটিকে আমি মাংস রান্নার ধারে কাছে আসতে দিই নি, তাকে খেতেও দিইনি ওই মাংস। মাংসের জন্য পেঁয়াজ, রসুন, আদা কাটতে হয়, ওসবও আমি নিজে কেটে নিয়েছি। ওকে কাজ থেকে ছুট্টি দিয়ে দিয়েছিলাম সারাদিনের জন্য। বলবো না আমি ওর অন্ধ বিশ্বাসের শুশ্রষা করেছি, নিতান্তই ওর ইচ্ছে-অনিচ্ছের মর্যাদা দিয়েছি মাত্র। শুধু সুমিতাভ আর আমি খেয়েছি সেদিনের রান্না করা মাংস। ইউরোপ আমেরিকায় যে গোমাংস আমি খাই, সে খুব ভালো জাতের। বাংলাদেশ বা ভারতের গোমাংসের মতো নয়। আমি গরুর মাংসের ভক্ত কখনও ছিলাম না। যখন দেশে ছিলাম, বাড়িতে গরুর মাংস রান্না হলে মন খারাপ হয়ে যেতো, কেন খাসির মাংস বা মুরগির মাংস রান্না হলো না, সে নিয়ে অনুযোগ করতাম। কিন্তু ইউরোপ আমেরিকায় থাকাকালীন দেখলাম ওসব দেশে গরুর মাংসই সব মাংসের সেরা। ধীরে ধীরে রুচি বদলেছে আমার।

দিল্লিতে শুনেছি গরুর মাংস পাওয়া যায় না। গরুর মাংস বলে যা বিক্রি হয়, তা হলো মোষের মাংস। না, মোষের মাংস খাওয়ার আমার কোনও ইচ্ছে নেই।

আমি কী খাবো না খাবো, তা কে বলে দেবে? আমি। তুমি যদি শাকসবজি খেতে চাও, আমার কোনও আপত্তি নেই, যত খুশি শাকসবজি খাও। আমি তোমাকে কখনও জোর করি না, বলি না, তোমাকে মাছ মাংস খেতে হবে। কিন্তু, লক্ষ করেছি, প্রায়ই শাকাহারি লোকেরা ঘৃণা ছুঁড়তে থাকে মাংসাশিদের দিকে। আমরা নাকি নৃশংস, আমরা বর্বর। যে প্রাণীগুলোকে খাদ্য হিসেবে চাষ করা হচ্ছে, সে প্রাণীগুলোর মাংস শুধু আমরা খাচ্ছি। আমরা তো বন-জঙ্গলের কোনও প্রাণীকে হত্যা করে তাদের মাংস খাচ্ছি না! মাংসাশিরা পশুপাখির অধিকার রক্ষায় সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আসে। কজন নিরামিষাশীপশুপাখির সেবাযত্ন করে, রাস্তার কুকুর বেড়ালকে পোষার জন্য ঘরে আনে? নিরামিশাসীরা নিরামিষাশীকারণ তাদের ধর্ম বলেছে নিরামিষাশীহতে, নিজের জন্য পুণ্য কামাতে, ভগবানের কৃপা পেতে তারা মাছ মাংস খায় না, জীবজন্তুর প্রতি দয়ায়, মায়ায় নয়।

বৈদিক যুগে ব্রাহ্মণরাও নাকি গোমাংস খেত। জানিনা কী করে কী করে কী হলো যে গোটা হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে গোমাংস স্পর্শ করা নিষিদ্ধ হয়ে গেলো। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতবর্ষ হিন্দু, মুসলমান শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি এরকম নানা ধর্মের লোক বাস করে। গোমাংস হিন্দু খায় না বলে আর কারও খাওয়া চলবে না, এমন নিয়ম মানবাধিকার বিরোধী। ভারতের কিছু বিজেপি শাসিত রাজ্যে গোমাংস নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ কী! তোমরা কি লোকের খাদ্যাভ্যাস আইন করে বদলাবে? গোটা বিশ্বই এখন ভারতের এই হিন্দু মুসলমানের সংঘর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। গরুর মাংস খেয়েছে বলে অথবা খেয়েছে সন্দেহে কিছু মুসলমানকে মেরে ফেলছে হিন্দুরা। ছি ছি করছে সারা বিশ্ব। মুসলিমরাই, বর্তমান বিশ্বে অসহিষ্ণুতা, হিংস্রতা, বর্বরতার ধারক এবং বাহক। এদের সঙ্গে তবে কি যোগ হলো হিন্দুরাও?

হিন্দু কট্টরপন্থীদের কথা হলো, মুসলিম দেশগুলোয় তো সংখ্যালঘু হিন্দুদের স্বাধীনতা বলতেই নেই, তবে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানের অত স্বাধীনতা থাকাই বা জরুরি কেন। পছন্দ না হলে এ দেশ ছেড়ে তারা চলে যেতে পারে মুসলমানের দেশে। মুসলমানদের তো মুসলমানদের দেশেই চলে যাওয়ার কথা ছিল সাতচল্লিশে! আর, এ দেশে থাকতে হলে গোমাংস খাওয়া চলবে না।

যে যাই বলুক, হিন্দু কট্টরপন্থীরাকিন্তু চাইলেই মুসলিম কট্টরপন্থীদের মতো ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে। মুসলিম দেশগুলোয় ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষ মেরে ফেলাটা সহজ। ভারতে কাজটা এখনও খুব সহজ নয়। কিন্তু যতটা ক্রুদ্ধ হলে মুসলিম সন্ত্রাসীদের মতো বীভৎস আর বর্বর হওয়া যায়, ততটাই ক্রুদ্ধ এখন বেশ কিছু হিন্দু কট্টরপন্থী। তারা যে করেই হোক তাদের ধর্ম বাঁচাবে, দেশ বাঁচাবে। তাদের ধর্ম আর দেশ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আপাতত কোনও আশংকা নেই। তারপরও বিশ্ব জুড়ে মুসলিম মৌলবাদীর উত্থান অনেক হিন্দুদের মনে ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে। ভয়, বুঝি হিন্দু ধর্ম বা হিন্দুস্থান বলে কিছু আর থাকবে না।

পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি গোমাংস রফতানি করছে ভারত। ইউরোপ আমেরিকা ইজরাইলে প্রতিদিন গরু হত্যা চলছে, মানুষ উৎসব করে গোমাংস খাচ্ছে, এতে কিন্তু সেই হিন্দুদের কোনও সমস্যা হচ্ছে না যারা গরুকে ভগবান বলে বিশ্বাস করছে। ভগবানকে ভারতবর্ষে হত্যা করা চলবে না, ভারতের বাইরে হত্যা করলে আপত্তি নেই।

বিবর্তন কাকে কোথায় নিয়ে যায়, কোন বিশ্বাসকে কোন পাঁকে ফেলে কেউ জানে না। ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তা করে বর্তমানকে দুঃসহ করার কোনও মানে হয় না। যার গরু খাওয়ার খাবে, যারা না খাওয়ার তারা খাবে না। একজনের মানবাধিকার ছিনিয়ে আরেকজনের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

চুম্বন

সুশান্ত সিনহা আমার সাক্ষাৎকার চাইছেন। আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু করে করে মাস ছয় পার করেছি। আবার যখন ফোন করলেন সাক্ষাৎকার চেয়ে, আমি খানিকটা বিরক্ত হয়েই বললাম, আপনার ঠিকানাটা বলুন তো।

–ঠিকানা কেন?

–ঠিকানা চাইছি কারণ আপনার সঙ্গে আমি দেখা করতে যাবো।

–তাহলে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন? আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ জানাবো।

সুশান্তর ঠিকানায় সেদিনই আমি পৌঁছে যাই। মাণ্ডি হাউজে দূরদর্শন বিল্ডিং। তারই চারতলায় সুশান্তর অফিক্স। টেবিল উপচে পড়ছে ফাইলে। এর মধ্যে ঘাড় গুঁজে বছর পঞ্চাশের এক ভদ্রলোক চিঠি লিখছেন। হাতে ঝর্ণা কলম। চারদিকটা দেখে একটি চেয়ার টেনে বসে বললাম, তাহলে আপনিই সুশান্ত সিনহা।

–আজ্ঞে। আমিই। আমিই সুশান্ত সিনহা।

–আমি ভেবেছিলাম আপনি বোধহয় একজিস্ট করেন না। তাই দেখতে এলাম, যে মানুষটা এতগুলো মাস নিরলস ফোন করে যাচ্ছেন, উনি কি আসলেই কেউ?

সুশান্ত জোরে হেসে উঠলেন।

–কী ভেবেছিলেন? ভূত টুত কিছু?

–ভূতে বিশ্বাস করলে তাই করতাম।

–এখন দেখছেন আমি আসলেই কেউ। আমি একজিস্ট করি। সাক্ষাৎকার আজ দেবেন তো?

–না, আমি সাক্ষাৎকার দিতে আসিনি।

সুশান্ত সিনহা বিস্মিত হন। তাঁর চোখের মণি স্থির হয়ে থাকে।

আমি হেসে বলি, চা টা পাওয়া যাবে আপনার অফিসে?

নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই বলে টেবিলের ওপর রাখা একটা বেল টিপলেন। পাশের ঘর থেকে এক যুবক এসে দাঁড়ালো। চা নিয়ে এসো। কালো চা। চিনি ছাড়া।

কী করে জানলেন আমি দুধ-চিনি ছাড়া চা খাই। আমি জিজ্ঞেস করি।

সুশান্ত সিনহা হাতের সামনের কাগজটা সরিয়ে রেখে হাতের কলমটা গুটিয়ে সার্টের পকেটে রেখে বললেন, আপনি বিখ্যাত মানুষ, আপনি কী খান, কী পরেন, সব খবর আমরা, মানে পাবলিকরা জানি।

–আচ্ছা বলুন তো। আমার সাক্ষাৎকার চাইছেন কেন। আমি কী এমন হাতি না ঘোড়া?

সুশান্ত সিনহা মধুর হাসি হেসে বললেন, আপনি হাতিও নন, ঘোড়াও নন। আপনি প্রিয়াংকা ঘোষাল। যাকে এক নামে সবাই চেনে।

–রাখুন আপনার এক নামে সবাই চেনে স্তুতি। পটাচ্ছেন বুঝি? আমি কিন্তু সাক্ষাৎকার দেবো না। চা খেয়ে উঠবো।

–এলেন কেন তবে?

–ইচ্ছে হলো, তাই।

চা এলো। ঠাণ্ডা চা। প্রথম চুমুকেই বুঝে যাই চায়ের পাতাটা ভালো নয়। কাপটা ঠেলে সরিয়ে দিই। সুশান্তর চোখের দিকে তাকিয়ে বলি, উঠছি আমি। চায়ের জন্য ধন্যবাদ।

–কিন্তু চাটা না খেয়েই উঠবেন?

–হ্যাঁ না খেয়েই। কারণ চা টা খুব বিচ্ছিরি হয়েছে। এত খারাপ চা আমি খাই না। আমি দার্জিলিং চা খাই। পারলে একদিন আমার বাড়ির চা খেয়ে যাবেন। চা কাকে বলে একটু বুঝে যাবেন।

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।

সুশান্ত সিনহা দাঁড়ালেন।

–কাল আসি, ম্যাডাম?

–কালই? কেন?

–চা খেতে।

–ও।

দেখতে আপাদমস্তক এক ভদ্রলোক। আমার টিপ্পনীকে নেমন্তন্ন ভেবে নিয়েছেন! ভদ্রলোককে আর দশটা ভদ্রলোকের মতো ভদ্র মনে হলেও আদপেই তিনি ভদ্র নন।

বেরিয়ে যেতে যেতে বলি, ঠিক আছে, চা খেতে আসুন কাল। নিশ্চয়ই আমার সবকিছু যখন জানেন, ঠিকানাটাও জানেন।

সুশান্ত সিনহা মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ জানি। কে টুয়েনটি ফোর, চিত্তরঞ্জন পার্ক।

উনি নিচে নেমে এলেন আমার সঙ্গে। গাড়িতে উঠলাম। উনি হাত নাড়লেন।

সুশান্ত সিনহার হাসিটা মনে গেঁথে রইলো। চেহারাটাও। নিঃসন্দেহে সুদর্শন তিনি। ছা-পোষা কেরানির মতো তাঁর কাজকর্ম। ২০১৫ সাল, এখনও হাতে চিঠি লেখেন। ঘরের এক কোণে একটা কমপিউটার। কিন্তু ওটা আদৌ ব্যবহার করেন বলে মনে হয় না। কিছুক্ষণের পরিচয়ে আমি আজ অবধি কাউকে বাড়িতে আসতে বলিনি। হয়তো বলতে পারতাম, না ওটা বলার জন্য বলা। ওটা সত্যিকারের চা খাওয়ার নেমন্তন্ন নয়।

সুশান্ত সিনহা পরদিন এলেন বড় এক ফুলের তোড়া নিয়ে। আমার প্রিয় ফুল। সাদা লিলি। কী করে জানেন আমার প্রিয় ফুলের কথা। কোথাও হয়তো কখনও আমার পছন্দ অপছন্দের কথা ছাপা হয়েছে। পড়েছেন এবং আজও মনে রেখেছেন। ড্রইং রুমে বসলেন। চা বানিয়ে আনলাম। তিনি নিজে দুধ চিনি দিয়ে চা খান। কিন্তু আমার কাছে এসে খেলেন, আমি ঠিক যেরকম চা খাই, সেরকম।

–কেউ থাকে না আপনার সঙ্গে?

–এতকাল একাই ছিলাম। ইদানীং একজন থাকছেন সঙ্গে। আমার তো সবই জানেন আপনি। কেন খামোকা জিজ্ঞেস করছেন?

সুশান্ত সিনহা আবার তাঁর মধুর হাসিটি হাসলেন। বললেন, না না, কী বলছেন। সব জানবো, এত সৌভাগ্যবান কি আমি? সামান্য কিছু জানি। সাংবাদিকদের এটুকু জানতেই হয়।

–ও। তাই বুঝি। কোন ফুল ভালোবাসি সেও তো জানেন?

–এসবকে কোইনসিডেন্সও বলতে পারেন।

বেশিক্ষণ বসেন নি সুশান্ত সিনহা। চা খেয়েই চলে গেলেন, বললেন, চা খেতেই যেহেতু এসেছিলেন, তাই চায়ের বাইরে আর সময় নষ্ট করা তাঁর উচিত নয়। আমার একবার বলতে ইচ্ছে করেছিলো, সে কি, এত দূর থেকে এসেছেন, এত অল্প সময়ের জন্য? বলিনি কারণ চায়ের জন্যই তো আসা। আর এ লোক তো আমার বন্ধু নন যে গল্প করার দরকার আছে। দু ঘণ্টা আসতে, দু ঘণ্টা যেতে। এই চারঘণ্টা সময় চায়ের জন্য ব্যয় করে তিনি একটি বাক্য উচ্চারণ করেননি চা নিয়ে। চায়ের অ্যারোমা নিয়ে একটি শব্দ নয়। আস্ত অভদ্রলোক। এত সময় কেউ কেবল চায়ের জন্য খরচ করে! এমন নয় যে চা নিয়ে গবেষণা করছেন উনি।

আমি এরপর সুশান্ত সিনহার ফোনের জন্য অপেক্ষা করি। যখনই ফোন বাজে, মনে হয় এ সুশান্ত। ইচ্ছে করে তাঁকে ফোন করতে। কিন্তু ফোনে কী বলবো? সুশান্ত হয়তো ভাববেন আমি সাক্ষাৎকার দিতে চাইছি। আমি কিন্তু চাইছি না। তাহলে কি তাঁকে বলবো, না, এই ফোন সাক্ষাৎকারে রাজি হওয়ার ফোন নয়। তবে কী ফোন এই ফোন? আমি উত্তর জানিনা বলে ফোন করিনি।

ফোন সাতদিন পর করেন সুশান্ত। আবারও ওই সাক্ষাৎকারের কথাই জিজ্ঞেস করেন।

আমি বলি, যদি সাক্ষাৎকার দিই কোনও দিন, যদি ইচ্ছে হয় কোনওদিন। খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে কী প্রশ্ন করবেন?

সুশান্ত বললেন, প্রায় তেইশ বছর আগে গর্ভবতী হয়েছিলেন। না, কারও সঙ্গে প্রেম করে নয়, কারও সঙ্গে যৌন সঙ্গম করে নয়। স্পার্ম ব্যাংক থেকে অচেনা লোকের স্পার্ম নিয়ে। ঘোষণা করেছিলেন, সন্তান নারীর, পুরুষের নয়। নিজে সন্তান প্রসব করে গোটা ভারতবর্ষকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। আপনার পরে কিন্তু আর কেউ ওই কাজটা করেনি। করলেও ঘোষণা করেনি। আপনার পথ কি কেউ অনুসরণ করেছে বলে জানেন?

–দ্বিতীয় প্রশ্ন?

–আপনার মেয়ে কি জানে তার যে বাবার পরিচয় নেই? সে কি শুধু মায়ের পরিচয়ে পরিচিত হয়ে সন্তুষ্ট? কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুদের সামনে অসুবিধে হয় না? টাইটেলটাও তো মায়েরই?

–তৃতীয় প্রশ্ন?

–মেয়ে কি আপনাকে দোষ দেয়? বলে, তোমার নারীবাদের ভিকটিম করেছো আমাকে, বা এই ধরনের কিছু?

আপনার কি আরও কোনও প্রশ্ন আছে? আমি জিজ্ঞেস করি।

সুশান্ত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, সবে তো শুরু হলো, আরো অনেক প্রশ্ন আছে। কবে সাক্ষাৎকার দেবেন ম্যাডাম?

না, আমি ইন্টারভিউ দেবো না।

–তবে প্রশ্ন শুনতে চাইলেন কেন?

চাইলাম।

–চাইলাম মানে? আমাকে একটা ফালতু লোক ভেবেছেন?

–না। মোটেও না। আসলে আপনি আমাকে ফালতু লোক বলে ভাবছেন?

ফালতু লোক ভাবলে ইন্টারভিউ নিতে চাইতাম?

–হ্যাঁ চাইতেন। আপনি ভেবেছেন আমি একটা ফালতু কাজ করেছি, আমি একটা ফালতু মেয়েছেলে। তাই আমাকে আরও বেশি ফালতু হিসেবে দেখানোর জন্য আপনি আমার ইন্টারভিউ চেয়েছেন।

–বাজে বকবেন না।

–বাজে বকছি না।

সুশান্ত বললেন, আমি আসছি। আপনার বাড়িতে আসছি।

–কেন?

–এসে বলবো।

দুঘণ্টার পথ পেরিয়ে সুশান্ত সত্যি সত্যি এলেন। অনেক কাজ ফেলে চলে এলেন। বললেন, আমাকে ভুল বুঝবেন না, প্রিয়াংকা।

আপনাকে আমি ভুল নয়, ঠিকই বুঝছি সুশান্ত বাবু। আপনি এ দেশের নারীবিদ্বেষী লোকদের চেয়ে মোটেও পৃথক কিছু নন। আমি ভেবেছিলাম, কুড়ি বছর পার হয়েছে, সমাজটা বোধহয় কিছুটা সভ্য হয়েছে। কিন্তু দেখছি, যা ছিল তাই আছে। সে কারণে আমি হাতে গোণা অল্প কিছু মানুষ ছাড়া আর কারও সঙ্গে মিশিটিশি না।

সুশান্ত দুহাত জড়ো করে বললেন, আমাকে ক্ষমা করুন। আমি সেরকম লোক নই। আসলে আমি চাইছিলাম, যারা আপনাকে ভুল বোঝে, তারা আপনার মুখ থেকেই শুনুক আপনার ব্যাখ্যাটা, তাদের ভুলটা ভাঙুক।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, দেখুন সুশান্তবাবু, ভুল বোঝাবোঝির ব্যাপার নয়। এখানে দুটো মত। এক মত হচ্ছে, নারীর স্বাধীনতায় বিশ্বাস করা। আরেক মত হচ্ছে, বিশ্বাস না করা। যারা আমার কাজকে মানে না, তারা সচেতন ভাবেই মানে না। তাদের মত বদলানোর জন্য চেষ্টা করার কোনও দরকার আমার নেই। বদলালে নিজেরাই বদলাবে। আমার জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। নিজেকে ডিফেন্ড করা আমার কাজ নয়। কারণ আমি মনে করি না..

–আপনি মনে করেন না আপনি কোনও ভুল করেছেন।

–হ্যাঁ,তাই।

সুশান্ত হাতে করে এত তোড়া ফুল এনেছিলেন। ফুলগুলো টেবিলে ওভাবেই পড়েছিল। হঠাৎ উঠে বললেন, ফুলদানি কোথায় বলুন তো, ফুলগুলোকে জলে না রাখলে মরে যাবে।

সোফায় যেভাবে বসে ছিলাম আমি, সেভাবেই বসে থাকি। সুশান্ত রান্নাঘর থেকে নিজেই একটা ফুলদানি যোগাড় করে নিয়ে ওতে ফুলের তোড়া রাখলেন। ঘরের ভেতর সুশান্তর এই হাঁটাচলা আমাকে, আমি জানি না কেন, ভালো লাগা দেয়। এভাবে তো বিনয়ও হাঁটে। কিন্তু দেখতে তো এত ভালো লাগে না। সুশান্তর এই ফুল হাতে নিয়ে বাড়ি আসা, ক্ষমা চাওয়া– আমার রাগটাকে অনেকটা কমায়। সুশান্ত আর সব লোকের মতোই। তারপরও সুশান্ত একটু আলাদা। হঠাৎ বললেন, চলুন দার্জিলিং চা পান করি। করবেন তো? চা আজ আমি বানাবো? আমি মাথা নেড়ে সায় দিই। সোফায় পা উঠিয়ে চুপচাপ বসে বসে দেখি। আমি যেখানে বসে আছি, সেখান থেকে সুশান্তকে রান্নাঘরে দেখা যায়। দেখি তিনি কেটলি খুঁজছেন, চায়ের পাতা খুঁজছেন, কাপ খুঁজছেন। মনে মনে বলি, খুঁজুন। মেয়েরা তো যে কোনও রান্নাঘরে গিয়ে খুঁজে সব পেয়ে যায়। একবার ছেলেরা পাক। জন্ম থেকে তো এদের মাথাটা বিগড়ে দেয় পরিবারের লোকেরা, এরপর সমাজ বিগড়ায়। এসব কাজ নাকি মেয়েদের কাজ। এসব যে ছেলেদেরও কাজ, তা এরা মৃত্যু অবধি জানে না। মৃত্যুর পর অবশ্য জানার প্রশ্ন ওঠে না। মৃত্যুই তো সব শেষ। সুশান্তও বিশ্বাস করেন মৃত্যুর পর আর কোনও জীবন নেই। শুধু বিনয়টাই মানলো না।

অনেকদিন আমি ছবি আঁকি না। ইচ্ছে করছে, সুশান্ত আজ বসে থাকুন, ওঁকে আমি আঁকবো। মনের খাঁচায় ইচ্ছেটাকে বন্দি করে রাখি। সুশান্তর বানিয়ে আনা চা খেতে খেতে লক্ষ্য করি সুশান্ত অপলক তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ফুলপাতাগুলোর আড়ালে তাঁর মুখটার অনেকটাই ঢাকা। কিন্তু চোখদুটো দেখা যাচ্ছে। আমিও যখন চোখদুটো দেখতে থাকলাম, সুশান্ত সরিয়ে নিলেন চোখ।

–মেয়ের নাম তো চুম্বন। তাই না?

সুশান্ত হঠাৎ প্রশ্ন করেন।

–হ্যাঁ। চুম্বন।

–এখন আছে কোথায়? নিউ ইয়র্কেই?

মাথা নাড়ি।

চুম্বন কার মতো দেখতে হয়েছে? আপনার মতো নাকি ওর বাবার মতো?

–এই প্রশ্ন কেন সুশান্তবাবু, আপনি এত কিছু জানেন আমার সম্পর্কে, আপনি নিশ্চয়ই জানেন ওর বাবা বলতে কেউ নেই। অথবা ওর বাবা কে আমি জানি না, কোনওদিন দেখিনি।

হ্যাঁ তা জানি। ইচ্ছে করে অচেনা কোনও জায়গা থেকে অচেনা লোকের স্পার্ম নিলে বাবা কে জানার তো প্রশ্ন ওঠে না। ইচ্ছে করলে জানতে পারতেন কে, কিন্তু জানতে তো চাননি।

–সবই তো জানেন। এও জানেন আমি নিজের সন্তান চেয়েছিলাম। অন্যের সন্তান নয়। চুম্বন আমার সন্তান। ওর কোনও বাবা নেই। ওর আছে শুধু মা। বাই দ্য ওয়ে, চুম্বন দেখতে আমার মতো।

–ওর ছোটবেলার ছবিগুলো দেখেছি, তখন তো পেপারে বেশ ছাপা হতো। বড় হয়ে ঠিক কেমন দেখতে হলো..

–তা দেখেননি তো! ওর এখনও বেবি ফেস। খুব একটা চেঞ্জ হয়নি।

–আপনার মতো?

–মানে?

–ওই বেবি ফেস-এর কথা বললেন তো, তাই।

এত অল্প চেনা মানুষটি আমার ত্বক ট্বক নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে, বেশ অস্বস্তি হয়।

–ওকে মিস করেন? সুশান্ত জিজ্ঞেস করেন।

–কাকে? চুম্বনকে?

–হ্যাঁ। নিশ্চয়ই করি।

সুশান্ত বেরিয়ে যান। মানুষটা ভীষণ ব্যস্ত, বুঝি। আমার আর বলা হয় না, ওঁকে যে আমার আঁকতে ইচ্ছে হয়েছিল। ইচ্ছেগুলো পুষে রাখি। ব্যস্ত মানুষ কি স্থির হয়ে বসবেন আমার ইজেলের সামনে কিছুদিন?

আমার এই ইচ্ছেগুলোর কথা বিনয় জানে না। বিনয় সকালে উঠে ইওগা করবে, স্নান করবে, পুজো করবে, ওটমিল খাবে, বেরিয়ে যাবে। ক্লিনিকে যাবে। রোগি দেখবে। দুপুরে ক্লিনিকের রেস্তোরাঁতেই লাঞ্চ সেরে নেবে। ফিরবে সন্ধ্যেয়। রাতে ঘরে বা বাইরে আমরা একসঙ্গে খাবে। আমার বিছানায় শোবে। শোওয়াটা অবশ্য ঘুম আসা পর্যন্ত। ঘুম পেলে বিনয় তার নিজের ঘরে চলে যাবে। আমিই বলেছি চলে যেতে। বিছানায়। একা না হলে আমি ঘুমোতে পারি না। গেস্টরুমকেই বিনয়ের ঘর বানিয়ে দিয়েছি। আমার চেয়ে প্রায় পনেরো বছরের ছোট। নিশ্চয়ই একদিন বিয়ে করার জন্য পাত্রী পেয়ে যাবে। আমি বিনয়কে বলে দিয়েছি, যখন ওর বিয়ে টিয়ে করে সংসার করতে ইচ্ছে করবে, যেন চলে যায়, আমি মন খারাপ করবো না, বাধাও দেবো না। পাঁচ বছর পার হয়ে গেলো, বিনয়ের যাওয়ার কোনও লক্ষণ আমি দেখি না। গত পাঁচ বছর, প্রতি রাতে ও আমার শরীর নিয়ে উন্মাদের মতো করে, এই শরীর ছাড়া, ও বলে, যে, অন্য কোনও শরীর ও চায় না। প্রতি রাতে ও দীর্ঘ দীর্ঘক্ষণ আমার পুরো শরীর সুখের জলে। ডুবিয়ে রাখে। সুখে নিজেও ডুবে থাকে। বিনয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা এমনই। শরীরের। মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করি আমাকে ভালোবাসে কি না, বিনয় বলে, হ্যাঁ বাসে। আমাকে কখনও কিন্তু, লক্ষ করেছি, বিনয় জিজ্ঞেস করে না, আমি বাসি কিনা। ও নিশ্চয়ই ভাবে আমি বাসি না। নিশ্চয়ই ভাবে আমি শুধু সেক্সের জন্য ওকে এ বাড়িতে রেখেছি। আমি যে বিনয়কে ভালোবাসি, সামান্য হলেও বাসি, সেটা বোঝাতে পারি না। আসলে পঁচিশ বছর বয়সে ওই কাণ্ডটি ঘটানোর পর জীবনটাই বদলে গেছে। আমার সম্পর্কে আমার আর বলতে হয় না, আমার সম্পর্কে লোকে বলে। আমি কী ভাবছি কী করছি, তা আমি নই, অন্যরা ব্যাখ্যা করে। অবিবাহিত মেয়ে স্পার্ম কালেক্ট করে দুনিয়াকে জানিয়ে গর্ভবতী হয়েছে, সন্তান প্রসব করে, সগর্বে ঘোষণা করে দিয়েছে যে এ তার সন্তান, তার একার সন্তান, জানিয়েছে সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য কোনও স্বামীর প্রয়োজন হয় না, তার ইচ্ছে হয়েছে মা হওয়ার, সে হয়েছে– এ কি সহজ কথা? লোকে তখনই আমার গায়ে নারীবাদী তকমা ঝুলিয়ে দিয়েছে। নারীবাদীদের নিয়ে যে উদ্ভট কিছু ধারণা আছে মানুষের, সেসব দ্বারা আক্রান্ত হই অহরহ। যেমন আমার চেয়ে বয়সে ছোট ছেলের সঙ্গে সেক্স করছি, নারীবাদী বলেই করছি। যে কারও সঙ্গে যখন খুশি শুতে পারি, নারীবাদী বলেই পারি। কোনও পুরুষের সঙ্গে যখন বছরের পর বছর আমার কোনও সম্পর্ক ছিল না, তখন কিন্তু দুমুখগুলো বলেছে, পুরুষকে ঘৃণা করে প্রিয়াংকা, তাই কোনও পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে না। কী ভয়ংকর পুরুষবিদ্বেষী! বাচ্চা নিলো, কিন্তু বাচ্চার বাবাকে স্বীকৃতি দিলো না। নারীবাদী তো, সে কারণেই।

বিনয়ের কাছে একদিন ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে সুশান্তর কথা পাড়ি। সুশান্ত আমার সাক্ষাৎকার নিতে চাইছেন কিন্তু আমি রাজি নই। এও বলি, সুশান্ত দেখতে ভালো, ওঁকে বলবো আমার ছবির জন্য মডেল হতে।

বিনয় জিজ্ঞেস করলো, কেন সাক্ষাৎকার চায় লোকটা?

–চায়, যে কারণে অন্যরা চায়। বোধহয় এক্সাইটিং কোনও খবর পাচ্ছে না আজকাল। তাই দুযুগ আগের ঘটনা নিয়ে পড়েছে। চুম্বন কত বড় হলো, কোথায় কী পড়ছে, এসব জানতে চাইছে। একেবারে হাঁড়ির খবর নিতে হবে এদের। এদের জ্বালায়ই তো চুম্বনকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছি।

–ভালো ডিসিশান নিয়েছিলে।

বিনয়ের বাবা ছিলেন চুম্বনের ত্বকের ডাক্তার। ছোটবেলায় চুম্বনের ত্বকে একটা অসুখ হতো, সেই অসুখের চিকিৎসা বিনয়ের বাবাই করতেন। ধীরে ধীরে ডাক্তার পরিবারের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্কই গড়ে উঠেছে, আমার বাড়িতে ওঁদের যাওয়া আসাও ছিল। বিনয়ের বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে হায়দারাবাদে চলে যাওয়ার পর বিনয়ের আর থাকার জায়গা ছিল না শহরে। শহরে বাড়ি ভাড়া করার ঝামেলাটা হয়নি, আমার বাড়িতেই উঠেছে সে। বাবা মা তার বিয়ের জন্য পাত্রী দেখেন, বিনয় জানিয়ে দেয়, বিয়ে সে এখন করছে না।

হঠাৎ সে জিজ্ঞেস করে, লোকটার বয়স কীরকম?

–কার?

–সুশান্তর।

–ও। মনে হয় পঞ্চাশ টাশ হবে।

শুনে বিনয় চোখ কপালে তুলে বললো, ওরে বাবা, অনেক বয়স।

–হ্যাঁ অনেক বয়স।

সুশান্তর অনেক বয়স বলেই হয়তো সুশান্তকে নিয়ে আমার আগ্রহের দিকে বিনয় নজর দেয় না। আমার চেয়ে বেশি বয়সের কোনও লোকের জন্য আমার কোনওরকম আগ্রহ জন্মাতে পারে না, এ ব্যাপারে বিনয় যেন নিশ্চিত।

২.

প্রচণ্ড ব্যস্ততা থাকা সত্ত্বেও সুশান্ত সিনহাআমাকে সময় দিচ্ছেন। আমি তাঁকে ঠিকঠিকই বসিয়ে ছবি আঁকছি। আমি ল্যান্ডস্কেপ আঁকি, পোরট্রেট খুব কম আঁকি। জানি না সুশান্তর পোরট্রেট আঁকার জন্য হাত কেন নিশপিশ করছিল। কিছু কিছু সময় এমন হয়, কী করি, কেন করি, বুঝতে পারি না। সুশান্তকে কিছুদিন কাছে পাওয়ার জন্য কী? বিনয়কে কাছে পাওয়ার জন্য তো এত আকুল হই না। বিনয়ের কিছু ন্যুড় এঁকেছিলাম। আমার আঁকা ছবিগুলো দেখতে গিয়ে সেই নডগুলোও দেখেছেন সুশান্ত। জিজ্ঞেস করেছেন, কে, বয়ফ্রেন্ড বুঝি? আমি মাথা নেড়েছি। হ্যাঁ, বয়ফ্রেণ্ড।

সুশান্তর ছবিটা ন্যুড নয়। একগাদা কাপড়চোপড় পরেই সুশান্ত বসেছিলেন। ছবিটা সাতদিনে শেষ হয়ে যায়। শেষ হওয়ার পর জিজ্ঞেস করেছেন, এ ছবি তো বিক্রি হবে না, শুধুশুধু আঁকলেন কেন?

বলেছি, আমি টাকার জন্য সব কিছু করি না। এ আমার নিজের সংগ্রহের জন্য। আপনাকে মনে রাখার জন্য। দেখা কখনও আর নাও হতে পারে আমাদের।

সুশান্ত বললেন, দেখা না হলেই বা কী! কত কত লোকের সঙ্গে কখনও হয়তো আর দেখা হবে না আপনার। আপনি কি সবার ছবি এঁকে রাখেন মনে রাখার জন্য?

–না। তা আঁকি না।

তবে আমারটা কেন আঁকলেন?

–ইচ্ছে হয়েছে তাই। সবারটা ইচ্ছে হয় না।

–ও। ভুলেই গিয়েছিলাম। আপনি তো আবার যা ইচ্ছে হয় তা করেন।

–বলুন। বলুন। বলুন নারীবাদী তো আমি, সে কারণেই যা ইচ্ছে হয় তা করি। পুরুষবাদীরাও কিন্তু যা তাদের ইচ্ছে হয়, তা করে। কিন্তু সে কথা চারদিকে কেউ এভাবে বলে বেড়ায় না।

ছবিটা দেয়ালে টাঙিয়ে রেখেছি। কোথায় সুশান্ত চেয়েছিলেন আমার সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকার দেওয়া হলো না। বরং একটি ছবি উঠলো দেয়ালে। আমারই অর্জন হয়। অন্যের বিসর্জনে। সুশান্ত বিস্মিত এবং অভিভূত, আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন যখন ছবিটা আমি ড্রইং রুমের দেয়ালে টাঙাচ্ছিলাম। বিশ্বাস করতে পারছিলেন না ঘটনাটি ঘটছে।

যখন আঁকছিলাম, সুশান্ত নড়াচড়া করেননি, কিন্তু অনর্গল কথা বলেছেন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আর বিবর্তন দিয়ে শুরু করে থেমেছেন নিজের জীবনে এসে। আমার জীবনের কিছু শুনতেও তাঁর আর বাকি নেই। আমার সব কথা জানার জন্যও হয়তো উনি মডেল হতে রাজি হয়েছেন। সাংবাদিকরা কী না পারেন! ছোট্ট কোনও নিউজ আইটেমের জন্য বরফ ঠাণ্ডা নদীও সাঁতরাতে পারেন। অবশ্য আমি তাঁর নিউজ আইটেম নই। সাক্ষাৎকার যে দেবো না তিনি জানেন। মেনেও নিয়েছেন।

বিনয়কে আমি ভালোবাসি কিনা সুশান্ত জিজ্ঞেস করেছেন। বলেছি, মাঝে মাঝে বুঝতে পারি না, কিন্তু মনে হয়, শুধু মনে হয় না, বিশ্বাসও হয় যে, ভালোবাসি।

৩.

ছবি আঁকার মাস খানিক পর হঠাৎ এক বিকেলে কলিং বেল বাজলো। সুশান্ত ঢুকলেন। হেসে বললেন, দার্জিলিং চা খেতে এলাম। বিনা নোটিশেই চলে এলাম।

চা বানিয়ে দুজন খেলাম। সুশান্ত বললেন তিনি সাংবাদিক হিসেবে আমার কাছে আসেননি। জিজ্ঞেস করেছি, তবে কী হিসেবে এসেছেন। বললেন, বন্ধু হিসেবে। কিছুক্ষণ দেশের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে করে সুশান্ত উঠলেন। দরজার কাছে। গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, চুম্বন মিস করেন?

চুম্বনকে মিস করি কি না? মিস তো করিই। তবে ও ভালো কলেজে পড়ছে আমেরিকায়। সেটাই শান্তি। বছরে একবার অবশ্য আমার যাওয়া হয়, তবে..

–আহ, প্রিয়াংকা, চুম্বন মিস করেন? আমি হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকি সুশান্তর দিকে। দরজার কাছে আমিও এসেছিলাম সুশান্ত যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করবো বলে। ঠিক বুঝে পাই না সুশান্ত কী বলছেন, কেন বলছেন। কোনও কথা না বলে সুশান্ত আমার হাত ধরে কাছে টেনে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলেন আমার ঠোঁটে, জিভে, অনেকক্ষণ। আমার সারা শরীর তিরতির করে কাঁপছিল তখন।

 চূর্ণী গাঙ্গুলী

চূর্ণী গাঙ্গুলীর নির্বাসিত আমার জীবনের কোনও এক সময়ের কোনও এক ঘটনা অবলম্বনে তৈরি। চূর্ণীর প্রথম ছবি এটি। চূর্ণী মূলত অভিনেত্রী। অসাধারণ অভিনয় করেন। কৌশিক গাঙ্গুলীর ছবিতে প্রচুর করেছেন অভিনয়। এমন প্রতিভাময়ী ব্যক্তিত্ব ঠিক ঠিকই আমার ওপর একটা ছবি বানিয়ে ফেললেন, যখন অন্য অনেকে বানাচ্ছি বানাচ্ছি করেও আজ অবধি কিছুই বানাতে পারেননি। এ অবধি কম লোকতো পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অনুমতিপত্রে সই নিয়ে যান নি! কিন্তু কেউ এখনও শুরুই করতে পারেননি কোনও ছবি। না আমাকে নিয়ে, না আমার গল্প নিয়ে।

ব্যাগ ফিল্মস নামের একটা কোম্পানি আমার ফরাসি প্রেমিক উপন্যাসটির চলচ্চিত্র স্বত্ব কিনেছে প্রায় দশ বছর আগে। দশ বছর ব্যাগ ফিল্মস আর যোগাযোগ করেনি। ভারতের বিখ্যাত মুভি কোম্পানি ইউটিভিও আমার আত্মজীবনীভিত্তিক ছবি করতে চেয়েছে। কেউ একজন চিত্রনাট্য লেখার কাজও শুরু করেছিল। পরে ওদেরও আর কোনও খবর নেই।

বোম্বের নামী পরিচালক মহেশ ভাট দুহাজার সালে ঘোষণা দিয়েছিলেন আমার জীবন নিয়ে ছবি বানাবেন। তিনিও তাঁর ওই ইচ্ছে থেকে কবেই একদিন আলগোছে। নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। এখনও আমার কাছে পড়ে আছে নিমন্ত্রণ আর ফেরার চলচ্চিত্র স্বত্ব বিক্রির টাকা। সৌরভ দে, প্রেমাংশু রায়রা চিত্রনাট্য লিখে কাস্টিংও ঠিক করে ফেলেছিলেন। সৌরভ তো বোম্বে থেকে নিয়ে এসেছিলেন নায়ক, নায়িকাকে নিয়ে মহড়াও শুরু করেছিলেন। কাপে প্লেটে নিমন্ত্রণ লিখে বিলিয়েছিলেন। প্রেমাংশু তো রুনা লায়লাকে দিয়ে গানও পর্যন্ত রেকর্ড করিয়ে নিয়েছিলেন। লোকেশন দেখতে গিয়েও টাকা খরচ হয়েছে। এত টাকা খরচ করেও প্রযোজক ছবি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর কারণ তসলিমা।

আমার নামটাকে নিয়ে ভীষণ ভয় সবার। শুনেছি কিছু বদলোক আমার নাম গন্ধ আছে এমন কিছু নিয়ে ছবি করা, সাফ সাফ বলে দিয়েছে, আর যেখানেই সম্ভব হোক, বাংলায় হবে না। সব রাজনৈতিক দলের অবস্থানই, দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমার বিরুদ্ধে। যুদ্ধটা, সবাই ধরেই নিয়েছে যে, আমার আর মুসলিম মৌলবাদীদের মধ্যে। সবাই খুব হিসেবে করেই মুসলিম মৌলবাদীর পক্ষ নিচ্ছে।

পক্ষ নেওয়ার আরেকটা পদ্ধতি হলো তসলিমার ক্ষতি করা, ক্ষতি করা সম্ভব না হলে নিদেনপক্ষে বিরোধিতা করা। পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা নিশ্চয়ই জানে বছর দুয়েক আগে তাদের মুখ্যমন্ত্রী কী করে টেলিভিশনের আকাশ আট চ্যানেলে হতে যাওয়া আমার মেগা সিরিয়াল দুঃসহবাসের প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে। কলকাতার রাস্তায়। বিশাল বিশাল বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং টাঙানো হয়েছিল, টিভিতে আমার মেগা সিরিয়াল, সত্যি বলতে কী, খুব ঘটা করেই আসছিল। চ্যানেলে ঘন ঘন বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে দুঃসহবাসের। স্কাইপের মাধ্যমে সাংবাদিক সম্মেলনও একদিন করতে হলো। কিন্তু যেদিন শুরু হবে আমার মেগা সিরিয়াল, তার দুদিন আগে, বলা নেই কওয়া নেই, পুলিশ এসে টিভি চ্যানেলকে হুমকি দিলেন, দুঃসহবাস দেখানো চলবে না। পঞ্চাশ এপিসোড় সুটিং হয়ে গেছে, আর কিনা সিরিয়াল দেখানো চলবে না। আমার বেলায় কেন চলবে নার উত্তর সব সরকারের জিভের ডগায়, চলবে না কারণ মুসলিম মৌলবাদিরা রায়ট লাগাবে, দাঙ্গা বাধাবে। আমার বই নিষিদ্ধ করার বেলায় মমতা ব্যানার্জীর আগে যিনি মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন পশ্চিমবঙ্গে, একই যুক্তি দিয়েছিলেন।

মুসলিম মৌলবাদিদের আবার ভারতের হিন্দুরাবিশেষ করে বাঙালি হিন্দুরা যমের মতো ভয় পায়। কলকাতার মানুষ জানে, কলকাতা বইমেলার এসি অডিটোরিয়ামে আমার নির্বাসন নামের বইটির উদ্বোধন অনুষ্ঠানটি বাতিল করে দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জী। তাছাড়া মানুষ তো দেখেছেই কী করে কলকাতা থেকে আমাকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। কী করে আমাকে হেনস্থা করা হয়েছে বছরের পর বছর। কী করে দৈনিক স্টেটসম্যান আমার নিয়মিত কলাম ছাপানো বন্ধ করে দিল। কী করে ঋতুপর্ণ ঘোষও বাধ্য হয়েছিলেন রোববার ম্যাগাজিনে আমার লেখা নিয়মিত ছাপা হবে ঘোষণা দেওয়ার পরও লেখা ছাপা বন্ধ করে দিতে।

এইসব দেখার পর কার সাহস হয় আমার ছিটেফোঁটা নিয়ে বা আমার গল্পের বিন্দুমাত্র কিছু নিয়ে ছবি করার! কারোর হয়নি। কেউ কেউ ভুল করে এ পথে পা বাড়িয়েও ভুল বুঝতে পেরে সরে গেছে। মানুষ দেখেছে কী করে পুরো পশ্চিমবঙ্গে আমাকে ব্ল্যাকআউট করে দেওয়া হয়েছে। এই অর্জন কি চাট্টিখানি অর্জন? সমাজের সকল স্তরের সকল শ্রেণীর সকল দলের ভয় এবং ঘৃণা, অবজ্ঞা আর অসম্মান অর্জন করা কি আদৌ সহজ? নিশ্চয়ই আমি কোনও কঠিন সত্য কথা বলেছি।

এমন যখন অবস্থা, তখন বাংলার প্রতিভাবান চলচ্চিত্র পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলী চাইলেন কলকাতা থেকে আমাকে বের করে দেওয়ার ঘটনা নিয়ে একটা কমেড়ি বানাতে। মুখ্য চরিত্রে থাকবে আমার বেড়াল। কৌশিক একদিন তাঁর লেখা স্ক্রিপ্টও আমাকে পাঠিয়ে দিলেন। কৌশিককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কৌতুকের আশ্রয় না নিয়ে সরাসরি বললে ভালো হতো না? কৌশিকের বক্তব্য, কৌতুকের মাধ্যমে বললে বেঁধে ভালো। চার্লি চ্যাপলিনের ছবিগুলো মনে ভাসলো। প্রযোজক জুটে গেছে, সুতরাং কৌশিক একদিন কলকাতা থেকে দিল্লি চলে এলেন আমার কাছ থেকে ছবি করার লিখিত অনুমতি নিতে। ছিলেন দুদিন। বেশ আড্ডা হলো।

কৌশিক খুব ভালো ছবি করেন, প্রতিটি ছবির জন্য কোনও না কোনও পুরস্কার পাচ্ছেন, এরকমই জানে লোকে। যেটা জানে না সেটা হলো কৌশিক মানুষটা অসাধারণ, তাঁর রসবোধের কোনও তুলনা হয় না। কলকাতার পত্র পত্রিকায় কৌশিকের নির্বাসিত নিয়ে বড় বড় খবর ছাপা হলো। আমার পোষা বেড়াল মিনুর ছবিখানাও বেশ চমৎকার ছাপা হতে লাগলো ওইসব খবরের সঙ্গে। কৌশিক জানালো বেড়ালের অডিশন চলছে। বেড়ালের মায়েরা ভিড় করছে বেড়াল নিয়ে। ছবির শুটিং সামনের মাসেই শুরু হবে। কিন্তু সামনের মাসে স্তব্ধতার ঝড় বইতে শুরু করলো।

একদিন পত্রিকায় দেখলাম কৌশিক তাঁর নতুন ছবি শব্দর শুটিং করছেন। কৌশিক বলেছিলেন তাঁর প্রযোজক শব্দ আর নির্বাসিতর গল্প শুনে নির্বাসিতকেই বেছে নিয়েছেন। বুঝি যে সেই বেছে নেওয়াটা শেষ বেছে নেওয়া নয়। শেষ পর্যন্ত নির্বাসিতকে ছুঁড়ে ফেলে শব্দকেই নির্বাচন করেছেন প্রযোজক। গণ্ডগোলটা তাহলে আমাকে নিয়েই।

কৌশিকের কাছে আমি আর জানতে চাইনি কী ঘটেছে। মনে মনে তো জানিই কী ঘটতে পারে। মাসের পর মাস চলে গেলো। কৌশিক এক ছবি করে আরেক ছবিতে হাত দিচ্ছেন, নির্বাসিত ওদিকে কবরে, অন্ধকারে, একা। অনুমান করি, অন্য পরিচালকেরা যেমন কোনও ছবি, শেষ করা তো দূরের কথা, শুরুই করতে পারেননি। কৌশিকও পারবেন না। কৌশিকের সঙ্গে মাঝে মাঝে তাঁর অন্য ছবি টবি নিয়ে কথা হয়। নির্বাসিতর কথা তুলি না। তুলে ওকে অপ্রস্তুত করি না।

এমন সময় হঠাৎ একদিন অভিনেত্রী চূর্ণী গাঙ্গুলী, কৌশিকেরই স্ত্রী, আমাকে জানালেন নির্বাসিতটা কৌশিক নয়, উনি করবেন। চূর্ণী নতুন করে স্ক্রিপ্ট লিখছেন। প্রযোজক পেয়ে গেছেন। চূর্ণী আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন দিল্লিতে। কয়েকদিন কাটালেন আমার আর আমার বেড়ালের সঙ্গে। কলকাতায় ফিরে গিয়ে শুটিং শুরু করলেন। সবকিছুই অপ্রত্যাশিত। তবে ছবিটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি নিশ্চিত নই ছবিটা শেষ হতে আদৌ পারবে কিনা। শত সহস্র উপদ্রব ওত পেতে আছে। সে কী এতদিনেও বুঝিনি!

ছবিতে আমার জীবন সংগ্রাম, আমার ওপর রাজনৈতিক অত্যাচার, আমার লেখালেখি, আমার আদর্শ বিশ্বাস, খুব স্পষ্ট করে দেখানো হয়নি, যা হয়েছে দেখানো তা হলো আমার সঙ্গে আমার বেড়ালের বিচ্ছেদ। মায়ের সঙ্গে কন্যার বিচ্ছেদ। বেড়াল আমাকে চাইছে, আমি বেড়ালকে চাইছি। চূর্ণী এভাবেই প্রতিবাদ করেছেন আমাকে দেশ থেকে, রাজ্য থেকে বিতাড়িত করে যে অন্যায় করা হয়েছে তার। এভাবেই উনি প্রকাশ করেছেন মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে ওর মত। অন্যভাবে হলে, উচ্চকণ্ঠ হলে হয়তো ছবিটা ছাড়পত্রই পেতো না। তাই খুব বেশি ঝুঁকি না নিয়ে তৈরি করেছেন ছবি।

ছবিটি শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ হয়েছে বলে, সেন্সরবোর্ডের অনুমতি পেয়েছে বলে আমি খুশি। চূর্ণী হয়তো আশংকা করছিলেন সেন্সর বোর্ড ছবিটাকে আটকে দেবে। মমতার পুলিশ বাহিনী কলকাতার টিভি চ্যানেলে গিয়ে সিরিয়াল প্রচার বন্ধ করতে পারে, সেন্সর বোর্ডকে হুমকি দিয়ে ছবি বন্ধ করার কৌশল এখনও বোধহয় রপ্ত করেনি। আমি খুশি ছবিটি বোম্বে, গোয়া আর দিল্লির ফিল্ম ফেস্টিভেলে দেখানো হয়েছে বলে, আমি খুশি দিল্লির ফিল্ম ফেস্টিভেল থেকে ছবিটি বেস্ট ফিল্ম এর পুরস্কার পেয়েছে বলে। আমি খুশি ছবিটি কলকাতায় নির্বিঘ্নে মুক্তি পেয়েছে বলে। আমি খুশি দিল্লি বোম্বে ব্যাঙালোর পুনে এসব বড় বড় শহরে নির্বাসিত দেখানো হয়েছে বলে। বাক স্বাধীনতা লংঘনের বিরুদ্ধে সামান্য হলেও, খুব শান্তকণ্ঠে হলেও, নির্বাসিত নামের একটি প্রতিবাদ হয়েছে বলে, আমি খুশি নিষিদ্ধ একটি মানুষের কথা ছবিটিতে বলা হয়েছে বলে। বাক স্বাধীনতার পক্ষে তিন যুগ লড়ছি। নির্বাসিতর গল্প আমার গল্প না হয়ে অন্য কারো গল্প হলেও আমি একইরকম পাশে দাঁড়াতাম। একইরকম বাহবা দিতাম। নির্বাসিত সম্ভবত এ বছরের মে মাসের দিকে ভারতবর্ষে মুক্তি পাবে। এ ছবি কেউ দেখুক না দেখুক, এ ছবি ফ্লপ হোক, এ ছবি এই সময়ের মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী এক লেখকের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক নির্যাতনের প্রতিবাদ। মুখ বুজে থাকা আপোসকামী মানুষের ভিড়ে চূর্ণী অনেকটা দেবীর মতো। আহ দেবীতে তো আমার বিশ্বাস নেই। তবে কি সুপারহিরোর মতো? সুপারহিরোতেও তো বিশ্বাস নেই। তাহলে কী? সত্যিকার মানুষের মতো! মনে হয় মহিয়ষীর মতো।

১৭ই ফেব্রুয়ারির ‘দেশ’এ শ্ৰী বাদল বসু তাঁর ধারাবাহিক রচনা পিওন থেকে প্রকাশকএ আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়েছেন, যার প্রতিবাদ করতেই এই চিঠি। যাঁরা আমাকে চেনেন-জানেন বলে বিশ্বাস করি, তাঁরা যখন মিথ্যে বলেন আমার সম্পর্কে, তখন বিস্মিত হই, ব্যথিত হই। আমার সম্পর্কে মিথ্যে বলার লোকের অভাব নেই, সম্ভবত এই কারণে যে, আমিই একমাত্র একজন, যার দিকে ঢিল ছুড়লে, কাদা ছুড়লে, যার চরিত্র হনন করলে, জবাবদিহি করতে হয় না, সমালোচিত হতে হয় না, নিন্দা শুনতে হয় না, মামলায় ফাঁসতে হয় না, মার খেতে হয় না।

তিনি লিখেছেন, সুনীলের চিঠি পেয়ে বুদ্ধবাবু সেই ফ্ল্যাটের ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন তসলিমাকে। অবশ্য শেষ পর্যন্ত ফ্ল্যাটটা নেয়নি তসলিমা। মিথ্যে কথা লিখেছেন বাদল বসু। আমার জন্য কোনও ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা বৃদ্ধবাবু কখনও করেননি। আর, এ কথা বাদল বসুই সবচেয়ে ভালো জানতেন। পত্রিকায় বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন দেখে আর রাস্তায় ঘুরে ঘুরে টু লেট লেখা দেখে ফ্ল্যাট খুঁজেছি, ভাড়া নিয়েছি। বুদ্ধবাবু তখন আমার দ্বিখণ্ডিত বইটি নিষিদ্ধ করতে ব্যস্ত।

একবার শান্তিনিকেতনে দোলের দিন অনেকের সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে। সেটি ছিল ১৯৯২ সাল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় দোল খেলে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ লোক সৌমিত্র মিত্র বাংলাদেশ থেকে শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব দেখতে আসা আমাদের কয়েকজনকে বললেন, সুনীলদা বলেছেন আমাদের নিয়ে যেন তিনি তাঁর বাড়িতে যান। সে কারণেই যাওয়া। বাদল। বসু লিখেছেন, আমার সারা গায়ে রং মাখা, বোঝা যায় দোল খেলেছে। সেটিই শান্তিনিকেতনে আমার প্রথম দোল। দোল খেলায় মোটেই আমি অভ্যস্ত নই। চেনা পরিচিত কেউ কেউ জোর করে আবীর মাখিয়ে দিয়েছিল। যতটুকু ঝেড়ে ফেলা সম্ভব, ফেলেছিলাম। বাদল বসু লিখেছেন আমি নাকি নেশায় চুর ছিলাম। আমি মদ্যপান করি না, মাদকদ্রব্য সেবনও করি না। নেশায় চুর থাকার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। বরং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে পৌঁছে দেখলাম বাদল বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং আরও যাঁরা ছিলেন, মদ্যপান করছেন। নেশায় চুর যদি কেউ হয়ে থাকেন সেদিন, সে বাদল বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং সে বাড়িতে মদ্যপানরত লোকেরা।

বাদল বসু লিখেছেন আমি নাকি সটান গিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পা জড়িয়ে ধরে বলেছি, শুভ দোল। মিথ্যে কথা। আমি কোনওদিনই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পায়ে হাত দিইনি, জড়িয়ে ধরা তো দূরের কথা। খুব শ্রদ্ধা করি, এমন কাউকে আমি বড়জোর হাত জোড় করে নমস্কার করি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কেও হাত জোড় করেই নমস্কার করেছি, কিন্তু তাঁর বাড়িতে নয়, কারণ তাঁর বাড়িতে যাওয়ার আগেই তাঁর সঙ্গে আমাদের কলাভবনে এবং ইন্দ্রনাথ মজুমদারের বইএর দোকান সুবর্ণরেখায় দেখা হয়েছিল। শুভ দোল আমি কাউকে আজ অবধি বলিনি।

বাদল বসু লিখেছেন, ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা থতমত খেয়ে গিয়েছি। সুনীলও কিছু বলার এবং বাধা দেওয়ার সুযোগ পাননি। যে ঘটনা আদৌ ঘটেনি, তার আকস্মিকতা বলে তো কিছু থাকতে পারে না। এবং সেই না-ঘটা ঘটনাকে গ্রহণ করা এবং বাধা দেওয়ারও কিছু থাকতে পারে না।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে আমরা বেশিক্ষণ ছিলাম না। লাঞ্চের আগেই চলে আসি। বাদল বসু লিখেছেন, তিনি নাকি ভেতরের ঘরে গিয়ে দেখলেন স্বাতী নিঃশব্দে কাঁদছেন। বাদল বসু কি বলতে চাইছেন তসলিমা সুনীলের জড়িয়ে ধরে শুভ দোল বলেছে, সুতরাং স্বাতী কেঁদেছেন? আমার প্রশ্ন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পা জড়িয়ে যদি আমি শুভ দোল বলতামই সেই দোলের দিন, তাতে স্বাতী কেন কাঁদবেন?

আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পা জড়িয়ে ধরে শুভ দোল যে বলে, তাকে কি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যৌন হেনস্থা করতে পারেন না? বাদল বসু মনে হয় বলতে চাইছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তসলিমাকে যৌন হেনস্থা করবে কী, তসলিমাই সুনীলকে যৌন হেনস্থা করেছিল ৯২ সালে সুনীলের জড়িয়ে শুভ দোল বলে! যদিও ঘটনাটি বাদল বসুর বানানো, কিন্তু যদি সত্যিও হতো, তাহলেও শান্তিনিকেতনে দোলের দিন কোনও বয়োজ্যেষ্ঠ লেখককে বাড়ি ভর্তি লোকের সামনে পা জড়িয়ে ধরে শুভ দোল বলাটা কোনওভাবেই কোনও রকম যৌন হেনস্থা নয়। এবং যার পা জড়িয়ে ধরা হয়, তার পক্ষে যে পা জড়িয়ে ধরে, তাকে, যৌন হেনস্থা করাটা সম্ভব নয় –এ সম্পূর্ণই অযৌক্তিক।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ করাতে বাদল বসু আমার সম্পর্কে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে, কুৎসা রটিয়ে, মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করছেন যে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমাকে যৌন হেনস্থা করেননি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ লোক হিসেবে বাদল বসু কিন্তু তাঁর অনেক গোপন কথা জানতেন। মেয়েদের যে তিনি যৌন হেনস্থা করেন, তা আমার চেয়েও ভালো জানতেন বাদল বসু। কিন্তু এখন সুনীলকে মহান প্রমাণ করতে যদি চান, তাহলে আমার নিন্দা করে সুনীলকে মহান করার পথ তিনি কী কারণে বেছে নিলেন? এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনও বদ উদ্দেশ্য আছে।

ছোট ছোট ভাবনা

১. মাহমুদুর রহমান মান্নাকে আমি প্রথম দেখেছিলাম ১৯৭৯ সালে ময়মনসিংহ, মেডিক্যাল কলেজের নবীন বরণ উৎসবে। আমি তখন নবীন। সবে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছি। গান কবিতা বক্তৃতা শুনিয়ে নবীনদের বরণ করে নিচ্ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন। জাসদের নবীন বরণ অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে এসেছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না। ঢাকা থেকে যত নেতা এসেছিলেন, সবচেয়ে ভালো বক্তৃতা করেছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না। কী যে মুগ্ধ হয়েছিলাম মান্নার বক্তৃতা শুনে। সবার জন্য শিক্ষা স্বাস্থ্য, সবার জন্য অন্ন বস্ত্র, সবার জন্য নিরাপত্তার দাবি সবচেয়ে বেশি ছিল মান্নার কণ্ঠে। আমার সতেরো আঠারো বছর বয়সের মুগ্ধতা সত্যি বলতে কী, কখনও ফিকে হয়নি। কিছু জিনিস চিরকাল রয়ে যায় স্মৃতিতে। বড় হয়ে খবরের কাগজে পড়েছি মাহমুদুর রহমান মান্নার নিয়মিত কলাম। একই কাগজে আমিও তখন লিখতাম। খুব গর্ব হত, যে পত্রিকায় মান্নার মতো আদর্শ রাজনীতিক লেখেন, সেই পত্রিকায় আমিও লিখি।

কিন্তু কাল শুনলাম তিনি নাকি দেশে কিছু লাশ ফেলে দেওয়ার কথা বলেছেন। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। মনে পড়ছিল এককালের সেই প্রচণ্ড আদর্শবাদী মান্নাকে, যার আহবানে যুব সমাজ দেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছিল। কোথায় গেল দেশ গড়া! আজ মান্না দেশের লোককে গুলি করে মেরে ফেলা হলে আপত্তি করবেন না বলে জানিয়েছেন। কবে থেকে যে তিনিও দেশের নোংরা রাজনীতিতে জড়িয়ে গেছেন জানি না। খুব বেশি কিছু না জানাও হয়তো ভালো। ও-ই ভালো ছিল, জানতাম যে, দেশে এখনও কিছু আদর্শবান মানুষ আছেন, যাঁরা দেশের জন্য, দেশের মানুষের নিরাপত্তার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতে পারেন। রাজনীতিকদের সবকিছু হয়তো জানতে নেই। তাঁরা যেটুকু জানান, শুধু সেটুকু জানাই হয়তো ভালো। শুধু সেটুকু জানলে আমাদের মনে আশা ভরসা, সুখ স্বপ্ন, সবকিছু অক্ষত অবস্থায় থাকে। তাঁদের লাশ ফেলে দেওয়ার ইচ্ছের কথা জানলে আমাদের পায়ের তলার মাটি সরে যায়। কেবল কি মান্নাই, সন্ত্রাস, নাশকতা আর লাশ ফেলে দেওয়ার ইচ্ছে নিশ্চয়ই আরও অনেক রাজনীতিকের। দেশটা ক্ষমতাবান,ষড়যন্ত্রবাজ,ধান্দাবাজ রাজনীতিকদের হাতে বন্দি।

২. এরই নাম বুঝি জাত্যাভিমান! বাঙালির বাঙালিত্ব কতটুকু অবশিষ্ট আছে বাংলাদেশে? আরবীয় সংস্কৃতি দিয়ে বাংলা সংস্কৃতিকে কি যথেচ্ছ ধর্ষণ করানো হয়নি? জাতীয় সঙ্গীতটা কেউ আগা থেকে গাইলো নাকি গোড়া থেকে গাইলো, তা বিরাট এক ব্যাপার বটে! কেউ মাঝখান থেকে গাইলে নাকি জনতার জাত্যানুভূতিতে আঘাত লাগে! জাতের নামে বজ্জাতি আর কাকে বলে। যাদের সভ্যতা সংস্কৃতি, শিক্ষা সচেতনতা বলতে প্রায় কিছুই নেই, যারা দারিদ্র, দুর্নীতি, অন্ধতা, হিংসা, ঘৃণা, লোভ, সন্ত্রাস ইত্যাদি থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারে না, তাদের আর কিছু না থাকুক, একটা জাতীয় সীমানা আছে, একটা জাতীয় সঙ্গীত আছে, আর একটা জাতীয় পতাকা আছে! ব্যর্থ সরকাররা ওগুলোই জনতার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজেদের ব্যর্থতাকে লুকোয়! আর নির্বোধ জনতা ওগুলোই আঁকড়ে ধরে বড় সন্তুষ্ট, তৃপ্ত আর গর্বিত।

৩. আচ্ছা, বাংলাদেশের নব্বই বা নিরানব্বই ভাগ লোক তো মুসলমান। তারা তো কোরান-হাদিসে, আল্লাহ মোহাম্মদে একশ ভাগ বিশ্বাস করে। তারা নামাজ পড়ে, রোজা করে, শবেবরাত করে, শবেকদর করে, মিলাদুন্নবি করে, ইদুল ফেতর করে, ইদুল আজহা করে। ঠিক কি না? আল্লাহ নিয়ে কেউ কোনওরকম সন্দেহ প্রকাশ করলে তাকে জবাই করতে প্রায় কারওরই আপত্তি নেই, মোহাম্মদের কার্টুনিস্টদের বেঁচে থাকার অধিকার আছে বলে প্রায় কেউই মনে করে না। বোরখা আর হিজাবের হিড়িক পড়েছে। টুপিদাড়ির সংখ্যা হাউমাউ করে বাড়ছে। এই সময়, আমার একটিই জরুরি প্রশ্ন, এত কিছু আনা হচ্ছে দেশে, গার্মেন্টসের সুতো, ইংলিশ এডুকেশন, মধ্যপ্রাচ্যের টাকা– শরিয়া আইন কেন আনা হচ্ছে না। আল্লাহ বিশ্বাসী লোকদের তো আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য কোনও আইন মানা উচিত নয়। আল্লাহ বলেই দিয়েছেন কোরানে, আল্লাহর প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি অক্ষর কোনও রকম প্রশ্ন, সংকোচ ও দ্বিধা ছাড়া বিশ্বাস করতে হবে।

জারি হয়ে যাক না কোরান হাদিসের আইন আই মীন শরিয়া আইন! চুরি করলে হাত কাটা যাবে। ইসলাম নিয়ে কটাক্ষ করো তো জনসমক্ষে মুণ্ডু উড়িয়ে দেওয়া হবে। স্বামী শারীরিক নির্যাতন করবে। তালাক তালাক তালাক বললেই তালাক হয়ে যাবে। স্বামী চার বিয়ে করবে। ধর্ষিতারা চাবুকের মার খাবে। প্রেম করার অপরাধে মেয়েদের পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলা হবে। এই ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা আর নির্যাতন কিন্তু শরিয়া আইনের চোখে বৈধ।

আল্লাহকে মানবো, আল্লাহর কোরান মানবো, কিন্তু আল্লাহর আইন মানবো না– এ আবার কেমন দাবি? এ ধরনের হিপোক্রেট-বান্দাদের আল্লাহ দোযখের আগুনে নিক্ষেপ করবেন।

দেশে অতি শীঘ্র শরিয়া আইন আনুন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। যে রাষ্ট্রের ধর্ম ইসলাম, যে রাষ্ট্রের মানুষ খাঁটি মুসলমান, সে রাষ্ট্রের আইন ইসলাম ছাড়া অর্থাৎ শরিয়া ছাড়া অন্য কিছু হয় না, হতে পারে না।

৪. শামিমা বেগম আর খাদিজা সুলতানা, দুজনারই ১৫ বছর বয়স, লগুন থেকে ইস্তানবুল হয়ে সিরিয়া গিয়েছে ইসলামিক স্টেট বা আইসিসে যোগ দিতে। এদের দেশ বাংলাদেশ। থাকছিল লন্ডনে। কিন্তু পাশ্চাত্যের শিক্ষা, সচেতনতা, সমতা, সমানাধিকার তাদের পছন্দ হয় না। তারা দূরের এক মরুভূমিতে ইসলামের নামে বর্বরতা চালাচ্ছে যে আইসিস নামের দল, সেই দলের প্রতি আকৃষ্ট। আইসিসের জঙ্গিরা ধরে ধরে মানুষ জবাই করছে, মানুষের মাথা লক্ষ্য করে গুলি করছে–এসব বর্বরতা মেয়েদুটোকে ভীষণই উত্তেজিত করেছে। তারা বাড়ি ঘর আত্মীয় স্বজন শহর বন্দর বন্ধু বান্ধব ছেড়ে দিয়ে আইসিসে যোগ দেওয়ার পণ করে বেরিয়ে পড়েছে। আইসিসের জঙ্গীদের কাছে যাওয়া মানে ধর্ষিতা হওয়া। জেনেবুঝেই মেয়েদুটো ধর্ষিতা হতে গেছে। জেহাদি পুরুষের যৌনইচ্ছে মেটানোই হয়তো জেহাদি নারীর কাজ। এই মেয়েদুটোকে নিয়ে কী করবে আইসিসের জঙ্গীরা, আমরা অনুমান করতে পারি। এদের ধর্ষণ করে, টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে রাখবে। নয়তো এদের বিক্রি করে দেবে, বা এদের সেবাদাসী বানাবে।

এতে নিশ্চয়ই শামিমা বেগম বা খাদিজা সুলতানার আপত্তি নেই। নিশ্চয়ই বাংলাদেশের আরও অনেক ছেলে মেয়েই আইসিসে যোগ দিতে আগ্রহী। আইসিসের সেবা করলে তাদের বিশ্বাস, তারা আল্লাহকে খুশি করতে পারবে। আল্লাহ তাদের বেহেস্ত নসিব করবেন।

জরিপে দেখা গেছে, পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি ধর্মবিশ্বাসী। কোনও ধর্ম কি সত্যিকার অর্থে নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান আর সমানাধিকার দিয়েছে? নারীর এই ধর্মে সমর্পণটা তবে ঠিক কেন? কেবল নরক থেকে বাঁচার জন্য? বেহেসতে পুরুষকে যে আরাম আয়েশে রাখবেন আল্লাহ তায়ালা, একই আরাম আয়েশ নারীর জন্য নেই কেন? এই প্রশ্নটি নারীরা করে না, অথবা করতে ভয় পায়। পুরুষ ধর্মান্ধ হলে বা ধর্মপ্রাণ হলে মানায়। নারীকে ধর্মপ্রাণ হওয়া ঠিক মানায় না। নারীর জন্য ইহজীবন যেমন দুর্বিষহ, পরজীবনও তেমন দুর্বিষহ। এত বড় বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা কি নারী পুরুষের মধ্যে এত বড় বৈষম্য করতে পারে? আমার তো মনে হয় না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, হয় সৃষ্টিকর্তা নেই, নয় বৈষম্য নেই।

জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রকে নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা

 

আমার মনে হয় আমার ওপর যা ঘটছে তা বর্ণনা করলেই অনুমান করা যায় বাক স্বাধীনতার হাল এখন কী। যেদিন বাক স্বাধীনতার পক্ষে সুপ্রীম কোর্টের রায় ঘোষিত হল, বলা হলো বাক স্বাধীনতা বিরোধী আইন ৬৬এ আইটি অ্যাক্ট এখন থেকে বাতিল, সেদিনই ঘোষণা করা হলো নির্বাসিত ছবিটিকে দেওয়া হচ্ছে সেরা বাংলা ছবির সম্মান। নির্বাসিত ছবিটি বাক স্বাধীনতা নিয়ে। বাক স্বাধীনতার জয় হলো সেদিন। ধীরে ধীরে ঘনিয়ে এলো পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের দিন। একখানা আমন্ত্রণপত্র চূর্ণী আমার জন্য ব্যবস্থা করেছিল বলেই যেতে পেরেছিলাম। সে এক অভিজ্ঞতা বটে। বিজ্ঞান ভবনের বিশাল অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠান হলো। রাষ্ট্রপতির হাত থেকেই পুরস্কার নিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক এবং কলা কুশলী। এই ছবিটি কখনও যে সত্যি সত্যি আলোর মুখ দেখবে, ভাবিনি। কয়েক বছর আগে বাংলার স্বনামধন্য চিত্রপরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলীই আমাকে বলেছিল আমার বেড়ালকে নিয়ে ও একটা কমেডি বানাতে চায়। মাঝখানে চুক্তিপত্রে সই করার পরও দেখেছি সব থেমে আছে। আমি অবাক হইনি। কারণ আমার গল্প নিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি বানাতে চেয়েছে অনেকেই। চলচ্চিত্র-স্বত্ব কিনে নিয়ে যাওয়ার পরও কলকাতায় গিয়ে জানি না কোন অন্ধকারে তলিয়ে যায় সবাই। আসলে সরকার কাউকে আমার জীবন নিয়ে বা আমার লেখা কোনও গল্প নিয়ে ছবি করতে দিতে চায় না। আমার নামটা খুব ভয়ংকর। লেখকের নামের জায়গায় আমার নামটার বদলে অন্য নাম থাকলেই কোনও সমস্যা হতো না।

দুবছর আগে আকাশ টেলিভিশন সারা শহরে বিশাল করে বিজ্ঞাপন সেঁটে আমার নতুন মেগাসিরিয়াল দুঃসহবাসের প্রচার করলো, মেগাসিরিয়ালের গল্প কেউ তখনও জানে না, কারণ প্রচার তো হয়নি ওটা। কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী টিভি চ্যানেলে পুলিশ পাঠালেন মেগাসিরিয়াল বন্ধ করতে। কী কারণে বন্ধ করতে হবে? হবে কারণ মুসলমানদের মনে আঘাত লাগবে এই মেগাসিরিয়াল দেখলে। তারা কী করে জানে যে আঘাত লাগবে? গল্পটাই তো কেউ জানে না এখনো! গল্পটা যে কী হবে তা অনুমান করতে পারছে ওরা। তিনটে হিন্দু বোনের গল্প শুনলে ওদের মনে আঘাত লাগবে কেন? লাগবে লাগবে। যে লেখক গল্প লিখেছে, তার নাম দেখলেই আঘাত লাগবে। সেটা বলুন। আকাশ৮ আপোসের চূড়ান্ত করেছে। মেগাসিরিয়াল পঞ্চাশ এপিসোড অবধি বানানো হয়ে গিয়েছিলো, সবগুলো এপিসোডের সিঁড়ি দিয়ে এলো এক দল মৌলবাদীকে। পাঁড় অশিক্ষিত কিছু লোক এলিয়ে কেলিয়ে সিরিয়াল দেখলো, যেন ভারতের সেন্সরবোর্ডের হোমড়াচোমড়া কোনও কর্মকর্তা ওরা। ওদের মধ্যেও এত অসততা ছিল না। ওরা দেখে বলে দিলো, না এমন কিছু নেই এতে, চ্যানেল চাইলে চালাতে পারে। মৌলবাদীরা অনুমোদন দিয়েছে, সুতরাং দেখানো চলবে। পরদিন প্রস্তুতি নেওয়া হয়ে গেছে মেগাসিরিয়ালের প্রচারের জন্য। এমন সময় পুলিশ এসে তছনছ করলো চ্যানেল অফিস, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর লিখিত নোটিশ নিয়ে এসেছে তারা। মুখ্যমন্ত্রী এই সিরিয়াল কিছুতেই প্রচার করতে দেবেন না। প্রচার করলে ওঁর লোকরা শাসিয়ে গেছে উনি দেখে নেবেন।

আমার নাম নিয়ে আপত্তি। ঝামেলা চুকে যেত যদি নামটা ওরা বদলে দিতো। আমি আকাশ কে বলেছিলাম নাম বদলে দিতে। ওরা রাজি হয়নি। যা বলছিলাম, যেদিন নির্বাসিত সেরা ছবির সম্মান পেলো, সেদিনই তৃণমূলের এক মুসলিম লোকসভা সদস্য বলে দিলো এই ছবি তারা পশ্চিমবঙ্গে দেখাতে দেবে না। লোকটা রাস্তার দাঙ্গাবাজ। মুসলিম সন্ত্রাসী। এরাই আজ সিদ্ধান্ত নেয় কে রাজ্যে থাকবে কে থাকবে না, রাজ্যের লোকরা কার বই পড়বে, কার বই পড়বে না, কার ছবি দেখবে, কার ছবি দেখবে না। রাজ্যের সরকার গুটিকয় মুসলিম সন্ত্রাসীর হাতে বন্দি। সরকার কিন্তু যেচে বন্দি হয়েছে। এরকম নয় যে তারা কোনও পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে। নির্বাসিত ছবিটা করা হয়েছে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। আমাকে নিয়ে এ ছবি, অথচ ছবিতে আমার নাম নেই। আমার যে সব গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাম, সে সব এই ছবিতে দেখানো হয়নি। বলা হয়নি আমি ধর্ম নিয়ে কী বলেছি, দেখানো হয়নি আমি নারীর অধিকার নিয়ে কী লিখেছি। অত সতর্ক থেকে কার কী লাভ হয়েছে। সেই তো ছবি নিষিদ্ধ করার দাবি উঠছেই। দাবি উঠছে ছবিতে কী আছে না আছের জন্য নয়। ছবিটির সঙ্গে আমার নাম জড়ানো বলে। আমার নামটি কারও সহ্য হয় না।

পশ্চিমবঙ্গ আমাকে ব্রাত্য করেছে। শুধু সরকার নয়, সব রাজনৈতিক দল, সব সংগঠন, সব মিডিয়া। যে আনন্দবাজার আমাকে দুবার আনন্দ পুরস্কার দিয়েছে, সেই আনন্দবাজারের কাছে আমি আজ ব্রাত্য। পৃথিবীর কোথাও কোনও মানুষ দেশের সব সরকার এবং সব রাজনীতিক দ্বারা ব্রাত্য নয়, একঘরে নয়। আমি যা বলি তা কি এতই ভয়ংকর? নারীর সমানাধিকার ভয়ংকর? মানবাধিকার ভয়ংকর? মানববাদ ভয়ংকর? নাকি একটা ইসলাম-বিরোধী তকমা লাগিয়ে আজ যে আমাকে ভোটের জন্য ব্যবহার করছে রাজনীতিক দলগুলো, মুসলিম মৌলবাদীগুলো সেটা ভয়ংকর? যে আমাকে যত বেশি লাথি দিতে পারবে, যত জোরে চড় কষাতে পারবে, সে মুসলিম ভোট তত পাবে। এই অংক সবাই কষছে। প্রতিষ্ঠানগুলোও সরকারি সাহায্যে চলে। সংগঠনগুলোও। সুতরাং আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে যেই আসবে, তার মরণ হবে। এর চেয়ে ভয়ংকর আর কী ঘটনা থাকতে পারে!

আমার নামটা বদলে ফেললে চমৎকার হবে। বড় প্রকাশক আমার বই ছাপাবেন, পত্র পত্রিকাগুলোয় লেখা ছাপানো হবে। আমার গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ হবে, মেগাসিরিয়াল তৈরি হবে। আমার জীবন নিয়েও ছবি হবে, সে সব ছবিকে মুক্তি পেতে দেওয়া হবে না বলে কেউ হুমকি দেবে না। কিন্তু নাম বদলে ফেললে তো আমাকে মুখোশ পরতে হবে। আর মুখোশ পরতে তো আমি কিছুতেই পারবো না।

বাংলাদেশেও আমার নামটি নিষিদ্ধ একটি নাম। আমি কে, আমি কী, আমার লেখা বইপত্র কোনওদিন না পড়েও আমার নামটিকে ঘৃণা করতে শিখেছে মানুষ। এই ঘৃণা মস্তিষ্কের গভীরে ঢুকে গেছে। ধর্ম বিশ্বাস করতে হলে এদের যেমন কোনও যুক্তি বা প্রমাণের প্রয়োজন হয় না, আমাকে ঘৃণা করতে হলেও সেসবের কিছুর প্রয়োজন হয় না।

কলকাতা থেকে চেনা কয়েকজন বললো, নির্বাসিত চলচ্চিত্র পুরস্কার হয়তো পেয়েছে, কিন্তু কলকাতায় ওটা দেখাতে দেবে না। কে দেবে না জিজ্ঞেস করায়। বললো, মুখ্যমন্ত্রী দেবে না। নাকি মুসলিমরা দেবে না? মুসলিমদের কোনও ক্ষমতা নেই না দেওয়ার। মুখ্যমন্ত্রী নিষিদ্ধ করে মুসলিমদের বলবে তোমাদের অনুভূতিতে যেন এই ছবিটা আঘাত না দেয় সে কারণে নিষিদ্ধ করেছি। ভোটটা যেন নিশ্চিন্তে দেয় অনুভূতিকাতর লোকগুলো। একজন লেখকের কতটুকু করুণ অবস্থা দাঁড়ায় যখন তাকে নিষিদ্ধ করার রাজনীতিই প্রতিটি রাজনৈতিক দলের, প্রতিটি অরাজনৈতিক দলের, প্রতিটি সংস্থার, সংগঠনের, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের এজেণ্ডা! লেখক যাবে কোথায়? আমি যাবো কোথায়?

 টুকরো টুকরো জীবন

১. মাঝে মাঝে ভারতের লোকদের জিজ্ঞেস করছি, কেমন খেলছে বাংলাদেশ। তারা উচ্ছ্বসিত। তারা বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সবার নাম জানে, কে ব্যাটসম্যান, কে বোলার, কে কেমন খেলে, সব তাদের নখদর্পণে। কবে বাংলাদেশ কার সঙ্গে খেলেছে, কবে জিতেছে, কবে হেরেছে–সব মুখস্ত। আমি তো হাঁ হয়ে যাই। আমিই জানিনা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলটি সম্পর্কে কোনও কিছু। ভারতের ক্রিকেট-ভক্তরা জানে। বাংলাদেশ ভালো খেললে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা তো বেজায় খুশি। এতদিন তো ক্রিকেট-জগতে একজন বাঙালিকে দেখেছে, এখন এগারো জন বাঙালিকে দেখে আহ্লাদে আটখানা। ভারতের লোকেরা জানে, আমি ভারত-পাকিস্তান, ভারত শ্রীলংকা, ভারত-অস্ট্রেলিয়া ভারত-হোয়াটএভার খেলা হোক, আমি ভারতের পক্ষ নিই। প্রশ্ন করলো, এবার কী করবে, যখন ভারত আর বাংলাদেশ খেলবে? ভারতের পক্ষ নেওয়া ছাড়াও আমার আরও একটি নীতি আছে। গরিব দেশ, নতুন দেশ, দুর্বল দেশের পক্ষ নিই আমি। ভারত-বাংলাদেশের খেলায় আমি আমার নীতি অনুযায়ীই বাংলাদেশের পক্ষ নেবো, কারণ বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় ক্রিকেট জগতে নতুন, ভারতের তুলনায় গরিব এবং দুর্বল।

একবার মনে আছে ভারতের সঙ্গে কোনো এক দলের খেলা হচ্ছিল, আমি ভারতকে নয়, অন্য দলকে সমর্থন করছিলাম, যেহেতু অন্য দলটি ভালো খেলছিল। টুইটারে আমার মত প্রকাশ করতেই উড়ে এলো জাতীয়তাবাদী ভারতীয়রা, পারলে আমাকে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে, নয়তো কান ধরে টেনে নিয়ে বর্ডার পার করে দিয়ে আসে। যদি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের খেলায় বাংলাদেশকে সমর্থন করি, আশা করছি, ভারত আমাকে ততোটা তিরস্কার করবে না। আর তিরস্কার করলেই বা কী! আমি কি পাছে লোকে কিছু বলের ভয়ে কোনওকালেই নিজের মতকে পাল্টেছি নাকি নিজের মতকে কোথাও অপ্রকাশ করেছি!

২. সেদিন, নারী দিবসের দিন, দিল্লির বেঙ্গল এসোসিয়েশন আমাকে সম্বর্ধনা দিল। যেহেতু আমি কোনও অনুষ্ঠানে আজকাল যাই টাই না, ঘরোয়া আড্ডা হবে এই বলে যখন ডাকা হলো, গিয়েছিলাম। কিন্তু দেখলাম তিনশ লোক বসে আছে, সামনে স্টেজ, মাইক। অনেকে কবিতা পড়লেন, গান গাইলেন, বক্তব্য রাখলেন। আমি অল্প কিছু কথা বললাম, দুটো কবিতা পড়লাম। কিন্তু দর্শক শ্রোতা ওটুকুতে সন্তুষ্ট ছিল না, তারা আমার আরও কথা, আরও কবিতা শুনতে চাইছিল। অনুষ্ঠান শেষে হুড়মুড় করে সবাই প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার ওপর, আমার অটোগ্রাফ নেবে, ছবি তুলবে, আমার হাতখানা একটুখানি ছোঁবে। বেশ চমকিত হলাম। সাত বছর পার হয়ে গেছে আমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাড়ানো হয়েছে। কোথাও আমার কোনও লেখা ছাপা হয় না বললেই চলে। পশ্চিমবঙ্গের সরকার আমাকে রাজ্যছাড়া করার সঙ্গে সঙ্গে পত্র পত্রিকাগুলো বন্ধ করে দিয়েছে আমার লেখা ছাপানো, আমার বইএর খবর বা রিভিউ ছাপানো। আমার বই যে বের হয়, বই কেমন হয়, সে খবর কোনও পাঠকই জানতে পারে না। বাংলা মিডিয়ার ব্যবহারে মনে হয়, আমি একজিস্ট করি না। জনপ্রিয় একজন লেখককে রাতারাতি একটা নিষিদ্ধ নামে পরিণত করেছে ওরা। ছোট একটি প্রকাশক, নষ্ট না হওয়া-চরম-বামপন্থী, বই ছাপিয়ে যাচ্ছেন এখনও। যে মানুষটা কোনওদিন কোনও রাজনীতি করলো না, তাকে নিয়ে রাজনীতি কে আগে করবে, কে বেশি করবে, তার প্রতিযোগিতা চলে ভারতবর্ষে। সবারই বিশ্বাস, আমাকে যে বেশি লাথি মারতে পারবে, আমার প্রতি ঘৃণা যে বেশি প্রকাশ করতে পারবে, সে-ই সংখ্যালঘুর ভোট পাবে বেশি। দেখে হাসি পায়, দুঃখও লাগে। তবে আটই মার্চের ওই অনুষ্ঠানটায় গিয়ে আমার মনে হয়েছে, বাঙালির মন থেকে এখনও আমাকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে পারেনি বাংলার সরকার এবং মিডিয়া জগৎ। এখনও মানুষ মনে রেখেছে আমাকে, এখনও তারা আমার বই পড়ে।

৩. আমি নারীবাদী লেখিকা। লোকে এ কারণেই ভেবে নেয় আমি রান্না করতে জানি না। নারীবাদের সঙ্গে রান্না না করার সম্পর্ক ঠিক কী, আমি জানি না। আমি নিজে বাজার করি, নিজে রান্না করি, বাগান করি, ঘর সাজাই। এগুলো করতে আমি খুব পছন্দ করি। আমি খুব নরম স্বরে কথা বলি, সদা হাস্যোজ্জ্বল, কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করি না, অতি উদার, অতি অতিথি পরায়ণ। এগুলো নাকি নারীবাদের সঙ্গে যায় না। আমাকে নাকি চিৎকার করতে হবে, গালাগালি করতে হবে, বর্বর পুরুষ দেখলে কিছু কিল ঘুসি লাগাতে হবে। সেদিন নারী দিবসের অনুষ্ঠানেও দেখলাম অনেকে বলছিল, ভেবেছিলাম কিছু কড়া কথা বলবেন। কিন্তু আমি যে গলা নামিয়ে, শান্ত কণ্ঠে, কড়া কথা বলতে পারি, তা অনেকে বুঝতে পারে না। কড়া কথা, উচিত কথা, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা–এসবের জন্য গলার স্বর সপ্তমে চড়ানোর আসলে দরকার পড়ে না।

তা যা বলছিলাম, রান্না। বন্ধুদের জন্য রান্না করতে, বন্ধুদের খাওয়াতে আমি খুব ভালোবাসি। প্রচুর মাছ টাছ রান্না করি। কিছুকাল হলো লক্ষ করছি, বন্ধুরা সবাই খুব কম খায়। সেদিন বাংলাদেশ থেকে আমার সঙ্গে দেখা করতে ছোটভাইমতো একজন এসেছিলো। অনেক কিছু রান্না করেছিলাম, চিংড়ি, পাবদা, ভেটকি, ইলিশ, পার্সে। খেলোনা প্রায় কিছুই। ভাত তো আজকাল কেউ এক চামচের বেশি নিতেই চায় না। কালও কলকাতা থেকে পুরোনো এক বন্ধু এসেছিলো। খাদ্যরসিক হিসেবেই তাকে জানতাম। কলকাতায় যখন ছিলাম, আমার বাড়িতে প্রায় দুপুরবেলায় ও চলে আসতো, তৃপ্তি করে খেতো। কাল দেখলাম ও শুধু মাছের কোনা ভেঙে ভেঙে নিচ্ছে, পুরো মাছটা খাবে না।ভাত তো নেবেই না। জিজ্ঞেস করলাম, ডায়বেটিস হয়েছে কি না। বললো, না। তবে কেন? বললো, পেটটায় যেন মেদ না হয়। পেটের মেদ নিয়ে শুধু মেয়েদের নয়, ছেলেদেরও আজকাল অস্বস্তি। বন্ধুটা বললো, অনেকদিন বাঁচতে চাই, তাই খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি। অনেকদিন বাঁচতে হলে বুঝি খাওয়া কমিয়ে দিতে হয়। লক্ষ করছি, খাবারের মধ্যে ভালো খারাপ না বেছে, খাবারের পরিমাণটা অনেকে কমিয়ে দেয়। পাতে ঘি নিচ্ছে, মাখন খাচ্ছে, পনির খাচ্ছে, মিস্টি খাচ্ছে, চায়ে চিনি খাচ্ছে কিন্তু ভাতটা খাচ্ছে না, ভাতে নাকি ক্যালোরি বেশি। নিরীহ শাক সবজি আর মাছ খেতেও অনেকের ভয়। আজকাল স্বাস্থ্য সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বাড়ছে। পার্কে, জিমে লোকের ভিড়। সবাই বেশিদিন বাঁচতে চায়। এদিকে আমি সেদিন আমার ট্রেডমিলটা দিয়ে দিলাম আমার এক বন্ধুকে। সে লুফে নিলো। আমার ব্যায়াম ট্যায়াম করতে ভালো লাগে না। আমি কি বেশিদিন বাঁচতে চাই না! চাই তবে নিজেকে কষ্ট দিয়ে নয়। মাঝে মাঝে সাইকেল চালাতে ইচ্ছে করলে চালাই বা সাঁতার কাটতে ইচ্ছে করলে কাটি। আর বায়ু যদি দুষিত না থাকে, চমৎকার যদি আবহাওয়া, মনটাও ফুরফুরে, তাহলে হাঁটতে ভালো লাগে, হাঁটি। যা খেতে ইচ্ছে করে খাই। শুধু দেশি খাবার নয়। পৃথিবীর নানা দেশে, নানা শহরে আর গ্রামে, লোকাল খাবার খাওয়া আমার শখের মধ্যে পড়ে। কোনওদিন যদি ভ্রমণ কাহিনী লিখি, লিখবো সেসব। স্বাস্থ্যকর খাবারের মধ্যেও হাজারো সুস্বাদু খাবার আছে। আমি মাছ ভেজে নিয়ে রান্না করি না। অতি স্বাস্থ্য-সচেতন বাঙালিরা আবার মাছ না ভেজে রান্না করলে মাছই মুখে দেয় না। খুব তেল মশলার খাবার না হলে তাদের মুখে রোচে না। আমার অল্প তেলের অল্প মশলার রান্নাকে বাঙালিরা বলে, তেলমশলা ছাড়া রান্না। ভারতের অবাঙালিরা বলে, সাদা খানা। অনেকে আমাকে বলেছে, রান্নার একটা বই লিখতে। অনেক বড় বড় লেখক রান্নার বই লিখেছেন। কিন্তু আমি জানি, আমার পক্ষে রান্নার বই লেখা সম্ভব হবে না। কারণ আমি রান্নার কোনও রেসিপি মানি না। কী করে রান্না করতে হয়। তা কোনওদিন শিখিনি। আমার রান্নাগুলো একধরনের এক্সপেরিমেন্ট। একদিন আমার রান্নার গল্প শোনাবো।

৪. স্বার্থপর মানুষের সংখ্যা খুব বেড়ে যাচ্ছে. নিষ্ঠুর, নির্দয়, হিংসুক, ঠগ, মিথ্যুক, লোভী লোকের সংখ্যা বাড়ছে সমাজে. আমি বলতে চাইছি না, আগে সব ভালো ছিল, এখন সব খারাপ. ভালো খারাপ সব সময়েই থাকে। তবে এটা কি ঠিক নয়। যে কিছুকাল আগেও মানুষ মানুষের সাহায্যে, এখন যত আসে, তার চেয়েও বেশি এগিয়ে আসত। এখন মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, হাত গুটিয়ে নেওয়ার মানুষই চারদিকে মনে হচ্ছে বেশি। ধনী দেশগুলোয় একে অপরকে সহযোগিতা করার, আমি দেখেছি, প্রবণতাটা এখনো আছে, গরিব দেশে মনে হয় ঘৃণাটা, নৃশংসতাটা বেশি। এক দেশে সবাই ধনী হলে সম্ভবত উদার হওয়ার সম্ভাবনাটা বাড়ে। আর কেউ কেউ ধনী, কেউ কেউ গরিব হলে মুশকিলটা শুরু হয়। টাকা পয়সাটা জীবনে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে। ধনী তার ধন কামড়ে রাখে, ধনী হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে গরিবেরা। গরিব দেশে এখন বোধ হয় মানুষ মানুষকে আর সাহায্য করে না, সাহায্য করার জন্য এনজিও ভাড়া করা হয়। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তাঁর মুভেবল ফিস্টএ লিখেছেন, তখন আমরা খুব গরিব ছিলাম এবং খুব সুখে ছিলাম। কজন আজকাল এমন কথা লেখে। আমি কিন্তু দারিদ্রকে গ্লোরিফাই করছি না। শুধু বলতে চাইছি ওপরে ওঠার সিঁড়ি বলতে কি শুধু ধনী হওয়ার সিঁড়িই বুঝব! আমাদের বাবা মারা বলতেন, টাকা পয়সা বড় নয়, লেখাপড়াটা বড়, জ্ঞানটা বড়, সততাটা বড়। আজকালকার বাবা মারা কি এমন কথা বলেন? আমাদের বাবা মারা, অনেকে হয়ত বলবে, বোকা ছিলেন। আমার কিন্তু মনে হয় না।

টুকরো ভাবনা

১.

আমরা ব্যারিকেড দিয়ে, কাঁটাতার লাগিয়ে, দেয়াল তুলে ভাগ করে দিই মাটি, ভাগ। করি মানুষ। এক ভূমিকম্পই আসে আমাদের বুঝিয়ে দিতে যে আসলে আমরা এক মাটির মানুষ।

মানুষ যে কত অসহায় প্রাণী, তা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময় সবচেয়ে বেশি বোঝা যায়। বুলড্রেজার যেমন পিঁপড়ের ঢিবিকে পিষে যাওয়ার সময় লক্ষ পিঁপড়েকে মেরে ফেলে, ভূমিকম্পও মানুষকে তেমন পিঁপড়ের মতোমারে। নেপালের ভূমিকম্পে আপাতত ৫ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে,সংখ্যাটা নাকি বেড়ে ১০,০০০ অবধি যেতে পারে।

এই একবিংশ শতাব্দীতে, এই বিজ্ঞানের যুগেও মানুষ প্রকৃতিক বিপর্যয়গুলো ঈশ্বর প্রদত্ত বলে মনে করে। ধ্বসের ভেতর থেকে কেউ বেঁচে বেরোলে বলা হয় এ নাকি ঈশ্বরের মহানুভবতা। সেই একই ঈশ্বর যে ভূমিকম্প দিলো, হাজারো প্রাণ নিয়ে নিলো, হাজারো নিষ্পাপ শিশুর প্রাণ, সে কারণে ঈশ্বরকে দোষ দেওয়া হয় না কেন আমি বুঝি না। গির্জায় প্রার্থনা হচ্ছে। মন্দিরে মন্দিরে দুগর্তদের জন্য পুজোর আয়েজন হচ্ছে। গ্যালন গ্যালন দুধ ঢালা হচ্ছে পুজোয়। দুধ যদি নেপালের শিশুদের দেওয়া হতো, যদি পুজোর বদলে টাকা পয়সা পাঠিয়ে দেওয়া হতো ভূমিকম্প আক্রান্তদের, তবে সত্যিকার লাভ হতো। এইসব প্রার্থনা তো, বারবার প্রমাণিত হয়েছে, যে, চরমভাবে ব্যর্থ।

ভূমিকম্প, শুনেছি, অনেকে নাকি টের পায় না। ভূমিকম্প হয়েছে, আর আমি টের পাইনি, খুব কমই ঘটেছে। টের পাওয়াটা একেক জনের বেলায় একেক রকম। কিছু লোক আছে আবার বেশি টের পায়। ভূমিকম্প না হলেও বলে, ভূমিকম্প। ছোটবেলায় আমার বাবা শিখিয়েছিলেন, ভূমিকম্প হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে, খোলা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে, ভূমিকম্প মানুষকে মারে না, মারে ঘরবাড়ির ধ্বস।

বাবার কথাটা প্রতিবারই স্মরণ করি, যখন ভূমিকম্প হয়। কিন্তু দৌড়ে ঘর থেকে একবারও আমার বেরোনো হয় না। ঘরেই হাঁটাহাঁটি করি আর ভাবি, শুধু শুধু দৌড়োদৌড়ির কী দরকার, এই তো কম্পন থেমে যাচ্ছে বা যাবে। ভূমিকম্প কোনও ক্ষতি করতে পারবে না, এমনভাবে দালানকোঠা বানানো হচ্ছে আজকাল। অবশ্য বানানো হচ্ছে ধনী দেশে। গরিব দেশ ওসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। যেন তেন ভাবে মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেই হলো। সে কারণে ধনী দেশে বড় ভূমিকম্প হলেও মানুষ বেঁচে যায়, আর গরিব দেশের ছোট ভূমিকম্পও মানুষকে রেহাই দেয় না। ঠিক এভাবেই বন্যা হলে গরিব দেশে লোক মরে, ধনী দেশ দিব্যি সামলে নেয়। অর্থনৈতিক দারিদ্রই যে সব কিছুর মূলে, তা নয়। চিন্তার দারিদ্র, সতোর দারিদ্রও বড় কারণ। গরিব দেশের মানুষকে গরিব-ধনী কোনও দেশই মূল্যবান বলে মনে করে না! মৃত্যু নিয়ে যারা রাজনীতি করে, তারা মৃত্যু রোধ করতে চায় না।

নাহ, এরপর ভূমিকম্প হলে ঠিক ঠিক ঘর থেকে বেরিয়ে যাবো। খোলা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবো। বাবা যেভাবে শিখিয়েছিলেন। আলসেমি করবো না। অপেক্ষা করবো না। জীবন তো একটাই। জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কী আছে। একে হেলায় হারানোর কোনও মানে নেই। যদি খোলা জায়গায় দাঁড়াবার পর দেখি ভূমিকম্প থেমে গেছে! যাক না। আক্ষেপ করার কী আছে! আমাদের কি খুব বেশি খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে খোলা আকাশ দেখার সুযোগ হয়? মাঝে মাঝে ভূমিকম্প এসে যদি সেই সুযোগটা করে দেয়, মন্দ কী!

ছোটবেলায় আমরা একতলা বাড়িতে থেকেছি। দরজাগুলো হাট করে খোলাই থাকতো বেশির ভাগ সময়। দৌড়ে বাইরে বেরোতে সময় লাগতো না। আজকাল উঁচু উঁচু দালানে বাস করে মানুষ। লিফট ব্যবহার করা যাবে না। হেঁটে হেঁটে তেইশ তলা বা বারো তলা থেকে নামা চাট্টিখানি কথা নয়। এখন তো বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঘরেই মুখ মাথা ঢেকে টেবিলের তলায় চলে যাও, কাঁচের জিনিসপত্তর থেকে দূরে থাকো। অথবা শক্ত দুদেয়ালের কর্নারে দাঁড়িয়ে থাকার। কী জানি, এসবে কতটুকু শেষ পর্যন্ত প্রাণ রক্ষা হয়। এ অনেকটা উড়োজাহাজের আশ্বাসের মতো, দুর্ঘটনা ঘটলে অক্সিজেন মাস্ক পরো, লাইফ জ্যাকেট পরে লাফ দাও, ওই করে কজন লোক আসলে বাঁচে! টেবিলের তলা একা কি কাউকে বাঁচায়, তলায় যেতে হয় মাথায় হেলমেট পরে যাওয়াই হয়তো ভালো, কষ্টেসৃষ্টে মাথাটা বাঁচাতে পারলে, আর খুব অতলে তলিয়ে না গেলে বাঁচার সম্ভাবনাটা হয়তো কিছুটা থাকে। মানুষের জীবন আরশোলাদের জীবনের চেয়েও নড়বড়ে। ভূমিকম্প ঢুমিকম্প কোনও আরশোলাকে এতটুকু কাঁপাতে পারে না।

২.

শুনেছি ভোট কারচুপি হয়েছে বাংলাদেশে। কারচুপি হলেই বা কী হলেই বা কী? সেই তো থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়। যেই বসুক গদিতে, দেশটাকে নষ্ট করা ছাড়া কি তাদের আর কোনও কাজ আছে? মানুষও ঠিক জানে সব দলের চরিত্র এক। মানুষ আসলে ভোট দেয় তাকে যার চরিত্র কিছু কম নষ্ট, যে কিছুটা কম সন্ত্রাসী। আর যারা এর মধ্যে সন্ত্রাসে বেশ হাত পাকিয়েছে, তারা খুব স্বাভাবিকভাবেই সন্ত্রাসে বেশি মদত দেওয়া দলটিকে জেতাতে চায়।

ভোট টোটের নিয়ম বন্ধ করে দিলেই হয়। অ্যানার্কি সৃষ্টি হবে? অ্যানাকি কি চলছে না?একটা সময় দেশের নড়বড়ে অবস্থা দেখে বলতাম, কামাল পাশার মতো একটা সেকুলার ডিক্টেটর চাই। এখন আর বলি না। গণতন্ত্রের বারোটা বেজেছে বলে তো ডিক্টেটরশিপ চাইতে পারি না। তারচেয়ে গণতন্ত্রের নামে দেশে যা হচ্ছে হোক। দেশটা গোল্লায় যাবে, নয়তো ধর্মতন্ত্র দেশটাকে একদিন গিলে খাবে। ধর্মতন্ত্রই দেশকে নিয়ে যাবে একনায়কতন্ত্রের দিকে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষ রুখে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে আছে যুগের পর যুগ। এভাবেই বাস করে অভ্যেস হয়ে গেছে। তারা রুখে তো দাঁড়ায়ই না, দেয়ালে পিঠ না থাকলেই বরং বিস্মিত হয়।

৩.

অসুখ হলে মা বাবার জন্য বড় ব্যাকুল হই। আজ সারাদিন জ্বর, গাব্যথা, বমি। সারাদিন চেয়েছি একটি হাত কপাল স্পর্শ করুক। জ্বর দেখুক। জ্বরের ঘোরে বারবার এপাশ ওপাশ করেছি। জ্বর হলে মা কপালে জলপট্টি লাগিয়ে দিত। খাটের কিনারে মাথাটা রেখে, পিঠ আর মাথার তলায় একটা অয়েলক্লথ বিছিয়ে অনেকক্ষণ মাথায় জল ঢালত। জল গুলো বালতিতে পড়ত, সেই বালতির জল আবার মাথায় ঢালত, এইভাবে কতক্ষণ যে মা জল ঢালত! মার কোনো ক্লান্তি ছিল না! জ্বর হলে পাশে বসে গায়ে হাত বুলিয়ে দিত বাবা আর ওষুধ গেলাত। জ্বর হলে আমি উদ্বিগ্ন হইনি কখনো, হয়েছে আমার মা বাবা। আমার অসুখ দ্রুত সারিয়ে তুলত আমার মা বাবা। এখন মা নেই, বাবাও নেই। এখন একা একাই অসুখে ভুগি। কেউ নেই কপাল স্পর্শ করে জ্বর দেখার, গায়ে হাত বুলোবার, কেউ নেই কপালে জলপট্টি দেওয়ার, কেউ নেই মাথায় জল ঢালার। ছোটবেলাটা বড় ফিরে পেতে ইচ্ছে করে।

ডেঙ্গি

তিন বছর আগে ডেঙ্গি হয়েছিল আমার। যে বাড়িতে ছিলাম, সে বাড়ির ছজন মানুষের সেবার ডেঙ্গি হয়েছিল। ডেঙ্গি নিয়ে যারা গবেষণা করছে তাদের টিকিটি দেখিনি ও বাড়িতে। গবেষণা করছিস, একটা বাড়িতে ছজনের কেন ডেঙ্গি হলো তা বুঝতে ও বাড়িতে আসবি না? আমি টুইটারে জানিয়েছিলাম ঘটনা। কারও কোনও হেলদোল দেখিনি।

ডেঙ্গি কিন্তু একা আসে না, সঙ্গে আরও রোগশোক নিয়ে আসে। আমার কাছে এসেছিল টাইফয়েডকে সঙ্গী করে। সেবার অরগান নষ্ট করতো ডেঙ্গি ভাইরাস। ডেঙ্গি এক একবার এক এক ক্ষমতা নিয়ে আসে। আমার প্যানক্রিয়াস আর লিভার নষ্ট করেছে। প্যানক্রিয়াস নষ্ট করেছে বলে ডায়বেটিস হয়েছে। ডায়বেটিসের মতো জঘন্য রোগ খুব কমই আছে।

দ্বিতীয়বার ডেঙ্গি হলে সর্বনাশ। আমার মস্তিষ্ক, হৃদপিণ্ড আর ফুসফুস অকেজো করবে। নির্ঘাত মারা পড়ব। হাজার হাজার জিহাদি আমাকে মারতে পারলো না। আর ছোট্ট এক ফোঁটা মশা কিনা আমাকে মেরে ফেলছে! স্টিভ আরউইনের মতো। শত শত বিষাক্ত রেপটাইল তাকে মারতে পারলো না, মারলো একটা মাছ, স্টিংরে নাম।

তাইপেই

ইউরোপ-আমেরিকার কবিতা উৎসব, সাহিত্য অনুষ্ঠান, নারীবাদ-মানববাদ মানবাধিকার- ইত্যাদি অনুষ্ঠানে আজ ২২ বছর যাবৎ পারটিসেপিট করছি। কিন্তু অন্য কোথাও যদি যাই, অন্য রকম দেশে? একবার আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হলো তাইপেই কবিতা উৎসবে। তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেই। কবিতা উৎসবের বিশাল মঞ্চে কবিতা পড়লাম। ওখানেই শেষ নয়, পরদিন এবং তার পরদিন আমাকে আরও আরও জায়গায় আরও আরও বিষয় নিয়ে বলতে হয়েছে। তাইপেই বিশ্ববিদ্যালয়। থেকেও আমন্ত্রণ, ওখানে কবিতা পড়তে হবে, সাহিত্য নিয়ে বলতে হবে, নানারকম জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে হবে। তাইওয়ানিজ সঞ্চালক ছিলেন, একজন দোভাষী ছিলেন। ওখানেও, আমি অবাক হই, একজন শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই হবেন, আমাকে নিয়ে তাঁর বইয়ে লিখেছেন, কবিতাও লিখেছিলেন আমাকে নিয়ে,বই আর কবিতা দুটোই সেদিন দিলেন হাতে।

উৎসবের আয়োজকরা অসাধারণ লোক। একজন তো নিজেই ফিল্ম মেকার। ওঁরাই আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন হাউ সিয়াও সিয়েনএর ছবি দেখার জন্য। দোকানে নিয়ে কিনেও দিয়েছিলেন এক সেট ডিভিড়ি। হাউএর ছবি দেখার পর থেকে হাউ আমার প্রিয় পরিচালকদের তালিকায় পাঁচজনের একজন হয়ে উঠেছেন। তাইপেই ছেড়ে আসার আগের রাতে অ্যাং লীর নতুন ছবি রিলিজ হয়েছিল, সেটা দেখলাম। লাস্ট, কশন। অ্যাং লী তো আমার প্রিয় পরিচালকদের মধ্য অন্যতম একজন। তাঁর ব্রোকবেক মাউন্টেন যে কতবার দেখেছি। যতবারই দেখি, চোখ জলে ভরে ওঠে। অ্যাং লীর নিজের শহর তাইপেইয়ে বসে তাইপেইয়ের সিনেমায় অ্যাং লীর ছবি দেখার আনন্দই আলাদা। লাস্ট কশন ছবিটাও অসাধারণ। গভীর রাতে হোটেলে ফিরেছি। সারারাত কি ঘুম হয়েছিল! কী জানি!

ছবিটা আমার বডিগার্ডকেও দেখিয়েছি। ওর নামটা এখন মনে নেই। ভীষণ সিরিয়াস মুখ। সবসময় একটা ব্যাগ রাখতো হাতে, ওই ব্যাগেই হয়তো রিভলভার টিভলভার ছিল। তাকে প্রথমদিন সঙ্গে বসে লাঞ্চ খেতে বললাম, কিছুতেই রাজি হলো না। রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে রইলো, বললো, আমার ডিউটি তোমাকে প্রটেক্ট করা, তোমার সঙ্গে লাঞ্চ খাওয়া নয়। প্রথম দিকে ভয়ে নীল হয়ে ছিলো মেয়ে, আমি বলেছি রিলাক্স, এখানে কেউ আমাকে মারবে না, তোমার টেনশনের কিছু নেই। ধীরে ধীরে বোধহয় বুঝেছে যে তাইপেইয়ে আমাকে মারার লোক কেউ নেই। একবার তো সমুদ্রের ধারেও নিয়ে গেলো আমাকে, প্যাগোড়া দেখলাম, মিউজিয়াম টিউজিয়ামেও গিয়েছি। তবে যাবার দিন ও একতোড়ো ফুল নিয়ে এলো আমার জন্য। নিজের নাম ঠিকানার কার্ড দিলো। আর এয়ারপোর্টে যখন আমাকে বিয়ে দিচ্ছে, আশ্চর্য, ওর চোখে জল। তাইপেইয়ের সব স্মৃতি ফিকে হয়ে আসছে, কিন্তু ওই মেয়েটির চোখের জল এখনও হীরের মতো দ্যুতি ছড়ায়। ভুলতে পারি না।

দুর্বৃত্ত

খবরে দেখছি দুর্বৃত্তরা নাকি প্রকাশকদের কুপিয়ে খুন করেছে। মুসলমানদের দুর্বৃত্ত কেন বলছে, বুঝি না। খুনীগুলোর তো একটা পরিচয় আছে, নাকি? খুনীগুলো ধার্মিক, কোরান হাদিস মেনে চলে। ওদের দুর্বৃত্ত বলাটা কি ঠিক হচ্ছে? দুর্বৃত্ত হলে সরকার ঠিক ঠিক ওদের শাস্তির ব্যবস্থা করতো। কিন্তু ধর্মপ্রাণ বলেই করছে না। সরকার নিজেও ধর্মপ্রাণ, দেশের অধিকাংশ মানুষই ধর্মপ্রাণ। ধর্মপ্রাণদের সাতখুন মাফ, এ কথা তো আমরা জানিই।

দেশ ১

কলকাতার দেশ পত্রিকা একসময় ছিল সাহিত্যের পত্রিকা। এখন হয়ে গেছে গুজব, স্ক্যান্ডাল, কাকাতু, নাক সিঁটকানো, খোঁচা মারা, দলবাজি, পুরুষবাজি, মাস্তানি, শয়তানি, মিথ্যে আর অপবাদের পত্রিকা। আর এগুলোর জন্য বেছে নেওয়া হয় স্বয়ং আমাকে। কারণ আমার সম্পর্কে কুৎসা রটালে মার খাবার ভয় নেই, মামলায় ফেঁসে যাওয়ার ডর নেই। সাগরময় ঘোষ মারা যাওয়ার পর একসময় অমিতাভ চৌধুরী নামের এক চরিত্রহীন লোককে দেশ এর সম্পাদক করা হয়েছিল। ওই সম্পাদক আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য একবার ১৯৯৯ সালের শেষের দিকে উন্মাদ হয়ে উঠলেন। কী, না, দেশ পত্রিকা আমার সাক্ষাৎকার ছাপাতে চান, সাক্ষাৎকারটা নেবেন সাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে আমার হোটেলে তিনি এক সকালে চলে এলেন। তাজ বেঙ্গলের লাউজে বসে ব্রেকফাস্ট করতে করতে কথা বলছিলাম। সাক্ষাৎকার চলাকালীন অমিতাভ চৌধুরী শ্যামলকে কনুইয়ের গুতো দিয়ে দিয়ে সেক্স নিয়ে প্রশ্ন করার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন। সেক্স নিয়ে যে প্রশ্নই তাঁরা করছিলেন, আমি খুব নিস্পৃহ নির্লিপ্ত কণ্ঠে সেসবের উত্তর দিচ্ছিলাম। জীবনে কজনের সঙ্গে সেক্স করেছি– ওঁদের ওসব বিদঘুঁটে প্রশ্ন আমাকে লজ্জা দিচ্ছিল না, আমাকে বরং লজ্জা দিচ্ছিল আমার সামনে বসে থাকা ওই দুই বুড়োর জিভ বেরিয়ে আসা, চোখ বেরিয়ে আসা চেহারা। আমার সঙ্গে আমার ফরাসি প্রেমিক ছিল। ও বুঝতে পারছিল না আমরা কী নিয়ে কথা বলছি।

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের নেওয়া অশ্লীল সাক্ষাৎকারটি অমিতাভ চৌধরী দেশ-এ ছাপিয়েছিলেন। যৌনতার বিষয় ছিল বলে ওটিকে অশ্লীল বলছি না। বরং যৌনতাকে অশ্লীল বলে বিচার করা হচ্ছিল বলে ওটিকে অশ্লীল বলছি। একজন নারী, যিনি নারীর স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, এমন কী যৌন স্বাধীনতায়ও, যে যৌন স্বাধীনতার অর্থ যত্র তত্র শুয়ে বেড়ানো নয়, বরং এক অর্থে যত্র তত্র শুয়ে না বেড়ানো, এবং যৌনসম্পর্কে হ্যাঁ বলার মতো না বলারও স্বাধীনতা–জেনেও তাকে লোকসমক্ষে একটা বিকট যৌন রাক্ষুসী রূপে দেখানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন দেশএর সম্পাদক। সাগরময় ঘোষের সঙ্গে রুচিতে যাঁর এক পাহাড় সমান ফারাক।

এরপর লোকটি ফের পরের বছর আমি কলকাতায় পৌঁছলেই উন্মাদ হয়ে উঠলেন। আমার সঙ্গে নাকি ভীষণ জরুরি কথা আছে। তাজ বেঙ্গলের এক বারে এক সন্ধ্যাবেলায় দেখা করতে চাইলেন। আমি কলকাতায় ওই হোটেলেই উঠেছিলাম। বারে গিয়ে দেখি তিনি হুইস্কি অর্ডার দিচ্ছেন দুজনের জন্য। না, আমি তো হুইস্কি খাবো না। তিনি পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। আমি বললাম, খেলে বড় জোর একটা কোক খাবো। শুনে তিনি চুপসে গেলেন। এরপর ইনিয়ে বিনিয়ে শুরু করলেন সেক্স প্রসঙ্গ। আমি প্রসঙ্গ পাল্টে অন্য কথা বলি। দেশ টেশ নিয়ে। তিনি সেক্স ছাড়া আর কিছুতে উৎসাহী নয় বুঝে, গ্লাসের কোকটুকু খেয়ে আমার বাবা এসেছেন দেশ থেকে, তিনি রুমে একা আছেন বলে উঠে যাই। তিনি চুপসে বসে থাকেন। তিনি ভেবেছিলেন আমি যৌন স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি, সুতরাং তিনি আমার সঙ্গে যৌনতা নিয়ে কথা বললে আমি মহা উৎসাহে শুনে যাবো। এই না শুনতে চাওয়াটা যে যৌন স্বাধীনতার মতোই আমার মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সেটুকু বুঝতে ম্যাগসেসাই পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিকমশাই পারেননি।

এরপরই দেশ পত্রিকায় অমিতাভ চৌধুরী ছাপিয়েছিলেন আমার বিরুদ্ধে লেখা সমরেশ মজুমদারের কুৎসারচনা, যে কুৎসারচনায় আমার সম্পর্কে লেখা তাঁর প্রতিটি বর্ণ মিথ্যে। এই মজুমদারকে আজ থেকে চব্বিশ বছর আগে, যখন তাঁকে বেশি লোকে চেনে না, আমার প্রকাশকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। ওঁর বই ছাপানোর জন্য অনুরোধ করেছিলাম। বাংলাদেশে আমি তখন জনপ্রিয় লেখক, আমার অনুরোধ রেখেছিলেন প্রকাশকরা। উপকারীর উপকার স্বীকার না করে মজুমদার আমার কুৎসা রটিয়েছিলেন, যে মিথ্যে বা কুৎসা অমিতাভ চৌধুরী অত্যন্ত যত্ন নিয়ে ছাপিয়েছিলেন, ২০০০ সালের ১০ জুন তারিখে। ওই সময়টায় কলকাতাও আমাকে ভীষণ ভালোবাসছে। অনেক বছর পর ভারতের ভিসা পেয়ে ইউরোপ থেকে কলকাতায় ছুটে গিয়েছি। কলকাতা বইমেলায় আমাকে দেখার জন্য, আমার অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য ভিড় উপচে পড়ছে। পুলিশকে লাঠিচার্য করতে হচ্ছে ভিড় সামাল দিতে। এসব দৃশ্য কলকাতার অনেক লেখকদের বড় পীড়া দিয়েছিল। মজুমদার সেই লেখকদের মধ্যে একজন। তাছাড়াও বাংলাদেশে তিনি দ্রুত জনপ্রিয় হতে চেয়েছিলেন, যত বই বিক্রি হচ্ছে, চাইছিলেন তার চেয়েও বেশি বিক্রি হোক। তিনি টের পেয়েছিলেন, বাংলাদেশের নারীবিরোধী মুসলিম সমাজ তসলিমবিদ্বেষী আর দেশ পত্রিকা বাংলাদেশের লোকরাও পড়ে সুতরাং এই পত্রিকাটিতে তিনি যদি আমার কুৎসা রটান, তবে পশ্চিমবঙ্গে আমার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়বে, বাংলাদেশে আমার নিন্দুক হিসেবে তাঁর সমাদরও বেশ হবে।

এরপর জানি না আর কোন কোন নিবন্ধ প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল আমার চরিত্র হনন করে। তবে কিছু না ছাপা হলেও ঈর্ষান্বিত তসলিমবিদ্বেষী লেখককুল দেশ পত্রিকায় তসলিমার লেখা বন্ধ করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে তসলিমার বই বেরোলে ইভেন নট এ সিঙ্গল ওয়ার্ড সে বই নিয়ে, এই কর্তব্যটি দেশ পত্রিকা সুষ্ঠুভাবে অনেকগুলো বছর পালন করে গেছে। আমাকে পাঠকের মন থেকে ভুলিয়ে দিতে চাইছে, ভালো কথা, তবে আমাকে কেন নিজেরাই তোমরা ভুলতে পারছে না হে? এই সেদিন, ১৭ ফেব্রুয়ারিতে, আমার বিরুদ্ধে বাদল বসুর করা এক গাদা কুৎসা ছাপিয়েছে। তারপর ১৭ মার্চে আবারও ছাপিয়েছো মিথ্যে-নির্ভর কুৎসা। দেশ এর এমনই মন্দা চলছে যে ছোটলোকদের দিয়ে গুজব লিখিয়ে তা বিক্রি করতে হয়? কলকাতার পাঁড় মাতালরা অন্য একজনকে মাতাল বলে গালি দিচ্ছে, বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ সাহিত্য পত্রিকায় তা অত্যন্ত গুরুত্বসহ ছাপা হচ্ছে। আমি কবে মদ খেয়েছি, কবে মদ খেয়ে মাতাল হয়েছি, রাত কটার সময় ঘরে ফিরেছি, ভেতর থেকে কে আমাকে গালি দিয়েছে — এসব লিখে নারীবিদ্বেষী ছোটলোকেরা এক নারীবাদী লেখককে চাইছেন যেন পাঠকসমাজে সে তার সম্মান হারায়।

মজুমদার আর বসু নিচুমনের নিচুমানের লোক। কিন্তু দেশ কেন এত নিচে নামলো?

দৈনন্দিন জীবন

১. দিল্লিতে বিধানসভা নির্বাচনের হৈ চৈ চলছে। কংগ্রেস মনে হচ্ছে ভারতের রাজনীতি থেকে এখন অনেকটাই আউট। এত শীঘ্র এত বড় দলের এই হাল হয়েছে, কল্পনা করা মুশকিল। প্রতিযোগিতা চলছে ভারতীয় জনতা পার্টি আর আম আদমি পার্টির মধ্যে। কিরণ বেদি আর অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সঙ্গে। কিরণ বেদি অবসরপ্রাপ্ত পুরস্কারপ্রাপ্ত পুলিশ। দুর্নীতিবিরোধী আন্না হাজারের সঙ্গে বসে আন্দোলন করেছিলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে। টিভির বিতর্কে ন্যায় নীতি নিয়ে প্রায়ই বলতে আসেন। একসময় মোদি আর বিজিপির বিরুদ্ধে বলেছেন। তাঁর বিজেপিতে প্রবেশ বেশ চমকে দিয়েছে অনেককে। বিজিপির অঢেল ক্ষমতা এখন। টাকা পয়সা, কর্পোরেট, মিডিয়া সবই বিজেপির হাতের মুঠোয় এখন। শেষ পর্যন্ত কিরণ বেদিও কি ক্ষমতার লোভ করলেন? অরবিন্দ কেজরিওয়ালও ছিলেন নীতি আদর্শের লোক। মূলত কংগ্রেসের দুর্নীতির বিরুদ্ধেই তিনি পথে নেমেছিলেন। গতবার জিতেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীনই সরকার বিরোধী ধর্না দিয়েছেন। একসময় আবেগের আতিসয্যে দলবলসহ ছেড়েই দিয়েছিলেন দিল্লির মসনদ। গোপন খায়েস ছিল প্রধানমন্ত্রী হওয়ার। সেই থেকে অরবিন্দ কেজরিওয়াল তাঁর জনপ্রিয়তা হারান। একসময় প্রচণ্ড জনপ্রিয় ছিলেন তিনি দিল্লিতে। এখন তাঁর আর আগের সেই জনপ্রিয়তা নেই। অনেকে বড় বড় নেতা আম আদমি পার্টি ছেড়ে চলেও গেছে। কে জিতবেন? কিরণ বেদি নাকি অরবিন্দ কেজরিওয়াল? আমার মনে হয় কিরণ বেদিই জিতবেন। কারণ কেজরিওয়ালের ওপর থেকে মানুষের আস্থা আসলেই কমে গেছে। আর দিল্লির জন্য কাজ করতে হলে একই দলের সরকার থাকলে সুবিধে হয়, এ কথা মানুষ জানে। কেজরিওয়াল লোক ভাল হতে পারে, তবে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি আপিসে সময় না কাটিয়ে রাস্তায় সরকারের বিরুদ্ধে ধর্না দিয়ে কাটাবেন বলেই অনেকে আশংকা করছে।

২. ওবামা আসছেন দিল্লিতে রিপাবলিক দিবস পালন করতে। সেদিন দিল্লির আকাশে কোনও উড়োজাহাজ উড়বে না। কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এদিকে যুক্তরাজ্য বলেছে, ভারত সাবধান, আইসিস ভারতে আসছে। আইসিসের আলামত ইতিমধ্যে ভারতে পাওয়া গেছে। সিরিয়া থেকে কিছু ভারতীয় মুসলমান মানুষ মারার ট্রেনিং নিয়ে ফিরে এসেছে ভারতে। ওরা নিশ্চয়ই বসে বসে আঙুল চুষবে না। আইসিসের মনে হচ্ছে শুধু ইরাক আর সিরিয়ায় বসে থাকার কোনও ইচ্ছে নেই। বিশ্ব জয় করার জন্যও বেরিয়ে পড়বে। জঙ্গী প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর আইসিস সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হবে। আমার ইদানীং আশংকা হচ্ছে যে, আমাকে এরা জবাই করবে কোনও একদিন। আমি তাদের পুরোনো শত্রু। টুইটারে আল কায়দা আর আইসিস দুদলই আমাকে লিখেছে জবাই হওয়ার জন্য আমি যেন তৈরি থাকি। টুইটার ফেসবুকেই এদের যোগাযোগের মাধ্যম। এরা তীরের আগায় হুমকি বেঁধে বাড়ি বাড়ি ছোঁড়ে না।

ভারতে থাকাটা আমার জন্য নিরাপদ নয় জানি। কিন্তু কোনও নিরাপদ দেশে, ইওরোপ বা আমেরিকায় আমার পক্ষে বাস করাও সম্ভব নয়। সোজা কথা, খরচ পোষাতে পারবো না। কিন্তু ভারতে যদিও আমার নিরাপত্তা রক্ষী প্রচুর, তবুও ভয় হয়। এখানকার নিরাপত্তা রক্ষী তো পাশ্চাত্যের নিরাপত্তা রক্ষীদের মতো নিরাপত্তা দেওয়ায় দক্ষ নয়। মাঝে মাঝে মনে হয়, যদি মারেই আমাকে, যেন মাথায় গুলি করে মারে। ছুরি দিয়ে গলা কাটবে, ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। না, ছুরি আমার একেবারেই পছন্দ নয়। দুজন জাপানি লোককে দুপাশে বসিয়ে ছুরি হাতে নিয়ে আইসিসের খুনীরা সেদিন দুশ মিলিয়ন ডলার চেয়েছে জাপান সরকারের কাছে। জাপান সরকার জানিয়ে দিয়েছে সন্ত্রাসের জন্য তারা কোনও টাকা দেবে না। অতএব, সন্ত্রাসীরা জাপানি লোকদুটোকে জবাই করবে। জবাই করবে আর আল্লাহু আকবর বলে চিৎকার করবে।

যে মুসলমানরা ইসলামকে শান্তির ধর্ম বলে প্রচার করে, তারা কজন আইসিসের হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ করে, আমার খুব জানার ইচ্ছে।

৩. আমার বেড়ালটার জন্য দেশের বাইরে কোথাও যেতে গেলে আমার সাতবার ভাবতে হয়। যাওয়ার ইচ্ছেগুলোকে বিদেয় করে দিই। না গেলেই নয় এমন কিছুতেই শুধু যাই। নারীবাদ, মানববাদ ইত্যাদি বিষয়ে বলার জন্য যেতে হয়। তখন আমার বেড়ালটাকে দেখাশোনার ভার কাজের লোক, চেনা লোক, পরিচিত লোক, বন্ধু লোক– এদের হাতে দিয়ে যেতে হয়। ভারতে খুব কম লোককে পেয়েছি যারা বেড়াল ভালোবাসে, বা বেড়ালের যত্ন করতে জানে বা একশভাগ ঘরের বেড়ালের জীবন যাপন বোঝে। বাড়িতে কাউকে রেখেই ঠিক শান্তি পাইনি। বাড়ি ফিরে দেখেছি বেড়াল ভুগছে। যারা দেখাশোনার দায়িত্বে ছিল তারা ওকে রাস্তার বেড়ালের সঙ্গে যেমন ব্যবহার করে, তেমন করেছে। আমার বেড়ালের যে টয়লেট অপরিষ্কার থাকা পছন্দ নয়, তার খাবার পানি বদলে বদলে দিতে হয় দিনে দুবার, পছন্দের মাছ হাজির থাকতে হয় চাওয়ার আগেই, ড্রাইফুড তাজা তাজা দিতে হয়, শীতকালে হিটারের পাশে তার কম্বল চাই, গরমকালে নরম বিছানা আর ঠাণ্ডা হাওয়া চাই, নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া পেলে বারান্দায় তার সূর্যস্নান করা চাই, সকাল বিকেল ফুটবল, হাই জাম্প, এসব খেলা চাই, তা কে বুঝবে। এ বেড়াল তো যেন তেন বেড়াল নয়। এ বেড়ালের টুইটার একাউন্ট আছে। রীতিমত জনপ্রিয় বেড়াল। এ বেড়াল নিয়ে বই লেখা হয়েছে, পত্রপত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হয়েছে, চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। আমাকে বিদেশ বিভূঁইয়ে যেতে হলে আমার বেড়াল রাখতে গিয়ে বাড়ি জুড়ে উৎসবের তাণ্ডব চালায় লোকেরা। এ দেশে যারাই আমার কাছাকাছি এসেছে, ঠকাতে বেশির ভাগই খুব ওস্তাদ। আসলে শুরু থেকেই আমার দরজা ছিল সবার জন্য খোলা। যে কেউ আসতো, যে কেউ চাকরি পেতে চাইতো বা বন্ধুত্ব পাতাতে চাইতো, আমার না ছিল না কারো জন্য। অতিথিপরায়ণতা আমার রক্তে। সুতরাং মুগ্ধ হয় সকলেই, জোঁকের মতো সেঁটেও থাকতে চায়। সারাজীবন এই করেছি, ভুল মানুষের সঙ্গে ওঠাবসা করেছি। সঠিক মানুষের সঙ্গে কেন আমার দেখা হয় না, জানি না। বেড়ালটা অনেকটা আমার মানুষ বোঝার লিটমাস। আজও আমি সৎ মানুষের খোঁজে। এ খোঁজা জীবনভর চলবে বলে মনে হয়।

৪. নিউইয়র্কে অসুস্থ ভাই পড়ে আছে। বোনটা তার দেখাশোনা করছে। বোনটা অমানুষিক পরিশ্রম করে। কুড়ি বছর বিদেশে বাস করার পর বলে, দেশেই ভালো ছিল। মানুষ সোনার হরিণের আশায় দেশ ছাড়ে। আমার বোনটা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে, আমার বোন হওয়ার অপরাধে ওর দেশে কোথাও কোনও চাকরি জুটছিল না বলে, দেশে ওকে হুমকি দিচ্ছিল ধর্মের রক্ষকরা। কুড়ি বছর চলে যাওয়ার পর ভুল শোধরানো যায় না। মেয়ে বড় হয়ে গেছে। মেয়ের টানে রয়ে যেতে হয়। আমার বোনই শুধু নয়, হাজারো অভিবাসীর প্রায় একই গল্প। বোনটাকে কোনও সান্ত্বনা আমি দিতে পারি না। জীবন আমাদের ফুরিয়ে যাচ্ছে। কেবল কষ্টে, কেবল সংগ্রামে, কেবল হতাশায়। দুটো তিনটে জীবন হলে স্বস্তি পেতাম। কিন্তু একটাই জীবন। এই একটা জীবনই কাটাতে হচ্ছে জীবনের কোনও রূপ রস গন্ধ আস্বাদন করা ছাড়াই। কে বলে স্বর্গ নরক এই জগতেই! মিথ্যে কথা। এই জগতের বেশির ভাগ অসৎ, ধর্ষক, ঠগবাজ, দুর্নীতিবাজ, খুনী স্বর্গসুখে আছে। যারা সৎ, কর্মঠ, উদার– তাদের বেশির ভাগই ভোগে নরকের যন্ত্রণায়, অভাবে, আর নিরাপত্তাহীনতায়।

বোনের সঙ্গে ইচ্ছে হয় প্রতিদিন কথা বলি। কিন্তু বোন বলে, তার সময় নেই কথা বলার। মন খারাপ হয়ে যায়। আত্মীয় স্বজনহীন জীবন আমি যাপন করছি আজ কুড়ি বছরেরও বেশি। বোনটা তো আমার মায়ের মতো উদার। ও কেন আমার সঙ্গে কথা বলার সময় পায় না! অভিমান হয়। আবার ভাবি, সময় পাবেই বা কী করে! দুদণ্ড সময় ওর নিজের জন্যই নেই। একটি পুরুষতান্ত্রিক পরিবার তো বাংলাদেশ থেকে মানুষ বহন করে নিয়ে যায় বিদেশে, যে পরিবারে গাধার খাটুনি খাটতে হয় মেয়েদের। দেশে থাকলে অন্তত সাহায্য করার কাউকে জুটতো। ওখানে কেউ নেই। স্বামী কাজ করবে, ঘরে ফিরে টিভি দেখবে। স্ত্রী বাইরে কাজ করবে, ঘরে ফিরে ঘরদোর পয়-পরিষ্কার করবে, কাটাবাছা করবে, রান্না করবে, লঞ্জী করবে, বাজার করবে, বাচ্চা লালন পালন করবে, বাচ্চা কুকুরবেড়াল রাখতে চায়, সুতরাং কুকুর বেড়ালের লালন পালনের ভারও স্ত্রীর ওপর। আমার বোনটা স্ত্রীর দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করছে। আরও একটি দায়িত্ব পালন করছে, সেটি হলো স্বামীর চিৎকার চেঁচামেচি দুর্ব্যবহার সওয়া। হাজারো মেয়ের তো একই গল্প। মাঝে মাঝে ভালো লাগে ভাবতে যে, আমার গল্প ওরকম নয়। আমার গল্পে দুঃখ আছে, কিন্তু দুঃখটা অন্যরকম। পুরুষতন্ত্রের অত্যাচার আমাকে বাইরে সইতে হয়, ঘরে নয়। ঘরটা পুরুষতন্ত্র থেকে মুক্ত। ঘরে কোনও পুরুষ নেই। আছি আমি আর আমার বেড়াল। আমার বেড়ালটা কিন্তু মেয়ে বেড়াল।

দ্বিখণ্ডিত

মত প্রকাশের পক্ষে যুদ্ধ করছি অনেককাল। দ্বিখন্ডিতকে নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করেছি। কলকাতার উচ্চ আদালত বলেছে এই বই নিষিদ্ধ করার কোনো কারণ নেই, যে অংশটুকুকে আপত্তিকর বলা হচ্ছে, সে অংশটুকুতে আছে শুধু ইসলামের ইতিহাস আর কোরান হাদিসের উদ্ধৃতি। বই মুক্তি পেয়েছে, কিন্তু তারপরও ইসলামের ইতিহাস এবং মহানবীর জীবন চরিত বই থেকে বাদ দিতে হয়েছে। দুটো পাতা খালি এখনো। আজকের মানবাধিকারের যুগে ইসলামের সাদা সিধে অথেন্টিক কাহিনিগুলোকেই অমানবিক, অনৈতিক, অবিবেচক, অন্যায় বলে মানুষ মনে করে। যারা ইসলামের ইতিহাস জানে না, তারা যদি ইসলামের পন্ডিতদের লেখা সেইসব ইতিহাস আজ পড়ে, তারা ভাববে বইগুলো নিশ্চই ইসলামবিরোধীদের লেখা। বহুবিবাহ, শিশুবিবাহ, ক্রীতদাসপ্রথা, নারীনিগ্রহ ইত্যাদিকে সপ্তম শতাব্দীর মানুষ এবং ইসলামের পন্ডিতরা স্বাভাবিক ভাবলেও একবিংশ শতাব্দীর মানুষ স্বাভাবিক ভাবে না।

ধর্ম আর রাজনীতি

বাংলাদেশে শুনেছি হিন্দুদের পুজোর প্রতিমা নাকি মুসলমানরা ভেঙে ফেলছে। আমি এই বর্বরতার প্রতিবাদ করছি। প্রশ্ন করতে পারেন, আমি নাস্তিক হয়ে হিন্দুদের পুজো আচ্চাকে সমর্থন করছি কেন। না, আমি হিন্দুদের পুজো আচ্চাকে, বা তাদের ধর্মকে সমর্থন করছি না। আমি হিন্দুদের ধর্ম পালন করার অধিকারের পক্ষে দাঁড়াচ্ছি। আমি অন্য সব ধর্মের মানুষের ধর্ম পালনের অধিকারের পক্ষেই দাঁড়াই এবং আমি সবারই ধর্ম পালন না করার অধিকারের পক্ষেও দাঁড়াই। পাকিস্তানে যখন খ্রিস্টানদের গির্জায়। হামলা করে মুসলমানরা, আমি প্রতিবাদ করি। যখন ইহুদিদের সিনেগগ আক্রমণ করে খ্রিস্টানরা বা মুসলমানরা, তার প্রতিবাদ করি। যখন মুসলমানদের মসজিদ উড়িয়ে দেয় ইজরাইল, অথবা মুসলমানরা নিজেরাই, প্রতিবাদ করি আমি। আমি বিশ্বাস করি, নাস্তিকদের যেমন ধর্ম পালন না করার অধিকার আছে, আস্তিকদের তেমন ধর্ম পালন করার অধিকার আছে। যারা ইতিমধ্যে ধর্মের আফিম খেয়ে ফেলেছে, তারা ঘুমোতে চাইলে ঘুমিয়ে থাকুক। ওদের ঘুমে আমি বাধা দেবো না। কিন্তু ধর্মের আফিম যেন নতুন করে আর কেউ খেতে না পারে, তার জন্য চেষ্টা করবো। এই চেষ্টাটা আমি ছুরি বা বন্দুক চালিয়ে করবো না। এই চেষ্টাটা আমি দেশের, সমাজের নিয়ম কানুন পাল্টে করবো, মানুষের মধ্যে শিক্ষা আর সচেতনতা বাড়িয়ে করবো।

ধর্ম এমনই এক জিনিস, এটিকে নামানো ক্ষতি নেই, কিন্তু এটিকে দূর করতে গেলেই গোল বাঁধে। অশিক্ষা আর অজ্ঞানতার কারণে মানুষের ভিতরে একটি অন্ধবিশ্বাসের জন্ম হয়েছে। এই বিশ্বাস কোনও যুক্তি মানে না। মুক্তবুদ্ধিকে পরোয়া করে না। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে যদি বিদেয় না করা হয়, তবে দেশটি হয়ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ থেকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র হতে সময় নেবে না। ধর্ম হল কর্কট রোগের মত, একবার পেয়ে বসলে একের পর এক ধ্বংস করতে থাকে হাতের কাছে যা পায়। তা-ই। এর কোনও নিরাময় নেই। সুস্থতার দিকে কিছুতে মুখ ফেরাতে দেয় না এই রোগ। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের কারণে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ধর্ম বিশ্বাসী মানুষকে অথবা ধর্মে বিশ্বাস না করলেও যারা ওই ধর্মাবলম্বীদের সন্তান, তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকতে হচ্ছে।

| প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীর বিচার করবেন কথা দিয়েছেন, কিন্তু রাষ্ট্রকে ধর্মের কবল থেকে মুক্ত করার তাঁর কোনও ইচ্ছে আছে বলে মনে হয় না। জামাতি ইসলামির সন্ত্রাসীরা মুক্তচিন্তক তরুণ তরুণীদের জবাই করছে, আর ওই কূপমণ্ডুকদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টে দেশের সরকার মুক্তচিন্তকদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন শাস্তি দেবেন বলে।

ধর্ম আর রাজনীতিকে মেশালে ধর্মও নষ্ট হয়, রাজনীতিও নষ্ট হয়। এ দুটোর আলাদা থাকাটা খুবই জরুরি। যে মানুষেরা বিজ্ঞান সম্পর্কে জানতে আলস্য বোধ করে, অথবা বিজ্ঞানকে জানতে গিয়ে দেখেছে রীতিমত কঠিন ব্যাপার এটি, তারা ধর্মে আশ্রয় নেয়, ধর্মে আরাম বোধ করে, যেহেতু ধর্মই সবকিছুর সহজ এবং চমৎকার সমাধান দেয়, ধর্ম সম্পর্কে জানতে কোনও বুদ্ধি খাটাতে হয় না, গভীরভাবে ভাবতে হয় না, কোনও প্রশ্ন করারও দরকার হয় না। যারা ধর্মের মতো অবিজ্ঞান আর নারীবিদ্বেষের একটা পিণ্ডের ভেতর নিজেকে পুরে সুখী হতে চায় হোক। কিন্তু দেশের রাজনীতি এই অবিজ্ঞান আর নারীবিদ্বেষের পিণ্ডের সঙ্গে ভাই পাবে কেন? এ দুটো ভাই পাতালে মানুষের মস্তিষ্ক নষ্ট হয়, পরিবার নষ্ট হয়, সমাজ নষ্ট হয়, দেশ নষ্ট হয়। সব নষ্টদের দখলে চলে যায়। রাজনীতির কাজ দেশের মানুষের দেখভাল করা। ঠিক ঠাক রাজনীতিটা হলে মানুষ সুখে স্বস্তিতে থাকে, অভাব, অনটন দূর হয়, সবার জন্য শিক্ষা স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা হয়, কাজকর্মের সুযোগ ভালো হয়, দুর্নীতি বদনীতির প্রকোপটা কমে যায়। রাজনীতির মধ্যে ধর্মের ছিটে ফোঁটা ঢুকলেই সর্বনাশ। এ দুটোকে আলাদা করতে গিয়েই দেখেছি আমাকে প্রচণ্ড আঘাত করা হচ্ছে। শুধু আমি নই, আরও অনেকেই শিকার হয়েছে এই বীভৎস ধর্মরাজনীতির। ধর্মনির্ভর রাজনীতি সব দেশেই নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। এর একটিই কারণ, ধর্মের সঙ্গে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারীর অধিকার, বাক স্বাধীনতা এসব যায় না। ধর্মের সঙ্গে চিরকালই এসবের বিরোধ।

রাষ্ট্র এবং রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা না করা হলে মানুষের দুর্ভোগের কখনও শেষ হবে না। সৎ এবং সাহসী মানুষদের খুন হয়ে যেতে হবে, পচতে হবে জেলে, নয়তো আমার মতো নির্বাসনে জীবন কাটাতে হবে।

ধর্মের সমালোচনা না করে তুমি সভ্য হতে চাও? এই বিজ্ঞানের যুগে ধর্মের মতো আজগুবি রূপকথাকে সত্য বলে মেনে, স্বঘোষিত সব ঠগবাজ পয়গম্বরকে পথ প্রদর্শক বলে মেনে তুমি কচু সভ্য হবে। তোমার সভ্য হওয়া চুলোয় যাক, ইসলামের আসল চেহারা চোখ খুলে যারা দেখতে পেয়েছে, যারা বেরিয়ে এসেছে, সেই আলোকিত তরুণ তরুণীদের গায়ে যদি আঁচড় লাগে আজ, এর দায় ওই চোখ বন্ধ করে রাখা অন্ধদের চেয়েও বেশি সব বুঝেও না বোঝার ভান করা বুদ্ধিজীবীদের, অদূরদর্শী রাজনীতিকদের আর ক্ষমতার আসনে বসা এক পাল মুই যেন কী হনুরে-দের।

মুসলিম দেশগুলোতে এখনও ইসলামি মৌলবাদি গোষ্ঠী প্রচণ্ড শক্তিশালী। ব্যক্তিগত ভাবে কেউ কেউ প্রতিবাদ করছে বটে, তবে এ প্রতিবাদ যথেষ্ট নয়। যতক্ষণ না রাষ্ট্রশক্তি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার সংগঠন, নারী-সংগঠন একযোগে মুসলিম মেয়েদের সমানাধিকারের ব্যবস্থা না করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সত্যিকার প্রগতির কিছু ঘটবে না। সত্যিকার প্রগতি চাইলে রাষ্ট্র থেকে, সমাজ থেকে, শিক্ষা থেকে, আইন থেকে ধর্মকে দূর করতে হবে। ধর্মও থাকবে, নারী স্বাধীনতাও থাকবে, এ মুখের কল্পনা বিলাস। ধর্ম যেহেতু নারীর স্বাধীনতা এবং অধিকারের বিপক্ষে, তাই ধর্মকে, ধর্মের বৈষম্যকে, ধর্মের আইনকে মাথার ওপরে অক্ষত অবস্থায় রেখে নারীর সমানাধিকার সম্ভব নয়। আমি কিন্তু সব ধর্মের কথাই বলছি। আর সব নারী-বিদ্বেষী ধর্মের মতোই ইসলাম একটি নারী বিদ্বেষী ধর্ম। কেবল ইসলামই মন্দ, অন্য সব ধর্ম ভালো, এই উদ্ভট ভাবনা আমার নয়।

সারা পৃথিবীতেই বিজ্ঞানমনস্ক, ধর্মমুক্ত, যুক্তি বুদ্ধি সম্পন্ন, মুক্তচিন্তার মানুষ আছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই সংগঠন গড়েছেন। এই সংগঠনগুলো থেকে মাঝে মাঝেই সেমিনার আর কনভেনশনের আয়োজন করা হয়, যেখানে মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সৃষ্টিশীল চিন্তক লেখক, শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। যে ভাবনাগুলো রক্ষণশীল সমাজ মেনে নেয় না, সেই ভাবনাগুলো সকলে ওইসব সেমিনার আর কনভেনশনে নিশ্চিন্তে প্রকাশ করেন, আগ্রহী বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ বিদ্বজনের বক্তব্য শুনতে আসেন। বোদ্ধা শ্রোতা আর বক্তার মধ্যে মতের আদান প্রদান হয়। সাধারণ মানুষকে বিজ্ঞান শিক্ষায় উৎসাহী করার, বিবর্তনের জ্ঞান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং প্রচার মাধ্যম থেকে ছড়িয়ে দেওয়ার, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার এসবের প্রতিবাদ করার প্রেরণা দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, মানবাধিকার, নারীর অধিকার, শিশুর অধিকার সমকামী বা রূপান্তরকামীর অধিকারের পক্ষেও আমরা উচচকণ্ঠ কই। গণতন্ত্র, মানবতন্ত্র, আর বৈষম্যহীন সমাজের প্রতিষ্ঠার জন্য যা করা দরকার, সকলে মিলে তার পরিকল্পনা করি। মূলত আমাদের স্বপ্ন, একটি সুস্থ সুন্দর পৃথিবী তৈরি করা, যেখানে ধর্মের, পুরুষতন্ত্রের, শোষক শ্রেণীর অত্যাচার নেই।

ধর্মীয় সন্ত্রাস

১. দুনিয়া এখন ডিজিটাল। ডিজিটাল দুনিয়ায় তুমি দ্রুত অনেক কিছু শিখে ফেলতে পারো। রান্না শিখতে চাও, ইউটিউবে পেয়ে যাবে, জল কী করে ফুটোতে হয়, সেটিও ইউটিউবে এভেইলেবল। আমার এক বন্ধু তো কোনও কিছু কিনতেই আর দোকানে যায় না, ফ্লিপকার্টই কিনে বাড়ির দরজায় পৌঁছে দিয়ে যায়। যে পর্ন দেখতে লোকে একসময় গভীর রাতে পা টিপে টিপে অন্ধকার গলির ভেতর স্যাঁতস্যাঁতে বাড়ির চিলেকোঠায় উঠতো, সেই পর্ন এখন প্রত্যেকের আঙুলের ডগায়। বলা যায়, জাস্ট এক ক্লিক দূরত্বে। ডিজিটাল দুনিয়ায় ভালো জিনিস যেমন শিখতে পারো, খারাপ জিনিসও পারো। প্রেসারকুকার-বোমা কী করে বানাতে হয়, সে শিক্ষাটা জারনায়েভ ছেলেদুটো ইন্টারনেট থেকেই পেয়েছে। ইসলামী মৌলবাদী, সন্ত্রাসী, খুনী সকলে ব্যবহার করছে হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইভার, ট্যাঙ্গো, গুগল, টুইটার, ফেসবুক,স্কাইপ, ইমো। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে বিজ্ঞানবিরোধী ধর্মান্ধরা। অল্প বয়সী তরুণ তরুণীর মগজধোলাই করার জন্য এখন ইন্টারনেট জিহাদই সবচেয়ে বেশ সফল। গরিব দেশগুলোতেও ইন্টারনেট জিহাদের পাশাপাশি প্রচুর মসজিদ মাদ্রাসা, ওয়াজ মাহফিল ইত্যাদি জিহাদিদের আঁতুড়ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

২. ইজরাইল আর আমেরিকা আইসিসকে গড়েছে? ইজরাইল আর আমেরিকাকে তাদের অন্যায় আর নির্বুদ্ধিতার জন্য যত খুশি গালাগালি দাও। কিন্তু আইসিসের প্রতি সহানুভূতি দেখিও না। আইসিস নিরীহ মানুষদের খুন করছে। এই খুন ওরা নিজেদের বুদ্ধিতেই করছে। ইজরাইল আর আমেরিকা নয়, ওদের খুন করার প্রেরণা দিচ্ছে ওদের ধর্ম। আমেরিকা যদি আইসিসকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য নাও করতো, খুন করার ট্রেনিং যদি নাও দিতো, আইসিসরা খুন করতো। বাংলাদেশের ইসলামী-খুনীদের ইজরাইল আর আমেরিকা খুন করতে শেখাচ্ছে না। চাপাতির সাপ্লাই ইজরাইল বা আমেরিকা থেকে আসছে না। ইসলামী-খুনীরা পাথর ছুঁড়ে মেয়েদের হত্যা করে, ওই পাথর ইজরাইল বা আমেরিকা থেকে আসে না। সুইসাইড ভেস্টগুলোও নিশ্চয়ই আসে না।

আচ্ছা এত প্ল্যান করে ওরা নিরীহ মানুষ হত্যা করে কেন? প্ল্যান করে যে দেশের সরকারের ওপর রাগ, সে দেশের সরকারকে মারার চেষ্টা করলেই তো পারে।

৩. সিরিয়ার লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে ইউরোপের কিছু দেশ। মানুষ বড় মমতায় তাদের বরণ করেছে। সমুদ্র সৈকতে মরে পড়ে থাকা একটি শিশুর জন্য কেঁদেছে সারা বিশ্ব। কেউ তখনও কল্পনা করতে পারেনি এই শরণার্থীর স্রোতের মধ্যে লুকিয়ে আছে আইসিস সন্ত্রাসী। প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার প্রথম আত্মঘাতী বোমা ছিলো এক সিরিয়ার লোক, যে লোক শরণার্থী হিসেবে অন্য শরণার্থীর সঙ্গে ইউরোপে ঢুকেছে। সিরিয়ার শরণার্থীর সঙ্গে মোট কজন সন্ত্রাসী বা আতঙ্কবাদি লুকিয়ে আছে। তার খবর কে নেবে! তাহলে কি ধরে নিতে হবে ইউরোপে এই সবে শুরু হলো ইসলামী সন্ত্রাস!

ফ্রান্সে এই ইসলামী হামলার পর আমি অবাক হবো না যদি দেখি ইউরোপে মুসলিম বিরোধী, ইমিগ্রেন্ট বিরোধী, রেসিস্ট, কট্টর ডানপন্থী রাজনীতি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সচেতন বিবেকবান মানুষ কতটা অসহায় হলে কট্টর ডানপন্থী রাজনীতিকে মেনে নিতে বাধ্য হয়।

৪. পোপ বলছেন প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু। কেউ কেউ বলছেন, প্যারিসে এই হামলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম। হিটলারের পর আইসিস। আমার মনে হয় এসব সবই অতিকথন। তবে সন্ত্রাসের উৎস যদি নির্মূল না হয়, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবে। তবে এই যুদ্ধে সন্ত্রাসীদের জিতে যাওয়ার কোনও কারণ নেই, কারণ সন্ত্রাসীদের হাতে যা মারণাস্ত্র আছে, তার চেয়ে লক্ষ গুণ বেশি আছে পশ্চিমা বিশ্বের হাতে। সন্ত্রাসীরা হয়তো মরবে, কিন্তু সন্ত্রাস কী করে মরবে? বর্বরতা আর নৃশংসতার আইডিওলজি কী করে দূর হবে?

৫. আমেরিকা আর ইউরোপ মিলে ইসলামী সন্ত্রাসী দলগুলোকে ধ্বংস করতে পারতো কিন্তু করেনি। যতদিন সন্ত্রাসী দল আর সন্ত্রাসের সূতিকাগারগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস না হচ্ছে, ততদিন সন্ত্রাস চলবেই। ততদিন আমরা মরবো, পৃথিবীর সর্বত্র। কোনও দেশ আর নিরাপদ নয়। সপ্তম শতাব্দীর ইসলাম এই একবিংশ শতাব্দীতে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। হাতে তাদের একবিংশ শতাব্দীর অস্ত্র, মস্তিষ্কে সপ্তম শতাব্দীর অজ্ঞানতা।

বামপন্থীরা সব দোষ সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোকে দেবে, বলবে ওদের কারণেই সন্ত্রাসী জন্ম নিয়েছে, বলবে অশিক্ষা দারিদ্র ইত্যাদিই সন্ত্রাসী জন্মের মুল কারণ। সন্ত্রাসীদের জন্য তাদের সহানুভূতি উথলে উঠবে। আর কতকাল এসব হিপোক্রেসি দেখবো!

মসজিদ মাদ্রাসা বন্ধ করার সময় এসেছে। ওয়াজ খুৎবা বন্ধ করার সময় এসেছে। শিশু কিশোরদের মগজধোলাই বন্ধ করার সময় এসেছে। ইন্টারনেটের সন্ত্রাসী সাইটগুলো বন্ধ করার সময় এসেছে। ইসলাম শান্তির ধর্ম –এই মিথ্যে প্রচারটা বন্ধ করার সময় এসেছে।

নতুন পৃথিবী

পৃথিবীর মতো আরেকটা গ্রহ পেয়ে যাওয়া, এর চেয়ে চমৎকার কী আর ঘটতে পারে এই পৃথিবীতে! একটা গ্রহ যেটার ওপরে জল আছে, যেটা একটা নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করছে, যেটা আমাদের এই পৃথিবীর মতোই দেখতে! এরকম পৃথিবী যে আরও পাওয়া যায়নি কখনও তা নয়। পাওয়া গেছে তবে ওগুলোর নক্ষত্র আমাদের সূর্য নামের নক্ষত্রের তুলনায় ছোট আর ঠাণ্ডা।

কিছুদিন আগে কেপলার ৪৫২বি নামের যে গ্রহটা পাওয়া গেল, সেটা যে নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করছে, সেই নক্ষত্রটা কিন্তু আমাদের সূর্যের মতোই। নক্ষত্র আর গ্রহের মধ্যে দূরত্ব ১৪০০ আলোকবর্ষ। কেপলার ৪৫২বি গ্রহ তার নক্ষত্রকে, আমাদের পৃথিবী সূর্যকে যতবার প্রদক্ষিণ করছে, তার চেয়ে পাঁচগুণ বেশি প্রদক্ষিণ করছে। সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবীর লাগে ৩৬৫ দিন। আর ৪৫২বির তার নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করতে লাগে ৩৮৫ দিন।

আমাদের সূর্যের চেয়েও ৪৫২বি গ্রহটি যে নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করছে তার বয়স বেশি। যত বেশি বয়স তত বেশি তাপ, সে কারণে কেপলার ৪৫২বি আমাদের পৃথিবী থেকেও বেশি গরম।

দুশ কোটি বছর আগে ৪৫২বির নক্ষত্রের তাপ এখনকার চেয়ে আরও কম ছিল। ঠিক আমাদের এখনকার সূর্যের মতো ছিল। দুশ কোটি বছর আগে আমাদের সূর্যের তাপ আর ৪৫২বির নক্ষত্রের তাপ ছিল একই রকম। এই গ্রহ আর ওই গ্রহ একই রকম আলো আর উষ্ণতা পেতো।

কিন্তু তারপরও কেপলার ৪৫২বিকে পৃথিবীর মতো বলা যাবে না। বলা যাবে না এই কারণে যে ৪৫২বি আমাদের পৃথিবীর চেয়ে আকারে বড়। এর ব্যাস পৃথিবীর ১.৬ গুণ বেশি। আর তাছাড়া আমরা এখনও জানিনা কী পদার্থ দিয়ে তৈরি ওই গ্রহ। পদার্থটি সম্পর্কে যতক্ষণ না জানছি, ততক্ষণ ওর ঘনত্বটাও তো জানা যাচ্ছে না। একেক পদার্থের ঘনত্ব একেকরকম। পানির একরকম, লোহার আরেকরকম, পাথরের আরেক।

যদি পৃথিবীতে যা আছে, তাই থাকে ৪৫২বি তে, তাহলে পৃথিবীর চেয়ে চার গুণ বেশি পদার্থ আছে ওর। তা যদি হয় তা হলে গ্র্যাভিটি বেড়ে যাবে পৃথিবীর চেয়ে ১.৬ গুণ। কারও ওজন যদি পৃথিবীতে একশ পাউণ্ড হয়, ৪৫২বিতে তার ওজন হবে ১৬০ পাউণ্ড, অবশ্য যদি আমাদের পৃথিবী যে পদার্থ দিয়ে তৈরি, সে পদার্থ দিয়ে যদি তৈরি হয় কেপলার ৪৫২বি। গ্র্যাভিটিটা বেশি হলে বেশি গ্যাস থাকে চারদিকে, এতে করে বাতাসটা বেশি ভারী হয়ে যায়। কেপলার ৪৫২বি গ্রহ কিন্তু আমাদের পৃথিবীর চেয়ে বেশি আলো আর বেশি তাপ গ্রহণ করতে পারে।

৪৫২বির আকার আমাদের পৃথিবীর মতো নয়। কিন্তু কেপলার-১৮-৬এফ-এর আকার ছিল পৃথিবীর আকারের মতো। কিন্তু ওটা ঠিক সাধারণ কোনও নক্ষত্রকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছিল না, যেটাকে ঘিরে আবর্তিত হতো সেটা যে কোনও নক্ষত্রের চেয়ে আকারে অনেক ছোট, তাপও যে কোনও নক্ষত্রের চেয়ে অনেক কম। কেপলার ১৮৬এফ-এ যদি প্রাণী থেকে থাকে, তবে সে প্রাণ ঠিক কেমন প্রাণ? ওখানকার বায়ুমণ্ডলই বা কেমন!জানতে ইচ্ছে হয়।

একটা সময় আমরা জানতাম না কোনও নক্ষত্রকে ঘিরে পৃথিবী ছাড়া আর কোনও গ্রহ আদৌ আবর্তিত হচ্ছে কি না। এখন আমরা জানি হাজারো গ্রহের খবর। আমাদের গ্যালাক্সিতেই তো কোটি কোটি পৃথিবীর মতো একই আকৃতির গ্রহ আছে। এও জানি ওগুলোর একটিও বাসযোগ্য নয়। ওগুলো হয় অতি ঠাণ্ডা নয়তো অতি গরম।

হয়তো কেপলার ৪৫২বি’টা ততটা পৃথিবীর মতো নয়, যতটা কেপলার ১৮৬এফ-টা। কারণ কেপলার ৪৫২বি টা পৃথিবীর চেয়ে আকারে অনেক বড়, গরমও অনেক বেশি। আমাদের কাজ পৃথিবীর মতো বাসযোগ্য কোনও গ্রহ খুঁজে পাওয়া। খাপে খাপে না মিললেও হয়তো চলে, বাসযোগ্য হওয়াটাই আসল। কেপলার ১৮৬এফ এর সঙ্গে আকৃতি মিললেও উষ্ণতায় মিল নেই। কেপলার ৪৫২বির সঙ্গে উষ্ণতা মিললেও আকৃতিতে মিল নেই।

আমরা যা পেয়েছি সেই টুকুতেই খুশি হলে চলবে না। আমাদের আরও খুঁজতে হবে গ্রহ নক্ষত্র। আমরা আরও জানতে চাই, আরও বুঝতে চাই, আরও পেতে চাই। আমাদের আরও ভালো, আরও বড় টেলিস্কোপ দরকার, যে টেলিস্কোপ দিয়ে গ্রহগুলো আরও নিখুঁত করে দেখতে পাবো, কী পদার্থ দিয়ে গ্রহগুলো তৈরি, কীরকম তাপমাত্রা ওগুলোর, সব বুঝতে পারবো।

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে হয়তো আমরা একা নই। কিন্তু মহাশূন্য এত বিশাল যে আমরা একা হলেও আমরা একা পড়ে গেছি। অন্যান্য প্রাণীও হয়তো আমাদের মতোই একা পড়ে গেছে। আসলে কী, এই সৌর জগতের বাইরে অন্য কোনও সৌর জগতে একদিন না একদিন আমাদের পাড়ি জমাতেই হবে, যদি মানুষ নামক প্রজাতিকে বাঁচাতে চাই। কারণ এই পৃথিবী যে কোনও কারণেই হোক একদিন আর বাসযোগ্য থাকবে না। কোনও এসটোরয়েড পড়ে পৃথিবী অন্ধকার করে ফেলবে, তাছাড়া আমাদের সূর্য একসময় তো গ্যাস ফুরিয়ে নিভে যাবেই। সে সময় পৃথিবীর মতো বাসযোগ্য কোনও গ্রহ আমাদের পেতেই হবে।

এত সহস্র কোটি গ্রহ বাসযোগ্য অবস্থানে যদি থাকে, তবে কোথাও না কোথাও প্রাণের জন্ম নিশ্চয়ই হয়েছে। সেই প্রাণীকূল আমাদের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান হলে হয়তো এতদিনে আমাদের খুঁজে পেতো। অথবা, কেউ একজন বলেছিলো, বেশি বুদ্ধিমান বলেই হয়তো আমাদের মতো গবেটদের সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন ওরা মনে করছে না।

এই অন্তহীন মহাশূন্যে আমরা একা, এটার চেয়ে আমরা একা নই, এটাই হয়তো অনেক ভয়ের।

 নাকুশা

শুনেছি মহারাষ্ট্রে অনাকাঙ্ক্ষিত শিশুদের নাকুশা বলে ডাকা হয়। অনাকাঙ্ক্ষিত শিশু তো মেয়েরাই। অনাকাঙ্ক্ষিত বলেই গর্ভাবস্থাতেই তাদের হত্যা করা হয়। যদি তা না করা যায়, তবে জন্মের পর তাদের পুঁতে ফেলা হয়। মেয়েদের জ্যান্ত পুঁতে ফেলার সংস্কৃতি বহু পুরনো।

মহারাষ্ট্র সরকার এখন মেয়ে শিশুদের পক্ষে একটি আন্দোলন শুরু করেছেন, নাকুশা নামে ডাকার বদলে সত্যিকার কোনও একটি নামে যেন অনাকাঙ্খিত মেয়ে শিশুদের ডাকা হয় তার ব্যবস্থা করছেন। কিন্তু জোর জবরদস্তিতে কি হাজার বছরের সংস্কৃতি বদলানো সম্ভব? আইন করে না-হয় নাকূশাদের কোনও নাম দেওয়ার বন্দোবস্ত হল, কিন্তু সমাজে মেয়ে শিশুরা যে কারণে অনাকাঞ্ছিত- সে অবস্থার পরিবর্তনের জন্য কোনও ব্যবস্থা হচ্ছে কি?

সমাজে এবং পরিবারে মেয়েরা যে ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হচ্ছে– তা গোটা নারীজাতিকে অনাকাঙ্ক্ষিত করে রাখার জন্য সবচেয়ে বড় কারণ। মেয়েদের নিতান্তই যৌন সামগ্রী, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র এবং পুরুষের দাসী হিসেবে চিহ্নিত হতে হয়। মেয়েরা এখনও স্বামীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি, শুধু তাই নয়, এখনও তাদের সমাজের সম্পত্তি হিসেবে ভাবা হয়। সে কারণে একটি মেয়ে কোথায় গেল, কার সঙ্গে গেল, কার সঙ্গে শুলো, কী পোশাক পরলো, কী খেলো, কী পান করলো– তালক্ষ্য রাখে সমাজের সবাই। শুধু লক্ষ্যই রাখে না, উপদেশ বিতরণ করে, বিচার করে, শাস্তির ব্যবস্থা করে।

একটি মেয়ে পরিবারে, সমাজে, রাজনীতিতে– সব জায়গায় অনাকাঙ্খিত। একটি মেয়ে নারীবিরোধী পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রতি মুহূর্তে ঝুঁকি নিয়ে বাস করে। যৌন নির্যাতনের শিকার তাদের হতে হয় জন্মের পর থেকেই। আজকাল মেয়েদের রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ করা হয়। মেয়েরা বাসে-ট্রেনে-স্কুলে-কলেজে-অফিসে আদালতে কোথাও নিরাপদ নয়। মেয়েদের বিয়েতে যৌতুক বা পণ দিতে হয়, তারপরও নিরাপদ নয় মেয়েরা। স্বামীরা আরও পণের লোভে শারীরিক-মানসিক অত্যাচার করে চলে। বধূহত্যা হামেশাই হচ্ছে। স্বামী শাশুড়িরা পুড়িয়ে মারছে বধূকে।

মেয়েদের জীবন জন্মের পর থেকেই দুঃসহ। কোন মা চাইবে জেনেশুনে কষ্ট যন্ত্রণা পোহাতে মেয়েদের এই বিশ্বে আমন্ত্রণ জানাতে? অনেক মা-ই কন্যাভ্রণের গর্ভপাত করায়। গর্ভপাতের অধিকার প্রত্যেক মেয়েরই আছে। মেয়েরা যদি মনে করে এই পৃথিবী, এই দেশ, এই সমাজ মেয়েদের বাসযোগ্য নয়– তবে তারা গর্ভপাত করাতেই পারে। গর্ভপাত করানোর অধিকার থেকে মেয়েদের বঞ্চিত করা মানবাধিকার লঙ্খন করা। শুধু অনাগত কন্যার জন্য দুশ্চিন্তাই গর্ভবতীদের গর্ভপাতে বাধ্য করছে তা নয়, নিজের জীবনও কন্যা শিশু জন্ম দেওয়ার অপরাধে দুঃসহ হয়ে ওঠে।

সমাজে যে লিঙ্গ অনাকাঙ্ক্ষিত, সেই লিঙ্গকে জন্ম দিয়ে সেই লিঙ্গের ভোগান্তি বাড়াতে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ দ্বারা তাদের নির্যাতিত, অত্যাচারিত, অবহেলিত, লাঞ্ছিত হতে অনেকে চাইছে না তাদের না-চাওয়া অযৌক্তিক কোনও না-চাওয়া নয়। রাষ্ট্র চাইছে তাদের ওপর নারী-পুরুষের রেশিও ঠিক করানোর দায়িত্ব চাপানো ঠিক নয়। আজ যদি পুরুষরা এই সমাজে অনাকাঙ্ক্ষিত হতো, আজ যদি পুরুষরা নির্যাতিত হতো পুরুষ হওয়ার কারণে, সমাজ যদি পুরুষবিদ্বেষী হতো, তাহলে কিন্তু মায়েরা ছেলে-শিশু জন্ম দিতে আপত্তি করতো।

শিক্ষিত মেয়েরা যে সমাজে নারীবিরোধী আচার পালন করে সে সমাজে মেয়েরা খুব শীঘ্র সমানাধিকার পাবে এ আমার বিশ্বাস হয় না। আজ করভা চৌত, ভাই ফোঁটা, সিঁদুর খেলা ইত্যাদি নানা পুরুষতান্ত্রিক উৎসবে মেয়েরা অংশ নিচ্ছে। স্বামীর দীর্ঘায়ুর জন্য স্ত্রীরা উপোস করছে। স্বামীর মঙ্গলের জন্য মঙ্গলসূত্র পরছে, শাঁখা-সিঁদুর পরছে। পুরুষদের কিন্তু কোনও ব্রত পালন করতে হচ্ছে না স্ত্রীর মঙ্গলের জন্য। স্ত্রী মরে গেলে পুরুষরা নতুন স্ত্রী পাবে। নতুন স্ত্রী পাওয়া মানে নতুন করে টাকা পাওয়া। প্রবাদ আছে; অভাগার গরু মরে, ভাগ্যবানের বউ মরে। সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে। বটে, কিন্তু ভিন্ন নামে সতীদাহ আজও টিকে আছে, সতীদাহের মানসিকতা তো সমাজে ভীষণভাবেই টিকে আছে। বিধবাদের কী করে ভুগতে হয়, বিশেষ করে বাংলায়, তা কারও অজানা নয়।

প্রায় প্রতিটি দেশেই নারীরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। নারীর নিরাপত্তা কোথাও নেই। নারীরা নির্যাতিত, যেহেতু তারা নারী। পুরুষও নির্যাতিত হয়, কিন্তু তারা পুরুষ বলে নির্যাতিত হয় না। এই যখন সমাজের বাস্তবতা, তখন নারীরা নারী-জন্ম দেখতে চায় না। তারা নিজেরা ভুগেছে নারী হয়ে জন্ম নেওয়ার কারণে–তাই তারা কন্যা-জন্ম দিতে চায় না। আমি যদি কোনও শিশু জন্ম দিতাম– আমি হয়তো কন্যা শিশু জন্ম দিতে গেলে দুবার ভাবতাম। হ্যাঁ, এই আমিও ভাবতাম, যে আমি একজন নারীবাদী– সেই আমিও চাইতাম না আমার কন্যাকে ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স, বধূ নির্যাতনের শিকার হতে হবে এমন পরিবেশে চলতে।

কন্যাশিশু জন্ম দেওয়ার চাপ নারীর ওপর না দিয়ে বরং পুরুষতান্ত্রিক সমাজটাকে মানবতান্ত্রিক সমাজ বা ইকুয়াল সোসাইটি হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা হোক। প্রতিটি ইস্কুলে মেয়েদের সমানাধিকারের শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হোক। প্রতিটি শিশু যেন শেখে নারী ও পুরুষের অধিকার সমান। পরিবারে যেন শিশুরা দেখে বাবা ও মা কোনও প্রভু ও দাসীর রোল প্লে করছে না, বরং দুজনে দুজনকে শ্রদ্ধা করছে–মানুষ হিসেবে, সঙ্গী হিসেবে, সহযাত্রী হিসেবে।

আমি তো মনে করি, নারী-বিরোধী সমাজে মেয়েদের শিশু জন্ম দেওয়াই বন্ধ করে দেওয়া উচিত। ছেলে-শিশু জন্ম দেওয়ার মানে ভবিষ্যতের নির্যাতক জন্ম দেওয়া–আর মেয়েশিশু জন্ম দেওয়ার মানে ভবিষ্যতের ভিকটিম জন্ম দেওয়া। নারী বিরোধী সমাজের সঙ্গে আপোস না করে বরং রেভলিউশান করা উচিত নারীদের। রেভুলিউশানের নাম হোক– নাজন্ম।

নারী

নারী

জন্মভূমি তোমাকে জন্ম দেয়নি। তুমি আমেরিকাতেও জন্ম নিতে পারতে। তুমি এস্কিমোদের দেশেও জন্ম নিতে পারতে। জন্মভূমি নিয়ে এত আবেগ আর উত্তেজনার কোনও কারণ নেই। দেশের সীমানা তৈরি করেছে হিংসুক মানুষেরা। অথবা ভয়ার্ত মানুষেরা। নারীকে শুইয়ে নারীর যোনী দেখিয়ে সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে জ্ঞান দিতে চেষ্টা করাটা নেহাতই হাস্যকর। আদিম যুগে যখন মানুষ কী করে মানুষের জন্ম হয় জানতো না, তখন যদি বলতো, ঠিক ছিল। এখন এই যুগে এটা বেমানান। এখন আমরা অনেক কিছু জানি। নারীকে সম্মান করার পদ্ধতি এটা নয়। নারী জন্ম দেয় বলে নারীর যোনী পূজা করা নারীকে রেসপেক্ট করা নয়। নারীর যোনী পুরুষের যৌনাঙ্গের চেয়ে পৃথক কিছু নয়। ওসব জাস্ট যৌনাঙ্গ। জন্ম দেওয়া কোন ক্রেডিট নয়। কোটি কোটি প্রজাতির স্ত্রী লিঙ্গ যেমন, নারীর লিঙ্গও তেমন, ওরাও প্রসব করে। নারী একা সন্তানের জন্ম দেয় না। পুরুষের স্পার্ম এর দরকার হয়। স্পার্ম এক সময় স্টেম সেল থেকে,স্কিন থেকে তৈরি হবে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু জন্ম দেওয়া কি বিশাল কিছু! আহামরি কিছু নয়। নারীকে সম্মান করতে চাও করো একজন ইন্ডিভিসুয়্যাল হিসেবে, তার গুণ যদি থাকে সম্মান কর। শুধু নারী বলে যদি তাকে সম্মান কর তবে সেটা সম্মান নয় অসম্মান। একজন নারী চোর হলে, বদমায়েশ হলে, খুনি হলে তাকে সম্মান করার প্রশ্ন আসে না। নারী পুরুষ উভয়েই বদমায়েশ হতে পারে। নারীর শরীরে ভাল মানুষের সেপারেট জীন নাই যারা নারীকে আলাদা করে দেখে– নারী জন্ম দেয় সূতরাং মহান, নারী ধর্ষিত হয় সুতরাং নারী অবলা, নারী লজ্জাবতী সুতরাং এরা ভাল,নারী খুন কম করে সুতরাং সে শান্তিপ্রিয় — সব ভুল কথা। নারী সুযোগ পেলে পুরুষের মতই ভয়ংকর হতে পারে।

নারী দিবস

নারী দিবসটা একটা বোরিং জিনিস। এ অনেকটা ইস্কুলের ক্লাস শুরু হওয়ার আগে রবোটের মতো দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার মতো। গাইতে হয় তাই গাওয়া। গাওয়ার সময় দেশের প্রতি কারও ভালোবাসা বাড়ে না। এই সঙ্গীত গেয়ে দেশের কোনও উন্নতিও হয় না। নারী দিবস পালন করে নারীর অবস্থারও কোনও পরিবর্তন হয়নি। পালন করতে হয় বলেই পালন করা। তবে হ্যাঁ, নারী দিবসটা আছে বলে। নারীর উন্নতির জন্য নানা কর্মসূচি নেওয়া যায়। আমার প্রশ্ন, নারীর উন্নতির জন্য কিছু করতে কি নারী দিবসের দরকার হয় নাকি? বছরের তিনশ-পয়ষট্টি দিনই তো তা করা যায়!

নারী দিবস

নারী বিরোধী সমাজে বসে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নারীর সমানাধিকারের কথা লিখছি আজ তিরিশ বছর। আমি আর কতটুকু কী করেছি। হাজারো নারীবাদী হাজার বছর আগে থেকেই আমার চেয়েও বেশি ঝুঁকি নিয়ে নারীর অধিকারের জন্য লড়ছে। তারপরও কি নারীরা তাদের প্রাপ্য অধিকার পেয়েছে? এ সহজ নয় পাওয়া।

নারী দিবসটা যদি উত্যাপন করতেই হয়, তবে নারীদের নয়, উৎযাপন করা উচিত পুরুষদের। কারণ নারীদের একা একা চেঁচিয়ে চিল্লিয়ে কোনও লাভ নেই। প্রাপ্য অধিকার থেকে নারীদের বঞ্চিত করছে পুরুষেরা। এই পুরুষেরা যেদিন নারীদের সমানাধিকার সম্পর্কে সচেতন হবে, যেদিন নারীদের বঞ্চিত করা বন্ধ করবে, সেদিনই নারীরা তাদের প্রাপ্য অধিকার ফিরে পাবে। যেদিন পুরুষেরা নারীদের অত্যাচার করা,যৌন হেনস্থা করা,ধর্ষণ করা,খুন করা বন্ধ করবে, সেদিনই বন্ধ হবে নারীর বিরুদ্ধে ঘৃণ্য জঘন্য নির্যাতন। নারীদের চেঁচিয়ে চিল্লিয়ে কোনও লাভ হয়নি এতকাল, হবেও না। কিছুই হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত কর্তাদের টনক না নড়ে। কর্তারা চিরকালই পুরুষ। সুতরাং চিৎকার করতে হবে পুরুষদের। পুরুষের চিৎকার পুরুষ কর্তাদের কর্ণকুহরে দ্রুত পৌঁছোয়। পুরুষেরা সতীদাহ প্রথা বন্ধ করতে চেয়েছিল, বন্ধ হয়েছে। পুরুষেরা বাল্য বিবাহ বন্ধ করতে চেয়েছিল, বেশির হয়েছে। পুরুষেরা নারী শিক্ষা চালু করতে চেয়েছিল, চালু হয়েছে। এই কাজগুলো যদি নারীরা করতে চাইতো, শত বছর কেটে গেলেও কিছুই হয়তো সম্ভব হতো না।

ভোটের অধিকারের জন্য নারীরা আন্দোলন করেছিল, সেই অধিকার পেতে নারীদের শত বছর লেগেছে। এই সময়টায় নারীরা কম মার খায়নি, কম জেল খাটেনি। সমাজে নারীর স্থান অত্যন্ত নিচে, নিচু স্তরের মানুষের কথা শুনতে উঁচু স্তরের মানুষ অভ্যস্ত নয়। পুরুষেরা উঁচু স্তরের। নারীবাদী-পুরুষরাও পুরুষ হওয়ার কারণে উঁচুস্তরের। নারীরা দাবি করলে সেই দাবি মেটাতে পুরুষেরা চিরকালই গড়িমসি করেছে। পুরুষেরা দাবি করলে সেই দাবি মেটাতে পুরুষদের এগিয়ে আসার সম্ভাবনা বেশি। তাদের হাতেই তো নারী-পুরুষের বৈষম্য কমানো-বাড়ানোর ক্ষমতা! পুরুষকেই তো দুর করতে হবে তাদের নারীবিদ্বেষী মানসিকতা! পুরুষকেই তো শুদ্ধ হতে হবে। পুরুষ না চাইলে কখনও কি তা সম্ভব! নারীরা পুরুষের মানসিকতা বদলাতে পারবে না। মানসিকতা বদলানোর কাজ নিজে করতে হয়।

মানুষই মানুষকে নির্যাতন করছে, মানুষই মানুষের অধিকারের জন্য লড়ছে। নারী-পুরুষের বৈষম্য ঘোচানোর দায় নারীর একার নয়। এ বৈষম্য ঘোচানোর দায় সব মানুষের। যে মানুষেরা সচেতন, যে মানুষেরা চেঁচালে, চেষ্টা করলে বৈষম্য ঘোচে, দায়িত্বটা তাদেরই নিতে হবে। নারী-পুরুষের বৈষম্য যতদিন থাকবে ততদিন মানবজাতিকে সভ্য জাতি বলার কোনও যুক্তি নেই।

পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশেই নারীবিরোধী পুরুষেরা পুরুষরক্ষা সংগঠন, পুরুষাধিকার সংগঠন ইত্যাদি গড়ে তুলেছে। এসব সংগঠন নারীবিরোধিতা, নারীবিদ্বেষ, নারীঘৃণা প্রচার করতে সারাক্ষণই ব্যস্ত। আমার খুব ভালো লাগে, যখন দেখি পুরুষেরা নারী দিবস পালন করছে, নারীর অধিকারের পক্ষে মিছিলে নামছে। এই পুরুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়, কিন্তু আজ নারী দিবসে আমার একান্ত চাওয়া, এই সংখ্যাটা বাড়ুক। এই সংখ্যাটা বাড়লেই সমাজে পরিবর্তন আসবে। যে পুরুষেরা নারীকে ধর্ষণ করে, খুন করে, তারা আজ প্রতিজ্ঞা করুক আজ থেকে কোনও নারীকে তারা ধর্ষণ করবে না বা খুন করবে না। যে পুরুষেরা নারী নির্যাতনে বেশ হাত পাকিয়েছে, তারা আজ প্রতিজ্ঞা করুক নারী নির্যাতন আর করবে না। যে পুরুষেরা যৌন হেনস্থা করে, তারা আজ থেকে বন্ধ করুক যৌন হেনস্থা। আজ থেকে সংসারের যাবতীয় কাজ, নিজেদের সন্তান-পালন, নিজেরা মিলে ঝিলে করুক। আজ থেকে বাইরের দুনিয়ার কাজ নারী-পুরুষ উভয়ে করুক, স্বনির্ভর আর পরনির্ভরের সংসারের বদলে সংসার হয়ে উঠুক দুজন স্বনির্ভর মানুষের সংসার। আজ থেকে নারী আর পুরুষের সমতা আসুক সংবিধানে, রাষ্ট্রে, আইনে, সমাজে, পরিবারে, অফিসে, আদালতে, রাস্তা-ঘাটে, বাসে, ট্রেনে, জাহাজে, লঞ্চে সর্বত্র। নারী-পুরুষের মধ্যে গড়ে উঠুক সত্যিকারের বন্ধুতা। প্রভু-দাসির সম্পর্কটা, উঁচু নিচুর সম্পর্কটা সম্পূর্ণ নির্মূল হোক।

দুদিন আগে কিছু আফগান পুরুষ নীল বোরখা পরে, হাতে ব্যানার নিয়ে, কাবুলের রাস্তায় হেঁটেছে। তারা নারী নির্যাতন বন্ধ হোক চায়। কী চমৎকার এই দৃশ্য! দেখ মুগ্ধ হই। নারী নির্যাতন বন্ধ করার জন্য পুরুষের মিছেলের দৃশ্য, নারীর মিছিলের দৃশ্যের চেয়ে, বেশি সুন্দর, বেশি যৌক্তিক, বেশি মানবিক। অত্যাচারের বিরুদ্ধে অত্যাচারিতদের রুখে দাঁড়ানোর চেয়ে অত্যাচারী গোষ্ঠীর রুখে দাঁড়ানোটা জরুরি। কাবুলের রাস্তায় মাত্র পনেরো-কুড়িজন আফগান ছেলে নেমেছে। এই সংখ্যাটা দিন দিন বাড়ক। রাস্তার পুরুষেরা নারী নির্যাতন বন্ধ করার জন্য পুরুষের উদ্যোগ দেখুক, শিখুক। এই দৃশ্য টিভিতে দেখাক। ইন্টারনেটে ছেয়ে যাক। লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখুক, শিখুক।

পাশ্চাত্যের পুরুষেরা মেয়েদের জুতো পরে রাস্তায় হাঁটে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, পুট ইওরসেল্ফ ইন মাই সুজ। মানে, আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে আমার অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করো। তারা আক্ষরিক অর্থে প্রচলিত বাক্যটি গ্রহণ করেছে। সত্যি সত্যি মেয়েদের জুতো পরে তারা এক মাইল পথ হাঁটে। এই হাঁটার উদ্দেশ্য হলো, মেয়েদের বিরুদ্ধে যত যৌন নির্যাতন পুরুষেরা করে, সেসব বন্ধ হোক, নারী-পুরুষের মধ্যে যত বৈষম্য আছে, সব দূর হোক। শুধু মেয়েদের হাই-হিল পরে হাঁটা নয়, পুরুষরা তুরস্কে, ভারতে, মেয়েদের স্কার্ট পরে মেয়েদের যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। নারী-পুরুষের সমানাধিকারে বিশ্বাস করা এই সচেতন পুরুষদের সংখ্যাটা লক্ষাধিক হোক। কোটি ছাড়িয়ে যাক।

নার্গিস

বত্রিশ বছর আগে আমাদের ময়মনসিংহের বাড়িতে কাজ করতে এসেছিলো নার্গিস। এত সরল মেয়ে আমি আমার জীবনে, সত্যি বলতে কী, দেখিনি। ওকে দিয়ে অতিরিক্ত কাজ করানো হতো। কোনও প্রতিবাদ না করে ও কাজ করতো। ওর নাওয়া খাওয়ার ঠিক ছিল না। কাকভোরে উঠতো, কিন্তু সকালের নাস্তা পেতে দুপুর হতো, দুপুরের খাবার পেতে বিকেল হতো। আর খেতোই বা কী! নিশ্চয়ই বাসি কিছু, পোড়া কিছু, অল্প কিছু। আমার কখনও মনে হয়নি, ওকে ওর যা প্রাপ্য, তা দেওয়া হচ্ছে। নার্গিসের জন্য কষ্ট হতো আমার। আশ্চর্য, কখনও অভিযোগ করতো না। ওর মুখ ভর্তি থাকতো মশার কামড়ের দাগে। ওর মশারি ছিল না। সারা রাত ওকে মশা কামড়াতো। অনেক অনেকদিন আমি চোখের জল ফেলেছি নার্গিসের জন্য। আগলে আগলে রাখতে চেষ্টা করতাম নার্গিসকে। ওর থালায় ভালো কিছু পড়তো না, নিজের পাত থেকে গোপনে তুলে দিতাম। আড়ালে ডেকে নিয়ে মাঝে মাঝে বিস্কুট, কেক, মিষ্টি খেতে দিতাম ওকে। কী যে লজ্জা পেতো খেতে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে গেলে রাতে রাতে ওকে বই পড়তে শেখাতাম। আমার ভাইয়ের বাড়িতেও ও কাজ করতো। ওখানে মুখ বুজে অত্যাচার সইতো। ভাইয়ের বাড়িতে ভাইয়ের এক শালা থাকতো, বাড়ি খালি পেয়ে ও নাকি নার্গিসকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছিল, এ খবর শুনে নার্গিসের মাকে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা যাওয়া আসার ট্রেনভাড়া দিয়ে পাঠিয়েছিলাম ভাইয়ের বাড়ি থেকে নার্গিসকে যেন তক্ষুণি নিয়ে আসে। যখন চাকরি করতে শুরু করেছি, ওদের বাড়িতে গিয়ে কিছু টাকা, কিছু কাপড়চোপড়, কিছু খাবার দিয়ে আসতাম। ওকে যেন কারো বাড়িতে কাজ করতে না হয়। যেন নিরাপদে বাবামা ভাই বোনের সঙ্গে নিজের বাড়িতে থাকতে পারে। যেন ও লেখাপড়া শেখে। যেন। ভালো কোনও চাকরি বাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াবার সুযোগ পায়।

একসময় ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা বদলি হই। নার্গিসের আর খোঁজ নেওয়া হয় না। শুনেছি ওর বিয়ে হয়ে গেছে। মার অসুখের সময়, ষোলো বছর আগে যখন গিয়েছি দেশে, নার্গিসের খোঁজ করেছি। নার্গিস এসেছিল দেখা করতে, ওর তিন বাচ্চা নিয়ে। ওর বিয়ে হয়েছে এক ডাকাতের সঙ্গে। নার্গিসকে বিষম মারধর করে। বিয়ের সময় ওরা জানতো না যে লোকটা ডাকাত। ডাকাতি করে স্বামী প্রায়ই ধরা পড়ে। জেল খাটে। স্বামীর আত্মীয় স্বজনের সব কাজকর্ম একা নার্গিসকেই করতে হয়। ওদেরও লাথি গুঁতো খায় ও। সেদিন কয়েক হাজার টাকা নার্গিসের হাতে দিয়েছি। দেখলাম সেই কিশোরী নার্গিসই যেন। তেমনই সরল। তেমনই লাজুক। অসহ্য অভাবের সংসার। তারপরও টাকা হাতে নিতে লজ্জা পায়। ছোটবেলায় ঠিক যেমন একটা বিস্কুট হাতে নিতে লজ্জা পেতো। নার্গিসকে বলেছিলাম ডাকাতের কাছে আর না যেতে, অথবা ডাকাতকে তালাক দিয়ে ভালো কোনও ছেলে দেখে যেন বিয়ে করে নেয়। নার্গিস হেসে বললো, আফা কী যে কইন, বিয়া তো জীবনে একবারই অয়। বিদেশ থেকে দুতিন বার কারো কারও হাতে নার্গিসের জন্য টাকা পাঠিয়েছি। ও টাকা ওর হাতে আর পোঁছয়নি। যার হাতে টাকা দিয়েছি, সে নিজেই সাবাড় করেছে টাকা।

নার্গিস পরশু ফোন করেছিল। কয়েক বছর চেষ্টা করে আমার ফোন নম্বর যোগাড় করেছে। ষোলো বছর পর নার্গিসের কণ্ঠস্বর শুনছি। সেই আগের মতোই। সততা আর সরলতা চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। আফা, কিরম আছুইন? শইলডা বালা? রাইতের খাওয়া খাইছইন? শুনে চোখ জ্বালা করে। ঠিক এভাবেই আমার সঙ্গে আদর করে কথা বলতো ও। আমার চেয়ে বয়সে ছোট। কিন্তু আমাকে দেখে রাখার দায়িত্ব যেন ও-ই নিয়েছিল।

নার্গিসের ডাকাত স্বামী আরেকটা বিয়ে করেছে। পাঁচ বাচ্চা সহ নার্গিসকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। নার্গিসের বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আরেক মেয়ে ক্লাস নাইনে পড়ে। নার্গিস বললো, আমার মেয়ের সাথে কতা কইন আফা। ফোনটা সে দিল তার নাইনে পড়া মেয়েকে। কত গর্ব করে বললো তার মেয়ে নাইনে পড়ে। আমার কী যে ভালো লাগলো জেনে যে নার্গিসের মেয়ে কারও বাড়িতে ক্রীতদাসীর মতো কাজ করে না। সে ইস্কুলে যায়। সে পড়ে।

নার্গিস কোনও টাকা চায়নি। কোনওদিন ও কারো কাছে কিছু চায়নি। আমি নিজেই ভেবেছি, এ বছর বের হওয়া আমার নতুন বইয়ের রয়্যালটির টাকা আমি নেবো না, নার্গিসকে পাঠিয়ে দেবো। এবার এমন ভাবে পাঠাবো যেন নার্গিসের হাতে পৌঁছোয় টাকাটা। আমি নিজে তো ধনী কেউ নই। পঞ্চাশ হাজার টাকা আমার জন্যও অনেক টাকা। আমার না হয় কিছুটা কমই হলো এবার। নার্গিসের তো সারা জীবন কম হয়েছে। আমি কি প্রায়শ্চিত্য করছি? আমার মনে হয়, আমি প্রায়শ্চিত্যই করছি। এই সমাজ একটা অসহায় দরিদ্র মেয়েকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করেছে, তার প্রায়শ্চিত্য। যে মেয়ের ইস্কুলে পড়ার কথা ছিল, সে মেয়ে লোকের বাড়িতে কাজ করতো, বাসন মাজতো, কাপড় কাঁচতো, ঘর মুছতো, উঠোন ঝাঁট দিত, রান্না করতো। প্রচণ্ড অসহায়তা, অনিশ্চয়তা, আর নিরাপত্তাহীনতানিয়ে লোকের বাড়িতে থাকতো, মশা কামড়াতো, মানুষ চড় থাপড় দিতো, কিল ঘুষি দিতো, পেটাতো, ধর্ষণ করতে চাইতো, তার প্রায়শ্চিত। ডাকাত স্বামী আর তার আত্মীয় স্বজনের অত্যাচারের প্রায়শ্চিত। নার্গিসকে তার জীবনটাই কাটাতে হয়েছে এক জীবন যন্ত্রণার মধ্যে, তার প্রায়শ্চিত্য। এই সমাজের পাপের প্রায়শ্চিত্য আমি করছি। লক্ষ লক্ষ মেয়ে নার্গিসের মতো ভোগে। কিন্তু সবার দুঃখ তো আমি একা ঘোচাতে পারবো না। একজনের দুঃখ অন্তত কিছুটা হলেও ঘোচাবার চেষ্টা না হয় করি।

নাস্তিক নাগরিকদের নিরাপত্তা দিন

আমার বিরুদ্ধে যখন বাংলাদেশ উত্তাল, যখন মৌলবাদী সন্ত্রাসী আর দেশের সরকার মিলে মিশে আমার বিরুদ্ধে হেন বদমাইশি নেই করছে না, তখন কিন্তু এখনকার অনেক নাস্তিক ব্লগারের জন্মও হয়নি। সেই আশির দশক থেকে বাংলাদেশের আগপাশতলা ইসলামের পানি দিয়ে ধোয়া হচ্ছে, ইসলামের সোনা দিয়ে মোড়ানো হচ্ছে। তার ফুল এখন হাতে নাতে পাচ্ছে সবাই। আমাকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছে বলে আজও প্রাণে বেঁচে আছি। এখন দেশের তরুণ নাস্তিক ব্লগারদের এক এক করে কুপিয়ে মারা হচ্ছে। প্রাণ বাঁচানোর জন্য এরা এখন দেশের বাইরে বেরোতে চাইছে। কিছুদিন আগে যুগান্তর পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো পুলিশের এক বিশেষ রিপোর্ট। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নাকি ভারতে তিনটে স্লিপার সেল পাঠিয়েছে আমাকে মেরে ফেলার জন্য। আমি ইউরোপের নাগরিক, আমেরিকার গ্রীনকার্ড ধারী। আমি বিপদের আঁচ পেলে উড়াল দিতে পারবো। কিন্তু বাংলাদেশের ব্লগাররা উড়াল দেবে কী করে? তাদের পাসপোর্ট চাই, বিদেশ থেকে আমন্ত্রণ চাই, ভিসা পেতে গেলে ব্যাংক ব্যালেন্স সহ হাবিজাবি কাগজপত্র চাই। সবাই ভাবছে, এর পরের ভিকটিম বোধহয় সে নিজেই। আমি লিখেছি অনেক, হাসিনা যেন নাস্তিক ব্লগারদের,যাদের জীবনের হুমকি আছে, নিরাপত্তা দেন। আমার কথা হাসিনা শুনবেন কেন? হু এম আই? তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রী। বিশাল জিনিস। হাতের কাছে পেলে তিনিই আমাকে কোপাবেন। আসল কথা হলো, হাসিনা পরের নির্বাচনে জেতার জন্য মৌলবাদী পটাচ্ছেন, তিনি ব্লগারদের নিরাপত্তা তো দেবেনই না, খুনীদের বিরুদ্ধেও কোনও ব্যবস্থা নেবেন না। এই দুঃসহ অবস্থায় দেশ ত্যাগ করা ছাড়া নাস্তিক ব্লগারদের আর কোনও উপায় নেই। আপাতত বাঁচুক। দেশের অবস্থা ভালো হলে না হয় ফিরবে দেশে। কিন্তু শাহরিয়ার কবির চান না ব্লগাররা দেশ ছাড়ক। তিনি বলছেন, এতে লাভ হবে না, জামাতে ইসলামিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। জামাতে ইসলামি নিষিদ্ধ হলে সন্ত্রাসীরা নাস্তিকদের খুন করবে না? কোনও কি গ্যারেন্টি আছে? এতকাল যাবৎ জামাতে ইসলামির বাইরেও লক্ষ লক্ষ মৌলবাদী-সন্ত্রাসীর জন্ম হয়েছে, তারা জামাতের চেয়েও লক্ষ গুণে ভয়ংকর। তারা আইসিস আলকায়দার নির্দেশে চলে। শাহরিয়ার কবির বললেন তাঁর হাতে পিস্তল আছে, এবং তিনি একা বাইরে বেরোন না। শাহরিয়ার কবির না হয় পিস্তল এবং পিস্তলের লাইসেন্স যোগাড় করতে পারেন। কিন্তু অল্প বয়সী নাস্তিক ব্লগাররা পিস্তল কোত্থেকে যোগাড় করবে, লাইসেন্সই বা তাদের কে দেবে? যে সরকার তাদের কোনও দেহরক্ষী দেয় না, সে সরকার দেবে লাইসেন্স?

অনন্ত বিজয় দাসকে কুপিয়ে মারা হয়েছে, একমাস হয়ে গেলো। এবার আরেকজন নাস্তিকের খুন হওয়ার সময় হয়েছে। ভয়ে একএকজন সেঁধিয়ে গেছে গর্তে। গর্ত থেকে তো বের হতে হবে। লিখতে হবে যেমন লিখছিলো। নিজের লেখা বন্ধ করে দেওয়া বা সেন্সর করার চেয়ে খারাপ কোনও সেন্সরশিপ নেই। দেশের ভেতর লেখালেখি মাচায় তুলে ভয়ে গুটিয়ে থাকবে। আর বিদেশে চলে গেলে ওখানে ব্যস্ত হয়ে পড়বে বাঁচার লড়াই চালাতে, হয়তো লেখাই তখন বাধ্য হয়ে বন্ধ করতে হবে। দেশের মৌলবাদী পরিবেশ থেকে খুব দূরে চলে গেলে অনেকের লেখা বন্ধ হয়ে যায়। মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের তাগিদটা চলে যায়। দেশকে বাঁচানোর চেয়ে নিজের বাঁচার প্রয়োজনটা বড় হয়ে দাঁড়ায়। তবে কি আমাদের মেনে নিতেই হবে যে দেশের প্রতিভাবান মানববাদী অস্তিত্ববাদী লেখকরা আর লিখবে না। এভাবেই সরকারের উদাসিনতা এই প্রতিভাবান প্রজন্মকে ধ্বংস করে দেবে?

অনন্ত বিজয় দাসের বন্ধু মনির হোসেন অত্যন্ত প্রতিভাবান ব্লগার। যুক্তি পত্রিকাটি অনন্ত আর মনির বের করতো। মনির হোসেনের নাম ওই ৮৪ জনের লিস্টে আছে, যাদের মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেছে ইসলামি সন্ত্রাসীরা। অনন্তকে খুন করার পর থেকেই মনির হোসেনকে খুনীরা মৃত্যুর জন্য তৈরি হতে বলছে। কুপিয়ে মারার জন্য খুনীরা মনিরের পিছু নিয়েছে। মনির এক শহর থেকে আরেক শহরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। দেশ ছাড়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। কিন্তু গরিব দেশের গরিব যুবকদের ভিসা দিতে আগ্রহী নয় বিদেশের রাষ্ট্রদূতগণ। তাঁরা ব্লগারের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করবেন, কিন্তু ওদের বাঁচাতে এগিয়ে আসবেন না। ইউরোপ আমেরিকা ভরে গেছে। মৌলবাদী সন্ত্রাসীতে। বড় বড় কূটনীতিকও জানেন না কাকে ভিসা দিতে হয়, এবং কাকে দিতে হয় না। বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী প্রতিভাবানকে ভিসা দিলে তাঁদের দেশের লাভ, আর ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীদের ভিসা দিলে তাঁদের দেশের ক্ষতি। হয়তো জানেন। শুধু চিনতে পারেন না কারা মন্দ লোক, কারা ভালো লোক। অনন্ত বিজয় দাসের মতো হীরের টুকরো ছেলেকে সুইডিশ দূতাবাস ভিসা দেয়নি। অথচ সুইডেন ভরে রয়েছে অনন্তকে যারা খুন করেছে, সেই ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীতে।

যাদের লেখা কোনও পত্রিকায় প্রকাশ হবে না, যাদের মত কোনও টিভিতে প্রচারিত হবে না,কারণ তাদের মত সমাজের অধিকাংশ মানুষের মতের চেয়ে ভিন্ন, তাদের জায়গা ছিল ফেসবুকে। ফেসবুকে তারা তাদের ভিন্নমত প্রকাশ করতে পারতো। সেই ফেসবুকও এখন মৌলবাদীদের খপ্পরে। ফেসবুক একটা নিয়ম চালু করেছিল, কেউ আপত্তিকর কথা লিখলে, নোংরা ফটো পোস্ট করলে ফেসবুকাররা রিপোর্ট করতে পারে। এটিই কাজে লাগাচ্ছে ইসলামিং রিপোর্টিং গোষ্ঠী। এরা লক্ষ লক্ষ। দলবদ্ধ। এদের সর্দার বলে দেয় আজ একে মারো, কাল ওকে ধরো। চলে তাদের গণরিপোর্টিং। এদের রিপোর্টের কারণে প্রগতিশীল, নারীবাদী, নাস্তিক, মৌলবাদ বিরোধীরা তাদের আইডি হারাচ্ছে। মৌলবাদবিরোধী নাস্তিকগোষ্ঠী সংগঠিত নয়, তারা সংখ্যায় লক্ষ লক্ষ নয়। তারা রিপোর্ট করে মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের ফেসবুক থেকে হঠাতে পারবে না। রিপোটিংএর ভয়ে, খুনীদের ভয়ে নাস্তিক ব্লগাররা বেশিরভাগই ব্লগ লেখা বন্ধ করে দিয়েছে। ইত্তিলা ইতু, চার্বাক শুভ্রর মতো প্রগতিশীল ফেসবুকারদের আইডি এখন কাজ করছে না। আবদুল মামুন অসাধারণ ফেসবুকার। তার লেখা মানুষকে সচেতন করে। মানুষকে ভাবতে শেখায়। আবদুল মামুন প্রগতিশীল পাঠকদের মধ্যে জনপ্রিয়। একটি নাম। আবদুল মামুনের আইডি ৩০ দিনের জন্য নিষিদ্ধ করেছে ফেসবুক। সেও মৌলবাদীদের রিপোর্টিংএর শিকার। আইসিস, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আর আল কায়দার খুনী সন্ত্রাসীদের আইডি কিন্তু যেমন ছিল তেমন আছে। ফেসবুকের কর্তারা এত কিছু বোঝে, শুধু এটা বোঝে না কাদের রাখতে হয়, কাদের বিয়ে করতে হয়? ফেসবুক এখন সন্ত্রাসীদের প্রিয় জায়গা। এটিকে তারা সন্ত্রাস ছড়ানোর কাজে ব্যবহার করে। কী ভালোই না হতো ফেসবুক কর্মকর্তা যদি ফেসবুককে ধর্মান্ধতা, মৌলবাদিতা, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, খুন বন্ধ করার কাজেও ব্যবহৃত হতে দিতো। কিন্তু কী করে হবে, যদি রিপোর্টিং এর ব্যবস্থা থাকে এবং ফেসবুক ভর্তি থাকে জঙ্গী সন্ত্রাসীতে। আমি বুঝি না কেন ফেসবুকের কেউ যাচাই করে দেখে না কারা রিপোর্ট করে, এবং যাদের আইডি রিপোর্ট করে, তারাই বা কারা, তারা কী লেখে! যাচাই না করলে, এভাবেই চলতে দিলে যেভাবে চলছে, আজ হোক কাল হোক সব মুক্তচিন্তককে ফেসবুক থেকে বিদেয় নিতে হবে। নাস্তিক ব্লগাররা বাংলাদেশের নাগরিক। এই নাগরিকরা প্রতিদিন মৃত্যুর হুমকি নিয়ে জীবন যাপন করছে। তারা জানেনা কে কখন পেছন থেকে তাদের মাথায় কোপ বসাবে। বাংলাদেশ যদি কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে থাকে, তবে নাস্তিক ব্লগারদের নিরাপত্তা দেবে। আর যদি এটি সম্পূর্ণ ইসলামী রাষ্ট্র, তবে নিরাপত্তা দেবে না। বাংলাদেশ ঘোষণা করে দিক যে, এটি এখন সম্পূর্ণই ইসলামী রাষ্ট্র। ঘোষণা করুক, কোনও সভ্য আইন বলে কিছু নেই এ দেশে, এ দেশ শরিয়ার দেশ। মদিনা সনদ অনুযায়ী দেশ চলছে, এবং চলবে, এটা ফাইনাল। বলে দিক।

পড়ানো

উড্রো উইলসন ফেলো হিসেবে আমেরিকার বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি কিছুকাল পড়িয়েছিলাম। আগে কখনও তো ছাত্র ছাত্রী পড়াইনি। ওই প্রথম। প্রথম দিকে ক্লাসের চাপ অতিরিক্ত মনে হচ্ছিল।পরে, ধীরে ধীরে সবকিছু সহজ হয়ে গিয়েছিল। আসলে আমার পড়ানোগুলো কোনও সিলেবাস থেকে নয়। এক একটা ক্লাসে একেকটা বিষয় পড়াতাম। এর জন্য আমার কোনও পড়াশোনা করার দরকার হতো না। আমি যা জানি, যে বিষয়ে যতটুকুই আমার জ্ঞান, তা ই বলতে হতো। মানববাদ, নারীবাদ,বর্ণবাদ,শিল্প, সাহিত্য, যুদ্ধ, ধর্ম, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শান্তি– কী ছিল না বিষয়! ছাত্রছাত্রীরা বেশ খুশি ছিল, বেশ উত্তেজিত। আমার কত কত অভিজ্ঞতা যে শেয়ার করেছি। কিন্তু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দুএকজন ধর্মপ্রাণ প্রধান একসময় আপত্তি জানালেন, তাঁরা উড্রো উইলসন ফেলো প্রোগ্রামে জানিয়ে দিলেন, কী, আমি নাকি ধর্মের সমালোচনাটা বেশি করছি। আমার লেকচার কিছু ছাত্রছাত্রীর ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিচ্ছে। আমার চাকরি নট। ইওরোপের কোনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে পড়াতে হয়েছে। ধর্ম নিয়ে কনজারভেটিভ আমেরিকার মতো সমস্যা ওখানে নেই। লুক্সেমবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা ক্লাস নিয়েছি একদিন। নারীর অধিকার নিয়ে বলতে গিয়ে ধর্মের সমালোচনা করেছি, বিশেষ করে ক্রিশ্চিয়ানিটির। মন দিয়ে শুনেছে সবাই। বুদ্ধিদীপ্ত সব প্রশ্ন করেছে। ক্লাস শেষ হলে আমার সঙ্গে ছবি তোলার জন্য ব্যাকুল হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান অনুরোধ করেছেন, ফের কখনও লুক্সেমবার্গ এলে আবার যেন ক্লাস নিই।

পতিতাপ্রথা বন্ধ হোক

পতিতাপ্রথা নির্মূল করার জন্য ফ্রান্সে চমৎকার একটা আইন পাশ হয়ে গেল। মূল কথা হলো, শরীর বেচতে পারো তুমি, কিন্তু শরীর কিনতে পারো না। ধরা পড়লে পতিতার খদ্দেরকে পনেরোশ ইউরো জরিমানা দিতে হবে। পনেরোশ ইউরো বাংলাদেশের টাকায় এক লক্ষ আটান্ন হাজার আটশ তিপান্ন। পতিতাদের জন্য কোনও জরিমানা বা শাস্তির ব্যবস্থা নেই। বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, দুঃখিতা, নির্যাতিতা মেয়েদের বাঁচাবার জন্য আসলে শরীর বেচা অন্যায় নয়, পতিতাপ্রথা নির্মূল আইনে এই অংশটির অবতারণা। পতিতাপ্রথা বন্ধ করার আইন অনেক দেশই করেছে, কিন্তু সুইডেনই প্রথম এই অভিনব আইনটি তৈরি করেছিল, যৌন সম্পর্কের জন্য শরীর বিক্রি করা অন্যায় নয়, শরীর কেনা অন্যায়। কিন্তু এখানেই সবকিছুর শেষ নয়। পতিতাদের জন্য নতুন চাকরি বা ব্যাবসার ব্যবস্থা করা দেওয়া তো আছেই, অন্যের যৌন পুতুল না হয়ে নিজের মান মর্যাদা নিয়ে নতুন জীবন যাপনে যাওয়ার পথও তাদের দেখিয়ে দেওয়া হয়। সুইডেনের আইনটি ইউরোপের অনেক দেশকেই প্রভাবিত করেছে, এবং অনেক দেশই সুইডেনের এই আইনটি গ্রহণ করেছে। ফ্রান্সের প্রথম নারী অধিকার মন্ত্রী নাজাত বেলকাসেম ফ্রান্সে এই পতিতাপ্রথা বিলুপ্তির আইনটি পাশ করার ব্যাপারে সেদিন আমার একটা লেখা বের হয়েছে লা মন্দ নামের ফরাসি পত্রিকায়। নাজাত খুব উচ্ছ্বসিত আমার লেখাটি নিয়ে। নাজাত কিন্তু জাতে ফরাসি নন, মরক্কোর মেয়ে, মুসলমান। কিন্তু ফান্সেই লেখাপড়া করেছেন, বেড়ে উঠেছেন। তিরিশের কোঠায় বয়স, নারীবাদী, সংগ্রামী।

বাংলাদশ থেকেও যেন অচিরে পতিতাপ্রথার বিলুপ্তি ঘটে। সমগ্র বিশ্ব থেকেই যেন নারীবিরোধী এই প্রথাটি নির্বংশ হয়। ব্যাপারটি সোজা নয়, পতিতাপ্রথা টিকিয়ে রাখার জন্য নানা মহল উদগ্রীব, এতে কিছু নারী সংগঠন যেমন আছে, স্বয়ং পতিতারাও আছে।

ক্রীতদাসপ্রথার সঙ্গে পতিতাপ্রথার মূলত কোনও পার্থক্য নেই। ক্রীতদাসরা যখন তুলো ক্ষেতে চাষের কাজ করতো, দাসমালিকরা প্রায়ই সশরীরে উপস্থিত হয়ে কিছু ক্রীতদাসীকে যৌনকর্মের জন্য তুলে নিয়ে যেতো। ত্বক যাদের একটু কম কালো, সাধারণত তাদেরকেই পছন্দ করতো। বাজারে নিয়ে যৌন ব্যবসার জন্য ভাড়া খাটাতো, নয়তো সরাসরি পতিতালয়েই তাদের নগদ টাকায় বিক্রি করে দিতো। আঠারো/উনিশ শতকে যে প্রথাটিকে বলা হতো ক্রীতদাস প্রথা, বিংশ/একবিংশ শতকে সেই প্রথাকে বলা হচ্ছে পতিতাপ্রথা।

উনিশ শতকে ক্রীতদাসপ্রথার বিলুপ্তির সময় মানুষের ক্রয় বিক্রয় নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল বিরাট বিতর্ক। ক্রীতদাসদের মুক্তির প্রশ্ন উঠলে সমাজের অনেক সাদা ভদ্রলোক মন্তব্য করেছিলো, আফ্রিকার কালো মানুষগুলো আসলে ক্রীতদাস হিসেবেই ভালো আছে। স্বাধীনতা উপভোগ করার কোনও অধিকার বা যোগ্যতা তাদের নেই। সত্যি কথা বলতে কী, এই ক্রীতদাসদাসীগুলোর সঙ্গে যত না মানুষের মিল, তার চেয়ে বেশি জন্তু জানোয়ারের মিল।

শুধু সাদারা নয়, অনেক ক্রীতদাসীও এই প্রথার বিলুপ্তি চায়নি। বিশেষ করে সেই ক্রীতদাসীরা, যারা মালিকদের বাড়িতে বাচ্চাকাচ্চা দেখাশোনা, রান্না বান্না আর ঘরদোর পরিষ্কারের কাজ করতো। তাদের অবস্থা হাড়ভাঙা খাটুনি খাটা চাষের ক্ষেতের ক্রীতদাসীদের চেয়ে ভালো ছিলো। মালিকদের বাড়ির খাবার খেয়ে, যদিও উচ্ছিষ্ট, তৃপ্তই ছিলো বাড়ির ক্রীতদাসীরা। আসলে ক্রীতদাসীর জীবন ছাড়া অন্য কোনও জীবনের কথা তারা নিজেদের জন্য ঠিক কল্পনাও করতে পারতো না। বাড়ির ক্রীতদাসীরা না চাইলেও ক্ষেতের ক্রীতদাসীরা কিন্তু ক্রীতদাসপ্রথার বিলুপ্তি চেয়েছিলো।

আমরা আজ সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি করছি। পতিতাপ্রথার পক্ষে সাধারণত যারা মুখর তারা নিজেরা কখনও পতিতা ছিলোনা বা যৌনব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলো না, পতিতালয়ের বা পতিতাপ্রথার নির্যাতন তাদের সইতে হয়নি। যৌনব্যবসায় জড়িত এমন অনেক মেয়েও পতিতাপ্রথার পক্ষে বলছে। তারা বলছে, অন্য যে কোনও শ্রমের মতো পতিতাবৃত্তিও শ্রম। আগ বাড়িয়ে এও কেউ কেউ বলছে যে এই শ্রম নাকি সমাজে মেয়েদের ক্ষমতায়নে সাহায্য করছে।

কলগার্ল হিসেবে যারা কাজ করে, ম্যাডামএর ভূমিকায় যারা, তাদের অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে রাস্তার পতিতাদের চেয়ে ভিন্ন। তাই পতিতাদের উঁচু শ্রেণী, মাঝারী শ্রেণী, আর নিচু শ্রেণীতে ভাগ করার একটা প্রবণতা দেখা দেয়। এ কিন্তু অনেকটা সেই ক্রীতদাসীর শ্রেণীভাগের মতো। বাড়ির ক্রীতদাসীরা উঁচু শ্রেণীর ক্রীতদাসী, আর ক্ষেতে খাটা ক্রীতদাসীরা নিচু শ্রেণীর ক্রীতদাসী। তা ঠিক, তবে সবচেয়ে নিষ্ঠুর সত্য হলো, তারা সবাই ক্রীতদাসী। এক মালিকের অধীনেই তাদের দাসত্ব করতে হয়েছে। দাসত্ব চকচক করলেই দাসত্বের সংজ্ঞা পাল্টে যায় না। যে মেয়েরা আজ এই পতিতাপ্রথার ভেতরে থেকে এই প্রথার পক্ষে কথা বলছে, এই প্রথা থেকে তারা না বেরিয়ে এলে তাদের পক্ষেও বোঝা সম্ভব নয় প্রথাটি ঠিক কী। বাড়ির ক্রীতদাসীদেরও ক্রীতদাসপ্রথার বাইরে এসে বুঝতে হয়েছে ক্রীতদাসপ্রথাটা ঠিক কী ছিল।

ক্রীতদাসপ্রথা আর পতিতাপ্রথার মূলে আছে খাঁটি দাসত্ব। শুধু পরিচয়টা দুক্ষেত্রে ভিন্ন হতে হয়। পতিতাপ্রথার জন্য দরকার যৌন পরিচয়, ক্রীতদাসপ্রথার জন্য দরকার বর্ণ পরিচয়। এই দুই প্রথা ও প্রতিষ্ঠান একই প্রকৃতির। একই প্রক্রিয়ায় মানুষের ওপর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার চালানো হয়। মানুষকে অসম্মানিত, অপমানিত, নির্যাতিত ও নিগ্রীহিত করা হয়।

এই পৃথিবীতে মেয়েদের বিরুদ্ধে একটা যৌনযুদ্ধ চলছে। দীর্ঘ দীর্ঘ কাল এই যুদ্ধটা চলছে। এটাকে পৃথিবীর প্রাচীনতম পেশা বলে লোককে ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা হয় বটে, আসলে এটা কিন্তু প্রাচীনতম পেশা নয়, এটা বরং মেয়েদের বিরুদ্ধে পৃথিবীর প্রাচীনতম নির্যাতন। শুধু প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের বিরুদ্ধে বলাটা ঠিক নয়, মেয়েশিশুদের বিরুদ্ধেও বটে। আজ বিশ্বের প্রায় সর্বত্র শিশুদের জোর জবরদস্তি করে, ভয় দেখিয়ে, ধর্ষণ করে, মেরে আধমরা করে যৌনক্রীতদাসী বানানো হচ্ছে। পুরুষের যৌনক্ষুধা মেটাতে, পুরুষের শরীরকে কিছুক্ষণের জন্য পুলক দিতে লক্ষ কোটি অসহায় মেয়ে ও শিশুকে বেঁচে থাকার সর্বসুখ বিসর্জন দিতে হচ্ছে, মানুষ হয়েও মানুষের ন্যূনতম অধিকার থেকে তারা নিজেদের বঞ্চিত করতে বাধ্য হচ্ছে।

পতিতাপ্রথার সহজ সংজ্ঞা হলো, মেয়েদের বিরুদ্ধে পুরুষের যৌন নির্যাতন। আরও একটু খুলে বললে পতিতাপ্রথার মানে মেয়েদের বিরুদ্ধে পুরুষের যৌন হেনস্থা, ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, মেয়েদের ওপর পুরুষের অবাধ আধিপত্য, মেয়েদের মানবাধিকার লঙ্খন। এসব যদিও যে কোনও গণতন্ত্রে আইনত নিষিদ্ধ, কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পতিতালয়ের ভেতরে এসব বহাল তবিয়তে চলছে। যতটা ঘৃণ্যতম, কুৎসিততম, জঘন্যতম, উৎকটতম, কদর্যতম, নিকৃষ্টতম ব্যবহার কোনও মেয়ের সঙ্গে করা সম্ভব পুরুষের, তা নির্দ্বিধায় পুরুষেরা করে পতিতাদের সঙ্গে। যদিও এই ব্যবহার করলে আইনের চোখে তারা অপরাধী, কিন্তু পতিতাবৃত্তিকে বৈধ করলে এইসব অপরাধকে আপনাতেই বৈধ বলে মেনে নেওয়া হয়।

বাংলাদেশে কত কোটি পতিতা এখন, জানি না। সম্ভবত পৃথিবীর অনেক দেশের জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। অভাবের তাড়নায় বাবার বিক্রি করে দিয়েছে মেয়েকে। প্রতারক প্রেমিকেরা বিক্রি করেছে, স্বামীরা জোর করে পতিতালয়ে পাঠিয়েছে যেন শরীর বেচে টাকা রোজগার করে স্বামীর ঘূর্তির আর সংসারের খরচ চালায়। পতিতাবৃত্তির সঙ্গে নারীপাচার অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এ দুটো একে অপরের পরিপুরক। যারা দাবি করে পতিতালয়ের সব মেয়েই প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে, স্বেচ্ছায় এই পেশায় নাম লিখিয়েছে, তারা মিথ্যে বলে। পতিতালয়ের মেয়েদের বেশির ভাগই শিশু, বেশির ভাগকেই জোর করে বা ভুলিয়ে ভালিয়ে বা অপহরণ করে এনে বিক্রি করা হয়েছে। পতিতার জীবন সাধারণত মেয়েরা বারো তেরো বছর বয়সে শুরু করে। ওই বয়সে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার কোনও স্বাধীনতা থাকে না, নানারকম বয়স্ক পুরুষের ধর্ষণ থেকে নিজেকে বাঁচানোর কায়দাও জানা থাকে না।

পতিতাবৃত্তিতে মেয়েদের দারিদ্র ঘোচে না। কোটি কোটি টাকা যা আয় হচ্ছে যৌন-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে, সেসব টাকা পতিতাদের বা নির্যাতিত মেয়েদের হাতে পৌঁছয় না। মেয়েরা প্রতিদিন নারী পাচারকারী, আর দালালের ভয়াবহ সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছে। মেয়েরা এই যৌন নির্যাতন থেকে বেরোতে চায়, কিন্তু তাদের বেরোতে দেওয়া হয় না। পছন্দমতো কোনও পেশা বেছে নেওয়ার কোনও অধিকার তাদের নেই।

নারী নির্যাতনকে কোনও না কোনও যুক্তিতে যারা মেনে নেয়, তারা দিব্যি দাবি করে মেয়েরা স্বেচ্ছায় পতিতা হয় না। কোনও মেয়েই শখ করে, পছন্দ করে, সংগ্রাম করে পতিতা হয় না। অন্য কোনও বৃত্তিতে যাওয়ার জন্য যত সংগ্রাম আছে, সেই সবকটি সংগ্রামে ব্যর্থ হয়েই পতিতা হয়। মেয়েরা স্বেচ্ছায় অসম্মানিত, অপমানিত আর অত্যাচারিত হতে চায় না। মেয়েরা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করে না যৌন নির্যাতন।

পতিতা বানাতে মেয়েদের বাধ্য করে পুরুষেরা। যদি মেয়েরা চায় পতিত হতে, নিশ্চয়ই কোনও না কোনও কারণে বাধ্য হয়ে চায়। বাধ্য হয়ে চাওয়া আর স্বেচ্ছায় চাওয়ার মধ্যে এক সমুদ্র ব্যবধান। কোনও মেয়ে শখ করে আগুনে ঝাঁপ দেয় না। সতীদাহের আগুনে মেয়েদের ছুঁড়ে দিয়ে বলা হতো মেয়েরা স্বেচ্ছায় ওই আগুনে ঝাঁপ দিয়েছে। যে বউরা স্বামীর মার খায়, সেই বউদেরও বলা হয় স্বামীর মার খেতে তাদের ভালো লাগে। যারা চায় বউরা স্বামীর মার খাক, তারাই এই রটনা রটায়।

ক্রীতদাসরা যেমন চাইতো ক্রীতদাসপ্রথার বিলুপ্তি, পতিতারাও পতিতাপ্রথার বিলুপ্তি চায়। যে ব্যবসায়ীরা মেয়েদের যৌনবস্তু বানিয়ে ব্যবসা করে লাভবান হচ্ছে, তারা মেয়েদের মুখ দিয়ে বলাতে চায় যে মেয়েরা পতিতা প্রথাকে টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী। মেয়েদের মানবাধিকারের ব্যাপারটি যেন গণনার মধ্যে আনা না হয়, তাই এই আয়োজন। আর তা ছাড়া, ক্রীতদাস হতে চাই বলে কেউ যদি চিৎকার করে, তাকে কি ক্রীতদাস হওয়ার সুযোগ করে দেবো। কেউ যদি বলে শেকলে বেঁধে তাকে প্রকাশ্যে পেটানো হোক। পেটাবো? নিশ্চয়ই তাকে মানসিকভাবে সুস্থ করে তোলার ব্যবস্থা করবো, আর যেসব কারণে অন্যায় আবদার সে করছে বা করতে বাধ্য হচ্ছে, সেই কারণগুলো দূর করবো।

মানুষের ওপর ঘৃণ্য আর অমানবিক নির্যাতনের কারণে ক্রীতদাসপ্রথা আজ বিশ্বে নিষিদ্ধ। কিন্তু কী কারণে পতিতাপ্রথাকে আজও পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ নির্মূল করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না! গর্দভরা গালভরে উচ্চারণ করছে যে যুক্তিহীন কারণগুলো, সেগুলো কিন্তু সত্যিকার কারণ নয় যে এই প্রথাটি টিকে ছিলো, সুতরাং টিকে থাকবেই অথবা বাজে চরিত্রের মেয়েরা এই পেশা চালিয়ে যাবেই। এই প্রথাটি মেয়েদের মন্দ চরিত্রের জন্য নয়, ক্ষমতাবান এবং বদ পুরুষেরা এই প্রথাকে ছলে বলে কৌশলে টিকিয়ে রাখছে বলে টিকে আছে। আরও একটি ভুল সংশোধনের প্রয়োজন আছে। শরীর বিক্রি করা কিন্তু পৃথিবীর প্রাচীনতম পেশা নয়। চাষ করা, হাতিয়ার বানানো বা ইত্যাদি ছিল মানুষের প্রাচীনতম পেশা। এক গোত্র আরেক গোত্রের সঙ্গে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিনিময়ের মাধ্যমে বাণিজ্য করতো।

আজ পতিতাপ্রথা বা যৌন নির্যাতন পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম তো বটেই, সবচেয়ে দ্রুত গতিতে বেড়ে ওঠা সফল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এই কারখানার কাঁচামাল দুর্ভাগা, অনাথ, শিশুদের দরিদ্র আর প্রতারিত মেয়েদের শরীর।

সভ্য দেশগুলো এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। দেশগুলোর মধ্যে সুইডেনই প্রথম নারীনির্যাতন ব্যবসাটিকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করার পদক্ষেপ নিয়েছে। পতিতাপ্রথাকে সরকারিভাবে নারীর ওপর পুরুষের জঘন্য যৌন নির্যাতন হিসেবে ঘোষণা করেছে সুইডেন। পতিতা ব্যবসাকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। তবে শরীর কেনা নিষিদ্ধ। যে পুরুষই শরীর কিনতে চায়, সেই অপরাধী হিসেবে গণ্য হয়। শরীর কেনার লোক না থাকলে, শরীরের বাজার হাট আপনাতেই উঠে যায়। পুরুষের আনন্দ স্ফুর্তির জন্য পুরুষরাই টিকিয়ে রেখেছে এই যৌন নির্যাতনের ব্যবসা। সুইডেনে শরীর বিক্রি কিন্তু নিষিদ্ধ নয়। নিষিদ্ধ নয় বলে দুর্ভাগা দরিদ্র মেয়েরা যারা শরীর বিক্রি করার জন্য রাস্তাঘাটে দাঁড়িয়ে থাকে বা এদিক ওদিক খদ্দের খুঁজে বেড়ায়, তারা পুলিশি হেনস্থার শিকার হয় না। অপদস্থ করা তো দূরের কথা, তাদের স্পর্শ করাও অপরাধ। কিন্তু যেই না কোনও পুরুষ কোনও মেয়েকে কিনতে নেবে, অমনি ক্রেতা পুরুষের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেওয়া হবে। নিরানব্বই সালে এই আইনটি জারি করার পর সুইডেনে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে পতিতাবৃত্তি। এভাবেই রোধ করা যায়। এই নারী নির্যাতন ব্যবসা। অনেকের প্রশ্ন, পতিতারা শরীর বিক্রি ছাড়া অন্য আর কোনও কাজ করতে পারবে কি না। প্রথমেই মনে রাখতে হবে পতিতাবৃত্তি কোনও পেশা নয়, পতিতাবৃত্তি নির্ভেজাল যৌন ক্রীতদাসীত্ব, যৌন নির্যাতন।

ভারতের আইনে পতিতালয়ের ভেতরে মেয়েদের ওপর যৌন নির্যাতন চললে অসুবিধে নেই। পতিতালয়ের সীমানা ডিঙোলে ভদ্র পরিবেশকে কলুষিত করার দায়ে পতিতাদের লাঞ্ছিত করা হয়। যারা মূল অপরাধী, যারা নির্যাতনকারী, তাদের শাস্তি না দিয়ে মেয়েদের, নির্যাতিতদের দেওয়া হয় শাস্তি। ভারতেও যদি আজ সুইডেনের আইনের মতো শরীর ক্রয় করা নিষিদ্ধ হয়, তাহলে নারী নির্যাতনের ব্যবসা এত ফুলে ফেঁপে উঠবে না।

পতিতাপ্রথাকে বৈধ করা মানে নারী নির্যাতনকে বৈধ করা। যে রাষ্ট্রে পতিতাপ্রথা বৈধ সেই রাষ্ট্র সত্যিকার কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। গণতন্ত্র মানবাধিকার নিশ্চিত করে, নারী পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করে। কোনও সভ্যতা বা কোনও গণতন্ত্র মানুষের ওপর নির্যাতনকে ছল ছুতোয় মেনে নেওয়ার চেষ্টা করে না। করতে পারে না। যদি করে, সেই গণতন্ত্রের নাম নিতান্তই পুরুষতন্ত্র, আর সেই সভ্যতার নাম বর্বরতা ছাড়া অন্য কিছু নয়।

পাকিস্তানে খুন

পাকিস্তানে খুন কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। সুন্নিরা আহমদিয়া, শিয়া, বেলুচ, খ্রিস্টানদের মারছে। কারও সঙ্গে মতে মিলছে না তো মেরে ফেলছে। এই খুনখারাবির দেশে কোনও কোনও খুনের খবর পড়লে গা কেঁপে ওঠে। দীর্ঘশ্বাস বেরোয়। চোখে জল আসে। পাকিস্তানি খুনীরা দুদিন আগে মেরে ফেললো বহুমুখী প্রতিভার উজ্জ্বল তরুণী সাবিন মাহমুদকে।

সাবিন মাহমুদ অনেক কিছু নিয়ে মাথা ঘামাতেন। মানবতাবাদ, নারীবাদ, মুক্তচিন্তা, আর্ট কালচার। নিজে একটা ক্যাফে খুলেছিলেন, ক্যাফের সঙ্গে ছিল স্পেস। একটা জায়গা, যেখানে মানুষ আসবে, বিভিন্ন বিষয়ে তাদের ভিন্ন মত প্রকাশ করবে। যেখানে আবার চিত্রপ্রদর্শনীও হবে। জায়গাটার নাম দিয়েছিলেন দ্য সেকেন্ড ফ্লোর। নিজে সেতার বাজাতেন। বড় মিউজিক ফেস্টিভ্যালের আয়োজক ছিলেন। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটা দলও গড়ে তুলেছিলেন। এই সাবিন মাহমুদকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে।

সমাজের জন্য ভালো কাজ করলে কিছু না কিছু শত্রু জন্মায়। সাবিন মাহমুদের শত্রু অল্প বিস্তর ছিল। ভ্যালেন্টাইনস ডে করতে দেবে না বলে করাচির মুসলিম মৌলবাদিরা লাফালাফি করলে সাবিন মাহমুদ ওদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। আর বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদী মামা আবদুল কাদিরকে তাঁর নিজের গড়ে তোলা দ্য সেকেন্ড ফ্লোরএ কথা বলার সুযোগ দিয়ে জাতীয়তাবাদীদের সেদিন শত্রু বানালেন। মামা আবদুল কাদির হারিয়ে যাওয়া বেলুচদের খোঁজ পাওয়ার জন্য আন্দোলন চালাচ্ছেন। ওই হারিয়ে যাওয়াদের মধ্যে নিজের পুত্রও ছিল। ২০০৯ সালে হারিয়ে যাওয়া পুত্রকে দুবছর পর উদ্ধার করেন। তবে অক্ষত এবং জীবিত অবস্থায় নয়। শরীর ছিন্নভিন্ন, মৃত। পাক আর্মির লোকেরা বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এভাবেই তুলে তুলে নিয়ে মেরে ফেলে। ওদের অভ্যেস আছে কাউকে পছন্দ না হলে মেরে ফেলা। সাংবাদিকরাও অনেকে এভাবে মারা পড়েছে। বেলুচদের ওপর পাক আর্মির অত্যাচারের প্রতিবাদে আবদুল কাদির ১২০০ মাইল হেঁটেছিলেন বেলুচ রাজধানী কেটা থেকে ইসলামাবাদ পর্যন্ত। সরকারের চক্ষুশূল এই ৭৩ বছর বয়সী বৃদ্ধ মামা আবদুল কাদির। সরকার একবার তাঁকে আমেরিকা যেতে দেয়নি, আমেরিকায় মানবাধিকার বিষয়ে এক সেমিনারে অংশ গ্রহণ করার কথা ছিল তাঁর। এ মাসেই লাহোর বিশ্ববিদ্যালয় একটা অনুষ্ঠান বাতিল করে দিতে বাধ্য হয়েছে, যে অনুষ্ঠানে আবদুল কাদিরের অংশগ্রহণ করার কথা ছিল। বেলুচিস্তানকে কথা বলতে দাও- এই বিষয়ে যে সেমিনার হচ্ছিল দ্য সেকেন্ড ফ্লোরে, সেই সেমিনার সম্পর্কে মিডিয়াকে বলে দেওয়া হয়েছিল লেখালেখি না করতে। খুব বেশিদিন আগের ঘটনা নয়, কাদিরকে নিয়ে পাক আর্মির সঙ্গে টিভির সাংবাদিক হামিদ মীর তর্ক করার পর হামিদ মীরকে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়।

বেলুচিস্তান আলাদা হয়ে গেলে পাকিস্তানের চলবে না। ওখানকার খনিজপদার্থ পাকিস্তানের দরকার। আর চীনের সঙ্গে বেলুচিস্তানের ওপর দিয়ে করিডোর বানানোর হাজার কোটি টাকার চুক্তিও হয়ে গেছে। কট্টর জাতীয়তাবাদিরা পাকিস্তান আবার বিভক্ত হোক চায় না। পূর্ব পাকিস্তানের আলাদা হয়ে যাওয়া এখনও তাদের অশান্তি দেয়। অনুমান করতে পারি, এই কট্টর জাতীয়তাবাদী কারা। পাক আর্মির ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টিলিজেন্স। নটোরিয়াস আইএসআই।

সাবিন মাহমুদ সবে বেলুচিস্তানের ওপর একটা সেমিনার থেকে বেরোচ্ছিলেন, ওই দ্য সেকেণ্ড ফ্লোর থেকেই বেরোচ্ছিলেন, গাড়িতে উঠবেন, তখনই পাঁচটা বুলেট এসে লাগে ওঁর শরীরে। আমি ঠিক বুঝে পাচ্ছি না, কাদিরকে খুন না করে সাবিনকে কেন খুন করা হয়েছে। কাদিরকে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর কারণেই যদি আততায়ীর রাগ সাবিনের ওপর পড়ে, তবে কাদির বেলুচিস্তানকে আলাদা করতে চাইছে, কাদিরই যত নষ্টের মূল, এই নষ্টের মূলটাকে মেরে ফেললেই তো ল্যাঠা চুকে যেতো, তাকে কোনও অনুষ্ঠানে কেউ আর ডাকতে পারতো না। ৭৩ বছর বয়সের এই বৃদ্ধকে যখন খুশি, যেভাবে খুশি মেরে ফেলা তো আইএসআইএর জন্য মোটেও কঠিন কোনও কাজ নয়।

সাবিন মাহমুদের কথা ভাবছিলাম আর ভাবছিলাম বাংলাদেশের রাজিব হায়দার, অভিজিৎ রায় আর ওয়াশিকুর বাবুর কথা। পাকিস্তানে এখনও গুলি করে মারা হয়। বাংলাদেশে আজকাল মারা হয় কুপিয়ে। অভিজিৎ আর ওয়াশিকুর ইন্টারনেটের মাধ্যমে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছিলেন সমাজ পরিবর্তনের জন্য। সাবিনের স্বপ্ন ছিল ইন্টারনেটের মাধ্যেম সমাজ পরিবর্তন করবেন। মাঠঘাটের অ্যাকটিভিস্টদের না হয় সহ্য হয়, এই ড্রিমারদেরই কিছুতেই সহ্য হয় না প্রতিক্রিয়াশীল রক্ষণশীল ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর। অ্যাকটিভিস্টদের হুমকি দিলে হয়তো মৃত্যুভয়ে পিছিয়ে যাবে। ড্রিমারদের পিছু হঠানো, ভয় পাওয়ানো সম্ভব নয়। ড্রিমাররা তাদের স্বপ্ন ছড়িয়ে দেন অন্যদের মধ্যে। অন্যরাও স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।

পাটনা

একবার পাটনা বইমেলায় গিয়েছিলাম। আমার বইয়ের উদ্বোধন হলো। আমার বই মানে আমার বাংলা বইয়ের হিন্দি অনুবাদ। আমার প্রায় সব বইয়েরই হিন্দি অনুবাদ বেরিয়েছে। আমার কোন বইটির সেদিন উদ্বোধন হয়েছিল সে আর মনে নেই। ৫০ হাজার লোক এসেছিলো বইমেলায়। বইমেলা শেষ হওয়ার পর একদিন চিড়িয়াখানা দেখেছিলাম টয় ট্রেনে চড়ে। পাটনায় সরকারি গেস্ট হাউজে ছিলাম। সরকার যত্ন নিয়েছিলেন ভালো। একসময় ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হতো। বিভিন্ন রাজ্য আমাকে সম্মান জানাতো। ২০০৭এ হায়দারাবাদি মুসলমানরা আমাকে আক্রমণ করার পর আর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য আমাকে রাজ্য থেকে বের করে দেওয়ার পর সব বন্ধ হয়ে গেছে। কোনও রাজ্যই এখন আমাকে আমন্ত্রণ জানাতে সাহস করে না। আমন্ত্রণ তো দুরের কথা, কোনও রাজ্যে প্রবেশের অনুমতিই নেই। কী দ্রুত ব্রাত্য হয়ে গেলাম। দোষ করলো অন্য লোকে, শাস্তি পাচ্ছি আমি।

পুরোনো পাপী

আমি পুরোনো পাপী। নারীর সমানাধিকারের কথা লিখতে গিয়ে দুনিয়ার সব ধর্মের কাপড় খুলে ছেড়ে দিয়েছি। আমার বিরুদ্ধে যখন বাংলাদেশ উত্তাল, যখন মৌলবাদী সন্ত্রাসী আর দেশের সরকার মিলে মিশে আমার বিরুদ্ধে হেন বদমাইশি নেই করছে না, তখন কিন্তু এখনকার অনেক নাস্তিক ব্লগারের জন্মও হয়নি। সেই আশির দশক থেকে বাংলাদেশের আগপাশতলা ইসলামের পানি দিয়ে ধোয়া হচ্ছে, ইসলামের সোনা দিয়ে মোড়ানো হচ্ছে। তার ফল এখন হাতে নাতে পাচ্ছে সবাই। আমাকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছে বলে আজও প্রাণে বেঁচে আছি। এখন দেশের তরুণ নাস্তিক ব্লগারদের এক এক করে কুপিয়ে মারা হচ্ছে। প্রাণ বাঁচানোর জন্য এরা এখন দেশের বাইরে বেরোতে চাইছে। কিছুদিন আগে যুগান্তর পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো পুলিশের এক বিশেষ রিপোর্ট। আনসারুল্লাহ বাংলাটিম নাকি ভারতে তিনটে স্লিপার সেল পাঠিয়েছে আমাকে মেরে ফেলার জন্য। আমি ইউরোপের নাগরিক, আমেরিকার গ্রীনকার্ড ধারী। আমি বিপদের আঁচ পেলে উড়াল দিতে পারবো। কিন্তু বাংলাদেশের ব্লগাররা বেরোবে কী করে? সবাই ভাবছে, এর পরের ভিকটিম বোধহয় সে ই। আমি লিখেছি অনেক, হাসিনা যেন নাস্তিক ব্লগারদের,যাদের জীবনের হুমকি আছে, নিরাপত্তা দেন। আমার কথা হাসিনা শুনবেন কেন? হু এম আই? তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রী। বিশাল জিনিস। আসল কথা হলো, হাসিনা পরের নির্বাচনে জেতার জন্য মৌলবাদী পটাচ্ছেন, তিনি নিরাপত্তা তো দেবেনই না, খুনীদের বিরুদ্ধেও কোনও ব্যবস্থা নেবেন না। এই দুঃসহ অবস্থায় দেশ ত্যাগ করা ছাড়া নাস্তিক ব্লগারদের আর কোনও উপায় নেই। আপাতত বাঁচুক। দেশের অবস্থা ভালো হলে না হয় ফিরবে দেশে। কিন্তু শাহরিয়ার কবির চান না ব্লগাররা দেশ ছাড়ক। তিনি বলছেন, এতে লাভ হবে না, জামাতি ইসলামিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। জামাত নিষিদ্ধ হলে সন্ত্রাসীরা নাস্তিকদের খুন করবে না? কোনও গ্যারেন্টি নেই। এতকাল যাবৎ জামাতি ইসলামির বাইরেও লক্ষ লক্ষ মৌলবাদী-সন্ত্রাসীর জন্ম হয়েছে, তারা জামাতির চেয়েও লক্ষ গুণে ভয়ংকর। তারা আইসিস-আলকায়দার নির্দেশে চলে। শাহরিয়ার কবির বললেন তিনি একা বাইরে বেরোন না, আর বেরোলে সঙ্গে লোক থাকে এবং হাতে পিস্তল থাকে। শাহরিয়ার কবির না হয় পিস্তল এবং পিস্তলের লাইসেন্স জোগাড় করতে পারলেন। কিন্তু অল্প বয়সী নাস্তিক ব্লগাররা পিস্তল কোত্থেকে জোগাড় করবে, লাইসেন্সই বা তাদের কে দেবে? যে সরকার তাদের কোনও দেহরক্ষী দেয় না, সে সরকার দেবে লাইসেন্স?

প্রতিবাদ

টুপ টুপ করে সবাই তো সাহিত্য আকাদেমি প্রাইজ ফেরত দিচ্ছেন। আমি হলেও দিতাম। লেখক কালবুরগিকে হত্যা করার পর সাহিত্য আকাদেমি চুপ করে বসে থাকলে, প্রতিবাদ না করলে, রাগ তো হতোই। গরুর মাংস খেয়েছে বলে কাউকে মেরে ফেলা হবে, এ তো আমিও মানি না। এ নিয়ে লিখেছি, খুনীদের ধিক্কার দিয়েছি। পত্রিকায় কলাম লিখে, টুইট করে, ফেসবুকে লিখে কালবুরগি হত্যার প্রতিবাদ করেছি। শুধু কালবুরগি নয়, দাভোলকার, পানসারে হত্যার প্রতিবাদও করেছি। এখানেই থেমে থাকিনি, ভারতবর্ষে আমাকে যারা আক্রমণ করেছে, যে মুসলিম মৌলবাদীরা, যে বামপন্থীরা, যে ডানপন্থীরা –তাদের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদও আমি করেছি। আমার বই যারা নিষিদ্ধ করেছে, আমাকে রাজ্য থেকে যারা তাড়িয়েছে, আমার বইয়ের উদ্বোধন যারা বাতিল করেছে, আমার মেগাসিরিয়াল যারা বন্ধ করেছে, তাদের অসহিষ্ণুতার প্রতিবাদ আমি প্রচুর করেছি। কিন্তু যাঁরা আজ আকাদেমি পুরস্কার ফেরত দিচ্ছেন, তাঁদের কাউকে কিন্তু আমার ওপর কোনও সরকারি বা বেসরকারি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে দেখিনি। আমি ভারতীয় নই বলে? কিন্তু অন্যায় যারা করেছে তারা তো ভারতীয়। অত্যাচারিতরা অন্য দেশের হলে অত্যাচারীর সাত খুন মাপ– তাই বুঝি?

ফাঁসি

দুটো লোককে ফাঁসি দেবে বলে বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ আজ উত্তেজিত। ভায়োলেন্স খারাপ লোকেরা করে, ইলিগ্যালি করে। এখন রাষ্ট্র করছে ভায়োলেন্স, লিগ্যালি। চোখের বদলে চোখ নিচ্ছে। দাঁতের বদলে দাঁত নিচ্ছে। রাষ্ট্র বোধহয় ভায়োলেন্স শেখায় মানুষকে, এভাবেই। খুনী আর রাষ্ট্রের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য দেখতে পাই না। কাউকে ফাঁসি দিলেই যে পার্থক্যটা দেখিনা তা নয়, ব্লগার-লেখকদের যারা খুন করেছে তাদের বিরুদ্ধে যখন রাষ্ট্র কোনও ব্যবস্থা নেয় না, বরং খুনীর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলে কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিলে কিন্তু সইবো না, তখনও পার্থক্যটা দেখি না।

ইসলামের জন্য যারা একাত্তরে মানুষ খুন করেছিল, তাদের ফাঁসি হচ্ছে আজ। ইসলামের জন্য যারা ২০১৪/২০১৫ সালে মানুষ খুন করেছে, তাদের বিচার পর্যন্ত হচ্ছে না। এই ইনজাস্টিসটাও কি রাষ্ট্র শেখাচ্ছে না? মানুষকে সভ্য শিক্ষিত সচেতন সংবেদনশীল হিসেবে গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রের কি কোনও ভূমিকা আছে? মানবাধিকার সম্পর্কে কিছু শিক্ষা কি রাষ্ট্র কখনও দিয়েছে কাউকে?

মানুষকে খুনী বানাবার সব রকম রসদ মন্ত্র পুঁথি পত্র ওয়াজ খুৎবা দেশে বৈধ। কিন্তু খুন বৈধ নয়। নিতান্তই অক্সিমরন। তারচেয়ে এটা ভালো নয়, খুনী বানিয়ো না কাউকে, খুনও কোরো না কাউকে? অবশ্য আজকাল জঙ্গীবাদ যেভাবে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ছে, একে রোধ করা কী করে সম্ভব, তা হয়তো অনেকেই আমরা জানি না। তবে এটা ভালো বুঝি, ফাঁসি দিয়ে, মেরে, কোনও সমস্যার সত্যিকার সমাধান হয় না। সুশিক্ষাটা ছড়িয়ে পড়া দরকার। বিশ্বময়। ফাঁসি হলো সহজ সমাধান, সুশিক্ষা ছড়ানোটা কঠিন। কঠিনকেই ভালোবাসতে হবে।

ফেসবুক

গত পরশু আমার ফেসবুক আইডি ভ্যানিশ করে দিয়েছে ফেসবুক কর্তারা। এই জঘন্য ব্যবহার নতুন নয়, এর আগেও একই কাণ্ড করেছে ফেসবুক। আইডি আর ফেরত দেয়নি। আইডি ভ্যানিশ করা মানে পেজ টেজ সহ পারসোনাল একাউন্ট গায়েব করে দেওয়া। আর একাউন্টের সঙ্গে যে সব ইমেইল বা মোবাইল ফোন জড়িত থাকে, সেগুলোকেও কালো তালিকাভুক্ত করে দেওয়া। ওই ইমেইল বা মোবাইল নতুন করে ফেসবুক একাউন্ট খুলতে আর ব্যবহার করা যায় না। যত ইমেইল আছে। আমার, যত মোবাইল আছে, সবই ফেসবুক দ্বারা কালো তালিকাভুক্ত।

আমাকে আমার নামে একাউন্ট খুলতে দেয়না ফেসবুক। তাই গতবার নামটা উল্টে, তসলিমা নাসরিনের জায়গায় নাসরিন তসলিমা লিখে আমাকে একাউন্ট খুলতে হয়েছিল। আমার নামটি কিন্তু অন্যদের ব্যবহার করতে দিচ্ছে ফেসবুক। এই নামে অন্যদের একাউন্ট খুলতে সুবিধে করে দিচ্ছে। একবার গুনে দেখেছিলাম তসলিমা নাসরিন নামে অন্তত একহাজার ফেক একাউন্ট আছে ফেসবুকে।

যতবারই আমি ফেসবুকে একাউন্ট খুলেছি বা পেইজ শুরু করেছি, জনপ্রিয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেসবের বিরুদ্ধে ধর্মান্ধ নারীবিরোধী সন্ত্রাসী জল্লাদরা ফেসবুকে রিপোর্ট করেছে। ফেসবুক পলিসি অত্যন্ত খারাপ একটা পলিসি। আমার শত্রুরা অনেকে মিলে রিপোর্ট করলেই আমি বাতিল হয়ে যাবো, ফেসবুক কর্তারা বিচার করবে না কে ভালো কে মন্দ। ফেসবুক কর্তারা আমার বাংলা স্ট্যাটাসগুলো অনুবাদ করে দেখবে না কী লিখি আমি? যারা আমার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করে, তারা ফেসবুক কী কারণে ব্যবহার করে? ফেবুককে তারা ধর্মীয় সন্ত্রাস ছড়ানোর উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে, ফেসবুককে তারা নারীবিদ্বেষ ছড়ানোর কাজে ব্যবহার করছে। ফেসবুক কোন পক্ষ নেবে, সমাজকে ধ্বংস করার কাজে যারা ফেসবুক ব্যবহার করে? নাকি সমাজকে নির্মাণ করার কাজে যারা ফেসবুক ব্যবহার করে?

পুঁতিগন্ধময় বৈষম্যের সমাজকে যারা বদলাতে চায়, মানুষকে যারা সমতা, সমানাধিকার, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলে, যারা মানুষকে ভালো কাজের জন্য প্রেরণা দেয়, পুরুষতান্ত্রিক রক্ষণশীল গণ্ডমূর্খরা যাদের বিপক্ষে লাফায়, তাদের কোনও অধিকার নেই ফেসবুকে থাকার?

ফেসবুক তবে কি শুধু অজাতশত্রুকেই চায়! যার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করার কেউ নেই, যার লেখা সবারই সক্কলেরই পছন্দ হবে? ছিঃ ফেসবুক ছিঃ। আজ সারা পৃথিবীর মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করছে। এটি কোনও ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান নয়। আজ এই প্রতিষ্ঠানের আচার ব্যবহার সস্তা রোবোটের মতো।

ফেসবুকে যত একাউন্ট আছে তসলিমা নাসরিন নামে, সব ফেক, সব নকল। এইসব ফেক একাউন্ট যারা বানিয়েছে, তারা মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্যই বানিয়েছে। মানুষ মনে করছে ওই একাউন্টগুলো বোধহয় আমার। আর তারা আমার কথা বলে তাদের নিজের কথা গেলাচ্ছে নিরীহ পাঠকদের। ফেসবুক কর্তাদের আমি অনেক বলেছি ওই ফেক একাউন্টগুলো বন্ধ করার জন্য। ফেসবুক বন্ধ করেনি। আমার রিপোর্টের কোনও মূল্য নেই। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের রিপোর্টে কোনও ফল পাওয়া যায় না। আরগানাইজড মৌলবাদী শক্তিই জিতে যায় ফেসবুকের এই অদ্ভুত পলিসিতে। ফেসবুক আমার নামে তৈরা করা ফেক একাউন্ট বন্ধ করতে নয়, বরং আমার আসল একাউন্ট বন্ধ করার জন্য উদগ্রীব। এর কারণ একটিই, আমার বিরুদ্ধে মৌলবাদীদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার কমপ্লেইন যায়।

দুই বাংলায় সরকার আমার উপস্থিতি নিষিদ্ধ করেছে, আমার বই নিষিদ্ধ করেছে, পত্র পত্রিকা আমার লেখা নিষিদ্ধ করেছে, প্রকাশকরা আমার বই প্রকাশ বন্ধ করেছে, সেকারণে ফেসবুকই ছিল ভরসা। ফেসবুকেই নিষেধাজ্ঞা আর সেন্সরশীপের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছি। ফেসবুকেই আমার সমস্ত মত আমি প্রকাশ করছিলাম। আমার ফেসবুকের বন্ধু এবং অনুসারীদের প্রায় সবাই ছিল বাঙালি। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি। তারা অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে পড়ছিল আমার লেখা। দ্রুত অনুসারীর সংখ্যা বাড়ছিল। দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল আমার ফেসবুকের লেখাগুলো। যারা আমার লেখা পড়ার সুযোগ পায় না, ফেসবুকের মাধ্যমে তারা সেই সুযোগটা পেয়েছিল। পৃথিবীতে আর কোনও লেখক এত ব্যানিং আর এত সেন্সরশিপের শিকার নয়। এক আমিই। আমারই প্রবেশ নিষেধ সবখানে। এখন, শেষ আশ্রয়, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকেও কি আমার প্রবেশ নিষেধ? চিরকালের জন্য? মৌলবাদী অপশক্তি সমাজটাকে দখল করে নিচ্ছে, কে দেশের ভেতর থাকবে, কে বেরিয়ে যাবে, কে বেঁচে থাকবে, কাকে মরতে হবে এই সিদ্ধান্ত তো এরা নিচ্ছেই। এই মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা ফেসবুকেও খুব অ্যাকটিভ। অরগানাইজড। মনে হচ্ছে এরা ধীরে ধীরে দখল করে নিচ্ছে ফেসবুক। এরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কে ফেসবুকে থাকবে, কে থাকবে না। ফেসবুক কর্তাদের বুদ্ধিসুদ্ধি বলে কিছু নেই। এটুকু বোঝার ক্ষমতা নেই যে তারা সন্ত্রাসীদের অঙ্গুলি হেলনে চলছে।

ফ্রিডম ফ্রম রিলিজন

গতকাল ফ্রিডম ফ্রম রিলিজন ফাউন্ডেশনের কনভেনসন হলো যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন রাজ্যের ম্যাডিসন শহরে। ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট অ্যানি লরি গেইলোর আর ডান বেকার অসাধারণ সব কাজ করছেন। গোটা আমেরিকাকে ধর্মান্ধতা আর কুসংস্কার থেকে মুক্ত করার পণ করেছেন। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় অ্যানি নিকল গেইলোর শুরু করেছিলেন এই ফাউন্ডেশন। তাঁরই সুযোগ্য কন্যা এটি আজও চালিয়ে যাচ্ছেন। আজ এটির সদস্যসংখ্যা তেইশ হাজার। বিরাট এক বাড়ি হয়েছে। বাড়ির নাম ফ্রিথট হল। কনভেনশনে আমাকে এমপারার হ্যাজ নো ক্লথস পুরস্কার দেওয়া হলো। অস্কার পুরস্কারের মূর্তি যেখান থেকে বানানো হয়, সেখান থেকেই এই ন্যাংটো রাজার মুর্তিটা বানানো হয়েছে। ম্যাডিসনের মনোনা লেকের পাড়ে, হিলটন হোটেলে মনোনা রোসে হলো আমাদের কনভেনশন। ছায়ার মতো একটা সিকিউরিটি ছিল। আমার। ম্যাট নাম। আমি আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের ছেলে রন রিগ্যান বক্তৃতা করলাম। রন রিগ্যান বলেছেন আমি বলার পর। আমার কথা উনি বারবারই উল্লেখ করলেন। তসলিমাদের দরকার পৃথিবীটা বদলাবার জন্য। আরও হাজারও তসলিমা চাই–এসব। আমার বক্তৃতাটা অতি সাধারণ ছিল। দুনিয়াতে কী ঘটছে- বাংলাদেশে, ভারতে, সৌদি আরবে, আমেরিকায়–এসবই একটু একটু বললাম। ও মা, তাতেই দেখি বিশাল কাণ্ড। সকলে স্ট্যান্ডিং ওভেশন দিল। লাইন দিয়ে বই কিনলো। কত শত মানুষ যে এসে জানালো তারা আমার পিচ শুনে মুগ্ধ, আমি খুব সাহসী, আমি একা নই, তারা আমার সঙ্গে আছে। এসব অবশ্য শুনে আসছি আজ প্রায় পঁচিশ বছর। কিছুই আমাকে আর চমকিত করে না। লেকচার ফি ওরা দিয়েছে পাঁচ হাজার ডলার, সেটা সংসারের কাজে লাগবে।

বইমেলায় প্রবেশ নিষেধ

ইস্কুলের লাইব্রেরিতে খুব কম গল্পের বইই বাকি ছিল যেগুলো পড়া হয়নি আমার। পাবলিক লাইব্রেরি থেকেও বই নিয়ে আসতাম। ইস্কুলে যাওয়ার রিক্সাভাড়া বাঁচিয়ে ঝালমুড়ি নয়, আইসক্রিম নয়, চুড়ি ফিতে নয়, বই কিনতাম। গাঙ্গিনারপাড়ে ছিল দুটো নির্জন বইয়ের দোকান। টাকা জমিয়ে ওই দুটো দোকানেই ছুটে যেতাম। বইপোকা বলে খুব দুর্নাম ছিল। রাত জেগে বই পড়া তো ছিলই। পাঠ্য বই দিয়ে গল্পের বই আড়াল করে বছরের পর বছর পড়েছি। ধরা পড়ে বাবা মার হাতে প্রচুর চড় থাপ্পড়, কিল ঘুসি খেয়েছি। কে রুখবে আমাকে! বিকেলে ছাদে চলে যেতাম বই নিয়ে। সন্ধ্যে নামতো, বই থেকে চোখ সরতো না, খুব ঘোরের মধ্যে থাকলে হয়তো বোঝা যায় না যে অন্ধকার থেকেও সময় সময় আলো ঠিকরে বেরোয়। মাঝে মাঝে ভাবি, আমার অমন বই পড়ার অভ্যেসটা কোত্থেকে হয়েছিল। বাড়িতে তো গল্পের বই পড়ার খুব বেশি চল ছিল না। বাবা ডাক্তারি বই পড়তেন। মা কোরান হাদিস পড়তেন। দাদারা বই পড়তেন, তবে বইয়ের চেয়ে ম্যাগাজিন ট্যাগাজিন বেশি পড়তেন। অভ্যেসটা সম্ভবত নানির বাড়ি থেকে এসেছে। ও বাড়িতে সাত আট বছর বয়স অবধি ছিলাম। তখনই দেখেছি, নানির ঘরে বিকেল হলেই বই পড়ার আসর বসে। মেজ খালা বা ছোট খালা পড়েন, বড় মামা, মেজ মামা, মা, নানি, নানির পড়শিরা শোনেন। কোনও ধর্মের বই নয়। গল্প উপন্যাস। কোনওদিন প্রেমের গল্প, কোনওদিন রহস্য উপন্যাস।

পড়ার অভ্যেসই আমাকে লেখার অভ্যেস দিয়েছে। ইস্কুলের বড় ক্লাসে উঠে রাফ খাতাগুলোকে লেখার খাতা বানিয়ে ফেলি, প্রচুর গল্প কবিতা লিখি। ওসব খাতাইস্কুলে নিলে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। মেয়েরা গোগ্রাসে আমার লেখা পড়ে। বাড়িতে নিয়ে যায় পড়তে, একজন ফেরত দিলে আরেকজন নেয়। মফস্বলের লিটল ম্যাগাজিনে, এমনকী ঢাকার বড় পত্রিকাতেও বেরোতে থাকে লেখা। একসময় কবিতাপত্র সম্পাদনা আর প্রকাশনা দুটোই করতে শুরু করি। সবে তখন সতেরো বছর বয়স আমার। ইস্কুল কলেজের বাইরে কোথাও যাওয়া নিষেধ। তখনও বাড়িতে বাবা বা দাদাদের বন্ধুরা এলে পর্দার আড়ালে চলে যেতে হয়। বাইরে শৃঙ্খল, ভেতরে অদম্য কৌতূহল। ততদিনে ধর্ম থেকে, কুসংস্কার থেকে অসংখ্য নারীবিরোধী প্রথা থেকে একা একাই নিজেকে মুক্ত করেছি। উৎসব বলতে যদি কিছুর প্রতি আমার টান থাকে, সে ইদ নয়, পুজো নয়, বড়দিন নয়, শবেকদর নয়, শবেবরাত নয়, মহররম নয়, মিলাদুন্নবী নয়, সে বইমেলা। ঢাকায় বিশাল বইমেলা হয়। কেবল শুনেছিই, দেখা হয়নি। স্বপ্ন ছিল একুশে ফেব্রুয়ারির ভোরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি.. গাইতে গাইতে ঢাকার রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটার, শহিদ মিনারে ফুল দেওয়ার, বইমেলা ঘুরে ঘুরে বই কেনার। স্বপ্ন, আশ্চর্য, একদিন সত্যি হয়। আমার ছোট খালা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। আমার কান্নাকাটিতে একদিন তিনি আমাকে ঢাকায় নিয়ে গেলেন। মার অনুমতি নেওয়া হয়েছিল। বাবার অনুমতি চাইনি, কারণ, চাইতে গেলে তিনি পায়ের টেংরি ভেঙে আমাকে ঘরে বসিয়ে রাখবেন। লেখাপড়া বাদ দিয়ে ঢাকা শহরে ফুর্তি করতে যাওয়ার অনুমতি তিনি পৃথিবী উল্টে গেলেও দেবেন না। ফিরে আসার পর বাবার হাতে সন্ধি-বেতের মার খেয়েছিলাম। সেই মার আমার পিঠের চামড়া তুলে নিয়েছিল, কিন্তু কোনও অনুশোচনা দেয়নি। সেই থেকে যা কিছুই ঘটুক, চড়-থাপড়, সন্ধিবেত, চাবুক– পরোয়া করিনি। যেখানেই থাকি আমি, যত দূরেই থাকি, ঢাকার বইমেলায় ছুটে ছুটে গেছি। এ বইমেলা কোনোকালেই ঠিক বইমেলা ছিল না আমার কাছে, ছিল প্রাণের মেলা। একটি মাস আসবে বলে বছরের এগারোমাস অপেক্ষা করেছি। সারা বছরের বই এক মাসেই কিনেছি। বাবা গজরাতেন, মেডিক্যালে পড়ছো, কোথায় চোখে সর্ষের তেল ঢেলে সারারাত মেডিক্যালের বই পড়বে, তা নয়তো আউট বইএর নেশায় ঢাকায় গেছে, এই আউটবইই তোমার মেডিক্যালের পড়ার বারোটা বাজাবে, এ জন্মে তোমার আর ডাক্তারি পাশ হবে না।

বাবার ভবিষ্যৎবাণী ঠিক ছিল না। আমি নির্বিঘ্নে ডাক্তারি পাশ করেছি। ডাক্তারির ফাঁকে ফাঁকে লেখালেখি করতাম। একসময় আমার বই বেরোনো শুরু হলো। কবিতার বই, প্রবন্ধের বই, গল্প উপন্যাস। সেসব বই বইমেলার স্টলে স্টলে। বিক্রি হতে লাগলো। লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষ আমার বই কিনতো। পাঠকেরা ভিড় করতো আমার সঙ্গে একটুখানি কথা বলার জন্য, বইয়ে সই নেওয়ার জন্য। অনেক লেখক কবির সঙ্গে দেখা হতো, মত বিনিময় হতো। বইমেলায় যেদিকে দুচোখ যেতো, দেখতাম শুধু বই আর বইয়ের পাঠক। বই দেখতে, বই কিনতে, বই পড়তে মানুষ উপচে পড়ছে। অন্ধকার কবন্ধের যুগে এর চেয়ে চমৎকার দৃশ্য আর কী হতে পারে! একজন লেখকের জন্য এ যদি বেহেস্ত না হয়, বেহেস্ত তবে কোথায়?

আমার লেখা শুরু থেকেই কেবল লেখার জন্য লেখা ছিল না। নারীর ওপর ধর্ম আর পুরুষতন্ত্রের অত্যাচারের বিরুদ্ধে অনড় দাঁড়িয়ে যা লেখার লিখেছি। মুক্তচিন্তকরা আমাকে ভালোবেসেছেন। কিন্তু আমার পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে মৌলবাদী গোষ্ঠী। বইমেলায় আমাকে আক্রমণ করেছে, আমার বই পুড়িয়েছে। রাস্তায় লক্ষ লোক আমার ফাঁসি চেয়ে মিছিল করেছে। আমার মাথার দাম ঘোষণা করেছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকার কোথায় বাক স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়াবে, তা নয়তো মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছি এই অভিযোগে আমার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেছে, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। আমাকে বাধ্য করেছে দেশ ছাড়তে। আমাকে নিষিদ্ধ করেছে।

ইওরোপের নির্বাসিত জীবনে অনেক বইমেলায় গিয়েছি। কিন্তু মন ভরেনি। মন পড়ে থাকতো বাংলার বইমেলায়। কুড়ি বছর আগের কথা। ভারতের ভিসা চেয়েছি কিন্তু ভিসা দেওয়া হয়নি। ছবছর পর যখন ভিসা দেওয়া হলো, আর দেরি করিনি, ছুটে গিয়েছি কলকাতার বইমেলায়। পৃথিবীর যেখানেই থাকি, যত দূরেই থাকি, যত ব্যস্ততাই থাকুক আমার, সব ফেলে, সব ঠেলে, প্রতি বছর বইমেলায়। গিয়েছি। মেলায় ঘুরে বেড়িয়েছি, নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকেছি, বই কিনেছি, পড়েছি, বাঙালি পাঠকের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছি, বাঙালি কবির কবিতা পড়া শুনেছি। বাংলা বইমেলা আমাকে আমার হারিয়ে যাওয়া দেশ দিতো। যে ভাষা আমার মায়ের ভাষা, যে ভাষা আমার ভাষা, যে ভাষায় আমি বই লিখি, ভাবি, স্বপ্ন দেখি– সে ভাষার কাছে গিয়ে, সে ভাষার বইমেলায় গিয়ে আমার নির্বাসনের দুঃখ যন্ত্রণা অনেকটাই আমি ভুলে গিয়েছিলাম।

একসময় ভাষার টানে কলকাতায় বাস করতে শুরু করি। কলকাতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেককালের। ছোটবেলা থেকেই কলকাতার সাহিত্য পড়ি। আমার কবিতাপত্র সেঁজুতিতে কলকাতার অনেক কবিই লিখতেন। আমিও লিখতাম তাঁদের কাগজে। বড় ভালোবেসেছিলাম কলকাতাকে, অথচ বছর তিন পার হতেই কলকাতা ঠিক ঢাকার মতোই আচরণ করলো। আমাকে গৃহবন্দি করে রাখলো চার মাস। তারপর গোটা রাজ্য থেকেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলো। আমার অপরাধ, আমাকে মৌলবাদীরা পছন্দ করে না। আমাকে পছন্দ না করার অনেক কারণ আছে, আমি নারীকে দাসত্বের শৃংখল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে বলি, নারীবিদ্বেষকে রুখে দাঁড়াতে বলি, নারীর সমানাধিকারের কথা বলি। আমাকে ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সহ্য হয় না। কিন্তু দেখলাম সরকারেরও সহ্য হয় না, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোরও হয় না। আমাকে ব্রাত্য করলো পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ পৃথিবীর সবার জন্য অবারিত হলেও আমার জন্য নয়। শুধু আমি মানুষটা নই, আমার নামটাই, কারওর, কোনও ব্যক্তির বা কোনও গোষ্ঠীর সইছে না আজকাল। নামটা শুনেই তারা ভয় পায়, কেটে পড়ে, এড়িয়ে যায়, মুখ ফেরায়, প্রসঙ্গ পাল্টায়। মুখ্যমন্ত্রী এই সেদিন কলকাতা বইমেলায় আমার বইয়ের উদ্বোধন নিষিদ্ধ করেছেন, টিভিতে আমার মেগাসিরিয়াল প্রচারের আগেই পুলিশ পাঠিয়ে বন্ধ করেছেন। এসব অন্যায় মুখ বুজে দেখে গেছে কলকাতা।

বাংলাদেশের বইমেলায় আমি নিষিদ্ধ আজ কুড়ি বছরেরও বেশি। পশ্চিমবঙ্গে নিষিদ্ধ আট বছর। একজন বাঙালি লেখক, যে লেখক বহুবার পুরস্কৃত হয়েছে, বাংলা ভাষায় চল্লিশটিরও বেশি বই লিখেছে, যে বইগুলোর অধিকাংশই পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে বাংলা ভাষার মূলভূমিতে বাংলা বইয়ের মেলায় তার প্রবেশের কোনও অধিকার নেই। আমি মানুষ খুন করিনি, কারও কোনও অনিষ্ট করিনি, নিঃসঙ্কোচে বলতে পারি আমার লেখা পড়ে অনেক স্ত্রীপুরুষই সচেতন হয়েছে, ধর্মান্ধতা আর কুসংস্কার দূর করেছে, বিজ্ঞানমনস্ক হয়েছে, উদার আর সহিষ্ণ হয়েছে।

অথচ আমার মত প্রকাশের অধিকারের বিরুদ্ধে দুই বাংলাই আজ সমান সরব। তবে কি আমার এ ই দোষ যে আমি সত্য কথা বলেছি? এমন কিছু সত্য আছে, যে সত্য বলতে হয় না, লোকে বলে না, বলেনা কিন্তু আমি বলেছি?

স্রোতের বিরুদ্ধে গেলে বাক স্বাধীনতা হরণ করা হয়, বই নিষিদ্ধ করা হয়, বইমেলায় প্রবেশ বারণ করা হয়, লেখালেখি বন্ধ করে দেওয়া হয়, গৃহবন্দি করা হয়, নির্বাসন দেওয়া হয়। বাংলা থেকে আমার নির্বাসন হয়ে গেছে। যতদিন বাঁচি, এইটুকু বুঝেছি, বাংলার বাইরে আমাকে বাস করতে হবে। বাংলায় পা দেওয়ার কোনও অধিকারই আমার নেই। ছোটবেলায় বইমেলা দেখার যে স্বপ্ন ছিল, সেই স্বপ্নটা আজও ফিরে ফিরে আসে। বইমেলায় না যেতে পারার কষ্ট পৃথিবীর সর্বসুখ দিয়েও আমি সামান্য কমাতে পারি না। একটু না হয় অন্যরকম আমি। না হয় একটু অন্যরকমই। অন্যরকমের কি অধিকার নেই এই সমাজে বাস করার! সবাই কি আর আপোস করে, সবাই কি আর হিসেব করে কথা বলে! কেউ কেউ তো থাকে সংসারে, যারা মিথ্যেকে মানে না, অন্যায়ের সঙ্গে, যা হয় হোক, আপোস করে না!

বজরঙ্গি ভাইজান

বজরঙ্গি ভাইজান

কাল কবির খান পরিচালিত সালমান খান অভিনীত বজরঙ্গি ভাইজান দেখলাম। আশির দশকের পর থেকে আমি হিন্দি ছবি দেখি না। কিন্তু এক বন্ধুর অনুরোধ আমাকে ছবিটা দেখতে হলো।বলিউডের চলচ্চিত্র নির্মাণ পদ্ধতি আশির দশকের নির্মাণ পদ্ধতির চেয়ে এখন অনেক উন্নত। তবে চলচ্চিত্র এখনও মেলোড্রামা মুক্ত হতে পারেনি। এখনও ছবিগুলো অযথা নাচে গানে ভরপুর। হাফ মিউজিক্যাল যাকে বলে। বজরঙ্গি ভাইজান সব কিছুর মিশেল। ছবিটায় নাওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী বরাবরের মতো ভালো অভিনয় করেছেন। ভালো একটা মেসেজ দেওয়ার জন্য ছবিটার গল্প লেখা হয়েছে। গল্পে গোঁজামিল আছে, অসম্ভব অসম্ভব ঘটনা আছে, ওগুলো না হলে হয়তো মূল মেসেজটার দিকে এত দ্রুত যাওয়া যেত না। রাজনীতিকরা বিভেদ সৃষ্টি করছে মানুষের মধ্যে, হিন্দু আর মুসলমানকে আলাদা করছে, কিন্তু সাধারণ মানুষ এখনও হৃদয়বান, এখনও তাদের কাছে মানুষের পরিচয় মানুষই। এক কট্টর হিন্দুত্ববাদীর কাছে ধর্মের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে মানবতার সেবা। পাকিস্তানের মুসলমানের কাছে বজরঙ্গীও তার মানবতার জন্য হয়ে ওঠে ভাইজান।

আমরা জানি, আমরা দেখেছিও, সরকার ধর্মকে ব্যবহার করে, মানুষের মধ্যে ঘৃণা আর বিদ্বেষ ছড়াতে, কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে এখনও মানবতাই সবচেয়ে বড় ধর্ম। এটা যে শত ভাগ সত্য নয়, তা আমরা জানি। মানুষের বর্বর, নৃশংস, কুৎসিত চরিত্র বারবারই তো প্রকাশিত হয়। আমরা এও দেখি, এক নেতা আরেক নেতার সঙ্গে ঠিক ঠিক ভাব করে নেয়, কিন্তু তারা যাদের মগজধোলাই করেছে, মারামারিটা, হিংসাহিংসিটা, খুনোখুনিটা সাধারণত তারাই করে।

সেদিন ভারতের ওয়াঘা-আত্তারি আন্তর্জাতিক সীমান্তে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে গিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে মিষ্টি পাঠিয়েছে। কিন্তু পাক সেনারা সেই মিষ্টি গ্রহণ করেনি। সেনারাও ঘৃণার রাজনীতি শিখেছে। এদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ আম পাঠালে মোদি কিন্তু সেই আম ফিরিয়ে দেননি।

ভারত-পাকিস্তানের শত্রুতা ভারত ভাগের শুরু থেকেই। শত্রুতা শুরু করেছিল রাজনৈতিক নেতারা, জনগণ প্রভাবিত হয়েছিল। হয়েছিল বলেই ভারতভাগের সময়। হিন্দু মুসলমানকে কুপিয়ে, মুসলমান হিন্দুকে কুপিয়ে, দশ লক্ষ মানুষের লাশ ফেলেছে। আমি আজও মনে করি, ইচ্ছে করলেই সাতচল্লিশে ভারত ভাগ ঠেকাতে পারতো রাজনীতিকরা। ইচ্ছে করলেই অগুনতি মৃত্যু ঠেকাতে পারতো। ধর্মটাকে মানবতা হিসেবে প্রচার করলেই ঘৃণা হিংসে বর্বরতাগুলো দূর হয় না। বরং মানবতাকে ধর্ম হিসেবে প্রচার করলে শান্তির দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

একাত্তরের যুদ্ধে ভারত যদি বাংলাদেশকে সাহায্য না করতো, তা হলে বাংলাদেশের যুদ্ধে জেতা হতো না। তিরিশ লক্ষ শুধু নয়, আরও অনেক লক্ষ মানুষকে মরতে হতো। দুলক্ষ নারীকে ধর্ষণ করে পাক সেনারা থামতো না, আরও অনেক লক্ষকে ধর্ষণ করতো ওরা। এই মিত্রশক্তি ভারতকেও রাজনীতির প্রভাবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ শত্রু বলে মনে করে। আর যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। বিশ্বাস করে, তাদের অনেকের কাছেও মানবতার ভাষাটা ঠিক বোধগম্য নয়।

দুদিন আগে এমন এক প্রগতির পক্ষের যুবকের সঙ্গে কথা হলো। যুবকটি এখন নরওয়েতে। কথোপকথন পুরোটাই তুলে দিচ্ছি।

যুবক: বাইরে কারো সাথে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে কথা বলতে গেলে ঐ একই কথা শোনা যায়, বাংলাদেশে নাকি ইসলামিস্ট নেতাদের ফাঁসি দেয়া হচ্ছে। বিচার করা হচ্ছে?

তারপর যখন বলি যে, মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশের তিন মিলিয়ন লোককে হত্যা করেছিলো এবং যাদের বিচার হচ্ছে তারা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলো, কেউ কেউ নিজের হাতেই হত্যা করেছে এবং জামাতে ইসলামীর ইসলাম আসলে একটা লেবাস মাত্র, তখন তারা কিছুটা হলেও বুঝতে পারে।

কিন্তু কেউ যখন প্রশ্ন করে যে, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তোমাদের তিন মিলিয়ন লোক হত্যা করলো, তারপরও বাইরের দেশে পাকিস্তানীদের সাথে বাংলাদেশীদের ভাল সম্পর্ক কেন, তখন বেদনা হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না।

আমি: বাঙালিদের মেরেছে পাকিস্তানি সরকারের আদেশে পাকিস্তানি সেনা বাহিনী। এ কারণে সাধারণ পাকিস্তানিদের দোষ দিচ্ছেন কেন? বাংলাদেশের সরকার বা সেনা বাহিনী কোনো অন্যায় করলে তার দায় কি আপনার? নরওয়ের বিশাল পপুলেশন পাকিস্তানি অরিজিন। ওরা ষাটের দশকে শ্রমিক হিসেবে নরওয়েতে এসেছিল, পরে ফেরত যায়নি দেশে। ওদের মধ্যে নিশ্চয়ই অনেক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আছে। মিলে মিশে থাকবেন।

যুবক: আপনার কথা ঠিক দিদি। কিন্তু যখন শুনি যে পাকিস্তানীরা এখনো বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অংশ মনে করে তখন আর ঠিক মনে হয় না। পাকিস্তান বা পাকিস্তানীদের একাত্তরে বাংলাদেশের হত্যা সম্পর্কে কোন সিমপ্যাথি বা অনুশোচনা না থাকলে আমি একপাক্ষিক প্রেম দেখানোকে ভাল চোখে দেখতে পারি না। আর ভাল মানুষ সবখানেই আছে, খুঁজলে জামাতে ইসলামীতেও পাওয়া যাবে।

আমি: আপনি জেনারাইলাইজ করছেন। পাকিস্তানীরা যারা বাংলাদেশকে পাকিস্তানের অংশ মনে করে, তাদের সংখ্যাটা কত? সব পাকিস্তানিই নিশ্চয়ই তা মনে করে না। এটা মনে রাখতে হবে, আমাদের মতো তারাও ইসলামি রাজনীতির ভিকটিম। অনেক পাকিস্তানী মানুষ একাত্তরের গণহত্যার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। নিজেদের সরকারকে দোষ দিয়েছেন। পাকিস্তানের সবাই ইসলামি-মৌলবাদী নয়, তাঁদের অনেকে শিক্ষিত, সচেতন, অনেকে মুক্তচিন্তায় গভীরভাবে বিশ্বাস করেন, ইসলামিজমের বিরুদ্ধে তাঁরা লড়াই করে বেঁচে আছেন। জামাতি ইসলামিতে খুঁজলে। কিছু খুনী এবং ধর্ষক নাও পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু ভালো আদর্শবান মানুষ পাওয়া কঠিন। কারণ জামাতির আদর্শ নারীবিরোধী, প্রগতিবিরোধী, সমানাধিকার বিরোধী, বিজ্ঞানবিরোধী। এই আদর্শকে জেনেশুনে যারা সমর্থন করছে, তাদেরকে আমরা আমাদের লোক বলে গণনা করতে পারি না।

যুবক; জেনারেলাইজেশন যে হয়েছে তা আমি মানছি। সেজন্য এই পোস্টে আপনার মন্তব্য পেয়েছি। এটাও কিন্তু একটা পাওয়া আমার। জেনারেলাইজ না করলে তো পেতাম না। তবে পাকিদের সাথে যারা বেশি অন্তরঙ্গ হয়, ভাই মনে করে, তারা আসলে নিজেরাও নষ্ট।

আমি: তবে পাকিদের সাথে যারা বেশি অন্তরঙ্গ হয়, ভাই মনে করে, তারা আসলে নিজেরাও নষ্ট।–এটাও জেনারাইজেশন। পাকিস্তানি একজন মানববাদীর সঙ্গে বাংলাদেশি একজন মানববাদীর বন্ধুত্ব হতেই পারে। তারা সে কারণে নষ্ট হবে কেন?

কথোপকথন যারা পড়েছে, আমার মানবতার আহবান তাদের উত্তেজিত করেনি। ঘৃণা আর হিংসের ভাষাটা এখনও খুব শক্তিশালী কিনা। এখনও এই ভাষা মানুষকে আকৃষ্ট করে।

বর্ণবাদ

আস্তালাভিস্তা বেবিআমেরিকার বর্ণবাদ ইজ ব্যাক

ব্যাক? ও তো ছিলই। ঘুমিয়ে হলেও ছিল। যখন জাগার জাগবে। ঘুমিয়ে থাকে বর্ণবাদ সব মানুষের অন্তরে। সব না হলেও অধিকাংশ মানুষের অন্তরে। কালোদের সেই কতকাল আগে সাদাদের ক্রীতদাস বানানো হলো। সেই কতকাল আগে ক্রীতদাস প্রথাও বিলুপ্ত হলো। বিলুপ্ত হওয়ার কতকাল পরও কালোদের ঘৃণা করা বন্ধ হয়নি। খারাপ লোকে যেমন গিজগিজ করছে পৃথিবী, কিছু কিছু ভালো মানুষও তেমন একই সঙ্গে আছে। সাদাদের মধ্য থেকেই কালোর পক্ষে আন্দোলন হয়েছে, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সাদারা লড়েছে।

শুধু যে কালোরাই মরে, কালোরাই ভোগে তা নয়, সাদারাও মরে, সাদারাও ভোগে। অনেক কালো দিব্যি আছে। যেহেতু তাদের নামটা বা যশটা ভালো আছে। গরিবের কোনও সাদা কালো বাদামী হলুদ নেই। গরিবরা এই সমাজের চোখে সবাই কালো। ধনী নারীরাও কালো, যেহেতু তারা নারী, যেহেতু তারা এই সমাজে নিম্নলিঙ্গ। যে কোনও সংখ্যালঘুই কালো।

এই পৃথিবী বৈষম্যের পৃথিবী। এই পৃথিবী থেকে বৈষম্য দূর করার একটা অসম্ভব কাজে আমরা নেমেছি। অসম্ভব কখনও কি আর সম্ভব হয়!

বাংলা সংস্কৃতি চলবে কী চলবে না

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান বৌদ্ধ মুসলমান এবং ধর্মমুক্ত মানুষ সবাই আমরা পালন করতাম পয়লা বৈশাখ। বাংলা গান গাইতাম, বাঙালি খাবার খেতাম। বৈশাখি মেলায় গিয়ে দা বটি, শিল নোড়া, বেলান পিঁড়ি, হাঁড়িকুড়ি, মুড়ি মুড়কি, খই-খেলনা, মাটির পুতুল টুতুল আর বাঁশি বেলুন কিনে আনতাম। বিকেলে বাবার হাত ধরে জুয়েলারির দোকানে দোকানে গিয়ে হালখাতার মণ্ডা মিঠাই খাওয়া ছিল আমাদের পয়লা বৈশাখ।

ঢাকার রমনায় ছায়ানটের গান, ইলিশ পান্তা খাওয়া বা রাস্তায় মঙ্গল শোভাযাত্রা নিতান্তই নতুন ট্রাডিশান, বাঙালি এলিট শ্রেণী ওভাবেই কয়েক দশক আগে পয়লা বৈশাখের আধুনিকীকরণ করেছে। আমি দুটো উৎসবই দেখেছি, গ্রামের এবং শহরের উৎসব, পুরোনো এবং নতুন উৎসব। দুটোই জরুরি।

বেশ কয়েকবছর যাবৎ খবর পাচ্ছি, বাংলাদেশের ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী ঘোষণা করেছে তারা পয়লা বৈশাখের কোনও উৎসব অনুষ্ঠান চায় না। ভালো কথা, যারা চায় না তারা উৎ্যাপন না করুক, যারা চায় তারা করুক। এরপর শুনি, তারা নিজেরা তো উৎযাপন করবেই না, তারা কাউকেই উৎযাপন করতে দেবে না। এ কেমন কথা! বাংলাদেশ তো জানতাম গণতান্ত্রিক দেশ। আমি একা বলে না হয়। আমাকে দেশ থেকে তাড়িয়েছে, পয়লা বৈশাখ পালন করছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। লক্ষ লক্ষ মানুষের সংস্কৃতি গুটিকয় মৌলবাদীর হুমকির সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে? গুটিকতক হয়তো এখন আর গুটিকতক নেই।

ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা বাংলা সংস্কৃতি পছন্দ করে না, তাদের পছন্দ ইসলামি সংস্কৃতি, তারা বাংলা সংস্কৃতিকে বলছে হিন্দু সংস্কৃতি। হিন্দু সংস্কৃতি বলে দোষ দিলে হিন্দু বিদ্বেষী মুসলমানরা পয়লা বৈশাখ ত্যাগ করবে। করছেও হয়তো। তারা আজ যে করেই হোক আরব দেশের কালচার আনবে বাংলাদেশে! সে কারণেই হিজাব পরাচ্ছে। মেয়েদের। তারা জানে হিজাব কখনও হিজাবে থেমে থাকবে না। হাঁটি হাঁটি পা পা করে হিজাব যাবে বোরখার দিকে।

সৌদি আরবে সব মেয়েরই বোরখা পরা বাধ্যতামুলক। আপাদমস্তক বোরখায় ঢাকা মেয়েরাও কিন্তু ধর্মীয় পুলিশের চাবুক থেকে রেহাই পায় না। রাস্তাঘাটে, মাঠে ময়দানে ধর্মীয় পুলিশরা কোনও মেয়ের কপালে দুএকটা মাথার চুল কোনও ফাঁক-ফোকর দিয়ে অসাবধানে কখনও বেরিয়ে এলো কি না দেখার জন্য টহল দেয়। বেরোলেই চাবুক।

তাহলে ঢাকা শহরে পয়লা বৈশাখের ভিড়ে ওরকম ধর্মীয় পুলিশ মোতায়েন করেছিল তারা, যারা বাংলাদেশে আরব দেশের কালচার আনতে চাইছে। শাড়ি পরা যে মেয়েদের নাভি দেখা যায়, ঝুঁকলেই যে মেয়ের ক্লিভেজ শো করে, তাদের তারা শাস্তি দিয়েছে। এ নিতান্তই মহড়া। হাঁটি হাঁটি পা পা করে ধর্মীয় পুলিশরা যাচ্ছে সেই ভয়ংকর দিনের দিকে, যে দিন তারা বোরখা পরা মেয়েদেরও কপালে চুল দেখা গেলে পেটাবে।

অলরেডি ধর্মান্ধ জল্লাদ বেরিয়ে গেছে রাস্তায়। আরব দেশের জল্লাদরা যেমন পাবলিক প্লেসে তলোয়ার দিয়ে অপরাধিদের মুণ্ডু এক কোপে ফেলে দেয়, তেমনি বাংলাদেশের ধর্মান্ধ জল্লাদরাও মানুষের মুণ্ডু ফেলছে। তবে এক কোপে না ফেলতে পারলেও কয়েক কোপের দরকার পড়ছে। রাজিব, অভিজিৎ, বাবুদের ওপর দেশি জল্লাদরা মহড়া চালিয়েছে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে সেই দিনের দিকে তারা যাচ্ছে,যে দিন চাপাতি টাপাতির ঝামেলা না করে ইসলামি মতেই বৈধ তরবারি হাতে নেবে, সরকারি আদেশে এক একটা বৈধ কোপে বিধর্মী, বুদ্ধিজীবি আর মুক্তমনা লেখক ব্লগারদের মুণ্ডু ফেলবে।

হাঁটি হাঁটি পা পা করে? মাঝে মাঝে মনে হয় বিশাল বিশাল লম্ফ দিয়েই যাচ্ছে। খুব দ্রুতই যাচ্ছে।

আমি জানি না বাংলাদেশের ভবিষ্যত কী। বাংলাদেশ কি সৌদি আরব হতে যাচ্ছে, পাকিস্তান হতে যাচ্ছে, নাকি যে বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা এককালে দেখেছিলাম, বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে সেই বাংলাদেশ? বাংলাদেশ তার বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরবে, বাংলাদেশের কোনও রাষ্ট্রধর্ম থাকবে না, কোনও একটি নির্দিষ্ট ধর্ম বাকি ধর্মের মাথার ওপর বসে ছড়ি ঘোরাবে না, কাউকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করবে না বাংলাদেশ, বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদের কোনও স্থান থাকবে না– এরকম বাংলাদেশ আজকাল আমার মনে হয় অসম্ভব তৈরি হওয়া। বাহান্নোতে যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম, উনসত্তরে যে বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলাম, একাত্তরে যে বাংলাদেশ গড়বো বলে ঘর ছেড়েছিলাম, সেই বাংলাদেশকে গড়ার সুযোগ আমরা হাতে পেয়েও কাজে লাগাইনি, একে নষ্ট করে ফেলেছি, একে হায়েনার মুখে জেনে শুনে ছুঁড়ে দিয়েছি। জানি দেশ আর দেশ নেই, তারপরও শাহবাগ আন্দোলনের আর পয়লা বৈশাখের বিশাল জনস্রাত দেখে আশা জাগে। তাহলে হয়তো হায়েনার মুখ থেকে ছিনিয়ে এনে ক্ষত বিক্ষত রক্তাক্ত দেশটাকে শুশ্রূষা করে আবার সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে পারি। ত্রিসীমানা থেকে আগে দূর করতে হবে হায়েনাকে।

পেণ্ডুলামের মতো দুলি আমি আশা আর নিরাশায়।

বাংলাদেশের কী কী করা উচিত ছিল এবং ছিল না

১. পাকিস্তানি সেনারা বাংলাদেশে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। তিরিশ লক্ষ মানুষকে খুন করেছে আর দু লক্ষ মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর উচিত ছিল। ওই বর্বর খুনীধর্ষকদের শাস্তির ব্যবস্থা করা।

২. রাজাকার, আলবদর, আলশামস–যারা লুটপাট করায়, সন্ত্রাস সৃষ্টি করায়, ধর্ষণ করায়, ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ায়, মানুষ হত্যায় পাকিস্তানি সেনাদের সাহায্য করেছিলো–যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওদের বিচার করা উচিত ছিল।

৩. যুদ্ধাপরাধীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করাটা উচিত ছিল না।

৪. যুদ্ধপরাধীদের যাবজ্জীবন হওয়া উচিত ছিল। ওই দীর্ঘ সময়ে ওরা নিজেকে শুদ্ধ করার সুযোগ পেত। ওদের শোধরানোর ব্যবস্থা রাষ্ট্র থেকেও করা উচিত ছিল।

৫. ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চিরকালের জন্য নিষিদ্ধ করা উচিত ছিল। জামাতে ইসলামি এবং অন্য কোনও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল যেন কোনও কারণেই ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করার সুযোগ আর না পায়।

৬. শেখ মুজিবুর রহমানের উচিত ছিল না বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানে ওআইসি (অরগানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশন) সম্মেলনে যোগ দেওয়া। বরং সেকুলার আদর্শে তাঁর দৃঢ় থাকা উচিত ছিল।

৭. শেখ মুজিবুর রহমানের উচিত ছিল না বাকশাল গঠন করা এবং সব রাজনৈতিক দলকে বাতিল ঘোষণা করা।

৮. কারও উচিত ছিল না শেখ মুজিবকে হত্যা করা এবং সেনাবাহিনীর লোককে ক্ষমতায় বসানো।

৯. উচিত ছিল না ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে বদলানো, বিসমিল্লাহ বসানো। ১০.উচিত ছিল না সেকুলার সংবিধানকে ধর্ষণ করা। রাষ্ট্রধর্ম আনা।

১১. উচিত ছিল না রাজাকারদের প্রেসিডেন্ট বানানো। মন্ত্রী বানানো। সংসদ সদস্য বানানো।

১২. উচিত ছিল না মহল্লা মহল্লায় মসজিদ বানানো এবং মসজিদ চালাবার দায়িত্ব পাকিস্তানপন্থী রাজাকারপন্থী জিহাদপন্থী মুসলিম মৌলবাদীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া।

১৩. উচিত ছিল না কচুরিপানার মত মাদ্রাসায় ছেয়ে ফেলা দেশ। মাদ্রাসাগুলোকে মৌলবাদীর আঁতুড়ঘর যেন মোটেও না বানানো হয়, উচিত ছিল সতর্ক থাকা।

১৪. রোধ করা উচিত ছিল মধ্যপ্রাচ্যের মৌলবাদীদের অর্থে বাংলাদেশের ইসলামিকরণ, ওয়াহাবিকরণ।

১৫. বন্ধ করা উচিত ছিল সংখ্যালঘু নির্যাতন। উচিত ছিল সংখ্যালঘুদের জন্য কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা।

ওপরের তালিকায় আরও উচিত ছিল এবং উচিত ছিল না যোগ হতে পারে। আপাতত ওটুকুই ভেবেছি। ৪৪ বছর অনেকগুলো বছর। এতগুলো বছরে একাত্তরের বাংলাদেশ-বিরোধী ইসলামি-মৌলবাদী শক্তি দেশটাকে প্রায় পুরোটাই নষ্ট করে ফেলেছে। ওই অপশক্তিকে ইন্ধন জুগিয়ে গেছে শাসকগোষ্ঠী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যারা গর্তে লুকিয়েছিল, আজ তারা দেশের বিশাল এক রাজনৈতিক শক্তি, তাদের তৈরি ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী সৈনিকে দেশ আজ টইটম্বুর। এই দেশটাকে শুদ্ধ করতে আরও কত ৪৪ বছরের দরকার হবে কে জানে।

কাল ফাঁসি হয়েছে আলবদর নেতা যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামানের। কামারুজ্জামানের ফাঁসি হওয়ার পর বাংলাদেশের কি কোনও পরিবর্তন হবে? জামাতির সন্ত্রাস বন্ধ হবে?শিবিরের হত্যাকাণ্ড থামবে? হুমায়ুন আজাদরা আক্রান্ত হবেন না? অভিজিত্রা আর খুন হবেন না? ওয়াশিকুরদের কেউ মারবে না? এর উত্তরে যে কেউ বলবে, হত্যাকাণ্ড চলতেই থাকবে। আমিও জানি চলতেই থাকবে। সন্ত্রাস দেখতে দেখতে ক্লান্ত, তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দিতে। আমার মনে হয় রাগটা যত না ৪৪ বছর আগের সন্ত্রাসের জন্য, তার চেয়ে বেশি এখনকার সন্ত্রাসের জন্য, কামরুজ্জামানের শিষ্যরা যে সন্ত্রাস বুক ফুলিয়ে করছে। আর মানুষ বাধ্য হচ্ছে ঘোর অনিশ্চয়তা আর নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বাস করতে। মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা ধর্মমুক্ত মানুষদের অনেক বছর যাবৎ ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করছে। সন্ত্রাস বিরোধী-শক্তি যেহেতু হাতে চাপাতি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় না, তারা রাষ্ট্রকে চাপ দিয়ে দুএকটা মৃত্যুদণ্ড ঘটায়।

যথেষ্ট খুনোখুনি হলো। বাংলাদেশের মানুষ এবার পেছনে কবে কী করেছিলো ভুলে এখন কে কী করছে সেটা দেখুক। এখন থেকে যেন জামাতিরা কোনও সন্ত্রাস, কোনও রগ কাটা, গলা কাটা, বোমা ছোঁড়া কিছুই করতে না পারে। এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, মাদ্রাসা মসজিদের আতংকবাদী রাজনীতি আর অশ্লীল ওয়াজ মাহফিলগুলো বন্ধ না করলে শুধু কামারুজ্জামানদের মেরে কোনও ফল পাওয়া যাবে না।

দেশটাকে ভালো করতে হলে দেশটার গলায় ছাগলের দড়ি বেঁধে ছেড়ে দিলে হয় না। দেশটাকে দেখে দেখে রাখতে হয়। দেশটার পেছনে প্রচুর সময় দিতে হয়। দেশ বলতে তো মানুষ। মানুষের জন্য কাজ করতে হয়। মানুষের জন্য সুশিক্ষা আর সুস্বাস্থ্যর ব্যবস্থা করতে হয়। দারিদ্র ঘোচাতে হয়, জীবন যাপনের মান বাড়াতে হয়। কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, সন্ত্রাস থেকে মানুষকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে হয়। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ তৈরি করতে হয়। ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতিকে চারদিকে ছড়িয়ে দিতে হয়। ধর্মভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি–এসব যেহেতু সমাজের ধ্বংস ডেকে আনে, এগুলো থেকে সমাজকে মুক্ত করতে হয়। শেখাতে হয় ধর্ম মানে হিজাব বোরখা টুপি জোব্বা নয়, ধর্ম মানে মানবতা। ধর্ম মানে মসজিদ মাদ্রাসা নয়, ধর্ম মানে মানবতা। ধর্ম মানে পাঁচবেলা নামাজ আর একমাস রোজা নয়, ধর্ম মানে মানবতা। ধর্ম মানে অন্য ধর্মকে ঘৃণা করা নয়, ধর্ম মানে মানবতা। ধর্ম মানে ধর্মে অবিশ্বাসীদের হত্যা করা নয়, ধর্ম মানে মানবতা। আর সব কিছুর মতো ধর্মেরও বিবর্তন ঘটে। ১৪০০ বছর ধরে ইসলাম যদি এক জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে এ নিশ্চয়ই বিষম দুশ্চিন্তার বিষয়। ধর্মের বিবর্তন আপনাআপনি হয় না, এটিকে হওয়াতে হয়। হওয়ায় ওই ধর্ম যারা পালন করে, তারা। ইসলামের বিবর্তনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ধুরন্দর মুসলিমরা, যারা এই ধর্মকে অবিবর্তিত অপরিবর্তিত অবস্থায় রেখে দিতে চায় এটি নিয়ে ব্যবসা করার জন্য, এটির অপব্যবহার করার জন্য, এটি নিয়ে সন্ত্রাস করার জন্য, এটিকে রাজনীতি ব্যবহার করার জন্য। এরাই এই ধর্মের মূল শত্রু। এদের কারণে ইসলাম একটি অমানবিক ধর্ম হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। খ্রিস্টান ধর্ম বা ইহুদি ধর্ম কম অমানবিক নয়, কিন্তু বিবর্তিত হয়েছে বলে আজ এসবকে মানবিক বলে মনে হয়। ইসলামের পরিবর্তন ছাড়া এখন আর উপায় নেই। হয় তলিয়ে যাও ধর্মান্ধতায়, নয় উঠে দাঁড়াও, শক্ত হাতে হাল ধরো, সমাজকে শুদ্ধ করো, রাষ্ট্রকে ধর্মমুক্ত করো। ধর্ম দিয়ে যে যুগে রাষ্ট্র চালানো হতো–সে যুগকে বলা হয় অন্ধকার যুগ যে কোনও একটিকে বেছে নিতে হবে; অন্ধকার যুগের দিকে ফিরে যাওয়া, অথবা সামনে আলোর দিকে যাওয়া।

কামরুজ্জামানের ফাঁসি হয়ে বাংলাদেশের কী লাভ হয়েছে? কামরুজ্জামান ছিলেন ৬২ বছর বয়সের এক বৃদ্ধ। তিনি যৌবনেই যত অপকর্ম আছে করে ফেলেছেন। তাঁকে চার দশকের চেয়েও বেশি সময় দেওয়া হয়েছে অপকর্ম করার। তিনি একাত্তরে যত অন্যায় করেছেন, যত ক্ষতি করেছেন দেশের, তার চেয়েও বেশি করেছেন একাত্তরের পরে। তিনি দেশের নিরীহ ছেলেমেয়েদের মগজধোলাই করেছেন। ইসলাম দিয়ে, আর বিশাল এক ধর্মান্ধ খুনীবাহিনী তৈরি করেছেন। তাঁর খুনীবাহিনীই আজ লেখক অভিজিৎ রায়কে খুন করে, তাঁর খুনীবাহিনীই আজ ব্লগার ওয়াশিকুর বাবুকে খুন করে। এক কামারুজ্জামান মরে গেছেন, লক্ষ কামারুজ্জামান আজ বাংলার ঘরে ঘরে। খুব সাবধান বাংলাদেশ, বাঁচতে চাও তো চাপাতি ছুঁড়ে ফেলো, ফাঁসির দড়ি ছিঁড়ে ফেলো, শুভবুদ্ধি জাগাও সবার মধ্যে।

বাক স্বাধীনতা

২০১৫ সালের ২৪ মার্চ। ভারতের সর্বোচ্চ আদালত ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬ক ধারাকে বাতিল করেছেন। ওটি ছিল বাক স্বাধীনতার বিপক্ষে একটি আইন। সর্বোচ্চ আদালত সেদিন বলে দিয়েছেন, আইনটি মতপ্রকাশের-অধিকার বিরোধী তো বটেই, ভারতের সংবিধান বিরোধিও। মাননীয় বিচারকমণ্ডলীকে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই। ওঁদের রায়টি নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক রায়। আমার জন্য সবচেয়ে সুখের বিষয়, কালো আইনটি বাতিল করার লড়াইয়ে হাতে গোণা কয়েকজনের মধ্যে ছিলাম আমিও। আমি ভারতের নাগরিক না হয়েও ভারতের একটি অসাংবিধানিক আইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি, এবং জিতেছি। ভারতের মত প্রকাশ বিরোধী আইন হঠাতে আমার একটি ভূমিকা রয়ে গেল।

এই আইনটির কারণে অনেক নিরপরাধ মানুষের ভোগান্তি হয়েছে। আমারও হয়েছে। গত বছর আগে আমার একটি টুইটের কারণে উত্তর প্রদেশের এক মৌলবাদী আমার বিরুদ্ধে ৬৬ক ধারায় মামলা করেছিল। আমার টুইটটা ছিল এরকম, যে অপরাধীরা নারীর বিরুদ্ধে ফতোয়া দেয়, নারীর মাথার দাম ঘোষণা করে, তাদের কোনও শাস্তি হয় না ভারতবর্ষে। টুইটটি করার পেছনের কারণ ছিল, কয়েক বছর আগে মুসলিম ল বোর্ডের প্রধান তৌকির রাজা খান আমার মাথার মুল্য ধার্য করেছিল। ৫ লক্ষ টাকা। এই ফতোয়া জারির জন্য তার কোনও শাস্তি হয়নি। শাস্তি বরং আমার হয়েছে। ভুক্তভোগীকেই আরও ভোগানোর জন্য বেছে নেওয়া হয়, ধর্মসংক্রান্ত রীতিনীতিগুলো অনেকটা এরকমই। এর আগেও পাটনায় একটি মামলা হয়েছিল। আমার এক টুইটের জন্য। ওটা ৬৬ক ধারায় ছিল না। কিন্তু ওটাতে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। ওই মামলাটি আজও খারিজ হয়নি, প্রায় দুবছর যুদ্ধ করে উচ্চ আদালত থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানাকে স্থগিত করার ব্যবস্থা হয়েছে। ৬৬ক ধারায় উত্তর প্রদেশের মামলাটির জন্য আমি সর্বোচ্চ আদালতের একজন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলি। টুইটের কথা তাঁকে বলাতে তিনি বললেন, আপনি তো ভুল কিছু লেখেননি। ক্রিমিনালকে ক্রিমিনাল বলেছেন। যে লোক মানুষের মাথার মূল্য ধার্য করে, সে অবশ্যই ক্রিমিনাল। সে জনসমক্ষে মানুষকে হত্যার প্ররোচনা দিচ্ছে। যে কেউ একটা টুইট লিখবে, ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেবে, বা একটা ব্লগ লিখবে– সে কারণে তাকে গ্রেফতার হতে হবে, তাকে জেলে যেতে হবে, মত প্রকাশের কোনও স্বাধীনতা তবে এদেশে নেই! আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে ঠিক হলো, আমি শুধু আমার বিরুদ্ধে জারি হওয়া মামলার বিরুদ্ধে লড়বো না, গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রে এমন একটি বাক স্বাধীনতা বিরোধী আইন থাকার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবো। সেই শুরু। আইনের ছাত্রী শ্রেয়া সিংঘাল প্রথম প্রশ্ন তুলেছিলেন। সেই মিছিলে যোগ দিলাম আমিও। আটজন, সম্ভবত আটজনই, প্রশ্ন তোলার পর মামলাটি সর্বোচ্চ আদালতে উঠলো।

মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে আজ লড়ছি প্রায় তিন যুগ। শুধু নিজের লেখা বই আর টিভি সিরিয়ালের বিরুদ্ধে, অর্থাৎ আমার চিন্তা ভাবনা আদর্শ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে শান্ত হয়নি কোনও মৌলবাদী বা কোনও সরকার, আমি মানুষটাকেও নিষিদ্ধ করেছে। আমার আজ বাংলার মাটিতে পা দেওয়ার কোনও অধিকার নেই। অথচ এই বাংলা নিয়ে আমার ভাবনার কূলকিনার নেই, আমার গদ্যপদ্যের ভাষাটিও তো বাংলাই। এতকালের লড়াইয়ের সুফল বাংলায় না হোক, অন্য কোথাও পেলাম আজ। তবে ৬৬ক ধারাটি বাতিল করার সঙ্গে সঙ্গেই যে মুক্তচিন্তার জয় হয়ে গেলো তা নয়। তথ্যপ্রযুক্তির ৬৯-ক নামের যে ধারাটি এখনও বহাল আছে, সেটি ব্যবহার করে সরকার এখনও বন্ধ করে দিতে পারে যে কোনও ওয়েবসাইট। তথ্যপ্রযুক্তির আইন আর কত ব্যবহৃত হচ্ছে, মুক্তচিন্তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি যে আইনটি ব্যবহৃত হয় সেটি ভারতীয় ফৌজদারি আইনের ২৯৫ ক, খ ধারা। এটি শুধু ভারতবর্ষে নয়, পুরো উপমহাদেশেই বহাল তবিয়তে বিরাজ করছে। আইনটি একশ পঞ্চাশ বা তারও অধিক বয়সী একটি আইন। ইংরেজরা বানিয়েছিল বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে মারামারি বন্ধ করার জন্য। পুরোনো এই আইনটি উপমহাদেশে মূলত ব্যবহৃত হয় মুক্তচিন্তকদের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে কেউ যদি ইসলামের সমালোচনা করে। বাংলাদেশে এবং ভারতে মুক্তচিন্তক আর যুক্তিবাদীদের হেনস্থা করার জন্য, নির্যাতন করার জন্য, এই আইনটি মুলত ব্যবহৃত হয়। পাকিস্তানে আবার ক, খ ছাড়াও গ নামক ধারাটি আছে, যেটি মৃত্যুদণ্ড দেয়। মৃত্যুদণ্ডের জন্য পাকিস্তানের সংখ্যালঘু খ্রিস্টানদের ঘন ঘন বেছে নেওয়া হয়।

২৯৫ ক,খ,গ এই তিনটি ধারাকেই উপমহাদেশ থেকে অতি শীঘ্র বিদেয় করা উচিত। এটি থাকলে এটি ব্যবহৃত হবেই মানুষের বাক স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। সুতরাং না থাকাটাই বাঞ্ছনীয়। ৬৬ক বাতিল করাটা প্রথম ছোট্ট পদক্ষেপ। ধীরে ধীরে পা ফেলতে হবে বৃহত্তর শত্রুর দিকে। পৃথিবীর কোনও সভ্য দেশে বাক স্বাধীনতা বিরোধী এত আইন নেই। থাকলেও মৃত পড়ে আছে, লেখক-শিল্পীর স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এখানকার মতো ওসব আইন অন্য কোথাও এত ব্যবহৃত হয় না। ফোজদারি আইনের ২৯৫ক,খ কে বাতিল করার জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন সব করবো।

বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির ৫৭ ধারাটিও ভারতের ৬৬ক এর মতো, একই ধরনের। বাংলাদেশে কেউ কি নেই ওই ধারাটিকে চ্যালেঞ্জ করার? বাংলাদেশেও ৫৭ ধারার আওতায় হুটহাট ধরে নিয়ে যায় ছেলে মেয়েদের। অন-লাইনে কেউ কোনও লেখার লাইক দিল, বা কোনও প্রতিবাদে নাম লেখালো, ওমনি তাকে বেধে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুলিশ আসবে। ৫৭ ধারায় কম ধর-পাকড় হয়নি, কম হেনস্থা হয়নি। আশা করে আছি বাংলাদেশের মানুষ ৫৭ ধারাটি অতি শীঘ্র বাতিল করবে এবং দেশটির পরিবেশ বাসযোগ্য করে তুলবে। একটা গণতন্ত্র শুধু ধর্মবিশ্বাসী মানুষের নিরাপত্তার অঙ্গীকার করে না, ধর্মমুক্ত মানুষদের নিরাপত্তা দেওয়ার অঙ্গীকারও করে। মত এবং ভিন্ন মত– দুই অধিকারও নিশ্চিত করে।

নারীবিরোধী ও মানবতাবিরোধী ধর্মান্ধদের তথাকথিত ধর্মানুভূতিতে যেন আঘাত লাগে, সে কারণে জগৎ সজাগ। এখনও কি জগতের সময় হয়নি সবাইকে সমান চোখে দেখার! ধর্মান্ধদের বাড়তি খাতির না করার! যুক্তিবাদীদের মানবাধিকারকে সম্মান করার!

বাঘ আর বেড়াল

১. প্রসেনজিৎ লিখেছেন, বাঘের কিন্তু জাত আলাদা হয়, বেড়ালকে ভুল করে বাঘ না ভাবাই ভাল। অমনি বাংলাদেশের লোকরা ভেবে বসলো প্রসেনজিৎ বাংলাদেশের ক্রিকেট টিম নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। বেচারাকে ননস্টপ গালাগালি করতে লাগলো সবাই। এদিকে প্রসেনজিৎ ক্ষমা চাইলেন, বললেন তাঁর ওই মন্তব্যের সঙ্গে বাংলাদেশ বা এর ক্রিকেট দলের কোনও সম্পর্ক নেই, তিনি তাঁর সিনেমার একটি ডায়লগ বলেছেন মাত্র। বাংলাদেশের ক্ষুব্ধ দেশপ্রেমিকদের রাগ এখনও পড়েনি। নায়ক মশাইকে হাতের কাছে পেলে কী করতো, ওরাই জানে।

আমি মনে করি প্রসেনজিৎ ভুল লিখেছেন। বাঘ এবং বেড়ালের জাত মোটেও আলাদা নয়। ওরা এক জাত। ওরা ফিলাইন জাত। বাঘরাও একধরনের বেড়াল। আকারে বড় এই যা। প্রসেনজিৎ বেড়ালকে তুচ্ছ করে কথা বলেছেন। বাংলাদেশের লোকরাও বেড়ালকে অপমান করেছে। বাঘ না ডেকে তাদের বেড়াল ডাকা হয়েছে। মনে করে ক্ষুব্ধ হয়েছে তারা।

যে বেড়াল দশ হাজার বছর আগে জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়ে এসে মানুষের উপকার করেছিলো, যে বেড়ালকে প্রাচীন মানুষেরা রীতিমতো পুজো করতো, যে বেড়াল এখনও মানুষের সঙ্গে মানুষের ঘরে পরিবারের একজন হয়ে বাস করে, সেই বেড়ালকে নিচু করে, বাঘকে– যে বাঘের সঙ্গে আমাদের ঘরগেরস্থালীর সম্পর্ক নেই, যে বাঘ আমাদের পেলে চিবিয়ে খাবে, সেই বাঘকে আমরা আপন ভাবছি বেশি, ভালবাসছি বেশি! না, বাঘের সঙ্গে আমার কোনও বিরোধ নেই। বাঘ যেন বিলুপ্ত না হয়, তা আমি ভীষণই চাই।

কিন্তু বেড়ালকে খবরদার এভাবে আর তুচ্ছতাচ্ছিল্য করোনা। বেড়াল না থাকলে মানুষের একসময় না খেয়ে মরতে হতো, মনে রেখো। বাঘ হিংস্র, তাই ভালো লাগে? বেড়ালও কিন্তু হিংস্র হতে পারে। চটিয়ে একবার দেখ না!

২.বেড়ালের ইতিহাসটা না জানো তো বলি, শোনো। মানুষের এলাকায় বাস করা যত বেড়াল আছে পৃথিবীতে, সবারই পূর্বনারী বা পূর্বপুরুষই নিয়ারইস্টার্ন ওয়াইল্ডক্যাট বা নিকটপ্রাচ্যের বনবেড়াল। এই বেড়ালদের ডিএনএ নিকটপ্রাচ্যের বনবেড়াল ছাড়া অন্য চার রকম যে বনবেড়াল আছে– ইওরোপীয় বনবেড়াল, দক্ষিণ আফ্রিকার বনবেড়াল, মধ্য এশীয় বনবেড়াল, চীন-মরুভূমির বনবেড়াল– ওদের ডিএনএ-র সঙ্গে মেলে না। জিজ্ঞেস যদি করো নিকটপ্রাচ্যের দেশগুলো কী কী, বলবো, বাহরাইন, সাইপ্রাস, মিশর, ইরান, ইরাক, ইজরাইল, জর্দান, কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া, ওমান, কাতার, সৌদী আরব, সুদান, সিরিয়া, তুরস্ক, আরব আমিরাত, প্যালেস্টাইন, ইয়েমেন।

আমরা এতকাল জানতাম চার হাজার বছর আগে জঙ্গল থেকে বনবেড়াল প্রথম ঢুকেছিল মিশরের লোকালয়ে। কিন্তু আমাদের এতকালের ওই জানাটা ভুল ছিল। বনবেড়াল জঙ্গল থেকে লোকালয়ে এসেছে আরও আগে। নানা রকম প্রমাণ জড়ো করে এখন অবধি যা তথ্য পাওয়া গেছে, তা হল, নিকটপ্রাচ্যের বনবেড়ালদের মধ্যে কেউ কেউ, সম্ভবত হায়েনা আর বাঘ ভালুকের হাত থেকে বাঁচার জন্য, মানুষের এলাকায় ঢুকে পড়েছিল, দশ বা বারো হাজার বছর আগে, কোনও নিকটপ্রাচ্যদেশে। আজ তারই বংশধর আমাদের মাঠে ময়দানে, রাস্তা ঘাটে, অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়ানো আর বাসা বাড়িতে বাসা করা বেড়াল। ১৯৮৩ সালে সাইপ্রাসে প্রথম পাওয়া গেছে আট হাজার বছর পুরোনো বেড়ালের চোয়ালের হাড়। তারপর বছর দশ আগে যেটা পাওয়া গেছে, সেটা চোয়ালের হাড়-টাড় নয়, রীতিমত কঙ্কাল। আস্ত একটা মানুষের সঙ্গে আট মাস বয়সী আস্ত একটা বেড়ালকে কবর দেওয়া হয়েছিল, কবরটা সাড়ে নহাজার বছর পুরোনো। কবরটা দেখেই বোঝা গেছে, ওই এলাকায় বেড়ালরা মানুষের সঙ্গে বসবাস শুরু করেছে বেশ অনেক আগেই। কিছু কিছু নৃতাত্ত্বিক তো বলতে শুরু করেছেন, দশ বারো নয়, পনেরো হাজার বছর আগে বনবেড়াল মানুষের এলাকায় ঢুকেছে। দীর্ঘকালের সম্পর্ক না হলে অত আদর করে কেউ কোনও বেড়ালকে নিয়ে কবরে শুতো না। সাইপ্রাসে তুরস্কের চাষীরা বাসা বেঁধেছিল। তারাই সম্ভবত তুরস্ক থেকে পোষা বেড়াল নিয়ে আসে। তুরস্ক থেকেই, তা না হলে আর কোথাও থেকে বেড়াল জোটার কোনও সম্ভাবনা ছিল না সাইপ্রাসে। সাইপ্রাসের আশে পাশের কোনও জঙ্গলে বনবেড়াল ছিল না।

সারা পৃথিবীতে বেড়ালের সংখ্যাট কোটি। বিবর্তনের মজা এখানেই। মানুষের সঙ্গে মানুষের এলাকায় বাস করা বেড়ালগুলোই টিকে আছে। বনের বেড়ালগুলো বরং নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। যে বেড়ালগুলো বুদ্ধি করে বন থেকে চলে এসেছিল মানুষের আশ্রয়ে, তারা ঠিক কাজ করেছিল। চোখ কান খোলা রাখতে হয়, ভালো ভাবে বাঁচা যাবে এমন কিছুর গন্ধ পেলে পুরোনা জায়গা ছেড়ে নতুন জায়গায় তড়িঘড়ি চলে যেতে হয়। মানুষ তার জীবনের শুরু থেকেই জায়গা বদলাচ্ছে। ক্রমশ ভালো আবহাওয়া, ভালো পরিবেশ, ভালো বাড়ি, ভালো খাদ্য, ভালো শিক্ষা, ভালো বেঁচে থাকার দিকে যাচ্ছে। জায়গা বদলেছে বলে হোমো সেপিয়েন্স নামের মানুষ-প্রজাতি টিকে আছে, নিয়ানডার্থাল নামের মানুষ-প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

মানুষ যখন মূলত শিকারী ছিল, তখন কুকুরকে সঙ্গে রাখতো। যখন থিতু হলো, কৃষিকাজ শুরু করলো, তখন কুকুরের বদলে বেড়াল হলো বিশ্বস্ত সঙ্গী। বেড়াল শস্য খেতে আসা ইঁদুর মারতো, ও খেয়েই দিব্যি মনের সুখে খামারে বাস করতো। আর মানুষও খুশি ছিল বেড়ালের ওপর, বেড়ালকে দিয়ে ইঁদুর মারার কাজ চলতো বলে, শস্যের অভাব হতো না বলে। প্রাচীন মিশরীয়রা বেড়ালের পুজো করতো। বেড়াল দেবীর নাম ছিল বাস্ট। বেড়াল-পুজোর মন্দিরও ছিল মিশরে। মিশরীয় আইনে মানুষের চেয়েও বেশি মর্যাদা পেতো বেড়াল। কোনও বাড়িতে আগুন ধরলে, আগে মানুষকে নয়, আগে বেড়ালকে বাঁচানোর নিয়ম ছিল। শুধু মিশরের রাজা বাদশাহর মমি বানানো হতো তা নয়, বেড়ালেরও মমি বানানো হতো, বেড়ালের এক কবরখানায় তিন লক্ষ বেড়ালের মমি পাওয়া গেছে। কেউ কোনও বেড়ালকে প্রাণে মেরে ফেললে জেল-হাজত জরিমানা নয়, যাবজ্জীবনও নয়, রীতিমত মৃত্যুদণ্ড হত। প্রাচীন রোমও অনেকটা এরকমই ছিল। বেড়ালকে স্বাধীনতার প্রতীক বলে ভাবা হত। দুরপ্রাচ্যে বেড়ালের মর্যাদা আবার অন্য কারণে বেশি ছিল। বেড়ালরা নথিপত্র। পাণ্ডুলিপি এসব ইঁদুরের দাঁত থেকে রক্ষা করত বলে।

চারদিকে বেড়ালকে যখন মানুষ ঈশ্বরের বা প্রায় ঈশ্বরের সম্মান দিচ্ছে, তখন মধ্যযুগে, হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই, বেড়ালকে অশুভ প্রতীক, ডাইনির সঙ্গী, শয়তানের দূত বলে ভাবতে শুরু করলো ইওরোপীয়রা। প্লেগের জন্য দায়ী বেড়াল, এমনও অভিযোগ করেছে। ভারতীয় উপমহাদেশে বেড়াল নিয়ে এখনও কুসংস্কার চূড়ান্ত। কালো বেড়াল পথে পড়লে গাড়ি থামিয়ে দেয় লোকে। একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, কালো বেড়াল রাস্তা পার হচ্ছে মানে কী? এর মানে, বলেছিলাম, কালো বেড়ালটা কোথাও যাচ্ছে। কুসংস্কার যারা বোঝে, তারা কৌতুক বোঝে না।

যে প্রাণীটি লোকে সবচেয়ে বেশি পোষে, তা গরু নয়, ঘোড়া নয়, কুকুর নয়, পাখি নয়, তা বেড়াল। ইওরোপ আমেরিকার প্রায় ঘরে ঘরে বেড়াল। এক যুক্তরাষ্ট্রেই পোষা বেড়ালের সংখ্যা নকোটি। যে প্রাণীটি কোনও দুধ দেয় না, বোঝা বইতে পারে না, যার চামড়া দিয়ে কোনও কিছু বানাবার উপায় নেই, যে মানুষের কোনও উপকারে আসে না আজকাল, সেই প্রাণীকেই সবচেয়ে বেশি পুষছে মানুষ, ব্যাপারটি খুবই অদ্ভুত। এক বন্ধু বলেছিল, বেড়াল জল এড়িয়ে চলে, আর তাদের সবচেয়ে প্রিয় খাবার কি না মাছ! বিবর্তন দুনিয়ার কত কিছু যে পাল্টে দেয়। আমার বেড়ালটার কথাই বলি, নাম মিনু। নিজের মাছটাও নিজে খেতে জানে না। কাঁটা বেছে দিলে তবে খাবে। দেখে একবার আমার এক বন্ধু বলেছিলো, কী ব্যাপার, তুমি তো বেড়ালটাকে কাঁটা বেছে মাছ খেতে দিচ্ছ। আমি তো এতকাল জানতাম বেড়ালরা কাঁটা খায়। কাঁটা বেছে বেড়ালকে মাছ খেতে দেওয়ার মানে বেড়ালের বেড়ালত্ব কিছু আর অবশিষ্ট নেই, মনুষ্যত্ব ডেভেলপ করেছে।

তা ঠিক, মিনুকে দেখলে যে কেউ বলবে মিনুর ভেতরে বেড়ালত্ব কিছু আর নেই, যা আছে, তা মনুষ্যত্ব। আজ নবছর মিনু আমার সঙ্গে। গড়িয়াহাটের মাছের বাজারে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকা ছানাটাকে বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম, আজ তার জীবন অনেকটা রানির মতো বা দেবীর মতো। কত রকম সরকারী নির্যাতন গেল আমার ওপর, সবাই চলে গেলো, সব বন্ধু, সব অনুরাগী, শুধূ মিনু রয়ে গেলো। ও আর যাবে কোথায়! রাস্তার জীবনে ও আর অভ্যস্ত নয়, শিকার করেও খেতে পারবে না, চুরি করেও না। ওসব ও অনেককাল ভুলে গেছে অথবা শেখেইনি কোনওদিন। রাস্তায় বেরোলে গাড়ি ঘোড়া কুকুর মানুষের হাতে নির্ঘাত মরবে। তার চেয়ে নিরাপদ ঘরে ঘুমোবে খেলবে, সুস্বাদু খাবার দেওয়া হবে, বিদেশি কোম্পানির ট্রিটস,রয়েল ক্যানিন ফুড, কখনও নাক সিঁটকাবে, অভিমান করবে, রাগ করবে, খেতে পীড়াপীড়ি করলে খাবো না বলে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে থাকবে, হাতে পায়ে ধরেও মুখ খোলানো যাবে না, কখনও মর্জি হলে তবেই মুখে খাবার তুলবে। বাড়ি ভর্তি তার খেলনা, পুরো বিকেল জুড়ে তার সঙ্গে খেলতে হবে। আবদারের অন্ত নেই। গরমে তার এসি চাই, শীতে তার পশমী কম্বল চাই, উলের জ্যাকেট চাই, হিটার চাই। কেউ বিশ্বাস করুক না করুক, তার আলাদা শোওয়ারঘর, আলাদা বিছানা, আলাদা টয়লেট। টয়লেট কখনও অপরিষ্কার পেলে। চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করবে। আগে তার টয়লেট পরিষ্কার চাই, পরে অন্য কথা। শুধু যে নিজের কথাই ভাবে, তা নয়। সেদিন জ্বর হয়েছিল আমার, যতক্ষণ না জ্বর না সারলো, শিয়র থেকে নড়লো না। এই হলো আমার পালিতা কন্যা মিনু।

মিনু আর এখন বেড়ালের মতো কাঁদে না। কাঁদে মানুষের মতো। হাসেও হয়তো মানুষের মতো। এই মিনুরই পূর্বনারীরা জঙ্গল থেকে মানুষের এলাকায় ঢুকে পড়েছিল। এককালে, ইঁদুর শিকার করার কাজ পেয়ে বর্তে গিয়েছিল। আজ সেই বনবেড়ালের বংশধর ঘরের জীবন যাপনে এমনই অভ্যস্ত হয়েছে যে ইঁদুর দেখলে ভয় পায়। খেলনা ইঁদুরের ঘাড়ে বেশ ছুটে এসে কামড় দেয়, কিন্তু জ্যান্ত ইঁদুর দেখে দৌড়ে পালায়। ঘর-পোষা বেড়ালগুলোর স্বভাব চরিত্র এত পাল্টে যাচ্ছে যে বেড়ালের বদলে অন্য কোনও নামে হয়তো এদের ডাকতে হবে। কী নামে?

বারসেলোনা

বারসেলোনার গল্প বলেছি? শহরটা আমার খুব প্রিয়। আমার স্প্যানিশ পাবলিশার এডিশান বিবারসেলোনারই। প্রথমবার যখন গিয়েছিলাম আমার বই উদ্বোধনে,মাদ্রিদ থেকে উড়ে এসেছিলেন এক মন্ত্রী। জাস্ট অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য মূলত হয়তো ফটো তোলার জন্য আমার সঙ্গে। পরের দিনের নিউজপেপার ছেয়ে গিয়েছিল দুজনের ছবিতে। অনুষ্ঠানে বক্তব্য পেশ করার চেয়ে আমার ভালো লেগেছে পিকাসো মিউজিয়াম, দালি মিউজিয়াম, গাউদির গির্জায় ঘুরে বেড়াতে, মিরোর কাজ দেখতে। ভূমধ্যসাগরের পাড়ে বসে থাকতে। বারসেলোনার মেয়র বাড়িতে ডিনার খেতে ডেকেছিলেন। শহরের চাবি টাবিও হয়তো দিয়েছিলেন। ক্যাটালান লেখকরাও ডেকেছিলেন। ওঁরা বারসেলোনাকে ক্যাটালুনিয়া বলেন। ক্যাটালান কালচার নিয়ে। ভীষণ গর্বিত।

শেষবার বারসেলোনায় গিয়েছি বারসেলোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টারকালচারাল কমিউনিকেশনএর ওপর একটি বক্তৃতা দিতে। সেবার কী আশ্চর্য, ছাত্রছাত্রীরা আমাকে নিয়ে উৎসব করেছিল। ওদের ক্যাটালান কালচারে পোরোঁ নামে ওয়াইন রাখার জন্য একধরনের পাত্র আছে, যেটি দেখতে বোতল আর বদনির মতো। সেই পোরোঁর নল দিয়ে ওয়াইন ঢালতে হবে মুখে। হাতটা যত দূরে সম্ভব রেখে। এভাবে ওয়াইন খাওয়া ওদের ট্র্যাডিশান। কিন্তু এ তো আমার ট্র্যাডিশান নয়। বাইরের মানুষ হিসেবে আমি যেভাবে পোরোঁ থেকে খেতে পেরেছি, একটুও না ফেলে, দেখে ছাত্রছাত্রীরা রীতিমত মুগ্ধ। আমাকে একটা সার্টিফিকেট দিয়েছিল, পোরোঁ থেকে ওয়াইন খাওয়ায় ব্যাপারে থিওরি অ্যান্ড প্র্যাকটিসে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করার জন্য। আস্ত একটা পোরোঁও দিয়েছিল উপহার। সেন্স অব হিউমার যে কী প্রচণ্ড ওদের। দুটো ছবি আছে। বলে ওরা দেখতে কেমন তা জানি, কিন্তু ওদের কারওর নাম এখন মনে নেই।

বিলবাও

বিলবাওয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম একবার। বিলবাও স্পেনের একটি শহর। বাস্ক ভাষার দেশ বলা যায়। যে বাস্ক ভাষা পৃথিবীর অন্য কোনও ভাষার সঙ্গে মেলে না। এ ভাষাটি কোত্থেকে এলো কেউ জানে না। আপাতত ধরা যাক এটি আকাশ থেকে এসেছে। আমার বক্তৃতার টপিক ছিল ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন। মূলত অনুষ্ঠান ছিল ফ্রিডম অব মিউজিক নিয়ে। শিল্পীরা এসেছিল বিভিন্ন দেশ থেকে। বিশেষ করে যে সব শিল্পীকে গান গাইতে বাধা দেওয়া হয়, কারণ তাদের গানের কথাগুলো সরকারের পছন্দ হয় না। আমার হোটেল রুমে একদিন অনেক রাত অবদি আড্ডা দিয়েছিলো ডেনমার্কের ফ্রিমিউজের অ্যাকটিভিস্ট, ইরান আর জিম্বাবুয়ের শিল্পীরা। তারা আমাকে সেইসব নিষিদ্ধ গান গেয়ে শুনিয়েছিল।

প্রায় সাতদিন ছিলাম। ওই সাতদিনে চমৎকার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল আমার বডিগার্ডদের সঙ্গে। ওরা আমাকে বাস্ক কিছু শব্দ শিখিয়েছিলো। টয়লেটটা কোথায় বাস্ক ভাষায় কমুনা, নন ডাগো, ধন্যবাদ বাস্ক ভাষায় এসকেরিক আস্কো। এরকম আরও অনেক। আমি যেতে চেয়েছিলাম তাপাস খেতে, আর গুগেনহাইম মিউজিয়াম দেখতে। ওখানে তো নিয়ে গেলই, বিলবাওটা পুরো ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলো, লাঞ্চ খাইয়েছিল, হ্যাঁ আমাকে খাইয়েছিল ওরা, দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল একটা ব্রিজ, গুস্তাভ ইফেলের এক শিষ্য যে ব্রিজটি বানিয়েছিল।

সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, আমাকে যখন এয়ারপোর্টে বিদায় দিতে এসেছিল। ওরা, ওদের মুখ ছিল বিষণ্ণ, একজনের চোখে ছিল জল। বুঝি যে ওরা মন্ত্রী টস্ত্রীর বডিগার্ড হয়ে অভ্যস্ত, কখনও হয়তো কোনও লেখকের বডিগার্ড হয়নি যারা ওদের সম্মান দেয়, তাই বলে জল? অনেকদিন নেটে যোগাযোগ করেছে আমার সঙ্গে। বলেছে নর্থ সীতে সেইলিংএ যাবে ফ্যামিলি নিয়ে, আমিও যদি যাই তাহলে ভীষণ আনন্দ পাবে। আমার যাওয়া হয়নি।

 ব্যক্তিগত শোক

আমার ছোড়দার মৃত্যু হলো নিউইয়র্কের বেলভিউ হাসপাতালে। ঠিক যেভাবে মৃত্যু হয়েছিল লেখক হুমায়ুন আহমেদের। ওই একই হাসপাতালে। হুমায়ুন আহমেদের ছিল কোলন ক্যানসারের সঙ্গে লিভার মেটাসটাসিস। আমার ছোড়দারও ছিল লিভার মেটাসটাসিস, তবে মূল ক্যানসার কোলনে ছিল না, ছিল প্যানক্রিয়াসে। ক্যানসারের ভালো চিকিৎসা পাওয়ার পর দুজনের শরীরে ক্যানসার প্রায় ছিল না বললেই চলে। কিন্তু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের রক্তে ঢুকে পড়ে হাসপাতালের ভয়ংকর ব্যাকটেরিয়া, কোনও ওষুধেই যার মৃত্যু নেই, যে ব্যাকটেরিয়া দ্রুত খেয়ে ফেলতে থাকে ফুসফুস, কিডনি, মস্তিষ্ক, হৃদপিণ্ড। এই ব্যাকটেরিয়াগুলোকে হসপিটাল বাগ বলা হয়। খুব ভয়ংকর এই বাগ। কোনও অ্যান্টিবায়োটিকই এই বাগকে সামান্যও স্পর্শ করতে পারে না, এই বাগের জন্ম হাসপাতালেই। হাসপাতালের নানা অ্যান্টিবায়োটিক পেতে পেতে কিছু ব্যাকটেরিয়া আজরাইলে পরিণত হয়। এই ব্যাকটেরিয়া যাকে ধরে, তার মৃত্যু অনিবার্য। হসপিটাল বাগকে কাবু করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। হুমায়ুনের আহমেদের মৃত্যু দেখিনি, পূরবী বসুর কাছে শুনেছি কী ভাবে মারা গেছেন তিনি। তবে আমার ছোড়দার মৃত্যুটা আমাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়েছে। যদি ছোড়দা ক্যানসারে মারা যেতো, দুঃখ হতো না। ক্যানসারে মারা যাবে এরকমই জানতাম। ডাক্তারও এরকমই বলেছিলেন। প্রস্তুতিও নেওয়া ছিল। কিন্তু হাসপাতালের ব্যাকটেরিয়া একটা জলজ্যান্ত মানুষকে মেরে ফেলবে, সেটা ভাবা যায় না। বিশেষ করে সে হাসপাতাল যদি পৃথিবীর উন্নত দেশের অন্যতম একটি হাসপাতাল হয়। বেলভিউ হাসপাতালে হসপিটাল বাগ আছে। কারণ হাইজিন সুবিধের নয় এই হাসপাতালে। সাধারণত মেডিক্যালের যন্ত্রপাতির মধ্যেই লেগে থাকে এই ব্যাকটেরিয়া। নার্সরা এক রোগীকে স্পর্শ করে হাত না ধুয়ে আরেক রোগীকে স্পর্শ করলেও এই ব্যাকটেরিয়া ছড়ায়। কী করে ছড়িয়েছে হসপিটাল বাগ এই হাসপাতালে, কী করে আমার ছোড়দার রক্তে ঢুকেছে, তা আমরা জানি না। ডাক্তাররা যখন বুঝতে পারলেন ছোড়দার ফুসফুস চলে গেছে, কিডনি চলে গেছে, তখন আমাদের কাঁচুমাচু মুখে বললেন, কালচার রিপোর্টে দেখছি রেসিসট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া রক্তে, কোনও অ্যান্টিবায়োটিকই কাজ করছে না। হাঁ হয়ে থাকি। তাহলে কি জানিয়ে দেবো, নিউইয়র্কের বড় হাসপাতালটি নোংরা, এখানে চিকিৎসা করতে এলে হসপিটাল বাগআক্রমণ করে, এবং রোগীদের মেরে ফেলে? দুএকজন ডাক্তার মিনমিন করছিল, আসলে কেমোথেরাপি নিতে নিতে ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এত কমে গেছে যে…। ইমিউনিটি কমে যাওয়ার কারণে কি আর হসপিটাল বাগ ধরেছে, কোনও সুস্থ মানুষকেও তো ধরতে পারতো এই বাগ!

ডাক্তাররাও চান হাসপাতালকে দুর্নাম থেকে রক্ষা করতে।

গতবছর আমাকেই তো দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। তিরিশের পর সব মেয়েকেই প্রতিবছর ম্যামোগ্রাম করার উপদেশ দেন ডাক্তাররা। স্তনের ক্যানসার শুরুতেই যদি ধরা পড়ে, অনেক বছর বেঁচে থাকা যায়। ম্যামোগ্রামে স্তনের ক্যানসার ধরা পড়ে। আমার ম্যামোগ্রামে কিছু একটা পাওয়া গিয়েছিলো, অবশ্য কোনও ডাক্তারই বুঝতে পারেননি কী পাওয়া গিয়েছিল। বায়োপসি করে বলে দিলেন, ও কিছু না। ছমাস পর আবার ম্যামোগ্রাম করে এক ডাক্তার ভ্রু কুঁচকালেন, বললেন এটি ফেলে দাও, মনে হচ্ছে, টিউমারটা বড় হচ্ছে। আমি তো রীতিমত ভয় পেয়ে গেলাম। সারা শরীর অজ্ঞান করে অতপর টিউমার ফেলতে হয়েছে। টিউমারের বায়োপসি রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি। যা রিপোর্ট এলো, তা দেখে তো আমি চমকে উঠলাম। ও কোনও টিউমারই ছিল না। কী ছিল তবে? কিছুই ছিল না। তবে কী পেয়েছিলো ম্যামোগ্রামে? ফ্যাটি টিস্যুগুলো একটু ঘনঘন ছিল, এই যা, তার একটা ছায়া বোধহয় পড়েছিল। কিন্তু এত বড় বড় ডাক্তার বুঝতে পারলো না ওটা কোনও টিউমারই নয়? একটা কিছুই না জিনিসের জন্য আমাকে অজ্ঞান করলো, শরীরে কাটাছেঁড়া করলো! বন্ধুরা উপদেশ দিয়েছিলো মামলা করার জন্য। মামলার ঝামেলায় যেতে ইচ্ছে করে না। তাই করিনি। তবে ডাক্তারদের ভৎসর্না করে একটা ইমেইল পাঠিয়েছিলাম।

আমেরিকার হাসপাতালের ওপর থেকে আমার মন ওঠার কথা আমার মার ওপর যা ঘটেছিল তার পরই। মার ক্যানসার ধরা পড়ার পর আমি মাকে নিউইয়র্কের স্লোন কেটেরিং হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলাম। ওরা আগে থেকেই সাড়ে তেরো হাজার ডলার নিয়ে রেখেছিল, যেহেতু মা বিদেশি রোগী, ওই টাকাটা এয়ারপোর্ট থেকে মাকে নিয়ে আসার খরচ, সমস্ত চিকিৎসার খরচ, হাসপাতালে থাকার খরচ, ওদের হোটেলে থাকার খরচের অগ্রীম। এই টাকা না দিলে ওরা রোগি দেখবে না। মাকে ওরা নিয়ে আসেনি এয়ারপোর্ট থেকে, মাকে কোনও হোটেলে থাকতে হয়নি, হাসপাতালেও থাকতে হয়নি। মানিউইয়র্কে আমার অ্যাপার্টমেন্টে ছিল। মাকে শুধু একটা এমআরআই করে ওরা বলে দিলো মা আর তিনমাস বাঁচবে, যেন দেশে ফেরত নিয়ে যাই। ব্যস এইটুকুই। এইটুকুর খরচ রেখে বাকি টাকা ফেরত দাও। না, ওরা টাকা ফেরত দিল না। মেমোরিয়াল স্লোন কেটেরিংএর নাম বিশ্ব জুড়ে। এদের ছোটলোকির কথা কজন জানে? বেলভিউএর হাসপাতাল বাগের খবরই বা কজন রাখে। মানুষ জানে বেলভিউ হাসপাতাল খুব প্রাচীন, খুব বড়, খুব নামী হাসপাতাল। খুব কম লোকই জানে, এটি খুব নোংরা হাসপাতাল। এই নোংরা হাসপাতালে নার্সরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নয়, ডাক্তাররা উদাসীন। আজ আমার ছোড়দা বেলভিউ হাসপাতালের অস্বাস্থ্যকর অবস্থার জন্য জীবন দিলো। এরকম আরও অনেকে জীবন দেবে। কিন্তু আমরা তৃতীয় বিশ্বের গরিব মানুষ ভাববো ধনীর দেশের হাসপাতালগুলো ভালো, নার্সরা হাইজিন মানে, ডাক্তাররা অনেক জানে।

আমার ছোড়দা খুব বাঁচতে চেয়েছিলো। বিদেশের মাটিতে মরতে চায়নি। কিন্তু আমেরিকার হাসপাতাল তা হতে দেয়নি। হাসপাতালের নিজস্ব ব্যাকটেরিয়া তাকে মেরেছে। ক্যানসারের রোগীরা অপঘাতে মারা গেলেও লক্ষ্য করেছি কেউ বিশেষ দুঃখ করে না। ক্যানসার হওয়ার পর মানুষ সম্ভবত মনে মনে চিরবিদায় জানিয়ে দেয়। আমার ছোঁড়া দীর্ঘদিন ক্যানসারের চিকিৎসা নিয়েছিল, অনেক কষ্ট সয়ে সে চিকিৎসা নিয়েছিলো, কিছুদিন বেশি বাঁচার জন্যই নিয়েছিলো চিকিৎসা। শরীরে কেমোথেরাপির বিষ নিয়ে তাকে দুদিনের বেঁচে থাকা ক্রয় করতে হতো, সুতরাং তার বেঁচে থাকাটা খুব মূল্যবান ছিলো। এই মৃত্যুটা সওয়া যায় না। তারপরও সব মৃত্যুকেই আমাদের শেষ অবধি মেনে নিতে হয়।

বিদেশমানেই স্বর্গ। বিদেশের চিকিৎসা মানেই ভালো চিকিৎসা এই ধারণা থেকে মানুষের মুক্ত হওয়া জরুরি। ভারতে থাকাকালীন দেখেছি পেট ব্যথা হলো, কী পায়ে কাঁটা বিঁধলো বাংলাদেশের মানুষ ভারতে চলে যায় চিকিৎসা করাতে। বাংলাদেশের চিকিৎসার ওপর কারও যেন আর আস্থা নেই। এ কবে হলো কী করে হলো জানি না। যখন দেশের মেডিক্যাল কলেজে পড়েছি, হাসপাতালে চাকরি করেছি–নিষ্ঠ, কর্মঠ, দায়িত্বশীল, ডেডিকেটেড ডাক্তারদের কাজ দেখেছি। ভালো ডাক্তারি দেখেছি। আমার পুরো ডাক্তার জীবনে কোনও রোগীর অবহেলা হতে দেখিনি। এই বাংলাদেশ এখন শুনি চিকিৎসা করতে জানে না। আমার বাবার কিডনি ফেইলুরের পর একবার শুধু ডায়ালাইসিস হয়েছিল, দ্বিতীয়বার হতে পারেনি, বারডেমের মতো হাসপাতালে সেপটিসেমিয়ায় মরতে হলো আমার বাবাকে। আমার মার চিকিৎসা ভুল করেছিলো বারডেম। কোলনে যে জায়গায় ক্যানসার হয়েছিল, সেই জায়গাটুকু শুধু অপারেশন না করে একটা বিশাল র‍্যা ডিক্যাল অপারেশন করেছিল, যেটা করতে হয় কোথাও মেটাসটাসিস না থাকলে অর্থাৎ ক্যানসার শরীরের কোথাও ছড়িয়ে না পড়লে। পেটের যা আছে সব ফেলে টেলে ব্যাগ ব্যাগ রক্ত দিয়ে পাঁচ ঘন্টার অপারেশন শেষে ত্বক শেলাই করার আগে লিভারে হাত দিয়ে দেখেছে লিভারে মেটাসটাসিস ক্যানসার। লিভারে হাতটা অপারেশন শুরু করার সময় দিতে পারতো। ডাক্তারদের জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন তারা লিভারটা দেখে নেয়নি। ডাক্তাররা বলেছিলো লিভারের রিপোর্ট নাকি ভালো এসেছিলো। তার মানে বারডেমের ল্যাবরটরিও খারাপ? মার ওই অপারেশনকে ভুল অপারেশন বলার চেয়ে ক্রাইম বলাই ভালো। এত দীর্ঘক্ষণের অপারেশনে ক্যানসার দ্রুত ছড়ায়। রক্তই যেহেতু ক্যানসার ছড়ানোর বড় এক মাধ্যম। এই ক্রাইমটা না হলে মা আরও বেশিদিন বাঁচতে পারতো। দেশ বিদেশের হাসপাতালগুলোয় মানুষ শুধু বাঁচানোই হয় না, মানুষ মারাও হয়। এখন ভাগ্য ভালো কী মন্দ সেটাই দেখার বিষয়।

ব্লগার হত্যা?

আমি একে ব্লগার হত্যা বলবো না। প্রচুর ধর্মান্ধ-মৌলবাদী-সন্ত্রাসীও ব্লগ লেখে। তাদের কিন্তু খুন হতে হয় না। তারা তাদের মত প্রকাশ করে বলে কেউ তাদের কুপিয়ে মেরে ফেলে না। কিন্তু যারা মুক্তচিন্তায় বিশ্বাস করে, যারা শিক্ষিত, সচেতন, চিন্তক, যারা সমাজকে বাসযোগ্য করতে চায়; অন্ধতা, গোঁড়ামি, কুসংস্কার থেকে সমাজকে মুক্ত করতে চায়; বৈষম্য, নিপীড়ন, নির্যাতন থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে চায়; তারাই আজ নৃশংসতার শিকার। আমি বরং একে বলবো বুদ্ধিজীবী হত্যা। আলোকিত মানুষগুলোকে আজ অন্ধকারের বোবা-কালা-বধিরেরা বিভৎসভাবে হত্যা করছে। তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইছে। অন্ধকারে আচ্ছন্নরা জগৎটাকে অন্ধকারে ঢেকে ফেলতে চায়। এই অন্ধকারে আলোকিত মানুষদের কোনও ঠাঁই নেই। অন্ধকারের বোবা-কালা-বধিরগুলো আলোকিত সাহসীদের বড় ভয় পায়। পৃথিবীর আর কাউকে ভয় পায় না ওরা। আর যারা আছে, এমনকী বড় বড় নেতা-শাসকরাও তারা ভীতু, ভীরু, আপোসকামী, পদলেহনকারী তাদের নিয়ে কোনও সমস্যা নেই অন্ধকারের লোকদের।

আলোকিত মানুষরা নিরস্ত্র। কারণ তারা অস্ত্রে আর খুনোখুনিতে বিশ্বাসী নয়। অন্ধকারের লোকদের হাতে চাপাতি, হাতে রক্ত, মগজে মূর্খ। যারা দূরে দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চপ, তাদের এখন যে কোনও একটি পথ বেছে নিতে হবে, নিজেকে তারা জিজ্ঞেস করুক, তারা অন্ধকারের পথে যেতে চায় নাকি আলোর পথে। অন্ধকারের পথ মিথ আর মিথ্যের পথ, খুন খারাবির পথ, বৈষম্য, নারী বিদ্বেষ, ঘৃণা আর সংকীর্ণতার পথ। পাথর ছুঁড়ে মানুষ হত্যা আর কথায় কথায় মুণ্ডু কেটে ফেলার জগতে শ্বাসরুদ্ধকর অনিশ্চয়তা নিয়ে বেঁচে থাকতে যারা চায়, তারা অন্ধকারের হাত ধরে হেঁটে যাক, হেঁটে যাক রূপকথার স্বর্গর্বাসের লোভে। আর যারা ও পথে চায় না যেতে, যারা মানবাধিকার, মনুষ্যত্ব, সমতা আর শান্তিতে বিশ্বাস করে, তারা রুখে দাঁড়াক। আজ যদি তারা রুখে না দাঁড়ায়, তবে আর কবে? রাজপথ ভাসছে তাজা তরুণের রক্তে।

দেশে মৌলবাদ বাড়ছে, মানুষ সতর্ক হও, রুখে দাঁড়াও– বলেছিলাম পঁচিশ বছর আগে। তখন আমাকে দোষ দিয়েছিল সমাজের তাবড় তাবড় বুদ্ধিজীবীরা। বলেছিল, কোনও মৌলবাদীর অস্তিত্বই নেই দেশে, আর যদি থাকেই তবে আমার কারণে নাকি মৌলবাদীর উৎপত্তি হয়েছে, আমিই যত নষ্টের মূল। আমাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো। গত কুড়ি বছর তো আমার চিহ্নমাত্র কেউ দেখতে পায়নি, আমার লেখাপত্রও কেউ ছাপায়নি, তাহলে মৌলবাদীরা এত ভয়ংকর একটি চেহারা কী করে পেলো! কে তাদের ননীটা ছানাটা খাইয়ে ফ্রাংকেন্সটাইন বানিয়েছে? কেন আজ দেশ ছেয়ে গেছে ধর্মান্ধতায়, মৌলবাদে আর সন্ত্রাসে? দেখেও দেখবো না, শুনেও শুনবো না করলে এই হয়। সুবিধেবাদী বুদ্ধিজীবী আর দূরদৃষ্টিহীন মুখ রাজনীতিকদের দেশে মৌলবাদ বাড়বে না তো মানববাদ বাড়বে?

যে বীজ রোপণ করা হয়েছে, তার ফসল আজ ভোগ করছে বাংলাদেশ। ধর্মীয় অনুভূতিকে উসকে দেওয়ার জন্য অগুনতি মসজিদ মাদ্রাসা বানানো হয়েছে। আখেরে এগুলো ক্ষতিকর জেনেও বানানো হয়েছে। মাদ্রাসা থেকে পাশ করে আজ অবধি কেউ বিজ্ঞানী বা দার্শনিক বা মহামানব কিছু হয়নি। কিন্তু দেশটার সর্বোচ্চ ক্ষমতায় যে ই এ যাবৎ এসেছে, দুদিনের গদির লোভে দেশটার ধ্বংস ডেকে এনেছে, জেনে বুঝে মৌলবাদীদের মাথায় তুলে নেচেছে, ওদের সঙ্গে আপোসের ষড়যন্ত্র করেছে। ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা অবাধ স্বাধীনতা পেয়েছে মসজিদ মাদ্রাসাকে মৌলবাদী তৈরির কারখানা হিসেবে ব্যবহার করার। রাজনৈতিক ইসলামের নেতৃত্ব দেওয়া হচ্ছে মসজিদ মাদ্রাসা থেকেই, আর দুরদৃষ্টিহীন সরকার জেনে বুঝেই সায় দিচ্ছে এসবে। কোনও এক নারীবিরোধী বিজ্ঞানবিদ্বেষী আল্লামা শফিকে শুনেছি হাসিনা সরকার কত হাজার একর জমি দান করেছেন। ওই জমিতে তিনি যেন একটা বিশাল কারখানা বানিয়ে ফেলতে পারেন, যে কারখানায় ছেলেপিলেদের মাথা-মগজের সর্বনাশ হবে, এবং ভয়ংকর সব সন্ত্রাসী তৈরিও হবে। শুধু অর্ডার দিলেই হয়, মাদ্রাসার ছাত্ররা তাদের হুজুরের অর্ডার মাথা পেতে মেনে নেবে। বোবা-কালা-বধিরদের বোধশক্তি নেই কাজটা অন্যায় কি না, কাজটা করা উচিত হচ্ছে কিনা, কাজটা করলে ফলটা কী হবে তা চিন্তা করার। হুজুররা তাদের দেখিয়েছে এক রূপকথার ফুলের লোভ। খুন করলে। তারা বেহেশত পাবে। বেহেশতের লোভে আজ এরা বর্বর খুনী হতে দ্বিধা করছে না। এ জীবনে আমোদ প্রমোদের সুযোগ হলো না, পরকালে যথেচ্ছ ভোগের ব্যবস্থা পাকা করার জন্যই এই খুন। সরকার জঙ্গী তৈরিতে পরোক্ষভাবে সাহায্য করছে ইহকালের গদিরক্ষার জন্য, জঙ্গীরা ইসলাম-সমালোচকদের খুন করছে পরকালের গদি রক্ষার জন্য। সরকার আর জঙ্গীর চরিত্রে খুব একটা ফারাক নেই।

ফারাবিকে ধরা হয়েছে অভিজিৎকে হত্যার জন্য। আসল খুনীদের টিকিটি চাইলেও ছুঁতে পারবে না পুলিশ, এ আমি বিশ্বাস করি না। ছুঁতে চাইলে কি ছুঁতে পারতো না? আরিফুর আর জিকিরুল্লাহকে ধরা হয়েছে ওয়াশিকুর বাবুকে হত্যা করার কারণে। কিন্তু এখনও ধরা হচ্ছে না ওদের হুজুরটিকে, যে হুজুর তাদের বলেছে ওয়াশিকুরকে খুন করলে ওদের বেহেশত মিলবে। ছোট-হুঁজুরের বাপ বড়-হুঁজুরকে ধরা হচ্ছে না, ধরা হচ্ছে না মাদ্রাসার প্রধান নাটের গুরু শফিকে, যে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে ব্লগারদের মেরে ফেলা মুসলমানদের ঈমানী দায়িত্ব।

সন্ত্রাসীরা আমার মুণ্ডুটা এর মধ্যে কেটে না ফেললে হয়তো দেখে যেতে পারবো বাংলাদেশে শরিয়া আইন চালু হয়েছে, সৌদি আরবে যেমন রাস্তার ওপর মানুষকে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে তলোয়ার দিয়ে মুণ্ডুটা ঝপাং করে কেটে ফেলা দেওয়া হয়, বাংলাদেশেও তাই হচ্ছে। ধর্ষিতা মেয়েরা সাক্ষীর অভাবে ব্যাভিচারি বলে সাব্যস্ত হচ্ছে, দুররার মার খাচ্ছে। কোনও মেয়েই বোরখা ছাড়া বাইরে বেরোতে পারছে না, গাড়ি ঘোড়া সাইকেল রিক্সা কিছুই চালাতে পারছে না, অভিভাবক ছাড়া দেশের বাইরে যেতে পারছে না। আত্মীয় নয় এমন কোনও পুরুষের সঙ্গে জরুরি কোনও কথাও বলতে পারছে না। অধিকার বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই মেয়েদের।

অনেকে রাগ করে বাংলাদেশকে মিনি পাকিস্তান বা পাকিস্তান বলে। আমি বাংলাদেশকে পাকিস্তানের চেয়েও ভয়ংকর দেশ বলি। বাংলাদেশে মৌলবাদের অবাধ চাষ হয়। ফলনও বেশ ভালো। পাকিস্তানে মৌলবাদ নানাভাবে দমন করা হয়। পাকিস্তানে মৌলবাদী খুনীরা ধরা পড়ে এবং জেলে যায়। বাংলাদেশে মৌলবাদী খুনীদের ইচ্ছে করেই ধরা হয় না। তাদের কোনও শাস্তিও দেওয়া হয় না। পাকিস্তানে বাংলাদেশের মতো মুক্তচিন্তক আর যুক্তিবাদীদের এক এক করে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা হচ্ছে না। একসময় বাংলাদশে আর কোনও মুক্তচিন্তক হয়তো থাকবে না। কিন্তু পাকিস্তানে থাকবে। পাকিস্তানের মুক্তচিন্তকরা একসময় তাদের দেশটা যেন বাংলাদেশ হয়ে না যায়, তার চেষ্টা করবে।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের গৌরব করার মতো বেশি কিছু নেই। স্বাধীনতার পর থেকে এ যাবৎ যা ঘটেছে বাংলাদেশে, সবই ইসলামি মৌলবাদীদের পক্ষের ইতিহাস। সেকুলার সংবিধানের ইসলামিকরণ, সংবিধানে বিসমিল্লাহ বসানো, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আনা, দেশ জুড়ে অগুনতি মসজিদ মাদ্রাসা গড়ে তোলা, মাদ্রাসার ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ দেওয়া, একশ পঞ্চাশ বছরের পুরোনো বাক স্বাধীনতা বিরোধী আইনকে ( বাংলাদেশ ফৌজদারি আইনের ২৯৫-ক খ ধারা) মুক্তচিন্তকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা, ইন্টারনেটেও যেন কেউ ইসলাম নিয়ে কোনও প্রশ্ন করতে না পারে সে জন্য আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারা বানানো, এবং ওই ধারায় আলোকিতদের ফাঁসানো, রেডিও টেলিভিশনে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা ইসলামের গীত গেয়ে যাওয়া, দেশের সর্বত্র ইসলামী ওয়াজের ব্যবস্থা, দেশের সার্বিক ইসলামিকরণ, ইসলামী প্রতিষ্ঠানে দেশ ছেয়ে যাওয়া, এমনকী সেকুলার বিশ্ববিদ্যালয়েও লখিন্দরের বাসরঘরের মতো মৌলবাদী সাপের ঢুকে যাওয়া, তসলিমার মাথার মূল্য ঘোষণা করেও মৌলবাদীদের পার পেয়ে যাওয়া, আজাদ, হায়দার, এবং আরও অনেককে কুপিয়ে হত্যা করেও শাস্তি না পাওয়া..। মৌলবাদীদের ঝুড়িতে অসংখ্য বিজয়ের মুকুট। এই বিজয়ী দল ধর্মের পতাকা ওড়াতে ওড়াতে মানুষের শিরোচ্ছেদ করবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ভিত্তিটা তো এতকাল ধরে তৈরিই করা হয়েছে ওদের যা খুশি তাই করার জন্য। অভিজিৎ রায় আমার অনেককালের বন্ধু, ও আমার ফেসবুক বন্ধুও ছিল। ওয়াশিকুর বাবুও আমার ফেসবুক বন্ধু ছিল। আমার প্রতিভাবান তরুণ বন্ধুরা এক এক করে চলে যাচ্ছে, যারা আর কোনওদিন ফেরত আসবে না। পড়ে থাকছে লাখো খুনী, তাদের আকাশে উড়ছে হাজারো শকুন। অভিজিতের মৃতদেহ দেখে আমি চিৎকার করেছি রাগে, ক্রোধে। আজও মানতে পারিনি ওর চলে যাওয়া। আজও খাঁ খাঁ করছে আমাদের মুক্তচিন্তার জগৎ। ওয়াশিকুর বাবুর মৃতদেহ দেখে আমি নিঃশব্দে কাঁদছি। আমার ভালো লাগছে না দেখতে আমার চোখের জল। আমি রাগে ক্রোধে আগের মত চিৎকার করতে চাই, চিৎকার করার আরো শক্তি চাই। একুশ বছর আগে আমাকে ওরা ওভাবেই মেরে ফেলতে চেয়েছিল। আমি বেঁচে আছি। প্রতিভাবান তরুণদের একের পর এক হত্যা করে দেশটাকে ওরা কাদের জন্য বাসযোগ্য করছে! এত ক্ষতি আমি আর সইতে পারছি না।

ভারতে পর্নোগ্রাফি নিষিদ্ধ

ভারত সরকার পর্নোগ্রাফির ৮৫৭টা সাইট নিষিদ্ধ করেছে। কোনও রকম আওয়াজ না দিয়েই ব্লক মারা যাকে বলে, সেটিই করেছে। কোনও রকম কারণ না দর্শিয়ে কম্মটি করেছে সরকার। ইন্টারনেটে পর্ন কারা সবচেয়ে বেশি দেখে? সবচেয়ে বেশি দেখার মধ্যে এক নম্বরে আছে পাকিস্তান, পাঁচ নম্বরে আছে ভারত। আমি জানি না কারা এই সাভেটা করেছে। আদতেই এর কোনও ভিত্তি আছে কি না। ভারতে এ সময় পর্ন বন্ধ করার কারণ কী, এটি একটি বড় প্রশ্ন। সুপ্রিম কোর্ট যেখানে কদিন আগেই পর্ন নিষিদ্ধ করার আবেদন নাকচ করে বলে দিয়েছে, প্রতিটি প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের অধিকার আছে ঘরে বসে নিভৃতে পর্ন ছবি দেখার। এরপর তো আর কোনও ম্যাওমাও চলতে পারে না। কিন্তু আবেদনটি যিনি করেছেন, সেই কমলেশ বাসওয়ানী ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। এই বাসওয়ানী নিজেই খেটেখুটে ৮৫৭টা পর্ন সাইট বের করেছেন যেসব সাইট ভারতে খুব জনপ্রিয়। এই ৮৫৭টা সাইটকে ব্লক করার জন্যই তিনি সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছিলেন। বাসওয়ানী আবেগে ভরপুর। তিনি হয়তো মনে করছেন পর্নোগ্রাফি বলে যা কিছু আছে তা দুর হলেই ভারতের সমাজ গঙ্গাজলে চান করে শুদ্ধ হয়ে উঠবে। তিনি তাঁর আবেদনে লিখেছেন, পর্নোগ্রাফি হিটলারের চেয়েও, এইডসের চেয়েও, ক্যানসারের চেয়েও খারাপ, এটা নিউক্লিয়ার হলোকস্টের চেয়ে ভয়ংকর, সুতরাং একে বন্ধ করা ভীষণই দরকার। দিল্লির বাসে ফিজিওথেরাপির ছাত্রী জ্যোতি সিংএর নৃশংস গণধর্ষণের পর ৪৫ বছর বয়সী লইয়ার বাসওয়ানী পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তাঁর একার যুদ্ধ। সুপ্রিম কোর্ট তাঁর আবেদন বাতিল করে দেওয়ার পর তিনি মোদি সরকারের আইন বিশেষজ্ঞ পিংকি আনন্দকে দিয়েছিলেন ৮৫৭টি সাইটের তালিকা। পিংকি আনন্দ তালিকাটা সোজা পাঠিয়ে দিয়েছেন টেলি যোগাযোগ বিভাগে। টেলি যোগাযোগ বিভাগ যথারীতি পাঠিয়ে দিয়েছে ইন্টারনেট প্রোভাইডারের কাছে। ইন্টারনেট প্রোভাইডার মোদি পর্যন্ত যায় না, তাদের কাছে টেলি যোগাযোগ বিভাগই সরকার। সুতরাং তারা ব্লক করে দিয়েছে বাসওয়ানি নির্বাচিত ৮৫৭ পর্ন সাইট।

সরকারের মধ্যেই অনেকে পর্ন সাইট বন্ধ করার পক্ষপাতি। পর্ন দেখছে বলেই লোক ধর্ষণ করছে, এই বিশ্বাস অনেকের। সমাজে নারী পুরুষের বৈষম্য প্রকট হলে, নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য প্রবল হলে নারী ধর্ষণ বাড়ে, এ সহজ সত্যটা অধিকাংশ লোকই জানে না, অথবা জানলেও কেউ স্বীকার করে না। এই প্রথম ভারত সরকার একসঙ্গে এতগুলো সাইট ব্লক করে দিলো। তবে কি উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের জয় হচ্ছে যারা শুধু প্রজননের প্রয়োজনেই সেক্সকে ব্যবহার করা উচিত বলে মনে করে? এই নিষেধাজ্ঞজ্ঞা নিশ্চিতই মত প্রকাশের অধিকারের বিরুদ্ধে যায়। সরকার কি আবারও বাক স্বাধীনতার টুটি টিপে ধরলো! সেদিন না বিলুপ্ত হলো আইটি অ্যাক্ট ৬৬এ?

সেক্সয়ালিটি যে সমাজে টাবু, বিয়ে না হলে সেক্স করা যাবে না যে সমাজের রীতি, সে সমাজে পর্ন ছবি দেখে অনেক অবিবাহিত অথবা যৌনসঙ্গীহীন যুবক যুবতী নিজেদের যৌনক্ষুধা নিজেরাই মেটাতে পারে। পর্নের পজিটিভ একটি দিক এটিই। যে ভারতের প্রাচীন মন্দির জুড়ে পর্নোগ্রাফি, যে ভারতের প্রাচীন কাব্যে পর্নোগ্রাফি, বাৎসায়ন যে ভারতে বসে লিখেছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পর্নোগ্রাফি, যে ভারতে এক পর্ন অ্যাকট্রেস দুদিনেই তারকা বনে যায়, সেই ভারতে আজ পর্নোগ্রাফি নিষিদ্ধ! দিন দিন মানুষ দৌড়ে যাচ্ছে সামনে, ভারতই কেবল ফিরে যাচ্ছে ভিক্টোরিয়ার যুগে।

এ তো গেল মত প্রকাশের অধিকারের পক্ষে আমার মত। পর্ন সম্পর্কে আমার কিছু নিজস্ব মত আছে, আমার মতের সঙ্গে অনেকে একমত নাও হতে পারেন, সম্ভবত না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। পর্ন শব্দটির উৎপত্তি গ্রীক শব্দ পর্ন থেকে। পর্ন শব্দের অর্থ যৌনদাসী। পর্নোগ্রাফি শুরু থেকেই মেয়েদের জন্য নয়, তৈরিই হয় পুরুষের সুখের জন্য। পর্নোগ্রাফিতে যৌনদাসির ভুমিকা ছাড়া মেয়েদের মুলত আর কোনও ভূমিকা নেই। তারা যৌন-আনন্দ দেবে পুরুষকে, পুরুষরা ঠিক যেভাবে যেভাবে যেভাবে পছন্দ করে, সেভাবে। পর্ন মানে পুরুষরা তাদের ইচ্ছেমতো কামড়ে খামচে ভোগ করবে মেয়েদের। পুরুষদের ইচ্ছেমতো, মেয়েদের ইচ্ছেমতো নয় কিন্তু। মেয়েদের ইচ্ছের কোনও মূল্য পর্নে নেই। মেয়েদের যৌনাঙ্গকে, পায়ুপথকে, মুখগহবরকে তুচ্ছার্থে বলা হয় ছিদ্র বা ফুটো, এগুলো পুরুষরা যতবার খুশি, যতক্ষণ খুশি, যত জন খুশী ব্যবহার করবে। শত যন্ত্রণাতেও, শত কষ্টেও শত অনিচ্ছেতেও মুখে হাসি ধরে রাখতে হবে মেয়েদের, আর ক্ষণে ক্ষণেই বলতে হবে ইয়েস ইয়েস, ভালো লাগছে, আরও চাই। অনেক পর্নতারকা জীবনের একটা সময়ে এসে স্বীকার করেছে তাদের ওই ইয়েসগুলো আসলে ইয়েস ছিল না, ওগুলো আসলে নো ছিল। পর্নে আমরা এই দৃশ্য খুব দেখি যে, একসঙ্গে একাধিক পুরুষ সেক্সের নামে নির্যাতন করছে একটা মেয়েকে, চড় দিচ্ছে, থাপ্পড় লাগাচ্ছে, চুল ধরে টানছে, যত বেশি যন্ত্রণা পাচ্ছে মেয়েটি, তত বেশি সে হাসছে। পর্নে মেয়েদের শারীরিক যন্ত্রণার নাম দেওয়া হয়েছে যৌনসুখ। মেয়েদের যন্ত্রণাকে ইরোটিসাইজ করা হয় পর্নোগ্রাফিতে পুরুষরা ইনভেড করে, আক্ষরিক অর্থেই দখল করে নেয় একটি মেয়ের শরীর, অথচ মেয়েটির জন্য তাদের কোনও প্রেম তো নেইই, ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধও নেই, এটিকে আর যে যাই বলুক, আমি অন্তত যৌন সঙ্গম বলি না। পর্নোগ্রাফি ধর্ষণের মতোই, যেখানে প্রাধান্য পায় পুরুষের আধিপত্য আর বর্বরতা। ধর্ষণের সময় যেমন বলা হয়, মেয়েটা চেয়েছিল, মেয়েটার ভালো লাগছিল ধর্ষণ, ধর্ষিতার না টাকে হ্যাঁ বলে ধরা নেওয়া হয়। পর্নোগ্রাফিতেও ওই একই মিথ্যের বেসাতি চলে, মেয়েটার ওই ডবল পেনেট্রেশন বা ট্রিপল পেনেট্রেশন ভালো লাগছিল, মেয়েটা আনন্দ পাচ্ছিল। যত বেশি নিগ্রহ আর নির্যাতন ঘটে মেয়ের ওপর, তত দর্শক উত্তেজিত হয়। আজকাল ইন্টারনেটের পর্ন সাইটগুলো বিজ্ঞাপন দেয় এই ভাষায়, ধর্ষণ আছে, যন্ত্রণায় মেয়েরা কাঁদে, চিৎকার করে, মেয়েটাকে ছিঁড়ে খাওয়া হচ্ছে, কচি মেয়েকে রাপচার করে দিচ্ছি, দেখবে এসো। পর্নোগ্রাফি দেখে উত্তেজিত হয়ে বাস্তবে কে কটা ধর্ষণ করেছে আমি জানি না। কেউ কোনও ধর্ষণ না করলেও, পর্নোগ্রাফির কারণে কোনও দুর্ঘটনা না ঘটলেও, পর্নোগ্রাফি নারীবিদ্বেষীদের কাজ, এ কথা জোর গলায় বলতে পারি। পর্নোগ্রাফি নারীকে শুধু অপমানই করে না, নারীকে আস্ত একটা যৌনাঙ্গ ছাড়া আর কিছু মনে করে না। পর্নোগ্রাফিতে অংশগ্রহণ করতে শিশুদের বাধ্য করছে। বিলিয়ন ডলারের পর্ন ব্যবসায়ীরা। শিশু পাচার বাড়ছে এ কারণে।

পর্নকে নয়, ইরোটিকাকে মূল্য দিই আমি। ইরোটিকা শব্দটি এসেছে ইরোস থেকে। ইরোস শব্দের অর্থ প্রেম। ইরোটিকার যৌনতার সঙ্গে মিশে আছে প্রেম। ইরোটিকাগুলো শুধু পুরুষের যৌন-আনন্দের জন্য নয়, নারীর যৌন-আনন্দের জন্যও। পর্নোগ্রাফি আর ইরোটিকার মধ্যে পার্থক্যটা বুঝতে হবে। পর্নোগ্রাফির সঙ্গে সম্পর্ক বর্বরতার, আর ইরোটিকার সঙ্গে সম্পর্ক নির্ভেজাল সেক্সের, লাভ মেকিংএর। ইরোটিকায় কেউ কারও ওপর আধিপত্য বিস্তার করে না, কেউ কারও যৌনপ্রভু নয়, কেউ কারও যৌনদাস বা যৌনদাসী নয়। দুজনই পরস্পরের সঙ্গী। সেই ইরোটিকাগুলোকে নিষিদ্ধ করা মোটেও স্বাস্থ্য সম্মত নয়।

রতের হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীরা মুক্তমনাদের খুন করছে

বাংলাদেশে যা ঘটছে, তা ভারতেও ঘটছে। বাংলাদেশে যুক্তিবাদী আর মুক্তচিন্তকদের ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হচ্ছে। ভারতেও তাই হচ্ছে। নরেন্দ্র দাভোলকার, গোবিন্দ পানেসার, আর দুদিন আগে খুন হলেন এম এম কালবুরগি। দাভোলকার, পানেসর, আর কালবুরগি ছিলেন যুক্তিবাদী, মুক্তমনা বুদ্ধিজীবি। অনেককাল লক্ষ করছি হিন্দুদের মধ্যে একটি দল অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে দিন দিন। হাতে ত্রিশূল, কপালে চন্দন বা গায়ে গেরুয়া পোশাক না থাকলে চেনার উপায় নেই তারা হিন্দু সন্ত্রাসী নাকি মুসলিম সন্ত্রাসী। সন্ত্রাসী, সে যে ধর্মেরই হোক, যে বিশ্বাসেরই হোক, তারা নিজের ছাড়া অন্যের মত প্রকাশের অধিকারে বিশ্বাস করে না, মুলত তারা কোনও গণতন্ত্রেই বিশ্বাস করে না।

গত রোববার সকালে কর্ণাটকের ধারবাদে কালবুরগির বাড়ির দরজায় একটি ছেলে বেল বাজিয়েছে। ছেলেটি একা আসেনি, সঙ্গে একজন ছিল। সে ছিল বাড়ির সামনে মোটরসাইকেলে বসা। বেল শুনে কালবুরগির স্ত্রী বেরিয়ে এলেন। ছেলেটি বললো সে কালবুরগি স্যারের ছাত্র, স্যারের সঙ্গে দেখা করতে চায়। তাকে ভেতরে ঢুকিয়ে কালবুরগিকে ডেকে দিলেন স্ত্রী। নিজে চলে গেলেন কিচেনে। কিচেনে দাঁড়িয়েই শুনতে পেলেন গুলির শব্দ। দৌড়ে এসে দেখতে পান মরে পড়ে আছেন কালবুরগি। কালবুরগি স্যারের কপালে আর বুকে গুলি করেই অপেক্ষারত মোটরসাইকেলে চড়ে পালিয়ে যায় খুনী।

কে বা কারা মেরেছে কালবুরগিকে, তা আমরা অনুমান করতে পারি। ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা তাঁকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল আগেই। দিয়েছিল কারণ গত বছর কোনও এক সেমিনারে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন মূর্তিপূজা টুজা নেহাতই অর্থহীন। এমনকী তিনি নাকি বলেছিলেন, দেব দেবীর মূর্তিতে চাইলে পেচ্ছাব করা যায়। কট্টরপন্থী হিন্দুরা রেগে আগুন হয়েছে তাঁর ওপর। কালবুরগি, সাহিত্য একাডেমির পুরস্কার পাওয়া লেখক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, হিন্দু ধর্ম নিয়ে কটাক্ষই শুধু করেননি, এর দুঃসহ জাতপাতের বিরুদ্ধেও অবিরাম প্রতিবাদ করেছেন।

নরেন্দ্র দাভোলকারকে প্রায় একইভাবে খুন করা হয়েছে, ২০১৩ সালে। থাকতেন মহারাষ্ট্রের পুনে শহরে। প্রতিদিনকার মতো সকালে হাঁটাতে বেরিয়েছিলেন, তখনই মোটরসাইকেল থেকে নেমে এসে একজন তাঁকে গুলি করে চলে যায়। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে গোবিন্দ পানসারেকেও একই পদ্ধতিতে খুন করা হয়। কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে খুনীদের গ্রেফতার করার জন্য। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের এখানেই তফাৎ। বাংলাদেশের সরকার কিন্তু এটা বলছে না যে তারা যে করেই হোক খুনীদের খুঁজে বের করবে। ভারত কিন্তু বলছে।

কালবুরগি ছিলেন সৎ ও সাহসী, যুক্তিবাদী গবেষক এবং প্রাচীন কন্নড় সাহিত্যের শিক্ষক। হামপি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরও তিনি ছিলেন। পেরুমাল মুরুগান নামের এক তামিল লেখক হিন্দুত্ববাদীদের হুমকি পেয়ে তাঁর ফেসবুক পেইজে লিখেছিলেন, পেরুমাল মুরুগান মরে গেছে। পেরুমাল প্রতিজ্ঞা করেছেন লেখালেখি ছেড়ে দেবেন। হুমকি এসেছে, কিন্তু শেষ অবধি পেরুমাল মরেননি। মরেছেন কালবুরগি। কালবুরগির বয়স ছিল ৭৭। মৃত্যুর কোনও হুমকিকে সিরিয়াসলি নেননি। সরকার তাঁর নিরাপত্তার জন্য পুলিশ মোতায়েন করেছিলেন, কিন্তু দেড় বছর পর কী মনে করে পুলিশ উঠিয়ে নিয়েছেন।

কালবুরগি অনন্তমূর্তিকে সমর্থন করতেন, যে অনন্তমূর্তি লিখেছিলেন ছোটবেলায় তিনি দেব-দেবীর মূর্তির ওপর পেচ্ছাব করতেন। এই ঘটনা ডানপন্থীদের প্রচণ্ড ক্ষেপিয়েছিল। কালবুরগি কর্ণাটকের লিঙ্গায়ত গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন। লিঙ্গায়ত গোষ্ঠীতে তাঁরাই ছিলেন, যাঁরা বহুঈশ্বরবাদে নন, বরং একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী। শিবকে মানেন। কিন্তু বেদ মানেন না, জাত পাত মানেন না। কুসংস্কার মানেন না। লিঙ্গায়ত গোষ্ঠী সম্ভবত অনেকটা বাংলার ব্রাহ্মসমাজের মতো। এই গোষ্ঠীকে কালবুরগি হিন্দু বলে স্বীকার করেন না। এটিও একটি কারণ হিন্দুদের রাগ করার।

কী হচ্ছে এই উপমহাদেশে? মুসলিম মৌলবাদ যেমন বাড়ছে, হিন্দু মৌলবাদও বাড়ছে। অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। ঘৃণা বাড়ছে। ধর্মীয় সন্ত্রাস বাড়ছে। বাংলাদেশের মুক্তচিন্তকদের মাথায় কোপ পড়ে, ভারতের মুক্তচিন্তকদের মাথা লক্ষ করে গুলি ছোঁড়া হয়। এ দেশের মুক্তচিন্তকদের সমর্থন করবে, কিন্তু ও দেশের মুক্তচিন্তকদের সমর্থন করবে না–আর যে-ই হোক, এটি আমি নই আমি সব দেশের সব মুক্তচিন্তকের পাশে দাঁড়াই, এবং সব দেশের সব সন্ত্রাসীর বিপক্ষে লড়ি, তারা যে ধর্মেরই হোক না কেন।

বুদ্ধিজীবী হত্যা করে সমাজের কোনও উপকার হয় না। বরং এভাবে চলতে থাকলে সমাজ একসময় বুদ্ধিহীন হয়ে উঠবে। মানুষ অন্ধকারে পড়ে থাকবে, সেখান থেকে তাদের বাঁচাবার, অন্ধকারে বাতি জ্বালাবার, কেউ আর থাকবে না।

এ দেশে অভিজিৎ, অনন্ত, ওয়াশিকুর, নীলকে ইসলামি সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে মেরেছে। ও দেশে দাভোলকার, পানেসার, কালবুরগিকে হিন্দু সন্ত্রাসীরা গুলি করে মেরেছে। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে অভিজিত্রা, দাভোলকাররা সরব ছিলেন। যুক্তিবাদীরা তো কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়েন। কুসংস্কারে, অন্ধত্বে, অজ্ঞতায় যাদের বিশ্বাস তারা আলোকিত মানুষের বড় ভয় পায়। তাই তাঁদের যে করে তোক সরিয়ে দিয়ে পৃথিবীটার দখল নিতে চায় নিজেরা।

মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলতে ঠিক কী বোঝায় তা এই উপমহাদেশের বেশির ভাগ মানুষ জানে না। জানে না যে এ আমি নিশ্চিত। হিন্দু মুসলিম দু গোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষের মুখেই একটা কথা শুনি, যে, বাক স্বাধীনতার মানে এই নয় যে তুমি ধর্ম নিয়ে কথা বলবে, বা অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেবে। অধিকাংশ লোক মানুক বা না মানুক, আসলে বাক স্বাধীনতা মানে কিন্তু ওটিই। আঘাত দেওয়ার অধিকারটিই। আঘাত না দিলে বাক স্বাধীনতা বলতে কোনও কিছুর কোনও প্রয়োজনও পড়তো না।

সমাজ যাঁরা বদলাতে চান, তাঁরা চিরকালই নিন্দিত হয়েছেন রক্ষণশীল সমাজের উগ্রপন্থী রক্ষণশীল দ্বারা। যুগে যুগে স্বপ্নবান সেইসব মানুষ স্বপ্ন রচনা করে গেছেন নিজের জীবনকে বিপন্ন করে। তাঁরা কারাভোগ করেছেন, নির্বাসিত হয়েছেন, ফাঁসিতে ঝুলেছেন, তাঁদের আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। সেই পুরোনো অজ্ঞতা আর অন্ধকারের যুগের এখনও অবসান হয়নি। আমরা হয়তো মঙ্গলগ্রহে যাওয়ার জন্য বাক্স-প্যাঁটরা গোছাচ্ছি, আমরা হয়তো আমাদেরই তৈরি দুরবীনে আমাদের গ্যালাক্সির বাইরে অন্য গ্যালাক্সির ভেতরে অন্য গ্রহ দেখতে পাওয়ার মতো জ্ঞানী হয়ে উঠেছি, এখনও আমরা ধর্মের নামে মানুষ খুন করি।

ভারত বাংলাদেশ বা পাকিস্তান নয়। ভারতের গণতন্ত্র এখনও বাংলাদেশ বা পাকিস্তান থেকে মজবুত। ভারত এখনও প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে বেশি ধর্মনিরপেক্ষ। তারপরও ভারতে কিন্তু এখন দাভোলকার আর পানেসরের খুনীদের গ্রেফতার করা হয়নি। এখনও কোনও বিচার হয়নি। এই একটি জায়গায় হয়তো বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কোনও পার্থক্য নেই। ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশেও গোপনে গোপনে বেড়ে উঠছে। এবং এই সন্ত্রাসীরা যখন বুদ্ধিজীবী খুন করে পালিয়ে যায়, এত বড় দেশটির এত বড় গোয়েন্দা বাহিনী তাদের খুঁজে পায় না। এই ব্যাপারেও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অদ্ভুত মিল দেখতে পাচ্ছি। চোখ বুজে খুনী খুঁজলে কি খুনীর খোঁজ পাওয়া যায়? তবে কাল ভূবিথ শেঠি বলে বজরং দলের এক হিন্দু কট্টরপন্থীকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যে কালবুরগির মৃত্যুতে খুশি হয়ে টুইট করেছিলো, হিন্দু ধর্ম নিয়ে বিদ্রূপ করো তো কুকুরের মতো মরতে হবে এবং কে.এস. ভাগওয়ান নামের কাউকে হুমকি দিয়েছিল এই বলে যে, এরপর তোমাকেও মরতে হবে। জানিনা ভুবিথ শেঠিকে কতদিন জেলে রাখা হবে। তবে ভুবিথ শেঠি খুব সম্ভবত খুন করেনি। খুনীদের না গ্রেফতার করে এদিক ওদিক থেকে লোক ধরে এনে দেশের মানুষকে বোকা বানাবার চেষ্টা করতে দুদেশই পারদর্শী। যতদূর জানি অপকর্ম করে পালিয়ে যাওয়া প্রচুর হিন্দু সন্ত্রাসীদের এখনও ধরি ধরি করেও ধরা হচ্ছে না। ২০০৬ আর ২০০৮ এর মালেগাঁও বিস্ফোরণ যারা করেছিল, তারা আজও ধরা পড়েনি। ২০০৭ সালে ভারত-পাকিস্তানের সমঝোতা এক্সপ্রেসে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। যারা, তাদের আজও ধরা হয়নি। একই বছর মক্কা মসজিদে যারা বোমা ছুঁড়েছিল, তাদেরও ধরা হয়নি। এসব বোমা বিস্কোরণের পেছনে, গোয়েন্দাদের রিপোর্টে জানা যায়, রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ আর বজরং দলের ভূমিকা আছে।

অনেক হয়েছে, আশা করছি ভারত আর চুপচাপ বসে থাকবে না, সন্ত্রাসীরা যে গর্তেই লুকিয়ে থাকুক না কেন, সেই গর্ত থেকে তাদের তুলে এনে শাস্তির ব্যবস্থা করবে। মুক্তমনা বুদ্ধিজীবীদের খুনের বিচার ভারত করবে। এই আশা আমাদের করতেই হবে। এ ছাড়া উপায় নেই। আজ ভারতে ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা পার পেয়ে গেলে প্রতিবেশী দেশগুলোতেও এই ট্রেণ্ড চলে আসবে। তখন হয়তো নবারুণ ভট্টাচার্যের মতো করে আমরা বলতে বাধ্য হব, এই মৃত্যু উপত্যকা আমার উপমহাদেশ নয়।

ভাষা দিবস

আজ দিল্লির বেঙ্গল এসোসিয়েশন পালন করলো ১৯শে মে, ভাষা দিবস। আসামের শিলচরে বাংলাভাষার জন্য ১৯৬১ সালের ১৯শে মে তারিখে এগারো জন বাঙালি প্রাণ দিয়েছিলেন, তাঁদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্যই ছিলো আজকের এই ভাষা দিবসের অনুষ্ঠান। তখনকার প্রাদেশিক সরকার বাঙালি অধ্যুষিত শিলচর, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দির বাংলা ভাষার বদলে অহমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র ভাষা বলে। ঘোষণা করেছিলেন, তখনই বাঙালিরা শুরু করেন ভাষা আন্দোলন। ১৯শে মে সকালে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে রেলপথ অবরোধের সময় আসাম রাইফেলস বাংলা ভাষার সৈনিকদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে, ঘটনাস্থলেই মারা যান এগারো জন ভাষা সৈনিক, অর্ধশত বাঙালি আহত হয়েছিলেন সেদিন।

আজ শুধু শ্রোতা হিসেবেই অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। মাঝে মাঝে শুধু শ্রোতা হতে খুব ভালো লাগে। অন্যরকম আরাম বোধ করি। অনেকে ভাষণ দিয়েছেন। এতকাল ২১শে ফেব্রুয়ারি পালন করেছি। এই প্রথম আমার ১৯শে মে পালন করা। শুধু ভাষণ নয়, কবিতা হলো, আবৃত্তি হলো। দেশাত্মবোধক গানের সঙ্গে নাচের অনুষ্ঠানও হলো। তিন-চার বছর বয়সী বাচ্চারও নাচের পোশাক পরে নেচেছে। নাচ পরিচালনা করেছে স্মিতা চক্রবর্তী, স্মিতা নেচেছেও। ও যে কী করে এত ছোট ছোট বাচ্চাদের নাচ শিখিয়েছে! নিশ্চয়ই খুব কঠিন কাজ। স্মিতা চক্রবর্তী অনুষ্ঠানের আগে আমাকে এসে বলে গেছে, আমার লেখা ও কী ভীষণ ভালোবাসে। তারপর অনুষ্ঠান শেষে মঞ্চ থেকে বলেছে, আমার উপস্থিতি তার জন্য বিশাল কিছু। বেঙ্গল এসোসিয়েশনের প্রধান তপন সেনগুপ্তও অনুষ্ঠানের শুরুতে ঘোষণা করেছিলেন, আমার উপস্থিতির জন্য তাঁরা গর্বিত। এই ভালোবাসা, এই শ্রদ্ধা কখনও কখনও বড় অপ্রস্তুত করে আমাকে, কখনও কখনও চোখে জল এনে দেয়।

ভিন্নমতের নিরাপত্তা নেই, বাংলাদেশ কি আদৌ কোনও ডেমোক্রেসিং?

১.

আহমেদ রাজিব হায়দার (থাবা বাবা)
অভিজিৎ রায়
অনন্ত বিজয় দাশ
ওয়াশিকুর রহমান বাবু
জগৎজ্যোতি তালুকদার
আশরাফুল আলম
নিয়াজ মোর্শেদ বাবু
আরিফ রায়হান দ্বীপ
নীলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় (নিলয় নীল)

এরপর কে? আমরা জানি না এরপর কে। অনেক ব্লগার দেশ ছেড়েছে। যারা আছে দেশে, তাদের কুপিয়ে মেরে ফেলা হবে। ধর্মে অবিশ্বাস, এমন কারও অস্তিত্ব বাংলাদেশে রাখা হবে না।

বাংলাদেশ কোনও নাস্তিককে নিরাপত্তা দেবে না। হাসিনা ভয় পাচ্ছেন, নাস্তিকদের নিরাপত্তা দিলে তাঁকে না আবার নাস্তিক বলে ভাবা হয়। নাস্তিক বলে ভাবলে তাঁর তো আবার মুসলমানের ভোট জুটবে না। শেখ হাসিনা কি নাস্তিক নন? নাস্তিক তো আসলে প্রায় সবাই। তুমি যদি হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস না করো, তুমি একজন অবিশ্বাসী। তুমি খ্রিস্টান ধর্মে বিশ্বাস না করো, তুমি একজন অবিশ্বাসী। যদি ইহুদি ধর্মে বিশ্বাস না করো, মরমন ধর্মে, জিহোবাজ উইটনেসে, প্যাগান ধর্মে বিশ্বাস না করো, তুমি একজন অবিশ্বাসী। পৃথিবীতে প্রচুর ধর্ম ছিল, আছে। সব ধর্মের কাছে। তুমি অবিশ্বাসী। তুমি শুধু একটি ধর্ম বিশ্বাস করো, বাকি হাজারো ধর্ম অবিশ্বাস করো। তুমি যত না বিশ্বাসী, তার চেয়ে বেশি অবিশ্বাসী। যত না আস্তিক, তার চেয়ে ঢের বেশি নাস্তিক।

নাস্তিক ব্লগারদের যারা খুন করেছে, তাদের বিরুদ্ধে মনে হচ্ছে হাসিনা কোনও পদক্ষেপ নেবেন না, কারণ ওই একটিই, পদক্ষেপ নিলে যদি আবার তাঁকে নাস্তিকদের বন্ধু বা ইসলাম-সমোলোচকদের বন্ধু বলে ভাবা হয়! একবার ওরকম ভেবে বসলে মুসলমানের ভোট তো তাঁর জুটবে না।

বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকারই দেশটাকে পুরো নষ্ট করে দিয়েছে। যে ফ্রাংকেনস্টাইন তাঁরা তৈরি করেছেন, সেই ফ্রাংকেনস্টাইন তাঁদের এখন কোপানোর কথা। কিন্তু তাঁরা এতই নিরাপত্তার মধ্যে নিজেদের রাখেন যে তাঁদের কোপাতে না পেরে ফ্রাংকেনস্টাইন এখন নিরীহ জনগণকে কোপাচ্ছে।

২. নিলয় নীল ভয় পাচ্ছিল। নীল লিখেছিল তাকে ফলো করা হচ্ছে। তাকে ফলো করা হচ্ছে মেরে ফেলার জন্য। নীল দুমাস আগেই লিখেছিল যে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করতে গিয়েছে সে, বলেছে, তাকে ফলো করছে কিছু লোক, লোকগুলোকে তার সন্দেহ হচ্ছে। নীল লিখেছিল পুলিশ তাকে বলেছে দেশ থেকে পালাতে। নীল দেশ থেকে পালাতে পারছিল না। দেশের ভেতর বাঁচার জন্য ছুটোছুটি করছিলো। নীলকে বাংলাদেশ সরকার তারপরও নিরাপত্তা দেয়নি। একজন প্রতিভাবান মুক্তচিন্তককে বাঁচাবার কোনও চেষ্টা সরকার করেনি।

৩.আনসারুল্লাহ বাংলা ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে তারা নিলয় নীলকে খুন করেছে। এর আগেও খুন করে এসে একইরকমভাবে সদর্পে ঘোষণা করেছিল তারাই খুনি। তারপরও পুলিশ নাকি খুনিদের খুঁজে পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে নিজেদের এবার পুলিশের কাছে গিয়ে বলতে হবে আমরা খুন করেছি, আমাদের গ্রেফতার করো। তাতেও ওদের গ্রেফতার করা হবে বলে মনে হচ্ছে না। তখনও তদন্ত চলবে, যে তদন্ত বছরের পর বছর চলে যায়, শেষ হয় না। আমার তো ভয় হয়, কবে স্বয়ং রক্ষাকর্তা বিধাতা হাসিনাকে ওরা কোপাতে শুরু করে। নীলের মাথা থেকে যত রক্ত গড়িয়েছে, হাসিনার মাথা থেকে তো তুত রক্তই গড়াবে, কিছু কম তো নয়। রক্ত দেখতে দেখতে আমাদের এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। আমরা হয়তো বিস্মিত হবো না।

৪.নিলয় নীলের পুরো নাম নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায়। বয়স ২৭। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিলোসফিতে মাস্টার্স করেছে। ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে পাস করা মেধাবী ছাত্র। প্রচুর পড়াশোনা করতো। ভালো লিখতো।শিক্ষিত। সচেতন। আজ তার ঘরে পড়ে আছে তার বই আর তার রক্ত। তুমি যদি খুব পড়ো, খুব বোঝে, তুমি যদি মুক্তচিন্তায় বিশ্বাস করো, তুমি যদি ধর্মান্ধতা আর কুসংস্কারের দিকে আঙুল তোলো, প্রশ্ন করো, তোমার রক্তে এভাবেই ভেসে যাবে ঘর। সুতরাং বাংলাদেশে বাঁচতে হলে তোমাকে বোকা হতে হবে, বুদ্ধিমান হলে চলবে না। তোমাকে ধর্মভীরু হতে হবে, তোমাকে ধর্মমুক্ত হলে চলবে না। তোমাকে অমানুষ হয়ে থাকতে হবে, মানুষ হলে চলবে না।

৫. তসলিমা পক্ষ নামে একটি মানবাধিকার সংগঠন দাঁড় করিয়েছিল কিছু ছেলেমেয়ে, নীল সেই সংগঠনের একজন ছিল একসময়।

ফেসবুকে ওর অনেক লেখাই পড়েছি আমি। হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম, ইসলাম ধর্ম –সব ধর্ম নিয়েই ও লিখতো। হিন্দুরা ওকে মারলো না, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ওকে মারলো না, শুধু ইসলাম ধর্মের লোকেরাই মারলো। যারা বলে সব ধর্মই মূলত এক, কোনও ধর্মান্ধদের মধ্যে মূলত কোনও পার্থক্য নেই তারা নিশ্চয়ই ভুল বলে।

৬. বাংলাদেশের পুলিশপ্রধান বলেছেন, ব্লগাররা যেন সীমা লজ্বন না করে, মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে এমন কিছু যেন না লেখে, লিখলে ১৪ বছরের জেল। সরকারি ওলামারা বলেছে, ব্লগারদের ফাঁসি দিতে হবে, ব্লগ বন্ধ করে দিতে হবে, অথবা দেশ থেকে সবকটা ব্লগারকে বের করে দিতে হবে।

ভাইয়েরা আমার, একটু আস্তে বলুন এসব কথা। পাকিস্তান শুনলে হাসবে।

৭. বাংলাদেশ সরকার সোজাসুজি বলে দিয়েছে ধর্মের বিরুদ্ধে লিখলে গ্রেফতার করা হবে। আমার খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে কোন ধর্মের বিরুদ্ধে লিখলে গ্রেফতার করা হবে! হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে লিখলে কি গ্রেফতার করা হবে? বৌদ্ধ ধর্মের বিরুদ্ধে লিখলে? খ্রিস্টান ধর্মের বিরুদ্ধে লিখলে? সরকার না বললেও উত্তর আমরা সবাই জানি যে অন্য কোনও ধর্মের বিরুদ্ধে লিখলে কিচ্ছু হবে না, শুধু ইসলামের বিরুদ্ধে লিখলেই গ্রেফতার করা হবে। সরকারের তো বুকের পাটা কম নয়। তাহলে সত্যি কথাটা বলে ফেললেই হয় যে যারা ইসলামের বিরুদ্ধে লিখবে, তাদের হেনস্থা করা হবে, গ্রেফতার করা হবে, জেলে ভরা হবে, ফাঁসি দেওয়া হবে।

মাঝে মাঝে ইসলামী সন্ত্রাসী আর বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে আমি কোনও পার্থক্য দেখি না আজকাল। দেখে শুনে মনে হচ্ছে দেশ আসলে চালাচ্ছে ইসলামী সন্ত্রাসীরা, সরকার তাদের সেবাদাস মাত্র।

৮. যুক্তিবাদী মুক্তচিন্তকদের পরিকল্পিতভাবে খুন করা হচ্ছে বাংলাদেশে। খুন করার পর খুনিরা জানিয়ে দিচ্ছে তারা কারা, তাদের নাম কী, তারা কোন গোষ্ঠীর। জানি না ঠিকানা ফোন নম্বরও হয়তো জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু পুলিশ তাদের টিকিটি স্পর্শ করছে না। করবে না বলেই করছে না।

প্রথম দিকে রাস্তায় করা হতো, রাতের অন্ধকারে করা হতো খুন, এখন দিন দুপুরে খুন করা হচ্ছে, বাড়িতে ঢুকে করা হচ্ছে। খুনিরা এখন খুন করে পালিয়ে যাচ্ছে। এমন দিন আসছে যখন খুনিরা আর পালাবে না। লুকিয়ে নয়, সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়েই রামদা বা চাপাতি হাতে নিয়ে ব্লগারদের বাড়িতে ঢুকবে, দেখিয়ে দেখিয়েই কোপাবে, সবার সামনে দিয়েই হাসতে হাসতে হেঁটে যাবে, মোড়ের দোকানে বসে চা খাবে। কেউ তাদের কিছু বলবে না।

এমন ভয়াবহ দিন আসছে সামনে। শুধু ব্লগার নয়, কোনও মেয়ের শরীরে বোরখা নেই তো রাস্তায় সে মেয়েকে দুটুকরো করে ফেলে রাখবে খুনিরা, দুটো ছেলে মেয়ে কোথাও বসে প্রেম করছে দেখলে দুটোকেই কোপাবে। কেউ ধর্মীয় শাসন মানতে আপত্তি করবে তো প্রকাশ্য দিবালোকে তাকে জবাই করবে। এমন দিন আসছে সামনে। এমন যুগ। সেই যুগের নাম ইসলামী শরিয়ার যুগ।

৯. ১ জন ব্লগার গ্রেট খায়, ১০ জন ব্লগার ব্লগ গুটিয়ে ফেলে। ১ জন ব্লগার কোপ খায়, ১০০ জন ব্লগার ব্লগ লেখা বন্ধ করে দেয়। এরকমই মনে হচ্ছে। এভাবেই বাঙালির অতি স্বল্প আয়ুর যুক্তিবাদের যুগ বা এজ অব রিজনের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে। ব্লগারদের পাশে দেশের শিল্পী সাহিত্যিক, দেশের বিজ্ঞানী বুদ্ধিজীবী কেউ নেই। এসব দেখে মনে পড়ছে ২২ বছর আগে আমার পাশেও খুব বেশি কেউ ছিল না। অলমোস্ট একা আমি ভারসেস গোটা দেশ ইনক্লডিং অপদার্থ সরকার। লক্ষ মৌলবাদী শহর জুড়ে লম্ফঝম্ফ করছে, আমার মুণ্ডুর জন্য উন্মাদ হয়ে উঠছে। কোথায় আমার পাশে দাঁড়াবে সরকার, তা নয় আমার বিরুদ্ধেই কেস দিয়ে বসলো। তখন আইটি অ্যাক্ট ছিল না, তখন পিনাল কোডের ২৯৫ এ ই সাহসী লেখককে মেরে ফেলার জন্য যখেষ্ট। হাতে গোণা কিছু বুদ্ধিজীবী গোপনে গোপনে অবশ্য ছিল পাশে। ওরকম থাকায় লাভ কিছু হয় না। যদি দেশজুড়ে বিক্ষোভ হতো ইসলামী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে, আমার বাক স্বাধীনতার পক্ষে যদি অন্তত পাঁচশ লোকও দাঁড়াতো, তাহলে কারও সাধ্য ছিল না আমাকে দেশ থেকে তখন বের করে। সেই দুযুগ আগের ঘটনাকেই যেন পূনরায় ঘটতে দেখছি এখন। এখনও প্রগতিশীল ব্লগারদের খুন হয়ে যাওয়ার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে বিক্ষোভ নেই। ইঁদুরের মতো সবাই গর্তে লুকিয়ে পড়েছে। যাদের সচেতন শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী বলে মনে করা হয়, তারাও লুকিয়েছে। স্টুপিড সরকার দেশের জনগণকেও ছলে বলে কৌশলে স্টুপিড বানিয়েছে। ডেমোক্রেসি নেই বাংলাদেশে, যা আছে তার নাম ইডিওক্রেসি।

ভূমিকম্প, গরুর মাংস

আমরা কী ভীষণ অসহায়, তাই না? মাটি একটু নড়ে ওঠে আর আমরা হাজার হাজার মানুষ মরে যাই। সমুদ্রে জল একটু উথলে ওঠে আর আমরা ভেসে যাই হাজার হাজার মানুষ। প্রকৃতির সামনে এতই অসহায় আমরা অথচ ভাব দেখাচ্ছি আমাদের মতো শক্তিমান আর কেউ নেই। আমরা অন্য সব প্রজাতিকে বন্দি করি, নির্যাতন করি, আমাদের ক্রীতদাস বানাই। আমরা এই নিষ্ঠুর প্রজাতির নাম দিয়েছি সৃষ্টির সেরা জীব। আমরা কবিতা আওড়াই, সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই। আসলে আমরা খুব নির্লজ্জ প্রজাতি। প্রাণীজগতে হায়েনা ছাড়া মানুষের মতো আর কেউ এত নির্লজ্জ নয়।

ভূমিকম্পে নেপালের কত হাজার মানুষ পিঁপড়ের মতো মরে গেলো। জানিনা আর কী দুর্যোগ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এক দুর্যোগে তো পৃথিবীর সমস্ত ডায়নোসোর মরে গিয়েছিলো। মানুষ এখন ডায়নোসারের মতো পৃথিবী শাসন করে। ডায়নোসোরকে ভয় পেয়ে চলতো অন্যান্য প্রজাতি। মানুষকেও ভয় পেলে চলে এখনকার বেশির ভাগ প্রজাতিই। অত শক্তিমান ডায়নোসোরকে যদি বিলুপ্ত হতে হয়, তবে মানুষকে কেন হবে না? নতুন নতুন রোগ আসছে। নতুন নতুন উপদ্রব। আর বিরুদ্ধ প্রকৃতি তো আছেই।

অন্যান্য প্রজাতি আর মানুষের মধ্যে পার্থক্য লোকে বলবে, অনেক। বলবে, মানুষের মস্তিষ্ক অন্য প্রজাতির মস্তিষ্কের চেয়ে উন্নতমানের। তা মানি। কিন্তু মানুষ যেভাবে ধর্ম আর কুসংস্কারগুলো বানিয়েছে এবং হাজার বছর ধরে তার চর্চা করে যাচ্ছে, তা দেখে মাঝে মাঝে আমার মনে হয় অন্যান্য প্রাণীই বরং মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমান। তারা কোনও আজগুবি গল্প তৈরি করে নিজেদের মধ্যে হানাহানি করছে না। নিজেদের তুলোর মতো উড়িয়ে দেওয়ার মতো পারমাণবিক অস্ত্রও কিছু বানাচ্ছে না।

আমরা ভালোবাসতে জানি। পশুরাও ভালোবাসতে জানে। ওদের ভালোবাসাটা বরং অকৃত্রিম। মানুষ তো অভিনয়ে দক্ষ। পশুর এই জিনিসটা ভালো লাগে আমার, অভিনয় জানে না। কোনও হাতি মারা গেলে তার আত্মীয় বন্ধুরা যেভাবে কাঁদে, মানুষের জন্যও বোধহয় কোনও মানুষ অমন কাঁদে না। পশুদের শুধু নিজের বাচ্চার প্রতিই যে মমতা তা নয়। ভালোবাসা আর সহমর্মিতা বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত জরুরি, শুধু নিজের প্রজাতির জন্য নয়, অন্য প্রজাতির জন্যও। কত পাখি জেনে শুনে অন্য পাখির বাচ্চাকে লালন পালন করে! কত পশু বন্ধু হয়ে ওঠে অন্য পশুর!

কী ভেবেছি আমরা নিজেদের? আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ জীব, যেহেতু কিছু মেশিন টেশিন অস্ত্র উস্ত্র বানিয়েছি। এগুলো আমরা আমাদের হিংসে বিদ্বেষের কাজে ব্যবহার করি, মানুষ ধ্বংস করি, সভ্যতা নষ্ট করি। ভূমিকম্পে আমরা টের পাই নিজেদের যত শক্তিমান বলে ভাবি, তত শক্তিমান আমরা নই। মানুষ নিষ্ঠুর জানি, কিন্তু মানুষ সমমর্মীও হতে পারে প্রচণ্ড। ভূমিকম্পেও এর প্রমাণ আমরা দেখি। পৃথিবীর গরিব ধনী সব দেশই এগিয়ে আসে সাহায্য করতে। মানুষকে বাঁচাতে মানুষ দৌড়ে আসে। ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে জীবনের ঝাঁকি নিয়ে অসহায়কে উদ্ধার করা, খাবার দাবার, পানীয় জল, ওষুধ পত্র যা কিছুরই প্রয়োজন উদার হাতে দুর্গতদের দান করা–তুলনা হয় না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের এক করে। আমরা মানুষরা সুখে এক হই না। দুঃখে এক হই। কিন্তু তা কি ঠিক? লক্ষ লক্ষ গরিবের দুঃখের পাশে ধনীরা তো দাঁড়ায়। না। দাঁড়ালে সারা পৃথিবী জুড়ে ধনী দরিদ্রর ফারাকটা এত বিশাল হতো না।

ভারত প্রচুর সাহায্য করছে নেপালকে। আশে পাশের অনেক দেশই সাহায্য করছে। পাকিস্তান পাঠিয়ে দিয়েছে খাবার। কিন্তু সে খাবারে নাকি ছিল গরুর মাংস। গরুর মাংস, আমি বিশ্বাস করি, সবচেয়ে সুস্বাদু মাংস। কিন্তু মুশকিল হলো নেপালের অধিকাংশ লোক হিন্দু, তারা পুজো পার্বণে মোষ মেরে সর্বনাশ করলেও গরুর মাংস মুখে দেবে না। গরুকে দেবতা ভাবে বলে গরুর মাংস খায় না। ভারতেও তাই। এখানে তো প্রায়ই আমি চেঁচাই, দেবতা ভাবো তো এদের এভাবে কষ্ট দিচ্ছ কেন! তোমরা দেবতাদের পেচ্ছাব পান করছো, অথচ এই দিল্লিতে দেখছি গরুরা রাস্তায় ক্ষুধার্ত হাঁটে, কোথাও কোনও খাবার নেই, ফুটপাতের আবর্জনা ঘেঁটে প্লাস্টিকের ব্যাগ খেয়ে বাঁচে। দিল্লির সবুজ ঘাসে ছাওয়া পার্কগুলোয় কোনও দেবতার ঢোকার কোনও অনুমতি নেই। ভারতেও তো গরু জবাই নিষিদ্ধ। ভারতের গরুগুলো কোথাও কোথাও জবাই হতে চলে যায়। মাংস না খেলেই যে লোক পশুর অধিকারে বিশ্বাস করে, এ কথা বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। পশুর অধিকারকে বেশির ভাগই দুপয়সার মূল্য দেয় না। পশুর মাংস খায় না কারণ ধর্ম বলেছে খেও না, অথবা জন্ম থেকে খেয়ে অভ্যেস নেই বলেই খায় না। পশুর অধিকার নিয়ে যারা আন্দোলন করে তারা বেশির ভাগই আমিষ খেয়ে অভ্যস্ত। গরুর মাংস না খাওয়ার পেছনে। ভালো কোনও যুক্তি হয়তো নেই, কিন্তু যখন কেউ খাচ্ছে না, তার সেই না খাওয়ার অধিকারকে সম্মান জানানো উচিত। অন্তত আমি জানাই।

একবার আমার কলকাতার বাড়িতে আমি গরুর মাংস বেঁধেছিলাম। আমার এক হিন্দু বন্ধুর খুব শখ ছিল গরুর মাংস খাবে। ওই নিয়ে এসেছিলো মাংস। আমি সুজাতাকে, যে মেয়েটা আমার বাড়িতে কাজ করতো, বলিনি যে আমি গরুর মাংস রাঁধছি। ও ভেবেছিল আমি পাঁঠার মাংস রান্না করছি। গরুর মাংসের কথা জানলে ও হয়তো তল্পিতল্পা নিয়ে চলে যেতো, এবং কোথাও না খেয়ে কষ্ট করতো। এত ভালো মাইনের চাকরি তো ওর কোথাও জুটবে না। সে কারণে ওকে আমি বলিনি যে আমি গরুর মাংস রাঁধছি। কিন্তু ওকে সে মাংস স্পর্শও করতে দিইনি, সে মাংস রান্না হলে ওকে খেতেও দিইনি। ওকে রান্না ঘরের বাইরেই রেখেছি। ওর জন্য সেদিন আলাদা করে মাছ রান্না হয়েছিল। আমি বলেছি, আজ এই মাংস তোমাকে দিচ্ছি না, কারণ এ আমি আর আমার বন্ধু দুজনই খেয়ে শেষ করবো পণ করেছি। সুজাতাকে বলতে পারতাম, এ পাঁঠার মাংস, দিতেও পারতাম কিছু টুকরো ওর পাতে। কিন্তু মিথ্যে বলা আর অসততা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় বলেই করিনি।

কোনও মুসলমান আত্মীয় বা বন্ধু পাশে থাকলে আমি শুয়োরের মাংসটা একটু আড়াল করেই খাই, শুয়োর খাওয়ার জন্য ওদের অনুরোধ আবদার করি না। কী রকম হতো যদি ভুমিকম্পে বাংলাদেশ ধ্বংস হতো, আর কোনও দেশ বাংলাদেশকে সাহায্য পাঠাতে ট্রাক বোঝাই শুয়োরের মাংস! বাংলাদেশ কী করতো! ধর্ম এবং ধর্মীয় অনুভূতিকে সম্মান জানাতে আমি শুয়োরের মাংস মুসলমান থেকে, বা গরুর মাংস হিন্দু থেকে আড়াল করি না। আমি অধিকারকে সম্মান জানাই। ওই মাংস তারা খেতে চায় না, তাদের না খাওয়ার অধিকারকে আমি সম্মান জানাই। আমি যেমন সাপ খাই না, কুকুর বেড়ালের মাংস খাই না। আমাকে যারা সম্মান করে, তারা নিশ্চয়ই আমাকে ওই মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করবে না।

নেপালে খাদ্য পাঠানোর জন্য নিশ্চয়ই পাকিস্তানের দুটে তিনটে লোক জড়িত ছিল না, নিশ্চয়ই অনেক লোক ছিল। ওই অনেকের মধ্যে কি কারও জানা ছিল না যে নেপাল একটা হিন্দু প্রধান দেশ এবং নেপালের লোকরা গরুর মাংস খায় না? এই তথ্যটা কেউ একবারও জানায়নি কাউকে, ভেবে অবাক হয়ে যাই। সে কারণে সংশয়, কাজটা কি ইচ্ছে করে করা হয়েছে, নাকি অন্যান্য ভুলের মতো এটিও একটি ভুল!

মনে আছে সেই গল্পটা, এক দুষ্ট শেয়াল একবার এক বককে নেমন্তন্ন করলো। খেতে দিলো চ্যাপ্টা থালায়। বকও নেমন্তন্ন করেছিল প্রতিশোধ নিতে। খেতে দিয়েছিল লম্বা গলাওয়ালা বোতলে। অতিথিরা প্রায় কিছুই খেতে পারেনি। কী লাভ এই নেমন্তন্নে, যদি ক্ষিধেই না মেটে, যদি তৃপ্তিই না হয়!

পাকিস্তানের উচিত গরুর মাংস ফিরিয়ে নেওয়া। বরং গরুর পরিবর্তে ভেড়া বা খাসি বা মুরগির মাংস দেবার ব্যবস্থা করা। অথবা কিছুই না দেওয়া। খাবার জন্য অখাদ্য কিছু দেওয়ার চেয়ে কিছু না দেওয়া অনেক ভালো।

মা

একসময় আমি কেশবতী ছিলাম। কেশের কিছু দুর্লভ ছবি পেয়েছি। ছবিগুলো আমাদের ময়মনসিংহের বাড়িতে তোলা। মা আমার কেশ নিয়ে মেতে থাকতেন দিন রাত। নারকেল তেল লাগাতেন, আচড়াতেন, উকুন থাকলে বেছে দিতেন, সাদা কালো ফিতে দিয়ে কলাবেণী করে দিতেন। কেশ চিরকালই আমার জন্য ছিল ভীষণ এক ঝামেলা। স্নান করে ভেজা কেশ কী করবো বুঝে না পেয়ে হাতখোঁপা করে ইস্কুলে যেতাম। আমার দুতিনটে কেশ মাটিতে পড়লো কী পড়লো না, মা কেঁদে বুক ভাসাতেন। মূলত আমার চুল গুলো আমার জন্য আমার মাথায় ছিল না, ছিল মার জন্য। একদিন একটুখানি বড় হওয়ার পর মার আবেগের নিকুচি করে কোমর অবধি লম্বা চুলকে ঘাড়ের কাছে ঘচাং। মা নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিলেন।

মাকে সারাজীবন কম কষ্ট দিইনি। মার আবেগ নিয়ে কত মশকরা করেছি। এখন মা নেই। এখন দুঃখ হয়। এখন আমার চুলের যা ইচ্ছে তাই হোক, কেউ আহা উঁহু করবে না। মা তাঁর নিজের চুলগুলো অযত্নে অযত্নে নষ্ট করেছেন। কিন্তু আমার চুলের যত্ন তিনি নিরলস করে গেছেন। ভালোবাসা ছাড়া মার দেবার আর কিছু ছিল না। এই ভালোবাসাই সম্পূর্ণ উপুড় করে ঢেলে দিয়েছেন। আমার অনেক কিছু ছিল। আমি আর কাউকে দিতে কার্পণ্য না করলেও মাকে দিতেই করেছি। ভেবেছি, মা ই তো। মাকে আবার দিতে হবে কেন। মাকেই যে দিতে হয়, বুঝিনি।

মানুষ মানুষের জন্য?

কয়েক হাজার মানুষ সমুদ্রে ভাসছে। জল তাদের নিচ্ছে, কিন্তু স্থল তাদের নিচ্ছে না। আসলে স্থলের আপত্তি নেই, আপত্তি স্থলের প্রাণীদের। অবশ্য স্থলের অন্য প্রাণীদের কোনও আপত্তি নেই। আপত্তি শুধু মানুষ নামক প্রাণীর। যারা সমুদ্রে ঠিকানাহীন ভাসছে, তারা কিন্তু মানুষই।

মানুষ ক্ষিধে তৃষ্ণায় কাতরাচ্ছে। কিন্তু কোনও দেশ তাদের নেবে না। বাংলাদেশ ফেরত নেবে না বাংলাদেশের লোকদের। মায়ানমারের লোকদের মায়ানমার নেবে না। মালোয়েশিয়ায় যেতে চেয়েছিলো ওরা। মালয়েশিয়া বলেছে ওদের নেবে না। ইন্দোনেশিয়া বলেছে নেবে না। থাইল্যাণ্ড বলেছে নেবে না। কেউ ওদের নিতে চায় না। কারণ ওরা গরিব। গরিবরা সোজা কথায় ব্রাত্য। অনাকাঙ্খিত। ওদের কেউ নেই, কিছু নেই। ধনীরা যদি ভাসতো সমুদ্রে। কোনও তীরে তাদের নাও ভেড়াতে কেউ কি বাধা দিতো! আমার তো মনে হয় না। দৌড়ে এসে তাদের লুফে নিত সবাই।

পাচারকারীরা তাদের নৌকো সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়েছে। জল পথে মানুষের পাচার হওয়াকে তারা বলে কলম্বাস ভিসা। আর বন-জঙ্গল দিয়ে পাচার হওয়াকে বলে টারজান ভিসা। পাচারকারীদের রসবোধ বলতে কিছুই নেই, এ কথা শত্রুও বলবে না। মাথা পিছু কত টাকা নেয় পাচারকারীরা। দশ হাজার। অনেক লোক ভিটেমাটি বা শেষ সম্বল বিক্রি করে পাচারকারীদের হাতে টাকা দেয়। শুধু পাচারকারীদের হাতে নয়, গন্তব্যে পৌঁছানোর পর বড় নৌকোর মালিককে দিতে হয় মাথা পিছু পঁচিশ হাজার টাকা। ভাগ্যটা খানিকটা বদলানোর জন্যই দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যাওয়ার সিন্ধান্ত নেয় মানুষ। মুসলিম লোকরা মুসলিম দেশে যাবে। কত আশা করেই না ছিল লোকগুলো। ইন্দোনেশিয়া বলে দিয়েছে, ওদের ডুবে যেতে দেখলেও যেন কোনও জেলে ওদের তীরে না তোলে। মুসলিম মুসলিম ভাই ভাই স্লোগান শুনেছি কত! সৌদি আরবে তো বাংলাদেশের মুসলিম মিসকিনদের এক কোপে কল্লা কেটে ফেলা হয়। মুসলিমরা, আসলে সবচেয়ে বেশি ভালো আছে অমুসলিমদের দেশে। ইওরোপে,যুক্তরাষ্ট্রে, কানাডায়। গরিবদের অত দূর যাওয়ার ক্ষমতা নেই। তারা তাই আশেপাশের দেশের পানেই ধায়। কিন্তু এখানেও অনিশ্চিত ভাসতে হয় সমুদ্রে। অনেকের সলিল সমাধি হয়ে গেছে। ট্রলার ভর্তি মুসলিমদের যখন দুর দুর করে তাড়াচ্ছে মুসলিম দেশগুলো, তখন ফিলিপাইন নামের এক খ্রিস্টান প্রধান দেশ কথা দিয়েছে এদের আশ্রয় দেবে।

আচ্ছা আং সান সুচি তো বিশাল শান্তির নোবেল পেয়েছিলেন। কী করছেন তিনি মায়ানমারে বসে? রোহিঙ্গা মুসলিমদের পক্ষে তাঁর মুখ থেকে কোনও শান্তির বাণী বেরোয় না কেন? ক্ষমতার লোভে তিনিও মুখে কুলুপ এঁটেছেন। বড় হতাশ হই এইসব বিশাল নেতানেত্রীর কীর্তিকলাপ দেখে।

মানবপাচার বন্ধ করার কোনও উদ্যোগ বাংলাদেশ সরকারের নেই। টেকনাফ, উখিয়া, মহেশখালি থেকে বেশি পাচার হয় মানুষ, সেখানকার পুলিশ পাচারকারীর কাছ থেকে শুনেছি ঘুষ খায়। পাচার রোধে মায়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার কোনও কথা বলছে না। সমুদ্র টহল দেওয়ার জন্য নৌকো টৌকো নেই বাংলাদেশের। কক্সবাজার আর টেকনাফে আশিটি পথ দিয়ে নাকি মানুষ পাচার হচ্ছে। এই আশিটি পথে যথেষ্ট পাহারানেই। পাচারকারীরাবাংলাদেশ থেকে ছোট ট্রলারেকরেমায়ানমারে মানুষ নিয়ে যায়, ওখান থেকে বড় ট্রলারে করে থাইল্যাণ্ড বা মালয়েশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। শুধু রাতে সেই ট্রলার গুলো চলে। দিনে ট্রলার দাঁড়িয়ে থাকে নীল জালে গা ঢেকে। সমুদ্রের রঙের সঙ্গে মিশে। যেন কেউ বুঝতে না পারে মানুষবাহী কোনও ট্রলার ভাসছে সমুদ্রে। জীবনের কত ঝুঁকি নিয়ে মানুষ সমুদ্র পাড়ি দেয় শুধু খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য। ভাবলে গা শিউরে ওঠে। পাচারকারীরা নাকি বলে, মালয়েশিয়ায় গেলে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে তোমাদের জেলে নিয়ে যেতে পারে, তবে ওখানকার জেলে ভালো খাবার দাবার পাবে। মালয়েশিয়ার জেল দেশের চেয়ে ভালো। দেশে কাজ নেই, কর্ম নেই। ভাত নেই, কাপড় নেই। অন্তত বিদেশি জেলে তো দুবেলা খেতে পাবে। দুবেলা খেতে পাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে, বিসমিল্লাহ বলে গরিবরা রাতের অন্ধকারে পা টিপে টিপে অচেনা সাগরের উত্তাল ঢেউএ ভাসতে থাকা অচেনা নৌকোয় চড়ে। জেলে স্বাধীনতা নেই। তবে দেশের অনেক মানুষের কাছে দুবেলা খাবার স্বাধীনতার চেয়ে বড় স্বাধীনতা আর কিছু নেই। জেলে বন্দি করে রাখুক। খেতে তো দেবে, পরতে তো দেবে।

দারিদ্রের এত বিভৎস চেহারা দেখলে আঁতকে উঠি।

শুভবুদ্ধিসম্পন্ন লোকরা চাইছেন বাংলাদেশ-মায়ানমার-থাইল্যাণ্ড এসব দেশের মধ্যে মানবপাচার রোধের চুক্তি হোক। আমার কিন্তু এই মানবপাচারকে মানবপাচার বলতে বাধছে। এক জায়গা থেকে তল্পিতল্পা নিয়ে আরেকটা ভালো জায়গায় বাস করতে যাওয়া মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম কৌশল, যে কৌশল আমাদের আদি নারী-পুরুষরা অবলম্বন করেছিলো বলে আমরা হোমো সেপিয়ান নামের মানুষ প্রজাতি আজও এই পৃথিবীতে টিকে আছি। এই কৌশলটি অবলম্বন করেনি বলে। নিয়ানডার্থাল নামের মানুষরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যেখানে ভালো খাবার আছে, যেখানে আবহাওয়া ভালো, জীবন যাপনের মান উন্নত, সেখানে যাওয়ার প্রবণতা আমাদের রক্তে। শুধু আমাদের নয়, সব প্রাণীরই রক্তে। যারা যেতে পারে, তারা বেঁচে যায়, যারা পারে না, তারা মরে যায়। নতুন নতুন পরিবেশের সঙ্গে যত খাপ খাওয়াতে পারবো, তত আমাদের প্রজাতি বাঁচবে। বিবর্তন এভাবেই কোটি কোটি বছর ধরে হচ্ছে, হবে। আমরা আমাদের দুঃশাসন দিয়ে মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে ঠেকাতে চাইছি। এই ই আমাদের ভুল। যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাওয়ার এবং থাকার অধিকার অন্যতম মানবাধিকার। মানুষের পায়ে শেকল পরিয়ে দিয়ে মানবাধিকারের পক্ষে সওয়াল করা যায় না। বাংলাদেশ এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বরং এই চুক্তি হোক, যে, যে কোনও দেশের যে কেউ যে কোনও দেশে ঢুকতে পারবে, বাস করতে পারবে। পাসপোর্ট ভিসার পদ্ধতি উঠে যাক। মানুষের জন্য মানুষের আর ঘৃণা নয়, অবিশ্বাস নয়, সংশয় নয়, আশংকা নয়, মানুষের জন্য জন্ম নিক মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সহানুভূতি, সমমর্মিতা।

মুসলিম শরণার্থীদের সাহায্য করছে অমুসলিম দেশগুলো

আমরা নাইন ইলেভেন ভুলিনি, মুসলিম মৌলবাদীরা কী করে আমেরিকার আকাশ ছোঁয়া গৌরবকে ভূলুণ্ঠিত করলো, মেরে ফেললো কয়েক হাজার নিরপরাধ মানুষ, ভুলিনি। ডেনমার্কের কার্টুনিস্টকে নিয়ে বিশ্বসুদ্ধ কী আগুন তারা জ্বালিয়েছে ভুলিনি। সুইডিশ কার্টুনিস্টকে নিয়েও তো কম জ্বালাও পোড়াও হয়নি। সেদিন ফ্রান্সের শার্লি হেবদোর অফিসের সবাইকে মুসলিম মৌলবাদীরা গুলি করে মেরে ফেললো, ভোলা তো সম্ভব নয়। এটা নিষিদ্ধ, ওটা নিষিদ্ধ– এ তো লেগেই আছে। কথা বলা যাবে না, ছবি আঁকা যাবে না, ভিন্ন মত প্রকাশ করা যাবে না। এসব বাক স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের জনকদের ঘরের মধ্যে তাদের নাকের ডগায় ঘটেছে। আর এই সময়ই কি না লক্ষ লক্ষ মুসলিমের জন্য ইউরোপ-আমেরিকার দরজা খুলে দেওয়া হচ্ছে।মুসলিমরা পঙ্গপালের মতো ধেয়ে যাচ্ছে ইউরোপ-আমেরিকার দিকে।তারা শরণার্থী, আশ্রয় ভিক্ষে চাইছে। চিরকাল শুনে এসেছি মুসলিম মুসলিম ভাই ভাই। শুনে এসেছি মুসলিম ভ্রাতৃত্ব বড় ভ্রাতৃত্ব। ভাইয়ের দুঃসময়ে ভাইরা পাশে দাঁড়াচ্ছে কেন, এই প্রশ্নটি সবার মনেই জাগাটা স্বাভাবিক। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো আজ কোথায়! যুদ্ধ বিধ্বস্ত সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া এবং মৌলবাদ-আক্রান্ত অন্যান্য দেশের মুসলিম ভাইবোনদের পাশে আজ তারা নেই কেন। তারা অবশ্য জানিয়ে দিয়েছে, তারা আশ্রয় দেবে না। মুসলিম ভ্রাতৃত্ব তবে কি কেবল জেহাদ করার জন্যই প্রয়োজন?

যা খবর পেয়েছি তা হলো, প্রায় পাঁচ লক্ষ লোক সিরিয়া থেকে বেরিয়ে গেছে। আড়াই হাজারের ওপর মানুষ সমুদ্রে ডুবেছে, অথবা এখন অবধি নিখোঁজ। কিছুদিন আগে সমুদ্র তীরে একটি সিরীয় শিশুর উল্টে মরে থাকার ছবি বিশ্বকে কাঁদিয়েছে। ইউরোপের শহরগুলোয় লক্ষ লক্ষ মানুষ নেমেছে শরণার্থীদের সমর্থনে। মানুষ চিৎকার করে বলছে শরণার্থী এখানে এসো। এখনও মানবতা বেঁচে আছে। হ্যাঁ, মানবতা এখনও বেঁচে আছে। কিন্তু কেন আরব দেশের সেই মুসলিম দেশগুলোয় মানবতা বেঁচে নেই যারা ইচ্ছে করলেই পারতো এই বিপদে প্রতিবেশীদের আশ্রয় দিতে। কী আশ্চর্য! মানবতা শুধু সেসব দেশেই বেঁচে আছে, যেসব দেশের মানুষ মুসলিম নয়, যে অমুসলিম বা বিধর্মীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব না করার কথা মুসলিমদের পবিত্র কিতাবে লেখা আছে। কিছু আরব দেশ অবশ্য কিছু যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু তা নিশ্চয়ই যথেষ্ট নয়।

হিটলারও চ্যান্সেলর ছিলেন। এঙ্গেলা মেরকেলও চ্যান্সেলর। হিটলার সাদা জার্মান ছাড়া আর সবাইকে তুচ্ছ বলে মনে করেছেন, তাদের অত্যাচার করেছেন, খুন করেছেন। এঙ্গেলা মেরকেল তাদের বাঁচাচ্ছেন, যারা অন্য দেশে অত্যাচারিত হচ্ছে, খুন হচ্ছে, যারা জার্মান নয়, ইউরোপের লোক নয়, এমনকী খ্রিস্টানও নয়। তিনি মুসলমানদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য এগিয়ে এসেছেন, যে মুসলমান যে কোনও দিনই হয়ে যেতে পারে মৌলবাদী, হয়ে যেতে পারে সন্ত্রাসী। এই ঝুঁকিটা জেনেশুনেই নিচ্ছেন এঙ্গেলা মেরকেল। তিনি জার্মানির দরজা খুলে দিয়েছেন, যে দরজা দিয়ে প্রতিদিন ১০০০ শরণার্থী ঢুকছে জার্মানিতে। সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে শরণার্থী শিবিরের কাজ করতে। স্বেচ্ছাসেবকদের একজন বলেছেন, আমরা ব্যাংক সেইভ করতে পেরেছি, মানুষও সেইভ করতে পারবো। এই জার্মানিই একদিন কুৎসিত নাৎসির দখলে ছিল। এই জার্মানিই আজ নাৎসি বিরোধী, বর্ণবাদ বিরোধী, মানবিক।

জার্মানিতে আড়াই লক্ষ আশ্রয়প্রার্থীর দরখাস্ত পড়ে আছে। এদের শুধু আশ্রয় দিলেই চলবে না, এদের ভাষা শেখানো, এদের খাওয়ানো পরানো, এদের বাসস্থান, স্বাস্থ্য আর শিক্ষার ব্যবস্থা, এদের নিরাপত্তা– সব সেবাই সরকার করবে। জার্মানিতে বুড়োর সংখ্যা বেশি, শিশুর সংখ্যা কম, কারণ জার্মান দম্পতি সন্তান জন্মাতে খুব উৎসাহী নয়। শিশুজন্মের হার শুধু জার্মানিতে কম নয়, ইউরোপের অন্যান্য দেশেও কম। সে কারণে অভিবাসীরা বাড়তি উপপ হিসেবে নয়, বরং দেশকে সচল রাখার দক্ষ মানবশক্তি হিসেবে একসময় কাজে লাগতে পারে। দূরদৃষ্টি যাদের আছে, তারা সীমান্তে কড়া পাহারা বসাবেন না। এঙ্গেলা মেরকেল সম্ভবত তেমনই দুষ্প্রাপ্য দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ! তাই হয়তো অভিবাসী শিশুদের শিক্ষার ব্যাপারে তিনি জোর দিচ্ছেন।ষাট সত্তরের দশকে তুরস্ক থেকে শ্রমিক এনেছিল জার্মানি। কাজের চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ার পর শ্রমিকরা দেশে ফিরে না গিয়ে জার্মানিতেই রয়ে গিয়েছিল। ওদের শিক্ষিত করার ব্যাপারে নজর দেয়নি তখনকার জার্মানি। তুর্কী অভিবাসীদের অনেকেই জার্মান ভাষাটাই জানে না। ভালো কোনও কাজও তাই অনেকের জোটেনি।

আগস্টে জার্মানিতে ঢুকেছে এক লক্ষ ষাট হাজার শরণার্থী। অনুমান করা হচ্ছে। এ বছরের শেষে ঢুকবে অন্তত দশ লক্ষ শরণার্থী। যেখানে যত খালি জায়গা পাওয়া যাচ্ছে, শরণার্থীর জন্য তাঁবু বসানো হচ্ছে। মানবতার সেবায় নিজেকে যেভাবে সঁপে দিয়েছেন জার্মানির চ্যান্সেলর, এ থেকে কি অন্য দেশের রাজনীতিকরা শিক্ষা নেবেন? তাঁরাও কি সে পথে হাঁটবেন, যে পথে হেঁটেছেন এঙ্গেলা মেরকেল? পথটি বড় কণ্টকাকীণ বলে অনেকে হয়তো পিছিয়ে যাবেন!

কিছু কিছু শরণার্থী-বিরোধী মিছিল এদিক ওদিক হয়েছে। মূলত কট্টর ডানপন্থীরাই ওই মিছিলগুলো করেছে। মুসলিমদের প্রতি তাদের ঘৃণা এবং ভয় দুটোই প্রচণ্ড। তাদের ভাষ্য, এই মুসলিমরা শরিয়া আইনের দাবি করবে, রাস্তা বন্ধ করে নামাজ পড়বে, জার্মান সংস্কৃতির বিপরীত কোনও সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেবে, একাধিক বিয়ে করবে, স্ত্রীদের পেটাবে, মেয়েদের বোরখা পরতে বা হিজাব পরতে বাধ্য করবে, সেকুলার শিক্ষার বদলে নিজেদের ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করবে, পাড়ায় পাড়ায়। মসজিদ মাদ্রাসা গড়বে, বিধর্মী জার্মানদের ঘৃণা করবে, ঘরে বসে বসে বেকার ভাতা খাবে। এবং সবচেয়ে ভয়ংকর, অনেকের মগজধোলাই হবে, অনেকে সন্ত্রাসী হবে। বোমা ছুড়বে, মানুষ হত্যা করবে। সৌদি আরব এর মধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে, জার্মানিতে আশ্রয় নেওয়া সিরিয়ার শরণার্থীর জন্য ২০০ মসজিদ গড়ে দেবে। অনেক মসজিদেই কিন্তু নিরীহ মুসলমানদের সন্ত্রাসী বানানোর জন্য মগজধোলাই করা হয়। সৌদি আরব মুসলমান-শরণার্থীদের আশ্রয় দেবে না, তাদের খাদ্য বস্ত্র দেবে না, তাদের শিক্ষা দেবে না, স্বাস্থ্য দেবে না, কিন্তু ধর্ম দেবে। মুসলমানদের ধর্মান্ধ বানানো ছাড়া বা মনে হয় যেন আর কোনও উদ্দেশ্য নেই আর। বিভিন্ন গরিব মুসলিম দেশগুলোয় অঢেল টাকা ঢেলে যুবসমাজকে বিভ্রান্ত করছে ওয়াহাবিবাদে বিশ্বাসীরা। এই ওয়াহাবিবাদে গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন ওসামা বিন লাদেন। এক বিন লাদেন নেই তাতে কী, আরও বিন লাদেন তৈরি করতে অনেকই তৎপর।

জার্মানি আর সুইডেনই নেবে অধিকাংশ শরণার্থী। এ বছরে সুইডেন নিচ্ছে মোট ৯০,০০০ শরণার্থী। ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলো মুখে যত সহানুভূতি প্রকাশ করুক না কেন, শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার প্রশ্ন এলেই পিছিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বলে দিয়েছে দশ হাজার শরণার্থী নেবে। সংখ্যাটা আরও বাড়বে ভবিষ্যতে। শরণার্থীর জন্য জার্মানি দরজা খুলেছে, সুইডেন খুলেছে, ইউরোপের অনেক দেশই দরজা হয়তো খুলবে। আমেরিকাও আরও খুলবে। যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশগুলোর সহায় এখন ইউরোপ আর আমেরিকাই। অমুসলামরাই। বিধর্মীরাই। পাশ্চাত্যে মুসলমানের সংখ্যা বাড়ছে। একদিন হয়তো এমন দিন আসবে, মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠবে, পাশ্চাত্যের শ্বেতাঙ্গরা হয়ে উঠবে সংখ্যালঘু। একদিন হয়তো মুসলমানরাই শাসন করবে পৃথিবী। অমুসলমানরাই মুসলমানদের পেলে পুষে বড় করবে তাদের দেশে। অতঃপর আসবে সেই দিন, দারুল ইসলাম কায়েম করার দিন। শত্রুকে, বিধর্মীকে, অবিশ্বাসীকে কতল করে সুন্নি মুসলমানের তামাম দুনিয়ার খলিফা বনার দিন। এ কি শুধু কট্টর ডানপন্থীরাই ভাবছে? উদারপন্থীদের মনেও এমন আশংকা যে মাঝে মাঝে উঁকি দেয় না, তা হলফ করে বলা যাবে না।

অন্যরকমও হতে পারে। সেই অন্যরকমটিই যেন হয়। অন্যরকমটি এরকম– মুসলিম অভিবাসীরা সেকুলার শিক্ষায় শিক্ষিত হবে, বিজ্ঞানমনস্ক হবে, যুক্তিবাদী হবে, নারী পুরুষের সমান অধিকারে বিশ্বাস করবে। যে দেশে তারা বাস করবে যেন সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে বাস করতে পারে, যেন তাদের কোনও ঘেটোতে বা বস্তিতে বাস করতে বাধ্য করা না হয়, যেন তাদের শিক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়, চাকরি বাকরির সুযোগ দেওয়া হয়। তাদেরকে যত পৃথক করা হবে মূলধারা থেকে, তত তারা বিচ্ছিন্ন হবে, তত তারা ধর্ম আর কুসংস্কার আঁকড়ে ধরবে, তত তাদের জাপটে ধরবে ক্ষদ্রতা আর অন্ধতা। কেবল আশ্রয় দিলেই আর খাওয়া পরার নিশ্চয়তা দিলেই নিরাশ্রয়দের সব সমস্যার সমাধান হয় না, কী করে তারা বেঁচে থাকবে, কতখানি মর্যাদা নিয়ে, কী শিক্ষা আর কতটা সচেতনতা নিয়ে, সেটা একটা বড় বিষয়। তা না হলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধ্বংস হয়ে যাবে, এইসব লোক দেখানো আশ্রয় কারও সত্যিকার কোনও উপকার করবে না।

মেক্সিকো

মেক্সিকোতে গিয়ে আমার এক চমৎকার অভিজ্ঞতা হয়েছে, প্রায় প্রত্যেকে ভেবেছে আমি মেক্সিকান, আমার সঙ্গে স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলতে শুরু করেছে। যতই বলি। আমি মেক্সিকান নই, ততই তারা যেন শিওর হয় আমি মেক্সিকানই। মাথায় যখন আমার ব্রাউন ক্যাপটা পরি, তখন আমাকে পেরুভিয়ান বলবে ওরা, বলবেই।

সবুজ সার্ট পরা মানুষটি আমি। আমার পাশে একজন মেক্সিকান ইণ্ডিয়ান। কোথায় আমি? সম্ভবত আজটেকদের সান টেম্পল-মুন টেম্পল দেখতে গিয়েছি। আমার খুব ইচ্ছে ল্যাটিন আমেরিকাটা চষে বেড়ানোর। সেই কতকালের ইচ্ছে, আজও যাই যাই করে যাওয়া হয়নি। সঙ্গে যাওয়ার জন্য স্প্যানিশ জানে এরকম একজন বন্ধু খুঁজছি। ল্যাটিন আমেরিকার প্রতিটি দেশেই, আমার বিশ্বাস, আমাকে বলবে, আমি ওখানকার লোক। চিলিয়ান, ব্রাজিলিয়ান, আর্জিন্টিয়ান, কলোম্বিয়ান… যে কোনও কিছুই হতে পারি। আমার চেহারাটা স্প্যানিয়ার্ডদের মতো নয়, বরং নেটিভ ইণ্ডিয়ানদের মতো অনেকটা, অথবা মিক্সড, ক্রিয়ল। ল্যাটিন আমেরিকায় কেউ আমাকে বলবে না আমি ট্যুরিস্ট অথবা আউটসাইডার। চষে বেড়াতে হলে তো এই ই চাই।

মেনোপজ?

মেনোপজকে বাংলায় সম্ভবত রজঃনিবৃত্তি বলে। আমার রজঃনিবৃত্তি হচ্ছে হবে বলে একটা আশংকা করছিলাম গত তিন চার বছর। হতে হতে তিপ্পান্ন গড়ালো। গত আড়াই মাস আমি ঋতুর দেখা পাইনি, ফুলে ধরেই নিয়েছি আমার রজঃনিবৃত্তি ঘটেছে। অবশ্য রজঃনিবৃত্তি দুম করে ঘটে যায় না, বেজায় বাহানা করে বিদেয় নেওয়ার আগে। কান পাতলে এই যাচ্ছি, খানিকটা জিরোই, অত তাড়া কিসের এসবও শুনি। এমনও হতে পারে হঠাৎ আমাকে চমকে দিয়ে উনি এসে উপস্থিত হবেন। আমি অবশ্য ঋতুর মুখ আর দেখতে চাইনে বলে আবদার করিনি। দেখতে পেলে যত্নআত্তির অভাব রাখবো না,আর না পেলে প্রকৃতির বিচারকে বিনাতকে মেনে নেবো। আমার একটা ক্ষীণ অস্বস্তি ছিল রজঃনিবৃত্তির মন্দ দিকগুলো নিয়ে। হরমোন নিঃসৃত না হলে শরীর আর আগের মতো বিপদমুক্ত থাকবে না জানি। ভেবেছিলাম যৌন ইচ্ছেগুলোরও বোধহয় ছুট্টি হয়ে যাবে। ও মা, গত আড়াই মাস ধরে একটুও দেখলাম না কিছু বদলেছে। যেমন ছিল, তেমনই। আমি বলবো না আমার সেই পঁচিশে যেমন ছিল, এখনও তেমন। সেরকম পাগলপাগল না হলেও খুব কম নয়।

এখন যৌনতা কী চমৎকার উপভোগ করছি আমি, আর মনে পড়ছে আমার মার কথা। মাকে দেখেছি সম্ভবত তার পঁয়ত্রিশ বা তারও কম বয়স থেকেই আলাদা বিছানায় থাকে। কাচ্চা বাচচা খানিকটা বড় হয়ে গেলে বাঙালি বাবা মারা আর এক বিছানায় ঘুমোন না। যখন ছোট ছিলাম, বাবা মাদের এক বিছানায় না ঘুমোনোটাকেই খুব স্বাভাবিক মনে হতো। আত্মীয় স্বজন, পাড়া পড়শি সব বাড়িতেই এই নিয়ম দেখেছি। ঘর আলাদা। বিছানা আলাদা। ছোটবেলায় বাবা মাদের বয়স খুব বেশি বলে মনে হতো। যখন বয়স তাদের তিরিশের ঘরে, তখনও মনে হতো তারা পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ। লজ্জা শরমের বালাই না থাকলেই ওই বয়সে যৌনতার বোধ থাকে। এরকম ভাবতাম। কিন্তু এখন ভাবছি ওই অল্প বয়সে আমার মা একা একা কী করে যৌনতাহীন জীবন কাটাতো! শুধু মা কেন, আর সব মেয়েরা! চার পাঁচটা বাচ্চা পর পর প্রসব করার পর মায়ের দায়িত্ব ওদের বড় করা। ওই নিয়েই পড়ে থাকা। নিজের জীবন বলে আর কিছু না থাকা। শরীরের সুখ আনন্দ বলে কিছু না থাকা। তখন তাদের পরিচয় আর প্রেমিকা নয়, স্ত্রী নয়, শুধুই মা। মাদের যৌনতা নৈব নৈব চ।

যৌনসুখ ভোগ করার অধিকার সবার। কিন্তু ছলে বলে কৌশলে কী করে বয়সের দোষ দিয়ে মেয়েদের বঞ্চিত রাখা হচ্ছে যৌন সুখ থেকে! কেবল যৌন সুখ নয়, হাজার রকম সুখ থেকে বঞ্চিত করা হয় মেয়েদের।

কলকাতায় দেখেছি কিছু যুবক পাড়াতুতো বৌদিদের বাড়িতে ঢোকে দুপুরবেলার দিকে। দাদারা তখন আপিসে। ওই যুবকগুলোকে দুপুর ঠাকুরপো বলে ডাকে কেউ কেউ। বেশ তো!

মেয়েদের কেন ঠকানো হয়?

১৯৯৩ সালে আমার কাছে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির কিছু মেয়ে আসতো। ফ্যাক্টরিতে মেয়েদের টাকা-পয়সায় ঠকানো, মেয়েদের বেতন কম দেওয়া, বড় পদে মেয়েদের নিয়োগ না করা, ম্যাটারনিটি লীভ না দেওয়া, অসুখ বিসুখে ছুটি না দেওয়া, যৌন হয়রানির শিকার করা, ওভারটাইম করতে বাধ্য করা, রাত বিরেতে ট্রান্সপোর্ট না দেওয়া, এরকম অনেক অভিযোগ করতো। আজ ২২ বছর পর গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির খবর নিয়ে দেখি, আগের সেই অবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। মেয়েরা আগের মতোই দারিদ্রের শিকার, আগের মতোই মেয়ে হওয়ার কারণে কাজটা বেশি করতে হয়, বেতনটা কম পেতে হয়, আগের মতোই তারা যৌন হয়রানির শিকার। আর মাঝে মাঝে তো আমরা দেখিই কী করে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোয় আগুন লাগছে আর পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে ফ্যাক্টরির ভেতর আটকে পড়া শত শত বস্ত্র-বালিকা।

১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে প্রথম গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির শুরু, নব্বইএর দশকে হৈ হৈ করে এর বাণিজ্য গেল বেড়ে। আজ বাংলাদেশ থেকে যা কিছু রফতানি হয়, তার আশি ভাগই গার্মেন্টস। তিরিশ লক্ষের চেয়েও বেশি গার্মেন্টস শ্রমিকদের ৮৫ ভাগই মেয়ে। দেশটি যদি সভ্য হতো, এই মেয়েদের মাথায় তুলে রাখতো। সভ্য নয় বলেই ষড়যন্ত্রের নীল নকশাআঁকে, এদের কী করে আরও ঠকানো যায়, কী করে আন্তর্জাতিক শ্রমিক আইন লংঘন করে এদের আরও নির্যাতন করা যায়, জাতিসঙ্খের সব রকম বৈষম্য থেকে নারীর মুক্তির কনভেনশনকে পায়ে মাড়িয়েও বৈষম্যের শিকার করে রাখা যায় এদের। বাংলাদেশের পুরুষতন্ত্র বিষমই দক্ষ এসবে।

গার্মেন্টসে মেয়ে-শ্রমিক নেওয়ার পেছনে মেয়েদের প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা নয়, যা কাজ করে তা হলো মেয়েদের সস্তা মাল বলে ভাবার মানসিকতা। সস্তা মাল সস্তায় মেলে। সস্তা মাল আদেশ পালন করে। সস্তা মালকে দেখভাল করার দরকার হয় না। সস্তা মাল কী খাবে কী পরবে কোথায় শোবে তা না ভাবলেও চলে। সস্তা মাল দুঃখকষ্ট সইতে পারে। সস্তা মাল এটা চাই ওটা দাও করে না। সস্তা মালের দাবি দাওয়া নেই। সস্তামাল থেকে সহজে শ্রম আদায় করা যায়। সস্তা মালকে মারো ধরো, মুখ খোলে না। সস্তা মালরা মরে গেলেও কারও কিছু যায় আসে না।

একই কাজ করে একটা পুরুষ পারিশ্রমিক পায় বেশি, একটা মেয়ে পায় কম। এই সমস্যা শুধু বাংলাদেশে নয়, এই সমস্যা সারা পৃথিবীতে। মেয়েদের কম বেতন দেওয়ার কারণ, জেণ্ডার স্টেরিওটাইপ। জেণ্ডার স্টেরিওটাইপ মানে কোন লিঙ্গ কী চরিত্রের, সে সম্পর্কে মানুষের বদ্ধমূল ধারণা অথবা পুঁতিগন্ধময় বিশ্বাস, যে বিশ্বাস সহজে মন থেকে দূর করা যায় না। জেণ্ডার স্টেরিওটাইপের কিছু উদাহরণ দিচ্ছি মেয়েদের টাকা পয়সা উপার্জনের খুব একটা দরকার নেই, কারণ মেয়েদের সংসার চালাতে হয় না। সংসার চলে পুরুষের উপার্জনে; মেয়েদের বেতন পুরুষের বেতনের সমান হওয়ার কোনও প্রয়োজনই নেই, কারণ পুরুষের মতো পরিবারের দায়িত্ব। মেয়েদের নিতে হয় না; মেয়েদের উপার্জন নিতান্তই স্বামীর মূল উপার্জনের বাইরে একটি বাড়তি উপার্জন; ঘরের বাইরে কাজ না করলেও মেয়েদের চলে, কিন্তু পুরুষকে কাজ করতেই হবে, মাস্ট; মেয়েরা উঁচুপদে চাকরি করতে পারবে না, কারণ মেয়েরা ঝুটঝামেলা সামলাতে পারবে না, প্রয়োজনে শক্ত হতে পারবে না, কঠিন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে তো পারবেই না; মেয়েরা উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয়, আত্মবিশ্বাসী নয়, তার ওপর আবার তাদের কাচ্চা বাচ্চা পোষার ব্যাপার আছে; মেয়েরা হিসেব কষতে জানে না, বুদ্ধিতে-বিচক্ষণতায় কাঁচা, অল্পতে ভেঙে পড়ে, আবেগ প্রবণ, অহেতুক কান্নাকাটি করে, অতি নরম, দুর দুরান্তে ভ্রমণ করতে পারবে না, রাতে চলাফেরা করতে ভয় পাবে; মেয়েরা সেবা যত্ন করায় হয়তো দক্ষ, কিন্তু পুরুষেরা দায়িত্ব নেওয়ায় দক্ষ; মেয়েরা মা হতে চায়, দীর্ঘকাল চাকরি বাকরি করতে চায় না; সন্তানের দেখাশোনা করতে হয় বলে মেয়েরা চাকরিতে মনোযোগ দিতে পারে না। স্টেরিওটাইপের শেষ নেই। দক্ষ মেয়েদেরও শুধু মেয়ে হওয়ার কারণে উঁচু পদে কাজ করতে দেওয়া হয়। না। লিঙ্গ বৈষম্য সবখানে, ঘরে বাইরে, অফিসে আদালতে। লিঙ্গ বৈষম্যের কারণে মেয়েদের চাকরি পাওয়াটা সহজ নয়, কিন্তু চাকরি হারানোটা সহজ।

জগত বদলাচ্ছে, মেয়েরাই অনেক সময় সংসার চালায় একা, স্বামী সন্তানের ভরণ পোষণও করে। তারপরও মেয়ে বলেই তারা দায়িত্বজ্ঞানহীন হিসেবে চিহ্নিত হয়। মেয়েরা অংক কম জানে, বিজ্ঞান কম বোঝে, এরকম ধারণাও ঢুকে আছে মানুষের মনে ও মস্তিষ্কে। মেয়েদের সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু বিশ্বাস কত সহস্র বছর আগে ঘুণপোকার মতো ঢুকে গেছে মানুষের মগজে, তা থেকে মুক্তি আজও মানুষের নেই, আজও সেই বিশ্বাস উচ্চারিত হয় সবখানে, কোনও রকম প্রমাণ খাড়া করার দায়িত্ব কেউ বোধ করে না। মানুষের এই বিশ্বাসের জন্যও মেয়েরা কোনও কাজে পারদর্শী হয়েও যোগ্য পদ পায় না। মেয়েদের সম্পদ মেয়েদের শরীর, এই বিশ্বাসও শেকড় গেড়ে বসা। সে কারণে মেয়েদের শরীরের দিকেই চোখ পড়ে মানুষের। মেয়েরা কী বিষয়ে কতটা জানে, কতটা বোঝে, কতটা দক্ষ, সেসব কেউ জানতে চায় না, মেয়েদের রূপ হয়ে ওঠে প্রধান, মেয়েদের গুণ হয়ে ওঠে গৌণ। মেয়েদের যৌনসামগ্রী হিসেবে দেখা হয় বলে মেয়েদের মধ্যে যাদের বয়স অল্প, যারা দেখতে সুন্দর, তাদের চাকরি পেতে অসুবিধে হয় না। বিভিন্ন চাকরিতে, বিশেষ করে শোবিজে আমরা কাস্টিং কাউচের গল্প শুনেছি। মেয়েরা, ঘরে কাজ করুক কী বাইরে কাজ করুক, ব্যবহৃত হয় পুরুষের যৌন স্বার্থে। প্রায় মেয়েরাই কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। মেয়েদের অধিকার এবং স্বাধীনতা যেখানে যত কম, মেয়েদের ওপর যৌন হয়রানির হার সেখানে তত বেশি।

সেদিন এক লোক আমাকে বললো, মেয়েদের পেশির জোর কম, পুরুষের পেশির জোর বেশি, তাই পুরুষের স্থান উঁচুতে, মেয়েদের স্থান নিচে, তাই চাকরিতে মাইনেটা মেয়েরা কম পায়, পুরুষরা পায় বেশি। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, চাকরিগুলো কি নারী পুরুষের মধ্যে মল্লযুদ্ধ হওয়ার চাকরি, যেখানে শরীরের পেশির প্রয়োজন হয়? লোকটি ভুরু কুঁচকে বলেছে, না। আমিও ভুরু কুঁচকে বললাম, তবে পেশির প্রশ্ন ওঠে কেন? এও বললাম, আমরা পেশি দিয়ে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার কোনওটাই চালাই না। আমরা মস্তিষ্ক দিয়ে চালাই সব। নারী পুরুষের মস্তিষ্কে তো কোনও পার্থক্য নেই বলেই জানি। লোকটি এরপর কোনও উত্তর দিতে পারেনি। সম্ভবত কুৎসিত কোনও গালি খুঁজছিল আমার দিকে ছোঁড়ার জন্য। জুৎসই উত্তর না থাকলে কুৎসিত গালিই ওদের ভরসা।

সবার আগে এই নারীবিদ্বেষী বিশ্বাসগুলোকে বিনাশ করতে হবে। এসবের বিনাস না হলে এসব বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে যে লিঙ্গ বৈষম্য গড়ে উঠেছে, সেই লিঙ্গ বৈষম্যকে বিনাশ করা সম্ভব নয়। অসুখ দূর করতে হলে অসুখের কারণ দূর করতে হয়, তা না হলে অসুখ সারে না।

পৃথিবীর জনশক্তির অর্ধেক নারী। এই অর্ধেক জনশক্তিকে যদি দুর্বল বলে ভাবা হয়, ছলে বলে কৌশলে যদি তাদের পারদর্শিতা দেখানোর সবরকম সুযোগ কেড়ে নেওয়া হয়, যদি তাদের শোষণ করা হয়, যদি তাদের কাজকে কাজ বলে না ভাবা হয়, উপার্জনকে উপার্জন বলে গণ্য করা না হয়, যদি তাদের প্রাপ্য সম্মান তাদের না দেওয়া হয়, তাদের সমতা আর সমানাধিকারকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিশ্বাস না করা হয়, কর্মঠ, নিষ্ঠ, জ্ঞানী, বুদ্ধিমতি, দায়িত্বশীল, ও দক্ষ হওয়ার পরও যদি তাদের তুচ্ছ করা হয়, শুধু মেয়ে বলেই তুচ্ছ করা হয়, তবে এই লজ্জা সম্পূর্ণই আমাদের দুর্ভাগা জাতির! আবারও বলছি, মেয়ে বলেই যদি তাদের হাঁড়ি ঠেলার, রাঁধা-বাড়ার, সন্তান জন্ম দেওয়ার বস্তু, আর আবেগের পিণ্ড বলে ভাবা হয়, মেয়ে বলেই যদি তাদের কিছু কম-বুদ্ধির, কিছু কম-সম্মানের, কিছু কম মর্যাদার কিছু কম মানুষ বলে মনে করা হয়, তবে এই লজ্জা সম্পূর্ণই আমাদের দুর্ভাগা জাতির। এইসব অসুস্থ ভাবনা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে না পারলে আখেরে মুক্তি নেই কারোর।

লজ্জা দিবস

২২ নভেম্বর, ২০০৭ সাল। আমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। এই বের করে দেওয়ার পরিকল্পনা দেড়-দুবছর ধরেই চলছিল। যে বইটি বামফ্রন্ট সরকার নিষিদ্ধ করেছিল ২০০৩ সালে, সেটিকে দুবছর পর কলকাতা হাইকোর্ট মুক্তি দেয়। বইয়ের এই মুক্তি পাওয়া বামপন্থীরা পছন্দ করেননি। থেকে থেকেই বলছিলেন রাজ্য ছাড়তে। চাপটা চরমে উঠলো হায়দারাবাদে মুসলিম মৌলবাদীরা আমার ওপর হামলা করার পর। কলকাতায় আমাকে গৃহবন্দি করা হলো। পুলিশ কমিশনার বাড়িতে এসে থ্রেট করতেন। রাজ্য ছাড়ার জন্য হুকুম দিতেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহকে দিয়েও মুখ্যমন্ত্রী বলতেন আমি যেন কলকাতা ছাড়ি। এমনকী বাড়িওয়ালা ডাক্তার দেবল সেনকে দিয়েও বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিয়েছিলেন। এমন সময় পার্ক সার্কাসের গলিতে মুসলমানদের বের করা হলো। ছিল নন্দীগ্রাম,সিঙ্গুর আর রিজওয়ানকে নিয়ে বিক্ষোভ, হয়ে দাঁড়ালো তসলিমার ডিপোর্টেশনের পক্ষে মিছিল।

মুসলমানের আপরাইজিং হলে মেটিয়াবুরুজ, খিদিরপুরেও হতো। কোথাও কিন্তু কিছু হয়নি। পার্কসার্কাসের মুসলমানরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের সামনেই গাড়িটাড়ি পোড়ালো। খামোকা আর্মি নামানো হয়েছিল, মনে আছে। কাফু ঢাকা হয়েছিল। মশা মারতে কামান দাগা বোধহয় একেই বলে।

বামফ্রন্ট সরকার মুসলমানের ভোট পাওয়ার জন্য আমাকে তাড়িয়েছিল, কিন্তু মুসলমানের ভোট তাদের পাওয়া হয়নি। সামনেই ছিল পঞ্চায়েত ইলেকশন। সেই ইলেকশনো গোহারা হেরেছিল বামফ্রন্ট। (আজও রাজনীতিকদের এই শিক্ষাটা হয়নি যে তসলিমাকে গৃহবন্দি করে, মেরে, তাড়িয়ে, তার সর্বনাশ করে, তার টিভি সিরিয়াল ব্যান করে, তার বইয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বাতিল করে মুসলমানের ভোট জোটেনা, জোটেনি কোনওকালে।)

এরপর তো ফতোয়াবাজরা ধর্মতলার মোড়ে দাঁড়িয়ে বিরাট জনসভা করে আমার মাথার দাম আনলিমিটিড অ্যামাউন্ট টাকা ঘোষণা করলো। হায়দারাবাদি মোল্লাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। তিনি এবং কলকাতার টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম ছিলেন ফতোয়া ঘোষণার নায়ক। এই যে কারও মুণ্ডু কেটে নিয়ে এলে হাজার কোটি অথবা যত ইচ্ছে টাকা চাও তো দেবো বলা হলো, এর জন্য কারও কোনও শাস্তি হলো না। পুলিশ ছিল সভায়, ফতোয়াবাজদের নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা দিতেই ছিল। ওই ফতোয়াবাজ ইমাম আবার বামফ্রন্ট সরকারের, এবং এখনকার তৃণমুলী সরকারের পরম বন্ধু।

কলকাতা থেকে তাড়াবার পর কিছু বন্ধু, খুব সাধারণ বন্ধু, প্রতিবাদ করতো এই ২২ নভেম্বর তারিখে। নাম দিয়েছিল এই দিনটির, লজ্জা দিবস। একজন বাঙালি লেখক, যে ভালোবেসে কলকাতায় থাকতো, তাকে কলকাতা থেকে বের করে দেওয়াটা কলকাতার জন্য লজ্জা, সে কারণেই ২২ নভেম্বরের দিনটিকে ওরা লজ্জা দিবস বলতো। তসলিমাকে কলকাতায় ফেরত চাই বলে বলে প্রতিবছর চিৎকার করতো ওরা কয়েকজন বড় লেখক কবি আসতেন প্রতিবাদ অনুষ্ঠানে। ওই লেখক কবিরা তৃণমুলে ভিড়ে যাবার পর অবশ্য এ পথ আর মাড়ান না। লজ্জা দিবস বলে। কোনও দিবসের কথাও ওঁদের আর স্মরণ নেই।

লিঁও

ফ্রান্সের শহর লিও। ২০০৯ সাল। আমাকে লিওর মেয়র ফ্রেঞ্চ সোশালিস্ট পার্টির জেরার্ড কলোম্ব দিলেন লিওর সর্বোচ্চ সম্মান। পেলাম মেডেল অব লিও। একই সঙ্গে পেলাম লিওর সাম্মানিক নাগরিকত্ব, অনারারি সিটিজেনশিপ। নিজের দেশের সরকার লাথি মেরে তাড়ায়, আমার নাগরিকত্ব অস্বীকার করে, আর অন্য দেশ, অন্য শহর আমাকে নাগরিকত্ব দিয়ে ঘোষণা করে এতে নাকি তাঁরাই সম্মানিত। শুধু লিও নয়, ইউরোপের অনেকগুলো শহর আমাকে সাম্মানিক নাগরিকত্ব দিয়েছে। ওই শহরগুলোর কোনওটিতেই আমি বাস করিনি। বাস করতে চেয়েছি শুধু সেই শহরগুলোয়, যে শহরগুলোয় প্রবেশ করার আমার কোনও অধিকার নেই। যেমন ঢাকা, যেমন কলকাতা।

লিঙ্গসূত্র

তেরো বছর বয়স আমার তখন। একদিন শুনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র হঠাৎ মেয়ে হয়ে গেছে। নাম ছিল আবুল হোসেন, মেয়ে হওয়ার পর নাম হোসনে আরা। কদিন পরই লাল বেনারসি পরে হোসনে আরা বিয়ে করে ফেললো তার রুমমেটকে। ঘটনাটা আমকে খুব আলোড়িত করেছিল। খবরের কাগজে আবুল হোসেন আর হোসনে আরা ছবি পাশাপাশি ছাপা হত। আবুল হোসেন সবসময় মৌলানাদের স্কার্ফের মতো একটা স্কার্ফ পরতো, বুক আড়াল করার জন্য। ভেতরে ভেতরে মেয়েই ছিল সে, কিন্তু জন্মের পর আত্মীয় স্বজন ভেবেছিল সে ছেলে, ভাবার নিশ্চয়ই কোনও কারণ ছিল। বড় হয়ে আবুল হোসেন বুঝতে পেরেছিল সে ছেলে নয়। লজ্জায় ভয়ে অনেক বছর কাউকে কিছু বলেনি। ছেলেদের হোস্টেলে থাকতো, সবাই তাকে ছেলে বলেই জানতো। কিন্তু একসময় অস্বস্তির চরমে পৌঁছে ডাক্তারের শরণাপন্ন হল। ডাক্তার কী একটা অপারেশন করলেন, ব্যস, আবুল হোসেন মেয়ে হয়ে গেল। খবরটা পড়ে আমার খুব ইচ্ছে হয়েছিল হঠাৎ একদিন ছেলে হয়ে যাওয়ার। কিন্তু বুঝতাম, আবুল হোসেনের শরীরটা যেমন ভেতরে ভেতরে মেয়ের শরীর ছিল, আমার শরীরটা ভেতরে ভেতরে ছেলের শরীর নয়। আসলে মেয়েদের ওপর পারিবারিক সামাজিক ধার্মিক রাষ্ট্রিক অত্যাচার এত বেশি হত যে ছেলেতে রূপান্তরিত হয়ে এসব থেকে বাঁচতে চাইতাম। অন্য কোনও কারণ ছিল না।

মেয়েদের পোশাক পরতাম, কিন্তু ফাঁক পেলেই ছেলেদের পোশাক পরার ইচ্ছে হত। তখনও আমাদের শহরের মেয়েদের মধ্যে ছেলেদের প্যান্টের মতো প্যান্ট পরার চল শুরু হয়নি। মনে আছে প্রথম যখন প্যান্টের কাপড় কিনে দরজির কাছে গিয়ে নিজের জন্য একখানা প্যান্ট বানানোর প্রস্তাব করলাম, দরজি বানাতে চাইল না, পরে দাদকে দিয়ে অনুরোধ করার পর বানালো বটে, কিন্তু ছেলেদের প্যান্টের মতো সামনে চেইন দিল না, চেইন দিল কিনারে। বলার পরও পকেট দিল না প্যান্টে। প্যান্ট যদি নিতান্তই মেয়েরা পরতে চায়, তবে সেই প্যান্ট পুরুষের প্যান্টের চেয়ে ভিন্ন করে বানানোর জন্য সত্তর দশকের ময়মনসিংহে দরজিদের কায়দাকানুনের কমতি ছিল না। প্যান্ট পরাই তখন রেভুলুশান, সার্টের প্রশ্নই আসে না। অবশ্য সার্টও বানিয়েছিলাম, দরজিরা কায়দা করে ছেলেদের সার্টের চেয়ে একটু আলাদা করে বানিয়েছিল। বুক পকেট তো দেয়ইনি, বরং বুকের ওপর অনর্থক দুতিনটে কুঁচি বসিয়ে দিয়েছিল। পরে অবশ্য দরজিকে বেশ ধমক টমক দিয়ে মেয়েদের পোশাক পুরুষের পোশাকের থেকে যে করেই হোক ভিন্ন করার ওদের দুষ্টুমিটা বন্ধ করেছিলাম। যেহেতু নিষেধ ছিল ছেলেদের পোশাকের মতো পোশাক পরা, নিষেধ ভাঙতেই ওই কাজটা করতাম। কিছু লোক নিয়ম বেঁধে দেবে কী করে হাঁটতে হবে, হাসতে হবে, কাঁদতে হবে, খেতে হবে, কী করে কথা বলতে হবে, কী বলতে হবে, কণ্ঠস্বরটা কতখানির পর আর ওঠানো চলবে না, কী পোশাকের বাইরে কী পোশাক পরা যাবে না, বাড়ি থেকে কখন বেরোতে হবে, কখন ফিরতে হবে, আর আমিও সেই নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো, কোনও প্রশ্ন করবো না, এ মানা আমার সেই কৈশোরেই আমার মনে হয়নি যে উচিত। ছেলেদের পোশাক মেয়েদের পরতে হয় না। এই উপদেশ উঠতে বসতে শুনতাম বলে ছেলেদের পোশাক পরে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম, যে, ইচ্ছে করলে যা খুশি পরা যায়। আমি তখন বুঝে পাইনি, ছেলেরাও কেন মেয়েদের জন্য বরাদ্দ পোশাক পরে বুঝিয়ে দেয় না যে তারাও নিয়ম মানে না! কেন তারা স্কার্ট পরে না, শাড়ি, কামিজ পরে না? পুরুষ তো কম বিপ্লব করেনি, তবে পোশাকের এই বিপ্লবে এত আপত্তি কেন? পরে অবশ্য বুঝেছি, মেয়েদের স্থান সমাজে এত নিচে নামিয়ে রাখা হয়েছে, যে, বেশির ভাগ পুরুষ মনে করে, নিচুদের পোশাক পরা মানে নিজে নিচু হওয়া, অথবা দ্বিতীয় লিঙ্গের পোশাক পরার অর্থ প্রথম লিঙ্গকে অপমান করা। আর ওদিকে মেয়েরা যারা পুরুষের পোশাক পরে, তাদের মধ্যে অনেকেই মনে মনে এই ভেবে সুখ পায়, যে, একটু বুঝি প্রভুদের কাতারে ওঠা গেল, মানটা বাড়লো। পুরুষ ক্রস-ড্রেসারদের অনেকে ট্রান্সজেণ্ডার বা রূপান্তরকামী হলেও মেয়ে ক্রস ড্রেসারদের অনেকেই তা নয়। পুরুষ আর নারীর সামাজিক বৈষম্য না থাকলে সম্ভবত একই পোশাক পরতো উভয়েই। হাসপাতালে, জেলখানায় উভয়ের একই পোশাক। ডাক্তারিশাস্ত্রের চোখে সব রোগী, আইনের চোখে সব অপরাধী সমান বলেই হয়তো।

পুরুষ আর নারীর শরীরে, মাঝে মাঝে মনে হয়, এক সুতোর ব্যাবধান। নারীণ দিয়ে পুরুষের যাত্রা শুরু, মাঝপথে ওয়াই ক্রেমোজম এসে নারীশ্রুণকে পুরুষণে রূপান্তর করে। নারী পুরুষ দুজনের শরীরেই থাকে পুরুষ-হরমোন টেস্টোস্টেরন আর নারী হরমোন এস্ট্রোজেন। পুরুষের শরীরে একটু বেশি টেস্টোস্টেরন আর নারীর শরীরে একটু বেশি এস্ট্রোজেন, এই যা পার্থক্য। হরমোনের পরিমাণ একটু এদিক ওদিক হলেই মেয়েকে দেখতে লাগবে ছেলের মতো, ছেলেকে মেয়ের মতো। চাইলে হরমোন কিন্তু আরও ভয়ংকর ভয়ংকর কাণ্ডও করতে পারে। পুংলিঙ্গ আর স্ত্রীলিঙ্গ উল্টে পাল্টে ফেলতে পারে।

লিঙ্গ অত সহজ নয়, যত সহজ বলে একে ভাবা হয়। লিঙ্গ শুধু শারীরিক নয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মনস্তাত্বিকও। অধিকাংশ লোক ভাবে, জগতের সব সুস্থ মানুষই বুঝি শরীরে পুরুষ, মনেও পুরুষ, অথবা শরীরে নারী, মনেও নারী। কিন্তু এর ব্যাতিক্রমও আছে। ব্যতিক্রমটা বুঝতে হলে জোর বা মনোলিঙ্গ বুঝতে হবে। শরীরে যেমন লিঙ্গ থাকে, মনেও একধরনের লিঙ্গ থাকে, লিঙ্গবোধ থাকে। যাদের জৈবলিঙ্গের সঙ্গে মনোলিঙ্গের কোনও বিরোধ নেই, তারা সিসজেণ্ডার। জগতের সবাই সিসজেণ্ডার নয়, অনেকে ট্রান্সজেণ্ডার, সিসজেণ্ডারের ঠিক উল্টো। পুরুষের শরীর নিয়ে জন্মেছে, কিন্তু মনে করে না যে সে পুরুষ, মনে করে সে নারী, আবার ওদিকে নারীর শরীর নিয়ে জন্মেছে, কিন্তু মোটেও সে বিশ্বাস করে না যে সে নারী, তার দৃঢ় বিশ্বাস সে পুরুষ। এই ট্রান্সজেণ্ডারা বা রূপান্তরকামীরা নড়নচড়নহীন রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পেইন ইন দ্য অ্যাস। এদের দুর্ভোগ প্রতি পদে পদে। প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে গেলে সবাইকেই অবশ্য দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

ধরা যাক, জন্মানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শরীরে পুরুষাঙ্গের উপস্থিতি দেখে বাবা মা বা ডাক্তাররা রায় দিয়ে দিলেন, সন্তান ছেলে, পরিবারের এবং সমাজের সকলে জানলো যে সে ছেলে, কিন্তু নিজে সে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে আর অনুভব করতে থাকে যে সে ছেলে নয়, সে মেয়ে। সে যখন নিজেকে মেয়ে ভেবে মেয়েদের সাজ-পোশাকে বাইরে বেরোয়, এবং সত্য কথাটা প্রকাশই করে ফেলে যে পুরুষের শরীর সে ধারণ করছে বটে, কিন্তু সে আসলে পুরুষ নয়, সে মেয়ে, লোকেরা তাকে হাস্যরসের বস্তু ভাবে, সার্কাসের ক্লাউনের চেয়েও বড় ক্লাউন ভাবে, চিড়িয়াখানার চিড়িয়া ভাবে, তাকে শেকলে বাঁধে, পাগলা গারদে বন্দি করে। লোকেরা কেউ ছি ছি করে, কেউ বিদ্রূপ ছোড়ে, কেউ গালি দেয়, ন্যাংটো করে, পেটায়। কেউ কেউ জন্মের মার মেরে তার মাথার ভূত তাড়াতে চায়। মাথার ভূত মাথা ছেড়ে কিন্তু এক পা নড়ে না। মাথার লিঙ্গ মাথা কামড়ে পড়ে থাকে।

মেয়েরা ছেলেদের মতো আচরণ করলে আজকাল তবু সহ্য করে মানুষ, কিন্তু ছেলেরা মেয়েদের মতো আচরণ করলে আজও অধিকাংশ মানুষ সহ্য করে না। দ্বিতীয়। লিঙ্গ প্রথম লিঙ্গকে অনুকরণ করে করুক, কিন্তু প্রথম লিঙ্গের লিঙ্গাভিমান এমনই যে, দ্বিতীয় লিঙ্গের কিছু অনুকরণ করার মানে দাঁড় করায় প্রথম লিঙ্গের অপমান। মেয়েরা দিব্যি ছেলেদের মতো পোশাক পরছে, ব্যবসাবাণিজ্য করছে, ছেলেদের মতো মদগাঁজা খাচ্ছে, মোটরবাইক চালাচ্ছে, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়র, বিজ্ঞানী বৈমানিক হচ্ছে, নেতা মন্ত্রী হচ্ছে, অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করছে, মানুষ খুন করছে। আর, ওদিকে, ছেলেরা চোখে সামান্য একটু কাজল, ঠোঁটে একটুখানি লিপস্টিক আর মেয়েদের মতো জামা জুতো পরলেই সমাজের ভিত কেঁপে ওঠে।

মানুষ তার নিজের জীবনটা যাপন করবে, নাকি নিজের যৌন পরিচয়কে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করার যুদ্ধই করে যাবে সারা জীবন? নিজের যৌনপরিচয় দেবার ভার নিজের কাছে থাকলে উটকো অনেক ঝামেলা থেকে বাঁচে মানুষ। তুমি নিজেকে যে লিঙ্গের মানুষ বলে মনে করছে, কেউ মানুক বা না মানুক, সেটাই তোমার সত্যিকারের লিঙ্গ পরিচয় বা যৌন পরিচয়।

কোনও পুরুষ যদি বলে সে নারী, অথবা কোনও নারী যদি বলে সে পুরুষ অথবা কোনও নারী বা পুরুষ যদি বলে সে নারীও নয় পুরুষও নয়, পাগল সন্দেহ না করে তাকে বরং আমাদের বিশ্বাস করা উচিত। কারণ একমাত্র সেই মানুষটাই জানে সে কী। আমাদের সমাজ এখনও নারী আর পুরুষের ভাঙা-ভোঁতা সংজ্ঞা খাড়া করে। জোর গলায় বলে, যাদের শরীরে এক্স এক্স ক্রোমোজম, তারা কেউ পুরুষ হতে পারে, আর যাদের শরীরে এক্স ওয়াই, তারা কেউ নারী হতে পারে না! কেন হতে পারে, শুনি? নিশ্চয়ই হতে পারে। কোনও ক্রোমোজম আর কোনও জৈবলিঙ্গের ওপর মনোলিঙ্গ নির্ভর করে না। শরীরের বাহ্যিক বৈশিষ্টের ওপর নির্ভর করে না, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব, ডাক্তার বদ্যি তাকে কী লিঙ্গে চিহ্নিত করলো, তার ওপরও নির্ভর করে না। জেণ্ডার বা মনোলিঙ্গ সেক্স বা জৈবলিঙ্গের চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কেটে ছিঁড়ে মাড়িয়ে পুড়িয়ে গলিয়ে থেতলে আর যে লিঙ্গকেই দূর করা যাক, মনের লিঙ্গকে করা যায় না। জৈবলিঙ্গটা শরীর, মনোলিঙ্গটা আইডেনটিটি, প্রেজেনটেশন, সে এক্সপ্রেশন,ইন্টারপারসোনাল সম্পর্ক, সোশিয়-কালচারাল রোল।

কোনও মেয়ে তার নিজের শরীরের দিকে তাকালেই যদি দেখে শরীরটা অন্য কারো, শরীরটা অচেনা, অদ্ভুত, শরীরটা পুরুষের, যে শরীরটা তার শরীর হলেও তার শরীর নয়, শরীরটাকে নিজের বলে ভাবতে তার অস্বস্তি হয়, কষ্ট হয়, যন্ত্রণা হয়, এ শরীর তাকে শুধুই দুঃসহবাস দেয়, তবে কী করবে সে? গুমরে গুমরে একলা ঘরে কাঁদবে সারা জীবন? দরজা বন্ধ করে সকলের চোখের আড়ালে পুরুষের পোশাক খুলে নারীর পোশাক পরে চোরের মত নিজেকে দেখবে আয়নায়, বছরের পর বছর? বন্ধ দরজাটা খুললেই বা সত্য উচ্চারণ করলেই লোকের লাঞ্ছনা গঞ্জনা সইতে হবে তাকে। এ কার দোষ, তার, নকি যারা বাস্তবকে মেনে নেয় না, তাদের? এ তাদের দোষ, যারা প্রকৃতির এক রূপকে স্বীকার করে, আরেক রূপকে করে না, যারা মনে করে দুনিয়াতে সিসজেন্ডারই বা অরূপান্তরকামীরাই সত্য, ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরকামীরা নয়, যারা মনে করে নারী ও পুরুষের যৌনআকর্ষণই সঠিক যৌন আকর্ষণ, বাকি সব যৌন আকর্ষণ ভুল, মিথ্যে।

তুমি ট্রান্সজেণ্ডার, রূপান্তরকামী। তুমি লিঙ্গ পরিবর্তন করে এখন ট্রান্সসেক্সয়াল হয়েছো। তুমি সাজতে ভালোবাসো, গয়না পরতে ভালোবাসো, মেয়েদের পোশাক পরতে পছন্দ করো, পুরুষের সঙ্গে শুতে পছন্দ করো, তাই বলে কিন্তু তুমি লিঙ্গ পরিবর্তন করোনি। তুমি লিঙ্গ পরিবর্তন করেছো, কারণ তুমি মূলত নারী, তুমি তোমার মতো করে তোমার নারীত্বকে প্রকাশ করেছে। তোমার জোর নারীর, তোমার শরীরটা দেখতে আকাশ বাতাস হাতি ঘোড়া এক্স ওয়াই যা কিছুই হোক না কেন, তুমি মনে প্রাণে, অন্তরে বিশ্বাসে নারী। যৌনসম্পর্কের জন্য পুরুষকে পছন্দ না করে, তুমি কোনও মেয়েকেও পছন্দ করতে পারতে। সম্ভবত তুমি মনে মনে বিষমকামী বা হেটারোসেজুয়াল নারী বলেই পুরুষের প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করেছো। তুমি কিন্তু তোমার প্রেমিক পুরুষকে বিষমকামিতার সুখ দিতে নিজের লিঙ্গ বদলাওনি, তুমি লিঙ্গ বদলেছো কারণ তোমার ভয়ংকর যন্ত্রণা হচ্ছিল একটা পুরুষের শরীরকে বছরের পর বছর অকারণে বহন করতে, এ অনেকটা কাঁধে হিমালয় নিয়ে হাঁটার মতো। ভালুকের ছাল পরে প্রতিটা দিন যাপন করলে আমার ঠিক কেমন বোধ হবে, ভাবি। ট্রান্সজেণ্ডার বা রূপান্তরকামী মানুষদের বোধহয় ঠিক সেরকমই অসহ্য অস্বস্তি হয় আর ওই ওপরের আবরণটা খোলসটা ঝামেলাটা উপদ্রপটা খুলে ফেলতে তারা মরিয়া হয়ে ওঠে। লিঙ্গ-বদল সব ট্রান্সরা করে না। কেউ কেউ করে। করুক বা না করুক, করার অধিকার সবারই আছে। মানবাধিকার সবার জন্যই।

জীবন একটাই, এই একটা মাত্র জীবনকে যেমন ইচ্ছে যাপন করার অধিকার সবার। লিঙ্গ যারা অক্ষত রাখতে চায় রাখুক, যারা একে কেটে বাদ দিতে চায় দিক, যে লিঙ্গকে তাদের মন বা মস্তিষ্ক নিজের লিঙ্গ বলে বিশ্বাস করে- সেই লিঙ্গকে যদি শরীরে স্থাপন করতে চায় করুক। অনাকাঙ্ক্ষিত অবাঞ্ছিত লিঙ্গের বোঝা শরীরে বহন করে জীবনভর ভোগা থেকে বাঁচুক। নারীর শরীরটাকে পুরুষের শরীর করে ফেলা, অথবা পুরুষের শরীরকে নারীর করে ফেলা যদি সম্ভব হয় তবে করবে না কেন? আমার শরীর নিয়ে আমি যা খুশি করবো, এতে অন্যের আপত্তি হবে কেন? শরীরটা আমার নাকি অন্যের?

লিঙ্গান্তর করে যদিও একশ ভাগ পুরুষ বা একশ ভাগ নারী হওয়া যায় না, কিন্তু যতটুকুই হওয়া যায়, তাতে যদি সুখ পায় মানুষ, সুখ পাওয়ার অধিকার তাদের একশ ভাগ।

নাতালি নামে আমার এক বন্ধু এখন আপাদমস্তক মেয়ে। কদিন আগে তার গোটা শরীরটাই ছিল পুরুষের। তার মন তার শরীরকে কখনও মেনে নেয়নি। শুধু নারীর পোশাক পরে নাতালির নারী হওয়ার সাধ মেটেনি, লিঙ্গ বদলে ফেলে সে তার সাধ মিটিয়েছে। নিজের শরীর নিয়ে যা কিছু করার অধিকার তার আছে। কাউকে কৈফিয়তই বা দিতে হবে কেন সে কী করেছে বা যা করেছে কেন করেছে? নাতালিকে মেয়ে বলে না মানা মানে নাতালিকে অশ্রদ্ধা করা, নাতালির মানবাধিকার, ট্রান্সঅধিকার লঙ্ন করা। পুরুষাঙ্গ নিয়ে জন্মেছিল, সেই পুরুষাঙ্গটির কারণে লিঙ্গান্তরিত নাতালিকে এখন পুরুষ বলে সম্বোধন করলে তাকে ঘোরতর অপমান করা হয়। ওই কাজটা আমি অন্তত করিনি। তাকে মিস্টার এক্স বলিনি, মিস নাতালি বলেই ডেকেছি। যারা লিঙ্গ বদলে নিয়েছে শুধু তাদেরই কেন, শরীরে আস্ত একটি পুরুষাঙ্গ থাকা সত্ত্বেও যারা নিজেদের নারী বলে মনে করছে, বিশ্বাস করছে, তাদেরও নারী হিসেবেই সম্বোধন করা উচিত সবার।

পুংলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ অথবা পুরুষ ও নারী, এ নিয়েই যদি মানুষের দুনিয়াটা হত, তাহলে দুনিয়াটা নিতান্তই বেরসিক, বিদঘুঁটে আর বোরিং কিছু একটা হত। ভালো যে দুনিয়াটা বিচিত্র। ভালো যে দুনিয়াতে দুটো লিঙ্গের বাইরেও তৃতীয় লিঙ্গ আছে। উভলিঙ্গের কথাই ধরি না কেন, পুংলিঙ্গ আর স্ত্রীলিঙ্গ এক শরীরেই জড়াজড়ি করে থাকে। প্রকৃতি যদি সবাইকে নারী ও পুরুষ হিসেবে চাইতো, তাহলে উভলিঙ্গ বলে কিছু থাকতো না দুনিয়ায়।

প্রচুর মেয়ে ওয়াই ক্রোমোজম নিয়ে দিব্যি জীপন যাপন করছে। জিনটা পুরুষের, কিন্তু অ্যান্ড্রোজেন ইনসেনসিটিভিটি সিনড্রোম থাকার কারণে অ্যান্ড্রাজেন রিসেপটর কম, ফলে পুরুষ হরমোন বেরিয়ে যে ভ্রুণকে পুরোপুরি পুরুষের দ্রুণ করে গড়ে তুলবে, তা হয় না। কলকাতার পিংকি প্রামাণিক সম্ভবত এই সিনড্রামের শিকার। আবার ওদিকে অনেকে আছে, জিনটা মেয়েদের, কিন্তু কনজেনিটাল অ্যাডরেনাল হাইপারপ্লাসিয়া হওয়াতে মেয়েদের হরমোন জোটে না, সে কারণে তারা মেয়ে হয়েও ঠিক মেয়ে নয়।

নারীর যৌন আকর্ষণ পুরুষের জন্য, আর পুরুষের যৌন আকর্ষণ নারীর জন্য, এটাই ন্যাচারাল, বা প্রাকৃতিক, বাকি সব অপ্রাকৃতিক, প্রকৃতিবিরুদ্ধ–এরকম ভাবাটা সম্পূর্ণ ভুল। সমকামীর সংখ্যা দুনিয়াতে যে কম নয়, তা মানুষ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সব সমকামীকেই এক বাক্সে ফেলা যায় না। সমকামীরা যে সবাই একশভাগ সমকামী তা নয়। বাইজেণ্ডার বা উভকামীর সংখ্যাও প্রচুর। সব উভকামীও একশ ভাগ উভকামী নয়। পুরুষ আর নারীর প্রতি কোনও কোনও উভকামী একই রকম যৌন আকর্ষণ বোধ করে, কেউ কেউ আবার ভিন্ন রকম।

বিচিত্র সব কাম চারদিকে। কেউ কেউ বহুঁকামী বা পলিজেণ্ডার। কেউ আবার সর্বকামী বা প্যানজেণ্ডার। কেউ কিন্তু নিস্কামী। কোনওরকম কামের বালাই নেই। খাঁটি এজেণ্ডার বা জেন্ডার নিউট্রাল যাকে বলে। আবার জেণ্ডারকুইয়ারও আছে, যারা নিজেদের নারীও মনে করে না, পুরুষও মনে করে না, বা দুটোই মনে করে, দুটোতেই সাঁতার কাটে, তাদের যৌনপরিচয়-যৌনবোধ-যৌনতা সব একাকার হয়ে যায়। সব কামই, সব যৌন আচরণই–যত কম সংখ্যক লোকই সে আচরণ করুক না কেন–প্রাকৃতিক, যেহেতু প্রকৃতিতেই এই ঘটনাগুলো ঘটছে। বেশি সংখ্যক লোক যে আচরণটা করে, সেটাকেই ন্যাচারাল বা প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক বলে ধরা হয়। তা ধরলেও ভিন্নতাকে আর ভ্যারিয়শনকে স্বাভাবিক বলে না মানার কোনও যুক্তি নেই। সংখ্যালঘুরা প্রকৃতির বাইরের কোনও ঘটনা নয়।

প্রাণীজগতে মানুষ ছাড়াও শত শত প্রজাতির মধ্যে আছে বিচিত্র যৌনপ্রবৃত্তি; সমকামিতা, উভকামিতা, রূপান্তরকামিতা। সমকামিতা আগাগোড়া বাস্তব, এ কোনও ব্যতিক্রমী কাম নয়, বিকল্প যৌনতা নয়। সমকামিতা বিষমকামিতার বা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণের মতোই স্বাভাবিক। ভেড়া, শিম্পাঞ্জি, হাতি, জিরাফ, সিংহ, ডলফিন, পেঙ্গুইন, হাঁস ফাঁক পেলেই সমকামে মেতে ওঠে। মানুষের সবচেয়ে কাছের আত্মীয়, বনোবো, যাদের ডিএনএ-র সঙ্গে আমাদের ডিএনএ-র মিল শতকরা আটানব্বই ভাগ, ভীষণই উভকামী। প্রকৃতি শুধু প্রজনন করো, প্রজাতি টেকাও মন্ত্র জপে না। প্রকৃতি আরও অনেক কিছু করে। বিবর্তনের তত্ত্ব দিয়ে বিচার করলেও সমকামিরা সমাজে অপ্রয়োজনীয় নয়। যৌনতার একমাত্র উদ্দেশ্য বংশ বিস্তার করা নয়। সামাজিকতাও যৌনতার উদ্দেশ্য। বনোবোরা হাতের কাছে স্ব-প্রজাতির যাকেই পায়, তার সঙ্গেই যৌনসঙ্গম করে, এর ফলে পরস্পরের মধ্যে বন্ধুতা গড়ে ওঠে, একজনের বিপদে-বিপর্যয়ে আরেকজন দাঁড়ায়, সকলে মিলে নিজেদের প্রজাতিকে নির্মূল হওয়া থেকে বাঁচায়। যদি বংশ বিস্তারই প্রজাতির টিকে থাকার পেছনে একমাত্র পদ্ধতি হত, তাহলে পিঁপড়ে, মৌমাছি, বোলতাদের জগতে এত বন্ধ্যা সৈন্য থাকতো না, যাদের কাজ বংশ বিস্তার করা নয়, বরং প্রজাতিকে বাইরের শত্রু থেকে রক্ষা করা।

সমকামীদের এককালে মানসিক রোগী বলা হত। ভয়াবহ নির্যাতন করা হত সমকামীদের। সমকামকে জেনেটিক রোগও একসময় বলা হয়েছে, কিন্তু বিজ্ঞানীরা সাফ সাফ বলে দিয়েছেন, এ জেনেটিক ভেরিয়েশন বা জেনেটিক কারণ হতে পারে, জেনেটিক রোগ নয়। আর, সমকামিতা কোনও অ্যান্ড্রোজেন ইনসেনসিটিভিটি সিনড্রোম নয়, কোনও মানসিক রোগ তো নয়ই।

রূপান্তরকামীরা ভুগছে সব দেশেই। তবে সব রূপান্তরকামী বা ট্রান্সজেণ্ডারদের সমস্যা এক নয়। ট্রান্স মেয়েদের সমস্যা ট্রান্স পুরুষের সমস্যার চেয়ে অনেক বেশি। ট্রান্স মেয়েরা নারীবিদ্বেষ, নারীঘৃণা বা মিসেজিনির শিকার। সিস মেয়েরা মেয়ে হওয়ার অপরাধে জন্মের পর থেকে ঘৃণা, অবজ্ঞা, অবহেলা, হেনস্থা, উৎপাত, উপদ্রব, অত্যাচার, নির্যাতনের শিকার হয়, ট্রান্স মেয়েরা সেসব তো আছেই, আরও দ্বিগুণ লাঞ্ছনার শিকার হয়, কারণ পুরুষের মতো একটা উন্নততর লিঙ্গকে অস্বীকার করে নিম্নলিঙ্গ নারী বনতে যাওয়া যে নিতান্তই বোকামো, পাগলামো, আর ধৃষ্টতা — তা বিরতিহীন বিদ্রুপে লিঙ্গান্তরিত মেয়েদের জীবন জর্জরিত করে জানিয়ে দেয় পুরু্যতান্ত্রিক নারীবিদ্বেষীরা।

দুনিয়াতে দুষ্ট ধর্মান্ধরা যেমন অন্যের ওপর নিজের ধর্ম চাপিয়ে দিয়ে ঘোর অন্যায়। করে, দুষ্ট বিষমকামীরাও ঠিক তেমন অন্যকে বিষমকামী হওয়ার দায়িত্ব চাপিয়ে ঘোর অন্যায় করে। ধর্মান্ধরা ধর্ম-না-মানা মানুষদের আজ শত শত বছর ধরে অত্যাচার করছে, বিষমকামীরাও ঠিক তাই করছে, তাদের হেনস্থা করছে, যারা বিষমকামী বা হেটারোসেক্সয়াল নয়, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যাদের যৌন আকর্ষণ নেই। ধর্মীয় আর বিষমকামী সন্ত্রাসীদের ভয়ে আজ মানববাদী, নাস্তিক্যবাদী, সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামী, রূপান্তরিত, লিঙ্গান্তরিতরা সিঁটিয়ে থাকে।

বিবর্তনের ভূরি ভূরি প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বেশির ভাগ মানুষ বিবর্তনে না বিশ্বাস করে ভগবানে করছে, যে ভগবানের অস্তিত্বের আজও কোনও প্রমাণ মেলেনি। যুক্তি বুদ্ধির সমুদ্রে মানুষকে ডুবিয়ে রাখলেও মানুষ অনড় মুখতাকে আঁকড়ে ধরে থাকে। প্রকৃতি থেকে তুলে যত প্রমাণই চোখের সামনে রাখি না কেন, রূপান্তরকাম, সমকাম, উভকাম –কোনওটাই ন্যাচারাল নয়, এমন কথা বলবেই কিছু লোক। ধরা যাক, ন্যাচারাল নয়। তাতে কী? সবাইকে ন্যাচারাল হতেই বা হবে কেন, শুনি? ন্যাচারাল ব্যাপারগুলো বরাবরই বড় পানসে। ন্যাচারাল হওয়ার জন্য স্বাধীনতা বা অধিকারের দরকার হয় না, আন-ন্যাচারাল হওয়ার জন্য দরকার। আন-ন্যাচারাল হওয়ার জন্য বুকের পাটারও বেশ দরকার।

প্রকৃতিকে হাতিয়ার করে মুখ আর দুষ্ট লোকেরা কি আজ থেকে মানুষকে ভোগাচ্ছে। একসময় মেয়েদের লেখাপড়া করা, ঘরের বার হওয়া, চাকরি বাকরি করা, সব কিছুকেই এরা প্রকৃতি বিরুদ্ধ বলেছে। খুব বেশিদিন আগের কথা নয় এসব। প্রকৃতির কিছুই না জেনে প্রকৃতি বিশেষজ্ঞ সাজার লোক চারদিকে প্রচুর।

প্রকৃতি চিরকালই বিস্ময়কর, বৈচিত্রময়, বর্ণময়। যৌনতার মতো। আবার, আরও একটা প্রশ্নও এখানে করা যায়, কে বলেছে প্রকৃতির সবকিছু সবসময় ভালো এবং গ্রহণযোগ্য, কে বলেছে প্রকৃতিকে মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ? প্রকৃতিকে দিনরাত আমরা অস্বীকার করছি না? অস্বীকার করে নির্মাণ করছি না প্রকৃতি যা দিতে পারে, তার চেয়েও চমৎকার কিছু? পঙ্গু শিশু জন্ম নিলে তার পঙ্গুত্ব সারাচ্ছি, নকল হিপ লাগাচ্ছি, পা লাগাচ্ছি, ফুটো হৃদপিণ্ড নিয়ে জন্মাচ্ছে, নকল হৃদপিণ্ড অবধি লাগিয়ে নিচ্ছি। আমাদের স্মৃতিশক্তির দুর্বলতা সারাতে কাগজ-কলম-কম্পিউটার ব্যাবহার করছি। নানা যন্ত্রপাতির মাধ্যমে প্রকৃতির ভূল ভ্রান্তি, প্রকৃতির অপারগতা, অক্ষমতা, সীমাবদ্ধতা সংশোধন করছি প্রতিদিন, আমাদের ডানা নেই, বিমান বানিয়েছি ওড়ার জন্য, প্রকৃতি আমাদের যে চোখ দিয়েছে, তার ক্ষমতা যথেষ্ট নয়। বলে টেলেস্কোপ বানিয়েছি, মাইক্রোসকোপ ব্যবহার করছি।

সমাজে সম্মান নিয়ে বাঁচার অধিকার সব লিঙ্গের সমান। পুরুষ লিঙ্গের যেমন অধিকার, নারী লিঙ্গেরও একই অধিকার, উভলিঙ্গেরও একই। হেটারোসেক্সয়াল বা বিষমকামীদের অধিকার যতটুকু, সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামীদেরও ততটুকুই। এতে যাদের বিশ্বাস নেই, তাদের মানবাধিকারে বিশ্বাস নেই। যারা সমকামী আর রূপান্তরকামীদের নিগ্রহ করছে, যারা সিসজেণ্ডার আর বিষমকামী ছাড়া, অর্থাৎ পুংলিঙ্গের পুরুষ ও নারী লিঙ্গের নারী ছাড়া আর সবাইকে, পুরুষ আর নারীর কাম ছাড়া আর সব কামকে অস্বাভাবিক আর প্রকৃতিবিরুদ্ধ বলে ঘোষণা করছে তাদের শিক্ষিত করা, সচেতন করা, মানুষ করা অত্যন্ত জরুরি। আকাটমূখের সংখ্যা বেশি বলেই তাদের মূখামি মেনে নিতে হবে, গণতন্ত্রও বলে না। গণতন্ত্র সব মানুষের সমান অধিকারের কথা বলে। সমকামী বলে বা রূপান্তরকামী বলে যদি ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব হয়, অধিকার কিছু কম জোটে কোথাও, তবে তা নিতান্তই বিষমতন্ত্র, গণতন্ত্র নয়।

রূপান্তরকামীদের মানবাধিকার নিয়ে সংগ্রাম চলছে চারদিকে। ওরা চাইছে। নিজের জেণ্ডার নিজের নির্ণয়ের অধিকার এবং সেই জেণ্ডারকে জনসমক্ষে প্রকাশ করার অধিকার, রূপান্তরকামী বলে নিগৃহীত না হওয়ার অধিকার, নিজের জৈবলিঙ্গকে পরিবর্তন করার অধিকার, লিঙ্গ পরিবর্তনের জন্য চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার, মানসিক রোগী হিসেবে চিহ্নিত না হওয়ার অধিকার, যৌনসঙ্গমের অধিকার, বিয়ে করার অধিকার, সন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকার। যে সমাজে আজও নারীকে নারী হয়ে জন্ম নেওয়ার অপরাধে লাঞ্ছিত হতে হয়, সে সমাজে সমকামী আর রূপান্তরকামীদের অধিকারের জন্য আরও দীর্ঘ দীর্ঘকাল সংগ্রাম করতে হবে, অনুমান করতে পারি। মানুষ প্রজাতি সেদিন সত্যিকার সভ্য হবে, যেদিন কোনও মানুষকেই নিজের মৌলিক অধিকারের জন্য আর লড়াই করতে হবে না।

সমকামী আর রূপান্তরকামীদের মানবাধিকার যেন লজ্বন না হয়, তা লক্ষ রাখার দায়িত্ব সমকামী আর রূপান্তরকামীদেরই শুধু নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ বিষমকামীদেরও। মানবতার জন্য সব মানুষকেই এগিয়ে আসতে হয়। সবাই যদি এগিয়ে নাও আসে, তাহলেও ক্ষতি নেই। লক্ষ লক্ষ লোক দল বেঁধে সমাজ বদলায় না। ইতিহাস বলে, হাতে গোণা কিছু সাহসী আর স্বপ্নবান মানুষই সমাজ বদলায়। একবিংশ শতাব্দি চলছে। মানুষ আর কবে সভ্য হবে? মাঝে মাঝে মনে হয়, এখনও বুঝি গুহায় বাস করছে মানুষ। হাজার বছর ধরে খেটে খুটে যা একখানা সমাজ বানিয়েছে, মুখতার জাঁকালো উৎসবই চলে প্রতিদিন। সমাজের চেহারা চরিত্র দেখলে মনে হয়, এগুলো আর কিছু নয়, এক একটা অন্ধকার গুহা। মানুষগুলো চোখ কান বন্ধ করে অন্ধকারে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। গুহা থেকে বেরোচ্ছে না, চোখে আলো লাগবে এই ভয়ে আলোর দিকেও তাকাচ্ছে না।

সন্ত্রাসের দুনিয়া

আমরা সন্ত্রাসের পৃথিবীতে বাস করছি। সন্ত্রাস চিরকালই অল্পবিস্তর ছিল। আমরা রাষ্ট্রীয়-সন্ত্রাস দেখেছি, দলীয়-সন্ত্রাস দেখেছি, ব্যক্তি-সন্ত্রাস দেখেছি। কিন্তু বিশ্ব জুড়ে ধর্মীয় সন্ত্রাস ঠিক এভাবে দেখিনি। এই সন্ত্রাস শেষ অবধি কোথায় গিয়ে শেষ হয়, অনুমানও করাও সম্ভব নয়। ধর্মের নামে মানুষ খুন করা হচ্ছে চারদিকে। এর ফলে কী হচ্ছে? ইউরোপের দেশগুলোতে, বিশেষ করে ফ্রান্সে, মুসলিম বিরোধী হয়ে উঠছে মানুষ। আমেরিকাতেও একই চিত্র। কথা ছিল দশ হাজার সিরিয়ার শরণার্থীকে আমেরিকা নেবে। এখন সেখানকার নাগরিকরা সাফ সাফ বলে দিচ্ছে, সিরিয়ার কোনও শরণার্থীকে তারা তাদের দেশে দেখতে চায় না। শরণার্থীর ভিড়ে জঙ্গীরা মিশে গেছে। প্যারিসের জঙ্গী হামলায় সিরিয়ার এক আইসিস সদস্য ছিল, যে কিনা শরণার্থী হয়ে সিরিয়া থেকে ইউরোপে ঢুকেছে। এসব খবর জানাজানি হওয়ার পর কী ভরসায় তাদের আশ্রয় দেওয়ার পক্ষে কথা বলবে আমেরিকার সাধারণ মানুষ!

আজ ফ্রান্সের আবালবৃদ্ধবনিতা লা মারসিয়েজ গাইছে। এই গান ভায়োলেন্সের গান। গানের কথাগুলো যে কোনও সভ্য মানুষকেই অস্বস্তি দেবে। অপবিত্র রক্তে দেশ ধুয়ে দেবো..– এটি যে কোনও কারণেই হোক, ফ্রান্সের জাতীয় সঙ্গীত। এটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে অনেকেই অবশ্য পছন্দ করে না। এই জাতীয় সঙ্গীত কট্টর ডানপন্থীদের পছন্দ হলেও বামপন্থীরা প্রায়ই এর সমালোচনা করেছে। কিন্তু এখন সকলে মিলে এই সঙ্গীতটি গাইছে। এটি এখন ফ্রান্সকে এক করার লক্ষ্যে গাওয়া হচ্ছে। এই ভায়োলেন্সের গানটি এত গাওয়ার পর, আমি জানি না, শেষ অবধি ফরাসিরা শান্তির গান গাইতে আগ্রহী হবে কি না।

প্যারিসের জঙ্গি হামলার নীল নকশা এঁকেছে আবদেল হামিদ আবাউদ। বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসের মোলেনবিক এলাকায় মরক্কো থেকে আসা মধ্যবিত্ত ইমিগ্রান্ট পরিবারে তার জন্ম। পড়াশোনা করেছে ব্ৰাসলসের নামিদামি ইস্কুল কলেজে। কিন্তু একসময় দুষ্টচিন্তা ঢোকে মস্তিষ্কে। কলেজ ছেড়ে দিয়ে আবদেল হামিদ ড্রাগ ডিলারদের সঙ্গে চলাফেরা শুরু করে, ছোট ছোট ক্রাইম করতেও অভ্যস্ত হয়ে। পড়ে। এসব কারণে জেলও খেটেছে কয়েক বছর আগে। আবদেল হামিদ সালাফি ইসলামের আদর্শে গড়ে ওঠা কেউ নয়। দারুল ইসলামের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত কোরান হাদিস ঠোঁটস্থ করে রাখা, নামাজ রোজা করা কোনও সাচ্চা মুসলমান নয়। সিরিয়ায় গিয়ে মানুষ-মারার ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। প্রতিবেশী সালাহ আবদেসসালাম এবং আরও কিছু ইমিগ্রেন্ট পরিবারের বীতশ্রদ্ধ ফরাসিভাষী মুসলমান নিয়ে সে প্যারিসে হামলা করার পরিকল্পনা করে। দলে সিরিয়ার এক আইসিস সদস্য ছিল, যে কিনা সিরিয়ার শরণার্থী দলে মিশে গিয়ে ইউরোপে ঢুকেছে। স্টেডিয়ামের বাইরে প্রথম আত্মঘাতি বোমা বিস্ফোরণটি সেই ঘটিয়েছে। হামলায় আবদেল হামিদের জঙ্গী বন্ধুরা মোটামুটি সাকসেসফুল। ১২৯ জন মানুষকে হত্যা করা কম কথা নয়। আবদেল হামিদের রাগ আমেরিকা আর ইউরোপের ওপর, মুসলমানের রক্তে দুনিয়া ভেজাচ্ছে ওরা, এখন ওদের রক্তের হোলি খেলতে হবে। মূলত ঘৃণা আর রাগ থেকেই নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো। আইসিস লিডার আবু মোহাম্মদ আল আদনানি অথবা আল বাগদাদির অনুমতি নিয়েই সম্ভবত হত্যাকাণ্ডের নীল নকশা এঁকেছিল আবদেল হামিদ। অনুমতি না নিলেও প্যারিসের টেরর অ্যাটাকের দায় আইসিস দল নিজের ঘাড়েই তুলে নিয়েছে। সব হত্যাকাণ্ড অবশ্যই ইসলামের নামে। আবদেল হামিদের পরিবারের লোকরা চায় আবদেল হামিদ মরে যাক। সে তার নিজের ছোট ভাই ইউনেসকে আইসিসে ঢুকিয়েছিল, তার বাবা ওমর তখন আবদেল হামিদের বিরুদ্ধে পুলিশে রিপোর্ট করেছিল। এই জঙ্গী ছেলে মরে গেলে পরিবার জানিয়ে দিয়েছে, তারা অখুশি নয়, বরং খুশিই হবে।

আবদেল হামিদকে এখন পুলিশ খুঁজে চলেছে। নিশ্চয়ই পেয়েও যাবে একদিন। ওর পরিণতি আমরা কিছুটা হলেও অনুমান করতে পারি। কেন মানুষ জেনে বুঝে জঙ্গীদলে যোগ দেয়? এই প্রশ্নটি অনেকে করে। কী আকর্ষণ এই আইসিসের। সোজা সরল উত্তর, ইসলামি খেলাফতের ঘোষণা দিয়েছে বলে। টাকা পয়সা অঢেল আছে বলে। এই আইসিস আলকায়দা থেকে বেরিয়ে আসা একটি দল। আইসিস ছোট ক্রাইম করবে, আল কায়দা নাইন ইলেভেনের মতো বড় কিছু। এরকম একটা অলিখিত চুক্তি সম্ভবত আছে। আমেরিকার ভয় আলকায়দাকে নিয়ে, আইসিসকে নিয়ে ততটা উদ্বিগ্ন নয় আমেরিকা। আইসিসকে একরকম গড়েছে তারা, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদকে হটানোর জন্য। অবশ্য আইসিস যে শেষ অবধি এমন ভয়ংকর ফ্রাংকেনস্টাইন হয়ে উঠবে, তা আমেরিকার কল্পনাতেও আসেনি। তালিবানকেও একসময় রাশিয়ার বিরুদ্ধে শক্তি হিসেবে গড়েছিল, সেও ফ্রাংকেনস্টাইন হয়েছে। আর কত সন্ত্রাসী দল জন্ম দেবে আমেরিকা! ইরাকে যুদ্ধটি না করলে ইরাকী আল কায়দার জন্ম হতো না, আইসিসেরও হয়তো জন্ম হতো না। আজ আইসিসকে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুটিন বললেন, চল্লিশটি দেশ আর্থিক সাহায্য দিচ্ছে। চল্লিশটি দেশের মধ্যে, অনুমান করছি, বেশির ভাগই মধ্যপ্রাচ্যের দেশ।

কেবল সন্ত্রাসীদের হত্যা করে সন্ত্রাস বন্ধ হবে না। গোড়া থেকে সন্ত্রাস উপড়ে ফেলার সময় এসেছে। যতদিন সন্ত্রাসের সূতিকাগারগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস না হচ্ছে, ততদিন সন্ত্রাস চলবেই। ততদিন আমরা পৃথিবীর আনাচে কানাচে অপঘাতে মরবো। কোনও দেশ আর নিরাপদ নয়। সন্ত্রাসীদের হাতে এখন একবিংশ শতাব্দীর অস্ত্র, মস্তিষ্কে সপ্তম শতাব্দীর অজ্ঞানতা।

মাঝে মাঝে ভাবি, আমেরিকা যদি আইসিসকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য না করতো, খুন করার ট্রেনিং না দিতো, তাহলে কি ওরা খুন করতো না? হয়তো করতো। বাংলাদেশে যারা মুক্তচিন্তক ব্লগার-লেখক-প্রকাশকদের খুন করছে, তাদের তো আমেরিকা খুন করতে শেখাচ্ছে না? চাপাতির সাপ্লাই তো আমেরিকা থেকে আসছে না। খুনীরা শরিয়া আইন অনুযায়ী পাথর ছুঁড়ে মেয়েদের হত্যা করে, ওই পাথর ইউরোপ, ইজরাইল বা আমেরিকা থেকে আসে না। সুইসাইড ভেস্টগুলোও নিশ্চয়ই আসে না। ওসব লোকাল। বাংলাদেশেও জঙ্গী ট্রেনিং চলছে। আমেরিকার সাহায্য ছাড়াই চলছে।

শুধু অন্যকে দোষ দিয়ে বসে থাকলে সমস্যার সমাধান কিছু হবে না। নিজেদের দোষও দেখতে হবে। দেখতে হবে আমাদের কিছু কিছু মসজিদ মাদ্রাসায় কী শেখানো হচ্ছে, ওয়াজে বা খুৎবায় কী বলা হচ্ছে। অমুসলিমদের এবং অবিশ্বাসীদের ঘৃণা করার কথা বলা হচ্ছে কি না, ওদের খুন করার কথা বলা হচ্ছে কি না। আজ যারা প্রগতিশীল লেখকদের কোপাচ্ছে, কাল তারা মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীদের কোপালে অবাক হওয়ার কিছু কিন্তু নেই। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যারা অশুভশক্তিকে প্রশ্রয় দেয়, অশুভশক্তিই একদিন তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। ইতিহাস তা ই বলে।

প্যারিস হামলার পরপরই ফ্রান্সের গোয়েন্দারা পেয়ে গেছে সবগুলো সন্ত্রাসীর নাম ধাম চেয়ারা চরিত্র। সন্ত্রাসীদের হাড়ি নক্ষত্রের খোঁজ পেতে পশ্চিমের দেশগুলোর খুব বেশি সময়ের দরকার হয় না। কেবল আমারাই অদক্ষ লোক। আজও আমরা জানি না কে দাভোলকার, পানসারে, কালবুর্গির হত্যাকারী, কে হত্যা করেছে অভিজিৎ রায়কে, অনন্ত বিজয় দাশকে, ওয়াশিকুর বাবুকে, নিলয় নীলকে, ফায়সাল আরেফীন দীপনকে।

সুমন

সুমন চট্টোপাধ্যায় আজ এই সময় পত্রিকায় উপসম্পাদকীয় লিখেছেন, যেটির খানিকটা চূর্ণীর ছবি নির্বাসিত নিয়ে। আমি তো প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না সুমন এই কাজটা করেছেন, লিখেছেন। কারণ নির্বাসিতয় তো আড়ালে হলেও আমি আছি। আমি মানুষটা, যতদূর জানি, এই সময়ে একরকম নিষিদ্ধ। ইদানীং যে দুএকটি লেখা আমি এই সময়ে লিখেছি, তা আমাকে অন্য কেউ অনুরোধ করেছেন লিখতে, সুমন নন। সুমন তখন ছুটিতে ছিলেন। আমার লেখা বই প্রতিবছর প্রতিটি পত্রিকায় পাঠানো হয়, এই সময়েও হয়, প্রকাশক পাঠান। কিন্তু আজ বারো বছর হলো সেসব বইয়ের কোনও রিভিউ কোথাও ছাপানো হয় না। নির্বাসন নামের বইটিও পাঠানো হয়েছিল, যেখানে বর্ণনা করেছি কী করে কলকাতা থেকে, এবং শেষ অবধি ভারতবর্ষ থেকে আমাকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। ওই বইটির সবটাই ফ্যাক্টস। সুমন বইটির রিভিউ করেননি বা কাউকে করতেও দেননি। কিন্তু এখন নির্বাসিতর প্রশংসা করছেন, যে ছবিটায় আছে আমাকে কলকাতা থেকে বের করার কাহিনী, যে কাহিনীর বেশির ভাগটাই ফিকশান। ফিকশানটা অতি সাবধানে করা, তাই ফিকশানটা কোনও হরর স্টোরি হয়ে ওঠেনি। ফ্যাক্টস কিন্তু ভয়ংকর।

সুমন লিখেছেন, দুঃখ করেই লিখেছেন, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আমাকে ভুলে গেছে। ভুলে যদি যায়, তার জন্য দায়ি কিন্তু সাধারণ মানুষ নয়, দায়ি মিডিয়া। আমি, সাদা কথায়, পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়ার বয়কটের শিকার। আমার কিন্তু মনে হয় না, সাধারণ মানুষ আমাকে পুরোপুরিই ভুলে গেছে। এখনও মানুষ আমার বই কেনে। তবে মিডিয়া চেষ্টা করছে মানুষের মন থেকে আমাকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলতে। এই যে নারীবাদ নিয়ে এত লেখা তিনি ছাপাচ্ছেন তাঁর পত্রিকায়, যাঁরা লিখছেন, তাঁদের অনেকেই দুদশকেরও বেশি আগে বলা আমার কথাগুলোরই পুনরাবৃত্তি করছেন। সুমন কিন্তু তারপরও আমার মত প্রকাশ করার কোনও সুযোগ আমাকে দেবেন না। সম্ভবত বলবেন, আমি বড় বাড়াবাড়ি করি। সুমন বাংলার মানুষকে বলেছেন আমাকে রাজ্য থেকে তাড়ানোর দৃশ্য দেখেও যারা মুখ বুজে ছিল, তারা যেন তাদের সেই মুখ বুজে থাকার লজ্জাটি নির্বাসিত দেখে মোচন করে। ছবিটা দেখলেই কি লজ্জামোচন হবে? সুমন কি আমার লেখা তাঁর এই সময়ে নিয়মিত ছাপিয়ে লজ্জামোচন করার কথা ভাবতে পারেন না?

আচ্ছা, স্বৈরতান্ত্রিক বুদ্ধদেব আমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বের করে দিয়েছিলেন, তারপর তো একটি মা মাটি মানুষএর গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এলো, সেই মমতাময় সরকারও কেন আমাকে পশ্চিমবঙ্গে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিলো না, সে ব্যাপারে সুমন একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না কেন? এই প্রশ্নটি একটি বড় প্রশ্ন। যাঁরা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে আমাকে কী করে খুঁটি বানানো হচ্ছে জানেন, তাঁরা জানেন আমাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য একটি সংগঠিত ষড়যন্ত্র পশ্চিমবঙ্গে অনেককাল ধরেই চলছে।

বাংলা স্টেটসম্যান পত্রিকায় আমি প্রতি সপ্তাহে কলাম লিখতাম। রাজ্য ছাড়া হওয়ার পর সেটি বন্ধ করে দেওয়া হল। প্রায়ই আনন্দবাজার আর প্রতিদিনে লিখতাম। সেগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রবিবাসরীয়তে হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়েছে কিছু, সে চন্দ্ৰিলের কারণে। দেশ পত্রিকায় মাঝে মাঝেই লিখতে বলা হতো, সেই পত্রিকায় তো লেখা বন্ধ করা হয়েছেই, এখন ধারাবাহিক ভাবে কুৎসা রটানো হচ্ছে। ঋতুপর্ণ ঘোষ রোববারের জন্য আমি প্রতি সপ্তাহে কলাম লিখবো এ কথা সম্পাদকীয়তে সগর্বে ঘোষণা করেও লেখা ছাপাতে পারেননি। একটি লেখা ছাপানোর পরই আমার লেখা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। বইয়ের দেশ পত্রিকায় কী কী বই বেরোলো তার খবর ছাপা হয়, হাবিজাবি নানা বইয়ের খবরই থাকে, সযত্নে বাদ দেওয়া হয় আমার বই বেরোনোর খবর।

ইংরেজি সাহিত্যের কিছু বিখ্যাত লেখকের নাম উল্লেখ করে সুমন লিখেছেন, আমি ধারে আর ভারে ওদের সমকক্ষ নই। তা নিশ্চয়ই নই। কিন্তু ধার কম হওয়ার পরও আমাকে দেশ এবং রাজ্য থেকে তাড়ানো হয় কেন, সেটা বুঝি না। ভার কম হওয়ার পরও আমার ভার কোনও বাংলাই বইতে পারে না কেন, সেটাও বোধগম্য নয়। যে বইগুলো আমি এ যাবৎ লিখেছি, যে চল্লিশটি বই, সে বইগুলোই যদি বাংলায় না লিখে ইংরেজি ভাষায় লিখতাম, সবই হয়তো অন্যরকম হতো। আর যে বাঙালিরা ইংরেজি ভাষায় লিখে বিখ্যাত হয়েছেন, তাঁরা ইংরেজি ভাষায় না লিখে তাঁদের বইগুলোই বাংলা ভাষায় লিখলে কেউ হয়তো পুছতোও না। সুমনও পুছতেন কি না সন্দেহ।

সৌদি আরবে সেক্স শপ

দুতিন দিন আগে আরব দেশে একটা খবর বেরিয়েছে, সৌদি আরবে সেক্স শপ শুরু হচ্ছে। হাবিজাবি সেক্স শপ নয়, হালাল সেক্স শপ। সেক্স শপ হালাল কখন হয়, আর হারাম কখন হয়, তা আমার জানা নেই। আমার এও খুব জানার ইচ্ছে, সেক্স শপে গিয়ে একা একটা মেয়ে তার ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কিছু কিনতে পারবে কিনা। যে দেশে মেয়েদের ন্যূনতম ব্যক্তি স্বাধীনতা নেই, যে দেশে পুরুষের যৌনদাসী ছাড়া আর কোনও পরিচয় নেই মেয়েদের, সে দেশে সেক্স শপ শুধু পুরুষের যৌন আনন্দের জন্য খোলা হবে, এ নিয়ে নিশ্চয়ই কারও কোনও সংশয় নেই।

সৌদি পুরুষদের হাতে অঢেল টাকা। যত খুশি বিয়ে করতে পারে তারা, কলগার্ল বা দামি পতিতা পেতে দেশের বাইরেও অনেকে সেক্স ট্যুরে যায়, সেক্স শপগুলোতেও ঘুরে বেড়ায়। এখন থেকে কষ্ট করে এর জন্য আর বিদেশ ভ্রমণ করতে হবে না। হাতের নাগালে চলে আসছে সেক্স শপ। যৌন সুখ পেতে এরা শুনেছি চীনদেশ পর্যন্ত যেতে পারে। সৌদি পুরুষদের দেখেছি মেয়েদের দিয়ে অশ্লীল নাচ নাচায় আর শরীরে টাকা ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারে। এসব ভিডিও এখন ইউটিউবেই বিস্তর আছে।

বার্লিনে বিয়াটে উসের সেক্স মিউজিয়াম দেখেছিলাম আজ প্রায় কুড়ি বছর আগে, সে-ই আমার প্রথম কোনও সেক্স মিউজিয়াম দেখা। তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলাম। এরকমও যে কিছু জিনিস হতে পারে, আমার কল্পনার মধ্যেও ছিল না। এখন, ইওরোপ আমেরিকা থেকে সেক্স শপ এশিয়ার প্রগতিশীল দেশগুলোয় এলোনা, লাফ দিয়ে চলে গেলো পৃথিবীর সবচেয়ে রক্ষণশীল দেশে, যেখানে চলমান যৌনাঙ্গ ছাড়া আর কিছু হিসেবে মেয়েদের দেখা হয় না। বিয়াটে উসে সৌদি আরবের পুরুষদের জন্য সেক্স শপ খুলছেন শীঘ্রই।

সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহর ছিল তিরিশটা স্ত্রী। তিরিশ স্ত্রীর এক স্ত্রী আলানোদ আল ফায়াজকে তালাক দিয়েছিলেন আবদুল্লাহ। আলানোদের চার কন্যা প্রাসাদে বন্দি। জাওহার, মাহা, সাহার, আর হালা আক্ষরিক অর্থে বন্দি। তাদের কোনও স্বাধীনতা নেই প্রাসাদের বাইরে পা ফেলার। তাদের দুবেলা খাবারও দেওয়া হয় না, সৎ ভাইগুলো বেধড়ক পেটায়, কারও কারও চল্লিশ পার হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও অবিবাহিত। বিয়েটুকু করারও অধিকার নেই। এদের মা আলানোদ বিলেতে থাকেন, দুনিয়ার মিডিয়াকে জানিয়েছেন চারটে মেয়ের দুর্দশার খবর। এতে লাভ কিছু হয়নি। আমেরিকার সরকারই যদি সৌদি আরবের বাদশার সামনে মাথা নুইয়ে চলে, আর কারও কী শক্তি আছে প্রতিবাদ করার! এই সেদিন ওবামা তাঁর স্ত্রী নিয়ে ঘুরে এলেন। একবারও কি বলেছেন ওই চার বন্দী মেয়ের শেকল খুলে দিতে!

এই হচ্ছে সৌদি আরব, যা তার প্রাণে চায় তাই সে করবে। সৌদি মেয়েদের আজ বোরখা ছাড়া ঘরের বাইরে বেরোতে দিচ্ছে না। মেয়েরা কথা বলতে পারছে না। পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলা হারাম, তাদের সঙ্গে গাড়িতে চড়া হারাম। পুরুষ দ্বারা ধর্ষিত হয়, আবার সে কারণে কঠিন শাস্তিও পায় তারা। সপ্তম শতাব্দীর আইন চলছে এই একবিংশ শতাব্দীর সৌদি আরবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। রাইফ বাদাভিকে আজও চাবুক মারা হচ্ছে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতো বলে। কোনওরকম আধুনিকতা আর সভ্যতার তোয়াক্কা না করে দিব্যি আছে সৌদি আরব। বিশ্বের দেশগুলোকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে। গরিব মুসলিম দেশগুলোতে পাচার করছে মৌলবাদ। চরিত্রহীন, নীতিহীন দেশটিকে শিক্ষা দেওয়ার ইচ্ছে কোনও চরম নীতিবান দেশেরও নেই।

সৌদি পুরুষের কী সেবা করতে পারে সেক্স শপ! সেক্স শপের লেদার, চাবুক, শেকল, মাস্ক ইত্যাদি এখন দেদার ব্যবহার করবে পুরুষরা। মেয়েদের বাধ্য করবে সাব-ডোম রোল প্লে করতে। শুরু হবে মেয়েদের ওপর আরেক রকম যৌন অত্যাচার। কিন্তু মুখ বুজে সবই সইতে হবে তাদের।

সুখটা পুরুষের জন্যই। মেয়েরা সত্যিকার কোনও যৌন সুখ পাবে না। মৌলিক অধিকারই যাদের নেই, তাদের আবার যৌন-অধিকার কী! যৌন অধিকার বা যৌন স্বাধীনতা যাদের নেই, তাদের যৌন সুখও নেই। যৌনদাসীরা যৌন সুখ উপভোগ করে না। বন্দিকে প্রথম মুক্তি দিতে হয়।

মেয়েরা নিজের জীবনটা উৎসর্গ করে গেলো পুরুষদের নানা কিসিমের সুখের জন্য। জানি না কবে রুখে দাঁড়াবে সচেতন সৌদি নারী-পুরুষ। সময় যে চলে যায়।

সৌদি আরবের কীর্তিকলাপ

১. সৌদি আরবের স্বাস্থ্য মন্ত্রী খালিদ আল-ফালিহ বলেছেন, মিনায় পদদলিত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা আল্লার ইচ্ছেয় ঘটেছে। এ ধরনের দুর্ঘটনাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না, এ তাঁর মত। তেরোশ হাজির মৃত্যুর জন্য হাজিদেরই দায়ী করেন খালিদ আল-ফালিহ। হাজিরা নাকি হজ্বের নিয়ম অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে মরেছেন। আসল ঘটনা যা শোনা যাচ্ছে, তা ভয়াবহ। এক সৌদি প্রিন্সের প্রাসাদে যাওয়ার পথ সুগম করতে দুটো রাস্তা, লক্ষ লক্ষ হাজিদের সাধারণত যে দুটো রাস্তা ব্যবহার করতে হয়, বন্ধ করে দেওয়া হয়, সে কারণেই এ প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। রাস্তা বন্ধ না করলে এ ঘটনা ঘটতো না। অনেকে বলছে, হাজিদের বিপরীতমুখী দুটি স্রোত পরস্পরকে অতিক্রম করার সময় দুর্ঘটনাটি ঘটে। যুক্রাজ্যের ওমরা হজ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের মোহাম্মদ জাফরি অবশ্য বলেছেন, এ দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বাদশাহ, তাঁর প্রাসাদ প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও গাল্ফ কো অপারেশন কাউন্সিলের সদস্যসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল, এ কারণে দুটো রাস্তা তারা বন্ধ করে দিয়েছিলো, ওই দুটো রাস্তাই শয়তানের উদ্দেশে পাথর নিক্ষেপ করার জায়গায় যাওয়ার রাস্তা। রাস্তা বন্ধ থাকার কারণেই ভিড় আর জটলার সৃষ্টি হয়। ভিড় আর জটলার কারণেই পদদলনের ঘটনা ঘটে।

এসব খবর থেকে যা অনুমান করতে পারি, তা হলো, এতগুলো হাজিকে প্রাণ দিতে হলো তার কারণ, ১. সৌদি রাজপরিবারের খামখেয়ালি ২. সৌদি রাজপরিবার হজুকে মোটেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভাবে না। ৩. হাজিদের প্রাণের মূল্য আছে বলে মনে করে না।

সৌদি আরব প্রতিবছর ৮.৫ বিলিয়ন ডলার পায় শুধু হজ্ব থেকেই। অথচ হাজিদের নিরাপত্তার দিকে দৃষ্টি নেই। হাজিরা নিতান্তই সৌদিদের ধর্ম ব্যবসার খদ্দের। তেল থেকে যেহেতু বেশি টাকা আসে, তাই তেল ব্যবসার খদ্দেরদের সৌদি আরব বেশি খাতির করে, তাদের নিরাপত্তার দিকেও কড়া নজর তাদের।

জাফরি বলেছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রীর আল্লাহকে দোষ দেওয়াটা ঠিক হয়নি। প্রতিটি দুর্যোগের সময় সৌদি সরকার বলে, আল্লাহর ইচ্ছায় ঘটেছে। এটি আল্লাহর ইচ্ছায় নয়, এই মানুষের হেঁয়ালির কারণে ঘটেছে।

এবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ২০ লাখের বেশি মানুষ মক্কায় হজ্ব পালন করতে গেছেন।এক বাংলাদেশ থেকেই নাকি এক লক্ষেরও বেশি।

২. মোহন কুমার মণ্ডল আমার ফেসবুক বন্ধু। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে কারণ সে নিজের মত প্রকাশ করেছিল ফেসবুকে, যে মতটি বাংলাদেশ সরকারের পছন্দ হয়নি। সৌদি আরব যেভাবে রাস্তা বন্ধ করে হাজারো মুসলমানকে খুন করেছে, তা এতই নৃশংস আর হৃদয়বিদারক যে মোহন কুমার মুসলমান না হয়েও মুসলমানের গণহত্যার প্রতিবাদ করেছে। শয়তানকে মারা যদি প্রতীকী ব্যাপার হয়ে থাকে, তবে সেই প্রতীকী ব্যাপারটি নিজের দেশেই ঘটাতে পারে। ওটির জন্য অত দুর সৌদিতে যাওয়ার কোনও দরকার পড়ে না। মোহন এমনই বলেছিল। এতে নাকি আওয়ামী লীগের কোন লোকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে।

ধর্মীয় অনুভূতিকে এমন একটা ভয়ংকর অস্ত্র হিসেবে ব্যাবহার করছে দেশের খারাপ লোকগুলো যে, কোনও ভালো লোককে তারা আর বাঁচতে দিতে চাইছে না। খারাপ লোকের মিছিলে যোগ দিয়েছে দেশের সরকারও।

সারা পৃথিবী সৌদি আরবের নিন্দে করছে। কিন্তু বাংলাদেশ করছে না। বরং কেউ সৌদি সরকারের বর্বরতার প্রতিবাদ করলে তাকেই শাস্তি দিচ্ছে। শত শত হাজির মৃতদেহ কী করে বুলডোজার দিয়ে আবর্জনার স্তূপে ফেলা হয়েছে দেখলে গা শিউরে ওঠে। কোনও সভ্য দেশ কি এই আচরণ করতো!

সৌদি আরব সভ্য দেশ নয়। বাংলাদেশও সভ্য দেশ নয়। তাই বাংলাদেশেও সৌদির অসভ্যতা নিয়ে প্রতিবাদ নেই। গাঁজায় ইহুদিদের বুলডোজারে মুসলমান মরলে। বাংলাদেশের মুসলমান উন্মাদ হয়ে ওঠে। কিন্তু আইসিস, বোকো হারাম, আল শাবাবরা হাজারো মুসলমান হত্যা করলেও মুসলমানদের রাগ হয় না। সৌদি আরবের অব্যবস্থার কারণে হজ্ব করতে আসা শত শত মুসলমানের মৃত্যু হলেও তারা রাশব্দ করে না। এই হলো মুসলমানের চরিত্র।

হজ্ব করতে গিয়ে পদদলিত হয়ে ১৩০০ হাজির করুণ মৃত্যুর প্রতিবাদ অনেকে করছেন বাংলাদেশে, কিন্তু সবাইকে বাদ দিয়ে মোহন কুমারকে গ্রেফতার করা হলো কেন? মোহন কুমার হিন্দু বলে? হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করলে অধিকাংশ মুসলমান চুপচাপ মেনে নেয় বলে?

৩. জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কাউন্সিল প্যানেলের প্রধান হতে যাচ্ছে আমাদের সৌদি আরব। এ কী করে সম্ভব। সৌদি আরব– যে দেশে মেয়েদের, অমুসলিমদের, সমকামীদের, রূপান্তরকামীদের কোনও মানবাধিকার নেই, সেই দেশকে কী করে মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রধান নির্বাচন করে জাতিসংঘ?

এর প্রতিবাদ কি কেউ করবে না? আমরা যারা প্রতিবাদ করি, আমাদের শাস্তি পেতে হয়। যতক্ষণ মুখ বুজে থাকি, ততক্ষণ সব ঠিকঠাক। মুখ খুললেই বিপদ। সৌদি আরব অন্যায় করলেও অন্যায় করেছে বলা যাবে না। মানবাধিকার লংঘন করলেও সৌদি আরব মানবাধিকার লংঘন করেছে, এ কথা বলা যাবে না। চীন দেশ মানবাধিকার লংঘন করেছে বলে রাস্তায় নেমে মিছিল করাটা সহজ। সৌদি আরবে ইসলামের পয়গম্বরের মুহাম্মদ জন্মেছেন। সুতরাং এ দেশের সাত খুন মাফ। ১৩০০ মানুষকে নিজেদের খামখেয়ালির কারণে মেরে ফেললেও বলতে হবে সৌদি আরবের দোষ নেই, যা হয়েছে আল্লাহর ইচ্ছেয় হয়েছে, যারা পবিত্র স্থানে মারা গিয়েছে, সবাই বেহেস্তে যাবে, সুতরাং কারও দিকে অভিযোগের আঙুল যেন না ওঠে।

লজ্জা সৌদি আরবের হবে না। কারণ দেশটির শাসকরা ভয়ানক নির্লজ্জ। আমি অনুরোধ করছি, সৌদি আরবকে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল প্যানেলের প্রধান যেন না করা হয়। মানবাধিকারে বিশ্বাস না করা কাউকে মানবাধিকারের মাথায় বসিয়ে দিলে যা দাঁড়ায়, তাই দাঁড়াবে এখন। মানবাধিকারের মুণ্ডু চিবিয়ে খাবে, মানবাধিকারের বারোটা বাজাবে অথবা একে নিশ্চিহ্ন করে ছাড়বে। ধর্মের সঙ্গে যেমন মানবাধিকারের সম্পর্ক নেই, সৌদি আরবের সঙ্গেও তেমন মানবাধিকারের সম্পর্ক নেই।

স্টেটমেন্ট

এ নতুন নয়, প্রায়ই হিন্দু মৌলবাদীরা স্টেটমেন্ট ছড়িয়ে দেয় টুইটার, ফেসবুক, হোয়াটসআপে, যেগুলোর লেখক হিসেবে থাকে আমার নাম। এসব কন্ট্রোল করার ক্ষমতা আমার নেই। এ কাজ হিন্দু মৌলবাদীদের, তা বুঝি, কারণ স্টেটমেন্টগুলোয়। থাকে হিন্দুত্ববাদের গুণগান এবং মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা। এই স্টেটমেন্টগুলো জাস্ট কিছু টাইপ করা লেখার ফটো। কোনও লিংক নেই, কোনও সোর্সের উল্লেখ নেই। মানুষ কেন এসবকে আমার লেখা বলে ভুল করে বুঝি না। বোধবুদ্ধিহীন লোক ছাড়া আর কারও তো এসব বিশ্বাস করার কথা নয়। কী বলবো, বড় বড় মিডিয়াও এসব বিশ্বাস করে। মিডিয়ার তো উচিত প্রচার করার আগে ভেরিফাই করে নেওয়া।

গতকাল আমির খানকে নিয়ে একটা স্টেটমেন্ট ভাইরাল হয়ে গেল। বেশ কয়েকবার প্রতিবাদ করেছি টুইটারে। বলেছি, এ আমার ওয়ার্ডস নয়, আমার স্টেটমেন্ট নয়, আমার মেসেজ নয়। কে শোনে কার কথা। আগুনের মতো ছড়িয়ে গেলো ওই মিথ্যে স্টেটমেন্ট। অন্যের নাম লেখক হিসেবে বসিয়ে যারা এসব বক্তব্য বানায়, তারা কিন্তু ক্রিমিনাল। লক্ষ লক্ষ লোক জেনে গেছে আমার কথা যা আসলে আমার কথা নয়। কজন আর পড়েছে আমার প্রতিবাদ!

কী করে এসব বন্ধ করা যায়, কারও জানা আছে কি?

স্বপ্নগুলো

ভারত থেকে প্রায়ই আমি ইউরোপ অথবাআমেরিকায় যাই, সাধারণত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নারীর অধিকার বা মানবাধিকার নিয়ে বক্তৃতা করতে। ইউরোপ এবং আমেরিকার বিভিন্ন সরকার, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন আমাকে বক্তৃতার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছে আজ বাইশ বছর। যেখানেই বাস করি না কেন, বক্ততার জন্য আমাকে যেতে হয় বিভিন্ন দেশে। ভারতীয় উপমহাদেশের কোনও পত্রিকায় আমার বক্তৃতা করা, আমার সম্মান অর্জন, মানবাধিকার পুরস্কার পাওয়া, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট পাওয়া, এসব নিয়ে কিছু কখনও লেখেনি। লিখেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায়, কটা পুরুষের সঙ্গে আমি শুয়েছি, মোট কজনকে বিয়ে করেছি, এবং কত লোক আমাকে ঘৃণা করে, এবং মৌলবাদীরা কী করে আমাকে প্যাদানি দিচ্ছে, আমার দিকে লোহার চেয়ার ছুঁড়ে মারছে, রাজ্য কী করে আমার বই নিষিদ্ধ করেছে, কী করে রাজ্য থেকে আমাকে তাড়িয়েছে, এসব। আমার নামের আগে জুড়ে দেয় একটি শব্দ- বিতর্কিত। এই শব্দটি জুড়তে জুড়তে এখন এটিকে তারা আমার নামের অংশ বলেই সম্ভবত ভাবে। এই বিতর্কিত বিশেষণটি তারাইতিবাচক নয়, ব্যবহার করে নেতিবাচক অর্থে। দুই বাংলা আমাকে শুধু তাড়িয়ে শান্ত হয়নি, আমাকে বানিয়েছে আস্ত একটা নিষিদ্ধ নাম, আপাদমস্তক নিষিদ্ধ লেখক। ভারত থেকে আমি এখন আমেরিকায় এসেছি, এর মানে কিন্তু এই নয় যে আমি জন্মের মতো ছেড়ে এসেছি ভারত। ভারতে এখনও আমার সবকিছু, সমস্ত জরুরি জিনিসপত্র। আমি শুধু ছোট একটা সুটকেসে নিয়ে আমেরিকায় এসেছি, সঙ্গে এনেছি আমার নিত্যসঙ্গী ল্যাপটপ আর আইপ্যাড়। আর আমার এক জোড়া রিডিং গ্লাস। দেশের বাইরে যেখানেই যাই, এগুলো নিয়েই যাই।

বাংলাদেশ আমাকে তাড়িয়েছে। আমার বই নিষিদ্ধ করেছে। নারীবিদ্বেষী মৌলবাদীর দল আর নারীবিদ্বেষী তথাকথিত প্রগতিশীলের দল দুদলই দুযুগ ধরে আমার পেছনে –আমাকে অপমান করতে, অপদস্থ করতে, অবাধে আমার কুৎসা রটাতে ব্যস্ত। ইউরোপ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেছিলাম। বাংলাকে ভালোবেসে কী অসম্ভব অসম্ভব কাণ্ডই না করেছি। সেখানেও ওই একই ঘটনা ঘটলো, রাজনীতিক, নারীবিদ্বেষী মৌলবাদীর দল, আর এক দল সেকুলার নামধারী কাপুরুষ আমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠলো। আমাকে গৃহবন্দি করেছিল ভারত সরকার। ভারত ছাড়তে বাধ্য করেছিল দুহাজার আট সালে। তারপরও ফিরে ফিরে গেছি ভারতে। আশ্রয় ভিক্ষে চাইনি। আশ্রয়ের দাবি জানিয়েছি। গণতন্ত্রের কাছে দাবি। একটি সেকুলার রাষ্ট্রের কাছে দাবি। মানবাধিকারের পক্ষে লড়াই করা একজন লেখক হিসেবে দাবি। দিল্লি ছাড়া আর কোথাও যাওয়া নিষেধ, তারপরও ওই দিল্লিতেই থেকেছি। কেন দিল্লিতে পড়ে আছি, কেউ প্রশ্ন করলে বলতাম, যেহেতু এখানকার গাছগুলো চিনি। দিল্লি আমার জন্য সম্পূর্ণ নতুন একটি শহর, নতুন চারদিক। তারপরও রয়েছি দিল্লিতে, কারণ গোটা ভারতবর্ষে ওই ছোট শহরটি ছাড়া আর কোনও শহর ছিল না আমার থাকার। ওই শহরটি ত্যাগ করা মানে গোটা একটি উপমহাদেশ ত্যাগ করা। আমার ভারত-বাসের অনুমতি আর না পাওয়া মানে আমার জন্য উপমহাদেশের দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়া। এবারই তো নতুন সরকার এসে ভারত বাসের অনুমতিকে এক বছর থেকে কমিয়ে দুমাসে এনেছিল। শুধু যুদ্ধ করে বেঁচে আছি। নিজের আদর্শের জন্য যুদ্ধ। যেখানে বাস করতে ইচ্ছে করে, সেখানে বাস করার স্বাধীনতা চাই বা অধিকার চাই। পৃথিবীর সর্বত্র বাক স্বাধীনতা চাই। আমি স্বাধীনভাবে আমার মত প্রকাশ করবো, সে কারণে আমাকে জেল খাটতে হবে না, আমার ফাঁসি হবে না, আমার পিঠে চাবুক চালানো হবে না, আমাকে দুররা মারা হবে না, আমাকে পাথর ছোঁড়া হবে না, আমাকে নির্বাসনে যেতে হবে না। এই নিশ্চয়তা চাই। শুধু আমার জন্য নয়। সবার জন্য।

আমার অধিকাংশ পাঠকের বাস উপমহাদেশে। সে কারণে পাঠকের কাছাকাছি রয়েছি, ভাষার কাছাকাছি রয়েছি, আমার পোষা বেড়ালের কাছাকাছি রয়েছি, যে মেয়েদের কথা লিখি, যে নির্যাতিত মানুষের কথা লিখি, তাদের কাছাকাছি রয়েছি। তাদের কাছাকাছি আমাকে তো থাকতেই হবে যতদিন বাঁচি। আমি তো ভাসমান এক মানুষ। আমার পায়ের তলায় মাটি নেই। আমার কোনও শহর নেই, গ্রাম নেই, দেশ নেই। এক শহর থেকে আরেক শহরে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে আজ একুশ বছর যাবৎ কেবল ভেসে যাচ্ছি। এই ভাসমান মানুষটিই মানুষের মত প্রকাশের অধিকারের জন্য, নারীর সমানাধিকারের জন্য, দেশে-দেশের কাঁটাতার উপড়ে ফেলার জন্য, মানুষের যেখানে খুশি সেখানে যাওয়ার এবং বসবাসের স্বাধীনতার জন্য, মানবতার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, লাথিঝাঁটা খেয়ে, গালি খেয়ে, ঘৃণা পেয়ে, ফতোয়া সয়ে, নির্যাতন সয়ে লড়াই করে যাচ্ছি।

আমেরিকায় আসার পেছনে এবার আমার মূল উদ্দেশ্য সেকুলার হিউম্যানিস্ট কনফারেন্সে নাস্তিক ব্লগাররা কী রকম মৃত্যুভয়ে গুটিয়ে আছে, সে সম্পর্কে বলা। তাদের প্রাণে বাঁচানোর জন্য ইউরোপ-আমেরিকার সরকার এবং সংগঠনের কাছে আবেদন করা। যে ফাণ্ড তৈরি করা হচ্ছে আমার জন্য, সেটি মূলত যাবে দেশের প্রতিভাবান নাস্তিক ব্লগারদের দেশ থেকে বিদেশে আসা এবং বিদেশে বসবাসের খরচে। আমার নিজের নিরাপত্তা? অনেক তো হলো বাঁচা। এবার মাথায় কোপ খেলে, বা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হলে এমন কোনও সর্বনাশ হবে না কারও। গত একুশ বছর কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করেনি আমি কোথায় আছি, কেমন আছি। আমি ভালো আছি কি না। আমি বেঁচে আছি কি না। আজ হঠাৎ আমি ভারত ছেড়ে কেন চলে গেলাম জানতে চাইছে সবাই। ভারতে থাকাকালীন মুখ ফুটে ভারতের রাজনীতি, ভারতের মেয়েদের অসহায়ত্ব, ভারতের গরিবদের দুরবস্থা, কোনও সামাজিক অব্যবস্থা, কোনও ধর্ম, কোনও পুরুষতন্ত্র, কোনও কুসংস্কার নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করলে জাতীয়তাবাদী, ধর্মান্ধ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, পুরুষতান্ত্রিক লোকেরা আমাকে ধমক দিতো, গালি দিত, বলতো ভারত ছাড়তে, বাংলাদেশে চলে যেতে, কী জঘন্য অপমানই না করতো। বাংলাদেশ একটা গরিব দেশ বলে, বাংলাদেশে আমার জন্ম হয়েছে বলে তারা ভারতীয়রা তুই তোকারি করে কথা বলতো। পৃথিবীর সব দেশকে আপন ভাবলে, নিজের দেশ ভাবলে, দেশ আর দেশের মানুষের ভালো চাইলে, বিশেষ করে যেচে, আগ বাড়িয়ে ভালো করতে চাইলে অনেক কষ্ট পেতে হয়। বিদেশী, বাইরের লোক, আমাদের দেশের ব্যাপারে নাক গলাবে না, ইত্যাদি কটুক্তি শুনতে হয়। অনেক ধারণা করে আমার নিশ্চয়ই কোনও বদ অভিসন্ধি আছে। তা না হলে অন্য দেশের মেয়েরা ধর্ষিতা হলে আমার কী, ডমেস্টিক ভায়োলেন্স বাড়লে আমি উদ্বিগ্ন কেন, এ তো আর আমার দেশ নয়! আমি আপন ভাবলেও আমাকে আপন ভাবার লোক আমি খুব কমই পেয়েছি। আমার কথা পছন্দ না হলে আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে, আমাকে লাথি মেরে ভারত থেকে তাড়াবে। প্রায় প্রতিদিন শুনেছি এমন হুমকি। একদিকে মুসলিম মৌলবাদীদের আক্রমণ। আরেকদিকে নারীবিদ্বেষী, কট্টর ডানপন্থী, হিন্দুত্ববাদীর আক্রমণ। আর যাদের থাকার কথা আমার পাশে, যে বামপন্থী সেকুলার দলের, তারা আমার বই নিষিদ্ধ করে, আমাকে রাজ্য থেকে তাড়ায়, আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটায়। তারা মিথ্যে দোষ দেয়, তাদের সহজ সমীকরণ এই, আমি যেহেতু ইসলামী মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি, আমি তবে নিশ্চয়ই হিন্দুত্ববাদীদের বন্ধু। ভারতের সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ উদারপন্থীদের মধ্যে একটা বড় অংশই ভণ্ড।

এদের বাইরেও অনেক মানুষ আছে, যারা ভালোবাসে, যারা শ্রদ্ধা করে। হাটে, মাঠে, ঘাটে কত মানুষ দৌড়ে এসেছে অটোগ্রাফ নিতে, কত মানুষ ছবি তুলতে, জড়িয়ে ধরতে, একটু হাত স্পর্শ করতে, একটু কাঁদতে, একটুখানি পায়ের ধুলো নিতে। ওই ভালোবাসা আমাকে টানে। ওই ভালোবাসার কাছে আমি ফিরে যাবোই। ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই আমার কাছে বড় নয়। আমার সবজিওয়ালা জয়ন্ত আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকে, আমার মাছওয়ালা গোবিন্দ আর বনমালী আমার জন্য অপেক্ষা করে। অপেক্ষা করে শাড়ির দোকানের মজুমদার। অপেক্ষা করে আছে মিনু বেড়াল, অসংখ্য চেনা অচেনা শুভাকাঙ্ক্ষী।

অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর ঘাড়ের কাছটায় চাপাতির একখানা কোপ আজ বসে কাল বসে এইরকম একটি বিচ্ছিরি কিছু অনুভূত হচ্ছিল। বার বার পেছন ফিরে দেখছিলাম কেউ অনুসরণ করছে কি না। ওটা আমেরিকায় এসে এ কদিনে খানিকটা গেছে। সম্পূর্ণ চলে যেতে খানিকটা সময় নেবে। নব্বইয়ের শুরুতে আমি লক্ষ লক্ষ মৌলবাদীদের মিছিল আর সভা দেখেছি, যেখানে আমার ফাঁসির দাবিতে দেশকে অনেকদিন পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছিল। ওই মৌলবাদীদের সুযোগ্য পুত্ররা আজ সন্ত্রাসী, আজ তারা চাপাতি চালানো খুনী। আমার দিকে নজর তাদের নতুন নয়।

পৃথিবীটাকে দেশ বলে আজও ভাবি। আমি ইউরোপের নাগরিক অনেককাল। আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা অনেককাল। এসব জায়গায় বাস না করে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমি বাংলায় বাস করতে চেয়েছি। এখনও চাই। যতদিন বাংলা শাসন করবে মুখ লোকেরা, জঙ্গীদের সঙ্গীরা, ততদিন আমার প্রবেশাধিকার নেই বাংলায়। এই প্রবেশাধিকার ফেরত চাই। পৃথিবীটায় যতদিন বাঁচি যেখানে খুশি সেখানে যাওয়ার, যেখানে ইচ্ছে করে সেখানে বাস করার অধিকার পেতে চাই। যেন চাইলে আমেরিকায়, যেন এস্কিমোদের দেশে গ্রীনল্যাণ্ডে, যেন আফ্রিকার যে কোনও দেশে, অস্ট্রেলিয়ায়, ইউরোপ বা এশিয়ার যেখানে খুশি সেখানে বাস করার অধিকার পেতে পারি। শুধু আমি নই। পৃথিবীর সবাই।

জানি আমার স্বপ্নগুলো মানুষ পায়ে মাড়িয়ে যাবে। সে যাক। আমার কিছু যায় আসে না। আমি স্বপ্ন রচনা করে যাবোই।

স্যানিটারি প্রতিবাদ

স্যানিটারি প্যাডের ওপর প্রতিবাদের স্লোগান লেখা হচ্ছে আজকাল। প্যাডের এই প্রতিবাদটি বেশ চমৎকার। প্রথম যেদিন দেখেছিলাম, বেশ ফুরফুরে লেগেছিল। প্রায় তিরিশ বছর যাবৎ অনেকটা একা একাই ট্যাবু ভেঙে চলেছি। তাই কাউকে ট্যাবু ভাঙতে দেখলে বেশ আনন্দ হয়। স্যানিটারি প্যাড়কে প্রতিবাদের মাধ্যম করা এই প্রথম নয়, আগেও করা হয়েছে। চার্লি নামে এক মেয়ে গতবছর একটা টুইট করেছিল, টুইটটা এরকম: মেয়েদের পিরিয়ডকে যেরকম ঘেন্না করে পুরুষেরা, ধর্ষণকেও যদি একইরকম ঘেন্না করতো। এই টুইট দেখে এলোনে নামের এক জার্মান শিল্পী এমনি উত্তেজিত ছিলেন যে তিনি চার্লির ওই টুইটের কথাগুলো চল্লিশটা স্যানিটারি প্যাডের ওপর লিখে তাঁর শহরের দেয়ালে দেয়ালে সেঁটে দিয়েছিলেন। টুইটের ওই কথা ছাড়াও নিজ থেকে আরও লিখেছিলেন, পুরুষরা মেয়েদের শরীরকে ধর্ষণ করে, পোশাককে নয়। এসবের জন্য এলোনে নিন্দিত নন্দিত দুইই হয়েছেন। এলোনে বলেছেন, মানুষকে একটু নাড়া খাওয়ানোর জন্য তিনি ইচ্ছে করেই স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করেছিলেন। সেক্সিজম যে প্রতিদিনকার সমস্যা তা তাঁর মনে হয়েছে সবাইকে জানানো দরকার। এলোনে টের পেয়েছেন, পিরিয়ডকে ধর্ষণের সঙ্গে মিলিয়ে দিলে। ভদ্রলোকদের বেশ অস্বস্তি হয়। ওই অস্বস্তি দিতে পারাটাই সাকসেস। এলোনেই প্রথম স্যানিটারি প্যাডকে শিল্পের পর্যায়ে তোলেননি। এর আগে ট্রেসি এমিন নামের একজন শিল্পী প্রেগনেন্সি টেস্টের পাশে একটা জারে পুরোনো ব্যবহৃত ট্যাম্পুন রেখেছিলেন। ওটাই ছিল ওঁর আর্ট। ওই আর্টটার নাম ছিল পেইনটিংএর ইতিহাস-১। চিলির একজন আর্টিস্ট পাঁচ বছর ধরে জমানো ঋতুস্রাবের রক্তের একটা প্রদর্শনী করেছিলেন। প্রদর্শনীটা দেখে একজন মন্তব্য করেছিলেন, পুরুষের রক্ত উৎযাপন হয়, কারণ এ রক্ত সাহসের, আর আমাদের মেয়েদের রক্তকেই চিরকাল লজ্জার বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। চাবুকের মতো গায়ে লাগে এই সত্যটা।

দিল্লির জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে স্যানিটারি প্যাডের প্রতিবাদ। কলকাতার যাদবপুরে এসে এটি থেমেছে। না, এখানেই থামলে চলবে না। প্রতিবাদকে সারা উপমহাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। প্রতিবাদের এই ভাষাটি সার্থক এই কারণে যে, এই ভাষাটি ভদ্রলোকদের পছন্দ হচ্ছে না। ওদের পছন্দের ভাষা দিয়ে ওদের পছন্দের পুরুষতন্ত্রের প্রতিবাদ করলে প্রতিবাদটায় জোর থাকে না। যে ভাষা এতকাল ব্যবহৃত হয়েছে, সেই ম্যাড়ম্যাড়ে ভাষা পাল্টে আরও তীব্র, তীক্ষ্ণ ভাষা ব্যবহারের সময়। এসেছে। নিষিদ্ধ রক্তমাখা কাপড় পতাকার মতো উড়িয়ে প্রতিবাদ হোক পুরুষতন্ত্রের, নারীবিদ্বেষের। পুরুষের শেখানো ভাষায়, পুরুষের দেখানো পথে এতকাল মেয়েরা হেঁটেছে, এবার নিজেদের মতো করে হাঁটুক।

নারীর না হয়ে ঋতুচক্র যদি পুরুষের হতো, তবে কিন্তু ঋতুস্রাবের রক্ত নিয়ে সমাজে লজ্জা করার কিছু থাকতো না। বরং পুরুষের ওই রক্তকে পবিত্র বলে ঘোষণা করা হতো, ওদের রক্তকে পুজোও করা হতো, ওদের স্যানিটারি প্যাডকে ওরা অত্যন্ত গৌরবের সঙ্গে প্রদর্শন করতো। নারীর ঋতুস্রাবের রক্তকে পুরুষেরা এতকাল ঘৃণা করেছে, এই রক্তকে অপবিত্র বলেছে, আজ নারীরাই তাদের রক্তকে পবিত্র বলে ঘোষণা করুক। এই পবিত্র রক্ত দিয়ে লিখে রাখুক যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে তাদের গর্জে ওঠার কাহিনী।

স্যানিটারি প্যাড সাঁটিয়ে আন্দোলন করাটাকে, অনেকে বলছে, নান্দিনক নয়। আমি মনে করি, এটা অভিনব এবং নান্দনিক। আসলে নারীবিদ্বেষীদের গায়ে এই আন্দোলনটা জ্বালা ধরাচ্ছে বলে এই আন্দোলনটার সফল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। পুরুষেরা যখন জামা খুলে বুকে পিঠে গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক লিখে মিছিলে হাঁটে, লোকে মুগ্ধ হয়, কবিরা তাদের নিয়ে কাব্য লেখে, শিল্পী ছবি আঁকে, চিত্রপরিচালক চলচ্চিত্র নির্মাণ করে, চারদিকে তাদের জনপ্রিয়তা হৈ রৈ করে বাড়ে। আর ফেমেন গোষ্ঠীর যে মেয়েরা খোলা বুকে-পিঠে একই জিনিস লিখে রাস্তায় হাঁটে, পুলিশ দৌড়ে এসে চ্যাংদোলা করে তাদের সবকটাকে তুলে থানায় নিয়ে যায়। স্লোগান লেখা পুরুষের খোলা শরীর গৌরবের, আর স্লোগান লেখা নারীর খোলা শরীর লজ্জার,ঘৃণার, সংকোচের! খোলা বুকে ফেমেনের যে প্রতিবাদ, তাকে নান্দনিক বলবে না সমাজের ভদ্রলোকেরা। ফেমেনের প্রতিবাদ ভদ্রলোকদের অস্বস্তি দেয়। অস্বস্তি দেয় বলেই নারীর সমস্যা নিয়ে ফেমেনের প্রতিবাদগুলো সাড়া ফেলেছে, মানুষ উঠে বসেছে, সমস্যাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছে, সচেতন হচ্ছে।

যারা অভিযোগ করছে স্যানিটারি প্যাড সাঁটিয়ে আন্দোলন করাটা নান্দনিক নয়, তাদের বলছি– যৌনহেনস্থা নান্দনিক নয়, ধর্ষণ নান্দনিক নয়, ডমেস্টিক ভায়োলেন্স নান্দনিক নয়, তবে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদটাকে কেন নান্দনিক হতে হবে? অভিযোগ করার লোক সমাজে আগেও ছিল, এখনও আছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে এদের সংখ্যাটা অনেক বেশি। এদের মূল্য দেওয়ার আদৌ কোনও প্রয়োজন আছে। বলে আমি মনে করি না। এরা মেয়েদের নিতান্তই যৌন সামগ্রী ছাড়া আর কিছু বলে ভাবতে পারে না। এরা যত শীঘ্র বিলুপ্ত হয়, তত শীঘ্র আসবে সমাজের মঙ্গল।

রূপী কৌরের ঋতুস্রাবের রক্তমাখা ছবিটা নিয়ে হৈ চৈ হচ্ছে। ইনস্টিগ্রাম ছবিটাকে সরিয়ে দিয়েছে। আমি তো মনে করি ছবিটা দুর্দান্ত। দিপিকা পাড়ুকোনের মাই চয়েজ ভিডিওটাও অসাধারণ। মেয়েরা শেষ অবধি কথা বলছে। যাদবপুরেও মেয়েরা জেগে উঠেছে। মানবসভ্যতা টিকিয়ে রাখতে হলে এই জাগরণটার ভীষণ প্রয়োজন। মানুষ-প্রজাতির এক দল তার নিজের প্রজাতিকে কেবল ভিন্ন লিঙ্গ হওয়ার কারণে নির্যাতন করছে, বঞ্চিত করছে, লাঞ্ছিত করছে, হেনস্থা করছে, এবং হাজার হাজার বছর ধরে এটা চলছে; গায়ের জোরে, পেশির জোরে, অশিক্ষা আর কুশিক্ষার জোরে চলছে — ভাবলে শিউরে উঠি। আরও হাজার বছর আগেই উচিত ছিল এই জাগরণের। নারী পুরুষকে এক মিছিলে হাঁটতে হবে সমানাধিকারের দাবিতে। আমরা পেশি দিয়ে সমাজ চালাই না, বুদ্ধি দিয়ে চালাই। সুতরাং যার পেশির জোর বেশি, সে বেশি মূল্যবান, যার পেশির জোর কম, সে কম মূল্যবান–এভাবে ভাবাটা হাস্যকর। নারী তার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পেলে নারীর চেয়ে পুরুষই বেশি উপকৃত হবে। সঙ্গিনী হিসেবে শিক্ষিত স্বনির্ভর সমকক্ষ নারীকে পাওয়া আর দাসি বাঁদিকে পাওয়ার মধ্যে বিরাট পার্থক্য।

আমার আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড আমার মেয়েবেলায় আমার ঋতুমতী হওয়ার কাহিনী বর্ণনা করেছি বলে, অথবা কিভাবে যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছি আমি, সেই গল্পটা দ্বিধাহীন বলেছি বলে যারা আমার নিন্দে করে, যারা আমার সত্য বলাটা অপছন্দ করে তাদের আমি বড় করুণার চোখে দেখি, তাদের ক্ষুদ্রতার সঙ্গে আমি কোনওকালেই আপোস করি না। বাংলাদেশে আমার মেয়েবেলা বইটি হাসিনা সরকার অশ্লীলতার দোষ দিয়ে নিষিদ্ধ করেছে ১৯৯৯ সালে। বইটি আজও ও দেশে নিষিদ্ধ। ছোটলোকরা তো বলেই বেড়িয়েছে, নিজের ওপর যৌন হেনস্থার বর্ণনা এত নির্লজ্জ ভাবে কোনও ভদ্রঘরের মেয়ে দিতে পারে না। বড় কিছু পুরুষ লেখক বলেছেন, তোমার মেয়েবেলাটা ভালোই লিখেছিলে, তবে ওই যৌনতার বর্ণনাটা দেওয়ার দরকার ছিল না। ওটা ভালগার। হ্যাঁ আমি তোমাদের বদমাইশির কথা লিখলে সেটা ভালগার, আমি আমার শরীরের কথা লিখলে সেটা অশ্লীল। আর তোমরা যখন নারীর শরীরের বর্ণনা দাও, যৌন সঙ্গমের বর্ণনা দাও, সেটা শিল্প। নারীর শরীর নিয়ে পুরুষরা লিখলেই আর্ট, আর নারীরা লিখলেই অশ্লীলতা,বেশ্যাদের মতো কাজ। এই নষ্ট সমাজ থেকে এর চেয়ে ভালো কিছু হয়তো আশা করাও যায় না।

মেয়েরা যদি পুরুষের শেখানো ভাষায় না লেখে, কী বলবে-কতটুকু বলবে কোথায় সীমা টানবে— এই রুলটা না মানে, তবে পুরুষতান্ত্রিক লোকদের বড় রাগ হয়। এই সমাজে যে মেয়েরা নারীবিরোধীদের গায়ে রাগ না ধরাতে পারে, যে মেয়েরা নারীবিরোধীদের কাছ থেকে নষ্ট, স্লাট, বেশ্যা ইত্যাদি আখ্যা না পায় — সেই মেয়েদের নিয়ে খুব বেশি আশা করার নেই। নারীবিরোধী সমাজের সঙ্গে আপোস যারা করে না, যারা অবাধ্য, যারা নিয়ম ভাঙে, তারাই সমাজ পাল্টায়। তারাই বিবর্তন ঘটায়। আমি তাদেরই স্যালুট করি।

যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে যাদবপুরের আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের জানাচ্ছি আমার সংগ্রামী অভিনন্দন। সারা দেশে কন্যাশিশু হত্যা, বাল্য বিবাহ, পণপ্রথা, বধূনির্যাতন, বধূহত্যা, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, খুন, ঘৃণা, ইত্যাদির শিকার হচ্ছে মেয়েরা। মেয়েদের নিরাপত্তা কোথাও নেই, ঘরে নেই, রাস্তা ঘাটে নেই, এমনকী সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠেও নেই। যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অশিক্ষা, কুশিক্ষা, কুসংস্কার, অন্ধত্ব, বৈষম্য থেকে মুক্ত হওয়ার কথা, যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নারী-পুরুষের সমানাধিকার বিষয়ে জ্ঞান দেয়, শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে, সচেতন করে, আলোকিত করে — সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থা ঘটে, এর চেয়ে লজ্জা আর কী আছে। সবচেয়ে সুস্থ, শিক্ষিত, সচেতন, চরিত্রবান, আদর্শবান নাগরিক তো আশা করি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই। নারী-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীকেই সরব হতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেই সত্যিকার শিক্ষিত হওয়া হয় না। নারীকে যারা যৌনবস্তু ঠাওরায়, তাদের শিক্ষিত বলে গণ্য করা উচিত নয়।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকে যদি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার ভালো চোখে না দেখে, তাহলে বুঝতে হবে রাজ্য সরকার নারীর অধিকারকে ভালো চোখে দেখে না। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী একজন নারী। পুরুষতন্ত্র এমনই ভয়ংকর ক্ষমতাধর যে নারীকেও, বাধ্য করে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা গ্রহণ করতে। বদ-পুরুষের মতো অনেক নারী ধর্ষণের জন্য দোষ দেয় ধর্ষিতাকে। যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাটাকে অন্যায় বলে ধরে নেয় যাদবপুরের প্রশাসন, তবে বুঝতে হবে এই প্রশাসন আজ নারীবিদ্বেষীদের দখলে। সত্যিকার শিক্ষিত মানুষের বড় অভাব আজকাল। এখন তরুণদের ওপর ভরসা। ওরাই জীর্ণ পুরাতনকে বিদেয় করবে।

হজ্ব

মক্কার পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মরার দৃশ্য দেখার পরও কি মানুষ আবার হজু করতে মক্কা যাবে? শুনেছি এগারোশ নাকি তেরোশ মানুষ শুধু মানুষের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মরেছে। আহা কী করুণ মৃত্যু! লাশগুলোকে বুলডোজার দিয়ে আবর্জনার মতো ফেলেছে সৌদি সরকার। সৌদি রাজপরিবারের বর্বরতা কারও অজানা নয়। কোনও এক রাজপুত্তুর নাকি ও পথ দিয়ে যাবেন, তাই তাঁর পথটি সাফ করতে গিয়ে আশেপাশের সব রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, যেসব রাস্তা ধরে লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মানুষ কোন এক অদৃশ্য শয়তানকে পাথর ছুড়বে বলে ছুটছিল। শয়তান কি এমনই শক্তিশালী যে তাকে মারার জন্য লক্ষ লক্ষ পাথরের দরকার পড়ে? তাছাড়া, পাথর ছুড়লে কি শয়তান মরে? শয়তান তো রূপকথার চরিত্র। একটা শিশুতোষ রূপকথার জন্য কত কত লোককে আজ মরতে হলো। মানুষ আর কতকাল এইসব রূপকথাকে বিশ্বাস করবে? বিশ্বাস খুব ভয়ংকর, এ কোনও যুক্তি বোঝে না।

আমার ধর্মে বিশ্বাস থাকলেও মরতে আমি মক্কা যেতাম না। মানুষের যেমন সুস্থভাবে বাঁচার অধিকার আছে, তেমনি তাদের স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকার আছে।

হাতি ঘোড়া

আজ বিকেলে নিরিবিলি এক রাস্তায় হঠাৎ দেখলাম হাতি, লাফিয়ে নামলাম গাড়ি থেকে। হাতি দেখলেই আমি কাছে গিয়ে কুশল শুধাই। এই হাতির শরীরে ফুল পাতা আঁকছিল একটি ছেলে। হাতিও জানতো তাকে সাজানো হচ্ছে। তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছেলেটিকে সাহায্য করছিল সাজাতে। কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল দুটো উট। বিয়ে বাড়িতে নাচতে এসেছে ওরা। যখন উটের মাহুতকে বললাম, উট কী করে নাচে দেখবো। মাহুত বললো, এখানে ডিজে নেই, গান নেই, নাচবে কী করে ওরা, ওরা তো গানের সঙ্গে নাচে।

কষ্ট হয় যখন দেখি মানুষ হাতিঘোড়াউটমোষকে বন্দি করেছে। ক্রীতদাস বানিয়েছে। দড়ি খুলে দিলে হয় না? মুক্ত ঘুরে বেড়াক সকলে। এই পৃথিবী তো ওদেরও। ওদের কি ইচ্ছে হয় না যেমন ইচ্ছে তেমন ভাবে বাঁচতে!

হুমায়ুন আজাদ

বাংলাদেশের লেখক হুমায়ুন আজাদকে প্রথাবিরোধী বলে কেউ কেউ। হুমায়ুন আজাদ প্রথাবিরোধী ছিলেন না, তিনি একটা কট্টর পুরুষতান্ত্রিক লোক ছিলেন। পুরুষতান্ত্রিক প্রথায় তিনি গভীর বিশ্বাসী ছিলেন এবং প্রথামত জীবন যাপন করেছেন। তিনি গৃহের কর্তা ছিলেন এবং সন্তানদের নামের শেষে তিনি নিজের পদবী জুড়ে দিয়েছেন। তিনি নারীবিদ্বেষী ছিলেন। নারীদের যৌনবস্তু হিসেবে দেখতেন। স্ত্রীর আড়ালে তিনি ঘরের বাইরে অন্য নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত থাকতেন। তিনি রক্ষিতাও পুষতেন। তিনি প্রচণ্ড মিত্থুক লোক ছিলেন। আমি নাকি তাঁকে যৌন সম্পর্কের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। এই মিথ্যে কথা বলে তিনি সবার সামনে দাঁত কেলিয়ে হাসতেন। আমি তখন নারীবাদী সংগ্রামী লেখক, আমাকে নিয়ে অপমানজনক এবং মিথ্যে বলতে লোকটির লজ্জা হয়নি। তিনি প্রায়ই প্রতিষ্ঠিত লেখক লেখিকা সম্পর্কে অশোভন এবং অশ্লীল মন্তব্য করতেন। নারী সম্পর্কে তাঁর উক্তি বরাবরই ছিল বড় কুৎসিত এবং নোংরা। আমার নারীবাদী কলামের জনপ্রিয়তা দেখে তাঁর এমনই লোভ হতো যে নারী নিয়ে একটা বই লিখে ফেললেন। নারী বইটি তার কোনও মৌলিক বই নই। এটি পৃথিবীর নারীবাদীরা যা যা এতকাল বলেছেন, তা শুধু অনুবাদ করে নিজের ভাষায় বর্ণনা করেছেন মাত্র। হুমায়ুন আজাদ ব্যক্তিজীবনে একটা মিথ্যুক, লম্পট, চরিত্রহীন লোক ছিলেন। তিনি পুরুষতান্ত্রিক স্তাবক নিয়ে সবসময় ঘোরাফেরা করতেন।

হুমায়ুন আজাদ কিছু ভালো বই লিখেছেন। কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁর পাক সার জমিন বইটি একটি অত্যন্ত নিম্ন মানের উপন্যাস। এ ব্যাপারেও কোনও সন্দেহ নেই। যারা এই বইটির প্রশংসা করে, তারা হয় বইটি পড়েনি, নয়তো তারা সাহিত্য কাকে বলে জানে না।

হুমায়ুন আজাদকে যারা জানে ভালো করে তারা মুখ বুজে থাকে, কারণ তাঁর ওপর মৌলবাদী আক্রমণ হওয়ার পর তিনি রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। জনপ্রিয় নারী-লেখকের বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতে কারও আপত্তি নেই, কিন্তু জনপ্রিয় পুরুষ-লেখক সম্পর্কে একটি অপ্রিয় সত্য কথা বলতেও মানুষের দ্বিধা।

হৃদপিণ্ডের কোনও অসুখ না থাকা সত্ত্বেও কী কারণে হুমায়ুন আজাদের হঠাৎ হৃদপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হলো এ নিয়ে কেউ কি জানতে চেয়েছে? পোস্টমর্টেম রিপোর্ট কী বলে। জার্মানির কিছু লোক তো বলে অতিরিক্ত মদ্যপান এবং উত্তেজক দ্রব্য সেবন তাঁর হৃদপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ করেছে।

হুমায়ুন আজাদের সঠিক মূল্যায়ন হওয়া উচিত। নবীন আঁতেলরা তাঁকে ঈশ্বরের জায়গায় বসিয়ে পুজো করছে। কিন্তু লোকটি যে একটা ইতর শ্রেণীর লোক ছিল, তা মানুষের জানা উচিত।

Exit mobile version