সুতরাং বুঝিতে পারিতেছ, কেবল নিরাপদে থাকার জন্য স্পঞ্জ্ প্রাণীরা সুড়ঙ্গযুক্ত ঘর নির্ম্মাণ করে না, ইহাতে খাদ্যও কাছে আসে।
প্রাণিমাত্রেই সন্তান রাখিয়া মরিয়া যায়। এই ব্যবস্থা না থাকিলে কোনো প্রাণীর বংশ থাকে না। স্পঞ্জ্ প্রাণীরা একটু উন্নত হইলেও, পশুপক্ষীদের মত উন্নত নয়। ইহারা এই জন্য ডিম বা সন্তান প্রসব করে না। বয়স বেশি হইলে ইহাদের শরীর হইতে ডিমের মত কতকগুলি অংশ খসিয়া পড়ে। ইহাই বড় হইয়া নূতন প্রাণী হয় এবং তাহারাই আবার স্পঞ্জের ঘরবাড়ী তৈয়ার করিতে আরম্ভ করে।
আমাদের দেশের খালবিলের বদ্ধ জলে এক রকম স্পঞ্জের মত প্রাণী দেখা যায়। তোমরা ইহা দেখিয়াছ কি না জানি না। জলের মধ্যে যে-সকল গাছের ডালপালা পচিতে থাকে, তাহারি উপরে ইহারা ছোট ছোট মৌ-চাকের মত বা বোল্তার চাকের মত ঘর করে। ইহাদেরও দেহ ঠিক স্পঞ্জ্ প্রাণীদের মত আাঠালো। ইহারা স্পঞ্জের জ্ঞাতি হইলেও ঠিক স্পঞ্জ্ নয়। প্রকৃত স্পঞ্জ্-প্রাণী আমাদের দেশের জলাশয়ে জন্মে না, নিকটের সমুদ্রেও খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। কাজেই তোমরা এদেশে জীবন্ত স্পঞ্জ্-প্রাণী দেখিতে পাইবে না। এই কারণে এই প্রাণীদের সকল কথা তোমাদিগকে বলিলাম না। সকল স্পঞ্জ্-প্রাণীই যে রবারের মত ঘর প্রস্তুত করে তাহা নয়। সমুদ্রের জল হইতে চূণ টানিয়া লইয়া ইহাদের কয়েক জাতি পাথরের মত শক্ত ঘর নির্ম্মাণ করে। এই সকল ঘরের উপরে ছুঁচের মত কাঁটা বাহির করা থাকে বলিয়া কোনো প্রাণীই কাছে ঘেঁষিতে পারে না।
যাহা হউক, স্পঞ্জ্-প্রাণীদের যে সকল কথা শুনিলে, তাহা হইতে বোধ হয় বুঝিতে পারিতেছ, ইহারা প্রথম শাখার এক-কোষ প্রাণীদের চেয়ে অনেক উন্নত। ইহাদের বিশেষ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নাই সত্য, কিন্তু তথাপি শরীর এক-কোষ প্রাণীদের মত নয়। ইহাদের দেহের কতকগুলি কোষ শুঁয়োর আকার পাইয়া খাদ্য সংগ্রহ করে। আবার কতকগুলি কোষ খাদ্য হজম করে। মানুষ, গোরু, পাখী প্রভৃতি বড় প্রাণীদের শরীরে যেমন কতকগুলি কোষ মিলিয়া পাকযন্ত্র নির্ম্মাণ করে, আবার কতকগুলি দলে দলে ভাগ হইয়া কেহ চোখ, কেহ কান এবং কেহ বা নাকের সৃষ্টি করে—ম্পঞ্জ্-প্রাণীতে আমরা তাহারি সূত্রপাত দেখিতে পাইলাম। এই জন্যই ইহাদিগকে দ্বিতীয় শাখার প্রাণীদের দলে ফেলা হইল।
৩.১ হাইড্রা
তৃতীয় শাখার প্রাণী
হাইড্রা
হাইড্রা জলচর প্রাণী, এবং স্পঞ্জ্-প্রাণীদের চেয়েও উন্নত। ইহাদের রঙ্ কখনো সবুজ এবং কখনো বাদামীও দেখা যায়। তোমরা পুকুরের জলে খোঁজ করিলে ইহাদিগকে শেওলা বা জলের লতাপাতার গায়ে দেখিতে পাইবে। হাইড্রা খুব বড় প্রাণী নয়,—আধ ইঞ্চির বেশি প্রায়ই লম্বা হয় না। তোমরা হয় ত পুকুরের জলে ইহাদিগকে দেখিয়াছ; শেওলা বা জলের গাছপালার শিকড় ভাবিয়া সেগুকেলি লক্ষ্য কর নাই। খালি চোখে ইহাদিগকে বেশ ভালোই দেখা যায়, কিন্তু শরীরটা ঠিক্ কি রকম তাহা জানিতে হইলে, অণুবীক্ষণ যন্ত্রের দরকার হয়। অণুবীক্ষণে হাইড্রাকে বড় করিয়া দেখিলে, তাহার আকৃতি যে রকম হয়, এখানে তাহার একটা ছবি দিলাম।
হাইড্রাদের চোখ, কান বা নাক নাই, কিন্তু মুখ আছে, উদর আছে এবং খাদ্য সংগ্রহ করিবার জন্য ফন্দিও জানা আছে। দেহ একটা নল বলিলেই হয়,—কারণ তাহার আগাগোড়া ফাঁপা। কিন্তু এই নলের মত শরীরের একটা দিক্ বন্ধ। এই বন্ধ দিক্টাই টোপা-পানার তলায় বা শেওলার গায়ে লাগাইয়া এবং খোলা দিক্টা নীচে রাখিয়া ইহার জলের মধ্যে ঝুলিতে থাকে! যে-দিক্টা ঝুলিতে থাকে, সেইটি তাহাদের মুখ কিন্তু চিবাইবার জন্য মুখে দাঁত নাই এবং চাকিয়া খাইবার জন্য জিহ্বাও নাই। দাঁত পড়িয়া গেলে, বুড়ো মানুষেরা যেমন সব জিনিস চুষিয়া খায়, ইহারাও সেই রকমে খায়।
তোমরা ছবিতে দেখিতে পাইবে, হাইড্রার মুখের গোড়ায় ডালপালার মত অনেকগুলি লম্বা লম্বা অংশ রহিয়াছে। মাগুর মাছের মুখে যেমন শুঁয়ো থাকে, এগুলিও সেই রকমের জিনিস। এগুলিকে শিকার ধরিবার ফাঁদ বলিলেই হয়। হাইড্রারা খুব তাড়াতাড়ি চলিয়া ফিরিয়া বেড়াইতে পারে না, অথচ পেটে যথেষ্ট ক্ষুধা আছে। তাই ভগবান্ ইহাদের মুখের গোড়ায় শুঁয়োর মত অনেকগুলি লম্বা হাত লাগাইয়া রাখিয়াছেন। জলের পোকা বা ছোট মাছ কাছে আসিলেই উহারা সেগুলিকে ঐ শুঁয়ো দিয়া চাপিয়া ধরে। পোকারা পালাইবার জন্য ঝটপট করে, কিন্তু শুঁয়োর শক্ত বাঁধন ছিঁড়িবার সাধ্য থাকে না। এই রকমে জখম হইয়া আসিলে হাইড্রারা শিকার মুখে পুরিয়া দেয়।
তোমরা হয় ত ভাবিতেছ, কয়েকটি সরু শুঁয়ো দিয়া শিকার ধরিতে গেলে, হাইড্রাদের বুঝি খুব বুদ্ধি খরচ করিতে হয়। কিন্তু তাহা নয়,—আমাদের মত উহাদের বুদ্ধি-সুদ্ধি একটু নাই। শিকার ধরিবার জন্য ইহা ছাড়া আরো যে-সকল ব্যবস্থা আছে, তাহাতে শিকার আপনিই ধরা পড়ে।
তোমরা ঠগী ডাকাতদের কথা বোধ হয় শুনিয়াছ। এই ডাকাতের দল সত্তর-আশী বৎসর পূর্ব্বে আমাদের দেশের পথিকদের উপরে ভয়ানক অত্যাচার করিত। সে-সময়ে রেল বা ষ্টীমারের রাস্তা ছিল না, ব্যবসায়ের জন্য বা তীর্থ করার জন্য লোকে দলে দলে হাঁটা পথে চলিত। ঐ ডাকাতেরা ভালো মানুষের মত এক-এক গাছি দড়ির ফাঁস কোমরে বাঁধিয়া পথিকদের দলে মিলিত। দড়ির ফাঁস ছাড়া আর কোনো অস্ত্র ডাকাতেরা সঙ্গে লইত না। পথিকেরা যখন নিশ্চিন্ত হইয়া গল্প করিতে করিতে রাস্তা দিয়া চলিত, ঠগ্ ডাকাতেরা চক্ষের নিমেষে পথিকদের গলায় সেই ফাঁস লাগাইত। এই রকমে হাজার হাজার পথিককে খুন করিয়া ঠগেরা তাহাদের সর্ব্বস্ব লুঠ করিয়া লইয়া যাইত। ইংরেজ-গবর্ণমেন্টের কড়া শাসনে এখন আমাদের মধ্যে ঠগ্ ডাকাত নাই কিন্তু হাইড্রারা আজও ফাঁস লাগাইয়া প্রাণিহত্যা করিতেছে।