Site icon BnBoi.Com

দি টেনটেড থ্রোন – এম্পায়ার অভ দা মোগল

দি টেনটেড থ্রোন - এম্পায়ার অভ দা মোগল

দি টেনটেড থ্রোন – এম্পায়ার অভ দা মোগল

১.০১ বালিতে রক্তের দাগ

এম্পায়ার অভ দা মোগল – দি টেনটেড থ্রোন (কলঙ্কিত মসনদী কথা)
অ্যালেক্স রাদারফোর্ড / অনুবাদ: সাদেকুল আহসান কল্লোল

অনুবাদকের উৎসর্গ স্নেহস্পাদেষু রাকিবুল হাসান

প্রধান চরিত্রসমূহ:

জাহাঙ্গীরের পরিবারের সদস্যবৃন্দ

আকবর, জাহাঙ্গীরের পিতা এবং তৃতীয় মোগল সম্রাট
হুমায়ুন, জাহাঙ্গীরের দাদাজান এবং দ্বিতীয় মোগল সম্রাট
হামিদা, জাহাঙ্গীরের দাদিজান
কামরান, হুমায়ুনের সৎ-ভাই, জাহাঙ্গীরের দাদাজান।
আসকারি, হুমায়ুনের সৎ-ভাই, জাহাঙ্গীরের দাদাজান
হিন্দাল, হুমায়ুনের সৎ-ভাই, জাহাঙ্গীরের দাদাজান
মুরাদ, জাহাঙ্গীরের ভাই
দানিয়েল, জাহাঙ্গীরের ভাই।
খসরু, জাহাঙ্গীরের জ্যেষ্ঠ পুত্র
পারভেজ, জাহাঙ্গীরের দ্বিতীয় পুত্র
খুররম (পরবর্তীতে সম্রাট শাহজাহান), জাহাঙ্গীরের তৃতীয় পুত্র
শাহরিয়ার, জাহাঙ্গীরের কনিষ্ঠ পুত্র
মান বাঈ, জাহাঙ্গীরের স্ত্রী এবং খসরুর জন্মদাত্রী মাতা
জোধা বাঈ, জাহাঙ্গীরের স্ত্রী এবং খুররমের জন্মদাত্রী মাতা
শাহিব জামাল, জাহাঙ্গীরের স্ত্রী এবং পারভেজের জন্মদাত্রী মাতা।
মেহেরুন্নিসা (নূরজাহান এবং নূর মহল নামেও পরিচিত) জাহাঙ্গীরের শেষ স্ত্রী

মেহেরুন্নিসার পরিবার

লাডলি, শের আফগানের ঔরসে মেহেরুন্নিসার কন্যা
গিয়াস বেগ, রাজকোষাগারের আধিকারিক এবং মেহেরুন্নিসার পিতা
আসমত, মেহেরুন্নিসা আর তার ভাইদের জননী
আসফ খান, আগ্রা সেনানিবাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক এবং মেহেরুন্নিসার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা
মীর খান, মেহেরুন্নিসার কনিষ্ঠ ভ্রাতা।
আরজুমান্দ বানু, মেহেরুন্নিসার ভাস্তি, আসফ খানের কন্যা এবং খুররমের (শাহ জাহান) স্ত্রী।
শের আফগান, বাংলার গৌড়ে অবস্থিত সেনানিবাসের আধিকারিক এবং মেহেরুন্নিসার প্রথম স্বামী

জাহাঙ্গীরের অমাত্য, সেনাপতি আর সুবেদার

সুলেমান বেগ, জাহাঙ্গীরের দুধ-ভাই
আলী খান, মানডুর সুবেদার
ইকবাল বেগ, দাক্ষিণাত্যে অবস্থানরত একজন জ্যেষ্ঠ সেনাপতি
মহবত খান, পারস্য থেকে আগত আর জাহাঙ্গীরের সেরা সেনাপতিদের অন্যতম।
মাজিদ খান, জাহাঙ্গীরের উজির এবং ঘটনাপঞ্জির রচয়িতা
ইয়ার মহম্মদ, গোয়ালিয়রের সুবেদার
দারা শুকোহ, খুররমের (শাহ জাহান) জ্যেষ্ঠ পুত্র
শাহ শুজা, খুররমের (শাহ জাহান) দ্বিতীয় পুত্র
আওরঙ্গজেব, খুররমের (শাহ জাহান) তৃতীয় পুত্র
মুরাদ বকস্, খুররমের (শাহ জাহান) কনিষ্ঠ পুত্র
জাহানারা, খুররমের (শাহ জাহান) জ্যেষ্ঠ কন্যা
রওন্নারা, খুররমের (শাহ জাহান) কনিষ্ঠ কন্যা

বাদশাহীহারেমের অভ্যন্তরে

মালা, খাজাসরা, রাজকীয় হারেমের তত্ত্বাবধায়ক
ফাতিমা বেগম, সম্রাট আকবরের বিধবা স্ত্রী
নাদিয়া, ফাতিমা বেগমের পরিচারিকা
সাল্লা, মেহেরুন্নিসার আর্মেনীয় সহচর

খুররমের অন্তরঙ্গ হচর

আজম বকস্, আকবরের একজন প্রাক্তন বৃদ্ধ সেনাপতি
কামরান ইকবাল, খুররমের একজন সেনাপতি।
ওয়ালিদ বেগ, খুররমের অন্যতম প্রধান তোপচি

অন্যান্য চরিত্র

আজিজ কোকা, খুসরুর সমর্থক
হাসান জামাল, খসরুর সমর্থক
মালিক আম্বার, মুক্তি লাভ করা আবিসিনীয় ক্রীতদাস এবং বর্তমানে মোগলদের বিরুদ্ধে দাক্ষিণাত্যের সালতানাতের সম্মিলিত বাহিনীর সেনাপতি
শেখ সেলিম চিশতি, সুফি সাধক, এবং নিজেও একজন সুফি সাধকের পুত্র।

মোগল দরবারে আগত বিদেশী

বার্থোলোমিউ হকিন্স, ইংরেজ সৈনিক এবং ভাগ্যান্বেষনকারী
ফাদার রোনাল্ডা, পর্তুগীজ পাদ্রী।
স্যার টমাস রো, মোগল দরবারে প্রেরিত ইংরেজ রাজদূত
নিকোলাস ব্যালেনটাইন, স্যার টমাস রো’র সহচর

.

প্রথম পর্ব – রমণীকুল মাঝে এক প্রভাকর

১.১ বালিতে রক্তের দাগ

উত্তরপশ্চিম ভারতবর্ষ ১৬০৬ সালের বসন্তকাল

জাহাঙ্গীর তার টকটকে লাল বর্ণের নিয়ন্ত্রক তাবুর চাঁদোয়ার নিচে দিয়ে মাথা নিচু করে বাইরে বের হয়ে আসে এবং আধো-আলোর ভিতরে উঁকি দিয়ে দূরের পর্বতের শৈলশিরাময় অংশের দিকে তাকায় যেখানে তার জ্যেষ্ঠপুত্র খুররমের সৈন্যবাহিনী শিবির স্থাপন করেছে। পরিষ্কার আকাশের নিচে প্রায় মরুভূমির মত এলাকাটার ভোরের বাতাসে শীতের প্রকোপ ভালোই টের পাওয়া যায়। জাহাঙ্গীর এতদূর থেকেও শিবিরের এদিক সেদিক চলাচল করতে থাকা অবয়ব ঠিকই লক্ষ্য করে, তাদের কারো কারো হাতে জ্বলন্ত মশাল রয়েছে। রান্নার জন্য এর মধ্যে বেশ কয়েক স্থানে অগ্নিকুণ্ড প্রজ্জ্বলিত হয়েছে। শৈলশিরার একেবারে শীর্ষদেশে একটা বিশাল তাবুর সামনে ভোরের আধো আলোর প্রেক্ষাপটে বেশ কয়েকটা নিশানকে উড়তে দেখা যায়, খুব সম্ভবত খুররমের ব্যক্তিগত আবাসস্থল। সহসা ভোরের বাতাসের মত শীতল একটা বিষণ্ণতাবোধ সামনের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় জাহাঙ্গীরকে আপুত করে তুলে। পরিস্থিতির এমন পরিণতি কেন হল? কেন আজ তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে আপন পুত্রের মোকাবেলা করতে হবে?

তার আব্বাজান আকবরের মৃত্যুর পরে, মাত্র পাঁচমাস আগেই, বহুদিন ধরে সে কামনা করেছিল এমন সবকিছুর উপরে শেষ পর্যন্ত তার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজবংশের চতুর্থ মোঘল সম্রাট হিসাবে তার নাম ঘোষণা করা হয়। জাহাঙ্গীর, এই নামে সে রাজত্ব পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার মানে পৃথিবীর সংরোধক। পশ্চিমে বেলুচিস্তানের পাহাড়ি এলাকা থেকে পূর্বে বাংলার নিম্নাঞ্চল এবং উত্তরে কাশ্মীরের জাফরানশোভিত ফসলের মাঠ থেকে দক্ষিণে দাক্ষিণাত্যের লাল মাটির শুষ্ক মালভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত একটা সাম্রাজ্যের অধিশ্বর হবার অনুভূতিটাই দারুণ। দশ কোটি মানুষের প্রাণ তার অনুবর্তী কিন্তু সে কারো অনুবর্তী নয়।

সম্রাট হিসাবে প্রথমবারের মত নিজের প্রজাদের সামনে নিজেকে উপস্থাপনের নিমিত্তে আগ্রা দূর্গের ইন্দ্রকোষ ঝরোকায় সে যখন পা রাখে, এবং নিচে যমুনার তীরে ভীড় করে থাকা মানুষের ভীড় থেকে সম্মতির সমর্থন ভেসে আসে, তাঁর আব্বাজান মৃত সেই বিষয়টাই তখন প্রত্যয়াতীত মনে হয়। আকবর সমৃদ্ধ আর জাক-জমকপূর্ণ একটা সাম্রাজ্য নির্মাণ করেছিলেন সমস্ত বিপদ আর প্রতিবন্ধকতাকে দূরে সরিয়ে রেখে। আকবর বেঁচে থাকার সময় জাহাঙ্গীরের যেমন প্রায়শই মনে হতো সে কখনও আকবরের ভালোবাসা পুরোপুরি অর্জন করতে পারে নি কিংবা তার প্রত্যাশা অনুযায়ী জীবন যাপন করতে পারে নি, আকবরের মৃত্যুর পরে তার মনে এখন সহসাই সন্দেহের মেঘ ঘনীভূত হয় যে এখন সেটা আদৌ তার পক্ষে অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু সে চোখ বন্ধ করে এবং নিরবে একটা প্রতিজ্ঞা করে। আপনি আমাকে সম্পদ আর ক্ষমতা দান করেছেন। আপনার যোগ্য উত্তরসূরি হিসাবে আমি নিজেকে প্রমাণ করবো। আপনি আর আমার পূর্বপুরুষেরা যা নির্মাণ করেছেন আমি সেটা রক্ষা করবো এবং বর্ধিত করবো। নিজের কাছে নিজের এই প্রতিজ্ঞার ব্যাপারটা তাঁর আত্মবিশ্বাসকে শাণিত করে তুলে।

কিন্তু এই ঘটনার সপ্তাহখানেকের ভিতরেই প্রথম আঘাত আসে, কিন্তু কেএনা আগন্তুক নয় বরং তাঁর নিজের আঠারো বছরের ছেলেই সেই আঘাতটা হানে। বিশ্বাসঘাতকতা–এবং এর ফলে সৃষ্ট বাতাবরণ সবসময়েই একটা নোংরা ব্যাপার, কিন্তু নিজের সন্তানই যখন সেটার উদ্গাতা তখন এর চেয়ে জঘন্য আর কিছুই হতে পারে না। মোগলদের যখন একত্রিত থাকার কথা তখন পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করে মোঘলরা অনেক সময়ে নিজেরাই নিজেদের প্রবল শত্রুতে পরিণত হয়েছে। এই একই বিন্যাসের পুনরাবৃত্তি সে কখনও, কিছুতেই অনুমতি দিতে পারে না এবং এখন তাঁর রাজত্বের সূচনা লগ্নে সে সবাইকে দেখিয়ে দিতে চায় যে পারিবারিক অবাধ্যতার বিষয়টা সে ভীষণ ঐকান্তিকতার সাথে গ্রহণ করেছে এবং কত দ্রুত আর পুরোপুরি সে এই বিদ্রোহীদের দমন করবে।

বিগত কয়েকটা সপ্তাহ তাঁর নিজের বাহিনী আর তাঁর পুত্রের বাহিনীর মাঝে দূরত্ব হ্রাস করার অভিপ্রায় ছাড়া আর কিছুই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। সে আর তার বাহিনী গতকাল সন্ধ্যাবেলা খসরুর নাগাল পায় এবং সে যেখানে শিবির স্থাপন করেছে সেই শৈলশিরাময় অংশটা ঘিরে ফেলে। আপন সন্তানের বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়ে সে যতই চিন্তা করে ততই গা গুলিয়ে ওঠা ক্রোধের একটা ঢেউ তার উপরে এসে আছড়ে পড়ে এবং পায়ের গোড়ালী দিয়ে সে বালুকাময় মাটিতে সজোরে আঘাত করে। সে সহসা নিজের পাশে তার দুধ-ভাই সুলেমান বেগের উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে। ‘এতক্ষণ কোথায় ছিলে?’ সে জানতে চায়, অবদমিত আবেগের কারণে তাঁর কণ্ঠস্বর রুক্ষ শোনায়।

রাতেরবেলা খসরুর শিবিরের কাছাকাছি আমাদের গুপ্তদূতদের যারা গিয়েছিল তাদের কাছ থেকে সর্বশেষ অগ্রগতি সম্পর্কে শুনছিলাম।

‘তারা তাহলে, কি বললো? আমার ছেলে কি অনুধাবন করতে পেরেছে যে সে আমাদের নাগাল থেকে পালাতে পারবে না এবং তাকে অবশ্যই নিজের বিদ্রোহের পরিণতি ভোগ করতে হবে?

“জ্বী। সে যুদ্ধের জন্য নিজের বাহিনীকে প্রস্তুত করছে।’

‘সে আর তাঁর সেনাপতিরা কীভাবে নিজেদের সৈন্যদের বিন্যস্ত করছে?

‘শৈলচূড়ায় বেলেপাথরের তৈরি হিন্দুদের কয়েকটা স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। তাঁরা এগুলোর চারপাশে নিজেদের মালবাহী শকটগুলোকে উল্টে দিয়েছে এবং নিজেদের তবকী আর তিরন্দাজদের সুরক্ষিত রাখতে এবং তাঁদের কামানগুলোকে আড়াল করতে মাটির অবরোধক নির্মাণ করছে।

তার মানে আক্রমণ করার পরিবর্তে তারা আক্রমণ প্রতিহত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে?’

‘জ্বী। তাঁরা জানে এটাই তাদের সাফল্যের শ্রেষ্ঠ সুযোগ। খসরু কিংবা তাঁর প্রধান সেনাপতি আজিজ কোকা কেউই নির্বোধ নয়।’

‘আমার কর্তৃত্ব অগ্রাহ্য করা ছাড়া, জাহাঙ্গীর তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে।

‘আমি কি আমাদের বাহিনীকে আসন্ন আক্রমণের জন্য এখনই বিন্যস্ত হবার আদেশ দেব?

‘আমি সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বে, শৈলচূড়ার উপরে পানি কিংবা ঝর্ণার কোনো উৎসের ব্যাপারে আমরা কি কিছু জানি?

‘গতকাল সন্ধ্যাবেলা আমাদের সাথে কেবল একজন পশুপালকের দেখা হয়েছিল আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম। সে বলেছে নেই কিন্তু বেচারা এতটাই আতঙ্কিত ছিল যে আমি যা শুনতে চাই বলে তার কাছে মনে হয়েছিল সে হয়ত সেটাই তখন বলেছিল। অবশ্য, চূড়াটার সর্বত্রই লাল ধূলো আর পাথর মাঝে মাঝে কেবল কয়েকটা মৃতপ্রায় গাছ আর বিক্ষিপ্তভাবে জন্মানো ঘাস রয়েছে।

‘পশুপালক লোকটা তাহলে হয়তো ঠিকই বলেছে। সেক্ষেত্রে, তাঁদের সাথে যৎসামান্য যতটুকু পানি রয়েছে সেটা নিঃশেষ করার জন্য আমরা বরং এখনই তাঁদের আক্রমণ করা থেকে আরো কিছুক্ষণ বিরত থাকি তারা এখন যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের ভাগ্য নিয়ে চিন্তা করুক। খসরুর মতই, তাঁরা সবাই অল্পবয়সী আর যুদ্ধে অনভিজ্ঞ। এমনকি যুদ্ধের ভয়ঙ্কর বিভীষিকাও তাঁদের কল্পনাকে ছাপিয়ে যাবে।’

‘হয়ত, কিন্তু আমাদের দেয়া আত্মসমর্পণের প্রস্তাবে আমি যেমনটা আশা করেছিলাম তারা ঠিক সেভাবে সাড়া দেয়নি।

জাহাঙ্গীর চোখমুখ কুঁচকে কিছু একটা ভাবে। গত সন্ধ্যায় সে সুলেমান বেগের প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছিল খসরুর শিবির লক্ষ্য করে বার্তাবাহী তীর নিক্ষেপ করার ব্যাপারে যেখানে লেখা থাকবে যেকোনো নিম্নপদস্থ সেনাপতি কিংবা কোনো সৈন্য যারা সেই রাতে খসরুর শিবির ত্যাগ করে আত্মসমর্পণ করবে তাদের প্রাণ রক্ষা পাবে। দ্বিতীয় কোনো সুযোগ দেয়া হবে না। কেউ যেন মনে না করে যুদ্ধের পরে কারো প্রতি কোনো ধরনের করুণা প্রদর্শন করা হবে।’

কতজন আত্মসমর্পণ করেছে?

‘হাজারখানের চেয়ে সামান্য কিছু কম হবে, বেশিরভাগই অপ্রতুল অস্ত্র আর পোষাক পরিহিত পদাতিক সৈন্য। অনেকেই সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ হয়েছে যারা খসরুর বাহিনী অগ্রসর হবার সময় উত্তেজনা আর লুটের মালের বখরার আশায় তাঁর সাথে যোগ দিয়েছিল। স্বপক্ষত্যাগী একজন বলেছে কীভাবে পালাবার চেষ্টা করার সময় ধৃত এক কিশোর সৈন্যকে খসরুর আদেশে শিবিরের জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছে এবং বর্শার সুতীক্ষ্ণ অগ্রভাগ দিয়ে তাকে অগ্নিশিখায় ঠেসে রাখা হয়েছিল যতক্ষণ না তার চিৎকার স্তব্ধ হয়ে যায়। তার অঙ্গার হয়ে যাওয়া দেহটা এরপরে শিবিরের। ভেতরে প্রদর্শিত করা হয় অন্যদের তারমত পালাবার প্রয়াস গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখতে।

‘খসরুর সাথে এখন তাহলে কতজন লোক রয়েছে?

‘স্বপক্ষত্যাগী লোকটার বক্তব্য অনুযায়ী বারো হাজার। আমার মনে হয় সংখ্যাটা কমিয়ে বলা হয়েছে কিন্তু তাঁদের সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই পনের হাজারের বেশি হবে না।’

‘তাঁদের চেয়ে এখনও আমাদের তিন কি চার হাজার লোক বেশি রয়েছে। নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যুহের পেছনে গুঁড়ি মেরে প্রতিক্ষারত খসরুর সৈন্যদের চেয়ে আক্রমণকারী হিসাবে, অনেকবেশি অরক্ষিত থাকার কারণে আমাদের সৈন্যদের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য এই সংখ্যাটা যথেষ্ট।

জাহাঙ্গীর তার নিয়ন্ত্রক তাবুতে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হবার জন্য যখন তাঁর পরিচারক, তাঁর কর্চির জন্য অপেক্ষা করার সময় যখন পায়চারি করছে তার মনে একের পর এক প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। সাফল্য নিশ্চিত করার জন্য সে কি সম্ভাব্য সবকিছু করেছে? একজন সেনাপতির জন্য আত্মবিশ্বাসে ঘাটতির মতই অতিরিক্ত-আত্মবিশ্বাসও বিশাল একটা হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। গতকাল অনেক গভীর রাত পর্যন্ত তিনি আর সুলেইমান বেগ যে পরিকল্পনা করেছেন সেটা কি সম্রাট হিসাবে তার প্রথম যুদ্ধে তাকে বিজয়ী করার জন্য যথেষ্ট বলে প্রমাণিত হবে? খসরুর বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়ে তিনি কেন পূর্বেই প্রস্তুত ছিলেন না? আকবর যখন বেঁচে ছিলেন খসরু তাঁর দাদাজানের অনুগ্রহভাজন হবার চেষ্টা করেছিল, তার উত্তরাধিকারী হিসাবে মনোনীত হবার আশায়। আকবর যখন তাঁর পরিবর্তে জাহাঙ্গীরকে নির্বাচিত করেন, খসরু আপাত দৃষ্টিতে সেটা মেনে নিলেও সে আসলে নিজের সুযোগের জন্য অপেক্ষা করছিল। আগ্রা থেকে পাঁচ মাইল দূরে সিকানদারায় তাঁর দাদাজানের বিশাল সমাধিসৌধ নির্মাণের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণের বাহানা দেখিয়ে সে তার পুরো বাহিনী নিয়ে আগ্রা দূর্গ থেকে বের হয়ে যায়। সিকানদারা অভিমুখে না গিয়ে সে উত্তর দিকে সোজা দিল্লির উদ্দেশ্যে ঘোড়া হাঁকায়, পথে যেতে যেতে নতুন সৈন্য নিয়োগ করে সে তার বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে থাকে।

জাহাঙ্গীর যখন চূড়ান্ত আদেশ দেয়ার জন্য তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠ সেনাপতিদের একত্রিত করে সূর্য তখন আকাশের অনেক উঁচুতে উঠে গিয়েছে। আবদুর রহমান, আপনি, অশ্বারোহী বকি আর তীরন্দাজদের একটা বাহিনীর সাথে আমাদের রণহস্তির দলকে নেতৃত্ব দিয়ে পশ্চিম দিকে নিয়ে যাবেন শৈলচূড়া যেখানে ধীরে ধীরে সমভূমির সাথে এসে মিশেছে। আপনি সেখানে অবস্থান গ্রহণের পরে, শৈলচূড়ার হলরেখা বরাবর অগ্রসর হয়ে, খসরুকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করবেন যে এটাই হবে, যেমনটা প্রচলিত রণনীতিতে অনুসৃত হয়, আমাদের আক্রমণের প্রধান অভিমুখ।

‘কিন্তু এটা একটা ভাওতা। খসরুর সৈন্যদের যতবেশি সংখ্যায় সম্ভব নিবিষ্ট রাখার জন্য এটা একটা কৌশল। আমি আপনাকে শত্রুর সাথে পুরোপুরি নিবিষ্ট দেখার পরে, সুলেইমান বেগ আর আমি আমাদের আরেকদল অশ্বারোহী নিয়ে রওয়ানা দেব। প্রথমে, আপনাকে সহযোগিতা দেয়ার জন্য আমরা পশ্চিম দিকে যাবার ভান করবো কিন্তু তারপরেই আমরা ঘুরে গিয়ে সরাসরি আমাদের সামনে চূড়ার শীর্ষে অবস্থিত খসরুর তাবু অভিমুখে আক্রমণ করার জন্য পেয়ে যাব। ইসমাঈল আমল, এখানে অতিরিক্ত বাহিনীর নেতৃত্বে আপনি অবস্থান করবেন এবং লুটপাটের কোনো প্রয়াস থেকে আমাদের শিবিরকে রক্ষা করবেন। আপনারা সবাই কি নিজেদের ভূমিকা ঠিকমত বুঝতে পেরেছেন?

“জ্বী, সুলতান, সাথে সাথে প্রত্যুত্তর ভেসে আসে।

‘তাহলে আল্লাহতালা আমাদের সহায়। আমরা ন্যায়ের পক্ষে রয়েছি।

*

আধ ঘন্টা পরে, জাহাঙ্গীর পুরোদস্তুর যুদ্ধের সাজে সজ্জিত অবস্থায়, তাঁর ইস্পাতের শিরোস্ত্রাণের নিচে ঘামতে থাকে এবং ইস্পাতের কারুকাজ করা বক্ষ–এবং পৃষ্টরক্ষাকারী বর্ম তার দেহখাঁচা আবৃত করে রেখেছে। নিজের সাদা ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায়, বিশাল প্রাণীটা খুর দিয়ে অস্থিরভাবে কেবলই মাটিতে আঘাত করছে যেন আসন্ন লড়াইয়ের আভাস আঁচ করতে পেরেছে, সে আবদুর রহমানের বাহিনীকে তূর্য ধ্বনি, ক্রমশ জোরালো হতে থাকা ঢোলের আওয়াজ আর মন্দ্র বাতাসে পতপত করে উড়তে থাকা সবুজ নিশানের মাঝে, সঙ্ঘবদ্ধভাবে অগ্রসর হতে দেখে। আগুয়ান বহরটা বিস্তৃত শৈলশিরার পাদদেশের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করতে খসরুর তোপচিরা নিকটবর্তী অবস্থান থেকে আক্রমণকারীদের লক্ষ্য করে নিজেদের অপেক্ষাকৃত বড় কামানগুলো থেকে গোলাবর্ষণ শুরু করলে বাতাসে সাদা ধোয়া ভাসতে দেখা যায়।

অবশ্য, স্পষ্টতই বোঝা যায় যে গোলন্দাজেরা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে এবং তড়িঘড়ি করে আগেই কামান থেকে গোলাবর্ষণ করা থেকে নিজেদের তারা বিরত রাখতে পারে না কারণ আবদুর রহমানের অগ্রবর্তী দলের অনেক সামনে তাদের নিক্ষিপ্ত গোলাগুলো এসে আছড়ে পড়ে ঝর্ণার মত উপরের দিকে ধুলো নিক্ষেপ করে। কিন্তু তারপরেই জাহাঙ্গীরকে আতঙ্কিত করে তুলে তাঁর আগুয়ান একটা রণহস্তী ইস্পাতের বর্ম দিয়ে আবৃত থাকা সত্ত্বেও হুড়মুড় করে মাটিতে আছড়ে পড়ে, বিশাল প্রাণীটা ভূপাতিত হবার সময় পিঠের হাওদাটাকে একপাশে ছিটকে ফেলে দেয়। আরো একটা হাতি মাটিতে পড়ে যায়। জাহাঙ্গীরের কাছে মনে হয় আক্রমণ বুঝি ব্যর্থ হতে চলেছে কিন্তু তারপরেও বিশাল প্রাণীগুলোর কানের পেছনে বসে থাকা মাহুতের দল প্রাণীগুলোকে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার আদেশ দিতে, অবশিষ্ট হাতিগুলো তাদের ভূপাতিত সঙ্গীদের পাশ কাটিয়ে তাদের দেহের তুলনায় বিস্ময়কর দ্রুতগতিতে পাহাড়ের চূড়ার দিকে উঠে যাওয়া পথ দিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করে। মাঝে মাঝে ধোয়ার কুণ্ডলী সৃষ্টি হতে বোঝা যায় যে হাতিগুলোর হাওদায় স্থাপিত ছোট কামান, গজনলগুলো থেকে গোলা বর্ষণ করা হচ্ছে। জাহাঙ্গীর একই সময়ে লক্ষ্য করে তার অশ্বারোহী যোদ্ধারা পর্বত শিখরোপরি পথ দিয়ে আক্রমণ শুরু করেছে, তারা লাল মাটির জোড়াতালি দিয়ে তৈরি করা অবরোধক লাফিয়ে অতিক্রম করার সময় সবুজ নিশানগুলো উঁচুতে তুলে ধরে এবং বর্শার ফলা সামনের দিকে বাড়িয়ে রাখে এবং খসরুর অশ্বারোহীদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। উভয়পক্ষেই প্রচুর হতাহত হয় এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দুলকি চালে আরোহীবিহীন ঘোড়াগুলো ছুটে যায় আবার কিছু ঘোড়া আক্রমণকারীদের অগ্রসর হবার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। জাহাঙ্গীরের দৃষ্টি ক্রমেই যুদ্ধক্ষেত্রের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া সাদা ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় কিন্তু তার আগেই সে একদল অশ্বারোহীকে দেখতে পায়, মধ্যাহ্নের সূর্যকিরণে তাঁদের বক্ষস্থল আবৃতকারী বর্ম চিকচিক করছে, খসরুর তাবুর সামনে নিজেদের অবস্থান ত্যাগ করে দ্রুত আবদুর রহমানের আক্রমণের মুখে তাঁদের সহযোদ্ধাদের অবস্থান মজবুত করতে পশ্চিম দিকে এগিয়ে যায়। তার উপরেই যুদ্ধের সন্ধিক্ষণ নির্ভর করছে।

‘আমাদের এবার যাবার সময় হয়েছে, জাহাঙ্গীর ময়ান থেকে তাঁর পূর্বপুরুষের ব্যবহৃত ঈগলের মাথাযুক্ত হাতল বিশিষ্ট তরবারি আলমগীর টেনে বের করার মাঝে সুলেইমান বেগের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে রেকাবের উপরে দাঁড়িয়ে নিজের তূর্যবাদকের উদ্দেশ্যে সেটা আন্দোলিত করে তাঁদের অগ্রসর হবার সংকেত ঘোষণা করতে বলে। জাহাঙ্গীরের সাদা ঘোড়া অচিরেই আস্কন্দিত বেগে ছুটতে শুরু করে, আবদুর রহমানকে সহায়তা দানে পূর্বে পরিকল্পিত মেকী যুদ্ধের ঢঙে ছোটার সময় জন্তুটার খুরের আঘাতে মাটিতে থেকে ধুলো উড়তে থাকে।

যুদ্ধের সমূহ সম্ভাবনায় জাহাঙ্গীরের নাড়ীর স্পন্দন দ্রুততর হতে থাকে। তার বয়স ছত্রিশ বছর হতে চলেছে কিন্তু তাঁর পূর্বপুরুষেরা এই বয়সে যত যুদ্ধের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন সে তার তুলনায় অনেক কম যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছে, তাকে সামরিক নেতৃত্ব প্রদানে তাঁর আব্বাজানের অস্বীকৃতি এর জন্য আংশিক দায়ী এবং আংশিক দায়ী রাজ্য পরিচালনায় আকবরের সাফল্য যার ফলে মোগলদের খুব কমই যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হতে হয়েছে। সাম্রাজ্য যেহেতু তার সেই কারণে নেতৃত্বও তার এবং সে সমস্ত প্রতিদ্বন্দ্বীকে আজ গুঁড়িয়ে দেবে।

জাহাঙ্গীর তার সাদা ঘোড়া নিয়ে নিজের দেহরক্ষীদের মাঝ থেকে সামনে এগিয়ে যায় এবং তারপরে তাঁদের ইঙ্গিত করে ঘুরে গিয়ে পর্বতের শীর্ষে অবস্থিত শৈলশিরা বরাবর উঠে গিয়ে সামনের দিকে আক্রমণ করতে। তারা সবাই যখন আক্রমণ করতে ব্যস্ত, জাহাঙ্গীর পর্যাণের উপর মোড় দিয়ে পিছনে তাকিয়ে একজন অশ্বারোহী যোদ্ধা আর তাঁর খয়েরী রঙের ঘোড়াকে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখে, স্পষ্টতই বোঝা যায় খুব দ্রুত আর তীক্ষ্ণ বাঁক নিতে গিয়ে তাদের এই অবস্থা। মাটিতে পড়ে থাকা খয়েরী ঘোড়ার গায়ে আরেকটা ঘোড়া হোঁচট খায়, পাগুলো বাতাসে অক্ষম আক্রোশে আঘাত করে বিশাল জটা প্রাণপনে উঠার চেষ্টা করে। নিমেষের ভিতরে ভূপাতিত জন্তু আর তাঁদের আরোহীরা শৈলশিরার ক্রমশ খাড়া হয়ে উপরের দিকে উঠে যাওয়া পথ দিয়ে আক্রমণের বেগ ধীরে ধীরে জোরালো করতে আরম্ভ করলে তাদের পায়ের নিচে হারিয়ে যায়।

জাহাঙ্গীর তার হাতের তরবারি আলমগীর সামনে দিকে বাড়িয়ে ধরে, দূর্ঘটনা এড়াতে নিজের সাদা ঘোড়াটার গলার কাছে নিচু হয়ে ঝুঁকে এসে, পাহাড়ী ঢালটার গায়ে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ছোটবড় পাথরের টুকরো এড়িয়ে যেতে মনোনিবেশ করে। সে তারপরেই পটকা ফাটার মত কড়কড় একটা শব্দ শুনতে পায় এবং একটা হিস শব্দ তুলে তার কানের পাশ দিয়ে গাদাবন্দুকের গোলা অতিক্রম করে। সে মাটির তৈরি প্রতিবন্ধকতার প্রথম সারির প্রায় কাছে চলে এসেছে। সে তার হাতে ধরা লাগাম আলগা করে দিয়ে ঘোড়র কানের কাছে ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে। সামনের প্রতিবন্ধকতা লাফিয়ে অতিক্রম করতে সাহস দেয়, যা খুব বেশি হলে ফুট তিনেক লম্বা হবে। ঘোড়াটা যেন এই আদেশের অপেক্ষায় ছিল এবং সাথে সাথে লাফ দেয়। প্রতিবন্ধকতার উপর দিয়ে লাফিয়ে অতিক্রম করার সময় সেটার পিছনে লুকিয়ে থাকা শত্রুপক্ষের এক দীর্ঘদেহী তবকিকে লক্ষ্য করে জাহাঙ্গীর তরবারি চালায় বেচারা তখন মরীয়া হয়ে নিজের গাদাবন্দুকের লম্বা নল দিয়ে সীসার একটা নতুন গুলি ঠেসে ঢুকিয়ে দিয়ে সেটাকে পুনরায় গুলিবর্ষণের উপযোগী করার চেষ্টা করছে। লোকটা নিজের অভীষ্ট উদ্দেশ্য কখনই অর্জন করতে পারবে না, জাহাঙ্গীরের তরবারির প্রচণ্ড আঘাত লোকটার অরক্ষিত ঘাড়ের পেছনের অংশে কামড় বসায়, হাড়ের ভিতর দিয়ে একটা বীভৎস মড়মড় শব্দ করে এবং হতভাগ্য লোকটার কাঁধের উপর থেকে মাথাটা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

জাহাঙ্গীর হাপড়ের মত শ্বাস নিতে নিতে শৈলশিখরের চূড়ার দিকে আস্কন্দিত বেগে ঘোড়া হাঁকায় এবং যে তাবুটাকে খসরুর নিয়ন্ত্রক তাবু হিসাবে সে করেছে, সেটা তখনও আধমাইলের মত দূরে, এমন সময় সহসাই তার বাহনের গতি মন্থর হতে আরম্ভ করে। সে পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখে প্রাণীটার বামপাশ ফুড়ে দুটো তীরের ফলা বাইরে বের হয়ে রয়েছে। ক্ষতস্থান থেকে গাঢ় লাল বর্ণের রক্ত ইতিমধ্যেই কুলকুল করে গড়াতে আরম্ভ করে প্রাণীটার সাদা চামড়ায় একটা দাগের জন্ম দিয়েছে। জাহাঙ্গীরের তখন নিজের সৌভাগ্য নিয়ে চিন্তা করার মত বিলাসিতার সময় নেই–তার বাম হাঁটু থেকে মাত্র এক কি দুই ইঞ্চি দূরে একটা তীর বিদ্ধ হয়েছে–তার আগেই ঘোড়াটা হুড়মুড় করে মাটিতে আছড়ে পড়তে আরম্ভ করে এবং বিশাল জন্তুটা মাটিতে ভূপাতিত হবার সময় এর নিচে চাপা পড়ার হাত থেকে বাঁচতে সে লাফিয়ে উঠে পর্যাণ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়। মাটিতে আছড়ে পড়ার সময় জাহাঙ্গীর তাঁর শিরোস্ত্রাণ আর তরবারি দুটোই খোয়ায় এবং পাথুরে মাটিতে বেকায়দায় অবতরণ করায় তার বুক থেকে সব বাতাস বের হয়ে যায়।

জাহাঙ্গীর মাটিতে বার বার গড়াতে গড়াতে নিজেকে কুকড়ে ফেলে একটা বলে পরিণত করতে চেষ্টা করে এবং সে তার দস্তানা আবৃত হাত দিয়ে পেছনের অশ্বারোহী যোদ্ধাদের ঘোড়ার খুরের আঘাত থেকে নিজের মাথা বাঁচাতে চেষ্টা করে যারা তাকে অনুসরণ করে আক্রমণে উদ্যত হয়েছে। ধাবমান ঘোড়ার পাল আর খণ্ডযুদ্ধের মূল এলাকা থেকে বেশ খানিকটা দূরে ঢাল বরাবর নিচের দিকে বেশ খানিকটা দূরত্ব অতিক্রম করার পরে ঢালের পাশে অবস্থিত পাথরের একটা স্তূপের সাথে ধাক্কা লেগে তার যন্ত্রণাদায়ক পতনের বেগ স্তব্ধ হয় কিন্তু তা সত্ত্বেও, দুদ্দাড় ভঙ্গিতে ধাবমান একটা খুর তার পিঠের ইস্পাতের বর্মে আঘাত করে। বিমূঢ় আর বিভ্রান্ত এবং কানের ভিতরে হাজারো ঘন্টা ধ্বনি আর চোখে অস্পষ্ট দৃষ্টি নিয়ে সে টলমল করে নিজের পায়ে দাঁড়াবার সময় সে কাছাকাছি অবস্থিত কালো পাথরের আরেকটা স্তূপের পেছন থেকে একজন লোককে উঠে দাঁড়াতে দেখে এবং একটা তরবারি বাতাসে আন্দোলিত করতে করতে তাঁর দিকে ধেয়ে আসে, স্পষ্টতই তাকে চিনতে পেরেছে এবং তাকে হত্যা কিংবা বন্দি করতে পারলে প্রাপ্য সম্মান আর সম্পদ অর্জনে একচিত্ত।

জাহাঙ্গীর সহজাত প্রবৃত্তির বশে তাঁর পরিকরের দিকে হাত বাড়ায় যেখানে রত্নখচিত ময়ানে তার খঞ্জরটা রয়েছে। সে পরম স্বস্তিতে আবিষ্কার করে সেটা এখনও সেখানেই রয়েছে এবং চাপদাড়ি আর কালো পাগড়ি পরিহিত রুক্ষ-দর্শন এবং স্থূলকায়–লোকটা তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই সে সময়মত খঞ্জরটা ময়ান থেকে বের করে। জাহাঙ্গীর লোকটার প্রথম আক্রমণের ঝাপটা কৌশলে এড়িয়ে যায় কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তার পা পিছলে যায় এবং আবারও মাটিতে আছড়ে পড়ে। তাঁর হামলাকারী সুযোগ বুঝতে পেরে এবার দু’হাতে নিজের ভারি দুধারী তরবারি আঁকড়ে ধরে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে সেটা জাহাঙ্গীরের গলায় নামিয়ে আনতে চেষ্টা করে কিন্তু সে আঘাত করতে গিয়ে বড় তাড়াহুড়ো করায় জাহাঙ্গীরের বক্ষস্থল রক্ষাকারী বর্মে লেগে লোকটার আনাড়ি অভিঘাত পিছলে গেলে, লোকটা নিজেই নিজেকে ভারসাম্যহীন করে তোলে। জাহাঙ্গীর তার নাগরা পরিহিত পা দিয়ে প্রাণপনে লাথি হাঁকায় এবং তার প্রতিপক্ষের দু’পায়ের সংযোগস্থলে লাথিটা মোক্ষমভাবে আঘাত করলে সে নরম পেশীতন্তুর একটা তৃপ্তিকর স্পর্শ অনুভব করে। লোকটা তাঁর হাতের অস্ত্র ফেলে দিয়ে নিজের থেতলে যাওয়া অণ্ডকোষ খামচে ধরে, চরাচর স্তব্ধকারী ব্যাথায় হাঁটুর উপর কুকড়ে দু’ভাঁজ হয়ে আসে।

জাহাঙ্গীর নিজের সুবিধাজনক অবস্থার সুযোগ নিয়ে, তাঁর আক্রমণকারীর অরক্ষিত পায়ের গুলের শক্ত মাংসপেশীতে হাতের খঞ্জর দিয়ে দ্রুত দু’বার আঘাত করায়, লোকটা টলমল পায়ে একপাশে সরে গিয়ে মাটিতে পড়ে যায়। জাহাঙ্গীর ধুলি আচ্ছাদিত মাটির উপর দিয়ে হাচড়পাঁচড় করে এগিয়ে এসে নিজেকে লোকটার উপরে আছড়ে ফেলে এবং লোকটার কণ্ঠার হাড়ের ঠিক উপরের অরক্ষিত কণ্ঠনালীতে খঞ্জরের লম্বা ফলাটা আমূল গেঁথে দেয়। ফিনকি দিয়ে কিছুক্ষণ রক্ত উৎক্ষিপ্ত হয় আর তারপরে লোকটা নিথর ভঙ্গিতে মাটিতে পড়ে থাকে।

প্রাণহানির ঝুঁকি থেকে ভারমুক্ত হয়ে জাহাঙ্গীর যখন তার চারপাশে তাকায় তখনও সে চার হাতপায়ের উপর ভর দিয়ে রয়েছে এবং ঘন ঘন শ্বাস টানছে। সে তার ঘোড়র উপর থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ার পরে অনেকটা সময় অতিক্রান্ত হয়েছে মনে হলেও আসলে পাঁচ মিনিটও অতিবাহিত হয়নি। মূল লড়াইটা বোধহয় শৈলচূড়ার বেশ খানিকটা উপরের দিকে সংঘটিত হচ্ছে। সে যদিও তখনও চোখে ঝাপসা দেখছে তার ভেতরেই সে বেশ কিছুটা দূরে অশ্বারোহী একটা অবয়বকে লক্ষ্য করে দ্রুত এগিয়ে আসছে এবং, ঝাপসা চোখে সে যতটা বুঝতে পারে, লোকটার সাথে আরেকটা অতিরিক্ত ঘোড়া রয়েছে। জাহাঙ্গীর টলমল করতে করতে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ায় এবং নতুন কোনো আক্রমণের বিরুদ্ধে নিজেকে প্রস্তুত করতে চেষ্টা করে কিন্তু তারপরেই সে একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। জাহাঙ্গীর, আপনি কি সুস্থ আছেন?’ সুলেইমান বেগের কণ্ঠস্বর।

‘হ্যাঁ, আমার তো তাই মনে হয়… আপনার সাথে কি পানি আছে?

সুলেইমান বেগ তাঁর দিকে পানিপূর্ণ একটা চামড়ার তৈরি মশক এগিয়ে দেয়। জাহাঙ্গীর দু’হাতে মশকটা আঁকড়ে ধরে, সেটা উপুড় করে ধরে ব্যগ্রভাবে পানি পান করে।

‘আক্রমণের সময় এতটা বেপরোয়া হয়ে উঠা আপনার মোটেই উচিত হয়নি। আপনি আমাকে আর আপনার দেহরক্ষীদের পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গিয়েছিলেন। সম্রাট নিজেকে এভাবে অরক্ষিত করতে পারেন না।’

‘এটা আমার লড়াই। আমার নিজের ছেলে আমার শাসন অমান্য করে বিদ্রোহ করেছে এবং তাকে দমন করাটা আমার দায়িত্ব, জাহাঙ্গীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে, তারপরে জানতে চায়, ‘লড়াইয়ের কি খবর? অতিরিক্ত ঘোড়াটা আমাকে দাও। আরো একবার আক্রমণের নেতৃত্ব দিতে আমাকে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে।’

‘আমি ঘোড়াটা আপনার জন্যই এনেছি–এবং আমি আপনার তরবারিও উদ্ধার করেছি, জাহাঙ্গীরের দিকে তরবারি আর ঘোড়ার লাগাম এগিয়ে দিয়ে, সুলেইমান বেগ বলে। কিন্তু আপনি কি নিশ্চিত যে আপনি সুস্থ রয়েছেন?

‘হ্যাঁ, জাহাঙ্গীর যতটা অনুভব করে কণ্ঠে তাঁর চেয়ে বেশি নিশ্চয়তা ফুটিয়ে বলে। অতঃপর সে তাঁর নতুন বাহন, খয়েরী রঙের উঁচু, ছিপছিপে ঘোড়ার পর্যাণে সুলেইমান বেগের সহায়তায় চার হাত পায়ের সাহায্যে বহু কষ্টে আরোহণ করে। সময় অতিবাহিত হবার সাথে সাথে তাঁর মাথা থেকে বিভ্রান্তির মেঘ অপসারিত হওয়ায় সে স্বস্তি বোধ করে, তারপরে সুলেমান বেগ আর নিজের কতিপয় দেহরক্ষী যারা ইতিমধ্যে তাঁর পাশে এসে অবস্থান গ্রহণ করেছে তাদের নিয়ে সে পুনরায় শৈলশিখরোপরি পথ দিয়ে উপরে উঠতে আরম্ভ করে যেখানে কয়েকটা তাবুর চারপাশে দারুণ লড়াই জমে উঠেছে। খসরুর অনুগত লোকেরা সেখানে দারুণ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। সে দেখে দু’পক্ষের যোদ্ধাদের বহনকারী ঘোড়াগুলো দুই পায়ের উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় তাদের আরোহীরা পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হলে। খসরুর বেশ কয়েকজন অশ্বারোহী যোদ্ধা, সম্ভবত জাহাঙ্গীর আর সুলেইমান বেগকে চিনতে পেরে তাবুর চারপাশের লড়াই থেকে সরে আসে এবং তাঁদের আক্রমণ করতে আস্কন্দিত বেগে নিচের দিকে নামতে নামতে চিৎকার করে খসরু জিন্দাবাদ’, যুবরাজ খসরু দীর্ঘজীবি হোন!

একজন সরাসরি জাহাঙ্গীরের দিকে ধেয়ে আসে। হাত আর পা আন্দোলিত করে, উন্মত্তের ন্যায় ঘোড়া হাঁকিয়ে লোকটা ধেয়ে আসতে, জাহাঙ্গীর লক্ষ্য করে সে আর কেউ না আজিজ কোকার ছোট ভাই। তরুণ যোদ্ধা আরেকটু কাছাকাছি এসে জাহাঙ্গীরকে লক্ষ্য করে সে নিজের হাতের বাঁকানো তরবারি দিয়ে তাকেই লক্ষ্য গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে আঘাত হানতে সম্রাট মাথা নিচু করে আঘাতটা এড়িয়ে যান এবং তাঁর মাথার দুই ইঞ্চি উপর দিয়ে তরবারির ফলাটা বাতাসে শূন্যের ভিতর দিয়ে কক্ষপথে ঘুরে আসে। অশ্বারোহী আক্রমণকারী পাহাড়ের ঢাল দিয়ে নিচের দিকে আক্রমণের জন্য ধেয়ে আসার সময় গতিপ্রাবল্যের কারণে জাহাঙ্গীরকে অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলে, জাহাঙ্গীর পর্যাণের উপর কোমর থেকে দেহের উধ্বাংশ এক মোচড়ে ঘুরিয়ে নেয় এবং লোকটাকে বাধা দিতে তরবারির তীব্র বিপ্রতীপ আঘাত করতে তাঁর ঊর্ধ্ববাহুর হাড় মাংসের গভীরে তরবারির ফলা প্রবেশ করে, হাতটাই দেহ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আক্রমণকারী লোকটা তার বাহনের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, তরুণ যোদ্ধা পাহাড়ের ঢাল দিয়ে দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে জাহাঙ্গীরের শিবিরের দিকে ধেয়ে নামতে থাকে যতক্ষণ না শিবিরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উল্টানো মালবাহী শকটের পেছনে ইসমাইল আমলের মোতায়েন করা জাহাঙ্গীরের তবকিদের একজনের নিশানা ভেদী দুর্দান্ত একটা গুলি তাকে পর্যাণ থেকে ছিটকে দেয়।

জাহাঙ্গীর নিজের চারপাশে তাঁর চিরাচরিত তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে যে অন্য আক্রমণকারীদের হয় তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে কিংবা পাহাড়ের ঢাল দিয়ে উপরের দিকে পশ্চাদপসারণে বাধ্য করা হয়েছে। অনেকগুলো নিথর দেহ মাটিতে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ধুসর শ্মশ্রুমণ্ডিত, লাল আলখাল্লা পরিহিত দীর্ঘদেহী একটা লোক কাছেই পিঠের উপর ভর দিয়ে হাত পা ছড়িয়ে আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে পড়ে রয়েছে। তার উদরের ভেতর থেকে বর্শার একটা রক্তাক্ত ফলা বের হয়ে আছে। জাহাঙ্গীর লোকটাকে চিনতে পারে, তুহিন সিং, তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত দেহরক্ষীদের একজন–তাঁর আম্মাজানের মাতৃভূমি আম্বার থেকে আগত এক রাজপুত যোদ্ধা।লোকটা প্রায় সিকি শতাব্দি যাবত তাকে পাহারা দিয়েছে এবং এখন যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর জন্য প্রাণ দিয়েছে। কয়েক গজ দূরেই, লাল ধুলির মাঝে ক্ষীণদর্শন একটা অবয়ব তীব্র যন্ত্রণায় মোচড় খায় এবং তাঁর দেহ আক্ষিপ্ত হয়, তাঁর পায়ের গোড়ালী মাটিতে পদাঘাত করছে এবং দৃঢ়মুষ্ঠিতে নিজের উদর আঁকড়ে রয়েছে যেখান থেকে লালচে-নীল রঙের নাড়িভূড়ি বের হয়ে আসতে চেষ্টা করছে। লোকটা অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করে নিজের মাকে ডাকছে। ইমরানের শুশ্রুবিহীন বিকৃত মুখটা, আজিজ কোকার একেবারেই অল্পবয়সী ভাই, চিনতে পেরে জাহাঙ্গীর আঁতকে উঠে জোরে শ্বাস নেয়। তার বয়স কোনোমতেই তের বছরের বেশি হবে না এবং নিশ্চিতভাবেই আগামীকালের সূর্যোদয় দেখার জন্য সে বেঁচে থাকবে না।

খসরু, আজিজ কোকা আর তাদের সহযোগী ষড়যন্ত্রকারীদের ক্ষমতার প্রতি অপরিণামদর্শী মোহের কারণে এতগুলো তাজা প্রাণের অকাল মৃত্যুতে তাঁদের প্রতি চরাচরগ্রাসী এটা ক্রোধ জাহাঙ্গীরকে আপুত করে তোলে। জাহাঙ্গীর তার খয়েরী ঘোড়াটার পাজরে গুঁতো দিয়ে ঢাল দিয়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু করার আগে সুলেইমান বেগ আর নিজের দেহরক্ষীদের চিৎকার করে আদেশ দেয় তাকে অনুসরণ করতে। সে অচিরেই খণ্ডযুদ্ধের নিয়ামক স্থানে পৌঁছে, তার চারপাশে ইস্পাতের ফলা মৃত্যুর সিদ্ধান্ত করছে। জাহাঙ্গীরের তরবারি আলমগীর প্রতিপক্ষের এক অশ্বারোহীর গলায় একটা মোক্ষম ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিতে সেখান থেকে ছিটকে উঠা রক্তে তাঁর মুখ ভিজে যেতে সে কয়েক মুহূর্ত চোখে কিছুই দেখতে পায় না। সে দ্রুত হাতের আস্তিনে চোখ মুছে নিয়ে, ইস্পাতের ফলার প্রতিদ্বন্দ্বীতা, চিৎকার আর আর্তনাদে মুখরিত এলোপাথাড়ি লড়াইয়ের দিকে ধেয়ে যায়।

ঘাম আর বারুদের ঝাঁঝালো গন্ধ তাঁর নাসারন্ধ্রে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয় আর বাতাসে আধিপত্য বিস্তারকারী লাল ধুলো তাঁর চোখে ক্রমাগত গুল ফোঁটাতে থাকলে তার কাছে শত্রু মিত্রে প্রভেদকারী সীমান্ত প্রায় বিলীন হয়ে আসে। কিন্তু সে সুলেইমান বেগ আর দেহরক্ষীদের বেষ্টনীর মাঝে অবস্থান করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। আলমগীরের চূড়ান্ত একটা আঘাত যা খসরুর এক লোকের হাঁটুর উপর মোক্ষমভাবে ছোবল দিয়ে, পেশীত আর অস্থিসন্ধির গভীরে কেটে বসে যায় এবং আঘাতে প্রচণ্ডতায় আরো একবার জাহাঙ্গীরের হাত থেকে তরবারির হাতল প্রায় ছুটে যাবার দশা হয়, আর সেই সাথে জাহাঙ্গীর যুদ্ধক্ষেত্রের প্রথম ব্যুহ অতিক্রম করে। সে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখে যে মাত্র চারশ গজ দূরে পর্বত শৃঙ্গের চূড়ায় খসরুর তাবুগুলোর অবস্থান। অবশ্য, সে যখন তাকিয়ে রয়েছে, দেখতে পায় বিশাল একদল অশ্বারোহী তাবুগুলো পরিত্যাগ করে শৈলচূড়ার অপর পাশে হারিয়ে যায়। অশ্বারোহীদের দলটা যখন চলে যাচ্ছে সে দেখে–বা তার মনে হয় সে দেখেছে–খসরু তাদের মাঝখানে অবস্থান করছে।

‘ওদের ধাওয়া কর। কাপুরুষগুলো পালিয়ে যাচ্ছে, সে নিজের খয়েরী ঘোড়ার পাঁজরে গুঁতো দিয়ে সুলেমান বেগ আর নিজের দেহরক্ষীদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে। বিশাল জটা ইতিমধ্যে অবশ্য, কিছুক্ষণ আগে সংঘটিত যুদ্ধের ধকল সামলাতে নাকের পাটা প্রসারিত করে, ভীষণভাবে হাঁপাতে শুরু করেছে, এবং এই ঘোড়াটা যার স্থান নিয়েছে তাঁর আগের সেই সাদা ঘোড়ার মত স্বাস্থ্যবান আর তেজী এটা না। সে যখন পর্বত শীর্ষের চূড়ায় পৌঁছে, জাহাঙ্গীর শৈল শিখরের পাদদেশে মোতায়েন করা তাঁর যোদ্ধাদের একটা প্রতিরক্ষা ব্যুহের সাথে পলায়নকারী দলটাকে সংঘর্ষে লিপ্ত অবস্থায় দেখে। কিছুক্ষণের ভিতরেই মরিয়া দলটা প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে বের হয়ে আসে, তাদের মাত্র একজন যোদ্ধা হত হয়েছে যার আরোহীবিহীন ঘোড়াটা লাগাম মাটিতে পরা অবস্থায়, মূল দলটার পেছন পেছন দৌড়াতে থাকে, সমভূমির উপর দিয়ে খুব কাছাকাছি অবস্থানে বিন্যস্ত হয়ে উত্তরের দিকে এগিয়ে যায়।

জাহাঙ্গীর খয়েরী ঘোড়াটার পাঁজরে পুনরায় গুতো দিয়ে ধাওয়া শুরু করলেও সে মনে মনে ঠিকই বুঝতে পারে পুরো প্রয়াসটাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। তার কুলাঙ্গার সন্তান নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। পলায়নের যে কোনো প্রয়াস বাধাগ্রস্থ করতে সে কেন আরো বেশি সংখ্যক অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েন করে নি? তাকে তারপরেই পরম স্বস্তিতে ভাসিয়ে মোগলদের সবুজ নিশান–খসরুর নিজের প্রতীকচিহ্ন হিসাবে দাবি করা বেগুনী নয়–উড়িয়ে সে দেখে একদল অশ্বারোহী পশ্চিম দিক থেকে অনিবার্য মুখোমুখি সংঘর্ষের অনিবার্য পথ বরাবর আবির্ভূত হয়। আবদুল রহমানও নিশ্চয়ই আগেই দলটার গতিবিধি দেখতে পেয়েছিল এবং তাঁদের পাঠিয়েছে। তারা খুব দ্রুত পলায়নপর দলটার সাথে নিজেদের দূরত্ব হ্রাস করতে থাকে। জাহাঙ্গীর তার দেহরক্ষী আর সুলেইমান বেগকে সাথে নিয়ে নিজের ক্লান্ত ঘোড়াটাকে পর্বত শিখরের শৈল শিরার দূরবর্তী প্রান্তের ঢালের দিকে ছোটার জন্য তাড়া দেয়। কিন্তু সে শৈল শিরার পাদদেশে পৌঁছাবার পূর্বেই, খসরুর লোকেরা তাদের পশ্চাদ্ধাবনকারীদের নিকট হতে চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করে এবং তাঁদের পেছনে ধুলার একটা মেঘের সৃষ্টি করে, উত্তরপূর্ব দিকে আস্কন্দিত বেগে ছুটতে থাকে। জাহাঙ্গীর তখন খসরুর চার বা পাঁচজন পশ্চাদ্‌রক্ষীকে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে উদ্যত তরবারি মাথার উপরে আন্দোলিত করে আবদুর রহমানের বাহিনীর দিকে ছুটে যায় উদ্দেশ্য একটাই নিজেদের জীবনের বিনিময়ে পলায়নের জন্য তাদের সহযোদ্ধাদের কিছুটা সময় করে দেয়া।

সে কয়েক গজ দূরত্ব অতিক্রম করার পূবেই এই সাহসী লোকগুলোর একজন, হাত দুপাশে ছড়িয়ে, তাঁর কালোর ঘোড়র উপর থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ে, ধাওয়াকারীদের দলে আবদুর রহমানের বিচক্ষণতার কারণে প্রেরিত অশ্বারোহী তীরন্দাজদের কোনো একজনের নিক্ষিপ্ত তীরের আঘাতে এবং জাহাঙ্গীর কেবল বুঝতে পারে রেকাবের উপরে দাঁড়িয়ে তাঁরা তাঁদের আয়ুধ শূন্যে ছুড়ছে। খসরুর আরেক অনুগত যোদ্ধার বাহন কিছুক্ষণ পরেই আরোহীকে মাথার উপর দিয়ে ছিটকে দিয়ে, ভূপাতিত হয়। অন্য যোদ্ধারা তাঁদের আক্রমণের অভিপ্রায়ে নিজেদের ছুটে চলা অব্যাহত রাখে এবং আবদুর রহমানের অগ্রবর্তী অশ্বারোহীদের মাঝে আছড়ে পড়তে তারা নিজেদের সারির ভিতরে একটা শূন্যস্থানের সৃষ্টি করে তাদের মোকাবেলা করতে এবং ঘিরে ফেলে, তাঁদের অগ্রসর হবার গতি এর ফলে শ্লথ হয় কি হয় না। জাহাঙ্গীরের লোকেরা এক মিনিটেরও কম সময়ের ভিতরে ঘোড়ার গলার কাছে মাথা নিচু করে রেখে আবারও বল্পিত বেগে ছুটতে শুরু করে বিদ্রোহীদের বেশ কয়েকজনের মৃতদেহ আর ঘোড়া এলোমেলোভাবে তাঁদের পেছনে পড়ে থাকে। খুসরুর অনুগত যোদ্ধারা তাদের শত্রুদের কমপক্ষে দু’জনকে নিজেদের সাথে মৃত্যুর ছায়ায় টেনে নিয়েছে, কিন্তু তাঁদের সাহসিকতা খসরুকে বাঁচাতে পারবে না। আবদুর রহমানের বাহিনী পালাতে থাকা দলটার এখন প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে এবং আরো দু’জন পশ্চাদ্ক্ষীর, একজনের ঘোড়ার সাথে সংযুক্ত দণ্ডে খসরুর বেগুনী নিশান উড়ছে, ভবলীলার সমাপ্তি ঘটে, সম্ভবত অশ্বারোহী তীরন্দাজদের নৈপূণ্যের শিকার। নিশান-বাহকের পা তার ঘোড়ার রেকাবে আটকে যায় এবং সে লাল ধুলার উপর দিয়ে প্রায় একশ গজ হেঁচড়ে যাবার সময় বেগুনী নিশানটা তার পেছনে উড়তে থাকে। রেকাবের চামড়ার বাঁধন এরপরে ছিঁড়ে যেতে হতভাগ্য লোকটা আর তার বহন করা নিশানা দোমড়ানো মোচড়ানো অবস্থায় নিথর হয়ে পড়ে থাকে।

জাহাঙ্গীর তার খয়েরী রঙের ঘোড়াটাকে যখন তাড়া দেয়, যা পশ্চাদ্ধাবনের প্রয়াসের কারণে আরো জোরে জোরে শ্বাস নেয়, সরু পাজর হাপরের মত উঠানামা করে, সে দেখে খসরুর লোকেরা আবারও একপাশে সরে যায় কিন্তু তারপরেই করকটে বৃক্ষাদির একটা ঝাড়ের কাছে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। সে প্রথমে ভাবে প্রতিপক্ষ বোধহয় সেখানে অবস্থান নিয়ে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিন্তু তারপরে তাঁদের চারপাশে বিক্ষুব্ধ তরঙ্গের ন্যায় আন্দোলিত হতে থাকা ধুলোর মাঝে সে মাটিতে পরে থাকা পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্রের ঝিলিক দেখতে পায়। আজিজ কোকার নিষ্পাপ কিশোর ভাই আর আবদুর রহমানের অগ্রবর্তী বাহিনীকে যারা আক্রমণ করেছিল সেইসব সাহসী লোকদেরমত, আরো অনেককে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে তারা এখন নিজেদের মূল্যহীন জীবন বাঁচাতে আত্মসমর্পণ করতে চাইছে। জাহাঙ্গীর চোখে মুখে একটা ভয়াবহ অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে নিজের খয়েরী ঘোড়াটা থেকে এর প্রাণশক্তির শেষ নির্যাসটুকু নিংড়ে নিতে পায়ের গোড়ালী দিয়ে নির্মমভাবে পরিশ্রান্ত জন্তুটার পাঁজরে গুতো দিয়ে ভাবে অপদার্থগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে সত্যিকারের পুরুষের মত মৃত্যুবরণ না করার সিদ্ধান্তের জন্য ভীষণ আফসোস করবে।

*

‘আমার সামনে তাঁদের হাজির করো।’

জাহাঙ্গীরের দেহে লড়াইয়ের স্বেদবারি তখনও উষ্ণতা হারায়নি এবং হৃৎপিণ্ড ক্রোধে উদ্বেল, সে বৃক্ষাদির ঝাড়ের নিচের ছায়া থেকে দেখে যে তাঁর সৈন্যরা খসরু, তাঁর প্রধান সেনাপতি, আজিজ কোকা এবং তাঁর অশ্বপালের আধিকারিক, হাসান জামালকে টেনে হেঁচড়ে সামনের দিকে নিয়ে আসে এবং তাঁর সামনে ধাক্কা দিয়ে তাঁদের হাঁটু মুড়ে বসিয়ে দেয়। সম্রাটের দিকে বাকি দু’জন যদিও চোখ তুলে তাকাবার সাহস দেখায় না, খসরু তার আব্বাজানের দিকে সানুনয়ে তাকিয়ে থাকে। তাদের পেছনে, খসরুর ত্রিশজনের মত লোক যারা তাঁর সাথে আত্মসমর্পণ করেছিল, তাঁদের পরনের কাপড় থেকে ছিঁড়ে নেয়া টুকরো কিংবা পর্যাণে ব্যবহৃত কম্বলের ফালি দিয়ে ইতিমধ্যে তাদের হাত পিছমোড়া করে বাঁধা হয়েছে। জাহাঙ্গীরের সৈন্যরা নির্মমভাবে ধাক্কা দিয়ে তাঁদের মাটিতে বসিয়ে দেয়। জাহাঙ্গীর বন্দিদের ভেতর সহসা দীর্ঘকায়, পেশল দেহের অধিকারী একজন লোককে চিনতে পারে, লোকটার দাড়ি মেহেদী দিয়ে লাল রঙ করা। তার মনে পড়ে যুদ্ধক্ষেত্রে লোকটাকে নিমেষের জন্য দেখেছিল, মুখে নির্মম হাসি ফুটিয়ে, নিজের ঘোড়া থেকে মাটিতে পড়ে যাওয়া অল্প বয়সী এক তরুণ যোদ্ধার উদর বর্শা দিয়ে এফোঁড়ওফোঁড় করে দেয়ার আগে, যে তাঁর সামনে আতঙ্কিত আর অসহায় অবস্থায় পড়ে ছিল, হাতের বর্শা দিয়ে বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে খোঁচা দিচ্ছে।

চরাচরগ্রাসী এমন একটা ক্রোধ জাহাঙ্গীরকে আপুত করে যে সে কিছুক্ষণের জন্য ঠিকমত কিছুই চিন্তা করতে পারে না। সে যখন নিজের উপর পুনরায় নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায় তখন তার মাথা জুড়ে কেবল একটাই বিষয় কীভাবে এমন নিশ্চেতন বিদ্রোহীকে যথাযুক্ত নির্মমতার সাথে শাস্তি দেবে। তারপরে সে যথাযথ শাস্তি খুঁজে পায়। মোগলরা পুরুষানুক্রমে জঘন্যতম অপরাধীদের শিশু হত্যাকারী, ধর্ষণের মত অন্যান্য অপরাধকারী–শূলে দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। প্রথম মোগল সম্রাট, বাবর, তাঁর প্রপিতামহ, বিদ্রোহী আর দস্যুদেরও এই শাস্তি দিতেন–এই লোকগুলোরও ঠিক একই রকম শাস্তি প্রাপ্য। আত্মসমর্পণের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা তাদের বিদ্রোহ চালিয়ে গিয়েছে, তাঁদের বর্শার ফলায় সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ সেইসব অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদের বিদ্ধ করেছে। তাদের এবার বুঝতে দেয়া হোক শূলবিদ্ধ হবার অনুভূতি। একই আতঙ্ক আর যন্ত্রণা তাঁরাও সহ্য করুক। একমাত্র এভাবেই ন্যায়বিচার সম্ভব। সে বিষয়টা নিয়ে আর চিন্তাভাবনা না করে ক্রোধে কর্কশ হয়ে থাকা কণ্ঠে তার সৈন্যদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে, এই গাছগুলো থেকে তোমাদের রণকুঠার আর তরবারি ব্যবহার করে শক্ত কাষ্ঠ দণ্ড প্রস্তুত কর। দণ্ডগুলো মাটিতে ভালোমত পুঁতে দাও। তোমাদের পক্ষে যতটা সম্ভব সেগুলোকে সূচালো করো কিংবা দণ্ডগুলোর অগ্রভাগে বর্শার ফলা সংযুক্ত করে নরকের কীট এই বিদ্রোহীদের সেইসব দণ্ডে বিদ্ধ কর। কাজটা করতে হবে এবং এখনই সেটা করতে হবে। আমার পুত্র আর তাদের, তার দুই প্রধান সহযোগীকে কেবল রেখে যাও। নিজেদের নিয়তি সম্পর্কে তারা অবহিত হবার পূর্বে নিজেদের লোকদের যন্ত্রণা তাদের দেখতে দেয়া হোক। তারা অন্যদের কেমন দুর্ভোগের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে সে বিষয়ে তারা সামান্য হলেও অনুধাবন করবে ভবিষ্যতের গর্ভে তাঁদের জন্য কি অপেক্ষা করছে তার পূর্বাভাষ।’

তার সৈন্যরা আদেশ পালনে দ্রুত ব্যস্ত হয়ে উঠে, রণকুঠার দিয়ে কেউ গাছ কাটতে আরম্ভ করে, অন্যরা তাৎক্ষণিকভাবে হাতের কাছে যা কিছু খুঁজে পায় এমনকি কেউ শিয়োস্ত্রাণ দিয়েই শূলের জন্য গর্ত তৈরি করতে মাটি খুড়তে আরম্ভ করলে বাকিরা তখন বন্দিদের শক্ত করে ধরে মাঠের উপর দিয়ে তাঁদের সবলে টেনে নিয়ে যায়, জাহাঙ্গীর তার বাহুর উপরে সুলেইমান বেগের হাত অনুভব করে। জাহাঙ্গীরের দুধ-ভাই কোনো কিছু বলার আগেই সে বলে, না, সুলেইমান বেগ, এটা কার্যকর করতেই হবে। তারা নিজেরাই শাস্তিটা বয়ে এনেছে। তাঁরা কোসো ধরনেরই করুণা প্রদর্শন করে নি। আমিও করবো না। আমি অবশ্যই একটা দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করবো।’

জাহাঙ্গীর তাকিয়ে দেখে খসরু, তখনও হাঁটু ভেঙে বসে রয়েছে, কাপুরুষোচিত আতঙ্কের একটা অভিব্যক্তি নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। নিজের সন্তানের বিশ্বাসঘাতকতা, এত বিপুল সংখ্যক সৎ লোকের অনর্থক আত্মত্যাগের কথা চিন্তা করে, সে বহু কষ্টে খালি হাতে তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়া থেকে নিজেকে সংযত রাখে। পাঁচ মিনিটের মত কেবল প্রায় অতিক্রান্ত হয়েছে তারপরেই জাহাঙ্গীরের চারজন তোক উন্মত্তের মত ধ্বস্তাধ্বস্তি আর লাথি ছুঁড়তে থাকা বন্দিদের প্রথমজনকে–গাট্টাগোট্টা, রোমশ দেহের এক লোক যার পরনের কাপড়ের অধিকাংশই তাঁরা ছিঁড়ে ফেলেছে–শূন্যে অনেক উঁচুতে তুলে ধরে। তারা তারপরে তাদের পুরো শক্তি প্রয়োগ করে বর্শা আর কাঠের দণ্ডের সাহায্যে তড়িঘড়ি করে নির্মিত শূলগুলোর একটার উপরে তার দেহটা নিয়ে আসে। লোকটার মলদ্বারের কাছের নরম মাংসে যখন শক্ত তীক্ষ্ণ অংশটা প্রবিষ্ট হয়, তাঁর চিৎকারে–মানুষের চেয়ে পশুর সাথেই বেশি মিল–চারপাশের বাতাস বিদীর্ণ হয়। জাহাঙ্গীরের লোকেরা যখন হতভাগ্য বন্দির পা ধরে নিচের দিকে টানতে শুরু করে, সবেগে নির্গত রক্তে নিচের মাটি লাল করে, দণ্ডটা লোকটার কণ্ঠার হাড়ের কাছ দিয়ে দেহের বাইরে বের হয়ে আসে। তারপরে আরো বেশি সংখ্যক বিদ্রোহীদের যখন শূলবিদ্ধ করা হলে নাড়িভূঁড়ির বিদারণের এবং আতঙ্কিত মানুষজনের বিষ্ঠার, যারা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেদের নাড়িভূঁড়ির উপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, দুর্গন্ধ বাড়তে আরম্ভ করে। কিন্তু জাহাঙ্গীর, সে তখনও আপন ক্রোধে অধীর হয়ে রয়েছে এবং নিষ্ঠুর ন্যায়পরায়ণতা বিষয়ে একচিত্ত, এসব কিছুই লক্ষ্য করে না।

খসরুর এবার বিভীষিকা খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করার পালা যার জন্য তাঁর মাত্রাছাড়া উচ্চাকাঙ্খ দায়ী। জাহাঙ্গীর সামনের দিকে হেঁটে আসে এবং নিজের হাঁটু গেড়ে বসে থাকা সন্তানকে কাঁধ ধরে টেনে তুলে নিজের পায়ের উপরে তাকে জোর করে দাঁড় করিয়ে দেয়। দেখো, তোমার কারণে সবার কি দুর্গতি। কেবল তোমার কারণেই এই লোকগুলো কষ্ট পাচ্ছে। দণ্ডগুলোর মাঝ দিয়ে হেঁটে যাও… হাঁটতে শুরু কর,’ খসরুর মুখের একেবারে সামনে নিজের মুখ নিয়ে এসে, সে চিৎকার করে। তারপরে, নিজের সন্তানকে ছেড়ে দিয়ে, শূলের অভিমুখে সে তাকে একটা ধাক্কা দেয়। কিন্তু খসরু, তাঁর বাহুদ্বয় শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখে এবং দুচোখ প্রাণপনে বন্ধ করে রাখা, ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। জাহাঙ্গীর সাথে সাথে নিজের দেহরক্ষীদের কয়েকজনকে চিৎকার করে ডাকে। সবগুলো শূলের পাশ দিয়ে তাকে হেঁটে যেতে এবং পুনরায় ফিরে আসতে বাধ্য কর। সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে কাজটা করবে। সবগুলো মৃতদেহের দিকে তাঁর তাকাবার বিষয়ে নিশ্চিত হবে…’

দু’জন প্রহরী সাথে সাথে দু’পাশ থেকে খসরুর হাত শক্ত করে ধরে এবং শূলের দিকে তাকে নিয়ে যায়। খসরুর মাথা প্রতি পদক্ষেপের সাথে নিচের দিকে ঝুঁকে আসে কিন্তু প্রতিবারই কয়েক পা হাঁটার পরে তাঁর প্রহরীরা শূলের উপর যন্ত্রণায় মোচড়াতে আর পা ছুঁড়তে থাকা এবং এটা করার কারণে নিজেকে আরো বেশি করে শূলবিদ্ধ করতে থাকা, তাঁর মৃত্যু পথযাত্রী সমর্থকদের কোনো একজনের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে যায়, এবং সৈন্যদের একজন খসরুর মাথা চুল ধরে পেছনের দিকে টেনে এনে, তাকে দেখতে বাধ্য করে। কিন্তু স্পষ্টতই বোঝা যায় খসরুর যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। জাহাঙ্গীর তাঁর সন্তানকে প্রহরীদের বাহুর মাঝে ঝুলে পড়তে এবং তারপরে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখে। সে অনুমান করে খসরু জ্ঞান হারিয়েছে। যথেষ্ট হয়েছে। আমার ছেলেকে এখানে ফিরিয়ে নিয়ে এসো, সেই সঙ্গে আজিজ কোকা আর হাসান জামালকে।

জাহাঙ্গীর কিছুক্ষণ পরে, তাঁর সামনে পুনরায় নতজানু হয়ে থাকা তিনজনকে খুটিয়ে দেখে। খসরুকে চাঙ্গা করতে প্রহরীদের একজন পানির মশকে রক্ষিত উপাদান তার উপরে নিক্ষেপ করায় তার লম্বা কালো চুল ভেজা। সে মড়ার মতো ধুসর আর থরথর করে কাঁপছে এবং দেখে মনে হয় যে কোনো মুহূর্তে বমি করবে। চারপাশের শূল থেকে ভেসে আসা যন্ত্রণার তীক্ষ্ণ আর্তনাদ, যেখানে অবশিষ্ট বিদ্রোহীদের তখনও শূলবিদ্ধ করা অব্যাহত রয়েছে, ছাপিয়ে তাঁর কথা সবার কাছে পৌঁছে দিতে জাহাঙ্গীর নিজের কণ্ঠস্বর একটু উঁচু করে বলে, তোমরা সবাই একজন প্রজা তাঁর জমিদারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জঘন্য অপরাধের দোষে দোষী–সশস্ত্র বিদ্রোহ। তুমি

‘আমি কেবল একজন প্রজা না… আমি আপনার পুত্র…’ খসরু মিনতি জানায়, তাঁর একদা সুদর্শন তারুণ্যদীপ্ত মুখাবয়বে বিভীষিকার একটা অবিমিশ্র মুখোশ।

‘খামোশ! সন্তানের অধিকার দাবি করার পূর্বে নিজেকে প্রশ্ন করো তুমি কি সন্তানের যোগ্য আচরণ করেছে। তুমি কোনোভাবেই নরকের ঐ কীটগুলোর চেয়ে সহনশীল আচরণের উপযুক্ত নও যাদের নিদারুণ যন্ত্রণার জন্য আমি নই, বা তোমার পাশে যে দু’জন দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা দায়ী, কেবল তুমি দায়ী। আজিজ কোকা, হাসান জামাল, আপনারা একসময়ে আমার প্রতি আনুগত্যের শপথ নিয়েছিলেন কিন্তু আপনাদের সেই অঙ্গীকার আপনারা ভঙ্গ করেছেন। তার দিকে অসহায়ভাবে তারা তাকিয়ে থাকে, সে কথা বলা বজায় রাখলে তাদের চোখে ভয় খেলা করতে থাকে, কোনো ধরনের করুণার প্রত্যাশা করবেন না, কারণ আমার কাছে প্রদর্শনের মত কোনো অজুহাত নেই। বিশ্বাসঘাতক আর অনবধান উচ্চাকাঙ্খী মানুষের পাশাপাশি পশুর অন্ধ মূঢ়তা আপনাদের ভিতরে কাজ করেছে। আপনাদের কুৎসিত পশু প্রবৃত্তি প্রতীকায়িত করতে আপনাদের লাহোর নিয়ে গিয়ে সেখানে বাজারে আপনাদের উলঙ্গ করা হবে এবং একটা ষাড় বা গাধার সদ্য ছাড়ানো চামড়ার ভিতরে ঢুকিয়ে সেলাই করা হবে। তারপরে গাধার পিঠে উল্টো করে বসিয়ে দিনের খরতাপে তোমাদের শহরের প্রধান সড়ক দিয়ে প্রদক্ষিণ করানো হবে আমার অনুগত প্রজারা যেন তোমাদের অপমানের সাক্ষী হতে পারে এবং অনুধাবন করতে পারে আমাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তোমাদের অভিপ্রায় কতটা হাস্যকর ছিল।

জাহাঙ্গীর দু’জনকে আঁতকে উঠতে শুনে। তাদের শাস্তি দেয়ার ধারণাটা সে কথা শুরু করার ঠিক আগ মুহূর্তে আকস্মিক প্রেরণার একটা ঝলকের মত তার কাছে প্রতিভাত হয়েছে। সে জানে তার দাদাজান হুমায়ুন অপরাধের উপযুক্ত শাস্তিবিধান করতে অভিনব এবং কখনও উদ্ভট উপায় খুঁজে বের করতে পারার জন্য নিজেকে নিয়ে গর্ব বোধ করতেন। সেও এখন সেটা পারে। সে অবশ্য অপকর্মের সহযোগীদের নিয়ে আর কোনো সময় নষ্ট করতে আগ্রহী নয় আর তাই ঘুরে খুসরুর দিকে তাকায় যে দু’হাত অনুনয়ের ভঙ্গিতে জোড়া করে, বিপদে মিহমান লোকের মত ফুঁপিয়ে কাঁদছে এবং বিড়বিড় করে কিছু বলছে জাহাঙ্গীর ঠিক বুঝতে পারে না কিন্তু যা শুনে দুর্বোধ্য মনে হয়। সে নিজেকে সংযত করে উঠে দাঁড়িয়ে, তার সন্তানকে তাঁর অনিবার্য বিপর্যয়ের মাঝে প্রেরণ করবে যে শব্দগুলো সেগুলো উচ্চারণ করতে নিজেকে প্রস্তুত করে।

‘খসরু, তুমি বৈরী বিশ্বাসঘাতকদের নিয়ে একটা বাহিনী গঠন করেছিলে যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য আমাকে–তোমার আব্বাজান এবং ন্যায়সঙ্গত মোগল সম্রাট ক্ষমতাচ্যুত করা এবং তোমার জন্য আমার সিংহাসন জবরদখল করা। রক্তপাত ঘটাবার জন্য তুমিই দায়ী এবং ন্যায়পরায়ণতার স্বার্থে তোমাকে রক্তেই এর মূল্য পরিশোধ করতে হবে। তার কণ্ঠস্বরের রুক্ষতার অকৃত্রিমতা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই এবং তাঁর উচ্চারিত প্রতিটা শব্দ তাঁর সংকল্প ব্যক্ত করে। খসরু নিজেও সেটা ভালো করেই জানে এবং ভয়ে সে নিজের মূত্রথলির উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। জাহাঙ্গীর তাকিয়ে দেখে খসরুর পরনের সুতির পাজামায় একটা গাঢ় দাগ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে এবং টপটপ করে পড়তে থাকা প্রস্রাব মাটিতে জমে হলুদ একটা ডোবার সৃষ্টি করে।

খসরু যে মানসিক অবস্থায় নিজেকে নিয়ে এসেছে সেজন্য করুণার একটা স্রোতধারা তাকে জারিত করে। যদিও কিছুক্ষণ আগেও খসরুর শিরোচ্ছেদের আদেশ দেয়ার পুরো অভিপ্রায় তার মাঝে বিরাজ করছিল, সহসাই সে আর তার মৃত্যু কামনা করে না। ইতিমধ্যে যথেষ্ট রক্তপাত আর দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে… কিন্তু আমি তোমার জান বখশ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সে নিজেকে বলতে শুনে। তুমি আমার সন্তান এবং আমি তোমাকে হত্যা করবো না। তোমাকে এর পরিবর্তে কারাগারে বন্দি করে রাখা হবে যেখানে অনাগত মাস বছরের গণনায় তুমি সীমালঙ্নের ব্যাপারে চিন্তা ভাবনার প্রচুর সময় পাবে যা তোমাকে তোমার স্বাধীনতা আর সম্মান খোয়াতে বাধ্য করেছে।’

খসরু, আজিজ কোকা আর হাসান জামালকে সরিয়ে নিয়ে যাবার পরে জাহাঙ্গীর তার দুধ-ভাইয়ের দিকে ঘুরে তাকায়, যে তখনও পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। সুলেইমান বেগ, শূলবিদ্ধ বন্দিদের যারা এখনও বেঁচে রয়েছে, আমার সৈন্যদের আদেশ দাও তাঁদের কণ্ঠনালী কেটে দিতে। তাঁরা যথেষ্ট যন্ত্রণা সহ্য করেছে। তাদের মৃতদেহগুলোকে একটা সাধারণ কবরে দাফন করে, শূলগুলো তুলে ফেলে তার উপরে তাজা মাটি ছড়িয়ে দাও। যুদ্ধে যারা আহত হয়েছে–শত্রু কিংবা মিত্র নির্বিশেষে আমাদের হেকিমদের তাঁদের চিকিৎসা করতে বলো। আজ কি পরিমাণ রক্তপাত হয়েছে তাঁর কথা আমি ভুলে যেতে চাই।’

*

এক সপ্তাহ পরে, বারগাত দূর্গে অবস্থানের সময় যে স্থানটা, সে তার বাহিনীকে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে পুনর্গঠিত হবার সময় দিতে, অস্থায়ী সদরদপ্তর করেছে, জাহাঙ্গীর লাহোরের শাসনকর্তার কাছ থেকে সদ্য প্রাপ্ত দীর্ঘ চিঠিটা মনোযোগ দিয়ে পাঠ করে যেখানে আজিজ কোকা আর হাসান জামালের ভাগ্যে কি ঘটেছে সেটার বিবরণ রয়েছে। জাহাঙ্গীর চিঠিটা পড়ার সময়ে, পুরো দৃশ্যপটটা মানসচক্ষে দেখতে পায়–নিজেদের আভিজাত্য ভুলে ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে থাকা দু’জন লোক, যাদের কাছ থেকে তাদের সমস্ত মর্যাদা কেড়ে নেয়া হয়েছে, সদ্য ছাল ছাড়ান তীব্র দুর্গন্ধযুক্ত রক্তাক্ত পশুচামড়ার ভিতরে তাঁদের ঢুকিয়ে সেলাই করে দেয়া হয়েছে। প্রদেশের শাসককর্তা জানিয়েছেন, পশুর মাথাটা তখনও চামড়ার সাথে যুক্ত ছিল এবং তাঁদের শহরের ভিতর দিয়ে প্রদক্ষিণ করাবার সময় উপস্থিত লোকজন যখন বিদ্রূপ করে আর পঁচা তরকারি আর পাথর তাঁদের দিকে ছুঁড়ে মারে তখন চামড়ার ভিতরে বন্দিদের প্রতিটা ব্যর্থ বেপরোয়া প্রয়াসের সাথে সাথে পশুর মাথাগুলো উদ্ভট ভঙ্গিতে আঁকি খায়। আজিজ কোকা, গাধার চামড়া দিয়ে তাকে মুড়ে দেয়া হয়েছিল, প্রচণ্ড গরমে চামড়াটা শুকিয়ে সংকুচিত হলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান। মোষের চামড়ার ভিতর থেকে হাসান জামালকে টেনে বের করার সময় তিনি বেঁচে থাকলেও প্রায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন। তিনি এখন লাহোরের ভূগর্ভস্থ কারাপ্রকোষ্ঠে রয়েছেন। শাসনকর্তা, তার চিঠির একেবারে শেষে, জানতে চেয়েছে জাহাঙ্গীর কি হাসান জামিলকে প্রাণদণ্ড দিতে আগ্রহী।

জাহাঙ্গীর মন্থর পায়ে জানালার দিকে হেঁটে যায় এবং বালুকাময়, নিরানন্দ দৃশ্যপটের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার এখন পুরো ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় আছে, নিজের আরোপিত শাস্তির নৃশংসতায় সে খানিকটা লজ্জিত বোধ করে যদিও তাঁরা এই শাস্তির উপযুক্ত এবং অন্যান্য বিদ্রোহীদের বিদ্রোহ প্রয়াস থেকে বিরত রাখবে। সে যখন ক্রোধে উন্মত্ত তখন ক্ষণিকের উত্তেজনায় কাজটা হয়েছে। তার আবেগ এখন অনেক প্রশমিত তার কেবলই মনে হতে থাকে সে যদি ভিন্নভাবে ব্যাপারটা নিষ্পত্তি করতে পারতো। একজন দুর্বল শাসকই কেবল করুণা প্রদর্শনের ব্যাপারে ভীত হতে পারেন… সে হাসান জামালের মৃত্যু কামনা করেছিল। লোকটা যে প্রাণে বেঁচে গিয়েছে সেটা কেবল অলৌকিক কোনো কারণে সম্ভব হয়েছে কিন্তু এটা তাকে ক্ষমাশীলতা প্রদর্শনের একটা সুযোগ দিয়েছে যা খসরুর বিদ্রোহের কারণে তাঁর অমাত্যদের ভেতরে সৃষ্ট বিরোধ প্রশমিত করার কাজ শুরু করবে। সে তখনই একজন খুশনবিশকে ডেকে পাঠায় এবং লাহোরের শাসনকর্তার কাছে নিজের জবাব শব্দ করে পাঠ করতে থাকে। হাসান জামালকে যথেষ্ঠ শাস্তি দেয়া হয়েছে। তাকে বাঁচিয়ে রাখা হবে।’

জাহাঙ্গীর আবার কক্ষে একা হওয়া মাত্র সে গভীরভাবে চিন্তা করে, নিজের সন্তানকে সে কঠোর শিক্ষা দিয়েছে, কিন্তু খসরু কি বিষয়টা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে? সে গোঁয়ার, স্বেচ্ছাচারী, আত্মদর্পী এবং সবচেয়ে বড় কথা উচ্চাভিলাষী। তার নিজেরই খুব ভালো করে জানা আছে যে উচ্চাকাঙ্খ সহজে গোপন করা যায় না। তার আব্বাজান আকবর তাকে হয়ত তাঁর আরাধ্য সিংহাসন থেকে বঞ্চিত করবেন এই ভয়ের কারণে নিজের জীবনের প্রায় বিশটা বছর কি সে যন্ত্রণায় দগ্ধ হয় নি? সে নিজে কি বিদ্রোহ করে নি? সে ঠিক যেমনটা করেছিল, খসরুকে জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে যে সে কি তাকে, তার জ্যেষ্ঠ সন্তানকে, বিদ্রোহী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করবে। এবং এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য প্রচুর সময় পাওয়া যাবে। আল্লাহতা’লা সহায় থাকলে, সে এখনও আরও বহু বছর বেঁচে থাকবে।

কিন্তু তাঁর অন্য সন্তানদের কি মনোভাব? তাঁর আব্বাজানের সাথে তার বিরোধ দীর্ঘ সময়ের জন্য তাঁদের কাছ থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। আকবরের দরবারে তার প্রত্যাবর্তনের পরে একজন পিতা আর তার সন্তানদের ভিতরে সম্পর্ক যতটা ঘনিষ্ঠ হওয়া উচিত সেভাবে সম্পর্ক পুনর্গঠন করাটা তাঁর কাছে বেশ কঠিন বলে মনে হয়। বহু বছর পূর্বে মরমী সুফি সাধক শেখ সেলিম চিশৃতির, যিনি তাঁর নিজের জন্ম সম্পর্কে পূর্বেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, জাহাঙ্গীরকে বলা কথাগুলো তাঁর মানসপটে ঝলসে যেতে সে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। নিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অনিশ্চিত এক যুবরাজ হিসাবে সে বৃদ্ধ লোকটার কাছে পরামর্শের জন্য গিয়েছিল। তোমার চারপাশে যারা রয়েছে তাদের লক্ষ্য করো। তুমি কারো উপরে নির্ভর করার ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকবে এবং বিশ্বাসের উপর কোনোকিছু ছেড়ে দিবে না, রক্তের বন্ধনে তুমি যাদের সাথে সম্পর্কিত এমনকি তাঁদের কাছ থেকেও… এমনকি তোমার যারা সন্তান হবে,’ বিজ্ঞ সুফি সাধক বলেছিলেন। ‘উচ্চাকাঙ্খর সবসময়ে দুটো দিক রয়েছে। এটা মানুষকে মহত্বের দিকে ধাবিত করে কিন্তু তাদের আত্মাকে বিষাক্তও করতে পারে…’ তার এই সতর্কবাণীর প্রতি মনোযোগ দেয়া উচিত। সর্বোপরি, সুফি সাধক যা কিছু সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন সে সবের অধিকাংশই ইতিমধ্যে ঘটেছে। সে বাস্তবিকই সম্রাট হয়েছে এবং তাঁর সন্তানদের একজনকে উচ্চাকাঙ্খ আদতেই কলুষিত করেছে।

খসরুর প্রতি তাঁর ক্রোধের তীব্রতা সম্ভবত এ কারণেই এত বেশি তীব্র। তাঁর মনে আছে কীভাবে খসরুর সাথে যুদ্ধের মাত্র দু’দিন আগে, তাঁর সৈন্যরা একটা ছোট মাটির দেয়াল ঘেরা গ্রাম দখল করেছিল। সেই গ্রামের পলিত কেশ সর্দার জাহাঙ্গীরের সামনে প্রণত হবার পরে, তার পরনের খয়েরী রঙের অধধায়া আলখাল্লার একটা পকেট থেকে তিনটা তামার পয়সা বের করে দাবি করে সেগুলো তাকে খসরুর গুপ্তদুতের একটা বাহিনী দিয়েছে। সে নিজের আনুগত্যের স্মারক হিসাবে দৃশ্যত কম্পিত আঙুলে জিনিষগুলো ধরে জাহাঙ্গীরের হাতে তুলে দেয়। জাহাঙ্গীর মুদ্রাগুলো খুটিয়ে দেখতে খেয়াল করে যে আপাত ব্যস্ততায় তৈরি করা প্রতিটি মুদ্রায় খসরুর প্রতিকৃতি খোদাই করা রয়েছে এবং খসরুকে হিন্দুস্তানের সম্রাট ঘোষণা করে প্রতিকৃতির চারপাশে বৃত্তাকারে বাণী মুদ্রিত রয়েছে। জাহাঙ্গীর ক্রোধে এতটাই উন্মত্ত হয়ে উঠে যে মুদ্রাগুলো কাছে রাখা ধৃষ্টতা দেখাবার কারণে সর্দারকে চাবুক মারার আদেশ দেয়, কামারশালায় তখনই মুদ্রাগুলোর আকৃতিনাশ করতে আদেশ দেয় এবং একটা ফরমান জারি করতে বলে যে ভবিষ্যতে কারো কাছে এমন মুদ্রা পাওয়া গেলে সেগুলো রাখার দায়ে শাস্তি হিসাবে তার ডান হাতের আঙুলগুলো কেটে নেয়া হবে। সুলেইমান বেগ সদারকে ক্ষমা করার জন্য জাহাঙ্গীরকে রাজি করাবার আগেই সর্দারের হাড্ডিসার দেহ কোমর পর্যন্ত নগ্ন করে গ্রামের চৌহদ্দির ভিতরে অবস্থিত একমাত্র গাছের সাথে বাধা হয় আর জাহাঙ্গীরের সবচেয়ে শক্তিধর দেহরক্ষী হাতে সাত বেণীর চাবুক নিয়ে বাতাসে শিস তুলে কশাঘাতের মহড়া দিতে থাকে। সে খুবই ভাগ্যবান সুলেইমান বেগকে সে তার যৌবনের সময় থেকে পাশে পেয়েছে–একজন বিশ্বস্ত বন্ধু যে তার মেজাজ মর্জি সহজপ্রবৃত্তিতে আঁচ করতে পারে এবং এখন বিজ্ঞ পরামর্শদাতা হিসাবে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রাখছেন।

কিন্তু পারভেজ আর খুররম–খসরুর চেয়ে খুব বেশি ছোট না খোল আর চৌদ্দ বছর বয়স–তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তাঁদের সৎ-ভাইয়ের প্রচেষ্টা এবং সেজন্য তাঁর প্রদত্ত শাস্তি সম্বন্ধে তারা কি চিন্তা করছে? পারভেজের জননী মোগলদের এক প্রাচীন গোত্রের মেয়ে হলেও খসরুর মত, খুররমের জননী রাজপুত রাজকন্যা এবং খুররম বড় হয়েছে আকবরের কাছে যিনি প্রকাশ্যে তাকে বিশেষ প্রশ্রয় দিতেন। দুই যুবরাজ বিশেষ করে খুররম, মনে করতেই পারে সিংহাসনে তাঁদের দাবি খসরুর মতই জোরালো। অন্ত ত তার সবচেয়ে ছোট ছেলে শাহরিয়ারের উচ্চাকাঙ্খ সম্বন্ধে তাঁর এখনই উদ্বিগ্ন হবার প্রয়োজন নেই এটাই যা স্বস্তির বিষয়, সে এখনও শাহী হারেমে তার জননী, জাহাঙ্গীরের উপপত্নির সাথে বাস করছে।

তাকে যত শীঘ্রি সম্ভব আগ্রায় নিজের অল্পবয়সী সন্তানদের কাছে ফিরে যেতে হবে। খসরু আর তাঁর অনুসারীদের প্রতি আপোষহীন আচরণের দ্বারা সে প্রতিপাদন করেছে যে সম্রাট হিসাবে সে কোনো ধরনের মতদ্বৈধ সহ্য করবে না। কিন্তু সেইসাথে সে এখনও যে একজন স্নেহময় পিতা সে অবশ্যই তাঁদের সেটাও দেখাবে আর খসরুর বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই কেবল সে এমন নির্মম আচরণ করতে বাধ্য হয়েছিল…

১.০২ অতর্কিত আততায়ী

‘তুমি নিশ্চিত কি করতে হবে তুমি বুঝতে পেরেছো?’ জাহাঙ্গীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইংরেজ লোকটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বার্থোলোমিউ হকিন্সের সাথে এটা কেবল তাঁর দ্বিতীয় মোলাকাত কিন্তু এটাই তার মাঝে প্রত্যয় উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট যে লোকটা আততায়ীর ভূমিকায় ভালোই উতরে যায়। হকিন্স ভাঙা ভাঙা ভুলভালো পার্সীতে কথা বলে যা সে ইস্ফাহানে পারস্যের শাহের বাহিনীতে ভাড়াটে সৈন্য হিসাবে কাজ করার সময় রপ্ত করেছিল কিন্তু নিজের সন্তুষ্টির স্বার্থে তাকে পরীক্ষা করার জন্য জাহাঙ্গীরের কাছে সেটাই যথেষ্ট।

‘আমি এখন তোমাকে বাংলায় যাবার এবং ফিরে আসবার খরচ হিসাবে পাঁচশ সোনার মোহর দেবো। শের আফগান যখন মারা যাবে তখন আমি তোমাকে আরও এক হাজার মোহর দেবো।’

বার্থোলোমিউ হকিন্স মাথা নাড়ে। তার চওড়া মুখে, সূর্যের খরতাপে লাল, সন্তুষ্টির অভিব্যক্তি। লোকটা যদিও প্রায় দশ ফিট দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে জাহাঙ্গীর তার গায়ের প্রায় পশুর মত তীব্র দুর্গন্ধ তারপরেও টের পায়। এই ফিরিঙ্গিগুলো গোসল করে না কেন? আগ্রায় তাঁর দরবারে ক্রমশ আরো বেশি সংখ্যায় তাদের আগমন ঘটছে। এই লোকটার মত ইংরেজ, ফরাসী, পর্তুগীজ, এবং স্পেনীশ এবং ধর্মপ্রচারক, ব্যবসায়ী বা ভাড়াটে সৈন্য সে যেই হোক, তাদের সবাই যেন দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। সম্ভবত এর কারণ তাঁদের পরনের পোষাক। হকিন্সের ঘর্মাক্ত, চওড়া, দেহ কালো চামড়া দিয়ে তৈরি একটা আঁটসাট জামা, হাঁটুর ঠিক উপরে গাঢ় লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা পাতলুন এবং পিঙ্গল বর্ণের পশমের মোজা দিয়ে আবৃত। তাঁর পায়ে রয়েছে ঘোড়ায় চড়ার উপযোগী বহু ব্যবহারে ক্ষয় হয়ে যাওয়া একজোড়া গুলফ পর্যন্ত পরিহিত বুটজুতা।

‘আমি তাকে কীভাবে হত্যা করবো সেটা নিশ্চয়ই আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না?

‘না। একটা ব্যাপারই এখানে প্রধান যে সে মারা গিয়েছে। তুমি যদি তাকে কেবল আহত করো তাহলে আমার কাছে সেটার কোনো মূল্য নেই।

‘আমি গৌড়ে পৌঁছাবার পরে সেখানে কীভাবে আপনার এই শের আফগানকে খুঁজে পাবো?

‘সে শহরের শাসনকর্তা এবং গৌড় দূর্গের সেনাছাউনির অধিপতি। চোখ কান খোলা রেখে অপেক্ষা করলেই তাঁর প্রাত্যহিক জীবনযাপন কালে তুমি তাকে দেখতে পাবে। আর কোনো প্রশ্ন আছে?”

হকিন্স এক মুহূর্ত ইতস্তত করে। আপনি কি আমাকে একটা সনদপত্র দেবেন–সেটা আমার সীলমোহরযুক্ত একটা চিঠি হতে পারে–যেখানে বিবৃত থাকবে যে আমি আপনার অধীনে কর্মরত।

না। শের আফগানের মৃত্যুর সাথে আমাকে যেন কোনোভাবেই জড়িত করা না হয়। আমি তোমাকে তোমার উদ্ভাবনকুশলতার জন্য টাকা দিচ্ছি। তুমি আমাকে বলেছে যে শাহের পক্ষে তুমি এমন অনেক স্পর্শকাতর অভিযান পরিচালনা করেছে।

ইংরেজ লোকটা নিজের স্থূলকায় কাঁধ ঝাঁকায়। আমার তাহলে আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই। আমি আগামীকাল যাত্রা শুরু করবো।’

জাহাঙ্গীর যখন কামরায় একা হয় তখন সে ধীর পায়ে তাঁর ব্যক্তিগত কক্ষের ঝুল বারান্দার দিকে এগিয়ে যায় যেখান থেকে যমুনা নদী দেখা যায়। বার্থোলোমিউ হকিন্স কি সফল হবে? তাকে দেখে যথেষ্ট কঠোর বলেই মনে হয় এবং দরবারের বেশিরভাগ ইউরোপীয়দের মত না, সে ভাঙা ভাঙা ফার্সী বলতে পারে। কিন্তু তার তাকে পছন্দ করার অন্যতম। প্রধান কারণ একটাই-লোকটা একজন ভিনদেশী। সে যদি নিজের লোকদের কাউকে পাঠাতো তাঁরা তাহলে হয়তো বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতো, যদিও সেটা কেবল বন্ধু বা কোনো আত্মীয় এবং সে কি পরিকল্পনা করছে সেটার খবর হয়তো শের আফগানের কাছে পৌঁছে যায় এবং তাকে পলায়ন করার জন্য যথেষ্ট সময় দেয়। বার্থোলোমিউ হকিন্সের সাথে এমন ভুল হবার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ এবং হিন্দুস্তানে কোনো গোত্র কিংবা কোনো পরিবারের সাথে তাঁর আত্মীয় সম্পর্কে সংবাদ নেই। হিন্দুস্তানে কোনো পরিবার বা গোত্রের আনুগত্য এবং কোনো মানুষ তাঁর কাছে কিছু পায় না। জাহাঙ্গীর কেন শের আফগানকে মৃত্যু কামনা করে সে বিষয়ে লোকটা কোনো কিছু প্রশ্নই করে নি। এমন আগ্রহহীনতা একটা চমকপ্রদ বিষয়…’

ইংরেজ ভাড়াটে সৈন্যের সাথে তাঁর সাক্ষাৎকারের বিষয়ে জাহাঙ্গীর কাউকে কিছু বলেনি। সুলেইমান বেগকে বিশ্বাস করে তাকে কথাটা সে হয়তো বলতে কিন্তু তাঁর দুধ-ভাই টাইফয়েড রোগে কিছুদিন আগেই মারা গিয়েছে। খসরুর কিছু অনুসারীর বিরুদ্ধে যারা আগ্রার দক্ষিণপূর্বের জঙ্গলে পালিয়ে গিয়েছিল সংক্ষিপ্ত একটা অভিযান শেষ করে তারা একত্রে ফিরে আসবার পরেই সে মারা যায়। সেঁতসেঁতে, গুমোট একটা তাবুতে মাত্র বারো ঘন্টা আগে অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে শায়িত সুলেইমান বেগের জীবনের অন্তিম সময়গুলোর কথা স্মরণ করলে যখন বাইরে সীসার ন্যায় আকাশ থেকে বর্ষার অবিরাম ধারা এর ছাদে ঝরে পড়ছে এখনও জাহাঙ্গীরের গা শিউরে উঠে। সে আক্রান্ত হবার পরে এত দ্রুত জ্বরবিকারের শিকার হয় যে জাহাঙ্গীরকেও চিনতে পারে না। তার চিৎকারের দ্যোতনায় টানটান হয়ে থাকা ঠোঁট সাদা থুথুর গেঁজলায় ভরা আর পাতলা একটা চাদরে ঢাকা অবস্থায় দেহটা বিরামহীনভাবে মোচড়ায় আর কাঁপতে থাকে। সে তারপরে একদম নিথর হয়ে যায়, তাকে শেষ বিদায় জানাবার বা নিজের পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পুরোটা সময় বা সম্প্রতি খসরুর বিদ্রোহকালীন অন্ধকার দিনগুলোতে তাঁর বিজ্ঞ এবং আবেগহীন পরামর্শ জাহাঙ্গীরের কাছে কতটা গুরত্বপূর্ণ ছিল সেটা বলার কোনো সুযোগ সে পায় না।

সবকিছু যখন একদম ঠিকভাবে চলছে তখন সে সবার চেয়ে বেশি যাকে বিশ্বাস করতো তাঁর মৃত্যুটা সত্যিই বড় বেদনাদায়ক মনে হয়। সুলেইমান বেগের মৃত্যুর পরে গত দশ মাসে কোথাও আর কোনো বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেনি–এমনকি অসন্তোষের সামান্যতম আভাসও কোথাও দেখা যায় নি। তাঁর সাম্রাজ্য এখন সুরক্ষিত। পারস্যের যুদ্ধমান শাসক শাহ্ আব্বাসের কাছ থেকে কেবল হুমকির আশঙ্কা রয়েছে–যদি আবদুল রহমানের গুপ্তদূতদের আনীত বিবরণী সঠিক হয়–যিনি মোগলদের কাছ থেকে কান্দাহার পুনরায় দখল করার পরিকল্পনা করেছেন। জাহাঙ্গীর সাথে সাথে বিশটা ব্রোঞ্জের কামান আর দুইশ রণহস্তীসহ একটা শক্তিশালী বাহিনী উত্তরপশ্চিম দিকে প্রেরণ করায় নিজের পরিকল্পনা নিয়ে পুনরায় চিন্তা করতে শাহকে বাধ্য করেছে। জাহাঙ্গীরের সৈন্যরা কান্দাহারের উঁচু মাটির দেয়ালের কাছাকাছি পৌঁছাবার পূর্বেই তাঁর টকটকে লাল টুপি পরিহিত বাহিনী পশ্চাদপসারণ করে।

সে এখনও তার দুধ-ভাইয়ের অভাব খুবই অনুভব করে। তাঁর স্ত্রী এবং অবশিষ্ট সন্তানরা থাকার পরেও, তাঁর ক্ষমতা আর বিত্তবৈভব সত্ত্বেও, সে নিঃসঙ্গ বোধ করে–কখনও নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে হয়–সুলেইমান বেগ জীবিত থাকার সময় সে কখনও এমন অনুভব করে নি। তার ছেলেবেলায় সে একদিকে চেষ্টা করেছে তার আব্বাজান আকবরের, এমন একজন মানুষ যিনি জানেন না ব্যর্থতা কাকে বলে, প্রত্যাশা অনুযায়ী নিজেকে প্রমাণ করতে অন্যদিকে তার রাজপুত জননীর যিনি আকবরকে ঘৃণা করতেন তার জনগণের বর্বর নিগ্রহকারী হিসাবে প্রতি বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করতে গিয়ে তার ছেলেবেলাটা ছিল এক ধরনের অনিশ্চয়তায় ভরা। তাঁর দাদীজান হামিদা যদি সবসময়ে তখন তাঁর কথা না শুনতো এবং তাকে সাহস না দিতো তাহলে অনেক আগেই সে হয়তো হঠকারী কিছু একটা করে ফেলতো। সুলেইমান বেগই কেবল আরেকজন মানুষ যিনি তাঁর জীবনে এমন একটা স্থান অধিকার করেছিলেন–বিশ্বস্ত আর বিজ্ঞ একজন বন্ধু, সে যার পরামর্শ যতই অপ্রীতিকর হোক, পদোন্নতি আর পুরষ্কারের জন্য মরীয়া, তাঁর অমাত্যদের নিজেদের স্বার্থ সম্পর্কিত পরামর্শের চেয়ে বেশি বিশ্বাস করতো।

সে আগ্রা দূর্গের কাছে সুলেমান বেগের জন্য বেলেপাথরের গম্বুজযুক্ত সমাধিসৌধ নির্মাণের আদেশ দিয়েছে সেটার নির্মাণ কাজের অগ্রগতি সে গতকালই গিয়েছিল পরিদর্শন করতে। সে নির্মাণ শ্রমিকদের বাটালি দিয়ে পাথরের চাই কাটতে দেখে নতুন করে নিজের বন্ধু বিয়োগের ঘটনা তাকে আপুত করে এবং সে একাকী পুরো সন্ধ্যাবেলাটা নিজের ভাবনায় মশগুল হয়ে থাকে। সুলেইমান বেগের মৃত্যুর মত অন্য কোনো কিছু তাকে জীবনের নশ্বরতা সম্বন্ধে এভাবে সজাগ করতে পারতো না। কোনো মানুষের বয়স যতই অল্পই হোক, বা যতই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী কিংবা যতই প্রাণবন্ত হোক জানে না যে তার জীবনের আর কতদিন বাকি আছে। মৃত্যু এসে তাকে শরণ দেয়ার পূর্বেই নিজের জীবন উপভোগ করা ছাড়াও–জীবনের যত বেশি বা অল্প দিনই বাকি রয়েছে–তাকে তাঁর পক্ষে সম্ভব এমন সবকিছু অর্জন করতে হবে এবং সেটা করার জন্য সে নিজেকে কেন তার ক্ষমতা ব্যবহার করতে দেবে না? তার ভাবনা চিন্তা শেষ পর্যন্ত তাকে প্ররোচিত করে বার্থোলোমিউ হকিন্সকে ডেকে পাঠাতে এবং আর কোনো কালক্ষেপণ না করে সে গোপন দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে তাঁর উপরে আস্থা আরোপ করে।

জাহাঙ্গীর আকাশের দিকে তাকায় যেখানে প্রতিদিনই বৃষ্টিতে ভারি আর গাঢ় হয়ে থাকা মেঘ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কয়েক সপ্তাহের ভিতরেই পুনরায় বর্ষার বৃষ্টি শুরু হবে। সে আশা করে প্রথমে যমুনা বরাবর তারপরে গঙ্গাকে অনুসরণ করে বাংলা অভিমুখে হকিন্সের যাত্রা এই বৃষ্টির কারণে বিঘ্নিত হবে না। নদীগুলো যদিও শীঘ্রই দু’কুল ছাপিয়ে ফুলেফেঁপে উঠে নৌকাগুলোকে দ্রুত অগ্রসর হতে সাহায্য করলেও নদীর স্রোত তখন আরো বেশি বিপদসঙ্কুল হয়ে উঠবে। সময়টা এমন একটা অভিযানের জন্য মোটেই উপযুক্ত নয় কিন্তু সে অধৈর্য হয়ে পড়েছে। বার্থোলোমিউ হকিন্স যদি অর্পিত দায়িত্ব পালনে সফল হয়, সে তাহলে একটা জিনিষের–বা বলা ভালো একজন লোকের–অধিকার গ্রহণ করতে পারবে যা তার জীবনকে সম্পূর্ণ করবে, এমনকি যদিও অভীষ্ট অর্জনে তাঁর গৃহীত পদ্ধতি নিয়ে সতর্ক সুলেইমান বেগ হয়তো প্রশ্ন তুলতেন।

*

বার্থোলোমিউ হকিন্স তাঁর চোয়ালের উপরে এইমাত্র হুল ফোঁটান মশাটাকে একটা থাপ্পড় মারে। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে সে দেখে যে সেখানে কালচে লাল রক্তের দাগ লেগে রয়েছে। বেশ, হতভাগাটার রক্তের সাধ সে, চিরতরে ঘুচিয়ে দিয়েছে যদিও ঝক ঝক রক্তচোষা কীটপতঙ্গের একটার বিরুদ্ধে যারা তাঁর জীবনকে অতিষ্ট করে তুলেছে এটা একটা ক্ষুদ্র বিজয়। গৌড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রার শেষ পর্যায়ে তার কেনা ঘোড়াটা বেশ বুড়ো, উটের মত এর পাঁজরের হাড় বাইরের দিকে বের হয়ে আছে, কিন্তু তারপরেও গিরিমাটির থকথকে কাদার ভিতরে স্বাস্থ্যবান কোনো প্রাণীর পক্ষেও এর বেশি অগ্রসর হওয়াটা কষ্টকর বলেই প্রতিয়মান হবে। মাথার পেছনে সহস্র মোহরের ভাবনাটাই তাকে এখনও এগিয়ে নিয়ে চলেছে। আগ্রা ত্যাগ করার পরে সে দু’দুবার দীর্ঘ সময়ের জন্য জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল–তাঁর দেহ, পরনের কাপড় আর বিছানা পর্যন্ত ঘামে ভিজে গিয়েছিল–এবং একবার প্রচণ্ড হুল ফোঁটানোর মত ডায়রিয়া এবং সেই সাথে এমন যন্ত্রণাদায়ক পেট ব্যাথা যে সে শপথ করেছে–এবং সে সত্যিই সংকল্পবদ্ধ–সে উপকূলের কাছে পৌঁছে সে প্রথম যে জাহাজট খুঁজে পাবে সেটাতে চড়ে সে ইংল্যান্ডে স্বদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। কিন্তু সে যখন শেষবার জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল তখন সে অন্তত নৌকায় ছিল এবং সাদা কাপড় পরিহিত, মাথায় সাদা চুলের মায়াবী খয়েরী চোখের অধিকারী একজন হিন্দু পুরোহিত তখন তাঁর সেবা শুশ্রূষা করেছিল। বার্থোলোমিউ পরে পুরোহিতের হাতে একটা মোহর গুঁজে দিতে চেষ্টা করতে লোকটা নিজেকে কেমন গুটিয়ে নেয়। এই দেশটা সে কখনও ভালো করে বুঝতে পারলো না।

ক্রমশ ধুসর হয়ে আসা আলোয় সামনের দিকে তাকিয়ে কোনোমতে গৌড় অভিমুখী খচ্চরের মালবাহী কাফেলার পেছনের অংশটুকু দেখতে পায় সে নিজেকে যার পেছনে সংশ্লিষ্ট করেছে। বিপদসঙ্কুল এলাকা দিয়ে বণিকেরা নিজেদের মালবাহী পশুগুলোকে এগিয়ে নিতে ব্যস্ত থাকায় তাঁর ব্যাপারে কেউ খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি যা তাঁর জন্য স্বস্তিদায়ক যদিও সে নিজের জন্য একটা গল্প আগেই তৈরি করে রেখেছে–সে একজন পর্তুগীজ আধিকারিক গঙ্গার মোহনার কাছে হুগলিতে অবস্থিত বাণিজ্যিক উপনিবেশে যাবে নীল আর কেলিকোর ব্যবসা বৃদ্ধির সম্ভাবনা যাচাই করে দেখতে। তাকে দেখে কোনোভাবেই কুঠির কর্মকর্তা মনে হয় না–তার চেয়েও বড় কথা তার মাথার কোকড়ানো লালচে-সোনালী চুল আর ধুসর নীল চোখের কারণে তাকে পর্তুগীজও মনে হয় না–কিন্তু একটাই বাঁচোয়া এই লোকগুলো সেটা জানে না। বা তারা এটাও জানে না তার ঘোড়ার পর্যাণের ব্যাগে ইস্পাতের তৈরি চমৎকার দুটো ধারালো খঞ্জর রয়েছে একটা পারস্যে তৈরি যার ফলা এতই ধারালো যে সেটা দিয়ে ঘোড়ার লেজের চুল দ্বিখণ্ডিত করা সম্ভব এবং অন্যটা বাঁকানো ফলাযুক্ত আবরীতে খোদাই করা তূর্কী খঞ্জর–বা তাঁর কাছে এটা যে বিক্রি করেছে সেই তুর্কী অস্ত্র ব্যবসায়ী অন্তত তাই বলেছে–যেখানে লেখা রয়েছে আমি তোমাকে হত্যা করবো বটে কিন্তু তুমি বেহেশতে না দোযখে যাবে সেটা আল্লাহর মর্জির উপরে নির্ভরশীল।

সম্রাটের আচরণ দেখে বোঝা যায় শের আফগান দোযখে গেলেই তিনি খুশি হবেন কিন্তু তিনি কেন লোকটাকে হত্যা করতে চান সেবিষয়ে কিছুই খুলে বলেননি। বার্থোলোমিউ তার চামড়ার মশকের দিকে হাত বাড়ায় এবং এক ঢোক পানি খায়। মশকের পানি উষ্ণ হয়ে আছে আর পূতিগন্ধময় কিন্তু সে বহু পূর্বে এসব বিষয়ে মাথা ঘামান বন্ধ করেছে। সে এখন কেবল একটাই প্রার্থনা করে যে আরেকবার যেন সে পেটের ব্যামোয় আক্রান্ত না হয়। মশকের ছিপি বন্ধ করে সে আবারও জাহাঙ্গীরের কথা ভাবতে শুরু করে, বার্থোলোমিউকে সে তার আদেশ দেয়ার সময় কীভাবে তাঁর সুদর্শন মুখাবয়বের কালো চোখের দৃষ্টিতে একাগ্রতা ফুটে ছিল। তার পরনের বুটিদার রেশমি পোষাক আর হাতের সব আঙুলে আংটি চকচক করলেও, বার্থোলোমিউয়ের কিন্তু মনে হয় যে লোকটা হয়ত তারই মত অনেকটা… একজন যে জানে সে কি চায় এবং সেটা অর্জনে প্রয়োজনে নির্মম হতে হবে। সে সেই সাথে প্রায় মিলিয়ে যাওয়া ক্ষতচিহ্ন খেয়াল করে–একটা জাহাঙ্গীরের বাম হাতের পেছনের অংশে আর অন্যটা তার ডান দ্রুর উপর থেকে শুরু হয়ে কপালের যেখানে চুল শুরু হয়েছে সেখানে মিলিয়ে গিয়েছে। সম্রাট নিজের হত্যার রীতিনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।

বার্থোলোমিউ সহসা সামনে থেকে কাফেলার লোকদের একে অন্যের উদ্দেশ্যে চিৎকার করতে শুনে। সে সহজাত প্রবৃত্তির বশে নিজের তরবারি স্পর্শ করে যদি লুটেরার দল–স্থানীয় লোকেরা যাদের ডাকাত বলে–হ্যামলা করে থাকে। লুটেরাদের আক্রমণগুলো সাধারণত সকালের দিকে হয়ে থাকে যখন শেষ মুহূর্তের জড়িয়ে থাকা অন্ধকার ডাকাতদের আড়াল দেয় এবং বণিকেরা সারা রাত পাহারা দিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তিন রাত্রি আগের ঘটনা বার্থোলোমিউ ঠিক এমন সময়েই এক দুর্বল গালিচা ব্যবসায়ীকে রক্ষা করেছিল। লোকটা টিপটিপ বৃষ্টির ভিতরে থেমে তার মালবাহী খচ্চরের পালে খোঁড়া হয়ে যাওয়া একটা খচ্চরের পিঠের বোঝা অন্য জন্তুর পিঠে পুনরায় চাপিয়ে দিচ্ছিলেন। লোকটা প্রায় নিজের সমান লম্বা একটা মোড়ানো গালিচা নিয়ে যখন হিমশিম খাচ্ছে তখনই অন্ধকারের আড়াল থেকে দু’জন ডাকাত দুলকি চালে তার দিকে এগিয়ে আসে। তারা তাদের টাটু ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে মাটিতে নেমে, একজন গালিচা ব্যবসায়ীকে এক লাথিতে মাটিতে ফেলে দেয় এবং অন্যজন তাঁর খচ্চরের লাগামগুলো জড়ো করতে থাকে সেগুলোকে নিয়ে যাবে বলে। তারা দুজনেই নিজেদের কাজে এতই মশগুল ছিল তারা বার্থোলোমিউর গাঢ় অন্ধকারের ভিতর দিয়ে দুলকি চালে ঘোড়া ছুটিয়ে আসা খেয়ালই করে নি, যতক্ষণ না বড্ড দেরি গিয়েছে। সে তার ইস্পাতের তৈরি টোলেডো তরবারি বের করে একজন ডাকাতের কাঁধের উপর থেকে তার মাথাটা প্রায় আলাদা করে দেয় এবং পাকা তরমুজের মত অন্যজনের খুলি দ্বিখণ্ডিত করে। ছোটখাট দেখতে গালিটা ব্যবসায়ী কৃতজ্ঞতায় অস্থির হয়ে পড়ে এবং চেষ্টা করে জোর করে তাকে একটা গালিচা উপহার দিতে। কিন্তু বার্থোলোমিই ততক্ষণে নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য আফসোস করতে শুরু করেছে। সে যদি নিজের অভিযান সফল করতে এবং পুরষ্কার লাভ করতে চায় কারো মনোযোগ আকর্ষণ করা তার উচিত হবে না।

কিন্তু এবারে ডাকাতদের কারণে হট্টগোলের সৃষ্টি হয়নি। চিৎকারটা ভয়ের না স্বস্তি আর আনন্দের চিৎকার। বার্থোলোমিউ তার সামনে সূর্যাস্তের আলো দিনের মত একেবারে মুছে যাবার আগেই নিজের সামনে পর্যবেক্ষণ গম্বুজ দেখতে পায়–তাঁরা গৌড়ে পৌঁছে গিয়েছে। বার্থোলোমিউ তাঁর তরবারির হাতল থেকে হাত সরিয়ে আনে এবং নিজের ঘর্মাক্ত ঘোড়াটার গলায় আলতো করে চাপড় দেয়। এখন আর বেশি দেরি নেই, বুড়ো ঘোড়া কোথাকার।

*

এই সময় আঙিনায় এহেন জটলার মানে কি? গৌড়ের প্রধান তোরণ দ্বারের পাশে প্রতিরক্ষা দেয়ালের ভিতরে একটা ছোট সরাইখানায় বার্থোলোমিউ তাঁর ভাড়া নেয়া ছোট কক্ষের খড়ের গদিতে শুয়ে বিরক্তির সাথে মনে মনে চিন্তা করে। সে বিছানায় উঠে বসে এবং প্রচণ্ডভাবে সারা দেহ চুলকায় তারপরে টলমল করে উঠে দাঁড়িয়ে জুতা পায়ে না দিয়েই বাইরে বের হয়ে আসে। যদিও মাত্র সকাল হয়েছে, বণিকেরা প্রাঙ্গণের ঠিক কেন্দ্রে অবস্থিত একটা বিশালাকৃতি পাথরের চাতালের উপরে নিজেদের পশরা: বস্তা ভর্তি মশলা, থলে ভর্তি চাল, বজরা আর ভূট্টা, সুতি কাপড়ের পিঙ্গল বর্ণের বাণ্ডিল আর ক্যাটক্যাটে ধরনের রেশমের কাপড় সাজিয়ে রাখছে তারা বেচা কেনা শুরু করতে প্রস্তুত। বার্থোলোমিউ কোনো ধরনের আগ্রহ ছাড়াই তাদের পর্যবেক্ষণ করে কিন্তু সে ঘুরে দাঁড়াবে এমন সময় সে খেয়াল করে যে গালিচা ব্যবসায়ীকে সে বিপদ থেকে রক্ষা করেছিল তাঁর দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

‘জনাব, গৌড় খুব চমৎকার একটা লোকালয়।

‘খুবই সুন্দর, বার্থোলোমিউ অনেকটা যান্ত্রিকভাবে উত্তর দেয়। সে তাঁর কক্ষে ফিরে যাবার জন্য যাত্রা করবে–সে অনায়াসে আরো এক কি দুই ঘন্টা দিব্যি ঘুমাতে পারে–কিন্তু তারপরে তার মনে একটা ভাবনার উদয় হয়। হাসান আলি–এটাই সম্ভবত আপনার নাম, তাই নয় কি?

লোকটা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।

হাসান আলি, গৌড় আপনি কেমন চেনেন?

‘জ্বী। আমি বছরে ছয়বার এখানে আসি এবং আমার দুইজন আত্মীয় সম্পর্কিত ভাই এখানে বেচাকেনা করে।’

তুমি বলেছিলে আমার সাহায্যের প্রতিদান তুমি আমায় দিতে চাও। আমার পথপ্রদর্শক হও। আমি এই এলাকাটা চিনি না এবং পর্তুগালে আমার নিয়োগকারীরা চায় এই এলাকার একটা সম্পূর্ণ বিবরণ আমি তাঁদের পাঠাই।

বার্থোলোমিউ এক ঘন্টা পরে সরাইখানার বর্গাকৃতি খোলা প্রাঙ্গণের উপর দিয়ে হাসান আলিকে অনুসরণ করে এর উঁচু খিলানাকৃতি তোরণদ্বারের নিচে দিয়ে বাইরে গৌড়ের ব্যস্ত সড়কে এসে দাঁড়ায়। প্রথম দর্শনে শহরের সংকীর্ণ, আবর্জনা পূর্ণ রাস্তা দেখে এলাকাটা সম্বন্ধে একটা বিশ্রী ধারণা জন্মে কিন্তু হাসান আলি, তাঁর মত ছোটখাট একটা লোকের তুলনায় বিস্ময়কর দ্রুতগতিতে হাঁটতে শুরু করলে, পথ দেখিয়ে তাকে শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করলে রাস্তাগুলো ক্রমশ প্রশস্ত হতে থাকে এবং বাড়িগুলোও কোনো কোনোটা আবার দোতলা উঁচু–ক্রমশ আরো দর্শনীয় রূপ ধারণ করে। বার্থোলোমিউ সেইসাথে অবশ্য লক্ষ্য রাখে রাস্তায় তারা সৈন্যদের কতগুলো দল অতিক্রম করেছে। এই সৈন্যরা কোথায় যাচ্ছে?’ সে দুই সারিতে বিন্যস্ত সবুজ পরিকর আর সবুজ পাগড়ি পরিহিত বিশজন সৈন্য পাশ দিয়ে এগিয়ে যাবার সময় সেদিকে ইঙ্গিত করে।

তারা রাতের বেলা শহরের নিরাপত্তা প্রাচীরের প্রহরায় নিয়োজিত সৈন্যদল কিন্তু তাদের এখন পালাবদল হয়েছে এবং তারা এখন তাদের ছাউনিতে ফিরে যাচ্ছে।’

‘ছাউনিটা কোথায়?

‘বেশি দূরে না। আমি আপনাকে ছাউনিটা দেখাবো।

কয়েক মিনিট পরে বার্থোলোমিউ সামনে কুচকাওয়াজের ময়দান বিশিষ্ট অনেকটা দূর্গের মত একটা বর্গাকৃতি লম্বা দালান দেখতে পায়। মাটির ইট দিয়ে নির্মিত এর দেয়ালগুলো প্রায় পঞ্চাশ ফিট উঁচু। সে তাকিয়ে থাকার সময় অশ্বারোহীদের একটা দল, নিঃসন্দেহে তাদের ঘোড়াগুলোকে প্রাত্যহিক অনুশীলনের পরে ফিরে আসছে, দুলকি চালে ধাতব কীলকযুক্ত ভারি দরজার নিচে দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে যা ছাউনির একমাত্র প্রবেশ পথ। ছাউনিটা দেখতে চমৎকার।

হ্যাঁ। সম্রাট আকবর, তাঁর বাংলা বিজয়ের পরে–আল্লাহতা’লা তাঁর আত্মাকে বেহেশত নসীব করুন–দালানটা নির্মাণ করেছিলেন। তিনি শহরের প্রতিরক্ষা প্রাচীরও মজবুত করেছিলেন এবং আমাদের এখানে যে মনোরম সরাইখানাগুলো রয়েছে সেগুলোও নির্মাণ করেছিলেন। তিনি সত্যিই একজন মহান মানুষ ছিলেন।

‘আমি সে বিষয়ে নিশ্চিত। এখানে কে মোগল সৈন্যবাহিনীর সেনাপতি? সম্রাটের এত অনুগ্রহভাজন তিনি নিশ্চয়ই একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।

‘আমি তাঁর নাম জানি না। আমি দুঃখিত।

‘সেটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ না। আমার কেবল জানবার কৌতূহল হয়েছিল এমন একটা কাজের দায়িত্ব কার উপর অর্পিত হয়েছে। আমার নিজের দেশের তুলনায় হিন্দুস্তান একটা বিশাল দেশ। আমাদের দেশে, একজন সম্রাটের পক্ষে তার নিজের ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা এবং কোথায় কি ঘটছে জানাটা সহজ…’।

‘সেটা সত্যি কথা। সারা পৃথিবীতে আমাদের সাম্রাজ্যের কোনো তুলনা পাওয়া যাবে না।’ হাসান আলি আত্মতুষ্টির সাথে মাথা নাড়ে। এবার চলুন। সরাইখানার বাইরে যেখানে বেশির ভাগ বেচাকেনা হয় সেই বড় বাজার আমি আপনাকে দেখাতে চাই।’

তারা চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে এমন সময় কর্কশ ধাতব তূর্যধ্বনি তাদের দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য করে। কিছুক্ষণ পরেই বারোজন চৌকষ সৈন্য খয়েরী রঙের সুসজ্জিত ঘোড়ায় উপবিষ্ট হয়ে অর্ধবল্পিত বেগে পাশের একটা সড়ক দিয়ে বের হয়ে কুচকাওয়াজ ময়দানের উপর দিয়ে সেনাছাউনির দিকে এগিয়ে যায়। তাদের একজনের হাতে পিতলের একটা ছোট তূর্য রয়েছে তাঁদের আগমনের সংকেত সে এইমাত্র যেটা দিয়ে ঘোষিত করেছে। বারোজনের দলটাকে আরো তিনজন অশ্বারোহী অনুসরণ করছে–চূড়াকৃতি শিরোস্ত্ৰাণ পরিহিত দুজন দীর্ঘদেহী এক লোকের দুপাশে অবস্থান করছে যিনি ডানে বা বামে কোনো দিকেই না তাকিয়ে সোজা তাকিয়ে রয়েছেন এবং সাদা পালকযুক্ত শিয়োস্ত্রাণের নিচে তার লম্বা কালো চুল বাতাসে উড়ছে।

বার্থোলোমিউর নাড়ীর স্পন্দন দ্রুততর হয়ে উঠে। হাসান আলির খোঁজে সে চারপাশে তাকায় এবং ময়লা ধুতি পরিহিত একজন তরমুজ বিক্রেতার সাথে তাকে দর কষাকষি করতে দেখে। বার্থোলোমিউ কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করে কিন্তু তাঁদের কথোপকথনের বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারে না। সে ভাবে, তারা নিশ্চয়ই স্থানীয় কোনো ভাষায় কথা বলছে। এটা কোনোমতেই পার্সী হতে পারে না। তরমুজ বিক্রেতাকে দেখে মনে হয় সে অনেক কিছু বলতে চায়। সে তার সবুজাভ-হলুদ সিলিন্ডারের মত দেখতে ফলের স্তূপের পেছন থেকে বের হয়ে আসে এবং সেনাছাউনির দিকে ইঙ্গিত করে উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথা বলতে থাকে পালকযুক্ত শিরোস্ত্ৰাণ পরিহিত লোকটা তার দেহরক্ষীদের নিয়ে যার ভিতরে এখন অদৃশ্য হয়েছে।

‘মহাশয়, হাসান আলি বলে, ‘সেনাছাউনির আধিকারিকের নাম শের আফগান। আমরা এইমাত্র যাকে যেতে দেখলাম তিনিই সেই ব্যক্তি। তরমুজ বিক্রেতা আমাকে বলেছে সে একজন চৌকষ যোদ্ধা। দুই বছর পূর্বে আমাদের মরহুম সম্রাট এখান থেকে পূর্বদিকে অবস্থিত আরাকানের জলাভূমি আর বনেবাদাড়ে লুকিয়ে থাকা জলদস্যুদের শায়েস্তা করতে তাকে পাঠিয়েছিলেন। এলাকাটা, কুমীর ভর্তি, বিপদসঙ্কুল হলেও শের আফগান লক্ষ্য অর্জনে সফল হন। তিনি পাঁচশ জলদস্যুকে বন্দি করে করেন এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে, তাদের জ্বলন্ত নৌকার চিতায় তাঁদের দেহগুলো নিক্ষেপ করেন।

তিনি কি সেনাছাউনিতেই বসবাস করেন?

না। শহরের উত্তর দিকে, অসিনির্মাতাদের তোরণের কাছে অবস্থিত একটা বিশাল উদ্যানের ভেতরে তাঁর হাভেলী অবস্থিত। এবার চলেন আমরা বাজারের দিকে যাই। সেখানে আপনাকে আগ্রহী করে তোলার মত অনেক কিছুই খুঁজে পাবেন… গতবার আমি এখানে এসে আমি কাঠের উপর অঙ্কিত আপনাদের এক পর্তুগীজ দেবতার প্রতিকৃতি দেখেছিলাম। প্রতিকৃতিটার সোনালী ডানা ছিল…’।

*

বার্থোলোমিউ অলস সময় অতিবাহিত করে। প্রতিদিন এখনও বৃষ্টি হয়, সরাইখানার শান বাধান আঙিনায় বৃষ্টির বড় আর ভারি ফোঁটাগুলো এসে ক্রমাগত আছড়ে পড়তে থাকে। বৃষ্টি পড়া মাঝে মাঝে কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হলে সে মানুষের মাঝে নিজের উপস্থিতি বেশি দৃশ্যমান হওয়া থেকে বিরত রাখতে বাজার থেকে কেনা মস্তকাবরণীযুক্ত গাঢ় খয়েরী রঙের আলখাল্লাটা গায়ে দিয়ে গৌড়ের ভিতরে হেঁটে বেড়ায় যতক্ষণ না সেনাছাউনি আর শের আফগানের হাভেলীর মধ্যবর্তী এলাকার রাস্তার প্রতিটা বাঁক, প্রতিটা গলিপথের নক্সা তাঁর মানসপটে স্থায়ীভাবে বসে যায়। সে সেইসাথে তার সম্ভাব্য শিকারের চলাফেরা পর্যবেক্ষণ করে যা, আবহাওয়া যখন ভালো থাকে তখন মাঝে মাঝে শিকারে কিংবা বাজপাখি উড়াতে যাওয়া ছাড়া, বিস্ময়কর নিয়মিত বলে মনে হয়। শের আফগান প্রায় প্রতিদিনই দুপুরবেলা কয়েক ঘন্টা সেনাছাউনিতে অতিবাহিত করে। সোমবার ময়দানে সে তার বাহিনীর অনুশীলন পর্যালোচনা করে, তাঁদের নিশানাভেদের দক্ষতা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে এবং বুধবার সে শহরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নির্বাচিত অংশ তদারকিতে ব্যস্ত থাকে।

আগ্রা থেকে সুদীর্ঘ যাত্রাকালীন সময়ে বার্থোলোমিউ প্রায়শই শের আফগানকে হত্যার সবচেয়ে ভালো সুযোগ কীভাবে খুঁজে বের করবে সেটা নিয়ে ক্রমাগত চিন্তা করেছে। সে এমনকি তার সাথে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বাঁধাবার কথাও চিন্তা করেছিল যেন গৌড় কোনো ইংলিশ শহর যেখানে কোনো সরাইখানায় তাঁর এবং শের আফগানের সাথে দেখা হওয়া আর ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়া সম্ভব চিন্তা করেছিল ভেবে নিজের মনেই হেসে উঠে। সে এখন লোকটার শারীরিক শক্তির নমুনা প্রত্যক্ষ করা ছাড়াও লোকটা যেখানেই যায় সেখানেই তাঁর সাথে সার্বক্ষনিকভাবে একজন দেহরক্ষী থাকে লক্ষ্য করার পরে ধারণাটা খুব একটা গ্রহণীয় মনে হয় না। সে যাই করুক না কেন ব্যাপারটা গোপনীয় হতে হবে। একটা সুবিধাজনক স্থান হয়ত খুঁজে পাওয়া সম্ভব যেখান থেকে একটা তীর ছোঁড়া কিংবা একটা খঞ্জর নিক্ষেপ করা যাবে কিন্তু সেক্ষেত্রে তাকে সাথে সাথে হত্যা করার কথা বাদই দেয়া যাক, তাকে আহত করার সম্ভাবনাই খুবই সামান্য। জাহাঙ্গীর স্পষ্টই বলে দিয়েছে যে সে শের আফগানকে মৃত দেখতে চায়।

অবশেষে একটা মেঘমুক্ত পরিষ্কার দিনে যখন বৃষ্টিপাত সত্যিই থেমেছে বলে মনে হয় এবং বাতাসে একটা নতুন সতেজতা বিরাজ করছে, বার্থোলোমিউ সমাধানটা খুঁজে পায়। একটা সহজ সরল আর দারুণ স্পষ্ট সমাধান–যদিও এতে তাঁর নিজের বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে–যে সে কেন এটা আগে ভাবেনি চিন্তা করার সময় সে মুচকি মুচকি হাসে।

*

দুই সপ্তাহ পরের কথা, রাত প্রায় এগারটা হবে–রাতের মত সরাইখানার দরজা বন্ধ হবার ঠিক এক ঘন্টা পূর্বে–ঘামের দাগযুক্ত খড়ের বিছানাটায় শেষবারের মত একটা লাথি মেরে যেখানে বহু অস্বস্তিকর রাত সে কাটিয়েছে, বার্থোলোমিউ তাঁর কামরা থেকে গোপনে বের হয়ে আসে। তার গাঢ় রঙের আলখাল্লার নিচে, তাঁর দুটো খঞ্জরের সাথে তাঁর কোষবদ্ধ তরবারিটা একটা ইস্পাতের শেকলের সাহায্যে তাঁর কোমর থেকে ঝুলছে, তাঁর ডান পাশে রয়েছে তূর্কী তরবারি আর বামপাশে ঝুলছে পারস্যের খঞ্জর। সে আলখাল্লার মোটা কাপড় এমনভাবে চিরে দিয়েছে যাতে প্রয়োজনের সময়ে সহজে সেগুলো সে বের করতে পারে।

বার্থোলোমিউ দ্রুত সরাইখানার সামনের খোলা প্রাঙ্গন অতিক্রম করে এবং এর তোরণাকৃতি প্রবেশদ্বারের নিচে ঘুমন্ত দ্বাররক্ষীকে পাশ কাটিয়ে বাইরে বের হয়ে আসে যার দায়িত্ব ছিল গভীর রাতে নিজেদের শোবার জন্য একটা বিছানা আর তাদের পশুর জন্য আস্তাবলের সন্ধানে আগত আগন্তুকদের প্রতি নজর রাখা। সে বাইরে এসেই দ্রুত চারপাশে একবার তাকিয়ে দেখে সে একাকী রয়েছে সেটা নিশ্চিত হতে। সে তারপরে সংকীর্ণ, নির্জন সড়ক দিয়ে এগিয়ে যায়। সে বহুবার এই নির্দিষ্ট পথ দিয়ে হেঁটে গিয়েছে এবং সে কুচকাওয়াজ ময়দান আর সেনাছাউনি অতিক্রম করে শহরের উত্তর দিকে এগিয়ে যাবার সময় খুব ভালো করেই জানে রাস্তাটা তাকে কোথায় নিয়ে যাবে। একটা ছোট হিন্দু মন্দিরের সামনে পৌঁছাবার পরে, যেখানে দেবতা গনেশের মূর্তির সামনে পিতলের একটা পাত্রে মোম লাগান সলতে জ্বলছে, বার্থোলোমিউ ঘুরে গিয়ে একটা গলিতে প্রবেশ করে যেখানে দুপাশের বাড়িগুলোর বাইরের দিকে ঝুলে থাকা উপরিতলগুলো এত কাছাকাছি তারা পরস্পরকে প্রায় স্পর্শ করেছে। একটা বাসা থেকে সে একজন মহিলার গুনগুন গানের শব্দ এবং অন্য আরেকটা থেকে একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতে শুনে। এখানে সেখানে জানালা ঢেকে রাখা নক্সা করা কাঠের জালির ভিতর দিয়ে তেলের প্রদীপের কমলা আলো দপদপ করে।

বার্থোলোমিউর পায়ে সহসা নরম কিছু একটা আটকে যায়। একটা কুকুর যার করুণ আর্তনাদ সে আয়েশী ভঙ্গিতে এগিয়ে যাওয়া বজায় রাখলে তাকে অনুসরণ করতে থাকে। তাড়াহুড়ো করার কোনো দরকার নেই আর তাছাড়া একজন ব্যস্ত মানুষ সবসময়ে অধিকতর মনোযোগ আকর্ষণ করে। গলিপথটা চওড়া হতে শুরু করেছে এবং এটা যতই বৃত্তাকারে বামদিকে বাঁক নিতে থাকে এটা একটা বড় প্রাঙ্গণে এসে মিশে যায়। বার্থোলোমিট দিন আর রাতের প্রতিটা প্রহরে এটা দেখেছে। সে জানে দিনের বেলা গরমের সময় নিজেদের দ্রব্যসামগ্রী বিক্রয়রত ছোট দোকানদারের দোকানে কতগুলো নিমগাছ ছায়া দেয়, কতগুলো অন্য গলিপথ আর রাস্তা এখানে এসে মিশেছে এবং প্রাঙ্গণের শেষ প্রান্তে তার ঠিক বিপরীত দিকে অবস্থিত লম্বা দালানটা ঠিক কতজন লোক পাহারা দেবে। বার্থোলোমিউ মস্তকাবরণী আরও ভালো করে মুখের উপরে টেনে দিয়ে গলির বাঁক থেকে সতর্কতার সাথে প্রাঙ্গণের দিকে তাকায়। অমাবস্যার পরে সদ্য নতুন চাঁদ উঠায় চারপাশ একেবারেই অন্ধকার কিন্তু তার অভীষ্ট বাড়ির ধাতু দিয়ে বাঁধান দরজার দু’পাশে জ্বলন্ত কয়লাদানির আভায় দেখা যায় যে–ঠিক অন্যান্য রাতের মতই–চারজন প্রহরী পাহারায় রয়েছে। আবছা আলোয় আরো দেখা যায় যে প্রবেশপথের উপরে একটা গিল্টি করা দণ্ড থেকে একটা সবুজ নিশান উড়ছে–সে হাসান আলির কাছ থেকে যেমনটা জেনেছে যে এটা সেনাপতির গৃহে অবস্থান করার একটা নিশানা। সবকিছু কেমন নির্জন দেখায়। কোনো ধরনের ভোজসভা বা সমাবেশ যদি আয়োজিত হয়ে থাকে তাহলে তাকে তাঁর পরিকল্পনা আজকের মত বাতিল করতে হবে…

বার্থোলোমিউ যা দেখতে চেয়েছিল দেখার পরে, সে গলির ছায়ার ভেতরে পিছিয়ে আসে এবং ঘুরে দাঁড়িয়ে, যেদিন থেকে এসেছে সেদিকে তার পায়ের ধাপগুণে এগিয়ে যেতে থাকে। একশ কদমের মত যাবার পরে সে বামদিকে একটা ছোট রাস্তার মুখে এসে দাঁড়ায়। দিনের বেলা রাস্তাটা সজিবিক্রেতায় গিজগিজ করে কর্কশ কণ্ঠে সাগ্রহে পথচারীদের তাঁরা নিজেদের সজির গুণগান করে এবং তাঁদের প্রতিযোগীদের সজির বদনাম করতে থাকে, কিন্তু রাস্তাটা এখন নির্জন আর জনমানবহীন। বার্থোলোমিউ রাস্তা বরাবর হেঁটে যায়, তাঁর পায়ের নিচে সজির পঁচতে শুরু করা পাতায় পিচ্ছিল হয়ে আছে এবং তাদের পচন ক্রিয়ার তীব্র দুর্গন্ধ বাতাসে কিন্তু তাঁর মনে অন্য বিষয় খেলা করছে। এই রাস্তাটা প্রাঙ্গণের পেছন দিয়ে বৃত্তাকারে বেঁকে গিয়েছে। কয়েকশ গজ পরেই শের আফগানের বাড়ির পেছনে একটা মনোরম উদ্যানের পশ্চিম পাশের দেয়ালের কাছ দিয়ে রাস্তাটা অতিক্রম করেছে।

দেয়ালটা বেশ উঁচু–কমপক্ষে বিশ ফিট হবে–কিন্তু সে জানে দেয়ালের ইটের গাঁথুনিতে হাত আর পা-রাখার অজস্র জায়গা থাকায় দেয়ালটা বেয়ে উপরে উঠা সম্ভব। গত দুই রাত্রি সে দেয়ালের উপরে নিজেকে টেনে তুলেছে, একটা স্থান পছন্দ করেছে যেখানে দেয়ালের অন্য পাশে লম্বা একটা বাশের ঝাড় থাকায়, ঘন গাছপালার ভিতরে লাফিয়ে নামা যাবে। পাতাবহুল বাঁশের ভিতর দিয়ে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে যাবার সময় সে চোখ কান সজাগ রাখে। বৃক্ষের আন্দোলিত কাণ্ডের ভিতর দিয়ে সে বুদ্বুদ নিঃসরণকারী ঝর্ণাবিশিষ্ট একটা উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ আর তারপরে বাড়ির অন্ধকার দেয়াল দেখতে পায়। বাড়ির ভিতরে প্রবেশের জন্য সামনে অবস্থিত ধাতব দরজার মত অবিকল এখানেও আছে কিন্তু দুটো গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। দরজার পাল্লাগুলো খোলা থাকে–যাঁদের পেছনে সে ভেতরের একটা আঙিনার খানিকটা দেখতে পেয়েছে–এবং সেইসাথে দরজায় পাহারার ব্যবস্থাও সামান্য। রাতের বেলা একজন প্রহরী–তার হালকা পাতলা অবয়ব দেখে বার্থোলোমিউ যত দূর বুঝতে পেরেছে একজন যুবকের চেয়ে বেশি বয়স হবে না–দরজার ঠিক ভেতরে একটা কাঠের তেপায়ার উপরে বসে থাকে। তাঁর কাছে কোনো অস্ত্র থাকে বলে মনে হয় না–কেবল একটা ছোট ঢোল থাকে বিপদ বুঝতে পারলে সেটা বাজিয়ে বাড়ির লোকদের সতর্ক করতে।

কিন্তু শের আফগান কি ধরনের বিপদ আশঙ্কা করছেন? তিনি শক্তিশালী আর শান্তিপূর্ণ একটা সাম্রাজ্যের এক শান্ত অঞ্চলে–যদিও সেটা দূরবর্তী–অবস্থিত একটা সেনানিবাসের আধিকারিক। সামনের দরজায় পাহারারত সৈন্যরা অন্য কোনো কিছু না সম্ভবত প্রদর্শনীর জন্য মোতায়েন রয়েছে। সম্রাট এই লোককে কেন মৃত দেখতে চান এবং কেন তিনি–সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী একজন–তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার জন্য এই পন্থার আশ্রয় নিয়েছেন বার্থোলোমিউ আরো একবার নিজেকে এই ভাবনায় ব্যপৃত দেখতে পায়। শের আফগান যদি কোনো অপরাধ করে থাকে তাহলে জাহাঙ্গীর কেন তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করছেন না? সবচেয়ে বড় কথা তিনি একজন সম্রাট। কিন্তু যাই হোক এটা নিয়ে তাঁর মাথা না ঘামালেও চলবে। সহস্র মোহর এখানে মূল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

কোনো অঘটন ছাড়াই দেয়ালের কাছে পৌঁছাবার পরে, বার্থোলোমিউ নিশ্চিত হবার জন্য তার চারপাশে আরো একবার তাকিয়ে দেখে যে কেউ আশেপাশে নেই। সে সন্তুষ্ট হয়ে নিজের কালো আলখাল্লাটা তুলে ধরে দেয়াল বেয়ে উঠতে আরম্ভ করে। সে এইবার কোনো কারণে, সম্ভবত কাজ শেষ করার জন্য অধৈর্য হয়ে উঠায় বা উত্তেজনার বশে, হাত রাখার জায়গা ভালো করে বাছাই করতে পারে না। সে যখন প্রায় পনের ফিট উপরে উঠে গেছে, তার ডান হাত দিয়ে আঁকড়ে রাখা একটা ইটের কোণ গুঁড়িয়ে যায় এবং তার প্রায় চিৎ হয়ে মাটিতে পড়ার দশা হয়। ইটের মাঝে বিদ্যমান ফাঁকে পায়ের আঙুল শক্ত করে গুঁজে দিয়ে এবং বাম হাতে ঝুলে থেকে–সে টের পায় নখের নিচে দিয়ে টপটপ করে রক্ত পড়ছে–সে কোনো মতে নিজের অবস্থান সংহত করে। সে ডান হাত বাড়িয়ে উঁচুতে রুক্ষ উপরিভাগে হাতড়াতে থাকে যতক্ষণ না সে নিরাপদ মনে হয় এমন একটা জায়গা খুঁজে পায়। সে শেষ একটা ঝাঁকি দিয়ে নিজেকে দেয়ালের উপরে তুলে আনে।

সে মুখ থেকে ঘাম মুছে সতর্কতার সাথে দেয়ালের অপর পাশে নিজেকে নিচু করে, বাঁশ ঝাড়ের মাঝে তাঁর খুঁজে পাওয়া ফাঁকা স্থানে মাটি থেকে যখন দশ ফিট উপরে রয়েছে সে হাত ছেড়ে দেয়। সে উবু হয়ে বসে, হৃৎপিণ্ডের ধকধক শব্দের ভিতরে, শুনতে চেষ্টা করে। কোনো শব্দ নেই, সব চুপচাপ। এটা ভালো লক্ষণ। এখন নিশ্চিতভাবেই মধ্যরাত্রি অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু এখনও তার পরিকল্পনামাফিক কাজ শুরু করার জন্য অনেক সময় বাকি আছে। সে সামান্য নড়েচড়ে নিজের অবস্থানকে একটু আরামদায়ক করে। সে টের পায় একটা ছোট জম্ভ–একটা ইঁদুর বা টিকটিকি হবে–তাঁর পায়ের উপর দিয়ে দৌড়ে যায় এবং মশার চির পরিচিত ভনভন শুনতে পায়। খানিকটা কুচকে, সে সামনের কাজটায় মনোসংযোগের চেষ্টা করে।

রাত যখন প্রায় একটার কাছাকাছি, বার্থোলোমিউ তখন ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে, প্রথমে বাঁশের ঝাড়ের এবং পরে একটা ছড়ান ডালপালাযুক্ত পাতাবহুল আমগাছের আড়াল ব্যবহার করে। চাঁদের আলোয়, সে দেখতে পায় প্রহরীর তরুণ মাথাটা তাঁর বুকের উপরে ঝুঁকে এসেছে এবং সে স্পষ্টতই নিজের তেপায়ার উপরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তার পেছনে বাড়ির ভেতরের আঙিনা, দেয়ালের কুলঙ্গিতে রক্ষিত কয়েকটা ক্ষুদ্রাকতি মশালের আলোয় আধো আলোকিত, নিরব আর শান্ত। বার্থোলোমিউ বাগানের উপর দিয়ে দ্রুত বেগে দৌড়ে পানি নির্গত হতে থাকা ঝর্ণার পাশ দিয়ে বাড়ির দেয়ালের দিকে এগিয়ে গিয়ে, দরজার বাম পাশে ঝুল বারান্দার কারণে অন্ধকার হয়ে থাকা একটা জায়গা বেছে নেয়। সে দেয়ালের সাথে পিঠ সোজা করে রেখে এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে সে নিজের শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।

সে তারপরে গুটি গুটি পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। দরজার কাছে পৌঁছে সে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দেয়। সে দ্বাররক্ষীর এতটাই কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে যে তার মৃদু নাক ডাকার শব্দ অব্দি সে শুনতে পায়। কিন্তু কোথাও আর কোনো শব্দ নেই। সে মাংসপেশী টানটান করে, দরজার ভিতর দিয়ে সে লাফ দিয়ে সামনে এগিয়ে গিয়ে, তরুণ প্রহরীকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে তাকে তুলে বাগানে নিয়ে আসে এবং ডান হাতে শক্ত করে তাঁর মুখ চেপে রেখেছে। একটা শব্দ তুমি করেছছা তো জানে মেরে ফেলবো, সে ফার্সী ভাষায় কথাটা বলে। আমার কথা বুঝতে পেরেছো? সে যখন মাথা নাড়ে তার তরুণ চোখ ভয়ে বিস্ফারিত হয়ে রয়েছে। বেশ এখন তাহলে তোমার মনিব শের আফগান যেখানে ঘুমিয়ে আছে আমাকে সেখানে নিয়ে চলো।’

তরুণ প্রহরী আবার মাথা নাড়ে। সে বাম হাতে অসহায় তরুণের গলার পেছনের দিক এত জোরে আঁকড়ে ধরে যে তার নখ বেচারার মাংসের গভীর প্রবেশ করে, এবং ডান হাতে মোষের চামড়ার ময়ান থেকে বাকান ফলার তুর্কী খঞ্জরটা বের করে, বার্থোলোমিউ ভেতরের আঙিনার উপর দিয়ে তাকে অনুসরণ করে কোণায় অবস্থিত একটা দরজার নিচে দিয়ে এগিয়ে যায় এবং কয়েক ধাপ পাথুরে সিঁড়ি অতিক্রম করে একটা লম্বা করিডোরে এসে উপস্থিত হয়। সে টের পায় তার আঁকড়ে ধরা হাতের ভিতরে ভয় পাওয়া ভীত কুকুরছানার মত তরুণ প্রহরী কাঁপছে।

‘মহাশয়, এখানেই। এটাই সেই কামরা।’ পিতলের ব্যাঘ্র বসান কালো কোনো কাঠের তৈরি ভীষণ চকচকে দরজাবিশিষ্ট একটা কক্ষের বাইরে ছেলেটা এসে থামে। বার্থোলোমিউর মনে হয় সে মশলাযুক্ত কোনো সুগন্ধ। তাঁর নাকে পেয়েছে–সম্ভবত কুন্দু–এবং সে তরুণ ছেলেটাকে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে, আতঙ্কিত খয়েরী চোখে, সে ঘুরে তাকায়। সে কোনো হুশিয়ারি না দিয়েই চিৎকার করে বিপদসঙ্কেত দিতে মুখ হাঁ করে।

বার্থোলোমিউ বিন্দুমাত্র ইতস্তত করে না। সে চোখের পলকে দু’বার হাত চালিয়ে বাম হাতে ছেলেটার মাথা পেছনের দিকে টেনে আনে এবং একই সাথে তার উজ্জ্বল ফলাযুক্ত তূর্কী খঞ্জর ধরা ডান হাতটা উঁচু করে আর মসৃণ ত্বকযুক্ত গলায় চালিয়ে দেয়। উন্মুক্ত ক্ষতস্থান দিয়ে তরুণ প্রহরীর শেষ নিঃশ্বাস বুদ্বুদের মত বের হতে সে নিথর দেহটা মাটিতে নামিয়ে রাখে। পরিস্থিতি ভিন্ন হলে, সে হয়ত তাকে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখতো, কিন্তু এখানে সেই উদারতা দেখাবার কোনো স্থান নেই যেখানে নিজের কোনো ভুলের খেসারত তাকে নিজের জীবন দিয়ে দিতে হতে পারে। সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে খঞ্জরের ফলাটা নিজের আলখাল্লায় মুছে নেয়। তার সমস্ত চিন্তা জুড়ে এখন কেবল একটাই ভাবনা দরজার চকচক করতে থাকা ব্যাঘ্রখচিত পাল্লার অপর পাশে সে কি দেখতে পাবে। সে শুনেছে যে ‘শের’ মানে ব্যাঘ–যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে সে ঠিক জায়গায় পৌঁছেছে এবং শের আফগান মাত্র কয়েক ফিট দূরে রয়েছে।

তার ডান হাতে তখনও খঞ্জর ধরে রেখে, বার্থোলোমিউ বামহাতে ডানপাশের পাল্লার–এটাও আবার বাঘের মতই দেখতে–কারুকার্যখচিত ধাতব অর্গলটা সতর্কতার সাথে নামিয়ে আলতো করে কৌতূহলী একটা ধাক্কা দেয়। দরজার পাল্লাটা নিরবে আর মসৃণভাবে খুলে যেতে সে দারুণ। স্বস্তি পায়। পাল্লাটা যখন ছয় ইঞ্চির মত ফাঁক হয়েছে সে ধাক্কা দেয়া বন্ধ করে। ধুসর সোনালী আলোর একটা স্রোত তাকে জানায় সে যেমনটা আশা করেছিল তেমন অন্ধকার একটা কক্ষে সে প্রবেশ করতে যাচ্ছে না। শের আফগান সম্ভবত দরজার পাল্লাটা ইতিমধ্যেই খুলে যেতে দেখেছে এবং এখন নিজের তরবারি হয়ত কোষমুক্ত করছে…

বার্থোলোমিউ আর বেশিক্ষণ ইতস্তত না করে দরজার পাল্লা ধাক্কা দিয়ে খুলে দিয়ে কক্ষের ভেতর পা দেয়। সোনালী জরির কারুকাজ করা লাল রেশমের পর্দা শোভিত বিশাল একটা কামরা। তাঁর পায়ের নিচে নরম পুরু গালিচা এবং কলাই করা ধূপদানিতে জ্বলন্ত একটা স্ফটিক থেকে ঘোয়ার কুণ্ডলী বাতাসে ভেসে উঠছে। তেল পূর্ণ ব্রোঞ্জের দিয়ায় সলতেগুলো মিটমিট করে জ্বলছে। কিন্তু বার্থোলোমিউয়ের দৃষ্টিতে এসব কিছুই ধরা পড়ে না। সে কক্ষের মাঝামাঝি পর্দা টেনে এটাকে দুই ভাগকারী প্রায় স্বচ্ছ ধুসর গোলাপি মসলিনের পর্দা ভিতর দিয়ে সরাসরি তাকিয়ে রয়েছে। কাপড়ের ভিতর দিয়ে সে একটা নিচু বিছানা এবং সেটার উপরে একজন নারী আর একজন পুরুষের, পরস্পরগ্রন্থিত দুটো নগ্ন দেহ, দেখতে পায়। পুরুষটা নিজের রমণক্রিয়ায় এতটাই আবিষ্ট যে বার্থোলোমিউ যদি লাথি মেরেও দরজার পাল্লাটা খুলতে সে ব্যাপারটা খেয়ালই করতো না। মেয়েটা তাঁর পিঠের উপর ভর দিয়ে শুয়ে, সুগঠিত পা দুটো দিয়ে সঙ্গী পুরুষের পেষল কোমর জড়িয়ে রেখেছে যখন সে রমণের মাত্রা বৃদ্ধিতে বিভোর এবং তাঁর প্রেমিকের দেহ দরজার প্রতি তাঁর দৃষ্টিতে ব্যাহত করেছে।

ভাগ্য তাকে এরচেয়ে ভালো আর কোনো সুযোগ দিতে পারতো না। বার্থোলোমিউ কাছে এগিয়ে যাবার সময় ভাবে। সতর্কতার সাথে সে মসলিনের পর্দা অতিক্রম করে এবং পা টিপে টিপে সন্তর্পণে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। সে এখন বিছানার এত কাছাকাছি চলে এসেছে যে সে পুরুষ লোকটার দেহের ঘামের চকচকে আভা দেখতে পায় এবং এর ঝাঁঝালো নোতা গন্ধ তাঁর নাকে ভেসে আসে কিন্তু বিছানায় ব্যস্ত পুরুষ আর নারী, যার মাথাটা একপাশে কাত হয়ে আছে, তার চোখ দুটোও বন্ধ, এখনও তার উপস্থিতি সম্বন্ধে একেবারে বেখেয়াল। রমণের মাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে তুঙ্গস্পর্শী অনুভূতির কাছাকাছি পৌঁছে গিয়ে শের আফগান উৎফুল্ল ভঙ্গিতে নিজের মাথা পেছনের দিকে হেলিয়ে দেয়। সে মাথা এমন করতেই, বার্থোলোমিউ লাফিয়ে সামনে এগিয়ে আসে, তার মাথার ঘন কালো চুল আঁকড়ে তাকে ধরে তাঁর মাথাটা আরো পিছনের দিকে টেনে আনে এবং গলার শ্বাস নালী একটানে নিখুঁতভাবে দুই ভাগ করে দেয়। বার্থোলোমিউ একজন দক্ষ আততায়ী। গলার মুখ ব্যাদান করে থাকা ক্ষতস্থান থেকে তাঁর উষ্ণ লাল রক্ত ছিটকে আসলে শের আফগান, ঠিক তোরণ রক্ষীর মত, একটা শব্দও করে না।

বার্থোলোমিউ ভারি দেহটা শক্ত করে ধরে, মুহূর্তের জন্য তখন খোলা চোখের দিকে তাকায় নিজেকে নিশ্চিত করতে যে লোকটা আসলেই শের আফগান তারপরে দেহটা ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেয় এবং সঙ্গিনী মেয়েটার দিকে মনোযোগ দেয় যে এখন চোখ খুলে রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে হাঁটু বুকের কাছে নিয়ে এসে বিছানায় উঠে বসেছে। তাঁর প্রেমিকের রক্ত তাঁর নিটোল স্তনের মাঝে দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে এবং তার কালো চোখের দৃষ্টি বার্থোলোমিউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে যেন বুঝতে চেষ্টা করছে সে এরপর কি করবে। কোনো শব্দ করবেন না এবং আমিও তাহলে আপনার কোনো ক্ষতি করবো না, সে বলে। তাঁর মুখ থেকে একবারের জন্যও দৃষ্টি না সরিয়ে, সে ধীরে ধীরে একটা চাদর নিজের দেহের উপর টেনে নেয় কিন্তু কোনো কথা বলে না।

সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে–একজন মহিলাকে হত্যা করার চেয়ে সে কিছুতেই তরুণ প্রহরীকে হত্যা করতে বেশি আগ্রহী ছিল না–কিন্তু একই সাথে বলতেই হবে সে বিস্মিত হয়েছে। সে আশা করেছিল মেয়েটার মত এমন পরিস্থিতিতে যে কেউ উন্মত্তের মত চিৎকার করবে বা গালিগালাজ করবে কিন্তু যে লোকটা কিছুক্ষণ পূর্বেও পরম আবেগ আর প্রাণবন্ত ভঙ্গিতে আদিম খেলায় মেতে উঠেছিল এখন সেই মেঝেতে জমাট বাধা রক্তের মাঝে নিথর পড়ে রয়েছে দেখে তাঁর যতটা বিপর্যস্ত হওয়া উচিত ছিল তাকে ঠিক ততটা বিপর্যস্ত দেখায় না। তার চোখে মুখে বরং কৌতূহলের একটা অভিব্যক্তি ফুটে রয়েছে। সে টের পায় মেয়েটা তার পরনের গাঢ় রঙের, নোংরা আলখাল্লা এবং রক্ত রঞ্জিত হাত থেকে শুরু করে তাঁর মাথায় পেচানো পিঙ্গল বর্ণের কাপড়ের নিচে দিয়ে বের হয়ে আসা লালচে-সোনালী চুলের বিক্ষিপ্ত গোছা সবকিছু খুটিয়ে লক্ষ্য করছে।

সে চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়। সে ইতিমধ্যেই প্রয়োজনের চেয়ে বেশিক্ষণ অবস্থান করে ফেলেছে। মেয়েটার কাছে কোনো লুকান অস্ত্র থাকতে পারে ভেবে সে উল্টো হেঁটে দরজার কাছে পৌঁছে, প্রহরীদের উদ্দেশ্যে তার চিৎকারের শব্দ যেকোনো মুহূর্তে শুনবে বলে সে প্রস্তুত। কিন্তু সে দরজা দিয়ে বের হয়ে এসে, করিডোর দিয়ে নিচে নেমে পাথুরে সিঁড়ি দিয়ে নিচের নির্জন আর জনমানব শূন্য আঙিনায় পা রাখার পরেই সে কেবল একজন মহিলার তীক্ষ্ণ কণ্ঠের চিৎকার শুনতে পায় ‘খুন! সে অন্ধকার উদ্যানের ভিতর দিয়ে দৌড়ে যাবার সময় নিজের পেছনে একটা শশারগোল শুরু হবার আভাস শুনতে পায়–লোকের উত্তেজিত গলার আওয়াজ, দ্রুতগামী পায়ের শব্দ–কিন্তু সে এখন প্রায় দেয়ালের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। বাঁশের ঝাড়ের ভিতর দিয়ে গায়ের জোরে এগিয়ে, সে নিজের কাটা ছেঁড়া নিয়ে কোনো চিন্তাই করে না, সে নিজেকে দেয়ালের উপর ছুঁড়ে দেয় এবং এই বার কোনো অসুবিধা ছাড়াই দেয়াল বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করে।

শহরের রাস্তায় পৌঁছাবার পরে সে মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায়। সে শের আফগানের জমাট রক্ত রঞ্জিত নিজের তূর্কী খঞ্জরটা তুলে নিয়ে সেটায় আলতো করে চুমু দেয়। সে এখন সহস্র মোহরের অধিকারী।

১.০৩ এক বিধবা নারী

‘আপনার স্বামীর মৃতদেহ গোসল করিয়ে আমরা তাকে দাফনের জন্য প্রস্তুত করেছি, হেকিম এসে বলেন। আমি ভেবেছিলাম যে আমরা তাকে কফিনে শোয়াবার পূর্বে আপনার আদেশ অনুযায়ী সবকিছু যে ঠিকমত পালিত হয়েছে আপনি সে বিষয়ে নিজেকে নিশ্চিত করতে চাইবেন।’

‘ধন্যবাদ।’ মেহেরুন্নিসা সামনে এগিয়ে আসেন এবং তাঁর স্বামীর মৃতদেহের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। অনুগ্রহ করে আমাকে একটু একা থাকতে দিন…’ তাকে যখন সবাই একা রেখে যায় সে মৃতদেহের উপর ঝুঁকে আসে এবং শের আফগানের মুখটা খুটিয়ে দেখে, যা এমন নৃশংসভাবে মৃত্যুবরণ করা একজন লোকের তুলনায় বেশ প্রশান্ত দেখায়। হেকিম আর তার সহকারীরা মৃতদেহ পরিষ্কার করার সময় কর্পূর দেয়া যে পানি ব্যবহার করেছে মেহেরুন্নিসা তাঁর রুক্ষ গন্ধ টের পায়।

‘আপনাকে এভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে বলে আমি সত্যিই দুঃখিত, সে ফিসফিস করে আপন মনে বলে, কিন্তু আমি মোটেই দুঃখিত নই আপনার কবল থেকে আমি মুক্তি পেয়েছি। আততায়ী যদি আপনার বদলে আমায় হত্যা করতো আপনি হয়তো ব্যাপারটা পরোয়া করতেন না। সে এক মুহূর্তের জন্য তার স্বামীর গালে আঙুলের অগ্রভাগ দিয়ে স্পর্শ করে। ‘আপনার ত্বক এখন শীতল কিন্তু আপনি সবসময়ে আমার এবং আমার কন্যার প্রতি শীতল অভিব্যক্তি প্রদর্শন করেছেন, ছেলে না হয়ে জন্মাবার জন্য আপনার কাছে যার কোনো গুরুত্বই ছিল না…’

মেহেরুন্নিসা চোখের কোনে কান্নার রেশ অনুভব করে, কিন্তু এই কান্না শের আফগানের জন্য নয়। সে যদিও আত্ম-করুণা অপছন্দ করে তবুও অক্ষর উপস্থিতি তাঁর নিজের জন্য এবং এমন একজন লোকের সাথে অতিবাহিত জীবনের নষ্ট সময়ের জন্য যে তার দেয়া যৌতুক কুক্ষিগত করার পরে তাকে নিজের বাসনা আর ক্ষমতা প্রদর্শন করার একটা বস্তুতে পরিণত করেছিল। লোকটার সাথে যখন তাঁর বিয়ে হয়েছিল তখন তার বয়স মাত্র সতের বছর। তাঁর প্রতি বিয়ের পরে লোকটার নিশ্চেতন উদাসীনতা বা–সে যদি কখনও অভিযোগ করার স্পর্ধা দেখাত–তাঁর রীতিবিবর্জিত আর দুর্বিনীত নিষ্ঠুরতার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। সে মুখ ঘুরিয়ে নেয়, তার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে এবং সে অসুস্থবোধ করে। আততায়ীর হামলার পরে ছয় ঘন্টাও এখনও অতিবাহিত হয়নি। তাঁর মানসপটে পুরো দৃশ্যটা এখনও দগদগে আর প্রাণবন্ত হত্যাকারীর চোখ-পারস্যের মার্জারের মত ধুসর নীল রং–সে যখন তাঁর শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, তার খঞ্জরের ফলার রূপালী ঝিলিক, শের আফগানের কণ্ঠনালীর ক্ষতস্থান থেকে তার নগ্ন দেহে ছিটকে আসা উষ্ণ লাল রক্ত, তাঁর জীবন প্রদীপ নিভে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে তার স্বামীর মুখে ফুটে উঠা নিখান বিস্ময়। পুরো ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটে গিয়েছিল যে সে তখন ভয় পাবার সময়ই পায়নি, কিন্তু এখন যখন তার মনে হয় যে খুনী ইচ্ছা করলেই নিজের রক্তাক্ত খঞ্জর তার দিকে তাক করতে পারতো সে শিহরিত হয়। তরুণ দ্বাররক্ষীকে হত্যা করার সময় আততায়ী ক্ষনিকেন জন্য দ্বিধা করে নি…

অনুগত সৈন্যরা ইতিমধ্যে শহর তন্ন তন্ন করে হত্যাকারীর সন্ধান করেছে। তাঁর বর্ণনা থেকে একটা বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেছে যে হত্যাকারী যেই হোক লোকটা ভিনদেশী। একজন নীল চোখঅলা লোকের সন্ধান ইতিমধ্যেই পাওয়া গিয়েছে–কারও মতে লোকটা পর্তুগীজ-শহরের সরাইখানায় লোকটা গত বেশ কয়েকদিন ধরেই অবস্থান করছিল কিন্তু এখন একেবারে যেন বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছে… গ্রীষ্মের নিদাঘ তপ্ত দিন হওয়া সত্ত্বেও মেহেরুন্নিসা উষ্ণতার জন্য নিজেকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে, সে তাঁর স্বামীর মৃতদেহের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ায় এবং সে যখন কিছু চিন্তা করতে চায় তখন যেভাবে পায়চারি করে সেভাবে হাঁটতে থাকে। তার কাছে হত্যাকারীর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তার অভিপ্রায়। হত্যাকাণ্ডটা কি বড় কোনো অভ্যুত্থানের পূর্বাভাষ? গৌড় কি অচিরেই আক্রমণের সম্মুখীন হবে? যদি তাই হয়, তাহলে তাঁর নিজের এবং তাঁর কন্যার জীবনও হয়তো হুমকির সম্মুখীন হবে।

বা এমনও হতে পারে শের আফগানের মৃত্যু কারো ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার ফসল? তাঁর স্বামী প্রচুর শত্রু তৈরি করেছিলেন। সে প্রায়ই তার কাছে দম্ভোক্তি করতে কীভাবে সে নিজেকে ধনী করতে রাজকীয় অর্থ তছরূপ করার পাশাপাশি প্রজাদের কাছ থেকে নিজের এক্তিয়ারের বেশি খাজনা আদায় করেছে। সে তাকে আরও বলেছিল গৌড়ের উত্তরের ডাকাত সর্দারদের অবাধে ডাকাতির সুযোগ দিয়ে কীভাবে তাঁদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছিল, এবং মেহেরুন্নিসা জানে যে গত বর্ষা মওসুমে বৃষ্টি শুরু হবার ঠিক আগ মুহূর্তে, বেশ কয়েকজন ধনী বণিক আগ্রায় অভিযোগ জানাতে তাঁদের চাপে পড়ে, সে তার কথার বরখেলাপ করে অবিশ্রান্তভাবে ডাকাতদের ধাওয়া করতে শুরু করেছিল এবং সে যাদের হত্যা করেছিল হুশিয়ারী হিসাবে তাদের ছিন্ন মস্তক শহর রক্ষাকারী প্রাচীরের উপরে গেঁথে রেখেছিল। শের আফগান নিহত হওয়ায় অনেক লোকই খুশি হয়েছে, কিন্তু তাকে তার নিজের শয়নকক্ষে হত্যা করার মত সাহস কার হতে পারে?

কক্ষের বাইরে থেকে বেশ কয়েকটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে–শবাধারের নির্মাতারা সম্ভবত শবদেহের মাপ নিতে এসেছে–মেহেরুন্নিসা জোর করে এসব ভাবনা থেকে নিজেকে সরিয়ে আনে। আগামী দিনগুলোতে সে অবশ্যই তার নিজের এবং তাঁর মেয়ের প্রতি কোনো ধরনের হুমকির বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখবে কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে একজন শোকাতুর বিধবার ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে। তার পরিবারের সম্মানের বিষয়টা এর সাথে জড়িয়ে আছে। সে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কৃত্যানুষ্ঠান একজন বিবেকবান স্ত্রীর মতই পালন করবে এবং তাকে দেখে কারো মনে কোনো ধরনের সন্দেহের উদ্রেক হবে না যে নিজের অন্তরে সে মুক্তির আনন্দ ছাড়া কোনো রকমের দুঃখ অনুভব করছে না।

*

জাহাঙ্গীরের নিভৃত কক্ষে ধুলিতে আচ্ছাদিত চুল নিয়ে ভ্রমণজীর্ণ বার্থোলোমিউ হকিন্স উপস্থিত হয়। যদিও মাঝরাত অতিক্রান্ত হতে চলেছে, ফিরিঙ্গি লোকটার আগমনের সংবাদ শুনে জাহাঙ্গীর তার খবরের জন্য অস্থির হয়ে রয়েছে।

‘বেশ, কি অবস্থা বলো?

‘সুলতান, কাজটা সম্পূর্ণ হয়েছে। আমি নিজ হাতে তার কণ্ঠনালী চিরে দিয়েছি।’

‘কেউ তোমাকে দেখে ফেলেনি তো?

‘তাঁর শয্যাসঙ্গী এক রমণী ছাড়া আর কেউ দেখতে পায়নি।’

জাহাঙ্গীর পলকহীন চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, মুখে সহসা ভীতিবিহ্বল অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে। তুমি তার কোনো ক্ষতি করোনি?

না, সুলতান।

‘তুমি পুরোপুরি নিশ্চিত?

‘আমি আমার জীবনের দিব্য করে বলতে পারি।’

বার্থোলোমিউর চেহারায় ফুটে উঠা বিমূঢ়তা জাহাঙ্গীরের দৃষ্টি এড়ায় না। স্পষ্টতই বোঝা যায় লোকটা সত্যি কথাই বলছে। সে ক্রমশ স্বস্তির সাথে শ্বাস নিতে আরম্ভ করে। তুমি তোমার দায়িত্ব ভালোমতই পালন করেছে। আগামীকাল সকালে আমার কচিদের একজন তোমাকে তোমার অর্থ পৌঁছে দেবে…’ তাঁর মনে সহসা অন্য একটা ভাবনা খেলা করতে সে কথা শেষ করে না। তুমি এখন কি করবে বলে ঠিক করেছো? নিজের দেশে ফিরে যাবে?

‘সুলতান, আমি ঠিক নিশ্চিত নই।’

‘তুমি যদি আমার দরবারে অবস্থান করো তাহলে আমি তোমাকে আরও অনেক কাজ দিতে পারি। তুমি যদি আমার অর্পিত দায়িত্ব ঠিকমত পালন করো যা তুমি ইতিমধ্যেই একবার করেছো, তুমি নিজের জাহাজ কিনে দেশে ফিরে যাবার মত ধনী আমি তোমায় করে দিতে পারি।’ বার্থোলোমিউ হকিন্সের রোদে পোড়া মুখ থেকে তার সমস্ত ক্লান্তি মুছে গিয়ে সহসা তাঁর চোখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। জাহাঙ্গীর মনে মনে ভাবে, সে একসময় যেমন বিশ্বাস করতো মানুষকে বুঝতে পারাটা আসলে ততটা কঠিন নয়।

*

শীতের প্রকোপ থেকে রক্ষা করতে পর্যাপ্ত সংখ্যক গালিচা আর পশমের কম্বল থাকা সত্ত্বেও, মেহেরুন্নিসাকে খাইবার গিরিপথের ভিতর দিয়ে কাবুল অভিমুখে বহনকারী গরুর গাড়িটা মোটেই আরামদায়ক ছিল না। সে বাংলা থেকে শুরু হওয়া এই দীর্ঘ যাত্রাটা কখন শেষ হবে সেই অপেক্ষা করছে। তাঁর মেয়ে লাডলী বেগম, ফারিশার কোলে মাথা রেখে, মেয়ের লালনপালনের জন্য নিয়োজিত পার্সী মহিলা, যে জন্মের সময় থেকে তাঁর তত্ত্বাবধায়নের দায়িত্বে রয়েছে, অঘোরে ঘুমিয়ে আছে। বাচ্চা মেয়েটা নদীপথে নৌকায় গঙ্গার উপর দিয়ে পশ্চিমমুখী এবং তারপরে যমুনা নদীর উপর দিয়ে উত্তরমুখী যাত্রা খুবই উপভোগ করেছিল, কিন্তু শেষ ছয়শ মাইল স্থলপথে ভ্রমণের জন্য তাঁরা দিল্লির কাছে নৌকা থেকে অবতরণের পর থেকেই মেয়েটা ক্রমশ খিটখিটে হয়ে উঠেছে। গরুর গাড়ির ছইয়ের অভ্যন্তরে চতুর্দিক মোটা পর্দা দিয়ে ঘেরা থাকায়, ভিতরটা শ্বাসরুদ্ধকর আর অন্ধকার। ছয় বছরের লাডলী বেগমের এখনও বোঝার বয়স হয়নি যে তাঁদের সাধারণের দৃষ্টির আড়ালে রাখতে অবশ্যই পর্দা টানা থাকতে হবে। দিনের শেষে যাত্রা বিরতি করতে যখন অস্থায়ী ছাউনি স্থাপন করা হয় মেয়েটা কেবল সেই সময়টুকু খানিকটা উপভোগ করে এবং কাঠের উঁচু অস্থায়ী কাঠামো দিয়ে মেয়েদের জন্য পৃথক করা স্থানে সে তখন কিছুক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করতে পারে।

কিন্তু তারা অন্ততপক্ষে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। তারা মওসুমের প্রথম তুষারপাতের পূর্বেই গিরিপথ অতিক্রম করবে। শীতের প্রকোপ কাবুলে ভীষণ তীব্র। মেহেরুন্নিসার তাঁর বাবার বাড়ির ছাদের প্রান্তদেশে মানুষের হাতের মত মোটা ঝুলন্ত তুষারিকার কথা এখনও মনে আছে এবং শহরের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের বাইরে তুষার শুভ্র বিস্তৃর্ণ অঞ্চলে মাঝে মাঝে খাবারের সন্ধানে ক্ষুধার্ত নেকড়ে ছাড়া আর বেশি কিছু চলাফেরা করতো না। যদিও বাংলার উষ্ণ আর স্যাঁতসেঁতে বাতাসের মাঝে গালে কনকনে শীতল বাতাসের স্পর্শ পেতে এবং শ্বাস নেয়ার সময় হিমশীতল বাতাসের কুণ্ডলী দেখতে তার বহুবার ইচ্ছে হয়েছে।

সে যখন গৌড় ত্যাগ করে রওয়ানা হয়েছিল তখনও শের আফগানের হত্যাকারীর কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নি এবং হত্যাকাণ্ডের পেছনের অভিপ্রায় সম্বন্ধেও কোনো কিছু জানা যায় নি। পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ থাকায় সে স্বস্তি পেয়েছিল এবং একই সাথে গৌড় এখন তাদের থেকে বহুদূরে থাকায় সে খুশি। তাঁর দীর্ঘ যাত্রার জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি তাঁর আব্বাজানই গ্রহণ করবেন বলে সে আশা করেছিল এবং সে কারণেই তিনি যখন তাকে চিঠি লিখে জানান যে গৌড়ের পশ্চিমে গঙ্গার তীরে মুঙ্গের দূর্গ থেকে রাজকীয় সৈন্যের একটা বহর কাবুল পর্যন্ত পুরোটা পথ তার সাথে অবস্থান করবে সে তখন সত্যিই বিস্মিত হয়েছিল। মহামান্য সম্রাট তোমার দুঃখ ভারাক্রান্ত পরিস্থিতিতে তোমার জন্য শোক প্রকাশ করেছেন। তাঁর ইচ্ছা তুমি দ্রুত আর নিরাপদে তোমার পরিবারের কাছে ফিরে আসো, তার আব্বাজান চিঠিতে লিখেছিলেন। সম্রাট আমাকে আমার প্রত্যাশার অতীত অনুগ্রহ প্রদর্শন করেছেন। তোমার জন্য আমার আশীর্বাদ রইল। চিঠিতে গিয়াস বেগের দস্ত খত আর কাবুলের কোষাধ্যক্ষের বিশাল সীলমোহর দিয়ে সেটা বাঁধা ছিল।

মেহেরুন্নিসা, তাঁর দীর্ঘ যাত্রা পথে, প্রায়শই তাঁর আব্বাজানের কথাগুলো নিয়ে চিন্তা করেছে। তাঁদের পরিবারের প্রতি সম্রাটের এই উদারতার উৎস সম্ভবত কাবুলে বর্তমান সম্রাটের, তখন তিনি যুবরাজ, অতিবাহিত সেই মাসগুলোতে নিহিত যখন তার আব্বাজান সম্রাট আকবর-তাকে সেখানে নির্বাসিত করেছিলেন। যুবরাজের আগমনের বহু পূর্বেই গুজব ছড়িয়ে গিয়েছিল, আকবরকে ভীষণভাবে ক্রুদ্ধ করেছিলেন জাহাঙ্গীর। কাবুলের শাসনকর্তা, সাইফ খানের স্ত্রী মেহেরুন্নিসার আম্মিজানকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে ছিল যে আসলেই কি ঘটেছিল–যুবরাজ তার আব্বাজানের একজন উপপত্নীর সাথে আপত্তিকর অবস্থায় ধরা পড়েছিলেন। তাকে নির্বাসিত করে শাস্তি দেয়া হলেও মেয়েটার কপালে জুটেছিল মৃত্যুদণ্ড…

তার আব্বাজানের বাড়ির নিয়মিত অতিথিতে পরিণত হয়েছিলেন যুবরাজ। শহরের দূর্গপ্রাসাদ থেকে যুবরাজের রওয়ানা হবার সংবাদ নিয়ে বার্তাবাহক যখন উপস্থিত হতো তখন তাঁদের প্রস্তুতির কথা এখনও তাঁর দিব্যি মনে আছে–কীভাবে তাঁর আম্মিজান ধূপদানিতে মূল্যবান ধূপ জ্বালাতে আদেশ দিতেন, কীভাবে তাঁর আব্বাজান নিজের দামী আলখাল্লাগুলোর একটা পরিধান করতেন এবং তাকে অভ্যর্থনা জানাতে দ্রুত প্রবেশ পথের দিকে এগিয়ে যেতেন। একটা রাতের কথা তাঁর বিশেষভাবে মনে আছে তার আব্বাজান–যিনি তাকে কোনো আভাসই দেননি তিনি কি চান সে সম্বন্ধে–তাদের সম্মানিত অতিথির জন্য পারস্যের ধ্রুপদী নাচের একটা প্রদর্শনের জন্য তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর পরিচারিকার দল তার চুল ভালো করে বেঁধে আর সুগন্ধি ধোয়া দিয়ে সুরভিত করলে সে বিচলিত বোধ করার সাথে সাথে উত্তেজিতও হয়েছিল। সে সোনালী বৃক্ষের নৃত্য প্রদর্শন করেছিল, তার দু’হাতে বাঁধা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সোনালী ঘন্টা, শরতে গাছ থেকে বনের মাটিতে ঝরে পড়া সোনালী পাতায় আসন্ন শীতের হিমশীতল বাতাসের দ্বারা সৃষ্ট আলোড়ন প্রতীকায়িত করেছিল।

সে নাচের মুদ্রা ঠিক করতে এতই মগ্ন ছিল–ভীষণ জটিল একটা নাচ যা নিখুঁত করতে সে তাঁর ওস্তাদজির কাছে ঘন্টার পর ঘন্টা অভ্যেস করেছে–যে নাচের শুরুতে সে সরাসরি যুবরাজের দিকে তাকায়নি। তারপরে যখন, নাচের আবেশ তাকে আচ্ছন্ন করতে আরম্ভ করে, সে যুবরাজের চোখের দিকে নিজের চোখ তুলে তাকায়, মেহেরুন্নিসা তার দৃষ্টির ঐকান্তিকতা অনুভব করতে পারে। সেই সময়ে সে কোনো কারণে বুঝতে পারে নি এবং এখন, এত বছর পরেও, ব্যাপারটা বোধগম্যতার বাইরেই রয়েছে, সে তার নেকাব ইচ্ছে করেই ফেলে দিয়েছিল। তিন বা চারবারের জন্য এর বেশি নয়–সে যুবরাজকে নিজের মুখ দেখতে দিয়েছিল এবং সে জানে তিনি এতে খুশিই হয়েছিলেন।

সম্রাট আকবর এর কিছু দিন পরেই, নিজের সন্তানকে আগ্রা ফিরে আসবার আদেশ দেন। মেহেরুন্নিসাও ততদিনে শের আফগানের সাথে তাঁর আসন্ন বিয়ের নানা ভাবনায় আপ্লুত হয়ে পড়েছে। মোগল রাজদরবারে কপর্দকশূন্য অবস্থায় আগত এক পার্সী অভিজাত ব্যক্তির মেয়ের জন্য এরচেয়ে উপযুক্ত সম্বন্ধ আর হতে পারে না। সম্রাটের অধীনে চাকরি এবং কাবুলের উপর দিয়ে অতিক্রমকারী বণিকদের সাথে বিভিন্ন ব্যবসায়ী উদ্যোগের কারণে তাঁর আব্বাজান যদিও যথেষ্ট সম্পদ অর্জন করেছিলেন, নিজের মেয়েকে তিনি বিশাল যৌতুক দিতে পারলেও–দশ সহস্র সোনার মোহর–তাঁর নিজের কোনো জমি, কোনো বিশাল মহল ছিল না। শের আফগান অন্য দিকে প্রাচীন এক মোগল অভিজাত বংশের সন্তান, তাঁর প্রপিতামহ বাবরের সাথে, প্রথম মোগল সম্রাট, তার হিন্দুস্তান অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। মেহেরুন্নিসা তাঁর আসন্ন বিয়ের প্রস্তুতির জন্য সে যুবরাজকে–বা সম্রাটকে যা এখন তিনি–জোর করে নিজের মনের এক কোণে সরিয়ে দিয়েছিল: সত্যি হতে পারতো এমন এক মধুর বাঁধনহারা কল্পনা।

গরুর গাড়িটা সহসা সশব্দে কম্পিত হয়। মেহেরুন্নিসা ভাবে, গাড়ির সামনের কোনো একটা চাকা হয়ত বড় কোনো শিলাখণ্ডের সাথে ধাক্কা খেয়েছে। এই যাত্রাটা যখন শেষ হবে সে তখন আন্তরিকভাবেই খুশি হবে।

*

মেহেরুন্নিসা তাঁর আব্বাজান তার জন্য তাবরিজ থেকে সম্প্রতি আগত এক বণিকের কাছ থেকে পার্সী কবি ফেরদৌসের সংগৃহীত কবিতার যে খণ্ডটা ক্রয় করেছেন একপাশে সরিয়ে রাখে, উঠে দাঁড়ায় এবং আড়মোড়া ভাঙে। কোনো একটা কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে, সে তার আব্বাজানের বাসার সমতল ছাদে উঠতে শুরু করে, মেহেদী দেয়া নাঙা পায়ের নিচে পাথরের নিচু ধাপের উষ্ণতা সে দারুণ উপভোগ করে। সে ছাদে উঠে প্রথমেই উত্তরের দিকে তাকায়। তুষারাবৃত পাহাড়ের প্রেক্ষাপটে সেখানে শহরের তত্ত্বাবধায়নে পাহাড়ের রুক্ষ চূড়ায় স্থাপিত ভয়ালদর্শন দূর্গপ্রাসাদ অবস্থিত।

সে গৌড়ে থাকাকালীন সময়ে প্রায়ই এই স্থাপনাটার কথা ভাবতো–এর নিরেট শক্তিশালী দেয়ালের ক্ষুদ্রাকৃতি রন্ধগুলোর কাবুলের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখা চোখের সাথে কি ভীষণ মিল। দূর্গপ্রাসাদটা যদিও শাসনকর্তার বাসভূমি, তাঁর আব্বাজান তাকে বলেছে স্থাপনাটার কোথাও বিলাসিতার নামগন্ধও খুঁজে পাওয়া যাবে না–বাবরের আগমনের বহু পূর্বে নির্মিত পাথরের শীতল একটা দূর্গ যেখান থেকে বাবর তাঁর হিন্দুস্তান অভিযান সূচনা করেছিলেন। সে যাই হোক তার ইচ্ছা এমন বিশাল একটা উচ্চাকাঙ্খ যেখানে অঙ্কুরিত হয়েছিল সেই স্থানটার ভেতরটা সে যদি একবার ঘুরে দেখতে পেতো। বিজয়ের অভিপ্রায়ে আয়োজিত যুদ্ধযাত্রায় দূর্গপ্রাসাদের ভিতর থেকে মোগল সৈন্যের স্রোত বের হয়ে আসছে যা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বদলে দেবে নিশ্চয়ই সেটা দেখার মতই একটা দৃশ্য ছিল? নিজের উচ্চাকাঙ্খকে বাস্তবে রূপান্তরিত হতে দেখে বাবরের অভিব্যক্তি কেমন হয়েছিল?

এবং সে কি কখনও সত্যিই হুসটা বুঝতে পারবে? সে যদি তার বড়ভাই আসফ খানের মত, এখন শাহী সেনাবাহিনীতে একজন সেনাপতি এবং এখান থেকে হাজার মাইল দক্ষিণে দাক্ষিণাত্যে একটা অভিযানের দায়িত্ব পালন করছেন, বা তার ছোটভাই মীর খানের মত, গোয়ালিওরের শাহী সেনানিবাস যেখানে সম্রাটের সন্তান খসরুকে অন্তরীণ রাখা হয়েছে সেখানে দায়িত্ব পালন করছে, একজন পুরুষ হিসাবে জন্ম গ্রহণ করতো, সে তাহলে হয়তো পৃথিবীর আরো অনেক কিছু দেখতে পেতো, আরো অনেক বেশি কিছু বুঝতে পারতো… তার আব্বাজানও তাহলে সম্ভবত পারস্য থেকে আগ্রা অভিমুখে বিপদসঙ্কুল যাত্রাপথে জন্মের সাথে সাথে তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাতে পথের মাঝে পরিত্যাগ করতো না, কাজটা করতে তাঁর যতই অনিচ্ছা থাকুক, এবং ভাগ্য আর একজন বন্ধুবৎসল বণিক তাকে উদ্ধারের সুযোগ দিলে তিনি তখন যতই আনন্দিত হোন। তাঁর প্রতি আব্বাজানের ভালোবাসার চেয়ে তিনি সেই মুহূর্তে নিজের নিরাপত্তাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন এই ভাবনাটা–এবং সে ভালো করেই জানে বাবা-মা দুজনেই তাকে ভীষণ ভালোবাসে–এমন একটা ব্যাপার যা সবসময়েই তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। বাংলায় তার তিক্ত অভিজ্ঞতা এর সাথে যুক্ত হতে, সে জানে, মানুষ আর তাঁদের অভিপ্রায়ের বিষয়ে তাঁর মাঝে নৈরাশ্যবাদী একটা মনোভাবের জন্ম দিয়েছে। সঙ্কটকালে খুব কম মানুষই নিজেকে ছাড়া অন্য আর কিছু ভাববার সামর্থ্য রাখে।

আর তাছাড়া, একজন রমণীর জীবন, তাঁর নিজের জীবন, এখানে তাঁর আব্বাজানের বাসায় কিংবা পরবর্তীতে গৌড়ে অবস্থান কালে শের আফগানের হেরেমে, যেখানেই হোক ভীষণ সীমাবদ্ধ। সে যখন থেকে বুঝতে শিখেছে তখন থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে তার দারুণ কৌতূহল… পশ্চিমে তাঁদের পরিবারের আদি বাসস্থান পারস্য সম্বন্ধে আর কীভাবে শাহ্ সেই সাম্রাজ্য শাসন করেন; উত্তর-পূর্বদিকে সমরকন্দের গম্বুজ আর মিনারগুলোয় আসলেই কি সে গল্পগাথায় যেমন শুনেছে নীল, সবুজ আর সোনালী রঙ ঝিলিক দেয়। তাঁর আব্বাজান–সে যখন তাকে জোর করে তার নথিপত্রের সামনে থেকে তুলে আনতে পারতো–তার প্রশ্নের যথাসাধ্য উত্তর দিতে চেষ্টা করতেন কিন্তু সে আরো অনেক বেশি কিছু জানতে চায়। পাঠাভ্যাস তার হতাশা প্রশমিত করতে সাহায্য করেছে। গৌড়ে স্বপ্নভঙ্গের প্রথম ধাক্কা সামলে নেয়ার পরে শের আফগানের সাথে জীবন অনেক সহনীয় করে তুলেছিল তাঁর সংগৃহীত পাণ্ডুলিপিগুলো। কিন্তু পাণ্ডুলিপিগুলো সেই সাথে তাঁর অস্থিরতা, তাঁর অসন্তোষও বাড়িয়ে দিয়েছিল। তার পঠিত সবকিছু–পর্যটকের রোজনামচা, এমনকি কবিতা–তার আগে থেকেই প্রাঞ্জল কল্পনাকে আরো উদ্দীপিত করে, ইঙ্গিত দেয় জীবন গৌড়ে সেনাপতির হারেমে ভালোবাসাহীন সহবাস কিংবা তার পৈতৃক বাড়িতে ঘরোয়া আনন্দফুর্তির চেয়েও অনেক বেশি সম্ভাবনায় উদ্বেল।

সে সহসা নিচের আঙিনায় একটা হৈচৈ এর শব্দ শুনতে পায়। মেহেরুন্নিসা ছাদের উপর দিয়ে লাল আর কমলা রঙের পর্দার দিকে দ্রুত হেঁটে গিয়ে যা পথচারীদের দৃষ্টি থেকে আঙিনা সংলগ্ন ছাদের অংশটা ঘিরে রেখেছে, উঁকি দিয়ে নিচে তাকায়। একজন সেনাপতি আর নিশানা-বাহকের নেতৃত্বে রাজকীয় অশ্বারোহীদের একটা বহর নিচের আঙিনায় প্রবেশ করছে। অশ্বারূঢ় সৈন্যরা ঘোড়া থেকে নামতেই তাঁর আব্বাজানের সহিসেরা বাড়ির ভেতর থেকে দ্রুত বের হয়ে এসে লাগামগুলো ধরে এবং কিছুক্ষণ পরেই স্বয়ং গিয়াস বেগের কৃশকায় দীর্ঘদেহী অবয়ব সেখানে উপস্থিত হয়। চকিতে মাথা নত করে এবং ডানহাতে নিজের বুক স্পর্শ করে সে সেনাপতিকে বাড়ির ভেতর নিয়ে যায়। লোকগুলো কেন এসেছে? সে মনে মনে ভাবে।

আগত অন্য সৈন্যরা আঙিনার চারপাশে হাঁটাহাঁটি শুরু করে, গল্পগুজব আর হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠে আর বৃদ্ধ ফল বিক্রেতার কাছ থেকে কেনা আখরোট–তাঁর মুখের বলিরেখার মতই তাঁর বিক্রীত বাদামগুলো কোঁচকানো–ভেঙে খুঁটে খুঁটে খেতে থাকে, যে সচরাচর সেখানেই নিজের পসরা সাজিয়ে বসে। কিন্তু সে যতই কান খাড়া করে শুনতে চেষ্টা করুক তাদের কোনো কথাই বুঝতে পারে না। সময় অতিবাহিত হতে থাকায় এবং রাজকীয় সেনাপতি তাঁর আব্বাজানের সাথেই অবস্থান করায়, মেহেরুন্নিসা পুনরায় মেয়েদের আঙিনায় নেমে আসে এবং তাঁর তেপায়ার উপরে বসে পড়ার জন্য আরো একবার পাণ্ডুলিপিটা হাতে তুলে নেয়। আঙিনায় ছায়া ক্রমশ দীর্ঘ হতে শুরু করতে এবং দু’জন পরিচারিকা তেলের প্রদীপের সলতেয় আগুন জ্বালাতে শুরু করছে তখন মেহেরুন্নিসা তাঁর আব্বাজানের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। মুখ তুলে তাকাতে, সে দেখে তাকে ক্রুদ্ধ দেখাচ্ছে।

‘আব্বাজান, কি ব্যাপার?

তিনি পরিচারিকাদের চলে যাবার ইঙ্গিত করেন তারপরে লম্বা আঙুলগুলো দিয়ে নীলা বসান সোনার আঙুরীয়টি অস্থির ভঙ্গিতে ঘোরাবার মাঝে, তাঁর পাশে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে পড়েন, সে তার জন্মের পর থেকেই তাকে বাম হাতের তৃতীয় আঙুলে অঙ্গুরীয়টি পরিধান করতে দেখে আসছে। সে পূর্বে কখনও তাঁর আব্বাজানকে–সাধারণত শান্ত আর সংযত–এমন অবস্থায় দেখেনি। তিনি কথা শুরু করার আগে কিছুক্ষণ ইতস্তত করেন, তারপরে এমন একটা স্বরে কথা বলতে শুরু করেন যা মোটেই তাঁর স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর নয়। আমি তোমায় গৌড়ে যে চিঠিটা পাঠিয়েছিলাম তোমার কি সেটার কথা স্মরণ আছে? তোমায় বাসায় পৌঁছে দিতে নিরাপত্তা সহচর হিসাবে রাজকীয় সৈন্য প্রেরণ করায় সম্রাটের উদারতায় আমি যে বিস্মিত হয়েছিলাম…?

‘হ্যাঁ।

‘আমি তোমায় তখন পুরো বিষয়টা খুলে বলিনি…সম্রাটের সম্ভাব্য অভিপ্রায় কি হতে পারে সে সম্বন্ধে আমার একটা ধারণা ছিল।

‘আপনি কি বলতে চাইছেন?

‘এই কাবুল শহরে কয়েকবছর আগে একটা ঘটনা ঘটেছিল–যার সাথে তোমার একটা সম্পর্ক রয়েছে। আমি বিষয়টা তোমাকে কখনও বলিনি কারণ আমার মনে হয়েছিল বিষয়টা না জানাই তোমার জন্য উত্তম। ঘটনাপ্রবাহ যদি ভিন্ন হতো তাহলে আমি একাই বিষয়টা সম্বন্ধে অবহিত থাকার ব্যাপারটা আমার মৃত্যুর সাথে সাথে করে নিয়ে যেতাম… আমাদের বর্তমান সম্রাট তখনও কেবল একজন যুবরাজ, আমাদের এই কাবুলে নির্বাসিত, সে সময়ে আমি আর তিনি নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম। আমি যদিও ছিলাম তাঁর আব্বাজানের একজন মামুলি কোষাধ্যক্ষ, আমার মনে হয়েছিল একজন শিক্ষিত ব্যক্তি হিসাবে তিনি আমার সঙ্গ উপভোগ করেন–আমাকে একজন বন্ধু হিসাবেও হয়ত বিবেচনা করেন। সেজন্যই একরাতে আমি তোমায়, আমার একমাত্র মেয়ে হিসাবে, তাঁর মনোরঞ্জনের জন্য নাচতে বলেছিলাম। আমার একমাত্র অভিপ্রায় ছিল আমার সাধ্যের শেষপ্রান্তে গিয়ে তাকে শুভেচ্ছাজ্ঞাপন করা। কিন্তু অচিরেই–খুব সম্ভবত পরের দিনই, আমি ঠিক নিশ্চিত নই–তিনি আমার সাথে দেখা করতে আসেন… তিনি কি দাবি করেছিলেন তুমি কি ধারণা করতে পারো? গিয়াস বেগের দৃষ্টিতে ক্ষুরধার তীক্ষ্ণতা।

না।

তিনি তাঁর স্ত্রী হিসাবে তোমায় পেতে চেয়েছিলেন।’

মেহেরুন্নিসা এত দ্রুত উঠে দাঁড়ায় যে তার তেপায়া একপাশে উল্টে যায়। তিনি আমায় বিয়ে করতে চেয়েছিলেন…?

‘হ্যাঁ। কিন্তু আমি তাকে বলেছিলাম তোমার সাথে ইতিমধ্যে শের আফগানের বাগদান সম্পন্ন হয়েছে–যে আমার পক্ষে কোনোমতেই এই অঙ্গীকারের অবমাননা করা অসম্ভব…’

মেহেরুন্নিসা দু’হাত আঁকড়ে ধরে, বাড়ির ভিতরের আঙিনায় অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করতে থাকে। তার আব্বাজান জাহাঙ্গীরকে মুখের উপর না বলেছিলেন… বাংলার পূতিগন্ধময় উষ্ণ আবহাওয়ায় অনুভূতিহীন, নিষ্ঠুর শের আফগানের স্ত্রী হবার বদলে সে মোগল রাজদরবারের, সবকিছু যা গুরুত্বপূর্ণ তাঁর কেন্দ্রের কাছাকাছি, এক যুবরাজের স্ত্রী হতে পারতো। কেন? তিনি এটা কীভাবে করতে পারলেন? তাকে এমন নির্মমভাবে সবকিছু থেকে বঞ্চিত করার পেছনে তার কি অভিপ্রায় কাজ করেছিল? সমস্ত পরিবারের সাথে সাথে তিনি নিজেও এই সম্বন্ধের ফলে উপকৃত হতেন… ‘আমার উপরে তুমি রাগ করেছে এবং সম্ভবত তোমার রাগ করাটা সঙ্গত। আমি জানি শের আফগানের সাথে তোমার বিয়েতে তুমি সুখী হওনি, কিন্তু আমার পক্ষে সেটা আগে থেকে বোঝা সম্ভব ছিল না। আমার মনে হয়েছিল আমি যা করেছি সেটা করা ব্যতীত আমার সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। আর তাছাড়া, যুবরাজ নিজেও তখন তাঁর আব্বাজানের নির্দেশে নির্বাসিত। তোমায় বিয়ে করার জন্য তাকে তার আব্বাজানের অনুমতি নিতে হতো এবং তাঁর পক্ষে তখন অনুমতি লাভ করাটা অসম্ভব ছিল। সেই সময়ে ম্রাট হিসাবে অভিষিক্ত হবার বদলে তাঁর মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবারই সমূহ সম্ভাবনা ছিল। সম্রাটের কাছে তার সাথে আত্মীয়তা করার বিষয়টা আমাদের পরিবারের জন্য সুখকর নাও হতে পারতো। গিয়াস বেগ দম নেয়ার জন্য থামেন।

মেহেরুন্নিসার কাছে তাঁর আব্বাজানের মুষলধারে এখনকার এই সাফাই দেয়ার ভিতরে একটা স্ববিরোধিতা চোখে পড়ে। যুবরাজ জাহাঙ্গীরের প্রস্তাব আব্বাজান ফিরিয়ে দিয়েছিলেন নিজের সম্মান বাঁচাতে নাকি নিজের স্বার্থে? কিন্তু সে বেশিক্ষণ ভাববার সময় পায় না তিনি আবার কথা শুরু করেন।

‘আমার অন্য আরো কিছু বলার আছে সেটা আগে শুনে নাও তারপরে তুমি হয়তো আমার প্রতি এত বিরূপ মনোভাব পোষণ করবে না। সম্রাট আমাকে তাঁর রাজকীয় খাজাঞ্চিখানার নিয়ন্ত্রক হিসাবে নিয়োগ দিয়ে, আগ্রা যাবার আদেশ দিয়েছেন। তাঁর আব্বাজানের চোখ সহসা অশ্রুসজল হয়ে উঠে–মেহেরুন্নিসা আগে কখনও তার আব্বাজানের চোখে অশ্রু দেখেনি। ‘গত বিশটা বছর এবং আরো বেশি সময়–আমরা সপরিবারে প্রথম এখানে আসবার পর থেকেই–আমি সবসময়ে সেই মুহূর্তটার কথা ভাবতাম যখন আমাকে আমার গুণাবলীর জন্য স্বীকৃতি দেয়া হবে এবং আমি গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে মনোনীত হবে। আমি সেই আশা ত্যাগ করেছিলাম এবং পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে শিখেছিলাম… কিন্তু আরো বিষয় আছে। সম্রাট লিখেছেন যে তুমি রাজকীয় হেরেমে সম্রাট আকবরের একজন বিধবা পত্নীর সঙ্গিনী হবে। বাছা আমার, আমার মনে হয় না তোমায় তিনি ভুলতে পেরেছেন। এখন তুমি যখন বিধবা আর তিনি একজন সম্রাট, তিনি এখন সেই পদক্ষেপ নিতে পারেন যেটা তিনি যখন কেবল যুবরাজ আর তুমি অন্য আরেকজন লোকের প্রতি অঙ্গীকারবন্ধ থাকায় তখন করতে পারেন নি।

*

ছয়দিন পরের কথা, মেহেরুন্নিসা তাঁর পালকিতে শুয়ে রয়েছে যখন ভারতবর্ষের সমভূমিতে অবতরণের প্রথম পর্যায়ে সংকীর্ণ পাথুরে খুদ গিরিপথের ভিতর দিয়ে তাকে আর তার ঘুমন্ত মেয়ে লাডলী বেগমকে বহনকারী পালকিটা দ্রুত এগিয়ে চলেছে গিলজাই উপজাতির আটজন শক্তসমর্থ লোকের চওড়া নির্ভরযোগ্য কাঁধে পালকির বাঁশের দণ্ড অবস্থান করছে। তাকে ঘিরে রাখা বুটিদার গোলাপি পর্দা বাতাসে আলোড়িত হতে সে এক ঝলকের জন্য বাইরের খাড়াভাবে নেমে যাওয়া, নুড়িপাথরপূর্ণ ঢালে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত চিরহরিৎ ওকের ঝোঁপঝাড় দেখতে পায়। পালকিবাহকেরা প্রায় দৌড়াবার ভঙ্গিতে চলার সময় গান গাইতে গাইতে, তাঁরা পালকির দুলুনিতে একটা নিয়মিত ছন্দ বজায় রেখেছে। সে আশার করে জাহাঙ্গীরের অভিপ্রায়ের বিষয়ে তাঁর আব্বাজানের ধারণাই যেন সত্যি হয়। তার ধারণা সত্যি হোক সেটা সে নিজেও চায় কিন্তু তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে সে শিখেছে যে পুরুষমানুষ পরিবর্তনশীল। শের আফগানও তাঁদের বিয়ের প্রথম কয়েকমাস যতক্ষণ তাঁর প্রতি তার আগ্রহ ছিল একজন মনোযোগী স্বামী, স্নেহপরায়ন প্রেমিক ছিলেন… সে হয়তো জাহাঙ্গীরকেও আর মোহিত করতে পারবে না। পুরুষমানুষেরা অল্পবয়সী নারীদেহ পছন্দ করে। সে তখন ছিল ষোল বছরের এক কিশোরী; এখন চব্বিশ বছরের একজন রমণী।

তার ভাবনার জাল ছিন্ন করে তাকে বহনকারী বহরের পেছন থেকে বিপদসঙ্কেতজ্ঞাপক সনির্বন্ধ চিৎকার আর গাদা বন্দুকের গুলির শব্দ ভেসে আসে। তার বেহারারা গান গাওয়া বন্ধ করে তাঁদের অগ্রসর হবার গতি বৃদ্ধি করতে পালকিটা ভীষণভাবে দুলতে আরম্ভ করে। একহাতে লাডলিকে অভয়দানের ভঙ্গিতে জড়িয়ে ধরে সে পর্দার একটা ধার উঁচু করে বাইরে উঁকি দেয় কিন্তু ধুসর নুড়ি আর পাথর ছাড়া সে কিছুই দেখতে পায় না। পুরোটা সময় গাদা বন্দুকের শব্দ আর চিৎকার আরো প্রবল হয় এবং কাছে এগিয়ে আসতে থাকে। তারপরে বহরের পেছন থেকে একজন অশ্বারোহী তীব্রবেগে ঘোড়া হাঁকিয়ে পালকির পাশ দিয়ে অতিক্রম করে, এতই কাছ দিয়ে যে সে লোকটার ঘোড়ার ঘামের গন্ধ পায় এবং প্রাণীটার খুরের আঘাতে ছিটকে উঠা ধুলো তাঁর চোখে এসে পড়ে এবং সে কাশতে শুরু করে। লোকটা চিৎকার করছে, মালবাহী বহরে ডাকাতেরা হামলা করেছে। তিনজন মানুষ আর দুটো মালবাহী উট ভূপাতিত হয়েছে। সেখানে দ্রুত আরো সৈন্য প্রেরণ করো!’

মেহেরুন্নিসা তার চোখ থেকে ধুলো ঘষে ফেলে পিছনের দিকে তাকায় কিন্তু তার দৃষ্টি থেকে মালবাহী বহরটা ফেলে আসা পথের একটা তীক্ষ্ণ বাকের আড়ালে অদৃশ্য হয়েছে। এই গিরিপথগুলো বর্বর আফ্রিদি উপজাতির কারণে কুখ্যাত যারা পর্যটকদের ছোট ছোট বহর লুণ্ঠন করে থাকে কিন্তু রাজকীয় সৈন্যবাহিনীর প্রহরায় সুরক্ষিত একটা বহরে হামলা করাটা নিঃসন্দেহে হঠকারী। তারা জানে না তারা কাদের উপরে হামলা করতে এসেছে… বা হয়তো তারা জানে। কাবুলের ধনী কোষাধ্যক্ষের ভ্রমণের সংবাদ সম্ভবত তাঁদের হামলায় প্ররোচিত করেছে। ছায়াগুলো দীর্ঘতর হতে শুরু করেছে। সূর্য আর এক কি দুই ঘন্টার ভিতরে চারপাশের পাহাড়ের চূড়ার নিচে হারিয়ে যাবে। তাদের বহরের পেছনে অবস্থিত মালবাহী শকটগুলোকে হয়ত আক্রমণ করা হয়েছে তাদের তাড়াহুড়ো করে সংকীর্ণ খুদ গিরিপথের আরো গভীরে নিয়ে যাবার অভিপ্রায়ে যেখানে অন্ধকারের ভিতরে হামলাকারীদের আরেকটা বিশাল দল ওত পেতে রয়েছে? লাডলী আর তাঁর নিজের এবং বহরের সাথে তাঁর সামনে ভ্রমণরত তাঁর পিতামাতার–বিপদের ভাবনা তাকে কিছুক্ষণের জন্য নিথর করে দেয় এবং তারপরে সে দ্রুত চিন্তা করতে শুরু করে। সে কীভাবে নিজেকে আর নিজের কন্যাকে রক্ষা করবে? তার সাথে কোনো অস্ত্র নেই। লাডলী ঘুম থেকে জেগে উঠলে সে মেয়েকে নিজের কাছে টেনে নেয়। লাডলী বিপদের সম্ভাবনায় কাঁটা হয়ে থাকা মায়ের উৎকণ্ঠা টের পাওয়া মাত্র ফোঁপাতে আরম্ভ করে। শান্ত হও, মেহেরুন্নিসা তার কণ্ঠে একটা উৎফুল্লভাব ফুটিয়ে বলে। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আর তাছাড়া, কান্নায় কখনও কারো উপকার হয় নি।

ঠিক সেই মুহূর্তে চিৎকার করে কেউ একজন থামবার নির্দেশ দেয়। তার বেহারারা এত দ্রুত দাঁড়িয়ে পড়ে যে মেহেরুন্নিসা হুমড়ি খেয়ে সামনের দিকে উল্টে পড়ে। তাঁর হাত থেকে লাডলী ছিটকে যায় এবং পালকির কাঠামো গঠনকারী বাঁশের বাঁকানো চক্ৰবলয়ের একটার সাথে তার কপাল গিয়ে এত জোরে ধাক্কা খায় যে কিছুক্ষণের জন্য সে চোখে ঝাপসা দেখে। নিজেকে সুস্থির করে সে লাডলীকে জোর করে পালকির মেঝেতে শুইয়ে দেয়। এখানে চুপ করে শুয়ে থাকো!’ সে এরপরে পর্দার ভেতর থেকে সারসের মত মাথা বের করে বাইরে তাকিয়ে দেখে যে তাঁর সামনে পুরো বহরটা থমকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তবকিরা ঘোড়া থেকে মাটিতে নামতে শুরু করেছে এবং বন্দুক পিঠের উপরে আড়াআড়িভাবে ঝুলিয়ে নিয়ে, নুড়িতে আবৃত ঢাল বেয়ে হুড়মুড় করে উপরে উঠার চেষ্টা করে, তাদের পায়ের আঘাতে পাথরের টুকরো আর বালু আলগা হতে থাকে, উপরের দিকে বিক্ষিপ্ত পড়ে থাকা কয়েকটা পাথর তাদের গন্তব্য যেখানে তারা খানিকটা হলেও আড়াল পাবে। রাজকীয় অশ্বারোহী বাহিনীর একটা দল এমন সময় তার পাশ দিয়ে দ্রুতবেগে তাঁদের বহরের পেছনের দিকে ছুটে যায় যেখানে লড়াইয়ের শব্দ প্রতি মুহূর্তে তীব্রতর হচ্ছে। পথটা এখানে এতই সংকীর্ণ যে তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তারা এক সারিতে বিন্যস্ত হতে বাধ্য হয়। বিশাল একটা কালো ঘোড়ায় উপবিষ্ট হাতে ইতিমধ্যেই উদ্যত তরবারি আর উদ্বিগ্ন মুখাবয়বের এক তরুণ অশ্বারোহী দলটার একদম শেষে রয়েছে।

মেহেরুন্নিসা ভাবে, লাডলীকে সাথে নিয়ে পর্দার তোয়াক্কা না করে তাঁর কি। নিজের পিতামাতার গাড়ির দিকে দৌড়ে যাওয়া ঠিক হবে, কিন্তু পরমুহূর্তে সে ধারণাটা নাকচ করে দেয়। তাদের মাথার উপরে পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কোনো নিশানাবাজের কাছে তারা এর ফলে নিজেদের কেবল অরক্ষিত প্রতিপন্ন করবে। লড়াইয়ের গতিপ্রকৃতি পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত নড়াচড়া করার কোনো মানেই হয় না। সে এর বদলে পালকির চারপাশের পর্দা পুনরায় ভালো করে টেনে দেয়। সময় গড়িয়ে ধীরে ধীরে আধো অন্ধকারের আবর্তে এগিয়ে যায়। পুরোটা সময় গাদা বন্দুকের শব্দ–কখনও মনে হয় কাছে এগিয়ে আসছে, কখনও মনে হয় দূরে সরে যাচ্ছে–এবং সৈন্যদের অগ্রসর আর পিছিয়ে আসবার তীক্ষ্ণ আদেশের ব্যাপারে কান খাড়া করে রাখার, সাথে যুক্ত হয় তার কপালের যন্ত্রণা যেখানে ইতিমধ্যে বিশাল মাপের একটা আলুর সৃষ্টি হয়েছে, সে নিজেকে বাধ্য করে লাডলিকে পারস্যের লোকগীতি জোর গেয়ে শোনাতে।

তাঁদের বহরের পেছন থেকে চিৎকার আর গুলিবর্ষণের শব্দ অবশেষে থিতিয়ে আসতে আরম্ভ করে, কিন্তু এর মানে কি? সে তারপরে শুনতে পায় নিজের পালকির কাছে ঘোড়ার খুরের শব্দ, বিজয়ীর হাঁকডাক এবং সেখানে অবস্থানরত বেহারা আর সৈন্যদের উল্লাসের জবাব দিতে দিতে এগিয়ে আসছে। হামলাকারী নিশ্চয়ই মেরে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে… সে আরো একবার পর্দার আড়াল থেকে বাইরে তাকিয়ে দেখে রাজকীয় অশ্বারোহীরা বিজয়ীর বেশে ফিরে আসছে। সে তাকিয়ে দেখে বেশ কয়েকজনের ঘোড়ার, যাঁদের ভিতরে সেই তরুণ আধিকারিকও রয়েছে, পর্যাণের উঁচু হয়ে থাকা বাঁকানো অংশে তাঁদের হাতে যারা নিহত হয়েছে তাদের ছিন্ন মস্তকগুলো চুল বাঁধা অবস্থায় ঝুলে রয়েছে, তাদের গলার কর্তিত অসমান অংশ থেকে টপটপ করে রক্ত পড়ছে। কিন্তু দলটার শেষ অশ্বারোহী যে তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করে। লোকটা একটা ছোট আঁটসাট চামড়ার জ্যাকেটে অদ্ভুতভাবে সজ্জিত এবং তাঁর মাথায় চুড়াকৃতি মোগল শিরোস্ত্রাণের সাথে গলা রক্ষা করতে সংযুক্ত ধাতব শৃঙ্খলের বর্মের বদলে রয়েছে গোলাকৃতি একটা শিরোস্ত্রাণ। সে এগিয়ে তার পাশাপাশি আসতে, লোকটা মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। একজোড়া ধুসর, মার্জার সদৃশ্য নীল চোখ তার দিকে সরাসরি তাকিয়ে রয়েছে।

 ১.০৪ রাজকীয় হেরেম

মালকিন, যাবার সময় হয়েছে। অধমের নাম মালা। আমি মহামান্য সম্রাটের খাজাসারা, তাঁর রাজকীয় হেরেমের তত্ত্বাবধায়ক এবং আপনাকে পথ দেখিয়ে ফাতেমা বেগমের আবাসন কক্ষে পৌঁছে দেয়ার জন্য এসেছি আপনি তাঁর খিদমত করবেন। মালা যৌবন প্রায় অতিক্রান্ত দীর্ঘদেহী, মর্যাদাপূর্ণ চেহারার অধিকারিনী এক রমণী। তার হাতের হাতির দাঁতের তৈরি রাজকীয় দফতরের কর্তৃত্বসূচক দণ্ডের শীর্ষদেশে খোদাই করা পদ্মফুলের আকৃতি তার চেহারায় বাড়তি আভিজাত্য যোগ করেছে। মেহেরুন্নিসা তাঁর স্মিত হাসির পেছনে দুর্দান্ত এক ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি আঁচ করতে পারে।

সে এবার তাঁর পিতামাতার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে, আগ্রা দূর্গের নিরাপত্তা প্রাচীরের অভ্যন্তরে গিয়াস বেগের বসবাসের জন্য বরাদ্দকৃত প্রশস্ত আবাসন কক্ষসমূহের আঙিনায় তারা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাঁর আম্মিজান লাডলির হাত ধরে রেখেছে। মেহেরুন্নিসা হাঁটু ভেঙে বসে নিজের মেয়ের গালে চুমু দেয়। সে এই মুহূর্তটার জন্য বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে প্রতীক্ষা করেছিল, কিন্তু এখন যখন সময়টা এসেছে, আগ্রা পৌঁছাবার তিন সপ্তাহ পরে, তার মাঝে কেমন একটা উদ্বেগ এমনকি এক ধরনের অনীহা কাজ করতে থাকে। নিজের সন্তানের কাছ থেকে আলাদা হওয়া যে ছিল তার একমাত্র সান্ত্বনা ভীষণ দুঃসহ একটা অভিজ্ঞতা, লাডলী যদিও তাঁর দাদা-দাদী আর আয়া ফারিশার কাছে যত্নেই থাকবে এবং হেরেমে তাঁর সাথে দেখা করার অনুমতি পাবে।

খাজাসারা তাকিয়ে রয়েছে বুঝতে পেরে, মেহেরুন্নিসা নিজেকে বাধ্য করে নিজের আবেগ গোপন করতে, শের আফগানের সাথে তাঁর অতিবাহিত জীবন যা ভালোভাবে করতে তাকে পারদর্শী করে তুলেছে, এবং মুখাবয়ব আবেগহীন রাখতে। লাডলীকে শেষবারের মত একবার আলিঙ্গন করে সে উঠে দাঁড়ায়, তাঁর পিতামাতার দিকে ঘুরে এবং তাঁদেরও আলিঙ্গন করে সে তাঁদের সান্নিধ্য থেকে পিছনে সরে আসবার সময়, গিয়াস বেগের মুখ গর্বে জ্বলজ্বল করতে থাকে। তোমার প্রতি আমাদের শুভকামনা রইলো। তোমার গৃহকত্রীকে ভালোভাবে খিদমত করবে,’ তিনি বলেন।

মেহেরুন্নিসা খাজাসারাকে অনুসরণ করে প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে আসে এবং বেলেপাথরের একপ্রস্থ সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে যা আগ্রা দূর্গের প্রাণকেন্দ্রের অভিমুখে খাড়াভাবে উঠে যাওয়া একটা ঢালের পাদদেশে এসে শেষ হয়েছে। কয়েক গজ দূরেই সবুজ রঙের পোষাক পরিহিত ছয়জন মহিলা পরিচারিকা রেশমের কাপড় দিয়ে সজ্জিত একটা পালকির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাঁরা সবাই দেখতে লম্বা আর চওড়া। সে ইতিমধ্যে পেষল দেহের অধিকারিনী তুর্কি মেয়েদের কথা শুনেছে যারা হেরেম পাহারা দেয়, কিন্তু সে আরেকটু কাছাকাছি যেতে পরিচারিকার দলটা মেয়ে নয়, বরং বিশাল হাত পা বিশিষ্ট এবং না পুরুষ না মেয়েলী, আশ্চর্য ধরনের কোমল মুখের অধিকারী, খোঁজা দেখে সে চমকে উঠে সশব্দে শ্বাস টানে। তাদের সবারই পরনে দামী অলঙ্কার শোভা পায় এবং বেশ কয়েকজনের চোখে কাজল দেয়া রয়েছে। সে খোঁজা আগেও দেখেছে, গৃহপরিচারক হিসাবে নিয়োজিত বা বাজারে লোকদের মনোরঞ্জনের জন্য নাচ গান করে, কিন্তু মেয়েদের মত পোষাক পরিহিত এমনটা আগে কখনও দেখেনি।

মালিকা, এই পালকিটা আপনার জন্য পাঠান হয়েছে, খাজাসারা বলে। মেহেরুন্নিসা পালকিতে উঠে ভেতরের নিচু আসনে আড়াআড়িভাবে পা রেখে বসে। তার চারপাশে রেশমের পর্দাগুলোকে কয়েক জোড়া হাত জায়গা মত গুঁজে দেয় এবং খোঁজার দল পালকিটা নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে সেটা শূন্যে ভেসে উঠে। তাকে নতুন একটা জীবনে বয়ে নিতে পালকিটা খাড়া ঢাল দিয়ে মৃদু দুলুনির সাথে উপরে উঠতে শুরু করতে, সে দেখে সে নিজের হাত মুঠো করে রেখেছে এবং তাঁর হৃৎপিণ্ড এত দ্রুত স্পন্দিত হয় যে তার কানে মনে হয় যেন তার দেহের রক্ত এসে আছড়ে পড়ছে। এত অল্প সময়ের ভিতরে কত কিছু ঘটে গিয়েছে… কাবুলে সে যখন তার সামনে নৃত্য প্রদর্শন করছিল তখন তিনি তাঁর দিকে যেভাবে তাকিয়ে ছিলেন, ছায়াময় আধো-আলোতে সে চেষ্টা করে জাহাঙ্গীরের সেই কৃশ কিন্তু সুদর্শন মুখমণ্ডল পুনরায় স্মরণ করতে… তাঁর আব্বাজান যেমন দাবি করেছেন এবং সে নিজেও যা প্রত্যাশা করে তিনি কি আসলেই সেভাবে তার ভবিষ্যত? সে শীঘ্রই সেটা জানতে পারবে।

*

‘সম্রাট, আপনি আমাকে কি কথা বলতে চান? আমি আপনার আদেশ লাভ করা মাত্র ফতেপুর শিক্রি থেকে যত দ্রুত সম্ভব এসেছি। সুফি বাবার কণ্ঠস্বর কোমল কিন্তু চোখে ক্ষুরধার দৃষ্টি। এখন যখন বহু প্রতীক্ষিত মুহূর্তটা এসে উপস্থিত হয়েছে, জাহাঙ্গীর কথা বলতে অনীহা বোধ করে। সুফি সাধক, যাকে ধার্মিক ব্যক্তি হিসাবে তার যশের কারণে শ্রদ্ধার বশবর্তী হয়ে সে তার নিজের নিভৃত কক্ষে নিজের আসনের পাশেই আরেকটা তেপায়ায় তাকে বসতে অনুরোধ করেছে, মনে হয় তাঁর নাজুক পরিস্থিতি আঁচ করতে পারেন এবং কথা চালিয়ে যান, আমি জানি যে আপনি যখন একেবারেই ছোট একটা বালক তখন আপনি আমার আব্বাজানের কাছে নিজের মনের কথা খুলে বলেছিলেন। আমার মনে হয় না যে আমার আব্বাজানের মত আমার ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা আছে বা আমি তারমত অন্তদৃষ্টির অধিকারী, কিন্তু আপনি যদি আমার উপরে আস্থা রাখতে পারেন আমি আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করতে পারি।’

ফতেপুর শিক্রির সেই উষ্ণ রাতে জাহাঙ্গীরের ভাবনা ফিরে যায় যখন সে তাঁর প্রশ্নের উত্তর পাবার আশায় প্রাসাদ থেকে দৌড়ে শেখ সেলিম চিশতির বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। আপনার আব্বাজান ছিলেন একজন মহান ব্যক্তি। তিনি আমাকে হতাশ হতে বারণ করেছিলেন, বলেছিলেন যে আমিই সম্রাট হবো। আমি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত তাঁর কথাগুলো আমাকে অনেক কঠিন সময় অতিক্রান্ত করতে সাহায্য করেছে।’

‘আমার কথাও হয়তো আপনাকে খানিকটা স্বস্তি দিতে পারবে।’

জাহাঙ্গীর সুফি সাধকের দিকে তাকায়–তার রুগ্ন-দর্শন আব্বাজানের চেয়ে অনেক বিশালাকৃতি দেহের অধিকারী একজন লোক। সে প্রায় জাহাঙ্গীরের সমান লম্বা এবং একজন সৈন্যের মতই স্বাস্থ্যবান, কিন্তু জাহাঙ্গীর ভাবে শারীরিক শক্তি কোনোভাবেই তাকে নৈতিক দূর্বলতার প্রতি আরো বেশি ক্ষমাশীল করে তুলতে পারে নি… সে লম্বা একটা শ্বাস নেয় এবং যত্নের সাথে শব্দ চয়ন করে কথা বলতে শুরু করে। আমার আব্বাজান আমাকে যখন কাবুলে নির্বাসিত করেছিলেন আমি সেখানে একটা মেয়েকে দেখেছিলাম, আমার আব্বাজানের এক আধিকারিকের কন্যা। আমি সহজপ্রবৃত্তিতে বুঝতে পারি যে সেই আমার মানসকন্যা আমি যাকে খুঁজছি। আমি যদিও ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজনকে তখন বিয়ে করেছিলাম কিন্তু আমি সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চিত যে সেই হতো আমার আত্মার সহচরী–আমার অবশ্যই তাকে বিয়ে করা উচিত। কিন্তু সেখানে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল। আমার আব্বাজানের একজন সেনাপতির সাথে এর আগেই তার বাগদান সম্পন্ন হয়েছিল এবং আমি যদিও আব্বাজানের কাছে অনুনয় করেছিলাম তিনি আমার খাতিরে তাঁদের বাগদান ভাঙতে অস্বীকার করেছিলেন।

‘সম্রাট, আমরা জানি যে সম্রাট আকবর ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক।

‘হ্যাঁ, কিন্তু সবসময়ে এটা বলা যাবে না বিশেষ করে যখন ঘটনার সাথে তার আপন পরিবারের সদস্যদের বিষয় জড়িত। তিনি একেবারেই বুঝতে চেষ্টা করেন নি যে আমার দাদাজান হুমায়ুন তাঁর স্ত্রী হামিদাকে প্রথমবার দেখার পর যেমন অনুভব করেছিলেন আমারও ঠিক একই অনুভূতি হয়েছিল। তিনি হামিদাকে আপন করে নিতে, নিজের ভাই হিন্দালের সাথে পর্যন্ত, তিনিও হামিদাকে ভালোবাসতেন, সম্পর্কছেদ করেছিলেন। হামিদার জন্য নিজের ভালোবাসার কারণে তিনি তাঁর সাম্রাজ্যকে পর্যন্ত বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন। অনেকেই হয়ত তাকে বোকা বলবে…’ জাহাঙ্গীর তাঁর পাশে হাঁটুর উপর হাত রেখে, সাদা পাগড়ি পরিহিত মাথা সামান্য নত করে বসে থাকা সুফি সাধকের দিকে আড়চোখে তাকায়, কিন্তু তিনি ঠিকই করেছিলেন। তাঁদের বিয়ে হয়ে যাবার পরে তিনি আর হামিদা খুব কম সময়ই পরস্পরের থেকে আলাদা হয়েছেন। তিনি শেষ পর্যন্ত মোগল সিংহাসন ফিরে পাবার আগে পর্যন্ত বিপদসঙ্কুল বছরগুলো তিনি নিরবিচ্ছিন্নভাবে হুমায়ুনের সাথে ছিলেন। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুর পরে হামিদা সিংহাসনে আমার আব্বাজান আকবরের উত্তরাধিকার নিশ্চিত করার মত সাহসিকতা প্রদর্শন করেছিলেন।

‘আপনার দাদীজান ছিলেন একজন সাহসী মহিলা এবং গুনবতী সম্রাজ্ঞী। আপনার মনে হয়েছে যাকে আপনি বিয়ে করতে আগ্রহী হয়েছিলেন তিনি আপনার এমনই যোগ্য সহচর হতেন?

‘আমি এটা জানি। আমার আব্বাজান আমাকে বাধ্য করেছিলেন তাকে উৎসর্জন করতে কিন্তু আমি সম্রাট হিসাবে অভিষিক্ত হবার পরে আমি জানি সময় হয়েছে যখন আমি তার সাথে একত্রে থাকতে পারবো।

‘কিন্তু আপনি বলেছেন অন্য আরেকজনের সাথে তার বাগদান হয়েছিল।

সেই লোককে কি তিনি বিয়ে করেন নি?

‘হ্যাঁ।

‘কি এমন তাহলে পরিবর্তিত হয়েছে? তার স্বামী কি মৃত্যুবরণ করেছে?

‘হ্যাঁ, তিনি মারা গিয়েছেন। জাহাঙ্গীর কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থাকে তারপরে উঠে দাঁড়ায় এবং সুফি সাধকের মুখোমুখি ঘুরে দাঁড়াবার আগে কিছুক্ষণ অস্থিরভাবে পায়চারি করে। সে খোদাভীরু লোকটার মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে যে সে যা বলতে চলেছে তিনি ইতিমধ্যেই সেটা জানেন। তার নাম শের আফগান। সে ছিল বাংলার গৌড়ে আমার সেনাপতি। আমার নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়েছে এবং তাঁর বিধবা পত্নীকে এখানে বাদশাহী হেরেমে নিয়ে আসবার আদেশ দিয়েছি।’

‘সম্রাট, একজন লোককে হত্যা করা যাতে করে আপনি তার স্ত্রীকে পেতে পারেন একটা গর্হিত পাপাচার। সুফি সাধক তার তেপায়ায় পিঠ খাড়া করে একদম সটান বসে রয়েছে এবং কঠোর একটা অভিব্যক্তি তার মুখাবয়বে।

‘এটা কি নরহত্যা? আমি একজন সম্রাট। আমার সমস্ত প্রজার জীবন আর মৃত্যুর উপরে আমার অধিকার আছে।

কিন্তু সম্রাট হিসাবে আপনি সেই সাথে ন্যায়বিচারের উৎসমুখ। আপনি খেয়ালের বশে বা আপনার সুবিধার জন্য হত্যা করতে পারেন না।

‘শের আফগান দুর্নীতিপরায়ন ছিল। তার স্থানে আমার মনোনীত সেনাপতি সে কি পরিমাণ বাদশাহী অর্থ আত্মসাৎ করেছিল তাঁর প্রচুর প্রমাণ আমাকে দিয়েছে। ঘোড়া আর অন্যান্য উপকরণ ক্রয়ের জন্য আমার কোষাগার থেকে প্রেরিত সহস্রাধিক মোহর তাঁর ব্যক্তিগত সিন্দুকে জমা হয়েছে। সে মিথ্যা অভিযোগে ধনী বণিকদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে যাতে করে সে তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারে। শের আফগানকে দশ, বিশবার মৃত্যুদণ্ড দেবার মত প্রচুর প্রমাণ আমার কাছে আছে…

‘কিন্তু আপনি যখন তাকে হত্যা করার আদেশ দিয়েছিলেন তখন আপনি তার এসব অপরাধ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না?

জাহাঙ্গীর ইতস্তত করে, তারপরে বলে, ‘না।’

‘সম্রাট, সেক্ষেত্রে–এবং কথাটা সরাসরি বলার জন্য আমার মার্জনা করবেন–নিজের স্বেচ্ছাচারীতাকে ন্যায্যতা প্রতিপাদন করার চেষ্টা করাটা আপনার উচিত হবে না। আত্মগ্ৰাহী আবেগের বশবর্তী হয়ে আপনি কাজটা করেছেন, এর বেশি কিছু না।

কিন্তু আমার দাদাজানের থেকে আমার কৃতকর্ম কি এতটাই আলাদা? আমার অপরাধ কি তার চেয়ে এতটাই নিকৃষ্ট? এক ভাইয়ের কাছ থেকে তিনি একজন রমণীকে-যে তাকে ভালোবাসতো এবং তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত ছিল-ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। হিন্দালকে তিনি যদি বৈরীভাবাপন্ন না করতেন, হিন্দাল নিজে কখনও খুন হতো না।

‘আপনার অপরাধ আরও নিকৃষ্ট কারণ আপনি নিজের স্বার্থে একজন লোককে হত্যা করেছেন। আপনি আল্লাহতালার চোখেই কেবল পাপ করেন নি সেইসাথে আপনার কাঙ্কি রমণীর পরিবারের বিরুদ্ধে এবং স্বয়ং সেই রমণীর প্রতিও আপনি পাপাচার করেছেন। আপনি আপনার অন্তরে এটা জানেন, নতুবা কেন আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন? তার মুখের দিকে সুফি সাধকের পরিষ্কার খয়েরী চোখ অপলক তাকিয়ে থাকে। জাহাঙ্গীর যখন কিছু বলে না তিনি বলতে থাকেন, আমি আপনাকে আপনার পাপবোধ থেকে মুক্তি দিতে পারবো না… আল্লাহতালাই কেবল আপনাকে মার্জনা করতে পারেন।’

জাহাঙ্গীর মনে মনে ভাবে, সুফি বাবার প্রতিটা কথাই অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। বিশ্বাস করে কারো কাছে মনের গোপন কথাটা বলার প্রয়োজনীয়তা ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছিল এবং সে খুশি যে অবশেষে সে এটা করতে পেরেছে, কিন্তু ধার্মিক লোকটা তার অপরাধ হয়ত না দেখার ভাণ করবেন এই আশা করে সে নিজে নিজেকেই প্রতারিত করেছিল। আমি আল্লাহতা’লার ক্ষমা লাভ করার চেষ্টা করবো। আমি দরিদ্রদের যা দান করি তাঁর পরিমাণ তিনগুণ বৃদ্ধি করবো। আমি দিল্লি, আগ্রা আর লাহোরে নতুন মসজিদ নির্মাণের আদেশ দেব।

আমি আদেশ দেব।’ সুফি বাবা নিজের হাত উঁচু করেন। সম্রাট, এসব যে যথেষ্ট নয়। আপনি বলেছেন আপনি বিধবা রমণীকে আপনার হেরেমে নিয়ে এসেছেন। তাঁর সাথে আপনি কি ইতিমধ্যে সহবাস করেছেন?

না। সে মোটেই সাধারণ কোনো উপপত্নী নয়। আমি আপনাকে যেমন বলেছি, আমি তাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক। সে বর্তমানে আমার এক সৎ-মায়ের খিদমতকারী হিসাবে রয়েছে এবং এসব বিষয়ে সে বিন্দুমাত্র অবহিত নয়। কিন্তু আমি শীঘ্রই তাকে ডেকে পাঠাব… আমার অনুভূতির কথা তাকে বলবো…’

না। আপনার প্রায়শ্চিত্তের কিছুটা অবশ্যই ব্যক্তিগত হতে হবে। আপনাকে অবশ্যই আত্ম-সংযমের পরিচয় দিতে হবে। এই রমণীকে এখন বিয়ে করলে আল্লাহতা’লা হয়ত ভয়ঙ্কর মূল্য আদায় করবেন। আপনাকে অবশ্যই নিজের বাসনা দমন করতে হবে এবং অপেক্ষা করতে হবে। আপনি অন্তত ছয়মাস তার সাথে সহবাস করবেন না এবং সেই সময়ে আপনি প্রতিদিন নামায আদায় করবেন আল্লাহতালার মার্জনা লাভ করতে।’ কথা বলে সুফি বাবা উঠে দাঁড়ায় এবং তাকে চলে যাবার জন্য জাহাঙ্গীরের আদেশের অপেক্ষা না করে কক্ষ থেকে বের হয়ে যায়।

*

ফাতিমা বেগমের চওড়া মুখটা পার্চমেন্টের মত শুষ্ক আর রেখাযুক্ত এবং তার থুতনির বাম পাশের একটা বিশালাকৃতি তিলে বেশ লম্বা তিনটা সাদা চুল বের হয়েছে। তিনি কি কখনও সুন্দরী ছিলেন–এতটাই সুন্দরী যে আকবর তাকে স্ত্রী করার জন্য উদগ্রীব হয়েছিলেন? মেহেরুন্নিসা, নিচু একটা বিছানায় স্তূপীকৃত কমলা রঙের সুডৌল তাকিয়ায় তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় শুয়ে থাকা বয়স্ক মহিলার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে। তার মনে হয় সে হয়ত উত্তরটা জানে। আকবর যদিও নিজের দৈহিক আনন্দের জন্য তাঁর উপপত্নীদের বাছাই করতেন, তিনি বিয়েকে রাজনৈতিক মৈত্রী সম্পাদনের একটা মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করতেন। সিন্ধের সীমান্ত এলাকায় একটা ছোট রাজ্যের শাসক ফাতিমা বেগমের পরিবার।

মেহেরুন্নিসা অস্থিরভাবে নড়াচড়া করে। তাঁর কোনো কিছু পাঠ করতে ইচ্ছে করে কিন্তু ফাতিমা বেগম নিজের কক্ষে আলো মৃদুতর রাখতে পছন্দ করেন। খিলানাকৃতি জানালায় ঝুলন্ত মসলিনের পর্দা সূর্যের আলো পরিশ্রুত করে। সে উঠে দাঁড়ায় এবং একটা জানালার দিকে এগিয়ে যায়। সে পর্দার ভিতর দিয়ে যমুনা নদীর হলুদাভ-বাদামি পানির স্রোত এক নজর দেখতে পায়। একদল লোক এর কর্দমাক্ত চওড়া তীর ধরে দুলকি চালে ঘোড়া নিয়ে যাচ্ছে, তাদের শিকারী কুকুরগুলো পিছনে দৌড়াচ্ছে। সে আবারও পুরুষদের তাদের স্বাধীনতার জন্য হিংসা করে। এখানে এই বাদশাহী হোরেমে মেয়েদের এই স্বয়ংসম্পূর্ণ বসবাসের এলাকায়-তাঁর জীবন কাবুলে যেমন ছিল তারচেয়ে বেশি দমবন্ধ করা মনে হয়। হেরেমের ফুলে ফুলে ছাওয়া বাগান আর চত্বরের সৌন্দর্য, এখানের বৃক্ষশোভিত সড়কগুলো এবং চিকচিক করতে থাকা সুগন্ধিযুক্ত পানির প্রস্রবন, বিলাসবহুল আসবাবপত্র–কোনো মেঝে কখনও খালি থাকে না, এবং দরজা আর জানালায় ঝলমলে রেশমের রঙিন পট্টি বাঁধা আর মখমলের দৃষ্টিনন্দন পর্দা থাকা সত্ত্বেও–হেরেমটা কেমন যেন বন্দিশালার মত মনে হয়। রাজপুত সৈন্যরা এখানে প্রবেশের বিশালাকৃতি তোরণগুলো সবসময়ে পাহারা দিচ্ছে এবং দেয়ালের ভেতরে মহিলা রক্ষী আর বৈশিষ্ট্যহীন-মুখাবয়ব এবং চতুর-দৃষ্টির খোঁজারা সবসময় টহল দেয় যাদের উপস্থিতি, এমনকি আট সপ্তাহ পরেও তাঁর কাছে অস্বস্তিকর মনে হয়।

সে এখনও সম্রাটের কাছ থেকে কোনো কিছু শুনতে না পাওয়ায় সেটা আরো বেশি অস্বস্তিকর মনে হয়… সে তাকে এমনকি এক ঝলকের জন্যও দেখতে পায়নি যদিও সে জানে তিনি দরবারেই রয়েছেন। তিনি কেন তাকে ডেকে পাঠান নি বা এমনকি ফাতিমা বেগমকেও দেখতে আসেন নি যেখানে আসলে তিনি নিশ্চিতভাবে জানেন যে তিনি অবশ্যই তাকে দেখতে পাবেন? ব্যাপারটা কি তাহলে এমন যে তাঁর আশাগুলো–এবং তাঁর আব্বাজানের আশাগুলোর–আসলে কোনো ভিত্তি নেই? মেহেরুন্নিসা জানালার কাছ থেকে সরে আসবার সময় নিজেই নিজেকে বলে, তাকে অবশ্যই ধৈর্য ধারণ করতে হবে। সে এছাড়া আর কিইবা করতে পারে? তাকে যদি এখানে সাফল্য লাভ করতে হয় সহজপ্রবৃত্তি তাকে বলে এই বিচিত্র নতুন পৃথিবী তাকে বুঝতে হবে। ফাতিমা বেগম তাকে যখনই কোনো কাজ দেবেন তাকে অবশ্যই হেরেম সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। সে ইতিমধ্যে আবিষ্কার করেছে যে শান বাঁধানো বর্গাকার আঙিনার তিনদিকে মধুচক্রের মত নির্মিত ঘরগুলো যেখানে ফাতিমা বেগমের বাসস্থান অবস্থিত সেখানে আরো ডজনখানেক অন্য মহিলা বাস করেন যারা কোনো না কোনোভাবে রাজপরিবারের সাথে সম্পর্কিত–খালা, ফুপু, অন্যান্য দূর সম্পর্কের বোন।

সে সেই সাথে এমন অনেক কিছু প্রত্যক্ষ করেছে যা তাকে নিশ্চিত করেছে যে মালার গুরুত্ব আর চরিত্র সম্বন্ধে তাঁর আন্দাজ পুরোপুরি সঠিক। খাজাসারা সুগন্ধি আর প্রসাধনী প্রস্তুতি থেকে শুরু করে হিসাবপত্র পরীক্ষা করা, রান্নাঘর তদারকি আর বাজার করা পর্যন্ত হারেমের সবকিছু কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করে। কর্তৃত্বপরায়ণ কিন্তু দক্ষ মালা তার সাহায্যকারীদের ক্ষুদ্র দলটার প্রত্যেক সদস্য আর ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ যেখানে মলমূত্র জমা হয় সেসব পরিষ্কার করার জন্য নিয়োজিত মেয়ে খলুপদের নাম জানে। সেই মহিলা অতিথিদের হেরেমে প্রবেশের অনুমতি দেয়। খাজাসারার অনেক দায়িত্বের ভিতরে এটাও রয়েছে–মেহেরুন্নিসা অন্তত তাই শুনেছে– সম্রাটের সাথে সহবাস করা প্রতিটা মহিলার, যাঁদের ভিতরে তাঁর স্ত্রীরাও রয়েছেন, বিস্তারিত বিবরণী এবং ঘটনাচক্রে কেউ কেউ গর্ভবতী হলে সেই তারিখ সংরক্ষণ করা। সে এমনকি-প্রতিটা কক্ষের দেয়ালের উঁচুতে এই বিশেষ উদ্দেশ্যে স্থাপিত ক্ষুদ্রাকৃতি পর্দার ভিতর দিয়ে তাকিয়ে সহবাস সংখ্যাও লিখে রাখে।

জাহাঙ্গীরের স্ত্রীরা, মেহেরুন্নিসা জানতে পেরেছে যে, হেরেমের পৃথক একটা অংশে চমৎকার সব সুসজ্জিত কামরায় বাস করে যা সে এখনও দেখেনি। তার আব্বাজান কেবল যদি বহু বছর পূর্বেই জাহাঙ্গীরের প্রস্তাবে সম্মতি দিতেন তাহলে সে হয়তো তাদের একজন হতো। তারা সবাই কেমন রমণী এবং তিনি কি এখনও তাদের শয্যায় সঙ্গী হন? নবাগত হবার কারণে সরাসরি কিছু জানতে চাওয়াটা তার জন্য কঠিন কিন্তু হেরেমের প্রধান অবসর বিনোদন হল পরচর্চা এবং সে আলাপচারিতার গতিপথ সহজেই ইচ্ছামত পরিবর্তিত করতে পারে। সে ইতিমধ্যে শুনেছে যে যুবরাজ খুররমের মাতা, যোধা বাঈ একজন রসিক আর সদাশয় মহিলা এবং এটাও জেনেছে যে যুবরাজ পারভেজের পারস্যে জন্মগ্রহণকারী মাতা মিষ্টি খাবার কারণে যার প্রতি তাঁর ভীষণ দূর্বলতা রয়েছে প্রচণ্ড মোটা হয়ে গিয়েছেন কিন্তু নিজের রূপ সম্বন্ধে এখনও এতটাই গর্বিত যে তিনি এখনও বৃদ্ধাঙ্গুলের অঙ্গুরীয়তে স্থাপিত মুক্তাখচিত ক্ষুদ্রাকৃতি আয়নায় যা এখন কেতাদুরস্ত ঘন্টার পর ঘন্টা নিজের চেহারা বিভোর হয়ে দেখে কাটিয়ে দেন।

সে আরো জেনেছে যে যুবরাজ খসরুর বিদ্রোহের পর থেকে তাঁরা মা মান বাঈ নিজের কামরায় অতিবাহিত করেন এবং পর্যায়ক্রমে খসরু আর তার সন্তানকে অন্য যারা বিপথগামী করেছে তাদের অভিযুক্ত করে দোষারোপ করে সময় কাটান। জোর গুজব রয়েছে মান বাঈ সবসময়ে ভীষণ অস্থির হয়ে থাকেন। একজন মহিলা স্বামী আর সন্তানের বিরোধের মাঝে যার ভালোবাসা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে চিন্তা করতেই খারাপ লাগে, কিন্তু মান বাঈয়ের আরো দৃঢ়তা প্রদর্শন করা উচিত ছিল… মেহেরুন্নিসা নিজের ভাবনায় তখনও এতটাই মগ্ন যে দরজার পাল্লা খুলে ফাতিমা বেগমের বছর চল্লিশের বিধবা ভ্রাতুস্পুত্রী সুলতানা, উত্তেজিত ভঙ্গিতে ভিতরে প্রবেশ করতে সে চমকে উঠে।

‘আমি দুঃখিত। ফাতিমা বেগম এখন ঘুমিয়ে আছেন, মেহেরুন্নিসা ফিসফিস করে বলে।

‘আমি সেটা দেখতেই পাচ্ছি। সে যখন ঘুম থেকে উঠবে তাকে বলবে যে আমি পরে আসবো। নীলের একটা চালান সম্বন্ধে জরুরি ব্যবসায়িক ব্যাপারে আমাকে তাঁর সাথে আলোচনা করতে হবে।’ সুলতানার কণ্ঠস্বর শীতল এবং অভিব্যক্তি বৈরীভাবাপন্ন যখন সে চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়।

মেহেরুন্নিসা হেরেমের বাসিন্দাদের কারো কারো তার প্রতি শীতল ব্যবহার, এমনকি বৈরিতার এবং তাদের কৌতূহলের সাথে ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। আততায়ীর হাতে নিহত শের আফগানের বিধবা স্ত্রীকে কেন ফাতিমা বেগমের সঙ্গিনী করা হয়েছে সে বিষয়ে দু’জন বয়স্ক মহিলার আলাপচারিতা সে আড়াল থেকে শুনেছে। সে অল্পবয়সী এবং দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী। সে এখানে কি করছে? তুমি নিশ্চয়ই ভেবেছো তারা তাকে পুনরায় বিয়ে দিয়েছে,’ একজন মহিলা মন্তব্য করে। এটা একটা ভালো প্রশ্ন। সে এখানে কি করছে? মেহেরুন্নিসা মনে মনে ভাবে। কামরার অন্য প্রান্তে, ফাতিমা বেগম ঘুমের ভিতরে অবস্থান পরিবর্তন করে নাক ডাকতে শুরু করেন।

*

‘খাজাসারা সবাইকে অবিলম্বে আঙিনায় সমবেত হতে বলেছে, নাদিয়া নামে কৃশকায়, তারের মত দেহের অধিকারী ছোটখাট দেখতে এক মহিলা ফাতিমা বেগমের পরিচারিকাদের একজন, বলে। মালকিন, এমনকি আপনাকেও অবশ্যই আসতে হবে, সে তার বয়স্ক গৃহকত্রীর দিকে শ্রদ্ধার সাথে মাথা নত করে পুনরায় যোগ করে।

‘কেন? কি হয়েছে? বিকেলের নাস্তার ব্যাপারটা বিঘ্নিত হওয়ায় ফাতিমা বেগমকে দেখতে মোটেই সুন্দরী মনে হচ্ছে না, মেহেরুন্নিসা ভাবে।

‘খোঁজাদের একজনের সাথে হাতে নাতে একজন উপপত্নীকে ধরা হয়েছে। অনেকেই বলাবলি করছে যেমনটা ভাব করে তার চেয়ে সে বেশি পুরুষ, অন্যদের ধারণা তারা কেবল চুমু দেয়া নেয়া করছিল। মেয়েটাকে চাবুকপেটা করা হবে।’

‘আমার যখন বয়স ছিল তখন এসব অপরাধের একমাত্র শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। ফাতিমা বেগমের আপাত কোমল মুখাবয়বে অননুমোদনের ছাপ স্পষ্ট। খোঁজাটার কি হবে?

‘তাকে হাতির পায়ের নিচে পিষে মারার জন্য ইতিমধ্যে কুচকাওয়াজের ময়দানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’

‘ভালো, ফাতিমা বেগম বলেন। এটাই যথার্থ এমনটাই হওয়া উচিত।’

ফাতিমা বেগমকে অনুসরণ করতে, মেহেরুন্নিসা দেখে প্রাঙ্গণে ইতিমধ্যে গালগল্প করতে থাকা মহিলারা এসে ভীড় করেছে, তাদের কাউকে উদ্বিগ্ন মনে হয় বাকীদের যখন কৌতূহলী দেখায় এবং তারা বিভিন্ন কৌশলে প্রাঙ্গণের কেন্দ্রস্থলের দৃশ্য ভালোভাবে দেখার জন্য চেষ্টা করছে যেখানে হেরেমের পাঁচজন মহিলা রক্ষী ফাঁসিকাঠের মত দেখতে কাঠের তৈরি একটা কাঠামো স্থাপণ করছে। আমার পেছনে দাঁড়াও, ফাতিমা বেগম মেহেরুন্নিসাকে আদেশ দেন, এবং আমার রুমাল আর সুগন্ধির বোতল ধরে রাখো।

প্রহরীদের একজন এখন তার শক্তিশালী খালি হাতে শাস্তিদানের কাঠামোটা ধাক্কা দিয়ে, এর দৃঢ়তা পরীক্ষা করছে। সে সন্তুষ্ট হয়ে এক পা পিছিয়ে আসে এবং অন্য আরেকজন প্রহরীর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তে সে ব্রোঞ্জের একটা বিষাণ ঠোঁটে রেখে ফুঁ দিতে সেটা একটা কর্কশ ধাতব শব্দে বেজে উঠে। মেহেরুন্নিসা শব্দের রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই আঙিনার ডানদিক থেকে আপাদমস্তক টকটকে লাল রঙের আলখাল্লায় আবৃত হয়ে নিজের স্বভাবজাত মন্থর আর গম্ভীর ভঙ্গিতে হেঁটে খাজাসারাকে প্রবেশ করতে দেখে, সমবেত মহিলারা দু’পাশে সরে গিয়ে তাকে সামনে এগোবার জায়গা করে দেয়। মালার পিছনে, নাদুসনুদুস দেখতে অল্পবয়সী এক মেয়েকে, দুইজন মহিলা প্রহরী দু’পাশ থেকে ধরে টেনে নিয়ে আসে, যার। দু’চোখ থেকে ইতিমধ্যেই অঝোরে অশ্রু ঝরছে এবং তাঁর শোচনীয় অঙ্গস্থিতিই বলে দেয় যে সে নিজেও জানে কোনো ধরনের করুণা তাকে দেখান হবে না। খাজাসারা কাঠের ভয়ঙ্কর দর্শন কাঠামোর দিকে এগিয়ে যাবার ফাঁকে সে আদেশের সুরে বলে, মেয়েটাকে নগ্ন কর। কশাঘাত শুরু করা যাক।

মেয়েটাকে যে প্রহরীরা ধরে রেখেছিল তারা সামনের দিকে ধাক্কা দিয়ে জোর করে তাকে হাঁটু ভেঙে বসতে বাধ্য করে এবং রুক্ষভাবে তাঁর রেশমের অন্তর্বাস খুলে নেয় এবং সূক্ষ মসলিনের তৈরি লম্বা চুড়িদার পাজামার কাপড় টেনে ছিঁড়ে ফেলে এবং পাজামা বাঁধার মুক্তাখচিত বেণী করা ফিতে ছিঁড়ে গিয়ে পুরো আঙিনায় সেগুলো ছড়িয়ে যায়। মেহেরুন্নিসার পায়ের কাছে এসে একটা থামে। প্রহরীরা নগ্ন অবস্থায় তাকে টেনে হিঁচড়ে কাঠের কাঠামোটার কাছে নিয়ে যেতে শুরু করতে মেয়েটা চিৎকার করতে শুরু করে, তার দেহ ধনুকের মত বাঁকা হয় আর টানটান হয়ে যায় এবং সে ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে থাকলে তার ভারি স্তন আন্দোলিত হতে থাকে কিন্তু প্রহরীদের পেশী শক্তির সাথে তার তুলনায় চলে না এবং তাঁরা অনায়াসে কাঠামোর নিচের প্রান্তের সাথে তাঁর গোড়ালী আর উপরের প্রান্তের সাথে তাঁর দুই কব্জি জোড়া করে চামড়ার শক্ত সরু ফালি দিয়ে বেঁধে দেয়। মেয়েটার লম্বা চুলের গোছা তাঁর নিতম্বের বেশ নিচে পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রহরীদের একজন তার কোমর থেকে খঞ্জর বের করে গলার কাছে ঘাড়ের ঠিক উপর থেকে কেটে দেয় এবং চকচক করতে থাকা পুরো গোছাটা মাটিতে কুণ্ডলীকৃত অবস্থায় পড়তে দেয়। মেহেরুন্নিসা তার চারপাশ থেকে একটা সম্মিলিত আঁতকে উঠার শব্দ শুনতে পায়। একজন মেয়ের কাছে তাঁর চুল পরিত্যাগ করাই–তাঁর শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্যের মধ্যে অন্যতম–একটা ভয়ঙ্কর আর লজ্জাজনক বিষয়।

মহিলা প্রহরীদের দু’জন এবার সামনে এগিয়ে আসে, তাঁদের আঁটসাট জামার বাইরের অংশ তারা খুলে রেখেছে এবং কোমরের কারুকাজ করা চামড়ার চওড়া কোমরবন্ধনী থেকে ছোট হাতলযুক্ত গিট দেয়া দড়ির চাবুক বের করে। কাঠামোর দু’পাশে নিজেদের নির্ধারিত স্থানে দাঁড়িয়ে তারা নিজেদের হাত উঁচু করে এবং পর্যায়ক্রমে বন্দির ইতিমধ্যেই কাঁপতে শুরু করা শিহরিত দেহে কশাঘাত শুরু করে। প্রতিবার আঘাত করার সময় তারা উচ্চস্বরে–এক, দুই, তিন–সংখ্যা গুনতে থাকে এবং প্রথমদিকে প্রতিবার বাতাস কেটে হিসহিস শব্দে চাবুকের গিঁটঅলা দড়ি মেয়েটার নরম, মসৃণ ত্বকে কামড় দেয়ার সময় সে চিৎকার করে উঠে যতক্ষণ না সেটা একটানা একটা প্রায় পাশবিক গোড়ানিতে পরিণত হয়। সে বেপরোয়াভাবে কিন্তু বৃথাই মোচড়াবার চেষ্টা করে নিজের দেহকে চাবুকের নাগাল থেকে সরিয়ে নিতে চায়। শীঘ্রই তাজা রক্ত তার মেরুদণ্ড আর পিঠ বেয়ে পড়তে শুরু করে এবং নিতম্বের মাঝ দিয়ে গড়িয়ে তার পায়ের কাছে পাথরের উপরে চকচক করতে থাকে। মেহেরুন্নিসা টের পায় তাঁর চারপাশের প্রাঙ্গণে একটা থমথমে নিরবতা নেমে এসেছে।

‘উনিশ’, ‘বিশ’, প্রহরীরা গুনে চলে, তাঁদের নিজেদের দেহও এখন ঘামের জেল্লায় চিকচিক করছে। চাবুকের পনেরতম আঘাতের সাথে সাথে কড়িকাঠে ঝুলন্ত নিস্তেজ, রক্তাক্ত দেহটা ভয়ঙ্কর চিৎকার করা বন্ধ করেছে এবং অচেতন দেখায়। অনেক হয়েছে, খাজাসারা হাত তুলে বলেন। সে যেমন আছে সেভাবেই নগ্ন অবস্থায় তাকে যাও এবং বাইরের রাস্তায় তাকে ফেলে দাও। বাজারের বেশ্যাপল্লীতে সে নিজের স্বাভাবিক স্থান খুঁজে নেবে। তারপরে সে তার পদমর্যাদাসূচক দণ্ডটা সামনে ধরে আঙিনার ভিড়ের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যেতে শুরু করলে তার পেছনে সম্মিলিত কণ্ঠের একটা দুর্বোধ্য শব্দের সৃষ্টি হয়।

মেহেরুন্নিসা কাঁপতে থাকে এবং সে সামান্য অসুস্থবোধও করতে থাকে। তাঁর তাজা বাতাস এবং ফাঁকা জায়গা দরকার। ফাতিমা বেগমকে কথাটা বলেই যে সে অসুস্থবোধ করছে, সে দ্রুত খালি হতে থাকা প্রাঙ্গণের একপ্রান্তে অবস্থিত ঝর্ণার কাছে প্রায় দৌড়ে যায় এবং ঝর্ণার মার্বেলের কিনারে বসে সে তার চোখে মুখে পানির ঝাপটা দেয়।

মালকিন, আপনি কি ঠিক আছেন?’ সে তাকিয়ে দেখে নাদিয়া দাঁড়িয়ে রয়েছে।

‘হ্যাঁ। ব্যাপারটা আসলে আমি জীবনে এমন কিছু কখনও দেখিনি। আমি জানতাম না যে হারেমের শাস্তি এমন ভয়ঙ্কর হতে পারে।

‘মেয়েটাকে ভাগ্যবান বলতে হবে। কশাঘাতের চেয়ে আরও ভয়ঙ্কর কিছু হতে পারতো। আপনি নিশ্চয়ই আনারকলির গল্প শুনেছেন।

মেহেরুন্নিসা তাঁর মাথা নাড়ে।

‘তাকে লাহোরের রাজকীয় প্রাসাদের ভূগর্ভস্থ কুঠরিতে জীবন্ত কবর দেয়া হয়েছিল। তাঁরা বলে যে রাতের বেলা আপনি যদি সেখান দিয়ে যান তাহলে তাকে বের হতে দেয়ার জন্য এখনও তার কান্নার শব্দ শুনতে পাবেন।’

“সে এমন কি করেছিল যেজন্য তাকে এভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে?

‘সে ছিল সম্রাট আকবরের সবচেয়ে প্রিয় এবং কাঙ্খিত রক্ষিতা কিন্তু সে তাঁর সন্তান, আমাদের বর্তমান সম্রাট জাহাঙ্গীরকে, নিজের প্রেমিক হিসাবে বরণ করেছিল।

মেহেরুন্নিসা পরিচারিকার দিকে নিস্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে। আনারকলি নিশ্চয়ই সেই রক্ষিতার নাম যার আলিঙ্গণের কারণেই জাহাঙ্গীরকে কাবুলে নির্বাসনে যেতে হয়েছিল। মুহূর্তের দুর্বলতার কারণে কি চরম মূল্যই না দিতে হয়েছে… ‘নাদিয়া, ঘটনাটা আসলে কি ঘটেছিল? গল্পের সুযোগ দেখে পরিচারিকার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। সে স্পষ্টতই গল্পটা বলতে পছন্দ করে। অন্যকারো চেয়ে আনারকলির জন্য আকবরের আকর্ষণটা বেশি ছিল। সে একবার আমাকে বলেছিল যে তারা দু’জনে যখন একলা থাকতো তখন তিনি তাকে নগ্ন অবস্থায় কেবল দেয়া অলঙ্কার পরিহিত হয়ে তাঁর নাচ দেখতে পছন্দ করতেন। গুরুত্বপূর্ণ নওরোজ উৎসবের একরাতে তিনি বিশাল এক ভোজসভার আয়োজন করে সেখানে তার এবং তাঁর অভিজাতদের সামনে আনারকলিকে তিনি নাচতে আদেশ করেন। আকবরের সন্তান যুবরাজ জাহাঙ্গীরও অতিথিদের একজন ছিলেন। তিনি আগে কখনও তাকে দেখেননি এবং আনারকলির সৌন্দর্য তাকে এতই মোহিত করে ফেলে যে সে তার আব্বাজানের রক্ষিতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাকে পাবার জন্য মরীয়া হয়ে উঠেন। তিনি সেই সময়ের হেরেমের খাজাসারাকে ঘুষ দেন যে আকবর যখন দরবারে থেকে দূরে ছিলেন তখন আনারকলিকে তাঁর কাছে নিয়ে আসে।

‘আর তাদের কেউ দেখে ফেলেছিল। ‘প্রথম প্রথম কেউ দেখেনি, নাহ্। কিন্তু আনারকলির জন্য জাহাঙ্গীরের কামনা বৃদ্ধি পাবার সাথে সাথে তাঁর হঠকারিতাও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। খাজাসারা সবকিছু দেখে ভয় পেয়ে গিয়ে সম্রাটের কাছে সবকিছু বলে দেয়। তিল তিল করে মৃত্যুর বদলে পুরষ্কার হিসাবে দ্রুত তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। সম্রাট তারপরে আনারকলি আর জাহাঙ্গীরকে তার সামনে হাজির করার আদেশ দেন। আকবরের দেহরক্ষীদের একজন ছিলেন আমার চাচাজান এবং তিনি সবকিছু দেখেছিলেন। তিনি আমাকে বলেছেন আনারকলি নিজের জীবন ভিক্ষা চেয়ে অনুনয় বিনয় করেছিল, অশ্রুতে তার চোখের কাজলে সারা মুখ লেপ্টে গিয়েছিল, কিন্তু তার ব্যাপারে আকবর চোখ কান বন্ধ করে ছিলেন। এমনকি জাহাঙ্গীর পর্যন্ত যখন চিৎকার করে বলে যে আনারকলি নয়, সেই দোষী সম্রাট তাকে চুপ করে থাকতে বলেন। তিনি আনারকলিকে একটা ভূগর্ভস্থ কক্ষে রেখে দেয়াল তুলে দিতে বলেন এবং সেখানেই ক্ষুধা তৃষ্ণায় মৃত্যুবরণ করার জন্য ফেলে রাখেন।

‘যুবরাজের ভাগ্যে আমার চাচাজান বলেছেন যে সম্রাটের অভিব্যক্তি দেখে সবাই ধরে নিয়েছিল যে আকবর তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেবেন। আনারকলিকে টেনেহিঁচড়ে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়ার পরে উপস্থিত অমাত্যদের মাঝে একটা থমথমে নিরবতা বিরাজ করতে থাকে। কিন্তু তার আসল অভিপ্রায় যাই হোক, তাঁর ক্রোধ যতই প্রবল হোক, শেষ মুহূর্তে আকবর নিজের সন্তানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া থেকে কোনো মতে নিজেকে বিরত রাখেন। তিনি এরবদলে যুবরাজকে নির্বাসিত করেন কেবল তার দুধ-ভাই তার সাথে সঙ্গী হিসাবে গমন করে।

মেহেরুন্নিসা মাথা নাড়ে। আমি জানি। আমার আব্বাজান যখন কাবুলের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন তখন তাকে সেখানে পাঠান হয়েছিল।

‘কিন্তু আনারকলির গল্পের এখানেই সমাপ্তি নয়, অন্তত আমার মনে হয় না ব্যাপারটা এভাবে…’

‘তুমি কি বলতে চাও?

‘অন্তত হেরেমের ভিতরে একটা গুজব রয়েছে যে আনারকলির যন্ত্রণা লাঘব করতে জাহাঙ্গীর তার দাদিজান হামিদাকে রাজি করিয়ে ছিল এবং তাকে জীবন্ত সমাধিস্থ করতে দেয়ালের শেষ ইটটা গাঁথার আগে যেভাবেই হোক হামিদা তাঁর কাছে বিষের একটা শিশি পৌঁছে দেন যাতে করে সে দীর্ঘ আর যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর বিভীষিকা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে।’

বিকেলের বাতাসের সমস্ত উষ্ণতা সত্ত্বেও মেহেরুন্নিসা কাঁপতে থাকে। প্রথমে কশাঘাত এবং তারপরে এই ভয়ঙ্কর গল্প। আমার ফাতিমা বেগমের কাছে ফিরে যাওয়া উচিত, সে বলে। সে যখন নাদিয়ার সাথে প্রাঙ্গণের উপর দিয়ে হেঁটে যায়, যেখানে স্থাপিত কড়িকাঠটা ততক্ষণে সরিয়ে ফেলে পাথরের উপর থেকে রক্তের চিহ্ন ধুয়ে ফেলা হয়েছে, তার মাথায় তখনও আনারকলির শোকাবহ ঘটনাই ঘুরপাক খায়। আকবর কি এতটাই উদাসীন আর নির্মম লোক ছিলেন? অন্যেরা তার সম্বন্ধে এমন কথা বলে না এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর আব্বাজানও তাকে এভাবে মনে রাখেন নি। গিয়াস বেগ সবসময়ে মৃত সম্রাটের প্রশংসা করেন এবং বিশেষ করে শাসনকার্য পরিচালনার সময় তিনি যে ন্যায়পরায়ণতা আর ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। আকবর ক্রোধের বশবর্তী হয়ে সম্ভবত আত্মবিস্মৃত হয়েছিলেন এবং একজন সম্রাট হিসাবে নিজের ভাগ্যের উপরে সামান্য নিয়ন্ত্রণের অধিকারী একজন দুর্বল নারীর উপরে এমন আক্রোশপূর্ণ প্রতিশোধ নেয়া থেকে বিরত থাকার বদলে আতে ঘা লাগা একজন সাধারণ মানুষের মত আচরণ করেছেন।

জাহাঙ্গীর… নিশ্চিতভাবে সেই এখানে সবচেয়ে বেশি দোষী? তাঁর চরিত্র সম্বন্ধে এই গল্পটা থেকে সে কি বুঝতে পারে? এটাই বলে যে সে একাধারে হঠকারী, আবেগপ্রবণ আর স্বার্থপর কিন্তু সেই সাথে সে অমিত সাহসী এবং শক্তিমান প্রেমিক। সে পুরো দোষ নিজের কাঁধে নিয়ে আনারকলিকে রক্ষা করতে চেষ্টা করেছিল। সে যখন সেটা করতে ব্যর্থ হয়েছে তখন তাকে আরও কষ্টের হাত থেকে বাঁচাতে তাঁর পক্ষে যা করা সম্ভব ছিল সে তাই করেছে। মেহেরুন্নিসা তাঁর চমৎকার দৈহসৌষ্ঠব তাঁর চোখের সেই আবেগঘন চাহনি যা তাঁর সামনে নাচার সময় তাকে বাধ্য করেছিল মুখের নেকাব ফেলে দিতে। পুরো ব্যাপারটাই অদ্ভূত, কিন্তু আনারকলির প্রতি তাঁর অভিশপ্ত ভালোবাসার গল্প কোনোভাবে তাকে তার দৃষ্টি ছোট করে না–বরং প্রায় উল্টো হয়। পৌরুষদীপ্ত শক্তিতে ভরপুর আর এত অমিত ক্ষমতার অধিকারী এমন একটা মানুষের সাথে জীবন কাটান কতটা রোমাঞ্চকর হতে পারে।

একান্ত অনাহূতভাবে অন্যান্য আরো সংযত ভাবনাগুলো প্রায় একই সাথে উঁকি দিতে শুরু করে। আনারকলির গল্প আর তাঁর নিজের ভিতরে কি মনোযোগ নষ্টকারী সাদৃশ্য নেই? জাহাঙ্গীর আনারকলিকে মাত্র একবার দেখেছিলেন এবং সেটাই আনারকলিকে নিজের করে পাবার জন্য তাকে মরীয়া করে ভোলার জন্য যথেষ্ট ছিল এবং তাকে পাবার জন্য তার প্রয়াস ছিল নির্মম। মেহেরুন্নিসাকেও তিনি কেবলই একবারই দেখেছিলেন এবং সেটা আনারকলির মৃত্যুর খুব বেশি দিন পরে নয় এবং তিনি তাকেও পেতে চেয়েছিলেন। সে নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে দুটো ব্যাপার এক নয়। জাহাঙ্গীর প্রকাশ্যে এবং যথাযথ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক তাঁর আব্বাজানের কাছে তার জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। তাঁর আব্বাজান যখন সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল তিনি সেটা মেনেও নিয়েছিলেন। তিনি কি আসলেই মেনে নিয়েছিলেন?

মেহেরুন্নিসার মস্তিষ্ক এখন ঝড়ের বেগে কাজ করতে শুরু করে। কাবুল থেকে গিরিপথের ভিতর দিয়ে সমভূমিতে নামার সময় তার পাশ দিয়ে অতিক্রমকারী নীল-চোখের সেই অশ্বারোহীকে অনাদিষ্টভাবে সে তার চোখের সামনে আরো একবার দেখতে পায়। সেই সময়ে, সে লাডলির আয়া ফারিশাকে বলেছিল, একটা ভয়ঙ্কর আর ততদিনে ভুলে যাওয়া একটা গুজব, লোকটা কে খুঁজে বের করতে। মাত্র দুই দিন পরেই মেয়েটা তাকে উৎফুল্ল ভঙ্গিতে জানায় যে নীল চোখের অধিকারী একজন বিদেশী সৈন্য আদতেই দেহরক্ষীদের ভিতরে রয়েছে–একজন ইংরেজ যাকে সম্রাট সম্প্রতি নিয়োগ করেছেন। সেই সময়ে এই সংবাদটা শুনে মেহেরুন্নিসা নিজেকে বুঝিয়ে ছিলেন যে ফারিশার কোথাও ভুল হয়েছে। শের আফগানের কথিত আততায়ী একজন পর্তুগীজ। তাছাড়া, সে নিজেকে আরও বোঝাতে থাকে, এই ফিরিঙ্গিগুলোকে দেখতে প্রায়শই একইরকম লাগে এবং সে আধো আলোকে আর ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে কয়েক পলকের জন্য তার স্বামীর আততায়ীকে দেখেছিল। কিন্তু সে এখনও মনে মনে ব্যাপারটা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তাঁর স্বামীর গলায় খঞ্জর চালাবার সময় ধুসর চোখের সেই দৃষ্টি সে কীভাবে ভুলে যাবে বা সে যখন সেই চোখ আবার দেখবে তখন কীভাবে তার ভুল হবে?

কিন্তু মেহেরুন্নিসা এখন চিন্তা করে সে কি আসলেই সত্যের কাছাকাছি পৌঁছেছে। আনারকলিকে জাহাঙ্গীর কামনা করতেন এবং তাকে পাবার জন্য তিনি কোনো বাধাই মানেননি। তিনি যদি তাকে, মেহেরুন্নিসাকে, কামনা করে থাকেন, তাহলে তিনি কেন কম নির্দয় হবেন? মেহেরুন্নিসা দ্বিতীয়বারের মত কেঁপে উঠে কিন্তু এবার মৃত রক্ষিতার বদলে তাঁর নিজের কথা চিন্তা করে। জাহাঙ্গীর তাকে এতটাই কামনা করে ভাবতেই ব্যাপারটা তাঁর দেহে শিহরণ তোলে, কিন্তু আনারকলির ভাগ্য দেখে এটাও বুঝতে পারে যে রাজপরিবারের সাথে এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পুরষ্কারের পাশাপাশি বিপদও বয়ে আনতে পারে…

১.০৫ মীনা বাজার

জাহাঙ্গীর টের পায় প্রতিপক্ষের তরবারির বাঁকানো ফলা পিছলে গিয়ে তাঁর গিল্টি করা চামড়ার পর্যাণের গভীরে কেটে বসার পূর্বে উরু রক্ষাকারী ধাতব শৃঙ্খল নির্মিত বর্মের ইস্পাতের জালিতে ঘষা খায়। সে তার কালো ঘোড়ার লাগাম শক্ত হাতে টেনে ধরে সে শত্রুর হাত চিরে দেবার অভিপ্রায়ে তরবারি হাঁকায় লোকটা তখন নিজের অস্ত্র দিয়ে আরেকবার আঘাত করতে সেটা সরিয়ে আনতে চেষ্টা করছে। সে অবশ্য, অন্য অশ্বারোহী ভীষণ ভাবে নিজের ধুসর ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরায় জন্তুটা পিছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে, লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হয়। জটার হাচড়পাঁচড় করতে থাকা সামনের পায়ের খুর তার বাহনের উদরে এসে লাগে। অন্যটা তার পায়ের গুলের উপরের অংশে আঘাত করে। আঘাতটা যদিও পিছলে যায় কিন্তু এটা তাঁর পায়ের নিচের অংশ অবশ করে দেয় এবং তাঁর পা রেকাব থেকে ছিটকে আসে।

জাহাঙ্গীরের ঘোড়াটা যন্ত্রণায় চিহি শব্দ করে একপাশে সরে যেতে, সে ভারসাম্য হারায় কিন্তু দ্রুত সামলে নিয়ে, নিজের বাহনকে শান্ত করে এবং রেকাবে পুনরায় পা রাখতে সক্ষম হয়। অন্য লোকটা ততক্ষণে পুনরায় তাকে আবার আক্রমণ করতে এগিয়ে এসেছে। জাহাঙ্গীর তার কালো ঘোড়ার ঘামে ভেজা গলার কাছে নুয়ে আসতে তার প্রতিপক্ষের তরবারির ফলা বাতাসে ফণা তোলার মত শব্দ করে ঠিক তার শিরোস্ত্রাণের পালক স্পর্শ করে বের হয়ে যায়। জাহাঙ্গীর তার ঘোড়াটা বৃত্তাকালে ঘুরিয়ে নিয়ে পুনরায় শত্রুর মুখোমুখি হবার ফাঁকে চিন্তা করার খানিকটা অবসর পেতে ভাবে, রাজা বিদ্রোহী হলেও একজন সত্যিকারের যোদ্ধা যে হামলার সময় তাঁর মুখোমুখি হবার সাহস দেখিয়েছে। উভয় যোদ্ধাই নিজেদের বাহনের পাঁজরে তাদের গোড়ালি দিয়ে গুঁতো দেয় এবং একই সাথে সামনে এগিয়ে আসে আক্রমণ করতে। জাহাঙ্গীর এবার তার প্রতিপক্ষের গলা লক্ষ্য করে নিজের তরবারি হাঁকায়। আঘাতটা প্রথমে ইস্পাতের বক্ষাবরণীর প্রান্তে আটকে যায় কিন্তু তারপরে মাংসে এবং পেশীতন্তুতে কামড় বসায়। রাজার বাঁকানো তরবারির ফলা তার তরবারি ধরা হাতের লম্বা চামড়ার দাস্তানা চিরে ভেতরে ঢুকতে জাহাঙ্গীরও একই সময়ে হুল ফোঁটানর মত যন্ত্রণা অনুভব করে এবং সাথে সাথে তাঁর হাত বেয়ে রক্ত পড়তে শুরু করে। ঘোড়ার মুখ দ্রুত ঘুরিয়ে নিয়ে সে দেখে তার প্রতিপক্ষ ধীরে ধীরে নিজের পর্যাণ থেকে একপাশে কাত হয়ে যাচ্ছে এবং তারপরে ভোতা একটা শব্দ করে ধুলি আচ্ছাদিত মাটিতে আছড়ে পড়তে তার হাত থেকে তরবারির বাট ছিটকে যায়।

জাহাঙ্গীর নিজের পর্যাণ থেকে লাফিয়ে নিচে নামে এবং পায়ের আঘাতপ্রাপ্ত গুলের কারণে খানিকটা দৌড়ে, খানিকটা খুড়িয়ে ভূপাতিত লোকটার দিকে নিজেকে ধাবিত করে। তার ঘাড়ের ক্ষতস্থান থেকে যদিও টকটকে লাল রক্ত স্রোতের মত বের হয়ে তার ঘন, কালো কোঁকড়ানো দাড়ি এবং বুকের বর্ম সিক্ত করছে, সে তখনও নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে।

‘আত্মসমর্পণ করো, জাহাঙ্গীর আদেশের সুরে বলে।

‘আর তোমার প্রাসাদের ভূগর্ভস্থ কুঠুরিতে নিজের জানটা খোয়াই? কখনও না। আমি এই লাল মাটির বুকেই মৃত্যুবরণ করবো বহু পুরুষ ধরে যা আমার পরিবারের অধিকারে রয়েছে–আমাদের ভূমি দখলকারী তোমাদের লোকের চেয়ে তাদের সংখ্যা অনেক বেশি। শব্দগুলো রক্তের বুদ্বুদের সাথে মিশে তার ঠোঁট দিয়ে বের হতে সে তার দেহের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে তার পায়ের ঘোড়সওয়াড়ীর জুতোর ভিতরে রক্ষিত একটা ময়ান থেকে খাঁজকাটা ফলাযুক্ত লম্বা একটা খঞ্জর টেনে বের করে আনে। সে আঘাত করার জন্য নিজের হাত পিছনে নেয়ার পূর্বেই জাহাঙ্গীরের তরবারি আরো একবার লোকটার গলায় আঘাত হানে, এবার তার কণ্ঠার হাড়ের ঠিক উপরে আঘাত করতে, তার দেহ থেকে তাঁর মাথাটা প্রায় আলাদা হয়ে যায়। লোকটা পিছনে শুয়ে পরলে, তার রক্ত ছিটকে এসে ধুলো লাল করে দিতে থাকে। তার দেহটা একবার কি দুইবার মোচড় খায় এবং তারপরে সে নিথর হয়ে পড়ে থাকে।

জাহাঙ্গীর প্রাণহীন শবদেহটার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। তার উধ্ববাহুর ক্ষতস্থান থেকে তাঁর নিজের উষ্ণ আর পিচ্ছিল রক্ত এখনও তার হাত বেয়ে গড়িয়ে তার দাস্তানার ভেতরের আঙুলের জমা হচ্ছে। সে গলা থেকে আহত হাত দিয়ে নিজের মুখ মোছার কাপড়টা টেনে নিয়ে পায়ের গুলুইয়ের ক্ষতস্থানে সেটা কোনোমতে হাল্কা করে জড়িয়ে রাখে যেখানে খুরের আঘাতে সেখানের ত্বকের সাথে নিচের চর্বির স্তর ভেদ করে তার পায়ের গোলাপি রঙের মাংসপেশী বের করে ফেলেছে।

সে আজ সহজেই নিহত হয়ে, তার উচ্চাকাঙ্খ পরিপূর্ণ করা শুরু করার আগেই, অনায়াসে প্রাণ হারাতে এবং সিংহাসন হারাতে পারতো। সে কেন। মির্জাপুরের রাজার বিরুদ্ধে অভিযানে যে এই মুহূর্তে তাঁর পায়ের কাছে হাত-পা ছড়িয়ে নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে তার মন্ত্রণাদাতাদের পরামর্শ উপেক্ষা করে নিজে ব্যক্তিগতভাবে সেতৃত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল? খসরুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় সে যেমন করেছিল ঠিক তেমনই রাজার সৈন্যদের বিরুদ্ধে হামলা করার সময় নিজের দেহরক্ষীদের পিছনে ফেলে সে কেন দ্রুত সামনে এগিয়ে গিয়েছিল? মির্জাপুরের রাজা বস্তুতপক্ষে তার সিংহাসনের জন্য তেমন সত্যিকারের হুমকির কারণ ছিল না, সামান্য এক অবাধ্য জায়গীরদার, রাজস্থানের মরুভূমির সীমান্তে অবস্থিত একটা ছোট রাজ্যের শাসক যে রাজকীয় কোষাগারে বাৎসরিক খাজনা পরিশোধ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। সে তার মন্ত্রণাদাতাদের যা বলেছিল–সে দেখাতে চায় যে সে তার অধীনস্ত কারো কাছ থেকে কোনো ধরনের অবাধ্যতা সহ্য করবে না তাঁরা যতই ক্ষমতাধর কিংবা তুচ্ছ হোক এবং বিদ্রোহীদের শাস্তি দিতে সে কারো উপরে নির্ভরশীল হতে চায় না–সেটা ছিল আংশিক উত্তর।

অভিযানটায় তাঁর নিজের নেতৃত্ব দেয়ার পিছনে অবশ্য অতিরিক্ত আরো একটা কারণ রয়েছে সেটা সে নিজেই নিজের কাছে স্বীকার করে। অভিযানটা আগ্রা থেকে এবং সুফি বাবার নিষেধ সত্ত্বেও তাকে নিজের কাছে ডেকে পাঠাবার প্রায় অপ্রতিরোধ্য বাসনা থেকে তাকে সরিয়ে রেখে, তাঁর মেহেরুন্নিসার ভাবনায় চিত্তবিক্ষেপ ঘটাবে। রক্তক্ষরণ আর গরমের কারণে সহসা দুর্বলবোধ করায় জাহাঙ্গীর তার লোকদের পানি নিয়ে আসতে বলে। তারপরেই পৃথিবীটা তাঁর সামনে ঘুরতে শুরু করে।

কয়েক মিনিট পরে তার সংজ্ঞা ফিরে আসতে সে মাটিতে বিছানো একটা কম্বলের উপর নিজেকে শায়িত দেখতে পায় যখন দু’জন হেকিম উদ্বিগ্ন মুখে মরুভূমির সূর্যের নিচে তার ক্ষতস্থানের রক্তপাত বন্ধ আর সেলাই করছে। সংজ্ঞা ফিরে আসবার সাথে সাথে একটা আকষ্মিক ভাবনা তাকে পেয়ে বসে। রাজা এখন মৃত এবং অভিযান শেষ হওয়ায় সে এখন সহজেই নববর্ষ উদ্যাপনের জন্য আগ্রায় যথাসময়ে ফিরে যেতে পারবে। মেহেরুন্নিসার বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য সুফি বাবার কঠোর নির্দেশ ভঙ্গ না করেই উৎসবের আয়োজন তাকে নিশ্চিতভাবেই তার সাথে আবারও অন্তত দেখা করার সুযোগ দেবে। হেকিমদের একজনের হাতে ধরা সুই তাঁর ঊর্ধ্ববাহুর ত্বক ভেদ করতে লোকটা তার উন্মুক্ত ক্ষতস্থানের দুই পাশ সেলাই করতে শুরু করায় যন্ত্রণার তীক্ষ্ণ খোঁচা সত্ত্বেও জাহাঙ্গীর হাসি চেপে রাখতে পারে না।

*

‘আচ্ছা, আগ্রা দূর্গ সম্বন্ধে তোমার কি ধারণা?’ মেহেরুন্নিসা গিয়াস বেগের আবাসস্থলে বসে থাকার সময় তার ভ্রাতুস্পুত্রীকে জিজ্ঞেস করে। সে মনে মনে ভাবে, আরজুমান্দ বানু দেখতে কি রূপসী হয়েছে। কাবুলে খুব ছোটবেলায় দেখার পরে মেয়েটাকে সে আর দেখেনি। আরজুমান্দের বয়স এখন চৌদ্দ বছর কিন্তু তাঁর বয়সের অনেক মেয়ের মত কোনো বেমানান আনাড়িপনা তার ভিতরে নেই। তাঁর মুখটা কোমল ডিম্বাকৃতি, ভ্রু যুগল নিখুঁতভাবে বাঁকানো, এবং মাথার ঘন কালো চুল প্রায় তার কোমর ছুঁয়েছে। তার চেহারায় তার পার্সী মায়ের আদল স্পষ্ট যিনি তাঁর যখন মাত্র চার বছর বয়স তখন মারা গিয়েছেন কিন্তু তার চোখ আবার তাঁর বাবা, আসফ খানের মত, কালো রঙের।

‘আমি কখনও এরকম কিছু দেখিনি–এতো অসংখ্য পরিচারিকা, এত অগণিত আঙিনা, এতগুলো ঝর্ণা, এত এত রত্নপাথর। আমরা যখন দূর্গে প্রবেশ করছিলাম তারা আমার আব্বাজানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে তোরণদ্বারে দামামা বাজিয়েছিল।’ সবকিছুর অভিনবত্ব দেখে উত্তেজনায় আরজুমান্দের চোখ মুখ জ্বলজ্বল করতে থাকে।

মেহেরুন্নিসা স্মিত হাসে। তার কেবল মনে হয় সে যদি আবার এই বয়সে যেতে পারতো… ‘আকবরের রাজত্বকালের সময় থেকে, বিজয়ী সেনাপতির আগমনকে সম্মান প্রদর্শন করতে দামামা বাজাবার রীতির প্রচলন হয়েছে। বাজনা শুনে আমিও যারপরনাই গর্বিত হয়েছি।’

মেহেরুন্নিসার আব্বাজান কয়েক সপ্তাহ পূর্বে তাকে পত্র মারফত জানিয়েছিলেন যে তাঁর বড় ভাই আসফ খান দক্ষিণে দাক্ষিণাত্যে লড়াইয়ের সময় নিজেকে এতটাই স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত করেছেন যে সম্রাট তাকে আগ্রায় ডেকে পাঠিয়েছেন এখানের সেনানিবাসের দায়িত্ব গ্রহণ করতে। দুই সপ্তাহ পূর্বে আসফ খান আগ্রা এসে পৌঁছেছেন। মেহেরুন্নিসার প্রথমে ফাতিমা বেগম এবং পরে কর্তৃত্বপরায়ণ খাজাসারার কাছ থেকে গিয়াস বেগের আবাসস্থলে আসবার জন্য ছুটি পেতেই এতদিন সময় লেগেছে এবং সে তার ভাইয়ের সাথে দেখা করার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছে।

‘তোমার আব্বাজান কোথায়? আমি এখানে কেবল সূর্যাস্ত পর্যন্ত থাকতে পারব।’

“তিনি সম্রাটের সাথে নতুন পরিখাপ্রাচীরাদিনির্মাউ বিষয়ে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করছেন কিন্তু তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যত শীঘ্র সম্ভব তিনি আপনার সাথে দেখা করতে আসবেন।’

মেহেরুন্নিসা শুনতে পায় তার আম্মিজান লাডলিকে আঙিনার পাশেই একটা কামরায় গান গেয়ে শোনাচ্ছে। মেয়েটা খুব দ্রুত তার অনুপস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে এবং সে জানে যে তার ব্যাপারটা সম্বন্ধে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত যদিও সেটা তাকে খানিকটা আহত করে যে তাঁর মেয়ে সত্যিই তার অনুপস্থিতি তেমনভাবে উপলব্ধি করে না। তার পরিবার শনৈ শনৈ উন্নতি লাভ করছে। সম্রাটের কোষাগারের দায়িত্ব নিয়ে গিয়াস বেগকে সবসময়ে ব্যস্ত থাকতে হয়, তাঁর আম্মিজান অন্তত তাকে তাই বলেছেন, তাছাড়া আসফ খানও স্পষ্টতই জাহাঙ্গীরের অনুগ্রহভাজনদের তালিকায় শীর্ষেই রয়েছে। সেই কেবল, মেহেরুন্নিসা, যে ব্যর্থ হয়েছে। সম্রাটের কাছ থেকে সে এখনও কোনো ইঙ্গিত পায় নি এবং ফাতিমা বেগমকে খিদমত করার একঘেয়েমি প্রতিদিনই আরো বিরক্তিকর হয়ে উঠছে।

‘ফুফুজান, কি ব্যাপার? আপনাকে বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।

নাই কিছু না। আমি ভাবছিলাম কতদিন পরে আমরা সবাই আবার একত্রিত হয়েছি।’

‘আর সম্রাটের মহিষীদের কথা বলেন? তাঁর স্ত্রী, রক্ষিতা, তাঁরা সবাই কেমন দেখতে? আরজুমান্দ নাছোড়বান্দার মত জিজ্ঞেস করে।

মেহেরুন্নিসা তাঁর মাথা নাড়ে। আমি তাঁদের কখনও দেখিনি। তাঁরা হেরেমের একটা পৃথক অংশে বাস করে যেখানে সম্রাট আহার করেন আর নিদ্রা যান। আমি যেখানে বাস করি সেখানে প্রায় সব মহিলাই, আমার গৃহকত্রীর মত, বয়স্ক।

আরজুমান্দকে হতাশ দেখায়। রাজকীয় হেরেম আমি অন্যরকম ভেবেছিলাম।’

‘আমিও সেটাই ভেবেছিলাম-’ মেহেরুন্নিসা সেই সময়েই বাইরের করিডোরে পায়ের শব্দ শুনতে পায়, এবং প্রায় সাথে সাথেই আসফ খান ভেতরে প্রবেশ করেন।

‘আমার প্রিয় বোন! পরিচারিকাদের কাছে শুনলাম তোমাকে এখানেই পাওয়া যাবে। মেহেরুন্নিসা তাঁর আসন ছেড়ে পুরোপুরি উঠে দাঁড়াবার আগেই সে তাকে তার বাহুর মাঝে জাপটে ধরে মেঝে থেকে প্রায় শূন্যে তুলে নেয়। ভাইজান তাঁদের আব্বাজানের মতই লম্বা কিন্তু আরো চওড়া আর থুতনি চৌকা। সে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তুমি বদলে গিয়েছে। আমি তোমায় শেষবার যখন দেখেছিলাম তখন তুমি নিতান্তই একজন বালিকা–আরজুমান্দের চেয়ে বেশি বয়স হবে না, এবং অনেকবেশি লাজুক। কিন্তু এখন তোমায় দেখে…’

‘আসফ খান আপনার সাথে দেখা হয়েও খুব ভালো লাগছে। আমিও যখন শেষবার আপনাকে দেখেছিলাম তখন আপনি কৃশকায় লম্বা পা আর মুখে ফুস্কুড়িবিশিষ্ট একজন তরুন যোদ্ধা, সেও পাল্টা খোঁচা দেয়। আর এখন আপনি আগ্রা সেনানিবাসের দায়িত্বে রয়েছেন।

আসফ খান কাঁধ ঝাঁকায়। সম্রাট আমার প্রতি সদয়। আমি আশা করি আমার ভাইও আমার মতই ভাগ্যবান হবে। আমি যদি পারতাম তাহলে মীর খানকে গোয়ালিওর থেকে এখানে বদলি করে আনতাম তাহলে আমাদের পরিবার সত্যিই আবার একত্রিত হতে পারতো। আমাদের অভিভাবকদের, বিশেষ করে আম্মিজান এতে খুবই খুশি হতেন… কিন্তু আরো খবর রয়েছে। সম্রাট সামনের মাসে আগ্রা দূর্গে আয়োজিত রাজকীয় মিনা বাজারে অংশ নিতে আমাদের পরিবারকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।’

‘সেটা আবার কি? আরজুমান্দ বিভ্রান্ত চোখে তার আব্বাজানের দিকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু মেহেরুন্নিসা তাঁর কৌতূহল নিবৃত্ত করতে উত্তর দেয়।

‘বাজারটা হলো নওরোজেরই একটা অংশ–রাশিচক্রের প্রথম রাশি মেষে সূর্যের প্রবেশ করা উপলক্ষ্যে সম্রাট আকবরের প্রবর্তন করা আঠারো দিনব্যাপী নববর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠান। ফাতিমা বেগম সবসময়ে অভিযোগ করেন যে উৎসব শুরু হবার দুই সপ্তাহ আগে থেকে মিস্ত্রিরা দূর্গের উদ্যানে সুসজ্জিত শিবির স্থাপন করা আরম্ভ করলে হারেমে তখন কেবল তাদের হাতুড়ির আওয়াজ শোনা যায়।’

‘আর রাজকীয় মিনা বাজার?

‘অনুষ্ঠানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এটা অনেকটা সত্যিকারের বাজারের মতই পার্থক্য হল এখানে রাজপরিবারের সদস্য আর অভিজাতেরা কেবল ক্রেতা। দূর্গের উদ্যানে রাতের বেলা এটা আয়োজন করা হয়। অমাত্যদের –স্ত্রী আর কন্যারা–আমাদের মত মেয়েরা–টেবিলের উপরে পট্টি করে বাঁধা রেশম আর তুচ্ছ অলংকারের পসরা সাজিয়ে বসে এবং বিক্রেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তাঁদের সম্ভাব্য ক্রেতাদের রাজকুমারী আর রাজপরিবারের প্রবীণাদের আর সেই সঙ্গে সম্রাট আর তাঁর যুবরাজদের সাথে দর কষাকষি আর হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠে। অনুষ্ঠানটা এতটাই ঘরোয়া যে সব মেয়েরা এদিন নেকাব ছাড়াই চলাফেরা করে।

‘আব্বাজান, আমি যেতে পারবো, আমি পারবো না?’ আরজুমান্দকে সহসা উদ্বিগ্ন দেখায়।

‘অবশ্যই। আমাকে এখন আবার তোমাদের ছেড়ে যেতে হচ্ছে। আমাকে আরো কিছু সামরিক সমস্যার তদারকি করতে হবে কিন্তু আমি শীঘ্রই ফিরে আসবো।’

আসফ খান চলে যেতে, মেহেরুন্নিসা আরজুমান্দ বানুর সাথে বসে তার উৎসুক সব প্রশ্নের উত্তর দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু তার মনটা অন্য কোথায় পড়ে থাকে। ফাতিমা বেগম তাকে বাজারের সব কথাই বলেছেন কিন্তু সবকিছু তার পছন্দ হয়নি এবং এমন কিছু তিনি বলেছেন মেহেরুন্নিসা অবশ্যই যা তার ভাস্তির সামনে বলতে পারবে না। মিনা বাজার আসলে একটা মাংসের বাজার–এর বেশি কিছু না। আকবর এটা শুরু করেছিলেন কারণ তিনি নতুন শয্যাসঙ্গিনী পছন্দ করার একটা সুযোগ চেয়েছিলেন। কোনো কুমারী মেয়ে যদি তার চোখে ধরতো তাহলে তাঁর মনোরঞ্জনের জন্য মেয়েটাকে প্রস্তুত করতে তিনি খাজাসারাকে আদেশ দিতেন। বৃদ্ধার আপাত সহানুভূতিশীল চেহারায় ভ্রুকুটি দেখে মেহেরুন্নিসা আঁচ করে যে বহু দিন আগে বাজারে এমন কিছু একটা হয়েছিল যাতে তিনি আহত হয়েছেন। তিনি সম্ভবত আকবরের বাছবিচারহীন যৌন সংসর্গ অপছন্দ করেন। আরজুমান্দের মতই মেহেরুন্নিসাও অন্তরের গভীরে উত্তেজনা অনুভব করে–বাজারই একমাত্র স্থান যেখানে সে নিশ্চিতভাবেই সম্রাটকে দেখতে পাবে। কিন্তু ফাতিমা বেগম কি তাকে অংশগ্রহণের অনুমতি দেবেন?

*

এক সপ্তাহ পরের কথা ফাতিমা বেগমের দমবন্ধ করা আবাসস্থলে সন্ধ্যার মোমবাতি জ্বালানো হতে মেহেরুন্নিসা তাঁর প্রশ্নের উত্তর পায়। যেদিন থেকে সে বৃদ্ধাকে তার আমন্ত্রণের কথা বলেছে তিনি বাকচাতুরীর আশ্রয় নিতে শুরু করেছেন। মেহেরুন্নিসা এখন যদিও নিজেকে সবচেয়ে সুন্দর পোষাকে এবং মূল্যবান অলঙ্কারে সজ্জিত করেছে, তিনি তাঁর মুখাবয়বে একটা একগুয়ে অভিব্যক্তি ফুটিয়ে রাখেন মেহেরুন্নিসা যার অর্থ ভালোই বুঝে।

‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুমি একজন বিধবা। বাজারে অংশগ্রহণ করাটা আপাত দৃষ্টিতে তোমার জন্য সমীচিত হবে না। আর এসব হাঙ্গামায় যাবার জন্য আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। তুমি বরং আমাকে পার্সী কোনো কবিতা পড়ে শোনাও। আমাদের দুজনের জন্যই সেটা বাজারের হট্টগোল আর অশিষ্টতার চেয়ে আনন্দদায়ক হবে।

মেহেরুন্নিসা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে কবিতার একটা খণ্ড তুলে নেয় এবং হতাশায় কম্পিত আঙুলি দিয়ে লাল রঙের সুগন্ধি কাঠের মলাটের রূপার বাকল ধীরে ধীরে খুলে।

*

আগ্রা দূর্গের বিশাল দূর্গপ্রাঙ্গন সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে, খুররম ভাবে যখন সে, তিনবার তূর্যবাদনের সাথে, তাঁর বড় ভাই পারভেজের সাথে তাদের আব্বাজান জাহাঙ্গীরকে অনুসরণ করে সেখানে প্রবেশ করে, তাদের তিনজনেরই পরনে আজ সোনার জরির কারুকাজ করা পোষাক। গাছের ডাল আর ঝোঁপঝাড় থেকে ঝুলন্ত কাঁচের রঙিন গোলাকার পাত্রে মোমবাতি জ্বলছে এবং সোনা আর রূপার তৈরি কৃত্রিম গাছে রত্ন-উজ্জ্বল ছায়া–লাল, নীল, হলুদ, সবুজ-মৃদু বাতাসে আন্দোলিত হয়। দেয়ালের চারপাশে সে মখমল দিয়ে মোড়া ছোট ছোট উন্মুক্ত দোকানে পলকা অলঙ্কারের পসরা। সাজিয়ে মেয়েদের সেখানে অপেক্ষমান দেখে। তাঁর দাদাজানের সময়ের মতই পুরো ব্যাপারটা জমকালো দেখায়। সমস্ত নওরোজ উৎসবকালীন সময়ে আকবরের আনন্দ সে এখনও প্রাঞ্জলভাবে মনে করতে পারে। ‘সম্পদশালী হওয়াটা ভালো–বস্তুতপক্ষে এটা আবশ্যিক। কিন্তু একজন সম্রাটের জন্য সেটা প্রদর্শন করা যে তুমি সম্পদশালী সেটা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

জাঁকজমকপূর্ণ প্রদর্শনীর অর্থ আকবর ভালোই বুঝতেন। খুররমের ছেলেবেলার কিছু স্মৃতি রয়েছে যেখানে সে ঝলমলে হাওদার নিচে আকবরের পাশে বসে রয়েছে আর তারা আগ্রার সড়ক দিয়ে হাতির পিঠে চড়ে চলেছে। নিজের প্রজাদের কাছে নিজেকে দর্শন দেয়ার বিষয়ে বরাবরই আকবরের দুর্বলতা ছিল এবং তাঁরাও এজন্য তাকে ভালোবাসতো। আকবর ছিলেন সূর্যের মত এবং তার খানিকটা প্রভা খুররম ভাবে তাঁর নিজের উপরেও পড়েছে। তাঁর আব্বাজান জাহাঙ্গীর অবশ্য এই মুহূর্তে, যিনি হীরকসজ্জিত অবস্থায় জ্বলজ্বল করছেন, তাঁর অমাত্যদের পরিবেষ্টিত অবস্থায় এগিয়ে চলেছেন সবসময়ে ছায়াতেই অবস্থান করেছেন। খুররম যখন ছোট ছিল তখনও তার চারপাশে উৎকণ্ঠা আঁচ করতে পারতো–তার আব্বাজান আর দাদাজানের মাঝে, তার আব্বাজান আর তার সৎ-ভাইদের ভিতরে বড় যে সেই খসরুর মাঝে, যে তাঁদের আব্বাজানের রাজত্বকালে আয়োজিত প্রথম নওরোজের আনন্দ এখানে ভাগাভাগি করার বদলে গোয়ালিয়রে অজ্ঞাত কোনো ভূগর্ভস্থ কুঠরিতে বন্দি রয়েছে। খুররম প্রাঙ্গণের ঠিক মাঝখানে রূপার কারুকাজ করা চাঁদোয়ার নিচে একই কাপড় দিয়ে মোড়ানো বেদীর দিকে তাঁর আব্বাজানকে অনুসরণ করে এগিয়ে যাবার সময় ভাবে, খসরু অবাধ্য আর সেই সঙ্গে আহাম্মক, বেদীস্থলটা দুপাশে প্রজ্জ্বলিত মশালের আলোয় আলোকিত।

জাহাঙ্গীর বেদীতে আরোহণ করে এবং বক্তৃতা আরম্ভ করে। আজ রাতে আমাদের নওয়োজ উৎসবের যবনিকাপাত হবে যখন আমরা নতুন চন্দ্র বৎসরকে স্বাগত জানাব। আমার জ্যোতিষীরা আমাকে বলেছে যে আমাদের সাম্রাজ্যের জন্য আগামী বছরটা আরো সমৃদ্ধি বয়ে আনবে। আমার দরবারের মেয়েদের সম্মান জানাবার এখন সময় হয়েছে। রাতের তারা যতক্ষণ না আকাশ থেকে মিলিয়ে যায় তারাই, আমরা নই, এখানের। অধীশ্বর। তারা তাদের দ্রব্যের জন্য যা দাম চাইবে আমরা অবশ্যই সেটাই দিতে বাধ্য থাকবো যদি না আমরা তাঁদের অন্যভাবে ভুলাতে পারি। রাজকীয় মিনা বাজার শুরু হোক।’

জাহাঙ্গীর বেদী থেকে নেমে আসে। খুররমের কাছে মনে হয় যে তার আব্বাজান নামার সময় এম মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়ে তার চারপাশে তাকিয়ে দেখেন যেন নির্দিষ্ট কাউকে তিনি খুঁজছেন, এবং তারপরে তাঁর মুখাবয়বে হতাশার একটা অভিব্যক্তি ফুটে উঠে। কিন্তু জাহাঙ্গীর সাথে সাথে নিজেকে সংযত করে নেন এবং হাসিমুখে মেরুন রঙের মখমল বিছানো একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে যান খুররম চিনতে পারে পারভেজের দুধ-মায়ের একজন সেখানে বিক্রেতা সেজে স্মিত মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পারভেজ আব্বাজানের পিছনেই রয়েছে কিন্তু খুররম দাঁড়িয়ে যায়। পারভেজের এই দুধ-মা দারুণ বাঁচাল মহিলা এবং এই মুহূর্তে তার আর পারভেজের ছেলেবেলা সম্বন্ধে লম্বা গল্প শোনার মানসিকতা তার নেই। তার পরনের কোমর পর্যন্ত আঁটসাট কোটটা ভীষণ ভারি আর অস্বস্তিকর। সে শক্ত কাপড়ের নিচে নিজের চওড়া কাঁধ খানিকটা নমনীয় করতে চেষ্টা করলে টের পায় পিঠের চেটালো অস্থির মাঝ দিয়ে ঘামের একটা ধারা নিচের দিকে নামছে।

খুররম তাঁর আব্বাজানকে অনুসরণ করার চেয়ে আঙিনার নির্জন প্রান্তের দিকে এগিয়ে যায় যেখানে তাঁর ধারণা অপেক্ষাকৃত কমবয়সী মেয়েরা তাঁদের পসরা সাজিয়ে বসেছে। তাদের মাঝে হয়তো কোনো সুন্দরী রয়েছে যদিও এই মুহূর্তে আগ্রা বাজারের বর্তুলাকার নিতম্ব আর ভরাট বুকের এক নর্তকী তার সমস্ত মনোযোগ দখল করে রেখেছে। খুররম তারপরে খেয়াল করে প্রাঙ্গণের দেয়ালের কাছে সাদা জুই ফুলের একটা সুবিস্তৃত ঝাড়ের কাছে প্রায় অন্ধকারের ভিতরে একটা ছোট দোকানে মাটির কিছু জিনিষপত্র বিক্রির জন্য রাখা আছে। দোকানে দীর্ঘাঙ্গি, হালকা পাতলা দেখতে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে মেয়েটার মুখটা দেখতে পায় না কিন্তু মেয়েটা যখন তার দোকানের পসরাগুলো সাজিয়ে রাখছে তখন সে তার চারপাশে আন্দোলিত লম্বা, ঘন চুলে হীরা আর মুক্তার ঝলক লক্ষ্য করে। খুররম আরো কাছে এগিয়ে যায়। মেয়েটা আপনমনে গান গাইছে এবং খুররম যখন দোকানটা থেকে মাত্র কয়েক কদম দূরে এসে দাঁড়ায় তখনই কেবল সে তার অস্তিত্ব টের পায়। বিস্ময়ে মেয়েটার কালো চোখ বড় দেখায়।

খুররম আগে কখনও এমন নিখুঁত মুখশ্রী দেখেনি। আমি তোমায় চমকে দিতে চাইনি। তুমি কি বিক্রি করছো?

মেয়েটা তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উজ্জ্বল নীল আর সবুজ রঙে চিত্রিত একটা ফুলদানি এগিয়ে দেয়। ফুলদানিটা মামুলি হলেও দেখতে খুবই সুন্দর। অবশ্য তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকা ঘন, দীপ্তিময় পাপড়িযুক্ত লাজুক চোখ দুটিকে কোনোভাবেই সাধারণ বলা যাবে না। খুররমের নিজেকে বেকুব মনে হয় এবং তাঁর কথা জড়িয়ে যায় আর সে ফুলদানির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবতে চেষ্টা করে কি বলা যায়।

‘আমি নিজে এটা রং করেছি। আপনার পছন্দ হয়েছে? মেয়েটা জানতে চায়। সে চোখ তুলে মেয়েটার দিকে আবার তাকালে সে দেখে মেয়েটা খানিকটা আমুদে ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে ভাবে, মেয়েটার বয়স কোনোমতেই চৌদ্দ কি পনের বছরের বেশি হবে না। দরবারে আরব বণিকদের আনা মুক্তার মত একটা দীপ্তি মেয়েটার কোমল ত্বকে এবং তাঁর পুরু ঠোঁট গোলাপি রঙের আর কোমল।

‘ফুলদানিটা আমার পছন্দ হয়েছে। তুমি এর দাম কত চাও?

‘আপনি কত দিতে চান? মেয়েটা নিজের মাথা একপাশে কাত করে।

‘তুমি যা চাইবে।

‘আপনি তাহলে একজন ধনবান ব্যক্তি?

খুররমের সবুজ চোখে বিস্ময় ঝলসে উঠে। মেয়েটা কি তাকে প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে এবং তার আব্বাজান যখন কথা বলছিলেন তখন বেদীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেনি? যদি নাও দেখে থাকে, তারপরেও সবাই নিশ্চিতভাবেই যুবরাজদের চেনে… ‘ঠিকই বলেছো আমি যথেষ্ট ধনী।

‘বেশ।

‘দরবারে তুমি কতদিন ধরে রয়েছে?

‘চার সপ্তাহ।’

‘তুমি এর আগে তাহলে কোথায় ছিলে?

‘সম্রাটের সেনাবাহিনীকে আমার আব্বাজান আসফ খান একজন সেনাপতি। সম্রাট তাকে আগ্রা সেনানিবাসের অধিনায়কত্ব দেয়ার পূর্বে তিনি দাক্ষিণাত্যে কর্মরত ছিলেন।

‘আরজুমান্দ… আমি তোমাকে এতক্ষণ একা রাখতে চাইনি…’ মধু-রঙা আলখাল্লায় মার্জিতভাবে সজ্জিত একজন মহিলা দ্রুত এগিয়ে আসে যার কাটা কাটা চেহারার সাথে মেয়েটার মুখের স্পষ্ট মিল রয়েছে। বয়স্ক মহিলাটা সামান্য হাপাচ্ছে কিন্তু খুররমকে দেখার সাথে সাথে তিনি সোজা হয়ে দাঁড়ান এবং মাথা সামান্য নত করেন এবং মৃদু কণ্ঠে বলেন, ‘মহামান্য যুবরাজকে ধন্যবাদ আমাদের দোকানে পদধুলি দেয়ার জন্য। আমাদের পসরাগুলো মামুলি হলেও আমার নাতি সবগুলো নিজের হাতে তৈরি করেছে।

‘সবগুলো জিনিষই দারুণ সুন্দর। আমি সবগুলোই কিনতে চাই। তুমি কেবল দামটা আমায় বলো।’

‘আরজুমান্দ, তোমার কাছে উনি জানতে চাইছেন?

আরজুমান্দকে, যে এতক্ষণ আন্তরিকতার সাথে খুররমকে পর্যবেক্ষণ করছিল, অনিশ্চিত দেখায়, তারপরে সে বলে, একটা সোনার মোহর।

‘আমি তোমায় দশটা দেবো। কর্চি আমার এখনই দশটা মোহর দরকার, খুররম তার কয়েক পা পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সহকারীকে ডেকে বলে। কর্চি সামনে এগিয়ে আসে এবং আরজুমান্দের দিকে স্বর্ণমুদ্রাগুলো এগিয়ে ধরে। না, ওগুলো আমাকে দাও।’ তার সহকারী তার ডান হাতের তালুতে স্বর্ণমুদ্রার একটা স্রোত অর্পণ করে। খুররম ধীরে হাত তুলে ধরে এবং মেয়েটার দিকে মোহরগুলো বাড়িয়ে দেয়। বাতাসের বেগ বেড়েছে এবং

আরজুমান্দকে দেখে মনে হয় চারপাশে আন্দোলিত কাঁচের গোলক থেকে রংধনুর প্রতিটা রং বিচ্ছুরিত যেন তাকে জারিত করেছে। সে তার হাতের তালু থেকে স্বর্ণমুদ্রাগুলো একটা একটা করে তুলে নেয়। তার হাতের তালুর ত্বকে মেয়েটার আঙুলের স্পর্শ তাঁর এযাবতকালের অভিজ্ঞতার মাঝে সবচেয়ে ইন্দ্রিয়গ্রাহী অনুভূতি। চমকে উঠে, সে মেয়েটার মুখের দিকে তাকায় এবং মেয়েটার কালো চোখের তারায় তাকিয়ে নিশ্চিত প্রমাণ দেখে যে সেও একই অনুভূতিতে দগ্ধ। শেষ মুদ্রাটা তুলে নেয়া হতে সে পুনরায় হাত নামিয়ে নেয়। তাঁর কেবলই মনে হয় মেয়েটার ত্বক তাকে স্পর্শ করার যে অনুভূতি তার স্থায়িত্ব যেন অনন্তকালব্যাপী হয়… সহসা তাঁর এই অনুভূতির কারণে সে অনিশ্চিত, বিভ্রান্তবোধ করে।

“তোমাকে ধন্যবাদ।’ সে ঘুরে দাঁড়িয়ে, দ্রুত সেখান থেকে সরে আসে। প্রধান দোকানগুলোর চারপাশে ভিড় করে থাকা কোলাহলরত মানুষের চিৎকার চেঁচামেচির মাঝে ফিরে আসবার পরেই কেবল তার মনে হয় যে সে তার ক্রয় করা দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে আসেনি এবং মেয়েটাও তাকে পেছন থেকে ডাকেনি।

*

খুররমের ঘামে ভেজা বুকে জামিলা ঠাট্টাচ্ছলে হাত বুলায়। আমার প্রভু, আজ রাতে আপনার দেহে বাঘের শক্তি ভর করেছিল। সে আলতো করে তার কানে ঠোকর দেয় এবং তার নিঃশ্বাসে সে এলাচের গন্ধ পায় মেয়েটা চিবাতে পছন্দ করে।

‘এসব বন্ধ করো।’ সে খানিকটা জোর করে তার হাত সরিয়ে দেয় এবং আলতো করে নিজেকে তার আলিঙ্গন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। কাঠের নক্সা করা অন্তঃপট দিয়ে যদিও কক্ষটা, পাশের ঘর যেখানে মেয়েটা অন্যান্য নর্তকীদের সাথে আহার করে, আলাদা করে ঘেরা রয়েছে যেখানে সে রাতের বেলা ঘুমায় কিন্তু সে তারপরেও একজন বৃদ্ধাকে মেঝের এবড়োথেবড়ো হয়ে থাকা মাটিতে প্রবলভাবে শুকনো লতাপাতার তৈরি ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করতে দেখে। মেয়েরা তাদের খদ্দেরদের কাছ থেকে যা আদায় করে তাতে তার বেশ ভালোই দিন চলে যায়।

খুররম একটা ধাতব পাদানির উপরে রাখা মাটির পাত্র থেকে নিজের মুখে পানির ঝাপটা দেয়।

“কি ব্যাপার? আমি কি আপনাকে খুশি করতে ব্যর্থ হয়েছি? জামিলা কথাটা বললেও তার মুখের আত্মবিশ্বাসী হাসি বুঝিয়ে দেয় যে নিজের পারঙ্গমতার বিষয়ে তাঁর মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।

নাহ্। অবশ্যই তুমি ব্যর্থ হওনি।

‘তাহলে কি ব্যাপার? জামিলা তার পার্শ্বদেশ ঘুরিয়ে নিয়ে দাঁড়ায়।

সে তার গোলাকৃতি সুন্দর মুখশ্রী, মেয়েটার নধর, ইন্দ্রিয়পরায়ণতার দিকে চোখ নামিয়ে আনে যে গত ছয়মাস ধরে তার আনন্দসঙ্গী। সে বাজারের পরুষ আবহাওয়া বেশ উপভোগ করে এবং মেয়েরা–এত মুক্ত আর সাবলীল মনে হয় আগ্রা দূর্গে খাজাসারা তার জন্য যেসব রক্ষিতাদের হাজির করতে পারবে তাদের চেয়ে অনেক কম ভীতিকর যেখানে সবসময়ে অসংখ্য চোখ তাকে লক্ষ্য করছে। জামিলা তাকে রতিকর্মের খুটিনাটি শিখিয়েছে। সে আগে ছিল অতিশয়-ব্যগ্র, এক আনাড়ি কিন্তু জামিলা তাকে শিখিয়েছে কীভাবে একজন নারীকে তৃপ্তি দিতে হয় এবং আনন্দদান কীভাবে তার নিজের তৃপ্তি বর্ধিত করতে পারে। মেয়েটার উষ্ণ সুনম্য দেহ, তাঁর উদ্ভাবন কুশলতা তাকে বিমুগ্ধ করতো। কিন্তু এখন সেসব অতীত। সে ভেবেছিল জামিলার সাথে সহবাস করলে হয়তো সে আরজুমান্দের প্রতি নিজের আবিষ্টতা থেকে মুক্তি পাবে কিন্তু সেরকম কিছুই হয়নি। এমনকি সে যখন জামিলার দেহ পরম আবেশে আঁকড়ে ধরেছিল তখনও সে আরজুমারে মুখ দেখতে পেয়েছে। রাজকীয় মিনা বাজার যদিও দুইমাস আগে শেষ হয়েছে, সে আসফ খানের মেয়ের কথা কিছুতেই নিজের মাথা থেকে দূর করতে পারছে না।

‘শয্যায় ফিরে চলেন। আপনার নিশ্চয়ই কিছু শক্তি এখনও অবশিষ্ট আছে এবং আমিও আপনাকে নতুন কিছু একটা দেখাতে চাই…’ জামিলা’র আদুরে কণ্ঠস্বর তাঁর ভাবনার জাল ছিন্ন করে। সে বিছানায় টানটান হয়ে বসে আছে, তার মেহেদী রাঙান স্তনবৃন্ত উদ্ধত, এবং সেও তার দু’পায়ের সংযোগস্থলে পরিচিত সক্রিয়তা অনুভব করে। কিন্তু এটা পুরোটাই হবে কেবল আরো একবার সহবাসের অভিজ্ঞতা। সে আর জামিলা অনেকটা যেন যৌনক্রিয়ায় মিলিত হওয়া দুটি পশু, শীর্ষ অনুভূতির জন্য ক্ষুধার্ত আর উদ্গ্রীব হলেও পরস্পরের প্রতি কারো কোনো আন্তরিক অনুভূতি কাজ করে না। সে যদি তার কাছে না আসতো মেয়েটা তাহলে অন্য কাউকে খুঁজে নিত, এবং সে আর তার নর্তকীর দল যখন আগ্রা ত্যাগ করবে তখন সে সহজেই তার বদলে অন্য কাউকে পেয়ে যাবে। তাদের এই ক্ষিপ্ত সহবাস, একে অন্যকে নিয়ন্ত্রণের উর্ধ্বে পৌঁছে দেয়া, একটা অস্থির বাসনাকে পরিতৃপ্ত করার আকাঙ্খ ছাড়া আর কিছুই নয়। আরজুমান্দের ভাবনা এখন যখন তার মনে সবসময়ে ঘুরপাক খাচ্ছে তখন এসব কিছু তার জন্য আর যথেষ্ট নয়।

*

‘আব্বাজান, আমি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।’

‘কি কথা?’ জাহাঙ্গীর নীলগাইয়ের অণুচিত্রটা সরিয়ে রাখে যা সে নিজের নিভৃত ব্যক্তিগত কক্ষে বসে পর্যবেক্ষণ করছিল। দরবারের পেশাদার শিল্পী প্রতিটা খুঁটিনাটি বিষয় সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছে, এমনকি কৃষ্ণসার মৃগের চামড়ার হালকা নীলাভ আভাস, এর চোখের জটিল আকৃতি… খুররম ইতস্তত করে। আমরা কি একা থাকতে পারি…

‘আমাদের একা থাকতে দাও, জাহাঙ্গীর তাঁর পরিচারকদের আদেশ দেয়। শেষ পরিচারকটার বের হয়ে যাবার পর দরজা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হবার আগেই, খুররম অনেকটা বোকার মত কথা শুরু করে। আমি একজনকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে চাই।’

জাহাঙ্গীর স্থির দৃষ্টিতে নিজের ছেলের দিকে তাকায়–তার এখন প্রায় ষোল বছর বয়স এবং ইতিমধ্যেই একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের মতই লম্বা এবং পেষল দেহের অধিকারী হয়ে উঠেছে। তাঁর আধিকারিকদের ভেতরে খুব জনই তাকে কুস্তি কিংবা তরোয়ালবাজিতে পরাস্ত করার সামর্থ্য রাখে।

‘তুমি ঠিকই বলেছে, জাহাঙ্গীরকে চিন্তাকুল দেখায়। আমার প্রায় তোমার মতই বয়স ছিল যখন আমি আমার প্রথমা স্ত্রীকে গ্রহণ করি কিন্তু আমাদের তাড়াহুড়ো করার প্রয়োজন নেই। আমি বিবেচনা করে দেখবো কে তোমার জন্য যোগ্য পাত্রী হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। জয়সলমিরের রাজপুত শাসকের বেশ কয়েকজন বিবাহযোগ্য কন্যা রয়েছে এবং তাঁর পরিবারের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন আমার হিন্দু প্রজাদের প্রীত করবে। অথবা আমি আমাদের সাম্রাজ্যের সীমানার বাইরেও খুঁজে দেখতে পারি। পারস্যের শাহ পরিবারের কারো সাথে বিয়ে হলে মোগলদের কাছ থেকে কান্দাহার কেড়ে নেয়ার বাসনা ত্যাগ করতে তাকে হয়তো আরো বেশি আগ্রহী করে তুলবে…’ জাহাঙ্গীরের মন দ্রুত ভাবতে শুরু করে। সে তার উজির মাজিদ খানকে ডেকে পাঠাতে পারে এবং তাঁর অন্যান্য কয়েকজন পরামর্শদাতাকেও সম্ভবত ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনার জন্য ডেকে পাঠান যায়। আমি খুব খুশি হয়েছি খুররম, তুমি ব্যাপারটা নিয়ে সরাসরি আমার সাথে আলোচনা করেছো। তোমার প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠার বিষয় এটা দৃশ্যমান করেছে এবং সেই সাথে তুমি আসলেই যে তোমার প্রথম স্ত্রীকে গ্রহণ করার উপযুক্ত হয়ে উঠেছে। আমার আবার এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো যখন আমি বিষয়টা নিয়ে আরো ভালোভাবে চিন্তা করবো–আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, সেটা খুব শীঘ্রই হবে।’

‘আমি আমার স্ত্রী হিসাবে আমার পছন্দের মেয়ে ইতিমধ্যে খুঁজে পেয়েছি।’ খুররমের কণ্ঠস্বর জোরালো শোনায় এবং তাঁর সবুজ চোখের মণিতে আন্তরিক অভিব্যক্তি খেলা করে।

বিস্ময়ে জাহাঙ্গীরের চোখের পাতা কেঁপে উঠে। কে সে?

‘আগ্রায় অবস্থিত আপনার সেনানিবাসের সেনাপতির কন্যা।

‘আসফ খানের মেয়ে? তুমি তাকে কোথায় দেখতে পেলে?

‘রাজকীয় মিনা বাজারে আমি তাকে দেখেছি। তার নাম আরজুমান্দ।

‘মেয়েটার বয়স কত হবে? একজন বিবাহযোগ্যা কন্যার পিতা হিসাবে আসফ খানের বয়স কমই বলতে হবে।

‘মেয়েটা আমার চেয়ে সম্ভবত সামান্য কয়েক বছরের ছোট হবে।

জাহাঙ্গীর ভ্রূকুটি করে। তার প্রথম প্রতিক্রিয়া হয় যে এটা কেবল এক ধরনের তারুণ্যপূর্ণ মোহ–সম্ভবত ব্যাপারটা তাই ছিল–কিন্তু ব্যাপারটা অদ্ভূত। খুররমের নজর কেড়েছে যে কিশোরী সে সম্ভবত মেহেরুন্নিসার ভাস্তি এবং সেই সাথে তাঁর কোষাধ্যক্ষ গিয়াস বেগের নাতনি। বহু বছর আগে গিয়াস বেগ যখন কপর্দকশূন্য অবস্থা আর হতাশা নিয়ে আকবরের দরবারে প্রথমবার আসে তখন তাঁর দাদিজান হামিদা তাকে যা কিছু কথা বলেছিলেন তার মনে পড়ে। কি বলেছিলেন যেন? কথাগুলো অনেকটা এমন ছিল, অনেক ঘটনাই ঘটে যা এলোমেলো মনে হবে, কিন্তু আমি প্রায়শই উপলব্ধি করি আমাদের অস্তিত্বের ভিতর দিয়ে একটা ছক প্রবাহিত হচ্ছে অনেকটা যেন কোনো দিব্য কারিগরের হাত তাঁতে বসে নক্সা বুনছে… একদিন এই গিয়াস বেগ আমাদের সাম্রাজ্যের জন্য হয়ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। তার দাদিজান হামিদার ভবিষ্যতের ঘটনাবলি প্রত্যক্ষবৎ দেখার ক্ষমতা ছিল। তার কথাগুলো কেবল একজন নির্বোধই খারিজ করবে।

‘খুররম। তোমার বয়স এখনও অনেক কম কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি মনস্থির করে ফেলেছে। তোমার হৃদয় যদি এই মেয়েটাকে পাবার জন্য সংকল্পবদ্ধ হয়, আমি তাহলে আপত্তি করবো না এবং তার পরিবার আর আমাদের পরিবারের ভিতরে বৈবাহিকসূত্রে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হবার ইঙ্গিত দিতে আমি নিজে তাঁর আঙুলে বাগদানের অঙ্গুরীয় পরিয়ে দেবো। আমি তোমায় কেবল একটা অনুরোধই করবো যে বিয়ে করার পূর্বে তুমি কিছুদিন একটু অপেক্ষা করো।

জাহাঙ্গীর নিজ সন্তানের চোখে বিস্ময় দেখতে পায়–স্পষ্টতই সে এত সহজে উদ্দেশ্য সাধনের ব্যাপারটা আশা করে নি–কিন্তু তারপরেই সেটা মিলিয়ে গিয়ে আনন্দের হাসিতে পরিণত হয় এবং খুররম তাকে আলিঙ্গণ করে। আমি অপেক্ষা করবো এবং আপনি আর যা কিছু বলবেন সব করবো…’

‘আমি আসফ খানকে ডেকে পাঠাবো। আমাকে তার সাথে অনেক কিছু নিয়ে আলোচনা করতে হবে। ততদিন পর্যন্ত বিষয়টা গোপন রাখবে। তোমার আম্মিজানকেও এ ব্যাপারে এখনই কিছু বলার প্রয়োজন নেই।

খুররম বিদায় নিতে জাহাঙ্গীর যখন কক্ষে আবার একা হয়, সে নিজের মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। খুররমের সাথে তার কথোপকথন অনেক ভাবনার স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করেছে। খুররম মোটেই খসরুর মত না, যার বিশ্বাসঘাতকতা সে এখনও ক্ষমা করতে পারে নি, সে সবসময়েই একজন অনুগত সন্তান যাকে নিয়ে যেকোনো লোক গর্ববোধ করতে পারে। তার ইচ্ছে করে যে খুররমের বয়সে সে যদি এমন আত্মবিশ্বাসী হতে পারতো এবং সেই সাথে নিজের সন্তানকে সে ভালো করে চিনতো, কিন্তু নিজের প্রিয় নাতির জন্য আকবরের চরম পক্ষপাতিত্ব পুরো ব্যাপারটাকে কঠিন করে তুলেছে। আকবরের সংসারে খুররম প্রতিপালিত হয়েছিল। তাঁর দাদাজানই ছিলেন সেই ব্যক্তি–তাঁর নিজের আব্বাজান নয়–যিনি প্রথমবারের মত যুবরাজকে পাঠশালায় নিয়ে যাবার মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু সেসবই এখন অতীতের কথা, এবং সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পিতা আর পুত্র একত্রে প্রচুর সময় অতিবাহিত করার সুযোগ পেয়েছে।

সে যাই হোক, খুররমের অনুরোধে নির্দ্বিধায় রাজি হয়ে সে নিজেই নিজেকে বিস্মিত করেছে। মোগল সাম্রাজ্যের একজন যুবরাজ নিজেই তার স্ত্রী নির্বাচন করতে পারে। আরজুমান্দ যদিও অভিজাত এক পার্সী পরিবারের সন্তান কিন্তু তারপরেও তাঁর নিজের মনে এমন একটা সম্বন্ধের কথার কখনও উদয় হতো না। কিন্তু সে নিজেই খুব ভালো করেই জানে যে, পছন্দ এখানে সবসময়ে পরিণতি লাভ করে না। হুমায়ুন আর হামিদার ক্ষেত্রে এমনটা হয়নি। মেহেরুন্নিসার প্রতি সে যেমন অনুভব করে সেজন্য কেউ তাকে বাধ্য করে নি এজন্যই নিজের সন্তান এভাবে অতিক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে প্রেমে পড়ায় সে তাকে কোনোভাবেই অভিযুক্ত করতে পারে না। গিয়াস বেগের পরিবারের মেয়েরা মনে হয় তাঁর মত লোকদের সম্মোহিত করার ক্ষমতা রাখে, কিন্তু খুররমের মত তাকেও অবশ্যই অপেক্ষা করতে হবে…

১.০৬ নিহন্তার খড়গ

মালকিন, উঠুন।’ কেউ একজন যেন তাঁর কাঁধ ধরে প্রবল ভাবে ঝাঁকাতে থাকে এবং মেহেরুন্নিসার মনে হয় সে কি স্বপ্ন দেখছে, কিন্তু ঘুম ঘুম চোখ খুলে সে নাদিয়াকে তাঁর উপর ঝুঁকে থাকতে দেখে।

‘কি হয়েছে? কেন তুমি আমার ঘুম ভাঙালে?’ পরিচারিকাটা তাঁর শয্যার পাশে রাখা মার্বেলের তেপায়ার উপরে একটা জ্বলন্ত তেলের প্রদীপ রেখেছে এবং কক্ষের আওয়াজির ভিতর দিয়ে প্রবাহিত উষ্ণ বাতাসে এটা কম্পমান একটা কমলা রঙের আভার জন্ম দিয়েছে।

আপনার কাছে একটা চিঠি এসেছে। হেরেমের প্রবেশ দ্বারে যে বার্তাবাহক এটা পৌঁছে দিয়েছে সে বলেছে এটা যেন অবিলম্বে আপনাকে দেয়া হয়। মেহেরুন্নিসা খেয়াল করে পরিচারিকা কথাগুলো বলার সময় কৌতূহলের কারণে প্রায় থরথর করে কাঁপছে। সে বিছানায় উঠে বসে, তাঁর হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন সহসাই বেড়ে গিয়েছে এবং নাদিয়ার হাত থেকে তার জন্য ধরে রাখা সীলমোহর করা কাগজটা নেয়। রাতের অন্ধকারে যে সংবাদ আসে সেটা কেবল দুঃসংবাদই হতে পারে। সে যখন চিঠিটার ভাঁজ খুলছে তখন তাঁর আঙুল মৃদু কাঁপে এবং সে তার ভাইঝির ঝরঝরে হস্তাক্ষর দেখা মাত্র চিনতে পারে। চিঠিটা খুব ব্যস্ততার মাঝে লেখা হয়েছে। পুরো চিঠিটা বেমানান কালির দাগ আর বেশ কয়েকটা শব্দ কেটে দেয়া হয়েছে।

ফুপিজান, ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটেছে। আমার আব্বাজান সামরিক প্রয়োজনে দিল্লি গিয়েছেন এবং আমার আর আমার দাদিজানের পক্ষে আর কারো মুখাপেক্ষী হওয়া সম্ভব নয়। আজ রাতের বেলা আমি যখন দূর্গে আমার পিতামহের আবাসস্থলে অবস্থান করছিলাম তখন প্রহরীরা আমার দাদাজানকে গ্রেফতার করতে এসেছিল। তারা দাবি করে গোয়ালিওরে নিজের কারাপ্রকোষ্ঠ থেকে সম্রাটকে হত্যা করার অভিপ্রায়ে যুবরাজ খসরু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটা ষড়যন্ত্রে তাঁর ভূমিকা রয়েছে এবং রাজকীয় কোষাগার দখল করতে তাঁর সাহায্যের জন্য খসরু তাকে তাঁর উজির হিসাবে নিয়োগ করে তাকে পুরস্কৃত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তুমি ভালো করেই জানো আমার দাদাজান কেমন মানুষ–সবসময়েই ভীষণ শান্ত, ভীষণ সম্মানিত। তিনি আমাদের দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করে নিরবে তাঁদের সাথে গিয়েছেন কিন্তু আমি ঠিকই দেখেছি তিনি কতটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন এবং সেইসাথে তিনি ভয়ও পেয়েছেন।

চিঠিতে আরও কিছু লেখা রয়েছে, কিন্তু মেহেরুন্নিসা ইতিমধ্যে যতটুকু পড়েছে সেটুকুই সে টায়টোয় কোনোমতে আত্মীভূত করে। তার আব্বাজান গিয়াস বেগ, যিনি প্রথমে আকবর আর পরবর্তীতে জাহাঙ্গীরের অধীনে দুই দশকের বেশি সময়কালব্যাপী এমন বিশ্বস্ততার সাথে দায়িত্ব পালন করে আসছেন, তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে সম্রাটকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করার কারণে… এটা একেবারেই অসম্ভব। তাঁর মুহূর্তের জন্য মনে হয় সে এখনও বোধহয় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন রয়েছে এবং পুরো ব্যাপারটাই একটা অদ্ভুত দুঃস্বপ্ন, কিন্তু মুশকিল হল আশেপাশেই কোথাও একটা মশা উচ্চ স্বরগ্রামে ক্লান্তিকরভাবে গুনগুন করছে আর নাদিয়া সবসময়ে যে সুগন্ধি ব্যবহার করে থাকে সেটার তীব্র কস্তুরি গন্ধ, সন্দেহাতীতভাবে বাস্তব।

‘এটা কি? আশা করি কোনো দুঃসংবাদ নেই? নাদিয়া জানতে চায়, তার চোখ উত্তেজনায় চক চক করছে।

‘আমাদের পারিবারিক একটা ব্যাপার। তুমি এখন যেতে পারো, কিন্তু প্রদীপটা রেখে যাও আমি যেন পড়ার জন্য আলো পেতে পারি।’

মেহেরুন্নিসা যখন নিশ্চিত হয় যে পরিচারিকা বাস্তবিকই চলে গিয়েছে সে তার মুখের উপর থেকে নিজের লম্বা কালো চুলের গোছা সরিয়ে নিয়ে পুনরায় আরজুমান্দের লেখা চিঠিটার দিকে তাকায়, ধীরে ধীরে চিঠিটার পুরো বিষয়বস্তু আত্মস্থ হতে আরম্ভ করতে তাঁর হাত পায়ের রক্ত নিস্তেজ হয়ে আসতে থাকে। তাঁর আব্বাজানের জীবন হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর তাঁদের পুরো পরিবার ধ্বংস কিংবা আরো মারাত্মক পরিণতির মুখোমুখি এসে উপনীত হয়েছে। যুবরাজ খুররমের সাথে আরজুমান্দের বিয়ের ধারণাই এখন হাস্যকর হয়ে পড়েছে, এবং তাঁর নিজের আশা আকাঙ্খও… সে এক মুহূর্তের জন্য তখনও আন্দোলিত হতে থাকা জরির কারুকাজ করা পর্দার দিকে ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারে না, প্রতি মুহূর্তে তার কেবলই মনে হতে থাকে যেকোনো মুহূর্তে পর্দার নাজুক কাপড় একপাশে সরিয়ে হেরেমের প্রহরী আর খোঁজার দল ঝড়ের বেগে ভেতরে প্রবেশ করবে তাকেও গ্রেফতার করতে।

তাকে এখন অবশ্যই মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। আরজুমান্দের চিঠিখানা শক্ত করে ধরে সে পড়তে থাকে। আমার দাদাজানকে তাঁরা নিয়ে যাবার সময় সেখানে আগত প্রহরীদের একজন তাকে বলেছিল, আপনার ছোট ছেলে মীর খানকে দুই দিন পূর্বে একই অভিযোগে গোয়ালিওরে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় আগ্রায় নিয়ে আসা হয়েছে। দুশ্চিন্তায় আমার দাদাজান প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ফুপুজান দয়া করে আমাদের সাহায্য করেন। আমাদের কর্তব্য করণীয় সম্পর্কে সত্ত্বর আমাদের অবহিত করবেন। চিঠিটার শেষে দ্রুত টানে আরজুমান্দ লেখা।

মেহেরুন্নিসা শয্যা থেকে উঠে দাঁড়ায় এবং চিঠিটা যত্নের সাথে ভাঁজ করে তেপায়ার উপরে তেলের প্রদীপের পাশে রাখে। সে তারপরে মন্থর পায়ে হেঁটে বাতায়নের কাছে যায় এবং সূর্যের তাপে তখনও উত্তপ্ত হয়ে থাকা বেলেপাথরের সংকীর্ণ পার্শ্বদেশে হাত রাখে। সে নিচের দিকে তাকিয়ে দু’জন মহিলা প্রহরীকে হেরেমের আঙিনায় পরিক্রমণ করতে দেখে, তাদের আলকাতরায় চোবানো ছেঁড়া কাপড়ের মশালের আলোয় তাদের চারপাশে নৃত্যরত ছায়ারা ছড়িয়ে যায়। দরবারের সময়রক্ষক, ঘড়িয়ালীকে সে কাছাকাছি কোথাও থেকে ঘণ্টার সংকেত ধ্বনি করতে শুনে–একবার, দুইবার, তিনবার… সে আকাশের দিকে তাকালে সেখানে আকাশের মসিকৃষ্ণ গভীরতার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে উজ্জ্বল তারকারাজির অসংখ্য নক্সা ছড়িয়ে থাকতে দেখে। পৃথিবীর সমস্যাবলী থেকে এত দূরবর্তী, তারকারাজির দূরাগত শীতল সৌন্দর্য কীভাবে যেন তাঁর মাঝে শক্তি জোগায়, তাকে শান্ত করে এবং আরো পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে তাকে সাহায্য করে।

তাঁর আব্বাজান গিয়াস বেগ, সম্মান আর অতিমাত্রায় অনুগত, নিরপরাধ, সে নিশ্চিত। তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ সেটা নিঃসন্দেহে ভুল বোঝাবুঝি কিংবা ঈর্ষাপ্রসূত। কিন্তু তাঁর ছোট ভাই মীর খানের অভিযোগের বিষয়টার ব্যাখ্যা কি হতে পারে? সে নিশ্চিতভাবে কিছুই বলতে পারে না। কাবুলে তাঁরা একসাথে বড় হয়েছে। সে সবসময়েই জানে যে তার এই ছোটভাইটা তার কিংবা আসফ খানের মত বুদ্ধিমান–কিংবা তাদের মত মানসিক শক্তির অধিকারী হয়নি। মীর খান আত্মাভিমানী এবং নিজের এই সীমাবদ্ধতা সে কখনও স্বীকার করে না। সে খুব ভালো করেই জানে তাকে কত সহজে ভুল পথে পরিচালিত করা সম্ভব। তারা যখন ছোট ছিল তখন কতবার যে সে তাকে তার নিজের নয় বরং তার স্বার্থে তাকে হঠকারী কাজে প্রলুব্ধ করেছে। তার জন্য ফল সংগ্রহ করতে ভাইকে সে একবার খুবানির গাছের পচা ডাল বেয়ে উঠতে প্ররোচিত করেছিল মনে পড়তে সে আপন মনে হেসে উঠে। সেই ডাল তার ভাইকে নিয়ে নিচে ভেঙে পড়েছিল।

অনেকদিন আগের সেসব কথা। মীর খানের এতদিনে বিচক্ষণ আর বিবেচক হবার কথা, কিন্তু আসাফ খান যেমন অল্প বয়সেই উন্নতি করেছিলেন তেমন সাফল্য সে লাভ করে নি। হতাশা, বড় ভাইয়ের সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে আর হতাশার কারণেই কি বিশাল পুরষ্কারের মিষ্টি প্রলোভনে ভুলে সে অবাস্তব কোনো ষড়যন্ত্রে সামিল হয়েছিল? তাঁর জানার কোনো উপায় নেই। তাঁর ছোট ভাই তাঁদের আব্বাজান গিয়াস বেগের মতই নিরপরাধও হতে পারে। তাকে বিচার করতে গিয়ে সে কোনো ধরনের তাড়াহুড়ো করতে চায় না। এখন কি করণীয় সেটাই বরং ঠাণ্ডা মাথায় আর যুক্তি সহকারে ঠিক করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর নিজের এবং তার পরিবারের ভাগ্য–এমনকি হয়তো তাঁদের জীবন–এখন একটা সরু সুতার মাথায় ঝুলছে। তার এখন কোনোভাবেই হঠকারীতা প্রদর্শন করা চলবে না, কিন্তু হাত পা গুটিয়ে বসে থাকাটা হয়তো প্রাণঘাতি প্রতিপন্ন। হতে পারে…

সে দিল্লিতে আসাফ খানকে সবকিছু জানিয়ে চিঠি লিখতে পারে। তিনি হয়তো ইতিমধ্যেই এখানকার পরিস্থিতি সম্বন্ধে অবহিত হয়েছেন এবং এই মুহূর্তে আগ্রার পথে ঘোড়া নিয়ে ধুলোর ঝড় তুলে ছুটে আসছেন। তাঁরা একসাথে বসে সিদ্ধান্ত নিবে তাঁদের পরিবারকে এই বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচাতে তাঁদের কি করা উচিত। তাছাড়া এই ষড়যন্ত্রে তিনিও হয়তো জড়িয়ে পড়েছেন এবং এখন হয়তো বন্দি রয়েছেন। নাহ্, আসাফ খানের ভাগ্যে কি ঘটেছে সেটা জানার জন্য সে অপেক্ষা করবে না। তাকে এবং তাকে একলাই যা করার করতে হবে।

নিজের ছোট কক্ষে প্রায় ঘন্টাখানেক অস্থিরভাবে পায়চারি করার পরে, দিগন্তের কোণে ভোরের ধুসর আলোর রেখা উঁকি দিতে মেহেরুন্নিসা পা আড়াআড়িভাবে রেখে তার লেখার টেবিলের সামনে এসে বসে। সে সবুজ অনিক্স পাথরের দোয়াতদানিতে–তাঁর আব্বাজান দোয়াতদানিটা তাকে উপহার দিয়েছিল–নিজের কলমটা ডুবিয়ে নিয়ে আরজুমান্দের উদ্দেশ্যে দ্রুত কয়েকটা কথা সাজিয়ে লিখে। তোমার আব্বাজান ফিরে আসা পর্যন্ত আমার দাদিজানের কাছে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করো এবং আমার কাছ থেকে পুনরায় কোনো সংবাদ না পাওয়া পর্যন্ত কিছু করবে না। আমার উপরে আস্থা রাখো। সে লেখাটা শেষ করেই ভিজা কালি শুষে নেয়ার জন্য বালির মিহিগুড়ো সেটার উপরে ছিটিয়ে দিয়ে, কাগজটা ভাজ করে এবং গালার লম্বা একটা টুকরো উত্তপ্ত করে সেটা ফোঁটায় ফোঁটায় ভজের উপরে ফেলে এবং নিজের মোহর দিয়ে সেটার উপরে ছাপ দেয়, পারস্যে বহু শতাব্দি যাবত তাঁদের পরিবারে ব্যবহৃত ঈগলের প্রতীক মোহরটায় খোদাই করা রয়েছে। সে মোহরটা কদাচিত ব্যবহার করে কিন্তু এখন ব্যবহার করলে কারণ তাঁদের পরিবারের গৌরবোজ্জল দীর্ঘ অতীতের কথা অহঙ্কারী ঈগলটা, সে যা করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিন্তু আরজুমান্দের কাছে প্রকাশ করে নি সেটা করার জন্য পদক্ষেপ নিতে তাকে সাহস জোগায়।

সে পুনরায় দোয়াতদানি থেকে লেখনীটা তুলে নিয়ে জাহাঙ্গীরের উদ্দেশ্যে আরেকটা চিঠির মুসাবিদা শুরু করে। মহামান্য সম্রাট, আপনাকে এই চিঠি লেখার সাহস আমার কখনও হতো না যদি না আমার পরিবারের প্রতি আমার ভালোবাসা এবং তাঁদের সম্মান রক্ষার জন্য তাঁদের প্রতি আমার ভিতরে একটা কর্তব্যবোধ কাজ করতো। মহামান্য সম্রাট, অনুগ্রহ করে আমাকে একবার দেখা করার অনুমতি দেন। গিয়াস বেগের কন্যা, মেহেরুন্নিসা। সে চিঠিটার আবার ভাঁজ করে এবং গালা গরম করে আর কিছুক্ষণ পরে রক্ত-লাল গালার নরম ফোঁটায় গলে পরতে শুরু করে।

*

যন্ত্রণাদায়ক মন্থরতায় দিনটা অতিবাহিত হতে থাকে। চারপাশ অন্ধকার করে শীঘ্রই সন্ধ্যা নামবে। মেহেরুন্নিসা ভাবে, সবাই নিশ্চয়ই জানে কি হয়েছে। ফাতিমা বেগম আজ তাকে ডেকে পাঠান নি। বাস্তবিকপক্ষে কেউই তাঁর কাছেই আসে নি, এমনকি সদা-উৎসুক নাদিয়ারও আজ কোনো পাত্তা নেই। তাদের ভিতরে নিশ্চয়ই গিয়াস বেগের পরিবারের সাথে বেশি খাতিরের ব্যাপারে একটা ভয়ের সংক্রমণ ঘটেছে, তার মানে এই না যে সেও বিষয়টা পাত্তা দেয়। একজন পরিচারিকাকে চিঠির সাথে একটা স্বর্ণমুদ্রা ঘুষ দিয়ে এবং জাহাঙ্গীরের উজির মাজিদ খানের কোনো পরিচারিকার হাতে চিঠিটা পৌঁছে দিতে বলে সাথে এটাও বলবে যে গিয়াস বেগের মেয়ের কাছ থেকে চিঠিটা এসেছে, কিন্তু তারপরেও জাহাঙ্গীরের কাছে চিঠি লেখার পরে প্রায় বারোঘন্টা অতিবাহিত হতে চলেছে। মাজিদ খানের বিষয়ে সে যা কিছু শুনেছে তার মনে হয়েছে যে মাজিদ খান একটা বিবেকসম্পন্ন মানুষ, যিনি গত কয়েকমাস যাবত তাঁর আব্বাজানের বাসার একজন নিয়মিত অতিথি ছিলেন, কিন্তু তিনিও এখন হয়তো গিয়াস বেগের সাথে একটা দূরত্ব বজায় রাখবেন। উজির মহাশয় একটা জ্বলন্ত মোমবাতির শিখায় চিঠিটা ধরে রেখে, তাঁর শেষ আশাটাও ভষ্ম করে দিচ্ছে সে কল্পনা করে।

‘এই মুহূর্তে আমার সাথে চলেন। মেহেরুন্নিসা চমকে ঘুরে তাকায়। খাজাসারাকে প্রবেশ করতে সে শুনেনি এবং মালাকে তাঁর কাছ থেকে মাত্র চার ফুট দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে কেঁপে উঠে। সে তার হাতের কর্তৃত্বের নিদর্শনসূচক দণ্ড দিয়ে দরজার দিকে ইঙ্গিত করার সময় তাঁর চোখে মুখে একটা আবেগহীন অভিব্যক্তি ফুটে থাকে। মেহেরুন্নিসার পরনে নীল রেশমের তৈরি তাঁর সবচেয়ে সুন্দর আলখাল্লা রূপার জরি দিয়ে যার উপরে সোলোমী ফুলের নক্সা করা ভাগ্যক্রমে যদি সম্রাট দেখা করার জন্য তাকে ডেকে পাঠান সেই কথা ভেবে, কিন্তু মালার কঠোর মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে তাঁর সন্দেহ হয় যে মালা আদতেই তাকে সেজন্যই ডাকতে এসেছে। রাজকীয় হেরেম থেকে সে সম্ভবত বহিস্কৃত হতে চলেছে, সেক্ষেত্রে সে কোনোভাবেই নিজের প্রিয় জিনিষগুলো যেমন অনিক্সের সবুজ দোয়াতদানি আর বিশেষ করে তাঁর অলঙ্কারগুলো ফেলে যাবে না। সে দামী একটা কাশ্মিরী শাল, আসাফ খান তাকে দিয়েছিলেন, তুলে নিয়ে নিজের অলঙ্কারের বাক্সের দিকে হাত বাড়ালে খাজাসারা তখন অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে বলে, কিছু নিতে হবে না। তুমি যেভাবে রয়েছে ঠিক সেভাবেই আমার সাথে এসো। নিজেকে কেবল অবগুণ্ঠিত করে নাও।

মেহেরুন্নিসা শালটা নামিয়ে রাখে এবং নেকাব বেঁধে নিয়ে নিজের চোখ আজ্ঞানুবর্তীভাবে নত করে রাখে। মালার সবুজ আলখাল্লায় আবৃত লম্বা অবয়বকে অনুসরণ করে নিজের আবাসন কক্ষ থেকে বের হয়ে এসে, দরদালান দিয়ে এগিয়ে গিয়ে হেরেমের আঙিনা অতিক্রম করার সময়, যেখানে ইতিমধ্যেই সাঁঝের ঝাড়বাতি জ্বালান হয়েছে, সে ভাবে আমার জীবনের তাহলে এভাবেই সমাপ্তি ঘটবে। তীর্যক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে, কটু মন্তব্য শুনে, কান্নায় তাঁর চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে কিন্তু সে সবকিছু ঝেড়ে ফেলে ধীরে সুস্থে গর্বিত ভঙ্গিতে মাথা তুলে দাঁড়ায়। খাজাসারা যদিও দ্রুত হেঁটে যাচ্ছে কিন্তু বেত্রাহত কুকুরের মত তাড়াহুড়ো করে সে হেরেম থেকে বের হয়ে যাবে না।

কিন্তু তখনই সে খেয়াল করে যে তাঁদের ঠিক উল্টো দিকে অবস্থিত হেরেমের দরজার দিকে মালা তাকে নিয়ে যাচ্ছে না। সে বরং দ্রুত বামদিক দিকে বাঁক নেয় এবং নিচু ধাপ বিশিষ্ট একপ্রস্থ সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায় যা দূর্গের এমন একটা অংশের দিকে উঠে গিয়েছে মেহেরুন্নিসা আগে কখনও দেখেনি। তার বক্ষপিঞ্জরের সাথে তার হৃৎপিণ্ড ধাক্কা খায়। মালা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? খাজাসারা সিঁড়ির একেবারে উপরের ধাপে পৌঁছে থামে এবং কাঁধের উপর দিয়ে পিছনের দিকে ঘুরে তাকায়। ‘পা চালিয়ে এসো। মেহেরুন্নিসা তাঁর নীল আলখাল্লার ঝুল সামলে নিয়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু করে। সে উপরে উঠে এসে একটা প্রশস্ত চতুরে নিজেকে আবিষ্কার করে। ঠিক উল্টো দিকে দুই পাল্লা বিশিষ্ট উঁচু একটা দরজা যার গায়ে কমদামি পাথর বসান রূপার পাতা ঝলমল করছে। মালা দরজার বাইরে প্রহরারত চারজন রাজপুত প্রহরীকে দ্রুত কিছু একটা বলার সময় মেহেরুন্নিসার দিকে ইঙ্গিত করে।

প্রহরীরা দরজার পাল্লা খুলে দেয়। মালা দরজার নিচে দাঁড়িয়ে মেহেরুন্নিসার এগিয়ে আসবার জন্য অপেক্ষা করে, তারপরে তাঁর কব্জি আঁকড়ে ধরে তাকে নিয়ে দু’পাশে বুটিদার রেশমের পর্দা দেয়া একটা প্রশস্ত অলিন্দ দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। পুরুষ ময়ুরের মত দেখতে, যার ছড়ান পেখমে পান্না আর নীলা বসান, সোনার দাহকে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা ধূপ আর মশলার সুগন্ধে অলিন্দের বাতাস ভারি হয়ে আছে। তাদের সামনে আরো একজোড়া দরজা পেছনের দরজার চেয়ে আরও উঁচু আর চওড়া আর পাল্লার উপরে সোনার পাতের উপরে কচ্ছপের খোলা আর হাতির দাঁতের কারুকাজ করা। দরজার সামনে ইস্পাতের ফলাযুক্ত বর্শা হাতে দশজন রাজপুত প্রহরী ঋজু আর স্থির ভঙ্গিতে সামরিক কায়দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। ‘আমরা কোথায় এসেছি?’ সে মালার কাছে ফিসফিস করে জানতে চায়।

রাজকীয় হেরেমে মহামান্য সম্রাটের এটা ব্যক্তিগত প্রবেশ পথ। এই দরজা দিয়ে তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষে যাওয়া যায়।

‘তুমি আমাকে সম্রাটের কাছে নিয়ে চলেছো?

‘হ্যাঁ। তোমার সাথে কি করা হবে সন্দেহ নেই তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন।

মেহেরুন্নিসা কিছুই শুনতে পায় না। সে সম্রাটের সামনে উপস্থিত হবার পূর্বে মূল্যবান সময়ের যতটুকু অবশিষ্ট রয়েছে সেই অবসরে জাহাঙ্গীরের কাছে চিঠিটা লেখার পর থেকেই তাকে বলার জন্য সে নিজের মনে যে কথাগুলো আউড়ে এসেছে সেগুলোই আরেকবার স্মরণ করে নেয়। বিশাল দরজাটার সোনালী পাল্লা দুটো এখন ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে। মালা একপাশে সরে দাঁড়ায় এবং তাকে একলাই সামনে এগিয়ে যেতে হবে। সে মাথা উঁচু করে দরজার নিচে দিয়ে এগিয়ে যায়।

বিশাল কক্ষের দূরবর্তী প্রান্তে সম্রাট একটা নিচু মঞ্চে উপবিষ্ট। মেহেরুন্নিসা আশা করেছিল কর্চি, পরিচারকদের, এমনকি প্রহরীও হয়তো দেখতে পাবে সম্ভাব্য বিশ্বাসঘাতকের মেয়ে আর বোনের হাত থেকে সম্রাটকে সুরক্ষিত রাখতে, কিন্তু কক্ষে তারা দু’জন ছাড়া আর কেউ নেই। বাতায়ন দিয়ে আগত আলোয় দীর্ঘায়িত হতে থাকা ছায়া আর মোমবাতির কাঁপতে থাকা আলোর কারসাজিতে তাঁর পক্ষে জাহাঙ্গীরের অভিব্যক্তি বোঝাটা কঠিন করে তুলে। সে তাঁর কাছ থেকে তখনও পনের ফিট দূরে থাকার সময়ে, মেহেরুন্নিসা যেমন ঠিক করে রেখেছিল সেভাবেই মুখ নিচের দিকে রেখে তাঁর সামনে ছুঁড়ে দেয়, তাঁর খোলা চুল তার চারপাশে উড়ছে। সেইসাথে সে তার পরিকল্পনা অনুসারে জাহাঙ্গীর কথা বলা পর্যন্ত অপেক্ষা করে না।

‘সম্রাট আমার সাথে দেখা করার মহানুভবতা প্রদর্শনের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি এখানে এসেছি আপনার সামনে আমার আব্বাজান গিয়াস বেগের পক্ষে সাফাই দিতে। আমি আমার জীবনের দিব্যি দিয়ে বলতে পারি যে আপনার, তাঁর শুভাকাঙ্খি, যিনি তাকে সবকিছু দিয়েছেন, ক্ষতি হয় এমন কোনো কিছু তিনি কখনও করবেন না। আমার আব্বাজান কখনও নিজের পক্ষে সাফাই দিবেন না তাই আমাকেই সেটা করতে হলো। আমি কেবল ন্যায়বিচার কামনা করছি।’ মেহেরুন্নিসা স্থির হয়ে পুরু গালিচায় মুখটা আরো গুঁজে দিয়ে, দুই হাত দু’পাশে ছড়িয়ে, যেভাবে ছিল সেভাবেই থাকে।

তাঁর সামনের ছায়াচ্ছন্ন বেদীতে উপবিষ্ট লোকটার কাছ থেকে কোনো শব্দ ভেসে আসে না। সে মাথা তুলে তাকাবার ইচ্ছাকে জোর করে দমন করে কিন্তু সে যখন কেবল ভাবতে শুরু করেছে যে তার দিকে না তাকিয়ে তার পক্ষে আর থাকা সম্ভব না ঠিক তখনই তার শক্তিশালী হাত নিজের বাহু নিচে সে অনুভব করে, তাকে পায়ের উপরে দাঁড় করাবার জন্য তুলছে। সে চোখ বন্ধ করে থাকে। তিনি যখন তাঁর এত কাছে অবস্থান করছেন তখন সে তার মুখে করুণার পরিবর্তে দোষারোপের অভিব্যক্তি দেখবে সেই ভয়ে চোখ খুলে তার মুখের দিকে তাকাতে পারে না। তাঁর কাঁধ থেকে হাত সরে যায় কিন্তু তারপরেই সে টের পায় তিনি তাঁর নেকাবের একটা পাশ সরিয়ে দিচ্ছেন। সে চোখ খুলে তাকায় এবং জীবনে দ্বিতীয়বারের মত তার চোখে চোখ রাখে। কাবুলে বহু বছর আগে দেখার পর থেকে তার মনে গেঁথে থাকা সেই মুখ সে সামনে দেখতে পায়। মুখাবয়বে বয়সের ছাপ পড়ায় আরও বেশি সুদর্শন দেখায় কিন্তু এই মুহূর্তে সেখানে কঠোর আর শীতল একটা অভিব্যক্তি ফুটে রয়েছে যার দিকে তাকিয়ে সে সহসাই অসুস্থবোধ করে এবং নিস্তেজ হয়ে যায়। জাহাঙ্গীর তার দিকে আগ্রহের সাথে তাকিয়ে কিন্তু তাঁর ভাবনার বিন্দুমাত্র চিহ্ন মুখে ফুটে উঠে না। সে কয়েক মুহূর্ত পরে ঘুরে দাঁড়ায় এবং নিজের বেদীতে উঠে সেখানে পুনরায় আসন গ্রহণ করে। আপনার আব্বাজান আর ভাইজান দু’জনকেই জেরা করা হয়েছে।’

‘আমার আব্বাজান কোনো অপরাধ করতে পারেন না, মেহেরুন্নিসা নিজের কণ্ঠস্বর শান্ত আর সংযত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে কোনোমতে বলে। কে তাকে অভিযুক্ত করেছে?

‘গোয়ালিওর দূর্গের প্রধান আধিকারিক। তাঁর গুপ্তচরেরা আড়িপেতে আমার ছেলেকে আপনার ভাই মীর খানের সাথে আলোচনা করতে শুনেছে যে পারস্যের শাহের কাছে যদি কান্দাহার সমর্পণের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় তাহলে কি সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে আমাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সাহায্য করতে তিনি রাজি হবেন। আপনার ভাই উত্তর দেয় যে পারস্যের রাজদরবারে গিয়াস বেগের এখন প্রভাব রয়েছে… সে ইঙ্গিত দেয় সে তাকে ষড়যন্ত্রে অংশ নিতে হয়তো রাজি করাতে পারবে।’

মেহেরুন্নিসার মুখ ক্রোধে রক্তিম হয়ে উঠে। সে চোখের সামনে পুরো পরিস্থিতিটা স্পষ্ট দেখতে পায় একজন যুবরাজের বিশ্বাসভাজন হতে পারার গর্বে মীর খান এতটাই উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে যে সে যেকোনো কিছু করবে বা বলবে…মেহেরুন্নিসা থুতনি উঁচু করে। এমন একটা ধারণা ঘৃণার অযোগ্য। মীর খান কেবল নিজেকে একজন কেউকেটা হিসাবে জাহির করতে চেয়েছে। আমি ভূমিষ্ঠ হবার আগেই আমার আব্বাজান পারস্য ত্যাগ করেছেন। তিনি পারস্যের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন মোগল সাম্রাজ্যের একজন আধিকারিক নিযুক্ত হবার পরে আর যোগ্যতার সাথেই তিনি নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাকে যদি ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত করা সম্ভবও হয়–যা তিনি কোনোভাবেই হবেন না–আর পুরো বাপারটা কোনো অর্থ বহন করে না যেখানে তার নাতনির সাথে যুবরাজ খুররমের বিয়ের হতে চলেছে সেখানে আপনার বিরুদ্ধে আপনার অন্য সন্তানকে সমর্থন করে তাঁর কি লাভ?

জাহাঙ্গীর তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মেহেরুন্নিসা ভাবে তার জন্য যদি এখনও কোনো অনুভূতি তার ভিতরে অবশিষ্ট থাকেও সেটা তিনি ভালোভাবেই গোপন রেখেছেন।

‘আপনার কথায় যুক্তি রয়েছে কিন্তু আপনি এতটা উত্তেজিত হয়ে তর্ক করার আগেই আমি ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে ষড়যন্ত্রের বিষয়ে গিয়াস বেগ কিছুই জানেন না, জাহাঙ্গীর অবশেষে কথা বলে। আমি তাকে বহুদিন ধরেই চিনি এবং বিশ্বাস করি তিনি একজন সৎ লোক।

মেহেরুন্নিসা ভাবে, আমার আব্বাজান নিরাপদ। তার চারপাশের সবকিছু এক নিমেষের জন্য মনে হয় যেন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে উঠে এবং সে নিজের চোখের উপর হাত রাখে, নিজেকে শক্ত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে।

কিন্তু আপনার ভাইয়ের ব্যাপারে এটা প্রযোজ্য নয়…’

‘আমার ভাইজান…’।

‘মীর খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। সে প্রথমে যদিও সবকিছু অস্বীকার করেছিল, একটা সময় পরে… জেরার একটা পর্যায়ে… সে স্বীকার করে যে আমার বিশ্বাসঘাতক সন্তান যুবরাজ খসরু তাকে বিপুলভাবে পুরস্কৃত করার লোভ দেখিয়ে আমার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্রে তাকে অংশ গ্রহণ করতে বলে এবং সে রাজি হয়।

মেহেরুন্নিসা কথা বলে না।

‘আপনি এখানে ন্যায়বিচার চাইতে এসেছেন। এইমাত্র আপনি প্রমাণ করেছেন যে আপনি কতটা বিবেচনাবোধের অধিকারী। আমার স্থানে আপনি থাকলে কি করতেন?

সে কোনো কথা না বলে গাঢ় নীলের জমিনে ঘন লাল ফুলের নক্সা করা পুরু গালিচার দিকে তাকিয়ে থাকে যখন হাসতে হাসতে খুবানি গাছের পচা ডাল বেয়ে এগিয়ে গিয়ে তার জন্য কয়েকটা ফল পারতে এগিয়ে যাওয়া উৎফুল্ল, ভাবনাহীন মীর খানের বালক বয়সের স্মৃতি, তাকে প্রায় দৈহিক যন্ত্রণায় বিদ্ধ করে। সম্রাট। তার কণ্ঠস্বর শান্ত, সংযত, আতঙ্কের লেশমাত্র নেই সেখানে। আপনার সামনে পছন্দের কোনো সুযোগ নেই। মীর খান একজন বিশ্বাসঘাতক। তাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করুন। আপনার স্থানে আমি থাকলে তাই করতাম।

‘আপনি চিঠিটে আপনার পরিবারের প্রতি আপনার ভালোবাসার কথা উল্লেখ করেছেন। ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য পরামর্শ দেয়াটা কি একজন স্নেহময়ী বোনের উপযুক্ত কাজ?

‘পারস্যে একটা প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে: “একটা গাছে যদি বাছে ফল ফলে তাহলে বাগান বাঁচাতে হলে গাছটা কেটে ফেল।” মীর খান তাঁর সম্রাট হিসাবে আপনার প্রতি নিজের কর্তব্য পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং সেই সাথে নিজের পরিবারের প্রতিও সে তার দায়িত্ব পালন করে নি। সে একটা কীট আক্রান্ত বৃক্ষ। তাঁর বাকি পরিবার হল প্রবাদে উল্লেখ করা উদ্যান।

‘বেশ কথা। আপনার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ হবে। জাহাঙ্গীর ঝুঁকে পড়ে তার পেছনে রাখা পিতলের একটা ঘন্টা তুলে নিয়ে সেটা বেশ জোরে বাজায়। ঘন্টার ধাতব শব্দ দুই কি তিনবার বোধহয় ধ্বনিত হয়েছে বেদীর ডানদিকে অবস্থিত একটা দরজা দিয়ে একজন কর্চি কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে।

‘আদেশ করুন, সম্রাট?

‘বিশ্বাসঘাতক মীর খানকে আমার সামনে হাজির করা হোক।’

মেহেরুন্নিসা কিংবা বেদীর উপরে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা জাহাঙ্গীর কেউ কোনো কথা বলে না অপেক্ষার সময়গুলো যখন অতিবাহিত হয়। নিজের জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘতম বিপর্যয়ের পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য সে নিজেকে প্রস্তুত করে। এখন বোধহয় সন্ধ্যা সাতটা বাজে–আরজুমান্দ বানুর আতঙ্কিত চিঠি নাদিয়া তাকে পৌঁছে দেয়ার পরে পনের ঘন্টা অতিবাহিত হয়েছে। সে মানসিকভাবে যদিও পরিশ্রান্ত কিন্তু তার এখন কোনোভাবেই নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা চলবে না। সে এই পরিস্থিতির ভিতর দিয়ে কেবল শক্ত থেকেই বের হয়ে আসতে পারবে এবং নিজেকে আর নিজের পরিবারকে রক্ষা করতে পারবে।

পুরুষ কণ্ঠস্বর আর আগুয়ান পায়ের শব্দ এক ঝটকায় তাকে তার ভাবনা থেকে বের করে আনে। কর্চি সেই একটা দরজা দিয়ে কক্ষের ভিতরে প্রবেশ করেছে এবং তারপরে দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে সে চিৎকার করে বলে, “মীর খানকে ভিতরে নিয়ে এসো।

দু’জন প্রহরী নিজেদের মাঝে তৃতীয় আরেকজনকে টেনে ভিতরে নিয়ে আসে। মোমবাতির দপদপ করতে থাকা আলোয় তারা যখন বেদীর দিকে এগিয়ে যায় মেহেরুন্নিসা তখন নিজের উপর রীতিমত বলপ্রয়োগ করে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়া থেকে বিরত থাকতে। সে যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রহরীরা তার পাশে এসে দাঁড়ায় এবং তাদের মাঝের লোকটা ঠেলে সামনের দিকে মাটিতে ফেলে দেয়। মীর খান কোনো বাধা না দিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে। বস্তুতপক্ষে, তাকে দেখে মনে হয় না যে তার জ্ঞান আছে। সে যখন সামনের দিকে টলমল করে আছড়ে পড়ে সেই অবসরে মেহেরুন্নিসা তাঁর কালচে, রক্তাক্ত মুখ দেখতে পায়। তার পরনের কাপড় ছেঁড়া, তাঁর পিঠে আগুনের ছ্যাকার লাল ক্ষত, সম্ভবত তপ্ত লোহার সাহায্যে সৃষ্ট। সে নিজেকে প্রবোধ দেয় মীর খানকে নিজের ভুলের মাশুল অবশ্যই দিতে হবে–যে তাকে অবশ্যই উৎসর্গ করতে হবে যাতে বাকি সবাই তারা রক্ষা পায়–কিন্তু তার পাশে মেঝেতে নিজের অত্যাচারিত ছোট ভাইকে পড়ে থাকতে দেখাটা সহ্য করাও তাঁর জন্য কষ্টকর হয়ে উঠে। জাহাঙ্গীর মীর খান নয় বরং তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে বুঝতে পেরে, সে প্রাণপণে আত্মসংবরণের চেষ্টা করে। সম্রাট কিছুক্ষণ পরে বন্দির দিকে তাকায়।

‘মীর খান, নিজের সাফাই দিতে তোমার কি বলার আছে?

মীর খানের পুরো দেহ থরথর করে কাঁপছে। প্রহরীদের একজন তাঁর মাথার লম্বা কালো চুলের ঝুটি ধরে এবং তার মাথাটা তুলে ধরে। মহামান্য সম্রাটের প্রশ্নের জবাব দাও।’

মীর খান বিড়বিড় করে দুর্বোধ্য কিছু একটা বলে এবং প্রহরী নিজের জুতো পরা পা তুলে এবার তার পেটে সজোরে একটা লাথি বসিয়ে দেয়। সে এইবার কয়েকটা শব্দ স্পষ্ট করে উচ্চারণ করতে সক্ষম হয়। সম্রাট, আমাকে ক্ষমা করুন।

‘বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ক্ষমা করার প্রশ্নই উঠে না। একজন বিশ্বাসঘাতকের মৃত্যুই তোমার প্রাপ্য। তোমায় প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করার পরামর্শ এমনকি তোমার নিজের বোনও দিয়েছে।’ মীর খান হতাশ চোখে তার দিকে তাকালে মেহেরুন্নিসা কুঁকড়ে যায়। আমার উচিত ছিল তোমাকে হাতির পায়ের নিচে পিষে ফেলা কিংবা শূলে দেয়া যেমনটা আমি আমার সন্তানের পূর্ববর্তী বিদ্রোহের সমর্থকদের করেছিলাম যাঁদের পরিণতি থেকে শিক্ষা নেয়ার মত বুদ্ধিও তোমার নেই।’ জাহাঙ্গীরের কণ্ঠস্বর হিম শীতল শোনায়। মীর খানের পাশে বসে তাকে আগলে ধরে একটু আগে যা বলেছিল সেসব ভুলে গিয়ে ভাইয়ের জীবনের জন্য করুণা ভিক্ষা করা থেকে মেহেরুন্নিসা অনেক কষ্টে নিজেকে বিরত রাখে। জাহাঙ্গীর অবশ্য এসবে ভ্রূক্ষেপ না করে বলতে থাকে, কেবল তোমার বোনের খাতিরে যার মত সাহসী তুমি কখনও হতে পারবে না আমি তোমাকে এই জীবন থেকে তোমার প্রাপ্য ধীর আর যন্ত্রণাদায়ক নিস্কৃতির হাত থেকে রেহাই দিলাম। মৃত্যুর পূর্বে তোমার কি কিছু বলবার আছে?

মীর খান অনেক কষ্ট করে হাঁটুর উপর ভর দিয়ে বসে কিন্তু সে যখন কথা বলে সেগুলো না তার বোন না সম্রাটকে উদ্দেশ্য করে বলা। কথাগুলোর মাঝে কোনো প্রকার ক্ষোভ কিংবা ক্রোধ না থাকায় সে হাফ ছেড়ে বাঁচে। ‘মেহেরুন্নিসা… আমাকে ক্ষমা করে দিও…’

‘ভাইজান, আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তার মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে থাকায় কথাগুলো ধীরে নিঃসৃত হয়।

‘আর আমাদের আব্বাজান আর আসাফ খানকেও বলে দিও আমায় যেন মার্জনা করে। ষড়যন্ত্রের বিন্দুবিসর্গ সম্বন্ধে তারা জানতো না… এবং আমাদের আম্মাজানকে জানিয়ে তাকে আমি ভালোবাসি আর আমার জন্য যেন কষ্ট না পায়। মীর খান এখন ফুঁপিয়ে কাঁদছে, অশ্রুধারায় তার মুখের শুকনো রক্ত গলতে শুরু করে।

‘জল্লাদকে ডেকে পাঠাও, জাহাঙ্গীর আদেশ দেয়। লোকটা নিশ্চয়ই এতক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করেছিল কারণ সাথে সাথে কালো পাগড়ি ধাতব-বোম শোভিত আটসাট জামা পরিহিত দীর্ঘদেহী একটা লোক দুই মাথাযুক্ত একটা কুঠার হাতে ভেতরে প্রবেশ করে এবং তার অন্য পেষল হাতে মনে হয় একটা পশুর চামড়া মুড়িয়ে ধরা রয়েছে।

‘সম্রাট?

‘এই লোকটার শিরোচ্ছেদ কর।

জাহাঙ্গীরের আদেশ শুনে মীর খান পুনরায় মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। জল্লাদ লোকটা এবার চামড়াটার ভাঁজ খুলে, তারপরে বেদীর সামনে থেকে গালিচাটা সরিয়ে দিয়ে সেখানে পাথরের মেঝের উপরে যত্ন নিয়ে চামড়াটা বিছিয়ে দেয়। সে প্রস্তুত হতে প্রহরীদের উদ্দেশ্যে মাথা নাড়ে। মীর খান তখনও ফুঁপিয়ে কাঁদছিলো যখন প্রহরীরা তাকে পুনরায় ধরে এবং টেনে সামনের দিকে চামড়ার উপরে নিয়ে আসে। তোমার গর্দান বাড়িয়ে দাও, জল্লাদ আদেশের সুরে বলে। একজন প্রহরী তার ডান হাতটা দেহের কাছ থেকে টেনে ধরলে যা এখন ভীষণভাবে কাঁপছে অন্য প্রহরীও তাঁর বাম হাতটা একইভাবে টেনে ধরতে, মেহেরুন্নিসা লক্ষ্য করে তার ভাই দারুণ সাহসের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে ধীরে নিজের গলা বাড়িয়ে দেয়। জল্লাদ তাঁর ঘাড়ের উপর থেকে কালো চুলের গোছা সরিয়ে দেয় তারপরে, সন্তুষ্টচিত্তে পিছিয়ে এসে কুঠারটা হাতে তুলে নেয়। সে তারপরে যত্নের সাথে কুঠারটার ওজন নিজের হাতে ভারসাম্য অবস্থায় রেখে কাঁধের উপর দিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জাহাঙ্গীরের দিকে তাকাতে সে বোঝা যায় কি যায় না এমনভাবে মাথা নাড়ে।

মেহেরুন্নিসা মোমের আলোয় বাঁকা ফলাটা ঝলসাতে দেখে যখন জল্লাদ কুঠারটা এক মোচড়ে নিজের মাথার উপর তুলে ধরে। হন্তারক ফলাটা নামিয়ে আনতে সে টের পায় তার গালের পাশ দিয়ে বাতাসের একটা ঝাপটা বয়ে যায়, তারপরে ফলাটা তার ভাইয়ের গলা নিখুঁতভাবে দ্বিখণ্ডিত করতে হাম আর মাংসের সাথে ইস্পাতের সংঘর্ষের ভোঁতা আওয়াজ সে শুনতে পায় এবং আরো একটা মৃদু ভোঁতা শব্দের সাথে তাঁর ছিন্ন মস্তক মাটিতে আঘাত করতে উজ্জ্বল রক্ত ছিটকে উঠতে দেখে। মেহেরুন্নিসা কিছুক্ষণ নিথর দাঁড়িয়ে থাকে। তারপরে স্বস্তিকর একটা অনুভূতি–জল্লাদ লোকটা নিজের কাজ ভালোই জানে। তাঁর ভাই কষ্ট পায় নি। সে তাকে যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর হাত থেকে নিকৃতি দিয়েছে। সে তাকিয়ে দেখে জল্লাদ দ্রুত মীর খানের ছিন্ন মস্তক আর দেহটা চামড়া দিয়ে ঢেকে দেয় এবং একজন প্রহরীর সাহায্যে সেগুলো কক্ষ থেকে সরিয়ে নেয়। আয়তাকার পাথরের খণ্ডের উপরের পড়ে থাকা কয়েক ফোঁটা রক্তই কেবল সাক্ষী দেয় যে কিছুক্ষণ আগে এখানে একজনের জীবনাবসান হয়েছে।

‘সবকিছু মিটে গিয়েছে, মেহেরুন্নিসা শুনতে পায় জাহাঙ্গীর বলছেন। ‘আপনি এবার হেরেমে ফিরে যেতে পারেন।’

মেহেরুন্নিসার অনুভব করার আর চিন্তা করার সব শক্তি যেন বিলীন হয়েছে। সে অন্ধের মত আদেশ পালন করে, কক্ষের দূরবর্তী প্রান্তের অতিকায় সোনালী দরজার দিকে টলতে টলতে এগিয়ে যায় যা ইতিমধ্যে তার জন্য খুলতে শুরু করেছে।

হেরেমে নিজের কক্ষে ফিরে এসে যা সে ভেবেছিল আর কখনও দেখতে পাবে না মেহেরুন্নিসার কিছুটা সময় লাগে অবশেষে কান্নায় ভেঙে পড়তে। নিজের ভাইয়ের মৃত্যুদণ্ড প্রত্যক্ষ করা খুবই কঠিন। নিজেকে সুস্থির রাখার জন্য সে তার হাতের নখ দিয়ে যেখানে আঁকড়ে ধরেছিল সেখান থেকে এখন রক্তপাত শুরু হয়েছে। কিন্তু মীর খান নিজেই নিজেকে এই বিপর্যয়ে আপতিত করেছে। সে দোষী আর ন্যায়বিচার সম্পন্ন হয়েছে। তাকে বাঁচাবার জন্য তার কিছুই করার ছিল না এবং সেই চেষ্টা করতে গেলে সে সম্ভবত নিজেকে আর সেই সাথে তাঁদের পুরো পরিবারকে বিপদগ্রস্থ করে তুলতো। তাঁর আব্বাজান যেমন শিশুকালে তাকে মরুভূমিতে পরিত্যাগ করেছিলেন তাঁদের বাকি পরিবারকে বাঁচবার একটা সুযোগ দিতে, তাকে ঠিক সেভাবেই মীর খানকেও উৎসর্গ করতে হয়েছে। তাঁর বিচক্ষণতার মানে এই নয় যে সে ভাইকে ভালোবাসে না, যতই দুর্বল আর বোকা সে হোক। কিন্তু এখন কি করণীয়? জাহাঙ্গীরের সাথে সাক্ষাতের বিষয়ে সে এতদিন ধরে যে স্বপ্ন দেখছিলো তা অবশেষে পূরণ হয়েছে কিন্তু সে যেমন কল্পনা করেছিল তার থেকে একেবারে ভিন্ন একটা প্রেক্ষাপটে। ভবিষ্যতের গর্ভে তার জন্য… বা তাঁর পরিবারের জন্য… কি অপেক্ষা করছে?

১.০৭ পাপস্খলন

ফতেপুর শিক্রি যাবার পথে শুকনো মাটির উপরে ঘোড়ার খুরের ছন্দোবদ্ধ শব্দ তাঁর কানে সন্তুষ্টির পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে, জাহাঙ্গীর ভাবে। শব্দটা তাকে বলছে যে মাসাধিক কাল অপেক্ষার পরে সে অবশেষে অভীষ্ট সাধনে কাজ করছে। মেহেরুন্নিসাকে দেখার পর থেকেই তাকে নিজের ভাবনা থেকে সে কদাচিত দূরে রাখতে পেরেছে। সে যে সাহসের সাথে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে নিজের বাবার পক্ষে সাফাই দিয়েছে সেটা বহুবছর পূর্বে সে যা আঁচ করেছিল সেটাকেই অভ্রান্ত প্রমাণিত করেছে–যে সে রূপবতী হবার সাথে সাথে একজন অসাধারণ মহিলা। অন্য যে কেউ হলে শোকে কাঁদতে বিলাপ করতো কিন্তু তিনি নিজের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। তাঁদের মধ্যকার আলাপচারিতা শেষে একটা বিষয়ে তাঁর মনে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে তার পুরো পরিবারে মীর খানই একমাত্র বিশ্বাসঘাতক। সে সেই সাথে এটাও জানে যে বহু বছর আগে সে তার মাঝে যে অনুভূতির জন্ম দিয়েছিল সেটা আজও একই রকম রয়েছে। সে এখন তাকে আগের চেয়ে আরও বেশি করে কামনা করে।

অবশ্য, গোয়ালিওরে খসরুর কারাপ্রকোষ্ঠ থেকে অঙ্কুরিত তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার শেষ প্রচেষ্টা সাফল্যের সাথে মোকাবেলা করাই ছিল তাঁর প্রথম লক্ষ্য। যতই দিন অতিবাহিত হয়েছে সে ততই মীর খানের মত আরো মাথা গরম তরুণদের কথা জানতে পেরেছে যারা খসরুর প্রতি নিজেদের আনুগত্য ঘোষণা করেছিল তার প্রতিশ্রুতির বহরের কারণে মোহিত হয়ে যা করার কোনো এক্তিয়ারই তার উচ্চাকাঙ্খী ছেলের ছিল না। সে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়, খসরুর সহযোগীরা উড়াল দেয়ার আগেই তাদের গ্রেফতারের বিষয়টা নিশ্চিত করে, তাদের জেরা করে আরো ষড়যন্ত্রকারীদের নাম তাঁদের কাছ থেকে আদায় করে এবং তারপরে তাঁদের প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করে।

খসরুর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়াটাই ছিল সবচেয়ে কঠিন। সে অতীতে অনেক বেশি করুণা প্রদর্শন করেছে কিন্তু তার ফলাফল কি হয়েছে? খসরু তাঁর উদারতার বদলে কেবলই ছলনার আশ্রয় নিয়েছে। না, সে তার কাছ অনুতাপ কিংবা কৃতজ্ঞতা কিছুই আশা করতে পারে না। খসরুকে সে যে শাস্তিই দিক না কেন সেটা যেন এতটাই কঠোর হয় যে ভবিষ্যতে তাঁর বিদ্রোহের ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ না থাকে। কিন্তু তারপরেও তাঁর তাড়াহুড়ো করার কোনো দরকার নেই… সে বর্তমানে খসরুকে কেবল গোয়ালিওরের ভূগর্ভস্থ একটা কারা কুঠরিতে অন্তরীণ করে রাখতে আদেশ দিয়েছে এবং নির্দেশ দিয়েছে তাকে যেন সম্পূর্ণভাবে নিঃসঙ্গ অবস্থায় রাখা হয়।

সে ইয়ার মোহাম্মদকে, বাদখশান থেকে আগত বৃদ্ধ কিন্তু কঠোর শাসক, বিশ্বাস করতে পারে যাকে সে সম্প্রতি গোয়ালিয়রের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছে, তার আদেশ যেন যথাযথভাবে পালিত হয় সেটা নিশ্চিত করতে। পূর্ববর্তী শাসনকর্তার বিষয়ে, সে নিশ্চিতভাবেই অনেক বিষয়ে শিথিলতা প্রদর্শন করেছিল আর খসরুকে অনেকবেশি সুযোগ সুবিধা দিয়েছিল। যুবরাজকে ষড়যন্ত্রের সুযোগ দেয়ার জন্য সেই সবচেয়ে বেশি দায়ী আর সে কারণেই জাহাঙ্গীরের কোপানলে পরার ভয়ে সে নিজের অবহেলার জন্য খেসারত দিতে মরীয়া হয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের বিষয়ে যাবতীয় তথ্য সরবরাহ করেছে, এমনকি নিজেকে বাঁচাতে সে নিরীহ গিয়াস বেগকেও পর্যন্ত ফাঁসিয়ে দিয়েছে। জাহাঙ্গীর তাকে বরখাস্ত করতে, তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে এবং তাকে নির্বাসিত করতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করে নি।

তার ঠোঁটের কোণে নিষ্ঠুর এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে। সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবার হঠকারী ভাবনা বহুদিন আর কারো মনে উদয় হবে না। আর বিপর্যয় এখন যখন সমাপ্তির কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে তখন সে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত কিছু বিষয়ে মনোযোগ দেবার মত সময় সে অবশেষে লাভ করেছে। গতরাতে, মেহেরুন্নিসার ভাবনা যখন তাকে পুনরায় আবার রাতের বেলা জাগিয়ে রাখতে আরম্ভ করেছে, তখন সে না ভেবে থাকতে পারে নি যে খসরুর এই অনাকাঙ্খিত বিদ্রোহের কারণে মেহেরুন্নিসার পরিবার আর তার নিজের মধ্যকার পরিস্থিতি কি আদতে খুব সূক্ষভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। এই প্রশ্নের উত্তর কেবল পাক কেবলা সুফি বাবাই দিতে পারবেন। আর এই কারণেই তাঁর প্রাত্যহিত দরবারিক কর্মকাণ্ড সমাধা হতেই সে তার সাথে দেখা করার জন্য যাত্রা করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

জাহাঙ্গীর তার সামনে দ্রুত ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যালোকে, সে দেখতে পায় ইতিমধ্যেই রাতের খাবারের জন্য আগুন জ্বালান হয়েছে। ফতেপুর শিক্রি এখান থেকে খুব একটা দূরে নয়। সে তার কচি আর দেহরক্ষীদের চমকে দিয়ে সহসাই নিজের ঘোড়ার খুরে ঝড়ের বোল তুলে। তারা সবাই নিজের ঘোড়ার গতিবেগ বৃদ্ধি করে তার কাছাকাছি থাকবার প্রয়াসে তাঁদের ব্যস্ত হয়ে উঠার আওয়াজ সে পেছনে থেকে ভেসে আসতে শুনে।

পনের মিনিট পরে, তাকে বেশিরভাগই এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা ফতেপুর শিক্রির বেলেপাথরের শহরের মূল প্রতিরক্ষা প্রাচীরের বাইরে নিচু একটা মাটির বাড়ির সামনে ঘোড়া থেকে নামতে দেখা যায়। সে ছেলেবেলায় বর্তমান সুফি সাধকের বাবার সাথে প্রথমবার যখন দেখা করতে এসেছিল তখনকার চেয়ে বাড়িটাকে এখন যেন অনেকবেশি ছোট আর হতদরিদ্র মনে হয়, কিন্তু এটাও সত্যি যে স্মৃতির সাথে সময় প্রায়শই বিবিধ ছলনা করে থাকে। তোমরা সবাই এখানেই অপেক্ষা করো।’ দরজার ডানপাশে অবস্থিত একটা ক্ষুদ্র জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে সে একটা তেলের প্রদীপের খুবানি আভা দেখতে পায়। সে হাত থেকে ঘোড়া চালনার দস্তানা জোড়া খুলে ফেলে কাঠের দবেজ দরজায় টোকা দেয় এবং তারপরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে দরজার পাল্লা খুলে। কক্ষের ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সে আবারও দরজায় টোকা দেয় এবং এবার মাথা নত করে নিচু সরদলের নিচে দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।

কক্ষটার মেঝে দুরমুজ করা মাটির তৈরি তার উপরে কেবল কয়েকটা জীর্ণ মাদুর বিছানো রয়েছে এবং তাঁর যতদূর মনে পড়ে এক কোণে একটা দড়ির চারপায়া থাকবার কথা কিন্তু সুফি বাবার কোনো চিহ্ন সেখানে নেই। জাহাঙ্গীরের মনটা এক মুহূর্তের জন্য হতাশায় ছেয়ে যায় কিন্তু পরক্ষণেই সে বাইরে থেকে কণ্ঠস্বরের আওয়াজ ভেসে আসতে শুনে এবং মুহূর্ত পরেই সুফিবাবা ভেতরে প্রবেশ করেন, তিনিও নিজের সাদা পাগড়ি পরিহিত মাথা সরদলের সাথে গুতো খাওয়া থেকে বাঁচাতে নিচু করে রেখেছেন।

‘সম্রাট, আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত, আপনাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থাকতে পারি নি। আমি আগুন জ্বালাবার কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়েছিলাম।’

‘আপনাকে আগে থেকে না জানিয়ে আসবার কারণে আমিই আসলে ভুল করেছি।’

‘সম্রাট, অনুগ্রহ করে…’ সুফিবাবা একটা মাদুরের দিকে ইঙ্গিত করে এবং জাহাঙ্গীর যখন তাঁর মুখোমুখি আসন পিড়ি হয়ে থিতু হয়ে বসে। এত ব্যগ্রভাবে আমার কাছে ছুটে আসবার কারণটা কি এবার জানতে পারি?

‘আপনার দিক নির্দেশনা আমার আবার প্রয়োজন।

‘সেই একই বিষয়ে?

জাহাঙ্গীরের মনে হয় সে বুঝি সুফিবাবার চোয়াল সামান্য চেপে বসতে দেখেছে। হ্যাঁ। পরিস্থিতি এখন বদলে গিয়েছে।

কীভাবে সেটা হয়েছে?

‘আপনি আমায় বলেছিলেন যে আমি কেবল আল্লাহতালার চোখের গুনাহগার নই সেইসাথে আমি আমার ভালোবাসার রমণীর এবং যাকে আমি আমার স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চাই–আমার কোষাধ্যক্ষ গিয়াস বেগের কন্যা মেহেরুন্নিসার–পরিবারের প্রতিও অন্যায় করেছি, তাঁরা তাঁর জন্য যাকে স্বামী হিসাবে নির্বাচিত করেছিল তাকে হত্যা করে। আমার এই অন্যায়ের কারণে আপনি আমাকে হুশিয়ার করেছিলেন আমি যা চাই সেটা পাবার জন্য কোনো ধরনের ব্যগ্রতা প্রদর্শন করে আল্লাহ্তা’লার রোষানলে পড়ার ঝুঁকি না নিয়ে বরং ধৈর্য ধারণ করতে আর অপেক্ষা করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। সুফিসাধক কোনো কথা না বলে কেবল মাথা নাড়ে এবং জাহাঙ্গীর পুনরায় বলতে শুরু করে, আমার সন্তান খসরু আবারও আমায় সিংহাসনচ্যুত করে আমাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিল। গিয়াস বেগের ছোট ছেলে প্রধান ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম–মেহেরুন্নিসার আপন ভাই। সে অপরাধ স্বীকার করে এবং আমি তাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করি। আপনার কাছে আমার প্রশ্ন হলো আমার প্রতি তার অপরাধ কি তাঁর পরিবারের প্রতি আমার অন্যায়কে কি নাকচ করবে না?

সুফিবাবা চোখ এখন অর্ধনিমিলিত এবং তার থুতনি এই মুহূর্তে নিজের ভাঁজ করা হাতের উপরে রাখা কিন্তু এখনও তিনি কোনো কথা বলেন না। জাহাঙ্গীর ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে। সে সম্ভবত মেহেরুন্নিসাকে এমনিও ডেকে পাঠাতে পারতো কিন্তু সুফি সাধক আর বহুকাল আগে গত হওয়া তার বাবার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা তাকে সেটা করা থেকে বিরত রেখেছে।

সুফিবাবা অবশেষে মৌনতা ভঙ্গ করেন। আপনি যা বললেন তার কিছুটা অংশ বাস্তবিকই যুক্তিযুক্ত। আপনার অপরাধের চুড়ান্ত বিচারের ভার আল্লাহতালার হাতে কিন্তু এই মুহূর্তে আপনাদের দুই পরিবারের ভিতরে এখন আপনিই কেবল একমাত্র অপরাধী নন। আমার বিশ্বাস পাপে পাপ ক্ষয় হয়েছে। কিন্তু স্মরণ রাখবেন যে আপনার ভাগ্যে যাই লেখা থাকুক, আপনি নিজের আকাঙ্খকে চরিতার্থ করতে আপনি যে পদক্ষেপ নিয়েছেন সেটা একজন মানুষ আর বিশেষ করে একজন সম্রাট হিসাবে আপনার জন্য অগৌরবের।’

‘আমি জানি। জাহাঙ্গীর তার মাথা নত করে। সুফিবাবা ঠিকই বলেছেন। শের আফগানকে হত্যা করাটা তার একেবারেই ঠিক হয় নি। পুরো ব্যাপারটা ঈর্ষাতুর এক প্রেমিকের মত কাজ হয়েছে কোনোভাবেই সেটা একজন অমিত-ক্ষমতাধর সম্রাটের উপযুক্ত নয়। কিন্তু সুফিবাবার কথাগুলো এসব ভাবনা ছাপিয়ে তাকে আনন্দে আপ্লুত করে তুলে। মেহেরুন্নিসা অবশেষে তার হতে চলেছে। সুফিবাবা আমায় বলেন ভবিষ্যতের গর্ভে কি অপেক্ষা করছে? এই রমণী কি আমি যাকে খুঁজছি আমার সেই আত্মার আত্মীয় হবে?

‘সম্রাট আমার পক্ষে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। আমি আপনাকে আগেই বলেছি আমার আব্বাজানের মত আত্মার অধিকারী আমি নই। তাঁর মত ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু আপনি যেমন বলেছেন সত্যিই যদি আপনি তাকে সেরকমই ভালোবাসেন–এবং তার মাঝেও আপনার প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পারেন তাহলে সবকিছুই সম্ভব।

বাঁচালেন। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না আপনার কথায় আমি কতটা স্বস্তি পেয়েছি। আমি কীভাবে আপনাকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাতে পারি?

‘আমি যা কিছু বলেছি সবই আল্লাহতালার প্রতি আমার বিশ্বাস আর তাঁর অভিপ্রায় মাথায় রেখে বলেছি কোনো পুরষ্কারের আশায় নয়, কিন্তু ফতেপুর শিক্রি থেকে চলে যাবার আগে আমার আব্বাজানের কবরটা জিয়ারত করলে আমি খুশি হব। আপনার সমস্ত অত্যাচার আর পাপের জন্য, কেবল শের আফগানের হত্যাকাণ্ডের জন্যই না, আবারও আল্লাহতা’লার কাছে করুণা ভিক্ষা করবেন। আব্বাজান হয়ত তাহলে বেহেশত থেকে আপনাকে আশীর্বাদ করবেন এবং আপনার আগামী জীবনটা আরও সুগম করে দেবেন।

*

‘নাহ্, এটাও পুরোপুরি ঠিক হয় নি। শোন…’ সাল্লা পংক্তিটা জোরে জোরে আবৃত্তি করে, আবৃত্তি করার সময় সে তার মাতৃভাষা আর্মেনীয় থেকে পার্সীতে অনুবাদ করতে থাকে। মেহেরুন্নিসা মাথা নাড়ে। ভাষাটা রপ্ত করতে তাঁর আরও সময় লাগবে কিন্তু এই বিনোদনটা তার ভালোই লাগে। এখানে প্রতিটা দিন আগের দিনের মতই এবং নিঃসন্দেহে আগামী দিনও। সে যদিও পুনরায় ফাতিমা বেগমের সাথেই বসবাস করছে, তাকে একঘরে করে রাখা হয়েছে। পুরোটা সময় কেবলই খসরুর সাথে ষড়যন্ত্রকারী সন্দেহভাজনদের গ্রেফতারের তাজা খবর সে শুনছে। তাঁর ভাইয়ের মৃত্যুদণ্ডই হেরেমের অধিবাসীদের তাঁর প্রতি সতর্ক করার জন্য যথেষ্ট। সাল্লার যদিও, তাঁর বিদ্বান বাবা রাজকীয় পাঠাগারের আধিকারিক, এসব নিয়ে কোনোপ্রকার হেলদোল আছে বলে মনে হয় না। ফাতিমা বেগমের পরিচারিকা হিসাবে তাকে সম্প্রতি নিয়োগ করা হয়েছে এবং মেহেরুন্নিসা তাঁর সান্নিধ্য পেয়ে একরকম বর্তে গিয়েছে। সাল্লা আর্মেনিয়াসের পাশাপাশি মেহেরুন্নিসাকে খানিকটা ইংরেজিও শিখাবে বলেছে, যা তার আব্বাজান, যখন তরুণ বয়সে জনৈক ইংরেজ ব্যবসায়ীর অধীনে মুনশী বা সেক্রেটারি হিসাবে কর্মরত থাকার সময়ে রপ্ত করেছিলেন, তাকে শিখিয়েছে।

মেহেরুন্নিসা যে পংক্তিগুলো ভাষান্তর করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল সেই পংক্তিগুলো সে পুনরাবৃত্তি করার সময়ে সাল্লার আন্তরিক মুখের চারপাশে তাঁর ঘন কালো লম্বা চুলের গোছা বৃত্তাকারে ঝুলতে থাকে তাঁর চুল এতই ঘন যে চুল আচড়াবার সময়ে তাকে চিরুনির সাথে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়: ‘রাত যখন গম্ভীর হয়ে আলকাতরার ন্যায় কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে তখন ভয় পাবে না। জানবে সেটা কেবলই ভেসে যাওয়া কোনো মেঘের কারসাজি যা চাঁদ আর তারাদের আলো শুষে নিয়েছে। আবারও তাদের আলোর দীপ্তি ফিরে আসবে, পূর্বের মতই সৌন্দর্যমণ্ডিত যা একদা হারিয়ে গিয়েছিল।’

শব্দগুলো মেহেরুন্নিসাকে স্পর্শ করে। এটা কার কবিতা?

‘আমাদের অন্যতম মহান কবি-ইয়েরেভানের হ্যাগোপান।

কতদিন আগের…’ মেহেরুন্নিসা কথা শেষ করতে পারে না কারণ নাদিয়া ঝড়ের বেগে তার কক্ষে এসে প্রবেশ করেছে।

‘মালকিন, আপনাকে এখনই আমার সাথে যেতে হবে। খাজাসারা আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।

আবার কি ঘটলো? মেহেরুন্নিসা চিন্তিত মুখে উঠে দাঁড়ায়। জাহাঙ্গীরের সাথে তার সাক্ষাৎকারের পর থেকেই সে আশঙ্কা করছে যেকোনো মুহূর্তে তাকে তার বাবা-মায়ের কাছে ফেরত পাঠানো হবে। বাবা মা আর ভাই আসাফ খানের কাছে যে চিঠিগুলো সে লিখেছিল সেগুলোয় আশঙ্কার কথা ছিল। সে নিশ্চিত যে হেরেম থেকে বাইরের সাথে যেকোনো ধরনের সংবাদ বিনিময়–বিশেষ করে ষড়যন্ত্রের দায়ে অভিযুক্ত পরিবারের সাথে সতর্কতার সাথে খুটিয়ে দেখা হবে।

নাদিয়াকে অনুসরণ করে বাইরের আলোকউজ্জ্বল প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়াতে–উত্তল মার্বেলের উপর সূর্যঘড়ির ছায়া বলছে এখনও দুপুর হয়নি–মেহেরুন্নিসা দেখে মালা তার জন্য অপেক্ষা করছে। খাজাসারার দীর্ঘদেহী অবয়বের পিছনে গাঢ় সবুজ বর্ণের আলখাল্লা পরিহিত ছয়জন পরিচারিকা মালার দিকে তাকিয়ে থেকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাঁদের ভিতরে তিনজন খোঁজা আর তিনজন মহিলা।

‘আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন, মেহেরুন্নিসা খাজাসারার উদ্দেশ্যে বলে।

‘হ্যাঁ, মালকিন।

‘আপনি কি বলতে চান?

‘জনসমক্ষে কথাটা বলার অনুমতি আমায় দেয়া হয়নি। অনুগ্রহ করে আমায় অনুসরণ করুন।

খাজাসারা উচ্চপদস্থ কোনো রাজকীয় কর্মচারীর ন্যায় দন্ডটা হাতে নিয়ে সদর্পে এগিয়ে যায়, একদিক দিয়ে বিবেচনা করতে গেলে সে আসলেও তাই। পরিচারিকার দল তাকে অনুসরণ করে এবং মিছিলটার একেবারে শেষে থাকে মেহেরুন্নিসা। ছোট্ট মিছিলটা জাহাঙ্গীরের ব্যক্তিগত খাস কামরায় প্রবেশের বাঁকটা এড়িয়ে, যা মেহেরুন্নিসা এখন ভালো করেই চেনে, প্রধান প্রাঙ্গণের উপর দিয়ে হেরেমের প্রবেশ পথের দিকে এগিয়ে যায়। তাকে শেষ পর্যন্ত তাহলে বহিষ্কারই করা হচ্ছে…

কিন্তু তখনই মেহেরুন্নিসা তোরণগৃহের বামে একটা ক্ষুদ্র খিলানযুক্ত তোরণদ্বার লক্ষ্য করে। সেখানে পৌঁছে মালা ভেতরে প্রবেশ করে হারিয়ে যায়। পরিচারিকার দলকে অনুসরণ করে খিলানাকৃতি তোরণের নিচে দিয়ে এগিয়ে যেতে মেহেরুন্নিসা একটা সংকীর্ণ গলিপথের মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করে যা বামদিকে বাঁক খেয়ে খাড়াভাবে নিচের দিকে নেমে গিয়েছে। সে এক মুহূর্তের জন্য আতঙ্কিত হয়ে চিন্তা করে তাকেও কি একই ভূগর্ভস্থ কারাপ্রকোষ্ঠে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কিন্তু তারপরেই সে খেয়াল করে যে ভেতরের বাতাস ক্রমশ উষ্ণ হচ্ছে। বেলেপাথরের দেয়াল বেয়ে জলকণা গড়িয়ে নামছে এবং কারাগারের সেঁতসেঁতে গন্ধের বদলে তাঁর নাকে–গোলাপজল, চন্দনকাঠ আর তিমিমাছ থেকে প্রাপ্ত গন্ধদ্রব্যের সুগন্ধ ভেসে আসে। সামনে আরেকটা তীক্ষ্ণ বাঁক দেখা যায় এবং মেহেরুন্নিসা সামনে আলো দেখতে পায়। আরও কয়েক কদম সামনে এগিয়ে যেতে সে নিজেকে একটা ক্ষুদ্র আয়তাকার আঙ্গিণায় আবিষ্কার করে যার চারদিকেই উঁচু দেয়াল। সে উপরের দিকে তাকিয়ে সে কেবল ছোট আয়তাকার আকাশের ধাতব নীল দেখতে পায়। প্রাঙ্গণের মাঝে একটা ঝর্ণা থেকে বুদ্বুদ নিঃসৃত হচ্ছে এবং ঠিক উল্টোদিকের দেয়ালের ফাঁকাস্থানের ভিতর দিয়ে সুগন্ধি স্রোত, আর্দ্রতার উৎস দেখা যায়– হাম্মামখানা।

‘অনুগ্রহ করে কাপড় খুলে রাখুন, খাজাসারা বলে।

মেহেরুন্নিসা বিস্মিত চোখে অপলক তাকিয়ে থাকে।

‘হেরেমের প্রচলিত নিয়মরীতির কারণে আমরা এই নিভৃতস্থানে পৌঁছাবার পূর্বে আপনাকে কিছু জানানো থেকে আমায় বিরত রেখেছিল, কিন্তু সম্রাট আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। আজ রাতে আপনি যদি তাকে প্রীত করতে, পারেন তাহলে আপনি তার সাথে একই শয্যায় শয়ন করবেন। কোনো তর্ক করা চলবে না। আমি যা বলছি আপনাকে তাই করতে হবে।

মেহেরুন্নিসা এতটাই বিস্মিত হয় যে পরিচারিকার দল তার দেহ থেকে পোষাকের আবরণ সরিয়ে নিয়ে তাকে নগ্ন করতে থাকলে সে বাধা না দিয়ে পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকে। তারা প্রথমেই তাঁর পালিশ করা গোলাপি স্ফটিকের টুকরো বসানো কলাই করা পরিকরের মুক্তাখচিত টাসেল খুলে দেয় তার পরনের গোলাপি রেশমের আলখাল্লা সরিয়ে দিয়ে তাঁর অন্তর্বাস খুলে নেয় এবং তার পা থেকে রেশমের তৈরি চটিও তাঁরা সরিয়ে নেয়। সে কিছু বোঝার আগেই সে দেখে পুরোপুরি নগ্ন অবস্থায় সে ছোট আঙিনায় নেমে আসা উজ্জ্বল সূর্যালোকে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর খাজাসারা কাবুলের দাসবাজারে তার দেখা দাস ব্যবসায়ীদের মত নিরাসক্ত চোখে তাকে খুটিয়ে দেখছে। নিজের ঘন কালো চুল ঝাঁকিয়ে সে চেষ্টা করে নিজের স্তনযুগল আড়াল করতে এবং ঘুরে দাঁড়ায়, সে এখনও মালা একটু আগে যা বলেছে সেটাই বুঝতে চেষ্টা করছে। জাহাঙ্গীর অবশেষে তাহলে তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন কিন্তু মনে হচ্ছে তিনি তাকে আর নিজের স্ত্রী করতে চান না। মামুলী একজন রক্ষিতার মত তাকে তার শয্যার জন্য উপযোগী করা হচ্ছে।

‘চলুন, খাজাসারা উন্মুক্তস্থানটার দিকে ইশারা করে তাকে হাম্মামে প্রবেশ করতে বলে। ভেতরে, গরম পাথরের উপরে প্রবাহিত সুগন্ধি পানির স্রোত থেকে উষ্ণতা নির্গত হচ্ছে যা মার্বেলের সংকীর্ণ ঢালু পথ দিয়ে নিচে নামছে। তার চোখ জ্বালা করে এবং সে টের পায় তাঁর ত্বক ঘামতে শুরু করেছে। সে বরাবরই হাম্মাম পছন্দ করে কিন্তু এখন দীর্ঘ প্রক্রিয়া শুরু হতে সে অনুভব করে তার দেহ উত্তেজনায় টানটান হয়ে আছে। প্রথমে, একটা মার্বেল পাথরের খণ্ডের উপর শুয়ে থাকার সময় পরিচারিকার দল গরম হিসহিস করতে থাকা উষ্ণ পাথরের উপরে আরো পানি ঢালে, সে টের পায় এবার আসলেই তাঁর দেহ কুলকুল করে ঘামতে শুরু করেছে, তার ত্বক পরিষ্কার করে এবং সেটাকে এখন রেশমের ন্যায় নরম আর তুলতুলে মনে হয়। এরপরে, পাশের একটা কক্ষে সে পানির ছোট্ট একটা চৌবাচ্চায় অবগাহন করে যার পানি এত ঠাণ্ডা যে দূর্গের বরফঘর থেকে চৌবাচ্চায় দেয়ার জন্য নিয়ে বরফের টুকরোগুলো এখনও পানিতে ভাসছে। তাকে এরপরে তৃতীয়, বড় একটা কক্ষে নিয়ে আসা হয়। কক্ষটায় কোনো প্রাকৃতিক আলো নেই কিন্তু চারপাশের দেয়ালের কুলুঙ্গিতে স্থাপিত অসংখ্য তেলের প্রদীপের আভায় দেখা যায় দেয়ালের আস্তরের উপরে আর উঁচু খিলানাকৃতি ছাদে জটিল ফুলের নক্সা করা রয়েছে। সেখানে তূর্কী এক মহিলা বিশাল পুরুষালি হাতে সুগন্ধি তেল দিয়ে তার সারা দেহ মালিশ করে দেয়ার সময় সে মুখ নিচু করে একটা মার্বেলের বেঞ্চে শুয়ে থাকে।

কামরাটার এক কোণে পিতলের ধূপাধারে জ্বলতে থাকা ধূপের ঝাঁঝালো গন্ধে তার মাথা ঘুরতে শুরু করে। সে সময়ের হিসাব হারিয়ে ফেলে যখন তার মালিশ শেষ হতে কোথা থেকে এক খোঁজা এসে তাঁর দেহ মসলিনের একটা আলখাল্লায় জড়িয়ে দেয় যা এতই সূক্ষ যে তার দেহের চারপাশে এটাকে প্রায় স্বচ্ছ দেখায় এবং তাকে একটা নিচু তেপায়র কাছে বসার জন্য নিয়ে আসে। তাকে সেখানে বসিয়ে খোঁজাটা এবার তার চুল আচড়াতে আরম্ভ করে, সুগন্ধি ছিটিয়ে দেয় এবং পাথরখচিত ফিতে দিয়ে চুলে বেণী করে দেয়। আরেক খোঁজা, মনোসংযোগের কারণে এর জ্বটা কুঁচকে রয়েছে, তার ভ্র তুলে দেয় এবং তারপরে চোখে সুন্দর করে কাজল দিয়ে তার লম্বা কালো চোখের পাপড়িতে আরও কালো করে তুলে। তারপরে, মর্মরসদৃশ অ্যালাবাস্টারের একটা আলতার পাত্র থেকে আলতা নিয়ে তার ঠোঁট দুটো রাঙিয়ে দেয়। খোঁজাটা যখন উঠে দাঁড়িয়ে উফুল্ল একটা শব্দ করে মেহেরুন্নিসা বুঝতে পারে সে নিজের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট। তৃতীয় খোঁজা এবার সবুজ জেড পাথরের পাত্রে মেহেদী নিয়ে আসে। একটা সূক্ষ্ম তুলি দিয়ে সে তার হাতে পায়ে আর বাহুতে জটিল আলপনা এঁকে দেয়। অন্যমনস্কভঙ্গিতে তাকিয়ে থেকে যেন অনেক দূর থেকে দেখছে এমনভাবে সে তার কাজ দেখে-ভাবটা এমন যেন সে একটা ছোট্ট পুতুল সাজাচ্ছে যার সাথে তার নিজের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু লোকটা পরবর্তী কথায় তার সম্বিত ফিরে সে বুঝতে পারে এটা আসলেই তাঁর দেহ। মালকিন, এবার আপনার আলখাল্লাটা খুলতে যে হবে।’

মেহেরুন্নিসা তার মসৃণ, খানিকটা বিরক্তিকর মুখে দিকে চোখ তুলে তাকায়। খোঁজা হলেও তার কণ্ঠস্বর পুরুষের মতই ভারি। তুমি কি বলছো?’

‘অনুগ্রহ করে আপনার আলখাল্লাটা খুলেন, সে আবারও বলে। সে তারপরেও যখন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন সেই তার দিকে ঝুঁকে এসে তাঁর মসলিনের আলখাল্লার গলার নিচে হাত ঢুকিয়ে আলতো করে সেটা তার কাঁধের উপরে তুলে নিয়ে আসে যতক্ষণ না তাঁর স্তনযুগল অনাবৃত হয়। তারপরে, শক্ত করে ঠোঁট চেপে রেখে সে তার স্তনবৃন্তে তুলির অগ্রভাগ আলতো করে ছুঁইয়ে সেগুলোকে আরও গাঢ় করে তুলতে তুলির স্পর্শে তার স্তনবৃন্ত শক্ত হয়ে যায় এবং এসব কিছুই লক্ষ্য না করে লোকটা তার স্তনবৃন্তের চারপাশের আপাত ধুসর ত্বকে ছোট ছোট ফুলের নক্সা আঁকতে থাকে। তার কাজ শেষ হতে সে পুনরায় তাঁর আলখাল্লাটা জায়গামত নামিয়ে দেয় এবং চিৎকার করে বলে, ‘খাজাসারা মালকিন প্রস্তুত।’

মালা তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায় তারা দু’জনে জহুরীর চোখ নিয়ে তাকে খুটিয়ে দেখে। তারপরে মালা সন্তুষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। চমৎকার। তুমি দারুণ কাজ দেখিয়েছে। আর মেহেরুন্নিসাকে সে বলে, বাইরের আঙিনায় আবার ফিরে চলো।’ প্রাঙ্গণের বিভিন্ন স্থানে বন্ধনীযুক্ত মশালদানে মশাল জ্বলতে শুরু করেছে এবং আঙিনার উপরের এক চিলতে আকাশের বুকে তাকিয়ে সে দেখে ইতিমধ্যে রাতের প্রথম তারারা উঁকি দিতে শুরু করেছে, যেন তাকে বলছে প্রস্তুতি নিতে তার কত দীর্ঘসময় অতিবাহিত হয়েছে।

‘এসো কিছু খেয়ে নেবে। খাজাসারা ঝর্ণার কাছে একটা রূপার তৈরি কাঠামোর উপরে রাখা একটা পাত্রে রক্ষিত খুবানি, পেস্তা আর অন্যান্য শুকনো ফলের দিকে ইঙ্গিত করে কিন্তু মেহেরুন্নিসার পেটে শক্ত গিট অনুভূত হয় এবং সে মাথা নেড়ে মানা করার সময় মাথায় পরানো অলঙ্কারের ভার অনুভব করে। যেমন তোমার অভিরুচি। খাজাসারা আবার হাততালি দিতে তিন মহিলা পরিচারিকা হলুদ রঙের ব্রোকেডের কাজ করা ঢোলা একটা আলখাল্লা, স্যাটিনের সোনালী রঙের পাদুকা এবং গলায় পরার জন্য হলুদ বিড়ালাক্ষের মত দেখতে পাথরের ছড়া তার গলায় আর কোমড়ে পরাবার জন্য নিয়ে আসে। অনুগ্রহ করে একটু ঘুরে দাঁড়ান যাতে করে আমি অন্তত সন্তুষ্ট হতে পারি যে সবকিছু ঠিক ঠিক করা হয়েছে, পরিচারিকার দল তাদের কাজ শেষ করার পরে মালা কথাটা বলে। মেহেরুন্নিসা অনুগত ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে পাক খেয়ে ঘুরতে শুরু করে। মালা তাকে আসন্ন রাতে তাঁর জন্য কি অপেক্ষা করছে খুলে বলার পর থেকেই তাঁর কেবলই মনে হচ্ছে যে কেউ একজন যেন তার নিয়তির ভার তার হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে আর এই বোধটা আশঙ্কাজনকভাবে কেবল প্রবলতর হচ্ছে। সে অচিরেই আরো একবার জাহাঙ্গীরের সামনে নিজেকে দেখতে পাবে। শেষবার তার কি বলা আর করা উচিত সে সম্বন্ধে তার ঠিক ঠিক ধারণা ছিল। এইবার তাঁর কোনো ধারণাই নেই…

যথেষ্ট হয়েছে। মালা বলে। চলুন এবার যাওয়া যাক। সময় হয়ে এসেছে।’

‘খাজাসারা… আমাকে পথ দেখান, একটু পরামর্শ দিন।’ সে যদিও তাকে অনুরোধ করে মেহেরুন্নিসা এর জন্য নিজেকে তিরস্কার করে, কিন্তু সে কোনোভাবেই নিজেকে বিরত রাখতে পারে না।

মালা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কেমন চাপা একটা হাসি হাসে। তোমার দায়িত্ব সম্রাটকে প্রীত করা। এটুকুই কেবল তোমার জানা থাকা জানা দরকার।

*

মেহেরুন্নিসাকে খোঁজাদের একজন মূল আঙিনায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে এবং উপরে সম্রাটের কক্ষের দিকে উঠে যাওয়া সিঁড়ি বেয়ে সে উঠে আসে। মালা সতর্কতার সাথে তাঁর মাথায় সোনালী চুমকি বসানো যে নেকাবটা পরিয়ে দিয়েছে সেটার ঝকমকে পর্দার ভিতর দিয়ে তাকাতে সবকিছু কেমন নির্বাক আর তুচ্ছ মনে হয়–রাজপুত প্রহরীর দল দরজার রুপালি পাল্লাগুলো হট করে খুলে দিয়ে তাকে আর তাঁর সঙ্গী খোঁজাকে অতিক্রম করতে দেয়, জাহাঙ্গীরের ব্যক্তিগত কামরার অতিকায় দরজার সোনালী পাল্লাগুলো মনে হয় যেন শীতল শক্ত ধাতুর চেয়ে নরম কাপড়রে মত যেন চকচক করছে।

সোনালী দরজার পাল্লার ঠিক মুখেই অপেক্ষমান মহিলা পরিচারিকাকে মেহেরুন্নিসা জীবনে কখনও দেখেনি, কিন্তু এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে খোঁজা আর মেয়েটা পরস্পর পরস্পরের পরিচিত। খোঁজাটা মাথা নত করে, বলে, মহামান্য সম্রাটের আদেশ অনুসারে আমি মেহেরুন্নিসাকে নিয়ে এসেছি।’

‘খালেদ আপনাকে ধন্যবাদ, ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা উত্তর দেয় এবং তারপরে, তার সঙ্গে আসা খোঁজাটা বের হয়ে যায় এবং প্রহরীরা সোনালী পাল্লা দুটো বাইরে থেকে টেনে তার পেছনে সেটা বন্দ করে দেয়, মেয়েটা এবার মেহেরুন্নিসার হাত আঁকড়ে ধরে। আমার নাম আশা, আমি মহামান্য সম্রাটের বামা দেহরক্ষীবাহিনীর প্রধান এবং এটা আমার দায়িত্ব যে রাজকীয় শয়নকক্ষে গমনকারী সব রমণী যে নিরস্ত্র সেটা নিশ্চিত করা। অনুগ্রহ করে আপনি হাত তুলে দাঁড়ান। মেয়েটা এবার দ্রুত কিন্তু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেহেরুন্নিসার দেহ তল্লাশি করে। বেশ। আমার সাথে এসো।’

মেহেরুন্নিসা আশাকে অনুসরণ করে লম্বা কক্ষটার দূরতম প্রান্তের দিকে এগিয়ে যাবার সময়, বেদীটার পাশ দিয়ে হেঁটে যায় যেখানে জাহাঙ্গীর তার ভাইয়ের বিচারের সময় উপবেশন করেছিল এবং বেদীটা থেকে প্রায় পনের ফিট পেছনে একটা পর্দা দ্বারা আড়াল করা একটা দরজার নিচে দিয়ে বের হয়ে আসে। দরজাটা তাঁদের বেশ প্রশস্ত একটা করিডোরে পৌঁছে দেয় যার শেষ প্রান্তে অবস্থিত একটা ছোট বর্গাকার দরজার কাছে যাবার রাস্তাটা আরো রাজপুত সৈন্য পাহারা দিচ্ছে। মেহেরুন্নিসা তাঁর নেকাবের ভেতর থেকেও দরজায় বসান পাথর থেকে বিচ্ছুরিত হওয়া আগ্নেয় আলোর আভা স্পষ্ট দেখতে পায়। আশা দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে প্রহরীদের উদ্দেশ্যে কথা বলে। এই রমণীকে সম্রাটের মনোরঞ্জনের জন্য পাঠান হয়েছে। দরজা খুলে দাও।’ রাজপুত প্রহরীর দল বিনা বাক্য ব্যয়ে আদেশ পালন করে। মেহেরুন্নিসা অনুভব করে আশা তার পিঠের মাঝে আলতো করে হাত রেখে তাকে সামনের দিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষের মাঝে তাকে পথ দেখায়।

দরজার পাল্লাগুলো তার পেছনে বন্ধ হতে, মেহেরুন্নিসা দাঁড়িয়ে পড়ে। জাহাঙ্গীর মাত্র কয়েক ফিট দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার পরনের ব্রোকেডের আলখাল্লাটা গলার কাছে রুবির একটা বকলেশ দিয়ে আটকানো, তাঁর কালো চুল কাঁধের উপর ছড়িয়ে রয়েছে।

‘সম্রাট, আপনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তাদের শেষবার দেখা হবার সময় সে যে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে এত কষ্ট করেছিল দেখা যায় এই দফা তাকে পরিত্যাগ করেছে এবং সে নিজের কণ্ঠস্বরে মৃদু একটা কম্পন টের পায়।

জাহাঙ্গীর আরো কাছে এগিয়ে আসে। তোমার নেকাবটা খুলে রাখো। সে ধীরে ধীরে হাত তুলে রেশমের চুমকি শোভিত টুকরোটা টেনে ছিঁড়ে ফেলে এবং সেটাকে ভাসতে ভাসতে মাটিতে পড়তে দেয়। মেহেরুন্নিসা, আমি দীর্ঘসময় আপনার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। আমি আজ রাতটা আপনার সাথে অতিবাহিত করতে চাই, কিন্তু তার আগে আমাকে জানতে হবে আপনি কি আমার সাথে রাত কাটাতে আগ্রহী?

‘জাঁহাপনা, আমি আগ্রহী, সে নিজেই কথাগুলো বলছে টের পায়।

‘আসুন তাহলে।’ সে ঘুরে দাঁড়িয়ে ফুলের নক্সা তোলা রেশমের চাদর দিয়ে আবৃত বিশাল একটা নিচু বিছানার দিকে এগিয়ে, কিন্তু বিছানায় কোনো বালিশ বা কোনো তাকিয়া কিছুই নেই। বিছানার দুই পাশে রূপার মোমদানিতে জ্বলন্ত লম্বা মোমবাতি বিছানার মসৃণ উপরিভাগে ছায়া ফেলেছে। জাহাঙ্গীর নিজের আলখাল্লাটা খুলে ফেলে এবং অবহেলা ভরে সেটাকে মাটিতে ফেলে দেয়। মৃদু আলোতে তাঁর তৈলাক্ত, পেষল দেহ চিকচিক করে। মেহেরুন্নিসা যখন ধীরে ধীরে নিজের বসন ত্যাগ করে আপন নগ্নতা প্রতিভাত করতে তখন সে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে। তিনি যদি জোর করে তাকে নিজের বাহুর ভেতর টেনে আনতেন তাঁর স্বামী শের আফগান মেসটা করতে পছন্দ করতো তারচেয়ে তার দেহের প্রতিটা বাঁক, প্রতিটা ফাটল চোখে পড়তে জাহাঙ্গীরের চোখে ফুটে উঠা চাঞ্চল্য অনেকবেশি উত্তেজক। অচিরেই যা ঘটতে চলেছে সেটা একটা দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কে সূচনা করবে নাকি তাঁদের জীবনের কেবলই স্বল্পকালস্থায়ী একটা অধ্যায় মেহেরুন্নিসার নিজের ভেতরে উপচে উঠা শারীরিক চাহিদার তুলনায় সহসাই গুরুত্বহীন হয়ে উঠে। সে এতদিন বিশ্বাস করে এসেছে যে মন দেহকে নিয়ন্ত্রণ করে কিন্তু এখন সে বুঝতে পারে ব্যাপারটা সবক্ষেত্রে সত্যি নয়।

জাহাঙ্গীর কিছু বলবে সেজন্য অপেক্ষা না করে সে নিজেই ধীরে ধীরে তাঁর দিকে এগিয়ে যায় এবং নিজের হাত উঁচু করে সে নিজের সুরভিত দেহ দিয়ে তাঁর দেহকে প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরে। সে অনুভব করে তাঁর স্তনবৃন্ত জাহাঙ্গীরের বুকের কাছে শক্ত হয়ে উঠেছে এবং তার কামোত্তেজনাও কম প্রবল নয়। সে দু’হাতে তাঁর নিতম্ব আঁকড়ে ধরতে সে সহজাত প্রবৃত্তির কারণে সাথে সাথে বুঝতে পারে সে তার কাছে কি চাইছে। সে তার কাঁধ শক্ত করে আঁকড়ে ধরে, সে দু’পায়ে তার কোমর সাপের মত পেঁচিয়ে ধরে। জাহাঙ্গীর তার ওজন সামলাতে গিয়ে আরও জোরে তার নিতম্ব চেপে ধরে এবং নিজের ভেতর সম্রাটের প্রবল উপস্থিতি অনুভব করে সে কেঁপে উঠে এবং চাপানউতোর শুরু হয়। সে যতই তার গভীর থেকে গভীরতর অংশে প্রবিষ্ট হয় ততই তাঁর পিঠ ধনুকের মত বেঁকে যায় আর শীৎকার শুরু করে, তার নখ জাহাঙ্গীরের ত্বক খামচে ধরে তাকে আরো প্রবল হতে উৎসাহিত করে।

‘সোনা অপেক্ষা করো, সে ফিসফিস করে মেহেরুন্নিসার কানে কানে বলে। সে তাকে বিছানার কাছে নিয়ে এসে তাকে সেখানে শুইয়ে দিয়ে আপাতনের ছন্দপতন না ঘটিয়ে তার উপরে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। তাঁর মুখ এখন তাঁর ডান স্তনবৃন্তে, তাঁর জীহ্বা সেটাকে উত্তেজিত করে আর তাঁর দাঁত এর চারপাশের নরম জায়গাগুলো ঠোকরাতে থাকে। তাদের দুজনের শ্বাসপ্রশ্বাসের বেশ জোরালো হয়। সে টের পায় জাহাঙ্গীরের পিঠ টানটান হয়ে উঠেছে। সে শীর্ষানুভূতির চূড়ায় পৌঁছে গিয়েছে কিন্তু কোনমতে নিজেকে প্রশমিত করে, অপেক্ষা করে সঙ্গীর সহচর্যের। সে শেষ একটা প্রবল অভিঘাতে মেহেরুন্নিসাকেও সেখানে উঠিয়ে আনে। মেহেরুন্নিসা তাঁদের দুজনের সম্মিলিত শীৎকারের শব্দ শুনতে পায় যখন তাঁর ঘামে ভেজা দেহটা ভগ্নস্তূপের মত তার উপরে নেমে আসে আর তারা দুজন পরস্পরকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে, হৃৎপিণ্ডে ঝড়ের মাতম। তাকে আপুত করে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া অনুভূতি ধীরে ধীরে প্রশমিত হতে শুরু করতে সে নিজের আরুক্তম মুখ দিয়ে তার বুকে ঘষতে থাকলে জাহাঙ্গীরের আঙুল তার লম্বা চুল নিয়ে খেলতে থাকে।

*

মেহেরুন্নিসা ছয় ঘন্টা পরে নিদ্রালু ভঙ্গিতে তার চোখের পাতা মেলে এবং আধ-খোলা গবাক্ষ দিয়ে ভোরের ধুসর আলো বর্শার মত নেমে আসতে দেখে। সে সেই সাথে আরও দেখে কেন তাঁর নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে। আশা তাঁর শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মেহেরুন্নিসা এস্ত ভঙ্গিতে নিজের নগ্ন দেহ রেশমের চাদরের একপাশ টেনে নিয়ে ঢাকতে চেষ্টা করে।

‘জাহাপনা,’ আশা পিঠের উপর ভর দিয়ে, একহাত বুকের উপরে রাখা আর অন্যহাত নিজের মাথার উপর প্রসারিত করে, তখনও গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন জাহাঙ্গীরের দিতে তাকিয়ে কথাটা বলে। অনুগ্রহ করে উঠেন, জাহাঙ্গীর চোখ খুলে তাকায়। জাহাপনা, ঝরোকা বারান্দায় আপনার উপস্থিতির সময় হয়েছে।’

জাহাঙ্গীর সাথে সাথে শয্যা থেকে উঠে পড়ে এবং আশা ইতিমধ্যে তার জন্য নিজের হাতে যে রেশমের আলখাল্লাটা ধরে রয়েছে সেটার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। সে মাথা নিচু করে তাকে সুযোগ করে দেয় রেশমের একটা সবুজ পাগড়ি মাথায় পরিয়ে দিতে যেটায় লম্বা একটা সারসের পালক হীরক খচিত ব্রোচ দিয়ে আটকানো রয়েছে। তারপরে, তার দিকে আশার বাড়িয়ে রাখা ব্রোঞ্জের আয়নায় নিজের উপস্থিতি দ্রুত একবার পর্যবেক্ষণ করে, সে রেশমের উড়তে থাকা সবুজ পর্দা সরিয়ে বাইরে অবস্থিত ঝরোকা-ই-দর্শনের, উপস্থিতির বারান্দা যেখান থেকে দিকে যমুনা নদী দেখা যায় সেদিকে, এগিয়ে যায়।

মেহেরুন্নিসা শয্যা ত্যাগ করে, কক্ষের ভিতর দিয়ে নগ্নভাবেই নেমে এসে পর্দার আড়াল থেকে দেখার জন্য এগিয়ে যায়। জাহাঙ্গীর সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে যেমনটা সে প্রতিদিন সকালেই করে নিজের লোকদের কাছে প্রমাণ করতে যে মোগল সম্রাট এখনও জীবিত রয়েছেন। তোরণগৃহে রক্ষিত অতিকায় দুষ্টুভি ঢাকের বোলের তালে সে তার হাত উঁচু করে। দূর্গের নিচে নদীর তীরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা জনতার অনুকূল গর্জন শোনার সময় মেহেরুন্নিসাও সেই উত্তেজনায় জারিত হয়। এটাই হল আসল ক্ষমতা যখন একজনের বেঁচে থাকা বা মারা যাওয়া নিয়ে লক্ষ কোটি মানুষ চিন্তিত। দূর্গপ্রাকার থেকে এবার তূর্যধ্বনি ভেসে আসে–সবকিছুই সম্রাটের প্রাত্যহিক কৃত্যানুষ্ঠানের অংশ।

মহান সম্রাট… মেহেরুন্নিসার সহসাই শীত শীত অনুভূত হওয়ায় সে শয্যায় ফিরে আসে এবং তাঁদের দেহের ওমে তখনও উষ্ণ রেশমের চাদরটা দিয়ে নিজের দেহ আবৃত করে। গত রাতে সে মুহূর্তের জন্য ইতস্তত না করে রক্ত মাংসের তৈরি একজন মানুষের কাছে নিজেকে এমন আবেগের সাথে সমর্পিত করেছিল যে সে নিজেই জানতো না তার মাঝে এমন আবেগ রয়েছে। তারা তিনবার দৈহিকভাবে মিলিত হয়েছিল, প্রতিবারই আবেগের প্রচণ্ডতা পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। কিন্তু এখন দিনের আলোয় চারপাশ অভিষিক্ত এবং তাঁর প্রেমিক মোটেই কোনো সাধারণ লোক নয় বরং একজন সম্রাট যার নিজের পছন্দের কোনো শয্যাসঙ্গিনী থাকা খুবই সম্ভব। তিনি কেন তাকে ডেকে পাঠালেন? কাবুলে তাকে প্রথমবার দেখার পর থেকে কাটার মত তাকে বিব্রত করতে থাকা একটা বাসনাকে প্রশমিত করতে? কেবলই কৌতূহল?

তাঁর কি আশা করা উচিত? মাঝে মাঝে সম্রাটের শয্যাসঙ্গিণী হবার নিয়তি মেনে নেয়া? তার উপপত্নীর মর্যাদা লাভ করা? তিনি সম্ভবত বাসনা চরিতার্থ করার পরে তার সম্পর্কে আর আগ্রহ প্রদর্শন করবেন না। তার চেয়ে দশ বছরের ছোট কোনো মেয়েকে তিনি অনায়াসে শয্যাসঙ্গিনী করতে পারেন… আধঘন্টা পরে জাহাঙ্গীর যখন ফিরে আসে তখনও সে এই বিষয়টা নিয়েই আকাশ কুসুম ভেবে চলেছে। তিনি ইতিমধ্যেই গোসল করে নিয়েছেন–তাঁর মুখের চারপাশে ভেজা চুলের কালো গোছ ঝুলে আছে। সে আগেই যেমন লক্ষ্য করেছে তার অভিব্যক্তি আন্দাজ করা খুবই কঠিন।

‘সম্রাট, আমি কি এবার হেরেমে ফিরে যাবো? সে জানতে চায়, রাতের অন্ধকারে যে লোকটার বাহুলগ্না হয়ে তার সম্পূর্ণভাবে নিজেকে যার সমকক্ষ মনে হয়েছে তাঁর কাছ থেকে চলে যাবার আদেশ শোনবার চেয়ে প্রশ্নটা সে ইচ্ছে করে নিজেই করে।

‘হ্যাঁ।

মেহেরুন্নিসা নিজের সাবলীল পা দুটো এক ঝটকায় শয্যার উপর দিয়ে ঘুরিয়ে আনে এবং ঝুঁকে নিজের হলুদ রঙের আলখাল্লাটা তুলে নেয়। জাহাঙ্গীর তার পেছনে এসে দাঁড়ায়। সে স্তনবৃন্তে তার হাতের আর ঘাড়ের কাছে তার ঠোঁটের উপস্থিতি অনুভব করে। সে তারপরে তাকে এক ঝটকায় তুলে নেয় এবং তাকে ঘুরিয়ে নিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড়াতে বাধ্য করে।

‘তুমি কিছুই বুঝতে পার নি, সে বলে, আর আমি নিজেও ঠিক নিশ্চিত নই যে আমিও পুরোপুরি বুঝেছি…’

‘জাহাপনা?’

‘গত রাতে তোমায় এখানে ডেকে পাঠানোটা কিন্তু আমার খেয়াল ছিল না। কাবুলে তোমায় প্রথম দেখার মুহূর্ত থেকেই আমি তোমায় কামনা করেছি এবং তোমায় নিয়ে আমার ভাবনা কখনও থেমে থাকেনি। আমি যখন জানতে পারলাম আমার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্রে তোমার পরিবারকে মিথ্যা জড়ানো হয়েছে আমি তখন ভয় পেয়েছিলাম ঘটনাটা হয়তো চিরতরে তোমায় আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেবে। একজন সম্রাট কখনও অসন্তোষ… রাজবৈরীতাকে প্রশ্রয় দিতে পারে না, উচিত নয়। তাঁর শক্তিশালী চোয়াল দৃঢ়ভাবে চেপে বসে। তুমি যখন আমার সাথে দেখা করার অনুমতির জন্য রীতিমত অনুনয় করেছিলে তখনও আমি জানতাম না তুমি আসলে ঠিক কি অনুরোধ করবে। গিয়াস বেগের ব্যাপারটা খুব একটা জটিল ছিল না। আমি তোমায় তখনই বলেছিলাম আমি ততক্ষণে বিশ্বাস করেছি যে তিনি নির্দোষ। সে যাই হোক, তুমি সাহসিকতার সাথে তাঁর পক্ষাবলম্বন করেছিলে যখন তুমি জানতে যে আমি তাকে ইতিমধ্যে দোষী সাব্যস্ত করেছি। কিন্তু তোমার ভাই মীর খানের বিষয়ে তোমার আচরণ আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছিল। আমি জানি পরিবারের ভিতরে একজন বিশ্বাসঘাতক থাকলে নিজের কাছে কেমন লাগে…’ তিনি কথাটা শেষ না করে খানিকটা নির্দয় ভঙ্গিতে হাসেন, ‘আমি জানি পরিবারের প্রতি ভালোবাসার টান প্রশমিত করাটা কত কঠিন। সেটা করবার মত সামর্থ্য তোমার রয়েছে–আমি তোমার ভাইয়ের প্রাণদণ্ড কার্যকর করছি তুমি প্রত্যক্ষ করেছে যাতে করে তোমার পরিবারের বাকি সমস্যরা বাঁচবার একটা সুযোগ পায়।

তিনি তাঁর থুতনি উপরের দিকে কাত করে তার মুখের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকালে মেহেরুন্নিসার চোখের কোণে কান্নার রেশ জমতে শুরু করে।

‘আমার দাদাজান হুমায়ুন নিজের জীবনসঙ্গিনী হামিদার মাঝে আত্মার আত্মীয়কে খুঁজে পেয়েছিলেন। আমার মনে হয় আমি তোমার মাঝেই যাকে খুঁজছি পেয়েছি। আমি তোমায় আমার সম্রাজ্ঞী করতে চাই এবং আমার সব স্ত্রীদের প্রধান। আমার বিরুদ্ধে নিজ পুত্রের বিদ্রোহ দমন করা শেষ হলেই আমরা বিয়ে করবো_যদি তুমি আমায় গ্রহণ করতে সম্মত হও।

‘আমি অন্য কারো কথা চিন্তাই করতে পারি না। সে টের পায় তিনি পরম মমতায় তাঁর অশ্রু মুছিয়ে দিচ্ছেন।

কিন্তু আমি তোমায় আরো একটা কথা বলতে চাই। আমি যদি কথাটা না বলি তাহলে আমি নিজের কাছেই ছোট হয়ে যাব। তোমার স্বামী শের আফগানকে আমার নির্দেশেই হত্যা করা হয়েছিল। আমিই আগ্রা থেকে গৌড়ে একজন আততায়ী প্রেরণ করেছিলাম তাকে হত্যা করতে।’

মেহেরুন্নিসা চমকে উঠে, সে আরো একবার সেই ধুসর নীল চোখ দুটো নিজের মানস পটে ভেসে উঠতে দেখে। খুনী কি একজন ফিরিঙ্গি ছিল?

‘হা। তার নাম বার্থোলোমিউ হকিন্স। সে এখন আমার দেহরক্ষীদের একজন। আমি তাকে হত্যা করার পরেই কেবল জানতে পেরেছি যে তোমার স্বামী অসংখ্য অপরাধে অপরাধী ছিল–উৎকোচ গ্রহণ, নিষ্ঠুরতা, হুমকি প্রদর্শন করে অর্থ আদায়–কিন্তু তাকে হত্যা করার সময়ে আমি এসব কিছুই জানতাম না। আমি তাকে হত্যা করার আদেশ দিয়েছিলাম কারণ সে আমার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মেহেরুন্নিসা… তুমি কি পারবে আমায় ক্ষমা করতে?

মেহেরুন্নিসা তাঁর আঙুলের অগ্রভাগ জাহাঙ্গীরের ঠোঁটে পরম আবেগে স্থাপন করে। কোনো কিছু বলার কোনো দরকার নেই আর আমার ক্ষমা করার প্রশ্নই উঠে না। আমি শের আফগানকে ঘৃণা করতাম। সে আমার সাথে ভীষণ নিষ্ঠুর আচরণ করতো। আমি তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছি বলে আমি কৃতজ্ঞ।

‘তাহলে আমাদের মিলনের মাঝে আর কোনো বাঁধাই রইল না। জাহাঙ্গীর মাথা নুইয়ে এনে মেহেরুন্নিসাকে লম্বা আর আবেগঘন একটা চুম্বন দেয়।

*

পরিচারকের দল তাঁর ব্যক্তিগত দর্শনার্থী কক্ষে তাঁর প্রবেশের জন্য প্রবেশ পথের পর্দা দুপাশে সরিয়ে ধরতে, জাহাঙ্গীর ইয়ার মোহাম্মদের চওড়া কাঠামোটা দেখতে পায়, তাঁর সদ্য নিযুক্ত গোয়ালিওরের শাসনকর্তা। ইয়ার মোহাম্মদ, জাহাঙ্গীরকে দেখা মাত্র, মধ্য এশিয়ায় অবস্থিত নিজ মাতৃভূমিতে প্রচলিত অভিবাদন জানাবার ঐতিহ্যবাহী রীতি অনুসারে নিজেকে সামনের দিকে নিক্ষেপ করে, শ্ৰদ্ধাপ্রকাশের জন্য হাত শরীরের দু’পাশে প্রসারিত করে অধোমুখে মাটিতে প্রণত হয়।

‘ইয়ার মোহাম্মদ, ওঠো। আমার বিরুদ্ধে আমার বিশ্বাসঘাতক ছেলের সাথে মিলিত হয়ে যারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল তুমি কি তাদের হাত থেকে পৃথিবীকে মুক্তি দিয়েছো?

‘জাঁহাপনা, আমি বিশ্বাস করি, আমি তাঁদের সবাইকে সনাক্ত করতে আর তাদের সবার সাথে হিসাব চূড়ান্ত করতে সক্ষম হয়েছি। আপনার আদেশ অনুসারে, যারা অপরাধ স্বীকার করেছিল জল্লাদের তরবারির নিচে আমি তাদের দ্রুত আর সহজ মৃত্যু দান করেছি। সাদ আজিজ নামে একজনই কেবল তপ্ত লাল লোহার দ্বারা নির্যাতন করার পরেও নিজের দোষ স্বীকার করতে অস্বীকার করেছিল। আমার মনে হয় তার ধারণা ছিল সে চালাকি করে আমাদের পরাস্ত করতে এবং বিচার এড়িয়ে যেতে পারবে কিন্তু অন্য একজন ষড়যন্ত্রকারীকে যখন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন সে সাদ আজিজের লেখা একটা চিঠি আমাকে দেখিয়েছিল– আমার মনে হয় মৃত্যুর পূর্বে সে নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকতে চেয়েছে। সাদ আজিজ সেই চিঠিতে যুবরাজ খসরুকে সমর্থন করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। আমি যখন চিঠিটা নিয়ে তার মুখোমুখি হয় সে ঔদ্ধত্যের চরমে পৌঁছে দাবি করে যে চিঠিটা জাল।

বিশ্বাসঘাতকতা পুরষ্কার সম্বন্ধে সবার সম্যক ধারণা থাকা উচিত বিবেচনা করে আমি তৃণভূমি এলাকায় প্রচলিত প্রাচীন মোগল শাস্তির একটা তাকে দেই, গোয়ালিওর দূর্গের নিচে অবস্থিত বিশাল কুচকাওয়াজ ময়দানে আমি সেনাছাউনি আর শহরের লোকদের সমবেত হবার আদেশ দেই। তোরণগৃহ থেকে দামামার বাদ্যের সাথে আমি সাদ আজিজের চার হাত পায়ের সাথে শক্ত করে বুনো স্ট্যালিয়ন বাঁধার আদেশ দেই। প্রহরীরা ঘোড়ার লাগাম ছেড়ে দেয় এবং চাবুকের আঘাতের বল্পা চালে ঘোড়াগুলোকে ছুটতে বাধ্য করে যাতে করে সাদ আজিজের চার হাত পা তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসে। আমি তাঁর চার হাত পা দূর্গের চারটা প্রবেশ পথের প্রতিটায় একটা করে স্থাপন করি আর তার দেহ আর মস্তক বাজারে প্রদর্শন করার জন্য রাখা হয়।

ইয়ার মোহাম্মদের বাম গালের সীসা-রঙের ভয়ঙ্কর ক্ষতচিহ্ন বিশিষ্ট সরু মুখটা ভাবলেশহীন দেখায় যখন সে তার কার্যবিবরণী পেশ করে। জাহাঙ্গীর এক মুহূর্তের জন্য তাঁর নিযুক্ত শাসনকর্তার নিষ্ঠুরতার বিষয়ে নিজের কাছেই প্রশ্ন করে কিন্তু সে যা করেছে সেটা করার এক্তিয়ার তার রয়েছে। সাদ আজিজকে দোষ স্বীকার করার যথেষ্ট সুযোগ দেয়া হয়েছিল। তার যন্ত্রণাদায়ক আর লজ্জাজনক মৃত্যু দেখে যদি অন্যরা বিদ্রোহের ভাবনা থেকে নিজেদের বিরত রাখে তাহলে কাজটা যুক্তিযুক্ত হয়েছে। বস্তুত পক্ষে একটা বিষয় জেনে তাঁর ভালো লাগে যে মাত্র তিনমাসের ভিতরে সে তার সন্তানের বিদ্রোহ প্রচেষ্টা পুরোপুরি নস্যাৎ করতে সক্ষম হয়েছে। এরপরেও অবশ্য পরবর্তী প্রশ্ন জিজ্ঞেস করাটা তার জন্য খুব কঠিন হয়।

“আর যুবরাজ খসরু?

‘আপনি ঠিক যেমন আদেশ দিয়েছিলেন ঠিক সেভাবেই শাস্তি কার্যকর করা হয়েছে। আপনার প্রেরিত হেকিম, যিনি বাস্তবিকই এসব বিষয়ে ভীষণ দক্ষ, প্রথমেই যন্ত্রণা লাঘব করার জন্য তাকে আফিম দিয়েছিল। তারপরে আমার চারজন শক্তিশালী সৈন্য তাকে মাটিতে চেপে ধরে এবং পঞ্চমজন তাঁর মাথাটা শক্ত করে ধরে রাখে যাতে নড়াচড়া করতে না পারে যখন হেকিম রেশমের মজবুত সুতো দিয়ে তার চোখের পাতা একসাথে শক্ত করে সেলাই করে দেয়। যুবরাজ তার চারপাশের পৃথিবীর কিছুই দেখতে পাবেন না এবং জাহাপনা আপনার আর আপনার সাম্রাজ্যের শান্তির জন্য তিনি এখন আর কোনো হুমকি নন।

জাহাঙ্গীরের কাছে ভাবতে খারাপই লাগে যে তাঁর সুদর্শন আর প্রাণবন্ত ছেলেটার এমন পরিণতি হয়েছে কিন্তু সে নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দেয় যে সে নিজেই এই পরিণতি ডেকে এনেছে। অন্ধ করে দেয়াটা মোগলদের আরেকটা ঐতিহ্যবাহী শাস্তি দেয়ার পদ্ধতি যা তাদের সাথেই মধ্য এশিয়া থেকে হিন্দুস্তানে এসেছে। একজন শাসক এই পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে নিজের পরিবারের অবাধ্য সদস্যদের হত্যা না করে তাদের নিষ্ক্রিয় করতে পারেন। তাঁর উজির মজিদ খান তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল যে এভাবেই তার দাদাজান হুমায়ুন নিজের সৎ-ভাইদের ভিতরে সবচেয়ে দুর্দমনীয়, কামরানের সমস্যার সমাধান করেছিল। জাহাঙ্গীর বিষয়টা নিয়ে যতই চিন্তা করেছে ততই তাঁর কাছে মনে হয়েছে এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত শাস্তি হতে পারে। কামরানের ক্ষেত্রে তার চোখের মণিতে সুই দিয়ে এঁফোড় ওফোঁড় করার পরে তাতে লবণ আর লেবু ঘষে দিয়ে চিরতরে তাঁর দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করে দেয়া হয়েছিল। খসরুর চোখের পাতা কেবল সেলাই করে দেয়া হয়েছে, তার সন্তান যদি কোনোদিন সত্যিই নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয় সে তখন তাহলে হেকিমকে আবার তাঁর চোখের পাতা খুলে দেয়ার আদেশ দিবে।

জাহাঙ্গীর সহসা একটা শব্দ শুনে ঘুরে দাঁড়িয়ে কক্ষের প্রবেশ পথে সন্ত্রস্ত দর্শণ এক কর্চিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।

‘জাহাপনা-’ সে বলতে শুরু করে, কিন্তু মাঝপথেই থেমে যায়।

‘আমি আদেশ দিয়েছিলাম যে আমাকে যেন কোনোভাবেই বিরক্ত করা না হয়, আমি ইয়ার মোহাম্মদের সাথে একা আলাপ করতে চাই।’ জাহাঙ্গীর ক্রুদ্ধ চোখে অল্পবয়সী ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

‘আমি হেরেম থেকে একটা জরুরি সংবাদ নিয়ে এসেছি।’

‘সেটা কি?’ জাহাঙ্গীর ভাবতে গিয়ে সহসাই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে, মেহেরুন্নিসার কি কিছু হয়েছে।

‘মহামান্য সম্রাজ্ঞী, মান বাঈ। তাঁর পরিচারিকা তাকে তার বিয়ের পোষাকে নিজের শয্যায় শায়িত অবস্থায় খুঁজে পেয়েছে। তাঁর শয্যার পাশে আফিম মিশ্রিত পানির একটা বোতল পড়ে ছিল। তাঁদের ধারণা তিনি মাত্রাতিরিক্ত সেবন করেছেন–বোতলে কেবল তলানি পড়ে ছিল।

জাহাঙ্গীরের মনটা করুণার সাথে সাথে বিরক্তিতে ছেয়ে যায়। মান বাঈ সবসময়েই অস্থিরপ্রকৃতির কখনও কখনও উন্মত্ত, এবং তার প্রথম স্ত্রী হবার কারণে একটা সময়ে সে পরবর্তীতে যাদের বিয়ে করেছে তাদের পাগলের মত ঈর্ষা করতো। সে একাধিকবার নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করে তার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছে। সে নিশ্চয়ই তার সন্তান খসরুর অন্ধত্বের কথা শুনেছে। গোয়ালিওর থেকে ইয়ার মোহাম্মদের সাথে আগত পরিচারিকাদের একজন নিশ্চয়ই শাস্তির কথা আলোচনা করেছে এবং খবর দ্রুত দেখা যাচ্ছে বেশ তড়িৎ গতিতে ছড়িয়েছে। নিজের সন্তানের প্রতি মান বাঈয়ের অন্ধ স্নেহের কারণে তিনি সবসময়ে ছেলের অপরাধের গুরুত্ব অস্বীকার করেছেন। তিনি সবসময়ে তাকে অবাধ্য, একটু বেশিমাত্রায় প্রাণবন্ত হিসাবেই দেখেছেন। খসরুর উচ্চাশার রক্তলোলুপ গভীরতা এবং সেটা অর্জন করার জন্য সে কত কিছু করতে পারে, তিনি কখনও বোঝার চেষ্টা করেন নি। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তিনি জাহাঙ্গীরের কাছে বারবার অনুরোধ করেছেন খসরুকে ক্ষমা করতে, কখনও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন কখনওবা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। আফিম সেবন সম্ভবত সংবাদটা পাবার পরে তাঁর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া–শোক আর প্রতিবাদের অভিব্যক্তি। কিন্তু খসরুকে অন্ধ করে দিয়ে তিনি যেমন সন্তুষ্ট বোধ করেন নি তেমনি ব্যাপারটা নিয়ে তার ভিতরে কোনো ধরনের আক্ষেপও নেই। ষড়যন্ত্র দমনে শাস্তি প্রদান করা না হলে, বিশৃঙ্খলার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। ‘আমি এখনই যাচ্ছি। ইয়ার মোহাম্মদ আমায় মার্জনা করবেন, সে কথাটা বলেই দ্রুত কক্ষ থেকে বের হয়ে আসে।

হেরেমে মান বাঈয়ের কক্ষের কাছাকাছি পৌঁছাতে, সহসা সে বিলাপধ্বনি শুনতে পায়। সে ভিতরে প্রবেশ করতে, একহাত প্রসারিত করে, ডিভানের উপর নিখুঁতভাবে শুয়ে থাকা একটা আকৃতির চারপাশে তার রাজপুত পরিচারিকাদের জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। তাঁর প্রথম স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেছে এটা জানার জন্য জাহাঙ্গীরকে কারো সাথে কোনো কথা বলতে হয় না।

সে কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তাঁর মনে সন্দেহ, মর্মপীড়া আর আত্মনিন্দার একটা ঝড় বইতে থাকে। সে তাকে প্রথমবার যখন দেখেছিল সেই মান বাঈয়ের স্মৃতি-তরুণী এবং তাকে তার অশুভ সত্ত্বা দখল করার আগে ভালোবাসা আর বেঁচে থাকার জন্য কাঙাল-হুহু করে তার চোখের সামনে ভেসে উঠে। সে একটা সময়ে তাকে পছন্দই করতে এবং কখনও তার ক্ষতি চায় নি, এমন নির্মম মৃত্যুর প্রশ্নই উঠে না। তাঁর চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু টলটল করতে থাকে, কিন্তু সে চোখ মুছে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তার আত্মহত্যায় তাকে কোনোভাবেই দায়ী করা যাবে না। খসরু নিজের জীবনের সাথে সাথে আরও অনেকের জীবনই ধ্বংস করেছে, এবং সে, একমাত্র সেই নিজের হঠকারীতা আর স্বার্থপর উচ্চাশার দ্বারা নিজের মায়ের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। জাহাঙ্গীরের মুখের অভিব্যক্তি কঠোর হয়ে উঠে। সে আর কখনও নিজের পরিবারের কোনো সদস্যকে সুযোগ দেবে না তার রাজতুকে হুমকির সম্মুখীন করে বা তার সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।

‘অন্তেষ্টিক্রিয়ার জন্য চিতা নির্মাণের আদেশ দাও। মান বাঈকে তাঁর হিন্দু ধর্ম অনুসারে দাহ করা হবে কিন্তু সেই সাথে সম্রাটের স্ত্রী হিসাবে তাকে তার প্রাপ্য সম্মান দেখান হবে, সে গম্ভীরভাবে বলে এবং তারপরে একটা কথা না বলে কামরা থেকে বের হয়ে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়।

১.০৮ ‘প্রাসাদের নূর’

জাহাঙ্গীর তাঁদের বিয়ের পরের দিন সকালে অলসভাবে আড়মোড়া ভাঙে তারপরে তার পাশে নিরাভরণ হয়ে শুয়ে থাকা মেহেরুন্নিসার দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। তাঁর ত্বকের মুক্তোর মত আভা দেখে তার দিকে আড়াআড়িভাবে ঘুরে থাকা তার কোমর স্পর্শ করতে তাঁর খুব ইচ্ছা হয় কিন্তু সে তার ঘুম ভাঙাতে চায় না। ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁর নিটোল স্তনের উঠা নামা, পুরু ঐ ঠোঁট, ছোট খাড়া নাক আর চওড়া ভ্রু যুগল দেখতে তার ভালোই লাগে। সে নিশ্চিত, তার কমনীয় মুখশ্রী দেখতে তার ভিতরে কখনও বিরক্তি উদ্রেক হবে না। সে নিশ্চিত, দ্বিতীয়বারের মত খসরুর বিদ্রোহ প্রচেষ্টা দমন আর মান বাঈয়ের মৃত্যুর ঠিক পরপরই, তাদের বিয়েটা অবশ্যই তার জীবন আর তাঁর রাজত্বকালের একটা নতুন সূচনার স্মারক হয়ে থাকবে। সে তার নিজের এবং তাঁর সাম্রাজ্যের জন্য যত স্বপ্ন দেখেছে সবকিছু সে তাকে পাশে নিয়ে সফল করবে।

মেহেরুন্নিসা সহসাই তার বড় বড় চোখ দুটো খুলে সরাসরি তার দিকে তাকায়।

‘তোমার কাছে আমি একটা ওয়াদা করতে চাই,’ সে বলে।

‘সেটা কি?

‘সেটা হল যে আমি আর কখনও বিয়ে করবো না। আমার যদিও আরও অনেক স্ত্রী রয়েছে কিন্তু তুমিই হবে আমার শেষ স্ত্রী। মেহেরুন্নিসা তাকে চুম্বন করার জন্য সামনের দিকে ঝুঁকে আসে কিন্তু নিজের অভিপ্রায়ে সফল হবার আগে সে বলতেই থাকে, দাঁড়াও মেয়ে আমার আরও কিছু বলার আছে। আমাদের বিয়ে স্মরণীয় করতে দরবারে আজ থেকে সবাই তোমায় নূর মহল হিসাবে জানবে।’

মেহেরুন্নিসা উঠে বসে। নূর মহল মানে প্রাসাদের আলো। এটা একটা বিশাল সম্মানের…’

‘আমার রক্ষিতাদের মত কথা বলো না, যাদের মুখে মুখ আর অন্তরে অভিলাষ আর ছলনা। সে এমনভাবে তাকায় যেন সে ভেবেছিল তিনি তাঁর সাথে ঠাট্টা করছেন কিন্তু তিনি মোটেই ঠাট্টা করছেন না এবং বলতে থাকেন, তার কণ্ঠস্বর গম্ভীর, তোমার কৃতজ্ঞতা আমি চাই না। এই উপাধিটা আমি পছন্দ করেছি কারণ তুমি আমার জীবনে আলোকচ্ছটা বয়ে এনেছো। তোমার জন্য দরবারের একজন অলঙ্কার প্রস্তুতকারী তোমার নতুন নামযুক্ত একটা সীলমোহর প্রস্তুত করছে–হাতির দাঁতের উপর পান্নাখচিত… এটা আমার হৃদয়ে এবং আমার দরবারে তুমি যে স্থান দখল করে রেখেছো সেটা প্রকাশ করবে। কিন্তু আমার কাছে তুমি সবসময়ে মেহেরুন্নিসাই থাকবে। আমার এখনও মনে আছে আমার মরহুম আব্বাজানের দর্শনার্থী কক্ষের একটা স্তম্ভের পেছনে দাঁড়িয়ে আমি তোমার আব্বাজানকে পারস্য থেকে তার যাত্রার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে শুনছি–কেমন করে, তুমি ভূমিষ্ঠ হবার প্রায় সাথে সাথে, তিনি এমন বেপরোয়া পরিস্থিতির ভিতরে ছিলেন যে তোমায় তিনি পরিত্যাগ করেছিলেন, এবং কীভাবে বৈরী আবহাওয়া আর নেকড়ের মুখে তোমায় ফেলে যাবার ভাবনা সহ্য করতে না পেরে তোমার জন্য আবার ফিরে এসেছিলেন… আমার কাছে তখন মনে হয়েছিল যদিও আমি তখন কেবলই একজন বালক যে অদৃষ্ট তোমার জীবনে একটা ভূমিকা পালন করেছে। অদৃষ্ট আমার পরিবারেও ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে। আমার প্রপিতামহ বিশ্বাস করতেন যে এখানে এই হিন্দুস্তানে একটা সাম্রাজ্যের সন্ধান পাওয়া তাঁর অদৃষ্টে রয়েছে। আমার আর আমার সন্তানদের অদৃষ্ট উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সেই সাম্রাজ্যের উন্নতি বিধান করা।

‘আমি আপনাকে সাহায্য করবো, মেহেরুন্নিসা বলে, প্রতিটা শব্দ সে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে। নিয়তি তাকে প্রভাব আর প্রতিপত্তি লাভের একটা সুযোগ দান করেছে তার মত খুব মেয়েই যা লাভ করে এবং সে সুযোগটা হাতছাড়া করবে না।

জাহাঙ্গীর উঠে বসে এবং কাঁধের উপর থেকে নিজের কালো চুল আঁকিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসে, তার নগ্ন অবয়বের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ হতে তাঁর মেজাজ আরো একবার হাল্কা হয়ে উঠে। এটা আমাদের বাসর রাতের শয্যা। আমি গম্ভীর বিষয় নিয়ে বড় বেশি কথা বলছি। আমরা এখন কেবল একজন নববিবাহিত পুরুষ আর নববধূ, আর আমি এখন কেবল তোমার সাথে আবারও মিলিত হতে চাই।

মেহেরুন্নিসা তাঁর দিকে দু’বাহু বাড়িয়ে দেয়।

*

সাল্লা চিরুনি দিয়ে তার লম্বা চুল আঁচড়ে দেবার সময় মেহেরুন্নিসা তাঁর চোখ বন্ধ করে রাখে। সে আর্মেনিয়ান মেয়েটাকে তাঁর সঙ্গিনী করতে সমর্থ হওয়ায় সে খুব খুশি হয়েছি কিন্তু মালার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার চেয়ে সন্তুষ্টিজনক আর কিছুই হতে পারে না। তার বিয়ের তিন সপ্তাহ পরে যমুনা নদী দেখা যায় এমন একটা বুরুজে নিজের নতুন আর বিলাসবহুল আবাসন এলাকায়–যেখানে একসময় জাহাঙ্গীরের দাদিজান হামিদা বাস করতেন–সে খাজাসারাকে ডেকে পাঠায়।

‘তুমি যেভাবে রয়েছে ঠিক সেভাবেই বিদায় নেবে। সবকিছু রেখে যাবে, মেহেরুন্নিসা, মালা তাকে যা বলেছিল ঠিক সেই শব্দগুলোই পুনরাবৃত্তি করে, তাকে বলেছিল। খাজাসারা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

‘কিন্তু আপনি আমাকে বরখাস্ত করতে পারেন না। আমি আমার দায়িত্ব সততা আর বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থেকে পালন করেছি।’

‘তুমি তোমার ক্ষমতা বড্ড বেশি উপভোগ করো।

খাজাসারার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে। সে প্রত্যুত্তরে কিছু একটা বলবে বলে মনে হয় কিন্তু বুঝতে পারে সেটা বলাটা মোটেই বুদ্ধিমানের মত কাজ হবে না এবং মাথা ঝাঁকিয়ে সে চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়।

‘তুমি কিছু একটা ভুলে যাচ্ছো।

মালা থমকে যায় এবং সে যখন তার মাথা ঘুরিয়ে পুনরায় মেহেরুন্নিসার দিকে তাকায় দেখে যে তার চোখ ক্রোধের অশ্রুতে চিকচিক করছে। ‘মহামান্য সম্রাজ্ঞী, সেটা কি?

“তোমার কর্তৃত্বের দণ্ড।

মেহেরুন্নিসা বিয়ের অনুষ্ঠানের সময় মেহেদি রঞ্জিত হাত বাড়িয়ে দেয়, এবং মালা অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাতির দাঁতের কারুকাজ করা দণ্ডটা তাঁর দিকে এগিয়ে দেয় তার স্পর্শের কারণে সেটা তখনও উষ্ণ হয়ে রয়েছে।

‘মালকিন–এই জুঁই ফুলগুলি আমি কি আপনার চুলে গেঁথে দেবো? সাল্লা তার আবলুস কাঠের তৈরি চিরুনি বাতাসে আন্দোলিত করে জানতে চায়।

মেহেরুন্নিসা মাথা নাড়ে। সাল্লার চপল আঙুলগুলো নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠতে সে আরো অনেক আনন্দময় স্মৃতির মাঝে নিজের মনকে হারিয়ে যেতে দেয়। জাহাঙ্গীরের সাথে তার বিয়ের রাতটা শের আফগানের সাথে তার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেটা থেকে কতই না আলাদা প্রকৃতির। তাঁর তখন অনেক অল্প বয়স, অনেক অনভিজ্ঞ, বিশেষ করে পুরুষরা যা পছন্দ করে। শের আফগানের কাছে কেবল নিজের সন্তুষ্টিই মূখ্য ছিল। জাহাঙ্গীর একজন কুশলী প্রেমিক কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা সে তার প্রতিটা প্রণয়স্পর্শের মাঝে তার ভালোবাসার আবেগ অনুভব করতে পারে। সে প্রতিদিনই তাকে উপহার পাঠায় এবং তাকে বলে, তোমার যদি কিছু পছন্দ হয় তুমি কেবল মুখ ফুটে সেটা বলবে আর সেটা তোমার হবে। একজন সম্রাজ্ঞী হিসাবে, তার ভাবতে ভালোই লাগে, শ্রেষ্ঠ সবকিছু সে চাইলেই পেতে পারে। সে এই জাঁকালো দরবারে নিজের অবস্থানের যথাযথ প্রয়োগ করতে পারবে।

কিন্তু কি হবে সেই অবস্থান? জাহাঙ্গীর মনেপ্রাণে যা কামনা করে সেই আত্মার আত্মীয় সে কীভাবে হবে? সে হুমায়ুন আর হামিদার মাঝে বিদ্যমান আন্তরিক সম্পর্কের কথা বলেছে। তার কাছে হুমায়ুন আর হামিদা কেবল দুটি নাম, কিন্তু তাকে তাদের ব্যাপারে আরও অনেক কিছু জানতে হবে, জাহাঙ্গীর তাকে যেভাবে কামনা করে তাকে চেষ্টা করতে হবে সেভাবে নিজেকে পরিবর্তিত করতে আর তার মাঝে দিয়েই সে নিজের অস্থির আকাঙ্খা আর উচ্চাশাগুলো পূরণ করতে পারবে। সবচেয়ে বড় কথা তাঁর প্রতি তাঁর ভালোবাসা যেন বজায় থাকে। সেটা ছাড়া আর কিছুরই কোনো মূল্য নেই…।

তার জন্য–এবং তাঁর পরিবারের জন্য এই মুহূর্তে সম্ভাবনাগুলো-অসীম বলে প্রতিয়মান হয়। জাহাঙ্গীর তার আব্বাজানকে রাজকীয় কোষাধ্যক্ষ হিসাবেই কেবল পূর্নবহাল করেন নি সেই সাথে নতুন অনেক খেতাবে তাকে ভূষিত করেছেন যার ভিতরে রয়েছে ইতিমাদ-উদ-দৌলা উপাধি, যার মানে সাম্রাজ্যের স্তম্ভ। খুররমের সাথে আরজুমান্দের বিয়ের ব্যাপারে সে অচিরেই উদ্যোগ নেবে কিন্তু কোনো তাড়াহুড়ো করতে যাবে না… কেউ যেন বলতে না পারে যে নতুন সম্রাজ্ঞী অধিষ্ঠিত হতে না হতেই তিনি নিজের পরিবারের সমৃদ্ধির জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। হেরেমে যদিও সবাই এখন তার সাথে শ্রদ্ধাপূর্ণ আচরণ করে, সে জানে জাহাঙ্গীরের সাথে তার বিয়ের ফলে নিশ্চিতভাবেই অনেকেই নারাজ হয়েছে। জাহাঙ্গীরের অন্যান্য স্ত্রীদের মত তার জন্ম কোনো অভিজাত বংশে হয় নি। খুররমের আম্মিজান, যোধা বাঈ, একজন রাজপুত রাজকুমারী, অন্যদিকে তাঁর বড়ভাই পারভেজের আম্মিজান, সাহিব জামালের জন্ম প্রাচীন এক মোগল অভিজাত বংশে। তাঁদের সাথে এখন পর্যন্ত তাঁর কেবল একবারই দেখা হয়েছে–উভয়েই তাঁর আবাসিক এলাকায় সৌজন্যমূলক দেখা করতে এসেছিল–সে তখন তাদের আনুষ্ঠানিক শিষ্টাচার আর রসিকতার নিচে চাপা তাচ্ছিল্য আর সতর্কতা আঁচ করতে পেরেছে।

‘পারস্য থেকে তোমার আব্বাজানের কপর্দকশূন্য অবস্থায় মোগল দরবারে আগমন করাটা ছিল একটা অসাধারণ ঘটনা, মেহেরুন্নিসার দেয়া রূপার তবকযুক্ত খুবানির তশতরী থেকে একটা তুলে নেয়ার সময় যোধা বাঈ তাঁর বৃত্তাকার মুখে একটা বাঁকা হাসি ফুটিয়ে রেখে কথাটা বলে।

‘আমার আব্বাজান ছিলেন একজন অভিজাত ব্যক্তি যার নিজের দেশে অদৃষ্ট কখনও তার উপরে সদয় হয় নি। তিনি ভাগ্যবান মৃত সম্রাটের অনুগ্রহ তিনি লাভ করেছিলেন।

বস্তুতপক্ষে, তোমাদের পুরো পরিবারটাই ভাগ্যবান বলতেই হবে। যোধা বাঈয়ের মুখের হাসি একটু যেন টানটান হয়ে উঠে।

‘সেটা সত্যি কথা, অবশ্য এসব কিছুই আল্লাহতা’লার মেহেরবানি, মানুষের এতে কোনো হাত নেই, মেহেরুন্নিসা প্রত্যুত্তরে বলে এবং খুররমের সুন্দর চেহারার প্রশংসা করে আলোচনার মোড় খুররমের দিকে ঘুরিয়ে দেয়।

যোধা বাঈ, একজন মমতাময়ী আর সন্তানগর্বে গর্বিত মা হবার কারণে খানিকটা নমনীয় হন, কিন্তু তারপরেই সরাসরি মেহেরুন্নিসার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন, এটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ যে আমার সন্তান যেন ভালো কোনো বংশে বিয়ে করে। তার ধমনীতে একই সাথে মোগল রাজবংশ আর ক্ষমতাবান রাজপুত গোত্রের রক্ত বইছে।

মেহেরুন্নিসা শিষ্টাচার বজায় রেখে সম্মতি জানায় কিন্তু সে ঠিকই বুঝতে পারে যোধা বাঈ আসলে কি বোঝাতে চেয়েছে–আরজুমান্দকে বিয়ের ব্যাপারে খুররমের আকাঙ্খ সে সমর্থন করে না। সে এখন বিয়েটাকে পরিণতির দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য আরো অনেক বেশি সংকল্পবদ্ধ।

পারভেজের আম্মিজান তুলনামূলকভাবে মৃদুভাষী। সাহিব জামালের ঘন পাপড়িযুক্ত কালো চোখের মণিতে মেহেরুন্নিসা এক ধরনের উদ্ধত কৌতূহল লক্ষ্য করে, যদিও সে অনেক কম প্রশ্ন করে। সে কেবল নিজের আর নিজের পরিবার সম্পর্কে তাঁর পূর্বপুরুষেরা কীভাবে বাবরের সাথে তাঁর হিন্দুস্তান অভিযানে অংশ নিয়েছিল–কেবল সেই কথাই বয়ান করে। সে একটা বিষয় পরিষ্কার বুঝিয়ে দেয় যে মেহেরুন্নিসা তাঁর কাছ থেকে সামান্যতম ঘনিষ্ঠতা প্রত্যাশা না করলেই ভালো। আমি নিরূপদ্রব, নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করি, সাহিব জামাল বিড়বিড় করে বলে। আমার স্বাস্থ্য খুবই নাজুক আর সঙ্গত কারণেই আমার বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা খুবই সীমিত।

তাদের এই বিদ্বেষের কিছুটা অবশ্য অল্পবয়স্কা, সুন্দর মুখশ্রীর অধিকারী প্রতিপক্ষের প্রতি যৌবনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়া দু’জন রমণীর স্বাভাবিক ঈর্ষা। মেহেরুন্নিসা নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে নিজেই হেসে ফেলে। সে জুই ফুলের প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছে…সে কোনোমতেই তাদের বৈরীতাকে দ্বারা নিজেকে প্রভাবিত হতে দেবে না এবং সে ইতিমধ্যে ইয়াসমিনার, জাহাঙ্গীরের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সন্তান শাহরিয়ারের উপপত্নী মাতা, সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করেছে। সে ছেলেটাকে যতটুকু দেখেছে তাতে তাঁর মনে হয়েছে দেখতে অস্বাভাবিক রকমের সুদর্শন হলেও, অতিরিক্ত প্রশ্রয়ের কারণে ছিচকাদুনে হয়ে উঠেছে এবং যখনই কোনো কিছু তার মনঃপুত হবে সে সোজা দৌড়ে গিয়ে মায়ের কাছে নালিশ জানাবে–যদি তাঁর শিক্ষকদের কথা বিশ্বাস করতে হয় এবং সেইসাথে পড়ালেখায় ভীষণ দুর্বল। তাকে হেরেম থেকে সরিয়ে নিয়ে এবার আলাদা থাকবার বন্দোবস্ত করতে হবে। কিন্তু ইয়াসমিনাকে সে এসব কিছুই বলেনি, স্পষ্টতই ছেলের প্রতি তাঁর প্রবল ভালোবাসা।

সাল্লা তার চুল বাঁধা শেষ করতে, মেহেরুন্নিসা তার আলখাল্লার নিচে লাল মখমলের ময়ানে আবদ্ধ ইস্পাতের হালকা খঞ্জরটার অস্তিত্ব অনুভব করে যা সে পোষাকে নিচে লুকিয়ে রেখেছে। ফাতিমা বেগমের সাথে অবস্থান করার সময় সে নাদিয়ার কাছে হেরেমের অনেক ঝগড়া আর ঈর্ষার কাহিনী শুনেছে। এক অল্পবয়স্ক সুশ্রী রক্ষিতাকে নিয়ে একটা গল্প রয়েছে যাকে তাঁর প্রতিপক্ষ এক খোঁজাকে উৎকোচ দিয়ে পাথুরে বারান্দা থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়ায় তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। আকবরের এক অল্পবয়স্কা স্ত্রীকে নিয়ে অন্য আরেকটা গল্প প্রচলিত রয়েছে যার খাবারে তার এক শত্রু কাঁচের গুড়ো মিশিয়ে দেয়ায় যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে বেচারীর মৃত্যু হয়েছিল। না, খঞ্জর বহন করাকে কোনোভাবেই বাড়াবাড়ি বলা যাবে না বা বাস্তবিক পক্ষেই খাদ্য পরীক্ষক হিসাবে কাউকে নিয়োগ দেয়া যার কাজ হবে বিয়ের উপহার হিসাবে প্রাপ্ত মিষ্টান্ন আর ফলমূল পরীক্ষা করা যা এখনও প্রতিদিন অজস্র পরিমাণে আসছে। অবশ্য সে যখন জাহাঙ্গীরের সাথে আহার করে তখন সে নিরাপদ। সম্রাটের খাদ্য প্রস্তুতকে কেন্দ্র করে বিশদ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে, যার ভিতরে রয়েছে বাদশাহী রাধুনিদের পরিহিত বিশেষ ধরনের খাটো হাতার আলখাল্লা থাকে যাতে করে সবসময়ে তাঁদের হাত দৃশ্যমান থাকে যাতে করে জাহাঙ্গীরের টেবিলে খাবারের পাত্রগুলো বয়ে নিয়ে যাবার আগে রসুইখানায় খাবারের পাত্র বহনকারীদের চোখের সামনে ময়দার লেই দিয়ে সেগুলোর মুখ বন্ধ করার সময় তারা খাবারে বিষের গুড়ো মিশিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে না পারে। সে যখন একা থাকবে বিপদের সম্ভাবনা তখনই আর তাকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।

*

মেহেরুন্নিসা, আধঘন্টা পরে উঁচু-চূড়াযুক্ত একটা রূপালী হাওদায় উপবিষ্ট অবস্থায় আগ্রা দূর্গের ঢালু পথ দিয়ে নিচে নেমে আসবার সময়, উত্তেজনা আর গভীর সন্তুষ্টির একটা যুগপত অনুভূতিতে জারিত হয়। বাঘ শিকারে জাহাঙ্গীরের সাথে যোগ দেয়ার জন্য সে যখন প্রথমবার প্রস্তাব করেছিল, জাহাঙ্গীরের চোখে মুখে নিখাদ বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠেছিল। কোনো রাজকীয় মোগল রমণী এমন কিছু আগে কখনও করে নি, সে কোনোমতে তাকে বলে।

‘কিন্তু কেন নয়? আমি কেন প্রথম হতে পারি না? আমার পক্ষে যতখানি সম্ভব আমি আপনার সঙ্গী হতে এবং আপনার সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে চাই। আর তাছাড়া, ব্যাপারটা আমার কাছে দারুণ উত্তেজক বলে মনে হয়েছে।’

‘আমি বিষয়টা ভেবে দেখবো, তিনি তাকে বলেন, কিন্তু সে নিশ্চিত বুঝতে পারে তার অনুরোধ তাকে কৌতূহলী করে তুলেছে। জাহাঙ্গীর পরের দিন তাকে হাতির দাঁতের আর আবলুস কাঠের কারুকাজ করা বাটযুক্ত অবিকল দেখতে একজোড়া মাস্কেট উপহার দেয় এবং তাকে বলে যে সে তার শিকারের জন্য এই বিশেষ হাওদা নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন। হাওদাটার চারদিকে প্রশস্ত খোলা জায়গা রয়েছে এবং তাকে মানুষের দৃষ্টির আড়ালে রাখতে যদিও পাতলা কাপড়ের পর্দার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে পর্দাগুলো বড় বড় পিতলের আংটা থেকে ঝোলানো হয়েছে এবং শিকারের সঙ্কটপূর্ণ মুহূর্তে তাকে তার অস্ত্র তাক করার সুযোগ দিতে সেগুলোকে দ্রুত একপাশে টেনে সরিয়ে দেয়া সম্ভব।

মেহেরুন্নিসা বন্দুক ছোঁড়া মকশো করার সময় জাহাঙ্গীর তার প্রশিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তিনি শিকারের সময় নিজের হাতির পিঠে সওয়ার হয়ে পর্দা ঘেরা হাওদায় তার সাথে অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেয়ায় বিষয়টা তার আনন্দ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের পেছনে হেরেমের দু’জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত খোঁজা বসে রয়েছে যারা যত দ্রুত সম্ভব তাদের শিকারের মাস্কেট গুলি ভর্তি করতে সক্ষম।

‘তোমায় উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। জাহাঙ্গীরের ঠোঁট তার গলার পাশে আলতো করে ছোঁয়া দিয়ে যায়।

‘আমি আসলেই খুশি। আজ আমি জীবনের প্রথম শিকার করতে সংকল্পবদ্ধ।

‘আমাদের ভাগ্য হয়ত প্রসন্ন নাও হতে পারে। আজ সকালে আমার শিকারীরা বাঘের যে দলটাকে দেখেছিল তারা হয়ত ইতিমধ্যে অন্যত্র সরে গিয়েছে।

প্রথমে মনে হতে থাকে যে জাহাঙ্গীরের কথাই বোধ হয় ফলতে চলেছে। তাঁদের সামনে দুলকি চালে ছুটতে থাকা শিকারীর দল বাঘের দলটার কোনো নিশানাই খুঁজে পায় না। আগ্রা ত্যাগ করার প্রায় তিনঘন্টা পরে জাহাঙ্গীর হয়তো ফিরে যাবার আদেশ দিতো কিন্তু মেহেরুন্নিসা ব্যাকুল কণ্ঠে অনুরোধ করে, আরেকটু। অনুগ্রহ করে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখি। দেখেন, আজ সকালে যে পাহাড়ের কাছে বাঘের দলটা দেখা গিয়েছিল আমরা প্রায় তার কাছে পৌঁছে গিয়েছি…’

জাহাঙ্গীর তার ব্যগ্রতা দেখে মুচকি হাসে। বেশ, দেখা যাক।

প্রথম দর্শনে গুটিকয়েক কণ্টকযুক্ত ঝোঁপ বিশিষ্ট বালিয়াড়ি-সদৃশ্য প্রান্তর দেখে খুব একটা সম্ভাবনাময় বলে মনে হয় না। বাঘের জন্য এখানে পর্যাপ্ত আড়াল নেই। কিন্তু তারপরেই হঠাৎ পায়ের নিচের মাটি কয়েকটা বিশাল ধুসর রঙের পাথরের দিকে উঠতে শুরু করেছে যার মাঝে তেঁতুল গাছ জন্মায়। তাঁদের বহনকারী হাতিটা সহসাই দাঁড়িয়ে পড়ে এবং জাহাঙ্গীর শিকারীর কথা শোনার জন্য হাওদা থেকে নিচে ঝুঁকে আসে।

‘তাঁরা তাজা পায়ের ছাপ খুঁজে পেয়েছে। তাঁরা সাথে করে নিয়ে আসা ছাগলের একটা মৃতদেহ পাথরের কাছে রাখতে চলেছে, জাহাঙ্গীর কিছুক্ষণ পরে ফিসফিস করে বলে। আমরা এখানে বাতাসের স্রোতের দিকে অপেক্ষা করবো।’

সময় অতিবাহিত হবার সাথে সাথে বাতাসের মৃদুমন্দ প্রবাহ তেঁতুল গাছের মাঝে একটা আলোড়ন সৃষ্টি করে কিন্তু আর কোথাও কোনো শব্দ বা নড়াচড়া দৃষ্টিগোচর হয় না। মেহেরুন্নিসা এরপরেই একটা তীব্র, কস্তরীবৎ গন্ধ পায় এবং জাহাঙ্গীর আরও একবার ফিসফিস করে বলে, তারা আসছেন… চেয়ে দেখো… দু’জন, পাথরের ভিতরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

মাস্কেটগুলো আমাদের হাতে দাও এবং মোম লাগানো সুতোয় আগুন জ্বেলে প্রস্তুত রাখো, সে খোঁজা দু’জনকে আদেশ দেয় এবং এক ঝটকায় হাওদার পর্দা সরিয়ে দেয়। মেহেরুন্নিসা দ্রুত ভারসাম্যের জন্য হাওদার প্রান্তে নিজের অস্ত্রের কারুকাজ করা লম্বা ইস্পাতের ব্যারেল আলম্বিত করে এবং পলিতার পাতলা ক্ষুদ্র দৈর্ঘ্য পরীক্ষা করে। তারপরে, জাহাঙ্গীর তাকে যেভাবে শিখিয়েছে সেভাবে সামনের দিকে অবনত হয়ে, সে ব্যারেল বরাবর তির্যকদৃষ্টিতে তাকায়। পাথরের আড়াল থেকে নিশ্চিতভাবেই এইমাত্র দুটো কালো আর কমলা রঙের আকৃতি বের হয়ে এসেছে। বাঘ দুটো, নিজেদের পিঠের অতিকায় চেটালো অস্থির মাঝে মাথা নিচু করে রেখে, ধীরে এবং সতর্কতার সাথে মৃত ছাগলটার দিকে এগিয়ে আসছে। সে জ্বলন্ত মোমের সুতার জন্য পেছনের দিকে হাত বাড়াতে যাবে তখনই জাহাঙ্গীর বলে, না, এখন নয়। তুমি যদি তাড়াহুড়ো করো তাহলে তুমি হয়তো তাদের ভয় পাইয়ে দেবে।

নিজের কানের ভেতর রক্তের দবদব শব্দ শুনতে শুনতে অপেক্ষা করাটা রীতিমত অত্যাচার মনে হয়। বাঘ দুটো ইতিমধ্যে ছাগলের মৃতদেহটার কাছে পৌঁছে গিয়েছে এবং তারা মাংসের ভিতরে নিজেদের দাঁত বসাবার সাথে সাথে সে টের পায় তাঁদের সতর্কতায় একটা ঢিলেমী এসেছে।

‘এখন!’ জাহাঙ্গীর বলে। তুমি ডানপাশের বাঘটাকে নিশানা করো। আমি বাম পাশেরটাকে সামলাচ্ছি।’

মেহেরুন্নিসা তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা খোঁজাটার কাছ থেকে মোম দেয়া জ্বলন্ত সুতাটা নিয়ে সে তার লক্ষ্যবস্তুর চওড়া বুকে জমে থাকা ছাগলের রক্ত নিশানা করে। সে গুলি করার সাথে সাথে আকষ্মিক তীক্ষ্ণ একটা শব্দ শুনতে পায়, এবং তারপরেই তাঁর গুলিবিদ্ধ বাঘটা একপাশে কাত হয়ে পড়ে যায়, জন্তুটার সাদা গলা তাজা লাল রক্তে ক্রমশ লাল হয়ে উঠে। জাহাঙ্গীরের গুলি করা বাঘটাও প্রায় একই সময়ে বিকট একটা গর্জন করে হুড়মুড় করে মাটিতে আছড়ে পড়ে এবং কিছু সময় থরথর করে কাঁপার পরে নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকে, গোলাপি আর কালচে রঙের জীহ্বা জন্তুটার আধ খোলা মুখ থেকে বের হয়ে থাকে। নতুন এক ধরনের আন্ত্রিক রোমাঞ্চ মেহেরুন্নিসার ভিতর দিয়ে বিদ্যুৎ চমকের মত বয়ে যায়। জ্বলজ্বলে চোখে এবং ঠোঁট ভাঁজ করে সে জাহাঙ্গীরের দিকে ঘুরে তাকায়।

তাঁদের বহনকারী হাতির পেছন থেকে ঠিক সেই সময়ে উচ্চ স্বরগ্রামের একটা প্রলম্বিত চিৎকার ভেসে আসে এবং পিঙ্গল বর্ণের মাদী ঘোড়ায় উপবিষ্ট এক তরুণ কর্চি মাস্কেটের শব্দে আতঙ্কিত হয়ে তাঁদের পাশ দিয়ে দ্বিগ্বিদিক শূন্য হয়ে ঘোড়া হাঁকায়। তাঁদের হাতিটা আতঙ্কিত হয়ে শুড় উঁচু করে এবং পা নাড়ায় কিন্তু মাহুত কোনোমতে তাকে শান্ত করে। কনুই আর গোড়ালী উন্মত্তের ন্যায় ঝাপটাতে ঝাপটাতে তরুণ অশ্বারোহী বৃথাই লাগাম টেনে ধরতে চেষ্টা করে। হতভাগ্য লোকটাকে নিজের ঘোটকীর মাথার উপর দিয়ে নিখুঁতভাবে সামনের দিকে মৃত বাঘ দুটোর কয়েক গজের ভিতরে আছড়ে পড়ে সেখানেই বিমূঢ়ভাবে শুয়ে থাকতে দেখে মেহেরুন্নিসা আরেকটু হলেই হেসে ফেলেছিল। মেহেরুন্নিসাকে সহসাই সহজাত একটা প্রবৃত্তি অধোমুখ হয়ে পড়ে থাকা তরুণের বদলে উপরে পাথরের দিকে তাকাতে বলে। কালো আর কমলা রঙের কিছু একটা সেখানে নড়াচড়া করছে। ‘আমার অন্য মাস্কেটটা দাও-জলদি!’ হাতে ধরা মাস্কেটটা ফেলে দিয়ে সে খোঁজার হাত থেকে নতুন আরেকটা নেয় এবং দ্রুত দু’বার নড়িয়ে হাওদার প্রান্তদেশে সেটা স্থাপণ করে এবং পাথরের দিকে ব্যারেলটা তাক করে। বাঘটা যখন নিচে পড়ে থাকা পরিচারক যুবককে লক্ষ্য করে, যে তখনও মাটিতে পড়ে রয়েছে, বিশাল একটা বক্ররেখায় লাফ দিতে বোঝা যায় এটা আগের দুটোর চেয়েও বিশালদেহী মেহেরুন্নিসা একেবারে সময়মত নিশানা স্থির করে। সে গুলি চালায়। সে তাড়াহুড়োর কারণে নিজেকে ঠিকমত অবলম্বন প্রদান করতে ভুলে গিয়েছিল এবং মাস্কেটটা থেকে গুলিবর্ষণের সময়ের পশ্চাদাভিঘাত তাকে পিছনের দিকে ছিটকে ফেলে দেয়। সে টলমল করে কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে দেখে বাঘটা পরিচারক ছেলেটার দেহের উপরে, যে এই মুহূর্তে নিজেকে প্রাণপনে মুক্ত করতে চেষ্টা করছে, আড়াআড়িভাবে পড়ে রয়েছে।

দারুণ নিশানাভেদ। তুমি ঠিক আছে তো?’ জাহাঙ্গীর জানতে চায়। জোরে শ্বাস নিতে নিতে সে মাথা নাড়ে। আমায় তুমি সবসময়ে বিস্মিত করো।’ তিনি মেহেরুন্নিসার দিকে নিখাদ প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। আমার চেয়েও দ্রুত তোমার প্রতিক্রিয়ার গতি।

‘বাঘটা একটা হুমকি ছিল। আমি সহজাত প্রবৃত্তির বশে যা করার করেছি।’

‘বাঘের বদলে যদি একটা লোক থাকতো তাহলেও কি তুমি গুলি চালাতে? হ্যাঁ, যদি সে আমার শত্রু হয়… বা আপনার, তাহলে কেন নয়।

*

খুররম তার হবু-স্ত্রীর এই চিত্রকর্মটা উপহার হিসাবে পেয়ে খুশিই হবে, জাহাঙ্গীর প্রতিকৃতিটা খুটিয়ে অবেক্ষণ করার সময় মনে মনে চিন্তা করে যা মুসক খান, তাঁর দরবারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রকর, তাঁর ব্যক্তিগত আবাসন কক্ষে কারুকাজ করা রোজউডের একটা কাঠামোর উপর সাজিয়ে রেখেছে। ইংল্যান্ড নামে বহুদূরের একটা ছোট রাজ্যের শাসক সম্প্রতি দরবারে কিছু উপহার প্রেরণ করেছেন যার ভিতরে তার নিজের আর তার পরিবারের প্রতিকৃতিও রয়েছে। তাঁদের আঁটসাঁট পোষাক আর উঁচু-চূড়াযুক্ত এবং পালকশোভিত ঢেউ-খেলান প্রান্তযুক্ত টুপিতে যদিও তাদের দেখতে অদ্ভুত লাগলেও, তার চারপাশে যারা রয়েছে তাঁদের প্রতিকৃতি ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার ধারণাটা জাহাঙ্গীরের পছন্দ হয়েছে এবং সে বেশ কয়েকটা প্রতিকৃতি তৈরীর নির্দেশ দিয়েছে। মোল্লারা ব্যাপারটা পছন্দ করে নি, তাদের দাবি মনুষ্য সৃষ্টি এমন প্রতিকৃতি স্রষ্ঠার দৃষ্টিতে তাঁর প্রতি কটাক্ষপূর্ণ, কিন্তু তাকে তুষ্ট করতে উদ্গ্রীব কিছু অমাত্যের দল, এখন আবার পাগড়ির অলঙ্কার হিসাবে নিজেদের সম্রাটের প্রতিকৃতির অলঙ্কৃত অনুচিত্র পরিধান করতে আরম্ভ করেছে।

আরজুমান্দের মুখাবয়ব যত্নের সাথে পর্যবেক্ষণ করে, জাহাঙ্গীর মেহেরুন্নিসার সাথে একটা সাদৃশ্য খুঁজে পায়, যদিও তাঁর কাছে মনে হয় তাঁর স্ত্রীর মুখাবয়বে বিদ্যমান ঐশ্বরিক সৌন্দর্য এখানে অনুপস্থিত যা তাঁদের বিয়ের ছয় মাস পরে তাকে এখনও ক্রমাগতভাবে মুগ্ধ করছে। মেহেরুন্নিসার সাথে সে নিজেকে সম্পূর্ণ বোধ করে যেমনটা সে আগে কখনও অনুভব করে নি। তাঁর ভালোবাসা তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। মেহেরুন্নিসা যে কেবল তার মানসিক স্থিতি বুঝতে পারে তাই নয় সে সেটা পরিবর্তনও করতে সক্ষম। সে যদি কখনও বিষণবোধ করে তাহলে সে তাকে হাসাতে পারে। সে যদি কোনো কারণে উদ্বিগ্ন হয় সে। তখন সুন্দর কথা বলেই কেবল তার দুশ্চিন্তা প্রশমিত করে না সেই সাথে বাস্তবসম্মত বিচক্ষণ পরামর্শও দেয়–কখনও কোনো কিছুতেই উত্তেজিত হয় না এবং সবসময়েই প্রাসঙ্গিক। সে তার উজির মাজিদ খান এবং মন্ত্রিপরিষদের বাকি সদস্যদের সাথে সাথে তার পরামর্শ শোনার জন্যও প্রায় সমান সময় ব্যয় করে, যাদের কথা থেকে তাকে ব্যক্তিগত স্বার্থ প্রণোদিত বক্তব্য থেকে বিজ্ঞ জনোচিত পরামর্শ আলাদা করতে হয়। এক মাসের ভিতরে সে তার পরামর্শ অনুযায়ী আরজুমান্দ বানুর সাথে তাঁর সন্তান খুররমের বিয়ের অনুমতি প্রদান করবে। যোধা বাঈ তাকে বোঝাতে চেয়েছিল যে বিয়েটা মোটেই পাল্টাপাল্টি ঘরে হচ্ছে না কিন্তু তার সংকল্প লক্ষ্য করে সে তার বেশি কিছু বলেনি।

সে ইতিমধ্যে দিনও ঠিক করে ফেলেছে–১০ মে, ১৬১২, তাঁর জ্যোতিষীরা তাকে নিশ্চয়তা দিয়েছে দিনটা নববিবাহিত দম্পতির সর্বাত্মক শান্তি নিশ্চিত করবে। মোগল দরবারে এখন পর্যন্ত যা প্রত্যক্ষ করেছে তাঁর ভিতরে সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করাই এখন কেবল তার দায়িত্ব। নিজের সন্তানের খাতিরে সে কেবল এমন আয়োজন করবে না সেই সাথে নিজের পরিবারকে এভাবে সম্মানিত হতে দেখে মেহেরুন্নিসা যে আনন্দ লাভ করবে সেটাও একটা বড় কারণ।

*

খুররম তাঁদের বাসর কক্ষে মিহি তাঁর দিয়ে তৈরি পর্দার কাছেই একাকী দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার পরনে কেবল ব্রোকেডের সুবজ রঙের একটা আলখাল্লা যা কোমরের কাছে একটা সরু সোনার পরিকর দিয়ে বাঁধা, পর্দার পেছনে আরজুমান্দ বানুর পরিচারিকারা তাকে তাঁদের বিয়ের পূর্ণতা অর্জনের জন্য প্রস্তুত করছে। সে নিজের হাতের দিকে তাকায়, সেদিনই সকালে তার আম্মিজান সৌভাগ্যের স্মারক হিসাবে সেখানে মেহেদী আর হলুদের সাহায্যে বিভিন্ন নক্সা এঁকে দিয়েছেন। সে এখনও জ্বলজ্বলে মুক্তোর তৈরি বিয়ের তাজ পরিধান করে রয়েছে যা আব্বাজান তাঁর মাথায় বেঁধে দিয়েছিলেন, সে দূর্গ থেকে হীরক খচিত মাথার সাজ পরিহিত হাতিতে, যা গ্রীষ্মের সূর্যালোকে সাদা আগুনের মত গনগন করছে, উপবিষ্ট হয়ে আসফ খানের প্রাসাদের উদ্দেশ্যে গমনকারী বিয়ের বিশাল শোভাযাত্রাকে অনুসরণ করার জন্য রওয়ানা দেবার ঠিক আগ মুহূর্তে। তাঁর হাতির ঠিক আগেই কুচকাওয়াজ করে এগিয়ে চলেছে তূর্যবাদক আর ঢুলীর দল, পেছনে রয়েছে সোনালী তশতরীর উপরে স্তূপ হয়ে থাকা মশলা বহনকারী পরিচারকদের সারি, তারপরে খুররমের বন্ধু আর দুধ-ভাইয়েরা সবাই একই রকম দেখতে কালো স্ট্যালিয়নে উপবিষ্ট।

বিয়ের অনুষ্ঠান আর আনুষ্ঠানিকতা উদ্যাপন মনে হয় যেন শেষ হবে না–মোল্লাদের সুললিত কণ্ঠের গম্ভীর উচ্চারণ, ফিসফিস করে বিয়েতে আরজুমান্দের সম্মতি প্রদান, গোলাপজলে তাঁর হাত ধুয়ে দেয়ার কৃত্যানুষ্ঠান এবং শুভ মিলন নিশ্চিত করতে হাতলবিহীন পানপাত্র থেকে পানি পান, সবশেষে ভোজসভা আর উপহার আদানপ্রদান। চকচক করতে থাকা পর্দার পরতের আড়ালে তার পাশে বসে থাকা আরজুমান্দের দিকে সে আড়চোখে তাকায় বুঝতে চেষ্টা করে তার মনে কি ভাবনা খেলা করছে। সে শীঘ্রই অবশ্য সেটা জানতে পারবে। সে তাকে প্রায় পুরোপুরি লাভ করেছে… তার হৃৎপিণ্ড ধকধক করে এবং সে বিস্মিত হয়ে অনুধাবন করে কতটা অনিশ্চিত সে বোধ করছে, খানিকটা হয়ত বিচলিত…তার প্রত্যাশা এত বেশি যে তাঁর ভয় হয় সবকিছু বোধহয় মিলবে না। আরজুমান্দ বানুর সাথে সহবাসের অভিজ্ঞতা যদি শেষ পর্যন্ত বিশেষ কোনো দ্যোতনা লাভ না করে তাহলে কি হবে? তার আপন মা, সচরাচর যিনি হাসিখুশি থাকেন, খুব বেশি কিছু প্রত্যাশা না করার জন্য তাকে সতর্ক করে দিয়েছেন, কিন্তু সে জানে সবকিছুর পরে তাকে শেষ পর্যন্ত নিজের সহজাত প্রবৃত্তির উপরেই ভরসা রাখতে হবে। মেহেরুন্নিসাকে যোধা বাঈ অপছন্দ করেন এবং তার পরিবারের আরেকজন মহিলার সাথে নিজের ছেলের বিয়েকে তিনি স্বাভাবিক কারণে তাই স্বাগত জানাননি। আম্মিজানকে যখন বলা হয় যে মেহেরুন্নিসা জাহাঙ্গীরকে তার শক্তি আর নিঃশ্বাসের সৌরভের কারণে প্রশংসা করেছে তখন সে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে আম্মিজানকে বলতে শুনেছে যে বহুভোগ্যা একজন রমণীর পক্ষেই কেবল এমন তুলনা করা সম্ভব।

একজন পরিচারিকা অবশেষে হেঁচকা এক টানে পর্দা সরিয়ে দেয়। আরজুমান্দ গজদন্তবর্ণের রেশমের একটা তাকিয়ায় একেবারে নিরাভরণ হয়ে শুয়ে রয়েছে, তার লম্বা চুল কাঁধের উপরে খোঁপা করে বেঁধে দেয়া হয়েছে। তার দেহ সুগন্ধি তেলের কারণে মৃদু দীপ্তি ছড়ায় যা তার ত্বকে মালিশ করা হয়েছে–এই আনুষ্ঠানিকতা উদ্দেশ্য কেবল নববধূকে তার স্বামীর কাছে আকর্ষণীয় করে তোলাই নয় সেই সাথে রতিক্রিয়ার জন্য তাকে প্রস্তুত আর উত্তেজিত করে তোলা। হেরেমের পরিচারিকারা নিজেদের কাজ বেশ ভালোভাবেই সম্পন্ন করেছে। খুররম তাঁর নিটোল স্ত নযুগলের উঠা নামা, কিশমিশের মত ছোট স্তনবৃন্তের টানটান আকর্ষণ এবং তাঁর চোখের দ্যুতিময়তা লক্ষ্য করে।

‘আমাদের একা থাকতে দাও, সে পরিচারিকাদের আদেশ দেয়ার সময় ঠিকই বুঝতে পারে যে তারা তাদের পাতলা নেকাবের ভিতর দিয়ে কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। সে তারপরে ধীরে শয্যার দিকে এগিয়ে যায় এবং আলখাল্লার পরিকরের বাধন খুলে সেটাকে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেয়। সে তাঁর নবপরিণীতা বধূর পাশে শোয়, তার খুব কাছে তাকে স্পর্শ না করে। তাকে পুরোপুরি নিজের করে পাবার আগে সে তাকে কিছু বলতে চায় যদি কথাগুলো বলার মত শব্দ সে খুঁজে পায়। সে এক কনুইয়ের উপর উঁচু হয়ে তার জ্বলজ্বল করতে থাকা চোখের মণির দিকে তাকায়। আরজুমান্দ। আমার আগামী অনাগত সময়ে যাই লেখা থাকুক আমি তোমায় ভালোবাসব এবং রক্ষা করবো। আল্লাহতালা যতদিন আমাদের একসঙ্গে থাকার ক্ষণ নির্দিষ্ট করেছেন ততক্ষণ আমার নিজের চেয়ে তোমার সুখই আমার কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হবে। আমি শপথ করে বলছি।

‘আর আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি আমি নিজেকে আপনার যোগ্য স্ত্রী হিসাবে প্রমাণ করবো। আমার আব্বাজান প্রথম যখন আমাকে বলেন যে আপনি আমাকে বিয়ে করতে আগ্রহী আমি ভয় পেয়েছিলাম… আপনার সাথে আমার যোজন ব্যবধান, আপনি এমন একটা পৃথিবীর মানুষ যা আমার কাছে একেবারেই অজানা…কিন্তু আমার চাচাজানের বিশ্বাসঘাতকতা যখন আমাদের পরিবারের জন্য অসম্মান বয়ে আনে তখনও আপনি আমায় ভুলে যাননি। আজ রাতে আমি নিজেকে আপনার কাছে নিবেদন করবো যতটা সম্পূর্ণভাবে এবং যতটা বিশ্বস্ততার সাথে একজন মেয়ের পক্ষে করা সম্ভব। তার সুন্দর মুখশ্রী প্রায় মলিন দেখায় কথাটা বলার সময়।

‘আর কথা নয়, খসরু ফিসফিস করে বলে এবং তাকে নিজের কাছে টেনে নেয়।

*

মালকিন। যুবরাজ খুররম আর তাঁর নবপরিণীতা বধূর বাসর শয্যার নিরীক্ষণ সমাপ্ত হয়েছে। বিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছে এবং আরজুমান্দ বানু বাস্তবিকই একজন কুমারী ছিল। মেহেরুন্নিসা আর জাহাঙ্গীরের সামনে নতজানু হয়ে খুররমের হেরেমের তত্ত্বাবধায়ক কথাগুলো বলার পরে নতুন দম্পতির সন্ত নি কামনায় প্রথাগত মোনাজাত করে। দোয়া করি আল্লাহতা’লা তাঁদের যেন এত সন্তান দেন যাতে নববধূ রাজবংশের রত্নগর্ভা হিসাবে ভাস্বর হয়ে থাকে। মেহেরুন্নিসা জাহাঙ্গীরের দিকে তাকিয়ে প্রণয়মিশ্রিত হাসি হাসে। সে একজন সম্রাজ্ঞী এবং তাঁর ভাইঝি সম্রাটের প্রিয় সন্তানের স্ত্রী। ভবিষ্যত এত সম্ভাবনাময় আগে কখনও মনে হয় নি…

১.০৯ জীবন আর মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ

‘খুররম, বিবাহিত জীবনের সাথে তুমি মানিয়ে নিয়েছে।’ কথাটা সত্যি, জাহাঙ্গীর শ্বেতপাথরের দাবার ছকের দিকে তাকিয়ে মনে মনে নিজের পরবর্তী চাল নিয়ে চিন্তা করার অবসরে ভাবে। খুররমকে দেখে পরিতৃপ্ত মনে হয়। জাগতিক সবকিছুর চেয়ে তুমি ভালোবাস এমন একজন রমণীকে খুঁজে পাওয়া বেহেশতের আশীর্বাদ। সে খুবই খুশি যে তাঁর নিজের মত তাঁর সন্তানও এমন আনন্দের সন্ধান লাভ করেছে।

খুররম মৃদু হাসে কিন্তু কোনো উত্তর দেয় না। আরো কিছুক্ষণ চিন্তা করে সে তার একটা হাতিকে সামনের দিকে দুই ঘর বাড়িয়ে দেয়। জাহাঙ্গীর ছেলের চোখে মুখে ফুটে উঠা সন্তুষ্ট অভিব্যক্তি দেখে বুঝে যে তাঁর ধারণা সে একটা মোক্ষম চাল দিয়েছে। বস্তুতপক্ষে, বেটা তাঁর চালে ভুল করেছে। আর দুটো চাল এবং সে তাহলে কিস্তিমাত করবে।

‘সুখ তোমায় অসতর্ক করে তুলেছে। গত কয়েক মাস তুমি আমার কাছে দাবায় পরাজিত হও নি কিন্তু আজ রাতে তুমি হারবে। দশ মিনিট পরে খেলা শেষ হয় এবং পরাজিত আর খানিকটা হতাশ খুররম উঠে দাঁড়ায়, তাঁর ঘোড়া নিয়ে আসবার আদেশ দেবে। কিন্তু জাহাঙ্গীর মনে কিছু একটা রয়েছে সে বলতে চায়। সে ঠিক নিশ্চিত নয় আরজুমান্দের সাথে তার বিয়ের কয়েক দিনের ভিতরে এমন একটা সংবাদ শুনে তার ছেলের কি প্রতিক্রিয়া হবে এবং সে জানে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা সে এতদিন স্থগিত করে রেখেছিল। কিন্তু খুররম একজন মোগল যুবরাজ এবং তার অবশ্যই বোঝা উচিত তার আসল কর্তব্য কোথায়…

‘খুররম… তুমি বিদায় নেয়ার আগে আমি তোমায় একটা কথা বলতে চাই।’

কি আব্বাজান?”

সুস্থির হয়ে একটু বসো এবং মন দিয়ে আমি কি বলি শোন। আমি তোমায় যা বলতে যাচ্ছি সেটা আমাদের সাম্রাজ্য এবং আমাদের রাজবংশ উভয়ের জন্যেই মঙ্গলকর।’

খুররমের চোখে মুখে সহসা সতর্ক অভিব্যক্তি ফুটে উঠতে দেখে, জাহাঙ্গীর খানিকটা বিষণ্ণভাবে চিন্তা করে, কি দ্রুত একজনের মন মানসিকতা পরিবর্তিত হতে পারে। তারা কিছুক্ষণ আগেই আগ্রার নিদাঘতপ্ত রাতে পিতা পুত্রের ভূমিকায় কি চমৎকারভাবে দাবা খেলা উপভোগ করছিল। শাসক হওয়া মানে অবিরত একটা দুঃসহ বোঝা বহন করে চলা… সাধারণ মানুষ থেকে একেবারে আলাদা এবং তাঁদের কাছে একেবারে অজানা একটা চাপ সহ্য করা… কিন্তু সে নিজেকে অন্য কোনো পরিস্থিতির মাঝে কল্পনাও করতে পারে না। সে একেবারেই বাল্যকাল থেকেই, যখন সে বুঝতে শিখেছে সে কে, তখন থেকেই সে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হতে চেয়েছে। সে নিশ্চিত, খুররমও ঠিক তাই চায়। এহেন উচ্চাশার সাথে সাথে আসে রাজবংশের প্রতি একটা দায়িত্ববোধ, ব্যক্তিগত জীবনে সেটা যতই অনাকাঙ্খিত বা ধ্বংসকারী হোক। জাহাঙ্গীর গভীর একটা শ্বাস নিয়ে বলতে আরম্ভ করে।

*

আগ্রা দূর্গের নিকটে যমুনা নদীর অর্ধ বৃত্তাকার বাক বরাবর নির্মিত খুররমের হাভেলীর হেরেমের প্রাচীর বেষ্টিত উদ্যানে একটা রেশমের চাঁদোয়ার নিচে একটা লম্বা আর নিচু শয্যার উপরে স্থূপীকৃত তাকিয়ার মাঝে আরজুমান্দ শুয়ে রয়েছে। গ্রীষ্মকালের গনগনে উষ্ণ বায়ুপ্রবাহ শুরু হয়েছে। সে এখানে সেসব অস্বস্তি থেকে নিরাপদ এবং শহরে যারা কাদা বা পোড়ামাটির সাধারণ গুমোট বাড়িতে বাস করে তাদের সে মোটেই ঈর্ষা করে না। মাঝেমাঝে রান্নার আগুন থেকে নির্গত স্ফুলিঙ্গ বাতাসে ঘুরপাক খেয়ে অনেক উঁচুতে উঠে; বাড়িগুলোর শুকনো খড়ের ছাদে আগুন ধরিয়ে দেয়। তাঁর পরিচারিকা তাকে বলেছে যে তিনদিন আগে দুটো বাড়ি আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়ে ভেতরে অবস্থানরত মহিলাদের পুড়িয়ে মেরেছে যারা আগুনের লেলিহান শিখার কবল থেকে দৌড়ে বাইরে বের হয় নি পর্দা তথা শালিনতার ভয়ে।

কিন্তু মনখারাপ করা ভাবনার সময় এখন না–যখন সে উফুল্ল থাকে তখনও না। তাঁর দু’হাত নিজের মসৃণ সমতল পেটের উপর আগলে রাখার ভঙ্গিতে রাখা থাকে যেখানে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। সে আট সপ্তাহের গর্ভবতী। খুররমের জন্য তাঁর ভালোবাসা ততটাই পরিপূর্ণ যতটা তার জন্য খুররমের ভালোবাসা। তাকে ছাড়া–সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবার সাথে সাথে সে যে উত্তেজনা অনুভব করে সেটা ছাড়া–সে এখন আর কোনো কিছু চিন্তাও করতে পারে না এবং জানে যে নিজের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করে সে তার কাছে আসবে। তাঁদের বিয়ের রাতে সে যদিও লাজ ছিল, আজকাল তার শারীরিক আকাঙ্খ খুররমের সাথে পাল্লা দেয়। তার আলিঙ্গনের মাঝে নিজের খুঁজে পাওয়া উদ্দামতার জন্য তাঁর লজ্জা পাওয়া উচিত কিন্তু সে তারবদলে গর্ব অনুভব করে, জানে যে তাকেও সে একই রকম আনন্দ জারিত করে।

সহসা সে হেরেমের উদ্যান থেকে প্রাসাদের আঙিনাকে পৃথককারী কাঠের উঁচু তোরণদ্বারের ওপাশে ঢালু পথ বেয়ে উঠে আসা ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পায়। খুররম সম্ভবত একটু আগেই ফিরে এসেছে। তূর্যধ্বনির একটা সংক্ষিপ্ত বাজনা তাকে আশ্বস্ত করে তার ধারণাই সঠিক। উদ্যানের দূরবর্তী প্রান্তে অবস্থিত দরজার পাল্লা খুলে গিয়ে তাকে প্রকটিত করতে, সে সাদা কালো টালি বসান পথের উপর দিয়ে তার দিকে দৌড়ে যাবার সময় সে খালি পায়ের তালুতে টালির উষ্ণতা অনুভব করতে পারে। সে তাকে আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে কিন্তু চুম্বন না করে এমন এক অব্যক্ত আবেগে তাকে জড়িয়ে থাকে যে তার চোখে মুখে ফুটে থাকা আন্তরিক অভিব্যক্তি সত্ত্বেও সে ঠিকই বুঝতে পারে কোথাও মারাত্মক কোনো একটা ঝামেলা হয়েছে। ‘খুররম, মালিক আমার কি হয়েছে? কি ব্যাপার?’ সে তাকে আলিঙ্গন থেকে মুক্তি দিলে অবশেষে সে জানতে চায়।

‘আমি তোমায় একটা কথা বলতে চাই।’ তাঁর কণ্ঠস্বর কেমন ধারালো শোনায় কিন্তু তার অভিব্যক্তিতে সে তার জন্য ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। ব্যাপারটা যাই হোক না কেন নিশ্চয়ই ততটা খারাপ…

‘আমার আব্বাজান বলেছেন আমার পুনরায় বিয়ে করা উচিত।’

নাহ্…’ মাতৃত্বের সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে নিজের উদর স্পর্শ করে। তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে খুররম তাকে পুনরায় নিজের বাহুর মাঝে টেনে নেয় এবং তাকে নিজের খুব কাছে নিয়ে আসে। আরজুমান্দ…সোনা আমার… এতটা ভেঙে পড়ো না…’

‘মেয়েটা কে?

‘মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতি সদিচ্ছার স্মারক হিসাবে রাজকুল বধূ হবার জন্য শাহের প্রেরিত এক পার্সী রাজকন্যা। আমার আব্বাজানের ধারণা তাকে প্রত্যাখান করার বোকামীর পরিচায়ক হবে।

কিন্তু খুররম আপনিই কেন? কেন পারভেজ নয়? সে আপনার চেয়ে বয়সে বড়।

‘আব্বাজানকে ঠিক এই কথাটাই আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি আমাকে বলেছেন যে তার সব সন্তানের ভিতরে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসাবে আমিই যোগ্যতম। খসরু বিশ্বাসঘাতক, পারভেজ সুরা আর আফিমে মাত্রাতিরিক্ত রকমের আসক্ত, আর তরুণ শাহরিয়ার ভীতু আর লাজুক। তিনি বলেছেন যে আমি যদি আদতেই পরবর্তী মোগল সম্রাট হিসাবে অভিষিক্ত হই তাহলে তিনি চান আমার সিংহাসনকে যতটা সম্ভব সুরক্ষিত করতে। শাহের পরিবারের সাথে মৈত্রীর সম্বন্ধ ভবিষ্যতে সহায়তা করবে।

‘আপনি কি উত্তর দিয়েছেন?

‘আমার আর কিইবা বলার আছে? আমি একজন যুবরাজ এবং আমার আব্বাজানের উত্তরাধিকারী হতে আগ্রহী… আমার পক্ষে কেবল নিজের খেয়াল খুশিমত আচরণ করা সম্ভব নয়। আমি তাকে বলেছি যে আমার আর কাউকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করার আগ্রহ নেই–বলেছি যে মনে প্রাণে আমি তোমাকেই আমার স্ত্রী হিসাবে গন্য করি–কিন্তু আমি তাঁর আদেশ পালন করবো।’

আরজুমান্দ নিজেকে তাঁর আলিঙ্গণ থেকে সরিয়ে নেয়। আপনি তাকে কবে বিয়ে করবেন?

‘দরবারের জ্যোতিষী নির্দিষ্ট দিন ঠিক করবে কিন্তু যথাযথভাবে রাজকুমারীর আগ্রায় উপস্থিত হওয়া আর যৌতুকের পরিমাণ নিয়ে সম্মতিতে পৌঁছাবার জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের কথা বিবেচনা করলে বলা যায় আগামী কয়েক মাসের আগে নয়। আমার আব্বাজান পরিকল্পনা করছেন তাকে আর তার সাথে আগত সফরসঙ্গীদের পারস্যের সীমান্তে স্বাগত জানাবার জন্য উপযুক্ত সংখ্যক রক্ষীবাহিনী প্রেরণ করবেন।’

“আর আমাকে কি জাফরি কাটা অন্তঃপটের পেছন থেকে দেখতে হবে যে বাসর শয্যার জন্য তাঁর দেহকে তেল আর সুগন্ধি সিক্ত করতে এবং মেহেদী দিয়ে পরিচারিকার দল তাঁর শরীরে আল্পনা করছে?’ আরজুমান্দের পুরো দেহ এখন থরথর করে কাঁপছে এবং সে আর পরোয়া করে না তার অশ্রু সে এখন দেখল কি না।

‘আমি আর তুমি দুজনেই হতভাগ্য। আমাদের মত অবস্থানের মানুষ জীবনে খুব কমই ভালোবাসার জন্য বিয়ে করে এবং আমার আব্বাজান ইচ্ছে করলে আমাদের বাধা দিতে পারতেন। সাম্রাজ্যের প্রতি আর তাঁর প্রতি নিজের কর্তব্য থেকে আমি কখনও বিচ্যুত হব না। কিন্তু আমি তোমায় একটা প্রতিশ্রুতি করছি–তুমিই আমার পুরো পৃথিবী। তুমি আমার মুমতাজ–এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যেকোনো রমণীর চেয়ে তুমি আমার কাছে অনন্য–তুমি সেই রমণী যাকে আমি আমার সন্তানদের জননী হিসাবে কামনা করি। এই রাজকন্যা কখনও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হবে না, আমি শপথ করে বলছি। সে এখানে নয় অন্য আরেকটা প্রাসাদে বাস করবে। তাঁর কণ্ঠস্বর সামান্য কেঁপে যায় এবং সে তাকে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ মুছতে দেখে।

খুররমের যেকোনো কথার চেয়ে তাঁর এই সামান্য অঙ্গভঙ্গিই তাকে অনেক কিছু বলে দেয়। কিন্তু আরজুমান্দের কাছে পৃথিবী সহসাই একটা খাপছাড়া জায়গা বলে মনে হয়।

*

সে আগে কখনও এমন যন্ত্রণার সাথে পরিচিত ছিল না–দু’জন ধাত্রীর তত্ত্বাবধায়নে তাঁদের কথা অনুযায়ী দায়িত্ব নিয়ে চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করার সময় তার শরীর যে শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করছে কেবল সেটাই নয় এর সাথে যুক্ত হয়েছে মাত্র আধ মাইল দূরে আগ্রা দূর্গে খুররম আরেকজনকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করছে সেটা জানা থাকায় অবর্ণনীয় মানসিক কষ্ট। তার পুরো দেহ ঘামে জবজব করছে এবং ব্যাথায় কুঁকড়ে যাবার মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকলেও তাঁর মাথায় কেবল একটা কথাই ঘুরছে যে জাহাঙ্গীর তার ছেলের মাথায় বিয়ের তাজ বেঁধে দিচ্ছেন আর পার্সী রাজকন্যা নেকাবের আড়ালে বসে রয়েছে। মেয়েটা যদি অপরূপ সুন্দরী হয়? খুররম কীভাবে যে মেয়েকে জীবনেও দেখেনি তাকে ভালো না বাসবার প্রতিশ্রুতি দেয়?

‘মালকিন, শুয়ে পড়ুন। সুতির ঘামে ভেজা চাদর সে যার উপরে শুয়ে ছিল শক্তিশালী হাত তাকে পুনরায় তার উপরে শুতে বাধ্য করে। সে কোনো কিছু না ভেবেই জানালার কাছে গিয়ে রাতের আকাশ চিরে উৎসবের আতশবাজি দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠে বসার চেষ্টা করেছিল। তারা যখন এসব শুরু করবে তার মানে হল যে নতুন বিয়েকে সম্পূর্ণতা দানের সময় আসন্ন…

‘আপনার শরীরকে শীথিল করতে চেষ্টা করুন। ব্যাথার জন্য অপেক্ষা করুন। ধাত্রীদের একজন তাঁর উঠে বসবার চেষ্টাকে ভুল করে সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য শক্তি প্রয়োগের আকাঙ্খ ভেবেছে। আরজুমান্দ নিজেকে চুপ করে শুয়ে থাকতে বলে, ধাত্রীরা তাকে ঠিক যেমন করতে বলেছে।

মালকিন, এবার, চাপ দিন!

নিজের দেহের অবশিষ্ট শক্তিটুকু একত্রিত করে এবং দুপাশ থেকে ধাত্রী দুজন তার দুই কাঁধ শক্ত করে চেপে ধরে থাকলে, আরজুমান্দ তার পক্ষে যত জোরে সম্ভব চাপ দেয়। তার চারপাশের সব কিছু কেমন ঘোলাটে হয়ে যায়। সে তাকিয়ার উপরে আবার এলিয়ে পড়ে। তার কানে ভেসে আসা এই তীক্ষ্ণ স্বরের কান্না কে করছে? এই আতঙ্কিত শব্দটা কি সেই করছে? সে নিজের চোখ বন্ধ করে এবং পালকের মত নির্ভার হয়ে ভাসতে থাকার একটা অনুভূতি তাকে আচ্ছন্ন করে…

‘মালকিন…’ একটা হাত আলতো করে তাঁর কাঁধ স্পর্শ করে। সে ভাবে, নির্ঘাত ধাত্রীদের একজন হবে আর চেষ্টা করে নিজেকে সরিয়ে নিতে। কোনো লাভ হয় না–সে কিছুই করতে পারে না। যেকোনো মুহূর্তে ব্যাথাটা আবার শুরু হবে এবং তার মাঝে ব্যাথাটার সাথে লড়াই করার মত আর বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই।

‘আমাদের একা থাকতে দাও, আরেকটা উঁচু আর পুরুষ কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। একটা দরজা খুলে আবার বন্ধ হয়ে যায়। সে চোখ খুলে তাকায়। উল্টোদিকের দেয়ালের জানালা দিয়ে চুঁইয়ে প্রবেশ করা সকালের আলোয় প্রথমে তার দেখতে কষ্ট হয়।

‘আরজুমান্দ, তোমার কি নিজের স্বামী আর কন্যাকে কিছুই বলার নেই? খুররম চোখ ধাঁধানো আলোর মাঝ থেকে বের হয়ে আসে। তার বাহুতে কারুকাজ করা সবুজ রেশমের কাপড়ে জড়ানো একটা পোটলা। তাঁর পাশে হাঁটু মুড়ে বসে সে বাচ্চাটাকে তাঁর বাহুতে আলতো করে শুইয়ে দেয়।

*

শীতের সন্ধ্যাবেলা সূর্য যখন অস্তাচলে যেতে বসেছে এবং জাহাঙ্গীর দ্রুত তার মন্ত্রণা কক্ষের দিকে হেঁটে যাবার সময়, যমুনার পানির দিকে তাকিয়ে তার মনে হয় পানিতে বুঝি কেউ স্বর্ণকুচি মিশিয়ে দিয়েছে, জাফরশানকে সমরকন্দের দেয়ালের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তথাকথিত স্বর্ণবাহী নদী এবং যার কথা সে তার মহান পূর্ব পুরুষ মহামতি বাবরের রোজনামচায় পড়েছে–সে ঠিক যেমন কল্পনা করেছে। মোগলদের জন্য সাম্রাজ্য জয় করতে বাবর প্রাণপণ করে যুদ্ধ করেছিলেন এবং তাদের সেখান থেকে বিতাড়িত করতে আশাবাদী এমন লোক সবসময়েই থাকবে। হিন্দুস্তানের লাল মাটিতে তাঁরা তাঁদের সবুজ নিশান প্রোথিত করার পর থেকে বহুবার তাঁদের যুদ্ধ করতে হয়েছে এবং এখন তারা আবারও সেই সম্ভাবনার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সাম্রাজ্যের দক্ষিণ সীমান্ত থেকে প্রাপ্ত শান্তি বিঘ্নিতকারী সংবাদ পর্যালোচনার জন্য সে তার সমর উপদেষ্টাদের বৈঠক আহ্বান করেছে।

দক্ষিণে দাক্ষিণাত্যের মালভূমির ধনী মুসলিম সালতানাত–গোলকুণ্ডা এবং বিশেষ করে আহমেদনগর আর বিজাপুর–সবসময়ে চেষ্টা করেছে নিজেদের স্বাধীনতা আর তারচেয়েও বেশি প্রয়াস নিয়েছে নিজেদের ভূখণ্ডে অবস্থিত রত্নখনির প্রভূত সম্পদ প্রবলভাবে রক্ষা করতে এবং দীর্ঘকাল যাবত মোগলদের জন্য একটা সমস্যা হয়ে রয়েছে। এই রাজ্যগুলো মাঝে মাঝে যদিও পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, কিন্তু অনেকবারই তারা সম্মিলিতভাবে তাদের অধিরাজের বিরুদ্ধে নিজেদের বাহিনী একত্রিত করেছে। তার মনে আছে আকবর তাকে বলেছিলেন কীভাবে তিনি তাদের মোগল কর্তৃত্বের অধীনে এনেছিলেন আর কীভাবে বিজাপুর এবং আহমেদনগরের শাসকেরা সহসা খাজনা পাঠাতে অস্বীকার করায়, তাদের ভূখণ্ডের কিছু অংশ দখল করার জন্য সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে তাঁদের তিনি ভয় দেখিয়েছিলেন।

দক্ষিণের এই রাজ্যগুলো এখন আবার মোগলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ঝাণ্ডা তুলেছে। শত্রুপক্ষের এবারের সেনাপতি মালিক আম্মার নামে এক অপরিচিত আবিসিনিয়ান। ক্রীতদাস হিসাবে ভারতবর্ষে আগমনের পর সে আহমেদনগরের সুলতানের অধীনে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ক্ষমতার শিখরে উঠে আসে এবং এখন আহমেদনগর আর বিজাপুর উভয় রাজ্যের শাসকরা তাঁদের পক্ষে মোগলদের বিরুদ্ধে গুপ্ত গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য তাকে নিয়োগ করেছে। মালিক আম্বার নিজের তুচ্ছ অবস্থান থেকে ক্ষমতার শিখরে উঠে আসায় নিশ্চিতভাবেই সংকল্প, উচ্চাশা আর চারিত্রিক দৃঢ়তার অধিকারী হবার সাথে সাথে অবশ্যই একজন চতুর আর দক্ষ যোদ্ধা। জাহাঙ্গীর ভাবে নিশ্চিতভাবেই পারভেজের চেয়ে ধূর্ত, ছয়মাস পূর্বে মালিক আম্বারের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে প্রথমবারের মত অবহিত হবার পরে বিদ্রোহ সমূলে দমন করার আদেশ দিয়ে যাকে দাক্ষিণাত্যে প্রেরণ করেছিল।

জাহাঙ্গীর তার মন্ত্রণা কক্ষে প্রবেশ করার সময় তার সেনাপতি আর উপদেষ্টারা তাকে স্বাগত জানাতে উঠে দাঁড়ালে সে তাদের প্রত্যেকের চেহারায় একায়ত অভিব্যক্তি দেখতে পায়। তাদের ভিতরে ইকবাল বেগের দীর্ঘদেহী অবয়ব, পারভেজের সাথে প্রেরিত তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠ আধিকারিকদের অন্যতম, তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁর মুখাবয়বের বলিরেখায় চরম পরিশ্রান্তির ছাপ। তাঁর একহাতে পট্টি বাঁধা আর সেটা একটা দড়ির সাহায্যে কাঁধ থেকে ঝোলানো রয়েছে। পট্টির উপরে ভেসে উঠা রক্তের ছোপ দেখে বোঝা যায় তার ক্ষতস্থান এখনও পুরোপুরি সারে নি।

‘ইকবাল বেগ, আপনার অভিযানের পুরো প্রতিবেদন আমাদের সামনে পেশ করেন, জাহাঙ্গীর বৃত্তাকারে উপবিষ্ট উপদেষ্টাদের কেন্দ্রে নিজের নির্ধারিত আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে বলে।

‘জাহাপনা, আমি খেদের সাথে জানাচ্ছি মালিক আম্বার আমাদের বাহিনীর ললাটে দুর্ভাগ্যজনক এক পরাজয়ের কলঙ্ক এঁকে দিয়েছে। আমরা অতর্কিত আক্রমণের শিকার হয়েছি এবং আমাদের সহস্রাধিক সৈন্য নিহত হয়েছে আর ততোধিক সৈন্য আহত হয়েছে। আমরা বিশাল একটা ভূখণ্ড হারিয়েছি।’

‘আমাকে ঠিক কি ঘটেছিল বিস্তারিতভাবে খুলে বলো, জাহাঙ্গীর আদেশ দেয়, চেষ্টা করে তাঁর অনুভূত উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার কোনো লক্ষণই যেন তার অভিব্যক্তিতে প্রকাশ না পায়।

ইকবাল বেগকে, অবশ্য দৃশ্যত বিপর্যস্ত দেখায়, সে তার অক্ষত হাত দিয়ে নিজে আচকানের প্রান্তদেশ অস্বস্তির সাথে মোচড়ায় নিজের বিপর্যয়ের কাহিনী পুনরাবৃত্তি করার সময়। একদিন সকাল বেলা দাক্ষিণাত্যের পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত সংকীর্ণ এক উপত্যকায় আমাদের অস্থায়ী ছাউনিতে আমার লোকেরা তাদের তৈরি করা রান্নার আগুনের চারপাশে জটলাবদ্ধ হয়ে অবস্থান করে, ওম পোহাচ্ছিল আর ডাল এবং চাপাটি সহযোগে যখন সকালের প্রাতরাশ করছিল ঠিক সেই সময় মালিক আম্বারের অশ্বারোহী বাহিনী অতর্কিতে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আপনার সন্তানের আদেশে মোতায়েন করা আমাদের গুটিকয়েক প্রহরী চৌকিকে শস্য মাড়াইয়ের কস্তুনীর সামনে পড়া তুষের ন্যায় ছত্রভঙ্গ করে তারা আমাদের শিবিরের মাঝে উন্মত্তের ন্যায় বিচরণ শুরু করে, আমরা যখন আমাদের কোষবদ্ধ অস্ত্র আর অন্যান্য উপকরণের জন্য সংবেগে ছুটোছুটি করছি বা তাদের উদ্যত তরবারি আর বর্শার ফলা তাবুর অগ্নিকুণ্ড থেকে তুলে নেয়া জ্বলন্ত কাঠের টুকরোর সাহায্যে প্রতিরোধের চেষ্টা করছি, তারা নির্বিচারে আমাদের অসংখ্য সৈন্যকে হতাহত করে।

জাহাঙ্গীর লক্ষ্য করে ইকবাল বেগ যখন তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছে তাঁর মুখ তখন অশ্রুতে ভিজে গিয়েছে। একদল অশ্বারোহী আমার পুত্র আসিফ আর তাঁর গুটিকয়েক সঙ্গীকে কয়েকটা মালবাহী শকটের কাছে কোণঠাসা করে ফেলে তারা যখন সেসব শকটে রক্ষিত সিন্দুকের অর্থ আর অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। সে আর তার সহযোদ্ধারা যদিও বীরত্বের সাথে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল কিন্তু তাঁরা লড়াই করছিল মাটিতে দাঁড়িয়ে আর তাঁদের সাথে ছিল কেবল তরবারি। তাঁরা অশ্বারোহীদের আহত করার জন্য তাদের কাছে যেতেই ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে, মালিক আম্বারের একজন যোদ্ধা আসিফকে তার বর্শার ধারালো ইস্পাতের ফলায় বিদ্ধ করে। আঘাতটা তাকে হতবিহ্বল করে ফেলে, মালবাহী শকটের কাঠের কাঠামোর এতটাই গভীরে প্রোথিত হয় যে বর্শার অধিকারী সেটা সেখানেই পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। আমি তার কাছে পৌঁছাবার পূর্বেই আসিফ মারা যায়…’ ইকবাল বেগের কণ্ঠস্বর মিলিয়ে গিয়ে ধারাবাহিত ফোঁপানিতে পরিণত হয়। জাহাঙ্গীর জানে আসিফ ছিল তার একমাত্র জীবিত সন্তান।

ইকবাল বেগ আরেকদফা কথা থামিয়ে নিজের রুমাল দিয়ে মুখ থেকে অশ্রু মোছে এবং ধীরে ধীরে আত্মসংবরণ করে, সে বলতে শুরু করে। সংগঠিত প্রতিরোধের ন্যূনতম সম্ভাবনা নাকচ করে, মালিক আম্বারের লোকেরা এরপর নিজেরা তিনটি দলে বিভক্ত হয়। প্রথম দলটা মনোনিবেশ করে আমাদের যত বেশি সংখ্যক রণহস্তী হত্যা করা যায় সেই প্রচেষ্টায়, তাঁরা জম্ভগুলোর মুখে বর্শার ফলা আমূল বিদ্ধ করে কিংবা স্রেফ তাঁদের শূড়গুলো কেটে দেয় যা ছাড়া প্রাণীগুলো বাঁচতে পারবে না। দ্বিতীয় দলটা আমার ছেলে যে মালবাহী শকটের বহর রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে সেখান থেকে নগদ অর্থ আর যত বেশি সংখ্যক অন্যান্য উপকরণ তাঁরা বহন করতে পারবে সেই প্রয়াস নেয় এবং তৃতীয় দলটা আমাদের অস্থায়ী শিবিরে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ড থেকে জ্বলন্ত কাঠ নিয়ে আমাদেরই শিবিরে আগুন ধরিয়ে দেয়। তারা এরপরে যেমন ঝড়ের বেগে নেমে এসেছিল ঠিক সেই দ্রুততায় ফিরে যায়। আমাদের পক্ষে হতাহতের সংখ্যা এতবেশি ছিল আর সত্যি কথা বলতে আমাদের আত্মবিশ্বাসে এমনই চিড় খেয়েছিল যে তাদের পিছু ধাওয়া করার মানসিকতাও আমাদের তখন ছিল না। আহত পশুর মত নিজেদের ক্ষতস্থান পরিচর্যা করা ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারি নি।

‘তাঁরা এত সহজে কীভাবে আপনাদের শিবিরে হামলা করলো? জাহাঙ্গীর কঠো কণ্ঠে জানতে চায়।

‘তারা পাহাড় টপকে এসে আক্রমণ করেছিল বিশাল কোনো বাহিনীর পক্ষে যা অনতিক্রম্য বলে আমরা ধরে নিয়েছিলাম। সেনাপতি মাথা নত করে বলে। জাহাপনা, আমার স্বীকার করে লজ্জা নেই, তাঁরা আমাদের চেয়ে এলাকাটা ভালো করে চিনে।

‘আর আমার ছেলে পারভেজ?’

‘আক্রমণ যখন শুরু হয় তিনি তখনও নিজের তাবুতেই অবস্থান করছিলেন। তার দেহরক্ষী দল সর্তক আর সশস্ত্র ছিল যেমনটা তারা সবসময়েই থাকে। তারা আপনার সন্তানের তাবুর চারপাশে ভালোমতই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। আর তাছাড়া, মালিক আম্বার সহজ লক্ষ্যবস্তুকে আক্রমণের নিশানা করেছিল। আমাদের আরও সর্তক থাকা উচিত ছিল… আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত, জাঁহাপনা।

‘আমি আপনার মনোভাব অনুধাবন করতে পারছি এবং আপনার সন্তান বিয়োগে আমিও আপনার সাথে শোকাগ্রস্থ। যা হবার হয়ে গিয়েছে। মালিক আম্বারের এই ধৃষ্টতা আর আমাদের ভূখণ্ড থেকে তাকে বিতাড়িত করার প্রতি আমাদের এখন নিজেদের সমস্ত প্রয়াস নিবদ্ধ করতে হবে। এটা কীভাবে সর্বোত্তম উপায়ে হাসিল করা সম্ভব আসুন আমরা সবাই মিলে সেটা আলোচনা করি। আমরা আগামীকাল সকালে আমাদের আলোচনা শুরু করবো।

যুদ্ধ উপদেষ্টাদের সভা শেষ হলে জাহাঙ্গীর খুররমকে অপেক্ষা করতে বলে। এই পরাজয় একটা অপমান যার অবশ্যই প্রতিশোধ নিতে হবে। আমরা যদি এটা করতে ব্যর্থ হই তাহলে আমাদের প্রতিবেশীরা এমনকি বিদ্রোহভাবাপন্ন সামন্ত রাজ্যগুলোও ব্যাপারটা থেকে প্রেরণা লাভ করতে পারে। আমি পারভেজকে ফেরত আসতে আদেশ দিচ্ছি। যুদ্ধ করার মত মন মানসিকতা তার নেই এবং ইকবাল বেগ যদিও বিষয়টা উল্লেখ করার মত অবস্থানে নেই কিন্তু আমার অন্য সেনাপতিদের কথা যদি ঠিক হয় তাহলে খুব কম সময়েই সে সংযত অবস্থায় থাকে। আমার মনে হয় শিবিরের চারপাশে যথেষ্ট সংখ্যক প্রহরী মোতায়েন আর তাঁর দেহরক্ষীরা যখন সজাগ এবং বাইরে গিয়ে শক্রর মোকাবেলা করছে তখন তার তাবুতে অনর্থক সময়ক্ষেপন উভয়ের পেছনেই তার সুরাপানের একটা ভূমিকা রয়েছে। সে অভিযানের দায়িত্ব লাভের জন্য আমার কাছে রীতিমত অনুনয় করেছিল এবং আমিও ভেবেছিলাম দায়িত্ব লাভ করলে সে নিজেকে শুধরে নিতে চেষ্টা করবে, কিন্তু আমি ভুল ভেবেছিলাম।

খুররম কোনো উত্তর দেয় না। সে আর পারভেজ যদিও কেবল দুই বছরের ছোটবড়, তাঁরা দুজনে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বড় হয়েছে আর তাদের ভিতরে কখনও কোনো ধরনের ঘনিষ্ঠতা ছিল না। জাহাঙ্গীর আলোচনা চালিয়ে যায়, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তার পরিবর্তে তোমায় রাজকীয় সেনাবাহিনীর সেনাপতি করে দাক্ষিণাত্যে প্রেরণ করবো। মহামান্য সম্রাজ্ঞী তাই বলেছেন এবং আমিও তার সাথে একমত যে তুমি তার চেয়ে অনেক বেশি যোগ্য। মালিক আম্বারের বিরুদ্ধে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করো এবং তখন দেখবে আরো অনেক সম্মান তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।

‘আব্বাজান, আমি আপনাকে নিরাশ করবো না, খুররম, জীবনে প্রথমবারের মত স্বাধীন নেতৃত্ব লাভের উত্তেজনা কোনোমতে গোপন করে, বলে।

‘খুশি হলাম। আজ থেকে তোমার অভিযান শুরু হওয়া পর্যন্ত–যা আমার ইচ্ছা তোমার জন্য নতুন সৈন্য আর উপকরণ প্রস্তুত হওয়া মাত্র শুরু হোক–আমি চাই যুদ্ধ উপদেষ্টাদের প্রতিটা বৈঠকে তুমি উপস্থিত থাকো।

*

আগ্রা দূর্গ থেকে নিজের হাভেলীর সদর দরজা পর্যন্ত পুরোটা পথ খুররমের তূরীয় আনন্দ বজায় থাকে, সেখানে পৌঁছে সে আরজুমান্দকে কি বলবে সেটা চিন্তা করতে গিয়ে তার আনন্দের সলিল সমাধি ঘটে। তাঁদের কন্যা জাহানারার বয়স মাত্র দুই বছর। তাদের দুজনকে এখানে রেখে যাবার চিন্তাটাই অকল্পনীয়। আর তাছাড়া আরজুমান্দ কি বলবে? কিন্তু সে এমন একটা সুযোগের জন্যই অপেক্ষা করেছিল আর তার উচিত সুযোগটা গ্রহণ করা। সে যদি আরজুমান্দের মুখোমুখি হতে না পারে তাহলে শত্রুর মোকাবেলা কীভাবে করবে? সে হেরেমের দিকে অগ্রসর হবার সময় নিজেই নিজের কাছে প্রশ্ন করে।

আরজুমান্দ বরাবরের মতই তার জন্য অপেক্ষা করছিল। আজ তাঁর পরনে নীল রঙের স্বচ্ছ পাজামা আর আঁটসাট কাচুলি যার ফলে তার তলপেট অনাবৃত, এবং তার নাভীমূলে হীরকখচিত একটা পোখরাজ জ্বলজ্বল করছে। তার মনে হয় সে বোধহয় আগে কখনও তাকে এত সুন্দরী দেখেনি, ভাবনাটা আজ এজন্যই যে সম্ভবত সে জানে যে তাঁর রূপ উপভোগের বিলাসিতা থেকে সে অচিরেই বঞ্চিত হতে চলেছে।

সে আশ্লেষে তাঁর অধর চুম্বন করে তারপরে ব্যগ্র ভঙ্গিতে তাঁর দু’হাত ধরে।

‘আরজুমান্দ। আব্বাজান আজ আমায় বিশাল এক সম্মানে ভূষিত করেছেন। তিনি আমায় দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধমান রাজকীয় বাহিনীর অধিনায়কত্ব দান করেছেন। আমি যদি এই দায়িত্ব পালনে সফল হই তাহলে সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে তিনি সর্বসম্মক্ষে আমায় তার উত্তরাধিকার হিসাবে ঘোষণা করবেন…’।

সে কিছুক্ষণের জন্য নির্বাক হয়ে থাকে তারপরে গম্ভীর কণ্ঠে বলে, আমি আপনার জন্য গর্ব অনুভব করছি। আপনি আপনার আব্বাজানের প্রত্যাশা ছাপিয়ে যাবেন। আপনাকে কবে নাগাদ রওয়ানা দিতে হবে?

‘অচিরেই। আমার কেবল একটা বিষয়েই আক্ষেপ থাকবে… যে আমাকে আমার স্ত্রী কন্যাকে এখানে রেখে যেতে হচ্ছে।

আরজুমান্দ তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। আপনাকে কেন এমনটা করতে হবে?

‘আমি তোমায়–পাঁচশো মাইল কিংবা তারও বেশি পথ–যা বিপদসঙ্কুল, গরম আর অস্বস্তিকর সেখানে নিয়ে যেতে পারি না। তোমার সেখানেই থাকা উচিত যেখানে আমি জানবো যে তুমি নিরাপদে রয়েছে।’

‘খুররম, আপনি যখন বলেছিলেন আপনাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে হবে–যে এটা আপনার কর্তব্য–আমি সেটা মেনে নিয়েছিলাম। আমি এখন আপনাকে বলছি যে আমি অবশ্যই আপনার সাথে যাব–কারণ সেটা আমার কর্তব্য–আর আপনার সেটা মেনে নেয়া উচিত। আমার দাদাজান আর দাদিজান পরিস্থিতি যতই বিপদসঙ্কুল হোক সবসময়ে একত্রে থেকেছেন। তাঁরা ভালো করেই জানতেন যে অন্য যেকোনো সম্ভাবনার চেয়ে তাঁদের পৃথক হওয়াটা সবচেয়ে জঘন্য পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে। সম্রাট আর সম্রাজ্ঞী মেহেরুন্নিসাকেই দেখেন–তাঁরা কখনও পরস্পরের কাছ থেকে পৃথক হোন না। তিনি যখন শিকারে যান এমনকি তখনও তিনি তার সাথে থাকেন। সম্রাটের চেয়ে তিনি একজন দক্ষ নিশানাবাজ আর শিকারী। তারা যখন একা থাকেন তখন তিনি তাঁর সাথে একত্রে ঘোড়ার পিঠে পর্যন্ত আরোহণ করেন। আমি নিশ্চিত তিনি যদি যুদ্ধ যাত্রা করেন তাহলে মেহেরুন্নিসাও তাঁর সঙ্গী হবেন। আমি তাহলে কেন ভিন্ন আচরণ করবো?

‘তুমি শারীরিকভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী নও। জাহানারার জন্মের সময় তোমায় কঠিন সময় অতিবাহিত করতে হয়েছিল… তোমার এখানে থাকা উচিত যেখানে সবসময়ে সেরা হেকিম পাওয়া যাবে, তোমার আবারও গর্ভধারণ করা উচিত…’।

‘সেরা হেকিম আমাদের সাথেই যেতে পারে। খুররম আমি কাঠের পুতুল নই। আমি এখানে হারেমের স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ করি কিন্তু আপনার সাথে একত্রে থাকার আনন্দের সাথে এসব কিছুর তুলনাই চলে না। আমায় যদি নগ্ন পায়ে জাহানারাকে কোলে নিয়ে আপনাকে অনুসরণ করতে হয় আমি করবো আর সেটা খুশি মনেই করবো।’ সে তার কব্জি আঁকড়ে ধরে এবং খুররম তার নখের তীক্ষ্ণতা নিজের পেশীতে বেশ অনুভব করে। সে তাকে কখনও এতটা সংকল্পবদ্ধ দেখেনি, তাঁর কোমল মুখাবয়বে এখন প্রায় যুদ্ধংদেহী একটা অভিব্যক্তি।

‘আমার আব্বাজানের সম্ভবত উচিত আমার বদলে আপনাকে মালিক আম্বারের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ করা–আপনাকে দারুণ হিংস্র দেখাচ্ছে। সে মুচকি হাসে, আশা করে প্রত্যুত্তর দিতে গিয়ে আরজুমান্দও হেসে ফেলবে, কিন্তু তাঁর অভিব্যক্তি সামান্য শীথিলও হয় না। তার এখন কি করা উচিত? পরবর্তী সম্রাট হিসাবে নিজের যোগ্যতা প্রদর্শনের সুযোগ আব্বাজান তাকে দিয়েছেন… সে যদিও সমরবিদ্যায় প্রশিক্ষণ নিয়েছে, ঘন্টার পর ঘন্টা ওস্তাদের কাছে পূর্ববর্তী মোগল অভিযানের কৌশল অধ্যয়ন করেছে, খঞ্জর, তরবারি, গাদাবন্দুক আর গদা নিয়ে লড়াই করতে জানে কিন্তু সে পূর্বে কখনও কোনো অভিযান পরিচালনা করে নি। তার মনোনিবেশে কোনোকিছু–কোনো ব্যক্তিও–যেন বিঘ্ন ঘটাতে না পারে। সেই সাথে এটাও সত্যি আরজুমান্দকে এখানে রেখে যাবার অর্থ নিজের দেহের একটা অংশকেই নিজের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা। সে যদি একটা বিষয়ে নিশ্চিত থাকে যে প্রতিটা দিনের শেষে সে এখানে তার জন্য প্রতিক্ষা করছে তাহলে সম্ভবত সে আরও পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে আরও দক্ষতার সাথে লড়াই করতে পারবে। সে নিশ্চিতভাবেই আনন্দিত হবে…

‘খুররম…’ তার নখ আরও গভীরভাবে আঁকড়ে বসে।

সবকিছুই সহসা অনেক সহজ হয়ে যায়। তাদের পরস্পরের কাছ থেকে পৃথক হতে হবে না আর সেও তাকে নিরাপদ রাখার জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করবে। বেশ। চলো একসাথেই যাওয়া যাক।

‘আর সবসময়েই তাই হবে। তাঁর কণ্ঠস্বর আত্মপ্রত্যয়ে গমগম করে।

১.১০ ‘পৃথিবীর অধিশ্বর’

আগ্রার সাড়ে চারশ মাইল দক্ষিণপশ্চিমে, বুরহানপুরের বেলেপাথরের তৈরি দূর্গ-প্রাসাদের সম্পূর্ণ অবয়ব প্রশস্ত তপতী নদীর শান্ত জলস্রোতে প্রতিফলিত হয়। খুররম শহরটায়-দাক্ষিণাত্যে মোগল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত–মাসখানেক পূর্বে এসেছিল এবং এখন মালিক আম্বারের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযান শুরুর বাসনায় কৃতসংকল্প হয়ে পুনরায় শহরটা ত্যাগ করছে। চারতলা বিশিষ্ট হাতির আস্তাবল, হাতিমহল থেকে বাকান ঢালু পথ দিয়ে যূথবদ্ধ হস্তিবাহিনী একপাশে প্রসারিত হয়ে অংশত আবৃতকারী ইস্পাতের বর্মে সজ্জিত হয়ে দূর্গের পাশে অবস্থিত কুচকাওয়াজ ময়দানে সমবেত হতে শুরু করেছে। তাঁদের মাহুতেরা সেখানে জম্ভগুলোর কানের পেছনে বসে, তাদের হাতে থাকা লোহার লোহার দণ্ড দিয়ে অতিকায় প্রাণীগুলোর কানের পিছনে আলতো করে টোকা দিতে তারা হাঁটু ভেঙে বসে পড়লে অন্য সহকারীরা তাঁদের পিঠে গিল্টি করা হাওদা স্থাপন করছে। হাওদাগুলো চামড়া ফালি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হতে খুররমের প্রধান সেনাপতিরা তাদের কর্চি আর দেহরক্ষীদের নিয়ে সেখানে চার হাত পায়ের সাহায্যে উঠে বসছে, প্রতিটা হাওদায় সাধারণত তিনজন আরোহণ করছে কিন্তু বড় হাতির ক্ষেত্রে সংখ্যাটা চার। ঘর্মাক্ত দেহে কেবলমাত্র সাদা লেঙ্গট পরিহিত অবস্থায় শ্রমিকের দল অন্য হাওদাগুলোয় ছোট ছিদ্রব্যাসের কামান, গজনল তুলছে।

সবার প্রস্তুতি সম্পন্ন শেষ হতে দূর্গের প্রধান তোরণদ্বার খুলে যায় এবং সেখান দিয়ে খুররমের নিজের রণহস্তী বাইরে বের হয়ে আসে। অন্য যেকোনো হাতির চেয়ে বৃহদাকৃতি, এর পিঠে সবুজ চাঁদোয়া বিশিষ্ট একটা হাওদা যেখানে খুররম ইতিমধ্যেই, মাথায় সোনালী গিল্টি করা শিয়োস্ত্রাণ আর ফিরোজা খচিত কারুকাজ করা ইস্পাতের বর্ম পরিহিত অবস্থায় যুদ্ধের জন্য নিখুঁতভাবে সজ্জিত হয়ে, অবস্থান গ্রহণ করেছে। আরো চারটা হাতির একটা দল তাকে অনুসরণ করে। প্রথম হাতিটার হাওদার চারপাশ কারুকাজ করা মসলিনের পর্দা সোনালী ফিতে দিয়ে শক্ত করে বাঁধা রয়েছে আরজুমান্দ বানুকে কোনো ধরনের কৌতূহলী দৃষ্টি থেকে আড়াল করতে; অবশিষ্ট তিনটা হাতির প্রতিটায় চারজন করে কমলা-পাগড়ি পরিহিত রাজপুত যোদ্ধা রয়েছে, খুররমের দেহরক্ষীদের ভিতরে সবচেয়ে বিশ্বস্ত, তার আদেশ অনুযায়ী আরজুমান্দকে যেকোনো ধরনের অপমানের হাত থেকে তারা নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে রক্ষা করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। চৌকষভাবে অস্ত্র সজ্জিত প্রত্যেক রাজপুত যোদ্ধার সাথে সর্বাধুনিক গাদাবন্দুক ছাড়াও রয়েছে অপেক্ষাকৃত কম প্রাণঘাতি কিন্তু দ্রুত নিক্ষেপযোগ্য তীর আর ধুনক এবং অবশ্যই তরবারি। সযত্ন চর্চিত চওড়া গোফের আড়ালে তাদের মুখে কঠোর একটা অভিব্যক্তি ফুটে রয়েছে। তোরণদ্বারের পাশে সমবেত হওয়া অল্প সংখ্যক মানুষের ভীড়ে সামান্যতম ঝামেলার ইঙ্গিত পেতে, মোগল বাহিনীকে নেতৃত্ব শূন্য করতে বা তাঁদের নেতাকে তার সুন্দরী স্ত্রীর সাহচর্য বঞ্চিত করতে ওঁত পেতে থাকা সম্ভাব্য আততায়ীল সন্ধানে যাকে হয়ত মালিক আম্বার পাঠিয়েছে, তারা সতর্ক দৃষ্টিতে এখনও আবেক্ষণ করছে। সমবেত জনতার মাঝে অবশ্য কেবল ভক্তি ভরে মাথা নত করা আর খালি হাতে হাততালি দেয়া আর হাত নেড়ে বিদায় জানানোই চোখে পড়ে।

খুররম, আরজুমান্দ আর তাদের দেহরক্ষীদের বহনকারী হাতির পেছনে অন্য রণহস্তীগুলো এবার বিন্যস্ত হয়। পুরো দলটা একসাথে কাঠের মালবাহী ভারি শকটে স্থাপিত সূক্ষ কারুকাজ করা ব্রোঞ্জের কামান আর সেগুলোর সাথে ইতিমধ্যে জোয়াল দিয়ে বাঁধা ষাড়ের পালের পাশ দিয়ে ধীরে ধীরে ধূলিধূসরিত কুচকাওয়াজ ময়দান অতিক্রম করে। সবচেয়ে বড় কামানগুলো টেনে নেয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত দলগুলোয় সর্বোচ্চ সংখ্যক ত্রিশটি ষাড় রয়েছে সবগুলোর শিং মোগল বাহিনীর স্মারক সবুজ রঙে রঞ্জিত, প্রতি তিনটা পশুর জন্য রয়েছে একজন করে চাবুকধারী গাড়োয়ান যাতে কেউ নিজেদের কাজে অবহেলা করতে না পারে। কামানবাহী শকটগুলোর মাঝে মাঝে রয়েছে আট চাকাবিশিষ্ট উট বা খচ্চর বাহিত গোলা-বারুদ বহনকারী শকট, কামানের জন্য যেগুলোতে বারুদের বস্তা রয়েছে, বৃষ্টি আর আদ্রতার হাত থেকে রক্ষা করতে বাগুলো পানিনিরোধক বস্ত্র দিয়ে ভালো করে আবৃত করা রয়েছে আর বস্তাগুলোর পাশেই রয়েছে পাথরের অথবা লোহার তৈরি কামানের গোলা।

খুররম আর তাঁর সঙ্গীদের বহনকারী হাতির বহর অবশেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তার উৎকৃষ্ট অশ্বারোহীদের বারো জনের আড়াআড়িভাবে বিন্যস্ত একটা সেনাপুরঃসর অগ্রদলের পেছনে নির্ধারিত স্থান গ্রহণ করে এবং খুররমের আদেশে তাদের প্রত্যেকের পরনে একই ধরনের সোনালী কাপড়ের পোষাক সাথে একই কাপড় দিয়ে তৈরি পাগড়ির শীর্ষভাগে সারসের লম্বা সাদা পালক পতপত করে উড়ছে। গাঢ় বর্ণের ঘোড়া তাদের সবাইকে বহন করছে এবং তাদের বর্শার অগ্রভাগে সবুজ আর সোনালী রঙের নিশান উড়ছে। আমি একটা বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত মালিক আম্বার যখন গুপ্তচর মারফত আমাদের সৈন্য সজ্জার সংবাদ জানতে পারবে, খুররম তার পাশে অবস্থানরত কর্চির উদ্দেশ্যে বলে, সে অনুধাবন করবে একজন সেনাপতি অস্ত্র আর রসদের সংস্থান ছাড়াও জনসমক্ষে নিজেদের উপস্থাপনের মত খুটিনাটি ব্যাপারেও যার মনোযোগ রয়েছে এমন একজনকে তাঁর ভয় পাওয়া উচিত। তারপরে, গর্ব আর আত্মবিশ্বাসে ভরপুর খুররম চিৎকার করে অগ্রসর হবার আদেশ দেয়। দূর্গের প্রাকার থেকে ব্রোঞ্জের তূর্য ধ্বনি ভেসে আসবার সাথে সাথে সেনাপুরঃসর অগ্রদলের মাঝ থেকে অশ্বারূঢ় তূর্যবাদকেরা প্রত্যুত্তর দেয়। তোরণগৃহ থেকে দশ ফুট পরিধির বিরাটাকৃতি নাকাড়াগুলো মন্দ্র শব্দে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয় এবং অশ্বারোহী বাদকদলের লোকেরা ঘোড়ার পিঠের দু’পাশে ঝোলানো ঢাকে সংবদ্ধ বোল বাজাতে শুরু করলে এর সাথে সঙ্গতি রেখে সৈন্যবাহিনীর সারিগুলো ধীরে ধীরে গতিশীল হয়ে উঠে।

দক্ষিণে তপতীর বালুকাময় তীরের দিকে এবং দূর্গ থেকে দূরে বহরটা এগিয়ে যেতে শুরু করলে আরও অশ্বারোহী বাহিনী তাদের সাথে এসে যোগ দেয় আর তারপরে যোগ দেয় নিম্নমানের চলনসই পোষাক পরিহিত কিন্তু তারপরেও পর্যাপ্ত অস্ত্র সজ্জিত পদাতিক বাহিনীর সারি। এঁদের পেছনে থাকে মূল মালবাহী বহরের বিভিন্ন আকৃতির শকট। সবশেষে, যখনই কোনো সেনাবাহিনী যাত্রা আরম্ভ করে, যারা পূর্বে গমন করেছে তাঁদের বাহনের খুর থেকে উত্থিত ধুলার মাঝে কাশতে কাশতে আসে সৈন্যদের প্রয়োজনীয় সেবা করতে উদ্গ্রীব সেনাছাউনি অনুসরণকারী বিশৃঙ্খল আর উচ্ছঙ্খল জনতার একটা দল এবং অস্থায়ী ছাউনিতে তারাই মনোরঞ্জন আর বিশ্রামের সুযোগ করে দেয়। যাত্রার কারণে ক্ষয়ে যাওয়া জুতো আর নতুন পোষাক তৈরি করার জন্য বহরের সাথেই রয়েছে দর্জি আর মুচির দল। তাদের সাথে আরো রয়েছে মিষ্টান্ন বিক্রিকারী হালুইকর আর সুরা বিক্রেতা। তাদের ভিতরে রয়েছে আগুন খেকোর দল, দড়াবাজ আর জাদুকরের পাশাপাশি রয়েছে আত্মমগ্ন দরবেশের একটা দল। প্রাতিজনিক প্রবোধ আর বিমুক্তি দেয়ার জন্য সৈন্যসারির সাথে যোগ দেয় অগণিত বেশ্যা, তাঁদের সবাই দেখতে সুন্দরী বা অল্পবয়সী নয় কিন্তু একবেলার ডাল ভাতের মূল্যের বিনিময়ে তাঁরা নিজেদের দেহ বিক্রি করতে উদ্গ্রীব।

*

খুররম ছয় সপ্তাহ পরে হেরেমের নির্ধারিত তাবুতে আরজুমান্দের সাথে একই শয্যায় শুয়ে থাকা অবস্থায় সে চোখ খুলে এবং দেখে ইতিমধ্যেই তার ঘুম ভেঙেছে। সে তাকে নিজের বাহুর মাঝে আলিঙ্গণ করে, দিনের লড়াইয়ের সময়ে সাবধানতা অবলম্বনের জন্য তার কাছে মিনতি করে। সে সতর্ক থাকবে বলে তাকে প্রতিশ্রুতি দেয় এবং আশ্বস্ত করে মালিক আম্বারের বাহিনীকে দুর্বল করতে সে কেবল তাদের উপরে একটা ঝটিকা আক্রমণ পরিচালনার পরিকল্পনা করেছে, সে তাঁর উষ্ণ অধর চুম্বন করে। সে তারপরে আলতো করে নিজেকে তাঁর আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে এবং শয্যার কারুকাজ করা নীল পশমের আচ্ছাদনী একপাশে সরিয়ে দেয়। সে উঠে দাঁড়ায়, নিজের নগ্ন পেষল দেহে সবুজ রেশমের একটা আলখাল্লা জড়িয়ে নেয় এবং ভোরের প্রথম আলো অস্থায়ী শিবিরের চারপাশের নিচু পাহাড়ী এলাকাকে সোনালী আভায় গিলটি শুরু করার মুহূর্তে সে মাথা নিচু করে দ্রুত হেরেমের তাবু থেকে বের হয়ে আসে। ভোরের শীতল তাজা বাতাসে শ্বাস নেয়ার জন্য কয়েক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে সে পার্শ্ববর্তী একটা তাবুর দিকে এগিয়ে যায় যেখানে তার কচিঁ যুদ্ধের উপযুক্ত পোষাকে সজ্জিত হতে তাকে সাহায্য করার জন্য অপেক্ষা করছে। খুররম দ্রুত নিজের কারুকাজ করা বক্ষস্থল রক্ষাকারী বর্ম বেঁধে নেয় এবং তাঁর গলাকে সুরক্ষিত রাখতে লোহার জালির তৈরি সঞ্জাবযুক্ত তাঁর চূড়াকৃতি শিরোস্ত্রাণ পরিধান করে। সে মশলা দিয়ে তন্দুরে ঝলসান মুরগী আর গরম দুটো নান দিয়ে দ্রুত প্রাতরাশ সমাপ্ত করে, তারপরে তার কালো ঘোড়ায় আরোহণ করে এবং যেখানে তার শ্রেষ্ঠ অশ্বারোহী যোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত প্রায় পাঁচ হাজারের একটা আক্রমণকারী বাহিনী অপেক্ষা করছে সেদিকে দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত অবস্থায় এগিয়ে যায়, আক্রমণ শুরু করার জন্য মুখিয়ে থাকায়, তাঁদের বাহনগুলো অস্থির ভঙ্গিতে মাটিতে খুর দিয়ে আঘাত করছে।

‘যাত্রা করা যাক, সে তার অশ্বারোহী বাহিনী স্থূলকায় তরুণ সেনাপতি কামরান ইকবালকে বলে এবং তাঁরা যাত্রা শুরু করে। খুররম তার শিবিরের বহিঃসীমানার শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যুহের ভিতর দিয়ে অতিক্রম করার সময় সে শেষবারের মত দীর্ঘক্ষণ হেরেমের তাবুর দিকে তাকিয়ে থাকে। আরজুমান্দ সেখানে রয়েছে বলে সে খুশি। গতরাতে, আজকের সকালের এই আক্রমণ পরিকল্পনা চূড়ান্ত হবার পরে, আরজুমান্দের প্রশান্ত উপস্থিতি তাঁর দেহমন শমিত করতে সহায়তা করেছে এবং আজকের যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে সে খানিকটা ঘুমিয়ে নিতে পেরেছে। সে কালো ঘোড়ার পাজরে গুঁতো দিয়ে রুক্ষ পল্লীপ্রান্তরের উপর দিয়ে নিজের লোকদের নিয়ে প্রায় বারো মাইল দূরে অবস্থিত নির্দিষ্ট স্থানের দিকে এগিয়ে যায় যেখানে, যদি তার গুপ্তদূতদের অনুমান সঠিক হয়ে থাকে, আজ সকালের মাঝামাঝি কোনো একটা সময়ে মালিক আম্বারের বাহিনীর উপস্থিত হবার কথা।

খুররম সকাল প্রায় নয়টা নাগাদ একটা নিচু রিজের ছায়ায় তাঁর লোকদের নিয়ে যাত্রা বিরতি করে যা তাঁর অনুমিত দিক থেকে যদি মালিক আম্বারের লোকের অগ্রসর হয় তাহলে তাকে তাদের দৃষ্টিপটের আড়ালে রাখবে। সে গিল্টি করা ভঁজু-অগ্রভাগ বিশিষ্ট পর্যাণের উপর থেকে পিছলে মাটিতে নেমে এসে রিজের শীর্ষদেশের দিকে দ্রুত দৌড়ে যায়। শীর্ষের কাছাকাছি পৌঁছাবার ঠিক আগ মুহূর্তে সে পেটের উপর ভর দিয়ে মাটিতে সটান শুয়ে পড়ে এবং উঁকি দেয়। তার কয়েকজন সেনাপতি অচিরেই তার সাথে এসে যোগ দেয়। কয়েকটা ছাগল ছাড়া কেউই নড়াচড়া করছে এমন আর কিছু খুঁজে পায় না। শঙ্কাকুল দৃষ্টিতে দিগন্ত তন্নতন্ন করে প্রায় পৌনে এক ঘন্টা আবেক্ষন করার সময় তার মাথার ভিতরে দুশ্চিন্তার ঝড় বইতে থাকে যে তার গুপ্তদূতেরা হয়তো কোথাও ভুল করেছে বা মালিক আম্বার কোনোভাবে তার অভিপ্রায়ের কথা জানতে পেরেছেন এবং গুপ্তদূতদের বিভ্রান্ত করে নিজের গতিপথ পরিবর্তিত করেছেন বা এমনকি মোগল ছাউনি হয়তো আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তারপরেও খুররমের দৃষ্টিতে কিছুই আটকায় না। সে নিজেই নিজের সাথে তর্ক করতে থাকে তার কি নিজের বাহিনীর একাংশ প্রেরণ করা উচিত শিবিরে সবকিছু ঠিক আছে কিনা দেখে আসবার জন্য কিন্তু শেষে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে দশ মিনিট পরে পরম স্বস্তির সাথে পূর্বদিকে ধূলোর একটা দেখতে পায়–মালিক আম্বার যেদিক থেকে আসবে বলে সে প্রত্যাশা করেছিল। তাঁর গুপ্তদূতের দলের একজন সদস্য কয়েক মিনিট পরেই, নিরাপদ দূরত্ব থেকে মালিক আম্বারের বাহিনীর উপর পর্যায়ক্রমে নজর রাখার জন্য যাদের আদেশ দেয়া হয়েছিল, তাঁর ঘর্মাক্ত হবার কারণে চিত্রবিচিত্র খয়েরী রঙের ঘোড়ায় চেপে হাজির হয়।

‘তারা কতদূরে অবস্থান করছে?’ খুররম জানতে চায়। গ্রীষ্মের দাবদাহের কারণে দূরত্বের ধারণা অনেক সময় ভ্রান্তিজনক হয়ে উঠে।

‘জাহাপনা, দুই কি তিন মাইল হবে।

‘আমি যা ভেবেছিলাম এটা তারচেয়েও কম। তাঁরা কি ধরনের ব্যুহ বজায় রাখছে?

‘তাদের মূল বাহিনী থেকে প্রায় সোয়া মাইল দূরে পুরো বাহিনীকে ঘিরে নিজেদের গুপ্তদূতেরা বৈরী প্রতিপক্ষের সন্ধানে ভ্রমণ করছে কিন্তু আমি যেখানে অবস্থান করছিলাম সেখান থেকে দেখে অবশিষ্ট বাহিনীকে আমার বেশ শমিত মনে হয়েছে। কামান আর বারুদবাহী শকটগুলো এখনও আচ্ছাদিত রয়েছে–এই বিষয়ে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত।

‘তার মানে আমরা এত কাছে থাকতে পারি সেটা তারা এখনও সন্দেহ করে নি?’

‘জাহাপনা, আমার সেটা মনে হয় না।’

‘বেশ, তাঁরা অচিরেই অবগত হবে, খুররম কথা বলে, রিজ থেকে নামার জন্য সে ইতিমধ্যেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সে চিৎকার করে নিজের সেনাপতিদের ডাকে, আমরা সরাসরি তাদের আক্রমণ করতে যাচ্ছি। সবাই মনে রাখবেন তাঁদের কামানগুলো অকেজো করে দেয়াই আমাদের লক্ষ্য। আমরা তাঁদের যতবেশি সংখ্যক কামান ধ্বংস বা অকেজো করে দিতে পারবো আমরা আমাদের শত্রুর লড়াই করার ক্ষমতা ততবেশি হ্রাস করতে পারবো।’

খুররম সোয়া ঘন্টা পরে নিজের বাহিনীর পুরোভাগে অবস্থান করে মালিক আম্বারের সৈন্যসারির দিকে আস্কন্দিত বেগে ঘোড়া হাকিয়ে এগিয়ে যায়। শুষ্ক মাটির বুকে ঘোড়ার খুরের আঘাতে ঢাকের বোল উঠে আর ছিটকে উঠা ধূলিকণা তাঁদের সওয়ারীর চোখে বিদ্ধ হয় এবং তাঁদের নাক মুখ ধূলোয় কিচকিচ করতে থাকে। খুররম মৃত্যুদায়ী অভিপ্রায়ে অগ্রসর হবার সময় চারপাশ অন্ধকার করে থাকা ধূলোর মেঘের ভিতর দিয়ে দেখতে পায় যে মালিক আম্বারের লোকেরা এতক্ষণে বিপদ বুঝতে পেরেছে। অশ্বারোহী যোদ্ধারা আক্রমণ প্রতিহত করতে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিতে শুরু করে আর তোপচিরা হন্তদন্ত হয়ে কামানের উপর থেকে আবরণ সরাতে থাকে আর কামানের মুখ প্রতিপক্ষের দিকে ঘোরাবার জন্য ষাড়ের পালকে নির্বিচারে চাবুক দিয়ে আঘাত করতে থাকে, যখন অন্যেরা গোলাবারুদ বহনকারী শকট থেকে কামানের গোলা আর বারুদের বস্তা টেনে নামায়। তীরন্দাজেরা রণহস্তীর হাওদায় অবস্থান গ্রহণের জন্য বেয়ে উঠতে থাকে। তবকীরা তাঁদের বন্দুকগুলোকে প্রস্তুত করে এবং সেগুলোর দীর্ঘ ব্যারেল তেপায়ার উপর স্থাপন করে যাতে করে আরো নিখুঁতভাবে নিশানাভেদ করা যায়। খুররম আরো দেখতে পায় সূর্যের আলোয় ঝকঝক করতে থাকা বক্ষস্থল আবৃতকারী বর্ম পরিহিত একদল লোক সৈন্যব্যুহের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ব্যস্তভাবে ঘোড়া নিয়ে ছোটাছুটি করছে। তারা সম্ভবত মালিক আম্বার আর তার আধিকারিকেরা, সৈন্যদের উৎসাহ জোগাচ্ছে আর প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছে।

আকাশের বুক চিরে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর তাঁর বল্পিত গতিতে ধাবমান লোকদের উপরে আছড়ে পড়তে শুরু করে। তাঁর কানের পাশ দিয়ে গাদাবন্দুকের গুলি মৃত্যুর শিস বাজিয়ে যায় আর মালিক আম্বারের প্রতিরক্ষা ব্যুহ থেকে আলোর ঝলকানি আর সাদা ধোয়ার কুণ্ডলী দেখা যেতে বোঝা যায় যে শত্রুপক্ষের গুটিকয়েক তবকি এখন অন্তত গুলিবর্ষণ শুরু করেছে। সে এর কিছুক্ষণ পরেই আরো মন্দ্র একটা অভিঘাত আর উত্তাল তরঙ্গের ন্যায় ধোয়ার কুণ্ডলী উঠতে দেখলে তার মাঝে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না যে এইমাত্র মালিক আম্বারের একটা কামানও যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। খুররম দশ গজেরও কম দূরত্বে তাঁর সামনের সারির একজন যোদ্ধাকে–এক তরুণ রাজপুত নিশানা বাহক–তার পর্যাণ থেকে পেছনের দিকে ছিটকে মাটিতে আছড়ে পড়তে দেখে, হতভাগ্য অশ্বারোহী ভূপাতিত হবার সময় তার হাত থেকে সবুজ রঙের মোগল নিশানা ছিটকে যায়। তাকে অনুসরণরত–আরেকজন রাজপুত–অশ্বারোহীর বাহন ভূপাতিত দেহের কারণে হুমড়ি খায় এবং তারপরে নিশানের সাথে পা জড়িয়ে যেতে এটাও মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, তাঁর রাজপুত সওয়ারীকে মাথার উপর দিয়ে মাটিতে ছিটকে ফেলে এবং তারপরে আরো একটা ঘোড়াকে তার আরোহীসহ ধূলোয় ফেলে দেয়। খুররম ভাবে, মালিক আম্বারের সৈন্যসারি আর মাত্র সোয়া মাইল দূরে রয়েছে। এই দূরত্ব অতিক্রম করতে যে সময় প্রয়োজন সেই অবসরে শত্রুপক্ষ খুব বেশি একটা ক্ষতিসাধন করতে পারবে বলে তার কাছে মনে হয় না। সে তার ঘোড়ার গলার কাছে সহজাত প্রবৃত্তির বশে নুয়ে এসে, সে মালিক আম্বারের কামানের অবস্থান অভিমুখে আরো সরাসরি অগ্রসর হবার অভিপ্রায়ে লাগামে মোচড় দেয় এবং ছোটার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা কালো ঘোড়ার পাজরে দিনের প্রথমবারের মত গুঁতো দেয়।

সে এরপরেই নিজেকে মালিক আম্বারের সৈন্যসারির মাঝে নিজেকে দেখতে পেয়ে, কামানগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে সেগুলোর কয়েক গজ সামনে একটা ব্যুহ রচনা করে নিজের সহযোদ্ধাদের সাথে অবস্থানরত বেগুনী রঙের পাগড়ি পরিহিত এক তবকীর উদ্দেশ্যে তরবারি কোপ বসিয়ে দেয়। সে ইতিমধ্যে একবার গুলি করেছে এবং সে বন্দুকে পুনরায় গুলি ভর্তি করতে তাঁর পাশে সীসার গুলিভর্তি সাদা সুতির থলে থেকে একটা গুলি নিয়ে ইস্পাতের দণ্ডের সাহায্যে লম্বা ব্যারেলে প্রবেশ করাতে মরীয়া হয়ে চেষ্টা করছে। সে তাঁর আরাধ্য কাজ আর কখনও শেষ করতে পারবে না। খুররমের তরবারি, সেদিন সকালেই অস্ত্রাগারের তত্ত্বাবধায়ক নিখুঁতভাবে শান দিয়ে ধারালো করে তুলেছে, তবকীর মুখের একপাশে আঘাত হেনে বেচারার চোয়াল প্রায় বিচ্ছিন্ন করে তার সাদা দাঁতের সারি অনাবৃত করে ফেলে। হাতের বন্দুক ফেলে দিয়ে লোকটা মাটিতে পড়ে যেতে খুররম পেছনের দিকে একবারও না তাকিয়ে সামনের কামান আর গোলাবারুদবাহী শকটের দিকে দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত অবস্থায় দিকে ছুটে যায়। খুররমের অবস্থান থেকে মাত্র দশ গজ দূরে একটা কামান কানে তালা ধরিয়ে দেয়া শব্দ আর সাদা ধোয়ার মেঘ সৃষ্টি করে গোলাবর্ষণ করে। খুররমের আরেকজন দেহরক্ষীর উদরে গিয়ে গোলাটা আঘাত করতে তার দেহের উপরের অংশ নিমেষে স্থানচ্যুত হয় আর তার রক্তাক্ত ঘোড়াটা সহসা তাল হারিয়ে আরেক দিকে দৌড়ে যায় তখনও তার দেহের নিচের অংশ পর্যাণে বসে রয়েছে।

বারুদের ঝাঁঝালো ধোঁয়ায় কাশতে শুরু করে, তার কান ভোঁ-ভোঁ করতে থাকে, খুররম তার ঘোড়াকে পুনরায় সামনের দিকে অগ্রসর হবার ইঙ্গিত করে, আরেকজন তোপচীকে লক্ষ্য করে তরবারি চালায় যে পাথরের অসম্ভব ভারি কামানের একটা গোলার ওজনে নুয়ে প্রায় বাঁকা হয়ে গিয়ে নিজের অস্ত্রের দিকে যাবার জন্য প্রাণান্তকর পরিশ্রম করছে। পিঠে আঘাত প্রাপ্ত হতে, লোকটার হাত থেকে পাথরের গোলাটা পড়ে যায় এবং তার সাদা রঙের নোংরা জোব্বাটা রক্ত শুষে নিতে থাকলে, সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এক মিনিট বা সম্ভবত তারও কম হবে–যুদ্ধক্ষেত্রে সময় যেন সহসাই স্থবির হয়ে উঠে–খুররম সৈন্যসারির অন্যপাশে পৌঁছে যায়। নিজের চারপাশে তাকিয়ে সে দেখতে পায় যে আরো অনেক তোপচি হাতের ইস্পাতের দণ্ড ফেলে দিয়ে নিজের অবস্থান পরিত্যাগ করে দৌড়ে পালাতে শুরু করেছে। অধিকাংশের প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয় যেহেতু তাঁর অনুগত অশ্বারোহী যোদ্ধারা তাদের তরবারি নিয়ে পেছন থেকে তাঁদের উপর চড়াও হয় তারা দৌড়াতে করায় বা বর্শা দিয়ে তাদের গেঁথে ফেলে।

খুররমের লোকজন দ্রুত তার চারপাশে সমবেত হতে আরম্ভ করে। ‘তোমাদের ভিতরে যাঁদের কীলক বিতরণ করা হয়েছে সেগুলো কামানের পশ্চাদভাগে সর্বশক্তি দিয়ে ঢুকিয়ে দেবে, সে আদেশ দেয়। যাদের কাছে কাঠের ছোট হাতুড়ি রয়েছে তারা চেষ্টা করবে কামানের সম্মুখভাগের বহনকারী শকটের চাকাগুলো ভেঙে দিতে। আর যাদের উপরে বারুদের চিহ্নরেখা তৈরি করে বারুদ বহনকারী শকটগুলো গুঁড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তারা আমরা প্রস্থান করার সাথে সাথে কাজ শুরু করে দেবে। তোমাদের কাজের সময়ে মালিক আম্বারের লোকদের আমরা বাকি যারা রয়েছি তারা ব্যস্ত রাখবো।

তার সৈন্যরা ঘোড়া থেকে নেমে যখন কাজ শুরু করবে খুররম একটা তূর্যধ্বনি শুনতে পায় এবং পোয়র স্রোতের মাঝে বিদ্যমান একটা ফাঁক দিয়ে–সে ইতিমধ্যেই বুঝতে পেরেছে যা রণক্ষেত্রকে এমন বিভ্রান্তিকর স্থানে পরিণত করে–সে মালিক আম্বারের বিশৃঙ্খল সৈন্যসারির পেছন থেকে তাঁর একদল অশ্বারোহীকে আবির্ভূত হতে দেখে এবং কৃতসংকল্প ভঙ্গিতে তাঁরই অবস্থানের দিকে হামলা করতে এগিয়ে আসতে দেখে। ‘এসো, আমরা তাঁদের মুখোমুখি হই,’ খুররম চিৎকার করে এবং তাঁর কালো ঘোড়াকে সামনে অগ্রসর হতে ইঙ্গিত করে।

সে আর তার লোকেরা তাদের ঘোড়াগুলোকে বল্পিত বেগে ধাবিত করার পূর্বেই শত্রু সৈন্য তাদের আক্রমণ করে। খুররমকে দেখে মনে হয় চিনতে পারায়, প্রতিপক্ষের গাট্টাগোট্টা দেখতে এক যোদ্ধা যে শিরোস্ত্রাণ পরার কিংবা বর্মে সজ্জিত হবার সময় পায়নি তার দিকে সরাসরি এগিয়ে যাবার জন্য লাগাম ধরে টান দেয়। খুররম তার ঘোড়াকে চক্রাকারে ঘোরায়, জটা এখন নিজের পূর্ববর্তী যুদ্ধ প্রয়াসের কারণে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে, তার মুখোমুখি হতে। তাঁর প্রতিপক্ষ অবশ্য আঘাত করার প্রথম সুযোগ লাভ করে, খুররমের বক্ষ আবৃতকারী বর্ম লক্ষ্য করে সে হাত দুলিয়ে নিজের বাঁকানো তরবারি নামিয়ে আনতে আঘাতটা নিশানা ভেদ করে আর তারপরে ইস্পাতে প্রতিহত হতে, খুররমও ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে ফলে তাঁর প্রথম আঘাতও বিফলে যায়, প্রতিপক্ষের যোদ্ধা মাথা নিচু করতে তরবারিটা উপরের বাতাস কেটে বের হয়ে যায়। কিন্তু খুররম তারপরেই, দ্রুত ভারসাম্য লাভ করে, পুনরায় তরবারি দিয়ে আঘাত করে, তাঁর তরবারির ক্ষুরধার ফলা লোকটার বুকের লম্বালম্বি হাড়ের ঠিক নিচে তাঁর স্ফীত আর অরক্ষিত উদরের গভীরে আঘাত হানে। সে অস্ত্র আর লাগাম ছুঁড়ে ফেলে এবং নিজের ক্ষতস্থান খামচে ধরে লোকটা তার ঘোড়া থেকে পাথরের মত খসে পড়ে, জটা তার প্রবল ভার থেকে মুক্ত হতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা পরিহার করে সেখান থেকে দ্রুত অন্যদিকে ধাবিত হয়।

খুররম আক্রমণের আকষ্মিকতা শেষে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে দম ফিরে পাবার চেষ্টা করার সময়ে নিজের চারপাশে তাকিয়ে দেখে যে মালিক আম্বারের যোদ্ধারা ক্রমশ আরো বেশি সংখ্যায় লড়াইয়ে যোগ দিচ্ছে এবং সেই সাথে এটাও লক্ষ্য করে যে তার পক্ষের বেশ কয়েকজন সৈন্য মাটিতে আহত বা নিহত অবস্থায় হাত পা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। সে যেমন আশা করেছিল তাঁদের এই ঝটিকা আক্রমণ ঠিক ততটাই সফল হয়েছে, মালিক আম্বারের যুদ্ধ উপকরণ আর তার শক্তি অনেকটাই তাঁরা আজ হ্রাস করেছে। তাদের অভিপ্রায় এখন যখন অর্জিত হয়েছে তখন এটাই উপযুক্ত সময় তাঁর আর তার অনুগত লোকদের নিরাপদে পশ্চাদপসারণ করা যখন তারা সেটা করতে পারবে। যথেষ্ট হয়েছে, সবাই এখনই ঘোড়ায় চাপো, কামানগুলো অকেজো করা যারা প্রায় শেষ করে ফেলেছে তাদের উদ্দেশ্যে সে চিৎকার করে। আহত কিংবা ঘোড়া হারিয়েছে এমন প্রত্যেককে তুলে নাও আর একটা ঘোড়ায় দু’জন আরোহণ করো কিন্তু তোমরা যখন স্থান ত্যাগ করবে তখন বারুদ বহনকারী শকটের চারপাশে তোমাদের সৃষ্ট বারুদের চিহ্নরেখায় অবশ্যই মনে করে অগ্নি সংযোগ করবে।

সে তার পদাতিক হিসাবে দায়িত্ব পালনরত সৈন্যদের হুড়োহুড়ি করে নিজেদের বাহনের পর্যাণে আরোহণ করতে, সহযোদ্ধাদের পেছনে তুলে নেয়ার সময় সে তাকিয়ে থাকে। দীর্ঘদেহী এক রাজপুত আহত একজন সহযোদ্ধাকে নিজের ধুসর ঘোড়ায় তুলে নেয়া জন্য প্রাণান্ত হচ্ছে তখনই শূন্য থেকে মৃত্যু মুখে নিয়ে দুটো তীর অল্প সময়ের ব্যবধানে নেমে এসে আহত যোদ্ধাকে বিদ্ধ করে, এবং সে পেছনের দিকে উল্টে পড়ে, স্পষ্টতই মৃত্যু ভূমি স্পর্শ করার পূর্বেই হয়েছে। চলে এসো, খুররম উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে, এবং নিজের কালো ঘোড়ার পাঁজরে গোড়ালী দিয়ে গুতো দেয় যার কালো চামড়া ঘামের সাদা ফেনায় জবজব করছে। সবশেষে যাঁরা শত্রুপক্ষের এলাকা ত্যাগ করবে সে তাদের সাথে অবস্থান করে। সে তীব্র বেগে ঘোড়া দাবড়ের নেয়ার সময়, পেছনের পরিস্থিতি দেখার জন্য নিজের পর্যাণে ঘুরে গিয়ে সে তার পেছনে তাকাতে সে দেখে, মালিক আম্বারের সৈন্যদের ছোঁড়া একটা বর্শা আঘাতে, তার আরেকজন যোদ্ধা নিজের বাহন থেকে কাত হয়ে একপাশে পড়ে যাচ্ছে। হতভাগ্য লোকটার পা রেকাবে আটকে যায় এবং রেকাবের চামড়া ছিঁড়ে যাবার আগে বেশ কিছুটা দূরত্ব সে ঘোড়ার পেছনে ছেচড়ে যায়।

খুররম সহসা অনুভব করে গরম বাতাসের একটা হলকা তার পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে এবং আবারও একটা বিকট বিস্ফোরনের শব্দ তাঁর কানে তালা ধরিয়ে দেয়। বারুদবাহী শকটগুলোর একটা অন্তত বিস্ফোরিত হয়েছে। আরেকটা বিস্ফোরণের আওয়াজ ভেসে আসে এবং খুররম তাঁর বাম গালের নাকের কাছে তীব্র একটা যন্ত্রণা অনুভব করে আর তরল কিছু একটা তার মুখের উপর দিয়ে গড়িয়ে ঠোঁটের কাছে আসে। জিনিষটার স্বাদ নোনতা আর তার জীহ্বায় কেমন ধাতব একটা অনুভূতি–রক্ত। সে ঘোড়ায় চেপে ছোটার মাঝেই গালে হাত দিয়ে একটা পাতলা ধাতুব টুকরো টেনে বের করে। সে ভাবে, জিনিষটা সম্ভবত টিনের তৈরি বারুদ রাখার তোড়ং।

সে অচিরেই আবার সেই রিজের চূড়ায় ফিরে আসে যেখান থেকে সে আক্রমণ আরম্ভ করেছিল, যেখানে তাঁর বাকি সৈন্যরা পুনরায় নতুন করে গোষ্ঠীবদ্ধ হচ্ছে। সে তার ঘোড়ার প্রবলভাবে স্পন্দিত হতে থাকা পাজরে করতল দিয়ে মৃদু আঘাত করে জটাকে আদর করে, এবং আবারও নিজের পেছন দিকে তাকালে, সে দেখে যে গুটিকয়েক পিছিয়ে পড়া দলছুট মোগল সৈন্য তখনও মালিক আম্বারের বিভ্রান্ত সৈন্যদের কাছ থেকে পালিয়ে আসছে। একটা ধুসর ঘোড়ার সামনের পা ঢাল দিয়ে উপরের দিকে উঠার সময়ে নিজের দেহের ভারে বেঁকে যায় এবং বিশাল প্রাণীটা ভূপাতিত হয়, পিঠের গাট্টাগোট্টা দেখতে, ধনুকের মত বাঁকানো পায়ের আরোহী সময়মত পর্যাণ থেকে লাফ দিয়ে সরে যায়। খুররম ভালো করে খেয়াল করলে দেখে যে ঘোড়াটার পার্শ্বদেশে তরবারির বিশাল একটা ক্ষত রয়েছে। প্রাণীটা তার উপরে অর্পিত দায়িত্ব ভালোমতই পালন করেছে এবং সাহসিকতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে পিঠের আরোহীকে এত দূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে।

মালিক আম্বারের লোকেরা তাদের পিছু ধাওয়া করে নি। খুররম বুরহানপুর ত্যাগ করার পর থেকে অতিবাহিত দু’মাসে এমন ঘটনা আরো দু’বার ঘটেছে, তাঁদের প্রতিপক্ষ সবসময়ে কৌশলগত নিরাপদ আশ্রয়স্থলে অবস্থান অব্যাহত রেখেছে, ঝটিকা হামলায় নিজের বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারটা আপাত দৃষ্টিতে বোধহয় মেনেই নিয়েছে এবং আজ সকালের মত ঝটিকা আক্রমণের সময় নিজ পক্ষের হামলাকারীদের, তারা যখন মূল বাহিনী থেকে পৃথক হয়ে হামলা শুরু করে, তখনও তাদের অনুসরণ করার কোনো তাগিদ তার ভিতরে লক্ষ্য করা যায়নি। মালিক আম্বার মনে হচ্ছে দাক্ষিণাত্যের মালভূমির সীমান্তের লাগোয়া পাহাড়ের অভ্যন্তর পর্যন্ত পশ্চাদপসারণ অব্যাহত রাখতে সংকল্পবদ্ধ যা খুররমের আগমনের সংবাদ প্রথমবার শোনার পরে থেকেই তিনি বজায় রেখেছেন। তার সংখ্যায় অপ্রতুল সৈন্যবাহিনী এখানে যেকোনো যুদ্ধে পরিচিত ভূপ্রকৃতি নিজের সুবিধামত ব্যবহার করতে সক্ষম হবে।

খুররম তার রক্তে রঞ্জিত তরবারির ফলা পর্যাণে রক্ষিত এক টুকরো কাপড়ের সাহায্যে পরিষ্কার করে এবং পরম যত্নের সাথে আরো একবার তরবারিটাকে এর রত্নখচিত ময়ানে কোষবদ্ধ করে, হতাশা আর সন্তুষ্টির একটা মিশ্র অনুভূতির মাঝে সে বিরাজ করছে। সে মালিক আম্বারের সৈন্যবাহিনীর আরো ক্ষতি সাধন করতে পেরেছে, তাদের গোলাবর্ষণের ক্ষমতা আর সৈন্য সংখ্যা ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য মোগল প্রাণহানির বিনিময়ে অর্জিত হওয়ায় সে সন্তুষ্ট, আর হতাশ এই জন্য যে মালিক আম্বার এখনও চূড়ান্ত নিষ্পত্তিমূলক যুদ্ধে নিজেকে নিয়োজিত করে নি। সে অবশ্য নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে মনে মনে বলে যে এমন একটা যুদ্ধের সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে খুব বেশি দিন দেরি হবে না।

*

‘দেখি, আমাকে দেখতে দাও, আরজুমান্দ আদেশের সুরে বলে। খুররম তার পরিশ্রান্ত কালো ঘোড়া নিয়ে মাত্র পাঁচ মিনিট আগেই তার অস্থায়ী সেনাছাউনিতে আস্কন্দিত বেগে এসেছে। আরজুমান্দ রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে হেরেম থেকে ছুটে এসেছে, সে তাবুর উষ্ণ অভ্যন্তরভাগে মধ্যবর্তী সময়টা নিরন্তর পায়চারি করে অতিবাহিত করেছে, তার পরিচারিকারা দরবারের সাম্প্রতিক গুজবের রসালো মুখরোচক অংশ শুনিয়ে তার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করলে বা যখন জলখাবারের কথা জিজ্ঞেস করেছে সে তাদের সব কিছুরই যন্ত্রবৎ উত্তর দিয়েছে। খুররমের মুখে জমাট বাধা রক্তের দাগ দেখে সে সাথে সাথে তাকে তাবুতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।

‘কিস্যু হয়নি। সামান্য আচড় মাত্র। সত্যিই বলছি। ক্ষতস্থানে ইতিমধ্যেই মামাড়ি পড়া শুরু হয়েছে, খুররম প্রতিবাদ জানায় কিন্তু আরজুমান্দ সে সবে মোটেই পাত্তা না দিয়ে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করার জন্য নিম পাতার নির্যাস আনতে বলে, সে শুনেছে সংক্রমণ প্রতিরোধে এটা একটা নিশ্চিত উপায়। পরিচারিকাদের একজন হন্তদন্ত হয়ে নিম পাতার সন্ধানে যেতেই, আরজুমান্দ খুররমের বুকের বর্মের বাঁধন খুলে এবং তার দেহ থেকে সেটা সরিয়ে নেয়ার সময় সে আপন মনেই বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘আল্লাহতালাকে লাখ লাখ শুকরিয়া যে আপনি নিরাপদে ফিরে এসেছেন। ‘আমি তোমাকে বলেছি সোনা আমি অবশ্যই ফিরে আসবো… তোমায় ভীষণ উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। তুমি কি নিশ্চিত যে আমার সাথে যুদ্ধযাত্রায় অংশ নেয়া তোমার জন্য সত্যিই ভালো হবে? বুরহানপুরে তুমি কি আরও শান্তিতে থাকতে না?”

না, আরজুমান্দ সাথে সাথে উত্তর দেয়, তাঁর কণ্ঠস্বর কঠোর। সংবাদের জন্য অপেক্ষার প্রহর এখানে সংক্ষিপ্ত। বার্তাবাহকের আগমনের জন্য প্রতীক্ষা করা এবং তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে তারা কি সংবাদ নিয়ে এসেছে সেটা আন্দাজ করার চেষ্টা অনেক বেশি মারাত্মক। আমি এখানে সেনাছাউনিতে আপনার সাথে থাকতে পারছি এবং আপনার ভাবনা জানতে আর চূড়ান্ত বিজয়ের ক্ষণে, আমি জানি যা অবশ্যম্ভাবী, উপস্থিত থাকতে পারবো। সে তার কথার মাঝেই তাকে আলিঙ্গণ করে, ঘামের ঝাঁঝালো গন্ধ যা তার জোব্বাকে নোংরা করেছে পাত্তা না দিয়ে।

খুররম যখন তার গালে প্রণয়স্পর্শ ফিরিয়ে দিচ্ছে, তাঁর মন তখনও ভাবতে থাকে বিজয় অর্জনের জন্য সে আরও কীভাবে তার প্রচেষ্টা জোরদার করতে পারে যা আরজুমান্দ অবশ্যম্ভাবী মনে করে। মালিক আম্বার এখনও সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রতিপক্ষ হিসাবে বর্তমান।

*

‘যুবরাজ, উন্মুক্ত প্রান্তরে যুদ্ধে আমাদের মোকাবেলা না করে মালিক আম্বার এখান থেকে পাঁচ মাইল দূরে একটা বদ্ধ একটা উপত্যকায় পশ্চাদপসারণ করেছে, কামরান ইকবাল, তাঁর গুপ্তদূতের অভিযান সমাপ্ত করে ফিরে এসে পোষাক পরিবর্তন করে যখন পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করে দাবদাহের উত্তাপে তাঁর গোলগাল মুখটায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তার লোকজন ইতিমধ্যে প্রবেশ পথে পাথর, মালবাহী শকট উল্টে রেখে আর অন্য যা কিছু তারা হাতের কাছে পেয়েছে সবকিছু দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

খুররম মনে মনে ভাবে, অবশেষে অপেক্ষার পালা সমাপ্ত হতে চলেছে। আক্রমণ শুরু হবার পর থেকেই যার কারণে তাকে নিজের গালে একটা অগভীর ক্ষত সহ্য করতে হয়েছে তার লোকেরা মালিক আম্বারের বাহিনীর উপরে সবসময়ে নজর রেখে এসেছে বিশেষ করে তারা যখন আহমেদনগরের সুলতানের ভূখণ্ডের দিকে ফিরে যেতে শুরু করে। খুররম পরবর্তীতে শত্রুপক্ষকে পর্যায়ক্রমিক পার্শ্ববর্তী আক্রমণ আর হয়রানিমূলক ঝটিকা হামলা চালিয়ে প্রতিপক্ষকে তাদের সব শক্ত ঘাঁটি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে যেখানে পৌঁছাতে পারলে তারা নতুন করে সৈন্য সংগ্রহ করতে পারতো। মালিক আম্বার, যিনি পশ্চাদপসারণের সময় নিজের লোকদের ভিতরে শৃঙ্খলা বজায় রাখার কঠিন কাজে আপাত দৃষ্টিতে সফল হয়েছেন, অবশেষে স্পষ্টতই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাকে এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে হবে। আবিসিনিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধা প্রতিরক্ষার জন্য সবচেয়ে উপযোগী ভূখণ্ডও যদি নির্বাচিত করে থাকেও, খুররম নিজের বিজয়ের ব্যাপারে আস্থাশীল। পেছনের উপত্যকা সম্বন্ধে কি জানো? আসলেই কি সেটা কানাগলি?’

‘উপত্যকাটা অনেকটা বোতল আকৃতির। প্রবেশ পথটা বোতলের গলা বা বলা যায় সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশ। দুই পাশ খাড়াভাবে উঠে গিয়েছে আর পায়ের চাপে গড়িয়ে পড়তে পারে এমন পাথর এবং আলগা নুড়িতে ঢাকা। উপত্যকার মাঝে ঝর্ণার পানিতে সৃষ্ট একটা নদী রয়েছে যা মালিক আম্বারের লোকদের পানির সংস্থান দেবে। আর সেখানে প্রচুর কাঠও রয়েছে। তাঁরা কিছু গাছ কেটে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে এবং তারপরেও যথেষ্ট গাছ দাঁড়িয়ে থাকবে আমাদের যেকোনো আক্রমণ বিক্ষিপ্ত করে দিতে।’

‘তোমার কি মনে হয়? আমরা কি এখন আক্রমণ করবো?’ শেষ যুদ্ধের সম্ভাবনায় অধৈর্য হয়ে উঠা খুররম জানতে চায়।

‘না, যুবরাজ। যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে আক্রমণ করাটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হচ্ছে, আমার মনে হয় সেটা ঠিক হবে না, কামরান ইকবাল বলে। উপত্যকার প্রবেশ মুখটা খুবই সংকীর্ণ আর সহজেই এলাকাটা সুরক্ষিত করা সম্ভব। আমরা যদি কেবল আমাদের সঙ্গে থাকা অশ্বারোহী যোদ্ধাদের ভরসায় আক্রমণ শুরু করি তাহলে মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবার ঝুঁকি রয়েছে। রণহস্তীর বহর আর কামানবাহী শকটগুলো এসে যোগ দেয়া পর্যন্ত আমাদের অবশ্যই অপেক্ষা করা উচিত।’

খুররম বুঝতে পারে কামরান ইকবাল ঠিকই বলেছে। এতগুলো সপ্তাহ। কৌশলী অভিযান পরিচালনা করে মালিক আম্বারের বাহিনীকে বর্তমান অবস্থানে নিয়ে এসে এখন ব্যর্থতার সম্ভাবনা আছে জেনেও আক্রমণ করলে সে বোকামির পরিচয় দেবে। মালিক আম্বারের অবস্থা এই মুহূর্তে নিজ গুহায় কোণঠাসা অবস্থায় আহত সিংহের ন্যায়, যে এখনও অসতর্ক বা অতি উৎসাহী শিকারীকে প্রাণঘাতি আঘাত করতে সক্ষম।

*

‘আজ আমরা জয়লাভ করবো, খুররম এক ঘন্টা আগে আরজুমান্দকে বলেছে। মালিক আম্বারের সৈন্যরা যে উপত্যকায় নিজেদের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অবরুদ্ধ করে রেখেছে সেখান থেকে আধ মাইল দূরে একটা টিলার উপরে রোকের অবস্থান থেকে সে এখন সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। প্রবেশ পথটা সত্যিই খুব সংকীর্ণ–কোনোমতেই দুইশ গজের বেশি চওড়া হবে না-এবং দু’পাশের পাহাড় এতটাই খাড়াভাবে উঁচু হয়েছে যে সেটা বেয়ে উপরে উঠা বিশেষ করে এমন একদল মানুষের জন্য যাদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হচ্ছে। মালিক আম্বারের সৈন্যরা প্রবেশ পথটা পাথর, গোড়া থেকে কেটে ফেলা গাছ এমনকি কাঁটাগাছের ঝোঁপ যা আশেপাশের এলাকায় প্রচুর জন্মে একসাথে বেঁধে গোছা করে ফেলে রাখার সাথে সাথে নিজের সাথের মালবাহী শকটগুলোও উল্টে দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। প্রতিবন্ধকতা বরাবর নিয়মিত দূরত্বে খুররমের অতর্কিত হামলার পরেও কার্যক্ষম রয়েছে মালিক আম্বারের এমন অবশিষ্ট কামানের নল মুখ ব্যাদান করে রয়েছে।

খুররম এখন আগের চেয়েও বেশি নিশ্চিত যে গতকাল সন্ধ্যাবেলা যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণী বৈঠকে সে ঠিকই বলেছিল যে উপত্যকার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এসে নদীটা যেখানে বাইরে বের হয়ে এসেছে সেটাই একমাত্র সম্ভাব্য দূর্বল স্থান। মালিক আম্বারের লোকজন নদীতে বাঁধ না দিয়ে সেখানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না যা অচিরেই তাদের পেছনের স্থান প্লাবিত করে এলাকাটা পাহারা দেয়াই তাদের জন্য অসম্ভব করে তুলবে।

যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণী সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে তাঁর রণহস্তীর একটা বহর ইতিমধ্যেই আক্রমণের জন্য অগ্রসর হতে আরম্ভ করেছে, উপত্যকার প্রবেশ পথের দিকে ধীরে কিন্তু নিশ্চিন্ত নিশ্চয়তায় এগিয়ে চলেছে। খুররম কয়েকটা হাওদা থেকে গাদাবন্দুকের গুলির ঝলক দেখতে পায় এবং অন্যগুলো থেকে ভেসে আসে তাঁর বহনযোগ্য ছোট কামান–গজলের চাপা গর্জন আর ঘোয়া। হাতির বহরের ঠিক পেছনে আড়াআড়িভাবে বিন্যস্ত অশ্বারোহী যোদ্ধাদের সারি ইতিমধ্যেই সমবেত হতে শুরু করেছে প্রতিবন্ধকতায় সৃষ্ট সামান্যতম ফাটলের সর্বোচ্চ সুযোগ নিতে। খুররমের মন চাইছে তাদের সাথে থেকে আক্রমণের নেতৃত্ব দিতে কিন্তু যুক্তি দিয়ে সে জানে যে আরজুমান্দ ঠিকই বলেছে এবং কেবল তার নিরাপত্তার কথা ভেবেই না বরং সে তাকে তাঁর সেনাপতিদের পরামর্শ অনুসরণ করতে অনুরোধ করেছিল এই জন্য যে যুদ্ধক্ষেত্র আর সেখানকার ঘূর্ণায়মান ধোয়ার কুণ্ডলী আর এর অনুগামী বিভ্রান্তি থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে রণনীতি পরিচালনা করলেই সে তার দায়িত্ব অনেকবেশি কার্যকরভাবে পালন করতে পারবে।

মালিক আম্বারের সৈন্যদের তড়িঘড়ির করে তৈরি করা প্রতিবন্ধকতার পেছন থেকে কামানগুলো এখন গোলাবর্ষণ করতে শুরু করেছে এবং খুররম তাঁর হাতির বহরের অগ্রগামী একটা হাতিকে থমকে দাঁড়িয়ে যেতে এবং তারপরে ধীরে ধীরে একপাশে কাত হয়ে নদীতে ভূপাতিত হতে দেখে, পিঠের হাওদাটা ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। আরেকটা হাতির ঘাড়ের দু’পাশ থেকে দুই মাহুতই নিচে আছড়ে পড়ে, সম্ভবত তবকীদের সম্মিলিত গুলিবর্ষণের একটা ঝাপটা তাদের আঘাত করেছে। হাতিটা আক্রমণের অভিমুখ থেকে নিজেকে ঘুরিয়ে নেয়, ভয় আর আতঙ্কে শুড় উঁচু করে রেখেছে। বিশাল জন্তুটা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাবার সময় এর গজদাঁতের সাথে সংযুক্ত ধারালো তরবারির আঘাতে পেছনে অনুসরণরত আরেকটা হাতির পা প্রায় দ্বিখণ্ডিত করে ফেললে সেটাও ভূপাতিত হয়। হাতিটা ভূপাতিত হবার সময় খুররম এর হাওদা থেকে গজনল মাটিতে আছড়ে পড়ে বিধ্বস্ত হতে দেখে। আরেকটা হাতি সেটার সাথে হোঁচট খেয়ে সামনের দিকে ছিটকে পড়লে ঘাড়ের দু’পাশ থেকে দুই মাহুতের সাথে সাথে পিঠে স্থাপিত হাওদাও স্থানচ্যুত হয়।

হাতির বহরের গুটিকয়েক দাঁড়িয়ে থাকা সদস্য এখনও সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে কিন্তু স্বগোত্রের ভূপাতিত সহযোদ্ধাদের ধরাশায়ী দেহ পাশ কাটিয়ে অগ্রসর হওয়াটা তাদের জন্য ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। মালিক আম্বারের প্রতিবন্ধকতায় ফাটল ধরাতে তাদের যদি সফল হতে হয় তাহলে সেদিকে যে গতিতে তাদের ছুটতে হবে সেই গতি অর্জন করা তাদের জন্য এই মুহূর্তে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। খুররমের চোখের সামনেই আরো একটা হাতি ভূপাতিত হয়, এত মন্থরভাবে জন্তুটা ভূপাতিত হয় যে পিঠের হাওদায় অবস্থানরত চারজন যোদ্ধাই লাফিয়ে মাটিতে নামতে পারে এবং নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য পেছনের দিকে দৌড়াতে শুরু করে। খুররম হতাশ হয়ে চারজনের একজনকে, স্পষ্টতই গাদাবন্দুকের গুলির আঘাতে, মুহূর্ত পরেই মাটিতে ছিটকে পড়তে দেখে। ভূপাতিত সহযোদ্ধাকে সাহায্য করার জন্য দ্বিতীয়জন ঘুরে দাঁড়ায় কিন্তু আহত লোকটার কাছাকাছি পৌঁছাবার আগে সে নিজেই গুলিবিদ্ধ হয়। তৃতীয়জনও গুলিবিদ্ধ হয় কিন্তু তার আঘাত বোধহয় খুব একটা মারাত্মক না এবং বুকে ভর দিয়ে খুররমের অবস্থানের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসতে শুরু করে। চতুর্থজন নদীর অগভীর অংশের ভিতর দিয়ে দৌড়াবার কারণে গাদাবন্দুকের গুলির আওতা থেকে প্রায় বের হয়ে আসবার মুহূর্তে সেও গুলিবিদ্ধ হয়, প্রচণ্ড আক্ষেপে বাতাসে দু’হাত ছোঁড়াছুড়ি করতে করতে মুখ নিচের দিকে দিয়ে পানিতে আছড়ে পড়ে।

ইত্যবসরে আরো অন্তত চারটা হাতি ভূপাতিত হয়েছে যখন অন্য দুইটা কি তিনটা হাতি গতিপথ পরিবর্তন করতে শুরু করেছে। বিশাল প্রাণীগুলোর একটা, মারাত্মকভাবে আহত, টলমল করতে করতে নদীর দিকে এগিয়ে গিয়ে ফোয়ারার মত উপরের দিকে পানি ছিটিয়ে দিয়ে জলশয্যা নেয়, রক্তে দ্রুত বহমান পানি লাল হয়ে যায়। খুররম মনে মনে চিন্তা করে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো ব্যাপক হবার আগে এখনই আক্রমণ বন্ধ করা উচিত, এবং সে সাথে সাথে কালক্ষেপণ না করে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সামরিক সংবাদ বহনকারী অপেক্ষমান অশ্বারোহীকে যুদ্ধ বন্ধের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়। সে বরাবরই জানতো যে মালিক আম্বার একজন কুশলী, দক্ষ আর অভিজ্ঞ প্রতিপক্ষ। সে নিশ্চিত পোড় খাওয়া আবিসিনিয়ান সেনাপতি ভেবেছে যে উপত্যকায় ভালোভাবে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলে সে যদি মোগল বাহিনীর এতটাই ক্ষতিসাধন করতে পারে যার ফলে তারা হয় পশ্চাদপসারণ করবে, নিজেদের তার পাল্টা আক্রমণের ঝুঁকির সম্মুখীন করে, নতুবা লড়াইটাকেই নিদেনপক্ষে এতটাই দীর্ঘস্থায়ী করা যার ফলে একটা অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে যা কাজে লাগিয়ে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সে নিজেদের জন্য শান্তি আর নিরাপদ অতিক্রমণের সুবিধা আদায় করে নিতে পারবে। খুররম যদি এই দুটো সম্ভাবনার একটাও যদি মেনে নেয় তাহলে নিজের বদরাগী পিতার প্রতিক্রিয়া আন্দাজ করতে তাঁর খুব একটা কষ্ট হয় না আর সেই সাথে সে নিজের প্রথম অভিযানে সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হবে। তাকে এখন একটু সময় নিয়ে নতুন কৌশলের কথা ভাবতে হবে। আজ দুপুরের পরে পুনরায় আরেকদফা নিষ্ফল সম্মুখ আক্রমণ শুরু করার চেয়ে আগামী দুই কি একদিন আক্রমণ মূলতবি রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

‘আমাদের কেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে? খুররম পরে তার চারপাশে অর্ধবৃত্তাকারে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে থাকা তার সেনাপতিদের কাছে জানতে চায়।

কমপক্ষে ছয়শ সৈন্য হয় নিহত হয়েছে নতুবা মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। আমাদের হেকিমরা কেবল তাঁদেরই চিকিৎসা করার সময় পেয়েছে যাদের বেঁচে থাকার একটা সম্ভাবনা রয়েছে বলে তাদের কাছে মনে হয়েছে। সম্ভবত একইরকম গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের সেরা রণহস্তির ত্রিশটা মারা গেছে অথবা এত জঘন্যভাবে আহত হয়েছে যে তাদের কষ্ট লাঘব করাই করুণা প্রদর্শনের সামিল, কামরান ইকবাল পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে। ‘আমি যতটা ভয় করেছিলাম পরিস্থিতি তারচেয়েও একটু বেশি মারাত্মক। আমার মনে হয় আপাতত প্রকাশ্যে সম্মুখ আক্রমণের ধারণা আমাদের বাতিল করা উচিত। আমরা কি নিশ্চিতভাবে জানি যে উপত্যকার পেছন দিক দিয়ে বাইরে বের হবার জন্য কোনো পথ নেই আর আমরা যেমন ধারণা করেছি উপত্যকার পার্শ্বদেশ ঠিক ততটাই খাড়া হয়ে উঠে গিয়েছে।’

‘হ্যাঁ, যুবরাজ, আমরা এ ব্যাপারে যতদূর জানি তাতে তাই মনে হয়েছে। স্থানীয় অধিবাসীরা, যারা প্রায়শই তথ্যের একটা ভালো উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে, ভয়ে হয় পালিয়ে গিয়েছে বা এতটাই আতঙ্কিত যে তাঁরা দরকারি তথ্য দেবে না। আমরা যদি তথ্যের জন্য তাঁদের চাপ দেই তাহলে আমরা যা শুনতে চাই বলে তাদের মনে হবে তারা ঠিক সেটাই আমাদের বলবে আর সেটা তাহলে তখন অপ্রয়োজনীয় তথ্যের চেয়েও ভয়ঙ্কর হবে।’

‘আমরা আমাদের গুপ্তদূতদের কয়েকজনকে প্রেরণ করেছিলাম, নাকি আমরা শেষ পর্যন্ত পাঠাইনি, চারপাশের পাহাড়ী ঢালে ঘুরে দেখতে আর পেছন থেকে উপত্যকাটা অনুসন্ধান করতে?

‘হা, কিন্তু মালিক আম্বারের নিজেরও মনে হয় অসংখ্য গুপ্তদূত চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। আমাদের লোকদের চেয়ে তাঁরা এই এলাকাটা অনেক ভালো করে চিনে বলে বেশ কয়েক দফা তারা সাফল্যের সাথে আমাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ পরিচালনা করেছিল। আক্রমণের কবল থেকে যারা বেঁচে এসেছিল আর যারা কোনো ধরনের বিপত্তি ছাড়াই অভিযান সমাপ্ত করতে পেরেছিল সবাই একই কথা বলেছে যে তারা যা দেখেছে তাতে সামনের সংকীর্ণ প্রবেশপথটাই বস্তুতক্ষে উপত্যকায় সশস্ত্র লোকজন প্রবেশের একমাত্র রাস্তা।

ভালো কথা, আমাদের আক্রমণ করার বিষয়ে আপনি কি পরামর্শ দেবেন? খুররম জিজ্ঞেস করে, কিছুক্ষণের জন্য নিজের মতামত দূরে সরিয়ে অন্যের কথা শুনতে চায়।

‘যুবরাজ, আমাদের আসলে কামানগুলোকে একটা অগ্রবর্তী স্থানে নিয়ে যাওয়া দরকার যেখান থেকে সেগুলো প্রতিবন্ধকতার সত্যিকারের ক্ষতিসাধন করতে পারবে, ওয়ালী বেগ, কৃশকায় দেখতে এক বাদশানি, খুররমের তোপচিদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ এবং বয়স কম করে হলেও যুবরাজের দ্বিগুণ।

কাজটা করার চেয়ে বলাটা অনেক সহজ। তোপচিদের জন্য সামান্যতম আড়াল থাকবে না এবং তাঁরা তাঁদের কামানগুলো কার্যকর করার আগেই মালিক আম্বারের তবকিরা সহজেই তাদের পাখির মত গুলি করে ভূপাতিত করবে।’

‘আমরা কামানের মঞ্চের জন্য আড়াল হিসাবে মৃত হাতির দেহগুলো কেন ব্যবহার করছি না?’ কামরান ইকবাল পরামর্শের সুরে বলে।

হ্যাঁ, কিন্তু তারপরেও কামানগুলো আমাদের জায়গামত নিয়ে যেতে হবে এবং সেটা করতে গেলে আমাদের প্রচুর লোকক্ষয়ের ব্যাপারটা মেনে নিতে হবে।

খুররমের মাথায় সহসা একটা ভাবনা খেলা করে যায়। যুদ্ধের পরামর্শদাতারা আর আরজুমান্দ উভয়পক্ষই যখন সামনে থেকে যুদ্ধের নেতৃত্ব না দেয়ার পরামর্শ দেয়, তারা তখন ধোয়ার কুণ্ডলীর ফলে সৃষ্ট বিভ্রান্তিকে তাদের পক্ষের অন্যতম যুক্তি হিসাবে উপস্থাপন করেছিল। ধোয়াকে নিজের সুবিধার্থে সে কেন ব্যবহার করার কথা চিন্তা করছে না?

“আমরা কি ঘোয়ার একটা অন্তরাল তৈরি করতে পারি আড়াল হিসাবে যা ব্যবহার করে আমাদের লোকেরা কামানগুলো নিয়ে এসে মৃত হাতির দেহগুলোর পিছনে সেগুলো স্থাপন করতে পারে? সে প্রশ্ন করে। আমি সেখানে প্রচুর ঘাস আর ঝোঁপঝাড় দেখেছি যা পোড়ালে প্রচুর ধোয়া সৃষ্টি হবার কথা। কয়েক ঘন্টার ভেতরেই প্রচুর ঘাস আর ঝোঁপঝাড় আমার লোকদের পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব।’

‘যুবরাজ, এতে কাজ হলেও হতে পারে, ওয়ালী বেগ বিষয়টা নিয়ে ভাবতে ভাবতে বলে।

কাজ হবে। আমরা আমাদের লোকদের আদেশ দিতে পারি তাঁরা যেন নিজেদের বাহুতে সবুজ বা সাদা রঙের কাপড় টুকরো বেধে রাখে যা ধূম্রমেহের ভিতরে তাদের পরস্পরকে সনাক্ত করতে সাহায্য করবে। অবিলম্বে পোড়াবার জন্য ঝোঁপঝাড় সংগ্রহ শুরু করতে লোক পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। আমরা রাতের বেলা সেগুলো জায়গামত নিয়ে যাব, এবং ওয়ালি বেগ, আপনি ভোরের আলো ফোঁটার ঘন্টা দুয়েক আগে কামানগুলো স্থানান্তরিত করার কাজ শুরু করবেন যাতে অন্ধকারও আমাদের বাড়তি আড়াল দান করে।

*

পরদিন সকাল চারটার সময় ষাড়ের দল তাঁর প্রথম কামানটা যখন টেনে নিয়ে ধীরে ধীরে উপত্যকার প্রবেশমুখের দিকে অশ্বারোহী প্রহরী সাথে করে এগিয়ে যেতে থাকে খুররম ততক্ষণে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ইতিমধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঝোঁপঝাড় মজুদ করা হয়েছে যেখান থেকে বাতাস মালিক আম্বারের অবস্থান অভিমুখে ধোয়া প্রবাহিত করে, তার লোকদের দৃষ্টি ঝাপসা করে দেবে। খুররম সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ হওয়া সত্ত্বেও আশা করে যে আগামী কয়েক ঘন্টা এখন যেমন মোটামুটি প্রবল বেগে বাতাস বইছে সেটা যেন দিক পরিবর্তন না করে বা বন্ধ না হয়ে যায়। তার ধারণা প্রায় বিশ মিনিট সময় অতিবাহিত হবার পরে সে গুলির শব্দ পায়। ষাড়ের দলটার তত্ত্বাবধায়করা ইতিমধ্যেই মালিক আম্বারের বেশ কিছু অগ্রগামী প্রহরীদের মোকাবেলা করেছে যাদের সে প্রতিবন্ধকতার বাইরে মোতায়েন করেছিল। খুররম মনে মনে ভাবে, আবিসিনিয়ান আসলেই একজন চৌকষ সেনাপতি, কিন্তু আমিও নিজেকে তার সমকক্ষ হিসাবে প্রমাণ করবো। ভোরের প্রথম আলো উঁকি দিতে শুরু করেছে এবং তার পোয় ব্যবহার করার পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার সময় হয়েছে। শুকনো পাতার বহ্নৎসবশুরু করো, সে চিৎকার করে বলে, এবং সাথে সাথে একজন অশ্বারোহী তাঁর আদেশ পালনের বিষয়টা নিশ্চিত করতে এগিয়ে যায়। ওয়ালি বেগ আর তাঁর তোপচিদের আগেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে হাতির মৃতদেহগুলোর পেছনে একটা সুবিধাজনক সুরক্ষিত স্থানে তারা যখন পৌঁছাতে পারবে তখনই যেন সাথে সাথে কামান থেকে গোলাবর্ষণ করা আরম্ভ করে। সে দুই বা এক মিনিটের ভিতরেই প্রথমবারের মত কামান থেকে গোলাবর্ষণ করার ভারি মন্দ্র শব্দ শুনতে পায়, প্রায় সাথে সাথেই পটকার মত তবকিদের গুলিবর্ষণের শব্দ ভেসে আসে। যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে, এবং মূল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সে যদিও ছয়শ গজ বা তারও বেশি দূরে অবস্থান করছে তারপরেও খুররম জ্বলন্ত ঝোঁপের গন্ধ অনায়াসে চিনতে পারে। পুরোপুরি যখন সকাল হয় সে দেখে যে ধোয়ার বেশির ভাগ আসলেই মালিক আম্বারের অবস্থানের দিকে বয়ে চলেছে।

খুররম তার সেনাপতিদের কাছ থেকে প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হলেও সিদ্ধান্ত নেয় যে প্রতিবন্ধকতায় সৃষ্ট ফাটলের ভিতর দিয়ে অশ্বারোহী যোদ্ধাদের আক্রমণের নেতৃত্ব সে নিজে দেবে। সেখানে এখন যেকোনো মুহূর্তে ফাটল দেখা দেবে। সে সহিসকে ডেকে এনে নিজের বিশাল কালো ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে এবং দুলকি চালে তার অপেক্ষমান দেহরক্ষী আর কামরান ইকবালের নেতৃত্বাধীন অন্যান্য অশ্বারোহী যোদ্ধাদের সমাবেশের দিকে এগিয়ে যায়। একজন বার্তাবাহককে মাত্র দশ মিনিট পরেই তাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। যুবরাজ, বোয়ার কারণে ঠিক নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না কিন্তু আমাদের ধারণা আমরা নদীর কাছ থেকে বিশ গজ দূরে যেখানে মূলত মালবাহী শকট উল্টে দিয়ে আর ঝোঁপঝাড়ের সাহায্যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছিল সেখানে একটা ফাটল সৃষ্টি করতে সফল হয়েছি।’

কামরান ইকবাল, তাহলে কি আর করা, এবার তাহলে দ্রুত অগ্রসর হওয়া যাক, খুররম উত্তেজনা চেপে রেখে আদেশ দেয়। অন্য যেকোনো যুদ্ধের আগমুহূর্তের চেয়ে নিজেকে এখন তাঁর অনেক বেশি সন্ত্রস্ত মনে হয়। তাঁর হৃৎপিণ্ড দ্রুতবেগে স্পন্দিত হচ্ছে, শিরায় অশ্বের গতি এবং তাঁর মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। সে অবশ্য ঘোড়ায় চেপে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া শুরু করতে নিজেকে বাধ্য করে মন থেকে সব ভাবনা ঝেড়ে ফেলতে এবং কেবল সামনের ব্যাপারটায় মনোনিবেশ করতে চেষ্টা করে। সে আর তার লোকজন কিছুক্ষণের ভিতরেই প্রথম মৃত হাতিটা পাশ কাটিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায় এবং বাতাসে এক ঝলকের জন্য ইতিমধ্যে শুরু হওয়া পচনের দুর্গন্ধ তাঁর নাসারন্ধ্রে এসে ধাক্কা দেয়। দুর্গন্ধ আর মৃতদেহের চারপাশে ভনভন করতে থাকা উপলবৎ বর্ণের কালো মাছির দল কারণে এর পেছনে অবস্থিত ব্রোঞ্জের বিশাল কামানগুলো থেকে গোলাবর্ষণ করা মোগল তোপচিদের জন্য একটা মারাত্মক পরীক্ষা। তারা এরপরে যে হাতির মৃতদেহটার পাশ দিয়ে যায় সেটা থেকে আরো প্রবল দুর্গন্ধ ভেসে আসে, সবচেয়ে কষ্টসহিষ্ণু পাকস্থলীর অধিকারীর পক্ষেও বমি চেপে রাখাটা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। মালিক আম্বারের লোকেরা ধোয়ার কারণে প্রায় অন্ধের মত নিজেদের কামান থেকে পাল্টা গোলাবর্ষণ আরম্ভ করে এবং ভাগ্যক্রমে তাঁদের একটা গোলা এসে মৃত হাতির উদরে বিস্ফোরিত হলে ফুলতে শুরু করা নাড়িভূড়ি ছিন্নভিন্ন হয়ে চারপাশে ছিটকে যায়–সেই সাথে দুর্গন্ধও।

সে বড় করে একটা ঢোক গিলে পাকস্থলী থেকে খাবারের উঠে আসা কোনোমতে দমন করে এবং মুখের চারপাশে জড়ানো সুতির বড় রুমালটা আরও ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে, খুররম তাঁর লোকদের অগ্রসর হবার গতি দ্রুততর করার আদেশ দেয়। ঘূর্ণায়মান ধোয়ার মাঝে বিদ্যমান একটা ফাঁকা স্থানের ভিতর দিয়ে সে দেখে যে মালিক আম্বারের প্রতিবন্ধকতা থেকে তাঁরা মাত্র তিনশ গজ বা তারও কম দূরে রয়েছে কিন্তু সেখানে কোনো ফাটল দেখতে না পেয়ে সে আতঙ্কিত হয়ে উঠে। ঘোয়ার আচ্ছাদন তারপরে আবার সরে যায় এবং এক মুহূর্তের জন্য সে তার বামপাশে নদীর কাছাকাছি ফাটলের মত কিছু একটা দেখতে পায় তারপরেই কেবল সে বিশ্বাস করে। ফাটল দেখা দিয়েছে!’ সে প্রাণপণে চিৎকার করে উঠে। ‘বামদিক দিয়ে আক্রমণ করো!

সে নিজের আদেশ অনুসরণ করে কালো ঘোড়ার পাঁজরে গুতো দিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটতে করে। এক মিনিটেরও কম সময়ের ভিতরে ধোয়ার মাঝে অবরোধকটা আবছাভাবে আবির্ভূত হয়ে পুনরায় আবার আড়ালে চলে যায়। অবরোধকটা কেবল আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। সে তাই বাধ্য হয় লাগাম শিথিল করতে এবং নিজের পর্যাণের উপরে সামনের দিকে ঝুঁকে এসে খুররম অবরোধকের অবশিষ্টাংশ লাফিয়ে অতিক্রম করার জন্য তার বাহনকে তাড়া দেয়, দূর থেকে দেখে যা প্রায় তিন ফিট উঁচু বলে মনে হয়। ঘোড়াটা তার নিতম্ব আর পিছনের পায়ের মাংসপেশি পুরোটা শক্তি ব্যবহার করে সামনের দিকে লাফ দিয়ে অনায়াসে প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে যায়।

সে এখন শত্রু শিবিরের ভেতরে, তাঁর দেহরক্ষীরা দ্রুততার সাথে তাকে অনুসরণ করে। তোপচিদের নিরস্ত্র করতে চেষ্টা করো, সে চিৎকার করে বলে। অবরোধক বরাবর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ভাসমান ধোয়ার মাঝে, সে একটা কামানের সামনে এসে পড়ে যা মুহূর্তের ভিতরে গোলাবর্ষণ করবে। সে তার ভারি কিন্তু নিখুঁত ভারসাম্যের তরবারিটা মাথার উপর থেকে মাত্র একবার অর্ধবৃত্তাকারে চালনা করে সলতেয় অগ্নি সংযোগ করতে ব্যস্ত তোপচিকে কবন্ধ করে দেয়। নিজের মুখে ছিটকে আসা উষ্ণ রক্তের স্বাদ অনুভব করার মাঝেই দ্রুত আরো দু’বার তরবারি চালিয়ে সে অন্য দু’জনের ভবলীলা সাঙ্গ করে, একজন কামানে বারুদ ভরার জন্য ব্যবহৃত লোহার দণ্ড ধরে দাঁড়িয়েছিল আর অন্যজনের হাতে ছিল কামানে ভরার জন্য বারুদের থলে। তাঁর দেহরক্ষীরা তখনও তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে অবস্থান করছিল, সে এর ভেতরেই অবরোধক বরাবর আস্কন্দিত বেগে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে আরেকটা কামানের গোলন্দাজদের তাদের সহায়তায় আহত কিংবা নিহত করে। সে এরপরে শত্রু শিবিরের আরো ভেতরে প্রবেশ করার জন্য দ্রুত বহমান নদীর নুড়িময় উপান্তের দিকে ঘুরে, তাঁর ইচ্ছে শত্রুপক্ষের আরো বেশি সংখ্যক যোদ্ধাকে যুদ্ধের জন্য প্রলুব্ধ করে টেনে আনে এবং তাঁদের ধ্বংসের নিয়ামক হয়।

সে তার লোকদের সাথে নিয়ে বেশ কয়েকজন তবকিকে কচুকাটা করে যাঁরা অবরোধকের চারপাশের লড়াই থেকে ইতিমধ্যে পালাতে শুরু করেছিল। কিন্তু সহসা মালিক আম্বারের অশ্বারোহী যোদ্ধাদের সঙ্ঘবদ্ধ একটা দল ধোয়ার ভেতর দিয়ে তাঁর ডানদিক থেকে বের হয়ে এসে পাশ থেকে তাঁর নিজস্ব অশ্বারোহীদের আক্রমণ করার জন্য প্রচণ্ড বেগে ছুটে আসে, তাদের আক্রমণের প্রাথমিক ধাক্কা সামলাতে না পেরে প্রতিপক্ষের দু’জন ভূপাতিত হয়। খুররম তাঁর আক্রমণকারীদের মুখোমুখি হবার জন্য নিজের কালো ঘোড়া চক্রাকারে ঘুরিয়ে নিয়ে দু’জন আক্রমণকারী যখন তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করছে তখন তাদের লক্ষ্য করে তার তরবারি দিয়ে আঘাত করে চায়। তাঁর প্রতিপক্ষের একজন যোদ্ধা তাঁর আঘাত এড়িয়ে গেলেও অন্যজন নিজের পাকস্থলীতে গভীর একটা ক্ষত নিয়ে নিজের পর্যাণ থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ে।

খুররম এরপর যখন খুব কষে লাগাম টেনে ঘুরতে চেষ্টা করে তাঁর প্রথম প্রতিপক্ষকে পুনরায় আক্রমণ করতে, আরেকজন শত্রু তার লম্বা বর্শা দিয়ে প্রাণপনে তাকে ধাক্কা দেয়। বর্শার ফলা তার বুকের বর্মে বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং ভিতরে প্রবেশ না করে পিছলে সরে যায় কিন্তু এত প্রবল শক্তিতে আঘাতটা করা হয়েছিল যে, সে ঘোরার সময় আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায়, খুররম তার ঘোড়র উপর থেকে একপাশে ছিটকে গিয়ে হুড়মুড় করে নদীর কিনারের মাটিতে আছড়ে পড়ে। সে নিচে থেকে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখে বর্শাধারী অশ্বারোহী পুনরায় তার দিকে বর্শা তাক করেছে। সময় মনে হয় যেন থমকে থেমে গিয়েছে এবং সহসাই তার মনে হয় আরজুমান্দকে তার আবার দেখতে খুব ইচ্ছা করছে এবং সে যদি অশ্বারোহীর গতিপথ থেকে নিজেকে সরিয়ে না নেয় তাহলে সে আর কোনোদিনই তাকে দেখতে পাবে না। সে একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করে থাকে, বস্তুতপক্ষে অশ্বারোহী প্রাণঘাতি আঘাতের জন্য বর্শা ইতিমধ্যেই পিছনে নিয়ে গিয়েছে। সে তারপরে পানির মাঝে আর নুড়িপাথরের উপর দিয়ে গড়িয়ে একপাশে সরে যায়। সে গড়িয়ে সরে যাবার ভিতরেই কোমরের পরিকর থেকে ছুঁড়ে মারার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত করা একটা খঞ্জর টেনে বের করে এবং প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে সেটা ছুঁড়ে মারে। খঞ্জরটা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে ব্যর্থ হলেও শত্রুর ঘোড়ার পশ্চাদ্ভাগে আঘাত হানলে জম্ভটা পিছনের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পিঠের আরোহীকে পিছনের দিকে ছিটকে ফেললে বিরাট শব্দ করে সে পানিতে অবতরণ করে।

খুররম চার হাতপায়ের উপর ভর করে নদীর অগভীর স্থানের ভিতর দিয়ে বাতাসের অভাবে খাবি খেতে থাকা লোকটা কাছে যায় এবং তার উপরে নিজেকে ছুঁড়ে দেয়। সে তার গলা আঁকড়ে ধরে, হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে কণ্ঠার হাড়ে ধাক্কা দেয় আর শক্ত করে চেপে রাখে যতক্ষণ না সে লোকটার ভিতর থেকে জীবনের সব ধরনের চিহ্ন বিলুপ্ত হয় এবং তাঁর দেহটা অসাড় হয়ে পড়ে। লাশটা একপাশে সরিয়ে রেখে, খুররম অনেক কষ্ঠ করে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ায় এবং টলমল করতে করতে নদীর পানি থেকে উঠে আসে, তাঁর পরনের কাপড় থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে এবং পায়ের নাগড়া পানিতে বোঝাই, তারপরেও প্রাণে বেঁচে রয়েছে বলে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দেয়। সে পানি থেকে উঠে আসার সময়েই তার এক দেহরক্ষীকে তাঁর কালোর ঘোড়ার লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। নদীর তীরে তাঁর দেহরক্ষীদের অন্তত পাঁচজনের দেহ নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে যখন তাঁদের দু’জন সহযোদ্ধা আরেকজনের বাহুর গভীর এক ক্ষতস্থান সেলাই করতে সাহায্য করছে, এক তরুণ রাজপুত, বেচারা দাঁতে দাঁত চেপে রেখে ক্ষতস্থান সেলাই করার সময়ে যন্ত্রণায় চিৎকার করা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছে। খুররম অবশ্য ঘোড়ার পিঠে পুনরায় আরোহণ করে চারপাশে তাকিয়ে দেখে খুশি হয় যে তার নিজের লোকদের চেয়ে তার শত্রুদের অনেক বেশি মৃতদেহ পড়ে রয়েছে এবং তাঁরা পশ্চাদপসারণ করে, যুদ্ধক্ষেত্রের এই অংশটা মোগলদের অনুকূলে পরিত্যাগ করেছে। মালিক আম্বারের লোকেরা কোথায় গিয়েছে?

নদীর তীর বরাবর উপত্যকার শেষপ্রান্তের দিকে তাদের আরো সঙ্গীসাথীদের নিয়ে পশ্চাদপসারণ করেছে।’

‘আমরা কি অবরোধকের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছি?

‘হ্যাঁ, যুবরাজ, কামরান ইকবাল প্রশ্নের উত্তর দেয়, সে দ্রুত শ্বাস নিতে নিতে এই মাত্র এসে উপস্থিত হয়েছে। কয়েকটা স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিরোধ গড়ে উঠলেও আমরা সহজেই তাদের পরাস্ত করেছি।’

‘বেশ, পশ্চাদপসারণকারীদের তাহলে পিছু ধাওয়া করা যাক, কিন্তু হুশিয়ার। আগুন নিভতে শুরু করেছে আর ধোয়ার আড়াল দ্রুত সরে যাচ্ছে। আমরা এখন অনেক বেশি দৃশ্যমান আর তবকি এবং গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা তীরন্দাজদের কাছে আমরা এখন অনেক সহজ নিশানা। আমরা তাই দ্রুত অগ্রসর হবো আর পুরোটা সময় নদীর তীর অনুসরণ করবো যেখানে সামান্য হলেও কিছুটা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।

খুররম কথা বলার মাঝেই গোড়ালি দিয়ে তাঁর ঘোড়ার পাঁজরে আবারও গুতো দেয় এবং নদীর তীর বরাবর এগিয়ে যাওয়া শুরু করে। সে আর তার লোকজন অচিরেই যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাতে থাকা তীরন্দাজ আর পদাতিক সৈন্যদের একটা দলকে আক্রমণ করে। সবাই নিজেদের অস্ত্র ফেলে দেয় কিন্তু একজন তীরন্দাজ সম্ভবত মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই অবনত হয় আর খুররমের দিকে ধনুক তাক করে। খুররমের দেহরক্ষীদের একজন তাঁর পিঠে তরবারির আড়াআড়ি এক কোপ বসিয়ে দিয়ে তাকে মাটিতে ফেলে দেয় কিন্তু তার আগেই সে তার কালো পালকযুক্ত তীরে মৃত্যুর মন্ত্র দিয়ে যুবরাজের দিকে নিক্ষেপ করে। তীরটা তাঁর গিল্টি করা পর্যাণে বিদ্ধ হবার আগে তাঁর উরুতে আচড় কেটে যায়। খুররম কোনো ব্যাথা অনুভব করে না কিন্তু বেশ বুঝতে পারে তার পা বেয়ে রক্ত পড়তে শুরু করেছে। সে বিষয়টা পাত্তা না দিয়ে আরও কয়েকশ গজ ঘোড়া নিয়ে সামনে এগিয়ে যায় যতক্ষণ না একটা ফাঁকা জায়গায় স্থাপিত কয়েক সারি তাবুর কাছে এসে পৌঁছে। পুরো এলাকাটা পরিত্যক্ত মনে হয় এবং বেশ কয়েকটা তাবুতে আগুন জ্বলছে, খুব সম্ভবত মালিক আম্বারের পশ্চাদপসারণকারী লোকের কাজ।

খুররম তাঁর দেহরক্ষীদের নিয়ে অস্থায়ী শিবির পেছনে ফেলে নদীর তীর বরাবর সামনের দিকে এগিয়ে যায় যা দু’পাশের পাহাড় ক্রমশ উঁচু এবং চারপাশ থেকে আরও ঘিরে আসায় প্রতিমুহূর্তে আরও সংকীর্ণ হয়ে আসছে। সহসা গাছের আড়াল থেকে গুলি বর্ষণের শব্দ ভেসে আসে এবং দেহরক্ষীদের একজন কপালে গাদাবন্দুকের তিলক নিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। নদীতে বিদ্যমান একটা বাঁক ঘুরতেই, খুররম সামনে গাছের কাণ্ড ফেলে তৈরি করা একটা অবরোধক দেখতে পায় যার পেছন থেকে কয়েকজন তবকী গুলি করছে। তাঁর সামনে পথটা এতটাই সংকীর্ণ যে সে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়ে সরাসরি অবরোধক অভিমুখে ঘোড়া হাকালে বন্দুকের গুলি তার চারপাশের বাতাস কেটে বের হয়ে যায়। অবশ্য, ভাগ্য তার সহায় থাকে এবং সে আর তার বাহন কালো ঘোড়াটা কোনো আচড় ছাড়াই গাছের গুঁড়ির তৈরি অবরোধক লাফিয়ে অতিক্রম করে। প্রতিরোধকারীরা প্রায় সাথে সাথে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং চারপাশের গাছপালা অভিমুখে পালিয়ে যায়। কিন্তু একজন যোদ্ধা, যার গায়ের কৃষ্ণবর্ণ ত্বক আর মুখাবয়বের বৈশিষ্ট্যের কারণে তাকেও মালিক আম্বারের মতই আবিসিনিয়ান বংশোদ্ভূত বলে মনে হয়, গাছের গুঁড়িতে পা আটকে গিয়ে হাত পা ছড়িয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে। তাকে জীবন্ত বন্দি করো!’ খুররম চিৎকার করে উঠে। তাঁর দু’জন দেহরক্ষী সাথে সাথে তাঁর আদেশ পালন করতে নিজেদের ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে মাটিতে নেমে কৃষ্ণবর্ণের পরিশ্রান্ত লোকটার দু’হাত দু’পাশ থেকে চেপে ধরে।

‘লোকটাকে আমার কাছে নিয়ে এসো, খুররম আদেশ দেয়। তারা তাই করে, তাঁর সামনে তাকে জোর করে হাঁটু মুড়ে বসতে বাধ্য করে। মালিক আম্বার কোথায়? খুররম দরবারে এবং বয়োজ্যেষ্ঠ আধিকারিকদের সাথে আলোচনার সময় ব্যবহৃত পার্সী বদলে হিন্দিতে প্রশ্নটা করে।

আপনাকে যদি বন্দি করা হতো তাহলে আপনি কখনও আপনার সেনাপতির অবস্থানের কথা বলতেন না এবং আমিও বলবো না। কিন্তু সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে আড়চোখে একবার উপত্যকার কিনারের দিকে তাকাতে নিজের অজান্তেই সে সত্যি কথা প্রকাশ করে ফেলে। সে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাতে নুড়িপাথরে ভর্তি পাহাড়ী ঢলের শীর্ষদেশে কয়েকটা অবয়ব দেখতে পায়। এই উপত্যকা থেকে বের হবার একটা পথ সেখানে রয়েছে, তাই না?

অবয়বগুলো দেখতে পেয়ে লোকটা অনেকটাই শমিত হয়েছে, এবং প্রশ্নের উত্তরে বলে, “আপনি যদি গাছের ডালপালা দিয়ে আমাদের তৈরি মইয়ের ব্যবস্থাকে বাইরে বের হবার পথ বলতে চান, তাহলে হ্যাঁ আছে। কিন্তু ব্যবস্থাটা আপনার কোনো কাজে লাগবে না। ঘোড়া মই ব্যবহার করতে পারবে না এবং আমাদের সেনাপতি আর তার সাথে যেসব সৈন্যরা রয়েছে তাদের জন্য উপরে আগে থেকেই ঘোড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং আপনি পিছু ধাওয়া করার কোনো প্রচেষ্টা নেয়ার অনেক আগেই তারা নাগালের বাইরে চলে যাবে।

‘সে যা বলেছে সেটার সত্যতা যাচাই করে দেখো, খুররম তার দেহরক্ষীদের উদ্দেশ্যে বলে, কিন্তু হুশিয়ার। সামনে আরও আক্রমণকারী ওঁত পেতে থাকতে পারে।’

*

খুররম সেদিন সন্ধ্যাবেলা আরজুমান্দের সান্নিধ্যে শুয়ে থাকে। তার উরুর ক্ষতটা ততটা মারাত্মক নয় এবং সেখানে এখন সাদা সুতি কাপড়ের পট্টি বাধা রয়েছে আর সেও গোসল করে পরিচ্ছন্ন হয়েছে। তার লোকজন বাইরে দারুণ হৈ-হট্টগোলের মাঝে নিজেদের বিজয় উদযাপন করছে। সে কিছুটা সময় তাঁদের সাথে অতিবাহিত করেছে তারপরে হেকিমের তাবুতে গিয়ে আহতদের পরিচর্যার বিষয়ে খবর নিয়ে অবশেষে আরজুমান্দের কাছে ফিরে এসেছে। সেনাপতি হিসাবে তার প্রথম একক অভিযানে বিজয়ের আনন্দে যুদ্ধে আহত সৈন্যদের কষ্ট আর আবিসিনিয়ান যোদ্ধা যে সত্যি কথাই বলেছে–মালিক আম্বার আসলেই পালিয়ে গিয়েছে, এই তথ্য খানিকটা কালিমা লেপন করেছে। অবশ্য যুদ্ধবন্দি আর নিহত সৈন্যদের লাশ গণনা করে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে সে নিজের সাথে খুব বেশি হলে কয়েক’শ যোদ্ধা নিয়ে যেতে পেরেছে। আহমেদনগরের সুলতানের সেনাবাহিনী পরাস্ত হয়েছে। তাকে এখন শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য দেনদরবার করতে হবে। মোগল বিজয় অর্জিত হয়েছে।

*

আগ্রা দূর্গের পাশে যমুনা নদীর তীরে খুররমের সেনাবাহিনী শ্রেণীবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান রয়েছে। অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে ইস্পাতের বর্মসজ্জিত রণহস্তির সারি সুশৃঙ্খলভাবে বিন্যস্ত–যেহেতু এটা যুদ্ধের নয় উৎসবের সময়–আজ তাদের গজদাতে কোনো তরবারি সংযুক্ত করা হয়নি, যা তাঁদের মাহুতেরা সোনালী রঙ করে দিয়েছে। কমলা আর লাল রঙের পাগড়ি পরিহিত রাজপুত রক্ষীবাহিনী পরিবেষ্টিত অবস্থায় সোনালী রঙ করা শিঙের সাদা ষাড় দিয়ে টেনে নিয়ে আসা মালবাহী শকটগুলোয় রয়েছে. খুররমের বাহিনীর দখল করা ধনসম্পদ ভর্তি বাক্স।

খুররম নিজেও একেবারে সামনের সারির সেনাপতিদের থেকে বিশ কদম আগে তাঁর কালো স্ট্যালিয়নে প্রাণীটা যুদ্ধক্ষেত্রে দারুণ সাহসিকতার সাথে তাকে সহযোগিতা করেছে উপবিষ্ট অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। সোনালী রঙের আনুষ্ঠানিক মাথার সাজ আর সবুজ মখমলের ভারি পর্যাণের কাপড় যা প্রায় মাটি ছুঁইছুই করছে ঘোড়াটা অভ্যস্ত না হওয়ায় থেকে থেকেই অস্থির ভঙ্গিতে নড়াচড়া করছে আর মাথা ঝাঁকাচ্ছে। শান্ত হও বাছা, খুররম বিড়বিড় করে বলে, জন্তুটার ঘামে চিকচিক করতে থাকা গলায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয়। তোমার উচিত আমাদের নিরাপদে ফিরে আসা লোকদের উদ্যাপন করতে এবং আমাদের বিজয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে দেয়া। সহসা দূর্গপ্রাকারের পুরোটা দৈর্ঘ্য জুড়ে অসংখ্য ক্র্য ধ্বনিত হতে জাহাঙ্গীর সেখানে আবির্ভূত হয়ে হাত নেড়ে বিজয়ী মোগল বাহিনীকে স্বাগত জানায়।

জাহাঙ্গীরের হাতের আন্দোলিত ভঙ্গি দেখে যমুনার অপর তীরে, কনুই দিয়ে ধাক্কাধাক্কি করতে থাকা এবং আরেকটু ভালো করে দেখার জন্য চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকা জনতার মাঝ থেকে উল্লসিত গর্জন ভেসে আসে। একটা খেপাটে আকাঙ্খ সহসা খুররমকে আবিষ্ট করে তার ইচ্ছে হয় নিজের ঘোড়া নিয়ে কালচে বাদামি পানি সাতরে অতিক্রম করে এবং উফুল্ল, মুগ্ধ দর্শকদের কাতারে গিয়ে যোগ দেয়। বিজয় আর জনগণের স্বহর্ষ করতালি কি সবসময়ে এত ভালো অনুভূতির সৃষ্টির করে? কিন্তু এসব চিন্তা দূরে সরিয়ে সে আবার উপরের দিকে তাকিয়ে দেখে তাঁর আব্বাজান প্রস্থান করেছেন। তাঁর কাছে যাবার এবার সময় হয়েছে। খুররম তার দেহরক্ষীদের দ্বারা অনুসৃত হয়ে দুলকি চালে ঘোড়া নিয়ে দূর্গ অভিমুখে খাড়াভাবে উঠে যাওয়া ঢালু পথটার দিকে এগিয়ে যায়। আরজুমান্দ সেখানে একটা রাজকীয় হাতির পিঠে পান্নাখচিত হাওদায়, দৃষ্টিগোচর হওয়া থেকে রেশমের পর্দা দিয়ে সৃষ্ট আড়ালে তার জন্য অপেক্ষা করছে। বারোজন অশ্বারোহী দেহরক্ষী–গুরুত্বের স্মারক হিসাবে জাহাঙ্গীরের প্রেরিত–তার হাতির পিছনে জোড়ায় জোড়ায় বিন্যস্ত হয়ে অবস্থান করছে। আগ্রায় তার স্ত্রীর বিজয়দৃপ্ত প্রত্যাবর্তনে তাঁর প্রতিরক্ষা সহচর হিসাবে সামনে অবস্থানকারী সৈন্যদের খুররম মনোনীত করেছে যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের প্রদর্শিত সাহসিকতার কথা বিবেচনা করে। খুররম সব শেষে আসা নিজের দেহরক্ষীদের আদেশ দিয়ে সামনে তার জন্য নির্ধারিত স্থানে অবস্থান নেয় এবং ঢাল দিয়ে অগ্রসর হতে সে নিজের দাস্তানাবৃত হাত দিয়ে তাঁর ক্ষুদ্র বহরের উদ্দেশ্যে ইশারা করে।

প্রধান তোরণগৃহের নিচে দিয়ে অতিক্রম করে তারা দূর্গে প্রবেশ করতে অতিকায় দামামাগুলো গুরুগম্ভীর শব্দে বেজে উঠে এবং পরিচারকের দল গিল্টি করা গোলাপের পাপড়ি আর চাঁদ এবং তারার মত দেখতে সোনা আর রূপার তৈরি ক্ষুদ্র অলঙ্কার মুঠো মুঠো ছুঁড়ে দেয় যা তাঁদের চারপাশে ভাসতে ভাসতে নিচে পড়ে। বাঁকানো আর খাড়া ঢাল দিয়ে তাঁরা উপরে উঠা অব্যাহত রাখলে খুররম লক্ষ্য করে প্রতিটা দেয়ালে ব্রোকেডের সবুজ পট্টি বাঁধা রয়েছে। তাঁরা শীঘ্রই আরেকটা তোরণদ্বার অতিক্রম করে এবং প্রাচীরবেষ্টিত প্রধান আঙিনায় এসে পৌঁছে, যার শেষপ্রান্তে রয়েছে তাঁর আব্বাজানের বহু স্তম্ভবিশিষ্ট তিন দিক খোলা, দেওয়ানি আম। আঙিনাটা অভিজাত অমাত্যদের ভীড়ে গিজগিজ করছে কিন্তু ঠিক মধ্যেখানে গোলাপের পাপড়ি শোভিত একটা প্রশস্ত পথ খালি রাখা হয়েছে। পথটার শেষ মাথায় একটা বেদীর উপরে সিংহাসনে উপবিষ্ট অবস্থায় সে তার আব্বাজানের ঝলমলে অবয়র দেখতে পায়।

জাহাঙ্গীর যেখানে বসে রয়েছে খুররম যখন সেখান থেকে ত্রিশ ফিট দূরে রয়েছে, সে তার হাত তুলে পিছনের শোভাযাত্রাকে থামার ইঙ্গিত করে এবং ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়ায় যাতে করে সে তার আব্বাজানের কাছে পায়ে হেঁটে যেতে পারে। সে বেদীর দিকে দুই কি তিন কদম এগিয়েছে যখন সে জাহাঙ্গীরের ডাক শুনতে পায়, ‘দাঁড়াও। আমিই আসছি তোমার কাছে।

চারপাশ থেকে রুদ্ধশ্বাস বিস্ময়ের শব্দ ভেসে উঠে। বিজয়ী সেনাপতিকে স্বাগত জানাতে নিজের সিংহাসন থেকে সম্রাটের নেমে আসা–এমনকি আপন রক্তসম্পর্কিত আত্মীয়ের ক্ষেত্রেও–অভূতপূর্ব একটা ঘটনা। জাহাঙ্গীর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, সিংহাসন থেকে বেদীর কিনারে হেঁটে আসে এবং মার্বেলের ছয়টা নিচু ধাপ বেয়ে নিচে নামে। খুররম তাকিয়ে দেখে তার দিকে এগিয়ে আসার সময় আব্বাজানের রত্নখচিত পাগড়ির সারসের পালক দুলছে এবং কীভাবে তার কানে, গলায় আর আঙুলের হীরকখণ্ড শুভ্র আগুনের ন্যায় জ্বলজ্বল করছে, কিন্তু সে এসব কিছু এমনভাবে তাকিয়ে দেখে যেন সে স্বপ্ন দেখছে।

তাঁর আব্বাজান যখন মাত্র কয়েকফিট দূরে অবস্থান করছে, খুররম হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে এবং মাথা নত করে। জাহাঙ্গীর তার চুল স্পর্শ করে, তারপরে বলে, ‘জিনিষটা নিয়ে এসো।’ খুররম আড়চোখে উপরে তাকিয়ে দেখে একজন পরিচারক ছোট একটা সোনার ট্রে নিয়ে এগিয়ে আসছে যার উপরে কিছু একটা স্তূপ করা রয়েছে–কি রয়েছে সে দেখতে পায় না–আর তাঁর আব্বাজান তাঁর কাছ থেকে সেটা নেয়। খুররম আবার দৃষ্টি নত করে এবং পরমুহূর্তে সে বুঝতে পারে তাঁর আব্বাজান ট্রের জিনিষগুলো তাঁর মাথায় আলতো করে ছোঁয়ান। তাঁর চারপাশে স্বর্ণমুদ্রা আর দামী রত্নপাথর বৃষ্টির মত ঝরে পড়তে থাকে।

‘আমার বিজয়ী আর প্রিয়তম পুত্র তোমায় স্বাগতম, তাঁর আব্বাজান বলছে সে শুনতে পায়, তারপরে নিজের কাঁধে জাহাঙ্গীরের হাত অনুভব করে, তাকে তুলে দাঁড় করায়। আমি চাই এখানে উপস্থিত সবাই সেনাপতি এবং আমার পুত্র হিসাবে তোমার জন্য আমার উচ্চ ধারণার কথা জানুক। তোমায় নিয়ে আমার গর্বের স্মারক হিসাবে, আমি আজ তোমায় শাহ জাহান উপাধিতে ভূষিত করছি, যার মানে পৃথিবীর অধিশ্বর।’

গর্বে খুররমের বুকটা ফুলে উঠে। সে অনেক আশা নিয়ে যুদ্ধাভিযানে যাত্রা করেছিল কিন্তু সেই সাথে সে কতটা সাফল্য লাভ করতে পারবে সেটা নিয়ে খানিকটা বিচলিতও ছিল। সে এখন একটা কাজ ভালো করে সমাপ্ত করার প্রগাঢ় সন্তুষ্টি বোধ করে। সে তাঁর আব্বাজানের কাছে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে এবং তিনিও সেটার প্রশংসা করেছেন। তাঁর আব্বাজানের উত্তরাধিকারী হিসাবে তার মনোনীত হবার উচ্চাশা পরিপূরণে নিশ্চিতভাবে এখন কোনো কিছুই আর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না।

১.১১ লাল মখমলের জুড়িগাড়ি

মেহেরুন্নিসা সম্রাটের একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষের লাগোয়া বারান্দায় একপ্রান্ত ঘেষে স্থাপিত রেশমের চাঁদোয়ার নিচে থেকে তাকিয়ে দেখে। প্রচেষ্টা সার্থক হয়েছে। দক্ষিণে খুররমের বিজয়ের সংবাদ এসে পৌঁছাবার পর থেকেই সে এই অন্তরঙ্গ উদ্যাপনের বিষয়টা পরিকল্পনা করছিলো। খাবারের বন্দোবস্ত ছিল চমৎকার, বিশেষ করে তাঁর নির্দেশে তাঁর পার্সী রাধুনির তৈরি করা পদগুলো–ডালিমের রসে ফোঁটান তিতিরের মাংস, আখরোট আর পেস্তা দিয়ে ঠাসা আস্ত ভেড়ার রোস্ট, জাফরান এবং শুকনো টক চেরী সহযোগে দিয়ে রান্না করা পোলাও–এবং মিষ্টি আঁশের, সুগন্ধিযুক্ত তরমুজ আর জাম যা জাহাঙ্গীরের পছন্দ। তাঁর আদেশে শেষের পদটা বরফ চূর্ণ পাত্রে পরিবেশন করার বদলে এমন একটা ট্রে’র উপরে পরিবেশিত হয় যার নিম্নভাগে মুক্তা আর হীরক খণ্ড বিছানো রয়েছে। সঙ্গীত শিল্পী, নর্তকী আর পায়রার ঝক ভালোমতই মনোরঞ্জন করেছে, কিন্তু এখন সবাই বিদায় নিয়েছে এবং তারা চারজন কেবল একাকী রয়েছে।

আরজুমান্দকে দেখতে দারুণ রূপসী দেখাচ্ছে, বারান্দার চারপাশের দেয়ালে আয়নাযুক্ত ক্ষুদ্র চোরকুঠরিতে রক্ষিত তেলের জ্বলন্ত প্রদীপের আলোয় আপন ভাস্তিকে খুটিয়ে দেখতে দেখতে মেহেরুন্নিসা ভাবে। জাহাঙ্গীর তাকে তার কন্যা জাহানারর ভূমিষ্ঠ হওয়াকে স্মরণীয় করে রাখতে রুবি আর পান্নার যে মুকুটটা দিয়েছিল সেটায় তাকে ভীষণ মানিয়েছে। সেইসাথে মাতৃত্বের অভিজ্ঞতা। আরজুমান্দ আবারও গর্ভবতী হয়েছে এবং তাঁর ত্বক আর চুল যেন বাড়তি জেল্লা ছড়াচ্ছে। মেহেরুন্নিসা গোড়ালির কাছে ফুলে থাকা রেশমের চওড়া লাল পাজামার উপরে তাঁর সংক্ষিপ্ত আঁটসাট চোলির কারণে নিরাভরণ নিজের মসৃণ, সমতল উদরের দিকে চোখ নামিয়ে তাকায়। সে প্রতি মাসে সন্তান ধারণের লক্ষণের জন্য আশা করে থাকে এবং প্রতি মাসে তাকে হতাশ হতে হয়। তার খুব ইচ্ছে জাহাঙ্গীরের ঔরসে সন্তানের জন্ম দেয়া–বিশেষ করে পুত্রসন্তান। সে তাকে তাহলে আরো বেশি ভালোবাসতে ব্যাপারটা সেরকম নয়, কিন্তু এটা দীর্ঘ সময়ের জন্য তাঁদের আরো কাছাকাছি বেঁধে রাখবে এবং অন্যদের চোখে তার মর্যাদা আরো বাড়িয়ে দেবে। মোগল রাজবংশের সাথে তাঁর নিজের রক্তের মিশ্রণ এবং পুরুষানুক্রমে সেটা উত্তরপুরুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে চিন্তা করতেই কেমন ভালো লাগে। কিন্তু সময় শেষ হয়ে আসছে। তার দেহ যদিও এখনও সুঠাম আর হালকা পাতলা রয়েছে কিন্তু গতমাসে সাল্লা তার দীঘল কালো চুলের বেণীর মাঝে একটা পাকা চুল খুঁজে পেয়েছে। প্রথমবারের মত সেটা পাওয়া গেলেও নিশ্চিতভাবেই এটা শেষবার নয়।

তাঁর পরিবারের অন্য আরেকজন অল্পবয়সী সদস্য–আরজুমান্দ যে এরচেয়ে বরং সম্রাটদের জননী আর পিতামহী হতে পারে। মেহেরুন্নিসা ভোজসভা শুরু হবার সময় তাকে হাতির দাঁতের বোতামযুক্ত, সাদা রেশমের মুক্তাখচিত যে জোব্বা উপহার দিয়েছে তাঁর ভাস্তি এই মুহূর্তে সেটা খুররমকে দেখাচ্ছে। সে তার পাশে উপবিষ্ট জাহাঙ্গীরের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে তাকে নিজের পুত্র আর আরজুমান্দের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার অভিব্যক্তিতে পরিষ্কার গর্বের ছাপ ফুটে রয়েছে। সেদিনই সন্ধ্যাবেলা তিনি তাকে বলেছিলেন, দাক্ষিণাত্যে পারভেজের পরিবর্তে খুররমকে পাঠাবার তোমার পরামর্শটা ঠিক ছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম না সে এমন দায়িত্বের যোগ্য হয়েছে কিনা কিন্তু আমার চোখে যা ধরা পড়েনি তুমি সেটা দেখতে পেয়েছিলে–যে যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় সাহসিকতার সাথে সাথে তাঁর সেই বুদ্ধিও রয়েছে।’

কিন্তু খুররম এখন যখন তাঁর আব্বাজানের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে কিছু একটা বলে আর জাহাঙ্গীর হাসি মুখে উঠে দাঁড়িয়ে তার দিকে এগিয়ে যায়, সহসা একটা সন্দেহ তাঁর মনে উঁকি দিয়ে যায়। তাঁর পরিবারের উপকারের জন্য–সেই সাথে তাঁর নিজের ভাস্তির সুখের কথা বিবেচনা করে–খুররমের সাথে আরজুমান্দের বিয়ের ব্যাপারটাকে বাস্তবতা দিতে সে তার ক্ষমতায় যতটুকু সম্ভব সব কিছুই করেছে। তাঁর মনে একটা বিষয়ে কখনও কোনো ধরনের সন্দেহ ছিল না যে খুররম যদি তার আব্বাজানকে অভিভূত করতে পারে সেটা তার নিজের পরিবারের জন্য মঙ্গলজনক হবে–এজন্যই সে জাহাঙ্গীরকে পরামর্শ দিয়েছিল তাকে দাক্ষিণাত্যের নেতৃত্ব দিতে। কিন্তু যদি তাঁর নিজের স্বার্থ আর তার বৃহত্তর পরিবারের স্বার্থ পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে যায়? খুররম কতটা সুচারুভাবে দায়িত্ব পালন করবে, জাহাঙ্গীর কতটা মুগ্ধ হবে এর মাত্রা সে আন্দাজ করতে পারেনি… সেদিনই দুপুরের দিকে দেওয়ানি আমের সিংহাসনের একপাশে অবস্থিত জালি পর্দার পেছন থেকে সে যখন তাকিয়ে ছিল তখন জাহাঙ্গীরকে নিজের সিংহাসন থেকে নেমে এসে নিজ সন্তানের মাথা মোহর আর রত্নপাথর বর্ষিত করতে দেখে সে ভীষণ অবাক হয়েছে। তিনি তাকে একবারও বলেননি যে এমন। একটা পদক্ষেপের পরিকল্পনা তিনি করছেন, এটাও বলেননি যে তিনি এরপরই, ঠিক যেমনটা তিনি করেছেন, খুররমকে যুদ্ধের সময় লাল তাবু ব্যবহারের অধিকার আর সেই সাথে কিসার ফিরোজের শাসকের উপাধি দান করবেন–দুটো বিষয় পরিষ্কার ইঙ্গিত করছে যে তিনি তাকে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসাবে ঘোষণা করতে ইচ্ছুক।

খুররম এখন যখন দরবারে ফিরে এসেছে জাহাঙ্গীর তাকে সম্ভবত সাম্রাজ্য পরিচালনার কাজে আরো বেশি করে নিয়োজিত করতে চাইবেন। খুররম, তাঁর চেয়ে হয়ত, তাঁর কাছে বেশি বিশ্বস্ত হয়ে উঠবে যার প্রতি তিনি স্বাভাবিকভাবেই বেশি মনোযোগ দেবেন। জাহাঙ্গীরকে, সম্রাট হিসাবে, নিয়মিত অনেক দায়িত্ব পালন আর তত্ত্বাবধান করতে হয়। সে নিশ্চিত, তাঁর উদ্যম আর স্বচ্ছ চিন্তাশক্তির কারণে জাহাঙ্গীরের এই বোঝার অনেকটাই সে পালন করতে সক্ষম–বস্তুতপক্ষে সে ইতিমধ্যেই তাঁর কাছে এর প্রমাণ রাখতে শুরু করেছে। তিনি মাত্র কয়েক মাস পূর্বে কাবুলের উত্তরপশ্চিম দিকে ভ্রমণরত বণিকদের শিবিরে রাতের বেলা ডাকাতদের আক্রমণের ব্যাপারে তাঁদের অভিযোগের ব্যাপারে তাকে বলেছিলেন। তাঁর পরামর্শ তাকে এতটাই প্রীত করেছিল যে তিনি ট্রাঙ্ক রুট বরাবর আরো অনেকগুলো রাজকীয় সরাইখানা নির্মাণের আদেশ দেন যেখানে পর্যটকের দল নিজেদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় এবং তাদের পণ্য আর পশুর জন্য সুরক্ষিত আস্তাবল নিশ্চিতভাবে খুঁজে পাবে।

এমন নয় যে সে কেবল এসব গতানুগতিক বিষয়েই সাহায্য করতে পারবে। সে ইতিমধ্যে জটিল সিদ্ধান্তের কারণে জাহাঙ্গীরের উপরে চেপে বসা দুশ্চিন্তার ভার উপলব্ধি করতে পেরেছে। সে যদি সাথে সাথে আবেগ কিংবা প্রণোদনার বশে কাজ না করে–যার জন্য সে প্রায়শই অনুতপ্ত হয়–সে প্রায়ই সেগুলো ফেলে রাখে, এবং বিশেষ করে সে যখন হতবুদ্ধি বা উদ্বিগ্ন থাকে মনকে প্রশান্ত করতে সে সামান্য আফিম আর সুরার আশ্রয় নেয়। সে তাঁর আব্বাজানের কাছে এবং জালি পর্দার পেছন থেকে জাহাঙ্গীরের উপদেষ্টাদের বৈঠকের আলোচনা শুনে রাজকীয় দপ্তর পরিচালনার ব্যাপারে অনেক কিছু জেনেছে বলে দায়িত্ব ভাগাভাগি করতে পারবে… এবং তাঁর কাছে এটা কেবল একটা দায়িত্ব না বরং গভীর সন্তুষ্টির বিষয়।

জাহাঙ্গীরের উচ্চগ্রামের হাসিতে তাঁর ভাবনার জাল ছিন্ন হয়। খুররম নিশ্চয়ই তাকে আমোদিত করার মত কিছু একটা বলেছে এবং তিনি তাঁর পুত্রের কাঁধ চাপড়ে দিচ্ছেন। খালি চোখে দেখলে একটা সুখী পারিবারিক দৃশ্য বলে মনে হবে কিন্তু মেহেরুন্নিসার কাছে সহসাই এই দৃশ্যটা অনেক অশুভ কিছু একটা সম্ভাবনা উপস্থাপন করে এবং অনেক আগেই এটা বুঝতে না পারার জন্য সে নিজেরই উপরেই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে। তাকে জীবনে আরো একবার অপেক্ষা আর পর্যবেক্ষণ করতে হবে কিন্তু নিজের স্বার্থের ব্যাপারে তাকে সব চেয়ে বেশি দৃষ্টি রাখতে হবে। জাহাঙ্গীরের কাছে অন্য কেউ না বরং সে নিজে কতটা গুরুত্বপূর্ণ জাহাঙ্গীর যেন সেটা বুঝতে পারে তাকে এটা প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে।

*

‘জাহাপনা, ইংল্যান্ড থেকে আগত দূত দেওয়ানি আমের বাইরে অপেক্ষা করছেন,’ শরতের এক পড়ন্ত বিকেলবেলা মেহেরুন্নিসার সাথে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষে বসে থাকার সময় কর্চি এসে বলে।

‘চমৎকার। আমার পরিচারকদের আসতে বলো। তাঁর পরিচারকেরা তাকে সজ্জিত করার কাজ শুরু করলে সে মুচকি হাসে। সে এই বৈঠকের জন্য খানিকটা কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করেছিল। মোগল রাজদরবারে আট সপ্তাহ আগে সংবাদ আসে যে সুরাট বন্দরে ইংল্যান্ড থেকে একজন দূত এসেছে। আগ্রা অভিমুখে দূত মহাশয়ের অগ্রসর হবার গতি মন্থর হওয়ায় তিনি উপহার সামগ্রী আগেই প্রেরণ করেছিলেন। উপহার সামগ্রীগুলোর একটা, উঁচু চাকার উপরে প্রকাণ্ড তরমুজের আকৃতির গিল্টি করা একটা অদ্ভুত দর্শন জুড়ি গাড়ি–জাহাঙ্গীর আগে কখনও এমন কিছু দেখেনি–তাকে ভীষণ প্রীত করে যদিও লাল মখমলে ছত্রাকের দাগ রয়েছে–নিঃসন্দেহে প্রত্যন্ত দ্বীপ যেখান থেকে দূতমহাশয় লবণাক্ত সাতসেঁতে জাহাজে দীর্ঘ ভ্রমণ শুরু করেছিলেন তার ফলে এমনটা হয়েছে। জুড়িগাড়িটা মেহেরুন্নিসাকেও পুলকিত করেছে এবং সে তাকে সেটা উপহার দিয়ে নিজের কারিগরদের নির্দেশ দিয়েছে হুবহু আরেকটা জুড়িগাড়ি তার জন্য তৈরি করতে। কিন্তু তাকে তার আগে জানতে হবে গাড়িটা কীভাবে টেনে নেয়া হবে–ষাড় নাকি ঘোড়া দিয়ে, আর কীভাবে তাঁদের গাড়ির সাথে জুড়ে দেয়া আর নিয়ন্ত্রণ করা হবে।

‘এই দূতমহাশয় কি অভিপ্রায় বলে আপনার মনে হয়?’ জাহাঙ্গীর একটা লম্বা আয়নায় নিজেকে খুটিয়ে দেখার সময় মেহেরুন্নিসা তাকে জিজ্ঞেস করে।

‘আমার ধারণা, পর্তুগিজ আর ডাচদের মত বানিজ্যের সুবিধা। আমি সুরাটে তার দেশের লোকদের একটা ছোট ঘাঁটি স্থাপন করার এবং কয়েকটা মৌলিক দ্রব্য রপ্তানির অনুমতি দেয়ার পর থেকেই তাঁরা নীল, কেলিকোর সাথে সাথে মূল্যবান রত্নপাথর আর মুক্তার মত দামি সামগ্রী কেনাবেচা করার অধিকারের জন্য আমার কাছে অনুরোধ করছে। আমি তাদের সিদ্ধান্ত জানাতে দেরি করছিলাম, তাদের দেশের শাসক এখন তাই তাদের পক্ষ সমর্থন করার জন্য কাউকে প্রেরণ করেছেন।

‘তাঁদের প্রস্তাবে দ্রুত রাজি না হয়ে আপনি বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। আমি যা শুনেছি তাতে মনে হয় এইসব ভিনদেশী বণিকেরা ক্রমশ ধৃষ্ট, ঝগড়াটে হয়ে উঠছে এবং আমাদের রাস্তায় নিজেদের মধ্যে লড়াই করছে আর স্থানীয় লোকদের অপমান করছে।

‘বাণিজ্য সম্পদ বৃদ্ধি করে। কিন্তু আমি তোমার সাথে একমত। তাঁদের অবশ্যই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।’

জাহাঙ্গীর পনের মিনিট পরে দর্শনার্থীদের জন্য নির্ধারিত দেওয়ানি আমে তূর্যধ্বনির মাঝে প্রবেশ করে এবং সিংহাসনে উপবিষ্ট হয়, তার প্রধান উপদেষ্টা আর অমাত্যরা বেদীর নিচে উভয়পাশে দলবদ্ধভাবে এবং খুররম সম্রাটের খুব নিকটের সম্মানজনক স্থানে অবস্থান নেয়।

তূর্যধ্বনি আর দামামার গুরুগম্ভীর শব্দের আরেকদফা সুতীব্র ঝঙ্কার সহযোগে দূতমহাশয়ের আগমন ঘোষিত হয়। জাহাঙ্গীর উচ্চস্বরে হেসে ওঠা থেকে অনেক কষ্টে নিজেকে নিবৃত্ত করে। একটা দীর্ঘদেহী অবয়ব যার গাঢ় বেগুনী রঙের সংক্ষিপ্ত, ঢোলা পাজামার মত দেখতে পোষাকটা, চিরে ফালা ফালা করা হয়েছে নিচের উজ্জ্বল লাল কাপড় প্রকাশ করতে এবং সেটা আবার হাঁটুর উপরে লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা নিচে তাঁর ভীষণ সরু দুটো পা ধুসর একটা উপকরণ দিয়ে আবৃত ধীরে ধীরে বেদীর দিকে এগিয়ে আসে। ব্রোকেডের একটা উজ্জ্বল হলুদ রঙের আঁটসাট জ্যাকেট কুঁচকির ঠিক উপরে শক্তভাবে সুচ্যগ্র হয়ে শেষ হতে তার চূড়ান্ত কৃশতার বিষয়টাকে গুরুত্ব প্রদান করেছে। লোকটা জাহাঙ্গীরের কাছাকাছি আসতে তাঁর বাকান পালকশোভিত উঁচু কিনারাযুক্ত টুপির নিচে একটা টকটকে লাল মুখ দেখতে পায়–ধুসর ত্বকের উপরে সূর্যের আলোর প্রভাব?–তার গলার চারপাশে শক্ত দেখতে সাদা উপাদানের তৈরি একটা চওড়া বৃত্ত সবকিছুকে আরও বেশি চমকপ্রদ করে তুলেছে। তার কাঁধের উপরে পড়ে থাকা খয়েরী চুল পাতলা হয়ে এসেছে কিন্তু সেটা পুষিয়ে দিয়েছে কোঁকড়ানো গোফের বাহার। অদ্ভুতদর্শন এই লোকটার বয়স আন্দাজ করা কঠিন কিন্তু জাহাঙ্গীর অনুমান করে লোকটার বয়স ত্রিশের কোটার শেষের দিকে।

তার পেছনে রয়েছে অল্পবয়সী এক তরুণ-বলা যায় সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ–একই রীতির পোষাক পরিহিত কেবল একটাই পার্থক্য তাঁর কাপড়গুলো সব গাঢ় খয়েরী রঙের কোনো উপকরণ দিয়ে তৈরি আর তাঁর মাথায় টুপি নেই। মধ্যম উচ্চতার লোকটার মাথার চুলের রঙ বার্লির মত এবং বার্থোলোমিউ হকিন্সের মত নীল চোখ–যে অতিসম্প্রতি সদ্য লাভ সম্পদে বোঝাই সিন্দুক নিয়ে ইংল্যান্ড ফিরে গিয়েছে জাহাঙ্গীর আক্ষেপ করে–যা এই মুহূর্তে সোনালী সিংহাসনে অধিষ্ঠিত তাঁর নিজের দিকে খানিকটা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। তার ডানহাতে রয়েছে লম্বা পায়ের, ধুসর চামড়ার একটা কুকুরের গলায় বাঁধা গলবন্ধনীর সাথে সংযুক্ত দড়ি, কুকুরটা এতটাই শুকনো দেখতে যে জাহাঙ্গীর তার পাজরের প্রতিটা হাড় আলাদা করে গুনতে পারে। দূতমহাশয় থেকে দেখতে খুব একটা আলাদা নয় জন্তুটা।

জাহাঙ্গীরের উজির মাজিদ খানের কাছ থেকে ইঙ্গিত পেয়ে বেদী থেকে দশফিট দূরে দূতমহাশয় দাঁড়িয়ে যায় এবং মাথার টুপি নামিয়ে নিয়ে সেটা ডানবাহুর নিচে গুঁজে দিয়ে একটা সরু পা নিজের সামনে সোজা বাড়িয়ে দিয়ে, অন্য পা ভাঁজ করে এবং কোমর থেকে দেহের উপরের অংশ সামনের দিকে নত করার সময় ডান হাত বৃত্তাকারে আন্দোলিত করে। বিচিত্র একটা অভিবাদন রীতি, এবং তরুণ লোকটা জাহাঙ্গীরের ধারণা যে নিশ্চিতভাবে তার কর্চি একই ভাবে অভিবাদন জানায়। সে হাত নেড়ে তার পণ্ডিতদের একজনকে যে দোভাষীর কাজ চালাবার মত চলনসই ইংরেজি জানে সামনে এগিয়ে যেতে বলবে যখন দূতমহাশয় নিজেই ভাঙা ভাঙা কিন্তু তারপরেও স্পষ্টতই বোধগম্য ভঙ্গিতে পার্সীতে কথা বলতে শুরু করে।

‘মহামান্য সম্রাট, অধমের নাম স্যার টমাস রো। আমি আমার নিজের রাজা, ইংল্যান্ডের প্রথম আর স্কটল্যাণ্ডের ষষ্ঠ জেমসের কাছ থেকে আপনার জন্য শুভেচ্ছা বয়ে নিয়ে এসেছি। শাসক হিসাবে আপনার মহত্বে কথা শুনে তিনি তার দেশ থেকে আপনাকে কিছু উপহার দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। আমি ইতিমধ্যেই এখানে আসবার আগেই কিছু উপহার পাঠিয়ে দিয়েছিলাম এবং আমি নিজে আরো নিয়ে এসেছি–চিত্রকর্ম, রূপার আয়না, চমৎকার পাকা চামড়া, পরিচিত পৃথিবীর মানচিত্র, আমাদের দ্বীপের উত্তরে প্রস্তুতকৃত একটা পানীয় আমরা যাকে হুইস্কি বলি, চারটা চমৎকার ঘোড়া দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রার ধকল তাঁরা খানিকটা সামলে নেয়ার পরে যা আমি নিজে মহামান্য সম্রাটকে উপহার দেব এবং আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি তারা আপনার তারিফের যোগ্য এবং আমাদের দেশের এই শিকারী কুকুরটা–আমরা ইংরেজিতে একে গ্ৰেহাউন্ড বলি। পৃথিবীতে এর চেয়ে দ্রুতগামী কুকুর আর হয় না। রো এবার তরুণের দিকে ঘুরে তাকায়, যে ঠিক তার ডান কাঁধের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অল্পবয়সী লোকটা এবার সামনে এগিয়ে আসে এবং কুকুরের গলা থেকে দড়িটা খুলে নেয়। জাহাঙ্গীর ভেবেছিল ভিনদেশী সারমেয় বুঝি দৌড়ে পালাবে কিন্তু এই মুহূর্তের জন্য নিশ্চয়ই তাকে যত্নের সাথে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। জন্তুটা কয়েক পা সামনে এগিয়ে এসে নিজের ডান থাবা অবিকল রোয়ের মত সামনে বাড়িয়ে দিয়ে মাথা নিচু করে, দূতমহাশয়ের নিজস্ব অভিবাদন রীতি অনুকরণ করে।

‘আমার দরবারে আপনাকে স্বাগতম। আপনার প্রভুকে তার উপহার সামগ্রীর জন্য আমার তরফ থেকে তাকে ধন্যবাদ জানাবেন। জাহাঙ্গীর তাঁর কচিদের একজনকে কুকুরটা সরিয়ে নেয়ার জন্য ইঙ্গিত করে। আমি বিশ্বাস করি দূর্গে আপনার বাসস্থান আরামদায়ক হবে এবং আগামী দিনগুলোতে আশা করি আপনার সাথে নানা বিষয়ে আরো আলোচনা হবে।

রোকে চোখেমুখে খানিকটা বিভ্রান্তি ফুটে উঠলে অল্পবয়সী লোকটা সামনে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে তার কানে কিছু একটা বলে। দূতমহাশয়কে সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে দেখে সে বলে, জাহাপনা, আমার প্রভুকে মার্জনা করবেন। তিনি সামান্য পার্সী শিখেছেন, আপনাকে সম্বোধন করার জন্য যা যথেষ্ট–এবং ভবিষ্যতে আরও ভালো করে শিখবেন বলে আশা রাখেন–কিন্তু ভাষাটা তিনি এখনও খুব সামান্যই বুঝতে পারেন। আমি তার দোভাষি এবং পথসঙ্গী। অধমের নাম নিকোলাস ব্যালেনটাইন। দূতমহাশয় আপনার সহৃদয়তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। তাঁর বসবাসের ব্যবস্থা সত্যিই আরামদায়ক। তিনি আপনার সাথে আলোচনার জন্য তিনি অপেক্ষা করবেন যখন তিনি আশা করেন আপনার বিশাল সাম্রাজ্যের সাথে আমাদের বাণিজ্যের অভিপ্রায় আপনি সহানুভূতির দৃষ্টিতে বিবেচনা করবেন। তার ইচ্ছা আমি আপনাকে বলি যে আমরা কেবল আমাদের নিজেদের পণ্যই আপনার কাছে বিক্রি করবো না সেই সাথে আমাদের জাহাজ আপনার সাম্রাজ্য থেকে হজ্জযাত্রীদের আরবেও পৌঁছে দিতে পারবে। আমরা দ্বীপের অধিবাসী আর আমাদের জাহাজ পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়। জাহাজগুলো বিশাল সমুদ্র অনায়াসে অতিক্রম করতে সক্ষম এবং আমাদের কামানগুলো অন্য যেকোনো জাতির জাহাজ ধ্বংস করতে পারদর্শী। জাঁহাপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, গত বছরের কথা, আপনার উপকূলের কাছেই পর্তুগিজরা ইংরেজদের দুটো জাহাজ আক্রমণ করার মত ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছিল। আমরা তাদের ডুবিয়ে দিয়েছিলাম।

জাহাঙ্গীর বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকে–ভিনদেশি যুবকের মুখে প্রায় নিখুঁত ফার্সী ভাষা শুনেই কেবল নয় সেই সাথে স্পষ্টভাবে প্রস্তাব পেশ করতে দেখে সে বিস্মিত হয়েছে। একজন মোঘল–বা বস্তুতপক্ষে একজন পার্সী–প্রসঙ্গ উত্থাপন করতে আরও অনেকবেশি সময় গ্রহণ করতো। কিন্তু ইংরেজ রাজা তার উপহার সামগ্রী ছাড়াও যে আরও কিছু সহায়তা করতে আগ্রহী সেটা স্পষ্ট হয়ে ভালোই হয়েছে। মুসলিম হজ্জযাত্রীদের গুজরাতের বন্দর থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে তাদের যাত্রার প্রথম পর্যায়ে সাগর অতিক্রম করে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে এতদিন পর্যন্ত আরব আর পর্তুগিজ জাহাজগুলো নিজেদের ভিতরে কার্যত একচেটিয়া ব্যবসা করে এসেছে। আরব জাহাজগুলো অধিকাংশ সময়েই গভীর সমুদ্রে চলাচলের উপযোগী হয় না–মাত্র তিন সপ্তাহ আগেই তিন যাত্রী নিয়ে একটা জাহাজ ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যেতে জাহাজের সবার সলিল সমাধি ঘটেছে। আর আরব নাবিকেরা হজ্জযাত্রীদের জাহাজ আক্রমণকারী জলদস্যুদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারে না।

পর্তুজিগদের বেলায়, তাঁরা তাঁদের যাত্রীদের কাছে তাঁদের প্রভুর প্রতিকৃতি অঙ্কিত–যিশু নামে শ্মশ্রুমণ্ডিত একজন অল্পবয়সী লোক এবং ধুসর মুখের এক কুমারী রাণি যার নাম মেরী–যে অনুমতিপত্র বিক্রি করে জাহাঙ্গীর সেটা দেখেছে। পর্তুগিজ জাহাজগুলো শক্তিশালী আর তাঁদের সশস্ত্র নাবিকেরা জলদস্যুদের ভালোমতই প্রতিরোধ করতে পারে কিন্তু পর্তুগিজরা গোয়ায় তাঁদের বাণিজ্য কেন্দ্রে ক্রমশ আরো বেশি উদ্ধত হয়ে উঠছে। তাদের পুরোহিতেরা হিন্দু আর মুসলমান জনসাধারণ উভয়ের ভিতরেই আগ্রাসী ভঙ্গিতে ধর্মান্তরিতকরণের প্রয়াস চালাচ্ছে এমনকি মক্কায় যাবার জন্য জাহাজের প্রতিক্ষারত হজ্জযাত্রীদেরও তাঁরা প্ররোচিত করার চেষ্টা করেছে যে তাদের বিশ্বাস ভ্রান্ত। পর্তুগিজরা সেই সাথে যাত্রীদের কাছ থেকে পরিবহণের জন্য ক্রমশ বেশি অর্থ দাবি করছে। ইংরেজ রাজা দরবারে একজন দূত প্রেরণ করেছেন এই বাস্তবতা হয়ত তাঁদের নিজেদের দাবির ব্যাপারে নমনীয় হতে সাহায্য করবে।

‘আপনার প্রভুকে জানাবেন আমি তার প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখবো এবং সেই জন্য আগামীতে আমরা আলোচনা করবো, জাহাঙ্গীর বলে। সে বেদীর ডানপাশে দাঁড়িয়ে থাকা তূর্যবাদকের উদ্দেশ্যে হাল্কা মাথা নাড়ে এবং লোকটা সাথে তার ব্রোঞ্জের তৈরি বাদ্যযন্ত্র ঠোঁটে রেখে সাক্ষাৎকার পর্ব সমাপ্তির ইঙ্গিতবাহী স্বল্পস্থায়ী একটা আওয়াজ করে। জাহাঙ্গীর উঠে দাঁড়ালে, দূতমহাশয় পুনরায় পা লম্বা করে দিয়ে নিজস্ব রীতিতে সুনির্মিত ভঙ্গিতে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে। সে যখন পুনরায় সোজা হয়ে দাঁড়ায় তার লাল মুখ আরও লালচে দেখায় আর তার ব্রোকেডের হলুদ জ্যাকেটের বাহুর নিচে ঘামের গাঢ় বৃত্ত সৃষ্টি হয়। লোকটা কি কোনো কারণে বিচলিত হয়ে রয়েছে নাকি এটা কেবল হিন্দুস্তানের অস্বাভাবিক গরমের ফল?

*

‘আরও ওয়াইন নিয়ে এসো, জাহাঙ্গীর তার কচিকে আদেশ দেয়। রো’র মুখ ঘামে ভিজে চকচক করছে, মাংসপেশী শিথিল–গত তিন ঘন্টা ধরে সে ক্রমাগতভাবে যে বিপুলপরিমাণ সুরা নিঃশেষ করেছে তার ফল। জাহাঙ্গীর পান করার এমন ক্ষমতাসম্পন্ন লোক কখনও দেখেনি, কিন্তু ওয়াইন রো’র রসিকত বোধ ভোঁতা না করে বরং উল্টোই করে বলে মনে হয়। সে যত বেশি পান করে জাহাঙ্গীর তত বেশি তার আলাপচারিতায় আনন্দ লাভ করে, তার আগ্রহী ঠোঁটের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকা তথ্য উপভোগ করে। রো স্পষ্টতই একজন শিক্ষিত মানুষ যদিও সে যেসব পণ্ডিতদের লেখা উদ্ধৃত করতে পছন্দ করে–গ্রীক আর রোমান দার্শনিক, সে বলেছে, তাঁদের অনেকেই প্রায় দু’হাজার বছর পূর্বে মারা গিয়েছেন–জাহাঙ্গীরের কাছে তাঁদের বেশিরভাগই অপরিচিত। তিনি গত চারমাস ধরে দরবারে অতিবাহিত অবস্থান করায় দূতমহাশয়ের পার্সী অনেক উন্নত হয়েছে এবং জাহাঙ্গীর যদিও উল্টো ফলাফল আশা করেছিল কিন্তু দেখা যাচ্ছে ওয়াইন তাকে স্বচ্ছন্দভাষী করে তুলেছে। জাহাঙ্গীর মাত্র গতকালই তাঁর দরবারের এক পণ্ডিতের সাথে তাকে প্রাণবন্ত ভঙ্গিতে যুক্তি পেশ করতে শুনেছে যে পরশ পাথরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করা–এমন একটা পদার্থ কেউ কেউ মনে করেন যার অবর ধাতুকে সোনা বা রূপায় পরিণত করার ক্ষমতা রয়েছে। এবং এটা অনন্ত জীবনের রহস্যও ধারণ করে–পুরোপুরি অযৌক্তিক আলাৎপালা। জাহাঙ্গীর ব্যক্তিগতভাবে, এমন কোনো কিছু যা প্রমাণ করা সম্ভব নয় সেসব বিষয়ে সাধারণত সন্দেহপ্রবণ, তার যুক্তির সাথে একমত পোষণ করে।

তাদের সামনের টেবিলের উপরে মানচিত্রের একটা বই খোলা অবস্থায় রয়েছে রো’র ভাষ্য অনুযায়ী যার স্রষ্ঠা মারকেটর নামে জনৈক মানচিত্র-প্রস্তুতকারী, দরবারে উপস্থিত হবার পরপরই জাহাঙ্গীরকে যা সে উপহার দিয়েছিল। রো বইটাকে ‘অ্যাটলাস’ বলে, ব্যাখ্যা করে বোঝায় যা একজন পৌরাণিক পুরুষের নাম যিনি নিজের কাঁধে পুরো পৃথিবীর ওজন বহন করছে প্রচ্ছদের উপরে যা অঙ্কিত রয়েছে। জাহাপনা, আমি জানি সিংহাসনে আরোহণের সময় আপনি “পৃথিবীর অধিকারী” উপাধি গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু দেখেন আসলেই বাইরের পৃথিবী কতটা বিশাল, দূতমহাশয় খানিকটা কৌতূকপূর্ণ কণ্ঠে কথাটা বললেও জাহাঙ্গীর হাসতে বাধ্য হয়। সে মুগ্ধচিত্তে বারবার বইটা নিয়ে বসে, ভারি পাতাগুলো যত্নের সাথে উল্টে সে জীবনে কখনও নামও শুনেনি এমন সব রেখাঙ্কিত এলাকা খুটিয়ে দেখে, পুরোটা সময় তাঁর মাথায় রো’র জন্য প্রশ্ন গিজগিজ করতে থাকে, এই জন্যই সে তাকে আবারও নিজের ব্যক্তিগত নিভৃত কক্ষে পুনরায় আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

‘আপনি নিজ মুখে আমায় যা বলেছেন সেটা অনুসারে, এটা মনে হয় যে স্পেনিশ, ডাচ আর পর্তুগিজরা ইংরেজদের চেয়ে অনেক ভালো ভ্রমণকারী? আপনি অন্য একদিন ম্যাগিলান নামে যে লোকটার কথা বলেছিলেন–প্রথম ব্যক্তি যার জাহাজ পুরো পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেছিল–সে একজন পর্তুগিজ, তাই না?

রো আরেকটু আরাম করে বসতে চেষ্টা করে। তাঁর পা লম্বা আর সরু হওয়ায় বেশিক্ষণ আসনপিড়ি করে বসে থাকাটা তার জন্য কষ্টকর। হ্যাঁ, জাঁহাপনা। এটা সত্যি কথা যে গুটিকয়েক ভিনদেশী অভিযাত্রী সমুদ্রযাত্রায় ভাগ্যের সহায়তা পেয়েছে, কিন্তু আমাদের ইংরেজ নাবিক আর তাঁদের জাহাজ কারো চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আমার দেশের মানুষ সম্প্রতি উত্তর আমেরিকাসের একটা স্থানে প্রথম বসতি স্থাপন করেছে আমাদের মহানুভব রাজা জেমসের নামানুসারে এলাকাটার নাম তাঁরা রেখেছে জেমসটাউন। নিজের প্রত্যন্ত ছোট দ্বীপের গুরুত্ব সম্পকে রো’র অনড় বিশ্বাস জাহাঙ্গীরকে সবসময়ে আমোদিত করে। দূতমহাশয় এতটা উৎসাহের সাথে যে জীবনের কথা বর্ণনা করেন, সাধারণ মানুষের অভ্যেস থেকে শুরু করে দরবারের রীতি রেওয়াজ পর্যন্ত, জাহাঙ্গীরের কাছে সবকিছুই কেমন সেকেলে মনে হয়, যদিও সৌজন্যতাবোধ আর সে রোকে ক্রমশ পছন্দ করতে শুরু করায় এমন কিছু বলা থেকে তাকে বিরত রাখে। ‘আপনি যা কিছু বলেছেন তা যদি সত্যি হয় এবং আপনার দেশ যদি বাস্তবিকই আমার হজ্জযাত্রীদের বহন করার জন্য জাহাজের যোগান দেয় আমি হয়ত আপনার কাঙ্খিত বাণিজ্যিক রেয়াত প্রদানে সম্মত হতে পারি, কিন্তু সেখানে কিছু শর্ত থাকবে।

‘অবশ্যই, জাহাপনা। সে যে পরিমাণ ওয়াইন পান করেছে তারপরেও রো’র চোখ সহসা একাগ্র দেখায়। দূতমহাশয়ের আগমনের পর থেকে বিগত মাসগুলোতে, জাহাঙ্গীর প্রতিশ্রুতির বিষয়ে সবসময়ে সতর্ক থেকেছে যদিও সে তার এই রাজা জেমসের জন্য উপহার পাঠিয়েছে, যত্নের সাথে যা বাছাই করা হয়েছে যেন একাধারে আকর্ষণীয় হয় কিন্তু সেই সাথে খুব বেশি জাঁকজমকপূর্ণ না হয় যে ইংরেজ শাসক অস্বস্তিবোধ করে, যিনি সঙ্গত কারণেই মোগলদের মত ঐশ্বর্যের অধিকারী নন। সে নিজে যদিও সোনা। মোড়ান স্ফটিকের একটা বাক্স খুব পছন্দ করেছে, ইংরেজদের অন্য উপহারের অনেকগুলোই ইতিমধ্যে নষ্ট হতে শুরু করেছে–চামড়ায় ফাটল ধরেছে সম্ভবত গরমের ফলে হয়েছে, ছবির ফ্রেম থেকে গিল্টির পরত উঠে আসতে শুরু করেছে, এবং সে ইতিমধ্যে জুড়িগাড়ির ছাতার গন্ধযুক্ত আস্তরন। বদলে গুজরাত থেকে নিয়ে আসা সবুজ ব্রোকেড লাগিয়েছে। রো তারপরেও এমন কিছু নিয়ে এসেছে যা অন্য কোনো দূত আগে কখনও নিয়ে আসেনি–বৃহত্তর পৃথিবী সম্বন্ধে তথ্য, যেমন মানচিত্র এবং এই নতুন পৃথিবী’ সেখানে পাওয়া যায় এমন সব উদ্ভিদ আর প্রাণীর বর্ণনা যে বিষয়ে কথা বলতে সে ভীষণ পছন্দ করে। তার আগমনের কিছুদিন পরেই সে জাহাঙ্গীরকে একটা সুতির ব্যাগ উপহার দিয়েছিল যেটায় কিছু শক্ত আর গোলাকৃতি উদ্ভিদের কন্দ ছিল–সে সেগুলোর নাম বলেছিল ‘আলু’–এবং আন্তরিকভাবে দাবি করেছিল যে কন্দগুলো পোড়ালে বা সিদ্ধ করলে খেতে দারুণ হয়।

কর্চি এতক্ষণে ফিরে এসেছে। জাহাপনা। এই সুরাটা–গোলাপজলের সুগন্ধিযুক্ত–সম্রাজ্ঞীর কাছ থেকে প্রেরিত একটা বিশেষ উপহার। তিনি আমাকে বলতে বলেছেন যে তিনি নিজ হাতে এই সুরা প্রস্তুত করেছেন।’

‘চমৎকার। দূতমহাশয় এবার, দেখা যাক আপনি আমার জন্য যে হুইস্কি নিয়ে এসেছিলেন সেটার তুলনায় এই সুরা কতটা জোরালো মাদকতার অধিকারী… এবং আমি চাই আপনি তোক পাঠিয়ে আপনার সেই কচিকে ডেকে নিয়ে আসেন যে আমাকে আরো কিছু ইংরেজি গান গেয়ে শোনাবে…’

*

মালকিন, সম্রাট গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।

মেহেরুন্নিসা তেলের প্রদীপের আলোয় বই পড়া বন্ধ করে চোখ তুলে তাকায়, যদিও এখন ভোরের প্রথম আলো গবাক্ষের ভিতর দিয়ে পরিশ্রুত হয়ে প্রবেশ করছে তার এখন আর এটার প্রয়োজন নেই। আর দূতমহাশয়?

“তিনিও ঘুমে আচ্ছন্ন, মালকিন।

‘সম্রাটকে এখানে তাঁর নিজের কক্ষে বয়ে নিয়ে আসবার জন্য পরিচারকদের আদেশ দাও এবং ইংরেজ ভদ্রলোকের ভৃত্যকে এসে তাকে তার আবাসিকস্থলে নিয়ে যেতে বলো।

রোয়ের সাথে জাহাঙ্গীরের পানাহার পর্বের ভোর পর্যন্ত স্থায়ী হবার এটাই প্রথম ঘটনা না এবং মেহেরুন্নিসা খুব ভালো করেই জানে কর্চি কি বোঝাতে চেয়েছে যখন সে বলেছে যে তার স্বামী ঘুমে আচ্ছন্ন: সম্রাট জ্ঞান হারিয়েছেন। রোর সাথে পানাহারের এসব জমায়েত ক্রমশ আরো বেশি বেশি হতে শুরু করেছে। জাহাঙ্গীর অজুহাত দেখায় যে অনেক আকর্ষণীয় বিষয় রয়েছে তাঁদের আলোচনা করতে হবে, অজস্র ধারণা অনুসন্ধান করতে হবে। তিনি গতকাল তাকে বলেছিলেন রোর কাছে তিনি নতুন ঔষধ নিয়ে তার কিছু পরীক্ষা-চিনার গাছের পাতা গাজিয়ে তোলা পানি ব্যবহার করে–ক্ষতস্থান দ্রুত নিরাময়কারী একটা মলম আবিষ্কারের বিষয়টা ব্যাখ্যা করতে চান। সে এই মলমটা একজন কর্চির উপরে পরীক্ষা করেছে যে শিকারের গিয়ে একটা মর্দা হরিণের শিং এর গুতো খেয়েছে। কিন্তু কয়েক ঘন্টা আগে একটা ক্ষুদ্র জালি পর্দার ভিতর দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে সে জানতে পেরেছে যে জাহাঙ্গীর আর রো কিছুক্ষণের ভিতরেই চটুল বিষয়ে আলোচনা শুরু করে, আদি রসাত্মক গান–পার্সী আর ইংরেজি–যা তাঁরা পরস্পরকে শিখিয়েছে গলা ছেড়ে গাইতে থাকে, এবং পাঞ্জা লড়ে শক্তির পরীক্ষার প্রয়াস নেয় যা দৈহিকভাবে অনেকবেশি শক্তিশালী জাহাঙ্গীর অবিকার্যভাবে জিতে।

তাঁদের তখন একজন সম্রাট আর ভিনদেশী শাসকের দূতের চেয়ে এক জোড়া দুষ্ট ছেলে মনে হয়, কিন্তু ইংরেজ রাজদরবারে এমন পানোৎসব সম্ভবত সাধারণ বিষয়। নিজের দরবারের সুর্নিমিত আনুষ্ঠানিকতার তুলনায় সম্ভবত, যেখানে তাকে অবশ্যই একজন মানুষের চেয়েও ক্ষমতা আর ঐশ্বর্যের প্রতিমূর্তি হিসাবে আচরণ করতে হবে, জাহাঙ্গীরের কাছে এটা নিশ্চিতভাবেই আকর্ষণীয়। রো যখন তার উপস্থিতিতে সশব্দে এবং দীর্ঘস্থায়ী বাতকর্ম করে জাহাঙ্গীর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে এবং তাঁর কাঁধ চাপড়ে দেয়। তারা যদিও মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান করে কিন্তু এই আড্ডাগুলো হয়ত খারাপ কিছু না। জাহাঙ্গীরকে এসব শমিত করে এবং, কোনো কোনো রাতে সম্রাটকে তার শয্যা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা ছাড়া, তাঁর কাছ থেকে কিছু কেড়ে নিচ্ছে না। সম্রাটের জন্য এসব কারণে সে অনেক কিছু করার সুযোগ পাওয়ায়, বস্তুতপক্ষে উল্টোটা সত্যি। সে অবশেষে প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা নিয়ে, ঘুম থেকে জেগে উঠলে সে তখন তার যত্ন নেয়, ব্যাথা দূর করতে চন্দনকাঠ আর ঘৃতকুমারী পাতার মিশ্রিত নির্যাস তার কপালের দু’পাশে ঘষে দেয়।

কখনও কখনও, আগের রাতের পানোৎসবের কারণে চোখ তখনও ঝাপসা হয়ে থাকায়, সে তাঁর উপদেষ্টাদের বৈঠকে আলোচিত বিষয়বস্তুসমূহে খাজনা বৃদ্ধি, তার অমাত্যদের জায়গীর আর খিলাত বিতরণ, এবং তার সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশের শাসকদের প্রয়োজনীয় আদেশ পাঠান মনোনিবেশ করাটা তার জন্য খুব কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। তাকে এসব বিষয় সে যখন সুরার প্রভাব মুক্ত থাকে তখনও বিরক্ত করে। সে, অবশ্য, কখনও একটা অধিবেশনও বাদ দেয় না, রাজমহিষীদের প্রেক্ষণিকার জালি অন্ত ওপটের পেছনে একায়ত ভঙ্গিতে বসে সবকিছু শোনে এবং তিনি যদি কখনও বিষয়টা নিয়ে কিছু জানতে চান তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে পারবে। সে প্রায় প্রতিদিনই রাজকীয় নথিপত্র পাঠ করার প্রস্তাব দেয় যা তার কাছে ভীষণ বিরক্তিকর বলে মনে হয় এবং সে পুরোটা পাঠ করে বিষয়বস্তুর সারাংশ তাকে জানায় এবং তিনি সাথে সাথে সম্মতি দান করেন, নিজের কাঁধ থেকে কিছুটা দায়িত্ব তার কাঁধে চাপিয়ে দিতে পেরেই তিনি আনন্দিত। সে তার কাছে ঠিক যেমনটা আশা করেছিল, তিনি আজকাল প্রায়ই তাঁর কাছে পরামর্শ চায়, এমনকি কখনও কৌতুক করেন যে বেচারা মাজিদ খান তাঁর উজির যেকোনো দিন বুঝি চাকরিটা হারাবে। প্রভাব আর ক্ষমতার মধ্যবর্তী সীমারেখা খুব একটা প্রশস্ত না, এবং সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সে প্রায়ই অনুভব করে রেখাটা সে অতিক্রম করতে শুরু করেছে…

তাঁর ভয় যে জাহাঙ্গীর হয়ত খুররমের উপর বেশি মাত্রায় নির্ভর করতে শুরু করবে এখন পর্যন্ত অমূলক প্রমাণিত হয়েছে। খুররম আর আরজুমান্দের আরেকটা পুত্র সন্তান, দারা শুকোহ্, ভূমিষ্ঠ হওয়ায় তিনি ভীষণ আনন্দিত, কিন্তু তিনি আর খুররম আজকাল যদিও অনেক বেশি সময় একত্রে অতিবাহিত করেন সাধারণত এসময় তারা বাজপাখি উড়াতে বা শিকারে যান, বা তীরন্দাজিতে পরস্পরের দক্ষতা পরীক্ষা করেন নয়তো একসাথে হাতির লড়াই দেখেন। যুবরাজ দাক্ষিণাত্য থেকে ফিরে এসে শাসনকার্যের খুঁটিনাটি বিষয়ে নিজেকে যুক্ত করার সামান্যতম আগ্রহ প্রদর্শন না করায় ব্যাপারটা তাকে আরও বেশি উৎফুল্ল করেছে এবং তাঁর নিজের আকাঙ্খ আরও বাড়িয়ে তুলেছে। অন্যরা অবশ্য তাঁর ক্রমবর্ধমান প্রতিপত্তি খেয়াল করেছে। গত সপ্তাহে রাজকীয় হেরেমে সরাসরি তাকে সম্বোধন করে প্রেরিত প্রায় আধ ডজন আবেদন পত্র এসেছে। জাহাঙ্গীরকে সে শীঘ্রই জিজ্ঞেস করবে যে তাকে ঝামেলার হাত থেকে বাঁচাতে সে কি তার নিজের নামে অধ্যাদেশ জারি করা শুরু করতে পারে। তিনি তাকে খোদাই করা যে পান্নাটা দিয়েছেন যেখানে তাঁর উপাধি, নূর মহল উত্তীর্ণ রয়েছে, সেটা ব্যবহার করবে…।

দরজার পাল্লা দুটো খুলে যায় এবং একটা বাঁশের খাটিয়া নিয়ে চারজন পরিচারক ভেতরে প্রবেশ করে যার উপরে জাহাঙ্গীর চিত হয়ে দু’হাত দু’পাশে ছড়িয়ে দিয়ে শুয়ে রয়েছে, পরিশ্রমের কারণে তাঁদের সবার পা সামান্য বেঁকে রয়েছে। সে তার ভারি, ছন্দোবদ্ধ শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পায়।

‘খাটিয়াটা ওখানে নামিয়ে, তারপরে আমাদের একা রেখে তোমরা বিদায় নাও, মেহেরুন্নিসা, গবাক্ষ দিয়ে প্রবেশ করা উজ্জ্বল সূর্যালোক থেকে দূরে কক্ষের অন্ধকার কোণের দিকে ইঙ্গিত করে, আদেশ দেয়। পরিচারকের দল তাঁদের একা রেখে কক্ষ ত্যাগ করা মাত্র সে পিতলের পাত্রে রক্ষিত পানিতে রেশমের রুমাল ভিজিয়ে নেয়, তারপরে জাহাঙ্গীরের কাছে এগিয়ে এসে তাঁর পাশে হাঁটু মুড়ে বসে। কি গভীর ঘুমে লোকটা আচ্ছন্ন হয়ে আছে, সে তার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে, মাস অন্তে বছর অতিক্রান্ত হবার সাথে সাথে আগের চেয়ে একটু মাংসল দেখায় কিন্তু এখনও দেখতে সুদর্শন রয়েছেন। সে তার কপালের ঘাম মুছিয়ে দিতে শুরু করতে, তাঁর জন্য একটা স্নেহার্দ্র অনুভূতি তাকে আপুত করে। সে জীবনে যা কিছু চেয়েছে, এই লোকটা তাকে সবকিছু দিয়েছে–এখনও অনেক কিছু দিতে পারে।

জাহাঙ্গীর নড়াচড়া শুরু করে। সে সহসাই চোখ খুলে তাকায় এবং খানিকটা অনুতাপপূর্ণ ভঙ্গিতে হাসে। আমার মনে হয় আমি আবারও তোমার তৈরি সুরা একটু বেশিই পান করে ফেলেছি।

 ১.১২ বিষাক্ত লেখনী

‘মালকিন…আপনাকে ঘুম থেকে জাগাবার জন্য আমায় মার্জনা করবেন…’

মেহেরুন্নিসা ঘুম জড়ানো চোখ খুলে সাল্লাকে বিছানার উপরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যেখানে সে ঘুমিয়ে ছিল। আর্মেনিয়ান মেয়েটা জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে, যেন সে তার মালকিনের কামরায় দৌড়ে এসেছে। মেহেরুন্নিসা উঠে বসে, পরিত্রস্ত।

কি হয়েছে? সম্রাটের কি কিছু হয়েছে? জাহাঙ্গীর, ঘন্টাখানেক আগে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তাঁর পরীক্ষিত রণহস্তীর একটা–খুনি খাজা নামে বহু ক্ষতচিহ্নের অধিকারী দানবাকৃতি যুদ্ধপ্রবীন এক দাঁত ভাঙা কিন্তু ডান গজদাঁত এখনও ভীষণ কার্যকর একটা পশু–এবং গোয়ালিওরের শাসনকর্তার কাছ থেকে উপহার হিসাবে প্রেরিত এর চেয়েও বিশাল আরেকটা হাতির ভিতরে অনুষ্ঠিত লড়াই দেখতে গিয়েছে। সেও সাধারণত তাঁর সাথে লড়াই দেখতে যায়–সে পর্বতাকৃতি এই প্রাণীগুলোর লড়াই উপভোগ করে যেখানে তাঁরা তাঁদের শক্তির বরাভয়ে একে অপরের বিরোধিতা করছে এবং আন্দাজ করতে চেষ্টা করে কে জিততে পারে–কিন্তু নিজেকে আজ তার খানিকটা পরিশ্রান্ত মনে হচ্ছিল আর তাই সে বিশ্রাম করার সিদ্ধান্ত নেয়।

‘মালকিন, সম্রাটের কিছু হয় নি।

‘কি তাহলে?

সাল্লা ময়ূরের মত দেখতে পাথর বসান একটা চুলেরকটা এগিয়ে দেয় যার কলাই করা পেখমে ছোট ছোট নীলা আর পান্না বসান রয়েছে। এটা মেহেরুন্নিসার প্রিয় চুলেরকাঁটাগুলোর একটা এবং সেদিন সকালের দিকে দেওয়ানী আমের রাজকীয় সিংহাসনের একপাশের দেয়ালে স্থাপিত জালি অন্তঃপটের পেছনে অবস্থানের সময় এটা তার চুলে ছিল যখন লাহোরের শাসনকর্তার কাছ থেকে আগত প্রতিনিধি সেখানকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা উন্নতির লক্ষ্যে গৃহীত কার্যক্রমের অগ্রগতির প্রতিবেদন পেশ করছিলেন। কাঁটাটা নিশ্চয়ই তখন তার অজান্তে চুল থেকে খুলে মাটিতে পড়েছিল কিন্তু সাল্লা নিশ্চয়ই মামুলি একটা চুলেরকটা খুঁজে পাওয়ার কথা জানাবার জন্য তাকে বিরক্ত করতে আসে নি?

‘জালির পেছনে আপনার আসনের উপর কাঁটাটা পড়েছিল,’ সাল্লা বলতে থাকে। আমি যখন আমার চাদর যা আমি সেখানে ফেলে এসেছিলাম আনবার জন্য গিয়ে আমি এটা খুঁজে পাই, কিন্তু আমি যখন সেখানে ছিলাম তখন আমি আড়াল থেকে হঠাৎ কিছু শুনতে পেয়েছি…’

সাল্লাকে ভীষণ বিব্রত দেখালে মেহেরুন্নিসা নিজের অজান্তে তার হাত চেপে ধরে। আমায় বল তুমি কি শুনেছো।’ তাঁর ব্যক্তিগত পরিচারিকাকে কি এত বিব্রত করেছে জানবার জন্য সে নিজেও যদিও ভীষণ উদ্গ্রীব তারপরেও সে তার কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখে।

‘ইংরেজ দূতমহাশয় আর তার কর্চি। অমাত্যরা সবাই সম্রাটের সাথে হাতির লড়াই দেখতে গিয়েছিল বলে তারা তখন দেওয়ানী আমে একাই ছিল। দূতমহাশয়কে আমি তাঁর কচিকে বলতে শুনেছি যে খোলাখুলি কথা বলা এখনকার মত তাঁদের জন্য নিরাপদ। আমি কৌতূহলী হয়ে উঠি আর তাই অপেক্ষা করি–আপনি জানেন যে আমি তাঁদের ভাষায় পারদর্শী। দূতমহাশয় বেদীর পাশে বেলেপাথরের স্তম্ভগুলোর একটার গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল আর কর্চি সম্রাটের বেদীর প্রান্তে বসেছিল।

মেহেরুন্নিসার ভ্রু কুঁচকে ওঠে। সম্রাটের বেদীর উপর উপবেশন করাটা আদবকায়দার একটা প্রায় অচিন্তনীয় লঙ্ন কিন্তু দুই ভিনদেশী নিশ্চিতভাবেই ভেবেছিলেন তাঁদের কেউ দেখছে না। বলতে থাকো।

‘দূতমহাশয় বলেন যে তিনি ইংল্যাণ্ডে প্রেরণের জন্য একটা চিঠি মুসাবিদা করতে চান। তিনি বলেন তার প্রভুর সম্রাটের বিষয়ে সত্যি কথাটা জানবার সময় হয়েছে–যে তিনি কেবল গর্বোদ্ধতই না সেই সাথে সম্পূর্ণভাবে একজন রমণীর বশীভূত। তিনি বলেন–আমায় মার্জনা করবেন, মালকিন– যে তার দেশে আপনার মত রমণীকে লজ্জা দেয়ার জন্য ঘোড়ার লাগাম পরিয়ে রাখা হত।’

‘সে আর কি বলেছে?’ ক্রোধে মেহেরুন্নিসার কণ্ঠস্বর কেঁপে যায়।

‘আমি জানি না… আমি সাথে সাথে আপনাকে খুঁজে বের করার জন্য সেখান থেকে চলে আসি। আমি কি কোনো ভুল করেছি?

‘তুমি ঠিক কাজই করেছে। আমার সাথে এসো। দূতমহাশয় যদি এখনও সেখানে থাকে তাহলে তারা কি আলোচনা করছে বোঝার জন্য তোমার সাহায্য আমার প্রয়োজন হবে। সে যদিও ইংরেজি ভাষাটা আয়ত্ত করার জন্য বেশ পরিশ্রম করছে–এমনকি, সাল্লার সাহায্যে, শেকসপিয়ার নামে জনৈক ইংলিশ কবির রচিত চতুর্দশপদী কবিতা পাঠ করলেও যা রো জাহাঙ্গীরকে উপহার দিয়েছিল–মেহেরুন্নিসা খুব ভালো করেই জানে ভাষাটার উপরে তাঁর দখল এখনও সাল্লার চেয়ে অনেক দুর্বল।

মেহেরুন্নিসার আবাসন এলাকা থেকে দুই রমণী দ্রুত হাঁটতে আরম্ভ করে এবং জালির পেছনের ছোট অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষটার সাথে সংযোগকারী সংকীর্ণ গলিপথ অনুসরণ করে এগিয়ে সামনের দিকে যায়। মেহেরুন্নিসা কয়েক মিনিট পরেই সাল্লাকে পেছনে নিয়ে সন্তর্পণে কক্ষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। গোলাপি বর্ণের রেশমের কাপড় দিয়ে আচ্ছাদিত একটা তেপায়ায় উপবিষ্ট হয়ে, মেহেরুন্নিসা সামনের দিকে ঝুঁকে এসে বেলেপাথরের তৈরি জালিতে খোদাই করা তারকাকৃতি গহ্বরের একটার ভিতর দিয়ে একাগ্রচিত্তে তাকায়। রো, লাল স্যাটিনের আঁটসাঁট কোট পরিহিত একটা লম্বা আর কৃশকায় কাঠামো, সাল্লা যেমন বর্ণনা করেছে, একটা স্তম্ভের গায়ে হেলান দিয়ে, ঠিক সেভাবেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিকোলাস ব্যালেনটাইনের সোনালী চুলভর্তি মাথাটা একটা কাগজের উপর ঝুঁকে রয়েছে যার উপরে সে এই মাত্র বালি ছিটিয়েছে। তারমানে, শ্রুতলিপি দেয়ার পর্ব সমাপ্ত হয়েছে। মেহেরুন্নিসা যারপরনাই হতাশ হয়ে পেছনের দিকে হেলান দিয়ে বসে। তারপরেই সে রো’কে বলতে শুনে, ‘আমাকে লেখাটা আবার পড়ে শোনাও বলা যায় না তুমি হয়তো কিছু লিখতে ভুলে গেছ।

‘মহামান্য সম্রাট, ব্যালেনটাইন শুরু করে, অনুচ্চ স্বরে পড়লেও সাল্লার জন্য সেটাই যথেষ্ট কোনো অপরিচিত শব্দের অর্থ মেহেরুন্নিসাকে ফিসফিস করে বলার জন্য। মোগল দরবারে আমার আগমনের পরে আঠার মাসাধিককাল অতিবাহিত হয়েছে। সম্রাট নিজেকে যে বিপুল বিলাসিতার মাঝে নিম্মজিত করে রাখেন সে বিষয়ে অতীতে বহুবার আমি লিখেছি কিন্তু তিনি গত সপ্তাহেই প্রথম আমার খাতিরে তার ভূগর্ভস্থ কোষাগারের একটা পরিদর্শনের জন্য আমায় নিমন্ত্রণ জানান। আমি সেখানে যা দেখেছি তা ভাষায় প্রকাশ করার জন্য শব্দ খুঁজে পাওয়া কঠিণ–মোমের আলোয় আলোকিত কুঠরিতে পান্না আর রুবি স্তপ হয়ে রয়েছে যার একেকটার আকৃতি আখরোটের চেয়ে বড়, রেশমের গাঁটের সাথে একটা সমুদ্র থেকে যতটা আহরণ করা সম্ভব বলে আপনি মনে করেন তারচেয়েও অধিক পরিমাণ মুক্তা সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এবং সেই সাথে সূর্যের দীপ্তি ম্লান করে দেয় এমন সব হীরকখণ্ড। আমি অবশ্য নিজের বিস্ময়বিহ্বলতা প্রকাশ না করে এমন ভঙ্গিতে মৃদু মাথা নাড়ি যেন ঐশ্বর্যের এমন বিভার সাথে আমি পরিচিত। কিন্তু সত্যি বলতে, জাহাপনা, সম্রাটের প্রিয় ঘোড়া, হাতি আর শিকারী চিতারও এমন কি আমাদের রাজকীয় খাজাঞ্জিখানার চেয়েও বেশি দামি রত্ন রয়েছে, এবং সবকিছুই সোনার উপর বসান।

‘সম্রাটের কাছে, যে নিজেকে, নিজের সাম্রাজ্যকে আর নিজের রাজবংশকে নিয়ে লুসিফারেরমত গর্বিত, এই চোখ ধাধন ঐশ্বর্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি নিজের প্রাচুর্য্য প্রদর্শন করতে পছন্দ করেন এবং আরেকটা বিষয় জানাতে আমার নিজেরই কষ্ট হচ্ছে যে সম্প্রতি তাঁর এই গর্ব নতুন মাত্রা লাভ করেছে। আমি আপনাকে ইতিমধ্যেই জানিয়েছি কীভাবে মানুষ আর জীবজন্তুর প্রতিকৃতির ব্যাপারে মোল্লাদের নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে–আমাকে বলা হয়েছে তার আগে তাঁর আব্বাজানও তাই করেছিলেন তিনি আপনি তাকে আপনার নিজের যে প্রতিকৃতি পাঠিয়েছিলেন সেটা কতটা পছন্দ করেছেন। তিনি তাঁর নিজের প্রতিরূপ অঙ্কন করিয়েছেন। প্রতিকৃতিটা নিয়ে তিনি ভীষণ সন্তুষ্ট যেখানে জনৈক চিত্রকর–বিসি নামে এক লোক–তাকে আমাদের ধর্মীয় পর্বে ব্যবহৃত পানপাত্রের মত দেখতে রত্নখচিত একটা পাত্রে উপবিষ্ট অবস্থায় তাকে অঙ্কন করেছে যেখানে তাঁর মাথার চারপাশে রয়েছে একটা সোনালী জ্যোতিশ্চক্র। তিনি একজন মোল্লাকে একটা কিতাব দান করছেন, জাঁহাপনা, চিত্রকর্মটায় পারস্যের শাহ আর তুরস্কের সুলতানের সাথে আপনাকেও ইচ্ছাকৃতভাবে এককোণে ক্ষুদ্র আর তুচ্ছভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। সম্রাট এই চিত্রকর্মে নিজের ঔদ্ধত্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে নিজেকে পৃথিবীর অধিশ্বর বলে দাবি করেছেন।’

মেহেরুন্নিসা তেপায়ার উপরে দেহের ভর পরিবর্তন করে। রো’র এতবড় স্পর্ধা জাহাঙ্গীর সম্বন্ধে এতটা তাচ্ছিল্য আর পৃষ্ঠপোষকতার ভান করে কথা বলছে? কিন্তু পরিচারক তখনও পড়ছে এবং সে পুনরায় তাঁর মনোযোগ পরিচারকের উপরে নিবদ্ধ করে। প্রতিটা শব্দ, তাঁদের অর্থের সূক্ষতম দ্যোতনা বোঝার চেষ্টা করাটা তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

‘মহামান্য জাঁহাপনা এই চিত্রকর্মটায় আপনাকে ইচ্ছাকৃতভাবে অপমান করা হয়েছে, যদিও সম্রাট যখন আমাকে এটা দেখান আমি তাকে কেবল এটাই বলেছি যে চিত্রকর তার প্রতিমূর্তি প্রায় জীবন্ত করে ফুটিয়ে তুলেছে এবং প্রতিকৃতির একত্রীকরণের বিন্যাস নিয়ে কোনো মন্তব্য করা থেকে নিজেকে বিরত রাখি। সম্রাট নিজেকে নিয়ে এতটাই আত্মগর্বে ভুগছিলেন যে তিনি আমার শীতল আবেগহীন উত্তর খেয়ালই করেননি, আমি জানতাম তিনি করবেন না। আমি বস্তুতপক্ষে তাঁর সাথে এতটাই সময় অতিবাহিত করেছি–তিনি আমার সঙ্গ পছন্দ করেন আর আমাকে প্রশ্ন করার বিষয়ে তাঁর কোনো ক্লান্তি নেই–যে তাঁর চরিত্র পর্যালোচনা করার একটা চমৎকার সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। আমার মনে হয় যে এখন সময় হয়েছে যখন আমার উচিত তার মানসিক প্রকৃতি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা যাতে করে জাঁহাপনা আপনি যেন বুঝতে পারেন কেন, তুলা, নীল আর সুগন্ধি দ্রব্যের বাণিজ্যে সম্রাট যদিও আমাদের সামান্য কিছু ছাড় দিয়েছেন তারপরেও আরবে হজ্জ্বযাত্রী পরিবহণে ইংরেজ জাহাজগুলোকে অনুমতি দেয়ার ক্ষেত্রে আমাকে এখনও কেন কোনো স্পষ্ট উত্তর দেন নি–আপনার সাথে শেষ যোগাযোগের সময় থেকে আমি জানি যে বিষয়টা আপনার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দেবার উপক্রম করেছে।

‘সম্রাট জাহাঙ্গীর জটিল চরিত্রের অধিকারী একজন মানুষ যার মাঝে আমি অসংখ্য স্ববিরোধিতা লক্ষ্য করেছি। তিনি কখনও নিঃস্বার্থ, দয়ালু পরোপকারী এবং জাদুকরী ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাঁর একটা ক্রিয়াশীল মন রয়েছে, আর অকপটে নিজের ভাবনার কথা অন্যের কাছে প্রকাশ করেন এবং পার্থিব জগত পর্যবেক্ষণে তাঁর অসীম উৎসাহ। সম্প্রতি গ্রামবাসী এক প্রজা যখন খবর নিয়ে আসে যে আকাশ থেকে একটা অতিকায় প্রায় ভষ্মীভূত উল্কাপিণ্ড আগ্রার অনতিদূরে একটা টিলার পাশে এসে আছড়ে পড়েছে, তিনি সাথে সাথে উত্তপ্ত অবস্থায় সেটাকে খুড়ে বের করার আদেশ দেন এবং সেটা থেকে আহরিত গলিত ধাতু দিয়ে তরবারি তৈরি করে সেটার শক্তি পরখ করে দেখার আদেশ দেন। তিনিই আবার সিংহের অন্ত্র পরীক্ষা করে প্রাণীটার সাহসিকতার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় কিনা দেখার জন্য বাদশাহী সনদবলে লোক নিযুক্ত করেন।

‘সম্রাট অবশ্য একই সাথে আবেগপ্রবণ, অস্থির আর মাত্রাতিরিক্ত বদরাগী। তিনি যদিও বেশিরভাগ বিষয়েই সহনশীল, যার ভিতরে ধর্মের বিষয়টাও রয়েছে–যদিও আমার কাছে প্রায়শই মনে হয় যে তিনি নিজে এটা সামান্যই বিশ্বাস করেন–এই তিনিই আবার ক্ষেত্র বিশেষে অদ্ভূতধরনের নিষ্ঠুর। তিনি বাহ্যিক আড়ম্বরের গুরুত্বের প্রতি সবসময়েই আস্থাশীল, নির্যাতন আর মৃত্যুদণ্ডের মত বিষয়কেও একটা জমকালো প্রদর্শনীতে পরিণত করতে সক্ষম। তিনি মনে হয় কখনো-সখনো মানুষকে হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট হতে বা জীবন্ত অবস্থায় চামড়া ছাড়ানো দেখতে পছন্দই করেন। তিনি বলেন এগুলো এমন শাস্তি যা সবসময়ে অপরাধের পরিমাপ অনুযায়ী দেয়া হয়। আমার মনে সন্দেহ নেই যে কথাটা সত্যি–অথবা যে তাঁরা শাস্তির উপযুক্ত–কিন্তু তাকিয়ে দেখার সময় আমার পাকস্থলী কেমন যেন মোচড়াতে থাকে। সম্রাট পক্ষান্তরে শাস্তি প্রদানের এইসব পদ্ধতি খুব কাছ থেকে এমনভাবে পর্যবেক্ষণ করেন যেন সেগুলো কোনো অ্যালকেমিস্টের কোনো গবেষণা, চামড়া ছাড়াবার পরে বা শূলবিদ্ধ অবস্থায় একজন মানুষের দেহ থেকে প্রাণ বায়ু বের কতক্ষণ সময় লাগে বা তাদের দেহের আভ্যন্তরীণ কার্যপ্রণালীর কতটা এইসব নির্যাতনের ফলে প্রকাশ পেয়েছে সবকিছু লিপিবদ্ধ করেন।

‘জাহাপনা, আমার কাছে কিন্তু এর চেয়েও মারাত্মক বলে যেটা মনে হয়েছে, সম্রাট একজন মহিলার দ্বারা নিজেকে পরিচালিত করার বিষয়টা অনুমোদন করেছেন। এই মেহেরুন্নিসা, যার সম্বন্ধে আমি আপনাকে আগেই অবহিত করেছি, আমি নিশ্চিত, সম্রাট আর তার শাসিত সাম্রাজ্যের উপরে তার মারাত্মক প্রভাব রয়েছে। সম্রাটের দরবারে এটা সর্বজনবিদিত যে তিনি ক্ষমতার জন্য লালায়িত এবং সবাই এটাও জানে যে তিনি তাঁর স্বামীর সুরা আর আফিমের নেশাকে উৎসাহিত করেন ক্ষমতা প্রদানের ব্যাপারে তাকে আগ্রহী করতে। তাঁর গুরুত্ব যেকোনো অমাত্য–এমনকি সম্রাটের যিনি উজির তার চেয়েও অনেক বেশি। আমি অবশ্য তাকে উপঢৌকন আর প্রশংসাসূচক বার্তা প্রেরণের বিষয়টা খেয়াল করলেও আমি দরবারে কানাঘুষো যা শুনেছি তাতে একটা বিষয়ে আমি নিশ্চিত যে তিনি আমাদের বন্ধু নন। ইংরেজ জাহাজগুলোকে হজ্জ্বযাত্রী পরিবহনের অনুমতি প্রদানের বিষয়ে সম্রাটকে আমি তাঁর অনুমতি প্রদানের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে প্রতিবারই তিনি হাসি মুখে আমায় ধৈর্য ধারণ করতে বলেন। আমার ধারণা এই দীর্ঘসূত্রতার পিছনে সম্রাজ্ঞীর কোনো হাত রয়েছে। অমাত্যরা আমায় বলেছে যে, তিনি নিজে পার্সী বংশোদ্ভূত হলেও, মহিলা সব বিদেশীদের অবিশ্বাস করেন এবং আমাদের উদ্দেশ্যের বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন, তাঁর নিজের মতই সবাইকে স্বার্থান্বেষী মনে করেন, আমার বিশ্বাস। তিনি সেজন্যই, তাঁর সম্রাট স্বামীর কানে ফিসফিস করে পরামর্শ দেন, আমাদের সবাইকে একে অপরের বিরুদ্ধে বিরূপ ভাবাপন্ন করে তুলতে এবং এভাবেই নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি আর সংহত করতে চান। জাহাঙ্গীরের উচিত তাকে এতটা প্রশয় না দিয়ে তাকে তার নিজের অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করা এবং অনধিকার চর্চা থেকে বিরত রাখা।

কিন্তু আমি অবশ্য এখনও আমাদের উদ্দেশ্য অর্জনের বিষয়ে হতাশ হইনি। সম্রাট আমাকে তাঁর বন্ধু হিসাবে বিবেচনা করেন এবং আমি যদি ধৈর্য সংবরন করতে পারি হজ্জ্বযাত্রীদের বিষয়ে আমাদের প্রস্তাব সমর্থনে আমি এখনও হয়তো তাকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হব। আমি আপনাকে পুনরায় চিঠি লিখব যখন জানাবার মত–এবং আমার বিশ্বাস অনুকূল খবর থাকবে।

নিকোলাস ব্যালানটাইন মুখ তুলে কৌতূহলী চোখে তাকায়। দারুণ।’ রো মাথা নাড়ে। সত্যি বলতে কি, অসাধারণ। আমি চাই আজ রাতেই যেন চিঠিটা সুরাটের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করা হয় যাতে করে এক সপ্তাহের ভিতরে ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া পেরিগ্রিনে এটা তুলে দেয়া যায়। আমরা বরং এখন আমার কক্ষের দিকে যাই যেখানে গিয়ে আমি চিঠিটায় আমার মোহর লাগাতে পারবো।’

মেহেরুন্নিসা জালির ভিতর দিয়ে ব্যালেনটাইনকে চিঠিটা ভাঁজ করে সেটা নিজের থলেতে যত্ন করে রাখতে দেখে। দুই ফিরিঙ্গি তারপরে দবরার থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে যায়। নতুন প্রাণশক্তি আর সংকল্প তাকে জারিত করতে তার চেহারা থেকে একটু আগের ক্লান্তিকর অভিব্যক্তি মুছে যায়। রো তার বন্ধু নয় এই বিষয়টা এখন তাঁর কাছে দিনের আলোর মত পরিষ্কার। তার চেয়েও বড় কথা সে তাচ্ছিল্যের সাথে সম্রাট সম্বন্ধে কথা বলেছে। মেহেরুন্নিসা সাল্লাকে পাশে নিয়ে বহুক্ষণ নিথর হয়ে সেখানে নির্বাক ভঙ্গিতে বসে থাকে।

*

‘লাডলি, প্রথম তিনটা পংক্তি আমায় পড়ে শোনাও।’ মেয়েটা পড়তে শুরু করলে মেহেরুন্নিসা ভাবে, তার মেয়ে, এখন দশ বছর বয়স, তার মতই চটপটে হয়েছে। কবিতা যদিও তাঁর অন্যতম প্রিয় বিষয়, সে মনোযোগ দিতে পারে না। রো’র আবাসিক কক্ষে কি চলছে পুরো সময়টা তার মাথায় কেবল এই চিন্তাই ঘুরপাক খেতে থাকে। ফিরিঙ্গিটার উপরে কীভাবে সে তাঁর চরম প্রতিশোধ নেবে এবং বস্তুতপক্ষে, সেটা নেয়াটা যথার্থ হবে কি না এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর প্রচুর সময় অতিবাহিত হয়েছে। তার ক্রোধ প্রশমিত হবার সাথে সাথে সে রো’র চিঠির ব্যাপারে অনেক বেশি যুক্তিগতভাবে চিন্তা করতে পারে। রো, অতীতের যেকোনো দূতের ন্যায়, নিজের নৃপতির কাছে এখানে তার কতটা প্রভাব রয়েছে, মহান লোকদের জীবনের ব্যাপারে কত গভীর তার অন্তদৃষ্টি, তার নিজের দেশের স্বার্থ হাসিলের ক্ষেত্রে সে কত সুন্দরভাবে সবকিছু গুছিয়ে এনেছে, সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে তাঁর ব্যর্থতার জন্য সে দায়ী নয়… সেটাই বোঝাতে চেয়েছে… সে এখন যখন অনেকটাই সুস্থির তখন এসবের জন্য সে রো’র আচরণ খানিকটা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে প্রস্তুত।

সে এরপরেও তার ব্যাপারে রো’র দৃষ্টিভঙ্গি কোনোমতেই উপেক্ষা করতে পারে না। দরবারে বিষয়টা সুবিদিত যে সে ক্ষমতার জন্য লালায়িত, ফিরিঙ্গিটা ঠিক এভাবেই চিঠিতে লিখেছে… কিন্তু দরবারে সে তাঁর বন্ধু আর পরিচিতদের ভিতরে এমন আলোচনা সে উৎসাহিত করছে ব্যাপারটা যদি এমন হয়? পরিস্থিতি ভুল বিশ্লেষণ করায় সে নিজের উপরই বিরক্ত হয়। জাহাঙ্গীরের সাথে রো’র ঘনিষ্ঠতা সে লম্বা একটা সময় ধরে উৎসাহিত করেছে, পুরোটা সময় সে একটা বিষয় খুব ভালো করেই জানতো যে তার স্বামী দূতমহাশয়ের সঙ্গ পছন্দ করেন কিন্তু সেই সাথে তিনি ফিরিঙ্গিটার সাথে যত বেশি সময় অতিবাহিত করবেন দাপ্তরিক বিষয়ের জন্য যা তার কাছে একঘেয়ে মনে হয় তত কম সময় তিনি দিতে পারবেন এবং তাকে দায়িত্ব থেকে খানিকটা মুক্তি দিতে সে আগ্রহী–এবং যোগ্যতার সাথেই সে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম।

সে রোকে কোনোমতেই তাঁর অবস্থান আর সে এখন পর্যন্ত যা কিছু অর্জন করেছে এবং আরো বৃহৎ গৌবর লাভের আকাঙ্খ পোষণ করে এসব কিছু। হীন প্রতিপন্ন করার সুযোগ দিতে চায় না, পারে না। সে এখন যখন বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করছে তখন তার মনে পড়ে মাত্র দু’সপ্তাহ আগে জাহাঙ্গীর যখন তাঁর উজিরকে লাহোর দূর্গের সংস্কার কর্মসূচি সংক্রান্ত নথিপত্র অনুমোদনের জন্য তাঁর কাছে পাঠাতে বলেছিল তখন মাজিদ খানের চেহারায় সে অস্বস্তিকর একটা অভিব্যক্তি লক্ষ্য করেছিল। আরো সম্প্রতি সে হঠাৎ হেরেমে দু’জন বৃদ্ধ মহিলার কথোপকথন শুনে ফেলে– একজন জাহাঙ্গীরের পিতামহের ভগ্নি আর অন্যজন তাঁর আব্বাজানের দূরসম্পকের আত্মীয়সম্পর্কিত বোন–তাঁরা তাঁর পরিবারের প্রভাব নিয়ে খেদ প্রকাশ করছিল। গিয়াস বেগ সাম্রাজ্যের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে, আসফ বেগ আগ্রা দূর্গের সেনাপতি এবং তার কথা কি বলবো…’ সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারে তার’ বলতে আসলে দুই বৃদ্ধা কার কথা বোঝাতে চেয়েছেন।

তাঁর মেজাজ খোশ করতে সাল্লা দীর্ঘ এক ঘন্টা ধরে তার লম্বা চুল আচড়ে বেনী করে দেয় এবং সেই সময়ের ভিতরেই সে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। রোকে যেভাবেই হোক দরবার থেকে বিতাড়িত করতে হবে।

আর আজই সেই রাত যে রাতে তার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হবে কি না সে বুঝতে পারবে। সে সহসা উপলব্ধি করে যে লাডলি কবিতার পংক্তি পাঠ শেষ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চমৎকার। দারুণ হয়েছে।’ মেহেরুন্নিসা হেসে বলে, খানিকটা অপরাধবোধ অনুভব করে যে তাঁর কন্যা কেমন আবৃত্তি করেছে সে বিষয়ে তাঁর কোনো ধারণাই নেই।

*

নিকোলাস ব্যালেনটাইন বিছানায় শুয়ে থাকা তার প্রভুর ঘামে ভেজা আর নগ্ন দেহের দিকে আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে থাকে, তার লালচে মুখ এখন যন্ত্রণায় ফ্যাকাশে হয়ে আছে। আমার পেটের নাড়িভূঁড়িতে মনে হচ্ছে যেন কেউ আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে যদিও গত এক ঘন্টায় আমি ছয়বার পেট খালি করেছি,’ দূতমহাশয় চোখ বন্ধ অবস্থায়, কোঁকাতে কোঁকাতে বলে।

‘এসব কখন থেকে আরম্ভ হয়েছে?

‘রাতের খাবার শেষ করার প্রায় সাথে সাথে।

নিকোলাস ভাবে, লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে আমাশয়, হিন্দুস্তানে আগত বেশিরভাগ বহিরাগত কোনো না কোনো সময় যে রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। গন্ধ নিশ্চিতভাবে সেটাই ইঙ্গিত করছে–রো’র শয্যার নিচে প্রায় উপচে ওঠা পিতলের মূত্রাধার থেকে কামরার ভিতরে জমে থাকা দুর্গন্ধ মাথা ধরিয়ে দেয়। একজন পরিচারককে ডেকে মূত্রাধার খালি করতে আর নতুন আরেকটা দিয়ে যাবার আদেশ করে, নিকোলাস নিজেকে তার প্রভুর আরো কাছে যাবার জন্য নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে, বিছানার দু’পাশ দুই হাতে শক্ত করে ধরে থাকা অবস্থায় বেচারার শীর্ণ বুকটা হাপরের মত উঠানামা করছে যেন সে ভয় পাচ্ছে যেকোনো সময় আবার যন্ত্রণাটা ফিরে আসবে।

‘আমি একজন হেকিমকে ডেকে আনছি।’

নিকোলাস বিশ মিনিট পরে দরবারের একজন হেকিমকে, খয়েরী রঙের পাগড়ি পরিহিত খর্বাকৃতির মোটাসোটা দেখতে একটা লোক নিজের চিকিৎসার অনুসঙ্গ চামড়ার একটা থলেতে বহন করছে, নিয়ে যখন ফিরে আসে, রো তখন একজন পরিচারকের ধরে থাকা পিতলের পিকদানে নাড়িভূড়ি উল্টে আসবে এমন ভঙ্গিতে বমি করছে। তার বমি করা অবশেষে শেষ হয় এবং বিছানায় উল্টে পড়ে হেকিম তখন তার কপালে হাত রাখে তারপরে প্রথমে তার ডান চোখের এবং পরে বামচোখের পাতা তুলে দেখে। দেখি, আমাকে আপনার জিহ্বা দেখান,’ সে তাকে অনুরোধ করে। রো মুখ খুলে জিহ্বার অগ্রভাগ বের করলে, নিকোলাস সেখানে হলদে একটা কিছুর প্রলেপ দেখতে পায়। আরো বের করেন, হেকিম আদেশের সুরে বলে। রো দুর্বলভাবে তাঁর জিহ্বা আরেকটু বাইরে বের করে।

‘আপনি পচা কিছু একটা খেয়েছেন। গরমের সময়ে আপনার অবশ্যই আরো সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।’

‘সম্রাটের আদেশে দূতমহাশয়ের সব খাবারই রাজকীয় রন্ধনশালায় প্রস্তুত করা হয়, নিকোলাস বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে বলে। অনেক যত্ন নিয়ে সেখানে…’।

পচা খাবারের দ্বারাই কেবল এসব লক্ষণের প্রাদুর্ভাব দেখা যাবে। তার দেহ খাদ্যনালীর শুরু আর শেষপ্রান্ত দিয়ে রেচনের মাধ্যমে নিজেকে পরিষ্কার করছে যার কারণে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। নিকোলাস তখনও বিষয়টা পুরোপুরি মানতে পারছে না দেখে চিকিৎসক আরো বলেন, ‘শোন ছোকরা, জিনিষটা যদি বিষ হতো তাহলে এতক্ষণে তোমার প্রভুর ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেতো। অবস্থা যেমন দেখছি তোমায় এটুকু আমি বলতে পারি যদি তিনি চুপচাপ শুয়ে বিশ্রাম নেন, প্রচুর পানি পান করেন আর আগামী কয়েকদিন কেবল টকদই খেয়ে থাকেন যার সাথে তুমি অবশ্যই আফিমের গুলি গুড়ো করে মিশিয়ে দেবে তাহলে তাঁর প্রাণসংশয় হবার মত কোনো কারণ এখনও ঘটেনি। আমি এখন একটা মিশ্রণ প্রস্তুত করবো। আমি কি করছি খুব খেয়াল করে দেখবে তাহলে বুঝতে পারবে তোমায় ঠিক কি করতে হবে। তুমি তাকে দুই চামচ করে প্রতিঘন্টায় খেতে দেবে–এর বেশি নয়–যতক্ষণ না আমাশয় আর সেই সংক্রান্ত অসুস্থতা পুরোপুরি বন্ধ না হয়। সবকিছু বন্ধ হবার পরে আরো তিনদিন যেন সে পানি ছাড়া আর কিছু গ্রহণ না করে। তার শারীরিক অবস্থার যদি কোনো অবনতি হয় তাহলে সাথে সাথে আমায় ডেকে আনতে লোক পাঠাবে।

নিকোলাস মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। হেকিম বিদায় নিতে সে রো’কে পরিষ্কার করতে, বিছানার চাদর বদলে দিতে আর তাকে ভীষণভাবে কাঁপতে দেখে তাঁর জন্য রাতে পরার একটা পোষাক নিয়ে আসবার জন্য একজন পরিচারকদের ডেকে আনে।

‘আমার মনে হয় আমি সম্ভবত এখানে অনেক বেশি দিন অতিবাহিত করেছি,’ রো ঝাঁকিয়ে উঠে বলে। তার নুয়ে পড়া লম্বা গোফ আর গা মুছে দেয়ায় টপটপ করে গড়িয়ে পড়তে থাকা পানির ফোঁটায় শীর্ণকায় লোকটাকে একেবারে বিষণ্ণ, মনমরা দেখায়। সবাই বলে যে এ আবহাওয়া ইউরোপের লোকদের খুব একটা সহ্য হয় না এবং আমাদের ভিতরে খুব কম লোকই রয়েছে যারা পরপর দুটো বর্ষাকাল এখানে বেঁচেবর্তে অতিবাহিত করতে পারবে।’

‘সাহস রাখেন। আপনি এখনও সুস্থই আছেন। পৃথিবীর যেকোনো স্থানে এটা ঘটতে পারতো…এমনকি ইংল্যান্ডেও…এবং আপনি যে উদ্দেশ্যে এখানে এসেছেন সেটা এখনও হাসিল হয়নি।’

‘তোমার কথাই সম্ভবত সত্যি। নিকোলাস, তুমি একটা ভালো ছেলে, তোমাকে ধন্যবাদ। আমি কখনও ভুলবো না তুমি কত যত্ন নিয়ে আমার সেবা করেছে, রো কোনোমতে মুখে একটা দুর্বল হাসি ফুটিয়ে বলে কিন্তু সহসা নতুন করে যন্ত্রণার প্রকোপ শুরু হতে তার মুখের মাংসপেশীতে একটা খিঁচুনি উঠে। আমায় এখন একা থাকতে দাও…’ সে কোনোমতে বলে এবং আরো একবার পিকদানির দিকে এগিয়ে যাবার জন্য বিছানা থেকে নিজেকে টেনে তুলে।

*

‘আমি ভেবেছিলাম সন্ধ্যেটা আপনি স্যার টমাসের সাথে অতিবাহিত করার পরিকল্পনা করেছেন?’ জাহাঙ্গীর তার কক্ষে প্রবেশ করে তাকে চুম্বন করার জন্য ঝুঁকতে মেহেরুন্নিসা তার দিকে তাকিয়ে বলে।

‘সে একটা বার্তা পাঠিয়েছে যে তার শরীরটা ভালো নেই।’

‘খবরটা শুনে খারাপ লাগল। আশা করি তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন। সে মনে মনে গভীর একটা সন্তুষ্টি অনুভব করলেও মেহেরুন্নিসা তার চোখেমুখে আন্তরিক উদ্বেগের একটা অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে। রন্ধনশালার একজন পরিচারককে ঘুষ দিয়ে প্রচুর মশলা দেয়া ভেড়ার মাংসের তৈরি পোলাওয়ে এক টুকরো পঁচা মাংস দেয়াটা মোটেই কঠিন কাজ ছিল না যা রো খুব পছন্দ করে বলে সে জানে। সে কোনো ধরনের অপরাধবোধ অনুভব করে না–তাঁর সম্পর্কে বাজে কথা লেখার জন্য এই দুর্ভোগ তার প্রাপ্য। সে আশা করে মোগল দরবার ত্যাগ করার কথা বিবেচনা করার মত যথেষ্ট পরিমাণে অসুস্থ সে তাকে করতে পেরেছে। সম্ভবত না, কিন্তু দূতমহাশয়কে তাঁর নাড়িভূঁড়ির মাধ্যমে আক্রমণের উপায় খুঁজে পেয়ে সে বারবার এই উপায় ব্যবহার করবে যতক্ষণ না সে তাকে যথেষ্টভাবে দুর্বল করে দিয়ে তাকে দরবার থেকে বিতাড়িত করার তার লক্ষ্য অর্জিত হয়। তাঁর ধৈর্য কম এমন কথা তার শত্রুও বলবে না।

‘আমি এমনিও তোমার সাথে দেখা করতে আসতাম। আমি তোমার সাথে একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী। আমার গুপ্তচরেরা দক্ষিণ থেকে খবর নিয়ে এসেছে যে মালিক আম্বার নতুন করে আবার সৈন্য সংগ্রহ করছে। আমি ভেবেছিলাম আমরা তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়েছি কিন্তু তার ঔদ্ধত্য আর উচ্চাকাঙ্খর–দাক্ষিণাত্যের সেইসব রাজাদের মত যাঁদের পক্ষে সে লড়াই করছে–মনে হয় কোনো সীমা পরিসীমা নেই।’

‘আপনি কি আবারও খুররমকে পাঠাতে চান?

‘আমি সেটাই তোমার সাথে আলোচনা করতে চাই। সে গতবার যুদ্ধে ভালোই পারদর্শীতা প্রদর্শন করেছিল। আমি তাকে আবার পাঠাব সেটাই সে আমার কাছে আশা করবে কিন্তু আমি তাকে আবারও বিপদের মুখে ঠেলে দিতে আগ্রহী নই। আমি তাকে যতই দেখছি ততই একটা বিষয়ে আমি নিশ্চিত হচ্ছি যে আমার উত্তরাধিকারী হিসাবে তার নাম ঘোষণা করার এবং তাকে এখানে নিরাপদে রাখার সময় এসেছে। একটা সাম্রাজ্য কীভাবে পরিচালনা করতে হয় সে বিষয়ে আমার কাছে তাঁর অনেক কিছুই শিক্ষণীয় রয়েছে। আমার স্থলাভিষিক্ত হবার সময় হলে যা তাকে সাহায্য করবে। আমার আব্বাজানও যদি আমার জন্য এভাবে চিন্তা করতেন আর আমি আমার আব্বাজানের ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে চাই না।’

মেহেরুন্নিসা দ্রুত চিন্তা করে। তাঁর সহজাত প্রবৃত্তি তাকে চিৎকার করে বলছে জাহাঙ্গীর আর খুররমকে পরস্পরের এতটা কাছাকাছি আসবার সুযোগ দেয়া তাঁর মোটেই উচিত হবে না। খুররমের যদিও আরজুমান্দের সাথে বিয়ে হয়েছে যার প্রতি সে ভীষণ অনুরক্ত এবং দু’জনের এমন নৈকট্যে তাঁর পরিবারই আখেরে লাভবান হলেও তাঁর নিজের কপালে এরফলে কেবলই দুর্ভোগ লেখা হবে। সে কোনোভাবেই এটা অনুমোদন করতে পারে না, কিন্তু সে কি বলবে? তারপরে তাঁর মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। খুররমকে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে আপনার অনীহার কারণ আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু সে একজন গর্বিত তরুণ আর মালিক আম্বারকে মোকাবেলায় আপনি যদি তাকে পুনরায় প্রেরণ না করেন সে হয়তো অপমানিতবোধ করবে। সে শেষবার মালিক আম্বারকে বন্দি বা হত্যা করতে তার ব্যর্থতার প্রতিদান হিসাবে বিষয়টা বিবেচনা করতে পারে।

‘তো তুমি সত্যিই বিশ্বাস করো আমার তাকে পাঠানো উচিত?

‘হ্যাঁ। তাঁর জন্য, আবিসিনিয়ার অধিবাসীর সাথে বোঝাপড়াটা একটা অসমাপ্ত অধ্যায় আমি তাকে এমনটাই বলতে শুনেছি–এবং অন্য যেকোনো পদক্ষেপ কেবল তার মর্যাদাহানিই ঘটাবে। আর সে যখন ফিরে আসবে–আমি তার ফিরে আসবার ব্যাপারে নিশ্চিত, যদি তার নিজের জীবন ঝুঁকির সম্মুখীন না করার নির্দেশ আপনি তাকে দেন–ইতিমধ্যে তাকে আপনার উত্তরাধিকারী হিসাবে মনোনীত করবার বিষয়ে চিন্তা করার জন্য প্রচুর সময় পাওয়া যাবে। আপনার নিজেরই এখনও এমন কোনো বয়স হয়নি–এহেন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বিবেচনা করার জন্য এখনও আপনার হাতে প্রচুর সময় রয়েছে। আপনার অন্য সন্তানদের কথা আপনার ভুলে যাওয়া উচিত হবে না এবং খুররমের প্রতি আপনি যদি এতটা পক্ষপাত প্রদর্শন করেন তাহলে তাদের মনের অবস্থা কেমন হতে পারে সেটাও একটা ভেবে দেখার বিষয়।’

‘পারভেজ একটা মাথামোটা নির্বোধ আর বেহেড মাতাল। সে নিশ্চয়ই খসরুর চেয়ে বেশি সিংহাসন প্রত্যাশী নয়।

‘কিন্তু শাহরিয়ার। সে দ্রুত বেড়ে উঠছে এবং তাঁর চৌকষ হয়ে উঠার বিষয়ে আমি অনেক উৎসাহব্যঞ্জক কথা শুনতে পাই। সবাই বলে যে সে একজন দক্ষ ঘোড়সওয়ার এবং তীর-ধনুক বা গাঁদাবন্দুক দুটোতেই তাঁর নিশানা কখনও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না।

জাহাঙ্গীর মুচকি হাসে। তুমি দেখছি আমায় লজ্জায় ফেলে দিলে। আমাকে আমার নিজের সন্তানের সম্ভাবনা সম্বন্ধে তোমায় কিছু বলতে হবে না। আমি মানছি শাহরিয়ারের সাথে আমার কালেভদ্রে দেখা হয়।’

‘আপনার দেখা উচিত। আপনি তাহলে নিজেই তাকে যাচাই করতে পারবেন।

জাহাঙ্গীর মনে মনে ভাবে, মেহেরুন্নিসা বরাবরের মত ঠিকই বলেছে। উত্তরাধিকারী ঘোষণা করার জন্য এত তাড়াহুড়ো করার আসলেই কোনো প্রয়োজন নেই। আর সে এটাও ঠিকই বলেছে যে মালিক আম্বারের সাথে বোঝাপড়া করার জন্য তাঁর খুররমকেই সুযোগ দেয়া উচিত।

‘তোমার সহজাত প্রবৃত্তি বরাবরের মত এবারও অভ্রান্ত। তুমি পরিস্থিতি এত পরিষ্কার বিশ্লেষণ করতে পারো।

‘আমি কেবল আপনাকে সাহায্য করতে চাই। আর খুররম তাঁর অভিযানে রওয়ানা দেয়ার পরে আমি একটা ভোজসভার আয়োজন করে শাহরিয়ারকে আমন্ত্রণ জানাব যাতে আপনি নিজের চোখে দেখতে পান সে কত বড় হয়ে উঠেছে। আর সেদিন লাডলিকেও হয়তো আমি আমাদের সাথে যোগ দিতে বলতে পারি। মেয়েরা দ্রুত বড় হয়ে যায় এবং সেও দিনে দিনে রূপবতী আর গুনবতী হয়ে উঠছে। আমার মনে হয় তাঁর সঙ্গ আপনার ভালোই লাগবে।’

‘তবে তাই করো। কিন্তু কাজের কথা অনেক হয়েছে। তুমি আমার মনকে যথারীতি প্রশান্ত করেছে। এবার এসো দেহের উৎসবে আমরা নিজেদের ভাসিয়ে দেই। সে কথা শেষ করার আগেই আলতো করে তার গভীর-গলার কাচুলির কোরালের বোতাম খুলতে আরম্ভ করে এবং তাঁর চোখের তারায় সম্মতির আলো ফুটে উঠতে দেখে মুচকি হাসে। জাহাঙ্গীর কেবল মেহেরুন্নিসার এবং তাঁর জন্য কেবল সে জন্মেছে এবং কোনো কিছু বা কারো তাঁদের মাঝে আসা উচিত হবে না।

 ১.১৩ আবিসিনিয়ার অসুর

‘আমার আব্বাজান আমাদের আরো একবার মালিক আম্বারের মুখোমুখি হতে প্রেরণ করছেন। তার বিরুদ্ধে আমাদের পূর্ববর্তী বিজয়ের পরেও আবিসিনিয়ার এই ভাড়াটে যোদ্ধা পুনরায় আবার মোগল ভূখণ্ডে হানা দেয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছে, খুররম কথা শুরু করে। সে মুক্তার চারটা ছড়া পরিকর হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে এমন দুধসাদা রঙের একটা আলখাল্লায় অনবদ্যভাবে সজ্জিত হয়ে এবং তাঁর একই রঙের পাগড়িতে প্রায় আঙুরের মত বড় একটা দীপ্তিময় মুক্তা শোভিত অবস্থায় আগ্রা দূর্গের ঝরোকা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে নিচে কুচকাওয়াজ ময়দানে ঘন সন্নিবিষ্ট অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা তার সৈন্যদলের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে। বারান্দার পেছনে অবস্থিত কক্ষ থেকে তাকিয়ে দেখার সময়, জাহাঙ্গীর মনে মনে ভাবে এই বয়সে সে কি এতটা আত্মবিশ্বাস আর কর্তৃত্বের সাথে কথা বলতে পারতো। খুররমের কথায়, গমের খেতের উপর দিয়ে বাতাস বয়ে যাবার মত সারিবদ্ধ লোকের ভিতর দিয়ে মনে হয় যেন একটা মৃদু তরঙ্গ বয়ে যায় এবং তারা উল্লাস ধ্বনি করতে আরম্ভ করে।

‘আমরা এইবার মালিক আম্বারের সৈন্যদলকে পরাস্ত করে এবং তাকে আমাদের ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করেই কেবল শান্ত হবো না যেমনটা আমরা তিনবছর আগে করেছিলাম, খুররম তাঁর কথা অব্যাহত রাখে, সে তাঁর ডান হাত উঁচু করে সবাইকে শান্ত থাকতে হুকুম করে। আমরা সেইসাথে দাবি করবো তার প্রভুরা গোলকুণ্ডা, বিজাপুর আর আহমেদনগরের সুলতানেরা যেন তাদের ভূখণ্ডের একটা অংশ আর স্বর্ণমুদ্রা আমাদের হাতে ছেড়ে দেয়। যুদ্ধে অর্জিত লুণ্ঠিত দ্রব্যের পরিমাণ দারুণ হবে এবং আমি নিজে সেটা তোমাদের সবার ভিতরে ভাগ করে দেয়াটা নিশ্চিত করবো। খুররম তার হাত নিচু করে এবং তার লোকদের ভিতর থেকে খুররম জিন্দাবাদ, পাদিশাহ জাহাঙ্গীর জিন্দাবাদ এর সমবেত ঐক্যতান ভেসে আসতে সে মুচকি হাসে। জাহাঙ্গীর ভাবে, তাঁর পূর্বপুরুষ বাবর ঠিকই বলেছিলেন যখন তিনি তাঁর রোজনামচায় লিখেছিলেন যে একটা সৈন্যবাহিনীর সাহসিকতা আর আনুগত্য নিশ্চিত করার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উপায় লাভের সম্ভাবনা তাদের সামনে তুলে ধরা।

নিচে সমবেত লোকদের চিৎকার স্তব্ধ হয়ে পুনরায় নিরবতা বিরাজ করলে, খুররম বলতে থাকে, আজ রাতে, আমাদের চুড়ান্ত প্রস্তুতি যখন সমাপ্ত হলে, আমি আমাদের রাধুনিদের আদেশ দিয়েছি আমাদের জন্য বিশেষ ভোজের আয়োজন করতে যাতে আগামীকাল আমরা যখন আগ্রা দূর্গ থেকে যাত্রা করবো তখন আমরা আমাদের সর্বাত্মক বিজয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী থাকার সাথে সাথে আমাদের সবার পাকস্থলীও যেন খাদ্যে পরিপূর্ণ থাকে।’ খুররম ঘুরে দাঁড়াতে উল্লাসধ্বনির আরেকটা ঝাপটা তাকে আচ্ছন্ন করে, মাখন রঙের পোষাক পরিহিত দু’জন দীর্ঘদেহী দেহরক্ষী যাদের বক্ষাবরনী আর শিরোস্ত্রাণ পালিশ করে আয়নার দীপ্তি আনা হয়েছে তাঁর অনুগামী হয় এবং সে ভেতরে যেখানে তাঁর আব্বাজান অপেক্ষা করছে সেখানে যায়।

‘তুমি দারুণ বলেছে, জাহাঙ্গীর তাকে আলিঙ্গণ করে, বলে।

কারণ আমি চাই আমার লোকেরা যেন জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করে। আমার ভোজসভার ঘোষণা তাদের চূড়ান্ত প্রস্তুতিতে গতির সঞ্চার করবে।

‘মালিক আম্বারের গতিবিধি সম্বন্ধে আজ আমি আরও কিছু তথ্য পেয়েছি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে মানডুর আশে পাশের এলাকায় লুটতরাজের অভিপ্রায়ে সে সমৃদ্ধশালী জায়গিরগুলোতে হানা দিচ্ছে। সে দুটো জেলার কোষাগার আর একটা স্থানীয় অস্ত্রশালাও দখল করেছে।

‘সে তাহলে বেশ ভালো পরিমাণের লুষ্ঠিত দ্রব্য একত্রিত করেছে।

‘হা, কিন্তু সেটা তাঁর অগ্রসর হবার গতি সামান্য হ্রাস করে বিষয়টা হয়তো আমাদের পক্ষেই রাখবে আর তোমার জন্যও সহজ হবে তার নাগাল পাওয়া।’

‘এটাই হবে আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা। আমার সৈন্য সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি এবং তারা অনেক বেশি অস্ত্রে সজ্জিত। আমি যদিও আমার লোকদের অপ্রয়োজনীয় উপকরণ বা মালপত্র বহন করতে নিষেধ করেছি, তারপরেও তার সৈন্যবাহিনী অনেকবেশি দ্রুতগামী আর ক্ষিপ্রগতির। সেইসাথে দাক্ষিণ্যের সীমান্ত তাঁরা আমাদের চেয়ে অনেক ভালো করে চেনে, যা তিনবছর আগে আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম। তারা আবারও পলায়নপর একটা শিকার হিসাবে প্রতিপন্ন হবে…’।

‘কিন্তু সাফল্য অর্জনে তোমার দক্ষতা নিয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই।’

তার ছেলের মনেও যে এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই জাহাঙ্গীর সেটা খুররমের অভিব্যক্তি দেখেই বুঝতে পারে। তপতি নদীর কিনারে বুরহানপুরেই আমি এবারও আমার মূলশিবির স্থাপন করবো। মালিক আম্বারকে ধরতে সেখান থেকেই আমি মানডু অভিমুখে যাত্রা করবো। আমি সেই সাথে তার পশ্চাদপসারণ বন্ধ করার অভিপ্রায়ে দক্ষিণ দিন অবরোধ করতে সৈন্যবাহিনীও প্রেরণ করবো। আমি আমাদের ভূখণ্ড থেকে তাকে তাড়িয়ে বের করার বদলে তাকে দাবড়ে এখানে নিয়ে আসতে চাই যাতে আমরা স্থানীয় এলাকা সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞানের বাড়তি সুবিধা নাকচ করতে পারি। তাকে সেখানে একবার পরাস্ত করতে পারলে–যদি আল্লাহতালা সহায় থাকে আমি পারবো–তার বাহিনীর অবশিষ্টাংশ যখন নিজেদের এলাকা অভিমুখে পশ্চাদপসারণ শুরু করবে তাদের ধ্বংস করার সুন্দর সুযোগ আমি তখন পাবো এবং সেইসাথে মালিক আম্বারকে বন্দি করে তাঁর হুমকি চিরতরে শেষ করতে পারবো।’

‘সতর্ক থাকবে। শত্রু হিসাবে সে ভীষণ ধূর্ত।

‘সে এইবার আমার হাত থেকে পালাতে পারবে না।’

‘আমি জানি, কিন্তু মনে রাখবে তারুণ্যদীপ্ত ব্যগ্রতা আর আত্মবিশ্বাস, যতই যুক্তিযুক্ত মনে হোক, তোমার দক্ষতায় ব্যাঘাত না ঘটায়, তোমায় বিচক্ষণতা তোমায় পরিত্যাগ করে। তোমার সেনাপতিদের সাথে যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করবে। আর নিজে অপ্রয়োজনীয় কোনো ঝুঁকি নিতে যাবে না।

‘আব্বাজান, আমি চেষ্টা করবো আপনার কথা স্মরণ রাখতে।

‘আরজুমান্দ সন্তানসম্ভবা হওয়া সত্ত্বেও তোমার সাথে যাচ্ছে?

‘সে গতবারের মত এবারও যাবার জন্য জেদ করছে। সে আমাদের সন্তানদের কাছ থেকেও আলাদা হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, যদিও আমরা একবার বুরহানপুর পৌঁছাতে পারলে তারা সেখানের দূর্গের নিরাপত্তায় নিরাপদেই থাকবে। আব্বাজান এবার আমায় মার্জনা করবেন। আগামীকাল সকালে যাত্রা করতে হলে এবার আমায় বিদায় নিতেই হবে। বিদায়পূর্ব ভোজসভায় যোগ দেবার আগে আমায় রসদসংক্রান্ত শেষ মুহূর্তের কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

জাহাঙ্গীর তার সন্তানদের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দেয় এবং দু’জন পুনরায় পরস্পরকে আলিঙ্গন করে। আল্লাহতা’লা তোমার সহায় হোন এবং বাছা আমার, বিজয়ীর বেশে তুমি যেন দ্রুত আবার আমার কাছে ফিরে আসো।’ খুররম বিদায় নেয়ার পরে, জাহাঙ্গীর ঝরোকা বারান্দার দিকে ধীরপায়ে এগিয়ে যায়। কুচকাওয়াজ ময়দানে সমবেত সৈন্যরা সেখান থেকে বিদায় নিয়েছে। যমুনা নদীর দিকে তাকিয়ে সে হাতিমহল হাতির একটা সারিকে পান পান করার জন্য মন্থর গতিতে বাদামি পানির দিকে ধীরে ধীরে নামতে দেখে, কিন্তু এছাড়া নদীর তীরে আর কোনোকিছু চলাফেরা করতে দেখা যায় না। পশ্চিম আকাশে বেগুনী আর লালচে আভার ছড়িয়ে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। একজন মোগল সম্রাট কতবার এখানে দাঁড়িয়ে এমন একটা দৃশ্য উপভোগ করার সুযোগ লাভ করেছেন? জাহাঙ্গীর একমুহূর্তের জন্য কল্পনা করে তাঁর পূর্বপুরুষেরা–এশিয়ার তৃণাঞ্চল থেকে আগত যোদ্ধা বাবর, জ্যোতিষী হুমায়ুন, তার আব্বাজান মহামতি আকবর, নিজের প্রজাদের কাছে ভীষণ শ্রদ্ধেয়–তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তারা একটা প্রাচীন বংশ, তৈমূরের পূর্বেও লড়াকু যোদ্ধা চেঙ্গিস খান অব্দি তাদের বংশ বিস্তৃত… বংশচিন্তা চিন্তা মাথায় আসতে গর্বে তাঁর বুক ফুলে উঠে, এবং খুররমের মত একজন যোগ্য আর অনুগত সন্তানের পিতা হতে পেরে সে নিজেকে আরো গর্বিত মনে করে, যে তাঁর পূর্বপুরুষেরা যে সাম্রাজ্য স্থাপনের জন্য রক্তপাত করেছিল সেটা রক্ষা করতে মোগল বাহিনী নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করবে।

*

‘যুবরাজ, দাক্ষিণাত্যের সূর্যের খরতাপে কাপড়ের লাল নিয়ন্ত্রক তাবুর নিচে খুররম একটা ছোট নিচু ডিভানের উপর তাঁর বয়োজ্যষ্ঠ সেনাপতিদের দ্বারা পরিবেষ্টত অবস্থায় বসে থাকার সময় কামরান ইকবাল তাঁর বক্তব্য শুরু করে। আমরা মানডুর চারপাশের এলাকা মুক্ত করার পর থেকেই মালিক আম্বারের লোকেরা আমরা অগ্রসর হবার পূর্বেই পশ্চাদপসারণ করছে। তারা এখনও বারি নদীর গতিপথ অনুসরণ করছে, তারা নদীর পশ্চিম তীর ধরে দক্ষিণে অগ্রসর হচ্ছে। তারা এই মুহূর্তে তাঁদের নিজেদের এলাকা থেকে বিশ মাইল দূরে অবস্থান করছে।

‘বেশ। তার মানে বুরহানপুর থেকে আমরা আমাদের অভিযান শুরু করার পর আমরা কিছুটা হলেও সাফল্য লাভ করেছি, কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়… আমাদের দুটো এলাকার ভিতরে বিভাজন চিহ্নিতকারী উঁচু পাহাড়ের সারি আর তাদের ভিতরে আমাদের কোনো সৈন্যবাহিনী কি অবস্থান করছে?

না, যুবরাজ। গুপ্তদূতদের সামান্য কয়েকটা দল কেবল রয়েছে যাদের পক্ষে প্রলম্বিত যুদ্ধ পরিচালনা করা সম্ভব নয়।

‘আমারও তাই মনে হয়। মালিক আম্বার আবারও সুকৌশলে আমাদের ফাঁকি দিয়েছে। আমাদের সর্বাত্মক প্রয়াস সত্ত্বেও আমরা কখনও তাঁর অবস্থানের আর সীমান্তের মাঝামাঝি স্থানে আমাদের বাহিনী পর্যাপ্ত সংখ্যায় সমবেত করতে ব্যর্থ হয়ে তাকে আমাদের পছন্দের এলাকায় যুদ্ধ করতে বাধ্য করতে পারিনি। আমাদের প্রতিটা চাল যেন সে আগেই টের পেয়ে যায়।’

‘কিন্তু আমরা তাঁর লোকদের সাথে যতগুলো খণ্ডযুদ্ধে অবর্তীণ হয়েছি তাঁর প্রতিটাই আমরাই বিজয়ী হয়েছি এবং আমরা তাকে নতুন লুটতরাজের সম্ভাব্য সব স্থান থেকে দূরে রেখেছি–আমরা এমনকি তার আগে লুট করা কিছু সম্পদ উদ্ধারও করেছি, কামরান ইকবাল কথাটা বলে তার কণ্ঠে খানিকটা বুঝি গর্বেরও আভাস পাওয়া যায়, এসময় বেশ কয়েকজন আধিকারিক প্রবলবেগে মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করে।

সত্যি কথা, কিন্তু আমি তার হুমকি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে আরও বেশি কিছু করতে আগ্রহী। আমার এখন ভয় হচ্ছে যে আগামী দুই একদিনের ভিতরে সে তার পরিচিত পাহাড়ী এলাকায় পৌঁছে যাবে এবং সেখানে ফলাফল নির্ধারণী যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া প্রায় অসম্ভব, খুররম কথাগুলো বলার সময় নিজের হতাশা কণ্ঠে ফুটে উঠা থেকে লুকিয়ে রাখতে গিয়েও ব্যর্থ হয়। তার মাঝে মাঝে মনে হয় যে মালিক আম্বারের বোধহয় তার জ্যেষ্ঠ আধিকারিকদের ভেতর কোনো গুপ্তচর রয়েছে, গতকাল সন্ধ্যাবেলায় সে তার তাবুতে আরজুমান্দকে বিষয়টা নিয়ে রীতিমত অভিযোগ করেছে।

‘কিন্তু যদি তাই হবে তাহলে সে কেবল পশ্চাদপসারণ না করে আপনাকে অতর্কিত আক্রমণ করে পরাস্ত করার একটা সুযোগ কি খুঁজে পেতো না? সে পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন করে। তার অর্ধাঙ্গিনী হয়ত ঠিকই বলেছে, সে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করে।

‘যুবরাজ, আমাদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গুপ্তদূতদের একজন আমায় বলেছে যে মালিক আম্বারের বর্তমান অবস্থান থেকে প্রায় দশ মাইলের দূরে নদী সহসা পশ্চিমে তীক্ষ্ণ একটা বাঁক নিয়েছে। কামরান ইকবাল খুররমের তন্ময় ভাবনার ঘোর ছিন্ন করে বলে। আমরা কি তাকে নদীর বাঁকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করতে পারি না?’

‘চেষ্টা করা যায়, কিন্তু সেটা বাঁকের কাছে ভূমির গঠন প্রকৃতির উপর নির্ভর করছে। এলাকাটা নিশ্চয়ই জলাভূমি নয়, তাই কি?

‘না। জায়গাটায় বেশকিছু বালুচর রয়েছে যার হয়ত প্রতিরক্ষা সহায়ক হিসাবে প্রতীয়মান হতে পারে কিন্তু সেগুলো বেশ নিচু আর আপাতদৃষ্টিতে সেখানে খুব বেশি সংখ্যক বালুচরও নেই।’

‘তাহলে সম্ভবত ঝুঁকিটা নেয়া যায়, খুররম বলে, তার উদ্দীপনা বাড়তে শুরু করেছে। মালিক আম্বার সেখানে কখন পৌঁছাতে পারে?

‘আগামী কাল সকাল দশটা নাগাদ–সে যদি রাতের বেলা নয় ঘন্টা শিবির স্থাপনের তাঁর চিরাচরিত রীতি অনুসরণ করে।

‘বেশ, তাহলে তাকে আমরা সেখানেই আক্রমণ করবো। আমাদের আক্রমণের প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ করার মত কাছাকাছি আসা থেকে মালিক আম্বারের গুপ্তদূতদের বিরত রাখতে আমাদের শিবির থেকে দূরবর্তী পাহারার স্থানগুলোয় লোক সংখ্যা দ্বিগুণের দ্বিগুণ বৃদ্ধি কর। অন্ধকার নামার পর নিরাপত্তা জোরদার করতে আমরা প্রহরীর সংখ্যা বাড়িয়ে দেব।

*

খুররম পরের দিন সকালে নদীর বাঁকে মালিক আম্বারের অবস্থানের দিকে বালুময় ভূমির উপর দিয়ে ঘোড়া দাবড়ে এগিয়ে যাবার সময় ভয় আর উত্তেজনার একটা মিশ্র অনুভূতি সে টের পায় যা যুদ্ধের আগমুহূর্তে অন্যসব অনুভূতি মুছে গিয়ে সে সবসময়ে অনুভব করে। গতরাতে তাঁদের যুদ্ধ প্রস্তুতি আপাতদৃষ্টিতে তাদের শত্রুর অগোচরে সম্পন্ন হয়েছে কিন্তু তাঁর রণহস্তীর একটা অগ্রবর্তী দল নদীর বাঁকে অতর্কিত হামলার জন্য নির্ধারিত স্থান অভিমুখে দশ মাইল পথের মাত্র অর্ধেক দূরত্ব অতিক্রম করার পরেই মালিক আম্বারের গুপ্তদূতদের একটা দলের মুখোমুখি পড়ে যায়। হাওদায় অবস্থানরত তবকিরা যদিও তিনজনকে গুলি করে ধরাশায়ী করেছে কিন্তু অন্ততপক্ষে দু’জন মালিক আম্বারের সৈন্যসারি অভিমুখে অক্ষত অবস্থায় ঘোড়া হাঁকিয়ে পালিয়ে গিয়েছে, তার মানে সে তাঁদের আক্রমণের প্রায় এক ঘন্টা পূর্বেই হুশিয়ার হয়ে যাবে। খুররম ভাবে, কেবলমাত্র অশ্বারোহী বাহিনীর উপর পুরোপুরি নির্ভর না করে সে হয়ত ভুলই করেছে, কিন্তু সেক্ষেত্রে সে তার হাতির হাওদায় স্থাপিত ছোট কামানের গোলাবর্ষণের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতো, তার অশ্বারোহী বাহিনীর সামান্য পিছনে অবস্থান করে দুর্বহ-দর্শন অতিকায় প্রাণীগুলোর পক্ষে বিস্ময়কর দ্রুততায় যারা আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।

গুপ্তদূতেরা তাঁদের হুশিয়ার করার পরের অব্যবহিত সময়ে, মালিক আম্বারের তোপচিরা সম্ভবত তাঁদের ছয়টা কামান বালুচরের পেছনে সুবিধাজনক স্থানে মোতায়েন করতে পারবে, যা খুররম যেমনটা ধারণা করেছিল তারচেয়ে সামান্য নিচু হলেও সংখ্যায় মনে হয় অগণিত। তাঁদের প্রথম গোলাটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়, বালুমাটির বুকে ভোঁতা শব্দ করে নিরীহ ভঙ্গিতে আছড়ে পড়ে। এখন অবশ্য মোগল অশ্বারোহীদের অগ্রবর্তী দলের ভেতরে কামান থেকে নিক্ষিপ্ত দ্বিতীয় দফার দুটো গোলা কাছাকাছি একসাথে পতিত হয়।

খুররম, নিজে অশ্বারোহী বাহিনীর দ্বিতীয় দলটার সাথে অবস্থান করছিল যুদ্ধ পরিস্থিতি ভালো করে দেখতে আর যুদ্ধ পরিচালনার স্বার্থে, তাঁর অগ্রবর্তী দু’জন অশ্বারোহী যোদ্ধার ঘোড়া মাটিতে আছড়ে পড়তে দেখে, তাঁদের আরোহীরা ঘোড়ার মাথার উপর দিয়ে সামনের দিকে ছিটকে যায়। অন্য ঘোড়াগুলো যার ভেতরে মোগল ঝাণ্ডা বহনকারী একটা ঘোড়াও রয়েছে মাটিতে পড়ে থাকা দেহগুলোতে হোঁচট খায় এবং তাঁরাও নিষ্ফল ভঙ্গিতে বাতাসে পা আন্দোলিত করতে করতে ভূপাতিত হয়। সবুজ রঙের লম্বা ঝাণ্ডাটা বাহকের হাত থেকে ছিটকে গিয়ে বাতাসে মালিক আম্বারের সৈন্যসারির দিকে কয়েক গজ গড়িয়ে গিয়ে বালুচরের একপাশে জন্মানো একটা ছোট কাঁটাঝোঁপের সাথে জড়িয়ে যায়।

মালিক আম্বারের তোপচিরা দারুণ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আর নিয়মনিষ্ঠ। প্রতি মুহূর্তে আরো অধিক সংখ্যক কামানের গর্জন ভেসে আসতে থাকে আর সেই সাথে আরো সংখ্যায় অশ্বারোহী যোদ্ধা পর্যাণ থেকে মাটিতে ছিটকে পড়ে। দুটো ঘোড়া, একটার সামনের বামপায়ের বেশ কিছুটা অংশ উড়ে গিয়েছে এবং দুটোই সওয়ারীবিহীন অবস্থায় যন্ত্রণায় চিঁহি রব করে, কামানের আওতা থেকে সরে এসে অন্যান্য মোগল অশ্বারোহীদের পথে বাধার সৃষ্টি করে। ঘোড়া দুটো এমন আচরণ করার সাথে সাথে মোগল অশ্বারোহীর প্রথম আক্রমণ তাঁর সমস্ত প্রাণোন্মাদনা হারিয়ে ফেলতে আরম্ভ করে। অচিরেই অশ্বারোহীদের আক্রমণের দ্বিতীয় ঝপটার সামনের দিকের যোদ্ধারা আর খুররম অশ্বারোহীদের প্রথম দলটার অবশিষ্ট যোদ্ধাদের সাথে মিশে যায়। প্রাণোন্মাদনা

‘ফিরে এসো! আমাদের সাথে আক্রমণ করো!’ খুররম কতিপয় ভগ্নমনোরথ অশ্বারোহীদের প্রতি যুদ্ধের হট্টগোলের মাঝে তার পক্ষে যতটা জোরে সম্ভব চিৎকার করে বলে। বামে নিচু বালিয়াড়ির পেছনে সবচেয়ে কাছের কামানগুলোকে আক্রমণ করো। দূরত্ব অনেক কম থাকায়–আমরা তাদের কাছে পৌঁছাবার পূর্বে তাঁরা যথেষ্ট দ্রুততার সাথে কামানগুলোকে গোলাবর্ষণের উপযোগী করতে না পারায় একবারের বেশি গোলাবর্ষণ করতে পারবে না।’ খুররম, তাঁর ঘোড়ার গলার কাছে মাথা নুইয়ে এনে তরবারি ধরা ডানহাত সামনের দিকে প্রসারিত করে, তাঁর বাহন বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে নিয়ে মালিক আম্বারের সৈন্যসারির কেন্দ্রে নিচু বালিয়াড়ির দিকে সরাসরি তাঁদের সাথে নিয়ে এগিয়ে যায় যার পেছনে দুটো কামানের নল মুখব্যাদান করে রয়েছে।

সে অর্ধেক পথ অতিক্রম করার আগেই, সে বিকট একটা বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনতে পায় প্রায় সাথে সাথেই দ্বিতীয় আরেকটা গর্জন ভেসে আসে এবং তার চারপাশে কাঁকড় আর বালির সাথে ধাতুর টুকরো বৃষ্টির মত আছড়ে পড়তে উষ্ণ বাতাসের একটা ঝাপটা সে অনুভব করে এবং বালিয়াড়ির পেছন থেকে ঝাঁঝালো ধোয়ার কুণ্ডলী উঠতে থাকে। তাঁর পাশের এক যোদ্ধার খয়েরী রঙের ঘোড়া গলায় ধাতুর এবড়ো-থেবড়ো একটা টুকরো বিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আর এর পিঠে উপবিষ্ট কমলা রঙের পোষাক পরিহিত দীর্ঘদেহী রাজপুত যোদ্ধা মাথা নিচের দিকে দিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে এবং স্থির হয়ে থাকে, বেচারার ঘাড় ভেঙে গিয়েছে। খুররম তার ঘোড়ার পাঁজরে গুতো দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়, তার কান ভোঁ ভোঁ করে, মাথা ঠিকমত কাজ করে না এবং ধোয়া আর কাকড়ে তার চোখ মুখ জ্বালা করতে থাকে। সে যদিও হতভম্ভ বোধ করে তারপরেও বুঝতে পারে যে কামানের স্বাভাবিক গোলাবর্ষণের ফলে এমন ভীষণ বিস্ফোরণ হওয়া অসম্ভব। নিমেষের জন্য তাঁর চিন্তায় নতুন কোনো অস্ত্রের সম্ভাবনা উঁকি দিয়ে যায় কিন্তু তারপরেই যখন তার কালো ঘোড়াটা নিচু বালিয়াড়ি টপকে পার হয় এবং বোয়াও খানিকটা সরে যায় সে দেখে যে বালিয়াড়ির পিছনে বিশাল কামান দুটোর ভিতরে একটা বিস্ফোরিত হয়েছে। কামানের নল কলার ছিলকার মত পিছনের দিকে গুটিয়ে গিয়েছে। বিস্ফোরিত কামানের বেশ কয়েকজন তোপচির ছিন্নভিন্ন আর দুমড়ে যাওয়া নিথর দেহ চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। বালির উপরে কাছেই আরেকটা বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছে যার চারপাশে সাদা কাপড় আর টিনের টুকরো পড়ে রয়েছে। দ্বিতীয় বিস্ফোরণটার কারণ নিশ্চিতভাবেই কাছেই মজুদ করে রাখা বারুদ এবং প্রথম বিস্ফোরণের ফলে যা প্রজ্জ্বলিত হয়েছে।

প্রথম কামানের বিস্ফোরণ দ্বিতীয় কামানের লম্বা নলটাকে কাঠের ভারি কাঠামো থেকে ছিটকে ফেলায় এর নিচে কামানের দু’জন তোপচি চাপা পড়েছে। তৃতীয় আরেকজন ছিন্নভিন্ন বাম পা নিয়ে বিস্ফোরণ স্থল থেকে হামাগুড়ি দিয়ে সরে যেতে চেষ্টা করছে যা তাঁর পায়ের গোলাকৃতি মাংসপেশীর মাঝামাঝি স্থান থেকে নিচের দিকে হাড় আর মাংসের একটা রক্তাক্ত দলায় পরিণত হয়েছে।

খুররম তার ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে তার চারপাশে পুনরায় নিজের সৈন্যদের সমবেত হবার সুযোগ দিয়ে, সে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে যে তাঁর বক্ষাবরণীর নিম্নাংশ, তার পর্যাণের সামনের দিকে উঁচু হয়ে থাকা বাঁকা অংশ এবং তাঁর ঘোড়ার মাথাকে সুরক্ষা দানকারী ইস্পাতের একটা পাত সবকিছুতে রক্ত আর মাংসের ছোট টুকরো আটকে রয়েছে যা অবশ্যই প্রথম কামানের কোনো তোপচির দেহ থেকে ছিটকে এনেছে। সে কেঁপে উঠে ভাবে, তার ভাগ্যটা বেশ ভালোই বলতে হবে। তাঁর একেবারে সামনে বিস্ফোরণটা হয়েছিল। অত্যাধিক মাত্রায় গোলাবর্ষণ বা ত্রুটিযুক্ত গঠণের কারণে যদি কামানের নলটা বিস্ফোরিত না হত কামানের গোলা নিশ্চিতভাবেই তাকে এতক্ষণে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলতো। নিয়তি তাকে যে সুযোগ দিয়েছে সে অবশ্যই সেটার যথাযোগ্য ব্যবহার করবে।

সে পুলকিত হয়ে লক্ষ্য করে তার চারপাশে দ্রুত সমবেত হতে থাকা যোদ্ধারা এখন মালিক আম্বারের সৈন্যব্যুহের ভেতর অবস্থান করছে এবং আবিসিনিয়ান সেনাপতির তোপচিরা তাঁদের অবশিষ্ট কামানগুলোকে দৈহিক শক্তির দ্বারা কোনোভাবেই এমনকোন অবস্থানে নিয়ে যেতে পারবে না যেখান থেকে তাদের অবস্থানের উপর গোলাবর্ষণ করা যাবে এমনকি যদি, বিস্ফোরণের কারণে তাদের বিমূঢ় হয়ে পড়ার কথা, এটা করার মত তাদের মানসিক স্থিরতা বজায় থাকে। রণহস্তীর বহরের একটা অংশ এতক্ষণে এসে উপস্থিত হয়েছে, বালিয়াড়ির নরম বালির ভিতর দিয়ে তারা সবকিছু ভেঙে এগিয়ে যায়। খুররম তাঁদের সামনে মালিক আম্বারের অবস্থানের কেন্দ্রের দিকে ইঙ্গিত করে, যেখানে আরো বেশ কয়েকটা বালিয়াড়ির পেছনে সে মালবাহী শকটের বহর আর তাঁদের পেছনে একদল অশ্বারোহী যোদ্ধা দেখতে পাচ্ছে, এবং সে চিৎকার করে তার অশ্বারোহীদের অনুসরণ করতে বলে।

মালিক আম্বারের লোকজন তাদের বিভ্রান্তি কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। হাতির পাল সামনের দিকে এগিয়ে যেতে খুররম আশেপাশের বালিয়াড়ির আড়াল থেকে গাদাবন্দুকের শব্দের সাথে সাথে হাতির গায়ের ভারি ইস্পাতের পাতে বন্দুকের গুলি প্রতিহত হবার শব্দ শুনতে পায়। একটা হাতি, দেহের অরক্ষিত স্থানে মোক্ষমভাবে গুলিবিদ্ধ হতে, প্রথমে গতি শ্লথ করে এবং তারপরে দিক পরিবর্তন করে কিন্তু বাকিরা এমন প্রাণবন্ত ভাবে সামনে এগিয়ে যায় যেন তারা তাদের সাথীদের বিপর্যয়ের আর্তনাদ শুনতে পায়নি। গোলন্দাজদের মত তবকিদেরও গুলিবর্ষণের পরে পুনরায় গুলি ভরার ঝামেলাপূর্ণ পদ্ধতি সম্পূর্ণ করতে প্রয়োজনীয় সময়ের সমস্যার কথা জানা থাকায়, খুররম তার সৈন্যদলের পার্শ্বদেশে অবস্থানরত এক সেনাপতিকে কিছু অশ্বারোহী যোদ্ধা নিয়ে তবকিরা তাঁদের গাদাবন্দুকে গুলি ভরার আগেই তাদের নিষ্ক্রিয় করার ইঙ্গিত করে। লোকটা সাথে সাথে তার আদেশ পালন করে এবং এক মিনিটেরও কম সময়ের ভিতরে অশ্বারোহী যোদ্ধারা সবচেয়ে কাছের বালিয়াড়ির একপাশ দিয়ে ঘুরে গিয়ে আক্রমণ করতে বেশ কয়েকজন তবকি বালিয়াড়ির অন্যপাশ দিয়ে বের হয়ে আসে। শত্রুপক্ষের যোদ্ধারা তাদের অস্ত্র মাটিতে ফেলে দেয় এবং দৌড়ে পালাবার সময় তারা অসহায় ভঙ্গিতে পেছনে ধেয়ে আসা অশ্বারোহী যোদ্ধাদের ধারালো তরবারির ঘাতক ফলার হাত থেকে নিজেদের মাথা হাত তুলে বাঁচাতে চেষ্টা করে। তাঁদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং অচিরেই সবাই বালির উপরে হাত পা ছড়িয়ে নিথর পড়ে থাকে।

হাতির পাল ইত্যবসরে মালবাহী শকটের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করেছে। খুররম সহসা মালিক আম্বারের একদল লোককে দুটো অপেক্ষাকৃত ছোট মালবাহী শকট প্রাণপণে ঠেলে একপাশে সরাতে দেখে, তারা সেটা করতে দুটো কামান আর চামড়ার আঁটসাঁট পোষাক পরিহিত তাঁদের তোপচিরা দৃশ্যপটে আবির্ভূত হয়। তোপচির দল গোলাবর্ষণ করতে সাথে সাথে তাঁদের হাতের মোম লাগান জ্বলন্ত সলতে দিয়ে কামানে অগ্নিসংযোগ করে। আগুয়ান হাতির পালের একটা হাতি সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, কামানের একটা গোলা তাকে আঘাত করেছে যা তার একটা গজদন্ত একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়েছে এবং শুড় আর মুখের সম্মুখভাগ মাংসের রক্তাক্ত মণ্ডে পরিণত করেছে। কামানের দ্বিতীয় গোলাটা সৌভাগ্যক্রমে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় কিন্তু গোলাটা আরেকটা অতিকায় মোগল রণহস্তির পায়ের কাছে বালিতে আছড়ে পড়ার সময় বৃষ্টির মত আকাশে বালি ছিটিয়ে দেয়। অতিকায় দানবটা সাথে সাথে থমকে দাঁড়িয়ে যায়, ধূলিকণার কারণে সম্ভবত মুহূর্তের জন্য অন্ধ হয়ে গিয়েছিল, এবং বৃংহিতের শব্দে চারপাশ মুখরিত করে তুলে। অন্য হাতিরা অবশ্য, তাদের মাহুতের নির্দেশে সাড়া দিয়ে, সুবোধ ভঙ্গিতে তাকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে ভাবটা এমন যেন কুচকাওয়াজ ময়দানে কসরত করছে। একটা হাওদা থেকে তার গজনলগুলোর একটা গোলাবর্ষণ করতে খুররম আগুনের ঝলক দেখতে পায় এবং সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠতে দেখে। গোলাটা মালিক আম্বারের সবচেয়ে কাছের কামানে আঘাত করে, এর ধাতু দিয়ে বাধান কাঠের চাকার একটা গুঁড়িয়ে দিয়ে দুটো চাকাকে সংযুক্তকারী অক্ষদণ্ড ভেঙে দেয়ায় কামানের নলটা আকাশে দিকে এক উদ্ভট নতি করে উঁচু হয়ে আছে। অন্য আরেকটা হাওদায় অবস্থানরত তবকিরা দ্বিতীয় কামানের দু’জন তোপচিকে ঘায়েল করে, আহত তোপচিদের একজন চিৎ হয়ে মাটিতে শুয়ে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বালুর উপরে পায়ের গোড়ালি দিয়ে কষ্টের বোল তুলে। খুররম তাকিয়ে থাকার মাঝেই তাঁর চারজন অশ্বারোহী অবশিষ্ট দু’জন তোপচিকে ঘিরে ফেলে যারা আত্মসমর্পণের স্মারক হিসাবে মুখ মাটিতে দিয়ে উপুড় হয়ে বালিতে শুয়ে পড়ে।

নদীর তীরের দিকে অগ্রসর হবার জন্য খুররম তাঁর লোকদের আদেশ দিতে সে পুলকিত হয়ে লক্ষ্য করে যে মালিক আম্বারের যোদ্ধারা নদী অভিমুখে পশ্চাদপসারণ আরম্ভ করেছে। সে তার লোকদের ইশারায় যখন পলায়নপর শত্রুদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হতে আদেশ দেয়, খুররম তখন অনুধাবন করতে শুরু করে যে একঘন্টারও কম সময়ের ভিতরে সে পুনরায় আবার বিজয় অর্জন করবে, যদিও এই বিজয় নিশ্চিত করতে যখন কামান বিস্ফোরিত হয়েছিল তখন সৌভাগ্যের বিশাল একটা বরাভয় দারুণ ভূমিকা রেখেছে। সে অবশ্য এর মাঝেই আরেকটা বালিয়াড়ি টপকে যায় এবং প্রথমবারের মত নদীর পরিষ্কার একটা চিত্র তার সামনে ভেসে উঠে, সে দেখে যে নদীর অপরতীরে সেখানে অশ্বারোহী যোদ্ধাদের বিশাল একটা দল সমবেত হয়েছে এবং মাঝ নদীতে অন্যান্যদের বহনকারী ভেলা এস্তভঙ্গিতে দূরবর্তীপ্রান্ত অভিমুখে লগি মেরে পরিচালিত করা হচ্ছে। সে নদীর তীরে উপস্থিত হবার এক কি দুই মিনিট পরে ঘুরে দাঁড়াবার আগে একটা ক্ষুদ্রাকৃতি অবয়ব যার বুকের বর্ম আসন্ন মধ্যাহ্নের সূর্যালোকে আয়নার মত দ্যুতি ছড়াচ্ছে ঔদ্ধত্যের ভঙ্গিতে নিজের হাতের তরবারি আন্দোলিত করে এবং নিজের অবশিষ্ট সৈন্যদের নিয়ে যাত্রা করে। মালিক আম্বার আরো একবার সাফল্যের সাথে তাঁর নাগাল এড়িয়ে গিয়েছে, খুররম ভাবে, কিন্তু এটাও কম নয় যে লোকটা তাঁর পুরো বাহিনীই নদীর তীরে খুইয়েছে এবং–পরিত্যক্ত মালবাহী শকটগুলোয় যদি সে যা ভেবেছে সত্যিই তাই থাকে–সেই সাথে তাঁর লুণ্ঠিত ঐশ্বর্যের অধিকাংশ।

তাঁর আব্বাজান খুশি হবেন যখন খবরটা তাঁর কাছে পৌঁছাবে। তাঁর আম্মিজানও খুশি হতেন, কিন্তু যোধা বাঈ তিনমাস পূর্বে ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর কাছে যে খবর রয়েছে সেই অনুসারে তার মৃত্যু অপ্রত্যাশিতভাবে হলেও ঘুমের ভিতরে শান্তিপূর্ণভাবেই হয়েছে। সে এখনও প্রায়ই তাঁর কথা ভাবে এবং তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে আম্মিজান আর নেই।

*

কসরতবাজের নমনীয় দেহ, কমলা রঙের একটা ল্যাঙট ছাড়া একেবারে নগ্ন, জবজব করে তেল মাখার কারণে চকচক করছে, জাহাঙ্গীরের আবাসন কক্ষের শান বাঁধান বারান্দায় পায়ের উপরে শক্ত করে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সে পেছনের দিকে হেলে পড়ে এবং ডান হাত উঁচু করে দুই ফিট লম্বা ইস্পাতের সরু তরবারি যা জাহাঙ্গীর একটু আগেই নিজে পরখ করে দেখেছে নিজের ভোলা মুখে প্রবিষ্ট করতে। তরবারির ফলা একেবারে বাট পর্যন্ত ভিতরে প্রবেশ করতে জাহাঙ্গীর শ্বাস রুদ্ধ করে তাকিয়ে থাকে, তাঁর মনে হয় যেকোনো মুহূর্তে তরবারির ফলার অগ্রভাগ লোটার পেষল উদর ভেদ করে রক্তের ধারার সাথে বের হয়ে আসবে। কিন্তু লোকটা যত সাবলীলভাবে তরবারির ফলা মুখের ভেতরে প্রবেশ করিয়েছিল ধীরে ধীরে ততটাই সাবলীলভাবে তরবারিগুলো বের করে এনে, মেহেরুন্নিসা আর জাহাঙ্গীরের সামনে মাথা নত করে অভিবাদন জানায় এবং তরবারিগুলো মাটিতে নামিয়ে রাখে। সে হাততালি দিতে আরও দু’জন কসরতবাজ সামনে এগিয়ে আসে, প্রত্যেকের হাতে মাংসের কাবার তৈরির শিক ধরা রয়েছে যার চারপাশে তেলে ভেজান কাপড় শক্ত করে জড়ানো রয়েছে এবং এখন সেটায় আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। সে পুনরায় পিছনের দিকে হেলে যায়, এবার এতটাই যে তার লম্বা কালো চুল বারান্দার পাথর স্পর্শ করে, লোকটা এবার প্রথমে একটা জ্বলন্ত শিক গলধঃকরণ করে তারপরে দ্বিতীয়টা তারপরে দুটো একসাথে। ত্বক বিদীর্ণ যেমন হয়নি তেমনি এবার আগুনে চামড়া পোড়ার গন্ধও পাওয়া যায় না। লোকটা যখন আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গভীর একটা শ্বাস নিয়ে তখনও জ্বলন্ত শিকে ফুঁ দিয়ে আগুন নিভিয়ে দেয়, জাহাঙ্গীর তার দিকে এক মুঠো সোনার মোহর ছুঁড়ে দেয়।

‘আমি ভেবেছিলাম তারা আপনাকে আনন্দ দেবে, কসরতবাজেরা চপল পায়ে দৌড়ে বারান্দা থেকে বিদায় নিতে মেহেরুন্নিসা বলে। সুদূর উত্তরপূর্বের পাহাড়ী এলাকা থেকে লোকগুলো এসেছে সেখানে উপজাতীয় লোকেরা এসব করতে পারদর্শী।

‘তাঁরা আমাকে মুগ্ধ করেছে। সকালে আমি লোকগুলোকে আবার ডেকে পাঠাব এবং তাদের এই কসরতের রহস্য আমি তাদের তাদের ব্যাখ্যা করতে বলবো।

মেহেরুন্নিসা মুচকি হাসে। জাহাঙ্গীরকে ভুলিয়ে রাখতে সে সবসময়ে– কৌতূহল উদ্রেককারী কিছু খুঁজে বের করতে চেষ্টা করে। তাঁর সাথে সে যখন নিজের প্রশান্তি খুঁজতে চেষ্টা করে সে তখন সেটা বেশ পছন্দই করে এবং সন্ধ্যার নির্জনতা কথা বলার জন্য আদর্শ সময়।

সে জাহাঙ্গীরের জন্য গোলাপের সুগন্ধিযুক্ত যে সুরা প্রস্তুত করেছে সে তাতে চুমুক দেয়। শাহরিয়ারের কাছ থেকে আমি একটা চিঠি পেয়েছি। সে এখনও ভাদোরে অবস্থান করছে কিন্তু লিখেছে যে নতুন দূর্গ স্থাপনের জন্য সে একটা ভালো স্থান খুঁজে পেয়েছে। সে যা লিখেছে তাতে মনে হচ্ছে যে পুরো এলাকাটা সে বেশ ভালো করেই পর্যবেক্ষণ করেছে এবং দূর্গটার নির্মাণশৈলী কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে কিছু প্রয়োজনীয় পরামর্শও দিয়েছে।’

‘বেশ।’ মেহেরুন্নিসা মাথা নাড়ে। নিজের ভাইয়ের সাথে আগ্রা অভিমুখি দক্ষিণের প্রবেশপথ সুরক্ষিত করতে নতুন একটা দূর্গ নির্মাণে জাহাঙ্গীরের অভিপ্রায়ের বিষয়ে আলোচনার পরে শাহরিয়ারকে সে নিজে কিছু পরামর্শ দিয়েছিল। সে বুঝতে পেরেছে, শাহরিয়ারকে কাজটার দায়িত্ব দেয়ার–তার অনুরোধে, এমন নয় যে আসাফ খান জানে না–জাহাঙ্গীরের সিদ্ধান্তের শুনে আসাফ খানের চক্ষু ছানাবড়া হয়ে উঠেছিল। আগ্রা সেনানিবাসের সর্বাধিনায়ক হিসাবে তার ভাইয়ের মনে হয়েছিল তার অন্তত যুবরাজের সঙ্গী হওয়া উচিত। সে মেহেরুন্নিসাকে নিজের সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে প্রস্তাবিত নতুন দূর্গের জন্য সে কতকিছু করতে পারে সব বলেছিল। সে মুখে সহানুভূতিপূর্ণ হাসি নিয়ে মনেযোগ দিয়ে তার কথা শুনেছে এবং সবকিছু মনে রেখেছে। সে তারপরে শাহরিয়ারকে চিঠি লিখে তরুণ মনে নিগূঢ়ভাবে কিছু ধারণা প্রোথিত করেছে যার ভিতরে কিছু অবশ্য তার নিজের।

‘আমি ঠিক নিশ্চিত নই যে শাহরিয়ার এত বড় একটা দায়িত্ব সামলাতে পারবে–ভুলে গেলে চলবে না যে তার মাত্র সতের বছর বয়স–কিন্তু মনে হচ্ছে যে তাকে কাজটা দেয়ার জন্য তোমার পরামর্শ ঠিক ছিল।

‘আর আপনি তাকে একা পাঠিয়ে ঠিক কাজটাই করেছেন। আপনি প্রথমে যেমন প্রস্তাব করেছিলেন সেই অনুযায়ী যদি আমার ভাইকে তার সাথে পাঠাতেন, তাহলে শাহরিয়ারের হয়ত মনে হতো আপনি তার উপরে আস্থা রাখতে পারছেন না।

‘তুমি খুব ভালো মানুষ চিনতে পারো।

‘আপনি আপনাকে আগেই বলেছিলাম শাহরিয়ারের সামর্থ্যকে আপনি ছোট করে দেখছেন।

‘কেবল পারভেজের ব্যাপারে তুমি যদি আমাকে কোনো পরামর্শ দিতে পারতে। বিয়ের পরেও তার ভিতরে কোনো পরিবর্তন আসেনি–সত্যি বলতে কি ঠিক উল্টোটা হয়েছে। সে আমাকে আমার নিজের সৎ-ভাই ডানিয়েল আর মুরাদের কথা মনে করিয়ে দেয়। তাদের সুরাপান থেকে বিরত রাখতে আমার আব্বাজানের সমস্ত প্রয়াস ব্যর্থ করে তারা শেষে সুরাপানের কারণেই মারা গিয়েছে। আমার মাঝে মাঝে দুশ্চিন্তা হয় যে এটা আমাদের পরিবারের জন্য একটা অভিশাপ।

‘পারভেজ একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। নিজের দূর্বলতা অতিক্রম করা তাকেই শিখতে হবে। সে যে কদাচিৎ অপ্রমত্ত অবস্থায় থাকে সেটা আপনার দোষ না। আপনার উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে এমন কিছুর অনুমতি আপনি দিতে পারেন না।

জাহাঙ্গীর আপন মনে ভাবে, আমি কি করি না। তার বয়স যখন বিশের কোটায় ছিল তখন সে আফিম আর সুরার দাসে পরিণত হয়েছিল, তাকে দায়িত্বপূর্ণ কোনো পদ প্রদানে তার আব্বাজানের অনীহার জন্য নিজেকে সান্ত্বনা দিতে সে এসবের আশ্রয় নিত। সে নিজেও হয়ত এই আসক্তির কারণে মৃত্যুবরণ করতো যদি সে তার দুধ-ভাই সুলেমান বেগের ভালোবাসা না পেতো, সেই তাকে সাহায্য করেছিল আসক্তির কবল থেকে বের হয়ে আসতে। সুলেমান বেগের মুখটা তার মানসপটে মুহূর্তের জন্য ভেসে উঠে–সে শেষবার জ্বরের আক্রমণে বিপর্যস্ত অবস্থায় যেমন দেখেছিল তেমন না বরং প্রাণবন্ত আর আত্মবিশ্বাসী। সে ছিল তাঁর সত্যিকারের বন্ধু এবং এতগুলো বছর পরেও সে অনুভব করে এখনও সে তার অভাব কতটা বোধ করে। সুলেমান বেগ এখন তার সম্বন্ধে কি মন্তব্য করতো? তাঁর এই ক্রমশ বাড়তে থাকা আলস্য, সাম্রাজ্যের কাজে তার অনীহা, ইংরেজ রাজদূতের সাথে তাঁর উদ্দাম পানাহারের আসর–যদিও আক্ষেপের বিষয় আজকাল এসব পানাহারের আসর অনেকটাই কমে গিয়েছে স্যার টমাস আজকাল প্রায়ই কেমন অসুস্থ বোধ করেন–আর আফিমের প্রতি তার আসক্তি যার কবল থেকে সে আসলে কখনও পুরোপুরি নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি এবং এখন আবার সেটা প্রবল হয়ে উঠেছে।

আফিম আর সুরা সে কেন এত পছন্দ করে? তাঁর বয়স যখন অল্প ছিল তখন সে হৃদয়ের তিক্ততার উপশম ঘটাতে এসবে আসক্ত হয়েছিল জীবনের হতাশা ভুলে থাকতে। সে এখন যখন সমৃদ্ধ আর স্থায়ী একটা সাম্রাজ্যের অধিকারী প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এবং দুই পুত্রের জনক যাঁদের নিয়ে সে গর্ববোধ করতে পারে, আনন্দের জন্য সে এখন কেন এসব উপকরণ ব্যবহার করতে পারবে না? আফিম আর সুরা তাকে শমিত করে, এমনকি এগুলো তাঁর মনকে প্রসারিত করে। আফিম আর সুরা একত্রে তাকে যে সুখাবহ ভাব সমাধিতে পৌঁছে দেয় তখনই তাঁর পারিপার্শ্বিক পৃথিবীর প্রকৃতি সম্বন্ধে তাঁর সবচেয়ে অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন ভাবনাগুলো তাঁর কাছে ধরা দেয়… এবং রো’র সাথে চিত্রকলা থেকে শুরু করে খৃস্টান ধর্মের খামখেয়ালিপনা সবকিছু নিয়ে সে সবচেয়ে উদ্দীপক আলাপচারিতায় মেতে উঠতো। মেহেরুন্নিসা এইমাত্র মন্তব্য করেছে সে আসক্তির অনুসঙ্গগুলোকে তার উপর প্রভাব বিস্তার করতে দেয় না, কিন্তু সে নিজের বুকে হাত দিয়ে এত নিশ্চিতভাবে এই কথাটা বলতে পারবে না। সে যদি এসব অনুসঙ্গ ছাড়া অর্ধেক দিন অতিবাহিত করে তাহলেই এসবের জন্য ব্যাকুলতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে এবং সে কদাচিৎ দীর্ঘ সময় তাঁদের আসক্তি এড়িয়ে থাকতে পারে। তার সাম্রাজ্যের প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড থেকে এসব যদি আদতেই তাকে দূরে সরে থাকতে প্ররোচিত করেই, এতে কি এমন ক্ষতি বৃদ্ধি হবে? তাঁর অনুগত অসংখ্য বিশ্বস্ত লোক রয়েছে যারা তাঁর এই দায়িত্ব গ্রহণের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে রয়েছে, এঁদের ভিতরে মেহেরুন্নিসাও রয়েছে। তার ক্রমাগত নতুন দায়িত্ব গ্রহণের আকাঙ্খা দেখে সে মুগ্ধ হয়, প্রতিবারই তাকে আশ্বস্ত করতে ভুল হয় না যে সে কেবলই তাঁর সাহায্যকারী হতে আগ্রহী। সে নিশ্চিত, বিয়ষটা সত্যি, কিন্তু সে এটাই জানে যে বিষয়টা মেহেরুন্নিসা কতটা উপভোগ করে। তাকে আগলে রাখার জন্য মেহেরুন্নিসা যতক্ষণ তাঁর পাশে রয়েছে তার হয়ত সুরা আর আফিমের আসক্তির সাথে লড়াই করার ততটা প্রয়োজন নেই।

‘আপনি আজ খুররমের কাছ থেকে একটা বার্তা পেয়েছেন, তাই নয় কি? তাকে তার স্বপ্ন-কল্পনার রেশ থেকে মুক্ত করে, সে জানতে চায়।

‘হা। মালিক আম্বারের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযান ভালোই অগ্রসর হচ্ছে। সে একজন দক্ষ সেনাপতি। আমি কৃতজ্ঞ যে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ আমি তাকে দিয়েছি যা আমার আব্বাজান আমাকে কখনও দিতো না। তাঁর জন্মগ্রহণের সময় জ্যোতিষী যেমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, সৌভাগ্য মনে হয় তার পক্ষেই আছে। তার পরিবারও বড় হচ্ছে। সে চিঠিতে জানিয়েছে তাঁর সদ্যোজাত কন্যাসন্তান জ্বর থেকে সেরে উঠেছে এবং সুস্থ আছে। তাঁরা তাঁর নাম রেখেছে রওসোন্নারা।

মেহেরুন্নিসা চুপ করে থাকে। দাক্ষিণাত্যের উদ্দেশ্যে খুররমের যাত্রা করার পরে প্রায় নয়মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। জাহাঙ্গীর প্রথম দিকে তাঁর অভাব দারুণ অনুভব করতো এবং তার অনুপস্থিতির জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করতো কিন্তু ধীরে ধীরে তার প্ররোচনায় জাহাঙ্গীর ক্রমশ তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রের প্রতি অধিকতর আগ্রহী হয়ে উঠছে। সে অনুধাবন করতে পেরেছে যে নিজের বড় দুই ছেলের একজন বিশ্বাসঘাতক আর অন্যজন মাতাল এই বিষয়টা জাহাঙ্গীরকে কষ্ট দেয়… পিতা হিসাবে বিষয়টাকে সে নিজেরই ব্যর্থতা হিসাবে দেখে ঠিক যেমন সে মনে করে যে তার আব্বাজান আকবর তাকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল। ঠিক এই কারণেই সে যেমন যোগ্য আর শক্তিমান খুররমের কারণে গর্বিত বোধ করতে আগ্রহী, ঠিক একইভাবে সে সুদর্শন শাহরিয়ারের মাঝে ভালো গুণাবলী দেখে প্রসন্ন। জাহাঙ্গীরের সন্তানদের মাঝে তার অনুগ্রহ লাভের জন্য প্রতিযোগিতার আবহ বিরাজ করাটা একটা ভালো লক্ষণ, মেহেরুন্নিসা ভাবে। তাদের ঈর্ষা আর প্রতিদ্বন্দ্বীতা তাকে তার প্রভাব বিস্তারের আরেকটু সুযোগ করে দেবে যদি না কেবল খুররম তার একমাত্র প্রিয় পুত্র হতো।

১.১৪ ঘরের শত্রু বিভীষণ

‘জাঁহাপনা, আপনাকে বিরক্ত করার জন্য আমায় মার্জনা করবেন। জাহাঙ্গীরের কক্ষে প্রবেশ করার সময় মজিদ খান মুষ্ঠিবদ্ধ হাত দিয়ে বুক স্পর্শ করে। দাক্ষিণাত্য থেকে আরেকটা বার্তা নিয়ে রাজকীয় এক বার্তাবাহক এসেছে। আমি সেটা নিয়ে এসেছি।’

রওসোন্নারার আরোগ্য লাভের খবর নিয়ে আগত বার্তার পরে গত কয়েক সপ্তাহ জাহাঙ্গীর খুররমের কাছ থেকে কোনো সংবাদ পায় নি এবং তিনি জানতে উদগ্রীব হয়ে আছেন যে খুররম যেমনটা ধারণা করেছিল তার অভিযান কি আসলেই ততটা সাফল্যের সাথে অগ্রসর হচ্ছে। সে হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নেয় এবং সীলমোহর ভাঙে। আমি এখনও যদিও মালিক আম্বারকে বন্দি করতে সমর্থ হই নি আমি তাঁর সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করেছি এবং তাঁর সম্পদ কুক্ষিগত করেছি, খুররম তাঁর বলিষ্ঠ হাতে চিঠিতে লিখেছে। নদীর বাঁকে আবিসিনীয় সেনাপতির সৈন্যদের সাফল্যের সাথে মোকাবেলা করার পরে তার শেষ সর্বশেষ প্রফুল্ল শব্দচয়ন হল, আমাদের শত্রু লাথি খাওয়া কুকুরের মত নিজের এলাকায় পালিয়ে গিয়েছে। আমার বাহিনীকে একত্রিত আর পুনরায় রসদ মজুদ করেই আমি আবার তাকে ধাওয়া করবো। আমার বিজয় নিয়ে আমার ভিতরে কোনো ধরনের সন্দেহের অবকাশ নেই।

জাহাঙ্গীর আনন্দিত হয়ে মুচকি হাসে। মাজিদ খান, সুখবর। যুদ্ধক্ষেত্রে আমার পুত্র মালিক আম্বারকে পরাস্ত করেছে এবং পরাস্ত হয়ে মালিক আম্বার পালিয়েছে। সম্রাজ্ঞীকে খবরটা আমার জানাতেই হবে।

তাকে কয়েক মিনিট পরে মেহেরুন্নিসার আবাসন কক্ষে প্রবেশ করতে দেখা যায়। খুররমের কাছ থেকে আমি অবশেষে একটা বার্তা পেয়েছি। এই যে, এখানে…’

মেহেরুন্নিসা সতর্ক ভঙ্গিতে চিঠিটা পড়তে আরম্ভ করে, কিন্তু সে চিঠিটা পুরো পড়া শেষ করার আগেই জাহাঙ্গীর নিজের পুত্রের গুণকীর্তন করা আরম্ভ করে। সে দারুণ বিচক্ষণতা, ভীষণ বিবেচনাবোধের পরিচয় দিয়েছে… সে এবার যখন আগ্রা ফিরে আসবে আমি তাকে আমার সামরিক পরিষদের পূর্ণ সদস্য হিসাবে নিয়োগ দেবে। সে সেখানে নিজের স্থান অর্জন করেছে। জাহাঙ্গীর যখন নিজের উল্লাস প্রকাশ করতে থাকে, মেহেরুন্নিসার ঠোঁটের কোণে ফুটে থাকা হাসির ঝিলিকের চেয়ে তার মনের ভিতরে বইতে থাকা চিন্তাধারা অনেকবেশি অন্ধকারাচ্ছন্ন। সে ধারণা করতে পারেনি যে খুররম এতটাই সফল হবে এবং অবশ্যই এত দ্রুত। নিজের বিজয়ী বাহিনী নিয়ে সে যখন বিজয়ীর বেশে ফিরে আসবে তখন জাহাঙ্গীর তাঁর উত্তরাধিকারী ঘোষণা করতে বিলম্ব করবে? তার জন্য সেটা করাই একমাত্র যুক্তিসঙ্গত কাজ হবে….

‘আমাদের খবরটা উদ্যাপন করা উচিত। আজ বিকেলের দিকে, আবহাওয়া একটু শীতল হলে, আমি যমুনার তীরে উটের দৌড়ের আয়োজন করার আদেশ দিব। আম্বারের রাজা আমায় যে উটগুলো পাঠিয়েছে আমি তাঁদের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখতে আগ্রহী। তিনি দিব্যি দিয়ে বলেছেন যে দ্রুতগামী রাজপুত উটের কোনো তুলনা হয় না কিন্তু আমি ঠিক ভরসা করতে পারছি না…’

‘এটা দারুণ হবে। আমি আমার বারান্দা থেকে দেখবো।

সে পরবর্তীতে যখন জাহাঙ্গীর আর তাঁর দেহরক্ষীদের দুলকিচালে নদীর তীরের রৌদ্রদগ্ধ কাদার উপর দিয়ে সৈন্যরা দৌড় প্রতিযোগিতার জন্য আধ মাইল লম্বা একটা এলাকা প্রস্তুত করেছে সেদিকে এগিয়ে যেতে দেখে, তার মাথা ব্যাথা শুরু হয় এবং প্রদর্শনীটা তাকে বিন্দুমাত্র আকর্ষণ করে না। সে সচরাচর উটের দৌড় উপভোগই করে–জম্ভগুলোর নাক ডাকতে থাকার দৃশ্য, তাদের সামনের দিকে বাড়িয়ে রাখা গলা, তাদের আরোহীদের দ্বারা তাড়িত হওয়া, দর্শকদের উল্লসিত চিৎকার…তাঁর বিয়ের পরপরই জাহাঙ্গীর নিজে দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিত এবং বিজয়ী হতো। তাঁর মনে আছে সে প্রতিযোগিতা শেষে তাঁর কাছে আসতো, তাঁর দেহ তখনও বিজয়ের ঘামে সিক্ত…

তূর্যবাদকেরা তাঁদের বাজনা নিজেদের ঠোঁটে ঠেকিয়ে প্রথম দৌড় শুরুর সংকেত ঘোষণা করা মাত্র সে নদীর তীর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় এবং ভিতরে চলে আসে। ‘সাল্লা,’ সে ডাকে, আমার চোখের পিছনে কেমন একটা ব্যাথা করছে। অনুগ্রহ করে আমায় একটু মালিশ করে দাও–যা আমাকে সবসময়ে আরাম দেয়।

মেহেরুন্নিসা একটা লাল স্যাটিনের গড়িতে হেলান দিয়ে আরাম করে বসলে, আর্মেনিয়ান বাদী আলতো ভঙ্গিতে কাজ শুরু করে, তার গলার মাংসপেশী দক্ষতার সাথে মালিশ করতে থাকে। দবদব করতে থাকা ব্যাথাটা ধীরে ধীরে কমে আসে এবং মেহেরুন্নিসার মন আবার খুররমের বার্তা নিয়ে ভাবতে শুরু করে। খুররমকে পুনরায় দক্ষিণে পাঠাতে জাহাঙ্গীরকে প্ররোচিত করে সে সম্ভবত ভুলই করেছে… জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে তাকে দূরে সরাতে চেয়ে সে খুররমকে আরো বিপুল গৌরব অর্জনের সুযোগ করে দিয়েছে। মালিক আম্বারকে বন্দি কিংবা হত্যা করতে যদি খুররম সমর্থ হয়–যা সে করতে পারবে বলে তাকে নিশ্চিত মনে হচ্ছে–সে কয়েক মাসের ভিতরে পুনরায় দরবারে ফিরে আসবে এবং অবশ্যম্ভাবীভাবেই নতুন খেতাব, নতুন দায়িত্বের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে থাকবে। তার অবশ্যই কিছু প্রত্যাশা রয়েছে…।

তার স্বামীর বয়স যদিও এখনও পঞ্চাশ পূর্ণ হয়নি, ক্রমবর্ধমান আসক্তি ফলে যা তাঁর তৈরি আফিম ও সুরার মিশ্রণে বুঁদ হয়ে থাকতে তাকে আরও আগ্রহী করে তুলছে এবং সম্রাটকে তাঁর দায়িত্ব পালনে তাকে সুযোগ করে দিচ্ছে সেটাই হয়তো তাকে উৎসাহিত করবে সাম্রাজ্য পরিচালনার অধিকাংশ দায়িত্ব যোগ্য পুত্রের হাতে যাকে নিয়ে সে ভীষণ গর্বিত সমর্পিত করতে যাতে করে সে তার অবশিষ্ট দিনগুলোতে আগ্রহের সাথে প্রকৃতির অসামঞ্জস্য অধ্যয়নে মনোনিবেশ করতে পারেন। সম্রাটের ক্ষমতা আর উদ্দীপনা যা তাকে এত আকর্ষিত আর উত্তেজিত করে হ্রাস পাবে। সে নিজেকে বলে, জাহাঙ্গীরের জন্য এটা মোটেই শুভ হবে না। তিনি এর ফলে দ্রুত বার্ধক্যে উপনীত হবেন। আর তারই বা কি হবে? হেরেমের বৃদ্ধ আর বিরক্ত শাসক। তাঁর মানসপটে মুহূর্তের জন্য ফাতিমা বেগমের বিরক্ত, কুঞ্চিত মুখাবয়ব আর পৃথুল অলস দেহ ভেসে উঠে। তাঁর জন্য হেরেম খুব ছোট একটা রাজত্ব। জাহাঙ্গীরের উপরে কেবল তাঁরই অধিকার এবং আর কারো নয়–ঠিক যেমনটা তিনি তাকে প্রায়শই বলে থাকেন। খুররমের উত্থানকে অবশ্যই মন্থর না, বিঘ্নিত করতে হবে, এবং হয়তো এমনকি বাতিল করতে হবে…

‘মালকিন, আমি দুঃখিত, আমি কি আপনাকে ব্যাথা দিয়েছি? আমি আয়নায় দেখলাম সহসা আপনি ভ্রুকুটি করলেন।

‘না, সাল্লা, আমি আসলে চিন্তা করছিলাম।’

মেহেরুন্নিসা যতই বিষয়টা বিবেচনা করতে থাকে, আতঙ্কের মত একটা অনুভূতি সে অনুভব করে। সে কি করবে? সে তাঁর জীবনের সবচেয়ে হতাশাব্যঞ্জক পরিস্তিতিতেও সবসময়ে কোনো না কোনো পথ খুঁজে পেয়েছে। তার আব্বাজান তাকে যখন বায়ু আর নেকড়ের মুখে পরিত্যাগ করেছিলেন তখনও কি সে টিকে থাকেনি? তাঁর ভাইয়ের ষড়যন্ত্রের কারণে তাঁদের পরিবারের সবাই যখন অভিযুক্ত হবার মুখে পড়েছিল তখন কি সে নিজেকে আর তার পরিবারকে রক্ষা করে নি? এটা দ্বিধাগ্রস্থ হবার সময় না…

সে বিছানায় উঠে বসে। সাল্লা, তোমায় ধন্যবাদ, আমার মাথা ব্যাথা অনেকটা কমেছে। তুমি এখন যেতে পারো। আর খেয়াল রেখো আমাকে যেন কেউ বিরক্ত না করে।’ উন্মুক্ত গবাক্ষ দিয়ে ভেসে আসা জনতার উফুল্ল চিৎকার আর তূর্যবাদনের শব্দ তাকে বলে যে উটের দৌড় এখনও শেষ হয়নি, মেহেরুন্নিসা পায়চারি আরম্ভ করে যা সে সবসময়েই করে থাকে যখন সে কিছু চিন্তা করতে চায়। তাঁর দৃষ্টি একটা নিচু মার্বেলের টেবিলের উপরে নিবদ্ধ হয় যেখানে সম্প্রতি জাহাঙ্গীর তাকে যে খেতাব দান করেছে তার প্রতীক উত্তীর্ণ করা হাতির দাঁতের তৈরি সীলমোহরটা রাখা আছে। সে এখন আর নূর মহল নয়, সে এখন নূর জাহান, জগতের আলো। সে কেবল জাহাঙ্গীরের প্রিয় সম্রাজ্ঞীই নয় বরং তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা… যা তাঁর সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। তার মস্তিষ্কে অচিরেই একটা পরিকল্পনা দানা বাঁধতে আরম্ভ করে। ভীষণ সাহসী একটা পরিকল্পনা এবং এতে ঝুঁকিও রয়েছে, কিন্তু এটা যদি সফল হয় সে–তাঁর ভাস্তি আরজুমান্দ না–তাহলে হবে সম্রাটের পিতামহী এবং প্রপিতামহী। মেহেরুন্নিসার কক্ষে জাহাঙ্গীর যখন আবার আসে ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। তাকে উৎফুল্ল এবং শমিত দেখায়। আমিই ঠিক বলেছিলাম- রাজস্থানের এই উটগুলো দেখে যতটা মনে হয় তারা ততটা দ্রুতগামী নয়, এবং জন্তুগুলোকে পোষ মানান কঠিন। তুমি কি দেখেছিলে যে একটা তার আরোহীকে পিঠ থেকে মাটিতে ফেলে দিয়ে তারপরে তাকে লাথি মারতে চেষ্টা করেছিল?

‘আপনাকে সত্যি কথাই বলি আমি আসলে দৌড়টা দেখিনি। খুররমের বার্তাটা আমি দেখার পর থেকেই–সারাটা দুপুর আমার মন অন্য একটা বিষয়ে ব্যস্ত ছিল।

‘সেটা কি?

তার হৃৎপিণ্ড দ্রুত স্পন্দিত হয় কিন্তু সে উত্তর দেয়ার সময় নিজের মুখাবয়ব সংযত রাখে, এমনকি সামান্য বিষণ্ণতাও ফুটিয়ে তোলে। আমি বুঝতে পারছি না যে আপনাকে কথাটা আমার বলা উচিত কিনা কিন্তু আমি আপনার কাছ থেকে কিছু লুকিয়েও রাখতে পারি না।’

জাহাঙ্গীরের মুখমণ্ডল এখন তাঁর মতই গম্ভীর দেখায়। বলো।

‘আপনি জানেন আমি খুররমের সেনাছাউনিতে অবস্থানরত আপনার আধিকারিকদের কাছ থেকে প্রেরিত নিয়মিত প্রতিবেদন দেখি। প্রতিবেদনগুলো বেশিরভাগই নতুন তাবু বা মালবাহী শকট কিংবা আরও অধিক খাদ্যের চাহিদা সম্পর্কিত–দৈনন্দিন বিষয়সমূহ যা নিয়ে আপনার চিন্তা না করলেও চলবে। কিন্তু সম্প্রতি আমি অন্যসব বিবরণের মাঝে অন্য কিছু একটা বিষয় আঁচ করতে পারি–কিছু ইঙ্গিত যে খুররম ক্রমশ উদ্ধত হয়ে উঠছে… যে সে তার সামরিক পরামর্শ সভায় অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে ক্রমশ অধৈর্য হয়ে উঠছে, যার ভিতরে তার চেয়ে অনেক অভিজ্ঞ আর বয়োজ্যেষ্ঠ সেনাপতিরাও রয়েছেন, যেমন ওয়ালিদ বেগ, তাঁর গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান। এসব বিষয় হয়ত ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়–এখন পর্যন্ত খুররমের সামরিক অভিযান সফলই বলতে হবে। কিন্তু একেবারে সাম্প্রতিক কয়েকটা প্রতিবেদন থেকে এটাও প্রতিয়মান হয় যে খুররম আপনার সম্বন্ধে তাচ্ছিল্যপূর্ণ মন্তব্য করেছে, উদ্ধত ভঙ্গিতে বলেছে যে আপনার চেয়ে অনেক অল্প বয়সে সে সামরিক সাফল্য অর্জন করেছে…’।

জাহাঙ্গীর তার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে এবং সে খেয়াল করে তার শ্বাসপ্রশ্বাসের বেগ দ্রুততর হয়ে উঠেছে। তুমি নিশ্চিত? তার এমন প্রভৃষ্ট আচরণ করার কথা না…’।

‘এ বিষয়ে সন্দেহের সামান্যই অবকাশ রয়েছে। সে একজন দক্ষ সেনাপতি কিন্তু মুশকিল হল সেটা সে জানে এবং ক্রমশ আত্মগর্বী হয়ে উঠছে। আপনি অবশ্য চাইলে এত বিশাল সাফল্যের অধিকারী এমন একজন তরুণকে ক্ষমা করতেও পারেন। সাফল্যে তার মাথা খানিকটা ঘুরে যেতেই পারে, এটা খুবই স্বাভাবিক। তাঁর শেষ বার্তাটার বাচনভঙ্গিতে পরিষ্কার বোঝা যায় সে নিজের প্রতি কতটা মুগ্ধ। আমি একটা বিষয়ে নিশ্চিত সে খসরুর মত কোনো বোকামি সে করতে যাবে না কিন্তু তারপরেও এমন আচরণ যদি নিয়ন্ত্রণ করা না হয় তাহলে ভবিষ্যতে হয়তো বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে…’

‘এসব অভিযোগ কে করেছে? ব্যর্থতার জন্য খুররমের কাছে তিরস্কৃত হওয়া কিংবা যুক্তিসঙ্গত পদোন্নতি উপেক্ষিত হওয়ায় ক্ষুব্ধ লোকজন এসব অভিযোগ করতেই পারে?

‘আমার মনে হয় না। আমি নিজে যাচাই করে দেখেছি। সবাই অনেক নিচু পদস্থ কর্মকর্তা-খুররমের সরাসরি নজরে পড়া কিংবা তাঁদের নাম জানা আপনার জন্য একেবারেই গুরুত্বহীন। তারা যদিও তাদের দায়িত্ব পালন করছে বলেই সম্ভবত ভেবেছে, এসব কথা কাগজে লিখে তারা অবশ্য ভুল করেছে। এসব লেখা যদি ভুল লোকের চোখে পড়ে তাহলে সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে ভেবে… আপনার খাতিরে এবং অবিবেচক সেইসব কর্মকর্তাদের কথা ভেবে, আমি বার্তাগুলো পুড়িয়ে ফেলেছি। মেহেরুন্নিসা একটা ধূপদানির দিকে ইঙ্গিত করে যেখানে কিছু পোড়া কাগজের টুকরো পড়ে রয়েছে।

জাহাঙ্গীরের কানে সহসা মেহেরুন্নিসার পরিবর্তে বহু বছর পূর্বে বৃদ্ধ সেলিম চিশতির উচ্চারিত সতর্কবাণী ভাসতে থাকে: বিশ্বাসের উপর কোনো কিছু ছেড়ে দিবে না, এমনকি যাদের সাথে তোমার রক্তের বন্ধন রয়েছে এমনকি তোমার অনাগত সন্তানেরা…’ খসরুকে অন্ধ করে দেয়ার পরে, সে ভেবেছিল সন্তানদের কাছ থেকে তাঁর আর ভয়ের কোনো কারণ নেই–পারভেজের কাছ থেকে নয় বেশিরভাগ সকালে যার বিছানা ত্যাগ করার কোনো ইচ্ছাই থাকে না বা খুররমের কাছ থেকে, আপাতদৃষ্টিতে এমন দায়িত্বশীল এবং সে যা কিছু চেয়েছে সে পিতা হিসাবে তাই তাকে দিয়েছে–এমনকি আরজুমান্দের সাথে বিয়ে পর্যন্ত–এবং নিশ্চিতভাবেই শাহরিয়ারের কাছ থেকে তো নয়ই। কিন্তু সে সম্ভবত কোথাও ভুল করেছিল। তাঁর পুত্রদের ভিতরে খুররম অনায়াসে সবচেয়ে প্রতিভাবান সারা পৃথিবী সেটা দেখতে পাবে–এবং খুররমও সেটা টের পেয়েছে। মেহেরুন্নিসা তাকে পুনরায় আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করে–সে চায় না জাহাঙ্গীর উদ্বিগ্ন হয়ে উঠুক–কিন্তু সে কীভাবে নিশ্চিত হবে যে খসরুর মত খুররম ইতিমধ্যে বিদ্রোহের বিষয়ে পরিকল্পনা করতে শুরু করে নি?

‘আপনাকে এতটা উদ্বিগ্ন কেন দেখাচ্ছে? আমি আপনাকে সতর্ক করেছি যাতে আপনি সহজেই বিষয়টার পরিসমাপ্তি ঘটাতে পারেন।’

‘যদি তোমার কথা ঠিক হয়, তাহলে আমার কি করা উচিত?

‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।’ মেহেরুন্নিসা যেন এক মুহূর্তের জন্য ইতস্তত বোধ করে। খুররমকে আপনার অবশ্যই বিরত করতে হবে…’

‘আমার সেটাই করা উচিত, কিন্তু কীভাবে?

‘বেশ… আপনি সম্ভবত এখন পেছনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে বুঝতে পারবেন তাকে লাল তাবু স্থাপনের অধিকার দান করে বেশি মাত্রায় উদারতা প্রদর্শন করেছেন। আমি জানি, আপনি এটা করেছিলেন, কারণ আপনি তাকে পুরস্কৃত করতে চেয়েছিলেন কিন্তু এরফলে সম্ভবত তাঁর প্রত্যাশা আর গর্ব মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল… আপনি তাকে এখন কেন অবহিত করেন না যে আগামী কিছু দিনের জন্য আপনি তার এই পদমর্যাদা রদ করছেন। আপনি তাকে জানাতে পারেন যে যদিও আপনি তার বিজয়ে আনন্দিত হয়েছেন কিন্তু আপনি হয়তো একটু বেশিই তাড়াহুড়ো করেছিলেন…’

‘আমি নিশ্চিত–সে এটাকে নিশ্চিতভাবেই অপমান হিসাবে বিবেচনা করবে।

‘হা, কিন্তু একই সাথে তাকে পরীক্ষাও করবে। সে তার দাদাজানের কাছে তার অন্যসব নাতিদের চেয়ে বেশি প্রশ্রয় লাভ করেছিল এবং আপনি তাঁর সমস্ত ইচ্ছাপূরণ করায়, সে ভাবতে শুরু করেছে নিরূপদ্রব অগ্রযাত্রা তাঁর অধিকার এবং সেটা কোনো সম্মান বা উপহার নয় যা আপনিই কেবল তাকে দান করতে পারেন। তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখে আপনি বুঝতে পারবেন যে সে এখনও আপনার অনুগত আর বিশ্বস্ত ছেলেই রয়েছে নাকি তার উচ্চাশা এখন তাঁর দায়িত্ববোধকে অতিক্রম করেছে। মনে রাখবেন আপনি একই সাথে তার সম্রাট এবং পিতা। আর খুররমের নিজের মঙ্গলের জন্য আপনি এসব কিছু করছেন। আপনি এখনই একজন আদর্শ পিতার মত উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়ে তাকে আরও বিপথগামী করার হাত থেকে রক্ষা করতে পারবেন।’

জাহাঙ্গীর সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। মেহেরুন্নিসা যা বলেছে সত্যিই বলেছে। তিনি নিজে যুবক বয়সে যে বিরুদ্ধতার মোকাবেলা করেছেন খুররমকে সেসব কিছুই মোকাবেলা করতে হয়নি। খুররম যদি বিচক্ষণতার সাথে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তাহলে তাকে তার লাল তাবু অচিরেই ফিরিয়ে দেয়া হবে।

*

রঙধনুর সাত রঙে রঞ্জিত আর গলায় রত্নখচিত ক্ষুদ্রাকৃতি ফিতা বাঁধা–পায়রার দল বাতাসে ডানা ঝাপটে রাজকীয় পায়রার খোপে ফিরে আসতে শুরু করে জাহাঙ্গীর যখন মেহেরুন্নিসাকে পাশে নিয়ে তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষের বেলেপাথরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ছাগল আর উটের পালকে পানি খাওয়াতে নিচে যমুনার তীরে রাখালের দল এসেছে এবং গাধভূমিতে কালচে-ধূসর রঙের মহিষেরা উষ্ণ বাদামি পানিতে দিনের শেষবারের মত গড়াগড়ি দিয়ে নিচ্ছে।

জাহাঙ্গীর তারপরে অস্তগামী সূর্যের দিক থেকে অশ্বারোহীদের একটা ক্ষুদ্র দলকে দূর্গের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে। দলটা আরেকটু কাছে আসলে সে দলের একেবারে সম্মুখে নিজের ছোট ছেলে শাহরিয়ারকে চিনতে পারে এবং তার পেছনে কব্জিতে টোপর পড়ান বাজপাখি নিয়ে রয়েছে দু’জন শিকারী। তৃতীয় আরেক শিকারীর পর্যাণ থেকে ঝুলতে থাকা মৃত পাখির সংখ্যা দেখে বোঝা যায় তাদের পাখি শিকারের অভিযান বেশ সফল হয়েছে।

‘আপনি জানেন যে হেরেমে শাহরিয়ার একটা চিরকুট পাঠিয়ে লাডলিকে গর্ব করে বলেছে যে তাঁর বাজপাখিরা আজ কমপক্ষে এক ডজন পাখি শিকার করবে?’ মেহেরুন্নিসা জিজ্ঞেস করে। আমার মেয়ে উত্তর দিয়েছে সে যদি শিকারের সংখ্যা দ্বিগুণ করতে না পারে তাহলে খামোখা যেন বড়াই না করে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সে সফল হয়েছে। সে প্রায় আপনার মতই একজন চৌকষ খেলোয়াড় হয়ে উঠছে।

‘বলার অপেক্ষা রাখে না তুমিও…’।

‘আমাকে আর তোষামদ করতে হবে না। মেহেরুন্নিসা হেসে উঠে তারপরে বলে, ‘আমি শীঘ্রই লাডলিকে গাদাবন্দুক দিয়ে গুলি করতে শিখাবো। তাঁর এখন পনের বছর বয়স–শিকারে পর্দা দেয়া হাওদায় আমার সঙ্গী হবার মত তার যথেষ্ট বয়স হয়েছে।

জাহাঙ্গীর অন্ধকার হয়ে আসা আকাশের বুকে তার অবশিষ্ট একটা কবুতরের খোঁজে তাকিয়ে থাকে। শাহরিয়ারের বাজপাখি নিশ্চয়ই তাঁর কবুতর শিকার করে নি, নাকি করেছে? শাহরিয়ারকে তিনি বারবার নিষেধ করেছেন দূর্গের কাছাকাছি কখনও বাজপাখি নিয়ে শিকার না করতে কিন্তু তিনি ঠিক নিশ্চিত নন তার ছোট ছেলে তার নির্দেশের প্রতি কতটা মনোযোগ দেয়। তাছাড়া, কবুতরগুলোও তাদের যতদূর যাওয়া উচিত প্রায়ই সেই সীমা অতিক্রম করে আরো দূরে চলে যায়। তিনি তারপরেই পাখিটা দেখতে পান, পালকগুলো রাঙিয়ে হাল্কা লাইলাক ফুলের রঙে রাঙান, তাঁর কাছেই পাথরের রেলিং এর উপরে নামার জন্য উড়ে আসছে। তিনি যখন বিলম্বে আগত পাখিটিতে আলতো করে কবুতরের খোপে তুলে রাখছেন, মেহেরুন্নিসা তাঁর কথা চালিয়ে যায়, আমি ভাবছিলাম যে আপনাকে জিজ্ঞেস করবো–লাডলি সম্বন্ধে কি শাহরিয়ার আপনার কাছে কখনও কিছু বলেছে?

জাহাঙ্গীর এক মুহূর্ত চিন্তা করেন। শাহরিয়ারের সুদর্শন মাথাটা মনে হয় অন্য কোনো কিছুর চেয়ে শিকার আর বাজপাখি উড়ানো নিয়েই বেশি মেতে থাকে। নাহ্, আমার মনে পড়ে না, কেন?

নাহ্, ব্যাপারটা হয়ত কিছুই না কিন্তু সম্প্রতি বেশ কয়েকবার সে আমার কাছে লাডলি সম্পর্কে মুগ্ধ ভঙ্গিতে কথা বলেছে–বেশ কয়েকবার সে তার সাথে দেখা করেছে এবং নওরোজের উৎসবের সময় তারা একত্রে আলাপও করেছে। সে কথা শেষ করে কাঁধ ঝাঁকায়। সে তাঁর সম্পর্কে এমন কিছু বলেনি কিন্তু ব্যাপারটা হল যেভাবে সে কথাগুলো বলেছে।’

‘তোমার ধারণা লাডলির জন্য তার ভেতরে কোনো অনুভূতি কাজ করছে? ‘আমি জানি না। হয়ত…’

‘আমি তার সাথে কথা বলে দেখতে পারি।’

হা। আপনি আর শাহরিয়ার আজকাল বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। আমি নিশ্চিত, আপনার কাছে সে তাঁর মনে কথা খুলে বলবে… এবং লাডলির জন্য যদি তাঁর মনে কোনো ভালোবাসা কাজ করে থাকে তাহলে তাকে বলবেন এসব ভাবনা যেন সে এখানেই শেষ করে।

জাহাঙ্গীর বিস্ময়ে চোখ পিট পিট করে। শাহরিয়ার তার দিকে কেন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাতে পারবে না… এবং তাকে বিয়ে করলেই কি সমস্যা?

কিন্তু আমি মনে করেছিলাম আপনার ইচ্ছা সিন্ধের কোনো রাজপরিবার থেকে আপনি তার জন্য বধূ নির্বাচিত করবেন?

‘আমি তাই চাই। আমি ইতিমধ্যে বিষয়টা নিয়ে আমার পরামর্শদাতাদের সাথে আলোচনাও করেছি, কিন্তু সেটা ভবিষ্যতের বিষয়। শাহরিয়ার সিন্ধ থেকে যেকোনো সময় একজন স্ত্রী গ্রহণ করতে পারে কিন্তু এসব কিছুই তোমার মেয়েকে প্রথমে বিয়ে করা থেকে তাকে বিরত রাখতে পারে না। আর তাছাড়া, আমি তোমার ভাইঝির সাথে খুররমের বিয়ের অনুমতি দিয়েছিলাম পার্সী রাজকন্যাকে বধূ হিসাবে বরণ করার পূর্বে…’

মেহেরুন্নিসার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। শাহরিয়ার যদি সত্যিই লাডলিকে বিয়ে করতে আগ্রহী হয়, আমার কাছে এর চেয়ে আনন্দের আর কিছুই হতে পারে না–আপনি জানেন আমি তাকে কতটা পছন্দ করি।’

‘আমার মনে হয়, সে সবসময়ে তাঁর দাবিদার … গত সপ্তাহেই তাকে আমি তিরষ্কার করেছি আমাদের অশ্বারোহী বাহিনীর জন্য নতুন কতগুলো ঘোড়া কিনতে হবে সে বিষয়ে আমার অশ্বশালার প্রধানের সাথে সে আলোচনা করতে ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু তার বয়স এখন অল্প এবং সময় হলে শিখে নেবে। কে জানে, হয়ত বিয়ে করলে তার ভিতরে দায়িত্ববোধ জন্ম নেবে। আমি এখনই গিয়ে তাকে খুঁজে বের করছি।’

মেহেরুন্নিসা, কবুতরের খোপের কাছে একাকী প্রসন্নচিত্তে দাঁড়িয়ে থাকে। সে ভাবতেও পারেনি বিষয়টা এত সহজে সমাধা হবে। সে জানে শাহরিয়ার জাহাঙ্গীরকে ঠিক কি বলবে। শাহজাদাকে সে এই মুহূর্তের জন্য তিল তিল করে প্রস্তুত করেছে, অকপট আর প্রভাবিত করা সম্ভব এমন এক তরুণকে তার জন্য এবং তাঁর সুদর্শন চেহারার জন্য লাডলির মুগ্ধতার ইঙ্গিত দিয়ে এবং সেই সাথে এটাও নিশ্চিত করেছে বিনিময়ে সে যেন লাডলির সন্দেহাতীত সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণ করার যথেষ্ট সুযোগ লাভ করে। শাহরিয়ার তাকে ভালোবাসে এই বিষয়ে যুবরাজকে নিজেকে বিষয়টা বোঝাতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় নি। আর তাঁর মেয়ে, সে তাকে আগেই ভাবতে শিখিয়েছে যুবরাজের সাথে বিয়ের চেয়ে ভালো কোনো সম্বন্ধ হতে পারে না।

এই তরুণ দম্পতি সুখী হবে–এবং সে নিজেও, বিশেষ করে যখন শাহরিয়ারকে উত্তরাধিকারী ঘোষণা করতে জাহাঙ্গীরকে সে রাজি করাতে পারবে এবং সেটা করতেও বেশিও দিন সময় লাগবে না। বিপর্যয় কিংবা মতানৈক্যের সাথে অপরিচিত এবং তেজোদীপ্ত, খুররম, তাঁর চরিত্রের সাথে পরিচিত থাকায় সে যেমনটা আশা করেছিল ঠিক সেভাবেই, তাকে লাল তাবু স্থাপনের অধিকার থেকে তাঁর আব্বাজান বঞ্চিত করায় ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। সে আহত আর রুষ্ট হয়ে একটা চিঠি লেখে যেখানে প্রচলিত চমৎকারিত্বপূর্ণ সৌজন্যতা অনুপস্থিত যা মোগল শিষ্টাচারের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। জাহাঙ্গীরকে বিষয়টা ভীষণ ক্রুদ্ধ করে, যে চিঠিতে সৌজন্যতাবোধের অনুপস্থিতিকে নিজের মর্যাদার প্রতি প্রকাশ্য অপমান হিসাবে বিবেচনা করে। তিনি তাঁর একদা প্রিয় পুত্রকে যে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছেন সেটা ক্রমেই বাড়তে শুরু করে। সে যদি তাদের ভিতরে একটা প্রকাশ্য বিভেদের জন্ম দিতে পারে তাহলে তার নিজের স্থান দুর্ভেদ্য হয়ে উঠবে। এবং জাহাঙ্গীরের স্বার্থেই সবকিছু হবে। আর সর্বোপরি, সে ছাড়া অন্তরে তাঁর স্বার্থকে আর কে এতটা গুরুত্ব দেয়।

*

জাহাঙ্গীর এক মাস পরে তাঁর ব্যক্তিগত কক্ষে, অনুষ্ঠানের জন্য আজ রঙিন লণ্ঠন চারপাশে ঝুলছে, লাডলির পেলব আঙুলে পান্নার একটা বাগদানের আংটি পরিয়ে দেয় তারপরে তাঁর হাতটা নিয়ে শাহরিয়ারের হাতে দেয়। ‘আমি আজ এই আংটি পরিয়ে তোমাদের আসন্ন মিলনকে আশীর্বাদ করছি। এই বিয়ে তোমাদের জন্য সুখ আর সমৃদ্ধি এবং অসংখ্য সন্তানের সৌভাগ্য বয়ে আনুক। জাহাঙ্গীর বাগদানের নেকাবের আড়ালে লাডলির অভিব্যক্তি দেখতে পায় না কিন্তু মেহেরুন্নিসার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে সে তাকে আনন্দিত দেখে। তিনি খুব ভালো করেই জানেন যে তাকে পুত্র সন্তান উপহার দিতে না পারার বিষয়টা তাকে খুব কষ্ট দেয়–এবং বিয়ের এত বছর পরে সেটা হয়ত আর সম্ভব না–কিন্তু সে তাকে বলেছে যে তার একমাত্র সন্তানকে তার একজন পুত্রের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হতে দেখাটা তার কষ্টের উপশম হিসাবে কাজ করবে। তিনি নিজে অবশ্য বিষয়টা নিয়ে যতই চিন্তা করেন ততই তিনি এই মিলনের কারণে প্রীত বোধ করেন। শাহরিয়ারের যদিও এখনও অনেক কিছু শেখা বাকি আছে, সে সুপুত্র আর ভরসা করা যায় এমন ছেলে, পারভেজের কোনো বদভ্যাস বা খুররমের মত ক্রমশ গর্বিত বা উদ্ধত সে হবে না।

খুররমের কথা মনে পড়তে, জাহাঙ্গীরের মুখের অভিব্যক্তি বদলে যায়। শাহরিয়ারের বাগদানের সংবাদ সে যখন শুনতে পাবে তখন তার কি প্রতিক্রিয়া হবে? আব্বাজান তাকে বিষয়টা লিখিতভাবে জানায়নি বলে কি সে অপমানিত বোধ করবে? বেশ, তার অপমানিত বোধ করাই উচিত। সে তার নিজের শ্রদ্ধার ঘাটতির কারণে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করতে পারে না। সে যাই হোক, তিনি এখন যে ঘোষণা করতে যাচ্ছেন সেটা অনেক বেশি শীতল আচরণ হবে। শাহরিয়ার, তোমার বাগদানের উপহার হিসাবে আমি তোমাকে বাদাখপুর-জমিদারির–জাগির তোমায় দিচ্ছি এর পূর্ববর্তী জায়গিরদার সম্প্রতি মারা যাওয়া এটা আবারও সম্রাটের কাছে অর্পিত হয়েছে।

‘আব্বাজান, আপনাকে ধন্যবাদ। শাহরিয়ার হাঁটু মুড়ে বসে এবং জাহাঙ্গীর অঙ্গুরীয় পরিহিত হাতে তার মাথা স্পর্শ করে, তার উদারতায় ছেলেকে এতটা আপুত হতে দেখে প্রীত হয়েছে। একজন সন্তানের আচরণ–শ্রদ্ধা আর বিনয়ের সাথে এমন হওয়া উচিত। দাক্ষিণাত্যের উদ্দেশ্যে খুররম যাত্রা করার কিছুদিন পূর্বে জাহাঙ্গীর তাকে বাদখপুরের সমৃদ্ধ আর উর্বর জমিদারি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। জমিদারিটা এখন তার কনিষ্ঠ সৎ-ভাইকে তিনি দিয়েছেন এই সংবাদটা, মেহেরুন্নিসা যেমন বলেছে, আরেকটা হিতকার শিক্ষা বলে প্রতিয়মান হবে এবং সম্ভবত তাকে বাধ্য করবে বশীভূত হতে।

১.১৫ গৃহ প্রত্যাবর্তন

চম্বল নদীর বালুকাময় তীরে দুটো লাল-মাথাঅলা সারস নিশ্চল দাঁড়িয়ে রয়েছে। খুররমের বাহিনী কাছাকাছি পৌঁছালে তারা আকাশে ভাসে, তাদের সরু পা ঘুড়ির লেজের মত ভাসতে থাকে। এক জোড়া চকচকে মসৃণ মাথাবিশিষ্ট লম্বা গলাওয়ালা করমোরান্ট মাছের খোঁজে পানিতে ডুব দেয় কিন্তু দৃশ্যপটের এহেন সমাহিত সৌন্দর্য খুররমকে স্পর্শ করে না। দাক্ষিণাত্য থেকে উত্তরে তার দীর্ঘ ঝটিকা সফরের সময় পুরো চম্বল এলাকা তাঁর কাছে ছিল শেষ প্রতিবন্ধকতা। প্রথম সকালের আলো থেকে চোখ আড়াল করে সে নদীর অগভীর অংশ যাকে প্রতর বলে সেদিকে তাকায় যেখানে পিঠে জ্বালানী কাঠ বোঝাই উটের সারি নিয়ে ইতিমধ্যেই তাদের চালকেরা অতিক্রম করতে আরম্ভ করেছে। বর্ষাকাল যদিও নিকটেই কিন্তু এখনও বৃষ্টি পুরো দমে শুরু না হওয়ায় নদীর পানি বেশ নিচু দেখায়। সে এবং তার লোকজনের নদী অতিক্রম করতে কোনো অসুবিধা হবার কথা না। ভাগ্য সহায় থাকলে রাত নামার আগেই তারা আগ্রা পৌঁছে যাবে।

মালিক আম্বারের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের জন্য সে ঠিক যখন তাকে তার ভূখণ্ডের গভীরে ধাওয়া করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে তখন মাঝ পথে সে তার অভিযান সমাপ্ত করতে চায়নি কিন্তু সে বুঝতে পেরেছে তার সামনে অন্য কোনো বিকল্প নেই। তাকে জানতেই হবে তাঁর আব্বাজানের মনে কি রয়েছে। সে এখন থেকে আর টকটকে লাল তাবু স্থাপনের সম্মান লাভ করবে না বার্তা প্রেরণ করে জানানই ছিল যথেষ্ট অপমানজনক, কিন্তু এই ঘটনার পরে সে যখন জানতে পারে যে জাহাঙ্গীর প্রথমে তাকে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শাহরিয়ারকে সেই জমিদারি দান করেছে তার মানসিক শান্তির প্রতি এটা আরো বিব্রতকর আঘাত হানে। কিন্তু অচিরেই–সম্ভবত আর কয়েক ঘন্টার ভেতর–সে তার আব্বাজানের মুখোমুখি দাঁড়াবে এবং তার কাছে জানতে চাইবে সে কীভাবে তাকে অসন্তুষ্ট করেছে। তার আব্বাজান নিশ্চয়ই তাঁর অনুরোধের যথাযথ উত্তর দেবেন যদি সে ব্যক্তিগতভাবে সেটা তার কাছে পেশ করতে পারে।

খুররম যা আশা করেছিল বস্তুতপক্ষে যাত্রার শেষ অংশটুকু সমাপ্ত করতে তার চেয়ে একটু বেশিই সময় লাগে। চম্বল অতিক্রম করার পরেই, কালচে-বেগুনী রঙের মৌসুমী মেঘ, পশ্চিম দিক থেকে তাঁদের দিকে ধেয়ে এসে অঝোর ধারায় বর্ষণ শুরু করে, নিমেষের ভিতরে পায়ের নিচের মাটিকে পিচ্ছিল কাদায় পরিণত করায় তাদের পরিশ্রান্ত ঘোড়া আর মালবাহী প্রাণীগুলো এর উপরে পিছলে যায় এবং আছাড় খায়। কিন্তু সূর্যাস্তের ঠিক আগে আগে খুররম বৃষ্টির ভিতরে তাঁর হাভেলীর সদর দরজার দু’পাশে দপদপ করে জ্বলতে থাকা মশালের আলো দেখতে পায়, তাঁদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত হয়ে দরজার পাল্লা দুটো ইতিমধ্যে খুলে দেয়া হয়েছে। সে অবশ্য আগেই অনেক বিচারবিবেচনার পরে তাঁর আব্বাজানকে একটা ছোট চিঠি লিখেছে যেখানে সে তাঁর আহত অপাপবিদ্ধতার কথা বয়ান করেছে। আপনাকে ক্রুদ্ধ করার মত আমি কি করেছি সেটা না জেনে আমার পক্ষে আর দাক্ষিণাত্যে অবস্থান করা সম্ভব নয়। আমি কেবল আমার দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু আপনি আমার সাথে এমন আচরণ করছেন যেন আমি আপনার বিরোধিতা করেছি। আমি যখন আগ্রা পৌঁছাব আমি যেকোনো অভিযোগ, প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত থাকবো।

খুররম দুলকি চালে হাভেলীর আঙিনায় প্রবেশ করে এবং ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে মাটিতে নেমে লাগামটা তার কচির উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেয়। আরজুমান্দ আর বাচ্চারা পর্দা ঘেরা যে বিশাল গরুর গাড়িতে রয়েছে সেটা কেবলই মাত্র গড়িয়ে গড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। গাড়িটা থামতে খুররম ভেজা পর্দা তুলে ভেতরে উঁকি দেয়। আরজুমান্দ যদিও কোনোমতে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে তবুও স্পষ্টই সেখানে ক্লান্তি আর কষ্টের ছাপ বোঝা যায় এবং নিজের স্ফীত উদরে সে হাত দিয়ে রেখেছে। সাম্প্রতিক এই গর্ভাবস্থা বেশ কষ্টকর বলে প্রতিয়মান হচ্ছে। চার বছরের জাহানারা এবং তার ছোট বোন রওসোন্নারা যাকে সে কোলে নিয়ে আছে, দু’জনেই তাঁদের আম্মিজানের মতই জেগে রয়েছে কিন্তু তাঁদের দুই ভাই দারা শুকোহ্ আর শাহ শুজা ঘুমিয়ে কাদা, কুকুরের বাচ্চার মত তাদের দেহগুলো পরস্পরের সাথে কুণ্ডলী করে রয়েছে। খুররম তাঁর পরিবারের কচি সদস্যদের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় তার মাঝে ক্রোধের সঞ্চার হতে শুরু করে এই জন্য যে তাঁদেরও বাধ্য হয়ে এই ঝটিকা সফরের বিপদ আর কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। সে আগ্রায় গতবার যখন ফিরে এসেছিল সেবারের তুলনায় এবারের ফিরে আসা কত আলাদা, যখন আব্বাজান তার উপরে মোহর আর রত্ন বর্ষণ করে তাকে বরণ করেছিল এবং তাকে ‘শাহ জাহান’ নামে অভিনন্দিত করেছিল।

*

‘যুবরাজ, আপনার কাছে একজন অতিথি এসেছে।

খুররম উঠে দাঁড়ায়। সে আঙিনার মার্বেলের সূর্যঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে যে দুপুর প্রায় হয়ে এসেছে। সে গতরাতে তাঁর আব্বাজানের সাথে দেখা করার অনুরোধ জানিয়ে দূর্গে যে বার্তা প্রেরণ করেছিল সে তার উত্তরের জন্য সারা সকাল অপেক্ষা করেছিল। এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করিয়ে রাখা আরো একটা উপেক্ষাপূর্ণ আচরণ যদিও জাহাঙ্গীরের সাথে দেখা করার জন্য তাকে আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না। কিন্তু অতিথির চেহারা দেখে খুররমের মুখ নামিয়ে নেয়। তাঁর আব্বাজানের উজির মাজিদ খান বা দরবারের অন্য কোনো উচ্চপদস্থ অমাত্যের পরিবর্তে, সে ইংরেজ রাজদূতের কৃশকায়, লম্বা অবয়ব দেখতে পায়। স্যার টমাস রো যখন সামনে এগিয়ে আসে সে তার হতাশার মাঝেও লক্ষ্য করে তাকে দেখতে কতটা আলাদা লাগছে। লোকটা আগের চেয়েও কৃশকায় হয়েছে, তার দাগ টানা ছোট পাতলুনের নিচে দিয়ে বের হয়ে থাকা উরুদ্বয় খুররমের উৰ্দ্ধবাহুর চেয়ে সামান্যই পেষল হবে, এবং তার একদা লালচে মুখাবয়ব ফ্যাকাশে দেখায়। তাঁর চোখের সাদা অংশ প্রায় হলুদ হয়ে আছে এবং খুররম লক্ষ্য করে যে তার সামান্য কাঁপতে থাকা হাতে ধরে থাকা আবলুস কাঠের লম্বা লাঠিটা, যার হাতলে জমকালো ফিতে জড়ানো রয়েছে, মর্যাদা বা আভিজাত্যের জন্য নয় বরং অবলম্বনের কাজ করছে। দূতমহাশয় লাঠিটার উপরে ভীষণভাবে ভর দিয়ে রয়েছেন।

‘যুবরাজ, আমার সাথে দেখা করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

রেশমের চাঁদোয়ার নিচে একটা নিচু কাঠের আসনে বসার জন্য খুররম রো’কে ইঙ্গিত করে এবং পরিচারকদের তাকিয়া নিতে আসবার জন্য আদেশ দেয়। সে দূতমহাশয়কে কখনও পছন্দ করতো না–সব বিদেশী যারা দরবারে এসে সমবেত হয়েছে তাদের সবাইকে সে অবিশ্বাস করে এবং এই নমুনার প্রতি তাঁর আব্বাজানের আগ্রহ তাঁর কাছে দুর্বোধ্য মনে হয়েছে–কিন্তু লোকটার শারীরিক অবস্থা তাঁর সৌজন্যতাবোধের দাবি করে। রো সতর্কতার সাথে আসনের উপরে নিজেকে উপবিষ্ট করে এবং এটা করার সময়েই যন্ত্রণায় তাঁর চোখমুখ কুঁচকে যায় এবং কোনোভাবেই নিজের মুখ থেকে মৃদু গোঙানির আওয়াজ নিঃসৃত হওয়া বন্ধ করতে পারে না। যুবরাজ, আমি দুঃখিত। আমার পাকস্থলী আমাকে বেশ কষ্ট দিচ্ছে। আমার পাকস্থলীই কেবল না, দূতমহাশয় যন্ত্রণায় বাঁকানো মুখে ভাবে। তার পেটের নাড়িভুড়ি এখনও পীড়ন করছে। একটা সপ্তাহও ভালোমত অতিক্রান্ত হতে পারে না তার আগেই তারা আমাশয়ে আক্রান্ত হয়, এবং সে এখন অর্শরোগের কারণে বিব্রত- ইংল্যান্ডে বাড়িতে স্ত্রীর কাছে তাঁর ক্রমশ নালিশ করার স্বভাব লাভ করা চিঠিতে সে তাদের আমার পান্না বলে অভিহিত করে। সে অবশ্য এসব কিছুই এই তরুণ অহঙ্কারী যুবরাজের কাছে বলবে না। আলোচনার জন্য আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। খুররম দাক্ষিণাত্য থেকে ফিরে আসছে শোনার পর থেকেই সে তার সাথে দেখা করবে কিনা সেটা নিয়ে যুক্তির জাল বুনছে। তাঁদের আলোচনাটা বেশ কষ্টসাধ্য হবে কিন্তু আলোচনাটা করা তাঁর নিজের দেশ, নিজের সম্রাটের প্রতি তার দায়িত্ব।

‘যুবরাজ, আমার যা বলার আছে আমি সেটা কেবল আপনাকেই বলতে চাই।’

‘আমাদের একা থাকতে দাও, খুররম তাঁর পরিচারকদের আদেশ দেয়, এবং তাঁর দিকে ঝুঁকে আসে। কি বলতে চান?

রো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নিশ্চিত হতে যে আসলেই চারপাশে আর কেউ নেই। যুবরাজ, আপনি আগ্রা ফিরে আসবার পরে এত দ্রুত আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি বলে আমায় মার্জনা করবেন কিন্তু আপনার সাথে আমার দেখা হওয়াটা ভীষণ জরুরি ছিল। আপনার আব্বাজানের দরবারে আমি যদিও একজন বহিরাগত, কিন্তু আপনাদের এখানে অবস্থান করার সময় আমি আপনাদের ভাষা আয়ত্ত্ব করেছি এবং দরবারের অমাত্যদের অনেকের সাথে বন্ধুত্ব করার সুযোগ আমার হয়েছে। আমি আপনার আব্বাজানের অনুগ্রহ কিছু সময়ের জন্য উপভোগ করেছিলাম। বস্তুতপক্ষে, একটা সময়ে আমার মনে হত যে তিনি আমাকে তার একজন বন্ধুর চোখে দেখেন…’

তিনি কি তাহলে আপনাকে এখানে প্রেরণ করেন নি? ভাবনাটা সহসা খুররমের মনে উঁকি দেয়।

না। আমি তার নয়, আমার নিজের কৈফিয়ত দেয়ার জন্য এসেছি, আপনার আব্বাজানের নয়। সত্যি কথা বলতে, বেশ কিছুদিন যাবত তাঁর সাথে আমার একান্ত মোলাকাত হয়নি। আমি আপনাকে যা বলতে চাইছি তা আপনার কাছে হয়ত অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে কিন্তু আমার কথা বিশ্বাস করার জন্য আমি আপনাকে অনুরোধ করছি।’ রো তার দুই হাত নিজের হার ছড়ির উপর রেখে সামনের দিকে ঝুঁকে আসে। সম্রাজ্ঞী মেহেরুন্নিসার ব্যাপারে সাবধান থাকবেন। তিনি এখন আর আপনার বন্ধু নন। বাস্তবিক পক্ষে তিনি এখন আপনার শত্রু।

‘মেহেরুন্নিসা? ইংরেজ হতভাগার কি দেহের সাথে সাথে মস্তিষ্কবিকৃতিও শুরু হয়েছে? তাঁর এই উদ্ভট অভিযোগ বা সেটা করার সময় তার অসহিষ্ণুতা আর কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব না। আপনি ভুল করছেন, কামরান শীতল কণ্ঠে বলে। সম্রাজ্ঞী সম্পর্কে আমার স্ত্রীর ফুপুজান–আমার সন্তানদের পিতামহী। পারিবারিক বন্ধনের সাথে সাথে আমার স্ত্রীর প্রতি তার ভালোবাসার কারণে আমি জানি এটা অসম্ভব একটা ব্যাপার।

‘যুবরাজ, আমার কথা ভালো করে শোনেন। আমি শীঘ্রই ইংল্যান্ডে আমার স্বদেশে ফিরে যাচ্ছি। আমার শরীরের পক্ষে আর এখানকার আবহাওয়ার অত্যাচার সহ্য করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমি দেশে ফিরে যাবার সময় অন্তত এটুকু সন্তুষ্টি নিয়ে ফিরে যেতে চাই যে আমি আপনাকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছিলাম যদিও আপনি আমার কথায় কর্ণপাত করেন নি। আপনি একটা কথা মনে রাখবেন যে বিদেশী হবার কারণে আমি আপনাকে এমন কথা অবলীলায় বলতে পারি যা মোগল কোনো অমাত্য আপনাকে বলার সাহস করবে না। আপনার আব্বাজান কেন আপনার উপর বিরূপ হয়েছেন নিজেকে কেবল এই একটা প্রশ্নই করেন… নিজেকে জিজ্ঞেস করেন কেন তিনি শাহজাদা শাহরিয়ারকে আজকাল বেশি প্রশ্রয় দিচ্ছেন…’।

খুররম দূতমহাশয়ের অকপট কথায় চমকে উঠে। আমাদের মাঝে কিছুটা ভুল বোঝাবুঝির জন্ম হয়েছে, সে আড়ষ্ট কণ্ঠে বলে।

না। পুরো ব্যাপারটায় সম্রাজ্ঞীর নিজের হাত রয়েছে। তিনি নিজেকে ভীষণ চতুর মনে করলেও দরবারের অনেকেই তাঁর দুরভিসন্ধি আঁচ করতে পেরেছে। আপনি যখন দাক্ষিণাত্যে ছিলেন তখন তিনি শাহজাদা শাহরিয়ারকে সম্রাটের সুনজরের আনতে তাঁর সাধ্যের ভিতরে যা কিছু রয়েছে সবকিছুই করেছেন। আমি পুরো বিষয়টা নিজের চোখের সামনে ঘটতে দেখেছি এবং নিজেকে প্রশ্ন করেছি কেন। শাহজাদা নিজে এমন কোনো বিশেষ যোগ্যতা বা প্রতিভার অধিকারী নয় এবং–যুবরাজ, আমায় মার্জনা করবেন, আপনার সৎ-ভাই সম্বন্ধে এমন মন্তব্য করেছি বলে–আমার কানে এমন কথাও এসেছে যে তিনি নাকি খানিকটা স্থূলবুদ্ধির। সম্রাজ্ঞীর নিজের মেয়ের সাথে বাগদানের বিষয়টা যখন আমার কানে আসে, পুরো ব্যাপারটা আমার সামনে দিনের মত পরিষ্কার হয়ে যায়। সম্রাজ্ঞী ক্ষমতার জন্য লালায়িত। আপনি সম্ভবত জানেন না তিনি নিজে কত আদেশ জারি করেন, কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অনেকে তাকে পর্দার অন্তরালবর্তিনী সম্রাট হিসাবে অভিহিত করে থাকে। তিনি সম্রাটকে দিয়ে শাহরিয়ারকে–আপনি নন–তাঁর উত্তরাধিকারী হিসাবে ঘোষণা করতে প্ররোচিত করছেন। আপনার আব্বাজানের ইন্তেকালের পরে তিনি হিন্দুস্তান শাসন করবেন। শাহজাদা শাহরিয়ার আর শাহজাদী তার ক্রীড়ানকে পরিণত হবে।

খুররম অপলক দৃষ্টিতে দূতমহাশয়ের আন্তরিক মুখাবয়বের দিকে তাকিয়ে থাকে, চাঁদোয়ার নিচে ছায়ায় অবস্থান করার পরেও তার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছে। রো এখন পর্যন্ত যা কিছু বলেছে সবই অসম্ভব, কিন্তু তারপরেও… আমার আব্বাজান কখনও তাকে এভাবে প্রভাবিত করার অনুমতি নিজের স্ত্রীকে দেবেন না, সে মন্থর কণ্ঠে বলে, যতটা না দূতমহাশয়ের উদ্দেশ্যে তাঁর চেয়ে বেশি যেন নিজেকেই শোনায়।

‘আপনার আব্বাজান বদলে গিয়েছেন। শাসনকার্য তাঁর কাছে বিরক্তিকর মনে হয়। আপনি তার যেকোনো পরামর্শদাতাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। সম্রাজ্ঞী তাকে কাজ থেকে বিরত থেকে, প্রকৃতি সম্বন্ধে তাঁর আগ্রহের উত্তর খুঁজতে তাকে প্ররোচিত করেন যা তাকে ভীষণভাবে ব্যস্ত রাখে, তাকে সুরাপান আর আফিম গ্রহণে প্ররোচিত করেন… তিনি সম্রাটকে পুরোপুরি নিজের উপরে নির্ভরশীল করে ফেলেছেন এবং তাঁর আস্থাকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অপব্যবহার করছেন।

‘আপনি বলছিলেন আপনি এখন আর আমার আব্বাজানের প্রিয়পাত্র নন। কি হয়েছিল?

‘আমি ঠিক নিশ্চিত নই। একটা সময় ছিল যখন সম্রাটের সাথে আমি প্রচুর সময় কাটিয়েছি। আমি যখন প্রথমবার অসুস্থ হই, তিনিই সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন, উপশমের বিষয়ে নানা পরামর্শ দিয়েছিলেন এমনকি নিজের ব্যক্তিগত হেকিমকে একবার আমার চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু আমার প্রতি তার আগ্রহ ক্রমশ হ্রাস পায়। কিছুদিনের ভিতরেই আমি যখন সুস্থ থাকতাম তাঁর ডেকে পাঠাবার হার ক্রমশ পূর্বের চেয়ে হ্রাস পেতে থাকে এবং একটা সময় বন্ধই হয়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে কেবল রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানেই তাঁর সাথে আমার দেখা হয়েছে।

‘আমার আব্বাজান সম্ভবত আপনাদের বাণিজ্য শুল্ক হ্রাসের অনুরোধে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। খুররম রো’র অভিব্যক্তি দেখে বুঝতে পারে তাঁর মন্তব্য একেবারে জায়গামত আঘাত হেনেছে এবং সে কথা চালিয়ে যায়।

‘আপনি আমাকে সতর্ক করার সম্ভষ্টির কথা বলছিলেন। স্যার টমাস, কেন? আমার আব্বাজান তাঁর কোনো সন্তানকে প্রশ্রয় দেবেন সেটা নিয়ে আপনার কেন এত আগ্রহ?

‘আমার কাছে এটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ মক্কায় হজ্জযাত্রী পরিবহণে পর্তুগীজ আর আরব জাহাজের সাথে ইংরেজ জাহাজকে অনুমতি দিতে আমার অনুরোধ সম্রাট প্রত্যাখান করেছেন। আমার রাজা এতে দারুণ আশাহত হবেন। আপনার আব্বাজান যদি অনুমতি দিতেন তাহলে আরো অনেক ইংরেজ জাহাজ সুরাটে আসতো এবং সেখানে অবস্থিত আমাদের বাণিজ্য কুঠি তাহলে সমৃদ্ধি লাভ করতো। ইংল্যান্ড থেকে আমাদের জাহাজগুলো তাহলে আরো বেশি পরিমাণে পণ্যসামগ্রী নিয়ে আসতে পারতো এবং সেই সাথে হিন্দুস্তান থেকে আরবে বাণিজ্যের সাথে সাথে হজ্জযাত্রীদের বহন করতে পারতো কিংবা দেশে আরো বেশি পরিমাণে এখানের পণ্য নিয়ে যেতে পারতো। বাণিজ্য হওয়া উচিত প্রতিটা সভ্য দেশের আদর্শ এবং মোগল সাম্রাজ্যের সাথে ইংল্যান্ডের বাণিজ্য বিপুলভাবে সমৃদ্ধি লাভ করতো।

খুররম ভাবে, বাণিজ্যের জন্য ফিরিঙ্গিগুলোর এই উৎসাহের বিষয়টা সে হয়তো কোনোদিনই ঠিকমত বুঝতে পারবে না। রো একজন অভিজাত ব্যক্তি কিন্তু তিনি যখন ব্যবসার লাভ নিয়ে কথা বলেন তখন বাজারের মামুলি যেকোনো ব্যবসায়ীর মত তাঁর চোখ মুখ চকচক করতে থাকে। দৃতমহাশয় উত্তেজনার বশে হাত থেকে নিজের লাঠিটা ফেলে দেয় এবং তিনি ঝুঁকে সেটা তুলে নেয়ার আগেই কথা বলতে শুরু করে।

‘আমি বড় আশা করে এসেছিলাম যে নিজেকে রক্ষা করতে আমার তথ্য আপনাকে সাহায্য করবে… যে আপনি পরবর্তীতে মনে রাখবেন যে একজন ইংরেজ আপনাকে সতর্ক করেছিল এবং কৃতজ্ঞ বোধ করবেন… এবং একদিন আপনি যখন সম্রাট হবেন, আমি আশা করি এবং বিশ্বাস করি আপনি হবেন, তখন আমার মাতৃভূমির দাবি আপনার সুনজরে থাকবে।

‘নিজেকে রক্ষা করা বলতে আপনি ঠিক কি বোঝাতে চাইছেন?

‘সম্রাজ্ঞী নিজে একবার যখন এই সর্বনাশা খেলায় নেমেছেন তখন তিনি যতক্ষণ না আপনার এবং আপনার আব্বাজানের মাঝে একটা প্রকাশ্য বিরোধের সৃষ্টি করতে পারছেন–এমনকি যুদ্ধের সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না–ততক্ষণ তিনি বিরত হবেন না। খুররমের চোখে মুখে ততক্ষণ সন্ধিগ্ধ অভিব্যক্তি দেখে রো হতাশ ভঙ্গিতে নিজের মাথা নাড়ে। যুবরাজ, আমি এতক্ষণ আপনাকে যা বলেছি তা একটু ভেবে দেখবেন। আমি আপনাকে দিব্যি দিয়ে বলতে পারি যে আমি একটা কথাও মিথ্যা বলিনি। আপনি যদি আমার কথা উপেক্ষা করেন তাহলে আখেরে আপনারই ক্ষতি হবে।

খুররমের মনের অবিশ্বাসের মেঘ ভেদ করে প্রথমবারের মত রো’র আন্তরিক কণ্ঠস্বর, তাঁর আবেগপূর্ণ প্রত্যয় প্রবেশ করে। মেহেরুন্নিসা… তাঁর পক্ষে কি আসলেই এমনটা করা সম্ভব–কোনো অবাধ্য কর্মচারী কিংবা উচ্চাকাঙ্খি অমাত্যর পরিবর্তে–যে আব্বাজানকে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছে? তিনি যদি আসলেই তার শত্রুতে পরিণত হয়ে থাকেন তাহলে প্রতিটা হতবাক করে দেয়া ঘটনা এতদিন যার কোনো ব্যাখ্যা ছিল না সবকিছুই অর্থবহ হয়ে উঠে। আমি বুঝতে পারছি না আপনাকে আমার বিশ্বাস করা ঠিক হবে কিনা, কিন্তু আপনি যা বললেন সে বিষয়ে আমি ভেবে দেখবো।

‘আমি এতক্ষণ আপনাকে ঠিক এই কথাটাই বলতে চেয়েছি, সেই সাথে অবশ্য একটা অনুরোধও আছে। আমি আগেই বলেছি, আমি শীঘ্রই ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে জাহাজে উঠবো কিন্তু আমার ব্যক্তিগত পরিচারক নিকোলাস ব্যালেনটাইন হিন্দুস্তানে থেকে যেতে চায়। সে খুবই বিশ্বস্ত এবং বুদ্ধিমান আর যেকোনো মনিবের অধীনে কাজ করতে সক্ষম। আপনি কি অনুগ্রহ করে তাকে আপনার গৃহস্থালীর কোনো কাজে নিয়োজিত করবেন? যাতে গোপনে পর্যবেক্ষণ করতে এবং ইংল্যান্ডে আপনাকে সবকিছু লিখে জানাতে পারে?

রো’র মুখে প্রথমবারের মত হাসির আভাস ফুটে উঠে। না। আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি তাকে ইংল্যান্ডে ফিরে যাবার জন্য রাজি করাতে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। যুবরাজ, আপনি যদি তাকে কাজে নিযুক্ত না করেন, আমি দরবারে আমার কোনো পরিচিত জনকে তাঁর বিষয়ে অনুরোধ করে দেখবো।

*

আসফ খানের স্বভাবজাত প্রাণবন্ত মুখমণ্ডল শান্ত দেখায় কথাগুলো শোনার সময়। খুররম কথা শেষ করার পরে, তিনি উত্তর দেয়ার আগে কিছুক্ষণ সময় নেন। নিজের বোন সম্পর্কে এই মন্তব্য করাটা আমার পক্ষে কষ্টকর কিন্তু আমার মনে হয় দূতমহাশয় ঠিকই অনুমান করেছেন। মেহেরুন্নিসা আপনার শত্রুতে পরিণত হয়েছেন। শাহরিয়ারকে সামনে রেখে সে একদিন শাসনকার্য পরিচালনা করার পরিকল্পনা করেছে এবং আপনি তাঁর পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। দূতমহাশয় যেমনটা বলেছেন, লোকজন দরবারে ক্ষমতার প্রতি তাঁর মোহের বিষয়ে আলোচনা করতে আরম্ভ করেছে।

খুররম তাঁর দস্তানা পরা হাত দিয়ে সে যে স্তম্ভের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল সেটায় আঘাত করে। আমার আব্বাজান এতটা অন্ধ হন কীভাবে? এসব আলোচনার কথা কি তিনি জানেন না?

‘তিনি অবশ্যই এসব বিষয়ে অবগত কিন্তু এসব বিষয় উপেক্ষা করবেন বলে স্থির করেছেন। একমাস আগের কথা, মোল্লা শেখ হাসান শুক্রবার মসজিদে জুম্মার নামাযে নসিহত প্রদান করার সময় সম্রাট রাজকীয় আদেশ জারি করতে সম্রাজ্ঞীকে অনুমতি দেয়ায় তার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। তিনি দাবি করেন একজন মহিলার এটা করার কোনো অধিকার নেই। তিনি সুরাপানের জন্য সম্রাটের সমালোচনা করেন, আপনার আব্বাজানের মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করে রাখার জন্য এই অভ্যাসকে দোষারোপ করেন এবং ধর্মীয় পরামর্শদা, উলেমাদের, সভায় অংশ নেয়ার সময় তাকে ঘুমিয়ে পড়তে বাধ্য করেছিল। মেহেরুন্নিসা সেই মোল্লাকে চাবকাতে চেয়েছিল কিন্তু সম্রাট সেবারের মত তাকে বিরত করেন এবং বিক্ষোভের পুরো বিষয়টা একেবারে উপেক্ষা করেন। মেহেরুন্নিসার বিরুদ্ধে কেবলমাত্র মোল্লারাই ক্ষুব্ধ হননি। সেনাপতিদের বেশ কয়েকজন–বিশেষ করে, গোয়ালিয়রের শাসক, ইয়ার, মোহাম্মদের মত বয়োজ্যেষ্ঠ অনেকেই আমার কাছে অভিযোগ করেছে। যে তাঁদের কাছে প্রেরিত আদেশে সম্রাটের চেয়ে আজকাল তাঁর সীলমোহরই বেশি সংযুক্ত থাকে, অবশ্য তারা তাদের এই অসন্তোষ একান্ত আলাপচারিতার সময় ব্যক্ত করেছে। সম্রাটের সামনে একজন সাহস করে এ বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলায় পরেরদিন বাংলার জলাভূমির জ্বরজ্বালা অধ্যুষিত প্রদেশের একটা বসতিতে নিজের পদোন্নতি হয়েছে দেখতে পায়।’

একটু আগেই সন্ধ্যা হয়েছে। রো বিদায় নেয়ার পরে খুররম বৃথাই আব্বাজানের কাছ থেকে তাঁর দূর্গে যাবার শমন আগমনের জন্য অপেক্ষা করে। সে সারাদিন রো’র কথাগুলো নিজের মনে বারবার উল্টেপাল্টে দেখে, প্রতিবারই কথাগুলো আগের চেয়ে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়। সশরীরে দূর্গে উপস্থিত হয়ে জাহাঙ্গীরের সাথে দেখা করার দাবি জানাতে সে যখন নিজের ঘোড়া নিয়ে আসতে বলবে সেই সময়ে আসাফ খানের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করার কথা তার মাথায় আসে। নিজের বোনের মনে কি রয়েছে সে বিষয়ে তার চেয়ে ভালো আর কারো জানবার কথা নয়, এবং আরজুমান্দের আব্বাজান হবার কারণে নির্দ্বিধায় তাকে বিশ্বাস করা যায়।

‘আমার ক্ষতি করতে গিয়ে মেহেরুন্নিসা আরজুমান্দ আর আমাদের সন্তানদের অমঙ্গল সাধন করতে পারে। তার কাছে কি এর কোনো মূল্যই নেই?

না। জাহাঙ্গীরের ভালোবাসা অর্জন করার পরে, নিজের স্বার্থের বিষয়ে সে প্রথমে চিন্তা করে এবং তারপরেই কেবল নিজের মেয়ের কথা সে ভাবে। সে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীকে সহ্য করবে না… সে যেই হোক। তুমি দরবার থেকে দূরে ছিলে। আমি যা উপেক্ষা করতে অপারগ ছিলাম তুমি সেসব কল্পনাও করতে পারবে না। সে সম্রাটকে সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। আমি যদিও আগ্রা সেনানিবাসের প্রধান সেনাপতি, আজকাল কদাচিত আমি তাকে দেখতে পাই। এমনকি আমার সাথে তাঁর যখন দেখা হয়, মেহেরুন্নিসা সবসময়ে সেখানে উপস্থিত থাকে। অন্য সেনাপতিদের মত আমায় প্রদত্ত আদেশও সেই জারি করে। তাকে দেয়া জাহাঙ্গীরের নতুন খেতাবের সীলমোহর সেসব আদেশে জ্বলজ্বল করে। আমার বোন এখন আর কেবল “নূর মহল”, “প্রাসাদের আলো” নয়–তোমার আব্বাজান তাকে নতুন খেতার দিয়েছে “নূর জাহান”, “জগতের আলো”। গিয়াস বেগের কি মনোভাব?

তার উপরে এমনকি তারও কোনো প্রভাব নেই। রাজকীয় কোষাগারের নিয়ন্ত্রক হবার কারণে, তিনি ভালো করেই জানতেন বাদখপুর জায়গীর তোমাকে দেয়ার প্রতিশ্রুতি করা হয়েছে। মেহেরুন্নিসার কাছে তিনি যখন এর কারণ জানতে চান কেন সেটা শাহরিয়ারকে দেয়া হয়েছে তিনি তাকে কড়া ভাষা বলেন এ বিষয়ে তাঁর মাথা না ঘামালেও চলবে। আমার আব্বাজান একজন নরম স্বভাবের মানুষ। আমি কখনও ভাবিনি যে তাকে এতটা ক্রুদ্ধ দেখতে পাব।’ আসফ খান কথা শেষ করে কিছুক্ষণ নিরবে বসে থাকেন, তারপরে জানতে চান, আপনি এখন কি করতে চান?

‘এমন অবস্থা অবশ্যই চলতে দেয়া যায় না। আমি আমার আব্বাজানকে বাধ্য করবো আমার সাথে দেখা করতে, তিনি দেখা করতে চান বা না চান। আমি তাকে বোঝাব যে সম্রাজ্ঞী আমার নামে তাঁর কানে বিষ ঢালছে এবং এটাও যে আমি এখনও তার সেই বিশ্বস্ত সন্তানই রয়েছি। আমি দরবার থেকে অনেকদিন দূরে রয়েছি। তিনি আবার যখন আমায় দেখতে পাবেন আমার জন্য তার ভালোবাসা পুনরায় জাগ্রত হবে।’

‘যুবরাজ, সতর্ক থাকবেন। আবেগের সাথে যেন ভাবনাও আপনার কর্মকাণ্ডকে পরিচালিত করে। আপনি যদি আবেগকে যুক্তির উপরে স্থান দেন আপনার পরাজয় তাহলে কেউ আটকাতে পারবে না। দূতমহাশয়ের সতর্কবাণী সবসময়ে মনে রাখবেন। মেহেরুন্নিসার ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন। সে যতটা ধূর্ত ঠিক ততটাই নির্ভীক।

‘আসফ খান, উদ্বিগ্ন হবেন না। আমি এখন অন্তত জানি কে আমার শত্রু–আর সে কতটা ভয়ঙ্কর। যুদ্ধক্ষেত্রে আমার মানসিক অবস্থা যেমন থাকে তার চেয়ে বেশি আবেগ আমি নিজের ভেতরে প্রশ্রয় দেবো না। আমি আব্বাজানের জন্য পরিচালিত কোনো অভিযানে আজ পর্যন্ত পরাজিত হইনি। আমি এখন তার এই স্ত্রীকে আমাকে পরাস্ত করার সুযোগ দেবো না।

*

‘যুবরাজ, আমি দুঃখিত, সম্রাট আদেশ দিয়েছেন যে তাকে যেন বিরক্ত করা না হয়।

মাজিদ খান, আমি জানি আপনি আমার আব্বাজানের একজন বিশ্বস্ত কর্মচারী। তাঁর উজির হবার কারণে আপনি অবশ্যই সর্বান্তকরণে তার স্বার্থের বিষয়টা বিবেচনা করবেন, একই সাথে সাম্রাজ্যের স্বার্থরক্ষা করাও আপনার দায়িত্ব। আমার আর আব্বাজানের মাঝে একটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে যা মোটেই আমার দ্বারা সৃষ্ট নয়। আমি যদি তার সাথে নিভৃতে কয়েক মুহূর্ত সময় অতিবাহিত করতে পারি আমি নিশ্চিত যে আমি তাঁর মন থেকে আমার আনুগত্যের ব্যাপারে যাবতীয় সংশয় দূর করতে এবং আমাদের সম্পর্কের মাঝে জন্ম নেয়া দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে পারবো।’

উজির খুররমের বাম কাঁধের উপর একটা নির্দিষ্ট স্থানের দিকে তাকিয়ে থাকবার সময় তার লম্বা, কৃশকায় মুখমণ্ডলে চিন্তার ছাপ ফুটে থাকে। খুররম ভাবে, লোকটা জানে আমি ঠিক কথাই বলেছি, কিন্তু সে মনে মনে কৌতূহলী হয়ে উঠে লোকটা ম্রাজ্ঞীর আদেশের বিরোধিতা করে কিনা দেখতে। সে মাজিদ খানের বাহু আঁকড়ে ধরে, তাকে তার দিকে সামান্য ঘোরায় এবং তাঁর চোখের দিকে তাকাতে তাকে বাধ্য করে। আব্বাজান আমাকে ডেকে পাঠাবেন সেজন্য আমি আজ নিয়ে তিনদিন অপেক্ষা করছি। আমি খসরু নই। আমি ষড়যন্ত্র করি নি এবং আব্বাজানের সিংহাসন দখলের কোনো পরিকল্পনা আমার নেই। মাজিদ খান, আপনি সেটা নিশ্চয়ই জানেন। আমি আমার প্রিয়তমা স্ত্রী আর সন্তানদের নামে দিব্যি দিয়ে বলছি যে আমি কেবল ন্যায়বিচারের প্রত্যাশী। দেখুন…’ খুররম উজিরের হাত ছেড়ে দেয় এবং এক পা পিছিয়ে এসে কোমরের পরিকর থেকে নিজের বাঁকানো খঞ্জরটা বের করে সেটা বিস্মিত মাজিদ খানের হাতে তুলে দেয়। এটা আপনার কাছে রাখেন–এবং সেই সাথে আমার তরবারি।’

না, না, যুবরাজ। উজিরকে এবার পুরোপুরি অসহায় দেখায়। আপনার অভিপ্রায় সম্বন্ধে আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। তারপরে নিজের চারপাশে তাকিয়ে দেখে, যেন ভীত যে দূর্গে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষেও কেউ আড়িপেতে থাকতে পারে, তিনি তাঁর কণ্ঠস্বর নামিয়ে আনেন এবং বলেন, যুবরাজ, প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় সম্রাট নিয়মিত দূর্গপ্রাকারে তার কবুতরের খোপের কাছে তাঁর পাখিদের ফিরে আসা দেখতে যান। কবুতরগুলো ভয় পেতে পারে ভেবে তিনি সেখানে যাবার সময় সাথে কোনো প্রহরী বা পরিচারক রাখেন না। সম্রাজ্ঞী কখনও কখনও তার সাথে থাকেন কিন্তু আজ রাতে তিনি সম্রাটের বাসস্থানে একটা বিশেষ বিনোদনের আয়োজন করেছেন এবং তিনি, আমি নিশ্চিত, ব্যক্তিগতভাবে পুরো আয়োজনের তদারকি করবেন।

*

পশ্চিমের আকাশ গোলাপি বর্ণ ধারণ করতে শুরু করে খুররম যখন দূর্গের একেবারে পশ্চিমপ্রান্তে অবস্থিত একটা সংকীর্ণ, খাড়া সিঁড়ি বেছে নিয়ে সেখান দিয়ে দূর্গপ্রাকারের উদ্দেশ্যে উঠতে শুরু করে যেখানে ছেলেবেলায় সে আর তার ভাইয়েরা একসময় যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতো। মাকড়সার জাল আর ধূলো দেখে বোঝা যায় যে আজকাল খুব কম লোকই সিঁড়িটা ব্যবহার করে এবং সে কারো কৌতূহলের উদ্রেক না ঘটিয়ে, বস্তুতপক্ষে সবার অলক্ষ্যে দূর্গপ্রাকারে পৌঁছে যায়। সে তাঁর সামনে প্রায় একশ গজ দূরে চোঙাকৃতি কবুতরের খোপ দেখতে পায় এবং তার পেছনে একটা খিলানাকৃতি দরজার ভিতর দিয়ে একটা প্রশস্ত সিঁড়ি নিচের দিকে নেমে গেছে সে জানে নিচের রাজকীয় আঙিনায় গিয়ে সিঁড়িটা শেষ হয়েছে। সে নিজের চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখে কোথাও একজন প্রহরীও নেই।

সে কবুতরের খোপের আরেকটু কাছে এগিয়ে যায় তারপরে কি মনে করে সামান্য পিছিয়ে এসে ছায়ায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে শুরু করে। সে নিচের আঙিনায় মশাল আর তেলের প্রদীপ জ্বালাবার সময় পরিচারকদের গলার আওয়াজ শুনতে পায়। সে তারপরে অন্ধকার হয়ে আসা আকাশের বুকে সহসা আলোর একটা ঝলকানি দেখতে পায় যার মানে দেওয়ানি আমের পাশের প্রধান আঙিনায় অবস্থিত অতিকায় আকাশ দিয়া–বিশ ফিট উঁচু একটা সোনালী দণ্ডের মাথায় অবস্থিত একটা বিশালাকৃতির তেলপূর্ণ পাত্র-জ্বালানো হয়েছে। দৃশ্যটা তার মাঝে আকষ্মিক একটা বেদনার জন্ম দেয়। প্রদীপের আলোর কমলা রঙের আভা থেকে শুরু করে রাতের বাতাসে ভাসতে থাকা ধূপের গন্ধ, সবকিছু কত পরিচিত। এটাই তাঁর পৃথিবী, তার স্থান যেখানে তাঁর থাকবার কথা। তারপরে খিলানাকৃতি দরজার নিচে দিয়ে খালি-মাথায় দীর্ঘদেহী একটা অবয়ব আন্দোলিত আলখাল্লা পরিহিত অবস্থায় উপস্থিত হয় এবং কবুতরের খোপের দিকে এগিয়ে আসে।

আব্বাজান! জাহাঙ্গীরের দিকে খুররম দৌড়ে যেতে, যার ডান হাত সাথে সাথে নিজের কোমরের খঞ্জরের দিকে উড়ে যায়। খুররম আধো-আলোয় ইস্পাতের শানিত ঝিলিক খেয়াল করে। আব্বাজান… আমি, খুররম। সে তাঁর পায়ের কাছে নিজেকে ছুঁড়ে দেয় যা কিছু বলবে বলে ঠিক করে ছিল সব শব্দ হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। সে জাহাঙ্গীরের হাত তার মাথা স্পর্শ করবে বলে আশা করে, কিন্তু মাথায় কিছুই অনুভব করে না। সে মুখ তুলে উপরের দিকে তাকিয়ে সম্রাটের ক্রোধে টানটান হয়ে থাকা মুখমণ্ডল দেখতে পায়।

‘তোমার এত বড় স্পর্ধা আততায়ীর মত আড়াল থেকে আমার পায়ের কাছে লাফিয়ে পড়ো?’ জাহাঙ্গীরের কণ্ঠস্বর খানিকটা কর্কশ শোনায়, যেন এইমাত্র তিনি পান করে এসেছেন।

খুররম তাঁর আব্বাজানের এহেন কুপিত মূর্তি দেখে স্তম্ভিত হয়ে ধীরে ধীরে নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আমি কোনো আততায়ী নই, আমি উপরের আশা করে, যায়। সে জাহকছু বলবে বলেও হুররম। সে আপনার সন্তান। আপনার সাথে নিশ্চয়ই আমার দেখা করার অধিকার আছে।

‘তোমার কোনো অধিকার নেই।’ জাহাঙ্গীর এতক্ষণ পরে খঞ্জরের ফলাটা পুনরায় ময়ানে ঢুকিয়ে রাখে।

‘আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হচ্ছে। তিনদিন পূর্বে আগ্রায় পৌঁছাবার পর থেকেই আমার সাথে দেখা করার জন্য আমি বারবার আপনার কাছে অনুরোধ জানিয়েছি। আপনি কেন আমার আবেদনে সাড়া দেননি?”

কারণ আমি তোমার মুখদর্শন করতে চাই না, ঠিক যেমন দাক্ষিণাত্যে আমি তোমায় তোমার নেতৃত্ব পরিত্যাগ করার আদেশ দেইনি। তুমি ঔদ্ধত্যের বশবর্তী হয়ে তোমার যা ইচ্ছে তাই করছে।

‘আমি আগ্রা ফিরে এসেছি কেবল একটা বিষয়ে পরিষ্কার হতে যে আপনাকে অসন্তুষ্ট করার মত আমি কি করেছি। আপনার কাছ থেকে আগত প্রতিটা রাজকীয় বার্তা যখন নতুন নতুন অবজ্ঞা বয়ে নিয়ে আসে তখন আমার পক্ষে দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। পার্সীদের বিরুদ্ধে আপনি কেন শাহরিয়ারকে পাঠালেন? কেন আপনি তাকে আমার জায়গীর দান করলেন?

‘আমায় প্রশ্ন করার কোনো অধিকার তোমার নেই।’

‘আপনি যদি আমায় প্রশ্ন করার অধিকার না দেন তাহলে আমায় অন্তত অনুমতি দেন প্রশ্নগুলোর উত্তর হিসাবে আমি যা বিশ্বাস করি সেগুলো যেন আপনাকে বলতে পারি। আমার ধারণা কেউ হয়তো আমার বিরুদ্ধে আপনাকে খেপিয়ে দিয়েছে।’

‘কে?

খুররম সামান্য সময়ের জন্য ইতস্তত করে। মেহেরুন্নিসা।

জাহাঙ্গীর সামনের দিকে এক পা এগিয়ে আসে এবং খুররম মর্মাহত হয়ে দেখে তাঁর দাক্ষিণাত্যে অবস্থানের সময় গত আঠারো মাসে তার আব্বাজানের মাঝে কি বিপুল পরিবর্তন এসেছে। তার চোখ দুটো রক্তজবার মত লাল এবং তাঁর একদা দৃঢ় চোয়ালের উপরে ত্বক এখন শীথিলভাবে ঝুলে রয়েছে। সম্রাজ্ঞী আপনার মাঝে আমার জন্য–একটা সময়–যে ভালোবাসা ছিল তাঁর প্রতি ঈর্ষান্বিত, সে কথা চালিয়ে যেতে নিজেকে বাধ্য করে। তিনি আপনার প্রতি আমার প্রভাবকে ভয় পান এবং আমার প্রতি আপনার মমতাকে শাহরিয়ারের সাথে প্রতিস্থাপিত করতে আগ্রহী যার নিজের কোনো স্বাধীন মতামত নেই। সে যখন তার জামাতা হবে তখন নিজের কন্যার মত তার উপরও সম্রাজ্ঞীর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ অধিষ্ঠিত হবে… এবং সেই সাথে আপনার উপরেও!

‘অনেক হয়েছে! তোমার কি বুদ্ধিশুদ্ধি সব লোপাট হয়েছে? তোমার সাথে আরজুমান্দ বানুর বিয়ের দেয়ার জন্য সম্রাজ্ঞী স্বয়ং আমার কাছে অনুরোধ করেছিলেন এবং প্রথমবারের মত স্বাধীনভাবে তোমার উপরে সেনাপতির দায়িত্ব অর্পণ করতেও তাঁরই আগ্রহ বেশি ছিল। ব্যাপারটা মোটেই এমন নয় যে তিনি তোমায় ভয় পান বরং তুমিই আমার প্রতি তার ভালোবাসা এবং তার প্রভাবকে সহ্য করতে পারছে না। আমার মরহুম আব্বাজান একজন মহান মানুষ ছিলেন কিন্তু তুমি যখন একেবারে ছোট ছেলে তখন তোমায় মাত্রাতিরিক্ত প্রশ্রয় দেয়াটা তার অনেকগুলো ভুলের মধ্যে অন্যতম। আমার উত্তরাধিকারী হওয়া তোমার এক্তিয়ারের ভিতরে পড়ে এমন একটা ধারণা নিয়ে তুমি বড় হয়েছে।

না, কিন্তু সেরকম ভাবতে আপনিই আমায় সাহস যুগিয়েছেন। আপনি আমায় শাহজাহান উপাধি দিয়েছেন এবং লাল তাবু স্থাপনের অধিকার।

‘কিন্তু পরবর্তী মোগল সম্রাট হিসাবে আমি তোমায় মনোনীত করিনি। আমার সন্তানদের ভিতরে আমার উত্তরাধিকারী কে হবে সেই সিদ্ধান্ত আমি নেব। দাক্ষিণাত্যে তোমার উদ্ধত আচরণের কথা আমার কানে এসেছে, কীভাবে তুমি ইতিমধ্যে এমন আচরণ শুরু করেছিলে যেন সিংহাসন তুমি পেয়ে গেছো…’

‘এসব কার কাছে শুনেছেন?”

‘আমি তোমায় আগেই বলেছি আমায় পাল্টা প্রশ্ন করবে না। তুমি যেভাবে আগ্রায় ফিরে এসেছে এবং জোর করে যেভাবে নিজেকে আমার সামনে হাজির করেছে তাতে তোমার অহঙ্কার, হঠকারী আর বেপরোয়া উচ্চাকাঙ্খ সম্বন্ধে আমি যা কিছু ভয় করেছিলাম সবকিছুকে কি প্রমাণিত করে নি? জাহাঙ্গীরের পুরো শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। খুররম যখন তাঁর দিকে তাকায় তার মনে হয় যেন তাঁর আব্বাজান একজন অচেনা আগন্তুকে পরিণত হয়েছেন। সে আশা করেছিল একটা সময়ে তিনি যেমন তাকে ভালোবাসতেন সে তার সেই ভালোবাসাকে পুনরায় জাগ্রত করবে কিন্তু তার উপস্থিতি মনে হচ্ছে তাকে কেবল ক্রুদ্ধ করে তুলছে। একটা অসহায়, হতাশ অনুভূতি যার অভিজ্ঞতা যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর কখনও হয়নি ধীরে ধীরে তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে কিন্তু সে সিদ্ধান্ত নেয় শেষ একবার অনুরোধ করবে।

‘আমি ফিরে এসেছি কারণ আমি আপনার মুখোমুখি দাঁড়িব্বেলতে চেয়েছিলাম যে আমি আপনার অনুগত সন্তান। এটাই আমার বক্তব্য। তার কথাগুলো কি জায়গামত স্পর্শ করতে পেরেছে? জাহাঙ্গীরের অভিব্যক্তি একটু যেন মনে হয় নরম হয়। আমিও সন্তানের পিতা। খুররম সুবিধাজনক পরিস্থিতির সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে চেষ্টা করে। আগামী বছরগুলোতে তারা হয়ত এমন অনেক কিছুই করবে যা আমাকে প্রীত করবে না কিন্তু আমি আশা করি তাদের আমি সবসময়েই ভালোবাসবো এবং তাদের প্রতি সমান আচরণ করতে চেষ্টা করবো। আব্বাজান, আমি আপনার কাছে কেবল এটাই চাই–ন্যায়বিচার। আমি অবশ্যই কিন্তু তাকে হতাশ করে দিয়ে তার কানে পায়ের শব্দ ভেসে আসে এবং তারপরেই একজন কর্চি ডানহাতে জ্বলন্ত মশাল নিয়ে খিলানাকৃতি দরজার নিচে দিয়ে আবিভূর্ত হয় কারণ ইতিমধ্যে চারপাশ প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে।

‘জাঁহাপনা, সম্রাজ্ঞী জানিয়েছেন যে বাদ্যযন্ত্রীর দল প্রস্তুত।’

‘তাকে গিয়ে বলল আমি শীঘ্রই তাঁর সাথে যোগ দেব।

তরুণ পরিচারক বিদায় নিতে জাহাঙ্গীর কথা বলতে আরম্ভ করে। তুমি যা বলেছো আমি সেটা বিবেচনা করে দেখবো। এখন যাও, এবং আমি পুনরায় ডেকে না পাঠানো পর্যন্ত তুমি দূর্গে আসবে না।’ তিনি কথা শেষ করেই গোড়ালির উপরে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান। খুররম একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে কবুতরের ডাক শুনে। সে এবার হাভেলি ফিরে যাবে এবং তার আব্বাজানের আদেশ অনুযায়ী অপেক্ষা করবে। সে এছাড়া আর কি করতে পারে?

*

‘আপনাকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। আপনার কোনো কবুতর কি আজ ফিরে আসে নি?’ মেহেরুন্নিসা জানতে চায়।

তুমি আমার মনমর্জি ভালোই বুঝতে পার। না, আমাকে আমার কবুতরেরা বিরক্ত করে নি। আমি যখন দূর্গপ্রাকারে গিয়েছিলাম খুররম সেখানে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল।

‘খুররম? তার এতবড় স্পর্ধা!

‘আমিও তাকে ঠিক এই কথাই বলেছি।’

‘সে কি চায়?

‘জানতে চেয়েছিল কেন আমি তার সাথে দেখা করছি না এবং সে কীভাবে আমার অসন্তোষের কারণ হয়েছে সেটা জানতে।’

মেহেরুন্নিসা ভ্রূকুটি করে। কামরার ভেতরে একজন পরিচারিকা প্রবেশ করে, নিঃসন্দেহে তাঁর কাছে জানতে এসেছে বাইরের বারান্দায় বাদ্যযন্ত্রীরা এখন তাঁদের বাজনা শুরু করবে কি না, এবং সে হাতের ইশারায় মেয়েটাকে বিদায় করে। সে বুঝতে পারে নি যে খুররম তাঁর আব্বাজানের কাছে সরাসরি অনুরোধ করার কোনো উপায় খুঁজে বের করতে পারবে। তার অভিপ্রায় ছিল যে আগামী আরও কয়েকদিন পরে–যত বিলম্ব হবে ততই মঙ্গল এতে করে খুররমের অবমাননা আরও বেশি হবে–জাহাঙ্গীর তাকে দেওয়ানি আমে ডেকে পাঠাবে এবং পুরো দরবারের সামনে তাঁর দাক্ষিণাত্যের অভিযান পরিত্যাগ করার কারণে তাকে তিরষ্কার করবে এবং তাকে অবিলম্বে সেখানে ফিরে যাবার আদেশ দেবে। খুররম এমন একটা প্রকাশ্য দরবারে জাহাঙ্গীর আবেগতাড়িত হতে পারে এমন কিছুই বলার সুযোগ পাবে না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যুবরাজকে সে ঊনজ্ঞান করেছিল।

খুররমের অনেক দোষের ভিতরে একটা হল অনুমিতি,’ সে বলে।

‘তাকে দেখে বাস্তুবিকই সঙ্কটাপন্ন বলে মনে হয়েছে।

কারণ সে জানে যে তাঁর দুষ্টাচরণ ফাঁস হয়ে গিয়েছে। সে আপনার সহানুভূতি উদ্রেক করার চেষ্টা করেছিল।

‘সে দাবি করেছে সে কোনো অন্যায় করে নি… যেকোনো শত্রু চেষ্টা করছে তাকে আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে।

‘কোনো শত্রু? কে হতে পারে?

‘তুমি।’ জাহাঙ্গীর মাথা উঁচু করে এবং সরাসরি তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

‘কিন্তু আমি কেন তাঁর শত্রু হতে যাব?

‘সে দাবি করেছে যে তুমি ক্ষমতার জন্য লালায়িত এবং ভীত সে তোমার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

মেহেরুন্নিসা টের পায় তার হৃৎপিণ্ড প্রবল গতিতে স্পন্দিত হচ্ছে কিন্তু সে জোর করে নিজের অভিব্যক্তি সংযত রাখে, এমনকি খানিকটা অবজ্ঞার ভাবও সেখানে ফুটিয়ে তোলে। আমি চিন্তা করিনি তার উচ্চাকাঙ্খ তাকে এতটা বেপরোয়া করে তুলতে পারে। আপনার জন্য আমার ভালোবাসা সম্পর্কে সে জানে, সে আরও জানে কীভাবে আমি আপনার কাছ থেকে প্রসাশনিক দায়িত্বভার কিছুটা গ্রহণ করতে চেষ্টা করছি যাতে আপনি সাম্রাজ্যের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মনোনিবেশ করার সুযোগ পান। সে এজন্যই আমার মাধ্যমে আপনাকে আক্রমণ করার প্রয়াস নিয়েছে।

‘কিন্তু সে এটা কেন করবে?

‘আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না?’ জাহাঙ্গীরের হাত মেহেরুন্নিসা নিজের হাতে তুলে নেয়। আপনাকে সে যদি এমন কথা বলার স্পর্ধা দেখাতে পারে তাহলে কল্পনা করেন অন্যদের কাছে সে কতটা জঘন্য কথা বলতে পারে! একজন রমণী আপনাকে শাসন করে এমন দাবি করে সে আসলে বোঝাতে চাইছে যে আপনি আর শাসনকার্য পরিচালনা করার মত সুস্থ নন। সে আমার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ সৃষ্টি করেছে সিংহাসন দখলের জন্য একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করতে।’

কিন্তু বিষয়টা যদি তাই হবে তাহলে কেন আগ্রা এসেছে, কেন সে আমার কাছে এসেছে? দাক্ষিণাত্যে তাঁর অধীনে একটা সেনাবাহিনী রয়েছে যা সে আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধোদ্যোগে নিয়োজিত করতে পারতো।

‘সবকিছুই তার বিশদ পরিকল্পনার অংশ।’ মেহেরুন্নিসা জাহাঙ্গীরের হাত ছেড়ে দেয় এবং একটা কাঁচের বোতল তুলে নেয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়। সে বোতলের মুখ থেকে ছিপি খুলে নিয়ে ভেতরের তরল একটা পানপাত্রে ঢালে এবং পাত্রটা তাঁর হাতে তুলে দেয়। এই পানীয়টা সামান্য পান করেন। এটা আপনার অস্থিরতা প্রশমিত করবে।’

জাহাঙ্গীর সুরায় চুমুক দিয়ে এর হাল্কা তিতা স্বাদ থেকে বুঝতে পারে আফিমের বড়ি মেশান রয়েছে। পানীয়টা নিমেষের ভেতরে তাঁর পাকস্থলীকে উষ্ণ করতে শুরু করে এবং কয়েক মুহূর্ত পরে সে আরেক চুমুক দেয়, বেশ বড় চুমুক, তাঁর দেহের ভিতর দিয়ে অলক্ষ্যে প্রবাহিত হতে থাকা বিকিরণ সে উপভোগ করে। একটা নিচু বিছানার উপরে বসে মাথার নিচে রেশমের কারুকাজ করা একটা তাকিয়া রেখে সে পানপাত্রের তরলের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে, লক্ষ্য করে টকটকে লাল তরল কীভাবে আলোয় ঝলসে উঠে যখন সে পাত্রটা নিজের খুব একটা সুস্থির বলা যাবে না হাতে ধরে থাকে। বলতে থাকো…’

‘আমি যা বলছিলাম, আমার মনে হয় খুররম সিংহাসন দখলের পরিকল্পনা করেছে। দাক্ষিণাত্যে অবস্থানের সময় সে কোনো পদক্ষেপ নেয় নি কারণ সে দরবারের মনোভাব পরখ করে দেখতে চেয়েছিল। সে আগ্রা পৌঁছাবার পর থেকে সম্ভবত এটাই করছে–আমি একটা বিষয় নিশ্চিত করে বলতে পারি যে মাজিদ খানের সাথে সে আলাপ করেছে। সে সম্ভবত আমাদের দু’জন সম্পর্কে কুৎসা রটনার সুযোগের সদ্ব্যবহার করছে। তাঁর আপনাকে খোঁজার পেছনের কারণ এমনটাও হওয়া বিচিত্র না যাতে করে সে বলতে পারে যে সে আপনার কাছে আবেদন করার পরেও আপনি তার কথা শোনেন নি। আমি নিশ্চিত অচিরেই দাক্ষিণাত্য থেকে তার বাহিনী এসে উপস্থিত হবে। শাহরিয়ারের সাথে উত্তরপশ্চিমে আপনার অন্য বাহিনীগুলো অবস্থান করায়, আপনি অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছেন।

জাহাঙ্গীর পাত্র থেকে আরেকটু সুরা পান করে কিন্তু কোনো মন্তব্য করে না।

‘নিজের উচ্চাকাঙ্খ গোপন করার ব্যাপারে খুররম খসরুর চেয়ে অনেক বেশি ধূর্ত, কিন্তু সেও একই জিনিষ চায়।’ মেহেরুন্নিসা এগিয়ে এসে জাহাঙ্গীরের কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। একজন পিতার কাছে এর চেয়ে ভয়ঙ্কর কিছু হতে পারে না যখন তার আপন সন্তানেরা অবিশ্বাসী আর অবাধ্য হয়ে উঠে। এটা একটা দুঃখজনক ঘটনা যখন পরিবারগুলো বিভক্ত হয়ে পরস্পরবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করে অথচ তাদের তখন একত্রিত হয়ে শক্তির সন্ধান করা উচিত কিন্তু এটাই জগতের রীতি। আপনাকে এই পরিস্থিতি অতীতে একবার মোকাবেলা করতে হয়েছিল এবং এখন আবার আপনাকে ঠিক তাই করতে হবে। তার কণ্ঠস্বর বিষণ্ণ শোনায়। ‘উচ্চাকাঙ্খ একটা খুবই ভালো জিনিষ, কিন্তু বিপুল সম্মানের অধিকারী হবার বাসনা একজন মানুষকে সহজেই অসম্মানজনক কর্মকাণ্ডে প্রবৃত্ত…’

জাহাঙ্গীর ভাবে, মেহেরুন্নিসা ঠিকই বলেছে। শেখ সেলিম চিশতি কি বহু বছর আগে ঠিক একই শব্দগুলো ব্যবহার করেন নি? খসরু আর খুররমের অবাধ্যতার বিষয়টা সুফি সাধক আগেই দেখতে পেয়েছিলেন এবং মেহেরুন্নিসা এখন যেমন তাকে সতর্ক করতে চেষ্টা করছে ঠিক সেভাবে তিনিও তাকে হুশিয়ার করতে চেয়েছিলেন।

‘আমার এখন কি করা উচিত? তার চোখের কোণে আত্মকরুণার অশ্রু জমতে শুরু করলে সে এক চুমুকে পানপাত্রটা খালি করে ফেলে।

‘খুররমকে গ্রেফতার করেন।

*

খুররম আর আরজুমান্দ সাদা কাপড় বিছানো একটা নিচু টেবিলের সামনে আসন পিড়ি হয়ে বসে আছে। তাদের সামনে রাখা খাবারের পদগুলো থেকে–তেতুল দিয়ে রান্না করা ফিজ্যান্টের মাংস, শুকনো ফল দিয়ে ঠাসা ঝলসানো ভেড়ার মাংস এবং রুটি তন্দুর থেকে সদ্য বের করে আনায় এখনও ধোয়া বের হচ্ছে–রুচিকর ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। খুররমের যদিও কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না এবং আরজুমান্দের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে সেও একই রকম বোধ করছে। আব্বাজানের সাথে তাঁর সাক্ষাৎকারের বিবরণ তাকে একদম কাঁপিয়ে দিয়েছে।

‘তোমার অবশ্যই একটু কিছু মুখে দেয়া উচিত…’ সে কথা বলতে আরম্ভ করে কিন্তু শেষ করে না। আরজুমান্দের এক পরিচারিকা পর্দা দেয়া দরজা দিয়ে ঝড়ের বেগে ভেতরে প্রবেশ করে।

‘যুবরাজ, আমায় মার্জনা করবেন, কিন্তু আসফ খানের কাছ থেকে আপনার জন্য একটা জরুরি বার্তা এসেছে।’

‘আমার আব্বাজান? আরজুমান্দ খুররমের দিকে ঘুরে বিস্মিত চোখে তাকায়, যে লাফিয়ে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সে খাবারের বেশ কয়েকটা পাত্র মাটিতে ফেলে, এবং পরিচারিকার হাত থেকে এক ঝটকায় বার্তাটা নেয়। সে সীলমোহর ভেঙে চিঠিটার ভাঁজ খোলার সময় মনে মনে ভাবে যে জাহাঙ্গীরের নমনীয় হবার বিষয়ে আসফ খান কি কিছু জানতে পেরেছেন। কিন্তু দ্রুত হাতে মুসাবিদা করা শব্দগুলোর অর্থ অনুধাবন করার সাথে সাথে তার মনে হয় যেন শরীরের শিরা উপশিরায় রক্ত প্রবাহ বুঝি বরফ হয়ে গিয়েছে: সম্রাট তোমায় অবিলম্বে গ্রেফতার করার আদেশ দিয়েছেন। তোমায় অবশ্যই এখান থেকে পালাতে হবে। প্রহরীদের কাপ্তান, যে আমার বন্ধুও বটে, আমায় লিখিত আদেশ দেখিয়েছে। সে আদেশ পালন করতে অশ্বারোহী দল পাঠাতে সামান্য বিলম্ব করবে কিন্তু খুব বেশিক্ষণ সে অপেক্ষা করতে পারবে না। আমি দোয়া করি এই বার্তা যেন সময়মত তোমার হাতে পৌঁছে। বার্তাটা পড়া শেষ হওয়া মাত্র পুড়িয়ে ফেলবে নতুবা এর বিষয়বস্তু হয়ত আমাকে এবং আমার কাপ্তান বন্ধুকে ধ্বংস করে ফেলবে। খুররম এতটাই বিস্মিত হয় যে কিছুক্ষণ সে কোনো কথা বলতে বা কাজ করতে পারে না এবং পলকহীন চোখে হাতে ধরে থাকা কাগজের টুকরোটার দিকে তাকিয়ে থাকে যেন কোনোভাবে যদি সে শব্দগুলো গায়েব করতে পারতো।

‘খুররম… কি এটা? আরজুমাদের কণ্ঠস্বর তাকে নিজের মাঝে ফিরিয়ে আনে। সে যুদ্ধক্ষেত্রের মত সহজাত প্রবৃত্তির বশে তেলের প্রদীপের আগুনের শিখায় কাগজের টুকরো ধরে রাখে। সে তারপরে আরজুমান্দের হাত ধরে তাকে তুলে নিজের পায়ে দাঁড় করায়। আমার আব্বাজান আমায় গ্রেফতার করার আদেশ দিয়েছেন। আমাদের সন্তানদের নিয়ে এসো। আমরা এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যাব।’

আরজুমান্দের চোখ বড় বড় হয়ে যায় কিন্তু তার কণ্ঠস্বরের ব্যগ্রতা তাকে বলে যে এটা প্রশ্ন করার সময় না এবং সে কালক্ষেপণ না করে দৌড়ে বাচ্চাদের কক্ষের দিকে যায়। খুররম দরজার ভিতর দিয়ে তাকে অনুসরণ করে এবং তারপরে হেরেম থেকে বের হয়ে নিজের দেহরক্ষীদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে, আমাদের সবগুলো ঘোড়াকে যাত্রার জন্য প্রস্তুত করো। সদর দরজায় যেকোনো মুহূর্তে সম্রাটের অনুগত সৈন্যদের উপস্থিত হবার শব্দ শোনার আশঙ্কার মাঝে, সে দৌড়ে নিজের কক্ষের দিকে যায় এবং গলায় ঝোলানো একটা চাবি হাতে নিয়ে একটা রঙ করা সিন্দুক খোলে। সিন্দুকের ভেতর থেকে রত্নপাথরের একটা ছোট বাক্স আর স্বর্ণমুদ্রা ভর্তি একটা থলে তুলে নিয়ে সেগুলো একটা চামড়ার বগলিতে ঢুকিয়ে সেটা সে নিজের কাঁধে ঝুলিয়ে নেয়, তারপরে নিজের তরবারিটা নিয়ে সেটা কোমরে বাধতে বাধতে হাভেলীর মূল আঙিনার দিকে দৌড়াতে শুরু করে। আরজুমান্দ ইতিমধ্যে মাথায় একটা শাল জড়িয়ে নিয়ে সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে। তার পাশে, অশ্রুসজল দারা শুকোহর হাত ধরে জাহানারা দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং শাহ্ সুজা আর রওসোন্নারা আয়াদের কোলে। একজন সহিস শেষ ঘোড়াটায় পর্যাণ এবং লাগাম পরিয়ে জটার পেটের কাছে নিচু হয়ে পর্যাণ আঁটকে রাখার চামড়ার বেল্টের আঁটুনি পরীক্ষা করে দেখে। সে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালে তাঁর কাজ শেষ হবার সাথে সাথে খুররম চিৎকার করে যাত্রার আদেশ দেয় এবং খয়েরী রঙের একটা উঁচু ঘোড়ায় আরোহণ করে তার সাথে ভ্রমণের নিমিত্তে আরজুমান্দকে পেছনে তুলে নেয়। সে পেছন থেকে শক্ত করে খুররমের কোমড় জড়িয়ে ধরে থাকে যখন সে ঘোড়ার পাজরে গুঁতো দিয়ে সামনে অগ্রসর হতে শুরু করে পুতগতিতে সদর দরজার নিচে দিয়ে এগিয়ে যায় এবং হাভেলী থেকে বের হয়ে আসে। সে আবার কবে এটা দেখতে পাবে? তার পেছনে এবং একই গতিতে ঘোড়া তাড়িয়ে নিয়ে অনুসরণ করছে তার পরিবার-পরিজনের প্রায় ডজনখানেক সদস্য। দারা শুকোহ্ আর জাহানারা খুররমের দু’জন কর্চির ঘোড়ার পর্যাণের সামনের উঁচু অংশে বসে রয়েছে আর রওসোন্নারা এবং শাহ্ সুজা খুররমের দেওয়ান, শাহ্ গুলের চওড়া কাঁধবিশিষ্ট বে ঘোড়ার দু’পাশে ঝোলান খড়ের তৈরি ঝুরিতে রয়েছে।

খুররম কাঁধের উপর দিয়ে পিছনের দিকে তাকিয়ে দূর্গ থেকে নেমে আসা ঢালু পথটায় আলোর ঝলক দেখতে পায়। মশাল বহনকারী অশ্বারোহী দল নয়তো? না, এগুলো কেবল ধাতব কয়লাদানিতে দপদপ করতে থাকা আগুনের শিখা যা সাধারণত দূর্গের প্রবেশপথ গুলোকে আলোকিত করতে জ্বালানো হয়ে থাকে। সে কান খাড়া করে পিছু ধাওয়া করার শব্দ শুনতে চেষ্টা করে। নিজের জন্য না পরিবারের কথা চিন্তা করে সে ভয় পায়। তাকে যদি বন্দি কিংবা হত্যা করা হয় তাহলে তাদের কি নিয়তি হবে? আরজুমান্দ তখনই তাকে আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরলে সে একটা ক্ষিপ্ত চিৎকার শুনতে পায় এবং রাস্তার পাশের বস্তি থেকে দুটো বিশালাকৃতির কুকুর দৌড়ে এসে খুররমের ঘোড়ার চারপাশে লাফাতে থাকে যতক্ষণ না তাঁরা জন্তুগুলোকে অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যায়। তাদের চারপাশের অন্ধকার প্রেক্ষাপট শীঘ্রই নিরব হয়ে যায় কেবল যমুনার তীর দিয়ে দক্ষিণে অগ্রসর হতে থাকা তার ক্ষুদ্র মরীয়া দলটার ঘোড়ার খুরের শব্দ পাওয়া যায়। সে অবশ্য এখনও বিপদ কেটে গিয়েছে বলে ভাবতে পারে না। সে তার ঘোড়ার গলার কাছে নিচু হয়ে থাকে, তার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে এখন কেবল একটা বিষয়–ভোরের আলো ফোঁটার আগেই সে আর তার পরিবারের আগ্রা থেকে যতটা দূরে সম্ভব সরে আসবার বিষয়টা নিশ্চিত করা।

২.০১ আসিরগড়

সমতলের উপর দিয়ে একটা কালো ঘোড়ায় নিঃসঙ্গ এক অশ্বারোহী পুতগতিতে ছুটে যায়, শেষ অপরাহ্নের নিস্তরঙ্গ বাতাসে লাল ধূলো একটা ভারি আচ্ছাদনের মত তার পেছনে ঝুলতে থাকে। অশ্বারোহী যখন পর্বতশীর্ষের পাদদেশের দিকে এগিয়ে আসে যার উপরে আসিরগড় দূর্গ দাঁড়িয়ে রয়েছে, খুররম দূর্গের বেলেপাথরের প্রাকারবেষ্টিত সমতল ছাদে দাঁড়িয়ে দেখে অশ্বারোহী দূর্গের দিকে খাড়াভাবে এঁকেবেঁকে উঠে আসা পথ দিয়ে উপরে উঠতে শুরু করার সময় ঘোড়ার বেগ সামান্যই হ্রাস করে। লোকটা আরেকটু কাছে আসতে খুররম লক্ষ্য করে যে এই দাবদাহের ভিতরেও সে ইস্পাতের শিরোস্ত্রাণ এবং গায়ে ধাতব-কীলকযুক্ত চামড়ার আঁটসাট বহির্বাস পরিহিত রয়েছে। আমরা কি গুলি করে তাকে ফেলে দেব? কামরান ইকবাল, যে তাঁর পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে, শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।

‘নাহ্। একজন নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। দেখাই যাক কি তার অভিপ্রায়, খুররম, অশ্বারোহীর উপর থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে, উত্তর দেয় যে দূর্গের ঠিক নিচে অবস্থিত একখণ্ড সমতল ভূমিতে এসে পৌঁছেছে এবং নিজের হাপরেরমত হাপাতে থাকা বাহনকে আরো একবার পুতগতিতে ছোটার জন্য তাড়া দিচ্ছে। দূর্গের তোরণগৃহ থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে থাকার সময় সে তার ঘোড়ার পর্যাণে ঝুলতে থাকা একটা থলে তুলে নেয়, এবং ঘোড়াটাকে বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে নিয়ে আচমকা এমনভাবে দাঁড় করায় যে জন্তুটা পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যায়, থলেটা মাথার উপরে ঘোরায় এবং গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে দূর্গের লম্বা কীলকযুক্ত দরজার দিকে সেটা ছুঁড়ে দেয়। বিশ্বাসঘাতক খুররমের জন্য উপহার, তাঁর আত্মার যেন নরকে ঠাই হয়, সে চিৎকার করে বলে, তারপরে সে তার ঘোড়ার মাথা ঘুরিয়ে নেয় এবং ফিরতি পথে নিচের দিকে ছুটতে শুরু করে, সে তার বাহনের গলার কাছে নিচু হয়ে ঝুঁকে থাকে এবং সামান্য আঁকাবাঁকাভাবে যায় যেন দূর্গের ছাদে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকা সৈন্যরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়বে বলে সে প্রত্যাশা করছে।

অশ্বারোহী দ্রুত নিচের সমভূমির দিকে নামতে শুরু করলে খুররম চোখ কুঁচকে চারপাশের রুক্ষ ভূপ্রকৃতি তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখে, মনে মনে ভাবে আসিরগড়ের তোরণদ্বারে লোকটার ঔদ্ধত্যের সাথে ঘোড়া দাবড়ে আসা কি কোনো সম্ভাব্য আক্রমণের ইঙ্গিতবহ। কিন্তু আকাশের অনেক উঁচুতে বাতাসের স্রোতে ডানা ভাসিয়ে ভেসে থাকা কয়েকটা মরাখেকো শকুন ছাড়া আশেপাশে কোনো জীবন্ত প্রাণীর চিহ্নমাত্র নেই। থলিটা নিয়ে আসবার জন্য তোক পাঠাও,’ সে মুখ থেকে ঘাম মুছে আদেশ দেয়। জুন মাস মাত্র শুরু হয়েছে এবং প্রতিদিনই দাবদাহের আক্রমণ প্রবলতর হচ্ছে এবং বাতাস গুমোট আর অসহনীয় হয়ে উঠছে। সে কিছুক্ষণের ভিতরেই তোরণগৃহ থেকে ধাতব চক্রের পরস্পরকে সজোরে ঘর্ষণের শব্দ শুনতে পায় যার সাথে সাথে কাঠের প্রবেশ তোরণ রক্ষাকারী লোহার বেষ্টনী কম্পিত ভঙ্গিতে উপরে উঠতে শুরু করায় শিকলের ঝনঝন শব্দ ভেসে আসে। তারপরে তোরণের ডানপাশে অবস্থিত একটা ছোট দরজা-খুব বেশি হলে চারফিট উঁচুভেতরের দিকে খুলে যায়। দীর্ঘদেহী, কৃশকায় এক তরুণ, তাঁর মাথার সোনালী রঙের চুল সূর্যের আলোয় জ্বলজ্বল করে, দরজার নিচে দিয়ে ঝুঁকে বাইরে বের হয়ে আসে এবং ছুঁড়ে দেয়া থলিটা যেখানে একটা কাঁটা ঝোঁপের পাশে পড়ে রয়েছে সেদিকে দৌড়ে যায়। নিকোলাস পুটলিটা তোলার জন্য উবু হতে, খুররম ভাবে, টমাস রো ঠিকই বলেছিল। তরুণ ইংরেজ গত কয়েক মাসে নিজেকে একজন বিশ্বস্ত আর কুশলী কর্চি হিসাবে প্রমাণ করেছে। আগ্রা থেকে পলায়নের নাটকীয়তার মাঝে এই ইংরেজ তরুণকে তার অধীনে চাকরি দেয়ার ব্যাপারে রো’র অনুরোধের বিষয়টা সে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। নিকোলাস অবশ্য ভুলে যায়নি। সুরাটের বন্দর থেকে ইংল্যান্ডগামী একটা জাহাজে তাঁর মনিবকে তুলে দিয়ে সে এখানে দাক্ষিণাত্যের মালভূমির উত্তরপ্রান্তে আসিরগড়ে পথ চিনে নিয়ে হাজির হয়েছে।

খুররম লক্ষ্য করে নিকোলাস সহসা গুটিয়ে যায় এবং আরেকটু হলেই তাঁর হাত থেকে থলিটা মাটিতে পড়ে যেত। নিজেকে সামলে নিয়ে, সে থলিটা এবার দু’হাতে আঁকড়ে ধরে এবং দেহের কাছ থেকে যতটা দূরে সম্ভব ধরে রেখে সতর্কতার সাথে সেটা বয়ে নিয়ে ঢালু পথ দিয়ে উপরের দিকে উঠতে আরম্ভ করে এবং দূর্গের ভেতরে প্রবেশ করে। অশ্বারোহী কি ছুঁড়ে ফেলে গেছে জানবার কৌতূহলে খুররম দ্রুত পাথরের খাড়া সিঁড়ি দিয়ে নিচের প্রধান আঙিনায় নেমে আসে। নিকোলাসের চারপাশে একদল সৈন্য জটলা করে দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং চটের দাগযুক্ত থলিটা তার পায়ের কাছে পড়ে রয়েছে। খুররম সামনের দিকে এগিয়ে যেতে, তাঁর নাকে বিবমিষাকর একটা দুর্গন্ধ ভেসে আসে। থলির বাঁধন খুলো, সে নিকোলাসকে আদেশ দেয়। দ্রুত।

নিকোলাস কোমর থেকে নিজের খঞ্জরটা বের করে এক পোঁচে থলির মুখ আটকে রাখা মোটা দড়ি কেটে দেয় এবং তারপরে সেটাকে একপাশে কাত করে দেয়। থলির ভেতর থেকে পচনক্রিয়া শুরু হওয়া একটা কালচে বস্তু গড়িয়ে বের হয়ে আসে। খুররম কিছুক্ষণের জন্য বস্তুটাকে পচা তরমুজ মনে করে যতক্ষণ না সে নাকে বমি উদ্রেককারী মৃত্যুর মিষ্টি দুর্গন্ধ পুরোপুরি পায়। জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকা সৈন্যদের একজন, হালকা পাতলা এক তরুণ, ঘুরে দাঁড়ায় এবং মুখ বিকৃত করে বমনার্থে ওআক তুলে এবং খুররমও যখন বুঝতে পারে সে চোখের সামনে কি দেখছে সে তার গলায় পিত্তের স্বাদ অনুভব করে।

সে, উবু হয়ে বসে, নিজেকে জোর করে বাধ্য করে পচে ফুলে উঠা বস্তুটা পরীক্ষা করে দেখতে যা এক সময় তার বিশ্বস্ত গুপ্তদূতদের একজন, জামাল খানের কাঁধের উপরে শোভা পেত। সে কয়েক সপ্তাহ আগে মানজুর শাসনকর্তার কাছে জাহাঙ্গীরের সাথে তার বিরোধে শাসনকর্তার সমর্থন কামনা করে একটা বার্তা দিয়ে তাকে পাঠিয়েছিল। গুপ্তদূতেরা বাম চোখ তুলে ফেলা হয়েছে এবং একজোড়া শূককীট রক্তাক্ত অক্ষিকোটরে মোচড় দিচ্ছে। হাঁ করে থাকা মুখের ভিতর ভাঙা দাঁত, পূজ জমা মাড়ি আর বেঢপ ফুলে বেগুনী হয়ে উঠা ঠোঁটের মাঝে বের হয়ে থাকা একটা কাগজের টুকরোয় কামরান নিজের সীলমোহর সনাক্ত করতে পারে। এটা মানডুর শাসনকর্তার কাছে তাঁর প্রেরিত চিঠিটা ছাড়া আর অন্য কিছু না।

‘যুবরাজ, থলির ভিতরে আরো কিছু একটা রয়েছে, সে নিকোলাসকে বলতে শুনে। সে নিজের পায়ে ভর দিয়ে পুনরায় উঠে দাঁড়িয়ে কর্চির ধরে থাকা চামড়ার ছোট থলেটা নেয়, এবং সেটা খুলতে প্রাণপনে ঢোক গিয়ে পাকস্থলী থেকে উঠে আসা বমি দমন করে সে কয়েক পা পিছিয়ে আসে। বিশ্বাসঘাতক খুররমকে সম্বোধন করে ভেতর একটা চিঠি রয়েছে।

সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমি একজন অনুগত কর্মচারী। আমি তোমার বার্তাবাহকের সাথে যেমন আচরণ করা উচিত ছিল তাই করেছি। তাঁর মৃত্যু মোটেই দ্রুত হয়নি কিন্তু তোমার মত একজন প্রভুর অধীনস্ত কোনো কর্মচারী সহানুভূতি আশা করতে পারে না। সে শেষ সময়ে যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সে যা জানে সবকিছু সে স্বীকার করে গেছে–তোমার সাথে কতজন সৈন্য রয়েছে, কতগুলো কামান আছে, ষড়যন্ত্রের অনুরোধ নিয়ে এবং যাঁদের কাছে তুমি বার্তা প্রেরণ করেছে সেইসব বার্তাবাহকদের নাম। তুমি এই বার্তা যখন পাঠ করছে তখন আমি মোগল রাজদরবারে পৌঁছে যাব তোমার রাজবৈরী প্রস্তাবের বিষয়ে তোমার আব্বাজান, মহামান্য সম্রাটকে অবগত করতে।

বার্তাটার নিচে আলী খান, মানডুর শাসনকর্তা, স্বাক্ষর রয়েছে।

‘বার্তাটায় কিছু নেই, বাহাদুরি আর ধৃষ্টতাপূর্ণ এক টুকরো কাগজ, খুররম যতটা অনুভব করে কণ্ঠস্বরে তাঁর চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাস ফুটিয়ে তুলে বলে। মাথাটা যথাযথ ধর্মীয় আচার অনুসরণ করে কবর দাও। জামাল খানের জন্য আমরা এখন এতটুকুই কেবল করতে পারি।’

সে ঘুরে দাঁড়ায় এবং দূর্গের উপরিতলে অবস্থিত আরজুমান্দের কক্ষের অভিমুখে সে যখন রওয়ানা দেয় তখনও তার হাতে মানডুর শাসনকর্তার চিঠিটা ধরা রয়েছে। সে কক্ষের দরজার উন্মুক্ত পাল্লার মাঝ দিয়ে দেখে যে আরজুমান্দ গবাক্ষের কাছে বসে রয়েছে তার কোলে তাদের সদ্যোজাত সন্তান আওরঙ্গজেব।সে এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে তাদের প্রাণ ভরে দেখে। ছেলেটা এখন ভালোই আছে, যদিও সেই দিনটার কথা সে কখনও ভুলবে না, তারা আগ্রা ছেড়ে আসবার দুই মাস পরে এবং সন্তান ভূমিষ্ট হবার পুরো একমাস আগে, তাঁদের দলটা যখন বিন্ধ্যা পর্বতের ভিতর দিয়ে উপরের দিকে যাবার জন্য পরিশ্রম করছিল তখন আরজুমান্দের গর্ভযন্ত্রণা শুরু হয় যেখানে বর্ষার ভারি বর্ষণে ছোট ছোট খাড়িগুলো বিপদসঙ্কুল পাহাড়ী নদীতে পরিণত হয়েছে এবং তারা যখন যাত্রা বিরতি করে অস্থায়ী শিবির স্থাপন করে তখন টপটপ করে বৃষ্টির পানি পড়তে থাকা গাছের ডালপালা ছিল তাদের তাবু হিসাবে একমাত্র আশ্রয়।

কোনো হেকিম, বা ধাত্রীর সহায়তা ছাড়া কেবল তাঁদের সঙ্গে আসা দু’জন আয়ার সহায়তায় আরজুমান্দ পর্দা দেয়া গরুর গাড়িতে সন্তান জন্ম দেয়। বৃষ্টির নিচে দাঁড়িয়ে, অসহায়ভাবে তার আর্তনাদ শুনতে শুনতে ইচ্ছা করছিল এসব বন্ধ হোক কিন্তু একই সাথে ভয় হচ্ছিল সহসা এই আর্তনাদ বন্ধ হয়ে যাবার কি অর্থ ভেবে–এতটা ক্ষমতাহীন নিজেকে তার আর কখনও মনে হয়নি। কেন তার জীবনটা, যা প্রথমে তার দাদাজান তারপরে তার আব্বাজানের প্রশ্রয়ে এত ভালোভাবে শুরু হয়েছিল, এমন এক রমণীর সাথে তার বিয়ে হয়েছিল সে যাকে ভালোবাসে এবং যে তাকে ভালোবাসে তারপরে তার সফল যুদ্ধাভিযান, এতকিছুর পরেও কেন এমন ভাগ্যবিড়ম্বনার শিকার হল? সে মনে মনে ভাবে, তবে কি নিয়তি তাকে পরীক্ষা করছে, খানিকটা স্বস্তির জন্য দু’হাতে নিজেকে আঁকড়ে রয়েছে, দেখতে চায় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলে তাঁর উচ্চাকাঙ্খর কি দশা হয়? না, সে স্থিরসংকল্প, আরজুমান্দের আর্তনাদ তাঁদের সপ্তমে পৌঁছেছে মনে হতে সে নিজের দু’পাশে দু’হাত টানটান করে রেখে বুক টানটান করে দাঁড়ায়, তার দুর্ভাগ্য তাকে কেবল আরো দৃঢ়সঙ্কল্প করবে। আরজুমারে কান্নার শব্দ কিছুক্ষণ পরেই হ্রাস পায় এবং এক স্বাস্থ্যবান শিশুর তীক্ষ্ণ স্বরে কান্নার শব্দ তার বদলে ভেসে আসে।

সে এখন যখন দরজার ছায়ায় দাঁড়িয়ে তাকে তাঁদের সন্তানের সাথে দেখছে, তাঁদের জন্য উদ্বেগ, অনিশ্চয়তাবোধ যা সে কখনও দীর্ঘ সময় ভুলে থাকতে পারে না পুনরায় তাকে আচ্ছন্ন করে। তাঁর জন্য যুদ্ধের ময়দানে সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দেয়ার মাঝে ভয়ের খুব বেশি কিছু নেই কিন্তু চারপাশের সবকিছু যখন মনে হয় বিরুদ্ধে চলে গিয়েছে তখন তার পরিবারকে রক্ষা করা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। সে আশা করেছিল দাক্ষিণাত্যে অবস্থানরত তার বাহিনী তার প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে কিন্তু তার পরিবারের পলায়নের পরপরই কিন্তু সে নিজের বাহিনীর কাছে পৌঁছাবার অনেক আগেই জাহাঙ্গীর দ্রুতগামী অশ্বারোহী বার্তাবাহক প্রেরণ করে মালিক আম্বারের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান বন্ধের আদেশ দেয় এবং পুরো বাহিনীকে আগ্রায় ডেকে পাঠায়। খুররমের কতিপয় সেনাপতি-কামরান ইকবালের মত মানুষেরা–আদেশ অমান্য করে এবং আসরগড়ে তাকে। খুঁজে বের করে। আরো অনেকেই–কোথায় তাদের নিজেদের সুবিধা হবে সেই সম্বন্ধে সচেতন হবার সাথে সাথে জাহাঙ্গীরের শাস্তির ভয়দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে আগ্রায় ফিরে যায় যেখানে তারা প্রকাশ্যে সম্রাট জাহাঙ্গীরের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিতে বাধ্য হয়।

জামাল খানের হত্যাকাণ্ড–এখন আবার নতুন আরেকটা আঘাত। কোনো মানুষের পক্ষে নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করা সম্ভব না। জামাল খান বাস্তবিকই তার পরিকল্পনার কিছুটা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন কিন্তু তার কাছ থেকে বলপূর্বক আদায় করা স্বীকারোক্তি দ্বারা তাঁর নিজের খুব বেশি সংখ্যক সমর্থকদের নিরাপত্তার বিষয়টার আপোষ করা হয়নি। খুররম তার শিবিরে গুরুত্বপূর্ণ নৃপতি আর শাসনকর্তাদের ভিতর যাঁদের আকৃষ্ট করতে চেয়েছে তাঁদের কারো কাছ থেকে এখনও পর্যন্ত কোনো আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায়নি। বাতাস কোন দিকে প্রবাহিত হয় সেটা দেখার জন্য তারা অপেক্ষা আর পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই এবং তাঁদের কাছে তাঁর প্রেরিত বার্তাগুলো বাস্তবিকই যদি জাহাঙ্গীরের কাছে পৌঁছায় এই মনোভাবের কারণে তারা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। কিন্তু এরফলে তাঁদের পক্ষে তাকে সহায়তা দেয়ার সম্ভাবনা, গোপনে হলেও, অনেকটাই হ্রাস পাবে।

সে আরজুমান্দের কক্ষে প্রবেশ করার সময় চেষ্টা করে নিজের চেহারায় একটা উৎফুল্লভাব ফুটিয়ে রাখতে কিন্তু সে তাকে খুব ভালো করে চেনে। তার এগিয়ে আসবার শব্দ শুনে সে মুখ তুলে তাকায়, কিন্তু তার চোখেমুখে ফুটে থাকা টানটান উত্তেজনার অভিব্যক্তি দেখে আরজুমান্দের হাসি স্নান হয়ে যায়।

‘খুররম, কি হয়েছে?

সে তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে প্রথমে ঝুঁকে তাকে চুমো দেয় তারপরে হেঁটে গবাক্ষের কাছে গিয়ে পুনরায় শুষ্ক, ঝিকমিক করতে থাকা ভূপ্রকৃতির দিকে তাকায়। সে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকার সময়েই সে শুনতে পায় আরজুমান্দ আওরঙ্গজেবকে নিয়ে যাবার জন্য একজন পরিচারিকাকে ডাকে। সে তারপরে টের পায় তার হাত আলতো করে তাকে জড়িয়ে ধরছে এবং তাকে ঘুরিয়ে দাঁড় করায় নিজের মুখোমুখি করতে।

‘খুররম, এভাবে চেপে রেখো না, যাই ঘটুক না কেন তোমার অবশ্যই আমায় সেটা বলা উচিত।

‘তোমার কি মনে আছে যে জামাল খানকে আমি আমার গুপ্তচর হিসাবে মানডুর শাসনকর্তার কাছে পাঠিয়েছিলাম? বেশ, আমি আমার উত্তর পেয়েছি। আমার আব্বাজান তাকে পুরস্কৃত করবেন সেই আশায় সন্দেহ নেই, শাসনকর্তা তাকে শারীরিকভাবে নিপীড়ন করেছে আমাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে সে যা জানতো সেটা প্রকাশ করতে এবং তারপরে তাকে হত্যা করেছে। সে তার ছিন্নমস্তক সাথে একটা ধৃষ্টতাপূর্ণ চিরকুট দিয়ে আমার কাছে ফেরত পাঠাবার মত হঠকারিতা প্রদর্শন করেছে। সে নির্ঘাত বিশ্বাস করেছে যে আব্বাজান আমায় পুরোপুরি পরিত্যাগ করেছেন এবং আমার পূনর্বাসিত হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই নতুবা তিনি এমন কাজ করার সাহস করতেন না। আর তিনি সম্ভবত ঠিকই ভেবেছেন। আমাদের এখানে অবস্থানের এতগুলো মাস অবস্থানের সময় আব্বাজানের কাছ থেকে আমি কোনো বার্তা পাইনি যদিও নিজের নিরপরাধিতার বিষয়ে প্রতিবাদ করে আমি তাঁর কাছে বেশ কয়েকটা চিঠি পাঠিয়েছি।’

‘কিন্তু এটাও তো সত্যি যে তিনি এখনও আপনার বিরুদ্ধে কোন সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করেন নি। এটা নিশ্চয়ই কিছু অর্থবহন করে।

‘সেটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। অন্য আর সবার মত–আমি যাঁদের আমাকে সমর্থন করতে রাজি করাতে চেষ্টা করছি যারা এখনও কোনো সিদ্ধান্ত জানায় নি তাদের সকলের মত–তিনিও হয়ত অপেক্ষা করে কালক্ষেপণ করছেন এবং পুরষ্কার আর শাস্তির হুমকি প্রদান করছেন, আমি কোনোভাবেই যা করতে পারবো না, তার জন্য তার লড়াই লড়তে। আমার লোকজন ইতিমধ্যেই দলত্যাগ করতে আরম্ভ করেছে। শেষবার গণনার সময় আমার সাথে দুই হাজারেরও কম লোক ছিল… কে জানে একমাস, দুইমাস পরে আমার সাথে কতজন লোক থাকবে? আমরা এভাবে সবকিছু চলতে দিতে পারি না। আমার জন্মগত অধিকার আর যোগ্যতা আমাকে যে উচ্চাকাঙ্খী লক্ষ্যে অধিকার দিয়েছে আমি কীভাবে তা অর্জন করবো?

কিন্তু আপনি কি করবেন?

‘আগ্রায় আবার ফিরে গিয়ে আরো একবার নিজেকে আব্বাজানের করুণার কাছে নিজেকে সমর্পিত করে তাকে বাধ্য করবো আমার কথা শুনতে…’

না!” আরজুমান্দের কণ্ঠের প্রচণ্ডতা তাকে চমকে দেয়। খুররম, আমার কথা শোনেন। আপনি যা করতে চাইছেন সেটা করার মানে প্রায় নিশ্চিত মৃত্যু। আপনি নিদেন পক্ষে খসরুর মত অন্ধত্যুবরণ করা প্রত্যাশা করতে পারেন। আপনি প্রথমবার আমাকে যখন বলেন যে মেহেরুন্নিসা আমাদের শত্রুতে পরিণত হয়েছে আমার নিজের ফুপুজান হবার কারণে কথাটা বিশ্বাস করতে আমার কষ্ট হয়েছিল… কিন্তু তারপরে আমি চিন্তা করতে শুরু

করি এবং তখন বুঝতে পারি তাকে আমি আসলেই কত অল্প চিনি। আমি যখন বড় হচ্ছিলাম তখন তিনি তার প্রথম স্বামীর সাথে বাংলায় অবস্থান করছিলেন। তিনি সম্রাজ্ঞী হবার পরে তাকে তখন আরো দূরের কেউ বলে মনে হত, নিজের অবস্থান আর নিজেকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত… আমি তাকে কদাচিত একা দেখেছি। শাহরিয়ারের সাথে এখন যখন লাডলির বাগদান সম্পন্ন হয়েছে, আমরা তার জন্য প্রতিবন্ধকতা হয়ে উঠেছি… আমি এখন সেটা বুঝতে পেরেছি। আর আমি একটা বিষয় খুব ভালো করেই জানি আমার ফুপুজান কতটা ধূর্ত, কতটা স্থিরসংকল্প, কতটা শক্তিশালী… খসরুর বিদ্রোহের সাথে যখন আমার চাচাজান মীর খান যোগ দিয়েছিল তখন তিনি তাঁর এইসব গুণাবলি ব্যবহার করে নিজেকে আর সেই সাথে আমাদের পুরো পরিবারকে রক্ষা করেছিলেন এবং তিনি সেইসব গুণাবলি আবারও ব্যবহার করতে পিছপা হবেন না যদি তার কাছে সেটা প্রয়োজনীয় মনে হয়। আগ্রায় ফিরে যাবার কথা ভুলে যান… তার প্রভাবের কাছে নিজেকে সমর্পণ করবেন না। সম্রাটকে তিনি কি করার জন্য প্ররোচিত করতে পারেন সেটা ভেবে আমি আতঙ্কিত। আমার কথা দেন, অনুগ্রহ করে…’।

আরজুমান্দের কণ্ঠে খুররম আবেগপ্রবণ প্রত্যয় শুনতে পায়। সচরাচর তাঁর বিবেচনাবোধের উপর আস্থা রাখতে আগ্রহী আরজুমান্দ কদাচিৎ তার সাথে কিছু নিয়ে তর্ক করেছে। সে সম্ভবত ঠিকই বলেছে। সে নিজের নিরপরাধিতায় এবং যুক্তিতর্ক আর বোঝাবার ক্ষমতায় যতই বিশ্বাস করুক, জাহাঙ্গীরের ভালোবাসায় অপ্রতিরোধ্য, মেহেরুন্নিসা, খুব সম্ভবত আব্বাজানের সাথে তাকে আরেকবার দেখা করার সুযোগ থেকে বিরত রাখবে। বেশ, তাই হবে, সে অবশেষে মন্থর কণ্ঠে বলে, ‘আমি কথা দিচ্ছি… আমি আরেকটু ধৈর্য ধারণ করে দেখবো।

*

হেকিম জাহাঙ্গীরের উর্দ্ধবাহুতে শক্ত করে পট্টি বেধে দেয়ার সময় সে ব্যাথায় কুঁচকে উঠে। যমুনার তীরে বাজপাখি দিয়ে শিকার করার সময় তাঁর নিজের অসতর্কতার কারণে জখমটা হয়েছে। সে যদি চামড়ার দস্তানা পরিধান করে থাকতো তাঁর প্রিয় হলুদ বাজপাখির, পাখিটা তিনি নিজের হাতে পোষ মানিয়েছেন, তীক্ষ্ণ হলুদ ঠোঁট বাহুর একটা পুরাতন ক্ষতস্থানের মুখ উন্মুক্ত করতে পারতো না মির্জাপুরের রাজার সাথে লড়াই করার সময় ক্ষতটা হয়েছিল। হেকিম তার কাজ শেষ করার মাঝেই একজন পরিচারক ভেতরে প্রবেশ করে। জাহাপনা, মানডুর রাজ্যপাল আপনার সাথে দেখা করতে আগ্রহী। তিনি বলেছেন তিনি খবর নিয়ে এসেছেন যা অবিলম্বে আপনার শোনা উচিত।’

‘তাকে তাহলে এই মুহূর্তে আমার একান্ত কক্ষে নিয়ে এসো।’ এই লোকটা কি চায়? হেকিম যখন তার চিকিৎসার উপকরণ গুছিয়ে নিয়ে বিদায় নেয় জাহাঙ্গীর তখন আপন ভাবনায় মশগুল। মানডু দক্ষিণে অনেক দিনের দূরত্বে অবস্থিত এবং বয়স্ক আর গাট্টাগোট্টা আলী খান অযথা পথের ধকল সহ্য করবেন না। রাজ্যপাল পাঁচ মিনিট পরে তাকে অভিবাদন জানায়। তার পরনের ঘামে ভেজা আলখাল্লা আর পায়ের ধূলি ধূসরিত নাগরা দেখে বোঝা যায় তিনি বাস্তবিকই গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা জানাতে চান।

‘আলী খান, কি ব্যাপার?

‘আমি নিজ মুখে আপনাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ জানাতে চাই বা অন্যথায় আমার আশঙ্কা আপনি খবরটা হয়ত বিশ্বাস করবেন না।

‘কি সংবাদ বলেন।

‘আপনার সন্তান যুবরাজ খুররম আপনার প্রজাদের আপনার বিরুদ্ধে সংগঠিত করছে।’

‘আপনি কি বলতে চান?

‘আপনাদের ভিতরে প্রকাশ্য বিরোধের সম্ভাবনা যদি দেখা দেয় সে আমার সমর্থন কামনা করে আমার কাছে চিঠি লিখেছিল। আমি, অবশ্যই, তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছি এবং মনে করেছি সাথে সাথে আপনাকে জানান আমার দায়িত্ব।’

‘আমাকে তাঁর চিঠিটা দেখাও।

‘আমার কাছে সেটা এখন নেই, কিন্তু বার্তাটা যে বহন করে এনেছিল আমি সেই বার্তাবাহক বন্দি করে সে সবকিছু স্বীকার না করা পর্যন্ত তাকে নিপীড়ন করি। যুবরাজ খুররম দক্ষিণে একটা শক্তিশালী ঘাঁটি তৈরি করতে চাইছেন যেখান থেকে তিনি আপনার আধিপত্যকে প্রশ্ন করতে পারবেন। আমি কেবল একমাত্র রাজ্যপাল নই যুবরাজ যোগাযোগ করেছেন। এই দেখেন–আমার কাছে নামের একটা তালিকা আছে…’ আলী খান হাসলে জাহাঙ্গীর যা অনুগ্রহোদ্দীপক হাসি হিসাবে অনুমান করে।

জাহাঙ্গীর তার দিকে আলী খানের বাড়িয়ে ধরা কাগজটা নেয়। সে রাজ্যপালের বিশ্বস্ততার বিষয়ে অনেক দিন আগেই খসরুর শেষ বিদ্রোহের সময়েই সন্দেহ করার মত কারণ খুঁজে পেয়েছিল। আলী খান অবশ্য একাধারে ধূর্ত আর উঁচুমহলে আত্মীয়স্বজনও রয়েছে এবং জাহাঙ্গীর কখনও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মত যথেষ্ট প্রমাণ পায়নি। খুররম অবশ্যই জানতো লোকটার বিশ্বস্ততা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে এবং সম্ভবত সেই কারণেই সে তার সাথে যোগাযোগ করেছিল। খুররমের অবস্থানের দুর্বলতা সম্বন্ধে এটা থেকে অনেক কিছু অনুমান করা যায় যা আলী খান, কোনো সন্দেহ নেই সতর্কতার সাথে বিশ্লেষণ করে, তাকে তার আব্বাজানের কাছে ধরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

জাহাঙ্গীর নামের তালিকায় চোখ বুলাতে গিয়ে দেখে তালিকাটা বেশ লম্বা। সে সহসা ক্লান্তি অনুভব করে এবং একা থাকতে চায়। আলী খান, আমি তোমায় যথাযথভাবে পুরস্কৃত করবো। আমি এখন একা থাকবো।’

‘ধন্যবাদ, জাঁহাপনা। আপনি আমার আনুগত্যের উপর ভরসা রাখতে পারেন। আলী খান ঘুরে দাঁড়িয়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে যাবার জন্য অগ্রসর হবার সময় তাঁর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে থাকে।

রাজ্যপালের পেছনে দরজা বন্ধ হতে, জাহাঙ্গীর হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মোছে। সে যে সন্তানকে একটা সময় সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতো সে কীভাবে এতটা আনুগত্যহীন হতে পারে? দূর্গের প্রকারবেষ্টিত ছাদে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তাঁদের শেষবারের মত দেখা হবার পর থেকে, এমন একটা দিনও অতিবাহিত হয়নি যখন সে খুররমের বিষয়ে চিন্তা করে নি, নিজেকে মনে মনে প্রশ্ন করে নি সে কি করার পরিকল্পনা করছে। তার সত্ত্বার একটা অংশ আশা করেছে যে সে হয়তো নিজের ঔদ্ধত্যের জন্য অনুতপ্ত হবে এবং অনুবর্তী হবে। তাঁর আসিরগড় থেকে লেখা চিঠিগুলো প্রথমদিকে এই আশাগুলোকে সাহসী করে তুলতো, কিন্তু মেহেরুন্নিসা যখন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিত তার শব্দ চয়ন আর কিছু না নিজের কাজের স্বপক্ষে উদ্ধত যুক্তি প্রদর্শন–সেখানে ক্ষমাপ্রার্থনার কোনো ধরনের দোষ স্বীকারের কোনো প্রসঙ্গই নেই। তারই পরামর্শে তিনি চিঠির উত্তর প্রদান করা থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু তিনি একই সাথে মেহেরুন্নিসার অনুরোধ মেনে নিয়ে নিজের সন্তানকে গ্রেফতার করার জন্য সেনাবাহিনী প্রেরণ করা থেকে বিরত থাকেন। এটা এখন প্রতিয়মান হচ্ছে যে মেহেরুন্নিসা বরাবরের মতই ঠিক পরামর্শই দিয়েছিল। তিনি শিথিলতা প্রদর্শন করেছেন, কোনো ধরনের পদক্ষেপ না নিয়ে তিনি বৃথাই কালক্ষেপণ হতে দিয়েছেন, যা খুররমকে আরো উদ্ধত হতে উৎসাহিত করেছে।

*

জাহাঙ্গীর যখন মেহেরুন্নিসা কক্ষের দিকে এগিয়ে যায় তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। সে এইমাত্র পরামর্শদাতাদের একটা বৈঠকে যোগ দিয়ে এসেছে যেখানে আলী খান, পরিষ্কার সবুজ আলখাল্লা পরিহিত হয়ে, তাঁর গল্পের পুনরাবৃত্তি করেছে। তার পরামর্শদাতাদের রাজ্যপালকে উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে প্রশ্ন করা দেখে বোঝা গেছে তার নিজের মত তারাও দুশ্চিন্তাগ্রস্থবা নিদেনপক্ষে সেইরকমই ভান করেছে। আলী খানের তালিকায় তাদের কারও নাম নেই কিন্তু খুররমের ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে তাদের কেউ কি অবগত ছিল? ভাবনাটা জাহাঙ্গীরের অভিব্যক্তিকে কঠোর করে তুলে। মন্ত্রণা কক্ষের পেছনের দেয়ালে অবস্থিত একটা তিরস্করণীর আড়াল থেকে মেহেরুন্নিসা সবকিছু দেখেছে এবং শুনেছে। তাঁর কি বলার আছে তিনি শুনতে আগ্রহী–কিন্তু গিয়াস বেগ আর আসফ খানের সাথেও পরামর্শ করা প্রয়োজন, তাঁদের সাথে যোগ দিতে যাদের তিনি ডেকে পাঠিয়েছেন।

তিনি যখন ভেতর প্রবেশ করছেন মেহেরুন্নিসার কক্ষে তখন মাত্র সন্ধ্যের মোমবাতি প্রজ্জ্বলিত করা হয়েছে। তার প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা করছে। মেহেরুন্নিসা সাথে সাথে তার দিকে এগিয়ে এসে, তাঁর কাঁধে হাত রাখে এবং কোনো কথা না বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে তার জন্য পানপাত্রে সুরা ঢালার পূর্বে আলতো করে তাকে জড়িয়ে ধরে তার ওষ্ঠে মৃদু চুম্বন করে। তিনি পানপাত্রে লম্বা একটা চুমুক দেন। তিনি যখন মনে মনে ভাবেন, সুরার তৃপ্তি এবং এর প্রশমিতকারী উষ্ণতা তার প্রয়োজন, তখন কক্ষের দরজা পুনরায় খুলে যায় গিয়াস বেগের দীর্ঘদেহী বয়োজ্যষ্ঠ অবয়ব আর পেছনে রয়েছে তাঁর সন্তান আসফ খানের গোলগাল কাঠামো।

‘বেশ, আপনারা সবাই আলী খানের বক্তব্য শুনেছেন। কি মনে হয়েছে। শুনে? তিনি সরাসরি জিজ্ঞেস করেন।

‘জাহাপনা, কি বলবো আমি বুঝতে পারছি না। গিয়াস বেগ তাঁর রূপালী চুল ভর্তি মাথা নাড়ে। আমি কখনও ভাবতে পারিনি এমন কিছু ঘটনা ঘটতে পারে।’

‘এটাই কেবল সবচেয়ে বেশি সম্ভব। আমি ঠিক যেমন সন্দেহ করেছিলাম। খুররম সিংহাসন দখল করতে আগ্রহী। তাকে বহুদিন আগেই গ্রেফতার করার পরামর্শ দিয়ে আমি ভুল করিনি। প্রহরীরা সেদিন যদি একটু দ্রুত কাজ সমাধা করতো…’ মেহেরুন্নিসা বলে।

কিন্তু, জাঁহাপনা, এক মুহূর্ত ভেবে দেখেন–আলী খান কেবল এটুকুই বলেছে যে যুবরাজ খুররম সমর্থক সংগ্রহ করতে চেষ্টা করছেন। তার মানে এই নয় যে তিনি আপনার বিরুদ্ধে কোনো সামরিক অভিযানের নেতৃত্ব দিতে আগ্রহী, গিয়াস বেগ প্রতিবাদ করেন।

‘কিন্তু এমন একটা পদক্ষেপ কেন গ্রহণ করবে?’ মেহেরুন্নিসা জানতে চায়। কারণ, বাছা, সে নিজেকে অরক্ষিত মনে করছেন। জাহাপনা, আমার অকপট বাচনভঙ্গি মার্জনা করবেন, কিন্তু আপনি যুবরাজকে কখনও বলেননি কীভাবে সে আপনাকে ক্রুদ্ধ করেছে। তিনি এ কারণেই আপনাকে ক্রুদ্ধ করার ঝুঁকি নিয়ে হলেও আগ্রা এসেছিলেন আপনার সাথে কথা বলার চেষ্টা করতে… মাজিদ খান সেই রাতে যুবরাজের সাথে তাঁর কথোপকথনের বিষয়ে বলেছে। আর আমি যদি নিষ্কপট আমি এবং দরবারের আরো অনেকেই বুঝতে পারেনি কেন আপনি তার বিরুদ্ধে খেপে গিয়েছেন। আপনার আদেশ অনুযায়ী যুবরাজ খুররম সবকিছু করেছে… আনুগত্য আর সাহসিকতার সাথে আপনার বাহিনীকে বিজয়ী করেছে। অতি সম্প্রতিও তিনি ছিলেন আপনার সবচেয়ে গর্বের…সবাই আশা করেছিল আপনি তাঁর নাম আপনার উত্তরাধিকারী হিসাবে

‘ঠিক তাই। যেহেতু সম্রাট তার মমতার বিষয়ে এত ভোলামেলা, এত উদার, তিনি এহেন প্রত্যাশা জাগ্রত করেছেন, কিন্তু যুবরাজের মাঝে এসব প্রত্যাশা অন্য কিছুতে পরিণত হয়েছিল–একটা লোভী, অধৈর্য উচ্চাকাঙ্খা…’ মেহেরুন্নিসা বাধা দিয়ে বলে।

যুবকেরা সবসময়ে উচ্চাকাঙ্খী। কিন্তু তিনি যে কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করতে আগ্রহী চেয়েছিলেন তার কি প্রমাণ তোমার কাছে আছে?

‘সে দাক্ষিণাত্যে নিজের নেতৃত্ব পরিত্যাগ করে এখানে, আগ্রায় এসেছে।

কিন্তু তার কারণ এমন কিছু ঘটনা ঘটেছিল যা তিনি বুঝতে অপারগ হয়েছিলেন। যার একটা হল যুবরাজ শাহরিয়ারকে জায়গির প্রদানের বিষয় খুররমের বিশ্বাস সেটা তাকে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল… এবং ন্যায়সঙ্গতও, বটে।’

‘এসব জায়গির প্রদান সম্রাটের বিশেষ অধিকার। আপনার অবস্থান থেকে মহামান্য সম্রাটের সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে প্রশ্ন করা যায় না।’

‘এবং আপনিও পারেন না আমাকে মত প্রকাশে বাধা দিতে। আপনি সম্রাজ্ঞী হতে পারেন কিন্তু এখনও আমি আপনার জন্মদাতা পিতা। বৃদ্ধ লোকটা এক মুহূর্ত সময় নিয়ে নিজের ভাবনার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে পুনরায় বক্তব্য শুরু করে, জাঁহাপনা, আপনার মরহুম আব্বাজান আমাকে আর আমার পরিবারকে চরম দুর্গতি আর দারিদ্রের হাত থেকে উদ্ধার করার পর থেকে আমি চেষ্টা করে এসেছি আপনার রাজবংশের সর্বোচ্চ সেবা করতে। আমি আপনাকে সতর্কতা অবলম্বনের অনুরোধ করার সময় আমার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সেটা বলি। আপনি পরবর্তীতে আক্ষেপ করতে পারেন ঝোঁকের মাথায় এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না।

কক্ষের অভ্যন্তরে নিরবতা বিরাজ করে। মেহেরুন্নিসা মুখ ঘুরিয়ে থাকে। জাহাঙ্গীর তার বসার ভঙ্গি, তার মাথার নতি দেখে বুঝতে পারে সে কতটা ক্রুদ্ধ হয়েছে। জাহাঙ্গীর আগে কখনও তাকে তার আব্বাজানের সাথে তর্ক করতে কিংবা গিয়াস বেগকে, সচরাচর ভীষণ ধীরস্থির আর বিচক্ষণ, এতটা আবেগ নিয়ে কথা বলতে শোনেনি। আসফ খানের দৃষ্টি বাপ বেটির উপরে ঘুরতে থাকে, একটা গভীর ভ্রুকুটি তার চেহারায়।

‘আসফ খান, আপনি ভীষণ নিরব আর গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আপনার কি কিছুই বলার নেই?’ জাহাঙ্গীর জানতে চায়। খুররম যদি নিজেকে ধ্বংস করে দেয় তাহলে সে আপনার মেয়েকেও সেইসাথে ধ্বংস করবে।’

‘জাহাপনা, আমার ধারণা আব্বাজান ঠিকই বলেছেন। পরিস্থিতি সম্পর্কে আরো বিশদভাবে না জানা পর্যন্ত আপনার কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না। খুররম হৃদয় আর মনে আসলেই কি মনোভাব পোষণ করে আপনার সেটা খুঁজে দেখা উচিত। তাঁর কাছে একজন প্রতিনিধি প্রেরণ করেন–আপনি যদি অনুমতি দেন আমি খুশি মনে যেতে পারি।’

‘হ্যাঁ, গিয়াস বেগ সমর্থন জানায়। আপনি তাকে বিরোধ নিষ্পত্তির অন্তত একটা সুযোগ দিতে পারেন সে পথভ্রষ্ট হয়ে বহুদূরে সরে যাবার আগেই যখন বিরোধ নিষ্পত্তির সম্ভাবনা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

‘সে হয়তো বিরোধ নিষ্পত্তি করতেই চায় না।’

‘জাহাপনা, আপনি সেই প্রয়াস নেয়ার আগে সেটা নিশ্চিত জানেন না, নিজ সন্তানের সাথে যুদ্ধ এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করার কারণে প্রজারাও আপনার প্রশংসা করবে, গিয়াস বেগ দৃঢ়তার সাথে বলে।

জাহাঙ্গীর তাঁর পানপাত্রের গাঢ় তলানি পর্যবেক্ষণ করে। গিয়াস বেগের কথাগুলো তাঁর মনের একটা গোপন তন্ত্রীতে আঘাত করেছে। আকবর তাঁর সাথে যেমন আচরণ করেছিলেন তিনিও কি খুররমের সাথে ঠিক তেমনিই অন্যায় করেছেন? সেদিন রাতে প্রাকারবেষ্টিত দূর্গের ছাদে তিনি যদি আরো কিছুক্ষণ খুররমের বক্তব্য শ্রবণ করতেন তাহলে এমন কি ক্ষতি বৃদ্ধি হতো? তারা হয়তো একটা চলনসই বোঝাপড়ায় উপনীত হতে পারতো?

কিন্তু এমন সময় মেহেরুন্নিসা পুনরায় মন্তব্য করে। আব্বাজান, একটা আদর্শ পৃথিবীতে আপনি এইমাত্র যা পরামর্শ দিলেন তা হয়তো অর্থবহন করে। কিন্তু আমাদের পৃথিবী মোটেই নিখুঁত নয়। আমাদের সীমান্তের ভিতরে আর বাইরে শত্রুভাবাপন্ন লোকদের বাস সবাই সম্রাটকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে আপন আপন প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করতে আগ্রহী। এমনকি খুররমও এখন হয়ত সৈন্য সংগ্রহ করছে, আমাদের শত্রুর মাঝে মিত্রের সন্ধানে প্রকাশ্যে প্রস্তাব রাখছে।

‘তোমার কাছে কি এসবের স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ রয়েছে?

‘গুজব ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রতিটা দিন যা আমাদের নিশ্চায়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ব্যতিরেকে কেটে যাচ্ছে সম্রাটকে দুর্বল আর খুররমকে শক্তিশালী করছে এবং সে এটা জানতে পারবে। জাহাঙ্গীরের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে সে তার মুখটা দু’হাতের তালুতে ধরে। আমার কথা শোনেন। আমি কি আপনাকে সবসময়ে ভালো পরামর্শ দেইনি? আমি জানি, আপনার জন্য এটা কঠিন কিন্তু খুররমকে ধ্বংস করার জন্য আপনাকে অবশ্যই উদ্যোগ নিতে হবে। তাকে যখন বন্দি হিসাবে আপনার সামনে হাজির করা হবে তখন কথা বলার অনেক সময় পাওয়া যাবে। আপনি একজন পিতা বটে কিন্তু তার আগে প্রথমে আপনি একজন সম্রাট। নিজের সাম্রাজ্যকে রক্ষা করা কি আপনার মহান দায়িত্ব নয়? সে এক মুহূর্তের জন্য তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে তারপরে সে তাকে ছেড়ে দেয় এবং উঠে দাঁড়ায়। গিয়াস বেগ আবার নিজের মাথা নাড়তে শুরু করেছে। জাঁহাপনা, আমার কন্যার কথাগুলো অবিবেচনাপ্রসূত। আপনি অবশ্যই হঠকারী হয়ে কিছু করবেন না। কয়েকটা দিন অন্তত বিবেচনা করে দেখেন…’

‘আপনি জানেন আপনি এসব কথা বলছেন কারণ আপনি আমার আর আমার কন্যার চেয়ে আমার ভাই আর তার কন্যাকে বেশি পছন্দ করেন, মেহেরুন্নিসা চিৎকার করে উঠে, গলার স্বর কাঁপছে। আর আপনি, ভাইজান।’ সে চরকির মত আসফ খানের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। নিজেকে প্রশ্ন করে দেখেন আপনার সত্যিকারের আনুগত্য কোথায় নিহিত… আপনার সম্রাটের নাকি আপনার কন্যা?

আসফ খান এক কদম পেছনে সরে যায় এবং উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে জাহাঙ্গীরের দিকে আড়চোখে তাকায়, কিন্তু গিয়াস বেগ মোটেই ভীত নয়। ‘মেহেরুন্নিসা, তুমি এমন অভিযোগ করো তোমার এত বড় স্পর্ধা! আমরা একইভাবে তোমায় অভিযুক্ত করতে পারি খুররম আর আরজুমান্দের চেয়ে শাহরিয়ার আর তোমার কন্যার স্বার্থরক্ষায় তুমি ব্যক্তিগত কারণে সহায়তা করছো।’

‘আপনার বয়স হচ্ছে। আপনার স্মৃতি দুর্বল হয়ে পড়েছে নতুবা আপনি এমন কথা বলতে পারতেন না… সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি, কেবলমাত্র পারিবারিক স্বার্থ নিয়ে না।

‘তুমি উদ্ধত। তুমি আমাকে সম্মান প্রদর্শন করার তোমার কর্তব্য সম্বন্ধে ভুলে গিয়েছ।

কর্তব্য? আপনি কর্তব্যের কথা বলছেন? একটা গাছের নিচে সদ্য ভূমিষ্ট হওয়া শিশু অবস্থায় আমাকে মৃত্যুর হাতে সঁপে দিয়ে পরিত্যাগ করার সময় আপনার কর্তব্যবোধ কোথায় ছিল? আপনি সেই সময় আমায় কতটুকু সম্মান প্রদর্শন করেছিলেন?

‘মৃত্যু তখন আমাদের খুব কাছে ছিল। আমার সামনে আর কোনো উপায় ছিল না, তুমি সেটা খুব ভালো করেই জানো। আর ভাগ্য যখন প্রসন্ন হয়েছিল, আমি ফিরে এসেছিলাম তোমায় খুঁজতে…’।

‘আর আপনি এখন আরো একবার আমায় পরিত্যাগ করছেন।

‘এসব অনেক হয়েছে! জাহাঙ্গীরের মাথায় এখনও যন্ত্রণা হচ্ছে। মেহেরুন্নিসার উপরে সে এক মুহূর্তের জন্য হলেও অসহিষ্ণু হয়ে উঠে, যার সচরাচর মায়াবী চোখ ক্রোধে জ্বলজ্বল করছে এবং যার নিচের ঠোঁট বিশ্রী ভঙ্গিতে বাইরের দিকে ওল্টানো রয়েছে। আমি এই বিষয়ে আপনাদের বক্তব্য শুনতে চেয়েছিলাম কারণ এর সাথে আমাদের উভয়ের পরিবার জড়িয়ে রয়েছে, কিন্তু সিদ্ধান্ত কেবল আমি একাই গ্রহণ করবো।’

‘অবশ্যই।’ মেহেরুন্নিসা অনেক সংযত কণ্ঠে উত্তর দেয়। আমি দুঃখিত, আমি রেগে গিয়েছিলাম, কিন্তু আমি আপনার জন্যই ক্রুদ্ধ হয়েছিলাম, কারণ আমি আপনাকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে চাই… আমরা আমাদের ভালোবাসার মানুষের জন্য যা সবসময়ে করে থাকি।

জাহাঙ্গীর পালাক্রমে তাদের তিনজনের দিকে তাকায়–বাবা, ভাই আর বোন। সাম্প্রতিক ঘটনা প্রবাহ কেবল তাঁরই পরিবারকে বিভক্ত করে নি। ‘আপনারা যা বলেছেন আমি সে বিষয়ে ভেবে দেখবো, কিন্তু আমি এখন আমার একান্ত কক্ষে ফিরে যাব।’ সে মেহেরুন্নিসাকে তাঁর দিকে সামান্য এগিয়ে আসতে লক্ষ্য করে, কিন্তু তিনি তাকে উপেক্ষা করেন। আজ রাতে একাকী তাঁর চিন্তা করা প্রয়োজন।

*

অন্ধকারে খোলা জানালার পাশে জাহাঙ্গীর বসে আছে, মেহেরুন্নিসার আফিম মিশ্রিত সুরার একটা পাত্র তাঁর পাশে রাখা। তিনি পাত্রে চুমুক দিতে থাকলে তার মাথার যন্ত্রণাটা প্রশমিত হতে থাকে, কিন্তু এখনও নিজের ভাবনাগুলোকে ঠিকমত নিয়ন্ত্রণ করতে তার বেশ বেগ পেতে হয়। তার মানসপটে মনোযোগ বিঘ্নিতকারী সব অবয়ব ভেসে উঠেই মিলিয়ে যাবার সময় তারা সবকিছু এলোমেলো বিকৃত করে দিয়ে যায়–তিনি নিজেকে বালক হিসাবে তার আব্বাজান আকবরের দিকে তাকিয়ে থাকতে এবং ভাবতে দেখেন কখনও কি তিনি তার অনুমোদন লাভ করবেন, গ্রীষ্মের গুমোট রাতের অন্ধকারে সুফি সাধক, সেলিম চিশতির বাড়ির দিকে দৌড়ে চলেছেন নিজের ভয় আর আকবরের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহের অনিশ্চয়তার কথা বৃদ্ধ লোকটিকে বলতে। জাহাঙ্গীরের জন্য না তাঁর সন্তানদের প্রতি ছিল আকবরের সব মমতাবোধ, এবং খসরুর ক্ষেত্রে সেটা কি পরিণতি নিয়ে এসেছিল? নিজের বড় ছেলের শূলবিদ্ধ সমর্থকদের আর্তনাদ, তাঁর মাথায় প্রতিধ্বনিত হয়, এবং খসরু তাঁর দিকে দৃষ্টিহীন চোখে তাকিয়ে থাকে।

জাহাঙ্গীর এইসব অশরীরি অবয়বদের উপস্থিতির কারণে আতঙ্কিত হয়ে জোর করে নিজেকে পুরোপুরি জাগিয়ে তোলে এবং ধাতব পানপাত্রটা কক্ষের এক কোণে ছুঁড়ে ফেলে দিলে গালিচায় সুরার তলানি ছিটকে পড়ে। পরিষ্কার মন নিয়ে তাঁর চিন্তা করা দরকার। ভোলা বাতায়নের ভিতর দিয়ে বয়ে আসা শীতল বাতাস ধীরে ধীরে আফিম আর সুরার মাদকতাময় ধোয়া সরিয়ে দিচ্ছে বলে মনে হতে থাকে। আকবর যদি তার জন্য একজন ভালো পিতা হতেন এবং তিনি যদি তার সন্তানদের প্রতি দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতেন, খসরুর বিদ্রোহ আর খুররমের দ্রোহ হয়ত ঘটতো না। তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন আকবরের ব্যর্থতাগুলোর পুনরাবৃত্তি যেন তার মাঝে না ঘটে। যা ঘটেছে সেটা সম্ভবত অনিবার্য ছিল–এশিয়ার তৃণাঞ্চল থেকে সম্ভবত উত্তরাধিকার সূত্রে নিয়ে মোগলরা এটা নিয়ে এসেছিল যার কারণে এটা হয়েছে। সিংহাসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা তাঁদের রক্তে রয়েছে, ঠিক যেমন তরুন হরিণ পালের গোদার বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজের শক্তি পরীক্ষা করে। সন্তানদের কঠোর শিক্ষা দেয়া জন্মদাতা পিতাদের জন্য প্রকৃতির নির্ধারিত পাঠক্রম।

জাহাঙ্গীর তারকাখচিত আকাশে বুকে মগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তাঁর দাদাজান হুমায়ুন বিশ্বাস করতেন যে পুরো জীবনের রহস্যময়তার উত্তর তারকারাজি ধারণ করে রয়েছে। জাহাঙ্গীর ঠোঁট ওল্টায়। তাঁরা হুমায়ুনের সমস্যাবলী নিশ্চিতভাবেই সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছিল–সমস্যাগুলোর জন্ম হয়েছিল ক্ষমাশীল হওয়ায় যখন তাঁর কঠোর হওয়া উচিত ছিল, ইতস্তত করায় যখন তার উচিত ছিল নিশ্চায়ক হওয়া। তিনি সে কারণেই নিজের সাম্রাজ্য হারিয়েছিলেন।

তার ক্ষেত্রে এমন কখনও হবে না। তিনি সিংহাসনের জন্য অনেক দিন অপেক্ষা করেছেন… মেহেরুন্নিসা বরাবরের মত এবারও ঠিকই বলেছে। কোনো ধরনের বিলম্ব, দ্বিধাবোধ তার ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রতীয়মান হতে পারে। তাকে অবশ্যই আবেগমুক্ত হয়ে খুররমের মোকাবেলা করতে হবে।

*

পরেরদিন সন্ধ্যা নামার সময়, জাহাঙ্গীর দেওয়ানি-আমের মার্বেলের বেদীর নিচে সমবেত হওয়া তার পুরো দরবারের সামনে উঠে দাঁড়ায় সামনে সারিবদ্ধ অভিজাতদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিতে। তিনি এখন যখন তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন তিনি অনুভব করেন নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়ছে, ঠিক যেমন তাঁর রাজ্যাভিষেকের সময় যখন ঝরোকা বারান্দায় তাঁর প্রজাদের সামনে তাঁর প্রথমবার দর্শনের সময় হয়েছিল। বেদীর কাছে যারা দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের ভিতরে রয়েছে আসফ খান, গিয়াস বেগ আর তার উজির মাজিদ খান। তিনি কাউকে, এমনকি মেহেরুন্নিসাকেও বলেননি, তিনি কি বলবেন, কিন্তু কারো মনে কোনো সন্দেহ নেই যে তিনি গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু আজ ঘোষণা করবেন।

তিনি দরবারের বেলেপাথরের তৈরি একশ স্তম্ভ রেশমের কালো কাপড় দিয়ে মুড়ে দেয়ার আদেশ দিয়েছেন। বাইরের আঙিনার সবগুলো ফোয়ারা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং উজ্জ্বল রঙের ফুলের কেয়ারি আরো রেশমের কালো কাপড় বিছিয়ে দিয়ে, রঙিন সবকিছুর উপর আড়াল করা হয়েছে। তিনি নিজেও কালো রঙের একটা সাদাসিদে আলখাল্লা পরিধান করেছেন, মাথায় একই রঙের পাগড়ি আর আজ তিনি কোনো অলঙ্কার ধারণ করেন নি। তাঁর অমাত্যরা অস্বস্তির সাথে চারপাশে তাকায়। জাহাঙ্গীর অপেক্ষা করে, উত্তেজনার পারদ আরেকটু বৃদ্ধি পেতে দেয়, এবং তারপর সে তার বক্তব্য শুরু করে।

‘আপনারা সবাই জানে যে গতকাল মানডুর রাজ্যপাল আমায় জানিয়েছে যে আমার সন্তান যুবরাজ খুররম বিদ্রোহ সংগঠিত করার চেষ্টা করছে। সে আমার রাজ্যপালদের অনেকের কাছেই বার্তা পাঠিয়ে আমার বিরুদ্ধে তাঁর সাথে তাদের মৈত্রী করতে অনুরোধ করেছে। এটাই তার একমাত্র অপরাধ নয়। সে দাক্ষিণাত্যে তাঁর সামরিক নেতৃত্ব পরিত্যাগ করে আমার অনুমতি ছাড়াই আগ্রা এসেছিল। আমি তাকে যখন গ্রেফতার করার আদেশ দেই সে রাতের আঁধারে পালিয়ে যায়। আমি এমনকি তখনও আশা করেছিলাম সে নিজের ভুল দেখতে পাবে এবং কর্তব্যের পথে ফিরে আসবে। আমি আমার পিতৃসুলভ মমতায় ধৈর্য ধারণ করেছি, তাকে তার তারুণ্যের অহঙ্কারের জন্য অনুতপ্ত হবার সময় দিয়েছি। আমি তাঁর বিরুদ্ধে কোনো বাহিনী প্রেরণ করা থেকে বিরত থেকেছি। কিন্তু উচ্চাকাঙ্খা তাকে পুরোপুরি অসৎ করে ফেলেছে। সে নমনীয় হবার বদলে আরো বেশি স্পর্ধিত হয়ে উঠেছে। আমি এখন আর হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না।’

জাহাঙ্গীর দম নেয়ার জন্য থামে। দরবারে পাথরের মত ভারি নিস্তব্ধতা বিরাজ করে। তার চোখ গিয়াস বেগের উপরে পড়ে, যার মাথা নত করা রয়েছে। তিনি এই মাত্র যা বলতে যাচ্ছেন মেহেরুন্নিসার বাবা সেটা মোটেই পছন্দ করবে না কিন্তু তাঁর নিজের এবং সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার বিষয়টা অবশ্যই প্রথমে বিবেচ্য হওয়া উচিত। জাহাঙ্গীর মুহূর্তটার গুরুত্ব বোঝাবার জন্য উচ্চস্বরে এবং দৃঢ়তার সাথে আদেশ করে, ‘রাজকীয় খতিয়ান যেখানে আমি বা-দৌলত, খুররম নামের বদমাশটার নামটা, তার জন্মের অশুভ-তিথিতে উত্তীর্ণ করেছিলাম আমার কাছে নিয়ে এসো।

একজন পরিচারক যার হাতে সবুজ চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা একটা বিশাল খণ্ড রয়েছে সামনে এগিয়ে আসে এবং সেটা বেদীর উপরে ইতিমধ্যে আরেকজন পরিচারকের রাখা তুতকাঠের রেহেলের উপরে স্থাপন করে। জাহাঙ্গীর খতিয়ানের খণ্ডটা খুলে এবং ধীরে ধীরে পাতা উল্টাতে থাকে যতক্ষণ না সে যা খুঁজছিল সেটা খুঁজে পায়। তারপরে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পরিচারকের হাত থেকে লেখনী নিয়ে সেটা সে কালো অনিক্সের দোয়াতদানিতে চোবায় এবং একটা নিশ্চায়ক আচড়ে পাতার উপরে একটা দাগ টেনে দেয়। আপনাদের সবার সামনে আমি ঘোষণা করছি যে আমি বা-দৌলত, খুররমকে ত্যাজ্য করছি। আপনারা এইমাত্র আমাকে তাঁর নামটা আমার সন্তানদের নামের তালিকা থেকে কেটে বাদ দিতে দেখেছেন তেমনি আমার হৃদয় থেকেও আমি চিরতরে তাকে মুছে ফেলছি। আজকের এই দিন থেকে আগামীতে খুররম আর আমার সন্তান নয়।

জাহাঙ্গীর যখন কথা বলছিল, সে তখনই তাঁর কানে অমাত্যদের মাঝ থেকে বিস্মিত গুঞ্জণ ধ্বনি ভেসে আসতে শুনে। আসফ খান আর গিয়াস বেগ কয়েক ফিট দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁদের মুখাবয়বে আতঙ্ক ফুটে উঠে আর তার উজির মাজিদ খান, চোখ বন্ধ অবস্থায়, তসবি জপছিলেন আর সামনে পিছনে দুলছিলেন। কিন্তু সে এখনও তাঁর বক্তব্য শেষ করে নি।

‘আমার সাম্রাজ্যে আমি কোনোভাবেই বিদ্রোহ বরদাশত করবো না–সে চেষ্টা যেই করুক। আমি আজ সকালেই খুররমকে কলঙ্কিত অপরাধী ঘোষণা করে একটা ফরমানে স্বাক্ষর আর সীলমোহর করেছি এবং তাঁর মাথার জন্য একটা পুরষ্কার ধার্য করেছি–পঞ্চাশ হাজার স্বর্ণমুদ্রা যে তাকে বন্দি করতে সক্ষম হবে। আমি, তাছাড়ও আমার বিশ্বস্ত সেনাপতি মহবত খানের নেতৃত্বে তাঁর বিরুদ্ধে একটা মোগল বাহিনী প্রেরণ করছি। আগামী এক সপ্তাহের ভিতরে তাঁরা যাত্রা শুরু করবে।

জাহাঙ্গীর ঘুরে দাঁড়ায় এবং তাকে আবারও যন্ত্রণা দিতে থাকা পিতা জীবনের, সম্রাটের জীবনের রূঢ় বাস্তবতার তীব্রতা অসাড় করতে মেহেরুন্নিসার আফিম মিশ্রিত সুরার জন্য ব্যাকুল হয়ে দ্রুত দরবার থেকে হেঁটে বের হয়ে যায়।

২.০২ কলঙ্কিত যুবরাজ

উষ্ণ পৃথিবীর বুকে বৃষ্টি পড়ার সোঁদা ঘ্রাণ-বর্ষার অভ্রান্ত গন্ধ–প্রতিমুহূর্তে মনে হয় তীব্র হচ্ছে তারা যতই বাংলার পূতিগন্ধময় ভূমির উপর দিয়ে পূর্ব দিকে এগিয়ে চলেছে, খুররম তার সৈন্যসারির সামনে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে যাবার সময়, কাঁধের উপর দিয়ে পিছনের দিকে তাকিয়ে তার বাহিনীকে সেখানে কষ্ট করতে দেখে, মনে মনে ভাবে। গত কয়েক মাসে তাঁর বাহিনীর লোক সংখ্যা কমে পাঁচশ কি ছয়শ হয়েছে। মহবত খান আগ্রা থেকে বিশাল এবং সুসজ্জিত একটা বাহিনী–কারো কারো সংবাদ অনুযায়ী বিশ হাজার সৈন্য আর তিনশ রণহস্তী–নিয়ে তাকে পশ্চাদ্ধাবন করে বন্দি করার জন্য রওয়ানা হয়েছেন এই সংবাদটা তার বাহিনীর অনেক সৈন্যকে পক্ষত্যাগ করতে প্ররোচিত করেছে।

মহতাব খানের সাথে খুররমের একবারই দরবারে দেখা হয়েছিল কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে সে তাঁর সাহসিকতার কথা শুনেছে। লোকটা একজন পার্সী যে শাহের অনুগ্রহ বঞ্চিত যতক্ষণ না হয়েছিল, গিয়াস বেগের মত, সে তার অধীনে কর্মরত ছিল এবং পরে মোগল দরবারে চলে এসেছে। লোকটা সব বিচারেই ঝুঁকি গ্রহণ করতে ভালোবাসে, আবেগপ্রবণ মাঝে মাঝে যা হঠকারিতার পর্যায়ে পড়ে, কিন্তু সবসময়ে সাফল্য লাভ করেছে–অন্তত এখন পর্যন্ত তাই বাস্তবতা। তাঁর দুই হাজার রাজপুত যোদ্ধার চৌকষ অভিজাত বাহিনী বলা হয়ে থাকে তার প্রতি নিবেদিত প্রাণ। একজন বহিরাগত এবং মুসলমান হিসাবে তিনি যদি জাফরান রঙের পোষাক পরিহিত এসব অকুতোভয় হিন্দু যোদ্ধাদের মুগ্ধ করতে পারেন যাঁরা নিজেদের সূর্য আর চন্দ্রের সন্তান বলে বিশ্বাস করে, তাহলে বাস্তবিকই তিনি একজন প্রেরণা সঞ্চারী নেতা। খুররম ভাবে, অবাক হবার কিছু নেই, যে তার নিজের লোকদের অনেকেই মানে মানে সটকে পড়েছে। কিন্তু সত্যিকারের সমর্থকদের একটা ক্ষুদে বাহিনী লড়াইয়ে অনিচ্ছুক একটা বিশাল বাহিনীর চেয়ে অনেক ভালো।

সে গলার পাশে একটা কীট দংশন অনুভব করতে, সে হাত দিয়ে সেটাকে আঘাত করে এবং নিজের আঙুলের দিকে তাকিয়ে দেখে সেখানে রক্ত লেগে রয়েছে। সে কখনও এমন ক্লান্ত বা এতটা হতাশ বোধ করে নি। তার আব্বাজান তাকে কলঙ্কিত অপরাধী হিসাবে ঘোষণা করে সাম্রাজ্যের প্রতিটা লোককে তাঁর প্রতিপক্ষে পরিণত করেছেন। তার মাঝে অসহায়তার সাথে মিশে থাকা ক্রোধের একটা অনুভূতি বাড়তে থাকে। তাঁর আব্বাজান কীভাবে তাকে, নিজের পক্ষে সাফাই দেয়ার কোনো সুযোগ না দিয়ে, এতটা নিষ্ঠুরভাবে, এতটা প্রকাশ্যে অবমানিত আর ত্যাজ্য করেন? আব্বাজানকে নিয়ে, তার সাফল্য সে একটা সময় গর্ব অনুভব করতে সেসব আর মাঙ্গলিক জন্ম কীভাবে এমন প্রতিহিংসাপরায়ণ তিক্ততায় রূপান্ত রিত হলো? তার আব্বাজান যাই বিশ্বাস করতে চান না কেন, তিনি মেহেরুন্নিসার ক্রীড়ানক বই আর কিছু নন। সে জাহাঙ্গীরকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং আফিম আর সুরার জন্য তার দুর্বলতাকে শান্ত রেখে, সে তার সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করে। আর তিনি যা কিছু চান সবই ঘটে চলেছে। আসফ খানের কাছ থেকে প্রাপ্ত একটা চিঠি অনুযায়ী, আসিরগড় থেকে যার বার্তাবাহক খুররমের পশ্চাদপসারনকারী বাহিনীকে অনুসরণ করেছিল, দুই মাস পূর্বে, জাহাঙ্গীর শাহরিয়ারকে ডেকে এনে তাঁর মস্তকে রাজকীয় উষ্ণীষ স্থাপন করে তাকে নিজের উত্তরাধিকারী হিসাবে ঘোষণা করেছে। আর এখানেই বিষয়টা শেষ হয় নি। শাহরিয়ারের সাথে মেহেরুন্নিসার মেয়ে লাডলীর বিয়ের দিন দরবারের জ্যোতিষীরা নির্ধারণ করেছে এবং নববর্ষের উৎসব উদ্যাপনের মাঝে যা অনুষ্ঠিত হবে।

সে আর তার পরিবার, ইত্যবসরে, নিজেদের জীবন বাঁচাতে পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য হচ্ছে সাম্রাজ্যের সীমানার বাইরে সম্ভবত এমনকি তাঁদের যেতে হতে পারে। মেহেরুন্নিসা তাকে ঠিক তার প্রপিতামহ হুমায়ুন এবং তার আগে বাবরের মত ভূমিহীন যাযাবরে পর্যবসিত করেছে। কিন্তু তিনি জয়ী হবেন না। হুমায়ুন আর বাবরের মত একদিন সে ঠিকই রাজত্ব করবে। জাহাঙ্গীর তার যা ইচ্ছা বলতে বা করতে পারেন কিন্তু সে, খুররম, একমাত্র কেবল তাঁর চার ছেলের ভিতরে সম্রাট হবার জন্য উপযুক্ত এবং তার আব্বাজান তার আনুগত্য সত্ত্বেও সেই অধিকার বাতিল করেছেন।

খুররম সহসা পেছন থেকে একটা গুঞ্জন শুনতে পেয়ে ঘুরে তাকায়। মালপত্র বোঝাই একটা মালবাহী শকটের একটা চাকা কাদায় আঁটকে গিয়েছে। তার লোকজন যদি দ্রুত সেটা কাদা থেকে তুলতে না পারে তারা তাহলে সেটাকে পরিত্যাগ করতে বাধ্য হবে। তাঁর আব্বাজানের পিছু ধাওয়াকারী সেনাবাহিনীর সাথে নিজেদের দূরত্ব বাড়িয়ে তোলাটা এই মুহূর্তে খাদ্য কিংবা অন্য কোনো অনুষঙ্গের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর ছোট বাহিনী অন্ততপক্ষে কামানবাহী শকট টেনে নিয়ে অগ্রসরমান বড় বাহিনীর তুলনায় দ্রুত এমন একটা ভূখণ্ডের উপর দিয়ে অগ্রসর হতে পারে যা বর্ষার বৃষ্টির ফলে যা গত দুই মাস ধরে নিরবিচ্ছিন্নভাবে হবার কারণে আরও বেশি মাত্রায় বন্ধুর হয়ে উঠে, বিল আর জলাভূমি বিশাল বাহিনীর জন্য প্রায় দুর্গম একটা এলাকা হয়ে উঠেছে। সে পূর্বদিকে এই একটা কারণেই আসবার সিদ্ধান্ত নেয়। মহবত খানের বাহিনী যদি তাকে অনুসরণ করে বাংলায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়ও সে নৌকার আশ্রয় নিতে পারবে এবং উপকূলের আরও দক্ষিণে আশ্রয় খুঁজে দেখবে। সে মাত্র দুই সপ্তাহ পূর্বে একটা বিস্ময় উদ্রেককারী একটা চিঠি পেয়েছে–মালিক আম্বারের কাছ থেকে মৈত্রীর প্রস্তাব। যুদ্ধক্ষেত্রে আপনি আর আমি ছিলাম যোগ্য প্রতিপক্ষ,’ আবিসিনিয়ার অধিবাসী সেনাপতি চিঠিতে লিখেছে। আমরা এখন কেন তাহলে সহযোদ্ধা হতে পারবো না?’ খুররম চিঠির কোনো উত্তর দেয়নি কিন্তু সে আবার প্রস্তাবটা বাতিলও করে নি। মালিক আম্বার আর তাঁর পৃষ্টপোষকেরা, দাক্ষিণাত্যের শাসকবৃন্দ, তাঁদের সমর্থনের জন্য বেশ ভালো রকমের সুবিধা দাবি করবেন বলাই বাহুল্য কিন্তু তাদের সমর্থনের সাহায্যে সে তাঁর আব্বাজানের বিরোধিতা করার শক্তি অর্জন করতে পারবে। কিন্তু নিজের অবস্থান পুনরুদ্ধারে যা ন্যায্যত তাঁর আপাত দৃষ্টিতে সেটা যদিও তাঁর একমাত্র পথ বলে প্রতিয়মান হলেও, সে কি আসলেই মোগল সাম্রাজ্যের বহিশত্রুর সাথে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে একত্রিত হতে পারে।

তার লোকেরা যখন মালবাহী শকটটা কাদা থেকে তোলার জন্য সবলে টানছে খুররম অনুভব করে সে হতাশায় রীতিমত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে। সে তাঁর দেহরক্ষীদের এমনকি অনুসরণ করতে না বলেই নিজের ঘোড়ার পাঁজরে গুঁতো দেয় এবং সামনে কাদার কারণে প্যাঁচপেচে ধ্বনির সৃষ্টিকারী ভূখণ্ডের উপর দিয়ে অর্ধবল্পিত বেগে ছুটে যায়। গুঁড়িগুড়ি বৃষ্টির মাঝে মাত্র আধমাইল যাবার পরেই সে পানির একটা স্রোত দেখতে পায়। মুখের উপর থেকে বৃষ্টির পানি সরিয়ে সে আরও ভালো করে তাকিয়ে দেখে। অবশেষে এটা নিশ্চয়ই মহানন্দা নদী… সে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে সুসংবাদটা দেয়ার জন্য ফিরে আসতে যাবে এমন সময় বাতাসের মাঝে দিয়ে একটা তীর উড়ে আসে, অল্পের জন্য তাঁর মাথায় আঘাত করা থেকে তীরটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় কিন্তু তার মনের শান্তির বারোটা বাজিয়ে দেয়। তারপরে আরেকটা–কালো শরযষ্টি আর কালো পালকযুক্ত–তার পর্যাণের থলেতে ভোতা একটা শব্দ করে গেঁথে যায় আবহাওয়ার কারণে যার গিল্টি করা চামড়ায় ছত্রাক জন্মেছে এবং কয়েক ইঞ্চির জন্য তাঁর উরু বেঁচে যায় যখন তৃতীয় আরেকটা তীর তাঁর বাহনের সামনের পায়ের ঠিক সামনেই কাদাতে এসে আছড়ে পড়ে। সে তার ঘোড়ার গলার কাছে নিচু হয়ে এসে জন্তুটাকে ঘুরিয়ে নেয়ার জন্য লাগাম শক্ত করে টেনে ধরে, প্রাণীটাকে সৈন্যসারির দিকে বল্পিতবেগে ফিরিয়ে নিয়ে চলে, পুরোটা সময় ভয়ে প্রতিটা স্নায়ু টানটান হয়ে থাকে যে আরেকটা তীর পেছন থেকে তাকে আঘাত করবে এবং তাঁর স্বপ্নের অকাল সমাপ্তি ঘটাবে। সে ঘোড়া দাবড়ে ফিরে আসার সময় পুরোটা পথ নিজেকে নিজের আহাম্মকির জন্য অভিশাপ দিতে থাকে। তার উচিত ছিল গুপ্তদূতদের আগে পাঠান।

আক্রমণকারী সে হতে পারে? তার আব্বাজানের কোনো হুকুমবরদার, তাকে বন্দি করার জন্য ঘোষিত পুরষ্কার দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে হালকা অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দ্রুত ঘোড়া হাকিয়ে এসে তাদের দলটাকে পেছন থেকে ধরে ফেলেছে। মহবত খান আর তার বাহিনীও হতে পারে, বিচিত্র নয়? যদি তাই হয়ে থাকে, সে চড়া মূল্যে তার বিসর্জন দেবে। প্রায় এক যুগ পরে যেন মনে হয় আসলে এক মিনিটেরও কম সময় অতিক্রান্ত হয়েছে সে তার সৈন্যসারির দিকে এগিয়ে যায়। সে শুনতে পাবার মত দূরত্বে পৌঁছানো মাত্র চিৎকার করে উঠে, ‘সামনে তীরন্দাজ রয়েছে। আমরা হামলার সম্মুখীন হয়েছি। সৈন্যবহরের অগ্রযাত্রা বন্ধ রাখো। বৃষ্টির মাঝে আমাদের গাদাবন্দুক কোনো কাজে আসবে না। নিজেদের তীর আর ধনুক প্রস্তুত রাখো।’ নিজের লোকদের মাঝে পৌঁছে, সে তীর নিক্ষিপ্ত হবার দিক আর নিজের মাঝে ঘোড়াটা রেখে পর্যাণের উপর থেকে সে নিজেকে নামিয়ে আনে।

তাঁর লোকেরা নিজেদের বাহনের লাগাম টেনে ধরতে আর নিজ নিজ অস্ত্রের উদ্দেশ্যে হাত বাড়াতে, খুররম নদীর দিকে আবার তাকায় কিন্তু কিছু দেখতে পায় না। আক্রমণকারীরা হয়ত ইতিমধ্যে সরে পড়েছে… কিন্তু ঠিক তখনই বাতাসে শীষ তুলে আরো তীর উড়ে আসে যেন তার এমন ধারণাকে তাচ্ছিল্য করতে। খুররমের কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা এক তরুণ কর্চির শ্বাসনালীতে এসে একটা তীর বিদ্ধ হয় এবং সে নিজের গলা আঁকড়ে ধরলে তার আঙুলের ফাঁক গলে বন্ধুদ্বের মত রক্ত গড়িয়ে আসে। আরেকটা তীর মালবাহী একটা খচ্চরের গলায় বিদ্ধ হয় এবং জন্তুটা পুরু কাদায় হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবার আগে বিকট স্বরে মর্মস্পর্শী ভঙ্গিতে ডাকতে থাকে।

খুররমের প্রথমেই মনে হয় আরজুমান্দ আর বাচ্চাদের কাছে ছুটে যায়। তারা যে গরুর গাড়িতে রয়েছে তার চারপাশের পুরু চামড়ার আবরণ অন্ত তপক্ষে তীরের হাত থেকে তাদের খানিকটা হলেও সুরক্ষা দেবে। একটা শস্যবাহী শকটের পেছনে নিচু হয়ে এবং কাদার ভিতরে খানিকটা দৌড়ে, খানিকটা হামাগুড়ি দিয়ে সে আরজুমান্দ আর তাদের মেয়েরা যে গাড়িতে রয়েছে সে সেটার কাছে পৌঁছে। সে কাছে গিয়ে উঁচু হয়ে ভারি পর্দাটা একপাশে সরিয়ে ভেতরে উঁকি দেয়। জাহানারা আর রোসন্নারাকে দু’হাতে আগলে রেখে আরজুমান্দ এক কোণে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে রয়েছে, তাঁর খোলা মুখে ইতিমধ্যেই আর্তনাদ দানা বাঁধতে আরম্ভ করেছে যতক্ষণ না সে দেখছে কে উঁকি দিয়েছে।

‘আমরা হামলার মুখে পড়েছি, আমি জানি না কারা বা কেন আক্রমণ করেছে, খুররম জোরে শ্বাস নিতে নিতে অতিকষ্টে বলে। গাড়ির পাটাতনে শুয়ে থাকো, এবং আমি আবার ফিরে আসা পর্যন্ত সেখানেই শুয়ে থাকবে। যাই ঘটুক না কেন বাইরে বের হবে না। আরজুমান্দ মাথা নাড়ে। পর্দা ছেড়ে দিয়ে, খুররম উবু হয়ে দেহের মাঝ বরাবর বেঁকে দৌড়ে আরেকটা গাড়ির কাছে যায় যেখানে তাঁর ছেলেরা আর তাদের আয়ারা রয়েছে। আরজুমান্দকে সে একটু আগে যে নির্দেশ দিয়ে এসেছে সেই একই নির্দেশ শুনে তার ছেলেরা গোল গোল চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে যখন এসব করছে তখনই আরেকটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠের আর্তনাদ শুনে সে বুঝতে পারে আরেকটা তীর লক্ষ্যভেদ করেছে।

কাদায় মাখামাখি অবস্থায়, সে আবারও শস্যবাহী শকটের নিরাপত্তায় ফিরে আসে এবং, দ্রুত স্পন্দিত হৃৎপিণ্ডে, নিজের চারপাশে তাকিয়ে দেখে। চটচটে আঠালো কাদায় মুখ নিচের দিকে দিয়ে তার আরও দু’জন লোক হাত পা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। আরেকজন–নিকোলাস ব্যালেনটাইন, দ্রুত হাতে কাজ করতে থাকায় ফ্যাকাশে হাত তার নিজের রক্তে লাল হয়ে আছে–নিজের পায়ের গুলে হাতের খঞ্জর দিয়ে সজোরে খোঁচা দিচ্ছে চেষ্টা করছে তীরের অগ্রভাগ কেটে ফেলতে। তাঁর কাছেই আরেকটা খচ্চর একপাশে কাত হয়ে মাটিতে পড়ে রয়েছে, পাগুলো উন্মত্তের ন্যায় মাটিতে আছড়াচ্ছে। সে কিছু ভাববার আগেই আরো তীর তাদের ওপরে উড়ে এসে, একজন সৈন্যের পিঠে আঘাত করে, আরেকটা আরজুমান্দের গাড়ির একটা চাকার কেন্দ্রস্থলে ভোঁতা শব্দ করে গেঁথে যায়। তারপরে, সহসাই তীর নিক্ষেপ বন্ধ হয়। আক্রমণের পুরোটা সময় বৃষ্টির বেগ ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে, ছোট ছোট জল ভর্তি ডোবা থেকে ছিটকে উঠা পানি সবকিছু ভিজিয়ে দিচ্ছে। তীরন্দাজদের জন্য, তাদের ইতিমধ্যে ভেজা আঙুলের পক্ষে ভেজা ধনুকের ছিলায় তীর সংযোগ করা, এর ফলে কষ্টকর হয়ে উঠেছে।

কি ঘটছে? ক্লান্ত ভঙ্গিতে সে মাথা তুলে, অঝোর বর্ষণের মাঝে সে নদীর দিক থেকে ধীর গতিতে দুলকি চালের চেয়ে বেশি জোরে নয় অশ্বারোহীর একটা দলকে এগিয়ে আসতে দেখে। বৃষ্টির ইস্পাতের ন্যায় আবরণের কারণে তাঁর পক্ষে ধারণা করা কঠিন হয় ঠিক কতজন লোক রয়েছে দলটায়। তার বাহিনীর শক্তি যাচাই করতে সম্ভবত তাঁদেরও একই ধরনের মুশকিলের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। খুররম দাঁতে দাঁত চেপে ভাবে, বেশ, তাঁরা শীঘ্রই সেটা বুঝতে পারবে।

‘ঘোড়ায় ওঠো এবং আমায় অনুসরণ করো, সে তার ঘোড়ার দিকে দৌড়ে যাবার অবসরে দেহরক্ষীদের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে বলে এবং হাচড়পাঁচড় করে ভেজা পর্যাণে পুনরায় আরোহণ করে। তোমরা বাকিরা, পণ্যবাহী শকটগুলো পাহারা দাও আর আহতদের শুশ্রূষা করো।’ খুররম আর তার দেহরক্ষীর দল কয়েক মুহূর্তের ভিতরে তাঁদের অচেনা শত্রুর দিকে ধেয়ে যেতে থাকে, তাদের ঘোড়ার খুরের আঘাতে ছিটকে উঠা পানি আর কাদা তাঁদের চারপাশে উড়তে থাকে। নিচু হয়ে থাকো, সে তার ঘোড়ার গলার কাছে ঝুঁকে এসে চিৎকার করে, তরবারি কোষমুক্ত এবং উষ্ণ বৃষ্টির ফোঁটা তার মুখে গড়িয়ে যায়। নরম কাদায় তার ঘোড়া যদি কোনো কারণে হোঁচট খায় সেজন্য হাঁটু দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে রেখে সে চোখ সরু করে তাঁর আক্রমণের নিশানা খুঁজতে থাকে।

বৃষ্টির ভিতর দিয়ে খুররম আর তার লোকেরা বের হয়ে আসলে, তাঁরা তাঁদের আক্রমণকারীদের দিক থেকে বিস্মিত আর আতঙ্কিত চিৎকার শুনতে পায়। তাঁদের আক্রমণকারীরা সাথে সাথে উন্মত্তের ন্যায় নিজেদের ঘোড়ার লাগাম টানতে শুরু করে, নিজেদের ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তাঁদের দিক থেকে পুনরায় নদীর দিকে পালাতে শুরু করে। খুররম নিজের ঘোড়াকে দ্রুত ছোটার জন্য তাড়া দিয়ে সে একটা কাঁটা ঝোঁপের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে যার গায়ে একটা ময়লা গাগড়ির কাপড় আটকে রয়েছে। সে একটা বাঁক ঘুরে পুরো দলটাকে প্রথমবারের মত ঠিকমত দেখতে পায়: শিরোস্ত্রাণবিহীন ত্রিশ কি চল্লিশজন মানুষ, ধনুক আর তীরের তূণ এখন তাঁদের পিঠে ঝুলছে, হাত আর পা ব্যস্ত কাদার মাঝে যতটা দ্রুত ছোটা যায় নিজেদের ঘোড়াগুলোকে ছোটাবার চেষ্টায়–কিন্তু নিজেদের মোগলদের ভালোজাতের ঘোড়ার কাছ থেকে নিজেদের মাঝে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখার জন্য সেটা যথেষ্ট নয়। খুররম আর তার লোকেরা তাঁদের দিকে ধেয়ে যাবার সময় নির্মম সন্তুষ্টির সাথে সে ভাবে তারা তার শিকার। একটা লোক ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যায় এবং খুররমের দেহরক্ষীদের একজনের ঘোড়ার খুরের নিচে তার খুলি ফাটার শব্দ সে শুনতে পায়। দ্রুত অন্য আরেকজন যার বাদামি রঙের ছোট টাটু ঘোড়াটা প্রাণপণে ছোটার চেষ্টা করছে এগিয়ে গিয়ে খুররম গায়ের জোরে আঘাত করতে লোকটার পিঠে একটা বিকট ক্ষতের সৃষ্টি হয়। সে তার তরবারির এক ঝটকায় দ্বিতীয় আরেকজনকে কবন্ধ করে দেয়–বাদামি রঙের একটা রুক্ষ চোব্বা পরিহিত হাড্ডিসার একটা লোক যার পালাবার সময় গতি শ্লথ করে তাদের পিছু ধাওয়াকারীরা কত দূরে রয়েছে দেখার দুর্মতি হয়েছিল। তাঁর ছিন্ন মাথাটা একটা ডোবায় গিয়ে পড়ে এবং মস্তকহীন দেহটা ধীরে ধীরে পর্যাণ থেকে পিছলে যেতে শুরু করে এবং কয়েক মুহূর্ত পরে সেটাও কাদার মাঝেই উল্টে পড়ে। খুররম নিজের চারপাশে তার লোকদের নিজেদের শান দেয়া ধারালো ইস্পাতের আয়ুধের সাহায্যে আক্রমণকারীদের স্রেফ কচুকাটা করতে দেখে যার বিরুদ্ধে পাল্লা দেয়ার মত প্রতিপক্ষের কাছে কিছুই নেই। চারপাশের মাটিতে কর্দমাক্ত বৃষ্টির পানির ছোট ছোট নহরে উজ্জ্বল, তাজা টকটকে লাল রক্ত এসে মিশছে।

সে আর তাঁর লোকেরা পাঁচ মিনিটের কম সময়ের ভিতরে তাঁদের শত্রুদের প্রায় সবাইকে হত্যা করে সামান্য কয়েকজন কেবল প্রাণে বেঁচে যায় যারা নদীর তীর বরাবর অবস্থিত ঝোঁপের ভিতরে কোনোমতে পালিয়ে যেতে পেরেছে।

খুররম তাঁর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে নিজের লোকদের মূল সৈন্যসারির কাছে ফিরে যাবার নির্দেশ দিতে যাবে এমন সময় সে প্রায় ত্রিশ ফিট দূরে মরা ডালপালার একটা স্তূপের নিচে মানুষের নড়াচড়া লক্ষ্য করে। আক্রমণকারীদের একজন নিশ্চয়ই ঘোড়া হারাবার পরে সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। খুররম নিজের রক্তাক্ত তরবারিটা আরো একবার ময়ান থেকে বের করে এবং ঘোড়া থেকে দ্রুত নেমে এসে ডালপালার স্তূপের দিকে এগিয়ে যায় যেখানে সবকিছু এখন আপাত স্থির হয়ে রয়েছে। সে যখন মাত্র দশ ফিট দূরে তখন সে মন্থর ভঙ্গিতে ডানদিকে বৃত্তাকারে ঘুরতে আরম্ভ করে। উবু হয়ে ডালপালার মাঝে উঁকি দিয়ে সে একজনকে তাঁর দিকে পিঠ দিয়ে গুঁড়ি মেরে শুয়ে থাকতে দেখে, তীর আর তৃণ পাশেই রাখা এবং ডানহাতে একটা খাঁজকাটা শিকারের ছুরি ধরে রয়েছে। খুররমের উপস্থিতি সম্বন্ধে তার মাঝে কোনো ধরনের সন্দেহের উদ্রেক ঘটে না যতক্ষণ না তাঁর তরবারির ইস্পাতের অগ্রভাগ তাঁর পিঠে গিয়ে গুতো দেয়।

‘ওঠে দাঁড়াও এবং বের হয়ে এসো, খুররম ফার্সী ভাষায় আদেশ দেয়। সে শীঘ্রই জানতে পারবে এরা তাঁর আব্বাজানের প্রেরিত সৈন্য নাকি অন্য কেউ। লোকটা যখন কোনো উত্তর দেয় না সে তখন প্রশ্নটা হিন্দিতে করে এবং তরবারি দিয়ে লোকটা মাংসে একটা খোঁচা দিলে বেচারার ইতিমধ্যে নোংরা জোব্বায় রক্তের দাগ ফুটে উঠে। তাঁর শত্রু এতক্ষণে হাউমাউ করে উঠে এবং ডালপালা একপাশে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত হাচড়পাড় করে পায়ের উপর ভর দিয়ে ওঠে দাঁড়ায় এবং ঘুরে দাঁড়াবার আগে খঞ্জরটা হাতে ধরে রেখেই পাগলের মত পালাবার পথ খুঁজতে শুরু করে। লোকটা খর্বাকৃতি এবং তারের মত পাকানো শরীরের অধিকারী এবং বাম কানে একটা সোনার মাকড়ি রয়েছে। খঞ্জরটা ফেলে দাও, খুররম চিৎকার করে বলে। লোকটা আদেশ পালন করলে খুররম লাথি দিয়ে সেটাকে দূরে সরিয়ে দেয়। কে তুমি? আমায় আর আমার লোকদের কেন তোমরা আক্রমণ করেছো?

‘কেন করবো না? আমাদের এই জলাভূমির ভিতর দিয়ে এমন আহাম্মকের মত যদি কেউ ভ্রমণ করে আমরা কি করতে পারি।’

খুররম ভাবে, যাক এরা তাহলে কেবল স্থানীয় ডাকাতের দল, যদিও মারাত্মক বিপজ্জনক, পেছনে পথের উপরে পড়ে থাকা নিজের আহত আর মৃত সাথীদের কাদার উপরে হাত পা ছড়িয়ে পড়ে থাকার দৃশ্য স্মরণ করে। এই দুর্বিনীত দুবৃত্তকে তার অপরাধের মাশুল দিতে হবে কিন্তু সেটা এখনই নয়। তোমাদের নেতা কে? তোমাদের গ্রামই বা কোথায়?

‘আমাদের একটাও নেই। আমরা প্রত্যেকে স্বাধীন মানুষ। আমরা এই অঞ্চলে বিচরণ করি আর যখন এবং যেখানে আমাদের পছন্দ হয় সেখানে অস্থায়ী শিবির স্থাপন করি।’

‘তোমাদের কতজন লোক এখানে রয়েছে?

‘আমরা একটা ক্ষুদ্র দল যারা রান্নার জন্য শিকার করতে বের হয়েছিলাম। আপনার দলের সাথে আমাদের ভাগ্যক্রমে দেখা হয়েছে। আমরা আপনাদের বণিকদের একটা কাফেলা ভেবে ভুল করেছিলাম। আমরা যদি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারতাম আপনারা সেখানে কতজন মানুষ রয়েছেন তাহলে আমরা কখনও এত অল্প সংখ্যক লোক নিয়ে আপনাদের আক্রমণ। করার নির্বুদ্ধিতা দেখাতাম না। কিন্তু শীঘ্রই আমাদের আরও ভাইয়েরা আসবে–আমাদের শত শত ভাই, আপনাদের উপর আমাদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে। আপনি বুঝতেও পারবেন না তারা ওঁত পেতে রয়েছে একেবারে শেষ মুহূর্তের আগ পর্যন্ত। তারা আপনাদের শিবিরে হানা দিয়ে আপনার সৈন্যদের হত্যা করবে, আপনার দ্রব্য লুট করবে–এবং আপনাদের মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি করবে।

লোকটা কথা বলার মাঝেই হঠাৎ একপাশে লাফ দেয়, বেপরোয়া ভঙ্গিতে কাদায় আধা নিম্মজিত অবস্থায় পড়ে থাকা তার খঞ্জরটার কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করে। তাঁর আঙুল মাত্র বাট আঁকড়ে ধরতে যাবে যখন খুররম তার তরবারির ফলা সজোরে লোকটার পেটে ঢুকিয়ে দেয়। লোকটা পেছনের দিকে কাদার উপরে উল্টে পড়ে এবং কয়েক মুহূর্ত ধড়ফড় করে, রক্ত তাঁর জর্দার দাগ লাগা দাঁতের মাঝ দিয়ে বুদ্বুদ্ধের মত উঠে আসে, চোখ বিস্ফারিত, তারপরে নিথর হয়ে সেখানেই পড়ে থাকে।

খুররম ঘোড়ায় চেপে পথের দিকে ফিরে আসবার সময় ডাকাত লোকটা যা বলেছে সেসব নিয়ে চিন্তা করে। আসলেই কি এঁদের আরো লোক এখানে রয়েছে–কোনো এক ধরনের লুটেরা বাহিনী–নাকি পুরোটাই লোকটার অসার বাগাড়ম্বর? সে কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে পারে না। তারা আজ রাত নামার আগেই এগিয়ে গিয়ে নদী অতিক্রম করবে। সে কোনো নিরাপদ স্থানে পৌঁছাবার আগে আর কতবার তাকে ডাকাত দলের খেয়ালের শিকার হতে হবে–ভয়ঙ্কর অপরাধীর দল তার আব্বাজান ঠিক তাকে যেমনটা ঘোষণা করেছেন? তার আব্বাজান তাঁর সাথে কি আচরণ করেছেন সে বিষয়ে তিক্ততা এবং তার কতটা পতন হয়েছে এসব ভাবনা ঘোড়ায় চেপে যাবার সময় তার মনকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রাখে।

*

দুই ঘন্টা পরে, মৃতদের সমাধিস্থ করার পরে এবং গুপ্তদূতেরা এসে ডাকাতদের আর কোনো উপস্থিতির লক্ষণ না দেখতে পাবার কথা জানালে, সৈন্যসারি নদীর দিকে সংক্ষিপ্ত পথ অতিক্রম করে। বেশ চওড়া নদী–কিন্তু বৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও খুব একটা গভীর না, গুপ্তদূতেরা নদীর যে অগভীর অংশ খুঁজে বের করেছে সেটা চার ফিটের বেশি গভীর নয়। অগম্ভীর হলেও, পানিতে বেশ স্রোত রয়েছে এবং মাঝ নদীতে অমসৃণ পাথরের খণ্ড মাথা উঁচু করে রয়েছে। খুররম নিজের ঘোড়ার সামর্থ্য পরীক্ষা করার জন্য দ্রুত বহমান পানির দিকে এগিয়ে যাবার জন্য তাকে তাড়া দেয়। সে স্বস্তির সাথে লক্ষ্য করে জটা পানির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে–তারা যদি সতর্ক থাকে তাহলে তাঁরা নদী অতিক্রম করতে পারবে। প্রথমে একদল সৈন্য পাঠাও অন্য পাড়টা সুরক্ষিত করতে, সে তাঁর দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধানকে আদেশ দেয়। আমরা তারপরে কেরাঞ্চিগুলো–গরু টানা মালবাহী গাড়ি-পাঠাতে আরম্ভ করবো।’

খুররম খুব শীঘ্রই নদীর অপর তীরে জ্বলন্ত মশাল দেখতে পায়–এটা আসলে সংকেত যে মূল পারাপার শুরু করার জন্য ওপাশটা নিরাপদ। বৃষ্টিও থেমে গিয়েছে এবং আকাশে এমনকি এক টুকরো নীল আকাশও দেখা যায় গাড়োয়ানরা যখন মালবাহী শকটগুলো টেনে আনা ষাড়ের প্রথম দলটাকে পানিতে নামার জন্য তাড়া দিতে শুরু করে। প্রতিবাদমুখর জন্তুগুলো কষ্টকর মন্থরতার সাথে নড়া শুরু করে কিন্তু কোনো অঘটন ছাড়াই অপর পাড়ে পৌঁছে যায়। খুররম এরপর মালবাহী খচ্চরের একটা দলকে পাঠায়, কেবল হালকা বোঝা পিঠে চাপানো রয়েছে যেহেতু ভারি মালপত্র আগেই কেরাঞ্চিতে করে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। পানির স্তর যদিও তাদের পেটের ওপরে ওঠে আসে নদীর একটা জায়গায় জম্ভগুলোর কয়েকটা বর্শার অগ্রভাগ দিয়ে খোঁচা দিতে হয় অগ্রসর করতে কিন্তু এই দলটাও অপর তীরে পৌঁছে যায় যেখানে তাঁরা কুকুরের মত নিজেদের গা থেকে পানি ঝরতে শুরু করলে তাঁদের গলায় ঝোলান ঘন্টাগুলো ঝনঝন শব্দে বাজতে থাকে।

খুররম একটু স্বস্তি পায়। অবশিষ্ট শকটগুলোয় কেবল মানুষ রয়েছে এবং মালবাহী শকটের চেয়ে অনেক হালকা। ভাগ্য ভালো হলে দিনের মত বিপদ কেটে গিয়েছে। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে এখনও দিনের আলো বেশ ভালোই আছে। রাত নামার পূবেই তারা নদীর তীর আর নিজেদের মাঝে দুই কি তিনমাইলের একটা ব্যবধান তৈরি করতে পারবে এবং সে একটা নিরাপদ স্থানে শিবির স্থাপণ করবে আর রাতে প্রহরী মোতায়েন রাখবে। আহত লোক নিয়ে প্রথমে দুটো শকট নদী অতিক্রম করে। নিকোলাস ব্যালেনটাইন, তার পরনের চোগায় সে যেখানটা কেটেছে তার ভিতর দিয়ে তার পায়ের গুলে বাধা রক্তাক্ত পট্টিটা দেখা যায়, প্রথম কেরাঞ্চির গাড়োয়ানের পাশে বসে রয়েছে, পানির নিচে লুকিয়ে থাকা পাথর আর ভেসে আসা কাঠের টুকরো যা পানিতে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে আগেই লক্ষ্য করার জন্য সে সতর্ক চোখে তাকিয়ে রয়েছে। খুররমের তিন পুত্র আর তাদের আয়াদের বহনকারী কেরাঞ্চি এরপরে নদী অতিক্রম করে। তারা যখন নদীর অপর তীরে পৌঁছে তখন অবশেষে আরজুমান্দের শকটের পালা আসে।

শকটটাকে বহনকারী চারটা বিশালদেহী সাদা ষাড় পানিতে নামলে খুররম তাঁর ঘোড়াকে সেটার পেছনে নদীতে নামতে তাড়া দেয়, কোনো ধরনের বিপদ হলে সে কাছাকাছি থাকতে চায়। ধাতু দিয়ে বাধান বিশাল চাকাগুলোর যখন ধীরে ধীরে ঘুরতে শুরু করে তাঁদের ভিতর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। গাড়োয়ান ধারালো পাথরের খণ্ড এড়িয়ে যাবার জন্য বিশেষ দক্ষতা প্রদর্শন করে। কিন্তু কেরাঞ্চিটা যখন প্রায় মাঝ নদীতে একেবারে সামনের দুটো ষাড়ের একটা পিছলে পড়ে এবং জন্তুটার হাঁটু আধা বেঁকে যায়। গম্ভীর ডাক ছেড়ে ষাড়টা নিজেকে সামলে নেয় এবং একগুঁয়ে ভঙ্গিতে টানতে থাকে। খুররম পর মুহূর্তেই নদীর অপর তীর থেকে আতঙ্কিত চিৎকার শুনতে পায় এবং লোকজনকে দৌড়ে পানির দিকে আসতে দেখে। তাঁরা যেদিকে ইশারা করছে উজানে সেদিকে তাকিয়ে ফেনায়িত পানিতে ভেসে প্রচণ্ড গতিতে তাঁদের দিকে পানিতে উপড়ে আসা বিশাল একটা ডালপালাযুক্ত পাতাবহুল গাছ সে ভেসে আসছে দেখতে পায়। সে দৃশ্যটা ঠিকমত অনুধাবন করার আগেই গাছটা আরজুমান্দের কেরাঞ্চির বাম দিকে একটা রাম ধাক্কা দেয়। কেরাঞ্চির পেছনের চাকার স্পোক টুকরো টুকরো হয়ে যায় এবং পানির ভিতরে শকটা আস্তে আস্তে কাত হয়ে পড়ে, বিশাল গাছটা সামান্য কিছুক্ষণ এর উপরে আটকে থাকে কিন্তু তারপরেই স্রোতের বেগ তাঁর প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে সেটাকে ভাটির দিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

খুররম নিজের আতঙ্কিত ঘোড়ার পাঁজরে পাগলের মত গুতো দিয়ে উল্টে পড়া শকটের কাছে গিয়ে দেখে যে উন্মত্তের ন্যায় হাচড়পাঁচড় করতে থাকা ষাড়গুলো পানির নিচে আটকা পড়েছে। ষাড়গুলোর জোয়ালের বাঁধন কেটে দাও, সে চিৎকার করে গাড়োয়ানকে বলে। নিজের ঘোড়া থেকে তারপরে লাফিয়ে নেমে, সে ভাঙা স্পোকের একটা ধরতে সক্ষম হয় এবং কেরাঞ্চির বামপাশের যতটুকু অবশিষ্ট রয়েছে সেটাই সবলে নিজে টেনে তুলে কিন্তু পানির নিচে থেকে যেটা উঠে আসে সেটা কেরাঞ্চির উপরিভাগ। সে খাপ থেকে খঞ্জর বের করে মোটা চামড়ার আচ্ছাদনে একটা আঁকাবাঁকা পোচ দিয়ে ভিতরে উঁকি দেয়। প্রবল বেগে ভেতরে প্রবেশ করতে থাকা পানি আরজুমান্দের চিবুক পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে এবং তাঁর লম্বা চুল তাঁর চারপাশে স্রোতের মত ভাসছে, সে কেরাঞ্চির মূল কাঠামোর একটা কাঠের পোলিন্দ ডান হাত দিয়ে ধরে রয়েছে এবং বাম হাতে পানির উপরে রোসন্নারাকে ধরে রেখেছে। জাহানারা আরেকটা কাঠের পোলিন্দ দু’হাতে আঁকড়ে ধরে ঝুলছে।

খুররম তার পেছন থেকে অনেকগুলো কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে শুনে–তাকে সাহায্য করার জন্য অন্যেরা আসছে। জাহানারা তাঁর কাছেই রয়েছে সে নিজের ডানহাত মেয়ের দিকে বাড়িয়ে দেয়। কেরাঞ্চি ছেড়ে দিয়ে তুমি বরং আমায় ধর,’ সে আতঙ্কিত মেয়েকে বলে যে এক মুহূর্ত ইতস্তত করে তারপরে তাকে আঁকড়ে ধরে। সে তাকে তুলে বাইরে বের করে আনে এবং কেরাঞ্চির পাশে ঘোড়া নিয়ে উপস্থিত এক সৈন্যের হাতে তাকে তুলে দেয়। সে এরপর আবার কেরাঞ্চির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। আরজুমান্দ চেষ্টা করো একটু কাছে আসতে যাতে করে আমি তোমার কাছ থেকে রোসন্নারাকে নিতে পারি। সে আধো আলোয় আরজুমাদের চোখ দেখতে পায় এবং তার কষ্ট করে শ্বাস নেয়ার শব্দ শুনতে পায় যখন সে হাত পুরোপুরি না ছেড়ে দিয়ে ডান হাতটা কড়ি কাঠের উপর দিয়ে পিছলে নিয়ে এসে রোসন্নারাকে তার দিকে বাড়িয়ে দেয়। খুররম নিচু হয়ে নিজের মেয়ের বাহু ধরতে পারে এবং মেয়েটা যদিও ব্যাথা পেয়ে কেঁদে উঠে সে তাকে কেরাঞ্চির বাইরে টেনে বের করে আনে।

কিন্তু খুররম যখন ঘুরে দাঁড়িয়ে রোসন্নারাকে তার আরেকজন লোকের হাতে তুলে দিতে যাবে কেরাঞ্চির কাঠামো পুনরায় ভীষণভাবে দুলতে শুরু করে। তাঁর পা পিছলে যায় এবং সে টের পায় স্রোতের শক্তি রোসন্নারাকে তাঁর কাছ থেকে ছিটকে সরিয়ে নিচ্ছে। সে কোনোমতে আবারও দু’পায়ের উপরে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে উন্মত্তের মত চারপাশে তাকায়। রোসন্নারা! সে চোখের উপর থেকে পানি মুছতে মুছতে চিৎকার করে। রোসন্নারা! সে প্রথমে তাকে দেখতে পায় না কিন্তু পানির ভিতরে সে লাল কিছু একটা দেখে–তার পরনের কোট–এবং তারপরেই তাকে দেখে স্রোতের টানে ভেসে যেতে।

আরজুমান্দ তাঁর ক্ষিপ্ত আর্তনাদ শুনতে পায় এবং নিজেকে কেরাঞ্চির ভিতর থেকে টেনে বাইরে বের করে আনে, তাঁর গালের একটা ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পড়ছে। রোসন্নারা–আমার মেয়ে কোথায়? সে হাহাকার করে উঠে। খুররম ভাটির দিকে ইশারা করে। এখানেই থাকো। আমি তাকে উদ্ধার করছি। কিন্তু খুররম তার কথা শেষ করার আগেই আরজুমান্দ উত্তাল নদীর স্রোতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে যদিও একজন দক্ষ সাঁতারু–আগ্রায় তাঁর হাভেলীর হেরেমের সাঁতারকুণ্ডে সে সাঁতার কাটতে ভালোবাসতো–কিন্তু এখানের এই তীব্র স্রোতের বিরুদ্ধে সে কিছুই করতে পারবে না আর ইতিমধ্যে স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করেছে আর তাছাড়া পানির নিচে লুকিয়ে থাকা পাথর রয়েছে।

খুররম দ্রুত নিজের সিদ্ধান্ত নেয়। সে হাচড়পাঁচড় করে অপর পাড়ে গিয়ে পানি থেকে ওঠে আসে যেখানে ইতিমধ্যে তার বেশিরভাগ সৈন্য পৌঁছে গিয়েছে এবং চিৎকার করে তার জন্য একটা ঘোড়া নিয়ে আসতে বলে এবং তাঁর দেহরক্ষীদের আদেশ দেয় তাকে অনুসরণ করতে। ঘোড়ার পিঠে লাফিয়ে উঠেই পুরু কাদার ভিতর দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব এগিয়ে যেতে থাকে আর পুরোটা সময় মথিত হতে থাকা পানির দিকে তাকিয়ে থাকে। নদীটা আর মাত্র কয়েকশ গজ সামনে বাম দিকে গাছপালার ভিতরে তীক্ষ্ণ একটা বাঁক নিয়েছে। স্রোতের বেগ সেখানে কম থাকার কথা এবং সে দেখতে পায় মাঝনদীতেও পানির উপরে লম্বা লম্বা ডাল ঝুঁকে রয়েছে। আরজুমান্দকে এক টুকরো কাঠ আঁকড়ে ভাসতে দেখে তার হৃৎপিণ্ড ধক করে উঠে এবং তার থেকে একশ গজ দূরে একটা লাল কাঠামো–একটা পুতুলের চেয়ে কোনোমতেই বড় হবে না–সেটা রোসন্নারার। তারা বাকের কাছে পৌঁছাবার আগেই তাকে অবশ্যই সেখানে পৌঁছাতে হবে…

সে বাঁকের উদ্দেশ্যে ঘোড়া ছোটালে গাছের ডালপালা তাঁর মুখে চাবুকের মত আঘাত করে। নিজের ঘোড়াকে চক্রাকারে ঘুরিয়ে নিয়ে বেমক্কা তাকে থামিয়ে সে লাফিয়ে তার পিঠ থেকে নেমে আসে এবং নদীর উপরে ঝুলে থাকা একটা গাছে প্রাণপণে উঠতে শুরু করে। একটা চওড়া, মসৃণ ডালে যা পানির তিন ফিট উপরে রয়েছে সে বহুকষ্টে আরোহণ করে তাঁর ভর যতক্ষণ বহন করতে পারবে বলে তাঁর মনে হয় সে একটু একটু করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। সে তারপরে ডালটা একহাতে তখন আঁকড়ে রেখে সে নিজের দেহ স্রোতের ভিতরে নামায় এবং ঘুরে উজানের দিকে তাকায়। সে একেবারে ঠিক সময়মত এসেছে। মেয়েটা এক পুটলি ভেজা লাল ত্যানার মত দেখায়। সে নিজের খালি হাতটা রোসন্নারা দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সে প্রথমে রোসন্নারার পরনের লাল পোষাকটা ধরে এবং তারপরে তার এক হাত। এক হাতে মেয়েকে পানির ভিতর থেকে বাইরে আনতে তাঁর পুরো শক্তি প্রয়োজন হয় এবং পানি থেকে তুলে সে তাকে ডালের উপর বসায় এবং তারপরে সে নিজে উঠে বসে। মেয়ের কষ্ট করে শ্বাস নেয়ার শব্দ শুনে সে স্বস্তি লাভ করে। মেয়ের দেহ নিস্তেজ হয়ে রয়েছে কিন্তু সে বেঁচে আছে। তার সৈন্যদের একজন পাশের আরেকটা ডালে উঠে আসতে সে তার কাছে মেয়েকে দেয়।

রোসন্নারাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাবার সাথে সাথে খুররম আবার ডাল বরাবর সামনের দিকে এগিয়ে যেতে আরম্ভ করেছে। সে আরজুমান্দকে পানিতে হাবুডুবু খেতে খেতে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে, কাঠের টুকরোটা এখনও সে আঁকড়ে রয়েছে কিন্তু সে অনেক দূর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে তার পক্ষে তাকে ধরা সম্ভব হবে না। সে যখন ঠিক তার বরাবর পৌঁছে খুররম পানিতে লাফিয়ে নেমে তার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। নদী এখানে বেশ গভীর কিন্তু সে যেমনটা আশা করেছিল বাঁকের কারণে এখানে স্রোত বেশ দুর্বল। দশবারে সে আরজুমাদের পাশে পৌঁছে যায়। বাম হাতে তার কোমর জড়িয়ে ধরে, সে বলে, কাঠের টুকরোটা ছেড়ে দাও। আমি তোমায় ধরেছি।’ সে তাঁর কথামত কাজ করে এবং খুররম ডান হাত চালিয়ে আর দুই পায়ে যত জোরে সম্ভব লাথি মেরে তীরের দিকে এগিয়ে যেতে আরম্ভ করে। তার চোখে এতবেশি পানির ঝাপটা লাগে যে কেবল তীরের সবুজ অস্পষ্টতা আর আরজুমান্দকে কোনোভাবে ছুটতে না দেয়া ছাড়া সে পরিষ্কার করে কিছু চিন্তা করতে পারে না।

সে তারপরে কিছু একটা তাঁদের দিকে বাড়িয়ে রাখা হয়েছে দেখতে পায়। ‘জাহাঁপনা, বর্শার হাতলটা আঁকড়ে ধরেন, একটা কণ্ঠস্বর প্রাণপণে চিৎকার করে বলে। সে হাত বাড়াতে তার আঙুল কাঠের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারে। সে তারপরে বর্শার হাতল শক্ত করে আঁকড়ে ধরলে, টের পায় তাকে কেউ টানছে। সে আর আরজুমান্দ কিছুক্ষণ পরেই কাদার উপরে শুয়ে হাপরের মত শ্বাস নিতে থাকে। আরজুমান্দের ডান বাহুর উদ্ধাংশ ছড়ে গিয়েছে এবং বেশ রক্ত পড়ছে পানিতে কোনো পাথরের সাথে যেখানে সে আঘাত পেয়েছে এবং তাঁর গালেও জখম হয়েছে কিন্তু তার উচ্চারিত শব্দগুলো হলো, রোসন্নারা… আমার মেয়ে ঠিক আছে? খুররম কেবল মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। কর্দমাক্ত আর ভিজে জবজবে অবস্থায়, কাঁপতে কাঁপতে তারা যেমন রয়েছে সেভাবেই নিরব কৃতজ্ঞতায় একে অপরকে আঁকড়ে ধরে।

২.০৩ আগন্তুক মেহেরবান

খয়েরী অশুভ দুর্গন্ধযুক্ত, পিচ্ছিল কাদা এখনও তাদের কেরাঞ্চির চাকা আটকে ধরে ভাবটা এমন যেন তাদের অতিক্রম করতে দিতে অনিচ্ছুক। খুররম প্রায় হতাশ একটা অনুভূতি টের পায়। মহানন্দা নদী অতিক্রম করার পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে তারা যখন উত্তরপূর্বদিকে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অভিমুখে রওয়ানা হবার পরে তাঁদের অগ্রসর হবার গতি যন্ত্রণাদায়কভাবে শ্লথ হয়ে পড়েছে, এমনও দিন গিয়েছে যেদিন তারা দিনে তিন কি চার মাইলের বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারেনি। বর্ষাকাল অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু তার চিহ্ন এখনও এখানের, আর্দ্র বাতাস থেকে শুরু করে পচা পাতার পুরু গালিচায় এবং উপড়ে পড়া গাছপালার শাখাপ্রশাখায় এবং বৃষ্টির কারণে সৃষ্টি হওয়া জলাভূমির এখন বদ্ধ কালো পানির দীপ্তির ভেতর রয়েছে। ডাকাতের দল যদিও আর কোনো সমস্যার জন্ম দেয়নি এবং মহবত খানের উপস্থিতির কোনো লক্ষণ দেখা যায় নি, তারপরেও চারপাশে বিপদ যেন ওঁত পেতে রয়েছে। গাছের নিচে জন্ম নেয়া ঝোঁপঝাড়ে বিষাক্ত সাপ ঘুরে বেড়ায়। সন্ধ্যার সময় বোঁ-বোঁ শব্দ করে মশার ঝাঁক হুল ফোঁটাতে উড়ে আসে, উষ্ণ রক্তের জন্য ক্ষুধার্ত। আর তার লোকদের ভিতরে এখন শুরু হয়েছে রোগের প্রাদুর্ভাব–গত দুই সপ্তাহে তাঁর ছয়জন লোক মারা গিয়েছে যাদের ভিতরে রয়েছে তার সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ পরিচারক, শাহ্ গুল, যিনি আগ্রা থেকে তাঁর সাথে আনুগত্যের জন্য নির্বাসনে এসেছিলেন। প্রতিদিন সকালবেলা তার বাহিনীর লোকবল হ্রাস পায় কারণ লোকজন পালিয়ে যেতে শুরু করেছে, তারা নিজেদের ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখতে আগ্রহী।

হতাশার মাঝে নিজেকে আটকে রেখে, খুররম প্রতিটা গাছ থেকে ঝুলে থাকা সবুজ মসের সেঁতসেতে, রুক্ষ একটা জট ধাক্কা দিয়ে একপাশে সরিয়ে দেয়। আরজুমান্দ পুনরায় গর্ভবতী হওয়ায় তাকে, আর তাঁর সন্তানদের নিয়ে তাঁর সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা। বাচ্চাদের সবাইকে অসুস্থ আর প্যাকাটে দেখায় এবং আরজুমান্দের নিজেরও চোখমুখ দুশ্চিন্তায় বসে গেছে, তাঁর চোখের নিচে কালি পড়েছে। মহানন্দা অতিক্রমের সময় তাঁর উৰ্দ্ধবাহুতে যে ক্ষত হয়েছিল সেটা পুরোপুরি কখনও নিরাময় হয়নি। ক্ষতস্থানটা এখনও তাজা আর ফোলা দেখায় এবং প্রায়ই সেখানে হলুদ পুঁজ জমে। তার কি করা উচিত? তার মাঝে মাঝে মনে হয় মহবত খানের বাহিনীর অবস্থানের ব্যাপারে সে যদি জানতে পারতো… এখন যখন শুষ্ক মওসুম এসে গিয়েছে, তারা কি তার পিছু পিছু আসছে নাকি বর্ষার সময়েই তারা ফিরে গিয়েছে। কোনো তথ্য জানা না থাকলে পরিকল্পনা করা অসম্ভব। দশদিন আগে সে গুপ্তদূতের দায়িত্ব দিয়ে যাদের পাঠিয়েছিল তাঁদেরও এখন পর্যন্ত ফিরে আসবার কোনো লক্ষণ নেই এবং তারা সম্ভবত আসছেও না–স্বপক্ষত্যাগের প্ররোচনা এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেকবেশি প্রলুব্ধকারী।

তাঁর মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয় এবং চোখ নামিয়ে সে ছেঁড়া, কাদার দাগ যুক্ত পোষাকের দিকে তাকায়, অনেকটাই তাঁর একসময়ের চৌকষ ঘোড়ার মলিন চামড়ার মত লাগে বেচারার পাঁজরের হাড় এখন স্পষ্ট বোঝা যায়। সে চোখ তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রবোধ দিতে চায় জনবসতি ক্রমশ বিরল হয়ে আসছে। উপকূল থেকে তারা এখন নিশ্চয়ই খুব একটা দূরে নেই বা অন্ততপক্ষে গঙ্গার মোহনা থেকে যা নদীপথের একটা সম্পূর্ণ ব্যবস্থা। তারা যদি কোনোমতে একবার নদীগুলোর একটাকে খুঁজে বের করতে পারতো তাহলে সেটাকে ভাটিতে অনুসরণ করে সমুদ্রে… তাঁর ভাবনা যেন ভোজবাজির মত নিজেদের মূর্ত করে তুলে, নিকোলাস ব্যালেনটাইন আর তাঁর আরেকজন দেহরক্ষী সামনের সবুজ ছায়ার মাঝ থেকে আবির্ভূত হয়। সে তাঁদের সকালে পাঠিয়েছিল, নদীর তীরে ডাকাতদের সাথের তিক্ত অভিজ্ঞতা হবার পরে থেকে সে সবসময়েই সামনের পথটা এখন আগেই পর্যবেক্ষণ করে নেয়। কি অবস্থা? তাঁরা শ্রবণ সীমার ভেতর পৌঁছাতেই সে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে।

তার জন্য বিস্ময় অপেক্ষা করছিল যখন সে দেখে তারা একা ফিরে আসেনি। তাঁদের বিশ গজ পেছনে একটা সুন্দর দেখতে সাদা খচ্চরের পিঠে উপবিষ্ট খয়েরী রঙের মোটা কাপড়ের তৈরি লম্বা একটা আলখাল্লা পরিহিত একজন মানুষ যার মুখটা একটা বিচিত্র, চওড়া কিনারাযুক্ত, একটা টুপির আড়ালে ঢাকা।

যুবরাজ, নিকোলাস দুলকি চালে ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে আসে, তাঁর অল্পবয়সী মুখটা ঘামে গোলাপি হয়ে রয়েছে। এই লোকটা একজন পর্তুগীজ পুরোহিত। আমরা এখান থেকে পাঁচ মাইল দূরে জ্বালানী কাঠ কাটতে থাকা একদল লোককে তত্ত্বাবধায়ন করা অবস্থায় তাকে আবিষ্কার করেছি। তার ভাষ্য অনুযায়ী আমরা হুগলীর পর্তুগীজ কুঠির খুব কাছেই অবস্থান করছি।’

হুগলী? খুররম ভ্রুকুটি করে। বাণিজ্য কুঠির বিষয়ে সে তাঁর আব্বাজানকে কথা বলতে শুনেছে। দরবারে গুজব রয়েছে যে সেখানের পর্তুগীজ পুরোহিতেরা স্থানীয় লোকজনকে জোর করে তাঁদের নিজেদের ধর্মে দীক্ষিত করার চেষ্টা করছে আর তারচেয়েও বড় কথা পর্তুগীজ ব্যবসায়ীরা তাঁদের দাস ব্যবসায়ে যাদের জাহাজ সেখানে রয়েছে যারা সম্মতি না দেয় তাদের বিক্রিও করে দিচ্ছে… এই পুরোহিত কি জানে আমি কে?

না, যুবরাজ। তাকে কেবল জানানো হয়েছে যে আপনি একজন মোগল অভিজাত ব্যক্তি।

‘তাকে আমার কাছে আসতে বলো।

পুরোহিত যখন সামনের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে, তখন সে অভিবাদন জানাতে নিজের মাথা নত করে। খুররম পুরোহিতের চওড়া কিনারাযুক্ত টুপির নিচে ছোট করে ছাঁটা দাড়িযুক্ত লম্বা পাতলা বাঁশির মত নাক বিশিষ্ট একটা মুখে হলুদাভ চোখ দেখে। আমি বুঝতে পারছি আপনি হুগলীর একজন পর্তুগীজ পুরোহিত।

হ্যাঁ, জাঁহাপনা, লোকটা ফার্সীতে উত্তর দেয়।

আপনি আমাকে চেনেন?

‘আমার নাম ফাদার রোনাল্ডো। আমি কয়েক বছর পূর্বে আপনার আব্বাজানের দরবারে গিয়েছিলাম। আপনার আব্বাজান সেই সময়ে আমাদের ধর্মের–একমাত্র ধর্মবিশ্বাস–বিষয়ে বেশ আগ্রহ প্রদর্শন করেছিলেন। তিনি সেই সময়ে আমার মত একজন জেসুইট পুরোহিতকে আপনার ছোট ভাইয়ের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পর্যন্ত করতে চেয়েছিলেন।

খুররম মাথা নাড়ে। তার এখন মনে পড়েছে তার পিতামহ আকবরের ন্যায়–তাঁর আব্বাজানও এই জেসুইটদের বিষয়ে ঠিক কতটা আগ্রহী ছিলেন। একটা সময় ছিল যখন দরবাবে ঝাঁকে ঝাঁকে পুরোহিত দেখা যেত এবং যেনতেনভাবে প্রস্তুত কাঠের তৈরি বিশাল একটা ক্রুশ নিয়ে আগ্রার সড়কে তাঁদের মিছিলের ব্যাপারে আর গির্জা নির্মাণের জন্য তাদের নিরন্তর অনুরোধের বিষয়ে মোল্লারা ভীষণ আপত্তি জানিয়েছিল।

ফাদার রোনাল্ডো তাঁর পাতলা ঠোঁট কুঞ্চিত করে। সম্রাট তাঁর নিজের ধর্মমতের পুরোহিতদের গোড়া বিশ্বাসের কাছে, যারা আমাদের প্রভাবের কারণে ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠেছিল আর ঈশ্বরের সত্যিকারের পথ প্রদর্শক হিসাবে আমাদের ভয় করতো, নিজেকে প্রভাবিত হতে দিয়েছেন।

খুররম কোনো উত্তর দেয় না। এটা ধর্মীয় আলাপের উপযুক্ত সময় না। তার আর তার পরিবারের সাহায্য প্রয়োজন এবং সেটা হয়ত এই লোকটার কাছে পাওয়া যেতে পারে। আপনি কি জানেন কি কারণে আমাকে বাংলায় আসতে হয়েছে? সে পুরোহিতের মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে প্রশ্ন করে। হলুদাভ চোখের মণি চঞ্চল হয়ে উঠে।

‘আপনার আর আপনার আব্বাজানের ভিতরে কোনো কারণে একটা মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়েছে বলে আমরা শুনেছি, কিছুক্ষণ পরে ফাদার রোনাল্ডো উত্তর দেয়।

ব্যাপারটা মতানৈক্যের চেয়েও বড়। আমাদের ভিতরে প্রায় যুধ্যমান একটা অবস্থা বিরাজ করছে। আমি আমার পরিবার নিয়ে এখানে এসেছি কেবল একটা আশা নিয়ে যে আমি আমার বাহিনী পুনর্গঠিত করার সময় তাঁদের জন্য এখানে একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পাব। আমার সাথে এখনও অনেকের মৈত্রীর সম্পর্ক রয়েছে।

‘আপনি আসলেই বিশ্বাস করেন যে বিষয়টা যুদ্ধ পর্যন্ত গড়াতে পারে? পুরোহিতকে কেমন বিভ্রান্ত দেখায়।

‘আমি সেটা চাই না কিন্তু সেটাই হতে পারে। আমার আব্বাজান এখন আর কোনোমতেই স্বাধীন নন। তিনি আফিম আর সুরার কাছে নিজেকে বিক্রি করে দিয়েছেন এবং নিজের সাম্রাজ্যের শাসন ক্ষমতা নিজের স্ত্রীর হাতে অর্পন করেছেন।’

‘সম্রাজ্ঞী মেহেরুন্নিসা? আমাদের বণিকদের সম্প্রতি নীল বাণিজ্যের অধিকার দিয়ে জারি করা একটা হুকুমনামায় তার সীলমোহর ছিল। আমরা তখন বিস্মিত হয়েছিলাম, কিন্তু ধারণা করেছিলাম যে সম্রাট অসুস্থ বলেই এমনটা হয়েছে।

‘না। তিনি নন এখন সম্রাজ্ঞীই শাসন পরিচালনা করছেন। আমি পরে আপনাকে সবকিছু খুলে বলবো কিন্তু তার আগে আমায় জানতে হবে যে হুগলীতে আপনি আর আপনার সাথী অন্যান্য পর্তুগীজরা কি আমার পরিবারকে শরণস্থল দান করবেন? আমরা কয়েকশ মাইল পথ অতিক্রম করে এসেছি, অধিকাংশ সময়েই যা ছিল বিপদসঙ্কুল। আমার সন্তানদের বয়স অল্প আর আমার স্ত্রী অসুস্থ এবং সন্তানসম্ভবা। তাঁর বিশ্রাম প্রয়োজন।’

পুরোহিতকে এই প্রথমবার হাসতে দেখা যায়। যুবরাজ, আপনাকে সাহায্য করা খ্রিস্টান হিসাবে এটা আমাদের দায়িত্ব। আপনি যদি আপনার ইংরেজ পরিচারককে আমার সাথে আগে যাবার অনুমতি দেন, আমি তাহলে আমার পুরোহিত ভাইদের সাথে কথা বলতে এবং আপনার বসবাসের জন্য আমরা আবাসস্থল প্রস্তুত করতে পারি।

*

হুগলী নদীর তীরে উঁচু খুটির উপরে অবস্থিত একটা সাধারণ একতলা, তালপাতার বাসার চুনকাম করা একটা কক্ষের মসলিনের পর্দা মৃদু বাতাসে আন্দোলিত হয় যেখানে আরজুমান্দ একটা নিচু নরম ডিভানে শুয়ে রয়েছে। এক মুহূর্তের জন্য তাঁর দৃষ্টি উল্টো দিকের দেয়ালে ঝুলন্ত রহস্যময় একটা চিত্রকর্মের উপরে স্থির থাকে যেখানে একটা কাঠের ক্রুশে একটা মানুষকে পেরেক দিয়ে আটকানো রয়েছে। লোকটা এতই কৃশকায় যে তার পাজরের সবগুলো হাড় বাইরের দিকে বের হয়ে আছে এবং একটা কাঁটাযুক্ত মুকুটের নিচে থেকে তাঁর মোমের মত ফ্যাকাশে মুখে যা যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে রয়েছে, রক্ত গড়িয়ে নামছে যা এতই গাঢ় দেখতে যে প্রায় কালচে মনে হয়। তার দু’চোখ হতাশভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, চোখের মণি দেখা প্রায় যায়ই না, কেবল শিরাযুক্ত সাদা অংশ চোখে পড়ে। একটা ভয়ঙ্কর চিত্রকর্ম এবং রাতের বেলা সে একটা সাদা কাপড় দিয়ে ছবিটা ঢেকে রাখে কিন্তু দিনের বেলা সে তার পর্তুগীজ পরিচারিকাদের মনে আঘাত দিতে চায় না বলে যারা ভীষণ মমতা নিয়ে তাঁর তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত। পুরোহিতদের জন্য তাঁরাই খাবার রান্না করে আর সবকিছু ঝেড়েমুছে পরিষ্কার রাখে, এবং সেই সাথে এখানে পুরোহিতদের দেয়াল ঘেরা আঙ্গিণায় তাদের ছোট পরিবারের সব দায়িত্ব আর তাঁর এবং খুররমের সেবা শুশ্রূষার দায়িত্বও তারা নিয়েছে। তাঁরা প্রায়ই অবশ্য পর্তুগীজদের ভীষণ পছন্দের নোনতা মাছ যা এখানে শুঁটকি নামে পরিচিত তাঁদেরও খেতে দেয়। খুররমের সৈন্যরা হুগলীর তীরে বেশ আরামদায়কভাবেই শিবির স্থাপন করে অবস্থান করেছে যেখান থেকে প্রায় আধমাইল দূরে পর্তুগীজদের বাণিজ্য বহরগুলো নোঙর করে রাখা।

আগ্রার স্মৃতি এবং বিশেষ করে তার দাদাজান গিয়াস বেগের কথা, যাকে সে আর কোনোদিনই দেখতে পাবে না, প্রায়ই তার মনে এসে ভীড় জমায়। সে আর খুররম হুগলীতে পৌঁছাবার কিছুদিন আগেই একজন পর্তুগীজ বণিক এখানে এসেছিলেন যিনি পাদ্রীদের বলেছেন যে রাজকীয় কোষাধ্যক্ষ মারা গিয়েছেন এবং মোগল দরবার শোক পালন করছে। সে কথাটা একেবারেই বিশ্বাস করতে পারছে না। তাঁর জীবনে দাদাজানের উপস্থিতি–তাঁদের পুরো পরিবারের সবার কাছে–এতই ব্যাপক ছিল। সংবাদটা অনিবার্যভাবেই তার ভাবনাগুলোকে তাঁর ফুপুজান মেহেরুন্নিসার দিকে ধাবিত করে। মেহেরুন্নিসা নিশ্চিতভাবেই এখন শোকগ্রস্থ… নাকি তিনি? মেহেরুন্নিসার কারণেই, মোগল রাজপরিবার অতীতে বহুবার যেমন হয়েছে, পিতার বিরুদ্ধে পুত্র, সৎ-ভাইয়ের বিরুদ্ধে সৎ-ভাইয়ের মত, আবারও টুকরো হয়েছে। তার মাঝে মাঝে মনে হয় যে তাঁদের এই পারিবারিক সমস্যা অনেকটা ফুলের ভেতরের কীটের মত, অলক্ষ্যে থেকে কুড়ে কুড়ে সবকিছু খায় যতক্ষণ না অনেক দেরি হয়ে যায়।

কক্ষের বাইরে থেকে নিজের সন্তানদের চিৎকারের শব্দ শুনে, সে ভাবে, তার নিজের সন্তানদের ভিতরে একতার এমন অভাব যেন কখনও দেখা না যায়। খুররম তার তিন পুত্রকেই ভীষণ ভালোবাসে এবং তারাও তাকে ভালোবাসে। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর ছেলেরা সবাই আপন ভাই, আলাদা আলাদা মায়ের সন্তান না যারা বিভিন্ন স্থানে বড় হবার কারণে তাদের ভিতরে ভ্রাতৃত্ববোধ কখনও পুরোপুরি বিকশিত হতে পারে না, যাদের দেখাশোনা করার জন্য স্নেহময়ী এক মা আছেন। আর সেই সাথে যে বিপদ আর কষ্ট তারা সহ্য করেছে–সম্ভবত এখনও করছে–তাঁদের ভিতরে আরো গভীর বন্ধনের জন্ম দেবে।

নিজের ভিতরে একটা লাথি অনুভব করতে, সে নড়ে ওঠে। এই সন্তানটা কেমন হবে? আরেকটা ছেলে? এই সন্তানটা অনেক বড়–তার উদর আগে কখনও এত বিশাল হয়নি। সে গর্ভাবস্থায় সাধারণত ভালোই বোধ করে আর প্রতিটা সন্তান জন্ম নেয়ার সাথে সাথে সন্তান জন্ম দেয়াটা তার জন্য অনেকটাই সহজ হয়ে এসেছে। কিন্তু এইবার গর্ভাবস্থার সময় সে অসুস্থবোধ করেছে এবং খানিকটা ভয়ও পেয়েছে। সে যতকিছু সহ্য করেছে এবং তার বাহুর ক্ষতটা যা এখনও পুরোপুরি সারেনি, তাঁর মাঝে ভীষণ দূর্বল একটা অনুভূতি জন্ম দেয়… সহসা একটা তীক্ষ্ণ ব্যাথা ঢেউয়ের মত ছড়িয়ে পড়তে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।

*

হুগলী নদীর তীর বরাবর কয়েক ঘন্টা শিকার করে ফুরফুরে মেজাজে খুররম যখন জেসুইট পাদ্রীদের আবাসিক এলাকার দিকে ঘোড়ায় চেপে ফিরে আসে সে একটা যুবককে তার দিকে দৌড়ে আসতে দেখে যাকে সে পাদ্রীদের পরিচারকদের একজন হিসাবে চিনতে পারে। সে একজন ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান এবং সুতি কাপড়ের ধুতির পরিবর্তে তাঁর পরনে ইউরোপীয় রীতির কোট আর পাতলুন।

‘আপনার স্ত্রীর গর্ভযন্ত্রণা শুরু হয়েছে, খুররম শুনতে পাবে এমন দূরত্বে পৌঁছান মাত্রই সে চিৎকার করে বলে।

খুররম তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে, তাঁর মনে কেবল একটা ভাবনাই আকৃতি লাভ করে–অনেক তাড়াতাড়ি… অনেকবেশি আগে… সে ঘোড়া নিয়ে দ্রুত আবাসিক এলাকার দিকে এগিয়ে যায়, ঘোড়া থেকে নামে এবং কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে আরজুমান্দের কক্ষের দিকে দৌড়ে যায়। সে বন্ধ দরজার বাইরে এসে দাঁড়ায়, গর্ভযন্ত্রণার স্বাভাবিক কান্নাকাটি শুনতে চেষ্টা করে, কিন্তু সে সবের পরিবর্তে সেখানে নিরবতা বিরাজ করছে এবং বিষয়টা তার হাত পা ঠাণ্ডা করে দেয়। তারপরেই দরজা খুলে যায় এবং পর্তুগীজ পরিচারিকাদের একজন বাইরে আসে। কি হয়েছে? সে জানতে চায় কিন্তু পরিচারিকা মেয়েটা দুর্বোধ্য ভঙ্গিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। সে তাকে ধাক্কা দিয়ে একপাশে সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। আরজুমান্দ রক্তে মাখামাখি অবস্থায় শুয়ে রয়েছে এবং ধাত্রী বসে ছোট আর নিথর কিছু একটা একটুকরো কাপড়ে জড়াচ্ছে।

সে মন্থর পায়ে শয্যার দিকে এগিয়ে যায়, তাকে কি দেখতে হতে পারে ভেবে ভীত। সে তারপরে আরজুমালের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়।

‘খুররম–আমি দুঃখিত। আমরা আমাদের সন্তানকে হারিয়েছি…’।

তাঁর কথা বলতে এক মুহূর্ত দেরি হয় এবং তখনও তার গলার স্বর কাঁপছে। আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল তুমি বেঁচে রয়েছে… পুরোটাই আমার দোষ। তোমায় এত কষ্টের ভিতরে ফেলাটা আমার উচিত হয়নি। আমার উচিত ছিল আগ্রায় আমাকে গ্রেফতার করার সুযোগ আব্বাজানকে দেয়া সেটা না করে তোমায় আর আমাদের সন্তানদের হিন্দুস্তানের প্রান্তরে টেনে নিয়ে এসেছি যতক্ষণ না আমরা পেছনে শিকারী কুকুরের ধাওয়া খাওয়া শিকারে পরিণত হয়েছি।’

না, সে ক্লান্ত স্বরে ফিসফিস করে বলে। এসব কথা বলবেন না। আমরা অন্তত একসঙ্গে রয়েছি, এবং আমরা যতক্ষণ একসঙ্গে আছি ততক্ষণ আমরা আশাবাদী।’

খুররম তাকে আলিঙ্গণ করে এবং আর কোনো কথা বলে না, কিন্তু তাঁর ভিতরে তিক্ততা বাড়তে থাকে। তাঁর সন্তানের এই অপমৃত্যুর জন্য একমাত্র তাঁর আব্বাজান এতটাই দায়ী যে তিনি যেন নিজ হাতে তাকে গলা টিপে হত্যা করেছেন। তাকে আর তার পরিবারকে জাহাঙ্গীরের জন্য যদি এতটা যন্ত্রণা ভোগ না করতে হতো তাহলে আরজুমান্দকে কখনও পালিয়ে বেড়াতে হতো না, নদীতে দুর্ঘটনার শিকার হতে হতো না যা তাদের সন্তানকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত গর্ভে ধারণ করার পক্ষে তাকে ভীষণ দুর্বল করে ফেলেছিল।

*

‘এটা কোনোভাবেই আপনার অভিপ্রায় হতে পারে না।’ খুররম ফাদার রোনাল্ডোর দিকে তাকিয়ে কথাটা বলার সময় তাঁর কণ্ঠস্বরে অবিশ্বাস স্পষ্ট বোঝা যায়।

‘আমি দুঃখিত। আমরা আমাদের পক্ষে যতটা সম্ভব করেছি। আমরা তিনমাসের অধিক সময় আপনাদের আতিথিয়তা দান করেছি এবং আপনার এখন অবশ্যই চলে যাওয়া উচিত।’

‘আমার স্ত্রীর মাত্র গর্ভপাত হয়েছে। সে এখনও ভালো করে দাঁড়াতেই পারে না… এই শারীরিক অবস্থায় তাঁর পক্ষে ভ্রমণের ধকল সামলানো সম্ভব না।

‘আপনার স্ত্রীর গর্ভধারণের একটা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সহানুভূতি আর পরহিব্রত আমাদের হাত বেঁধে রেখেছিল… আমরা আমাদের যতটা করা উচিত তার চেয়ে অনেক বেশি ইতিমধ্যেই আপনার জন্য করেছি।’

‘আমি আপনার কথা বিশ্বাস করি না। কি এমন ঘটেছে যা আপনাকে আমাদের প্রতি বিরূপ করে তুলেছে?’ খুররম অকপটে জানতে চায়।

ফাদার রোনাল্ডোকে এক মুহূর্তের জন্য বিব্রত দেখায় কিন্তু তারপরে তিনি নিজের কৃশকায় কাঠামোটা নিয়ে উঠে দাঁড়ান। মহামান্য সম্রাট আপনার আব্বাজান জানেন যে আপনি হুগলীতে আমাদের এখানে রয়েছেন। দুই সপ্তাহ আগে আমাদের একটা জাহাজ দরবারের একটা বার্তা নিয়ে ফিরে এসেছে। আমাদের বলা হয়েছে যে আমরা যদি আপনাকে বহিষ্কার না করি তাহলে সম্রাট আমাদের বিরুদ্ধে তাঁর বাহিনী প্রেরণ করবেন আর এই কুঠি জ্বালিয়ে দেবেন। আমরা এটা ঘটতে দিতে পারি না। আমাদের ঈশ্বরের কাজ করতে হবে–অন্ধকারাচ্ছন্নতা থেকে মানবাত্মাকে মুক্তির আলোয় নিয়ে আসতে…’

‘আর মুনাফা করতে হবে, খুররম ক্রুদ্ধ স্বরে বলে উঠে। আমার আব্বাজানের যত দোষই থাক আপনাদের ভণ্ড আর স্বার্থান্বেষী বাক্য চয়নের অসারতা বোঝার মত মানসিক স্থিরতা তার এখনও রয়েছে। আপনারা সবসময়ে যে প্রেমময় করুণার বিষয়ে কথা বলেন সেই খ্রিস্টান পরহিত এখন কোথায়? তিন দিন আগে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা একজন অসুস্থ মহিলাকে নিয়ে আপনারা আমায় অনিশ্চিতের পথে রওয়ানা হতে বলছেন।’

‘আমি দুঃখিত। বিষয়টা এখন আর আমার হাতে নেই। আমাদের সম্প্রদায়ের প্রধান আর আমাদের বণিকমণ্ডলীর সভাপতি সম্মিলিতভাবে আমাদের পরামর্শদাতাদের একটা বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’

খুররম কোনো কিছু বোঝার আগেই সে টের পায় তার হাত কোমরে থাকা খঞ্জরের বাটে চেপে বসেছে। এই তোষামুদে, আত্ম-প্রবঞ্চক কণ্ঠস্বরটা থামিয়ে দিতে তার ভীষণ ইচ্ছে হয়। আপনি যে বার্তাটার কথা উল্লেখ করছেন–আমার আব্বাজানের স্বাক্ষর কি সেখানে রয়েছে?

না। পাদ্রী নিজের ধুলিধুসরিত স্যান্ডেলের দিকে তাকিয়ে থাকে। সম্রাজ্ঞীর স্বাক্ষর রয়েছে এবং তাঁর নিজস্ব সীলমোহর যেখানে তাঁর উপাধি নূর জাহান, দুনিয়ার আলো, উৎত্তীর্ণ রয়েছে।

‘আমি আপনাকে একটা কথা বলছি আর আপনার উচিত সেটা মনে রাখা। সম্রাজ্ঞী মোটেই আপনাদের বন্ধু নন। মোগল রসুইঘরের উচ্ছিষ্ট নিয়ে রাস্তার কুকুর যেমন নিজেদের ভিতরে কাড়াকাড়ি করে তিনি ঠিক সেইরকম ঘৃণা করেন প্রতিটা ইউরোপীয়কে। আপনি তার আদেশ পালন করে হয়ত তাঁর রোষের হাত থেকে বাঁচতে পারবেন কিন্তু কোনো পুরষ্কার পাবেন না। আর আমি একদিন যখন মোগল সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হব–আমি হবোই–আপনার আজকের এই নিশ্চেতন উদাসীনতার কথা তখন আমার স্মরণ থাকবে।

পাদ্রী বেত্রাহত কুকুরের মত কক্ষ থেকে বের হয়ে যাওয়া মাত্র, নিজের জাত ভাইদের কাছে তাদের এই আলোচনার বিষয়টা জানাতে গিয়েছে সেটা নিয়ে খুররম নিঃসন্দেহ, সে দ্রুত চিন্তা করতে করতে সরাসরি নিজের শিবিরে ফিরে যায়। পর্তুগীজদের মাথায় যদি কোনো দুর্মতির উদয় হয়–যেমন তারা যদি তাকে বন্দি করার চেষ্টা করে যাতে তারা তাকে তাঁর আব্বাজানের কাছে সোপর্দ করতে পারবে, তাহলে কুঠি পাহারায় নিযুক্ত পর্তুগীজ সৈন্যদের যেকোনো ধরনের হুমকি মোকাবেলায় তাঁর সঙ্গের তিনশ সৈন্য যথেষ্ট। সে সিদ্ধান্ত নেয়, শিবিরের চারপাশে দুই সারির প্রহরী মোতায়েন করবে এবং আজ রাতে সে নিজে, আরজুমান্দ আর তাদের সন্তানদের নিয়ে পাদ্রীদের সাথে না থেকে শিবিরেই রাত্রিযাপন করবে। সে তার কাছে পরে গিয়ে সবকিছু খুলে বলে তাকে বোঝাবে আসলেই এখানে কি ঘটেছে কিন্তু তার আগে সে অন্য যে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটা তাকে অবশ্যই করতে হবে।

খুররম প্রয়োজনীয় আদেশ দিয়ে নিজের আবাসিক কক্ষে ফিরে আসে এবং তাঁর নিচু লেখার টেবিলের সামনে আসন-পিঁড়ি হয়ে বসে। সে কিছুক্ষণ নিবিষ্ট মনে চিন্তা করার পরে একটা কাগজ নিয়ে গজদন্তের অগ্রভাগযুক্ত লেখনী তাঁর জেড পাথরের দোয়াতদানিতে ডুবিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে লিখতে শুরু করে, প্রতিটা শব্দ কাগজে লেখার আগে তাঁদের গুরুত্ব খুব যত্ন নিয়ে যাচাই করে। সে চিঠিটা মুসাবিদা শেষ করার পরে যা লিখেছে বেশ কয়েকবার পড়ে দেখে। সে তারপরে উঠে দাঁড়িয়ে প্রহরীদের একজনকে আদেশ দেয় নিকোলাস ব্যালেনটাইনকে ডেকে আনতে। ভিনদেশী কর্চি পাঁচ মিনিট পরে এসে উপস্থিত হয়, তাঁর মাথার উজ্জ্বল সোনালী চুল শক্ত করে বাঁধা একটা কালো পাগড়ির নিচে ঢাকা যা সে সম্প্রতি পরিধান করতে শুরু করেছে।

খুররম শক্ত করে তাঁর কাঁধ আঁকড়ে ধরে। তোমার প্রভু স্যার টমাস রো, হিন্দুস্তান ত্যাগ করার পূর্বে আমায় বলেছিল আমি যদি তোমায় আমার অধীনে নিয়োগ করি তুমি আন্তরিকতা আর আনুগত্যের সাথে আমার সেবা করবে। তিনি কি সত্যি কথা বলেছিলেন?

নিকোলাসের নীল চোখে তার বিস্ময় স্পষ্ট ফুটে উঠে। হ্যাঁ, যুবরাজ।

‘আমার কথা মন দিয়ে শোন–আমি তোমায় সবকিছু খোলাখুলি বলছি। আমাদের পক্ষে হুগলীতে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। পর্তুগীজরা ভয় করছে যদি আমাদের আর বেশি দিন এখানে আশ্রয় দেয় তাহলে তারা হয়ত আমার আব্বাজানের কোপের সম্মুখীন হবে আর আমাদের এখান থেকে চলে যেতে বলেছে। আমি ভালো করেই জানি আমাদের পক্ষে ভবঘুরের মত বিচরণ করা সম্ভব না। আমার আব্বাজানের সৈন্যবাহিনী তাহলে অচিরেই আমাদের নাগাল পাবে আর কচুকাটা করবে। আমরা উপকূল থেকে জাহাজে চেপে পারস্যে বা অন্য কোথায় চলে যেতে পারি। কিন্তু আমি আমার মাতৃভূমি থেকে এভাবে বিতাড়িত হতে চাই না। আর তাছাড়া আমার স্ত্রীর শরীরও নাজুক। আমাকে অবশ্যই তাঁর কথা চিন্তা করতে হবে। আমি তাই বিরোধের মীমাংসা করতে আমার আব্বাজানকে একটা চিঠি লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি জানি না তিনি আমার কথায় কর্ণপাত করবেন কিনা কিন্তু আমাকে অবশ্যই চেষ্টা করতে হবে। তোমার কাছে আমার প্রশ্ন হল তুমি কি আমার বার্তাবাহক হতে রাজি হবে? একজন ভিনদেশী হবার কারণে আর সেই সাথে স্যার টমাস রো’র অধীনে কাজ করার কারণে যিনি আমার আব্বাজানের বন্ধুস্থানীয় ছিলেন, অন্য যেকোনো মোগল অমাত্যের চেয়ে আমার আব্বাজানের প্রতিহিংসার সম্মুখীন হবার সম্ভাবনা তোমার প্রায় নেই বললেই চলে। তুমি সেই সাথে দরবারের আচার আচরণের সাথে পরিচিত এবং জানো কীভাবে সেখানে সবকিছু সম্পন্ন করা হয়। তোমার পক্ষে তাই আমার আব্বাজানের হাতে চিঠিটা পৌঁছে দেয়ার একটা ভালো সম্ভাবনা রয়েছে।

২.০৪ এক ভিনদেশী খবরগির

কাশ্মীরের নৈসর্গিক ভূস্বর্গে সবকিছুরই রং বেগুনী–ডাল হ্রদের দিকে নেমে যাওয়া প্রথম বসন্তে ফোঁটা কুঙ্কুমে ছেয়ে থাকা মাঠ, সূর্যের আলোয় হ্রদের পানির মাঝ থেকে ঝিলিক দেয়া নীলা, বৃত্তাকারে চারপাশ ঘিরে থাকা পাহাড়ের চূড়া… জাহাঙ্গীর প্রথম বসন্তে ফোঁটা ফুলের মাঠে পিঠ দিয়ে শুয়ে থাকে, প্রাণ ভরে তাঁদের তীব্র মিষ্টি সুগন্ধ নেয় আর মাঝে মাঝেই ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে উপরের দিকে ছুঁড়ে দেয় যাতে তাঁর চারপাশে তুষারকণার মত তাঁরা ঝরে পড়ে। নিজেকে তার ভীষণ পরিতৃপ্ত মনে হয়… সত্যিকারের তুষারপাত শুরু না হওয়া পর্যন্ত সে এখানে শুয়ে থাকতে পারবে, তাঁর সমস্ত শরীর ঝুলের মত পড়তে থাকা তুষারের পাতলা কণায় পুরোপুরি ঢেকে যাবে…

‘জাহাপনা। একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে এবং তাঁর স্বপ্নের মাঝে বাস্তবতা এসে হানা দেয়। আগ্রা দূর্গে নিজের ব্যক্তিগত আবাসন কক্ষে দুধের সরের মত রঙের রেশমের কারুকাজ করা নিচু বিছানার উপরে যেখানে সে শুয়েছিল জাহাঙ্গীর মৃদু গোঙানির মত শব্দ তুলে ঘুরে শোয়। সে তখন টের পায় একটা হাত আলতো করে তাঁর কাধ ধরে ঝাঁকাচ্ছে। জাঁহাপনা, যুবরাজ খুররমের কাছ থেকে একজন বার্তাবাহক এসেছে।’

জাহাঙ্গীর নিজের ছেলের নাম শুনে ধীরে ধীরে চোখের পাতা খুলে এবং ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে বসে। সুরা-আর আফিমের ধোয়ায় সৃষ্ট তাঁর চমৎকার, শব্দহীন কোমল পৃথিবীর স্বপ্ন ধীরে মিলিয়ে যায় এবং সে চোখ কচলায়। তার বিছানার উল্টো দিকের কারুকাজ করা জালির ভিতর দিয়ে চুঁইয়ে ভিতরে প্রবেশ করা আলোর স্তম্ভের মাঝে সবকিছুই ভীষণ উজ্জ্বল আর নিখুঁত দেখায়। ডিভানের পাশে একটা নিচু তেপায়ার উপরে রাখা রত্নখচিত পানপাত্রের প্রতি তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় যার ভেতর তখনও লাল সুরার কিছুটা অবশিষ্ট আছে। সে কাঁপা কাঁপা হাতে পানপাত্রটা তুলে নিয়ে একটা চুমুক দেয়, চোখ বন্ধ করে গলার পেছনে তিতকুটে তরলের প্রলেপ অনুভব করে। সে হঠাৎ কাশতে শুরু করে এবং তরুণ পরিচারক যে একটু আগে তার নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটিয়েছে তাঁর দিকে পানি ভর্তি আরেকটা পানপাত্র এগিয়ে দিতে সে পানিটা পান করে।

‘তুমি এইমাত্র কি বললে?

‘আপনার পুত্র, যুবরাজ খুররম, একজন বার্তাবাহক পাঠিয়েছেন। বার্তাবাহক আপনার সাথে দেখা করার অনুমতি প্রার্থনা করছে।

খুররম? জাহাঙ্গীর এক মুহূর্ত মনে মনে কিছু একটা ভাবে। সে মাঝে মাঝে নিজের প্রাঞ্জল বুনটের স্বপ্নে তার তৃতীয় পুত্রকে দেখেছে কিন্তু সবসময়েই দূর থেকে–নদীর অপর পাড়ে, বা দূর্গের প্রকারবেষ্টিত উঁচু ছাদে বা ধূলোর মেঘের মাঝে ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছে–সবসময়েই এত দূরে জাহাঙ্গীরের পক্ষে তাকে উদ্দেশ্য কিছু বলা হয়নি এবং আপাতদৃষ্টিতে তাঁর পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক। তিনি খুররমকে শেষবার যখন দেখেছিলেন তারপরে অতিক্রান্ত বছরগুলোতে তিনি জেগে থাকা অবস্থায়ও প্রায়ই তাঁর কথা ভেবেছেন, তার আচরণের ফলে সৃষ্ট ক্রোধ আর কষ্টের সাথে মিশে থাকতো অতীতের জন্য একটা আক্ষেপ যখন যুবরাজ ছিল তার সবচেয়ে অনুগত সন্তান যাকে নিয়ে তিনি এতটাই গর্ববোধ করতেন যে তিনি তাকে স্বর্ণমুদ্রা আর মূল্যবান রত্নপাথরে রীতিমত সাত করেছিলেন… সুরা আর আফিমের কারণে তার মন রীতিমত বিভ্রান্ত হয়ে থাকলেও তিনি এটা ঠিকই বুঝতে পারেন যে খুররমের কাছ থেকে এখন কোনো বার্তার একটাই সম্ভাব্য মানে হতে পারে–আত্মসমর্পণ, বিশেষ করে মহবত খান আর তাঁর বাহিনী যখন তাকে প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছে।

‘আমি দেওয়ানি আমে আসছি,’ তিনি পরিচারককে বলেন, তাঁর কণ্ঠস্বর চাপা শোনায়। দরবার ডাকতে বলো আর সম্রাজ্ঞীর কাছে সংবাদ পাঠাও। বার্তাবাহক কি বলতে চায় তিনি হয়ত জেনানাদের জন্য নির্ধারিত দর্শনার্থী কক্ষ থেকে শুনতে আগ্রহী হবেন… আর এটা আমার সামনে থেকে সরাও, রত্নখচিত পানপাত্রটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে, তিনি একটু থেমে যোগ করেন।

*

জাহাঙ্গীর প্রায় এক ঘন্টা পরে নিজের সিংহাসনে আসন গ্রহণ করে এবং তাঁর ইঙ্গিতে তূর্যবাদক তাঁর হাতের পিতলের বাদ্যযন্ত্রটা নিজের ঠোঁটে স্থাপন করে ধারাবাহিকভাবে ছোট ছোট ধ্বনির একটা সংকেত দিতে যার অর্থ দর্শন দানের জন্য সম্রাট প্রস্তুত। জাহাঙ্গীর তার সিংহাসনের একপাশের দেয়ালের অনেক উঁচুতে স্থাপিত কারুকাজ করা বেষ্টনীর দিকে তাকাতে তার মনে হয় তিনি মুক্তার উষ্ণীষের নিচে একজোড়া কালো চোখের দীপ্তি দেখতে পেয়েছেন। স্বস্তির বিষয়–মেহেরুন্নিসা সেখানে রয়েছেন।

মোগলদের ঐতিহ্যবাহী সবুজ আলখাল্লা পরিহিত চারজন প্রহরীর পেছনে মন্থর গতিতে খুররমের প্রেরিত বার্তাবাহক সামনে এগিয়ে আসবার সময় তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। বার্তবাহক প্রহরীদের পেছনে, অর্ধেক আড়াল হয়ে থাকায় জাহাঙ্গীর তার মুখটা ঠিকমত দেখতে পান না, যারা সিংহাসন থেকে বিশ ফিট দূরে পৌঁছে চৌকষ ভঙ্গিতে দুপাশে সরে যায়। বার্তাবাহক এবার খানিকটা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে, মনে হয় যেন সে এসবের সাথে খুব একটা অভ্যস্থ নয়, মুখ নিচের দিকে রেখে নিজেকে ভূমিতে শায়িত করে, প্রথাগত অভিবাদনের রীতি কুর্ণিশের অনুসারে দুই হাত দুপাশে ছড়ানো। কালো পাগড়ির নিচে, জাহাঙ্গীর দগদগে-লাল ত্বক দেখতে পায়। বার্তাবাহক একজন ইউরোপীয়।

‘আপনি এবার উঠে দাঁড়াতে পারেন, ভালোভাবে দেখার জন্য সামনের দিকে ঝুঁকে এসে, তিনি বলেন। লোকটা নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে এবং নিজের মাথা তুলতে জাহাঙ্গীর রোদে পোড়া একটা তরুণ মুখাবয়বের মাঝে একজোড়া নীল চোখ দেখতে পান। এই চোখ তার পরিচিত কিন্তু তাঁর মন তখনও মাদকের নেশায় আংশিকভাবে আচ্ছন্ন থাকায় তিনি বার্তাবাহকের দিকে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। কে তুমি?

‘অধমের নাম নিকোলাস ব্যালানটাইন। আমি একসময় মোগল দরবারে ইংল্যান্ডের রাজার প্রেরিত রাজদূত স্যার টমাস রো’র ব্যক্তিগত সহচর ছিলাম। নিকোলাস তাঁর কথা শেষ করার মাঝেই সে নিজের ডান পা সামনের দিকে প্রসারিত করে সামান্য নতজানু হলে জাহাঙ্গীরের মনে পড়ে যে স্যার টমাস প্রায়ই এমন ভঙ্গি করতেন। সেসব এখন যেন কয়েক যুগ আগের কথা মনে হয়… রো’র সাথে অতিবাহিত সন্ধ্যাবেলার কথা ভেবে জাহাঙ্গীরের মনটা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে।

‘আমি এখন আপনার সন্তান যুবরাজ খুররমের সহচর, তিনি আমার উপর বিশ্বাস করে মহামান্য সম্রাটের জন্য একটা চিঠি পাঠিয়েছেন। নিকোলাস তাঁর কাঁধে ঝুলতে থাকা উটের চামড়ার তৈরি লাল রঙের থলের ভেতর থেকে চিঠিটা বের করে। জাহাঙ্গীর দেখতে পায় উত্তেজনার কারণে তাঁর আঙুল মৃদু কাঁপছে যদিও সে যখন তাঁর উদ্ভট বাচনভঙ্গিতে ফার্সীতে কথা বলে তাঁর কণ্ঠস্বর স্পষ্ট আর সংযত শোনায়।

‘বদমাশটা কি বলার মত ধৃষ্টতা দেখিয়েছে আমি সেটা নিজে পড়ে দেখতে আগ্রহী, জাহাঙ্গীর তাঁর উজির মাজিদ খানকে ইঙ্গিত করতে, তিনি জাহাঙ্গীরের বেদীর ডানপাশে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখান থেকে সামনের দিকে এগিয়ে আসেন এবং তাকে দেবার জন্য নিকোলাসের হাত থেকে চিঠিটা গ্রহণ করেন। জাহাঙ্গীর ধীরে ধীরে সীলমোহর ভাঙেন, চিঠিটা খোলেন এবং মুক্তার মত ঝরঝরে হস্তাক্ষরে লেখা ঘন সন্নিবদ্ধ পংক্তির দিকে তাকান। তাঁর নিজের আব্বাজান মহামতি আকবর–যিনি নিজে লিখতে বা পড়তে অপারগ ছিলেন–খুররমের মার্জিত লিপিকলার জন্য গর্বিত ছিলেন। তিনি সহসা মানসপটে আকবরকে দেখতে পান প্রথমদিন মক্তবে যাবার সময় লাহোরের রাস্তা দিয়ে চার বছরের খুররমকে বহনকারী হাতি নিয়ে বিজয়দৃপ্ত শোভাযাত্রা সহকারে এগিয়ে যাচ্ছেন যখন পুরোটা সময় তিনি নিজে একপাশে কেবল দাঁড়িয়ে ছিলেন, নিজের জন্মদাতা পিতা আর আপন সন্তান উভয়ের কাছেই সেই মুহূর্তে তিনি ছিলেন অনুপস্থিত।

তার মাথা যেন যন্ত্রণায় ছিঁড়ে পড়তে চাইছে কিন্তু নিরবে এবং ধীরে পড়তে শুরু করে, তিনি নিজেকে মনোনিবেশ করতে বাধ্য করেন চিঠিতে কি লেখা রয়েছে সেটা বোঝার জন্য।

আব্বাজান, কোনো কারণবশত যা আমার বোধগম্যতার অতীত, আপনার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবার এবং আমার বিরুদ্ধে আপনার ক্রোধের উদ্রেক ঘটাবার দুর্ভাগ্য আমায় বরণ করতে হয়েছে। আপনি আমায় ত্যাজ্য করেছেন। আমায় বন্দি করার জন্য আপনি সেনাবাহিনী প্রেরণ করেছেন এমনকি আমায় অপরাধী ঘোষণা করে আপনি আপনা সাম্রাজ্যের সবাইকে আমাকে হত্যা করার অধিকার দিয়েছেন। আমি আপনার কাছে এসবের কারণ জানতে চাই না। আপনি একজন সম্রাট যার নিজের সাম্রাজ্য নিজের পছন্দমত শাসন করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু আমি আমার জন্মদাতা পিতা আর সেই সাথে আমার সম্রাট হিসাবে আপনার কাছে এই আবেদন করছি। আপনাকে ক্রুদ্ধ করার মত কোনো কিছু আমি হয়তো করেছি সেজন্য আমি দুঃখিত এবং আমি নিজেকে আপনার করুণার কাছে সমর্পণ করছি। আমার স্ত্রী আর সন্তানেরা এই যাযাবর জীবন আর সহ্য করতে পারছে না, বিশেষ করে কোথায় বা আদৌ আমরা নিরাপত্তা খুঁজে পাবো সেটাই যখন অজানা। আমার জন্য যদি নাও হয়, তাঁদের কথা বিবেচনা করে হলেও, আমি আপনার কাছে মিনতি করছি আমাদের বিরোধ নিষ্পত্তির একটা সুযোগ দেওয়া হোক। আপনি আমাকে যে আদেশ দেবেন আমি সেটা অবশ্যই পালন করবো–সাম্রাজ্যের যে প্রান্তেই আপনি আমাকে পাঠাতে চান আমি সেখানেই যেতে প্রস্তুত–কিন্তু আমাদের মাঝে বিদ্যমান এই বিরোধ সমাপ্ত করেন। আমি নিজের নামে এবং আমার পুরো পরিবারের নামে কসম করে বলছি যে আমি আপনার অনুগত আর বাধ্য সন্তান। আমায় অন্ধকারাচ্ছন্নতা থেকে আপনার ক্ষমার সূর্যালোকে ফিরিয়ে নিন।

জাহাঙ্গীর চিঠিটা নামিয়ে রাখে এবং নিজের সামনের দিকে চোখ তুলে তাকায়। তার অমাত্যদের সবাই তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তাদের কৌতূহলের তীব্রতা তিনি অনুভব করতে পারেন। তিনি আবারও দৃষ্টি নত করে চিঠিটা দেখেন। আপনি একজন সম্রাট যার নিজের সাম্রাজ্য নিজের পছন্দমত শাসন করার অধিকার রয়েছে। খুররম কি আসলেই কথাটা বোঝাতে চেয়েছে?

‘যুবরাজ খুররম আমার অনুগ্রহ ভিক্ষা করেছে, জাহাঙ্গীর অবশেষে বলেন এবং নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সারিবদ্ধ অমাত্যদের মাঝে একটা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়তে দেখেন, আমি আমার সিদ্ধান্ত বিবেচনা করবো। তার সামনে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকা নিকোলাসের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত নেয়ার পরে তোমায় ডেকে পাঠাব।’ তারপরে, খানিকটা কম্পিত ভঙ্গিতে এবং তখনও খুররমের চিঠি আঁকড়ে ধরে রেখে তিনি নিজের সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়ান, বেদী থেকে নেমে আসেন এবং মন আর মানসিকতায় একটা বিক্ষোভ নিয়ে দরবার ত্যাগ করেন।

*

হেরেমে নিজের কক্ষে জাহাঙ্গীরের আগমনের অপেক্ষায় প্রতিক্ষারত মেহেরুন্নিসা একাকী পায়চারি করে সে খুব ভালো করেই জানে তিনি আসবেন। খুররম চিঠিতে আসলেই কি লিখেছে? সে জানবার জন্য ছটফট করে কিন্তু একই সময়ে খানিকটা শঙ্কিতও বোধ করে। খুররম তার আব্বাজানের সাথে বিরোধের প্রথম মাসগুলোতে যে চিঠিগুলো লিখেছিল সেগুলোর মত এটাও যদি সে কোনোমতে অভিগ্রহণ করতে পারতো। খুররম চিঠিতে যাই লিখে থাকুক, সে খুব ভালো করেই দেখেছে তার চিঠি পেয়ে জাহাঙ্গীর ঠিক কতটা আবেগতাড়িত হয়েছেন। খুররমের প্রতি প্রচণ্ড ক্রোধ যা পুরো বিষয়টা তার জন্য সহজ করে দিয়েছিল তাকে অপরাধী ঘোষণা করতে সম্রাটকে রাজি করাতে প্রশমিত হতে আরম্ভ করেছে। শারীরিক আর মানসিকভাবে জাহাঙ্গীর বৃদ্ধ হচ্ছেন। বার্ধক্যের শীতল বাতাসের প্রথম ঝাপটা যখন পুরুষের উপর বইতে শুরু করে তখন তাদের মাঝে কখনও কখনও যখন সময় রয়েছে তখন নিজেদের জীবনের ভুলগুলি শুধরে নেয়ার একটা আকাঙ্খ জন্মে। জাহাঙ্গীর হয়ত নিজের মনের গহীনে খুররমের সাথে বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন।

দুই মাস পূর্বে, সুরার প্রভাবজনিত চিত্তবৈকল্যের কারণে উচ্চস্বরে প্রলাপ বকতে বকতে পারভেজের মৃত্যু তাকে প্রচণ্ড দুঃখ দিয়েছে, তিনি নিজেই নিজের সুরা আর মাদক সেবনের পরিমাণ সম্পর্কে অনেক বেশি সতর্ক হয়ে উঠেছেন আর সম্ভবত তার অন্যান্য সন্তানদের ভুলগুলোর প্রতিও তাঁর মনোভাব অনেকবেশি নমনীয় হতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক সময়গুলোয় তিনি বেশ কয়েকবার খসরুর বন্দিদশার কঠোরতা হ্রাস করার বিষয়ে আলোচনা করেছেন…

মেহেরুন্নিসা বাইরে পায়ের শব্দ আর কণ্ঠস্বর শুনতে পায় হুশিয়ার সম্রাট আসছেন। তারপরে তুতকাঠের উপর গজদন্তের কারুকাজ করা দুই পাল্লার দরজা খুলে যায়। জাহাঙ্গীর তার কক্ষে প্রবেশ করা মাত্র সে তার দিকে দৌড়ে যায় এবং তাঁর হাত ধরে। আপনাকে অসুস্থ আর বিব্রত দেখাচ্ছে। বা-দৌলত এমন কি লিখেছে যা আপনাকে এতটা বিপর্যস্ত করে তুলেছে? তুমি নিজে তাঁর চিঠিটা পড়ে দেখো।

মেহেরুন্নিসা তাঁর হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে দ্রুত সেটায় চোখ বুলায়। ‘খুররম খুব ভালো করেই মহবত খানের বিরুদ্ধে সে কোনো রকম প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারবে না তাই সে আপনার কাছে এমন ইনিয়ে বিনিয়ে চিঠি লিখেছে। সে যদিও আপনার করুণা ভিক্ষা করেছে কিন্তু তারপরেও সে এখনও তার দোষ স্বীকার করে নি। এই দেখেন সে কি লিখেছে।’ মেহেরুন্নিসা নিজের মেহেদী রঞ্জিত হাতের আঙুলের অগ্রভাগ একটা পংক্তির উপর রাখে কোনো কারণবশত যা আমার বোধগম্যতার অতীত, আপনার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবার এবং আমার বিরুদ্ধে আপনার ক্রোধের উদ্রেক ঘটাবার দুর্ভাগ্য আমায় বরণ করতে হয়েছে। সে এখনও অহঙ্কার আর ছলনা ভুলেনি। আপনি না চিঠির বক্তব্য অনেকটাই যেন সেই বরং আপনাকে ক্ষমা করছে।

“কিন্তু সে যদি সত্যিই আন্তরিকভাবে আপোষ করতে চায়, জাহাঙ্গীর যুক্তি দেখাতে চেষ্টা করে, আমার বোধহয় বিষয়টা বিবেচনা করে দেখা উচিত। মহবত খান আমার সেরা সেনাপতিদের একজন–আমি সেজন্যই খুররমকে বন্দি করার জন্য তাকে মনোনীত করেছিলাম–আর আমাদের গুপ্তচরেরা যেমন সংবাদ এনেছে যে পারস্যের শাহ আরো একবার কান্দাহার আক্রমণের পরিকল্পনা করছে সেটা যদি সত্যি হয় পারস্যের বাহিনী আক্রমণ করে সেক্ষেত্রে আমি পারস্যের বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রেরণের জন্য তার বাহিনীকে প্রস্তুত অবস্থায় পাবো। সে নিজে একজন পার্সী এবং শাহের প্রাক্তন সেনাপতি হবার কারণে সে তাদের কৌশল আর চিন্তাধারার সাথে বেশ ভালোভাবেই পরিচিত। আর তাছাড়া আমার সন্তানকে পুনরায় আমার কর্তৃত্বের প্রতি বশ্যতা প্রদর্শন করতে দেখলে, স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আনুগত্য প্রদর্শন করছে, আমার সম্মান অনেকটাই বৃদ্ধি করবে।’

মেহেরুন্নিসা তাঁর স্বামীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সে বহুদিন তাকে এমন স্পষ্টভাষায় কথা বলতে শোনেন নি। সে যদিও মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে শেষ পর্যন্ত সে যা চাইবে সেদিকেই তাকে সে নিয়ে যেতে পারবে, সম্ভবত তিনি ঠিকই বলছেন। একটা পরিবর্তনের সময় বোধহয় হয়েছে। সে জাহাঙ্গীরকে এইমাত্র যা বলেছে তারপরেও কোনো নিশ্চয়তা নেই যে মহবত খান, যোগ্য আর দক্ষ সেনাপতি হিসাবে তাঁর যতই সুনাম থাক, তিনি খুররমকে বন্দি করতে পারবেন, সে যতদিন বিদ্রোহী থাকবে ততদিনই সে জাহাঙ্গীরের জন্য তাঁর নিজের আর শাহরিয়ার এবং লাডলিকে নিয়ে তার পরিকল্পনার জন্য একটা হুমকি হয়ে থাকবে। খুররম নিজেও একজন দক্ষ আর যোগ্য নেতা। মহবত খানকে মোকাবেলা করতে সক্ষম এমন একটা বিশাল বাহিনী সে হয়ত গঠন করতে পারবে এই সম্ভাবনাকে কখনও উড়িয়ে দেয়া যায় না। সে গুজব শুনতে পেয়েছে যে মালিক আম্বার ইতিমধ্যে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে তার সাথে মৈত্রীর একটা প্রস্তাব দিয়েছে। সে হয়ত এমন একটা বাহিনী গঠনের অভিপ্রায়ে সাম্রাজ্য থেকে একেবারেই পালিয়ে যেতে পারে। পারস্যের শাহ ভৌগলিক ছাড়ের বিনিময়ে তাকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতে পারলে খুশিই হবে কোনো সন্দেহ নেই। খুররম যদি শাহকে কান্দাহার শহর যা তিনি ভীষণভাবে অধিকারের কামনা করেন। প্রত্যার্পণের প্রস্তাব দেয় তাহলে কি হবে? মোগল শাসকদের তাঁর নিজের দেশবাসী পূর্বে আরো দুবার সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছিল–প্রথমবার বাবর, দ্বিতীয়বার হুমায়ুন–প্রতিবারই তাঁদের কাঙ্খিত কোনো কিছুর বিনিময়ে।

‘তোমার কি মনে হয়? আমার কি রাজি হওয়া উচিত? জাহাঙ্গীর তার হাতের ব্যাঘের মস্তক খোদিত অঙ্গুরীয় যা একটা সময় তাঁর পূর্বপুরুষ মহান তৈমূরের হাতে শোভা পেত, অস্থির ভঙ্গিতে ঘোরাতে ঘোরাতে নাছোড়বান্দার মত জানতে চায়।

মেহেরুন্নিসার মস্তিষ্ক সহসা ঝড়ের বেগে চিন্তা করতে আরম্ভ করে কিন্তু তার অভিব্যক্তি শান্ত দেখায় যখন সে ধীরে কথা বলতে শুরু করে, আপনি সম্ভবত ঠিকই বলেছেন। বহুদিন ধরে এই বিরোধ চলছে এবং এর নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। আমার নিজের পরিবারের ভিতরেও এই বিরোধের ফলে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে যা আমার নিজের জন্যও অনেক দিন ধরেই কষ্টের একটা কারণ হয়ে উঠেছে। আমি জানি আমার ভাই আসফ খান কতটা খুশি হবে যদি এই দ্বন্দ্বের উপশম ঘটে। কিন্তু আমাদের যত্নের সাথে চিন্তা করতে হবে। আসুন এবং আমার পাশে বসুন।

জাহাঙ্গীর সবুজাভ-নীল রঙের একটা রেশমের তাকিয়ায় পিঠ ঠেকিয়ে মেহেরুন্নিসার পাশে আধশোয়া হতে, সে খুররমের চিঠিটা এমন ভঙ্গিতে পুনরায় হাতে তুলে নেয় যেন সে পুরো বিষয়টা বিবেচনা করতে আগ্রহী কিন্তু সে আসলে নিজে চিন্তা করার জন্য খানিকটা সময় নিতে চাইছে। তার মনে ইতিমধ্যেই একটা পরিকল্পনা রূপ নিতে শুরু করেছে কিন্তু তার নিজেকে আগে নিশ্চিত হতে হবে যে সে প্রতিটা আঙ্গিক বিবেচনা করেছে। খুররমকে সে কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারে না সে যদি একবার দরবারে ফিরে আসে ভালো করেই জানতে পারবে–যা সে করবেই–যে সেই ছিল তার আব্বাজানের ক্রোধের মূল উস্কানিদাতা আর ধারণকারী। সে অবশেষে নিজের প্রতিটা শব্দ যত্নের সাথে বাছাই করে মৃদু কণ্ঠে আর ধীরে কথা শুরু করে।

‘আমি প্রায়ই একটা বিষয় ভাবি কি পরিতাপের বিষয় যে খুররম উচ্চাকাঙ্খার দ্বারা নিজেকে এভাবে প্রলুব্ধ হবার সুযোগ দিয়েছে। সে এখন পর্যন্ত নিজের কর্মকাণ্ড দ্বারা একটা বিষয় নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছে যে শাসক হবার অধিকার খসরুর চেয়ে–বা বস্তুতপক্ষে হতভাগ্য পারভেজের চেয়ে যে সুরার প্রতি নিজের আসক্তি কখনও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি কোনোভাবেই তার বেশি প্রাপ্য নয়। কিন্তু তাঁর গুণ আছে এবং সে যদি আপনার প্রতি বাস্তবিকই অনুগত হয়ে থাকে তাহলে সাম্রাজ্যের মঙ্গলের জন্য তার গুণাবলী কেন নিয়োগ করা হবে না? আর আপনি একটু আগে যেমন বললেন, আপনি যদি তার সাথে উদারতাপূর্ণ আচরণ করেন তাহলে সেটা আপনার প্রতি প্রজাদের শ্রদ্ধাই কেবল বৃদ্ধি করবে।’

জাহাঙ্গীর মাথা নাড়ে, স্পষ্টতই খুশি হয়েছে। মেহেরুন্নিসা উৎসাহিত বোধ করে, কথা অব্যাহত রাখে। কিন্তু আপাতত তাকে কিছুদিন দরবার থেকে দূরে রাখাটাই হয়ত বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তাকে কোনো দুর্গম প্রদেশের রাজ্যপালের দায়িত্ব দেন। ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে অবস্থান করে কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসায় দ্বারা পুনরায় তাকে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে দেন। আপনি তারপরেই কেবল জানতে পারবেন যে তাঁর এই বশ্যতা স্বীকার ঠিক কতখানি আন্তরিক।’

‘আমি তাকে বালাঘাটের সুবেদার হিসাবে প্রেরণ করতে পারি…’

হিন্দুস্তানের মধ্যভাগের এই প্রত্যন্ত প্রদেশের নাম উল্লেখ করায় যেখান থেকে খুব কমই খাজনা পাওয়া যায়-যা নিশ্চিতভাবেই বিশাল একটা বাহিনীকে সুসজ্জিত করার জন্য যথেষ্ট নয়–মেহেরুন্নিসা হাসে। সে নিজেও এরচেয়ে উপযুক্ত কোনো প্রদেশের নাম ভাবতে পারে না। ‘চমৎকার একটা প্রস্তাব, সে বলে। বালাঘাট, কিন্তু সেই সাথে দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলো থেকে খুব একটা দূরে নয় যারা সবসময়ে আপনার জন্য সমস্যা সৃষ্টির চেষ্টা করে এসেছে। আপনার বিরুদ্ধে তাঁরা যুবরাজকে হয়তো বিদ্রোহী করার প্রয়াস নেবে। তারা বলছে যে যৌথ বাহিনী গঠন করার পরামর্শ মালিক আম্বার খুররমকে দিয়েছে।’

‘আমি হয়তো তার জন্য অন্য কোনো স্থান খুঁজে বের করবো? সেটা কাবুল হতে পারে?’ জাহাঙ্গীর তাঁর আব্বাজানের রক্ষিতা আনারকলিকে প্ররোচিত করার পরে সেখানে নিজের নির্বাসনের কথা ভেবে ক্ষণিকের জন্য হেসে উঠে। মেহেরুন্নিসাকে তখনই সে প্রথমবারের মত দেখেছিল।

না। কাবুল অনেকবেশি গুরুত্বপূর্ণ আর সমৃদ্ধশালী এলাকা, জাহাঙ্গীরের ভাবনা তাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে সে সম্বন্ধে উদাসীন, মেহেরুন্নিসা বলে। তাঁর ধৃষ্টতার জন্য এটা রীতিমত পুরষ্কার হিসাবে বিবেচিত হবে। বালাঘাট সেই তুলনায় অনেক ভালো। সে যদি সেখানে যায় তাহলে তাকে নিজের অহঙ্কার বিসর্জন দিতে হবে। কিন্তু আমাদের তার আগে নিশ্চিত হতে হবে সে আবারও বিদ্রোহ করার জন্য আগ্রহী হবে না।’

‘কিন্তু কীভাবে? তাঁর সম্বন্ধে খবর পাঠাতে গুপ্তচর প্রেরণ করা যায়।

না। গুপ্তচরদের কেনা সম্ভব। আমার ধারণা খুররম নিজেই হয়তো উত্তরটা দিতে পারবে। সে তাঁর চিঠিতে নিজের জীবনের কসম করে সে আপনার প্রতি নিজের আনুগত্যের কথা বলেছে–কিন্তু সেই সাথে সে নিজের পরিবারের কথাও বলেছে। আপনি সেটাই পরীক্ষা করে দেখেন।

কীভাবে?

আপনি আপনার ক্ষমার শর্ত হিসাবে তার বড় ছেলে দারা শুকোহকে দরবারে পাঠাবার আদেশ দেন–আর সেইসাথে দারার কোনো এক ভাই তার সাথে আসতে পারে।’

‘তুমি বলতে চাইছে বন্দি হিসাবে?’

‘হ্যাঁ, এক অর্থে দেখতে গেলে আপনি তাই বলতে পারেন। খুররমে ছেলেরা যদি আপনার কাছে থাকে তাহলে সে আপনার বিরুদ্ধে কোনো কিছু করার সাহস পাবে না।

‘আমি বিশ্বাস সেটা… কিন্তু তাকে তার সন্তানদের কাছ থেকে আলাদা করাটা কি ঠিক হবে? আমি আমার নিজের ছেলেবেলার অভিজ্ঞতা থেকে জানি পিতামাতার ভালোবাসা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।’ জাহাঙ্গীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে যেন পুরান একটা অন্ধকার ছায়া তাঁর মনের প্রান্তরে ভেসে উঠেছে।

তাঁদের সাথে ভালো আচরণ করা হবে এবং তারা তাদের দাদাজানের কাছে দরবারে অবস্থান করলে যেসব সুবিধা ভোগ করবে সেটার কথাও বিবেচনা করবেন। আর খুররম যদি সত্যিই চিঠিতে যা লিখেছে সেটা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের প্রশ্নই উঠবে না।’

জাহাঙ্গীর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। মেহেরুন্নিসা বুঝতে পারে তার পরামর্শ তাকে বিস্মিত করেছে, সম্ভবত তাকে চমকে দিয়েছে, কিন্তু তিনি যখন বিষয়টা নিয়ে ভাবতে শুরু করবেন তিনি অবধারিতভাবে এর মাঝে বিচক্ষণতার ছায়া দেখতে পাবেন। সে নিজে যতই বিষয়টা নিয়ে ভাবে, ততই তার ধারণাটা পছন্দ হয়, যদিও তাকে একটা বিষয় নিশ্চিত করতে হবে যে বস্তুতপক্ষে জাহাঙ্গীর যেন তার নাতিদের খুব বেশি একটা দেখতে না পায়…

‘আমি কেবল আপনার বিষয় ভাবছি,’ জাহাঙ্গীরের আরেকটু নিকটে সরে এসে সে কিছুক্ষণ পরে বলে এবং নিজের মাথাটা তার কাঁধে রাখে। সে টের পায় তিনি প্রায়শই যেমন করে থাকেন ঠিক সেভাবে তাঁর লম্বা চুলে বিলি কাটতে শুরু করেছেন। খুররমের আচরণের কারণে আপনি যথেষ্ট দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়েছেন। কিন্তু আপনি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে রাজি হয়ে একজন মহান সম্রাটের ন্যায় ক্ষমাপ্রদর্শন করেছেন কিন্তু আপনাকে নিজের জন্যও সতর্ক থাকতে হবে। আমার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেন এবং আমি নিশ্চিত তাহলে সবকিছু আপনি যেমন চান সেরকমই হবে। খুররমকে আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করতে হবে এবং আপনি মহবত খান আর তার বাহিনীকে প্রত্যাহার করতে পারবেন তাকে অনুসরণ করা বন্ধ করে। অকৃতজ্ঞ আর বিদ্রোহী সন্তানদের কারণে আপনি ইতিমধ্যে অনেক সহ্য করেছেন। এসবের একটা সমাপ্তি হওয়া দরকার।’

জাহাঙ্গীর তার হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে নিজের চোখ কচলায় তারপরে সে হাসে যদিও সেটা একটা বিষণ্ণ আর ক্লান্ত হাসি। আমি নিশ্চিত, তুমি ঠিকই বলেছো। তুমি সবসময়ে তাই বলে থাকো। আগামীকাল আমি আমার মন্ত্রণাদাতাদের ডেকে পাঠাব এবং তাদের আমার সিদ্ধান্ত জানাব। খুররমের সাথে বিরোধ নিষ্পত্তি হলে ভালোই হয়। আমি আমার নাতিদের সঙ্গ উপভোগই করবো। দারা শুকোহ নিশ্চয়ই এতদিনে অনেকটাই বদলে গিয়েছে।

*

পরের দিন সকালবেলা, নিকোলাস জাহাঙ্গীরের ব্যক্তিগত কক্ষে যাবার আদেশ লাভ করে। আগ্রায় পৌঁছাবার পর থেকেই সে খসরুর হুশিয়ারি স্মরণ করে আতঙ্কিত হয়ে রয়েছে। কিন্তু অনাকাঙ্খিত কিছুই এখনও ঘটেনি এবং সে নিরাপদে জাহাঙ্গীরের হাতে তাঁর চিঠিটা পৌঁছে দিয়েছে।

নিকোলাসকে একজন কর্চি যখন পথ দেখিয়ে একটা কক্ষে নিয়ে আসে সে জাহাঙ্গীরকে কক্ষের কেন্দ্রে নিজের রাত্রিবাস পরিহিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাঁর মাথার ধুসর চুল অবিন্যস্ত। নিকোলাসের মাথা নত করা অভিবাদনের প্রতি তিনি স্বীকৃতি দেয়ার সময় তাঁর ঝুলে পড়া মুখের মাঝে অতীতের সেই কর্তৃত্বপরায়ণতার একটা ছাপ ঠিকই ফুটে উঠে কিন্তু ইংরেজ দূত তাকে এখন যখন তাঁর একান্ত কক্ষে দেখে সে স্পষ্টই দেখতে পায় তিনি আর স্যার টমাস যখন পানাহারের সাথী ছিলেন আর সকাল না হওয়া পর্যন্ত সারারাত ভর গল্প করতেন সেই সময়ের তুলনায় তিনি কতটা বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন।

‘এটা আমার ছেলের কাছে নিয়ে যাও।’ জাহাঙ্গীর তার দিকে কারুকাজ করা একটা চামড়ার থলে এগিয়ে দেয়। তার চিঠির উত্তর ভেতরে রয়েছে। যত্ন করে রাখবে। আমি তোমার আর তোমার দেহরক্ষীদের জন্য তাজা ঘোড়ার বন্দোবস্ত করতে বলেছি যাতে তোমরা দ্রুত যেতে পারো।

‘জাহাপনাকে ধন্যবাদ।’ নিকোলাস থলেটা নেয়, জাহাঙ্গীর কি লিখেছেন জানবার জন্য তাঁর ভীষণ আগ্রহ হয়। সে এক মুহূর্ত ইতস্তত করে আশা করে যে জাহাঙ্গীর হয়ত তাকে কোনো ইঙ্গিত দেবেন কিন্তু সম্রাট ইতিমধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন এবং একজন পরিচারকের ধরে থাকা পানি ভর্তি রূপার পাত্রে মুখ প্রাক্ষালণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

জাহাঙ্গীর আধ ঘন্টা পরে একটা গবাক্ষ থেকে নিকোলাস আর তার দেহরক্ষীদের আগ্রা দূর্গ থেকে নিচে আগ্রার ঘিঞ্জি রাস্তার দিকে নেমে যাওয়া ঢালু পথ দিয়ে দুলকি চালে নামতে দেখে। তাঁর চিঠির প্রতি খুররমের প্রতিক্রিয়া কি হবে? তিনি ভাবতে চেষ্টা করেন। আর ঠিক তখনই আরেকটা ভাবনা প্রথমবাবের মত তার মনে উদিত হয়। আরজুমান্দ কীভাবে–তাঁর প্রিয় মেহেরুন্নিসার বংশের আরেকজন রমণী–প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে? সে কি নিজের সন্তানদের যেতে দিতে রাজি হবে নাকি খুররমকে অনুরোধ করবে বিষয়টা প্রতিহত করতে?

২.০৫ চরম মূল্যশোধ

‘মহবত খান আপনাকে পরাজিত আর বন্দি করার জন্য তার সাধ্য অনুযায়ী সবকিছু করবে।’ আজম বকস জ্বলন্ত কয়লার পাত্রে গুতো দেয় এবং খুররমকে তাঁর তেপায় নিয়ে আরেকটু নিকটে উষ্ণতার কাছে আসতে ইঙ্গিত করে। শরতকাল সমাগত প্রায় এবং পাহাড়ের উপর দিয়ে উত্তরপশ্চিম দিক থেকে ইতিমধ্যেই শীতল বাতাস প্রবাহিত হতে শুরু করায় তারা দু’জনে, গান্ধক নদীর তীরে মাটির ইটের তৈরি দূর্গের প্রাঙ্গণে যেখানে বসে রয়েছে যেখানে আজম বকস খুররম আর তার পরিবারকে আশ্রয় দিয়েছে, সামান্য কাঁপতে থাকে।

‘মহবত খানকে আপনি চেনেন? খুররম খানিকটা বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চায়। আজম বকস একজন বৃদ্ধ মানুষ–সত্তরের অনেক উপরে তাঁর বয়স–আর যুবক বয়সে তিনি আকবরের বাহিনীতে যুদ্ধ করেছেন।

‘কেবল তাঁর নামে চিনি। তারা বলে লোকটা নাকি জাত সেনাপতি, অকুতোভয় আর বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান আর সেই সাথে উচ্চাকাঙ্খী। তাঁর এমনই গুণ যে তাঁর রাজপুত অশ্বারোহীরা সে যদিও তাদের গোত্রের লোক না তবুও আমৃত্যু তাঁর প্রতি আনুগত্যের শপথ নিয়েছে।’

খুররম অপলক দৃষ্টিতে গনগনে কয়লার মাঝে তাকিয়ে থাকে। সেদিনই সকালে আজম বকসের কয়েকজন লোক এসে যখন জানিয়েছে যে মহবত খানের অগ্রবর্তী বাহিনী মাত্র চার সপ্তাহ দূরে অবস্থান করছে সে রীতিমত বিস্মিত হয়েছে। সে আশা করেছিল এখানে সে কিছুদিন নিরাপদে অবস্থান করতে পারবে। তার ছেলেবেলার স্মৃতিতে আবছা মনে থাকা এই বৃদ্ধ যোদ্ধার কাছ থেকে পাটনার উত্তরে তাঁর পৈতৃক শক্তঘাঁটিতে আশ্রয়ের আমন্ত্রণ লাভ করা তাঁর জন্য ছিল স্বাগত বিস্ময়। সে হুগলী ত্যাগ করার এক সপ্তাহ পরে আজম খানের লোকজন তাকে খুঁজে পায়। বৃদ্ধ লোকটা তাঁর চিঠিতে জানায় যে তিনি খুররমের দুরবস্থা সম্বন্ধে জানেন এবং আকবরের স্মৃতির খাতিরে, যাকে তিনি শ্ৰদ্ধ করেন, জানেন যে খুররম তার প্রিয় নাতি ছিল, তিনি তাকে সাহায্য করার প্রস্তাব করছেন। খুররম সাথে সাথে রওয়ানা দিয়েছিল যা তাকে হুগলীর প্রায় দুইশ মাইল উত্তরে নিয়ে আসে। কিন্তু আরো একবার মনে হচ্ছে এই আশ্রয়ও ক্ষণস্থায়ী প্রতিপন্ন হতে চলেছে। মহবত খানের বাহিনীর বিরুদ্ধে এই ছোট দূর্গ কোনো প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারবে না। সে তার বন্ধুকে কোনোভাবেই বিপদে ফেলতে পারে না। কিন্তু আসল প্রশ্ন হল মহবত খানের বাহিনী এখনও কেন তাকে অনুসরণ করছে।

‘আমি আশা করেছিলাম আমার আব্বাজান মহবত খানকে ডেকে পাঠাবেন। আমি আমার বার্তাবাহককে আগ্রা পাঠাবার পরে প্রায় দুই মাস অতিবাহিত হতে চলেছে।

‘আপনার বার্তাবাহক কি বিশ্বস্ত?

‘হ্যাঁ। আমি নিশ্চিত সে বিশ্বস্ত। কিন্তু আগ্রার পথে তাকে অনেক বিপদের সম্মুখীন হতে হবে এবং সে সম্ভবত কখনও সেখানে পৌঁছাতেই পারে নি। সম্রাজ্ঞী হয়ত আমার অভিযান সম্পর্কে আগেই জানতে পেরেছিলেন এবং তাকে অভিগ্রহণের জন্য আততায়ীর দল প্রেরণ করেছেন। সে হয়ত দস্যুবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে বা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমার হয়ত একজন ইউরোপীয়কে পাঠান উচিত হয় নি। আমাদের চেয়ে তারা অনেক অল্পতেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। সবকিছু যদি ঠিকমত সংগঠিত হতো তাহলে এতদিনে তার আমাকে খুঁজে পাবার কথা। মহবত খান যদি আমাকে অনুসরণ করা অব্যাহত রাখে তাহলে আমার গন্তব্য মোটেই গোপন কোনো ব্যাপার নয় আর তাছাড়া অনেকেই হুগলী থেকে এদিকে আমার বাহিনীকে আসতে দেখেছে। খুররম মুখ তুলে রাতের আকাশের উজ্জ্বল তারকারাজির দিকে তাকায়। মাথার উপরের এই রহস্যময় আর অনন্ত বিস্তারের কাছে মানুষের জীবন কত নগণ্য আর ক্ষণস্থায়ী…

‘এতটা বিষণ্ণ হবেন না। আজম খানের কর্কশ কণ্ঠস্বরে তার ভাবনার রেশ ছিন্ন হয়। সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি। আমার বহুবছরের অভিজ্ঞতা একটা জিনিষ অন্তত আমায় শিখিয়েছে–ধৈর্যধারণ করতে। সবকিছু এখনও হয়ত ঠিক হয়ে যাবে।’

খুররম মাথা নাড়ে কিন্তু সেটা কেবল ভদ্রতার খাতিরে। তাঁর পক্ষে ধৈর্যধারণ করা সম্ভব না বিশেষ করে তার নিজের এবং তাঁর পরিবারের জীবন যখন বিপজ্জনভাবে ভারসাম্যে বিরাজ করছে।

*

কিন্তু দুইদিন পরে, আজম বকসের ধারণাই সঠিক প্রমাণিত হয়। খুররম আরজুমান্দের সাথে বসে থাকবার সময় সহসা নতুন লোকের আগমন ঘোষণা করে দূর্গের ছোট তোরণদ্বার থেকে ঢোলের শব্দ ভেসে আসতে শুনে। সে লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সংকীর্ণ সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নিচের আঙিনার দিকে নামতে শুরু করে।

নিকোলাস ব্যালেনটাইন ঘোড়া থেকে নামছে। সে মুখ ঢেকে রাখা কাপড় সরাতে খুররম দেখে তাকে পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছে। তার চোয়ালের হাড় বসে গিয়েছে এবং তার গালে বেশ কয়েকদিনের না কামানো দাড়ির জঙ্গল।

‘যুবরাজ।

নিকোলাস যখন তাঁর সামনে হাঁটু ভেঙে বসতে যাবে খুররম দ্রুত তাকে বলে, ‘এসবের এখন কোনো প্রয়োজন নেই। আমায় বলো কি হয়েছিল। তুমি কি আব্বাজানের কাছে আমার পত্র পৌঁছে দিতে পেরেছিলে? তিনি কি উত্তর দিয়েছেন?

‘কোনো ঝামেলা ছাড়াই আমি আগ্রা পৌঁছাই যদিও আমি যেমনটা আশা করেছিলাম তার চেয়ে ধীর গতিতে অগ্রসর হই। সম্রাট দেওয়ানি আমে আমার সাথে দেখা করেন যেখানে বাস্তবিকই তিনি আপনার চিঠিটা পাঠ করেছিলেন। তিনি পরের দিন আমাকে এটা দিয়ে আপনার কাছে নিয়ে আসতে বলেন। নিকোলাস তার চামড়ার আঁটসাট জামার ভেতর হাত দিয়ে চামড়ার থলেটা বের করে যা জাহাঙ্গীর তার কাছে দিয়েছে। রাস্তায় কয়েক ঘন্টার জন্য ঘুমাবার সময়ও সে সবসময়ে এটার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সতর্ক থেকেছে, সবসময়ে থলেটা তার জামার ভেতরে বুকের কাছে গুঁজে রেখেছে। সে খুররমের হাতে থলেটা তুলে দেবার সময় বুঝতে পারে তার উপর থেকে একটা বোঝা নেমে গেল।

খুররম অস্থির আঙুল দিয়ে থলেটা খুলে, ভেতর থেকে চিঠিটা বের করে এবং পড়তে শুরু করে। নিকোলাস তার দিকে তাকিয়ে প্রথমে তাঁর চেহারায় খুশি, তারপরে বিভ্রান্তি এবং শেষে সেখানে ক্রোধের অভিব্যক্তি ফুটতে দেখে। সে একই সাথে খুররমকে দ্রুত শ্বাস নিতে শুনে এবং তাকিয়ে দেখে কীভাবে তার আঙুল কাগজটা দোমড়াতে শুরু করেছে। তারপরে সহসা নিকোলাস এবং তাঁর দেহরক্ষীদের এবং প্রাঙ্গণে উপস্থিত অন্যান্য পরিচারকদের উপস্থিতি সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠে, সবাই একাগ্রচিত্তে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে বুঝতে পেরে খুররম মনে হয় নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করে। তোমাকে ধন্যবাদ,’ সে মৃদু কণ্ঠে নিকোলাসকে বলে। তুমি একটা কঠিন দায়িত্ব আনুগত্যের সাথে আর দারুণভাবে সম্পন্ন করেছো। তোমার বিশ্রাম নেয়া হলে আমরা তখন আবার এ বিষয়ে আলোচনা করবো। আমি জানতে চাই দরবারে তোমার অবস্থানের সময় কি কি হয়েছিল কিন্তু তার আগে আমায় আমার স্ত্রীর সাথে দেখা করতে হবে।’

খুররম যখন ঘুরে দাঁড়িয়ে ছায়ার ভিতরে ফিরে এসে উপরের তলায় উঠে যাওয়া সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করে, নিকোলাসের কাছে তাকে তখন সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ মনে হয় যিনি কিছুক্ষণ আগে সূর্যালোকিত আঙ্গিণায় উদ্গ্রীব ভঙ্গিতে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর মাথা নত করা এবং তিনি ধীর পায়ে আরজুমান্দের কক্ষের দিকে এগিয়ে চলেছেন যেন তিনি সেখানে পৌঁছানোটা যতটা দেরি করা সম্ভব করতে আগ্রহী।

আরজুমান্দ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তোমার বার্তাবাহক দরবার থেকে ফিরে এসেছে, তাই না? খুররম মাথা নাড়ে এবং ধীরে ওক কাঠের পাল্লা যুক্ত দরজাটা নিজের পেছনে টেনে বন্ধ করে দেয় যাতে কেউ তাদের দেখতে না পায়।

‘খুররম, আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? আপনার আব্বাজান কি বলেছেন?

সে প্রথমে ইতস্তত করে, তারপরে বলতে আরম্ভ করে। আমি যদি বালাঘাটে আমার অবশিষ্ট লোকদের নিয়ে যেতে রাজি হই আমাকে সেখানের সুবেদার করা হয়েছে তাহলে আব্বাজান মহবত খান আর তার বাহিনীকে ডেকে পাঠাবেন। আমাকে সম্মতি দিতে হবে যে তিনি দরবারে ডেকে না পাঠান পর্যন্ত আমি সেখানে যাব না।’

আরজুমান্দের আড়ষ্ট মুখাবয়ব সহসা রক্তিম দেখায়। রাজকীয় মিনা বাজারে প্রথমবার সে যে লাজুক উচ্ছল মেয়েটাকে দেখেছিল তাকে পুনরায় সেরকম দেখায়। এটাতো ভীষণ আনন্দের কথা। তিনি আপনার সাথে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে সম্মত হয়েছেন। তিনি আপনাকে মার্জনা করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এটা অবশ্যই তারই ইঙ্গিত করে। এতগুলো বছর ভবঘুরের মত কাটাবার পরে আমি আর আমার সন্তানেরা অবশেষে এবার নিরাপদে থাকতে পারবো।’ সে দুহাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে কিন্তু খুররম যখন তাকে একই আবেগে জড়িয়ে ধরতে ব্যর্থ হয় সে তখন তাঁর গলা ছেড়ে দিয়ে কয়েক কদম পেছনে সরে আসে। কি ব্যাপার? আপনি কি এটাই আশা করছিলেন না? খুররম, আপনাকে কেন আনন্দিত দেখাচ্ছে না? আমাকে দয়া করে সব খুলে বলেন?

খুররম মনে মনে জাহাঙ্গীরের শীতল, সংক্ষিপ্ত, অপমানজনক শব্দগুলোর কথা ভাবে–পিতার কাছ থেকে পুত্রের কাছে মার্জনার কোনো বার্তা না বরং কোনো শাসকের কাছ থেকে অপকর্ম করা কোনো জায়গীরদারের কাছে প্রেরিত শর্তের তালিকা। আর এসব শর্তের ভিতরে যে শর্তটা এখনও মেনে নিতে তার কষ্ট হচ্ছে সেটাই তাকে এখন আরজুমান্দের কাছে খুলে বলতে হবে।

‘আমার সদাচারের নিশ্চয়তা হিসাবে, আব্বাজান দাবি করেছেন যে দারা শুকোহ আর তার এক ভাইকে আমায় দরবারে পাঠাতে হবে।

‘কি? আরজুমান্দ ফিসফিস কণ্ঠে বলে। সে নিজের মাথায় হাত দেয় যেন এইমাত্র কেউ তাকে সেখানে আঘাত করেছে এবং তারপরে সে ধীরে ধীরে লাল মলিন গালিচার উপর হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে। খুররম অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে সে যখন কাঁদতে শুরু করে। তার উচিত তাকে জড়িয়ে ধরা এবং কাছে টেনে নেয়া কিন্তু তাকে সে কীভাবে সান্ত্বনা দিতে পারে যখন সে নিজেও একই রকমের হতাশা বোধ করছে।

‘আমার আব্বাজান বলেছেন দুজনের সাথেই ভালো আচরণ করা হবে কিন্তু তোমার কাছ থেকে আমি সত্যি কথা গোপন রাখতে পারবো না। তারা আসলে বন্দি থাকবে সেটা যেভাবেই বলা হোক না কেন।

‘দারা শুকোহর বয়স এত অল্প… আমি বিষয়টা ভাবতেই পারছি না। আপনার আব্বাজান এতটা নিষ্ঠুর কীভাবে হতে পারেন? তিনি দারাকে একটা সময় ভালোবাসতেন… আমার মনে আছে দারার জন্মের সময় তিনি তাকে কি উপহার দিয়েছিলেন…’।

‘আমি নিশ্চিত আমার আব্বাজান আমার সন্তানদের কখনও কোনো ক্ষতি করবেন না। কিন্তু…’ সে কথা বন্ধ করে এবং আরজুমান্দের দিকে তাকায়, জানে সে বুঝতে পেরেছে।

হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখ থেকে অশ্রু মুছে নিয়ে এবং প্রাণপণে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবার চেষ্টা করতে করতে আরজুমান্দ কেবল একটা শব্দই কোনোমতে উচ্চারণ করে।

‘মেহেরুন্নিসা?

সে মাথা নাড়ে।

‘আপনার সত্যিই মনে হয় সে তাঁদের কোনো ক্ষতি করতে পারে।

খুররম মনে মনে ভাবে। সে মেহেরুন্নিসাকে যতটা ঘৃণা করে–এবং বিপরোয়া পরিস্থিতিতে তিনি কি করতে পারেন সেটা কে বলতে পারে?–তাতে সে কি তাকে ঠাণ্ডা মাথায় শিশু হত্যাকারী হিসাবে কল্পনা করতে পারে? না, আমার সেটা মনে হয় না, সে অবশেষে তাকে বলে। ‘আর সর্বোপরি, সে কেন এমনটা করবে? আমাদের সন্তানদের উপরে নিয়ন্ত্রণই তার জন্য যথেষ্ট। তিনি এটা জানার জন্য যথেষ্ট বুদ্ধি রাখেন যে তাঁদের প্রতি যেকোনো ধরনের বিরূপ আচরণ জনমতকে আঘাত করবে। আমাদের ঐতিহ্য–সেই তৈমূরের সময় কাল থেকে এটা চলে আসছে–সেটা হল অল্পবয়সী আর নির্দোষ যুবরাজদের জীবন পবিত্র জ্ঞান করা। তারা যখন বড় হয়ে বিদ্রোহ করে কেবল তখনই তারা কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হয়ে থাকে।

আরজুমান্দ ধীরে ধীরে নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং মুখের উপর থেকে খোলা চুলের গোছা সরিয়ে দিয়ে মন্থর পায়ে জানালার দিকে হেঁটে যায়। সূর্য অস্ত যাচ্ছে, দূরের গোলাপি পাহাড়ের চূড়া গোলাপিবর্ণ ধারণ করেছে। রাতের খাবার রান্না করার জন্য জ্বালান গোবরের আগুনের ঝাঁঝালো গন্ধ সে টের পায় এবং তাকিয়ে দেখে নিচের আঙিনায় রাতের প্রথম মশালের আলো জ্বলছে। সবকিছু কত স্বাভাবিক দেখাচ্ছে, সে ভাবে, অথচ তাদের সবার জীবন কেমন এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। একজন মা হিসাবে তার কি করণীয়? তাঁর দু’জন সন্তানকে সমর্পণ করে বাকিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা? সে এখন যে মানসিক যাতনা অনুভব করছে তাঁর সাথে সন্তান জন্ম দেবার কষ্টের কোনো তুলনাই হয় না।

‘আমাদের সামনে একটা পথ রয়েছে। আমরা আমার আব্বাজানের শর্ত উপেক্ষা করতে পারি। আমরা উত্তরে যাত্রা করতে পারি, পাহাড়ী এলাকায় যেখানে মহবত খানের পক্ষে আমাদের অনুসরণ করা কঠিন হবে…’

কিন্তু আরজুমান্দের মুখ সে যখন জানালা থেকে ঘুরে দাঁড়ায় কঠোর দেখায়। না। আপনি যদি আপনার আব্বাজানের প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন তাহলে তিনি কি বলবেন সেটা একবার ভেবে দেখেন যে তার কাছে আমাদের সন্তানদের-তার নাতিদের-বিশ্বাস করে প্রেরণ করতে আপনার অনিচ্ছার অর্থই হচ্ছে আপনি কখনও তার প্রতি অনুগত থাকতে চাননি। তিনি তখন প্রশ্ন করবেন একজন সম্ভাব্য অনুগত আর দায়িত্ববান সন্তান কেন নিজের সন্তানদের তাদের দাদাজানের কাছে পাঠাতে অস্বীকার করবে যদি না তার বিদ্রোহ করার কোনো অভিপ্রায় না থাকে। তিনি তখন আপনাকে গ্রেফতার করার জন্য দ্বিগুণ সৈন্য প্রেরণ করবেন আর আমাদের সন্তানদের তখন কি হবে?

একজন যুবরাজ আর একজন পিতা হিসাবে–যদিও তাঁর প্রথম সহজাত অভিপ্রায় ছিল–তাঁর আব্বাজানের প্রস্তাব প্রত্যাখান করা, কিন্তু আরজুমান্দ কি ঠিক কথাই বলেনি? খুররম চিন্তা করে, তাঁর বাক্য বিন্যাসের স্পষ্টতা আর তারমাঝে নিহিত সত্য তাকে চমকে দেয়। তাদের সামনে আসলে সত্যিই কি করার আছে? তাঁর সাথে মাত্র তিনশ লোক রয়েছে এবং নতুন সৈন্য নিয়োগের মত অর্থও তার নেই। সে যদি একা হত তাহলে প্রথম মোগল সম্রাট বাবরের মত সে একাকী লড়াই করতে পারতো, পাহাড়ে আশ্রয় নিয়ে চোরাগুপ্তা হামলার পাশাপাশি ভূখণ্ড অধিকার করার সুযোগের অপেক্ষা করতো। কিন্তু তাকে নিজের পরিবারের কথাও ভাবতে হবে…

সে এখন যখন অনেক শান্ত সুস্থির হয়ে চিন্তা করে সে দেখে যে জাহাঙ্গীরের প্রস্তাব দাবার জটিল চালের মত তাঁর আব্বাজানের অভিপ্রায়ে সাড়া দেয়া ছাড়া তাঁর সামনে আর কোনো পথই খোলা রাখেনি। জাহাঙ্গীর একটা সময় দাবা খেলতে পছন্দ করতো, কিন্তু খুব ভালো করেই জানে কার জটিল মন থেকে তাকে তার সন্তানদের সমর্পণ করার দাবি উত্থাপনের মত ধারণার জন্ম হয়েছে। সে মানসপটে দেখতে পায় মেহেরুন্নিসা তাঁর আঙুলের চারপাশে একগোছা কাল চুল নিয়ে খেলা করার ছলে হাসছেন এই ভেবে যে সে আর আরজুমান্দ কি করবে। মেহেরুন্নিসা অনেকটা মাকড়সার মত যে একটা বা দুটো মামুলি সুতো দিয়ে শুরু করে আরো জটিল একটা জাল বুনে ফেলে। তাঁর আব্বাজান বহু বছর আগেই সেই জালে আটকা পড়েছেন। একদিন, সে নিজের কাছে ওয়াদা করে, সে এই জাল ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করবে। সে নিজেকে, সেইসাথে তাঁর পরিবারকে এবং এমনকি তার আব্বাজানকেও–যদি না তিনি এরই মধ্যে মেহেরুন্নিসার জালে পুরোপুরি হারিয়ে না যেয়ে থাকেন–তাঁর বন্ধন থেকে মুক্ত করবে, মোগল সাম্রাজ্যকে আরো একবার উন্নতির সুযোগ দেবে। কিন্তু সেই সন্তুষ্টি কেবল ভবিষ্যতের গর্ভে লুকিয়ে রয়েছে। তাকে সবচেয়ে প্রথমে বর্তমানের দিকে নজর দিতে হবে।

‘তুমি ঠিকই বলেছো, সে কথা বলার সময় তার হৃদয়ের চারপাশে একটা ভার চেপে বসতে থাকে। সত্যি কথাটা–এবং আমার চেয়ে দ্রুত তুমি সেটা অনুধাবন করতে পেরেছো–আমাদের সামনে রাজি না হয়ে অন্য কোনো পথ নেই। কিন্তু দারা শুকোহর সাথে আমরা আমাদের অন্য কোনো সন্তানকে প্রেরণ করবো-শাহ সুজা না আওরঙ্গজেব?

‘আওরঙ্গজেব,’ আরজুমান্দ কিছুক্ষণ চিন্তা করে উত্তর দেয়। সে যদিও শাহ সুজার চেয়ে বয়সে এক বছরের ছোট কিন্তু সে শক্তিশালী–সে এখনও পর্যন্ত একদিনও অসুস্থ হয়নি–এবং সে নির্ভীক। সে এমনকি দরবারে যাবার সম্ভাবনায় উৎফুল্লও হতে পারে। আরজুমান্দের কণ্ঠস্বর সামান্য কেঁপে উঠে। তাঁদের কবে নাগাদ যেতে হবে?

‘আব্বাজান আমাকে আদেশ দিয়েছেন আমার সিদ্ধান্ত পাটনার সুবেদারের কাছে সাথে সাথে জানাতে যিনি রাজকীয় অশ্বারোহী বার্তাবাহকদের সাহায্যে আমার চিঠি দ্রুত আগ্রা প্রেরণের বন্দোবস্ত করবেন। আমরা যদি তাঁর প্রস্তাব মেনে নেই তাহলে কড়া প্রহরায় আমাদের সন্তানদের এলাহাবাদে প্রেরণ করতে হবে যেখানে তিনি তাঁর লোকদের পাঠাবেন তাঁদের স্বাগত জানাতে। আমাদের অবশ্যই তাদের দ্রুত প্রস্তুত করতে হবে। দারা শুকোহ বড় হয়েছে সে এটা বুঝতে পেরেছে যে আমার আর আমার আব্বাজানের মাঝে বিরোধ রয়েছে। আমাদের অবশ্যই তাকে বলতে হবে যে আমরা আমাদের বিরোধ মিটিয়ে ফেলেছি এবং তাদের দাদাজান তাঁদের দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে রয়েছেন। আমরা কতটা বিপর্যস্ত সেটা আমরা তাদের সামনে প্রকাশ করবো না…

২.০৬ সুবিধাবাদী শয়তান

মহবত খান ক্লান্ত-দর্শন রাজকীয় অশ্বারোহী বার্তাবাহকের হাত থেকে চামড়ার তৈরি বার্তার থলিটা গ্রহণ করে যে মাত্র পাঁচ মিনিট আগে খুররমকে মোকাবেলার উদ্দেশ্যে ধূলোর মেঘের আড়ালে অগ্রসরমান সৈন্যদলের সাথে এসে যোগ দিয়েছে। মহবত খান চামড়ার জীর্ণ থলিটা খুলে ভেতরে রক্ষিত একমাত্র চিঠিচা বের করেন এবং সবুজ সীলমোহর ভাঙেন। চিঠিটায় দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে তিনি তাঁর যা জানার জেনে নেন। সীলমোহরটা যদিও জাহাঙ্গীরের কিন্তু চিঠির লেখাটা মেহেরুন্নিসার, তাকে প্রদত্ত আদেশের ক্ষেত্রে প্রায়শই যা হয়ে থাকে। তাঁর চিঠির ভাষা কঠোর: বদমাশটার বোধোদয় ঘটেছে এবং শর্ত মেনে নিয়েছে, তাঁর ভবিষ্যতের ভালো ব্যবহারের নিশ্চয়তা স্বার্থে নিজের দুই ছেলেকে আমাদের তত্ত্বাবধানে প্রেরণে সম্মত হয়েছে। আপনার অভিযান সমাপ্ত হয়েছে। আগ্রায় ফিরে আমার পরবর্তী আদেশের জন্য অপেক্ষা করেন যা আমরা কাশ্মীর পৌঁছাবার পরে প্রেরণ করা হবে। মেহের। চিঠি লেখার স্থান আর তারিখ এরপরে দেয়া রয়েছে–লাহোর।

মহবত খান চিঠির কাগজটা নিজের হাতের মুঠোর মুচড়ে নিয়ে ভাবে, কোনো সামান্যতম ধন্যবাদজ্ঞাপন বা শুভেচ্ছার একটা শব্দও নেই। ‘কোনো উত্তর দেয়ার প্রয়োজন নেই, সে বার্তাবাহককে বলে, কেবল মামুলি প্রাপ্তিস্বীকার যে আমি আদেশ পেয়েছি। তার পাশে অবস্থানরত আধিকারিকের দিকে তাকিয়ে–খয়েরী রঙের ঘোড়ায় উপবিষ্ট, অশোক নামের এক সুঠামদেহী তরুণ রাজপুত–সে বলে, ‘সম্রাট–বা বলা যায় সম্রাজ্ঞী–আমাদের ফিরে যাবার নির্দেশ দিয়েছেন। অভিযান সমাপ্ত হয়েছে। আমরা এখানেই যাত্রাবিরতি করে আজ রাতের মত শিবির স্থাপন করবো। তারপরে, গলার স্বর মোলায়েম করে, সে তার একজন পরিচারকের উদ্দেশ্যে বলে, বার্তাবাহক যেন ভালো করে খাবার আর বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ পায় আর সেই সাথে সে ফিরতি পথে যাত্রা শুরু করার সময় তাকে যেন তাজা ঘোড়া দেয়া হয় সে বিষয়টা নিশ্চিত করবে।

*

মহবত খান সেই রাতে ভালো করে ঘুমাতে পারেন না, তার তাবুর অভ্যন্তরভাগ গরম আর বায়ুহীন সেটাই একমাত্র কারণ না–তাবুর ভেতরটা আসলেই সেরকম–বা তিনি তাঁর স্বদেশের সুরা সিরাজ নিজের কয়েকজন বয়োজ্যষ্ঠ সেনাপতিদের সাথে বসে প্রচুর পান করেছেন–সেটাও তিনি করেছেন–কিন্তু সেসব কারণে না তার ঘুম হয়না কারণ তিনি খানিকটা অসন্তুষ্টবোধ করেন যেভাবে সাংক্ষেপিক ভঙ্গিতে তাকে আর তার বাহিনীকে আগ্রা ডেকে পাঠান হয়েছে–এবং সেটাও ম্রাটের আদেশে নয়, তিনি চিন্তা করেন, সম্রাজ্ঞীর আদেশে। তাঁর অসন্তোষের বাড়তি আরেকটা কারণ এই যে তিনি অবশ্য পালনীয় আদেশজ্ঞাপক এই চিঠির মূল আরম্ভক। সে কল্পনা করে যদিও এবারই প্রথম নয় কেন সে সম্রাটের প্রতি তার আনুগত্যকে ব্যবহার করে তাকে একজন সাধারণ সৈন্যের মত এটা সেটা আদেশ দেয়ার সুযোগ কেন মেহেরুন্নিসাকে দেবে। খুররম আর তার মিত্রদের পরাস্ত করতে পারলে তার অনুসারীরা যে বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী হত সেটা থেকে এবার অযৌক্তিকভাবে তিনি তাকে আর তার লোকদের কেন বঞ্চিত করেছেন? এবং তিনি যদিও একজন মামুলি রমণী যদিও তিনি তার দেখা সবচেয়ে ধূর্ত আর হিসেবী মহিলা আর সেইসাথে তারই মত পারস্যের অধিবাসী।

তিনি যদিও সম্রাটকে–সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে পরাক্রমশালী মানুষ ভেড়য়া পোষা কুকুরে পর্যবসিত করেছেন কিন্তু সে নিজে তাঁর চেয়ে উন্নত বা নিদেনপক্ষে তাঁর সমকক্ষ সবক্ষেত্রে। তাঁদের দুজনের দেহেই যদিও পার্সী রক্ত প্রবাহিত কিন্তু পারস্যে তাঁর পরিবার অনেকবেশি অভিজাত হিসাবে স্বীকৃত। তাঁর চেয়ে কোনোভাবেই মেহেরুন্নিসার ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার এক্তিয়ার নেই। তিনি ধূর্ত হতে পারেন কিন্তু তিনি কোনোভাবেই তার চেয়ে বেশি ধূর্ত নন। তিনি তার মত কোনো সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দান করেন না এবং তাঁর পক্ষে সেটা সম্ভবও না। মহবত খান যতই নিজের সাথে তর্ক করে, সুতির চাদরের নিচে শুয়ে যতই গরমে মাথা নাড়ে এপাশ ওপাশ করে, ততই তার কাছে মনে হয় মেহেরুন্নিসার কর্তৃত্ব তাঁর আর সহ্য করা উচিত হবে না। খুররমের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আর উত্তরাধিকারী হিসাবে নিজের ভোঁতা বুদ্ধির জামাতা শাহরিয়ারকে প্রবর্ধন করে এখন যখন সুরা শেষ পর্যন্ত পারভেজের মৃত্যুর কারণ হয়েছে তখন সে নিজে তারই মত রাজকীয় ক্ষমতার একজন চৌকষ নিয়ন্তা। সে সম্ভবত ভুলই করেছে আরও আগেই হয়ত অসুস্থ সম্রাট আর তার হিসেবী, স্বার্থসিদ্ধিতে নিপূণা এবং রূঢ়ভাষী প্রধানা মহিয়ষীর বিরুদ্ধে তরুণ মহিমান্বিত খুররমের সাথে নিজের বাহিনী নিয়ে যোগ দেয়ার কথা ভাবা উচিত ছিল? অভিযানে প্রেরণ করার কারণে তারা উভয়েই দরবারে অনুপস্থিত থাকার মানে এই যে তার সাথে মাত্র একবারই খুররমের মুখোমুখি দেখা হয়েছে কিন্তু তিনি সব অর্থেই একজন ভালো আর উদার নেতা এবং মহবত খানের নিজস্ব বাহিনীকে তার এড়িয়ে যাবার সামর্থ্যই সেনাপতি হিসাবে তার দক্ষতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। খুররম এমনই আনুগত্যে উদ্বুদ্ধ করে যে তার দরবারে এবং দরবারের বাইরে এখনও অনেক অনুগামী রয়েছে যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা সবাই আত্মগোপন করে রয়েছে। তার এখন হয়তো পক্ষ পরিবর্তন করা উচিত? যুবরাজকে দীর্ঘ পশ্চাদপসারণের সময় তার সাথে খুররমের সমর্থকদের সংঘটিত বিচ্ছিন্ন লড়াই আর খণ্ডযুদ্ধ সবসময়েই যুদ্ধের রীতিনীতি মেনেই সংঘটিত হয়েছে। কোনো হত্যাযজ্ঞ, কোনো মৃত্যুদণ্ড, নিকট আত্মীয়ের মৃত্যু উভয়পক্ষের কোনো দিকেই ঘটেনি যার ফলে তিক্ত ঘৃণা বা দীর্ঘস্থায়ী জিঘাংসামূলক বিবাদের সূত্রপাত ঘটতে পারে।

রজনী অতিক্রান্ত হবার সাথে সাথে মহবত খানের আস্থর নড়াচড়া অব্যাহত থাকে, তার মন এখন ঘুমাবার পক্ষে অনেকবেশি সক্রিয়, তার মনে আরেকটা ভাবনার উদয় হয়। সে কি ক্ষমতার এই দ্বন্দ্বের ভিতরে নিজের জন্য আলাদা স্বাধীন একটা ভূমিকা তৈরি করতে পারে না? বার্তাবাহক আর তার আগে যারা এসেছিল তাঁদের কাছ থেকে সে জানতে পেরেছে যে বসন্তের এই সূচনালগ্নে সম্রাট আর সম্রাজ্ঞী অমাত্যদের বিশাল একটা দল আর সাথে মালবাহী বহর নিয়ে–তাঁদের সাথে বিশাল কোনো বাহিনী নেই–কাশ্মীরের অভিমুখে চলেছেন, খুররমকে সাফল্যের সাথে মোকাবেলা করার পরে তারা খুশি মনে ধরেই নিয়েছেন যে তাঁদের এই মুহূর্তে ভয় পাবার মত আর কোনো হুমকি নেই। তাদের যদি হিসাবে ভুল হয়ে থাকে তাহলে কি হবে এবং সে নিজে তাঁদের অনুগত, বশংবদও বলা চলে, যত রূঢ়ভাবেই দেয়া হোক না কেন সব আদেশ পালনকারী সেনাপতির ভূমিকা থেকে নিজেকে সম্রাজ্যের এবং সেই সাথে তাদের ভাগ্যের নিয়ন্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।

সম্রাট দম্পতি নয় বরং সেই কি তাদের নিয়ন্ত্রণ করার অবস্থানে নেই? সে আর তার অনুগত দশ হাজার সৈন্য যারা সবাই ব্যক্তিগত ভাবে তার প্রতি অনুগত সম্রাট আর সম্রাজ্ঞীকে অনুসরণ করতে শুরু করে এবং তাদের নিকট হতে খুররমের সন্তানদের ছিনিয়ে নেয় তাহলে কি হবে? এই মুহূর্তে মৈত্রী করার চেয়ে তখন কি সে খুররমের অনুগ্রহ লাভের জন্য সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে না? আরও ভালো হয়, যদিও সেটা আরও দুঃসাহসের কাজ হবে, সে আফিম আসক্ত সম্রাট আর তাঁর স্ত্রীকেও খুররমের সন্তানদের সাথে বন্দি করে, সে তাহলে উভয় পক্ষের সাথে আলোচনার শর্ত নির্ধারণের সুযোগ পাবে। তার অনুগ্রহ লাভ করতে সম্রাট আর খুররম একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করুক। সে যদি খুররমকে ধাওয়া করা অব্যাহত রাখে বা এই মুহূর্তে তার সাথে মৈত্রীর সম্বন্ধ স্থাপন করে তাহলে সে আর কত সম্পদ লুট করতে পারবে বা কত বেশি ক্ষমতার অধিকারী হবে? এমন একটা কৌশল মোটেই কল্পনা নয়। তাঁর দীর্ঘ সামরিক অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়েছে যে সবচেয়ে দুঃসাহসী আর অপূর্ববিদিত পরিকল্পনা অনেক সময় সবচেয়ে বেশি সাফল্য লাভ করে সম্ভবত তাঁদের অভিনবত্ব দ্বারা বিস্ময় আর আতঙ্ক সৃষ্টির কারণে। সে ভাবে পুরো বিষয়টাই ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু সে বিপদের মুখোমুখি হয়ে বা দীর্ঘ প্রতিকূলতা পরিহার করার পরিকল্পনা করার সময়েই সে কেবল বেঁচে রয়েছে বলে অনুভব করতে পারে। একজন সৈন্য হিসাবে এটাই তার প্রথম পরিচয়। আগামীকাল সকালে সে অবশ্যই নিজের লোকদের সাথে আলোচনা করবে কিন্তু তাদের আনুগত্য কিংবা পুরষ্কারের জন্য তাদের আকাঙ্খ সম্বন্ধে তার ভিতরে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর মন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। সে পুরো রাজকীয় দলকেই বন্দি করবে এবং সম্রাট তৈরি আর বিনাশের খেলা খেলবে। সিদ্ধান্ত নেয়ার কয়েক মিনিটের ভিতরে মশার ভনভন শব্দ আর গরম উপেক্ষা করে, মহবত খান গভীর, নিরপদ্রব নিদ্রায় তলিয়ে যায়।

*

জাহাঙ্গীর তার তাবুর পুরু গালিচার উপরে রেশমের বুটিদার কারুকাজ করা আবরণ দ্বারা আবৃত তাকিয়ার গায়ে আরেকটু আরাম করে নিজেকে স্থাপন করে। তিনি ভাবেন, তিনি বৃদ্ধ হচ্ছেন। রাজকীয় সৈন্যসারি–প্রায় এক মাইল দীর্ঘ–উত্তরপশ্চিম দিকে আরেকটা দিনের মন্থর অগ্রযাত্রা সমাপ্ত করার সময় হাওদায় প্রায় আটঘণ্টা অতিবাহিত করে তার সমস্ত শরীরের মাংসপেশী ব্যাথায় টনটন করছে। ঝিলম নদীর ফেনায়িত সবুজ স্রোতধারার দৃশ্য, তাদের কাশ্মীর পৌঁছাবার পূর্বে শেষ বিশাল অন্তরায়, প্রীতিকর। সেইসাথে অবশ্য সম্রাটের লাল তাবুও যা আগেই প্রেরণ করা হয়েছিল এবং ইতিমধ্যেই নদীর তীরে স্থাপিত হয়েছে।

‘আমরা অতিক্রম করা কত দ্রুত আরম্ভ করবো? মেহেরুন্নিসা, যে একটা নিচু তেপায়ার উপরে তার পাশেই বসে রয়েছে, জানতে চায়।

‘আমার আধিকারিকেরা জানিয়েছে পুরো বহরটার নদী অতিক্রম করতে দুই দিন, হয়তো আরও বেশি সময় লাগবে। তুমি দেখতেই পাচ্ছো, পাহাড় থেকে নেমে আসা বরফ গলা পানিতে ঝিলমের পানি কেমন স্ফীতি লাভ করেছে। সেতু নির্মাণ করতে একটু বেশি সময়ই লাগবে। তারা বলেছে আমরা দ্বিতীয় দিনের শুরুতে নদী অতিক্রম করবো।’

‘কোনো ব্যাপার না। আমাদের যাত্রা বিরতি করার স্থানটা ভালোই হয়েছে এবং আমাদের তাড়াহুড়ো করার কোনো প্রয়োজন নেই। সে নিজের মুখের উপর থেকে চুলের একটা গোছা সরায়। আপনি ক্লান্ত। আমি একটু পরেই পরিচারকদের আদেশ দেব হাম্মামখানায় আগুন জ্বালাতে যাতে আপনি গোসল করতে পারেন।

জাহাঙ্গীর মাথা নাড়ে এবং চোখ বন্ধ করে। তিনি কৃতজ্ঞ যে মেহেরুন্নিসা কাশ্মীর আসবার পরামর্শ দিয়েছিল। খুররমের সাথে বিরোধ অন্তত নিষ্পত্তি হয়েছে এবং রাজধানী আগ্রা থেকে এত দূরে ভ্রমণ করা এখন তার জন্য নিরাপদ। মাজিদ খানের নিকট হতে আগত শেষ বার্তা অনুসারে, খুররম বালাঘাট পৌঁছে গিয়েছে এবং সেখানের সুবেদার হিসাবে নিরবে নিজের কাজ আরম্ভ করেছে। মেহেরুন্নিসার আপত্তি সত্ত্বেও, সময়ই বলে দেবে, সে তার অংশের চুক্তির শর্ত রক্ষা করবে কি না জাহাঙ্গীর আশা যা সে করবে। নিজের দুই সন্তানকে সমর্পণ করাটা অবশ্যই তার সদাচারণের একটা নিদর্শন।

গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা এখন যখন এড়ান সম্ভব হয়েছে সীমান্তের ওপাশের শত্রুর কাছ থেকে তার ভয় পাবার সামান্যই কারণ রয়েছে যারা এতদিন মোগল সাম্রাজ্যের আভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার দিকে আশা নিয়ে তাকিয়ে ছিল ঠিক যেমন দূর থেকে শিয়াল আহত পশুর রক্তের গন্ধ টের পায়। তিনি আগ্রা ত্যাগ করার কিছুদিন পূর্বেই পারস্যের শাহের কাছ থেকে উপহার হিসাবে নিখুঁত কালো ছয়টা স্ট্যালিয়ন ঘোড়া এসেছে, সাথে ছিল অনন্ত বন্ধুত্বের স্বীকৃতি জ্ঞাপন করে একটা চিঠি। কিন্তু জাহাঙ্গীর খুব ভালো করেই জানেন যে শাহ যদি সামান্যতম সুযোগ আঁচ করতে পারতেন তিনি হিরাত, কান্দাহার কিংবা হেলমন্দ নদীর এবং তাঁর সীমান্তের নিকটবর্তী অন্য কোনো শক্ত মোগল ঘাঁটি দখল করতেন।

সাম্প্রতিক ঘটনাসমূহের পরে, তিনি উত্তেজনা প্রশমিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং কাশ্মীরের হ্রদ আর পুস্পোদ্যান সেটা দিতে পারে। তার আব্বাজান মোগলদের জন্য প্রথমবার অঞ্চলটা দখল করার পরে সে প্রথমবার যখন এখানকার বসন্তে প্রথম ফোঁটা জাফরানের ফিকে বেগুনী ফুলের কেয়ারি দেখেছিল তখনই সে এলাকাটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। সে সেখানে আকবরের নৈকট্য অনুভব করে। ডাল হ্রদের ঝকঝকে বুকে সে হয়ত সারাটা রাজকীয় নৌকা নিয়ে ভেসে বেড়াবে বা শিকারের সন্ধানে আশেপাশের পাহাড়ে ঘোড়ায় চেপে ঘুরে বেড়াবার অবসরে ধীরে ধীরে হয়ত মানসিক প্রশান্তি ফিরে পাবে যা খুররম নষ্ট করে দিয়েছিল। তিনি হয়ত নিজের শারীরিক শক্তিও পুনরুদ্ধার করতে পারবেন এবং সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যে অনবরত কাশির প্রকোপ তাকে পর্যদস্ত করেছে সেটা হয়ত সেরেও যেতে পারে।

তিনি সহসা বাইরে কোথাও থেকে বাচ্চাদের গলার স্বর ভেসে আসতে শুনেন। ওটা দারা শুকোহ নাকি আওরঙ্গজেবের কণ্ঠ?

মেহেরুন্নিসা মাথা নাড়েন। আমি তাদের নদীর তীরে তীরন্দাজি অনুশীলন করতে বলেছি। বাচ্চা দুটো এতবেশী প্রাণবন্ত… যাত্রার ক্লান্তি তাঁদের এতটুকুও স্পর্শ করে না।

‘আমি প্রায়ই ভাবি বেচারাদের তাদের বাবা-মার কাছ থেকে পৃথক করাটা কি ঠিক হয়েছে। তাদের নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে।’

‘আমাদের সামনে আর কোনো পথ ছিল না। সাম্রাজ্যের ভিতরে শান্তি স্থাপন করাটা জরুরি ছিল এবং তারা আমাদের হেফাজতে থাকলে সেটা অর্জন করতে সহায়তা করবে। আমরা তাঁদের সাথে ভালো আচরণ করছি। তাঁদের কোনো কিছুর অভাব রাখা হয়নি।’

‘কিন্তু তারা নিশ্চয়ই তাদের বাবা-মা’র অভাব অনুভব করে। তারা অন্তত তিনমাস তাঁদের না দেখে রয়েছে। আওরঙ্গজেবকে যদিও যথেষ্ট উহ্লুই মনে হয় কিন্তু দারা শুকোহকে আমি মাঝে মাঝে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি এবং ভ্রু কুঁচকে রয়েছে আর আমি নিজেকে প্রশ্ন করি সে কি চিন্তা করছে…’।

‘সে একটা বাচ্চা ছেলে। সে সম্ভবত ভাবছে সে আবার কখন শিকারে কিংবা বাজপাখি উড়াতে যাবে। মেহেরুন্নিসা দ্রুত আর ভাবনাটা মন থেকে দূর করার স্বরে বলে। আমার এখন মনে হয় নিজেরই হাম্মানের তাবুতে যাওয়া উচিত পানি গরম করার বিষয়টা তদারক করতে। গত সন্ধ্যায় পানি ঠিকমত গরম করা হয়নি–পরিচারকেরা অলস হয়ে উঠেছে এবং যথেষ্ট পরিমাণ কাঠ সংগ্রহ করে নি। আমি এরপরে আপনার সন্ধ্যাবেলার সুরা প্রস্তুত করবো।’

মেহেরুন্নিসা চলে যাবার পরে, জাহাঙ্গীর পুনরায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। তিনি দারা শুকোহ আর আওরঙ্গজেবের ভক্ত হয়ে উঠেছেন এবং আজকাল টের পান তাঁর প্রতি তাদের প্রাথমিক স্বল্পভাষিতা হয়ত শিথিল হতে শুরু করেছে। পিতা আর পুত্রের সম্পর্কের চেয়ে দাদাজান আর তাঁর নাতির মধ্যকার সম্পর্ক আরো কম অস্বস্তিকর হওয়া উচিত… প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোনো অনুষঙ্গ সেখানে থাকতে পারে না। তাঁর নিজের আব্বাজান আকবর হয়ত এই কারণেই তার নাতিদের মাঝে এমন আনন্দ খুঁজে পেতেন।

*

‘সেনাপতি, আমরা রাজকীয় বহরের নাগাল ধরে ফেলেছি। মহামান্য সম্রাট ঝিলম নদীর তীরে আমাদের প্রায় পাঁচ মাইল সামনে গত দু’রাত ধরে শিবির স্থাপন করে অবস্থান করছেন যখন তার লোকেরা নদীর উপর নৌকা দিয়ে সেতু নির্মাণে ব্যস্ত। তাঁর অধিকাংশ সৈন্য–আমার ধারণা তাঁর সাথের তিন হাজারের দুই হাজার–আজ সন্ধ্যাবেলা অন্ধকার নামার আগেই নদী অতিক্রম করেছে এবং আমি তারপরে চিৎকার করে রাতের মত পারাপার বন্ধ রাখার আদেশ দিতে শুনেছি এবং তারপরে রাতের খাবার তৈরির প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। আমি নিশ্চিত রাজকীয় বহর আগামী কাল নদী অতিক্রম করবে,’ চারপাশের ভূপ্রকৃতির সাথে মিশে যাবার জন্য ধুসর খয়েরী রঙের পোষাকে আপাদমস্তক আবৃত গুপ্তদূত সেদিন সন্ধ্যাবেলা অন্ধকার নামার পরে ভারমুক্ত মহবত খানকে জানায়।

মহবত খান তার লোকদের মানসিকতা সম্বন্ধে ঠিক যেমনটা আশা করেছিল তাঁরা তাঁর সাহসী আর আবেগতাড়িত পরিকল্পনার প্রতি সাথে সাথে এবং সবস্বরে নিজেদের সমর্থন জ্ঞাপন করে অনিবার্য ঝুঁকি আর বিপদের সম্ভাবনা সত্ত্বেও। তার পোড় খাওয়া রাজপুত বাহিনীর পুরো দলটাও একই রায় দিয়েছে। রাজকীয় বহরের চেয়ে আটগুণ দ্রুত অগ্রসর হয়ে তারা দ্রুত ব্যবধান হ্রাস করেছে। আসবার পথে কোনো রাজকীয় আধিকারিক তাঁদের এহেন দ্রুততার বা তাদের অভিযান সম্পর্কে খোঁজখবর নিলে মহবত খান জোরালো কণ্ঠে যখন জানিয়েছে যে আরেকটা সফল অভিযানের সংবাদ সে নিজে সম্রাটকে দিতে চায় তারা সহজেই সন্তুষ্ট হয়েছে। তা যাই হোক সে কৃতজ্ঞ যে ধাওয়া করার পর্ব সমাপ্ত হয়েছে এবং সময় হয়েছে তাঁদের পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করার।

শিবিরের পেছনের অংশে কি পাহারার বন্দোবস্ত রয়েছে?’ মহবত খান জানতে চায়।

না, গুপ্তদূত উত্তর দেয়। প্রহরী অবশ্যই রয়েছে, কিন্তু সেটাও গুটি কয়েকজন এবং তারা শিবিরের সীমানার কাছাকাছি অবস্থান করে আর তাঁদের দেখে ভীষণ নিরুদ্বিগ্ন মনে হয়েছে। আমি পরিক্রমণে কেবল তাঁদেরই বের হতে দেখেছি যারা সম্ভবত নদীর অপর তীরে সামনের পথ পর্যবেক্ষণে রওয়ানা হয়েছিল।

মহবত খান মৃদু হাসে। পরিস্থিতি তাঁর অনুকূলে চক্রান্ত শুরু করেছে। সকালে আরো রাজকীয় সৈন্য নদী অতিক্রম করা পর্যন্ত তাকে কেবল অপেক্ষা করতে হবে, সেতু পুড়িয়ে বা অবরোধ করে সে তারপরে শিবিরে হামলা চালিয়ে সম্রাট, সম্রাজ্ঞী আর খুররমের দুই সন্তানকে বন্দি করবে। নিরাপত্তার খাতিরে সে আর তার লোকেরা আজ রাতে অবশ্য এক বা দুই মাইলের মত পিছিয়ে যাবে এবং রান্নার জন্য আগুন জ্বালাবে না যা হয়ত তাদের অবস্থানের কথা ফাঁস করে দিতে পারে।

*

পাহাড়ের এবং ঝিলমের অববাহিকা ঘিরে রাখা পর্বতের ছায়ায় কনকনে শীতল একটা রাত। মহবত খান যখন সকাল হবার সাথে তার অশ্বারোহী যোদ্ধাদের নেতৃত্ব দিয়ে রওয়ানা দেয় তখনও চারপাশের চরাচর ভারি কুয়াশার চাদরে ঢাকা। ভাগ্য নিঃসন্দেহে তাঁর পক্ষে রয়েছে। সে ভাবে নদী পারাপারের স্থানে কুয়াশার কারণে তারা কারো চোখে ধরা না পড়ে পৌঁছে। যাবে। কিন্তু সে অবশ্যই কেবল ভাগ্যের উপর নির্ভর করবে না। সে অবশ্যই সংযত থাকবে এবং কোনো কিছুই ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেবে না। সে অনেক সেনাপতিকে যুদ্ধে পরাজিত হতে দেখেছে কারণ তারা ভেবেছিল সবকিছু অতিমাত্রায় তাদের পক্ষে রয়েছে যার কারণে তারা ঠিকমত পরিকল্পনা প্রণয়ন করে নি বা তাদের আক্রমণে যথেষ্ট যত্নশীল হয়নি। সে তাই তার অধীনস্তদের গত রাতে তাঁর জারি করা আদেশ সম্বন্ধে আরো একবার সতর্ক করে দেয়।

‘অশোক, সে তার বাহিনীর অগ্রভাগে বাদামি রঙের ঘোড়ায় উপবিষ্ট তরুণ রাজপুত যোদ্ধাকে ডাকে। তোমার দায়িত্ব নৌকার সেতু অকার্যকর করা যাতে কোনো রাজকীয় সৈন্য নদী পার হয়ে আসতে না পারে। দরকার মনে করলে সেতু পুড়িয়ে দেবে। রাজেশ, তুমি’–সে ঘুরে আরেকজন বয়স্ক ঝাঁকড়া দাড়িঅলা যোদ্ধার দিকে তাকায় যার মুখে চুলের প্রান্তদেশ থেকে দাড়ি পর্যন্ত আড়াআড়ি একটা ক্ষতচিহ্ন রয়েছে এবং যেখানে তাঁর বামচোখ থাকার কথা ছিল তার উপরে চামড়ার একটা পট্টি বাঁধা–’তুমি আর তোমার লোকেরা শিবির ঘিরে ফেলবে এবং দেখবে কেউ যেন দক্ষিণে আমাদের আক্রমণের খবর জানাতে পালিয়ে যেতে না পারে। আমি বাকি সৈন্যদের নিয়ে নিজে রাজকীয় পরিবারকে বন্দি করার জন্য যাব।

‘তোমরা সবাই মনে রাখবে, যতদূর সম্ভব হতাহতের বিষয়টা এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করবে কেবল আমাদের লোকদের ক্ষেত্রেই না রাজকীয় সৈন্যদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমাদের তাদের যত বেশি সম্ভব তত বেশি লোকের সহযোগিতা প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় কথা, রাজকীয় পরিবারের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। তাঁরা জীবিত অবস্থায় আমাদের কাছে তাদের ওজনের পরিমাণ সোনার চেয়েও কয়েক গুণ বেশি মূল্যবান। তারা মারা গেলে তাঁদের ওজন আমাদের টেনে পাতালে নিয়ে যাবে, সবাইকে আমাদের শত্রুতে পরিণত করবে এবং সমঝোতা অসম্ভব করে তুলবে। তোমরা আমার কথা বুঝতে পেরেছো?’ তাঁর আধিকারিকেরা মাথা নাড়ে। ‘এখন এসো এই কুয়াশার সর্বোচ্চ সুবিধা গ্রহণ করা যাক।

মহবত খান বৃত্তাকারে ঘোড়া ঘুরিয়ে নিয়ে চরাচর ঢেকে রাখা ধুসরতার মাঝে এগিয়ে যায়। তার ভবিষ্যতের জন্য আগামী কয়েক ঘন্টা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সে হয় সাম্রাজ্যের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ লাভ করবে নতুবা যদি তার ধৃষ্টতাপূর্ণ প্রয়াস ব্যর্থ হয়, ধীরে মৃত্যুমুখে পতিত হবে–সম্রাট কখনও একজন বিশ্বাসঘাতককে দ্রুত বা সহজে মৃত্যুবরণ করতে দেন না। সে শূলবিদ্ধ অবস্থায় বা গরম সূর্যের নিচে গলা পর্যন্ত বালিতে পুতে যাঁদের মৃত্যু বরণ করার জন্য ফেলে রাখতে দেখেছিল কিংবা জীবন্ত অবস্থায় ভাবলেশহীন চোখের নির্যাতনকারী নাড়িভূড়ি ইঞ্চি ইঞ্চি করে টেনে বের করে একটা লাঠির চারদিকে পেঁচানোর স্মৃতি মনে পড়তে সে কেঁপে উঠে। তাকে তার নিজের এবং তাঁর লোকদের খাতিরে অবশ্যই সফল হতে হবে এবং সে সফল হবেই। সে নিজের কালো স্ট্যালিয়নকে গম্ভীর মুখে সামনে এগোবার জন্য তাড়া দেয়।

এক ঘন্টার ভিতরে এবং কোনো ঘটনা ছাড়া বা তাদের অবস্থান ফাঁস হবার কোনো নির্দিষ্ট ইঙ্গিত ছাড়াই সে এবং তাঁর লোকেরা ঝিলম নদীর তীরের কিছু নিচু মাটির টিলায় উঠে আসে এবং নিচে অবস্থিত নৌকার সেতুর দিকে তাকায়। কুয়াশা এখনও যদিও রয়েছে কিন্তু দ্রুত পাতলা আর ছাড়া ছাড়া হয়ে উঠছে। মহবত খান কুয়াশার মাঝে বিদ্যমান ফাঁকের ভিতর দিয়ে দেখতে পায় যে আরো রাজকীয় সৈন্য সেতু অতিক্রম করছে তাদের সাথে রয়েছে হাতির পাল যাদের ওজন আর হাঁটার ভঙ্গির কারণে দ্রুত বহমান পানির স্রোতে সেতুর নৌকাগুলো টলমল করে উঁচুনিচু হয়, হিমবাহ আর পাহাড় থেকে বয়ে আনা পলি আর পাথরের কারণে পানির ধুসর সবুজাভ দেখায়। গড়াতে থাকা কুয়াশার মাঝে বিদ্যমান আরেকটা ফাঁক দিয়ে মহবত খান দেখে যে লাল রঙের রাজকীয় তাবু এখনও তার পাড়ের দিকেই রয়েছে এবং তাদের পাশেই রান্নার চুলা জ্বলছে–সম্রাট আর সম্রাজ্ঞী সম্ভবত আলস্যের সাথে সকালের প্রাতরাশ সম্পন্ন করছেন। সে দরবারে নিজের উপস্থিতি থেকে জানে যে সম্রাট, পূর্ববর্তী রাতে নিজের মাত্রাতিরিক্ত সেবনের কারণে বিভ্রান্ত থাকায়–সেটা হতে পারে আফিম, সুরা কিংবা উভয়ের মিশ্রণ–প্রায়শই দেরি করে ঘুম থেকে উঠেন আর আধা তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকেন এবং দুপুরের আগে কখনও পুরোপুরি মানসিকভাবে সঙ্গতিপূর্ণ হন না। সে দোয়া করে যে তিনি আজও যেন সেরকমই করেন কিন্তু সে এর উপর নির্ভর করতে পারে না।

মহবত খান নিজের আধিকারিকদের দিকে ঘুরে আদেশ দেয়, নষ্ট করার মত সময় নেই। এখন সক্রিয় হও এবং দ্রুত। তোমাদের লোকেরা যেন শৃঙ্খলা বজায় রাখে। তাদের আমাদের নিশান অবমুক্ত করতে আদেশ দাও যাতে রাজকীয় সৈন্যরা আমাদের পরিচয় বুঝতে পারে আর আমাদের অভিপ্রায় সম্বন্ধে তাদের যতক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব অনিশ্চয়তার মাঝে রাখতে চেষ্টা করো।’ সে কথাটা শেষ করেই গোড়ালি দিয়ে নিজের কালো ঘোড়ার পরে তো দেয়, যা সাগ্রহে সাড়া দেয় এবং মাটির পাহাড়ের উপর দিয়ে নিচের শিবিরের দিকে দ্রুত নামতে শুরু করলে মাটির ঢেলা ছিটকে উঠে।

*

মহবত খান পাঁচ মিনিট পরে জাহাঙ্গীরের খাপছাড়াভাবে সুরক্ষিত শিবিরের ভিতর দিয়ে আস্কন্দিত বেগে ঘোড়া হাঁকিয়ে এগিয়ে যায়। প্রথম কয়েকজন প্রহরী এতটাই বিভ্রান্তবোধ করে যে তাঁরা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দেরি করে ফেলে এবং তারা অস্ত্রধারণ করার আগেই সংখ্যায় অনেকবেশি তার নিজের লোক এসে তাঁদের ঘিরে ফেলে। সে নদীর দিকে এগিয়ে যাবার সময় চারপাশে তাকায় এবং রাজেশের লোকদের শিবিরের চারপাশে নিজেদের দ্বারা একটা বৃত্তাকার ব্যুহ রচনা করতে দেখে আর অশোকের সাথের লোকেরা ঘোড়া হাঁকিয়ে নৌকার সেতুর দিকে ছুটে চলেছে, যাবার সময় তাঁদের ঘোড়ার খুরের আঘাতে রান্নার পাত্র এবং শিবিরের অন্যান্য আলগা উপকরণ ছিটকে যায়। সে গুলির কোনো শব্দ শুনতে পায় না এবং কোনো তীর বাতাসে ভাসতে দেখে না, সে এবার তাই রাজকীয় তাবুর দিকে অগ্রসর হতে আরম্ভ করে। সে অচিরেই তাবুর সামনে নিজেকে দেখতে পায় এবং সে ঝড়ের বেগে সেদিকে এগিয়ে যেতে বেশ কয়েকজন লোক আতঙ্কে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। তাদের শত্রুবিহীন মুখাবয়ব এবং কোমল, উজ্জ্বল রঙের কাপড় দেখে মনে হয় তারা হাম্মামের খোঁজা। সে এত জোরে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে যে ঘোড়াটা পেছনের পায়ে ভর দিয়ে প্রায় দাঁড়িয়ে পড়ে। মহবত খান তার বাহনকে স্থির করে খোঁজাদের একজনের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য পিঠ থেকে দ্রুত লাফিয়ে নিচে নামে, নমনীয় দেহের অধিকারী তরুণ প্রথমে মহবত খানের হাত থেকে ছাড়া পেতে কিছুক্ষণ ধ্বস্তাধ্বস্তি করে মোড়ায় কিন্তু কোনো লাভ হবে না বুঝতে পারা মাত্র সে প্রতিরোধের আর কোনো চেষ্টা করে না। মহবত খান দ্রুত তাঁর কাঁধ ধরে এবং জোরে ঝাঁকি দেয়। সম্রাট কোথায়?

খোঁজা লোকটা কোনো কথা বলে না কিন্তু মাথা ঘুরিয়ে দশ ফিট দূরে অবস্থিত একটা এলাকার দিকে তাকায় যা শিকারের জটিল দৃশ্যাবলী অঙ্কিত কাঠের তিরস্করণী দ্বারা আলাদা করা এবং চামড়ার ফালি দিয়ে প্যানেলগুলো একত্রে বাঁধা। প্যানেলের নিচ দিয়ে পানি চুঁইয়ে পড়ছে। হাম্মাম তাবু–গোসলের তাবু–মহবত খান ভাবে গতরাতের ভোগলালসার চিহ্ন ধুয়ে ফেলতে তিনি নিশ্চয়ই সেখানে রয়েছেন। খোঁজাটাকে একপাশে ছুঁড়ে ফেলে, সে দৌড়ে ঘিরে রাখা এলাকাটার দিকে যায় এবং লাথি মেরে কয়েকটা প্যানেলে ছিটকে ফেলে।

গোলাপজলের গন্ধে ভেতরটা ভরে আছে। পাথরের একটা টুকরো থেকে তৈরি করা গোসলের বিশাল পাত্রটা থেকে বাষ্প উড়ছে যা সম্রাট ভ্রমণের সময় সর্বদা সাথে রাখেন কিন্তু গোসলের পাত্রটা খালি কেবল গরম পানি সেখানে রয়েছে এবং তাঁর পাশে যে দু’জনকে মহবত খান দেখতে পায় তাঁদের কমনীয় মুখে আতঙ্ক আর ভয় স্পষ্ট ফুটে রয়েছে। সে সহসা নদীর পাড় থেকে গাদাবন্দুকের পরপর কয়েকটা গুলির শব্দ শুনতে পায়। সম্রাট কোথায়? সবকিছু কি তাহলে ভেস্তে যেতে বসেছে? নাকি আল্লাহ না করেন, তাঁর দীর্ঘ যাত্রার সময় তাঁরই কোনো লোক কি তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, জাহাঙ্গীরকে সুযোগ করে দিয়েছে তার জন্য ফাঁদ পাততে? মহবত খান ঘুরে দাঁড়ায় এবং প্রচণ্ড বেগে হৃৎপিণ্ড স্পন্দিত হতে থাকা অবস্থায় দৌড়ে হাম্মাম থেকে বের হয়ে আসে। সম্রাটকে খুঁজে বের করো!’

*

জাহাঙ্গীরের স্বপ্নে ইস্পাতের সাথে ইস্পাতের ঘর্ষণ আর চিৎকারের শব্দ ছন্দোবদ্ধ ভঙ্গিতে আন্দোলিত হয়। কিন্তু তারপরে সহসা নিকটবর্তী হতে, তারা তাঁর নিদ্রা ভঙ্গ করে।

তিনি নিজের বিক্ষিপ্ত ভাবনাগুলোকে বিন্যস্ত করার চেষ্টা করতে করতে নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ান, এবং তার কর্চিকে ডেকে কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে তিনি ধীর পায়ে তাবুর প্রবেশ মুখের দিকে এগিয়ে যান।

মহবত খান ঘোড়ায় চেপে নদীর তীরে ফিরে যাবার জন্য মন স্থির করায় তাবুর পর্দা উঠার দৃশ্যটা তাঁর নজর এড়িয়ে যায় এবং তখনও রাতের পোষাক পরিহিত অবস্থায় ভেতর থেকে বের হয়ে আসা পিঠ টানটান করে দাঁড়িয়ে থাকা দুর্বল অবয়বের সাথে সে কোনোমতে নিজেকে ধাক্কা খাওয়া থেকে বিরত রাখে। সে সাথে সাথে জাহাঙ্গীরকে চিনতে পারে, আগের চেয়েও কৃশকায় এবং চোখ আরও কোটরে ঢুকে গিয়েছে।

সম্রাটই প্রথমে কথা বলেন। মহবত খান, এসব হট্টগোলের কি মানে?

মহবত খান কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা খুঁজে পায় না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো মতে উত্তর দেয়। আমি সাম্রাজ্যের খাতিরে আপনাকে বন্দি করতে এসেছি।’

‘সাম্রাজ্যের খাতিরে বন্দি করতে? কি উদ্ভট কথা! তুমি কি বলতে চাও?

‘সম্রাজ্ঞী এবং আপনার বর্তমান পারিষদবর্গ আপনার না বরং তাদের নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী কাজ করতে বেশি আগ্রহী। আপনাকে পরামর্শ দেয়ার জন্য তাদের চেয়ে আমি অনেক ভালো অবস্থানে আছি,’ মহবত খান আনাড়ির মত বলে।

‘তোমার এতবড় স্পর্ধা!’ জাহাঙ্গীর গর্জে উঠে তার চোখে মুখে সেই পুরাতন ক্রোধ আর আগুন ঝিলিক দেয় এবং তাঁর হাত কোমরের কাছে উঠে আসে যেখানে যদি তাঁর পোষাক সম্পূর্ণ হতো তবে সেখানে তাঁর খঞ্জরটা গোঁজা থাকত। খঞ্জর অনুপস্থিত দেখে তিনি চারপাশে নিজের প্রহরীদের খুঁজতে চেষ্টা করেন কিন্তু যে কয়েকজন তার চোখে পড়ে সবাই মাটিতে থেবড়ে বসে রয়েছে, হাত ইতিমধ্যে পিছমোড়া করে বাঁধা আর মহবত খানের লোকেরা সব জায়গায় উদ্যত তরবারি হাতে ঘুরে বেড়ায় প্রথম সকালের আলোয় তাদের হাতের তরবারি ঝিলিক দেয়। তিনি হাত নামিয়ে নেন এবং জানতে চান, পরামর্শদাতাদের এই সম্ভাব্য পরিবর্তন কি আমি নিজে পছন্দ করতে পারি?

‘জাহাপনা, যথা সময়ে, আপনি দেখতে পাবেন আপনার বর্তমান পরামর্শদাতাদের চেয়ে আমি কত ভালো পারদর্শিতা প্রদর্শন করতে সক্ষম। মহবত খানের মনে হয় আফিমের কারণে চোখের মণি প্রসারিত হওয়া সত্ত্বেও সম্রাট যেন নিজের পছন্দের বিষয়গুলো বিবেচনা করছেন। তিনি অবশেষে মাথা নাড়েন যেন বুঝতে পেরেছেন বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিরোধের চেষ্টা করা বৃথা এবং ধীরে ঘুরে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে তার তাবুর লাল চাঁদোয়ার নিচে ফিরে যান। সম্রাটের তাবু পাহারা দাও কিন্তু তার সাথে শিষ্টতা বজায় রেখে আচরণ করবে। তিনি আমাদের সম্রাট।

তাবুর অভ্যন্তরে জাহাঙ্গীর একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর অর্থ বুঝতে চেষ্টা করেন। মহবত খান কি অর্জন করতে পারবে বলে মনে করেছে? জাহাঙ্গীর জানেন এই মুহূর্তে তার সামান্যই করণীয় রয়েছে। তার নাতিরা আর মেহেরুন্নিসা কোথায়? তিনি শীঘ্রই বাইরে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় থেকে উত্তর জানতে পারেন।

‘সেনাপতি, আমরা খুররমের সন্তানদের হেফাজতে নিয়েছি, তিনি শুনতে পান। আমরা তাকে অন্যদের চেয়ে সামান্য দূরে স্থাপিত কঠোর পাহারাধীন এক তাবুতে খুঁজে পেয়েছি। দারা শুকোহ কেবল জানতে চাইছে তাদের বাবা-মার কাছে কখন ফিরিয়ে দেয়া হবে সে কেবলই বলছে আমাদের তাহলে ভালোমত পুরস্কৃত করা হবে। আমি তাকে বলেছি যে সেটা এখনই হবে না আর তাকে ধৈর্যধারণ করতে বলেছি। আওরঙ্গজেব সামান্যই কথা বলেছে কিন্তু আমি তার চোখে ঔদ্ধত্য দেখেছি।

‘রাজেশ, সেটা ভালো, জাহাঙ্গীর মহবত খানের উত্তর শুনতে পান। ‘খুররম, তাহলে অন্তত আমাদের সাথে সমঝোতায় আসতে পারলে খুশিই হবে। ছেলেদের ভালোমত যত্ন নাও কিন্তু তাদের চোখে চোখে রাখবে। আমি তাদের পালিয়ে যাবার সম্ভাবনা একেবারে নাকচ করছি না। সম্রাজ্ঞী কোথায়?

‘আমি জানি না। শিবিরের সবস্থানে আমার লোকেরা খুঁজে দেখছে কিন্তু এখনও পর্যন্ত তাকে পাওয়া যায় নি। হাম্মামখানার আমরা এক খোঁজাকে পেয়েছি যে বলছে কালো একটা আলখাল্লা পরিহিত অবস্থায় নিজের ধনুক আর তীরের তূণ নিয়ে তিনি লাফিয়ে একটা ঘোড়া পিঠে উঠে দুই পা দু’পাশে ঝুলিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে বের হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু সেনাপতি কোনো মেয়ের পক্ষে এভাবে ঘোড়া চড়া অসম্ভব।

‘সম্রাজ্ঞীকে তুমি কখনও দেখোনি তাই এমন বলছো। এই মহিলার বক্ষপিঞ্জরে বাঘিনীর হৃৎপিণ্ড স্পন্দিত হচ্ছে।

জাহাঙ্গীর মৃদু হাসে। মহবত খানকে মোটেই আহাম্মক বলা যাবে না। মেহেরুন্নিসা মুক্ত থাকায় এখনও সব আশা শেষ হয়ে যায় নি।

তাবুর বাইরে মহবত খান, দুশ্চিন্তা আর আশঙ্কায় তাঁর আরো একবার কুঁচকে উঠেছে, দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজের ঘোড়ায় উপবিষ্ট হোন এবং নৌকার তৈরি সেতুর দিকে এগিয়ে যান। সম্রাজ্ঞী যদি আসলেই পালিয়ে যেতে সক্ষম হোন তাহলে তার পরিকল্পনা কেবল অর্ধেক সফল হবে। নদী খুব কাছেই অবস্থিত হওয়ায় কয়েক মিনিটের ভিতরে তাকে আবার ঘোড়ার পিঠ থেকে নামতে দেখা যায়। সেতুর চারপাশে প্রাণের কোনো লক্ষণ নেই, যা অক্ষত রয়েছে তার কয়েকজন তবকিকে অনতিদূরে একটা উল্টান মালবাহী শকটের পেছনে আত্মগোপন করে থাকতে দেখা যায়। তারা তাদের বন্দুক গুলিবর্ষণের জন্য প্রস্তুত অবস্থায় তেপায়ায় রেখে অবস্থান করছে এবং নদীর অপর পাড়ে তাক করা অবস্থায় লম্বা ব্যারেলের উপর দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। অন্যদের ভিতরে অশোককে দেখা যায়, ঝুঁকে তাদের দু’জন সহযোদ্ধার তদারকি করছে যা দেখতে বন্দুকের গুলির ক্ষতচিহ্নের মত মনে হয়। অন্যত্র রক্তে রঞ্জিত কাপড় নিয়ে, নদীর তীরে দু’জনের মৃতদেহ হাত পা ছড়িয়ে নিথর হয়ে পড়ে রয়েছে। মহবত খানের কাছে এখন স্পষ্ট হয় গুলির শব্দ কোথা থেকে এসেছিল এবং সে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ধারণা করতে পারে এখানে আসলে কি ঘটেছিল। অশোক, কি ব্যাপার?

‘প্রথমে সবকিছুই ভালোমত চলছিল। আমরা সেতুতে উঠার পথ অবরোধ করি। সেতুর উপরে যারা অবস্থান করছিল তারা আমাদের আদেশ অনুযায়ী যদি বাধা দিতে চেষ্টা করে তাহলে আমাদের বন্দুকেন নিশানা হবার হুমকি শুনে ঘুরে দাঁড়িয়ে নেমে আসে বা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। যারা নদী পার হবার জন্য অপেক্ষা করছিলো–যাদের বেশির ভাগই খচ্চরের সাথে খচ্চর-চালক–প্রায় সাথে সাথে আত্মসমর্পণ করে কেবল তাঁদের পারাপারের ব্যবস্থা তদারককারী এই আধিকারিক তরবারি বের করেছিল। মহবত খান অশোকের হাতের নির্দেশ অনুসরণ করে তাকিয়ে হাত পিছমোড়া করে বাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা সুঠামদেহী এক অবয়বকে দেখতে পায় যাকে অশোকের দু’জন লোক পাহারা দিচ্ছে। তাকে নিরস্ত করার আগেই সে আমার একজন অধস্তন সেনাপতিকে সামান্য আহত করেছে, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।’

কিন্তু তাহলে অন্য লোকগুলো কীভাবে আহত হল আর মারা গেল?

‘এই ঘটনার কয়েক মিনিটের বেশি পরের কথা না যখন আমি আমার পেছনে ঘোড়ার ধাবমান খুরের আওয়াজ শুনতে পাই এবং আলখাল্লা পরিহিত একটা অবয়ব প্রচণ্ড গতিতে ঘোড়া হাঁকিয়ে সেতুর দিকে ছুটে যায়। আমি চিৎকার করি, “থামুন, নতুবা আমরা গুলি করব!” অশ্বারোহীর মাথা থেকে এমন সময় মস্তকাবরনী খসে গেলে আমি লম্বা কালো চুল বাতাসে উড়তে দেখি। আমি এক মুহূর্তের জন্য ভাবি যে অশ্বারোহী একজন মহিলা কিন্তু তারপরে আমি ধারণাটা নাকচ করে দেই। কোনো মেয়ের পক্ষে দু’পাশে দু’পা ঝুলিয়ে দিয়ে এভাবে প্রাণীটাকে হাত আর হাঁটু দিয়ে তাড়া দেয়া সম্ভব না। আমি গুলি করার আদেশ দিতে যাব তখন আমি বুঝতে পারি যে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আমি এতবেশি সময় নিজের সাথে তর্ক করেছি যে অশ্বারোহী সেই সুযোগে সেতুতে উঠার পথ পাহারা দেয়া দুই প্রহরীকে ধাক্কা দিয়ে সামনে থেকে সরিয়ে দিয়েছে একজন কাঁপতে কাঁপতে পানিতে গিয়ে পড়েছে আর সে ইতিমধ্যে সেতু অর্ধেক অতিক্রম করে ফেলেছে ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের দাপটে সেতুর নৌকাগুলো ভীষণভাবে টলমল করছে। আপনার নির্দেশ স্মরণে থাকায় যে প্রভাবশালী হতে পারে এমন লোকদের ক্ষতি যেন না হয় আমি অশ্বারোহীকে নির্বিঘ্নে সেতু অতিক্রম করার সুযোগ দেই। আমি লোকটার সাহসের তারিফ না করে পারছি না। তিনি নদীর অপর তীরে পৌঁছাবার পরে গাদাবন্দুকের গুলিবর্ষণ শুরু হয় এবং অবিরাম গুলিবর্ষণের প্রথম ঝাপটাই আমাদের হতাহতের কারণ। আমরা তারপর থেকে কিছুক্ষণ পর পরই গুলি বিনিময় করছি।’

‘তুমি গুলি না করে ভালো করেছে। তুমি চিন্তাও করতে পারো না তুমি তাহলে কাকে খুন করে বসতে,’ মহবত খান বলেন। তারপরে, তার পরিস্থিতিতে বিষয়টা অদ্ভুতভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ চিন্তা করে, তিনি যোগ করেন, ‘সেতু পুড়িয়ে দাও, যাতে কেউ ফিরে আসতে না পারে।

২.০৭ রক্তগঙ্গা

‘আল্লাহ্র সামনে, সম্রাট এবং তাঁর প্রজাদের সামনে আপনি নিজের সম্মানহানি ঘটিয়েছেন। আপনার অবহেলার কারণে অকল্পনীয় ঘটনা ঘটে গিয়েছে। সম্রাট বন্দি হয়েছেন! মেহেরুন্নিসা পর্দা প্রথা পুরোপুরি অবজ্ঞা করে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে জাহাঙ্গীরের দেহরক্ষীদের বয়োজ্যেষ্ঠ আধিকারিকদের সামনে পায়চারি করে। সে যখন সরাসরি তাদের চোখের দিকে তাকায় তখন তারা বাধ্য হয় দৃষ্টি সরিয়ে নিতে, অবলা কুমারী মেয়ের মত তারা মাথা নিচু করে রাখে। আপনারা কীভাবে নিজেদের সম্মান পুনরুদ্ধার করবেন? কীভাবে আপনারা সম্রাটকে উদ্ধার করবেন? আমি সেতুর উপর দিয়ে পালিয়ে আসবার প্রায় সাথে সাথে মহবত খানের লোকেরা যখন সেতুতে আগুন ধরিয়ে দেয় আপনার দাঁড়িয়ে দেখেছেন। আমরা এখন কীভাবে নদী অতিক্রম করবো? আমাদের যদি ঘোড়া আর হাতিগুলোকে সাঁতরে ওপাড়ে নিয়ে যেতে হয় তবুও আমরা নদী অতিক্রম করবোই। দাঁড়িয়ে থাকবেন না, আমার প্রশ্নের উত্তর দিন?

দীর্ঘ নিরবতা বিরাজ করতে থাকে। জাঁহাপনা।’ দীর্ঘদেহী, বাজপাখির মত নাকের অধিকারী এক বাদখশানি শেষ পর্যন্ত কথা বলে, সে তখনও অবশ্য সরাসরি তাঁর চোখের দিকে তাকান থেকে বিরত থাকে। চার কি পাঁচদিন আগে আমি যখন ঝিলম নদী অতিক্রম করার জন্য উপযুক্ত স্থানের সন্ধানে একটা অগ্রবর্তী রেকি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলাম তখন এখান থেকে প্রায় মাইলখানেক উজানে আমরা নদী পার হবার জন্য একটা সম্ভাব্য অগভীর স্থান খুঁজে পাই। আমরা জায়গা বাতিল করে দেই কারণ মানুষের জন্য সেখানে পানির গভীরতা বেশি থাকায় পানির ভিতর দিয়ে হেঁটে যাবার সময় স্রোতের টানে ভেসে যাবার একটা সম্ভাবনা ছিল। অশ্বারোহী আর হাতির পক্ষে কেবল সেখান দিয়ে নদী পার হওয়া সম্ভবএবং তারপরেও নদীর তলদেশ পাথুরে আর অসমান। সম্ভাব্য বিপদের ঝুঁকি এড়াবার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়াটা তখন সহজ ছিল এবং এখানে নৌকার সেতু তৈরি করা যেখানে–যদিও পানি অনেক বেশি গভীর-স্রোতের বেগ অনেক কম যেহেতু নদী এপাড়ে অবস্থিত ছোট টিলার কাছে একটা বাঁক নিয়েছে। জাঁহাপনা, আর কোনো উপায় যদি না থাকে আমরা তাহলে সেই অগভীর অংশ অতিক্রম করে আক্রমণের বিষয়টা বিবেচনা করতে পারি।’

‘আপনারা আর কেউ এর চেয়ে ভালো কিছু পরামর্শ দিতে পারবেন? মেহেরুন্নিসা জানতে চায়। নিরবে দেহের ভার এক পায়ের উপর থেকে অন্য পায়ে স্থানান্তরিত করা আর হতাশ দৃষ্টি বিনিময় করা ছাড়া আর কোনো উত্তর পাওয়া যায় না।

‘বেশ তাহলে, সেই অগভীর স্থানেই আমরা যাব–আমি এবং আপনারও নিশ্চয়ই দলত্যাগী, বিশ্বাসঘাতক মহবত খানের হাতে সম্রাটকে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দিতে চান না। আক্রমণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে কত সময় লাগবে?

‘আমাদের সাথে কি অস্ত্র রয়েছে আর ওপাড়ে আমরা কি ফেলে এসেছি সেটা মিলিয়ে দেখতে, পানি থেকে আমাদের পক্ষে যতটা সুরক্ষা দেয়া সম্ভব সেজন্য গাদা বন্দুকগুলো আর বারুদ তৈলাক্ত কাপড়ের থলেতে বাঁধতে, অবশিষ্ট রণহস্তীগুলোকে তাদের যুদ্ধের সাজে সজ্জিত করতে এসব খুটিনাটি বিষয়ের জন্য কয়েক ঘন্টা সময় প্রয়োজন… আমরা সন্ধ্যা নামার আগেই প্রস্তুত হতে পারবো কিন্তু সকালবেলা হলে ভালো হয়।

‘আমরা যখন এসব প্রস্তুতি গ্রহণ করবো ততক্ষণ মহবত খান দাঁড়িয়ে না থেকে অন্যত্র যাবার জন্য যাত্রা শুরু করবে না? নিখুঁতভাবে ছাটা দাড়ির অধিকারী এক অল্পবয়সী তরুণ সেনাপতি–সবচেয়ে কমবয়সী যোদ্ধাদের একজন–এতক্ষণে কথা বলে।

না। মহবত খান আর যাই হোক তোমার চেয়ে কম আহাম্মক, মেহেরুন্নিসা বলে। সে খুব ভালো করেই জানে যে সে যদিও সম্রাটকে বন্দি করেছে কিন্তু আমায় বন্দি করতে ব্যর্থ হওয়ায় সে ক্ষমতা দখল করতে ব্যর্থ হয়েছে। ভয় পেয়ো না–সে আমার পরবর্তী পদক্ষেপ দেখার জন্য অপেক্ষা করবে। আমরা সকালবেলায়ই আক্রমণ করবো যাতে তোমাদের কোনো অপদার্থ বলতে না পারে তারা প্রস্তুতি নেয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পায় নি। ইত্যবসরে, নদীর অপর পাড়ের অবস্থান লক্ষ্য করে মাঝে মাঝে গুলিবর্ষণ করা অব্যাহত থাকবে যাতে মহবত খানের। লোকেরা সারা রাত একটা অস্বস্তির ভিতরে কাটাতে বাধ্য হয়। আর সেই সাথে, চারদিকে রেকির দল পাঠাও যাতে সে আমাদের আসল অভিপ্রায় সম্বন্ধে অনুমান করতে ব্যস্ত থাকে। মেহেরুন্নিসার মুখে নির্মম হাসি ফুটে উঠে। সে পরিস্থিতি প্রায় উপভোগই করছে বলা যায়। মহবত খান তাকে সরাসরি সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ দিয়েছে এবং পূর্বের মত একজন মধ্যস্থতাকারী সহায়তা তাকে নিতে হচ্ছে না। আমার হাতি আর সেটা হাওদা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করো। আগামী কাল আমি তোমাদের সুনাম পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেব এবং আমাদের সম্রাটকে উদ্ধার করবো। তোমাদের ভিতরে হয়তো অনেকেই কাপুরুষ কিন্তু একজন মহিলা যখন নেতৃত্ব দিচ্ছে তখন তাঁরাও নিশ্চয়ই পিছিয়ে থাকবার দুঃসাহস দেখাবে না।

*

‘জাহাপনা, মহবত খান আপনার নাতিদের আপনার সাথে থাকবার অনুমতি দিয়েছেন, প্রবেশ পথের মখমলের পর্দা একপাশে সরিয়ে দীর্ঘদেহী এক রাজপুত কথাটা বলে।

দারা শুকোহ আর আওরঙ্গজেব ইতস্তত ভঙ্গিতে ভেতরে প্রবেশ করে। জাহাঙ্গীর ভাবে, যা কিছু ঘটছে এসব কিছুরই কোনো অর্থ তারা বুঝতে পারছে না। তাবুর ভেতরে তারা তিনজন ছাড়া যখন আর কেউ নেই তখন তিনি হাঁটু মুড়ে বসেন এবং দু’হাতে তাদের দু’জনকে আলিঙ্গণ করেন। ‘ভয় পেয়ো না। তোমাদের কেউ কোনো ক্ষতি করবে না। আমি এখানে আছি আর আমি তোমাদের আগলে রাখবো। আর অচিরেই সম্রাজ্ঞী আমাদের উদ্ধার করবেন। মহবত খানের কবল থেকে তিনি পালিয়ে গিয়েছেন এবং এই মুহূর্তে নদীর অপর তীরে তিনি আমাদের সৈন্য আক্রমণের লক্ষ্যে সজ্জিত করছেন।

আওরঙ্গজেব কোনো কথা বলে না কিন্তু জাহাঙ্গীর অনুভব করেন দারা শুকোহ কেমন গুটিয়ে যায়। সম্রাজ্ঞী মোটেই আমাদের বন্ধু নন–তিনি আমাদের শত্রু। আমি আব্বাজানকে সেরকমই বলতে শুনেছি।

‘তিনি ভুল করেছেন। মেহেরুন্নিসা সম্পর্কে তোমাদের দাদীজান হন আর তোমাদের মঙ্গলের জন্য তিনিও উদ্বিগ্ন। আমাদের সাহায্য করার একটা পথ তিনি ঠিকই খুঁজে বের করবেন… তোমাদের সাহায্য করার জন্য…’ জাহাঙ্গীর আওরঙ্গজেবকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

‘আমার আব্বাজান বলেছেন তিনি কেবল নিজের স্বার্থের কথাই বিবেচনা করেন, দারা শুকোহ্ বলতে থাকে। তিনি সেজন্যই আপনাকে এমন মদ্যপ করে তুলেছেন–যাতে করে তিনি নিজে সব আদেশ দিতে পারেন। তিনি আমাকে বলেছেন কখনও যেন তাকে বিশ্বাস না করি… এবং আমি করিওনা। আমি আর আমার ভাই বাসায় যেতে চাই।’

‘অনেক হয়েছে! আমি তোমাদের আমার কাছে নিয়ে আসতে বলেছিলাম কারণ আমার মনে হয়েছিল তোমরা বোধহয় ভয় পেয়েছো আর এভাবে তোমরা তাঁর প্রতিদান দিলে। দারা শুকোহ্ আমাদের এই বিপদ যখন কেটে যাবে তখন আমি ভুলে যাবার চেষ্টা করবো তুমি এইমাত্র যা বলেছে। কিন্তু আমি দুঃখ পেয়েছি যে আমার ছেলে নিজের মত তোমাদেরও অকৃতজ্ঞ আর উদ্ধত হবার শিক্ষাই দিয়েছে।

জাহাঙ্গীর ঘুরে দাঁড়িয়ে গভীর একটা শ্বাস নেয়। দারা শুকোহর উগ্রতা তাকে কাঁপিয়ে দিয়েছে।

*

‘সর্বাধিকারী, নদীর তীর বরাবর তাঁরা এগিয়ে আসছে, মহবত খানের একজন অধস্তন যোদ্ধা পরের দিন সকাল হবার ঘন্টা দুয়েক পরে চিৎকার করে জানায়। মহবত খান তাঁর গুপ্তদূতদের সতর্কতার সাথে অপর তীরের সৈন্য সমাবেশের উপর নজর রাখার আদেশ দিয়েছেন মেহেরুন্নিসা আর জাহাঙ্গীরের দেহরক্ষী বাহিনীর যোদ্ধাদের পরবর্তী পদক্ষেপ অনুমান করার প্রয়াসে। সে নিজে বন্দিদের প্রশ্ন করে–শারীরিক নির্যাতন না তার নতুন শাসকমণ্ডলীর অধীনে পুরষ্কারের প্রলোভন দেখিয়ে–জানতে যে জাহাঙ্গীরের সাথে আগত রাজকীয় বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা সে যেমন তিন হাজার অনুমান করেছিল সেটা সঠিক নয় তাদের সংখ্যা আসলে ছয় হাজার যাদের ভিতরে আনুমানিক দেড় হাজার সৈন্য প্রচুর যুদ্ধ উপকরণসহ তার হাতে বন্দি হয়েছে। তার সাথে দশ হাজার রাজপুত যোদ্ধার বাহিনী থাকায় তাত্ত্বিকভাবে মেহেরুন্নিসার চেয়ে এখন তার লোকবল দ্বিগুণ কিন্তু বাস্তবে সে জানে এই সংখ্যার এক চতুর্থাংশ সেনাছাউনি আর বন্দিদের পাহারা দেয়ার কাজে নিয়োজিত রাখতে হবে। সে অশোক আর তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত দু’শ ধীর স্থির সৈন্যদের বিশেষ করে নির্দেশ দিয়েছে জাহাঙ্গীর আর তার দুই নাতির নিরাপত্তা দিকে লক্ষ্য রাখতে কিন্তু সেই সাথে এটাও নিশ্চিত করতে যে তারা সর্বদা তাঁর হাতের মুঠোয় রয়েছে।

মেহেরুন্নিসার আদেশে বিভিন্ন দিকে অসংখ্য রেকি বাহিনীর প্রেরণে একটা সময় পর্যন্ত সে যদিও বিভ্রান্তবোধ করেছিল, কিন্তু একটা বিষয় তার কাছে ক্রমশ পরিষ্কার হতে শুরু করে যে রাজকীয় বাহিনী আসলে উজানে তাদের দিকের নদীর কিনারে একটা ছোট পাহাড়ের চারপাশে তাদের সমস্ত প্রয়াস একীভূত করছে। সকাল হবার ঠিক আগ মুহূর্তে তাঁর হাতে বন্দিদের একজন স্বেচ্ছায় তাকে অবহিত করে যে রাজকীয় বাহিনী ঝিলম নদী অতিক্রম করার জন্য নৌকার সেতু তৈরি করার পূর্বে সেখানে অবস্থিত নদীর একটা গভীর অংশ দিয়ে নদী পার হবার ব্যাপারটা বিবেচনা করলেও দ্রুত সেটা বাতিল করে দিয়েছিল। মহবত খানের এক মুহূর্ত সময় লাগে অনুধাবন করতে যে মেহেরুন্নিসার আদৌ পলায়নের কিংবা আত্মসমর্পণের কোনো অভিপ্রায় নেই বরং বন্দি স্বামীকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্য তিনি নদীর সেই গভীর অংশ দিয়েই আক্রমণের একটা পরিকল্পনা করেছেন। তিনি তাঁর স্বদেশী এই পার্সী মহিলাকে সাহসকে শ্রদ্ধা না করে পারেন না। তিনি বস্তুতপক্ষে তাকে তার নিজের স্ত্রীর কথা মনে করিয়ে দেয় এবং এক মুহূর্তের জন্য সেই কঠিন ইচ্ছাশক্তির অধিকারী মহিলার প্রশান্তিদায়ক সঙ্গ পেতে তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠেন। কিন্তু দাক্ষিণাত্য থেকে তাঁর এই আবেগপ্রবণ অভিযাত্রা শুরু করার আগেই তিনি চিঠি লিখে তাকে পারস্যে নিজের আত্মীয়স্বজনদের সাথে দেখার করার অজুহাতে আগ্রা ত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং তাকে রাজস্তানের আরাবল্লী পাহাড়ী এলাকায় চলে যেতে বলেছিলেন, যেখান থেকে তার সেরা যোদ্ধাদের অনেককেই তার বাহিনীতে যোগ দেয়ায় তিনি জানেন তার স্ত্রী সেখানে নিরাপদেই থাকবে। তিনি একবার যখন নিশ্চিত হন যে নদীর এই গভীর অংশ দিয়েই আগে বা পরে সম্ভাব্য আক্রমণ হতে চলেছে তিনি তখন তার সেরা তবকিদের ভিতরে একহাজার যোদ্ধাকে তাদের আটক করা মালবাহী বহরে খুঁজে পাওয়া গাদাবন্দুক থেকে অতিরিক্ত একটা করে বন্দুক সাথে নিতে আদেশ দেন যাতে তারা দ্রুত দু’বার গুলি বর্ষণ করতে পারে। তিনি তার অন্য লোকদের তাদের গুলি ভরতে সাহায্য করার নির্দেশ দেন, তাঁদের গুলিবর্ষণের হার বৃদ্ধি করার অভিপ্রায়ে। তিনি আশা করেন এভাবে কামানের অভাব পূরণ হবে যদিও রাজকীয় মালবাহী শকটের বহরে তাঁরা ব্রোঞ্জের তিনটি ছোট গজল পেয়েছেন যদিও এর সাথে সামান্যই বারুদ আর গোলা পাওয়া গিয়েছে। তিনি আদেশ দিয়েছেন এগুলো মালবাহী শকটে স্থাপন করে রাতের অন্ধকারে ষাড় দিয়ে টেনে নিয়ে অগভীর অংশের তীরের কাছে অবস্থিত কয়েকটা নিচু মাটির ঢিবির আড়ালে রাখতে বলেছেন, যেখানে তিনি তার বাছাই করা কিছু তবকিকে তাদের অতিরিক্ত বন্দুক আর সাহায্যকারী নিয়ে লুকিয়ে অবস্থান করার আদেশ দিয়েছেন।

যুদ্ধের মুহূর্ত এখন যখন আরো একবার নিকটবর্তী হয় মহবত খান ক্রমশ শান্ত সমাহিত হয়ে উঠেন। তিনি চিৎকার করে নিজের তবকি আর তীরন্দাজদের গুলিবর্ষণ করা থেকে বিরত থাকতে বলেন যতক্ষণ না তিনি নিশ্চিত হন যে তাদের লক্ষ্যবস্তু নিশানার ভিতরে এসেছে আর তিনি তারপরে আদেশ দেন। তাঁর লোকেরা এরপরে যত দ্রুত সম্ভব গুলিবর্ষণ শুরু করে। ছোট কামানগুলোর দায়িত্বে যারা রয়েছে তিনি তাদেরও একই আদেশ দেন, যদিও তিনি জানেন যে অস্ত্রটা ব্যবহারে তাদের অনভিজ্ঞতার কারণে গোলা বর্ষণ করতে তাদের সময় বেশি লাগবে। তিনি এরপরে রাজকীয় বাহিনীর কোনো সৈন্য যদি আক্ষরিক অর্থেই ঝিলম নদী অতিক্রম করতে সক্ষম হয় তবে তাদের যেকোনো আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য অপেক্ষমান অশ্বারোহী বাহিনীর সাথে মিলিত হবার জন্য অগ্রসর হন।

মহবত খান যুদ্ধবাজ প্রাণীর প্রথম দলটাকে নদীতে নামতে দেখেন, যেখানে নদী প্রায় আশি গজ প্রশস্ত, তিনটা রণহস্তীর একটা দল যাদের প্রত্যেকের দেহ আর মস্তক ইস্পাতের আবরণ দ্বারা আবৃত এবং লাল রঙ করা গজদন্তে ধারালো তরবারি সন্নিবিষ্ট রয়েছে। প্রত্যেকের জন্য দু’জন করে মাহুত রয়েছে যারা তার কানের পেছনে বসে রয়েছে আর নিজেদের অরক্ষিত অবস্থানের কারণে যতটা সম্ভব কুঁকড়ে রয়েছে নিজেদের যতটা সম্ভব ছোট নিশানায় পরিণত করতে। প্রত্যেকটা হাতির পিঠে উন্মুক্ত কাঠের হাওদায় পাঁচজন করে তবকি গাদাগাদি করে অবস্থান করছে। আরো দুটো হাতি প্রথম দলটাকে অনুসরণ করে শীতল পানিতে নামে এবং মহবত খান দেখে যে পেছনে আরো বিশটা কি ত্রিশটা হাতি সারিবদ্ধ অবস্থায় অপেক্ষা করছে। সে ভাবে হাতিগুলোর কিছু হয়তো মালবহনের কাজে ব্যবহৃত হয় যাদের এখন অপরিচিত ভূমিকা পালনের জন্য বাধ্য করা হয়েছে। নদীর তীরে শতাধিক অশ্বারোহী যোদ্ধা সমবেত হয়েছে আর তাদের খুরের আঘাতে জায়গাটা কাদায় পরিণত হয়েছে। তাদের অনেকেই লম্বা বর্শা বহন করছে যার অগ্রভাগে মোগলদের সবুজ নিশান সংযুক্ত রয়েছে। প্রথম সারির মধ্যের হাতিটা কেবল দশ গজ মত অগ্রসর হয়েছে এবং তাঁর লোকেরা এখন গুলিবর্ষণ করা থেকে নিজেদের সংবরণ করে রেখেছে যখন তার বন্দিরা নদীর তলদেশে যে গর্তের কথা বলেছিল খুব সম্ভবত সেগুলোর একটায় জটা সে প্রাণীটাকে হোঁচট খেতে দেখে। প্রাণীটা এমন ভয়ঙ্কর ভাবে দুলে উঠে যে তার পিঠের খোলা হাওদা থেকে দু’জন তবকি দ্রুত বহমান পানিতে আঁছড়ে পড়ে ভাটিতে নৌকার তৈরি সেতুর পোড়া অবশিষ্টাংশের দিকে ভেসে যায়।

মহবত খান জানেন এটাই তার সুযোগ এবং চিৎকার করে গুলিবর্ষণ শুরু করার আদেশ দেন। তবকি আর তীরন্দাজেরা নদী তীরের মাটির ঢালের পেছন থেকে বের হয়ে আসে এবং তাঁদের কাজ শুরু করে। গুলির প্রথম ঝাপটার কয়েকটা সামনের আরেকটা হাতির দুই মাহুতকেই ধরাশায়ী করে আর তারা উভয়েই ঝিলমের ঘুরপাক খাওয়া পানির স্রোতে আছড়ে পড়তে পানি ছিটকে উঠে আর চালকবিহীন জন্তুটা তখন আতঙ্কে ঘুরে দাঁড়িয়ে সে যেখান থেকে এসেছে সেই উত্তরের তীরের দিকে পুনরায় ফিরে যাবার চেষ্টা করে। জটা ঘুরে দাঁড়াতে সেও পিছলে যায় এবং তার বাম কাঁধ পানির নিচে নিমজ্জিত হয়। ভারি বর্মের কারণে বাধাগ্রস্থ হয়ে সে পুরোপুরি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং পানিতে আধা নিমজ্জিত অবস্থায় ভেসে যায় আর ডুবতে শুরু করলে এর হাওদায় অবস্থানরত তবকিরা পানিতে লাফিয়ে নেমে সাঁতরে যতটা সম্ভব নিজেদের জীবন বাঁচাতে চেষ্টা করে। প্রথম সারির অবশিষ্ট শেষ হাতিটা অবশ্য অগ্রসর হওয়া অব্যাহত রাখে সেইসাথে তার পেছনে অবস্থানরত হাতিগুলোও যতক্ষণ না গজলের একটা গোলা চতুর্থ সারির একটা একটা হাতিকে তাঁর মুখের অরক্ষিত অংশে আঘাত করে এবং সেও পানিতে আছড়ে পড়ে ঝিলমের জন্তুটার রক্তে ঝিলমের সবুজাভ পানিতে ছোপ ছোপ দাগের সৃষ্টি হয়।

রাজকীয় অশ্বারোহী বাহিনীর অসংখ্য যোদ্ধা ইতিমধ্যে পানিতে নেমেছে এবং তারা আর তাঁদের বাহন হোঁচট খেতে থাকা হাতির পালকে পাশ কাটিয়ে কখনও হেঁটে, কখনওবা সাঁতার কেটে বেশ ভালোই অগ্রসর হতে থাকে। অশ্বারোহীদের কেউ কেউ এমনকি সাহসিকতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে রেকাবের উপর দাঁড়ায় তীর নিক্ষেপ করতে বা–মহবত খানকে মনে মনে বিস্মিত করে–একজন এমনকি লম্বা ব্যারেলের গাদা বন্দুক থেকেও গুলি বর্ষণ করে। মহবত খানের দুই কি তিনজন তবকি ধরাশায়ী হয় এবং ইতিমধ্যে অন্যরা বন্দুকে গুলি ভরার কাজে ব্যস্ত থাকায় নদী তীরের তার দিক থেকে গুলি বর্ষণের হার হ্রাস পায়। এই সুযোগে বেশ কয়েকজন রাজকীয় অশ্বারোহী নদী অতিক্রম করে এপাড়ে চলে আসে।

‘আক্রমণ করো!’ মহবত খান চিৎকার করে উঠে এবং সে তাঁর অশ্বারোহী যোদ্ধাদের সম্মুখে অবস্থান করে নদীর কর্দমাক্ত তীরের দিকে ধেয়ে নামতে থাকে পানি থেকে উঠে আসা রাজকীয় অশ্বারোহী যোদ্ধাদের আক্রমণ করতে। তাঁর তরবারির প্রথম আঘাত প্রতিপক্ষের একজনের বুকের বর্মে লেগে প্রতিহত হয় কিন্তু তাঁর দ্বিতীয় আঘাত খয়েরী রঙের একটা ঘোড়ার গলায় গেঁথে গেলে হতভাগ্য জন্তুটা সাথে সাথে পিঠের আরোহীকে শূন্যে নিক্ষিপ্ত করে মাটিতে আঁছড়ে পড়ে। জন্তুটা কিছুক্ষণের জন্য পানির অগভীর অংশে পড়ে থেকে পা ছুঁড়ে, গলার ক্ষতস্থান থেকে গলগল করে রক্ত বের হয়ে পানিতে মিশে যায় কিন্তু তারপরেই নিথর হয়ে যায়। তার চারপাশে নদীর কিনারে অশ্বারোহী যোদ্ধারা লড়াই করছে। একটা ঘোড়া সেখানে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লে তাঁর পিঠের রাজকীয় যোদ্ধা পিছলে যায়; একটু দূরে তার এক রাজপুত যোদ্ধা পর্যাণ থেকে ছিটকে যায়, রান্নার জন্য মুরগী শলাকাবিদ্ধ করার মত এক রাজকীয় যোদ্ধা তাকে গেঁথে ফেলে। অন্যত্র দুজন যোদ্ধা অগভীর পানিতে দাঁড়িয়ে লড়াই করছে, তারা পানিতে একে অপরের মাথা চেপে ধরার চেষ্টা করতে গিয়ে কেবলই গড়াতে থাকে। একজন তারপরে খঞ্জর বের করতে সক্ষম হয় এবং প্রতিপক্ষের পাঁজরের ঠিক নিচে সেটা আমূল ঢুকিয়ে দেয়। পানিতে আবারও রক্ত এসে মিশে। বিজয়ী যোদ্ধা–মহবত খান স্বস্তির সাথে তাকিয়ে দেখে তাঁরই একজন রাজপুত যোদ্ধা–নিজের উপর থেকে মরণাপন্ন প্রতিপক্ষের দেহটা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সারা দেহ থেকে পানি ঝরে পড়া অবস্থায় টলতে টলতে নদী থেকে উঠে আসতে শুরু করে। কিন্তু মহবত খানের স্বস্তি হতাশায় পরিণত হয় লোকটা যখন সহসা হাত দুপাশে ছড়িয়ে দিয়ে পেছনের দিকে উল্টে পড়ে এবং স্রোতের টানে সাথে সাথে ভেসে চলে যায়। আরেকজন রাজপুত যোদ্ধা মহবত খানের এত কাছে প্রায় সাথে সাথেই ঘোড়া থেকে নিচে আঁছড়ে পড়ে যে তাঁর পতনের ফলে ছিটকে উঠা শীতল পানি তাকে প্রায় ভিজিয়ে দেয়। সে চারপাশে তাকিয়ে এহেন নিখুঁত লক্ষ্যভেদের উৎস খোঁজার চেষ্টা করে এবং সে যখন সেটা খুঁজে পায় তার মাথার উপর দিয়ে গাদাবন্দুকের আরেকটা গুলি ভয়াল শিস তুলে উড়ে যায়।

সে তখন দেখতে পায় গুলি কোথা থেকে করা হচ্ছে–প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে নদীর ভেতর দিয়ে মন্থর গতিতে অগ্রসর হতে থাকা একটা অতিকায় পিঠের গিল্টি করা হাওদা। হাওদায় চারটা অবয়র দেখা যায়। সামনে যে রয়েছে তার পরনে কালো রঙের আলখাল্লা। হাওদায় উপস্থিত বাকি তিনজন আদতে পরিচারক, দু’জন ব্যগ্রতার সাথে লোহার শিক দিয়ে গাদাবন্দুকের নলে সীসার বল প্রবিষ্ট করছে তৃতীয় জন গুলি ভর্তি বন্দুক আলখাল্লা পরিহিত অবয়বের সাথে সেটা তুলে দিচ্ছে। মহামান্য সম্রাজ্ঞী, মহবত খান সাথে সাথে বুঝতে পারে। সে সহজাত প্রবৃত্তির বশে এটাও বুঝে যে তিনিও তাকে চিনতে পেরেছেন। ব্যাঘ শিকারী হিসাবে তাঁর দক্ষতা সম্বন্ধে ভালোমতই অবহিত থাকার কারণে সে চেষ্টা করে নিজেকে কুঁকড়ে ছোট করে ফেলতে, নিজের ঘোড়ার কাঁধের উপর নুয়ে পড়ে দুহাতে জন্তুটার গলা আঁকড়ে ধরে। কিন্তু কিছুক্ষণের ভিতরে সে তীক্ষ্ণ একটা যন্ত্রণা অনুভব করে আর সাথে সাথে তার ডান হাতের উৰ্দ্ধাংশ অবশ হয়ে যায় আর ঘোড়াটা সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সে আর তার বাহন উভয়েই আহত হয়েছে।

সে সাথে সাথে নিজেকে শীতল পানিতে আবিষ্কার করে, স্রোতের টানে ভাটির দিকে ভেসে চলেছে। সে ঘোড়া থেকে ছেটকে যাবার সময় যদিও মাথার শিরোস্ত্রাণ হারিয়েছে কিন্তু দেহ রক্ষাকারী বর্মের ভারে সে পানির নিচে তলিয়ে যেতে থাকে। তার কানের ফুটো আর নাসারন্ধ্রে পানি প্রবেশ করেছে এবং সে বহু কষ্টে নিজের মুখ বন্ধ রাখে। তাঁর কানের ভিতরে ততক্ষণে দপদপ যন্ত্রণা শুরু হয়েছে আর তার ফুসফুস বুঝি ফেটে যাবে। তাকে দ্রুত কিছু একটা করে বুকের বর্মটার হাত থেকে রেহাই পেতে হবে। নতুবা পানিতে ডুবে মরার হাত থেকে কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না। আঘাত পাওয়া সত্ত্বে সে এখনও নিজের ডান হাত নাড়াতে পারে এবং সে। তার কোমরে গোঁজা খঞ্জরটা হাতড়াতে থাকে। সেটা খুঁজে পাবার পরে সে সাবধানে খঞ্জরটার জেড পাথরের বাটের চারপাশ আঙুল দিয়ে ভালো করে। আঁকড়ে ধরে যাতে ময়ান থেকে টেনে বের করার সময় সেটা তার হাত থেকে পিছলে পড়ে না যায়। বেশ সহজেই খঞ্জরটা বের হয়ে আসে এবং সে প্রথমে একটা বাঁধন কাটে তারপরে দেহের বামপাশে বর্মের আরেকটা চামড়ার বাঁধন কেটে দেয়। বর্মটার একপাশ খুলে যেতে পানির স্রোত সেটা লুফে নেয় এবং ডানপাশের বাঁধন তখনও অটুট থাকায় সে নিজেকে পুরোপুরি বর্মটার হাত থেকে আলাদা করার আগে ঘুরপাক খেতে খেতে পানির নিচে আরও তলিয়ে যায়। সে হাত পা ছুঁড়ে পানির উপর ভেসে উঠে এবং বুক ভরে শ্বাস নেয় কেবল আরেকটা তীক্ষ্ণ আঘাত অনুভব করার জন্য এবং তারপরে পিঠের মাঝামাঝি আরেকটা।

সে আরেকটা ভাসমান দেহের সাথে পেচিয়ে যেতে শুরু করেছে–মরণ যন্ত্রণায় পা ছুঁড়তে থাকা একটা মরণাপন্ন ঘোড়া। মহবত খান বড় একটা শ্বাস নিয়ে আবার পানিতে ডুব দেয় এবার ঘোড়ার দেহের নিচে এবং নদীর তলদেশের একটা পাথর আঁকড়ে সেখানেই অবস্থান করে যতক্ষণ না পানির স্রোতে ঘোড়ার দেহটা ভেসে যায়। সে আবার পানির উপর ভেসে উঠে এবং নদীর পানিতে সাঁতার কাটার ভুল করে বসে। শ্যাওলা আবৃত পিচ্ছিল একটা পাথরে তার পা পিছলে যায় আর সে আবারও পানিতে তলিয়ে যায়। সে এইবার আর ভুল করে না নিজের সামান্য সাঁতারের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে তীরের দিকে যেতে চেষ্টা করে। কিন্তু সে নদীর বাঁকের কাছে পৌঁছে গিয়েছে এবং স্রোতের বেগ হ্রাস পেতে শুরু করেছে। সে নিজের শেষ শক্তিটুকু কাজে লাগিয়ে কোনোমতে অগভীর পানিতে পৌঁছায় এবং হাচড়পাঁচড় করে উঠে দাঁড়ায় তার ভেজা কাপড় থেকে পানি চুঁইয়ে পড়ার সময় ডান হাতের ক্ষতস্থান থেকে পড়তে থাকা রক্তের সাথে মিশে যায়।

সে নদীর কর্দমাক্ত তীরে বসে ক্ষতস্থানটা পরীক্ষা করে। সে চর্বি আর লালচে মাংসপেশী দেখতে পেলেও কোনো হাড় দেখতে পায় না। আল্লাহতালা মেহেরবান, কেবল ক্ষতটা কেবল মাংসপেশীতে হয়েছে। সে তারপরে বুকের বর্মের ঘর্ষণজনিত ক্ষত পরিহার করতে গলায় জড়ানো হলুদ পশমের কাপড়টা খুলে নেয়। কাপড়টা পানিতে ভিজে জবজব করছে কিন্তু বামহাতে সে বহু কসরত করে অবশেষে সেটা নিংড়ে নেয় এবং দাঁতের সাহায্যে ডান হাতের ক্ষতস্থানে কোনোমতে সেটা বেধে দেয়। সে তারপরে পেছন থেকে আগত একজন অশ্বারোহীর ছায়া দেখতে পায়। সে নিমেষে বুঝতে পারে অশ্বারোহী যদি সম্রাটের সৈন্য হয় তাহলে তাঁর দফারফা হয়ে যাবে কিন্তু সে যখন ঘুরে দাঁড়ায় সে পরম স্বস্তির সাথে লক্ষ্য করে ব্যাপারটা সেরকম নয়। তাঁর দেহরক্ষীদের একজন খেয়াল করেছিল যে সে পানিতে পড়ে গিয়েছে এবং সে যদি কোনোক্রমে তীরে ভেসে আসে সেজন্য তাকে অনুসরণ করে ভাটিতে এসেছে।

মহামান্য সেনাপতি আপনি সুস্থ আছেন?’ লোকটা জিজ্ঞেস করে।

‘আমার তাইতো মনে হয়, সে বলে যদিও শীত আর আঘাতজনিত অভ্যাঘাতের কারণে সে ইতিমধ্যেই কাঁপতে শুরু করেছে। তোমার ঘোড়াটা আমায় দাও, সে একটু থেমে আবার যোগ করে। সে কোনোমতে উঠে দাঁড়ালে তাঁর হাঁটু দেহের ভর নিতে অস্বীকার করতে সে আবারও মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। অশ্বারোহী দ্রুত ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে আসে এবং সে তার কাছে পৌঁছাবার আগেই মহবত খান আবারও পায়ের উপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তাঁর হাঁটু এইবার দেহের ভর নিতে পারে এবং সে টলমল করতে করতে ঘোড়ার দিকে এগিয়ে যায়। দেহরক্ষীর কাছ থেকে সামান্য সাহায্য নিয়ে সে চার হাতপায়ের সাহায্যে ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে। তার পা এতই ঠাণ্ডা হয়ে আছে যে সে তাদের অস্তিত্ব প্রায় অনুভবই করতে পারে না কিন্তু তারপরেও আড়ষ্ট ভঙ্গিতে সে রেকাবে পা রাখে এবং দেহরক্ষীকে উচ্চকণ্ঠে ধন্যবাদ জানিয়ে নদীর অগভীর অংশের চারপাশে চলতে থাকা যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে ফিরে যেতে শুরু করে। জায়গাটা খুব একটা দূরে নয় এবং সে বুঝতে পারে গুলিবিদ্ধ হয়ে পানিতে আঁছড়ে পড়ার পড়ে খুব সম্ভবত সোয়া ঘন্টা সময় অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে এটা দীর্ঘ সময়। সে যতটা বুঝতে পারে তার লোকেরা আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছে, সংখ্যাধিক্যের কারণে আর তাদের প্রতিপক্ষকে গুলিবর্ষণের মুখে নদী অতিক্রম করতে হয়েছে বিধায় সেটাই হওয়া উচিত। সে তারপরে রাজেশকে দেখতে পায় এবং ঘোড়া নিয়ে তার দিকে এগিয়ে যায় এবং শ্রবণ সীমার মধ্যে পৌঁছাতে সে চিৎকার করে জানতে চায়, সোনালী হাওদার হাতিটার কি খবর?

‘আপনার দেহরক্ষীদের একজন আমায় বলেছে যে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে আপনি পানিতে পড়ার সাথে সাথে হাতিটার দুই মাহুতের একজন জন্তুটার গলা থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে যায় এবং অন্যজন, সম্ভবত আহত হওয়ায়, জটাকে ঠিকমত নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। হাতিটা ঘুরে আবার মাঝনদীর দিকে চলে গিয়েছে এবং প্রহরীরা সেটাকে আর দেখতে পায় নি।

‘হাতির পিঠে আমাদের মহামান্য সম্রাজ্ঞী ছিলেন, মহবত খান হঠাৎ বলে বসে, বিশাল হাতিটা বা তার পিঠের সোনালী হাওদার সামান্যতম চিহ্নের খোঁজে তাঁর দৃষ্টি নদীর বুকে ঘুরে বেড়ায়। আমাদের অবশ্যই হাতিটা খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের জানতেই হবে তিনি জীবিত না মৃত।

‘আমাকে জন্মের পর মৃত্যুবরণের জন্য পরিত্যাগ করা হয়েছিল কিন্তু আমি মারা যাই নি। মহবত খান আমাকে হত্যা করা তোমার পক্ষে সম্ভব না, তার পেছন থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। মহবত খান বিস্ময়ে চমকে উঠে এবং ঘুরে দাঁড়ায়। যুদ্ধের হট্টগোল আর নদীর বুকে নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে থাকার কারণে একজন বন্দি নিয়ে তাঁর দেহরক্ষীদের এগিয়ে আসবার শব্দ সে শুনতে পায় নি। মেহেরুন্নিসা বন্দি হলেও তাকে অনুত্তেজিত দেখায়।

মহবত খান তোমায় হত্যা করতে ব্যর্থ হওয়ায় আমায় মার্জনা করবে। আমি এইবার তোমাদের হাতে ধরা দিয়েছি নিজের স্বার্থের কারণে ভয়ে নয়। আমায় এখন আমার স্বামীর কাছে নিয়ে চল। আমি আমার লোকদের ইতিমধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছি। কেবল মনে রাখবে তোমার এই ‘বিজয় সাময়িক।

 ২.০৮ বিভেদের সূচনালগ্ন

‘জাহাপনা, আমি আবারও আপনার সমঝোতার জন্য আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। রাজেশ অশ্বশালার আধিকারিক হিসাবে যোগ্যতার সাথে দায়িত্ব পালন করবে–নিঃসন্দেহে আলিম দাসের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষতার সাথে লোকটা একে দূর্নীতিপরায়ণ তার উপরে ঘোড়াও ঠিকমত চিনে না। মহবত জান মাথা নত করে অভিবাদন জানায় এবং তারপরে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরবার হল ত্যাগ করে। জাহাঙ্গীর এত সহজে রাজেশকে বহাল করতে রাজি হয়েছে দেখে সে অবাক হয়েছে। বস্তুত পক্ষে ঘোড়া সম্পর্কে রাজেশের জ্ঞান পূর্ববতী আধিকারিকের চেয়ে সামান্যই বেশি আর তার মাঝেও অর্থগৃধনুতার লক্ষণ রয়েছে এবং নিজের অবস্থান ব্যবহার করে সেও হয়তো লাভবান হতে চেষ্টা করবে। অল্প কয়েকজন আধিকারিকই এর উপরে উঠতে পারে। কিন্তু নিদেন পক্ষে সে খারাপ না, আর তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত আধিকারিকের জন্য এই বহালটা একটা উপযুক্ত পুরষ্কার।

শ্রীনগরের হরি প্রাবত দূর্গে নিজের বিলাসবহুল আবাসন কক্ষের দিকে সে হেঁটে যাবার সময়, মহবত খান রাজপরিবারকে বন্দি করার পরের মাসগুলোর ঘটনাবলী গভীরভাবে ভাবে। সে অনেক ভাবনা চিন্তার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাঁরা একসাথেই শ্রীনগর অভিমুখে তাদের যাত্রা অব্যাহত রাখবে। তারা তাদের স্বাভাবিক যাত্রা বজায় রাখলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে যে কোথাও কোনো অনভিপ্রেত অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটে নি সেই সাথে তারা যদি আগ্রা বা লাহোর ফিরে যায় তাহলে কীভাবে অন্যান্য অমাত্য আর আধিকারিকদের প্রশ্নের উত্তর দেবে সেই দায় থেকে তাকে মুক্তি দেবে। কাশ্মীরের সুবেদার তার একজন পুরান সহযোদ্ধা এবং পারস্যের তাবরীজ থেকে আগত। সে উভয় কারণেই তাকে সম্ভাব্য সমব্যথী হিসাবে ভেবে নিয়েছে এবং সেটাই হয়েছে, অবশ্য দামী উপহার আর পদোন্নতির প্রস্তাবে সেটা আরও জোরদার হয়েছে।

তাঁর নিজের কাছে সবচেয়ে কঠিন হয়ে দেখা দিয়েছে–এবং এখনও সেটার সমাধান হয়নি–নিজের এই নতুন প্রাপ্ত ক্ষমতা কীভাবে ব্যবহার করবে সেটা নিয়ে; কীভাবে তাঁর এই নিয়ন্ত্রণকে অস্থায়ী তকমা মুক্ত করা যায়। সে জাহাঙ্গীর বা মেহেরুন্নিসার সাথে যখন কথা বলে তারা তাঁর পরামর্শ বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়। তারা কেবল একবারই আপত্তি জানিয়েছিল যখন সে তাদের কয়েকজন ঘনিষ্ট পরিচারককে পরিবর্তনের বা কাশ্মীর যাত্রায় তাদের সাথে আগত অবশিষ্ট দেহরক্ষীদের বরখাস্ত করার প্রস্তাব করেছিল। সে তাদের অভিপ্রায় বাহ্যিক ভাবমূর্তির কারণে মেনে নিয়েছিল এবং তাদের পরিচারক আর দেহরক্ষীরা তাঁদের সাথেই রয়েছে।

জাহাঙ্গীরের স্বাস্থ্য অবশ্য বেশ দুর্বল। তিনি সামান্যই আহার করেন কিন্তু আফিম আর সুরা পানের মাত্রা তাঁর দিন দিন বেড়েই চলেছে। মহবত খান চোখের সামনে দেখতে পায় যে আটান্ন বছর বয়সের একজন পুরুষের পুরো দেহে মাদকের বাহুল্য তাঁদের ছাপ ফেলতে শুরু করেছে। দিনের অধিকাংশ সময় পারিপার্শ্বিকের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ আর ঝাপসা চোখের পাশাপাশি আজকাল প্রায়ই কাশির দমকে তাঁর শরীর কুঁকড়ে যায়। তিনি অবশ্য এখনও দাবি করেন যে কাশ্মীরের পাহাড়ী বাতাসে তাঁর ফুসফুস পরিষ্কার হয়ে যাবে, কিন্তু মহবত খানের মনে হয় সুন্দর পাহাড়ী উপত্যকার উপকারী প্রভাব কার্যকর হতে বেশি সময় নিচ্ছে।

সম্রাট এখনও অবশ্য মাঝে মাঝে যখন তিনি মাদকের প্রভাব থেকে মোটামুটি মুক্ত থাকেন, তখন সামরিক বিষয়ে বিচক্ষণ পরামর্শ দিয়ে এবং তাঁর অমাত্য আর আধিকারিকদের চরিত্র এবং ব্যর্থতা সম্বন্ধে তীক্ষ্ণ মন্তব্য করে মহবত খানকে চমকে দেন। গাছপালা আর পশুপাখি এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের নিয়মকানুন বিশেষ করে কাশ্মীর সম্বন্ধে সম্রাটের বিশদ জ্ঞান দেখে পার্সী সেনাপতি যারপরনাই মুগ্ধ হয়।

জাহাঙ্গীর একবার মাত্র একবারই মহবত খানকে তার বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন। তারা দুজনে একদিন ডাল হ্রদের তীরে ঘোড়ায় চেপে পাশাপাশি ভ্রমণ করছিলো, দেহরক্ষীরা তাঁদের একটু পিছনে অবস্থান করছে তাদের উভয়ের সাথে সবসময়ে যাদের অবস্থান করা সম্রাটের পলায়ন রোধ করার ক্ষেত্রে আর আততায়ীর হাত থেকে তাঁর নিজের সুরক্ষার কারণে মহবত খানের কাছে বিচক্ষণতার পরিচায়ক বলে মনে হয়েছে, যখন জাহাঙ্গীর সহসা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘মহবত খান, তুমি কি এখনও যা চাও সেটা চাইবার ক্ষেত্রে সতর্ক হতে শিখেছো? আমিও অসীম ক্ষমতার অধিকারী হতে চাইতাম যখন সেটা তখনও আমার হয়নি। আর আমি যখন সেটার অধিকারী হলাম, আমি দেখলাম সেই ক্ষমতা নিয়ে কি করবো সেটা ঠিক করা আরো বেশি কঠিন, কাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করবো এমনকি নিজের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠদের ভিতরে যারা রয়েছে তাদের বিষয়েও কখনও সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারি নি।

মহবত খান এই স্বীকারোক্তির সততা অনুধাবন করে মুখ কুঁচকায় কিন্তু জাহাঙ্গীর বোধহয় সেটা লক্ষ্য করেননি এবং তিনি বলতে থাকেন, ‘ক্ষমতা বেশিরভাগ লোকেরই অবক্ষয় ঘটায়। আমি জানি আমার ক্ষেত্রে এটা হয়েছে, আর সেজন্যই আমার স্ত্রীর প্রস্তুত করা আফিম আর সুরার মিশ্রণের ভিতর দিয়ে এর কেন্দ্র থেকে সরে যেতে পেরে আমি আনন্দিত। সম্রাজ্ঞীর উপরে সিদ্ধান্তের দায়িত্ব অর্পণ করাটা ছিল পরম স্বস্তিদায়ক আর তিনিও এখন সেই দায়িত্ব থেকে মুক্ত কারণ তুমি সেটা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। আমি তোমায় সতর্ক করে দিতে চাই, ক্ষমতা নিঃসঙ্গতার দ্যোতক–বা আমার কাছে অন্তত তাই মনে হয়েছে। জাহাঙ্গীর এক মুহূর্ত কি যেন ভাবে তারপরে আবার বলতে শুরু করে। সম্ভবত আমি যে সময় এটা লাভ করেছিলাম ততদিনে আমি নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করতে শুরু করায় সেটা আরও বেশি করে মনে হয়েছিল। আমার দাদিজান হামিদা সদ্য মৃত্যুবরণ করেছেন–আমার একটা বিশাল আশ্রয়স্থল ছিলেন– অবশ্যই আমার আব্বাজানের মতই… যদিও আজ পর্যন্ত আমি জানি না তিনি আমায় কি আসলেই ভালোবাসতেন–এবং আমি তারপরেই আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু, আমার দুধ-ভাই সুলেমান বেগকে হারাই। আমার কোনো সন্তানের সাথে আমার কোনো ধরনের ঘনিষ্ঠতা জন্মায় নি বা আমার স্ত্রীদের সাথে। আমি কিছু দিন আমার কর্তৃত্বের মাঝে মহিমান্বিত হয়ে ছিলাম আর কখনও–এখন আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই–ক্ষমতার প্রয়োগে ছিলাম নির্মম আর খামখেয়ালী। তারপরে আমি মেহেরুন্নিসাকে বিয়ে করি। আমি তাকে ভালোবাসতাম এবং এখনও ভালোবাসি। আমার বিশ্বাস, তিনিও, আমায় ভালোবাসেন…আমায় সেই সাথে আমার ক্ষমতাকেও ভালোবাসেন। তিনি যত বেশি ক্ষমতার অধিকারী হতে চেয়েছেন আমি তার হাতে ততবেশি ক্ষমতা তুলে দিয়েছি। আমি কি ভুল করেছিলাম…?

জাহাঙ্গীর যত দীর্ঘ সময় কথা বলে তাঁর কণ্ঠস্বর ততই সমাহিত এবং অন্তবীক্ষপ্রবণ হয়ে উঠে আর একটা পর্যায়ে তিনি কথা বন্ধ করে সূর্যের আলোয় ডাল হ্রদের ঝিকমিক করতে থাকা পানির মাঝামাঝি কোথাও একটা অনির্ণেয় বিন্দুর দিকে আবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। মহবত খান কোনো উত্তর দেয় না এবং জানে যেকোনো উত্তর প্রত্যাশা করাও হয় নি বা তার কোনো প্রয়োজনও নেই।

সম্রাজ্ঞীর কি মনোভাব? সে ভাবতে চেষ্টা করে। সে যখনই জাহাঙ্গীরের সাথে কথা বলার সুযোগ পেতো তখনই তিনি সেখানে নিয়মিতভাবেই উপস্থিত থাকতেন এবং তাঁর সামনে কোনো ধরনের পর্দা বজায় রাখার ভান। পুরোপুরি ত্যাগ করতেন, যদিও বাকি সময় তিনি হেরেমের নির্জনতার মাঝে প্রত্যাবর্তন করতেন। তাঁদের যখনই দেখা হয়েছে তিনি অকপট চোখে তার চোখের দিকে তাকিয়েছেন এবং কখনও কখনও বিশেষ করে যখন তিনি বলতেন যে সম্রাটের ক্ষমতা তিনি ধারণ করেন, যে তিনি তাঁরই আদেশ পালন করেন, তাঁর চোখে সে যে অভিব্যক্তি দেখেছে তাকে কল্পনা করতে বাধ্য করেছে যে নিয়ন্ত্রণ লাভের একটা অনুষঙ্গ হিসাবে তাকেও প্রলুব্ধ করার ধারণা কখনও হয়ত তিনি অলস মনে চিন্তা করেছেন। তাঁর এখন মাত্র চল্লিশ বছর বয়স, তাঁর নিজের চেয়ে বয়সে মাত্র কয়েক বছরের বড় এবং রমণীদের যখন বয়স হয় বা তাদের শরীরে মেদ জমে তখন প্রায়শই যেমন হয়ে থাকে যে মোমবাতির গা বেয়ে গড়িয়ে নামা মোমের মত তাঁদের মাংসপেশী ঝুলে পরতে শুরু করে তেমনটা তার ক্ষেত্রে এখনও হয় নি। সে অবশ্য প্ররোচনার ধারণাটা কল্পনা হিসাবে বিবেচনা করে মন থেকে কঠোর ভাবে ঝেড়ে ফেলে কিন্তু তারপরেও এখনও তাদের যখন দেখা হয় সেই নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। তিনি যখন মৃদু কণ্ঠে কথা বলেন এবং হাসেন সে সাধারণত, কোনো অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই, তার অনুরোধের প্রতি সম্মতি দেয়, যেমনটা অবশিষ্ট দেহরক্ষীদের মোতায়েন রাখার ক্ষেত্রে দিয়েছে।

তিনি কি সম্রাটকে ভালোবাসেন? হ্যাঁ, সম্ভবত তিনি তাকে ভালোবাসেন। তিনি অবশ্য তাকে আফিমে আসক্ত করে তুলেছেন। তিনি অবশ্যই সম্রাটের ক্ষমতা উপভোগই করেন এবং মোটেই লাজুক নন তার ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারটা মানুষকে জানাতে। সে বহুবার এটা প্রত্যক্ষ করেছে। অবশ্য তিনি যখন তাঁর কপাল মুছে দেন বা তার অসুস্থতার সময়ে তিনি যখন তার সামনে থুতু ফেলার জন্য পিকদানি তুলে ধরেন তখন সে তার চোখে মুখে ভালোবাসার ছায়া দেখতে পেয়েছে। তাঁর নিজের মত বোধহয় তাঁরও অভিপ্রায়গুলো তালগোল পাকান। তারা যখন দক্ষিণে লাহোর অভিমুখে ফিরতি পথে দীর্ঘ যাত্রা শুরু করবে তখন হয়তো সবকিছু অনেক প্রাঞ্জল হয়ে উঠবে, যা আর বেশি দিন বিলম্বিত করা যাবে না। রাতের বেলা আজকাল বেশ শীত পড়ছে এবং শরতকাল প্রায় শেষ হয়ে আসছে। তাকেও ততদিনে নিজের কর্তব্য করণীয় সম্বন্ধে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে। সম্রাটকে তার দলবলসহ বন্দি করার বিষয়ে সে সতর্কতার সাথে পরিকল্পনা করেছিল, সে অনুধাবন করে নিজের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্বন্ধে সে যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা করে নি আর এখন কীভাবে নতুন মিত্র অর্জন করা যায় আর ক্ষমতার বলয়ে নিজের জন্য একটা নিরাপদ স্থান সৃষ্টির বিষয়ে সিদ্ধান্ত হীনতার কারণে সে প্রায় অথর্ব হয়ে পড়েছে। কাশ্মীরে তার আগমনের পরে আসফ খানের নিকট তাঁর জামাতার কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য বার্তা প্রেরণ করা ছাড়া সে আর কিছুই মূলত করে নি, চিঠিতে সে খুররমকে তাঁর সন্তানদের সুস্বাস্থ্য আর তাঁদের সাথে ভালো আচরণের বিষয়ে নিশ্চিত করেছে এবং রাজপরিবারের প্রতি তাঁর সার্বিক আনুগত্যের সাথে সাথে খুররমের অবস্থান বিশেষভাবে অনুধাবনের বিষয়ও জানিয়েছে। মহবত খান গভীরভাবে চিন্তা করে তার মন ঠিক করে যে এক সপ্তাহের ভিতরে নিচের সমতলের উদ্দেশ্যে তাদের যাত্রা শুরু করা উচিত।

*

কাশ্মীর ত্যাগ করতে আমার খারাপই লাগবে।’

‘যদিও আমরা এখানে বন্দি ছিলাম।’

‘হ্যাঁ। কোনো কিছুই এর সৌন্দর্যকে হরণ করতে পারবে না এবং মহবত খান আমাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল।’

‘তাকে সেই শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য কোনো মূল্য দিতে হয় নি। সে যদি আপনার কাছে জানতে চাইতো যে আপনি কাশ্মীর ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত কিনা তাহলে সেটা হতো প্রকৃত সম্মান প্রদর্শন। সে তার পরিবর্তে যাত্রার দিনটা কেবল মার্জিতভাবে ঘোষণা করে গেল যেন আমরা তার ভৃত্য।

‘আমাদের পক্ষে এখানে আর বেশি দিন অবস্থান করা সম্ভব হতো না, তাঁর প্রতি কোনো ধরনের পক্ষপাত প্রদর্শন না করেও বলতেই হয়। আর কয়েক সপ্তাহের ভিতরেই গিরিপথে শীতের প্রথম তুষারপাত শুরু হয়ে যাবে।’

‘সত্যি। যাই হোক, মহবত খানের ধৃষ্টতা সত্ত্বেও, আমরা এখান থেকে বিদায় নেওয়ায় আমি আনন্দিত। আমাদের পরিকল্পনার সাফল্য সমতলে আমাদের প্রত্যাবর্তনের উপরে নির্ভর করছে। মেহেরুন্নিসা উঠে বসে এবং তাঁর স্বামীর জন্য গোলাপজলে সামান্য পরিমাণ আফিম মিশ্রিত করতে থাকে। কাশ্মীর ত্যাগ করে আমরা যখন নিচে নামতে থাকবো আপনি তখন মহবত খানের যেকোনো অনুরোধের প্রতি সম্মতি প্রদর্শনের কথাটা স্মরণ রাখবেন, আপনি পারবেন’না? পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময় এখন যখন ঘনিয়ে এসেছে এটা গুরুত্বপূর্ণ যে তাঁর মনে সন্দেহ উদ্রেক করে এমন কোনো কিছুই আমরা করবো না বা বলবো না।

‘অবশ্যই। সে যাই হোক, মহবত খান খুব সামান্যই অনুরোধ করে।

‘আপনি সেই সাথে আপনার নাতিদের সামনে অবশ্যই সতর্ক থাকবেন। বাচ্চারা তাদের শোনা উচিত নয় এমন কিছু শোনার ব্যাপারে এবং তারপরে লোকজনকে মুগ্ধ করার জন্য সেটা বোকার মত বলতে ভীষণ পারদর্শী।

‘আমি কিছুই বলিনি।

‘ভালো। তারপরেও অবশ্য ঝুঁকি থেকেই যায় যে তারা তাদেরকে তাদের বাবা-মা’র কাছে ফেরত পাঠাবার বিষয়ে মহবত খানকে রাজি করাবার জন্য তাঁরা আড়ি পেতে শুনেছে এমন কিছু হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহার করবে–বিশেষ করে দারা শুকোহ্। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি সে মহবত খানের সাথে ঘুরতে, তাঁর কাছে যুদ্ধের গল্প শুনতে ভীষণ পছন্দ করে এবং সে সবসময়েই তাকে প্রশ্ন করতে থাকে।’

‘দারা বুদ্ধিমান আর কৌতূহলী ছেলে। আর তাছাড়া, সব বাচ্চারাই কি প্রশ্ন করে না? আমি করতাম, আমার বেশ মনে আছে। পুরোটাই বড় হয়ে উঠার একটা অংশ।’

‘সম্ভবত। কিন্তু আমাদের তারপরেও সতর্ক থাকতে হবে, বিশেষ করে আমরা যখন আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনের নিকটবর্তী হতে শুরু করেছি।’

‘আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা যদি তোমার এসব ষড়যন্ত্রের পরিবর্তে মহবত খানের সাথে কোনো ধরনের সমঝোতা, একটা সুবিধাজনক উপযোজনে উপনীত হতে পারতাম। ‘আপনি এমনভাবে বলছেন যেন মহবত খানকে বিশ্বাস করা যায়। তার মনে আসলেই কি রয়েছে সে বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না।’

‘তোমার নিশ্চয়ই মনে হয় না যে সে আমাদের কোনো ক্ষতি করতে চায়?

‘সে একজন মার্জিত ব্যক্তি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং সে নিঃসন্দেহে একজন দক্ষ সেনাপতি, কিন্তু একটা বিষয় কখনও ভুলে যাবেন যে সে সর্বোপরি একজন বিশ্বাসঘাতক যে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে যা জোর করে নয়, আপনিই কেবল প্রদান করতে পারেন। সে সেইসাথে বিশাল একটা ঝুঁকি নিয়েছে, যা–সে যদি অকাট মূর্খ না হয়ে থাকে–সে অবশ্যই বুঝতে পেরেছে। সে যদি নিজের বিপদ বুঝতে পারে তাহলে কে জানে সে তখন ঝোঁকের বশে কি করবে? আর তাছাড়া, আমার “ষড়যন্ত্র” আপনি যে নামেই সেটাকে অভিহিত করেন পরিস্থিতির সাথে মানানসই। মেহেরুন্নিসা গোলাপজল আর আমি একটা গোলাপি বোতলে নিয়ে আঁকায় তারপরে সেখান থেকে খানিকটা ঢেলে নিয়ে সেটা তাঁর হাতে তুলে দেয় এবং তার গায়ের সূক্ষ নক্সা করা কাশ্মিরী শালটা আরেকটু ভালো করে জড়িয়ে দেয়। জাহাঙ্গীরের কাশিটা বেড়েছে এবং বাতাসে শীতের প্রকোপ বাড়ছে।

‘আপনি আমার মত আপনার ভূমিকা পালন করবেন, আপনি করবেন’না? সে আবেদনের সুরে বলে। মহবত খান আমার সম্বন্ধে ভীষণ সতর্ক কিন্তু সে আপনাকে শ্রদ্ধা করে…’

*

জাহাঙ্গীর ঝিলমের উত্তর তীর থেকে তাঁর প্রিয় হাতি বজ্রদায়িনীর হাওদায় উপবিষ্ট অবস্থায়, মহবত খান আর অশোকের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। দক্ষিণের তীরে মাটির একটা ঢিবির উপরে তাঁরা দু’জন নিজ নিজ ঘোড়ায় নিরুদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে উপবিষ্ট অবস্থায়, কাশ্মীর থেকে ফিরতি পথের একেবারে শেষ পর্যায়ে ঝিলমের উপরে তাঁরা যে নতুন নৌকার সেতু নির্মাণ করেছে সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে। নদীতে এখন স্রোত অল্প এবং বসন্তের চেয়ে অনেকবেশি সংকীর্ণ এবং তারা সেতুর তলদেশ নির্মাণের জন্য দড়ি দিয়ে একসাথে বাঁধার জন্য যথেষ্ট সংখ্যক নৌকা বেশ সহজেই সংগ্রহ করতে পেরেছে এবং তারপরে একত্রে বাঁধা নৌকাগুলোর উপরে অস্থায়ী ছাউনির নানা বাতিল টুকরো আর কাঠেরখণ্ড তক্তার মত বিছিয়ে দিয়েছে। আহাওয়া এখনও সদয় আচরণ করেছে এবং গিরিপথ আর উপত্যকার ভিতর দিয়ে দ্রুত নিচে নেমে এসেছে। গাছের পাতা এখানে লাল আর সোনালী বর্ণ ধারণ করতে আরম্ভ করেছে এবং স্থানীয় লোকজন আপেল আর নাশপাতির ফলন ঘরে তোলা আর আঙুর ও আখরোট শুকানোর কাজও শেষ করেছে যার জন্য এই এলাকাটা পুরো ভারতবর্ষে বিখ্যাত। কৃষকেরা তাদের শস্যাগারে ভূট্টা, মূলা আর খড় রুক্ষ শীতকালের দীর্ঘ সময়টায় নিজেদের আর নিজেদের গৃহপালিত পশুদের আহারের জন্য মজুদ করছে। একটা প্রায় শান্তসমাহিত যাত্রা যা প্রায় সকলের মনকেই শান্ত করে তুলেছে। মেহেরুন্নিসা আপাতদৃষ্টিতে ফার্সী কবিতাচর্চায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে, সে কেবল জাহাঙ্গীরের জন্য অস্থায়ী ছাউনি ত্যাগ করে বাইরে থেকে শরতের ফুল আর কীটপতঙ্গের নমুনা সংগ্রহ করতে পরিচারকদের আদেশ দিতে নিজের আবাসন এলাকা থেকে বাইরে বের হোন, সে মহবত খানকে জানিয়েছে যে সম্রাট শরতের সৌন্দর্যে অনুপ্রাণিত হয়ে নতুন উদ্যমে প্রাকৃতিক জগৎ সম্বন্ধে তাঁর চর্চা আবার শুরু করেছেন।

মহবত খান সেদিনই সকালের দিকে জাহাঙ্গীরকে জানিয়েছিল যে সন্ধ্যা নামার অনেক আগেই প্রত্যেকে ঝিলমের অন্য তীরে পৌঁছে যাবে, এবং পরের দিন সকালে তারা লাহোরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে পারবে। সে তারপরে অশোককে আর তার বাহিনীর এক তৃতীয়াংশের অগ্রবর্তী একটা বাহিনী নিয়ে সেতু অতিক্রম করে, সে রাজেশকে রেখে যায়–সেদিন যার পেছনের দিকের নেতৃত্ব দেবার প্রস্তাব মহবত খান কৃতজ্ঞতার সাথে আর কোনো রকম চিন্তাভাবনা না করেই গ্রহণ করেছিল–রাজকীয় পরিবার আর তাঁদের প্রতিরক্ষা সহচরদের যখন আদেশ দেয়া হলে ওপারে পাঠবে এবং সেই সাথে সবার শেষে সে অবশিষ্ট বাহিনী নিয়ে নিজে সেতু অতিক্রম করবে।

সেতুর দিকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে জাহাঙ্গীর খয়েরী রঙের একটা বিশাল স্ট্যালিয়নে উপবিষ্ট বেগুনী পাগড়ি পরিহিত দীর্ঘদেহী এক রাজপুতকে লক্ষ্য করে, সেতুটা তাঁর ঘোড়ার খুরের নিচে দুলে উঠতে প্রাণীটা ঘাবড়ে গিয়ে ছটফট করে উঠে, সেতু অতিক্রম করে পুনরায় উত্তর দিকে ফিরে আসছে। সে সম্ভবত রাজপরিবারকে ওপাড়ে নিয়ে যাবার জন্য মহবত খানের কাছ থেকে রাজেশের কাছে আদেশ নিয়ে আগত বার্তাবাহক। রাজপুত অশ্বারোহী বাস্তবিকই জাহাঙ্গীরের হাতির কাছ থেকে কয়েক ফিট দূরে সাদা একটা ঘোড়ায় আড়ষ্ট ভঙ্গিতে উপবিষ্ট রাজেশের দিকে এগিয়ে যায়, এবং সম্রাট অনুভব করেন যৌবনে যুদ্ধ শুরু আগে তাঁর হৃৎপিণ্ড যেভাবে স্পন্দিত হতো ঠিক সেভাবেই একটু দ্রুত যেন স্পন্দিত হচ্ছে।

‘রাজেশ, সম্রাট আর সম্রাজ্ঞীকে নদীর ওপাড়ে নিয়ে যাবার জন্য মহবত খান তোমায় আদেশ দিয়েছেন।

রাজেশ মনে হয় যেন এক যুগ ধরে ইতস্তত করে। সে তারপরে বলে, তার কণ্ঠস্বর টানটান শোনায় আর আবেগের কারণে উঠানামা করে, মহবত খানকে গিয়ে বলবে আমি পারবো না… আমি বোঝাতে চাইছি আমি করবো না…’ জাহাঙ্গীর নিরুদ্বিগ্ন হয়। মেহেরুন্নিসার পরিকল্পনা কাজ করেছে। মেহেরুন্নিসার তত্ত্বাবধানে তাঁর নিজের রাজেশের সমর্থন লাভের চেষ্টার পাশাপাশি তাকে প্ররোচিত করা আর দীর্ঘসময় ধরে করা ষড়যন্ত্র কাঙ্খিত ফল দিয়েছে। দারুণ একটা মহিলা বটে যাহোক। মেহেরুন্নিসা যদি পুরুষ হতেন তাহলে দারুণ একজন প্রতিপক্ষ হতেন নিঃসন্দেহে।

রাজেশ কথা বলা চালিয়ে যায়, এখন যখন বিরোধের সূচনা হয়েছে অনেক সহজে সে শব্দ চয়ন করতে পারে। মহবত খানকে বলবে যে রাজকীয় দায়িত্বের অধিকারী হবার কারণে, বর্তমানে অশ্বশালার প্রধানের দায়িত্ব প্রাপ্ত হওয়ায়, কেবল সম্রাট আর সম্রাজ্ঞীর প্রতিই আমার কর্তব্য রয়েছে। সম্রাট আমায় আর আমার পঞ্চাশজন লোককে ভবিষ্যত পদোন্নতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যদি তাঁর কাছেই আমরা কেবল জবাবদিহি করি। আমি স্থানীয় অনুগত জায়গীরদারদের বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করবো যারা সম্রাটের পক্ষে এমনকি এই মুহূর্তেও সমবেত হচ্ছে। মহবত খানের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত, কিন্তু তার প্রতি অতীত আনুগত্যের খাতিরে আমি তোমাকে নিরাপদে আর কোনো ক্ষতি না করেই ফিরে যেতে দিয়েছি তাকে গিয়ে অবশ্যই বলবে এবং সেই সাথে এটাও বলবে যে তুমি নদী অতিক্রম করার পরে তুমি আর তোমার সাথের অন্য বিদ্রোহীদের প্রতি তার ন্যায়সঙ্গত ক্ষমতাবলে গুলিবর্ষণের আদেশ দানের পূর্বে আমি সম্রাটকে আধঘণ্টা অপেক্ষা করতে রাজি করেছি।’

মহবত খানকেও নদীর অপর পাড়ে গভীর চিন্তায় ডুবে থাকতে দেখা যায়। জাহাঙ্গীর আর মেহেরুন্নিসা যদিও শান্তভাবেই তাঁর কর্তৃত্ব মেনে নেয়া অব্যাহত রেখেছিলেন নিজের অবস্থান কীভাবে আরও জোরদার করা যায় সেই সম্বন্ধে নিজের সাথে নিজে যুক্তিতর্কের অবতারণা করতে গিয়ে সে নিজের কাছে অনেকটা পরিষ্কার হয়েছে। সম্রাট ঠিকই বলেছিলেন যে কর্তৃত্বের অধিকারী হবার মানেই একাকিত্ব বরণ করা। সে বুঝতে পারে অন্যদের সাথে পরামর্শ করতে বা নিজের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা করতে সে অপারগ, আশঙ্কা করে যে সেটা করলে বিষয়টাকে হয়তো তার সিদ্ধান্ত হীনতা বা দুর্বলতা হিসাবে দেখা হবে। একটা পর্যায়ে যা তাকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর প্রতি কালক্ষেপণের দিকে নিয়ে গিয়ে যাত্রাকালীন সময়ের রসদ আর খাবারের মত মামুলি বিষয়ে অত্যাধিক মাত্রায় মনোনিবেশে বাধ্য করে। সে এখন তাঁর ঘোড়াকে বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে নেয় এবং নৌকার সেতুর উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত পথ অনুসরণ করে নামতে শুরু করে। সম্রাট আর সম্রাজ্ঞী অচিরেই নদী অতিক্রম করা শুরু করবেন।

সে সেতুর কাছে পৌঁছে যখন মৃদু দুলতে থাকা নৌকার সেতুর উপর দিয়ে বেগুনী পাগড়ি পরিহিত রাজপুত অশ্বারোহীকে মন্থর ভঙ্গিতে ফিরে আসতে দেখে সে বিস্মিত হয়, এবং ওপাড়ে তাকিয়ে অনুসরণ করার জন্য প্রস্তুতি নেয়ার কোনো লক্ষণ রাজপরিবারের মাঝে দেখতে ব্যর্থ হয়। এসব কি হচ্ছে? সে লাফিয়ে নিজের ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে আসে এবং বার্তাবাহক অশ্বারোহী সেতুর উপর থেকে নেমে আসা মাত্র তাঁর দিকে দৌড়ে যায়। তরুণ রাজপুত যোদ্ধা তোতলাতে তোতলাতে রাজেশের বক্তব্য পেশ করতে ক্রোধে মহবত খানের মুখ বিকৃত দেখায় এবং সে তাঁর অশ্বচালনার দাস্তানা সজোরে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে।

মেহেরুন্নিসা তাকে কৌশলে পরাস্ত করেছে। সে এতটা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় কীভাবে দিলো? সহসা দিবালোলাকের মত বিষয়টা তার কাছে পরিষ্কার হয় যে ফুল আর কীটপতঙ্গের জন্য তিনি যখন পরিচারকদের তদানুসারে প্রেরণ করতেন তারা তখন আসলে সমর্থকদের কাছ থেকে চিঠি বা বার্তা আদান প্রদান করছিলো। সে এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারে যে রাজদম্পতির অনুরোধে জাহাঙ্গীরের অবশিষ্ট রাজকীয় দেহরক্ষীদের কোনো ধরনের ভাবনা চিন্তা না করে বহাল রাখার মূল্য এখন তাকে দিতে হচ্ছে। রাজেশ তার সাথে কীভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারলো? মেহেরুন্নিসা তাকে কীভাবে বশ করলেন? সম্রাটইবা কীভাবে তার অধীনস্ত যোদ্ধাকে নিজের পক্ষে যোগ দিতে প্রলুব্ধ করলেন?

মহবত খান ক্রোধে অন্ধ হয়ে থাকলেরও অচিরেই এসব প্রশ্নের উত্তর বেশ ভালো করেই অনুধাবন করতে পারে। অর্ধগৃধনু রাজেশের কাছে ক্ষমার প্রতিশ্রুতি আর সে নিজে নিজের জন্য যা অর্জন করেছে তার চেয়ে বেশি পদোন্নতি ছিল যথেষ্ট। তার লোকেরা, যারা বেশির ভাগই একটা দরিদ্র রাজপুত রাজ্যের অধিবাসী রাজেশের পিতা যেখানের রাজা। রাজেশের প্রতিই তাঁরা মূলত অনুগত। বিশ্বাসঘাতকতার কারণ যাই হোক সেটা নিয়ে বিষণ্ণ হবার সময় এখন না। তাকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে আর সেটা কার্যকর করতে হবে। বোধোদয় হবার সাথে সাথে তার মাঝে নতুন উদ্যমের সূচনা হয়। সেতু পুড়িয়ে দাও, সে চিৎকার করে অশোককে আদেশ দেয়, রাজেশ আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। দুপুরের রান্নার জন্য জ্বালান চুল্লি থেকে প্রজ্জ্বলিত কাঠের টুকরো নিয়ে এসো। আমি নিজে প্রথমে আগুন দেব।

বিমূঢ় অশোক ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আদেশ পালন করতে গেলে, মহবত খান অন্য আরেকটা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর ক্রোধ আর প্রতিশোধের অদম্য আকাঙ্খ সত্ত্বেও সে সম্রাট আর সম্রাজ্ঞীকে পুনরায় বন্দি করার আর কোনো চেষ্টা করবে না। সে সেখানেই কেবল যুদ্ধ করতে শিখেছে যেখানে শত্রু আর মিত্রের মধ্যে পরিষ্কার ভেদ রেখা বর্তমান আর প্রতিটা আঘাতের প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া রয়েছে, দরবারের সতত পরিবর্তশীল আর অনিশ্চিত প্রেক্ষাপটে সে লড়াইয়ের উপযুক্ত নয়। জাহাঙ্গীর ঠিকই বলেছিলেন। সর্বোময় ক্ষমতার জন্য আকাঙ্খর সফলতা আপন শাস্তির উল্টো পিঠ। সে আর তার সাথের অবশিষ্ট লোকেরা, এখন যখন তারা সংখ্যা অল্প, পাহাড়ের ভিতরে পশ্চাদপসারণ করবে। সে সেখানে একবার পৌঁছাবার পরেই কেবল নিজের ভবিষ্যত সম্বন্ধে চিন্তা করবে… সিদ্ধান্ত নেবে কার প্রতি সে নিজের আনুগত্যের প্রস্তাব দেবে, কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সর্বোময় নেতার দায়িত্ব যার কাছে অর্পণ করবে।

*

‘তোমার ষড়যন্ত্র সফল হয়েছে। আমি তোমায় অভিনন্দন জানাই,’ সেই রাতে জাহাঙ্গীর বলেন। মেহেরুন্নিসাকে জয়োল্লসিত দেখায়। তিনি ব্যাঘ্র শিকারের সময় সাফল্যের সাথে শিকার সমাপ্ত করার পরে প্রায়ই তার চোখে মুখে ঠিক এমনই অভিব্যক্তি দেখেছেন। মহবত খান–তাঁর অন্যতম সেরা আর সবচেয়ে বুদ্ধিমান সেনাপতিকে, মেহেরুন্নিসা কীভাবে সহযোগিতার ভান করে কৌশলে পরাস্ত করেছে চিন্তা করে তিনি হাসেন, তাঁর সাফল্য এমনই অনায়াস যে মহবত খানকে মনে হয়েছে সে ঝিলমের পানিতে একটা বেশ বড় ট্রাউট মাছ সম্রাজ্ঞীর মায়ার কাছে পরাভূত।

‘আমি মহবত খানকে এসব কিছু শুরু হবার দিনই সতর্ক করেছিলাম যে তার বিজয় সাময়িক। আমি আশা করি আমার কথা সে মনে রেখেছে।

‘আমি নিশ্চিত সে রেখেছে। তোমার কি মনে হয় সে এখন কি করবে?

‘আমি জানি না। আমার সন্দেহ হয় সে নিজেও সেটা জানে। সে যদি সাম্রাজ্য ত্যাগ করে, তাহলে বিচক্ষণতার পরিচয় দেবে, সম্ভবত পারস্যেই আবার ফিরে যাবে। সে অবশ্যই জানে যে তাঁর এই অপরাধের জন্য সে কোনোভাবেই শাস্তি এড়াতে পারবে না এবং আপনি লাহোরে নিরাপদে পৌঁছান মাত্রই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আপনি সৈন্য প্রেরণ করবেন।’

জাহাঙ্গীর মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। মেহেরুন্নিসা ঠিকই বলেছে। মজবত খান একটা সুযোগ দেখতে পেয়ে সেটা গ্রহণ করেছিল। তাকে যদি এর জন্য শাস্তি দেয়া না হয় তাহলে অন্যরা হয়ত বিদ্রোহের জন্য প্ররোচিত হতে পারে। কিন্তু এমন একটা ঘটনা ঘটার সুযোগই তৈরি হবার কথা না। তিনি সম্ভবত বৃদ্ধ হচ্ছেন… ভাবনাটা উঁকি দিতেই তার বিজয়োল্লাস খানিকটা হ্রাস পায়। তিনি যখন তার রাজধানীতে ফিরে যাবেন তখন তাকে অবশ্যই সবাইকে দেখাতে হবে যে নিজের সাম্রাজ্যের উপর এখনও তার অটুট নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কিন্তু তিনি নিজেকে আপাতত নিরুদ্বিগ্ন থাকতে পরামর্শ দেন–আজ রাতে তিনি আর মেহেরুন্নিসা তাঁদের এই নতুন প্রাপ্ত স্বাধীনতা কেবল উপভোগ করবেন এবং তাদের এই সাফল্য উদ্‌যাপন করার জন্য দারা শুকোহ্ আর আওরঙ্গজেবও তাঁদের সাথে যোগ দেবে।

‘আমার নাতিদের আমার কাছে নিয়ে এসো, তিনি একজন কচিকে ডেকে আদেশ দেন। কয়েক মিনিট পরে ছেলে দুটো তাবুর ভেতর প্রবেশ করে এবং জাহাঙ্গীর পর্যায়ক্রমে তাদের দু’জনকেই আলিঙ্গণ করেন। এটা দারুণ একটা মুহূর্ত, তিনি তাদের বলেন।

‘কেন, দাদাজান?’ দারা শুকোহ জানতে চায়।

জাহাঙ্গীর তার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় মনে মনে ভাবেন যে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যা কিছু ঘটেছে ছেলেদের কাছে সেসব নিশ্চয়ই বিচিত্র বলে প্রতিয়মান হয়েছে, আমরা আমাদের শত্রু মহবত খানকে কৌশলে পরাস্ত করেছি এবং আমাদের স্বাধীনতা পুনরায় অর্জন করেছি।

‘মহবত খান কি আমাদের শত্রু ছিল? দারা শুকোহকে বিস্মিত দেখায়।

‘হ্যাঁ, জাহাঙ্গীর উত্তর দেয়। সে আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাদের বন্দি রেখেছিল এবং আমার পরামর্শদাতা হিসাবে কাকে আমার মনোনীত করা উচিত আর সেই সাথে কীভাবে আমার সাম্রাজ্য পরিচালনা করা উচিত সেই নির্দেশ সে আমায় দিতে চেয়েছিল।

কিন্তু আমি ভেবেছিলাম… মানে আমি বলতে চাইছি আপনি যেভাবে তাঁর সাথে কথা বলতেন… আপনারা পরস্পরের বন্ধু হয়ে উঠেছেন।

জাহাঙ্গীর মুচকি হাসে। না। সেটা ছিল ভান। একজন শাসককে তিনি যা চান সেটা অর্জন করতে অনেক সময় ছলনার আশ্রয় নিতে হয়। তোমরা। আরো বড় হলে এটা বুঝতে পারবে। এখন, এসো একটু মিষ্টি মুখ করবে–আওরঙ্গজেব তুমিও এসো।

তিনি বাদামের গুড়ো দেয়া কেকের পুর দেয়া শুকনো খুবানি ভর্তি একটা রূপার তশতরি তাঁদের দিকে এগিয়ে দিতে, আওরঙ্গজেব যদিও একমুঠো খুবানি নেয় কিন্তু দারা শুকোহ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তাকে তখনও চিন্তিত দেখায়, সে তারপরে বলে, আমার আব্বাজান আপনার কাছে আমাদের প্রেরণ করার আগে আপনার সম্বন্ধে অনেক কিছু বলেছেন।

জাহাঙ্গীর আড়ষ্ট হয়ে যায়। কি বিষয়ে?

‘আপনি আমাদের দাদাজান আর সম্রাটই কেবল না আপনি একজন মহান মানুষ। আমরা তাই সবসময়ে আপনাকে যেন সম্মান প্রদর্শন করি। মহবত খান কি সেটাই করতে ভুল করেছিল? সে কি আপনাকে সম্মান প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়েছিল?

জাহাঙ্গীর মাথা নাড়ে, কিন্তু তার মন তখন অন্য কোথাও পড়ে রয়েছে। খুররম কি আসলেই তাঁর সম্বন্ধে এসব বলেছে? যদি তাই হয়, সেটা কি তাঁর ছেলেরা যেন তাকে বিরক্ত না করে সেজন্যই সে কেবল বলেছে নাকি কথাগুলো সে সত্যিই বিশ্বাস করে?

*

ভীমবর শহরের কাছে উত্তরপশ্চিমের সমভূমির উপর স্থাপিত তাঁর অস্থায়ী শিবিরের উপরের আকাশ আতশবাজিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে জাহাঙ্গীর সেদিকে তাকিয়ে থাকে। শাহরিয়ার আর লাডলি তাদের শিশু কন্যা–জাহাঙ্গীর কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে ভূমিষ্ট–এবং লাহোর পর্যন্ত বাকি পথটা তাকে পাহারা দেয়ার জন্য দশ হাজার সৈন্যের শক্তিশালী বাহিনী নিয়ে দু’দিন আগে তাদের সাথে এসে যোগ দিয়েছে। তাঁর সবচেয়ে বয়য়াজ্যেষ্ঠ বেশ কয়েকজন অমাত্য আর আধিকারিকও তাঁদের সাথে রয়েছে। তাদের নিরাপত্তার বিষয়টা এখন যখন সন্দেহের উর্ধ্বে, মেহেরুন্নিসা পরামর্শ দেয় তাদের আগমন আর মহবত খানের কাছ থেকে পরিত্রাণ দুটো ঘটনা উদ্যাপনু করতে একটা ভোজসভার আয়োজন করতে এবং তিনি সাথে সাথে সম্মতি দেন। সবশেষে সবচেয়ে বড় আতশবাজিটা বিস্ফোরিত হয়ে রাতের আকাশে লাল আর বেগুনী আলোক বিন্দু ছড়িয়ে দিতে জাহাঙ্গীর পরিতৃপ্ত বোধ করেন। মহবত খানের বিশ্বাসঘাতকতা সত্ত্বেও, নিজের সাম্রাজ্যের উপরে তার নিয়ন্ত্রণ এখনও অটুট রয়েছে। মহবত খান এক মাস আগে দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় পালিয়ে যাবার পর সেখান থেকে আর প্রকাশ্যে বের না হওয়ার বিষয়টা তার গুপ্তদূতেরা এসে নিশ্চিত করার ব্যাপারটাই কেবল না সেই সাথে তার আধিকারিকেরাও সংবাদ নিয়ে এসেছে যে খুররম দক্ষিণের প্রদেশে শান্তই রয়েছে, তারা সেই সাথে আরো জানিয়েছে যে গুজরাতের মোগল সুবেদার সেখানের একটা বিদ্রোহ প্রচেষ্ট কঠোর হস্তে দমন করেছে এবং সাম্রাজ্যের অন্যত্র শান্তি বিরাজ করছে।

আতশবাজি–উত্তরে পেশোয়ার আর খাইবার গিরিপথ অভিমুখে ভ্রমণকারী চিনা বণিকদের একটা কাফেলার কাছ থেকে আজ রাতের ফুর্তির উপক্রম হিসাবে যা কেনা হয়েছে–পোড়ান শেষ হতে জাহাঙ্গীর ভোজের আয়োজন নিজে তদারক করে। সে বিশাল শিবিরের একেবারে মধ্যখানে, তাঁর টকটকে লাল তাবু থেকে পঞ্চাশ গজ সামনে, রাজকীয় মঞ্চ স্থাপনের আদেশ দিয়েছে এবং সোনালী কাপড় দিয়ে পুরো মঞ্চটা মুড়ে দিতে বলেছে। নিচু রাজসিংহাসন আর তার পাশে শাহরিয়ারের জন্য সূক্ষ কারুকাজ করা একটা তেপায়া ইতিমধ্যেই সেখানে রাখা হয়েছে। একপাশে কিছুটা দূরে, মেহেরুন্নিসা আর তার মেয়ে লাডলীর আহারের জন্য সোনালী জরির কারুকাজ করা সবুজ রেশমের পর্দা দিয়ে একটা এলাকা ঘিরে দেয়া হয়েছে। পরিচারকেরা এখনও ব্যস্ত ভঙ্গিতে মঞ্চের সামনে জাহাঙ্গীরের বয়য়াজ্যেষ্ঠ সেনাপতি আর উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের জন্য রূপার থালা আর পানপাত্র সজ্জিত একটা লম্বা নিচু টেবিলের চারপাশে সোনালী জরির কারুকাজ করা লাল মখমলের তাকিয়া বিন্যস্ত করছে। নিম্নপদস্থ আধিকারিক আর অমাত্যদের জন্য আরেকটু পেছনে পাতা টেবিলগুলোর সজ্জায় আড়ম্বর একটু কম আর তাঁর বাকি লোকদের জন্য অন্য ভৃত্যরা শিবিরের অন্যত্র খাবারের বন্দোবস্ত করছে।

মাংস ঝলসানোর গন্ধ–হরিণ, ভেড়া, হাস, মোরগ আর ময়ূরী–ইতিমধ্যেই শতাধিক ভোলা উনুনের উপর স্থাপিত মাংসভর্তি শিক থেকে বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। বহনযোগ্য তন্দুরী উনুনের ভেতর টক দই আর মশলা দিয়ে মাখান মাংস দেয়া হয়েছে আরও রসনাতৃপ্তভাবে প্রস্তুত করতে। বিশাল সব হাড়িতে শুকনো কাশ্মীরী ফলের–খুবানি, চেরী আর সুলতানা–সাথে মশলার গন্ধযুক্ত বিভিন্ন পদ ইতিমধ্যেই টগবগ করে ফুটছে। ময়দা মাখিয়ে তাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে যাতে প্রয়োজন অনুযায়ী তৈরি করে গরম গরম অবস্থায় রুটি টেবিলে নিয়ে আসা যায়। চাল আর গোলাপজল আর গুড়ো করা কাঠবাদাম আর দুধ দিয়ে তৈরি ক্ষীরের পাত্র, কোনো কোনোটার উপরে সোনার তবক দেয়া কাপড় দিয়ে ঢাকা রয়েছে। হা, সবকিছু যেমনটা হওয়া উচিত তেমনই হয়েছে। জাহাঙ্গীর সন্তুষ্টির শব্দ করে সম্মতি জানায় এবং নিজের তাবুতে ফিরে যায় যেখানে ভোজসভার জন্য তাকে সজ্জিত করতে তাঁর কর্মিরা অপেক্ষা করছে।

এক ঘন্টা পরে, তাঁর আধিকারিকেরা নিজেদের আসন গ্রহণ করতে, তূর্যধ্বনির সাথে সাথে রাজকীয় তাবুর কানাত পুনরায় উঠে যায় এবং ভেতর থেকে চারটা পালকি বের হয়ে আসে প্রতিটাই চারজন করে বেহারা বহন করছে। প্রথম পালকি দুটো তাবুর সামনের মঞ্চের কাছে থামে। পরের পালকি দুটো, যেগুলোয় পর্দা দেয়া, পেছনে নিয়ে যাওয়া হয় যাতে মেহেরুন্নিসা আর লাডলি দর্শনার্থীদের দৃষ্টি এড়িয়ে পর্দা ঘেরা এলাকায় প্রবেশ করতে পারে। শেষবারের মত তূর্যধ্বনির গগনবিদারী একটা আওয়াজের সাথে সাথে জাহাঙ্গীর ধীরে ধীরে নিজের পালকি থেকে নিচে নামতে দ্বিতীয় পালকি থেকে হালকাঁপাতলা অবয়বের শাহরিয়ার নেমে আসে তাঁর সাথে যোগ দিতে। যুবরাজ মঞ্চে আরোহণ করে সিংহাসনের দিকে এগিয়ে যাবার সময় সম্রাটকে সাহায্য করে।

জাহাঙ্গীর সিংহাসনে উপবিষ্ট হবার আগে এক মুহূর্তের জন্য মাথার উপরে কালো মখমলের মত আকাশের বুকে জ্বলজ্বল করতে থাকা তারকারাজির দিকে তাকায়। তিনি কি অলীক কল্পনা করছেন নাকি সত্যিই আজ রাতে তারকারা উজ্জ্বলভাবে দীপ্তি ছড়াচ্ছে, তার সাফল্যের উদ্‌যাপনকে নিজেদের রূপালি প্রভা দিয়ে সম্মান জানাচ্ছে? তিনি তাঁর পরে ইঙ্গিতে সবাইকে চুপ করতে বলেন এবং কথা শুরু করেন, তাঁর কণ্ঠস্বর কঠোর। আমরা আজ রাতে এখানে আমার প্রিয় পুত্র শাহরিয়ারের আগমন আর কুটিল মহবত খানের আধিপত্য থেকে আমাদের পরিত্রাণ উদ্যাপন করতে সমবেত হয়েছি। তার অপরাধ ক্ষমা করা হয়নি কিংবা কেউই তার কথা ভুলে যায়নি। তার শাস্তি কেবল স্থগিত রয়েছে।’ তিনি কথা থামিয়ে নিজের চারপাশে তাকিয়ে দেখার সময় মোগলদের সবুজ রঙের পোষাক পরিহিত রাজেশকে উৎকণ্ঠিত দেখেন, তাঁর খালি অক্ষিকোটরের উপরে সবুজ রঙেরই একটা পট্টি রয়েছে। তাঁর এক চোখের দৃষ্টি তাঁর সামনে রক্ষিত রূপার থালার উপর নিবদ্ধ এবং সে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে নিজের পোষাকের একটা বোম অনবরত মোচড়াচ্ছে।

‘কিন্তু এটা অতীতের ঘটনাবলী এবং তাদের পরিণতি রোমন্থনের সময় না। সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জাহাঙ্গীর কথা বলার সময় লক্ষ্য করেন শাহরিয়ার নিজের তেপায়ার উপরে একটু নড়ে বসে, কিন্তু রাজকীয় তাবু ত্যাগ করার সময় মেহেরুন্নিসার অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে শাহরিয়ার তার উত্তরাধিকারী এই বিষয়টার পুনরাবৃত্তি করবেন না। আজ রাতে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই–বিশেষ করে তার কাশির প্রকোপ যখন কমে এসেছে এবং তিনি নিজের মাঝে অনেকবেশি প্রাণশক্তি অনুভব করছেন। শাহরিয়ার সম্বন্ধে মেহেরুন্নিসার ক্রমাগত আর মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা সত্ত্বেও জাহাঙ্গীর তাকে যেসব দায়িত্ব দিয়েছিলেন সুচারুভাবে সেগুলো সম্পাদনে তাঁর পারঙ্গমতা মাঝে মাঝে তার পিতাকে আশ্বস্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে যে তাকে যদি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা হয় তাহলে সে সাম্রাজ্যকে সমৃদ্ধির পথে নেতৃত্ব দেয়ার মত যথেষ্ট যোগ্যতা বা বুদ্ধির অধিকারী। তার সদ্য আগত অমাত্যদের কেউ কেউ অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে, কাশ্মীরে তাঁর বন্দিত্বকালীন সময়ে শাহরিয়ারের সিদ্ধান্তহীনতা আর নিষ্ক্রিয়তার খবর জানানোয় সেই ধারণা আরও প্রবল হয়েছে।

মেহেরুন্নিসাকে যদিও তিনি কিছুই জানাননি, কিন্তু তিনি মনে মনে চিন্তা করতে শুরু করেছেন নিজের আব্বাজানের বিরুদ্ধে তাঁর নিজের বিদ্রোহের পরে তিনি যেমন তার সাথে সব বিরোধের মীমাংসা করেছিল সেভাবে কি তার আর খুররমের মাঝে একদিন সবকিছু আবার আগের মত হতে পারে না। দারা শুকোহর কথা তাকে ভাবতে বাধ্য করেছে… হৃদয়ঙ্গম করতে যে সম্ভবত উভয় পক্ষেরই ভুল হয়েছে। খুররমের প্রতি এক সময় তার মনে যে ভালোবাসা ছিল সেটা আবার জাগ্রহ হতে শুরু করেছে, তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে তাঁর জন্ম কত মঙ্গলময় ছিল… সে কেমন সাহসী যোদ্ধা আর নেতা ছিল… সে নিজেকে আজ্ঞানুবর্তী কিন্তু মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষমতাহীন শাহরিয়ারের চেয়ে বাবরের প্রতিষ্ঠিত বংশের ধারা এগিয়ে নেয়ার জন্য অনেক বেশি যোগ্য হিসাবে প্রমাণ করতে পারতো। তিনি নিজেকে হয়ত ঠাকাচ্ছেন কিনা, সেটা সময়ই বলে দেবে…

নিজের দিবাস্বপ্নে বিভোর জাহাঙ্গীরকে একজন আধিকারিকের ইঙ্গিতপূর্ণ কাশি বর্তমানে এবং তিনি যা বলতে চেয়েছিলেন সেই মুহর্তে ফিরিয়ে আনে। আমার বিশ্বাস আমরা একটা স্বর্ণযুগের সূচনা দেখতে যাচ্ছি। আমাদের ভেতরের শত্রুরা পরাস্ত হয়েছে আর আমাদের বহিশত্রুরা আমাদের সীমান্তে আক্রমণ করতে ভীত। আমাদের মহান সাম্রাজ্যের প্রজাদের জন্য শান্তি আর সমৃদ্ধি অপেক্ষা করছে। আজ রাতে আমি তোমাদের এটাই বলতে চেয়েছি। কিন্তু সেই সাথে আরও কিছু আছে…তোমাদের সবার সামনে আমি আমার সম্রাজ্ঞী মেহেরুন্নিসাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই যিনি আমাদের সৌভাগ্যকে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসতে আমায় দারুণ সাহায্য করেছেন। পারিবারিক জীবনের বাইরে মেয়েরা সাধারণত এমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়না কিন্তু তিনি আমায় জীবনের সবক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন এবং আমি সেজন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই।’

জাহাঙ্গীর তারপরে নিজের দু’হাত শূন্যে তুলে চিৎকার করে উঠে, ‘মোগলদের জিন্দাবাদ! মোগল সামাজ্য জিন্দাবাদ!’ মোগল সাম্রাজ্য দীর্ঘজীবি হোক! সমবেত জনতার মাঝ থেকে সাথে সাথে ভেসে আসে, ‘পাদিশাহ জাহাঙ্গীর জিন্দাবাদ। সম্রাট জাহাঙ্গীর দীর্ঘজীবি হোন! জাহাঙ্গীর নিজের সিংহাসনে আসন গ্রহণ করতে উদ্দাম চিৎকারে চারপাশ মুখরিত হয়ে উঠে। বহু বছর আগে আগ্রা দূর্গের ঝরোকা বারান্দায় সম্রাট হিসাবে নিজের প্রথম উপস্থিতির ক্ষণটার কথা তার আবার মনে পড়ে যায়। কতটা পথ তিনি অতিক্রম করে এসেছেন। ভালো আর মন্দ কত অভিজ্ঞতাই না তার হয়েছে। তাঁর আব্বাজান আকবরের যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করার যে শপথ সে নিয়েছিল সেটা পুরোপুরি সম্পূর্ণ করতে তিনি আর কত কিছু অর্জন করতে চান। ঠিক তখনই ঝলসানো মাংসের সুগন্ধ তাঁর নাকে ভেসে আসে। একজন পরিচারক চুনিলাল ডালিমের কোয়া দিয়ে সাজান হরিণের মাংসের একটা পাত্র তার সামনে নামিয়ে রাখে। আজই অনেকমাসের ভিতরে প্রথমবারের মত তিনি খাবারের জন্য জোরালো রুচি অনুভব করেন। অনভ্যস্ত অভিরতি নিয়ে তিনি খেতে শুরু করেন।

*

তিনঘন্টা পরে মেহেরুন্নিসা যখন, জাহাঙ্গীরের শারীরিক দুর্বলতাকে বিব্রত না করতে, শয্যা থেকে ধীরে আর ধৈর্যসহকারে উঠে বসে যেখানে অনেকদিন পরে তারা পরস্পরের সঙ্গসুখ উপভোগ করেছে তখনও তাবুর বাইরে থেকে ভোজসভার আনন্দ মুখরিত শব্দ ভেসে আসে। তিনি এরপরে, রাতের বেলা সচরাচর তিনি যা করে থাকেন, তার জন্য গোলাপজলের সাথে আফিম মিশ্রিত করেন এবং গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবার আগে তিনি মিশ্রণটা ধীরে ধীরে পান করেন, মেহেরুন্নিসা আবারও যখন তাঁর পাশে এসে শয্যা গ্রহণ করে তখন তার মুখে প্রশান্তির একটা হাসি ফুটে থাকতে দেখে। এখন, নিজের রেশমের আলখাল্লাটা ভালো করে শরীরে জড়িয়ে নিয়ে মেহেরুন্নিসা তাঁর স্বামীর মুখের দিকে তাকায়। তাঁর কৃতজ্ঞতা–তার বেশিরভাগ বক্তৃতার মত, তাঁর সামনে আগে অনুশীলন করেন নি–মেহেরুন্নিসাকে গভীরভাবে আপুত করেছে। তাদের সামনে এখনও অনেকগুলো বছর রয়েছে এবং তার সাহায্যে সেগুলো হবে তাঁর জীবনের মহোত্তম। তারপরে… বেশ, সিংহাসনে অধিষ্ঠিত শাহরিয়ারকে নিয়ে–সে যেন সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয় সেটা তিনি নিশ্চিত করবেন–তখনও তিনি সাম্রাজ্যের সবচেয়ের ক্ষমতাবান মানুষ হিসাবে বিদ্যমান থাকবেন। শাহরিয়ারের বোধশক্তি খুব একটা প্রখর না এবং লাডলির সাহায্যে তিনি সহজেই তাকে নিজের মত করে গড়ে নিতে পারবেন। খুররম আর মিষ্টি আরজুমান্দ এবং তাঁদের দুই সন্তানের ভাগ্যের ব্যাপারে যারা এই মুহূর্তে তাবুর অন্য আরেকটা অংশে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তিনি পরে সিদ্ধান্ত নেবেন। সুখকর ভাবনায় মশগুল হয়ে তিনি ঘুরে দাঁড়ান এবং নিজের পর্দা ঘেরা শয়ন এলাকার দিকে হেঁটে যান।

*

‘হেকিমকে ডেকে নিয়ে এসো।

চিৎকারটা ছড়িয়ে যেতে মেহেরুন্নিসা নিজের বিছানায় উঠে বসেন। তিনি উঠে বসতে পরিচারিকাদের একজন তার বিছানার চারপাশের বৃত্তাকার পর্দা সরিয়ে দেয় এবং উত্তেজিত কণ্ঠে বলে, ‘সম্রাজ্ঞী, জলদি আসেন। আমাদের সম্রাট। তিনি অসুস্থ।’

মেহেরুন্নিসা সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায় এবং তাঁর ঘুমের সময়ে পরিহিত কামিজের উপরে সবুজ রেশমের আলখাল্লাটা জড়িয়ে নিয়ে, দ্রুত পায়ে তারপরে জাহাঙ্গীরের শয়ন কক্ষের দিকে এগিয়ে যায়। তিনি চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন, ঠোঁটের কোনো দিয়ে বমির একটা পাতলা রেখা গড়িয়ে পড়ছে। হেকিম ইতিমধ্যে পৌঁছে গিয়েছে এবং জাহাঙ্গীরের একান্ত পরিচারক যে শয্যার কাছেই শুয়ে থাকে বলছে, আমি একটু আগে তাকে কাশতে শুনেছি কিন্তু তারপরে সবকিছু শান্ত। আমি প্রতি ঘন্টায় যেমন তাকে এসে দেখে যাই সেরকম একটু আগে এসে তাকে এভাবে দেখতে পাই।’

হেকিম মুখ তুলে তাকান এবং মেহেরুন্নিসাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কোনোরকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই বলেন, ‘সম্রাজ্ঞী, সম্রাট ইন্তেকাল করেছেন। তিনি নিশ্চয়ই কাশির সময় বমি করেছিলেন এবং তারপরে শ্বাসরুদ্ধ হয়েছেন। আমার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব না।’

মেহেরুন্নিসার মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল একটা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। জাহাঙ্গীর মৃত… যে মানুষটা তাকে কখনও প্রত্যাখ্যান করে নি, সবসময়ে তাকে কামনা করেছে, তাকে কখনও পরিত্যাগ করার কথা কল্পনাও করে নি এবং সবসময়ে তার ভাবনা আর ইচ্ছার প্রতি মনোযোগী থেকেছে সে আর নেই। তিনি হাঁটু ভেঙে মাটিতে বসে এবং আঙুলের উল্টো দিক দিয়ে তার উষ্ণতা হারাতে থাকা মুখ স্পর্শ করতে তার গাল বেয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরতে শুরু করে–ভালোবাসার, বিহ্বলতার আর সর্বস্ব হারাবার অশ্রু। তিনি কিছু সময়ের জন্য কান্না আর শোকের মাঝে নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন, তারপরে অন্য আরেকটা ভাবনা ধীরে ধীরে তার বিক্ষিপ্ত চেতনায় আকৃতি লাভ করতে শুরু করে। এখন কি হবে? জাহাঙ্গীর ইচ্ছাকৃত ভাবে না হলেও তাকে পরিত্যাগ করেছেন। তাকে আরো একবার অবশ্যই নিজেকে আর নিজের অবস্থানকে সুরক্ষিত করতে হবে। তিনি হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখের অশ্রু মুছে ফেলেন, উঠে দাঁড়ান এবং নিজেকে খানিকটা সুস্থির করে নিয়ে তারপরে শান্ত কণ্ঠে বলেন, শাহরিয়ার আর লাডলিকে ডেকে নিয়ে এসো।

এক কি দুই মিনিট পরে তরুণ দম্পতিকে ভেতরে নিয়ে আসা হয়, তাঁদের বিমূঢ় চোখের তারায় বিভ্রান্তি, ঘুম আর আতঙ্ক মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। মেহেরুন্নিসা কালক্ষেপণ না করে কথা বলতে শুরু করে। তোমরা দেখতেই পাচ্ছো, সম্রাট ইন্তেকাল করেছেন। শাহরিয়ার, তুমি যদি তার স্থানে অভিষিক্ত হয়ে শাসন পরিচালনা করতে চাও তাহলে তোমরা দু’জনেই অবশ্যই আমি যা বলছি ঠিক তাই করবে।

২.০৯ সম্রাটের শবাধারের অনুগমনকারী

‘শাহ সুজা, আপনার তরবারি উঁচু রাখেন নতুবা আপনি কখনও একজন দক্ষ অসিবিদ হতে পারবেন না।’ বুরহানপুরের দূর্গ-প্রাসাদের বিশাল কামরাগুলোর একটায় খুররম তার এগার বছরের ছেলেকে হাত থেকে নিজের ভেতা অনুশীলনের অস্ত্র প্রবলভাবে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করতে দেখে হাসে। খুররম সহসা সর্তক হয়ে উঠে যে তার পেছনে কামরার ভেতরে অন্য কেউ প্রবেশ করেছে। সে দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়ে তাঁর কচিদের একজনকে প্রবেশ করতে দেখে।

‘যুবরাজ, আমায় মার্জনা করবেন, হতভম্ব তরুণ তোতলাতে তোতলাতে কোনোমতে বলে, কিন্তু এইমাত্র পাঁচজন অশ্বারোহীর একটা দল আস্কন্দিতবেগে অঘোষিতভাবে নিচের আঙ্গিনায় এসে উপস্থিত হয়েছে। তারা দাবি করেছে সম্রাটের অস্থায়ী শিবির থেকে যাত্রা করে গত বিশদিন তাঁরা নাগাড়ে ঘোড়া হাঁকিয়েছে, পথে খাওয়া, ঘুমান আর ঘোড়া বদলাতে সামান্য সময়ের জন্য কেবল যাত্রাবিরতি করেছে। তারা বলছে আসফ খানের কাছ থেকে তাঁরা অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটা চিঠি নিয়ে এসেছে যা আপনার কাছেই কেবল ব্যক্তিগতভাবে দেয়া যায়।

খুররম সাথে সাথে নিজের তরবারি নামিয়ে রাখে এবং, চিঠির সম্ভাব্য বিষয়বস্তু নিয়ে ইতিমধ্যেই তার মনে ঝড়ের বেগে ভাবনা বইতে শুরু করেছে, কামরা ত্যাগ করে এবং নিচের আঙিনার দিকে নেমে যাওয়া সিঁড়ির দুটো ধাপ একেকবারে টপকে নিচে নামতে শুরু করে। আওরঙ্গজেব বা দারা শুকোহর কি কিছু হয়েছে? মেহেরুন্নিসা কি জাহাঙ্গীরকে রাজি করিয়েছেন তাঁদের ভূগর্ভস্থ কোনো কারাপ্রকোষ্ঠে প্রেরণ করতে? নিশ্চয়ই না… কিন্তু যদি তাই হয় তাহলে আরজুমন্দকে তিনি সেকথা কীভাবে বলবেন? কিন্তু চিঠিতে সম্ভবত জাহাঙ্গীরের প্রধান পরামর্শদাতা হিসাবে মহবত খানের নিজেকে বহাল করার উদ্ভট গল্প সম্বন্ধে আরো গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলা হয়েছে। মহবত খানের আপোষমূলক কিন্তু অদ্ভুত চিঠিগুলো এবং দূরে থাকার আর শান্ত থাকার জন্য আসফ খানের বারংবার পরামর্শের কারণেই কেবল খুররম হস্তক্ষেপ করতে কোনো ধরনের বাহিনী গঠনের প্রয়াস থেকে বিরত থেকেছে, যদিও সে বালাঘাট থেকে তাঁর পরিবারসহ পশ্চিমে বুরহানপুরে চলে এসেছে উত্তরমুখী প্রধান পথগুলোর কাছাকাছি অবস্থানের অভিপ্রায়ে। সাম্প্রতিক সংবাদ হল মেহেরুন্নিসা পুনরায় নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন এবং মহবত খান দলবল নিয়ে পাহাড়ে পালিয়ে গিয়েছে। সেই সময়ে খুররমের কাছে মহবত খানের মত এমন নেতৃস্থানীয় একজন সেনাপতির লড়াইয়ের কোনো চেষ্টা না করাটা ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হয়েছে। তিনি সম্ভবত আরো বড় কোনো পরিকল্পনার অংশ হিসাবে আপাতত প্রস্থান করেছেন।

দূর্গের মধ্যবর্তী প্রাঙ্গণে নেমে এসে প্রখর সূর্যালোকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে খুররম সাথে সাথে ধূলিধূসরিত পাঁচজন অশ্বারোহীকে দেখতে পায়, প্রত্যেকেই তখনও একটা না বরং দুটো ঘোড়ার লাগাম ধরে রয়েছে। তাঁরা প্রত্যেকে নিশ্চয়ই তাঁদের প্রধান ঘোড়ার সাথে অতিরিক্ত একটা ঘোড়া রেখেছিল যাতে যখনই প্রয়োজন হবে ঘোড়া বদল করে তাঁরা অগ্রসর হবার গতি বৃদ্ধি করতে পারে। খুররমে চোখ আলোয় সয়ে আসতে সে অন্য চারজনের থেকে খানিকটা সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দীর্ঘদেহী তরুণকে চিনতে পারে, আসফ খানের সেরা সেনাপতি আর তাঁর অন্যতম সমর্থকের পুত্র হানিফ। হানিফের নিজে আসার অর্থ একটাই খবরটা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।

খুররম কুশল বিনিময়ে সময় নষ্ট না করে সরাসরি দীর্ঘদেহী তরুণের দিকে এগিয়ে যায়। হানিফ, তুমি আমার জন্য একটা চিঠি নিয়ে এসেছে? হানিফ সাথে সাথে তার বুকের উপর আড়াআড়িভাবে ঝুলন্ত চামড়ার থলে থেকে আসফ খানের সিলমোহরযুক্ত একটা চিঠি বের করে খুররমের হাতে তুলে দিতে সে কোনো কথা না বলে সিল ভেঙে চিঠিটা খুলে।

মহামান্য সম্রাট, তোমার আব্বাজান ইন্তেকাল করেছেন। দূর্গের আঙ্গিনায় সে খালি মাথায় দাঁড়িয়ে থাকায় মধ্যাহ্নের সূর্যের খরতাপের চেয়েও অধিক উষ্ণতায় শব্দগুলো খুররমকে দগ্ধ করে। তার আব্বাজানের মৃত্যুর কঠিন সংবাদের সাথে আসফ খান এটাও নিশ্চিত করেছেন যে আওরঙ্গজেব আর দারা শুকোহ ভালো আছে, কিন্তু তাগিদও দিয়েছেন, পদক্ষেপ নেয়ার এখন সময় হয়েছে। অন্যেরা তাঁদের সুযোগ নেয়ার আগেই দ্রুত চলে এসো এবং তোমার যা প্রাপ্য সেটা গ্রহণ করো।

চিঠির বিষয়বস্তুর কারণে স্তম্ভিত, খুররম পাঁচজনকে দ্রুততার সাথে চিঠিটা বয়ে নিয়ে আসবার জন্য সংক্ষেপে ধন্যবাদ জানায় এবং তাদের বিশ্রাম নেয়ার অনুমতি দেয়। নিজের পরিচারকদের হাত নেড়ে দূরে থাকতে বলে চিঠিটা তার হাতে ধরা অবস্থায় সে রৌদ্রস্নাত প্রাঙ্গণে একাকী দাঁড়িয়ে থাকে, সেখানে যা লেখা রয়েছে সেটার অর্থ বুঝতে চেষ্টা করে এবং সেইসাথে যা উহ্য রয়েছে। তার আব্বাজান যার সাথে গত কয়েকবছর তার দেখা হয়নি তিনি মৃত। এতটুকু স্পষ্ট। কিন্তু কীভাবে এবং কেন? মেহেরুন্নিসা কি তাকে বিষ দিয়েছে? তাছাড়া, তিনি তাঁর ভাই আসফ খানের কাছে খোলাখুলি দম্ভোক্তি করেছেন টমাস রো’র খাবারে ক্রমাগতভাবে পচা মাংস মিশিয়ে তিনি তাকে দরবার থেকে তাড়িয়েছেন। কিন্তু তার আব্বাজানের মৃত্যু থেকে তিনি কীভাবে লাভবান হতে পারেন? সম্রাটকে তার ভালবাসার বন্ধনে আটকে রাখার জন্য মেহেরুন্নিসা তাকে আফিম আর সুরার যে মিশ্রণ দিতেন তাঁর মাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করার মাধ্যমে জাহাঙ্গীরের মৃত্যুতে তার কোনো ভূমিকা যদি থাকেও সেটা সম্ভবত আপতিক।

সে তার আব্বাজানের মৃত্যুর প্রকৃতি নিয়ে যখন ভাবতে থাকে তখন জাহাঙ্গীরের জীবনের বিভিন্ন দৃশ্য তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠে–তাঁদের বিচ্ছেদের বছরগুলোর নয় বরং তার যৌবনের, আকবর তাকে উটে চড়ার আর দাবা খেলার জটিল বিষয়ে নির্দেশ দেয়ার সময় তাঁর আব্বাজানের একপাশে আড়ষ্ট আর বিব্রতভাবে দাঁড়িয়ে থাকা; আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সমাপ্তির পরে তার সাথে নিজের সম্পর্ক পুনর্গঠনে জাহাঙ্গীরের বাধাগ্রস্থ প্রয়াস; আকবরের মৃত্যু আর খসরুর বিদ্রোহ এবং তারপরে সুন্দর বছরগুলো যখন আরজুমান্দকে সে প্রথম বিয়ে করেছিল এবং সে ছিল তাঁর আব্বাজানের অগ্রগণ্য সেনাপতি আর বিশ্বস্ত ব্যক্তি।

খুররম এইসব স্মৃতি স্মরণ করতে বুঝতে পারে যে তার আব্বাজান তাকে ভালোবাসতো এবং সে তাকে। তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠতে শুরু করে। তাঁর ভাবনায় মেহেরুন্নিসা ফিরে আসতে সে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মোছে। জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে তাঁর বিচ্ছেদের মূল কারণ এই রমণী। তিনি এখনও জীবিত এবং তার দুই সন্তান মেহেরুন্নিসার কজায় রয়েছে। সম্রাটের মৃত্যুর পরবর্তী তিন সপ্তাহে তিনি নিঃসন্দেহে তিনি নিজের এবং নিজের দুই বশংবদ, শাহরিয়ার আর লাডলির জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে পরিকল্পনা করেছেন। ঠাণ্ডা মাথা, বিচক্ষণ আর স্বার্থসিদ্ধিতে নিপূণা, তিনি নিশ্চয়ই খুব বেশি সময় শোক করেন নি এবং সেও সেটা করবে না। আসফ খান যেমন বিচক্ষণতার সাথে লিখেছেন, তাকে অবশ্যই অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে হবে কিন্তু তার আগে তাকে অবশ্যই আরজুমান্দকে খবরটা জানাতে হবে।

*

না। বহু বছরের ভিতরে এই প্রথমবার আমাদের অবশ্যই পরস্পর থেকে আলাদা হতে হবে, খুররম মুখাবয়বে একগুয়ে অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলা আরজুমান্দকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে। তুমি কি দেখতে পাচ্ছো না, আমরা যখন আমার আব্বাজানের জন্য কোনো অভিযানে যেতাম বা তার সৈন্যদের হাত থেকে বাঁচতে পলায়ন করেছিলাম সেই সময়ের চেয়ে এখনকার বিষয়টা আলাদা? আমরা একটা বিষয় জানতাম যে আমরা যদি মারা যাই তাহলে আমাদের সন্তানদের যত্ন নেয়ার জন্য আমার আব্বাজান আর তোমার আব্বাজান রয়েছেন। আমরা যখন পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম তখন তারা আমাদের সাথে নিরাপদ ছিল। আমি এখন যখন আমাদের বাহিনী বিভক্ত করছি আর মিত্র সন্ধান করছি তখন এটাই ভালো যে তুমি এখানে তাঁদের সাথে অবস্থান করো। তুমি যদি এখানে থাকো এবং আমি যদি ব্যর্থ হই-আল্লাহ্ না করেন আমি ব্যর্থ হই–তারা তোমায় পাবে তাদের রক্ষা করার জন্য অন্যথায় তারা মেহেরুন্নিসার করুণার মুখাপেক্ষী অসহায় এতিমে পরিণত হবে।

আরজুমান্দের কঠোর অভিব্যক্তি খানিকটা নরম হয়। আমি আপনার যুক্তি বুঝতে পেরেছি এবং আমি সেটা মেনেও নিচ্ছি, কিন্তু আপনার অন্য পরিকল্পনাগুলো কি যুক্তিসঙ্গত? আপনি কেন আপনার সামান্য শক্তি বিভক্ত করছেন এবং এত অল্প সংখ্যক লোক নিয়ে উত্তরে যাচ্ছেন?

‘আমি ভেবেছিলাম আমি ব্যাপারটা খুলে বলেছি–কারণ আমি জানি না আর কে সিংহাসনের উপর দাবি জানাতে পারে এবং সেজন্য সবচেয়ে বড় হুমকি কোথা থেকে আসতে পারে। আমাকে বেশ কয়েকটা পদক্ষেপ একই সাথে নিতে হচ্ছে। আমাকে যতজন সম্ভব তোক দ্রুত সংগ্রহ করতে হবে। আর এটা করার জন্য সবচেয়ে ভালো পন্থা হল আমার সমর্থক আর বন্ধুদের কাছে আমার বিশ্বস্ত সেনাপতিদের অধীনে সৈন্যদল প্রেরণ করে সেখান থেকে লোকবল সংগ্রহ করা। তুমি জানো আমি ইতিমধ্যে মোহন সিংকে পাঠিয়েছি মহবত খানের অবস্থান সনাক্ত করতে। পার্সী এই সেনাপতি একজন বিচক্ষণ আর প্রয়োগবাদী লোক। তিনি জানেন যে আমার সাথে নিজেকে মৈত্রীর সম্বন্ধে আবদ্ধ করার মাঝেই তাঁর চোট খাওয়া সৌভাগ্য ফিরে পাবার সবচেয়ে ভালো সুযোগ রয়েছে। আমাকে সেই সাথে গুপ্তচর আর গুপ্তদূতদের শক্তিশালী দলও প্রেরণ করতে হবে। আমি কেবল তোমার আব্বাজানকেই–তিনি যদিও ভালো মানুষ আমাদের একমাত্র চোখ আর কানের ভূমিকা পালনকারীর দায়িত্ব দিতে পারি না। সবশেষে, ঘটনাপ্রবাহের দ্রুততম সুবিধা গ্রহণের নিমিত্তে, আমার মূল বাহিনীতে পর্যাপ্তসংখ্যক লোক সমবেত হবার পরেই কেবল অনুসরণ শুরু করতে পেছনে রেখে, আমাকে দ্রুত আর সবার অগোচরে আগ্রার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হতে হবে।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু আপনি কীভাবে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকবেন?

‘আমি এ বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেই নি। ছোট একটা বাহিনীকেও লুকিয়ে রাখা কঠিন এবং আমি নিশ্চিত মেহেরুন্নিসা ইতিমধ্যে গুপ্তচর প্রেরণ করেছে।’

‘তাহলে গোপন না করে ছদ্মবেশ ধারণ করছেন না কেন?

কীভাবে?

বণিকের কাফেলা হিসাবে, হতে পারে?

না। বর্তমানের এই উপদ্রুত সময়ে যেকোনো শত্রুই কাফেলা দেখলে অনুসন্ধান করবে, সেটা তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখবে আর সম্ভব হলে কাফেলা থেকে চুরি করবে। কিন্তু তুমি ঠিকই বলেছো। ছদ্মবেশ ধারণের প্রস্তাবটা ভালো। আমি কিছু একটা ভেবে বের করবো।’

*

‘এটা কার শবাধার? খুররম ষোলটা সাদা ষাড় দিয়ে টেনে নেয়া শবযানে কালো-রেশমের ব্রোকেড দিয়ে ঢাকা মখমলের আস্তরনযুক্ত রূপার শবাধারে মধ্যাহ্নের শ্বাসরুদ্ধকর উষ্ণতায় শুয়ে থাকার সময় একটা পুরুষ কণ্ঠকে জিজ্ঞেস করতে শুনে। বাম হাতের গাঁটে কয়েকদিনের পুরান মশার কামড় ভালো করে রগড়ে দেয়ার জন্য আর বাম পা সামান্য নাড়াতে, যা ইতিমধ্যে অসাড় হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছে, তার ভীষণ ইচ্ছা করে কিন্তু সে ভালো করেই জানে তাঁর এমন কিছু করা উচিত হবে না যার ফলে শবাধারটা নড়ে উঠে ভেতরে অবস্থানকারীকে জীবিত বলে প্রতিপন্ন করবে। তার মুখে যদিও চন্দন সুবাসিত কাপড় জড়ানো রয়েছে এবং মুখকে অভেদ্য করা হয়েছে, পচনক্রিয়ার দুর্গন্ধকে বাস্তবসম্মত করতে দশদিনের পচা বাসী মাংসের যে টুকরোটা তার শবাধারে রাখা হয়েছে সেটা কোনোভাবেই ভুলে থাকা অসম্ভব। কামানের গোলা নিক্ষেপের ছিদ্রযুক্ত বিশাল রোটাগড় দূর্গ থেকে একদল অশ্বারোহীকে লাল ধূলোর একটা ঝড় সৃষ্টি করে এগিয়ে আসতে দেখার সাথে সাথে সে শবাধারের ভিতরে অবস্থান নিয়েছে। দূগটা একটা শৃঙ্গময় উদগ্রভূমিতে অবস্থিত যা আগ্রার উত্তরপশ্চিমে প্রসারিত সড়ক আর চারপাশের অনুর্বর ভূপ্রকৃতির উপর কর্তৃত্ব বিস্তার করে রয়েছে, এবং ওয়াসিম গুলের শক্ত ঘাঁটি, মেহেরুন্নিসার সবচেয়ে নেতৃস্থানীয় সমর্থক।

আরজুমান্দ বস্তুতপক্ষে, সে নয়, তাঁর বাহিনীর জন্য ছদ্মবেশের প্রস্তাব হিসাবে দাক্ষিণাত্যে মৃত এক তথাকথিত সেনাপতির মৃতদেহ স্বভূমে সমাধিস্থ করার জন্য শবাধারের অনুগমনকারীর ধারণা বের করেছে, বলেছে যে এই সৈন্যসারিকে খুঁটিয়ে আবেক্ষণ করার সম্ভাবনা সবচেয়ে কম। আরজুমান্দই আবার পচা মাংসের পরিমার্জন প্রস্তাব করেছিল। সে, অবশ্য, অন্য আরেকটা ভাঁওতার পরিকল্পনা করেছে তার প্রপিতামহী হামিদা যেমন আকবরের পক্ষে সমর্থক সংগ্রহের সময় নিজের স্বামী হুমায়ুনের মৃত্যুর খবর ফাঁস হওয়া রোধ করতে হুমায়ুনের মত একই উচ্চতার আর গড়নের একটা লোককে হুমায়ুন সাজিয়ে ছিলেন, খুররম তেমনি তাঁর একজন বিশ্বস্ত সেনাপতিকে তাঁর পোষাক পরিধান করে বুরহানপুর দূর্গে তাঁর ব্যক্তিগত এলাকায় প্রবেশ আর প্রস্থান করা অবস্থায় দৃশ্যমান হতে বলেছে যাতে বিভ্রম সৃষ্টি হয় যে উত্তরের উদ্দেশ্যে সে এখনও রওয়ানা হয়নি।

শবানুগমনের এই কূটচাল এখন পর্যন্ত সাফল্যের সাথেই উতরে এসেছে। তাকে মাত্র দু’বার কেবল শবাধারের আড়াল ব্যবহার করতে হয়েছে, এবং উভয়ক্ষেত্রেই শবাধার বহনকারী দলটার গম্ভীর প্রকৃতি লক্ষ্য করা মাত্র এগিয়ে আসা দলটা দিক পরিবর্তন করেছিল। খুররম সহসা হাঁচির প্রচণ্ড একটা প্রণোদনা প্রাণপণে দমন করার চেষ্টা করতে গিয়ে ভাবে যে যদিও ওয়াসিম গুলের এই আধিকারিক মনে হচ্ছে ভিন্ন প্রকৃতির। সে শবাধারের ভেতর থেকে ইতিমধ্যেই তাকে কয়েকটা মালবাহী শকট পরীক্ষা করে দেখার জন্য নিজের লোকদের আদেশ দিতে শুনেছে। তার সাথের অতিরিক্ত গাদাবন্দুক আর বারুদ হয় পশুখাবারের অনেক গভীরে বা কয়েকটা শকটের গোপন তলদেশে লুকিয়ে রাখায় দারুণ বুদ্ধির পরিচয় দেয়া হয়েছে। তন্ন তন্ন করে তল্লাশি করলে অবশ্য সেগুলো খুঁজে পাওয়া সম্ভব এই ভাবনাটা তার মাথায় উঁকি দেয়া মাত্র তার হৃৎপিণ্ড আগের চেয়ে দ্রুত গতিতে স্পন্দিত হতে শুরু করে।

হাসান খানের–যুবরাজ খুররমের বাহিনীর একজন সেনাপতি আর মূলতানের সুবেদারের আত্মীয় সম্পর্কিত ভাই–শবদেহ যা আমরা তাঁর অনুগত সমর্থকেরা পেশোয়ারে তার জন্মস্থানে সমাধিস্থ করার জন্য ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। খুররম শুনতে পায় তার একজন লোক নবাগতদের প্রশ্নের উত্তর দেয়। “গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করার সময় নিজের তাবুতে ঘামে প্রায় গোসল করার মত অবস্থায় বলা তাঁর শেষ অর্থবহ কথার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে আমরা তাঁর শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে যাচ্ছি। খুররম অনুসন্ধিৎসু আধিকারিককে আঁতকে উঠে শ্বাস নিতে শুনে। গুটিবসন্তের কথা উল্লেখ করাটা অনুপ্রাণিত অভিব্যক্তি। রোগটা এত মারাত্মক এবং এত দ্রুত ছড়ায় যে কেউ এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি বা মৃতদেহের কাছে কখনও অবস্থান করতে চাইবে না। সে কয়েক মুহূর্ত পরে ওয়াসিম গুলের আধিকারিকের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, ইতিমধ্যেই খানিকটা দূরে সরে গিয়েছে, বলছে, সে যদিও একজন বিশ্বাসঘাতককে সমর্থন করেছিল, তারপরেও তাঁর বেহেশত নসীব হোক। তোমরা যেতে পারো।

*

খুররম সন্তুষ্টির সাথে হাসে যখন দুই সপ্তাহ পরে আগ্রা থেকে পঞ্চাশ মাইল দক্ষিণপূর্বে নিজের টকটকে লাল নিয়ন্ত্রক তাবুতে যখন সে নিজের চারপাশে ক্রমশ বাড়তে থাকা পরামর্শদাতাদের দিকে তাকায়। ওয়াসিম গুলের ভূখণ্ড অতিক্রম করার প্রায় সাথে সাথে তাঁর ক্ষুদ্র সৈন্যবাহিনী যে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার শবানুগমনকারী একটা দল সেই ছদ্মবেশ সে পরিত্যাগ করে। তিন দিন আগে তার বাহিনীর বিশাল একটা বহর এসে যোগ দিয়েছে, যাদের সাথে বেশ কয়েকটা রণহস্তী রয়েছে, যারা বুরহানপুর থেকে কামরান ইকবালের নেতৃত্বে অনেকটা ঘোরা পথ অনুসরণ করে এসেছে ওঁত পেতে থাকা গুপ্তচর বা গুপ্তদূতদের বিভ্রান্ত করতে। অধিকিন্তু, সে যেসব এলাকা দিয়ে অতিক্রম করেছে সেসব এলাকায় মোতায়েন রাজকীয় বাহিনীর অনেক সেনাপতি, সেই সাথে বেশ কয়েকজন অনুগত স্থানীয় শাসক, তাঁর প্রতি বিশ্বস্ততার অঙ্গীকার করেছে এবং তার বাহিনীর সাথে নিজের লোকজন নিয়ে যোগ দিয়েছে। তার বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা এখন প্রায় পনের হাজারের কাছাকাছি এবং সবাই সুসজ্জিত আর পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে।

‘আমরা মেহেরুন্নিসা, লাডলি আর শাহরিয়ারের সাম্প্রতিক গতিবিধি সম্পর্কে কি জানি?’ সে জিজ্ঞেস করে।

‘আমাদের গুপ্তচরদের ভাষ্য অনুযায়ী, একমাস পূর্বে লাহোরে শাহরিয়ার নিজেকে সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করার পর থেকে সে সেখানেই তাঁর স্ত্রী আর শ্বাশুড়ির সাথে অবস্থান করে মৈত্রীর খোঁজে কেবল দূত প্রেরণ করছে, কামরান ইকবাল জবাব দেয়।

‘আর মহবত খান?

‘মোহন সিংয়ের কাছ থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ বার্তা অনুসারে আপনার শ্বশুর আসফ খান আর তাঁর দলবলের সাথে যোগ দেয়ার জন্য সে মহবত খান আর তার বাহিনীর সাথে ভ্রমণ করছে। সে জোর দিয়ে বলেছে যে আসফ খানের নিজের আনুগত্যের ন্যায় মহবত খানের আনুগত্যের অঙ্গীকার নিয়ে সন্দেহের আর কোনো কারণ অবশিষ্ট নেই।’

‘ভালো কথা। মোহন সিং ভুল করে নি আমরা এখন সেটাই আশা করতে পারি আর সেই সাথে মহবত খানেরও রাজনীতি নিয়ে অনধিকার চর্চার কারণে যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। মোগল সাম্রাজ্যে সে যদি নিজের অবস্থান পুনরুদ্ধারের আশা করলে আমিই তার সেরা ভরসা সে নিশ্চয়ই এটুকু বোঝার মত বিচক্ষণ। মেহেরুন্নিসার সাথে সে বিরোধ নিষ্পত্তির প্রত্যাশা করতে পারে না।’

‘মোহন সিং নিশ্চিত যে মহবত খান সহজাত ভাবেই অনুগত এবং তাঁর প্রতি মেহেরুন্নিসার উদ্ধত আচরণই তাকে এমন হটকারী করে তুলেছিল। ‘আসফ খানের সাথে সে যখন আমাদের সাথে যোগ দেবে তখন আমরা তাঁর প্রতি নজর রাখবো। কবে নাগাদ আমরা তাদের আশা করতে পারি? ‘তারা অগ্রসর হবার সময় তাদের আরো বেশি সংখ্যক লোক মোতায়েনের জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের কথা বিবেচনা করে, সম্ভবত তিন কি চার সপ্তাহ। বিশেষ করে মহবত খান রাজস্থানে নিজের পুরাতন সহযোদ্ধাদের ডেকে পাঠাবার সাথে সাথে যোদ্ধাদের সেই আতুরঘর থেকে নতুন লোক নিয়োগের জন্য বার্তাবাহক প্রেরণ করেছে।’

‘বেশ, আমাদের সামনে এখন তাহলে কেবল খসরুই রয়েছে, তাই না? সিংহাসনের জন্য তাকে কি এখনও পদক্ষেপ গ্রহণে আগ্রহী মনে হয়?

হ্যাঁ। আমাদের তথ্য অনুযায়ী যদিও তাঁর চোখের পাতার সেলাই খুলে তাকে তার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিতে তাঁর হাকিমদের প্রচেষ্টা কেবল আংশিক সফল হয়েছে, স্পষ্টতই অন্যদের নিজের পক্ষে টানার ক্ষমতা তার এখনও নষ্ট হয়নি। গোয়ালিওরের সুবেদারকে সে দলে টেনেছে, যেখানে সে দীর্ঘদিন বন্দি অবস্থায় ছিল, এবং সেই সাথে স্থানীয় অনেক সেনাপতিও রয়েছে, এবং সে তৃতীয়বারের মত নিজেকে সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করেছে।

‘আর সে তৃতীয়বারের মত ব্যর্থ হবে, খুররম বলে। খসরু নাছোড়বান্দার মতো এমন অসম্ভব উচ্চাশা কেন পোষণ করছে? সে যতটুকু নবায়িত দৃষ্টিশক্তি পেয়েছে সেটা এবং তাঁর বিশ্বস্ত স্ত্রী জানির ভালোবাসা, যে নিজে বহুবছর তার সাথেই বন্দিত্ব বরণ করেছিল, তৃপ্তি নিয়ে উপভোগ করছে না? খুররম ঠোঁট কামড়ে জিজ্ঞেস করার আগে, নিজের মনে ভাবে, আমার বিরোধিতা করার জন্য তাকে কেন অবশ্যই যুদ্ধযাত্রা করতে হবে, সে কতজন লোক নিয়োগ করতে সফল হয়েছে?

দশ হাজার সম্ভবত–যাঁদের অনেকেই আপনার আব্বাজানের বিরুদ্ধে তাঁর পূর্ববর্তী বিদ্রোহের সময় যারা নিহত হয়েছিল তাদের পুত্র আর ভ্রাতা। তারা গোয়ালিওরের অস্ত্রশালা আর কোষাগার লুট করেছে এবং তাই তাদের অস্ত্র কিংবা রসদের কোনো সমস্যা নেই।’

‘তাঁরা কি এখনও আগ্রা অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে?

‘হ্যাঁ। আমাদের গুপ্তদূতেরা জানিয়েছে তারা আমাদের অবস্থান থেকে প্রায় পঁচিশ মাইল পশ্চিমে এবং আগ্রা থেকে চল্লিশ মাইল দূরে অবস্থান করছে।

‘শাহরিয়ার লাহোর ত্যাগের জন্য কোনো ধরনের উদ্যোগ না নেয়ায় এবং সেখানে তাঁর মোকাবেলা করার পূর্বে মহবত খান আর আসফ খান এবং তাঁদের সাথে আসা অতিরিক্ত বাহিনীর জন্য আমরা অপেক্ষা করলে আমরা বিচক্ষণতার পরিচয় দেব, আমার পরামর্শ হল যে আমরা প্রথমে খসরুর উচ্চাশা চিরতরে মিটিয়ে দেবো। আমরা আমাদের বেশিরভাগ মালবাহী শকট যদি এখানে রেখে যাই, আমরা তাহলে কি তাঁর সামনে যেতে এবং সে আগ্রা পৌঁছাবার আগে তাকে যুদ্ধে করতে বাধ্য করতে পারবো?

‘হা। গুপ্তদূতদের ভাষ্য অনুসারে সে সম্ভবত আগ্রা পৌঁছাবার আগে যতবেশী সম্ভব সমর্থক জড়ো করার আশায় দিনে আট মাইলের বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে না। তার বাহিনী থেকে আমাদের পৃথক করে রেখেছে যে প্রান্তরটা সেটা মূলত সমভূমি যেখানে কোনো উল্লেখযোগ্য নদী নেই, অশ্বারোহী তবকি আর তীরন্দাজ আর অশ্বারোহী যোদ্ধার সাথে আমরা যদি রণহস্তীও সাথে নেই তাহলেও আটচল্লিশ ঘন্টার ভিতরে আমরা তাকে পিছু ধাওয়া করে ধরে ফেলতে পারবো।’

‘বেশ তাহলে, আমরা এটাই করবো। আপনি এখানে মালবাহী শকট আর ভারি কামানগুলো পাহারা দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত সৈন্য রেখে যাবার বিষয়টা নিশ্চিত করবেন এবং অবিলম্বে প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করেন।

*

খুররম তার ভবিষ্যত নির্ধারণ করবে যে যুদ্ধ সেটা শুরু করার জন্য ব্যগ্র হয়ে তার বাহিনীর মূল সৈন্যসারি ছেড়ে নিজের কয়েকজন দেহরক্ষী সাথে নিয়ে সামনে এগিয়ে যায় যখন দুইদিন পরে মধ্যাহ্নের ঠিক আগ মুহূর্তে ঘামে ভেজা ধুসর রঙের একটা ঘোড়া নিয়ে তার গুপ্তদূতদের একজন আস্কন্দিত বেগে তার দিকে এগিয়ে আসে।

‘খসরুর লোকেরা সামনে অবস্থিত একটা গ্রামের চারপাশে নিজেদের জড়ো করছে। আমরা যা ভেবেছিলাম তারা সংখ্যায় তার চেয়েও বেশি–সম্ভবত বার হাজার বা সেরকম কিছু একটা। তারা যখন আমাদের অগ্রসর হবার বিষয়টা টের পায় তারা স্পষ্টতই সিদ্ধান্ত নেয় গ্রামের খোয়ারের চারপাশের বৃত্তাকার নিচু মাটির দেয়াল এবং এমনকি গ্রামের মামুলি খেজুর-পাতার পর্ণকুটির যতটুকু সুরক্ষা দিতে সক্ষম তার সুবিধা গ্রহণ করবে। তারা কামানগুলো সুবিধাজনক স্থানে টেনে নিয়ে যেতে ব্যস্ত এবং গ্রাম থেকে কয়েকশ গজ সামনে তারা তীরন্দাজ আর তবকিদের ছোট একটা আড়াল স্থাপন করেছে।

খুররম গুপ্তদূতের প্রসারিত হাতের দিক অনুসরণ করে দাবদাহের অস্পষ্টতার মাঝে দেখে যে একটা ছোট নহরের দূরবর্তী তীর বরাবর সমতল ভূমির উপর অবস্থিত গ্রামটা ছোট আকৃতির যা বর্তমান শুকনো মওসুমে মূলত মাটির তৈরি বলে মনে হয়। লোকবলের দিক থেকে খসরুর সামান্য প্রাধান্য রয়েছে কারণ মালবাহী শকট পাহারা দেয়ার জন্য সে তার বাহিনীর উল্লেখযোগ্য একটা অংশ পেছনে রেখে এসেছে। তাঁর লোকেরা যদিও খসরুকে অতিক্রম করার যাত্রার কারণে ক্লান্ত এবং দিনটা চুল্লীর মত উত্তপ্ত, খুররম যুদ্ধের পরামর্শের জন্য বয়োজ্যেষ্ঠ সেনাপতিরা এসে তাঁর সাথে মিলিত হবার জন্য অপেক্ষা না করে খসরুর বাহিনী নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ নির্মাণ সমাপ্ত করার আগেই তাদের আক্রমণ আর বিধ্বস্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়।

‘অবিলম্বে আক্রমণ করার জন্য আমাদের অর্ধেক অশ্বারোহীদের বিন্যস্ত করার আদেশ কামরান ইকবালের কাছে পৌঁছে দাও। সে যখন সামনে থেকে গ্রামটা আক্রমণ করবে আমি আমাদের অবশিষ্ট অশ্বারোহীদের নিয়ে ছোট নহরটা অতিক্রম করবো গ্রামের পেছনে পৌঁছাতে এবং গ্রামের প্রতিরক্ষায় যারা নিয়োজিত তাঁদের পেছন থেকে আক্রমণ করবো। রণহস্তীদের তাদের হাওদায় অবস্থিত ছোট কামান নিয়ে অশ্বারোহীদের যুদ্ধক্ষেত্রে যতটা কাছ থেকে অনুসরণ করা সম্ভব করতে আদেশ দাও।’

সোয়া এক ঘন্টা বা তারও পরে, খুররম দেখে তাঁর অশ্বারোহীরা, উঁচু কালো স্ট্যালিয়নে উপবিষ্ট স্থূলকায় কামরান ইকবালের নেতৃত্বে, তার ঠিক পেছনেই চারজন নিশানবাহক রয়েছে, গ্রাম অভিমুখে তাঁদের হামলার গতি বৃদ্ধি করছে। ধূলোয় খুররমের দৃষ্টি অস্পষ্ট হতে শুরু করতে সে নিজে এবার তাঁর প্রিয় খয়েরী রঙের একটা ঘোড়ায় উপবিষ্ট হয়ে তাঁর দু’হাজার সেরা অশ্বারোহীকে নেতৃত্ব দিয়ে দ্রুতবেগে বামদিকে ঘুরে গিয়ে গ্রামটা বৃত্তাকারে বেষ্টন করতে শুরু করে। ছোট কামানের চাপা শব্দ আর গাদাবন্দুকের ক্রমাগত পটপট শব্দ শীঘ্রই বোঝায় সে খসরু তার বাহিনীকে কামরান ইকবালের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ করেছে। ধূলো আর ধোয়ার কুণ্ডলীর মাঝে বিদ্যমান শূন্যস্থানের ভিতর দিয়ে খুররম দেখতে পায় যে তার সৎ-ভাইয়ের তোপচিরা নিশানাভেদে দারুণ পারদর্শী। কামরান ইকবালের সাথের লোকদের বেশ কয়েকজনের ঘোড়া ধরাশায়ী হয়েছে। বাকিগুলো আরোহীবিহীন অবস্থায় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তাঁদের লাগামগুলো ঝুলছে। খুররমের সহসা নিশানাবাহকদের একজনকে মনে হয় ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিতে চেষ্টা করছে; আক্রমণের মূল চালিকা শক্তি কেমন যেন খাপছাড়া প্রতিয়মান হতে শুরু করে। তারপরেই কুণ্ডলীকৃত ধোঁয়ার মেঘে তাঁর দৃষ্টি পুরোপুরি আচ্ছন্ন হয়ে যায়।

খুররম সহসা সন্দেহের শরবিদ্ধ হবার যাতনা অনুভব করে। সে কি অতিরিক্ত আগ্রহ প্রদর্শন করে ফেলেছে, হয়তো হঠকারীতা হয়েছে শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে অবিলম্বে আক্রমণের নির্দেশ দিয়ে যখন সে তার ক্লান্ত লোকদের বিশ্রাম আর অপেক্ষা করার সুযোগ দিলে বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়া হতো? সে কি নিজের বাহিনীকে দুইবার বিভক্ত করে ভুল করেছে, প্রথমে মালবাহী শকটের বহরকে পাহারা দেয়ার জন্য শক্তিশালী একটা বাহিনী পেছনে রেখে এবং দ্বিতীয়বার দ্বিমুখী সাঁড়াশি আক্রমণের আদেশ দিয়ে? এসব চিন্তা করার জন্য এখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। সে এখন পশ্চাদপসারণ কিংবা পৃথক হবার চেষ্টা করলে আরো বেশি ভুল করবে। তার লোকেরা তাহলে খসরুর বাহিনী পাল্টা আক্রমণের মুখে পড়বে। সে রক্ষণাত্মক কৌশল গ্রহণ করেছে। তাকে অবশ্যই বৃত্তাকারে ঘুরে এসে আক্রমণের সাফল্যের উপরে তার ভবিষ্যতকে ঝুঁকির সম্মুখীন করতে হবে। খসরুর লোকেরা যদিও প্রাণপণে লড়াই করছে এবং সামনের আক্রমণকারীদের মাঝে ব্যাপক হতাহতের জন্ম দিয়েছে, তাঁরা পেছন থেকে তার আক্রমণের সামনে অবশ্যই নিজেদের পশ্চাদপসারণের পথ বন্ধ হয়ে যাবার ভয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়বে। আর তাছাড়া, কামরান ইকবাল আর তার সাথের সৈন্যরা সাহসী আর অভিযোদ্ধা যোদ্ধা। তার যদি সাময়িক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েও থাকে তারা দমে না গিয়ে বরং নতুন উদ্যমে আবার আক্রমণ করবে।

খুররম ইতিমধ্যে নহরের প্রান্তদেশের দিকে এগিয়ে চলেছে। অনেক বন্যপ্রাণীর পায়ের চিহ্ন দ্বারা ক্ষতবিক্ষত, নহরে পানির চেয়ে আঠালো খয়েরী কাদাই বেশি, সে ভাবতে ভাবতে হাতের ইশারায় নিজের লোকদের নহর অতিক্রমের ইঙ্গিত দিয়ে নিজের খয়েরী ঘোড়াটাকে সামনের দিকে অগ্রসর হবার জন্য তাড়া দেয়। সে অচিরেই অপর পাড় ধরে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে, পেছনে তার দেহরক্ষী আর বাকি যোদ্ধারা তাকে অনুসরণ করছে। সে অবশ্য ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখে যে বেশ কয়েকটা ঘোড়া কাদায় পড়ে রয়েছে, সম্ভবত তাদের খুর গভীর আঠালো কাদায় আটকে গিয়েছিল যখন তাঁদের অসতর্ক আরোহীরা তাদের অনর্থক চাবুকপেটা করেছিল।

সে মাথা ঘুরিয়ে পুনরায় সামনের দিকে তাকিয়ে অনুধাবন করে যে গ্রামের গরুর গোয়ালের নিচু বেষ্টনী আর মাত্র দুইশ গজ দূরে রয়েছে। দেয়ালের পিছনে লুকিয়ে থাকা তবকীরা উঠে দাঁড়িয়ে গুলি বর্ষণ করতে সে সহসা আগুনের ঝলক দেখতে পায়। গাদাবন্দুকের সীসার গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে শিস তুলে তাঁর পাশ দিয়ে চলে যায়। তার আরেকজন অশ্বারোহী, কমলা রঙের পাগড়ি পরিহিত বিশাল দাড়ির অধিকারী এক রাজপুত যোদ্ধার কপালের ঠিক মাঝে একটা গুলি এসে বিদ্ধ হয়ে তাকে ঘোড়া থেকে ছিটকে পেছনের দিকে ফেলে দিলে লোকটা পেছন থেকে আগত ঘোড়ার খুরের নিচে দলিত হবার আগে ধূলোর ভিতরে বেশ কয়েকবার গড়িয়ে যায়। আগুনের ঝলক দেখে খুররম ভাবে দেয়ালের পিছনে কমপক্ষে পঞ্চাশজন তবকি লুকিয়ে আছে। কিন্তু তারপরেও, সে আর তার লোকেরা যদি জোরে ঘোড়া ছোটায় তাহলে তাঁরা দ্বিতীয়বার গুলি করার জন্য প্রস্তুত হবার আগেই তারা তাদের কাছে পৌঁছে যেতে পারবে। কিন্তু তারপরেই তাকে হতাশ করে তীরন্দাজের দল এবার দেয়ালের আড়াল থেকে বের হয়ে আসে এবং দ্রুত তীর নিক্ষেপ করেই আবার দেয়ালের আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে ফেলে। একটা তীর যেন সময়কে স্তব্ধ করে দিয়ে প্রায় তাকে লক্ষ্য করেই ছুটে আসছিল। সে নিজের খয়েরী ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরার আগেই তীরটা এসে ঘোড়ার মাথার ছোট ইস্পাতের বর্মে আঘাত করে এবং পিছলে যায়। তীরের ধাক্কা আর আঘাতের কারণে সৃষ্ট অভ্যাঘাত ঘোড়ার অগ্রসর হবার গতিকে ব্যাহত করে এবং জন্তুটা একপাশে পিছলে যেতে শুরু করতে খুররম প্রাণপণে ঘোড়ার উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবার চেষ্টা করতে থাকে এবং গায়ের জোর দিয়ে লাগাম টেনে ধরে আর ঘোড়ার গলার কাছে নুয়ে এসে সে প্রায় ভেঙে পড়া মাটির দেয়াল লাফিয়ে টপকে যেতে সক্ষম হয়, যা সেখানে চারফিটের বেশি উঁচু হবে না। তার বেশির ভাগ লোকই সাফল্যের সাথে দেয়াল টপকে যায় কিন্তু তাদের ভিতরে অন্তত দু’জনের বাহনের সামনের পা দেয়ালের পিছনে রাখা গোবরের স্তূপের উপরে গিয়ে পড়তে সামনের পা ঘোড়ার দেহের নিচ থেকে পিছলে গিয়ে তাঁদের উদরের নিচের অংশ মাটির দেয়ালে আটকে যায় এবং পিঠের আরোহীরা তাঁদের মাথার উপর দিয়ে সামনের দিকে নিক্ষিপ্ত হয়ে সজোরে মাটিতে আঁছড়ে পড়ে।

খুররম কালো রঙের আঁটসাট জ্যাকেট পরিহিত একজন আক্রমণকারীর উদ্দেশ্যে প্রচণ্ড জোরে তরবারি চালায় যে নিজের বিশাল দুই ছিলাবিশিষ্ট ধনুক দিয়ে আবারও তীর নিক্ষেপের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল। লোকটা সেরকম কিছু করার আগেই তরবারির ধারালো ফলা তার বুকের উপরে আড়াআড়ি আঘাত করে এবং নোকটা ধনুক ছেড়ে দিয়ে পেছনের দিকে উল্টে পড়ে যায়। খুররমের চারপাশে তার বেশ কয়েকজন লোক পর্যাণ থেকে আহত কিংবা নিহত অবস্থায় ছিটকে পড়ে। খুররম কানের ভিতরে যুদ্ধের দামামা ঝড় তুলতে শুরু করতে সে নিজের দু’জন দেহরক্ষীকে নিয়ে সরাসরি গ্রামের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে এবং পথে একটা নিচু চালাঘর পাশ কাটিয়ে যায়। চালা ঘরের ভেতর থেকে একটা ছাগল দৌড়ে বের হয়ে এসে তাঁর দেহরক্ষীদের একজনের ঘোড়ার সামনের পায়ের নিচে এসে পড়ে। ঘোড়াটা ছাগলের উপর হোঁচট খায় এবং তার আরোহী একপাশে কাত হয়ে তালগাছের পাতার উপরে পড়ে যা দিয়ে চালা ঘরের ছাদ তৈরি করা হয়েছে। তার দেহের ভারে ছাদটা দেবে গিয়ে সে তাঁদের দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যায়।

খুররম আর অবশিষ্ট দেহরক্ষীর ঘোড়াগুলো বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং ফলে আরো একবার তাঁদের অগ্রসর হবার গতি হ্রাস পায়। খুররম অবশ্য প্রায় সাথে সাথেই নিজের খয়েরী ঘোড়াটাকে গতিশীল করে এবং শীঘই গ্রামের একমাত্র সরু প্রধান সড়কে পৌঁছে যায়। তাঁর দৃষ্টি একমুহূর্তের জন্য সাদা রঙ করা একটা মন্দিরে আটকে যায় যেখানে লাল রঙ করা হিন্দুদের বহুভূজা দেবী কালির প্রতিকৃতি রয়েছে, দেবীর গলায় কমলা রঙের ফুলের একটা মালা। কিন্তু তারপরেই সড়কের শেষপ্রান্তে–বিশাল একটা বটবৃক্ষের পাতা আর ডালপালার কারণে সৃষ্ট ছায়ার আড়ালে আংশিকভাবে ঢাকা পড়া অবস্থায় খুররম একটা কামান দেখতে পায় একটা লোক বারুদের গর্তে এখনই আগুন দেবে। তাঁর পক্ষে যত জোরে লাগাম টেনে ধরা সম্ভব ধরে খুররম সড়কের পাশে দুটো ছোট বাসার মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থানে তার খয়েরী ঘোড়াটাকে মোচড় দিয়ে প্রবেশ করলে, বেশ কয়েকটা হাড় জিরজিরে মুরগীর ময়লা খুটে খাওয়া বাধাপ্রাপ্ত হয়, যারা পাখা ঝাঁপটে আর্তস্বরে প্রতিবাদ জানায়।

সে প্রায় সাথে সাথে কামানটা থেকে গোলাবর্ষণের আওয়াজ পায় এবং সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলী বাড়ির উপরে ভেসে উঠতে দেখে, এর পরেই একটা ভোতা শব্দ আর আর্তনাদ ভেসে আসে। তার একজন অশ্বারোহী আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে। তার ঠিক পেছনে অবস্থানরত দেহরক্ষী না–সেও তার সাথেই বাড়ির মাঝে ঢুকে পড়তে পেরেছে। খুররম এখন কামানের তোপচিদের বিস্মিত আর আক্রমণ করার অভিপ্রায়ে যাতে তারা পুনরায় কামান দিয়ে গোলা বর্ষণ করতে না পারে সে আর তাঁর দেহরক্ষী তাদের বাহন নিয়ে দ্রুত গতিতে কয়েকটা কাঁটাঝোঁপের ভিতর দিয়ে যা গৃহপালিত পশুর খোয়ারের দেয়াল হিসাবে কাজ করে এগিয়ে যায় এবং বাড়ির পিছনের উঠোনে থাকা দড়ির চারপায়া আর মাটির রান্নার বাসনপত্রের ভিতর দিয়ে তাঁরা এঁকেবেকে রাস্তা করে নেয় যেখান থেকে সেখানের বাসিন্দারা বহু আগেই পালিয়ে গিয়েছে।

সড়কের শেষ বাড়ির পেছনের কোণায় পৌঁছে এবং সেটাকে পাশ কাটিয়ে খুররম তাঁর ঘোড়া নিয়ে ঘুরতে সে বটবৃক্ষের ছায়ায় অবস্থিত কামানটা আর মাত্র কয়েক গজ দূরে রয়েছে দেখতে পায়। কামানের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা তোপচিদের উর্ধ্বাঙ্গ নিরাভরণ এবং মধ্যাহ্নে প্রচণ্ড দাবদাহে তারা ঘর্মাক্ত অবস্থায় কামানের নলে বারুদ আর গোলা প্রবেশ করাবার জন্য সাহসিকতার সাথে চেষ্টা করছে যখন তিন কি চারজন তবকী বটবৃক্ষের চওড়া কাণ্ডের সুরক্ষার পেছনে অবস্থান করে প্রধান সড়ক দিয়ে অগ্রসরমান তাঁর লোকদের উদ্দেশ্যে গুলিবর্ষণ করছে তোপচিরা কামানে গোলা ভরার সময় তাঁদের দূরে সরিয়ে রাখতে। কোনো কিছু চিন্তা না করে এবং হাত আর হাঁটু দিয়ে খয়েরী ঘোড়াকে সামনে যাবার জন্য তাড়া দিয়ে খুররম কামানটা লক্ষ্য করে ছুটে যায়, তার সাথের একমাত্র দেহরক্ষী তাকে অনুসরণ করে। তাদের এগিয়ে আসতে দেখে তিনজন তোপচির ভিতরে দুইজন ঘুরে দাঁড়িয়ে দৌড়ে পালাতে শুরু করলে তাঁর দেহরক্ষীর বর্শার অগ্রভাগ অনায়াসে তাঁদের পরপর বিদ্ধ করে। তৃতীয় তোপচি সাহসিকতার সাথে দাঁড়িয়ে নিজের হাতের ইস্পাতের লম্বা শলাকাটা দিয়ে খুররমকে ঘোড়ার উপর থেকে ফেলে দিতে চেষ্টা করে। লোকটার অনভ্যস্ত আঘাত লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় আর খুররম নিজের তরবারি বের করে তার নগ্ন কাঁধে প্রাণপণে আঘাত করে। তরবারির ফলা মাংসপেশী আর তন্তু ভেদ করে গভীরে প্রবেশ করে লোকটা কামানের নলের উপরে লুটিয়ে পড়তে রক্ত তাঁর ক্ষতস্থান থেকে নির্গত হয়ে চারপাশ ভিজিয়ে দিতে শুরু করে।

ইত্যবসরে, একজন তবকি তাঁর গাদাবন্দুকের নল ঘুরিয়ে নিয়ে খুররমকে নিশানা করতে চায় কিন্তু বন্দুকের নলটা লম্বা–প্রায় ছয়ফিট–আর লোকটা উত্তেজিত। গুলি করার সময় বন্দুকটা তাঁর হাতে কাঁপতে থাকায় সীসার গুলিটা খুররম এবং তার পেছনের দেহরক্ষী দুজনকেই আঘাত করতে ব্যর্থ হয়ে তাঁদের মাথার উপর দিয়ে শিস তুলে নির্দোষভঙ্গিতে উড়ে যায়। খুররম তবকির মাথায় এত জোরে তরবারি দিয়ে আঘাত করে যে খুলির সাথে অভিঘাতের ফলে আরেকটু হলেই তরবারিটা তার হাত থেকে পড়ে যেত এবং লোকটার খুলি পাকা তরমুজের মত ফাঁক হয়ে গিয়ে, রক্ত আর মগজ ধূলোয় ছিটকে পড়ে।

খুররম সহসা টের পায় যে খসরুর কিছু যোদ্ধা পালাতে শুরু করেছে, তাকে অনুসরণ করে গ্রামের ভিতরে প্রবেশ করা তার লোকেরা তাঁদের একেবারে কাছে অবস্থান করে পিছু ধাওয়া করছে। সে দম ফিরে পাবার মাঝেই কামরান ইকবালের লোকেরা শক্ত অবস্থানের সামনে যেখানে আক্রমণ করেছিল সেখান থেকে ভেসে আসা প্রচণ্ড লড়াইয়ের আওয়াজ শুনতে পায়। তার চোখ চারপাশে ঘুরতে থাকা ঝাঁঝাল থোয়ায় জ্বালা করতে থাকে। কয়েকটা বাড়ির তালপাতার ছাদে কামান কিংবা গাদাবন্দুকের স্ফুলিঙ্গের কারণেই নিশ্চয়ই আগুন ধরে গিয়েছে। আর এখন প্রবল বাতাসের ঝাপটা জ্বলন্ত পাতার টুকরো এক ছাদ থেকে অন্য ছাদে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। পুরো গ্রামটা অচিরেই দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করবে।

‘খসরুর সৈন্যদের এবার পেছন থেকে আক্রমণ করা যাক- খুররম তাঁর চারপাশে সমবেত হতে শুরু করা লোকদের উদ্দেশ্যে বলে কিন্তু সে আর কিছু বলার আগেই যুদ্ধস্থলের দিক থেকে গ্রামের প্রধান সড়কের মাঝামাঝি বরাবর একটা ছোট গলি থেকে একদল অশ্বারোহী ছিটকে বের হয়ে আসে। খুররমের অশ্বারোহী যোদ্ধাদের দেখতে পেয়ে দলটার নেতা সরাসরি তাদের দিকে তরবারি উঁচু করে ধেয়ে আসে। শত্রুর দলটা তাঁদের দিকে ধেয়ে আসার মাঝেই খুররম ধোয়ার মাঝেই লক্ষ্য করে দলটার মাঝে একজন অশ্বারোহী রয়েছে যার ঘোড়ার দ্বিতীয় আরেকপ্রস্থ লাগাম রয়েছে। যা সামনে অবস্থিত একজন অশ্বারোহী ধরে রেখেছে। তাঁর আংশিক দৃষ্টিশক্তি সৎ-ভাই ছাড়া লোকটা আর কেউ হতে পারে না।

খুররম প্রধান লাগাম ধরে থাকা অশ্বারোহীর দিকে এগিয়ে যাবার জন্য তাঁর খয়েরী ঘোড়াটার পাঁজরে গুঁতো দেয়। লোকটা নিজের খালি হাতে ধরে থাকা তরবারি উঁচু করে এবং খুররমের প্রথম আঘাতটা ফিরিয়ে দেয় কিন্তু দ্বিতীয় আঘাতটা এড়িয়ে যেতে পারে না যা তাঁর কব্জির ঠিক উপর থেকে তার হাত প্রায় দ্বিখণ্ডিত করে ফেলে। ক্ষতস্থান থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে শুরু করলে সে তার হাতে ধরা লাগাম ফেলে দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যেতে শুরু করে। খুররম সহজাত প্রবৃত্তির বশে দ্রুত নিচু হয়ে লাগামটা মাটিতে পড়ার আগেই ধরে ফেলে।

যুদ্ধক্ষেত্র থেকে খসরুর ঘোড়াটাকে–ধুসর রঙের একটা মাদি ঘোড়া–হেঁচকা টানে সরিয়ে নিয়ে আসার মাঝেই খুররম চিৎকার করে বলে, ‘আমি, খুররম। খুসরু তুমি এবার আত্মসমর্পণ করো। আমি তোমায় বন্দি করেছি। তার সৎ-ভাই কোনো কথা বলে না। তোমার জন্য কি অনেক লোক মারা যায় নি, কেবল এখন না তোমার অন্যান্য বিদ্রোহ প্রচেষ্টার সময়? কথা বলো, খুররম আবার চিৎকার করে বলে, যদি কোনো কারণে যুদ্ধের হট্টগোলের আর আগুনে জ্বলতে থাকা ছাদের পটপট শব্দের মাঝে তার আগের কথাগুলো চাপা পড়ে গিয়ে থাকে সেজন্য এবার আগের চেয়ে জোরে। খুসরুর মুখাবয়ব প্রায় আবেগহীন দেখায়। কেবল তাঁর একটা মাত্র চোখই মনে হয় কিছুটা ভাব ফুটে রয়েছে। আপাতভাবে দৃষ্টিহীন বাকি চোখটায় ফাঁকা দৃষ্টি। তালপাতার ছাদ থেকে একটা জ্বলন্ত পাতা বাতাসে উড়ে তার পাশে আসতে তার ঘোড়াটা ঝাঁকি দিয়ে নিজের মাথা সরিয়ে নিতে, খসরু কথা বলে।

‘আমি আত্মসমর্পণ করছি।’

*

‘আমি মধ্য এশিয়ার তৃণভূমি থেকে আগত আমার পূর্বপুরুষদের প্রাচীন রীতি অনুসারে জীবনযাপণ করেছিঃ “সিংহাসন কিংবা শবাধার”। আমি এবার তৃতীয়বারের মত সিংহাসন দখলের চেষ্টা করেছি এবং ব্যর্থ হয়েছি। আমি দু’বার শবাধারের নিয়তি এড়িয়ে যেতে পেরেছি কিন্তু আমার সাহসী সহযোদ্ধারা যা পারে নি। আমি দ্বিতীয় প্রয়াসের পরে নিজের দৃষ্টিশক্তি বিসর্জন দিয়েছিলাম। আমার স্ত্রী জানির ভালোবাসা না পেলে আমি হতাশার মাঝে পথভ্রষ্ট হতাম। আমি এখন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। আমায় কেবল তাকে শেষবারের মত একটা চিঠি লেখার অনুমতি দাও।’

খুররমের সামনে, মাত্র বিশ মিনিট পরে, খসরু দাঁড়িয়ে থেকে দু’পাশ থেকে দু’জন প্রহরী আলতো করে তার হাত ধরে রেখেছে, সে একঘেয়ে সুরে কথা বলতে থাকে। তার সৈন্যরা তাঁর আত্মসমর্পণের আদেশ পালন করেছে এবং এখনও তাদের খোঁজা হচ্ছে আর তাঁদের পরিত্যক্ত অস্ত্রের স্তূপ জমে উঠেছে। খুররম যখন–তার মুখে এখনও ধোয়ার কালি লেগে রয়েছে এবং পরনের কাপড় আর দেহ এখনও যুদ্ধের ঘামে সিক্ত–তাঁর সৎ-ভাইয়ের দিকে তাকায় তাঁর কাছে এটা মনে হয় যে খসরু ইচ্ছাশক্তির চূড়ান্ত প্রয়োগ করে নিজেকে তার চারপাশে ঘটমান সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে, হাল ছেড়ে দিয়ে নিয়তি তার ভাগ্যে যা রেখেছে সেটা বরণ করার জন্য সে প্রস্তুত।

এই মুহূর্তে, খসরুর মত না, সে কোনোভাবেই এতটা নিস্পৃহ থাকতে পারে না। নিজের বিজয়ে উল্লসিত এবং সিংহাসনের জন্য তার আকাঙ্খা পূরণে এটা যা কিছু অর্থ বহন করে সব কিছুর সাথে তাঁর এত বিপুল সংখ্যক লোকের নিহত হবার দুঃখ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। আহতদের ভিতরে কামরান ইকবালও রয়েছেন। গ্রামে তাঁদের সামনাসামনি হামলার প্রথম বিপর্যয়ের মুখে তিনি খুররমের লোকদের নতুনভাবে উজ্জীবিত করার সময় গাদাবন্দুকের সীসায় তাঁর বামহাত এমন জঘন্যভাবে গুঁড়িয়ে গিয়েছে যে হেকিম খুররমকে বলেছে অবিলম্বে কনুইয়ের নিচ থেকে তাঁর হাত কেটে বাদ দিলেই কেবল তাকে প্রাণে বাঁচান সম্ভব। তাঁরা ইতিমধ্যে নিজেদের শল্যচিকিৎসার শস্ত্রে শান দিতে আর রক্তপাত বন্ধ করার জন্য লোহা গরম করতে শুরু করেছেন। তার অল্পবয়সী এক কর্চির অবস্থা এরচেয়েও খারাপ। পাঁজরে তরবারির আঘাত নিয়ে মাটিতে পড়ে থাকার সময় একটা প্রায় আস্ত জ্বলন্ত তালপাতার ছাদ তার উপরে উড়ে এসে পড়েছে। খুররম যখন তাকে দেখতে গিয়েছিল তখন যন্ত্রণায় তার আর্তনাদ মানুষের চেয়ে বেশি পাশবিক মনে হয়, সে নিজেকে জোর করে বাধ্য করে তাঁর পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকাতে যেখানে চামড়া ফালিফালি হয়ে ঝুলে রয়েছে। হেকিম তাকে বলেছে তারা কেবল তাঁর ফোস্কা পড়া মুখে ফোঁটা ফোঁটা আফিম মিশ্রিত পানি দিয়ে বেহেশতের উদ্দেশ্যে তার যাত্রাকে কিছুটা সহনীয় করতে পারে। খুররম ভাবে, আল্লাহর কাছে দোয়া করি সেটা যেন তাড়াতাড়ি হয়।

সে তাঁর আবেগহীন সৎ-ভাইয়ের দিকে, এইসব দুর্ভোগের কারণ, তাকিয়ে থাকার সময় তার ভিতরে ক্রোধ পুঞ্জীভূত হতে থাকে, এবং সে তাকে চড় মারার জন্য হাত তুলে। কিন্তু তারপরে কি মনে হতে সে নিজেকে নিরস্ত করে। কি লাভ হবে? সে ক্রোধের বশবর্তী হয়ে কিছু করবে না। তোমায় বুরহানপুরের ভূগর্ভস্থ কারাপ্রকোষ্ঠে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে তুমি আমার সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করবে। আমাদের আব্বাজান যেমন একবার করেছিলেন তেমনি ক্রোধের বশবর্তী হয়ে আমি তোমার বা তোমার সৈন্যদের শাস্তির বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেব না।

‘তোমার জন্য কোনো ধরনের হুমকি না হওয়ার প্রতিশ্রুতি আমি দিতে পারবো না। আমি নিজেকে চিনি। আমার মাঝে যতক্ষণ প্রাণ থাকবে ততক্ষণ উচ্চাকাঙ্খও থাকবে… আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত, খসরু উত্তর দেয়, তার মুখ এখনও ভাবলেশহীন কিন্তু কিছুক্ষণ পরে সামান্য নমনীয় কণ্ঠে সে জানতে চায়, জানি হয়তো আমার সাথে বুরহানপুরে যেতে পারে?

খুররম অনুরোধটা নাকচ করতে যাবে এমন সময় আরজুমান্দ এবং তার জন্য নিজের অনুভূতির কথা তার মনে পড়ে। তার নিজের স্ত্রীর জন্য তাঁর ভালোবাসার মানে সে তার সৎ-ভাইয়ের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারবে না। হ্যাঁ। তুমি যতই তার অনুপযুক্ত হও, আমি তোমার অনুরোধ কেবল তাঁর কথা ভেবেই, তোমার কথা নয়, মঞ্জুর করছি।’

২.১০ পিতার যত অনৈতিকতা

লাহোর, জানুয়ারি ১৬২৮

মেহেরুন্নিসা রাভি নদীর তীর দেখতে পাওয়া যায় প্রাসাদের দ্বিতীয় তলায় নিজের আবাসন কক্ষে মখমল মোড়া নিচু একটা ডিভানে বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন। তার তলবে সাড়া দিয়ে লাহোরের দিকে নিজেদের বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসা অনুগত রাজাদের কাছ থেকে আগত সর্বশেষ প্রতিবেদন পড়ে রয়েছে। শাহরিয়ারের নাম উল্লেখ করেই যদিও তলব পাঠানো হয়েছে, যাকে চারমাস আগে লাহোরের মসজিদে শুক্রবারের জুম্মার নামাজের সময় সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে, এবং সঙ্গত কারণেই একইভাবে তাকে সম্বোধন করেই উত্তরগুলো এসেছে কিন্তু তার আব্বাজান যতটা আগ্রহ প্রদর্শন করতে সে সেগুলোর প্রতি তাঁর কিয়দংশ আগ্রহও দেখায় না। জাহাঙ্গীরের কথা স্মরণ করতে মেহেরুন্নিসা শোক আর দুঃখ অনুভব করে যা তাঁর মৃত্যুর পরে তাকে কখনও পুরোপুরি ছেড়ে যায় নি আবার বাড়তে শুরু করে। এই আবেগের গভীরতা আর অটলতা তাকে বিস্মিত করেছিল যতক্ষণ না সে বুঝতে পারে তার জন্য জাহাঙ্গীরের ভালোবাসা কতটা ব্যাপক ছিল। নিজের স্বাধীনতার প্রতি তাঁর গর্ব সত্ত্বেও সে তাঁর প্রতি নির্ভরশীল ছিল ঠিক যেমন তিনি তার উপরে নির্ভরশীল ছিলেন। সে তাকে এই কারণেই তার ক্ষমতার সাথে তাকেও এজন্য ভালোবাসতো।

সে যতটা আন্দাজ করেছিল শাহরিয়ার শাসক হিসাবে তারচেয়েও দুর্বল হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করে, বাহ্যিক আড়ম্বর আর অহমিকার কাছে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করেছে। সে দিনের বেশিরভাগ সময় নিজের আপাতস্বীকৃত সুদর্শন দেহসৌষ্ঠবে ধারণের জন্য পোষাক আর অলঙ্কার নির্বাচনে ব্যয় করে অথবা তারই মত নির্বোধ সঙ্গীদের নিয়ে চটুল আমোদপ্রমোদ আর শিকারে ব্যস্ত থাকে। সাম্রাজ্যের কোনো বিষয় তাকে একেবারেই বিব্রত করে না। মেহেরুন্নিসার এজন্য আনন্দিত হওয়া উচিত ছিল কিন্তু বস্তুতপক্ষে এটা সন্তুষ্টিরও অযোগ্য। সে যখন তাঁর পরামর্শদাতাদের নিয়ে বৈঠকে বসে তখন সরকারি আর সামরিক উভয় বিষয়ে তাঁর অজ্ঞতা এত নগ্ন আর শোচনীয়ভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে এর ফলে তার উপরে অনুগামীদের আস্থা আর বিশ্বাস চোট খায়। মেহেরুন্নিসা লাডলির সাহায্যে যতটা সহজভাবে সম্ভব করে তাকে যে সারসংক্ষেপ আর পরামর্শ সরবরাহ আর সেগুলো পুনরাবৃত্তি করে সে হয় সেগুলোর প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দেয় না অথবা পরামর্শদাতাদের সামনে স্নায়বিক চাপের কারণে সামান্য তাঁর যতটুকু বুদ্ধি রয়েছে সেটুকুও তাকে একলা ফেলে ঘুরতে বের হয়।

মেহেরুন্নিসা আরো একবার নারী হবার কারণে তার ওপরে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার জন্য গভীরভাবে আক্ষেপ প্রকাশ করে। সে যদি কেবল পরামর্শদাতাদের বৈঠকে অংশ নিতে পারতো… কিন্তু সে জানে সে সেটা পারবে না, উচিতও হবে না, অনর্থক আক্ষেপ বা হতাশায় কালক্ষেপণ। খুররম যদিও খসরুকে পরাজিত করেছে আর লাহোরের উদ্দেশ্যে আপাত অনুকম্পাহীনভাবে এগিয়ে আসছে তারপরেও করদ রাজ্যের রাজা আর অগ্রগণ্য অভিজাতদের অনেকেই উত্তরাধিকারজনিত বিরোধের ফলাফল সম্বন্ধে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা তারপক্ষে যোগ দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। বস্তুতপক্ষে, যদি তার সমর্থকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত চিঠির বক্তব্য বিশ্বাস করতে হয়, আরো অনেক সশস্ত্র যোদ্ধার দল লাহোরে এসে তার বাহিনীর সাথে অচিরেই যোগ দেবে। তার সাথে যারা ইতিমধ্যে যোগ দিয়েছে তাদের সাথে সাথে আর বেশ ভালো পরিমাণ অর্থপ্রদানের জন্য সে লাহোরের বিশাল কোষাগারের সম্পদ নিয়োগ করেছে, সেই সাথে খুররম পরাজিত হবার পরে আরও দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। লাহোরের চারপাশে যদিও কোনো নিরাপত্তা প্রাচীর নেই, শাহরিয়ারের আধিকারিকেরা তাঁর নির্দেশনায় নদীর তীরে অবস্থিত প্রাসাদকে সুরক্ষিত দুর্ভেদ্য করার কাজে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে, প্রাসাদের চারপাশে মাটি আর কাঠের শক্ত চোখা খুঁটার সাহায্যে শক্তিশালী বেড়া নির্মিত হয়েছে এবং তাদের কাছে লভ্য সবধরনের কামানের জন্য সেখানে বিপুল সংখ্যক কামানের মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী অবরোধ মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য শস্যের সাথে বারুদ আর অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণও বিপুল পরিমাণে মজুদ করা হয়েছে। সে যদি উন্মুক্ত প্রান্তরে খুররমকে মোকাবেলা করতে শাহরিয়ার আর তাঁর সেনাপতিদের আকস্মিক নিষ্ক্রমণ থেকে বিরত রাখতে পারে তাহলে খুররমের বাহিনী যখন প্রথম আক্রমণ করবে তখন তাকে প্রতিরোধ এবং সেই সাথে নিজেদের নিশ্চায়ক আক্রমণ সূচনা করার পূর্বে তার বাহিনীকে হীনবল করার একটা ভালো সম্ভাবনা তাদের রয়েছে। শাহরিয়ারের মাঝে এবং তার মাধ্যমে তাঁর সেনাপতিদের মাঝে অবরোধ মোকাবেলার জন্য যথেষ্ট সংকল্প আর আস্থা সঞ্চারিত করাই এখন তার মূল কাজ যাতে তারা বিশ্বাস করে যে তারাই শেষে বিজয়ী হবে। সৌভাগ্যবশত সে সেনাবাহিনীর জন্য অনুকূল সামরিক সত্ত্বা আর আস্থা যথেষ্টই ধারণ করে।

সে আরো অনুধাবন করেছে যে দারা শুকোহ আর আওরঙ্গজেব তাঁর কাছে থাকায় এটা তাকে একটা বাড়তি সুবিধা দান করেছে। কামরান তাঁর সৎ-ভাই সম্রাট হুমায়ুনের বিরুদ্ধে নিজের অসংখ্য বিদ্রোহের মাঝে একবার হুমায়ুনের শিশু সন্তান, ভবিষ্যত সম্রাট আকবরকে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে একবার কাবুলের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের উপর প্রদর্শন করেছিল হুমায়ুনকে শহর আক্রমণ করা থেকে নিরস্ত করতে যা আরেকটু হলেই সফল হতে চলেছিল। সে অবশ্যই এতদূর যাবে না–অন্ততপক্ষে যতক্ষণ না মারাত্মক জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হয়–কিন্তু আকবরের গল্পটা তার চেয়ে খুররম আরো ভালো করে জানে বিধায়, সে জানে যে সে এমনটা করতে পারে এই ভাবনাটা খুররমের মনে কি ধরনের চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বাচ্চা দুটো অবশ্য ইতিমধ্যে আরেকটা উদ্দেশ্য সিদ্ধিতে সাহায্য করেছে–সেটা হল শাহরিয়ারকে কাছে রাখা এবং পৃথক শান্তি চুক্তি সম্পাদনে তার সামান্যতম প্রচেষ্টা সম্ভাবনাকেও নাকচ করে দেয়া। লাডলিকে একজন মধ্যস্থতাকারী হিসাবে ব্যবহার করে–যে সৌভাগ্যবশত মায়ের প্রতি তাঁর নিরঙ্কুশ আনুগত্য থেকে এখনও সামান্যতম বিচ্যুতির লক্ষণও প্রকাশ করে নি–সে শাহরিয়ারকে নিশ্চিতভাবে বুঝিয়েছে যে দুই কিশোর যুবরাজ এতটাই আকর্ষণীয় আর অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা তাঁদের এতই বেশি যে দরবারে তাঁদের প্রকাশ্য উপস্থিতি, তাঁদের আব্বাজানের সাথে তাদের চেহারার প্রচুর মিল থাকায় তাঁর অমাত্যদের মাঝে তার স্মৃতি জাগরত করে, তার নিজের অবস্থানের জন্য মানহানিকর হিসাবে প্রতিপন্ন হতে পারে। সে সেই সাথে। তাকে পরামর্শের ছলে বুঝিয়েছে যে তারা হয়ত পালিয়ে যেতে পারে বা তাদের উদ্ধার করার কোনো প্রচেষ্টা হতে পারে। শাহরিয়ার এরফলে অত্যন্ত ব্যগ্র হয়ে উঠে দু’জনকে প্রাসাদের একটা নির্জন অংশে আলোবাতাসহীন দুটো পৃথক কক্ষে দিনের চব্বিশ ঘন্টা প্রহরাধীন অবস্থায় তাদের আটকে রাখার নির্দেশ দিয়েছে।

মেহেরুন্নিসা নিজের অবস্থানের শক্তি সম্পর্কে অবগত থাকায় উৎসাহিত হয়ে মনে মনে ভেবে রাখা কিছু কূটনৈতিক পদক্ষেপ সম্বন্ধে চিন্তা করে। সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো যদি খুররমের বিরুদ্ধে শাহরিয়ারের পক্ষে বিরোধে হস্তক্ষেপ করে তাহলে ভূখণ্ডগত ছাড়ের প্রস্তাব দিয়ে তার নিজের–নাকি আনুষ্ঠানিকভাবে শাহরিয়ারের উচিত প্রতিনিধি প্রেরণ করা? কান্দাহার আর পার্শ্ববর্তী ভূখণ্ডের বিনিময়ে পারস্যের শাহ খুশি মনে এটা করবে। দাক্ষিণাত্যের সুলতানদের হয়ত তাদের বাজেয়াপ্ত করা ভূখণ্ড ফিরিয়ে দেয়ার প্রস্তাবে সাড়া দিতে পারে–তার অবস্থান একবার সংহত হলে যা তারা পুনরায় দখল করতে পারবে এবং তাদের সেনাপতি মালিক। আম্বারের বয়স হলেও এখনও প্রাণবন্ত রয়েছেন, হয়তো তাদের পক্ষে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দান করতে পারেন। খুররম আর তার ভিতরে অমীমাংসিত বিরোধ রয়েছে। পর্তুগীজ বা ইংরেজরা হয়তো শুল্ক ছাড়ের বিনিময়ে তাদের জাহাজে মারাত্মক আধুনিক কামান সজ্জিত করে তাদের নাবিকদের প্রেরণ করতে পারে। যাচাই করে দেখার জন্য অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। শাহরিয়ারের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, সে তাকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত রাখতে চায়। আর তাছাড়া, জাহাঙ্গীরের হয়ে এতগুলো বছর সেই শাসন করেছে।

*

খুররম নিজের টকটকে লাল নিয়ন্ত্রক তাবুতে একটা নিচু টেবিলের চারপাশে আসফ খান আর মহবত খানের সাথে বসে রয়েছে। তাবুর পর্দাগুলো যদিও সোনালী দড়ি দিয়ে আটকে আটকানো রয়েছে, সে তারপরেও রাভি নদীর পানি বিকেলের সূর্যের আলোয় ঝলমল করতে দেখে এবং তার ওপারে দাঁড়িয়ে রয়েছে লাহোর প্রাসাদ যা এখন বৃত্তাকার প্রাচীর আর নিরাপত্তা ব্যবস্থা দ্বারা আবৃত। সে টেবিলের উল্টোদিকে নিরুদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে বসে ভেষজ ঔষধিমিশ্রিত পানি সে বলেছে তার মাতৃভূমি পারস্যে বলকারী পানীয় হিসাবে এটা ভীষণ জনপ্রিয় চুমুক দিতে থাকা মহবত খানের দিকে তাকায়। তাঁদের প্রথম সাক্ষাতের সময় তারা দুজনেই আড়ষ্ট আর আনুষ্ঠানিক ছিল, বলার অপেক্ষা রাখে না দু’জনের ভিতরেই পারস্পরিক সন্দেহ কাজ করেছে, যা হয়ত প্রতিদ্বন্দ্বি সেনাপতিদের মাঝে প্রত্যাশিত যারা বহু বছর ধরে বিরুদ্ধ বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছে। মহবত খান সশ্রদ্ধ ভঙ্গিতে নিজেকে আড়ালে রেখেছিল এবং পেছনে অবস্থান করেছে যতক্ষণ না আসফ খানের সহজিয়া উপস্থিতির কারণে যিনি খুররমের সাথে নির্দিষ্টস্থানে মিলিত হবার কিছুক্ষণ পূর্বে মহবত খানের সাথে যোগ দিয়েছেন, পুরো পারিপার্শ্বিকতা সহজ হয়ে উঠে। তারা দু’জনে এখন কোনো ধরনের সংবোধ ছাড়াই পেশাগত বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে সক্ষম হচ্ছে এমনকি কোনো বিশেষ কৌশলের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপনের সময় নিজেদের বৈরীতার সময়ের উদাহরণও তারা উল্লেখ করছেন। খুররম ভাবে, এটাই ভালো হয়েছে। খসরুর বাহিনীর উপরে তাঁর আক্রমণ একটা হঠকারী পদক্ষেপ ছিল এবং তাঁর লোকদের সাহসিকতার কারণেই সেবার তার পরাজয় এড়ানো সম্ভব হয়েছিল। লাহোরে মেহেরুন্নিসা আর শাহরিয়ারের মোতায়েন করা বাহিনী অনেকবেশি শক্তিশালী এবং তাঁদের দক্ষতার সাথে নির্মিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খসরুর তড়িঘড়ি নির্মিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার চেয়ে অনেক উন্নত। তাকে অবশ্যই নিজের ব্যগ্রতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং যতটা কম সম্ভব সুযোগের প্রত্যাশা না করে যত্নের সাথে পরিকল্পনা করতে হবে।

মহবত খান, আমরা আগেই একমত হয়েছি যে প্রতিপক্ষের গুলিবর্ষণের মাঝে নদী অতিক্রমের ব্যাপারটা জড়িত থাকায় সামনাসামনি আক্রমণ করলে আমাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হবে, কিন্তু আপনি আমাদের কোথায় রাভি অতিক্রম করার পরামর্শ দেবেন?

‘আমি লাহোরের উজানে আর ভাটিতে দুই স্থানে নদী পার হবার পরামর্শ দেবো যাতে উভয়দিক থেকে একসাথে আমরা শহর আক্রমণ করতে পারি। আমরা ইতিমধ্যে দুটো সেতু নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত সংখ্যক নৌকা আর পাটাতন সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি।’

‘মহবত খান আপনার পরিকল্পনাটা ভালোই, কিন্তু আমরা কত দ্রুত পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে পারবো?

‘একরাতে।

‘আপনি বলতে চাইছেন আমি যদি এই মুহূর্তে আদেশ দেই তাহলে সকালবেলায় আমরা আক্রমণ করতে পারবো?

‘হা। আমাদের লোকেরা ভালোমত প্রশিক্ষিত এবং আমাদের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আর অন্যান্য অনুষঙ্গ মালবাহী শকটের বহর থেকে ইতিমধ্যে নামিয়ে নেয়া হয়েছে।’

‘বেশ তাহলে, দিনটা আগামীকালই হোক। আমি যদি ভাটির পারাপারের নেতৃত্ব দেই তাহলে আপনি কি উজানের পারাপারের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন?

‘অবশ্যই।

‘কিন্তু খুররম আক্রমণকারী দলের একটার নেতৃত্ব দিয়ে আপনার কি নিজেকে ঝুঁকির মাঝে ফেলা উচিত হবে? আপনি কি এখানে আমাদের গোলন্দাজদের তত্ত্বাবধান করে এবং সর্বময় নেতৃত্ব গ্রহণের মাধ্যমে কি অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবেন না?’ আসফ খান তাদের কথার মাঝে বলে।

‘পরিস্থিতি যদি স্বাভাবিক হতো তাহলে হয়তো আপনার কথাই ঠিক ছিল, কিন্তু এটা মোটেই স্বাভাবিক সময় না। আমি সম্রাট হবার সাথে সাথে একজন পিতাও বটে। মেহেরুন্নিসা আর শাহরিয়ার আমার দুই সন্তানকে বন্দি করে রেখেছে। আমি নিজে তাঁদের কাছে যত দ্রুত সম্ভব পৌঁছাতে চাই। তোপচিদের নেতৃত্বের বিষয়ে আপনার উপর আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে, তারা যেন তাদের গোলাবর্ষণ প্রতিরক্ষা প্রাচীর আর কামানের মঞ্চের প্রতি নির্দিষ্ট রাখে এবং শাহরিয়ার আমার সন্তানদের–আপনার নাতিদের–বন্দি করে রাখতে পারে এমনসব স্থান পরিহার করে এই বিষয়টা কেবল নিশ্চিত করবেন।

*

পরের দিন খুব সকালবেলা খুররম লাহোরের আড়াই মাইল ভাটিতে রাভি নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকে যখন তার লোকেরা কয়েকটা দলে বিভক্ত হয়ে স্থানীয় জেলেদের কাছ থেকে বড় অংকের পুরষ্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দখল করা নৌকার ক্ষুদে বহরে সন্তপণে আরোহণ করতে শুরু করে। সৈন্যরা নিরবে বৈঠা পানিতে নামাতে থাকে এবং বেশির ভাগ নৌকার সাথে সংযুক্ত রিফু-করা এবং তপ্পি মারা সুতির একক পাল তুলে দেয়। সে তার লোকদের প্রথমে নদী পার হবার এবং শাহরিয়ারের বাহিনীর কাছ থেকে কোনো ধরনের প্রতিরোধের বিরুদ্ধে অবতরণের জায়গাটা নিরাপদ করার দায়িত্ব দিয়েছে এবং তারপরে আংশিক নির্মিত সেতুর একটা অংশ তাঁরা টেনে ওপারে নিয়ে যাবে এবং নিরাপদে সেটাকে ওপারে টেনে নিয়ে গিয়ে নোঙরের সাহায্যে নিরাপদ করে তার দিকের তীর থেকে ইতিমধ্যে বর্ধিত সেতুর অংশের সাথে যুক্ত করার জন্য প্রস্তুত করবে। তার লোকেরা রাতের বেলা যখন নদীর তীর বরাবর এগিয়ে এসে নৌকার সেতুর প্রাথমিক নির্মাণকাজ আরম্ভ করে তখন তারা কোনো ধরনের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় নি। সূর্যোদয়ের পরেও–সকালের কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশের বুকে একটা কমলা গোলক–এমনকি দূরবর্তী তীরের পাড়ের দিকে নেমে আসা নিম্নমুখী নিচু মাটির ঢিবির মাঝেও শাহরিয়ারের বাহিনীর আগমনের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। অবশ্য, তার মানে এই নয় যে তারা অবতরণকারী দলকে অতর্কিতে আক্রমণের জন্য গোপনে ওঁত পেতে অপেক্ষা করছে না। বর্ষাকালে খুবই অল্প বৃষ্টিপাত হওয়ায়, বছরের এই সময়ের তুলনায় নদীতে অন্তত পানির স্তর অনেক নিচুই রয়েছে এবং নদীর পানি এই মুহূর্তে দুইশ ফিটের বেশি প্রশস্ত হবে না।

খুররম তাকিয়ে দেখে যে তীর থেকে নৌকার প্রথম বহরটা যাত্রা শুরু করেছে, বৈঠা হাতে মাঝিদের পিঠ ওঠানামা করছে। প্রতিটা নৌকায় দুই তিনজন করে তবকি গলুইয়ের কাছে শুয়ে গুলিবর্ষণের জন্য তাঁদের লম্বা-নলযুক্ত বন্দুক প্রস্তুত অবস্থায় রেখে ওপাড়ের তীর বরাবর আনত করে রেখেছে। স্রোতের বাধা সত্ত্বেও, যা এখনও বেশ প্রবল, কয়েক মিনিটের ভিতরেই প্রথম নৌকাটার–লাল রঙ করা বেশ বড় একটা নৌকা–সামনের অংশ তীরের দিকে অগ্রসর হতে থাকার সময়েও প্রতিপক্ষের সাথে কোনো মোকাবেলা হয় নি। কয়েকজন সৈন্য নৌকার ধারে টলমল করতে করতে দাঁড়িয়ে রয়েছে, অগভীর পানিতে লাফিয়ে নেমে পানির ভিতর দিয়ে হেঁটে তীরে যাবার জন্য যখন খুররমের কানে পরপর কয়েকটা গুলির শব্দ ভেসে আসে। নৌকার একপাশে গুঁড়ি মেরে বসে থাকা লোকদের ভিতরে একজন পানি ছিটকে দিয়ে সামনের দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, পেছনে অবস্থানরত নৌকাগুলোয় আরো তিনজন তাকে অনুসরণ করে।

খুররম ঠিক যেমনটা সন্দেহ করেছিল, তীর থেকে প্রায় শ’খানেক গজ দূরে মাটির ঢিবিগুলোর একটার পেছন থেকে গুলি করা হয়েছে। গুলির পরপরই এক ঝাঁক তীর উড়ে আসে কিন্তু, তার মাথা ঝড়ের বেগে কাজ করতে শুরু করে, খুররম দেখে স্বস্তি পায় যে তীরের সংখ্যা ত্রিশের বেশি হবে না। স্পষ্টতই অপর তীরে শত্রুপক্ষের বড় কোনো বাহিনী ওঁত পেতে নেই। তার নিজের লোকেরা এখন তরবারি হাতে যত দ্রুত সম্ভব দৌড়াতে আরম্ভ করেছে এবং উন্মুক্ত তীরের উপর দিয়ে উপরের মাটির ঢিবির দিকে উঠে যাচ্ছে। তারা যখন প্রায় তিন চতুর্থাংশ পথ অতিক্রম করেছে তখন আরো গাদাবন্দুক ঢিবির পেছনের নিরাপদ স্থান থেকে বিচ্ছিন্নভাবে গর্জে উঠে এবং খুররমের বেশ কয়েকজন সৈন্য মাটিতে লুটিয়ে পড়ে যাদের ভিতরে একেবারে সামনে বাঁকানো তরবারি আন্দোলিত করে ছুটতে থাকা–সবুজ আলখাল্লা পরিহিত দানবাকৃতির এক যোদ্ধাও রয়েছে। লোকটা অবশ্য কিছুক্ষণের ভিতরেই আবার উঠে দাঁড়িয়ে তার ঊর্ধ্বমুখী ধাওয়া শুরু করে, কিন্তু সে বা অন্যকেউ মাটির ঢিবির শীর্ষদেশে পৌঁছাবার আগেই খুররম একদল অশ্বারোহীকে দেখতে পায়–সম্ভবত চল্লিশজনের একটা দল–ঢিবির পেছন থেকে বের হয়ে এসে লাহোরের অভিমুখে দ্রুত গতিতে ফিরে যাচ্ছে। তারা নিশ্চিতভাবেই সবচেয়ে দূরবর্তী পাহারাচৌকি এবং তারা যদি অনুরোধ করেও থাকে তাদের সাহায্যার্থে অতিরিক্ত সৈন্য প্রেরণ করা হয় নি।

ধাবমান দলটার একেবারে পেছনের অশ্বারোহী, উপরের দিকে হাত ছুঁড়ে এবং পর্যাণ থেকে সামনের দিকে ছিটকে পড়ে, সম্ভবত গাদাবন্দুকের গুলির আঘাতে। আরেকটা ঘোড়া–খয়েরী রঙের–পিঠের আরোহীকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে মাটিতে আঁছড়ে পড়ে, কিন্তু বাকিরা করকটে গাছের ঝাড়ের পেছনে অক্ষত অবস্থায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। খুররম জানে যে মেহেরুন্নিসা যদি ইতিমধ্যে না জেনে থাকে কিন্তু সে অচিরেই সতর্ক হয়ে যাবে যে খুররম আর তার লোকেরা নদী অতিক্রম করেছে। জলদি, সে তার একজন সেনাপতিকে তাড়া দেয়। দূরবর্তী তীরের দিকে নৌকা সেতুর অংশটা টেনে নিয়ে যাওয়া শুরু করো। আমাদের বাহিনীকে নদী পার হবার জন্য প্রস্তুত হতে বলল। সময় নষ্ট করা যাবে না।

*

দুই ঘন্টা পরে, খুররম নদীর দূরবর্তী তীরে অবস্থান করে। তাঁর লোকেরা দ্রুত নৌকা সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করেছে। সেতুর অংশ বিশেষ যদিও এর সাথে শক্ত শনের দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা ছোট নৌকায় অবস্থানরত মাঝিরা স্রোতের উল্টো দিকে দাঁড় টেনে সুস্থির রেখেছে, সেতুটা তৈরির উদ্দেশ্যে সার্থক হয়েছে। সেতুটা যদি এখন ছিঁড়েও যায়, তার অধিকাংশ অশ্বারোহী, অনেকগুলো রণহস্তী আর এমনকি তার ছোট কামানের বেশ কয়েকটা ইতিমধ্যেই নদী অতিক্রম করেছে–লাহোর প্রাসাদের চারপাশের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় হামলা শুরু করার জন্য পর্যাপ্ত।

খুররম তার সেনাপতিদের নিজের চারপাশে জড়ো করে, সবাই তারই মত যুদ্ধের জন্য মুখিয়ে রয়েছে, সে তাঁদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত একটা বক্তৃতা দেয়। এটা জেনে রাখো। আজকের দিন আমার জীবনের সবচেয়ে সঙ্কটপূর্ণ দিন। আজকের দিনাবসানে আমি তোমাদের সহায়তায় রাজকীয় সিংহাসনে অধিকার নিশ্চিত করবো এবং আমার প্রিয় সন্তানদের উদ্ধার করবো অথবা এই প্রয়াস বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমি মৃত্যুবরণ করবো। কিন্তু আমি জানি যে তোমাদের সহায়তায় আমি সফল হবই। আমি যখন সফল হব, লাহোরের কোষাগার থেকে তোমাদের প্রত্যেককে আমি চোখ ধাঁধানো উপহার প্রদান করবো এবং সেইসাথে অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখলকারী আমার সৎ-ভাইয়ের সমর্থকদের জমি বাজেয়াপ্ত করে আমি তোমাদের মাঝে বণ্টন করবো।

মনে রাখবে, আমাদের পরিকল্পনা কিন্তু একেবারে সহজ সরল। আমরা যেই মাত্র আসফ খানের নেতৃত্বে রাভি নদীর ওপারে প্রাসাদের নিরাপত্তা বেষ্টনী লক্ষ্য করে কামানের গোলাবর্ষণের শব্দ শুনতে পাব, আমরা আর মহবত খানের লোকেরা বার্তাবাহক আমায় জানিয়েছে তিনি উজান দিয়ে নিরাপদেই নদী অতিক্রম করেছেন যুগপৎ বিপরীত দিক থেকে নিরাপত্তা বেষ্টনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বো।’

খুররম কয়েক মিনিট পরেই আসফ খানের কামানের গোলাবর্ষণের গমগম শব্দ শুনতে পায়। পুরোভাগে তাঁর চারজন দেহরক্ষী নিয়ে সবাই গাঢ় সবুজ রঙের বিশালাকৃতি নিশান বহন করছে এবং পিতলের লম্বা বাদ্যযন্ত্রে গগনবিদারী আওয়াজ সৃষ্টিকারী চারজন তূর্যবাদক নিয়ে, সে তার লোকদের একেবারে সামনে অবস্থান করে তার কালো ঘোড়ার পাজরে গুঁতো দেয় সামনে এগিয়ে যেতে। সে শীঘ্রই নদীতীরের জমাট বাঁধা অনাবৃত কাদার উপর দিয়ে আস্কন্দিত বেগে ঘোড়া ছোটাতে থাকে। সে যখন যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে যায় তার হৃৎপিণ্ড স্বাভাবিকের চেয়েও জোরে স্পন্দিত হতে থাকে এবং আসন্ন লড়াইয়ে পুরোপুরি মনোসংযোগ করতে তাঁর রীতিমত কষ্ট হয়। সে কেবলই মনে মনে চিন্তা করতে থাকে প্রাসাদের কোথায় সে তাঁর সন্তানদের খুঁজে পাবে যদি সাফল্যের সাথে সে প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে।

সে খুব ভালো করেই জানে যে তাকে বর্তমান পরিস্থিতির উপরে মনোনিবেশ করতে হবে এবং সে যদি নিজের সন্তানদের রক্ষা করা আর নিজেকে এবং নিজের লোকদের নিরাপত্তার লক্ষ্য অর্জন করতে চায় তাহলে তাকে সামনে এগিয়ে গেলে চলবে না, সে নিজের ঘোড়ার লাগাম একটু টেনে ধরে। সে তারপরে আসফ খান আর শাহরিয়ারের তোপচিদের মাঝে কামানের গোলা বিনিময়ের ফলে সৃষ্ট কুণ্ডলীকৃত ধোয়ার মেঘের মাঝে উঁকি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করে। নিরাপত্তা প্রাচীরের ভিতরে অবস্থিত প্রাসাদ সামনে আর মাত্র মাইল দূরে রয়েছে। শাহরিয়ারের লোকেরা অবশ্য মনে হয় যেন নিরাপত্তা প্রাচীর আর তার বর্তমান অবস্থানের ভিতরের সব ঘরবাড়ি নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে গোলাবর্ষণের জন্য নিজেদের একটা পরিষ্কার মাঠের সুবিধা দিতে। গুঁড়িয়ে দেয়া বাড়িঘরের জমে থাকা ভাঙা টুকরো যা পরিষ্কার করা হয় নি তাঁর অশ্বারোহীদের গতি শ্লথ করে দেয়, এবং সে হতাশ হয়ে ভাবে যে নিরাপত্তা ব্যবস্থার কাছাকাছি পৌঁছাবার আগে তাঁদের অনেকেই পৃথিবী থেকে নিঃশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তারা যদি ঘোড়া থেকে নেমে শেষ আটশ গজ পায়ে হেঁটে এগিয়ে যায় তাহলে জমে থাকা ভাঙা ইটের স্তূপ তাদের আঁড়াল দিবে।

সে নিজের ঘোড়াকে বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে নিয়ে তাঁর লোকদের অগ্রগামী দলটাকে ঘোড়া থেকে নামার আদেশ দেয়। প্রতি ছয়জনে একজন লোককে ঘোড়াগুলোকে দড়ি দিয়ে বাঁধার জন্য পেছনে রেখে সে অবশিষ্ট লোকদের নেতৃত্ব দিয়ে একটা ধ্বংস স্তূপ থেকে আরেকটার দিকে এগোতে থাকার সময় কোমরের কাছ থেকে সামনের দিকে বেঁকে থাকে। তার পুরো দূরত্বে দশ ভাগের এক ভাগও অতিক্রম করার আগেই শাহরিয়ারের তাঁদের দেখতে পায় এবং তাদের কামান আর গাদাবন্দুকের নিশানায় পরিণত করে। খুররম একটা দেয়ালের অবশিষ্টাংশের পেছনে নিজেকে নিক্ষেপ করে। সে সেখানে আড়াল নেয়ার মাঝে সে দেখে ভাঙা ইটের একটা স্তূপের পেছনে লুকিয়ে থাকা তার একজন যোদ্ধা হঠাৎ ধপ করে বসে পড়ে, সম্ভবত প্রতিহত হওয়া কোনো গুলি আঘাত করেছে যেহেতু তাঁর সামনের দিক ভালোমতই সুরক্ষিত। তারপরে, নিজের দাস্তানা পরিহিত হাত আন্দোলিত করে নিজের লোকদের তাকে অনুসরণ করার ইঙ্গিত দিয়ে, যা তাঁরা সাহসিকতার সাথে করে, খুররম উঠে দাঁড়ায় এবং পুনরায় সামনের দিকে দৌড়াতে শুরু করে, আঘাত এড়াবার জন্য একটা ধ্বংসস্তূপ থেকে আরেকটার দিকে দিকে এগিয়ে যাবার সময় প্রতিপক্ষের নিশানা লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে সে খানিকটা এঁকেবেঁকে দৌড়ায়।

দুই মিনিট পরে সে যখন পুনরায় একটা নিম গাছের কাণ্ডের পেছনে ঘামে জবজবে অবস্থায় দম নেয়ার জন্য থামে যা কামানের গোলার আঘাতে ভূপাতিত হয়েছে, সে ততক্ষণে আরো ছয়শ গজের মত দূরত্ব অতিক্রম করেছে, গাদাবন্দুকের গুলি আর তীরের ঝাঁক শিস তুলে তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করে। সে তার বামগালে যাকে ঘামের একটা ধারা বলে মনে করেছিল সেটাকে সে তার গলায় ঝোলান মাখন রঙের বড় রুমাল দিয়ে মুছতে গিয়ে কাপড়ে রক্তের দাগ দেখতে পায়। সে হাতের দাস্তানা খুলে মুখে আঙুল দিয়ে খুঁজে দেখতে গিয়ে বাম কানের পাশে একটা ক্ষত আবিষ্কার করে, যা অবশ্য সামান্য ছড়ে যাবার ক্ষত, সম্ভবত কামানের কিংবা বন্দুকের গুলির কারণে ছিটকে আসা উড়ন্ত ইটের টুকরোয় সৃষ্টি। গাছের গুঁড়ির পাশ দিয়ে উঁকি দিয়ে সে দেখে যে নিরাপত্তা বেষ্টনী পর্যন্ত বাকি পথটায় তেমন আর কোনো আড়াল নেই যা প্রায় চারফিট উঁচু কিন্তু রাভি নদীর ওপাড় থেকে আসফ খানের কামানের গোলায় যার অনেকস্থানই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে দেখা যায়।

খুররম তার চারপাশে সমবেত লোকদের দম ফিরে পাবার জন্য কয়েক মিনিট সময় দিয়ে তূর্যবাদকদের চিৎকার করে আদেশ দেয় আসফ খানকে পূর্ব নির্ধারিত সংকেত পাঠাতে যে তারা এবার নিরাপত্তা প্রাচীর আক্রমণ করবে আর তাই তাঁর কামানগুলোকে সেখানে গোলাবর্ষণ করা থেকে বিরত রাখতে। সে এরপরে নিশানাবাহকদের তাদের বিশাল সবুজ ঝাণ্ডা উঁচু করার আদেশ দেয়। সে এরপরে উঠে দাঁড়ায় এবং দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত অবস্থায় মাথা নিচু করে নিরাপত্তা প্রাচীর লক্ষ্য করে আরো একবার দৌড়াতে শুরু করে। গাদাবন্দুকের গুলি আবারও তার পাশ দিয়ে বাতাসে শিস তুলে ছুটে যায় এবং একটা তীর তার বুকের বর্মে প্রতিহত হয়ে ছিটকে যায়। সে এর এক মুহূর্ত পরেই নদীর পাড়ে প্রায় অদৃশ্য একটা ইঁটের টুকরোয় হোঁচট খায় এবং প্রায় হাত-পা ছড়িয়ে মাটিতে ছিটকে পড়ে। নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে সে প্রায় সাথে সাথেই এরপর নিরাপত্তা প্রাচীরের কাছে পৌঁছে যায়। নিজের পেষল হাতের সাহায্যে দেহের পুরো ভর তুলে সে প্রাচীরের উপর দু’পা ফাঁক করে উঠে বসে এবং লাফিয়ে অন্যপাশে নেমে আসে। সে পায়ের উপর আলতো ভর দিয়ে লাফিয়ে নিচে নামার প্রায় সাথে সাথে দীর্ঘদেহী এক তবকির আক্রমণের মুখে পড়ে। গাদাবন্দুকটায় গুলি না থাকায় সে সেটাকে উল্টো করে ধরে এবং খুররমকে লক্ষ্য করে নলটা দিয়ে লাঠির মত তাকে আঘাত করতে চেষ্টা করে যে গোড়ালীর উপর ভর দিয়ে পেছনের দিকে ঝুঁকে গিয়ে আঘাতটা এড়ায় আর সেই সাথে নিজের তরবারি ঢ্যাঙা লোকটার বিশাল পেটের গভীরে ঢুকিয়ে দেয়। সে তার রক্তাক্ত অস্ত্র লোকটার দেহ থেকে হ্যাঁচকা টানে বের করে আনতে ক্ষতস্থান থেকে সশব্দে বায়ু নির্গত হয়। খুররম তারপরে তাকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে আরেকজনকে নিজের বাকান তরবারি মাথার উপর উত্তোলিত করতে দেখে। খুররম আবার পেছনে সরে যাবার চেষ্টা করার সময় পিছলে গিয়ে নিজের গোড়ালী মচকায় এবং একপাশে কাত হয়ে পড়ে যায়। সে মাটিতে পড়লে প্রতিপক্ষ তাঁর সামনে আবির্ভূত হয়ে আঘাত করার প্রস্তুতি নিতে সে মাটি স্পর্শ করার সাথে সাথে গড়িয়ে একপাশে সরে যায়। লোকটা তরবারি তার মাথার পাশের মাটিতে গেঁথে যায়। খুররম তাঁর নিজের তরবারি দিয়ে লোকটা পায়ে আঘাত করে এবং লোকটাও এবার ভূপাতিত হয়। খুররম আপ্রাণ চেষ্টা করে দ্রুত হাঁটুর উপর ভর দিয়ে বসে প্রতিপক্ষ মাটিতে পড়ে থাকায় তরবারিটা গলা লক্ষ্য করে তাঁর পক্ষে যত জোরে সম্ভব নামিয়ে আনে। রক্ত কিছুক্ষণ গলগল করে বের হতে থাকে তারপরে লোকটা চিরতরে নিথর হয়ে যায়।

খুররম হাচড়পাঁচড় করে নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং নিজের চারপাশে তাকালে, সে দেখে যে নিরাপত্তা প্রাচীর এখন তার লোকদের দখলে এবং সর্বত্র তাদের প্রতিপক্ষ লড়াই ছেড়ে পালাতে শুরু করেছে এবং প্রাণপণে প্রাসাদের নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটে যাচ্ছে। সে এরপরে নিজের সামনে থোয়ার ভিতর দিয়ে মোগলদের সবুজ নিশান আবির্ভূত হতে দেখে। মহবত খানের রাজপুত যোদ্ধারা অন্যপাশ দিয়ে নিরাপত্তা প্রাচীর ভেঙে ফেলেছে। প্রাসাদের মূল তোরণদ্বার আক্রমণ করো, খুররম চিৎকার করে বলে, উত্তেজনা আর ধোয়ায় তাঁর কণ্ঠস্বর কর্কশ শোনায়, এবং নিজের লোকদের সাথে নিয়ে সে মচকানো গোড়ালীর ব্যাথা সহ্য করে যতটা দ্রুত সম্ভব সামনের দিকে দৌড়াতে শুরু করে, পুরোটা সময় তবকি অথবা তীরন্দাজদের আক্রমণের সামনে পড়ার আশঙ্কা করতে থাকে। তাকে অবাক করে দিয়ে অবশ্য কোনো তীর অথবা সীসার গুলি ধেয়ে আসে না। শাহরিয়ারের বাহিনী যেন শূন্যে মিলিয়ে গিয়েছে। তারা কি যুদ্ধ করার মনোবল হারিয়ে ফেলেছে নাকি তারা পূর্বনির্ধারিত কোনো পরিকল্পনা অনুযায় ভেতরের কোনো শক্তঘাঁটি অভিমুখে বা অতর্কিত হামলার জন্য নির্ধারিত স্থানে পশ্চাদপসারণ করছে?

খুররম দৌড়াবার সময় মাটিতে পরিত্যক্ত অবস্থায় অসংখ্য গাদাবন্দুক আর তরবারি পড়ে থাকতে দেখে। সে উল্টে রাখা শকট আর অন্যান্য প্রতিরক্ষা অবস্থান পাশ কাটিয়ে যায়, যার কোনোটা কামান সজ্জিত যেখান থেকে তোপচি আর সেই সাথে তবকিরা মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করতে পারতো, কিন্তু একটা গোলা বর্ষণ না করেই যা পরিত্যক্ত হয়েছে। শাহরিয়ারের লোকেরা আসলেই পালাতে শুরু করেছে। খুররম শীঘ্রই প্রাসাদের উঁচু, ধাতব কীলক সজ্জিত কাঠের দরজার দিকে এগিয়ে যায় যা এখন খোলা এবং আপাতদৃষ্টিতে অরক্ষিত। সে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ভাবে, তাঁর বিজয় হয়েছে। নিজের সন্তানদের এখন তাকে খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু সহসা তাঁর পাশে দৌড়াতে থাকা দেহরক্ষী একটা পাথরের টুকরো এড়াবার জন্য দিক পরিবর্তন করে তাঁর সামনে চলে আসে এবং পরমুহূর্তেই হাত পা ছড়িয়ে সামনের মাটিতে পড়ে থাকে। লোকটার দেহ এড়িয়ে যাবার জন্য ঘুরে যাবার সময় খুররম নিচের তাকিয়ে দেখে লোকটা ঠিক কপালের মাঝখানে গুলি বিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু সে এটা নিয়ে আর কিছু ভাববার অবকাশ পায় না তার আগেই সে তোরণগৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।

*

মেহেরুন্নিসা প্রাসাদের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত নিজের আবাসন কক্ষের গবাক্ষ থেকে সরে দাঁড়ায় এবং শুক্তির রঙিন খোলা দিয়ে নক্সা করা বাটের গাদাবন্দুকটা নামিয়ে রাখে যা দিয়ে সে প্রচুর বাঘ শিকার করেছে। তার নিশানা এত দূর থেকেও লক্ষ্যভেদ করেছে। খুররমের সামনে দেহরক্ষীটা এভাবে কেন এগিয়ে এলো? সে তাকে দেখতে পেয়ে যুবরাজকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে এটা অসম্ভব। তার মন তারপরে এখন যখন প্রাসাদের পতন হয়েছে যা প্রতি মুহূর্তে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে আবার বরাবরের মত সক্রিয় হয়ে উঠে নিজেকে রক্ষা করার উপায় নিয়ে ভাবতে শুরু করে। খুররম আর তার লোকেরা শীঘ্রই তন্নতন্ন করে প্রাসাদে তল্লাশি চালান শুরু করবে তার সন্তানকে, তাকে এবং শাহরিয়ারকে খুঁজতে।

শাহরিয়ার কোথায়? সে ব্যক্তিগতভাবে সৈন্য পরিচালনা করে নি, বা সে লাডলির সাথেও নেই যে তাঁর সন্তানদের নিয়ে পাশের কক্ষে অবস্থান করছে সে জানে। তাদের কারো উপরে তাঁর পক্ষে নির্ভর করা সম্ভব না বরং তাকে অতীতের মত আবারও নিজের বুদ্ধির উপরেই নির্ভর করতে হবে। সে ভালো করেই জানে যে তাঁর গাদাবন্দুকের গুলিটা অনেক অর্থেই একটা দূরপাতী গুলি ছিল। সে যদি এমনকি খুররমকে হত্যা করতে সক্ষমও হতো তাহলেও বোধহয় তাঁর লোকেরা আত্মসমর্পণ করতো না। তারা বরং–আরজুমান্দ আর তার ভাই আসফ খানের তাড়াহুড়োর কারণে–দারা শুকোহকে সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করতো। তার তাহলে কি, নিজের গাদাবন্দুকটায় গুলি ভরা এবং তাঁর আবাসন কক্ষের দরজা দিয়ে তাঁরা ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করলে প্রথমজনকে হত্যা করে, লড়াই করেই মৃত্যুবরণ করা উচিত? না। সে তার জন্মের পর থেকে অসংখ্যবার বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েও বেঁচে রয়েছে। সে এখনও মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত নয়। একটা শান্ত, সমাহিত আর তীক্ষ্ণধী মন মারাত্মক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে আর সেটাকে স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারে। অসহায় নারী’ হিসাবে তাঁর অবস্থান একবারের জন্য হলেও তাকে সাহায্য করবে। সে জানে তাঁর কি করা উচিত…

*

খুররম তাঁর কয়েকজন দেহরক্ষীকে নিয়ে প্রাসাদের দ্বিতীয় তলার দিকে নেমে যাওয়া সাদা মার্বেলের দুই প্রস্থ সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নিচে নামতে শুরু করে যেখানে, তোরণগৃহের হট্টগোলের ভিতরে কিছুক্ষণ চিন্তা করার পরে তাঁর মনে পড়েছে রাজকীয় আবাসন কক্ষগুলো অবস্থিত। সে নিজের সন্তানদের খোঁজে একটামাত্র গবাক্ষ দ্বারা আলোকিত একটা স্থাপক পথের দু’পাশে অবস্থিত হাতির দাঁতের কারুকাজ করা দরজা একটার পর একটা খুলে দেখতে থাকে। তারা কোথায়? মেহেরুন্নিসা আর শাহরিয়ার কি নিজেদের নিরাপদ অতিক্রমণ নিশ্চিত করতে তাদের জিম্মি হিসাবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে গোপনে সরিয়ে ফেলেছে। নাকি তারচেয়েও জঘন্য, তাঁর সাফল্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁদের তাঁরা হত্যাই করেছে? সে ভাবে, মেহেরুন্নিসার কারণে সে সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারে না, নিজের অজান্তেই তার হাত তরবারির বাট আঁকড়ে ধরে।

সে প্রথম যে কক্ষটায় প্রবেশ করে সেটা পুরোপুরি ফাঁকা এবং জানালা দিয়ে প্রবাহিত হওয়া বাতাসে কেবল মাত্র মসলিনের পদাই আন্দোলিত হচ্ছে। দ্বিতীয় কক্ষটাও শূন্য এবং তৃতীয়টাও যদিও উপুড় হয়ে থাকা একটা রূপার পানপাত্র আর মাটিতে গড়িয়ে পড় শরবত দেখে বোঝা যায় যে কক্ষের বাসিন্দা একটু আগেই তাড়াহুড়ো করে জায়গাটা ত্যাগ করেছে। সে কক্ষটা থেকে তরবারি হাতে বের হয়ে আসতে স্থাপন পথ বরাবর দূরে অবস্থিত একটা দরজা খুলে যায় এবং ভেতর থেকে পিঠ সোজা করে কালো কাপড়ে আবৃত একটা নারী মূর্তি বের হয়ে আসে একটা মাখন রঙের শাল দিয়ে তাঁর মুখ ঢাকা। অবগুণ্ঠিত রমণী মাথা উঁচু করে তার দিকে স্থির পদক্ষেপে এগিয়ে আসতে শুরু করে। খুররম প্রায় সাথে সাথে অবয়বটা অঙ্গস্থিতি আর সৌশাম্য দেখে বুঝতে পারে যে সেটা স্বয়ং মেহেরুন্নিসা। সে তাকে আটকাবার আদেশ দেয়ার আগেই সে তাঁর শাল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তার কাছ থেকে বারো ফিট দূরে মেঝের উপর নিজেকে নিক্ষেপ করে।

‘খুররম, আমি আত্মসমর্পণ করছি। কাঙ্খিত সিংহাসন এখন কেবল তোমার। তোমার যা ইচ্ছা আমার সাথে করতে পারো,’ সে বলে কিন্তু তারপরে যোগ করে, কিন্তু তার আগে তুমি নিশ্চয়ই জানতে চাইবে দারা শুকোহ আর আওরঙ্গজেব কোথায় আছে?

খুররম অপলক তাকিয়ে থাকে। মেহেরুন্নিসা কি তাঁর একমাত্র সম্ভাব্য দরকষাকষির অনুষঙ্গ তাঁর সন্তানদের নিজের জন্য কোনো ধরনের ছাড় না চেয়েই সমর্পণ করবেন?

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। তারা কোথায় আছে?

‘প্রাসাদের পূর্বভাগে বৃত্তাকার বেলেপাথরের গম্বুজের ভূগর্ভে অবস্থিত দুটো ছোট কক্ষে শাহরিয়ার তাদের বন্দি করে রেখেছে। তারা চব্বিশ ঘন্টা প্রহরাধীন অবস্থায় রয়েছে, যদিও শাহরিয়ার আর তার লোকেরা সাহসের যে নমুনা দেখিয়েছে সেটা বিবেচনা করে বলা যায় প্রহরীরা নিজেদের জান বাঁচাতে এই মুহূর্তে নাক বরাবর ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালাচ্ছে। দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। তোমার সন্তানেরা সুস্থ আছে, যদিও আলো বাতাসের অভাব আর বন্দি থাকার কারণে খানিকটা ফ্যাকাসে আর রোগা হয়ে গিয়েছে।’

‘তুমি নিশ্চয়ই আমার কাছে মিথ্যা বলছো না, বলছো কি?’ খুররম আশা আর ভয়ের মাঝে দোদুল্যমান অবস্থায়, চিৎকার করে জিজ্ঞেস করে। সবকিছুই কেমন বেশি সহজ মনে হচ্ছে। এটাও কি মেহেরুন্নিসার অনেক চালাকির একটা–কোনো ধরনের ফাঁদ?

‘আমি কেন মিথ্যা বলতে যাব? সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছে। তুমিই চূড়ান্ত বিজয়ী। তোমার ক্রোধের কারণ হয়ে আমি সম্ভাব্য কি সুবিধা লাভ করতে পারবো? তুমি এখন আগে তাঁদের কাছে যাও।’

‘এই রমণীকে হেরেমে আটকে রাখো। আমি পরে তার ভাগ্য নির্ধারণ করবো, খুররম সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নিচে নেমে তোরণগৃহের নিচে দিয়ে বের হয়ে সূর্যালোকিত প্রাঙ্গণে যাবার আগে তাঁর লোকদের আদেশ দেয়। সে শাহরিয়ারের কিছু সৈন্যকে সেখানে হাত পিছমোড়া অবস্থায় আসনসিঁড়ি করে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে থাকতে দেখে যখন তাঁর লোকেরা অন্যদের খুঁজছে আর ধৃত অস্ত্র জমা করছে।

হা, পশ্চিম প্রান্তে একটা বৃত্তাকার গম্বুজ রয়েছে এবং, হ্যাঁ, সেখানে মনে হচ্ছে মাটির নিচে ভূ-গর্ভের দিকে একপ্রস্থ সিঁড়ি নেমে গিয়েছে। খুররম সেদিকে দৌড়ে যায় এবং একবারে দুটো করে ধাপ টপকে নিচে নামতে শুরু করে, কিন্তু শেওলা-আবৃত নিচের একটা ধাপে তার পা পিছলে যায় এবং সে আবারও গোড়ালি মচকায়। নিজেকে গড়িয়ে পড়ার হাত থেকে কোনোমতে রক্ষা করে, সে চারপাশে তাকিয়ে একটা নিচু খিলানের পেছনে সেঁতসেঁতে, ছাতার গন্ধযুক্ত, অন্ধকার গলি দেখতে পায়। সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে নিজের দেহরক্ষীদের নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। সেটা একটা কানা-গলি কিন্তু দেখা যায় দুপাশে একটা করে দরজা রয়েছে। প্রতিটা দরজার উপরিভাগ কেটে লোহার ছোট গরাদ বসানো হয়েছে এবং দুটো দরজাই লোহার শেকল দিয়ে আটকানো।

‘দারা আর আওরঙ্গজেব, খুররম চিৎকার করে উঠে, “তোমরা কি ভিতরে আছো?’

কোনো উত্তর শোনা যায় না। সবচেয়ে খারাপ সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে সে ডান দিকের দরজার উপরের লোহার গরাদের ভিতর দিয়ে উঁকি দেয়। আওরঙ্গজের গরীব গ্রামবাসীর গৃহে যেমন পাওয়া যায় সেরকম দড়ির একটা চারপায়ায় শুয়ে রয়েছে, একটা নোংরা খয়েরী কাপড় তার মুখে গোঁজা আর তার দু’হাত দেয়ালের সাথে শিকল দিয়ে আটকানো। চারপায়ার নিচে মল-মূত্রে কানায় কানায় ভরা একটা পিতলের পাত্রের পাশেই মাটির বাসনে আধ-খাওয়া একটা চাপাতি পড়ে রয়েছে। খুররম অন্য গরাদের ভিতর উঁকি দেয়ার সময় নিজের সন্তানকে জীবিত দেখার স্বস্তির সঙ্গে তাঁদের সাথে কেউ এমন আচরণ করতে পারে দেখে সৃষ্ট ক্রোধ মিশে যেতে থাকে এবং দেখে দারা শুকোহ একইভাবে মুখ আর হাত বাধা অবস্থায় সেখানে রয়েছে।

দরজাগুলো ভেঙে ফেলো, সে চিৎকার করে তার সাথের দেহরক্ষীদের আদেশ দেয়। একজন–স্থূলদেহী রাজপুত–দুটো দরজাই পর্যায়ক্রমে গায়ের পুরো শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিতে শুরু করে কিন্তু খুব একটা লাভ হয় না। অন্য আরেকজন তারপরে একটা লম্বা লোহার দণ্ড খুঁজে বের করে এবং দারা শুকোহর দরজার শিকলের ভেতর সেটা প্রবিষ্ট করায় এবং প্রবল একটা গর্জনের সাথে তীব্র মোচড় দিয়ে শিকলের একটা আংটা খুলে ফেলে। দরজা খোলা মাত্র খুররম তাঁর সামনের লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে একপাশে সরিয়ে পূতিগন্ধময় কামরার ভেতরে প্রবেশ করে। সে কাঁপা কাঁপা আঙুলে দ্রুত তার মুখের বাঁধন খুলতে শুরু করে যখন অন্য দেহরক্ষীরা হাতের শিকল ভেঙে ফেলে। দারা শুকোহ, তুমি এখন নিরাপদ, সে, প্রাণপণে কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত যখন মুখের বাঁধন খুলতে সফল হয়, বলে। দারা শুকোহ, একই সময়, তাঁর হাতের বাধন খুলে যেতে-আবেগে তাঁর পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে–দু’হাতে তার আব্বাজানের গলা জড়িয়ে ধরে। আওরঙ্গজেবকে অন্য দেহরক্ষীরা কিছুক্ষণ পরে মুক্ত করতে সক্ষম হলে সে দৌড়ে ভাইয়ের প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে এবং দু’জনকেই জড়িয়ে ধরে। খুররম স্বস্তি এবং আনন্দের অশ্রু আর চেপে রাখতে পারে না। কিন্তু বর্ণনার সাথে তাদের এই আপাত সাদৃশ্যের মাঝেও সে লক্ষ্য করে যে তাঁদের চোখ কোটরাগত এবং তাদের যেমন স্বাস্থ্য হওয়া উচিত তারা তারচেয়ে কৃশকায়।

কয়েক মিনিট পরে যে সময়টা তারা কেউই কোনো কথা বলতে পারে না খুররম জানতে চায়, তোমাদের কতদিন এভাবে বন্দি করে রাখা হয়েছে? ‘আব্বাজান, চৌদ্দদিন, দারা শুকোহ বলে, তার কণ্ঠস্বর মুখে কাপড় গোঁজা থাকার কারণে এখনও রুক্ষ আর কর্কশ।

‘আমাদের তখন থেকেই একহাত দেয়ালে বাধা অবস্থায় এসব প্রকোষ্ঠে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। কয়েক ঘন্টা আগে আমাদের দু’হাত বেধে মুখে কাপড় গোঁজা হয়েছে, আওরঙ্গজেব খুলে বলে।

‘তোমাদের বন্দি করার আদেশ কে দিয়েছিল?

‘আমাদের প্রথম যখন এখানে নিয়ে আসা হয় তখন প্রহরীদের একজন আমায় বলেছিল শাহরিয়ারের আদেশে, দারা শুকোহ বলে। প্রহরীটা আমার সাথে ভালো আচরণ করতো আর হাতকড়া পরাবার আগে কব্জিতে নরম কাপড় জড়িয়ে দিতে। তাঁর প্রতি অনুগ্রহ করে সদয় আচরণ করবেন।’

‘আমি দেখবো তাকে যেন কঠোর শাস্তি দেয়া না হয়। সে কি তোমায় বলেছিল যে শাহরিয়ার তোমায় কেন বন্দি করছে?

‘আমরা যাতে পালিয়ে যেতে না পারি অথবা আমাদের কেউ উদ্ধার করতে না পারে যাতে সে আমাদের জিম্মি হিসাবে ব্যবহার করতে পারে,’ দারা শুকোহ বলে এবং তারপরে এক মুহূর্ত পরে বলে, ‘আব্বাজান, আমার মনে হয় শাহরিয়ার কিছুক্ষণ আগে আমাদের নিয়ে যাবার জন্য এখানে এসেছিল। দরজার শিকল ধরে কেউ এমনভাবে নাড়াচাড়া করছিল যেন শিকল খুলতে চেষ্টা করছে এবং আমার মনে হয় প্রহরীদের উদ্দেশ্যে আমি একটা কণ্ঠস্বরকে জিকার করতে শুনেছি। কিন্তু তারা কেউ আসে নি এবং সেও দরজা খোলার কোনো উপায় খুঁজে পায় নি।

‘সেটা হয়ত ভালোই হয়েছে। ভয় আর আতঙ্কে জর্জরিত অবস্থায় সে কি করে বসতো তার কোনো ঠিক নেই, খুররম বলে, মেহেরুন্নিসার পরিবর্তে তার সমস্ত ক্রোধ ক্রমশ শাহরিয়ারের উপরে পুঞ্জীভূত হতে থাকে। তিনি অন্তত তাঁর মুখোমুখি হবার সাহস দেখিয়েছেন এবং এটুকু বোঝার মত শুভবুদ্ধি তার অন্তত রয়েছে যে কখন তিনি পরাস্ত হয়েছেন এবং তাঁর সন্তানদের অবস্থান প্রকাশ করা। নিজেকে সন্তানদের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে, সে বলে, চলো তোমাদের উপরে সূর্যের আলোয় নিয়ে যাই। আমি শাহরিয়ারকে খুঁজে বের করার সময় তোমরা গোসল করে খাবার খাবে।

তাঁরা দ্রুত ভূ-গর্ভস্থ সেঁতসেঁতে কক্ষ ত্যাগ করে এবং সিঁড়ি দিয়ে উপরের আলোয় উঠে আসে, দুই ছেলেই বেশ কয়েকদিন অন্ধকারে থাকায় তারা সূর্যের দীপ্তি থেকে হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে রাখে।

তারা উপরে উঠে আসবার এক কি দুই মিনিট পরে, খুররম দেখে হেরেমের দিক থেকে একজন মহিলাকে রূঢ়ভাবে ধাক্কা দিয়ে প্রাঙ্গণের দিকে নিয়ে আসা হচ্ছে। তার প্রথম প্রতিক্রিয়া হয় কল্পনা করার চেষ্টা করা মেহেরুন্নিসা নিরবে নিজের পরাজয় মেনে নিয়ে তাঁর কাছে নিজেকে সমর্পণ করার সত্ত্বেও আবার নতুন করে কি নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছে। সে, অবশ্য, শীঘ্রই বুঝতে পারে এই রমণী মেহেরুন্নিসার চেয়ে লম্বা এবং তার কাঁধও বেশ চওড়া। প্রহরীরা তাকে খুররমের কাছে টেনে নেয়ার সময় সে তার গায়ের সব শক্তি দিয়ে বাঁধা দিতে চেষ্টা করছে, নিজের পা ফেলতে অস্বীকার করছে এবং প্রাণপনে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে। সে যখন আরেকটু কাছে আসে খুররম দেখে তাঁর চিবুকে খোঁচা খোঁচা দাড়ি রয়েছে যা এমনকি সবচেয়ে লোমশ মহিলার থাকার কথা নয়। মেয়েমানুষের পোষাক পরিহিত একজন পুরুষ–শাহরিয়ার, তার তার সুদর্শন মুখাবয়ব ডান চোখের চারপাশ ফুলে বেগুনী হয়ে উঠার কারণে, যা প্রায় বন্ধ হয়ে আছে, নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সে স্পষ্টতই সুবোধ বালকের মত ধরা দেয় নি।

‘তোমরা একে কোথায় খুঁজে পেয়েছো?’ শাহরিয়ারকে ধরে রাখা প্রহরীদের একজনকে খুররম জিজ্ঞেস করে, যে ইতিমধ্যে হাঁটু ভেঙে বসে পড়েছে এবং তাঁর দু’হাত অনুনয়ের ভঙ্গিতে পরস্পরকে আঁকড়ে রয়েছে।

‘আমরা সম্রাজ্ঞী মেহেরুন্নিসা, তার কন্যা লাডলী এবং লাডলীর সন্তানকে বন্দি করার পরে হেরেমে তল্লাশি শুরু করি। আমরা সেখানে এমন কাউকে দেখতে পাইনি যার সেখানে থাকার অধিকার নেই যতক্ষণ না আমরা সেখানের সর্বশেষ আর সবচেয়ে ছোট কক্ষের সামনে উপস্থিত হই। আমি ভেতরে প্রবেশ করি। কক্ষটায় ময়লা কাপড় আর অপরিষ্কার বিছানার চাদর পরিষ্কার করতে পাঠাবার আগে জমা করা হয়। প্রথমে সবকিছুই ঠিকঠাক আছে বলে মনে হয়, কিন্তু আমি যখন বের হয়ে আসবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছি, দরজার কাছে ধোয়ার জন্য রাখা বিশাল একটা সাদা কাপড়ের স্তূপের ভেতরে একটা হাল্কা একটা নড়াচড়া আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে, এতই মৃদু যে ইঁদুর হওয়াও বিচিত্র না কিন্তু আমি ব্যাপারটা অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত নেই। আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ, আমি খুঁজে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমি কাপড়ের স্তূপে যখন লাথি মারি, আমার পা মাংসে আঘাত করে এবং একজন মহিলা লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং পালাতে চেষ্টা করে, সে পালিয়ে যাবার সময় আমার মুখে খামচে দিয়ে যায়। আমি পেছন থেকে তাঁর কাঁধ চেপে ধরি এবং তাকে কাপড়ের স্তূপের উপর চিৎ করে ফেলে দেই এবং সে যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেজন্য আমি তার দুপাশে দু’পা রেখে, হাঁটু ভেঙে বসে পড়ি। কে তুমি? কেন তুমি পালাতে চেষ্টা করছো?” আমি চিৎকার করে জানতে চাই। আমি ভেবেছিলাম তুমি আমায় ধর্ষণ করবে। আমি একজন কুমারী এবং তোমার মত একজন অভদ্র যোদ্ধার লালসার শিকার হবার কোনো ইচ্ছা আমার নেই,” সে বেশ উঁচু স্বরে বলে। আমি যদিও আগে কখনও কোনো মেয়ের এমন কর্কশ কণ্ঠস্বর শুনিনি, তারপরেও আমি তাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াতে শুরু করি কিন্তু আমি দাঁড়াতে গেলে সে হাঁটু দিয়ে আমার কুঁচকিতে আঘাত করে। আমি ব্যাথায় দু’ভাজ হয়ে কুঁকড়ে গেলে সে ধাক্কা দিয়ে আমায় একপাশে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে কিন্তু আমি তাকে ধরে ফেলি। সে এরপরে আমার বাহু কামড়ে দেয়। সেই সময়েই তার নেকাব আলগা হয়ে যায় এবং আমি দেখি সে আসলে একজন পুরুষ এবং আমি তাকে জোরে ঘুষি মারি। সে এরপরে আর ধ্বস্তাধ্বস্তি করার চেষ্টা করে নি।

‘তুমি ভালো কাজ করেছো, খুররম বলে। শাহরিয়ারের দিকে তাকিয়ে সে এরপরে জানতে চায়, আর শাহরিয়ার, নিজের পক্ষে সাফাই দেয়ার জন্য তোমার কি বলার আছে?

আমায় মাফ করে দাও, তার সৎ-ভাই মিনতি করে, খুররমের দিকে সে সানুনয়ে তাকিয়ে রয়েছে।

তুমি আমার সন্তানদের সাথে যে আচরণ করেছে তারপরে কেন আমি তোমায় ক্ষমা করবো? তোমার এতবড় স্পর্ধা তুমি নির্দোষ যুবরাজদের সাথে সাধারণ অপরাধীদের মত আচরণ করেছো?”

‘আমি এসব করিনি। আমি কেবল

‘কেবল কি?

‘মেহেরুন্নিসার আদেশ অনুসরণ করেছি।’

‘দেখা যাক তাঁর এসম্বন্ধে কি বলার আছে। সম্রাজ্ঞীকে এখানে নিয়ে এসো, খুররম সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরীদের একজনকে আদেশ দেয়। তাকে কয়েক মিনিট পরে খুররমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়, এখনও তাকে শান্ত আর সমাহিত দেখায়। এই কীট বলছে সে কেবল আপনার আদেশ পালন করেছে।’

‘বেশ, তাকে সেগুলো উপস্থাপন করতে বলেন। কি ধরনের পুরুষ মানুষ হলে তবে লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে নিজেকে সে মেয়েদের আঁচলের পেছনে লুকিয়ে রাখতে পারে? আমি কি পরামর্শদাতাদের সভায় অংশগ্রহণ করেছি? আমি কি তোমার সন্তানদের হাতকড়া পরাবার আদেশ দিয়েছি? তাদের প্রহরীদের জিজ্ঞেস করো–যদি তুমি তাদের খুঁজে পাও।

তার ছেলেরা তাকে কি বলেছে সেটা মনে করে, খুররম ভাবে, যুক্তিসঙ্গত কথা। বেশ শাহরিয়ার, এই অভিযোগের জবাব দাও।’

‘কিন্তু আমি জানি তিনি ঠিক এটাই চেয়েছিলেন… যে আমার কার্যকলাপ তাকে এবং লাডলীকে প্রীত করবে। আপনার অধপতন আর অপমান মেহেরুন্নিসাকে প্রহৃষ্ট করেছে। তিনি নিজে এর পেছনে ছিলেন, সবাই সেটা জানে।’

‘মেহেরুন্নিসা, এটা কি সত্যি?

‘বহু বছর যাবত আমি তোমার বন্ধু নই। আমি অবশ্যই সেটা স্বীকার করি। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত শত্রুতা কিংবা সংকীর্ণ আক্রোশের বশবর্তী হয়ে কোনো কাজ করি। আমাদের সবার উচিত প্রথমে নিজের দিকে তাকানো। আমি আমার নিজের স্বার্থরক্ষায় কাজ করেছি… সেটা করতে গিয়ে আমি তোমার আর আরজুমান্দের স্বার্থহানির কারণ হয়েছি কিন্তু সেটা মূল উদ্দেশ্য ছিল না সেটা ছিল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। হ্যাঁ, আমি হয়তো তোমার অধিকাংশ দুর্ভোগের জন্য দায়ী এবং হ্যাঁ, আমি সেজন্য মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত… কিন্তু তোমার জানা উচিত যে তোমার সন্তানদের প্রতি আচরণের মাঝে সংকীর্ণ, বিদ্বেষপূর্ণ পরিশোধন করা আমার চরিত্রের সাথে মানানসই না।’

খুররম ভাবে, এটা নিশ্চিতভাবে সত্যি। দারা শুকোহ তাকে প্রাসাদ প্রাঙ্গণে বলেছে যে বন্ধুভাবাপন্ন প্রহরী তাকে বলেছিল যে শাহরিয়ার ব্যক্তিগতভাবে তাকে নির্দেশ দিয়েছে যে তাদের প্রকোষ্ঠে সরবরাহ করা খাবার যেন রাজকীয় রন্ধনশালা থেকে পাঠান না হয় কেবল চাপাতি আর পানি আর তাদের ডিভানের পরিবর্তে চারপায়া। তার মাঝে আবারও ক্রোধ পুঞ্জীভূত হতে শুরু করে যখন সে জানতে চায়, মেহেরুন্নিসা যা বলেছে সেটা কি সত্যি?’ শাহরিয়ার কোনো উত্তর দেয় না। তোমার মৃত্যুদণ্ডই প্রাপ্য, খুররম তাকে বলে, এবং তারপরে মেহেরুন্নিসার দিকে ঘুরে জানতে চায়, ‘কেন তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে না সেজন্য সাফাই হিসাবে আপনার কিছু বলার আছে?

মেহেরুন্নিসা নিজেকে ইস্পাতের ন্যায় কঠোর করে তুলে ঠিক যেমনটা সে করেছিল বহুবছর আগে জাহাঙ্গীরের সামনে তার নির্যাতিত, রক্তাক্ত, কুচক্রী ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকার সময়। শাহরিয়ারের জন্য তার কিছুই করার নেই। তাঁর নিজেকে আর মেয়েকে এবং নাতনিকে বাঁচার একটা সুযোগ দিতে হলে শাহরিয়ারকে উৎসর্গ করা প্রয়োজন।

‘একজন মেয়ের পরামর্শের কি মূল্য আছে, তার কার্যকলাপ মৃত্যুদণ্ডের যোগ্য। তাকে বাঁচিয়ে রাখার অর্থই হল তোমার সিংহাসনের জন্য হুমকি হতে পারে এমন একজনকে বাঁচিয়ে রাখা। তোমার পূর্বপুরুষদের প্রদর্শিত উদারতার ফলে সৃষ্ট বিপদের কথা মনে রেখো। কামরান আর হুমায়ুন, খসরু আর তোমার আব্বাজানের কথা চিন্তা করো। বিদ্রোহী একবার ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করলে সে আবার সেটা চাইবে। তুমি, তোমার প্রিয়তমা আরজুমান্দ আর তোমার সন্তানেরা শাহরিয়ারের বিদায়ের ফলে নিরাপদে ঘুমাতে পারবে। তুমি নিজেও মনের গভীরে ভালো করেই সেটা জানো। তুমি শাহরিয়ারকে মৃত দেখতে চাও, এবং খসরুকেও। আমি সেটা দেখতে পাচ্ছি… প্রশ্ন হলো সেটা স্বীকার করার মত সাহস কি তোমার আছে? বেঁচে থাকার জন্য যা প্রয়োজন সেটা করতেই হবে। তোমার বিবেককে নতজানু করতে আমার শব্দগুলো ব্যবহার করতে পারো যদি তুমি এতই দুর্বল হও যে সেটা করা প্রয়োজন হয়। একজন নারী দোষের ভাগীদার হোক। কেন নয়?

খুররমের মাথার ভিতরে মেহেরুন্নিসার শব্দগুলো প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। হ্যাঁ, নিজের অন্তরে যদিও সে জানে তাঁর আব্বাজানের শূন্য সিংহাসন অধিকার করার জন্য সে তার সৎ-ভাইদের প্রতি ভিন্ন আচরণ প্রদর্শন করতো না, তারা যদি মারা যায় এবং তাদের হুমকি চিরতরে লোপ পায় তাহলে সে খুশিই হবে। আর হ্যাঁ, অন্যকারো উপরে সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব। চাপিয়ে দেয়ার মত আকাঙ্খ পোষন করার মত সে দুর্বলই বটে যাতে নিজের স্বার্থপরতার গভীরতার মুখোমুখি হবার তার কোনো প্রয়োজন হয়… কিন্তু সে যদি একজন সম্রাট হতে চায় তাহলে তাকে দায়িত্বের বোঝ নিতেই হবে। কিছু সময় পরে যে সময়টায় কেউই কোনো কথা বলে না, সে বলে, শাহরিয়ায়, এখন তোমার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে–এজন্য নয় যে তোমার অপরাধ এমনই গুরুতর বরং রাজবংশ, আমার আর আমার সন্তানদের খাতিরে। প্রহরী তাকে নিয়ে যাও। তরবারির আঘাতে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে। দ্রুত আর নিখুঁতভাবে এটা করবে।

শাহরিয়ার জ্ঞান হারিয়েছে বলে মনে হয় এবং প্রহরীরা নিচু হয়ে ঝুঁকে তাকে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করে। প্রাঙ্গণের অর্ধেক অতিক্রম করার পরেই সে চিৎকার শুরু করে, তাদের মুঠোর মাঝে বেঁকে যায়, লাথি মারতে চেষ্টা করে। কোনো কারণে, হয়তো যা ঘটছে সেজন্য নিজের সংকল্প আর দায়িত্ব প্রদর্শনের জন্য, খুররম নিজেকে বাধ্য করে প্রহরীরা যতক্ষণ না তার সৎ-ভাইকে নিয়ে দৃষ্টির আড়ালে চলে যায় ততক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে। সে তারপরে মেহেরুন্নিসার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। সে এখনও তাঁর দিকে শীতল আর অবজ্ঞার সাথে তাকিয়ে রয়েছে, চোখ সংহত আর ঠোঁটদ্বয় পরস্পরের শক্ত করে চেপে বসে আছে। কিন্তু সে যখন তাকে খুটিয়ে দেখে, খুররম অনুভব করতে শুরু করে যে তিনি একজন বৃদ্ধ মহিলা। তার চোখের নিচে ফোলা এবং তার কালো চোখের মণি কিনারার দিকে ধুসর হতে শুরু করেছে। তার উপরের ঠোঁট পাতলা ফিনফিনে চুলে আবৃত এবং তার মুখের চারপাশে বলিরেখা পরা আরম্ভ হয়েছে। তাঁর চোয়াল ঝুলতে শুরু করেছে। তিনি একজন বয়স্ক বিধবা যার কাছ থেকে তার রূপের মত ক্ষমতাও পুরোপুরি হ্রাস পেতে শুরু করেছে, তার যতই এখনও ঘটনাবলী প্রভাবিত করার আকাঙ্খ থাকুক। শাহরিয়ারের মত তিনি মৃত্যু ভয়ে ভীত নন। তাকে উপেক্ষা করাই হয়ত আরো বড় শাস্তি হবে। সে দেখুক কোনো কিছুর জন্য তাকে এখন কত কম গুরুত্ব দেয়া হয়।

‘মেহেরুন্নিসা, আপনার জন্য, রাজকীয় বিধবার কাছে যেমন প্রত্যাশিত আপনি সেভাবে নির্জনে আপনার শোক পালন করবেন। আমি আপনার জন্য একটা দূরবর্তী স্থান খুঁজে বের করবো যেখানে আপনি হয়তো আপনার ক্ষতি আর আপনার পাপের মাঝে মধ্যস্থতা করতে পারবেন এবং পৃথিবীর কর্মকাণ্ড দ্বারা কোনোভাবেই বিব্রত না হয়ে যা শীঘ্রই আপনার কথা বিস্মৃত হবে, আল্লাহর উপাসনায় মগ্ন থেকে পরপারের ডাকের জন্য অপেক্ষা করবেন।’

মেহেরুন্নিসাকে যখন নিয়ে যাওয়া হয় সে কোনো কথা বলে না। সে যা চেয়েছিল আরো একবার ঠিক তাই পেয়েছে। সে বেঁচে থাকবে। অবশ্য, তার নিয়তির বাস্তবতা যখন সে অনুধাবন করতে আরম্ভ করে তখন সে কল্পনা করতে শুরু করে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবার চেয়ে এখনই কি মৃত্যুবরণ করাটা তার জন্য ভালো হতো। মৃত্যু অবধারিত। সে কেন তাকে এখন ডেকে নিয়ে এলো না যখন সে জানতো সেটা করতে পারবে? একবারের মত হলেও কি সে সাহস দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে? এটা এমন একটা প্রশ্ন যা তাকে তাড়িত করতে থাকবে।

*

সেই রাতে, রাজকীয় আবাসন এলাকায় বসে নিজের লোকদের উৎফুল্ল পানাহারের আওয়াজ শুনতে শুনতে খুররম মোমের আলোয় দুটো চিঠির মুসাবিদা করে। প্রথমটা আরজুমান্দের কাছে, দীর্ঘ আর প্রেমপূর্ণ এবং তাঁদের সন্তানদের নিরাপত্তা আর কীভাবে সে সিংহাসন নিরাপদ করেছে সেই সংবাদ। তার রাজধানীতে তাঁর অভিষেকের প্রস্তুতির জন্য যত শীঘ্রি সম্ভব সে তাঁদের অবশিষ্ট সন্তানদের নিয়ে আগ্রার বাইরে তার সাথে মিলিত হবার জন্য চিঠিটায় তাকে আসতে বলা হয়েছে। দ্বিতীয় চিঠিটার প্রাপক বুরহানপুরের সুবেদার এবং অনেক সংক্ষিপ্ত আর অনেকবেশি বিষণ্ণ।

*

তূর্যনিনাদের ঝঙ্কারে খুররম, আওরঙ্গজেব আর দারা শুকোহকে নিয়েআগ্রা থেকে পাঁচ মাইল দূরে সিকান্দ্রা গ্রামে অবস্থিত তাঁর শিবিরে লাল তাবুর ভেতর থেকে মাথা নিচু করে দ্রুত বের হয়ে আসে। তাঁর প্রিয় দাদাজান আকবরের সমাধিসৌধের কাছে–আকাশের বুকে ভেসে থাকা বিশাল বেলেপাথরের তোরণদ্বার নিম গাছের মাঝ দিয়ে দৃশ্যমান–সিকান্দ্রাকে খুররমের কাছে মনে হয় আগ্রায় তার বিজয়দীপ্ত প্রবেশের পূর্বে যাত্রাবিরতির সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। অনাড়ম্বর সৈন্যদের তাবু আর সামরিক শৃঙ্খলায় পরিচালিত এটা কোনো সামরিক অভিযানের শিবির নয়, বরং একটা বিশাল তাবুর শহর যেখানে তাঁর বিজয় উদ্যাপনের উৎসব ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। তার তাবুর চারপাশে সবদিকে ছড়িয়ে থাকা অনুগত অভিজাত ব্যক্তি আর সেনাপতিদের তাবুর শীর্ষে সবুজ মোগল নিশান পতপত করে উড়ছে। দুই সপ্তাহ পূর্বে লাহোর থেকে তাঁর আগমনের পর থেকেই ভোজসভা আর মনোরঞ্জনের জন্য মক্তহস্তে ব্যয় করা হচ্ছে, আগ্রার কোষাগার থেকে, যার ব্যয় নির্বাহ করা হচ্ছে যার চাবি এখন তাঁর কাছে রয়েছে। অভিষেকের অপেক্ষায় অপেক্ষমান মোগল সম্রাটের ডাকে সাড়া দিয়ে অনুগত রাজাদের আগমনের ফলে প্রতিদিনই তাঁর শিবিরের আকার বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আর অবশেষে অন্য সবার চেয়ে যার আগমনের জন্য সে সবচেয়ে বেশি প্রতিক্ষায় ছিল ঘনিয়ে এসেছে। সে মধ্যাহ্নের উজ্জ্বল সূর্যালোকে আরজুমান্দকে তার যাত্রাপথের শেষ কয়েক মাইল বহন করে আনবার জন্য জাঁকজমকের সাথে সজ্জিত যে হাতি প্রেরণ করেছিল সেটার পান্না বসান রূপার হাওদা চিকচিক করতে দেখে। তাঁর হাতির সামনে মহবত খানের রাজপুত যোদ্ধাদের একটা দল রয়েছে আর পেছনে তার সন্তানের কোনো হাতিতে রয়েছে সে ঠিক বুঝতে পারে না যাঁদের ভিতরে রয়েছে তার সর্বকনিষ্ঠ পুত্র মুরাদ বকস যাকে সে এখনও দেখে নি। তাঁর পরিবার অবশেষে পুনরায় একত্রিত হচ্ছে এই ভাবনাটায় মোগল সিংহাসনে আরোহণের মুহূর্তের কথা সে যখন চিন্তা করে তারচেয়েও বেশি আনন্দে তাকে আপুত করে তুলে। সে আওরঙ্গজেব আর দারা শুকোহর দিকে তাকিয়ে হাসে, উভয়ের পরনে এই মুহূর্তের জন্য উপযুক্ত রূপার জরির কারুকাজ করা পাগড়ি আর কোট। তোমাদের আম্মাজান। তিনি আসছেন,’ সে মৃদু কণ্ঠে বলে।

আরজুমান্দের হাতির আগমন উপলক্ষ্যে হেরেমের তাবুর সামনে স্থাপিত প্রায় বিশ ফিট উঁচু চূড়াযুক্ত একটা তাবুর দিকে তাদের নিয়ে এগিয়ে যায়। আরজুমান্দকে বহনকারী হাতিকে তাঁর সোনালী রঙ করা কানের পেছনে বসে থাকা দুই মাহুত তাঁদের হাতের লোহার দণ্ডের সাহায্যে দক্ষতার সাথে বিশাল তাবুর দিকে নিয়ে আসবার সময় খুররম তার দুই সন্তানের কাঁধে হাত দিয়ে নিজেকে জোর করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করে। খুররম আর তার দুই সন্তানকে অনুসরণ করে অচিরেই হাতিটা তাবুর ভেতর করতে, পরিচারকেরা পর্দা আবার যথাস্থানে টেনে দেয়। খুররম অপেক্ষা করে যখন মাহুতেরা বিশাল প্রাণীটাকে হাঁটু মুড়ে বসায় এবং দ্রুত গলার উপর থেকে পিছলে নিচে নেমে এসে সোনার গিল্টি করা নামবার জন্য ব্যবহৃত কাঠের টুকরো জায়গামত স্থাপন করে যা প্রস্তুত অবস্থায় রাখা ছিল। তারপরে, পরিচারকেরা বুকে উপরে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত রেখে তাদের দিকে মুখ করে পেছনে হেঁটে তাবু থেকে বের হয়ে যায়।

খুররম বুকে হৃৎপিণ্ড মাদলের বোল তুলে স্পন্দিত হতে থাকলে, সে ধীরে কাঠের খণ্ডের ধাপ বেয়ে উপরে উঠে মুক্তোখচিত সবুজ রেশমের পর্দা ধীরে টেনে সরায়। আরজুমান্দের চোখের দিকে তাকিয়ে সে কোনো কথা বলতে পারে না। হাওদার মাঝে ঝুঁকে এসে সে তাকে আলিঙ্গন করে তার উষ্ণ ওষ্ঠদ্বয় আশ্লেষে চুম্বন করে। আমি এই মুহূর্তটার জন্য কতদিন ধরে অপেক্ষা করছি…মাঝে মাঝে মনে হতো যে এটা বোধহয় আর কখনও আসবে না। কিন্ত এখানে আরো দু’জন রয়েছে যারা আমার চেয়েও দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে রয়েছে, সে তাকে অবশেষে নিজের আলিঙ্গন থেকে মুক্তি। দেয়ার সময় ফিসফিস করে বলে। সে হাওদার রূপার দরজা খুলে দেয় এবং তাঁর মেহেদি রঞ্জিত হাত ধরে একসাথে ধাপ বেয়ে নিচে নামে। নিজের সন্তানদের দিকে তাকিয়ে ইতিমধ্যে তাঁর চোখ অশ্রু সজল হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছে। তাররে, তাবুর ভেতরে প্রজ্জ্বলিত অসংখ্য তেলের প্রদীপের কোমল আলোয় সে দারা শুকোহ আর আওরঙ্গজেবকে ভালো করে দেখে, তাঁদের ইতস্তত দেখায়, হয়ত খানিকটা লাজুকও… কান্নার মাঝেই হাসির অভয় ফুটিয়ে সে তাঁদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, আর তারা এবার তাঁর কাছে দৌড়ে ছুটে আসে।

*

তিন রাত পরে, পরস্পরের সঙ্গসুখ উপভোগের পরে তাঁরা যখন পাশাপাশি শুয়ে আছে, আরজুমান্দ ধীরে উঠে বসে। তার মুখের উপর থেকে কালো চুলের একটা গোছা সরিয়ে সে খুররমের চোখের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে। আমি কি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?

‘অবশ্যই।

আমরা যখন সিকান্দ্রা অভিমুখে এগিয়ে আসছিলাম, আমার এক পরিচারিকা আমায় এমন একটা কথা বলেছে যা বিশ্বাস করতে আমার রীতিমত কষ্ট হয়েছে–সে বুরহানপুর থেকে সদ্য আগত এক বার্তাবাহকের কাছ থেকে একটা গল্প শুনেছে। আমি গল্পটার কথা যতই ভুলতে চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই সেটাকে মন থেকে দূর করতে পারছি না।’

‘কি গল্প? আরজুমান্দের কণ্ঠে এমন একটা সুর ছিল যা খুররমকে বাধ্য করে উঠে বসতে।

‘গল্পটা হল খসরুর পরিচারকেরা তাকে তার কক্ষে একদিন সকালে মৃত অবস্থায় খুঁজে পেয়েছে যেখানে তাকে আপনি বন্দি করে রেখেছিলেন।

খুররম কোনো কথা না বলে একমুহূর্ত চুপ করে থাকে। তারপরে: ‘গল্প নয় সত্যি। আমার সৎ-ভাই মারা গিয়েছে, সে আবেগহীন কণ্ঠে বলে।

‘কিন্তু গল্পটা হল তাকে আপনার আদেশে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।’

খুররম আবারও চুপ করে থাকে। দ্বিতীয় চিঠিটায়–বুরহানপুরের সুবেদারের কাছে যেটা সে পাঠিয়েছিল–খসরুকে যতটা কম কষ্ট দিয়ে সম্ভব হত্যা করার আদেশ ছিল। সে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আদেশটা দিয়েছিল কিন্তু সে নিশ্চিত ছিল যে নিজের স্বার্থে তার পরিবারের মঙ্গলের জন্যই তাকে এটা করতে হবে। কিন্তু পরবর্তীতে সে যখন সংবাদের জন্য অপেক্ষা করছে যে তার অভিপ্রায় পালিত হয়েছে, সে কল্পনা করতে শুরু করে খসরুর কি অনুভূতি হয়েছিল নিজের কক্ষের দরজা অপ্রত্যাশিতভাবে খুলে যেতে… নিজের আংশিক প্রতিবন্ধী দৃষ্টি নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে… ভাবতে চেষ্টা করছে তার সাথে কারা দেখা করতে এসেছে… হয়তো ভেবেছিল তাঁর স্ত্রী জানি বুঝি এসেছে। তার সৎ-ভাই কখন বুঝতে পারে খোলা দরজা দিয়ে প্রেমময় স্ত্রী নয় হন্তারক আততায়ী প্রবেশ করেছে? খসরু কীভাবে মারা যায়? তার একমাত্র আদেশ ছিল মৃত্যু যেন ব্যাথামুক্ত হয়। তরবারির ফলার দ্রুত আঘাত নাকি বুকের গভীরে খঞ্জরের মারাত্মক খোঁচায় সেটা সম্পন্ন হয়েছে? বিষের পাত্র থেকে জোর করে অনিচ্ছুক ঠোঁটে পান করার হয়েছে নাকি বালিশ দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করা হয়েছে?

সে অবশ্য, একটা বিষয় অনুধাবন করে প্রয়োজনের উপরে আবেগকে স্থান দেয়া ঠিক হবে না আর এভাবে চিন্তা করাও। খসরু তার অবশ্যই একজন সম্ভাব্য আর বিগত বিদ্রোহী হিসাবে বিবেচনা করতে হবে–একজন জীবন্ত। আর অনুভূতিশীল মানুষ হিসাবে নয়। কিন্তু পরে, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে খসরুর মৃত্যুর খবর যখন তার কাছে পৌঁছায়, একটা নতুন উদ্বেগ তার মাঝে জন্ম নেয়। শাহরিয়ারকে নিয়ে তাঁর সামনে মেহেরুন্নিসা দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় যা বলেছিল সেই কথাগুলো তাকে আসলেই কতটা প্রভাবিত করেছে? সে। কি তার অনুভূতি নিয়ে খেলা করেছিল যখন সেগুলো নিজের বিজয়ে আর সন্তানদের সাথে একত্রিত হবার কারণে টানটান অবস্থায় ছিল এবং সুযোগ বুঝে তাকে এমন কিছু একটা করতে বাধ্য করেছে যার জন্য সে সারা। জীবন অনুতপ্ত হবে ঠিক যেভাবে সে তার আব্বাজানকে প্রভাবিত করতো? না, সে নিজেকে আবার জোর করে বোঝায়। সে নিজে কেবল এই অবশ্যম্ভাবী সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর সেটা যুক্তিসঙ্গত ছিল।

‘আমি তোমায় মিথ্যা বলতে পারবো না। সবই সত্যি। কিন্তু আমি আমাদের আর আমাদের সন্তানদের রক্ষা করার জন্য এসব করেছি। খুররম চুপ করে থাকে তারপরে জোর করে আবার বলতে থাকে। আর আরো কিছু রয়েছে… যার সম্বন্ধে আমি মাত্র গতকালই জানতে পেরেছি। খসরুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন সম্পন্ন করে, জানি নিজের কক্ষে ফিরে গিয়ে আত্মহত্যা করেছে–বলা হয়েছে যে শীতের প্রকোপ থেকে তাঁর কক্ষকে উষ্ণ রাখতে যে জ্বলন্ত কয়লার পাত্র ছিল সেখান থেকে সে জ্বলন্ত কয়লা ভক্ষণ করেছে।

আরজুমান্দের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠে এবং সে মাথা নাড়তে থাকে। ‘খুররম, আপনি এটা কীভাবে করলেন? মৃত্যুবরণের কি নির্মম উপায়। আমি নিজেই যেন গলায় জ্বলন্ত কয়লার উত্তাপ অনুভব করছি সবকিছু পুড়ে যাচ্ছে, আমার ফুসফুস ঝলসে দিচ্ছে। নিজের অন্তিম মুহূর্তে কি ভয়ঙ্কর, ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা তাকে ভোগ করতে হয়েছিল।

জানির মৃত্যু–বিশেষ করে যেভাবে সেটা হয়েছে–তাকেও আবেগআপ্লুত করে তুলেছিল যখন সে প্রথম খবরটা শুনে, কিন্তু সে কেবল কোনোমতে বলে, আমি তাকে মারবার আদেশ দেই নি।

‘কিন্তু খসরুকে হত্যা করার জন্য আপনার আদেশের ফলেই এটা হয়েছে… আমি আপনাকে যেমন ভালোবাসি জানিও তাকে ঠিক তেমনই ভালোবাসতো। একজনের জীবন নেয়া পাপ, আমি জানি, এবং আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি যে আপনি মারা যাবার পরে আমি যেন আমার সন্তানদের খাতিরে বেঁচে থাকার সাহস দেখাতে পারি, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি কতটা শোক তাকে আপ্লুত করেছিল।

খুররম আরজুমান্দের বিহ্বল মুখের দিকে তাকায়। সে এইমাত্র যা বলেছে তা সত্যি। তার কারণেই জানির মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু সে যতই সন্দিহান হোক–কিংবা অপরাধবোধ–তাকে সেসব থেকে মুক্ত হতে হবে এবং শক্ত থাকতে হবে। আমি সবকিছুই আমার সন্তানদের কথা ভেবে করেছি। তাঁরাই আমাদের ভবিষ্যত–আমাদের রাজবংশের ভবিষ্যত, সে বলে, নিজের মন থেকে নিজের জীবন আর শাসনকে নির্বিঘ্ন করতে সে এসব করেছে সেই চিন্তা জোর করে মন থেকে সরিয়ে দেয়। কিন্তু বাস্তবে বোধহয় সেই অভিপ্রায়গুলো মিলে যায়। অল্প মানুষই–এমন কি একজন সম্রাটও–তাদের মনের গহনে আর অভিপ্রায়ের মাঝে নিঃশঙ্কভাবে উঁকি দেয়ার মত শীতল সাহস রাখেন, সবাই নিজেদের কার্যকলাপের স্বপক্ষে বাগাড়ম্বরপূর্ণ সাফাই দিয়ে নিজেদের সাথে ছলনা করতেই পছন্দ করেন। ‘আমি দোয়া করি খসরু আর বিশেষ করে জানির যেন বেহেশত নসীব হয়, আরজুমান্দ বলে, আর আমি এটাও দোয়া করি যেন আল্লাহ আপনাকে মার্জনা করেন এবং আপনাকে বা আপনার সন্তানদের কোন শাস্তি না দেন।

‘আমিও সেই দোয়াই করি, খুররম বলে। সে জীবনে কখনও এভাবে অন্তর থেকে কিছু বলে নি এবং তাঁর বিয়ের পরে সে কখনও এতটা নিঃসঙ্গ বোধ করে নি। তাঁর আব্বাজান আর দাদাজান ক্ষমতার নিঃসঙ্গতা সম্বন্ধে এই কথাই তাকে বলেছিলেন। তাকে আর কখনও এই অনুভূতি ছেড়ে যাবে না।

২.১১ তখত তাউস

আগ্রা, ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৬২৮

আগ্রা দূর্গের বেলেপাথরের বিশাল তোরণদ্বার–তাঁর দূর্গ–খুররমের সামনে ভেসে উঠে যখন তাকে বহনকারী হাতি আনুষ্ঠানিক শোভাযাত্রা নিয়ে ফুলের পাপড়ি শোভিত ঢালু পথ দিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে উপর উঠতে থাকে। সে তাঁর আগ্রায় প্রবেশের তারিখ অনেক চিন্তা ভাবনা করে ঠিক করেছে–সৌর দিনপঞ্জি অনুসারে তাঁর দাদাজান আকবরের রাজত্বের সূচনার আজ বাহাত্তরতম বার্ষিকী। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে চারপাশে ভেসে থাকা কুয়াশার ভিতর দিয়ে হেঁটে সে আকবরের সমাধিসৌধে গিয়েছিল যেখানে, ময়ুরেরা তাঁদের রাত্রের আবাসস্থল থেকে মাত্র চারপাশের উদ্যানে নেমে আসতে শুরু করেছে, সে তাঁর পাথরের শীতল শবাধারে চুমো দিয়েছে। ‘আমি একজন উপযুক্ত সম্রাট হবো, সে ফিসফিস করে বলে।

কিন্তু আজকের দিনটা আবার বাবরের ১৪৫তম জন্মদিনও বটে যার সাহস আর উচ্চাকাঙ্খার কারণে মোগলরা প্রথমবারের মত হিন্দুস্তান জয় করেছিল। বাবরের ঈগলের মাথার বাটযুক্ত তরবারি আলমগীর এখন তাঁর কোমরে শোভা পাচ্ছে। অক্সাস নদীর তীর থেকে হিন্দুস্তানে আগমন পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ যাত্রাকালে তরবারিটা কত যুদ্ধই না দেখেছে… ঈগলের রুবির চোখ দুটো সূর্যালোকে জ্বলজ্বল করে।

খুররম তাঁর ডানহাতের দিকে তাকিয়ে সেখানে আরো প্রাচীন এক পূর্বপুরুষের একটা স্মারকের দিকে তাকিয়ে সন্তুষ্টির সাথে হাসে মুখব্যাদান করা ব্যাঘ্রের প্রতিকৃতি খোদাই করা সোনার ভারি অঙ্গুরীয় যা একসময়ে তৈমূরের হাতে শোভা পেত। সে, খুররম, সেই মহান শাসকের সাক্ষাৎ দশম অধঃস্তন উত্তরপুরুষ এবং শাসক যার সাম্রাজ্য একটা সময় পশ্চিমে ভূমধ্যসাগরের তীর থেকে পূর্বে চিনের সীমান্ত পর্যন্ত প্রসারিত ছিল, এবং তাঁর জন্মের সময় তারকারাজির অবস্থান তৈমূরের জন্মের সময়ের মত ঠিক একই ছিল, যা আকবরকে ভীষণ পুলকিত করেছিল। খুররমের এই মুহূর্তে মনে হতে থাকে যে কেবল তাঁর প্রজারা নয় তার ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষেরাও বুঝি ভীড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে, ছত্রিশ বছর বয়স্ক নতুন মোগল সম্রাট, নিজের চওড়া কাঁধের উপরে তাঁদের রাজবংশের আশা আর আকাঙ্খা বহন করছে।

খুররমকে বহনকারী হাতি প্রধান তোরণদ্বারের নিচে বেগুনী ছায়ায় ভিতর দিয়ে অতিক্রম করতে বিশালাকৃতি নাকাড়াগুলো শুভেচ্ছা জানিয়ে গমগম শব্দে বেজে উঠে। খুররম একমুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে, তার উচ্চাকাঙ্খা আর আর ইচ্ছার প্রতিফলন এই মুহূর্তটা উপভোগ করে। কিন্তু তারপরেই তার নিজের সৃষ্টি এক অন্ধকার ছায়া তাকে আপুত করে সমস্ত সমস্ত উল্লাস স্তব্ধ করে দেয়। দিনের উষ্ণতা আর তাঁর হীরক খচিত সবুজ রেশমের কারুকাজ করা ব্রোকেডের টিউনিকের ওজন সত্ত্বেও সে, তাঁর দাদাজানের সমাধিসৌধ থেকে ফিরে এসে তার নিয়ন্ত্রক তাবুর কাছে মাটিতে ইস্পাতের খঞ্জর দিয়ে গাঁথা একটা অজ্ঞাতনামা বার্তার কথা স্মরণ করে কেঁপে উঠে। বার্তার বিষয়বস্তু একেবারে সংক্ষিপ্ত: নিশ্চয়ই যে সিংহাসন অধিকার করতে এত রক্তপাত হয়েছে সেটা অবশ্যই অমঙ্গল বয়ে আনবে?

তাঁর প্রহরীদের নাকের ডগায় তাঁদের নজর এড়িয়ে বার্তাটা কীভাবে এলো? এটা কি এমন কেউ একজন লিখেছে যাকে সে বন্ধু মনে করলেও আদতে সে তা নয়–এমন কেউ তাঁর তাবুর কাছে যার উপস্থিতি কারও মনে সন্দেহের উদ্রেক করবে না? নাকি কোনো আগন্তুক গোপনে তাঁর শিবিরের কেন্দ্রস্থলে প্রবেশ করে বার্তাটা রেখে গিয়েছে? বিজয়দীপ্ত শোভাযাত্রা নিয়ে আগ্রায় প্রবেশের প্রস্তুতি সকালের অনেক আগেই শুরু হয়েছিল আর হাল্কা সাদা কুয়াশা তাঁদের একেবারে আবৃত করে রেখেছিল বলে কাজটা সম্পন্ন করাটা হয়তো একেবারে কঠিন না।

সে বার্তাটা জ্বলন্ত কয়লাদানিতে নিক্ষেপ করে এবং কমলা আগুনে সেটাকে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে দেখার সময়, মেহেরুন্নিসার উঁচু চোয়ালের হাড়যুক্ত মুখ, বাঁকা ঠোঁটে ফুটে থাকা শ্লেষপূর্ণ হাসি, তাঁর মনে নিমেষের জন্য ভেসে উঠে। সে কল্পনায় তাকে এমন একটা বার্তা লিখতে দেখে। লাহোরে নিজের কক্ষের নির্জনতা থেকে তাঁর পক্ষে কি আসলেই সম্ভব তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনের সমস্ত আনন্দ বিঘ্নিত করার এমন একটা প্রয়াস নেয়া? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে তাঁর উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। কাজটা যেই করে থাকুক, বার্তাটা তাকে একেবারে নাড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু সে চেষ্টা করে নিজের মন থেকে বার্তাটার কথা মুছে ফেলতে। সে আরজুমান্দকেও এ বিষয়ে কিছু বলেনি সেদিন সকালে হারেমের তাবুতে যার বিদায়ী চুম্বন তার মাঝে সেই একই পুরাতন যৌনকামনা উদ্রেককারী অনুভূতি তাকে শিহরিত করে যা তাঁদের বিয়ের পর থেকে এতগুলো বছরে এতটুকু হ্রাস পায় নি। তার মাঝে কামোত্তেজনা জাগাতে কখনও এটা ব্যর্থ হয় নি এবং কিছুক্ষণের জন্য সবধরনের নিরানন্দ ভাবনা কোথায় যেন মিলিয়ে যায়।

তাকে বহনকারী হাতি আবার সূর্যালোকে বের হয়ে এসে, তাকে সিংহাসনের দিকে নিয়ে যেতে থাকলে যার জন্য সে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করেছে, ভাবনাগুলো আবার ফিরে আসে। কেন? কারণ সে অপরাধবোধ করছে? না। শাহরিয়ার আর খসরুর মৃত্যুর প্রয়োজন ছিল, নয় কি? রাজত্বের শুরু সামান্য রক্তপাত কি ভালো নয় পরে প্রচুর রক্তপাতের চেয়ে কারণ তাঁর সেটা করার মত সাহস নেই? তাঁদের মৃত্যুর ফলে প্রাপ্ত সুবিধা কি তাদের মৃত্যুজনিত পাপের চেয়ে বেশি নয়? হ্যাঁ, সে নিজেকে আবার স্মরণ করিয়ে দেয়। সে এইসব মৃত্যুর সাহায্যে সিংহাসনের সম্ভাব্য প্রতিপক্ষকে চিরতরে পরাস্ত করেছে এবং নিজেকে আর নিজের পরিবারকে রক্ষা করেছে।

অনেক হয়েছে, খুররম নিজেকে বলে। সে তাই করেছে যেটা তাঁর করা উচিত ছিল এবং অতীত হল ঠিক তাই–অতীত। বর্তমান আর ভবিষ্যতই হল গুরুত্বপূর্ণ আর সে নিজের কর্মকাণ্ডের দ্বারা দুটোই নিরাপদ করেছে। নিজেকে সুস্থির করার চেষ্টা করে সে চারপাশে তাকিয়ে তাকে অনুসরণরত বিশাল শোভাযাত্রাটা লক্ষ্য করে। তাঁর চার সন্তানকে, রাজবংশের রাজপুত্রদের, বহনকারী হাতিটায় তারা রেশমের একটা সবুজ চাঁদোয়ার নিচে রয়েছে আর আরেকটু ছোট আরেকটায় আরজুমান্দ আর তাদের দুই কন্যার হাওদা রূপার জরির তৈরি কাপড়ের পর্দা দিয়ে ঘেরা যার ভেতরে সোনার তারের জালি বসান রয়েছে যাতে তারা ভেতর থেকে সবকিছু দেখতে পায় তার ঠিক পেছনেই রয়েছে। আরজুমান্দের পিতা আসফ খান বিশাল একটা সাদা স্ট্যালিয়নে উপবিষ্ট অবস্থায় এরপরেই রয়েছেন আর কারুকাজ করা পর্যাণের কাপড়যুক্ত কালো স্ট্যালিয়নে বসে মার্জিত ভঙ্গিতে জনগণকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে মহবত খান, এখন তাঁর খান-ই-খানান, প্রধান সেনাপতি। তারপরে রাজকীয় দেহরক্ষীদের অনুসরণ করছে অশ্বারোহী যোদ্ধার দল পাশাপাশি চারজন অবস্থান করে এগিয়ে চলেছে–যাঁদের অনেকেই লাল-পাগড়ি পরিহিত রাজপুত যোদ্ধা–এবং সবশেষে রয়েছে তবকি আর তীরন্দাজেরা, সবাই মোগল সবুজ রঙের পোষাকে দারুণভাবে সুসজ্জিত, সবাই অজেয় একটা বাহিনীর সদস্য যা এখন তাঁর নেতৃত্বাধীন।

দৃশ্যটা খুররমের মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনে। উপরের দূর্গে পরিচারকেরা দূর্গ প্রাকারের উপরে দৌড়াদৌড়ি করছে, সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে সোনার আর রূপার মোহর–টাকশাল থেকে নতুন তৈরি করা তাঁর রাজত্বের সূচনা ঘোষিত করতে–আর অল্পদামী পাথর–বৈদুর্যমণি, টোপাজ প্রভৃতি নিক্ষেপ করতে। রূপা আর সোনার পাতলা পাত দিয়ে তৈরি চাঁদ আর তারার প্রতিকৃতি অন্য পরিচারকেরা বাতাসে ছুঁড়ে দিচ্ছে। পুরো ব্যাপারটা দেখে মনে হবে বেহেশত থেকে যেন পৃথিবীর উপরে ধনসম্পদ বর্ষিত হচ্ছে–মোগল ধনসম্পদ। সে এসব কিছুর মালিক এবং তার ক্ষমতা আর সম্পদ সবকিছুকে আরও মহিমান্বিত করবে। সে কয়েকটা বিদ্বেষপূর্ণ শব্দের কারণে নিজেকে অস্থির করে তুলবে না।

দ্বিতীয় আরেকটা তোরণের নিচ দিয়ে অতিক্রম করে খুররম ফুলের পাপড়ি দিয়ে ঢাকা আঙিনার মাঝে আকবরের তৈরি করা ঝর্ণাগুলোকে দেখতে পায় এবং এর পেছনেই বহু স্তম্ভযুক্ত দেওয়ানি আম যেখানে মার্বেলের বেদীর উপরে সোনার তৈরি সিংহাসনটা স্থাপিত। তাঁর প্রধান অমাত্যরা ইতিমধ্যেই বেদীর নিচে অগ্রগণ্যতার বিন্যাস অনুসারে সমবেত হয়েছে। আর কয়েক মুহূর্ত পরেই সে ঐ সিংহাসনে নিজের আসন গ্রহণ করবে এবং প্রথমবারের মত তাঁর দরবারের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবে। রক্তপাত ঘটিয়ে সে যদি পাপ করে থাকে তাঁর প্রজাদের কাছে সে এই কারণে অনেকবেশি প্রায়শ্চিত্ত করবে। সে তাঁদের কাছে প্রমান করবে সিংহাসন আর তাঁদের ভালোবাসা তারই প্রাপ্য এবং তাদের পুলকিত করবে যে সে তাঁদের সম্রাট।

তাঁর দাদাজান আকবরের কয়েকটা বাক্য তাঁর মনে পড়ে যায়। মানুষ প্রদর্শন পছন্দ করে এবং নিজেদের শাসকেরা দ্বারা প্রভাবিত হতে আর তাদের জন্য সম্ভম অনুভব করতে চায়। একজন মহান শাসককে সূর্যের মত হতে হবে–চোখ তুলে তাকালে চোখ ধাধিয়ে যাবে আবার সব আলো আর আশা এবং উষ্ণতার উৎস যা ছাড়া অস্তিত্বের সম্ভাবনাই অসম্ভব। আকবর সত্যিকার অর্থেই জাঁকজমকপূর্ণ ছিলেন। কিন্তু সে, খুররম তাকে অনুসরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করবে, তার অর্জনের সমকক্ষ হতে আর সম্ভব হলে সেটা ছাড়িয়ে যেতে চেষ্টা করবে। সে তাঁর আব্বাজান একসময়ে তাকে যে উপাধি দান করেছিলেন সেই শাহ জাহান, পৃথিবীর অধিশ্বর নাম নিয়ে রাজত্ব পরিচালনা করবে। সোনার তৈরি সিংহাসন যে কিছুক্ষণের ভিতরেই যার উপরে উপবিষ্ট হবে সেটা পৃথিবীর অধিশ্বরের জন্য যথেষ্ট জমকালো নয়। সে ইতিমধ্যেই তাঁর সম্পদের সিন্দুক পরিদর্শন করেছে যেগুলো এত প্রচুর সংখ্যক উজ্জ্বল রত্নপাথরে পরিপূর্ণ যে তাঁর কোষাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের পক্ষে সেগুলো গণনা করা অসম্ভব তারা তাই সেগুলো কেবল ওজন করে যাতে তারা তাকে বলতে পারে, দেখেন জাহাপনা এখানে আপনার আধ টন হীরক রয়েছে এবং এখানে একটন পরিমাণ মুক্তা…’ সে সাম্রাজ্যের সেরা মণিকারকে ডেকে পাঠাবে এমন একটা সিংহাসন তৈরির জন্য যেখানে তার সবচেয়ে উজ্জ্বল রত্নগুলো প্রদর্শিত হবে। সে একটা রত্নখচিত চাঁদোয়ার নিচে উপবেশন করবে যা পদ্মরাগমণি খচিত স্তম্ভের উপর শোভা পাবে। চাঁদোয়ার উপরে একটা বৃক্ষ থাকবে যা জীবনের স্মারক হিসাবে ফুটিয়ে তোলা হবে, যার কাণ্ডটা হবে হীরকের আর মুক্তার এবং এর উভয় পাশে থাকবে ঝলমলে পালক ছড়ান ময়ূর। সে তার তখন তাউসে বসে থাকার সময় এতটাই জ্বলজ্বল করবে যে আসলেই তার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারবে না।

আকবরকে মহান আর ন্যায়পরায়ন শাসক হিসাবে, যাকে তার সব প্রজা ভালোবাসে, তাদের ধর্ম গোত্র বা মর্যাদা যাই হোক না কেন, অতিক্রম করা যদি কঠিন হয় তাহলে সে সংকল্পবদ্ধ তাকে রাজকীয় পরিবারের প্রধান হিসাবে সে ছাপিয়ে যাবে। আকবরের সাথে তাঁর সন্তানদের সম্পর্ক বিভেদপূর্ণ আর দূরবর্তী ছিল, ঠিক জাহাঙ্গীরের সাথে তাঁর নিজের যেমন সম্পর্ক ছিল। উভয় পুরুষেই–এবং তার আগে হুমায়ুনের সময়ে সৎ-ভাইয়েরা পরস্পরের সাথে সিংহাসনের অধিকারের জন্য লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতো। আকবরের মত না তাঁর নিজের একটা একতাবদ্ধ আর ভালোবাসাপূর্ণ পরিবারের অধিকারী হবার সৌভাগ্য হয়েছে এবং সে চেষ্টা করবে এটা যেন সেভাবেই থাকে। তার পুত্র আর কন্যারা একই মায়ের সন্তান এবং তাদের যে দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে সেটা তাঁদের পরস্পরের আরো কাছে নিয়ে আসায়, রাজবংশকে রূপান্তরিত করতে এগুলো তাকে সাহায্য করবে। দারা শুকোহ আর আওরঙ্গজেব যারা একসঙ্গে বন্দিত্ব বরণ করেছে। কীভাবে পরস্পরের সাথে লড়াই করবে? ভয়ঙ্কর পারিবারিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা পুরাতন ঐতিহ্যবাহী তক্তা তখতের রীতি, সিংহাসন বা শবাধার, যা পূর্ববর্তী বংশধরদের কালিমালিপ্ত করেছে এবং সাম্রাজ্যকে গৃহযুদ্ধের হুমকির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে–চিরতরে লোপ পাবে।

তারচেয়েও বড় কথা, সে নিজেকে আর নিজের পরিবারকে তাঁর রাজবংশের অন্যান্য দুর্বলতা থেকে দূরে রাখবে–আফিম আর সুরার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত দুর্বলতা যা তাঁর আব্বাজানের মনকে দুর্বল করে ফেলেছিল আর তার প্রপিতামহ হুমায়ুনকেও এবং তাঁদের পরিবারের অসংখ্য সদস্যকে অকালে সমাধি চিনিয়েছে–তার সৎ-ভাই পারভেজ এবং তাঁর চাচাজান দানিয়েল এবং মুরাদ। তাঁর প্রথম কাজ হবে নিজের জন্য এবং নিজের পরিবারের জন্য সুরা বর্জনের ঘোষণা দেয়া, যদিও তার পূর্বের আকবর আর বাবরের মত সে নিজেকে এসব মাদকের উপর প্রভুত্ব করার মত শক্তিশালী মনে করে এবং তাঁদের দাস নয়।

ঢাকের একটা প্রলম্বিত বাজনা ইঙ্গিত দেয় যে খুররমকে বহনকারী হাতির থামার সময় হয়েছে এবং প্রাণীটা হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে। কিছুক্ষণের ভিতরেই সে নিচে নামবে এবং তার ছেলেদের সাথে নিয়ে সিংহাসনের দিকে এগিয়ে যাবে যখন আরজুমান্দকে আর তার কন্যাদের বহনকারী হাতি তাঁদের হেরেমে নিয়ে যাবে। মেয়েদের দর্শনকক্ষ থেকে আরজুমান্দ, তাঁর ভালোবাসা এবং তার সমস্ত বিপর্যয়ের মাঝে তার একমাত্র স্বস্তির জায়গা, জালি তিরস্করণীর ভিতর দিয়ে তাকে প্রথমবারের মত তার দরবারের সামনে ভাষণ দিতে দেখবে। তার রাজত্বকাল শুরু হতে চলেছে। রক্তপাতের মাধ্যমে যদিও এর সূচনা হয়েছে, আরজুমান্দকে সাথে নিয়ে সে একে নিশ্চিতভাবেই গৌরবের মাঝে সমাপ্ত করবে…

৩. ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা

জাহাঙ্গীর তাঁর প্রপিতামহ বাবরের মত নিজের স্মৃতিকথা–তুজুকে-ই জাহাঙ্গীরি–লিখেছিল যা তিনি ১৬০৫ সালে লিখতে শুরু করেন, যে বছর সম্রাট হিসাবে তাঁর অভিষেক হয়। বাবরের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন একটা পৃথিবীর বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, জাহাঙ্গীরের স্মৃতিকথাও প্রাণবন্ত আর বিশদ এবং অনেকক্ষেত্রেই ভীষণ ভোলামেলা। তাঁর স্মৃতিকথায় আমরা বিরোধিতায় আকীর্ণ একজন মানুষকে খুঁজে পাই–তিনি কখনও চাম্পা ফুলের জটিল সৌন্দর্য কবিতার ছন্দে বর্ণনা করছেন বা আমের চমৎকার স্বাদের কথা বলছেন আবার পরমুহূর্তেই স্বীকার করছেন তিনি তার আব্বাজানের বন্ধু আর পরামর্শদাতা আবুল ফজলকে খুন করিয়েছেন কারণ তিনি তাঁর বন্ধু ছিলেন না। আরেকটা দীর্ঘ আর তিক্ত পরিচ্ছেদে তিনি নিজের একসময়ের প্রিয় পুত্র খুররমের কাছ থেকে বিচ্ছেদের বর্ণনা দিয়েছেন, অবজ্ঞাভরে তাকে সম্বোধন করেছেন যে অমঙ্গলের বার্তাবাহী এবং বি-দৌলত, বদমাশ’ হিসাবে। মেহেরুন্নিসার প্রতি তার ভালোবাসা স্পষ্ট। তিনি একটা পরিচ্ছদে তিনি বর্ণনা করেছেন কীভাবে একটা খাটিয়ার উপর থেকে এক গুলিতে মেহেরুন্নিসা একটা বাঘ শিকার করেছিল যা, তিনি লিখছেন ভীষণ কঠিন একটা কাজ। ১৬২২ সালে, ক্রমশ দুবর্ল হয়ে পড়ায় জাহাঙ্গীর তাঁর স্মৃতিকথা লেখার দায়িত্ব মুতামিদ খানকে, তার একজন লিপিকার, দেন যিনি মহবত খানের বিদ্রোহের সময় উপস্থিত ছিল। তিনি বিশ্বস্ততার সাথে ১৬২৪ সাল পর্যন্ত স্মৃতিভাষ্য লেখা বজায় রাখেন এবং তারপরে নিজের ভাষ্য লিখেন-ইকবাল-নামা-জাহাঙ্গীরের জীবনের শেষ তিনবছরের কথা। এসব ছাড়াও আরও কিছু দিনপঞ্জি রয়েছে যেমন ফারিশতা’র গুলশান-ই-ইব্রাহিম যা জাহাঙ্গীরের জীবনের আংশিক বিবরণ। শাহজাহাননামার মত দিনপঞ্জি খুররমের কথা শোনায়।

জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে বেশ কয়েকজন বিদেশী পর্যটক হিন্দুস্তান এসেছিল তাঁরা যা প্রত্যক্ষ করেছে সেসব প্রাণবন্তভাবে বর্ণনা দিয়েছে। স্যার টমাস রো, মোগল দরবারে আগত প্রথম ইংরেজ প্রতিনিধি, লিখিত পুস্তক বিস্তারিত বর্ণনায় ঠাসা এবং অনেক সময় সেখানে পক্ষপাতিত্বের সুর থাকলেও মোগল দরবারের জৌলুস দেখে একজন ইউরোপীয়ের বিস্ময় সেখানে ঠিকই টের পাওয়া যায়। অন্যান্য তথ্যসূত্রের ভিতর রয়েছে হিন্দুস্তানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী প্রেরিত উইলিয়াম হকিন্সের লেখা, যিনি আগ্রা জাহাঙ্গীরের দরবারে ১৬০৯ সাল থেকে ১৬১১ সাল পর্যন্ত অবস্থান করেছিলেন; উইলিয়াম ফিঞ্চ, হকিন্সের সহকারী, যিনি আকবরের রক্ষিতা আনারকলির, ‘ডালিম সুন্দরী’ গল্পের উৎস; এডোয়ার্ড টেরী, একজন পাদ্রী যিনি রো’র চ্যাপলিন ছিলেন কিছু সময়ের জন্য এবং তার সাথেই ইংল্যান্ডে ফিরে যান; এবং বিখ্যাত ইংরেজ পর্যটক টমাস ক্রোয়েট যিনি স্থলপথে হিন্দুস্তানে এসেছিলেন এবং ১৬১৫ সালে জাহাঙ্গীরের দরবারে উপস্থিত হন। তিনিই জাহাঙ্গীরের হাতির চোখ ধাঁধানো অলঙ্কারের বর্ণনা দেন যা ভিতরে রয়েছে। তাদের নিতম্বের জন্য সোনার তৈরি আসবাব।

এম্পায়ার অব দি মোগলের পঞ্চক উপন্যাসের প্রথম তিনটি উপন্যাসের মত, এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলো–রাজকীয় মোগল পরিবার, পারস্যের গিয়াস বেগ এবং তাঁর সমস্ত পরিবার যাদের ভিতরে মেহেরুন্নিসা এবং আরজুমান্দও রয়েছে, সুযোগ সন্ধানী মহবত খান, আবিসিনিয়ার সেনাপতি আর প্রাক্তন দাস মালিক আম্বার এবং টমাস রো’র মত আরো অনেকের–অস্তিত্ব রয়েছে। কিছু সহায়ক চরিত্র যেমন সুলেমান বেগ, নিকোলাস ব্যালেনটাইন এবং কামরান ইকবাল বাস্তব চরিত্রের উপর আধারিত হলেও আসলে কল্পিত চরিত্র।

প্রধান ঘটনাসমূহ–খসরুর বিদ্রোহ, মালিক আম্বারের বিরুদ্ধে খুররমের অভিযানসমূহ, এবং তার আব্বাজানের কাছ থেকে তাঁর বিচ্ছেদ, মহবত খানের অভ্যুত্থান–অবশ্য সত্যি ঘটনা যদিও আমি কিছু পরিবর্তন অথবা পরিবর্ধন করেছি এবং কোনো কোনো স্থানে ঘটনাবলি সংকুচিত আর সময়সীমা পরিবর্তন করেছি। জাহাঙ্গীর বাস্তবিক মেহেরুন্নিসার প্রতি, যাকে পরবর্তীতে নূর জাহান হিসাবে সবাই চিনবে, মোহাবিষ্ট ছিলেন যিনি নিজের প্রভাব খাটিয়ে ব্যক্তিগত ক্ষমতা লাভ করেন এবং কার্যত হিন্দুস্তানের শাসক হয়ে উঠেন–সেই সময়ের একজন রমণীর পক্ষে যা একটা অবিস্মরণীয় অর্জন। একটা ব্যাপার বিস্ময়কর যে যখন রাজঅন্তঃপুরের মহিলাদের চিত্রকর্ম খুব অল্প দেখা যেত তখন মেহেরুন্নিসার বেশ কয়েকটা প্রতিকৃতি যার ভিতরে একটার বর্ণনা এই উপন্যাসে রয়েছে এখনও টিকে আছে। সূত্র অনুযায়ী এটা স্পষ্ট যে মেহেরুন্নিসা প্রথমে নিজের ভাস্তি আরজুমান্দের বিয়ে খুররমের সাথে দেয়ার জন্য সহায়তা করে কিন্তু তারপরে তাঁদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। গল্পের গতিময়তার জন্য খানিকটা কল্পনার অবতারণা জরুরি। স্যার টমাস রো রাজত্বের একটা সুন্দর খণ্ডচিত্র দান করেছে যেখানে শেকসপিয়রীয় বিষাদের সমস্ত উপকরণসহ উপস্থিত: একজন অভিজাত রাজপুরুষ, একজন বিদূষী স্ত্রী, একজন বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা, একজন কুটিল সৎ-মা, একজন উচ্চাকাঙ্খি সন্তান, একজন ধূর্ত প্রিয়পাত্র…’ আর প্রায়শই মহান বিষাদগাঁথায় যে অন্তর্নিহিত বার্তা মূর্ত হয়ে সেটা হল–যে মূল চরিত্রগুলো তাদের নিজেদের বিনাশের রূপকার হয়ে উঠে।

উপন্যাসটা লেখার সময় সবচেয়ে পরম আনন্দের বিষয় ছিল গবেষণার জন্য ভারতবর্ষে ভ্রমণের সময় অতিবাহিত সময়টা। খুররমের মত আমি দক্ষিণে দাক্ষিণাত্যে গিয়েছি, নর্মদা নদী অতিক্রম করেছি এবং বেলেপাথরের আসিরগড় দূর্গের পাশ দিয়ে ক্ষয়াটে সোনালী পাহাড়ী ভূ-প্রকৃতির ভিতর দিয়ে ভ্রমণ করেছি। আমার গন্তব্যস্থল ছিল তাপ্তি নদীর তীরে বুরহানপুরের দূর্গ-প্রাসাদ-দাক্ষিণাত্যের সালতানের বিরুদ্ধে যা একটা সময় মোগলদের অগ্রবর্তী নিয়ন্ত্রক কেন্দ্র ছিল এবং এই স্থানে অনেক বিয়োগান্তক আর অশুভ ঘটনার জন্ম হয়েছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত ভগ্নস্তূপের মাঝে হেঁটে বেড়াবার সময় যেখানে একটা সময় মার্বেলের নহর দিয়ে চমৎকার ফ্রেসকো অঙ্কিত হাম্মামে পানি প্রবাহিত হতো আর খুররমের রণহস্তি একসময়ে হাতিমহলে যেখানে বিচরণ করতো সেখানে আমি মাঝে মাঝে মোগলদের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি।

যোধপুরের কাছে আমি আফিমের তিক্ত স্বাদযুক্ত পানি গ্রামের একজন বয়স্ক লোকের অঞ্জলি থেকে পান করেছি যা রাজপুত যোদ্ধাদের অবশ্যই যুদ্ধের পূর্বে পান করতে হয়। আগ্রায় আমি আমার পুরাতন জ্ঞান আবারও ঝালিয়ে নেই–লাল কেল্লা যেখানে একটা পাথরের খণ্ড থেকে প্রস্তুত জাহাঙ্গীরের পাঁচ ফিট উঁচু গোসলের আধার যা ভ্রমণের সময় সবসময়ে তার সঙ্গে থাকতো দূর্গ প্রাঙ্গণে এখনও রয়েছে; গিয়াস বেগের মার্বেলের কারুকাজ করা সমাধি যা মেহেরুন্নিসা তৈরি করেছেন, যা ইতিমাদ-উদ-দৌলার সমাধি’ হিসাবে পরিচিত; কাছেই সিকান্দ্রা অবস্থিত যেখানে মহামতি আকবরের অতিকায় বেলেপাথরের সমাধিসৌধ অবস্থিত যা জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে সমাপ্ত হয়; চম্বল নদী আর নদীর বিপুল সংখ্যক ‘ঘড়িয়াল (মাছখেকো কুমীর), সারস আর শুশুক। সেই সাথে সুযোগ হয়েছিল জাহাঙ্গীরের প্রিয় রসালো আম আর ঝাল রাজস্থানী লাল মাস খাওয়ার–মরিচ দিয়ে রান্না করা ভেড়ার মাংস এই সময়েই আনারস আর আলুর মত নতুন পৃথিবী থেকে মরিচও ভারতবর্ষে আসতে শুরু করেছে।

আমি ভ্রমণ করার সময় মোগল বাহিনীকে বিশাল ধূলোর মেঘের জন্ম দিয়ে যেন অবারিত ভূপ্রকৃতির মাঝে ধীরে কিন্তু নিশ্চিত ভঙ্গিতে এগিয়ে যেতে দেখি। আমি রাতের বেলা তাদের শিবিরে তাবু খাটাতে দেখি যার আকৃতি একটা প্রায় ছোট শহরের মত এবং পরিচারকেরা তুলার বিচি আর তেল বিশাল একটা পাত্রে পূর্ণ করে সেটা বিশ ফিট উঁচু একটা দণ্ডের উপর স্থাপন করছে সেটা অগ্নি সংযোগ করতে–আকাশ দিয়া, আকাশের আলো–রাতের আকাশে যা উপরের দিকে আগুনের শিখা ছড়িয়ে দেয়। আমি গোবরের ঘুঁটে দিয়ে জ্বালান হাজার রান্নার আগুন থেকে ভেসে আসা তিক্ত গন্ধ যেন টের পাই এবং বাদ্যযন্ত্রীদের বাজনার সুর শুনতে পাই যারা সবসময়ে আগুয়ান মোগল বাহিনীর সঙ্গে থাকতো। খুররম আর জাহাঙ্গীর যদিও প্রায় চারশ বছর পূর্বে জীবিত ছিল, কিন্তু কোনো কোনো সময় তাদের পৃথিবী আর তারা যেন আমাদের আশেপাশেই বিরাজ করতে থাকে।

.

অতিরিক্ত তথ্যসূচি

প্রথম অধ্যায়

আকবর ১৫৪২ সালের ১৫ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৬০৫ সালের ১৫ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন।

১৫৬৯ সালের ৩০ আগস্ট জাহাঙ্গীর জন্মগ্রহণ করেন এবং আকবরের মৃত্যুর পরে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন।

১৫৮৭ সালে আগস্টের কোনো একদিন খসরু ভূমিষ্ট হয় এবং জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে ১৬৬০ সালের এপ্রিলে সে প্রথমবারের মত বিদ্রোহ ঘোষণা করে। পারভেজের জন্ম ১৫৮৯ সালে।

১৫৯২ সালের ৫ জানুয়ারি খুররম জন্মগ্রহণ করে।

শাহরিয়ারের, এক উপপত্নীর সন্তান, জন্ম তারিখ সঠিকভাবে জানা যায় না কিন্তু অনুমান করা হয় আকবরের মৃত্যুর কাছাকাছি সময়েই তার জন্ম।

তৈমূর, যাযাবর বারলাস তূর্কীদের একজন গোত্রপতি, পশ্চিমে ‘তৈমূর দি লেম’ এর বিকৃত ট্যাম্বারলেন নামেই বেশি পরিচিত। ক্রিস্টোফার মারলোর নাটকে তাকে ‘ঈশ্বরের চাবুক’ হিসাবে দেখানো হয়েছে।

জাহাঙ্গীর হয়ত মুসলিম চন্দ্র মাসের দিনপঞ্জি ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু আমি দিনগুলো পশ্চিমে আমাদের ব্যবহৃত প্রচলিত সৌর, খ্রিস্টান, দিনপঞ্জি অনুসারে পরিবর্তন করেছি।

খসরুর দু’জন ঘনিষ্ট সেনাপতিকে বাস্তবিকই যেভাবে বর্ণিত হয়েছে সেভাবে পশুর চামড়া দিয়ে মুড়ে লাহোরের রাস্তায় প্রদক্ষিণ করানো হয়েছিল এবং আরো অনেককে সূক্ষ প্রান্তযুক্ত লাঠির অগ্রভাগে শূলবিদ্ধ করা হয়েছিল।

দ্বিতীয় অধ্যায়

জাহাঙ্গীরের নির্দেশে বলা হয়ে থাকে মেহেরুন্নিসার স্বামী শের আফগানকে হত্যা করা হয়েছিল, যদিও কোনো ইউরোপীয় এই কাজ করে নি।

তৃতীয় অধ্যায়

মেহেরুন্নিসাকে শিশু অবস্থায় তাঁর পরিবার কর্তৃক পরিত্যাগ করার বিষয়টা কিছু দিনপঞ্জিতে উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন জাহাঙ্গীরের সামনে তাঁর নেকাব ফেলে দেয়ার ঘটনা।

চতুর্থ অধ্যায়

হেরেমে যৌনতার সীমা লঙ্ঘনের জন্য চরম শাস্তি দেয়া হতো। যেমন একবার এক মহিলাকে গলা পর্যন্ত বালিতে কবর দিয়ে সূর্যের আলোয় ধুকে ধুকে মারা যাবার জন্য ফেলে রাখা হয়েছিল।

পঞ্চম অধ্যায়

শাহী মিনা বাজারের বাস্তবিকই খুররম প্রথম আরজুমান্দকে দেখে। তাঁর জন্ম ১৫৯৩ সালে।

ষষ্ঠ অধ্যায়

খসরুর দ্বিতীয় বিদ্রোহ এবং তাকে অন্ধ করার ঘটনা ১৬০৭ সালের গ্রীষ্মকালের কথা। গিয়াস বেগকে জিজ্ঞাসাবাদ করে মুক্তি দেয়া হয় এবং তাঁর ছেলে মীর খানকে ষড়যন্ত্র করার কারণে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

অষ্টম অধ্যায়

মেহেরুন্নিসা আর জাহাঙ্গীর ১৬১১ সালে বিয়ে করে এবং খুররম আর আরজুমান্দের বিয়ে হয় ১৬১২ সালে।

নবম অধ্যায়

মালিক আম্বারের বিরুদ্ধে খুররমের প্রথম অভিযানের সময়কাল ১৬১৬। জাহানারা, যিনি বস্তুতপক্ষে খুররম আর আরজুমান্দের দ্বিতীয় সন্তান–হুঁর আল-নিসা নামে তার এক বড় বোন ভূমিষ্ট হবার কিছুদিন পরেই মারা যায়–১৬১৪ সালের এপ্রিলে জন্মগ্রহণ করেছিল।

একাদশ অধ্যায়

রো ১৬১৫ সালে ভারতবর্ষে আগমন করেন বিভিন্ন উপহার সামগ্রী নিয়ে যার ভিতরে ছিল শকট, মারকেটোর’র মানচিত্র আর চিত্রকর্ম।

দ্বাদশ অধ্যায়

বো’র চিঠিতে বাস্তবিকই জাহাঙ্গীরের গর্বের, তার ধর্মীয় সহনশীলতা, নিষ্ঠুরতা, অজ্ঞেয়বাদ আর মেহেরুন্নিসার প্রভাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। রো চিঠিতে বর্ণনা করেছেন কীভাবে তিনি সম্রাটকে পরিচালিত করেন এবং তাকে নিজের খেয়াল খুশিমত ব্যবহার করেন। জাহাঙ্গীরের প্রতিকৃতি যেখানে রাজা জেমস তাঁর পায়ের কাছে রয়েছে লন্ডনের বৃটিশ লাইব্রেরিতে রয়েছে।

ত্রয়োদশ অধ্যায়

মালিক আম্বারের বিরুদ্ধে খুররমের দ্বিতীয় অভিযান পরিচালিত হয় ১৬২০ সালে।

পঞ্চদশ অধ্যায়

১৬২২ সাল নাগাদ খুররমের সাথে তাঁর আব্বাজানের বিচ্ছেদের সূচনা হয় যদিও রো ভারতবর্ষ ত্যাগ করেন ১৬১৯ সালে।

একুশ অধ্যায়

মহবত খানের অভ্যুত্থান ১৬২৬ সালের ঘটনা–সেই বছরই পারভেজ মারা যায়। জাহাঙ্গীর ১৬২৭ সালের ২৮ অক্টোবর মারা যায়।

চব্বিশ অধ্যায়

অনেক লেখক যাঁদের ভিতরে কয়েকজন সমকালীন সময়ের ইউরোপীয় লেখক নিজের অগ্রসর হবার কথা গোপন রাখতে তাঁর শবাধারের অনুগমনের বিষয়টার উল্লেখ করেছেন, অনেকে এমন দাবিও করেছে যে তিনি নিজের মৃত্যুর একটা নকল দৃশ্যের অবতারণাও করেছিলেন। ইতিহাস হলো, খসরু বুরহানপুরে খুররমের অধীনে বন্দি থাকা অবস্থায় ১৬২১ সালে মারা যায়। আধুনিক ইতিহাসবিদ আর সমসাময়িক পর্যবেক্ষকরা বিশ্বাস করে এর জন্য খুররম দায়ী। খসরুর স্ত্রী আসলেই আত্মহত্যা করেছিল। দাওয়ার বকস, খসরুর জ্যেষ্ঠ সন্তান যে জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পরে সিংহাসন পাবার চেষ্টা করেছিল এবং পরাজিত হয়েছিল আর খুররমের আদেশে শাহরিয়ার এবং তার অন্য কয়েকজন পুরুষ আত্মীয়ের সাথে পরবর্তীতে তাকে হত্যা করা হয়।

ছাব্বিশ অধ্যায়

খুররম (শাহ জাহান) আনুষ্ঠানিকভাবে সিংহাসনে আরোহণ করে ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৬২৮ সালে–আকবরের সিংহাসন আরোহণের ৭২তম বার্ষিকীতে এবং বাবরের ১৪৫তম জন্মবার্ষিকীতে। শাহ জাহান যেসব অহঙ্কারী খেতাব নিজের বলে দাবি করে তার ভিতরে রয়েছে পৃথিবীর অধিশ্বর’ এবং মাঙ্গলিক সমাপাতনের দ্বিতীয় প্রভু’–একসময়ে তৈমূরের গর্বের সাথে ব্যবহৃত খেতাবের নির্লজ্জ আত্মসাৎকরণ। তাঁর সিংহাসনে আরোহনের সময়ে আরজুমান্দের গর্ভে খুররমের দশম সন্তান ভূমিষ্ট হয় যাদের ভিতরে ছয়জন–জাহানারা, দারা শুকোহ, শাহ্ সূজা, রোসন্নারা, আওরঙ্গজেব এবং মুরাদ বকস–জীবিত ছিল।

Exit mobile version