Site icon BnBoi.Com

বেতাল পঞ্চবিংশতি – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

বেতাল পঞ্চবিংশতি – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

বেতাল পঞ্চবিংশতি – ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের লেখা একটি গল্পগ্রন্থ। বেতাল পঞ্চবিংশতি বা বেতাল পঁচিশি হচ্ছে পঁচিশটি ছোট গল্প নিয়ে গঠিত একটি গ্রন্থমালা। বইটির ২৫ টি গল্পে রাজা বিক্রমাদিত্য এবং বেতাল নামক এক অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন প্রাণীর মধ্যে গল্প এবং যুক্তির খেলা চলে। তাহলে আর দেরি না করে পড়তে শুরু করুণ ২৫ টি বিখ্যাত বেতাল উপাখ্যান।

বেতাল পঞ্চবিংশতি বইয়ের বিবরণঃ

০০. বিজ্ঞাপন ও উপক্ৰমণিকা

বেতাল পঞ্চবিংশতি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রচিত প্রথম গ্রন্থ৷ ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর লল্লুলাল রচিত হিন্দি “বেতাল পচীসী” গ্রন্থের আলোকে এই গ্রন্থ রচনা করেন৷ আপাতদৃষ্টিতে অনুবাদ মনে হলেও তিনি হুবহু অনুবাদ না করে মূল গ্রন্থের আলোকে এটি রচনা করেন৷ বেতাল পঞ্চবিংশতি তাঁর প্রথম গ্রন্থ হলেও এই গ্রন্থে শক্তিশালী  গদ্যের লক্ষণ সুষ্পষ্ট ছিল৷ বিদ্যাসাগর মহাশয় গ্রন্থের বিজ্ঞাপনে রচনার হেতু উল্লেখ করে লেখেন— ‘কালেজ অব ফোর্ট উইলিয়ম নামক বিদ্যালয়ে, তত্ৰত্য ছাত্ৰগণের পাঠার্থে, বাঙ্গালা ভাষায় হিতোপদেশ নামে যে পুস্তক নির্দিষ্ট ছিল, তাহার রচনা অতি কদৰ্য্য। বিশেষতঃ, কোনও কোনও অংশ এরূপ দুরূহ ও অসংলগ্ন যে কোনও ক্রমে অর্থবোধ ও তাৎপর্যগ্ৰহ হইয়া উঠে না। তৎপরিবর্তে পুস্তকান্তর প্রচলিত করা উচিত ও আবশ্যক বিবেচনা করিয়া, উক্ত বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মহামতি শ্ৰীযুত মেজর জি. টি. মার্শল মহোদয় কোনও নূতন পুস্তক প্রস্তুত করিতে আদেশ দেন। তদনুসারে আমি, বৈতালপচীসীনামক প্রসিদ্ধ হিন্দী পুস্তক অবলম্বন করিয়া, এই গ্রন্থ লিখিয়াছিলাম।’

————-

দ্বিতীয় বারের বিজ্ঞাপন

কালেজ অব্ ফোর্ট উইলিয়ম নামক বিদ্যালয়ে, তত্ৰত্য ছাত্ৰগণের পাঠার্থে, বাঙ্গালা ভাষায় হিতোপদেশ নামে যে পুস্তক নির্দ্দিষ্ট ছিল, তাহার রচনা অতি কদৰ্য্য। বিশেষতঃ, কোনও কোনও অংশ এরূপ দুরূহ ও অসংলগ্ন যে কোনও ক্রমে অর্থবোধ ও তাৎপর্য্যগ্ৰহ হইয়া উঠে না। তৎপরিবর্ত্তে পুস্তকান্তর প্রচলিত করা উচিত ও আবশ্যক বিবেচনা করিয়া, উক্ত বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মহামতি শ্ৰীযুত মেজর জি. টি. মার্শল মহোদয় কোনও নূতন পুস্তক প্রস্তুত করিতে আদেশ দেন। তদনুসারে আমি, বৈতালপচীসীনামক প্রসিদ্ধ হিন্দী পুস্তক অবলম্বন করিয়া, এই গ্রন্থ লিখিয়াছিলাম।

যৎকালে প্ৰথম প্রচারিত হয়, আমার এমন আশা ছিল না, বেতালপঞ্চবিংশতি সৰ্ব্বত্র পরিগৃহীত হইবেক। কিন্তু, সৌভাগ্যক্রমে, বাঙ্গালা ভাষার অনুশীলনকারী ব্যক্তিমাত্রেই আদরপূর্বক গ্ৰহণ করিয়াছেন, এবং এতদ্দেশীয় প্রায় সমুদায় বিদ্যালয়েই প্রচলিত হইয়াছে। ফলতঃ, দুই বৎসরের অনধিক কাল মধ্যেই প্রথম মুদ্রিত সমস্ত পুস্তক নিঃশেষ রূপে পৰ্য্যবসিত হয়।

প্রায় সংবৎসর অতিক্রান্ত হইল, পুস্তকের অসদ্ভাব হইয়াছে। কিন্তু, কোনও কোনও কারণবশতঃ, আমি পুনর্ম্মুদ্রাকরণে এ পর্য্যন্ত পরাঙ্মুখ ছিলাম। পরিশেষে, গ্রাহকমণ্ডলীর আগ্রহাতিশয় দর্শনে, দ্বিতীয় বার মুদ্রিত ও প্রচারিত করিলাম। যে যে স্থান কোনও অংশে অপরিশুদ্ধ ছিল, পরিশোধিত হইয়াছে, এবং অশ্লীল পদ, বাক্য, ও উপাখ্যানভাগ পরিত্যক্ত হইয়াছে। এক্ষণে বেতালপঞ্চবিংশতি পূর্ববৎ সর্বত্র পরিগৃহীত হইলে শ্রম সফল বোধ করিব।

শ্ৰীঈশ্বরচন্দ্ৰ শর্ম্মা
কলিকাতা।
১০ই ফাল্গুন। সংবৎ ১৯০৬।

————–

দশম সংস্করণের বিজ্ঞাপন

বেতালপঞ্চবিংশতি দশম বার প্রচারিত হইল। এই পুস্তক, এত দিন, বাঙ্গালা ভাষার প্রণালী অনুসারে, মুদ্রিত হইয়াছিল; সুতরাং, ইঙ্গরেজী পুস্তকে যে সকল বিরামচিহ্ন ব্যবহৃত হইয়া থাকে, পূর্ব পূর্ব সংস্করণে সে সমুদয় পরিগৃহীত হয় নাই। এই সংস্করণে সে সমস্ত সন্নিবেশিত হইল।

১৯০৩ সংবতে, বেতালপঞ্চবিংশতি প্ৰথম প্রচারিত হয়। ২৫ বৎসর অতীত হইলে, মদনমোহন তর্কালঙ্কারের জামাতা, শ্ৰীযুত বাবু যোগেন্দ্ৰনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এম. এ., তদীয় জীবনচরিত প্রচারিত করিয়াছেন। ঐ পুস্তকের ৪২ পৃষ্ঠায় লিখিত হইয়াছে—

বিদ্যাসাগরপ্রণীত বেতালপঞ্চবিংশতিতে অনেক নুতন ভাব ও অনেক সুমধুর বাক্য তর্কালঙ্কার দ্বারা অন্তর্নিবেশিত হইয়াছে। ইহা তর্কালঙ্কার দ্বারা এত দূর সংশোধিত ও পরিমার্জিত হইয়াছিল যে বোমাণ্ট ও ফ্লেচরের লিখিত গ্রন্থগুলির ন্যায়। ইহা উভয় বন্ধুর রচিত বলিলেও বলা যাইতে পারে।

যোগেন্দ্ৰ বাবু, কি প্রমাণ অবলম্বনপূর্বক, এরূপ অপ্রকৃত কথা লিখিয়া প্রচারিত করিলেন, বুঝিয়া উঠা কঠিন। আমি বেতালপঞ্চবিংশতি লিখিয়া, মুদ্রিত করিবার পূর্বে, শ্ৰীযুত গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ও মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে শুনাইয়াছিলাম। তাঁহাদিগকে শুনাইবার অভিপ্ৰায় এই যে, কোনও স্থল অসঙ্গত বা অসংলগ্ন বোধ হইলে, তাঁহারা স্ব স্ব অভিপ্ৰায় ব্যক্ত করিবেন; তদনুসারে, আমি সেই সেই স্থল পরিবর্ত্তিত করিব। আমার বিলক্ষণ স্মরণ আছে, কোনও কোনও উপাখ্যানে একটি স্থলও তাঁহাদের অসঙ্গত বা অসংলগ্ন বোধ হয় নাই, সুতরাং, সেই সেই উপাখ্যানের কোনও স্থলেই কোনও প্রকার পরিবর্ত্তন করিবার আবশ্যকতা ঘটে নাই। আর, যে সকল উপাখ্যানে তাঁহারা তদ্রূপ অভিপ্ৰায় প্ৰকাশ করিয়াছিলেন, সেই সেই উপাখ্যানে, স্থানে স্থানে, দুই একটি শব্দ মাত্র পরিবর্ত্তিত হইয়াছিল। বিদ্যারত্ন ও তর্কালঙ্কার ইহার অতিরিক্ত আর কিছুই করেন নাই। সুতরাং, “বেতালপঞ্চবিংশতি তর্কালঙ্কার দ্বারা এত দূর সংশোধিত ও পরিমাজিত হইয়াছিল যে ইহা উভয় বন্ধুর রচিত বলিলেও বলা যাইতে পারে”; যোগেন্দ্র বাবুর এই নির্দেশ, কোনও মতে, সঙ্গত বা ন্যায়ানুগত হয় নাই। শ্ৰীযুত গিরিশচন্দ্ৰ বিদ্যারত্ন অদ্যাপি বিদ্যমান আছেন। তিনি এক্ষণে সংস্কৃত কলেজে সংস্কৃত সাহিত্যশাস্ত্রের অধ্যাপক। এ বিষয়ে, তিনি, আমার জিজ্ঞাসার উত্তরে, যে পত্র লিখিয়াছেন, ঐ উত্তরপত্র, আমার জিজ্ঞাসাপত্রের সহিত, নিম্নে নিবেশিত হইতেছে।

অশেষগুণাশ্রয়
শ্ৰীযুত গিরিশচন্দ্ৰ বিদ্যারত্ন ভ্রাতৃপ্ৰেমাস্পদেষু

————-

সান্দরসম্ভাষণমাবেদনম্‌
তুমি জান কি না বলিতে পারি না, কিছু দিন হইল, সংস্কৃত কলেজের ভূতপূর্ব ছাত্ৰ শ্ৰীযুত বাবু যোগেন্দ্ৰনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এম. এ., মদনমোহন তর্কালঙ্কারের জীবনচরিত প্রচারিত করিয়াছেন। ঐ পুস্তকের ৪২ পৃষ্ঠায় লিখিত হইয়াছে, “বিদ্যাসাগরপ্রণীত বেতালপঞ্চবিংশতিতে অনেক নুতন ভাব ও অনেক সুমধুর বাক্য তর্কালঙ্কার দ্বারা অন্তর্নিবেশিত হইয়াছে। ইহা তর্কালঙ্কার দ্বারা এত দূর সংশোধিত ও পরিমার্জিত হইয়াছিল যে, বোমাণ্ট ও ফ্লেচরের লিখিত গ্রন্থগুলির ন্যায় ইহা উভয় বন্ধুর রচিত বলিলেও বলা যাইতে পারে”। বেতালপঞ্চবিংশতি সম্প্রতি পুনরায় মুদ্রিত হইতেছে। যোগেন্দ্ৰ বাবুর উক্তি বিষয়ে কিছু বলা আবশ্যক বোধ হওয়াতে, এই সংস্করণের বিজ্ঞাপনে তাহা ব্যক্ত করিব, স্থির করিয়াছি। বেতালপঞ্চবিংশতির সংশোধনবিষয়ে তর্কালঙ্কারের কত দূর সংস্রব ও সাহায্য ছিল, তাহা তুমি সবিশেষ জান। যাহা জান, লিপি দ্বারা আমায় জানাইলে, অতিশয় উপকৃত হইব। তোমার পত্ৰখানি, আমার বক্তব্যের সহিত, প্রচারিত করিবার অভিপ্ৰায় আছে, জানিবে ইতি।

ত্বদেকশর্ম্মশর্ম্মণঃ
শ্ৰীঈশ্বরচন্দ্ৰশৰ্ম্মণঃ
কলিকাতা।
১০ই বৈশাখ, ১২৮৩ সাল।

পরমশ্রদ্ধাস্পদ
শ্ৰীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগর মহাশয়
জ্যেষ্ঠভ্রাতৃপ্রতিমেয়ু

শ্ৰীযুত বাবু যোগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এম. এ. প্রণীত মদনমোহন তর্কালঙ্কারের জীবনচরিত গ্রন্থে বেতালপঞ্চবিংশতি সম্বন্ধে যাহা লিখিত হইয়াছে, তাহা দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন হইলাম। তিনি লিখিয়াছেন, “বিদ্যাসাগরপ্রণীত বেতালপঞ্চবিংশতিতে অনেক নূতন ভাব ও অনেক সুমধুর বাক্য তর্কালঙ্কার দ্বারা অন্তর্নিবেশিত হইয়াছে। ইহা তর্কালঙ্কার দ্বারা এত দূর সংশোধিত ও পরিমার্জিত হইয়াছিল যে, বোমাণ্ট ও ফ্লেচরের লিখিত গ্রন্থগুলির ন্যায় ইহা উভয় বন্ধুর রচিত বলিলেও বলা যাইতে পারে”। এই কথা নিতান্ত অলীক ও অসঙ্গত; আমার বিবেচনায়, এরূপ অলীক ও অসঙ্গত কথা লিখিয়া প্রচার করা যোগেন্দ্র বাবুর নিতান্ত অন্যায় কাৰ্য্য হইয়াছে।

এতদ্বিষয়ের প্রকৃত বৃত্তান্ত এই—আপনি, বেতালপঞ্চবিংশতি রচনা করিয়া, আমাকে ও মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে শুনাইয়াছিলেন। শ্রবণকালে আমরা মধ্যে মধ্যে স্ব স্ব অভিপ্রায় ব্যক্ত করিতাম। তদনুসারে, স্থানে স্থানে দুই একটি শব্দ পরিবর্তিত হইত। বেতালপঞ্চবিংশতি বিষয়ে, আমার অথবা তর্কালঙ্কারের, এতদন্তিরিক্ত কোন সংস্রব বা সাহায্য ছিল না।

আমার এই পত্ৰখানি মুদ্রিত করা যদি আবশ্যক বোধ হয়, করিবেন, তদ্বিষয়ে আমার সম্পূর্ণ সম্মতি ইতি।

সোদারাভিমানিনঃ
শ্রীগিরিশচন্দ্রশর্ম্মণঃ
কলিকাতা।
১২ই বৈশাখ, ১২৮৩ সাল।

যোগেন্দ্র বাবু স্বীয় শ্বশুরের জীবনচরিত পুস্তকে, আমার সংক্রান্ত যে সকল কথা লিখিয়াছেন, তাহার অধিকাংশই এইরূপ অমূলক। দৃষ্টান্তস্বরূপ আর একটি স্থল প্রদর্শিত হইতেছে। তিনি ১৮ পৃষ্ঠায় লিখিয়াছেন—

সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষের পদ শূন্য হইল। এরূপ শুনিতে পাই, বেথুন তর্কালঙ্কারকে এই পদ গ্রহণে অনুরোধ করেন। তিনি বিদ্যাসাগরকে ঐ পদের যোগ্য বলিয়া বেথুনের নিকট আবেদন করায়, বেথুন সাহেব বিদ্যাসাগর মহাশয়কেই ঐ পদে নিযুক্ত করিতে বাধ্য হইলেন। এই জনশ্রুতি যদি সত্য হয়, তাহা হইলে ইহা অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে যে তর্কালঙ্কারের ন্যায় সদাশয়, উদারচরিত ও বন্ধুহিতৈষী ব্যক্তি অতি কম ছিলেন। হৃদয়ের বন্ধুকে আপনি অপেক্ষা উচ্চতর পদে অভিষিক্ত করিয়া তর্কালঙ্কার বন্ধুত্বের ও ঔদার্য্যের পরা কাষ্ঠা দেখাইয়া গিয়াছেন।

গ্রন্থকৰ্ত্তার কল্পনাশক্তি ব্যতীত এ গল্পটির কিছুমাত্র মূল নাই। মদনমোহন তর্কালঙ্কার, ইঙ্গরেজী ১৮৪৬ সালে, সংস্কৃত কালেজে সাহিত্যশাস্ত্রের অধ্যাপকপদে নিযুক্ত হয়েন; ইঙ্গরেজী ১৮৫০ সালের নবেম্বর মাসে, মুরশিদাবাদের জজপণ্ডিত নিযুক্ত হইয়া, সংস্কৃত কালেজ হইতে প্ৰস্থান করেন। তর্কালঙ্কারের নিয়োগসময়েও, যিনি ( বাবু রসময় দত্ত ) সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষ ছিলেন, তর্কালঙ্কারের প্রস্থানসময়েও, তিনিই ( বাবু রসময় দত্ত) সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। ফলতঃ, তর্কালঙ্কার যত দিন সংস্কৃত কালেজে নিযুক্ত ছিলেন, সেই সময় মধ্যে, এক দিনের জন্যেও, ঐ বিদ্যালয়ে অধ্যক্ষের পদ শূন্য হয় নাই। সুতরাং, সংস্কৃত কালেজে অধ্যক্ষের পদ শূন্য হওয়াতে, বেথুন সাহেব মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে ঐ পদে নিযুক্ত করিতে উদ্যত হইলে, তর্কালঙ্কার, ঔদাৰ্য্যগুণের আতিশয্যাবশতঃ, আমাকে ঐ পদের যোগ্য বিবেচনা করিয়া, ও বন্ধুস্নেহের বশীভুত হইয়া, বেথুন সাহেবকে আমার জন্য অনুরোধ করাতে, আমি ঐ পদে নিযুক্ত হইয়াছিলাম, ইহা কি রূপে সম্ভাবিতে পারে, তাহা যোগেন্দ্ৰ বাবুই বলিতে পারেন।

আমি যে সূত্রে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষতাপদে নিযুক্ত হই, তাহার প্রকৃত বৃত্তাত্ত এই—মদনমোহন তর্কালঙ্কার, জজপণ্ডিত নিযুক্ত হইয়া, মুরশিদাবাদ প্ৰস্থান করিলে, সংস্কৃত কলেজে সাহিত্যশাস্ত্রের অধ্যাপকের পদ শূন্য হয়। শিক্ষাসমাজের তৎকালীন সেক্রেটারি, শ্ৰীযুক্ত ডাক্তর মোয়েট সাহেব, আমায় ঐ পদে নিযুক্ত করিবার অভিপ্ৰায় প্ৰকাশ করেন।[1] আমি, নানা কারণ দর্শাইয়া, প্রথমতঃ অস্বীকার করি। পরে, তিনি সবিশেষ যত্ন ও আগ্ৰহ প্ৰকাশ করাতে, আমি কহিয়াছিলাম, যদি শিক্ষাসমাজ আমাকে প্রিন্সিপালের ক্ষমতা দেন, তাহা হইলে আমি এই পদ স্বীকার করিতে পারি। তিনি আমার নিকট হইতে ঐ মর্মে একখানি পত্র লেখাইয়া লয়েন। তৎপরে ১৮৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে, আমি সংস্কৃত কালেজে সাহিত্যশ্যাস্ত্রের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হই। আমার এই নিয়োগের কিছু দিন পরে, বাবু রসময় দত্ত মহাশয় সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষতাপদ পরিত্যাগ করেন। সংস্কৃত কালেজের বর্ত্তমান অবস্থা, ও উত্তরকালে কিরূপ ব্যবস্থা করিলে, সংস্কৃত কালেজের উন্নতি হইতে পারে, এই দুই বিষয়ে রিপোর্ট করিবার নিমিত্ত, আমার প্রতি আদেশ প্রদত্ত হয়। তদনুসারে আমি রিপোর্ট সমৰ্পণ করিলে, ঐ রিপোর্ট দৃষ্টে সন্তুষ্ট হইয়া, শিক্ষাসমাজ আমাকে সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত করেন। সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষতাকাৰ্য্য, সেক্রেটারি ও আসিষ্টাণ্ট সেক্রেটারি, এই দুই ব্যক্তি দ্বারা নির্ব্বাহিত হইয়া আসিতেছিল; এই দুই পদ রহিত হইয়া, প্রিন্সিপালের পদ নূতন সৃষ্ট হইল। ১৮৫১ সালের জানুয়ারি মাসের শেষে, আমি সংস্কৃত কালেজের প্রিন্সিপাল অর্থাৎ অধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত হইলাম।

যোগেন্দ্র বাবুর গল্পটির মধ্যে, “এই জনশ্রুতি যদি সত্য হয়,” এই কথাটি লিখিত আছে। যাঁহারা, বহুকাল অবধি, সংস্কৃত কালেজে নিযুক্ত আছেন, অথবা যাঁহারা কোনও রূপে সংস্কৃত কালেজের সহিত কোনও সংস্রব রাখেন, তাঁহাদের মধ্যে কেহ কখনও এরূপ জনশ্রুতি কৰ্ণগোচর করিয়াছেন, এরূপ বোধ হয় না। যাহা হউক, যদিই দৈবাৎ ঐ রূপ অসম্ভব জনশ্রুতি কোনও সূত্রে যোগেন্দ্র বাবুর কর্ণগোচর হইয়াছিল, ঐ জনশ্রুতি অমূলক অথবা সমূলক, ইহার পরীক্ষা করা তাঁহার আবশ্যক বোধ হয় নাই। আবশ্যক বোধ হইলে, অনায়াসে তাঁহার সংশয়চ্ছেদন হইতে পারিত। কারণ, আমার নিয়োগবৃত্তান্ত সংস্কৃত কালেজ সংক্রান্ত তৎকালীন ব্যক্তিমাত্রেই বিলক্ষণ অবগত আছেন। যোগেন্দ্ৰ বাবু সংস্কৃত কালেজের ছাত্র; যে সময়ে তিনি আমার নিয়োগের উপাখ্যান রচনা করিয়াছেন, বোধ হয়, তখনও তিনি সংস্কৃত কালেজে অধ্যয়ন করিতেন। যদি সবিশেষ জানিয়া যথার্থ ঘটনার নির্দ্দেশ করা তাঁহার অভিপ্রেত হইত, তাহা হইলে, আমার নিয়োগ সংক্রান্ত প্রকৃত বৃত্তান্ত তাঁহার অপরিজ্ঞাত থাকিত না।

ইঙ্গরেজী ১৮৪৬ সালে, পূজ্যপাদ জয়গোপাল তর্কালঙ্কার মহাশয়ের লোকান্তরপ্রাপ্তি হইলে, সংস্কৃত কালেজে সাহিত্যশাস্ত্রের অধ্যাপকের পদ শূন্য হয়। সংস্কৃত কালেজের সেক্রেটারি বাবু রসময় দত্ত মহাশয় আমায় ঐ পদে নিযুক্ত করিবেন, স্থির করিয়াছিলেন।[2] আমি, বিশিষ্ট হেতুবশতঃ, অধ্যাপকের পদগ্রহণে অসম্মত হইয়া, মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে নিযুক্ত করিবার নিমিত্ত, সবিশেষ অনুরোধ করি।[3] তদনুসারে, মদনমোহন তর্কালঙ্কার ঐ পদে নিযুক্ত হয়েন। এই প্রকৃত বৃত্তান্তটির সহিত, যোগেন্দ্র বাবুর কল্পিত গল্পটির, বিলক্ষণ সৌসাদৃশ্য দৃশ্যমান হইতেছে।

শ্ৰীঈশ্বরচন্দ্ৰ শর্ম্মা
কলিকাতা।
১লা পৌষ, সংবৎ ১৯৩৩।

————–

[1] এই সময়ে আমি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে হেড রাইটর নিযুক্ত ছিলাম।
[2] এই সময়ে, আমি সংস্কৃত কালেজে আসিষ্টাণ্ট সেক্রেটারির পদে নিযুক্ত ছিলাম।
[3] এই সময়ে মদনমোহন তর্কালঙ্কার কৃষ্ণনগর কালেজে প্রধান পণ্ডিতের পদে নিযুক্ত ছিলেন।

————-

উপক্রমণিকা

উজয়িনী নগরে গন্ধৰ্বসেন নামে রাজা ছিলেন। তাঁহার চারি মহিষী। তাঁহাদের গর্ভে রাজার ছয় পুত্র জন্মে। রাজকুমারেরা সকলেই সুপণ্ডিত ও সর্ব বিষয়ে বিচক্ষণ ছিলেন। কালক্রমে, নৃপতির লোকান্তরপ্রাপ্তি হইলে, সর্বজ্যেষ্ঠ শঙ্কু সিংহাসনে অধিরোহণ করিলেন। তৎকনিষ্ঠ বিক্রমাদিত্য বিদ্যানুরাগ, নীতিপরতা ও শাস্ত্রানুশীলন দ্বারা
সবিশেষ বিখ্যাত ছিলেন; তথাপি, রাজ্যভোগের লোভসংবরণে অসমর্থ হইয়া, জ্যেষ্ঠের প্রাণসংহারপূর্বক, স্বয়ং রাজ্যেশ্বর হইলেন; এবং, ক্রমে ক্রমে, নিজ বাহুবলে, লক্ষযোজনাবিস্তীর্ণ জম্বুদ্বীপের অধীশ্বর হইয়া, আপন নামে অব্দ প্রচলিত করিলেন।

একদা, রাজা বিক্রমাদিত্য মনে মনে এই আলোচনা করিতে লাগিলেন, জগদীশ্বর আমায়, নানা জনপদের অধীশ্বর করিয়া, অসংখ্য প্ৰজাগণের হিতাহিতচিন্তার ভার দিয়াছেন। আমি, আত্মসুখে নির্বৃত হইয়া, তাহাদের অবস্থার প্রতি ক্ষণমাত্রও দৃষ্টিপাত করি না; কেবল অধিকৃতবর্গের বিবেচনার উপর নির্ভর করিয়া, নিশ্চিন্ত রহিয়াছি। তাহারা প্ৰজাগণের সহিত কিরূপ ব্যবহার করিতেছে, অন্ততঃ একবারও পরীক্ষা করিয়া দেখা উচিত। অতএব আমি, প্রচ্ছন্ন বেশে পৰ্যটন করিয়া, প্ৰজাগণের অবস্থা প্রত্যক্ষ করিব। অনন্তর তিনি, নিজ অনুজ ভর্তৃহরির হস্তে সমস্ত সাম্রাজ্যের ভারার্পণ করিয়া, সন্ন্যাসীর বেশে, দেশে দেশে ভ্ৰমণ করিতে লাগিলেন।

উজ্জয়িনীবাসী এক দরিদ্র ব্ৰাহ্মণ, বহু কাল, অতি কঠোর তপস্যা করিতেছিলেন। তিনি, আপন উপাস্য দেবতার নিকট বরস্বরূপ এক অমরফল পাইয়া, আনন্দিত মনে গৃহে আসিয়া, স্বীয় ব্ৰাহ্মণীকে বলিলেন, দেখ, দেবতা, তপস্যায় তুষ্ট হইয়া, আজ আমায় এই ফল দিয়াছেন; বলিয়াছেন, ইহা ভক্ষণ করিলে, নর অমর হয়। ব্ৰাহ্মণী শুনিয়া, অতিশয় খেদ করিয়া, কহিলেন, হায়! অমর হইয়া, আর কতকাল যন্ত্রণাভোগ করিবে। তুমি, কি সুখে, অমর হইবার অভিলাষ কর, বুঝিতে পারিতেছি না। বরং, এই দণ্ডে মৃত্যু হইলে, সাংসারিক ক্লেশ হইতে পরিত্রাণ হয়।

গৃহিণীর এই আক্ষেপবাক্য শুনিয়া, হতবুদ্ধি হইয়া, ব্ৰাহ্মণ কহিলেন, আমি তৎকালে, না বুঝিয়া, এই দেবদত্ত ফল লইয়াছিলাম; এক্ষণে, তোমার কথা শুনিয়া, আমার চৈতন্য হইল। এখন তুমি যেরূপ বলিবে, তাহাই করিব। ব্ৰাহ্মণী কহিলেন, এই ফল রাজা ভর্তৃহরিকে দিয়া, ইহার পরিবর্তে, পারিতোষিকস্বরূপ, কিঞ্চিৎ অর্থ লইয়া আইস; তাহা হইলে, অনায়াসে সংসারযাত্ৰা সম্পন্ন করিতে পরিবে।

ইহা শুনিয়া, ব্ৰাহ্মণ রাজার নিকটে উপস্থিত হইলেন এবং, যথাবিধি আশীৰ্বাদপ্রয়োগের পর, দেবদত্ত ফলের গুণব্যাখ্যা ও পূর্বাপর সমন্ত বৃত্তান্তের প্রকৃতরূপ বর্ণন করিয়া, বিনীত বচনে নিবেদন করিলেন, মহারাজ! আপনি, এই ফল লইয়া, আমায় কিছু অর্থ দেন। আপনি চিরজীবী হইলে, সমন্ত রাজ্যের মঙ্গল। রাজা, ফল গ্ৰহণ করিয়া, লক্ষমূদ্রাপ্ৰদানপূর্বক, ব্ৰাহ্মণকে বিদায় করিলেন এবং, নিতান্ত স্ত্ৰৈণতাবশতঃ, মনে মনে বিবেচনা করিলেন, যে ব্যক্তির চির জীবন ও স্থির যৌবন হইলে, আমি যাবজ্জীবন সুখী হইব, তাহাকেই এই ফল দেওয়া আবশ্যক। অনন্তর, অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া, রাজা প্ৰাণাধিক মহিষীর হস্তে ফল প্ৰদান করিলেন এবং কহিলেন, প্রিয়ে! তুমি আমার জীবন-সর্বস্ব; এই ফল খাও, চিরজীবিনী ও স্থিরযৌবনা হইবে। রাজ্ঞী, নিরতিশয় আহ্নলাদপ্রদর্শনপূর্বক, ফলগ্রহণ করিলেন। রাজা প্ৰীত মনে, সভায় প্রত্যাগমন করিয়া, অমাত্যবর্গের সহিত রাজকাৰ্য পৰ্যালোচনা করিতে লাগিলেন।

উজ্জয়িনীর নগরপাল রাজমহিষীর সাতিশয় প্রিয় পাত্র ছিল; তিনি, ঐ ফলের গুণব্যাখ্যা করিয়া, তাহার হস্তে সমর্পণ করিলেন। নগরপাল এক বারাঙ্গনাকে অত্যন্ত ভালবাসিত; সে, তাহার হস্তে প্ৰদানপূর্বক, ঐ ফলের সবিশেষ গুণবর্ণনা করিল। বারাঙ্গনা, ফল পাইয়া, মনে মনে বিবেচনা করিল, আমি অতি অধম জাতি, কুক্রিয়া দ্বারা উদরপূর্তি করি; আমার চিরজীবিনী হওয়া বিড়ম্বনা মাত্র। অতএব, এই ফল রাজাকে দেওয়া উচিত; রাজা চিরজীবী হইলে, অসংখ্য লোকের মঙ্গল হইবেক। অনন্তর, রাজার নিকটে গিয়া, বারবনিতা, বিনয়পূর্বক, নিবেদন করিল, মহারাজ! আমি এই এক অপূর্ব ফল পাইয়াছি; ইহা ভক্ষণ করিলে, নর অমর হয়; এই ফল আপনকার যোগ্য; আপনি গ্ৰহণ করুন।

রাজা, অমরফল বারাঙ্গনার হস্তগত দেখিয়া, বিস্ময়াপন্ন হইলেন; এবং, ফল লইয়া, পুরস্কারপ্রদানপূর্বক, তাহাকে বিদায় দিয়া, ভাবিতে লাগিলেন, এই ফল রাজ্ঞীকে দিয়াছি; ইহা কিরূপে বারাঙ্গনার হস্তগত হইল। পরে, সবিশেষ অনুসন্ধান দ্বারা, তিনি পূর্বাপর সমস্ত বৃত্তান্ত অবগত হইলেন এবং, সাংসারিক বিষয়ে নিরতিশয় বীতরাগ হইয়া, বিবেচনা করিতে লাগিলেন, সংসার অতি অকিঞ্চিৎকর, ইহাতে সুখের লেশমাত্র নাই; অতএব, বৃথা মায়ায় মুগ্ধ হইয়া, আর ইহাতে লিপ্ত থাকা, কোনও ক্রমে, শ্রেয়স্কর নহে। অতএব, সংসারযাত্রায় বিসর্জন দিয়া, অরণ্যে গিয়া, জগদীশ্বরের আরাধনায় প্রবৃত্ত হই; চরমে পরম পুরুষাৰ্থ মুক্তিপদার্থ প্রাপ্ত হইতে পারিব।

অন্তঃকরণে এইরূপ আলোচনা করিয়া, অন্তঃপুরে প্রবেশিয়া, রাজা রাজ্ঞীকে জিজ্ঞাসিলেন, তুমি সে ফল কি করিয়াছ। তিনি কহিলেন, ভক্ষণ করিয়াছি। রাজা, সাতিশয় বিরাগপ্রদর্শনপূর্বক, রাণীকে সেই ফল দেখাইলেন। রাণী, এক কালে, হতবুদ্ধি ও অধোবদন হইয়া রহিলেন, বাক্য নিঃসরণ করিতে পারিলেন না। রাজা ভর্তৃহরি, অবিলম্বে অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইয়া, প্রক্ষালনপূর্বক ফলভক্ষণ করিলেন। এবং, রাজ্যাধিকারে জলাঞ্জলি দিয়া, একাকী অরণ্যে গিয়া, যোগসাধনে প্ৰবৃত্ত হইলেন।

বিক্ৰমাদিত্যের সিংহাসন শূন্য রহিল। দেবরাজ, উজ্জয়িনীর অরাজকসংবাদ প্রাপ্ত হইবামাত্র, এক যক্ষকে রক্ষক নিযুক্ত করিয়া পাঠাইলেন। যক্ষ, সাতিশয় সতর্কতাপূর্বক, অহোরাত্ৰ, নগরীর রক্ষণাবেক্ষণ করিতে লাগিল। অল্পদিনের মধ্যেই, দেশে বিদেশে প্রচার হইল, রাজা ভর্তৃহরি, রাজত্বপরিত্যাগপূর্বক, বনপ্রস্থান করিয়াছেন। বিক্ৰমাদিত্য শ্রবণমাত্র, অতিমাত্র ব্যগ্র হইয়া, স্বদেশে প্রত্যাগমন করিলেন। তিনি, অর্ধারাত্র সময়ে, নগরে প্রবেশ করিতেছেন; এমন সময়ে, নগররক্ষক যক্ষ আসিয়া নিষেধ করিয়া কহিল, তুই কে, কোথায় যাইতেছিস, দাঁড়া, তোর নাম কি বল। রাজা কহিলেন, আমি বিক্ৰমাদিত্য, আপন নগরে যাইতেছি; তুই কে, কি নিমিত্তে আমার গতিরোধ করিতেছিস, বল।

যক্ষ কহিল, দেবরাজ ইন্দ্ৰ আমায় এই নগরের রক্ষক নিযুক্ত করিয়াছেন। তাঁহার অনুমতি ব্যতিরেকে, আমি তোমায় অসময়ে নগরে প্রবেশ করিতে দিব না। অথবা, যদি তুমি যথার্থই রাজা বিক্ৰমাদিত্য হও, অগ্রে আমার সহিত যুদ্ধ কর, পরে নগরে যাইতে দিব। রাজা শ্রবণমাত্র, বদ্ধপরিকর হইয়া, যুদ্ধার্থে প্ৰস্তুত হইলেন। যক্ষও, তৎক্ষণাং প্রস্তুত হইয়া, তাঁহার সম্মুখীন হইল। ঘোরতর সংগ্ৰাম হইতে লাগিল। পরিশেষে, রাজা, যক্ষকে ভূতলে ফেলিয়া, তাহার বক্ষঃস্থলে বসিলেন। তখন যক্ষ কহিল, মহারাজ! তুমি আমায় পরাভূত করিয়াছ। তোমার প্রভাব ও পরাক্রম দেখিয়া বুঝিতে পারিলাম, তুমি যথার্থই রাজা বিক্ৰমাদিত্য। এক্ষণে আমায় ছাড়িয়া দাও; আমি তোমায় প্ৰাণদান দিতেছি।

রাজা শুনিয়া ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, তুই বাতুল, নতুবা এরূপ অসঙ্গত কথা বলিবি কেন। তুই আমায় প্রাণদান কি দিবি; আমি মনে করিলে, এখনই তোর প্ৰাণদণ্ড করিতে পারি। যক্ষ শুনিয়া কিঞ্চিৎ হাস্য করিয়া কহিল, মহারাজ! যাহা কহিতেছ, তাহা সম্পূর্ণ যথার্থ, কিন্তু, আমি তোমায় আসন্ন মৃত্যু হইতে বাঁচাইতেছি, এজন্য এরূপ বলিতেছি। যাহা কহি, অবহিত হইয়া শ্রবণ কর। সবিশেষ সমস্ত অবগত হইয়া, তদনুযায়ী কাৰ্য করিলে, দীর্ঘজীবী হইবে, এবং নিরুদ্বেগে, অখণ্ড ভূমণ্ডলে, একাধিপত্য করিতে পরিবে। তখন ভূপতি, অতিশয় বিস্মিত ও উৎকণ্ঠিত হইয়া, যক্ষের বক্ষঃস্থল হইতে উত্থিত হইলেন। যক্ষও, ক্ষণ মধ্যে সমরশ্রান্তিপরিহারপূর্বক, বিক্ৰমাদিত্যকে সম্বোধিয়া, তদীয় জীবনসংক্রান্ত গৃঢ় বৃত্তান্ত তাঁহার গোচর করিতে আরম্ভ করিল।

মহারাজ! শ্রবণ কর,—

ভোগবতী নগরে, চন্দ্ৰভানু নামে অতি প্ৰতাপশালী নরপতি ছিলেন। তিনি, এক দিবস, মৃগয়ার অভিলাষে, কোনও অটবীতে প্ৰবিষ্ট হইয়া দেখিলেন, এক তপস্বী, অধঃশিরাঃ ও বৃক্ষে লম্ববান হইয়া, ধূমপান করিতেছেন। অনেক অনুসন্ধানের পর, তত্ৰত্য লোকের মুখে অবগত হইলেন, তপস্বী কাহারও সহিত বাক্যালাপ করেন না; বহুকাল অবধি, একাকী এইভাবে তপস্যা করিতেছেন। রাজা, সন্ন্যাসীর কঠোর ব্ৰত দর্শনে বিস্ময়াপন্ন হইয়া, নগর প্রত্যাবর্তন করিলেন; এবং পর দিন, যথাকালে, রাজসভায় অধিষ্ঠান করিয়া কহিলেন, হে অমাত্যবর্গ! হে সভাসদগণ! আমি গতকল্য, মৃগয়ায় গিয়া, বিপিনমধ্যে এক অদ্ভূত তপস্বী দেখিয়াছি; যদি কেহ তাঁহারে রাজধানীতে আনিতে পারে, তাহাকে লক্ষ মুদ্রা পারিতোষিক দিব।

এই রাজবাক্য নগর মধ্যে প্রচারিত হইলে, এক প্রসিদ্ধ বারবনিতা, নৃপতিসমীপে আসিয়া, নিবেদন করিল, মহারাজ! আজ্ঞা পাইলে, আমি, ঐ তাপসীর ঔরসে পুত্র জন্মাইয়া, ঐ পুত্র তাহার স্কন্ধে দিয়া, আপনকার সভায় আনিতে পারি। রাজা শুনিয়া সাতিশয় চমৎকৃত হইলেন এবং পরম সমাদরপূর্বক, বারনারীর উপর তাপসের আনয়নের ভারার্পণ করিলেন। সে ভূপালের নিয়োগ অনুসারে, যোগীর আশ্রমে উপস্থিত হইয়া দেখিল, যোগী যথার্থই মুদ্রিতনয়ন, অধঃশিরাঃ ও বৃক্ষে লম্বমান হইয়া, ধূমপান করিতেছেন; নিরতিশয় শীর্ণদেহ, কেহ কোনও প্রশ্ন করিলে উত্তর দেন না। তদ্দর্শনে বারযোষিৎ, সহসা সন্ন্যাসীর সমাধিভঙ্গ করা অসাধ্য জানিয়া তদীয় আশ্রমের অনতিদূরে এক সুশোভন উপবন ও তন্মধ্যে পরম রমণীয় বাসভবন নির্মিত করাইল এবং নানা উপায় চিন্তিয়া, পরিশেষে, যুক্তিপূর্বক, মোহনভোগ প্রস্তুত করিয়া, ধূমপায়ী তপস্বীর আস্যে অৰ্পিত করিল। তপস্বী, রসনাসংযোগ দ্বারা মিষ্ট বোধ হওয়াতে, ক্ৰমে ক্ৰমে সমুদয় ভক্ষণ করিলেন। বারাঙ্গনা পুনরায় দিল; তিনিও পুনরায় ভক্ষণ করিলেন।

এইরূপে, ক্ৰমাগত কতিপয় দিবস, মোহনভোগ উপযোগ করিয়া, শরীরে কিঞ্চিৎ বলসঞ্চার হইলে, সন্ন্যাসী, নেত্ৰদ্ধয় উল্মীলিত করিয়া, তরু হইতে অবতীর্ণ হইলেন, এবং বারনারীকে জিজ্ঞাসিলেন, তুমি কে, কি অভিপ্ৰায়ে, একাকিনী এই নির্জন বনস্থানে আগমন করিয়াছ। সে কহিল, আমি দেবকন্যা, দেবলোকে তপস্যা করি; সম্প্রতি, তীৰ্থপৰ্যটনপ্রসঙ্গে, পরম পবিত্র কর্মক্ষেত্র ভারতবর্ষে আসিয়া, যোগাভ্যাসবাসনায়, অনতিদূরে আশ্রমনির্মাণ করিয়াছি; নিয়ত তথায় অবস্থিতি করি। অদ্য সৌভাগ্যক্ৰমে, এই আশ্রমে প্রবেশ করিয়া, আপনকার সন্দর্শন ও সম্ভাষণানুগ্রহ দ্বারা, চরিতার্থতা প্রাপ্ত হইলাম। তপস্বী কহিলেন, আমি, তোমার সৌজন্য ও সুশীলতা দর্শনে, পরম পরিতোষ প্রাপ্ত হইয়াছি, এবং তোমার মধুর মূর্তি সন্দর্শনে আত্মাকে চরিতার্থ বোধ করিতেছি; যেহেতু জন্মান্তরীণ পুণ্যসঞ্চয় ব্যতিরেকে, সাধুসমাগম লব্ধ হয় না। যাহা হউক, তোমার আশ্রম দেখিবার নিমিত্ত, আমার অতিশয় বাসনা হইতেছে। যদি প্রতিবন্ধক না থাকে, ও অধিক দূরবর্তী না হয়, আমায় তথায় লইয়া চল।

বারবিলাসিনী, তপস্বীর অভ্যর্থনা শ্রবণে কৃতাৰ্থম্মন্য ও অতিমাত্র ব্যগ্ৰ হইয়া, তাঁহাকে আপন আলয়ে লইয়া গেল, এবং, সাতিশয় যত্ন ও সবিশেষ সমাদর পুরঃসর, নানাবিধ সুম্বাদ মিষ্টান্ন ও সুরস পানীয় প্রদান করিল। তিনি, বারনারীর কপটজালে বন্ধ হইয়া, তাহার দত্ত সমস্ত বস্তু ভক্ষণ ও পান করিলেন। এইরূপে, তপস্বী, ধূমপান পরিত্যাগপূর্বক, যোগাভ্যাসে জলাঞ্জলি দিয়া, বারবনিতার সহিত বিষয়বাসনায় কালব্যাপন করিতে লাগিলেন। বারাঙ্গনা গর্ভবতী ও যথাকালে পুত্রবতী হইল। কিছুদিন অতীত হইলে পর, সে সন্ন্যাসীর নিকট নিবেদন করিল, মহাশয়। বহু দিবস অতিক্রান্ত হইল, আমরা নিরন্তর কেবল বিষয়বাসনায় কালাহরণ করিলাম; এক্ষণে তীর্থযাত্রা দ্বারা দেহ পবিত্র করা উচিত।

বারবনিতা, এইরূপ প্রবঞ্চনা দ্বারা, তপস্বীকে সংজ্ঞাশূন্য করিয়া, তাঁহার স্কন্ধে পুত্রপ্রদানপূর্বক, চন্দ্ৰভানুর রাজধানীতে লইয়া চলিল। সে রাজসভার সমীপবৰ্তিনী হইলে, রাজা তাহাকে চিনিতে পারিয়া, এবং সন্ন্যাসীর স্কন্ধে পুত্ৰ দেখিয়া, সামাজিকদিগকে বলিলেন, দেখ দেখ, যে বারনারী যোগীর আনয়নবিষয়ে প্ৰতিজ্ঞা করিয়া গিয়াছিল, সে আপন প্রতিজ্ঞা পূৰ্ণ করিয়া আসিতেছে। আমি উহার অসম্ভব বুদ্ধিকৌশলে চমৎকৃত হইয়াছি। অধিক আর কি বলিব, এই বুদ্ধিমতী বারবনিতা চিরশুষ্ক নীরস তরুকে পল্লবিত এবং পুষ্পে ও ফলে সুশোভিত করিয়াছে। সামাজিকেরা কহিলেন, মহারাজ! যথার্থ আজ্ঞা করিতেছেন; এ সেই বারাঙ্গনাই বটে।

রাজা ও সভাসদগণের এইরূপ কথোপকথন শ্রবণে, সহসা বোধসুধাকরের উদয় হওয়াতে, সন্ন্যাসীর মোহান্ধকার অপসারিত হইল। তখন তিনি, পূর্বাপরপর্যালোচনা করিয়া, যৎপরোনাস্তি ক্ষোভ প্রাপ্ত হইলেন এবং আপনাকে বারংবার ধিক্কার দিয়া, মনে মনে কহিতে লাগিলেন, দুরাত্মা চন্দ্ৰভানু, ঐশ্বৰ্যমদে মত্ত ও ধর্মাধৰ্মজ্ঞানশূন্য হইয়া আমার তপস্যাভ্রংশের নিমিত্ত এই দুর্বিগাহ মায়াজাল বিস্তারিত করিয়াছিল। আমিও অতি অধম ও অবশেন্দ্ৰিয়; অনায়াসে স্বৈরিণীর মায়ায় মুগ্ধ হইয়া, চিরসঞ্চিত কর্মফলে বঞ্চিত হইলাম। অনন্তর, ক্ৰোধে কম্পান্বিতকলেবর হইয়া স্কন্ধস্থিত পুত্রকে ভূতলে নিক্ষিপ্ত করিয়া, তিনি তৎক্ষণাৎ তথা হইতে প্ৰস্থান করিলেন; অন্য এক অরণ্যে প্রবেশপূর্বক, পূর্ব অপেক্ষায় অধিকতর মনোযোগ ও অধ্যবসায় সহকারে, যোগসাধন করিতে লাগিলেন, এবং, কিয়াৎ কাল পরে, ঐ নরেশ্বরের মৃত্যুসাধন করিয়া, কৃতকাৰ্য হইলেন।

এইরূপে, আখ্যায়িকার সমাপন করিয়া, যক্ষ কহিল, মহারাজ! তুমি, ও রাজা চন্দ্ৰভানু, আর ঐ যোগী, এই তিন জন এক নগরে, এক নক্ষত্রে, এক লগ্নে, জন্মিয়াছিলো। তুমি, রাজবংশে জন্মগ্রহণ করিয়া পৃথিবীর রাজত্ব করিতেছ। চন্দ্ৰভানু, তৈলিকাগৃহে জন্মিয়া ভাগ্যক্রমে ভোগবতী নগরীর অধিপতি হইয়াছিল। আর, যোগী, কুম্ভকারকুলে উৎপন্ন হইয়া যত্নপূর্বক যোগসাধন করিয়া চন্দ্ৰভানুর প্রাণবধ করিয়াছে, এবং তাঁহাকে বেতাল করিয়া শ্মশানবর্তী শিরীষবৃক্ষে লন্বিত করিয়া রাখিয়াছে; এক্ষণে, অনন্যকর্মা হইয়া, তোমার প্রাণসংহার করিবার চেষ্টায় আছে; ইহাতে কৃতকাৰ্য হইলেই, উহার অভীষ্ট সিদ্ধ হয়। যদি তুমি তাহার হস্ত হইতে নিস্তার পাও, বহুকাল অকণ্টকে রাজ্যভোগ করিতে পরিবে। আমি, সবিশেষ সমস্ত কহিয়া, তোমায় সতর্ক করিয়া দিলাম; তুমি এ বিষয়ে ক্ষণমাত্রও অনবহিত থাকিবে না।

এইরূপ উপদেশ দিয়া, যক্ষ স্বস্থানে প্ৰস্থান করিল। রাজাও শুনিয়া, ত্ৰস্ত ও বিস্ময়গ্ৰস্ত হইয়া, নানাপ্রকার চিন্তা করিতে করিতে, রাজবাটীতে প্রবিষ্ট হইলেন। পর দিন প্রভাতে, তিনি সিংহাসনে উপবিষ্ট হইলে, ভৃত্যগণ ও প্ৰজাবৰ্গ, বহুদিনের পর, রাজসন্দর্শন প্ৰাপ্ত হইয়া, আনন্দপ্রবাহে মগ্ন হইল। রাজা বিক্ৰমাদিত্য, রাজনীতির অনুবর্তী হইয়া, রাজ্যশাসন ও প্ৰজাপালন করিতে লাগিলেন।

কিছুদিন পরে, শান্তশীল নামে এক সন্ন্যাসী, শ্ৰীফল হস্তে রাজসভায় উপস্থিত হইলেন এবং শ্ৰীফলপ্ৰদানপূর্বক রাজাকে আশীৰ্বাদ করিয়া, কক্ষস্থিত আসন পাতিয়া, তদুপরি উপবেশন করিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ কথোপকথন করিয়া, রাজার নিকট বিদায় লইয়া, সন্ন্যাসী সভা হইতে প্ৰস্থান করিলে পর, তিনি অন্তঃকরণে এই বিতর্ক করিতে লাগিলেন, যক্ষ যে সন্ন্যাসীর কথা কহিয়াছিল, এ সেই ব্যক্তি কিনা। যাহা হউক, সহসা শ্ৰীফলভক্ষণ করা উচিত নহে। রাজা, মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, কোষাধ্যক্ষের হন্তে সমর্পণপূর্বক কহিলেন, তুমি এই শ্ৰীফল সাবধানে রাখিবে। সন্ন্যাসী প্ৰত্যহ রাজদর্শন ও শ্ৰীফলপ্ৰদান করিতে লাগিলেন।

এক দিবস রাজা, বয়স্যবর্গ সমভিব্যাহারে, মন্দুরাসিন্দর্শনার্থ গমন করিয়াছেন, এমন সময়ে সন্ন্যাসী তথায় উপস্থিত হইয়া, পূর্ববং শ্ৰীফলপ্রদানপূর্বক, আশীৰ্বাদ করিলেন। দৈবযোগে, শ্ৰীফল ভূপতির করতল হইতে ভূতলে পতিত ও ভগ্ন হওয়াতে, তন্মধ্য হইতে এক অপূর্ব রত্ন নিৰ্গত হইল। রাজা ও রাজবয়স্যগণ তদীয় প্ৰভা দর্শনে চমৎকৃত হইলেন। রাজা যোগীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, মহাশয়। আপনি কি জন্যে আমায় এই রত্নগর্ভ শ্ৰীফল দিলেন।

যোগী কহিলেন, মহারাজ! শাস্ত্রে রাজা, গুরু, জ্যোতির্বিদ, ও চিকিৎসকের নিকট রিক্ত হস্তে যাইতে নিষেধ আছে; এইজন্যে, আমি এই রত্নগৰ্ভ শ্ৰীফল লইয়া আসিয়াছিলাম। আর, এক রত্নগৰ্ভ শ্ৰীফলের কথা কি কহিতেছেন, প্রতিদিন আপনাকে যে শ্ৰীফল দিয়াছি, সকলের মধ্যেই এতাদৃশ এক এক রত্ন আছে। তখন রাজা কোষাধ্যক্ষকে ডাকাইয়া কহিলেন, তোমাকে যত শ্ৰীফল রাখিতে দিয়াছি, সমুদয় এই স্থানে আন। কোষাধ্যক্ষ, রাজকীয় আদেশ অনুসারে, সমস্ত শ্ৰীফল তথায় উপস্থিত করিলে, রাজা প্রত্যেক শ্রীফল ভাঙ্গিয়া, সকলের মধ্যেই এক এক রত্ন দেখিয়া যৎপরোনাস্তি আহ্লাদিত ও চমৎকৃত হইলেন এবং, তৎক্ষণাৎ রাজসভায় গমনপূর্বক, এক মণিকারকে ডাকাইয়া, ঐ সমস্ত রত্বের পরীক্ষা করিতে আজ্ঞা দিয়া কহিলেন, এই অসার সংসারে ধর্মই সার পদার্থ; অতএব, তুমি ধর্মপ্রমাণ প্রত্যেক রত্বের মূল্য নির্ধারিত করিয়া দাও।

এইরূপ রাজবাক্য শ্রবণগোচর করিয়া, মণিকার কহিল, মহারাজ! আপনি যথার্থ আজ্ঞা করিয়াছেন। ধর্মরক্ষা করিলে, সকল বিষয়ের রক্ষা হয়; ধর্মলোপ করিলে সকল বিষয়ের লোপ হয়। অতএব, আমি ধৰ্মীসাক্ষী করিয়া প্ৰতিজ্ঞা করিতেছি, আপন জ্ঞান অনুসারে, যথার্থ মূল্য নির্ধারিত করিয়া দিব। ইহা কহিয়া, সে প্রত্যেক রত্নের লক্ষণপরীক্ষা করিয়া কহিল, মহারাজ! বিলক্ষণ বিবেচনা করিয়া দেখিলাম, সকল রত্নই সর্বাঙ্গসুন্দর; কোটি মুদ্রাও একৈকের প্রকৃত মূল্য নহে। এ সকল অমূল্য রত্ন।

রাজা শুনিয়া, সাতিশয় হৃষ্ট হইয়া, সমুচিত পারিতোষিক প্রদানপূর্বক, মণিকারকে বিদায় করিলেন এবং, হস্তদ্বারা সন্ন্যাসীর হস্তগ্রহণ করিয়া, সিংহাসনার্থে উপবেশন করাইয়া কহিলেন, মহাশয়! আমার, সমস্ত সাম্রাজ্যও আপনকার প্রদত্ত রত্নসমূহের তুল্যমূল্য হইবেক না। আপনি, সন্ন্যাসী হইয়া এ সকল অমূল্য রত্ন কোথায় পাইলেন, এবং কি অভিপ্ৰায়েই বা আমায় দিলেন, জানিতে ইচ্ছা করি। যোগী কহিলেন, মহারাজ! ঔষধ, মন্ত্রণা, গৃহচ্ছিদ্র, এসকল সর্বসমক্ষে ব্যক্ত করা বিধেয় নহে; যদি অনুমতি হয়, নির্জনে গিয়া নিবেদন করি। মহারাজ! নীতিজ্ঞেরা বলেন, মন্ত্রণা, ষট্ কৰ্ণে প্রবিষ্ট হইলে, অপ্রকাশিত থাকে না, তাহাতে কাৰ্যহানির সম্পূর্ণ সম্ভাবনা; চারিকর্ণে হইলে, প্রকাশিত হয় না, অথচ কাৰ্যসিদ্ধি করে; আর, দুই কর্ণের মন্ত্রণা, মনুষ্যের কথা দূরে থাকুক, ব্ৰহ্মাও জানিতে পারেন না।

ইহা শুনিয়া, রাজা সন্ন্যাসীকে নির্জনে লইয়া কহিতে লাগিলেন, যোগীশ্বর। আপনি আমায় এত রত্ন দিলেন, কিন্তু একদিনও আমার আলয়ে ভোজন বা জলগ্রহণ করিলেন না; এজন্য, আমি আপনকার নিকট অতিশয় লজ্জিত হইতেছি। আপনকার কোনও অভিপ্রায় থাকে, ব্যক্ত করুন: আমি প্রাণান্তেও তৎসম্পাদনে পরাঙ্মুখ হইব না। সন্ন্যাসী কহিলেন, মহারাজ! গোদাবরীতীরবর্তী শ্মশানে মন্ত্র সিদ্ধ করিবার সঙ্কল্প করিয়াছি; তাহাতে অষ্টসিদ্ধি লাভ হইবেক। অতএব, তোমার নিকট আমার প্রার্থনা এই, তুমি একদিন, সন্ধ্যা অবধি প্রভাত পর্যন্ত, আমার সন্নিহিত থাকিবে। তুমি সন্নিহিত থাকিলেই, আমার মন্ত্র সিদ্ধ হইবেক। রাজা কহিলেন, অবধারিত যাইব; আপনি দিন নির্ধারিত করিয়া বলুন। সন্ন্যাসী কহিলেন, তুমি, আগামী ভাদ্রীকৃষ্ণচতুর্দশীতে, সন্ধ্যাকালে, একাকী আমার নিকটে যাইবে। রাজা কহিলেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকিবেন; আমি, নিঃসন্দেহ, যথাসময়ে, আপনকার আশ্রমে উপস্থিত হইব। এইরূপে রাজাকে বচনবদ্ধ করিয়া, বিদায় লইয়া, সন্ন্যাসী স্বীয় আশ্রমে প্ৰতিগমন করিলেন।

কৃষ্ণচতুর্দশী উপস্থিত হইল। সন্ন্যাসী, সায়ং সময়ে, আবশ্যক দ্রব্যসামগ্রীর সংগ্ৰহপূর্বক, শ্মশানে যোগাসনে বসিলেন। রাজা বিক্ৰমাদিত্যও, প্রতিশ্রুত সময় সমুপস্থিত দেখিয়া, সাহসে নির্ভর করিয়া, করে তরবারি ধারণপূর্বক, একাকী সন্ন্যাসীর আশ্রমে উপস্থিত হইলেন; দেখিলেন, বহুসংখ্যক বিকটাকৃতি ভূত, প্ৰেত, পিশাচ, শঙ্খিনী, ডাকিনী প্রভৃতি আনন্দে উন্মত্তপ্রায় হইয়া, সন্ন্যাসীর চতুর্দ্দিকে নৃত্য করিতেছে; সন্ন্যাসী, যোগাসনে আসীন হইয়া, দুই হস্তে দুই নরকপাল লইয়া, বাদ্য করিতেছেন। রাজা, এতাদৃশ্য ভয়াবহ ব্যাপার দর্শনে, কিঞ্চিম্মাত্র ভীত হইলেন না; যথোপযুক্ত ভক্তিযোগ সহকারে প্রণাম করিয়া, কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিলেন, মহাশয়! ভৃত্য উপস্থিত; আদেশ দ্বারা চরিতার্থ করিতে আজ্ঞা হয়। যোগী, আশীৰ্বাদপ্রয়োগপূর্বক, সমীপপাতিত আসনের দিকে অঙ্গুলি প্রয়োগ করিয়া কহিলেন, এই আসনে উপবেশন কর।

রাজা, তদীয় আদেশ অনুসারে, আসন পরিগ্রহ করিয়া, কিয়ৎক্ষণ পরে, পুনরায় নিবেদন করিলেন, মহাশয়! ভৃত্যের প্রতি কি আজ্ঞা হয়। যোগী কহিলেন, মহারাজ! তোমার বাক্যনিষ্ঠায় নিরতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছি। বুঝিলাম, সৎপুরুষেরা, প্ৰাণান্তেও, প্ৰতিজ্ঞাপ্রতিপালনে পরাঙ্মুখ হয়েন না। যাহা হউক, যদি অনুগ্ৰহ করিয়া আসিয়াছ, এক বিষয়ে আমার সাহায্য কর। দুই ক্রোশ দক্ষিণে এক শ্মশান আছে; তথায় দেখিতে পাইবে, এক শিরীষবৃক্ষে শব ঝুলিতেছে; ঐ শব আমার নিকটে লাইয়া আইস। রাজা, যে আজ্ঞা বলিয়া, তৎক্ষণাৎ প্ৰস্থান করিলেন। এইরূপে, রাজাকে শবানয়নে প্রেরণপূর্বক, যথাবিধি বিবিধ আয়োজন করিয়া, সন্ন্যাসী পূজায় বসিলেন।

একে কৃষ্ণচতুর্দশীর রাত্ৰি সহজেই ঘোরতর অন্ধকারে আবৃত; তাহাতে আবার, ঘনঘটা দ্বারা গগনমণ্ডল আচ্ছন্ন হইয়া মুষলধারায় বৃষ্টি হইতেছিল; আর, ভূতপ্ৰেতগণ চতুর্দ্দিকে ভয়ানক কোলাহল করিতেছিল। এইরূপ সঙ্কটে কাহার হৃদয়ে না ভয়সঞ্চার হয়। কিন্তু রাজার তাহাতে ভয় বা ব্যাকুলতার লেশমাত্ৰ উপস্থিত হইল না। পরিশেষে, নানা সঙ্কট হইতে উত্তীর্ণ হইয়া, রাজা নির্দ্দিষ্ট প্ৰেতভূমিতে উপনীত হইলেন; দেখিলেন, কোনও স্থলে অতি বিকটমূর্তি ভূতপ্ৰেতগণ, জীবিত মনুষ্য ধরিয়া, তাহাদের মাংস ভক্ষণ করিতেছে; কোনও স্থলে ডাকিনীগণ, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালক ধরিয়া, তদীয় অঙ্গপ্ৰত্যঙ্গ চর্বণ করিতেছে। রাজা, ইতস্ততঃ অনেক অন্বেষণ করিয়া, পরিশেষে শিরীষবৃক্ষের নিকটে গিয়া দেখিলেন, উহার মূল অবধি অগ্রভাগ পর্যন্ত, প্ৰত্যেক বিটপ ও পল্লব ধক্‌ ধক্‌ করিয়া জ্বলিতেছে; আর, চারিদিকে অনবরত কেবল মার্‌ মার্, কাট্ কাট্ ইত্যাদি ভয়ানক শব্দ হইতেছে।

এই সমস্ত দেখিয়া শুনিয়াও রাজা ভয় পাইলেন না; কিন্তু মনে মনে বিবেচনা করিয়া স্থির করিলেন, যক্ষ যে যোগীর কথা কহিয়াছিল, এ সেই ব্যক্তি, তাহার সন্দেহ নাই। অনন্তর, তিনি সেই বৃক্ষের সন্নিহিত হইয়া দেখিলেন, শব রজ্জুবদ্ধ, অধঃশিরাঃ, লম্বমান রহিয়াছে। শবদর্শনে শ্রম সফল বোধ করিয়া, রাজা সাতিশয় আহ্লাদিত হইলেন। এবং, নিৰ্ভয়ে বৃক্ষে আরোহণপূর্বক, খড়গাঘাত দ্বারা, শবের বন্ধনরজ্জ্ব ছিন্ন করিলেন। শব, ভূতলে পতিত হইবামাত্ৰ, উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিল। রাজা, তদীয় কণ্ঠরব শ্ৰবণে, সাতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন, এবং ত্বরায় তরু হইতে অবতীর্ণ হইয়া, নিকটে গিয়া জিজ্ঞাসিলেন, তুমি কে, কি নিমিত্তে তোমার এরূপ দুরবস্থা ঘাঁটিয়াছে, বল। শব খিল্ খিল্ করিয়া হাসিয়া উঠিল। রাজা, দেখিয়া শুনিয়া, সাতিশয় বিস্ময়াপন্ন ও চিন্তান্বিত হইলেন, এবং এই অদ্ভুত ব্যাপারের মর্মাববোধে অসমৰ্থ হইয়া, অন্তঃকরণে অশেষপ্রকার কল্পনা করিতে লাগিলেন।

এই অবকাশে শব, বৃক্ষে উঠিয়া পূর্ববৎ রজ্জুবদ্ধ ও লম্বমান হইয়া রহিল। রাজাও তৎক্ষণাৎ বৃক্ষে আরোহণ ও রজ্জুচ্ছেদন পুরঃসর, শবকে কক্ষে নিক্ষিপ্ত করিয়া অবতীর্ণ হইলেন, এবং নিরতিশয় নির্বন্ধ সহকারে, তাহার এরূপ বিপৎপ্রাপ্তির কারণ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। সে কিছুই উত্তর দিল না। রাজা, ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া, মনে মনে কহিতে লাগিলেন, যক্ষের নিকট যে তৈলিকের উপাখ্যান শুনিয়াছিলাম, এ সেই ব্যক্তি; আর, যোগীও সেই কুম্ভকার, আপনি যোগসিদ্ধির উদ্দেশে, ইহার প্রাণসংহার করিয়া, শ্মশানে রাখিয়াছে। অনন্তর তিনি, শবকে উত্তরীয়বস্ত্ৰে বদ্ধ করিয়া, যোগীর নিকটে লইয়া চলিলেন।

অর্ধপথে উপস্থিত হইলে, শবাবিষ্ট বেতাল বিক্ৰমাদিত্যকে জিজ্ঞাসিল, অহে বীর পুরুষ! তুমি কে, আমায়, কি নিমিত্তে, কোথায়, লইয়া যাইতেছ, বল। ভূপতি কহিলেন, আমি রাজা বিক্ৰমাদিত্য; শান্তশীল নামক যোগীর আদেশ অনুসারে, তোমায় তাঁহার আশ্রমে লইয়া যাইতেছি। বেতাল কহিল, মহারাজ! মূঢ়, নিৰ্বোধ, ও অলসেরা কেবল নিদ্রায়, আলস্যে ও কলহে কালাহরণ করে; কিন্তু বুদ্ধিমান, চতুর, পণ্ডিত ব্যক্তিরা, সদা সদালাপ, শাস্ত্রচিন্তা, ও সৎকর্মের অনুষ্ঠান দ্বারা, আনন্দে কালযাপন করিয়া থাকেন। অতএব, সমস্ত পথ মৌনভাবে গমন করা অপেক্ষা, সৎকথার আলোচনা শ্ৰেয়সী বোধ করিয়া, এক এক প্রসঙ্গ করিতেছি, শ্রবণ কর। প্রত্যেক প্রসঙ্গের পরিশেষে প্রশ্ন করিব; যদি তুমি তত্তৎ প্রশ্নের প্রকৃত উত্তর দাও, তৎক্ষণাৎ ফিরিয়া যাইব; আর, যদি জানিয়াও যথার্থ উত্তর না দাও, অবিলম্বে তোমার বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ হইবেক। রাজা, অগত্যা তদীয় প্রস্তাবে সন্মত হইয়া, তাহাকে সন্ন্যাসীর আশ্রমে লইয়া চলিলেন এবং বেতালও উপাখ্যানের আরম্ভ করিল।

০১. প্রথম উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ! শ্রবণ কর,

বারাণসী নগরীতে, প্রতাপমুকুট নামে, এক প্রবলপ্ৰতাপ নরপতি ছিলেন। তাঁহার মহাদেবী নামে প্ৰেয়সী মহিষী ও বজ্রমুকুট নামে হৃদয়নন্দন নন্দন ছিল। একদিন রাজকুমার, একমাত্র অমাত্যপুত্রকে সমভিব্যাহারে লইয়া, মৃগয়ায় গমন করিলেন। তিনি নানা বনে ভ্রমণ করিয়া, পরিশেষে এক নিবিড় অরণ্যে প্রবেশপূর্বক, ঐ অরণ্যের মধ্যবর্তী অতি মনোহর সরোবর সন্নিধানে উপস্থিত হইলেন; দেখিলেন, ঐ সরোবরের নির্মল সলিলে হংস, বক, চক্ৰবাক প্রভৃতি নানাবিধ জলচর বিহঙ্গমগণ কেলি করিতেছে; প্রফুল্ল কমলসমূহের সৌরভে চারিদিক আমোদিত হইয়া আছে; মধুকরেরা, মধুগন্ধে অন্ধ হইয়া গুন গুন ধ্বনি করত, ইতস্ততঃ ভ্ৰমণ করিতেছে; তীরস্থিত তরুগণ অতিনব পল্লব, ফল, কুসুম সমূহে সুশোভিত রহিয়াছে; উহাদের ছায়া অতি স্নিগ্ধ; বিশেষতঃ, শীতল সুগন্ধ গন্ধবহের মন্দ মন্দ সঞ্চার দ্বারা, পরম রমনীয় হইয়া আছে; তথায় উপস্থিতি মাত্র, শ্রান্ত ও আতপক্লান্ত ব্যক্তির শ্রান্তি ও ক্লান্তি দূর হয়।

এই পরম রমণীয় স্থানে, কিয়ৎক্ষণ সঞ্চরণ করিয়া, রাজকুমার অশ্ব হইতে অবতীর্ণ হইলেন, এবং সমীপবর্তী বকুলবৃক্ষের স্কন্ধে অশ্ববন্ধন ও সরোবরে অবগাহনপূর্বক, স্নান করিলেন; অনন্তর, অনতিদূরবর্তী দেবাদিদেব মহাদেবের মন্দিরে প্রবেশপূর্বক, দর্শন, পূজা, ও প্ৰণাম করিয়া কিয়ৎ ক্ষণ পরে বহির্গত হইলেন। ঐ সময়মধ্যে এক রাজকন্যাও, স্বীয় সহচরী বর্গের সহিত, সরোবরের অপর পারে উপস্থিত হইয়া স্নান ও পূজা সমাপনপূর্বক, বৃক্ষের ছায়ায় ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। দৈবযোগে, তাঁহার ও বজ্রমুকুটের চারি চক্ষুঃ একত্র হইল। তদীয় নিরুপম সৌন্দর্য সন্দর্শনে, নৃপনন্দন মোহিত হইলেন। রাজকুমারীও, বজ্রমুকুটকে নয়নগোচর করিয়া, কৃতাৰ্থন্মন্য হইয়া, শিরঃস্থিত পদ্ম হন্তে লইলেন; অনন্তর, কর্ণসংযুক্ত করিয়া, দন্ত দ্বারা ছেদনপূর্বক, পদতলে নিক্ষিপ্ত করিলেন; পুনর্বার গ্রহণ ও হৃদয়ে স্থাপন করিয়া, বারংবার রাজতনয়ের দিকে সতৃষ্ণ দৃষ্টিপাত করিতে করিতে, স্বীয় প্ৰিয়বয়স্যাগণের সহিত স্বস্থানে প্ৰস্থান করিলেন।

কুমারী ক্ৰমে ক্ৰমে দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইলে, রাজকুমার বিরহবেদনায় অতিশয় অস্থির হইলেন, এবং সর্বাধিকারিকুমারের নিকটে গিয়া, লজ্জানম্র মুখে কহিতে লাগিলেন, বয়স্য! আজি আমি এক পরম সুন্দরী রমণী নিরীক্ষণ করিয়াছি; তাহার নাম ধাম কিছুই জানিতে পারি নাই; কিন্তু প্ৰতিজ্ঞা করিয়াছি, তাহাকে না পাইলে, প্ৰাণত্যাগ করিব। সর্বাধিকারিতনয়, সমস্ত শ্ৰবণগোচর করিয়া, তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে গৃহে প্রত্যানীত করিলেন। রাজকুমার, দুঃসহ বিরহবেদনায় নিতান্ত অধীর হইয়া, শাস্ত্রচিন্তা, সদালাপ, রাজকাৰ্যপর্যালোচনা, ও স্নান ভোজন প্ৰভৃতি আবশ্যক ক্রিয়া পর্যন্ত পরিত্যাগপূর্বক, একাকী নির্জনে বিষন্ন মনে কালব্যাপন করিতে লাগিলেন; পরিশেষে চিত্তবিনোদনের কোনও উপায় না দেখিয়া স্বহস্তে সেই কামিনীর প্রতিমূর্তি চিত্ৰিত করিলেন। দিন যামিনী, কেবল সেই প্ৰতিমূর্তির সন্দর্শন করেন; কাহারও সহিত বাক্যালাপ করেন না; কেহ কিছু জিজ্ঞাসা করিলে, উত্তর দেন না। সৰ্বাধিকারিপুত্র, নৃপনন্দনের এতাদৃশী দশা নিরীক্ষণ করিয়া, উপদেশচ্ছলে অশেষপ্রকার ভর্ৎসনা করিলেন।

প্রিয় বয়স্যের উপদেশবাক্য শ্ৰবণগোচর করিয়া, রাজকুমার কহিলেন, সখে! আমি যখন এ পদবীতে পদার্পণ করিয়াছি, তখন আমার হিতাহিতচিন্তা ও সুখদুঃখবিবেচনা নাই। প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, মনোরথ সম্পন্ন না হইলে, জীবনবিসর্জন করিব। রাজকুমারের ঈদৃশ আক্ষেপবাক্য কর্ণগোচর করিয়া, সৰ্বাধিকারিকুমার মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিলেন, আর এখন উপদেশ দ্বারা ধৈৰ্যসম্পাদনের সময় নাই; ইনি নিতান্ত অধীর হইয়াছেন; অতঃপর কোনও উপায় স্থির করা আবশ্যক। অনন্তর, তিনি রাজকুমারকে জিজ্ঞাসা করিলেন, বয়স্য! প্ৰস্থানকালে, সেই সীমন্তিনী তোমাকে কিছু বলিয়াছিল, কিংবা তুমি তাহাকে কিছু বলিয়াছিলে। রাজপুত্র কহিলেন, না বয়স্য! আমি তাহাকে কিছু বলি নাই; এবং সেই সৰ্বাঙ্গসুন্দরীও আমায় কোনও কথা বলে নাই। তখন সৰ্বাধিকারিপুত্ৰ কহিলেন, তবে তাহার সমাগম দুর্ঘট বোধ হইতেছে। রাজপুত্ৰ কহিলেন, যদি সেই সুলোচনা লোচনানন্দদায়িনী না হয়, আমি প্ৰাণত্যাগ করিব। তখন তিনি, অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া, পুনরায় কহিলেন, ভাল বয়স্য! জিজ্ঞাসা করি, প্ৰস্থানসময়ে, সে কোনও সঙ্কেত করিয়াছিল কি না।

রাজকুমার কমলবৃত্তান্ত বর্ণনা করিলেন। তখন সৰ্বাধিকারিপুত্ৰ কহিলেন, সখে! আর চিন্তা নাই; আমি তৎকৃত সঙ্কেতের তাৎপর্যগ্ৰহ করিয়াছি, এবং তাহার নাম ধাম জানিতে পারিয়াছি। এখন প্ৰতিজ্ঞা করিতেছি, অল্প দিনের মধ্যেই, তাহার সহিত তোমার সমাগম সম্পন্ন করিয়া দিব। অধিক ব্যাকুল হইলেই, অভীষ্টসিদ্ধি হয় না; ধৈৰ্য অবলম্বন কর। তখন রাজপুত্ৰ কহিলেন, যদি বুঝিয়া থাক, সমুদয় বিশেষ করিয়া বল; শুনিলেও, আপাততঃ স্থির হইতে পারি। তিনি কহিলেন, বয়স্য! শ্ৰবণ কর, পদ্মপুষ্প, মস্তক হইতে নামাইয়া, কৰ্ণে সংলগ্ন করিয়াছিল; তদ্বারা তোমাকে ইহা জানাইয়াছে, আমি কর্ণাটনগরীনিবাসিনী; দন্ত দ্বারা খণ্ডিত করিয়া, ইহা ব্যক্ত করিয়াছে, আমি দন্তবাট রাজার কন্যা; তৎপরে, পদতলে নিক্ষিপ্ত করিয়া, এই সঙ্কেত করিয়াছে, আমার নাম পদ্মাবতী; আর, হৃদয়ে স্থাপন করিয়া, এই অভিপ্ৰায় প্রকাশ করিয়াছে, তুমি আমার হৃদয়বল্লভ।

বয়স্যের এই বাক্য শ্রবণগোচর করিয়া রাজকুমার অপার আনন্দসাগরে মগ্ন হইলেন; এবং ব্যগ্র হইয়া বারংবার কহিতে লাগিলেন, বয়স্য! ত্বরায় আমায় কর্ণাটনগরে লইয়া চল। অনন্তর, উভয়ে সমুচিত পরিচ্ছদধারণ ও অস্ত্ৰবন্ধনপূর্বক অশ্বে আরোহণ করিলেন। কতিপয় দিবসের পরে, কর্ণাটনগরে উপস্থিত হইয়া, তাঁহারা রাজবাটীর নিকটে গিয়া দেখিলেন, এক বৃদ্ধ আপন ভবনদ্বারে উপবিষ্টা আছে। উভয়ে, অশ্ব হইতে অবতীর্ণ হইয়া, তাহার নিকটে গিয়া কহিলেন, মা! আমরা বাণিজ্যব্যবসায়ী বিদেশীয় লোক; দ্রব্যসামগ্ৰী সমগ্র পশ্চাৎ আসিতেছে; বাসার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত, আমরা অগ্রসর হইয়াছি; যদি কৃপা করিয়া স্থান দাও, তবে থাকিতে পাই। বৃদ্ধা, তাঁহাদের মনোহর রূপ দর্শনে ও মধুর আলাপ শ্রবণে প্ৰীত হইয়া, প্ৰসন্ন মনে কহিল, এ তোমাদের গৃহ, যতদিন ইচ্ছা, সচ্ছন্দে অবস্থিতি কর।

এইরূপে, উভয়ে সেই বর্ষীয়সীর সদনে আবাসগ্রহণ করিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে বৃদ্ধা, তাঁহাদের সন্নিধানে আগমন করিয়া, কথোপকথন আরম্ভ করিলে, সৰ্বাধিকারিপুত্র জিজ্ঞাসা করিলেন, মা! কয়জন তোমার পরিবার, আর কি প্রকারে বা সংসারযাত্ৰানিৰ্বাহ হয়। বৃদ্ধা কহিল, আমার পুত্র রাজসংসারে কর্ম করে, রাজার অতি প্ৰিয় পাত্র। আর, পদ্মাবতী নামে রাজার এক কন্যা আছেন, আমি তাঁহার ধাত্রী ছিলাম। এক্ষণে বৃদ্ধ হইয়াছি, গৃহে থাকি; রাজা অনুগ্ৰহ করিয়া অন্ন বস্ত্ৰ দেন। আর, রাজকন্যা আমায় ভালবাসেন; এজন্য, প্রতিদিন, এক একবার, তাঁহাকে দেখিতে যাই। এই কথা শুনিয়া, রাজপুত্ৰ কহিলেন, কল্য যখন রাজবাটীতে যাইবে, আমায় বলিবে; আমি তোমা দ্বারা রাজকন্যার নিকট কোনও সংবাদ পাঠাইব। বৃদ্ধা কহিল, যদি প্রয়োজন থাকে, বল, আজই আমি রাজকন্যাকে জানাইয়া আসি। রাজকুমার, এই কথা শুনিবা মাত্র, অতিমাত্র হৃষ্ট হইয়া কহিলেন, তুমি রাজকন্যাকে বলিবে, শুক্লপঞ্চমীতে, সরোবরতীরে, যে রাজকুমারকে দেখিয়াছিলে, সে, তোমার সঙ্কেত অনুসারে, উপস্থিত হইয়াছে।

এই বাক্য কর্ণগোচর হইবামাত্র, বৃদ্ধা যষ্টিগ্রহণপূর্বক রাজভবনে গমন করিল। সে কন্যান্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া দেখিল, রাজকন্যা একাকিনী নির্জনে উপবিষ্টা আছেন। বৃদ্ধা সম্মুখবর্তিনী হইবামাত্র, রাজকন্যা সমাদরপূর্বক বসিতে আসন দিলেন। সে উপবিষ্ট হইয়া কহিল, বৎসে। বাল্যকালে, অনেক যত্নে, তোমায় মানুষ করিয়াছি। এক্ষণে, ভগবানের অনুগ্ৰহে, তুমি তরুণাবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছ। আমার অন্তঃকরণের একান্ত অভিলাষ এই, অবিলম্বে উপযুক্ত পাত্রের হস্তগতা হও। এইরূপ আড়ম্বরপূর্বক ভূমিকা করিয়া, বৃদ্ধা কহিতে লাগিল, শুক্লপঞ্চমীতে, বাপীতটে, যে রাজকুমারের মন হরণ করিয়া আনিয়াছিলে, তিনি আমার গৃহে উপস্থিত হইয়াছেন, এবং আমা দ্বারা এই সংবাদ পঠাইয়াছেন, কমলসঙ্কেত দ্বারা যে অভিপ্ৰায় প্ৰকাশ করিয়াছিলে, তাহা সম্পন্ন কর; আমি উপস্থিত হইয়াছি। আর, আমিও কহিতেছি, এই রাজকুমার সর্বাংশে তোমার যোগ্য পাত্র; তুমি যেরূপ রূপবতী ও গুণবতী, তিনিও সর্বাংশে তদনুরূপ।

রাজকন্যা শ্রবণমাত্র, কোপ প্রকাশ করিয়া, হস্তে চন্দন লেপনপূর্বক, বৃদ্ধর উভয় গণ্ডে চপেটাঘাত করিলেন, এবং কহিলেন, তুমি এই মূহুর্তে আমার অন্তঃপুর হইতে দূর হও। বৃদ্ধা, এইপ্ৰকার তিরস্কার লাভ করিয়া, বিরক্ত হইয়া, বিষন্ন বদনে সদনে প্রত্যাগমনপূর্বক, পূর্বাপর সমস্ত বৃত্তান্ত রাজকুমারের কর্ণগোচর করিল। তিনি শ্রবণমাত্র, অতিমাত্র ব্যাকুল ও হতাশ্বাস হইয়া, দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্বক, পার্শ্ববর্তী প্রিয় বয়স্যের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া কহিতে লাগিলেন, সখে। এখন কি উপায় করি; নিতান্ত বুঝিলাম, বিধি বাম হইয়াছেন; মনস্কামসিদ্ধির কোনও সম্ভাবনা আছে, এরূপ বোধ হইতেছে না; নতুবা, সেই বামলোচনা, কি নিমিত্ত, তিরস্কার করিয়া, বৃদ্ধাকে বিদায় করিল। অন্তঃকরণে অনুরাগ সঞ্চার হইলে, দূতীর প্রতি এত অনাদর হয় না। তখন তিনি কহিলেন, বয়স্য! মৰ্মগ্রহ না করিয়া, অকারণে এত ব্যাকুল হও কেন। শ্ৰীখণ্ডরসে অভিষিক্ত দশ করশাখা দ্বারা প্ৰহারের তাৎপৰ্য এই যে, শুক্ল পক্ষের দশ দিবস অবশিষ্ট আছে; তদবসানে, অর্থাৎ কৃষ্ণ পক্ষে তোমার সহিত সমাগম হইবেক।

শুক্ল পক্ষ অতিক্রান্ত হইল। বৃদ্ধা, পুনরায় রাজকুমারীর নিকটে গিয়া, রাজকুমারের প্রার্থনা জানাইল। তিনি শুনিয়া সাতিশয় কোপপ্ৰকাশ করিলেন; এবং, গলহস্তপ্রদানপূর্বক, বৃদ্ধাকে, অন্তঃপুরের খড়কী দিয়া, বিদায় করিয়া দিলেন। সে, তৎক্ষণাৎ রাজকুমারের নিকটে গিয়া, এই বৃত্তান্ত জানাইল। তিনি শুনিয়া, নিতান্ত হতাশ্বাস হইয়া, দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্বক, অধোমুখে চিন্তা করিতে লাগিলেন। তখন সৰ্বাধিকারীর পুত্ৰ কহিলেন, বয়স্য! কেন উৎকণ্ঠিত হইতেছে, আর ভাবনা নাই; এ অনুকুল গলহস্ত, অপ্ৰশস্ত নহে; তুমি পূর্ণমনোরথ হইয়াছ। অন্য রজনীযোগে, তোমায়, সেই খড়কী দিয়া, তাহার অন্তঃপুরে যাইতে সঙ্কেত করিয়াছে। রাজপুত্র, আহ্লাদসাগরে মগ্ন হইয়া, নিতান্ত উৎসুক চিত্তে, সূৰ্যদেবের অস্তগমনপ্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।

রজনী উপস্থিত হইল। রাজকুমার, বিহারযোগ্য বেশভূষার সমাধান করিয়া, প্রিয় বয়স্যের সহিত, অন্তঃপুরের খড়কীতে উপস্থিত হইলেন। সর্বাধিকারীর পুত্র বহির্ভাগে দণ্ডায়মান রহিলেন; তিনি, তন্মধ্যে দিয়া, অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন; দেখিলেন, রাজকুমারী তাঁহার প্রতীক্ষা করিতেছেন। নয়নে নয়নে আলিঙ্গন হওয়াতে, উভয়ে চরিতার্থতা প্রাপ্ত হইলেন। রাজকুমারী, পার্শ্ববর্তিনী বয়স্যার প্রতি, দ্বার বদ্ধ করিবার আদেশ দিয়া, রাজকুমারের করগ্রহণপূর্বক, বিলাসভবনে প্রবেশ করিলেন, এবং সুশোভিত স্বর্ণময় পল্যঙ্কে উপবেশনানন্তর, বল্লভের কণ্ঠদেশে স্বহস্তসঙ্কলিত ললিত মালতীমালা সমৰ্পণ করিয়া, স্বয়ং তালবৃন্তসঞ্চালন করিতে লাগিলেন। তখন রাজকুমার কহিলেন, প্রিয়ে! তোমার বদনসুধাকরসন্দর্শনেই, আমার চিত্তচকোর চরিতার্থ হইয়াছে, আর এরূপ ক্লেশস্বীকারের প্রয়োজন নাই; বিশেষতঃ, তোমার কোমল করপল্লব শিরীষ কুসুম অপেক্ষাও সুকুমার, কোনও ক্রমে তালবৃন্তধারণের যোগ্য নহে; আমার হস্তে দাও; আমি তোমার সেবা দ্বারা আত্মাকে চরিতার্থ করি। পদ্মাবতী কহিলেন, নাথ! আমার জন্য, তোমায় অনেক ক্লেশভোগ করিতে হইয়াছে; অতএব, তোমার সেবা করাই আমার উচিত হয়।

উভয়ের এইরূপ বচনবৈদগ্ধী শ্ৰবণগোচর করিয়া, পার্শ্ববর্তিনী সহচরী, পদ্মাবতীর হস্ত হইতে তালবৃন্ত গ্রহণপূর্বক, বায়ুসঞ্চারণ করিতে লাগিল। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, রাজকুমার ও রাজকুমারী সহচরীদিগকে সাক্ষী করিয়া, গান্ধৰ্ব বিধানে, দাম্পত্যবন্ধনে আবদ্ধ হইলেন। অনন্তর, উভয়ের সাত্ত্বিক ভাবের আবির্ভাব দেখিয়া, সহচরীগণ, কার্যান্তরব্যপদেশে, বিলাসভবন হইতে বহির্গত হইলে, কান্ত ও কামিনী কৌতুকে যামিনী যাপন করিলেন।

রজনী অবসন্না হইল। রাজকুমার অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইবার অভিপ্ৰায় প্রকাশ করিলেন। তখন রাজকুমারী কহিলেন, নাথ! আমার এ অন্তঃপুরে, সখীগণ ব্যতিরেকে, অন্যের প্রবেশ করিবার অধিকার নাই; তুমি নিৰ্ভয়ে অবস্থিতি কর। আমি, তোমায় বিদায় দিয়া, ক্ষণমাত্রও প্রাণধারণ করিতে পারিব না। রাজকুমার, প্রিয়তমার ঈদৃশ প্রণয়রসাভিষিক্ত মৃদু মধুর বচন পরম্পরা শ্রবণে শ্রবণেন্দ্রিয়ের চরিতার্থতা লাভ করিয়া, তদীয় প্ৰস্তাবে সম্মত হইলেন, এবং তাঁহার সহচর হইয়া, পরম সুখে, কালব্যাপন করিতে লাগিলেন।

এইরূপে কতিপয় দিবস অতিবাহিত হইলে, রাজকুমার রাজধানীপ্ৰতিগমনের অভিপ্রায়প্ৰকাশ করিলেন। রাজকন্যা, কোনও মতে, সম্মত হইলেন না। ক্রমে ক্রমে, প্রায় মাস অতীত হইয়া গেল; রাজকুমার তথাপি প্ৰস্থানের অনুমতিলাভ করিতে পারিলেন না। এইরূপে, স্বদেশপ্ৰতিগমনবিষয়ে নিতান্ত নিরুপায় হইয়া, তিনি একদিন, নির্জনে বসিয়া মনে মনে এই আলোচনা করিতে লাগিলেন, আমি নিতান্ত নরাধম; অকিঞ্চিৎকর ইন্দ্ৰিয়সুখের পরতন্ত্র হইয়া, পিতা মাতা জন্মভূমি প্রভৃতি সকল পরিত্যাগ করিলাম; আর, যে জীবিতাধিক বান্ধবের বুদ্ধিকৌশলে ও উপদেশবলে, ঈদৃশ অসুলভ সুখসম্ভোগে কালাহরণ করিতেছি, মাসাবধি তাহারও কোনও সংবাদ লইলাম না; বোধ করি, বন্ধু আমায় নিতান্ত স্বার্থপর ও যার পর নাই অকৃতজ্ঞ ভাবিতেছেন।

রাজকুমার একাকী এইরূপ চিন্তা করিতেছেন, এমন সময়ে রাজকন্যা তথায় উপস্থিত হইয়া, তাঁহাকে সাতিশয় বিষন্ন দেখিয়া জিজ্ঞাসিলেন, নাথ! আজি কি জন্যে তুমি এমন উন্মনা হইয়াছ। তোমার চন্দ্ৰবদন বিষন্ন দেখিলে, আমি দশ দিক শূন্য দেখি। অসুখের কারণ কি, বল; ত্বরায় তাহার প্রতিবিধান করিতেছি। বজ্রমুকুট কহিলেন, পিতার সর্বাধিকারীর পুত্র আমার সমভিব্যাহারে আসিয়াছেন। তিনি আমার পরম সুহৃৎ; মাসাবধি তাঁহার কোনও সংবাদ পাই নাই; জানি না, তিনি কেমন আছেন। তিনি অতি চতুর, সর্বশাস্ত্ৰে পণ্ডিত, ও নানা গুণরত্নে মণ্ডিত। তাঁহারই বুদ্ধিকৌশলে ও মন্ত্রণাবলে, তোমার সমাগম লাভ করিয়াছি। তিনিই তোমার সমস্ত সঙ্কেতের মর্মোদ্ভেদ করিয়াছিলেন।

পদ্মাবতী কহিলেন, অয়ি নাথ! ঈদৃশ বন্ধুর অদর্শনে, চিত্ত অবশ্যই উৎকণ্ঠিত হইতে পারে। এত দিন তাহার কোনও সংবাদ না লওয়ায়, যৎপরোনাস্তি অভদ্রতা প্ৰকাশ হইয়াছে। রহস্যবিদ বন্ধু প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয়তর। বিবেচনা করিয়া দেখিলে, তুমি তাঁহার নিকট সম্পূর্ণ অপরাধী হইয়াছ, এবং, যার পর নাই, অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করিয়াছ। এক্ষণকার কর্তব্য এই, তাহার পরিতোষার্থে, আমি স্বহস্তে নানাবিধ মিষ্টান্ন প্রস্তুত করিয়া পাঠাই; এবং তুমিও, একবার, কিয়ৎ ক্ষণের নিমিত্ত, তথায় গিয়া, সমুচিত সদ্ভাবপ্রদর্শন করিয়া আইস। রাজপুত্র, তৎক্ষণাৎ, সেই খড়কী দিয়া, অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইয়া, বৃদ্ধার ভবনে উপস্থিত হইলেন, এবং, বহু দিবসের পর, অকপটপ্রণয় পবিত্র মিত্র সহ সাক্ষাৎকারলাভে অশ্রুপূর্ণলোচনা হইয়া, তাঁহার নিকট পূর্বাপর সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণন করিলেন।

রাজপুত্রকে বন্ধুদর্শনে প্রেরণ করিয়া, রাজকন্যা মনে মনে এই আলোচনা করিতে লাগিলেন, এ কেবল বন্ধুর বুদ্ধিকৌশলেই কৃতকাৰ্য হইয়াছে; অতএব অবশ্যই সকল কথা তাঁহার নিকট ব্যক্ত করিবেক; আর, সে ব্যক্তিও আপনি বান্ধবগণের নিকট, সমস্ত প্ৰকাশ করিবেক, সন্দেহ নাই। এইরূপে আমার কলঙ্কঘোষণা, ক্রমে ক্রমে, জগদ্ব্যাপিনী হইবার সম্ভাবনা। অতএব, এতাদৃশ ব্যক্তিকে জীবিত রাখা, কোনও ক্ৰমে, শ্রেয়স্কর নহে। এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়া, পদ্মাবতী, অবিলম্বে নানাবিধ বিষমিশ্ৰিত মিষ্টান্ন প্ৰস্তুত করিয়া সখী দ্বারা রাজকুমারের নিকট পাঠাইয়া দিলেন।

মিষ্টান্ন উপনীত হইলে, সর্বাধিকারিপুত্র জিজ্ঞাসা করিলেন, বয়স্য। এ সকল কি। রাজপুত্ৰ কহিলেন, মিত্র। আজ আমি তোমার জন্য অতিশয় উৎকণ্ঠিত হইয়াছিলাম। রাজকন্যা, আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া, কারণজিজ্ঞাসু হইলে, আমি তোমার সবিশেষ পরিচয় দিয়া ও অশেষবিধ প্ৰশংসা করিয়া বলিলাম, প্রিয়ে! আমি এই বন্ধুর অদর্শনে বিষন্ন হইতেছি। রাজকন্যা, তোমার সবিশেষ পরিচয় পাইয়া, সাতিশয় সন্তষ্ট হইয়াছেন, এবং আমায় অগ্ৰে পাঠাইয়া দিয়া, স্বহস্তে এই সমস্ত প্ৰস্তুত করিয়া, তোমার জন্য প্রেরণ করিয়াছেন। আমায় বলিয়া দিয়াছেন, তুমি আপন সমক্ষে তাঁহাকে মিষ্টান্ন ভোজন করাইয়া আসিবে। অতএব বয়স্য! কিছু ভক্ষণ কর, তাহা হইলে পরম পরিতোষ পাই, এবং যাইয়া তাঁহার নিকটে বলিতে চাই, আমার বন্ধু, মিষ্টান্ন আহার করিয়া, তোমার শিল্পনৈপুণ্যের অশেষপ্রকার প্রশংসা করিয়াছেন।

এই সকল কথা শুনিয়া, সর্বাধিকারিপুত্র, কিয়ৎ ক্ষণ মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন; অনন্তর রাজপুত্রের মুখে পুনর্বার মনোযোগপূর্বক পূর্বাপর সমস্ত শ্ৰবণ করিয়া কহিলেন, বয়স্য! তুমি আমার জন্যে কালকূট আনিয়াছ; এ মিষ্টান্ন নহে, সাক্ষাৎ কৃতান্ত, জিহ্বাস্পৰ্শমাত্রই প্ৰাণসংহার করিবেক। আমার পরম সৌভাগ্য এই, তুমি খাও নাই। তুমি নিতান্ত ঋজুস্বভাব, কাহার কি ভাব, কিছুই বুঝিতে চেষ্টা কর না। তোমায় এক সার কথা বলি, স্বৈরিণীরা, স্বভাবতঃ, আপনি প্ৰিয়ের প্ৰিয় পাত্রের উপর অতিশয় বিষদৃষ্টি হয়। অতএব, তুমি, তাহার নিকট আমার পরিচয় দিয়া, বুদ্ধির কার্য কর নাই।

রাজকুমার কহিলেন, বয়স্য। আমি তোমার এ কথায় বিশ্বাস করিতে পারি না। তুমি তাঁহার স্বভাব জান না, এজন্য এরূপ কহিতেছ। এমন সদাশয় স্ত্রীলোক তুমি কখনও দেখ নাই। তাঁহার নাম করিলে, আমার রোমাঞ্চ হয়। আর, আমি, সমবেত সখীগণ সমক্ষে, ধর্ম সাক্ষী করিয়া, গান্ধৰ্ব বিধানে, তাঁহার পাণিগ্রহণ করিয়াছি; এমন স্থলে, স্বৈরিণীশব্দে তাঁহার নির্দেশ করা, কোনও মতে, ন্যায়ানুগত হইতেছে না। সে যাহা হউক, তিনি যেমন চারুশীলা, তেমনই উদারশীলা, তিনি তোমার প্রাণসংহারের নিমিত্ত, মিষ্টান্নাচ্ছলে কালকূট পাঠাইয়াছেন, তুমি কেমন করিয়া এমন কথা মুখে আনিলে, বুঝিতে পারিতেছি না। বলিতে কি, তুমি আর বার এ প্রকার কহিলে, আমি তোমার উপর যার পর নাই, বিরক্ত হইব। ভাল, কথায় প্রয়োজন নাই, আমি তোমার সন্দেহ দূর করিতেছি। এই বলিয়া, এক লাড়ু লইয়া, রাজকুমার বিড়ালকে ভক্ষণ করাইলেন। বিড়াল তৎক্ষণাৎ পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইল। তখন রাজপুত্ৰ চকিত হইয়া কহিতে লাগিলেন, এরূপ দুর্বৃত্তার সহিত পরিচয় রাখা কদাচি উচিত নহে। আর আমি, জন্মাবচ্ছেদে, সে পাপীয়সীর মুখাবলোকন করিব না। মন্ত্ৰিপুত্র কহিলেন, না বয়স্য। তাহারে একবারে পরিত্যাগ করা হইবেক না; কৌশল করিয়া, রাজধানীতে লইয়া যাইতে হইবেক। রাজপুত্ৰ কহিলেন, তাহাও তোমার বুদ্ধিসাধ্য।

অমাত্যপুত্ৰ কহিলেন, বয়স্য! এক পরামর্শ বলি, শুন। আজ তুমি, পদ্মাবতীর নিকটে গিয়া, পূর্ব অপেক্ষা অধিকতর প্রণয়প্রদর্শন করিবে, এবং বলিবে, বন্ধু, মিষ্টান্ন ভক্ষণের অব্যবহিত পরক্ষণেই, অচেতন্যপ্ৰায় হইয়া, নিদ্রাগত হইয়াছেন। আমি, তোমায় দেখিবার নিমিত্ত নিতান্ত উৎসুক হইয়া, তাঁহার নিদ্ৰাভঙ্গ পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে না পারিয়া, চলিয়া আসিয়াছি। আমি এখন, তোমায় এক ক্ষণ নিরীক্ষণ না করিলে, দশ দিক শূন্য দেখি। ফলতঃ, আর আমি, বন্ধুর অনুরোধে এক মুহুর্তের নিমিত্তেও, তোমায় পরিত্যাগ করিয়া যাইতে পারিব না। এবম্প্রকার মনোহরবাক্যপ্রয়োগ দ্বারা, তাহারে মোহিত করিয়া, দিবাযাপন করিবে; অনন্তর, রাত্রিতে সে নিদ্রাগিতা হইলে, তদীয় সমস্ত আভরণ হরণপূর্বক, তাহার বাম জঙ্ঘাতে ত্ৰিশূলের চিহ্ন দিয়া, চলিয়া আসিবে। রাজপুত্র সম্মত হইলেন, এবং পদ্মাবতীর নিকটে গিয়া বিলক্ষণ প্রীতিপ্ৰদৰ্শন করিলেন। পরে, রজনীযোগে, উভয়ে শয়ন করিলে, রাজকন্যা ত্বরায় নিদ্রাভিভূত হইলেন। তখন রাজকুমার, মন্ত্রিপুত্রের উপদেশানুরূপ সমস্ত ব্যাপার সম্পন্ন করিয়া, বৃদ্ধার আবাসে উপস্থিত হইলেন।

পর দিন, প্রভাতে, মন্ত্রিপুত্র, সন্ন্যাসীর বেশধারণপূর্বক, এক শ্মশানে উপস্থিত হইলেন, এবং স্বয়ং গুরু হইয়া রাজপুত্রকে শিষ্য করিয়া কহিলেন, তুমি নগরে গিয়া এই অলঙ্কার বিক্রয় কর। যদি কেহ তোমায় চোর বলিয়া ধরে, তাহারে আমার নিকটে লইয়া আসিবে। রাজপুত্র, তদীয় উপদেশ অনুসারে, নগরে প্রবেশ করিয়া রাজসদনের সমীপবাসী স্বর্ণকারের নিকট, রাজকন্যার অলঙ্কারবিক্রয়ার্থে উপস্থিত হইলেন। সে, দর্শনমাত্র, বিস্ময়াপন্ন হইয়া, মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিল, কিছুদিন হইল, আমি রাজকন্যার নিমিত্ত এই সকল অলঙ্কার গড়িয়া দিয়াছি; ইহার হন্তে কি প্রকারে আইল। এ ব্যক্তিকে বৈদেশিক দেখিতেছি। অনন্তর, সাতিশয় সন্দিহান হইয়া, স্বর্ণকার কারিকরদিগকে জিজ্ঞাসা করাতে, তাহারা কহিল, হ্যাঁ, এ সমস্ত রাজকন্যার অলঙ্কার বটে। তখন সে, রাজকুমারকে চোর স্থির করিয়া, কহিল, এ রাজকন্যার অলঙ্কার দেখিতেছি, তুমি কোথায় পাইলে, যথাৰ্থ বল।

স্বর্ণকার, ভয়প্রদর্শনপূর্বক, বার বার এইপ্ৰকার জিজ্ঞাসা করাতে, রাজপথাবাহী বহুসংখ্যক লোক, কৌতুহলাক্রান্ত হইয়া, তথায় সমবেত হইল। ফলতঃ, অল্পকালমধ্যেই ঐ অলঙ্কার লইয়া, বিলক্ষণ আন্দোলন হইতে লাগিল। পরিশেষে, নগরপাল, এই সংবাদ পাইয়া, রাজকুমার ও স্বর্ণকার, উভয়কে রুদ্ধ করিল। পরে, সে অলঙ্কারের প্রাপ্তিবৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করিলে, রাজকুমার কহিলেন, শ্মশানবাসী গুরুদেব আমায় এই অলঙ্কার বিক্রয় করিতে পাঠাইয়াছেন; তিনি কোথায় পাইয়াছেন, আমি তাহার কিছুই জানি না। যদি তোমাদের আবশ্যক বোধ হয়, শ্মশানে গিয়া, তাঁহাকে জিজ্ঞাসা কর। পরিশেষে, নগরপাল, গুরু শিষ্য উভয়কে, অলঙ্কার সমেত রাজসমক্ষে লইয়া গিয়া, পূর্বাপর সমস্ত বিজ্ঞাপন করিল।

রাজা, অলঙ্কার দর্শনে, নানাপ্রকারে সন্দিহান হইয়া, যোগীকে, নির্জনে লইয়া গিয়া বিনয়বাক্যে জিজ্ঞাসা করিলেন, মহাশয়! আপনি এই সমস্ত অলঙ্কার কোথায় পাইলেন। যোগী কহিলেন, মহারাজ! কৃষ্ণচতুর্দশী রজনীতে, আমি নগরপ্রান্তবর্তী শ্মশানে ডাকিনীমন্ত্র সিদ্ধ করিয়াছিলাম। মন্ত্রপ্রভাবে ডাকিনী, স্বয়ং উপস্থিত হইয়া, প্ৰসাদস্বরূপ স্বীয় অলঙ্কার সকল উন্মোচিত করিয়া দিয়াছেন; এবং আমিও তাঁহার বাম জঙ্ঘাতে, যোগসিদ্ধির প্রমাণস্বরূপ ত্ৰিশূলের চিহ্ন করিয়া দিয়াছি। এ সমস্ত সেই অলঙ্কার। রাজা শুনিয়া বিস্ময়াপন্ন হইয়া, অবিলম্বে অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন, এবং রাজমহিষীকে বলিলেন, দেখ দেখি, পদ্মাবতীর বাম জঙ্ঘাতে কোনও চিহ্ন আছে, কি না। রাজ্ঞী সবিশেষ অবগত হইয়া, রাজার নিকটে আসিয়া কহিলেন, এক ত্ৰিশূলের চিহ্ন আছে।

রাজা, এবম্প্রকার অঘটনঘটনা দর্শনে, হতবুদ্ধি ও লজ্জায় অধোবদন হইয়া, ভাবিতে লাগিলেন, এতাদৃশী দুশ্চারিণীকে গৃহে রাখা কদাচি উচিত নহে; ইহাতে অধৰ্ম আছে। অতএব, এখন কি কর্তব্য। অথবা, পণ্ডিতমণ্ডলী সমবেত করিয়া, সবিশেষ কহিয়া জিজ্ঞাসা করি; তাঁহারা, ধর্মশাস্ত্র অনুসারে, যেরূপ ব্যবস্থা দিবেন, তদনুরূপ কাৰ্য করিব। কিন্তু, শাস্ত্ৰে গৃহচ্ছিদ্র প্রকাশ করিতে নিষেধ আছে। পণ্ডিতমণ্ডলী সমবেত করিয়া ব্যবস্থা জিজ্ঞাসিলে, আমার এই কলঙ্ক, ক্রমে ক্ৰমে দেশে বিদেশে প্রচারিত হইবেক। তদপেক্ষা উত্তম কল্প এই, সেই সন্ন্যাসীকেই ইহার পরামর্শ জিজ্ঞাসা করি। সন্ন্যাসী সবিশেষ সমস্ত অবগত আছেন; ধর্মতঃ প্রশ্ন করিলে, অবশ্যই যথাশাস্ত্র ব্যবস্থা দিবেন। অনন্তর, রাজা সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, মহাশয়! ধর্মশাস্ত্ৰে দুশ্চরিত্রা স্ত্রীর বিষয়ে কিরূপ দণ্ড নিরূপিত আছে। সন্ন্যাসী কহিলেন, মহারাজ! ধৰ্মশাস্ত্ৰে লিখিত আছে স্ত্রীলোক, বালক, ব্ৰাহ্মণ ইহারা অত্যন্ত অপরাধী হইলেও, বিধার্হ নহে; রাজা ইহাদের নির্বাসনারূপ দণ্ডবিধান করিবেন।

রাজা, এই সমস্ত শ্রবণ করিয়া, অন্তঃপুরে গিয়া, রাজ্ঞীকে কহিলেন, পদ্মাবতী অতি দুশ্চরিত্রা; এজন্য শাস্ত্রের বিধান অনুসারে, আমি উহারে দেশবহিস্কৃতা করিব। রাজ্ঞী কন্যার প্রতি নিরতিশয় স্নেহবতী ছিলেন; কিন্তু, পতিব্ৰতাত্বগুণের আতিশয্যবশতঃ রাজার মতেই সন্মতিপ্ৰদৰ্শন করিলেন। অনন্তর নরপতি, কন্যাকে শিবিকারোহণের আদেশ দিয়া, তাহার অগোচরে, বাহকদিগকে আজ্ঞা দিলেন, তোমরা, পদ্মাবর্তীকে কোনও অরণ্যানীতে পরিত্যাগ করিয়া, ত্বরায় আমায় সংবাদ দিবে। বাহকেরা রাজাজ্ঞাসম্পাদন করিল। অমাত্যপুত্রও, তৎক্ষণাৎ, রাজকুমারকে সঙ্গে লইয়া, রাজকুমারীর উদ্দেশে চলিলেন; এবং, ইতস্ততঃ অনেক অন্বেষণ করিয়া, পরিশেষে সেই অরণ্যানীতে প্রবেশিয়া দেখিলেন, পদ্মাবতী, একাকিনী বৃক্ষমূলে বসিয়া, যূথভ্রষ্টা হরিণীর ন্যায়, বিষন্নবদনে রোদন করিতেছেন। অশেষবিধ আশ্বাসপ্রদান দ্বারা তাঁহার শোকাবেগনিবারণ করিয়া, সঙ্গে লইয়া, উভয়ে স্বদেশ অভিমুখে প্ৰস্থান করিলেন। তাঁহার রাজধানীতে উপস্থিত হইলে, প্ৰজাগণ অতিশয় আনন্দিত হইল। রাজা প্রতাপমুকুট, বধূ সহিত পুত্ৰ পাইয়া, আনন্দপ্রবাহে মগ্ন হইয়া, নগরে মহোৎসবের আদেশ করিলেন।

এইরূপে আখ্যায়িকার সমাপন করিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ। রাজা ও মন্ত্রিপুত্র, এ উভয়ের মধ্যে কোন ব্যক্তি, নিরপরাধে রাজনন্দিনীর নির্বাসনজন্য দুরদৃষ্টভাগী হইবেন। বিক্ৰমাদিত্য কহিলেন, আমার মতে, রাজা। বেতাল কহিল, কি নিমিত্তে। রাজা কহিলেন, শাস্ত্রকারেরা আততায়ীর বধে ও বিদ্রোহাচরণে দোষাভাব লিখিয়াছেন। অতএব, বিষপ্রদায়িনী রাজতনয়ার প্রতি এরূপ প্রতিকূল আচরণের নিমিত্ত, মন্ত্রিপুত্রকে দোষী বলিতে পারা যায় না। কিন্তু, রাজা যে, অজ্ঞাতকুলশীল ব্যক্তির বাক্যে বিশ্বাস করিয়া, প্রমাণান্তরনিরপেক্ষ ও বিচারবহির্মুখ হইয়া, অপত্যস্নেহবিস্মরণপূর্বক, অকৃত অপরাধে, কন্যাকে নির্বাসিত করিলেন, ইহাতে তাঁহার, রাজধর্মের বিরুদ্ধ কর্মের অনুষ্ঠানজন্য, পাপম্পৰ্শ হইতে পারে।

ইহা শুনিয়া, বেতাল পূর্বকৃত প্রতিজ্ঞা অনুসারে, শ্মশানে গিয়া, পূর্ববৎ বৃক্ষে লম্বমান হইল; রাজাও, তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইয়া, তাহাকে, বৃক্ষ হইতে অবতারণপূর্বক, স্কন্ধে করিয়া, সন্ন্যাসীর আশ্রম অভিমুখে চলিলেন।

০২. দ্বিতীয় উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ! দ্বিতীয় উপাখ্যানের আরম্ভ করি, অবধান কর।

যমুনাতীরে, জয়স্থল নামে এক নগর আছে। তথায়, কেশব নামে এক পরম ধার্মিক ব্ৰাহ্মণ ছিলেন। ঐ ব্রাহ্মণের, মধুমালতী নামে, এক পরম সুন্দরী দুহিতা ছিল। কালক্রমে, মধুমালতী বিবাহযোগ্য হইলে, তাহার পিতা ও ভ্রাতা, উভয়ে উপযুক্ত পাত্রের অন্বেষণে তৎপর হইলেন।

কিয়ৎ দিন পরে, ব্ৰাহ্মণ, যজমানপুত্রের বিবাহ উপলক্ষে, গ্রামান্তরে গেলেন; ব্ৰাহ্মণের পুত্ৰও, অধ্যয়নের নিমিত্ত, গুরুগৃহে প্ৰস্থান করিলেন। উভয়ের অনুপস্থিতিসময়ে, এক সুকুমার ব্ৰাহ্মণকুমার কেশবের গৃহে অতিথি হইলেন। কেশবের ব্ৰাহ্মণী, তাহাকে রূপে রতিপতি ও বিদ্যায় বৃহস্পতি দেখিয়া, মনে মনে বাসনা করিলেন, যদি সৎকুলোদ্ভব হয় ও অঙ্গীকার করে, তবে ইহাকেই জামাত করিব; অনন্তর, যথোচিত অতিথিসৎকার করিয়া, তাহার কুলের পরিচয় লইলেন, এবং সৎকুলাজাত জানিয়া আনন্দিত হইয়া কহিলেন, বৎস! যদি তুমি স্বীকার কর, তোমার সহিত আমার মধুমালতীর বিবাহ দি। বিপ্রতনয়, মধুমালতীর লোকাতীত লাবণ্য দর্শনে মুগ্ধ হইয়া, কেশবপত্নীর প্রস্তাবে সম্মত হইলেন, এবং ব্ৰাহ্মণের প্রত্যাগমনপ্রতীক্ষায়, তদীয় আবাসে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন।

কতিপয় দিবস। অতীত হইলে, ব্ৰাহ্মণ ও তাঁহার পুত্র উভয়ে, মধুমালতীপ্রদানে প্ৰতিজ্ঞাবদ্ধ হইয়া, এক এক পাত্ৰ লইয়া, প্ৰবাস হইতে প্ৰত্যাগমন করিলেন। তিন পাত্র একত্র হইল; একের নাম ত্ৰিবিক্ৰম, দ্বিতীয়ের নাম বামন, তৃতীয়ের নাম মধুসূদন। তিন জনই রূপ, গুণ, বিদ্যা, বয়ঃক্রমে তুল্য, কোনও ক্রমে ইতরবিশেষ করিতে পারা যায় না। তখন ব্ৰাহ্মণ, বিলক্ষণ বিপদগ্ৰস্ত হইয়া, এই চিন্তা করিতে লাগিলেন, এক কন্যা, তিন পাত্ৰ উপস্থিত; কি উপায় করি; তিন জনেই তিন জনের নিকট প্রতিশ্রুত হইয়াছি; এক্ষণকার কর্তব্য কি।

ব্ৰাহ্মণ এবম্প্রকার চিন্তা করিতেছেন, এমন সময়ে ব্ৰাহ্মণী আসিয়া কহিলেন, তুমি এখানে বসিয়া কি ভাবিতেছ, সর্পাঘাতে মধুমালতীর প্রাণত্যাগ হয়। তখন কেশবশৰ্মা, সাতিশয় ব্যতিব্যস্ত হইয়া, চারি পাঁচ জন বিষবৈদ্য আনাইয়া, অশেষ প্রকারে চিকিৎসা করাইলেন; কিন্তু কোনও প্রকারেই প্রতীকার দর্শিল না। বিষবৈদ্যেরা কহিল, মহাশয়! আপনকার কন্যাকে কালে দংশন করিয়াছে, এবং বার, তিথি, নক্ষত্ৰ সমূদয়ের দোষ পাইয়াছে; স্বয়ং ধন্বন্তরি উপস্থিত হইলেও, ইহাকে বাঁচাইতে পরিবেন না। এক্ষণকার যাহা কর্তব্য থাকে, করুন; আমরা চলিলাম। এই বলিয়া, প্ৰণাম করিয়া, বিষবৈদ্যেরা প্রস্থান করিল।

কিয়ৎ ক্ষণ পরেই, মধুমালতীর প্রাণবিয়োগ হইল। তখন ব্ৰাহ্মণ, ব্ৰাহ্মণের পুত্র, এবং তিন বর, পাঁচজন একত্র হইয়া তদীয় মৃতদেহ শ্মশানে লইয়া গিয়া, যথাবিধি দাহ ক্রিয়া করিলেন। ব্ৰাহ্মণ, পুত্ৰ সহিত গৃহে আসিয়া, সাতিশয় বিলাপ ও পরিতাপ করিতে লাগিলেন। বরেরা তিন জনেই, এতাদৃশ অলৌকিকরূপনিধান কন্যানিধান লাভে হতাশ হইয়া, বৈরাগ্য অবলম্বন করিলেন। তন্মধ্যে, ত্ৰিবিক্রম চিতা হইতে অস্থিসঞ্চয়ন করিলেন, এবং বস্ত্রখণ্ডে বন্ধনপূর্বক, কক্ষে নিক্ষিপ্ত করিয়া, দেশে দেশে ভ্ৰমণ করিতে লাগিলেন; বামন সন্ন্যাসী হইয়া তীর্থযাত্ৰা করিলেন; মধুসূদন, সেই শ্মশানের প্রান্তভাগে পৰ্ণশালানির্মাণ করিয়া, তাহার এক কোণে মধুমালতীর রাশীকৃত দেহভস্ম রাখিয়া, যোগসাধন করিতে লাগিলেন।

একদিন, বামন, ভ্ৰমণ করিতে করিতে, মধ্যাহ্নকালে, এক ব্ৰাহ্মণের আলয়ে উপস্থিত হইলেন। ব্ৰাহ্মণ, ভোজনকালে সন্ন্যাসী উপস্থিত দেখিয়া, কৃতাঞ্জলি হইয়া কহিলেন, মহাশয়। যদি, কৃপা করিয়া, দীনের ভবনে পদার্পণ করিয়াছেন, তবে অনুগ্রহপূর্বক ভিক্ষাস্বীকার করুন; তাহা হইলে, আমি চরিতার্থ হই; পাকের অধিক বিলম্ব নাই।

সন্ন্যাসী সম্মত হইলেন এবং পাকান্তে ভোজনে বসিলেন। ব্ৰাহ্মণী পরিবেশন করিতে লাগিলেন। এই সময়ে, ব্ৰাহ্মণের পঞ্চমবৰ্ষীয় পুত্র, নিতান্ত অশান্তভাবে উৎপাত আরম্ভ করিয়া, পরিবেশনের বিলক্ষণ ব্যাঘাত জন্মাইতে লাগিল। ব্ৰাহ্মণী নানা প্রকারে সান্ত্বনা করিলেন; বালক কোনওক্রমে প্ৰবোধ মানিলেক না। তখন তিনি, ক্ৰোধাভরে, পুত্রকে প্রজ্বলিত হুতাশনপূর্ণ চুল্লীতে নিক্ষিপ্ত করিয়া, নিশ্চিন্ত হইয়া, নির্বিঘ্নে পরিবেশন করিতে লাগিলেন।

সন্ন্যাসী ব্ৰাহ্মণীর এইরূপ বিরূপ আচরণ দেখিয়া, নারায়ণ নারায়ণ বলিয়া, তৎক্ষণাৎ ভোজনপাত্ৰ হইতে হস্ত উত্তোলিত করিলেন। ব্ৰাহ্মণ কহিলেন, মহাশয়! অকস্মাৎ ভোজনে বিরত হইলেন কেন। সন্ন্যাসী কহিলেন, যে স্থানে এরূপ রাক্ষসের ব্যবহার, তথায় কি প্রকারে ভোজন করিতে প্রবৃত্তি হয়, বল। ব্ৰাহ্মণ, ঈষৎ হাস্য করিয়া, তৎক্ষণাৎ গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন, এবং সঞ্জীবনীবিদ্যার পুস্তক বহির্গত করিয়া, তন্মধ্যে হইতে এক মন্ত্র লইয়া জপ করিতে লাগিলেন। পুত্র, অবিলম্বে প্ৰাণদান পাইয়া, পূর্ববৎ উৎপাত করিতে আরম্ভ করিল। সন্ন্যাসী, চমৎকৃত হইয়া, ভোজনসমাপন করিলেন, এবং মনে মনে এই আলোচনা করিতে লাগিলেন, এই পুস্তকে মৃতসঞ্জীবন মন্ত্র আছে; ঐ মন্ত্র জানিতে পারিলে, প্ৰিয়াকে পুনর্জীবিত করিতে পারি। অতএব, যেরূপে হয়, পুস্তকখানি হস্তগত করিতে হইবেক।
মনে মনে এইরূপ কল্পনা করিয়া, সন্ন্যাসী ব্ৰাহ্মণকে কহিলেন, আদ্য অপরাহ্ন হইল; অতএব, আর স্থানান্তরে না গিয়া, তোমার আলয়েই রাত্রিকাল অতিবাহিত করিব। গৃহস্থ ব্ৰাহ্মণ, পরমসমাদরপূর্বক, স্বতন্ত্র স্থান নির্দ্দিষ্ট করিয়া দিলেন। রজনী উপস্থিত হইল। সমুদয় গৃহস্থ, ভোজনাবসানে, স্ব স্ব নির্দ্দিষ্ট স্থানে শয়ন করিল। সকলে নিদ্রাভিভূত হইলে, বামন, নিঃশব্দপদসঞ্চারে, গৃহে প্রবেশপূর্বক, সঞ্জীবনী বিদ্যার পুস্তক হস্তগত করিয়া, প্রস্থান করিলেন, এবং অল্পদিনের মধ্যেই, জয়স্থলের শ্মশানে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, মধুসূদন, স্বহস্তনির্মিত পর্ণকুটীরে অবস্থিত হইয়া, যোগসাধন করিতেছেন। এই সময়ে, দৈবযোগে, ত্ৰিবিক্রমও তথায় উপস্থিত হইলেন।

এইরূপে তিন বর একত্ৰ হইলে পর, বামন কহিলেন, আমি মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা শিখিয়াছি; তোমরা অস্থি ও ভস্ম একত্র কর, আমি প্ৰিয়াকে প্ৰাণদান দিব। তাঁহারা, মহাব্যস্ত হইয়া, অস্থি ও ভস্ম একত্র করিলেন। বামন, পুস্তক হইতে মৃতসঞ্জীবনী মন্ত্র বহিস্কৃত করিয়া, জপ করিতে লাগিলেন। মন্ত্রের প্রভাবে, অনতিবিলম্বে, কন্যার কলেবরে মাংস শোণিত প্ৰভৃতির আবিষ্কার ও প্রাণসঞ্চার হইল। তখন তিন জনে, মধুমালতীর রূপ ও লাবণ্যের মাধুরী দর্শনে মুগ্ধ হইয়া, এই কামিনী আমার আমার বলিয়া, পরস্পর বিবাদ করিতে লাগিলেন।

ইহা কহিয়া, বেতাল বিক্ৰমাদিত্যকে জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! এই তিনের মধ্যে, কোন ব্যক্তি মধুমালতীর পাণিগ্রহণে যথার্থ অধিকারী হইতে পারে। রাজা কহিলেন, যে ব্যক্তি কুটীর নির্মাণ করিয়া, এতাবৎকাল পর্যন্ত, শ্মশানবাসী হইয়াছিল, আমার বিবেচনায়, সেই এই কামিনীর পাণিগ্রহণে অধিকারী। বেতাল কহিল, যদি ত্ৰিবিক্ৰম অস্থিসঞ্চয়ন করিয়া না রাখিত, এবং বামন, নানা দেশে ভ্ৰমণ করিয়া, সঞ্জীবনী বিদ্যার সংগ্ৰহ করিতে না পারিত, তবে কি প্রকারে মধুমালতী প্ৰাণদান পাইত। রাজা কহিলেন, যাহা কহিতেছ, উহা সর্বাংশে সত্য বটে; কিন্তু ত্ৰিবিক্রম, অস্থিসঞ্চয়ন দ্বারা, মধুমালতীর পুত্ৰস্থানীয়, আর বামন, জীবনদান দ্বারা, পিতৃস্থানীয় হইয়াছে; সুতরাং, তাহারা উহার প্রণয়ভাজন হইতে পারে না। কিন্তু মধুসূদন, ভস্মরাশিসংগ্রহ ও উটজনির্মাণ পূর্বক শ্মশানবাসী হইয়া, যথার্থ প্রণয়ীর কাৰ্য করিয়াছে। অতএব, সেই, ন্যায়মার্গ অনুসারে, এই প্রমদার প্রণয়ভাজন হইতে পারে।

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।

 ০৩. দ্বিতীয় উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ!

বর্ধমান নগরে, রূপসেন নামে, অতি বিজ্ঞ, গুণগ্ৰাহী, দয়াশীল, পরম ধার্মিক রাজা ছিলেন। এক দিন, দক্ষিণদেশনিবাসী বীরবর নামে রজঃপূত, কর্মপ্ৰাপ্তির বাসনায়, রাজদ্বারে উপস্থিত হইল। দ্বারবান, তাহার প্রমুখাৎ সবিশেষ সমস্ত অবগত হইয়া, রাজসমীপে বিজ্ঞাপন করিল, মহারাজ! বীরবর নামে এক অস্ত্ৰধারী পুরুষ, কর্মের প্রার্থনায় আসিয়া, দ্বারদেশে দণ্ডায়মান আছে; সাক্ষাৎকারে আসিয়া স্বীয় অভিপ্ৰায় আপনকার গোচর করিতে চায়; কি আজ্ঞা হয়। রাজা আজ্ঞা করিলেন, অবিলম্বে উহারে লইয়া আইস।

অনন্তর, দ্বারী বীরবরকে নরপতিগোচরে উপস্থিত করিলে, রাজা, তদীয় আকার প্রকার দর্শনে, তাহাকে বিলক্ষণ কাৰ্যদক্ষ স্থির করিয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, বীরবর! কত বেতন পাইলে, তোমার সচ্ছন্দে দিনপাত হইতে পারে। বীরবর নিবেদন করিল, মহারাজ! প্রত্যহ সহস্ৰ স্বর্ণমুদ্রার আদেশ হইলে, আমার চলিতে পারে। রাজা জিজ্ঞাসিলেন, তোমার পরিবার কত। সে কহিল, মহারাজ! এক স্ত্রী, এক পুত্র, এক কন্যা, আর স্বয়ং, এই চারি; এতদ্ব্যাতিরিক্ত আর আমার পরিবার নাই। রাজা শুনিয়া মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিলেন, ইহার পরিবার এত অল্প, তথাপি কি নিমিত্ত এত অধিক প্রার্থনা করে। যাহা হউক, এক ভৃত্যের নিমিত্ত, নিত্য নিত্য, এবংবিধ ব্যয় যুক্তিসঙ্গত নহে। অথবা, এ অর্থব্যয় ব্যর্থ হইবেক না; অবশ্যই ইহার অসাধারণ গুণ ও ক্ষমতা থাকিবেক। অতএব, কিছুদিনের নিমিত্তে রাখিয়া, ইহার গুণের ও ক্ষমতার পরীক্ষা করা উচিত। অনন্তর, কোষাধ্যক্ষকে ডাকাইয়া, রাজা আজ্ঞা দিলেন, তুমি প্রতিদিন, প্রাতঃকালে, বীরবরকে সহস্ৰ সুবৰ্ণ দিবে; কোনও মতে অন্যথা না হয়।

বীরবর, রাজকীয় আজ্ঞা শ্রবণে পরম পরিতোষ প্ৰাপ্ত হইয়া, ধন্যবাদ প্ৰদান করিতে লাগিল এবং কোষাধ্যক্ষের নিকট হইতে, সে দিবসের প্রাপ্য নির্ধারিত সুবর্ণগ্রহণপূর্বক, নৃপনির্দ্দিষ্ট বাসস্থানে গমন করিল। তথায় উপস্থিত হইয়া, সে, প্রথমতঃ, সেই সুবৰ্ণকে ভাগদ্বয়ে বিভক্ত করিয়া, একভাগ বিপ্রসাৎ করিল; অবশিষ্ট ভাগ পুনর্বার দ্বিভাগ করিয়া, একভাগ বৈষ্ণব, বৈরাগী, সন্ন্যাসী প্ৰভৃতিকে দিল; অপর ভাগ দ্বারা নানাবিধ খাদ্যসামগ্রীর আয়োজন করিয়া, শত শত দীন, দুঃখী, অনাথ প্রভৃতিকে পৰ্যাপ্ত ভোজন করাইল; অবশিষ্ট যৎকিঞ্চিৎ স্বয়ং, পুত্র, কলত্র, ও দুহিতার সহিত, আহার করিল।

প্রতিদিন, এইরূপে দিনপাত করিয়া, সায়ংকালে বর্ম, খড়গ ও চর্ম ধারণপূর্বক, বীরবর সমস্ত রজনী, রাজদ্বারে উপস্থিত থাকে। রাজা, তাহার শক্তির ও প্রভুভক্তির পরীক্ষার্থে, কি দ্বিতীয় প্রহর, কি তৃতীয় প্রহর, যখন যে আদেশ করেন, অতি দুঃসাধ্য হইলেও, সে তৎক্ষণাৎ তাহা সম্পন্ন করিয়া আইসে।

এক দিন, নিশীথ সময়ে, অকস্মাৎ স্ত্রীলোকের ক্ৰন্দনধ্বনি শ্রবণগোচর করিয়া, রাজা বীরবরকে আহবান করিলে, সে তৎক্ষণাৎ সম্মুখবর্তী হইয়া কহিল, মহারাজ! কি আজ্ঞা হয়। রাজা কহিলেন, দক্ষিণ দিকে স্ত্রীলোকের ক্ৰন্দনশব্দ শুনা যাইতেছে; ত্বরায়, ইহার তথ্যানুসন্ধান করিয়া, আমায় সংবাদ দাও। বীরবর যে আজ্ঞা মহারাজ বলিয়া, তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করিল। রাজা বীরবরকে, এক মুহুর্তের নিমিত্তেও, আজ্ঞা প্রতিপালনে পরাঙ্মুখ না দেখিয়া, সাতিশয় সন্তুষ্ট ছিলেন; এক্ষণে তাহার সাহস ও ক্ষমতা প্ৰত্যক্ষ করিবার নিমিত্ত, স্বয়ং গুপ্ত ভাবে পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন।

বীরবর, সেই ক্ৰন্দনশব্দ লক্ষ্য করিয়া, অতি প্ৰসিদ্ধ এক ভয়ঙ্কর শ্মশানে উপস্থিত হইল; দেখিল, এক সর্বালঙ্কারভূষিতা সর্বাঙ্গসুন্দরী রমণী শিরে করাঘাত ও হাহাকার করিয়া, উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতেছে। বীরবর দেখিয়া অতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইল, এবং তাহার সম্মুখবর্তী হইয়া জিজ্ঞাসিল, তুমি কে, কি দুঃখে, এই ঘোর রজনীতে, একাকিনী শ্মশানবাসিনী হইয়া, বিলাপ ও পরিতাপ করিতেছি। সে কোনও উত্তর দিল না; বরং পূর্ব অপেক্ষায়, অধিকতর রোদন করিতে, লাগিল। অনন্তর, বীরবর, সবিশেষ ব্যগ্রতা প্রদর্শনপূর্বক, বারংবার জিজ্ঞাসা করাতে, সে কহিল, আমি রাজলক্ষ্মী; রাজা রূপসেনের গৃহে নানা অন্যায়াচরণ হইতেছে; তৎপ্রযুক্ত, তদীয় আবাসে, অচিরাৎ অলক্ষ্মীর প্রবেশ হইবেক; সুতরাং, আমি রাজার অধিকার পরিত্যাগ করিয়া যাইব। আমি প্রস্থান করিলে, অল্প দিনের মধ্যেই, রাজার প্ৰাণাত্যয় ঘটিবেক; সেই দুঃখে দুঃখিত হইয়া, রোদন করিতেছি।

প্রভুর এবম্ভূত অসম্ভাবিত ভাবি অমঙ্গল শ্রবণে বিষাদসাগরে মগ্ন হইয়া, বীরবর কহিল, দেবি! আপনি যে আজ্ঞা করিলেন, তাহাতে, কোনও মতে, সন্দেহ করিতে পারি না। কিন্তু, যদি এই হৃদয়বিদারণ অমঙ্গলঘটনার নিবারণের কোনও উপায় থাকে, বলুন; আমি, রাজার মঙ্গলের নিমিত্ত, প্রাণান্ত পর্যন্ত স্বীকার করিতে প্রস্তুত আছি। রাজলক্ষ্মী কহিলেন, পূর্বদিকে, অর্ধযোজনান্তে, এক দেবী আছেন। যদি কেহ ঐ দেবীর নিকটে, আপন পুত্রকে স্বহস্তে বলিদান দেয়, তবে তিনি, প্রসন্ন হইয়া, রাজার সমস্ত অমঙ্গলের সম্পূর্ণ নিবারণ করিতে পারেন। রাজলক্ষ্মীর এই বাক্য শুনিয়া, বীরবর, অতি সত্বর, ভবনাভিমুখে ধাবমান হইল। রাজাও, কৌতুকাবিষ্ট হইয়া, পশ্চাৎ পশ্চাং চলিলেন। বীরবর, গৃহে উপস্থিত হইয়া, আপন পত্নীকে জাগরিত করিয়া, সবিশেষ সমস্ত জ্ঞাত করিলে, সে তৎক্ষণাৎ পুত্রের নিদ্ৰাভঙ্গ করিয়া কহিল, বৎস! তোমার মন্তক দিলে, রাজার দীর্ঘ আয়ুঃ ও অচল রাজ্য হয়। তখন পুত্ৰ কহিল, মাতঃ! প্রথমতঃ, আপনকার আজ্ঞা; দ্বিতীয়তঃ, স্বামিকাৰ্য; তৃতীয়তঃ, ক্ষণবিনশ্বর পাঞ্চভৌতিক দেহ দেবসেবায় নিয়োজিত হইবেক; ইহা অপেক্ষা, আমার পক্ষে প্রাণত্যাগের উত্তম সময় আর ঘটিবেক না। অতএব, শুভ কর্মে বিলম্ব করা কর্তব্য নহে। আপনারা, সত্বর হইয়া, কাৰ্যসম্পাদন করুন।

বীরবর, পুত্রের এতাদৃশ পরমাদ্ভূত বাক্য শ্রবণে বিস্ময়াপন্ন হইয়া, অশ্রুপূর্ণ নয়নে, সহধর্মিণীকে কহিল, যদি তুমি সচ্ছন্দ মনে পুত্রপ্রদান কর, তবেই আমি দেবীর নিকটে বলিদান দিয়া, রাজকাৰ্য নিম্পন্ন করি। স্বামিবাক্য শ্রবণগোচর করিয়া, বীরবরের পত্নী নিবেদন করিল, নাথ! ধৰ্মশাস্ত্ৰে নির্দ্দিষ্ট আছে, স্বামী মূক, বধির, পঙ্গু, অন্ধ, কুব্জ, কুষ্ঠ, যেরূপ হউন, তাঁহাকে সন্তুষ্ট রাখিতে পারিলে, যেরূপ চরিতার্থতা লাভ হয়, শাস্ত্ৰবিহিত দান, ধ্যান, ব্রত, তপস্যা দ্বারা তদ্রুপ হয় না; আর যদি স্বামীর প্রতি অযত্ন ও অবজ্ঞা প্রদর্শন করিয়া, পারলৌকিক সুখসম্ভোগের লোভে, নিরন্তর শাস্ত্ৰবিহিত ধর্মকর্মের অনুষ্ঠান করে, সে সকল সর্বতোভাবে বিফল ও অন্তে অবধারিত অধোগতির কারণ হয়। অতএব, আমার পুত্র-পৌত্রে প্রয়োজন কি; তোমার চিত্তরঞ্জন ও চরণশুশ্রুষা করিলেই, উভয় লোকে নিস্তার পাইব। তাহার পুত্ৰ কহিল, পিতঃ! যে ব্যক্তি স্বামিকাৰ্যসম্পাদনে সমৰ্থ, তাহারই জন্ম সার্থক, এবং সেই স্বৰ্গলোকে অনন্ত কাল সুখসম্ভোগ করে। অতএব, আর কি জন্যে, সংশয়ে কালহরণ করিতেছেন, কাৰ্যসাধনে তৎপর হউন। বিলম্বে কাৰ্যহানির সম্ভাবনা৷

ইত্যাকার নানাপ্রকার কথোপকথনের পর, বীরবর সপরিবারে, দেবীর মন্দিরাভিমুখে প্রস্থান করিল। রাজা, এইরূপে, বীরবরের সপরিবারের প্রভূভক্তির প্রবলতা ও অচলতা দেখিয়া, যৎপরোনাস্তি চমৎকৃত ও আহ্লাদিত হইলেন, এবং মনে মনে অগণ্য ধন্যবাদ প্রদানপূর্বক, গুপ্ত ভাবে তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, বীরবর দেবীর মন্দিরে উপস্থিত হইল, এবং গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য আদি নানা উপচারে, যথাবিধি পূজা করিয়া, সাষ্টাঙ্গপ্ৰণিপাতপূর্বক, দেবীর সম্মুখে কৃতাঞ্জলি হইয়া কহিল, জগদীশ্বরি! তোমাকে প্ৰসন্ন করিবার নিমিত্ত, আমি প্ৰাণাধিকপ্রিয় পুত্রকে স্বহন্তে বলিদান দিতেছি। কৃপা কর, যেন প্রভুর দীর্ঘ আয়ুঃ ও অচল রাজ্য হয়।

এই বলিয়া, খড়্গ লইয়া, বীরবর, অকাতরে, পুত্রের মস্তকচ্ছেদন করিল। বীরবরের কন্যা, এইরূপে জীবিতাধিক সহোদরের প্রাণবিনাশ দেখিয়া, খড়্গপ্রহার দ্বারা প্রাণত্যাগ করিল। তাহার পত্নীও, শোকে একান্ত বিকলচিত্তা হইয়া, তৎক্ষণাৎ তনয়-তনয়ার অনুগামিনী হইল। তখন বীরবর বিবেচনা করিল, প্রভুকাৰ্য সম্পন্ন করিলাম; এক্ষণে আর কি নিমিত্তে, দাসত্বশৃঙ্খলে বদ্ধ থাকি; আর কি সুখেই বা জীবনধারণ করি; এই বলিয়া, সেই বিষম খড়্গ দ্বারা স্বীয় শিরচ্ছেদন করিল।

এইরূপে, অল্পক্ষণ মধ্যে, চারিজনের অদ্ভুত মরণ প্রত্যক্ষ করিয়া, রাজার অন্তঃকরণে নিরতিশয় নিৰ্বেদ উপস্থিত হইল। তখন তিনি কহিতে লাগিলেন, যে রাজ্যের নিমিত্ত এতাদৃশ প্রভূভক্ত সেবকের সর্বনাশ হইল, আর আমি সেই বিষম রাজ্যের ভোগে প্রবৃত্ত হইব না। আমি, অতিশয় স্বার্থপর ও নিরতিশয় নির্বিবেক; নতুবা, কি নিমিত্তে, বীরবরকে পুত্রহত্যা হইতে নিবৃত্ত করিলাম না; কি নিমিত্তেই বা, তাহাকে আত্মঘাতী হইতে দিলাম; উপক্ৰমেই, এই ঘোরতর অধ্যবসায় হইতে, বীরবারকে বিরত করা, সর্বতোভাবে, আমার উচিত ছিল। সৰ্বথা আমি অতি অসৎ কর্ম করিয়াছি। এক্ষণে, আত্মহত্যারূপ প্ৰায়শ্চিত্ত ব্যতীত, চিত্তসন্তোষ জন্মিবেক না।

এই বলিয়া, খড়্গ লইয়া, রাজা আত্মশিরচ্ছেদনে উদ্যত হইবামাত্র, ভগবতী কাত্যায়নী, তৎক্ষণাৎ আবির্ভূতা হইয়া, হস্তধারণপূর্বক, রাজাকে মরণব্যবসায় হইতে নিবৃত্ত করিলেন; কহিলেন, বৎস! তোমার সাহস ও সদ্বিবেচনা দর্শনে, যার পর নাই, প্রীত হইয়াছি; অভিপ্রেত বর প্রার্থনা কর। রাজা কহিলেন, মাতঃ! যদি প্ৰসন্ন হইয়া থাক, এই চারি জনের জীবনদান কর; এক্ষণে, ইহা অপেক্ষা আমার আর গুরুতর প্রার্থয়িতব্য নাই। দেবী, তথাস্তু বলিয়া, অবিলম্বে পাতাল হইতে অমৃত আনয়নপূর্বক, তাহাদের গাত্রে সেচন করিবামাত্র, চারিজনেই তৎক্ষণাৎ, সুপ্তোত্থিতের ন্যায়, গাত্ৰোখান করিল। রাজা, যথার্থ প্ৰভুভক্ত বীরবরকে, অপত্য কলত্র সহিত, পুনর্জীবিত দেখিয়া, অপরিসীম হর্ষ প্রাপ্ত হইলেন, এবং, নিরতিশয় ভক্তিযোগ সহকারে, দেবীর চরণারবিন্দে সাষ্টাঙ্গ প্ৰণিপাত করিয়া কৃতাঞ্জলি হইয়া, গদগদ বাক্যে স্তব করিতে লাগিলেন। রাজার ভক্তিদর্শনে ও স্তবশ্রবেণ পরম প্রীতি প্ৰাপ্ত হইয়া, দেবী, প্রার্থনাধিক বরপ্রদান দ্বারা, রাজাকে চরিতার্থ করিয়া, অন্তর্হিতা হইলেন।

পর দিন, প্ৰভাত হইবামাত্র, রাজা রূপসেন, সভাভবনে সিংহাসনে আসীন হইয়া, রাত্রিবৃত্তান্তকীর্তনপূর্বক, সৰ্ব সভাজন সমক্ষে, ধর্ম সাক্ষী করিয়া, অদ্ভূত প্রভূপরায়ণ বীরবরকে অর্ধরাজ্যেশ্বৱ করিলেন।

এইরূপে কথা সমাপ্ত করিয়া বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! পূর্বাপর সমন্ত শ্রবণ করিলে; এক্ষণে জিজ্ঞাসা করি, কাহার ঔদার্য অধিক হইল। বিক্ৰমাদিত্য উত্তর দিলেন, আমার বোধে রাজার ঔদার্য অধিক। বেতাল কহিল, কেন। রাজা বলিলেন, স্বামীর নিমিত্ত সর্বনাশস্বীকার ও প্ৰাণদান করা সেবকের কর্তব্য কৰ্ম। বীরবর, রাজকাৰ্যার্থে, ঈদৃশ ঔদার্য প্ৰকাশ করিয়া, আত্মধর্মপ্রতিপালন করিয়াছে। কিন্তু, রাজা যে, সেবকের নিমিত্ত, রাজ্যাধিকার তৃণতুল্য বোধ করিয়া, অনায়াসে প্ৰাণত্যাগে উদ্যত হইলেন, এতাদৃশ ঔদার্যের কার্য, কস্মিন কালেও, কাহারও কর্ণগোচর হয় নাই।

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।

০৪. চতুর্থ উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ!

ভোগবতী নগরীতে, অনঙ্গসেন নামে, অতি প্ৰসিদ্ধ মহীপাল ছিলেন। চূড়ামণি নামে সৰ্বগুণাকর শুকপক্ষী, সর্ব কাল, তাঁহার সন্নিহিত থাকিত। এক দিন, রাজা কথাপ্রসঙ্গে চূড়ামণিকে জিজ্ঞাসিলেন, শুক! তুমি কি কি জান। সে কহিল, মহারাজ! আমি ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান, কালক্রয়ের বৃত্তান্ত জানি। তখন রাজা কহিলেন, যদি তুমি ত্রিকালজ্ঞ হও, বল, কোন স্থানে আমার উপযুক্ত রমণী আছে। চূড়ামণি নিবেদন করিল, মহারাজ! মগধদেশের অধিপতি রাজা বীরসেনের চন্দ্রাবতী নামে এক কন্যা আছে; সে পরম সুন্দরী ও সাতিশয় গুণশালিনী; তাহার সহিত মহারাজের বিবাহ হইবেক।

রাজা অনঙ্গসেন, শুকের সর্বজ্ঞতা পরীক্ষার্থে, চন্দ্ৰকান্ত নামক সুপ্ৰসিদ্ধ দৈবজ্ঞকে ডাকাইয়া জিজ্ঞাসিলেন, মহাশয়! আপনি গণনা দ্বারা নির্ধারিত করিয়া বলুন, কোন কামিনীর সহিত আমার বিবাহ হইবেক। তিনি জ্যোতির্বিদ্যাপ্রভাবে অবগত হইয়া কহিলেন, মহারাজ! চন্দ্রাবতী নামে এক অতি রূপবতী রমণী আছে; গণনা দ্বারা দৃষ্ট হইতেছে, তাহার সহিত আপনকার পরিণয় হইবেক। রাজা শুনিয়া শুকের প্রতি অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন; পরে এক সদ্বক্তা, চতুর, বুদ্ধিমান, কাৰ্যদক্ষ ব্ৰাহ্মণকে আনাইয়া, নানা উপদেশ দিয়া, সম্বন্ধস্থিরীকরণার্থে, মগধেশ্বরের নিকট পাঠাইলেন।

চন্দ্রাবতীর নিকটেও মদনমঞ্জরী নামে এক শারিকা থাকিত। তাহারও সর্বজ্ঞতাখ্যাতি ছিল। তিনি, এক দিবস, তাহাকে জিজ্ঞাসিলেন, শারিকে! যদি তুমি ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান সমুদায় বলিতে পার, আমার যোগ্য পতি কোথায় আছেন, বল। শারিকা কহিল, রাজনন্দিনী। আমি দেখিতেছি, ভোগবতী নগরীর অধিপতি রাজা অনঙ্গসেন তোমার পতি হইবেন। ফলতঃ, অনঙ্গসেন ও চন্দ্রাবতী, উভয়েরই, এইরূপে শ্রবণ দ্বারা অন্তরে অনুরাগসঞ্চার হইল, এবং, সমাগমের অভাব নিবন্ধন, উভয়েরই, ক্রমে ক্রমে, পূর্বরাগ সংক্রান্ত স্মরদশার আবির্ভাব হইতে লাগিল।

কিয়ৎ দিন পরে, অনঙ্গসেনের প্ৰেরিত ব্ৰাহ্মণ, মগধেশ্বরের নিকট উপস্থিত হইয়া, স্বীয় রাজার অভিপ্ৰায় ব্যক্ত করিলে, তিনি তৎক্ষণাৎ সম্মত হইলেন এবং, বাগদানের দ্রব্যসামগ্ৰী সমভিব্যাহারে দিয়া, এক ব্ৰাহ্মণকে ঐ ব্ৰাহ্মণের সহিত পাঠাইলেন; কহিয়া দিলেন, তুমি তথা হইতে প্রত্যাগমন না করিলে, আমি কোনও উদ্‌যোগ করিতে পারিব না। বাগদানের দ্রব্যসামগ্ৰী লইয়া ব্ৰাহ্মণেরা, অনঙ্গসেনের নিকট উপস্থিত হইয়া, সবিশেষ সমস্ত বিজ্ঞাপন করিলে, তিনি আহ্লাদসাগরে মগ্ন হইলেন, এবং সুবিজ্ঞ দৈবজ্ঞ দ্বারা, বিবাহের দিন নির্ধারিত করিয়া, মগধেশ্বরের প্রেরিত ব্ৰাহ্মণ দ্বারা, তাঁহার নিকট সংবাদ পাঠাইয়া দিলেন। অনন্তর, নির্ধারিত দিবসে, যথাসময়ে মগধেশ্বরের আলয়ে উপস্থিত হইয়া, অনঙ্গসেন, চন্দ্রাবতীর পাণিগ্রহণপূর্বক, নিজ রাজধানী প্ৰত্যাগমন করিয়া, পরম সুখে কালক্ষেপণ করিতে লাগিলেন।

চন্দ্রাবতী, শ্বশুরালয়ে আগমনকালে, মদনমঞ্জরী শারিকারে সমভিব্যাহারে আনিয়াছিলেন। তিনি তাহাকে সর্বদা আপন সমীপে রাখিতেন। রাজাও, ক্ষণ কালের নিমিত্ত, চূড়ামণিকে দৃষ্টিপথের বহিস্কৃত করিতেন না। এক দিবস, রাজা ও রাজমহিষী অন্তঃপুরে একাসনে উপবিষ্ট আছেন, এবং পিঞ্জীরস্থ শুক-শারিকাও তাঁহাদের সম্মুখে আছে; সেই সময়ে রাজা রাজ্ঞীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, দেখ, একাকী থাকিলে অতি কষ্টে কালব্যাপন হয়; অতএব আমার অভিলাষ, শুকের সহিত তোমার শারিকার বিবাহ দিয়া, উভয়কে এক পিঞ্জরে রাখি; তাহা হইলে, উহারা আনন্দে কালাহরণ করিতে পরিবেক। রাজ্ঞী, ঈষৎ হাসিয়া, অনুমোদনপ্রদর্শন করিলে, রাজা, শুকের সহিত শারিকার বিবাহ দিয়া, উভয়কে এক পিঞ্জরে রাখিয়া দিলেন।

এক দিন, রাজা নির্জনে, রাজমহিষীর সহিত, রসপ্রসঙ্গে কালব্যাপন করিতেছেন, সেই সময়ে শুক শারিকাকে সম্ভাষণ করিয়া কহিতে লাগিল, দেখ, এই অসার সংসারে ভোগ অতি সার পদার্থ। যে ব্যক্তি, এই জগতে জন্মগ্রহণ করিয়া, ভৌগসুখে পরাঙ্মুখ থাকে, তাহার বৃথা জন্ম। অতএব, কি নিমিত্ত, তুমি ভোগবিষয়ে নিরুৎসাহিনী হইতেছ। শারিক কহিল, পুরুষজাতি আতিশয় শঠ, অধৰ্মী, স্বার্থপর ও স্ত্রীহত্যাকারী; এজন্য, পুরুষসহবাসে আমার রুচি হয় না। শুক কহিল, নারীও অতিশয় চপলা, কুটিলা, মিথ্যাবাদিনী, ও পুরুষঘাতিনী। উভয়ের এইরূপ বিবাদারম্ভ দেখিয়া, রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন, হে শুক! হে শারিকে! কেন তোমরা অকারণে কলহ করিতেছি। তখন শারিক কহিল, মহারাজ! পুরুষ বড় অধৰ্মী, এই নিমিত্তে পুরুষজাতির প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও অনুরাগ নাই। আমি পুরুষের ব্যবহার ও চরিত্র বিষয়ে এক উপাখ্যান কহিতেছি, শ্রবণ করুন।

ইলাপুরে, মহাধন নামে, অতি ঐশ্বর্যশালী এক শ্রেষ্ঠী ছিলেন। বহুকাল অতীত হইয়া গেল, তথাপি তাঁহার পুত্ৰ হইল না; এজন্য, তিনি সর্বদাই মনোদুঃখে কালাহরণ করেন। কিয়ৎ দিন পরে, জগদীশ্বরের কৃপায়, তাহার সহধর্মিণী এক কুমার প্রসব করিলেন। শ্রেষ্ঠী, অধিক বয়সে পুত্ৰমুখনিরীক্ষণ করিয়া, আপনাকে কৃতাৰ্থ বোধ করিলেন, এবং পুত্রের নাম নয়নানন্দ রাখিয়া, পরম যত্নে তাহার লালন পালন করিতে লাগিলেন। বালক পঞ্চমবর্ষীয় হইলে, তিনি তাহাকে, বিদ্যাভ্যাসের নিমিত্ত, উপযুক্ত শিক্ষকের হস্তে সমর্পণ করিলেন। সে, স্বভাবদোষবশতঃ, কেবল দুঃশীল, দুশ্চরিত্র বালকগণের সহিত কুৎসিত ক্রীড়ায় আসক্ত হইয়া, সতত কালব্যাপন করে, ক্ষণমাত্ৰও অধ্যয়নে মনোনিবেশ করে না। ক্রমে ক্রমে যত বয়োবৃদ্ধি হইতে লাগিল, তদীয় কুপ্রবৃত্তি সকল, উত্তরোত্তর, ততই উত্তেজিত হইতে লাগিল।

কিয়ৎ কাল পরে, শ্রেষ্ঠী পরলোক প্রাপ্ত হইলেন। নয়নানন্দ, সমস্ত পৈতৃক ধনের অধিকারী হইয়া, দ্যূতক্ৰীড়া, সুরাপান প্রভৃতি ব্যসনে আসক্ত হইল, এবং কতিপয় বৎসরের মধ্যে, দুষ্ক্রিয়া দ্বারা সমস্ত সম্পত্তি নষ্ট করিয়া, অত্যন্ত দুর্দশায় পড়িল। পরে সে, ইলাপুর পরিত্যাগপূর্বক, নানা স্থানে ভ্রমণ করিয়া, পরিশেষে, চন্দ্রপুরনিবাসী হেমগুপ্ত শেঠের নিকট উপস্থিত হইয়া, আত্মপরিচয়প্রদান করিল। হেমগুপ্ত তাহার পিতার পরম বন্ধু ছিলেন; উহাকে দেখিয়া, অতিশয় আহ্লাদিত হইলেন, এবং যথোচিত সমাদর ও সাতিশয় প্রীতিপ্ৰদৰ্শন-পূর্বক, জিজ্ঞাসা করিলেন, বৎস! তুমি, কি সংযোগে, অকস্মাৎ এস্থলে উপস্থিত হইলে।

নয়নানন্দ কহিল, আমি, কতিপয় অর্ণবপোত লইয়া, সিংহল দ্বীপে বাণিজ্য করিতে যাইতেছিলাম। দৈবের প্রতিকূলতা প্রযুক্ত, অকস্মাৎ প্রবল বাত্যা উত্থিত হওয়াতে, সমস্ত অর্ণবপোত জলমগ্ন হইল। আমি, ভাগ্যবলে, এক ফলকমাত্র অবলম্বন করিয়া, বহু কষ্টে প্রাণরক্ষা করিয়াছি। এ পর্যন্ত আসিয়া, আপনকার সহিত সাক্ষাৎ করিব, এমন আশা ছিল না। আমার সমভিব্যাহারের লোক সকল কে কোন দিকে গেল, বঁচিয়াছে, কি মরিয়াছে, কিছুই অনুসন্ধান করিতে পারি নাই। দ্রব্যসামগ্ৰী সমগ্র জলমগ্ন হইয়াছে। এ অবস্থায় দেশে প্ৰবেশ করিতে অতিশয় লজ্জা হইতেছে। কি করি, কোথায় যাই, কোনও উপায় ভাবিয়া পাইতেছি না। অবশেষে, আপনকার নিকট উপস্থিত হইয়াছি।

এই সমস্ত শ্ৰবণগোচর করিয়া, হেমগুপ্ত মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিলেন, আমি অনেক দিন অবধি, রত্নাবতীর নিমিত্ত, নানা স্থানে, পাত্রের অন্বেষণ করিতেছি; কোথাও মনোনীত হইতেছে না; বুঝি, ভগবান কৃপা করিয়া গৃহে উপস্থিত করিয়া দিলেন। এ অতি সদ্বংশজাত, পৈতৃক অতুল অর্থসম্পত্তির ন্যায়, পৈতৃক অতুল গুণসম্পত্তিরও উত্তরাধিকারী হইয়াছে, সন্দেহ নাই। অতএব, ত্বরায় দিন স্থির করিয়া, ইহার সহিত রত্নাবতীর বিবাহ দি। মনে মনে এইপ্ৰকার কল্পনা করিয়া, তিনি শ্রেষ্টিনীর নিকটে গিয়া কহিলেন, দেখ, এক শ্রেষ্ঠীর পুত্ৰ উপস্থিত হইয়াছে; সে সৎকুলোদ্ভব। তাহার পিতার সহিত আমার অতিশয় আত্মীয়তা ছিল। যদি তোমার মত হয়, তাহার সহিত রত্নাবতীর বিবাহ দি।

শ্রেষ্টিনী শুনিয়া সন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন, ভগবানের ইচ্ছা না হইলে, এরূপ ঘটে না। বিনা চেষ্টায় মনস্কাম সিদ্ধ হওয়া ভাগ্যের কথা। অতএব, বিলম্বের প্রয়োজন নাই; দিন স্থির করিয়া, ত্বরায় শুভ কর্ম সম্পন্ন কর। শ্রেষ্ঠী, স্বীয় সহধর্মিণীর অভিপ্ৰায় বুঝিয়া, মহাধননন্দনের নিকটে গিয়া, আপন অভিপ্ৰায় ব্যক্ত করিলেন। সে তৎক্ষণাৎ সম্মত হইল। তখন তিনি, শুভ দিন ও শুভ লগ্ন নির্ধারিত করিয়া, মহাসমারোহে কন্যার বিবাহ দিলেন। বর ও কন্যা, পরম কৌতুকে, কালব্যাপন করিতে লাগিল।

কিয়ৎ দিন পরে, নয়নানন্দ, মনোমধ্যে কোনও অসৎ অভিসন্ধি করিয়া, আপন পত্নীকে বলিল, দেখ, অনেক দিন হইল, আমি স্বদেশে যাই নাই, এবং বন্ধুবর্গেরও কোনও সংবাদ পাই নাই; তাহাতে অন্তঃকরণে কি পৰ্যন্ত উৎকণ্ঠা জন্মিয়াছে, বলিতে পারি না। অতএব, তোমার পিতা-মাতার মত করিয়া, আমায় বিদায় দাও; আর, যদি ইচ্ছা হয়, তুমিও সমভিব্যাহারে চল। পতিব্ৰতা রত্নাবতী, জননীর নিকটে গিয়া, স্বামীর অভিপ্ৰায় ব্যক্তি করিল।

শ্রেষ্টিনী স্বামীর সন্নিধানে গিয়া কহিলেন, তোমার জামাতা গৃহে যাইতে উদ্যত হইয়াছেন। শ্রেষ্ঠ শুনিয়া, ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, সে জন্যে ভাবনা কি; বিদায় করিয়া দিতেছি। তুমি কি জান না, জন, জামাই, ভাগিনেয়, এ তিন, কোনও কালে, আপন হয় না, ও তাহাদের উপর বলপ্ৰকাশ চলে না। জামাতা যাহাতে সন্তুষ্ট থাকেন, তাহাই সর্বাংশে কর্তব্য। তাঁহাকে বল, ভাল দিন দেখিয়া, বিদায় করিয়া দিতেছি। অনন্তর, শ্রেষ্ঠী আপন তনয়াকে হাস্যমুখে জিজ্ঞাসিলেন, বৎসে! তোমার অভিপ্ৰায় কি, শ্বশুরালয়ে যাইবে, না পিত্ৰালয়ে থাকিবে।

রত্নাবতী, কিয়ৎ ক্ষণ, লজ্জায় নম্রমুখী ও নিরুত্তর হইয়া রহিল; অনন্তর, কার্যান্তরব্যাপদেশে, তথা হইতে অপসৃত হইয়া, স্বামীর নিকটে গিয়া কহিল, দেখ, পিতা মাতা সম্মত হইয়াছেন; কহিলেন, তুমি যাহাতে সন্তুষ্ট হও, তাহাই করিবেন। অতএব, তোমায় এই অনুরোধ করিতেছি, কোনও কারণে, আমায় ছাড়িয়া যাইও না; আমি, তোমার অদর্শনে, প্ৰাণধারণ করিতে পারিব না।

পরিশেষে, শ্রেষ্ঠী জামাতাকে, অনেকবিধ দ্রব্যসামগ্রী ও প্রচুর অর্থ দিয়া, মহাসমাদরপূর্বক, বিদায় করিলেন, এবং কন্যাকেও, মহামূল্য অলঙ্কারসমূহে ভূষিতা করিয়া, তাহার সমভিব্যাহারিণী করিয়া দিলেন। নয়নানন্দ, নিরতিশয় আনন্দিত হইয়া, শ্বশ্রূ ও শ্বশুরের চরণবন্দনাপূর্বক, পত্নীর সহিত প্রস্থান করিল।

নয়নানন্দ, এক নিবিড় জঙ্গলে উপস্থিত হইয়া, শ্রেষ্ঠী কন্যাকে কহিল, দেখ, এই অরণ্যে অতিশয় দস্যুভয় আছে; শিবিকায় আরোহণ ও অঙ্গে অলঙ্কারধারণ করিয়া যাওয়া উচিত নহে; অলঙ্কারগুলি খুলিয়া আমার হস্তে দাও, আমি বস্ত্রাবৃত করিয়া রাখি; নগর নিকটবর্তী হইলে, পুনরায় পরিবে। আর, বাহকেরাও, শিবিকা লইয়া, এই স্থান হইতে ফিরিয়া যাউক, কেবল আমরা দুইজনে দরিদ্রবেশে গমন করি; তাহা হইলে, নিরুপদ্রবে যাইতে পারিব।

রত্নাবতী, তৎক্ষণাৎ, অঙ্গ হইতে উন্মোচিত করিয়া, সমস্ত আভরণ স্বামিহন্তে ন্যস্ত করিল, এবং দাস দাসী ও বাহকদিগকে বিদায় করিয়া দিয়া, একাকিনী সেই শঠের সমভিব্যাহারিণী হইয়া চলিল। নয়নানন্দ, এইরূপে মহামূল্য অলঙ্কারসমূহ হস্তগত করিয়া, ক্ৰমে ক্রমে, অরণ্যের অতি নিবিড় প্রদেশে প্রবেশ করিল, এবং তাদৃশ পতিপরায়ণা হিতৈষিণী প্রণয়িনীকে অন্ধকূপে নিক্ষিপ্ত করিয়া, পলায়নপূর্বক, স্বদেশে উপস্থিত হইল। রত্নাবতী, কুপে পতিত হইয়া, হা তাত! হা মাতঃ! বলিয়া, উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিল। দৈবযোগে, এক পথিক, তথায় উপস্থিত হইয়া, তাদৃশ্য নিবিড় অরণ্যমধ্যে অসম্ভাবিত রোদনশব্দ শ্রবণ করিয়া, অতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইল, এবং শব্দ অনুসারে গমন করিয়া, কূপের সমীপবর্তী হইয়া, তন্মধ্যে দৃষ্টিনিক্ষেপপূর্বক, অবলোকন করিল, এক পরম সুন্দরী নারী, উচ্চৈঃস্বরে রোদন ও পরিবেদন করিতেছে। পথিক দর্শনমাত্র, অতিমাত্র ব্যাকুল হইয়া, পরম যত্নে সেই স্ত্রীরত্নকে কূপ হইতে উদ্ধৃত করিয়া, জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কে, কি নিমিত্তে, একাকিনী এই ভয়ঙ্কর কাননে আসিয়াছিলে; কি প্রকারেই বা তোমার এতাদৃশী দুর্দশা ঘটিল, বল।

রত্নাবতী, পতিনিন্দা অতি গৰ্হিত বুঝিয়া, প্রকৃত ব্যাপার গোপনে রাখিয়া কহিল, আমি চন্দ্রপুরনিবাসী হেমগুপ্ত শেঠের কন্যা; আমার নাম রত্নাবতী; আপন পতির সহিত শ্বশুরালয়ে যাইতেছিলাম; এই স্থানে উপস্থিত হইবামাত্র, সহসা কতিপয় দুর্দান্ত দস্যু আসিয়া, প্রথমতঃ, অঙ্গ হইতে সমস্ত অলঙ্কার লইয়া, আমায় এই কূপে ফেলিয়া দিল, এবং আমার পতিকে নিতান্ত নির্দয়ারূপে প্ৰহার করিতে করিতে, লইয়া গেল। তাঁহার কি দশা ঘটিয়াছে, কিছুই জানি না। পান্থ শুনিয়া অতিশয় আক্ষেপ করিতে লাগিল, এবং অশেষবিধ আশ্বাসদান ও অভয়প্ৰদান পূর্বক, অতি যত্নে রত্নাবতীকে সঙ্গে লইয়া, তাহার পিত্ৰালয়ে পঁহুছাইয়া দিল।

রত্নাবতী পিতা-মাতার নিরতিশয় স্নেহপাত্র ছিল। তাঁহারা, তাহার তাদৃশ্য অসম্ভাবিত দুরবস্থা দর্শনে নিতান্ত বিস্ময়াপন্ন ও একান্ত শোকাক্রান্ত হইয়া, গলদশ্রু লোচনে, আকুল বচনে জিজ্ঞাসিলেন, বৎসে! কিরূপে তোমার এরূপ দুৰ্দশা ঘটিল, বল। সে কহিল, এক অরণ্যে, অকস্মাৎ চারিদিক হইতে, অস্ত্ৰধারী পুরুষেরা আসিয়া, বলপূর্বক আমার অঙ্গ হইতে সমুদায় অলঙ্কার খুলিয়া লইল, এবং তাঁহাকে যত সম্পত্তি দিয়া বিদায় করিয়াছিলে, সে সমুদায়ও কাড়িয়া লইল; অনন্তর, আমাকে এক অন্ধকূপে ফেলিয়া দিয়া, তাহার পৃষ্ঠে, নিতান্ত নিষ্ঠুর রূপে, যষ্টিপ্রহার করিতে করিতে, কহিতে লাগিল, আর কোথায় কি লুকাইয়া রাখিয়াছিস, বাহির করিয়া দে। তখন তিনি, নিতান্ত কাতর স্বরে অনেক বিনয় করিয়া বলিলেন, আমাদের নিকট যাহা ছিল, সমস্ত তোমাদের হস্তগত হইয়াছে; আর কিছুমাত্ৰ নাই। তোমাদের প্রহারে প্রাণ ওষ্ঠাগত হইতেছে; চরণে ধরিতেছি ও কৃতাঞ্জলি হইয়া ভিক্ষা করিতেছি, আমায় ছাড়িয়া দাও। তিনি বারংবার এইপ্ৰকার কাতরোক্তিপ্রয়োগ করিতে লাগিলেন; নির্দয় দস্যুরা তথাপি তাঁহাকে রজ্জুবদ্ধ করিয়া লইয়া গেল; তৎপরে ছাড়িয়া দিল, কি মারিয়া ফেলিল, কিছুই জানিতে পারি নাই। তখন তাহার পিতা কহিলেন, বৎসে! তুমি উৎকণ্ঠিত হইও না। আমার অন্তঃকরণে লইতেছে, তোমার পতি জীবিত আছেন। চোরেরা অর্থাপিশাচ, অর্থ হস্তগত হইলে, আর অকারণে প্ৰাণ নষ্ট করে না। এইরূপে অশেষবিধ আশ্বাস ও প্ৰবোধ দিয়া, তাহার পিতা, অবিলম্বে, আর এক প্ৰস্থ অলঙ্কার প্রস্তুত করিয়া দিলেন।

এদিকে, নয়নানন্দ, আপনি আলয়ে উপস্থিত হইয়া, অলঙ্কারবিক্রয় দ্বারা অর্থসংগ্ৰহ করিয়া, দিবারাত্র দূত্যক্রীড়া, সুরাপান প্রভৃতি দ্বারা কালক্ষেপ করিতে লাগিল, এবং কিয়ৎ দিনের মধ্যেই, পুনরায় নিঃস্বভাবাপন্ন ও অন্নবস্ত্রবিহীন হইয়া, মনে মনে বিবেচনা করিল, আমি যে কুব্যবহার করিয়াছি, তাহা শ্বশুরালয়ে, কোনও প্রকারেই, প্ৰকাশ পায় নাই। অতএব, একটা ছল করিয়া, তথায় উপস্থিত হই; পরে, দুই চারি দিন অবস্থিতি করিয়া, সুযোগক্রমে কিছু হস্তগত করিয়া, পলাইয়া আসিব। মনে মনে এই দুষ্ট অভিসন্ধি করিয়া, সে শ্বশুরালয়ে গমন করিল, এবং বাটীতে প্ৰবেশ করিরামাত্র, সর্বাগ্রে স্বীয় পত্নী রত্নাবতীর দৃষ্টিপথে পতিত হইল।

পতিপ্ৰাণ রত্নাবতী, পতিকে সমাগত দেখিয়া, অন্তঃকরণে চিন্তা করিল, পতি, অতি দুরাচার হইলেও, নারীর পরম গুরু। তাঁহাকে সন্তুষ্ট রাখিতে পারিলেই, নারী ইহলোকে ও পরলোকে চরিতার্থতা প্ৰাপ্ত হয়। আর, যে নারী, কুমতিপরতন্ত্র হইয়া, পরম গুরু স্বামীর কাদাচিৎক কুব্যবহারকে অপরাধ গণ্য করিয়া, তাহার প্রতি কোনও প্রকারে অশ্রদ্ধা বা অনাদর প্রদর্শন করে, সে আপন ঐহিক ও পারলৌকিক সকল সুখে জলাঞ্জলি দেয়। আর, উনি, কেবল ভ্ৰান্তিক্ৰমেই, সেরূপ ব্যবহার করিয়াছিলেন, সন্দেহ নাই। অতএব, আমি, সেই সামান্য দোষ ধরিয়া, উহার চরণে অপরাধিনী হইব না। যাহা হউক, উনি সবিশেষ না জানিয়াই এখানে আসিয়াছেন; আমায় দেখিতে পাইলেই, নিঃসন্দেহ, পলায়ন করিবেন। অতএব, অগ্ৰে উহার ভয়ভঞ্জন করিয়া দেওয়া উচিত।

রত্নাবতী, অন্তঃকরণে, এই সকল আলোচনা করিয়া, ত্বরায় তাহার সন্মুখবর্তিনী হইয়া কহিল, নাথ! তুমি অন্তঃকরণে কোনও আশঙ্কা করিও না। আমি পিতা মাতার নিকট কহিয়াছি, চোরেরা, অলঙ্কারগ্রহণপূর্বক, আমায় কুপে নিক্ষিপ্ত করিয়া, তোমায় বাঁধিয়া লইয়া গিয়াছে। অতএব, সে সকল কথা মনে করিয়া, ভীত হইবার আবশ্যকতা নাই। আমার পিতা মাতা তোমার নিমিত্ত অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত আছেন; তোমায় দেখিলে, যার পর নাই, আহ্লাদিত হইবেন। আর তোমার স্থানান্তরে যাইবার প্রয়োজন নাই; এই স্থানেই অবস্থিতি করা; আমি যাবজ্জীবন তোমার চরণসেবা করিব। এইরূপে তাহার ভয়ভঞ্জন করিয়া, পরিশেষে রত্নাবতী কহিল, আমি পিতা-মাতার নিকট যেরূপ বলিয়াছি, তোমায় জিজ্ঞাসা করিলে, তুমিও সেইরূপ বলিবে।

এইরূপ উপদেশ দিয়া, রত্নাবতী প্রস্থান করিলে পর, সেই ধূর্ত তৎক্ষণাৎ শ্বশুরের নিকটে গিয়া প্ৰণাম করিল। শ্রেষ্ঠী, আলিঙ্গনপূর্বক আশীৰ্বাদ করিয়া, অশ্রুপূর্ণ লোচনে গদগদ বচনে, জামাতাকে সবিশেষ সমস্ত জিজ্ঞাসিতে লাগিলেন। নয়নানন্দ, স্বীয় সহধর্মিণীর উপদেশানুরূপ সমস্ত বৰ্ণনা করিয়া, পরিশেষে কহিল, মহাশয়। যেরূপ বিপদে পড়িয়ছিলাম, তাহাতে প্রাণরক্ষার কোনও সম্ভাবনা ছিল না; কেবল জগদীশ্বরের কৃপায়, ও আপনাদের চরণারবিন্দের অকৃত্ৰিমস্নেহসম্বলিত আশীৰ্বাদের প্রভাবে, এ যাত্ৰা কথঞ্চিৎ পরিত্রাণ পাইয়াছি। যন্ত্রণার পরিসীমা ছিল না। অধিক আর কি বলিব, শত্রুও যেন কখনও এরূপ বিপদে না পড়ে। ইহা কহিয়া, যেন যথার্থই পূরব অবস্থার স্মরণ হইল, এরূপ ভান করিয়া, সে রোদন করিতে লাগিল। সবিশেষ সমস্ত শুনিয়া ও তাহার ভাব দেখিয়া, হেমগুপ্তের অন্তঃকরণে অতিশয় অনুকম্পা জন্মিল।

রজনী উপস্থিত হইল। পতিপ্ৰাণ রত্নাবতী, স্বামিসমাগমসৌভাগ্যমদে মত্ত হইয়া, তদীয় পূর্বতন নৃশংস আচরণ বিস্মরণপূর্বক, তৎসহবাসসুখসম্ভোগের অভিলাষে, মনের উল্লাসে, সর্বাঙ্গে সর্বপ্রকার অলঙ্কার পরিধান করিয়া, শয়নাগারে প্রবেশ করিল। নয়নানন্দ, কিয়ৎ ক্ষণ কৃত্রিম কৌতুকের পর, নিদ্রাবেশ প্রকাশ করিতে লাগিল। তখন রত্নাবতী কহিল, আজ তুমি পথশ্ৰান্ত আছ, আর অধিক ক্ষণ জাগরণক্লেশ সহ্য করিবার প্রয়োজন নাই। শয়ন কর, আমি চরণসেবা করি। সে কহিল, তুমিও শয়ন কর, চরণসেবা করিতে হইবেক না।

অনন্তর উভয়ে শয়ন করিলে, ধূর্তশিরোমণি নয়নানন্দ, অবিলম্বে, কপট নিদ্রার আশ্রয়গ্ৰহণপূর্বক, নাসিক্যধ্বনি করিতে আরম্ভ করিল। রত্নাবতীও, পতিকে নিদ্রাগত দেখিয়া, অনতিবিলম্বে নিদ্রায় অচেতন হইল। তখন, সেই অদ্ভুত দুরাত্মা, অবসর বুঝিয়া, গাত্ৰোখানপূর্বক, আপন কটিদেশ হইতে তীক্ষ্নধার ছুরি বহিস্কৃত করিল, এবং, নিরুপম স্ত্রীরত্ন রত্নাবতীর কণ্ঠনালীচ্ছেদনপূর্বক, সমস্ত আভরণ লইয়া পলায়ন করিল।

ইহা কহিয়া, শারিকা বলিল, মহারাজ! যাহা বর্ণিত হইল, সমস্ত স্বচক্ষে প্ৰত্যক্ষ করিয়াছি। তদবধি, আমার পুরুষজাতির উপর অত্যন্ত অশ্রদ্ধা ও অবিশ্বাস জন্মিয়াছে। প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, পুরুষের সহিত বাক্যালাপ করিব না, এবং সাধ্যানুসারে পুরুষের সংসর্গপরিত্যাগে যত্নবতী থাকিব। পুরুষেরা অতি ধূর্ত, অতি নৃশংস, অতি স্বার্থপর। মহারাজ! অধিক আর কি বলিব, পুরুষসহবাস সসৰ্প গৃহে বাস অপেক্ষাও ভয়ানক। এই সমস্ত কারণে, আর আমার পুরুষের মুখাবলোকন করিতে ইচ্ছা নাই।

রাজা শুনিয়া ঈষৎ হাস্য করিয়া, শুককে কহিলেন, আহে। চূড়ামণি! তুমি, শ্ৰীজাতির উপর কি নিমিত্তে এত বিরক্ত, তাহার সবিশেষ বর্ণন কর।

তখন শুক কহিল, মহারাজ! শ্ৰবণ করুন,

কাঞ্চনপুর নগরে সাগরদত্ত নামে এক শ্রেষ্ঠী ছিলেন। তাঁহার শ্ৰীদত্ত নামে সুরূপ, সুশীল, শান্তস্বভাব এক পুত্র ছিল। অনঙ্গপুরনিবাসী সোমদত্ত শ্ৰেষ্ঠীর কন্যা জয়শ্ৰীর সহিত তাহার বিবাহ হয়। কিয়ৎ দিন পরে, শ্ৰীদত্ত বাণিজ্যার্থে দেশান্তরে প্রস্থান করিল; জয়শ্ৰী আপনি পিত্ৰালয়ে বাস করিতে লাগিল। দীর্ঘ কাল অতীত হইল, তথাপি শ্ৰীদত্ত প্ৰত্যাগমন করিল না।

একদিন, জয়শ্ৰী আপন প্রিয়বয়স্যার নিকট কহিল, দেখ সখি! আমার যৌবন বৃথা হইল। আজ পর্যন্ত সংসারের সুখ কিছুমাত্র জানিতে পারিলাম না। বলিতে কি, এরূপে একাকিনী কালাহরণ করা কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। তুমি কোনও উপায় স্থির কর। তখন সখী কহিল, প্ৰিয়সখি! ধৈৰ্য ধর, ভগবানের ইচ্ছা হয় ত, অবিলম্বে তোমার প্রিয়সমাগম হইবেক। জয়শ্ৰী, ইচ্ছানুরূপ উত্তর না পাইয়া, অসন্তোষ প্ৰকাশ করিল, এবং তৎক্ষণাৎ তথা হইতে অপসৃত হইয়া, গবাক্ষদ্বার দিয়া রাজপথ নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। দৈবযোগে, ঐ সময়ে, এক পরম সুন্দর যুবা পুরুষ, অতিমনোহর বেশে, ঐ পথে গমন করিতেছিল। ঘটনাক্রমে, তাহার ও জয়শ্ৰীর চারিচক্ষুঃ একত্রে হইবাতে, উভয়েই উভয়ের মন হরণ করিল। জয়শ্ৰী তৎক্ষণাৎ, আপনি সখীকে কহিল, দেখ, যে রূপে পার, ঐ হৃদয়চোর ব্যক্তির সহিত সংঘটন করিয়া দাও। জয়শ্ৰীর সখী, তাহার নিকটে গিয়া, কথাচ্ছলে তাহার অভিপ্ৰায় বুঝিয়া কহিল, সোমদত্তের কন্যা জয়শ্ৰী তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চান; সন্ধ্যার পর, তুমি আমার আলয়ে আসিবে। এই বলিয়া, সে তাহাকে আপন আলয় দেখাইয়া দিল। তখন সে কহিল, তোমার সখীকে বলিবে, আমি অতিশয় অনুগৃহীত হইলাম; সায়ংকালে, তোমার আবাসে আসিয়া নিঃসন্দেহ তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিব।

তদনন্তর সখী, জয়শ্ৰীর নিকটে গিয়া, সবিশেষ সমুদায় তাহার গোচর করিলে, সে অত্যন্ত আহ্লাদিত হইল, এবং তাহাকে পারিতোষিক দিয়া, অশেষ প্রকার প্রশংসা করিয়া কহিল, যদি তুমি তাহার সহিত মিলন করিয়া দিতে পার, আমায় চিরকালের মত কিনিয়া রাখিবে; আমি, কোনও কালে, তোমার এ ধারা শুধিতে পারিব না। এক্ষণে তুমি আপন আলয়ে গিয়া অবস্থিতি কর; সে আসিবামাত্র আমায় সংবাদ দিবে। এই বলিয়া, সখীকে বিদায় করিয়া, জয়শ্ৰী, উল্লাসিত মনে, ইচ্ছানুরূপ বেশভূষা করিতে বসিল।

শুভ সন্ধ্যাকাল উপস্থিত হইলে, সেই যুব, রতিপতির আদেশানুরূপ বেশপরিগ্রহ করিয়া, সখীর আলয়ে উপস্থিত হইল। সে, পরম সমাদরে বসিতে আসন দিয়া, জয়শ্ৰীর নিকটে গিয়া, প্ৰিয়তমের উপস্থিতিসংবাদ দিল। জয়শ্ৰী শুনিয়া, আহ্লাদসাগরে মগ্ন হইয়া, কহিল, সখি! কিঞ্চিৎ কাল অপেক্ষা করি; গৃহজন নিদ্রিত হইলেই, তোমার সঙ্গে গিয়া, প্ৰাণনাথের হস্তে আত্মসমৰ্পণ করিয়া, জন্ম সাৰ্থক করিব। অনন্তর, পরিবারস্থ সমস্ত লোক নিদ্রাগত হইলে, জয়শ্ৰী, সখীর সহিত তদীয় আবাসে উপস্থিত হইয়া, অননুভূতপূর্ব, চিরাকাঙ্ক্ষিত মদনরসের আস্বাদন দ্বারা, যৌবনের চরিতার্থতা সম্পাদনা করিয়া, নিশাবসান সময়ে, স্বীয় আবাসে প্ৰতি গমন করিল। সে, এইরূপে, প্রত্যহ, প্রিয়সমাগমসুখে কালযাপন করিতে লাগিল।

কিয়ৎ দিন পরে, তাহার স্বামী, বিদেশ হইতে প্ৰত্যাগত হইয়া, শ্বশুরালয়ে উপস্থিত হইল। জয়শ্ৰী, শ্ৰীদত্তের সমাগমনে, মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিল, এ আপদ আবার, এত দিনের পর, কোথা হইতে উপস্থিত হইল। এখন কি করি, প্ৰাণনাথের নিকটে যাইবার ব্যাঘাত জন্মিল। কতদিন থাকিবেক, কত জ্বালাইবেক, তাহাও জানি না। এই চিন্তায় মগ্ন, ও স্নান, ভোজন প্রভৃতি সমস্ত বিষয়ে বিমুখ হইয়া, বিষন্ন মনে, সখীর সহিত, নানাপ্রকার মন্ত্রণা করিতে লাগিল।

রজনী উপস্থিত হইল। জয়শ্রীর মাতা, জামাতাকে, পরম সমাদর ও যত্নপূর্বক ভোজন করাইয়া, দাসী দ্বারা, শয়নাগারে গিয়া বিশ্রাম করিতে বলিলেন এবং আপন কন্যাকেও পতিশুশ্রূষার্থে গমন করিতে আদেশ দিলেন। জয়শ্ৰী প্রথমতঃ অসম্মত হওয়াতে, তাহার মাতা, নানাবিধ প্রবোধবাক্য ও ভর্ৎসনা দ্বারা তাহাকে নিরুত্তরা করিয়া বলপূর্বক গৃহপ্রবেশ করাইলেন। তখন সে বিবাশা হইয়া, শয়নাগারে প্রবেশপূর্বক, পল্যাঙ্কে আরোহণ করিয়া, বিবৃত্ত মুখে শয়ন করিয়া রহিল। শ্ৰীদত্ত, স্নিগ্ধ সম্ভাষণ করিয়া, প্ৰণয়িনীর প্রতি নানাপ্রকার প্রীতিবাক্য প্রয়োগ করিতে লাগিল। সে, তাহাতে সাতিশয় বিরক্তি প্ৰকাশ করিয়া, মৌন অবলম্বন করিয়া রহিল। শ্ৰীদত্ত, তাহার সন্তোষ জন্মাইবার নিমিত্ত, নিজানীত নানাবিধ বহুমূল্য অলঙ্কার ও পট্টশাটী প্রভৃতি কামিনীজনকমনীয় দ্রব্য প্রদান করিলে, জয়শ্ৰী, সাতিশয় কোপপ্রদর্শনপূর্বক, তদত্ত সমস্ত বস্তু দূরে নিক্ষিপ্ত করিল। তখন শ্ৰীদত্ত, নিতান্ত নিরুপায় ভাবিয়া, ক্ষান্ত রহিল, এবং একান্ত পথশ্ৰান্ত ছিল, তৎক্ষণাৎ নিদ্রাগত হইল।

জয়শ্ৰী, পতিকে নিদ্রায় অচেতন দেখিয়া, মনে মনে আহ্লাদিত হইল, এবং পতিদত্ত বস্ত্র ও অলঙ্কার পরিধান করিয়া, ঘোরতর অন্ধকারাবৃত রজনীতে, একাকিনী নিৰ্ভয়ে প্রিয়তমের উদ্দেশে চলিল। সেই সময়ে, এক তস্কর ঐ পথে দণ্ডায়মান ছিল। সে সর্বালঙ্কারভূষিত কামিনীকে, অর্ধারাত্র সময়ে, একাকিনী গমন করিতে দেখিয়া, বিবেচনা করিতে লাগিল, এই যুবতী, অসহায়িনী হইয়া, নিশীথ সময়ে, নিৰ্ভয়ে কোথায় যাইতেছে। যাহা হউক, সবিশেষ অনুসন্ধান করিতে হইল। এই বলিয়া, সে তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিল।

এদিকে, জয়শ্ৰীর প্রিয় সখা, সখীর আলয়ে একাকী শয়ন করিয়া, তাহার আগমনপ্ৰতীক্ষায় কালক্ষেপ করিতেছিল। অকস্মাৎ এক কালসৰ্প আসিয়া, দংশিয়া তাহার প্ৰাণসংহার করিয়া গেল। সে মৃত পতিত রহিল। জয়শ্ৰী, তথায় উপস্থিত হইয়া, মৃত প্রিয়তমকে কপটনিদ্রিত বোধ করিয়া, বারংবার আহবান করিতে লাগিল; কিন্তু উত্তর না পাইয়া, মনে মনে বিবেচনা করিল, আমার আসিতে বিলম্ব হওয়াতে, ইনি অভিমানে উত্তর দিতেছেন না; অনন্তর, তাহার পার্শ্বে শয়ন করিয়া, বিনয় ও প্রিয় সম্ভাষণপূর্বক, বিলম্বের হেতুনির্দেশ ও ক্ষমাপ্রার্থনা করিতে আরম্ভ করিল। চোর কিঞ্চিৎ দূরে দণ্ডায়মান হইয়া, সহাস্য আস্যে, এই রহস্য দেখিতে লাগিল।

নিকটস্থবটবৃক্ষবাসী এক পিশাচও এই কৌতুক দেখিতেছিল। সে, সাতিশয় কুপিত হইয়া, স্থির করিল, ঈদৃশী দুশ্চারিণীকে সমুচিত দণ্ড দেওয়া আবশ্যক; অনন্তর সে, তদীয় প্রিয়তমের মৃত কলেবরে আবিভূতি হইয়া, দন্ত দ্বারা জয়শ্ৰীর নাসিকাচ্ছেদনপূর্বক, আপন আবাসবৃক্ষে প্রতি গমন করিল। চোর, এই সমস্ত নয়নগোচর করিয়া, নিরতিশয় চমৎকৃত হইল।

জয়শ্ৰীর জ্ঞানোদয় হইল। তখন, সে, প্ৰিয়তমকে মৃত স্থির করিয়া, সখীর নিকটে গিয়া, পূর্বাপর সমস্ত ব্যাপার তাহার গোচর করিয়া কহিল, সখি! আমি এই বিষম বিপদে পড়িয়াছি; কি উপায় করি, বল। গৃহে গিয়া, কেমন করিয়া, পিতামাতার নিকট মুখ দেখাইব। তাঁহারা কারণ জিজ্ঞাসিলে, কি উত্তর দিব। বিশেষতঃ, আজি আবার সেই সৰ্বনাশিয়া আসিয়াছে; সেই বা, দেখিয়া শুনিয়া, কি মনে করিবেক। সখি! তুমি আমায় বিষ আনিয়া দাও, খাইয়া প্ৰাণত্যাগ করি; তাহা হইলেই সকল আপদ ঘুচিয়া যায়। এই বলিয়া, জয়শ্ৰী শিরে করাঘাত করিতে লাগিল। সখী শুনিয়া হতবুদ্ধি ও নিরুত্তরা হইয়া রহিল।

কিয়ৎ ক্ষণ পরে, জয়শ্ৰী, উৎপন্নমতিত্ববলে, এক উপায় স্থির করিয়া কহিল, সখি! আর চিন্তা নাই, উত্তম উপায় স্থির করিয়াছি; শুন দেখি, সঙ্গত হয় কিনা। আমি, এই অবস্থায় গৃহে গিয়া, শয়নমন্দিরে প্রবেশপূর্বক, চীৎকার করিয়া রোদন করিতে আরম্ভ করি। গৃহজন, রোদনশব্দে জাগরিত হইয়া, কারণ জিজ্ঞাসার্থে উপস্থিত হইলে, বলিব, আমার স্বামী, অকারণে, ক্ৰোধে অন্ধ হইয়া, নিতান্ত নির্দয়ারূপে বারংবার প্রহার করিয়া, পরিশেষে নাসিকাচ্ছেদন করিয়া দিলেন। সখী কহিল, উত্তম যুক্তি হইয়াছে; ইহাতে সকল দিক রক্ষা হইবেক। অতএব, অবিলম্বে গৃহে গিয়া, এইরূপ কর।

জয়শ্ৰী, সত্বর গৃহে গিয়া, শয়নাগারে প্রবেশপূর্বক, উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিল। গৃহজন, ক্ৰন্দনধ্বনি শ্রবণে ব্যকুল হইয়া, জয়শ্ৰীর শয়নগৃহে প্রবেশ করিয়া দেখিল, তাহার নাসিকা নাই; সমস্ত গাত্র ও বস্ত্ৰ শোণিতে অভিষিক্ত হইয়াছে; এবং, সে নিজে, ভূতলে পতিত হইয়া, রোদন করিতেছে। অনন্তর, তাহারা, ব্যগ্ৰতাপ্রদর্শন পুরঃসর, বারংবার হেতু জিজ্ঞাসা করাতে, জয়শ্ৰী আপনি স্বামীর দিকে অঙ্গুলিপ্রয়োগ করিয়া কহিল, ঐ দুর্বৃত্ত দস্যু আমার এই দুর্দশা করিয়াছে। তখন সমস্ত পরিবার, একবাক্য হইয়া, শ্ৰীদত্তের অশেষপ্রকার তিরস্কার আরম্ভ করিল।

সুশীল শ্ৰীদত্ত, পূর্বাপর কিছুই জানে না; অকস্মাৎ এতাদৃশি ভয়ঙ্কর কাণ্ড দর্শনে ও নানাপ্রকার তিরস্কারবাক্য শ্রবণে, বিস্ময়াপন্ন হইয়া, মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিল, আমি, সবিশেষ না জানিয়া, শ্বশুরালয়ে আসিয়া, যার পর নাই অবিবেচনার কর্ম করিয়াছি। ইহাকে অতি দুশ্চরিত্রা দেখিতেছি। প্রথমতঃ, শত শত চাটুবচনেও, যে ব্যক্তি আলাপ করে নাই; সেই এক্ষণে অনায়াসে, মুক্তকণ্ঠে, মিথ্যাপবাদ দিতেছে। এই নিমিত্তই নীতিজ্ঞেরা কহিয়াছেন, মনুষ্যের কথা দূরে থাকুক, দেবতারাও স্ত্রীলোকের চরিত্র ও পুরুষের ভাগ্যের কথা বুঝিতে পারেন না। জানি না, পরিশেষে কি বিপদ ঘটিবেক। এইরূপ নানাবিধ চিন্তায় মগ্ন হইয়া, মৌন অবলম্বনপূর্বক, সে অধোবদন হইয়া রহিল।

পর দিন, প্ৰভাত হইবামাত্র, জয়শ্ৰীর পিতা, রাজদ্বারে সংবাদ দিয়া, জামাতাকে বিচারালয়ে নীত করিল। প্রাড়্বিবাক, বাদী ও প্রতিবাদী উভয় পক্ষকে পরস্পর সম্মুখবর্তী করিয়া প্রথমতঃ জয়শ্ৰীকে জিজ্ঞাসিলেন, কে তোমার এ দুর্দশা করিয়াছে, বল; আমি সেই দুরাচারের যথোচিত দণ্ডবিধান করিতেছি। জয়শ্ৰী পতি প্ৰতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল, ধর্মাবতার। ইনি আমার স্বামী; ইঁহা হইতে আমার এই দুৰ্দশা ঘটিয়াছে। অনন্তর, প্রাড়্বিবাক শ্ৰীদত্তকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কি নিমিত্ত এমন দুষ্কৰ্ম করিলে। সে কহিল, ধর্মাবতার। আমি এ বিষয়ের ভালমন্দ কিছুই জানি না; ইহাতে, আপনকার বিচারে, যেরূপ ব্যবস্থা হয়, করুন; এই বলিয়া, কৃতাঞ্জলি হইয়া, বিষন্ন বদনে দণ্ডায়মান রহিল।

প্রাড়্বিবাক, বাদী ও প্ৰতিবাদীর বাক্যশ্রবণান্তে, সকল বিষয়ের সবিশেষ পর্যালোচনা করিয়া, ঘাতকাদিগকে ডাকাইয়া, শ্ৰীদত্তকে শূলে দিতে আদেশ করিলেন। চোর, কিঞ্চিৎ দূরে দণ্ডায়মান হইয়া, পূর্বাপর সমস্ত ব্যাপার, সবিশেষ সতর্কতাপূর্বক, দেখিতেছিল। সে, অকারণে এক ব্যক্তির প্রাণবিনাশের উপক্রম দেখিয়া, প্রাড়্বিবাকের সম্মুখবর্তী হইয়া নিবেদন করিল, মহাশয়! সবিশেষ অনুসন্ধান না করিয়া, বিনা অপরাধে, আপনি এ ব্যক্তির প্রাণদণ্ড করিতেছেন। আপনি ধর্মাবতার, যথার্থ বিচার করুন; ব্যভিচারিণীর বাক্যে বিশ্বাস করিবেন না।

প্রাড়্বিবাক চকিত হইয়া উঠিলেন, এবং চোরের বাক্য শুনিয়া, বারংবার জিজ্ঞাসা ও তথ্যানুসন্ধানপূর্বক, সবিশেষ সমস্ত অবগত হইলেন। তদীয় আদেশ অনুসারে, জয়শ্ৰীর মৃত পতিত উপপতির বক্ত্রমধ্য হইতে, তদীয় ছিন্ন নাসিকা আনীত হইল। তখন তিনি; নিরতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইয়া, চোরকে যথার্থবাদী ও শ্ৰীদত্তকে নিরপরাধ স্থির করিয়া, যথোচিত পারিতোষিক প্রদানপূর্বক, উভয়কে বিদায় দিলেন; এবং জয়শ্ৰীীর মস্তকমুণ্ডন ও তাহাতে তক্রসেচন, তৎপরে তাহাকে গর্দভে আরোহণ ও নগরে পরিভ্রমণ করাইয়া, দেশ হইতে বহিস্কৃত করিলেন।

এইরূপে আখ্যায়িকার সমাপন করিয়া, চূড়ামণি কহিল, মহারাজ। নারী ঈদৃশ প্রশংসনীয় গুণে পরিপূর্ণা হয়।

উপক্রান্ত উপাখ্যান সমাপ্ত করিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসিল, মহারাজ! জয়শ্ৰী ও নয়নানন্দ, এ উভয়ের মধ্যে কোন ব্যক্তি অধিক দুরাচার। রাজা কহিলেন, আমার মতে, দুই সমান।

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।

০৫. পঞ্চম উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ!

ধারা নগরে, মহাবল নামে, মহাবল পরাক্রান্ত নরপতি ছিলেন। তাঁহার দূতের নাম হরিদাস। ঐ দূতের, মহাদেবী নামে, এক পরম সুন্দরী কন্যা ছিল। কালক্রমে, কন্যা যৌবনসীমায় উপনীত হইলে, হরিদাস মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিল, কন্যা বিবাহযোগ্য হইল; অতঃপর, বর অন্বেষণ করিয়া, উহার বিবাহ সংস্কার সম্পন্ন করা উচিত। অনন্তর, পরিবারের মধ্যে, মহাদেবীর বিবাহের কথার আন্দোলন হইতে আরম্ভ হইলে, সে, এক দিন, আপনি পিতার নিকট নিবেদন করিল, পিতঃ! যে ব্যক্তির সহিত আমার বিবাহ দিবেন, তিনি যেন সৰ্বগুণে অলঙ্কত হন। হরিদাস, কন্যার এই প্রশংসনীয় প্রার্থনা শ্রবণে সন্তুষ্ট হইয়া, উপযুক্ত পাত্রের অনুসন্ধান করিতে লাগিল।

এক দিন, রাজা মহাবল হরিদাসকে কহিলেন, হরিদাস। দক্ষিণদেশে হরিশ্চন্দ্ৰ নামে রাজা আছেন। তিনি আমার পরম বন্ধু। বহু দিন অবধি, তাঁহার শারীরিক ও বৈষয়িক কোনও সংবাদ না পাইয়া, বড় উৎকণ্ঠিত হইয়াছি। অতএব, তুমি তথায় গিয়া, আমার কুশলসংবাদ দিয়া, ত্বরায় তাহার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলসংবাদ লইয়া আইস। হরিদাস, রাজকীয় আদেশ অনুসারে, কতিপয় দিবসের মধ্যে, রাজা হরিশ্চন্দ্রের রাজধানীতে উপস্থিত হইয়া, তাহার নিকট নিজ প্রভুর সন্দেশ জানাইল। হরিশ্চন্দ্ৰ, দূতমুখে মিত্রের মঙ্গলবাতাঁ প্রাপ্ত হইয়া, আনন্দসাগরে মগ্ন হইলেন; এবং সমুচিত পুরস্কার প্রদানপূর্বক, হরিদাসকে, কতিপয় দিবস, তথায় অবস্থিতি করিতে অনুরোধ করিলেন।

এক দিবস, রাজা হরিশ্চন্দ্ৰ সভামধ্যে হরিদাসকে জিজ্ঞাসা করিলেন, হরিদাস। তুমি কি বোধ কর, কলিযুগের আরম্ভ হইয়াছে কিনা। তখন সে কৃতাঞ্জলি হইয়া কহিল, হাঁ মহারাজ! কলিকাল উপস্থিত হইয়াছে। তাহার অধিকারপ্রভাবেই, সংসারে মিথ্যাপ্ৰপঞ্চ প্রবল হইয়া উঠিতেছে; সত্যের হ্রাস হইতেছে; পৃথিবী অল্প ফল দিতেছেন; লোক মুখে মিষ্ট বাক্য ব্যবহার করে, কিন্তু অন্তরে সম্পূর্ণ কপটতা; রাজারা, প্রজার সুখসমৃদ্ধির প্রতি দৃষ্টি না রাখিয়া, কেবল কোষ পরিপূরণে যত্নবান হইয়াছেন; ব্ৰাহ্মণের সৎকর্মের অনুষ্ঠানে বিসর্জন দিয়াছেন, এবং যৎপরোনাস্তি লোভী হইয়াছেন; স্ত্রীলোক লজ্জায় এককালে জলাঞ্জলি দিয়াছে, এবং সর্ব বিষয়ে সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন করিয়াছে; পুত্র পরম গুরু পিতামাতার শুশ্রূষায় ও আজ্ঞা প্রতিপালনে পরাঙ্মুখ হইয়াছে; ভ্রাতা ভ্রাতার প্রতি সৰ্বতোভাবে স্নেহশূন্য দৃষ্ট হইতেছে; মিত্ৰতা নিবন্ধন অকৃত্রিমপ্রণয়সম্বলিত সরল ব্যবহার আর দৃষ্টিগোচর হয় না; নিত্য, নৈমিত্তিক প্রভৃতি শাস্ত্রোক্ত কর্মে কাহারও আস্থা দেখিতে পাওয়া যায় না; পামরেরা, বুদ্ধি ও বিদ্যার অহঙ্কারে, প্রতিকূল তর্ক দ্বারা, ধৰ্মমূল সনাতন বেদশাস্ত্রের বিপ্লাবনে উদ্যত হইয়াছে। মহারাজ! ইত্যাদি নানা প্রকারে কেবল ধর্মের তিরোভাব ও অধর্মের প্রাদুর্ভাব সর্বত্র নেত্রগোচর হইতেছে। রাজা শুনিয়া, সন্তুষ্ট হইয়া, হরিদাসের সবিশেষ প্ৰশংসা করিলেন।

সভা ভঙ্গান্তে, রাজা অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন। হরিদাস, আপন অবস্থিতিস্থানে উপস্থিত হইয়া, এক অপরিচিত ব্ৰাহ্মণতনয়কে উপবিষ্ট দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কে, কি নিমিত্তে আসিয়াছ। সে কহিল, আমি তোমার নিকটে কিছু প্রার্থনা করিতে আসিয়াছি। হরিদাস কহিল, কি প্রার্থনা, বল; আমার সামর্থ্য হয়, সম্পন্ন করিব। সে কহিল, তোমার এক পরম সুন্দরী গুণবতী কন্যা আছে; আমার সহিত তাহার বিবাহ দাও। হরিদাস কহিল, আমি, কন্যার প্রার্থনা অনুসারে, প্ৰতিজ্ঞা করিয়াছি, যে ব্যক্তি সমস্ত বিদ্যায় পারদর্শী ও অসাধারণগুণসম্পন্ন হইবেক, তাহাকে কন্যাদান করিব। সে কহিল, আমি, বাল্যকাল অবধি, পরম যত্নে, নানা বিদ্যায় নিপুণ হইয়াছি; আর, আমার এক অসাধারণ গুণ এই যে, এক অদ্ভুত রথ নিৰ্মাণ করিয়াছি; তাহাতে আরোহণ করিলে, এক দণ্ডে, বর্ষগম্য দেশে উপস্থিত হওয়া যায়।

হরিদাস শুনিয়া সন্তুষ্ট হইল; এবং, কন্যাদানে সম্মত হইয়া কহিল, কল্য প্ৰাতঃকালে, তুমি রথ লইয়া আমার নিকটে আসিবে। এই বলিয়া, ব্ৰাহ্মণতনয়কে বিদায় দিয়া, হরিদাস স্নান, আহ্নিক, ও ভোজন করিল; এবং, অপরাহ্নে, রাজার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, বিদায় লইয়া, স্বদেশ প্ৰতিগমনের নিমিত্ত প্ৰস্তুত হইয়া রহিল।

পর দিন, প্ৰভাত হইবামাত্র, ব্ৰাহ্মণতনয় হরিদাসের নিকটে উপস্থিত হইলে, উভয়ে, রথে আরোহণ করিয়া, স্বল্প সময় মধ্যে, ধারানগরে উপস্থিত হইল। হরিদাসের প্রত্যাগমনের পূর্বে, তদীয় পত্নী ও পুত্র, পৃথক পৃথক, এক এক ব্ৰাহ্মণতনয়ের নিকট অঙ্গীকার করিয়াছিল, মহাদেবীর সহিত বিবাহ দিব; তাঁহাতে কেবল হরিদাসের গৃহপ্ৰত্যাগমনপ্রতীক্ষা প্রতিবন্ধক ছিল। এক্ষণে, সেই পূর্বাশ্বাসিত বরেরা, হরিদাসকে গৃহাগত শুনিয়া, বিবাহের নিমিত্ত, তদীয় আলয়ে উপস্থিত হইল।

এইরূপে তিন বর একত্র হইলে, হরিদাস, অতিশয়, ব্যাকুল হইয়া, মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিল, তিন জনে তিন জনের নিকট অঙ্গীকার করিয়াছি; তিন জনেই বিদ্যাবান ও অসাধারণগুণসম্পন্ন, কাহাকেই নিরাশ করি। অনন্তর, সে তাহাদিগকে কহিল, অদ্য তোমরা আমার আলয়ে অবস্থিতি করা; আমি, পুত্র ও গৃহিণীর সহিত পরামর্শ করিয়া, কর্তব্য স্থির করিব। তাহারা, সন্মত হইয়া, সে দিন, হরিদাসের আবাসে অবস্থিতি করিল। দৈববিড়ম্বনায়, সেই রজনীতে, বিন্ধ্যাচলবাসী এক রাক্ষস আসিয়া, হরিদাসের কন্যাকে হস্তগত করিয়া, প্ৰস্থান করিল।

গৃহজন প্ৰভাতে গাত্ৰোখান করিয়া দেখিল, মহাদেবী গৃহে নাই। তখন সকলে, একত্র হইয়া, নানাপ্রকার কল্পনা করিতে লাগিল। বিবাহাৰ্থী ব্ৰাহ্মণকুমারেরাও, ভাবিনী ভাৰ্যার আদর্শনবাতাঁ শ্ৰবণগোচর করিয়া, ম্লান বদনে তথায় উপস্থিত হইল। তন্মধ্যে এক ব্যক্তি, সমাধিবলে, ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান, সমুদয় প্রত্যক্ষবৎ দেখিত। সে হরিদাসকে কহিল, মহাশয়! উৎকণ্ঠিত হইবেন না। আমি দেখিতেছি, এক রাক্ষস, আপনকার কন্যার রূপলাবণ্যে মোহিত হইয়া, তাহাকে লইয়া গিয়া, বিন্ধ্য পৰ্বতে রাখিয়াছে; যদি তথা হইতে প্ৰত্যাহরণ করিবার কোনও উপায় থাকে, চেষ্টা দেখুন। দ্বিতীয় কহিল, আমি শব্দবেধী শর দ্বারা, বিপক্ষের প্রাণসংহার করিতে পারি; অতএব, কোনও উপায়ে তথায় উপস্থিত হইতে পারিলে, রাক্ষসেরা প্ৰাণবিনাশ ও কন্যার উদ্ধারসাধন করিতে পারিব। তখন তৃতীয় কহিল, আমার এই রথে আরোহণ করিয়া প্ৰস্থান কর, অবিলম্বে তথায় উপস্থিত হইতে পরিবে।

অনন্তর, সে, ঐ রথে আরোহণপূর্বক, বিন্ধাচলে উপস্থিত হইল; এবং, শব্দবেধী শর দ্বারা ক্ৰব্যাদের প্রাণসংহার করিয়া, মহাদেবী সমভিব্যাহারে, অবিলম্বে ধারানগরে প্রত্যাগমন করিল। অনন্তর, তিন বর, পরস্পর বিবাদ করিয়া, কহিতে লাগিল, আমিই ইহার পাণিগ্রহণে অধিকারী; আমি না হইলে, ইহার উদ্ধার হইবার কোনও সম্ভাবনা ছিল না। হরিদাস, তদীয় বাদানুবাদ শ্রবণে কর্তব্যাবধারণে বিমূঢ় ও যৎপরোনাস্তি ব্যাকুল হইল।

এইরূপে উপাখ্যানের সমাপন করিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! এই তিনের মধ্যে কোন ব্যক্তি মহাদেবীর পাণিগ্রহণে অধিকারী হইতে পারে। বিক্ৰমাদিত্য কহিলেন, যে ব্যক্তি রাক্ষসের প্ৰাণসংহার করিয়া, মহাদেবীর প্রত্যানয়ন করিয়াছে। বেতাল কহিল, তিন জনেই সমান বিদ্বান; এবং, তিন জনই, প্ৰত্যানয়নবিষয়ে, সমান সাহায্য করিয়াছে; তবে কি জন্য, অন্য কাহারও না হইয়া, এই কন্যা প্ৰত্যাহতাঁরই প্ৰণয়িনী হইবেক। রাজা কহিলেন, তিন জনই অসাধারণ গুণপ্রকাশ করিয়াছে, যথার্থ বটে; কিন্তু সূক্ষ্ম বিবেচনা করিলে, প্রত্যাহতাঁর গুণেই, প্রকৃত কার্য নিম্পন্ন হইয়াছে; অতএব, তাহারই প্রাধান্য যুক্তিযুক্ত বোধ হইতেছে।

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।

০৬. ষষ্ঠ উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ!

ধৰ্মপুর নামে অতি প্ৰসিদ্ধ নগর আছে। তথায় ধর্মশীল নামে অতি সুশীল রাজা ছিলেন। তাঁহার মন্ত্রীর নাম অন্ধক। মন্ত্রী, এক দিন, রাজাকে পরামর্শ দিলেন, মহারাজ। মন্দিরনির্মাণপূর্বক, কাত্যায়নীর প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করিয়া, প্রতিদিন, যথাবিধানে, পূজা করিতে আরম্ভ করুন; শাস্ত্রে এ বিষয়ে বিলক্ষণ ফলশ্রুতি আছে। রাজা, মন্ত্রীর পরামর্শে, পরম পরিতোষ প্রাপ্ত হইলেন; এবং, নূতন মন্দির নির্মিত করাইয়া, ভগবতী কাত্যায়নীর কাঞ্চনময়ী প্রতিমূর্তি সংস্থাপনপূর্বক, প্রত্যহ, মহাসমারোহে যথোপযুক্ত ভক্তিযোগ সহকারে, দেবীর পূজা করিতে লাগিলেন।

রাজা, এইরূপে, দেবতার আরাধানে নিয়ত যত্নবান ও গো-ব্ৰাহ্মণে সাতিশয় ভক্তিমান ছিলেন; তথাপি সংসারাশ্রমের সারভূত তনয়ের মুখচন্দ্ৰনিরীক্ষণে অধিকারী হইলেন না। সর্বদাই তিনি মনে মনে চিন্তা করেন, শাস্ত্রে ও লোকাচারে প্রসিদ্ধ আছে, অপুত্র ব্যক্তির সংসারাশ্রম, ধনে জনে পরিপূর্ণ হইলেও, শূন্যপ্রায়; এবং, পরকালেও, তাহার সদ্গতিলাভ হয় না। অতএব কি কর্তব্য।

এক দিন, রাজা, মন্ত্রিপ্রবর অন্ধকের পরামর্শ অনুসারে, কাত্যায়নীর মন্দিরে প্রবেশপূর্বক, সাষ্টাঙ্গ প্ৰণিপাত করিয়া, কৃতাঞ্জলিপুটে স্তব করিতে লাগিলেন, দেবি! তুমি ত্ৰিলোকজননী; ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর প্রভৃতি দেবগণ নিয়ত তোমার আরাধনা করেন; তুমি, কালে কালে, ত্ৰিভুবনের মহানর্থহেতু উৎপাতধূমকেতুপ্রায় মহিষাসুর, রক্তবীজ প্রভৃতি দূর্বৃত্ত দৈত্য-দানবগণের প্রাণসংহার করিয়া, ভূমির ভার হরিয়াছ; আর, যখন যে স্থানে তোমার ভক্তেরা বিপদগ্ৰস্ত হইয়াছে, তুমি তৎক্ষণাৎ, তথায় আবির্ভূত হইয়া, তাহাদের পরিত্রাণ করিয়াছ; তুমি শরণাগত ভক্তগণের মনোবাঞ্ছা পূৰ্ণ করিয়া থাক; এই নিমিত্ত, আমি তোমার শরণাপন্ন হইয়াছি; আমার মনস্কামনা পরিপূর্ণ কর। স্তবাবসানে রাজা, পুনর্বার সাষ্টাঙ্গ প্ৰণিপাত করিয়া, কৃতাঞ্জলি হইয়া, দণ্ডায়মান রহিলেন।

অনন্তর আকাশবাণী হইল, রাজন! আমি তোমার প্রতি আতিশয় প্রসন্ন হইয়াছি; অভিপ্রেতি বর প্রার্থনা কর। রাজা শুনিয়া, কৃতাৰ্থম্মন্য হইয়া, আনন্দগদ্গদ স্বরে কহিলেন, জননি! যদি প্ৰসন্ন হইয়া থাক, কৃপা করিয়া এই বর দাও, যেন আমি অবিলম্বে পুত্রের মুখ নিরীক্ষণ করি। দেবী কহিলেন, বৎস। অবিলম্বে তোমার পুত্ৰ জন্মিবেক, এবং ঐ পুত্ৰ সুশীল, শান্তস্বভাব, সর্বগুণসম্পন্ন, ও সর্ব বিষয়ে পারদর্শী হইবেক।

কিয়ৎ দিন অতীত হইলে, রাজার এক পুত্র জন্মিল। রাজা, মহাসমারোহে, সপরিবারে, দেবীর মন্দিরে উপস্থিত হইয়া, স্বহস্তে পূজাকাৰ্য সম্পন্ন করিলেন, এবং, সমাগত দীন, দরিদ্র, অনাথ প্রভৃতিকে প্রার্থনাধিক ধন দিয়া, পরিতুষ্ট করিয়া বিদায় করিলেন।

এক দিন, দীনদাস নামে তন্তুবায়, কোনও কার্য উপলক্ষে, নিজ বন্ধুর সহিত, রাজধানীতে গমন করিতেছিল। দৈবযোগে, তাহার সজাতীয়া, রাজধানীবাসিনী, এক পরম সুন্দরী কন্যা নয়নগোচর হওয়াতে, দীনদাস তদীয় অসামান্য রূপলাবণ্য দর্শনে মোহিত হইল। অনন্তর, সে দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইলে, তন্তুবায় মনে মনে চিন্তা করিল, আমাদের মহারাজ, পুত্ৰবিষয়ে নিতান্ত নিরাশ হইয়াও, ভগবতী কাত্যায়নীর প্ৰসাদে, বৃদ্ধ বয়সে, পুত্রের মুখনিরীক্ষণ করিয়াছেন। দেবীর কৃপাদৃষ্টি হইলে, আমারও স্ত্রীরত্নলাভ সম্পন্ন হইতে পারে।

এই চিন্তা করিয়া, দেবীর মন্দিরে প্রবেশপূর্বক, দৃঢ়তর ভক্তিযোগ সহকারে, সাষ্টাঙ্গ প্ৰণিপাত করিয়া, তন্তুবায় কৃতাঞ্জলিপুটে মানসিক করিল, ভগবতি! যদি এই কামিনীর সহিত আমার বিবাহ হয়, স্বহস্তে মস্তকচ্ছেদন করিয়া, তোমায় পূজা দিব। এইরূপ মানসিক করিয়া, প্ৰণামপূর্বক, সে, আপন বন্ধুর সহিত, নির্দ্দিষ্ট স্থানে প্ৰস্থান করিল; পরে, নিজালয়ে প্রতিগমন করিয়া, সেই সৰ্বাঙ্গসুন্দরী রমণীর দুঃসহ বিরহানলে দগ্ধহৃদয় হইয়া, আহার, বিহার প্রভৃতি সমস্ত বিষয়ে প্রবৃত্তিশূন্য হইল; এবং, অষ্ট প্রহর, অনন্যমন ও অনন্যকর্ম হইয়া, কেবল সেই কামিনীর বিভ্ৰম বিলাস আদি ধ্যান করিতে লাগিল।

তাহার সহচর, স্বীয় প্রিয় বয়স্যের এবংবিধ অপ্ৰতিবিধেয় স্মরদশার প্রাদুর্ভাব দেখিয়া, নিরতিশয় বিষন্নমনা হইল, এবং অশেষবিধ চিন্তা করিয়াও, উপায়নিরূপণে অসমর্থ হইয়া, পরিশেষে তাহার পিতার নিকট সবিশেষ সমস্ত নিবেদন করিল। তাহার পিতা, সমস্ত শ্রবণ ও স্বচক্ষে সমস্ত অবলোকন করিয়া, বিবেচনা করিল, ইহার যেরূপ অবস্থা দেখিতেছি, তাহাতে, বোধ হয়, সেই কন্যার সহিত বিবাহ না হইলে, প্রাণত্যাগ করিতে পারে। অতএব, এ বিষয়ে উপেক্ষা করা বিধেয় নহে; যাহাতে ত্বরায় ইহার অভীষ্ট সিদ্ধ হয়, সে বিষয়ে যত্নবান হওয়া কর্তব্য।

এই স্থির করিয়া, দীনদাসের পিতা, পুত্রের মিত্রকে সমভিব্যাহারে লইয়া, সেই কন্যার পিত্ৰালয়ে উপস্থিত হইল; এবং, যথোচিত শিষ্টাচার ও মিষ্টালাপের পর, গৃহস্বামীকে কহিল, আমি তোমার নিকট কিছু প্রার্থনা করিতে আসিয়াছি; যদি তুমি, দয়া করিয়া, প্রার্থনা পূর্ণ করিতে সম্মত হও, ব্যক্ত করি। সে কহিল, যদি সাধ্যাতীত না হয়, অবশ্য করিব, তাহাতে কোনও সন্দেহ নাই। এইরূপে গৃহস্বামীকে বচনবদ্ধ করিয়া, দীনদাসের পিতা, তাহার নিকট, আপন প্রার্থনা ব্যক্ত করিলে, সে, তৎক্ষণাৎ সম্মত হইয়া, শুভ দিন ও শুভ লগ্ন নির্ধারিত করিয়া, কন্যাদান করিল। তন্তুবায়তনয়, অভিলাষিত নারীসমাগম দ্বারা, কৃতাৰ্থম্মন্য হইয়া, পরম সুখে কালাহরণ করিতে লাগিল।

কিয়ৎ দিন পরে, দীনদাস, শ্বশুরালয়ে কর্মবিশেষ উপস্থিত হওয়াতে, নিমন্ত্রিত হইয়া, পূর্ব বন্ধুকে সমভিব্যাহারে লইয়া, পত্নীর সহিত তথায় প্রস্থান করিল। রাজধানীর নিকটবর্তী হইলে, ভগবতী কাত্যায়নীর মন্দির দীনদাসের দৃষ্টিগোচর হইল। তখন, পূর্বকৃত মানসিক স্মৃতিপথে আরূঢ় হওয়াতে, সে মনোমধ্যে এই আলোচনা করিতে লাগিল, আমি অতিশয় অসত্যবাদী পামর; দেবীর নিকট মানসিক করিয়া, বিস্মৃত হইয়া রহিয়াছি; জন্মজন্মান্তরেও, আমি এই গুরুতর অপরাধ হইতে নিষ্কৃতি পাইব না। যাহা হউক, এক্ষণে, ক্ষণমাত্র বিলম্ব না করিয়া, দেবীর ধার পরিশোধ করা উচিত।

এইরূপ স্থির করিয়া, দীনদাস স্বীয় সহচরকে কহিল, মিত্ৰ! তুমি ক্ষণ কাল অপেক্ষা কর; আমি, দেবীদর্শন করিয়া, ত্বরায় প্রত্যাগমন করিতেছি। এই বলিয়া, তথায় উপস্থিত ও সন্নিহিত সরোবরে স্নাত হইয়া, সে প্রথমতঃ যথাবিধি পূজা করিল; অনন্তর, ভগবতি কাত্যায়নী! বহু কাল হইল, আমি তোমার নিকট মানসিক করিয়াছিলাম; আদ্য তাহার পরিশোধ করিতেছি। এই বলিয়া, মন্দিরস্থিত খড়গ লইয়া, স্কন্ধাদেশে আঘাত করিবামাত্র, তাহার মস্তক, দেহ হইতে পৃথগ্‌ভূত হইয়া ভূতলে পতিত হইল।

দীনদাসের আসিতে অনেক বিলম্ব দেখিয়া, তাহার বন্ধু তাহার স্ত্রীকে কহিল, তুমি এই খানে থাক, আমি বন্ধুকে ডাকিয়া আনি। এই বলিয়া, তথায় গমন করিয়া, মন্দিরমধ্যে প্রবেশপূর্বক, সে দেখিল, দীনদাসের মস্তক ও কলেবর পৃথক পৃথক পতিত আছে। তখন সে, হতবুদ্ধি হইয়া, মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিল, সংসার অতি বিরুদ্ধ স্থান; কোনও ব্যক্তিই বোধ করিবেক না, এ স্বয়ং প্ৰাণত্যাগ করিয়াছে; সকলেই বলিবেক, আমি ইহার স্ত্রীর সৌন্দর্যে মোহিত হইয়া, নির্বিঘ্নে আপন অসৎ অভিপ্ৰায় সিদ্ধ করিবার নিমিত্ত, ইহার প্রাণবধ করিয়াছি। অকারণে, এরূপ বিরূপ লোকাপবাদে দূষিত হওয়া অপেক্ষা, প্রাণত্যাগ করাই বিধেয়। এই ভাবিয়া, সে ব্যক্তিও, তৎক্ষণাৎ, সেই খড়্গ দ্বারা, আপনার মস্তকাচ্ছেদন করিল।

তন্তুবায়তনয়া, বহুক্ষণ একাকিনী দণ্ডায়মান থাকিয়া, তাহদের অন্বেষণার্থে, দেবীর মন্দিরে উপস্থিত হইল; এবং উভয়কেই মৃত পতিত দেখিয়া, বিবেচনা করিল, দৈবদুৰ্বিপাকে আমার যে দুরবস্থা ঘটিল, তাহাতে বোধ করি, পূর্বজন্মে অনেক মহাপাতক করিয়াছিলাম। যাহা হউক, যাবজ্জীবন বৈধব্যযন্ত্রণা ভোগ করিয়া, অসার দেহভার বহন করা বিড়ম্বনামাত্র। আর, লোকেও বিশেষ না জানিয়া বলিবেক, এই স্ত্রী দুশ্চরিত্রা, আপনি অভীষ্ট সিদ্ধির নিমিত্ত, স্বামীর ও স্বামীর বন্ধুর প্রাণবধ করিয়াছে। অতএব, সর্ব প্রকারেই, আমার প্রাণত্যাগ করা উপযুক্ত।

এই বলিয়া, সেই শোণিতলিপ্ত খড়্গ লইয়া, তন্তুবায়তনয়া আত্মশিরশ্ছেদনে উদ্যত হইবামাত্র, দেবী, তৎক্ষণাৎ আবির্ভূতা হইয়া, তাহার হন্ত ধরিলেন এবং কহিলেন, বৎসে! আমি তোমার সাহস ও সদ্বিবেচনা দর্শনে প্ৰসন্ন হইয়াছি, বর প্রার্থনা কর। সে কহিল, জননি! যদি প্ৰসন্ন হইয়া থাক, ইহাদের দুইজনের প্রাণদান কর। দেবী, তথাস্তু বলিয়া, উভয়ের কলেবরের সহিত মস্তকের যোগ করিতে আদেশ দিয়া, অন্তর্হিতা হইলেন। তন্তুবায়তনয়া, কাত্যায়নীর বচন শ্রবণে আহ্লাদে অন্ধপ্রায়া হইয়া, একের মস্তক অন্যের শরীরে যোজিত করিয়া দিল। উভয়েই, তৎক্ষণাৎ প্ৰাণদান পাইয়া, গাত্ৰোত্থান করিল।

এইরূপে উপাখ্যান শেষ করিয়া, বেতাল বিক্রমাদিত্যকে জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! এক্ষণে কোন ব্যক্তি ঐ কন্যার স্বামী হইবেক বল। রাজা কহিলেন, শুন বেতাল! যেমন নদীর মধ্যে গঙ্গা উত্তম, পৰ্বতের মধ্যে সুমেরু উত্তম, বৃক্ষের মধ্যে কল্পতরু উত্তম; সেইরূপ, সমুদয় অঙ্গের মধ্যে মন্তক উত্তম; এই নিমিত্তে, শাস্ত্রকারেরা মস্তকের নাম উত্তমাঙ্গ রাখিয়াছেন। অতএব, যে ব্যক্তির কলেবরে পূর্বস্বামীর উত্তমাঙ্গ যোজিত হইয়াছে, সেই তাহার স্বামী হইবেক।

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।

০৭. সপ্তম উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ! শ্রবণ কর,

চম্পা নগরে চন্দ্ৰাপীড় নামে নরপতি ছিলেন। তাঁহার সুলোচনা নামে ভাৰ্যা ও ত্ৰিভুবনসুন্দরী নামে পরম সুন্দরী কন্যা ছিল। কন্যা কালক্রমে বিবাহযোগ্যা হইলে, রাজা উপযুক্ত পাত্রের নিমিত্ত অতিশয় চিন্তিত হইলেন। নানাদেশীয় রাজারা ক্রমে ক্রমে অবগত হইলেন, রাজা চন্দ্রাপীড়ের এক পরম সুন্দরী কন্যা আছে; তদীয় রূপলাবণ্যের মাধুরী দর্শনে, মুনিজনেরও মন মোহিত হয়। তাঁহারা সকলেই, বিবাহপ্রার্থনায়, নিপুণতার চিত্রকর দ্বারা স্ব স্ব প্রতিমূৰ্তি চিত্রিত করাইয়া, চন্দ্ৰাপীড়ের নিকট পাঠাইতে লাগিলেন। রাজা, মনোনীত করিবার নিমিত্ত, সেই সকল চিত্ৰ কন্যার নিকটে উপনীত করিতে লাগিলেন। কিন্তু, কাহারও ছবি তাহার মনোনীত হইল। না। তখন রাজা কন্যার স্বয়ংবরের আদেশ দিলেন। সে তাহাতে অসম্মতা হইয়া কহিল, তাত! স্বয়ংবর বৃথা আড়ম্বর মাত্র; তাহাতে আমার প্রয়োজন নাই। যে ব্যক্তি বিদ্যা, বুদ্ধি, বিক্ৰম, এই তিনে অসাধারণ হইবেক, আমি তাহাকেই পতিত্বে পরিগৃহীত করিব

কিয়ৎ দিন পরে, দেশান্তর হইতে, চারি বর উপস্থিত হইল। রাজা তাহাদিগকে স্ব স্ব গুণের পরিচয় দিতে বলিলেন। তন্মধ্যে এক ব্যক্তি কহিল, মহারাজ! আমি বাল্যকাল অবধি, বহু যত্নে ও বহু পরিশ্রমে, নানা বিদ্যায় নিপুণ হইয়াছি; আর, আমার এক অসাধারণ গুণ এই যে, প্ৰতিদিন, একখানি মনোহর বস্ত্ৰ প্ৰস্তুত করিয়া, পাঁচ রত্ন মূল্যে বিক্রয় করি। তাহার মধ্যে, সর্বাগ্রে এক রত্ন ব্ৰাহ্মণহন্তে সমর্পণ করি; দ্বিতীয় দেবসাৎ করিয়া, তৃতীয় আপন অঙ্গে ধারণ করি; চতুর্থ ভাবী ভাৰ্যার নিমিত্ত রাখিয়া, পঞ্চম দ্বারা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যয়ের নির্বাহ করিয়া থাকি। এই গুণ আমাভিন্ন অন্য কোনও ব্যক্তির নাই। আর আমার রূপের পরিচয় দিবার আবশ্যকতা কি; মহারাজ স্বচক্ষে প্ৰত্যক্ষ করিতেছেন। দ্বিতীয় কহিল, আমি, জলচর, স্থলচর, সমস্ত পশুপক্ষীর ভাষা জানি; আমার সমান বলবান ত্ৰিভুবনে আর কোনও ব্যক্তি নাই; আর, আমার আকার আপনকার সমক্ষেই উপস্থিত রহিয়াছে। তৃতীয় কহিল, আমি শাস্ত্রে অদ্বিতীয়; আমার সৌন্দৰ্য সাক্ষাৎ দেখিতেছেন, আপন মুখে বর্ণন করিয়া, নির্লজ্জ হইবার প্রয়োজন কি। চতুর্থ কহিল, আমি শস্ত্রবিদ্যায় অদ্বিতীয়, শব্দবেধী শর নিক্ষিপ্ত করিতে পারি; আর, আমার রূপলাবণ্যের বিষয় সর্বত্ৰ প্ৰসিদ্ধ আছে, এবং আপনিও স্বচক্ষে দেখিতেছেন।

এইরূপে, ক্ৰমে ক্ৰমে, চারি জনের রূপ, গুণ, ও বিদ্যার পরিচয় লইয়া, রাজা মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিলেন, চারি জনকেই রূপে, গুণে, ও বিদ্যায় অসাধারণ দেখিতেছি, কাহাকে কন্যা দান করি। অনন্তর, ত্ৰিভুবনসুন্দরীর নিকটে গিয়া, চারিজনের গুণের পরিচয় দিয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, বৎসে। এই চারি বর উপস্থিত, তুমি কাহাকে মনোনীত কর। শুনিয়া, ত্ৰিভুবনসুন্দরী লজ্জায় অধোমুখী ও নিরুত্তর হইয়া রহিল।

ইহা কহিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! কোন ব্যক্তি, যুক্তিমাৰ্গ অনুসারে, ত্ৰিভুবনসুন্দরীর পতি হইতে পারে। রাজা কহিলেন, যে ব্যক্তি বস্ত্ৰ নিৰ্মাণ করিয়া বিক্রয় করে, সে জাতিতে শূদ্র; যে ব্যক্তি পশুপক্ষীর ভাষা শিক্ষা করিয়াছে, সে জাতিতে বৈশ্য; যে সমস্ত শাস্ত্রে পারদর্শী হইয়াছে, সে জাতিতে ব্ৰাহ্মণ; কিন্তু শস্ত্ৰবেধী ব্যক্তি কন্যার সজাতীয়; সেই, শাস্ত্র ও যুক্তি অনুসারে, এই কন্যার পরিণেতা হইতে পারে।

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।

০৮. অষ্টম উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ!

মিথিলানগরে গুণাধিপ নামে রাজা ছিলেন। দক্ষিণদেশীয়, চিরঞ্জীব নামে, রজঃপূত, তাঁহার বদ্যান্যতা ও গুণগ্ৰাহকতা কীতি শ্রবণ করিয়া, কর্মের প্রার্থনায়, তাঁহার রাজধানীতে উপস্থিত হইল। কিন্তু, তাহার দূরদৃষ্টক্রমে, রাজা তৎকালে, সৰ্বক্ষণ অন্তঃপুরবাসী হইয়া, মহিলাগণের সহবাসে কালব্যাপন করিতেন, বহু কালেও একবার রাজসভায় উপস্থিত হইতেন না। সংবৎসর অতীত হইল, তথাপি চিরঞ্জীব রাজার সাক্ষাৎকার লাভ করিতে পারিল না; এ দিকে, ব্যয়নির্বাহের জন্য, যৎকিঞ্চিৎ যাহা সমভিব্যাহারে আনিয়াছিল, তাহা ক্ৰমে ক্ষয় প্রাপ্ত হইল।

এইরূপে নিতান্ত নিঃসম্বল হইয়া, চিরঞ্জীব মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিল, প্ৰায় সংবৎসর অতীত হইল, আশারাক্ষসীর মায়ায় মুগ্ধ হইয়া, শ্ববৃত্তি সেবার প্রত্যাশায়, দূর দেশ হইতে আসিয়া, রাজ্যতন্ত্রপরাঙ্মুখ স্ত্রীপরতন্ত্র রাজার আশ্রয় লইয়াছি। অভীষ্টসিদ্ধির কথা দূরে থাকুক, এ পর্যন্ত তাঁহার সাক্ষাৎকার লাভ করিতেও পারিলাম না। দেবতা, কত দিনে, আমার প্রতি প্রসন্ন হইয়া, রাজাকে অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইবার মতি ও প্রবৃত্তি দিবেন, তাহাও বুঝিতে পারিতেছি না। আর, এ ব্যক্তিকে অমাত্যায়িত্ত দেখিতেছি, স্বয়ং রাজকাৰ্যে মনোযোগ করেন না। কিন্তু, রাজা স্বায়ত্ত না হইলেও, তাঁহার নিকট মাদৃশ জনের অনায়াসে প্রার্থনাসিন্ধির সম্ভাবনা নাই। আর, অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইলেই, যে আমি, এতাদৃশ ব্যক্তির নিকট প্রার্থনা করিয়া, কৃতকাৰ্য হইতে পারিব, তাহারই বা নিশ্চয় কি। বিশেষতঃ, এক্ষণে আমি নিঃসম্বল হইলাম; ভিক্ষা দ্বারা উদরান্নসংগ্রহ ব্যতিরেকে, এ স্থলে অবস্থিতি করিবারও উপায় নাই। কিন্তু ভিক্ষাবৃত্তি মৃত্যু যন্ত্রণা অপেক্ষাও সমধিক ক্লেশদায়িনী। অতএব, এক অনিশ্চিত শ্ববৃত্তিলাভের প্রত্যাশায়, অন্য এক শ্ববৃত্তি অবলম্বন করা, নিতান্ত নিঘূর্ণ ও কাপুরুষের কর্ম। ফলতঃ, আশার দাসত্বস্বীকার করিলেই, নিঃসন্দেহ, দুঃসহ ক্লেশ ভোগ করিতে হয়। যে ব্যক্তি, আশাকে দাসী করিয়া, সকল ক্লেশের মস্তকে পদাৰ্পণ করিয়াছে, তাহারই জীবন সার্থক; যদি সংসারে কেহ সুখী থাকে, তবে সে ব্যক্তিই যথার্থ সুখী। অতএব, আদ্যই আমি, সংসারাশ্রমে জলাঞ্জলি দিয়া, অরণ্যে গিয়া, জগদীশ্বরের আরাধনায় প্রবৃত্ত হইব। এই নিশ্চয় করিয়া, মিথিলাপরিত্যাগপূর্বক, চিরঞ্জীব অরণ্যে প্রবেশ করিল।

কিয়ৎ দিন পরে, রাজা গুণাধিপ, অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইয়া, পুনর্বার রাজকাৰ্যে নিবিষ্টমনা হইলেন; এবং, কতিপয় দিবসের পর, সৈন্য সামন্ত সমভিব্যাহারে করিয়া, মহাসমারোহে, মৃগয়ায় গমন করিলেন। নানা বনে ভ্ৰমণ করিয়া, পরিশেষে, তিনি, এক মৃগের অনুসরণক্ৰমে, অশ্বারোহণে, একাকী, অরণ্যের নিবিড়তর প্রদেশে প্রবিষ্ট হইলেন। সকলভূবনপ্রকাশক ভগবান কমলিনীনায়ক অস্তাচলচুড়াবলম্বী হইলে, চারি দিক অন্ধকারে আচ্ছন্ন হইতে লাগিল; এবং সে মৃগও দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইল।

রাজা, যৎপরোনাস্তি ভীত ও ক্ষুৎপিপাসায় অভিভূত হইয়া, সাতিশয় বিষয় ও চিন্তাকুল হইলেন। কিন্তু, ভয়ক্ষোভ অপেক্ষা, বুভূক্ষা ও পিপাসার যন্ত্রণা, ক্রমে ক্রমে, অধিকতর প্রবল হইয়া উঠিল। তিনি, নিতান্ত অধৈৰ্য হইয়া, ইতস্ততঃ জলের অন্বেষণ করিতে করিতে, অরণ্যের মধ্যে অসম্ভাবিত কুটীর দর্শনে সাতিশয় হৃষ্টমনা হইলেন। রজঃপূত চিরঞ্জীব, বিষয়বিরক্ত হইয়া, ঐ কুটীরে তপস্যা করিতেছিল। তথায় উপস্থিত ও কুটীরদ্ধারে দণ্ডায়মান হইয়া, কৃতাঞ্জলিপুটে, কাতরতাপ্রদর্শনপূর্বক, রাজা জলদান দ্বারা প্ৰাণদানপ্রার্থনা করিলেন। চিরঞ্জীব, আতিথেয়তাপ্রদর্শনপূর্বক, তৎক্ষণাৎ, তপোবনসুলভ সুস্বাদ ফল ও সুশীতল জল প্ৰদান করিল।

রাজা, ফল ও জল পাইয়া, ক্ষুধানিবৃত্তি ও পিপাসাশান্তি করিলেন, এবং নিরতিশয় পরিতৃপ্ত হইয়া, আপনাকে পুনর্জীবিত বোধ করিতে লাগিলেন; পরে, মহোপকারক চিরঞ্জীবের ভাবিদর্শনে, প্রকৃত ঋষি বলিয়া বোধ না হওয়াতে, বিনয়নম্র বচনে বলিলেন, মহাশয়। আপনি আমার যে মহোপকার করিলেন, তাহাতে আমি আপনকার নিকট চিরক্রীত রহিলাম। এক্ষণে, এক অনুচিত প্রার্থনা দ্বারা, ধৃষ্টতাপ্রকাশে প্রবৃত্ত হইতেছি, অনুগ্রহপূর্বক অপরাধমার্জ্জনা করিবেন। আমি ক্রিয়া দ্বারা আপনাকে বিশুদ্ধ তপস্বী দেখিতেছি; কিন্তু, আকার ইঙ্গিত দর্শনে, কোনও ক্রমে, প্রকৃত তপস্বী বলিয়া বোধ হইতেছে না। এ বিষয়ে আমার গুরুতর সংশয় উপস্থিত হইয়াছে। আপনি, প্ৰাণসংশয়সময়ে, জলদান দ্বারা, আমায় প্ৰাণদান করিয়াছেন; এক্ষণে, কৃপা প্রদর্শনপূর্বক, সংশয়াপনোদন দ্বারা, আমায় চরিতার্থ করুন।

চিরঞ্জীব, রাজার অনুরোধলঙ্ঘনে অসমর্থ হইয়া, আত্মপরিচয়প্রদানপূর্বক কহিল, আমি, লোকমুখে মিথিলাধিপতি রাজা গুণাধিপের আশ্রিতপ্রতিপালনকীর্তি শ্রবণ করিয়া, কর্মপ্রার্থনায়, তাহার রাজধানীতে গিয়াছিলাম। কিন্তু, আমার ভাগ্যদোষে, রাজা, বিষয়সম্ভোগে আসক্ত হইয়া, সংবৎসর মধ্যেও, অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইলেন না। তৎপরে, নানা কারণে বিরক্ত হইয়া আমি অরণ্যবাস আশ্রয় করিয়াছি। কিন্তু, জাতিস্বভাবসিদ্ধ রজোগুণের আতিশয্যবশতঃ, আমার অন্তঃকরণ সাত্ত্বিক কাৰ্যে অনুরক্ত হইতেছে না; এখনও রাজসপ্রকৃতিসুলভ বিষয়ানুরাগে বিচলিত হইতেছে। অতএব, আপনকার এ সংশয় নিতান্ত অমূলক নহে; আপনি উত্তম অনুভব করিয়াছেন। রাজা শুনিয়া, মনে মনে, নিরতিশয় লজ্জিত হইলেন; কিন্তু, তখন কিছু মাত্র ব্যক্ত না করিয়া, চিরঞ্জীবের অনুমতিগ্রহণপূর্বক, তদীয় কুটীরেই রাজনীযাপন করিলেন।

পর দিন, প্রভাত হইবামাত্র, রাজা গুণাধিপ, আত্মপরিচয়প্রদানপূর্বক, চিরঞ্জীবকে রাজধানীতে লইয়া গেলেন; এবং, সাতিশয় অনুগ্রহভাজন ও প্রিয়পাত্ৰ করিয়া, আপন নিকটে রাখিলেন। তদবধি, তিনি, তাহার প্রতি, সতত, সাতিশয় সদয় ব্যবহার করিতে লাগিলেন। সে ব্যক্তিও, তদীয় নির্দেশ সম্পাদনে, প্ৰাণপণে যত্ন করিতে লাগিল।

একদা রাজা, অনুল্লঙ্ঘনীয় প্রয়োজনবিশেষাবশতঃ, চিরঞ্জীবকে দেশান্তরে প্রেরণ করিলেন। সে, রাজকাৰ্যসম্পাদন করিয়া, প্রত্যাগমনকালে অর্ণবকুলে এক অপূর্ব দেবালয় দেখিতে পাইল। তন্মধ্যে প্রবেশপূর্বক, দেবদর্শন করিয়া, চিরঞ্জীব বহির্গত হইবামাত্র, এক পরম সুন্দরী কামিনী সহসা তাহার সম্মুখবর্তিনী হইল। তদীয় কোমল কলেবরে লোকাতিগ লাবণ্য অবলোকনে মোহিত হইয়া, চিরঞ্জীব একতান মনে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল। সেই রমণী, তাহার এইরূপ ভাব দেখিয়া, জিজ্ঞাসা করিল, অহে পুরুষবর। তুমি, কি নিমিত্তে, এ স্থানে আসিয়াছ; এবং, কি নিমিত্তেই বা, চিত্ৰাপিতের ন্যায়, দণ্ডায়মান রহিয়াছ। চিরঞ্জীব কহিল, কাৰ্যবশতঃ দেশান্তরে গিয়াছিলাম; কাৰ্য শেষ করিয়া, স্বদেশে প্ৰতিগমন করিতেছি; কিন্তু, অকস্মাৎ, তোমার অলৌকিক রূপলাবণ্য দর্শনে, মোহিত ও হতবুদ্ধি হইয়া, দণ্ডায়মান আছি। তখন সেই সীমন্তিনী কহিল, তুমি এই সরোবরে অবগাহন কর, তাহা হইলে, আমি তোমার আজ্ঞানুবর্তিনী হইব।

চিরঞ্জীব, শ্রবণমাত্র অতিমাত্র হৃষ্ট হইয়া, সরোবরে অবগাহন করিল; কিন্তু, জলের মধ্য হইতে মস্তক উত্তোলিত করিয়া দেখিল, আপনি আলয়ে উপস্থিত হইয়াছে। তখন সে, যৎপরোনাস্তি বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া, আর্দ্র বস্ত্র পরিত্যাগ করিল। এবং, অবিলম্বে নরপতিগোচরে উপস্থিত হইয়া, পূর্বাপর সমস্ত বৃত্তান্ত নিবেদিল। এই অদ্ভুত ব্যাপার কর্ণগোচর করিয়া, রাজা অতিশয় চমৎকৃত হইলেন, এবং কহিলেন, তুমি ত্বরায় আমায় ঐ স্থানে লইয়া চল। অনন্তর, উভয়ে, সমুচিত যানে আরোহণপূর্বক, অর্ণবতীরে উপস্থিত হইয়া, সেই দেবালয়ে প্রবেশ করিলেন; এবং, যথোচিত ভক্তিযোগ সহকারে পূজা ও প্ৰণাম করিয়া, বহির্গত হইলেন।

এই সময়ে, সেই সৰ্বাঙ্গসুন্দরী রমণী, রাজার সম্মুখে আসিয়া, দণ্ডায়মান হইল, এবং, তদীয় সৌন্দৰ্য দর্শনে মোহিত হইয়া কহিল, মহারাজ! আমার প্রতি যে আজ্ঞা করিবেন, তাহাই শিরোধাৰ্য করিব। রাজা কহিলেন, যদি তুমি, আমার বাক্য অনুসারে, কাৰ্য করিতে চাও, আমার প্রিয়পাত্র চিরঞ্জীবের সহধর্মিণী হও। সে কহিল, আমি তোমার রূপের ও গুণের বশীভূত হইয়াছি; এমন স্থলে, কেমন করিয়া, উহার সহধর্মিণী হইব। রাজা কহিলেন, তুমি এইমাত্র অঙ্গীকার করিয়াছ, আমার আদেশ অনুসারে কর্ম করিবে। সজ্জনেরা, প্রাণ পৰ্যন্ত পণ করিয়া, প্রতিজ্ঞাপালন করেন। অতএব, আপনি বাক্যরক্ষা কর, চিরঞ্জীবের সহধর্মিণী হও। পরিশেষে, সেই কামিনী সম্মতিপ্রদর্শন করিলে, রাজা, গান্ধৰ্ব বিধান দ্বারা, উভয়কে পরস্পর সহচর করিয়া দিয়া, আপনি সমভিব্যাহারে, রাজধানীতে লইয়া গেলেন, এবং তাহাদের সচ্ছন্দরূপ জীবিকানিৰ্বাহের যথোচিত ব্যবস্থা করিয়া দিলেন।

বেতাল জিজ্ঞাসিল, মহারাজ! রাজা ও চিরঞ্জীবের মধ্যে, কোন ব্যক্তির অধিক সৌজন্য ও ঔদার্য প্ৰকাশ হইল। রাজা কহিলেন, চিরঞ্জীবের। বেতাল কহিল, কি প্রকারে। বিক্ৰমাদিত্য কহিলেন, রাজা পরিশেষে চিরঞ্জীবের নানা মহোপকার করিলেন, যথাৰ্থ বটে; কিন্তু চিরঞ্জীব, মৃগয়াদিবসে, ফল, জল, ও আশ্রয়দান দ্বারা, রাজার যে উপকার করিয়াছিল, তাহার সহিত ও সকলের তুলনা হইতে পারে না।

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।

০৯. নবম উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ!

মগধপুর নামে এক নগর আছে। তথায় বীরবর নামে রাজা ছিলেন। তাঁহার অধিকারে, হিরণ্যদত্ত নামে, এক ঐশ্বর্যশালী বণিক বাস করিত। ঐ বণিকের, মদনসেনা নামে, এক পরম সুন্দরী কন্যা ছিল। ঋতুরাজ বসন্ত সমাগত হইলে, মদনসেনা, স্বীয় সহচরীবর্গ সমভিব্যাহারে, উপবনবিহারে গমন করিল। দৈবযোগে, ধৰ্মদত্ত বণিকের পুত্র সোমদত্তও, পরিভ্রমণবাসনায়, সেই সময়ে, ঐ উপবনে উপস্থিত হইল। সে, কিয়ৎ ক্ষণ, ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিয়া, দূর হইতে দর্শন করিল, এক পরমা সুন্দরী, পূর্ণযৌবনা কামিনী, সখীগণ সহিত, ভ্রমণ করিতেছে। ক্ৰমে ক্রমে নিকটবর্তী হইয়া, সোমদত্ত, মদনসেনার অসামান্যরূপলাবণ্য নয়নগোচর করিয়া, মোহিত হইল; এবং, নিতান্ত অধৈৰ্য হইয়া, তাহার নিকটে গিয়া কহিল, সুন্দরি! তুমি আমার প্রতি প্ৰসন্ন হও; আমি, তোমার অলৌকিক রূপলাবণ্য দর্শনে, নিতান্ত বিচেতন হইয়াছি। অধিক আর কি বলিব, যদি আমার প্রতি অনুকুল না হও, তোমার সমক্ষে আত্মঘাতী হইব। মদনসেনা শুনিয়া, সাতিশয় ব্যাকুল হইয়া, সোমদত্তকে, অশেষ প্রকারে, সদুপদেশ প্ৰদান করিল; কিন্তু; কোনও প্রকারে তাহাকে প্রকৃতিস্থ করিতে পারিল না। সোমদত্ত, অধিকতর অধৈর্য ও ব্যাকুল হইয়া, অঞ্জলি বদ্ধ করিয়া, অশ্রুমুখে, সম্মুখে দণ্ডায়মান রহিল। তখন মদনসেনা, উদারস্বভাবতাবশতঃ, পরের প্রাণরক্ষা করা প্রধান ধর্ম বোধ করিয়া, কহিল, আগামী পঞ্চম দিবসে, আমার বিবাহ হইবেক; তৎপরে শ্বশুরালয়ে যাইব। প্ৰতিজ্ঞা করিতেছি, অগ্ৰে তোমার সহিত সাক্ষাৎ না করিয়া, স্বামিসেবায় প্রবৃত্ত হইব না। তুমি এক্ষণে ক্ষান্ত হও, গৃহে গমন কর। সোমদত্ত, মদনসেনার বাক্যে আশ্বাসিত হইয়া, বিশ্বসিত মনে, গৃহে গমন করিল।

তৎপরে, পঞ্চম দিবসে পরিণীতা হইয়া, মদনসেনা শ্বশুরালয়ে গেল। রজনী উপস্থিত হইলে, গৃহজনেরা তাহারে শয়নাগারে প্রবেশিত করিল। সে, সর্বাঙ্গ বস্ত্রাবৃত করিয়া, মৌন অবলম্বনপূর্বক, শয্যার এক পার্শ্বে উপবিষ্ট রহিল। তাহার স্বামী, পরম সমাদরে করগ্রহণপূর্বক, প্রিয় সম্ভাষণ করিতে লাগিল। কিন্তু মদনসেনা, তৎকালোচিত নবোঢ়াচেষ্টিতসমূদয়ের বৈপরীত্যে, সোমদত্তের বৃত্তান্ত বর্ণনা করিয়া কহিল, যদি তুমি আমায় তাহার নিকটে যাইতে অনুমতি না দাও, আমি আত্মঘাতিনী হইব। তাহার স্বামী প্রথমতঃ বিস্তর নিষেধ করিল; পরে তাহার আগ্রহের আতিশয্য দেখিয়া কহিল, যদি তুমি নিতান্তই তাহার নিকটে যাইতে চাও, যাও, আমি নিষেধ করিতে পারি না; প্ৰতিজ্ঞাপ্রতিপালন অবশ্যকর্তব্য বটে।

মদনসেনা, এইরূপে স্বামীর সন্মতিলাভ করিয়া, অর্ধরাত্র সময়ে, একাকিনী সোমদত্তের আলয়ে চলিল। রাজপথে উপস্থিত হইলে, এক তস্কর তাহার সম্মুখে আসিয়া জিজ্ঞাসিল, সুন্দরি। তুমি কে; এবং, সর্বাঙ্গে সর্বপ্রকার অলঙ্কার পরিয়া, এ ঘোর রজনীতে, কি অভিপ্ৰায়ে, কোথায় যাইতেছ। তোমায় একাকিনী দেখিতেছি; অথচ, তোমার অন্তঃকরণে ভয়সঞ্চার লক্ষিত হইতেছে না। মদনসেনা কহিল, আমি হিরণ্যদত্ত শ্রেষ্ঠীর কন্যা। আমার নাম মদনসেনা; প্রতিজ্ঞাপ্রতিপালনের জন্য, সোমদত্তের নিকট যাইতেছি।

চোর শুনিয়া, ঈষৎ হাসিয়া, তাহার গাত্ৰ হইতে অলঙ্কার গ্রহণের উদ্যম করিলে, মদনসেনা ব্যাকুল হইয়া, কৃতাঞ্জলিপুট, পূর্বাপর সমস্ত বৃত্তান্তের নির্দেশ করিয়া কহিল, ভ্রাতঃ! আমি, অনেক যত্নে, স্বামীকে সম্মত করিয়া, তাঁহার অনুমতি লইয়া, প্রতিজ্ঞাভার হইতে মুক্ত হইবার উপায় করিয়াছি; তুমি, আমার বেশভঙ্গ করিয়া, প্ৰতিবন্ধকতাচরণ করিও না। এই স্থানে অবস্থিতি কর; প্রতিজ্ঞা করিতেছি, প্রত্যাগমনকালে সমস্ত অলঙ্কার তোমার হস্তে সমৰ্পণ করিয়া যাইব। চোর, মদনসেনার বাক্যে বিশ্বাস করিয়া, তাহাকে ছাড়িয়া দিল; এবং, সেই স্থানে উপবিষ্ট হইয়া, অলঙ্কারের প্রত্যাশায় তদীয় প্রত্যাগমনের প্রতীক্ষা করিতে লাগিল।

মদনসেনা, সোমদত্তের শয়নাগারে প্রবেশ করিয়া, তাহাকে সুপ্ত দেখিয়া জাগরিত করিল। সোমদত্ত, মদনসেনার অসম্ভাবিত সমাগমে বিস্ময়াপন্ন হইয়া, জিজ্ঞাসা করিল, তুমি, এই ঘোর রজনীতে, একাকিনী কি প্রকারে কোথা হইতে উপস্থিত হইলে। মদনসেনা কহিল, বিবাহের পর শ্বশুরালয়ে গিয়াছি; তথা হইতে আসিতেছি। কয়েক দিবস হইল, উপবনবিহারকালে, তোমার নিকট যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম, সেই প্ৰতিজ্ঞার প্রতিপালনার্থে উপস্থিত হইয়াছি; এক্ষণে তোমার ইচ্ছা বলবতী। সোমদত্ত জিজ্ঞাসিল, তোমার পতির নিকটে এই বৃত্তান্ত ব্যক্ত করিয়াছ কি না। সে উত্তর দিল, তাঁহার নিকটে সকল বিষয়ের অবিকল বর্ণন করিলাম; তিনি, শুনিয়া ও বিবেচনা করিয়া, কিঞ্চিৎ কাল পরে, অনুমতি প্রদান করিলেন; তৎপরে তোমার নিকট আসিয়াছি।

সোমদত্ত কিয়ৎ ক্ষণ চিন্তা করিয়া কহিল, আমি পরকীয় মহিলার অঙ্গস্পর্শ করিব না। শাস্ত্রে সে বিষয়ে সবিশেষ দোষনির্দেশ আছে। যাহা হউক, তোমার বাক্যনিষ্ঠায় ও তোমার পতির ভদ্রতায়, অতিশয় প্রীত হইলাম। অকপট হৃদয়ে বলিতেছি, তুমি প্রতিজ্ঞাভার হইতে মুক্ত হইলে; এক্ষণে যাও, প্রকৃত প্রস্তাবে পতিশুশ্রূষায় প্রবৃত্ত হও।

তদনন্তর, মদনসেনা, প্রত্যাবর্তনকালে, মলিম্লুচের নিকটে উপস্থিত হইল। সে, তাহাকে ত্বরায় প্রত্যাগত দেখিয়া, কারণ জিজ্ঞাসিলে, মদনসেনা সবিশেষ সমস্ত বর্ণন করিল। চোর শুনিয়া, যৎপরোনাস্তি আহ্লাদিত হইয়া, অকপট হৃদয়ে কহিল, আমার অলঙ্কারের প্রয়োজন নাই। তুমি অতি সুশীলা ও সত্যবাদিনী। ধর্মে ধর্মে, তোমার যে সতীত্বরক্ষা হইল, তাহাই আমার পরম লাভ। তুমি নির্বিঘ্নে শ্বশুরালয়ে গমন কর। এই বলিয়া চোর চলিয়া গেল। অনন্তর, মদনসেনা স্বামীর সন্নিধানে উপস্থিত হইলে, সে, আর তাহার সহিত পূর্ববৎ সম্ভাষণ না করিয়া, অপ্রসন্ন মনে শয়ান রহিল।

ইহা কহিয়া, বেতাল বিক্রমাদিত্যকে জিজ্ঞাসিল, মহারাজ! এই চারি জনের মধ্যে কাহার। ভদ্রতা অধিক। রাজা উত্তর দিলেন, চোরের। বেতাল কহিল, কি প্রকারে। রাজা কহিলেন, মদনসেনার স্বামী, তাহাকে অন্যসংক্রান্তহৃদয়া দেখিয়া, পরিত্যাগ করিয়াছিল; প্রশস্ত মনে সোমদত্তের নিকট গমনে অনুমতি দেয় নাই; তাহা হইলে উহার মন এখন অপ্ৰসন্ন হইত না। আর, সোমদত্ত, উপবনে তাদৃশ অধৈৰ্যপ্রদর্শন করিয়া, এক্ষণে, কেবল রাজদণ্ডভয়ে, মদনসেনার সতীত্বভঙ্গে পরাঙ্মুখ হইল, আন্তরিক ধর্মভীরুতা প্রযুক্ত নহে। আর, মদনসেনা, সোমদত্তের নিকট প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল, এবং প্ৰতিজ্ঞাপ্ৰতিপালন করা উচিত কর্ম বটে; কিন্তু স্ত্রীলোকের পক্ষে, সতীত্বপ্রতিপালন করাই সর্বাপেক্ষা প্রধান ধর্ম। সুতরাং, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গভয়ে, সতীত্বভঙ্গে প্ৰবৃত্ত হওয়া, অসতীর কর্ম বলিতে হইবেক; অতএব, তাহার এই সত্যনিষ্ঠা সাধুবাদযোগ্য নহে। কিন্তু, চোর স্বভাবতঃ অর্থগৃধু; সে যে মহামূল্য অলঙ্কার সমস্ত হস্তে পাইয়া, মদনসেনার সতীত্বরক্ষা শ্রবণে সন্তুষ্ট হইয়া, লোভসংবরণপূর্বক, তাহাকে অক্ষত বেশে গমন করিতে দিল, ইহা অকৃত্রিম ঔদার্যের কার্য, তাহার সন্দেহ নাই।

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।

১০. দশম উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ।

গৌড়দেশে বর্ধমান নামে এক নগর আছে। তথায়, গুণশেখর নামে, অশেষগুণসম্পন্ন নরপতি ছিলেন। তাঁহার প্রধান অমাত্য অভয়চন্দ্ৰ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। নরপতিও, তদীয় উপদেশের বশবর্তী হইয়া, বৌদ্ধধর্ম অবলম্বন করিলেন; এবং, স্বয়ং শিবপূজা, বিষ্ণুপূজা, গোদান, ভূমিদান, পিতৃকৃত্য প্রভৃতি শাস্ত্ৰবিহিত অবশ্যকর্তব্য ক্রিয়াকলাপে এক কালে জলাঞ্জলি দিয়া, মন্ত্রিপ্রধান অভয়চন্দ্রের প্রতি আদেশ দিলেন, আমার রাজ্যমধ্যে, যেন এই সমস্ত অবৈধ ব্যাপার। আর প্রচলিত না থাকে।

সর্বাধিকারী, রাজকীয় আজ্ঞা অনুসারে, রাজ্যমধ্যে এই ঘোষণাপ্রদান করিলেন, যদি, অতঃপর, কোনও ব্যক্তি এই সকল রাজনিষিদ্ধ অবৈধ কর্মের অনুষ্ঠান করে, রাজা তাহার সর্বস্বহরণ ও নির্বাসনারূপ দণ্ডবিধান করিবেন। প্রজারা, কুলক্ৰমাগত আচার ও অনুষ্ঠানের পরিত্যাগে নিতান্ত অনিচ্ছা ও রাজার প্রতি মনে মনে নিরতিশয় অসন্তুষ্ট হইয়াও, দণ্ডভয়ে, প্রকাশ্য রূপে তদনুষ্ঠানে বিরত হইল।

এক দিবস, অভয়চন্দ্র রাজার নিকট নিবেদন করিলেন, মহারাজ! সংক্ষেপে ধর্মশাস্ত্রের মর্মপ্রকাশ করিতেছি, শ্রবণ করুন। এ জন্মে, কোনও ব্যক্তি কাহারও প্ৰাণহিংসা করিলে, হতপ্রাণ ব্যক্তি, জন্মান্তরে, ঐ প্রাণঘাতকের প্রাণহন্তা হয়। এই উৎকট হিংসাপাপের প্রবলতাপ্রযুক্তই, মানবজাতি, সংসারে আসিয়া, জন্মমৃত্যুপরম্পরারূপ দুর্ভেদ্য শৃঙ্খলে বদ্ধ থাকে। এই নিমিত্তই, শাস্ত্রকারেরা নিরূপণ করিয়াছেন, অহিংসা, মনুষ্যের পক্ষে, সর্বপ্রধান ধৰ্ম। মহারাজ! দেখুন, হরি, হর, বিরিঞ্চি প্ৰভৃতি প্ৰধান দেবতারাও, কেবল কর্মদোষে, সংসারে আসিয়া, বারংবার অবতার হইতেছেন। অতএব, অতি প্রবল জন্তু হস্তী অবধি, অতি ক্ষুদ্র জন্তু কীট পর্যন্ত, প্রত্যেক জীবের প্রাণরক্ষা করা সর্বপ্রধান কর্ম ও পরম পবিত্র ধর্ম। আর, বিবেচনা করিয়া দেখিলে, মনুষ্যেরা যে পরমাংস দ্বারা আপন মাংসবৃদ্ধি করে, ইহা অপেক্ষা গুরুতর অধর্ম ও যার পর নাই অসৎ কর্ম আর নাই। এবংবিধ ব্যক্তিরা, দেহান্তে নরকগামী হইয়া, অশেষ প্রকারে যাতনাভোগ করে। বিশেষতঃ, যে ব্যক্তি, স্বদৃষ্টান্ত অনুসারে, অন্যের দুঃখ বিবেচনা না করিয়া, প্ৰাণহিংসাপূর্বক, মাংসভক্ষণ দ্বারা, স্বীয় রসনা পরিতৃপ্ত করে, সে রাক্ষস; তাহার আয়ু, বিদ্যা, বল, বিত্ত, যশ প্রভৃতি হ্রাস প্রাপ্ত হয়; এবং সে কাণ, খঞ্জ, কুব্জ, মূক, অন্ধ, পঙ্গু, বধির রূপে পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করে। আর, সুরাপান অপেক্ষা গুরুতর পাপ আর নাই। অতএব, জীবহিংসা ও সুরাপান, সর্ব প্রযত্নে, পরিত্যাগ করা উচিত।

ঈদৃশ অশেষবিধ উপদেশ দ্বারা, অভয়চন্দ্ৰ বৌদ্ধধর্মে রাজার এরূপ শ্রদ্ধা ও অনুরাগ জন্মাইল যে, যে ব্যক্তি, তাঁহার সমক্ষে, ঐ ধর্মের প্রশংসা করিত, সে অশেষ প্রকারে রাজপ্ৰসাদভাজন হইত। ফলতঃ, রাজা, সবিশেষ অনুরাগ ও ভক্তিযোগ সহকারে, স্বীয় অধিকারে, অবলম্বিত অভিনব ধর্মের বহুল প্রচার করিলেন।

কালক্রমে রাজার লোকান্তরপ্রাপ্তি হইলে, তাহার পুত্র ধর্মধ্বজ পৈতৃক সিংহাসনে অধিরোহণ করিলেন। তিনি, সনাতন বেদশাস্ত্রের অনুবর্তী হইয়া, বৌদ্ধদিগের যথোচিত তিরস্কার ও নানাপ্রকার দণ্ড করিতে লাগিলেন; পিতার প্ৰিয়পাত্ৰ প্ৰধান মন্ত্রীকে, শিরোমুণ্ডনপূর্বক, গর্দভে আরোহণ ও নগর প্রদক্ষিণ করাইয়া, দেশবহিস্কৃত করিলেন; এবং, বৌদ্ধধর্মের সমূলে উন্মূলন করিয়া, বেদবিহিত সনাতন ধর্মের পুনঃস্থাপনে অশেষপ্রকার যত্ন ও প্রয়াস করিতে লাগিলেন।

কিয়ৎ দিন পরে, ঋতুরাজ বসন্তের সমাগমে, রাজা ধৰ্মধ্বজ, মহিষীত্রিয় সমভিব্যাহারে, উপবনবিহারে গমন করিলেন। সেই উপবনে এক সুশোভন সরোবর ছিল। রাজা, তাহাতে কমল সকল প্রফুল্প দেখিয়া, স্বয়ং জলে অবতরণপূর্বক, কতিপয় পুষ্প লইয়া, তীরে আসিয়া, এক মহিষীর হস্তে দিলেন। দৈবযোগে, একটি পদ্ম, মহিষীর হস্ত হইতে স্থলিত হইয়া, তদীয় বাম পদে পতিত হওয়াতে, উহার আঘাতে তাহার সেই পদ ভগ্ন হইল। তখন রাজা, হা হতোহস্মি বলিয়া, অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া, প্রতীকারচেষ্টা করিতে লাগিলেন। সায়ংকাল উপস্থিত হইল। সুধাকরের উদয় হইবামাত্র, তদীয় অমৃতময় শীতল কিরণমালার স্পর্শে, দ্বিতীয়া মহিষীর গাত্ৰ স্থানে স্থানে দগ্ধ হইয়া গেল। আর, তৎকালে অকস্মাৎ এক গৃহস্থের ভবনে উদূখলের শব্দ হইল; সেই শব্দ শ্রবণবিবরে প্রবিষ্ট হইবামাত্র, তৃতীয়া মহিষীর শিরোবেদনা ও মূর্ছা হইল।

ইহা কহিয়া বেতাল জিজ্ঞাসিল, মহারাজ! উহাদের মধ্যে কোন-কামিনী অধিক সুকুমারী। রাজা কহিলেন, সুধাকর করম্পর্শে যে রাজমহিষীর দেহ দগ্ধ হইল, আমার মতে, সেই সৰ্বাপেক্ষা সুকুমারী।

 

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।

১১. একাদশ উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ!

পুণ্যপুর নগরে, বল্লভ নামে, নিরতিশয় প্রজাবল্লভ নরপতি ছিলেন। তাঁহার অমাত্যের নাম সত্যপ্রকাশ। এক দিবস, রাজা সত্যপ্রকাশের নিকট কহিলেন, দেখ, যে ব্যক্তি, রাজ্যেশ্বর হইয়া, অভিলাষানুরূপ বিষয়ভোগ না করে, তাহার রাজ্য ক্লেশপ্ৰপঞ্চ মাত্র। অতএব, অদ্যাবধি, আমি ইচ্ছানুরূপ বৈষয়িক সুখসম্ভোগে প্ৰবৃত্ত হইব; তুমি, কিয়ৎ কালের নিমিত্তে, সমস্ত রাজকার্যের ভার গ্রহণ করিয়া, আমায় এক বারে অবসর দাও। ইহা কহিয়া, অমাত্যহস্তে সমস্ত সাম্রাজ্যের সম্পূর্ণ ভারার্পণ করিয়া, রাজা, অনন্যমন ও অনন্যকর্ম হইয়া, কেবল ভোগসুখে কালব্যাপন করিতে লাগিলেন। সত্যপ্রকাশ, অগত্যা, রাজকীয় প্রস্তাবে সম্মত হইলেন; কিন্তু, স্বতন্ত্র রাজতন্ত্রনির্বাহ ও অহর্নিশ দুরবগাহ নীতিশাস্ত্রের অবিশ্রান্ত পর্যালোচনা দ্বারা, একান্ত ক্লান্ত হইতে লাগিলেন।

এক দিবস, অমাত্য আপন ভবনে, উৎকণ্ঠিত মনে, নির্জনে বসিয়া আছেন; এমন সময়ে, তাহার গৃহলক্ষ্মী লক্ষ্মীনাম্নী পত্নী তথায় উপস্থিত হইলেন, এবং, স্বামীকে সাতিশয় অবসন্ন ও নিরতিশয় দুর্ভাবনাগ্ৰস্ত দেখিয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, এখন, কি নিমিত্তে, তোমায় সতত উৎকণ্ঠিত দেখিতে পাই, এবং, কি নিমিত্তেই বা, তুমি দিন দিন দুর্বল হইতেছ। তিনি কহিলেন, রাজা, আমার উপর সমস্ত বিষয়ের সম্পূর্ণ ভার দিয়া, নিশ্চিন্ত হইয়া, ভোগসুখে কালযাপন করিতেছেন। তদীয় আদেশ অনুসারে, ইদানীং, আমায় রাজশাসন ও প্ৰজাপালন সংক্রান্ত সমস্ত বিষয় সম্পন্ন করিতে হইতেছে। রাজ্যের নানাবিষয়ক বিষম চিন্তা দ্বারা, আমি এরূপ দুর্বল হইতেছি। তখন তাঁহার পত্নী কহিলেন, তুমি, অনেক দিন, একাকী সমস্ত রাজকাৰ্য নিম্পন্ন করিলে; এক্ষণে, কিছু দিনের অবকাশ লইয়া, নিশ্চিন্ত হইয়া, তীৰ্থপৰ্যটন কর।

সত্যপ্রকাশ, সহধর্মিণীর উপদেশ অনুসারে, নৃপতিসমীপে বিদায় লইয়া, তীৰ্থপৰ্যটনে প্ৰস্থান করিলেন। তিনি, ক্ৰমে ক্রমে, নানা স্থানের তীর্থদর্শন করিয়া, পরিশেষে, সেতুবন্ধ রামেশ্বরে উপস্থিত হইলেন। তথায় তিনি, রামচন্দ্রের প্রতিষ্ঠিত দেবাদিদেব মহাদেবের মন্দিরে প্রবেশপূর্বক, দর্শনাদি করিয়া, নির্গত হইলেন; এবং, সমুদ্রে দৃষ্টিপাতমাত্র, দেখিতে পাইলেন, প্রবাহমধ্য হইতে এক অদ্ভুত স্বর্ণময় মহীরুহ বহির্গত হইল। ঐ মহীরুহের শাখায় উপবিষ্ট হইয়া, এক পরম সুন্দরী পূর্ণযৌবনা কামিনী, হস্তে বীণা লইয়া, মধুর, কোমল, তানলয়বিশুদ্ধ স্বরে, সঙ্গীত করিতেছে। সত্যপ্রকাশ, বিস্ময়াবিষ্ট ও অনন্যদৃষ্টি হইয়া, নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, ঐ অদ্ভুত মহীরুহ প্রবাহগর্ভে বিলীন হইল।

ঈদৃশ অঘটন ঘটনা নিরীক্ষণে চমৎকৃত হইয়া, সত্যপ্রকাশ, ত্বরায় স্বদেশে প্ৰতিগমনপূর্বক, নরপতিগোচরে উপস্থিত হইলেন, এবং কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিলেন, মহারাজ। আমি এক অদৃষ্টচর, অশ্রুতপূর্ব আশ্চর্য দর্শন করিয়াছি; কিন্তু, বৰ্ণন করিলে, তাহাতে, কোনও প্রকারে, আপনকার বিশ্বাস জন্মাইতে পারিব না। প্রাচীন পণ্ডিতেরা কহিয়াছেন, যাহা কাহারও বুদ্ধিগম্য ও বিশ্বাসযোগ্য না হয়, তাদৃশ্য বিষয়ের কদাপি নির্দেশ করিবেক না; করিলে কেবল উপহাসাম্পদ হইতে হয়। কিন্তু, মহারাজ! আমি স্বচক্ষে প্ৰত্যক্ষ করিয়াছি; এই নিমিত্ত নিবেদন করিতেছি, যে স্থানে ত্রেতাবতার ভগবান রামচন্দ্ৰ, দুর্বৃত্ত দশাননের বংশধ্বংসবিধানবাসনায়, মহাকায় মহাবল কপিবল সাহায্যে, শতযোজনাবিস্তীর্ণ অর্ণবের উপর, লোকাতীত কীর্তিহেতু সেতুসঙ্ঘটন করিয়াছিলেন, তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, কল্লোলিনীবল্লাভের প্রবাহমধ্য হইতে, অকস্মাৎ এক স্বর্ণময় ভুরুহ বিনির্গত হইল; তদুপরি এক পরম সুন্দরী রমণী, বীণাবাদনপূর্বক, মধুর স্বরে সঙ্গীত করিতেছে। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, সেই বৃক্ষ কন্যা সহিত জলে মগ্ন হইয়া গেল। এই অদ্ভুত ব্যাপার দর্শনে বিস্ময়সাগরে মগ্ন হইয়া, তীৰ্থপৰ্যটন পরিত্যাগপূর্বক, আমি আপনকার নিকট ঐ বিষয়ের সংবাদ দিতে আসিয়াছি।

রাজা শ্রবণমাত্র, অতিমাত্র কৌতুহলাক্রান্ত হইয়া, পুনর্বার সত্যপ্রকাশের হস্তে রাজ্যের ভারপ্রদানপূর্বক, সেতুবন্ধ রামেশ্বরে উপস্থিত হইলেন। নিরূপিত সময়ে, মহাদেবের পূজা করিয়া, মন্দির হইতে বহির্গত হইবামাত্র, সত্যপ্রকাশের বর্ণনানুরূপ ভুরুহ মহীপতির নয়নগোচর হইল। তাঁহার উল্লিখিত সৰ্বাঙ্গসুন্দরী কামিনীর সৌন্দৰ্যসন্দর্শনে ও সঙ্গীতশ্রবণে, বিমূঢ় ও পূর্বাপরপর্যালোচনাপরিশূন্য হইয়া, রাজা অর্ণবপ্রবাহে লম্ফপ্রদানপূর্বক, অল্পক্ষণমধ্যে, ঐ বৃক্ষে আরোহণ করিলেন। বৃক্ষও, মহীপতি সহিত, তৎক্ষণাৎ পাতালপুরে প্রবিষ্ট হইল।

অনন্তর, সেই রমণী রাজার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল, অহে বীরপুরুষ! তুমি কে, কি অভিপ্ৰায়ে এ স্থানে আগমন করিলে, বল। তিনি কহিলেন, আমি পুণাপুরের রাজা; আমার নাম বল্লভ; তোমার সৌন্দর্য ও সৌকুমাৰ্য দর্শনে মুগ্ধ হইয়া আসিয়াছি। এই কথা শুনিয়া, সেই রমণী কহিল, আমি তোমার সাহসে সন্তুষ্ট হইয়াছি। যদি তুমি, কেবল কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে, আমার সহিত সর্ব প্রকারে সম্পর্কশূন্য হইতে পার, তাহা হইলে, আমি তোমার সহধর্মিণী হই। রাজা শুনিয়া, আহ্লাদসাগরে মগ্ন হইয়া, তৎক্ষণাৎ তদীয় প্রস্তাবে সম্মত হইলেন। তৎপরে সে রাজাকে, এই নিয়মের রক্ষার্থে, পুনরায় প্রতিজ্ঞাপাশে বদ্ধ করিয়া, গান্ধৰ্ব বিধানে আপন প্ৰতিজ্ঞ সম্পন্ন করিল। রাজা, নব মহিষীর সহিত, পরম কৌতুকে, কালব্যাপন করিতে লাগিলেন।

কৃষ্ণ চতুর্দশী উপস্থিত হইল। রাজমহিষী, সাতিশয় আগ্রহ ও নিরতিশয় ব্যগ্রতা প্রদর্শনপূর্বক, নিকটে থাকিতে নিষেধ করিলে, রাজা, পূর্বকৃত প্রতিজ্ঞা অনুসারে, তৎক্ষণাৎ তথা হইতে অপসৃত হইলেন। কিন্তু, কি কারণে পূর্বে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করিয়াছিল, এবং এক্ষণে, এতাদৃশ আগ্রহ ও ব্যগ্রতা প্রদর্শনপূর্বক, পুনর্বার নিষেধ করিল, যাবৎ ইহা সবিশেষ অবগত না হইব, তাবৎ আমার অন্তঃকরণে এক বিষম সংশয় থাকিবেক। অতএব, ইহার তথ্যানুসন্ধান করা আবশ্যক। এই বলিয়া, কৌতুহলাকুলিত চিত্তে, অন্তরালে থাকিয়া, রাজা অবলোকন করিতে লাগিলেন।

অর্ধারাত্র সময়ে, এক রাক্ষস আসিয়া কন্যার অঙ্গে করার্পণ করিল। রাজা দেখিয়া, একান্ত অসহমান হইয়া, করতলে করাল করবাল ধারণপূর্বক, তৎক্ষণাৎ তথায় উপস্থিত হইলেন, এবং অশেষপ্রকার তিরস্কার করিয়া কহিলেন, আরো দুরাচার রাক্ষস! তুই, আমার সমক্ষে, প্ৰিয়তমার অঙ্গে হস্তার্পণ করিস না। যাবৎ তোরে না দেখিয়াছিলাম, তাবৎ অন্তঃকরণে ভয় ছিল; এক্ষণে দেখিয়া নিৰ্ভয় হইয়াছি, এবং তোর প্রাণদণ্ড করিতে আসিয়াছি। এই বলিয়া, তিনি খড়্গপ্রহার দ্বারা তাহার শিরশ্চেদন করিলেন। তখন রাজমহিষী, অকৃত্রিম পরিতোষপ্রদর্শনপূর্বক, কহিলেন, তুমি, দুর্দান্ত রাক্ষসের হস্ত হইতে মুক্ত করিয়া, আমায় জীবনদান করিলে। আমি, এত কাল, কি যন্ত্রণাভোগ করিয়াছি, বলিতে পারি না।

রাজা জিজ্ঞাসিলেন, সুন্দরি। কি কারণে তুমি, এতাবৎ কাল পর্যন্ত, এই দারুণ দৈবদুর্বিপাকে পতিত ছিলে, বল।

তিনি কহিলেন, মহারাজ! শ্রবণ কর। আমি বিদ্যাধর নামক গন্ধৰ্বরাজের কন্যা; আমার নাম রত্নমঞ্জরী। ভোজনকালে আমি নিকটে উপবিষ্ট না থাকিলে, পিতার তৃপ্তি হইত না; এজন্য, নিত্যই, ভোজনসময়ে তাহার সন্নিহিত থাকিতাম। এক দিন, বাল্য খেলায় আসক্ত হইয়া, ভোজনবেলায় গৃহে উপস্থিত ছিলাম না। পিতা, আমার অপেক্ষায়, বুভূক্ষায় অভিভূত হইয়া, ক্ৰোধাভরে এই শাপ দিলেন, অদ্যাবধি তুমি রসাতলবাসিনী হইবে; এবং কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে এক রাক্ষস আসিয়া তোমায় অশেষ প্রকারে যন্ত্রণা দিবে। আমি শুনিয়া অত্যন্ত কাতর হইলাম, এবং, পিতার চরণে ধরিয়া, বহুবিধ স্তুতি ও বিনীতি করিয়া, নিবেদন করিলাম, পিতঃ! আমার দুরদৃষ্টবশতঃ, সামান্য অপরাধে, উৎকট দণ্ডবিধান করিলেন। এক্ষণে, কৃপা করিয়া, শাপমোচনের কোনও উপায় করিয়া দেন; নতুবা, কত কাল যন্ত্রণাভোগ করিব। ইহা কহিয়া, আমি, বিষন্ন বদনে, রোদন করিতে লাগিলাম। তখন তিনি, পূর্বার্জিত স্নেহরসের সহায়তা দ্বারা, আমার বিনয়ের বশীভূত হইয়া কহিলেন, এক মহাবল পরাক্রান্ত বীরপুরুষ আসিয়া, সেই রাক্ষসের প্রাণদণ্ড করিয়া, তোমার শাপমোচন করিবেন। আমি, সেই শাপে, এই পাপে আশ্লিষ্ট ছিলাম। বহু দিনের পর, তুমি আমায় মুক্ত করিলে। এক্ষণে, অনুমতি কর, পিতৃদর্শনে যাই।

রাজা কহিলেন, যদি তুমি উপকার স্বীকার কর, অগ্রে একবার আমার রাজধানীতে চল; পরে পিতৃদর্শনে যাইবে। রত্নমঞ্জরী, মহোপকারকের নিকট অবশ্য কর্তব্য কৃতজ্ঞতাস্বীকারের অন্যথাভাবে অধৰ্ম জানিয়া, রাজার প্রার্থনায় সম্মত হইলে, তিনি, তাহারে সমভিব্যাহারে লইয়া, রাজধানীতে উপস্থিত হইলেন; এবং, কিছু দিন, তদীয় সহবাসে বিষয়রসে কালব্যাপন করিয়া, পরিশেষে, নিতান্ত অনিচ্ছাপূর্বক, তাহাকে পিতৃদর্শনে যাইতে অনুমতি দিলেন। তখন রত্নমঞ্জরী কহিলেন, মহারাজ। বহু কাল মনুস্যসহবাস দ্বারা, আমার গন্ধৰ্বত্ব গিয়াছে; এখন, সর্বতোভাবে, মনুষ্যভাবাপন্ন হইয়াছি। পিতা আমার সর্বগন্ধৰ্বপতি; এক্ষণে, তাহার নিকটে গিয়া, সমুচিত সমাদর পাইব না। অতএব, আর আমার তথায় যাইতে অভিলাষ নাই; তোমার নিকটেই যাবজ্জীবন অবস্থিতি করিব। রাজা শুনিয়া অতিশয় হর্ষ প্রাপ্ত হইলেন; এবং, রাজকাৰ্যে এককালে জলাঞ্জলি দিয়া, দিন যামিনী, সেই কামিনীর সহিত, বিষয়বাসনায় কালযাপন করিতে লাগিলেন। এই সমস্ত ব্যাপার দেখিয়া, প্রধান অমাত্য সত্যপ্ৰকাশ প্ৰাণত্যাগ করিলেন।

ইহা কহিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসিল, মহারাজ! কি কারণে, অমাত্য প্ৰাণত্যাগ করিলেন, বল। বিক্রমাদিত্য কহিলেন, মন্ত্রী বিবেচনা করিলেন, রাজা বিষয়ারসে আসক্ত হইয়া, রাজ্যচিন্তায় জলাঞ্জলি দিলেন; প্ৰজা অনাথ হইল। অতঃপর, আর কোনও ব্যক্তি আমার প্রতি সমুচিত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করিবেক না। অহোরাত্র এই বিষম চিন্তাবিষ শরীরে প্রবিষ্ট হওয়াতে, সত্যপ্রকাশের প্রাণবিয়োগ হইল।

 

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।

১২. দ্বাদশ উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ!

চূড়াপুরে, দেবস্বামী নামে, এক ব্ৰাহ্মণ বাস করিতেন। তিনি রূপে রতিপতি, বিদ্যায় বৃহস্পতি, সম্পদে ধনপতি ছিলেন। কিয়ৎ দিন পরে, দেবস্বামী, লাবণ্যবতী নামে, এক গুণবতী ব্ৰাহ্মণতনয়ার পাণিগ্রহণ করিলেন। ঐ কন্যা রূপলাবণ্যে ভুবনবিখ্যাত ছিল। উভয়ে প্ৰণয়ে কালব্যাপন করিতে লাগিলেন।

একদা বিপ্রদম্পতী, গ্রীষ্মের প্রাদুর্ভাবপ্রযুক্ত, অট্টালিকার উপরিভাগে শয়ন করিয়া, নিদ্রা যাইতেছিলেন। সেই সময়ে, এক গন্ধৰ্ব, বিমানে আরোহণপূর্বক, আকাশপথে ভ্ৰমণ করিতেছিল। দৈবযোগে, বিপ্রকামিনীর উপর দৃষ্টিপাত হওয়াতে, সে তদীয় অলৌকিক রূপলাবণ্যদর্শনে মোহিত হইল; এবং, বিমান কিঞ্চিৎ অবতীর্ণ করিয়া, নিদ্রান্বিতা লাবণ্যবতীকে লইয়া পলায়ন করিল।

কিয়ৎ ক্ষণ বিলম্বে নিদ্রাভঙ্গ হইলে, দেবস্বামী, স্বীয় প্রেসয়ীকে পার্শ্বশায়িনী না দেখিয়া, অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া, ইতস্ততঃ অন্বেষণ করিতে লাগিলেন; কিন্তু কোনও সন্ধান না পাইয়া, সাতিশয় বিষন্ন ভাবে, নিশাযাপন করিলেন। পর দিন, প্ৰভাত হইবামাত্র, তিনি, অতিমাত্র ব্যগ্র ও চিন্তাকুল চিত্তে, পুনরায়, বিশেষ করিয়া, অশেষপ্রকার অনুসন্ধান করিলেন; পরিশেষে, নিতান্ত নিরাশ্বাস ও উন্মত্তপ্রায় হইয়া, সংসারাশ্রমে বিসর্জন দিয়া, সন্ন্যাসীর বেশে দেশে দেশে ভ্ৰমণ করিতে লাগিলেন।

এক দিন, দেবস্বামী, দিবা দ্বিপ্রহরের সময়, অতিশয় ক্ষুধার্ত হইয়া, এক ব্ৰাহ্মণের আলয়ে অতিথি হইলেন; কহিলেন, আমি ক্ষুধায় অত্যন্ত কাতর হইয়াছি; কিছু ভোজনীয় দ্রব্য দিয়া, আমার প্রাণরক্ষা কর। গৃহস্থ ব্ৰাহ্মণ, তৎক্ষণাৎ এক পাত্ৰ দুগ্ধে পরিপূর্ণ করিয়া, অতিথি ব্ৰাহ্মণের হস্তে অৰ্পণ করিলেন। গ্রহবৈগুণ্যবশতঃ, ইতঃপূর্বে, এক কৃষ্ণসৰ্প ঐ দুগ্ধে মুখাৰ্পণ করাতে, তাহা অতিশয় বিষাক্ত হইয়াছিল। পান করিবামাত্র, সেই বিষ, সৰ্বাঙ্গব্যাপী হইয়া, অতিথি ব্ৰাহ্মণকে ক্রমে ক্রমে অবসন্ন ও অচেতন করিতে লাগিল। তখন তিনি গৃহস্থ ব্ৰাহ্মণকে, তুমি বিষভক্ষণ করাইয়া ব্ৰহ্মহত্যা করিলে, এই বলিয়া ভূতলে পড়িলেন ও প্রাণত্যাগ করিলেন। ব্রাহ্মণ, অকস্মাৎ ব্ৰহ্মহত্যা দেখিয়া, যার পর নাই বিষন্ন হইলেন; এবং বাটীর মধ্যে প্ৰবেশিয়া, আপন পত্নীকে, তুই দুগ্ধে বিষ মিশ্ৰিত করিয়া রাখিয়াছিলি, তাহাতেই ব্ৰহ্মহত্যা হইল; তুই অতি দুর্বৃত্তা, আর তোর মুখাবলোকন করিব না; ইত্যাদি নানাপ্রকার তিরস্কার ও বহু প্ৰহার করিয়া, গৃহ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিলেন।

ইহা কহিয়া, বেতাল বিক্ৰমাদিত্যকে জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! এ স্থলে কোন ব্যক্তি দোষভাগী হইবেক। রাজা কহিলেন, সৰ্পের মুখে স্বভাবতঃ বিষ থাকে; সুতরাং, সে দোষী হইতে পারে না; গৃহস্থ ব্ৰাহ্মণ ও তাঁহার ব্ৰাহ্মণী, সেই দুগ্ধকে বিষাক্ত বলিয়া জানিতেন না; সুতরাং, তাঁহারাও ব্ৰহ্মহত্যাপাপে লিপ্ত হইবেন না; আর, অতিথি ব্ৰাহ্মণ, সবিশেষ না জানিয়া, পান করিয়াছেন; এজন্য, তিনিও আত্মঘাতী নহেন। কিন্তু, গৃহস্থ ব্ৰাহ্মণ, সবিশেষ অনুসন্ধান না করিয়া, নিরপরাধ সহধর্মিণীকে গৃহ হইতে বহিস্কৃত করিলেন, তাহাতে তিনি, অকারণে পত্নীপরিত্যাগজন্য, দুরদৃষ্টভাগী হইবেন।

 

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।

১৩. ত্ৰয়োদশ উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ!

চন্দ্ৰহৃদয় নগরে, রণধীর নামে, প্ৰবলপ্ৰতাপ নরপতি ছিলেন। রাজা রণধীরের প্রভাবে, প্ৰজারা চিরকাল নিরুপদ্রবে। বাস করিত। কিয়ৎ দিন পরে, নগরে গুরুতর চৌৰ্যক্রিয়ার আরম্ভ হইল। পৌরেরা, চৌরের উপদ্রবে অতিশয় ব্যতিব্যস্ত হইয়া, সকলে মিলিয়া, নৃপতিসমীপে স্ব স্ব দুঃখের পরিচয় প্ৰদান করিল। রাজা সবিশেষ সমস্ত শ্রবণগোচর করিয়া কহিলেন, যাহা হইয়াছে, তাহারা আর উপায় নাই; অতঃপর যাহাতে না হইতে পায়, সে বিষয়ে সবিশেষ যত্নবান থাকিলাম। এইরূপ আশ্বাস দিয়া, রাজা নগরবাসীদিগকে বিদায় করিলেন; এবং, নূতন নূতন প্রহরী নিযুক্ত করিয়া, তাহাদিগকে সাতিশয় সতর্কতাপূর্বক নগররক্ষার আদেশ দিয়া, স্থানে স্থানে পাঠাইলেন; বলিয়া দিলেন, চোর পাইলে তাহার প্রাণদণ্ড করিবে। প্রহরীরা, সাতিশয় সাবধান হইয়া, নগররক্ষা করিতে লাগিল; তথাপি চৌর্যের কিঞ্চিম্মাত্র নিবৃত্তি হইল না, বরং দিনে দিনে বৃদ্ধিই হইতে লাগিল।

পুরবাসীরা, পুনরায় একত্র হইয়া, রাজার নিকটে গিয়া, আপনি আপনি দুঃখ জানাইলে, তিনি তাহাদিগকে কহিলেন, এক্ষণে তোমরা বিদায় হও; আদ্য রজনীতে, আমি স্বয়ং নগররক্ষার্থে নির্গত হইব। প্রজারা, রাজাজ্ঞা অনুসারে, স্বীয় স্বীয় আলয়ে গমন করিল। রাজাও, সায়ংকাল উপস্থিত হইলে, অসি, চর্ম, ও বর্ম ধারণপূর্বক, একাকী নগররক্ষার্থে নির্গত হইলেন; এবং, কিয়ৎ দূরে গিয়া, এক অপরিচিত ব্যক্তিকে সম্মুখে দেখিয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কে, কোথায় যাইতেছ, তোমার বাস কোথায়। সে কহিল, আমি চোর; তুমি কে, কি নিমিত্তে আমার পরিচয় লইতেছ, বল। রাজা ছল করিয়া বলিলেন, আমিও চোর। তখন সে অতিশয় আহ্লাদিত হইয়া কহিল, আইস, উভয়ে একত্র হইয়া চুরি করিতে যাই। রাজা সন্মত হইলেন।

চোর, রাজাকে সহচর করিয়া, এক ধনাঢ্য গৃহস্থের ভবনে প্রবেশপূর্বক, বহু অর্থ হস্তগত করিল; এবং নগর হইতে নিৰ্গত হইয়া, কিয়ৎ দূরে গিয়া, এক প্রচ্ছন্ন সুরঙ্গ দ্বারা পাতালে প্রবিষ্ট হইল। আপনি আলয়ে উপস্থিত হইয়া, রাজাকে দ্বারদেশে বসিতে আসন দিয়া, সে বাটীর মধ্যে প্ৰবেশ করিল। এই অবকাশে, এক দাসী আসিয়া, কথায় কথায়, রাজার পরিচয় লইল, এবং সবিশেষ সমস্ত অবগত হইয়া কহিল, মহারাজ! তুমি কি নিমিত্ত, এই দুর্বৃত্ত দস্যুর আবাসে আসিয়াছ; সে না আসিতে আসিতে, যত দূর পার, পলায়ন কর; নতুবা, সে আসিয়াই তোমার প্রাণসংহার করিবেক। রাজা শুনিয়া সাতিশয় বিষন্ন হইলেন, এবং বলিলেন, আমি পথ জানি না, কিরূপে পলাইব; যদি তুমি কৃপা করিয়া পথ দেখাইয়া দাও, তাহা হইলে এবার আমার প্রাণরক্ষা হয়। তখন সেই দাসী পথপ্ৰদৰ্শন করিলে, রাজা পলাইয়া আপন আলয়ে উপস্থিত হইলেন।

পর দিন, প্রভাত হইবামাত্র, রাজা রণধীর, বহু সৈন্য সামন্ত সমভিব্যবহারে, পূর্বনির্দিষ্ট সুরঙ্গ দ্বারা পাতালে প্রবিষ্ট হইয়া, চোরের ভবনরোধ করিলেন। এক রাক্ষস সেই পাতালস্থ নগবীর, অধিষ্ঠাত্রী দেবতার ন্যায়, রক্ষণাবেক্ষণ করিত। চোর, রাজকীয় অবরোধ হইতে আত্মরক্ষার নিতান্ত অনুপায় দেখিয়া নগররক্ষক রাক্ষসের শরণাপন্ন হইল, এবং নিবেদন করিল, এক রাজা সসৈন্য আসিয়া আমার উপর আক্রমণ করিয়াছে। যদি তুমি এ সময়ে আমার সহায়তা না কর, অদ্যই তোমার নগর হইতে প্ৰস্থান করিব। এই বলিয়া, প্রলোভনস্বরূপ তাহার আহারোপযোগী দ্রব্য উপঢৌকন দিয়া, চোর সম্মুখে কৃতাঞ্জলি দণ্ডায়মান রহিল। আহারসামগ্ৰী উপহার পাইয়া, রাক্ষস সাতিশয় সন্তুষ্ট হইল; এবং, তুমি নিৰ্ভয় হও, কিয়ৎক্ষণমধ্যেই, আমি রাজার সমস্ত সৈন্য উচ্ছিন্ন করিতেছি; এই বলিয়া, তৎক্ষণাৎ তথায় উপস্থিত হইয়া, সৈন্যের অন্তর্গত নর, করী, তুরঙ্গ প্রভৃতি এক এক গ্রাসে উদরস্থ করিতে আরম্ভ করিল। রাজা, রাক্ষসের ভয়ানক আকার ও ক্রিয়া দর্শনে অতিশয় কাতর হইয়া, পলায়ন করিলেন। ফলতঃ, যে পলাইতে পারিল, তাহারই প্ৰাণ বাঁচিল; অবশিষ্ট সমস্ত সৈন্য, সেই দুর্দান্ত রাক্ষসের গ্রাসে পতিত হইয়া, পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইল।

রাজা একাকী পলায়ন করিতে লাগিলেন। চোর, রাক্ষসের সহায়তায়, সাহসী ও স্পর্ধাবান হইয়া, তাহার পশ্চাৎ ধাবমান হইল; এবং, ক্ৰমে ক্রমে সন্নিহিত হইয়া, ভর্ৎসনা করিয়া কহিতে লাগিল, অরে কুলাঙ্গার! ক্ষত্রিয়কুলে জন্মগ্রহণ করিয়া, এরূপ কাপুরুষতা প্রদর্শন করিতেছিস; তোরে ধিক! রাজা হইয়া, ভঙ্গ দিয়া, রণক্ষেত্ৰ হইতে পলায়ন করিলে, ইহলোকে অকীর্তি ও পরলোকে নরকপাত হয়। রাজা, তৎকালে নিতান্ত ব্যাকুল ও সৰ্বথা উপায়বিহীন হইয়াও, কেবল কুলাভিমান ও খড়্গ, চৰ্ম সহায় করিয়া, চোরর সম্মুখীন হইলেন।

ঘোরতর সংগ্ৰাম হইতে লাগিল। পরিশেষে, রাজা রণধীর চোরকে পরাজিত করিয়া, বন্ধনপূর্বক রাজধানীতে লইয়া গেলেন, এবং, পর দিন প্ৰাতঃকালে, শূলদানের ব্যবস্থা করিয়া, বধ্যবেশপ্রদানপূর্বক, তাহাকে গর্দভে আরোহণ করাইয়া, নগরের সমস্ত প্রদেশে পরিভ্রমণ করাইতে আদেশ দিলেন। চোর প্রায় সকলেরই সর্বনাশ করিয়াছিল; সুতরাং সকলেই তাহাকে তদাবস্থ দেখিয়া, নিরতিশয় আহ্লাদিত হইয়া, তাহার অশেষপ্রকার তিরস্কার ও রাজার ভূরি ভুরি প্রশংসা করিতে লাগিল।

কিন্তু, ধর্মধ্বজ নামক বণিকের গৃহের নিকটবর্তী হইলে, তাহার কন্যা শোভনা, গবাক্ষদ্বারা দিয়া চোরকে নয়নগোচর করিয়া, একবারে মোহিত হইল; এবং তৎক্ষণাৎ স্বীয় পিতার সমীপবৰ্তিনী হইয়া কহিল, তুমি রাজার নিকটে গিয়া, যেরূপে পার, ঐ চোরকে ছাড়াইয়া আন। বণিক কহিল, যে চোর সমস্ত নগর নির্ধন করিয়াছে; যাহার নিমিত্তে, রাজার সমস্ত সৈন্য উচ্ছিন্ন হইয়াছে; এবং রাজারও নিজের প্রাণসংশয় পর্যন্ত ঘটিয়াছিল; তাহাকে, আমার কথায়, কখনই ছাড়িয়া দিবেন না। শোভনা কহিল, যদি তোমার সর্বস্ব দিলেও, রাজা উহাকে ছাড়িয়া দেন, তাহাও তোমায় করিতে হইবেক। যদি তুমি উহারে না আন, তোমার সমক্ষে আত্মঘাতিনী হইব।

কন্যা ধর্মধ্বজের প্রাণ অপেক্ষা প্রিয় ছিল; সুতরাং সে, তদীয় নির্বন্ধ উল্লঙ্ঘনে অসমৰ্থ হইয়া, রাজার নিকটে গিয়া আবেদন করিল, মহারাজ! আমার যে কিছু সম্পত্তি আছে, সমস্ত দিতেছি; আপনি, দয়া করিয়া, এই চোরকে ছাড়িয়া দেন। রাজা কহিলেন, এই চোর। আমার ও পৌরবর্গের যৎপরোনাস্তি অপকার করিয়াছে; আমি, কোনও প্রকারে, উহারে ছাড়িয়া দিব না। তখন ধৰ্মধ্বজ, আপনি কন্যার নিকটে গিয়া কহিল, আমি, সর্বস্বদান পর্যন্ত স্বীকারপূর্বক, প্রার্থনা করিলাম; রাজা, কোনও ক্রমে, চোরকে ছাড়িয়া দিতে সম্মত হইলেন না। তখন শোভনা, অভীষ্টসিদ্ধিবিষয়ে নিতান্ত নিরাশ হইয়া, বিষাদসগারে মগ্ন হইল।

এই সময় মধ্যে, রাজপুরুষেরা চোরকে সমস্ত নগর পরিভ্রমণ করাইয়া, পরিশেষে বধ্যভূমিতে আনয়নপূর্বক, শূলস্তম্ভের নিকট দণ্ডায়মান করিল। শোভনার অপরূপ বৃত্তান্ত, তৎক্ষণাৎ নগর মধ্যে প্রচারিত হওয়াতে, অনতিবিলম্বে চোরেরও কর্ণগোচর হইল। তখন সে প্রথমতঃ হাসিতে লাগিল; অনন্তর, হাস্য হইতে বিরত হইয়া, রোদন আরম্ভ করিবামাত্র, রাজপুরুষেরা তাহাকে শূলে আরোহণ করাইল।

বণিককন্যা, চোরের মৃত্যুসংবাদ পাইবামাত্র, সহগমনের উদ্যোগ করিয়া, বধ্যভূমিতে উপস্থিত হইল; এবং, যথানিয়মে চিতা প্রস্তুত হইলে, চোরকে, শূল হইতে অবতীর্ণ করিয়া, গাঢ় আলিঙ্গনপূর্বক, তাহারে লইয়া মৃত্যুশয্যায় শয়ন করিল।

দাহিকেরা অগ্নিপ্রদানে উদ্যত হইল। নিকটে ভগবতী কাত্যায়নী দেবীর মন্দির ছিল। দেবী, তথা হইতে নির্গমনপূর্বক, শ্মশানভূমিতে উপস্থিত হইলেন, এবং কহিলেন। বৎসে! বরপ্রার্থনা কর; তোমার সাহস ও সতীত্ব দর্শনে সবিশেষ সন্তুষ্ট হইয়াছি। শোভনা কহিল, জননি! যদি প্ৰসন্ন হইয়া থাক, এই চোরের জীবনদান কর। দেবী, তথাস্তু বলিয়া, তৎক্ষণাৎ পাতাল হইতে অমৃত আনয়নপূর্বক, চোরর প্রাণদান করিলেন।

ইহা কহিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! চোর, কি নিমিত্তে, প্রথমে হাস্য ও পরে রোদন করিয়াছিল, বল। রাজা কহিলেন, চোর, কন্যার কামনা শুনিয়া, আমার মৃত্যুসময়ে ইহার অনুরাগ সঞ্চার হইল; ভগবানের কি ইচ্ছা, কিছুই বুঝা যায় না; এই আলোচনা করিয়া, প্ৰথমে হাস্য করিয়াছিল; অনন্তর, এই কন্যা, আমার নিমিত্তে, রাজাকে সর্বস্ব দিতে উদ্যত হইয়াছিল; আমি ইহার এমন কি উপকারে আসিতাম; এই অনুশোচনা করিয়া, দুঃখিত হৃদয়ে রোদন করিল।

 

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।

১৪. চতুর্দশ উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ!

কুসুমবতী নগরীতে সুবিচার নামে রাজা ছিলেন। তাহার, চন্দ্ৰপ্ৰভা নামে, অবিবাহিতা দুহিতা ছিল। রমণীয় বসন্তকাল উপস্থিত হইলে, রাজকুমারী, উপবনবিহারে অভিলাষিণী হইয়া, পিতার অনুমতিপ্রার্থনা করিলেন। রাজা সম্মত হইলেন; এবং রাজধানীর অনতিদূরে, যে যোজনবিস্তৃত অতি রমণীয় উপবন ছিল, উহাকে স্ত্রীলোকের বাসোপযোগী করিবার নিমিত্ত, বহুসংখ্যক লোক পাঠাইয়া দিলেন। তাহারা তথায় উপস্থিত হইবার পূর্বে, বিংশতিবর্ষবয়স্ক, অতি রূপবান, মনস্বী নামে, বিদেশীয় ব্ৰাহ্মণকুমার, পরিশ্রান্ত ও আতপক্লান্ত হইয়া, উপবনমধ্যবর্তী নিকুঞ্জমধ্যে প্রবেশপূর্বক, স্নিগ্ধ ছায়াতে নিদ্রাগত ছিল। রাজপরিচারকেরা, তথায় উপস্থিত হইয়া, আবশ্যক কাৰ্য সকল সম্পন্ন করিয়া, প্ৰস্থান করিল। দৈবযোগে, ঐ ব্ৰাহ্মণকুমার তাহাদের দৃষ্টিপথে পতিত হইল না।

রাজকুমারী, স্বীয় সহচরীবর্গ ও পরিচারিকাগণের সহিত, উপবনে উপস্থিত হইয়া, ইতস্ততঃ ভ্ৰমণ করিতে করিতে, ব্ৰাহ্মণকুমারের সমীপবৰ্তিনী হইলেন। ভ্রমণকারিণীদিগের পদশব্দে, মনস্বীরও নিদ্রাভঙ্গ হইল। ব্ৰাহ্মণকুমারের ও রাজকুমারীর চারি চক্ষুঃ একত্র হইলে, ব্ৰাহ্মণকুমার মোহিত ও মূৰ্ছিত হইয়া ভূতলে পড়িল; রাজকুমারীও, আবিস্তৃত সাত্ত্বিক ভাবের প্রভাবে, কম্পমানকলেবরা ও বিকলিতচিত্ত হইলেন। সখীগণ, অকস্মাৎ ঈদৃশ অতিবিষম বিষমস্মিরদশা উপস্থিত দেখিয়া, মনুষ্যবাহী যানে আরোহণ করাইয়া, তৎক্ষণাৎ রাজকুমারীকে গৃহে লইয়া গেল। ব্ৰাহ্মণকুমার, সেই স্থানেই, স্পন্দহীন পতিত রহিল।

শশী ও ভূদেব নামে দুই ব্ৰাহ্মণ, কামরূপে বিদ্যাশিক্ষা করিয়া, স্বদেশে প্রতি গমন করিতেছিলেন। তাঁহারাও, আতপে তাপিত হইয়া, বিশ্রামার্থে, উপবনস্থ নিকুঞ্জমধ্যে উপস্থিত হইলেন। প্রবেশমাত্র, সেই ব্ৰাহ্মণকুমারকে তদাবস্থা পতিত দেখিয়া, ভূদেব স্বীয় সহচরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, বল দেখি, শশী! এ এরূপ অচেতন হইয়া পতিত আছে কেন। শশী কহিলেন, বোধ করি, কোনও নায়িকা ভ্রূচাপ দ্বারা কটাক্ষবাণ নিক্ষিপ্ত করিয়াছে, তাহাতেই এরূপে পতিত আছে। ভূদেব কৌতুহলাক্রান্ত হইয়া কহিলেন, ইহাকে জাগরিত করিয়া, সবিশেষ জিজ্ঞাসা করা আবশ্যক।

অনন্তর, ভূদেব, শশীর নিষেধ না মানিয়া, নানাবিধ উপায় দ্বারা, ব্ৰাহ্মণকুমারের চৈতন্য সম্পাদনা করিলেন, এবং জিজ্ঞাসিলেন, অহে ব্ৰাহ্মণতনয়! কি কারণে তোমার ঈদৃশী দশা ঘটিয়াছে, বল। ব্ৰাহ্মণকুমার কহিল, যে ব্যক্তি দুঃখ দূর করিতে ইচ্ছা ও সমৰ্থ, তাহার নিকটেই দুঃখের কথা ব্যক্ত করা উচিত; নতুবা, যার তার কাছে বলিয়া বেড়াইলে, মূঢ়তামাত্র প্রকাশ পায়। ভূদেব কহিলেন, ভাল, তুমি আমার নিকটে ব্যক্ত কর; আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি, যে রূপে পারি, তোমার দুঃখ দূর করিব। মনস্বী কহিল, কিয়ৎ ক্ষণ পূর্বে, এক রাজকন্যা এই উপবনে ভ্রমণ করিতে আসিয়াছিল; তাহাকে দেখিয়া, আমার এই অবস্থা ঘাটিয়াছে। অধিক আর কি বলিব, প্ৰতিজ্ঞা করিয়াছি, তাহাকে না পাইলে, প্রাণত্যাগ করিব।

তখন ভূদেব কহিলেন, তুমি আমার সমভিব্যাহারে চল; যাহাতে তোমার মনোরথ সিদ্ধ হয়, সে বিষয়ে অশেষবিধ যত্ন করিব। আর, যদি তোমার প্রাৰ্থিত সম্পাদনে নিতান্তই কৃতকাৰ্য হইতে না পারি, অন্ততঃ, বহুসংখ্যক অর্থ দিয়া বিদায় করিব। মনস্বী কহিল, যদি আমার অভিপ্রেত স্ত্রীরত্নলাভের সদুপায় করিতে পার, তবেই তোমাদের সঙ্গে যাই; নতুবা, ধনের নিমিত্তে, আমার কিছুমাত্র স্পৃহা নাই। ভূদেব, মনস্বীর এই বাক্য শ্ৰবণগোচর করিয়া, ঈষৎ হাস্য করিলেন; এবং, অবশ্যই তোমার মনোরথ সম্পন্ন করিব, তুমি আমাদের সমভিব্যাহারে চল; এই বলিয়া, আপন আলয়ে লইয়া গেলেন। তথায় উপস্থিত হইয়া, তিনি তাহাকে এক একাক্ষর মন্ত্র শিখাইয়া দিলেন; বলিলেন, এই মন্ত্রের উচ্চারণ করিলে, তুমি ষোড়শবর্ষীয়া কন্যার আকৃতি ধারণ করিবে, এবং, ইচ্ছা করিলেই, পুনর্বার আপনি স্বরূপ প্রাপ্ত হইবে।

মনস্বী মন্ত্রবলে ষোড়শবর্ষীয়া কন্যা হইল। ভূদেব অশীতিবর্ষদেশীয়ের আকারধারণ করিলেন, এবং, মনস্বীকে বধুবেশধারণ করাইয়া, রাজা সুবিচারের নিকটে উপস্থিত হইলেন। রাজা, বৃদ্ধ ব্ৰাহ্মণ দর্শনমাত্র, গাত্ৰোখান করিয়া, প্ৰণামপূর্বক, বসিতে আসন প্ৰদান করিলেন।

ব্ৰাহ্মণ, আসনপরিগ্রহ করিয়া, আশীৰ্বাদ করিলেন, যিনি, এই জগম্মণ্ডল প্ৰলয়জলধিজলে নিলীন হইলে, মীন রূপধারণ করিয়া, ধৰ্মমূল অপৌরুষেয় বেদের রক্ষা করিয়াছেন; যিনি, বরাহমূর্তি পরিগ্রহ করিয়া, বিশাল দশনাগ্রভাগ দ্বারা, প্ৰলয়জলনিমগ্ন মেদিনীমণ্ডলের উদ্ধার করিয়াছেন; যিনি, কুৰ্মরূপ অবলম্বন করিয়া, পৃষ্ঠে এই সসাগরা ধরা ধারণ করিয়া আছেন; যিনি, নৃসিংহের আকারস্বীকার করিয়া, নখকুলিশপ্রহার দ্বারা বিষম শত্রু হিরণ্যকশিপুর বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ করিয়াছেন; যিনি, দৈত্যরাজ বলিকে ছলিবার নিমিত্ত, বামন অবতার হইয়া, দেবরাজকে পুনৰ্বার ত্ৰিলোকীর ইন্দ্ৰত্বপদে সংস্থাপিত করিয়াছেন; যিনি, জমদগ্নির ঔরসে জন্মগ্রহণ করিয়া, পিতৃবধামর্ষে প্ৰদীপ্ত হইয়া, তীক্ষ্নধার কুঠার দ্বারা, মহাবীৰ্য কার্তবীৰ্য অর্জুনের ভুজবনচ্ছেদন করিয়াছেন, এবং, একবিংশতি বার পৃথ্বীকে নিঃক্ষত্রিয়া করিয়া, অরতিশোণিতজলে পিতৃতৰ্পণ করিয়াছেন; যিনি, দেবতাগণের অভ্যর্থনা অনুসারে, দশরথ গৃহে অংশচতুষ্টয়ে অবতীর্ণ হইয়া, বানর সৈন্য সমভিব্যাহারে, সমুদ্রে সেতুবন্ধনপূর্বক, দুর্বৃত্ত দশাননের বংশধ্বংস করিয়াছেন; যিনি, দ্বাপরযুগের অন্তে, ধর্মসংস্থাপনার্থে, যদুবংশে অংশে অবতীর্ণ হইয়া, দৈত্যবধ দ্বারা ভূমির ভার হরিয়া, অশেষপ্রকার লীলা করিয়াছেন; যিনি, বেদমাৰ্গবিপ্লাবনের নিমিত্ত, বুদ্ধাবতার হইয়া, দয়ালুত্ব, জিতেন্দ্ৰিয়ত্ব প্রভৃতি সদগুণের পরা কাষ্ঠা প্ৰদৰ্শিত করিয়াছেন; যিনি, সম্ভল গ্রামে বিষ্ণুযশানামক ধর্মনিষ্ঠ ব্ৰহ্মপরায়ণ ব্ৰাহ্মণের ভবনে অবতীর্ণ হইয়া, ভুবনমণ্ডলে কল্কী নামে বিখ্যাত হইবেন, এবং, অতি দ্রুতগামী দেবদত্ত তুরঙ্গমে আরোহণ করিয়া, করতলে করাল করবাল ধারণপূর্বক, বেদবিদ্বেষী, ধৰ্মমার্গপরিভ্রষ্ট, নষ্টমতি দুরাচারদিগের সমুচিত দণ্ডবিধান করিবেন; সেই ত্রিলোকীনাথ, বৈকুণ্ঠস্বামী, ভূতভাবন ভগবান আপনার মঙ্গল করুন।

রাজা জিজ্ঞাসিলেন, মহাশয়! কোথা হইতে আসিতেছেন। বৃদ্ধবেশী ভূদেব কহিলেন, মহারাজ! আমি গঙ্গার পূর্বপার হইতে আসিতেছি। ইনি আমার পুত্রবধু। ইহাকে ইহার পিত্ৰালয় হইতে আনিতে গিয়াছিলাম; প্রত্যাগমন করিয়া দেখিলাম, মারীভয়ে গ্রামস্থ সমস্ত লোক, স্থানত্যাগ করিয়া, দেশান্তরে প্রস্থান করিয়াছে। গৃহে ব্ৰাহ্মণী ও বিংশতিবর্ষীয় পুত্র রাখিয়া গিয়াছিলাম; তাহারাও, সেই উপদ্রবের সময়, দেশত্যাগ করিয়াছে; কোথায় গিয়াছে, কিছুই অনুসন্ধান করিতে পারি নাই। জানি না, কত স্থানে ভ্ৰমণ করিলে, কত কালে, তাহাদিগকে দেখিতে পাইব। তাহাদের অদর্শনে, দুঃসহ শোকভারে আক্রান্ত হইয়া, এক বারে, আমি আহার ও নিদ্রায় বিসর্জন দিয়াছি। এক্ষণে মানস করিয়াছি, পুত্রবধূকে বিশ্বস্তহস্তে ন্যস্ত করিয়া, তাহাদের অন্বেষণে নিৰ্গত হইব। আপনি দেশাধিপতি; আপনকার ন্যায় প্রকৃত বিশ্বাসভাজন কোথায় পাইব। আপনি, অনুগ্ৰহ করিয়া, আমার প্রত্যাগমন পর্যন্ত, পুত্রবধুটিকে আপনকার আশ্রয়ে রাখুন।

রাজা শুনিয়া মনে মনে বিবেচনা করিলেন, পরকীয় মহিলা গৃহে রাখা অতি কঠিন কর্ম; কিন্তু, অস্বীকার করিলে, ব্ৰাহ্মণ মনঃক্ষুন্ন হইবেন; অতএব, চন্দ্ৰপ্ৰভার নিকটে দিয়া, তাহার উপর ইহার রক্ষণাবেক্ষণের ভার দি। এই ব্যবস্থা স্থির করিয়া, তিনি ব্ৰাহ্মণকে কহিলেন, মহাশয়! আপনি যে আজ্ঞা করিতেছেন, তাহাতে আমি সম্মত হইলাম। ভূদেব, হৃষ্টচিত্তে আশীৰ্বাদপ্রয়োগপূর্বক, রাজার হস্তে পুত্রবধু ন্যস্ত করিয়া, প্রস্থান করিলেন। রাজাও, অনতিবিলম্বে অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া, কন্যার হস্তে কন্যাবেশধারী মনস্বীর ভারসমৰ্পণ করিলেন। রাজকন্যা, ব্ৰাহ্মণবধূকে সমবয়স্ক দেখিয়া, আদরপূর্বক, তাহার ভার লইলেন, এবং, স্বীয় সহোদরার ন্যায়, যত্ন ও স্নেহ করিতে লাগিলেন। সর্বদা একত্র উপবেশন, একত্র ভোজন, এক শয্যায় শয়ন আদি দ্বারা, পরস্পর প্রণয়সঞ্চার হইতে লাগিল। মনস্বী, ক্ৰমে ক্রমে, রাজকন্যার প্রাণ অপেক্ষা প্রিয় হইয়া উঠিল। এক দিবস, সে, রাজকন্যার মনের ভাবপরীক্ষার্থে, কথাপ্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করিল, প্ৰিয়সখি। তুমি দিবানিশি কি চিন্তা কর, এবং, কি নিমিত্তে, দিন দিন দুর্বল হইতেছে, বল।

রাজপুত্ৰী কহিলেন, সখি! বসন্তকালে, এক দিন, সখীগণ সঙ্গে লইয়া, বনবিহারে গিয়াছিলাম। তথায়, দৈবযোগে, এক পরম সুন্দর যুবা ব্ৰাহ্মণকুমার আমার নয়নপথের পথিক হইলেন। তদবধি তদাসক্তচিত্ত হইয়া, তদ্বিরহে দিন দিন এরূপ দুর্বল হইতেছি। দুঃসহ বিরহানল, ক্রমে প্রবল হইয়া, নিরন্তর অন্তরদাহ করিতেছে। আমার আহার, বিহার, শয়ন, উপবেশন, কোনও বিষয়েই সুখ নাই। দিবানিশি কেবল সেই মোহিনী মূর্তির চিন্তা করিয়া, প্রাণধারণ করিতেছি, এবং চতুর্দিক তন্ময় দেখিতেছি। তাঁহার নাম ধাম কিছুই জানি না। ভাবিয়া চিন্তিয়া, কোনও উপায় স্থির করিতে পারি নাই। নিতান্ত নির্লজ্জা হইয়া, কাহারও নিকট মনের বেদনা ব্যক্ত করিতে পারি না। তুমি আমার দ্বিতীয় প্ৰাণ; তোমার কাছে কোনও কথাই গোপনীয় নাই। তুমি কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করিলে, তাহাতেই প্ৰকাশ করিলাম। ফলতঃ, তোমার নিকটে মনের বেদনা ব্যক্ত করিয়াও, অনেক অংশে, স্বাস্থ্যলাভ হইল। তুমি এ বিষয় অতি গোপনে রাখিবে।

এইরূপে রাজকন্যার অভিপ্রায় বুঝিয়া, মনস্বী আনন্দপ্রবাহে মগ্ন হইল, এবং কহিল, প্ৰিয়সখি! আমি যদি তোমার প্ৰিয়সমাগম সম্পন্ন করিতে পারি, আমায় কি পারিতোষিক দাও। রাজকন্যা কহিলেন, সখি! অধিক আর কি বলিব, যদি তুমি তাঁহাকে মিলাইয়া দিতে পার, তোমার দাসী হইয়া, চিরকাল চরণসেবা করিব। মনস্বী, তৎক্ষণাৎ আপনি স্বরূপ প্রাপ্ত হইয়া, প্রিয়সম্ভাষণপূর্বক, রাজকুমারীর করগ্রহণ করিল। রাজকন্যা অসম্ভাবিত প্ৰিয়সমাগম দ্বারা, মনোরথনদীর পার প্রাপ্ত হইয়া, প্রথমতঃ, বাকপথাতীত হর্ষ, বিস্ময়, লজ্জার উদ্রেক সহকারে, পরম রমণীয় অনিৰ্বাচনীয় দশান্তর প্রাপ্ত হইলেন; অনন্তর, লজ্জাভঙ্গ হইলে, মনস্বীর রূপান্তরপ্রতিপত্তিরূপ অদ্ভুত ব্যাপারের নিগৃঢ় তত্ত্ব জানিবার জন্য, একান্ত কৌতুহলাক্রান্ত হইয়া, সবিশেষ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। সে, আপন বিচেতনদশা অবধি, ভূদেবের তিরস্করণী বিদ্যাপ্রদান পর্যন্ত, আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত রাজকন্যার গোচর করিয়া, গান্ধৰ্ব বিধানে তাঁহার পাণিগ্রহণ করিল।

কিছু দিনের পর, রাজকুমারী অন্তর্বত্নী হইলেন। এই সময়ে, এক দিন, রাজা সুবিচার সপরিবার অমাত্যভবনে নিমন্ত্রিত হইলেন। রাজকন্যা, এক নিমিষের নিমিত্তেও, ব্রাহ্মণবধূকে নয়নের বহির্বর্তিনী করিতেন না; সুতরাং, তিনি অমাত্যভবনপ্রস্থানকালে, তাহারে সমভিব্যাহারে লইয়া গেলেন। অমাত্যপুত্র, ব্ৰাহ্মণবধুর অসামান্য রূপলাবণ্য দর্শনে, মোহিত হইল; এবং, নিতান্ত অধৈৰ্য হইয়া, আপনি মিত্রের নিকটে কহিল, যদি এই স্ত্রীরত্ন হস্তগত না হয়, প্ৰাণত্যাগ করিব। ফলতঃ, ক্ৰমে ক্ৰমে, মন্ত্রিপুত্রের বিরহবেদনা এরূপ বৃদ্ধি পাইতে লাগিল, যে কেবল দশমী দশা মাত্র অবশিষ্ট রহিল।

তখন তাহার মিত্র, অন্য কোনও উপায় না দেখিয়া, অমাত্যের নিকটে গিয়া, তদীয় অবস্থা ও প্রার্থনা জানাইল। আমাত্য, অপত্যস্নেহের আতিশয্যবশতঃ, উচিতানুচিতবিবেচনায় বিসর্জন দিয়া, রাজসমীপে সবিশেষ সমস্ত নির্দেশপূর্বক, ব্রাহ্মণবধূপ্রাপ্তির প্রার্থনা জানাইলেন। রাজা শুনিয়া অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইলেন এবং কহিলেন, আরে মুর্খ! স্থাপিত ধন, স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে, অন্যকে দেওয়া সৰ্বতোভাবে অতি গৰ্হিত কর্ম। বিশেষতঃ, ব্ৰাহ্মণ, কোনও কালে, কোনও ক্রমে, ব্যতিক্রমের আশঙ্কা নাই জানিয়া, বিশ্বাস করিয়া, আমার হস্তে পুত্রবধূসমৰ্পণ করিয়া গিয়াছেন। বিশ্বাসভঙ্গ, শাস্ত্র ও লোকাচার অনুসারে, যার পর নাই, গর্হিত ব্যবহার। আমি, তোমার অনুরোধে, এইরূপ দুষ্ক্রিয়ায়, প্ৰাণান্তেও, প্ৰবৃত্ত হইতে পারিব না। মন্ত্রী শুনিয়া, নিরাশ হইয়া, গৃহে প্ৰতিগমন করিলেন; কিন্তু পুত্রের তাদৃশী দশা দর্শনে, নিতান্ত কাতর হইয়া, আহার নিদ্রা পরিহারপূর্বক, বিষাদসাগরে মগ্ন হইলেন।

সর্বাধিকারী, ক্রমে ক্রমে, পুত্রের তুল্য দশা প্রাপ্ত হইলে, রাজকাৰ্যব্যাঘাতের উপক্রম দেখিয়া, অন্যান্য প্রধান রাজপুরুষেরা রাজার নিকটে নিবেদন করিলেন, মহারাজ! মন্ত্রিপুত্রের যাদৃশী অবস্থা ঘটিয়াছে, তাহাতে তাহার জীবনরক্ষা হওয়া কঠিন। যেরূপ দেখিতেছি, তাহার কোনও অমঙ্গল ঘটিলে, মন্ত্রীও অবধারিত প্ৰাণত্যাগ করিবেন। এরূপ সর্বাংশে কর্মদক্ষ কার্যসহায় দ্বিতীয় ব্যক্তি নাই; সুতরাং, রাজকাৰ্যনিৰ্বাহবিষয়ে বিষম বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইবেক। অতএব, আমরা বিনয়বাক্যে প্রার্থনা করিতেছি, বৃদ্ধ ব্ৰাহ্মণের পুত্রবধূকে অমাত্যপুত্রের নিকট প্রেরিত করুন। বহুদিন হইল, ব্ৰাহ্মণের উদ্দেশ নাই; আর তাঁহার আসিবার সম্ভাবনা, কোনও ক্রমে, বোধগম্য হইতেছে না; যদিও কালান্তরে প্রত্যাগমন করেন; ব্ৰাহ্মণজাতি সাতিশয় অর্থলোভী; বহুসংখ্যক অর্থ দিয়া, তুষ্ট করিয়া, অনায়াসে বিদায় করিতে পারিবেন; অথবা, কন্যান্তরসঙ্ঘাটন করিয়া, তাহার পুত্রের বিবাহ দিয়াও তাঁহাকে তুষ্ট করিতে পারা যাইবেক।

রাজা, নিতান্ত নিরুপায় ভাবিয়া, অবশেষে, ব্ৰাহ্মণবধুর নিকটে গিয়া, মন্ত্রিপুত্রের প্রার্থনা জানাইলেন। কপটাচারী বধুবেশধারী মনস্বী নিবেদন করিল, মহারাজ! আপনি দেশাধিপতি; আপনকার ইচ্ছা, সর্ব কাল, সর্ব বিষয়ে, সর্বাংশে বলবতী; বিশেষতঃ, এক্ষণে আমি আপনকার আশ্রয়ে আছি; আপনকার আজ্ঞাপ্ৰতিপালন, আমার পক্ষে, সর্বতোভাবে, সম্পূর্ণ উচিত কর্ম। কিন্তু মহারাজ! বিবেচনা করুন, আমি বিবাহিতা নারী; বিবাহিতা নারীর পুরুষান্তরসেবা-শঙ্কুনিষিদ্ধ ও লোকাচারবিরুদ্ধ। আপনি দণ্ডধারী হইয়া, কি রূপে, ঈদৃশ বিসদৃশ আজ্ঞা করিতেছেন, বুঝিতে পারিতেছি না। মহারাজ! আমি, প্ৰাণান্তেও পরপুরুষের মুখ দেখিব না। রাজা শুনিয়া, নিরতিশয় বিষন্ন, হতবুদ্ধি, ও কিংকৰ্তব্যবিমূঢ় হইয়া, অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইলেন।

মনস্বী, আর এখানে থাকায় ভদ্রস্থতা নাই, অতঃপর পলায়ন করাই সর্বাংশে শ্ৰেয়ঃ, এই স্থির করিয়া, বধূবেশপরিত্যাগপূর্বক, কৌশলক্রমে, রাজবাটী হইতে পলায়ন করিল। রাজা, ব্ৰাহ্মণবধূর অদর্শনবৃত্তান্ত অবগত হইয়া, এক বারে বিষাদপারাবারে মগ্ন হইলেন, এবং ভাবিতে লাগিলেন, এ আবার এক বিষম সর্বনাশ উপস্থিত হইল; ব্ৰাহ্মণ আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলে, কি উত্তর দিব; ব্ৰাহ্মণবধুর নিকট ও রূপ অনুচিত প্ৰস্তাব করাই অতি অসঙ্গত কর্ম হইয়াছে। যদৰ্থে প্রার্থনা করিলাম, তাহাও সিদ্ধ হইল না; অথচ ঘোরতর বিপদে পড়িলাম।

এদিকে, মনস্বী, ভূদেবের নিকটে গিয়া, পূর্বাপর সমস্ত বৃত্তান্ত বৰ্ণনা করিলে, তিনি অতিশয় প্রীত ও চমৎকৃত হইলেন; এবং, স্বীয় সহচর শশীকে বিংশতিবর্ষীয় পুত্ৰ সাজাইয়া, স্বয়ং, পূর্ববৎ বৃদ্ধবেশধারণপূর্বক, রাজসমীপে উপস্থিত হইলেন। রাজা, প্ৰণাম ও স্বাগত প্রশ্নপূর্বক বসিতে আসন দিয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, মহাশয়ের এত বিলম্ব হইল কেন। ভূদেব কহিলেন, মহারাজ! বিলম্বের কথা কেন জিজ্ঞাসা করেন। অনেক কষ্টে, অনেক অন্বেষণ করিয়া, পুত্ৰ পাইয়াছি। এক্ষণে, পুত্র ও পুত্ৰবধু লইয়া, গৃহে যাইব। রাজা, ব্ৰহ্মশাপভয়ে কম্পিত ও কৃতাঞ্জলি হইয়া, ব্ৰাহ্মণের নিকট সবিশেষ সমস্ত নিবেদন করিলেন।

ব্ৰাহ্মণ শুনিয়া কোপে কম্পমানকলেবর হইলেন, এবং শাপপ্রদানে উদ্যত হইয়া কহিলেন, তোমার এ কি ব্যবহার; আমি তোমাকে রাজা জানিয়া, বিশ্বাস করিয়া, তোমার হস্তে পুত্রবধূসমর্পণ করিয়াছিলাম। তুমি, আপনি ইষ্টসিদ্ধির নিমিত্ত, যথেচ্ছ বিনিয়োগে প্ৰবৃত্ত হইয়া, আমার সর্বনাশ করিয়াছ। বলিতে কি, কোনও কালে, আমার এ মনোবেদনা দূর হইবেক না। রাজা শুনিয়া যৎপরোনাস্তি ভীত হইলেন, এবং অশেষপ্রকার স্তুতি ও বিনীতি করিয়া কহিলেন, মহাশয়! কৃপা করিয়া আমায় ক্ষমা করিতে হইবেক; আপনকার যে অপকার করিয়াছি, তাহার প্রতিক্রিয়ার্থে, যে আজ্ঞা করিবেন, দ্বিরুক্তি না করিয়া, তাহাতেই সম্মত হইব। ভূদেব কহিলেন, যদি তুমি আমার পুত্রের সহিত আপন কন্যার বিবাহ দাও, তাহা হইলে, আমি কথঞ্চিৎ ক্ষমা করিতে পারি।

রাজা, ব্ৰহ্মকোপানলে কুলক্ষয়ভয়ে, তৎক্ষণাৎ তদীয় প্রস্তাবে সম্মত হইলেন; এবং, জ্যোতির্বিদ ব্ৰাহ্মণ দ্বারা, শুভ দিন ও শুভ লগ্ন নির্ধারিত করিয়া, ব্ৰাহ্মণতনয়ের সহিত কন্যার বিবাহ দিলেন। ভূদেব রাজকন্যা লইয়া আলয়ে উপস্থিত হইলে, শশী ও মনস্বী, উভয়ে, এই ভাৰ্য আমার আমার বলিয়া, পরস্পর বিষম বিবাদ আরব্ধ করিল। মনস্বী কহিল, আমি পূর্বে ইহার পাণিগ্রহণ করিয়াছি, এবং, আমার সহযোগে, ইহার গর্ভসঞ্চার হইয়াছে। শশী কহিলেন, রাজা সর্বসমক্ষে আমাকে কন্যাদান করিয়াছেন।

ইহা কহিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! এক্ষণে, এই কন্যা, শাস্ত্র ও যুক্তি অনুসারে, কাহার সহধর্মিণী হইতে পারে। বিক্রমাদিত্য কহিলেন, আমার মতে মনস্বীর। বেতাল কহিল, শাস্ত্ৰে লিখিত আছে, কন্যার দান, বিক্রয়, পরিত্যাগে পিতামাতার সম্পূর্ণ অধিকার। রাজা সর্ব সমক্ষে, ধর্ম সাক্ষী করিয়া, শশীকে কন্যা দান করিয়াছেন। অতএব, পিতৃদত্ত কন্যা শশীরই সহধর্মিণী হইতে পারে; তাহা না হইয়া, মনস্বীর কেন হইবেক, বল। রাজা কহিলেন, তুমি যাহা কহিতেছ, তাহার যথার্থতা বিষয়ে অণুমাত্ৰ সংশয় নাই। কিন্তু, মনস্বী পূর্বে বিবাহ করিয়াছে, এবং, তাহার সহযোগে, রাজকন্যার গর্ভসঞ্চার হইয়াছে। এমন স্থলে, সে মনস্বীর সহচারিণী হইলে, তাহারও সতীত্বরক্ষা হয়, ধর্মেরও মান থাকে।

 

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।

১৫. পঞ্চদশ উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ!

ভারতবর্ষের উত্তর সীমায়, হিমালয় নামে, অতি প্ৰসিদ্ধ পৰ্বত আছে। তাহার প্রস্থদেশে, পুষ্পপুর নামে, পরম রমণীয় নগর ছিল। গন্ধৰ্বরাজ জীমূতকেতু ঐ নগরে রাজত্ব করিতেন। তিনি, পুত্ৰকামনা করিয়া, বহু কাল, কল্পবৃক্ষের আরাধনা করিয়াছিলেন। কল্পবৃক্ষ প্রসন্ন হইয়া বরপ্রদান করিলে, রাজা জীমূতকেতুর এক পুত্র জন্মিল। তিনি পুত্রের নাম জীমূতবাহন রাখিলেন। জীমূতবাহন, স্বভাবতঃ, সাতিশয় ধর্মশীল, দয়াবান, ও ন্যায়পরায়ণ ছিলেন; এবং, স্বল্প পরিশ্রমে, স্বল্পকাল মধ্যে, সর্ব শাস্ত্রে পারদর্শী ও শস্ত্রবিদ্যায় বিশারদ হইয়া উঠিলেন।

কিয়ৎ কাল পরে, রাজা জীমূতকেতু, পুনরায় কল্পবৃক্ষকে প্রসন্ন করিয়া, এই বরপ্রার্থনা করিলেন, আমার প্রজারা সর্বপ্রকার সম্পত্তিতে পরিপূর্ণ হউক। কল্পবৃক্ষের বরদান দ্বারা, তদীয় প্রজাবৰ্গ সর্বপ্রকার সম্পত্তিতে পরিপূর্ণ হইল, এবং ঐশ্বৰ্যমদে মত্ত হইয়া, রাজাকেও তৃণজ্ঞান করিতে লাগিল। ফলতঃ, অল্পকালমধ্যে, রাজা ও প্রজা বলিয়া, কোনও অংশে, কোনও বিশেষ রহিল না। তখন, জীমূতকেতুর জ্ঞাতিবর্গ গোপনে পরামর্শ করিল, ইহার পিতাপুত্রে, অনন্যমন ও অনন্যকর্ম হইয়া, দিবানিশি, কেবল ধর্মচিন্তায় কালযাপন করিতেছে; রাজ্যের দিকে ক্ষণমাত্রও দৃষ্টিপাত করে না। প্ৰজা সকল উচ্ছৃঙ্খল হইতে লাগিল। অতএব, ইহাদের উভয়কে রাজ্যচ্যুত করিয়া, যাহাতে উপযুক্তরূপ রাজ্যশাসন হয়, এরূপ ব্যবস্থা করা উচিত। অনন্তর, বহুতর সৈন্যসংগ্রহপূর্বক, তাহার রাজপুরীর চতুর্দিক নিরুদ্ধ করিল।

এই ব্যাপার দেখিয়া, যুবরাজ জীমূতবাহন পিতার নিকট নিবেদন করিলেন, মহারাজ! জ্ঞাতিবর্গ, একবাক্য হইয়া, আমাদিগকে রাজ্যচ্যুত করিবার অভিসন্ধিতে, এই উদ্যোগ করিয়াছে। আপনকার আজ্ঞা পাইলে, রণক্ষেত্রে প্রবিষ্ট হইয়া, বিপক্ষপক্ষের সৈন্যক্ষয় ও সমুচিত দণ্ডবিধান করি।

জীমূতকেতু কহিলেন, এই ক্ষণভঙ্গুর পাঞ্চভৌতিক দেহ অতি অকিঞ্চিৎকর; বিনশ্বর রাজপদের নিমিত্ত, বহুসংখ্যক জীবের প্রাণহিংসা করিয়া, মহাপাপে লিপ্ত হওয়া উচিত নহে। ধর্মপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির, আত্মীয়গণের কুমন্ত্রণায়, কুরুক্ষেত্ৰযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া, পশ্চাৎ অনেক অনুতাপ করিয়াছিলেন। অতএব, রাজপদপরিত্যাগ করিয়া, কোনও নিভৃত স্থানে গিয়া, প্রশান্ত মনে, দেবতার আরাধনা করা ভাল। এইরূপ সঙ্কল্প করিয়া, পিতাপুত্রে নগর হইতে বহির্গত হইলেন; এবং, মলয় পর্বতে গিয়া, তদীয় অধিত্যকায় কুটীরনির্মাণপূর্বক, তপস্যা করিতে লাগিলেন।

এক ঋষিকুমারের সহিত, রাজকুমারের অতিশয় বন্ধুত্ব জন্মিল। এক দিন, দুই বন্ধুতে একত্র হইয়া ভ্ৰমণার্থে নিৰ্গত হইলেন। অনতিদূরে কাত্যায়নীর মন্দির ছিল; শ্রবণমনোহর বীণা শব্দ শ্রবণগোচর করিয়া, তাঁহারা, কৌতুকাবিষ্ট চিত্তে, সত্বর গমনে, তথায় উপস্থিত হইয়া, দেখিলেন, এক পরম সুন্দরী কন্যা, বীণানুগত স্তুতিগর্ভ গীত দ্বারা, ভগবতী কাত্যায়নীর উপাসনা করিতেছে। উভয়ে, একতানমন হইয়া, শ্রবণ ও দর্শন করিতে লাগিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, সেই কন্যা, জীমূতবাহনকে নয়নগোচর করিয়া, মনে মনে তাঁহাকে পতিত্বে বরণ, এবং স্বীয় সহচরী দ্বারা তাঁহার নাম, ধাম, ব্যবসায় প্রভৃতির পরিচয়গ্রহণপূর্বক, প্ৰস্থান করিল।

অনন্তর, তাহার সহচরী, তদীয় নির্দেশক্রমে, তাহার মাতার নিকট পূর্বাপর সমস্ত নিবেদন করিলে, তিনি স্বীয় পতি রাজা মলয়কেতুর নিকটে কন্যার অভিপ্রায় ব্যক্তি করিলেন। মলয়কেতু আপন পুত্র মিত্ৰা বসুকে কহিলেন, তোমার ভগিনী বিবাহযোগ্য হইয়াছে; আর নিশ্চিন্ত থাকা উচিত নহে; উপযুক্ত পাত্রের অন্বেষণ করা আবশ্যক। শুনিলাম, গন্ধৰ্বাধিপতি রাজা জীমূতকেতু, রাজ্যাধিকারপরিহারপূর্বক, নিজ পুত্ৰ জীমূতবাহন মাত্র সমভিব্যাহারে, মলয়াচলে অবস্থিতি করিতেছেন। আমার অভিপ্রায়, জীমূতবাহনকে কন্যাদান করি। তুমি, রাজা জীমূতকেতুর নিকটে গিয়া, আমার এই অভিপ্ৰায় তাহার গোচয় কর।

মিত্রাবসু, পিতার আদেশ অনুসারে, জীমূতকেতুর সমীপে উপস্থিত হইয়া, সবিশেষ সমস্ত বিজ্ঞাপন করিলে, তিনি তৎক্ষণাৎ সম্মত হইলেন; এবং, জীমূতবাহনকে, মিত্রাবসুর সমভিব্যাহারে, মলয়কেতুর নিকটে পাঠাইয়া দিলেন। মলয়কেতু, শুভ লগ্নে, স্বীয় কন্যা মলয়াবতীর বিবাহকাৰ্য সম্পন্ন করিলেন। বর ও কন্যা, পরম সুখে, কালব্যাপন করিতে লাগিলেন।

এক দিন, জীমূতবাহন ও মিত্রাবসু, উভয়ে, মলয় মহীধরের পরিসরে, পরিভ্রমণবাসনায়, বাসস্থান হইতে বহির্গত হইলেন। ভূধরের উত্তর ভাগে উপস্থিত হইয়া, দূর হইতে এক শ্বেতবর্ণ বস্তুরাশি নয়নগোচর করিয়া, জীমূতবাহন মিত্রাবসুকে জিজ্ঞাসা করিলেন, বয়স্য। গণ্ডশৈলের ন্যায়, ধবলবৰ্ণ, রাশীকৃত কি বস্তু দৃষ্ট হইতেছে। মিত্ৰাবসু কহিলেন, মিত্র। পূর্ব কালে, গরুড়ের সহিত, নাগগণের নিরন্তর ঘোরতর যুদ্ধ হইয়াছিল। কিয়ৎ কাল পরে, নাগেরা, সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হইয়া, সন্ধিপ্রার্থনা করিলে, গরুড় কহিলেন, যদি তোমরা, আমার দৈনন্দিন আহারের নিমিত্ত, এক এক নাগ উপহার দিতে পার, তাহা হইলে আমি তোমাদের প্রার্থনায় সম্মত হই; নতুবা, অবিলম্বে নাগকুল নিঃশেষ করিব। নিরুপায় নাগেরা, তাহাতেই সন্মত হইল। তদবধি, প্রতিদিন, এক এক নাগ, পাতাল হইতে আসিয়া, ঐ স্থানে উপস্থিত থাকে; গরুড়, মধ্যাহ্নকালে আসিয়া, ভক্ষণ করেন। এইরূপে, ভক্ষিত নাগগণের অস্থি দ্বারা, ঐ পর্বতাকার ধবলরাশি প্রস্তুত হইয়াছে।

শ্রবণমাত্র, জীমূতবাহনের অন্তঃকরণ কারুণ্যরসে পরিপূর্ণ হইল। তখন তিনি মনে মনে বিবেচনা করিলেন, মধ্যাহ্নকাল আগতপ্ৰায়; অবশ্যই এক নাগ, গরুড়ের আহারার্থে, পৰ্যায়ক্রমে, উপস্থিত হইবেক; আমি, আপন প্ৰাণ দিয়া, তাহার প্রাণরক্ষা করিব। অনন্তর, কৌশলক্রমে শ্যালককে বিদায় করিয়া, ক্ৰমে ক্রমে অস্থিরাশির নিকটবর্তী হইয়া, জীমূতবাহন রোদনশব্দশ্রবণ করিলেন; এবং, সত্বর গমনে, রোদনস্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, এক বৃদ্ধা নাগী, শিরে করাঘাতপূর্বক, হাহাকার ও উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতেছে। দেখিয়া, একান্ত শোকাক্রান্ত হইয়া, তিনি কাতর বচনে নাগীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, মা! তুমি কি নিমিত্তে রোদন করিতেছ। সে গরুড়বৃত্তান্তের বর্ণন করিয়া কহিল, অন্য আমার পুত্র শঙ্খচূড়ের বার; ক্ষণকাল পরেই, গরুড় আসিয়া, আহারার্থে তাহার প্রাণসংহার করিবেক। আমার দ্বিতীয় পুত্র নাই। আমি, সেই দুঃখে দুঃখিত হইয়া, রোদন করিতেছি। জীমূতবাহন কহিলেন, মা আর রোদন করিও না; আমি, আপন প্রাণ দিয়া, তোমার পুত্রের প্রাণরক্ষা করিব। নাগী কহিল, বৎস! তুমি, কি কারণে, পরের জন্যে প্রাণত্যাগ করিবে। আর, পরের পুত্রের প্রাণ দিয়া, আপন পুত্রের প্রাণরক্ষা করিলে, আমারও ঘোরতর অধৰ্ম ও যার পর নাই অপযশ হইবেক।

এইরূপে উভয়ের কথোপকথন হইতেছে, ইত্যবসরে শঙ্খচূড়ও তথায় উপস্থিত হইল; এবং, জীমূতবাহনের অভিসন্ধি শুনিয়া, তাহার পরিচয়গ্ৰহণপূর্বক, বিশেষজ্ঞ হইয়া কহিল, মহারাজ। আপনি অন্যায় আজ্ঞা করিতেছেন। বিবেচনা করিয়া দেখুন, আমার মত কত শত ব্যক্তি সংসারে জন্মিতেছে ও মরিতেছে; কিন্তু, আপনকার ন্যায় ধর্মাত্মা দয়ালু সংসারে সর্বদা জন্মগ্রহণ করেন না। অতএব, আমার পরিবর্তে, আপনকার প্রাণত্যাগ করা, কোনও ক্রমে, উচিত নহে। আপনি জীবিত থাকিলে, লক্ষ লক্ষ লোকের মহোপকার হইবেক। আমি জীবিত থাকিয়া, কোনও কালে, কাহারও কোনও উপকার করিতে পারিব না। মাদৃশ্য ব্যক্তির জীবন মরণ দুই তুল্য।

জীমূতবাহন কহিলেন, শুন শঙ্খচূড়। প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, আপন প্রাণ দিয়া, তোমার প্রাণরক্ষা করিব। আমি ক্ষত্ৰিয়কুলে জন্মগ্রহণ করিয়াছি; ক্ষত্ৰিয়েরা, প্রতিজ্ঞাভঙ্গ অপেক্ষা, প্রাণত্যাগ অতি লঘু ও সহজ জ্ঞান করেন। বিশেষতঃ, প্ৰাণস্নেহে প্ৰতিজ্ঞাপ্রতিপালনে পরাঙ্মুখ হইলে, নরকগামী হইতে হয়। অতএব, যখন স্বমুখে ব্যক্ত করিয়াছি, তখন অবশ্যই প্ৰাণ দিয়া, তোমার প্রাণরক্ষা করিব; তুমি স্বস্থানে প্রস্থান কর। এইরূপ বলিয়া, তিনি শঙ্খচূড়কে বিদায় করিলেন; এবং তদীয় প্রতিশীর্ষ হইয়া, গরুড়ের আগমনপ্রতীক্ষায়, নির্দ্দিষ্ট স্থানে উপবিষ্ট রহিলেন। শঙ্খচূড়, জীমূতবাহনের নির্বন্ধলঙ্ঘনে অসমর্থ হইয়া, বিষন্ন মনে, বিরস বদনে, মলয়াচলবাসিনী কাত্যায়নীর সম্মুখে উপস্থিত হইল; এবং, একাগ্ৰচিত্ত হইয়া, জীবনদাতা জীমূতবাহনের জীবনরক্ষণের উপায়প্রার্থনা করিতে লাগিল।

নিরূপিত সময় উপস্থিত হইলে, গরুড় আসিয়া, চঞ্চুপুট দ্বারা জীমূতবাহনগ্রহণপূর্বক, নভোমণ্ডলে উড্ডীন হইয়া, মণ্ডলাকারে ভ্রমণ করিতে লাগিল। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, জীমূতবাহনের দক্ষিণবাহুস্থিত নামাঙ্কিত মণিময় কেয়ুর, শোণিতলিপ্ত হইয়া, মলয়াবতীর সম্মুখে পতিত হইল। মলয়াবতী, নামাক্ষরপরিচয় দ্বারা, প্রিয়তমের প্রাণাত্যয় স্থির করিয়া, শিরে করাঘাতপূর্বক, ভূতলে পতিত হইয়া, উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিল। তাহার পিতা, মাতা, ভ্রাতা, কেয়ুর দর্শনে সাতিশয় বিষন্ন হইয়া, হাহাকার করিতে লাগিলেন। রাজা মলয়কেতু, চতুর্দিকে বহুসংখ্যক লোক প্রেরিত করিয়া, পরিশেষে স্বয়ং, পুত্ৰ সহিত, জীমূতবাহনের অন্বেষণে নির্গত হইলেন।

শঙ্খচূড়, কাত্যায়নীর আলয় হইতে, রাজপরিবারের কোলাহলশ্রবণ করিয়া, সবিশেষ অনুসন্ধান দ্বারা, জীমূতবাহনের অমঙ্গলবৃত্তান্ত অবগত হইয়া, অশ্রুপূর্ণ নয়নে পূর্বস্থানে উপস্থিত হইল; এবং, গরুড়কে সম্বোধন করিয়া, উচ্চৈঃস্বরে কহিতে লাগিল, অহে বিহঙ্গরাজ! তুমি, শঙ্খচূড়ক্রমে, রাজা জীমূতবাহনকে লইয়া গিয়াছ; উনি তোমার ভক্ষ্য নহেন। আমার নাম শঙ্খচূড়; অদ্য আমার বার। তুমি, তাহারে পরিত্যাগ করিয়া, আমায় ভক্ষণ কর; নতুবা, তোমায় সাতিশয় অধৰ্মগ্ৰস্ত হইতে হইবেক।

গরুড় শুনিয়া অতিশয় শঙ্কিত হইলেন; এবং মৃতকল্প জীমূতবাহনকে জিজ্ঞাসা করিলেন, অহে মহাপুরুষ! তুমি কে, কি নিমিত্তে প্ৰাণদানে উদ্যত হইয়াছ। জীমূতবাহন আত্মপরিচয়প্রদানপূর্বক, কহিলেন, অদ্য বা অশব্দতান্তে, অবশ্যই মৃত্যু ঘটিবেক। যে ব্যক্তি, ক্ষণবিধ্বংসী তুচ্ছ শরীরের বিনিয়োগ দ্বারা, পরোপকার করিয়া, দিগন্তব্যাপিনী ও অনন্তকালস্থায়িনী কীর্তি উপার্জন করে, তাহারই এই সংসারে জন্মগ্রহণ সার্থক; নতুবা, স্বোদরপরায়ণ কাক, কুকুর, শৃগাল প্রভৃতি হইতে বিশেষ কি। এই বিবেচনায়, আমি, আত্মপ্রাণব্যয় দ্বারা, শঙ্খচূড়ের প্রাণরক্ষা করিতে আসিয়াছি। গরুড় শুনিয়া, যার পর নাই, সন্তুষ্ট হইলেন, এবং জীমূতবাহনকে শত শত সাধুবাদপ্রদান করিয়া কহিলেন, জগতে জীবমাত্রেই স্ব স্ব প্রাণরক্ষায় যত্নবান। কিন্তু, আপন প্ৰাণ দিয়া, পরের প্রাণরক্ষা করে, এরূপ ব্যক্তি অতি বিরল। যাহা হউক, আমি তোমার দয়া ও সাহস দর্শনে সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছি; বরপ্রার্থনা কর।

জীমূতবাহন কহিলেন, খগেশ্বর। যদি প্রসন্ন হইয়া থাক, এই বর দাও, তুমি অতঃপর আর নাগহিংসা করিবে না; এবং, দীর্ঘ কাল ভক্ষণ করিয়া, যে অসংখ্য নাগের প্রাণসংহার করিয়াছ, তাহদেরও জীবনদান কর। গরুড়, তথাস্তু বলিয়া, তৎক্ষণাৎ পাতাল হইতে অমৃত আহরণপূর্বক, অস্থিস্তূপের উপর সেচন করিয়া, মৃত নাগগণের জীবনদান করিলেন, এবং জীমূতবাহনকে কহিলেন, রাজকুমার! আমার প্রসাদে, তোমাদের অপহৃত রাজ্যের পুনরুদ্ধার হইবেক। এইরূপ বরপ্রদান করিয়া, গরুড় অন্তহিত হইলে, শঙ্খচূড়ও জীমূতবাহনের বহুবিধ স্তুতি করিয়া, বিদায় লইয়া, স্বস্থানে প্রস্থান করিল।

জীমূতবাহন, এইরূপ বরলাভে চরিতার্থ হইয়া, পিতৃসমীপে উপস্থিত হইলেন; এবং, লোক দ্বারা, শ্বশুরালয়ে স্বীয় মঙ্গলসংবাদ পাঠাইয়া দিলেন। তাঁহাদের রাজ্যাপহারক জ্ঞাতিবর্গ, বরপ্রদানবৃত্তান্ত অবগত হইয়া, রাজা জীমূতকেতুর শরণাগত হইল; এবং, স্তুতি ও বিনতি দ্বারা প্রসন্ন করিয়া, তাহাকে রাজপদে পুনঃস্থাপিত করিল।

ইহা কহিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! জীমূতবাহন ও শঙ্খচূড়, এ উভয়ের মধ্যে কোন ব্যক্তির অধিক ভদ্রতাপ্রকাশ হইল। বিক্ৰমাদিত্য কহিলেন, শঙ্খচূড়ের। বেতাল কহিল, কি প্রকারে। রাজা কহিলেন, শঙ্খচূড়, জীমূতবাহনের প্রাণদান বিষয়ে, প্রথমতঃ কোনও মতে সম্মত হয় নাই; পরিশেষে, সম্মত হইয়াও, কাত্যায়নীর নিকটে গিয়া, উপকারকের মঙ্গলপ্রার্থনা করিতে লাগিল; এবং পুনরায় আসিয়া, প্রাণদানে উদ্যত হইয়া, জীমূতবাহনের প্রাণরক্ষা করিল। বেতাল কহিল, যে ব্যক্তি পরার্থে প্ৰাণদান করিল, তাহার। ভদ্রতা অধিক বলিয়া গণ্য হইল না কেন। রাজা কহিলেন, জীমূতবাহন ক্ষত্রিয়জাতি; ক্ষত্রিয়ের প্রাণত্যাগ অতি অকিঞ্চিৎকর জ্ঞান করে। অতএব, এই জীবনদান, জীমূতবাহনের পক্ষে, তাদৃশ দুষ্কর নহে।

 

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।

১৬. ষোড়শ উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ!

চন্দ্ৰশেখর নগরে রত্নদত্ত নামে বণিক বাস করিত। তাহার উন্মাদিনী নামে পরম সুন্দরী কন্যা ছিল। সে বিবাহযোগ্য হইলে, তাহার পিতা, তত্ৰত্য নরপতির নিকটে গিয়া, নিবেদন করিল, মহারাজ! আমার এক সুরূপা কন্যা আছে; যদি আপনকার অভিরুচি হয়, গ্ৰহণ করুন; নতুবা, অন্য ব্যক্তিকে দিব।

রাজা, দুই তিন বয়োবৃদ্ধ প্রধান রাজপুরুষদিগকে, উন্মাদিনীর লক্ষণপরীক্ষার্থে, প্রেরণ করিলেন। তাঁহারা, রাজকীয় আদেশ অনুসারে, রত্নদত্তের আলয়ে উপস্থিত হইলেন; এবং, উন্মাদিনীকে ইন্দ্রের অপ্সরা অপেক্ষাও অধিকতর রূপবতী ও সর্বপ্রকারে সুলক্ষণ দেখিয়া, পরামর্শ করিলেন, এই কন্যা মহিষী হইলে, রাজা, ইহার নিতান্ত বশতাপন্ন হইয়া, এক বারেই রাজ্যচিন্তা পরিত্যাগ করিবেন। অতএব উত্তম কল্প এই, রাজার নিকটে কুরূপা ও কুলক্ষণা বলিয়া পরিচয় দেওয়া যাউক। অনন্তর, তাঁহারা রাজসমীপে পরামর্শানুরূপ সংবাদ দিলে, তিনি, তদীয় বাক্যে বিশ্বাস করিয়া, অস্বীকার করিলেন। তখন রত্নদত্ত, সৈন্যাধ্যক্ষ বলভদ্রবর্মার সহিত, আপনি কন্যার বিবাহ দিল।

এক দিন, রাজা, নগরভ্রমণে নিৰ্গত হইয়া, সেনাপতির বাটীর নিকটে উপস্থিত হইলেন। ঐ সময়ে, উন্মাদিনী, মনোহর বেশভূষা করিয়া, অট্টালিকার উপরিদেশে দণ্ডায়মান ছিল। রাজা, উন্মাদিনীকে নয়নগোচর করিয়া, মোহিত ও উন্মত্তপ্রায় হইয়া, তৎক্ষণাৎ প্ৰত্যাগমন করিলেন। রাজাকে সহসা প্ৰত্যাগত ও বিচেতন্যপ্রায় দেখিয়া, এক প্রিয় পার্শ্বচর জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! কি নিমিত্তে আজ। আপনাকে নিতান্ত চলচিত্ত দেখিতেছি। রাজা কহিলেন, আদ্য বলভদ্রের ভবনে একটি স্ত্রীলোক দেখিলাম; তদীয় লোকাতীত রূপলাবণ্য দর্শনে, আমার মন মোহিত হইয়াছে, ও আমি এইরূপ বিকলচিত্ত হইয়াছি।

পার্শ্বচর কহিল, মহারাজ! যাহাকে নিরীক্ষণ করিয়াছেন, সে রত্নদত্তের কন্যা; তাহার নাম উন্মাদিনী। আপনি অস্বীকার করাতে, সেনাপতি বলভদ্রের সহিত তাহার বিবাহ হইয়াছে। রাজা কহিলেন, আমি যাহাদিগকে ঐ কন্যার রূপ ও লক্ষণ দেখিতে পাঠাইয়াছিলাম, বুঝিলাম, তাহারা প্রতারণা করিয়াছে। অনন্তর, রাজার আহ্বান অনুসারে, রাজপুরুষেরা তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইলে, তিনি তাঁহাদিগকে বলিলেন, দেখ, আজ আমি, নগরভ্রমণে নিৰ্গত হইয়া, রত্নদত্তের কন্যাকে স্বচক্ষে দেখিয়াছি। জন্মাবচ্ছিন্নে, তাহার ন্যায় সুরূপা সুলক্ষণা নারী আমার নয়নগোচর হয় নাই। তবে তোমরা, কি নিমিত্তে, তৎকালে তাহাকে কুরূপা ও কুলক্ষণা বলিয়া, আমায় তাদৃশ স্ত্রীরত্নলাভে বঞ্চিত করিলে।

রাজপুরুষেরা কৃতাঞ্জলি হইয়া নিবেদন করিলেন, মহারাজ! যে আজ্ঞা করিতেছেন, তাহা যথাৰ্থ বটে। কিন্তু তৎকালে আমরা বিবেচনা করিয়াছিলাম, এরূপ সুরূপা কন্যা মহিষী হইলে, মহারাজ, রাজকাৰ্য পরিত্যাগ করিয়া, অহোরাত্র অন্তঃপুরে অবস্থিতি করিবেন। তাহাতে রাজ্যভঙ্গের সম্ভাবনা। এই আশঙ্কায়, আমরা ঐ কন্যাকে, মহারাজের নিকট, কুরূপা ও কুলক্ষণা বলিয়াছিলাম। ইহাতে আমাদের যে অপরাধ হইয়াছে, ক্ষমা করিতে আজ্ঞা হয়। রাজা, তোমরা যাহা কহিলে, তাহা সৰ্বতোভাবে ন্যায়ানুগত বটে; ইহা কহিয়া তাহাদিগকে বিদায় দিলেন। কিন্তু আপনি, নিতান্ত বিচেতন হইয়া, দিন যামিনী, কেবল উন্মাদিনীচিন্তায় নিমগ্ন রহিলেন। রাজার এই অবস্থা কৰ্ণ পরম্পরায় নগর মধ্যে প্রচারিত হইলে, সেনাপতি বলভদ্ৰবৰ্মা, রাজসমীপে উপস্থিত হইয়া, কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিলেন, মহারাজ! বলভদ্র আপনকার দাস, উন্মাদিনী দাসী। দাসীর নিমিত্তে ঈদৃশ ক্লেশস্বীকারের আবশ্যকতা কি। মহারাজের আজ্ঞা হইলেই, সে উপস্থিত হইতে পারে।

রাজা শুনিয়া সাতিশয় ক্রুদ্ধ হইলেন; এবং কহিলেন, আমার কি ধৰ্মজ্ঞান নাই যে, পরস্ত্রীস্পর্শ দ্বারা পাপপঙ্কে নিমগ্ন হইব। শাস্ত্রকারেরা পরস্ত্রীতে মাতৃদৃষ্টি করিতে কহিয়াছেন। বলভদ্ৰ কহিলেন, মহারাজ! শাস্ত্রকারেরা ইহাও নির্দ্দিষ্ট করিয়াছেন, পত্নীর উপর পরিণেতার সর্বতোমুখী প্রভূত আছে। তদনুসারে, আমি আপনাকে উন্মদিনী দান করিতেছি; তাহা হইলে আর মহারাজের পরস্ত্রীস্পর্শদোষের আশঙ্কা থাকিতেছে না। রাজা কহিলেন, যাহাতে সমস্ত সংসারে অপযশ হইবেক, প্ৰাণান্তেও আমি এরূপ কৰ্ম করিব না। যশোধনেরা, পঞ্চীকৃতভূতপঞ্চময় ক্ষণবিনশ্বর শরীরের অনুরোধে, অবিনশ্বর যশঃশরীরের অপক্ষয় করেন না।

সেনাপতি কহিলেন, মহারাজ! আমি তাহাকে, গৃহ হইতে বহিস্কৃত করিয়া, অন্য স্থানে রাখিব; তাহা হইলে সে সাধারণ স্ত্রী হইবেক; তখন আর অপযশের আশঙ্কা কি। রাজা, শুনিয়া, পূর্ব অপেক্ষা অধিকতর ক্রুদ্ধ হইয়া, কহিলেন, যদি তুমি পতিব্ৰতা কামিনীকে কুলটা কর, আমি তোমার গুরুতর দণ্ডবিধান করিব, এবং জন্মাবচ্ছিন্নে আর মুখাবলোকন করিব না। তখন বলভদ্র, ভীত ও নিতান্ত নিরুপায় হইয়া, প্ৰণাম করিয়া বিদায় লইলেন। কিন্তু উন্মাদিনীচিন্তা, কালস্বরূপিনী হইয়া, দশম দিবসে রাজার প্রাণসংহার করিল।

প্রভূভক্ত বলভদ্র, এবংবিধ ধর্মশীল স্বামীর প্রাণবিনাশসংবাদ শ্রবণে, সাতিশয় শোক ও পরিতাপ প্রাপ্ত হইয়া, মনে মনে বিবেচনা করিলেন, এতাদৃশ প্রভূর লোকান্তর গমনের পর, আর জীবনধারণের প্রয়োজন কি। বিবেচনা করিলে, আমার নিমিত্তেই স্বামীর এই অকালমৃত্যু হইল। জানি না, জন্মান্তরে, এই পাপে, আমায় কত যাতনাভোগ করিতে হইবেক। এক্ষণে, প্ৰাণত্যাগীরূপ প্ৰায়শ্চিত্ত করিয়া, আত্মাকে বিশুদ্ধ করি। এইরূপ অধ্যবসায়ারূঢ় হইয়া, তিনি প্ৰেতভূমিতে উপস্থিত হইলেন, এবং, চিতা প্রস্তুত করিতে আদেশ দিয়া, সূর্যদেবের অভিমুখে দণ্ডায়মান হইয়া, প্রার্থনা করিতে লাগিলেন, ভগবান ভাস্কর! আমি, কৃতাঞ্জলি হইয়া, একাগ্ৰচিক্তে প্রার্থনা করিতেছি, যেন জন্মে জন্মে এইরূপ ধর্মপরায়ণ প্ৰভূ পাই।

এই বলিয়া, বলভদ্ৰ প্ৰজ্বলিত চিতায় আরোহণ করিলে, তাহার পত্নী উন্মাদিনী মনে মনে বিবেচনা করিল, আমার আর জীবনধারণের প্রয়োজন কি; বরং সহগমনপথ অবলম্বন করিলে, পরকালে সদগতি পাইব। ধর্মশাস্ত্রপ্রবর্তকেরা কহিয়াছেন, সহগমন স্ত্রীলোকের পরম ধর্ম। নারী, চিরকাল দুশ্চারিণী হইলেও, সহগমনবলে, স্বামীর সহিত স্বৰ্গলোকে, অনন্ত কাল, সুখসম্ভোগ করে; এবং, পতি অতি দুরাচার ও পাপাত্মা হইলেও, সহগমনপ্রভাবে, নারী তাহারও উদ্ধারকারিণী হয়। এই ভাবিয়া, সহগামিনী হইয়া, উন্মাদিনী প্ৰাণত্যাগ করিল।

ইহা কহিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ। এই তিন জনের মধ্যে, কোন ব্যক্তির ভদ্রতা অধিক। বিক্ৰমাদিত্য কহিলেন, রাজার। বেতাল কহিল, কি নিমিত্তে। তিনি কহিলেন, রাজা উন্মাদিনীর নিমিত্তে প্ৰাণত্যাগ করিলেন, তথাপি, অধর্ম ও আপযশের ভয়ে, পরস্ত্রীস্পর্শে প্রবৃত্ত হইলেন না। আর, স্বামীর নিমিত্ত সেবকের প্রাণত্যাগ করা উচিত কর্ম। স্ত্রীলোকেরও স্বামীর সহগামিনী হওয়া প্ৰধান ধর্ম। অতএব, রাজার ভদ্রতাই, আমার বিবেচনায়, সর্বাপেক্ষা অধিক।

 

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।

১৭. সপ্তদশ উপাখ্যান

 

বেতাল কহিল, মহারাজ!

হেমকূট নগরে, বিষ্ণুশৰ্মা নামে, পরম ধাৰ্মিক ব্ৰাহ্মণ ছিলেন। তাঁহার গুণাকর নামে পুত্র ছিল। ঐ পুত্র, বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া, দূত্যক্রীড়ায় সাতিশয় আসক্ত হইল; এবং, ক্ৰমে ক্রমে, পিতার সর্বস্ব দুরোদরমুখে আহুতি দিয়া, পরিশেষে, অর্থের নিমিত্ত, তস্করবৃত্তি অবলম্বন করিল। তখন বিষ্ণুশৰ্মা তাহাকে গৃহ হইতে বহিস্কৃত করিয়া দিলেন।

গুণাকর, নিতান্ত নিরুপায় হইয়া, যথেচ্ছ ভ্ৰমণ করিতে করিতে, এক নগরের প্রান্তভাগে উপস্থিত হইল, এবং দেখিল, এক সন্ন্যাসী, শ্মশানে উপবেশন করিয়া, যোগাভ্যাস করিতেছেন। পরে সে, যোগীর নিকটে গিয়া, সাষ্টাঙ্গ প্ৰণিপাতপূর্বক, সমীপদেশে উপবিষ্ট হইল। যোগী, গুণাকরের প্রতি দৃষ্টিপাত দ্বারা, তাহাকে ক্ষুধার্ত বোধ করিয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কিছু ভোজন করিবে। সে কহিল, মহাশয়! আপনি কৃপা করিয়া প্রসাদ দিলে, অবশ্য ভোজন করিব। তখন তিনি, অন্নব্যঞ্জনপূর্ণ এক নরকপাল তাহার সম্মুখে রাখিয়া, ভোজন করিতে বলিলেন। সে কহিল, মহাশয়। এ অন্ন, এ ব্যঞ্জন ভোজন করিতে আমার প্রবৃত্তি হইতেছে না।

তখন যোগী, যোগাসনে আসীন হইয়া, নয়নদ্বয় মুদ্রিত করিবামাত্র, এক যক্ষকন্যা, অঞ্জলিবন্ধপূর্বক, তাঁহার সম্মুখবর্তিনী হইয়া, নিবেদন করিল, মহাশয়! দাসী উপস্থিত; কি আজ্ঞা হয়। যোগী কহিলেন, এই ব্ৰাহ্মণ, ক্ষুধার্ত হইয়া, আমার আশ্রমে আসিয়াছেন; ইহার যথোচিত অতিথিসৎকার কর। যোগী আজ্ঞা করিবামাত্র, যক্ষকন্যার মায়াবলে, নিমিষমধ্যে, পরম রমণীয় সুসজ্জিত হর্ম্য আবির্ভূত হইল। সে ব্ৰাহ্মণকে, তথায় লইয়া গিয়া, সুরস অন্ন, ব্যঞ্জন, মৎস্য, মাংস, দধি, দুগ্ধ, মিষ্টান্ন প্রভৃতি দ্বারা ইচ্ছানুরূপ ভোজন করাইয়া, মণিময় পল্যাঙ্কে শয়ন করাইল; পরে, রজনী উপস্থিত হইলে, স্বয়ং মনোহর বেশভূষার সমাধান করিয়া, পল্যাঙ্কের এক দেশে উপবেশনপূর্বক, তাহার চরণসেবা করিতে লাগিল। গুণাকরের পরম সুখে রাজনীযাপন হইল।

প্রভাতে নিদ্ৰাভঙ্গ হইলে, যক্ষকন্যা ও তৎকৃত যাবতীয় অদ্ভুত ব্যাপারের চিহ্নমাত্র দেখিতে না পাইয়া, গুণাকর, নিরতিশয় দুঃখিত মনে, সন্ন্যাসীর নিকটে গিয়া, নিবেদন করিল, মহাশয়ের প্রসাদে, কল্য রাজভোগে রজনীযাপন করিয়াছি। কিন্তু, নিশাবসানে, সেই কামিনী প্ৰস্থান করিয়াছে, এবং তৎকৃত সেই সমস্ত হর্ম্যাদিও লয় পাইয়াছে। যোগী কহিলেন, যক্ষকন্যা যোগবিদ্যার প্রভাবে আসিয়াছিল। যে ব্যক্তি যোগবিদ্যায় সিদ্ধ হয়, তাহার নিকটে চিরকাল অবস্থিতি করে। গুণাকর কৃতাঞ্জলি হইয়া কহিল, মহাশয়। যদি কৃপা করিয়া উপদেশ দেন, আমিও সেই বিদ্যার সাধনা করি। যোগী, তদীয় বিনয়ের বশীভূত হইয়া, এক মন্ত্রের উপদেশ দিয়া কহিলেন, তুমি চত্বারিংশৎ দিবস, অর্ধারাত্র সময়ে, জলে আকণ্ঠ মগ্ন হইয়া, একাগ্র চিত্তে, এই মন্ত্রের জপ কর।

গুণাকর, সন্ন্যাসীর আদেশানুরূপ জপ করিয়া, তাহার নিকটে আসিয়া কহিল, মহাশয়। আপনকার আদেশ অনুসারে, যথানিয়মে, চল্লিশ দিন জপ করিয়াছি; এক্ষণে কি আজ্ঞা হয়। যোগী কহিলেন, আর চল্লিশ দিন, জ্বলন্ত অনলে প্রবেশপূর্বক, জপ কর, তাহা হইলেই তুমি কৃতকাৰ্য হইবে। তখন সে কহিল, মহাশয়! বহু দিবস হইল, গৃহপরিত্যাগ করিয়া আসিয়াছি। পিতা মাতা প্রভৃতিকে দেখিবার নিমিত্ত, চিত্ত অতিশয় চঞ্চল হইয়াছে। অতএব, অগ্ৰে একবার পিতামাতার চরণদর্শন করিয়া আসি; পশ্চাৎ, আপনকার আদেশানুরূপ মন্ত্রসাধন করিব। এই বলিয়া, সন্ন্যাসীর নিকট বিদায় লইয়া, গুণাকর আপনি অ্যালয়ে প্ৰস্থান করিল।

গৃহে উপস্থিত হইবামাত্র, তাহার পিতা মাতা, বহুকালের পর পুত্রকে প্রত্যাগত দেখিয়া, অত্যন্ত রোদন করিতে লাগিলেন, এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, বৎস! এতদিন তুমি কোথায় ছিলে; আমরা তোমার অদর্শনে মৃতপ্রায় হইয়া আছি। গুণাকর কহিল, হে তাত! হে মাতঃ! আমি, যদৃচ্ছাক্রমে নানা স্থানে ভ্ৰমণ করিয়া, পরিশেষে, সৌভাগ্যক্রমে, এক পরম দয়ালু সন্ন্যাসীর দর্শন পাইয়াছি, এবং তাঁহার শরণাপন্ন হইয়াছি। এক্ষণে, তদীয় উপদেশ অনুসারে, মন্ত্রসাধন করিতেছি। তোমাদিগকে বহু কাল না দেখিয়া, অতিশয় উৎকণ্ঠিত ও চলচিত্ত হইয়াছিলাম; তাহাতেই এক বার, কিয়ৎ ক্ষণের নিমিত্ত, দর্শন করিতে আসিয়াছি। সম্প্রতি, জন্মের মত বিদায় লইয়া, যোগসাধনাৰ্থে প্ৰস্থান করিব।

গুণাকর এই বলিয়া প্ৰস্থানের উদ্যম করিলে, তাহার জননী, বাষ্পাকুল লোচনে, শোকাকুল বচনে কহিতে লাগিলেন, বৎস! এ তোমার যোগাভ্যাসের সময় নয়। গৃহস্থাশ্রমে থাকিয়া, গৃহস্থ্যধর্ম প্রতিপালন কর; তাহা হইলেই, তুমি যোগাভ্যাসের সম্পূর্ণ ফল পাইবে। গৃহস্থাশ্রম সকল আশ্রমের মূল, এবং সকল আশ্রম অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। বিশেষতঃ, পরম গুরু পিতামাতার শুশ্রূষা করাই পুত্রের প্রধান ধর্ম। অতএব, যাবৎ আমরা জীবিত আছি, তাবৎ তোমার তীর্থযাত্রা বা যোগাভ্যাসের প্রয়োজন নাই। আমাদের শুশ্রূষা কর, তাহাতেই তোমার পরম ধর্মলাভ হইবেক। আর বিবেচনা কর, তুমি আমার একমাত্র পুত্র; মা বলিয়া সম্ভাষণ করিতে দ্বিতীয় ব্যক্তি নাই। অন্ধের যষ্টির ন্যায়, তুমি আমাদের জীবনের একমাত্র অবলম্বন আছে। আমরা, তোমায় বিদায় দিয়া, কোনও ক্রমে, প্ৰাণধারণ করিতে পারিব না। যদি নিতান্তই যোগাভ্যাসের বাসনা হইয়া থাকে, অন্ততঃ, আমাদের মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা কর; পরে ইচ্ছানুরূপ ধর্মোপার্জন করিবে।

গুণাকর শুনিয়া ঈষৎ হাস্য করিল; এবং কহিল, এই মায়াময় সংসার অতি অকিঞ্চিৎকর। ইহাতে লিপ্ত থাকিলে, কেবল জন্মমৃত্যুপরম্পরারূপ দুর্ভেদ্য শৃঙ্খলে বদ্ধ থাকিতে হয়। প্ৰত্যক্ষ পরিদৃশ্যমান পদার্থমাত্ৰই মায়াপ্রপঞ্চ, বাস্তবিক কিছুই নহে। কে কাহার পিতা, কে কাহার মাতা, কে কাহার পুত্র। সকলই ভ্ৰান্তিমূলক। অতএব, আর আমি বৃথা মায়ায় মুগ্ধ হইব না; এবং, শ্ৰেয়ঃসাধন বোধ করিয়া, যে পথ অবলম্বন করিয়াছি, তাহা ছাড়িতে পারিব না। এই বলিয়া, পিতামাতার চরণে সাষ্টাঙ্গ প্ৰণিপাত করিয়া প্ৰস্থান করিল; এবং, সন্ন্যাসীর আশ্রমে উপস্থিত হইয়া, অগ্নিপ্রবেশপূর্বক, মন্ত্রসাধনে যত্ন করিতে লাগিল; কিন্তু কৃতকার্য হইতে পারিল না।

ইহা কহিয়া, বেতাল বিক্ৰমাদিত্যকে জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! কি কারণে, ব্ৰাহ্মণ সাধনা করিয়া সিদ্ধ হইতে পারিল না, বল। বিক্রমাদিত্য কহিলেন, একাগ্ৰচিত্ত না হইলে, মন্ত্র সিদ্ধ হয় না। ব্ৰাহ্মণের মনে একান্ত নিষ্ঠ ছিল না; সেই বৈগুণ্যবশতঃ, তাহার সাধনা বিফল হইল। ইহা শুনিয়া বেতাল কহিল, যে সাধক, মন্ত্র সিদ্ধ করিবার উদ্দেশে, এতাদৃশ ক্লেশ স্বীকার করিলেক, সে একাগ্ৰচিত্ত হয় নাই, তাহার প্রমাণ কি। বিক্ৰমাদিত্য কহিলেন, সে, একাগ্ৰচিত্ত হইলে, পিতামাতার নিমিত্ত চলচিত্ত হইত না; এবং, মধ্যে যোগে ভঙ্গ দিয়া, তাহাদের দর্শনে যাইত না। ফলতঃ, সকলই অদৃষ্টমূলক; নতুবা, যোগাভ্যাস দ্বারা, সর্বাংশে নির্মম ও জ্ঞানসম্পন্ন হইয়াও, কি নিমিত্তে সিদ্ধপ্রায় সাধনফলে বঞ্চিত হইল, বল।

 

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।

১৮. অষ্টাদশ উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ!

কুবলয়পুরে, ধনপতি নামে, এক সঙ্গতিপন্ন বণিক ছিলেন। তিনি, ধনবতীনাম্নী নিজ কন্যার, গৌরীকালে, গৌরীদত্ত নামক ধনাঢ্য বণিকের সহিত বিবাহ দিলেন। কিয়ৎ কাল পরে, ধন্যবতীর এক কন্যা জন্মিল। গৌরীদত্ত কন্যার নাম মোহিনী রাখিলেন। কালক্রমে, তিনি লোকান্তর প্রাপ্ত হইলে, তদীয় জ্ঞাতিবর্গ, ধনবতীকে অসহায়িনী দেখিয়া, তাহার সর্বস্ব অপহরণ করিল। সে, নিতান্ত দুরবস্থাগ্রস্ত হইয়া, কন্যা লইয়া, এক তমিস্রা রজনীতে, পিত্ৰালয়ে প্রস্থান করিল।

কিয়ৎ দূর গমন করিয়া, পথ ভুলিয়া, উহার এক শ্মশানে উপস্থিত হইল। তথায় এক চোর, রাজদণ্ড অনুসারে, তিন দিন, শূলে আরোহিত ছিল; বিধিবিপাকে, সে পর্যন্ত, তাহার প্রাণপ্ৰয়াণ হয় নাই। দৈবযোগে, ধনবতীর দক্ষিণ কর চোরের চরণে লগ্ন হইলে, সে সাতিশয় ব্যথিত হইয়া কহিল, তুমি কে, কি নিমিতে, এমন দুঃখের সময়ে, আমায় মর্মান্তিক যাতনা দিলে। ধনবতী কহিল, জ্ঞানপূর্বক তোমাকে যাতনা দি নাই। যাহা হউক, আমার অপরাধ ক্ষমা কর। অনন্তর, আত্মপরিচয় দিয়া, সে চোরকে জিজ্ঞাসা করিল, তুমি কে, কি নিমিত্তে শ্মশানে আছ, ও কিরূপ দুঃখভোগ করিতেছি, বল।

চোর কহিল, আমি বণিকজাতি, চৌর্যাপরাধে শূলে আরোহিত হইয়াছি; অন্য তৃতীয় দিবস, তথাপি প্ৰাণ নিৰ্গত হইতেছে না; তাহাতেই যার পর নাই যাতনাভোগ করিতেছি। জন্মকালে, জ্যোতির্বিদেরা, গণনা দ্বারা, স্থির করিয়াছিলেন, অবিবাহিত অবস্থায় আমার মৃত্যু হইবেক না। যাবৎ বিবাহ না হইতেছে, তাবৎ আমায়, এই অবস্থায়, দুঃসহ যাতনাভোগ করিতে হইবেক। যদি তুমি কৃপা করিয়া কন্যাদান কর, তবেই আমি এ অসহ্য যাতনা হইতে পরিত্রাণ পাই। আমার চিরসঞ্চিত সুবৰ্ণরাশি আছে; যদি আমার প্রার্থনা পূৰ্ণ কর, সমস্ত তোমায় দি।

ধনবতী, অৰ্থলোভে বিমূঢ় হইয়া, মনে মনে, মলিম্লুচের প্রার্থনায় সম্মতপ্রায় হইল; এবং কহিল, তুমি যে প্রস্তাব করিলে, তাহাতে আমার আপত্তি নাই; কিন্তু, আমার দৌহিত্রমুখদর্শনের ঐকান্তিক অভিলাষ আছে; তোমায় কন্যাদান করিলে, আমার সে অভিলাষ পূর্ণ হয় না। এ কথা শুনিয়া, চোর কহিল, তুমি এখন, কন্যাদান করিয়া, আমায় যাতনা হইতে মুক্ত কর। আমি অনুমতি দিতেছি, তোমার কন্যার বয়ঃপ্রাপ্তি হইলে, কোনও ব্রাহ্মণতনয়কে ধনদান দ্বারা সম্মত করিয়া, তাহা দ্বারা ক্ষেত্ৰজ পুত্ৰ উৎপন্ন করিয়া লইবে; তাহা হইলে, তোমারও বাসনা পূৰ্ণ হইল; আমিও দুঃসহ যাতনা হইতে পরিত্ৰাণ পাইলাম।

ধনবতী কন্যাসম্প্রদান করিল। তখন চোর কহিল, ঐ পুরোবর্তী গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে আমার গৃহ। গৃহের পূর্ব ভাগে, কুপের নিকট, এক বটবৃক্ষ দেখিতে পাইবে; তাহার মূলে আমার সমস্ত সম্পত্তি নিহিত আছে; যাইয়া গ্রহণ কর। ইহা কহিবামাত্র, চোরের প্রাণবিয়োগ হইল; ধনবতীও, চৌরনির্দ্দিষ্ট ন্যগ্ৰোধবৃক্ষের মূলখননপূর্বক, সমস্ত স্বর্ণমুদ্রা হস্তগত করিয়া, পিত্ৰালয়ে প্রস্থান করিল। পরে সে, পিতাকে আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত অবগত করাইয়া, তাহার হস্তে সম্পত্তিসমর্পণপূর্বক, তদীয় আবাসে অবস্থিতি করিতে লাগিল।

কালক্রমে, মোহিনী যৌবনবতী হইল। সে, এক দিন, স্বীয় সহচরীর সহিত, গবাক্ষ দিয়া রাথ্যানিরীক্ষণ করিতেছে; এমন সময়ে, দৈবযোগে, এক পরমসুন্দর বিংশতিবর্ষীয় ব্ৰাহ্মণতনয় তথায় উপস্থিত হইল। তাহাকে উন্নয়নগোচরণ করিয়া, মোহিনীর মন মোহিত হইল। তখন, সে আপন সহচরীকে কহিল, তুমি এই ব্ৰাহ্মণকুমারকে আমার মার নিকটে লইয়া যাও। সখী ব্ৰাহ্মণতনয়কে তাহার জননীর নিকট উপস্থিত করিলে, সে চৌরবৃত্তান্ত স্মরণ করিয়া, তাহাকে প্রার্থনারূপ অৰ্থ দিয়া, মোহিনীর পুত্ৰোৎপাদনাৰ্থে নিযুক্ত করিল।

মোহিনী গর্ভবতী ও যথাকালে পুত্রবতী হইল। সূতিকাষষ্ঠীর রজনীতে, সে স্বপ্নে দেখিল, দুই হস্ত, পঞ্চ মস্তক, প্রতি মস্তকে তিন তিন চক্ষুঃ ও এক এক অর্ধচন্দ্ৰ, অতি দীর্ঘ জটাভার পৃষ্ঠদেশে লম্বমান, দক্ষিণ হস্তে ত্রিশূল, বাম হস্তে নরকপাল, ব্যাঘ্রচর্ম পরিধান, ভুজঙ্গের মেখলা, উজ্জ্বল রজতগিরির ন্যায় কলেবর, অতিশুভ্ৰ নাগযজ্ঞোপবীত, সৰ্বাঙ্গ ভস্মভূষিত; এবংবিধ আকার ও বেশ বিশিষ্ট বৃষভারূঢ় এক পুরুষ, তাহার সম্মুখে আসিয়া, কহিতেছেন, বৎসে মোহিনী! তোমার পুত্র জন্মিয়াছে, এজন্য আমি অতিশয় আহ্লাদিত হইয়াছি। এই বালক ক্ষণজন্ম। তুমি, আমার আজ্ঞা অনুসারে, ঐ শিশুকে, সহস্ৰ সুবৰ্ণ সহিত, পেটকের মধ্যগত করিয়া, কল্য অর্ধারাত্র সময়ে, রাজদ্বারে রাখিয়া আসিবে। রাজা তাহার, পুত্রনির্বিশেষে, প্রতিপালন করিবেন। রাজার স্বৰ্গারোহণের পর, তোমার পুত্র, তদীয় সিংহাসনে অধিরূঢ় হইয়া, ক্ৰমে ক্ৰমে, নিজ প্ৰতাপে ও নীতিবিদ্যাপ্রভাবে, সসাগর সদ্বীপা পৃথিবীর অদ্বিতীয় অধিপতি হইবেক।

মোহিনীর নিদ্রাভঙ্গ হইল। সে সমস্ত স্বপ্নবৃত্তান্ত স্ত্রীয় জননীর গোচর করিল। ধনবতী শুনিয়া নিরতিশয় আনন্দিত হইল; এবং, পর দিন নিশীথসময়ে, ঐ শিশুকে, সহস্ৰ স্বর্ণমুদ্রা সহিত, পেটকের মধ্যে স্থাপিত করিয়া, রাজদ্বারে রাখিয়া আসিল। সেই সময়ে, রাজাও স্বপ্নে দেখিতেছেন, পূর্বোক্তপ্রকার পুরুষ, তাহার সম্মুখবর্তী হইয়া, কহিতেছেন, মহারাজ! গাত্ৰোত্থান কর; এক পেটকমধ্যশায়ী চক্ৰবর্তিলক্ষণাক্রান্ত সন্তান তোমার দ্বারদেশে উপনীত। অবিলম্বে উহারে আনিয়া, পুত্রনির্বিশেষে, প্ৰতিপালন কর। উত্তর কালে, সেই তোমার উত্তরাধিকারী হইবেক।

রাজার নিদ্রাভঙ্গ হইল। তখন তিনি, রাজমহিষীকে জাগরিত করিয়া, স্বপ্নবৃত্তান্ত শুনাইলেন। অনন্তর, উভয়ে, দ্বারদেশে গিয়া পেটক পতিত দেখিয়া, যৎপরোনাস্তি আহ্লাদিত হইলেন, এবং তৎক্ষণাৎ পেটকের মুখ উদ্ঘাটিত করিয়া দেখিলেন, বালকের রূপে পেটক আলোকপূৰ্ণ হইয়া আছে। রাজ্ঞী, সেই শিশুকে ক্ৰোড়ে লইয়া, অগ্ৰগামিনী হইলেন; রাজা, স্বর্ণমুদ্রাগ্রহণপূর্বক, তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন।

প্রভাত হইবামাত্র, রাজা, সামুদ্রিকবেত্তা পণ্ডিতগণকে আনাইয়া, দেবপ্রসাদলব্ধ বালকের লক্ষণপরীক্ষার্থে, আজ্ঞাপ্ৰদান করিলেন। তাঁহারা সেই শিশুকে দৃষ্টিগোচর করিয়া কহিলেন, মহারাজ! আপাততঃ তিন স্পষ্ট সুলক্ষণ দৃষ্ট হইতেছে; দীর্ঘ আকার, উন্নত ললাট, বিস্তৃত বক্ষঃস্থল। অনন্তর, তাঁহারা সবিশেষ পরীক্ষা করিয়া কহিলেন; সামুদ্রিক শাস্ত্রে পুরুষের দ্বাত্রিংশৎ শুভ লক্ষণ নির্দ্দিষ্ট আছে; মহারাজ!

সেই সমুদয় এই একাধারে লক্ষিত হইতেছে। এই বালক সমস্ত পৃথিবীর সম্রাট হইবেন, সন্দেহ নাই।

রাজা পরম পরিতোষ প্রাপ্ত হইলেন, এবং, পারিতোষিকপ্ৰদানপূর্বক, ব্রাহ্মণদিগকে বিদায় করিয়া, দীন, দরিদ্র, অনাথ প্রভৃতিকে প্রার্থনাধিক অর্থদান করিলেন। ষষ্ঠ মাসে অন্নপ্রাশন দিয়া, তিনি বালকের নাম হরদত্ত রাখিলেন। বালক, অল্পকালমধ্যে, চতুৰ্দশ বিদ্যায় পারদর্শী হইলেন; এবং, রাজার লোকান্তরপ্রাপ্তি হইলে, তদীয় সিংহাসনে অধিরোহণ করিয়া, ক্ৰমে ক্রমে, সমস্ত ভূমণ্ডলে একাধিপত্য স্থাপন করিলেন। কিয়ৎ কাল পরে, হরদত্ত, তীর্থযাত্রায় নিৰ্গত হইয়া, প্রথমতঃ, পিতৃকৃত্যসম্পাদনাৰ্থে, গয়াধামে উপস্থিত হইলেন। ফল্গু তীরে যথাবিধি শ্ৰাদ্ধ করিয়া, রাজা পিতৃপিণ্ডপ্রদানে উদ্যত হইলে, নদীর মধ্য হইতে, পিণ্ডগ্রহণার্থে, তিন জনের তিন দক্ষিণ হস্ত যুগপৎ নির্গত হইল; প্রথম ক্ষেত্রিক চোরের, দ্বিতীয় বীজী ব্ৰাহ্মণের, তৃতীয় প্রতিপালক রাজার।

ইহা কহিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! ইহাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি, শাস্ত্র ও যুক্তি অনুসারে, হরদত্ত-দত্ত পিণ্ডের অধিকারী হইতে পারে। রাজা বলিলেন, চোর। বেতাল কহিল, অন্যেরা কি অপরাধ করিয়াছে। রাজা বলিলেন, ব্ৰাহ্মণ, অর্থ লইয়া বীজবিক্রয় করিয়াছেন; রাজাও, সহস্ৰ সুবৰ্ণ লইয়া, প্রতিপালন করিয়াছেন; এজন্য তাঁহারা পিণ্ডগ্রহণে অধিকারী হইতে পারেন না।

 

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।

 ১৯. উনবিংশ উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ!

চিত্ৰকুট নগরে রূপদত্ত নামে রাজা ছিলেন। তিনি, এক দিন, একাকী, অশ্বে আরোহণ করিয়া, মৃগয়ায় গমন করিলেন। মৃগের অন্বেষণে, বনে বনে অনেক ভ্ৰমণ করিয়া, পরিশেষে, তিনি এক ঋষির আশ্রমে উপস্থিত হইলেন। তথায় এক অতি মনোহর সরোবর ছিল। তিনি তাহার তীরে গিয়া দেখিলেন, কমল সকল প্রফুল্প হইয়া আছে; মধুকরেরা, মধুপানে মত্ত হইয়া, গুনগুন রবে গান করিতেছে; হংস, সারস, চক্রবাক প্রভৃতি জলবিহঙ্গগণ তীরে ও নীরে বিহার করিতেছে; চারিদিকে, কিসলয়ে ও কুসুমে সুশোভিত নানাবিধ পাদপসমূহ বসন্তলক্ষ্মীর সৌভাগ্যবিস্তার করিতেছে; সর্বতঃ, শীতল সুগন্ধ গন্ধবহের মন্দ মন্দ সঞ্চার হইতেছে। রাজা নিতান্ত পরিশ্রান্ত ছিলেন; বৃক্ষমূলে অশ্ববন্ধন করিয়া, তথায় উপবেশনপূর্বক, শ্ৰান্তি দূর করিতে লাগিলেন।

কিয়ৎ ক্ষণ পরে, এক ঋষিকন্যা আসিয়া স্নানার্থে সরোবরে অবগাহন করিল। রাজা, দর্শনমাত্র, অতিমাত্র মোহিত ও জ্ঞানরহিত হইলেন। স্নানক্রিয়ার সমাপন করিয়া, ঋষিতনয়া আশ্রমাভিমুখী হইলে, রাজা তাহার সম্মুখবর্তী হইয়া কহিলেন, ঋষিকন্যে! তোমার এ কেমন ধর্ম। আমি, আতপে তাপিত হইয়া, বিশ্রামার্থে তোমার আশ্রমে অতিথি হইলাম, তুমি এমনই আতিথেয়ী, যে সম্ভাষণ দ্বারাও, আমার সংবর্ধনা করিলে না। ঋষিতনয়া শুনিয়া দণ্ডায়মান হইলেন।

এই অবসরে, ঋষিও, বনান্তর হইতে ফল, পুষ্প, কুশ, সমিধ প্রভৃতির আহরণ করিয়া, প্রত্যাবৃত্ত হইলেন। রাজা, দর্শনমাত্র, আত্মপরিচয়প্রদানপূর্বক, সাষ্টাঙ্গ প্ৰণিপাত করিলে, ঋষি অভীষ্টসিদ্ধিৰ্ভবতু বলিয়া আশীৰ্বাদ করিলেন। রাজা, আশীৰ্বাদশ্রবণে, মনে মনে দুষ্ট অভিসন্ধি করিয়া, কৃতাঞ্জলি হইয়া, নিবেদন করিলেন, মহাশয়! আমরা চিরকাল শুনিয়া আসিতেছি, ঋষিবাক্য কস্মিন্ কালেও ব্যর্থ হয় না। আপনি আশীৰ্বাদ করিলেন আমার অভিলাষ পূর্ণ হউক, কিন্তু, আমি তাহার কোনও সম্ভাবনা দেখিতেছি না। ঋষি কহিলেন, আমি বলিতেছি, অবশ্যই তোমার অভিলাষ হইবেক। তখন রাজা অম্নান বদনে বলিলেন, আমি এই কন্যার পাণিগ্রহণের অভিলাষ করিয়াছি।

ঋষি, রাজার দুরভিপ্রায়শ্রবণে, মনে মনে নিরতিশয় কুপিত হইয়াও, স্বীয় আশীৰ্বাদবাক্যের বৈয়র্থ্যপরিহারের নিমিত্ত, রাজাকে কন্যাসম্প্রদান করিলেন। রাজা, নব প্ৰণয়িনীকে সমভিব্যাহারিণী করিয়া, রাজধানী অভিমুখে চলিলেন। পথিমধ্যে রজনী উপস্থিত হইল। রাজা ও রাজপ্রেয়সী, যথাসম্ভব ফলমূল আদি দ্বারা, কথঞ্চিৎ ক্ষুধানিবৃত্তি করিয়া, তরুতলে শয়ন করিলেন।

অর্ধারাত্র সময়ে, এক দুর্দান্ত রাক্ষস আসিয়া, রাজাকে জাগরিত করিয়া, কহিল, আমি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত হইয়া আসিয়াছি, তোমার। ভাৰ্যাকে ভক্ষণ করিব। রাজা কহিলেন, তুমি আমার প্রাণাধিক প্ৰেয়সীর প্রাণহিংসায় বিরত হও। অন্য যাহা চাহিবে, তাহাই দিব। তখন রাক্ষস কহিল, যদি তুমি, প্রশস্ত মনে, স্বহস্তে দ্বাদশবর্ষীয় ব্ৰাহ্মণকুমারের মস্তকচ্ছেদন করিয়া, আমার হস্তে দিতে পার, তাহা হইলে তোমার প্রিয়তমার প্রাণবধে ক্ষান্ত হই। রাজা, প্ৰিয়তমার প্রাণরক্ষার্থে, ব্ৰহ্মহত্যাতেও সম্মত হইলেন; এবং কহিলেন, তুমি সপ্তম দিবসে, আমার রাজধানীতে যাইবে; সেইদিন, আমি তোমার অভিলষিত সম্পন্ন করিব।

এইরূপে রাজাকে ব্ৰহ্মবধ প্ৰতিজ্ঞায় আবদ্ধ করিয়া, রাক্ষস প্ৰস্থান করিল। রাজাও, প্রভাত হইবামাত্র, প্ৰেয়সী সমভিব্যাহারে, রাজধানীতে গিয়া, প্রধানমন্ত্রীর সমক্ষে রাক্ষস বৃত্তান্তের বর্ণনা করিলেন। মন্ত্রী কহিলেন, মহারাজ। আপনি, ও জন্যে উৎকণ্ঠিত হইবেন না; আমি অনায়াসে উহা সম্পন্ন করিয়া দিব। রাজা, মন্ত্রিবাক্যে নির্ভর করিয়া, নিশ্চিন্ত হইয়া, নবপ্রণয়িনীর সহিত, পরম সুখে কালব্যাপন করিতে লাগিলেন।

মন্ত্রী, এক পুরুষপ্রমাণ কাঞ্চনময়ী প্রতিমা নির্মিত করাইয়া, মহামূল্য অলঙ্কারে মণ্ডিত করিয়া, নগরের চতুষ্পপথে স্থাপিত করিলেন, এবং প্রচার করিয়া দিলেন, যে ব্ৰাহ্মণ, বলিদানার্থে, স্বীয় দ্বাদশবৰ্ষীয় পুত্র দিবেন, তিনি এই প্রতিমা পাইবেন। এক অতি দরিদ্র ব্ৰাহ্মণের দ্বাদশবৰ্ষীয় পুত্র ছিল। তিনি, ঘোষণার বিষয় অবগত হইয়া, ব্ৰাহ্মণীকে বলিলেন, দেখ, নির্ধন ব্যক্তির সংসারাশ্রমে বাস করা বিড়ম্বনামাত্র। ধনই সকল ধর্মের ও সকল সুখের মূল। আমি জন্মদারিদ্র; এ পর্যন্ত, সাংসারিক কোনও সুখের মুখ দেখিতে পাইলাম না। এক্ষণে, ধনাগমের এই এক সহজ উপায় উপস্থিত। যদি তুমি মত কর, পুত্ৰ দিয়া স্বর্ণময়ী প্রতিমা লইয়া আসি; তাহা হইলে, যত দিন বাঁচিব, পরম সুখে কালযাপন করিতে পারিব।

ব্ৰাহ্মণী, সন্মত হইলেন। ব্ৰাহ্মণ, পুত্ৰ দিয়া, প্রতিমা লইয়া, তদ্বিক্রয় দ্বারা ধনসংগ্ৰহ করিলেন। সপ্তম দিনে, প্রত্যুষ সময়ে, রাক্ষস রাজার সহিত সাক্ষাৎ করিবামাত্র, মন্ত্রী, দ্বাদশবৰ্ষীয় ব্রাহ্মণকুমার ও তীক্ষ্নধার খড়গ আনিয়া, রাজার সম্মুখে রাখিলেন। অনন্তর, রাজা শিরশেছদনাৰ্থে খড়্গ উত্তোলিত করিলে, ব্ৰাহ্মণকুমার, অবনত বদনে, ঈষৎ হাস্য করিল। রাজা, অম্লান বদনে, তাহার মস্তকচ্ছেদন করিলেন। তদীয় ছিন্ন মস্তক রাক্ষসের হস্তে অপিত হইল।

ইহা কহিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! মৃত্যুসময়ে সকলে রোদন করিয়া থাকে; বালক হাস্য করিল কেন, বল। রাজা কহিলেন, বাল্যকালে পিতামাতা প্রতিপালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করেন; তৎপরে, কোনও বিপদ ঘটিলে, রাজা রক্ষা করিয়া থাকেন; কিন্তু, আমার ভাগ্যদোষে, সকলই বিপরীত হইল। পিতা মাতা অর্থলোভে বিক্রয় করিলেন; প্রাণভয়ে যে রাজার শরণাগত হইব, তিনিই স্বয়ং মস্তকচ্ছেদনে উদ্যত। মনে মনে এই আলোচনা করিয়া, সে হাস্য করিয়াছিল।

 

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।

২০. বিংশ উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ!

বিশালপুর নগরে, অর্থদত্ত নামে, ধনাঢ্য বণিক ছিলেন। তিনি, কমলপুরবাসী মদনদাস বণিকের সহিত, আপন কন্যা অনঙ্গমঞ্জরীর বিবাহ দিয়াছিলেন। কিছু দিন পরে, মদনদাস, ভাৰ্যাকে তদীয় পিত্ৰালয়ে রাখিয়া, বাণিজ্যার্থে দেশান্তরে প্ৰস্থান করিল।

এক দিন, অনঙ্গমঞ্জরী, গবাক্ষ দ্বারা, রাজপথনিরীক্ষণ করিতেছে; এমন সময়ে, কমলাকর নামে, সুকুমার ব্রাহ্মণকুমার তথায় উপস্থিত হইল। উভয়ের নয়নে নয়নে আলিঙ্গন হইলে, পরস্পর পরস্পরের রূপলাবণ্যদর্শনে মোহিত হইল। ব্ৰাহ্মণকুমার, নিকাম ব্যাকুল হইয়া, গৃহগমনপূর্বক, প্রিয় বয়স্যের নিকট স্বীয় বিরহবেদনার নির্দেশ করিয়া, বিচেতন ও শয্যাগত হইল। তাহার সখা, উশীরানুলেপন, চন্দনবারিসেচন, সরসকমলদলশয্যা, জলার্দ্রতালবৃন্তসঞ্চালন প্রভৃতি দ্বারা, শুশ্রূষা করিতে লাগিল।

এ দিকে, অনঙ্গমঞ্জরীও, অনঙ্গশরপ্ৰহারে জর্জরিতাঙ্গী হইয়া, ধরাশয্যা অবলম্বন করিলে, তাহার সখী, সবিশেষ জিজ্ঞাসা দ্বারা, সমস্ত অবগত হইয়া, প্ৰবোধদানচ্ছলে, অনেক ভর্ৎসনা করিল। তখন সে কহিল, সখি! আমি নিতান্ত অবোধ নহি; কিন্তু মন আমার প্রবোধ মানিতেছে না। নির্দয় কন্দৰ্পের নিরন্তর শরপ্ৰহারে আমি জর্জরিত হইয়াছি। আর যাতনা সহ্য হয় না। যদি সেই চিত্তচোরকে ধরিয়া দিতে পার, তবেই প্ৰাণধারণ করিব; নতুবা, নিঃসন্দেহ, আত্মঘাতিনী হইব।

ইহা কহিয়া, অনঙ্গমঞ্জরী, অশ্রুপূর্ণ নয়নে, অবিশ্রান্ত দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে লাগিল। তাহার সহচরী, কালবিলম্ব অনুচিত বিবেচনা করিয়া, কমলাকরের আলয়ে গমনপূর্বক, তাহাকেও স্বীয় সহচরীর তুল্যাবস্থ দেখিয়া, মনে মনে কহিতে লাগিল, দুরাত্মা কন্দৰ্পের কিছুই অসাধ্য নাই; কি স্ত্রী, কি পুরুষ, সকলকেই, সমান রূপে, স্বীয় কুসুমময় শরাসনের বশবর্তী করিয়া রাখিয়াছে। অনন্তর, সে কমলাকরের নিকটে বলিল, অর্থদত্ত শেঠের কন্যা অনঙ্গমঞ্জরী প্রার্থনা করিতেছে, তুমি তাহারে প্ৰাণদান কর। কমলাকর, শ্রবণমাত্র অতি মাত্র উল্লাসিত হইয়া, গাত্রোত্থান করিল, এবং কহিল, আপাততঃ তুমি, এই অমৃতবৰ্ষী মনোহর বাক্য দ্বারা, আমায় প্ৰাণদান করিলে।

তৎপরে সহচরী, কমলাকরকে সমভিব্যাহারে লইয়া, অনঙ্গমঞ্জরীর বাসগৃহে উপস্থিত হইয়া দেখিল, সে প্ৰাণত্যাগ করিয়াছে। অমনি কমলাকর, হা প্রেয়সি! বলিয়া, দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্বক, ভূতলে পতিত ও তৎক্ষণাৎ পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইল।

অনঙ্গমঞ্জরীর গৃহজন, আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত অবগত হইয়া, উভয়কে শ্মশানে লইয়া, একচিতায় অগ্নিদান করিল। দৈবযোগে, অর্থদত্তের জামাতা মদনদাসও, সেই সময়ে, শ্বশুরালয়ে উপস্থিত হইল; এবং, নিজ ভার্যা অনঙ্গমঞ্জরীর মৃত্যুবৃত্তান্ত শুনিয়া, হাহাকার করিতে করিতে, উর্ধ্বশ্বাসে শ্মশানে গিয়া, জ্বলন্ত চিতায় ঝম্পপ্রদানপূর্বক, প্রাণত্যাগ করিল।

ইহা কহিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! এই তিনের মধ্যে কোন ব্যক্তি অধিক ইন্দ্ৰিয়দাস। রাজা কহিলেন, মদনদাস। বেতাল কহিল, কেন। রাজা কহিলেন, অনঙ্গমঞ্জরী, পরপুরুষে অনুরাগিণী হইয়া, তাহার বিরহে প্রাণত্যাগ করিল; তাহাতে মদনদাসের অন্তঃকরণে অণুমাত্র বিরাগ জন্মিল না; প্রত্যুত, তদীয় মৃত্যুশ্রবণে প্রাণধারণে অসমর্থ হইয়া, অগ্নিপ্ৰবেশ করিল।

 

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।

২১. একবিংশ উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ!

জয়স্থল নগরে, বিষ্ণুস্বামী নামে, ধর্মাত্মা ব্ৰাহ্মণ ছিলেন। তাঁহার চারি পুত্র; জ্যেষ্ঠ দ্যূতাসক্ত; মধ্যম লম্পট; তৃতীয় নির্লজ্জ; চতুর্থ নাস্তিক। ব্ৰাহ্মণ, পুত্ৰগণের গৰ্হিত ব্যবহার ও কদাচার দর্শনে সাতিশয় বিরক্ত হইয়া, এক দিন, চারি জনকে একত্র করিয়া এইরূপ ভর্ৎসনা করিতে লাগিলেন;— যে ব্যক্তি দ্যূতক্রীড়ায় আসক্ত হয়, কমলা, ভ্ৰান্তিক্ৰমেও, তার প্রতি কৃপাদৃষ্টি করেন না। ধর্মশাস্ত্ৰে লিখিত আছে, নাসাকর্ণচ্ছেদনপূর্বক, গর্দভে আরোহণ করাইয়া, দ্যূতাসক্ত ব্যক্তিকে দেশ হইতে বহিষ্কৃত করিবেক। দ্যূতাসক্ত ব্যক্তি হিতাহিতবিবেচনারহিত ও ধর্মাধৰ্মজ্ঞানশূন্য হয়। ধর্মানন্দন রাজা যুধিষ্ঠির, দ্যূতাসক্ত হইয়া, সাম্রাজ্য ও ভার্যা পর্যন্ত হারাইয়া, পরিশেষে, দুঃসহ বনবাসক্লেশে কালযাপন করিয়াছিলেন। আর, যে ব্যক্তি লম্পট হয়, সে সুখভ্রমে দুঃখাৰ্ণবে প্রবেশ করে। লম্পটের, ইন্দ্ৰিয়তৃপ্তি উদ্দেশে সর্বস্বান্ত করিয়া, অবশেষে, চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন করিয়া থাকে। লম্পট ব্যক্তির আচার, বিচার, নিয়ম, ধর্ম, সমস্তই নষ্ট হয়। আর, যে ব্যক্তি নির্লজ্জ, তাহাকে ভর্ৎসনা করা বা উপদেশ দেওয়া বৃথা। তাহার লোকনিন্দার ভয় থাকে না, এবং, গহিত কর্ম করিয়াও, লজ্জাবোধ হয় না। এবংবিধ ব্যক্তির যত শীঘ্ৰ মৃত্যু হয়, ততই পৃথিবীর মঙ্গল। আর, যে ব্যক্তি পরকালের ভয় না করে, দেবতা ও গুরুজনে ভক্তিমান ও শ্রদ্ধাবান না হয়, এবং সনাতন বেদাদি শাস্ত্ৰে আস্থাশূন্য হয়, সে অতি পাষণ্ড; তাহার সহিত বাক্যালাপ করিলেও, অধৰ্মগ্ৰস্ত হইতে হয়। লোকে, পুত্রের মঙ্গলপ্রার্থনায়, জপ, তপ, দান, ধ্যান, ব্ৰত, উপবাস আদি করে; কিন্তু আমি, কায়মনোবাক্যে, নিয়ত, তোমাদের মৃত্যুপ্রার্থনা করিয়া থাকি।

পিতার এইপ্ৰকার তিরষ্কারবাক্য শ্রবণগোচর করিয়া, চারি জনেরই অন্তঃকরণে অত্যন্ত ঘৃণা জন্মিল। তখন তাহারা পরস্পর কহিতে লাগিল, বাল্যকালে বিদ্যাভ্যাসে ঔদাস্য করিয়াছিলাম, তাহাতেই আমাদের এই দুরবস্থা ঘটিয়াছে; এক্ষণে, বিদেশে গিয়া, প্ৰাণপণে যত্ন করিয়া, বিদ্যাভ্যাস করা উচিত। এইরূপ সঙ্কল্প করিয়া, চারি জনে, নানাদেশে ভ্রমণপূর্বক, অল্পকালমধ্যে, নানা বিদ্যায় পারদর্শী হইল। গৃহপ্ৰতিগমনকালে, তাহারা পথিমধ্যে দেখিতে পাইল, এক চর্মকার, মৃত ব্যাঘ্রের মাংস ও চর্ম লইয়া, প্ৰস্থান করিল; কেবল অস্থি সকল স্থানে স্থানে পতিত রহিল।

তাহাদের মধ্যে, একজন অস্থিসঙ্ঘটনী বিদ্যা শিখিয়াছিল; সে, বিদ্যাপ্রভাবে, সমস্ত অস্থি একস্থানস্থ করিয়া, ব্যাঘ্রের কঙ্কালসঙ্কলন করিল। দ্বিতীয়, মাংসসঞ্জননী বিদ্যা দ্বারা, ঐ কঙ্কালে মাংস জন্মাইয়া দিল। তৃতীয় চর্মযোজনী বিদ্যা শিখিয়াছিল; সে, তৎপ্রভাবে, শার্দুলের সর্বশরীর চর্ম দ্বারা আচ্ছাদিত করিল। অনন্তর, চতুৰ্থ, মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা দ্বারা, প্ৰাণদান করিলে, ব্যাঘ্র, তৎক্ষণাৎ, তাহাদের চারি সহোদরেরই প্ৰাণসংহার করিল।

ইহা কহিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! এই চারি জনের মধ্যে, কোন ব্যক্তি অধিক নির্বোধ। রাজা কহিলেন, যে ব্যক্তি প্ৰাণদান করিল, সেই সৰ্বাপেক্ষা অধিক নির্বোধ।

 

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।

২২. দ্বাবিংশ উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ!

বিশ্বপুর নগরে নারায়ণ নামে ব্ৰাহ্মণ ছিলেন। এক দিন, তিনি মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিলেন, এক্ষণে, বাৰ্ধক্যবশতঃ, আমার শরীর দুর্বল ও ইন্দ্ৰিয় সকল বিকল হইয়াছে; কিন্তু ভোগাভিলাষ পূর্ব অপেক্ষা প্রদীপ্ত হইতেছে। আমি পরকলেবরপ্ৰবেশনী বিদ্যা জানি। অতএব, ভোগাক্ষম, জরাজীর্ণ, শীৰ্ণ কলেবর পরিত্যাগ করিয়া, কোন যুবার কলেবরে প্রবিষ্ট হই; তাহা হইলে, আর কিছুকাল, অভিলাষানুরূপ বিষয়সুখসম্ভোগ করিতে পারিব। কিন্তু সহসা, কলেবরত্যাগ করিয়া, অন্য কলেবরে প্রবেশ করিলে, আমার এ অভিপ্ৰায় প্ৰকাশ হইবার সম্ভাবনা। অতএব, অগ্ৰে, যোগাভ্যাসাচ্ছলে, পরিবারের নিকট বিদায় লইয়া, বনপ্রবেশ করি; পরে, সুযোগক্রমে, স্বীয় অভিপ্রায় সম্পন্ন করিব। নারায়ণ, এইরূপ সঙ্কল্পারূঢ় হইয়া, পত্নী, পুত্র, পৌত্র, দুহিতৃ, দৌহিত্র প্রভৃতি পরিবারবর্গ একত্র করিয়া, তাহাদের সম্মুখে কহিতে লাগিলেন, দেখ, আমি, সংসারাশ্রমে আবদ্ধ থাকিয়া, বিষয়বাসনায় আসক্ত হইয়া, জীবনকাল অতিবাহিত করিলাম; এক দিন, এক মুহুর্তের নিমিত্তেও, পরকালের হিতচিন্তা করি নাই। এক্ষণে আমার শেষ দশা উপস্থিত। এজন্য, অভিলাষ করিয়াছি, অরণ্যপ্রবেশপূর্বক যোগাভ্যাস দ্বারা তনুত্যাগ করিব; আর আমার, এক ক্ষণের জন্যেও, মায়াময় অকিঞ্চিৎকর সংসারে লিপ্ত থাকিতে বাসনা নাই। এক্ষণে তোমরা, ঐকমত্য অবলম্বনপূর্বক, অনুমতি কর; নির্মম ও নিঃসঙ্গ হইয়া, মোক্ষপথের পথিক হই।

নারায়ণ, এইরূপ কপটবাক্যপ্রয়োগপূর্বক, পরিবারের নিকট বিদায় লইয়া, বনপ্রস্থান করিলেন; এবং তথায়, জীর্ণ কলেবর পরিত্যাগ করিয়া, এক যুবকলেবরে প্রবেশপূর্বক বিষয়াভিলাষ পূর্ণ করিতে লাগিলেন। কিন্তু মহারাজ। ব্রাহ্মণ, পূর্বকলেবর পরিত্যাগের অব্যবহিত পূর্ব ক্ষণে, রোদন করিয়া, পরকলেবরপ্রবেশকালে, বিকশিত আস্যে হাস্য করিয়াছিলেন। অতএব জিজ্ঞাসা করি, ইহার রোদন ও হাস্যের কারণ কি। বিক্ৰমাদিত্য কহিলেন, শুন বেতাল! পূর্ব কলেবর পরিত্যাগ করিলেই, বহু কালের, বহু যত্নের পরিবারের, সহিত আর কোনও সম্বন্ধ থাকিল না; এই মমতায় মুগ্ধ হইয়া, ব্ৰাহ্মণ রোদন করিয়াছিলেন; আর, পরকলেবরে প্রবেশ দ্বারা, অভিলষিত ভোগপথ অকণ্টক হইল, এজন্য, আহ্লাদিত হইয়া, হাস্য করিয়াছিলেন।

 

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।

 ২৩. ত্ৰয়োবিংশ উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ!

ধৰ্মপুরে গোবিন্দ নামে ব্ৰাহ্মণ ছিলেন। তাঁহার দুই পুত্র। তন্মধ্যে একজন ভোজনবিলাসী; অর্থাৎ, অন্নে ও ব্যঞ্জনে যদি কোনও দোষ থাকিত, তাহা দুজ্ঞেয় হইলেও, ঐ অন্নের ও ঐ ব্যঞ্জনের ভক্ষণে তাহার প্রবৃত্তি হইত না; দ্বিতীয় শয্যাবিলাসী; অর্থাৎ, শয্যায় কোনও দুর্লক্ষ্য বিঘ্ন ঘটিলেও, সে তাহাতে শয়ন করিতে পারিত না। ফলতঃ, এই এক এক বিষয়ে তাহাদের অসাধারণ ক্ষমতা ছিল। তদীয় ঈদৃশ বিস্ময়জনক ক্ষমতার বিষয় তত্ৰত্য নরপতির কর্ণগোচর হইলে, তিনি তাহাদের ঐ ক্ষমতার পরীক্ষার্থে, সাতিশয় কৌতুহলাবিষ্ট হইলেন, এবং উভয়কে রাজধানীতে আনাইয়া জিজ্ঞাসিলেন, তোমরা কে কোন বিষয়ে বিলাসী।

অনন্তর, তাহারা স্ব স্ব পরিচয় দিলে, রাজা, প্রথমতঃ ভোজনবিলাসীর পরীক্ষার্থে, পাচক ব্ৰাহ্মণকে ডাকাইয়া, নানাবিধ সুরস অন্ন ব্যঞ্জন প্রভৃতি প্ৰস্তুত করিতে আদেশ দিলেন। পাচক, রাজকীয় আজ্ঞা অনুসারে, সাতিশয় যত্ন সহকারে, চৰ্য্য, চুন্য, লেহ, পেয়, চতুবিধ ভক্ষ্য দ্রব্য প্রস্তুত করিয়া, ভূপতিসমীপে সংবাদ দিল। রাজা ভোজনবিলাসীকে আহার করিবার আদেশ করিলে, সে আহারস্থানে উপস্থিত হইল; এবং, আসনে উপবেশনমাত্র, গাত্ৰোত্থান করিয়া, নৃপতিসমীপে প্ৰতিগমন করিল।

রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন, কেমন, তৃপ্তিপূর্বক ভোজন করিয়াছ। সে কহিল, না মহারাজ! আমার ভোজন করা হয় নাই। রাজা জিজ্ঞাসিলেন, কেন। সে কহিল, মহারাজ। অন্নে শবগন্ধ নিৰ্গত হইতেছে; বোধ করি, শ্মশানসন্নিহিতক্ষেত্ৰজাত ধান্যের তণ্ডুল পাক করিয়াছিল। রাজা শুনিয়া, তদীয় বাক্য উন্মত্তপ্ৰলাপবৎ অসঙ্গত বোধ করিয়া, কিঞ্চিৎ হাস্য করিলেন; এবং এই ব্যাপার গোপনে রাখিয়া, ভাণ্ডারীকে ডাকাইয়া, সেই তণ্ডুলের বিষয়ে সবিশেষ অনুসন্ধান করিতে আদেশ দিলেন। তদনুসারে ভাণ্ডারী, সবিশেষ অনুসন্ধান করিয়া, নরপতিগোচরে আসিয়া নিবেদন করিল, মহারাজ। অমুক গ্রামের শ্মশানসন্নিহিতক্ষেত্ৰজাত ধান্যে ঐ তণ্ডুল প্রস্তুত হইয়াছিল। রাজা শুনিয়া নিরতিশয় চমৎকৃত হইলেন, এবং ভোজনবিলাসীর সবিশেষ প্রশংসা করিয়া কহিলেন, তুমি যথার্থ ভোজনবিলাসী।

অনন্তর, রাজা, এক সুসজ্জিত শয়নাগারে দুগ্ধফেননিভ পরম রমণীয় শয্যা প্রস্তুত করাইয়া, শয্যাবিলাসীকে শয়ন করিতে আদেশ দিলেন। সে, কিয়ৎ ক্ষণ শয়ন করিয়া, নৃপতিসমীপে আসিয়া, নিবেদন করিল, মহারাজ। ঐ শয্যার সপ্তম তলে এক ক্ষুদ্র কেশ পতিত আছে; তাহা আমার সাতিশয় ক্লেশকর হইতে লাগিল; এজন্য শয়ন করিতে পারিলাম না। রাজা শুনিয়া চমৎকৃত হইলেন; এবং, শয়নাগারে প্রবেশপূর্বক, অন্বেষণ করিয়া দেখিতে পাইলেন, শয্যার সপ্তমতলে যথার্থই এক ক্ষুদ্র কেশ পতিত রহিয়াছে। তখন, তিনি, যৎপরোনাস্তি সন্তোষপ্রদর্শনপূর্বক, বারংবার তাহার প্রশংসা করিয়া কহিলেন, তুমি যথার্থ শয্যাবিলাসী। অনন্তর, তাহাদের দুই সহোদরকে, যথোচিত পারিতোষিকপ্ৰদানপূর্বক, পরিতুষ্ট করিয়া বিদায় করিলেন।

ইহা কহিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! উভয়ের মধ্যে, কোন জন অধিক প্ৰশংসনীয়। রাজা কহিলেন, আমার মতে শয্যাবিলাসী।

 

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।

২৪. চতুর্বিংশ উপাখ্যান

বেতাল কহিল, মহারাজ!

কলিঙ্গদেশে যজ্ঞশৰ্মা নামে ব্ৰাহ্মণ ছিলেন। তিনি, অনেক কাল, অনেক দেবতার আরাধনা করিয়া, একমাত্র পুত্র প্রাপ্ত হয়েন। ঐ পুত্ৰ, অল্পকালমধ্যে, সর্ব শাস্ত্রে সবিশেষ পারদর্শী হইল; এবং, অনন্যকর্ম ও অনন্যধর্ম হইয়া, নিরন্তর পিতামাতার সেবা করিতে লাগিল। পিতামাতার ভাগাদোষে, ঐ পুত্র অষ্টাদশ বয়ঃক্রমকালে, কালগ্ৰাসে পতিত হইল। তাহার পিতামাতা, প্রথমতঃ, যৎপরোনাস্তি বিলাপ ও পরিতাপ করিলেন; পরিশেষে, পুত্রের মৃতদেহ, অগ্নিসংস্কারার্থে, গ্রামের উপান্তবর্তী শ্মশানে লইয়া গিয়া, চিতারচনা করিতে লাগিলেন।

এক বৃদ্ধ যোগী, বহুকাল অবধি, ঐ শ্মশানে যোগাভ্যাস করিতেছিলেন। তিনি, অষ্টাদশবর্ষীয় ব্ৰাহ্মণকুমারের মৃত কলেবর পতিত দেখিয়া, মনে মনে বিবেচনা করিলেন, আমার এই প্রাচীন দেহ, জরায় জীর্ণ ও শীর্ণ হইয়া, কার্যক্ষম হইয়াছে; অতএব, এই যুবদেহে প্রবেশ করি; তাহা হইলে, বহুকাল যোগাভ্যাস করিতে পারিব। এই বলিয়া, জগদীশ্বরের নামস্মরণপূর্বক, যোগী সেই যুবকলেবরে প্রবেশ করিলেন।

ব্ৰাহ্মণকুমার তৎক্ষণাৎ জীবিত হইয়া উঠিল। যজ্ঞশৰ্মা, পুত্রকে প্রত্যাগত জীবিত দেখিয়া, প্রথমতঃ, প্ৰফুল্ল বদনে, হাস্য করিলেন; কিন্তু, এক নিমেষ পরেই, বিষন্ন বদনে রোদনে প্ৰবৃত্ত হইলেন।

ইহা কহিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসিল, মহারাজ! ব্ৰাহ্মণ, পুত্রকে পুনর্জীবিত দেখিয়া, হৃষ্ট মনে হাস্য করিয়া, কি কারণে, পর ক্ষণে, রোদন করিলেন, বল। রাজা কহিলেন, ব্ৰাহ্মণ প্রথমতঃ, পুত্রকে পুনর্জীবিত বোধ করিয়া, আহ্লাদে হাস্য করিয়াছিলেন; কিন্তু তিনি পরকলেবর প্রবেশনী বিদ্যা জানিতেন; ঐ বিদ্যার প্রভাবে, পর ক্ষণেই জানিতে পারিলেন, পুত্র পুনর্জীবিত হয় নাই; যোগীর প্রবেশ দ্বারা এরূপ ঘটিয়াছে; এজন্য, রোদন করিলেন।

 

ইহা শুনিয়া বেতাল ইত্যাদি।

২৫. পঞ্চবিংশ উপাখ্যান‌

বেতাল কহিল, মহারাজ!

দাক্ষিণাত্য দেশে ধর্মপুর নামে নগর আছে। তথায়, মহাবল নামে, মহাবল পরাক্রান্ত মহীপতি ছিলেন। এক প্রবল প্রতিপক্ষ রাজা, চতুরঙ্গিণী সেনা লইয়া, তদীয় রাজধানীর অবরোধ করিলে, রাজা মহাবল, স্বীয় সমস্ত সৈন্যসামন্ত সমভিব্যাহারে, সমরসাগরে অবগাহন করিয়া, অশেষপ্রকার প্রতীকারচেষ্টা করিতে লাগিলেন; কিন্তু, দৈবদুর্বিপাকবশতঃ, ক্ৰমে ক্রমে, স্বপক্ষীয় সমস্ত সৈন্য ক্ষয়প্রাপ্ত হইলে, নিতান্ত নিরুপায় হইয়া, প্রাণরক্ষার্থে, মহিষী ও তনয়া সমভিব্যাহারে, অরণ্যপ্ৰস্থান করিলেন। পদব্ৰজে ভ্ৰমণ করিয়া, তিন জনেই অতিশয় ক্ষুধার্ত হইলেন। তখন রাজা, মহিষী ও তনয়াকে তরুতলে অবস্থিতি করিতে বলিয়া, আহারোপযোগী দ্রব্যের আহরণার্থে গমন করিলেন।

সায়ংকাল উপস্থিত হইল। রাজা প্রত্যাগত হইলেন না। রাজমহিষী ও রাজকুমারী, রাজার অনাগমনে, নানা অনিষ্টের আশঙ্কা কবিয়া, যৎপরোনাস্তি বিষন্ন হইয়া, অশেষবিধ চিন্তা করিতে লাগিলেন। ঐ দিনে, কুণ্ডিনের অধিপতি রাজা চন্দ্ৰসেন, আপন জ্যেষ্ঠ পুত্রকে সঙ্গে লইয়া, ঐ অরণ্যে মৃগয়া করিতে গিয়া ছিলেন। তাহারা, তাদৃশ নিবিড় অরণ্যমধ্যে, অসম্ভাবনীয় নরচরণচিহ্ন দেখিয়া, বিস্ময়ান্বিত চিত্তে, নানাপ্রকার কল্পনা করিতে লাগিলেন। পরিশেষে, পুংবিলক্ষণ লক্ষণ দ্বারা, উহা স্ত্রীলোকের পদচিহ্ন বলিয়া স্থিরীকৃত হইল। রাজা কহিলেন, চরণচিহ্ন দর্শনে স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে, দুই নারী, অচিরে, এই স্থান দিয়া, গমন করিয়াছে। চল, চারিদিকে অন্বেষণ করি।

পিতা-পুত্রে, অন্বেষণ করিতে করিতে, সায়ংসময়ে দেখিতে পাইলেন, দুই পরম সুন্দরী রমণী, তরুতলে উপবিষ্ট হইয়া, বাষ্পাকুল লোচনে, পরস্পর বদননিরীক্ষণ করত, যুথবিরহিত কুররীযুগলের ন্যায়, প্রগাঢ় উৎকণ্ঠায় কালযাপন করিতেছে। অবলোকনমাত্র, উভয়েরই অন্তঃকরণে অতিপ্রভূত কারুণ্যরস আবির্ভূত হইল। তখন তাঁহারা, স্নেহগর্ভ সম্ভাষণ পুরঃসর, অশেষপ্রকারে সান্ত্বনা ও অভয়প্রদান করিয়া, তাহাদিগকে রাজধানীতে লইয়া গেলেন। কিছুদিন পরে, রাজা রাজকন্যার, রাজকুমার রাজমহিষীর, পাণিগ্রহণ করিলেন।

 

ইহা কহিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ! এই দুই নারীর সন্তান জন্মিলে, তাহাদের পরস্পর কি সম্বন্ধ হইবেক, বল। রাজা বিক্রমাদিত্য, ঈষৎ হাসিয়া, মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন।

২৬. উপসংহার

বেতাল কহিল, মহারাজ! আমি তোমার সাহস ও অধ্যবসায় দর্শনে অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছি। এক্ষণে তোমায় কিছু উপদেশ দিতেছি, অবধানপূর্বক শ্রবণ কর।

যে যোগী তোমায় শবানয়নে নিযুক্ত করিয়াছে, সে কুম্ভকারকুলে উৎপন্ন; তাহার নাম শান্তশীল। আর, যে শব লইতে আসিয়াছ, উহা ভোগবতীর অধিপতি রাজা চন্দ্ৰভানুর মৃতদেহ। শান্তশীল, যোগসিদ্ধির নিমিত্ত, অনেক কৌশলে, চন্দ্ৰভানুর প্রাণবধ করিয়া, প্রায় কৃতকাৰ্য হইয়া আছে; এক্ষণে, তোমার প্রাণসংহার করিতে পারিলেই, উহার মনস্কামনা পূর্ণ হয়। এজন্য, আমি তোমায় সাবধান করিয়া দিতেছি; যোগী পূজাসমাপন করিয়া তোমায় বলিবেক, মহারাজ! সাষ্টাঙ্গ প্ৰণিপাত কর। তদনুসারে তুমি যেমন দণ্ডবৎ পতিত হইবে, অমনই সে খড়্গপ্রহার দ্বারা তোমার প্রাণসংহার করিবেক। অতএব, তুমি, কোনও ক্রমে, সেরূপ প্ৰণাম না করিয়া বলিবে, আমি কোনও কালে সাষ্টাঙ্গপ্ৰণাম করি নাই; এবং, কেমন করিয়া সেরূপ প্ৰণাম করিতে হয়, তাহাও জানি না; আপনি কৃপা করিয়া দেখাইয়া দিলে, আপনকার আজ্ঞাপ্রতিপালন করিতে পারি। অনন্তর, তোমায় দেখাইয়া দিবার নিমিত্ত, সে যেমন দণ্ডবৎ পতিত হইয়া প্ৰণাম করিবেক, অমনি তুমি, খড়্গপ্রহার দ্বারা, তাহার মস্তকচ্ছেদনপূর্বক, তাহার ও চন্দ্ৰভানুর মৃতদেহ সন্নিহিত জ্বলন্ত মহানসের উপরিস্থিত তৈলকটাহে নিক্ষিপ্ত করিবে; এবং, তাহা হইলেই, তদীয় সম্পূর্ণ যোগফল প্রাপ্ত হইয়া, অখণ্ড ভূমণ্ডলে অবিচল সাম্রাজ্যস্থাপন করিতে পরিবে। সে ব্যক্তি আততায়ী; আততায়ীর বধে পাতক নাই।

এইরূপে বিক্রমাদিত্যকে সতর্ক করিয়া দিয়া, বেতাল, সেই মৃত শরীর হইতে বহির্নিঃসরণ। পুরঃসর, স্বস্থানে প্রস্থান করিল। রাজা, সেই শব লইয়া, সন্ন্যাসীর সন্নিধানে উপস্থিত হইলে, তিনি সাতিশয় সন্তোষপ্ৰদৰ্শন ও রাজার অশেষপ্রকার প্রশংসাকীর্তন করিতে লাগিলেন; অনন্তর, চন্দ্ৰভানুর মৃত দেহে জীবনদানপূর্বক, বলিপ্ৰদান করিলেন; এবং, পূজার অন্যান্য অঙ্গ যথাবৎ সমাপ্ত করিয়া, রাজাকে বলিলেন, মহারাজ! সাষ্টাঙ্গ প্ৰণাম, কর; তোমার প্রতাপবৃদ্ধি ও অভীষ্টসিদ্ধি হইবেক। রাজা, বেতালদত্ত উপদেশ অনুসারে, কৃতাঞ্জলি হইয়া, অতি বিনীতভাবে আবেদন করিলেন, মহাশয়! আমি সাষ্টাঙ্গ প্ৰণাম করিতে জানি না; আপনি গুরু; কি প্রকারে ওরূপ প্ৰণাম করিতে হয়, কৃপা করিয়া দেখাইয়া দিউন। যোগী, রাজাকে সাষ্টাঙ্গপ্ৰণাম শিখাইবার নিমিত্ত, যেমন ভূতলে দণ্ডবৎ পতিত হইলেন, অমনি রাজা, বেতালের উপদেশ অনুসারে, খড়্গাঘাত দ্বারা, তাহার শিরশ্ছেদন করিলেন।

দেবতারা, এই ব্যাপার দর্শনে সাতিশয় পরিতুষ্ট হইয়া, দুন্দভিধ্বনি ও পুষ্পবৃষ্টি করিতে লাগিলেন। দেবরাজ, দেবলোক হইতে অবতরণপূর্বক, রাজাকে দর্শন দিয়া কহিলেন, মহারাজ! আমি তোমার সৌভাগ্যদর্শনে সাতিশয় প্রীত হইয়াছি, বরপ্রার্থনা কর। রাজা, অনিমিষ সহস্র নয়নে অলঙ্কৃত কলেবর দর্শনে, দেবরাজ স্থির করিয়া, আপনাকে চরিতার্থ বোধ করিলেন; এবং বলিলেন, আপনকার প্ৰসাদে, পৃথিবীতে আমার কোনও প্রার্থয়িতব্য নাই। এক্ষণে, এইমাত্র প্রার্থনা করি, যেন আমার এই বৃত্তান্ত সমস্ত সংসারে প্রসিদ্ধ হয়। ইন্দ্ৰ কহিলেন, মহারাজ! যাবৎ চন্দ্র, সূৰ্য, পৃথিবী, ও আকাশমণ্ডল বিদ্যমান থাকিবেক, তাবৎকাল পর্যন্ত, তোমার এই বৃত্তান্ত ধরাতালে প্ৰসিদ্ধ থাকিবেক।

 

এই রূপে রাজাকে বরপ্ৰদান করিয়া, দেবরাজ দেবালোকে প্ৰতিগমন করিলেন। অনন্তর রাজা, মন্ত্রপ্রয়োগপূর্বক, দুই মৃতদেহ তৈলকটাহে নিক্ষিপ্ত করিবামাত্র, দুই বিকটাকার বীরপুরুষ তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইল; এবং কৃতাঞ্জলি হইয়া নিবেদন করিল, মহারাজ! কি আজ্ঞা হয়। রাজা কহিলেন, আমি যখন যখন স্মরণ করিব, তোমরা আমার নিকটে উপস্থিত হইবে। তাহারা, যে আজ্ঞা মহারাজ! বলিয়া, প্রস্থান করিল। রাজা বিক্রমাদিত্যও, সর্বপ্রকারে চরিতার্থ হইয়া, নিরতিশয় হৃষ্ট চিত্তে, রাজধানী প্রতিগমনপূর্বক, অপ্রতিহত প্রভাবে রাজ্যশাসন ও প্রজাপলিন করিতে লাগিলেন।

Exit mobile version