Site icon BnBoi.Com

অ্যাম্পায়ার অব দ্য মোঘল – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড

অ্যাম্পায়ার অব দ্য মোঘল : রাইডারস ফ্রম দ্য নর্থ

অ্যাম্পায়ার অব দ্য মোঘল

 ১.১ প্রথম খণ্ড – তৈমূরের উত্তরাধিকারী

অ্যাম্পায়ার অব দ্য মোঘল – রাইডারস ফ্রম দ্য নর্থ
মূল : অ্যালেক্স রাদারফোর্ড
অনুবাদ : সাদেকুল আহসান কল্লোল

উৎসর্গ : রাকিবুল হাসান

.

প্রধান চরিত্রসমূহ বাবরের পরিবার আর আত্মীয়স্বজন আহমেদ, সমরকন্দের সুলতান, বাবরের চাচাজান এসান দৌলত, বাবরের নানীজান জাহাঙ্গীর, বাবরের সৎ-ভাই। খানজাদা, বাবরের বড়বোন। খুতলাঘ নিগার, বাবরের আম্মিজান উমর শেখ, বাবরের আব্বাজান, ফারগানার সুলতান

বাবরের স্ত্রীরা আয়েশা, মাঙ্গলিঘ গোত্রের প্রধানের কন্যা মাহাম, হুমায়ূনের মা এবং বাবরের প্রিয়তম স্ত্রী গুলরুখ, কামরান আর আসকারীর মা বিবি মুবারক, ইউসুফজাই গোত্রপ্রধানের কন্যা দিলবার, হিন্দালের মা

বাবরের পুত্র হুমায়ূন। কামরান। আসকারী হিন্দাল

বাবরের আত্মীয় সম্পর্কীয় ভাইয়েরা আজাদ খান, ফারগানার অভিজাত ব্যক্তি মাহমুদ, কুন্দুজের সুলতান মির্জা খান, ফারগানার এক গোত্রপতি তামবাল, ফারগানার অভিজাত ব্যক্তি

বাবরের বিশ্বস্ত পারিষদবর্গ বাবুরী, বাজারে বড় হওয়া এক ছেলে এবং বাবরের বিশ্বস্ত বন্ধু বাইসানগার, সমরকন্দের এক সেনাপতি, পরবর্তীতে বাবরের বিশ্বস্ত অধিনায়ক এবং তৎপরবর্তীকালে বাবরের শ্বশুর কাশিম, বাবরের অন্যতম রাজনৈতিক উপদেষ্টা এবং তার হয়ে প্রায়শই দৌত্যের দায়িত্ব পালনকারী ওয়াজির খান, তার পিতার দুধ-ভাই, বাবরের পরামর্শদাতা এবং বাল্যকালে আর সুলতান হবার প্রথম দিকে বাবরের অভিভাবক আবদুল মালিক, ব্যক্তিগত চিকিৎসক

ফারগানা বাবা কাশক, শাহী মহাফেজ বাকি বেগ, শাহী জ্যোতিষ ফাতিমা, প্রধান খিদমতগার কামবার আলী, উজির রেহানা, এক বৃদ্ধা যার দাদা তৈমূরের সাথে দিল্লী আক্রমণে অংশ নিয়েছিল রোক্সানা, বাবরের পিতার রক্ষিতা এবং জাহাঙ্গীরের মা ওয়ালিদ বাট্ট, এসান দৌলতের খিদমতগার ইয়াদগার, ফারগানার বেশ্যালয়ে বাবরের প্রিয় গণিকা ইউসুফ, কোষাধ্যক্ষ

বাবরের অনুগত উপজাতীয় গোত্রপতি আলী দোস্ত, পশ্চিম ফারগানার এক গোত্রপতি আলী ঘোসত, বাবরের প্রধান অশ্ব-পালক এবং পরবর্তীতে প্রধান রসদ সরবরাহকারী আলি মজিদ বেগ, শাহরুখিয়ার জমিদার বাবা ইয়াসাভাল, হিরাটের নিকটবর্তী কোনো স্থানের যোদ্ধা হুসেনি মজিদ, আলি মজিদ বেগের সম্পর্কীয় ভাই এবং গোত্রপতি

মধ্য এশিয়ায় বাবরের প্রধান শত্রু সাইবানি খান, শক্তিশালী উজবেক দলপতি এবং বাবরের গোত্রের আর তৈমূরের বংশধরদের এক পরাক্রমশালী শত্রু

পারস্য পারস্যের শাহ ইসমাইল মোল্লা হুসাইন, শাহ ইসমাইলের অধীনস্ত এক শিয়া মোল্লা

তূর্কী আলি কুলী, ওস্তাদ-গোলন্দাজ

কাবুল বাহলুল আইয়ুব, গ্রান্ড উজির হায়দার তকী, রাজকীয় সিলমোহরের রক্ষক। মুহাম্মাদ-মুকাঈম আর্গহান, হাজারাদের প্রধান ওয়ালি গুল, রাজকীয় কোষাগারের রক্ষক

হিন্দুস্তান বুয়া, ইবরাহিম লোদীর মা। ফিরোজ খান, হিন্দুস্তানী জমিদার গোয়ালিয়রের রাজপরিবার, বিখ্যাত কোহ-ই-নূর, পর্বতের আলো, হীরক খণ্ডের মালিক রানা সাঙগা, রাজপুত রাজ্য মেওয়ার রাজা সুলতান ইবরাহিম লোদী, দিল্লী সালতানাতের সুলতান এবং হিন্দুস্তানের অধিরাজ রোশান্না, বুয়ার খিদমতগার

বাবরের পূর্বপুরুষ চেঙ্গিস খান। তৈমূর, পশ্চিমে যাকে তৈমূর লঙ বলা হয়

.

আলোর পর্বত

কোনো অভিযোগ জানাতে আমি লেখনীর আশ্রয় নেইনি; আমার উদ্দেশ্য ছিলো সত্য বয়ান। নিজের প্রশংসা করাও আমার অভিপ্রায় ছিলো না, কেবল ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ছিলো আমার অভীষ্ট। এই ইতিহাসে আমি সত্যের আশ্রয়ে সবকিছু লিপিবদ্ধ করতে চেয়েছি। তার ফলশ্রুতিতে আব্বাজান, আত্মীয় বা আগন্তুকের ভিতরে যা কিছু ভালো বা মন্দ দেখেছি তার সবই আমি লিপিবদ্ধ করার প্রয়াস নিয়েছি। পাঠক আমার সীমাবদ্ধতা ক্ষমা করবেন…
—বাবরনামা, মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা

.

প্রথম খণ্ড – তৈমূরের উত্তরাধিকারী

০১.

গেরোবাজের চবুতরায় সংহনন

১৪৯৪ সালের গ্রীষ্মকাল, মধ্য এশিয়ার এক ধূলিময় দূর্গের পোড়া-মাটির প্রাকারবেষ্টিত সমতল ছাদ, দিনের আলোয় যা হাতির চামড়ার মত ধূসর দেখায়, সূর্যাস্তের সময় বাবরের চোখের সামনে এখন সেটাই গোলাপী বর্ণ ধারণ করে। অনেক নিচে জাক্সারটেস নদী ক্রমশ অন্ধকার হয়ে উঠা ভূখণ্ডের দিকে বয়ে যাবার সময়ে একটা স্লান লাল আভার জন্ম দিয়ে যায়। পাথুরে ধাপের উপরে বাবর নড়েচড়ে দাঁড়ায় এবং তার বাবা, এই দূর্গের সুলতানের প্রতি আবার মনোযোগ দেয়। দূর্গের সমতল ছাদে এই মুহূর্তে তিনি তার পরনের আলখাল্লার ফিরোজা রঙের কোমরবন্ধনীতে দু’হাত দৃঢ়মুষ্ঠি করে পায়চারী করছেন। তার বারো বছরের ছেলে আগে বহুবার যে গল্প শুনেছে, সেটা আবার তিনি নতুন করে বলতে শুরু করলে তার চোখে মুখে উত্তেজনার ছন্দ ফুটে উঠে। বাবরের কিন্তু মনে হয় গল্পটা বারবার শুনবার মতো। সে, গল্পটা নতুন করে বলার সময় এর সাথে প্রতিবার যে আনকোরা উপাদান যোগ হয়, সেটা শোনার জন্য কান খাড়া করে থাকে। তার বাবা। গল্পের পরিণতির দিকে এগিয়ে আসলে, সে বাবার কথা বলার সাথে ঠোঁট মেলায়-গল্পের এই একটা অংশ কখনও বদলায় না, তেজোদীপ্ত প্রতিটা শব্দ অলঙ্নীয়ভাবে প্রতিবার উচ্চারিত হয়।

“এবং অবশেষে ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায় যে, আমাদের পূর্বপুরুষ মহান তৈমূর যোদ্ধা তৈমূর, যার নামের মানে ‘লোহা’ আর পৃথিবীর উপর দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে দাবড়ে যাবার সময়ে তার অশ্বপালের গা থেকে ঘামের মত রক্ত ঝরতো- একটা বিশাল সাম্রাজ্য জয় করেন। যুবক বয়সে যদিও মারাত্মকভাবে জখম হবার কারণে তার এক পা অন্য পায়ের চেয়ে লম্বা হয়ে গিয়েছিল এবং হাঁটবার সময়ে তিনি সামান্য খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। তিনি তারপরেও দিল্লী থেকে ভূমধ্যসাগর, সমৃদ্ধ পার্সিয়া থেকে ভলগার অরণ্যভূমি পর্যন্ত একটা বিশাল এলাকা জয় করেছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো সেটা কি তৈমূরের জন্য যথেষ্ট ছিলো? প্রশ্নই ওঠে না! তার শরীর তখনও। শক্তিশালী আর প্রাণবন্ত, পাথরের মত শক্ত তার দেহ আর অফুরন্ত তার আকাঙ্ক্ষা, জীবনের আরো অনেকগুলো বছর তার তখনও উপভোগ করা বাকী। নব্বই বছর আগে চীনের বিরুদ্ধে অভিযানই ছিলো তার শেষ অভিযান। দু’লক্ষ অশ্বারোহী বাহিনীর নির্ভরতার বরাভয়ে তিনি অভিযানে বেরিয়েছিলেন এবং অবশ্যই বিজয় তার পদচুম্বন করতো, যদি আল্লাহতালা তাকে বেহেশতে নিজের সান্নিধ্যে ডেকে না। নিতেন। কিন্তু তৈমূর, মহান যোদ্ধাদের ভিতরে মহানতম- এমন কি তোমার আরেক পূর্বপুরুষ চেঙ্গিস খানের চেয়েও মহান- কিভাবে এসব সম্ভব করেছিলেন? বাছা, তোমার চোখে আমি এই প্রশ্নটাই ভাসতে দেখছি, এবং তোমার অধিকার আছে সেটা জিজ্ঞেস করবার।”

পরম মমতায়, সুলতান তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, তার দিকে বাবরের টানটান মনোযোগ খেয়াল করেন। তারপরে তিনি আবার বলতে শুরু করেন, কুশীলবের পারঙ্গমতায় তার কণ্ঠস্বরে তখন আবেগ খেলা করতে থাকে।

“তৈমূর ছিলেন সাহসী আর ধূর্ত কিন্তু তার বড় পরিচয় তিনি ছিলেন একজন জাত নেতা। আমার দাদা আমাকে বলেছিলো তার চোখ ছিলো মোমবাতির আলোর মত দূতিহীন, নিষ্প্রভ। মানুষেরা স্তব্ধ আলোর সেই ফাটলের দিকে একবার তাকালে আর চোখ ফিরিয়ে নিতে পারতো না। এবং তৈমূর তাদের আত্মার দিকে তাকিয়ে সেই গৌরবের কথা শোনাতেন শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে যার প্রতিধ্বনি শোনা যাবে এবং পৃথিবীর বুকে তাদের থেকে যাওয়া দেহাস্থির প্রাণহীন ধূলোয় ঘূর্ণি তুলবে। চকচকে সোনা আর দূতিময় রত্নের কথা তিনি শোনাতেন। তার রাজধানী সমরকন্দের দাসবাজারে রেশমের মত কালো চুলের যেসব নিটোল গড়নের মেয়েদের তারা দেখেছে, তিনি তাদের কথা বলতেন। এসব ছাড়াও তিনি তাদের জন্মগত অধিকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেন। পৃথিবীর অধিশ্বর হবার বকেয়া অধিকারের কথা তাদের মনে করিয়ে দিতেন। তাদের চারপাশে তৈমূরের মন্দ্র কণ্ঠস্বর বয়ে গিয়ে, তাদের মানসপটে সেইসব দৃশ্যের অবতারণা করতো, যা কেবল তাদের পদানত হবার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে আর শীঘ্রই তারা নরকের জ্বলন্ত তোরণের নিচে তার অনুগামী হতো।

“বাছা, তাই বলে তাকে বর্বর ভেবো না।” সুলতান প্রচণ্ড ভঙ্গিতে মাথা নাড়লে তার লালচে-খয়েরী রঙের সিল্কের পাগড়ীর সঞ্জাব এপাশ ওপাশ দুলতে থাকে। “না। তিনি ছিলেন একজন সংস্কৃতিবান মানুষ। তার প্রিয় সমরকন্দ ছিলো রুচি আর সৌন্দর্য, জ্ঞান আর পৃষ্ঠপোষকতার শহর। কিন্তু তৈমূর একটা কথা খুব ভালো করে জানতেন যে, একজন বিজয়ীর সামনে কোনো কিছুই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না। অভিযান সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত নির্মমতা তার মনপ্রাণ অধিকার করে রাখতে এবং যতবেশি মানুষ সেটার পরিচয় পেতো ততোই মঙ্গল।” তিনি নিজের চোখ বন্ধ করেন এবং পূর্বপুরুষের বিস্ময়কর গৌরবময় দিনগুলো যেনো মানসপটে দেখতে পান। গর্ব আর উত্তেজনার এমন তীব্র একটা রেশ তাকে জারিত কমে যে, তার কপালে স্বেদবিন্দু দেখা দেয়। একটা হলুদ রুমাল বের করে তিনি কপালের ঘাম মোছেন।

বাবর তার বাবার বাচনশৈলীতে সৃষ্ট দৃশ্যকল্পে বরাবরের মতই উল্লসিত হয়ে উঠে। তার দিকে তাকিয়ে হাসে, দেখাতে চায় একই হর্ষোৎফুল্ল গর্বের সেও সমান অংশীদার। কিন্তু সে তাকিয়ে থাকা সত্ত্বেও তার বাবার মুখের অভিব্যক্তি বদলে যায়। তার গভীর চোখে জন্ম নেয়া ঐকান্তিক আলো ম্লান হয়ে আসে এবং সেখানে হতাশার জন্ম হয়। সেখান থেকে আসে বিষণ্ণতা। বাবরের হাসি আড়ষ্ঠ হয়ে উঠে। তার বাবার গল্প সচরাচর তৈমূরের বন্দনার ভিতর দিয়ে শেষ হয়, কিন্তু আজ যেন সুলতানকে কথায় পেয়ে বসেছে। তিনি কথা চালিয়ে যান তার কণ্ঠের উদ্দীপনা মিলিয়ে গিয়ে সেখানে বিষণ্ণ নিরানন্দভাব ফুটে উঠে।

“কিন্তু আমি যদিও আমি মহান তৈমূরের উত্তরপুরুষ-আমার কি আছে? কেবল ফারগানা। এমন একটা রাজ্য যা টেনেটুনে দুইশ মাইল লম্বা বা একশ মাইল চওড়া। চারদিকে তাকিয়ে দেখো- তিনদিকে পাহাড়বেষ্টিত একটা উপত্যকা, যেখানে কেবল ভেড়া আর ছাগলের গলার ঘণ্টার আওয়াজ শোনা যায়।” মেঘাবৃত বেস্তর পর্বতের সুউচ্চ চূড়ার দিকে তিনি হাত তোলেন। “অথচ পশ্চিমে তিনশ মাইল দূরে আমার ভাইয়েরা স্বর্ণমণ্ডিত সমরকন্দের শাসক। আর দক্ষিণে হিন্দুকুশের ওপারে আমার অন্য ভাইয়েরা সমৃদ্ধ কাবুল কজা করে রেখেছে। গরীব আত্মীয় হিসাবে আমি তাদের অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্যের পাত্র। যদিও আমার ধমনীতে- তোমার ধমনীতেও তাদের মত একই রক্ত প্রবাহিত।”

“আব্বাজান-”

“আমরা সবাই যদিও তৈমূর বংশের শাহ্জাদা।” আবেগের আতিশয্যে তাকে থামিয়ে দিয়ে সুলতান বলতে থাকেন, তার সাথে আমাদের কাকে তুলনা করবে? তার বিশাল সাম্রাজ্যের ক্ষুদ্র ভূখণ্ড নিজেদের আয়ত্ত্বে রাখতে আমরা মামুলি গোত্রপতিদের মতো নিজেদের ভিতরে তুমুল ঝগড়ায় ব্যস্ত। বাকি সবার মতো আমিও একই দোষে দোষী।” তার কণ্ঠস্বরে এবার ক্রোধের রেশ পরিষ্কার টের পাওয়া যায়। “তৈমূর যদি আজ জীবিত থাকতেন তবে এই মূর্খতার কারণে আমাদের মুখ দর্শন করতেন না। মির্জা বলে নিজেদের পরিচয় দিতে আমরা গর্ববোধ করি, ‘আমিরের বংশধর, তাকে আমাদের পূর্বপুরুষ হিসাবে উল্লেখ করতে ব্যগ্র হয়ে থাকি, কিন্তু তিনি কি আমাদের নিজের বংশধর বলে স্বীকার করতেন? নিজেদের মহত্ত্ব আর উত্তরাধিকার খুইয়ে ফেলার কারণে কি আমাদের তার সামনে নতজানু হয়ে করুণা ভিক্ষা করা উচিত না?”

সুলতান কঠোর হাতে বাবরের কাঁধ এতো জোরে আঁকড়ে ধরেন যে সে ব্যথা পায়। “বোঝার মতো বয়স তোমার এখন হয়েছে। আমি সে কারণেই এসব কথা তোমাকে বলছি। আমরা তৈমূরের কাছে ঋণী। বাছা আমার, তিনি ছিলেন একজন মহান মানুষ। তোমার ধমনীতে তার রক্তই বইছে। এটা কখনও ভুলে যেয়ো না। যদি পার তারমতো হতে চেষ্টা করবে। তোমার নিয়তির প্রত্যাশা যেনো পূর্ণ হয়, আর সেটা যেনোনা হয় আমার চেয়ে বড়।”

“আব্বাজান আমি চেষ্টা করবো… আমি কথা দিলাম।”

বাবরের চোখের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে সুলতান কিছু একটা দেখতে চান। তারপরে সন্তুষ্টচিত্তে, একটা অব্যক্ত শব্দ করে তিনি ঘুরে দাঁড়ান। বাবর সেখানেই চুপ করে বসে থাকে। তার বাবার অপ্রত্যাশিত আবেগ বোধহয় তাকেও স্পর্শ করেছে। তিনি এইমাত্র যা বলে গেলেন সেটা আত্মস্থ করার ফাঁকে, সে তাকিয়ে দেখে যে সূর্য প্রায় অস্তমিত হয়েছে। অন্যান্য দিনের সন্ধ্যার মত, গোধূলির শেষ আলোয় সে দেখে উঁচু-নিচু দৃশ্যপট আবছা হয়ে এসেছে। আধো-অন্ধকার প্রেক্ষাপটের ভেতর থেকে বের হয়ে এসে রাখাল বালকের দল তাদের ভেড়া আর ছাগলের পাল নিয়ে গ্রামের দিকে ফিরে যায়। সেইসাথে কবুতরের ব্যগ্র জোরাল ডাক ভেসে আসে। তার বাবার প্রিয় সাদা পায়রার দল চবুতরায় ফিরে ডানা ঝাপটাচ্ছে।

তার বাবার ঠোঁট থেকে একটা মৃদু দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসবার শব্দ বাবরের কানে আসে, যেন সে স্বীকার করে যে জীবনের প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির হিসাব মেলানো এখনও বাকী আছে। সে সুলতানকে তার কোমরে ঝোলান চামড়ার ছোট বোতল থেকে একঢোক পানি পান করতে দেখে এবং মুখাবয়বে আবার প্রশান্তির ভাব ফুটে উঠতে, তিনি ঘুরে দাঁড়ান এবং দেয়ালের শীর্ষভাগে অবস্থিত চোঙাকৃতি কবুতরের বাসার দিকে ছাদের উপর দিয়ে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে যান, যা নিচের শুষ্ক গিরিখাদের উপরে আংশিক ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। পোড়া মাটির মেঝেতে তার পায়ের সোনার জরি দেয়া লাল মখমলের নাগরার শব্দ শোনা যায় এবং তার প্রিয় কবুতরকে উড়ে এসে হাতে বসার আমন্ত্রণ জানিয়ে আর তাদের নধর গলায় প্রেমিকের কোমলতায় হাত বুলিয়ে দেবার অভিপ্রায়ে তিনি ইতিমধ্যে দু’হাত প্রসারিত করে দিয়েছেন। বাবর পুরো বিষয়টার ভিতরে কোনো আকর্ষণ খুঁজে পায় না। নধর মাংসের উড়ন্ত দেহ। তাদের জন্য শ্রেষ্ঠ ব্যবস্থা হলো পালক ছাড়িয়ে নিয়ে আখরোট গুঁড়ো আর ডালিমের আখনিতে হাল্কা আঁচে জ্বাল দেয়া।

বাবরের কল্পনায় আবার তৈমূর আর তার পরাক্রমশালী বাহিনী ফিরে আসে। সারা পৃথিবী তোমার, এমন অনুভূতির আমেজটা কেমন? কোনো শহর দখলের পরে শহরের সুলতানকে তোমার পায়ের কাছে কাতরাতে দেখা? তার বাবার কথাই ঠিক। ছোট্ট এই ফারগানার শাসক হবার থেকে কি আলাদা সে অভিজ্ঞতা। আব্বাজানের দরবারের তুচ্ছ রাজনীতির মারপ্যাঁচ দেখে সে বিরক্ত। প্রধান উজির কামবার-আলী যার ঘামে ভেজা আলখাল্লা থেকে সবসময়ে বুড়ো খচ্চরের মত দুর্গন্ধ বের হয়। হলুদ হয়ে যাওয়া লম্বা দাঁতের কারণে তাকে অবশ্য সেরকমই দেখায়। আর সবসময়েই সে বিপদের আঁচ পাচ্ছে। রক্তলাল চোখে সে সবসময়ে ব্যগ্র কেউ তাদের কথা শুনছে কি না খুঁজতে। তার বাবার কানের কাছে অনবরত ফিসফিস করে কথা বলে চলেছে। তৈমূর এই কুৎসিত নির্বোধটার মাথা বিন্দুমাত্র ভাবনার অবকাশ না দিয়ে ধড় থেকে আলাদা করে দিতেন। বাবর ভাবে, অচিরেই, যখন সে সুলতানের পদে অভিষিক্ত হবে, সম্ভবত সে নিজেই সেটা করবে।

শীঘ্রই নামাযের ওয়াক্ত হবে আর তারপরে জেনানামহলে খেতে যাবার সময়। সে সিঁড়ির ধাপ থেকে লাফিয়ে নামে। ঠিক সেই মুহূর্তে প্রচণ্ড শব্দে সে কিছু একটা ভেঙে পড়তে শোনে, তার পায়ের নিচে ছাদের মেঝে কেঁপে উঠে। কয়েক লহমা পরে কিছু একটা ধ্বসে পড়ার ভেতা আওয়াজ ভেসে আসে। একহাত দিয়ে দেয়াল ধরে সে নিজেকে আগে ধাতস্থ করে এবং বুঝতে পারে চোখে কিছু দেখছে না। এসব কিসের আলামত? মাঝে মাঝে দূর্গকে যা কাঁপিয়ে তোলে সেরকম আরেকটা ভূমিকম্প? না, এবারের শব্দটার ধরণ আলাদা ছিলো। অভিঘাতের উত্তেজনায় সে নিজের অজান্তেই শ্বাসরোধী ধূলিকণা বুকে টেনে নেয় আর চোখ ছাপিয়ে পানির ধারা নেমে আসে দৃষ্টি স্বচ্ছ করার অভিপ্রায়ে। সহজাত প্রবৃত্তিতে বাবর মাথা আর মুখ আড়াল করে। এমন সময়ে সে দ্রুত কারো দৌড়ে আসবার শব্দ শুনতে পায়। এবং টের পায় একজোড়া শক্ত হাত তাকে আঁকড়ে ধরে এবং তুলে পেছনে নিয়ে আসে। “শাহজাদা, আপনি এখন নিরাপদ।”

ভারী কণ্ঠস্বরটা তার পরিচিত। তার বাবার দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধান ওয়াজির খানের কণ্ঠ। “কি বলতে চান আপনি…?” কথা বলতে তার রীতিমত কষ্ট হয়: মুখের ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ আর কেমন কাঁকড়ময় একটা অনুভূতি এবং জিহ্বার আকৃতি যেনো সহসা মুখের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। তার কথা কেমন জড়ান আর দুর্বোধ্য শোনায় এবং সে আবার বলতে চেষ্টা করে। “কি হয়েছিলো…?” অনেক কষ্টে সে বলে। “ভূমিকম্প ছিল না, তাই না?”

প্রশ্নটা করে বাবর নিজেই অনেক কষ্টে তার পানিপূর্ণ চোখের পাতা খুলে এবং উত্তরটা নিজের চোখেই দেখতে পায়। ছাদের যেখানে পায়রার চবুতরা ছিল সেখানের একটা বিশাল অংশ বেমালুম গায়েব হয়ে গেছে, যেনো কোনো অতিকায় হাত পিঠার একটা কোণা ভেঙে নিয়েছে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে শুষ্ক আর ফাটল ধরা অংশটা আর ভার বহন করতে পারেনি। কবুতরের দল বাতাসে তুষারকণার মত উড়াউড়ি করছে।

দীর্ঘকায় সৈনিকের নিরাপদ বাহুর বেষ্টনী থেকে মোচড় খেয়ে মুক্ত হয়ে বাবর সামনের দিকে এগিয়ে যায়। বাবাকে আর দেখতে পাবে না এই অনুভূতিটা সহসা তার পেটের ভেতরে একটা বিশাল শূন্যতার জন্ম দেয়। সুলতানের ভাগ্যে কি ঘটেছে? “সুলতান, অনুগ্রহ করে পিছনে সরে আসেন।”

বাবর ধবংসস্তূপে পরিণত হওয়া ছাদের টিকে থাকা অংশের উপর দিয়ে সন্তপণে এগিয়ে গিয়ে নিচের গিরিখাতের দিকে উঁকি দিতে তার কপালে শীতল ঘামের সৃষ্টি হয়। ধীরে ধীরে থিতিয়ে আসা ধূলোর কুয়াশার ভিতর দিয়ে সে কবুতরের চবুতরা আর দেয়ালের ভেঙে পড়া অংশটুকু নিচের পাথুরে ভূমিতে শতধাবিভক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে দেখতে পায়। সেখানে তার বাবার কোনো চিহ্ন সে খুঁজে পায় না। তারপরে বাবর পাথরের ফাটলে জন্ম নেয়া একটা ঝোঁপের ডালে তার বাবার লালচে-খয়েরী রঙের পাগড়িটা কাত হয়ে ঝুলে থাকতে দেখে। চবুতরার সাথে সে নিশ্চয়ই নিচে আছড়ে পড়েছে। ভেতর থেকে উঠে আসা ভয়ের একটা কাঁপুনি দমন করে বাবর ভাবে, সুলতান ধ্বংসস্তূপের নিচে আহত অবস্থায় চাপা পড়েছেন এবং সম্ভবত মৃত।

সে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এমন সময় দূর্গের পাদদেশে অবস্থিত তোরণ থেকে জ্বলন্ত মশাল নিয়ে সৈনিকেরা বেরিয়ে এসে পাথরের উপর দিয়ে দ্রুত গিরিখাদের ভেতরে নামতে শুরু করে।

“অপদার্থের দল, জলদি করো!” ওয়াজির খান বাবরের পাশে এসে তাকে পুনরায় নিরাপদ বেষ্টনীর মধ্যে নিয়ে সৈনিকদের লক্ষ্য করে চেঁচিয়ে ওঠে। তারা দুজনে নিরবে সন্ধ্যার ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে সৈনিকদের মশালের কমলা আভায় তাদের ধবংসস্তূপ সরিয়ে খুঁজতে দেখে। একজন একটা মৃত কবুতর খুঁজে পায় এবং ক্ষুদ্র নিথর দেহটা অপাংক্তেয়ভাবে একপাশে ছুঁড়ে ফেলে। কোথা থেকে একটা বাজপাখি এসে- ছো মেরে মৃত কবুতরটা নিয়ে আবার আকাশে উড়ে যায়।

“আব্বাজান…” বাবর তার দেহের কাঁপুনি কিছুতেই থামাতে পারে না। নিচের গিরিখাদে উদ্ধারকারী দল পাথর আর মাটির একটা বড় চাই সরাতে সে তার নিচে কাপড়ের টুকরোর মত কিছু একটা দেখতে পায়। বাবার আলখাল্লার অংশ। কিছুক্ষণ আগেই সেটার রঙ ছিল ধুসর আকাশী। এখন রক্তে ভিজে সেটা লাল আর নীলের মিশ্রণে রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। আরও কিছু অধীর মুহূর্ত অতিক্রান্ত হয়। সৈনিকেরা তার বাবার দেহ ধবংসস্তূপের নীচ থেকে বের করে নিয়ে আসে। উপর থেকে বাবরের কাছে সেটা কবুতরের নিথর দেহের মত দোমড়ানো প্রাণহীন মনে হয়। সৈনিকেরা এবার উপরে দাঁড়িয়ে থাকা সেনাপতির দিকে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে নির্দেশের জন্য তাকায়।

ওয়াজির খান ইশারায় সুলতানের দেহটা তাদের দূর্গের অভ্যন্তরে নিয়ে আসতে বলে। আদেশটা দিয়ে সে বাবরকে আরও ভেতরের দিকে নিয়ে এসে আলতো করে তার দৃষ্টি ধ্বংসযজ্ঞের দিক থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে। তার চোখে-মুখে এখন কঠোর অভিব্যক্তি, সেই সাথে বাবরের দিকে তাকাতে সেখানে বুঝি চিন্তার ঝিলিক দেখা যায়। তারপরে সে হাঁটু ভেঙে মাটিতে বসে সেজদার ভঙ্গিতে কপাল মাটিতে ঠেকায়। “মির্জা বাবর ফারগানার নতুন সুলতানের জয় হোক। আপনার পিতার রুহ্ পাখির মত উড়ে যেন বেহেশতের দ্বার অতিক্রম করে।”

বাবর একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন সে এইমাত্র যা বলেছে সেটা বুঝতে চেষ্টা করে। তার পিতা- কিছুক্ষণ আগেও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর একটা মানুষ- ফারগানার সুলতান, এখন মৃত। সে আর কখনও তার কণ্ঠস্বর শুনতে পাবে না, বা মাথায় তার ভারী হাতের উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করবে না, বা ভালুকের প্রবলতায় বাবা আর কখনও তাকে আলিঙ্গন করবে না। ফারগানার উপত্যকায় শিকারের অভিযানে সে আর কখনও তার সঙ্গী হবে না। তাঁবুর আগুনের সামনে তার পাশে গুটিসুটি হয়ে বসে রাতের বাতাসে সৈন্যদের গানের গুনগুন শব্দ মিশে যেতে শুনবে না। বাবর নিরবে কাঁদতে শুরু করে। তারপরে পেটের গভীর থেকে উঠে আসা তীক্ষ্ণ বিলাপে তার কিশোর দেহ কেঁপে কেঁপে উঠে।

কান্নার ভিতরেই সন্দেহ আর অনিশ্চয়তা, সেই সাথে তীব্র শোক তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এখন সে সুলতান… তার বংশগৌরব, মৃত্যুর আগ মুহূর্তে বাবার বলে যাওয়া আশা কি সে পূরণ করতে পারবে? কোনো অব্যক্ত কারণে তার বাবার মুখাবয়বের বদলে সেখানে কৃশ আরো বৃদ্ধ একজনের মুখ, যার চোখের নিম্নাংশের হাড় বেশ বেঁকে নেমে এসেছে এবং শীতল আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চোখে “দীপ্তিহীন মোমের আলো”র মত দৃষ্টি ভেসে উঠে। আর সেটা ভেসে উঠতে সে যেনো তার বাবার মন্ত্রগুপ্তির মতো আউড়ানো কথাগুলো শুনতে পায়: “তৈমূরের রক্ত আমার ধমনীতে প্রবাহিত।” নিজের অজান্তে সে কথাটার পুনরাবৃত্তি শুরু করে, প্রথমে আস্তে আস্তে পরে সেখানে প্রত্যয়ের বরাভয় বেশ অনুভব করা যায়। তৈমূর আর তার বাবা দু’জনের প্রত্যাশাই সে সফল করবে। বুক টান করে দাঁড়িয়ে ধূলিধূসরিত অশ্রুসিক্ত মুখ আলখাল্লার হাতায় মুছে নিয়ে সে ঘুরে দাঁড়ায়। “এইমাত্র এখানে যা ঘটে গেছে সেটা আমিই আম্মাজানকে বলবো।”

***

উত্তেজিত হওয়া সত্ত্বেও কামবার আলি স্পষ্ট টের পান তার অল্প বয়সী সুন্দরী স্ত্রী ফরিদা আজ অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি যন্ত্রবৎ সহবাসের দাম্পত্য দায়িত্ব পালন করছে। নানা কারণে প্রধান উজিরের মন আজ বিক্ষিপ্ত অশান্ত হয়ে রয়েছে। সুলতানের আকস্মিক অসাধারণ শাহাদাতবরণ তাকে গভীর চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। আর এ থেকে লাভবান হতে চাইলে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য তার হাতে সময় খুবই কম। বারো বছরের এক বালক সুলতান হবে? হতে পারে… কিন্তু আবার না হলেই বা কি ক্ষতি। কুঁচকিতে দ্রুত পানির ছিটে দিয়ে সে জরির কাজ করা ঘন নীল রঙের আলখাল্লা গায়ে কোনোমতে জড়িয়ে নিয়ে পেছনে একবারও না তাকিয়ে ফরিদার কামরা থেকে বের হয়ে যায়।

দপদপ করে জ্বলতে থাকা তেলের প্রদীপে আলোকিত দূর্গের আভ্যন্তরীণ গলিপথের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যাবার সময়ে শাহী হারেম থেকে ভেসে আসা বিলাপের ধ্বনি সে শুনতে পায়। বাবরের মা আর নানিজান, আঁদরেল দুই মহিলা, তাদের যুগল কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে সামান্য যেটুকু সংশয় অবশিষ্ট ছিল সেটাও দূর হয়। আনুষ্ঠানিক শোকপ্রকাশ তাহলে শুরু হয়েছে। এই দুজনের ব্যাপারে সর্তক থাকতে হবে। তারা শোকে এতটা দিশেহারা হবে না যে, বাবরের স্বার্থ কিংবা নিরাপত্তার বিষয়ে তাদের কোনো খেয়াল থাকবে না।

প্রধান উজির রাজকীয় দরবারের দিকে এগিয়ে যায়, যেখানে সে অন্যান্য রাজকীয় অমাত্যদের ডেকে পাঠিয়েছে। দরবারের সবুজ চামড়ার উপরে পিতলের গজাল আটকানো দরজা দু’জন প্রহরী ভেতরে প্রবেশের জন্য খুলে ধরতে, সে দেখে তিনজন রাজ-কর্মচারি ইতিমধ্যে সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছে: ইউসুফ, রাজকীয় কোষাগারের নির্ভীক কোষাধ্যক্ষ, কোষাগারের সোনালী চাবি একটা লম্বা চেনের সাহায্যে তার চওড়া গলায় ঝুলছে; বাকি বেগ, রাজ-জ্যোতিষী, যার রুগ্ন অস্থির আঙ্গুল তসবী জপছে; এবং লোমশ ভ্রর পাকানো তারের মত শরীরের বাবা কাশক রাজকীয় বাজার সরকার। ওয়াজির খান কেবল অনুপস্থিত।

শূন্য সিংহাসনের নিচে সুন্দর নকশা করা পুরু লাল গালিচার উপরে অসম দর্শন তিনজন আসন-পিঁড়ি হয়ে বসে অপেক্ষা করছে। অধিকার শূন্য বিধায় সিংহাসনটাকে ছোট, গুরুত্বহীন আর মলিন দেখায়, সোনার গিল্টিতে হাল্কা দাগ পড়েছে। আর লাল মখমলের সোনার টাসেলযুক্ত কুশনে সময় আর ব্যবহারের ছাপ স্পষ্ট বোঝা যায়।

“বেশ,” কামবার আলী উপস্থিত লোকদের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, “এমন ঘটতে পারে কে আর আগে থেকে ভেবেছিলো?” আরো কিছু বলবার আগে সে চুপ করে তাকিয়ে থেকে তাদের চোখের ভাষা পড়তে চেষ্টা করে।

“আল্লাহতা’লার মর্জি বোঝা ভার।” বাকি বেগ নিরবতা ভেঙে বলে উঠে।

“কি পরিতাপের কথা তুমি নিয়তির গর্ভে কি লুকিয়ে আছে দেখতে পাওনি। অন্তত একবারের জন্য হলেও তারকারাজি তাদের রহস্য তোমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে পেরেছে।” বাবা কাশক বলেন।

রাজজ্যোতিষী বাজার সরকারের বিদ্বেষপূর্ণ বাক্যবাণে ক্ষিপ্ত হয়ে ক্রুদ্ধ চোখে তার দিকে তাকায়। “ঈশ্বর চান না যে মানুষ সবসময়ে তার নিয়তির কথা জানতে পারুক- বিশেষ করে একজন সুলতান, যে তার প্রজাদের কাছে ঈশ্বরের মতোই প্রতাপশালী আর তার মতই তাদের দণ্ডমুণ্ডের হর্তাকর্তা।”

“আমি তোমাকে ক্ষিপ্ত করতে চাইনি, কিন্তু সুলতান যদি নিজের মৃত্যুর কথা আগে জানতে পারতেন, তাহলে নিশ্চয়ই তিনি বারো বছরের বালককে তার উত্তরাধিকারী হিসাবে মনোনীত করতেন না,” বাবা কাশক মুদুস্বরে কথাটা বলে আক্ষেপের সাথে মাথা নাড়ে।

কামবার আলীর নাড়ীর স্পন্দন সহসা বেগবান হয়ে উঠে। “বটেই তো। রাজ্য আর রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে শক্তিশালী, পরিণত নেতার প্রয়োজন। সুলতানের মৃত্যু সংবাদ শুনতে পেলে সাইবানী খান আর তার মোঙ্গল বর্ণসংকরের দল আমাদের সীমান্তের কাছে এসে হাঁকডাক শুরু করবে। তৈমূরের বংশের সুলতানদের চোখ উপড়ানো কাটা মুণ্ড দিয়ে সে একটা মিনার তৈরি করবে বলে শপথ নিয়েছে। একটা পুঁচকে ছোকরা তার কবল থেকে ফারগানাকে বেশি দিন স্বাধীন রাখতে পারবে না।”

সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়, সবার মুখে বিষণ্ণতার মুখোশ আঁটা। যেনো ফারগানার কল্যাণই তাদের একমাত্র বিবেচ্য বিষয়।

“উজবেকরাই কেবল আমাদের একমাত্র ভয়ের কারণ না। আমাদের মরহুম সুলতান তার নিজের পরিবারেই অনেক শত্রুর জন্ম দিয়েছেন- সমরকন্দের সুলতান, তার জ্ঞাতী ভাইয়ের রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল দখলে তার অভিযানের কথা নিশ্চয়ই তিনি এখনও ভুলে যাননি।”

“অবশ্যই সমরকন্দের সুলতান নিজে একজন শক্তিমান যোদ্ধা।” কামবার আলী মৃদু কণ্ঠে মনে করিয়ে দেয়। “মোঘুলিস্তানের খানও কম শক্তিশালী না।” শেষবার ফারগানা সফরে এসে খান স্বর্ণমুদ্রায় ঠাসা বেগুনী মখমলের একটা থলে তার লোভী হাতে গুঁজে দিয়েছিল, সেই স্মৃতি মুহূর্তের জন্য উজিরের মনে ভেসে উঠে। খানের কথা তার মনে আছে: “ফারগানায় যদি কখনও আমার প্রয়োজন অনুভূত হয়, আমাকে কেবল সংবাদ পাঠাবে এবং ঝড়ের বেগে আমি উপস্থিত হব।” সিংহাসন উপহার হিসাবে পেলে খান তাকে নিশ্চয়ই আরো উদারভাবে পুরস্কৃত করবে।

“আরো আছে কাবুলের শাসনকর্তা তিনিও তৈমূরের বংশধর, আমাদের প্রয়াত সুলতানের জ্ঞাতী ভাই।” বাবা কাশক এবার সরাসরি উজিরের চোখের দিকে তাকায়। “তিনি নিশ্চয়ই ফারগানাকে রক্ষা করবেন…”।

কামবার আলী, মাথা নুইয়ে ভদ্রতাসূচক সম্মতি প্রকাশ করে। তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয় আজ রাতেই উত্তরের পাহাড়ী পথে মোঘুলিস্তানের উদ্দেশ্যে দূত পাঠাবে নতুবা দেরি হয়ে যাবে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, তাড়াহুড়ো করলে আমরা হোঁচট খেতে পারি।” কণ্ঠস্বরে গভীর চিন্তার ব্যঞ্জনা ফুটিয়ে সে বলে। “শাহজাদা বাবরের স্বার্থ যাতে বিঘ্নিত না হয় সেজন্য আমাদের ভাবনা চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রাপ্তবয়স্ক হলে তিনিই হবেন সিংহাসনের যোগ্য হকদার। আর ততোদিন পর্যন্ত ফারগানাকে নিরাপদ রাখতে আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের ভেতর কাউকে রাজপ্রতিভূ নিয়োগ করতে পারি।” বাবরকে এ জীবনে আর তাহলে সিংহাসনে বসতে হবে না, সে মনে মনে ভাবে। একটা ছোট দূর্ঘটনা ঘটতে আর বেশি দেরি নেই। ঘটনাটা সাধারণভাবে সাজাতে হবে যে…

দরবারে ওয়াজির খান প্রবেশ করতে তারা চারজন উঠে দাঁড়ায়। তাকে ক্লান্ত দেখায় এবং তামাটে মুখের উপরে আড়াআড়ি গোলাপী ক্ষত চিহ্নটা- এক যুগ আগে চালানো তরবারির ছোবল যা তার ডানচোখের জ্যোতি ছিনিয়ে নিয়েছিল। এখন ফুলে থাকায় মনে হয় আঘাতটা যেন সপ্তাহখানেকের পুরানো। “মুরুব্বীগণ, দেরি। হবার জন্য আমাকে মার্জনা করবেন।” সে তার ডান হাতের তালু দিয়ে নিজের বুক স্পর্শ করে এবং কামবার আলী উজির পদে আসীন থাকায় তিনি তাদের ভিতরে প্রধান সেটা প্রকাশ করতে তাকে মাথা নত করে অভিবাদন জানায়। “আমি দূর্গের চারপাশে পাহারা দ্বিগুণ করেছি কিন্তু এখন পর্যন্ত সবকিছু শান্তই আছে। সুলতানের মরদেহ গোসল দেয়া হয়েছে এবং আগামীকালের জানাজার সব ইন্তেজাম করা হয়েছে।”

“ওয়াজির খান আমরা আপনার কাছে ঋণী থাকলাম। আমি খুশি হয়েছি।”

“আপনারা ফারগানায় রাজপ্রতিভূ নিয়োগের ব্যাপারে আলাপ করছিলেন?” ওয়াজির খান কামবার আলীর পাশে বসে এবং উজিরের দিকে নিজের ভাল চোখ দিয়ে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে সে তিক্ততা অনুভব করে।

“আমরা আলোচনা করছিলাম। রাজ্যের দায়িত্ব সামলাবার তুলনায় শাহজাদা বাবরের বয়স অল্প। আর উজবে কুকুরের দল আমাদের হুমকী দিচ্ছে।” উজবেকদের নাম উচ্চারণের সময়ে উজির থুতু ফেলার ভঙ্গি করে।

“শাহজাদার বয়স অল্প সেটা সত্যি, কিন্তু তিনি আমাদের প্রয়াত সুলতানের একমাত্র জীবিত সন্তান এবং রাজ্য পরিচালনার জন্য অল্পবয়স থেকেই তাকে প্রস্তুত করা হয়েছে। এটাই তার নিয়তি আর তার পিতা আমাদের মরহুম সুলতানের সেটাই ইচ্ছা ছিলো। বাবর সাহসী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আর দ্রুত সবকিছু রপ্ত করতে পারে। আমি নিজে তার সাক্ষী। সুলতানের অনুরোধে, বিশেষ করে বাবরই তার একমাত্র উত্তরাধিকারী এ বিষয়টা নিশ্চিত হতে, আমি তাকে অসি চালনা, তীরন্দাজি, কিভাবে বর্শা ব্যবহার করতে আর রণকুঠার ছুঁড়তে হয়, এসব কিছু যথেষ্ট সময় নিয়ে শিখিয়েছি। বাবর তার বয়সের অন্য ছেলেদের তুলনায় অনেক পরিণত, বিচক্ষণ। আমি নিশ্চিত আমাদের পাঁচজনের পরামর্শ তাকে এই বৈরী সময় অতিক্রম করতে সহায়তা করবে।” ওয়াজির খান নিরাসক্ত কণ্ঠে বলে।

“বন্ধু ওয়াজির খান, বিষয়গুলো যদি এত সহজ হত।” উজির ম্লান হেসে বলে। “শান্তিপূর্ণ সময়ে তোমার পরিকল্পনা অনুসারে কাজ হত, কিন্তু উজবেকদের আকাক্ষার কোনো সীমা পরিসীমা নেই। তারা যে মুহূর্তে শুনবে ফারগানার সুলতান তার অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেকে সিংহাসনে রেখে মারা গেছেন, তারা আমাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে, পেট চিরে আমাদের নাড়িভূড়ি বের করবে আর আমাদের রমণীদের অসম্মান করবে।”

“মহামান্য উজির, আপনি কি বলেন?”

“শাহজাদা বাবর প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত আমরা মরহুম সুলতানের কোনো আত্মীয়কে মসনদ রক্ষার দায়িত্ব দিতে পারি। কিন্তু প্রশ্নটা হলো আমরা কাকে অনুরোধ করবো…”

“আমি বুঝেছি। উত্তম প্রস্তাব। আমি মামূলি একজন সৈনিক আর আজ রাতে আমার আরও কাজ আছে। রাজনৈতিক বিষয়ে আপনারা আমার চেয়ে অনেক অভিজ্ঞ। আমাদের রাজ্যের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে আল্লাহতালা আপনাদের হেদায়েত করুন।” ওয়াজির খান উঠে দাঁড়ায়, মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে ধীর পায়ে দরবার ত্যাগ করে। দরবার থেকে বের হয়ে এসেই তার পায়ের গতি বৃদ্ধি পায়। মাঝের আঙ্গিনা অতিক্রম করে দূর্গের অপর প্রান্তে অবস্থিত শাহী হারেমের দিকে সে এগিয়ে যায়।

***

বাবর তার আম্মিজান, খুতলাঘ নিগারের পাশে বসে আছে। তার লম্বা কালো চুলে স্বস্তির পরশ পেতে মায়ের আঙ্গুল বিলি কাটে। বাবর ইতস্তত ভঙ্গিতে শোকসংবাদটা জানাবার পরেই তার মায়ের চেহারা এতোটাই ফ্যাকাশে হয়ে যায় যে তার ভয় হয় আম্মিজান বুঝি অজ্ঞান হয়ে যাবে এবং খবরটা শোনার পরে তিনি অন্ধ মহিলার মত শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাস্তবতা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরে, সে জিকির করার মত দুলতে শুরু করে। তার ভেতর থেকে তীব্র শোকের তীক্ষ্ণ ভয়ঙ্কর পরিদেবন বিষাদের মাত্রা সঞ্চয় করে বের হয়ে আসে। সুলতানের যদিও অনেক রক্ষিতা ছিলো কিন্তু তিনিই ছিলেন তার একমাত্র স্ত্রী। তাদের ভিতরে মহব্বতের সম্পর্কটা বেশ দৃঢ় ছিলো।

সে তাকিয়ে তার নানিজান, এসান দৌলতকে, আনমনে বীণার তারে টোকা দিতে দেখে। বীণার বিষণ্ণ সুর শরণ সন্ধানী পাখির মত কামরার ভেতরে প্রতিধ্বনি তুলে ভাসতে থাকে। তার মাথার সাদা চুল, যা অল্প বয়সে বেশ ঘন ছিলো কিংবা সেরকমই তিনি দাবি করেন, কাঁধের উপরে বেণী করা। তার কিশমিশের ন্যায় চোখ লালচে হয়ে আছে কিন্তু তিনি নিজেকে সামলে নিয়েছেন। বাবরকে একটু আগেই তিনি কান্না চেপে স্থিরসংকল্প কণ্ঠে বলেছেন, তিনি একজন খানিম, চেঙ্গিস খান, মানুষ যাকে মহাসাগরসম শাসক বলতো, তৈমূরের জন্মের দু’শো বছর আগে চেনা পৃথিবীর অর্ধেকটা যিনি অভিহরণ করেছিলেন, তার সাক্ষাৎ বংশধর।

বাবর তার নানীজানের মুখের দিকে তাকাতে, কে ছিলেন মহান যোদ্ধা- চেঙ্গিস খান নাকি তৈমূর, সেটা নিয়ে বাবার সাথে নানীজানের নিরন্তর তর্কের কথা তার মনে পড়ে যায়। জন্মের সময় বাবরের মাথা বড় থাকায়, আম্মিজানের যন্ত্রণাদায়ক দীর্ঘস্থায়ী গর্ভাবস্থার কথা এসান দৌলত সবসময়ে গল্প করেন। পুরোটা সময় তিনি তার মেয়েকে আশ্বাস বাণী শুনিয়েছিলেন যে, চেঙ্গিসের মতই বাবরও তার ক্ষুদ্র হাতের মুঠোয় রক্তের দলা নিয়ে তার যোদ্ধা নিয়তির প্রতীক- জন্ম নেবে। কিন্তু তার ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণিত হয়। অবশ্য এতে বিন্দুমাত্র হতাশ না হয়ে তিনি বলতে থাকেন, “সে নিশ্চয়ই একজন মহান শাসক হবে!”

এসান দৌলত যেনো তার চোখের দৃষ্টি অনুভব করে। তিনি বাবরের দিকে তাকালে সে নানীজানের চোখে এমন কিছু একটা দেখে যা আগে কখনও দেখেনিঃ অনিশ্চয়তা। তিনি এবার বীণাটা নামিয়ে রাখেন। “খানজাদা, কাউকে বলো বরফ দিয়ে শরবত দিতে,” তিনি তার মোল বছরের নাতির দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলেন।

বাবর দেখে তার লম্বা অপূর্ব সুন্দরী বোন দ্রুত উঠে দাঁড়ায়, পরিচারিকাকে আদেশ দেয়। সে কামরার প্রবেশপথের কাছে পৌঁছাতে যেখানে প্রদীপের আলোর আগ্রাসন সবচেয়ে ক্ষীণ, সে আরেকটু হলেই হারেমের প্রধান পরিচারিকা ফাতিমার সাথে ধাক্কা খেত। বেচারীর চওড়া, ভোতা মুখ অশ্রুসিক্ত। “মালিক,” খানজাদা বরফ দেয়া শরবতের কথা বলার আগে সেই বলতে শুরু করে, “মালিক, ওয়াজির খান আপনার মহামহিম আম্মিজান আর নানীজানের সাথে দর্শন প্রার্থনা করেছে।”

“আগামীকাল সকাল পর্যন্ত সে অপেক্ষা করতে পারবে না? তারা শোকাবিভূত এবং তাদের বিশ্রামের প্রয়োজন।

“সে বলেছে ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ।” ফাতিমা হাত দিয়ে অনুনয়ের ভঙ্গি করে যেন তার হয়ে মিনতি করছে।

খানজাদা তার আম্মিজান আর নানীজানের দিকে তাকিয়ে তাদের ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করতে দেখে। তারপরে খুতলাঘ নিগার বলেন, “আমরা তার সাথে দেখা করবো। বাবর, তুমি অনুগ্রহ করে এখন যেতে পার।”

“কিন্তু কেননা? আমি থাকতে চাই।”

“আমি যা বলছি তাই করো।” তার আম্মা এবার উঠে বসেন।

“না।” এসান দৌলত এবার হস্তক্ষেপ করেন, “সে ফারগানার নতুন সুলতান। ওয়াজির খান যা বলতে এসেছে তা আমাদের চেয়ে বেশি তাকে প্রভাবিত করবে। তাকে থাকতে দাও।”

খুতলাঘ নিগার তার কিশোর ছেলের স্থিরসংকল্প কচি মুখের দৃঢ় প্রতিজ্ঞ মনুস্থির দিকে তাকায় এবং মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। তিন রমণী নিজেদের সামলে নিয়ে তাদের মুখের নেকাব টেনে দেয়। বয়োজ্যেষ্ঠ রমণী তার একপাশে মেয়ে অন্যপাশে নাতিনকে নিয়ে দাঁড়াতে, বাবর তাদের কাছ থেকে দূরে সরে আসে। নানিজানের কথায় তার ভিতরে কিছু একটা বদলে গিয়েছে। সে আশঙ্কিত কিন্তু সেইসাথে উত্তেজিতও বটে।

ওয়াজির খান নিচু সরদলের নিচে দিয়ে ঝুঁকে ভেতরে প্রবেশ করে গভীর শ্রদ্ধায় নিজেকে তাদের সামনে প্রণত করে। “এত রাতে অনাহূত সাক্ষাৎ প্রার্থনার জন্য আমাকে মার্জনা করবেন, মালিক।”

“কি হয়েছে?” নেকাবের উপর দিয়ে এসান দৌলত বিচক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে তার মুখ খুটিয়ে দেখে।

“বিষয়টা আমাদের মহামান্য সুলতানকে নিয়ে।” ওয়াজির পলকের জন্য আঁধারে দাঁড়িয়ে থাকা বাবরের দিকে তাকায়। তিনি এখানে একটুও নিরাপদ নন। আমরা এখন এখানে যখন আলাপ করছি, কুচক্রীর দল তখন তার কাছ থেকে মসনদ কেড়ে নিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের ষড়যন্ত্র করছে।”

“তোমাকে আরও খুলে বলতে হবে। কে ষড়যন্ত্র করছে?” এসান দৌলত জানতে চান। তার চোখের রঙ বদলে গেছে এবং চোখের নিচের উঁচু হাড়ে লাল রঙের ছোপ দেখা যায়।

“আমরা তোমাকে বিশ্বাস করি।” খুতলাঘ নিগার মৃদুকণ্ঠে বলেন। “তুমি ছিলে মরহুম সুলতানের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সেনাপতি। তারচেয়েও বড় কথা, আমার স্বামীকে শিশুকালে তোমার আপন মা স্তন্যদুগ্ধ দ্বারা লালন করেছেন, যা তোমাকে সুলতানের দুধ-ভাইয়ের সম্মান দান করেছে। রক্তের মত অচ্ছেদ্য একটা বন্ধনে তোমাকে আবদ্ধ করেছে। সামনের অনাগত দিনগুলোয় আমি দেখতে চাই তুমি সেই বন্ধনের সম্মান রক্ষা করো… আমার সন্তানকে তুমি ঠিক তার আব্বাজানের মতো আগলে রাখবে… দয়া করে সব খুলে বলো। তুমি কি শুনেছো?”

“অসহিষ্ণু, রাজবৈরী, কুটিল স্বভাবের লোকেরা আপনাদের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে। উজির আর দরবারের অন্য সদস্যরা মসনদে অন্য আরেকজনকে অভিষিক্ত করার পরিকল্পনা আঁটছে- তারা ভেবেছে আমি তাদের কথোপকথনের শেষ অংশটুকু শুনেছি। কিন্তু তারা জানে না দরবারের বাইরে নিভৃতে দাঁড়িয়ে আমি তাদের পুরো আলোচনা শুনেছি। তারা রাজ্যের মঙ্গলের উসিলায় কাজটা হাসিল করতে চায়। আপনাদের সন্তান শাসনকার্য পরিচালনার পক্ষে নিতান্ত অল্পবয়সী এবং তাকে সিংহাসনের অধিষ্টিত করলে ফারগানায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে, যদি তারা শাহজাদা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠা পর্যন্ত কোনো রাজপ্রতিভূ নিয়োগ না করে। মুশকিল হল, আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর শাসকদের কাছে অনেক আগেই তারা নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছে। প্রত্যেকে নিজ নিজ প্রভুর স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে। রাজ্যে শীঘ্রই তাদের প্ররোচণায় অশান্তি শুরু হবে। তাদের লোভের কারণে, মসনদের জন্য প্রতিপক্ষের ভিতরে যুদ্ধ শুরু হবে। একটা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ আরেকটা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের জন্ম দেবে। আর সবশেষে যেই বিজয়ী হোক, আপনার ছেলে তততদিন জীবিত থাকবে না। যতোদিন সে বেঁচে আছে- সবাই তাকে একটা হুমকি হিসাবেই দেখবে।”

“এটা অসম্ভব। সনাতন মর্যাদার স্মারক তৈমূর বংশের শাহজাদাদের অলঙ্ঘনীয় নিরাপত্তা দিয়েছে…” খুতলাঘ নিগারের কণ্ঠস্বর হোঁচট খায়।

“আমাদের এখন কি করণীয়?” এসান দৌলত ওয়াজির খানের বাহু আঁকড়ে ধরে জিজ্ঞেস করে। হাড়সর্বস্ব অবয়ব সত্ত্বেও তার ভিতরে একটা যুদ্ধংদেহী শক্তি লুক্কায়িত রয়েছে। এসান দৌলত ধমনীতে চেঙ্গিস খানের রক্ত আর চেতনায় তার আত্মাকে ধারণ করেন।

“হ্যাঁ, এখন আমাদের কি করণীয়?” বাবর অন্ধকার ছেড়ে বের হয়ে এসে জানতে চায়। দেয়ালের কুলঙ্গিতে রক্ষিত প্রদীপের নিভুনিভু আলোয় তার মুখের স্থির সংকল্প আর সিদ্ধান্ত প্রতিফলিত হয়।

“আমাদের দ্রুত কাজ করতে হবে। আমাদের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।” ওয়াজির খান সংক্ষেপে কেবল এটুকুই বলে। “আগামীকাল আপনার আব্বাজান আমাদের মরহুম সুলতানের নামাজে জানাজার ঠিক অব্যবহিত পরেই দূর্গের শাহী মসজিদে আমরা আপনাকে সুলতান হিসাবে ঘোষণা করবো। মোল্লা একবার আপনার নামে খুবা পাঠ করার পরে কেউ যদি আপনার বিরোধিতা করে তবে সে চক্রান্তকারী হিসাবে চিহ্নিত হবে। আর আমাদের খেয়াল রাখতে হবে আমাদের শুভাকাক্ষিরা যেন এ সময় প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে উপস্থিত থাকে। আমার প্রহরীরা সবাই বিশ্বস্ত। ফারগানার অনেক অভিজাত ব্যক্তিও আমাদের পক্ষে রয়েছেন। বিশেষ করে আপনি যদি তাদের বিশ্বস্ততার প্রতিদান দেবার প্রতিশ্রুতি দেন।”

“আমাকে কাগজ, দোয়াতদানি আর পালক এনে দাও,” এসান দৌলত তার নাতিনকে আদেশ করে। “আজ রাতটা আমরা কেবল শোক পালনে কাটাবো না, আমাদের নিরুদ্বেগ আরও বড় বিপর্যয় আমাদের উপরে আপতিত করবে। আমি খুব ভালো করেই জানি কাদের উপরে আমরা বিশ্বাস রাখতে পারি আর কারা কপট, অবিশ্বাসী। সবাই মনে করে আমি কিছুই বুঝতে পারি না, কিন্তু চারপাশে কি ঘটছে আমি খুব ভালোই লক্ষ্য করি। এইসব গুরুত্বপূর্ণ চিঠি লেখার দায়িত্ব আমি কোনো খুশনবিশকে দিতে চাই না, চিঠিগুলো আমি নিজে লিখবো। ওয়াজির খান তোমার উপরে প্রতিটা চিঠি নিরাপদে আপন আপন গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব রইল। চিঠিগুলো কেন পাঠান হচ্ছে জিজ্ঞেস করবার ধৃষ্টতা কেউ দেখালে তাকে বলবে মরহুম সুলতানের জানাজা উত্তর ভোজের আমন্ত্রণপত্র। কথাটা আংশিক সত্যি কিন্তু সেগুলো একই সাথে মসজিদে বাবরের অভিষেকের আমন্ত্রণপত্রও বটে। আকশীর আশেপাশে ঘোড়ায় অর্ধদিনের দূরত্বে বসবাসকারী সব বিশ্বস্ত গোত্রপতিকে আমি ডেকে পাঠাচ্ছি। আমি তাদের অনুরোধ করবো জানাজা শেষে ভোজসভা আরম্ভ হবার পরে গোপনে আর নিঃশব্দে তারা যেন মসজিদে প্রবেশ করে। বাবর বেটা, আমার পাশে এসে তেলের প্রদীপটা একটু উঁচু করে ধরো।”

রাত গভীর হবার সাথে সাথে তাদের চারপাশে দূৰ্গটা নিরব হয়ে আসে। বাবর অপলক তাকিয়ে দেখে নানীজান অক্লান্তভাবে লিখে চলেছেন। মাঝে মাঝে কেবল পালকের মাথা তীক্ষ্ণ করতে বা কালি শেষ হয়ে গেলে লেখায় সাময়িক বিরতি দেন। অবিশ্বাস্য ব্যাপার, সে ভাবে, রক্তের বৈরীতা আর তিক্ত শত্রুতার কথাই নানীজান কেবল জানে না, চেঙ্গিস খানের সময় থেকে গোত্রসমূহের ভিতরে চলে আসা জটিল বৈবাহিক সম্পর্ক আর ব্যক্তিগত বিশ্বস্ততার গভীর সম্পর্কের বিষয়েও তার অসীম জ্ঞান। এই প্রথম সে তার প্রতি কৃতজ্ঞবোধ করে তাকে জোর করে গোত্রপতিদের ভিতরে কারা বন্ধু আর কে কে শত্রু সে বিষয়ে নানীজান তাকে ধৈর্য ধরে শিখিয়েছেন বলে তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- এর পেছনের কারণগুলো সম্পর্কেও তিনি তাকে বলেছেন। তার মুখের সূক্ষ্ম ভাঙাচোরা দাগের দিকে তাকিয়ে বাবর স্বস্তি বোধ করে যে এসান দৌলত তার মিত্র, শত্রু নন।

সবগুলো চিঠি লেখা শেষ হতে- কাগজের উপরে তুর্কী লিপির এলোমেলো বিন্যাস সেগুলো ভাজ করে লাল মোম দিয়ে সীল করে একজন বিশ্বস্ত লোক দিয়ে চিঠিগুলো পৌঁছে দেবার জন্য ওয়াজির খানকে দেয়া হয়। বাইরের প্রাঙ্গণে দূর্গ থেকে বের হয়ে যাওয়া ঘোড়ার খুরের শব্দ প্রতিধ্বনি তোলে। সুবেহসাদিকের সময়ে ফজরের নামাজের আজানের ধ্বনি ভেসে আসবার পরেই কেবল এসান দৌলত তার লেখনী বন্ধ করেন।

১.২ প্রথম রক্তপাত

০২. প্রথম রক্তপাত

বাবর ঘোড়ার পিঠে বসে, ওয়াজির খানের মনোনীত আটজন প্রহরীকে কাঁধে করে ধূসর-সবুজ জেড পাথরের শবাধারে তার বাবার মরদেহ বয়ে নিয়ে আসতে দেখে। ভারী পাথরের কাঠিন্যের জন্য তাদের প্রত্যেকের কাঁধে ভেড়ার চামড়ার পুরু আস্তর দেয়া থাকলেও শবাধারটা অসম্ভব ভারী। তাদের বাতাসে পুড়ে তামাটে বর্ণ ধারণ করা মুখ ঘামে ভিজে আছে এবং একজন হোঁচট খেয়ে আরেকটু হলেই কাঁধ থেকে শবাধারটা ফেলে দিতো। উপস্থিত সবাই আঁতকে উঠে জোরে শ্বাস টানে শবাধারটা যদি মাটিতে আছড়ে পড়ে তবে সেটা একটা অশনিসঙ্কেত হিসাবে বিবেচিত হবে। বাবরের পাকস্থলীর কাছটা টানটান হয়ে যায় কিন্তু কামবার আলীর কচ্ছপের মতো মুখ নির্বিকার থাকে।

“হুঁশিয়ার, তোমরা আমাদের সুলতানকে বহন করছে।” ওয়াজির খানের কণ্ঠস্বরের তীব্রতায় প্রহরীটা নিজেকে সামলে নিয়ে পুনরায় কাঁধে শবাধারের ভার নেয় এবং শবাধারবাহীরা স্মৃতিসৌধের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সমাধিকক্ষের দিকে ঢালু দরদালান বেয়ে ধীরে ধীরে নিচে নামতে থাকে।

বাবরের পিতা মৃত্যুর অনেককাল আগেই নিজের সমাধিসৌধের পরিকল্পনা করেছিলেন। বাবর যখন তার বিশাল-স্তনের দাইয়ের কোলে নিতান্ত দুগ্ধপোষ্য শিশু, সুলতান তখন ফারগানা আর ফারগানার বাইরে থেকে রাজমিস্ত্রী এবং অন্যান্য কারিগরদের ডেকে আনেন। তার ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধায়নে আকশি দূর্গের দেড় মাইল পশ্চিমে জাক্সারটেস নদীর তীরে কারিগরের দল সমরকন্দে মহান তৈমূরের শেষ বিশ্রামস্থলের একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ নির্মাণ করে। এখন ডিম্বাকৃতি গম্বুজের নীলাভ সবুজ টালির সাথে উজ্জ্বল বর্ণের রূপালি নীল টালির বিন্যাস জুন মাসের তীব্র সূর্যালোকে চোখ ধাধিয়ে দেয়। বাবর ভাবে, বাবা এসব দেখলে গর্ববোধ করতো এবং ভাবনাটা তার উত্তেজিত মুখমণ্ডলে আবছা একটা হাসির অভিব্যক্তির জন্ম দেয়।

তার চোখের দৃশ্যপট থেকে শবাধারটা আড়াল হতেই, উপস্থিত জনগণের মাঝে বিলাপের ক্রন্দন ধ্বনি গমগম করে উঠে- যাদের ভেতরে রেশমের আলখাল্লা পরিহিত গোত্রপতি আর অভিজাতদের সাথে একই কাতারে দাঁড়িয়ে রয়েছে মামুলি পশুপালকও, যাদের গায়ে তাদের পালিত পশুর গন্ধ। পার্থিব জীবনের পরিস্থিতি যাই হোক, সব মানুষই তাদের পরণের আলখাল্লা টেনে ছিঁড়ে এবং মাথার পাগড়িতে কবরের মাটি ছিটায় যার রেওয়াজ চেঙ্গিস খানের অনেক আগে থেকে চলে আসছে। তাদের মনে তখন কি ভাবনা খেলা করছিলো? এখানে কতজন তারমতো শোকগ্রস্ত? বাবর ভাবে। এসান দৌলতের চিঠির কারণে গোত্রপতিরা আজ এখানে উপস্থিত হয়েছে বটে, কিন্তু সময় যখন হবে সে তাদের কতজনের উপরে নির্ভর করতে পারবে?

“যাদের কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই এমন লোকদের থেকে সাবধান ব্যাপারটা অস্বাভাবিক, তার বাবা সবসময়ে তাকে এই উপদেশটা দিয়েছে। বাবর একবার ওয়াজির খানের দিকে আড়চোখে না তাকিয়ে পারে না, কিন্তু পরমুহূর্তে নিজেই লজ্জিত হয়। বাবা মারা যাবার পরে, আর নানীজান ছাড়া, লম্বা ঋজু-পৃষ্টদেশের এই সৈনিককেই পৃথিবীতে সে তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোক বলে জেনে এসেছে। কিন্তু ওখানে মুখে গুটিবসন্তের দাগভর্তি ধূসর দাড়িঅলা গোত্রপতি, পাহাড়ের সুরক্ষিত আশ্রয় থেকে রাতের আঁধারে বেরিয়ে এতো দ্রুত ঘোড়া দাবড়ে এসেছে যে তার গায়ের আলখাল্লা নিজের আর ঘোড়ার ঘামে মাখামাখি অবস্থা, তার কি মনোভাব? অথবা ঐ গাজরের মতো উঁচু-দাঁতঅলা, মোঙ্গলদের প্রাচীন রীতি অনুসারে যার মাথা পুরোটা কামান, যাকে তার মরহুম পিতা ষড়যন্ত্র, কপটতা আর লোভের কারণে একবার নির্বাসনে পাঠিয়েছিলেন এবং সম্প্রতিই ফিরে আসবার। অনুমতি দিয়েছিলেন, সে কি ভাবছে? এসান দৌলতকে আমন্ত্রণপত্র পাঠাবার সময়ে এসব ঝুঁকি নিতে হয়েছে। আশা করেছে যে কেবল মিত্রদেরই সে ডেকে পাঠিয়েছে, কিন্তু বাবর তার অল্প বয়সে একটা বিষয় খুব ভালো করেই জানে, এদের ভিতরে অনেকেই অনায়াসে পিঠ দেখাতে পারে।

কিন্তু এখন সেসবের সময় না। তার প্রথম কাজ এখন আব্বাজানকে সমাধিস্থ করা। ওয়াজির খান মাথা নত করে বাবরের ঘোড়ার অলঙ্কারখচিত মাথার সাজ শক্ত করে ধরতে সে ঘোড়া থেকে নামে। চোখের কোণের অশ্রু মুছে সে গভীর একটা শ্বাস নেয় এবং তার বাবার প্রিয় মোল্লা আর শোকার্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সমাধিগর্ভে শেষ শ্রদ্ধা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়। এক মুহূর্তের জন্য সে তার মায়ের কোমল হাতের স্পর্শ অনুভব করতে লালায়িত হয়ে। উঠে। কিন্তু খুতলাঘ নিগার, তার বোন আর নানীজানের সাথে শাহী হারেমে অপেক্ষা করছেন, যা বিধিসম্মত। এসব অনুষ্ঠানে মেয়েদের উপস্থিত থাকবার রেওয়াজ নেই। সুলতানের মৃতদেহ নিয়ে অনুগমনকারী অনুচরবর্গ দূর্গ থেকে বের হয়ে চপল ছন্দে বহমান জাক্সারটাসের তীরের দিকে রওয়ানা হবার সময়ে তারা দেয়াল থেকে ঝুলতে থাকা পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে নিরবে শেষ বিদায় জানিয়েছেন। সমাধিসৌধের অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রবেশপথের দিকে বাবর এগিয়ে যেতে সে দেখে যে, কামবার আলী তার আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছে, প্রথমে প্রবেশ করার বাসনায়। পরণের খয়েরী আলখাল্লা তার দেহের চারপাশে নিশানের মত উড়ছে। “উজির!” বাবরের কিশোর কণ্ঠ কঠোর শোনায়। মানানসই একটা কণ্ঠস্বর। থমকে থেমে পাশে সরে দাঁড়াবার সময়ে কামবার আলীর মুখে বিরক্তির সামান্য রেশ ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায়।

“আমার বাবার শবানুযাত্রীদের নেতৃত্ব আমি দেব। সেটাই বাঞ্ছনীয়।” বাবর তাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যাবার সময়ে উজিরের পায়ের নরম চামড়ার নাগরা ভালো করে মাড়িয়ে দেয়। বেশ তৃপ্তিকর একটা অনুভূতি।

“অবশ্যই, শাহজাদা।”

বাবর যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শনপূর্বক মোল্লাকে তার সাথে আসতে বলে। কামবার আলী দীর্ঘ অন্ধকার গলিপথে তাদের অনুসরণ করে। রাজদরবারের অন্য সদস্যরা, তাদের পদমর্যাদা অনুসারে বাবরের অনুবর্তী হয়। ইউসুফ, রাজকোষের কোষাধ্যক্ষ হবার। কারণে, মরহুম সুলতানের শবাধারের পাদদেশে রাখার জন্য একটা পাত্রে চকচক করতে থাকা সোনার আশরফি বহন করে আনে। বাবা কাশক, শাহী বাজারসরকার হিসাবে দায়িত্ব পালনের নিমিত্তে লাল চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা একটা খেরোখাতা বয়ে নিয়ে আসে। যেখানে মরহুম সুলতানের জীবদ্দশায় কৃত সমস্ত শাহী খরচের হিসাব লিপিবদ্ধ রয়েছে। খেরো খাতাটাও তার শবাধারে দেয়া হবে, যার মানে। সুলতান পরলোকে গমন করেছেন তার সমস্ত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন শেষ করে। বাকি বেগের হাতে শাহী জ্যোতিষবিদ হিসাবে একটা স্ফটিকের গোলক দেখা যায়। সে মনে মনে ভাবে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হবার পরে, এই চকচকে গোলকের। গভীরতায় দৃষ্টিপাত করে, বিষাদ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে সে ঘোষণা করবে যে, একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক বালককে সুলতান হিসাবে বরণ করে নিতে তারকারাজির সম্মতি নেই। অমাত্যগণ ভূগর্ভস্থ সমাধিকক্ষের সাতসেঁতে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালে অন্যেরা ঢালু গলিপথে ঠাসাঠাসি করে। অভ্যন্তরের ভারী বাতাসে মানুষের ঘামের গন্ধ ভুরভুর করে। ভীড়ের চাপে বাবরের দু’হাত নাড়াবার জায়গা থাকে না। মোল্লা মৃদুকণ্ঠে মোনাজাত শুরু করে। কিন্তু শীঘ্রই তার কণ্ঠস্বর তীব্রতা লাভ করে সমাধিকক্ষের অভ্যন্তরে ভাসতে থাকলে ভয়ের একটা শীতল স্রোত বাবরের মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে যায়। সে একটা বদ্ধস্থানে অবস্থান করছে। কোনো শত্রু যদি এখন হামলা করতে মনস্থ করে? সে তার মানসপটে নিজের দ্বিখণ্ডিত গলা থেকে রক্ত ছিটকে জেড পাথরের শবাধারের নার্গিস আর টিউলিপের জটিল অলঙ্করণে পড়তে দেখে। সে নিজেকে প্রাণপণে চিৎকার করতে শোনে, কিন্তু গলগল করে বের হতে থাকা রক্তে শ্বাসরুদ্ধ একটা ঘড়ঘড় শব্দ ভেসে আসে।

মূর্চ্ছাপ্রবণতা আর বিবমিষা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। বাবর চোখ বন্ধ করে প্রাণপণে নিজেকে সামলে নিতে চায়। অল্পবয়সের অনভিজ্ঞতা আর এখনও অজাতশত্রু হওয়া সত্ত্বেও, তাকে প্রাপ্তবয়স্ক একজন পুরুষের ভূমিকা পালন করতে হবে। ফারগানার মসনদ তার হবে যদি সে আগামী কয়েক ঘণ্টা, সাহসিকতার সাথে নিজের ভূমিকা পালন করতে পারে। তৈমূরের রক্ত তোমার ধমনীতে বহমান। সে তার বাবার প্রায়শই অসীম গর্বের সাথে উচ্চারিত বাক্যটা নিরবে মনে মনে আউড়ায়। শব্দগুলো তার মস্তিষ্কে অনুরণিত হতে থাকলে বহু বহুকাল পূর্বে সংঘটিত মহান গৌরবময় যুদ্ধের আর অনাগত অভিযানের ছবি তার মানসপটে ভেসে উঠে। স্থিরসংকল্পে জারিত মন তার রক্ত শাণিত করে তোলে- এর সাথে যুক্ত হয় কিছু মানুষ তার যুক্তিসঙ্গত দাবি আগ্রাহ্য করতে চায়, সেই ক্রোধ।

অন্তেষ্টিক্রিয়ার শোভাযাত্রা নিয়ে রওয়ানা হবার ঠিক আগমুহূর্তে খুতলাঘ নিগার বাবরের আলখাল্লার বেগুনী রঙের পরিকরে যে রত্নখচিত বাঁটযুক্ত খঞ্জরটা খুঁজে দিয়েছে সেটার ভার অনুভব করে এবং সেটার বাঁটে আঙ্গুল চেপে বসতে তার শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসে। চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে সে চারপাশে তাকায়। ওয়াজির খানের লোকেরা সমাধি গর্ভে উপস্থিত আছে। তারা নিশ্চয়ই আততায়ীর হাতে তাদের শাহজাদার কোনো ক্ষতি হতে দেবে না। নাকি তারাও বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে? প্রহরীদের মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারে তাদের কারো সম্বন্ধেই তার কোনো ধারণা নেই। মাত্র গতকালও পরিবারের প্রতি তাদের আনুগত্যের বিষয়টা তার কাছে ছিলো প্রশ্নাতীত। কিন্তু আজ পুরো বিষয়টাই পাল্টে গিয়েছে। তার আঙ্গুল খঞ্জরের বাঁট আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে।

সে জোর করে তার মনোযোগ আবার মোল্লার উপরে নিবদ্ধ করে। যিনি তার গভীর, সুরেলা কণ্ঠে তেলাওয়াত করছেন: “আল্লাহ পরম করুণাময়। আমাদের সুলতান উমর-শেখের আত্মা যেন বেহেশতের উদ্যানে এখন অধিষ্ঠিত থাকে। আমরা যারা তার পেছনে রয়ে গিয়েছি তাদের বিষণ্ণতা যেন মুক্তোবিন্দু হয়ে ঝরে এবং আমরা যেন এটা ভেবে উল্লসিত বোধকরি যে আমাদের সুলতান এখন পরম প্রশান্তির বারিধারা পান করছেন।” সে মোনাজাত শেষ করে এবং হাত ভাঁজ করে নিয়ে শবাধার থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ঢালু করিডোর দিয়ে উপরে উঠতে শুরু করলে, দর্শনার্থীরা বহুকষ্টে দু’পাশে ভাগ হয়ে গিয়ে তাকে বাইরে যাবার পথ করে দেয়।

বাবর এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে এবং তার প্রিয় আব্বাজানকে নিরবে বিদায় জানায়। তারপরে কোনোমতে অশ্রু চেপে রেখে সে মোল্লাকে অনুসরণ করে চোখ পিটপিট করতে করতে সূর্যালোকে বের হয়ে আসে। বাম কান ঘেষে উড়ন্ত পাখির ডানা ঝাপটানোর মতো একটা শব্দ তাকে চমকে দিতে সে লাফিয়ে পেছনে সরে আসে। বাজপাখি দিয়ে কেউ এই অসময়ে শিকার করছে? সে চারপাশে ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখতে চায় ফারগানার সুলতানকে তার সমাধিসৌধে অন্তিম শয়ানে শায়িত করার সময়ে বাজপাখি উড়ায়, কার এতবড় স্পর্ধা। বাঁকানো ঠোঁটে শিকারের খুবলে নেয়া অংশ এবং পায়ের নখে রেশমের বেণী করা ফিতে ঝোলানো, উজ্জ্বল চোখ আর গলায় অলঙ্কৃত কলারের কোনো পাখি সে দেখতে পায় না। তার বদলে নীল কালো পালকশোভিত, লম্বা শরযষ্টির একটা তীর বাবরের পায়ের কাছে মাটিতে গাঁথা অবস্থায় তিরতির করে কাঁপছে। আর কয়েক ইঞ্চি তাহলেই তীরটা তার দেহে বিদ্ধ হতো।

উপস্থিত লোকজনের ভিতরে আতঙ্কিত শোরগোল শুরু হয় এবং হুড়োহুড়ি করে ঝোপঝাড় আর গাছের পেছনে আশ্রয় নিতে ছুটোছুটি আরম্ভ করার আগে, সবাই বিভ্রান্ত চোখে আকাশের দিকে তাকায় যেন বিকেলের আকাশ অন্ধকার করে এক পশলা তীর তাদের এখনই বিদ্ধ করবে। গোত্রপতিরা নিজ নিজ অনুচরকে ঘোড়া আনতে বলে, ধনুক আর তূণীরের দিকে হাত বাড়ায়। ভোজবাজির মত ওয়াজির খান কখন যেন বাবরের পাশে এসে দাঁড়িয়ে, নিজের দেহ দিয়ে তাকে আড়াল করে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারপাশের দৃশ্যপট জরিপ করছে। আশেপাশের বিরান সমভূমিতে লুকিয়ে থাকার জায়গা অল্পই আছে, কিন্তু একটা নিঃসঙ্গ পাথর বা বিচ্ছিন্ন ঝোঁপের পেছনে সহজেই একজন আততায়ী ধনুর্ধর লুকিয়ে থাকতে পারে যার হাতে রয়েছে। কসাইয়ের নিপূণতা আর অন্তরের হত্যার জীঘাংসা। ওয়াজির খান তার দাস্তানা পরা। হাত দিয়ে জোরাল একটা ইঙ্গিত করতেই অশ্বারোহী প্রহরীদের একটা দল সম্ভাব্য আততায়ীর খোঁজে বেরিয়ে পড়ে।

“শাহজাদা, এই মুহূর্তে আপনার প্রাসাদে ফিরে যাওয়া উচিত।”

বাবর তখনও সম্মোহিতের দৃষ্টিতে তীরটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। “দেখো,” সে ঝুঁকে মাটিতে গেঁথে থাকা তীরটা তুলে নিয়ে বলে, “পালকের চারপাশে কিছু একটা আটকানো রয়েছে।” সে মোটা লাল সূতার বাঁধন ছিঁড়ে ফেলে যা পার্চমেন্টের একটা টুকরো তীরের সাথে আটকে রেখেছিল এবং সেটাতে লেখা হুমকির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মাতৃভাষা তুর্কীতেই চামড়ার ফালিতে লেখা রয়েছে কিন্তু অক্ষরগুলো তার চোখের সামনে লাফাতে থাকার কারণে তার এক মুহূর্ত সময় লাগে লেখাটার অর্থ উপলব্ধি করতে।

ওয়াজির খান পার্চমেন্টটা তার হাত থেকে কেড়ে নেয় এবং তাতে যা লেখা রয়েছে সেটা উচ্চকণ্ঠে পড়ে শোনায়: “পৃথিবীর অধিশ্বর পরাক্রমশালী সাইবানি খান তার শুভেচ্ছা পাঠাচ্ছে। তিন চন্দ্রমাসের সময় অতিক্রান্ত হবার আগেই তিনি ফারগানা নামে পরিচিত খোয়াড়ের দখল বুঝে নিয়ে এর সিংহাসন মূতে ভাসিয়ে দেবেন।”

“বেজন্মা উজবেক,” অবজ্ঞার সাথে একজন সৈনিক চেঁচিয়ে উঠলেও, বাবর তার চোখে আশঙ্কার মেঘ জমা হতে দেখে।

“এসবের অর্থ কি?” শাহী জ্যোতিষী হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এসে ওয়াজির খানের হাত থেকে চামড়ার টুকরোটা ছিনিয়ে নেয়। বাকী বেগ হুমকিটা পড়ে এবং বাবর তাকে আঁতকে উঠে সশব্দে শ্বাস নিতে শুনে। ছোটখাট মানুষটা পায়ের ডিমের উপরে দাঁড়িয়ে, মুষ্টিবদ্ধ হাতে সামনে পেছনে দুলতে শুরু করে এবং তার কীচকী কণ্ঠ থেকে একটা বিলাপ উথলে উঠে: “সাইবানি খান আসছে, সেই এলাচি খুনী…আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি…সে একটা বিশাল কালো ঘোড়ার পিঠে বসে রয়েছে যার খুরের দাপটে মানুষের খুলি গুঁড়িয়ে যাচ্ছে।” তার বিলাপ এবার চিল চিল্কারে পরিণত হয়: “সাইবানি খান আসছে! তার পেছনে ধেয়ে আসছে মৃত্যু আর মহামারী!”

কামবার আলীও ইতিমধ্যে বাবরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তার পেছনেই আছে শাহী কোষাধ্যক্ষ আর বাজারসরকার। তারা তিনজনই মাথা নাড়তে থাকে। “অন্তেষ্টিক্রিয়ার ভোজ শেষ হবার পরে আজ রাতেই শাহী পরামর্শকের দল বৈঠকে বসবে। সাইবানি খান মিথ্যা হুমকি দেবার পাত্র না,” উজির বলেন। ইউসুফ আর বাবা কাশক প্রবল বেগে মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করে। তাদের সাথে এবার বাকী বেগও তাল মিলিয়েছে।

ওয়াজির খান সম্মতি প্রকাশের কোনো ধরণের অভিব্যক্তি করা থেকে বিরত থাকে। তার বদলে সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কামবার আলীর দিকে তাকিয়ে থাকলে উজির বেচারা অস্বস্তির ভিতরে পড়ে। “শ্রদ্ধেয় উজির, জনগণকে শান্ত করতে আপনি নিশ্চয়ই তাদের উপরে আপনার সন্দেহাতীত প্রভাব খাটাবেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমার সৈন্যরা আপনার তত্ত্বাবধায়নে সদা প্রস্তুত থাকবে।”

“তোমার কথা যুক্তিসঙ্গত, ওয়াজির খান। আবারও তোমাকে ধন্যবাদ জানাই।” কামবার আলী তার পাগড়ী পরিহিত মাথাটা কাত করে কথাটা বলে দ্রুত বিদায় নিলে অন্যান্য অমাত্যরা পঙ্গপালের মত তাকে অনুসরণ করে। বাবর শুনতে পায় বাকী বেগ তখনও আসন্ন বিপর্যয় সম্পর্কে বিড়বিড় করছে, দমকা হাওয়ার মত বিরক্তি তাকে ঘিরে ধরে। সে একবার শুধু মসনদে অধিষ্ঠিত হোক, এই মেরুদণ্ডহীন ক্লিবটাকে দূর করে অন্য কোনো যোগ্য ব্যক্তিকে তার ব্যক্তিগত জ্যোতিষী হিসাবে নিয়োগ করবে। তার বাবা কেন এই লোকটাকে এত খাতির করতেন সেটা তার কাছে একটা রহস্য- আসলেই এত জ্যোতিষী থাকতে এই অপদার্থটাকে কেন বেছে নিয়েছিলেন। বাকী বেগের পরিবার হয়ত কখনও তার উপকার করেছিলো, যার প্রতিদান দেয়াকে তিনি নিজের কর্তব্য বলে বিবেচনা করেছিলেন।

আপাতত আক্রমণের আর কোনো সম্ভাবনা না থাকায়, শবানুগামীরা ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে আলখাল্লার ধূলো ঝাড়তে ঝাড়তে বের হয়ে আসে। সাইবানি খানের নাম মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তেই, বাবর তাদের কাউকে এমন আর্তস্বরে বিলাপ করতে শোনে, যেন তাদের ভবিতব্য ইতিমধ্যে নির্ধারিত হয়ে গেছে। সে ঘাড় উঁচু করে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে তাদের অজান্তে সূর্যকে ঢেকে দিয়ে দিগন্তের উপর দিয়ে মেঘের দল উড়ে এসে মাথার উপরে জড়ো হয়েছে। নিজের ঊর্ধ্বমুখী কপালে সে বৃষ্টির ফোঁটা অনুভব করে।

“শাহজাদা।” ওয়াজির খান আবার তাকে ধরে ঝাঁকি দেয় এবার এত জোরে যে তার মনে হয় কাঁধের কাছ থেকে পুরো হাতটাই খুলে আসবে। কণ্ঠস্বরে জরুরি ভাব ফুটিয়ে সে ফিসফিস করে কথা বলে: “সাইবানি খানের হুমকি। তার পক্ষে এটা কিভাবে সম্ভব? পাহাড়ের অন্যপ্রান্তে এত দ্রুত সুলতানের মৃত্যুর খবর সে কিভাবে পেলো। আমার মনে হয় এটা ভেতরের কারো কাজ, সম্ভবত কামবার আলীর যোগসাজশে এটা ঘটান হয়েছে। সে সম্ভবত আপনাকে খুন করার পায়তারা করছে। নিদেনপক্ষে, সে মানুষের মনে একটা আতঙ্কের জন্ম দিতে চায়, যাতে একজন কিশোরকে সুলতান হিসাবে গ্রহণ করার ব্যাপারে তাদের ভিতরে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। কিন্তু এতে আমাদের পরিকল্পনার কোনো হেরফের হবে না। দূর্গের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। পথে কোনো কারণে বা কারো জন্য ঘোড়ার গতি হ্রাস করবেন না। আমি যতদ্রুত পারি আপনাকে অনুসরণ করছি।”

ওয়াজির খানের উদ্বেগ বাবরের ভিতরেও সংক্রামিত হয়। সে তার ঘোড়া নিয়ে আসতে বলে এবং দ্রুত পর্যাণে উপবিষ্ট হয়। এক মুহূর্তের জন্য ওয়াজির খান তার ঘোড়ার লাগাম ধরে থাকে। “শাহজাদা, আর কয়েক ঘণ্টা তারপরে সব ঠিক হয়ে যাবে,” সে বলে। তারপরে, দেহরক্ষী বাহিনীর একটা দলকে বাবরের সাথে যাবার নির্দেশ দিয়ে সে ঘোড়ার মসৃণ পশ্চাদ্ভাগে একটা চাপড় বসিয়ে দিতে ঘোড়ার খুরে ছন্দের বোল উঠে।

বৃষ্টি আরো জোরে পড়তে শুরু করলে এবং বাড়ন্ত ঘাসের ঝোঁপের মাঝ দিয়ে দুলকি চালে এগিয়ে যাবার সময়ে, বাবর কাঁধের উপর ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। সে কামবার আলীকে উত্তেজিত জনতার মাঝে দু’হাত উঁচু করে এগিয়ে যেতে দেখে। সে আসলে কি চায়? তাদের শান্ত করতে না উত্তেজনা আরো উসকে দিতে? তার সহজাত প্রবর্তনা বলছে ওয়াজির খানের বিশ্লেষণে কোনো ফাঁক নেই: যে দুরাত্মার হাত তীরটা ছুঁড়েছে সেটা কোনো উজবেকের হাত হতে পারে না।

বাবর তার ফারের মোটা ওভারটিউনিকের পকেটের গভীরে হাত দিয়ে তীরটা বের করে নিয়ে আসে। ঘোড়ার লাগাম দাঁতে কামড়ে ধরে সে তীরটা দ্বিখণ্ডিত করে এবং চরম অবজ্ঞার সাথে সেটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে। দ্বিখণ্ডিত তীরটা মাটিতে পড়ে থাকা ভেড়ার লাদির উপরে গিয়ে পড়ে।

***

“বাছা, কেমন অভিজ্ঞতা হল।” খুতলাঘ নিগারের চেহারায় পরিশ্রান্তভাব, অবিরাম কান্নার কারণে চোখ রক্তজবার মত লাল। হারেমের অনেক ভেতর থেকে বাবর চাপাকান্না ভেসে আসার শব্দ শোনে। মৃত সুলতানের জন্য হারেমের সবাই শোকের কৃত্যানুষ্ঠান পালন করছে। বিষাদের এই রোলের ভিতরে অদ্ভুত একটা ঐক্যতান রয়েছে, যেন কোনো মহিলাই সাহস পায় না প্রথমে কান্না থামাবার।

“সবকিছু নির্বিঘ্নে সমাপ্ত হয়েছে।” সে সিদ্ধান্ত নেয় আম্মাজানকে তীরের কথা বলবে না- অন্তত এখনই না। জীবনে এই প্রথম সে মায়ের কাছে কিছু গোপন করলো। কিন্তু তার প্রাণ সংশয় দেখা দিয়েছিলো এটা জানতে পারলে তিনি আতঙ্কিত হয়ে উঠবেন।

“আর তোমার মরহুম আব্বাজান। তিনি শান্তিতে সমাহিত হয়েছেন?”

“হ্যাঁ, মা। আমরা সবাই তার জন্য মোনাজাত করেছি, তাকে যেন বেহেশত নসীব করা হয়।”

“এবার তাহলে দুনিয়াদারির কাজের তদারকি শুরু করতে হয়।” খুতলাঘ নিগার হাতে তালি দিলে, তার ব্যক্তিগত পরিচারিকা ফাতিমা ছায়ার ভেতর থেকে বের হয়ে আসে। তার হাতে হলুদ রেশমের উপরে সোনা আর রূপার জরি দিয়ে ফুলের নক্সা তোলা একটা আলখাল্লা আর একই কাপড়ের একটা পাগড়ি যার উপরে একটা ময়ূরের পালক গোঁজা রয়েছে। খুতলাঘ নিগার বিম্র চিত্তে আলখাল্লাটা তার হাত থেকে নেয়। “এটা ফারগানার সুলতানদের মসনদে অভিষেকের আলখাল্লা। এর আমেজ অনুভব করো, এটা এখন তোমার।”

বাবর হাত বাড়িয়ে ভাঁজ করা চকচকে আলখাল্লাটা স্পর্শ করে এবং গর্বের একটা শিরশিরে অনভূতি তার ভিতরে ছড়িয়ে যায়। সুলতানের আলখাল্লা- তার আলখাল্লা। রেশমের শীতল পরশ তার আঙ্গুলের ডগায় ছড়িয়ে পড়ে।

তার স্বপ্নবেশের চটকা ঘোড়ার খুরের সম্মিলিত বোলে ভেঙে যায়। বাবর জানালা থেকে নিচের বৃষ্টিস্নাত আঙ্গিনার দিকে তাকায়। সন্ধ্যে প্রায় হয়ে এসেছে এবং রাত্রির প্রস্তুতি হিসাবে ইতিমধ্যে মশাল জ্বালান হয়েছে। সে ওয়াজির খান আর মোল্লাকে ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় দূর্গে প্রবেশ করতে দেখে। তাদের ঘোড়াগুলো ঘন ঘন নাক টানে আর তাদের গা থেকে ভাপ বের হয়। শীঘ্রই বাকি শবানুগামীরা দূর্গে ফিরে আসবে আর তারপরেই তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাহেন্দ্রক্ষণ যা তাকে এই আলখাল্লা পরিধানের অধিকার দান করবে। বাবর মুখ তুলে তার মায়ের দিকে তাকায়। তার চোখে শঙ্কার ছায়া ফুটে থাকলেও অভিব্যক্তিতে দৃঢ়তার ছাপ। “জলদি করো,” খুতলাঘ নিগার বলেন। “আমাদের হাতে সময় বড় কম। আলখাল্লাটা তোমার বড় হবে কিন্তু এটা দিয়েই আমাদের কাজ চালিয়ে নিতে হবে।” তিনি ফাতিমার সাহায্যে বাবরের গায়ে আলখাল্লাটা পরিয়ে পরিকর দিয়ে সেটা শক্ত করে কোমরের কাছে বেঁধে দেন এবং তার পরে তার মাথার লম্বা কালো চুলে পাগড়িটা পরান। “দেখি আমার ছেলেকে? এই মুহূর্তে তুমি কেবল একজন শাহজাদা বটে, কিন্তু চাঁদ উঠার পরেই তুমি হবে ফারগানার সুলতান।” তিনি তার সামনে একটা চকচকে পিতলে বাঁধান আয়না তুলে ধরলে বাবর সেখানে নিজের। কঠোর, হয়তো সামান্য বিস্মিত মুখের প্রতিবিম্ব ফুটে উঠতে দেখে।

“খানজাদা!” তার মা চেঁচিয়ে বাবরের বোনকে ডাকেন। মসনদের দাবি ঘোষণার সময়ে বাবরের পোশাক এবং অন্যান্য অনুষঙ্গ কি হবে সে বিষয়ে স্পষ্টতই বোঝ যায় তিনি যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা করেছেন। তার বোন বাইরে অপেক্ষা করছিল এবং করিডোরে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করে মায়ের ডাকের প্রতীক্ষায় ছিল। সে দ্রুত কামরার ভিতরে প্রবেশ করে। সবুজ মখমলে মোড়ান একটা লম্বা, সরু বস্তু তার হাতে ধরা। যত্নের সাথে সে তার হাতের জিনিসটা নামিয়ে রেখে সামান্য নাটকীয় ভঙ্গিতে মখমলের ভাজটা সরিয়ে ভেতরের কোষ থেকে একটা বাঁকান তরবারি বের করে আনে।

খুতলাঘ নিগার সেটা নিয়ে বাবরের দিকে বাড়িয়ে ধরেন। “ফারগানার প্রতীক, ন্যায়বিচারের তরবারি- আলমগীর।”

সাদা জেড পাথরের উপরে নানা দামী রত্নে খচিত ঈগলের মাথার মত বাঁটটা দেখামাত্র বাবর চিনতে পারে। পাখিটার বিস্তৃত ডানা মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের বিভঙ্গ লাভ করেছে আর বাঁটের উপরে উঁচু হয়ে থাকা চুনির চোখ সম্ভাব্য আক্রমণকারীর দিকে শাণিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। তার মৃত আব্বাজানের হাতে সে বেশ কয়েকবারই এটা দেখেছে তিনি অবশ্য তাকে এটা কখনও স্পর্শ করতে দিতেন না। “প্রথমবারের মত নিজের হাতে ধরতে পেরে বেশ ভাল লাগছে।” সে বাঁটটা ধরে অদৃশ্য শত্রুর উদ্দেশ্যে সেটা কয়েকবার বাতাসে আন্দোলিত করে।

“তোমার বাবার রেখে যাওয়া সম্পদের ভিতরে এটা অন্যতম। লোকে বলে চোখের চুনি দুটো তৈমূরের, তিনি দিল্লী থেকে পাথর দুটো নিয়ে এসেছিলেন। ফারগানার নতুন সুলতান হিসাবে এখন থেকে তুমি এগুলোর মালিক।” খুতলাঘ নিগার তার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে তরবারির মণিমুক্তা খচিত খাপটা তার কোমরের সাথে আটকে দেয়, যে ইস্পাতের শিকলের সাহায্যে সেটা ঝুলছে তার দৈর্ঘ্য ঠিক করে দেয়।

“নানিজান কোথায়?” এসান দৌলতকে আশেপাশে কোথাও দেখা যায় না এবং বাবর এই সময়ে তার উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভব করে। সে মনে মনে চায় তিনি তাকে সুলতানের এই বেশে দেখুক তাকে অবিকল সুলতানের মত দেখাচ্ছে বলে মন্তব্য করুক।

“তিনি নামাজে বসেছেন। তিনি বলেছেন ফারগানার সুলতান হিসাবে তিনি তোমাকে স্বাগত জানাবেন।”

এক মহিলা ভৃত্য ভিতরে প্রবেশ করে প্রণত হয়। “মালিক, ওয়াজির খান সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থনা করেছেন।”

খুতলাঘ নিগার মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়। তিনি আর খানজাদা নেকাবের নিম্নাংশ দিয়ে মুখ ঢাকতে না ঢাকতে ওয়াজির খান ভিতরে প্রবেশ করে। বাবর খেয়াল করে, এইবার সে প্রণত হয় না- সময় এত গুরুত্বপূর্ণ যে সেসব সৌজন্য প্রকাশের আবশ্যিকতা নেই। দীর্ঘদেহী সেনাপতি শাহী আলখাল্লা পরিহিত বাবরের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে সন্তুষ্টির সাথে মাথা নাড়ে। “মহামান্য শাহী পরিবার, মোল্লা আর আমার সৈন্যরা কর্তব্য পালনে প্রস্তুত। কিন্তু, এই মুহূর্তে, কামবার আলীও অন্তে যষ্টিক্রিয়ার ভোজপর্ব শেষে উপস্থিত শোকাহত অভ্যাগতদের সামনে বক্তৃতা দেবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে তাদের বলবে যে রাজ্য বিপর্যয়ের সম্মুখীন, আর এই বিপর্যয় সামাল দেবার পক্ষে আমাদের সুলতানের বয়স অনেক অল্প। সে তৈমূরের বংশের অন্য কোনো শাহজাদাকে রাজপ্রতিভূ হিসাবে মনোনীত করতে অনুরোধ করবে। গতরাতে মোঘুলিস্তানের খানের কাছে তার পাঠান একটা চক্রান্তপূর্ণ চিঠি আমার প্রহরীদের হস্তগত হয়েছে, যার বিষয়বস্তু তাকে মসনদে অধিষ্ঠিত করান, এছাড়াও উজিরের কুটিল ষড়যন্ত্রের অন্যান্য প্রমাণ আমাদের হাতে রয়েছে।”

“কিন্তু আমাদের হাতে এখনও সময় আছে?” খুতলাঘ নিগার হারেমের রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে ওয়াজির খানের বাহু আঁকড়ে ধরে ব্যগ্র কণ্ঠে জানতে চান।

“আমাদের হাতে সময় আছে, কিন্তু শাহজাদাকে এখন আমার সাথে যেতে হবে নতুবা কামবার আলী আমাদের আসল উদ্দেশ্য বুঝে ফেলতে পারে। সে ভেবে বসে আছে শাহজাদা দূর্গে ফিরে এসে আপনার সাথে বসে দোয়া’দরূদ পাঠ করছেন।”

সে এবার বাবরের দিকে তাকায়। “শাহজাদা, অন্য আরেকটা আলখাল্লা দিয়ে নিজেকে অনুগ্রহ করে আবৃত করে নিন।” সে তার হাতে ধরা বাবরের ঘোড়ায় চড়ার ধূলি ধূসরিত আলখাল্লাটা তার দিকে এগিয়ে দিলে বাবর দ্রুত সেটা গায়ে চাপিয়ে নেয়, আর তার আম্মিজান দক্ষ হাতে আলখাল্লার ধাতব বাকলেসগুলো আটকে দিয়ে অভিষেকের পাগড়ির ঢেউতোলা শোভাবর্ধক পালকটা শিরাবরণী দিয়ে ঢেকে দেয়।

তরবারির বাঁটে হাত রেখে ওয়াজির খান বাবরকে তার পেছনে পেছনে বাইরের করিডোরে আসতে ইঙ্গিত করে ঘুরে দাঁড়ায়। খানজাদার পাশ দিয়ে এগিয়ে যাবার সময়ে সে আঙ্গুল দিয়ে ভাইয়ের চিবুকে হাত বুলিয়ে দেয়। তার বোনের চোখে আশঙ্কার ছায়া ভারী উপস্থিতি।

আতপ্ত আর উল্লাসের যুগপৎ উপস্থিতি বাবর নিজের ভিতরে অনুভব করে। আজ সন্ধ্যার ঘটনাবলীর উপরে তার পুরো ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। বৃদ্ধ উজিরের ধূর্ততা ছোট করে দেখবার কোনো অবকাশ নেই। ওয়াজির খান সম্ভবত তার এই আশঙ্কা টের পেয়ে মুহূর্তের জন্য দাঁড়ায়। “শাহজাদা, সাহস রাখেন, সব ঠিক হয়ে যাবে।” “সাহস।” বাবর শব্দটা বিড়বিড় করে উচ্চারণ করার ফাঁকে তরবারির অলংকৃত বাটে আঙ্গুল বুলায়।

তারা অন্ধকারাচ্ছন্ন গলিপথ, তীক্ষ্ণ ধাপযুক্ত প্যাচান সিঁড়ির কুলঙ্গিতে রাখা তেলের প্রদীপের আলোয় কিম্ভুতকিমাকার ছায়ার জন্ম দিতে দিতে দ্রুত এগিয়ে যায়। দূর্গের সবচেয়ে প্রাচীন অংশে মসজিদটা অবস্থিত, বাবরের পূর্বপুরুষদের আদেশে পেছনের পাথুরে পাহাড় খোদাই করে এটা নির্মাণ করা হয়েছে। গুহা-সদৃশ্য পাথুরে প্রকোষ্ঠ কেয়ামত পর্যন্ত টিকে থাকবে- রোদে পোড়ান মাটির ইটের তৈরি ছাদের মত ভঙ্গুর না, যা ধ্বসে পড়ে তার পিতাকে বেহেশতের পথে নিয়ে গিয়েছে।

মসজিদের সামনের ছোট শান্ত উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ওয়াজির খানকে অনুসরণ করে সে উপস্থিত হয়। বৃষ্টি থেমে গিয়েছে এবং মেঘের আড়াল ছেড়ে চাঁদ বের হয়ে এসেছে। চাঁদের শীতল খাপছাড়া আলোতে সে ওয়াজির খানের ছয়জন প্রহরীকে মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। তারা নিরবে তাদের সেনাপতিকে অভিবাদন জানায়।

বাবরকে বাইরে অপেক্ষা করার জন্য অনুরোধ করে ওয়াজির খান কোরানের আয়াত উত্তীর্ণ করা তীক্ষ্ণ শীর্ষদেশযুক্ত বাঁকান তোরণাকৃতি খিলানের নীচ দিয়ে মসজিদের ভিতরে প্রবেশ করে। উল্কণ্ঠিত কয়েক মুহূর্ত অতিক্রান্ত হবার পরে সে বাইরে বের হয়ে আসে। “মহামান্য শাহজাদা,” সে মৃদু কণ্ঠে বলে, “আপনি এবার ভিতরে প্রবেশ করতে পারেন।”

বাবর তার উপরের আলখাল্লা খুলে ফেলে ভিতরে প্রবেশ করে। মক্কাশরীফের দিকে মুখ করা মিহরাবের দুপাশে দুটো মশাল জ্বলছে, যেখানে দাঁড়িয়ে ইমাম সাহেব নিরবে নামাজ আদায় করছেন। আবছা আলোতে বাবর প্রায় বিশজনের মত গোত্রপতিকে আসনসিঁড়ি অবস্থায় বসে থাকতে দেখে, প্রতিটা লোক, গোত্রগত মৈত্রীর বন্ধন আর রক্তের সম্বন্ধের কারণে তার প্রতি বিশ্বস্ততা ঘোষণা করতে প্রস্তুত।

মসজিদের ভিতরে উপস্থিত প্রত্যেকের চোখের দৃষ্টি তার উপরে আপতিত, তাকে মাপছে বুঝতে পেরে, বাবর অতীতে- যারা ফারগানার সুলতান ছিলেন তাদের ওজন নিজের উপরে ভারী হয়ে চেপে বসছে অনুভব করে, মনে হয় তার কাঁধ সেই ভারের চাপে বেঁকে যাচ্ছে। বাবর মসজিদের মেঝেতে কালো পাথরে চিহ্নিত স্থানের দিকে এগিয়ে গিয়ে যেখানে তার পিতা ফারগানার মরহুম সুলতান নামাজ পড়তেন সেখানে আনত হয়ে পরম শ্রদ্ধায় পাথরের শীতল মেঝেতে কপাল স্পর্শ করে। বাইরের তারকাশোভিত আকাশে একটা প্যাচা তীক্ষ্ণ শব্দ করে উড়ে যেতে, ইমামসাহেব খুতবা পাঠ আরম্ভ করেন, যে নসিহতে বাবরকে আল্লাহতালা আর পৃথিবীর সামনে ফারগানার সুলতান হিসাবে অভিহিত করা হবে।

***

“আপনারা বুঝতেই পারছেন, সম্মানিত ভদ্ৰোমহোদয়গণ, এই বিষয়ে আমাদের বিবেচনার সামান্যই অবকাশ রয়েছে। কামবার আলী তার চেহারায় যথোচিত গম্ভীর হালছাড়া একটা অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলে। “এমন কি আজই, আমাদের মহামান্য মরহুম সুলতানের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময়েই, উজবেক হার্মাদ সাইবানি খান নরকে যেন স্থান হয় বেজন্মাটার- আমাদের হুমকি দেবার মত ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। কেবল কুটিল উজবেকরাই না, আমাদের রাজ্যের প্রতি আরও অনেকের লোলুপ দৃষ্টি আছে। এই রাজ্য পরিচালনা আর রক্ষা করতে চাইলে শাহজাদা বাবরের মত অল্পবয়সী কিশোরের পরিবর্তে পাশ্ববর্তী রাজ্যের কোনো অভিজ্ঞ শক্তিশালী ব্যক্তিকে আমাদের বেছে নিতে হবে। আমরা কাকে নির্বাচিত করবো সেটা এখনই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না… আজ রাতের কোনো এক সময়ে শাহী মন্ত্রণা পরিষদ বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করার জন্য মিলিত হবে।”

কামবার আলী তার চারপাশে তাকিয়ে বর্গাকার প্রস্তরখণ্ডের মেঝের উপরে নিচু কাঠের টেবিলের পেছনে তাকিয়ার উপরে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে থাকা গোত্রপতিদের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বরের ফিসফিস গুঞ্জন শোনে। কি পরিতাপের বিষয় তার বেল্লিক তীরন্দাজ বাবরকে শরবিদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

শাহী দরবারের অন্য সদস্যরা, ইউসুফ, বাবা কাশক, এবং বাকী বেগও চুপ করে দেখে আর অপেক্ষা করে, তাদের সবাই নিজ নিজ পৃষ্ঠপোষককে রাজপ্রতিভূ হিসাবে নিয়োগ দিয়ে প্রাপ্ত উপঢৌকনের সম্ভাব্য পরিমাণ বিশ্লেষণের সুখস্বপ্নে বিভোর।

“আল্লাহ সাক্ষী, এটা হতে পারে না!” ফারগানার পশ্চিমাঞ্চল থেকে আগত গোত্রপতি আলী-দোস্তের কর্কশ কণ্ঠস্বর কামবার আলীর স্বপ্নচারিতায় বিঘ্ন ঘটায়। কাঠবাদামের সসে ঝলসানো আস্ত ভেড়া রাখা কাঠের অস্থায়ী টেবিলের উপরে আলী- দোস্ত সজোরে ঘুসি বসিয়ে দেয়। তার হাতে ধরা তেল চর্বি মাখান মাংস কাটার ছুরিটা সে বাতাসে আন্দোলিত করে। “শাহজাদার বয়স রাজ্য পরিচালনার পক্ষে নিতান্তই অল্প কথাটা সত্যি, আর তাই বলে আগন্তুকের দ্বারস্থ হতে হবে। আমি তৈমূর বংশের সন্তান। আমার বাবা ছিলেন মৃত সুলতানের রক্ত-সম্পর্কের ভাই। আমি একজন পরীক্ষিত যোদ্ধা- গত শীতেই প্রথম তুষারপাতের পরে আমি নিজ হাতে বিশজন উজবেককে হত্যা করেছি আমাদের গবাদি পশুর পালে হামলা করার সময়ে…?! রাজপ্রতিভূ নিযুক্ত করতে হলে আমার চেয়ে যোগ্য কাউকে খুঁজে পাবে না ভেড়ার চর্বি লেপটানো আবেগে লাল হয়ে উঠা মুখে, সে গনগনে চোখে কামরায় উপস্থিত সবার দিকে তাকায়।

“ভাইয়েরা, শান্ত হোন।” বাকী বেগ হাত তোলে সবাইকে শান্ত করার অভিপ্রায়ে কিন্তু কেউ তার বাক্যে কর্ণপাত করে না।

আলী-দোস্ত হাচড়পাঁচড় করে উঠে দাঁড়াতে, তার লোকেরা ক্রুদ্ধ মৌমাছির মত বিড়বিড় করতে করতে তার চারপাশে এসে সমবেত হয়। কিছুক্ষণের ভিতরেই একের পর এক গোত্রপতি নিজের স্বপক্ষে অকাট্য দাবি আর মসনদে নিজের অধিকার জানিয়ে উঠে দাঁড়াতে আরম্ভ করে। আলী-দোস্ত তার গামলার মত হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে তাকে অপমান করেছে ভেবে নিয়ে পাশে দাঁড়ানো একটা লোককে আঘাত করতে চেষ্টা করে এবং লোকটা উল্টে পরতে সে এবার অন্য হাতে ধরা মাংস কাটার ছুরির ডগাটা তার গলায় ঠেকায়। কাঠের অস্থায়ী টেবিলের উপরে কিছুক্ষণ আগে পরিবেশন করা ঘিয়ে ভাজা শুকনো বাদাম দিয়ে রান্না করা মুখরোচক বিরানী আশেপাশের তাকিয়ার উপরে ছিটকে পড়তে শুরু করে।

কামবার-আলী কামরার দূরবর্তী প্রান্তে নিরাপদ স্থানে দাঁড়িয়ে কামরায় বিদ্যমান বিশৃঙ্খলার দিকে তাকিয়ে থাকেন, তার অভিব্যক্তিতে বিষণ্ণতার কোনো চিহ্ন পরিলক্ষিত হয় না। এসব তথাকথিত যোদ্ধারা সব বাচ্চা ছেলের মত একটা ভেড়া- বা একটা মেয়ে মানুষের জন্য এরা খুন করতে পিছপা হয় না। ওয়াইনের মাদকতায় শুরু হওয়া এই বিশৃঙ্খলা শীঘ্রই প্রশমিত হবে এবং এর ফলে তার পরামর্শের যৌক্তিকতা আরও বৃদ্ধি পাবে। সে তাকিয়ে দেখে তালুকের মত এক গোত্রপতি আরেকজনের গলা চেপে ধরে শূন্যে তুলে তাকে ইঁদুরের মত ঝকাতে থাকে যতক্ষণ না ভরপেট খাওয়া লোকটা সবকিছু তার মুখে উগড়ে দেয়।

“ফারগানার সুলতানের নামে বলছি এসব বন্ধ করো!”

কামবার আলী চমকে ঘুরে তাকায়। বিশাল দরজার নিচে ওয়াজির খান দাঁড়িয়ে আছে আর তার পেছনে বর্ম-পরিহিত প্রহরীর দল। উজিরের মুখে ফুটে উঠা বিদ্রুপের হাসি, কামরার ভিতরে তাদের অবস্থান গ্রহণের সময়ে প্রহরীদের একজনের ধাক্কায় মাটিতে ছিটকে পড়ার সাথে সাথে অদৃশ্য হয়ে যায়। ক্রুদ্ধ দাঙ্গাকারীরা প্রথমে বুঝতে পারে না কি ঘটছে। প্রহরীরা তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে কোষমুক্ত তরবারি চামড়ার ঢালে আঘাত করতে, শাপশাপান্ত করে, ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে থাকা গোত্রপতিরা পরস্পরকে ছেড়ে দিয়ে থিতু হয়ে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকিয়ে নির্বাক হয়ে যায়।

“নতুন সুলতানকে অভিবাদন জানাবার জন্য প্রস্তুত হও,” ওয়াজির খান কঠোর কণ্ঠে বলে।

“পরিতাপের বিষয়, এটা আল্লাহর ইচ্ছা যে এই মুহূর্তে আমাদের কোনো সুলতান নেই,” উজির মাটি থেকে কোনমতে উঠে দাঁড়িয়ে তার পরণের আলখাল্লার ধূলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলে।

ওয়াজির খান কামবার আলীর শীর্ণ কাধ বজ্রমুষ্ঠিতে চেপে ধরে। “আমাদের সুলতান আছেন। মসজিদে তার নামে খুতবা পাঠ করা হয়েছে। উপস্থিত সবাই এখন মাথা নত কর।” মদের প্রভাবে বিভ্রান্ত লোকগুলো বেকুবের মত তাকিয়ে থাকে। প্রহরীরা দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর মাঝে প্রবেশ করে জোর করে তাদের হাঁটু ভেঙে বসিয়ে দেয় এবং যারা সামান্য গাইগুই করে তাদের হাতের তরবারির চ্যাপ্টা প্রান্ত দিয়ে লাঠির মত আঘাত করে।

“ফারগানার ন্যায়সঙ্গত সুলতান, মির্জা বাবরের জয় হোক,” ওয়াজির খানের কণ্ঠস্বর গর্জে উঠে ঘোষণা করে এবং দেহের মাপের চেয়ে বড় হলুদ আলখাল্লা আর লম্বা মখমলের পাগড়ি মাথায় বাবর ভিতরে প্রবেশ করতে সে নিজেকে তার সামনে প্রণত করে। গোত্রপতিদের যারা তার সালতানাত মেনে নিয়েছে তারা তার পেছনে এসে দাঁড়ায়। সবার চোখে সতর্ক দৃষ্টি, যদি প্রয়োজন পড়ে সেজন্য সবার হাত তরবারির বাঁটে।

বাবরের মনে ক্ষীণ সন্দেহ আছে তারা তার প্রতি বিশেষ কোনো মৈত্রীর বন্ধন অনুভব করে কিনা সেটা নিয়ে। তারা কেবল একটা বাজি ধরেছে। কিন্তু এখন তারা বিজয়ী পক্ষে থাকতে ইচ্ছুক যাতে প্রতিশ্রুত প্রতিদান লাভ করতে পারে।

বিশৃঙ্খলার দিকে তাকিয়ে বাবরের কাছে পুরো দৃশ্যটা হাস্যকর মনে হয়- ভারী শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে থাকা লোকেরা মাটিতে তাকিয়া, মাংসের ঝোল আর পোলাও এ মাখামাখি অবস্থায় পড়ে আছে এবং তাদের পোষা কুকুরের দল হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভোজের সম্মুখীন হয়ে নিজেদের ভিতরে কামড়াকামড়ি করছে। গড়গড় করতে থাকা কুকুরের দলের চেয়ে আন্তরিক বলা যাবে না কামবার আলীর অভিব্যক্তিকে যখন সে ধীরে বাবরের সামনে হাঁটু ভেঙে বসে কপাল মাটিতে ঠেকায়।

“উজির, আর উপস্থিত সবাই এবার উঠে দাঁড়াতে পারেন।” সুলতান হিসাবে বাবর তার প্রথম আদেশ দেয়ামাত্র নিজের ভিতরে সে একটা আন্ত্রিক উত্তেজনা বোধ করে।

কামবার আলী ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়ায়, ভেতরের আতঙ্ক দমনের ব্যর্থ প্রয়াসের লক্ষণ তার চেহারায় স্পষ্ট ফুটে আছে। “সুলতান, আপনার দরবারের সদস্যরা আপনার আদেশ পালনে প্রস্তুত।”

“তাহলে তুমি এটা কিভাবে ব্যাখ্যা করবে- মোঘুলিস্তানের খানের কাছে পাঠান এই আমন্ত্রণপত্র?” বাবর হাত বাড়ালে ওয়াজির খান তার হাতে একটা চামড়ার বাক্স উঠিয়ে দেয়। বাবর ভেতর থেকে একটা কুণ্ডলীকৃত কাগজ বের করে উজিরের চোখের সামনে ধরতে তার ভিতরে কোনো বিকার দেখা যায় না।

“রাজ্যের ভালোর জন্য আমি এটা পাঠিয়েছিলাম।” উজিরের শ্বাস-প্রশ্বাসের বেগ দ্রুত হয়ে উঠেছে।

“নিজের ভালোর জন্য এটা পাঠিয়েছিলে-” ওয়াজির খান ক্রুদ্ধ কণ্ঠে শুরু করতে বাবর হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দেয়। শাসক হিসাবে এটা তার প্রথম পরীক্ষা এবং সে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে চায় নতুবা আগামীকাল, আগামী মাসে বা আগামী বছর কোনো না কোনো সময়ে তাকে তার জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ষড়য়ন্ত্র আবার শুরু হবে।

কামবার আলীর মুখে এখন ক্রোধের আভাস এবং বাবর ভয় আর ঘামের তিক্ত ঘ্রাণ উজিরের ভিতর স্পষ্ট টের পায়। কিন্তু তার মৃত আব্বাজানের কাছে যে লোকটা এত প্রশ্রয় পেয়েছে তার প্রতি সামান্যতম করুণা সে বোধ করে না। কেবল ক্রোধ আর প্রতিশোধের কামনা তাকে জারিত করে।

শাহী জ্যোতিষী, শাহী কোষাধ্যক্ষ আর শাহী বাজারসরকারকে একস্থানে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে এবং হতাশায় তাদের চোখ মুখ ঝুলে পড়েছে। তাদের নিয়ে যাও,” বাবর প্রহরীদের আদেশ করে। “আমি পরে তাদের বিষয় বিবেচনা করবো।” দেয়ালের অনেক উপরে স্থাপিত একটা ক্ষুদে জাফরীর দিকে তার নজর যায় এবং মনে হয় জাফরির পেছনে সে একটা নড়াচড়া লক্ষ্য করেছে। সেখানে বসেই রাজকীয় মহিলারা উৎসবে আর ভোজসভায় মার্জিতভঙ্গিতে সবার চোখের আড়ালে থেকে অংশগ্রহণ করেন। সহজাত প্রবত্তির বলে সে বুঝতে পারে সেখানে কারা রয়েছে তার আম্মিজান আর নানিজান সেখান থেকে সুলতান হিসাবে তার প্রথম পদক্ষেপ দেখছে আর তাকে এগিয়ে যেতে অনুরোধ করছে।

তার নিজের কাছেই অবাক লাগে ভাবতে যে এখন সে মানুষের জীবন মৃত্যুর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সে বহুবার নিজের আব্বাজানকে দেখেছে মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দিতে। গত দু’এক বছরে সে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে দেখেছে শিরোচ্ছেদ, চামড়া তুলে নেয়া, ঘোড়া দিয়ে টেনে দেহ টুকরো করে ফেলা। তাদের আর্তনাদ আর রক্তের গন্ধ এখনও তার গলায় সে অনুভব করে কিন্তু যতক্ষণ তা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করছে তার কখনও মনে হয়নি ব্যাপারটায় কোনো অসঙ্গতি রয়েছে।

আর এখন সে নিশ্চিতভাবেই জানে তার মা আর নানীমা তার কাছে ঠিক কি প্রত্যাশা করছেন। তার নামের মানে “বাঘ” আর তাকেও সেই বিশাল মার্জারের দ্রুততায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। “তুমি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছো আমাকে হত্যা করতে চেয়েছো, তাই নয় কি?” সে শীতল কণ্ঠে বলে। কামবার আলী তার চোখের দিকে তাকায় না। বাবর ধীরে ধীরে তার তরবারি কোষমুক্ত করে। “প্রহরী!” সে ওয়াজির খানের দু’জন লোকের উদ্দেশ্যে ইঙ্গিত করতে তারা উজিরকে মাটিতে ঠেসে ধরে তার দু’হাত শক্ত করে দেহের পেছনে চেপে ধরে। তারপরে তারা তার মাথা থেকে পাগড়ি খুলে নেয় এবং আলখাল্লার পেছনটা ছিঁড়ে ফেলে তার গর্দানের পেছনের দিক উন্মুক্ত করে।

উজির গর্দান টান করে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দাও যে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা সত্ত্বেও তোমাকে আমি দ্রুত মৃত্যু দান করছি।” বাবর টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে, মায়ের কামরায় দাঁড়িয়ে কয়েক ঘন্টা আগে যেমন অনুশীলন করেছিলো তেমনিভাবে একবার তরবারিটা বাতাসে আন্দোলিত করে। সে মনে মনে প্রার্থনা করে, আল্লাহ কাজটা করার শক্তি আমাকে দাও। মাথা যেন নিখুঁতভাবে দ্বিখণ্ডিত হয়। সৈন্যদের হাতের ভিতরে উজির ছটফট করতে থাকে তার চোখে বিষাক্ত দৃষ্টি। বাবর আর একমুহূর্তও ইতস্তত না করে, তরবারি উপরে তুলে ধরে ফলাটা সজোরে উজিরের ঘাড় লক্ষ্য করে নামিয়ে আনে। পাকা তরমুজ দ্বিখণ্ডিত করার মত তরবারির ফলা উজিরের ঘাড়ের শীর্ষ, কোমলাস্থির ভিতর দিয়ে কেটে বের হয়ে আসে। বর্গাকৃতি পাথরের মেঝে, উপর দিয়ে বিচ্ছিন্ন মুণ্ডটা হলুদ দাঁত বের হয়ে থাকা গড়িয়ে যায়, তরল চুনির মত রক্তধারা গড়িয়ে পড়ে।

বাবর ধীর গতিতে আতঙ্কিত লোকদের দিকে তাকায়। “আমি হয়ত কিশোর কিন্তু আমি তৈমূরের বংশধর আর তোমাদের ন্যায়সঙ্গত সুলতান। উপস্থিত কারো মনে এ বিষয়ে দ্বিধার অবকাশ রয়েছে?”

সারা ঘরে পরিপূর্ণ নিরবতা বিরাজ করে। তারপরে ধীরে ধীরে একটা আওয়াজ ভেসে উঠে। “বাবর মির্জা, বাবর মির্জা।” শব্দটা জোরাল হয়ে কামরায় ভাসতে থাকে এবং একটা সময় মনে হয় কেবল শব্দটা যেন পরিপূর্ণ করতে পারছে না পুরো ব্যাপারটা, লোকগুলো তাদের তরবারির চ্যাপ্টা দিক দিয়ে চামড়ার গোলাকৃতি ঢালে আঘাত করতে থাকে বা হাত মুঠো করে দেয়াল বা টেবিল চাপড়াতে শুরু করে, যতক্ষণ না পুরো কামরাটা তাদের আবেগে মথিত হয়ে উঠে।

১.৩ তৈমূরের অঙ্গুরীয়

০৩. তৈমূরের অঙ্গুরীয়

বাবর দরবারে প্রবেশ করতে সভাসদবৃন্দ বুকে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নত করে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে। বাবর ভাবে, কেবল আঠারজন, এবং তার উদ্দেশ্যে উচ্চারিত নানীজানের হুঁশিয়ারী, তাদের আনুগত্যের কি ভয়ঙ্কর পরীক্ষার মুখেই না এনে দাঁড় করিয়েছে। চোখ সরু করে সে প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করে জরিপ করে। মাত্র একমাস আগে, যখন তার আব্বাজান জীবিত ছিলেন, তার ভাবনাচিন্তা কি বিচিত্রভাবে অন্যরকম ছিল। সে তখন কল্পনা করতে পোড় খাওয়া এসব যোদ্ধাদের ভেতরে কে তাকে অসি চালনা শেখার জন্য তাদের সাথে যোগ দিতে আহবান জানাবে, কে জাক্সারটাসের তীরে পোলো খেলার ছলে তাদের সাথে ঘোড়সওয়ারির জন্য আমন্ত্রণ করবে। এখন বিষয়টা একেবারে আলাদা। তার বাল্যকালের অকাল মৃত্যু হয়েছে। খেলার সময় শেষ। তারা এখন যুদ্ধের মন্ত্রণাসভায় সমবেত হয়েছে।

বাবর তার জন্য নির্দিষ্ট মখমলের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে, গোত্রপতিদেরও বসতে ইঙ্গিত করে, হাত উঁচু করে। “কাশিম, চিঠিটা নিয়ে এসো।”

তার পেছনে পেছনে সভাকক্ষে কালো আলখাল্লা পরিহিত যে লম্বা, শীর্ণকায় লোকটা প্রবেশ করেছিলো, সে এবার সামনে এগিয়ে এসে মাথা নত করে অভিবাদন জানায় এবং আগের দিন ক্লান্ত বার্তাবাহক যে চিঠিটা নিয়ে এসেছে সেটা তার হাতে তুলে দেয়। শান্তি হারাম করে দেয়া চিঠিটা হাতে ধরতে তার আঙ্গুলের সবগুলো গাট সাদা হয়ে আসে। এমনকি এখন তার নিজের আম্মিজানও কামরায় বসে কাঁদছেন, মুখটা নিজের বুকের উপরে ঝুঁকে পড়েছে, বাবরের বোন খানজাদার কোনো কথাই কানে তুলছেন না এমনকি নিজের মা, তার নানীজান এসান দৌলতের তীক্ষ্ণ যুক্তিও তার কান্না প্রশমিত করতে পারছে না। আম্মাজানের এভাবে ভেঙে পড়া দেখে তার নিজের আত্মবিশ্বাসে চিড় খেয়েছে। বাবার আকষ্মিক দুর্ঘটনার পরেও খুতলাঘ নিগার এভাবে ভেঙে পড়েননি, কিন্তু এখন হতাশা তাকে আপুত করে ফেলেছে।

“উজির সাহেব, চিঠিটা উচ্চকণ্ঠে পাঠ করুন যাতে উপস্থিত সবাই আমার চাচাজান, সমরকন্দের সুলতান আহমেদের, বিশ্বাসঘাতকতার কথা পরিষ্কার শুনতে পায়।”

কাশিম চিঠিটা পুনরায় তার হাত থেকে নিয়ে ধীরে ধীরে সেটা খুলে। বাবর ভাবে, তাকে উজির নির্বাচিত করে সে ভুল করেনি। পরিবার পরিজনহীন একজন দরিদ্র ব্যক্তি অথচ ঈর্ষণীয় জ্ঞানের অধিকারী তার পূর্ববতী উজির কামবার আলীর মত উচ্চাকাতি কুচক্রী না লোকটা, যার মাথা এখন দূর্গের প্রবেশদ্বারে একটা দণ্ডের শীর্ষদেশে সংস্থাপিত হয়ে পচছে।

কাশিম কেশে গলা পরিষ্কার করে। “বিষাদের এই মুহূর্তে আল্লাহতালার আশীর্বাদ আমার ভাতিজার উপরে অবিশ্রান্ত ধারায় বর্ষিত হোক। আল্লাহতালা, তার পিতা আমার ভাইকে পার্থিব বোঝা থেকে মুক্তি দেয়াকে যুক্তিসংগত মনে করে তার আত্মাকে বেহেশতের উদ্যানে ডেকে নিয়েছেন। আমরা যারা পেছনে রয়ে গিয়েছি যাদের শোকাহত হবার কারণ রয়েছে কিন্তু জীবিতদের প্রতি কর্তব্যও আমাদের স্মরণে রাখতে হবে। ফারগানা আমি কোনমতেই স্বজ্ঞানে এই ক্ষুদ্র, দারিদ্রপীড়িত এলাকাকে রাজ্য হিসাবে অভিহিত করতে পারি না- অরক্ষিত আর একলা হয়ে পড়েছে। তৈমূরের উত্তরসূরীদের শত্রুরা চারপাশ থেকে ঘিরে আসছে। আমার ভাইয়ের ছেলে, নিতান্তই বালক, নগ্ন আর আক্রম্য অবস্থায় রয়েছে। তাকে রক্ষার্থে আমি যদি এখনই কোনো পদক্ষেপ না নেই, তবে নিজের পরিবারের প্রতি যথাযথ ভালবাসা প্রদর্শনে আমি ব্যর্থ হয়েছি বলে মনে করবো। প্রিয় ভাতিজা, এই চিঠি যখন তুমি পড়ছে, আমার সৈন্যরা তখন সমরকন্দের নীলাভ-সবুজ তোরণ অতিক্রম করে ফারগানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেছে। ফারগানার নিরাপত্তার জন্য আমি একে অঙ্গীভূত করছি। তোমার আন্তরিক ধন্যবাদ এক্ষেত্রে কেবল বাক্যের অপচয় ঘটাবে। কোনো ধরণের ঝামেলা বা প্রতিরোধ আমি বরদাশত করতে রাজি নই এবং আশা করছি খুদে ফারগানা একটা দারুণ শিকারের ক্ষেত্র বলে ভবিষ্যতে বিবেচিত হবে। তোমার প্রসঙ্গে বলি, প্রিয় ভাতিজা, আমি তোমাকে আমার আশ্রয়ে নিয়ে আসব এবং পিতার আদর কাকে বলে আমার কাছ থেকে তুমি সেটা আবার জানতে পারবে। এবং যখন তুমি প্রাপ্তবয়স্ক হবে, তখন আমিই তোমার জন্য একটা খুদে জায়গীর খুঁজে বের করবো, যেখানে তুমি শান্তিতে এবং সন্তুষ্টিতে বসবাস করতে পারবে।”

যোদ্ধার দল অস্বস্তির সাথে নড়েচড়ে বসে, ভুলেও কেউ কারো চোখের দিকে তাকায় না। তাম্‌বাল, বাবরের দুরসম্পর্কের আত্মীয়, অস্পষ্ট কণ্ঠে কিছু একটা বলে এবং আলি মাজিদ বেগ, সমরকন্দের আগুয়ান বাহিনী তারই এলাকার উপর দিয়ে সরাসরি এগিয়ে আসবে, ভেড়ার চামড়ার কারুকাজ করা আঁটসাট জ্যাকেট মনোযোগ দিয়ে খোটাতে শুরু করে যেন সহসা সেটায় পোকার সংক্রমণ ঘটেছে। বাবর তাদের আশঙ্কা অনুভব করতে পারে। তৈমূরের বংশধরদের ভিতরে তারা চাচাজান সবচেয়ে ক্ষমতাবান আর সমরকন্দ চীন আর পারস্যের ভিতরে বিদ্যমান সিল্ক রুটের উপরে অবস্থিত, চারপাশে উর্বর ফলের বাগান, আর গম এবং তুলার ক্ষেত থাকার কারণে তৈমূরের অধিকৃত এলাকার ভিতরে সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী। সমরকন্দ নামের অর্থই হল চর্বির শহর যাব দেয়ালের পাশ দিয়ে প্রবাহিত জারাফশান নদীকে বলা হয় স্বর্ণ প্রসবিনী।

“আমি আমার দ্রুতগামী অশ্বারোহীদের কেন পাঠিয়েছিলাম এত্তেলা দিতে আপনারা এখন বুঝতে পারছেন। ফারগানার স্বাধীনতার প্রতি এই জঘন্য হুমকীর সমুচিত জবাব দিতে হলে আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। আমি অল্পবয়স্ক হতে পারি, কিন্তু আমি আপনাদের ন্যায়সঙ্গত সুলতান। আমার নামে মসজিদে খুতবা পাঠের সময়ে আপনারা উপস্থিত ছিলেন। কামবার আলী আর তার সহযোগীদের আমি শায়েস্তা করেছি। এখন আমি আপনাদের আহ্বান জানাচ্ছি, বহিঃশত্রুর মোকাবেলায় আমার পাশে এসে দাঁড়াবার জন্য, নিজেদের সম্মান রক্ষার্থেই যা আপনাদের করা উচিত।” বাবরের কণ্ঠস্বর শান্ত আর পরিষ্কার, তার উচ্চারিত শব্দ পাথরের দেয়ালে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে সুমধুর প্রতিধ্বনির জন্ম দেয়। ওয়াজির খানের সহায়তায় বাবর আজ যা বলবে সেটা আগে থেকেই অনুশীলন করেছে।

নিরবতা। বাবরের আশা স্তিমিত হতে থাকে এবং সে টের পায় তার পেটের ভিতরটা কেমন ফাঁপা লাগছে। প্রয়োজন হলে সে ওয়াজির খানকে ডেকে পাঠাবে কথা বলার জন্য তার অকাট্য যুক্তি গোত্রপতিরা যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে, যদিও বাবর তার বিশ্বস্ত দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধানের সহায়তা ছাড়াই সফল হবার আশা পোষণ করে। তাকে অবশ্যই কঠোর হতে হবে…বয়সের কারণে যতটা সম্ভব ঠিক ততটাই মন্দ্র কণ্ঠে সে আবার অনুরোধ করে: “আমাদের অবশ্যই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমরা যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকি, তবে আগামী পূর্ণিমার আগেই সমরকন্দের বাহিনী আমাদের তোরণের বাইরে এসে শিবির ফেলবে।”

“মহামান্য সুলতানের অভিপ্রায় কি জানতে পারি?” আলি মজিদ বেগ মাথা তুলে সরাসরি বাবরের চোখের দিকে তাকায়। তার বাবার সবচেয়ে বিশ্বস্ত গোত্রপতিদের ভিতরে সে অন্যতম এবং বাবর লোকটার পটোলচেরা চোখের দৃষ্টিতে সমর্থন দেখতে পেয়ে কৃতজ্ঞ বোধ করে।

“সুলতানের বাহিনী সমরকন্দ থেকে জারাফশান নদীর তীর বরাবর পূর্বদিকে এগিয়ে যাবে। আমরা বৃত্তাকারে তাদের পাশ কাটিয়ে গিয়ে উত্তরের পাহাড়ের দিক থেকে তাদের আক্রমণ করবো। তারা সেদিক থেকে আক্রমণ প্রত্যাশা করবে না। আমরা আমার চাচাজানকে দেখিয়ে দেবো যে ফারগানা নিজেকে রক্ষা করতে জানে।” পরিকল্পনাটা ওয়াজির খান তাকে বলেছে এবং সে পুরো বিষয়টা তাকে একে দেখালে বাবর বুঝতে পেরেছে এতে কাজ হলেও হতে পারে।

আলি মজিদ বেগ চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। “সুলতান, আপনি ঠিকই বলেছেন। উত্তরের গিরিপথ থেকে আমরা তাদের আক্রমণ করতে পারি এটা ব্যাটাদের মাথাতেও আসবে না।”

“আমরা আপনার চাচাকে প্রতিহত করতে পারব। এটা সম্ভব- অন্তত এখনকার মত হলেও। কিন্তু সাইবানি খান আসলে আমরা কি করবো- সে আসবেই?” তামবাল শান্ত কণ্ঠে প্রশ্নটা করে। আলি মজিদ বেগের মত সে বাবরের চোখের দিকে তাকায় না, চোখ সরিয়ে নেয়।

বাবর টের পায় তামবালের কথায় আবার অস্বস্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। তৈমূরের রাজত্বে অনেক আগে থেকেই উজবেক সম্প্রদায় হামলা করে এসেছে, উত্তরের তৃণভূমির মাঝে অবস্থিত আশ্রয়স্থল ছেড়ে তারা ঘনঘন আক্রমণ করেছে এবং লুঠতরাজ চালিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে, তাদের নতুন নেতা সাইবানি খানের নেতৃত্বে তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তারা এবার প্রভূত্ব স্থাপনের অভিপ্রায়ে অভিযানে বের হতে চাইছে। আর ক্ষুদ্র ফারগানা যথেষ্ট লোভনীয় একটা লক্ষ্যবস্তু হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। “সময় হলে সেই উজবেক আর তার ছুঁচোদেরও আমরা সমুচিত জবাব দেবো,” বাবর নির্ভীক কণ্ঠে বলে।

“কিন্তু আমাদের মিত্র প্রয়োজন। তৈমূরের বংশধরদের অধীনে শাসিত রাজ্য বা ফারগানা কেউই একা নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারবে না। উজবেকরা, শেয়াল যেমন একটা একটা করে মুরগী ধরে তেমনি এক এক করে আমাদের পরাজিত করবে,” তামবাল বলতে থাকে।

“অবশ্যই আমাদের মিত্র প্রয়োজন, কিন্তু আমরা সেটা স্বাধীন মানুষ হিসাবে বেছে নেব, ভাল মনিবের অধীনে নতজানু দাসের মত নয়,” বাবর তাদের বোঝাতে চেষ্টা করে।

“স্বাধীন মানুষের চেয়ে একজন দাস হয়ত বেশি দিন বেঁচে থাকতে পারে। আর সময় যখন অনুকূল হবে সে তখন আবার স্বাধীনতা লাভের জন্য প্রয়াস নেবে। আমরা যদি আপনার চাচার অধীনতা মেনে নেই তবে আমরা উজবেকদের শায়েস্তা করতে পারব। আর সাইবানি খানের মাথা তার কাঁধের উপর থেকে গড়িয়ে পড়লে এবং তার ভিতরে খড় ভরে হারেমে ঝোলাবার জন্য একটা দর্শনীয় বস্তুতে পরিণত হলে ফারগানার স্বাধীনতার বিষয়টা বিবেচনা করার জন্য আমাদের পক্ষে সেটা হবে উপযুক্ত সময়।”

কামরার ভিতরে একটা ঐক্যমতের গুঞ্জন ধ্বনিত হয় এবং অবশেষে এবার তামবাল তার চোখের দিকে তাকায়। তার মুখের অভিব্যক্তি বিষণ্ণ কিন্তু ঠোঁটের সামান্য বাঁক সেটা ভেস্তে দিয়ে সন্তুষ্টি ঠিকই ফুটিয়ে তুলেছে যে তার কথা মোক্ষম স্থানে আঘাত করেছে।

বাবর সহসা উঠে দাঁড়ায় এবং সিংহাসনের নিচে একটা পাদানি থাকায় ভাগ্যকে মনে মনে ধন্যবাদ জানায় যা তার কিশোর অবয়বকে সামান্য বাড়তি উচ্চতা দান করে। “অনেক হয়েছে! আমরা আমার চাচাজানের বাহিনীকে আগে ফিরিয়ে দেব, এবং তারপরে লোকবলের ভিত্তিতে আমি- আপনারা কেউ না- সিদ্ধান্ত নেব ফারগানা কার সাথে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হবে।”

গোত্রপতিরা কিছু না বলে সবাই পড়িমড়ি করে উঠে দাঁড়ায়- সুলতান দাঁড়িয়ে আছেন এসময়ে বসে থাকাটা একটা অচিন্তনীয় ব্যাপার, সে তারা মনে মনে যাই ভাবুক না কেন। এমনকি অপরের বাহু ছিঁড়ে নেয়ার মত শক্তিশালী যোদ্ধাও দরবারের এসব আদবকায়দা সম্বন্ধে পরিপূর্ণ ওয়াকিবহাল।

“আগামী চারদিন পরে আমরা রওনা দেব। আমি তোমাদের আদেশ করছি সমস্ত লোকজন নিয়ে এখানে এসে আমার সাথে যোগ দেবার জন্য। তাদের সবাইকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে আসতে বলবে।” সহজাত প্রবৃত্তির বশে বাবর কথাটা শেষ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে দরবার থেকে বের হয়ে আসলে, তার উজির আর ওয়াজির খান তাকে অনুসরণ করে।

“সুলতান আপনি ভালই সামলেছেন বিষয়টা আর তর্কের কোনো অবকাশ না দিয়ে বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন।” দরবারের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়া মাত্র ওয়াজির খান মন্তব্য করে।

“আমি সত্যিই জানি না। আমার আহবানের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য আমাকে আগামী চারদিন অপেক্ষা করতে হবে। তাদের ভিতরে কেউ কেউ সম্ভবত সমরকন্দে আমার চাচার কাছে ইতিমধ্যে দূত পাঠিয়েছে। আমার চেয়ে তিনি তাদের বেশি উপঢৌকন দেবার সামর্থ্য রাখেন।” বাবর হঠাৎ ক্লান্ত বোধ করে আর তার মাথা যেন ব্যাথায় ছিঁড়ে যায়।

“সুলতান, তারা আসবে।” কাশিমের নিরুদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর বাবরকে চমকে দেয়। উজির সাহেব সাধারণত তাকে কোনো প্রশ্ন করা না হলে নিজে থেকে কথা বলেন না। মাত্র চার সপ্তাহ আগে আপনার নামে “খুতবা পাঠ করা হয়েছে-আপনার গোত্রপতিরা নিজের লোকদের কাছেই মুখ দেখাতে পারবে না যদি তারা আপনাকে এত দ্রুত আর যুদ্ধে নিজেকে প্রমাণ করার কোনো সুযোগ না দিয়েই পরিত্যাগ করে। আর সুলতান, এখন যদি আমার জন্য আর কোনো আদেশ না থাকে তবে আমি আমার কাজে ফিরে যেতে চাই।” সে দ্রুত তাদেরকে রেখে গলিপথ দিয়ে এগিয়ে যায়। “আমি কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি যেন তার কথাই ঠিক হয়,” বাবর বিড়বিড় করে বলে, তারপরে সহসা ক্ষেপে উঠে পাথরের দেয়াল একবার না দুইবার, লাথি বসিয়ে দিলে তার ভিতরে জমা হওয়া আবেগ অনেকটা প্রশমিত হয়। সে যখন তাকিয়ে দেখে ওয়াজির খান বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, তখন নিজের মুখে সামান্য হাসি ফুটিয়ে তোলে এবং এক মুহূর্তের জন্য তার মন থেকে দুশ্চিন্তার সব মেঘ অপসারিত হয়েছে।

***

বাবর জেনানামহলের দিকে এগিয়ে যেতে, পরিচারকের দল আগে আগে দৌড়ে যায় সুলতানের আগমন সংবাদ ঘোষণা করতে। আজকের দিনটা সেসব দিন থেকে কত আলাদা, যখন সে এই একই গলিপথ দিয়ে দৌড়ে গিয়ে তার মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ত, আর তিনি প্রথমে বকা দিলেও পরক্ষণেই পরম মমতায় তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতেন। আর এখন কত আড়ম্বরের ঘনঘটা। মধূমক্ষিকার মত ঘরের বিন্যাসে প্রবেশ করতে, কালো চোখের একটা ঝলক আর মসৃণ, সুগঠিত গোড়ালির শোভাবর্ধনকারী সোনার মলের আভা সে দেখতে পায় এবং চন্দনকাঠের গন্ধে ভারী হয়ে থাকা বাতাসে শ্বাস নেয়। সে এখনও যদিও নারী সংসর্গ করেনি এবং বয়স এখনও অল্প হওয়া সত্ত্বেও মেয়েরা তার চোখে পড়ার জন্য এখনই প্রতিযোগিতা শুরু করেছে- এমনকি ফরিদা, কামবার আলীর তরুণী বিধবা স্ত্রী, তার মা দয়াপরবশ হয়ে তাকে হারেমে আশ্রয় দিলে, সেও বাদ যায় না। সে যদিও এখনও তার মৃত স্বামীর জন্য শোকপালন করছে, কিন্তু বাবর ঠিকই তাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছে। আর বাকীরা ইচ্ছা করেই তার যাত্রা পথে উঁকি দেয়, তাদের প্রত্যেকের চোখে স্পষ্ট আমন্ত্রণ।

সে যেখানে দেখে গিয়েছিল সেখানেই তার মাকে দেখতে পায়, কিন্তু এখন তিনি ঘুমিয়ে আছেন। তার বোন খানজাদা পিঠ সোজা করে মাটিতে বসে রয়েছে, থুতনির নিচে হাটু ভাঁজ করা, কামরার এককোণে বসে আনমনে মেহেদী রাঙান হাতে, সোনালী শেকলের প্রান্তে ফিরোজা খচিত বকলেসে বাঁধা পোষা বেজীর সাথে খেলছে। ভাইকে দেখামাত্র সে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। “ভালো?” সে ব্যগ্র কণ্ঠে জানতে চায়, কিন্তু গলার স্বর নিচু রাখে যাতে খুতলাঘ নিগার জেগে না উঠেন।

“আমরা অচিরেই জানতে পারবো। আগামী চারদিনের ভিতরে রওয়ানা দেবার আদেশ দিয়ে আমি আসছি। আম্মিজান কেমন আছেন?”

খানজাদার ভ্রু কুচকে উঠে। “তাকে কিছুতেই বোঝাতে পারবে না। তিনি ধরেই নিয়েছেন আমাদের চাচাজান মসনদ দখল করে তোমাকে হত্যা করবে। তিনি একবার তাকে নাকি বলতে শুনেছেন যে ফারগানা সমরকন্দের সাথে একটা আকর্ষণীয় বাড়তি অংশ হিসাবে যুক্ত হতে পারে। আম্মিজান বারবার বলছেন তিনি সবসময়ে আমাদের রাজ্যকে দখলযোগ্য আর ঘৃণার সাথে অভিহিত করতেন। আব্বাজান এ কারণেই তার সীমান্তে মাঝেমাঝে হামলা চালিয়েছিল- গৌরবের খাতিরে, দেখাতে চেয়েছিলেন তিনি মোটেই ভীত নন।”

“বেশ, আমি নিজেও অবশ্য ভীত নই। আমরা যদি এই হুমকির যথাযথ উত্তর দিতে ব্যর্থ হই তাহলে তৈমূরের বংশধর বলে আমাদের মুখ দেখাবার উপায় থাকবে না। পরাভব স্বীকার করার চেয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যাওয়াও আমি মেনে নেব।” বাবর তার নিজের কণ্ঠের আবেগে নিজেই চমকে উঠে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখে তার মা ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন। তার কথা নিশ্চয়ই তিনি শুনতে পেয়েছেন। তার চোখ যদিও এখনও লাল কিন্তু তার অভিজাত মুখাবয়বে গর্ব ঝলসে উঠে। “আমার বেটা,” মৃদু কণ্ঠে হাত বাড়িয়ে তিনি বলেন। “আমার বালক বীর।”

***

দূর্গের প্রকারবেষ্টিত সমতল ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে, তারাদের এত উজ্জ্বল বা এত বেশি সংখ্যককে আকাশের গায়ে ভেসে থাকতে সে আগে কখনও দেখেনি। বাতাস শীতল আর নির্মল। বুক ভরে তাজা বাতাস টেনে নিতে আসন্ন শীতের আমেজ বাবর অনুভব করতে পারে যখন নদীগুলো জমে বরফে পরিণত হবে। আর পাহাড়ের উপর থেকে নেকড়ের দল গ্রামগুলোতে এসে হাজির হবে এবং পশুপালকের নধর ভেড়াগুলো শিকার করবে।

আর কয়েকঘণ্টা পরেই সে তার প্রথম অভিযানে রওয়ানা দেবে। তার বাবার ঈগলের মত বটের তরবারি, আলমগীর তার পরিকর থেকে ঝুলছে কিন্তু সুলতানের বর্ম তার এখনও বড় হয়। ওয়াজির খান শাহী অস্ত্রশালা থেকে তার জন্য একটা ধাতব-শৃঙ্খল নির্মিত অলঙ্কৃত বক্ষাবরণী আর চূড়াযুক্ত শিয়োস্ত্রাণ খুঁজে বের করেছে, যেগুলো তার গায়ের প্রায় মাপমতই হয়েছে। তৈমূরের কোনো শাহজাদার ছিল এসব যুদ্ধসাজ, উপরের তারকারাজির মত বর্মে খচিত শীতল আর উজ্জ্বল পাথরের উপরে আঙ্গুল বুলিয়ে সে ভাবে, আর তার কি পরিণতি হয়েছিলো?

নিচের আস্তাবল থেকে মৃদু হ্রেষারব ভেসে আসে। ওয়াজির খান তাকে বলেছে, ঘোড়া আগে থেকেই আসন্ন যুদ্ধের কথা টের পায়। দূর্গের দেয়ালের বাইরে, বাবর ঝুড়িসদৃশ পা-ওয়ালা বহনযোগ্য ধাতব পাত্রে কয়লার গনগনে লাল আভা এখান থেকেই দেখতে পায়। অস্থায়ী শিবিরগুলো জেগে উঠতে শুরু করেছে। চামড়ার তাবুর ভেতর থেকে আবছা অবয়ব বাইরে বের হয়ে এসে হাত পা নেড়ে প্রত্যূষের শীতের আমেজ ভাঙতে চেষ্টা করে। পরিচারকের দল পানি ভর্তি জগ নিয়ে আসা যাওয়া করে আর আলকাতরায় ডুবান কাপড়ে আগুন ধরিয়ে মশাল জ্বালিয়ে দেয়।

তার প্রায় সব গোত্রপতিই এসেছে, বাবর সন্তুষ্ট চিত্তে ভাবে। চারহাজার সৈন্যের একটা বাহিনী নিয়ে সে যাত্রা শুরু করবে। সমরকন্দের শক্তির কাছে নেহাতই ছোট, কিন্তু নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতে আর ক্ষতি সাধনের জন্য পর্যাপ্ত হয়ত সন্ধি আর মীমাংসায় সম্মত করানোর জন্য যথেষ্ট। তার মরহুম আব্বাজানের রেখে যাওয়া কৌতূহলকর আর ঘটনাবহুল সামরিক অভিযানের প্রতি আরও মনোযোগ দেয়া তার উচিত ছিল। আর সেটা না দেবার কারণে তাকে এখন ওয়াজির খানের পরামর্শের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। কিন্তু নিজেকে সে প্রতিশ্রুতি দেয় যে শীঘ্রই সব শিখে নেবে। তাকে শিখতেই হবে।

ভোরের আলো এখন ফুটতে শুরু করেছে, একটা ধূসর কমলা রঙের আলোর আভা পাহাড়ের উপর দিয়ে ভেসে উঠে তার এবড়োখেবড়ো প্রান্তরেখা আলোকিত করে তোলে। বাবর সহসা একদল অশ্বারোহীকে উপত্যকার উপর দিয়ে দ্রুতবেগে ছুটে আসতে দেখে- সম্ভবত দেরি করে আসা কোনো যোদ্ধার দল। ঘোড়সওয়াড়দের এগিয়ে আসবার দ্রুততায় প্রীত হয়ে সে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে নিচের আঙ্গিনায় নেমে আসে তাদের স্বাগত জানাতে।

দূর্গের প্রবেশ পথের ঢাল ধরে ঘোড়ার আগুয়ান বহর ভাপ ছড়াতে ছড়াতে উঠে আসে। তাদের দলনেতা চিৎকার করে দূর্গের গজাল দিয়ে মজবুত করে তোলা। দরজা খুলে তাদের ভিতরে প্রবেশ করতে দেবার অনুমতি প্রার্থনা করে।

“দাঁড়াও!” ওয়াজির খানের কণ্ঠস্বর বাতাস চিরে ভেসে আসে। বাবর দেখে হন্তদন্ত হয়ে নেমে এসে তার দেহরক্ষী বাহিনীর প্রধান সদর দরজার জাফরির ফুটো দিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। তাদের সবুজ রেশমের বুকে গুঁড়িমেরে থাকা বাঘের নিশান ঘোষণা করছে নতুন আগত অশ্বারোহী বাহিনী ফারগানা নয় সমরকন্দ থেকে আসছে।

অশ্বারোহী বাহিনীর দলনেতার ঘোড়া লাগামে টান পড়তে পিছিয়ে আসে। “আমরা সংবাদ নিয়ে এসেছি,” সে কর্কশ কণ্ঠে বলে। “আমাদের সুলতান ইন্তেকাল করেছেন।”

“মহামান্য সুলতান, আপনি অনুগ্রহ করে সরে দাঁড়ান। আমাকে ব্যাপারটা সামলাতে দেন। পুরোটাই কোনো ধরণের চালাকি হতে পারে,” ওয়াজির খান তাকে সতর্ক করে দিয়ে তারপরে অশ্বারোহী বাহিনীকে ভিতরে প্রবেশের সুযোগ করে দেবার জন্য প্রহরীদের ইঙ্গিত করে দরজা খুলে দেবার জন্য। তরবারির বাঁটে হাত রেখে সে সামনে এগিয়ে আসে। “তোমাদের পরিচয় দাও।”

“আমি বাইসানগার, সমরকন্দের সুলতানের দেহরক্ষী বাহিনীর একজন অধিনায়ক। এরা আমার লোক।”

বাইসানগারের মুখ ঘাম আর ধূলোয় মাখামাখি কিন্তু বাবরের যেটা সবচেয়ে চোখে পড়ে সেটা হল ধূলোর আস্তরণের নিচে তার চরম ক্লান্তি। এটা কোনো ধোকাবাজির ঘটনা হতে পারে না। ওয়াজির খানের হুঁশিয়ারী অমান্য করে সে সামনে এগিয়ে আসে। “আমি বাবর, ফারগানার সুলতান। আমার চাচাজানের কি হয়েছে?”

“আমাদের সুলতান ফারগানার মহামান্য সুলতানকে… প্রতিরক্ষার অভয় দানের জন্য সমরকন্দ থেকে রওয়ানা হয়েছিলেন। রাতের বেলায় তিনি তার বাহিনীর সাথে একটা খরস্রোতা নদীর পাশে অস্থায়ী ছাউনি স্থাপন করেছিলেন এবং তার লোকের নদীর উপরে একটা অস্থায়ী সেতু নির্মাণের সময়ে উজবেকরা আমাদের অতর্কিতে আক্রমণ করে। আলো ফোঁটার দু’ঘণ্টা পরের ঘটনা এটা। বিস্ময় আর বিভ্রান্তিতে আমরা কচুকাটা হয়ে যাই। আমাদের রণহস্তী, উটের বহর আর অন্যান্য ভারবাহী জম্ভর দল আতঙ্কে দিগ্বিদিক ছুটে পালায়, তাদের সামনে যা কিছু পড়েছে সব কিছু তারা মাড়িয়ে গেছে। আমাদের লোকেরা বীরত্বের সাথে মোকাবেলা করতে চেষ্টা করে কিন্তু তাদের বেশিরভাগই মারা যায়। কেউ কেউ অসমাপ্ত সেতুর উপর দিয়ে পালাতে চাইলে তাদের ভারে সেতু ভেঙে পড়ে এবং পানির তোড়ে তারা ভেসে যায়। নদীর পানি শীঘ্রই লাল হয়ে উঠে- উজবেক আর আমাদের রক্তে, এটা সত্যি- কিন্তু আমরা পর্যদস্ত হয়েছি।”

“আর আমার চাচাজান?”

“আক্রমণ আরম্ভ হবার সময়ে তিনি নদীর তীরে তার লাল রঙের তাবুতে অবস্থান করছিলেন। তিনি সেখান থেকে কোনমতে ঘোড়ায় চেপে শত্রুর মোকাবেলা করতে এগিয়ে আসেন কিন্তু কোথা থেকে একটা তীর এসে তার গলা বিদ্ধ করতে তিনি মাটিতে পড়ে গিয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন। আমরা তাকে ঘোড়ার খুরের আওতা থেকে সরিয়ে নিয়ে আসি বটে, কিন্তু হেকিম বৈদ্যদের ডেকে কোনো লাভ হয়নি- হেকিমের কিছুই করার ছিল না। তারা রক্তপাতই বন্ধ করতে পারেনি। কয়েক ঘণ্টার ভিতরেই তিনি ইন্তেকাল করেন। খবরটা আমাদের লোকদের ভিতরে ছড়িয়ে পড়তে কোনো কোনো গোত্রপতি, অনাগত আশঙ্কায় নিজেদের লোকদের ডেকে নিয়ে গ্রামে ফিরে গেছে।” ক্ষোভে বাইসানগারের কণ্ঠস্বর তিক্ত শোনায়।

“আর তোমরা কেন এখানে এসেছো?”

“আপনার চাচাজানের অন্তিম ইচ্ছা পূরণ করতে। ফারগানার জন্য লোভ করার কারণেই আল্লাহতালা তাকে শাস্তি দিয়েছে। গলায় জমে থাকা রক্তের বুদবুদের ভিতর দিয়ে শেষ নিঃশ্বাস নেবার তিনি আপনার কাছে করুণা ভিক্ষা চেয়েছেন যাতে বেহেশতের উদ্যানে প্রশান্তিতে বিশ্রাম নিতে পারেন।”

বাবর ভাবে, আমি যে চাচাজানকে চিনি মোটেই তার মত আচরণ না, কিন্তু হয়ত মৃত্যু সন্নিকটে উপস্থিত বুঝতে পারলে মানুষ বদলে যায়।

“তুমি যা বলছে তার স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ তোমার কাছে আছে?” ওয়াজির খানের এক চোখে এখন জ্বলজ্বল করছে সন্দেহ এবং বাবর এবার খেয়াল করে সে তার লোকদের এখনও সরে দাঁড়াবার নির্দেশ দেয়নি। বাইসানগারের দিকে তার তিনজন সৈন্য এখনও ধনুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে।

“এই আমার প্রমাণ।” বাইসানগার তার আঁটসাট চামড়ার জ্যাকেটের গভীরে হাত ঢুকিয়ে একটা ছোট, দাগযুক্ত থলে বের করে। থলেটার গলার কাছের বেণী করা দড়ির ফাঁস আলগা করে সে ভেতর থেকে একটা কাপড়ের টুকরো বের করে আনে। যত্নের সাথে, শ্রদ্ধাবনত চিত্তে, সে কাপড়ের ভাঁজ খুলতে ভেতরের বস্তু দৃশ্যমান হয়: রক্তে রঞ্জিত একটা সোনার বেশ ভারী আংটি।

বাইসানগার আংটিটা বাড়িয়ে ধরলে বাবরের দম আটকে আসতে চায়। “দেখেন,” প্রায় ফিসফিস কণ্ঠে বাইসানগার বলে, “মহান তৈমূরের অঙ্গুরীয়।” হলুদ ধাতুর উপর খোদাই করা ক্রুদ্ধ বাঘটা এখনই বুঝি গর্জে উঠে লেজ ঝাপটাবে।

***

যুদ্ধকালীন মন্ত্রণা পরিষদের মেজাজ এবার একেবারেই আলাদা। বাবর, একপাশে উজির আর অন্যপাশে ওয়াজির খান পরিবেষ্টিত হয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে, ভেতরে অবস্থানরত গোত্রপতিদের ঘটনাবলীর অসাধারণ পরিণতি নিয়ে উচ্চকণ্ঠে আলাপ করতে শোনে।

“সুলতান, নিয়তির লিখন পরিষ্কার।” তামবালের চোখ উত্তেজনায় চকচক করে। “সুলতান আপনাকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করে গিয়েছেন তার কোনো পুত্র সন্ত নি ছিল না। অন্যরা সমরকন্দ দখল করতে চাইবে, কিন্তু আমরা যদি একটু তৎপরতা দেখাই তাহলে সেটা আপনার নিজের রাজত্ব হতে পারে।”

বাবর চেষ্টা করেও মুখে বিড়ম্বনার হাসি ফুটে উঠা ঠেকাতে পারে না। আর উজবেকদের কি হবে? কয়েকদিন আগেই আমরা তাদের সম্পর্কে আতঙ্কে ছিলাম। আর তোমাদের কথাই ফলেছে তারা আমার চাচাজানকে বেঘোরে মেরেছে, তার সৈন্যবাহিনী তছনছ করে দিয়েছে, তার রসদের বহর কুক্ষিগত করেছে। এখন তারাও যদি সমরকন্দ দখলের পায়তারা করে?”

“কিন্তু এখন প্রায় শরৎ কাল। মৌসুম আমাদের পরম বান্ধব। প্রতিবছর একই ঘটনা ঘুরে ফিরে ঘটে। প্রতিবার শীতের সময়ে সাইবানি খান উত্তরে তুর্কিস্তানের নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যায় আর বরফ না গলা পর্যন্ত সেখানেই থাকে।”

“আলি মজিদ বেগ, আপনার কি অভিমত?” কিন্তু বাবর ইতিমধ্যেই তার উত্তরটা জেনে ফেলেছে। লোকটার পুরো দেহ থেকে ইতিমধ্যে উচ্ছ্বাস এবং আত্মবিশ্বাস চুঁইয়ে পড়তে শুরু করেছে। সম্ভাব্য গৌরব আর গনিমতের মালের কথা চিন্তা করে তার চোখে উজ্জ্বল দীপ্তি ফুটে উঠেছে। সমরকন্দ ধনী সমৃদ্ধ শহর ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা এটা ছিল তৈমূরের সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। তৈমূরের বংশোদ্ভূত প্রতিটা শাহজাদা আর অভিজাত ব্যক্তি সেখানে নিজের উপস্থিতি কামনা করে। বাবরও এর ব্যতিক্রম না। বয়স তার এখনও যদিও অল্প কিন্তু নিয়তি তাকে এমন একটা সুযোগের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে যা হয়ত জীবনে দ্বিতীয়বার সে পাবে না। সে দীর্ঘজীবন কামনা করে না বা রেশমের তাকিয়ায় শুয়ে কি সুযোগ হেলায় হারিয়েছে সেটা ভেবে শান্তিতে মরতেও চায় না। মনে কোনো খেদ নিয়ে সে বেহেশতে যেতে চায় না।

আলি মজিদ বেগ তাকে নিরাশ করে না। “আমি বলি কি শীত আসবার আগেই আমাদের রওয়ানা দেয়া উচিত।”

“আর ওয়াজির খান, আপনি কি বলেন?”

তার সাথে পরিকল্পনা আলোচনার সময় এখন বাবরের হাতে নেই। সে কি তার শরীরে ভীষণভাবে আলোড়ন তোলা উত্তেজনা যা তাকে রীতিমত কাঁপিয়ে তুলেছে তা প্রশমিত করতে কিছু বলবে? ওয়াজির খান তার একমাত্র চোখ দিয়ে বাবরের দিকে ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বাবর ভাবে এই শুরু করলো শীতল যুক্তির বিন্যাস, আমার উত্তেজনা প্রশমিত করার অভিপ্রায়ে। সে আমাকে বলবে আমার বয়স অল্প নিজের রাজত্ব বজায় রাখা এক কথা আর আরেকটা রাজ্য দখল করা একেবারেই আলাদা কথা। সে আমাকে বলবে অপেক্ষা করেন, আমাকে বলবে অভিজ্ঞতাকে অবশ্যই সাহস, ধৈৰ্য্য আর উচ্চাশার সাথে সমন্বিত করতে হবে।

“তামবাল, ঠিকই বলেছে। রক্তের তৃষ্ণা নিবারন করে সাইবানি খান তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে এখন উত্তরের দিকে যাচ্ছে, জাল্লারটাস নদীর তীর বরাবর ফারগানা থেকে অনেকদূরে তাদের গন্তব্যস্থল। আমি রেকী করতে লোক পাঠাব। কিন্তু উজবেক নির্মমতা অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও এধরণের অভিযানের জন্য আমাদের সৈন্য সংখ্যা অপ্রতুল। আমাদের মিত্র দরকার, বেতনভোগী- আপনি যাদের বলেন, ভাড়াটে সৈন্য। পার্বত্য গোত্রগুলোকে আমাদের সাথে যোগ দেবার জন্য প্ররোচিত করতে হবে। আমরা যদি বেতন দেই তাহলে তারা আসবে, এবং তারা যদি আসে আমরা তাহলে আল্লাহ সহায় থাকলে নিশ্চয়ই বিজয়ী হব।”

বাবর এমনভাবে ওয়াজির খানের দিকে তাকায় যেন সে আগে কখনও তাকে দেখেনি। “আপনি হবেন আমার সর্বাধিনায়ক। যা প্রয়োজন বিনা দ্বিধায় সেটা সম্পন্ন করেন। আমরা দু’সপ্তাহ পরে রওয়ানা দেব।”

“সুলতান।” ওয়াজির খান মাথা নত করে।

***

শীতল ধরণীর বুকে ঘোড়ার খুর আঘাত করে, তারপরে আবার, যেন তাদের খুরের বোলই একমাত্র বাস্তবতা। বাবর ক্লান্তিতে টলতে থাকলে সে তার ঘোড়ার কেশর আঙ্গুল দিয়ে পেচিয়ে ধরে নিজেকে সামলে নেয়। আকশী দূর্গ ত্যাগ করার পরে, প্রতিদিন সে অগ্রগামী বাহিনীর সাথে রওয়ানা হয়েছে, তাবু, রান্নার সরঞ্জাম আর রসদবাহী, ভারবাহী পশুর দলকে ছেড়ে এবং প্রতিদিন রাতের বেলা আবার পশ্চাদবর্তী তাদের সাথে এসে যোগ দিয়েছে। চারদিন আগে তার পুরো বাহিনী ফারগানা অতিক্রম করে সমরকন্দের ভূমিতে প্রবেশ করেছে কিন্তু নিঃসঙ্গ কয়েকজন পশুপালক ছাড়া আর কারও দেখা তারা পায়নি।

বাবর উপরের দিকে তাকায়। এক ঘণ্টার ভিতরে সূর্য তাদের সামনে অস্ত যাবে কিন্তু তার আগেই পাহাড়ী গিরিপথ আর খরস্রোতা নদী অতিক্রম করে পশ্চিমে তাদের তিনশ মাইল পথ পরিক্রমা শেষ হবার কথা। সমরকন্দের অট্টালিকাসমূহের গম্বুজ নৈবেদ্যের মত তাদের সামনে অবারিত পড়ে রয়েছে। সম্ভবত আজ রাতেই সে তৈমূরের রাজধানী অধিকার করবে। বাবর মানসপটে দেখতে পায় নতুন তৈমূর বংশীয় সুলতান তাদের রক্ষা করতে উপস্থিত হয়েছে দেখতে পেয়ে শহরের কৃতজ্ঞ মানুষ তার চারপাশে এসে জড়ো হয়েছে।

ভাবনাটা মনে উদিত হতেই সে তার ঘোড়র পেটে খোঁচা দেয় এবং ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে যাওয়া সত্ত্বেও, জন্তুটা ছিটকে সামনে এগোয়, একটা টিলার ঢাল বেয়ে উঠে যায়। সেখান থেকে কিছুটা দূরে জারাফশান নদীর টলটলে পানির ওপারে রোমাঞ্চকর আকাশের গায়ে আবছাভাবে ফুটে আছে সমরকন্দ। বাবর সম্মোহিতের ন্যায় তাকিয়ে থাকে। তার শ্বাস গলায় আটকে আসে। সম্ভবত, এই মুহূর্তের পূর্বে, সে বিশ্বাসই করতো না সমরকন্দ বলে সত্যি কিছু একটার অস্তিত্ব রয়েছে। এখন আর সন্দেহের অবকাশ নেই। কোনো উপকথার গল্প না, কোনো অশরীরি প্রেতাত্মার আনাগোনায় অতিষ্ট না, কেবল রক্ত মাংসের মানুষের বসবাস রয়েছে এখানে, যা সে নিজের বলে দাবি করতে এসেছে।

বাবর তার কণ্ঠ চিরে একটা উল্লসিত চিৎকার বের করতে চায় কিন্তু তার উল্লাস গলাতেই শুকিয়ে আসে। দক্ষিণে শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে সমরকন্দের প্রসিদ্ধ ফলের বাগানের পত্রহীন গাছ যা কয়েক সপ্তাহ আগেই সুগন্ধি আপেল আর ডালিমের ভারে নুয়ে ছিল সেখানে একটা অস্থায়ী ছাউনি দেখা যায়। হিম বাতাসে নিশান উড়তে দেখা যায় আর রান্নার জন্য তৈরি উনুন থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী পেঁচিয়ে আকাশে উঠে যাচ্ছে। তাকিয়ে থাকার সময়েই বাবর দেখতে পায় অশ্বারোহী একটা বাহিনী ছাউনিতে দুলকি চালে প্রবেশ করেছে, বিভিন্ন তাবুর ভিতর দিয়ে তারা দক্ষতার সাথে বিচরণ করতে করতে এগিয়ে গেলে ট্রাম্পেটের ধাতব শব্দ তাদের স্বাগত জানায়।

তারমানে, তার সমস্ত ব্যগ্রতা সত্ত্বেও, সমরকন্দে প্রথমে পৌঁছান সম্ভাব্য সুলতানের কাতারে সে পড়ে না। কেউ একজন তার আগেই এসে হাজির হয়েছে। ছুরিকাহতের মত হতাশার একটা অনুভূতি তাকে বিদ্ধ করে।

ওয়াজির খান তার পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং সামনের দৃশ্যাবলী দেখে সেও উচ্চস্বরে গাল বকছে। “সুলতান, আমি আমার অগ্রগামী সৈন্যদের পাঠাব।”

“সাইবানি খানের শিবির এটা?”

“আমার মনে হয় না। শিবিরটা যথেষ্ট বড় না। আর মনে হয় না যে শহর কেউ আক্রমণ করেছে বা অবরোধ করেছে, সাইবানি খান এখানে উপস্থিত থাকলে সে চুপ করে বসে থাকতো না।”

“তাহলে কে?”

“আমি জানি না। আমাদের আর সামনে এগোনো ঠিক হবে না। আমরা ঐ পাহাড়ের পাদদেশে ফিরে যাবো, সেখানে বাতাসের আড়ালে ছাউনি ফেলবো, আমাদের অস্তিত্ব কেউ টের পাবে না, আর আগামীকাল আমাদের মূল বাহিনীর এখানে পৌঁছাবার জন্য অপেক্ষা করবো।”

ওয়াজির খান বাবরের অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠা মূর্ত হতাশা ঠিকই বুঝতে পারে। “এই জায়গাটার নাম কোলবা টিলা, আশা আর স্বপ্নের মিলনস্থল। পাঁচ বছর আগে আপনার মরহুম আব্বাজানের সাথে, এখানে, এই স্থানে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম আমাদের পিছনে ছিল ফারগানার সেনাবাহিনী। সুলতান, আপনার মত তিনিও সমরকন্দের দিকে তাকিয়ে ছিলেন এবং যা দেখেছিলেন সেটা তার হৃদয়ে শ্বাসরুদ্ধকর উচ্চাশা আর কামনার জন্ম দিয়েছিলো।”

“তারপরে কি হয়েছিলো?”

“সমরকন্দের সুলতান পশ্চিমে বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত ছিলেন। আক্রমণের জন্য সময়টা ছিল নিখুঁত, কিন্তু আল্লাহ্র অভিপ্রায় বোঝা মুশকিল। সেদিন রাতেই আপনার আব্বাজান, যিনি এত তীব্র গতিতে ঘোড়া দাবড়ে এসেছিলেন যে তার শ্রেষ্ঠ ঘোড়াগুলোর একটা ক্লান্তির ধকল সামলাতে পারেনি, এমন ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত হন যে হেকিমরা তাকে বাঁচাবার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলো। আমাদের সামনে ফিরে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো গত্যন্তর ছিল না। আপনার আব্বাজান কষ্ট পেয়েছিলেন কিন্তু সেটাই ছিল তার নিয়তি।”

“আমার আব্বাজান আর চাচাজান পরস্পরকে এত ঘৃণা করতো কেন? তারা রক্তসম্পর্কের ভাই।”

“সৎ-ভাই, ভিন্ন মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া এবং যে মুহূর্ত থেকে তারা বুঝতে পারে যে দু’জনেই একই জিনিস কামনা করে-তৈমূরের শহর, তারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হয়। আপনার চাচাজান ছিলেন চার বছরের বড়। তিনি সমরকন্দ দখল করেন আর বাকি জীবনটা সেজন্য আপনার আব্বাজানকে বিব্রত করতে ব্যয় করেছেন। কিন্তু আপনার আব্বাজান এমন কিছু অর্জন করেছিলেন যেটা তিনি পারেননি। তার অসংখ্য স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও, এবং হেকিমের ভেষজ আর মালিশ ব্যবহার করেও তিনি একজন উত্তরাধিকারীর জন্ম দিতে ব্যর্থ হন যে তার অবর্তমানে মসনদে অধিষ্ঠিত হবে। অন্য কোনো কারণে না, কেবল এ জন্যই তিনি আপনার আব্বাজানকে ক্ষমা করতে পারেননি। এজন্যই তিনি আপনার কাছ থেকে ফারগানা ছিনিয়ে নেবার পায়তারা করেছিলেন। সম্ভবত আপনাকে জানে শেষ করে দেবারও অভিপ্রায় তার ছিল।”

বাবর মানসপটে চাচাজানের অগ্রসর হবার সংবাদে তার বিহ্বল আম্মিজানকে তীব্র যন্ত্রণায় কাঁদতে দেখে। চাচাজানের শত্রুতার আসল কারণ তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর সময়ে তার চাচাজান ভুল বুঝতে পারেন এবং তৈমূরের আংটি তাকে দিয়ে যান। এটা নিয়তির কারসাজি ছাড়া আর কি? সমরকন্দ শাসন করাই তার নিয়তি, এবং তার আব্বাজানের মত সারা জীবন নিজেকে হতাশার জালে জড়িয়ে রাখতে হবে না।

“সুলতান, ফিরে চলুন।”

বাবর বুনো উন্মত্ততায় ঘোড়া দাবড়ে গিয়ে এসব অনাহুত আগন্তুকদের মুখোমুখি হয়ে তার স্বপ্নে বাগড়া দেয়ার জন্য তাদের একটা চরম শিক্ষা দেয়ার অভিপ্রায় অনেক কষ্টে দমন করে। বিষণ্ণ চিত্তে সে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয় এবং কোলবা টিলার উপর থেকে বাড়ন্ত ঘাসের ঢিবির মধ্যে দিয়ে ওয়াজির খানকে অনুসরণ করে নিচে নেমে আসে।

শীঘ্রই তাবু টাঙানো হয় কিন্তু ধোঁয়ার গন্ধে সমতলে ছাউনি ফেলা লোকগুলো টের পেয়ে যাবে ভেবে গরম খাবারের বন্দোবস্ত করা হয় না। তাপমাত্রা হ্রাস পেতে বাবর কয়েক পরত ভারী ঝাঝালো গন্ধের ভেড়ার চামড়া গায়ে চাপিয়েও শীতে কাঁপতে থাকে। অবশেষে নিজের অজান্তে কখন যেন সে ঘুমিয়ে পড়ে তাকে ঝাঁকি দিয়ে কেউ তার তন্দ্রা ভাঙালে তার মনে হয় কয়েক মিনিট অতিক্রান্ত হয়েছে। “সুলতান, আমার কাছে সংবাদ আছে।” ওয়াজির খান তার পাশে হাঁটু ভেঙে বসে আছে। তার মুখের অভিব্যক্তিও অনেকটাই স্বাভাবিক। এমনকি সেখানে সামান্য হাসির আভাসও সে যেন দেখতে পায়। “আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে আমরা হৃদয় বিনিময়ের কোনো ঘটনায় বাগড়া দিয়েছি।”

“আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?”

“পাঁচদিন আগে, কুনদুজের শাহজাদা, আপনার জ্ঞাতি ভাই মাহমুদ এখানে উপস্থিত হন। পুরো শহর না কেবল একটা মেয়েকে এখান নিয়ে যাবার অভিপ্রায় তার ছিল। সমরকন্দের বিশৃঙ্খলার ভিতরে সে ভেবেছিল নিঃশব্দে ভেতরে প্রবেশ করে তাকে খুঁজে বের করবে। মেয়েটা আর কেউ না প্রধান উজিরের কন্যা।”

“সে বসে আছে কেন?” বাবরের নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। তার আম্মিজানের প্রিয় বোনের ছেলে মাহমুদকে শেষবার যখন দেখেছে তখন সে ছিল উচ্ছল, দুরন্ত একটা ছেলে, যার মুখে তখনও দাড়ি গজায়নি আর বাঁদরামির কারণে, যাকে প্রায়ই ঝামেলায় পড়তে হত। বাবর অন্ধের মত তার পেছনে ঘুরে বেড়াত। সেই মাহমুদ একটা মেয়ের জন্য বিরহে কাতর হয়ে মনোকষ্টে ভুগছে এই ধারণাটাই তার কাছে হাস্যকর মনে হয়।

ওয়াজির খানের মুখে আবার চিরাচরিত গম্ভীর অভিব্যক্তি ফিরে এসেছে। “আপনার ভাই শহরের প্রবেশ দ্বার রুদ্ধ দেখতে পেয়েছেন। প্রধান উজির নিজেকে সমরকন্দের সুলতান বলে ঘোষণা করেছে- শহর আর আশেপাশের পুরো এলাকার।

“সে এই অধিকার কিভাবে লাভ করলো?”

“কোনভাবেই না। তৈমূরের সাথে তার কোনো রক্তের সম্বন্ধ নেই। কিন্তু সে ক্ষমতাবান। কোষাগার তার নিয়ন্ত্রণে সে ইচ্ছা করলে যে কাউকে ঘুষ দিয়ে বশ করতে পারে।”

“কিন্তু তিনি যখন শুনবেন প্রয়াত সুলতানের ভাস্তে আমি এখানে এসেছি তিনি নিশ্চয়ই তার দাবি ত্যাগ করবেন। তিনি তার চারপাশের লোকদের উদ্দেশ্যে যতই মোহর বর্ষণ করুক আমার দাবি তার চেয়ে অনেক জোরাল।”

বাবরের কণ্ঠের বালকসুলভ ক্রোধ টের পেয়ে ওয়াজির খান আবার হেসে উঠে। “তিনি সংবাদ পেয়েছেন যে আপনি আসছেন কিন্তু তিনি ঘোষণা দিয়ে বসেছেন যে কোনো অনভিজ্ঞ কিশোরের হাতে তিনি মসনদ ছেড়ে দেবেন না। আর শাহজাদা মাহমুদের সাথেও নিজের মেয়ে বিয়ে দেবেন না। তিনি মনে মনে পরিকল্পনা করেছেন আপনার আরেক জ্ঞাতি ভাই- কাবুলের শাহজাদার সাথে তার মেয়ের বিয়ে দেবেন।”

“আমরা তাকে বিয়ে দেওয়াচ্ছি।” বাবর লাফিয়ে উঠে দাঁড়াতে তার গায়ের ভেড়ার চামড়ার কম্বল ছিটকে যায়। “আমার ঘোড়া নিয়ে আসতে বলেন, আমি আমার ভাইয়ের শিবিরে যাব।”

আকাশে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে এমন সময় বাবর তার দেহরক্ষীদের সাথে নিয়ে, মাহমুদের ছাউনির দিকে এগিয়ে যায়, একটা কালো আলখাল্লায় তার আপাদমস্তক আবৃত।

“হুঁশিয়ার।” নির্জীব ধূসর আলোর পেছন থেকে এক সৈনিকের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। “নিজের পরিচয় দেন।”

“বাবর, ফারগানার সুলতান, যিনি তার ভাই কুন্দুজের শাহজাদা মাহমুদের, সাথে দেখা করতে ইচ্ছুক।”

নিরবতা, তারপরে বিড়বিড় আলোচনা, তারপরে একটা জ্বলন্ত মশাল উঁচু করে ধরতে চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠে। সৈন্যরা তার ছোট দলটা ঘিরে রাখতে বাবর হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে। অবশেষে সে একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, সে শেষবার যেমন শুনেছিল তার চেয়ে এখন অনেক গম্ভীর হয়েছে কিন্তু আন্তরিকতা সেই আগের মতই আছে। “ভাই, তোমাকে স্বাগতম।” ঘাড় পর্যন্ত লম্বা কালো অবিন্যস্ত চুল, বাম হাতের দাস্তানায় একটা বাজপাখি নিয়ে মাহমুদ এগিয়ে এসে। ডানহাত দিয়ে বাবরের কাঁধ জড়িয়ে ধরে। “অসময়ে এসে ভোর বেলা বাজপাখি দিয়ে শিকারের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি খুশি হয়েছি তোমাকে দেখে।” সে একটা বিশাল বর্গাকার তাবুর দিকে ইশারা করে।

মাটিতে পুরু গালিচা পাতা এবং দেয়াল আর ছাদ কাপড়ের পর্দা দিয়ে আড়াল করা। মাহমুদ তার বাজপাখির চোখে ঠুলি পরিয়ে সোনালী দাঁড়ে বসিয়ে দেয়, আর নিজে মখমলের তাকিয়ার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাবরও তার দেখাদেখি একই কাজ করে। “তোমার আব্বাজানের মৃত্যুর সংবাদ শুনে আমি দুঃখ পেয়েছি। তিনি ছিলেন একজন খাঁটি মানুষ আর মহান যোদ্ধা। তার আত্মা শান্তি লাভ করুক। কুন্দুজে আমরা তার স্মরণে নিশ্চয়ই শোক পালন করেছি।”

“ধন্যবাদ।” বাবর মাথা নামিয়ে বলে।

“আর আমার খুদে ভাইটা এখন তাহলে সুলতান।”

“আপনি যেমন একদিন হবেন।”

মাহমুদ হাসে। “সত্যি।”

“কিন্তু আজ আপনার ভাবনা অন্য খাতে বইছে।”

মাহমুদের হাসি কান পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে। “বাবর, তুমি যদি তাকে দেখতে। রেশমের মত ত্বক, ধনুকের ছিলার মত টানটান দেহ আর প্রায় আমারই সমান লম্বা। আমি তাকে বেগম করবো। আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছি আর সেটা ভঙ্গ করার কোনো অভিপ্রায় আমার নেই।”

“তোমাদের দেখা হয়েছিলো কোথায়?”

“সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা কোরো না- আমি মোটেই মেয়েদের ছদ্মবেশে উজিরের হারেমে গোপনে প্রবেশ করিনি। ব্যাপার হয়েছে কি, গত বছর তার বাবা সমরকন্দ থেকে কুন্দুজ আসছিলো রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব নিয়ে তখন সে তার সাথে সফরসঙ্গী হিসাবে ছিলো। তারা আমাদের উত্তরের সীমান্ত দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে দস্যুদের কবলে পড়ে। আমি আমার সৈন্যদের নিয়ে যাচ্ছিলাম তাদের অভ্যর্থনা জানাতে। আক্রমণ যখন হয় আমরা নিকটেই ছিলাম। আমরা শোরগোলের শব্দ শুনে তাদের উদ্ধার করতে ছুটে যাই। আর তখনই আমি তাকে প্রথম দেখি- সে একটা পাথরের পেছন থেকে যার আড়ালে সে লুকিয়ে ছিল বের হয়ে আসে, তার নেকাব আর পরণের কাপড় অর্ধেকই ছেঁড়া…” মাহমুদ চুপ করে যায় সেই নয়নাভিরাম দৃশ্য আবার কল্পনা করে।

“প্রধান উজিরের উচিত তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা।”

“সে তাই ছিল। কিন্তু কুন্দুজ কাবুলের মত সমৃদ্ধ না।” মাহমুদ কাঁধ ঝাঁকায়। “আর, ভাইটি তুমি কি জন্য এখানে এসেছো?”

“উচ্চাশা নেই এমন লোকের থেকে সাবধান।” বাবরের মনে তার আব্বাজানের এই কথাটা অনাদিষ্টভাবেই চকিতের জন্য উঁকি দেয়। কিন্তু যার উচ্চাশা আছে তার থেকেও কি সতর্ক থাকা উচিত নয়? মাহমুদ কি আসলেই এই সময়ে সমরকন্দ এসেছে কেবলই একটা মেয়ের জন্য, হোক না সে যতই রূপসী?

বাবর ঠিক করে সত্যি কথাই বলবে। “সমরকন্দের সুলতান যদিও আমার আব্বাজানের ভাই ছিলেন কিন্তু তিনি মোটেই ফারগানার মিত্র ছিলেন না আর আমাকে মসনদ চ্যুত করার ব্যবস্থা প্রায় পাকা করে ফেলেছিলেন। কিন্তু পথে মৃত্যু বরণ করার সময়ে তিনি তার লোকদের আদেশ দিয়ে যায় এটা আমার কাছে পৌঁছে দেবার জন্য।” বাবর তার হাত প্রসারিত করে দেখায়। তার অনামিকায় তৈমূরের অঙ্গুরীয়, এখন আর তাতে রক্তের দাগ লেগে নেই, শোভা পাচ্ছে। আংটিটা তার হাতে সামান্য বড় হলেও সে লাল রেশমের সুতো দিয়ে ব্যাপারটা আপাতত সামলে নিয়েছে। জ্বলন্ত কাঠ কয়লার কুলঙ্গি থেকে ভেসে আসা আলোয় আংটিটা দ্যুতি ছড়ায় আর সে শুনতে পায় মাহমুদ জোরে শ্বাস নেয়।

“তুমি বিশ্বাস কর যে তুমিই তৈমূরের উত্তরাধিকারী?”

“আমার ধমনীতে তার রক্ত বইছে। আমি আমার শহর ঠিকই আদায় করে নেব।”

“আমার ধমনীতেও তার রক্তই বইছে,” মাহমুদ মৃদু কণ্ঠে বলে। তারা পরস্পরের চোখের দিকে তাকায় আর সহসা যেন দুজনের চোখ থেকেই সব বালখিল্যতা উধাও হয়ে যায়। বাবর কৃতজ্ঞ বোধ করে যে তার খঞ্জরটা দামী রত্নখচিত খাপসহ তার কোমরের বেগুনী পরিকরের ভেতরে গোজা রয়েছে বলে।

“দুশ্চিন্তা কোরো না, খুদে ভাইটি- যদিও সম্ভবত তোমাকে আর খুদে বলার অবকাশ নেই। নেকড়ে মায়ের মুখের অনুভূতির মতই কিছু একটা আমি দেখছি যার শাবক সামান্য আগেই আমার হাতে খুন হয়েছে।” মাহমুদ আবার হাসতে শুরু করে। “এটা সত্যি যে আমি সমরকন্দে এসেছিলাম কারণ মনে হয়েছিলো শহরটায় একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে। কিন্তু আমার ছাউনি ভালো করে দেখো আমার সাথে একশোর বেশি লোক নেই। শহর অবরোধের কোনো অভিপ্রায় আমার ছিল না, আমি এসেছিলাম আচমকা হামলা চালিয়ে কিছু সম্পদ বাগিয়ে নেয়া আর এখানের আগুন প্রশমিত করতে।” সে একটা ভেংচি কেটে দুপায়ের ফাঁকে উদ্দেশ্যপ্রনোদিত ভঙ্গিতে হাত বুলায়।

“তোমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হোক। আগুন নির্বাপিত হোক।”

“আর ভাইটি তোমার সাথে কতজন লোক আছে?”

“আমরা মূল বাহিনী যখন এসে পৌঁছাবে তখন সেটা হবে ছয় হাজারের বেশি যোদ্ধার একটা বহর যাদের ভিতরে অনেকেই তীরন্দাজ।” বাস্তবে বাবরের সৈন্য। সংখ্যা টেনেটুনে পাঁচ হাজার হবে কিন্তু একটু বাড়িয়ে বলতে ক্ষতি কি।

মাহমুদ বেশ অবাক হয়েছে বোঝা যায়। “আমি ভাবিনি যে ফারগানা এত বড় একটা সৈন্যবহর একত্রিত করতে পারবে।”

“অনেকেই আমার বেতনভোগী আর তাদের লোকজন কিন্তু বাকীরা পাহাড়ী গোত্রগুলি থেকে এসেছে।”

“চলো আমরা একসাথে আক্রমণ করি।” মাহমুদ বাবরের হাত আঁকড়ে বলে। “প্রধান উজিরের মাথা তুমি একটা বর্শার ফলায় গেথে নিলে আমি আমার বেগমকে লাভ করবো।”

“ক্ষতি কি?” বাবর হেসে বলে। তার প্রশিক্ষিত সৈন্যবহর থাকতে মাহমুদ কোনো বেগরবাই করতে পারবে না, আর মসনদের দিকে তাকাবার তার প্রশ্নই উঠে না।

***

দু’মাস পরে তার লোকেরা যখন ক্লান্ত পায়ে পূর্বে ফারগানার দিকে ফিরে চলে তখন ব্যর্থতার জ্বালায় জ্বলতে থাকা বাবর শীতের কোনো তীব্রতাই টের পায় না। ঘোড়াগুলোর, আলুথালু কেশরে তুষারকণা আটকে আছে, পেছনের পায়ের মাঝখানের জোড়া অব্দি বরফে দেবে যায়। নাক টেনে এগিয়ে যাবার জন্য তারা চেষ্টা করতে থাকলে তাদের নিঃশ্বাস থেকে কুয়াশার মেঘ সৃষ্টি হয়। কোথাও কোথাও বরফ এত পুরু যে সওয়ারী তখন বাধ্য হয় নিজের ওজনের ভার থেকে পশুটাকে রেহাই দিতে এবং তারপরে সেও তার পাশে পাশে কষ্ট করতে থাকে। মালপত্র রসদের বেশিরভাগই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরিত্যক্ত অবস্থায় বরফের ভেতরে পড়ে থাকে।

বাবর বিষণ্ণ মনে ভাবে, এবারের অভিযান এমনভাবে শেষ হবার কথা ছিল না। লাল সুতো দিয়ে মোটা করা আংটিটা তার আঙ্গুলে তারপরেও একটু ঢিলে হয়। পুরোটাই একটা দর্পোদ্ধত অভিজ্ঞতা তার ব্যর্থতা আর অপমানের সাক্ষর।

ওয়াজির খান তার পাশেই রয়েছে, ভারী উলের কম্বলে আবৃত থাকায় দাড়ি আর ভুরুতে বরফ জমেছে। ধূসর আকাশে ভারী তুষারপাতের সম্ভাবনায় মেঘের আনাগোনা শুরু হতে হাজির হয়েছে, ওয়াজির খান তাকে অনুরোধ করেছিলো আক্রমণ স্থগিত রাখার জন্য নিষ্ঠুর নিয়তে শীতকাল এবার আগেই এসে। কিন্তু বাবর সে অনুরোধে কর্ণপাত করেনি- মাহমুদও যখন তার দু’পায়ের মাঝের আগুন নির্বাপিত না করেই বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়েছিলো তখনও না, বা যখন তার টাকা দিয়ে কেনা মিত্র আর পাহাড়ী অধিবাসীরা লুঠপাটের কথা বলে সেটা না করতে পারার জন্য গাল বকতে বকতে ফিরে যায় তখনও তার সম্বিৎ ফিরেনি। আর এখন সে তার অহঙ্কার আর ঔদ্ধত্যের মূল্য পরিশোধ করছে। সমরকন্দের প্রাকার তারা ভাঙতে পারেনি আর শহরের ভেতরে প্রধান উজির যে মসনদ তার না সেটা আগলে বসে রয়েছে আর সাথে আছে তার মেয়ে যার জন্য সে বিশাল পরিকল্পনা তৈরি করেছে- মাহমুদ না নিজের মেয়ের কুমারীত্ব সে কাবুলের শাহজাদার কাছে সমর্পন করবে।

“মহামান্য সুলতান, আমরা আবার ফিরে আসব।” ওয়াজির খান বরাবরের মতই এবারও তার মনের কথা বুঝতে পেরেছে। শীতে অসার হয়ে আসা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে আসা শব্দগুলো ধীরে ধীরে ভেসে আসে। “এটা ছিল কেবল একটা হামলা। আমরা একটা সুযোগ দেখে সেটা নিয়েছিলাম কিন্তু পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে ছিল না।”

“ওয়াজির খান, সেটাই আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। আমি যখন চিন্তা করি কি হতে পারত তখন মনে হয় কেউ যেন আমার পাজরে জ্বলন্ত খঞ্জর ঢুকিয়ে দিয়েছে…”

“কিন্তু যুদ্ধের প্রথম স্বাদ আপনি লাভ করেছেন। পরেরবার আমরা প্রস্তুতি নিয়ে আসব এবং পুরো সাজসজ্জার সাথে আর তখন আপনি জানবেন সাফল্য কাকে বলে।” নিজের দুর্ভোগ সত্ত্বেও, কথাগুলো বাবরকে উৎফুল্ল করে তুলে। সে কিশোর বয়সী। ইতিমধ্যেই একটা রাজ্যের সুলতান। সমরকন্দ এই শীতে সে দখল করতে পারেনি- এই সত্যিটা স্বীকার করার ভিতরে সে কোনো দুর্বলতা খুঁজে পায় না। দুর্বলতা লুকিয়ে থাকে হতাশার ভিতরে, যখন বুকে দম আর বাহুতে বল থাকা সত্ত্বেও, কেউ হাল ছেড়ে দেয় এবং সেটা সে কখনই করবে না। “আমি আবার ফিরে আসব,” বাতাসের গর্জন ছাপিয়ে সে চিৎকার করে উঠে এবং মাথা উঁচু করে তার বাবার শিখিয়ে দেয়া রণহুঙ্কার দেয়। স্পর্ধিত শব্দটা শীতের ঝড়ো বাতাসে মিলিয়ে যায় বটে কিন্তু তার প্রতিধ্বনি বাবরের মস্তিষ্কে অনুরণিত হতেই থাকে।

১.৪ সমৃদ্ধির শহরে

০৪. সমৃদ্ধির শহরে

বাবরের সৌভাগ্যেই বলতে হবে যে খুনী তাড়নায় সময়ের আগে হাজির হওয়া শীতকাল এবার বসন্তের অকালবোধনে শেষ হয়েছে। বাবর তার কামরায় দাঁড়িয়ে বালকের দলকে জমে থাকা জাক্সারটাসের বুকে পাথর ছুঁড়ে মারতে দেখে, বরফের বুকে সৃষ্টি হওয়া ফাটল দিয়ে পানি উথলে উঠে। কয়েকটা নিশ্চিন্ত ভেড়া জমে থাকা স্রোতের উপর চড়ে বেড়াচ্ছিল, শীতল তোড়ে তারা ভেসে যায়। তাদের মিহি, উচ্চ মাত্রার আর্তস্বর কয়েক সেকেন্ড পরেই মিলিয়ে যায়।

জাক্সারটাসের পরে এগিয়ে যাওয়া সমভূমিতে, তার গোত্রপতিরা আবার নিজেদের লোকজন নিয়ে এসে ছাউনি ফেলেছে। এবার ডাক পাঠাবার সময়ে সে তার বার্তাবাহকদের আরও দূরে যেতে বলেছে, উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম চারদিক থেকে যাযাবর গোত্রগুলিকে প্রাচুর্যপূর্ণ লুণ্ঠিতদ্রব্যের প্রতিশ্রুতি ফুলের কাছে মৌমাছির মত টেনে এনেছে। সাইবানি খান তার উত্তরের শীতকালীন আশ্রয়ে আটকে থাকার কারণে, বাবর ভাবে, আক্রমণের এটাই উত্তম সময়। শীঘ্রই সে তার বাহিনীকে যাত্রার আদেশ দেবে।

কিন্তু সমরকন্দের অভিমুখে তার অসমাপ্ত অভিযান শুরু করার পূর্বে আম্মিজানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসতে হবে সে দ্রুতপায়ে তার কামরার দিকে এগিয়ে যায়। এইবার, খুতলাঘ নিগারের পিতলের বার্ণিশ করা আয়নায় সে তার ভিন্ন। চেহারা দেখে যার সাথে আব্বাজানের মারা যাবার রাতের সেই অনিশ্চিত অন্ধকার সময়ের চেহারার কোনো মিল নেই। কয়েক সপ্তাহ আগে বাবর তার ত্রয়োদশ জন্মদিন উদযাপন করেছে। তার গালে হাল্কা শত্রু দেখা দিয়েছে আর আগের চেয়ে সে অনেকটাই লম্বা আর চওড়া হয়েছে। কণ্ঠস্বরে ভাঙন এসেছে আর তৈমূরের অঙ্গুরীয় এখন আর আঙ্গুলে মোটেই ঢিলে হয় না।

“বাছা, তুমি দ্রুত যুবকে পরিণত হচ্ছো।” আম্মিজান তাকে বিদায় চুম্বন দিতে তার কণ্ঠে গর্বের প্রচ্ছন্ন ছোঁয়া টের পাওয়া যায়। এমন কি সন্তুষ্ট-আর সেই কঠোর বুড়িকে প্রীত করা কোনো মামুলি বিষয় না, কুচকে যাওয়া কিশমিশের মতই যার মুখের ত্বক কিন্তু তার ক্ষুরধার চোখে কিছুই এড়িয়ে যাবার জো নেই।

“শহরটা আমার দখলে আসবার পরে আমি তোমাদের সবাইকে নিয়ে যাবার জন্য লোক পাঠাব।”

“তুমি ওয়াদা করছো?” খানজাদা নিমেষে চিবুক উঁচু করে জানতে চায়। “ওয়াদা করছি।” সে নিচু হয় বোনকে চুমো দেয়ার জন্য যে এখন বাবরকে প্রীত করে, লম্বায় তার চেয়ে ইঞ্চি ছয়েক খাটো।

হারেমের ভিতর দিয়ে ফিরে আসার সময়ে সে একটা খোলা দরজা অতিক্রম করে। জানালাবিহীন কক্ষটায় তেলের প্রদীপের মৃদু আলোয় এক লম্বা তরুণী কেবল কাচুলী আর গোলাপী ফুলের ছোপ তোলা ঘাঘড়া পরিহিত অবস্থায় সামনে ঝুঁকে বসে চুল আচড়াচ্ছে। বাবর নিচু চৌকাঠ অতিক্রম করে।

সে তাকে দেখা মাত্র হাঁটু ভেঙে বসে কপাল মাটিতে ঠেকায় আর তার মাথার চুল চকচকে পানির মত চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। “ফারগানার সুলতান, বাবরকে আমার অভিনন্দন। আল্লাহতালা আপনার উপর প্রসন্ন হোন।” তার কণ্ঠস্বর চাপা কিন্তু পরিষ্কার উত্তরের পাহাড়ী মানুষের টান তাতে স্পষ্ট।

“আপনি দাঁড়াতে পারেন।”

মার্জিত ভঙ্গিতে সে উঠে দাঁড়ায়। তার চোখ পটলচেরা, দেহবল্লরী তন্বী এবং মধুর রঙের মত ত্বক। বাবর খেয়াল করে তার কামরার এককোণে রাখা পুরান দুটো কাঠের সিন্দুক থেকে কাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

“আমি ভ্রমণ করে ক্লান্ত। আমার পরিচারকদের বলেছি আমাকে একটু একা থাকতে…” সে কথা শেষ না করেই থেমে যায় এবং বাবর তার চেহারায় অনিশ্চয়তা ভর করতে দেখে যেন সে কিছু একটা ভোলা করে দেখছে। সে ঘুরে দাঁড়ায় বেরিয়ে আসার জন্য। সৈন্যবহর যাত্রা শুরু করার আগে আরো অনেক কিছু তদারকি করা বাকি।

আমাকে এখানে নিয়ে আসবার জন্য “সুলতানকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাই।” সে তার দিকে একপা এগিয়ে আসলে বাবরের নাকে মৃগনাভীর গন্ধ ভেসে আসে। “আমার বাবার রক্ষিতারা, অবশ্যই, আমার দূর্গে সাদরে আমন্ত্রিত।”

“আর সেই রক্ষিতার গর্ভে তার ঔরসজাত সন্তান?”

একটা বিরক্তিবোধ ক্ষণিকের জন্য বাবরকে আপুত করে। “অবশ্যই।” এই রোক্সানার সামান্য গোত্রপতির কন্যার কোনো অধিকার নেই তাকে এই প্রশ্ন করার। তার অস্তিত্বের কথা সে কেবল কয়েক সপ্তাহ আগে জানতে পেরেছে। কোনো দুর্বোধ্য কারণে তার মরহুম আব্বাজান তাকে দূর্গে নিয়ে না এসে তার নিজের লোকদের মাঝেই তাকে রেখেছিলেন। শিকারে গেলেই কেবল তিনি তার সাথে দেখা করতেন। রোক্সানার কথা তিনি কাউকে বলেননি। একথাও কখনও বলেননি, যে আট বছর আগে যখন তার বয়স চৌদ্দ বছরের বেশি কোনভাবেই না, তখন রোক্সানা তাকে একটি পুত্রসন্তান উপহার দিয়েছে, জাহাঙ্গীর।

তুষারপাত শেষ হবার ঠিক পরপরই, যখন রোক্সানার বাবা দূর্গে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন তখন কেউই অবিন্যস্ত দাড়িশোভিত মলিন গোত্রপতিকে ভালো করে লক্ষ্যই করেনি। সে তখন ভেড়ার চামড়ার কোটের ভেতরের পকেট থেকে বাবরের বাবার নিজের হাতে লেখা একটা চিঠি বের করে যেখানে তিনি রোক্সানাকে তার রক্ষিতা আর ছেলেকে নিজের বংশধর বলে স্বীকার করেছেন। সেখানে আরও লেখা আছে তার অকালমৃত্যু ঘটলে রোক্সানাকে যেন শাহী হারেমের নিরাপত্তায় নিয়ে আসা হয়।

খুতলাঘ নিগার কোনো উচ্চবাচ্য করে ব্যাপারটা মেনে নেন। তার স্বামীর অধিকার আছে যত ইচ্ছা রক্ষিতা রাখার আর বস্তুত তার স্ত্রীর সংখ্যা তিনজন। খুতলাঘ নিগার নিজে তো জানেন তিনিই ছিলেন তার ভালোবাসা, প্রতিদিনের সহচরী, তার উত্তরাধিকারী সন্তানের মাতা। পৃথিবীর আর কোনো দম্পতি তাদের শারীরিক আর মানসিক বন্ধনের জুড়ি হতে পারবে না। তাদের মিলনের আত্মিক অভিরূপ এমনই যে তাদের কেবল দুটি সন্তান বেঁচে আছে। রোক্সানা আর বাবরের সভাইয়ের অপ্রত্যাশিত আবির্ভাব তাকে মোটেই বিচলিত করেনি। আর তাই আম্মিজান যখন বাবরকে অনুরোধ করেন, সে অন্যসব অল্পবয়সী ছেলের মতই নিজের বাবা-মা’র প্রেমের বিষয়ে আলাপ করতে অস্বস্তি বোধ করে, আলোচনাটা সংক্ষিপ্ত করতে চায়। তাকে তার সন্তানকে নিয়ে আসতে দাও,” তিনি অবশেষে শীতল কণ্ঠে আলোচনা শেষ করেন। বাবর পরে খেয়াল করে দেখেছে যে খুতলাঘ নিগারের কামরার পাশেই রোক্সানার জন্য কামরা বরাদ্দ করা হয়েছে। অচেনা লোকদের মাঝে এসে উপস্থিত হওয়া নারীর প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন? মোটেই না। তিনি তাকে কাছে রেখেছেন যেন তার উপরে লক্ষ্য রাখতে পারেন।

“সুলতানের মহানুভবতার তুলনা হয় না। রোক্সানা এবার তার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠে। “আপনার ভাইও আপনাকে তার কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে।”

সভাই, বাবর ভাবে, এবং মোটেই হাসির উত্তর দেয় না। সে তাকে এখনও দেখেনি। ছেলেটা কোনো কারণে জ্বরে আক্রান্ত সন্দেহ নেই মশার বা আটুলির কামড়ের ফল। খুতলাঘ নিগার তাকে এবিষয়ে কিছুই বলেনি। “আপনার সন্তান শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠুক, বাবর বলে। সৌজন্যমূলক বাক্য কিন্তু বাবর জানে বাক্যটায় শীতল একটা অনুভূতি রয়েছে। সেটা বাবরের ইচ্ছাকৃত। গোড়ালির উপরে ঘুরে দাঁড়িয়ে বাবর দ্রুত বের হয়ে যায়, তার মন ইতিমধ্যেই আসন্ন অভিযানের উত্তেজনায় ব্যপৃত হয়ে পড়েছে।

***

চোখে প্রচ্ছন্ন গর্ব নিয়ে বাবর তার অশ্বারোহী বাহিনীকে পশ্চিমের চারণভূমিতে ছড়িয়ে পড়তে দেখে, সে ভাবে এবারের অভিযানের জন্য আট হাজার লোক আমার আহবানে সাড়া দিয়েছে। অশ্বারোহী বাহিনীর ঠিক পেছনেই জমিদারদের বরকন্দাজ আর তাদের লোকেরা। তারপরে আছে গাট্টাগোট্টা চেহারার গোত্রপতির দল, বুনো চকরাখের মত, যারা কাশগড় আর ফারগানার মধ্যবর্তী উঁচু পাহাড়ী এলাকায় বাস করে তাদের ঘোড়া, ভেড়া আর লোমশ ইয়াকের পাল নিয়ে। মালবাহী গরুর গাড়িগুলো যাতে লম্বা তীক্ষ্ণ শিংএর বলদ জোতা হয়েছে মালের ভারে সেগুলোর চাকা তীব্র শব্দে প্রতিবাদ জানায়। এইবার ভাগ্যের উপরে সে কিছুই ছেড়ে দেয়নি। তার যুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণাসভায় সে লম্বা অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু বারবার পর্যালোচনা করেছে, অবরোধী অনুষঙ্গ থেকে সমরকন্দের দেয়াল টপকাবার সিঁড়ি, এত লোকের খাবারের বন্দোবস্ত, তাদের শান্ত রেখে বিজয়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে গানবাজনার ব্যবস্থা সবকিছুর দিকেই লক্ষ্য রাখা হয়েছে।

শীতের অলস মাসগুলোতে ওয়াজির খান আর বাবর, তাদের অনুপস্থিতিকালীন সময়ে ফারগানার নিরাপত্তা কিভাবে নিশ্চিত করা যায় সেটাও বিবেচনা করেছে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার উজির কাশিম, যার আনুগত্য আর দক্ষতা প্রশ্নাতীত, তাকেই রাজপ্রতিভূ হিসাবে রেখে যাওয়া হবে। উজবেক অনুপ্রবেশের কোনো সংবাদ এখনও পাওয়া যায়নি, এবং কোনো ধরণের বিপদ হলে কাশিম সাথে সাথে তাকে সংবাদ পাঠাবে।

এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সমরকন্দের শত্রুর মনোভাব আঁচ করা, সে কি করতে পারে। বাবর জানে যে প্রধান উজির এবারও- এখন প্রকাশ্যে নিজেকে সমরকন্দের সুলতান হিসাবে অভিহিত করেন-তার অভিযানের খবর আগেই পাবে। শহরের শস্যাগারে গত বসন্তের ফসল এখনও মজুদ করা আছে এবং শহরের দেয়াল সুরক্ষিত রাখার জন্য সৈন্যদের বিশ্বস্ততা কেনার মত স্বর্ণখণ্ড কোষাগারে মজুদ রয়েছে।

নাগাড়ে দশদিন পথ চলার পরে কোলবা টিলা তাদের দৃশ্যপটে ভেসে উঠে। বাবর ওয়াজির খানের পাঠান রেকীদলের ফেরত আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে না। সে তার ধূসর স্ট্যালিয়নটা পান্নার মত সবুজ ঘাস, যা গত শীতের তুষারপাতের আর্দ্রতায় এখন ও সিক্ত আর মাঝে মাঝে হলুদ, গোলাপী আর সাদা বসন্তের ফুলের নকশায় শোভিত, উপর দিয়ে দাবড়ে নিয়ে যায়। তার ঘোড়ার আগুয়ান গতিতে একটা লম্বা লেজবিশিষ্ট পাখি, শান্তি বিঘ্নিত হতে শূন্যে ডানা ঝাঁপটে ত্রাহি রব তুলে বাতাসের রবাভয়ে নিজেকে উঠিয়ে নেয়। দিগন্তের বুকে আকাশের প্রেক্ষাপটে সমরকন্দের গম্বুজ আর মিনারের দৃশ্যপট সামনে ভেসে উঠলে বাবর টের পায় তার নাড়ীর স্পন্দনে মাদলের বোল উঠছে। পুরো শহরটা ঘিরে আছে একটা শক্তিশালী দেয়ালের ব্যুহ এবং তার ভিতরে বাবরের চোখ খুঁজে নেয় আরেকটা বেষ্টনীর প্রাকার, শহরের ভেতরের নিরাপদতম স্থান তৈমূর যা নিজের সর্বোচ্চ অট্টালিকা কোক সরাই এর চারপাশে নির্মাণ করেছিলো। তার মৃত্যুর পর থেকে জায়গাটার একটা বদনাম ছড়িয়ে পড়েছে। বাবর ছোটবেলা থেকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী শাহজাদাদের নির্যাতন, হত্যা আর অন্ধ করে দেয়ার গল্প এবং প্রাসাদে নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া অমাত্যদের কাহিনী শুনে এসেছে।

বাবর তার আজদাহাটাকে এক জায়গায় স্থির করে দাঁড় করায়। এত দূর থেকেও বাবর টের পায় একটা অতিকায় দানবের মত শহরটা সতর্ক আর উদগ্রীব হয়ে আছে এবং অপেক্ষা করছে। অসংখ্য চোখ বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, অনুমান করতে চেষ্টা করছে কখন আর কোনো দিক থেকে বাবর এসে উপস্থিত হবে এবং তার সাথে লোকবল কত থাকবে। ফারগানা থেকে পশ্চিমে তাদের তিনশ মাইল যাত্রাপথের পুরোটাই গুপ্তচরের নজরদারির ভিতরে ছিল।

এইবার অবশ্য আশেপাশে অন্যকোন অস্থায়ী ছাউনি দেখা যায় না। নিজের বিরহকাতর ভাই মাহমুদের কথা ভেবে বাবর আনমনেই হেসে উঠে। কোনো সন্দেহ নেই নিজের প্রজ্জ্বলিত নিম্নাঞ্চল নির্বাপিত করতে সে ইতিমধ্যেই আরেকজন রমণীকে খুঁজে নিয়েছে। কিন্তু তারপরেও যদি সে তাকে বেগম করতে চায়, বাবর শপথ নেয় উজিরের কন্যা তারই হবে। ভেট হিসাবে বাবর তাকে পাঠিয়ে দেবে।

***

“সুলতান, আপনাকে ধৈৰ্য্যশীল হতে হবে,” ওয়াজির খান গত পাঁচমাস ধরে যা বলে আসছে সে কথারই পুনরাবৃত্তি করে। অস্থায়ী শিবিরের সদাসতর্ক চোখ কানের ব্যাপ্তি এড়িয়ে, একটা ফলবাগানের ভিতরে তারা বসে আছে। ওয়াজির খান শীতের প্রকোপ কমাবার জন্য এক ঝুড়ি জ্বলন্ত কয়লা নিয়ে এসেছিল যার দিকে এখন ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে। এই উষ্ণতাটুকু তাদের প্রয়োজন ছিল। শরৎকাল আসছে। বাতাসে এখনই হাড় কাঁপিয়ে দেয়ার মত কনকনে হিম। “আমি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি আমাদের ভেতরেই বিভীষণ আছে। আমরা নিকুচি শের যখনই শহরের কোনো অংশের দেয়াল আক্রমণ করতে যাই বা নিচে সুড়ঙ্গ বানাই সেখানেই তারা আগে এসে বসে থাকে। খবর পায় কি করে।” বাবর জ্বলন্ত কয়লায় ভিতরে খঞ্জরের অগ্রভাগটা দিয়ে একটা গুতো দেয়।

“সুলতান সব শিবিরেই গুপ্তচর থাকে। এই বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। আর আমাদেরও কি চর নেই শহরের ভেতরে।”

“তারা সবাই ঘোড়ার লাদি পরিষ্কার করছে।”

“আরও অনেক কিছুই করবে, যখন করার সময় হবে। গত পাঁচমাস আমরা শহরটা অবরোধ করে রেখেছি। আমাদের পানি আর রসদের কোনো ঘাটতি নেই কিন্তু শহরের ভেতরের অবস্থা ঠিক উল্টো। শীঘ্রই তারা বাধ্য হবে খাবারের অন্বেষণে লোক পাঠাতে। আমাদের গুপ্তচরদের এখন কেবল সতর্ক থেকে তাদের গোপনে বের হবার রাস্তাটা চিনে নিতে হবে। শক্তি দিয়ে যা কাবু করা যায় না ছলনায় সেটা সহজেই পরাভূত হয়।”

হতাশায় বাবর অব্যক্ত স্বরে গুঙিয়ে উঠে। বিজ্ঞ আর ঠাণ্ডা বিচক্ষণ ওয়াজির খান যে লোক যুদ্ধ বিষয়ক কলাকৌশলে অজ্ঞ বাবরকে নিজ হাতে সবকিছু শিখিয়েছেন তিনি তাকে ভালো করে মনে করিয়ে দেন তার আরও অনেক কিছু শেখার বাকি আছে। বিগত মাসগুলো তাকে অনেক কিছুই শিখিয়েছে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে, সে জেনেছে যেখানে ঘাস আশেপাশের থেকে বেশি লম্বা আর সবুজ, বুঝতে হবে সেখানে লুকান পানির ধারা অবশ্যই আছে। সে শিখেছে যুদ্ধের সম্ভাবনা পিছিয়ে গেলে কিভাবে কুচকাওয়াজ আর শরীরচর্চার মাধ্যমে সৈন্যদের প্রস্তুত আর মনোবল চাঙ্গা রাখতে হবে। সে তাদের আদেশ দিয়েছে সমরকন্দের উঁচু দেয়ালের বাড়াবাড়ি ধরণের কাছে গিয়ে পোলো খেলতে এবং শহরের শ্রেষ্ঠ তীরন্দাজদের হেলায় মোকাবেলা করতে বলে সে ঘোড়ার খুরে মত্ত মাদলের বোল তুলে ছুটে গিয়ে ভেড়ার মাথার বলে তার ম্যালেট দিয়ে আঘাত করেছে যা তারা তাদের খেলা শেষ হলে- ইচ্ছাকৃতভাবে শহর রক্ষাকারী প্রাকারের উপর দিয়ে চরম অবজ্ঞায় ভেতরে ছুঁড়ে দিয়েছে।

বাবর, অন্ধকারে কিভাবে নিরবে দলবল নিয়ে এগিয়ে যেতে হয় এবং কিভাবে লম্বা মই স্থাপন করতে হয় উঁচু দেয়ালের সাথে, যার শীর্ষভাগ ভেড়ার চামড়া মোড়ান রয়েছে কৌতূহল উদ্রেককারী শব্দ রোধ করতে, আয়ত্ব করেছে। মই বেয়ে সে। তাদের সাথে উপরে উঠতে গিয়ে প্রস্তরখন্ড, তীরের ঝাপটা আর বালতি ভর্তি গরম জ্বলন্ত আলকাতরার সামনে পড়েছে এবং পিছিয়ে এসেছে। সে তার লোকদের খোঁড়া অন্ধকার, বালুময় সুড়ঙ্গে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে দেয়ালের দিকে আশা করেছে নিচে দিয়ে যেতে পারবে কিন্তু ফারগানার পাহাড়ের মত অনড় ভিতের মুখোমুখি হয়েছে।

বাবর দিনের বেলায় আক্রমণ করেছে, তার লোকেরা ঘামে ভিজে অতিকায় অবরোধ অনুষঙ্গ টেনে এনেছে বিশাল প্রস্তরখণ্ড ছুঁড়ে মারতে। কিন্তু সমরকন্দের লোহা দিয়ে বাধান গেট আর পুরু দেয়াল এসব ঝাপটা আর মাথায় লোহার পাত দেয়া বড় ভারী কাঠের লাঠির আঘাত অনায়াসে সামলে নিয়েছে।

“আমি বুঝতে পারছি না। আমার চাচা সমরকন্দের সুলতান ছিল। আমি তৈমূরের সাক্ষাৎ বংশধর। আমি আশ্বস্ত করেছি যে শহরে কোনো অরাজকতা সৃষ্টি হবে না। লোকজন নিজের গরজে দরজা খুলে আমাকে প্রবেশ করার জন্য অনুরোধ করছে না কেন? সুদখোর উজিরের ভিতরে তারা কি পেল?”

ওয়াজির খানের হাসি হাসি মুখ দেখে বাবর বুঝতে পারে সে আবার বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে। “এমন হতে পারে সে তাদের ভয় দেখিয়ে বশে রেখেছে। একটা কথা মনে রাখবেন সাধারণ মানুষ আপনাকে চেনে না। তৈমূর মারা যাবার পর থেকে অগণিত সুলতান আর গোত্রপতির দল নিজেকে মহান যোদ্ধার আত্মীয় দাবি করে সমরকন্দ অবরোধ করেছে স্বর্ণ আর সৌভাগ্যের প্রত্যাশায়। আপনার আপন। চাচাও বাহুবলে শহরটা অবরোধ করেছিলেন। শহরবাসীরা উপদ্ৰবকারীর প্রতি কেন সদয় হবে? হাম্বলদস্তা উজিরকে অন্তত তারা চেনে।”

পেঁচার ডাক শুনে তারা আকাশের দিকে তাকায়, সেখানে ইতিমধ্যেই রাতের তারারা বিদায় নিতে শুরু করেছে।

“সুলতান, এবার আমাদের ফেরা উচিত।” ওয়াজির খান কয়লা ভর্তি ঝুড়িটা লাথি মেরে উল্টে দিয়ে জ্বলন্ত কয়লাগুলি পা দিয়ে মাটি চাপা দেয়।

বাবর কেঁপে উঠে, কিন্তু সেটার কারণ কেবল উষ্ণতার সমাপ্তির ভিতরে নিহিত ছিল না। “ওয়াজির খান আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে। আমরা যদি শীঘ্রই শহরটা দখল না করি তবে শীতকাল এসে আবার আমার সৈন্যবাহিনীর দফারফা করে দেবে। আমি বিজয় অর্জন না করেই দ্বিতীয়বারের মত ফারগানায় ফিরে যেতে বাধ্য হব। তখন আমার লোকেরা কি ভাববে আমাকে?”

ওয়াজির খান তার বাহুতে হাত রাখে। “আমাদের হাতে সময় আছে। সূর্য এখনই ক্রান্তিকালে আসেনি। আল্লাহতা’লা সহায় থাকলে, সমরকন্দের পতন হবেই।” বাবর ভাবে, তার কথাই ঠিক। তার মরহুম আব্বাজান অনেক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিলেন কিন্তু তাই বলে কখনও হতাশ হননি। তিনি যেন কি একটা কথা বলতেন? “তোমার সৈন্যরা যদি তোমাকে দ্বিধাগ্রস্থ দেখে তবে সব শেষ। তারা তোমার প্রতি নেতৃত্ব আর নিয়মানুবর্তিতার জন্য তাকিয়ে রয়েছে।” হ্যাঁ, সুলতানের কাজ হচ্ছে শক্ত থাকা। তাকে অবশ্যই এটা মনে রাখতে হবে।

তারা ঘোড়ায় চড়ে ছাউনির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। ছাউনির কাছাকাছি পৌঁছালে ঘোড়ার খুরের বোল ছাপিয়ে একটা লোকের ক্রুদ্ধ কণ্ঠ বাবরের কানে ভেসে আসে। দূর্বিনীত বদমাশগুলো কি নিজেদের ভিতরে আবার ঝামেলা বাধিয়েছে, যারা তার সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় অংশ? বাতাসে শোরগোলের আওয়াজ আরও জোরাল হতে এবং শপথ আর প্রতিজ্ঞার ঝড় বইতে থাকলে, সে ক্লান্ত মনে ভাবে।

হাম্মামখানার তাবুর কাছ থেকে গোলমালের শব্দ আসছে। সে আর ওয়াজির খান আরেকটু সামনে এগিয়ে যেতে, বাবর দেখে তার একজন ভাড়াটে সেনাপতি বনাঞ্চলে বিচরণ করা যাযাবর-নিজের কয়েকজন মার্কামারা সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে দুটো বস্তার জিনিসপত্র তল্লাশি করছে। আরেকজন লোক, পোশাক-আশাক দেখে মনে হয় আশেপাশের গ্রামের কৃষক, দাঁড়িয়ে দেখছে। “আমার কাছ থেকে এভাবে কেড়ে নেবার কোনো অধিকার তোমার নেই। তোমরা যদি সবই এভাবে রেখে দাও-আমার শস্য এমনকি আমার ভেড়াগুলোও বাদ দাওনি, তাহলে এই শীতে আমি আমার পরিবারকে কি খেতে দেব।” লোকটা ইশারায় কাছেই জড়োসড়ো হয়ে থাকা আলুথালু বাদামী রঙের ভেড়ার দিকে ইশারা করে। ক্রোধে লোকটার চোখে পানি টলটল করছে।

এই গোবেচারা, হাল্কা পাতলা, বিপর্যস্ত চেহারার কৃষিজীবি লোকটা ক্রোধে হতাশায় যেসব যোদ্ধাদের সামনে দাপাদাপি করছে তারা হাতের ঝটকায় তাকে জানে মেরে ফেলতে পারে, কিন্তু তার স্পর্ধা চোখে পড়ার মত, কিছু একটা আছে লোকটার ভিতরে, বাবর ভাবে।

“জানে বেঁচে গেলে বলে কপালকে ধন্যবাদ দিতে দিতে তোমার আস্তাকুড়ে ফিরে যাও। আর তোমার স্ত্রীর সাথে দেখা হলে তাকে আমার তরফ থেকে একটা চুমো দিয়ে বোলো, তার সঙ্গ আমি উপভোগ করেছি, যোদ্ধাদের একজন খিকখিক করে হাসতে হাসতে লোকটার পোদে একটা লাথি বসিয়ে দিলে বেচারা দূরে ছিটকে গিয়ে পড়ে। লোকটা উঠতে চেষ্টা করলে আরেকটা লাথি কষিয়ে দেয়।

“এখানে কি হচ্ছে?”

চমকে উঠে বোকা বোকা চোখে লোকগুলো বাবরের দিকে তাকিয়ে থাকে।

“মহামান্য সুলতানের প্রশ্নের উত্তর দাও,” ওয়াজির খান বাঘের ঝাপটা নিয়ে বলে। কিন্তু তবুও কেউ উত্তর দেয় না।

“উঠে দাঁড়াও,” বাবর মাটিতে পড়ে থাকা কৃষককে ইঙ্গিত করতে, সে ধীরে, পেটে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, তার বলিরেখা পূর্ণ মুখে আশঙ্কার আঁকাজোকা। সে যদি সৈন্যদের ঘৃণা করে বোঝাই যায় তাদের সুলতানের প্রতিও তার কোনো আস্থা নেই। সে কারুকার্যময় লাগাম সজ্জিত ঘোড়ায় উপবিষ্ট কর্তৃত্বব্যঞ্জক বালকের কাছ থেকে দূরে সরে আসে।

“যেখানে আছে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকো।” বাবর ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে জীবন্ত চিত্রপটের দিকে তাকিয়ে দেখে। তার সামনে দুটো পাটের তৈরি বস্তা অসহায়ের মত উল্টে পড়ে ভেতরের সব মামুলি জিনিসপত্র ছত্রাকারে ছিটিয়ে রয়েছে। বাবর তার হাতের চামড়ার দাস্তানা খুলে ফেলে, একটা বস্তায় হাত ঢুকায় এবং ভেতর থেকে মলিন কাপড়চোপড়, একটা কাঠের পাত্র এবং কয়েকটা কাপড়ের ব্যাগ বের করে আনে। কাপড়ের ব্যাগগুলো খুলে সে ভেতরে ইঁদুরের কালো বিষ্ঠার সাথে মিশ্রিত ছাতা ধরা শস্যদানা দেখতে পায়। অন্য থলেটা ভারী প্রতিয়মান হয়। ভেতরে ছয়টা হাড্ডিসার মুরগী, যাদের সদ্য মাথা মোচড়ানো হয়েছে, এবং একটা। পনিরের পিণ্ড আর বস্তার আস্তরে মুরগীর পালক আর রক্তে দলা পাকিয়ে রয়েছে। দেখা যায়।

বাবর বস্তাটা একপাশে ঠেলে সরিয়ে দেয়ার সময় লক্ষ্য করে দাঁড়িয়ে থাকা কৃষক তার যথাসর্বস্ব ধনের মত সেটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এগুলো কোথা থেকে এসেছে?” বাবর জানতে চায়। নিরবতা। “আমি জানতে চাইছি এসব কোথা থেকে এসেছে?” দ্বিতীয়বার সে সরাসরি কৃষকের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করে। ‘সুলতান, জাফরশান নদীর ওপারে আমার গ্রাম থেকে এসেছে।”

“আর এসব তোমার কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নেয়া হয়েছে?”

“হ্যাঁ, সুলতান।”

“জোর করে?”

“হ্যাঁ, সুলতান। এই দুইজন কেড়ে নিয়েছে।”

লোকটা লজ্জায় মাথা নিচু করে।

বাবর তার সেনাপতির দিকে তাকায়। “আমি পরিষ্কার আদেশ দিয়েছিলোম গ্রাম থেকে কোনো কিছু লুঠ করা হবে না, আমরা সব কিছু দাম দিয়ে কিনে নেবো। তৈমূরের উত্তরসূরী গরীব লোকদের নিপীড়ন করতে তাদের রক্তে ধরণী সিক্ত করতে এখানে আসেনি।”

যাযাবর লোকগুলো তার দিকে গনগনে চোখে তাকায়। “আমরা এখানে কয়েক। সপ্তাহ যাবৎ আছি। আমরা কিছুই জোর করে নেইনি। লুঠ করার মত কোনো মালই নেই। আমার লোকেরা বিরক্ত হয়ে পড়েছে। তাদের আমোদ দরকার। আর কি এমন নিয়েছে কৃষক নামের এই লার্ভাকীটের কাছ থেকে মামুলি কিছু সামগ্রী।”

“আর তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছে।”

“তারা তো বললো সেই মহিলা খুব একটা অনিচ্ছুক ছিল না।” দলপতি খিকখিক করে হাসতে তার চওড়া কোদালের মত দাঁতের মধ্যেখানের ফাঁক উন্মুক্ত হয়ে পড়ে।

ক্রোধের একটা ঝাপটা বাবরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তার ইচ্ছে হয় তাদের এখনই এখানেই তরবারির আঘাতে দ্বিখণ্ডিত করে হতভাগাদের দেহবিহীন মুণ্ড গোবরের ঢিপিতে লাথি মেরে ফেলে দেয়। “ওয়াজির খান এই দুই লুটেরাকে এখনই গ্রেফতার করেন। তারা লুঠতরাজ আর ধর্ষণের অভিযোগে দোষী। তারা জানে এর কি শাস্তি। তাদের গোত্রের অন্য সদস্যদের উপস্থিতিতে আমি চাই এই মুহূর্তে তাদের সাজা কার্যকর করার ব্যবস্থা নেয়া হোক।”

ওয়াজির খান হাত উঁচু করে ইশারা করতেই প্রহরীরা এসে দু’জনকে বন্দি করে যারা কোনো প্রকারের বাধা দেবার পরিবর্তে আহাম্মকের মত দাঁড়িয়ে চোখ পিটপিট করে যেন আশেপাশে যা ঘটছে সেটা তাদের জ্ঞানগম্যির বাইরে।

“আর তোমাকে বলছি,” বাবর গোত্রপতির দিকে এবার তাকায় যার মুখের আমুদে হাসি অনেক আগেই উবে গেছে। বাবর খেয়াল করে তার আঙ্গুল কোমরে খয়েরী রঙের উলের তেলতেলে মসৃণ কাপড়ে জড়ান খঞ্জরের বাটের আশেপাশে চঞ্চল ভঙ্গিতে নড়াচড়া করছে এবং দেহ টানটান হয়ে আছে, মূর্খটার মাথায় কোনো ধরণের দূর্মতি ভর করলে সেটা মোকাবেলার জন্য সে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। “এই অভিযানে তুমি আমার আইন মেনে চলবে অথবা তার পরিণতি ভোগ করবে এই শপথ নিয়েই তুমি আমার সাথে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। ভবিষ্যতেও যদি তুমি তোমার লোকদের সামলে রাখতে ব্যর্থ হও তাহলে জেনো তোমারও একই পরিণতি হবে।” বাবরের কণ্ঠে হুমকির প্রচণ্ডতা। “তুমি সবার সামনে ঘোষণা করবে এটা ন্যায়বিচার-শাহী ন্যায়বিচার। আমি আমার শিবিরে কোনো ধরণের রক্তপাত চাই না। এখনই তোমার সব লোকদের এখানে ডেকে পাঠাও!”

গোত্রপতির দৃষ্টি বাবর, ওয়াজির খান আর প্রহরীদের হাতে ধৃত দুই লুণ্ঠনকারীর চোখের মরিয়া-দৃষ্টির ভিতরে ঘোরাফেরা করে। বাবর তার চোখে আর অভিপ্রায়ে মৃত্যুর শাণিত সঙ্কেত অনুভব করে। কিন্তু অস্ফুট কসম আউরে গোত্রপতি তরবারির বাট থেকে হাত সরিয়ে নেয় এবং তার পরিষ্কার কামান মাথা আনুগত্য প্রদর্শনের অভিপ্রায়ে নত করে।

দশ মিনিট পরে, অভিযুক্ত দুজনের চারপাশে একটা নিরব বৃত্ত তৈরি করে তাদের ক্ষুদ্র গোত্রের সব সদস্য এসে জড়ো হয়। বাবর ইশারায় অনুমতি দিলে সে কেশে গলা পরিষ্কার করে এবং বন্দিদের উদ্দেশ্যে বলে: “আমি যে আইন রক্ষা করব বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, তোমরা সেটা ভঙ্গ করেছে। আমি, গোত্রপতি হবার কারণে, বিচারের জন্য তোমাদের সোপর্দ করলাম। তোমাদের দেহ টুকরো করে হায়না আর শকুনের খোরাক হিসাবে ফেলে রাখা হবে। এখানে উপস্থিত সবাই আরেকটা কথা শুনে রাখো, আমার আদেশে এটা সংঘটিত হবে। দণ্ড কার্যকর যারা করবে তাদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো প্রতিশোধমূলক মনোভাব পোষণ করবে না।”

ওয়াজির খান তার প্রহরীদলকে সামনে এগোবার ইঙ্গিত দেয়। কোষমুক্ত তরবারি নিয়ে তারা কাঁপতে থাকা বন্দির দিকে এগিয়ে যায় এবং তাদের হাঁটু ভেঙে দাঁড়াতে বাধ্য করে। ঝকঝকে তরবারির ফলা মৃত্যু মুখে নিয়ে তাদের ঘাড়ের উপরে নেমে আসতে সকালের তাজা শীতল বাতাসে লোকগুলোর শেষ আর্তনাদ পুকুরে ঢিল পড়ার মত ভেসে উঠে ডুবে যায়।

বাবরের পেটের খাবার মোচড় খেয়ে উঠে আসতে চায় এবং গভীর শ্বাস নিয়ে সে নিজেকে শান্ত রাখে। এটাই আইন। শৃঙ্খলা আর শ্রদ্ধা বজায় রাখতে কোনো নেতা যা করতো সে কেবল সেটাই করেছে। আর্তনাদ প্রশমিত হয়ে শকুনের দল আশু ভোজের সম্ভাবনায় কোলাহল শুরু না করা পর্যন্ত বাবর নিজেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়া থেকে বিরত রাখে।

“তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও আর এটা ধরো।” বাবর রৌপ্য মুদ্রা ভর্তি উটের চামড়ায় তৈরি একটা থলে হতভম্ব কৃষকের দিকে বাড়িয়ে ধরতে সে কয়েক মুহূর্ত সেটার দিকে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে তারপরে সেটা হাতে নেয়। বাবর পিঠ ঘুরিয়ে নিয়ে রওয়ানা দেবে এমন সময় লোকটা গলা পরিষ্কার করে ইতস্তত ভঙ্গিতে কিছু একটা বলতে চায়।

“আর কিছু বলবে?” চর্মসার আর দুর্দশাগ্রস্থ কৃষকটা- বাবরের মনে বিরক্ত আর ক্লান্ত একটা অনুভূতির জন্ম দেয়। আজ এখানে যা কিছু ঘটেছে তাতে এই লোকটার কোনো হাত নেই, কিন্তু লুটেরার দল যখন তার গ্রামে হানা দিয়েছিলো তখন সেই সত্যিকারের মানুষের মত তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিল…বাবর ভাবনাটা অবান্তর বলে সেখানেই থামিয়ে দেয়। এই লোকটা যোদ্ধা না, সে একজন পরিশ্রমী মানুষ এবং সে সাহস করে তার শিবিরে এসেছিল ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায়।

“সুলতান…একটা ব্যাপার যা আপনার বোধহয় জানা উচিত…তিন দিন আগে পূর্ণিমার সময়ে যা আমি নিজের চোখে দেখেছি।”

“কি দেখেছো?…বলো।”

“আমি দেখেছি কিছু লোক…সম্ভবত, গুপ্তচর– শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আমি তখন ভেড়া চরাতে গিয়েছিলাম, গাছের আড়ালে লুকিয়ে আমি তাদের বের হতে দেখি, এবং বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে তাদের ফিরেও আসতে দেখেছি। সুইপ্রস্তুতকারকদের ফটকের পাশে দিয়ে একটা গলিপথ সমরকন্দের দিকে চলে গেছে। সুলতান চাইলে আমি সেটা দেখাতে পারি।”

বাবরের হৃৎস্পন্দন হঠাৎ বেড়ে যায়। “তুমি যদি সত্যি কথা বলে থাকো তবে ঐ রৌপ্যমুদ্রার কয়েকগুণ বেশি আমি তোমার ওজনের সমান সোনার মোহর তোমাকে দেব।”

***

“সুলতান, এটা স্রেফ পাগলামি।”

“হয়ত।” বাবর টের পায় তার নিজের ভেতরে উত্তেজনার রাশ আলগা হচ্ছে। আর কয়ের ঘণ্টা পরে সে সমরকন্দের ভেতরে থাকবে।

“অন্তত আমাকে আপনার সাথে যাবার অনুমতি দেন।”

“না, ওয়াজির খান। ছিন্ন বস্ত্র পরিহিত একটা কিশোরকে কে ভাল করে খেয়াল করতে যাবে? কিন্তু সমরকন্দের অনেকেই তোমায় চেনে। আমি একলাই বরং নিরাপদে থাকব।”

ওয়াজির খানকে অন্তত একবার হলেও কিংকর্তব্যবিমূঢ় দেখায়। তার অন্ধ চোখের উপরের আড়াআড়ি ক্ষতচিহ্ন স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে কুঞ্চিত হয়ে উঠে। “কিন্তু আপনি আমাদের সুলতান,” সে একগুয়ে কণ্ঠে বলে। “ফারগানার কি হবে যদি আপনি আর ফিরে না আসেন?”

“আমি ফিরে আসছি। এখন আমাকে যেতে দাও।”

বাবর তার নিজের পছন্দ করা নির্ভরযোগ্য, শক্তপোক্ত দেখতে কালো টাটু ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসে এবং পেছন দিকে একবারও না তাকিয়ে রাতের আঁধারে অজানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়।

চাঁদের আলোয় পশ্চিমদিকে বয়ে যাওয়া নহরের সমান্তরালে এগিয়ে যাওয়া। এবড়োখেবড়ো পথটা আলোকিত হয়ে আছে, যা আগের রাতে সে নিজে ওয়াজির খান আর সেই কৃষকটার সাথে এসে দেখে গিয়েছিল। তার মস্তিষ্কে পথটার প্রতিটা নুড়িপাথর যেন গাঁথা হয়ে রয়েছে। সে এখন খান উর্তি তৃণভূমির উপর দিয়ে ঘোড়া দাবড়ে চলেছে- তার মরহুম আব্বাজান তাকে প্রায়ই এর কথা বলতো- গ্রীষ্মকালে তৈমূর একবার এখানে অবকাশযাপনের উদ্দেশ্যে ছাউনি ফেলেছিল। রেশমের ছাউনির নিচে শুয়ে পানির ধারা বয়ে যাবার শব্দ শুনবে বলে, যা ছিল বেহেশতের উদ্যানে প্রবাহিত জলধারার ন্যায় শীতল আর বিশুদ্ধ। এখন সেই একই জলধারার চঞ্চল শব্দ যেন মহান তৈমূরের কণ্ঠস্বর হয়ে বয়ে চলেছে, তাকে বলছে: “এগিয়ে যাও। সব কিছু তুচ্ছ করে।”

এক ঘণ্টা নিরবিচ্ছিন্নভাবে পথ চলার পরে স্রোতধারা বিভক্ত হতে বাবর বামদিকের স্রোত অনুসরণ করে সেটা সমরকন্দের বিশাল সবুজাভ-নীল তোরণের আধমাইল দক্ষিণ দিয়ে বয়ে গেছে। তাকে খুব সতর্ক থাকতে হবে। দূর্গ প্রকারের পেছন থেকে তাকিয়ে থাকা সতর্ক দৃষ্টি নিঃসঙ্গ অশ্বারোহীকেও সন্দেহের চোখে দেখবে যদি সে খুব কাছে এগিয়ে যায়। সে স্রোতধারার দূরবর্তী পাড় দিয়ে এগিয়ে যায়, যেখানে সে পাড়ে জন্মানো উইলো গাছের ছায়ায় মিশে গিয়ে সবার দৃষ্টি এড়িয়ে অশরীরির মত এগিয়ে যেতে পারবে।

ওয়াজির খান অবশ্য ঠিকই বলেছিল। পুরো ব্যাপারটাই পাগলামির চুড়ান্ত। এতগুলো মাস শহর অবরোধ করে রাখার পরে এখন যদি শহরের রক্ষাব্যুহের দুর্বল স্থান আর তার অধিবাসীদের মনোভাব জানবার শখ বাবরের হয়ে থাকে তবে সে নিজে একলা না এসে তার অধীনস্থ কোনো গুপ্তচরকে সুড়ঙ্গ পথে পাঠাতে পারতো। কৃষকটার ইতস্তত ভঙ্গিতে উচ্চারিত সেই কয়েকটা বাক্য শোনবার মুহূর্ত থেকে বাবর জানে নিয়তির অমোঘ হাত তাকে সামনে টেনে নিয়ে চলেছে।

মাথার উপরে ঝুঁকে থাকা উইলোর শাখার ভেতর দিয়ে রাতের মেঘহীন পরিষ্কার আকাশ দেখা যায়। স্রোতস্বিনীর অপর পাড়ে সে শহরের আবছা অবয়ব দেখতে পায়। আর কয়েক মিনিট আর তারপরেই অন্ধকারের ভেতর থেকে দৈত্যের মত সবুজাভ-নীল তোরণদ্বার প্রকটিত হবে। শীঘ্রই একদিন, বাবর নিজেকে কথা দেয়, রাতের আঁধারে চোরের মত নিজের শহরে প্রবেশের বদলে, সে এই তোরণদ্বারের নীচ দিয়ে নিজের বাহিনী নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করবে।

একটা ক্ষুদ্র জন্তু- ইঁদুর, খুব সম্ভবত নদীর তীরে বসবাসকারী ইঁদুর- তার টাটুর খুরের নীচ দিয়ে দৌড়ে গেলে আতঙ্কে হেষাধ্বনি তুলে বেচারা চঞ্চল ভঙ্গিতে পাশে সরে যায়। বাবর নুয়ে পড়ে তার টাটুর নরম, ঝাকড়া গলায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করে। এখান থেকে পায়ে হেঁটে এগিয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। বাবর ঘোড়ার সাজ খুলে নেয় এবং পিঠ থেকে ভাঁজ করা কম্বলটা নামায় যার উপরে সে এতক্ষণ বসে ছিল তারপরে ওয়াজির খানের সাথে তার যেমন কথা হয়েছিলো, টাট্ট ঘোড়াটা ছেড়ে দেয় যাতে সেটা পথ খুঁজে ছাউনিতে ফিরে যেতে পারে। আগামীকাল ঠিক এই সময়ে ওয়াজির খান এখানেই আরেকটা নতুন ঘোড়া নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করবে।

কোমল অন্ধকারের ভিতর দিয়ে দক্ষিণে আরও আটশ গজ এগিয়ে যাবার পরে সে সুইপ্রস্তুতকারকদের তোরণদ্বারের উভয়পার্শ্বে জ্বলন্ত মশালের বিরক্তিকর লালবিন্দু সে দেখতে পায়। লম্বা আর সংকীর্ণ, সমরকন্দের ছয়টা প্রবেশদ্বারের ভিতরে, এটা সবচেয়ে সেটা আর নিরাভরণ। এই তোরণদ্বার সাধারণত কৃষক আর ব্যবসায়ীরা সচরাচর ব্যবহার করে থাকে। তৈমূর কদাচিত এটা ব্যবহার করেছেন। অতিকায় লোহার তোরণদ্বার আর নীল টাইলে সজ্জিত সবুজাভ-নীল তোরণদ্বার তিনি সাধারণত ব্যবহার করতেন যার প্রবেশ পথের খিলানাকৃতি তোরণের উপরের কামরায় অবস্থানরত নকীবের দল কাড়াকাড়া আর কর্কশ-সুরের তূর্যনাদের মাধ্যমে তার আগমন ঘোষণা করতো।

সময় হয়েছে এবার স্রোতস্বিনী অতিক্রম করার, যা এখানে অনেক গভীর প্রায় নদীর দ্যোতনায় প্রবাহিত হচ্ছে। বাবর প্রায় তার কাঁধ ছাপিয়ে বয়ে যাওয়া পানিতে ধীরে ধীরে নেমে আসে। প্রায় তীরের কাছে পৌঁছে সে তলদেশের আলগা পাথরে হোঁচট খায় আর ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। শীতল পানির স্রোত মাথার উপরে বয়ে গিয়ে তার শ্বাসরোধ করে ফেলে সে টের পায় পানির টানে সে ভেসে যাচ্ছে। ডুবন্ত। মানুষের মত অকুলান হয়ে সে কোনমতে একহাত পানির উপরে তুলে আর সেটা গাছের ডালের মত কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেতে সে ব্যাথায় কুচকে যায়। আরেকবারের চেষ্টায় সে একটা ডাল কোনমতে ধরে আর এবার দু’হাত ব্যবহার করে নিজেকে তীরে তুলে নিয়ে আসে।

হাঁপাতে হাঁপাতে, সে চোখের উপর থেকে চুল সরিয়ে চারপাশে ভাল করে তাকায়। অন্ততপক্ষে সে নহরের অপর পারে এসে পৌঁছেছে। সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে তার। তৈমূরের আংটি খোঁজে, যা তার গলায় একটা চামড়ার পাতলা দড়ির সাহায্যে ঝুলে আছে। তার আঙ্গুল ভারী, মোটা ধাতব অস্তিত্ব টের পেতে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সে নিরবে গুটিসুটি মেরে কাঁপতে কাঁপতে কান খাড়া করে। কিছুই না। না কোনো ফেঁকড়ি ভাঙার আওয়াজ না বাদুরের নরম ডানার ঝাপটানি। সে এবার সামনে সুইপ্রস্তুতকারকদের আবছাভাবে দৃশ্যমান তোরণদ্বারের দিকে তাকায়। গুঁড়ি মেরে নিঃশব্দে সামনে এগিয়ে সে একটা পুরান বাগানের ধ্বসে পড়া দেয়ালের কাছে। এসে পৌঁছে, যেখানে ডালিম গাছের মাঝে মরা ডালপালার স্তূপের নিচে গোপন সুড়ঙ্গে প্রবেশের মুখটা ঢাকা রয়েছে।

গতরাতে পাহারা দেবার জন্য কোনো প্রহরী ছিল না। বাবর কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করে আজও যেন সেরকমই থাকে। আর তাছাড়া সুড়ঙ্গের ভেতরেও সে কারো মুখোমুখি হতে চায় না। তাকে দ্রুত করতে হবে- আর সেই সাথে সতর্কও থাকতে হবে। খোলা স্থানের দিকে দৌড়ে যাবার প্রবণতা গলা টিপে মেরে সে একটা বুড়ো গাছের কোটরে গা-ঢাকা দেবার স্থান খুঁজে বের করে এবং সেখানে চুপ করে বসে কান খাড়া করে চারপাশে লক্ষ্য রাখে। তোমার নামের অর্থ বাঘ, বাবর নিজের মনে বলে, আজ রাতে তাই সেরকমই আচরণ করো। খোলা জায়গা এড়িয়ে গিয়ে তাই আঁধারের আলিঙ্গনে নিজেকে আবৃত করো আর নিজের অসহিষ্ণুতা দমন করতে শেখো।

কিছুক্ষণ পরে, একটা বাচ্চা শেয়াল তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করে। বাবরের গায়ের গন্ধ সে ঠিকই টের পায়, কিন্তু সেটা অগ্রাহ্য করে সামনে এগিয়ে যায়। শেয়ালের আচরণ দেখে বাবর নিশ্চিত হয় আশেপাশে কোনো দ্বিপদী প্রাণী নেই। আর সে তার লুকিয়ে থাকার স্থান থেকে এবার তাই বেরিয়ে আসে। তার পরণের মোটা কাপড়ের তৈরি আলখাল্লা আর ভেড়ার চামড়ার আঁটসাট জ্যাকেট- গরীব কৃষকের লেবাস- এখনও ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে আর তার ত্বকে শীতল অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে। পানিতে ভেজা কুকুরের মত সে নিজেকে ঝাঁকায়, তারপরে নিজেকে ভাল করে রগড়ে নেয়।

কম্পিত বুকে, সে সুড়ঙ্গের মুখের দিকে এগিয়ে যায় এবং মুখ থেকে ডালপালা সরিয়ে দেয়। তারপরে বুকে ভর দিয়ে সুড়ঙ্গে প্রবেশ করে এগিয়ে যাবার আগে নিজের পেছনে পুনরায় ডালপালাগুলো আবার জায়গামত রেখে দেয়। হাত বাড়িয়ে সে সুড়ঙ্গের মুখ আটকে রাখা ঝুলদরজার প্রান্ত খুঁজে। এই তো পেয়েছি! দরজাটার হাতল আঁকড়ে ধরতে একটা ছোট পোকা- সম্ভবত পিঁপড়ে বা পেটের নিচে চিমটেওয়ালা ক্ষুদে পোকা- তার আঙ্গুলের উপর দিয়ে হেঁটে যায়। বাবর সাবধানে দরজাটা খুলে এবং ভেতরে উঁকি দেয়। খনিকূপের মত সরু পথটা ইটের তৈরি আর দু’পাশে কাঠের ডাসা লাগান রয়েছে। সে দু’পাশের ডাসায় পা দিয়ে নামতে শুরু করে আর মাথার উপরে ঝুলদরজাটা টেনে যথারীতি বন্ধ করে দেয়।

তার চারপাশে এখন সূচীভেদ্য অন্ধকার এবং কেমন একটা অস্বাস্থ্যকর, স্যাঁতাস্যাঁতে, মাটি মাটি গন্ধ তার নাকে ভেসে আসে যেন কোনকিছু- বা কেউ একজন- এখানে মারা গিয়েছে, যা সম্ভবত এখানেই থেকে গিয়েছে। সমরকন্দের একটা গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে, সত্যি কিন্তু সেই সাথে সেটা সংঘাতময়ও বটে। এই সুড়ঙ্গটা প্ৰথমকে খুঁড়েছিল? সে কল্পনা করতে চেষ্টা করে। তারা কি ভয়ঙ্কর ভবিতব্য এড়াতে নাকি ভেতরে প্রবেশের জন্য এই গর্তটা খুড়েছিল?

সতর্কতার সাথে, বাবর খনিকূপ সদৃশ সুড়ঙ্গটার তলদেশে নিজেকে নামিয়ে নিয়ে আনে, আগের রাতের অভিযানের অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে সুড়ঙ্গটা মাত্র দশ ফিট গভীর। কিন্তু প্রশ্ন হল সুড়ঙ্গটা এখান থেকে কোথায় গিয়েছে? সে দুহাত দিয়ে দু’পাশে শক্ত করে ধরে পা টিপে টিপে সামনে এগিয়ে যায়। তার পায়ের নিচের মাটিতে প্যাঁচপ্যাঁচে শব্দ সৃষ্টি হয় এবং মনে হয় ক্রমশ ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে। পিছলে গিয়ে টলতে টলতে সে সামনে এগিয়ে যায় এবং কয়েক কদম পরে পায়ের নিচে শক্ত পাথরের অস্তিত্ব অনুভব করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

মাথার উপরের ছাদ নিচু হয়ে আসতে বাবর ঝুঁকে অন্ধকারের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যায়। এখন কোনো শত্রুর মুখোমুখি হলেই হয়েছে, আর দেখতে হবে না। সোজা হয়ে সে দাঁড়াতেই পারছে না, শত্রুর মোকাবেলা করবে কিভাবে। আর তরবারি চালাবার কোনো প্রশ্নই উঠে না। সে সাথে করে তার মরহুম আব্বাজানের ঈগলের মাথার বাটযুক্ত তরবারি নিয়ে আসেনি। কপাল খারাপ হলে সে যদি ধরা পড়ে তখন। তার মত একজন কৃষকের সন্তানের কাছে সেটা কিভাবে এল তা নিয়ে অনেক প্রশ্নের উদ্রেক হবে। কিন্তু মুশকিল হল তরবারিটা ছাড়া তার নিজেকে অরক্ষিত মনে হয়।

স্যাঁতস্যাঁতে, পাতিগন্ধময় বাতাসে সে যেভাবে কুঁজো হয়ে রয়েছে, তাতে শ্বাস নেয়া রীতিমত কষ্টকর হয়ে উঠেছে। পায়ের ধাপ গুনতে গুনতে, সে দ্রুত এগিয়ে যায়- দশ, বিশ, ত্রিশ। সে আগে হিসেব করে রেখেছে যে ছয়শো ধাপ তাকে শহরের দেয়ালের কাছে যাবে। কিন্তু তার কোনো ধারণা নেই সুড়ঙ্গটা আসলে কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। সে গোনার চেষ্টা চালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। নব্বই, একশ। কপালের ঘাম গড়িয়ে মুখে একটা নোনতা স্বাদ ছড়িয়ে যায়। অসহিষ্ণুচিত্তে সে জিহ্বা দিয়ে লবণাক্ত ঘামের ফোঁটা ঘন ঘন টুসকি দিয়ে ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করে। একশ পঞ্চাশ…সুড়ঙ্গটা এখন বেশ প্রশস্ত হয়ে উঠেছে, দু’জন অনায়াসে হেঁটে যেতে পারবে। বাবরের গতিবেগ দ্রুততর হয়ে উঠে। সে এখন প্রায় দৌড়াচ্ছে। চারশ….

তারপরে সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। কিসের শব্দ? পুরুষ কণ্ঠের হৈচৈ আর কর্কশ অট্টহাসি সে নিশ্চিতভাবেই শুনতে পায়। সহসা তাকে চমকে দিয়ে সামনে থেকে কমলা আলোর আভা ভেসে আসে। বাবর এবার অস্পষ্ট দেয়াল দেখতে পায় এবং সেটা বাম দিকে তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়েছে। বদ্ধস্থানে গলার স্বর গমগম করে প্রতিধ্বনি তুলছে। মুহূর্তের ভিতরেই কণ্ঠস্বর যাদের তারা বাঁক ঘুরবে আর তাকে দেখতে পাবে। বাবর পাগলের মত ঘুরে দাঁড়িয়ে অন্ধকার কোণায় ছুটে যায়। হতাশায় প্রায় ফোঁপাতে ফোঁপাতে সে দৌড়াতে থাকে এবং সুড়ঙ্গের একটা ভাজের মাঝে নিজেকে আপ্রাণ চেষ্টা করে মিলিয়ে দিতে। কিন্তু কণ্ঠস্বরগুলো এখন আবার মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে। লোকগুলোকে যদি সুড়ঙ্গটা পাহারা দেবার জন্য পাঠান হয়ে থাকে তবে বলতেই হবে তারা তাদের দায়িত্ব ঠিকমত পালন করেনি। একটা মলিন হাসি তার মুখে ফুটে উঠে। ওয়াজির খানের লোক হলে এতক্ষণে কাজে গাফিলতির জন্য। তাদের চামড়া জীবন্ত খালিয়ে নেয়া হত।

বাবর অপেক্ষা করে। পুনরায় অন্ধকার আর নিরবতা নেমে এসেছে। বেশ কয়েকবার গভীরভাবে শ্বাস নিয়ে, কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে সে আবার সামনে এগোতে শুরু করে। বাবর তার পায়ের ধাপের গণনা গুলিয়ে ফেলেছে কিন্তু সে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত যে সে শহরে দেয়ালের কাছে নিশ্চিতভাবে পৌঁছে গেছে। সে এবার বাম দিকের তীক্ষ্ণ বাঁকটা ঘুরে এবং সামনে এগিয়ে যায়। আরও পাঁচ মিনিট নাগাড়ে হাঁটবার পরে সে তার সামনে আবছা আলোর আভাস বুঝতে পারে যা জ্বলন্ত মশালের কমলা রঙের আভা না বরং চাঁদের আর রাতের তারার একটা শীতল বিকিরণ।

হাতের উল্টোপিঠ সে তার কপালের ঘাম মোছে এবং দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে নিজেকে যতটা সম্ভব অন্ধকারে মিশিয়ে দিতে চেষ্টা করে যেন দূরবর্তী প্রান্তে ধনুকে তীরে জুড়ে তৈরি থাকা সতর্ক প্রহরী তাকে সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে না পারে। কিন্তু সামনে কেবল নিরবতা বিরাজ করছে। পুরো শহর এখন বোধহয় ঘুমে বিভোর। সে তার বিবর্ণ মাটির দাগ লাগা পোষাক আর হাত সুড়ঙ্গের ভিতরের আলোতে কোনমতে দেখতে পায়। তাকে তৈমূরের বংশের রাজপুত্র বলে কেউ চিনতে পারবে সে ভয় এখন আর নেই। শহরের ভিতরে সে অনায়াসে ভীড়ের মাঝে মিশে যেতে পারবে, গতকালের বাসি রুটির সন্ধানে আরেকজন হতভাগ্য কিশোর এসেছে।

সুড়ঙ্গটা এসে দূষিত পানিতে পূর্ন একটা বৃত্তাকার গর্তে এসে শেষ হয়েছে, বাবর ভাবে, সম্ভবত কোনো অব্যবহৃত ইঁদারার খাড়া ফাঁকা স্থান। উঁকি দিয়ে সে রাতের তারকাখচিত আকাশের চাঁদোয়া দেখতে পায়। নিরবে সন্তর্পনে সে খাঁড়া দেয়ালে গাঁথা ধাতব কীলক বেয়ে উপরে উঠতে আরম্ভ করে। এমন সুড়ঙ্গ এই শহরে আর কতগুলো আছে? কোনো সন্দেহ নেই শত্রুরা তার প্রতিটা পরিকল্পনা সম্পর্কে আগেই অবহিত হয়েছে। তার ছাউনি দূষিত করতে দলে দলে গুপ্তচরের দল ইঁদুরের মত হাজির হয়ে তার গোপন তথ্য জেনে নিয়ে ঘরে ফিরে এসেছে। কিন্তু এখন, বাবর ভাবে, ইঁদুর হবার পালা এবার আমার।

দেয়ালের উপরে পাথরের গোলাকার রক্ষামূলক বেষ্টনীর উপর দিয়ে বাবর নিজেকে টেনে তুলে এবং ছায়ার ভিতরে আলতো করে নেমে আসে। চাঁদের আলোতে বাবর দেখে সে একটা আঙ্গিনার মত জায়গায় উপস্থিত হয়েছে যেখানে কেবল দুটো হাড্ডিসার নেড়ী কুত্তা ঘুমিয়ে রয়েছে। বাবর তাদের পাঁজরের হাড় ছন্দোবদ্ধ ভঙ্গিতে উঠানামা করতে দেখে এবং তাদের মৃদু কেঁউ কেউ স্বরে ফোঁপানি শুনতে পায়। পরাক্রমশালী সমরকন্দে তৈমূরের উত্তরাধিকারীর আগমনের কি অনবদ্য তরীকা কেবল নেড়ী কুকুরের সহচর্যে গায়ের গন্ধে ভূত পালাবে আর করণে ছেঁড়া ফাটা কাপড়।

এখন প্রশ্ন হল সে ঠিক কোথায় আছে? বাবর জানতে পারলে বর্তে যেত। এখন সে কেবল লোকজন উঠে চলাচল শুরু করা পর্যন্ত লুকিয়ে থাকতে পারে। লোকের আড়াল তার প্রয়োজন। শীতে কাঁপতে কাঁপতে সে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে রাখা একটা কাপড়ের স্তূপ খুঁজে পায়। এতেই কাজ চলবে। সে কাপড়ের নিচে আলতো করে ঢুকে আসে এবং সে মাথার উপরে টেনে দিয়ে নিজেকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলে। সে ভাবে, সমরকন্দ। সমরকন্দ! তারপরে কিছু বুঝে উঠবার আগেই ঘুম জোয়ারের মত দুচোখ ছাপিয়ে এসে তার ক্লান্ত শরীরের দখল বুঝে নেয়।

“এটা আমার জায়গা! তোমার পঁচা গাজর নিয়ে অন্য কোথাও যাও।”

বাবর ঘুম ভেঙে চমকে উঠে এবং কাপড়ের ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয়। কয়েক ঘণ্টা আগে যে জায়গাটা জনমাবনহীন ছিল এখন লোকজনে গমগম করছে। ভোরের আবছা আলোতে, তার মনে হয় লোকগুলো একটা বাজার বসাতে চাইছে। যার কণ্ঠস্বরে তার ঘুম ভেঙেছে সে তাকিয়ে কালো, ধূলি ধূসরিত আলখাল্লা পরিহিত এক লম্বা, শীর্ণকায় বৃদ্ধলোকের। নিজের পছন্দসই স্থানের দখল বুঝে নিয়ে, সে আসনপিড়ি হয়ে বসে এবং জোব্বার পকেট থেকে কয়েকটা ছাতা-পড়া পেঁয়াজ বের করে।

সতর্কতার সাথে, বাবর তার লুকানর স্থান থেকে বের হয়ে আসে। রুক্ষ দর্শন, ছিন্ন বস্ত্র পরিহিত লোকের দল ততোধিক কুঞ্চিত আনাজপাতির সামান্য পরিমাণ কাপড়ের উপরে সাজিয়ে রাখছে- গাজর রঙ বিগড়ে গিয়েছে এবং অঙ্কুরিত হয়েছে আর কুচকে যাওয়া মুলা। আরেক বৃদ্ধা যার কুঞ্চিত মুখ থেকে নেকাব খসে পড়েছে। বেপড়োয়া অনটনে, সমাধিস্থ করার জন্য যেভাবে মৃতদেহ পবিত্র করা হয় ঠিক একই যত্নে একটা মৃত ইঁদুর সাজিয়ে রাখছে। অন্যেরা, বোঝাই যায় যাদের কাছে বিক্রি করার মত কিছু নেই আর কেনার সামর্থ্যের প্রশ্নই উঠে না, তারা চারপাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে ক্ষুধার্ত চোখে তাকিয়ে রয়েছে।

বাবর বিস্মিত হয়ে ভাবে, এই লোকগুলো উপবাস করছে। অবরোধ অনেক মাস হল বজায় আছে এবং সে আশা করেনি যে রসদের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে, কিন্তু তাই বলে…এক শিশুর কান্নায় তার চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায়। এক তরুণী মাতা যার স্তনের দুগ্ধধারা শুকিয়ে গেছে এবং যার চোখের তারা ভর করেছে অসহায়তা। নেকাবের একটা কোণা পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে সেটাই নিজের সন্তানের বুভুক্ষ ঠোঁটে গুঁজে দেয়।

“নিজেদের ঘাঁটিতে ব্যাটারা ভালই আছে,” বৃদ্ধলোকটা বলে, তারপরে এমন ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে থুতু ফেলে যে আরেকটু হলে কফের দলা তার নিজের সাতটা পেঁয়াজের স্তূপে গিয়ে পড়ত। “তারা আমাদের কাছ থেকে সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। তারা বছরের পর বছর টিকে থাকতে পারবে, রেশমের আলখাল্লার নিচের ভূড়ি আমাদের খাবার দিয়ে পূর্ণ করবে। ন্যায়বিচার বলে কি কিছু নেই?”

“বুড়া মিয়া, চুপ করো, মুখে লাগাম দাও, তোমার কারণে আমরা সবাই বিপদে পড়বো। শীতকাল আসলে গতবারের মত এবারও আক্রমণকারীরা দেশে ফিরে যাবে।”

“আর তারপরে কি ঘোড়ার ডিম হবে? কৃতজ্ঞতায় উজিরকে আরো বেশি করে তখন খাজনা দিতে হবে! বেশ্যার বেটার বড্ড বাড় বেড়েছে! আর সবাই বলছে আমাদের বিবি, বেটীদের সে নাকি ভীষণ পছন্দ করে। মরহুম সুলতান, আল্লাহ তাকে বেহেশত নসীব করুন, তার চেয়েও নাকি দ্বিগুণ বড় আমাদের উজিরের হারেম। আমি শুনেছি একরাতে সে তিনজন নারীর সাথে সহবাস করে।”

“বুড়া মিয়া, শান্ত হও, তোমার বসন্তের দাগঅলা স্ত্রী আর মেয়ের চেয়ে ঐ ছাগলটা অনেক বেশি যৌনাবেদনময়,” আরেক লোক ফোড়ন কাটে।

নিজের বিবি-বেটীদের আব্রু রক্ষায়, পেঁয়াজ বিক্রেতা ক্রুদ্ধ কণ্ঠে সাফাই দিতে শুরু করতে বাবর আলগোছে সেই চত্বর থেকে সরে আসে এবং একটা গলি ধরে হাঁটতে শুরু করে। সব জায়গাতেই একই দৃশ্য। চোখে মুখে অনাহারের নির্মম ছাপ পড়া, ক্ষুধার্ত মানুষের দল ছায়ামূর্তির মত ধীরপায়ে হেঁটে চলেছে, যেন তাদের দেহের শেষ বিন্দু জীবনীশক্তি নিংড়ে নেয়া হয়েছে। সে দাঁতহীন মাড়ি দেখিয়ে এক বৃদ্ধাকে হাসতে দেখে, যে শিশুর মত মমতায় একটা মৃত বিড়ালের নির্জীব দেহ কোলে করে রেখেছে। ইঁদারার ধারে গতরাতে ঘুমন্ত কুকুরগুলো যে এতদিন বেঁচে রয়েছে সেটা ভেবে সে বেশ অবাক হয়।

ম্লান কমলা রঙের উদীয়মান সূর্যের কাক্ষিত দৃশ্যপট- যা তাকে নিজের অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করবে। বাবর জানে যে সূর্যের দিকে পিঠ করে হাঁটলে তৈমূরের সুরক্ষিত আস্তানার দেয়ালের কাছে তার পৌঁছে যাওয়া উচিত। আপাতভাবে মনে হয় তার ধারণাই ঠিক। সে দ্রুত এগিয়ে যেতে শুরু করে, খেয়াল করে রাস্তাগুলো ক্রমশ চওড়া হয়ে উঠেছে আর দুপাশের ভবনগুলো এখন অনেক বেশি অভিজাত দর্শন। সে সুদৃশ্য ফুল লতাপাতা আর জ্যামিতিক নকশার প্রাণবন্ত টাইলসে সজ্জিত হাম্মামখানা, গম্বুজযুক্ত মসজিদ আর অপরূপ সুন্দরভাবে তৈরি করা মাদ্রাসা দেখতে পায়, যেখানে বিদ্যার্থীর দল নামাজ আদায় করে আর অধ্যয়ন করে।

তার পূর্বপুরুষেরা এত সুন্দর একটা শহর তৈরি করেছে এমন বালকসুলভ একটা গর্ববোধ তার ভিতরে জন্ম নেয়। সে যখন সমরকন্দের সুলতান হবে, শহরের আশেপাশের বাগান আর ক্ষেত থেকে সজি এবং ফল এসে আবার বাজার বোঝাই করে ফেলবে। রুটিঘর আর রন্ধনশালা- যা এখন শূন্য আর পরিত্যক্ত থেকে আবারও বাতাসে সুবাস ছড়াবে। সমৃদ্ধশালী আর সুখী নাগরিকের দল, তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠবে। এবং, তৈমূরের সময়ের মত, প্রতিভাবান মানুষের দল- কবি, চিত্রকর, পণ্ডিত- সভ্য দুনিয়ার নানা প্রান্ত থেকে এখানে এসে মিলিত হবে। পুরো বিষয়টার তাৎপর্য অনুধাবন করতে পেরে, বাবর চোখ বন্ধ করে ফেলে। “বাছা, আমাদের পথ থেকে সরে দাঁড়াও।”

বাবরের পিঠের নাজুক অংশে শক্ত কিছু একটা আঘাত করে। সহজাত প্রবৃত্তির বশে, সে কোমরে অস্ত্রের জন্য হাত দিয়ে দেখে সেখানে কিছু নেই। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে, সমরকন্দের রাজকীয় পান্না সবুজ রঙের পরিকর পরিহিত দুজন সৈন্য। তাদের যাবার মত পাশে যথেষ্ট জায়গা রয়েছে কিন্তু তারপরেও তাদের একজন তার হাতের বল্লমের বাঁট দিয়ে বাবরকে আবার আঘাত করে, এবার পাঁজরে খোঁচাটা লাগে এবং সে ঘুরতে ঘুরতে দেয়ালে গিয়ে আঘাত করে। সেঁতো হাসি দিয়ে, লোক দুটো সদম্ভে সামনে এগিয়ে যায়।

বাবর, মার্জারের-মত অপলক দৃষ্টিতে পেছন থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু তারা পেছনে ফিরেও তাকায় না। সৈন্য দু’জন বাঁক ঘুরতে সে তাদের পিছু নেয়। তারা যেদিকে এগিয়ে চলেছে, তাতে সে নিশ্চিত দু’জন কোক সরাইয়ের দিকেই যাচ্ছে। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে, অনুসরণ শুরু করতে সে আরো বেশি সৈন্যের দেখা পেতে থাকে, তাদের কেউ কেউ শহরের সুনসান, আতঙ্কিত নগরের রাস্তায় টহল দিচ্ছে, কেউবা শহর রক্ষাকারী প্রাচীর থেকে ফিরে আসা প্রতিহারী, সেনা। পূর্বের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে, কেউ এগিয়ে আসছে বুঝতে পারলে সে। জঞ্জালের আড়ালে কিংবা চৌকাঠের পেছনে লুকিয়ে পড়ে চেষ্টা করে তাদের চোখে আড়ালে থাকতে।

আর তারপরে, একটা সময়ে সে উপরের দিকে তাকালে তৈমূরের দেয়াল পরিবেষ্টিত আস্তানা দেখতে পায় এবং এর ঠিক কেন্দ্রে তৈমূরের সুউচ্চ দূর্গপ্রাসাদ, অতিকায় কোক সরাই। দূর্গের প্রাকার-বেষ্টিত চিহ্নিত স্থান থেকে সবুজ রেশমের নিশান বাতাসে পতপত করে উড়ছে। বাবর ভাবে, ওটা আমার প্রাসাদ। অবচেতন মনে সে তৈমূরের আংটিটা স্পর্শ করে এবং সেটা মুঠোর ভিতরে আঁকড়ে ধরে।

পাথর দিয়ে বাঁধান পথে সৈন্যদের কুচকাওয়াজের শব্দে তার দিবা স্বপ্নের চটকা ভাঙে। একটা দল আস্তানায় ফিরে আসছে। তাদের অনেক পেছনে থেকে বাবর তীক্ষ্ণ চোখে সৈন্যদলটা আর তাদের অস্ত্রশস্ত্র খুঁটিয়ে দেখে। দীর্ঘকায়, মজবুত শরীরের মানুষ, তাদের অবয়বে অপুষ্টির বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। আর প্রত্যেকের হাবেভাবে যোদ্ধার অভিব্যক্তি: এদের পরণেও সমরকন্দের উজ্জ্বল সবুজ পরিকর। জোর করে জুড়ে বসা উজির তাদের আনুগত্যের জন্য কত মোহর দিয়েছেন?

সহসা পেছন থেকে কেউ একজন তার কাঁধে হাত দেয় এবং আতঙ্কিত বাবর, সব কিছু অগ্রাহ্য করে দৌড় দেবার জন্য প্রস্তুত হয়, কিন্তু হাতটা ইস্পাতের মত কঠিন। অসহায় বাবর ঘুরে দাঁড়ায় তার আক্রমণকারীর মুখোমুখি হতে।

“শুভেচ্ছা নেবেন। আমি আশা করিনি এত শীঘ্রই আপনাকে সমরকন্দে দেখবো। অবরোধ এখনও শেষ হয়নি।”

বাবর ঢোক গিলে। “বাইসিনগার!” তৈমূরের রক্ত রঞ্জিত আংটি ফারগানায় কাছে পৌঁছে দেবার সময়েই তার সাথে বাবরের শেষ দেখা হয়েছিলো।

“আপনি অনর্থক ঝুঁকি নিয়েছেন। গত ত্রিশ মিনিট ধরে আমি আপনাকে অনুসরণ করছি।”

বাবরের মুখ এতটাই শুকিয়ে আছে যে সে কথা বলতে পারে না এবং সে নিচের দিকে তাকায়। সে যা দেখে তা দেখে আবার ঢোক গিলে। বাম হাত দিয়ে বাইসিনগার যদিও তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে, তার ডান হাত শক্ত হয়ে তার পাশে কাঠের দণ্ডের মত ঝুলছে।

বাইসিনগার তার দৃষ্টি অনুসরণ করে। “আপনার চাচার শেষ নির্দেশ পালন করে তৈমূরের আংটি পৌঁছে দেবার শাস্তি। আমি ভাগ্যবান যে এখনও মাথাটা আস্ত আছে, কারণ সমরকন্দের নিরাপত্তার জন্য গ্রান্ড উজিরের আমাকে দরকার আছে।” সে নিজের হৃৎপিণ্ডের গতি প্রশমিত করে এবং চারপাশে তাকিয়ে পালাবার সম্ভাবনা বিচার করতে গেলে হতাশায় দমে যায় যখন দেখে একদল সৈন্য তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা নিশ্চয় অবাক হচ্ছে তাদের দলপতিকে একটা ময়লা পোশাক পরিহিত কৃষক বালকের সাথে কথা বলতে দেখে। সে এখন যদি পালাতে চেষ্টা করে তবে তারা তাকে এক নিমেষে ধরে ফেলবে। “এখন কি করবে?” সে অবশেষে কথা বলে।

“ব্যাপারটা খুব সাধারণ। আমি যদি আপনাকে গ্রান্ড উজিরের কাছে ধরিয়ে দেই তবে আমার কপাল ফিরে যাবে। বিলাসবহুল প্রাসাদে, যেখানে ঝর্ণা থেকে গোলাপজল প্রবাহিত হচ্ছে আর সুন্দরী দাসীরা আমার সব ইচ্ছা পালনের জন্য মুখিয়ে রয়েছে, আমি অনায়াসে নিজেকে অধিষ্ঠিত করতে পারব।” বাইসিনগারের চোখ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। “জীবন অনেক বেশি জটিল। আপনার মরহুম চাচা একজন ভাল শাসক ছিলেন এবং তার শেষ আদেশ যে কোনো মূল্যে পালনের জন্য আমাকে কতৃত্ব দিয়েছিলেন। উজির আমার সম্মান আর অহংকারে আঘাত করেছে। তাকে আমার হাতে তুলে দেবার প্রতিশ্রুতি যদি আপনি আমাকে দেন, তবে আমি আপনার হাতে সমরকন্দ তুলে দেব।”

বাবরের চোখ ঝলসে উঠে। “আমি তোমাকে কথা দিলাম। তৈমূরের রক্ত ধমনীতে বইছে এমন একজন সুলতান তোমাকে কথা দিচ্ছে।”

“আমার সুলতান।” তাদের দিকে যারা তাকিয়ে রয়েছে সবার চোখ এড়িয়ে বোঝা যায় কি যায় না এমন ভঙ্গিতে বাইসিনগার বশ্যতা স্বীকার করে মাথা নত করে।

১.৫ কোক সরাই

০৫. কোক সরাই

সন্ধ্যা নেমে আসতে, ওয়াজির খানকে পাশে নিয়ে বাবর, তার সেনাবাহিনীর তুঙ্গস্পর্শী উত্তেজনায় শিহরিত হতে থাকা একটা দলের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করে, ভরপেট খেয়ে তরবারিতে শান দিয়ে আর পিঠে চামড়ার তৈরি ঢাল বেঁধে যারা পায়ে হেঁটে প্রধান ছাউনি থেকে রওয়ানা দেবার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। প্রথমে তারা তিন রাত আগে নহরের কিনারা ধরে বাবরের অনুসৃত পথ অনুসরণ করবে, কিন্তু তারপরে চাহাররাহা তোরণদ্বার দিয়ে সমরকন্দে প্রবেশের জন্য সংকেতের অপেক্ষায় লুকিয়ে অপেক্ষা করবে, শহরে প্রবেশের এই তোরণদ্বারের পাহারায় নিয়োজিত আছে বাইসিনগার, আর সে বাবরকে সেটা খুলে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

“আমার সাথী-যোদ্ধারা, আজ রাতে আমরা আমাদের নিয়তির মুখোমুখি হব। এসো আমরা যোদ্ধার আত্মায় বলীয়ান হয়ে হৃদয়ের সবটুকু সাহস জড়ো করি- লড়াই করার শারীরিক সাহস কেবল না, আমি জানি সেটা তোমাদের ভালই আছে, বরং নহর ধরে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে আমাদের জন্য আক্রমণের সংকেত না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার ধৈৰ্য্য যেন তোমাদের থাকে। আমরা প্রত্যেকেই তার সহযোদ্ধার বাঁচা-মরার দায়িত্ব বহন করছি। নিজের অবস্থান থেকে আমাদের ভিতরে একজনও যদি পিছিয়ে আসে- অনিচ্ছাসত্ত্বেও বা অসহিষ্ণুতার জন্য- জেনে রেখো, সে আমাদের সবার সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমার বয়স কম হতে পারে, আমি জানি আমি আমার ভূমিকা ঠিকমতই পালন করবো। তোমরা কি আমাকে। প্রতিশ্রুতি দেবে যে তোমাদের দায়িত্বও তোমরা ঠিকমত পালন করবে?”

সমস্বরে সবাই একসাথে চিৎকার করে বলে উঠে “হাঁ, সুলতান।”

সময় আর নষ্ট না করে বাবর অগ্রবর্তী দলটাকে যাত্রা করবার আদেশ দেয়। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দুটো সারি তৈরি করে নহরের পাশ দিয়ে তারা কুয়াশার ভিতরে হারিয়ে যায়। পানির যতটা কাছে সম্ভব থেকে, তীরের উইলো গাছে ডালপালা আর ঝোপঝাড়ের সামান্য আড়ালের পুরোটা সদ্ব্যবহার করে তারা এগিয়ে যায়। নিরবে এভাবে পনের মিনিট এগিয়ে যাবার পরে সহসা, সামনের কাতারের সৈন্যদের ভেতরে কেউ সামান্য কেশে উঠে। বাবরের কানে প্রহরী কুকুরের হুঙ্কারের মত জোরাল শোনায় হচিটা। অবশ্য সমরকন্দের দিক থেকে কোনো ধরণের নড়াচড়ার আওয়াজ পাওয়া যায় না। বাবর আবারও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তারপরেই সৈন্যটা আবার কেশে উঠে, এবার মনে হয় আগের চেয়েও জোরে এবং মনে হয় অনন্তকাল ধরে কাশতে থাকতে যা আদতে এক মিনিটেরও অনেক কম। এখনও মশার ভনভন আওয়াজ ছাড়া আর কিছুর শব্দ পাওয়া যায় না, অন্ধকারে প্রতিটা মানুষের উন্মুক্ত ত্বকে তারা মহানন্দে কামড়াতে শুরু করেছে।

“সুলতান, আমি তাকে ফেরত পাঠাব,” ওয়াজির খান ফিসফিস করে তাকে বলে। “বাঁচলাম।”

মূল ছাউনি থেকে রওয়ানা দেবার দুই ঘণ্টা পরে, বাবর সঁইপ্রস্তুতকারকদের তোরণদ্বারের কাছের সেই স্থানটা চিনতে পারে, যেখান থেকে সমরকন্দে রেকী করার অভিপ্রায়ে গোপন সুড়ঙ্গের উদ্দেশ্যে সে উঠে গিয়েছিল। আজ রাতে অবশ্য সে তার লোকদের নিয়ে নহরের কিনারা ধরে সামনে এগিয়ে যায়। জ্যোৎস্নার আলোয় প্রসন্ন চিত্তে বয়ে যাওয়া স্রোতস্বিনী আরও একবার তার বন্ধুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, যখন উত্তরদিকে বাঁক নিয়ে সেটা চারহাররাহা তোরণদ্বারের মাত্র দুইশ গজ দূর দিয়ে বয়ে গিয়েছে দেখা যায়।

বাবর আর তার লোকেরা, নহরের কিনারের আগাছা আর উইলোর আড়ালের পুরো সদ্ব্যবহার করে কোনো ধরণের অবাঞ্ছিত শব্দের জন্ম না দিয়ে তোরণদ্বারের খুব কাছাকাছি জায়গায় পৌঁছে যায়। ওয়াজির খানের সাথে সংক্ষিপ্ত পরামর্শ করে নিয়ে, বাবর চাঁদ মাথার উপরে উঠে না আসা পর্যন্ত তার লোকদের ঝোপঝাড়ের আড়ালে আত্মগোপন করে থাকার আদেশ দেয়- তোরণদ্বার খুলে দেবার ব্যাপারে বাইসানগারের সাথে তার সেরকমই কথা হয়েছে।

***

অস্বস্তি দূর করতে বাবর একটু নড়ে উঠে। কিন্তু ব্যাপারটা কঠিন। মশার ঝাঁক তাকে এখনও ছেকে ধরে আছে। আর না চুলকে কামড়ের জায়গা থাকতে পারছে না। আসনপিড়ি হয়ে বসে থাকায় তার কাপড়ে কাদা লেগেছে এবং নড়লেই নিচে থেকে প্যাঁচপেচে শব্দ ভেসে আসে, কিন্তু ঘন আগাছার কারণে জায়গাটা বেশ ভাল আড়াল তৈরি করেছে। সে যদি, ঠিক তার মাথার উপরের চারকোণা আকাশের তারা আর চাঁদের আবর্তন দেখে, ঠিকমত সময় আন্দাজ করে থাকে, তাহলে এখানে থানা নেয়ার পরে নব্বই মিনিট অতিবাহিত হয়েছে।

সে যেখানে গুঁড়ি দিয়ে আত্মগোপন করে রয়েছে, সেখান থেকে অবশ্য আশেপাশের এলাকা আর আকাশের এমন বেশি কিছু অংশ দেখা যায় না, যার ফলে সে চাঁদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবে। তাকে নিশ্চিতভাবে জানতে হবে আরও কতক্ষণ তাদের এখানে অপেক্ষা করতে হবে। ওয়াজির খানের পিতৃব্যসুলভ উপদেশ অমান্য করে, যে অন্য আর সবার মত তারও মাথা নিচু করে রেখে, সময়ের হিসাবের ভার তার নিজস্ব আরও অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার উপরে ছেড়ে দেয়া উচিত, বাবর মাথা উঁচু করে। আগাছার আড়াল থেকে ভাল করে দেখার জন্য উঁকি দিতে, ওয়াজির খানের পরামর্শে পরিধান করা ইস্পাতের জালিকা দেয়া জ্যাকেট, যেটা তার দেহের মাপের চেয়ে অনেক বড়, কুঁচকে গিয়ে তার বাহুর নিচে বোগলের কাছে খোঁচা দেয়। অসহিষ্ণুভাবে বাবর টানাহেঁচড়া শুরু করে, আলখাল্লার নিচে হাত দেয় এবং চেষ্টা করে কুঁচকে যাওয়া ইস্পাতের জ্যাকেট সোজা করতে। কিন্তু সে বিষয়টা আরও জটিল করে তোলে।

তার ঠিক মুখের সামনে, আগাছার আড়াল থেকে একজোড়া বুনো হাঁস আর্তস্বরে ডানা ঝাঁপটে উঠে। বর্ম ঠিক করতে গিয়ে তার মাত্রাতিরিক্ত নড়াচড়ায় বোধহয় বেচারারা আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে। বিব্রতভঙ্গিতে সে আবার মাথা নিচু করে, কিন্তু আগাছার আড়ালে মাথা নিচু করতে সে তার কয়েক ফিট দূরে পায়ের আওয়াজ শোনে যা দ্রুত কাছে এগিয়ে আসছে। যদিও যুক্তি তাকে বলে যে সেটা তারই কোনো লোকের পায়ের আওয়াজ, কিন্তু সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে তার মরহুম আব্বাজানের ঈগলের মাথার বাঁটযুক্ত আলমগীর আঁকড়ে ধরে। লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের জীবন বাঁচাতে লড়তে প্রস্তুত। শব্দটা আরও বাড়তে এবার ওয়াজির খানের কাদামাখা মুখ আগাছার আড়াল থেকে উঁকি দেয়, পেটের উপরে ভর দিয়ে কনুইয়ের সাহায্যে অনেকটা বাইম মাছের মত এঁকেবেঁকে তার দিকে এগিয়ে আসছে। বাবর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে এবং সেই সাথে কোনো একটা অদ্ভুত কারণে তার মনে হয় যে পিঠে ঢাল আটকানো এবং প্রায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকার কারণে ওয়াজির খানকে বেঢপ আকৃতির কচ্ছপের মত দেখাচ্ছে।

“সুলতান, সময় হয়েছে। আমি কি সংকেত দিতে আদেশ দেব।”

কোনমতে হাসি চেপে বাবর মাথা নাড়ে।

ওয়াজির খান যেভাবে এসেছিল সেভাবেই মাথা নিচু করে পিছলে পেছনে সরে যায়। মুহূর্ত পরে, তার আদেশে, রাতের নির্মেঘ আকাশে একটা জ্বলন্ত তীর বিশাল বৃত্তচাপ তৈরি করে আকাশে উঠে আসে, ধূমকেতুর মত জ্বলছে তার জ্বলন্ত পুচ্ছ। আগাছার ভিতরে এবার বাবর উঠে দাঁড়ালে তার পেট গুলিয়ে উঠে এবং উত্তেজনা আর আশঙ্কায় তার পা কাঁপছে টের পায়। তার লোকেরা তার চারপাশে, আড়াল ছেড়ে একে একে উঠে দাঁড়াতে থাকে।

ওয়াজির খানও তার পাশে এসে দাঁড়ায়। “আমরা শীঘ্রই জানতে পারব বাইসিনগার এক কথার মানুষ কিনা।”

“সে তার কথা রাখবে।” বাবর সে ব্যাপারে নিশ্চিত কিন্তু পোড় খাওয়া ওয়াজির খানের মনের সংশয় দূর হয় না, উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন যে তরুণ অনভিজ্ঞ বাবর হয়ত প্রতারিত হয়েছেন।

বাবর আর ওয়াজির খানকে সামনে রেখে, তাদের যোদ্ধারা আগাছার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে এবং আক্রমণাত্মক বিন্যাসে সজ্জিত হয় আর জলাভূমির উপর দিয়ে দ্রুত চারহাররাহা তোরণদ্বারের দিকে এগিয়ে যায়, তাদের পায়ের চামড়ার নাগরা মাঝেমধ্যেই কাদায় আটকে যায় এবং সবাই শান্ত ভঙ্গিতে শ্বাস নেয়। তারা আরও এগিয়ে যেতে বাবর দেখে সুউচ্চ সবুজাভ-নীল তোরণ বা পুঁইপ্রস্তুতকারকদের তোরণের তুলনায় সেটা অনেক ছোট। তোরণদ্বারের দু’পাশে শক্তপোক্ত পাথরের যেনতেনভাবে তৈরি করা বুরুজ নির্মানের সময় দর্শনীয়তার চেয়ে উদ্দেশ্যের বিষয়ে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এবং বাবর এখান থেকেই তোরণদ্বারের ভারী লোহার গ্রিল দেখতে পায়, যা শহরে প্রবেশের সংকীর্ণ গলিপথটা সুরক্ষিত করে রেখেছে। তার মনে হয় ফোকলা দাঁতের কেউ তার দিকে মুখব্যাদান করে হাসছে।

সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ে কিনা দেখতে বাবর চোখ পিটপিট করে চারপাশে তাকালে বুঝতে পারে কোথাও কিছু নড়ছে না- এমন কি তোরণদ্বারের উপরের প্রকোষ্ঠ যেখান থেকে বাইসানগার কপিকল দিয়ে গ্রিল তোলার আদেশ দেবে সেখানেও কোনো আলো জ্বলছে না। কোনো কিছু না ঘটলে সে কি করবে? হয়ত পুরোটাই একটা নির্মম ছলনা। বা এটাও হতে পারে পুরো পরিকল্পনাই ফাঁস হয়ে গিয়েছে আর বাইসানগার এখন কোনো অন্ধকার কুঠরিতে নিপীড়ন সহ্য করতে না পেরে তাদের পায়তারা যন্ত্রণাক্লিষ্ট কণ্ঠে বয়ান করছে।

বাবর নিজেকে শান্ত করে চিন্তা করতে থাকে। তার সামনে এখন কি পথ খোলা রয়েছে? কিন্তু মনে মনে সে জানে তার সামনে এই একটাই পথ রয়েছে। তাদের এগিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। এমন কি এখন, জ্বলন্ত তীরের বাঁকান গতিপথের মাধ্যমে যা সূচীত হয়েছে, বাছাই করা চার’শ যোদ্ধার দল ইতিমধ্যে তার তিন রাত আগের যাত্রাপথ পুনরায় অনুসরণ করে স্যাঁতস্যাঁতে সংকীর্ণ সুড়ঙ্গে নেমেছে, যা তাদের শহরের ভেতরে নিয়ে যাবে। সে তাদের পরিত্যাগ করবে না। যাই ঘটুক না কেন, সে তার লোকদের নেতৃত্ব দিয়ে তোরণ আক্রমণ করবেই।

তার মন যখন এসব বিক্ষিপ্ত ভাবনার দোলাচালে আচ্ছন্ন, বাবর তোরণদ্বারের ডান পাশের দেয়ালের উপরে হাতে মশাল ধরা একটা ছায়ামূর্তি দেখতে পায়। যেটা ইচ্ছাকৃতভাবে সে এপাশওপাশ দোলাতে থাকে। একই সাথে বাবর আশেপাশে কোথাও বিশাল একটা পুলির ঘুরতে শুরু করার কর্কশ খরখর আওয়াজ শুনতে পায়। লোহার গ্রীলটা প্রথমে কেঁপে উঠে, তারপরে অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেন উপরে উঠতে শুরু করে। ওয়াজির খানের দিকে তাকিয়ে সে বিজয়ীর একটা হাসি দেয়, তারপরে আক্রমণের জন্য পূর্ব নির্ধারিত সংকেত চাপা স্বরে বলে উঠে। তার লোকেরা সংকেতটা পুনরাবৃত্তি করতে সে একটা চাপা গমগমে আওয়াজ শুনতে পায়। সংকেতটার কোমল আবেদন, থিতিয়ে আসতে নিজের ভেতরে সে একটা উদ্দীপনা টের পায় যা তাকে সামনে এগিয়ে যেতে বাধ্য করে।

ডান হাতে তার মরহুম আব্বাজানের তরবারি, বাম হাতে খঞ্জর নিয়ে বাবর তোরণদ্বারের বাকি পথটুকু দৌড়ে অতিক্রম করে। লোহার গ্রীল ইতিমধ্যে এক তৃতীয়াংশ উঠে এসেছে। তার লোকেরা তাকে ঘিরে ধরতে গ্রীলের নিচের তীক্ষ্ণ শলাকার খোঁচা থেকে বাঁচতে সে নিজেকে গুটিয়ে একটা বলের মত করে এবং নীচ দিয়ে গড়িয়ে আসে। কুণ্ডলাকৃতি থেকে মুক্ত হয়ে সে লাফিয়ে পায়ের উপরে উঠে দাঁড়ায় এবং অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে, বাতাস কেটে মৃত্যু মুখে নিয়ে ছুটে আসা তীরের অমোঘ শব্দ বা অন্ধাকারে হুল্লোড় তুলে ডিগবাজি দিয়ে ধেয়ে আসা কুঠারের সামান্যতম আভাসের জন্য তার প্রতিটা ইন্দ্রিয় টানটান হয়ে রয়েছে। কিন্তু তোরণদ্বারের উপরের প্রকোষ্ঠ থেকে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নেমে আসা পায়ের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। বাইসানগার এগিয়ে আসে, মুখের অভিব্যক্তি ভাবলেশহীন। “স্বাগতম। আমি আমার কথা রেখেছি।” সে বাবরের সামনে এসে নতজানু হয়। “আমাদের দ্রুত যা করার করতে হবে। গুপ্তচরের দল সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে- এমন কি এখনও হয়ত কেউ আমাদের দেখছে এবং যেকোন মুহূর্তে পাগলাঘন্টি বেজে উঠতে পারে। আমার বিশজন লোক এই তোরণের পাহারায় রয়েছে আর বাকিরা কোক সরাইয়ের নিকটে অপেক্ষা করছে।” শহরের দিকে এগিয়ে যাওয়া একটা অন্ধকার গলির দিকে ইশারা করে সে দেখায়। “আমার সঙ্গে আসুন।”

বাইসানগারের কথা শেষ হতে, সামনে, নগর প্রাকারের অভ্যন্তরে কোক সরাইয়ের ছাদে অন্ধকার বিদীর্ণ করে সহসা কমলা রঙের আলোর আভা দেখা যায়- মশাল। তাদের উপস্থিতির খবর সেনাছাউনিতে পৌঁছে গেছে। শিঙার গগনবিদারী আর্তনাদ এবং কর্কশ স্বরে সেনাপতিদের নিজ নিজ লোককে ডাকার শব্দ ভেসে আসতে বোঝা যায় যে বিপক্ষকে চমকে দেবার সুযোগ তারা হারিয়েছে। বাবর ইতস্তত করে না। তরবারি উপরে তুলে গায়ের পুরোটা শক্তি ব্যবহার করে সে তার লোকদের রণহুঙ্কার দেয়- “ফারগানা।” তার কানের পর্দা দপদপ করে, সে সামনের দিকে। ধেয়ে যায়।

গলিটার দুপাশে লম্বা, উঁচু, মাটির ইটের সারিবদ্ধ বাসা যার দরজা নিশ্চিতভাবেই ভেতর থেকে বন্ধ। বাবর এক মুহূর্তের জন্য দরজাগুলোর পেছনে জড়সড় হয়ে বসবাসকারী পরিবারগুলোর কথা ভাবে, যারা দোয়া করছে যেন এই ঝড় শীঘ্রই শেষ হয়। তাদের জানবার কথা না যে সাধারণ নাগরিকদের হত্যা বা লুট করার উপরে সে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তার শত্রুদের অবশ্যই উপযুক্ত মূল্য দিতে হবে, নিরীহ লোকদের রক্তে স্নান করে সে সমরকন্দে তার শাসনকাল শুরু করতে চায় না।

“সুলতান, এই পথে।” বাইসানগার বাবরের বাহু আঁকড়ে ধরে এবং হেঁচকা টানে বামদিকে বাঁক নেয়া একটা সরু গলিতে তাকে নিয়ে আসে। হঠাৎ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে বাবর টলে উঠে এবং আরেকটু হলেই সে আছাড় খেতো। মুহূর্তের জন্য সে তার পেছনে ওয়াজির খানের দিকে তাকায়। গলিটার দুপাশে উঁচু দেয়াল আর ভীষণ সংকীর্ণ। পাশাপাশি একজন বড়জোর দুজন লোক এগিয়ে যেতে পারবে- অতর্কিত আক্রমণের জন্য আদর্শ স্থান। গাঢ় অন্ধকারের ওপাশে তাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে?

“দূর্গে পৌঁছাবার এটা সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথ।” বাইসানগারের কণ্ঠ তীক্ষ্ণ আর তাতে আর্তি ঝরে পড়ে।

বাবর চোখ সরু করে তার দিকে তাকায়। সে জানে যে তার বয়স কম হওয়া সত্ত্বেও তার লোকেরা এখন তার মাঝে একজন নেতাকে দেখতে চাইছে। এখন ইতস্তত করার কোনো অবকাশ নেই, যখন শত্রুর কণ্ঠস্বর প্রতি মুহূর্তে তাদের দিকে। এগিয়ে আসছে। সে বাইসানগারকে বিশ্বাস করে, যা তাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। ওয়াজির খানকে পাশে নিয়ে সে তার লোকদের বলে অনুসরণ করতে এবং ঘুরে দাঁড়িয়ে বাইসানগারের পেছন পেছন গলিতে প্রবেশ করে। বাবর বিস্মিত হয় যে শহর দখলের লড়াই শুরু হতে তার ভিতরের ভয় কোথায় যেন উবে গেছে এখন সেখানে কেবল উত্তেজিত উল্লাস বিরাজ করছে। সব যুদ্ধেই কি একই অনুভূতি হয়? সহসা, পূর্বদিকে খানিকটা দূর থেকে, সে একটা জোরাল হুঙ্কার ভেসে আসতে। তার লোকেরা নিশ্চয়ই সুড়ঙ্গ থেকে বের হয়ে এসেছে এবং এখন শহরের কেন্দ্রস্থলের দিকে ছুটে যাচ্ছে। তারা গ্রান্ড উজিরের অনুগত সেনাবাহিনীকে ব্যস্ত রাখবে।

গলিটা এবার ডান দিকে আরেকটা তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়েছে, এবং তারপরে সহসাই শেষ হয়েছে। চারপাশে আধো-অন্ধকারে তাকিয়ে বাবর দেখে সে একটা প্রাঙ্গনের মত জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, যার একদিকে, ঠিক তার উল্টোপাশে, তৈমূরের দূর্গপ্রাসাদের উঁচু দেয়াল। গতবারের অভিযানের স্মৃতি আর তার পর্যবেক্ষণ করা পরিকল্পনার কথা স্মরণ করে, সে বুঝতে পারে তারা নিশ্চয়ই দক্ষিণ দিকে এসে পৌঁছেছে। হ্যাঁ, কয়েক’শ গজ সামনে দেয়ালের ভিতরে, পূর্বদিকে বিস্তৃত কোক সরাইয়ের তীক্ষ্ণ দাঁতের মত প্রাচীরের বেষ্টনী দেয়া দূর্গপ্রাসাদ সে দেখতে পায়। বাইসানগার তাদের ভালই পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে। আরও খুশির কথা বাবর ঠিক তার মাথার উপরের দেয়ালে কোনো প্রহরী দেখতে পায় না। সম্ভবত তারা কল্পনাও করেনি শত্রু এখান দিয়ে বেয়ে উপরে উঠতে পারে।

যাই হোক, বাইসানগার আর ওয়াজির খানের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বাবর দ্রুত আঙ্গিনাটা অতিক্রম করে এবং দূর্গপ্রাসাদের দেয়ালে গায়ে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে দাঁড়ায়। গলিপথে তার লোকেরা এসে উপস্থিত হলে সে ইশারায় তাদেরও একইভাবে দাঁড়াতে বলে। কোনো ধরণের দ্বিধাদ্বন্দ্বে না ভুগে তারা তার আদেশ পালন করে। বাইসানগার নিচু স্বরে কিছু একটা বলতে, কালো আলখাল্লা পরিহিত, গম্বুজাকৃতি শিরোস্ত্রাণ মাথায় দেয়া ছায়ামূর্তির দল আঙ্গিনার পশ্চিমদিকের কোণায় অবস্থিত ভাপ উঠতে থাকা আবর্জনার স্তূপের আড়াল ছেড়ে বের হয়ে আসে। বাইসানগারের সৈন্যদল। তারা এসে নিরবে তাদের সেনাপতিকে ঘিরে দাঁড়ায়।

“সুলতান, সামনের বাঁকের মুখে একটা বন্ধ করে দেয়া তোরণদ্বারের কাছে দূর্গপ্রাসাদের দেয়ালের উচ্চতা সবচেয়ে কম,” বাইসানগার ফিসফিস করে বলে। “আর আমরা সেখান দিয়েই ভিতরে প্রবেশ করবো। আমার লোকেরা মই নিয়ে এসেছে এবং আমি আমার তীরন্দাজদের বলবো নিরাপত্তার আড়াল দিতে।” বাবর আর ওয়াজির খান সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ে। দেয়ালের গায়ের সাথে প্রায় মিশে গিয়ে এবং বাইসানগারের নেতৃত্বে আক্রমণকারী দলটা দূর্গপ্রাসাদের দেয়ালের কোণার দিকে আস্তে আস্তে এগিয়ে যায়। সতর্কতার সাথে বাইসানগার একবার চারপাশে তাকিয়ে দেখে এবং তারপরে পেছনে সরে এসে বাবর আর ওয়াজির খানকে ইঙ্গিত করে দেখতে।

দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে তারা সবাই নিশ্চিত হয় যে সবকিছু ঠিক আছে। তোরণদ্বারটা এখান থেকে মাত্র ত্রিশ গজ দূরে। সহসা এই উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠা বাবরের কাছে অসহ্য মনে হতে থাকে। ওয়াজির খানের আগলে রাখা বাহুর বেষ্টনী থেকে এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে, সে চিৎকার করে তার লোকদের অনুসরণ করতে বলে, তোরণদ্বার লক্ষ্য করে দৌড়াতে শুরু করে। দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে থাকার কথা সে বেমালুম ভুলে যায় এবং সাথে সাথে সে তীরের বাতাস কেটে এগিয়ে যাবার হুশ শব্দ শুনতে পায় তারপরেই আরেকটা, কোনো। সন্দেহ নেই তার মাতালের মত চিৎকার শুনে তীরন্দাজের দল দূর্গের ছাদের। বেষ্টনীর পিছনে এসে হাজির হয়েছে। একটা লম্বা শরযষ্টি বিশিষ্ট তীর তার গালে আঁচড় কেটে যায় পেছনের ভূমিতে গেঁথে যাবার পূর্বে। তীব্র জ্বালার প্রতি সে ভ্রূক্ষেপ করে না। মুহূর্তের উল্লাস ছাড়া আর কিছুই সে অনুভব করে না। সে তোরণদ্বারের দিকে দৌড়ে যায়। কোনমতে অক্ষত দেহে সে সেখানে পৌঁছে, যে পাথর দিয়ে তোরণদ্বার আটকানো সেটার সাথে নিজেকে প্রায় মিশিয়ে দেয়, আশা করে মাথার উপরে ঝুলন্ত সরদল তাকে কিছুটা হলেও আড়াল দেবে। চারপাশে তাকিয়ে সে তার পাশের পাথরের চৌকাঠে একটা গুটিসুটি মেরে থাকা বাঘ খোদাই করা দেখতে পায়, সমরকন্দের শাহী প্রতীক, কান দুটো মাথার সাথে লাগানো আর মুখটা ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে বাঁকানো রয়েছে।

বাইসানগারের তীরন্দাজের দল এখন অবস্থান নিয়ে, দেয়ালের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপত্তা রক্ষীদের সমুচিত জবাব দিয়ে চলেছে। বাবর টের পায় কপালের উপর থেকে উষ্ণ তরলের একটা ধারা গড়িয়ে চোখে এসে পড়ছে। আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করে সে টের পায় জিনিসটা রক্ত কিন্তু তার নিজের না। উপরের দিকে তাকিয়ে সে দেখে গলায় শরবিদ্ধ এক সৈন্য দেয়ালের উপরে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। হাত উঁচু করে সে লোকটার শরবিদ্ধ জায়গাটা স্পর্শ করতে, সে তাল হারিয়ে ফেলে। মুহূর্ত পরে, বাবরের পায়ের কাছে একটা ভোতা শব্দ করে লোকটার দেহ আছড়ে পড়ে। রক্ত আর শ্লেষ্ম ছিটকে, হতভাগ্য লোকটা কুঁকড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ ছটফট করে এবং তারপরে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়া কালো রক্তের মাঝে তার দেহটা নিথর হয়ে যায়।

বাইসানগারের লোকের এখন দেয়ালের গায়ে লম্বা লম্বা কাঠের মই স্থাপন করছে। কাঠের ধাপের দু’পাশে চামড়ার ফালি আটকে মইগুলো তৈরি করা হয়েছে বটে কিন্তু দারুণ কার্যকর মইগুলো। তাদের লোকেরা ইতিমধ্যে মই বেয়ে উঠতে শুরু করেছে, তারা একহাতে কাঠের ডাসা ধরে অন্য হাতে মাথার উপরে ঢাল ধরে রেখেছে উপর থেকে ছোঁড়া তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে।

বাবরের হৃৎপিণ্ড এখনও দুরন্ত গতিতে স্পন্দিত হচ্ছে এবং সে দ্রুত কিছু একটা করতে মরিয়া হয়ে উঠে। সে চারপাশে তাকায় উপরে উঠার অন্য কোনো পথ খোঁজে। তোরণদ্বার ভাঙার কোনো সুযোগ নেই। প্রথম দৃষ্টিতে, পাথরের দেয়াল। মসৃণ দেখায়, প্রতিটা পাথর নিখুঁতভাবে জোড়া দেয়া। ফারগানার বুনো পাহাড় আর দরীতে সে খামোখাই বেড়ে উঠেনি, বাবর নিজেই নিজেকে বলে। ভাল করে তাকাতে সে পাথরের দেয়ালে অনেক ফাটল আর চিড় দেখতে পায় যেখানে হাত। আর পা দিয়ে তার মত হাল্কা পাতলা একজন বেয়ে উঠতে পারবে। তার মরহুম। আব্বাজানের মূল্যবান তরবারি পিঠে ঝুলিয়ে, বাবর গভীর একটা শ্বাস নেয়। শেষবারের মত চারপাশে তাকাতে সে দেখে ওয়াজির খান তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তাকে রীতিমত উদ্বিগ্ন দেখায়। বাবর দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায় এবং দেয়ালের পাদদেশ দিয়ে দৌড়ে যাবার সময়ে তাকে লক্ষ্য করে ছোঁড়া তীর ফাঁকি দিয়ে মইয়ের কাছ থেকে দূরে সরে যায়।

সে দেয়াল বেয়ে উঠতে শুরু করে, তার হাত দেয়ালের উপরে হাতড়াতে থাকে, সামান্য বের হয়ে থাকা পাথরের কোণা, এবং চুনের আস্তর খসে পড়ার কারণে দুই পাথরের মাঝে উন্মুক্ত হয়ে উঠা ফাঁক কিংবা রাজমিস্ত্রীদের বাটালির ঘাইয়ের ফলে সৃষ্ট দাগ খুঁজে- যেখানে সে বুড়ো আঙ্গুল কিংবা হাত বা পায়ের কিনারা রাখতে পারে। সে তার ঊর্ধ্বমুখী গতি অব্যাহত রাখে নতুবা সে পড়ে যাবে, এবং প্রতিমুহূর্তে তার হাত নতুন অবলম্বন খুঁজতে থাকে। তৈমূরের রাজমিস্ত্রীরা অসাধারণ কাজ করেছে- হাতের কাজের দক্ষতার কারণেই কি তিনি তাদের সমরকন্দে নিয়ে আসেননি? বড্ড বেশি দক্ষ সম্ভবত, বাবরের ভাবনা সহসা মাটি থেকে বিশ ফিট উপরে একটা ঝকি খায়, যখন তার পা কোনো অবলম্বন ছাড়া শূন্যে ঝুলতে থাকে এবং সে টের পায় কেবল হাতের উপরে ঝুলে থাকার কারণে তার নখ উপরে আসতে চাইছে।

পাথরের মত শুষ্ক আর ধূলোময় মুখে, বাবর কোনো মতে ঝুলে থাকতে চেষ্টা করে, পাগলের মত পা দিয়ে ডানে বামে খুঁজতে থাকে কোনো অবলম্বন পাওয়া যায় কিনা, কিন্তু কেবল মসৃণ পাথরের দেয়ালে তার পা ঘষা খায়। দেহের পুরো ওজন নেবার কারণে তার বাহুদ্বয় প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে। তারপরে, যখন তার মনে হতে শুরু করে যে হাত ছেড়ে দিয়ে নিচে গড়িয়ে পড়াই শ্রেয়, ঠিক তখনই তার ডান পা নরম কিছু একটায় গিয়ে পড়ে শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ঘাসের একটা গোছা, পাথরের ফাটলের গভীরে যার বীজ প্রোথিত। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, বাবর এবার তার ডান পা গোছাটার উপরে রেখে দেখে সেটা ভার নিতে পারে কিনা এবং সেটা তার দেহের ভর কিছুটা সামাল দিলে তার হাতের অসহ্য ব্যাথা কমে আসে।

এক নিমেষের জন্য সে তার চোখ বন্ধ করে। নিজেকে তার ক্ষুদ্র, অরক্ষিত, অসহায়, একটা কীটের মত মনে হয়। কিন্তু সে অন্তত এক মুহূর্তের জন্য বিশ্রাম নিতে পারে। পুনরায় চোখ খুলে, মাথার অবিন্যস্ত চুলের মাঝ দিয়ে তাকিয়ে সে দেখে দেয়ালের শীর্ষদেশ বাড়াবাড়ি ধরণের কাছে সম্ভবত মাথার সাত কি আট ফিট উপরে। সতর্কতার সাথে, অনুসন্ধানী ভঙ্গিতে সে ডান হাত উপরে বাড়িয়ে দেয় এবং মাথার দুই ফিট উপরে বের হয়ে থাকা একটা পাথরের খাঁজ খুঁজে পেতে সে স্বস্তিতে আরেকটু হলে জোরে হেসে উঠত। তারপরে, ডান পা ঘাসের গোছর উপরে রেখে যা তার প্রাণ বাঁচিয়েছে, সে বাম পা ভাঁজ করে এবং উপরের দিকে সেটা রাখার জায়গা পাওয়া যায় কিনা দেখে। পুনরায় সে আরেকটা খাজ খুঁজে পায়- খুব বড় কোনো ফাটল না- সংকীর্ণ একটা খাঁজ, পাথরের গায়ে একটা আড়াআড়ি ফাটল, কিন্তু সেটাই যথেষ্ট। শেষ একটা হেঁচকা টানে, দেয়ালের শীর্ষভাগে সে নিজেকে উপরে টেনে তোলে এবং কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করতে থাকে যেন তরবারির ফলা তার আঙ্গুলের উপরে নেমে না আসে।

ছাদের কিনারের প্যারাপেটের উপর দিয়ে টপকে সে নিজেকে দেয়ালের উপরের চওড়া অংশে নিয়ে আসে যেখানের পাথর প্রহরীদের পায়ের ঘষায় মসৃণ হয়ে গিয়েছে। বাবর চারপাশে তাকিয়ে অবাক হয়ে দেখে যে প্রথম যারা উপরে উঠে এসেছে সে তাদের অন্যতম। সে ভেবেছিল তার অনেক সময় লেগেছে কিন্তু কিছুক্ষণের ভিতরে ওয়াজির খানের নেতৃত্বে তার আরও লোক এসে হাজির হয় এবং দড়ির মই বেয়ে উঠে আসবার কারণে সবাই হাঁসফাঁস করছে।

দেয়ালের নিরাপত্তা রক্ষায় যারা নিয়োজিত ছিল, বোধহয় পালিয়েছে। একপা পিছিয়ে এসে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বাবর পালিয়ে যাওয়া কোনো সৈন্যের একপাশে ফেলে যাওয়া একটা রূপা দিয়ে বাধান ঢালের সাথে হোঁচট খায়। সে ঝুঁকে ঢালটা তুলতে যাবে। কিন্তু পেছন থেকে ভেসে আসা একটা শব্দ শুনে সে ঘুরে তাকায়। দেয়ালের ভিতরের দিকে অবস্থিত একটা আঙ্গিনা থেকে উপরে উঠে আসা একটা সংকীর্ণ সিঁড়ি দিয়ে সমরকন্দের অপেক্ষাকৃত সাহসী সৈনিকের একটা দল হুড়মুড় করে উপরে উঠে আসছে। বাবর, তাদের উজ্জ্বল সবুজ রঙের পরিকর আর বর্শার মাথায় উড়তে থাকা সবুজ নিশান দেখে ধারণা করে, গ্রান্ড উজিরের ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর দল। একটা হুঙ্কার দিয়ে, বাবর তাদের দিকে ধেয়ে যায়, জানে যে ওয়াজির খান আর তার লোকেরা তাকে অনুসরণ করবে এবং শপথ, হুঙ্কার, আর এলোপাথাড়ি তরবারি ধারালো যোতের ভিতরে নিজেকে আবিষ্কার করে। দেয়ালের উপরের অংশটা যদিও বেশ চওড়া- সম্ভবত দশ ফিট প্রশস্ত- দু’পাশ থেকে শীঘ্রই টপাটপ মানুষ নিচে আছড়ে পড়তে থাকে। কেউ আহত হয়ে নিচে পড়ে, কাউকে আবার অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ঠেলেই ফেলে দেয়। ঘামের উষ্ণ, নোতা গন্ধ তার নাক প্রায় বন্ধ করে দেয়। সে এরপরে যতদিন বেঁচে থাকবে তার স্মৃতিতে এটা যুদ্ধের ঘ্রাণ হিসাবে বিরাজ করবে।

কাঁচাপাকা লম্বা দাড়ির এক দীর্ঘকায় যোদ্ধা ভীড়ের ভিতরে বাবরকে আলাদা করে, তার হাল্কা দেহকাঠামো আর অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়স লক্ষ্য করে লোকটার মাংসল চোখেমুখে ক্রুদ্ধ বিদ্রুপের হাসি খেলে যায়। ইঁদুর শিকারের আগে বাবর বিড়ালের চোখে মুখে এমন ভাব দেখেছে এবং লোকটার অবজ্ঞা বাবরকে ক্ষেপিয়ে তোলে। ওয়াজির খান অনুরোধ করেছিলে যে বাবর যেন এমন কিছু পরিধান না করে যাতে তাকে ফারগানার সুলতান হিসাবে সনাক্ত করা না যায় কিন্তু এই হোঁকা উদ্ধত শুয়োরটাকে সে আজ তার জাত চিনিয়ে দেবে।

“বুড়ো খোকা তোমার বাসায় থাকা উচিত ছিল, আগুনের পাশে বসে থেকে তোমার ভেজা পাজামা বদলে দেয়ার জন্য পরিচারককে ডাকতে।”

এক মুহূর্তের জন্য উদ্ধত যোদ্ধাটা হতবাক হয়ে যায় কিন্তু তারপরে বাবর কি বলছে সেটা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরে তার অভিব্যক্তি ক্রোধে ফেটে পড়ে। সে তার চর্মসদৃশ শক্ত হাতে বর্শাটা ধরে বাবরের দিকে এগিয়ে আসে। “পুঁচকে ইঁদুরের ছানা, আমি যদি তোমাকে পিষে না দিয়েছি।”এত দ্রুত সবকিছু ঘটে যে বাবর কোনো প্রতিরোধই করতে পারে না, সে বর্শার মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে ভোঁতা দিকটা বাবরের পেটে বেমক্কা একটা গুতো দেয়।

বাবর টের পায় ধাক্কার চোটে তার পা ভারসাম্য হারিয়েছে আর সে পিছনে ছিটকে পড়েছে। ডুবন্ত মানুষের মত সে হাত নাড়ে, ভয় পায় যে আঘাতের প্রাবল্য তাকে দেয়ালের নিচে ছিটকে ফেলবে। কিন্তু সে টের পায় তার মাথা পেছন দিকে হেচকা টানে নিচু প্যারাপেটের গায়ে বুকে যায়। ক্ষণিকের জন্য তার চারপাশের জগত আলোর ফুলঝুরিতে ভরে উঠে, খানিক আগে নহরের ধারে আগাছার আড়াল থেকে যে বিশুদ্ধ রূপালি নক্ষত্রের দীপ্তির দিকে তাকিয়ে ছিল, সে রকম না অনেকটা উজ্জ্বল এবড়োথেবড়ো আকৃতির একটা জটলা মত যা পিচ্ছিল রক্তের মত লালে জারিত। তার মুখ লবণাক্ত পানিতে ভরে উঠতে সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে সেটা উগরে দেয়। তারপরেও সে ঠিকমত শ্বাস নিতে পারে না- আঘাতটা তার বুকের সব বাতাস বের করে দিয়েছে।

দাড়িঅলা লোকটা তার দিকে আবার ধেয়ে আসে। “খোকা ওটা কেবল শুরু ছিল। ঐ বিদ্রুপের কারণে মারা যাবার আগে তোমার কপালে আরো ভোগান্তি আছে, সে থুতু ফেলে এবং একই সাথে বর্শাটা দিয়ে বাবরের নিতম্বে খোঁচা দিতে চায়। একেবারে সময়মত বাবর গড়িয়ে পাশে সরে গিয়ে আঘাতটা এড়ায় এবং বর্শার ফলা পাথরের মেঝেতে ধাক্কা খেয়ে আগুনের ফুলকি ছোটায়। তার প্রতিপক্ষ গালবকে। দশাসই ওজন হওয়া সত্ত্বেও বিস্ময়করভাবে লোকটার চলাফেরা অনেক দ্রুত। বিশাল ভালুকের মত সে বাবরের দিকে স্থির প্রতিজ্ঞ ভঙ্গিতে ধেয়ে আসে, সে অর্ধেক ঝুঁকে এক হাতে প্রচণ্ড ব্যাথা করতে থাকা পেট আঁকড়ে ধরে দম ফিরে পেতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু অন্য হাতে ঠিকই তরবারিটা ধরা রয়েছে। তার নিঃশ্বাস সবে আগের চেয়ে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে এবং সে মাত্র সুস্থির বোধ করতে শুরু করেছে।

“তা ইঁদুরের ছানা- শীঘ্রই তুমি তোমার দলের বাকি ধাড়ি ইঁদুরগুলোর সাথে নিচের গোবরের গাদায় গড়াগড়ি খাবে,” লোকটা কথা বলার ফাঁকে বর্শার ফলার তীক্ষ্ণ দিকটা সরাসরি বাবরের মুখের দিকে নিশানা করে। বাবর হীরক দ্যুতিময় শীতল আভাযুক্ত ফলার দিকে সম্মোহিতের ন্যায় তাকিয়ে থাকে। এক মুহূর্তের জন্য তার নিজেকে পক্ষাঘাতগ্রস্থ মনে হয় কোনো ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখাতে অক্ষম, কিন্তু দানবটা তার দিকে বর্শার ফলা দিয়ে আঘাত করেছে, সহজাত প্রবৃত্তির বলে সে ঠিকই বুঝতে পারে তার কি করতে হবে। নিজের সবটুকু ক্ষিপ্রতা আর গতি জড়ো করে সে মাটিতে শুয়ে পড়ে এবং তার আততায়ীর নাগালের কাছ থেকে সরে গিয়ে আগুয়ান বর্শার নিচে দিয়ে তার দিকে গড়িয়ে আসে। তার দেহ দানবটার পায়ে এসে ধাক্কা খেতে সে তার লম্বা ফলাযুক্ত খঞ্জর দিয়ে বদমায়েশটার একটা পায়ের হাঁটুর পেছনের মাংসপেশী দ্বিখণ্ডিত করে দেয়। একটা বিকট আর্তনাদ করে, তার প্রতিপক্ষ একপাশে কাত হয়ে পড়ে যায় এবং পায়ের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হয়। বাবর টলোমলো পায়ে উঠে দাঁড়ায় এবং আবার আঘাত করে। এবার সে লোকটার বাম বোগলের নিচে পাজর লক্ষ্য করে আঘাত করে যা তার বর্ম আবৃত করে রাখেনি। সে অনুভব করে তার খঞ্জরের ফলা মাংসপেশী আর মোটা কার্টিলেজ ভেদ ভেতরে প্রবেশ করে, লোকটার পাঁজরের ভিতরে পিছলে যায়। দানবটা নিচু কণ্ঠে একটা ফ্যাসফেসে আওয়াজ করে এবং সামনের দিকে ঝুঁকে আসে। বাবর তার খঞ্জরের ফলা বের করে আনলে রক্ত ছিটকে বেরিয়ে আসে। সে বিস্মিত দৃষ্টিতে হাতাহাতি লড়াইয়ে প্রথম হত্যা করা লোকটার লাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।

“সুলতান! সাবধান!” ওয়াজির খান একেবারে ঠিক সময়ে হুঁশিয়ার করে দেয়। এক ঝটকায় ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে, বাবর তার ঘাড় লক্ষ্য করে রণকুঠার নামিয়ে আনা অন্য আরেক আক্রমণকারীকে ভীষণভাবে আঘাত করে। সহসা বাবর আবার জানতে পারে ভয় কাকে বলে। কি আহাম্মক সে এভাবে পেছন থেকে তাকে আক্রমণের সুযোগ দিয়েছিলো। মওকা পেয়ে ওয়াজির খান তার নতুন আক্রমণকারীকে লাথি মেরে ভূপাতিত করে এবং বাঁকা তরবারির মোক্ষম কোপ বসিয়ে দিতে, ছাদের উপরে তার ছিন্ন মাথা গড়াতে থাকে।

দ্বিতীয় সুযোগ লাভ করে কৃতজ্ঞ, বাবর, জানে অনেক অনভিজ্ঞ যোদ্ধাই এই সুযোগ লাভে বঞ্চিত হয়, ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়েছে, দু হাতে খঞ্জর আর তরবারি প্রস্তুত, কিন্তু চারপাশে তাকাতে দেখে গ্রান্ড উজিরের রক্ষীবাহিনী ইতিমধ্যে হয় খুন হয়েছে নয়তো প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছে। সবাই তারা একজন দু’জনের দল করে একে অন্যের উপরে পড়ে রয়েছে বা পাথরের উপরে অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে, তাদের একদা উজ্জ্বল পরিকর এখন রক্তে ভেজা। ছিন্নভিন্ন নাড়িভূড়ি আর গড়িয়ে পড়া মলের গন্ধ নাকে বাবর ঝাপটা দেয়।

“আসুন।” বাইসানগার তার পাশে দাঁড়িয়ে। তার কাঁধের একটা গভীর ক্ষত থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে আর মুখটা ব্যাথায় শক্ত হয়ে আছে। কিন্তু সেসব পাত্তা না দিয়ে সে কয়েকশ ফিট দূরে কোক সরাইয়ের আবছা অবয়বের দিকে বারবার ইঙ্গিত করে। “গ্রান্ড উজির ওখানেই লুকিয়ে রয়েছে- আমি যদি তাকে ঠিক চিনে থাকি তাহলে ব্যাটা গিয়ে জেনানা মহলে আশ্রয় নেবে।”

নিজের লোকদের অনুসরণ করতে বলে, বাবর হোঁচট খেতে খেতে বাইসানগারে পিছু নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়, যা দেয়াল থেকে নিচের আঙ্গিনায় নেমে গিয়েছে। পড়ে থাকা লাশ আর আধা পিচ্ছিল জমাট রক্তের উপর দিয়ে কোনমতে টপকে যাবার সময়ে একটা মুখের উপরে তার দৃষ্টি আটকে যায়। মুখটা সম্ভবত তারই বয়সী আরেক কিশোর যোদ্ধার। রক্তশূন্য, মৃত্যুযন্ত্রণার নিরব চিৎকারে তার ঠোঁট পেছনে বেঁকে গিয়ে মাড়ি বের হয়ে আছে এবং তার চোখের লম্বা পাপড়ির নিচে বিশাল কালো চোখে দৃষ্টির মায়া মিলিয়ে গিয়ে ফুটে আছে মৃত্যুর বিভীষিকা। বাবর কেঁপে উঠে এবং দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নেয়। ওয়াজির খান তাকে হুঁশিয়ার করে চিৎকার করে না উঠলে তারও একই ভাগ্য বরণ করতে হতো।

বাবর আর ওয়াজির খান এবং তাদের লোকেরা বাইসানগারকে প্রাঙ্গনের উপর দিয়ে অনুসরণ করে এগিয়ে গেলে দূর্গ আস্তানাকে নিরব আর শান্ত দেখায়। দেয়ালের উপরে একচোট লড়াইয়ের পরে তাদের আর নিরবে এগিয়ে যাবার কোনো মানে হয় না- দূর্গ আস্তানায় তাদের উপস্থিতি এখন আর গোপন নেই। কিন্তু বাবরের লোকদের অনেকেই গরু আর ভেড়া-চোর হবার কারণে তারা নিরবে আর গোপনে এগিয়ে যায়। গ্রান্ড উজিরের বাকী দেহরক্ষী এবং সৈন্যরা সব কোথায়? বাবর আশঙ্কা করে যে কোনো সময়ে তীরের একটা ঝাপটা ধেয়ে আসতে পারে, কিন্তু সে রকম কিছুই ঘটে না।

চার-তলা কোক সরাইয়ের কাছে গোপনে পৌঁছালে তারা সেটাকে রহস্যজনকভাবে নিরব দেখতে পায়, ড্রাগনের হাতল যুক্ত পিতলের চকচকে দরজাগুলো খোলা এবং অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। তৈমূরের কিংবদন্তির দূর্গ। এমন চমৎকার একটা কিছু নির্মাণের জন্য না জানি আত্মবিশ্বাসের প্রয়োজন। দূর্গের প্রতিটা পাথর থেকে শক্তি আর ক্ষমতা যেন ঠিকরে পড়ছে। বাবরের তার মরহুম আব্বাজানের বলা অশুভ গল্পগুলো মনে পড়ে। “তৈমূরের সব সন্তান যারা বিদ্রোহ করেছে এবং সিংহাসনে বসেছে সবাই সেখানেই বসেছে। সিংহাসনের মোহে পড়ে যারা নিজের প্রাণ হারিয়েছে সবাই সেখানেই প্রাণ দিয়েছে। বলা হয় তারা তাদের শাহজাদাকে কোক সরাইয়ে নিয়ে গিয়েছে’ কথাটার মানে সেই শাহজাদা ইতিমধ্যে মারা গিয়েছে।”

ওয়াজির খান আর বাইসানগার নিজেদের ভিতরে আলাপ করে। ভিতরে প্রবেশের জন্য অধীর বাবর তাদের সাথে এসে যোগ দেয়। “সুলতান, আমাদের সতর্ক থাকতে হবে,” বাবরের ভিতরের অস্থিরতা লক্ষ্য করে ওয়াজির খান দ্রুত কথাটা বলে। “পুরো ব্যাপারটা একটা ফাঁদও হতে পারে।” বাবর মাথা নাড়ে। সে ঠিকই বলেছে। কেবল অসতর্ক আহাম্মকই হুড়মুড় করে ভেতরে প্রবেশের মত ভুল করবে। বন্ধ তোরণদ্বারের কাছে তাড়াহুড়োর কারণে প্রায় মরতে বসার ঘটনা স্মরণ করে বাবর অনেক কষ্টে নিজের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করে। তারপরেও ওয়াজির খান যখন তার ছয়জন লোককে দেয়ালে প্রজ্জ্বলিত মশাল খুলে নিয়ে সতর্কতার সাথে তাদের ভিতরে প্রবেশ করে দেখতে বলে যে কোনো ধরণের ফাঁদ পাতা আছে কিনা, বাবরকে তখনও অস্থিরভাবে উসখুশ করতে দেখা যায়।

বাবরের কাছে যা কয়েক যুগের মত মনে হয়, বস্তুত পক্ষে, কয়েক মিনিট পরে, লোকগুলো বাইরে এসে জানায় যে আপাত দৃষ্টিতে সবই ঠিক আছে। বাবরের হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠে এবং সে ভিতরে প্রবেশ করে, তার লোকেরা জোটবদ্ধ ভঙ্গিতে তাকে অনুসরণ করে। পিতলের দরজা অতিক্রম করে তারা একটা উঁচু খিলানাকৃতি ছাদের প্রবেশ কক্ষ দেখতে পায় এবং তারপরেই ঠিক সামনে রয়েছে চওড়া নিচু সিঁড়ির ধাপ। ধীরে, সতর্কতার সাথে দপদপ করতে থাকা মশালের আলোয় তারা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করে, সামনের অন্ধকারের দিকে সবাই চোখ কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে। ত্রিশ ধাপ ওঠার পরে তারা দ্বিতীয় তলায় এসে পৌঁছে। সামনে সিঁড়ির আরেকটা ধাপ দেখা যায়। বাবর প্রথম ধাপে ইতিমধ্যে পা রেখেছে এমন সময় সে একটা চিৎকার শুনতে পায়।

“সুলতান, নেমে আসুন, শীঘ্রই নেমে আসুন!” বাবর ঝুঁকে পড়তে সামনের অন্ধকার। থেকে ছুঁড়ে মারা একটা বর্শা তার মাথার উপর দিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে চলে যায়, এতটাই কাছ দিয়ে যে তার ঘাড়ের চুল দাঁড়িয়ে পড়ে। নিমেষ পরেই, গ্রান্ড উজিরের দুই ডজন দেহরক্ষীর আরেকটা দল সিঁড়ি বেয়ে তাদের দিকে ধেয়ে আসে। পরের মুহূর্তে বাবর পাগলের মত ডানে বামে মোচড় খেয়ে তরবারি চালাতে শুরু করে। বিভ্রান্তির মাঝে তার তরবারির চেয়ে এখন খঞ্জরই বেশি কাজে আসে। সে শত্রুর ঢালের নিচে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে তার খঞ্জরের ফলাটা উপরের দিকে করে কোপ বসিয়ে দেয়, সে জায়গামত আঘাত করতে পারলে হাতে আর কব্জিতে উষ্ণ রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়ছে টের পায়। তার লোকেরা তাকে চারপাশে থেকে ঘিরে রেখেছে, হুঙ্কার দিয়ে এবং ঘোঁতঘোঁত শব্দ করতে করতে পুরো দলটা সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে।

গ্রান্ড উজিরের লোকেরা সিঁড়ির নিচে থেকে উঠে আসা আক্রমণের চাপ সামলাতে না। পেরে পিছু হটতে শুরু করে। শীঘ্রই তাদের আরও পেছনে নিয়ে যাওয়া হয়। সহসা তাদের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে এবং হেরে যাওয়া যুদ্ধে প্রাণ না দেয়া আর পালাবার প্রবণতা জোরালো হতে তারা সিঁড়ি ভেঙে পালাতে আরম্ভ করে। বাবরের লোকেরা এবার দো-তলার সিঁড়ি বেয়ে পলায়মান অবয়বগুলোকে কোপাতে কোপাতে এগিয়ে। যায় এবং তৃতীয় তলার কিছুটা পর্যন্ত দাবড়ে দেয়।

তাড়াহুড়োয়, বাবর একটা অসমান ধাপে পিছলে যায় এবং কাত হয়ে গড়িয়ে পড়ে। তার আগুয়ান লোকদের একজন ঠিক পিছনেই ছিল, যে নিজেকে সামলাতে না পেরে বাবরের গায়ে হোঁচট খায় এবং তার পেলব পিঠের উপর পা দিয়ে মাড়িয়ে গেলে আরও একবার বাবরের বুক থেকে সব বাতাস বের হয়ে যায়। লড়াই তৃতীয় তলায় স্থানান্তরিত হতে বাবর চোখমুখ কুঁচকে কোনো মতে উঠে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণের জন্য তার বমি বমি পায় এবং চোখে ঝাপসা দেখে। দেয়ালে হাত দিয়ে সে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করে এবং জোরে শ্বাস নিতে গেলে কালশিটে পরা পাঁজর আর পেটের টান খাওয়া মাংসপেশী ব্যাথায় প্রতিবাদ জানায়।

“সুলতান।” ওয়াজির খান সিঁড়ি ভেঙে তার দিকে ছুটে আসে। “আপনি কি জখম হয়েছেন?”

বাবর মাথা নাড়ে। “না, আমি ঠিক আছি।”

“গ্রান্ড উজিরের অবশিষ্ট সৈন্যরা যারা আমাদের হাত থেকে পালিয়ে বেঁচেছে- এই ভবনের ছাদে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা প্রায় জয় লাভ করেছি।” ওয়াজির খানের মুখে দুর্লভ একটা হাসি ফুটে উঠে এবং সে বাবরের কাঁধ স্পর্শ করে। “আসুন।”

ঠিক সেই মুহূর্তে নিচে থেকে একটা গোলমালের শব্দ ভেসে আসে এবং পাথরের সিঁড়িতে দুদ্দাড় শব্দে অনেকগুলো পা তাদের দিকে ছুটে আসে। বাবর ঝটিতে ঘুরে দাঁড়ায় নতুন দুর্দৈব মোকাবেলা করতে। সিঁড়ির অন্ধকার থেকে বের হয়ে আসা ছায়াগুলোকে সে চিনতে পারে, তারই লোক, একেবারে সামনে রয়েছে আলি মজিদ বেগ ফারগানার পশ্চিম থেকে আগত পেশল দেহের গোত্রপতি, যাকে সে আর ওয়াজির খান সুড়ঙ্গ পথে আগত লোকদের নেতা হিসাবে মনোনীত করেছে।

“সুলতান, দূর্গ আর নগর প্রাসাদ আমাদের দখলে- সেই সাথে পুরো শহর।” আলি মজিদ বেগকে বিধ্বস্ত দেখায়, কিন্তু ঘাম আর রক্তের নিচে তার পটল-চেরা চোখে বিজয়োল্লাস চিকচিক করে।

“তোমরা দারুণ যুদ্ধ করেছে।”

“সুলতান।” আলি মজিদ বেগ যদিও এখনও হাঁপাচ্ছে, নিজের আর অধীনস্থ লোকদের সাফল্যে তার কণ্ঠে গর্ব উথলে উঠে।

“তোমরা কি গ্রান্ড উজিরকে কোথাও দেখেছো?”

আক্ষেপের সাথে আলি মজিদ বেগ মাথা নাড়ে।

“তাহলে বাইসানগার যা ভেবেছে সেটাই ঠিক। এখানেই কোক সরাইয়ে রক্ষিতাদের আঁচলের তলায় গিয়ে ব্যাটা লুকিয়েছে, যদি না কোনক্রমে শহর ছেড়ে পালিয়ে না যায়।”

“সুলতান, সে পালিয়ে যাবে কোথায়? কে তাকে আশ্রয় দেবে?” ওয়াজির খান প্রশ্নের ভঙ্গিতে বলে।

ওয়াজির খানকে পাশে নিয়ে বাবর সিঁড়ির বাকি ধাপগুলো অতিক্রম করে কোক সরাইয়ের উপরের তলায় উঠে আসে। সিঁড়ি যেখানে শেষ হয়েছে ঠিক তার উল্টো দিকে, তার উৎফুল্ল যোদ্ধাদের মাঝ দিয়ে সে রূপার উপরে সবুজাভ-নীল মিনে আর পাথরের কারুকাজ করা একজোড়া দরজা দেখতে পায়।

“জেনানা মহল?” বাবর জানতে চায়।

বাইসানগার সম্মতি প্রকাশ করে মাথা নাড়ে।

মানস চোখে, বাবর সহসা নিজের বোন খানজাদার ভয়ার্ত চোখ দেখতে পায়। সে কেমন অনুভব করতো, যদি তার বোন এমন একটা দরজার পেছনে, বিজয়োল্লাসে উন্মাদ যোদ্ধাদের হাত থেকে। অসহায় ভাবে লুকিয়ে থাকতো? সে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের দিকে ঘুরে তাকায়। “মেয়েদের যেন কেউ অপমান না করে। আমি সমরকন্দ এসেছি এর নতুন সুলতান হিসাবে, রাতের আঁধারে আসা কোনো হন্তারক আমি নই।”

সে তার লোকদের অনেকের ভেতরে তাদের আবেগতাড়িত মুখে আশাহতের বেদনা দেখতে পায়। তারা সম্ভবত বিশ্বাস করে যে, সে এমন কথা বলতে পেরেছে কারণ সে একজন লোকের চাহিদা আর হতাশা সম্পর্কে অসম্পূর্ণ ধারণাযুক্ত এক কিশোর। যাকগে তাদের যা ইচ্ছা তারা ভাবতে পারে। আড়চোখে ওয়াজির খানের দিকে তাকালে সে তার সেনাপতির মুখে প্রসন্নতা দেখে বুঝতে আরও একটা পরীক্ষায় সে উতরে গিয়েছে।

নিচের আঙ্গিনা থেকে নিয়ে আসা মাথায় লোহার পাতযুক্ত দেয়াল চূর্ণকারী দুরমুশের আঘাতে রূপার দরজা কেঁপে উঠে এবং সবুজাভ-নীল পাথরের উজ্জ্বল টুকরো খোলামকুচির মত ছিটকে মাটিতে পড়ে। কিন্তু দরজাটা তারপরেও অনড় দাঁড়িয়ে থাকে। চকচকে রূপার পাতের নিচের কাঠ নিশ্চয়ই সেরকম মজবুত আর হুড়কাও দৃঢ়। তার লোকেরা চতুর্থবারের মত দুরমুশটা দিয়ে দরজায় ধাক্কা দেবার সময় বাবর মনে মনে ভাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দরজার রূপার আস্তরণ ফেটে বেঁকে যায় এবং নিচের কাঠ গুঁড়িয়ে যায়। দু’জন যোদ্ধা তাদের রণকুঠার দিয়ে একজন মানুষ প্রবেশের মত একটা বড় ফোকড় তৈরি করে।

বাবর আর তার লোকেরা কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে, অস্ত্রের ধার পরীক্ষা করে। সে নিশ্চিত যে কোনো মুহূর্তে হারেম রক্ষা করতে এগিয়ে আসা যোদ্ধার হুঙ্কার তারা শুনতে পাবে কিংবা ভেতর থেকে নিক্ষিপ্ত তীরের কারণে বাধ্য হবে ফাঁকা স্থানটা থেকে সরে দাঁড়াতে। তার বদলে কেবল নিরবতাই বিরাজ করে। আর চন্দনকাঠের ভারী মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসে যা তাকে শেষবার মায়ের কাছে বসে থাকার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। গন্ধটা তাদের চারপাশে ঘুরপাক খায়, ঘামের সাথে মিশে একটা আলাদা গন্ধের জন্ম দেয়।

তার লোকদের চুপ করে থাকার ইঙ্গিত দিয়ে, বাবর দরজার ফোকরের দিকে এগিয়ে যায়, সে আবার পণ করেছে প্রথমে সেই ভিতরে প্রবেশ করবে। “না। সুলতান।” নিষেধাজ্ঞা জ্ঞাপন করা ওয়াজির খানের হাত তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। “প্রথমে আমাকে ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি দেন।”

বাবর ভাবে, আমি তার কাছে ঋণী। হতাশা লুকিয়ে রেখে সে ওয়াজির খান আর তার দু’জন যোদ্ধাকে অস্ত্র হাতে সতর্কতার সাথে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে। কিছুক্ষণ পরেই সে শুনতে পায় ওয়াজির খান বলছে, “সুলতান, আপনি এবার ভিতরে আসতে পারেন।”

বাবর দরজার ফোকড় গলে ভেতরে প্রবেশ করে নরম রেশমের গালিচায় পা রাখে। এমন কোমলতা সে জীবনেও অনুভব করেনি। তাদের ফারগানা গালিচাগুলোকে এর তুলনায় জীর্ণ কম্বল মনে হয়।

ওয়াজির খান ইশারায় তাকে সতর্ক থাকতে বলে। তার বাকি লোকেরা পেছন থেকে চাপ প্রয়োগ করতে, বাবর সামনে এগিয়ে যায়, বিশাল কক্ষের প্রতিটা আনাচে কানাচে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়, যেকোন আক্রমণ প্রতিহত করতে প্রস্তুত। কাঁচ লাগান কুলুঙ্গিতে প্রজ্জ্বলিত শত শত মোমবাতির আলোতে কক্ষটা আলোকিত। স্বচ্ছ হলুদাভ আলো দেয়ালে ঝোলান হাতে বোনা পর্দায় ফুটিয়ে তোলা টিউলিপ, সোলোমী আর সমরকন্দের অন্যান্য ফুল, এবং চকচকে স্যাটিন বা মখমলের পুরু তাকিয়ার উপরে খেলা করছে। অপেক্ষাকৃত ছোট ছয়টা রূপার দরজা একেকপাশে। তিনটা করে, বাবর অনুমান করে সেগুলোর পেছনে মেয়েদের ব্যক্তিগত কামরা রয়েছে। ঠিক নাক বরাবর সামনে আরেকটা দরজা, এটা সোনার পাত দিয়ে মোড়ান। আর তার উপরে সমরকন্দের বাঘের প্রতিরূপ খোদাই করা রয়েছে।

তার লোকেরা আবারও তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে টের পেয়ে, বাবর কেশে উঠে গলা পরিষ্কার করে। “উজির!” সোনায় মোড়ান দরজার দিকে লক্ষ্য করে সে বলে, তার কণ্ঠস্বর হতে পারে এখনও পুরুষালী হয়নি কিন্তু পরিষ্কার এবং দৃঢ়। “আপনি নিজেকে বাঁচাতে পারবেন না, কিন্তু নিজের মৃত্যু দ্রুত আর সম্মানজনক করতে পারেন।” দরজার পেছনে একটা মৃদু নড়াচড়ার শব্দ মনে হয় সে শুনতে পায় কিন্তু তারপরেই আবার সব আগের মত নিরব হয়ে যায়। “উজির, আপনার কি লজ্জা বা সম্মানবোধ বলে কিছু নেই?” বাবর অনড় ভঙ্গিতে বলে।

এইবার নিশ্চিতভাবেই একটা ধ্বস্তাধ্বস্তির আওয়াজ আর ক্রুদ্ধ কণ্ঠের চিৎকার শোনা যায়। সহসা সোনালী দরজাটা খুলে যেতে সেখানে গ্রান্ড উজিরের দু’জন দেহরক্ষীকে দেখা যায়, একজনের গালে আড়াআড়ি একটা তরবারির আঘাতের চিহ্ন। তাদের প্রতিবাদ করতে থাকা প্রভুর হাত ধরে টেনে আনছে, তার উজ্জ্বল সবুজ রঙের জরির কাজ করা আলখাল্লা পেছনে ঢেউয়ের মত দুলছে। কোনো রকমের ভণিতা না করে তারা গ্রান্ড উজিরকে বাবরের পায়ের কাছে ছুঁড়ে দেয়, তারপরে নিজেরা তার সামনে বশ্যতা স্বীকারের ভঙ্গিতে নতজানু হয়। অন্য দেহরক্ষীরা, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে নিজেদের প্রণত করে। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে বাবর পুরো নাটকটা দেখে। “বাইসানগার সবাইকে নিরস্ত্র কর।”

বাইসানগারের লোকেরা দ্রুত আদেশ পালন শুরু করতে, মলিন নীল রঙের রেশমের পোশাক পরিহিত এক কিশোরী সোনালী দরজা দিয়ে ছুটে বের হয়ে এসে, বাইসানগারের লোকদের নাগাল এড়িয়ে সোজা গ্রান্ড উজিরের দিকে ছুটে যায়। তার পাশে হাঁটু ভেঙে বসে বেচারী তাকে জড়িয়ে ধরতে চেষ্টা করে কিন্তু একটা প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সে তার তন্বী দেহটা এক ঝটকায় দূরে সরিয়ে দেয়। মেয়েটা সুস্থির হয়ে সরাসরি বাবরের চোখের দিকে তাকায়। সে দেখে একটা ডিম্বাকৃতি মুখ এবং চোখ যা কান্নায় ভরাক্রান্ত হলেও সুন্দর। “আমার বাবাকে ছেড়ে দাও। তিনি একজন বৃদ্ধ মানুষ।” ভয়হীন কণ্ঠে মেয়েটা কথাগুলো বলে, যদিও রণ ক্লান্ত একদল যোদ্ধার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, যাদের কাছ থেকে সে নিশ্চয়ই জানে যে সে সামান্যই সহানুভূতি বা করুণা প্রত্যাশা করতে পারে।

“তার বাঁচার কোনো অধিকার নেই। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার যোগ্যতার সীমা ছাড়িয়েছে।” বাবর কাঠখোট্টাভাবে উত্তর দেয়। “অন্য মেয়েরা কোথায়?”

মেয়েটা প্রথমে ইতস্তত করে তারপরে বলে, “সবাই নিজ নিজ কামরায় রয়েছে।” সে ছয়টা ছোট দরজা ইশারায় দেখায়। বাবর ওয়াজির খানের উদ্দেশ্যে মাথা নাড়ে। “সবগুলো তল্লাশি করেন। কোনো সৈন্য যেন সেখানে লুকিয়ে না থাকতে পারে। তারপরে মেয়েদের সেখানেই আটকে রাখেন আমরা যতক্ষণ তাদের দিকে মনোযোগ দেবার সময় না পাই।” ওয়াজির খান দ্রুত তার লোকদের দরজা ভাঙার নির্দেশ দেয়। প্রায় সাথে সাথে বাবর হারেমের ভেতর থেকে প্রতিবাদ আর বিলাপের সুর ভেসে আসতে শুনে। কিন্তু সে জানে তার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হবে। মেয়েদের ভয় পাওয়া থেকে সে তাদের বিরত রাখতে পারবে না, কিন্তু তাদের কেউ অপমানও করবে না।

উজিরের কন্যা এখন তার দিকে সরাসরি তাকিয়ে রয়েছে, তার বাদামী চোখে গর্বিত অভিব্যক্তি। সে তার অভিযুক্ত চাহনী থেকে ঘুরে দাঁড়ায়। “তাকে ব্যক্তিগত কামরায় নিয়ে যাও এবং তালাবন্ধ করে রাখো।” উজিরকে ছেড়ে দেবার কোনো অভিপ্রায় তার নেই। কিন্তু বুঝতে মেয়েটাকে তার বাবার মৃত্যুদণ্ড দেখা থেকে সে বিরত রাখতে চাইতে। মেয়েটাকে কেউ ধরার আগেই, সে নিজে থেকেই উঠে দাঁড়ায় এবং পেলব গলার উপরে গর্বিত মাথা উঁচু করে রেখে একটা দরজা দিয়ে ঢুকে ভেতরে হারিয়ে যায়, যাবার সময়ে কোনো অনুরোধ বা ঘাড় ঘুরিয়ে একবারও ফিরে তাকায় না। বাবর পেছন থেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, কল্পনা করে এমন সম্মান প্রদর্শন করতে তাকে কি মূল্য দিতে হয়েছে।

“বেশ, উজির দেখা যাচ্ছে আপনার মেয়ে আপনার দেহরক্ষীদের চেয়ে সাহসী আর অনেক বেশি বিশ্বস্ত। এমন সম্মান পাবার যোগ্য আপনি নন।” বাবর বুঝতে পারে সবার সামনে মেয়েটাকে তার বাবা এভাবে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে অপমান করায় সে নিজেই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে।

“সমরকন্দের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবার কোনো অধিকার তোমার নেই।” গ্রান্ড উজির নিজেকে টেনে তুলে বসার আসনে নিয়ে আসেন এবং বাবরের দিকে গুটিবসন্তে ক্ষতবিক্ষত, চওড়া-চোয়াল বিশিষ্ট মুখে অশুভ অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তাকিয়ে থাকেন, আসন্ন মৃত্যুর সম্ভাবনা সম্পর্কে তাকে আপাতদৃষ্টিতে নিরুদ্বিগ্ন দেখায়। “আমার ধমনীতে তৈমূরের রক্ত বইছে, শেষ সুলতানের আমি ভাস্তে। আমার চেয়ে আর কার দাবি জোরাল?”

গ্রান্ড উজির তার রক্তজবার মত চোখ কুচকে তাকায়। “তুমি হয়ত ভাবছে সমরকন্দ দখল করেছে, কিন্তু জেনে রাখো তুমি কখনও এটা নিজের অধিকারে রাখতে পারবে না, সে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে। “পাহাড়ী জঞ্জাল, কথাটা চিন্তা করে দেখো। ফারগানায় নিজেদের নোংরা ভেড়ার পালের কাছে ফিরে যাও। সম্ভবত তাদের ভিতরেই তুমি নিজের যোগ্য স্ত্রী খুঁজে পাবে- আমি শুনেছি তোমরা বিশেষ কোন…”।

“অনেক হয়েছে!” বাবর কাঁপতে থাকে যা সে বুঝতে পারে বয়ঃসন্ধিক্ষণের উত্তেজনা, কিন্তু আশা করে তার লোকেরা যেন সেটাকে রাজকীয় ক্রোধ বলে মনে করে। “বাইসানগার,” সে নাটকীয় ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠে।

সেনা অধিপতি তার দিকে এগিয়ে আসে। “সুলতান?”

“অন্যায়ভাবে সিংহাসন অধিকার করা ছাড়াও শেষ সুলতানের শেষ আদেশ পালন করার জন্য এই লোকটা তোমার সাথে নির্মম জুলুম করেছে।” বাবর লক্ষ্য করে বাইসানগার তার ডান হাত যেখানে থাকবার কথা ছিল সেদিকে চকিতে তাকায়। “পরবর্তী জীবনের পাওনা বুঝে নেবার জন্য এই পাপীকে সেখানে পাঠাবার ভার তোমাকে দেয়া হল। নিচের প্রাঙ্গণে তার ভবলীলা সাঙ্গ করবে এবং তার কন্যার সাহসিকতার জন্য খেয়াল রাখবে পুরো ব্যাপারটা যেন দ্রুত নিষ্পন্ন হয়। তারপরে তার দেহটা সবুজাভ-নীল তোরণদ্বার থেকে শিকল দিয়ে ঝুলিয়ে দেবে, যেন লোকেরা দেখতে পায় যে লোকটার উচ্চাশা আর ধনলিপ্সা তাদের অভাব আর কষ্টে ফেলেছিল তাকে আমি কিভাবে সাজা দিয়েছি। তার দেহরক্ষীর দল যদি আমাকে তাদের সুলতান হিসাবে মেনে নিয়ে আনুগত্যের শপথ নেয় তবে তারা প্রাণে বেঁচে যাবে।”

বাইসানগারের লোকেরা উজিরকে টানতে টানতে নিয়ে যেতে, সহসা ক্লান্তি এসে বাবরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এক মুহূর্তের জন্য সে চোখ বন্ধ করে এবং রেশমী কোমল গালিচাটা স্পর্শ করার জন্য ঝুঁকে যা আগামীকাল গুটিয়ে নিয়ে তার মায়ের কাছে উপহার হিসাবে পাঠাবার আদেশ দেবে বলে ঠিক করেছে। “সমরকন্দ,” সে নিজেকে ফিসফিস করে শোনায়। “এখন আমার।”

১.৬ একশ দিবসের রাজত্বকাল

০৬. একশ দিবসের রাজত্বকাল

নীল, সবুজ আর সোনালী টালির উজ্জ্বলতায় সূর্যের আলো ঠিকরে যেতে সবুজাভ নীল তোরণদ্বার ঝিকমিক করতে থাকে। সমরকন্দে আনুষ্ঠানিক প্রবেশের উদ্দেশ্যে তোরণদ্বারের দিকে এগিয়ে যাবার সময়ে বাবরের মনে হয় সে বুঝি সূর্যের কেন্দ্রে ঘোড়ায় চেপে এগিয়ে চলেছে। মৃদু বাতাসে তার পরণের রেশমের সবুজ আলখাল্লা চারপাশে আন্দোলিত হতে থাকে। ক্রুদ্ধ গর্জনরত বাঘের প্রতিকৃতি খচিত তৈমূরের সোনার আংটি তার আঙ্গুলে জ্বলজ্বল করছে, এবং আকাটা পান্নার তৈরি গলার হার তার নিঃশ্বাসের সাথে বুকের উপরে উঠছে আর নামছে। সহস্র চোখ তাকে খুটিয়ে দেখছে, সে বিষয়ে সচেতন। বাবর জোর করে চোখেমুখে একটা কঠোর অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলে, যদিও তার ইচ্ছে করে মাথাটা পেছন দিকে হেলিয়ে দিয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে বুকের সবটুকু বাতাস বের করে দিয়ে চিৎকার করে উঠে।

অধীনস্ত গোত্রপতি আর সেনাপতিরা তার ঠিক পেছনেই ঘোড়ার চড়ে তাকে অনুসরণ করছে। ফারগানা থেকে তাদের সাথে আগত উপজাতি চাষাভূষোদের দিয়ে গত দুদিনে ওয়াজির খান একটা চলনসই সেনাবাহিনী দাঁড় করিয়েছেন যারা। শহরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময়ে সবাই ঈর্ষান্বিত চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে থেকেছে। কোক-সরাইয়ের বন্ধ প্রকোষ্ঠগুলোতে যথেষ্ট পোশাক পরিচ্ছদ তারা খুঁজে পেয়েছিল যা দিয়ে তার শিরস্ত্রাণ আর কেবল বর্ম পরিহিত রুক্ষ, যাযাবর যোদ্ধার দলকে, নিজের লোকদের কষ্টে রেখে গ্রান্ড উজিরের জমিয়ে রাখা উজ্জ্বল রেশমের পোশাকে সজ্জিত করা হয়েছে।

বাবর মনে মনে শপথ নেয়, এই মহান শহরের সমৃদ্ধি সে আবার ফিরিয়ে আনবে, তূর্যধ্বনি আর টানটান চামড়া দিয়ে বাঁধান রণদামামার গুরুগম্ভীর প্রতিধ্বনির মাঝে, সে যে তোরণদ্বার দিয়ে শহরে প্রবেশ করে তার চূড়ো থেকে উজিরের কবন্ধ দেহ। লোহার খাঁচায় ঝুলছে। সূর্যের তাপে যা ইতিমধ্যেই কালো হতে শুরু করেছে। সে সামনের দিকে এগিয়ে গেলে শহরের নীল গম্বুজ আর মিনার দেখতে পায়। শীঘ্রই সে একটা বিশাল বাজারের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যায়, যার দুপাশে ভ্রাম্যমাণ বণিকদের আশ্রয় দেয়ার জন্য নির্মিত হয়েছে সারি সারি সরাইখানা। তার মরহুম আব্বাজান প্রায়ই তৈমূরের সময়ের প্রাচুর্যময় কাফেলার কথা বলতেন- হেলেদুলে নাক ঝাড়তে ঝাড়তে এগিয়ে যাওয়া উটের সারিবদ্ধ দল আর ক্ষিপ্রগামী খচ্চরের বহর যারা পশ্চিম থেকে পশম, চামড়া আর মসৃণ কাপড়, পূর্ব থেকে নিয়ে আসত চিনামাটির বাসনকোসন, সোনা রূপার কারুকাজ করা রেশমী বস্ত্র আর তীব্র গন্ধযুক্ত কস্তুরি, এবং সিন্ধু নদী অতিক্রম করে দূরবর্তী অঞ্চল থেকে সুগন্ধি জায়ফল, লবঙ্গ, দারুচিনি আর উজ্জ্বল রত্নপাথর নিয়ে আসত।

সড়কের দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জনগণকে সতর্ক কিন্তু মোটেই বিরূপ মনে হয় না। প্রশস্ত রেজিস্তান চত্বরে, ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় প্রবেশের সময়ে বাবর তাদের কৌতূহল অনুভব করে, যেখানে ডোরাকাটা সবুজ রেশমের চাঁদোয়ার নিচে একটা মার্বেলের মঞ্চ রয়েছে। তার প্রয়াত চাচাজানের পারিষদবর্গ আর সমরকন্দের অভিজাত ব্যক্তিরা মঞ্চের সামনে বশংবদের ন্যায় নতমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

বাবর ঘোড়া থেকে সরাসরি মঞ্চের উপরে নামে এবং এর কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যায়, যেখানে বাঘের পায়াযুক্ত সোনার গিল্টি করা সিংহাসন অপেক্ষা করছে। সে যেন সহসাই তাকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকা দৃষ্টি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে। আর তার ঢাউস আলখাল্লা সামলে নিয়ে তার পক্ষে যতটা সম্ভব ভারিক্কী দেখিয়ে সে সিংহাসনে উপবিষ্ট হয়। সে এখনও কিশোর বয়স পুরোপুরি চৌদ্দও হয়নি। জনগণ তাদের সামনে উপবিষ্ট একটা বালকের ভিতরে কি দেখতে চায়? কিন্তু সে নিজেকে প্রবোধ দেয়, সমরকন্দ তার উত্তরাধিকার সূত্রে এবং বিজয় গৌরবে। সে তার চিবুক উঁচু করে এবং গর্বিত ভঙ্গিতে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে।

জমকালো সিংহাসনে আড়ষ্ঠ ভঙ্গিতে উপবিষ্ট অবস্থায়, সে তার নতুন প্রজাদের আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করে এবং বিনিময়ে তাদের খেলাত প্রদান করে আর গ্রান্ড উজিরের সঞ্চিত ধনসম্পদ বিলিয়ে দেয়। লোকজন সারিবদ্ধভাবে নিজেদের তার সামনে প্রণত করে কিন্তু সে খুব ভালভাবেই জানে যে এদের কেউই তার বিশ্বাসের যোগ্য নয়। চিন্তাটা মাথায় আসতেই সে সংযত হয় আর গ্রান্ড উজিরের ক্রুদ্ধ উক্তিগুলো আবার তার মনে পড়ে যায়: “তুমি কখনও সমরকন্দ দখলে রাখতে পারবে না।”

জনগণকে সে দেখিয়ে দেবে শাসক হবার যোগ্যতা তার আছে। সে কি ইতিমধ্যে যথেষ্ট করুণা আর উদারতা প্রদর্শন করেনি? যারা তার কর্তৃত্ব মেনে নিয়েছে সে তাদের সবাইকে অকাতরে ক্ষমা করেছে। গ্রান্ড উজিরের হারেমের রমণীকুল, বিজয়ের প্রথম মুহূর্তে বলাৎকারের শিকার হবার বদলে, যথাযথ সময়ে, বাবরের গোত্রপতিদের কাছে ঠাই পাবে। আর উজিরকন্যা, সে ইতিমধ্যে তাকে কুন্দুজে তার চাচাতভাই শাহজাদা মাহমুদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। সে যাবার বিষয়ে কোনো ধরণের অনীহা প্রদর্শন করেনি। বস্তুতপক্ষে, মেয়েটার বরং খুশি হওয়া উচিত। সে যে কেবল তৈমূরের সাক্ষাৎ বংশধরের এক শাহজাদার স্ত্রী হবে তাই না, এই মাহমুদই তাকে মাত্র দু’বছর আগে দস্যুদের হাতে সম্ভ্রমহানির হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। সে তার প্রেমে এতটাই মজেছিল যে তাকে পাবার জন্য সমরকন্দ পর্যন্ত অবরোধ করেছিলো।

হ্যাঁ, বাবর ভেবে দেখে, সে ভালমতই উতরে গেছে। জনগণের তাকে ভয় পাবার কোনো কারণই নেই বরং তাদের তাকে শ্রদ্ধা করা উচিত। তারপরেও, গ্রান্ড উজিরের কথা তাকে ঘুণপোকার মত কুরে কুরে খেতে থাকে…

সহসা বাবর ওয়াজির খানকে ঘোষণা করতে শোনে, “সমরকন্দের সুলতান, মির্জা বাবর, জিন্দাবাদ!” ঘোষণাটা নিমেষে সহস্র কণ্ঠে ধ্বনিত হলে পুরো প্রাঙ্গন গমগম করে আর বাবরের চিন্তাজাল ছিন্ন হয়। একজন মৃত মানুষ যার কবন্ধ লাশ এখন খাঁচায় ঝুলছে তার কথার কারণে নিজেকে কষ্ট দেয়াটা বোকামী। এই অনুষ্ঠানের যখন আয়োজন করা হয় তখন ওয়াজির খানের সাথে তার যে কথা হয়েছিলো, সেই অনুসারে বাবর এই জয়ধ্বনির খেই ধরে। সে উঠে দাঁড়ায় এবং ধীরে ধীরে মঞ্চের চারপাশে সমবেত হওয়া জনগণের দিকে তাকায়, তাদের নতুন সুলতানকে এক নজর ভাল করে দেখার সুযোগ দেয়। তারপরে সে জনতার উদ্দেশ্যে বলে, “সমরকন্দের প্রতিটা মানুষ আমার শাসনকালে শান্তি আর সমৃদ্ধি লাভ করবে। আমার সদিচ্ছার স্মারক হিসাবে, শহরের বাজার থেকে এক মাস কোনো ধরণের কর আদায় করা হবে না।”

উপস্থিত জনগণ উৎফুল্ল কণ্ঠে তাদের সম্মতি জানায়। তার নিজের অভিব্যক্তি যদিও নির্বিকার থাকে, তার ভেতরটা আবারও বিজয়ানন্দে মেতে উঠে। তৈমূর যখন সমরকন্দ দখল করেন তখন তার বয়স ছিল একত্রিশ বছর, তার এখনকার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। এটাই ছিল তার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিজয়, যা পরবর্তীতে একটা বিশাল সাম্রাজ্যের ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছে। বাবরের ক্ষেত্রেও ঠিক একই ঘটনা ঘটবে।

আজ রাতে তার উদারতার আরেকটা নমুনা হিসাবে অবরোধকালীন দুর্ভোগ প্রশমিত করার উদ্দেশ্যে সে সারা শহরে খাবার বিতরণ করবে। তার আর তার লোকদের জন্য ভোজের আয়োজন করা হবে, এবং এই একটা ক্ষেত্রে সে ইতিমধ্যে তৈমূরকে ম্লান করে দিয়েছে, যার পছন্দ ছিল একেবারেই অনাড়ম্বর নিরাভরণ: ঝলসানো ঘোড়ার মাংস, সিদ্ধ ভেড়া আর ফুটানো চাল। বাইরের তৃণভূমি থেকে নিরন্ন শহরে নধর ভেড়ার পাল ধরে আনা হয়েছে যা তাদের রসনা নিবৃত্ত করবে এবং ইতিমধ্যে বেচারীদের শিকে গাথা অবস্থায় আগুনে ঝলসানোও শুরু হয়ে গেছে। তিতির আর বনমোরগ, তেঁতুল আর ডালিমের রসে ডুবিয়ে ফোঁটান হচ্ছে। মধুর মত মিষ্টি রসে টইটুম্বুর করতে থাকা তরমুজ আর বেগুনী আঙ্গুরের সতেজ থোকা কারুকার্যখচিত ধাতুর ট্রেতে স্তূপাকারে রাখা। বাবরের খিদে পেয়ে যায়।

আনুষ্ঠানিকতা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে কিন্তু বিজয় উদযাপন শুরু হবার আগে। বাবরকে আরেকটা কাজ করতে হবে। সে ধীরে ধীরে মঞ্চ থেকে নেমে আসে এবং ঘোড়ায় উপবিষ্ট হয়। ওয়াজির খান আর তার রক্ষীদের অনুসরণের ইঙ্গিত দিয়ে, সে প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে গুর এমিরের দিকে রওয়ানা হয়। নীল টালিতে আবৃত খাঁজকাটা, ডিম্বাকৃতি গম্বুজ আর দুটো সুঠাম মিনার যেখানে তৈমূরকে চিরশয্যায় শায়িত করা হয়েছে।

বাবর, দেয়াল দিয়ে ঘেরা সমাধিভবনের লম্বা, খিলানাকৃতি দ্বারের কাছে পৌঁছালে, লাফ দিয়ে ঘোড়া থেকে নামে। ব্যাখ্যার অতীত কোনো অজানা কারণে, সে কিছুক্ষণ একা থাকতে চায়। ওয়াজির খান আর তার রক্ষীদের অপেক্ষা করতে বলে, তারপরে সে ভিতরে প্রবেশ করে। সে একটা আঙ্গিনা অতিক্রম করে যেখানে উঁত গাছের ডালে অসংখ্য চড়ুই পাখি কিচিরমিচির করছে, প্রথা অনুযায়ী পায়ের কারুকাজ করা বুট জুতা খুলে সে ভেতরের সমাধিকক্ষে প্রবেশ করে।

ভেতরে বাইরের উজ্জ্বল আলোর বিপরীত অবস্থা বিরাজ করায় তার দেখতে কষ্ট হয় এবং চোখ পিটপিট করতে করতে সে একটা অষ্টাভূজাকৃতি কামরায় প্রবেশ করে। ধনুকাকৃতি খিলানের উপরের নকশা কাটা জাফরির ভিতর দিয়ে প্রবেশ করা আলোর ধারায় বিষণ্ণ বৈভব দেখে তার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে। মার্বেলের উপরে সবুজ অ্যালাব্যাস্টার বসান এবং মাথার উচ্চতায় অধিরোপিত সোনালী টালির দেয়ালে সে আনমনে আঙ্গুল বোলায়। তার উপরে, নীল আর সোনালী কাগজের বোর্ড দিয়ে দেয়ালে নানান নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এবং চারপাশে প্যানেলের ভিতরে অপরূপ সুন্দর লিপিকলায় পবিত্র কোরানের নানা আয়াত উত্তীর্ণ করা রয়েছে। সে গলা উঁচু করে গম্বুজের ছাদে অঙ্কিত সোনালী তারকারাজিকে তাদের নিজস্ব ভূবনে বাড়াবাড়ি রকমের বিন্যস্ত অবস্থায় দেখে।

গম্বুজের সরাসরি নিচে মার্বেলের সমতল পাটাতনে একটা শবাধার দেখা যায়। শবাধারটা প্রায় ছয় ফিট লম্বা এর উপরে সবুজ জেড পাথরের মেরাপ যা এতটাই সবুজ যে প্রায় কালো বলে মনে হয় তৈমূরের উপযুক্ত সমাধিসৌধ, কিন্তু বাবর এখনও জানে না, সে কোথায় শায়িত হবে। সমাধিকক্ষের একপাশে, খিলানাকতি একটা পথ ঢালু হয়ে নেমে নিচের ভূগর্ভস্থ কক্ষে চলে গেছে। কয়েক মুহূর্ত পরে, বাবর সেখানে প্রবেশ করে। করিডোরটা এতটাই সরু যে দু’পাশের দেয়ালে তার কাঁধ ঘষা খায় যখন সে ধীরে ধীরে নিচে নামতে থাকে- খালি পা পাথরের মসৃণ মেঝেতে পিছলে যেতে চায়- একটা অনেক ছোট কক্ষে এসে সে উপস্থিত হয়। একটা ছোট মার্বেলের তিরস্করণী পর্দা দেয়ালের উঁচুতে স্থাপিত আর সেটাতে মৌচাকের মত জাফরি কাটা নকশা কক্ষটার একমাত্র আলোর উৎস, সেখান থেকে হাল্কা আলোর ধারা এসে অলংকৃত সাদা মার্বেলের শবাধারে পড়ছে, যেখানে তৈমূরের মৃতদেহ শায়িত রয়েছে।

চীনের উদ্দেশ্যে অভিযানে যাত্রা করার পরে যখন তৈমূর অকস্মাৎ মৃত্যুবরণ করলে, তার অনুচরেরা গৌরবের সাথে তাকে সমরকন্দে ফিরিয়ে এনে সমাধিস্থ করার পূর্বে গোলাপজল, কর্পূর আর মৃগনাভি দিয়ে তার মরদেহ সংরক্ষিত করে। আড়ম্বরপূর্ণ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও, বলা হয়ে থাকে মহান এই বীর কবরে প্রথমে শান্তি পাননি। রাতের পরে রাত তার শবাধার থেকে আক্রোশপূর্ণ চিৎকার ভেসে এসে সমরকন্দের লোকদের ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলত। মৃত সম্রাট আপাত দৃষ্টিতে অন্তিম শয়ানে শায়িত হতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। এই ক্রোধান্বিত যন্ত্রণাদগ্ধ চিৎকার এক বছর স্থায়ী হলে শহরের লোকেরা মরীয়া হয়ে তৈমূরের ছেলের কাছে ধর্ণা দেয়। তার সামনে হাঁটু ভেঙে বসে তারা, তৈমূর তার যুদ্ধযাত্রার সময়ে যেসব বন্দিদের বিশেষ করে বিভিন্ন শিল্পে দক্ষ কারিগরদের সমরকন্দে নিয়ে এসেছিলেন এর সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্দেশ্যে তাদের মুক্তি দিতে অনুরোধ করে। যাতে লোকগুলো তাদের নিজের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারে। তৈমূরও তাহলে অবশেষে তার মহাপ্রয়ানের পথে রওয়ানা হতে পারবেন। প্রজাদের ভীতসন্ত্রস্ত আর বিহ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে তৈমূরের ছেলে তাদের কথা শোনেন। বন্দিদের মুক্তি দিয়ে দেশে ফিরে যাবার ব্যবস্থা করা হয় আর এরপরে তৈমূরের আর্তনাদ আর শোনা যায়নি।

নানী- দাদীর গল্প, বাবর মনে মনে ভাবে। কিন্তু আরেকটা কাহিনী আছে যা সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে বলা হয়ে থাকে তৈমূরের শবাধারের মেরাপের নিচে একটা সমাধিলিপি খোদাই করা রয়েছে: “আমি যদি আমার সমাধি থেকে উঠে আসি তাহলে পৃথিবী প্রকম্পিত হবে।”

বাবর বিনম্রচিত্তে শবাধারের দিকে এগিয়ে যায়। প্রায় ভীতচকিত ভঙ্গিতে, সে হাত বাড়ায় মেরাপটা স্পর্শ করতে যার উপরিভাগে তৈমূরের বংশ পরিচয় বয়ান করা রয়েছে। বাবর ভাবে, আমারও বংশ পরিচয়। আমার রক্ত। সে মাথা নিচু করে শীতল পাথরের গায়ে চুমু খায়। “আমি তোমার যোগ্য উত্তরসূরী হব,” সে ফিসফিস করে বলে। মহান তৈমূর আর আব্বাজানের কাছে এটা তার প্রতিশ্রুতি। তারচেয়েও বড় কথা এটা তার নিজের কাছে নিজের প্রতিশ্রুতি।

***

তৈমূরের হৃদয় প্রশান্ত করা উদ্যান, বাগ-ই-দিলকুশার কামরার মুক্তার মিহি জালের তৈরি কারুকাজ করা পর্দা ভোরের বাতাসে আলোড়িত হয় যেখানে সমরকন্দে বিজয়ীর বেশে প্রবেশের দুমাস পরে- বাবর ঘুমিয়ে রয়েছে। সমরকন্দের চারপাশের এলাকা আর তৃণভূমিতে তৈমূর যতগুলো উদ্যান নির্মাণ করেছিলেন, এটা বাবরের সবচেয়ে প্রিয়। আগের দিন সন্ধ্যাবেলা, সূর্য যখন অস্ত যেতে বসেছে, হঠাৎ খেয়ালের বশে সে ওয়াজির খান আর তার দেহরক্ষীদের তলব করে। সবুজাভ-নীল তোরণদ্বার দিয়ে তারা বের হয়ে এসে দু’মাইল লম্বা বাতাসে আন্দোলিত রাজকীয়, মার্জিত পপলার গাছে শোভিত রাজপথ ধরে এগিয়ে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছিলো। ঘোড়া ছুটিয়ে তারা যখন সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে ততক্ষণে রাত নেমে এসেছে। বাবর তার ভেতরেই তৈমূরের গম্বুজযুক্ত, সমব্যবধানে স্থাপিত স্তম্ভযুক্ত গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ আর তার চারপাশের খোলামেলা ভবনের আবছা অবয়ব অন্ধকার গাছের মাঝে মুক্তার মত চমকাতে দেখে।

বাবর ঠিক করে সে, ছিপছিপে গাঢ় সবুজ বর্ণের সাইপ্রেস, চিনার আর দেবদারু ঘেরা এবং মার্বেলের স্তম্ভের উপরে চীনা পোর্সেলিনের কারুকাজ করা প্রশস্ত ভবনের একটায় রাত কাটাবে। সে জানে, তৈমূরও বাগানে রাত কাটাতে পছন্দ করতো। সে দুটো নহরের সঙ্গমস্থলের উপরে স্থাপিত একটা মঞ্চে নিজের সিংহাসন স্থাপনের মত নির্দেশও দিয়েছিলো। বহমান চারটা ধারা জীবনের চারটে নদীর স্মারক আর ভূগোলকের চারপ্রান্তে তার আধিপত্যের উপস্থাপক।

বাবর তৈমূরের কথা যতই ভাবছে ততই শ্বাসরুদ্ধকর বলে প্রতিয়মান হয় তার দৃষ্টিভঙ্গি আর আকাঙ্ক্ষা। নিজেকে তৈমূরের উত্তরাধিকারী বলাটা সহজ, কিন্তু যখন সে এর দ্যোতনার কথা বিবেচনা করে, সে একাধারে উল্লসিত আর অকিঞ্চিৎকর বোধ করে।

কিছু একটা সম্ভবত তিতিরের ডাক- তাকে স্বপ্ন থেকে জাগিয়ে তোলে। সে চমকে উঠে বসে এবং চারপাশে তাকায়। এই বিলাসিতা- মেঝেতে ধূসর গজদন্ত আর কালো আবলুস কাঠের কারুকাজ, মার্বেলের ভাস্কর্য, সোনার পানপাত্রে পান্না, ফিরোজা আর চুনির কারুকাজ- এসব অবাস্তব বলে মনে হয়। সোনার সুতার কাজ করা গোলাপী রঙের যে রেশমের চাদরে সে শুয়ে আছে সেটায় হাত বুলিয়ে দেখে। গোলাপী পাথরের কারুকাজ সংবলিত রূপা আর সোনার জলে সূক্ষ গিল্টি করা অন্তঃপট তার আর পরিচারকদের দৃষ্টির মাঝে একটা আড়ালের জন্ম দিয়েছে।

গ্রান্ড উজির যত অপরাধই করে থাকুক, সে অন্তত তৈমূরের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদের ভালই যত্ন নিয়েছিলেন। গোলমালের প্রাথমিক আভাস পাবার সাথে সাথেই তিনি সব মূল্যবান গালিচা, ঝালর আর ফুলদানী এবং পাত্রসমূহ সমরকন্দে নিয়ে যাবার আদেশ দিয়েছিলেন, যা তিনি সেখানের দূর্গপ্রাসাদের ভূগর্ভস্থ কোষাগারে গোপনে সংরক্ষণ করেছিলেন। উজিরের পারিষদবর্গ নতুন শাসকের কাছে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের অভিপ্রায়ে দ্রুত এসব কিছুর অবস্থান বাবরের লোকদের কাছে প্রকাশ করেছে। যদিও প্রাসাদের অনেক মূল্যবান অলংকরণ কুপিয়ে তুলে ফেলা হয়েছে আর অবরোধেরকালে কাঠের তৈরি কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ ভবন জ্বালানী কাঠের জন্য ভেঙে ফেলা হয়েছে, বাবর ভেবে দেখে প্রাসাদের আসল সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে খুব একটা বেশি খাটাখাটনির প্রয়োজন হবে না।

শহরটা নিরাপদ হলে সে যখন তার আম্মাজান, আর বোনকে এখানে ডেকে আনবে, তখন তারা কি বলবে সেটা ভেবে বাবর নিজের মনেই হেসে উঠে। সমরকন্দের প্রসিদ্ধ পুরু কাগজে লেখা তার চিঠিগুলোতে শহরের ইতিহাস, মহিমা কিংবা বিশালতার প্রতি সে মোটেই সুবিচার করতে পারেনি। এই শহরটা আর যাই হোক আঠারশ বছর আগে সোনালী চুলের, নীল চোখের দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডার কর্তৃক স্থাপিত। যিনি সুদূর পশ্চিম থেকে তার সেনাবাহিনী নিয়ে তৈমূরের মতই সব প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে এসেছিলেন। চওড়া র‍্যামপার্টযুক্ত সমরকন্দের বাইরের দেয়াল বাবর মেপে দেখতে বললে দেখা যায় একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের পুরো চারপাশটা ঘুরে আসতে এগার হাজার পা হাঁটতে হয়। তৈমূর তার শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি আসলেই লক্ষ্য রেখেছিলেন- অবশ্য বাবরের প্রথম রাজকীয় আদেশ ছিল যে সুড়ঙ্গ পথে সে ভেতরে প্রবেশ করেছিলো সেটার মুখ পাথর দিয়ে বন্ধ করে দেয়া। সে চায় না অন্যরা- এবং যাদের সংখ্যা অনেক যারা সমরকন্দের দিকে শকুনের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে- আক্ষরিক অর্থে তার পদচিহ্ন অনুসরণ করুক। সে আরও কোনো সুড়ঙ্গ আছে কি না সেটা তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখবারও আদেশ দেয়।

বাবর আবার তার মাথার চাপে দেবে বসে থাকা বালিশে শুয়ে পড়ে। গত কয়েক সপ্তাহের দৃশ্যপট আর অভিজ্ঞতা এতটাই সমৃদ্ধ যে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় এত অল্প সময় অতিবাহিত হয়েছে। কাছে লেখা তার চিঠিগুলো, যিনি এসব বিষয়ে দারুণ আগ্রহী, সে শহরের বাইরে কোহাক টিলায় অবস্থিত তিনতলা বিশিষ্ট বৃত্তাকার মানমন্দির প্রথমবারের মত দেখে তার বিস্ময়ের কথা চিঠিতে ফুটিয়ে তুলতে চায়, যেখানে তৈমূরের নাতি উলুঘ বেগ সৌর আর চন্দ্র বর্ষপঞ্জি নিয়ে গবেষণা করতেন। বাবর হতবাক হয়ে, উলুঘ বেগের সেক্সট্যান্টের ইটের তৈরি মার্বেলের আস্তরণ দেয়া নিখুঁত বৃত্তচাপটা দেখে, প্রায় দুইশ ফিট লম্বা এবং একশ ত্রিশ ফিট তার ব্যাসার্ধ আর রাশিচক্রের বিভিন্ন চিহ্ন দ্বারা অলংকৃত। সেক্সট্যান্টের উভয় পার্শ্বে ধাতব রেলের উপরে স্থাপিত এ্যাস্ট্রোলোব ব্যবহার করে উলুঘ বেগ তার পর্যবেক্ষণ করতেন।

সবুজ মাঠের উপর দিয়ে পঙ্গপালের মত একটা ধ্বংসের মেঘের ন্যায় বিচরণ করে তৈমূরের যোদ্ধারা যদি পৃথিবী জয় করে থাকে, তবে তার উত্তরসুরী উলুঘ বেগ স্বর্গ দখল করেছেন। সমরকন্দের জ্যোতিষবিদরা এখনও তার তৈরি করা রাজকীয় জ্যোতিষবিদ্যার চার্ট ব্যবহার করে। বাবর তার পর্যবেক্ষণ আরও বেশি করে পাঠ করতে চায় কিন্তু তারপরেও মানমন্দিরের পরিশীলিত সূক্ষ মাত্রা তার ভিতরে নিজের পূর্বপুরুষ সম্পর্কে এক ধরণের গর্বের জন্ম দেয়। উলুঘ বেগের নিজের ছেলে, বাবার জ্ঞান আর বীক্ষার প্রতি এই সাধনায় অস্বস্তিবোধ নিজের করে এবং ধর্মান্ধ মৌলবাদী মোল্লাদের প্ররোচণায়, যারা ভয় পেয়েছিল হয়ত এর ফলে তাদের রহস্যের মূল উন্মোচিত হয়ে পড়বে আর তাদের ধর্মমত প্রশ্নের সম্মুখীন হবে, নিজের পিতাকে খুন করে।

উলুঘ বেগের নির্মিত মাদ্রাসা বাবর পরিদর্শন করেছে। রেজিস্তান প্রাঙ্গনের একপাশে সেটা অবস্থিত এবং আকাশী আর সবুজাভ-নীল টালিতে শোভিত, এর নকশা এতটাই জটিল যে লোকেরা একে হাজারবাফ “সহস্র-স্রোত” বলে থাকে। শহরের একেবারে কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বিবি খানম মসজিদ তাকে পুরোপুরি অভিভূত করে। মসজিদটা তার ফারগানার দূর্গের আড়ম্বরহীন, সাদামাটা মসজিদের থেকে একেবারেই আলাদা, যেখানে পূর্ণিমার আলোয় গোত্রপতিরা তার প্রতি অনুগত থাকবার শপথ নিয়েছিল, আজ ঘটনাটাকে মনে হয় যেন বহুযুগ আগের কোনো কথা।

এক মোল্লা বাবরকে বলেছে, কিভাবে তৈমূরের প্রিয় স্ত্রী, বিবি খানম, গজদন্তের মত দেহের তৃক বিশিষ্ট চীনা রাজকুমারী যার দীপ্ত সৌন্দর্য অবলোকন করে তৈমূরের চোখে জল চলে আসত, কোনো একটা অভিযান থেকে ফিরে আসবার পরে তৈমূরকে একটা চমক দেবার জন্য মসজিদটা তৈরি করেছিলেন। কিন্তু পারস্য থেকে মসজিদটা নির্মাণের জন্য রাণীর ডেকে আনা স্থপতি, মুহূর্তের স্বেচ্ছাচারী আবেগেতাড়িত হয়ে, তাকে আলিঙ্গন করে গলায় একটা কামড়ের দাগ বসিয়ে দেয়। এই ঘটনার মাত্র কয়েকদিন পরেই তৈমূর তার অভিযান থেকে ফিরে এসে তার স্ত্রীর আপাত খুঁতহীন ত্বকে দাগটা লক্ষ্য করে এবং খালুমের কাছে পুরো ঘটনাটা শুনে সেই বেয়াদপ স্থপতিকে ধরে আনবার জন্য লোক পাঠালে, সে ভয়তরাসে তার সদ্য তৈরি করা আকাশ-স্পর্শী মিনারের একটার উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে। কাহিনীটার সারবত্ত্বা যাই হোক, লম্বা অভিজাত প্রবেশ পথের দু’পাশে দেড়শ ফুটের বেশি উঁচু মিনার আর তার চেয়েও উঁচুতে অবস্থিত মসজিদটার গম্বুজ- মোজাইকের দ্বারা অলংকৃত- দেখে বাবরের ভিতরে একটা ভয় জাগান সমবোধ জেগে উঠে।

বাবর হাই তুলে এবং আড়মোড়া ভাঙে। তার আম্মিজান যখন সমরকন্দে পৌঁছাবে তিনি আনন্দিত আর পুলকিত হবেন এবং খানজাদা কৌতূহল আর উত্তেজনায় কেমন একটা ঘোরের ভেতরে থাকবে। কিন্তু এসান দৌলতের ব্যাপারটা সে ঠিক অনুধাবন করতে পারে না। তার খুশি করাটা খুব কঠিন একটা কাজ। সে কল্পনার চোখে দেখতে পায়, বলিরেখায় জর্জরিত মুখের সঙ্কটা মোকাবেলায় প্রস্তুত কালো কালো খুদে দুই চোখে তাকিয়ে তিনি মাথা নাড়ছেন এবং সাফল্যের কারণে বেশি উৎফুল্ল না হয়ে তাকে ভাবতে বলছেন এরপরে কি অপেক্ষা করছে।

বাবর ভাবে, সে যাই হোক তারপরেও সে তার অধিকার আদায় করে নিয়েছে। নিয়তির বাড়িয়ে দেয়া সুযোগ সে অকুণ্ঠ চিত্তে গ্রহণ করেছে। সে হাততালি দিতে একজন পরিচারক সাথে সাথে একটা বিশাল রূপার পাত্র যা এক জগ গোলাপজল মেশান উষ্ণ পানি দিয়ে পূর্ণ নিয়ে হাজির হয়। পাত্রটা সাবধানে নিয়ে সে বাবরের দিকে এগিয়ে আসে, হাতে ধরা একটা কাপড় দিয়ে তাকে পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সে হাত নেড়ে তাকে বিদায় করে। তার সব কাজ অন্য কেউ করে দেবে এখনও সে পুরো এই ব্যবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি এবং পরিচারককে সে তার বিছানার পাশে রাখা ছোট টেবিলে কাপড় আর পানির পাত্রটা রেখে যেতে বলে। পানির সমতল পৃষ্ঠে ভেসে উঠা নিজের অবয়বের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ফারগানার কোনো একটা পাহাড়ী ঝর্ণার শীতল পানিতে মাথা ডোবানোর একটা অপ্রত্যাশিত ইচ্ছা তাকে পেয়ে বসে।

কিন্তু তার এই ভাবনার রেশ সদ্য তৈরি করা রুটি আর পরিজের মন মাতান গন্ধে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। বেহেশতে বাস করার সময়ে সে যদি বাড়ির কথা ভেবে বা অন্য কারণে মন খারাপ করে তাহলে তাকে আহাম্মক বলতে হবে। তার লোকদেরও আপাতভাবে সন্তুষ্ট মনে হয়- যা একটা বিরল ব্যাপার, গলা আর কাঁধ ডলে পরিষ্কার করতে করতে সে ভাবে। অবশ্য, সে তাদের তার প্রতিশ্রুতিমত বা তার চেয়েও বেশি পুরস্কৃত করেছে। সমরকন্দের মোহরে ঠাসা সিন্দুক তাকে উদার হতে এক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। সে তার সব গোত্রপতিকে একশটা করে সোনার আশরফি আর তাদের অধিনস্ত লোকদের আশাতীত রকমের রৌপ্যমুদ্রা দিয়েছে। বাবর অবশ্য প্রাপ্ত ধনসম্পদের একটা ভাল অংশ ফারগানায় তার প্রতিনিধি কাশিম আর তার অনুসারীদের পুরস্কৃত করতে আর আশেপাশের ঝামেলাবাজ গোত্রগুলোর আনুগত্য যাতে সে বজায় রাখতে পারে সেজন্য পাঠাতে ভুল করেনি। বাবরের অনেক লোকই নতুন দ্বার পরিগ্রহ করেছে। সে যেমনটা আশা করেছিলো, গ্রান্ড উজিরের হারেমের তরুণীর দল অনেকটা আগ্রহের সাথেই তার লোকদের সাথে গিয়েছে। টাকার থলে ভর্তি বিজয়ী যোদ্ধার আবেদন ছোট করে দেখার উপায় নেই।

তার এখন পোশাক পরার সময় হয়েছে। নিজের অসহিষ্ণুতা চেপে রেখে সে তার অনুচরদের মোসাহেবের ভঙ্গিতে তাকে ঘিরে ধরে, নরম হরিণের চামড়া দিয়ে তৈরি পাজামা আর সাদা রেশমের কাফতানে তাকে সুসজ্জিত করে তোলার অনুমতি দেয়, তারপরে তাদের বাড়িয়ে রাখা রেশমের একাধিক কারুকাজ করা টিউনিক থেকে একটা- তার নতুন প্রজাদের মন রক্ষার্থে উজ্জ্বল সবুজ রঙের যাতে তার ফারগানার হলুদ ডোরাকাটা রয়েছে সাথে ইস্পাতের বকলেস- সে পছন্দ করে। ফারগানার রুক্ষ কাপড় আর যেনতেন প্রকারে হরিণের চামড়া থেকে তৈরি পোশাকের চেয়ে সমরকন্দের দর্জির নিখুঁত সেলাই করা পোশাক একদম আলাদা মনে হয়। এক পরিচারক তার কোমরে একটা সঞ্জাবযুক্ত পরিকর গাণিতিক নিপূণতায় পরিয়ে দেয়। আরেকজন পায়ের কাছে বসে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা সোনার সুতা দিয়ে কারুকাজ করা বুট পরতে সাহায্য করে। তারপরে চন্দনকাঠের একটা বাক্স থেকে বাবর কিছু অলঙ্কার পছন্দ করে। গয়নার প্রতি তার কোনো বিশেষ আগ্রহ নেই কিন্তু আজ বিবি খানম মসজিদে তাকে লোকজনের সাথে নামাজ পড়তে হবে আর উৎসুক জনতার চোখে তাকে যেন পুরোদস্তুর একজন সুলতানের মত দেখায়, যার প্রাচুর্য– আর একই সাথে তার উদারতা- সতত পরিবর্তনশীল মৈত্রী আর আনুগত্যের দুনিয়ায় যেন অফুরন্ত।

সামনে রাজদণ্ড-বহনকারী আর পেছনে লম্বা চারজন দেহরক্ষী নিয়ে বাবর মার্বেল মোড়া পথের উপর দিয়ে হেঁটে বাগানের দিকে আসে, যেখানে ফুল লতা পাতা শোভিত চাদোয়ার নিচে বিছান গালিচায় তার পারিষদবর্গ আসনপিড়ি হয়ে বসে তার অপেক্ষা করছে। এইসব দীর্ঘ বৈঠক বাবরের বিরক্ত লাগে কিন্তু এখনও অনেক কাজ বাকী রয়েছে। তার চাচাজানের মৃত্যুর পরে উদ্ভূত অনিশ্চয়তা আর দ্বন্দ্ব এবং তারপরে তার অবরোধে অনেক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। সমরকন্দের চারপাশের ক্ষেত আর তৃণভূমি যথেষ্ট উর্বর, কিন্তু কৃষকরা ভয়ে চাষই করেনি এবং এ বছরের ফসলের অনেকটাই নষ্ট হয়েছে। ফারগানা থেকে নিজেদের রসদের জন্য আনা শস্যবীজ আগামী বসন্তে চাষীরা যাতে চাষের কাজে ব্যবহার করতে পারে সেজন্য তাদের মাঝে বন্টনের আদেশ দিয়েছে বাবর। আর এছাড়া পশুপালকদের অনেকেই যুদ্ধের হাঙ্গামা থেকে দূরে পশ্চিমের নিজেদের গৃহপালিত পশুর পাল নিয়ে পালিয়ে গেছে। তাদেরও অভয় দিয়ে ফিরিয়ে আনার বন্দোবস্ত করতে হবে।

বাবর ভাবে, তাকে সাহায্য করার জন্য যোগ্য লোক অন্তত তার পাশে আছে। ওয়াজির খান, তার ইচকিসের, পারিষদবর্গের ভিতরে অন্যতম। এছাড়াও বাইসানগার আছে, সমরকন্দের সৈন্যরা তাকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করে। শহরের পতনের পরেই কেবল বাবর বুঝতে পেরেছে বাইসানগারের স্তোকবাক্য, নাশকতামূলক তৎপরতা, আর ঘুষের কারণে তাকে এত দুর্বল প্রতিপক্ষ মোকাবেলা করতে হয়েছে। তার প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত, সমরকন্দের পুরো নিরাপত্তার দায়িত্ব বাবর বাইসানগারের উপরে অর্পণ করেছে।

আলি মজিদ বেগের পোড় খাওয়া মুখের উপরে তার দৃষ্টি আপতিত হয়। তাকে পারিষদবর্গের অন্তর্ভূক্ত করে সে বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে। অনেকটা অতীত আনুগত্যের কারণে পুরষ্কার যে কয়েকজন গোত্রপতি শুরু থেকে দ্ব্যর্থহীনভাবে শুরু থেকে বাবরকে সমর্থন জানিয়ে এসেছে, সে তাদের অন্যতম। কিন্তু এর ভেতরেও বিচক্ষণতার মারপ্যাঁচ রয়েছে। আলি মজিদ বেগ ফারগানার অন্যতম প্রভাবশালী গোত্রপতি। সমরকন্দে সে যে বাবরের সাথে অবস্থান করছে এটা অনেককেই প্রভাবিত করেছে- বাবরের ধারণা যাদের ভিতরে অনেকেই এই মুহূর্তেই ফারগানায় ফিরে যেতে চায়- থাকতে।

কিন্তু, অনেকেই অবশ্য ফিরে গিয়েছে। তারা এই অভিযানে এসেছিলো লুট করতে আর একবার সেটা পাবার পরে বাড়ি ফিরে যাবার জন্য তারা অধীর হয়ে উঠেছে। বুনো আর উচ্ছঙ্খল চকরাস, নিষ্ঠুরতা আর বিশ্বাসঘাতকতা যেখানে নৈমিত্তিক ব্যাপার সেখানেও তারা তাদের সতত পরিবর্তনশীল মনোভাব আর নির্মমতার জন্য বিখ্যাত। তাদের দুর্গম পাহাড়ী আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে সটকে পড়তে শুরু করেছে এবং শরৎ কাল এসে পড়ার কারণে প্রতিদিনই আরও বেশি সংখ্যক লোক চলে যাচ্ছে। বাবরের পারিষদগণ সে এগিয়ে আসতে নতজানু হয়। কিন্তু সে হাতের ইশারায় তাদের উঠে দাঁড়াবার ইঙ্গিত দেয়। দিনের কাজ শুরু করার জন্য সে উদগ্রীব হয়ে আছে। সে ইতিমধ্যে একটা কথা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছে যে, একজন সুলতানকে বড় বড় ব্যাপারেই মাথা ঘামালে কেবল চলবে না। মাত্র গতকালের ঘটনা, শকুনের মত দেখতে দুই গালিচা ব্যবসায়ীর ভিতরে উদ্ভূত ঝগড়ার মধ্যস্থতা তাকে করতে হয়েছে। সুদূর পারস্যের তিবরিজ থেকে আনা লাল, গোলাপী আর নীলরঙের গালিচার মূল্য নিয়ে দুজনেই বালখিল্যসুলভ বিবাদে লিপ্ত হয়েছিলো। সেই জানে। কিভাবে সে হাসি চেপে রেখেছিলো।

“সুলতান, এগুলো আজকের দিনের আর্জি।” তার পরিচারক হাতের রূপার ট্রের দিকে ইঙ্গিত করে। সেখানে একতাড়া কাগজ। বাতাসে যাতে উড়ে না যায় সেজন্য একটা পিতলের ওজন দিয়ে চেপে রাখা আছে।

উপরের আর্জিতে লেখা বিবরণীর দিকে তাকিয়ে বাবরের মন হতাশায় ভরে ওঠে। সম্ভবত কারো ছাগল বা ভেড়া হারিয়ে গেছে বা পাহাড়ের বিরান জমিতে পশুচারণের অধিকার চেয়ে কোনো আর্জি। “আমি ওগুলো পরে দেখবো।” এসবের চেয়ে শিকারে যাবার জন্য তার ভেতরটা ছটফট করে। সে হাতের ইশারায় তার পারিষদবর্গকে বসতে বলে এবং কাঠের নিচু মঞ্চের উপরে তার জন্য নির্দিষ্ট গজদন্তের কারুকাজ করা টুলে উপবেশন করে। তাদের মতো নিচে আসনপিড়ি হয়ে বসা অনেক বেশি কষ্টকর।

“শহরের নিরাপত্তার পর্যালোচনা কবে নাগাদ শেষ হবে?” সে বাইসানগারকে জিজ্ঞেস করে।

“সুলতান, প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। অস্ত্রাগারে অস্ত্রের মজুদের চুড়ান্ত হিসাব সম্পন্ন হয়েছে। তবে রাজমিস্ত্রীরা এখনও শহর রক্ষাকারী দেয়াল আর র‍্যামপার্টের অবস্থা খুঁটিয়ে দেখছে। তারা বলেছে দু’বছর আগের ভূমিকম্পে দেয়ালের কয়েক জায়গার ভিতে ক্ষতি হয়েছে যা মেরামত করতে হবে।”

বাবর মাথা নেড়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। “মেরামত যা কিছু করার, সব দ্রুত শেষ করতে হবে। এতো সহজে সমরকন্দের পতন হয়েছে যে ব্যাপারটা আরো অনেকের মনোযোগ আকর্ষণ করবে। ওয়াজির খান, সাইবানি খান আর তার হায়েনাদের কি খবর?”

“তাদের ফিরে আসবার জন্য আমরা সর্বদা সতর্ক রয়েছি। কিন্তু আমাদের সীমান্তে টহল দেয়া সৈন্যরা এখনও উজবেক আক্রমণকারীদের কোনো আনাগোনা লক্ষ্য করেনি। সাইবানি খান জানে শীতকালের আগে আক্রমণ করার জন্য তার হাতে অল্প সময় আছে।”

“কিন্তু সে অবশ্যই আসবে।” চিন্তিত কণ্ঠে বাবর বলে। সাইবানি খান ইতিমধ্যে সমরকন্দের একজন সুলতানকে হত্যা করেছে: আরেকজনকে বিশেষ করে কিশোর আর সদ্য সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে এমন একজনকে হত্যা করতে তার ইতস্তত করার কোনো সঙ্গত কারণ নেই।

“হ্যাঁ, সুলতান, আমি জানি সেটা। আমরা সবাই জানি। কিন্তু বসন্তের আগে সে এখানে আসবে না। আমরা ততোদিনে তাকে আর তার বদমায়েশ শিষ্যগুলোকে একটা ভালো শিক্ষা দেবার জন্য প্রস্তুত থাকবো।” ওয়াজির খানের আত্মবিশ্বাস বাবরকে সামান্য হলেও স্বস্তি দেয়।

সহসা অনেকগুলোর কণ্ঠস্বর শুনে তারা সবাই চারপাশে তাকায়। উদ্যানের বিপরীত দিকে কমলা রঙের ম্যারিগোল্ড আর গোলাপী রঙের গোলাপের বাগিচার অপরপাশে, বাবর একজন প্রহরীর সাথে ঝুঁকেপড়া ক্ষুদে একটা অবয়বকে তাদের দিকে হেঁটে আসতে দেখে। লোকটার পরণে ভ্রমণের পোশাক এবং সে কাছে এসে রাস্তার ধূলো থেকে বাঁচবার জন্য মুখের চারপাশে জড়িয়ে রাখা বেগুনী রঙের গলবস্ত্র খুলতে বাবর তার দাদীজানের বয়োবৃদ্ধ খিদমতগার, ওয়ালিদ বাট্টের, বলিরেখায় পূর্ণ মুখমণ্ডল আর পাতলা হয়ে আসা সাদা চুল চিনতে পারে। তাকে দেখে বাবরের কেমন যেনো বিপর্যস্ত মনে হয়, আর সেটার কারণ ঘোড়ায় চড়ে দীর্ঘপত্র পরিক্রমা না- তার বয়সী লোকের জন্য অবশ্য সেটাই যথেষ্ট উপলক্ষ- বরং সে সাথে করে যে লেফাফা নিয়ে এসেছে সেটা।

এক মুহূর্তের জন্য, গ্রীষ্মকালের সন্ধ্যাবেলা সত্ত্বেও বাবর টের পায় একটা শিরশিরে অনুভূতি তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এসান দৌলত কি তবে মৃত? দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে সে মঞ্চ থেকে নেমে বৃদ্ধ লোকটার কাঁধ জড়িয়ে ধরে। “খিদমতগার কি হয়েছে খুলে বলো? কি সংবাদ তুমি নিয়ে এসেছো?”

ওয়ালিদ বাট্ট ইতস্তত করে, যেনো বুঝতে পারে না কোথা থেকে শুরু করবে। বাবরের ইচ্ছা করে এক ধমকে তার ইতস্ততভাব ঘুচিয়ে দেয়। কিন্তু জন্মের পর থেকে দেখে আসা লোকটার প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধের কথা স্মরণ রেখে সে নিজের অসহিষ্ণুতা দমন করে।

“সুলতান, আপনার কাছে এভাবে হাজির হয়েছি বলে আমার অপরাধ মার্জনা করবেন কিন্তু আমাকে দ্রুত আসতে হয়েছে।” খিদমতগার আলখাল্লার ভিতর থেকে একটা চামড়ার থলে বের করে যা একটা ছোট দড়ির সাহায্যে তার গলা থেকে ঝুলছিল এবং সেটার ভেতর থেকে সে ফারগানার রাজকীয় সিলমোহর করা একটা চিঠি বের করে।

বাবর চিঠিটা নিয়ে দ্রুত সেটা খুলে পড়তে শুরু করে। হাতের লেখা দেখে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কিন্তু তার মানসিক প্রশান্তি অচিরেই বাষ্পীভূত হয়। এসান দৌলতের লেখা শব্দগুলো তার চোখের সামনে যেনো নাচতে শুরু করে। “তুমি যদি আমাদের বিপর্যয়ে সাড়া না দাও তবে আমরা নিশ্চিত ধ্বংসের মুখোমুখি হবো।” পুরো চিঠিটা সে দ্রুত পড়া শেষ করে, কথা পুরোপুরি আত্মস্থ করতে পেরে তার হতভম্বভাবটা আরো বেড়ে যায়।

“কি হয়েছে, সুলতান?” ওয়াজির খান জানতে চায়।

“আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। আমার জারজ সৎ-ভাই জাহাঙ্গীরকে ফারগানার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে- একটা বাচ্চা পুতুল যাকে নিয়ে খেলছে আমার রক্তসম্পর্কীয় ভাই তামবাল। উপজাতি গোত্রপতিদের বখশিশের লোভ দেখিয়ে সে দলে টেনেছে…নিজের সুবিধার্থে সে জাহাঙ্গীরকে ব্যবহার করছে…” বাবরের আঙ্গুলের ফাঁক গলে চিঠিটা মাটিতে পড়ে গেলে বাতাস সেটাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে গোলাপ ঝাড়ে আটকে দেয়। সে ভাবে আমার জন্মভূমির মসনদ আমি হারিয়েছি।

ওয়াজির খান চিঠিটা তুলে নিয়ে দ্রুত পড়তে থাকলে আরেকটা আরো ভয়ঙ্কর সম্ভাবনা বাবরের মাথায় উঁকি দেয়। আবার সে ওয়ালিদ বাট্টের কাঁধ চেপে ধরে। এবার এতোটাই জোরে যে কবুতরের মতো পলকা বৃদ্ধ লোকটা ব্যাথায় গুঙিয়ে উঠে। আমার মা, বোন আর নানীকে তুমি শেষবার কখন দেখেছো? তারা কোথায় আছে? তারা কি নিরাপদ আছে?”

ওয়ালিদ বাট্ট অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। “দূর্গে আপনার উজির কাশিম আর তাদের সবাইকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। আপনার নানীজান অনেক কষ্টে এই চিঠিটা আমাকে দিয়ে বলেছেন আপনার কাছে পৌঁছে দিতে। কিন্তু আমি বলতে পারবো না তারা জীবিত না মৃত। আমি জানি না। গত দু’সপ্তাহ আমার রাস্তাতেই কেটেছে।” তার কণ্ঠস্বর ভেঙে আসে।

সে সহসা টের পায় বুড়ো লোকটাকে ব্যাথা দিচ্ছে, বাবর তার মুঠো আলগা করে। “খিদমতগার, তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছে। এখন খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নাও। তোমার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।” পেছন থেকে ওয়ালিদ বাট্টের দিকে তাকিয়ে তার মনে হয় বাতাস একটু জোরে বইলে বেচারার ক্ষীণকায় দেহ বোধহয় উড়েই যাবে।

বাবর বিচলিত বোধ করে। তার প্রারম্ভিক অবিশ্বাসের জায়গায় জলোচ্ছাসের মত ক্রোধ এসে ভর করে। তামবালের এত বড় আস্পর্ধা তার সালতানাত দখল করে তারই পরিবারকে অন্তরীণ করেছে…? কিন্তু সে নিজের মনোভাব নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করে। সে এখন যে সিদ্ধান্ত নেবে তার উপরেই সবকিছু নির্ভর করছে। তার দিকে উদগ্রীব চোখে তাকিয়ে থাকা পারিষদবর্গের দিকে তাকিয়ে সে একটা গভীর শ্বাস নেয়।

“ওয়াজির খান, আমার দেহরক্ষী বাহিনীকে প্রস্তুত করেন। আমরা এই মুহূর্তেই ফারগানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো। বাইসানগার একটা বাহিনী প্রস্তুত করেন। আমার অধীনস্ত গোত্রপতি আর তাদের লোকদের ডেকে পাঠান- তামবাল আর তার অনুগত উপজাতীয় বাহিনীকে শায়েস্তা করতে হলে দু’হাজার লোকের বাহিনীই যথেষ্ট হবে। আমার ধারণা একবার আকশি পৌঁছালে ফারগানার বেশিরভাগ লোকই তাদের ন্যায়সঙ্গত সুলতানের পক্ষ সমর্থন করবে। যাই হোক, সাইবানি খান আসলে যাতে নিরাশ না হয়, সেজন্য এখানে যথেষ্ট সেনা মোতায়েন রাখেন এবং এক সপ্তাহের ভিতরে আমাদের অনুসরণ করবেন। আর হ্যাঁ, দুরমুজ আর অবরোধ যন্ত্র এবং নিক্ষেপক প্রস্তুত রাখবেন, যেনো আমি নির্দেশ পাঠালে সাথে সাথে পাঠাতে পারেন। আলি মজিদ বেগ আমার অনুপস্থিতিতে আপনি সমরকন্দের রাজপ্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্বপালন করবেন। ঠিকমতো পাহারা দেবেন আশা করি।”

তিন বয়স্ক লোক মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। বাবর তার অলংকার খুলতে খুলতে ঘুরে দাঁড়ায় এবং তার ঘোড়সওয়ারের পোশাক আর হাতিয়ার আনতে আদেশ দেয়।

***

ওয়াজির খানের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সে গ্রীষ্মের দাবদাহে এখনও তৃণহীন চারণভূমির উপর দিয়ে ঘোড়া হাকিয়ে যায়। বাবরের মনে নিদারুণ যন্ত্রণার ঝড় বয়ে চলে। নিজের পরিবারের জন্য অপরাধবোধ আর ভয় এবং যারা নয় বছরের এক বালকের সাহায্যে তাকে তার সালতানাত থেকে উচ্ছেদ করতে পারবে বলে ভেবেছে তাদের জন্য তার ভেতরে ক্রোধের দাবাগ্নি ধিকিধিকি জ্বলতে থাকে। গত কয়েক সপ্তাহ সে মূখের স্বর্গে বাস করেছে। স্বপ্নহতের মত সমরকন্দের চারপাশে বিচরণ করে বেড়িয়েছে, নিজের পরিবারকে কিভাবে এই রূপকথার শহর দেখাবে তার পরিকল্পনা করেছে।

ঔদ্ধত্যের সাথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টাই সে এড়িয়ে গেছে। ভেবেছে ফারগানায় সবাই তাকে বীরের চোখে দেখবে আর বিদ্রোহের কথা কল্পনাও করবে না। তামবাল আর তার সমর্থকেরা নেকড়ের মতো পশুপালকের পিঠ ঘুরিয়ে নেয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছে। যাতে তারা নিশ্চিন্তে ভেড়ার পালের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। আর ব্যাটারা অবশ্যই ধূর্ত, নতুবা তার নানীজান, আম্মিজান অথবা কাশিম ঠিকই কিছু একটা গোলমালের আভাস আঁচ করে এবং বাবরকে আগেই সতর্ক করতো। তার পরিবারের মেয়েদের যদি কিছু হয়…রোক্সানা যদি ফারগানার নতুন সুলতানের মা হিসাবে তার প্রতিপক্ষ আর শত্রুদের বিনাশ করতে চায়… সে বিষয়টা নিয়ে আর চিন্তা করতে চায় না।

প্রতি রাতে ঘোড়ার পিঠে বহু ঘণ্টা কাটিয়ে তারা যখন ক্লান্ত হয়ে হয়ে অস্থায়ী ছাউনি ফেলে, তখনও বাবর দুচোখের পাতা এক করতে পারে না। পূর্বদিকে না এগিয়ে বৃথা বিশ্রামে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত তার কাছে বিষবৎ মনে হয় এবং তাকে বিশ্রাম নিতে অনুরোধ করায় সে খামোখাই ওয়াজির খানের উপরে ক্ষেপে উঠে। কিন্তু চতুর্থ রাত্রে ঘুমাবার কোনো প্রশ্নই উঠে না। মাটিতে পাতা বিছানায় পিঠ দেয়া মাত্র সে কাঁপতে থাকে এবং তার কপাল ঘামে ভিজে উঠে। সকাল নাগাদ তার দাঁতে দাঁত লেগে এমন ঠকঠক করতে থাকে যে, সে কোনো কথাই বলতে পারে না। সে যখন উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে তার পা দেহের ভার নিতে অস্বীকার করায় সে অসহায়ের মতো আবার মাটিতে শুয়ে পড়ে। ওয়াজির খান নিমেষে তার পাশে এসে উপস্থিত হয়, নাড়ী দেখে চোখের পাতা টেনে ধরে মণি দেখতে। “সুলতান আজ আপনি অশ্বারোহন করতে পারবেন না।”

এই প্রথম বাবর তর্ক করার মত শক্তি খুঁজে পায় না। সে টের পায় ওয়াজির খান তার দেহ ভারী উলের কম্বল দিয়ে মুড়ে দিচ্ছে। কিন্তু চোখ তুলে তার দিকে তাকাতে গেলে তার চোখের সামনে পুরো পৃথিবীটা দুলে উঠে এবং আঁধার হয়ে আসে। তারপরে পুরোটা অন্ধকারে ছেয়ে যায়।

***

জ্বরের উত্তাপে শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁটের ফাঁকে ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। বাবরের জিহ্বা তালুতে অর্ধেক আটকে ছিলো, এখন খুলে এসে আগ্রহের সাথে পানির স্পর্শ গ্রহণ করে। তার কোনো ধারণাই নেই সে কোথায় আছে। মূল্যবান আর্দ্রতা লাভ করাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অবশেষে কেঁপে উঠে তার চোখের পাতা খুলে যায়। ওয়াজির খানের চিরবিশ্বস্ত অবয়ব তার দিকে ঝুঁকে আছে। এক হাতে একটা লম্বা সুতির কাপড়ের টুকরো ধরে রয়েছে। তার অন্য হাতে একটা পানির বোতল। বাবরকে জ্ঞান ফিরে পেতে দেখে সেগুলো মাটিতে নামিয়ে রেখে সে হাঁটু মুড়ে বসে অপেক্ষা করে।

পিপাসায় বাবরের বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে রয়েছে। আরো পানি।” সে বলতে চেষ্টা করে, কিন্তু শুকনো ঠোঁটের ফাঁক গলে কেবল একটা কর্কশ আর্তনাদ বের হয়। ওয়াজির খান বুঝতে পারে। কাপড়ের টুকরোর একটা প্রান্ত সে বাবরের ঠোঁটের মাঝে স্থাপন করে এবং বাবরের অজান্তে গত এক ঘণ্টা ধরে সে যা করে আসছিলো সেটাই করতে থাকে: কাপড়টাতে পানির একটা ক্ষীণ ধারা ঢালতে থাকে, যাতে বাবরের মুখে কয়েক ফোঁটার বেশি পানি গড়িয়ে না পৌঁছে।

অনেকক্ষণ পরে, বাবর শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পানি ছিটকে ফেলে এবং কোনোমতে উঠে বসে। ওয়াজির খান কাপড় আর পানির বোতলটা আবার একপাশে সরিয়ে রাখে এবং তার কপালে হাত রেখে উত্তাপ অনুভব করে। “সুলতান, আপনার জ্বর অবশেষে কমতে শুরু করেছে।”

চারপাশে তাকিয়ে বাবর দেখে তারা একটা ছোট গুহার ভেতরে রয়েছে, যার কেন্দ্রে আগুন জ্বলছে। তার মাথা আবার ঘুরতে শুরু করলে সে চোখ বন্ধ করে ফেলে। “আমি কতদিন ধরে অসুস্থ?”

“সুলতান, চারদিন হয়ে গেছে। আজ পঞ্চমদিনের দুপুরবেলা।”

“কি হয়েছিলো? নিশ্চয়ই বিষের ক্রিয়া না…?”

ওয়াজির খান অসম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। “না। কেবল জ্বর- খুব সম্ভবত ভেড়ার আঁটুলির দংশন।”

বাবর প্রায় হেসে ফেলে- এই সময়ে ভেড়ার আঁটুলির দংশন!

“কে আছে, সুরুয়া নিয়ে এসো।” ওয়াজির খান তার এক লোককে উদ্দেশ্য করে বলে। যবের আটার তৈরি সুরুয়া ভর্তি পাত্রটা নিয়ে আসলে সে বাবরের পাশে হাঁটু ভেঙে বসে এক হাতে পাত্রটা তার মুখের কাছে তুলে ধরে। অন্য হাতে তার মাথাটা। ধরে। উষ্ণ তরলটার স্বাদ ভালই, কিন্তু সামান্য খাবার পরেই তার পাকস্থলী মোচড় দিয়ে উঠলে সে পাত্রটা একপাশে সরিয়ে দেয়।

“সমরকন্দ থেকে কোনো সংবাদ এসেছে? বাইসানগারের সেনাবাহিনী নিয়ে এতদিনে পৌঁছে যাবার কথা।”

“না, সুলতান। কোনো সংবাদ আসেনি।”

“আর ফারগানার কি খবর?” এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার জন্য বাবর নিরবে ভাগ্যকে অভিশাপ দেয়। কপাল ভালো হলে এতদিনে ফারগানা তাদের দৃষ্টিসীমায় পৌঁছে যাওয়া উচিত ছিলো।

ওয়াজির খান আবার মাথা নাড়ে। “আমি কোনো সংবাদের প্রত্যাশা করিনি। আমি আমার কোনো লোককে রেকী করতেও পাঠাইনি। আমার একমাত্র অভিপ্রায় ছিলো সুস্থ হয়ে উঠা পর্যন্ত আপনাকে লুকিয়ে রাখা। ফারগানা আর এখানে অনেক গুপ্তচর রয়েছে। আপনার অসুস্থতার সংবাদ ফারগানায় পৌঁছালে-…”

সে বাক্যটা শেষ না করলেও বাবর ঠিকই বুঝতে পারে। বালক সুলতানের পেছনের কুশীলবরা যদি একবার ভেবে নেয় যে সে মারা গেছে তবে তার পরিবারের জেনানারা পরের দিনের সূর্যোদয় দেখার জন্য বেঁচে থাকবে না।

“ধন্যবাদ, ওয়াজির খান। আরো একবার আমার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে, এমন সব কিছুর প্রতি আপনি লক্ষ্য রেখেছেন।” ওয়াজির খানের কথা শুনে নিজের দুর্দশার কথা তার আবার মনে পড়ে যায়। বাবর আধশোয়া হয়, আশা করে তার দেহে আবার শক্তি ফিরে আসবে। কিন্তু এই মুহূর্তে নিজের দুর্বলতার ব্যাপারে সে পুরোপুরি সচেতন। আজ বাকি দিনটা আমি বিশ্রাম নেবো, কিন্তু কাল থেকে আমরা আবার যাত্রা শুরু করছি।”

“হ্যাঁ, সুলতান আপনার স্বাস্থ্য যদি আমাদের সে অনুমতি দেয়।”

“আমি ঠিকই পিরবো।” বাবর পুনরায় চোখ বন্ধ করে মনে মনে দোয়া করে তার কথাই যেনো ঠিক হয়।

পুরো দিনটা আর রাতের বাকি সময়টা সে ঘুমিয়ে কাটায়। কিন্তু পরের দিন সকালের আলো গুটিগুটি পায়ে গুহার ভিতরে প্রবেশ করতেই তার ঘুম ভেঙে যায়। সতর্কতার সাথে উঠে বসে সে দেখে, মাথা আগের চেয়ে পরিষ্কার লাগছে এবং দুর্বল বোধ করলেও কারো সাহায্য ছাড়াই সে উঠে দাঁড়াতে পারে। গুহার শৈবালের প্রলেপযুক্ত দেয়ালের গায়ে হাত রেখে সে আড়ষ্ঠ ভঙ্গিতে হেঁটে এর মুখের দিকে এগিয়ে আসে এবং মাথা নিচু করে বাইরে বের হয়। ভেড়ার চর্বি দিয়ে জ্বালানো উজ্জ্বল আলোর চারপাশে ওয়াজির খান আর তার কয়েকজন দেহরক্ষী আসনপিড়ি হয়ে বসে রয়েছে। একটা অস্থায়ী কাঠামো থেকে আগুনের উপরে একটা পেতলের কেতলি ঝুলছে।

ওয়াজির খান মাটির কাপে ধোঁয়ার গন্ধযুক্ত একটা উষ্ণ পানীয় আর একটুকরো শুকনো রুটি তার হাতে ধরিয়ে দিলে সে চিবোতে শুরু করে। সে চারপাশে তাকিয়ে লক্ষ্য করে ঘোড়ার পাল দড়ি দিয়ে লতা ঝোঁপের সাথে বেঁধে রাখা হলেও ইতিমধ্যে তাদের পিঠে মালপত্র আর পর্যাণ চাপান শেষ। বরাবরের মতোই ওয়াজির খান সবকিছু ঠিকমতো গুছিয়ে রেখেছে। আধঘণ্টার ভেতরেই তারা নিভুনিভু আগুনের উপরে মাটি চাপা দিয়ে কাছের ঝর্ণা থেকে চামড়ার পানির বোতলগুলো ভরে নিয়ে ঘোড়ায় চেপে বসে।

বাবর তার চিরাচরিত ক্ষিপ্রতা ছাড়াই ঘোড়ার পিঠে উঠে বসলে টের পায় কেবল ওয়াজির খান না, তার দলের বাকি সবাই তাকিয়ে আছে। এক মুহূর্তের জন্য ইতস্তত করে সে সূর্যোদয় আর ফারগানার উদ্দেশ্যে ঘোড়া হাঁকায়।

***

জাক্সারটাস নদী আর তার বাড়ি দূর থেকে চোখে পড়তে বাবরের হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুত হয়ে উঠে। নদীর উপরের চূড়োর অর্ধেকটা নিয়ে নির্মিত দুর্ভেদ্য আকশি দূর্গে তার বাল্যকালের সবচেয়ে মধুর সময় কেটেছে। এই মুহূর্তে সমরকন্দ বিজয়ের গৌরবও তুচ্ছ মনে হয় এবং সে টের পায় তার চোখে অশ্রু জমে উঠছে।

“সুলতান, আজ রাতে আর এগোনো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।” ওয়াজির খানের। চোখেও অশ্রু টলমল করে। “তারা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের অগ্রগামী বাহিনী পাঠানো পর্যন্ত আমরা আত্মগোপন করে থাকবো।”

ঘোড়া হাঁকিয়ে দূর্গের ফটকে গিয়ে বাবরের ইচ্ছা করে ভেতরে প্রবেশ করতে। কিন্তু ওয়াজির খানের কথাই ঠিক। টলোমলো ভঙ্গিতে সে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামে এবং হাতেপায়ে জ্বরের পরের ব্যাথা অনুভব করে, এবং শুনতে পায় ওয়াজির খান নিজের দুইজন শ্রেষ্ঠ আর দ্রুতগামী ঘোড়সওয়াড়কে সামনে গিয়ে রেকী করে আসবার জন্য আদেশ দিচ্ছে।

দূর্গ এখান থেকে কমপক্ষে একঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত। ক্রমশ ঘনিয়ে আসা। অন্ধকারে আর অগ্রগামী দলটাকে সতর্ক থাকতে হবে সম্ভবত আরও বেশি যেনো কেউ তাদের দেখতে না পায়। তাদের ফিরে আসতে বেশ সময় লাগবে। পাহাড়ের শীর্ষভাগে বাবর আর তার লোকেরা যেভাবে অবস্থান করছে আর ঢালে ফিরে যেতে অনিচ্ছুক সেখানে নিজেদের উষ্ণ রাখতে বা খাবার রান্না করার জন্য আগুন জ্বালানোটা বোকামীর নামান্তর হবে। অবশ্য এমন না যে, তাদের সাথে পর্যাপ্ত রসদ রয়েছে। বাবর আরোগ্য লাভ করার পরের ছয় দিন তারা শিকারের অন্বেষণে এতটুকুও সময় নষ্ট করেনি বরং সমরকন্দ থেকে নিয়ে আসা শুকনো ফল, আপেল, পনির আর প্রায় গুড়ো হয়ে আসা রুটির উপরে নির্ভর করে কাটিয়েছে। বাবর একটা কম্বলে নিজেকে ভালমতো জড়িয়ে নিয়ে একটা শুকনো তরমুজের ফালি চিবুতে থাকে। ফালিটার মিষ্টত্ব তাকে রীতিমত বিরক্ত করে এবং সে সেটা মুখ থেকে ফেলে পানির বোতলে বড় একটা চুমুক দিয়ে মিষ্টির কারণে সৃষ্ট মুখের অরুচি দূর করতে চেষ্টা করে।

ভোর হবার দু’ঘণ্টা আগে তাদের পাঠানো রেকী ফিরে আসে। আর বাবর যেমনটা আশা করেছিলো পরিস্থিতি ঠিক ততোটাই খারাপ। দূর্গের ফটক বন্ধ আর প্রচুর পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নদীর পাশের তৃণভূমিতে আগুন পোহাতে থাকা এক পশুপালক আর তার দু’ছেলেকে পেয়েছিল তার স্কাউটরা, বেচারা তাদের দেখে এতটাই ভড়তে গিয়েছিলো যে গড়গড় করে তারা যা জানতে চেয়েছিলো সব বলে দিয়েছে। যাযাবর গোষ্ঠীর অনেক নেতাই বাবরের সৎ-ভাইকে সমর্থন দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সমরকন্দের বাইরে কৃষকের স্ত্রীকে ধর্ষণ আর তার শস্য চুরির অপরাধে যে গোত্রপতির লোকদের সে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলো তারা বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দিয়েছে জানতে পেরে বাবর মোটেই অবাক হয় না। আর জাহাঙ্গীরের দাদাও তার সাথে রয়েছে। রোক্সানা আর তার ছেলেকে দূর্গে নিয়ে এসেছিলো যে আপাত নির্বিরোধী বুড়ো লোকটা বাবর তার কথা ভাবে। তাদের আশ্রয় দেয়াটাই তার ভুল হয়েছিলো। কিন্তু এছাড়া তার আর কিইবা করার ছিলো? জাহাঙ্গীর তার সৎ-ভাই। রক্ত রক্তই।

ইউসুফ, তার বাবার সময়ের সেই মোটাসোটা কোষাধক্ষ্য, সাথে বাবা কাশকা, শাহী বাজারসরকার, এবং তার খর্বকায় অস্থিরচিত্ত শাহী জ্যোতিষী বাকী বেগও তার সৎ-ভাইয়ের সাথে যোগ দিয়েছে শুনতে পেয়ে সে মোটেই অবাক হয় না- বাবর যদিও তাদের প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু তাদের বাধ্য করেছিলো লাভজনক শাহী পদ থেকে ইস্তফা দিতে।

বোন, আম্মিজান আর কথা তার মনে ভিড় করে। অগ্রগামী দল তাদের কোনো খবর জানতে পারেনি। নিজের অক্ষমতাকে সে অভিশাপ দেয়। সে নিজে আর সাথের দু’ডজন দেহরক্ষী আর কিইবা করতে পারে? তার মূল বাহিনী এসে পড়া পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতেই হবে।

সূর্য উঠতে বেশতর পাহাড়ের শীর্ষদেশে জমে থাকা বরফ স্ফটিকের মত চমকাতে থাকলে বাবর তার আলখাল্লা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ইশারায় সে একা থাকতে চায় বলে তারা যেখানে ছাউনি ফেলেছে সেই টিলা বেয়ে উঠতে শুরু করে। তার পায়ের নিচের শিশির সিক্ত পান্না সবুজ ঘাস বেশ পিচ্ছিল। বেশ তাজা আর মিষ্টি একটা গন্ধ। কিন্তু অচিরেই শীত নামবে আর এই ঢাল তখন জমে শক্ত আর সাদা হয়ে উঠবে। ভাবনাটা তাকে বিচলিত করে তোলে। শীতকালে সে কিভাবে অভিযান পরিচালনা করবে?

পূর্ব থেকে বয়ে আসা বাতাসে শীতের কাঁপন স্পষ্ট। একটা পাথরের আড়ালে বসে বাবর তীক্ষ্ণ চোখে সামনের ভূখণ্ডের দিকে তাকিয়ে থাকে, যার প্রতিটা ঢাল সে এতো ভালো করে চেনে যে সেগুলোকে তার নিজের দেহের একেকটা অংশ বলে মনে হয় সবুজ তৃণভূমির প্রতিটা বিস্তার, প্রতিটা খাড়া ঢাল বিশিষ্ট উপত্যকার ধূসর পাথরের বিন্যাস, পর্বতের আঁকাবাঁকা চূড়া আর জাক্সারটাসের বাঁক। সর্বস্ব হারাবার বেদনা তাকে উদ্বেল করে তুললে সে মাথা নিচু করে বসে থাকে।

নির্মেঘ, উজ্জ্বল আকাশের অনেক উঁচুতে সূর্য উঠে আসবার পরে বাবর পশ্চিম থেকে ঘোড়ার অস্পষ্ট পায়ের শব্দ ভেসে আসতে শুনে। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে সে ঘুরে পেছনে তাকায় এবং অশ্বারোহী বাহিনীর একটা লম্বা সারিকে দূর থেকে উপত্যকার ভিতর দিয়ে এগিয়ে আসতে দেখে। চোখ কুঁচকে তাকিয়ে, সে গুনতে চেষ্টা করে সম্ভবত দুইশো হয়তো আরো বেশি এবং সবুজ নিশানের একটা ঝলক সে দেখতে পায়। নিঃসন্দেহে এটা বাইসানগারের পাঠান অগ্রগামী দল।

নিজের ভেতরে নতুন শক্তির একটা স্ফুরণ অনুভব করে। হতাশা ঝেড়ে ফেলে সে ঘুরে দাঁড়ায় এবং পাহাড়ের পাদদেশে স্থাপিত অস্থায়ী ছাউনির দিকে হোঁচট খেতে খেতে নেমে আসে। “ওয়াজির খান, আমাদের বাহিনী এসে পৌঁছেছে।” ছাউনিতে দৌড়ে প্রবেশের ফাঁকে সে চিৎকার করে ঘোষণা করে।

“আপনি নিশ্চিত তারা আমাদেরই লোক?”

“আমি নিশ্চিত। সমরকন্দের সবুজ নিশান তারা বহন করছে।”

“সুলতান, আমি পথ দেখিয়ে তাদের এখানে নিয়ে আসবার জন্য একটা অভ্যর্থনা বাহিনী পাঠাচ্ছি।”

কম্পিত হৃদয়ে বাবর তার লোকদের একটা অংশকে এগিয়ে যেতে দেখে। এবার দূর্গ থেকে অপদার্থ নচ্ছাড়গুলোকে তাড়িয়ে দেবো। তামবাল তার বিশ্বাসঘাতকতার জন্য পস্তাবে এবং তার সাথে বাকি সবাই… বাবর পর্যাণ থেকে তার আব্বাজানের তরবারিটা বের করে আনে। খাপ থেকে সেটা বের করতে বটের চুনি সূর্যের আলোতে ঝলসে উঠে। হাতে নিয়ে তরবারিটার ওজন পরখ করতে তার ভালোই লাগে এবং মানসপটে সে তামবালের ভোলা ঘাড়ে সেটা সে এককোপে নামিয়ে আনতে দেখে, ফারগানা শাসনের প্রথম দিনে সে কামবার আলির ঘাড়ে যেভাবে এটা নামিয়ে এনেছিলো।

অচিরেই বাইসানগারকে সামনে নিয়ে অভ্যর্থনাকারী বাহিনী ফিরে আসে।

বাবর সামনে এগিয়ে যায়। শিরোস্ত্রাণের নিচে বাইসানগারকে বিধ্বস্ত দেখায়। “মূল বাহিনী কখন এসে পৌঁছাবে? তারা কি অনেক দূরে রয়েছে?”

উত্তর দেবার আগে বাইসানগার এক মুহূর্ত ইতস্তত করে। “সুলতান, মূল বাহিনী। বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই।”

বাবরের চোখের আশার আলো যেন দপ করে নিভে যায়। “কি বলতে চাইছো?”

“আপনার চাচাতো ভাই, কুন্দুজের মাহমুদ, সমরকন্দ অবরোধ করেছিলো। তামবালের সাথে সে নিশ্চয়ই আগেই পরিকল্পনা করেছিলো এবং নিজের বাহিনীকে সেভাবে প্রস্তুত রেখেছিলো। অগ্রগামী বাহিনীকে সাথে নিয়ে আমি শহর ত্যাগ করা পর্যন্ত সে অপেক্ষা করেছে। তারপরেই আক্রমণ শানিয়েছে। গ্রান্ড উজিরের কয়েকজন প্রাক্তন পারিষদ যাদের উজিরের কন্যা, মাহমুদের স্ত্রী, বার্তাবাহকদের মাধ্যমে প্রচুর বখশিশের লোভ দেখিয়ে দলে টেনেছিল, তারা তাকে ভেতর থেকে সাহায্য করেছে। আমরা পাঁচদিন পথ চলার পরেই কেবল বার্তাবাহক সমরকন্দ পতনের সংবাদ নিয়ে আমার কাছে পৌঁছে। আমি দুঃখিত সুলতান। আমি আমার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি।”

“মাহমুদ…” বাইসানগারের কথা যেনো বাবর বিশ্বাস করতে পারে না। তার সারা জীবনের পরিচিত, যাকে সে বন্ধু মনে করতো, তার সেই ভাই- যাবো স্ত্রীকে সেই তাকে উপহার হিসাবে পাঠিয়েছে। এভাবে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে এটা যে অবিশ্বাস্য। “আলি মজিদ বেগের কি অবস্থা?”

“সুলতান তিনি মৃত। সবুজাভ তোরণদ্বারে এখন উজিরের বদলে তার মৃতদেহ ঝুলছে এবং তার সাথে আপনার প্রতি বিশ্বস্ত আরো অনেকেই মারা গিয়েছে।” বাবর ঘুরে দাঁড়ায়, চাচাত ভাইয়ের প্রতি বিতৃষ্ণা এবং অনুগত আলী মজিদ বেগের মৃত্যু তাকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। একই সাথে অন্য আরেকটা ব্যাপারে তার মন ধাতস্থ হতে চায় তার এই সর্বস্ব হারাবার ব্যাপকতা। সমরকন্দ সে ঠিক কতোদিন শাসন করেছিলো। একশ দিন…? আর এখন সে সালতানাহীন এক সুলতান, ফারগানাও তার হাতছাড়া হয়েছে। তার মরহুম আব্বাজানের তরবারি এখনও সে হাতে ধরে রেখেছে এবং বাঁটের নিরেট অনুভূতি তাকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেয়। বাঁটটা আরো শক্ত করে ধরে সে নিজেকে প্রতিশ্রুতি দেয় এটা তার নিয়তি হতে পারে না। এটা সে কিছুতেই হতে দেবে না। যতো সময়ই লাগুক, যতো রক্তপাত প্রয়োজন হোক, সে নিজের অধিকার আবার আদায় করে নেবে। তাকে যারা অপমানিত করেছে সবাইকে তার মূল্য শোধ করতে হবে।

২.১ দ্বিতীয় খণ্ড – সালতানাৎবিহীন এক সুলতান

দ্বিতীয় খণ্ড – সালতানাৎবিহীন এক সুলতান

০৭. আয়োধন আর অন্তর্ধান

বৃষ্টি আর তুষারপাতের মিশ্রণের প্রকোপ বাবরের ভেড়ার চামড়ার প্রলেপ দেয়া ভারী জ্যাকেটের আবরণও আটকাতে ব্যর্থ হয়। ফারগানার উত্তরে উঁচু পর্বতমালার অভ্যন্তরে এক প্রত্যন্ত উপত্যকার ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনীর তীরের প্রায় কাদা হয়ে থাকা বরফের ভিতর দিয়ে তার অবশিষ্ট লোকদের সামনে থেকে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে চলেছে, বৃষ্টি আর তুষারপাতের হাত থেকে বাঁচতে মাথা নিচু করে রাখা।

নিজের দুটো সালতানাই হারিয়েছে এটা অনুধাবন করার পরের প্রথম দিকের মুশকিল দিনগুলোতে, বাবর আকশি দূর্গের আশেপাশেই থাকবে বলে ভেবেছিলো আশা করেছিলো সব কিছু বাজি রেখে হলেও সে তার পরিবারকে মুক্ত করতে পারবে। ওয়াজির খান অনেক কষ্টে তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, তার শত্রুরাও এমনই একটা মরীয়া প্রচেষ্টা আশা করছে আর তারা সেজন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। ওয়াজির খান, তার চিরাচরিত পিতৃসুলভ ভঙ্গিতে তাকে আশ্বস্ত করে পরামর্শ দিয়েছে, “আপনি যদি আপনার আম্মিজান, নানীজান আর বোনকে বাঁচাতে চান তাহলে নিজেকে বিপদের মুখে না ফেলে বরং শত্রুদের তটস্থ করে তুলেন, যাতে তারা আপনার নাম শুনলেই ভয় পায়। আর সেটা করতে হলে তাদের চাপের ভিতরে রাখেন। এখানে সেখানে তাদের আক্রমণ করে, আপনার বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশ করবার আগেই সেখান থেকে সরে আসেন। ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে সবসময়ে একটা ভীতির সঞ্চার করতে থাকেন। আপনার শত্রুরা যাতে শান্তিতে ঘুমাতে না পারে। আর এটা করতে পারলেই সুলতান, তারা আপনার পরিবারের ক্ষতি করার কথা চিন্তাও করতে পারবে না।”

বাবর ওয়াজির খানের বক্তব্য মোটের উপরে বুঝতে পারে। সাবধানে বিবেচনা করে, সে একটা পরিকল্পনার কথা বলে। আমাদের একটা নিরাপদ আশ্রয়স্থল চাই। যেখানে আমরা শীতকালটা কাটাতে পারবো এবং প্রথম হামলার ছক কষতে পারবো। আমার মনে আছে যে প্রতিবার গ্রীষ্মের সময়ে সামরিক প্রশিক্ষণের অংশ হিসাবে আপনি একবার আমাকে উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলে একটা অভিযানে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং উপত্যকার কেন্দ্রস্থলে একটা মাটির দূর্গে আমরা অবস্থান করেছিলাম। তামবালের অনুগত এক জায়গীরদার সেই নগণ্য সেনাছাউনির প্রধানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো। সেই দূর্গটা আমাদের জন্য চমৎকার আশ্রয়স্থল হিসাবে প্রতিপন্ন হতে পারে। কারো মাথাতেই বিষয়টা আসবে না। আপনি কি বলেন?”

“জায়গার কথা আমার মনে আছে। বাস্তবিকই প্রত্যন্ত অঞ্চলে দূর্গটা অবস্থিত, আর আমাদের উদ্দেশও হাসিল হবে।”

আর সে জন্যই সে ওয়াজির খানকে নিয়ে পাহাড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিলো। তাদের সাথে কেবল দুশো লোক ছিলো। ওয়াজির খানের সাহায্যে বাবর অনেক যত্ন নিয়ে তাদের বাছাই করেছে, সে কেবল তাদেরই বাছাই করেছে যাদের বয়স অল্প আর কোনো পারিবারিক পিছুটান নেই বা বাইসানগারের মতো যারা তার বিশ্বস্ত অন্তরঙ্গ। বাকি সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে, তার ডাকের অপেক্ষা করতে বলেছে, যা তারা নিশ্চিতভাবেই পাবে। তাদের যাত্রার দ্বিতীয় সপ্তাহে তুষারপাত শুরু হয় এবং উচ্চতা বাড়বার সাথে সাথে তুষারের স্তর বৃদ্ধি পেয়ে তাদের যাত্রাকে শ্লথ করে তুলেছে।

“ওয়াজির খান, আপনার কি মনে হয় আমরা দূর্গ থেকে কতোটা দূরে অবস্থান করছি?”

“সুলতান, আবহাওয়া যদি এতোটা বিরূপ না হতো, আমরা তাহলে দূর্গটা এতক্ষণে দেখতে পেতাম। অবশ্য সুবিধাও হয়েছে, দূর্গের নিরাপত্তা রক্ষীরা আমাদের আগে থেকে দেখতে পাবে না। দূরের ঐ গাছগুলোর আড়ালে আমরা অবস্থান নেবো আর সামনেটা রেকী করার জন্য গুপ্তদূত পাঠিয়ে আমরা পর্যাণে যেটুকু শুকনো মাংস রয়েছে সেটা দিয়ে আহার সেরে নেবো।”

তাদের পাঠানো গুপ্তদূতেরা রেকী করে ফিরতে যে নব্বই মিনিট সময় লাগে তার পুরোটা সময়ই অবিশ্রান্তভাবে তুষারপাত হয়। কখনও ভারী বা কখনও হাল্কাভাবে। তার লোকেরা ফিরে আসতে দেখা যায়, ঘোড়া আর তার আরোহী তুষারে পুরো ঢেকে গেছে এবং গুপ্তদূতদের দলনেতা ঠাণ্ডায় নীল হয়ে আসা ঠোঁটে কোনোমতে কথা বলে। “এখান দু’মাইল দূরে একটা বাকের পরেই দূর্গটা অবস্থিত। দূর্গের বাইরে আমরা কোনো ঘোড়ার বা পায়ের ছাপ দেখতে পাইনি যাতে বোঝা যায়, আজ ভেতর থেকে কেউ টহল দিতে বা পর্যবেক্ষণ-ফাঁড়িতে যায়নি। আমরা যখন ঘোড়া থেকে নেমে দূর্গের কাছে এগিয়ে যাই, দূর্গের এক অংশ থেকে আমরা ধোয়া উঠতে দেখেছি- সম্ভবত রসুইখানা- কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দূর্গের মূল ফটক তখন ভোলা ছিলো। স্পষ্টতই এই আবহাওয়ায় কেউ আক্রমণ করতে পারে সেই ব্যাপারটা তাদের মাথাতেও নেই।”

“চমৎকার, শীঘ্রই তাদের এই নিশ্চয়তা নরকে পরিণত হতে চলেছে। ওয়াজির খান, এটা ইতস্তত করার সময় না, সবাইকে এই মুহূর্তে প্রস্তুত হতে বলুন এবং তুষারপাতের মাঝে আমরা আত্মগোপন করে গুপ্তদূতদের সহায়তায় দূর্গে পৌঁছাবার পথের শেষ বাঁকে দ্রুত আর নিরবে গিয়ে হাজির হবো। সেখান থেকে মূল ফটকের উদ্দেশ্যে ঘোড়া দাবড়ে যাবো।”

ওয়াজির খান মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় এবং পাঁচ মিনিট পরে অশ্বারোহী বাহিনীর একটা সারিকে মন্থর গতিতে পাহাড়ী পথ বেয়ে উপরের দিকে উঠে যেতে দেখা যায়। তুষারাবৃত প্রেক্ষাপটের মাঝ দিয়ে প্রায় দু’মাইল এগিয়ে যায়। তুষারপাত এখন আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে। বাবরের চোখের সামনে একটা পাথুরে অবয়ব ভেসে ওঠে। দূর্গটা আর মাত্র হাজারখানেক গজ সামনে অবস্থিত। এখান। থেকে দূর্গ পর্যন্ত রাস্তাটা বেশ প্রশস্ত।

“আমরা এখান থেকেই আক্রমণ শুরু করবো। লোকদের বলেন অপ্রয়োজনীয় সবকিছু এখানে পাথরের আড়ালে রেখে কেবল হাতিয়ার নিয়ে প্রস্তুত হতে। যাতে বরফের উপর দিয়ে যতোটা সম্ভব দ্রুত ঘোড়া দাবড়ে আমরা দূর্গে পৌঁছাতে পারি।” তার লোকেরা নিরবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। কিন্তু তারা প্রস্তুত হতে হতে তুষারপাত একেবারে বন্ধ হয়ে যায় এবং সামনে- সাদা প্রেক্ষাপটের মাঝে একটা কালো আকৃতির মত দূর্গটা ভেসে উঠে।

“যারা প্রস্তুত, ঘোড়ায় আরোহন করো! কারো চোখে পড়ে যাবার আগেই আমাদের আক্রমণ করতে হবে!” বাবর চিৎকার করে কথাটা বলার ফাঁকে ময়ান থেকে আলমগীর বের করে আনে। সে লাফিয়ে জিনের উপরে উঠে বসে এবং তার বিশাল কালো ঘোড়াটাকে দূর্গের দিকে এগোতে বলে পেটে খোঁচা দেয় যার ফটক সে খোলা দেখতে পেয়েছে। দশজন যোদ্ধা পরিবেষ্টিত অবস্থায় এবং বাকীরা তার পেছনে সারিবদ্ধভাবে বিন্যস্ত। ঘোড়ার কাধ ধরে ঝুঁকে ছুটে যাবার সময়ে বাবর টের পায় তার কানে রক্তের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। দূর্গের ফটক থেকে সে যখন মাত্র দুশো গজ দূরে, তখন ভেতর থেকে একটা চিৎকার তার কানে ভেসে আসে- শত্রুরা তাদের দেখে ফেলেছে। ভেতরের লোকেরা বিপদ টের পায়। তারা ফটকের পাল্লা বন্ধ করার চেষ্টা করতে সেটা কেঁপে উঠে। কিন্তু নতুন জমা বরফ পাল্লা নড়তে বাধা দেয়। দু’জন লোক বাইরে ছুটে আসে, বরফের স্তূপে লাথি দেয় এবং বৃথাই চেষ্টা করে পাল্লাটা বরফের উপর দিয়ে সরাতে।

“ব্যাটাদের পেড়ে ফেলো!” বাবর হুঙ্কার দিয়ে বলে। কিন্তু ঘোড়ার গতি বিন্দুমাত্র হ্রাস করে না। নিমেষের ভিতরে সে একজনকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে, একটা তীর তার গলায় বিদ্ধ হয়েছে। একই সাথে সে নিজেও দূর্গের তোরণদ্বারের কাছে পৌঁছে যায়। দ্বিতীয় লোকটাকে সে আলমগীর দিয়ে একটা কোপ বসিয়ে দেয়। টের পায় তার তরবারি জায়গা মতোই নরম মাংসপেশীতে কামড় বসিয়েছে। কিন্তু কোথায় সেটা দেখবার জন্য সে ঘোড়ার গতি একটুও হ্রাস করে না। তার বদলে, সে তার হাতে ধরা লাগামে একটা ঝাঁকি দিয়ে ঘোড়ার মাথা তখনও আংশিক খোলা ফটকের দিকে ঘুরিয়ে দেয়। বিশাল কালো ঘোড়াটা নাক দিয়ে একটা শব্দ করে এবং বাবর টের পায় ঘোড়াটার একটা পা পিছলে গেছে কিন্তু কালো পাহাড় ঠিকই ঘুরে দাঁড়ায়। একই সাথে তার পেছনে তিনজন যোদ্ধা এসে হাজির হয়।

কিন্তু চতুর্থজন ঢুকতে ব্যর্থ হয়। ভেতরে প্রবেশপথ আটকে ঘোড়া আর তার আরোহীর ভূপাতিত হবার শব্দ বাবর শুনতে পায়। সে দূর্গের ভিতরে প্রবেশ করেছে বটে। কিন্তু তাকে সহায়তা করবার জন্য মাত্র তিনজন যোদ্ধা তার সাথে রয়েছে। চারপাশে তাকালে সে সারি সারি স্থাপিত উঁচু দরজার পেছন, সম্ভবত দূর্গের প্রধান সেনানিবাস থেকে পিলপিল করে লোকজনকে বের হয়ে আসতে দেখে। কেউ কেউ ইস্পাতের বর্ম গায়ে চাপাতে ব্যস্ত। আর বাকিরা ইতিমধ্যে অস্ত্রধারণ করেছে।

“আমার সাথে এসো! এখনই আক্রমণ করতে হবে!” বাবর পেটে খোঁচা দিয়ে পুনরায় তার ঘোড়ার গতি বৃদ্ধি করে। আর একটু পরেই তাকে তার তিনজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে আতঙ্কিত লোকগুলোকে কচুকাটা করতে দেখা যায়। সহসা একটা লম্বা লোক বাবরের নজর কাড়ে, যাকে দেখে সেনাপতিদের একজন বলে মনে হয়। ব্যাটকে মাথা নিচু করে পুনরায় ঘরের ভিতরে প্রবেশ করতে দেখলে সেও ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। কাঠের সরদলের নিচে দিয়ে ঝুঁকে পার হয়ে সে ভেতরের আধো অন্ধকারে চোখ পিটপিট করে প্রবেশ করতে যে বিশ ত্রিশজন সেখান থেকে বের হয়ে এসেছে, বুঝতে হবে সেটাই এই দূর্গের মোট জনবল। কেবল সেনাপতিগোছের লোকটাই এখন ভেতরে রয়েছে। লোকটা দৌড়ে একটা অস্ত্র সজ্জিত তাকের দিকে ছুটে গিয়ে সেখান থেকে একটা বর্শা আর ঢাল তুলে নিয়ে বাবরের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।

“ফারগানার ন্যায়সঙ্গত সুলতান, আমি বাবর তোমাকে আদেশ দিচ্ছি অস্ত্র নামিয়ে রাখো।”

“আমি আত্মসমর্পন করবো না। তোমাকে আমি সুলতান বলে মানি না। আমার নাম হানিফ খান। আমি তামবালের প্রতি অনুগত, সেই এখন পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। পারলে সম্মুখ যুদ্ধে আমাকে পরাস্ত করো।”

বাবর তার কালা পাহাড়ের উপর থেকে লাফিয়ে নামে এবং আলমগীর হাতে ধরা অবস্থায় হানিফ খানের দিকে এগিয়ে যায়। যে তক্কে তক্কে ছিলো বাবর তার। কাছাকাছি যেতেই হাতের বর্শা দিয়ে সে বাবরকে আঘাতের চেষ্টা করে। বাবর লাফিয়ে একপাশে সরে যায়। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে অর্ধভুক্ত খাবারে ভর্তি একটা নিচু টেবিলের পায়ার সাথে তার বাম পা আটকে যায়। বেকায়দা ভঙ্গিতে সে টেবিলের উপরে আছড়ে পড়ে। টেবিলের উপরে থাকা কাঠের পেয়ালা আর তার ভেতরের খাবার ছিটকে ফেলে। মাংসের সুরুয়া অর্ধেকটা ভর্তি একটা বিশাল ধাতব পাত্রের মুখে তার তরবারি ধরা হাতের কব্জি আটকে যেতে, আলমগীর তার মুঠো থেকে ছুটে যায়।

হানিফ খান বাবরের অসহায় অবস্থার সুযোগে তাকে একেবারে শেষ করে দেবার জন্য ছুটে আসে। তার বর্শাটা দু’হাতে মাথার উপরে তুলে বাবরের উন্মুক্ত গলায় সেটা সর্বশক্তিতে নামিয়ে আনবে। বাবর একটা কাঠের বড় বারকোশ তখন তুলে নিয়ে সেটাকে ঢালের মত ব্যবহার করে। বর্শা বারকোশে বিদ্ধ হয়। তবে সেটাকে ছিন্ন করতে পারে না। ছিটকে পড়া খাবারের উষ্ণ চটচটে সুরুয়ার ভিতরে গড়িয়ে একপাশে সরে যাবার সময়ে সে বারকোশটা ফেলে দিয়ে বর্শার হাতল ধরে মোচড় দেয় এবং হানিফ খানের হাত থেকে সেটা টেনে নেয়।

বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে হানিফ খান, লাফিয়ে পেছনে সরে গিয়ে কোমরের পরিকর থেকে একটা সরু খঞ্জর টেনে বের করে। আলমগীর কোথায় পড়েছে সেটা দেখার সময় নেই বাবরের, হাতের বর্শাটা দিয়ে সে লোকটাকে সজোরে আঘাত করলে ফলার মাথায় আটকানো বারকোশটা খুলে পড়ে। আর একই সময়ে, নিজের গালে সে একটা তীক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভব করে। হানিফ খান বাবরের গলা লক্ষ্য করে খঞ্জরটা চালিয়েছিলো কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। বাবর এবার বশার ফলাটা সজোরে তাকে লক্ষ্য করে আঘাত করে হানিফ খান একপাশে ঘুরে আঘাতটা এড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু ফলাটা তাকে বামদিকে স্পর্শ করলে সে টেবিলের পাশে রাখা শক্ত কুশনের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাবর এবার বর্শাটা মোচড় দেয় এবং মুহূর্ত মাত্র চিন্তা না করে প্রতিপক্ষের কণ্ঠনালী লক্ষ্য করে সজোরে বর্শাটা নামিয়ে এনে গালিচার উপরে তাকে গেথে ফেলে। যা অচিরেই ফিনকি দিয়ে রক্তে ভিজে লাল হয়ে যায়।

ইতিমধ্যে ওয়াজির খান, বাইসানগার আর বাকী লোকেরা এসে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে তার সাহসিকতার জন্য তাকে শুভেচ্ছা জানায়। দূর্গটা এখন তাদের দখলে। ফারগানা উদ্ধারের বন্ধুর পথে সে মাত্র প্রথম পদক্ষেপটা সাফল্যের সাথে রেখেছে। বাইরে বের হয়ে এসে বাবর দেখে আবার তুষারপাত শুরু হয়েছে। শত্রুর পড়ে থাকা দেহের চারপাশের লাল রঙ ইতিমধ্যে অনেকটাই ঢাকা পড়েছে। একটু আগে তামবালের চামচার ভবলীলা সে যেভাবে সাঙ্গ করেছে, সেভাবে পালের গোদাটাকে কখন মুঠোর ভেতরে পাবে সেই মুহূর্তটার জন্য সে অধীর হয়ে রয়েছে।

*

আর এভাবেই পুরো ঘটনাটার সূচনা হয়। বাবর একজন হানাদারে পরিণত হন। ঝটিকাবেগে আক্রমণ করেন এবং ফিরে যাবার সময় প্রতিবারই মৃত শত্রুর কারো একজনের মুখে রক্ত দিয়ে নিজের নাম লেখা একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে যান। আর তার সাফল্য ক্রমশ বাড়তে থাকে। তার বাহিনীর সংখ্যা, মিষ্টি কথা আর মধুর প্রতিশ্রুতি, সেই সাথে শক্তি বা তার অভিযানে প্রাপ্ত সম্পদের বিচক্ষণ ব্যবহার নতুন সমর্থকদের আকৃষ্ট করে এবং প্রতিপক্ষকে দলে টেনে, ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। মাটির দূর্গ দখলের বিশ মাসের মধ্যে, নিষ্ঠা আর একাগ্রতার সাথে একটার পরে একটা ছোট দূর্গ আর গ্রামের পর গ্রাম দখল করে ফারগানার পশ্চিমাঞ্চলের অধিকাংশই সে দখল করে নেয়। তার কৌশল কার্যকরী বলে প্রতীয়মান হয়। তামবাল আকশির উত্তর বা পশ্চিমে বাবরের শক্ত ঘাঁটির দিকে বেশিদূর অগ্রসর হবার মতো সাহস দেখায় না। আর বাবরও মনে করে এবার সময় হয়েছে নিজের দাবির কথা প্রকাশ করবার।

প্রথম দাবিটা সে ছয়মাস আগে জানায় এবং তারপরে প্রায়শই তার পুনরাবৃত্তি করেছিলো তার আম্মিজান, নানীজান আর বোনের মুক্তির বদলে এক বছর আকশি দূর্গ আক্রমণ না করবার প্রতিশ্রুতি। তিনমাস আগে তামবাল এক বার্তাবাহকের মাধ্যমে প্রেরিত এক চিঠিতে অনেক মধুর ভাষায় জানায় এসান দৌলত, খুতলাঘ নিগার আর খানজাদা প্রত্যেকেই সুস্থ আছে এবং শাহী পরিবারের উপযুক্ত ব্যবহারই করা হচ্ছে তাদের সাথে। কিন্তু চিঠিতে সে তাদের মুক্তি দেবার তার কোনো অভিপ্রায়ের কথা উল্লেখ করেনি।

বাবর এখন পূর্বদিকে পঞ্চাশ মাইল দূরে অবস্থিত শহর গাভার দিকে অগ্রসর হচ্ছে কিছুদিন আগে তামবাল ভাড়াটে চকরাখ যোদ্ধাদের সহায়তায় সেখানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে। সেখানে একটা হিসাব মেলানো এখনও বাকি আছে। সেখানকার দূর্গের চাকরাখ সর্দার তার সৎভাই আর তামবালকে শাহী প্রতিনিধি হিসাবে মেনে নিয়ে প্রথম আনুগত্য প্রদর্শনকারীদের অন্যতম। শহরটা দখল করলে তামবালকে আরেকটা জোরালো সঙ্কেত পাঠানো হবে যে, সময় হয়েছে বাবরের কাছে তার পরিবারকে ফেরত পাঠাবার।

এক ক্ষুদ্র নহরের পাশে সাময়িক যাত্রাবিরতি করে বাবর আর তার লোকেরা ঘোড়াগুলোকে পানি পান করার সুযোগ দেয়। ঘোড়ার দুধ থেকে তৈরি টক পনির কোনোক্রমে গলধঃকরণের ফাঁকে বাবর তাকিয়ে দেখে তার এক গুপ্তদূত ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে আসছে। বাবর চমকে উঠে দেখে তার পর্যানে একটা দেহ আড়াআড়িভাবে বাঁধা রয়েছে। লোকটার দিকে দৌড়ে গিয়ে বাবর চিৎকার করে জানতে চায়, “কি হয়েছিলো? এই লোকটা কে?”

“লোকটা একটা ব্যবসায়ী। পথের পাশে পেটে তরবারির আঘাত নিয়ে নিজেরই রক্তে অর্ধচেতন অবস্থায় পড়ে থাকার সময়ে তাকে আমি খুঁজে পেয়েছি। আমি তাকে আমার ঘোড়ার পিঠে তুলে নেবার কিছুক্ষণ পরেই বেচারা মারা যায়। অবশ্য মারা যাবার আগে সে আমাকে বলেছে যে আরও তিনজন ব্যবসায়ীর সাথে সে। এখান থেকে দশ মাইল দূরে একটা ছোট সরাইখানার উদ্দেশ্যে যাবার পথে তারা চকরাখ হানাদারদের হামলার শিকার হয়। তার তিন সঙ্গীকে হত্যা করে তাকেও মৃত ভেবে তাদের সব মালপত্র নিয়ে তারা চলে গেছে।”

“চকরাখ হানাদারদের অবশ্যই খুঁজে বের করে তার হত্যার আমরা বদলা নেবো। তোমার অধীনস্ত কয়েকজন গুপ্তদূতকে হত্যাকারীদের খুঁজতে পাঠাও।”

“সুলতান, আমার মনে হয় না তার কোনো দরকার আছে। বণিক লোকটা মারা যাবার আগে আমাকে বলেছে যে, সে চকরাখদের বলতে শুনেছে তারা সরাইখানায় যাচ্ছে, সেখানে আরও শিকার যদি তারা খুঁজে পায়…”

“তাহলে আমরা প্রথমে সরাইখানায় যাবো।”

***

গানের সুর বন্য আর কর্কশ চকরাখদের নিজেদের মতোই অনেকটা। মদের নেশায় চুরচুর হয়ে থাকা পুরুষদের কণ্ঠস্বর নতুন মাত্রায় উঠে এমন সব অশ্লীল ক্রিয়াকলাপের বর্ণনায় মেতেছে যা একাধারে শারিরীকভাবে অসম্ভব আর মোটাদাগের যে বাবর চেষ্টা করেও হাসি চাপতে পারে না। সে আড়চোখে ওয়াজির খানের দিকে তাকিয়ে দেখে সেও হাসছে।

লম্বা ঘাসের আড়ালে বাবর তার চারপাশে শুয়ে থাকা লোকদের ইশারা করে। সবাই। তারমতো পেটের উপরে ভর দিয়ে শুয়ে আছে, লুকিয়ে অপেক্ষা করছে। তারপরে সে গুঁড়ি মেরে মাটির ইট দিয়ে তৈরি একতলা সরাইখানার দিকে এগিয়ে যায় যেটা ফারগানার অন্যতম খরস্রোতা একটা নদীর অগভীর অংশের পাড়ে অবস্থিত। যেখানে হল্লাবাজেরা মচ্ছবে মেতেছে। নূপুরের নিক্কন ধ্বনি ভেসে আসতে বোঝা যায় ভেতরে বাইজি মেয়েরাও আছে। সেই সাথে কুপিত নারী কণ্ঠের সহসা একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার আর তার সঙ্গে ভেসে আসে- পুরুষ কণ্ঠের অট্টহাসি।

দুপুর মাত্র অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু বিশজন বা তার কিছু বেশি চাকরাখরা ইতিমধ্যেই বেহেড মাতাল হয়ে পড়েছে। তারা এমনকি তাদের ঘোড়াগুলিকে ঠিকমতো বাঁধার কষ্টও করেনি এবং কিছু ঘোড়া, যাদের কেশর পুরু আর লেজ এতো লম্বা যে মাটিতে ঘষা খাচ্ছে, ইতিমধ্যেই ছুটে পালিয়েছে। চারো ব্যবসায়ীর কাছ থেকে লুট করা মালামালও তারা ভিতরে নিয়ে যাবার গরজ দেখায়নি। বণিকদের মালবাহী ধুসর খচ্চরগুলো দড়ি দিয়ে একত্রে বাঁধা এবং মনোযোগ দিয়ে চরে বেড়াচ্ছে। তাদের পিঠে আটকানো বেতের ঝুড়িগুলো দেখে মনে হয় এখনও চামড়া আর লোমে ঠাসা। চাকরাখরা মনে হয় কেবল মদের পিপে নিয়ে সরাইখানার ভিতরে প্রবেশ করেছে।

বর্বর অসভ্য, বাবর ভাবে। তাদের কপালে আজ কি লেখা আছে সেটা এখনই ব্যাটারা টের পাবে। আর এই ভাবনাটা তাদের উৎফুল্ল করে তোলে। লম্বা ঘাসের উপরে মাথা তুলে বাবর চারপাশে তাকায়। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। সে ঠিক যেমনটা ভেবেছিলো, ঘোড়া বা মালামাল দেখার জন্য বাইরে কোনো বাচ্চাকে রাখার কথা ব্যাটাদের মাথাতেই আসেনি। সে এবার উঠে দাঁড়িয়ে, গুটিগুটি পায়ে সরাইখানার নীচু প্রবেশদ্বারের ডান দিকে মোটা দেয়ালের গায়ে জানালার মতো দেখতে একটা ফাঁকা জায়গার দিকে এগিয়ে গিয়ে ভেতরে সতর্কতার সাথে উঁকি দেয়। ঘরটা প্রায় খালি, কেবল ভেতরের দেয়ালের গায়ে ঠেকানো অবস্থায় একটা লম্বা কাঠের টেবিল দেখা যায়। কয়েকটা তেপায়া টুল আর একটা আধ ভাঙা বেঞ্চি দেখা যায়। ঘরের মাঝে মোটাসোটা, বোচা-নাকের একটা মেয়ে পরনে রঙচটা হলুদ রঙের ঢোলা সালোয়ারের উপরে লাল ফুলের ছাপ দেয়া একটা আঁটোসাঁটো কামিজ, পায়ে আর হাতের কব্জিতে ঘুঙুর বাঁধা। নীল সালোয়ার কামিজ পরিহিত লম্বা আরেকটা মেয়ে তার নোংরা হাতে একটা খঞ্জনী, বর্গাকার পাথরের মেঝের উপরে খালি পায়ে সজোরে পদাঘাত করে বৃত্তাকারে আবর্তিত হচ্ছে। সে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চকরাখদের কয়েকজন, ভেড়ার চামড়ার তৈরি টুপির নিচে তাদের গোলাকার মুখ ঘামে ভিজে আছে, টলোমলো পায়ে মেয়েদের বুকে পাছায় বৃথা চেষ্টা করে থাবা দিতে এবং মুখ থুবড়ে মাটিতে আছড়ে পড়লে তাদের সঙ্গীসাথীদের উদ্দীপনা আরও বেড়ে যায়।

এক কোণে ধোঁয়া উঠতে থাকা অগ্নিকুণ্ডের উপরে বিশাল একটা কেতলি ঝুলতে দেখা যায়। আরেক কোণে, বাবর এক চকরাখ দুবৃত্তকে কাপড় খুলে ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাল্কা হতে দেখে, দুর্গন্ধে তার সঙ্গীসাথীদের আপাতভাবে কোনো অসুবিধা হয় না। আরেক বদমাশ উঠে দাঁড়িয়ে হলুদ বমি বৃত্তচাপ তৈরি করে ছুঁড়ে ফেলে আবার বসে পড়ে আর মনোযোগ দিয়ে জামার হাতায় পড়া বমির ফোঁটা বড়বড় নখ দিয়ে টুসকি দেয়। বাবর পুনরায় মাথা নামিয়ে নেয়। সে যা দেখার তা দেখে নিয়েছে।

মাটিতে গুঁড়ি দিয়ে সে পুনরায় ওয়াজির খান যেখানে আছে সেখানে ফিরে আসে। “মদ্যপ আহাম্মকগুলো আমাদের হাতে মারা যাবার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। ব্যাটারা তাদের তরবারি আর ঢাল পর্যন্ত দরজার কাছে স্তূপ করে রেখেছে।”

ওয়াজির খানের একটা ক্ৰ উপরে উঠে যায়। “সুলতান, এখনই?”

“হ্যা!”

বাবর আর ওয়াজির খান উঠে দাঁড়িয়ে তাদের লোকদেরকেও উঠে দাঁড়াবার ইশারা করে। তারা এই কাজটা আগে এতোবার করেছে যে, মৌখিক আদেশের আর কোনো প্রয়োজন হয় না। ঠোঁটের উপরে আঙ্গুল চেপে, ওয়াজির খান ইশারায় ঘুরে কয়েকজনকে সরাইখানার পেছনে যেতে বলে। যদি সেখান দিয়ে পালাবার কোনো পথ থেকে থাকে। তারপরেই কেবল বাবর তার প্রিয় রণহুঙ্কারে চারপাশ প্রকম্পিত করে: “ফারগানা!”

বাবর একেবারে সামনে থেকে তার লোকদের নেতৃত্ব দেয়। মদের নেশায় মাতাল আর বিস্ময়ে আড়ষ্ঠ চকরাখরা সামান্যই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। বাবর আর তার লোকেরা নির্মমভাবে প্রতিপক্ষের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লে বোঁচা-নাকের সেই মেয়েটার কাছ থেকেই কেবল বলার মতো প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। মেয়েটা তার কাচুলির ভিতর থেকে একটা খঞ্জর বের করে এবং বাবরের বাহুতে সেটা মরিয়া ভঙ্গিতে গেথে দিতে চাইলে, বাবর অনায়াসে তার ঘুঙুর পরা হাতের কব্জি ধরে এবং তাকে ঘুরিয়ে দিয়ে তার নধর নিতম্বে বুট দিয়ে একটা সপাট লাথি বসিয়ে দিতে বেচারী ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে।

কয়েক মিনিটের ভিতরে সবকিছু শেষ হয় এবং বাবরের লোকদের হাঁপিয়ে ওঠার আগেই নিজেদের তরবারির ফলা পরিষ্কার করে কোষবদ্ধ করতে দেখা যায়। তার লোকদের গায়ে একটা আঁচড়ও লাগেনি। অবশ্য তার লোকদের সবাই পোড়খাওয়া যোদ্ধা, এসব মদ্যপ মাতালদের চেয়ে অনেক দক্ষ লোকদের সাথে তারা আগে লড়াই করেছে। “লাশগুলো বাইরে নিয়ে যাও দেখা যাক আমরা কাদের হত্যা করেছি,” বাবর আদেশটা দিয়ে কৃতজ্ঞচিত্তে দ্রুত পূতিগন্ধময়, ধোঁয়াটে ঘরটা থেকে বাইরের খোলা বাতাসে বের হয়ে আসে।

তার লোকেরা চকরাখদের লাশগুলি তাদের বুট-পরা পা ধরে হেঁচড়ে বাইরে এনে সারিবদ্ধভাবে সাজালে, বাবর লাশগুলো শুনে দেখে। মোট পনেরটা লাশ। কারো গলা দুভাগ হয়ে আছে, কোনোটা আবার কবন্ধ। তার লোকেরা অবশ্য কাটাপড়া মাথাগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। কোনোটার মাথায় তখনও ভেড়ার চামড়ার টুপি রয়েছে। কাটা মুণ্ডগুলোর দিকে তাকিয়ে যখন বাবর একটা বিশেষ মুখ চিনতে পারে, তখন তার মুখ থেকে সন্তুষ্টিসূচক একটা শব্দ ধ্বনিত হয়। তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এমন সব চকরাখকে সে হত্যা করবে বলে মনস্থ করেছে। এবং প্রতিটা হত্যাযজ্ঞ যা তাকে তার লক্ষ্যের নিকটবর্তী করছে প্রচণ্ড তৃপ্তিদায়ক।

তারস্বরের চিৎকার শুনে বাবর ঘুরে তাকায়। তার দু’জন যোদ্ধা বাইজি মেয়েদের ধরে তাদের টেনে সরাইখানার বাইরে বের করে আনে। “তাদের উপরে বল প্রয়োগ করবে না। আমার আদেশ তোমরা জানেনা। অর্থের বিনিময়ে যদি তারা স্বেচ্ছায় তোমাদের সঙ্গ দিতে রাজি হয় তবে সেটা আলাদা কথা।” কথাটা বলে বাবর আবার ঘুরে দাঁড়ায়।

দেখা যায় মেয়েগুলো আদতেই ব্যবসায়ী এবং কয়েক মুহূর্তের দ্রুত আলোচনার পরে, সরাইখানার পেছনের এক আপেল বাগিচায় তারা তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। বাবর ধারণা করে বাইজি দু’জন সরাইখানার শকুনের মতো দেখতে মালিকের মেয়ে হবে। যে ঝামেলার গন্ধ পাওয়া মাত্র সেই যে টেবিলের তলায় গিয়ে ঢুকেছে তারপরে আর বের হবার কথা চিন্তাও করেনি। আপেল বাগিচায় শীঘ্রই বাবরের লোকদের দল বেঁধে আসা যাওয়া করতে দেখা যায়। বাগান থেকে হাসিমুখে তাদের বের হয়ে আসা দেখে বোঝা যায় মেয়ে দু’জন তাদের বাবার সরাইখানায় আসা। অতিথিদের খেদমত করতে ভালোই অভ্যস্ত।

ওয়াজির খান ইতিমধ্যে চকরাখদের পালিয়ে যাওয়া ঘোড়াগুলো ধরে আনবার বন্দোবস্ত করেছেন এবং বণিকদের কাছ থেকে লুট করা মালপত্রগুলো পর্যবেক্ষণ। করছেন। “সুলতান, দেখেন,” দুটো উজ্জ্বল বর্ণের গালিচা বের করে সে বাবরের। দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করে। গালিচা দুটোর জেল্লা দেখে বোঝা যায় তন্তুবায়ের দল। সেটা বুননের সময়ে রেশমের সাথে উলের মিশ্রণ ঘটিয়েছে আর গালিচাগুলোর নকশাও অপরিচিত- বণিকের দলটা সম্ভবত পূর্বের, কাশগর থেকে এসেছিল। যেখানের তাঁতিরা এ ধরণের গালিচা তৈরিতে দক্ষ। উল আর চামড়া বেচে ভালো অর্থই পাওয়া যাবে, বাবর ভাবে, যা দিয়ে তার লোকদের সে বকেয়া বেতন দিতে পারবে।

তার যোদ্ধাদের জন্য একটা ভোজসভার আয়োজন করলে মন্দ হয় না। তারা ভালো। কাজ দেখিয়েছে এবং তারও উচিত এর মূল্যায়ন করা। পশ্চিমে, শাহরুখিয়ায় ফিরে যাওয়া মাত্রই সে এই ভোজসভার ঘোষণা দেবে। সেখানে, ছয়মাস আগে। তামবালের কাছ থেকে সে দূৰ্গটা ছিনিয়ে নিয়েছে এবং নিজের ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। সমরকন্দে খুন হবার আগে শাহরুখিয়ার সর্দার আলি মজিদ বেগের পূণ্য স্মৃতির প্রতি তারা তাদের শ্রদ্ধা জানাবে। তারা তার উপযুক্ত সন্তানের আত্মার মাগফেরাত কামনা করবে। যে তামবালের চকরাখ যোদ্ধাদের হাত থেকে দূর্গটা রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে। আলি মজিদ বেগের নিহত হবার সংবাদ ফারগানায় পৌঁছানো মাত্র তামবাল দূর্গটা দখল করতে তাদের পাঠিয়েছিলো।

নিজের বিশ্বস্ত সর্দারের কথা মনে পড়তে বাবরের ভাবনা বিষণ্ণ হয়ে উঠে। আজকাল তার প্রায়ই এমন হচ্ছে। সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারে আলি মজিদ বেগের মৃতদেহ প্রদর্শিত হবার পরের দু’বছরে সে কি অর্জন করেছে? নিজের পরিবারকে মুক্ত করার ব্যাপারে বা ফারগানা পুনরায় অধিকার করার ব্যাপারে সে কতটা অগ্রসর হয়েছে, সমরকন্দের কথা না হয় সে বাদই দিল? আর কতদিন তাকে সালতানাৎবিহীন একজন সুলতান হিসাবে দিন কাটাতে হবে? আকশি আক্রমণ করে তার পরিবারকে মুক্ত করে সিংহাসন পুনরুদ্ধার করার মতো একটা সেনাবাহিনী গঠন করা একটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আর সমরকন্দ, সেখানে শাসক হিসাবে কাটানো কয়েকটা দিন এখন কেবল ধূসর স্মৃতি। মাঝে মাঝে তার বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয় যে এমন কিছু আসলেই ঘটেছিলো। গ্রান্ড উজিরের কথাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো।

ভাবনাটা বাবরকে ক্রুদ্ধ করে তোলে। সে তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা কর্তিত মস্তকে লাথি বসিয়ে দিলে সেটা ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে। তার লোকদের যেমন, তারও বিনোদনের দরকার আছে। কয়েকটা ডাল কেটে পোলো খেলার লাঠি তৈরি করো।” সে চিৎকার করে বলে। “এইসব দুবৃত্তদের মাথা দিয়ে পোলো খেলা যাক। গোলপোস্ট হবে ঐ দূরের গাছগুলো।”

পুরো একটা ঘণ্টার জন্য, উদ্দাম খেলায় বাবর নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। চকরাখদের ক্ষিপ্রগামী টাটুঘোড়ার একটা নিয়ে সে একেবেঁকে দাবড়ে বেড়ায় এবং শাখাপ্রশাখা ছেটে ফেলা গাছের ডাল দিয়ে ছিন্ন মস্তকগুলোকে সজোরে আঘাত করে। যাতে ঘাসের উপর দিয়ে লাফাতে লাফাতে সেগুলো গড়িয়ে যায়। শীঘ্রই সেগুলোকে আর কাটা মাথা বলে চেনার কোনো উপায় থাকে না- নাক, কান গুঁড়িয়ে যায়, অক্ষিকোটর থেকে অক্ষিগোলক বের হয়ে আসে এবং বাবর আর তার ঘর্মাক্ত সাথী খেলোয়াড়েরা আর সেই সাথে তাদের সবার ঘোড়া, রক্তের ফুটকিতে চিত্রিত হয়ে উঠে।

অবশেষে খেলাটার প্রতি তার বিরক্তি জন্মায় কিন্তু ভেতরের জমে ওঠা হতাশা আর ক্ষোভ নিঃসৃত হওয়ায়, বাবর ঘামে ভিজে ওঠা ঘোড়াটাকে অবশেষে রেহাই দেয়। চারপাশে তাকাতে সে দেখে ওয়াজির খান তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। এই প্রথম সে তার চোখে বিরক্তি দেখতে পায়। কিন্তু বাবর তাতে বিন্দুমাত্র লজ্জি বোধ করে না। জীবিত বা মৃত, সে তার শত্রুদের সাথে তাদের প্রাপ্য ব্যবহারই করেছে।

“চলো এবার যাওয়া যাক।” সে আদেশ দেয়। “গাভা এখনও অনেক দূরে, আর আমাদের গৃহকর্তাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখাটা ঠিক হবে না।” বাবর ঘোড়ার পাঁজরে এত জোরে খোঁচা দেয় যে সেটা ছুটতে শুরু করে। বাবর সরাইখানা থেকে সোজা নদীর অগভীর অংশের দিকে এগিয়ে যায়।একবারও পেছনে ফিরে তাকায় না। আঙ্গিনায় পড়ে থাকা রক্তাক্ত মাথাগুলোকে ইতিমধ্যে কাকের দল ঠোকরাতে শুরু করেছে এবং সরাইখান মেয়ে দুটো পা ঈষৎ ধনুকের মত ফাঁক করে এগিয়ে গিয়ে চকরাখদের লাশগুলো হাতিয়ে দেখে যে বাবরের লোকেরা ভুলে কিছু রেখে। গেছে নাকি, যা তাদের বেশ্যাবৃত্তির পাওনার উপরি বলে বিবেচিত হতে পারে।

***

তিন সপ্তাহ পরে। উঁচু পাহাড়ী এলাকার তৃণভূমির উজ্জ্বল সবুজ ঘাসের মাঝে মাঝে ফুটে থাকা হলুদ গোলাপী আর সাদা ফুলের মাঝ দিয়ে বাবর আর তার লোকেরা দুলকি চালে ঘোড়া দাবড়ে শাহরুখিয়ার দিকে এগিয়ে যায়। গাভার অভিযানে ক্ষয়ক্ষতি হলেও তারাই জয়ী হয়েছে। তিনশ গজ দূরে ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা অবস্থায় বাবর নিজে তীর ছুঁড়ে দূর্গের সেনাপতিকে হত্যা করেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার নিজের ব্যবহৃত ছোট নিখুঁতভাবে বাঁকানো ধনুক দিয়ে তীর ছোঁড়ার অভ্যাসে কাজ হয়েছে। ত্রিশটা শর ভর্তি তূণীর সে এক মিনিটের ভিতরে খালি করে ফেলতে পারে।

সেনাপতি মারা যাবার পরে, প্রতিরোধকারীদের মনোবল ভেঙে যায়। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সেনানিবাসের সৈন্যরা কেবল আত্মসমর্পনই করেনি, নিজেদের লুটের মাল পুরো তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। যা বাবর আর তার লোকদের ঘোড়ার পিঠে ঝোলানো চামড়ার থলির উপচে পড়া আকৃতি সাক্ষ্য দিচ্ছে।

ওয়াজির খান খুব খুশি হবে। এবারের অভিযান বাবরকে তার বুড়ো বন্ধুটির সহায়তা ছাড়াই পরিচালনা করতে হয়েছে। সরাইখানা আক্রমণ করার পরের দিন ওয়াজির খানের ঘোড়া সাপের ভয়ে বেমাক্কা লাফিয়ে উঠতে সে পড়ে গিয়ে উরুতে ব্যথা পেয়েছিলো। বাবরের সনির্বন্ধ অনুরোধে তিনি শাহরুখিয়ায় ফিরে যেতে রাজি হন বাইসানগারের সাথে যোগ দিতে, যাকে তারা সেখানের নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়ে এসেছে।

আজ রাতে তারা বিজয় উদযাপন করবে। সে তার লোকদের সম্মান জানাতে তাদের মাঝে উলুশ বিতরণ করবে। যোদ্ধাদের ভিতরে যারা সবচেয়ে সাহসিকতা আর বীরত্ব প্রদর্শন করেছে প্রথা অনুযায়ী আজ সে ভোজসভার শেষে তাদের মাঝে লুটের মালের সিংহভাগ বিলিয়ে দেবে এবং বাইসানগার আর ওয়াজির খানকে গাভা আক্রমণের কাহিনী শোনাবে। তার গল্প শুনে ওয়াজির খান সম্ভবত হেসে অস্থির হবেন এবং সদা গম্ভীর বাইসানগারের মুখেও সে আজ হয়তো হাসির আভাস দেখতে পাবে।

পাথরের তৈরি দূর্গের অভ্যন্তরস্থ প্রাঙ্গনে প্রবেশের সাথে সাথে, বাবর তার ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে তাদের খোঁজে আশেপাশে তাকায়। বাইসানগারকে সে কোথাও খুঁজে পায় না। কিন্তু ওয়াজির খানকে আস্তাবলের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার খুরের উপরের আর পেছনের অংশের কেশগুচ্ছ পর্যবেক্ষণ করতে দেখে। তার বুড়ো বান্ধবকে সামান্য খোঁড়াতে খোঁড়াতে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলে: বাবর ভ্রূ কোঁচকায়। তারপরে সে তাকিয়ে দেখে ওয়াজির খানের মুখ আনন্দে আলোকিত হয়ে রয়েছে।

“সুলতান, দারুণ সুখবর আছে! সত্যিই চমকে দেবার মত সুখবর!”

“কি হয়েছে?”

“এক সপ্তাহ আগে আকশি থেকে এক বার্তাবাহক এসেছে। আপনার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীরের পক্ষে তামবালের বাণী নিয়ে সে এসেছে। অন্তত বার্তাবাহকের তাই ভাষ্য এবং সে বলেছে তারা আপনার আম্মিজান, নানীজান আর আপনার বোনকে আপনার কাছে পাঠাতে সম্মত আছেন।”

“সে কি এর বিনিময়ে কিছু দাবি করেছে?”

“সুলতান, প্রকাশ্যে তারা কিছু দাবি করেনি। আপনাকে সে কতোটা শ্রদ্ধা করে কেবল সে সম্পর্কে কিছু মধুর বাক্য ছাড়া।”

বাবরের হৃৎপিণ্ড আনন্দে নেচে উঠে। তার পরিবার শীঘ্রই তার সাথে মিলিত হবে। এই খবরটা আবার তাকে আবেগতাড়িত করে তোলে।

“তারা এখানে কবে নাগাদ পৌঁছাবে?”

“সবকিছু ঠিক থাকলে আগামীকাল সূর্যাস্ত নাগাদ তাদের এখানে পৌঁছাবার কথা।”

পরের দিন সন্ধ্যাবেলা, গোধূলির অস্তমিত আলোয় বাবরকে দূর্গের প্রকারবেষ্টিত সমতল ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আজকের দিনের অধিকাংশ সময় সে এখানেই কাটিয়েছে। অস্থিরচিত্তে রাস্তাটা যেখানে একটা গিরিখাদের দিকে বাঁক নিয়েছে, সেদিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে। ঘনায়মান আধো-অন্ধকারের ভিতর থেকে সে পিঠের দুপাশে ঝুড়ি ঝুলছে উটের এমন একটা তরঙ্গায়িত সারিকে বাঁক ঘুরে এগিয়ে আসতে দেখে। তাদের ঠিক পেছনেই রয়েছে যাত্রার শেষ পর্যায়ে মেয়েদের অভ্যর্থনা জানাতে। আর তাদের নিরাপদে দূর্গে নিয়ে আসবার জন্য, ওয়াজির খানের পরামর্শে, বাইসানগারের অধীনে পাঠানো সৈন্যবাহিনীর একটা চৌকষ দল।

বাবর এতদূর থেকে ঝুড়িতে ভ্রমণকারীদের চেহারা দেখতে পায় না। নিজেকে আর সামলে রাখতে না পেরে, এবং দেহরক্ষীদের কাউকে ডাকবার বা ঘোড়ার পিঠে জিন চাপাবার মতো ধৈর্যের মারাত্মক অভাব দেখা দেয়ায়, সে লাফিয়ে একটা খালি ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে এবং সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত তৃণভূমির উপর দিয়ে ছোট কাফেলাটার দিকে ছুটে যায়।

তার রোদে পোড়া গাল বেয়ে দরদর করে কান্না ঝরতে থাকে। কিন্তু সেসব সে মোটেই পরোয়া করে না। আশেপাশে কেউ নেই তার কান্না দেখবার মতো এবং তার চেয়েও বড় কথা, দেখলে দেখুক সে থোড়াই পরোয়া করে। দুর্বলতার না, আজ এটা আনন্দের অশ্রু। এক হাতে ঘোড়ার কেশর আঁকড়ে ধরে সে অন্য হাতে গাল থেকে কান্না মুছে। বাবর ঘোড়াটার কানে কানে তাকে এমন গতিতে ছুটতে বলে, যাতে মনে হয় হঠাৎ তার পাখা গজিয়েছে।

কাফেলাটাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে আনা সৈন্যদের থেকে চারজন সহসা আলাদা হয়ে বর্শা নিচু করে তার দিকে এগিয়ে আসে। যদিও বাইসানগার সম্ভবত ধারণা করতে পেরেছিলো খালি ঘোড়ার পিঠে এমন উদ্দাম ভঙ্গিতে কে তাদের দিকে ছুটে আসছে। কিন্তু তার মত অভিজ্ঞ পোড়খাওয়া যোদ্ধা তার কাছে এটাই প্রত্যাশিত যে সে নিজের লোকদের আদেশ দিয়েছে তার পরিচয় নিশ্চিত করতে। অশ্বারোহী দল নিকটবর্তী হতে, বাবর জোর করে নিজের ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তাকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য করে। ঘামে জবজব করতে থাকা দেহে নাক ঝেড়ে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করে ঘোড়াটা।

বাবর মাথাটা পেছনে হেলিয়ে দিয়ে তার পূর্বপুরুষের রণহুঙ্কার কণ্ঠে তুলে নেয়। “ফারগানা!”

অশ্বারোহী দল এখন আরো কাছে চলে আসায় তারা তাকে চিনতে পেরে অভিবাদন জানায়। বাবর কোনোমতে তাদের অভিবাদনের জবাব দিয়ে উটের কাফেলা যেখানে যাত্রা বিরতি করেছে সেদিকে ঘোড়া ছোটায়। তার হৃদয় যদি আবেগে ভারাক্রান্ত না থাকত অন্যসময় হলে তাহলে সে হয়তো বাজারে নিয়ে যাওয়া মুরগীর মতো ভীরু ভঙ্গিতে বেতের ঝুড়ির ভিতর থেকে এসান দৌলতের উঁকি দেবার হাস্যকর ভঙ্গি দেখে হয়তো হেসেই ফেলতো। তার ওজন এতোটাই হাল্কা যে অন্যপাশের ঝুড়িতে ভারসাম্য রক্ষার জন্য বাঁধাকপির চেয়ে ভারী কিছু রাখতে হয়নি। আর তার বীণা ঝুড়ির বাইরে চামড়ার ফালি দিয়ে আটকানো রয়েছে। একটা বিশাল পুরু লোমের দুধসাদা রঙের উট যা বাবরকে এগোতে দেখে পচাৎ করে থুতু ফেলে সেটার দু’পাশে দুটো ঝুড়িতে খুতলাঘ নিগার আর খানজাদা আরোহন করেছেন। উটের পেছনে বাবর তার আম্মিজানের পরিচারিকা দলের কয়েকজন পরিচিত সদস্য, যাদের ভিতরে ফাতিমাও রয়েছে আর তার উজির কাশিমকে দেখতে পায়।

উটের চালকরা লাফিয়ে নেমে, উটের গ্রন্থিযুক্ত হাঁটুতে তাদের হাতের লাঠি দিয়ে আঘাত করে উটগুলোকে বাধ্য করে মাটিতে বসতে। বয়োবৃদ্ধ হবার কারণে, বাবর দৌড়ে প্রথমে এসান দৌলতের কাছে যায় এবং হাঁটু মুড়ে বসে তাকে আলতো করে ঝুড়ি থেকে তুলে আনে। বাবর কোনো কথা খুঁজে পায় না, আর এই প্রথমবারেরমতো মুখরা এসান দৌলতও বাক্যহারা হয়ে পড়েন। সে টের পায় নানীজান তার মাথা আলতো স্পর্শ করেন। সে উঠে দাঁড়িয়ে তার ছোট ছোট উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকালে সেখানে তার পুরানো সত্ত্বার ঝলক দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। নানীজানকে এখন তিনি বরাবর যার জন্য গর্ব করেন,সেই খামের- চেঙ্গিস খানের রক্তের উত্তরসুরী এক নারীর মতোই দেখাচ্ছে।

সে এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে তার আম্মিজানকে ঝুড়ি থেকে তুলে মাটিতে নামিয়ে দেয় এবং তাকে জড়িয়ে ধরে তার আশৈশব পরিচিত চন্দনকাঠের উষ্ণ সুগন্ধে বুক ভরে শ্বাস নেয়। সে তার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাকিয়ে দেখে আম্মিজানের চোখে অশ্রু টলটল করছে। “বাছা তোমাকে আবার দেখতে পেয়ে খুশি হলাম,” কোনো রকমের আবেগ না দেখিয়ে তিনি বলেন, এবং তার মুখে একটা হাসির আভাস ফুটে উঠে যা বাবরের যেমনটা মনে আছে তার চেয়েও ম্লান এবং বলিরেখায় আকীর্ণ।

খানজাদা ইতিমধ্যে তাকে বহনকারী ঝুড়ি থেকে নিজেই ধড়ফড় করে নেমে এসেছে। এবং সে সোজা ভাইকে লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার পোষা বেজী যেটা সে বামহাতে ধরে রেখেছে, কুইকুই করে প্রতিবাদ জানায়। শেষবার বাবর তার বোনকে দেখেছিলো হাড্ডিসার একটা মেয়ে, যার মুখে কয়েকটা দাগ রয়েছে। খানজাদা এখন রীতিমত একজন মহিলাতে পরিণত হয়েছে, তার দেহে ভরা নদীর জোয়ার বইছে। মুখ আগের চেয়ে অনেক দাগহীন আর সুন্দর। কিন্তু ফিচেল হাসি আগের মতোই আছে দেখে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সে তাকে জড়িয়ে ধরে এবং তারপরে ছেড়ে দিয়ে এক পা পিছিয়ে আসে ভালো করে তাকে দেখবে বলে।

খানজাদাও কম যায় না সেও ভাইকে জরিপ করে। “তুমি লম্বা হয়েছে।” সে বলে, “আর তোমার কাঁধ আগের চেয়ে চওড়া হয়েছে। কিন্তু একি চেহারা হয়েছে। তোমার থুতনিতে ছাগলের মত দাড়ি আর চুলের অবস্থা যাচ্ছেতাই- তোমার চুল দেখছি আমার মত লম্বা! আর নখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না- কালো হয়ে আছে।”

বাবর পেছন থেকে, খানজাদার নাক কোঁচকানো বিশেষণগুলোর সমর্থনে এসান দৌলতকে জিহ্বা আর টাকরার সাহায্যে একটা শব্দ করতে শোনে এবং সে হেসে ফেলে। অবশেষে তার প্রিয়জনেরা তার কাছে এসেছে এবং সবকিছু যেমনটা থাকার কথা তেমনই রয়েছে। তাদের সাথে সে পরে কথা বলবে এবং শুনবে বিগত দিনগুলো তাদের কেমন কেটেছে। কিন্তু এখনকার মতো এই যথেষ্ট।

তারা দূর্গের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। অবশেষে মুক্তি লাভ করা ফারগানার শাহী রমণীদের অভ্যর্থনা জানাতে তূর্যনিনাদ আর রণভেরী গমগম আওয়াজে বেজে উঠে- অন্তত এখনকার জন্য হলেও তারা নিরাপদ।

দূর্গের উপরের তলায় প্রস্তুত রাখা জেনানামহলে মেয়েদের পৌঁছে দিয়ে, বাবর তার বঁধুনিকে ডেকে পাঠায়। তার পরিকল্পিত ভোজসভার সব আয়োজন কি অবস্থায় আছে তা জানতে। এখানের ভোজসভা সমরকন্দের মতো জাঁকজমকপূর্ণ হবে না। যেভাবে সে তাদের অভ্যর্থনা জানাতে চেয়েছিলো। অবশ্য, তাহলেও বিশটা ভেড়া জবাই করা হয়েছে আর আঙ্গিনায় সেগুলোকে আগুনে ঝলসানো হচ্ছে। মুরগীর পালক ছাড়িয়ে, আখরোট আর খুবানির সাথে মাখন দিয়ে সিদ্ধ করা হচ্ছে। আস্ত আপেল ঘন সোনালী বর্ণের মধু আর লাল রসে ভরা ডালিমের দানার সাথে কাঠবাদাম আর পেস্তার মিশ্রণে চিকচিক করছে। তাদের কোনো এক অভিযানে তার লোকদের লুট করা রূপালি বর্ণের কাঠবাদামের স্তূপের দিকে সে বিশেষ সন্তুষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। এসান দৌলত অন্য যে কোনো মিষ্টির চেয়ে এগুলো বেশি পছন্দ করেন।

নির্মেঘ, তারা-শোভিত আকাশে চাঁদ উঠলে, এবং কোনো আকষ্মিক হামলা থেকে আগেই সাবধান করতে দূর্গপ্রাকারে সৈন্য মোতায়েন করে ভোজসভা শুরু হয়। বাবর আর তার লোকেরা নিচুলার একটা নিচু, লম্বা কামরায় আহার সারে। যখন উপরে নিজেদের কামরায় মেয়েদের তাদের পছন্দের অংশ পরিবেশন করা হয়। মোমবাতির কাঁপা আলোতে বাবরের লোকেরা উদাত্ত কণ্ঠে গান শুরু করে। বাকীরা যে নিচু কাঠের টেবিলের চারপাশে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে আছে তাতে চাকুর বাট দিয়ে আঘাত করে তাল দেয়। বাবর ভাবে, তার লোকেরা খুশি হয়েছে। মেয়েদের মুক্তিতে তারাও প্রীত হয়েছে। তার সাথে সাথে তার লোকদেরও এটা সম্মানহানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো- যেনো মেয়েদের মুক্ত করার সামর্থ্য তাদের নেই।

বাবর খেতে চেষ্টা করে কিন্তু কিছুই খেতে পারে না। তার ইচ্ছা করে এখান থেকে উঠে যায় এবং তার আম্মিজান, খানজাদা আর এসান দৌলতের সাথে নিভৃতে সময় কাটায়। কিন্তু তার অনুসারীদের প্রতি সৌজন্যতাবশত তাকে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। গানের মাত্রা ধীরে ধীরে চড়তে শুরু করে এবং ক্রমশ কর্কশ হয়ে উঠে। যোদ্ধার দল উচ্চকণ্ঠে নিজেদের পূর্বপুরুষের বীরত্বের কথা বয়ান করতে থাকে এবং বাবরও এবার তাদের সাথে কণ্ঠ মেলায়। কিন্তু অবশেষে, কেউ কেউ টেবিলের উপরে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে। আর অন্যেরা ঝাপসা চোখে টলোমলো পায়ে কামরা থেকে বের হয়ে বাইরের আঙ্গিনায় নিজেদের হাল্কা করতে শুরু করলে, বাবর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পাথরের বাঁকানো সিঁড়ি বেয়ে জেনানামহলের দিকে রওয়ানা দেয়।

খুতলাঘ নিগার দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাকে স্বাগত জানায় এবং সে ভিতরে প্রবেশ করে গালিচা পাতা মেঝেতে তার পাশে এসে বসে। তাদের সামনের পিতলের থালায় পড়ে থাকা খাবারের অবশিষ্টাংশ দেখে সে বুঝতে পারে মেয়েরা ভালমতোই খেয়েছে। কিন্তু তারপরেও সে এখন যখন তাদের মুখের দিকে তাকায় সেখানে সে একটা টানটান অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে। তাদের তিনজনকেই ফ্যাকাশে আর বিবর্ণ দেখায়। যেনো বহুকাল সূর্যের আলোর উষ্ণতা অনুভব করেনি বা তাজা বাতাসে তারা শ্বাস নেয়নি। কাউকে না কাউকে অবশ্যই এর মূল্য দিতে হবে- রক্ত দিয়ে। কিন্তু মেয়েদের খাতিরে আপাতত সে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে না। তারা যাই বলুক তাকে, সে অবশ্যই সব কিছু শান্ত ভঙ্গিতে শুনবে।

কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ বসে থাকে। প্রাথমিক উত্তেজনা প্রশমিত হতে, কেউই বুঝতে পারে না কোথা থেকে শুরু করা উচিত।

অবশেষে এসান দৌলত শুরু করেন: “বাবর তুমি তাহলে সরমকল দখল করেছিলে।” তার বিচক্ষণ মুখে বিরল একটা হাসির আভাস ফুটে উঠে।

“অধিকার করেছিলাম বটে, কিন্তু দখলে রাখতে পারিনি।” বাবর তার মাথা নিচু করে। এমন কিছু কথা আছে যা তাকে বলতেই হবে। “নানীজান, আমি আপনাকে হতাশ করেছি। আপনি আমার সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন এবং আমি সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমার আসতে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল আর লোকজন ছিল অনেক অল্প।”

“আমাদের তুমি মোটেই হতাশ করনি। আর জেনে রেখো, আমাদের কারণেই তুমি সমরকন্দ হারিয়েছে। আমাদের সাহায্য করার জন্য তুমি সাথে সাথে যাত্রা করেছিলে। তুমি এরচেয়ে বেশি আর কিইবা করতে পারতে?”

বাবর আক্ষেপের সাথে মাথা নাড়ে। “ফারগানা আর আপনারা ছিলেন আমার প্রধান দায়িত্ব। সমরকন্দে আমি নতুন কোনো খেলনা হাতে পাওয়া শিশুর মতো আচরণ করেছিলাম। আমার তখন অন্য কিছু সম্বন্ধে ভাববার সামান্যই অবকাশ ছিলো। আপনাদের আর ফারগানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমার উচিত ছিলো ওয়াজির খানকে পাঠিয়ে দেয়া।” সে তার মায়ের গায়ে হেলান দেয় এবং বরাবরের মতোই মায়ের আঙ্গুল তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে টের পায়। এতে সে কিছুটা শান্ত হয়।

“কিছু কিছু বিষয় তামবাল আমাদের কাছে কখনও গোপন করেনি।” খুতলাঘ নিগার বলেন। “আমার মনে হয় এতে সে আনন্দই পেতো। আমরা, তোমার চাচাতো ভাই মাহমুদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা অবশ্যই জানি- আমরা জানি সেই সমরকন্দ তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। বাছা, সে আর তামবাল মিলে তোমার জন্য একটা ফাঁদ পেতেছিলো। তারা দু’জনে মিলে ঠিক করেছিলো, ফারগানায় সে তোমাকে মসনদ থেকে সরিয়ে দিয়ে জাহাঙ্গীরকে তোমার স্থলাভিষিক্ত করবে। তারা জানতো এর ফলে তুমি বাধ্য হবে- তোমার বেশিরভাগ সৈন্য নিয়ে ফারগানায় ফিরে আসতে। আর মাহমুদ এর ফলে তার কাঙ্ক্ষিত সুযোগ পায়। তুমি তখন সদ্য সমরকন্দের সুলতান হয়েছে। তারা বলেছে যে সেখানকার অভিজাত ব্যক্তিরা তোমার প্রতি তেমন একটা আনুগত্য বোধ না করায়, মাহমুদ আর তার কলহপ্রিয় স্ত্রী, গ্রান্ড উজিরের কন্যা সহজেই ঘুষ দিয়ে তাদের কিনতে পেরেছে।”

নিজের সবচেয়ে জঘন্য সন্দেহটা প্রমাণিত হতে বাবর চোখ বন্ধ করে ফেলে। কি আহাম্মকই না সে ছিলো।

“তোমার এটাও জেনে রাখা উচিত, মাহমুদের স্ত্রীর কারণে সে গো ধরায় আলি মজিদ বেগকে হত্যা করা হয়েছিলো।” এসান দৌলতের কণ্ঠস্বর তিক্ত শোনায়। নিহত গোত্রপতির মা ছিলো তার বান্ধবী আর তিনি নিজেও তাকে পছন্দই করতেন। “সে নাকি বলেছে তোমার শিরোচ্ছেদ করতে না পারায়, তাকে শিরোচ্ছেদ করলেই আপাতত চলবে- তার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ হিসাবে। মাহমুদ তার কথা ফেলতে পারেনি। সবাই বলে সেই আসলে সমরকন্দের নতুন শাসক। নিজের বাবার চেয়েও সে বেশি লোভী আর প্রতিহিংসাপরায়ণ।”

বাবর বিস্ময়ে চোখ পিটপিট করে। সে ভাবতেও পারেনি সেই সুঠামদেহী তরুণী, যে এমন সাহসিকতার সাথে গ্রান্ড উজিরের প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলো কিভাবে এতো অনুভূতিহীন নিষ্ঠুর আর নির্মম হতে পারে। একদিন তাকে অবশ্যই তার এই স্পর্ধার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু সেটা পরেও হতে পারে। তার আগে তাকে অন্য অনেক বিষয় জানতে হবে এবং সেগুলো মেনে নিতে হবে।

সে আলতো করে দু’হাতের মাঝে মায়ের হাত জড়িয়ে ধরে। “আমাকে তোমাদের কথা বলল। তোমরা বন্দি থাকা অবস্থায় কেমন আচরণ করছে তারা তোমাদের সাথে?”

“কয়েকজন মাত্র পরিচারকসহ আমাদের একটা ছোট জায়গায় আটকে রাখা হয়েছিলো কিন্তু আমাদের বংশ গৌরব আর মর্যাদার কারণে তারা বাধ্য হয়েছিলো আমাদের যথাযথ সম্মান দেখাতে। তামবাল আমাদের অপমান বা হুমকি দেয়নি।” তার মা বলে, “আর সম্প্রতি- সম্ভবত তোমার সাফল্যের কথা যখন সে জানতে পারে- আমাদের বড় একটা মহলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।”

“আর সে রোক্সানাকে আমাদের গহনা কেড়ে নিতে দেয়নি। অবশ্য অন্যদের মুখে শুনেছি সে ক্রুদ্ধ হয়ে চেঁচামেচি করেছে, যদিও সে তামবালের অঙ্কশায়িনী ছিলো।” এসান দৌলত কুপিত কণ্ঠে কথাগুলো বলেন।

“আর আমার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীর? এসবে তার ভূমিকা কতটুকু?” বাবর প্রায়ই তার স্থান দখল করে নেয়া বালকটার কথা ভাবে যাকে সে কখনও দেখেনি। শেষবার আকশি থেকে আসবার সময়ে, সমরকন্দ অবরোধের প্রস্তুতি নেবার সময়ে, ছোঁড়া অসুস্থ ছিলো।

“বেচারা পরিস্থিতির শিকার, আর প্রায়ই অসুস্থ থাকে। তামবালের পুরো শরীরে কয়েক চামচ পরিমাণ রাজরক্ত থাকায় সে কখনও নিজে সিংহাসন দাবি করতে পারবে না। অন্য গোত্রপতিরা সেটা তাকে করতেও দেবে না। কিন্তু জাহাঙ্গীরের রাজপ্রতিভূ হিসাবে যে ক্ষমতার জন্য সে লালায়িত সেটা অর্জন করতে পারবে।” এসান দৌলত ভাবাবেগশূন্য কণ্ঠে কথাগুলো বলেন। “সে এখন তোমাকে ভয় পায়। সে যদি তোমাকে খুশি করতে না চাইতো, তাহলে আমাদের এতো সহজে মুক্তি দিতো না?”

সুলতান হিসাবে বাবর নিজের প্রথম দিনগুলোর কথা ভাবে, তার মনে পড়ে তামবাল তখন কিভাবে অন্য নেতাদের মনে সন্দেহের বীজ বপনের চেষ্টা করেছে। সব সময়ে সে নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিবৃত্ত করার চেষ্টারত ছিলো। কী সাংঘাতিক সুবিধাবাদি এক লোক- কামবার আলীর ষড়যন্ত্রে যোগ দেবার ব্যাপারে ভীষণ বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে সঠিক সময়ের জন্য ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করেছে। এজন্যই কি সমরকন্দ দুবার অবরোধ করতে সে তাকে প্ররোচিত করেছিলো? বাইসানগার যখন তৈমূরের অঙ্গুরীয় নিয়ে এসেছিল তখন আগ্রহে চকচক করতে থাকা তামবালের চেহারা তার এখনও মনে আছে। তার আরো মনে আছে, সমরকন্দ অধিকার করার পরে কি রকম তাড়াহুড়ো করে সে ফারগানা ফিরে এসেছিলো।

“আমাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন সময় ছিলো প্রথম কয়েক মাস, যখন আমরা জানতাম না তোমার ভাগ্যে কি ঘটেছে। ফাতিমা- তুমি জান সে কেমন গপ্পোবাজ সে একবার একটা কথা শুনে আসে- একটা গুজব কিন্তু সেটাই আমাদের আতঙ্কিত করে তোলার জন্য যথেষ্ট ছিলো- যে তুমি ফারগানায় ফিরে আসার সময়ে পথে অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছে। তার মায়ের কণ্ঠস্বর কেঁপে যায়। কিন্তু তারপরেই আমরা শুনতে পাই যে তুমি সুস্থ আছো, আর পাহাড়ে আত্মগোপন করে রয়েছে। আমরা জানতাম না কোনটা সত্যি। যতদিন না তামবাল ক্রুদ্ধ হয়ে আমাদের কাছে আসে…সে আমাদের বলে তুমি গ্রামের পর গ্রাম আক্রমণ করে, সবকিছু জ্বালিয়ে দিচ্ছ, তছনচ করে দিচ্ছ এবং নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছো, কাউকে রেয়াত না দিয়ে।”

“তামবাল যা বলেছে, সেটাই তাহলে সত্যি, তাই না বাবর? যে তুমি একজন সাধারণ দস্যু আর গরু-চোরে পরিণত হয়েছো?” এসান দৌলত প্রশ্রয়ের কণ্ঠে বলেন।

বাবর সম্মতি প্রকাশ করে মাথা নাড়ে এবং মুহূর্ত পরে নানীজানের দিকে তাকিয়ে সেঁতো হাসি হাসে। তার মা আর নানী তার সম্বন্ধে কি ভাববে সেটা নিয়ে সে প্রায়ই দুশ্চিন্তা করতো। তারা কি কখনও বুঝতে পারবে কেনো একজন শাহজাদা পাহাড়ী দুৰ্বত্তের জীবন গ্রহণ বাস্তবিক পক্ষে উপভোগ করতে পারে।”

“বাবর, আমাদের সেসব কথা বল।”

পশুর চর্বি দিয়ে তৈরি মোমবাতির দপদপ করতে থাকা শিখা নিভু নিভু হয়ে আসতে, বাবর তার সময় কিভাবে কেটেছে সেটা তাদের কাছে বর্ণনা করতে চেষ্টা করে। দুইশ কি তিনশ অভিযাত্রীর একটা বাহিনী নিয়ে, পাহাড়ের উপর থেকে ধেয়ে আসবার উত্তেজনাই আলাদা। রাতের বেলা তামবালের অনুগত বাহিনীর দূর্গ ঝটিকা আক্রমণের উল্লাস। আর তার পরে রাতের আঁধারে হারিয়ে যাবার, তার পর্যাণে বাধা শিকারের ছিন্নমস্তক থেকে টপটপ করে ঝরে পড়া রক্তের ধারার অনুপ্রেরণা। প্রাচীন মোঙ্গল প্রণালী অনুসরণে তার দলের এক লোক। ঘোড়ার দুধ গজিয়ে যে খভাস তৈরি করতো সেটা পান করার কারণে মাথা ঘুরতে থাকলে সারা রাত ধরে পানোন্মত্ত অবস্থায় ফুর্তি করা। চকরাখদের ছিন্নমস্তক দিয়ে উদ্দাম পোলো খেলার কথা সে কেবল এড়িয়ে যায়। যদিও খানজাদাকে হয়তো পরে সে সেটাও বলবে। তার কথা বলার সময়ে খানজাদার চোখ চকচক করতে থাকে। তার হাতের মুঠি খোলে আর বন্ধ হয়, যেনো সে নিজে সেখানে ছিলো। তার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। এসান দৌলতও মগ্ন হয়ে শোনেন। কিন্তু সে খেয়াল করে মৃত্যুর করাল থাবার হাত থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যাবার ঘটনাগুলো শোনার সময়ে তার মায়ের ভ্রু কুঁচকে উঠে।

“আমি কিন্তু কেবল যারা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাদেরই আক্রমণ করেছি। আর আমি কখনও তোমাদের কথা ভুলে যাইনি। তোমাদের স্বাধীনতা আমার মসনদের চেয়েও বেশি কাম্য ছিল আমার কাছে।” চারপাশে তাকিয়ে, বাবর দেখে গবাক্ষের সরু ফাঁক দিয়ে ফ্যাকাশে, ধুসর আলোর একটা ধারা লুকিয়ে কখন যেন কামরায় প্রবেশ করেছে। প্রায় সকাল হয়ে এসেছে।

“তুমি এটা অর্জন করেছে। কিন্তু যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে। এখন আমাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হবে।” এসান দৌলতের কণ্ঠে একটা সতেজতা ফুটে থাকে এবং তার দৃষ্টি বাবর নিজের উপরে অনুভব করলে সে অস্বস্তিবোধ করে, যেন কোনো বাচ্চা ছেলে এখনই তার ওস্তাদের কাছে ধমক খাবে। “বাবর, তুমি এই ক’দিনে কি শিখেছো?” নানীজান তার দিকে ঝুঁকে এসে তার কব্জি আঁকড়ে ধরে। “ তোমার কথা অনুযায়ী মসনদহীন দিনগুলো থেকে তুমি কি শিখেছো?”

যুক্তিসঙ্গত একটা প্রশ্ন। এই বিপজ্জনক, মরীয়া সময় তাকে কি শিক্ষা দিয়েছে? “বিশ্বস্ত বন্ধু আর মিত্রের গুরুত্ব,” সে অবশেষে কথা খুঁজে পেয়ে বলে, “এবং তাদের যোগ্যতা অনুসারে প্রতিদান দেয়া। এছাড়া পরিষ্কার উদ্দেশ্য, একাগ্রচিত্ত কৌশল আর সেটা অর্জনের পথে কোনো কিছুকে বাধা হিসাবে গণ্য না করার প্রয়োজনীয়তা।”

এসান দৌলত সন্তুষ্টির মাথা নাড়েন। “অবশ্যই। এবং এছাড়া আর কি?”

“আমি শিখেছি একজন সুলতানের পক্ষে সবসময়ে উদারতা দেখান সম্ভব না, শ্রদ্ধা অর্জনের জন্য তাকে কঠোর হতে হবে- কখনও নির্মম। অন্যথায় তাকে দুর্বল মনে হবে। নেতৃত্ব দেবার বদলে সবার ভালবাসার পাত্রে পরিণত হবার ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। আর সেই সাথে মিষ্টিভাষী ষড়যন্ত্রকারীর ফাঁদে পা দিয়ে বসতে পারে। আমি শিখেছিঃ আনুগত্য অর্জন করতে হলে কেবল কৃতজ্ঞতা আর সম্ভ্রম উদ্রেক করলেই চলবে না। এর সাথে সামান্য ভয়েরও মিশেল থাকতে হবে। আমি প্রথমবার ফারগানার শাসক হবার পরে বাকী বেগ, বাবা কাশক, আর ইউসুফকে প্রাণদণ্ড দেয়া উচিত ছিলো। তার বদলে আমি কেবল তাদের শাহী দায়িত্বপালন থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলোম এবং জীবন ধারণের জন্য কোনো বাধা না দিয়ে বরং মনের ভিতরে তাদের তিক্ততা পোষণের সুযোগ দিয়েছি। এছাড়া, সমরকন্দ দখল করার পরে গ্রান্ড উজিরের কতিপয় সমর্থককেও কড়কে দেয়া উচিত ছিলো।

“তারচেয়েও বড় কথা, আমার নিয়তির প্রতি আমি আর কখনও অবহেলা প্রদর্শন করবো না। আমাদের সাথে আমার সাথে যা ঘটেছে তারপরেই কেবল আমি হাল্কা হাল্কা বুঝতে পারছি মানুষ তৈমূর লোক হিসাবে কেমন ছিলেন। মাঝে মাঝে তার নিজেকে কেমন একা মনে হয়েছে- নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে তাকে কেমন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। আর তাছাড়া, তাদের সব দায়দায়িত্ব পরে বহুবছর ধরে তাকে নিজের কাঁধে বহন করতে হয়েছিলো… আমি নেতৃত্ব দেবার মতো সাহসও অর্জন করেছি…ওয়াজির খানের মতো আমার যতো দক্ষ পারিষদ থাকুক আমার নিয়তি কেবল আমিই নির্ধারণ করতে পারি।

বাবর মুখ তুলে তার নানীজানের দিকে তাকায়। “দেখে নিয়ে, আমি ঠিক তৈমূরের মতই বীর হবো। আমি শপথ করে বলছি…”

“কথাগুলো সত্যিই শুনতে ভাল লাগে।” এসান দৌলত মন্তব্য করেন। “চলো আমাদের অনেক কাজ এখনও বাকি আছে। একটা নতুন দিনের প্রভাত হচ্ছে।”

দ্বিতীয় খণ্ড – সালতানাৎবিহীন এক সুলতান

০৭. আয়োধন আর অন্তর্ধান

বৃষ্টি আর তুষারপাতের মিশ্রণের প্রকোপ বাবরের ভেড়ার চামড়ার প্রলেপ দেয়া ভারী জ্যাকেটের আবরণও আটকাতে ব্যর্থ হয়। ফারগানার উত্তরে উঁচু পর্বতমালার অভ্যন্তরে এক প্রত্যন্ত উপত্যকার ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনীর তীরের প্রায় কাদা হয়ে থাকা বরফের ভিতর দিয়ে তার অবশিষ্ট লোকদের সামনে থেকে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে চলেছে, বৃষ্টি আর তুষারপাতের হাত থেকে বাঁচতে মাথা নিচু করে রাখা।

নিজের দুটো সালতানাই হারিয়েছে এটা অনুধাবন করার পরের প্রথম দিকের মুশকিল দিনগুলোতে, বাবর আকশি দূর্গের আশেপাশেই থাকবে বলে ভেবেছিলো আশা করেছিলো সব কিছু বাজি রেখে হলেও সে তার পরিবারকে মুক্ত করতে পারবে। ওয়াজির খান অনেক কষ্টে তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, তার শত্রুরাও এমনই একটা মরীয়া প্রচেষ্টা আশা করছে আর তারা সেজন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। ওয়াজির খান, তার চিরাচরিত পিতৃসুলভ ভঙ্গিতে তাকে আশ্বস্ত করে পরামর্শ দিয়েছে, “আপনি যদি আপনার আম্মিজান, নানীজান আর বোনকে বাঁচাতে চান তাহলে নিজেকে বিপদের মুখে না ফেলে বরং শত্রুদের তটস্থ করে তুলেন, যাতে তারা আপনার নাম শুনলেই ভয় পায়। আর সেটা করতে হলে তাদের চাপের ভিতরে রাখেন। এখানে সেখানে তাদের আক্রমণ করে, আপনার বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশ করবার আগেই সেখান থেকে সরে আসেন। ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে সবসময়ে একটা ভীতির সঞ্চার করতে থাকেন। আপনার শত্রুরা যাতে শান্তিতে ঘুমাতে না পারে। আর এটা করতে পারলেই সুলতান, তারা আপনার পরিবারের ক্ষতি করার কথা চিন্তাও করতে পারবে না।”

বাবর ওয়াজির খানের বক্তব্য মোটের উপরে বুঝতে পারে। সাবধানে বিবেচনা করে, সে একটা পরিকল্পনার কথা বলে। আমাদের একটা নিরাপদ আশ্রয়স্থল চাই। যেখানে আমরা শীতকালটা কাটাতে পারবো এবং প্রথম হামলার ছক কষতে পারবো। আমার মনে আছে যে প্রতিবার গ্রীষ্মের সময়ে সামরিক প্রশিক্ষণের অংশ হিসাবে আপনি একবার আমাকে উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলে একটা অভিযানে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং উপত্যকার কেন্দ্রস্থলে একটা মাটির দূর্গে আমরা অবস্থান করেছিলাম। তামবালের অনুগত এক জায়গীরদার সেই নগণ্য সেনাছাউনির প্রধানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো। সেই দূর্গটা আমাদের জন্য চমৎকার আশ্রয়স্থল হিসাবে প্রতিপন্ন হতে পারে। কারো মাথাতেই বিষয়টা আসবে না। আপনি কি বলেন?”

“জায়গার কথা আমার মনে আছে। বাস্তবিকই প্রত্যন্ত অঞ্চলে দূর্গটা অবস্থিত, আর আমাদের উদ্দেশও হাসিল হবে।”

আর সে জন্যই সে ওয়াজির খানকে নিয়ে পাহাড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিলো। তাদের সাথে কেবল দুশো লোক ছিলো। ওয়াজির খানের সাহায্যে বাবর অনেক যত্ন নিয়ে তাদের বাছাই করেছে, সে কেবল তাদেরই বাছাই করেছে যাদের বয়স অল্প আর কোনো পারিবারিক পিছুটান নেই বা বাইসানগারের মতো যারা তার বিশ্বস্ত অন্তরঙ্গ। বাকি সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে, তার ডাকের অপেক্ষা করতে বলেছে, যা তারা নিশ্চিতভাবেই পাবে। তাদের যাত্রার দ্বিতীয় সপ্তাহে তুষারপাত শুরু হয় এবং উচ্চতা বাড়বার সাথে সাথে তুষারের স্তর বৃদ্ধি পেয়ে তাদের যাত্রাকে শ্লথ করে তুলেছে।

“ওয়াজির খান, আপনার কি মনে হয় আমরা দূর্গ থেকে কতোটা দূরে অবস্থান করছি?”

“সুলতান, আবহাওয়া যদি এতোটা বিরূপ না হতো, আমরা তাহলে দূর্গটা এতক্ষণে দেখতে পেতাম। অবশ্য সুবিধাও হয়েছে, দূর্গের নিরাপত্তা রক্ষীরা আমাদের আগে থেকে দেখতে পাবে না। দূরের ঐ গাছগুলোর আড়ালে আমরা অবস্থান নেবো আর সামনেটা রেকী করার জন্য গুপ্তদূত পাঠিয়ে আমরা পর্যাণে যেটুকু শুকনো মাংস রয়েছে সেটা দিয়ে আহার সেরে নেবো।”

তাদের পাঠানো গুপ্তদূতেরা রেকী করে ফিরতে যে নব্বই মিনিট সময় লাগে তার পুরোটা সময়ই অবিশ্রান্তভাবে তুষারপাত হয়। কখনও ভারী বা কখনও হাল্কাভাবে। তার লোকেরা ফিরে আসতে দেখা যায়, ঘোড়া আর তার আরোহী তুষারে পুরো ঢেকে গেছে এবং গুপ্তদূতদের দলনেতা ঠাণ্ডায় নীল হয়ে আসা ঠোঁটে কোনোমতে কথা বলে। “এখান দু’মাইল দূরে একটা বাকের পরেই দূর্গটা অবস্থিত। দূর্গের বাইরে আমরা কোনো ঘোড়ার বা পায়ের ছাপ দেখতে পাইনি যাতে বোঝা যায়, আজ ভেতর থেকে কেউ টহল দিতে বা পর্যবেক্ষণ-ফাঁড়িতে যায়নি। আমরা যখন ঘোড়া থেকে নেমে দূর্গের কাছে এগিয়ে যাই, দূর্গের এক অংশ থেকে আমরা ধোয়া উঠতে দেখেছি- সম্ভবত রসুইখানা- কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দূর্গের মূল ফটক তখন ভোলা ছিলো। স্পষ্টতই এই আবহাওয়ায় কেউ আক্রমণ করতে পারে সেই ব্যাপারটা তাদের মাথাতেও নেই।”

“চমৎকার, শীঘ্রই তাদের এই নিশ্চয়তা নরকে পরিণত হতে চলেছে। ওয়াজির খান, এটা ইতস্তত করার সময় না, সবাইকে এই মুহূর্তে প্রস্তুত হতে বলুন এবং তুষারপাতের মাঝে আমরা আত্মগোপন করে গুপ্তদূতদের সহায়তায় দূর্গে পৌঁছাবার পথের শেষ বাঁকে দ্রুত আর নিরবে গিয়ে হাজির হবো। সেখান থেকে মূল ফটকের উদ্দেশ্যে ঘোড়া দাবড়ে যাবো।”

ওয়াজির খান মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় এবং পাঁচ মিনিট পরে অশ্বারোহী বাহিনীর একটা সারিকে মন্থর গতিতে পাহাড়ী পথ বেয়ে উপরের দিকে উঠে যেতে দেখা যায়। তুষারাবৃত প্রেক্ষাপটের মাঝ দিয়ে প্রায় দু’মাইল এগিয়ে যায়। তুষারপাত এখন আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে। বাবরের চোখের সামনে একটা পাথুরে অবয়ব ভেসে ওঠে। দূর্গটা আর মাত্র হাজারখানেক গজ সামনে অবস্থিত। এখান। থেকে দূর্গ পর্যন্ত রাস্তাটা বেশ প্রশস্ত।

“আমরা এখান থেকেই আক্রমণ শুরু করবো। লোকদের বলেন অপ্রয়োজনীয় সবকিছু এখানে পাথরের আড়ালে রেখে কেবল হাতিয়ার নিয়ে প্রস্তুত হতে। যাতে বরফের উপর দিয়ে যতোটা সম্ভব দ্রুত ঘোড়া দাবড়ে আমরা দূর্গে পৌঁছাতে পারি।” তার লোকেরা নিরবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। কিন্তু তারা প্রস্তুত হতে হতে তুষারপাত একেবারে বন্ধ হয়ে যায় এবং সামনে- সাদা প্রেক্ষাপটের মাঝে একটা কালো আকৃতির মত দূর্গটা ভেসে উঠে।

“যারা প্রস্তুত, ঘোড়ায় আরোহন করো! কারো চোখে পড়ে যাবার আগেই আমাদের আক্রমণ করতে হবে!” বাবর চিৎকার করে কথাটা বলার ফাঁকে ময়ান থেকে আলমগীর বের করে আনে। সে লাফিয়ে জিনের উপরে উঠে বসে এবং তার বিশাল কালো ঘোড়াটাকে দূর্গের দিকে এগোতে বলে পেটে খোঁচা দেয় যার ফটক সে খোলা দেখতে পেয়েছে। দশজন যোদ্ধা পরিবেষ্টিত অবস্থায় এবং বাকীরা তার পেছনে সারিবদ্ধভাবে বিন্যস্ত। ঘোড়ার কাধ ধরে ঝুঁকে ছুটে যাবার সময়ে বাবর টের পায় তার কানে রক্তের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। দূর্গের ফটক থেকে সে যখন মাত্র দুশো গজ দূরে, তখন ভেতর থেকে একটা চিৎকার তার কানে ভেসে আসে- শত্রুরা তাদের দেখে ফেলেছে। ভেতরের লোকেরা বিপদ টের পায়। তারা ফটকের পাল্লা বন্ধ করার চেষ্টা করতে সেটা কেঁপে উঠে। কিন্তু নতুন জমা বরফ পাল্লা নড়তে বাধা দেয়। দু’জন লোক বাইরে ছুটে আসে, বরফের স্তূপে লাথি দেয় এবং বৃথাই চেষ্টা করে পাল্লাটা বরফের উপর দিয়ে সরাতে।

“ব্যাটাদের পেড়ে ফেলো!” বাবর হুঙ্কার দিয়ে বলে। কিন্তু ঘোড়ার গতি বিন্দুমাত্র হ্রাস করে না। নিমেষের ভিতরে সে একজনকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে, একটা তীর তার গলায় বিদ্ধ হয়েছে। একই সাথে সে নিজেও দূর্গের তোরণদ্বারের কাছে পৌঁছে যায়। দ্বিতীয় লোকটাকে সে আলমগীর দিয়ে একটা কোপ বসিয়ে দেয়। টের পায় তার তরবারি জায়গা মতোই নরম মাংসপেশীতে কামড় বসিয়েছে। কিন্তু কোথায় সেটা দেখবার জন্য সে ঘোড়ার গতি একটুও হ্রাস করে না। তার বদলে, সে তার হাতে ধরা লাগামে একটা ঝাঁকি দিয়ে ঘোড়ার মাথা তখনও আংশিক খোলা ফটকের দিকে ঘুরিয়ে দেয়। বিশাল কালো ঘোড়াটা নাক দিয়ে একটা শব্দ করে এবং বাবর টের পায় ঘোড়াটার একটা পা পিছলে গেছে কিন্তু কালো পাহাড় ঠিকই ঘুরে দাঁড়ায়। একই সাথে তার পেছনে তিনজন যোদ্ধা এসে হাজির হয়।

কিন্তু চতুর্থজন ঢুকতে ব্যর্থ হয়। ভেতরে প্রবেশপথ আটকে ঘোড়া আর তার আরোহীর ভূপাতিত হবার শব্দ বাবর শুনতে পায়। সে দূর্গের ভিতরে প্রবেশ করেছে বটে। কিন্তু তাকে সহায়তা করবার জন্য মাত্র তিনজন যোদ্ধা তার সাথে রয়েছে। চারপাশে তাকালে সে সারি সারি স্থাপিত উঁচু দরজার পেছন, সম্ভবত দূর্গের প্রধান সেনানিবাস থেকে পিলপিল করে লোকজনকে বের হয়ে আসতে দেখে। কেউ কেউ ইস্পাতের বর্ম গায়ে চাপাতে ব্যস্ত। আর বাকিরা ইতিমধ্যে অস্ত্রধারণ করেছে।

“আমার সাথে এসো! এখনই আক্রমণ করতে হবে!” বাবর পেটে খোঁচা দিয়ে পুনরায় তার ঘোড়ার গতি বৃদ্ধি করে। আর একটু পরেই তাকে তার তিনজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে আতঙ্কিত লোকগুলোকে কচুকাটা করতে দেখা যায়। সহসা একটা লম্বা লোক বাবরের নজর কাড়ে, যাকে দেখে সেনাপতিদের একজন বলে মনে হয়। ব্যাটকে মাথা নিচু করে পুনরায় ঘরের ভিতরে প্রবেশ করতে দেখলে সেও ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। কাঠের সরদলের নিচে দিয়ে ঝুঁকে পার হয়ে সে ভেতরের আধো অন্ধকারে চোখ পিটপিট করে প্রবেশ করতে যে বিশ ত্রিশজন সেখান থেকে বের হয়ে এসেছে, বুঝতে হবে সেটাই এই দূর্গের মোট জনবল। কেবল সেনাপতিগোছের লোকটাই এখন ভেতরে রয়েছে। লোকটা দৌড়ে একটা অস্ত্র সজ্জিত তাকের দিকে ছুটে গিয়ে সেখান থেকে একটা বর্শা আর ঢাল তুলে নিয়ে বাবরের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।

“ফারগানার ন্যায়সঙ্গত সুলতান, আমি বাবর তোমাকে আদেশ দিচ্ছি অস্ত্র নামিয়ে রাখো।”

“আমি আত্মসমর্পন করবো না। তোমাকে আমি সুলতান বলে মানি না। আমার নাম হানিফ খান। আমি তামবালের প্রতি অনুগত, সেই এখন পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। পারলে সম্মুখ যুদ্ধে আমাকে পরাস্ত করো।”

বাবর তার কালা পাহাড়ের উপর থেকে লাফিয়ে নামে এবং আলমগীর হাতে ধরা অবস্থায় হানিফ খানের দিকে এগিয়ে যায়। যে তক্কে তক্কে ছিলো বাবর তার। কাছাকাছি যেতেই হাতের বর্শা দিয়ে সে বাবরকে আঘাতের চেষ্টা করে। বাবর লাফিয়ে একপাশে সরে যায়। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে অর্ধভুক্ত খাবারে ভর্তি একটা নিচু টেবিলের পায়ার সাথে তার বাম পা আটকে যায়। বেকায়দা ভঙ্গিতে সে টেবিলের উপরে আছড়ে পড়ে। টেবিলের উপরে থাকা কাঠের পেয়ালা আর তার ভেতরের খাবার ছিটকে ফেলে। মাংসের সুরুয়া অর্ধেকটা ভর্তি একটা বিশাল ধাতব পাত্রের মুখে তার তরবারি ধরা হাতের কব্জি আটকে যেতে, আলমগীর তার মুঠো থেকে ছুটে যায়।

হানিফ খান বাবরের অসহায় অবস্থার সুযোগে তাকে একেবারে শেষ করে দেবার জন্য ছুটে আসে। তার বর্শাটা দু’হাতে মাথার উপরে তুলে বাবরের উন্মুক্ত গলায় সেটা সর্বশক্তিতে নামিয়ে আনবে। বাবর একটা কাঠের বড় বারকোশ তখন তুলে নিয়ে সেটাকে ঢালের মত ব্যবহার করে। বর্শা বারকোশে বিদ্ধ হয়। তবে সেটাকে ছিন্ন করতে পারে না। ছিটকে পড়া খাবারের উষ্ণ চটচটে সুরুয়ার ভিতরে গড়িয়ে একপাশে সরে যাবার সময়ে সে বারকোশটা ফেলে দিয়ে বর্শার হাতল ধরে মোচড় দেয় এবং হানিফ খানের হাত থেকে সেটা টেনে নেয়।

বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে হানিফ খান, লাফিয়ে পেছনে সরে গিয়ে কোমরের পরিকর থেকে একটা সরু খঞ্জর টেনে বের করে। আলমগীর কোথায় পড়েছে সেটা দেখার সময় নেই বাবরের, হাতের বর্শাটা দিয়ে সে লোকটাকে সজোরে আঘাত করলে ফলার মাথায় আটকানো বারকোশটা খুলে পড়ে। আর একই সময়ে, নিজের গালে সে একটা তীক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভব করে। হানিফ খান বাবরের গলা লক্ষ্য করে খঞ্জরটা চালিয়েছিলো কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। বাবর এবার বশার ফলাটা সজোরে তাকে লক্ষ্য করে আঘাত করে হানিফ খান একপাশে ঘুরে আঘাতটা এড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু ফলাটা তাকে বামদিকে স্পর্শ করলে সে টেবিলের পাশে রাখা শক্ত কুশনের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাবর এবার বর্শাটা মোচড় দেয় এবং মুহূর্ত মাত্র চিন্তা না করে প্রতিপক্ষের কণ্ঠনালী লক্ষ্য করে সজোরে বর্শাটা নামিয়ে এনে গালিচার উপরে তাকে গেথে ফেলে। যা অচিরেই ফিনকি দিয়ে রক্তে ভিজে লাল হয়ে যায়।

ইতিমধ্যে ওয়াজির খান, বাইসানগার আর বাকী লোকেরা এসে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে তার সাহসিকতার জন্য তাকে শুভেচ্ছা জানায়। দূর্গটা এখন তাদের দখলে। ফারগানা উদ্ধারের বন্ধুর পথে সে মাত্র প্রথম পদক্ষেপটা সাফল্যের সাথে রেখেছে। বাইরে বের হয়ে এসে বাবর দেখে আবার তুষারপাত শুরু হয়েছে। শত্রুর পড়ে থাকা দেহের চারপাশের লাল রঙ ইতিমধ্যে অনেকটাই ঢাকা পড়েছে। একটু আগে তামবালের চামচার ভবলীলা সে যেভাবে সাঙ্গ করেছে, সেভাবে পালের গোদাটাকে কখন মুঠোর ভেতরে পাবে সেই মুহূর্তটার জন্য সে অধীর হয়ে রয়েছে।

*

আর এভাবেই পুরো ঘটনাটার সূচনা হয়। বাবর একজন হানাদারে পরিণত হন। ঝটিকাবেগে আক্রমণ করেন এবং ফিরে যাবার সময় প্রতিবারই মৃত শত্রুর কারো একজনের মুখে রক্ত দিয়ে নিজের নাম লেখা একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে যান। আর তার সাফল্য ক্রমশ বাড়তে থাকে। তার বাহিনীর সংখ্যা, মিষ্টি কথা আর মধুর প্রতিশ্রুতি, সেই সাথে শক্তি বা তার অভিযানে প্রাপ্ত সম্পদের বিচক্ষণ ব্যবহার নতুন সমর্থকদের আকৃষ্ট করে এবং প্রতিপক্ষকে দলে টেনে, ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। মাটির দূর্গ দখলের বিশ মাসের মধ্যে, নিষ্ঠা আর একাগ্রতার সাথে একটার পরে একটা ছোট দূর্গ আর গ্রামের পর গ্রাম দখল করে ফারগানার পশ্চিমাঞ্চলের অধিকাংশই সে দখল করে নেয়। তার কৌশল কার্যকরী বলে প্রতীয়মান হয়। তামবাল আকশির উত্তর বা পশ্চিমে বাবরের শক্ত ঘাঁটির দিকে বেশিদূর অগ্রসর হবার মতো সাহস দেখায় না। আর বাবরও মনে করে এবার সময় হয়েছে নিজের দাবির কথা প্রকাশ করবার।

প্রথম দাবিটা সে ছয়মাস আগে জানায় এবং তারপরে প্রায়শই তার পুনরাবৃত্তি করেছিলো তার আম্মিজান, নানীজান আর বোনের মুক্তির বদলে এক বছর আকশি দূর্গ আক্রমণ না করবার প্রতিশ্রুতি। তিনমাস আগে তামবাল এক বার্তাবাহকের মাধ্যমে প্রেরিত এক চিঠিতে অনেক মধুর ভাষায় জানায় এসান দৌলত, খুতলাঘ নিগার আর খানজাদা প্রত্যেকেই সুস্থ আছে এবং শাহী পরিবারের উপযুক্ত ব্যবহারই করা হচ্ছে তাদের সাথে। কিন্তু চিঠিতে সে তাদের মুক্তি দেবার তার কোনো অভিপ্রায়ের কথা উল্লেখ করেনি।

বাবর এখন পূর্বদিকে পঞ্চাশ মাইল দূরে অবস্থিত শহর গাভার দিকে অগ্রসর হচ্ছে কিছুদিন আগে তামবাল ভাড়াটে চকরাখ যোদ্ধাদের সহায়তায় সেখানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে। সেখানে একটা হিসাব মেলানো এখনও বাকি আছে। সেখানকার দূর্গের চাকরাখ সর্দার তার সৎভাই আর তামবালকে শাহী প্রতিনিধি হিসাবে মেনে নিয়ে প্রথম আনুগত্য প্রদর্শনকারীদের অন্যতম। শহরটা দখল করলে তামবালকে আরেকটা জোরালো সঙ্কেত পাঠানো হবে যে, সময় হয়েছে বাবরের কাছে তার পরিবারকে ফেরত পাঠাবার।

এক ক্ষুদ্র নহরের পাশে সাময়িক যাত্রাবিরতি করে বাবর আর তার লোকেরা ঘোড়াগুলোকে পানি পান করার সুযোগ দেয়। ঘোড়ার দুধ থেকে তৈরি টক পনির কোনোক্রমে গলধঃকরণের ফাঁকে বাবর তাকিয়ে দেখে তার এক গুপ্তদূত ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে আসছে। বাবর চমকে উঠে দেখে তার পর্যানে একটা দেহ আড়াআড়িভাবে বাঁধা রয়েছে। লোকটার দিকে দৌড়ে গিয়ে বাবর চিৎকার করে জানতে চায়, “কি হয়েছিলো? এই লোকটা কে?”

“লোকটা একটা ব্যবসায়ী। পথের পাশে পেটে তরবারির আঘাত নিয়ে নিজেরই রক্তে অর্ধচেতন অবস্থায় পড়ে থাকার সময়ে তাকে আমি খুঁজে পেয়েছি। আমি তাকে আমার ঘোড়ার পিঠে তুলে নেবার কিছুক্ষণ পরেই বেচারা মারা যায়। অবশ্য মারা যাবার আগে সে আমাকে বলেছে যে আরও তিনজন ব্যবসায়ীর সাথে সে। এখান থেকে দশ মাইল দূরে একটা ছোট সরাইখানার উদ্দেশ্যে যাবার পথে তারা চকরাখ হানাদারদের হামলার শিকার হয়। তার তিন সঙ্গীকে হত্যা করে তাকেও মৃত ভেবে তাদের সব মালপত্র নিয়ে তারা চলে গেছে।”

“চকরাখ হানাদারদের অবশ্যই খুঁজে বের করে তার হত্যার আমরা বদলা নেবো। তোমার অধীনস্ত কয়েকজন গুপ্তদূতকে হত্যাকারীদের খুঁজতে পাঠাও।”

“সুলতান, আমার মনে হয় না তার কোনো দরকার আছে। বণিক লোকটা মারা যাবার আগে আমাকে বলেছে যে, সে চকরাখদের বলতে শুনেছে তারা সরাইখানায় যাচ্ছে, সেখানে আরও শিকার যদি তারা খুঁজে পায়…”

“তাহলে আমরা প্রথমে সরাইখানায় যাবো।”

***

গানের সুর বন্য আর কর্কশ চকরাখদের নিজেদের মতোই অনেকটা। মদের নেশায় চুরচুর হয়ে থাকা পুরুষদের কণ্ঠস্বর নতুন মাত্রায় উঠে এমন সব অশ্লীল ক্রিয়াকলাপের বর্ণনায় মেতেছে যা একাধারে শারিরীকভাবে অসম্ভব আর মোটাদাগের যে বাবর চেষ্টা করেও হাসি চাপতে পারে না। সে আড়চোখে ওয়াজির খানের দিকে তাকিয়ে দেখে সেও হাসছে।

লম্বা ঘাসের আড়ালে বাবর তার চারপাশে শুয়ে থাকা লোকদের ইশারা করে। সবাই। তারমতো পেটের উপরে ভর দিয়ে শুয়ে আছে, লুকিয়ে অপেক্ষা করছে। তারপরে সে গুঁড়ি মেরে মাটির ইট দিয়ে তৈরি একতলা সরাইখানার দিকে এগিয়ে যায় যেটা ফারগানার অন্যতম খরস্রোতা একটা নদীর অগভীর অংশের পাড়ে অবস্থিত। যেখানে হল্লাবাজেরা মচ্ছবে মেতেছে। নূপুরের নিক্কন ধ্বনি ভেসে আসতে বোঝা যায় ভেতরে বাইজি মেয়েরাও আছে। সেই সাথে কুপিত নারী কণ্ঠের সহসা একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার আর তার সঙ্গে ভেসে আসে- পুরুষ কণ্ঠের অট্টহাসি।

দুপুর মাত্র অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু বিশজন বা তার কিছু বেশি চাকরাখরা ইতিমধ্যেই বেহেড মাতাল হয়ে পড়েছে। তারা এমনকি তাদের ঘোড়াগুলিকে ঠিকমতো বাঁধার কষ্টও করেনি এবং কিছু ঘোড়া, যাদের কেশর পুরু আর লেজ এতো লম্বা যে মাটিতে ঘষা খাচ্ছে, ইতিমধ্যেই ছুটে পালিয়েছে। চারো ব্যবসায়ীর কাছ থেকে লুট করা মালামালও তারা ভিতরে নিয়ে যাবার গরজ দেখায়নি। বণিকদের মালবাহী ধুসর খচ্চরগুলো দড়ি দিয়ে একত্রে বাঁধা এবং মনোযোগ দিয়ে চরে বেড়াচ্ছে। তাদের পিঠে আটকানো বেতের ঝুড়িগুলো দেখে মনে হয় এখনও চামড়া আর লোমে ঠাসা। চাকরাখরা মনে হয় কেবল মদের পিপে নিয়ে সরাইখানার ভিতরে প্রবেশ করেছে।

বর্বর অসভ্য, বাবর ভাবে। তাদের কপালে আজ কি লেখা আছে সেটা এখনই ব্যাটারা টের পাবে। আর এই ভাবনাটা তাদের উৎফুল্ল করে তোলে। লম্বা ঘাসের উপরে মাথা তুলে বাবর চারপাশে তাকায়। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। সে ঠিক যেমনটা ভেবেছিলো, ঘোড়া বা মালামাল দেখার জন্য বাইরে কোনো বাচ্চাকে রাখার কথা ব্যাটাদের মাথাতেই আসেনি। সে এবার উঠে দাঁড়িয়ে, গুটিগুটি পায়ে সরাইখানার নীচু প্রবেশদ্বারের ডান দিকে মোটা দেয়ালের গায়ে জানালার মতো দেখতে একটা ফাঁকা জায়গার দিকে এগিয়ে গিয়ে ভেতরে সতর্কতার সাথে উঁকি দেয়। ঘরটা প্রায় খালি, কেবল ভেতরের দেয়ালের গায়ে ঠেকানো অবস্থায় একটা লম্বা কাঠের টেবিল দেখা যায়। কয়েকটা তেপায়া টুল আর একটা আধ ভাঙা বেঞ্চি দেখা যায়। ঘরের মাঝে মোটাসোটা, বোচা-নাকের একটা মেয়ে পরনে রঙচটা হলুদ রঙের ঢোলা সালোয়ারের উপরে লাল ফুলের ছাপ দেয়া একটা আঁটোসাঁটো কামিজ, পায়ে আর হাতের কব্জিতে ঘুঙুর বাঁধা। নীল সালোয়ার কামিজ পরিহিত লম্বা আরেকটা মেয়ে তার নোংরা হাতে একটা খঞ্জনী, বর্গাকার পাথরের মেঝের উপরে খালি পায়ে সজোরে পদাঘাত করে বৃত্তাকারে আবর্তিত হচ্ছে। সে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চকরাখদের কয়েকজন, ভেড়ার চামড়ার তৈরি টুপির নিচে তাদের গোলাকার মুখ ঘামে ভিজে আছে, টলোমলো পায়ে মেয়েদের বুকে পাছায় বৃথা চেষ্টা করে থাবা দিতে এবং মুখ থুবড়ে মাটিতে আছড়ে পড়লে তাদের সঙ্গীসাথীদের উদ্দীপনা আরও বেড়ে যায়।

এক কোণে ধোঁয়া উঠতে থাকা অগ্নিকুণ্ডের উপরে বিশাল একটা কেতলি ঝুলতে দেখা যায়। আরেক কোণে, বাবর এক চকরাখ দুবৃত্তকে কাপড় খুলে ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাল্কা হতে দেখে, দুর্গন্ধে তার সঙ্গীসাথীদের আপাতভাবে কোনো অসুবিধা হয় না। আরেক বদমাশ উঠে দাঁড়িয়ে হলুদ বমি বৃত্তচাপ তৈরি করে ছুঁড়ে ফেলে আবার বসে পড়ে আর মনোযোগ দিয়ে জামার হাতায় পড়া বমির ফোঁটা বড়বড় নখ দিয়ে টুসকি দেয়। বাবর পুনরায় মাথা নামিয়ে নেয়। সে যা দেখার তা দেখে নিয়েছে।

মাটিতে গুঁড়ি দিয়ে সে পুনরায় ওয়াজির খান যেখানে আছে সেখানে ফিরে আসে। “মদ্যপ আহাম্মকগুলো আমাদের হাতে মারা যাবার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। ব্যাটারা তাদের তরবারি আর ঢাল পর্যন্ত দরজার কাছে স্তূপ করে রেখেছে।”

ওয়াজির খানের একটা ক্ৰ উপরে উঠে যায়। “সুলতান, এখনই?”

“হ্যা!”

বাবর আর ওয়াজির খান উঠে দাঁড়িয়ে তাদের লোকদেরকেও উঠে দাঁড়াবার ইশারা করে। তারা এই কাজটা আগে এতোবার করেছে যে, মৌখিক আদেশের আর কোনো প্রয়োজন হয় না। ঠোঁটের উপরে আঙ্গুল চেপে, ওয়াজির খান ইশারায় ঘুরে কয়েকজনকে সরাইখানার পেছনে যেতে বলে। যদি সেখান দিয়ে পালাবার কোনো পথ থেকে থাকে। তারপরেই কেবল বাবর তার প্রিয় রণহুঙ্কারে চারপাশ প্রকম্পিত করে: “ফারগানা!”

বাবর একেবারে সামনে থেকে তার লোকদের নেতৃত্ব দেয়। মদের নেশায় মাতাল আর বিস্ময়ে আড়ষ্ঠ চকরাখরা সামান্যই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। বাবর আর তার লোকেরা নির্মমভাবে প্রতিপক্ষের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লে বোঁচা-নাকের সেই মেয়েটার কাছ থেকেই কেবল বলার মতো প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। মেয়েটা তার কাচুলির ভিতর থেকে একটা খঞ্জর বের করে এবং বাবরের বাহুতে সেটা মরিয়া ভঙ্গিতে গেথে দিতে চাইলে, বাবর অনায়াসে তার ঘুঙুর পরা হাতের কব্জি ধরে এবং তাকে ঘুরিয়ে দিয়ে তার নধর নিতম্বে বুট দিয়ে একটা সপাট লাথি বসিয়ে দিতে বেচারী ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে।

কয়েক মিনিটের ভিতরে সবকিছু শেষ হয় এবং বাবরের লোকদের হাঁপিয়ে ওঠার আগেই নিজেদের তরবারির ফলা পরিষ্কার করে কোষবদ্ধ করতে দেখা যায়। তার লোকদের গায়ে একটা আঁচড়ও লাগেনি। অবশ্য তার লোকদের সবাই পোড়খাওয়া যোদ্ধা, এসব মদ্যপ মাতালদের চেয়ে অনেক দক্ষ লোকদের সাথে তারা আগে লড়াই করেছে। “লাশগুলো বাইরে নিয়ে যাও দেখা যাক আমরা কাদের হত্যা করেছি,” বাবর আদেশটা দিয়ে কৃতজ্ঞচিত্তে দ্রুত পূতিগন্ধময়, ধোঁয়াটে ঘরটা থেকে বাইরের খোলা বাতাসে বের হয়ে আসে।

তার লোকেরা চকরাখদের লাশগুলি তাদের বুট-পরা পা ধরে হেঁচড়ে বাইরে এনে সারিবদ্ধভাবে সাজালে, বাবর লাশগুলো শুনে দেখে। মোট পনেরটা লাশ। কারো গলা দুভাগ হয়ে আছে, কোনোটা আবার কবন্ধ। তার লোকেরা অবশ্য কাটাপড়া মাথাগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। কোনোটার মাথায় তখনও ভেড়ার চামড়ার টুপি রয়েছে। কাটা মুণ্ডগুলোর দিকে তাকিয়ে যখন বাবর একটা বিশেষ মুখ চিনতে পারে, তখন তার মুখ থেকে সন্তুষ্টিসূচক একটা শব্দ ধ্বনিত হয়। তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এমন সব চকরাখকে সে হত্যা করবে বলে মনস্থ করেছে। এবং প্রতিটা হত্যাযজ্ঞ যা তাকে তার লক্ষ্যের নিকটবর্তী করছে প্রচণ্ড তৃপ্তিদায়ক।

তারস্বরের চিৎকার শুনে বাবর ঘুরে তাকায়। তার দু’জন যোদ্ধা বাইজি মেয়েদের ধরে তাদের টেনে সরাইখানার বাইরে বের করে আনে। “তাদের উপরে বল প্রয়োগ করবে না। আমার আদেশ তোমরা জানেনা। অর্থের বিনিময়ে যদি তারা স্বেচ্ছায় তোমাদের সঙ্গ দিতে রাজি হয় তবে সেটা আলাদা কথা।” কথাটা বলে বাবর আবার ঘুরে দাঁড়ায়।

দেখা যায় মেয়েগুলো আদতেই ব্যবসায়ী এবং কয়েক মুহূর্তের দ্রুত আলোচনার পরে, সরাইখানার পেছনের এক আপেল বাগিচায় তারা তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। বাবর ধারণা করে বাইজি দু’জন সরাইখানার শকুনের মতো দেখতে মালিকের মেয়ে হবে। যে ঝামেলার গন্ধ পাওয়া মাত্র সেই যে টেবিলের তলায় গিয়ে ঢুকেছে তারপরে আর বের হবার কথা চিন্তাও করেনি। আপেল বাগিচায় শীঘ্রই বাবরের লোকদের দল বেঁধে আসা যাওয়া করতে দেখা যায়। বাগান থেকে হাসিমুখে তাদের বের হয়ে আসা দেখে বোঝা যায় মেয়ে দু’জন তাদের বাবার সরাইখানায় আসা। অতিথিদের খেদমত করতে ভালোই অভ্যস্ত।

ওয়াজির খান ইতিমধ্যে চকরাখদের পালিয়ে যাওয়া ঘোড়াগুলো ধরে আনবার বন্দোবস্ত করেছেন এবং বণিকদের কাছ থেকে লুট করা মালপত্রগুলো পর্যবেক্ষণ। করছেন। “সুলতান, দেখেন,” দুটো উজ্জ্বল বর্ণের গালিচা বের করে সে বাবরের। দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করে। গালিচা দুটোর জেল্লা দেখে বোঝা যায় তন্তুবায়ের দল। সেটা বুননের সময়ে রেশমের সাথে উলের মিশ্রণ ঘটিয়েছে আর গালিচাগুলোর নকশাও অপরিচিত- বণিকের দলটা সম্ভবত পূর্বের, কাশগর থেকে এসেছিল। যেখানের তাঁতিরা এ ধরণের গালিচা তৈরিতে দক্ষ। উল আর চামড়া বেচে ভালো অর্থই পাওয়া যাবে, বাবর ভাবে, যা দিয়ে তার লোকদের সে বকেয়া বেতন দিতে পারবে।

তার যোদ্ধাদের জন্য একটা ভোজসভার আয়োজন করলে মন্দ হয় না। তারা ভালো। কাজ দেখিয়েছে এবং তারও উচিত এর মূল্যায়ন করা। পশ্চিমে, শাহরুখিয়ায় ফিরে যাওয়া মাত্রই সে এই ভোজসভার ঘোষণা দেবে। সেখানে, ছয়মাস আগে। তামবালের কাছ থেকে সে দূৰ্গটা ছিনিয়ে নিয়েছে এবং নিজের ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। সমরকন্দে খুন হবার আগে শাহরুখিয়ার সর্দার আলি মজিদ বেগের পূণ্য স্মৃতির প্রতি তারা তাদের শ্রদ্ধা জানাবে। তারা তার উপযুক্ত সন্তানের আত্মার মাগফেরাত কামনা করবে। যে তামবালের চকরাখ যোদ্ধাদের হাত থেকে দূর্গটা রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে। আলি মজিদ বেগের নিহত হবার সংবাদ ফারগানায় পৌঁছানো মাত্র তামবাল দূর্গটা দখল করতে তাদের পাঠিয়েছিলো।

নিজের বিশ্বস্ত সর্দারের কথা মনে পড়তে বাবরের ভাবনা বিষণ্ণ হয়ে উঠে। আজকাল তার প্রায়ই এমন হচ্ছে। সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারে আলি মজিদ বেগের মৃতদেহ প্রদর্শিত হবার পরের দু’বছরে সে কি অর্জন করেছে? নিজের পরিবারকে মুক্ত করার ব্যাপারে বা ফারগানা পুনরায় অধিকার করার ব্যাপারে সে কতটা অগ্রসর হয়েছে, সমরকন্দের কথা না হয় সে বাদই দিল? আর কতদিন তাকে সালতানাৎবিহীন একজন সুলতান হিসাবে দিন কাটাতে হবে? আকশি আক্রমণ করে তার পরিবারকে মুক্ত করে সিংহাসন পুনরুদ্ধার করার মতো একটা সেনাবাহিনী গঠন করা একটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আর সমরকন্দ, সেখানে শাসক হিসাবে কাটানো কয়েকটা দিন এখন কেবল ধূসর স্মৃতি। মাঝে মাঝে তার বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয় যে এমন কিছু আসলেই ঘটেছিলো। গ্রান্ড উজিরের কথাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো।

ভাবনাটা বাবরকে ক্রুদ্ধ করে তোলে। সে তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা কর্তিত মস্তকে লাথি বসিয়ে দিলে সেটা ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে। তার লোকদের যেমন, তারও বিনোদনের দরকার আছে। কয়েকটা ডাল কেটে পোলো খেলার লাঠি তৈরি করো।” সে চিৎকার করে বলে। “এইসব দুবৃত্তদের মাথা দিয়ে পোলো খেলা যাক। গোলপোস্ট হবে ঐ দূরের গাছগুলো।”

পুরো একটা ঘণ্টার জন্য, উদ্দাম খেলায় বাবর নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। চকরাখদের ক্ষিপ্রগামী টাটুঘোড়ার একটা নিয়ে সে একেবেঁকে দাবড়ে বেড়ায় এবং শাখাপ্রশাখা ছেটে ফেলা গাছের ডাল দিয়ে ছিন্ন মস্তকগুলোকে সজোরে আঘাত করে। যাতে ঘাসের উপর দিয়ে লাফাতে লাফাতে সেগুলো গড়িয়ে যায়। শীঘ্রই সেগুলোকে আর কাটা মাথা বলে চেনার কোনো উপায় থাকে না- নাক, কান গুঁড়িয়ে যায়, অক্ষিকোটর থেকে অক্ষিগোলক বের হয়ে আসে এবং বাবর আর তার ঘর্মাক্ত সাথী খেলোয়াড়েরা আর সেই সাথে তাদের সবার ঘোড়া, রক্তের ফুটকিতে চিত্রিত হয়ে উঠে।

অবশেষে খেলাটার প্রতি তার বিরক্তি জন্মায় কিন্তু ভেতরের জমে ওঠা হতাশা আর ক্ষোভ নিঃসৃত হওয়ায়, বাবর ঘামে ভিজে ওঠা ঘোড়াটাকে অবশেষে রেহাই দেয়। চারপাশে তাকাতে সে দেখে ওয়াজির খান তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। এই প্রথম সে তার চোখে বিরক্তি দেখতে পায়। কিন্তু বাবর তাতে বিন্দুমাত্র লজ্জি বোধ করে না। জীবিত বা মৃত, সে তার শত্রুদের সাথে তাদের প্রাপ্য ব্যবহারই করেছে।

“চলো এবার যাওয়া যাক।” সে আদেশ দেয়। “গাভা এখনও অনেক দূরে, আর আমাদের গৃহকর্তাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখাটা ঠিক হবে না।” বাবর ঘোড়ার পাঁজরে এত জোরে খোঁচা দেয় যে সেটা ছুটতে শুরু করে। বাবর সরাইখানা থেকে সোজা নদীর অগভীর অংশের দিকে এগিয়ে যায়।একবারও পেছনে ফিরে তাকায় না। আঙ্গিনায় পড়ে থাকা রক্তাক্ত মাথাগুলোকে ইতিমধ্যে কাকের দল ঠোকরাতে শুরু করেছে এবং সরাইখান মেয়ে দুটো পা ঈষৎ ধনুকের মত ফাঁক করে এগিয়ে গিয়ে চকরাখদের লাশগুলো হাতিয়ে দেখে যে বাবরের লোকেরা ভুলে কিছু রেখে। গেছে নাকি, যা তাদের বেশ্যাবৃত্তির পাওনার উপরি বলে বিবেচিত হতে পারে।

***

তিন সপ্তাহ পরে। উঁচু পাহাড়ী এলাকার তৃণভূমির উজ্জ্বল সবুজ ঘাসের মাঝে মাঝে ফুটে থাকা হলুদ গোলাপী আর সাদা ফুলের মাঝ দিয়ে বাবর আর তার লোকেরা দুলকি চালে ঘোড়া দাবড়ে শাহরুখিয়ার দিকে এগিয়ে যায়। গাভার অভিযানে ক্ষয়ক্ষতি হলেও তারাই জয়ী হয়েছে। তিনশ গজ দূরে ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা অবস্থায় বাবর নিজে তীর ছুঁড়ে দূর্গের সেনাপতিকে হত্যা করেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার নিজের ব্যবহৃত ছোট নিখুঁতভাবে বাঁকানো ধনুক দিয়ে তীর ছোঁড়ার অভ্যাসে কাজ হয়েছে। ত্রিশটা শর ভর্তি তূণীর সে এক মিনিটের ভিতরে খালি করে ফেলতে পারে।

সেনাপতি মারা যাবার পরে, প্রতিরোধকারীদের মনোবল ভেঙে যায়। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সেনানিবাসের সৈন্যরা কেবল আত্মসমর্পনই করেনি, নিজেদের লুটের মাল পুরো তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। যা বাবর আর তার লোকদের ঘোড়ার পিঠে ঝোলানো চামড়ার থলির উপচে পড়া আকৃতি সাক্ষ্য দিচ্ছে।

ওয়াজির খান খুব খুশি হবে। এবারের অভিযান বাবরকে তার বুড়ো বন্ধুটির সহায়তা ছাড়াই পরিচালনা করতে হয়েছে। সরাইখানা আক্রমণ করার পরের দিন ওয়াজির খানের ঘোড়া সাপের ভয়ে বেমাক্কা লাফিয়ে উঠতে সে পড়ে গিয়ে উরুতে ব্যথা পেয়েছিলো। বাবরের সনির্বন্ধ অনুরোধে তিনি শাহরুখিয়ায় ফিরে যেতে রাজি হন বাইসানগারের সাথে যোগ দিতে, যাকে তারা সেখানের নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়ে এসেছে।

আজ রাতে তারা বিজয় উদযাপন করবে। সে তার লোকদের সম্মান জানাতে তাদের মাঝে উলুশ বিতরণ করবে। যোদ্ধাদের ভিতরে যারা সবচেয়ে সাহসিকতা আর বীরত্ব প্রদর্শন করেছে প্রথা অনুযায়ী আজ সে ভোজসভার শেষে তাদের মাঝে লুটের মালের সিংহভাগ বিলিয়ে দেবে এবং বাইসানগার আর ওয়াজির খানকে গাভা আক্রমণের কাহিনী শোনাবে। তার গল্প শুনে ওয়াজির খান সম্ভবত হেসে অস্থির হবেন এবং সদা গম্ভীর বাইসানগারের মুখেও সে আজ হয়তো হাসির আভাস দেখতে পাবে।

পাথরের তৈরি দূর্গের অভ্যন্তরস্থ প্রাঙ্গনে প্রবেশের সাথে সাথে, বাবর তার ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে তাদের খোঁজে আশেপাশে তাকায়। বাইসানগারকে সে কোথাও খুঁজে পায় না। কিন্তু ওয়াজির খানকে আস্তাবলের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার খুরের উপরের আর পেছনের অংশের কেশগুচ্ছ পর্যবেক্ষণ করতে দেখে। তার বুড়ো বান্ধবকে সামান্য খোঁড়াতে খোঁড়াতে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলে: বাবর ভ্রূ কোঁচকায়। তারপরে সে তাকিয়ে দেখে ওয়াজির খানের মুখ আনন্দে আলোকিত হয়ে রয়েছে।

“সুলতান, দারুণ সুখবর আছে! সত্যিই চমকে দেবার মত সুখবর!”

“কি হয়েছে?”

“এক সপ্তাহ আগে আকশি থেকে এক বার্তাবাহক এসেছে। আপনার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীরের পক্ষে তামবালের বাণী নিয়ে সে এসেছে। অন্তত বার্তাবাহকের তাই ভাষ্য এবং সে বলেছে তারা আপনার আম্মিজান, নানীজান আর আপনার বোনকে আপনার কাছে পাঠাতে সম্মত আছেন।”

“সে কি এর বিনিময়ে কিছু দাবি করেছে?”

“সুলতান, প্রকাশ্যে তারা কিছু দাবি করেনি। আপনাকে সে কতোটা শ্রদ্ধা করে কেবল সে সম্পর্কে কিছু মধুর বাক্য ছাড়া।”

বাবরের হৃৎপিণ্ড আনন্দে নেচে উঠে। তার পরিবার শীঘ্রই তার সাথে মিলিত হবে। এই খবরটা আবার তাকে আবেগতাড়িত করে তোলে।

“তারা এখানে কবে নাগাদ পৌঁছাবে?”

“সবকিছু ঠিক থাকলে আগামীকাল সূর্যাস্ত নাগাদ তাদের এখানে পৌঁছাবার কথা।”

পরের দিন সন্ধ্যাবেলা, গোধূলির অস্তমিত আলোয় বাবরকে দূর্গের প্রকারবেষ্টিত সমতল ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আজকের দিনের অধিকাংশ সময় সে এখানেই কাটিয়েছে। অস্থিরচিত্তে রাস্তাটা যেখানে একটা গিরিখাদের দিকে বাঁক নিয়েছে, সেদিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে। ঘনায়মান আধো-অন্ধকারের ভিতর থেকে সে পিঠের দুপাশে ঝুড়ি ঝুলছে উটের এমন একটা তরঙ্গায়িত সারিকে বাঁক ঘুরে এগিয়ে আসতে দেখে। তাদের ঠিক পেছনেই রয়েছে যাত্রার শেষ পর্যায়ে মেয়েদের অভ্যর্থনা জানাতে। আর তাদের নিরাপদে দূর্গে নিয়ে আসবার জন্য, ওয়াজির খানের পরামর্শে, বাইসানগারের অধীনে পাঠানো সৈন্যবাহিনীর একটা চৌকষ দল।

বাবর এতদূর থেকে ঝুড়িতে ভ্রমণকারীদের চেহারা দেখতে পায় না। নিজেকে আর সামলে রাখতে না পেরে, এবং দেহরক্ষীদের কাউকে ডাকবার বা ঘোড়ার পিঠে জিন চাপাবার মতো ধৈর্যের মারাত্মক অভাব দেখা দেয়ায়, সে লাফিয়ে একটা খালি ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে এবং সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত তৃণভূমির উপর দিয়ে ছোট কাফেলাটার দিকে ছুটে যায়।

তার রোদে পোড়া গাল বেয়ে দরদর করে কান্না ঝরতে থাকে। কিন্তু সেসব সে মোটেই পরোয়া করে না। আশেপাশে কেউ নেই তার কান্না দেখবার মতো এবং তার চেয়েও বড় কথা, দেখলে দেখুক সে থোড়াই পরোয়া করে। দুর্বলতার না, আজ এটা আনন্দের অশ্রু। এক হাতে ঘোড়ার কেশর আঁকড়ে ধরে সে অন্য হাতে গাল থেকে কান্না মুছে। বাবর ঘোড়াটার কানে কানে তাকে এমন গতিতে ছুটতে বলে, যাতে মনে হয় হঠাৎ তার পাখা গজিয়েছে।

কাফেলাটাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে আনা সৈন্যদের থেকে চারজন সহসা আলাদা হয়ে বর্শা নিচু করে তার দিকে এগিয়ে আসে। যদিও বাইসানগার সম্ভবত ধারণা করতে পেরেছিলো খালি ঘোড়ার পিঠে এমন উদ্দাম ভঙ্গিতে কে তাদের দিকে ছুটে আসছে। কিন্তু তার মত অভিজ্ঞ পোড়খাওয়া যোদ্ধা তার কাছে এটাই প্রত্যাশিত যে সে নিজের লোকদের আদেশ দিয়েছে তার পরিচয় নিশ্চিত করতে। অশ্বারোহী দল নিকটবর্তী হতে, বাবর জোর করে নিজের ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তাকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য করে। ঘামে জবজব করতে থাকা দেহে নাক ঝেড়ে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করে ঘোড়াটা।

বাবর মাথাটা পেছনে হেলিয়ে দিয়ে তার পূর্বপুরুষের রণহুঙ্কার কণ্ঠে তুলে নেয়। “ফারগানা!”

অশ্বারোহী দল এখন আরো কাছে চলে আসায় তারা তাকে চিনতে পেরে অভিবাদন জানায়। বাবর কোনোমতে তাদের অভিবাদনের জবাব দিয়ে উটের কাফেলা যেখানে যাত্রা বিরতি করেছে সেদিকে ঘোড়া ছোটায়। তার হৃদয় যদি আবেগে ভারাক্রান্ত না থাকত অন্যসময় হলে তাহলে সে হয়তো বাজারে নিয়ে যাওয়া মুরগীর মতো ভীরু ভঙ্গিতে বেতের ঝুড়ির ভিতর থেকে এসান দৌলতের উঁকি দেবার হাস্যকর ভঙ্গি দেখে হয়তো হেসেই ফেলতো। তার ওজন এতোটাই হাল্কা যে অন্যপাশের ঝুড়িতে ভারসাম্য রক্ষার জন্য বাঁধাকপির চেয়ে ভারী কিছু রাখতে হয়নি। আর তার বীণা ঝুড়ির বাইরে চামড়ার ফালি দিয়ে আটকানো রয়েছে। একটা বিশাল পুরু লোমের দুধসাদা রঙের উট যা বাবরকে এগোতে দেখে পচাৎ করে থুতু ফেলে সেটার দু’পাশে দুটো ঝুড়িতে খুতলাঘ নিগার আর খানজাদা আরোহন করেছেন। উটের পেছনে বাবর তার আম্মিজানের পরিচারিকা দলের কয়েকজন পরিচিত সদস্য, যাদের ভিতরে ফাতিমাও রয়েছে আর তার উজির কাশিমকে দেখতে পায়।

উটের চালকরা লাফিয়ে নেমে, উটের গ্রন্থিযুক্ত হাঁটুতে তাদের হাতের লাঠি দিয়ে আঘাত করে উটগুলোকে বাধ্য করে মাটিতে বসতে। বয়োবৃদ্ধ হবার কারণে, বাবর দৌড়ে প্রথমে এসান দৌলতের কাছে যায় এবং হাঁটু মুড়ে বসে তাকে আলতো করে ঝুড়ি থেকে তুলে আনে। বাবর কোনো কথা খুঁজে পায় না, আর এই প্রথমবারেরমতো মুখরা এসান দৌলতও বাক্যহারা হয়ে পড়েন। সে টের পায় নানীজান তার মাথা আলতো স্পর্শ করেন। সে উঠে দাঁড়িয়ে তার ছোট ছোট উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকালে সেখানে তার পুরানো সত্ত্বার ঝলক দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। নানীজানকে এখন তিনি বরাবর যার জন্য গর্ব করেন,সেই খামের- চেঙ্গিস খানের রক্তের উত্তরসুরী এক নারীর মতোই দেখাচ্ছে।

সে এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে তার আম্মিজানকে ঝুড়ি থেকে তুলে মাটিতে নামিয়ে দেয় এবং তাকে জড়িয়ে ধরে তার আশৈশব পরিচিত চন্দনকাঠের উষ্ণ সুগন্ধে বুক ভরে শ্বাস নেয়। সে তার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাকিয়ে দেখে আম্মিজানের চোখে অশ্রু টলটল করছে। “বাছা তোমাকে আবার দেখতে পেয়ে খুশি হলাম,” কোনো রকমের আবেগ না দেখিয়ে তিনি বলেন, এবং তার মুখে একটা হাসির আভাস ফুটে উঠে যা বাবরের যেমনটা মনে আছে তার চেয়েও ম্লান এবং বলিরেখায় আকীর্ণ।

খানজাদা ইতিমধ্যে তাকে বহনকারী ঝুড়ি থেকে নিজেই ধড়ফড় করে নেমে এসেছে। এবং সে সোজা ভাইকে লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার পোষা বেজী যেটা সে বামহাতে ধরে রেখেছে, কুইকুই করে প্রতিবাদ জানায়। শেষবার বাবর তার বোনকে দেখেছিলো হাড্ডিসার একটা মেয়ে, যার মুখে কয়েকটা দাগ রয়েছে। খানজাদা এখন রীতিমত একজন মহিলাতে পরিণত হয়েছে, তার দেহে ভরা নদীর জোয়ার বইছে। মুখ আগের চেয়ে অনেক দাগহীন আর সুন্দর। কিন্তু ফিচেল হাসি আগের মতোই আছে দেখে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সে তাকে জড়িয়ে ধরে এবং তারপরে ছেড়ে দিয়ে এক পা পিছিয়ে আসে ভালো করে তাকে দেখবে বলে।

খানজাদাও কম যায় না সেও ভাইকে জরিপ করে। “তুমি লম্বা হয়েছে।” সে বলে, “আর তোমার কাঁধ আগের চেয়ে চওড়া হয়েছে। কিন্তু একি চেহারা হয়েছে। তোমার থুতনিতে ছাগলের মত দাড়ি আর চুলের অবস্থা যাচ্ছেতাই- তোমার চুল দেখছি আমার মত লম্বা! আর নখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না- কালো হয়ে আছে।”

বাবর পেছন থেকে, খানজাদার নাক কোঁচকানো বিশেষণগুলোর সমর্থনে এসান দৌলতকে জিহ্বা আর টাকরার সাহায্যে একটা শব্দ করতে শোনে এবং সে হেসে ফেলে। অবশেষে তার প্রিয়জনেরা তার কাছে এসেছে এবং সবকিছু যেমনটা থাকার কথা তেমনই রয়েছে। তাদের সাথে সে পরে কথা বলবে এবং শুনবে বিগত দিনগুলো তাদের কেমন কেটেছে। কিন্তু এখনকার মতো এই যথেষ্ট।

তারা দূর্গের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। অবশেষে মুক্তি লাভ করা ফারগানার শাহী রমণীদের অভ্যর্থনা জানাতে তূর্যনিনাদ আর রণভেরী গমগম আওয়াজে বেজে উঠে- অন্তত এখনকার জন্য হলেও তারা নিরাপদ।

দূর্গের উপরের তলায় প্রস্তুত রাখা জেনানামহলে মেয়েদের পৌঁছে দিয়ে, বাবর তার বঁধুনিকে ডেকে পাঠায়। তার পরিকল্পিত ভোজসভার সব আয়োজন কি অবস্থায় আছে তা জানতে। এখানের ভোজসভা সমরকন্দের মতো জাঁকজমকপূর্ণ হবে না। যেভাবে সে তাদের অভ্যর্থনা জানাতে চেয়েছিলো। অবশ্য, তাহলেও বিশটা ভেড়া জবাই করা হয়েছে আর আঙ্গিনায় সেগুলোকে আগুনে ঝলসানো হচ্ছে। মুরগীর পালক ছাড়িয়ে, আখরোট আর খুবানির সাথে মাখন দিয়ে সিদ্ধ করা হচ্ছে। আস্ত আপেল ঘন সোনালী বর্ণের মধু আর লাল রসে ভরা ডালিমের দানার সাথে কাঠবাদাম আর পেস্তার মিশ্রণে চিকচিক করছে। তাদের কোনো এক অভিযানে তার লোকদের লুট করা রূপালি বর্ণের কাঠবাদামের স্তূপের দিকে সে বিশেষ সন্তুষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। এসান দৌলত অন্য যে কোনো মিষ্টির চেয়ে এগুলো বেশি পছন্দ করেন।

নির্মেঘ, তারা-শোভিত আকাশে চাঁদ উঠলে, এবং কোনো আকষ্মিক হামলা থেকে আগেই সাবধান করতে দূর্গপ্রাকারে সৈন্য মোতায়েন করে ভোজসভা শুরু হয়। বাবর আর তার লোকেরা নিচুলার একটা নিচু, লম্বা কামরায় আহার সারে। যখন উপরে নিজেদের কামরায় মেয়েদের তাদের পছন্দের অংশ পরিবেশন করা হয়। মোমবাতির কাঁপা আলোতে বাবরের লোকেরা উদাত্ত কণ্ঠে গান শুরু করে। বাকীরা যে নিচু কাঠের টেবিলের চারপাশে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে আছে তাতে চাকুর বাট দিয়ে আঘাত করে তাল দেয়। বাবর ভাবে, তার লোকেরা খুশি হয়েছে। মেয়েদের মুক্তিতে তারাও প্রীত হয়েছে। তার সাথে সাথে তার লোকদেরও এটা সম্মানহানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো- যেনো মেয়েদের মুক্ত করার সামর্থ্য তাদের নেই।

বাবর খেতে চেষ্টা করে কিন্তু কিছুই খেতে পারে না। তার ইচ্ছা করে এখান থেকে উঠে যায় এবং তার আম্মিজান, খানজাদা আর এসান দৌলতের সাথে নিভৃতে সময় কাটায়। কিন্তু তার অনুসারীদের প্রতি সৌজন্যতাবশত তাকে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। গানের মাত্রা ধীরে ধীরে চড়তে শুরু করে এবং ক্রমশ কর্কশ হয়ে উঠে। যোদ্ধার দল উচ্চকণ্ঠে নিজেদের পূর্বপুরুষের বীরত্বের কথা বয়ান করতে থাকে এবং বাবরও এবার তাদের সাথে কণ্ঠ মেলায়। কিন্তু অবশেষে, কেউ কেউ টেবিলের উপরে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে। আর অন্যেরা ঝাপসা চোখে টলোমলো পায়ে কামরা থেকে বের হয়ে বাইরের আঙ্গিনায় নিজেদের হাল্কা করতে শুরু করলে, বাবর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পাথরের বাঁকানো সিঁড়ি বেয়ে জেনানামহলের দিকে রওয়ানা দেয়।

খুতলাঘ নিগার দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাকে স্বাগত জানায় এবং সে ভিতরে প্রবেশ করে গালিচা পাতা মেঝেতে তার পাশে এসে বসে। তাদের সামনের পিতলের থালায় পড়ে থাকা খাবারের অবশিষ্টাংশ দেখে সে বুঝতে পারে মেয়েরা ভালমতোই খেয়েছে। কিন্তু তারপরেও সে এখন যখন তাদের মুখের দিকে তাকায় সেখানে সে একটা টানটান অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে। তাদের তিনজনকেই ফ্যাকাশে আর বিবর্ণ দেখায়। যেনো বহুকাল সূর্যের আলোর উষ্ণতা অনুভব করেনি বা তাজা বাতাসে তারা শ্বাস নেয়নি। কাউকে না কাউকে অবশ্যই এর মূল্য দিতে হবে- রক্ত দিয়ে। কিন্তু মেয়েদের খাতিরে আপাতত সে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে না। তারা যাই বলুক তাকে, সে অবশ্যই সব কিছু শান্ত ভঙ্গিতে শুনবে।

কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ বসে থাকে। প্রাথমিক উত্তেজনা প্রশমিত হতে, কেউই বুঝতে পারে না কোথা থেকে শুরু করা উচিত।

অবশেষে এসান দৌলত শুরু করেন: “বাবর তুমি তাহলে সরমকল দখল করেছিলে।” তার বিচক্ষণ মুখে বিরল একটা হাসির আভাস ফুটে উঠে।

“অধিকার করেছিলাম বটে, কিন্তু দখলে রাখতে পারিনি।” বাবর তার মাথা নিচু করে। এমন কিছু কথা আছে যা তাকে বলতেই হবে। “নানীজান, আমি আপনাকে হতাশ করেছি। আপনি আমার সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন এবং আমি সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমার আসতে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল আর লোকজন ছিল অনেক অল্প।”

“আমাদের তুমি মোটেই হতাশ করনি। আর জেনে রেখো, আমাদের কারণেই তুমি সমরকন্দ হারিয়েছে। আমাদের সাহায্য করার জন্য তুমি সাথে সাথে যাত্রা করেছিলে। তুমি এরচেয়ে বেশি আর কিইবা করতে পারতে?”

বাবর আক্ষেপের সাথে মাথা নাড়ে। “ফারগানা আর আপনারা ছিলেন আমার প্রধান দায়িত্ব। সমরকন্দে আমি নতুন কোনো খেলনা হাতে পাওয়া শিশুর মতো আচরণ করেছিলাম। আমার তখন অন্য কিছু সম্বন্ধে ভাববার সামান্যই অবকাশ ছিলো। আপনাদের আর ফারগানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমার উচিত ছিলো ওয়াজির খানকে পাঠিয়ে দেয়া।” সে তার মায়ের গায়ে হেলান দেয় এবং বরাবরের মতোই মায়ের আঙ্গুল তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে টের পায়। এতে সে কিছুটা শান্ত হয়।

“কিছু কিছু বিষয় তামবাল আমাদের কাছে কখনও গোপন করেনি।” খুতলাঘ নিগার বলেন। “আমার মনে হয় এতে সে আনন্দই পেতো। আমরা, তোমার চাচাতো ভাই মাহমুদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা অবশ্যই জানি- আমরা জানি সেই সমরকন্দ তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। বাছা, সে আর তামবাল মিলে তোমার জন্য একটা ফাঁদ পেতেছিলো। তারা দু’জনে মিলে ঠিক করেছিলো, ফারগানায় সে তোমাকে মসনদ থেকে সরিয়ে দিয়ে জাহাঙ্গীরকে তোমার স্থলাভিষিক্ত করবে। তারা জানতো এর ফলে তুমি বাধ্য হবে- তোমার বেশিরভাগ সৈন্য নিয়ে ফারগানায় ফিরে আসতে। আর মাহমুদ এর ফলে তার কাঙ্ক্ষিত সুযোগ পায়। তুমি তখন সদ্য সমরকন্দের সুলতান হয়েছে। তারা বলেছে যে সেখানকার অভিজাত ব্যক্তিরা তোমার প্রতি তেমন একটা আনুগত্য বোধ না করায়, মাহমুদ আর তার কলহপ্রিয় স্ত্রী, গ্রান্ড উজিরের কন্যা সহজেই ঘুষ দিয়ে তাদের কিনতে পেরেছে।”

নিজের সবচেয়ে জঘন্য সন্দেহটা প্রমাণিত হতে বাবর চোখ বন্ধ করে ফেলে। কি আহাম্মকই না সে ছিলো।

“তোমার এটাও জেনে রাখা উচিত, মাহমুদের স্ত্রীর কারণে সে গো ধরায় আলি মজিদ বেগকে হত্যা করা হয়েছিলো।” এসান দৌলতের কণ্ঠস্বর তিক্ত শোনায়। নিহত গোত্রপতির মা ছিলো তার বান্ধবী আর তিনি নিজেও তাকে পছন্দই করতেন। “সে নাকি বলেছে তোমার শিরোচ্ছেদ করতে না পারায়, তাকে শিরোচ্ছেদ করলেই আপাতত চলবে- তার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ হিসাবে। মাহমুদ তার কথা ফেলতে পারেনি। সবাই বলে সেই আসলে সমরকন্দের নতুন শাসক। নিজের বাবার চেয়েও সে বেশি লোভী আর প্রতিহিংসাপরায়ণ।”

বাবর বিস্ময়ে চোখ পিটপিট করে। সে ভাবতেও পারেনি সেই সুঠামদেহী তরুণী, যে এমন সাহসিকতার সাথে গ্রান্ড উজিরের প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলো কিভাবে এতো অনুভূতিহীন নিষ্ঠুর আর নির্মম হতে পারে। একদিন তাকে অবশ্যই তার এই স্পর্ধার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু সেটা পরেও হতে পারে। তার আগে তাকে অন্য অনেক বিষয় জানতে হবে এবং সেগুলো মেনে নিতে হবে।

সে আলতো করে দু’হাতের মাঝে মায়ের হাত জড়িয়ে ধরে। “আমাকে তোমাদের কথা বলল। তোমরা বন্দি থাকা অবস্থায় কেমন আচরণ করছে তারা তোমাদের সাথে?”

“কয়েকজন মাত্র পরিচারকসহ আমাদের একটা ছোট জায়গায় আটকে রাখা হয়েছিলো কিন্তু আমাদের বংশ গৌরব আর মর্যাদার কারণে তারা বাধ্য হয়েছিলো আমাদের যথাযথ সম্মান দেখাতে। তামবাল আমাদের অপমান বা হুমকি দেয়নি।” তার মা বলে, “আর সম্প্রতি- সম্ভবত তোমার সাফল্যের কথা যখন সে জানতে পারে- আমাদের বড় একটা মহলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।”

“আর সে রোক্সানাকে আমাদের গহনা কেড়ে নিতে দেয়নি। অবশ্য অন্যদের মুখে শুনেছি সে ক্রুদ্ধ হয়ে চেঁচামেচি করেছে, যদিও সে তামবালের অঙ্কশায়িনী ছিলো।” এসান দৌলত কুপিত কণ্ঠে কথাগুলো বলেন।

“আর আমার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীর? এসবে তার ভূমিকা কতটুকু?” বাবর প্রায়ই তার স্থান দখল করে নেয়া বালকটার কথা ভাবে যাকে সে কখনও দেখেনি। শেষবার আকশি থেকে আসবার সময়ে, সমরকন্দ অবরোধের প্রস্তুতি নেবার সময়ে, ছোঁড়া অসুস্থ ছিলো।

“বেচারা পরিস্থিতির শিকার, আর প্রায়ই অসুস্থ থাকে। তামবালের পুরো শরীরে কয়েক চামচ পরিমাণ রাজরক্ত থাকায় সে কখনও নিজে সিংহাসন দাবি করতে পারবে না। অন্য গোত্রপতিরা সেটা তাকে করতেও দেবে না। কিন্তু জাহাঙ্গীরের রাজপ্রতিভূ হিসাবে যে ক্ষমতার জন্য সে লালায়িত সেটা অর্জন করতে পারবে।” এসান দৌলত ভাবাবেগশূন্য কণ্ঠে কথাগুলো বলেন। “সে এখন তোমাকে ভয় পায়। সে যদি তোমাকে খুশি করতে না চাইতো, তাহলে আমাদের এতো সহজে মুক্তি দিতো না?”

সুলতান হিসাবে বাবর নিজের প্রথম দিনগুলোর কথা ভাবে, তার মনে পড়ে তামবাল তখন কিভাবে অন্য নেতাদের মনে সন্দেহের বীজ বপনের চেষ্টা করেছে। সব সময়ে সে নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিবৃত্ত করার চেষ্টারত ছিলো। কী সাংঘাতিক সুবিধাবাদি এক লোক- কামবার আলীর ষড়যন্ত্রে যোগ দেবার ব্যাপারে ভীষণ বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে সঠিক সময়ের জন্য ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করেছে। এজন্যই কি সমরকন্দ দুবার অবরোধ করতে সে তাকে প্ররোচিত করেছিলো? বাইসানগার যখন তৈমূরের অঙ্গুরীয় নিয়ে এসেছিল তখন আগ্রহে চকচক করতে থাকা তামবালের চেহারা তার এখনও মনে আছে। তার আরো মনে আছে, সমরকন্দ অধিকার করার পরে কি রকম তাড়াহুড়ো করে সে ফারগানা ফিরে এসেছিলো।

“আমাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন সময় ছিলো প্রথম কয়েক মাস, যখন আমরা জানতাম না তোমার ভাগ্যে কি ঘটেছে। ফাতিমা- তুমি জান সে কেমন গপ্পোবাজ সে একবার একটা কথা শুনে আসে- একটা গুজব কিন্তু সেটাই আমাদের আতঙ্কিত করে তোলার জন্য যথেষ্ট ছিলো- যে তুমি ফারগানায় ফিরে আসার সময়ে পথে অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছে। তার মায়ের কণ্ঠস্বর কেঁপে যায়। কিন্তু তারপরেই আমরা শুনতে পাই যে তুমি সুস্থ আছো, আর পাহাড়ে আত্মগোপন করে রয়েছে। আমরা জানতাম না কোনটা সত্যি। যতদিন না তামবাল ক্রুদ্ধ হয়ে আমাদের কাছে আসে…সে আমাদের বলে তুমি গ্রামের পর গ্রাম আক্রমণ করে, সবকিছু জ্বালিয়ে দিচ্ছ, তছনচ করে দিচ্ছ এবং নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছো, কাউকে রেয়াত না দিয়ে।”

“তামবাল যা বলেছে, সেটাই তাহলে সত্যি, তাই না বাবর? যে তুমি একজন সাধারণ দস্যু আর গরু-চোরে পরিণত হয়েছো?” এসান দৌলত প্রশ্রয়ের কণ্ঠে বলেন।

বাবর সম্মতি প্রকাশ করে মাথা নাড়ে এবং মুহূর্ত পরে নানীজানের দিকে তাকিয়ে সেঁতো হাসি হাসে। তার মা আর নানী তার সম্বন্ধে কি ভাববে সেটা নিয়ে সে প্রায়ই দুশ্চিন্তা করতো। তারা কি কখনও বুঝতে পারবে কেনো একজন শাহজাদা পাহাড়ী দুৰ্বত্তের জীবন গ্রহণ বাস্তবিক পক্ষে উপভোগ করতে পারে।”

“বাবর, আমাদের সেসব কথা বল।”

পশুর চর্বি দিয়ে তৈরি মোমবাতির দপদপ করতে থাকা শিখা নিভু নিভু হয়ে আসতে, বাবর তার সময় কিভাবে কেটেছে সেটা তাদের কাছে বর্ণনা করতে চেষ্টা করে। দুইশ কি তিনশ অভিযাত্রীর একটা বাহিনী নিয়ে, পাহাড়ের উপর থেকে ধেয়ে আসবার উত্তেজনাই আলাদা। রাতের বেলা তামবালের অনুগত বাহিনীর দূর্গ ঝটিকা আক্রমণের উল্লাস। আর তার পরে রাতের আঁধারে হারিয়ে যাবার, তার পর্যাণে বাধা শিকারের ছিন্নমস্তক থেকে টপটপ করে ঝরে পড়া রক্তের ধারার অনুপ্রেরণা। প্রাচীন মোঙ্গল প্রণালী অনুসরণে তার দলের এক লোক। ঘোড়ার দুধ গজিয়ে যে খভাস তৈরি করতো সেটা পান করার কারণে মাথা ঘুরতে থাকলে সারা রাত ধরে পানোন্মত্ত অবস্থায় ফুর্তি করা। চকরাখদের ছিন্নমস্তক দিয়ে উদ্দাম পোলো খেলার কথা সে কেবল এড়িয়ে যায়। যদিও খানজাদাকে হয়তো পরে সে সেটাও বলবে। তার কথা বলার সময়ে খানজাদার চোখ চকচক করতে থাকে। তার হাতের মুঠি খোলে আর বন্ধ হয়, যেনো সে নিজে সেখানে ছিলো। তার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। এসান দৌলতও মগ্ন হয়ে শোনেন। কিন্তু সে খেয়াল করে মৃত্যুর করাল থাবার হাত থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যাবার ঘটনাগুলো শোনার সময়ে তার মায়ের ভ্রু কুঁচকে উঠে।

“আমি কিন্তু কেবল যারা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাদেরই আক্রমণ করেছি। আর আমি কখনও তোমাদের কথা ভুলে যাইনি। তোমাদের স্বাধীনতা আমার মসনদের চেয়েও বেশি কাম্য ছিল আমার কাছে।” চারপাশে তাকিয়ে, বাবর দেখে গবাক্ষের সরু ফাঁক দিয়ে ফ্যাকাশে, ধুসর আলোর একটা ধারা লুকিয়ে কখন যেন কামরায় প্রবেশ করেছে। প্রায় সকাল হয়ে এসেছে।

“তুমি এটা অর্জন করেছে। কিন্তু যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে। এখন আমাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হবে।” এসান দৌলতের কণ্ঠে একটা সতেজতা ফুটে থাকে এবং তার দৃষ্টি বাবর নিজের উপরে অনুভব করলে সে অস্বস্তিবোধ করে, যেন কোনো বাচ্চা ছেলে এখনই তার ওস্তাদের কাছে ধমক খাবে। “বাবর, তুমি এই ক’দিনে কি শিখেছো?” নানীজান তার দিকে ঝুঁকে এসে তার কব্জি আঁকড়ে ধরে। “ তোমার কথা অনুযায়ী মসনদহীন দিনগুলো থেকে তুমি কি শিখেছো?”

যুক্তিসঙ্গত একটা প্রশ্ন। এই বিপজ্জনক, মরীয়া সময় তাকে কি শিক্ষা দিয়েছে? “বিশ্বস্ত বন্ধু আর মিত্রের গুরুত্ব,” সে অবশেষে কথা খুঁজে পেয়ে বলে, “এবং তাদের যোগ্যতা অনুসারে প্রতিদান দেয়া। এছাড়া পরিষ্কার উদ্দেশ্য, একাগ্রচিত্ত কৌশল আর সেটা অর্জনের পথে কোনো কিছুকে বাধা হিসাবে গণ্য না করার প্রয়োজনীয়তা।”

এসান দৌলত সন্তুষ্টির মাথা নাড়েন। “অবশ্যই। এবং এছাড়া আর কি?”

“আমি শিখেছি একজন সুলতানের পক্ষে সবসময়ে উদারতা দেখান সম্ভব না, শ্রদ্ধা অর্জনের জন্য তাকে কঠোর হতে হবে- কখনও নির্মম। অন্যথায় তাকে দুর্বল মনে হবে। নেতৃত্ব দেবার বদলে সবার ভালবাসার পাত্রে পরিণত হবার ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। আর সেই সাথে মিষ্টিভাষী ষড়যন্ত্রকারীর ফাঁদে পা দিয়ে বসতে পারে। আমি শিখেছিঃ আনুগত্য অর্জন করতে হলে কেবল কৃতজ্ঞতা আর সম্ভ্রম উদ্রেক করলেই চলবে না। এর সাথে সামান্য ভয়েরও মিশেল থাকতে হবে। আমি প্রথমবার ফারগানার শাসক হবার পরে বাকী বেগ, বাবা কাশক, আর ইউসুফকে প্রাণদণ্ড দেয়া উচিত ছিলো। তার বদলে আমি কেবল তাদের শাহী দায়িত্বপালন থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলোম এবং জীবন ধারণের জন্য কোনো বাধা না দিয়ে বরং মনের ভিতরে তাদের তিক্ততা পোষণের সুযোগ দিয়েছি। এছাড়া, সমরকন্দ দখল করার পরে গ্রান্ড উজিরের কতিপয় সমর্থককেও কড়কে দেয়া উচিত ছিলো।

“তারচেয়েও বড় কথা, আমার নিয়তির প্রতি আমি আর কখনও অবহেলা প্রদর্শন করবো না। আমাদের সাথে আমার সাথে যা ঘটেছে তারপরেই কেবল আমি হাল্কা হাল্কা বুঝতে পারছি মানুষ তৈমূর লোক হিসাবে কেমন ছিলেন। মাঝে মাঝে তার নিজেকে কেমন একা মনে হয়েছে- নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে তাকে কেমন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। আর তাছাড়া, তাদের সব দায়দায়িত্ব পরে বহুবছর ধরে তাকে নিজের কাঁধে বহন করতে হয়েছিলো… আমি নেতৃত্ব দেবার মতো সাহসও অর্জন করেছি…ওয়াজির খানের মতো আমার যতো দক্ষ পারিষদ থাকুক আমার নিয়তি কেবল আমিই নির্ধারণ করতে পারি।

বাবর মুখ তুলে তার নানীজানের দিকে তাকায়। “দেখে নিয়ে, আমি ঠিক তৈমূরের মতই বীর হবো। আমি শপথ করে বলছি…”

“কথাগুলো সত্যিই শুনতে ভাল লাগে।” এসান দৌলত মন্তব্য করেন। “চলো আমাদের অনেক কাজ এখনও বাকি আছে। একটা নতুন দিনের প্রভাত হচ্ছে।”

দ্বিতীয় খণ্ড – সালতানাৎবিহীন এক সুলতান

০৭. আয়োধন আর অন্তর্ধান

বৃষ্টি আর তুষারপাতের মিশ্রণের প্রকোপ বাবরের ভেড়ার চামড়ার প্রলেপ দেয়া ভারী জ্যাকেটের আবরণও আটকাতে ব্যর্থ হয়। ফারগানার উত্তরে উঁচু পর্বতমালার অভ্যন্তরে এক প্রত্যন্ত উপত্যকার ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনীর তীরের প্রায় কাদা হয়ে থাকা বরফের ভিতর দিয়ে তার অবশিষ্ট লোকদের সামনে থেকে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে চলেছে, বৃষ্টি আর তুষারপাতের হাত থেকে বাঁচতে মাথা নিচু করে রাখা।

নিজের দুটো সালতানাই হারিয়েছে এটা অনুধাবন করার পরের প্রথম দিকের মুশকিল দিনগুলোতে, বাবর আকশি দূর্গের আশেপাশেই থাকবে বলে ভেবেছিলো আশা করেছিলো সব কিছু বাজি রেখে হলেও সে তার পরিবারকে মুক্ত করতে পারবে। ওয়াজির খান অনেক কষ্টে তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, তার শত্রুরাও এমনই একটা মরীয়া প্রচেষ্টা আশা করছে আর তারা সেজন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। ওয়াজির খান, তার চিরাচরিত পিতৃসুলভ ভঙ্গিতে তাকে আশ্বস্ত করে পরামর্শ দিয়েছে, “আপনি যদি আপনার আম্মিজান, নানীজান আর বোনকে বাঁচাতে চান তাহলে নিজেকে বিপদের মুখে না ফেলে বরং শত্রুদের তটস্থ করে তুলেন, যাতে তারা আপনার নাম শুনলেই ভয় পায়। আর সেটা করতে হলে তাদের চাপের ভিতরে রাখেন। এখানে সেখানে তাদের আক্রমণ করে, আপনার বিরুদ্ধে সৈন্য সমাবেশ করবার আগেই সেখান থেকে সরে আসেন। ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে সবসময়ে একটা ভীতির সঞ্চার করতে থাকেন। আপনার শত্রুরা যাতে শান্তিতে ঘুমাতে না পারে। আর এটা করতে পারলেই সুলতান, তারা আপনার পরিবারের ক্ষতি করার কথা চিন্তাও করতে পারবে না।”

বাবর ওয়াজির খানের বক্তব্য মোটের উপরে বুঝতে পারে। সাবধানে বিবেচনা করে, সে একটা পরিকল্পনার কথা বলে। আমাদের একটা নিরাপদ আশ্রয়স্থল চাই। যেখানে আমরা শীতকালটা কাটাতে পারবো এবং প্রথম হামলার ছক কষতে পারবো। আমার মনে আছে যে প্রতিবার গ্রীষ্মের সময়ে সামরিক প্রশিক্ষণের অংশ হিসাবে আপনি একবার আমাকে উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলে একটা অভিযানে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং উপত্যকার কেন্দ্রস্থলে একটা মাটির দূর্গে আমরা অবস্থান করেছিলাম। তামবালের অনুগত এক জায়গীরদার সেই নগণ্য সেনাছাউনির প্রধানের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো। সেই দূর্গটা আমাদের জন্য চমৎকার আশ্রয়স্থল হিসাবে প্রতিপন্ন হতে পারে। কারো মাথাতেই বিষয়টা আসবে না। আপনি কি বলেন?”

“জায়গার কথা আমার মনে আছে। বাস্তবিকই প্রত্যন্ত অঞ্চলে দূর্গটা অবস্থিত, আর আমাদের উদ্দেশও হাসিল হবে।”

আর সে জন্যই সে ওয়াজির খানকে নিয়ে পাহাড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিলো। তাদের সাথে কেবল দুশো লোক ছিলো। ওয়াজির খানের সাহায্যে বাবর অনেক যত্ন নিয়ে তাদের বাছাই করেছে, সে কেবল তাদেরই বাছাই করেছে যাদের বয়স অল্প আর কোনো পারিবারিক পিছুটান নেই বা বাইসানগারের মতো যারা তার বিশ্বস্ত অন্তরঙ্গ। বাকি সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে, তার ডাকের অপেক্ষা করতে বলেছে, যা তারা নিশ্চিতভাবেই পাবে। তাদের যাত্রার দ্বিতীয় সপ্তাহে তুষারপাত শুরু হয় এবং উচ্চতা বাড়বার সাথে সাথে তুষারের স্তর বৃদ্ধি পেয়ে তাদের যাত্রাকে শ্লথ করে তুলেছে।

“ওয়াজির খান, আপনার কি মনে হয় আমরা দূর্গ থেকে কতোটা দূরে অবস্থান করছি?”

“সুলতান, আবহাওয়া যদি এতোটা বিরূপ না হতো, আমরা তাহলে দূর্গটা এতক্ষণে দেখতে পেতাম। অবশ্য সুবিধাও হয়েছে, দূর্গের নিরাপত্তা রক্ষীরা আমাদের আগে থেকে দেখতে পাবে না। দূরের ঐ গাছগুলোর আড়ালে আমরা অবস্থান নেবো আর সামনেটা রেকী করার জন্য গুপ্তদূত পাঠিয়ে আমরা পর্যাণে যেটুকু শুকনো মাংস রয়েছে সেটা দিয়ে আহার সেরে নেবো।”

তাদের পাঠানো গুপ্তদূতেরা রেকী করে ফিরতে যে নব্বই মিনিট সময় লাগে তার পুরোটা সময়ই অবিশ্রান্তভাবে তুষারপাত হয়। কখনও ভারী বা কখনও হাল্কাভাবে। তার লোকেরা ফিরে আসতে দেখা যায়, ঘোড়া আর তার আরোহী তুষারে পুরো ঢেকে গেছে এবং গুপ্তদূতদের দলনেতা ঠাণ্ডায় নীল হয়ে আসা ঠোঁটে কোনোমতে কথা বলে। “এখান দু’মাইল দূরে একটা বাকের পরেই দূর্গটা অবস্থিত। দূর্গের বাইরে আমরা কোনো ঘোড়ার বা পায়ের ছাপ দেখতে পাইনি যাতে বোঝা যায়, আজ ভেতর থেকে কেউ টহল দিতে বা পর্যবেক্ষণ-ফাঁড়িতে যায়নি। আমরা যখন ঘোড়া থেকে নেমে দূর্গের কাছে এগিয়ে যাই, দূর্গের এক অংশ থেকে আমরা ধোয়া উঠতে দেখেছি- সম্ভবত রসুইখানা- কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দূর্গের মূল ফটক তখন ভোলা ছিলো। স্পষ্টতই এই আবহাওয়ায় কেউ আক্রমণ করতে পারে সেই ব্যাপারটা তাদের মাথাতেও নেই।”

“চমৎকার, শীঘ্রই তাদের এই নিশ্চয়তা নরকে পরিণত হতে চলেছে। ওয়াজির খান, এটা ইতস্তত করার সময় না, সবাইকে এই মুহূর্তে প্রস্তুত হতে বলুন এবং তুষারপাতের মাঝে আমরা আত্মগোপন করে গুপ্তদূতদের সহায়তায় দূর্গে পৌঁছাবার পথের শেষ বাঁকে দ্রুত আর নিরবে গিয়ে হাজির হবো। সেখান থেকে মূল ফটকের উদ্দেশ্যে ঘোড়া দাবড়ে যাবো।”

ওয়াজির খান মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় এবং পাঁচ মিনিট পরে অশ্বারোহী বাহিনীর একটা সারিকে মন্থর গতিতে পাহাড়ী পথ বেয়ে উপরের দিকে উঠে যেতে দেখা যায়। তুষারাবৃত প্রেক্ষাপটের মাঝ দিয়ে প্রায় দু’মাইল এগিয়ে যায়। তুষারপাত এখন আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে। বাবরের চোখের সামনে একটা পাথুরে অবয়ব ভেসে ওঠে। দূর্গটা আর মাত্র হাজারখানেক গজ সামনে অবস্থিত। এখান। থেকে দূর্গ পর্যন্ত রাস্তাটা বেশ প্রশস্ত।

“আমরা এখান থেকেই আক্রমণ শুরু করবো। লোকদের বলেন অপ্রয়োজনীয় সবকিছু এখানে পাথরের আড়ালে রেখে কেবল হাতিয়ার নিয়ে প্রস্তুত হতে। যাতে বরফের উপর দিয়ে যতোটা সম্ভব দ্রুত ঘোড়া দাবড়ে আমরা দূর্গে পৌঁছাতে পারি।” তার লোকেরা নিরবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। কিন্তু তারা প্রস্তুত হতে হতে তুষারপাত একেবারে বন্ধ হয়ে যায় এবং সামনে- সাদা প্রেক্ষাপটের মাঝে একটা কালো আকৃতির মত দূর্গটা ভেসে উঠে।

“যারা প্রস্তুত, ঘোড়ায় আরোহন করো! কারো চোখে পড়ে যাবার আগেই আমাদের আক্রমণ করতে হবে!” বাবর চিৎকার করে কথাটা বলার ফাঁকে ময়ান থেকে আলমগীর বের করে আনে। সে লাফিয়ে জিনের উপরে উঠে বসে এবং তার বিশাল কালো ঘোড়াটাকে দূর্গের দিকে এগোতে বলে পেটে খোঁচা দেয় যার ফটক সে খোলা দেখতে পেয়েছে। দশজন যোদ্ধা পরিবেষ্টিত অবস্থায় এবং বাকীরা তার পেছনে সারিবদ্ধভাবে বিন্যস্ত। ঘোড়ার কাধ ধরে ঝুঁকে ছুটে যাবার সময়ে বাবর টের পায় তার কানে রক্তের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। দূর্গের ফটক থেকে সে যখন মাত্র দুশো গজ দূরে, তখন ভেতর থেকে একটা চিৎকার তার কানে ভেসে আসে- শত্রুরা তাদের দেখে ফেলেছে। ভেতরের লোকেরা বিপদ টের পায়। তারা ফটকের পাল্লা বন্ধ করার চেষ্টা করতে সেটা কেঁপে উঠে। কিন্তু নতুন জমা বরফ পাল্লা নড়তে বাধা দেয়। দু’জন লোক বাইরে ছুটে আসে, বরফের স্তূপে লাথি দেয় এবং বৃথাই চেষ্টা করে পাল্লাটা বরফের উপর দিয়ে সরাতে।

“ব্যাটাদের পেড়ে ফেলো!” বাবর হুঙ্কার দিয়ে বলে। কিন্তু ঘোড়ার গতি বিন্দুমাত্র হ্রাস করে না। নিমেষের ভিতরে সে একজনকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে, একটা তীর তার গলায় বিদ্ধ হয়েছে। একই সাথে সে নিজেও দূর্গের তোরণদ্বারের কাছে পৌঁছে যায়। দ্বিতীয় লোকটাকে সে আলমগীর দিয়ে একটা কোপ বসিয়ে দেয়। টের পায় তার তরবারি জায়গা মতোই নরম মাংসপেশীতে কামড় বসিয়েছে। কিন্তু কোথায় সেটা দেখবার জন্য সে ঘোড়ার গতি একটুও হ্রাস করে না। তার বদলে, সে তার হাতে ধরা লাগামে একটা ঝাঁকি দিয়ে ঘোড়ার মাথা তখনও আংশিক খোলা ফটকের দিকে ঘুরিয়ে দেয়। বিশাল কালো ঘোড়াটা নাক দিয়ে একটা শব্দ করে এবং বাবর টের পায় ঘোড়াটার একটা পা পিছলে গেছে কিন্তু কালো পাহাড় ঠিকই ঘুরে দাঁড়ায়। একই সাথে তার পেছনে তিনজন যোদ্ধা এসে হাজির হয়।

কিন্তু চতুর্থজন ঢুকতে ব্যর্থ হয়। ভেতরে প্রবেশপথ আটকে ঘোড়া আর তার আরোহীর ভূপাতিত হবার শব্দ বাবর শুনতে পায়। সে দূর্গের ভিতরে প্রবেশ করেছে বটে। কিন্তু তাকে সহায়তা করবার জন্য মাত্র তিনজন যোদ্ধা তার সাথে রয়েছে। চারপাশে তাকালে সে সারি সারি স্থাপিত উঁচু দরজার পেছন, সম্ভবত দূর্গের প্রধান সেনানিবাস থেকে পিলপিল করে লোকজনকে বের হয়ে আসতে দেখে। কেউ কেউ ইস্পাতের বর্ম গায়ে চাপাতে ব্যস্ত। আর বাকিরা ইতিমধ্যে অস্ত্রধারণ করেছে।

“আমার সাথে এসো! এখনই আক্রমণ করতে হবে!” বাবর পেটে খোঁচা দিয়ে পুনরায় তার ঘোড়ার গতি বৃদ্ধি করে। আর একটু পরেই তাকে তার তিনজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে আতঙ্কিত লোকগুলোকে কচুকাটা করতে দেখা যায়। সহসা একটা লম্বা লোক বাবরের নজর কাড়ে, যাকে দেখে সেনাপতিদের একজন বলে মনে হয়। ব্যাটকে মাথা নিচু করে পুনরায় ঘরের ভিতরে প্রবেশ করতে দেখলে সেও ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। কাঠের সরদলের নিচে দিয়ে ঝুঁকে পার হয়ে সে ভেতরের আধো অন্ধকারে চোখ পিটপিট করে প্রবেশ করতে যে বিশ ত্রিশজন সেখান থেকে বের হয়ে এসেছে, বুঝতে হবে সেটাই এই দূর্গের মোট জনবল। কেবল সেনাপতিগোছের লোকটাই এখন ভেতরে রয়েছে। লোকটা দৌড়ে একটা অস্ত্র সজ্জিত তাকের দিকে ছুটে গিয়ে সেখান থেকে একটা বর্শা আর ঢাল তুলে নিয়ে বাবরের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।

“ফারগানার ন্যায়সঙ্গত সুলতান, আমি বাবর তোমাকে আদেশ দিচ্ছি অস্ত্র নামিয়ে রাখো।”

“আমি আত্মসমর্পন করবো না। তোমাকে আমি সুলতান বলে মানি না। আমার নাম হানিফ খান। আমি তামবালের প্রতি অনুগত, সেই এখন পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। পারলে সম্মুখ যুদ্ধে আমাকে পরাস্ত করো।”

বাবর তার কালা পাহাড়ের উপর থেকে লাফিয়ে নামে এবং আলমগীর হাতে ধরা অবস্থায় হানিফ খানের দিকে এগিয়ে যায়। যে তক্কে তক্কে ছিলো বাবর তার। কাছাকাছি যেতেই হাতের বর্শা দিয়ে সে বাবরকে আঘাতের চেষ্টা করে। বাবর লাফিয়ে একপাশে সরে যায়। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে অর্ধভুক্ত খাবারে ভর্তি একটা নিচু টেবিলের পায়ার সাথে তার বাম পা আটকে যায়। বেকায়দা ভঙ্গিতে সে টেবিলের উপরে আছড়ে পড়ে। টেবিলের উপরে থাকা কাঠের পেয়ালা আর তার ভেতরের খাবার ছিটকে ফেলে। মাংসের সুরুয়া অর্ধেকটা ভর্তি একটা বিশাল ধাতব পাত্রের মুখে তার তরবারি ধরা হাতের কব্জি আটকে যেতে, আলমগীর তার মুঠো থেকে ছুটে যায়।

হানিফ খান বাবরের অসহায় অবস্থার সুযোগে তাকে একেবারে শেষ করে দেবার জন্য ছুটে আসে। তার বর্শাটা দু’হাতে মাথার উপরে তুলে বাবরের উন্মুক্ত গলায় সেটা সর্বশক্তিতে নামিয়ে আনবে। বাবর একটা কাঠের বড় বারকোশ তখন তুলে নিয়ে সেটাকে ঢালের মত ব্যবহার করে। বর্শা বারকোশে বিদ্ধ হয়। তবে সেটাকে ছিন্ন করতে পারে না। ছিটকে পড়া খাবারের উষ্ণ চটচটে সুরুয়ার ভিতরে গড়িয়ে একপাশে সরে যাবার সময়ে সে বারকোশটা ফেলে দিয়ে বর্শার হাতল ধরে মোচড় দেয় এবং হানিফ খানের হাত থেকে সেটা টেনে নেয়।

বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে হানিফ খান, লাফিয়ে পেছনে সরে গিয়ে কোমরের পরিকর থেকে একটা সরু খঞ্জর টেনে বের করে। আলমগীর কোথায় পড়েছে সেটা দেখার সময় নেই বাবরের, হাতের বর্শাটা দিয়ে সে লোকটাকে সজোরে আঘাত করলে ফলার মাথায় আটকানো বারকোশটা খুলে পড়ে। আর একই সময়ে, নিজের গালে সে একটা তীক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভব করে। হানিফ খান বাবরের গলা লক্ষ্য করে খঞ্জরটা চালিয়েছিলো কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। বাবর এবার বশার ফলাটা সজোরে তাকে লক্ষ্য করে আঘাত করে হানিফ খান একপাশে ঘুরে আঘাতটা এড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু ফলাটা তাকে বামদিকে স্পর্শ করলে সে টেবিলের পাশে রাখা শক্ত কুশনের উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। বাবর এবার বর্শাটা মোচড় দেয় এবং মুহূর্ত মাত্র চিন্তা না করে প্রতিপক্ষের কণ্ঠনালী লক্ষ্য করে সজোরে বর্শাটা নামিয়ে এনে গালিচার উপরে তাকে গেথে ফেলে। যা অচিরেই ফিনকি দিয়ে রক্তে ভিজে লাল হয়ে যায়।

ইতিমধ্যে ওয়াজির খান, বাইসানগার আর বাকী লোকেরা এসে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে তার সাহসিকতার জন্য তাকে শুভেচ্ছা জানায়। দূর্গটা এখন তাদের দখলে। ফারগানা উদ্ধারের বন্ধুর পথে সে মাত্র প্রথম পদক্ষেপটা সাফল্যের সাথে রেখেছে। বাইরে বের হয়ে এসে বাবর দেখে আবার তুষারপাত শুরু হয়েছে। শত্রুর পড়ে থাকা দেহের চারপাশের লাল রঙ ইতিমধ্যে অনেকটাই ঢাকা পড়েছে। একটু আগে তামবালের চামচার ভবলীলা সে যেভাবে সাঙ্গ করেছে, সেভাবে পালের গোদাটাকে কখন মুঠোর ভেতরে পাবে সেই মুহূর্তটার জন্য সে অধীর হয়ে রয়েছে।

*

আর এভাবেই পুরো ঘটনাটার সূচনা হয়। বাবর একজন হানাদারে পরিণত হন। ঝটিকাবেগে আক্রমণ করেন এবং ফিরে যাবার সময় প্রতিবারই মৃত শত্রুর কারো একজনের মুখে রক্ত দিয়ে নিজের নাম লেখা একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে যান। আর তার সাফল্য ক্রমশ বাড়তে থাকে। তার বাহিনীর সংখ্যা, মিষ্টি কথা আর মধুর প্রতিশ্রুতি, সেই সাথে শক্তি বা তার অভিযানে প্রাপ্ত সম্পদের বিচক্ষণ ব্যবহার নতুন সমর্থকদের আকৃষ্ট করে এবং প্রতিপক্ষকে দলে টেনে, ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। মাটির দূর্গ দখলের বিশ মাসের মধ্যে, নিষ্ঠা আর একাগ্রতার সাথে একটার পরে একটা ছোট দূর্গ আর গ্রামের পর গ্রাম দখল করে ফারগানার পশ্চিমাঞ্চলের অধিকাংশই সে দখল করে নেয়। তার কৌশল কার্যকরী বলে প্রতীয়মান হয়। তামবাল আকশির উত্তর বা পশ্চিমে বাবরের শক্ত ঘাঁটির দিকে বেশিদূর অগ্রসর হবার মতো সাহস দেখায় না। আর বাবরও মনে করে এবার সময় হয়েছে নিজের দাবির কথা প্রকাশ করবার।

প্রথম দাবিটা সে ছয়মাস আগে জানায় এবং তারপরে প্রায়শই তার পুনরাবৃত্তি করেছিলো তার আম্মিজান, নানীজান আর বোনের মুক্তির বদলে এক বছর আকশি দূর্গ আক্রমণ না করবার প্রতিশ্রুতি। তিনমাস আগে তামবাল এক বার্তাবাহকের মাধ্যমে প্রেরিত এক চিঠিতে অনেক মধুর ভাষায় জানায় এসান দৌলত, খুতলাঘ নিগার আর খানজাদা প্রত্যেকেই সুস্থ আছে এবং শাহী পরিবারের উপযুক্ত ব্যবহারই করা হচ্ছে তাদের সাথে। কিন্তু চিঠিতে সে তাদের মুক্তি দেবার তার কোনো অভিপ্রায়ের কথা উল্লেখ করেনি।

বাবর এখন পূর্বদিকে পঞ্চাশ মাইল দূরে অবস্থিত শহর গাভার দিকে অগ্রসর হচ্ছে কিছুদিন আগে তামবাল ভাড়াটে চকরাখ যোদ্ধাদের সহায়তায় সেখানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে। সেখানে একটা হিসাব মেলানো এখনও বাকি আছে। সেখানকার দূর্গের চাকরাখ সর্দার তার সৎভাই আর তামবালকে শাহী প্রতিনিধি হিসাবে মেনে নিয়ে প্রথম আনুগত্য প্রদর্শনকারীদের অন্যতম। শহরটা দখল করলে তামবালকে আরেকটা জোরালো সঙ্কেত পাঠানো হবে যে, সময় হয়েছে বাবরের কাছে তার পরিবারকে ফেরত পাঠাবার।

এক ক্ষুদ্র নহরের পাশে সাময়িক যাত্রাবিরতি করে বাবর আর তার লোকেরা ঘোড়াগুলোকে পানি পান করার সুযোগ দেয়। ঘোড়ার দুধ থেকে তৈরি টক পনির কোনোক্রমে গলধঃকরণের ফাঁকে বাবর তাকিয়ে দেখে তার এক গুপ্তদূত ঘোড়ায় চড়ে এগিয়ে আসছে। বাবর চমকে উঠে দেখে তার পর্যানে একটা দেহ আড়াআড়িভাবে বাঁধা রয়েছে। লোকটার দিকে দৌড়ে গিয়ে বাবর চিৎকার করে জানতে চায়, “কি হয়েছিলো? এই লোকটা কে?”

“লোকটা একটা ব্যবসায়ী। পথের পাশে পেটে তরবারির আঘাত নিয়ে নিজেরই রক্তে অর্ধচেতন অবস্থায় পড়ে থাকার সময়ে তাকে আমি খুঁজে পেয়েছি। আমি তাকে আমার ঘোড়ার পিঠে তুলে নেবার কিছুক্ষণ পরেই বেচারা মারা যায়। অবশ্য মারা যাবার আগে সে আমাকে বলেছে যে আরও তিনজন ব্যবসায়ীর সাথে সে। এখান থেকে দশ মাইল দূরে একটা ছোট সরাইখানার উদ্দেশ্যে যাবার পথে তারা চকরাখ হানাদারদের হামলার শিকার হয়। তার তিন সঙ্গীকে হত্যা করে তাকেও মৃত ভেবে তাদের সব মালপত্র নিয়ে তারা চলে গেছে।”

“চকরাখ হানাদারদের অবশ্যই খুঁজে বের করে তার হত্যার আমরা বদলা নেবো। তোমার অধীনস্ত কয়েকজন গুপ্তদূতকে হত্যাকারীদের খুঁজতে পাঠাও।”

“সুলতান, আমার মনে হয় না তার কোনো দরকার আছে। বণিক লোকটা মারা যাবার আগে আমাকে বলেছে যে, সে চকরাখদের বলতে শুনেছে তারা সরাইখানায় যাচ্ছে, সেখানে আরও শিকার যদি তারা খুঁজে পায়…”

“তাহলে আমরা প্রথমে সরাইখানায় যাবো।”

***

গানের সুর বন্য আর কর্কশ চকরাখদের নিজেদের মতোই অনেকটা। মদের নেশায় চুরচুর হয়ে থাকা পুরুষদের কণ্ঠস্বর নতুন মাত্রায় উঠে এমন সব অশ্লীল ক্রিয়াকলাপের বর্ণনায় মেতেছে যা একাধারে শারিরীকভাবে অসম্ভব আর মোটাদাগের যে বাবর চেষ্টা করেও হাসি চাপতে পারে না। সে আড়চোখে ওয়াজির খানের দিকে তাকিয়ে দেখে সেও হাসছে।

লম্বা ঘাসের আড়ালে বাবর তার চারপাশে শুয়ে থাকা লোকদের ইশারা করে। সবাই। তারমতো পেটের উপরে ভর দিয়ে শুয়ে আছে, লুকিয়ে অপেক্ষা করছে। তারপরে সে গুঁড়ি মেরে মাটির ইট দিয়ে তৈরি একতলা সরাইখানার দিকে এগিয়ে যায় যেটা ফারগানার অন্যতম খরস্রোতা একটা নদীর অগভীর অংশের পাড়ে অবস্থিত। যেখানে হল্লাবাজেরা মচ্ছবে মেতেছে। নূপুরের নিক্কন ধ্বনি ভেসে আসতে বোঝা যায় ভেতরে বাইজি মেয়েরাও আছে। সেই সাথে কুপিত নারী কণ্ঠের সহসা একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার আর তার সঙ্গে ভেসে আসে- পুরুষ কণ্ঠের অট্টহাসি।

দুপুর মাত্র অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু বিশজন বা তার কিছু বেশি চাকরাখরা ইতিমধ্যেই বেহেড মাতাল হয়ে পড়েছে। তারা এমনকি তাদের ঘোড়াগুলিকে ঠিকমতো বাঁধার কষ্টও করেনি এবং কিছু ঘোড়া, যাদের কেশর পুরু আর লেজ এতো লম্বা যে মাটিতে ঘষা খাচ্ছে, ইতিমধ্যেই ছুটে পালিয়েছে। চারো ব্যবসায়ীর কাছ থেকে লুট করা মালামালও তারা ভিতরে নিয়ে যাবার গরজ দেখায়নি। বণিকদের মালবাহী ধুসর খচ্চরগুলো দড়ি দিয়ে একত্রে বাঁধা এবং মনোযোগ দিয়ে চরে বেড়াচ্ছে। তাদের পিঠে আটকানো বেতের ঝুড়িগুলো দেখে মনে হয় এখনও চামড়া আর লোমে ঠাসা। চাকরাখরা মনে হয় কেবল মদের পিপে নিয়ে সরাইখানার ভিতরে প্রবেশ করেছে।

বর্বর অসভ্য, বাবর ভাবে। তাদের কপালে আজ কি লেখা আছে সেটা এখনই ব্যাটারা টের পাবে। আর এই ভাবনাটা তাদের উৎফুল্ল করে তোলে। লম্বা ঘাসের উপরে মাথা তুলে বাবর চারপাশে তাকায়। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না। সে ঠিক যেমনটা ভেবেছিলো, ঘোড়া বা মালামাল দেখার জন্য বাইরে কোনো বাচ্চাকে রাখার কথা ব্যাটাদের মাথাতেই আসেনি। সে এবার উঠে দাঁড়িয়ে, গুটিগুটি পায়ে সরাইখানার নীচু প্রবেশদ্বারের ডান দিকে মোটা দেয়ালের গায়ে জানালার মতো দেখতে একটা ফাঁকা জায়গার দিকে এগিয়ে গিয়ে ভেতরে সতর্কতার সাথে উঁকি দেয়। ঘরটা প্রায় খালি, কেবল ভেতরের দেয়ালের গায়ে ঠেকানো অবস্থায় একটা লম্বা কাঠের টেবিল দেখা যায়। কয়েকটা তেপায়া টুল আর একটা আধ ভাঙা বেঞ্চি দেখা যায়। ঘরের মাঝে মোটাসোটা, বোচা-নাকের একটা মেয়ে পরনে রঙচটা হলুদ রঙের ঢোলা সালোয়ারের উপরে লাল ফুলের ছাপ দেয়া একটা আঁটোসাঁটো কামিজ, পায়ে আর হাতের কব্জিতে ঘুঙুর বাঁধা। নীল সালোয়ার কামিজ পরিহিত লম্বা আরেকটা মেয়ে তার নোংরা হাতে একটা খঞ্জনী, বর্গাকার পাথরের মেঝের উপরে খালি পায়ে সজোরে পদাঘাত করে বৃত্তাকারে আবর্তিত হচ্ছে। সে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চকরাখদের কয়েকজন, ভেড়ার চামড়ার তৈরি টুপির নিচে তাদের গোলাকার মুখ ঘামে ভিজে আছে, টলোমলো পায়ে মেয়েদের বুকে পাছায় বৃথা চেষ্টা করে থাবা দিতে এবং মুখ থুবড়ে মাটিতে আছড়ে পড়লে তাদের সঙ্গীসাথীদের উদ্দীপনা আরও বেড়ে যায়।

এক কোণে ধোঁয়া উঠতে থাকা অগ্নিকুণ্ডের উপরে বিশাল একটা কেতলি ঝুলতে দেখা যায়। আরেক কোণে, বাবর এক চকরাখ দুবৃত্তকে কাপড় খুলে ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাল্কা হতে দেখে, দুর্গন্ধে তার সঙ্গীসাথীদের আপাতভাবে কোনো অসুবিধা হয় না। আরেক বদমাশ উঠে দাঁড়িয়ে হলুদ বমি বৃত্তচাপ তৈরি করে ছুঁড়ে ফেলে আবার বসে পড়ে আর মনোযোগ দিয়ে জামার হাতায় পড়া বমির ফোঁটা বড়বড় নখ দিয়ে টুসকি দেয়। বাবর পুনরায় মাথা নামিয়ে নেয়। সে যা দেখার তা দেখে নিয়েছে।

মাটিতে গুঁড়ি দিয়ে সে পুনরায় ওয়াজির খান যেখানে আছে সেখানে ফিরে আসে। “মদ্যপ আহাম্মকগুলো আমাদের হাতে মারা যাবার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। ব্যাটারা তাদের তরবারি আর ঢাল পর্যন্ত দরজার কাছে স্তূপ করে রেখেছে।”

ওয়াজির খানের একটা ক্ৰ উপরে উঠে যায়। “সুলতান, এখনই?”

“হ্যা!”

বাবর আর ওয়াজির খান উঠে দাঁড়িয়ে তাদের লোকদেরকেও উঠে দাঁড়াবার ইশারা করে। তারা এই কাজটা আগে এতোবার করেছে যে, মৌখিক আদেশের আর কোনো প্রয়োজন হয় না। ঠোঁটের উপরে আঙ্গুল চেপে, ওয়াজির খান ইশারায় ঘুরে কয়েকজনকে সরাইখানার পেছনে যেতে বলে। যদি সেখান দিয়ে পালাবার কোনো পথ থেকে থাকে। তারপরেই কেবল বাবর তার প্রিয় রণহুঙ্কারে চারপাশ প্রকম্পিত করে: “ফারগানা!”

বাবর একেবারে সামনে থেকে তার লোকদের নেতৃত্ব দেয়। মদের নেশায় মাতাল আর বিস্ময়ে আড়ষ্ঠ চকরাখরা সামান্যই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। বাবর আর তার লোকেরা নির্মমভাবে প্রতিপক্ষের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়লে বোঁচা-নাকের সেই মেয়েটার কাছ থেকেই কেবল বলার মতো প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। মেয়েটা তার কাচুলির ভিতর থেকে একটা খঞ্জর বের করে এবং বাবরের বাহুতে সেটা মরিয়া ভঙ্গিতে গেথে দিতে চাইলে, বাবর অনায়াসে তার ঘুঙুর পরা হাতের কব্জি ধরে এবং তাকে ঘুরিয়ে দিয়ে তার নধর নিতম্বে বুট দিয়ে একটা সপাট লাথি বসিয়ে দিতে বেচারী ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে।

কয়েক মিনিটের ভিতরে সবকিছু শেষ হয় এবং বাবরের লোকদের হাঁপিয়ে ওঠার আগেই নিজেদের তরবারির ফলা পরিষ্কার করে কোষবদ্ধ করতে দেখা যায়। তার লোকদের গায়ে একটা আঁচড়ও লাগেনি। অবশ্য তার লোকদের সবাই পোড়খাওয়া যোদ্ধা, এসব মদ্যপ মাতালদের চেয়ে অনেক দক্ষ লোকদের সাথে তারা আগে লড়াই করেছে। “লাশগুলো বাইরে নিয়ে যাও দেখা যাক আমরা কাদের হত্যা করেছি,” বাবর আদেশটা দিয়ে কৃতজ্ঞচিত্তে দ্রুত পূতিগন্ধময়, ধোঁয়াটে ঘরটা থেকে বাইরের খোলা বাতাসে বের হয়ে আসে।

তার লোকেরা চকরাখদের লাশগুলি তাদের বুট-পরা পা ধরে হেঁচড়ে বাইরে এনে সারিবদ্ধভাবে সাজালে, বাবর লাশগুলো শুনে দেখে। মোট পনেরটা লাশ। কারো গলা দুভাগ হয়ে আছে, কোনোটা আবার কবন্ধ। তার লোকেরা অবশ্য কাটাপড়া মাথাগুলো সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। কোনোটার মাথায় তখনও ভেড়ার চামড়ার টুপি রয়েছে। কাটা মুণ্ডগুলোর দিকে তাকিয়ে যখন বাবর একটা বিশেষ মুখ চিনতে পারে, তখন তার মুখ থেকে সন্তুষ্টিসূচক একটা শব্দ ধ্বনিত হয়। তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এমন সব চকরাখকে সে হত্যা করবে বলে মনস্থ করেছে। এবং প্রতিটা হত্যাযজ্ঞ যা তাকে তার লক্ষ্যের নিকটবর্তী করছে প্রচণ্ড তৃপ্তিদায়ক।

তারস্বরের চিৎকার শুনে বাবর ঘুরে তাকায়। তার দু’জন যোদ্ধা বাইজি মেয়েদের ধরে তাদের টেনে সরাইখানার বাইরে বের করে আনে। “তাদের উপরে বল প্রয়োগ করবে না। আমার আদেশ তোমরা জানেনা। অর্থের বিনিময়ে যদি তারা স্বেচ্ছায় তোমাদের সঙ্গ দিতে রাজি হয় তবে সেটা আলাদা কথা।” কথাটা বলে বাবর আবার ঘুরে দাঁড়ায়।

দেখা যায় মেয়েগুলো আদতেই ব্যবসায়ী এবং কয়েক মুহূর্তের দ্রুত আলোচনার পরে, সরাইখানার পেছনের এক আপেল বাগিচায় তারা তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। বাবর ধারণা করে বাইজি দু’জন সরাইখানার শকুনের মতো দেখতে মালিকের মেয়ে হবে। যে ঝামেলার গন্ধ পাওয়া মাত্র সেই যে টেবিলের তলায় গিয়ে ঢুকেছে তারপরে আর বের হবার কথা চিন্তাও করেনি। আপেল বাগিচায় শীঘ্রই বাবরের লোকদের দল বেঁধে আসা যাওয়া করতে দেখা যায়। বাগান থেকে হাসিমুখে তাদের বের হয়ে আসা দেখে বোঝা যায় মেয়ে দু’জন তাদের বাবার সরাইখানায় আসা। অতিথিদের খেদমত করতে ভালোই অভ্যস্ত।

ওয়াজির খান ইতিমধ্যে চকরাখদের পালিয়ে যাওয়া ঘোড়াগুলো ধরে আনবার বন্দোবস্ত করেছেন এবং বণিকদের কাছ থেকে লুট করা মালপত্রগুলো পর্যবেক্ষণ। করছেন। “সুলতান, দেখেন,” দুটো উজ্জ্বল বর্ণের গালিচা বের করে সে বাবরের। দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করে। গালিচা দুটোর জেল্লা দেখে বোঝা যায় তন্তুবায়ের দল। সেটা বুননের সময়ে রেশমের সাথে উলের মিশ্রণ ঘটিয়েছে আর গালিচাগুলোর নকশাও অপরিচিত- বণিকের দলটা সম্ভবত পূর্বের, কাশগর থেকে এসেছিল। যেখানের তাঁতিরা এ ধরণের গালিচা তৈরিতে দক্ষ। উল আর চামড়া বেচে ভালো অর্থই পাওয়া যাবে, বাবর ভাবে, যা দিয়ে তার লোকদের সে বকেয়া বেতন দিতে পারবে।

তার যোদ্ধাদের জন্য একটা ভোজসভার আয়োজন করলে মন্দ হয় না। তারা ভালো। কাজ দেখিয়েছে এবং তারও উচিত এর মূল্যায়ন করা। পশ্চিমে, শাহরুখিয়ায় ফিরে যাওয়া মাত্রই সে এই ভোজসভার ঘোষণা দেবে। সেখানে, ছয়মাস আগে। তামবালের কাছ থেকে সে দূৰ্গটা ছিনিয়ে নিয়েছে এবং নিজের ঘাঁটিতে পরিণত করেছে। সমরকন্দে খুন হবার আগে শাহরুখিয়ার সর্দার আলি মজিদ বেগের পূণ্য স্মৃতির প্রতি তারা তাদের শ্রদ্ধা জানাবে। তারা তার উপযুক্ত সন্তানের আত্মার মাগফেরাত কামনা করবে। যে তামবালের চকরাখ যোদ্ধাদের হাত থেকে দূর্গটা রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে। আলি মজিদ বেগের নিহত হবার সংবাদ ফারগানায় পৌঁছানো মাত্র তামবাল দূর্গটা দখল করতে তাদের পাঠিয়েছিলো।

নিজের বিশ্বস্ত সর্দারের কথা মনে পড়তে বাবরের ভাবনা বিষণ্ণ হয়ে উঠে। আজকাল তার প্রায়ই এমন হচ্ছে। সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারে আলি মজিদ বেগের মৃতদেহ প্রদর্শিত হবার পরের দু’বছরে সে কি অর্জন করেছে? নিজের পরিবারকে মুক্ত করার ব্যাপারে বা ফারগানা পুনরায় অধিকার করার ব্যাপারে সে কতটা অগ্রসর হয়েছে, সমরকন্দের কথা না হয় সে বাদই দিল? আর কতদিন তাকে সালতানাৎবিহীন একজন সুলতান হিসাবে দিন কাটাতে হবে? আকশি আক্রমণ করে তার পরিবারকে মুক্ত করে সিংহাসন পুনরুদ্ধার করার মতো একটা সেনাবাহিনী গঠন করা একটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আর সমরকন্দ, সেখানে শাসক হিসাবে কাটানো কয়েকটা দিন এখন কেবল ধূসর স্মৃতি। মাঝে মাঝে তার বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয় যে এমন কিছু আসলেই ঘটেছিলো। গ্রান্ড উজিরের কথাই শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো।

ভাবনাটা বাবরকে ক্রুদ্ধ করে তোলে। সে তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা কর্তিত মস্তকে লাথি বসিয়ে দিলে সেটা ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ে। তার লোকদের যেমন, তারও বিনোদনের দরকার আছে। কয়েকটা ডাল কেটে পোলো খেলার লাঠি তৈরি করো।” সে চিৎকার করে বলে। “এইসব দুবৃত্তদের মাথা দিয়ে পোলো খেলা যাক। গোলপোস্ট হবে ঐ দূরের গাছগুলো।”

পুরো একটা ঘণ্টার জন্য, উদ্দাম খেলায় বাবর নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। চকরাখদের ক্ষিপ্রগামী টাটুঘোড়ার একটা নিয়ে সে একেবেঁকে দাবড়ে বেড়ায় এবং শাখাপ্রশাখা ছেটে ফেলা গাছের ডাল দিয়ে ছিন্ন মস্তকগুলোকে সজোরে আঘাত করে। যাতে ঘাসের উপর দিয়ে লাফাতে লাফাতে সেগুলো গড়িয়ে যায়। শীঘ্রই সেগুলোকে আর কাটা মাথা বলে চেনার কোনো উপায় থাকে না- নাক, কান গুঁড়িয়ে যায়, অক্ষিকোটর থেকে অক্ষিগোলক বের হয়ে আসে এবং বাবর আর তার ঘর্মাক্ত সাথী খেলোয়াড়েরা আর সেই সাথে তাদের সবার ঘোড়া, রক্তের ফুটকিতে চিত্রিত হয়ে উঠে।

অবশেষে খেলাটার প্রতি তার বিরক্তি জন্মায় কিন্তু ভেতরের জমে ওঠা হতাশা আর ক্ষোভ নিঃসৃত হওয়ায়, বাবর ঘামে ভিজে ওঠা ঘোড়াটাকে অবশেষে রেহাই দেয়। চারপাশে তাকাতে সে দেখে ওয়াজির খান তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। এই প্রথম সে তার চোখে বিরক্তি দেখতে পায়। কিন্তু বাবর তাতে বিন্দুমাত্র লজ্জি বোধ করে না। জীবিত বা মৃত, সে তার শত্রুদের সাথে তাদের প্রাপ্য ব্যবহারই করেছে।

“চলো এবার যাওয়া যাক।” সে আদেশ দেয়। “গাভা এখনও অনেক দূরে, আর আমাদের গৃহকর্তাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখাটা ঠিক হবে না।” বাবর ঘোড়ার পাঁজরে এত জোরে খোঁচা দেয় যে সেটা ছুটতে শুরু করে। বাবর সরাইখানা থেকে সোজা নদীর অগভীর অংশের দিকে এগিয়ে যায়।একবারও পেছনে ফিরে তাকায় না। আঙ্গিনায় পড়ে থাকা রক্তাক্ত মাথাগুলোকে ইতিমধ্যে কাকের দল ঠোকরাতে শুরু করেছে এবং সরাইখান মেয়ে দুটো পা ঈষৎ ধনুকের মত ফাঁক করে এগিয়ে গিয়ে চকরাখদের লাশগুলো হাতিয়ে দেখে যে বাবরের লোকেরা ভুলে কিছু রেখে। গেছে নাকি, যা তাদের বেশ্যাবৃত্তির পাওনার উপরি বলে বিবেচিত হতে পারে।

***

তিন সপ্তাহ পরে। উঁচু পাহাড়ী এলাকার তৃণভূমির উজ্জ্বল সবুজ ঘাসের মাঝে মাঝে ফুটে থাকা হলুদ গোলাপী আর সাদা ফুলের মাঝ দিয়ে বাবর আর তার লোকেরা দুলকি চালে ঘোড়া দাবড়ে শাহরুখিয়ার দিকে এগিয়ে যায়। গাভার অভিযানে ক্ষয়ক্ষতি হলেও তারাই জয়ী হয়েছে। তিনশ গজ দূরে ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা অবস্থায় বাবর নিজে তীর ছুঁড়ে দূর্গের সেনাপতিকে হত্যা করেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার নিজের ব্যবহৃত ছোট নিখুঁতভাবে বাঁকানো ধনুক দিয়ে তীর ছোঁড়ার অভ্যাসে কাজ হয়েছে। ত্রিশটা শর ভর্তি তূণীর সে এক মিনিটের ভিতরে খালি করে ফেলতে পারে।

সেনাপতি মারা যাবার পরে, প্রতিরোধকারীদের মনোবল ভেঙে যায়। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সেনানিবাসের সৈন্যরা কেবল আত্মসমর্পনই করেনি, নিজেদের লুটের মাল পুরো তাদের হাতে তুলে দিয়েছে। যা বাবর আর তার লোকদের ঘোড়ার পিঠে ঝোলানো চামড়ার থলির উপচে পড়া আকৃতি সাক্ষ্য দিচ্ছে।

ওয়াজির খান খুব খুশি হবে। এবারের অভিযান বাবরকে তার বুড়ো বন্ধুটির সহায়তা ছাড়াই পরিচালনা করতে হয়েছে। সরাইখানা আক্রমণ করার পরের দিন ওয়াজির খানের ঘোড়া সাপের ভয়ে বেমাক্কা লাফিয়ে উঠতে সে পড়ে গিয়ে উরুতে ব্যথা পেয়েছিলো। বাবরের সনির্বন্ধ অনুরোধে তিনি শাহরুখিয়ায় ফিরে যেতে রাজি হন বাইসানগারের সাথে যোগ দিতে, যাকে তারা সেখানের নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়ে এসেছে।

আজ রাতে তারা বিজয় উদযাপন করবে। সে তার লোকদের সম্মান জানাতে তাদের মাঝে উলুশ বিতরণ করবে। যোদ্ধাদের ভিতরে যারা সবচেয়ে সাহসিকতা আর বীরত্ব প্রদর্শন করেছে প্রথা অনুযায়ী আজ সে ভোজসভার শেষে তাদের মাঝে লুটের মালের সিংহভাগ বিলিয়ে দেবে এবং বাইসানগার আর ওয়াজির খানকে গাভা আক্রমণের কাহিনী শোনাবে। তার গল্প শুনে ওয়াজির খান সম্ভবত হেসে অস্থির হবেন এবং সদা গম্ভীর বাইসানগারের মুখেও সে আজ হয়তো হাসির আভাস দেখতে পাবে।

পাথরের তৈরি দূর্গের অভ্যন্তরস্থ প্রাঙ্গনে প্রবেশের সাথে সাথে, বাবর তার ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে তাদের খোঁজে আশেপাশে তাকায়। বাইসানগারকে সে কোথাও খুঁজে পায় না। কিন্তু ওয়াজির খানকে আস্তাবলের সামনে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার খুরের উপরের আর পেছনের অংশের কেশগুচ্ছ পর্যবেক্ষণ করতে দেখে। তার বুড়ো বান্ধবকে সামান্য খোঁড়াতে খোঁড়াতে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলে: বাবর ভ্রূ কোঁচকায়। তারপরে সে তাকিয়ে দেখে ওয়াজির খানের মুখ আনন্দে আলোকিত হয়ে রয়েছে।

“সুলতান, দারুণ সুখবর আছে! সত্যিই চমকে দেবার মত সুখবর!”

“কি হয়েছে?”

“এক সপ্তাহ আগে আকশি থেকে এক বার্তাবাহক এসেছে। আপনার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীরের পক্ষে তামবালের বাণী নিয়ে সে এসেছে। অন্তত বার্তাবাহকের তাই ভাষ্য এবং সে বলেছে তারা আপনার আম্মিজান, নানীজান আর আপনার বোনকে আপনার কাছে পাঠাতে সম্মত আছেন।”

“সে কি এর বিনিময়ে কিছু দাবি করেছে?”

“সুলতান, প্রকাশ্যে তারা কিছু দাবি করেনি। আপনাকে সে কতোটা শ্রদ্ধা করে কেবল সে সম্পর্কে কিছু মধুর বাক্য ছাড়া।”

বাবরের হৃৎপিণ্ড আনন্দে নেচে উঠে। তার পরিবার শীঘ্রই তার সাথে মিলিত হবে। এই খবরটা আবার তাকে আবেগতাড়িত করে তোলে।

“তারা এখানে কবে নাগাদ পৌঁছাবে?”

“সবকিছু ঠিক থাকলে আগামীকাল সূর্যাস্ত নাগাদ তাদের এখানে পৌঁছাবার কথা।”

পরের দিন সন্ধ্যাবেলা, গোধূলির অস্তমিত আলোয় বাবরকে দূর্গের প্রকারবেষ্টিত সমতল ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আজকের দিনের অধিকাংশ সময় সে এখানেই কাটিয়েছে। অস্থিরচিত্তে রাস্তাটা যেখানে একটা গিরিখাদের দিকে বাঁক নিয়েছে, সেদিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে রয়েছে। ঘনায়মান আধো-অন্ধকারের ভিতর থেকে সে পিঠের দুপাশে ঝুড়ি ঝুলছে উটের এমন একটা তরঙ্গায়িত সারিকে বাঁক ঘুরে এগিয়ে আসতে দেখে। তাদের ঠিক পেছনেই রয়েছে যাত্রার শেষ পর্যায়ে মেয়েদের অভ্যর্থনা জানাতে। আর তাদের নিরাপদে দূর্গে নিয়ে আসবার জন্য, ওয়াজির খানের পরামর্শে, বাইসানগারের অধীনে পাঠানো সৈন্যবাহিনীর একটা চৌকষ দল।

বাবর এতদূর থেকে ঝুড়িতে ভ্রমণকারীদের চেহারা দেখতে পায় না। নিজেকে আর সামলে রাখতে না পেরে, এবং দেহরক্ষীদের কাউকে ডাকবার বা ঘোড়ার পিঠে জিন চাপাবার মতো ধৈর্যের মারাত্মক অভাব দেখা দেয়ায়, সে লাফিয়ে একটা খালি ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে এবং সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত তৃণভূমির উপর দিয়ে ছোট কাফেলাটার দিকে ছুটে যায়।

তার রোদে পোড়া গাল বেয়ে দরদর করে কান্না ঝরতে থাকে। কিন্তু সেসব সে মোটেই পরোয়া করে না। আশেপাশে কেউ নেই তার কান্না দেখবার মতো এবং তার চেয়েও বড় কথা, দেখলে দেখুক সে থোড়াই পরোয়া করে। দুর্বলতার না, আজ এটা আনন্দের অশ্রু। এক হাতে ঘোড়ার কেশর আঁকড়ে ধরে সে অন্য হাতে গাল থেকে কান্না মুছে। বাবর ঘোড়াটার কানে কানে তাকে এমন গতিতে ছুটতে বলে, যাতে মনে হয় হঠাৎ তার পাখা গজিয়েছে।

কাফেলাটাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে আনা সৈন্যদের থেকে চারজন সহসা আলাদা হয়ে বর্শা নিচু করে তার দিকে এগিয়ে আসে। যদিও বাইসানগার সম্ভবত ধারণা করতে পেরেছিলো খালি ঘোড়ার পিঠে এমন উদ্দাম ভঙ্গিতে কে তাদের দিকে ছুটে আসছে। কিন্তু তার মত অভিজ্ঞ পোড়খাওয়া যোদ্ধা তার কাছে এটাই প্রত্যাশিত যে সে নিজের লোকদের আদেশ দিয়েছে তার পরিচয় নিশ্চিত করতে। অশ্বারোহী দল নিকটবর্তী হতে, বাবর জোর করে নিজের ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তাকে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য করে। ঘামে জবজব করতে থাকা দেহে নাক ঝেড়ে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করে ঘোড়াটা।

বাবর মাথাটা পেছনে হেলিয়ে দিয়ে তার পূর্বপুরুষের রণহুঙ্কার কণ্ঠে তুলে নেয়। “ফারগানা!”

অশ্বারোহী দল এখন আরো কাছে চলে আসায় তারা তাকে চিনতে পেরে অভিবাদন জানায়। বাবর কোনোমতে তাদের অভিবাদনের জবাব দিয়ে উটের কাফেলা যেখানে যাত্রা বিরতি করেছে সেদিকে ঘোড়া ছোটায়। তার হৃদয় যদি আবেগে ভারাক্রান্ত না থাকত অন্যসময় হলে তাহলে সে হয়তো বাজারে নিয়ে যাওয়া মুরগীর মতো ভীরু ভঙ্গিতে বেতের ঝুড়ির ভিতর থেকে এসান দৌলতের উঁকি দেবার হাস্যকর ভঙ্গি দেখে হয়তো হেসেই ফেলতো। তার ওজন এতোটাই হাল্কা যে অন্যপাশের ঝুড়িতে ভারসাম্য রক্ষার জন্য বাঁধাকপির চেয়ে ভারী কিছু রাখতে হয়নি। আর তার বীণা ঝুড়ির বাইরে চামড়ার ফালি দিয়ে আটকানো রয়েছে। একটা বিশাল পুরু লোমের দুধসাদা রঙের উট যা বাবরকে এগোতে দেখে পচাৎ করে থুতু ফেলে সেটার দু’পাশে দুটো ঝুড়িতে খুতলাঘ নিগার আর খানজাদা আরোহন করেছেন। উটের পেছনে বাবর তার আম্মিজানের পরিচারিকা দলের কয়েকজন পরিচিত সদস্য, যাদের ভিতরে ফাতিমাও রয়েছে আর তার উজির কাশিমকে দেখতে পায়।

উটের চালকরা লাফিয়ে নেমে, উটের গ্রন্থিযুক্ত হাঁটুতে তাদের হাতের লাঠি দিয়ে আঘাত করে উটগুলোকে বাধ্য করে মাটিতে বসতে। বয়োবৃদ্ধ হবার কারণে, বাবর দৌড়ে প্রথমে এসান দৌলতের কাছে যায় এবং হাঁটু মুড়ে বসে তাকে আলতো করে ঝুড়ি থেকে তুলে আনে। বাবর কোনো কথা খুঁজে পায় না, আর এই প্রথমবারেরমতো মুখরা এসান দৌলতও বাক্যহারা হয়ে পড়েন। সে টের পায় নানীজান তার মাথা আলতো স্পর্শ করেন। সে উঠে দাঁড়িয়ে তার ছোট ছোট উজ্জ্বল চোখের দিকে তাকালে সেখানে তার পুরানো সত্ত্বার ঝলক দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। নানীজানকে এখন তিনি বরাবর যার জন্য গর্ব করেন,সেই খামের- চেঙ্গিস খানের রক্তের উত্তরসুরী এক নারীর মতোই দেখাচ্ছে।

সে এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে তার আম্মিজানকে ঝুড়ি থেকে তুলে মাটিতে নামিয়ে দেয় এবং তাকে জড়িয়ে ধরে তার আশৈশব পরিচিত চন্দনকাঠের উষ্ণ সুগন্ধে বুক ভরে শ্বাস নেয়। সে তার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাকিয়ে দেখে আম্মিজানের চোখে অশ্রু টলটল করছে। “বাছা তোমাকে আবার দেখতে পেয়ে খুশি হলাম,” কোনো রকমের আবেগ না দেখিয়ে তিনি বলেন, এবং তার মুখে একটা হাসির আভাস ফুটে উঠে যা বাবরের যেমনটা মনে আছে তার চেয়েও ম্লান এবং বলিরেখায় আকীর্ণ।

খানজাদা ইতিমধ্যে তাকে বহনকারী ঝুড়ি থেকে নিজেই ধড়ফড় করে নেমে এসেছে। এবং সে সোজা ভাইকে লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার পোষা বেজী যেটা সে বামহাতে ধরে রেখেছে, কুইকুই করে প্রতিবাদ জানায়। শেষবার বাবর তার বোনকে দেখেছিলো হাড্ডিসার একটা মেয়ে, যার মুখে কয়েকটা দাগ রয়েছে। খানজাদা এখন রীতিমত একজন মহিলাতে পরিণত হয়েছে, তার দেহে ভরা নদীর জোয়ার বইছে। মুখ আগের চেয়ে অনেক দাগহীন আর সুন্দর। কিন্তু ফিচেল হাসি আগের মতোই আছে দেখে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। সে তাকে জড়িয়ে ধরে এবং তারপরে ছেড়ে দিয়ে এক পা পিছিয়ে আসে ভালো করে তাকে দেখবে বলে।

খানজাদাও কম যায় না সেও ভাইকে জরিপ করে। “তুমি লম্বা হয়েছে।” সে বলে, “আর তোমার কাঁধ আগের চেয়ে চওড়া হয়েছে। কিন্তু একি চেহারা হয়েছে। তোমার থুতনিতে ছাগলের মত দাড়ি আর চুলের অবস্থা যাচ্ছেতাই- তোমার চুল দেখছি আমার মত লম্বা! আর নখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না- কালো হয়ে আছে।”

বাবর পেছন থেকে, খানজাদার নাক কোঁচকানো বিশেষণগুলোর সমর্থনে এসান দৌলতকে জিহ্বা আর টাকরার সাহায্যে একটা শব্দ করতে শোনে এবং সে হেসে ফেলে। অবশেষে তার প্রিয়জনেরা তার কাছে এসেছে এবং সবকিছু যেমনটা থাকার কথা তেমনই রয়েছে। তাদের সাথে সে পরে কথা বলবে এবং শুনবে বিগত দিনগুলো তাদের কেমন কেটেছে। কিন্তু এখনকার মতো এই যথেষ্ট।

তারা দূর্গের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। অবশেষে মুক্তি লাভ করা ফারগানার শাহী রমণীদের অভ্যর্থনা জানাতে তূর্যনিনাদ আর রণভেরী গমগম আওয়াজে বেজে উঠে- অন্তত এখনকার জন্য হলেও তারা নিরাপদ।

দূর্গের উপরের তলায় প্রস্তুত রাখা জেনানামহলে মেয়েদের পৌঁছে দিয়ে, বাবর তার বঁধুনিকে ডেকে পাঠায়। তার পরিকল্পিত ভোজসভার সব আয়োজন কি অবস্থায় আছে তা জানতে। এখানের ভোজসভা সমরকন্দের মতো জাঁকজমকপূর্ণ হবে না। যেভাবে সে তাদের অভ্যর্থনা জানাতে চেয়েছিলো। অবশ্য, তাহলেও বিশটা ভেড়া জবাই করা হয়েছে আর আঙ্গিনায় সেগুলোকে আগুনে ঝলসানো হচ্ছে। মুরগীর পালক ছাড়িয়ে, আখরোট আর খুবানির সাথে মাখন দিয়ে সিদ্ধ করা হচ্ছে। আস্ত আপেল ঘন সোনালী বর্ণের মধু আর লাল রসে ভরা ডালিমের দানার সাথে কাঠবাদাম আর পেস্তার মিশ্রণে চিকচিক করছে। তাদের কোনো এক অভিযানে তার লোকদের লুট করা রূপালি বর্ণের কাঠবাদামের স্তূপের দিকে সে বিশেষ সন্তুষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে। এসান দৌলত অন্য যে কোনো মিষ্টির চেয়ে এগুলো বেশি পছন্দ করেন।

নির্মেঘ, তারা-শোভিত আকাশে চাঁদ উঠলে, এবং কোনো আকষ্মিক হামলা থেকে আগেই সাবধান করতে দূর্গপ্রাকারে সৈন্য মোতায়েন করে ভোজসভা শুরু হয়। বাবর আর তার লোকেরা নিচুলার একটা নিচু, লম্বা কামরায় আহার সারে। যখন উপরে নিজেদের কামরায় মেয়েদের তাদের পছন্দের অংশ পরিবেশন করা হয়। মোমবাতির কাঁপা আলোতে বাবরের লোকেরা উদাত্ত কণ্ঠে গান শুরু করে। বাকীরা যে নিচু কাঠের টেবিলের চারপাশে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে আছে তাতে চাকুর বাট দিয়ে আঘাত করে তাল দেয়। বাবর ভাবে, তার লোকেরা খুশি হয়েছে। মেয়েদের মুক্তিতে তারাও প্রীত হয়েছে। তার সাথে সাথে তার লোকদেরও এটা সম্মানহানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো- যেনো মেয়েদের মুক্ত করার সামর্থ্য তাদের নেই।

বাবর খেতে চেষ্টা করে কিন্তু কিছুই খেতে পারে না। তার ইচ্ছা করে এখান থেকে উঠে যায় এবং তার আম্মিজান, খানজাদা আর এসান দৌলতের সাথে নিভৃতে সময় কাটায়। কিন্তু তার অনুসারীদের প্রতি সৌজন্যতাবশত তাকে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। গানের মাত্রা ধীরে ধীরে চড়তে শুরু করে এবং ক্রমশ কর্কশ হয়ে উঠে। যোদ্ধার দল উচ্চকণ্ঠে নিজেদের পূর্বপুরুষের বীরত্বের কথা বয়ান করতে থাকে এবং বাবরও এবার তাদের সাথে কণ্ঠ মেলায়। কিন্তু অবশেষে, কেউ কেউ টেবিলের উপরে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে। আর অন্যেরা ঝাপসা চোখে টলোমলো পায়ে কামরা থেকে বের হয়ে বাইরের আঙ্গিনায় নিজেদের হাল্কা করতে শুরু করলে, বাবর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পাথরের বাঁকানো সিঁড়ি বেয়ে জেনানামহলের দিকে রওয়ানা দেয়।

খুতলাঘ নিগার দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাকে স্বাগত জানায় এবং সে ভিতরে প্রবেশ করে গালিচা পাতা মেঝেতে তার পাশে এসে বসে। তাদের সামনের পিতলের থালায় পড়ে থাকা খাবারের অবশিষ্টাংশ দেখে সে বুঝতে পারে মেয়েরা ভালমতোই খেয়েছে। কিন্তু তারপরেও সে এখন যখন তাদের মুখের দিকে তাকায় সেখানে সে একটা টানটান অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে। তাদের তিনজনকেই ফ্যাকাশে আর বিবর্ণ দেখায়। যেনো বহুকাল সূর্যের আলোর উষ্ণতা অনুভব করেনি বা তাজা বাতাসে তারা শ্বাস নেয়নি। কাউকে না কাউকে অবশ্যই এর মূল্য দিতে হবে- রক্ত দিয়ে। কিন্তু মেয়েদের খাতিরে আপাতত সে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে না। তারা যাই বলুক তাকে, সে অবশ্যই সব কিছু শান্ত ভঙ্গিতে শুনবে।

কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ বসে থাকে। প্রাথমিক উত্তেজনা প্রশমিত হতে, কেউই বুঝতে পারে না কোথা থেকে শুরু করা উচিত।

অবশেষে এসান দৌলত শুরু করেন: “বাবর তুমি তাহলে সরমকল দখল করেছিলে।” তার বিচক্ষণ মুখে বিরল একটা হাসির আভাস ফুটে উঠে।

“অধিকার করেছিলাম বটে, কিন্তু দখলে রাখতে পারিনি।” বাবর তার মাথা নিচু করে। এমন কিছু কথা আছে যা তাকে বলতেই হবে। “নানীজান, আমি আপনাকে হতাশ করেছি। আপনি আমার সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন এবং আমি সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমার আসতে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল আর লোকজন ছিল অনেক অল্প।”

“আমাদের তুমি মোটেই হতাশ করনি। আর জেনে রেখো, আমাদের কারণেই তুমি সমরকন্দ হারিয়েছে। আমাদের সাহায্য করার জন্য তুমি সাথে সাথে যাত্রা করেছিলে। তুমি এরচেয়ে বেশি আর কিইবা করতে পারতে?”

বাবর আক্ষেপের সাথে মাথা নাড়ে। “ফারগানা আর আপনারা ছিলেন আমার প্রধান দায়িত্ব। সমরকন্দে আমি নতুন কোনো খেলনা হাতে পাওয়া শিশুর মতো আচরণ করেছিলাম। আমার তখন অন্য কিছু সম্বন্ধে ভাববার সামান্যই অবকাশ ছিলো। আপনাদের আর ফারগানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমার উচিত ছিলো ওয়াজির খানকে পাঠিয়ে দেয়া।” সে তার মায়ের গায়ে হেলান দেয় এবং বরাবরের মতোই মায়ের আঙ্গুল তার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে টের পায়। এতে সে কিছুটা শান্ত হয়।

“কিছু কিছু বিষয় তামবাল আমাদের কাছে কখনও গোপন করেনি।” খুতলাঘ নিগার বলেন। “আমার মনে হয় এতে সে আনন্দই পেতো। আমরা, তোমার চাচাতো ভাই মাহমুদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা অবশ্যই জানি- আমরা জানি সেই সমরকন্দ তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। বাছা, সে আর তামবাল মিলে তোমার জন্য একটা ফাঁদ পেতেছিলো। তারা দু’জনে মিলে ঠিক করেছিলো, ফারগানায় সে তোমাকে মসনদ থেকে সরিয়ে দিয়ে জাহাঙ্গীরকে তোমার স্থলাভিষিক্ত করবে। তারা জানতো এর ফলে তুমি বাধ্য হবে- তোমার বেশিরভাগ সৈন্য নিয়ে ফারগানায় ফিরে আসতে। আর মাহমুদ এর ফলে তার কাঙ্ক্ষিত সুযোগ পায়। তুমি তখন সদ্য সমরকন্দের সুলতান হয়েছে। তারা বলেছে যে সেখানকার অভিজাত ব্যক্তিরা তোমার প্রতি তেমন একটা আনুগত্য বোধ না করায়, মাহমুদ আর তার কলহপ্রিয় স্ত্রী, গ্রান্ড উজিরের কন্যা সহজেই ঘুষ দিয়ে তাদের কিনতে পেরেছে।”

নিজের সবচেয়ে জঘন্য সন্দেহটা প্রমাণিত হতে বাবর চোখ বন্ধ করে ফেলে। কি আহাম্মকই না সে ছিলো।

“তোমার এটাও জেনে রাখা উচিত, মাহমুদের স্ত্রীর কারণে সে গো ধরায় আলি মজিদ বেগকে হত্যা করা হয়েছিলো।” এসান দৌলতের কণ্ঠস্বর তিক্ত শোনায়। নিহত গোত্রপতির মা ছিলো তার বান্ধবী আর তিনি নিজেও তাকে পছন্দই করতেন। “সে নাকি বলেছে তোমার শিরোচ্ছেদ করতে না পারায়, তাকে শিরোচ্ছেদ করলেই আপাতত চলবে- তার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ হিসাবে। মাহমুদ তার কথা ফেলতে পারেনি। সবাই বলে সেই আসলে সমরকন্দের নতুন শাসক। নিজের বাবার চেয়েও সে বেশি লোভী আর প্রতিহিংসাপরায়ণ।”

বাবর বিস্ময়ে চোখ পিটপিট করে। সে ভাবতেও পারেনি সেই সুঠামদেহী তরুণী, যে এমন সাহসিকতার সাথে গ্রান্ড উজিরের প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলো কিভাবে এতো অনুভূতিহীন নিষ্ঠুর আর নির্মম হতে পারে। একদিন তাকে অবশ্যই তার এই স্পর্ধার জন্য জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু সেটা পরেও হতে পারে। তার আগে তাকে অন্য অনেক বিষয় জানতে হবে এবং সেগুলো মেনে নিতে হবে।

সে আলতো করে দু’হাতের মাঝে মায়ের হাত জড়িয়ে ধরে। “আমাকে তোমাদের কথা বলল। তোমরা বন্দি থাকা অবস্থায় কেমন আচরণ করছে তারা তোমাদের সাথে?”

“কয়েকজন মাত্র পরিচারকসহ আমাদের একটা ছোট জায়গায় আটকে রাখা হয়েছিলো কিন্তু আমাদের বংশ গৌরব আর মর্যাদার কারণে তারা বাধ্য হয়েছিলো আমাদের যথাযথ সম্মান দেখাতে। তামবাল আমাদের অপমান বা হুমকি দেয়নি।” তার মা বলে, “আর সম্প্রতি- সম্ভবত তোমার সাফল্যের কথা যখন সে জানতে পারে- আমাদের বড় একটা মহলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।”

“আর সে রোক্সানাকে আমাদের গহনা কেড়ে নিতে দেয়নি। অবশ্য অন্যদের মুখে শুনেছি সে ক্রুদ্ধ হয়ে চেঁচামেচি করেছে, যদিও সে তামবালের অঙ্কশায়িনী ছিলো।” এসান দৌলত কুপিত কণ্ঠে কথাগুলো বলেন।

“আর আমার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীর? এসবে তার ভূমিকা কতটুকু?” বাবর প্রায়ই তার স্থান দখল করে নেয়া বালকটার কথা ভাবে যাকে সে কখনও দেখেনি। শেষবার আকশি থেকে আসবার সময়ে, সমরকন্দ অবরোধের প্রস্তুতি নেবার সময়ে, ছোঁড়া অসুস্থ ছিলো।

“বেচারা পরিস্থিতির শিকার, আর প্রায়ই অসুস্থ থাকে। তামবালের পুরো শরীরে কয়েক চামচ পরিমাণ রাজরক্ত থাকায় সে কখনও নিজে সিংহাসন দাবি করতে পারবে না। অন্য গোত্রপতিরা সেটা তাকে করতেও দেবে না। কিন্তু জাহাঙ্গীরের রাজপ্রতিভূ হিসাবে যে ক্ষমতার জন্য সে লালায়িত সেটা অর্জন করতে পারবে।” এসান দৌলত ভাবাবেগশূন্য কণ্ঠে কথাগুলো বলেন। “সে এখন তোমাকে ভয় পায়। সে যদি তোমাকে খুশি করতে না চাইতো, তাহলে আমাদের এতো সহজে মুক্তি দিতো না?”

সুলতান হিসাবে বাবর নিজের প্রথম দিনগুলোর কথা ভাবে, তার মনে পড়ে তামবাল তখন কিভাবে অন্য নেতাদের মনে সন্দেহের বীজ বপনের চেষ্টা করেছে। সব সময়ে সে নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিবৃত্ত করার চেষ্টারত ছিলো। কী সাংঘাতিক সুবিধাবাদি এক লোক- কামবার আলীর ষড়যন্ত্রে যোগ দেবার ব্যাপারে ভীষণ বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে সঠিক সময়ের জন্য ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা করেছে। এজন্যই কি সমরকন্দ দুবার অবরোধ করতে সে তাকে প্ররোচিত করেছিলো? বাইসানগার যখন তৈমূরের অঙ্গুরীয় নিয়ে এসেছিল তখন আগ্রহে চকচক করতে থাকা তামবালের চেহারা তার এখনও মনে আছে। তার আরো মনে আছে, সমরকন্দ অধিকার করার পরে কি রকম তাড়াহুড়ো করে সে ফারগানা ফিরে এসেছিলো।

“আমাদের জন্য সবচেয়ে কঠিন সময় ছিলো প্রথম কয়েক মাস, যখন আমরা জানতাম না তোমার ভাগ্যে কি ঘটেছে। ফাতিমা- তুমি জান সে কেমন গপ্পোবাজ সে একবার একটা কথা শুনে আসে- একটা গুজব কিন্তু সেটাই আমাদের আতঙ্কিত করে তোলার জন্য যথেষ্ট ছিলো- যে তুমি ফারগানায় ফিরে আসার সময়ে পথে অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছে। তার মায়ের কণ্ঠস্বর কেঁপে যায়। কিন্তু তারপরেই আমরা শুনতে পাই যে তুমি সুস্থ আছো, আর পাহাড়ে আত্মগোপন করে রয়েছে। আমরা জানতাম না কোনটা সত্যি। যতদিন না তামবাল ক্রুদ্ধ হয়ে আমাদের কাছে আসে…সে আমাদের বলে তুমি গ্রামের পর গ্রাম আক্রমণ করে, সবকিছু জ্বালিয়ে দিচ্ছ, তছনচ করে দিচ্ছ এবং নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছো, কাউকে রেয়াত না দিয়ে।”

“তামবাল যা বলেছে, সেটাই তাহলে সত্যি, তাই না বাবর? যে তুমি একজন সাধারণ দস্যু আর গরু-চোরে পরিণত হয়েছো?” এসান দৌলত প্রশ্রয়ের কণ্ঠে বলেন।

বাবর সম্মতি প্রকাশ করে মাথা নাড়ে এবং মুহূর্ত পরে নানীজানের দিকে তাকিয়ে সেঁতো হাসি হাসে। তার মা আর নানী তার সম্বন্ধে কি ভাববে সেটা নিয়ে সে প্রায়ই দুশ্চিন্তা করতো। তারা কি কখনও বুঝতে পারবে কেনো একজন শাহজাদা পাহাড়ী দুৰ্বত্তের জীবন গ্রহণ বাস্তবিক পক্ষে উপভোগ করতে পারে।”

“বাবর, আমাদের সেসব কথা বল।”

পশুর চর্বি দিয়ে তৈরি মোমবাতির দপদপ করতে থাকা শিখা নিভু নিভু হয়ে আসতে, বাবর তার সময় কিভাবে কেটেছে সেটা তাদের কাছে বর্ণনা করতে চেষ্টা করে। দুইশ কি তিনশ অভিযাত্রীর একটা বাহিনী নিয়ে, পাহাড়ের উপর থেকে ধেয়ে আসবার উত্তেজনাই আলাদা। রাতের বেলা তামবালের অনুগত বাহিনীর দূর্গ ঝটিকা আক্রমণের উল্লাস। আর তার পরে রাতের আঁধারে হারিয়ে যাবার, তার পর্যাণে বাধা শিকারের ছিন্নমস্তক থেকে টপটপ করে ঝরে পড়া রক্তের ধারার অনুপ্রেরণা। প্রাচীন মোঙ্গল প্রণালী অনুসরণে তার দলের এক লোক। ঘোড়ার দুধ গজিয়ে যে খভাস তৈরি করতো সেটা পান করার কারণে মাথা ঘুরতে থাকলে সারা রাত ধরে পানোন্মত্ত অবস্থায় ফুর্তি করা। চকরাখদের ছিন্নমস্তক দিয়ে উদ্দাম পোলো খেলার কথা সে কেবল এড়িয়ে যায়। যদিও খানজাদাকে হয়তো পরে সে সেটাও বলবে। তার কথা বলার সময়ে খানজাদার চোখ চকচক করতে থাকে। তার হাতের মুঠি খোলে আর বন্ধ হয়, যেনো সে নিজে সেখানে ছিলো। তার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। এসান দৌলতও মগ্ন হয়ে শোনেন। কিন্তু সে খেয়াল করে মৃত্যুর করাল থাবার হাত থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যাবার ঘটনাগুলো শোনার সময়ে তার মায়ের ভ্রু কুঁচকে উঠে।

“আমি কিন্তু কেবল যারা আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাদেরই আক্রমণ করেছি। আর আমি কখনও তোমাদের কথা ভুলে যাইনি। তোমাদের স্বাধীনতা আমার মসনদের চেয়েও বেশি কাম্য ছিল আমার কাছে।” চারপাশে তাকিয়ে, বাবর দেখে গবাক্ষের সরু ফাঁক দিয়ে ফ্যাকাশে, ধুসর আলোর একটা ধারা লুকিয়ে কখন যেন কামরায় প্রবেশ করেছে। প্রায় সকাল হয়ে এসেছে।

“তুমি এটা অর্জন করেছে। কিন্তু যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে। এখন আমাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হবে।” এসান দৌলতের কণ্ঠে একটা সতেজতা ফুটে থাকে এবং তার দৃষ্টি বাবর নিজের উপরে অনুভব করলে সে অস্বস্তিবোধ করে, যেন কোনো বাচ্চা ছেলে এখনই তার ওস্তাদের কাছে ধমক খাবে। “বাবর, তুমি এই ক’দিনে কি শিখেছো?” নানীজান তার দিকে ঝুঁকে এসে তার কব্জি আঁকড়ে ধরে। “ তোমার কথা অনুযায়ী মসনদহীন দিনগুলো থেকে তুমি কি শিখেছো?”

যুক্তিসঙ্গত একটা প্রশ্ন। এই বিপজ্জনক, মরীয়া সময় তাকে কি শিক্ষা দিয়েছে? “বিশ্বস্ত বন্ধু আর মিত্রের গুরুত্ব,” সে অবশেষে কথা খুঁজে পেয়ে বলে, “এবং তাদের যোগ্যতা অনুসারে প্রতিদান দেয়া। এছাড়া পরিষ্কার উদ্দেশ্য, একাগ্রচিত্ত কৌশল আর সেটা অর্জনের পথে কোনো কিছুকে বাধা হিসাবে গণ্য না করার প্রয়োজনীয়তা।”

এসান দৌলত সন্তুষ্টির মাথা নাড়েন। “অবশ্যই। এবং এছাড়া আর কি?”

“আমি শিখেছি একজন সুলতানের পক্ষে সবসময়ে উদারতা দেখান সম্ভব না, শ্রদ্ধা অর্জনের জন্য তাকে কঠোর হতে হবে- কখনও নির্মম। অন্যথায় তাকে দুর্বল মনে হবে। নেতৃত্ব দেবার বদলে সবার ভালবাসার পাত্রে পরিণত হবার ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। আর সেই সাথে মিষ্টিভাষী ষড়যন্ত্রকারীর ফাঁদে পা দিয়ে বসতে পারে। আমি শিখেছিঃ আনুগত্য অর্জন করতে হলে কেবল কৃতজ্ঞতা আর সম্ভ্রম উদ্রেক করলেই চলবে না। এর সাথে সামান্য ভয়েরও মিশেল থাকতে হবে। আমি প্রথমবার ফারগানার শাসক হবার পরে বাকী বেগ, বাবা কাশক, আর ইউসুফকে প্রাণদণ্ড দেয়া উচিত ছিলো। তার বদলে আমি কেবল তাদের শাহী দায়িত্বপালন থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলোম এবং জীবন ধারণের জন্য কোনো বাধা না দিয়ে বরং মনের ভিতরে তাদের তিক্ততা পোষণের সুযোগ দিয়েছি। এছাড়া, সমরকন্দ দখল করার পরে গ্রান্ড উজিরের কতিপয় সমর্থককেও কড়কে দেয়া উচিত ছিলো।

“তারচেয়েও বড় কথা, আমার নিয়তির প্রতি আমি আর কখনও অবহেলা প্রদর্শন করবো না। আমাদের সাথে আমার সাথে যা ঘটেছে তারপরেই কেবল আমি হাল্কা হাল্কা বুঝতে পারছি মানুষ তৈমূর লোক হিসাবে কেমন ছিলেন। মাঝে মাঝে তার নিজেকে কেমন একা মনে হয়েছে- নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করতে গিয়ে তাকে কেমন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। আর তাছাড়া, তাদের সব দায়দায়িত্ব পরে বহুবছর ধরে তাকে নিজের কাঁধে বহন করতে হয়েছিলো… আমি নেতৃত্ব দেবার মতো সাহসও অর্জন করেছি…ওয়াজির খানের মতো আমার যতো দক্ষ পারিষদ থাকুক আমার নিয়তি কেবল আমিই নির্ধারণ করতে পারি।

বাবর মুখ তুলে তার নানীজানের দিকে তাকায়। “দেখে নিয়ে, আমি ঠিক তৈমূরের মতই বীর হবো। আমি শপথ করে বলছি…”

“কথাগুলো সত্যিই শুনতে ভাল লাগে।” এসান দৌলত মন্তব্য করেন। “চলো আমাদের অনেক কাজ এখনও বাকি আছে। একটা নতুন দিনের প্রভাত হচ্ছে।”

২.২ পরিনায়ক

০৮. পরিনায়ক

বাবরের মুনশীর আঁকা ফারগানার সীমারেখা চিহ্নিত পার্চমেন্টের ভাঁজ শীর্ণ শিবহুল ছোট ছোট হাতে সমান করতে করতে এসান দৌলতের দৃষ্টিতে সন্তুষ্টি ভাসে। কোনোমতে আঁকা মানচিত্রে, উত্তর-পূর্বের বরফাবৃত পর্বত থেকে প্রবাহিত হয়ে এর শীতল জল পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে এসে প্রশস্ত উপত্যকার উপর দিয়ে দুরন্ত মেয়ের উজ্জ্বলতায় এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া দেখাবার বদলে জাক্সারটাসকে পূর্ব-পশ্চিমে সোজাসুজি বহমান দেখানো হয়েছে। অবশ্য সেটার কোনো দরকারও নেই। গুরুত্বপূর্ণ হলো, সিন্দুরে রঙের কালিতে চিহ্নিত শহর আর গ্রামের মন ভরিয়ে তোলা সংখ্যা যা এখন বাবরের নিয়ন্ত্রণাধীন।

দু’বছরের বন্দি জীবন কাটালেও ফারগানার অভিজাতদের রাজনৈতিক আনুগত্য, তাদের দুর্বলতা আর উচ্চাকাক্ষা সম্বন্ধে জ্ঞান তার বিন্দুমাত্র ফিকে হয়নি। রক্তের জটিল সম্পর্ক আর আনুগত্য সম্পর্কে যা কিছু জানবার সবই এসান দৌলতের নখদর্পণে। কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা তিনি যেন মানুষের মনের ভিতরটা পড়তে পারেন। এক লহমায় তাদের দুর্বলতা, অহেতুক গর্ববোধ আর অহমিকা বুঝে নিয়ে কিভাবে সেটা নিজেদের সুবিধার্থে কাজে লাগানো যায়। তার নির্দেশনায়, বাবরের ভিতরে প্ররোচিত করার ক্ষমতা জন্ম নিচ্ছে, সেই সাথে নিপূণভাবে নিজ উদ্দেশ্যসিদ্ধির দক্ষতা, নিজের এই দক্ষতা সম্পর্কে বাবর এতদিন অজ্ঞ ছিলো ইতিমধ্যে কয়েকজন প্রভাবশালী গোত্রপতিকে নিজের পক্ষে আনতে সফল হয়েছে। অন্যেরা, ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন আঁচ করতে পেরে নিজেরাই তার সাথে যোগ দিয়েছে। তাদের হিসাবে বাবর এখনই তাদের পুরস্কৃত করতে না পারলেও অচিরেই এমন সময় আসবে, যখন সে উদারভাবে তাদের আজকের বঞ্চনা ভরিয়ে দেবে।

নিজের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং তার সতত বিকাশমান সেনাবাহিনীর সহায়তায় বাবর ধীরে ধীরে পূর্বদিকে চাপ বৃদ্ধি করতে থাকে। গত ছয়মাসে তার সেনাবাহিনীর কাছে কারনন, কাস্সান আর সোখ দূর্গের পতন হয়েছে। শেষের দুটো আপসে আত্মসমর্পন করেছে এবং অবশেষে সে আকশিকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলতে শুরু করেছে। জাহাঙ্গীরকে সিংহাসনচ্যুত করাটা এখন কেবল সময়ের। ব্যাপার এবং সে নিশ্চিত শীঘ্রই আবার ফারগানার সুলতান হিসাবে সে পরিচিত হবে। কিন্তু শীতকালটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে ধৈর্য ধারণ করতেই হবে। মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে সে ভাবে। বরফাবৃত প্রেক্ষাপটের বুকে জীবন্ত কিছুই দেখা যায় না- কদাচিৎ খাবারের সন্ধানে দু’একটা হরিণ বা শিয়ালকে এদিক ওদিক দৌড়ে যেতে দেখা যায়। আর শীতল আকাশের বুকে চিলের আঁক অসতর্ক হঁদুরের খোঁজে ডানা ভাসিয়ে উড়ে বেড়ায়। দূর্গ প্রাকারে জমে থাকা সূচাগ্র তুষারিকা বলে দেয়, অভিযানের সময় এটা না। আর বাতাস এতো শীতল সে শ্বাস নিলে যে কোনো মানুষের বুক ব্যাথা করবে।

“বাবর মনোযোগ দিয়ে শোন। তোমার সাথে আমার কিছু জরুরি আলাপ আছে। তোমার আম্মিজান আর আমি ঠিক করেছি এবার তোমার বিয়ের বয়স হয়েছে। তোমার এখন সতের বছর বয়স। কিন্তু তার চেয়েও যেটা গুরুত্বপূর্ণ হলো উপযুক্ত সম্বন্ধ তোমার অবস্থানকেই শক্তিশালী করবে।”

এসান দৌলত বিজয়দৃপ্ত ভঙ্গিতে তার দিকে তাকায়। “সব বন্দোবস্ত সম্পন্ন হয়েছে অন্তত নৈতিকভাবে বলা চলে। আমি আর তোমার আম্মিজান যখন বন্দি ছিলাম, তখনই আমরা পরিকল্পনা করতে শুরু করি। বন্দিদশা থেকে মুক্তি লাভ করার সাথে সাথে আমরা সম্ভাব্য সম্বন্ধের কথা প্রচার করতে থাকি এবং দুদিন আগে বার্তাবাহক আমার কাছে সুসংবাদ নিয়ে এসেছে। আমি যে পরিবারের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের কথা মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম তারা তাদের সম্মতি জানিয়েছে। যদি তুমি সম্মতি দাও এবং আমি তোমার অখুশি হবার কোনো কারণ অবশ্য দেখতে পাচ্ছি না- বরফ গলতে শুরু করা মাত্র তুমি তোমার নবপরিণীতা স্ত্রীকে গ্রহণ করার জন্য রওয়ানা দেবে।”

বাবর হতবাক হয়ে নানীজানের দিকে তাকিয়ে থাকে, চোয়াল ঝুলে পড়ে এবং বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পায় না। এমনকি তার বিচক্ষণ নানীজান এতো চিন্তা ভাবনা করে কাকে তার স্ত্রী হিসাবে মনোনীত করেছে সেটা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করার কথা তার মনে থাকে না।

***

বাতাসে এখনও শীতলতা বিরাজ করছে, কিন্তু শীতের প্রকোপ কমার সাথে সাথে শাহরুখিয়ার দেয়ালের উপরে উজ্জ্বল সবুজ ছোপের আকৃতি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। জেনানামহলে অচিন্তনীয় উত্তেজনা বিরাজ করছে- খানজাদা আসন্ন বিয়ে ছাড়া অন্য কোনো বিষয়েই কথা বলতে পারছে না। আস্তাবল থেকে ঘোড়া দেখে আঙ্গিনার উপর দিয়ে হেঁটে আসবার পথে বাবর আমুদে ভঙ্গিতে ভাবে। শীতকালের জন্য জমানো খাবার খেয়ে ঘোড়াগুলো শীর্ণ আর খিটমিটে মেজাজের হয়ে পড়েছে। আস্তাবলের দেয়ালের গায়ে তাদের পায়ের খুরের দাগে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে পাহাড়ের বুক চিরে আবার ছোটার জন্য তাদের অসহিষ্ণু আকাক্ষা। ঘোড়াগুলোর জন্য বাবরের মন সহানুভূতিতে ভরে উঠে। তার নিজেরও একই অবস্থা।

বস্তুত পক্ষে, অসহিষ্ণুতা ছাপিয়ে অন্য কিছু একটা তাকে আপুত করে ফেলেছে। সে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছে। শাহী পরিবারের সদস্যদের বিয়ের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের চেয়ে রাজনৈতিক কারণ আর আনুগত্যের বন্ধনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছেলেবেলা থেকেই সে এই কথাটা শুনে বড় হয়েছে। সে যখন নিতান্তই শিশু, তখনই তার জন্য সম্ভাব্য বিবাহাৰ্থ বাগদানের কথা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের কথা আলোচিত হয়েছিলো। কিন্তু তার আব্বাজানের আকস্মিক মৃত্যু এবং তার ভাগ্যের উত্থান পতনের কারণে তারা সবাই পিছিয়ে গিয়েছে। তখন থেকে, সে মনে মনে ভেবে রেখেছিলো উপযুক্ত সময় আসলে বিয়ের ব্যাপারে সে নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে। দেখা যাচ্ছে তার আম্মিজান আর নানীজান একজন সুলতানের চেয়ে তার সাথে অর্বাচীন কিশোরের মতো ব্যবহার করছে। নিজেদের ভিতরে সবকিছু আগে ঠিক করে নিয়ে একেবারে শেষ মুহূর্তে পুরো বিষয়টা অনিবার্য হিসাবে তার সামনে হাজির করেছে। যদিও এসান দৌলতের ধারণা এই কাজের জন্য তার অভিনন্দন প্রাপ্য এবং সে তাকে শ্রদ্ধা আর পছন্দ করলেও এই মুহূর্তে নানীজানের গলাটা মুচড়ে দিতে পারলে সে শান্তি পেত।

কিন্তু অন্যদিকে আম্মিজানের চোখের নিরব আনন্দ, তিনি যা কিছু সহ্য করেছেন এবং তার মরহুম আব্বাজানের সাথে আম্মিজানের বিয়ে কেবল রাজনৈতিক কারণে আয়োজন করা হলেও পরবর্তীতে তা একটা সফল বিয়েতে পরিণত হওয়া সম্পর্কে তার ব্যাখ্যা শোনার পরে, বাবর প্রতিবাদ করার মতো কোনো যুক্তি খুঁজে পায় না। আর নিজের মনে সে জানে সেটা উচিতও হবে না। এই দুই মহিলার কথাই ঠিক: বিয়ের বন্ধনের মাধ্যমে সৃষ্ট শক্তিশালী মৈত্রীর অতিরিক্ত সমর্থন তার প্রয়োজন। এই জুড়ির ব্যাপারে তার সব অমাত্যই বলেছে এর চেয়ে ভালো পছন্দ আর সমঝোতা হতে পারে না, যদিও সেটা বলার সময়ে তারা বৃথাই তার নাম নিয়েছে। বাবর ওয়াজির খানকে যখন বলেছে যে কি পরিকল্পনা করে হচ্ছে। তখন তার মুখের হাসি। আর বিস্ময়ের অভাব দেখে সে ঠিকই বুঝতে পারে যে পুরো ব্যাপারটা দানা বাঁধবার আগে তার সাথে ঠিকই অন্তত আলোচনা করা হয়েছে।

আর মাত্র কয়েকদিন পরেই, সে জামমীন প্রদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। ফারগানার দক্ষিণ-পশ্চিমে দক্ষিণ সীমান্তের কাছে সাত দিনের দূরত্বে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। সবাই তার জন্য যাকে বধূ হিসাবে নির্বাচিত করেছে তার নাম আয়েশা। জামমিনের শাসক আর মাঙ্গলিঘ গোত্রের সর্দার, ইবরাহিম সারুর বড় মেয়ে। আয়েশা বয়সে তার চেয়ে দুই বছরের বড়। সে দেখতে কেমন হবে? সে কি গ্রান্ড উজিরের মেয়ের মতো চমৎকার দেহ-সৌষ্ঠবের অধিকারী, নাকি শত্রুরা তার জন্য মুখে গন্ধওয়ালা কোনো উটনী খুঁজে বের করেছে? বাবর কাঁধ ঝাঁকায়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইবরাহিম সারু একজন ক্ষমতাবান সর্দার আর এখন পর্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে তিনি কোনো পক্ষ অবলম্বন করেননি। এখন থেকে তার অধীনস্ত সেনাবাহিনী। বিশেষ করে তার দুর্ধর্ষ তীরন্দাজ বাহিনী- বাবরের নেতৃত্বে তার ন্যায়সঙ্গত অধিকার পুনরুদ্ধারের অভিযানে অংশ নেবে। এই বিষয়টার দিকে লক্ষ্য রেখে, এসান দৌলত তাকে বারবার একটা কথাই পাখিপড়ার মত করে পড়িয়েছে মেয়ে দেখতে কেমন সেটা কোনো ব্যাপারই না। রাতের দায়িত্ব যথাযথের চেয়েও ভালভাবে সম্পূর্ণ করতে তার কিশোর রক্তের কোনো অসুবিধাই হবে না। আর তাছাড়া সে অবশ্যই পরে আরো দার পরিগ্রহ করতে বা উপপত্নী রাখতে পারবে। বাবর তার আম্মিজানের মহলে প্রবেশ করলে সেখানে খুতলাঘ নিগার বা এসান দৌলত কাউকেই দেখতে পায় না। কিন্তু খানজাদাকে একটা কাঠের ছোট বাক্স থেকে কিছু ক্ষুদ্র অলঙ্কার মেঝেতে ঢেলে আনমনে বাছতে দেখে। “আমি কি এগুলো আয়শাকে দিতে পারি? তার কি এসব পছন্দ হবে?” সে ছোট ছোট রুবি বসানো সোনার সুক্ষ তারের একটা ঝালরের মতো কানের দুল এবং দুলের নিচে মুক্তার একটা তিরতির করে কাঁপছে, দেখিয়ে জানতে চায়।

“তোমার ইচ্ছা হলে দিও।” বাবর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে। তার নবপরিণীতা বধূকে তার দেয়া উপহার সামগ্রী- ফুলের নকশা করা রেশমের গাইট, মশলার বস্তা, সোনার তৈরি ভারী কণ্ঠহার আর বাজুবন্ধ যা বহু শতাব্দি ধরে ফারগানার শাহী পরিবারের স্মারক হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে- সবই তার আম্মিজান আর নানীজানের পছন্দ করা এবং তিন সপ্তাহ আগে ভারী প্রহরায় জামমীন পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। সে তার সম্ভাব্য হবু শ্বশুরের জন্য সোনার মোহর, নিখুঁত শৃঙ্গযুক্ত পাঠা, খুরের পেছনের আর সামনের অংশে সাদা কেশগুচ্ছ রয়েছে এমন কালো স্ট্যালিয়নের একটা নিখুঁত জোড়া পাঠিয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই এই একটা উপহার পাঠাতে তার খুব কষ্ট হয়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সে তার সাধ্য অনুযায়ী বরপণ দিয়েছে। সেটা অবশ্য ইবরাহিম সারুর মতো সর্দারের মর্যাদা অনুরূপ হয়নি। বাবর আবার চিন্তা করে সর্দার এই বিয়েতে কেনো মতো দিলো? তিনি নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেন যে বাবরের সালতানাত্তীন অবস্থা বেশি দিন বজায় থাকবে না। নিঃসন্দেহে তিনি তার মেয়েকে সুলতানা হিসাবে দেখলে এবং বাবরের উত্তরাধিকারীর নানা হতে পারলে খুশিই হবেন। আর সেজন্য কে তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করবে? উচ্চাকাঙ্ক্ষা বড় সুন্দর। “বা আমি এটাও দিতে পারি?” নিজের অলঙ্কারের দঙ্গলে ভাইয়ের হবু বউয়ের জন্য পছন্দসই উপহার খুঁজতে ব্যস্ত খানজাদার কালো চুল সুযোগ পেয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে।

বাবর সহসা নিজেকে নিয়ে লজ্জিত হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে খানজাদা আনন্দ করার অবকাশ পায়নি বললেই চলে। তার জন্য বোনের এতো আনন্দ- এবং এতোটা উদার আর ভোলা-মনের পরিচয় দেয়াতে তার খুশিই হওয়া উচিত। আয়েশার চেয়ে সে অবশ্য বয়সে বড়ই হবে। তাদের এবার উচিত হবে বোনের জন্য উপযুক্ত স্বামী খোঁজা। সে আবার যখন ফারগানার সুলতান হবে, তখন সে বোনের জন্য ভালো একটা ছেলে খুঁজে বের করবে বলে নিজের কাছে নিজে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। এবং নিজের বিয়ের সময়ে যেমন তার সাথে আলোচনা করা হয়েছে এর চেয়ে বেশিই সে বোনের সাথে বিয়ের ব্যাপারে আলোচনা করবে।

দু’সপ্তাহ পরের ঘটনা। বাবর দাঁড়িয়ে থেকে খুতলাঘ নিগার, এসান দৌলত আর খানজাদাকে শীতের কামড় বসানো বাতাসের হাত থেকে বাঁচতে ভারী উলের পরত দেয়া আলখাল্লায় আবৃত অবস্থায় বড় চাকাঅলা, ছই দেয়া গরুর গাড়িতে উঠতে দেখে। পুরো গাড়িটা ভেড়ার চামড়ার মোটা পরত দিয়ে মোড়া আর ভেতরে পুরু গালিচা পাতা রয়েছে, আর লোকের দৃষ্টি থেকে আরোহীদের আড়াল করতে লাল রঙের পর্দার ঝালর ঝুলছে গাড়িটায়। গাড়িটার সাথে যে সাদা রঙের চারটা ষাড় জোতা হয়েছে বিয়ের উপলক্ষ্যের তাদের সবগুলোর শিং সোনালী রঙ করা হয়েছে আর তাদের চওড়া, পেষল কাঁধের উপরের জোয়ালগুলো নীল আর সোনালী রঙের। বাবর তার প্রিয় কালো কেশরযুক্ত বাদামী রঙের ঘোড়ার পিঠে উঠে বসতে, ঘোড়াটাও উত্তেজনা আঁচ করতে পেরে প্রাণোচ্ছল, বল্পিত ভঙ্গিতে দু’পা শূন্যে তুলে লাফালাফি আরম্ভ করে। আবার জিনে উপবিষ্ট হতে পেরে সে বর্তে যায় এবং ঘোড়াটার মালিশ করা চকচকে ঘাড়ে পরম মমতায় একটা চাপড় বসিয়ে দেয়। সে একটা শক্তিশালী রক্ষীবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে বাইসানগারকে শাহরুখিয়ায় রেখে ওয়াজির খান আর পাঁচশ সুসজ্জিত যোদ্ধার একটা বাহিনী নিজের সাথে রাখে। বিয়ের খবর ছড়িয়ে গেছে এবং অনেকেই- যাদের মধ্যে কিছু বিরূপভাবাপন্ন জামমীনের উদ্দেশ্যে তাদের দক্ষিণমুখী যাত্রা আগ্রহের সাথে পর্যবেক্ষণ করবে। কিন্তু এমন একটা সুসজ্জিত বাহিনী সাথে গুপ্তদূত আর অশ্বারোহী প্রহরী দল থাকায় বাবর এবার গুপ্তহামলার কোনো আশঙ্কা করে না।

দূর্গের তোরণদ্বারের কাছে রক্ষীদের জন্য নির্মিত ভবনের কাছে দাঁড়িয়ে ওয়াজির খান শেষবারের মতো বাইসানগারের সাথে শেষ মুহূর্তের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সেরে নেয়। কথা শেষ করে সে অসমান খাড়া সিঁড়ি বেয়ে নিচের আঙ্গিনার উদ্দেশ্যে নামতে শুরু করে। সেখানে এক সহিস তার ঘোড়া অবদমিত শক্তির কারণে দাপাদাপি আর নাক ঝাড়তে শুরু করতে তাকে সামলে রাখতে হিমসিম খেয়ে যায়। বাবর ভাবে, বছরখানেক আগের তুলনায় এখন ওয়াজির খানের হাঁটতে কতো কষ্ট হচ্ছে। খুঁড়িয়ে হাঁটার এই উপসর্গটা তার সাথে কবর অব্দি যাবে।

অবশেষে, হেলেদুলে এগিয়ে চলা ষাড়ের গাড়ির সামনে থেকে বাবর আর ওয়াজির খান ধীরে ধীরে দূর্গের ঢালু পথ বেয়ে বের হয়ে এসে এবং তৃণভূমির মাঝ দিয়ে সামনের দিকে এগোতে থাকে যেখানে অস্থায়ী শিবির স্থাপনের জন্য খচ্চরে টানা গাড়িতে প্রয়োজনীয় তাঁবু, রসদ আর অন্যান্য সরঞ্জামাদি নিয়ে অগ্রবর্তী দল ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে। আর অবশ্যই এসব সামগ্রীর সাথে আরো আছে বিয়েতে পরিহিত পোশাক-পরিচ্ছদ, তার হবু স্ত্রীর পরিবারের লোকদের জন্য আরও উপহার উপঢৌকন, যার ভিতরে রয়েছে তার শ্বশুরের জন্য একটা হলুদ চোখের বাজপাখি।

পুরো বহরটা ধীরে ধীরে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। কিছুক্ষণ আগে শাহরুখিয়ার দূর্গের প্রাকারবিশিষ্ট ছাদ থেকে বিদায় জানিয়ে বাজানো ড্রামের আওয়াজের বদলে এবার দখল করে বনের মর্মর ধ্বনি, চাকার ক্যাচকোচ, জোয়ালের সাথে বাঁধা ঘণ্টা ধ্বনি, মালবাহী খচ্চরের ঘোতঘোত শব্দ এবং নরম মাটির উপর দিয়ে দুলকিচালে ছুটে চলা অশ্বারোহী বাহিনীর খুরের বোল।

প্রতিদিন ওয়াজির খানের নিয়োজিত রক্ষীবাহিনী কাফেলার চারপাশে সর্তক পাহারায় থাকে। কিন্তু শান্ত উপত্যকা আর তৃণভূমিতে আসন্ন প্রসবিনী গর্ভবতী ভেড়ী আর তার পাল ছাড়া কোনো নড়াচড়াই চোখে পড়ে না। মাঝে মাঝে ধীর গতির কারণে আর ভবিষ্যতের গর্ভে কি অপেক্ষা করছে সে জন্য অস্থির হয়ে বাবর দেহরক্ষীর একটা ছোট দল নিয়ে ঘোড়া ছোটায়।

মুখে এসে ধাক্কা দেয়া বাতাস সে দারুণ উপভোগ করে। তার বাবার ইন্তেকালের পরে সে এমন স্বাধীনতা উপভোগ করেনি। এই মুহূর্তে, সমরকন্দ হাতছাড়া হওয়া বা ফারগানার বিশ্বাসঘাতকতা কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারে না। তার কাঁধে চেপে বসা দায়িত্বের বোঝা- অন্যদের প্রতি তার নৈতিক কর্তব্য, অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব আর লক্ষ্য অর্জনের চাপ- যা তাকে প্রায়শই নির্মমভাবে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে মনে হয় যেনো গড়িয়ে নেমে যায়। অনেকটা বসন্তের আগমনের মতো একটা অনুভূতি, যখন তীব্র শীতের কারণে মাসের পর মাস ভেড়ার কয়েক স্তর পুরু চামড়ার নিচে কাটাবার পরে সে অবশেষে সবকিছু ঝেড়ে ফেলে পিঠের উপরে সূর্যের উষ্ণতা অনুভব করতে পারে। তাকে বহন করা ঘোড়ার গলার কাছে ঝুঁকে এসে বাবর তার মন থেকে সব ভাবনা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। সে যা নিয়ে এই মুহূর্তে চিন্তা করতে চায় না সেসব কিছুর উপরে বিস্মৃতির চাদর বিছিয়ে দেয়।

যাত্রা শুরু করার পরে ষষ্ঠ দিন দুপুরে, ষাঁড়ের গাড়ির পাশে প্রশান্ত মনে বাবর যখন ঘোড়ার পিঠে উপবিষ্ট হয়ে এগিয়ে চলেছে এবং যে সময়ে তারা একটা পাহাড়ের ঢালের পাদদেশের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। দূরে দিগন্তের নিচে কালো-আলখাল্লা পরিহিত একদল ঘোড়সওয়ারের একটা সারি দেখা যায়। ওয়াজির খান সাথে সাথে চামড়ার দাস্তানাযুক্ত হাত উঁচু করে থামবার সংকেত দেয়।

“ওয়াজির খান, কি মনে হয় আপনার? ওরা কারা? মালিক ঘোড়সওয়ার?” বাবর চোখ কুঁচকে তাকিয়ে জানতে চায়। কিন্তু বৈশিষ্ট্যসূচক কিছু- কোনো নিশান, বা কোনো পতাকা- তার চোখে কিছুই আটকায় না। ঘোড়সওয়ারের দলটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে কেবল তাকিয়ে থাকে।

“সুলতান, তারাই সম্ভবত। আমরা নিশ্চয়ই তাদের সীমান্তের কাছে পৌঁছে গেছি। কিন্তু আমাদের অগ্রবর্তী রক্ষীবাহিনী এসে কিছু না জানানো পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।”

“ঠিক আছে। তারপরেও, নিশ্চিত হতে আরও গুপ্তদূতের দল পাঠাও আর একটা রক্ষণাত্মক বিন্যাসে কাফেলাকে বিন্যস্ত কর।”

ওয়াজির খানের বাছাই করা বারোজন যোদ্ধার একটা দলকে কোমরে তরবারি ঝুলিয়ে, পর্যাণে রণকুঠার এমনভাবে রাখা যেনো হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় এবং এতোক্ষণ পিঠে বাঁধা বৃত্তাকার ঢাল বাম হাতে চামড়ার ফালি দিয়ে দৃঢ়ভাবে আটকে নিয়ে, বাবর দ্রুতবেগে শিবির ত্যাগ করতে দেখে। দলের শেষ দু’জন যোদ্ধা বর্শা বহন করছে। সবকিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকা ভালো। কি হচ্ছে সেটা নিয়ে মেয়েরা হয়তো উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে বুঝতে পেরে, বাবর ঘোড়া নিয়ে দুলকিচালে ষাঁড়ের গাড়ির কাছে এগিয়ে যায় এবং ঘোড়ার পিঠ থেকে ঝুঁকে পড়ে চামড়ার পর্দার ভেতরে মাথা প্রবেশ করায়। “সামনে সম্ভবত ইবরাহিম সারুর অশ্বারোহীরা রয়েছে কিন্তু তাদের পরিচয় সম্পর্কে আমাদের নিশ্চিত হতে হবে। আমরা আমাদের গুপ্তদূতদের ফিরে আসবার জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু সেই অবসরে আমরা নিজেদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করছি।” তার আম্মিজান আর খানজাদা ঘুমে চুল ঢুল করলেও, এসান দৌলতের উজ্জ্বল চোখজোড়া সতর্ক, সে মাথা নাড়ে। “ঠিক আছে। কোনো সুযোগ দেবার প্রয়োজন নেই।”

কয়েক মিনিট পরে, ওয়াজির খান তার তীরন্দাজদের আশেপাশের গাছপালা আর পাথরের আড়ালে আত্মগোপন করে থাকতে আদেশ দেয়। ষাড়ের গাড়ির চারপাশে মালবাহী গাড়িগুলোকে বৃত্তাকারে বিন্যস্ত করে অবশিষ্ট সৈন্যদের দিয়ে একটা রক্ষণাত্মক ব্যুহ রচনা করে। কিন্তু সব আয়োজন শেষে অপেক্ষার পালা যেনো আর শেষ হতে চায় না। বাবর কান খাড়া করে রাখে। বাতাসে ভেসে আসা কোনো অবাঞ্ছিত শব্দ শুনতে চেষ্টা করে। কোথাও কিছু নড়াচড়া শব্দ শোনা যায় না। তারপরে তাদের মাথার উপরে পাহাড়ের ধারে ছাগলের একটা পালের গলায় বাঁধা ঘণ্টার বেসুরো সুর শোনা যায়। পালটা খেদিয়ে আনা রাখাল ছেলেটা নিচের দৃশ্যপটের দিকে আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে দেখে এবং হাতের লাঠিটা পাগলের মতো আন্দোলিত করে ছাগলের পালকে পুনরায় চোখের আড়ালে নিয়ে যায়।

বাবরের লোকেরা অবশেষে দুলকিচালে ফিরে আসে। তাদের পেছন পেছন কালো আলখাল্লা পরিহিত ঘোড়সওয়ারের দল হাজির হয়। বাতাসের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাদের মুখে পটি বাধা। সব কিছুই নিশ্চয়ই ঠিক আছে। ঘোড়সওয়ারের দল কাছে আসতে, বাবর তাদের একজনের বহন করা নিশানে লাল বাজপাখি দেখতে পায় যেটা মোঙ্গলিঘ গোত্রের প্রতীক। সে নিজের ঘোড়া কয়েক কদম সামনে নিয়ে যায়। তারপরে বাদামী দানবটার লাগাম টেনে ধরে আগন্তুকদের পৌঁছাবার জন্য অপেক্ষা করে।

“ফারগানার বাবর মির্জাকে স্বাগত জানাই।” দলটার নেতৃত্ব দেয়া অশ্বারোহী জিনে বসে থাকা অবস্থায় ঝুঁকে পড়ে তাকে অভিবাদন জানায়। শক্তিশালী দর্শন লোকটা মুখের কালো পটি খুলতে, বাবর তার কালো দাড়ি, চোয়ালের চওড়া হাড় এবং তার উপরে বিশাল কালো অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন একজোড়া চোখ, অদ্ভুতভাবে তার মণিতে হলুদের ছোপ রয়েছে। লোকটার বয়স আনুমানিক চল্লিশ বছর। “আমি ইবরাহিম সারু, মোঙ্গলিঘদের সর্দার। আমি আপনাকে আর আপনার পরিবারকে স্বাগত জানাই। আজ আপনারা আমার অতিথি আর আগামীকাল বাবর আপনি আমার পুত্রে পরিণত হবেন।” ইবরাহিম সারু যদিও বাবরের মাতৃভাষা তূর্কীতে কথা বলছে, কিন্তু তার বাচনভঙ্গির কারণে শব্দগুলোকে কেমন অপরিচিত মনে হয়। মোঙ্গলিঘদের আদিবাসস্থান ছিলো পারস্যে- ফার্সী আজও সম্ভবত তাদের মাতৃভাষা।

বাবর এবার ঝুঁকে ফিরতি অভিবাদন জানায়। “আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি আমাদের সম্মানিত করেছেন।”

“আমাদের অস্থায়ী ছাউনি এখান থেকে দু’ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত। আমরা আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম আর পাহারা দিচ্ছিলাম। আমি নিজে এসেছি কারণ, আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে প্রথমে স্বাগত জানাতে চেয়েছি।”

বাবর আবার ঝুঁকে অভিবাদন জানায় এবং পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ধীরে ধীরে ইবরাহিম সারুকে অনুসরণ করতে তার ঘোড়ার পেটে খোঁচা দেয়।

***

বৃত্তাকার যে তাঁবুটা বাবরকে রাত কাটাবার জন্য দেয়া হয়, সে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খুঁটিয়ে দেখে স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে যথেষ্ট সুন্দরভাবেই তাঁবুটা সাজানো হয়েছে। শুকনো চামড়া দিয়ে সেলাই করা দশ ফুট উঁচু দেয়ালের পুরোটা লাল আর নীল বুননের পর্দা দিয়ে ঢাকা। কুণ্ডলীকৃত সাপের মতো দেখতে পিতলের মোমদানিতে মোমবাতি জ্বলছে। মোমদানিগুলো আবার স্বর্ণালী আভাযুক্ত আস্ত নীলকান্তমণির ভিত্তির উপরে স্থাপিত। গাঢ় নীল রঙের যে তাকিয়ায় সে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে সেটার উপরে সোনার জরির পুরু কারুকার্য তার ঘাড়ের পেছনে সুড়সুড়ি দেয় এবং গদিটাকে মনে হয় মোটা কাপড়ের একটা ঢাউস ব্যাগ যার উপরে পুরু পিচ্ছিল কিংখাব দেয়া। তাঁবু ভেতরের পুরো মেঝে চামড়ার পুরু আস্তরণ দিয়ে ঢাকা।

সমরকন্দের সাথে এর কোনো তুলনাই চলে না কিন্তু ইবরাহিম সারু অতিথিদের জন্য এমন জাঁকজমকপূর্ণ শিবির স্থাপন করতে তার সাধ্যের অতীত চেষ্টা করেছে। আগের দিন রাতে তারা যখন এখানে এসে পৌঁছায়, দেখে সারি সারি তাঁবু বাবরের লোকদের জন্য যে তাঁবুগুলো সেগুলোর উপরে ফারগানার হলুদ নিশান উড়ছে এবং তার কেন্দ্রে রয়েছে বাবরের নিজস্ব বিশাল আনুষ্ঠানিক তবু একটা। দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য। কোনো সন্দেহ নেই ইবরাহিম সারুও ঠিক তাই চেয়েছে।

কারুকাজ করা ধাতব বকলেশ দিয়ে আটকানো প্রবেশ দ্বারের পর্দার ফাঁক দিয়ে গুটিগুটি পায়ে প্রবেশ করা আলোর তীব্রতা দেখে বাবর ধারণা করে অনেক আগেই সকাল হয়েছে। সে গত রাতে ইবরাহিম সারুর কারুকাজ করা চাদোয়া আর প্রবেশ পথ পর্যন্ত গালিচা বিছানো তাঁবুর দরবার মহলে আয়োজিত পোলাও, ভেড়ার মাংসের কাবাব, মাটির নিচে জন্মানো সজি আর কড়া পানীয় সহযোগে আয়োজিত নৈশভোজের কথা চিন্তা করে। বাবরের ইচ্ছা ছিলো সন্ধ্যেটা এসান দৌলত, খুতলাঘ। নিগার আর তার বোনের সাথে মেয়েদের তাবুতে কাটায়। কিন্তু সেটা অবশ্য সম্ভব না। পুরোটা সন্ধ্যাটা তাকে হাসি হাসি মুখে বসে বাজিকরের ভেল্কি, আগুন-খেকোর দক্ষতা, নিপূণ দড়াবাজের কসরত, এবং নাদুসনুদুস দেখতে বাঈজিদের কোমরের দুলুনি দেখতে হয়েছে। যারা নিজেদের ভরাট বুক আর নিতম্ব আঁকাবার ফাঁকে সরাসরি তার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকেছে। এরপরে, সে হাসি হাসি মুখে বসে তার নিজের আর ইবরাহিম সারুর লোকদের একসাথে নাচগান করার ফাঁকে, শীঘ্রই তারা একে অপরের সহযোদ্ধায় পরিণত হবে বলে পরস্পরের স্বাস্থ্য পান করতে দেখেছে। যতক্ষণ না তারা সুরার নেশায় বিভ্রান্ত হয়ে মেঝেতেই শুয়ে ঘুমিয়ে না পড়েছে।

বাবর যে অনায়াসে যে কোনো লোকের মত পান করতে পারে। গত রাতে অল্পই পান করেছে, আশা করেছে যে ইবরাহিম সারু হয়তো তাদের আসন্ন মৈত্রীর বন্ধন সম্পর্কে তার সাথে কথা বলতে চাইবেন। অনেক কিছু আলাপ করার বাকী আছে। সে নিশ্চিত, তার হবু শ্বশুরের সাহায্যে আকশি আক্রমণ করে কয়েক সপ্তাহ না হোক অন্তত কয়েক মাসের ভিতরে সে তার সিংহাসন উদ্ধার করতে পারবে। তারপরে সমরকন্দ থেকে তার চাচাতো ভাই মাহমুদকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করাটা কেবল সময়ের ব্যাপার। কিন্তু ইবরাহিম সারু এসবের আশপাশ দিয়ে যায় না, কেবল সামাজিকতা রক্ষার্থে মামুলি কথাবার্তা বলে এবং বাবরও অনুভব করে এমন আনন্দের সময়ে যুদ্ধের আলোচনা করাটা অভদ্রতা হবে, সে তখন নিজেকে সংযত করে।

গায়ের উপর থেকে বাবর নরম চামড়ার কম্বল, যার নিচে সে আরামে রাত কাটিয়েছে, সরিয়ে উঠে বসে। ভবিষ্যতের গর্ভে কি অপেক্ষা করছে ভেবে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিজের পরিস্থিতি আর নিজের উপরে সে যুগপৎ অস্থির হয়ে উঠছে। এই মুহূর্তে এক অচেনা তরুণীকে বিয়ে করার বদলে সে তার লোকদের নিয়ে যুদ্ধে যাবার জন্য যে কোনো কিছু করতে রাজি আছে। কিন্তু সে একজন সুলতান, বীর আর যোদ্ধা এবং এখন সে প্রাপ্তবয়স্ক একজন পুরুষ। পাহাড়ে কাটানো সেইসব নিঃসঙ্গ সময়ে সে কত রাত শক্ত মাটির উপরে শুয়ে মাথার উপরের শীতল রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে কোমল, উষ্ণ নারীদেহের কথা কল্পনা করেছে?

সে কেন তাকে সঙ্গ দিতে কাউকে ডেকে পাঠায়নি? তার অবশ্য নির্দিষ্ট কোনো পছন্দ ছিলো না। সম্ভবত সেটা ছিলো পিতৃহীন একমাত্র ছেলের বিনয়াভিমান। এমনও হতে পারে সেই পরিস্থিতিতে কোনো সন্তানের জনক হবার ব্যাপারে সে। অনিচ্ছুক ছিল? সম্ভবত নিজের মর্যাদা রক্ষার ব্যাপারে অতিরিক্ত সচেতন সে চায়নি বারবণিতাদের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে বা সেরকম মেয়ে তার কাছে আসুক সে ব্যাপারেও তার আপত্তি ছিলো। তার আগে অনেক শাহজাদাই তাদের সাথে মানানসই না এমন নারীর কল্যাণে সালতানাৎ হারিয়েছে। কিন্তু আজ রাতে একজন নারীকে আলিঙ্গন করতে তার মালিক হিসাবে নিজেকে কল্পনা করার অনুভূতি কেমন সে অনুভব করবে। তার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

তার শ্বশুরের সৌজন্যতাবশত জোর করে পাঠানো চারজন পরিচারককে সে হাততালি দিয়ে ডাকে। আজ তার বিয়ে এবং তার অবশ্যই উচিত নীতিনিয়মের শুদ্ধতা উদযাপন করা। তাঁবুর বাইরে থেকে তাদের ভেসে আসা আলাপচারিতার আওয়াজ সে শুনতে পায় এবং তার ইশারা শুনে তারা ভিতরে প্রবেশ করে তাঁবুর পর্দা উঠিয়ে দিলে সূর্যের আলোয় ভেতরটা আলোকিত হয়ে উঠে।

বাবরের বিয়ের পোশাক- হরিণের নরম চামড়ার তৈরি শালোয়ার, হলুদ রেশমের তৈরি খাটো আস্তিনযুক্ত আজানুলম্বিত আঁটসাট বহির্বাস, সাথে তার মরহুম আব্বাজান নিজের বিয়েতে যে সোনার ভারী কোমরবন্ধনী ব্যবহার করেছিলেন সেটা এবং উপরে পরার জন্য তামার কারুকার্যখচিত আলখাল্লা- আগের রাতে সবই গাঁটরি খুলে বের করে গম্বুজাকৃতি একটা সিন্দুকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। একটা উঁচু নীল মখমলের টুপি, খানজাদা যেটাতে ছোট ছোট মুক্তা যত্ন নিয়ে বসিয়েছে এবং সাথে ঈগলের পালকের তৈরি শিরস্ত্রাণ কাছেই একটা টুলের উপরে রাখা।

দু’ঘণ্টা পরে হাম্মামখানার তাঁবুতে গরম পাথরের উপরে ফোঁটানো পানিতে গোসল করার পরে তার পরিচারকের দল টাটকা তাজা ঔষধি লতাগুল্ম দিয়ে তার দেহ ভালো করে রগড়ে মুছে দেয়। তার লম্বা চুল সুগন্ধি তেল দিয়ে আচড়িয়ে দেয় এবং তাকে তার নির্বাচিত পোশাকে সজ্জিত করলে, বাবর পুরো দিনের মতো প্রস্তুত হয়। সূর্যের আলোয় পা রাখতে তার উষ্ণীষের ঈগলের পালকের লম্বা ছায়া প্রতি পদক্ষেপের সাথে সাথে মাটির অনেক দূর পর্যন্ত নাচতে নাচতে এগিয়ে যায়।

সহসা শিবিরের অন্যপ্রান্ত থেকে কর্ণবিদারী একটা চিৎকার ভেসে উঠে। “সুলতান, জেনানামহলের দিক থেকে আসছে।” বাবরের অভিব্যক্তিতে বিভ্রান্তির ছায়া দেখতে পেয়ে তার একজন পরিচারক বলে। “বধূকে তারা বিদায় জানাচ্ছে ঠিক যেভাবে আর কয়েক ঘণ্টা পরে সে নিজের কুমারীত্বকে বিদায় জানাবে।” মেয়ের কণ্ঠের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়ে এখন প্রায় আর্তনাদের মত শোনায়। আওয়াজটা মোটেই শ্রুতিমধুর না- ফারগানার গ্রামে বিয়ের সময় যেমন হর্ষোৎফুল্ল গানের আওয়াজ শোনা যায় তার সাথে এর কোনো মিলই নেই। বিলাপের সাথেই বরং এর মিল বেশি।

বাবরের তাঁবুর পাশে তৈরি করা আরেকটা তাঁবুর নিচু প্রবেশপথ দিয়ে সুন্দর পোশাকে সজ্জিত ওয়াজির খানকে ঝুঁকে বের হয়ে আসতে দেখে বাবরের মনটা খুশিতে ভরে উঠে। “সুলতান, আপনার বিবাহ দিবসে আমার অভিবাদন গ্রহণ করুন।” ওয়াজির খানের এক চোখের দৃষ্টিতে উষ্ণতার ছোঁয়া এবং সে আজ তার পাশে থাকবে ভেবে বাবর কৃতজ্ঞবোধ করে। “সুলতান, আপনি কি প্রাতঃরাশ করেছেন?”

“আমি মোটেই ক্ষুধার্ত নই। কিছুক্ষণ আগেই আমি পানি পান করেছি।”

ওয়াজির খানের অভিব্যক্তিতে বাবর সহমর্মিতা দেখতে পায়।

“আমাদের রক্ষীদল শীঘ্রই এখানে এসে উপস্থিত হবে আপনার সাথে সহচর হিসাবে বিবাহ মণ্ডপে যাবে বলে।”

“ওয়াজির খান…” বাবর বুঝতে পারে না সে কি বলতে চায় এবং সে কিছু ভাববার আগেই আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে ঢাক ঢোল বেজে উঠতে রমণীদের আতঙ্কজনক বিলাপের শব্দ চাপা পড়ে যায় এবং সে দেখে ওয়াজির খানের লোকেরা ফারগানার উজ্জ্বল হলুদ রঙের পোশাকে সজ্জিত হয়ে দু’সারিতে এগিয়ে আসছে এবং তাদের সামনে রয়েছে তার নিজস্ব যন্ত্রীদল। একটা সহিস বাবরের বাদামী বর্ণের আজদাহাটার লাগাম ধরে টেনে আনে। আজকের বিশেষ উপলক্ষের জন্য একটা উজ্জ্বল হলুদ রঙের পর্যানের কাপড় তার বস্ত্রাবরণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। লেজ আর কেশর হলুদ ফিতা দিয়ে বেণী করা আর মাথায় সোনালী-বাদামী বর্ণের বাঘের চোখ পাথরের তৈরি সাজ।

বাবর জিনে উঠে বসে এবং তার লোকদের ঘোড়ার লাগাম ধরে গত রাতে যেখানে ভোজসভা হয়েছিলো সেই একই তাঁবুর সভাগৃহের দিকে নিয়ে যাবার অনুমতি দেয়। এখন সেখানে ইবরাহিম সারু তার মেয়েকে নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছেন। বাবর জিনের উপর থেকে নামতে, কালো পোশাকে সজ্জিত মাঙ্গলিঘ রক্ষীবাহিনী তাকে অভিবাদন জানায়। তূর্যনাদের মাঝে ধীরে ধীরে সে গাঢ় বেগুনী মখমলের আলখাল্লা পরিহিত ইবরাহিম সারুর দিকে এগিয়ে যায়, যেখানে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে।

তিন ফুট উঁচু জাফরিকাটা কাঠের পর্দা দিয়ে আলাদা করা একপাশে ইবরাহিম সারুর দরবারের রমণীরা রয়েছে। তাদের মুখের নিচের অংশ নেকাবের আড়ালে। কিন্তু হাল্কা আবরণীর উপরে তাদের ঘন আর লম্বা পাপড়ির নিচের কালো চোখ তাকে পরিষ্কার কৌতূহলে জরিপ করছে। তাদের কেন্দ্রে, সম্মানিত স্থানে, সে তার। নানীজান, আম্মিজান আর বোনকে দেখতে পায়। মাথা আর ঘাড় ভালো করে সোনার তারাখচিত একটা নীল রঙের শাল দিয়ে আবৃত করে পিঠ সোজা করে বসে আছেন এসান দৌলত। খুতলাঘ নিগারের পরণে একটা ঢিলেঢালা হলুদ জোব্বা এবং কয়েক গাছি মুক্তার মালা গলার শোভা বাড়িয়েছে। গর্বিত চোখে বাবরের দিকে তাকিয়ে আছেন। যখন খানজাদার চোখ- মাঙ্গলিঘ রমণীদের চেয়ে অনেক বেশি কমনীয়- চকচক করে।

বিশাল তাঁবুটার ঠিক কেন্দ্রে, মেরুন রঙের গালিচা পাতা মঞ্চের উপরে তার স্ত্রী সোনালী তাকিয়ায় বসে আছে। ধূপ দিয়ে সুবাসিত করা কয়লা ভর্তি ঝুড়ি তার সামনে জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে সোনালী কাপড়ের তৈরি মস্তকাবরণের নিচে থেকে বের হয়ে আসা দুধসাদা রঙের ভারী কাপড়ের নেকাবই তাকে আড়াল করে রাখেনি, মাথার উপরের ছাদে অবস্থিত গবাক্ষের খুলে রাখা পর্দার দিকে বাতাসের সাথে পাঁক খেয়ে উঠে যাওয়া ধোঁয়ার কুণ্ডলীও তাকে ঢেকে রেখেছে। বাবর তার দিকে হেঁটে যেতে, আয়েশা স্থাণুর ন্যায় বসে থাকে। বাবর যে শীঘ্রই তার শৌহর হবে সে বিষয়ে কোনো ধরণের সচেতনতা তার মাঝে প্রকাশিত হয় না। আয়েশার অভিব্যক্তি দেখতে তার ইচ্ছা করে।

ভেরীর আওয়াজ স্লান হয়ে আসে এবং মুহূর্তের জন্য চারপাশে নিথর নিরবতা নেমে আসে।

“আয়েশা!” তার বাবার ডাক শুনে, মেয়েটা উঠে দাঁড়ায়। তাকে লম্বাই দেখায় কিন্তু স্থূলকায়া নাকি ক্ষীণাঙ্গী, দেহসৌষ্ঠব সাবলীল নাকি অন্যরকম, বাবর কিছুই বুঝতে পারে না। সে কেবল মেয়েটার লম্বা পায়ে মেহেদীর ভরাট বরফিকাটা নকশা লক্ষ্য করে।

“এদিকে এসো।” ইবরাহিম সারু বাবরকে মঞ্চে উঠে তার হবু বধূর মুখোমুখি হতে ইশারা করে। এরপরে, তিনি নিজের মেয়েকে বোরখার ভেতর থেকে ডান হাত বের করে তার দিকে এগিয়ে দিতে বলে। হাতটা ধরে। তিনি সেটা বাবরের ডান হাতের উপরে স্থাপন করেন। আয়েশার হাত শুষ্ক আর শীতল।

কালো আলখাল্লা পরিহিত, শ্মশ্রুমণ্ডিত লম্বা এক মোল্লা এবার এগিয়ে আসে এবং মন্দ্র, অনুনাদক কণ্ঠে কিছু আবৃত্তি করে। কিছু সুরেলা কণ্ঠে সুর করে বলে, যা সম্ভবত দোয়া বা আশীর্বাদ হবে বলে বাবর মনে করে। সে যদিও পুরোটা মনোযোগ দিয়ে শুনে, কিন্তু সে বুঝতে পারে না কোনো ভাষায় লোকটা কথা বলছে। খুব সম্ভবত ফার্সী হবে। অবশেষে মোল্লার দোয়া শেষ হয় এবং বুকের কাছে কোরান শরীফ ধরে সে পিছিয়ে আসতে, ইবরাহিম সারু এক মুঠো শস্য তরুণ দম্পতির উপরে ছিটিয়ে দেন। পুরুষকণ্ঠের সম্মিলিত ঐক্যতানে পুরো তাবুটা গমগম করে উঠে এবং সহসা মুঠি ভর্তি আঁশযুক্ত শস্যদানা বাতাসে ভাসতে থাকে। মাঙ্গলিঘ মেয়েরা বাতাসে ডানামেলা পাখির ঝাঁকের মতো উঁচু আর কর্ণবিদারী উলুধ্বনি দিতে শুরু করে।

আয়েশা বাবরের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। বাবর হাসে এবং আয়েশার কাছ থেকে কোনো ধরণের ইঙ্গিতের আশা করে। কিন্তু এক মুহূর্ত নিরবে দাঁড়িয়ে থেকে সে হাতটা টেনে সরিয়ে নেয় এবং মঞ্চ থেকে নেমে যায়। মাঙ্গলিঘ মেয়েরা সাথে সাথে কাঠের আবডালের আড়াল থেকে উঠে দাঁড়ায় এবং সবাই এগিয়ে এসে আয়েশার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাবর তাজ্জব হয়ে দেখে, আনন্দে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠে, তার কাছ থেকে তারা দুধসাদা রঙের নেকাব টেনে নিয়ে, ঘূর্ণির বৃত্তাকারে ঘোরাতে শুরু করে এবং তার পরণের পোশাকের পলকা আবরণ টেনে ছিঁড়ে।

সর্দার আর তার পরিবার এসব কি শুরু করেছে? বাবর তাকিয়ে দেখে তাঁবুতে প্রবেশের মুখের কাছে ওয়াজির খান দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাবর জানে তার নিজের অভিব্যক্তির মতোই তারও অবশ্যই কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। আবডালের আড়ালে এখনও নম্র ভঙ্গিতে বসে থাকা খানজাদার চোয়াল ঝুলে পড়ে আমোদর আভাস পেয়ে। এসান দৌলত আর খুতলাখ নিগার সোজা আড়ষ্ঠ ভঙ্গিতে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে। যেনো এসব অদ্ভুত ব্যাপারে আগ্রহী হবার শিক্ষা তাদের দেয়া হয়নি।

আয়েশা তখনও অর্ধেক আবৃত। এমন সময় যন্ত্রীদল তাদের পিতলের লম্বা বাঁশি, করতাল, ঘণ্টা আর শক্ত করে বাঁধা চামড়ার ঢোল একসাথে বাজাতে শুরু করে দেয়। আয়েশার কাছ থেকে মেয়েরা পেছনে সরে আসে এবং হাত দিয়ে তালি দিয়ে পা ঠুকে তালে তালে তারা গান গাইতে শুরু করে। বাবর এবার টের পায় যে ঘরে উপস্থিত লোকেরা তাঁবুর দেয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়েছে এবং মেয়েরা নববধূর চারপাশে একটা মানব ব্যুহ তৈরি করেছে যে, সে আর আয়েশার বাবাই কেবল তাকে দেখতে পাবে। আয়েশা এবার সর্পিল ভঙ্গিতে নাচতে শুরু করে, মোচড়ায়, বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে যতক্ষণ না মুখের নিচের অংশ ঢেকে রাখা নেকাব ছাড়া, ঝালরের শেষ অংশটুকু দেহ থেকে খসে পড়ে।

বাবর এবার দেখে এক জোড়া কয়লার মতো কালো চোখ চঞ্চল দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। তার মাথার চুল পরিপাটি করে বেণী করা এবং ছোট মাথার চারপাশে। সেটা কুণ্ডলী করে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার লম্বা দেহ, পরনের গাঢ় বেগুনী রঙের শালোয়ার গোড়ালীর কাছে কুঁচকে জমে আছে। আর উধ্বাঙ্গের আঁটসাটো কাঁচুলির কারণে তার তলপেট উন্মুক্ত হয়ে আছে, লম্বা, জালি জালি অন্তর্বাস দিয়ে তার বেঁধে রাখা স্তনযুগলকে দেখে মনে হয় ছোট আর পেষল। একটা গাঢ় রঙের পাথর- খুব। সম্ভবত নীলা- তার নাভিতে দ্যুতি ছড়াচ্ছে।

“তাকে গ্রহণ করো। সে এখন তোমার।” ইবরাহিম সারু আয়েশার দিকে বাবরকে ঠেলে দেন। “বিয়ের শয্যা তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে- যাও। তাকে উপভোগ করো, ভোজসভা তারপরে আরম্ভ হবে…”

বাবরের হতবাক হওয়া অভিব্যক্তি দেখে তার শ্বশুর হেসে ফেলে। “ফারগানার শাহজাদাদের দুপায়ের মাঝে কি আগুন জ্বলে না?”

বাবরের মুখ লাল হয়ে উঠে এবং সে আয়েশার হাত ধরে। ইবরাহিম সারু একটা আলখাল্লা নিজের মেয়েকে পরিয়ে দিয়ে, দু’বার হাততালি দিতে যন্ত্রীদল উঠে দাঁড়ায়। দু’সারি অবস্থান নিয়ে তারা এখনও তাদের সেই উদ্দাম বাদ্য বাজাতে থাকে।

“তোমার বাসরশয্যা পর্যন্ত তারা বাজনা বাজিয়ে যাবে। আমি আমার অভিজাতদের সাথে তোমাকে অনুসরণ করবো।” ইবরাহিম সারুর মুখে একটা চওড়া হাসি ফুটে আছে।

যন্ত্রদলের বিড়ালের মতো চিৎকার করে বাজনার সাথে বিয়ের শোভাযাত্রা ইবরাহিম। সারুর দৃষ্টিনন্দন তাঁবু থেকে সূর্যালোকে বের হয়ে আসতে বাবরের মাথা দপদপ করতে শুরু করে। জেনানামহলের কাছেই বাসরশয্যার তাবু স্থাপন করা হয়েছে। ফারগানার হলুদ আর জামমীনের কালো লাল নিশানে সেটা জমকালোভাবে সাজানো। বাবর ভাবে, এটা মোটেই প্রীতিকর দৃশ্য নয়।

যন্ত্রীদল ছড়িয়ে গিয়ে, প্রবেশ পথের দু’পাশে অবস্থান নেয়। বাবর আয়েশাকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার সময়ে পরিচারকের দল ভূমিতে কপাল ঠেকিয়ে সেজদার ভঙ্গিতে অবস্থান করে। তাদের পরণে লাল আর কালো পোশাক। বিশাল তাঁবুটা পুরু গালিচা দিয়ে ঢাকা। কিন্তু বাবর যেমনটা আশা করেছিলো তার চেয়ে অনেক বেশি নিরাভরণ। তাঁবুর ঠিক কেন্দ্রে একটা ঢাউস গদি ধূসর ফুলের ছোপ দেয়া রেশমের কিংখাব দিয়ে ঢাকা। যা দুপাশে দুই বিশাল মোমবাতির ঝাড় আলোকিত করে রেখেছে। গদির উপরে একটা চতুর্ভূজাকৃতি কাঠের কাঠামো থেকে সারি সারি কাঠবিড়ালের চামড়া ঝুলছে। যা টেনে দিয়ে শয্যার চারপাশে একটা আবডাল তৈরি করা যায়। পুরো তাঁবুতে আর কিছু নেই। না কোনো আয়না, না কোনো সিন্দুক বা না কোনো বসার টুল।

বাবর পুরো পরিস্থিতির সাথে ধাতস্থ হবার আগেই কোলাহলরত মেয়েরা আয়েশাকে নিয়ে এসে গদির উপরে বসিয়ে চারপাশে পর্দা টেনে দেয়। যাতে তাকে দেখা না যায়। এক মুহূর্ত পরে পুরুষ পরিচারকবৃন্দ বাবরের পোশাক খুলতে শুরু করে। ব্যগ্র, কৌতূহলী আঙ্গুল মাথা থেকে পাগড়ি তুলে নিয়ে তার বর্হিবাস আর জোব্বার বাঁধন আলগা করে। শালোয়ার বন্ধনমুক্ত করে দু’পা থেকে পর্যায়ক্রমে বুট খুলতে শুরু করলে বাবর বহু কষ্টে তাদের ধমক দেয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখে। নিমেষের ভিতরে বাবর নিজেকে নগ্ন দেখতে পায়। পরিচারকের দল এবার একটা রেশমের আলখাল্লায় তাকে মুড়ে দিয়ে, কিছু একটা বলতে শুরু করে। তারা কি বলছে বাবর বুঝতে পারে না, কিন্তু আন্দাজ করে পর্দার পেছনে থাকা মেয়েদের উদ্দেশ্যে কিছু একটা বলেছে যারা দ্রুত চোখের দৃষ্টি অন্যদিকে করে তাবু থেকে বেরিয়ে যায়। পুরুষ পরিচারকের দল তাদের অনুসরণ করে যাবার আগে তাঁবুর প্রবেশপথের পর্দা শক্ত করে আটকে দিয়ে যায়।

সে আর আয়েশা এখন একা। এক মুহূর্তের জন্য সে ইতস্তত করে। তারপরে আলখাল্লাটা তার গা থেকে খসে পড়তে দেয়, সে বাসরশয্যার দিকে এগিয়ে যায় এবং পর্দা টেনে সরিয়ে দেয়। আয়শা নগ্ন দেহে ভেতরে শুয়ে আছে, তার মাথার চুল এখনও শক্ত করে বেণী করা রয়েছে কিন্তু তার দেহের কোমল বাঁক চড়াই উতরাই পুরোপুরি তার দৃষ্টির সামনে অবারিত হয়ে রয়েছে। তার পেলব বাহু, লম্বা সাবলীল উরুতে বাবর বিয়ের মণ্ডপে তার পায়ের পাতায় মেহেদীর যে বিস্তৃত আল্পনা দেখেছিলো সেই একই আল্পনা আঁকা। তার স্তনবৃন্ত টকটকে লাল রঙ করা এবং চারপাশে মেহেদীর বৃত্ত আঁকা। বাবরের নগ্নতার দিকে সে যেভাবে তাকিয়ে থাকে সে তার ভিতরে বিচলিত করার মতো এক ধরণের শীতলতা অনুভব করে। সে কি ভাবছে? তার ক্ষতচিহ্নগুলো অন্তত একটা বিষয় প্রমাণ করে যে সে কোনো বালক না বরং রক্তপাত ঘটিয়েছে এমন যোদ্ধা।

বাবর এবার ঝুঁকে তার পাশে বসে এবং তার পাশে এমনভাবে শোয় যাতে তাদের পরস্পরের দেহ পাশাপাশি থাকলেও স্পর্শ করে না। এক মুহূর্ত পরে কিছু বলে না। কারণ সে বুঝতে পারে না কি বলা উচিত-সে নিজের ভদ্র কিন্তু অনুসন্ধানী হাত আয়েশার কোমরের উষ্ণ তুকে স্থাপন করে এবং সে কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখাতে, সাহসী হয়ে উঠে সে তার হাত কটিদেশের নমনীয় বাঁকে প্রণয়স্পর্শে আলোড়িত করে। তারপরেও কোনো প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না দেখে সে উরুর মধ্যবর্তী ত্রিভূজাকৃতি অন্ধকারের দিকে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে এগিয়ে যায়।

বাবর সহসা টের পায় তার তরুণ রক্ত আর কোনো বাধা মানতে চাইছে না। সারা দিনের উত্তেজনা যেনো তার ভিতরে নিমেষে বিস্ফোরিত হয়ে মারাত্মক একটা শারীরিক আকাঙ্ক্ষায় পরিণত হয়, যা অবশ্যই নিবৃত্ত করতে হবে। সে এবার নিজেকে আয়েশার উপরে তুলে নিয়ে আসে এবং ব্যগ্র হাতে তার স্তনের কোমলতা আনাড়ি ভঙ্গিতে আঁকড়ে ধরতে চায়। সে তার মাঝে উপগত হতে চায় কিন্তু অপারগ হয়। তার নিচে শুয়ে থাকা শরীরটা আড়ষ্ঠ আর দলা হয়ে পড়ে থাকে। সে মাথা তুলে আয়েশার চোখের দিকে তাকায়। তার সাহায্য কামনা করে, কিন্তু সেখানে তার জন্য কোনো উষ্ণতা দেখতে পায় না। তার নিরব আবেদনে সাড়া দেবার বা সক্রিয় ভূমিকার চেয়ে খেলোয়াড়ী ভূমিকায় আবিভূর্ত হবার কোনো আগ্রহ নেই সেখানে কেবল, তার কাছে অন্তত তাই মনে হয়, তার অনভিজ্ঞ আনাড়ি আচরণের জন্য কূপিত অভিব্যক্তি।

কামনা তাড়িত হয়ে, সে আবার চেষ্টা করে এবং কঠোরভাবে এগিয়ে যেতে চায়, অবশেষে সাফল্যের সাথে আয়শাতে উপগত হয়। ছন্দোবদ্ধ ভঙ্গিতে নড়াচড়া আরম্ভ করতে সে আয়েশার কাঠিন্য টের পায় এবং তারপরে সে তীক্ষ্ণ জোরাল কণ্ঠে একবার আর্তনাদ করলে আয়েশার কাঠিন্য ধীরে ধীরে সহজ হয়ে আসে। হাঁফাতে হাঁফাতে সে আরো গভীর অনুসন্ধানে রত হয়। আরো গভীরে, বাকি সবকিছু সম্পর্কে বিস্মৃত হয়ে পড়ে। অবশেষে ঘামে ভেজা দেহে নিঃশেষ হয়ে সে আয়েশার উত্তান দেহের উপরে নেতিয়ে পড়ে।

নিজের শিরা উপশিরায় রক্তের ধাবমান গতি তখনও হ্রাস না পাওয়াতে, বাবরের কয়েক মুহূর্ত সময় দরকার হয় নিজেকে ফিরে পেতে। মনে পড়ে সে কোথায় আছে, আর একটু আগে কি ঘটে গেছে। নিজেকে ফিরে পেয়ে, সে আয়েশার উপর থেকে উঠে বসে। তার চোখের দিকে তাকাতে চাইলে রাজ্যের অনীহা এসে তাকে ঘিরে ফেলে। তারপরে, শেষ পর্যন্ত সে তার দিকে তাকায়, দেখে মেয়েটা একটুও নড়েনি, আর তার মুখের অভিব্যক্তি আগের মতই দুর্বোধ্য, নিষ্প্রাণ আর স্পর্শের অতীত। সে হয়তো নিজের জন্য একটা স্ত্রী পেয়েছে কিন্তু পুরো বিষয়টা এভাবে ঘটবে বলে সে কল্পনা করেনি। বাবর উঠে বসে এবং তার দিকে পিঠ ফিরাবার আগে স্যাটিনের চাদরে আয়েশার কোমরের নিচে চুঁইয়ে জমা হওয়া রক্তের দাগ ঠিকমত খেয়ালও করে না, যা উপযুক্ত সময়ে বিয়ের দিন তার কৌমার্য ভঙ্গের স্মারক হিসাবে সর্বসাধারণের সামনে প্রদর্শিত হবে।

২.৩ বাবুরী

০৯. বাবুরী

শাহরুখিয়ার আশেপাশের এলাকা শিকারের জন্য বিখ্যাত। ঘন জঙ্গলে হরিণ আর সারাক্ষণ ভয়ে আর্তস্বরে চেঁচাতে থাকা নধর শূকর প্রচুর রয়েছে। পশুচারণভূমি আর ছোট ছোট বৃক্ষপ্রধান এলাকাগুলোতে খরগোস, শেয়াল আর লম্বা লেজের রঙিন পাখির প্রাচুর্যের কারণে শিকারের জন্য আদর্শ বলে বিবেচিত। বাবর চোখ কুঁচকে ধনুকের ছিলা পেছনে টেনে আনে। তারপরে যখন তাকিয়ে দেখে তার ছোঁড়া তীর বাতাস কেটে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে। সে হাসে- একটা নাদুসনুদস হাঁসের সাদা গলায় তীর বিদ্ধ হতে সেটা ছটফট করতে করতে আছড়ে পড়ে। দু’মাস আগে জামমীন থেকে বিয়ে করে আসবার পরে, অধিকাংশ সময় সে শিকার করেই কাটিয়েছে।

এখন সন্ধ্যার অন্ধকার চারপাশে ছেয়ে আসতে শুরু করলে, বাবর দূর্গের উদ্দেশ্যে তার ঘোড়া ঘুরিয়ে নেয়। তার শিকারী বাজ গিল্টি করা চামড়ার টোপরের নিচে পুনরায় নিষ্ক্রিয় হয়। বাঁশে বাঁধা হরিণ এবং তার সাথে আসা ব্যাধের পর্যাণ থেকে খরগোস, আর রঙিন পালকের ফিজ্যান্ট নিস্তেজ ভঙ্গিতে ঝুলতে থাকে। সে টের পায় একটা অস্থিরতা তাকে ছেয়ে আছে। সে তার নানীজানের সাথে জীবনে কখনও উঁচু গলায় কথা বলেনি। কিন্তু দিন দিন এসান দৌলতের সব কিছুতে নাক গলানোর স্বভাব অসহনীয় হয়ে উঠছে। পাজি বুড়ি আক্ষরিক অর্থে আয়েশার সাথে তার মিলনের হিসাব রাখতে আরম্ভ করেছে আর অনবরত অভিযোগ জানাচ্ছে। প্রথম দিকে তুমি সপ্তাহে দু’বার তার সাথে রাত কাটাতে। এখন কেবল সাতদিন অন্তর কখনও আরও দীর্ঘসময় পরে তুমি তার সান্নিধ্যে রাত অতিবাহিত করো… মেয়েটাকে তুমি অপমান করছে। ফারগানার প্রতি তোমার কর্তব্যের কথা ভুলে গেলে চলবে কেন।” আজ সকালেই তার অস্বস্তি আর ক্রোধের তোয়াক্কা না করে তিনি তিরস্কারের সুরে কথাগুলো বলেছেন। “যোদ্ধা হিসাবে তোমার ভিতরে কোনো ধরণের ভয় কাজ করে না, তাহলে একটা মেয়ের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকো কেনো…?”

খোঁচা খেয়ে সে পাল্টা চিৎকার করে, “আপনি মোটেই আমার মালিক নন, আর আমিও কোনো প্রজনন ঘোড়া নই যে আদেশ করা মাত্র প্রজনন ঘুড়ির উপরে উপগত হবো।”

বিয়ের ব্যাপারে সে কোনো আপত্তি করেনি, এবং এর প্রয়োজনীয়তা সে অনুধাবন করতে পেরেছে। কিন্তু সে নিজে যেচে পড়ে বিয়ে করতে চায়নি এবং তার স্ত্রীর শীতল অবজ্ঞা- তাদের বিয়ের দিনই যা আপাতভাবে প্রতিয়মান হয়ে উঠেছিলো একটুও কমেনি বরং দিন দিন সেটা আরও কঠিন হয়েছে। আয়েশা বাবরের সাথে কদাচিৎ কথা বলে, আর যা বলে সেটাও তার কোনো অনুরোধ বা প্রশ্নের জবাবে এক শব্দের উত্তর। সে কখনও তার মুখে হাসি দেখেনি- একবারের জন্যও না। হাসলে হয়তো তার চেহারা একটু কোমল হয়তো এবং আয়েশার প্রতি তার নিজের অনুভূতিও হয়তো বদলাতো। আয়েশার সাথে শয্যায় তার কেবল মনে হয় একটা। উষ্ণ মৃতদেহের সাথে সে শুয়ে আছে তার অপ্রতিরোধী দেহের মাঝে সে নিজেকে যখন নিঃশেষ করছে, তখন তার আপাত পলকহীন কালো চোখ দুজনের মাঝের শূন্যতার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, কোনো আবেগ, কোনো প্রতিক্রিয়া বা কোনো ধরণের নৈকট্য ব্যাতিরেকে।

আয়েশার মনের ভিতরে কি খেলা করে? বসন্তের আগমনে অঙ্কুরোদগমের ফলে সবুজ হয়ে উঠা বনানীর মাঝে একটা পথ ধরে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে যাবার সময়ে বাবর আবারও কল্পনা করতে চেষ্টা করে মানসিক বা শারীরিক কোনোভাবেই কেননা আয়েশা কোনো ধরণের প্রতিক্রিয়া তার প্রতি প্রদর্শন করে না। দোষটা কি তার নাকি আয়েশার? আয়েশারই দোষ নিশ্চয়ই। মেয়েটার সমস্যাটা কোথায়? আয়েশার অনুরোধে জেনানামহল থেকে দূরে তার আর তার মাঙ্গলিঘু পরিচারিকাদের জন্য আলাদা বাসস্থানের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। সে যখনই আয়েশার মহলের দিকে হেঁটে যায় দূর থেকে তাদের বিচিত্র ভাষায় কথা বলতে শোনে। কখনও তাদের। হাসির আওয়াজও ভেসে আসে। কিন্তু সে যাহা মাত্র ভিতরে প্রবেশ করে তারা সাথে সাথে নিরব হয়ে যায়। আয়েশা তার মাথা নুইয়ে তাকে আনুষ্ঠানিক অভিবাদন জানায়। তারপরে তার উদ্যোগের জন্য, ভাবলেশহীন চোখ নিচের দিকে নামিয়ে নিরবে অপেক্ষা করে। স্ত্রীর চেয়ে ক্রীতদাসীর সাথেই তখন তার সাদৃশ্য বেশি। অবশ্য একটা পার্থক্য আছে সেটা হলো ক্রীতদাসী বিনয়ী হয় কিন্তু আয়েশার মাঝে সেটাও নেই।

বাবরের কাছে মনে হয় আয়েশা তার অহংকার বর্মের মতো ব্যবহার করছে নিজেকে আড়াল করে রাখতে। তার এই নির্লিপ্ততা তাকে তাড়িত করে। মাঝেমাঝে তাদের যান্ত্রিক রমণক্রিয়ার সময়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে তার সাথে কঠোর আচরণ করে, নিজের শারীরিক শক্তির রূঢ় প্রয়োগ করে আশা করে সে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে- তা সে যাই হোক। কিন্তু তার মনোবাসনা পূর্ণ হয় না, এবং আয়েশা যদিও তাকে কোনো ধরণের বাধা দেয় না কিন্তু বাবরের নিজেকে আইনসঙ্গত স্বামীর চেয়ে নারীর প্রতি নিপীড়নকারী বলে তখন মনে হয়। আবার কখনও সে তার সাথে নম্র আচরণ করে প্রেমিক পুরুষের মতো তার দেহের কোমনীয় বাঁকে স্পর্শ করে, তার স্তনবৃন্তে চুম্বন দিয়ে তার নিটোল উদরে মুখ রাখে- বয়ঃসন্ধিক্ষণের স্বপ্নে সুখনম্য রমণীদের প্রতি সে যেমন আচরণ করেছে। কিন্তু আয়েশা তাদের মতো কোনো প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন না করে, আড়ষ্ঠভঙ্গিতে ততোধিক অনীহার মাঝে নিজেকে আড়াল করে রাখে।

খানজাদাকে সে যখন লাল হয়ে তোতলাতে তোতলাতে জিজ্ঞেস করে- যে শাহী বিয়ের সহযাত্রী হবার জন্য মুখিয়ে ছিলো আর যত্ন নিয়ে বাছাই করা উপহার সামগ্রীর ব্যাপারে ছিলো এত উদার- আয়েশা তার বা তার আচরণের ব্যাপারে তার সাথে কখনও কোনো আলাপ করেছে কিনা, সে মাথা নেড়ে অপারগতা প্রকাশ করে। সে অবশ্য তাকে একটা কথা বলে যে, বিয়ের পর পর সে যখন আয়েশার সাথে তার মহলে দেখা করতে যেতো, তখন সে সব সময়ে তাকে শীতল উদাসীন ভঙ্গিতে অভ্যর্থনা জানিয়েছে। কোনো ধরণের আবেগ দেখানো দূরে থাক, আলাপ করার কোনো ইচ্ছাই সে দেখাতো না- সে তাই বাধ্য হয়ে একতরফা যাওয়া বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। খানজাদা বলে, ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে, আয়েশা যেনো অন্য কোথাও থাকতে চায়, আর সেখানেই রয়েছে বলে মনে মনে ধরে নিয়েছে।

শাহরুখিয়ার দূর্গপ্রাকারের নিচে যত্রতত্র গড়ে উঠা কাঠের চালাঘর। মাটির ইটের বাসা এবং চামড়ার গোলাকৃতি তাঁবুর দঙ্গলের ভিতর দিয়ে বাবর আর তার লোকেরা ঘোড়া ছুটিয়ে অতিক্রম করার সময়েও সে নিজের ভাবনায় বিভোর হয়ে থাকে। হতদরিদ্র কাপড় পরিহিত অধিবাসীরা আগুনের ধোয়ার পাশে আসনপিড়ি হয়ে বসে রাতের খাবারের আয়োজন করছে, যখন তাদের বাচ্চারা ঢালু গলিপথে খালি পায়ে দৌড়ে বেড়ায়। সংকীর্ণ নালা, যেখান দিয়ে বর্জ্য প্রবাহিত হয় তার উপর দিয়ে লাফিয়ে যায় আর অন্যরা আবর্জনা এবং জঞ্জালের ঢিপির উপর দিয়ে বীরবিক্রমে লাফ দেয়। তারা পাথর নির্মিত তোরণদ্বারের লোহা দিয়ে বাঁধানো দরজার দিকে এগিয়ে যেতে, একটা বাচ্চা ছেলে- দুই কি তিন বছরের বেশি বয়স হবে না সহসা দৌড়ে বাবরের সামনে এসে পড়ে। আতঙ্কে চিহি শব্দ করে উঠে তার ঘোড়া পিছনের পায়ে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।

বাবর গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে লাগাম টেনে ধরে বাদামী আজদাহাটার মুখ ঘুরিয়ে নেয়। যাতে আতঙ্কিত হয়ে এলোপাথাড়ি চালাতে থাকা ঘোড়ার খুরের আঘাত থেকে বাচ্চাটা বেঁচে যায়, যে এখন চোখ বড় বড় করে উচ্চস্বরে কাঁদছে এবং ভয়ে অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাবরের ঠিক পেছনের একজন অশ্বারোহীর ব্যাপারটা বুঝতে দেরি হয়ে যায় এবং মনে হয় যেনো সে বাচ্চাটাকে মাড়িয়ে যাবে। কিন্তু। পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা সুঠামদেহী এক তরুণ সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে শুয়ে পড়ে নিজের দেহ দিয়ে তাকে আড়াল করে রাখে। উচ্চস্বরে অভিশাপ দিতে দিতে আগুয়ান অশ্বারোহী তার বিশাল কালো ঘোড়াটা। নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করে। কোনোমতে তাদের উপর দিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে যায়। কিন্তু ঘোড়ার পেছনের পায়ের একটা খুর তরুণের মাথার পেছনে খুব জোরে আঘাত করে।

বাবর জিনের উপর থেকে নেমে অচেতন তরুণের পাশে হাঁটু মুড়ে বসে বাচ্চাটাকে সে তখনও নিজের বাহু দিয়ে আগলে রেখেছে- বাবর এখন দেখতে পায় একটা বাচ্চা মেয়ে। মেয়েটা তখনও ফোঁপাচ্ছে। শিকনির সরু একটা ধারা তার উপরের ঠোঁট বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। বাবরের লোকজন তাকে সরিয়ে নিতে সে এবার ছেলেটাকে পিঠের উপর শোয়ায়। বাবর ভাবে, আমারই মতো বয়স দেখছি। ঈগলের মত বাঁকানো নাক, চোখের নিম্নাংশের হাড় উঁচু এবং থুতনিতে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। অসংখ্য যুদ্ধের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চোখে সে ছেলেটার মাথার আঘাত খুটিয়ে দেখে এবং কালো চুলের নিচে একটা জায়গা দেখে যেখানটা থেতলে গিয়ে রক্তে চটচট করছে। তরুণ ছেলেটা যার ভাসাভাসা শ্বাসপ্রশ্বাস দেখে। মনে হয় গভীরভাবে অচেতন হয়ে রয়েছে। বাচ্চা মেয়েটাকে বাঁচাতে গিয়ে বেচারা বেশ ভালোই আঘাত পেয়েছে। মেয়েটাকে যে বাঁচিয়েছে এটা জানার জন্য যদি সে জীবিত না থাকে তবে ব্যাপারটা দুঃখজনক হবে।

“একে দূর্গে নিয়ে চলো। দেখা যাক আমাদের হেকিম তার কোনো কিছু করতে পারে কিনা।” বাবর ঘোড়ায় উঠে বসে এবং দূর্গের তোরণের দিকে এগিয়ে যাবার সময়ে সে আগের চেয়েও বিষণ্ণ হয়ে উঠে।

***

সেই রাতে, বাবর বুঝতে পারে তার আয়েশার কাছে যাওয়া উচিত। তার নানীজান আর আম্মিজান তাহলে খুশি হবে এবং একবার গর্ভবতী হলে সম্ভবত আয়েশা নিজেও খানিকটা পরিতৃপ্তি খুঁজে পাবে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দৌহিত্রের সম্ভাবনায় হয়তো ইবরাহিম সারু প্রতিশ্রুত তীরন্দাজ বাহিনী দিয়ে বাবরকে তার জন্মস্থান আকশি পুনরুদ্ধারের সহায়তা করবে। এখন ভরা বসন্তকাল। তার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করার উপযুক্ত সময়। অথচ সে যখনই জামমীনে তার বার্তাবাহক পাঠায় কখন তীরন্দাজ বাহিনী পৌঁছাবে জানতে, প্রতিবারই সেখান থেকে একই উত্তর আসে: তীরন্দাজ বাহিনী শীঘ্রই পৌঁছাবে, শীঘ্রই…

হাম্মামখানা থেকে বের হয়ে এসে বাবর তার স্ত্রীর মহলের দিকে কর্তব্যপরায়ন ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করে। কিন্তু সামনে সবুজ চামড়া দিয়ে মোড়া দুই দরজা বিশিষ্ট প্রবেশপথ চোখে পরতে সে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। না। এসান দৌলতকে যেমন বলেছে, সে কারো আদেশে প্রজনন অশ্বের ভূমিকা পালন করবে না। সে একজন পুরুষ যে নিজেকে জানে তার কি ভাললাগে এবং সে তাই করবে। গোড়ালির উপরে ঘুরে দাঁড়িয়ে সে দ্রুত ফিরতি পথে রওয়ানা দেয়।

***

তরুণের আঘাতের ব্যাপারে বাবরের আশঙ্কা অবশ্য ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়। ছয় ঘণ্টা পরে এক পরিচারক এসে তাকে জানায় যে তার জ্ঞান ফিরে এসেছে। ব্যাপারটা সেখানেই শেষ হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু কোনো একটা কারণে বাবর আরও জানতে আগ্রহী হয়ে উঠে এবং দুর্ঘটনার দ্বিতীয় দিন সে আদেশ দেয় যদি সম্ভব হয় তবে একটা খাঁটিয়ায় করে ছেলেটাকে যেনো তার কাছে নিয়ে আসা হয়।

ছেলেটাকে ভীষণ ফ্যাকাশে দেখায়। কিন্তু নিজের অধোমুখ অবস্থান থেকে হাত বুকের উপরে রেখে মাথা নুইয়ে সে বাবরকে অভিবাদন জানায়- ভঙ্গিটা করতে তার কষ্ট হয় সেটা পরিষ্কার বোঝা যায় কারণ বেচারা ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে।

“বাচ্চা মেয়েটাকে ওভাবে বাঁচিয়ে তুমি দারুণ সাহসের পরিচয় দিয়েছে। আমি কৃতজ্ঞ যে তোমার নিজের জীবন বখশ দিয়ে আল্লাহ তোমার প্রতি উপযুক্ত করুণা প্রদর্শন করেছেন। তোমার নাম কি?”

“বাবুরী, সুলতান।”

বাবর স্পষ্টতই বিস্মিত দৃষ্টিতে এবার তার দিকে তাকায়। বাবুরী একটা অপ্রচলিত নাম। কিন্তু সেই সাথে তার নিজের নামের সাথে দারুণ মিল রয়েছে নামটার। “তুমি কোথাকার বাসিন্দা? তোমার গোত্রের নাম কি?”

“আমার বাবা ছিলেন বারীন গোত্রের একজন যোদ্ধা এবং আপনার মরহুম পিতার অধীনে লড়াই কিন্তু আমি যখন নিতান্তই শিশু তখন তিনি মারা যান। আমার বাবার কথা আমার মনে নেই। আমার মা আমাকে নিয়ে সমরকন্দ চলে যান। কিন্তু সেখানে আমার যখন সাত বছর বয়স, তখন গুটিবসন্তে তিনি মারা যান। তখন থেকেই আমি একা একা মানুষ হয়েছি।”

“তুমি কি করো? যোদ্ধা?”

“না, সুলতান।” বাবুরী এবার বাবরের চোখের দিকে তাকায়। চোখের মণি গাঢ় প্রায় ধূম্রনীল।

“কিছু দিন আগেও আমি বাজারে বাজারে ফেরি করে বেড়াতাম। সমরকন্দের সড়কে আমি বাঁধাকপি ফেরি করেছি।”

“তুমি শাহরুখিয়ায় কিভাবে এসেছো?”

“সুলতান, আপনি যখন সমরকন্দ অবরোধ করেছিলেন তখন আমি আপনার এক সর্দারের অধীনে পানি বাহকের কাজ নেই। তিনি ফারগানা চলে যাবার পরে আমি থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেই।” কোনো রকমের ভনিতা না করে বাবুরী কথা বলে যায়।

“কিন্তু আমি তোমাকে আগে কখনও দেখিনি?”

“এতে অবাক হবার কিছু নেই। আমি এখন রসুইখানায় কাজ করি। ভেড়ার চামড়া ছাড়াই, মুরগীর নাড়িভূড়ি পরিষ্কার করি। বলবার মতো কোনো কাজ না তবে কাজ।” তার ঠোঁটের কোণে একটা আধো হাসি ফুটে উঠে। “আরও খারাপ কিছু কপালে জুটতে পারতো।”

বাবর বিস্মিত হয়ে ভাবে সে আমাকে নিয়ে রসিকতা করছে। আমি তার কাছে আনন্দের উপকরণ। “আমি নিশ্চিত আরো খারাপ কিছু হতে পারতো- মাঝে মাঝে নিয়তি যা নির্ধারিত করে রেখেছে আমাদের সেটাই মেনে নিতে হয়, এমনকি সেটা মুরগীর নাড়িভূড়ি বের করা হলেও। কিন্তু নিয়তি সম্ভবত এবার অন্য কিছু ঠিক করেছে। তোমার সাহসিকতা দেখে মনে হয়েছে সৈন্য হবার যোগ্যতা তোমার রয়েছে।”

“আমারও সেটা পছন্দ যে…তাছাড়া, আমি প্রমাণ করেছি আঘাত সহ্য করার মতো যথেষ্ট মোটা মাথা আমার রয়েছে…এবং রসুইখানায় কাজ করার চেয়ে সেটা অনেক বেশি কাম্য- কখনও কখনও যদি আমাকে মানুষের নাড়িভূড়ি বা নিজেরও কিছু খোয়াতে হয়, তারপরেও।” ছেলেটা এখনও হাসছে।

“খুব ভালো কথা। তুমি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠো, আমার অশ্বারোহী বাহিনীতে তুমি যোগ দেবে।”

বাবর ভেবেছিলো ছেলেটা আনন্দে অধীর হয়ে তাকে কৃতজ্ঞতা জানাবে। কিন্তু দেখে উল্টো তার মুখের হাসি উবে যায়। তার অভিব্যক্তিতে একটা আড়ষ্ঠতা ফুটে উঠে এবং তার ফ্যাকাশে মুখ লাল দেখায়। “কি ব্যাপার কি হয়েছে?”

“সুলতান, আমি ঘোড়ায় চড়তে জানি না।”

নিজের নির্বুদ্ধিতায় বাবর নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে। যাযাবর সমাজে যেখানে কেবল হতদরিদ্ররাই ঘোড়ার ব্যাপারে অজ্ঞ হয়, সেখানে সেটা স্বীকার করাটা লজ্জাজনক। এক গরীব ফেরিওয়ালা কিভাবে অশ্বারোহী বাহিনীতে যোগ দেবার মতো দক্ষ ঘোড়সওয়ার হবে?

বাবুরীকে আরও অস্বস্তিতে ফেলার আগেই সে দ্রুত বলে, “তুমি ইতিমধ্যে প্রমাণ করেছো যে ঘোড়া দেখে তুমি মোটেই ভীত বোধ করো না। সুস্থ হয়ে অশ্বশালার আধিকারিকের কাছে গিয়ে বলবে সে তোমাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে অশ্বারোহী বাহিনীর যোগ্য করে তুলবে।”

***

“আমরা তাহলে একমত। আগামী পূর্ণিমার পূর্বে যদি জামমীন থেকে মাঙ্গলিঘ তীরন্দাজের দল এসে না পৌঁছে, আমরা তারপরেও আকশির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেব।” বাবর তাকে অর্ধবৃত্তাকারে ঘিরে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে থাকা পারিষদবৃন্দের দিকে তাকায়।

মাঙ্গলিঘ থেকে আগত অতিরিক্ত সৈন্যবাহিনীর এখনও কোনো খবর নেই এবং বাবরেরও ধৈৰ্য্যচ্যুতি ঘটেছে। তার অধিকৃত ভূখণ্ড এখনও নিরাপদে তার আয়ত্ত্বে আছে। দূর্গগুলোতে তার বিশ্বস্ত সর্দারদের অধীনে ভালোমতো রক্ষীবাহিনী মোতায়েন করা রয়েছে, কিন্তু তার পক্ষে আর অপেক্ষা করা সম্ভব না। আকশি তাকে অতিসত্ত্বর পুনরায় দখল করতে হবে। তারপরেই সে কেবল নিজেকে ফারগানার সত্যিকারের সুলতান বলে অভিহিত করতে সক্ষম হবে এবং ভবিষ্যতের জন্য উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা হাতে নিতে পারবে।

“সুলতান ইত্যবসরে আমাদের উচিত সৈন্যবাহিনীর কুচকাওয়াজ অব্যাহত রাখা। অবরোধ যন্ত্র আর নিক্ষেপক আমাদের যথেষ্ট রয়েছে কিন্তু সৈন্যবাহিনীর একটা বিরাট অংশ এখনও সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসাবে জমাট বাঁধেনি। যুদ্ধাবস্থায় আমরা তাদের মাথায় যা ঢোকাতে চেয়েছি, সেটা হয়তো তারা বেমালুম ভুলে বসে থাকবে। আর আমাদের উচিত রসদের পরিমাণ বৃদ্ধি করা। আমরা যদিও দীর্ঘ অবরোধের পক্ষপাতি নই, শেষ পর্যন্ত হয়তো সেটাই অবধারিত হয়ে উঠতে পারে, ওয়াজির খান বলেন।

“আপনি ঠিকই বলেছেন। আর আমরা যখন অভিযান শুরু করবো, আমাদের উচিত হবে আগেই হামলাকারী বাহিনী পাঠিয়ে গবাদি পশুর পাল দখল করে নেয়া। আকশির রক্ষীবাহিনী নিজেদের খাবার জন্য সেগুলো দখল করার আগেই। বাইসানগার, এই কাজের উপযুক্ত বাহিনী গড়ে তোলার জন্য আমি আপনার উপরে নির্ভর করছি- এমন লোক যাদের আমরা বিশ্বাস করতে পারি। আমার লোকেরা হত্যাযজ্ঞের শিকার যেন না হয় বা তাদের উপরে যেন লুটতরাজও চালান না হয়। আমরা সব কিছু অর্থের বিনিময়ে কিনে নেব। আমি একজন সুলতান যে তার নিজের রাজ্যে ফিরে আসছে, লুটতরাজে প্রবৃত্ত কোনো উজবেক দস্যু নই।”

বাবর উঠে দাঁড়ায়, নিজে নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে বলে খুশি হয় এবং অপেক্ষার পালা শীঘ্রই শেষ হবে। অস্থিরবোধ করতে, সে আঙ্গিনায় বের হয়ে আসে এবং তার প্রিয় ঘোড়াকে প্রস্তুত করতে বলে। বিস্মিত সহিসের দল দৌড়ে যায় তার আদেশ পালন করতে। তার দেহরক্ষীর দল নিজেদের ঘোড়ার জন্য চেঁচামেচি শুরু করতে বিভ্রান্তি আরো বেড়ে যায়। সবাই অলস আর অগোছালো হয়ে পড়েছে। সে বাবুরীর চওড়া কাঁধ আর সরু কোমরযুক্ত অবয়ব লক্ষ্য করে, ঝাড়ু হাতে আস্তাবল থেকে বের হয়ে আসতে সে তাকে হাতের ইশারায় কাছে আসতে বলে।

“সুলতান?” আজ বাবুরীকে কোনো কারণে বাবরের চোখের দিকে তাকাতে অনিচ্ছুক মনে হয়।

“তোমার ঘোড়ায় চড়ার প্রশিক্ষণ কেমন চলছে?”

নিরবতা।

“আমি আদেশ দিয়েছিলোম অশ্বারোহী বাহিনীর সদস্য হবার জন্য তুমি প্রশিক্ষণ নেবে?”

আবারও নিরবতা।

“আর আমি আদেশ অমান্য করা দেখতে অভ্যস্ত নই।” বাবর বিস্মিত হয়। ছেলেটাকে তার আগ্রহী বলেই মনে হয়েছিলো। কিন্তু সে এখনও প্রশিক্ষণ আরম্ভ করেনি। সে বাবুরীকে সাহায্য করতে চায় এবং ভেবেছিলো তার ভিতরে সে একটা আগ্রহ দেখতে পেয়েছে। কিন্তু তার নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হয়েছে। বাবুরী যে বাঁধাকপি ফেরি করতে সে সেগুলোর মতই অকর্মণ্য। হতাশ হয়ে বাবর ঘুরে দাঁড়ায়। ঘুরে দাঁড়াতে গিয়ে সে বাবুরীর চোখের নিচের হাড়ে একটা কালশিটে দাগ দেখতে পায়। “দাঁড়াও, দাঁড়াও। ওটা কিসের দাগ?”

“আপনার অশ্বশালার প্রধান আমাকে মেরেছে।”

“কেন?”

বাবুরী এতক্ষণ পরে এবার চোখ তুলে তাকায়। “কারণ আমি তাকে বলেছিলাম অশ্বারোহী বাহিনীতে যোগ দেবার জন্য ঘোড়ায় চড়া শিখতে চাই। সে বলেছে আমি ঘোড়ার বিষ্ঠা পরিষ্কার করার যোগ্য।”

“তুমি কি তাকে বলেছে যে আমি ব্যক্তিগতভাবে এর জন্য ইচ্ছা পোষণ করেছি?”

“সম্ভবত এভাবে আমি কথাটা তাকে বলিনি। আমি ভেবেছিলাম সে বিষয়টা জানে। আর আঘাত করার আগে সে আমাকে সেটা বলবার কোনো সুযোগও দেয়নি। পরে, আমি কেবল তাকে পাল্টা আঘাত করা থেকে বহু কষ্টে নিজেকে বিরত রেখেছি। ব্যাখ্যা করার জন্য সেটা উপযুক্ত সময় ছিলো না, বা আর্জি জানাবার। আপনি যদি সত্যিই চান আমি ঘোড়া চালনা শিখি তবে সেটার বন্দোবস্ত হয়ে যাবে। আর তা যদি না হয়, তাহলে রসুইখানার চেয়ে আস্তাবল অনেক ভাল, বলতেই হবে।”

বাবর তার এক দেহরক্ষীর দিকে তাকায়। “আলী গোসতকে ডেকে আন।”

কিছুক্ষণ পরে, লোকটাকে তার সামনে নতজানু অবস্থায় বসে থাকতে দেখা যায়। সে বাবরের মতই, চেঙ্গিস খানের বংশধর, সাগরিচি গোত্রে অন্তর্গত আর ঘোড়ার ব্যাপারে তার দক্ষতা সর্বজনবিদিত। বলা হয় সে একটা স্ট্যালিয়ন মাত্র দু’দিনে বশ মানাতে পারে। বদরাগী আর নিজের বহু কষ্টে অর্জিত মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন আলী গোসত বিশ্বস্ত আর বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন। বাবরের ধারণা বাবুরী নিজের বক্তব্য পেশ করার সময় বা তরিকার ব্যাপারে খুব একটা সচেতন ছিলো না। কোনো সন্দেহ নেই আলী গোসত ভেবেছে বাবুরী বড়াই করছে- বারীন গোত্রের এ ব্যাপারে আবার দারুণ সুনাম রয়েছে। বাবর ভাবে, তারই ভুল হয়েছে, পরিষ্কার করে আদেশটা না দিয়ে।

“আমি চাই এই লোকটা আমার অশ্বারোহী বাহিনীর একজন সদস্যে পরিণত হোক। আমরা এখন তার প্রশিক্ষণ আরম্ভ করবো। শাহী আস্তাবল থেকে তার জন্য একটা ঘোড়ার ব্যবস্থা করো।”

“এখনই করছি, সুলতান।”

কয়েক মিনিট পরে বাবর, সাথে বাবুরী তার বাহনের কেশর আঁকড়ে- একটা শান্ত ঘোটকী- শাহরুখিয়ার দূর্গ থেকে দুলকি চালে বের হয়ে আসে। রক্ষীবাহিনী বরাবরের মতো একটু পেছনে থেকে তাকে অনুসরণ করে। চমৎকার উষ্ণ এক দুপুরবেলা এবং তৃণভূমিতে ফুটে থাকা গবাদি পশুর ভোজ্য এক বোঁটায় তিনপাতা বিশিষ্ট ছোট গাছের সাদা পুষ্ট ফুলে মৌমাছির দল ব্যস্ত ভঙ্গিতে উড়াউড়ি করছে এবং বাতাসে একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আছে। বাবর লাগাম টেনে ধরে এবং ঘুরে তাকায় বাবুরীর হালহকিকত দেখতে। সামান্য সোজা অবস্থায় তাকে এখন উপবিষ্ট দেখা যায়, ঘোটকীর কেশর টানা বন্ধ করেছে। “হাঁটু দিয়ে আঁকড়ে ধরে থাকো। গোড়ালির গাঁট ভিতরের মুখ করে নিচের দিকে নামিয়ে রাখবে এবং পায়ের পাতা থাকবে রেকাবের উপরে।”

বাবুরী মাথা নাড়ে, মনোসংযোগের তাগিদে তার ভ্রু কুঁচকে আছে। বাবর ভাবে, ব্যাটার জিনে বসার একটা সহজাত ভঙ্গি রয়েছে এবং ভালো অশ্বারোহী হবে। তার জীবন এতোদিন কেমন কেটেছে? বাবরের পক্ষে সেটা কল্পনা করাটা কঠিন। বাবরের চোখে কেবল সুড়ঙ্গ পথে লুকিয়ে সন্তর্পনে সমরকন্দে প্রবেশের পরে লুকিয়ে থাকার সময়ে প্রাঙ্গনের সেই হাড্ডিসার বুড়ো আর তার সেই ছত্রাক আক্রান্ত পেঁয়াজের দৃশ্য ভাসতে থাকে। সেইদিন সকালে বাবুরীও সম্ভবত প্রাঙ্গণের কোথাও দাঁড়িয়ে ছিলো।

“জলদি এসো।” বাবর তাড়া দেয়। “দ্রুত ঘোড়া হাঁকাও।”

“আমি সেটাই চাইছি, কিন্তু সুলতান আমি এই ঘোটকীটাকে মোটেই রাজি করাতে পারছি না।”

***

কয়েকদিন পরের কথা, আস্তাবলের বাইরে বাবর তার ঘোড়ার লাগাম একজন সহিসের কাছে বুঝিয়ে দিচ্ছে যখন, সে বাবুরীকে আস্তাবলের ভিতরে দেখতে পায়। তার দিকে পেছন ফিরে ঝুঁকে নিজের ঘোড়ার পা মালিশ করছে। বাবর সন্তর্পনে তার দিকে হেঁটে যায় এবং তার প্রশিক্ষণ কেমন চলছে জানার জন্য হাত বাড়ায় তার কাঁধে টোকা দেবে বলে। টোকা দিতে গিয়ে সে তার কাঁধ আঁকড়ে ধরে এবং তার দিকে মোচড় দেয়। বাবুরী ধনুকের ছিলার মতো ছিটকে ঘুরে দাঁড়িয়ে তাকে আঘাত করার জন্য জড়িয়ে ধরে। সে কাকে ধরেছে সেটা দেখা মাত্র অবশ্য সে বাবরকে ছেড়ে দেয় এবং হাঁটু মুড়ে নতজানু হয়। “আমাকে মার্জনা করবেন, সুলতান। আমি বুঝতে পারিনি।”

“অবশ্যই তুমি বুঝতে পারনি। কিন্তু এমন প্রতিক্রিয়ার কি বিশেষ কোনো কারণ আছে?”

“সহজাত প্রবৃত্তি। আপনার বাল্যকাল যদি রাস্তায় কাটে এবং টের পান আপনার পেছনে কিছু একটা ঘাপটি মেরে রয়েছে, আপনার যথাসর্বস্ব হতে পারে সেটা একটা তামার পয়সা, খাবার বা হয়তো আপনার নিজের স্বাধীনতা- বাঁচাতে আপনাকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অনেক লোক আছে যারা বাচ্চাদের অপহরণ করে ক্রীতদাস বা আরো জঘন্য উদ্দেশ্যে বিক্রি করে দেয়।”

“তোমার খেয়াল রাখার মতো কেউই কি ছিলো না?”

“আমার আম্মিজান মারা যাবার পরে আর কেউ ছিল না। কিছু মানুষ আসলেই দয়ালু কিন্তু বাকী সবাই সাধারণত বিনিময়ে কিছু চায় হতে পারে সেটা নিতান্তই কতজ্ঞতা বা চাটুবাদিতা কিংবা তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী কোনো কিছু করা। আপনি সবচেয়ে বেশি নির্ভর করতে পারেন- রুটির টুকরো চুরি করতে রুটিঘরের পেছনের পথের দিশা বা শীতের রাতে ঘুমাবার গরম জায়গা কোথায় পাওয়া যাবে আরেকটা রাস্তার ছেলের উপরে যদিও সেও আগে নিজের খেয়ালই রাখবে।” “বাইরের পৃথিবীটা কি আসলেই এমন? মানুষ কি এতোই স্বার্থপর?”

“হতে পারে আমি বাড়িয়ে বলেছি। আমার কিছু ভালো বন্ধু ছিলো” বাবুরী বলে, তারপর তার মুখে একটা রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে। “দরবারের কথা একেবারেই আলাদা? আপনার পারিষদবর্গের ভিতরে কতোজনের উপরে আপনি নির্দ্বিধায় নির্ভর করতে পারেন? নিজের সমগোত্রীয়দের উপরে উঠার জন্য তুচ্ছ সম্মান বা উপহার বা মামুলী সুবিধার জন্য আপনার স্বার্থের বিনিময়ে কে এমন আছে যে নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে না? আপনার সমগোত্রীয় কতজন শাসক- আত্মীয় হোক বা না হোক- রুটিঘরের মালিক অন্য খদ্দেরকে বিদায় করতে যখন ব্যস্ত, সেই সুযোগে আমি যেমন রুটিঘরে চুরি করেছি, ঠিক তেমনি, আপনার মনোযোগর বিক্ষিপ্ততার সুযোগ নিয়ে আপনারই রাজ্যে লুটতরাজ চালানো থেকে বিরত থাকবে?”

বাবর নিজের সৎভাই জাহাঙ্গীর, চাচাতো ভাই মাহমুদ আর তামবাল তার সাথে কি করেছে ভেবে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে ভ্রুকুটি করে। “আমি তারপরেও রাস্তার জীবনের চেয়ে দূর্গের জীবনই বেছে নেবো- আর তুমিও তাই চাও, নতুবা আজ তুমি এখানে থাকতে না।”

“আমার অন্তত পছন্দ করার সুযোগ ছিলো। আপনি হয় সর্দার হবেন নতুবা আপনার জীবন বৃথা। আপনার পক্ষে কখনও অখ্যাত অবস্থায়, নিরূপদ্রব জীবন কাটানো সম্ভব না। কেউ না কেউ আপনাকে হুমকি হিসাবে দেখবে আর হত্যা করবে। নিজের ভাগ্য বেছে নেবার স্বাধীনতা আমার রয়েছে, আমার সামনে তাই। সম্ভাবনা প্রচুর, যদিও সবই কম উত্তেজনাপূর্ণ। হ্যাঁ, আমি এখানে থাকতে পছন্দ করি, কিন্তু এখানে থাকাটা আমি আমার অভ্যেসে পরিণত করবো না।”

“খুবই সত্যি কথা। আমার মরহুম আব্বাজান প্রায়ই একটা কথা বলতেন, নিজের ভালো একজন খুব ভালোই বুঝতে পারে এবং আমার মনে হয় কথাটা একজন শাহজাদা আর ভিখারীর জন্য সমান প্রযোজ্য।” কথাটা বলেই বাবর ঘুরে দাঁড়ায় এবং শেষ কথাটার জন্য সে নিজেই নিজেকে বাহবা দেয়।

***

সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সে বারবার যা করেছে, বাবর নিজের কোমরে আরও একবার মোটা নীল কাপড়ের একটা ফালি কষে বাঁধে। তার পরণের কালো সালোয়ার ছেঁড়াফাটা এবং পিঙ্গল বর্ণের জোব্বার উপরের পরা চামড়ার আঁটসাট জ্যাকেট চকচকে আর পুরাতন।

“সুলতান, সাবধানে থাকবেন।” ওয়াজির খানকে উদ্বিগ্ন দেখায়।

বাবর ধারণা করে, তার এইসব নৈশ অভিযান আর তারচেয়েও বড় কথা বাবুরীর সাথে তার ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতা, আর রাতের বেলার এইসব অভিযানে তার সঙ্গী হওয়ার ব্যাপারটা তিনি মেনে নিতে পারছেন না। কিন্তু তার লোকজন কিভাবে বসবাস করছে সেটার একেবারে আসল অবস্থা দেখার এইসব অভিযান বাবরের কাছে ক্রমশ একটা নেশার মতো হয়ে উঠছে। “আমি সতর্ক থাকবো।” তার বুড়ো হয়ে উঠা বিশ্বস্ত বন্ধুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বাবর চুপিসারে কক্ষ থেকে বের হয়ে এসে পেছনের একটা সংকীর্ণ সিঁড়ি দিয়ে দূর্গের পেছনের অংশে অবস্থিত একটা ছোট প্রাঙ্গণে নেমে আসে, যেখানে অন্ধকারে বাবুরী তাদের আগে থেকে ঠিক করা স্থানে তার জন্য অপেক্ষা করছে।

তারা নিরবে পাশের একটা দরজার দিকে এগিয়ে যায়, যেখানে অবস্থানরত ওয়াজির খানের প্রহরীকে আগে থেকেই সতর্ক করে দেয়া হয়েছে তাদের ব্যাপারে। ফলে সে, নিরবে তাদের বাইরে যেতে দেয়। বাবর চোখ কুঁচকে তাকিয়ে দূর্গ থেকে কয়েকশ গজ দূরে তার আদেশমতো দুটো টাটু ঘোড়াকে জিন চাপানো অবস্থায় দড়ি দিয়ে বাঁধা দেখতে পায়।

তারা ঘোড়াগুলোর বাঁধন খুলে লাফিয়ে পিঠে চেপে বসে এবং টাকরার সাহায্যে একটা শব্দ করে আর ঘোড়াগুলোর পুষ্ট পাঁজরে গোড়ালি দিয়ে তবলার বোল তুলে, অর্ধবল্পিত বেগে অন্ধকারে হারিয়ে যায়। অসাধারণ একটা ব্যাপার। বাবুরী যেভাবে মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে, বাবর ভাবে, তার কখনও ছিলো এমন রক্ত সম্পর্কীয় ভাইয়ে পরিণত হয়েছে। সে তাকে অসি চালনা, আর কুস্তি করতে শিখিয়েছে। এমন কি কিভাবে ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় তীর ছুঁড়তে হয়- ঠিক যেমন ওয়াজির খান তাকে একসময়ে শিখিয়েছিলো। বাবুরী যে আসলেই একজন সহজাত ঘোড়সওয়ার সেটা সে প্রমাণ করেছে এবং কয়েকবার পটকান খেয়ে তার বোধবুদ্ধিও ভালোই হয়েছে, এখন সে বাবরের সাথে প্রায় সমান তালেই ঘোড়া ছোটাতে পারে।

বাবুরী তাকে এর বদলে শিখিয়েছে লোকগান আর নৃত্য- এবং ছিঁচকে চোর হতে হলে লুকিয়ে থাকার যে কৌশল আর পটুতা দরকার সেটাও বাবর তার কাছে থেকে শিখেছে। কিভাবে একজন কৃষকের মতো পোশাক পরতে হবে, যা তাদের নৈশ অভিযানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেটাও বাবুরীই তাকে শিখিয়েছে। তারা যখন রাতের বেলা ঘোড়া নিয়ে বেড়াতে বের হয়, তখন গ্রামে আর অস্থায়ী বসতির আশেপাশের বাজারে জিনিসপত্রের দরদাম করে এবং উবু হয়ে গ্রামের বারোয়ারী আগুনের পাশে বসে ধূমায়িত চা পানের ফাঁকে বয়স্কদের গল্প শোনে।

কখনও তার আর অন্যান্য গোত্রপতিদের বিরুদ্ধে বাবর তাদের বিষোদগার করতে শোনে। যাদের কল্যাণে সাধারণ মানুষের জীবন এখন পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। প্রথম প্রথম এইসব মন্তব্য তাকে ক্রুদ্ধ করে তুলতো, কিন্তু এখন সে শোনার চেষ্টা করে বুঝতে চায়, তার লোকদের মনে আর মননে কি ভাব খেলা করছে। অবশ্য দূর্গে বসবাসকারীদের চারিত্রিক দুর্বলতার বিষয়ে যেসব সম্ভব অসম্ভব গুজব বাজারে প্রচলিত রয়েছে তারা দুজনেই সেসব দারুণ উপভোগ করে। কাশেম- বাবরের নির্বিরোধী আর ধীরস্থির উজির- গুজব রয়েছে তার নাকি এমন একজন পুরুষ সঙ্গী রয়েছে যার যন্ত্র নাকি প্রজনন অশ্বকেও ঈর্ষান্বিত করবে। কিন্তু মুশকিল হলো মেয়েদের মতো পোশাকে সজ্জিত হলে আর বিছানায় বাধা অবস্থায় কেবল তার রমণ প্রবণতা জাগ্রত হয়।

অবশ্য আজ রাতে কাশেমের রুচি রমণের চেয়ে আরেকটা বীর্যবান আকর্ষণ রয়েছে। আজ রাতে তারা যে গ্রামে যাচ্ছে, জহাজাক, সেটা আসলে একটা বেশ্যালয়। যেখানে তারা আগেও অনেকবার গিয়েছে- কাঠের একটা প্রায় ধ্বসে পড়া চালাঘর। যেখানে আগুনের আলোয় মেয়েরা নাচে, সগর্বে নিজেদের পোশাক জাহির করে এবং পুরুষরা তাদের মধ্যে থেকে পছন্দসই মেয়ে নিজের অঙ্কশায়িনী করতে বেছে নেয়। এইসব মেয়েদের একজন ইয়াদগার, তার আকর্ষণীয় স্তন আর প্রশস্ত কটিদেশের কথা চিন্তা করতেই বাবরের শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি দ্রুততর হয়ে উঠে। আজকের পুরোটা দিন আসন্ন অভিযানের প্রস্তুতির ভাবনায় তার কেটেছে। কিন্তু এখন রাত নামতে ইয়াদগারের কোমল আঁধারে নিজেকে প্রোথিত করার তাড়না সে কোনোমতেই দমন করতে পারে না।

ইয়াদগারের উষ্ণ আর সহজলভ্য দেহ, অনুসন্ধানী ওষ্ঠ তাকে একটা নতুন জগতের সন্ধান দিয়েছে। আর অনেক কৌশল এবং রোমাঞ্চকর অনুভূতির উপস্থিতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ করে তুলেছে। আয়েশার থেকে মেয়েটা কতো আলাদা, তাদের এতোদিনের যৌনসম্পর্কের বেলায় মেয়েটা তাকে একবারও প্রণয়সিক্ত স্পর্শ করেনি। তার দু’হাত অসারের মতো শয্যার দুপাশ আঁকড়ে থাকে। তার ওষ্ঠদ্বয় শীতল আর বাবরের জন্য সবসময়েই বন্ধ থাকে। বাসর শয্যায় যদি সে আরও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। প্রেমিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারতো, সবকিছু তখন হয়ত অন্যভাবে ঘটতো… কিন্তু সেটা এখন অতীতের বিষয়। সে আবার যখন ফারগানার সুলতান হবে তখন সে ইয়াদগারকে তার উপপত্নী করবে। উজ্জ্বল রত্নের সমাহারে ইয়াদগারের বাড়িয়ে। তোলা সৌন্দর্য সে উপভোগ করবে এবং তার হলুদাভ ত্বকে ঝলমল করতে থাকা সোনার মালা আর তাদের প্রণয় অভিসাড়ের ঘামে সিক্ত মুক্তার দীপ্তি কোমল স্তনের ভজে উঠানামা করছে তাকিয়ে দেখবে। ভাবনাটার রেশ অনুভব করে বাবরের টাট্ট ঘোড়াটা পাঁজরে তীব্র এতটা গুঁতো খেয়ে।

শীঘ্রই তারা জহাজাকের প্রান্তদেশে অবস্থিত উইলোর বনে এসে পৌঁছে। এবং নৈশপ্রহরীকে ডেকে বলে যে, তারা মুসাফির রাতের মতো আশ্রয় চায়। নৈশপ্রহরী তার হাতে ধরা মশালের কাঁপা কাঁপা আলো তাদের মুখের কাছে ধরে ভালো করে দেখে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবং তাদের যেতে দেয়। তারা ঘোড়া থেকে। নামে এবং নিচু, কাঁচা-ইটের তৈরি বাড়ির মাঝ দিয়ে ঘোড়ার দড়ি ধরে এগিয়ে যায় এবং সরু গলিপথ অতিক্রম করে বাজারে পৌঁছে, যেখানে সওদাগরদের তেলের প্রদীপের মৃদু হলুদ আলোতে কাকর ভর্তি, নিম্নমানের চাল আর মাটির নিচে জন্মান সজির ছাতা পরা একটা স্তূপ আবছা আলোকিত হয়েছে। পুরো মেঝেতে ভেড়া আর ছাগলের লাদি এবং হাড্ডিসার কয়েকটা মুরগীর বিষ্ঠা ফুটকির মত পড়ে রয়েছে। বেশ্যালয়টা বাজারের অন্যপ্রান্তে অবস্থিত। হাঁ, ইয়াদগার এখানেই আছে। ঘুঁটে পোড়ান আগুনে ওম পোহাতে থাকা তার হাত বাবর এখান থেকেই দেখতে পেয়েছে। বাবুরীর বরাবরের পছন্দের মেয়েটাও রয়েছে- হাল্কা পাতলা, বালকসুলভ, বুনো পাহাড়ী একটা মেয়ে। মাথার চুলে লালচে দীপ্তি এবং প্রগলভ মুখাবয়ব।

ইয়াদগার তাদের দেখামাত্র দৌড়ে এসে বাবরের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে দু’হাত বাড়িয়ে গলা জড়িয়ে ধরতে। তার গাট্টাগোট্টা গোড়ালীতে পরা সস্তা নুপূরের ঝঙ্কার উঠে। তার ঠোঁট কাক্ষিত গন্তব্য খুঁজে নিতে ব্যস্ত। সে নিজের পুরো ওজন বাবরের উপরে চাপিয়ে দিয়ে সাথে সাথে তার উত্তেজনা অনুভব করে খিলখিল করে হেসে ওঠে। হাত ধরে সে এবার তাকে গণিকালয়ের ভেতর নিয়ে আসে, যেখানে একটা কাঠের প্রকোষ্ঠের মেঝেতে কোনোমতে একটা গালিচা পাতা রয়েছে, সে ত্রস্ত হাতে নিজের কাপড় খুলে এবং উরুদ্বয় উন্মোচিত করে নিজের উষ্ণ আর্দ্র অভ্যন্তরে তাকে প্রবেশের অনুমতি দেবার আগে হাত আর ঠোঁট দিয়ে দক্ষতার সাথে বাবরকে জাগিয়ে তোলে।

ধুসর গোলাপী বর্ণের সকাল হতে হতে সন্তুষ্ট, আর উজ্জ্বল আর গণিকালয়ে পরিবেশিত শক্তিশালী পানীয়ের কল্যাণে সামান্য মাতাল বাবর এবং বাবুরী শাহরুখিয়ার দৃষ্টিসীমার ভিতরে পৌঁছে যায়। ফিরতি পথে নিজ নিজ রক্ষিতার আর নিজ নিজ মাত্রা এবং উদ্ভাবন কুশলতার বিষয়ে কিছু অকপট মন্তব্য ছাড়া পুরোটা পথ তারা নিরবে এসেছে। দূর্গের ভিতরে পৌঁছে বাবর নিজের মহলে ফিরে যায়, স্বাধীনতা আর বেপরোয়া কাটানো সময়ের শেষ রেশটুকু তাড়িয়ে উপভোগ করার আগেই ভোজবাজির মতো চোখের সামনে এসে দাঁড়ানো পরিচারকের দলকে হাতের ইশারায় চোখের সামনে থেকে বিদায় করে।

নিজের কামরায় প্রবেশ করে দরজা ঠিকমতো বন্ধ করার আগেই সে পরণের কাপড় খুলতে শুরু করেছে। বাম কানে তীক্ষ্ণ একটা টান পড়তে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সে ঘুরে দাঁড়ায়। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে এসান দৌলত। হাত তখনও উঁচিয়ে রেখেছেন, দু’চোখ ধকধক করছে। তার নিজস্ব কামরায় তিনি আগে কখনও এভাবে এসে হাজির হননি। নানীজানের পেছনে তার দুই বয়স্ক পরিচারিকা। বাবর জানে দুটোই পাজির হদ্দ। ভাজা মাছ উল্টাতে জানে না এমন ভঙ্গিতে মাটির দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে রয়েছে।

“তুমি আর তোমার ঐ বাজারু ছোকরার মাগিবাজি যদি শেষ হয়ে থাকে, তবে আমাদের এবার আলাপ করার সময় হয়েছে।” তার নানীজান ধমকে উঠে বলেন। “গতরাতে সমরকন্দ থেকে আগত বার্তাবাহক একটা বার্তা নিয়ে এসেছে। তোমার প্রাণপ্রিয় চাচাতো ভাই মাহমুদের মহাফেজ বার্তাটা পাঠিয়েছে।” তার মুখের সামনে নানীজান একটা কাগজের টুকরো মেলে ধরেন।

“আমার ভাইজানের কি বক্তব্য? চুরি করে নেয়া সালতানাৎ কি তিনি আমাকে উপহার হিসাবে দিতে চান?” বাবর কান ডলতে ডলতে বলে। সে যে নারী সংসর্গে সময় কাটিয়ে এসেছে, সেটা এসান দৌলত জানে দেখে বাবর খুব একটা অবাক হয় না। এই বুড়ির কাছে কিছু গোপন করা অসম্ভব। কিন্তু চাষাভূষোর বেশে, ইয়াদগারের আলিঙ্গন থেকে সদ্য আগত। সম্ভবত এখনও তার গন্ধ গায়ে লেগে রয়েছে, এভাবে তার হাতে ধরা পড়ে সে একটু অস্বস্তিবোধ করে।

“তোমার গুণধর ভাই কিছু বলেনি- এবং আর বলবেও না কখনও। তুমি কেবল জয়ঢাকের আওয়াজ শুনতে পাবে। সাইবানি খান সমরকন্দ দখল করেছে, আর জীবন্ত অবস্থায় মাহমুদের ছাল ছাড়িয়েছে। তার চামড়া দিয়ে হারামজাদা একটা জয়ঢাক তৈরি করে সেটা সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারের শীর্ষে স্থাপন করেছে। যা প্রতিবার শূয়োরটা শহরে প্রবেশ আর বের হবার সময় বাজানোর আদেশ দিয়েছে। তৈমূর বংশের এক শাহজাদার উজবেক অসভ্যের হাতে এমন অপমানিত নাজেহাল হওয়ায় এসান দৌলতের বিচক্ষণ বয়স্ক চোখে ক্রোধের সুনিশ্চিত সংঘাত।

“শোন।” চোখ কুঁচকে তিনি পড়তে আরম্ভ করেন। পঙ্গপালের মতো উজবেকরা আমাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সংখ্যার ভারে তারা শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা তছনচ করে আমাদের বাসিন্দাদের নির্বিচারে কচুকাটা করেছে। বাজারের প্রাঙ্গন আর কুয়োগুলো লাশে বোঝাই হয়ে গেছে, পচছে। আমি আর দরবারের গুটি কয়েক সদস্য এখনও তাদের নজর এড়িয়ে লুকিয়ে আছি কিন্তু আমাদের সামনে সমূহ বিপর্যয়…আমাদের লুকিয়ে থাকার মতো অল্প কয়েকটা স্থানই এখন পর্যন্ত টিকে আছে। মহান আল্লাহতালার অপার করুণা, তার অসীম প্রজ্ঞার বলে যা তিনি অন্যদের দেখানো থেকে বিরত ছিলেন, আমাদের উপরে যেনো বর্ষিত হয়।”

বাবরের মনটা সাথে সাথে ধীর-স্থির হয়ে যায়। সে যখন উত্তেজনায় মনে মনে ছটফট করতে শুরু করেছে এমন সময় বিদ্যুৎ চমকের মতো তার কিছু একটা মনে হয়। “ আমি এখনই আমার দরবার আহ্বান করছি এবং সেখানেই ঠিক করবো। আমাদের কি করণীয়। কিন্তু তার আগে আমাদের আরও তথ্য প্রয়োজন। চিঠির এই সংবাদ অনেক পুরাতন। পশ্চিম দিকে আমি আমার গুপ্তদূত পাঠাবো…”

এসান দৌলত সম্মতি জানান। তাকে দেখে মনে হয় তিনি আর কিছু বলতে আগ্রহী নন। আঙ্গুলের এক তুড়িতে তার দু’পাশে পরিচারিকাদ্বয় এসে দাঁড়ায় এবং তিনি দরজার দিকে হাঁটা ধরেন। বাবর নিজে দরজা খুলে দেয় এবং পেছনে মাথা নত করে অনুসরণরত পরিচারিকাদের নিয়ে মৃদু আলোকিত অলিন্দ দিয়ে দ্রুত জেনানামহলের দিকে হেঁটে যাওয়া তার ঋজু অবয়বের দিকে সে অপলক তাকিয়ে রয়।

সমরকন্দের ঘটনাপ্রবাহে তখনও বিক্ষিপ্ত বাবর দ্রুত হাতমুখ ধুয়ে নেয়। যতো যাই হোক, মাহমুদের এমন নির্মম পরিণতি বাবর কামনা করেনি এবং সাইবানি খানের লোকেরা তৈমূরের অপূর্ব সুন্দর শহরটা কলুষিত করছে, এর লোকদের হত্যা করছে। ভাবতেই তার মন বিষাদ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। সে যদি তার চাচাতো ভাই বা সমরকন্দের দোদুল্ল্যমান বাসিন্দাদের উপরে প্রতিশোধ নিতে চাইতো তারপরেও সে এমন অশ্লীল কষাইয়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারত না…।

পৌনে এক ঘণ্টা পরে, আরো একবার সুলতানের উপযুক্ত পোশাকে সজ্জিত হয়ে বাবর তার পারিষদবর্গের দিকে তাকায়। সকালের এই বৈঠকের জন্য অনেকেই মাত্র ঘুম থেকে উঠে এসেছে। তার আঙ্গুলে তৈমূরের অঙ্গুরীয় শোভা পায়- যা পরিস্থিতির গুরুত্বের মাত্রা নির্দেশ করে। “আপনারা নিশ্চয়ই খবরটা শুনেছেন?”

পারিষদবর্গ মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।

“আমার আশঙ্কা ঘটনাটা সত্যি। কিন্তু আকশি আক্রমণ থেকে আমাদের বিরত রাখতে এটা কোনো ষড়যন্ত্র কি না সেটা জানতে, আমি চাই বাইসানগার আপনি পশ্চিমে সমরকন্দের অভিমুখে গুপ্তদূতের দল পাঠাবেন। দেখতে যে তারা কি জানতে পারে। তাদের অনুসন্ধানের প্রাত্যহিক প্রতিবেদন আমি চাই সবকিছু শান্তি পূর্ণ হলেও। শহরের কাছে তারা যখন পৌঁছাবে- আমি তার একটা বিশদ বিবরণ চাই। উজবেকরা যদি সত্যি সেখানে থাকে তাহলে আমি জানতে চাই সাইবানি খান শহরটা দখলে রাখার পরিকল্পনা করেছে, নাকি এটা কেবলই একটা ঝটিকা হামলা। এখন আপনি যেতে পারেন।”

বাইসানগার যাবার জন্য উঠে দাঁড়ায়।

বাবর এবার তার মুনশির দিকে তাকায়। “আমি একটা চিঠি পাঠাতে চাই।” কাঠের লেখার টুকরোর উপরে লোকটা একটা কাগজ সমান করে বিছায়। তারপরে গলায় চামড়ার ফালি দিয়ে ঝোলানো পাথরের দোয়াতদানে কলম ডোবায়। যেখানে সে প্রতিদিন সকালে ঘন কালো কালির মিশ্রণ প্রস্তুত করে রাখে।

“আমার পরম শ্রদ্ধেয় আব্বাজান।” বাবর বলতে আরম্ভ করে। তারপরে দ্রুত সৌজন্যমূলক সব বিশেষণ আউড়ে যায়- ইবরাহিম সারুর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে খোঁজ খবর নেয়, তার সীমাহীন সমৃদ্ধি কামনা করে, আন্তরিকতাহীন অথচ বলার জন্য অনেক কিছু বলে বাবর আসল প্রসঙ্গে আসে: “আপনার বদান্যতা, আমার মসনদ পুনরুদ্ধারে এবং আপনার মেয়েকে আক্ষরিক অর্থে সালতানাতের সুলতানা হতে সাহায্য করতে আপনি তীরন্দাজবাহিনী দিয়ে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আমি মর্মাহত যে আমার বারংবার তাগিদ সত্ত্বেও সেই প্রতিশ্রুত বাহিনী এসে এখনও পৌঁছেনি। আমার দরবারে কানাঘুষো শুরু হয়েছে যে আপনার কথার বোধহয় কোনো দাম নেই। এমন ভাবনা আমি আমার চিন্তাতেও আনতে চাই না। আপনি যদি আমাকে এখন নিশ্চিত করতে না পারেন যে, তীরন্দাজ বাহিনী শাহরুখিয়ার পথে রওয়ানা হয়েছে, তাহলে আমি ধরতে বাধ্য হবো যে আপনি আসলেই আমাদের মধ্যে হওয়া চুক্তির বরখেলাপ করেছেন।”

সে স্বাক্ষর করে এবং মুনশীকে বলে তার সীলমোহর সংযুক্ত করতে। ইবরাহিম সারুর এটাই শেষ সুযোগ। তার সাথে একটা গ্রাম্য গোত্রপতির এমন ছলনা মেনে নেয়া যায় না।

বাবর আর তার পারিষদবর্গ, চিন্তিত চেহারায় এবং আন্তরিকভাবে আলোচনা করে। কিন্তু তাদের হাতে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় তারা কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে ব্যর্থ হয়। তারা সবাই কেবল প্রশ্ন উত্থাপন করে, যার উত্তর তাদের কারো জানা নেই। বাবর হতাশ হয়ে একটা পর্যায়ে দরবার ভেঙে দেয়, কেবল ওয়াজির খানকে থাকতে বলে।

“সুলতান?”

“সাইবানি খান যদি সমরকন্দ দখল করেই থাকে, তাহলে আমি ভাবছি তার জায়গায় আমি থাকলে তারপরে আমি কি করতাম। আর আমি কেবল একটাই উত্তর পাচ্ছি। আমি আমার সৈন্যদের পূর্বে পাঠাতাম এখানে আমাদের পরাস্ত করতে। তারপরে আকশি গিয়ে তামবাল আর জাহাঙ্গীরকে পরাজিত করতাম। সাইবানি খান তৈমূরের বংশ নির্বংশ করার শপথ নিয়েছে। ফারগানার শেষ দুই বংশধরকে নিমূর্ল করার এই সুযোগ ঘটে বুদ্ধি থাকলে সে হাতছাড়া করবে না।”

ওয়াজির খান আশ্বস্ত করার মতো কোনো কথা খুঁজে পান না। তারা দুজনেই চুপচাপ বসে থাকে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ ভাবনার রাজ্যে হারিয়ে গেছে।

নতুন সংবাদের জন্য অবশ্য তাদের বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। শাহরুখিয়ার পশ্চিম থেকে প্রলয়ংকরী বিপর্যয়ের খবর সূর্যাস্তের আগেই এসে পৌঁছে। সওদাগরদের একটা ক্ষিপ্ত কাফেলা যারা সমরকন্দ ছাড়িয়ে এসে পাহাড়ে ছাউনি ফেলেছিল তারা শহর রক্ষাকারী দেয়ালের বাইরে ঘোড়সওয়ার বাহিনীর মাঝে খণ্ডযুদ্ধের খবর দেয়। তারা যুদ্ধের ফলাফল দেখার জন্য অপেক্ষা করেনি। নিজেদের মালবাহী পশুর পাল নিয়ে কোনমতে পূর্বদিকে পালিয়ে এসেছে। অন্য মুসাফিররা চলার পথে শোনা গল্প এসে বলে যে উত্তর থেকে সাইবানি খান আর তার দস্যু বাহিনী এসে সমরকন্দের উপর হামলে পড়েছে।

বাবর সে রাতে ঘুমাতে পারে না, উষ্ণ, গুমোট বাতাস ভারী আর দম আটকানো তার অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে তোলে। গতকালই সে হয়তো বাবুরীকে ডেকে পাঠাতো মজার সব গল্প বলে তাকে উৎফুল্ল রাখতে বা ইয়াদগারের কাছে যাবার সময় তাকে সঙ্গ দিতে। কিন্তু এখন সব কিছু বদলে গেছে। সে একাকী জানালায় বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার আঙ্গুলের ভারী আংটিটা চকচক করে। তৈমূর তার স্থানে থাকলে কি করতো? তিনি কি নিয়তির উপরে নির্ভর করে চুপচাপ বসে থাকতেন, কি হয় সেটা দেখার জন্য? না। তিনি পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে আনতে কোনো একটা উপায় ঠিকই বের করতেন।

একটার পরে একটা নিভে আসা মোমবাতির আলোয় বাবর গালে হাত দিয়ে বসে থাকে এবং একটা সময়ে সে অন্ধকারে ডুবে যায়। বারবার সে সব কিছু নিজের মনে বিবেচনা করে। পূর্বের আকাশে সোনালী আভা দেখা দিতে তার হতাশ মনের কোণে আশার ঝিলিক উঁকি দিতে আরম্ভ করে। সহসা নিজের কর্তব্যকর্ম সম্পর্কে সে নিশ্চিত হয়ে যায়। একটা ঝুঁকির কথা সে বিবেচনা করছে এবং ব্যর্থ হলে ঘুরে দাঁড়ানো তার জন্য মুশকিল হবে। কিন্তু এটাই তার একমাত্র সুযোগ…

ভোরের আলো ঠিকমতো ফোঁটার সাথে সাথে সে তার সব পারিষদকে ডেকে পাঠায়। “সাইবানি খান তৈমূরের বংশের সবার জন্য একটা জলজ্যান্ত হুমকী। সে যদি আমাকে পরাস্ত করতে পারে, তাহলে তার পরবর্তী লক্ষ্য হবে আমার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীর। সেটা তখন কেবল সময়ে ব্যাপার। সে তৈমূরের পুরো এলাকা দখল করতে চায় এবং সে ঠিক তাই করবে- যদি না আমরা আমাদের মধ্যকার বিরোধ আপাতত ভুলে না যাই। তামবাল আর জাহাঙ্গীরের সাথে আমি ঠিক এ কারণেই মিত্ৰতা করতে আগ্রহী। এই উজবেক বলদটাকে সমরকন্দ থেকে বিতাড়িত করতে সদি তারা আর তাদের অনুগত গোত্র আমাকে সহায়তা করে, তাহলে আমি কথা দিচ্ছি ফারগানার উপর থেকে আমি আমার দাবি প্রত্যাহার করে নেবো…”

ওয়াজির খানের আঁতকে উঠে শ্বাস নেবার শব্দ শুনে বাবর আন্দাজ করে বুড়ো লোকটাকে সে কতোখানি চমকে দিয়েছে। কিন্তু, সুলতান-”।

“আমাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। কাশিম, তুমি আমার বিশেষ দূত হিসাবে দায়িত্ব পালন করবে।”

বাবর কঠোর দৃষ্টিতে তার পারিষদবৃন্দের দিকে তাকায়, সহসা নিজের মাঝে সে নতুন দৃঢ়তা অনুভব করছে। “আকশি থেকে কোনো সংবাদ না আসা পর্যন্ত এ বিষয়ে আপনারা কারো সাথে কোনো ধরণের আলোচনা করবেন না। এটা আমার আদেশ।”

বাবর উঠে দাঁড়াবার ফাঁকে ওয়াজির খানের দিকে তাকিয়ে দেখে তাকে কেমন বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। আগের দিন হলে সে তার পরিকল্পনা নিয়ে বৃদ্ধ শার্দুলের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করতে চেষ্টা করতো, তাকে রাজি করাতে। কিন্তু এখন কেউ তাকে সাহায্য করতে পারবে না। তার নিয়তি এটা, নিজেরই বেছে নেয়া। তার সাহসিকতায় যদি কাজ হয়, তবে শীঘ্রই সে আবার সমৃদ্ধ সমরকন্দের মসনদে অধিষ্ঠিত হবে। একে নিজের ন্যায়সঙ্গত সম্পত্তি হিসাবে সে সবসময়ে ভেবে এসেছে বা এটা হারাবার শোক তার কখনও কমেনি। তার মরহুম আব্বাজান এই শহরটার জন্য নিজের মনে গুমরে কষ্ট পেয়েছেন এবং যার কাছে পার্বত্যময় ক্ষুদ্র ফারগানা আর তার অবাধ্য সর্দার আর ভ্যা ভ্যা করা ছাগলের পাল সবসময়েই দ্বিতীয় পছন্দ। তার স্বর্গীয় পিতার ব্যর্থতাকে যদি সে সাফল্যে পর্যবসিত করতে চায়, তাহলে আবেগের বদলে উচ্চাকাঙ্ক্ষা হবে তার মূল চালিকাশক্তি।

***

পরবর্তী দিনগুলোতে শাহরুখিয়ার চারপাশে প্রথমে একজন দু’জন করে শরণার্থী এসে হাজির হতে শুরু করে। একটা পর্যায়ে গিয়ে সেটা আশেপাশের বসতিতে বাধভাঙা ঢলের মত হাজির হতে শুরু করে। বাবর তার লোকদের পাঠায় তাদের জেরা করতে এবং জানা যায় বেশিরভাগ লোকই সমরকন্দের আশেপাশের গ্রামাঞ্চল থেকে এসেছে। মূল শহর থেকে আগত লোকজনের সংখ্যা আশঙ্কাজনক রকমের অল্প এবং তাদের ভিতরে সাহায্য চেয়ে আকুল হয়ে খবর পাঠানো মাহমুদের মহাফেজকে খুঁজে পাওয়া যায় না। মাহমুদের স্ত্রী, গ্রান্ড উজিরের কন্যারও কোনো খবর নেই…

দূর্গের প্রকারবেষ্টিত সমতল ছাদ থেকে বাবর ভ্রমণ ক্লান্ত লোকদের বিষণ্ণ শোভাযাত্রার দিকে তাকিয়ে থাকে। হাতের কাছে যা কিছু পেয়েছে তাই নিয়ে কোনোমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে- বৃদ্ধ আর নাকে শ্লেষ্ম জমা বাচ্চারা গাড়িতে, যার কোনোটাকে দেড়শ মাইল পথ হাতে টেনে আনা হয়েছে। দিশেহারা মায়েদের শুকনো স্তনবৃন্তে নবজাতকের দল মুখ দিয়ে বৃথাই দুধের সন্ধান করে। ক্ষুধার্ত এসব মুখ- কোনো সাহায্য করবে না বরং তারা একটা বোঝ। বাবর তার সব দূর্গের শস্যভাণ্ডার খুলে দিতে বলে। কিন্তু সেসবও বেশি দিন চলবে না।

বাবর আশা করেছিলো সমরকন্দের কিছু যোদ্ধা অন্তত উজবেকদের নাগাল এড়িয়ে পূর্ব দিকে পালিয়ে আসবে। কিন্তু বাইসানগারের প্রেরিত গুপ্তদূতের পাঠানো খবর সে আশায় পানি ঢেলে দেয়। বিজয়ের পথ উজবেকরা কুপিয়ে কেটে পরিষ্কার করায় একটা বিষয় স্পষ্ট যে, সেখানে একটা গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। সমরকন্দের আশেপাশের সমভূমিতে তার সৈন্যদের ফুলেফেঁপে উঠা বীভৎস লাশে ভরে গিয়েছে। সামান্য কয়েকজনই পালিয়ে বেঁচেছে। বাবরের সাহায্যে কেবল অশরীরি সৈন্যদের আত্মাই এখন এগিয়ে আসতে পারে।

জাহাঙ্গীর আর তামবালের উপরে এখন সবকিছু নির্ভর করছে। সন্ধির নিশান উড়িয়ে তার কি নিজেরই প্রস্তাব নিয়ে যাওয়া উচিত ছিলো? সে ভাবে। কাশিম কি জাহাঙ্গীর আর তামবালকে বোঝাতে পারবে যে তাদের মঙ্গল কেবল- সম্ভবত অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ক্ষীণ সম্ভাবনা তার প্রস্তাবিত শান্তি চুক্তি গ্রহণের মধ্যে নিহিত রয়েছে। এবং সাইবানি খানের বিরুদ্ধে জোট গঠন। নাকি তারা তার উদ্দেশ্যের ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে সাইবানি খানের হুমকি উপেক্ষা করবে।

কাশিমের ফিরে আসবার খবর বাবর যখন পায় তখন সে তার আম্মিজান আর নানীজানের সাথে ছিলো। কোনো ধরণের ব্যাখ্যার ভিতরে না গিয়ে এবং এসান দৌলতের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়িয়ে সে নিজের কামরার দিকে এগিয়ে যায়, যেখানে সে কাশিমকে নিয়ে আসবার আদেশ দিয়েছে। কাশিমের চিরাচরিত শান্ত সমাহিত ভাব ভঙ্গি দেখে তার বয়ে নিয়ে আসা বার্তা সম্পর্কে সামান্যতম উত্তেজনা বা বিক্ষোভের আঁচ পাওয়া যায় না।

“বেশ?” বাবর তাকে আঁকড়ে ধরার ইচ্ছা প্রাণপণে দমন করে কোনোমতে কেবল বলে।

“সুলতান আমি আপনার প্রস্তাবের উত্তর নিয়ে এসেছি। তারা আপনার শর্ত মেনে নিয়েছে।” এতক্ষণ পরে কাশিমের মুখে একটা মৃদু হাসির আভাস দেখা যায়। “সুলতান, এই দেখুন।” একটা কৃষ্ণ-লাল বর্ণের উটের চামড়ার থলির ভিতর থেকে, যার মুখটা হাতির দাঁতের বন্ধনী দিয়ে বন্ধ, সে একটা চিঠি বের করে।

সেটার দিকে তাকিয়ে বাবরের হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠে। হ্যাঁ! সৌজন্যমূলক সম্ভাষণের ফালতু অংশ বাদ দিয়ে সে যা খুঁজছিলো সেটা দেখতে পায়। লেখাগুলো সে নিজে বারবার পরে, শব্দগুলোর মর্মার্থ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে। “ভাইজান আপনি যা প্রস্তাব দিয়েছেন উজবেক হুমকির হাত থেকে বাঁচবার সেটাই একমাত্র পথ। এই চিঠিটা আপনি যখন পাবেন ততোক্ষণে আমার সেনাবাহিনী জানবেন শাহরুখিয়ার পথে রওয়ানা হয়ে গেছে। আমি আমার সামর্থ অনুযায়ী চার হাজার অশ্বারোহী আর একহাজার তীরন্দাজের একটা বাহিনী পাঠালাম।” চিঠিটা ফারগানার রাজকীয় সীলমোহরের উপরে জাহাঙ্গীরের দস্তখত সম্বলিত।

ঘন মোমের উপর আঙ্গুল বোলাবার সময়ে বাবর একটা যন্ত্রণার খোঁচা অনুভব করে- রাজকীয় সীলমোহর ব্যবহারের অধিকার কেবল তারই রয়েছে: জন্মসূত্রে আর রক্তের অধিকার বলে সেই ফারগানার সুলতান। কিন্তু সে তার পছন্দ বেছে নিয়েছে। এবং তাকে অবশ্যই সেটা মান্য করতে হবে। জাহাঙ্গীর আর তার নিয়ন্ত্রক তামবাল তাদের কথা রাখবে বলে তাকে বিশ্বাস করতেই হবে। এখন যদি তারা তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাহলে বিপর্যয়ের হাত থেকে কেউ তাদের বাঁচাতে পারবে না।

২.৪ এক সনাতন পুরঞ্জয়

১০. এক সনাতন পুরঞ্জয়

বাবর তার পেছনে সারিবদ্ধভাবে বিন্যস্ত ঘোড়সওয়ার বাহিনীর দিকে ঘুরে তাকায়। তাদের বহন করা উজ্জ্বল হলুদ বর্ণের সগর্বে ঘোষণা করছে তারা সবাই ফারগানা থেকে আগত যোদ্ধা। আভ্যন্তরীণ গোত্র সংঘাত আর শাহী বিবাদ ভুলে তারা সনাতন এক পুরঞ্জয়ের বিপক্ষে যুদ্ধে নেমেছে। তিন ঘণ্টা আগে, দূর্গের জেনানামহলে নিজেদের কামরায় এসান দৌলত আর খুতলুঘ নিগার তাকে তাদের আশীর্বাদ জানিয়েছেন আর আম্মিজান বাবরের বাবার তরবারি আলমগীরের ঈগল আকৃতির বাঁটে চুমো খেয়েছেন ধাতব- নকশা করা বেল্টে যেটা ঝুলছে। সে অবাক হয়েছে এটা দেখে যে দু’জনেই আসলে সেয়ানা পাগল। তার সৎ-ভাইয়ের সাথে আপোষরফায় তারা কোনো আপত্তিই জানাননি- এসান দৌলত আবার এক কাঠি সরেস, তিনি বাস্তবিক অর্থে তার দূরদর্শিতা আর সাহসের প্রশংসাই করেছেন। খানজাদাই কেবল তার আবাল্যের পরিচিত জন্মভূমি আকশি হয়তো আর কখনও দেখতে পাবে না সেই আশঙ্কায় আপাতভাবে খানিকটা বিচলিত।

গতরাতে সে আয়শার কাছে শেষবারের মতো সংক্ষিপ্ত সময় কাটাতে গিয়েছিলো। সে যদি আর ফিরে না আসে, তাহলে তার গর্ভে অন্তত সে একজন উত্তরাধিকারী রেখে যেতে চায়, নিরানন্দ কিন্তু প্রচণ্ড বেগে, তার অনুভূতি শূন্য ঈষৎ ফিরিয়ে নেয়া চোখের দিকে না তাকিয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে, উপগত হবার ফাঁকে ভেবেছিলো। বাবর শীর্ষ অনুভূতির তুঙ্গে পৌঁছাবার সাথে সাথে- আয়েশা বরাবর যা করে থাকে আজও তাই করেছিলো তার কাছ থেকে গড়িয়ে সরে গিয়ে নিজের নগ্ন দেহ চাদর দিয়ে ঢেকেছে। দ্রুত পোশাক পরার অবসরে সে একবারও তার দিকে তাকায়নি এবং কোনো ধরণের বিদায় সম্ভাষণ বা অন্য কোনো কিছু না বলে সে আয়েশার কক্ষ থেকে বের হয়ে এসেছে। আবেগঘটিত আগন্তুক ছাড়া তারা একে অপরের কাছে কখনও অন্য কিছু ছিলো না।

একটাই বাঁচোয়া, আয়েশার বাবার অন্তত সুমতি হয়েছে। লম্বা সামরিক সারির একেবারে শেষ মাথায়, ফারগানার হলুদ নিশানের শেষে, কালো আর লাল পোশাক পরিহিত অশ্বারোহী মাঙ্গলিঘ তীরন্দাজ বাহিনীর একটা দলকে দেখা যায়। সাইবানি খানের বিরুদ্ধে বাবর আর জাহাঙ্গীরের মাঝে সন্ধির বিষয়টা আঁচ করতে পারার সাথে সাথে ইবরাহিম সারু তাদের শাহরুখিয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছেন।

ওয়াজির খান আর বাইসানগার তার দু’পাশে রয়েছে এবং তার অশ্বারোহী বাহিনীর মাঝে কোথাও অবস্থান করছে বাবুরী। সমরকন্দ পতনের সংবাদ পাবার পর থেকে বন্ধুর সাথে তার একটা কি দুটো কথা হয়েছে এবং তার চপল সঙ্গের অভাব সে বোধ করেছে। কিন্তু বন্ধুত্ব- সাহচর্য- এসব বোধহয় রাজাদের জন্য নয়। বাবর ভাবে, আরও বড় কিছুর প্রতি তাদের সর্বদা দৃষ্টি সজাগ রাখতে হয়।

গ্রীষ্মের দাবদাহে শুকিয়ে শক্ত হয়ে যাওয়া সমভূমির উপর দিয়ে তারা ঘোড়াগুলি দুলকিচালে দাবড়ে যায়। তাদের সঙ্গে জিনিসপত্রও খুব অল্প রয়েছে। বাবর সিদ্ধান্ত নিয়েছে গন্ধমাদন অবরোধ অনুষঙ্গগুলোর এবার তাদের প্রয়োজন হবে না। দ্রুত অপ্রত্যাশিত আক্রমণের উপরেই সে তার বাজি রেখেছে। আজ পর্যন্ত তৈমূরের কোনো না কোনো বংশধর সমরকন্দের শাসক ছিলো। সমরকন্দের অধিবাসীদের যারা বেঁচে গিয়েছে- সাইবানি খানের মতো অনাহুত, নিষ্ঠুর লুণ্ঠকের হাত থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া হয়ে উঠা উচিত। তার বাহিনীকে অগ্রসর হতে দেখলে, নিপীড়কের বিরুদ্ধে তারাও রুখে দাঁড়াবে বলেই তার ধারণা।

সবকিছুর পরে, শেষ কথা হলো সাইবানি খানের নিজস্ব পরিকল্পনা। শরৎকাল প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। সে কি সমরকন্দেই শীতকাল কাটাবার ফন্দি এঁটেছে? বাবর তার বাদামী রঙের আজদাহাটার ছন্দোবদ্ধ খুরের শব্দে এগিয়ে যেতে যেতে, ভ্র কুচকে তার শত্রুর মনে ভেতরে প্রবেশ করতে চেষ্টা করে। সে আসলে কি চায়? সমরকন্দ লুণ্ঠন আর ধর্ষণের অপমানে ডুবিয়ে দিয়ে তারপরে সে কি তার লুণ্ঠনকারী নেকড়ের দল নিয়ে কি উত্তরের তৃণভূমিতে ফিরে যাবে লুট করা মালামাল উপভোগের অভিপ্রায়ে? নাকি তার অন্য কোনো মহাপরিকল্পনা রয়েছে? সমরকন্দে তার আক্রমণ কি কেবলই একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নাকি তার নিজের একটা রাজবংশ আর সাম্রাজ্য স্থাপনের অভিপ্রায় রয়েছে?

বাবর তার বাল্যকালে যে সব গল্প শুনেছিলো, তা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে সমরকন্দের প্রতি সাইবানি খানের একটা আক্রোশ রয়েছে। তার মরহুম আব্বাজানের বলা গল্পগুলো সে মনে করে। কিভাবে এক উজবেক বসতিতে সমরকন্দের শাহী বাহিনীর এক হামলার সময় সাইবানি খান তাদের হাতে ধরা পড়েছিলো, তার তখন নিতান্তই অল্প বয়স। তার বাবা আর ভাইয়েরা সেই হামলার। সময়ে মারা যায়। কিন্তু কেবল দশ বছর বয়স হবার কারণে তার গলায় একটা চামড়ার দড়ি বেঁধে সেটা উটের লেজের সাথে আটকে ক্রীতদাস হিসাবে তাকে সমরকন্দের দাসবাজারে নিয়ে আসা হয়। উপস্থিত বুদ্ধি আর ভীষণ চালাক হবার কারণে সে কামারশালার কঠিন পরিবেশে মানিয়ে নেয়। সেখানেই ক্রীতদাসের প্রতীক তার বাম গালে পুড়িয়ে এঁকে দেয়া হয় এবং সে কোক সরাইয়ের এক অমাত্যের চোখে পড়ে।

অভিজাত সেই ভদ্রলোক তার উপযুক্ত শিক্ষার বন্দোবস্ত করেন এবং মুনশি হিসাবে তাকে একটা ভালো পরিচয় দান করেন। কিন্তু একই সাথে তাকে বাধ্য করেন তার শয্যাসঙ্গী হতে। এক রাতে সাইবানি খান তার প্রভুর গলা দু’ফাঁক করে দেয়। নিহত প্রভুর রক্তে আঙ্গুল ডুবিয়ে মুনশি হিসাবে সে তার শেষ বাণীটা লিখে দেয়ালে লেখা সেই বাণী শহরটার উপরে যেনো একটা অভিশাপ বয়ে নিয়ে আসে। সে পুনরায় তার নিজের লোকদের মাঝে ফিরে যায়। নিজের গোত্রের সাথে পুনরায় মিলিত হয়ে সে ধীরে ধীরে নিজেকে উজবেকদের অবিসংবাদিত অধিরাজে পরিণত করে এবং তখন থেকে তৈমূরের বংশধরদের প্রতি একটা আক্রোশ সে লালন করে আসছে। সে এখন আনুমানিক পঁয়ত্রিশটা গ্রীষ্মকাল দেখেছে এমন একজন পূর্ণবিকশিত পুরুষ। একজন দুর্ধর্ষ শত্ৰু, যে সামনে ধ্বংসের অশুভ ছায়া বিস্তার করে পেছনে কেবল মৃত্যুর বরাভয় রেখে যায়। এমন একজনকে পরাস্ত করাটা মোটেই সহজ কাজ না…

এক্ষেত্রে শক্তির চেয়ে কৌশলের আশ্রয় নেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আনুমানিক চারদিনের ভিতরে, যদি তারা তাদের বর্তমান এই গতিবেগ বজায় রাখতে পারে তবেই, তারা সমরকন্দে হামলা চালাবার মতো দূরত্বে পৌঁছে যাবে। কিন্তু সাইবানি খানকে তার অভিপ্রায়ের ব্যাপারে একটা ধন্দে রাখাটাই বোধহয় ভালো হবে- বা, তারচেয়েও ভালো হয় যদি তাকে ভুল পথে পরিচালিত করা যায়। সে যদি গাড়লটাকে বোঝাতে পারে যে, সে ফারগানা থেকে পালাতে চাইছে সমরকন্দকে পাশ কাটিয়ে তার অভিপ্রায় পশ্চিমে গমন করা- সে হয়তো তাহলে তার শত্রুকে শহর থেকে বের করে আনতে পারবে।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা, বাবর, ওয়াজির খান, আর বাইসানগারের সাথে অস্থায়ী শিবিরে একটা অগ্নিকুণ্ডের পাশে বসে, স্থির দৃষ্টিতে আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে এখনও নিজের মাঝে উদ্দীপনার অভাব বোধ করছে। তারা যেখানে শিবির স্থাপন করেছে সে জায়গাটা কেমন বালুময়। সহসা সে উঠে দাঁড়ায়, এবং মাটি থেকে একটা কাঠি তুলে নিয়ে সমরকন্দের একটা মানচিত্র অঙ্কন করে- পাঁচ মাইল বিস্তৃত দেয়ালের একটা ব্যুহ যা ছয়টা তোরণদ্বার দ্বারা সম্পূর্ণ, আশেপাশে তৃণভূমি, ফলের বাগার আর উদ্যান, উত্তর আর পূর্বদিকে নহর আর নদীর আবছা ধারা বহমান। “আমরা যদি আব-ই-সিয়া নদীর অপর পারে, সমরকন্দের উত্তর ধারের দেয়ালের সমান্তরালে, আমাদের সেনাদলের একটা অংশ পাঠাই তাহলে কি হবে… লোহার দরোজা আর শেখজাদা তোরণদ্বারের পাহারায় নিয়োজিত প্রহরীর দল তাদের দেখতে পাবে বটে কিন্তু উজবেকরা তাদের শক্তিমত্তা যাচাই করানো পক্ষে অনেক দূরেই থাকবে। আমরা হয়তো তাদের বিশ্বাস করতে বাধ্য করতে পারি যে, ওটাই আমাদের পুরো সেনাবাহিনী…”

“এবং, তারপরে কি হবে, সুলতান?” বাইসানগার জানতে চায়।

“ভাগ্য যদি আমাদের সহায় থাকে, উজবেকরা তাহলে ধাওয়া করবে এবং আমরা তখন আমাদের কাঙ্ক্ষিত সুযোগটা পাবো। কান-ই-গিল তৃণভূমির লাগোয়া ঝোপঝাড় আর করকটে গাছের বনে আমাদের বাকি সৈন্যদের লুকিয়ে রাখি লোহার দরোজার পূর্ব দিকে। আমরা তাহলে দেখতে পাবো যে ঠিক কি ঘটছে। আল্লাহতালা যদি আমাদের সহায় থাকেন এবং উজবেকরা সত্যিই বিভ্রান্ত হয় সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারের কাছে শহরের পূর্ব দিকের দেয়ালে আমরা হামলা করবো।”

বালির উপরে আঁকা মানচিত্রটার দিকে চিন্তিত মুখে ওয়াজির খান তাকিয়ে থাকেন, যার উপর দিয়ে লম্বা-দেহের পিপড়ার একটা সারি, যোদ্ধার মতো নিষ্ঠায় এগিয়ে চলেছে। কেউ কেউ তাদের বাসার জন্য পাতার টুকরো বয়ে নিয়ে চলেছে। “উজবেকদের শহর থেকে টেনে বের করে আনতে আমরা যাদের পাঠাবো তাদের অবশ্যই আমাদের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আর দ্রুতগামী অশ্বারোহী দলের সদস্য হতে হবে। ধাওয়াকারীদের যেনো তারা সহজেই পেছনে ফেলতে সক্ষম হয়। বৃত্তাকারে ঘুরে এসে মূল বাহিনীর সাথে যোগ দিয়ে শহর আক্রমণে অংশ নিতে পারে।”

“হ্যাঁ।” বাইসানগার জোরে জোরে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। “দক্ষিণে আর পূর্ব দিকে তাদের এভাবে অগ্রসর হতে হবে…” বাবরের ফেলে দেয়া কাঠিটা সে তার বাম হাত দিয়ে তুলে নেয় এবং বালির উপর তীরচিহ্ন আঁকতে আরম্ভ করে। চাহাররাহা তোরণদ্বার অতিক্রম করে দক্ষিণের দেয়াল ঘুরে এসে সুইপ্রস্তুতকারকদের তোরণদ্বার অতিক্রম করে সেটা সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারের কাছে এসে শেষ হয়। আর পুরো পরিকল্পনাটা বালির বুকে আঁকতে গিয়ে সে কতিপয় পিঁপড়ের ভবলীলা সাঙ্গ করে ফেলে। কিন্তু তাদের বাকী বেঁচে থাকা সহযোদ্ধার দল কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গি করে পুনরায় সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে তাদের এগিয়ে যাবার গতি অব্যাহত রাখে।

“সুলতান, পুরো পরিকল্পনাটা কিন্তু সাংঘাতিক বিপজ্জনক।” বাইসানগারকে উদ্বিগ্ন দেখায়। আমরা জানি না ঠিক কত উজবেক শহরে অবস্থান করছে বা এর রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে। আমরা যদি তাদের একটা অংশকে বাইরে টেনে বের করে আনতে পারিও, ভেতরে প্রতিরক্ষার দায়িত্বে থেকে যাওয়া বাহিনীর সংখ্যা। তখনও হয়তো আমাদের জন্য অনেক বেশি বলে প্রতিয়মান হতে পারে। আমাদের প্রথমে বোধহয় গুপ্তচরদের সাহায্য নেয়া উচিত।”

“আমি যেমন এক সময়ে গুপ্তচর ছিলাম?” নর্দমায় বাস করা ইঁদুরের মতো কিভাবে সে গুঁড়ি দিয়ে শহরে প্রবেশ করেছিলো, বাবর সে কথা ভাবে। “না, আমাদের হাতে এতো সময় নেই। আমরা যদি উজবেকদের ফাঁদে ফেলতে চাই তাহলে সেটা অবশ্যই দ্রুত করতে হবে আর ঝুঁকিও নিতে হবে।”

বাবর নিশ্চিত তার কোনো ভুল হয়নি কিন্তু তার পরিকল্পনা যদি ব্যর্থ হয় তাহলে বিপর্যয়ের মাত্রা কতটা ভীষণ হতে পারে? সে মাত্রা নিয়ে ভাববার কোনো চেষ্টাই করে না। ফারগানায় একটা কথা প্রচলিত আছে: “সুযোগ নেবার সাহস যার নেই, বুড়ো বয়স পর্যন্ত সে এর জন্য আফসোস করবে।”

বুড়ো বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকার চেয়ে আফসোস করে জীবননাশ করাও শ্রেয়।

***

তিনদিন পরের কথা- বাবর যেমন আশা করেছিলো তার চেয়েও দ্রুতগতিতে তারা দেড়শ মাইল পথ অতিক্রম করে সামনের দু’সারি পাহাড়ের পেছনেই, যা এই মুহূর্তে গ্রীষ্মের দাবদাহে খয়েরী বর্ণ ধারণ করেছে, রয়েছে সমরকন্দ যা কয়েক সপ্তাহ পরেই পাহাড়গুলো আবার তুষারপাতে রূপালি বর্ণ ধারণ করতে আরম্ভ করবে। গত তিন ঘণ্টা যাবৎ বাবরের প্রত্যক্ষ আদেশে, তার লোকেরা প্রায় নিঃশব্দে ধৌরিতক চালে ঘোড়া হাঁকিয়েছে। সামনে কেউ ওঁত পেতে আছে কিনা জানতে গুপ্তদূতের দল নিয়মিত বিরতিতে ফিরে এসে জানিয়েছে যে তারা কিছুই দেখেনি, শোনেনি যা তাদের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে পারে।

বাবর, তারপরেও কোনো সুযোগ নিতে চায় না। উজবেকরা পোড়খাওয়া সব যোদ্ধা। তাজা মাংসের জন্য বেপরোয়া শেয়ালের ধূর্ততা তাদের সহজাত। আর তারা সেভাবেই হত্যা করে থাকে। মুরগির খোঁয়াড়ে প্রবেশ করা শেয়ালের মতো নির্বিচারে তারা প্রতিটা মুরগিকে হত্যা করে। কিন্তু চোয়ালে করে কেবল একটাই চুরি করে নিয়ে যায়।

অন্ধকার রক্তাভ হতে দৃশ্যপট অস্পষ্টভাবে আকার নিতে শুরু করলে, যোদ্ধাদের একটা নিঃশব্দ সারি অবশেষে কোলবা পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। সমরকন্দের আগে শেষ উঁচু পাহাড়ের সারি। পাঁচ বছর আগে বাবর যেখান থেকে প্রথমবারের মতো শহরটা দেখেছিলো। এইবার অবশ্য চূড়োর দিকে না উঠে সে দলটাকে দাঁড়াতে বলে। ওয়াজির খান, বাইসানগার আর অন্যান্য সর্দারদের ডেকে এনে তার শেষ আদেশ দেয়। “কোলবা পাহাড়কে আড়াল হিসাবে ব্যবহার করে। আমরা পশ্চিমে যাবে এবং কোলবা তৃণভূমির লাগোয়া গাছের সারির নিচে ছাউনি স্থাপন করবো। সেখানেই আক্রমণের চুড়ান্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হবে। আমাদের অবস্থান জানাজানি হতে পারে। সেজন্য কোনো আগুন জ্বালান হবে না। আগামীকাল সূর্য উঠবার ঠিক আগে, বাইসানগার তুমি আমাদের হয়ে ফাঁদ পাতা শুরু করবে। আমাদের তিনশ শ্রেষ্ঠ ঘোড়সওয়ার তোমার সাথে থাকবে। আব-ই-সিয়ার তীর ধরে নিচে নেমে তারপরে পশ্চিমে রওয়ানা দেবে। শহরের দেয়ালে নিয়োজিত প্রহরীরা যেনো তোমাদের দেখতে পায় সেটা অবশ্যই নিশ্চিত করবে। সকালের কুয়াশায় তোমাদের প্রকৃত সংখ্যা প্রহরীর দল বুঝতে পারবে না। কোনো ধরণের ঝুঁকি নেবে না। শেখজাদা তোরণদ্বার অতিক্রম না করা পর্যন্ত নদী অতিক্রম করতে যেও না। আমাদের সাথে তোমাদের পুনরায় মিলিত হবার উপরে আমি অনেকাংশে নির্ভর করছি এবং আমরা দুটো দলে বিভক্ত হবার পরে সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারের কাছে শহরের প্রতিরক্ষা দেয়াল আক্রমণ করার সময়ে আমাদের সাথে আবার যোগ দিতে তোমাদের যেনো চার ঘণ্টার বেশি দেরি না হয়।”

“ওয়াজির খান, উজবেকরা টোপ গিলেছে এবং বাইসানগারকে ধাওয়া করতে শুরু করেছে এটা দেখামাত্র আমরা পূর্ব দিক থেকে শহরের দেয়াল আক্রমণ করবো। আমরা শহরে প্রবেশ করার পরে, আমি আদেশ দিচ্ছি উজবেক দেখামাত্র খুন করবে- তাদের কোনো ধরণের দয়া দেখাবে না। কারণ তারা আমাদের লোকদের। প্রতিও কোনো ধরণের করুণা দেখায়নি কিন্তু সমরকন্দের অধিবাসী আর তাদের সম্পত্তির হেফাজত করবে। তারা আমার প্রজা।”

“হ্যাঁ, সুলতান।” তার সেনাপতিরা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। সবাই আপন আপন ভাবনায় বিভোর। সম্ভবত ভাবছে আগামীকালের সূর্যোদয় দেখবার জন্য কি সে। বেঁচে থাকবে। যুদ্ধক্ষেত্রে সাইবানি খান কখনও পরাজিত হয়নি। কিন্তু অস্ত্রের ধারের সাথে এবার বুদ্ধির ক্ষিপ্রতাও বিবেচ্য শক্তি এবং ভাবনাটা বাবরকে নতুন সাহসে বলীয়ান করে তোলে।

***

বাইসানগার আর তার লোকেরা আধঘণ্টা আগে রওয়ানা দিয়েছে। একটা পোক্ত আপেল গাছের গুঁড়িতে, যার শাখাপ্রশাখা আপেলে ভর্তি। পাকা আপেলের গন্ধ বাবরকে খানিকক্ষণের জন্য হলেও ইয়াদগারের কথা মনে করিয়ে দেয়। সে পিঠ ঠেকিয়ে বসে। সকালের কুয়াশায় গাছপালা, ঝোপঝাড় সবকিছু অস্পষ্ট দেখায়। দেয়াল বেয়ে উঠার জন্য মই তৈরি করা শেষ এবং তিনজন লোক পাশাপাশি উঠতে পারে এমন চওড়া করে সেগুলো বানানো হয়েছে। দুটো ঘোড়ার মাঝে ঝুলিয়ে মইগুলো আক্রমণ স্থলে নিয়ে যাওয়া হবে। ওয়াজির খান নিরবে নামাজ আদায় করেন। সেজদার সময়ে তার কপাল ভক্তি ভরে মাটি স্পর্শ করে।

বাবর ভাবে, তারও কি নামাজ পরা উচিত। নামাজ না পড়ে সে কয়েক মুহূর্ত নিরবে বসে চিন্তা করে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই যুদ্ধের চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করে। তার গুপ্তদূতেরা এসে খবর দিয়েছে শহর রক্ষাকারী দেয়ালের বাইরে বড়সড় ধরণের কোনো উজবেক ছাউনি আশেপাশে কোথাও নেই। যার মানে সম্ভবত সাইবানি খানের বাহিনীর একটা অংশ ইতিমধ্যে আশেপাশে লুটতরাজ শুরু করেছে। সমরকন্দের এখন যখন পতন হয়েছে- লোভের মাত্রা আশেপাশের গ্রামাঞ্চল আর লোকালয়ে তার নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ডাকাতি করাতেই অনেকে বেশি আগ্রহ দেখাবে। কপাল ভালো হলে, সাইবানি খানের দেহের উপরাংশে সংবদ্ধ উদ্ধত মস্তিষ্কে এটা ঢুকবে না যে তাকে কেউ আক্রমণ করার দুঃসাহস দেখাতে পারে। আর এ কারণেই সে পরিতৃপ্ত মনে তাদের যেতে দিয়েছে।

সহসা, বাবরের মনে হয় সে কোনো শব্দ শুনতে পেয়েছে এবং তার কল্পনার জাল নিমেষে ছিঁড়ে যায়। গাছপাকা আপেলে অর্ধেক পিছলে সে উঠে দাঁড়াবার ফাঁকে সে গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করে। দূরে নদীর উপরে জমে থাকা কুয়াশার উপর দিয়ে সে সমরকন্দের পরিচিত দেয়াল দেখতে পায় এবং এখানে সেখানে প্রাকারবেষ্টিত ছাদে আলোর ক্ষুদ্র রশ্মি চোখে পড়ে।

তারপরে, চোখ কান খাড়া করতে, সে আবার শব্দটা শুনতে পায়: ঢাকের মন্দ্র ছন্দোবদ্ধ আওয়াজ, খানিক পরে আরও ঢাকের শব্দ শোনা যায়। সহসা ছাদে মানুষের চলাচল বেড়ে যায়। সে যেমনটা চেয়েছিলো, বাইসানগার আর তার লোকেরা নিশ্চয়ই বৃত্তাকার পথে পশ্চিমে যাবার সময়ে প্রতিপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এখন প্রশ্ন হলো সাইবানি খান কি টোপটা গিলবে?

“আপনাদের লোকদের ঘোড়া নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলেন, কিন্তু আমি আদেশ না দেয়া পর্যন্ত কেউ যেনো তার জায়গা থেকে না নড়ে।” বাবর নিচু স্বরে তার সেনাপতিদের সাথে কথা বলে, যারা এসে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে তার মতোই ঢাকের বাদ্যি শুনছে।

আনতাবাড়ি বোল শীঘ্রই একটা মন্দ্র ভয়ঙ্কর ছন্দে পরিণত হয়। বাবর ভাবে সে যে ঢাকের আওয়াজ শুনছে সেটা মাহমুদের চামড়া দিয়ে তৈরি ঢাকের আওয়াজ নিশ্চয়ই না। একেকটা মুহূর্ত অতিক্রম করার সাথে সাথে অনিশ্চয়তা সবার উপরে একটা চাপ সৃষ্টি করে। কুয়াশার আড়ালে আত্মগোপন করে বাবর সামনে এগিয়ে যায়, আরেকটু ভালো করে চারপাশটা দেখার জন্য এবং দেয়ালের কাছেই জন্মানো ছোট গাছের একটা ঝাড়ের পাশে সে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। তার নতুন সুবিধাজনক অবস্থান থেকে লোহার দরোজা আর তার পরে শেখজাদা তোরণদ্বারের যতোটুকু সে দেখতে পায়- বাইসানগার আর তার লোকেরা, যাদের ভিতরে বাবুরীও রয়েছে, যার। কাছ দিয়ে অতিক্রম করেছে– বুঝতে পারে সেগুলো এখনও বন্ধ রয়েছে। কিন্তু তারপরে, বাবরের যখন মনে হতে শুরু করেছে এই উত্তেজনা সে আর সহ্য করতে পারছে না। লোহার দরোজার উত্তোলন আর অধঃকরণের উপযোগী লোহার গরাদ উপরে উঠতে শুরু করে। গরাদ অশ্বারোহী বের হয়ে আসতে পারে এমন উচ্চতায় উঠতেই, পাশাপাশি দুজন করে অশ্বারোহী বাহিনীর একটা স্রোত দুলকিচালে বের হয়ে এসে বল্পিতবেগে উত্তর-পশ্চিম দিকে ধাওয়া করে। অশ্বারোহীরা বের হয়ে। আসা শেষই হতে চায় না- চারশো হবে কম করে হলেও। সে ভেবে উত্তেজিত হয়ে উঠে। অবশেষে শেষ যোদ্ধাটাও ভেতর থেকে বের হয়ে এসে ছায়ামূর্তির মতো কুয়াশার ভেতরে হারিয়ে যেতে একটা সাময়িক স্তব্ধতা এসে ভর করে। বাবর আশা করেছিলো, লোহার দরোজার গরাদ এবার নেমে আসবে কিন্তু এক নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী মন্থর বেগে ভেতর থেকে বের হয়ে আসে। দরোজা থেকে কয়েক কদম এগিয়ে এসে সে লাগাম টেনে ধরে মাথা ঘুরিয়ে ডানে বামে তাকিয়ে দেখে। শিকারের আগে বাতাসে নাক উঁচিয়ে শিকারী কুকুর যেমন করে, অবিকল সেই ভঙ্গিতে সে বাতাসে শ্বাস নেয়। মুহূর্তের জন্য তার মনে হয় নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী নিচু জমি আর তৃণভূমির উপর দিয়ে কুয়াশার চাদর ভেদ করে সরাসরি বাবরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। যদিও সে জানে সেটা অসম্ভব।

বাবরের মনে লোকটার পরিচয়ের ব্যাপারে সামান্যই সন্দেহ রয়েছে- সাইবানি খান। স্বয়ং। উজবেক দলপতির কি অভিপ্রায়? অবশেষে নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী তার হাত উঁচু করে। লোহার দরোজার ভিতর থেকে আরো যোদ্ধারা এসে তার পেছনে জড়ো হতে সে ঘোড়ার পাজরে খোঁচা দিয়ে কর্কশ কণ্ঠে তার লোকদের চিৎকার করে কিছু একটা বলে, যা বাবরের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে একটা অস্পষ্ট গুঞ্জনে পরিণত হলেও সে সেটা ঠিকই শুনতে পায়, উত্তর-পশ্চিম দিকে হারিয়ে যায়। আরো কয়েক মিনিট পরে, সব অশ্বারোহী যোদ্ধার দল বিদায় নিতে লোহার গরাদ ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসে।

নিজের অস্থিরতা দমন করে, বাবর তার মূল বাহিনীর কাছে ফিরে এসে তার লোকদের আরো একবার চুপ করে নিরবে দাঁড়িয়ে থাকবার আদেশ দেয়। তারা যদি এখনই শহর আক্রমণ করতে যায় তাহলে কোলাহলের শব্দ শুনে সাইবানি খান। হয়তো ফিরেও আসতে পারে। ওয়াজির খান চুপ করে দাঁড়িয়ে না থেকে নিজের ঘোড়ার পেটি শক্ত করে বাঁধে এবং নিজের আয়ুধের ধার পরখ করে দেখে তরবারি, খঞ্জর আর রণকুঠার। বাবর তার বিজ্ঞ পরামর্শদাতার স্থিরতা আর বিচক্ষণতার প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করে নিজেও তাকে অনুসরণ করে। তার পিঠে চামড়ার তূণ ঝুলছে, এবং সদ্যই কামারশালা থেকে তৈরি হয়ে আসা লম্বা তীরের তীক্ষ্ণ সূচাল ডগায় হাত বুলাতে সে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর হয়ে উঠে। সে তার বাঁকানো ধনুক আলতো করে খাপ থেকে ধরে বের করে তেল দিয়ে পাকা করে তোলা গুণের স্থিতিস্থাপকতা পরীক্ষা করে দেখে। সন্তুষ্টির সাথে নাক দিয়ে ঘোঁত করে অব্যক্ত শব্দ করে। সে বের হবার আগে যেমন শক্ত করে বেঁধেছিলো এখনও ঠিক তেমনই আছে।

অবশেষে আক্রমণের চুড়ান্ত সময় উপস্থিত হয়। দূর্গের ছাদে সবকিছু আবার আগের মতো নিরব হয়ে এসেছে এবং সাইবানি খান তার দলবল নিয়ে এতক্ষণে নিশ্চয়ই শ্রবণ সীমার বাইরে চলে গিয়েছে।

“যাত্রা শুরু হোক!” উত্তেজনায় অধীর কণ্ঠে বাবর চিৎকার করে উঠে। নিজের ঘোড়র উপরে লাফিয়ে উঠে বসে সে গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে আসে এবং তার লোকদের আক্রমণের ছকে বিন্যস্ত হতে দেয়। ওয়াজির খানের নেতৃত্বে তার দেহরক্ষী বাহিনী বিলম্ব না করে তার পেছনে এসে অবস্থান নেয়। তাদের পরেই থাকে আরোহন সহায়ক মই বহনকারী জোড়া ঘোড়সওয়ারের দল। তারপরে থাকে অশ্বারোহী বাহিনীর বাকি অংশ আর ইব্রাহিম সারুর তীরন্দাজ দল থাকে একেবারে শেষে।

বাবর ঘোড়ার পেটে গোড়ালী দিয়ে গুতো দিতে সেটা লাফিয়ে উঠে সামনে এগিয়ে যায়। ক্রমশ হাল্কা হয়ে আসা কুয়াশার মাঝে তারা তৃণভূমির বুক চিরে দক্ষিণে এগিয়ে যায়। সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারের দিকে এগিয়ে যাবার সময়ে শহর রক্ষাকারী দেয়াল তাদের ডান দিকে থাকে। তারা দেয়ালের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর দূরবর্তী পাড় ধরে এগোতে থাকে এবং এবার আর অগভীর অংশ দিয়ে নদী পার হবার দরকার নেই। কারণ কাঠের তক্তার তৈরি একটা চওড়া মজবুত সেতু– সদ্য নির্মিত, কোনো সন্দেহ নেই উজবেকদের কীর্তি- সবুজাভ-নীল তোরণদ্বার থেকে তিনশ গজ দূরে উজানে দেখা যায়।

বাবর তার তার বাহিনী খুরে বজ্রের বোল তুলে সেটা পেরিয়ে আসে এবং সোজা তোরণ রের দিকে ধেয়ে যায়। দূর্গের ছাদ থেকে আতঙ্কিত চিৎকার শুরু হতে, মাঙ্গলিং তীরন্দাজ বাহিনী ঢেউয়ের পরে ঢেউ তীরের ঝাপটা শূন্যে ভাসিয়ে দেয়। কয়েক মিনিটের ভিতরে সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারের দুপাশের সবচেয়ে নিচু স্থানে আরোহন মই স্থাপন করা হয়। ঘোড়া থেকে নামার ফাঁকে সে উপরের দিকে তাকিয়ে সেখানে একজনকেও প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত দেখতে না পেয়ে সে বিস্মিত হয়।

মই বেয়ে উপরে উঠতে কয়েক মিনিটের বেশি সময় লাগে না এবং শেষ কয়েক ফিট তারা পাথরের উপরে হাত দিয়ে বেয়েই উঠে যায়। তার যোদ্ধারা তার পাশে ভিড় করলে নড়াচড়ার জায়গা থাকে না। তরবারি কোষমুক্ত করা তো আরো পরের কথা। কিন্তু উজবেক রক্ষীবাহিনীর মাঙ্গলিঘ তীরন্দাজদের নিক্ষিপ্ত তীরে শজারুর মত আকৃতি নিয়ে পড়ে থাকা মৃত যযাদ্ধাদের ছাড়া অবশিষ্টাংশের কোনো চিহ্ন কোথাও দেখা যায় না।

তারপরে, একশ গজ দূরে একটা শক্তিশালী ঘাঁটি থেকে নিক্ষিপ্ত তীরের ঝাপটা বুঝিয়ে দেয় উজবেক রক্ষীবাহিনীর সব সদস্যই পালিয়ে যায়নি। কালো পালকযুক্ত একটা তীর বাবরের গম্বুজাকৃতি শিরস্ত্রাণে আঘাত করে দিকভ্রষ্ট হয়। আরেকটা তীর তার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা এক দেহরক্ষীর উরুর গভীরে কামড় বসায়। তৃতীয় আরেকটা তীর মই বেয়ে উঠে এসে প্রাকারের উপর দিয়ে ছাদে ধড়ফড় করে নামতে ব্যস্ত সৈনিকের গালে বিদ্ধ হয়। তার মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়তে শুরু করতে, তার হাত মই থেকে ছুটে যায় এবং তার ঠিক নিচে মই বেয়ে উঠে আসা অপর এক সৈন্যকে সাথে নিয়ে নিচের পাথুরে ভূমির দিকে মরণ পতন যাত্রা করে। তীরের পরের ঝাপটা থেকে বাঁচতে বাবর ঢাল উঁচু করে নিজের লোকদেরও তাই। করতে বলে দুর্ভেদ্য অবস্থানটার দিকে ধেয়ে যায়। আরো দুটো তীর ঢালে এসে আছড়ে পড়ে। কিন্তু পুরু চামড়া আর কাঠের কাঠামো দক্ষতার সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করে। অবশ্য বাবরের পেছনের এক সৈন্য গলায় তীরবিদ্ধ হয়ে ভূমি শয্যা নেয়। বাবর তারপরেই দুর্ভেদ্য অবস্থানটায় পৌঁছে যায়। সেখানে প্রবেশ করার জন্য কোনো দরোজা নেই। সে প্রথম যাকে সামনে পায় তাকে কোনো বাছবিচার ছাড়া কোপ বসিয়ে দেয়। বেচারা ধনুক ছেড়ে তখনও তলোয়ার বের করতে পারেনি। অন্যজনের আঙ্গুল তরবারির বাট আকড়ে ধরেছে। কিন্তু বাবর তার কব্জি লক্ষ্য করে তরবারি চালাতে, হাত দেহ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। লোকটা ঘুরে দাঁড়িয়ে অপর দিকের দরজা দিয়ে দৌড়ে পালায় এবং দেয়ালের পাশ দিয়ে পঞ্চাশ গজ দূরে অবস্থিত সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারের তোরণ রক্ষীর কক্ষের দিকে ছুটে যায়।

দুর্ভেদ্য স্থানের অন্য যোদ্ধারা তাকে অনুসরণ করতে চেষ্টা করে। কিন্তু হাতাহাতি লড়াইয়ের হাত থেকে তারা পালিয়ে যেতে চাইলে বাবর আর তার লোকেরা তাদের নির্দ্বিধায় হত্যা করে। তার তীরন্দাজেরা আরো দু’জনকে তোরণ রক্ষকের কক্ষে দৌড়ে যাবার সময়ে ভূপাতিত করে। অবশ্য তাদের মধ্যে একজন তারপরেও টলমল পায়ে কোনোমতে গড়িয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে সক্ষম হয়।

“সুলতান, আমাদের দেখে ব্যাটাদের পাখা গজিয়েছে!”

বাবর ঘুরে তাকিয়ে এক হাতে খঞ্জর অন্য হাতে রক্তাক্ত তরবারি হাতে হাঁফাতে হাঁফাতে কিন্তু গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়ানো ওয়াজির খানকে দেখতে পায়। “এখনও না। তোরণ আর দেয়ালের এই অংশ পাহারা দেবার জন্য প্রহরী নিয়োগ করেন। আপনি নিজে এখানের দায়িত্বে থাকবেন। ইত্যবসরে আমি বাকিদের নিয়ে তোরণ রক্ষকের কক্ষে প্রবেশ করে তোরণদ্বার খুলে আমাদের বাকি লোকদের ভেতরে প্রবেশের ব্যবস্থা করা যায় কিনা দেখি।”

ওয়াজির খানকে বকুনি খাওয়া বালকের মতো অপ্রতিভ দেখায়। কিন্তু বাবর ক্রমেই দুর্বল হয়ে উঠা তার সবচেয়ে বিজ্ঞ অমাত্যকে শহরের রাস্তায় হাতাহাতি লড়াইয়ের মধ্যে ফেলতে চায় না, যেখানে একজন লোকের দ্রুত দৌড়াবার ক্ষমতা অনেক সময় জীবন মৃত্যুর মধ্যে ভেদ রেখা টেনে দিতে পারে।

মাথার উপরে ঢাল ধরে এবং কুঁজো হয়ে বাবর পঞ্চাশ গজ দূরে অবস্থিত তোরণ রক্ষকের কক্ষের দিকে দৌড়ে যায়। সে ভেতরে এক হাত প্রায় কাটা পড়া সেই উজবেক যোদ্ধাকে পড়ে থাকতে দেখে। দেয়ালে হেলান দিয়ে সে দ্রুত শ্বাস নেয়। তার হাতের ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ছিটকে এসে পাথরের মেঝে লাল করে দিয়েছে। যন্ত্রণায় সে শাপশাপান্ত করছে। নিচের তোরণদ্বারের দিকে নেমে যাওয়া সিঁড়ি থেকে দুদ্দাড় ভেসে আসা পায়ের আওয়াজ বলে দেয় বাকী রক্ষীদের কোথায় পাওয়া যাবে। সে আর তার লোকেরা সন্তর্পনে পায়ের শব্দ অনুসরণ করে। আশঙ্কা করে সিঁড়ি থেকে বের হওয়া মাত্র হামলার মুখে পড়তে হতে পারে, কিন্তু সেরকম কিছুই ঘটে না।

“তালাটা ভেঙে দরজাটা খুলে দাও।” বাবর চেঁচিয়ে উঠে বলে।

রণকুঠার হাতে তার দুই দেহরক্ষী আদেশ পালন করতে দৌড়ে যায়। তাদের কুঠার তোরণের তালার উপরে সজোরে নেমে আসতে ধাতুর সাথে ধাতুর সংঘর্ষের কর্কশ শব্দ উঠে এবং কিছুক্ষণ পরে একটা শেষ ঘাইয়ের সাথে তারা তাদের কাজ সমাপ্ত করে। শীঘ্রই প্রাচীন, লোহার-কীলক দিয়ে সজ্জিত দরজা দোল খেয়ে খুলে যায় বাবরের অবিশিষ্ট যোদ্ধার দলকে ভেতরে প্রবেশের সুযোগ দিতে। যাদের ভিতরে মাঙ্গলিঘ তীরন্দাজের দলও রয়েছে।

আলমগীর হাতে নিয়ে বাবর চারপাশে তাকায়। বড্ড বেশিই যেনো নির্জন চারপাশটা। উজবেক শেয়ালের দল কোথায় লুকিয়ে আছে? বাবর সতর্কতার তাবিজ খুলে রেখে চওড়া গলিপথ ধরে ফারগানার নামে জয়ধ্বনি দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে শুরু করে।

নিস্তব্ধতার মাঝে বাবরের চিৎকারের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। তীরের কোনো ঝাঁক আর তাদের দিকে ধেয়ে আসে না বা উজবেক অবজ্ঞার কোনো চিৎকারও শোনা যায় না। তারপরে বাবরকে চমকে দিয়ে বন্ধ দরোজা, জানালার পাল্লা খিড়কি একে একে খুলতে শুরু করে। সে দৌড়ে আড়াল খোঁজে এবং পুনরায় তার তীর ধনুকের দিকে হাত বাড়ায়। কিন্তু দেখা যায় উঁকি দেয়া মাথাগুলো কোনো উজবেক যোদ্ধার না। তারা সবাই সমরকন্দের সাধারণ মানুষ বণিক, দোকানদার, সরাইখানার মালিক- যারা বাবর আর তার লোকদের চিনতে পেরে তাদের স্বাধীন করায় তার জন্য দোয়া করছে। শীঘ্রই তারা পিলপিল করে বাইরের গলিতে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। খুশিতে সবার প্রায় পাগল হবার দশা।

“জলদি! এই দিকে!” একটা অপরিচিত লোক চিৎকার করে বলে। “আমি এক উজবেক বদমাশকে এদিকে পালাতে দেখেছি।” সে একটা সংকীর্ণ গলির দিকে ইশারা করে দেখায়। যেখানে পড়ে থাকা রক্তের ফোঁটা ইতিমধ্যে ধূলোয় জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। ব্যাপারটা দেখার জন্য বাবর তার লোকদের কিছু বলার আগেই, দু’জন সাধারণ নাগরিক। তাদের একজনকে দেখে মনে হয় কসাই হবে। অন্যজন গাট্টাগোট্টা দেখতে তারের মতো পাকানো শরীর যার নাকের পাশে জরুল রয়েছে- গলির ভিতরে দৌড়ে প্রবেশ করে। কিছুক্ষণের ভিতরে তারা এক তরুণ উজবেকের পা ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসে। ফলে বেচারার মাথা রাস্তায় বলের মত লাফাতে থাকে। তার বুক ভেদ করে একটা মাঙ্গলিঘ তীরের মাথা বের হয়ে আছে এবং বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করার ফাঁকে সে করুণা ভিক্ষা করে। বাবর কিছু বলার আগেই কসাইর মতো দেখতে লোকটা একটা চাকু বের করে ছেলেটার কণ্ঠনালী থেকে কান পর্যন্ত কেটে ফাঁক করে দেয়। তাজা রক্ত ছিটকে তার পায়ের নাগরা ভিজিয়ে দিতে তার চেহারা খুশিতে বাকবাক করতে থাকে। চারপাশে সবাই হাতের কাছে যে যা পাচ্ছে তাই নিয়ে নিজেদের যুদ্ধের জন্য সজ্জিত করে- পাথরের টুকরো, কামারের হাতুড়ি, খড় তোলার কাঁটা লাগানো দণ্ড…বাবর আর তার সৈন্যদের সাথে তারা দৌড়াতে শুরু করলে তাদের জ্বলজ্বল করতে থাকা চোখের দৃষ্টি দেখে বাবরের বুনো কুকুরের কথা মনে পড়ে। গলি থেকে গলিতে তারা উজবেকদের খুঁজতে থাকে এবং তাদের ঘৃণার তীব্রতা এতো বেশি, তারা এতো অপমান সহ্য করেছে যে, মৃত কোনো উজবেককে দেখতে পেলে তাকেও নির্বিচারে চাকু দিয়ে কোপাতে থাকে।

দেয়ালের কাছে যারা আহত হয়েছিলো তারা বেশিদূর পালাতে পারেনি। প্রতিরোধের মাত্রা অনেক অল্প- প্রায় নেই বললেই চলে। উজবেকরা নিশ্চয়ই তাদের আগে আগে পালিয়ে যাচ্ছে। রেজিস্তান চত্বরে পৌঁছে বাবর সেখানে সাময়িক যাত্রা বিরতির ঘোষণা করে। উজবেকরা সম্ভবত ভেবেছে যে, সে আসলেই অনেক বড় বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করেছে। কিংবা পুরো বিষয়টাই একটা ফাঁদ। সামনেই কোথাও তারা তাদের জন্য ওঁত পেতে আছে। বাবর তার সেনাপতিদের সাথে একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনায় বসে এবং তারপরে সৈন্যদের সাবধানে শহরের উত্তর, পূর্ব আর পশ্চিমে পাঠায়। আসলেই ব্যাপারটা কি সেটা দেখতে।

ভোরের সূর্য এতক্ষণে মধ্য সকালের আলোয় সমাসীন এবং নির্মেঘ উজ্জ্বল আকাশের নিচে আরো বেশি বেশি লোক এসে চত্বরে হাজির হয়। সবাই খাবার নিয়ে এসেছে- রুটি, শুকনো ফল, এমনকি সুরা ভর্তি মশক- যা বাবরের লোকদের নেবার জন্য জোরাজুরি করছে। তার চারপাশে উত্তেজিত সব কণ্ঠস্বরের একটা কোলাহল ধীরে ধীরে দানা বেঁধে উঠে। চরম বিশৃঙ্খলা- উজবেকরা যদি শক্তি সঞ্চয় করে পাল্টা আক্রমণ করে তাহলে কি হবে? বাবরের লোকেরা এই হট্টগোলের ভিতরে কোনো প্রতিরোধই তৈরি করতে পারবে না।

বাবর তার দেহরক্ষীদের আদেশ দেয় শহরের জনগণকে একটু দূরে সরিয়ে দেয়ার জন্য। দেহরক্ষীর দল বর্শা দিয়ে একটা বেষ্টনী তৈরি করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চারপাশে চাপ দিতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে সাফল্যের সাথে বিশৃঙ্খল জনতাকে ঠেলে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয় এবং চত্বরে প্রবেশ আর বর্হিগমনের গলি ভীড়মুক্ত করে। এই বেশ হয়েছে। “আমি চাই আশেপাশের এইসব ভবনগুলো ভালো করে তল্লাশি করা হোক আর চত্বরের চারপাশের প্রতিটা কৌশলগত স্থানে প্রহরী নিয়োগ করা হোক।” বাবর আদেশ দেয়। উজবেক তীরন্দাজের দল হয়তো এতোক্ষণে চত্বরের আশেপাশের সব প্রাসাদ, মসজিদ আর মাদ্রাসার মিনার আর নীল টালি শোভিত গম্বুজের সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নিয়ে সুযোগের অপেক্ষা করছে।

“সুলতান…” ঘামে ভেজা চওড়া মুখের এক তরুণ সৈন্য বাবরের কনুইয়ের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলো। তার কণ্ঠস্বর শুনে মনে হয় সে এতোক্ষণ জোরে দৌড়ে এসেছে। “কি হয়েছে?”

“সাইবানি খানের সাথে যোগ দেবার আশায় উজবেকদের একটা বিশাল সংখ্যা শেখজাদা তোরণ দিয়ে উত্তর দিকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। তারা বের হবার চেষ্টা করলেই আমাদের তীরন্দাজ বাহিনী তাদের লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ে মারছে। অবশ্য, স্থানীয় লোকজন লোহার দরোজার প্রহরীর কক্ষে কিছু উজবেককে আটকাতে সক্ষম হয়েছে।”

‘চমৎকার। আমরা আমাদের শত্রুর শেষ নিশানাও এই শহর থেকে বিতাড়িত করবো এবং সাইবানি খান ফিরে আসবার আগেই শহর রক্ষাকারী দেয়াল পাহারা দেবার বন্দোবস্ত করো।” বাবর তার ঘোড়া নিয়ে আসতে বলে এবং দেহরক্ষীর দল নিয়ে লোহা দরোজার দিকে এগিয়ে যায়। তৈমূরের মসজিদের চমৎকার নীল গম্বুজ আলোয় ঝকঝক করে। কিন্তু তার পেছনেই সে কুণ্ডলী আকারে ধোয়া উঠতে দেখে এবং বাবর চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পায়। লোহা দরোজার দিকে এগিয়ে যেতে সে প্রহরীর কক্ষের ছাদ ভেদ করে বের হয়ে আসা আগুনের শিখা দেখতে পায় এবং চিৎকার করছে ভেতরে আটকে পড়া উজবেক রক্ষীর দল। আরো কাছে যেতে, সে দেখে বেপরোয়া এক উজবেক জানালা গলে বাইরে বের হয়ে আসতে চেষ্টা করলে সমরকন্দের কিছু লোক তাকে আবার জোর করে ভেতরে ঠেলে দিয়ে জানালার খড়খড়ি বন্ধ করে দিয়ে সেটা বাইরে থেকে তক্তা দিয়ে বন্ধ করে দেয়। আরেক উজবেক, কাপড়ে আগুন নিয়ে ছাদ থেকে নিচে লাফিয়ে পড়তে উপস্থিত জনতা সাথে সাথে তাকে ঘিরে ধরে উন্মত্তের মতো তার দেহ ছুরি চাকু দিয়ে কোপাতে থাকে বেচারার মৃত্যু নিশ্চিত করতে। শীঘ্রই উল্লসিত জনতা তার কাটা মাথাটা একটা স্মারকের মতো প্রদর্শন করতে থাকে।

বাবর সেখানে এসে পৌঁছাতে, উপস্থিত জনতার একজন তার মুখ ধোয়ায় কালো হয়ে গেছে তার দিকে দৌড়ে আসে এবং বাবরের দেহরক্ষী দলের একজনের হাতে ফারগানার রাজকীয় প্রতীক দেখে চিনতে পেরে, হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে। “সুলতান আমরা শয়তানগুলোকে আটকে তাদের এখন পোড়াচ্ছি। আমাদের যেমন কষ্ট দিয়েছে তারা এখন তার প্রতিদান পাচ্ছে। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, কেউ বিনা কষ্টে মরবে না।” বাহবার জন্য বাবরের দিকে তাকিয়ে থাকা লোকটার চোখে কেবল রক্ত লোলুপতা খেলা করতে থাকে। কিন্তু মানুষের মাংস পোড়ার মিষ্টি গন্ধে বাবরের গা গুলিয়ে উঠলে কোনো কথা না বলে সে হাত নেড়ে তাকে যেতে বলে। প্রজ্জ্বলিত প্রহরী কক্ষের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নয়ে। ইতিমধ্যে ভিতরে বন্দি উজবেকদের যন্ত্রণাক্লিষ্ট চিৎকারের মাত্রা কমে এসেছে। সে রেজিস্তান চতুরের দিকে ধীরে ধীরে ফিরে চলে। সমরকন্দ বোধহয় সে আবার ফিরে পেলো, কিন্তু যতো দ্রুত আর অনায়াসে শহরটার পতন হলো সেটা তার কেনো যেনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।

সামনে থেকে ঘোড়ার ধাবমান খুরের শব্দ ভেসে আসে এবং একটা পরিচিত মুখ সে দেখতে পায়। বাইসানগার এবং তার সহযোদ্ধাদের ভিতরে সে বাবুরীকেও দেখতে পায়।

“সমরকন্দের সুলতান মির্জা বাবরের জয় হোক!” বাইসানগার গলার সর্বশক্তি দিয়ে জয়ধ্বনি দেয় এবং বাকি লোকেরা তার সাথে গলা মেলায়। বাবর হাত উঁচু করে তাদের অভিবাদনের জবাব দেয় এবং ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যায়। সব কিছু তার কাছে কেমন স্বপ্নের মতো মনে হয়। তার উৎফুল্ল হবার কথা, কিন্তু কেমন একটা অদ্ভুত বিচ্ছিন্নতা তার মাঝে ভর করে। সহসা, ভাববার জন্য সময় আর নির্জনতা তার পরম কাম্য বলে মনে হয়।

***

সেই রাতে কোক সরাইতে, বাবর তার খিদমতগারকে কাগজ আর কলম নিয়ে আসার জন্য আদেশ দেয়। খিদমতগার যখন জানতে চায় মুনশিকেও ডেকে আনবে কিনা। সে মাথা নেড়ে নিষেধ করে। সে কিছু একটা সিদ্ধান্তে পৌঁচেছে। সে এখন উনিশ বছরের পূর্ণ বয়স্ক এক পুরুষ, এবং চাঞ্চল্যকর ঈর্ষণীয় সাফল্য সে অর্জন করেছে। আজ থেকে সে রোজনামচা লিখবে। যেখানে সে তার হৃদয়ের কথাই কেবল লিপিবদ্ধ করবে। সে কেবল জানবে রোজনামচায় কি লেখা আছে। দোয়াতদানিতে কলমের নিব ডুবিয়ে নিয়ে এক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে সে লিখতে শুরু করে; প্রথমে লেখনীর গতি মন্থর থাকে কিন্তু ধীরে ধীরে আবেগের উৎসমুখে বাঁধ খুলে যেতে লেখার গতি বৃদ্ধি পায়:

যুগ যুগ ধরে সমরকন্দ তৈমূরের বংশধরেরা শাসন করে এসেছে। তারপরে উজবেকরা- আমাদের সভ্য দুনিয়ার বাইরে মানবতার প্রান্তে বসবাসকারী এক বহিরাগত শত্রু- এটা দখল করে একে বিধ্বস্ত করে। এখন আল্লাহতা’লার কৃপায় আমাদের হাতছাড়া হওয়া এই শহরটা আবার আমাদের হাতে ফিরে এসেছে। সমৃদ্ধ সমরকন্দ আবার আমার হয়েছে।

একটা গভীর শ্বাস নিয়ে সে ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে দেয় এবং লেখনী নামিয়ে রাখে। সেদিন বিছানায় গিয়ে শোয়ার প্রায় সাথে সাথে সে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।

২.৫ অপমানের তিক্ততা

১১. অপমানের তিক্ততা

তুষারপাতের প্রথম ঝাপটা সমরকন্দের ডিম্বাকৃতি গম্বুজ, সুদৃশ্য মিনার আর চিনামাটির টালিশোভিত তোরণের জটিল অবয়ব কেউ রূপার তবক দিয়ে ঢেকে দিয়েছে বলে মনে হতে থাকে। ফলের বাগানের পুত্রহীন ডালপালার ভিতর দিয়ে শনশন শব্দে বয়ে চলা শীতল বাতাস আর হুড়মুড় করে ভেঙে পড়া তুষারের স্তূপ। বাবরের কাছে শহরটাকে ঘোমটার আড়ালে নববধূর মত মনে হয়- যার সৌন্দর্য চোখের আড়াল হলেও পুরোপুরি ঢাকা পড়েনি।

তার প্রিয় বাদামী রঙের আজদাহাটা ফেস-ফোঁস করে নিঃশ্বাসের সাথে কুয়াশার মেঘ নির্গত করে এবং বুকের কাছে পা তুলে নরম তুষারের ভিতর থেকে খুর বের আনে। মাথায় নেকড়ের চামড়ার নরম টুপি। চামড়ার পরত দেয়া আলখাল্লা গায়ে শক্ত করে আটকে আর পায়ে মেষের চামড়ার বুট পরিহিত অবস্থায় বাবর শহর রক্ষাকারী দেয়ালের বাইরের দিকের অবস্থা পর্যবেক্ষণ শেষে ফিরে আসছে। দেহরক্ষী বাহিনী খুব কাছ থেকে তাকে অনুসরণ করছে। গত দুসপ্তাহ ধরে ওয়াজির খান জ্বরে ভুগছে। এই প্রথম সে তার সাথে নেই, অবশ্য বাবুরী সাথে রয়েছে। শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে একটা উজ্জ্বল সবুজ কাপড়ের ফালি দিয়ে তার মুখটা ঢাকা।

গলবস্ত্র দিয়ে মাথা ঢাকা থাকা সত্ত্বেও বাতাসের প্রবাহের মাঝে তারা পরস্পরের কথা শুনতে পারবে। কিন্তু ঠাণ্ডার কারণে তাদের কথাই বলতে ইচ্ছা করে না। বাবরের অবশ হয়ে থাকা ঠোঁটের কারণে একটা শব্দও উচ্চারণ করতে হলে তাকে যথেষ্ট কসরত করতে হবে। কিন্তু সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারের ছাদের নিচে ঝুলে থাকা সুতীক্ষ বরফের শলাকার দিকে এগিয়ে যেতে, শীতের কথা সে বেমালুম ভুলে যায়। সাফল্যের উল্লাস, কড়া মাদকের উষ্ণ ধারার ন্যায় তার ভেতরটা চাঙ্গা করে তুলে।

তোরণদ্বারের নিচে দিয়ে বাবর তার লোকদের নিয়ে দুলকিচালে ভেতরে প্রবেশ করে পশ্চিম দিকে অবস্থিত নগরদূর্গের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে একটাই দুশ্চিন্তা তাকে ত করে। সমরকন্দ দখল করার পরে যে তিন মাস অতিক্রম করেছে। সেই পুরোটা সময় যা তাকে অনবরত খুঁচিয়ে আসছে। বর্তমানে শীতের কড়াল থাবা আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার বরাভয় দিচ্ছে কিন্তু বরফ গলতে শুরু করণে কি হবে? সাইবানি খান যদিও সাথে সাথে শহর অবরোধ না করে, উত্তরে নিজের দূর্গে ফিরে গিয়ে শীতকাল শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন বলে ঠিক করেছেন। আর বাবর খুব ভালো করেই জানে নিজের সীমিত সম্পদ দিয়ে সাইবানি খানের কাছ থেকে সমরকন্দ হয়তো দখল করা যায়, কিন্তু সেটা রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। শহর দখল করার প্রায় সাথে সাথে বাবর তার লোকদের এর নিরাপত্তা জোরদার করতে নিয়োগ করে। অতিরিক্ত পর্যবেক্ষণ গম্বুজ নির্মাণ করতে বলে এবং শহর রক্ষাকারী দেয়ালের উচ্চতা কয়েক স্থানে বৃদ্ধি করার আদেশ দেয়। তুষারপাতের কারণে কাজ বন্ধ হবার আগে পর্যন্ত তার লোকেরা সাধ্যমত কাজ করেছে।

কোক সরাইয়ের আঙ্গিনায় ঘোড়া নিয়ে প্রবেশ করে বাবর ভাবে, নানীজান, আম্মিজান আর খানজাদার বিলাসবহুল মহলে তাদের সাথে দেখা করতে যাবে কিনা। যেখানে বিজয় অর্জনের অব্যবহিত পরে সমরকন্দে আসা অব্দি তারা অবস্থান করছেন। সে ওয়াজির খানকে দেখতে যাবে বলে ঠিক করে। তার শারীরিক অবস্থার নিশ্চয়ই এতক্ষণে উন্নতি হয়েছে… ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে গা গরম করার অভিপ্রায়ে দুহাতে নিজের শরীরের দু’পাশে চাপড় দিতে দিতে পাথরের তৈরি নিচু কামরার দিকে এগিয়ে যায়, যেখানে ওয়াজির খান অবস্থান করছে। বাবরের তাকে। এখন বড় প্রয়োজন, আর সে তার আরোগ্য কামনায় অস্থির হয়ে উঠেছে।

পায়ের জুতো থেকে বরফ ঝাড়তে ঝাড়তে এবং মাথা থেকে নেকড়ের চামড়ার তৈরি টুপি খুলে- নেকড়ের লম্বা লোম বরফে শলাকার ন্যায় আকৃতি নিয়েছে সে। ভেতরে প্রবেশ করে। ওয়াজির খানের কক্ষের নিচু দরোজার নীচ দিয়ে ঝুঁকে প্রবেশ করে সে তার বৃদ্ধ বান্ধবকে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে। একটা হাত মুখের উপরে রাখা, যেনো ঘুমিয়ে রয়েছে। কাছে আসতে সে আঁতকে উঠে দেখে হাকিমের পরামর্শে ছাগলের চামড়ার তৈরি কম্বলের কয়েক পরত দিয়ে ঢেকে দিয়ে বিছানার পাশে একটা ঝুড়িতে জ্বলন্ত কয়লা রাখার পরেও ওয়াজির খান থরথর করে কাঁপছে। গতকালও তার কাঁপুনি এতো প্রবল ছিলো না।

“সে কেমন আছে?”

আগুনের কাছে দাঁড়ানো হাকিম তামার পাত্রে তৈরি একটা মিশ্রণ নাড়ছে। “সুলতান, তার অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। তার জ্বর প্রশমিত করতে আমি দ্রাক্ষারস, লতাগুল্ম আর দারুচিনি দিয়ে তৈরি একটা এলিক্সির আগুনে উত্তপ্ত করছি।” লোকটার কণ্ঠস্বর বিষণ্ণ এবং মুখের অভিব্যক্তিতে চিন্তার ছাপ- গতকালের সাক্ষাতের ভক্তিপূর্ণ আন্তরিকতা থেকে একেবারেই আলাদা।

ওয়াজির খান মারা যেতে পারে প্রথমবারের মতো এই সম্ভাবনার কথা তার মাঝে। উদয় হতে পেটের ভেতরে অস্বস্তির একটা গিঁট দানা বাঁধে। “তাকে আপনার বাঁচাতেই হবে।”

“সুলতান, আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করবো। কিন্তু প্রাণ দেয়া বা নেয়ার অধিকার কেবল সৃষ্টিকর্তার এক্তিয়ারে। আমি কেবল এটুকুই বলতে পারি শীঘ্রই যদি তার অবস্থার উন্নতি না হয়, তবে সে আমার সামর্থের বাইরে চলে যাবে…” হাকিম ঘুরে দাঁড়িয়ে পাত্রের মিশ্রণ আরো জোরে নাড়তে আরম্ভ করে।

বাবর ওয়াজির খানের কাছে যায় এবং আলতোভাবে তার হাত মুখের উপর থেকে সরিয়ে দেয় যা ঘামে ভিজে চপচপ করছে। ওয়াজির খান নড়ে উঠে এবং এক মুহূর্তের জন্য তার একটা চোখ খুলে তাকায়। “সুলতান…” তার চিরাচরিত মন্দ্র কণ্ঠস্বর এখন ক্ষীণ কষ্টসাধ্য কর্কশ আর্তনাদ।

“কথা বলার দরকার নেই। নিজেকে অনুগ্রহ করে কাহিল করবেন না।” বাবর সতর্কতার সাথে ওয়াজির খানের কাধ চেপে ধরে। তার কাঁপুনি থামাতে চেষ্টা করে। অসুস্থ বন্ধুর শরীরে নিজের শক্তির কিছুটা প্রবাহিত করতে চায়। ওয়াজির খানের পরণের মোটা আলখাল্লা ভেদ করে সে তার দেহের অস্বাভাবিক উষ্ণতা অনুভব করতে পারে।

একটা মাটির পেয়ালা নিয়ে হাকিম এগিয়ে আসে।

“আমাকে দিন।” বাবর পেয়ালাটা তার হাত থেকে নেয় এবং এক হাতে ওয়াজির খানের মাথাটা তুলে ধরে অন্য হাতে পেয়ালাটা তার ঠোঁটের কাছে ধরে। ওয়াজির খানের চেষ্টা সত্ত্বেও পেয়ালার বেশিরভাগ উষ্ণ লাল তরল তার চিবুকের খোঁচা খোঁচা। দাড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। নিজের অনাড়িপনাকে সে অভিসম্পাত করে। বাবর আবার চেষ্টা করে, তার মনে পড়ে কিভাবে একটা স্যাঁতসেতে গুহার অভ্যন্তরে জ্বরের সময়ে ওয়াজির খান একবার তার শুশ্রূষা করেছিলো। কাপড়ের ফালি পানিতে ভিজিয়ে ভক্তিভরে আর ধৈর্যসহকারে তার শুষ্ক মুখ পানির ফোঁটায় সিক্ত করে তুলেছিলো। সে ওয়াজির খানের মাথাটা আরেকটু উঁচু করে এবার কাজ হয়। হাকিমের তৈরি করা আরকের কিছুটা গলধঃকরণ করতে পারে ওয়াজির খান, তারপরে আরেকটু। পুরোটা শেষ হতে বাবর ওয়াজির খানের মাথা বালিশে নামিয়ে রাখে।

“সুলতান, তার অবস্থার উন্নতি হতেই আমি আপনাকে জানাবো।”

“আমি এখানেই থাকছি।” ওয়াজির খানের কোনো নিকটাত্মীয় নেই যে তার যত্ন নেবে। তার স্ত্রী আর একমাত্র পুত্রসন্তান বহুবছর আগে গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে এবং প্রায় দশ বছর আগে সন্তান জন্মদান করার সময়ে তার একমাত্র কন্যা মারা গিয়েছে। বাবর কয়েকটা জরির কারুকাজ করা তাকিয়া নিয়ে ওয়াজির খানের বিছানার পাশের দেয়ালে সেগুলো স্তূপ করে সেখানে আধশোয়া হয়। পৃথিবীর বুকে যদি ওয়াজির খানের অবস্থানের সময় শেষ হয়ে আসে, তবে অন্তিম মুহূর্তে সে তার পাশে থাকতে চায়।

রাত ক্রমশ গম্ভীর হয়। বাবর চুপচাপ তাকিয়ে থাকে এবং হাকিম ওয়াজির খানের চারপাশে পায়চারি করার ফাঁকে নাড়ি পরীক্ষা করতে, চোখের পাতা খুলে চোখের মণিতে উঁকি দিতে বা বুকে হাত রেখে জ্বরের মাত্রা পরিমাপ করতে বিছানার পাশে আসলে সে তাকে সাহায্য করে। যন্ত্রণায় ঝটফট আর কাঁপতে থাকলেও মাঝে মাঝে ওয়াজির খান কিছুটা শান্তভাবে শুয়ে থাকে। আবার কখনও প্রলাপ বকে। তার বেশিরভাগ কথাই বোঝা যায় না কিন্তু বিড়বিড় করে বলতে থাকা দুর্বোধ্য শব্দের ভিতরে বাবরের কানে কিছু আটকায়..

“কবুতর…কবুতর যাদের পালকে চুনির মতো লাল রক্ত লেগে রয়েছে…সুলতান দেখেন কিভাবে সেগুলো আছড়ে পড়ছে…”

আকশি দূর্গের ছাদ থেকে বাবরের আব্বাজান আর তার প্রিয় চবুতরা যেদিন বিস্মরণের অতলে ধ্বসে পড়েছিলো ওয়াজির খান বোধহয় সেদিনের কথা বলতে চাইছে। আজ এতদিন পরেও বাবর সেদিন গিরিখাতের কিনার, যার অতলে তার আব্বাজানের দেহ অষ্টবক্র হয়ে পড়ে ছিলো, থেকে তাকে সরিয়ে আনা ওয়াজির খানের হাতের শক্ত পাঞ্জার স্পর্শ আজও অনুভব করতে পারে… ওয়াজির খানের কাছে তার কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। তার আব্বাজানের অকাল মৃত্যুর পর থেকে লোকটা তাকে পিতার মতোই আগলে রেখেছে, কিন্তু তাকে বাঁচাবার জন্য সে কিছুই করতে পারছে না।

ওয়াজির খান আবার একটু শান্ত হতে বাবরের চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসে। ওয়াজির খানের ভালোমন্দ কিছু একটা হয়ে গেলে তার কি হবে?

***

“সুলতান…সুলতান… উঠুন!”

বাবর চমকে উঠে বসে। পুরো ঘরটা প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন। কেবল হাকিমের ডান হাতে উঁচু করে ধরা একটা তেলের প্রদীপের দপদপ করতে থাকা শিখা যতটুকু আলোকিত করতে পারে।

চোখ পিটপিট করে বাবর কোনোমতে উঠে দাঁড়ায়। বিছানার দিকে তার তাকাতে সাহস হয় না। কারণ জানেই তাকালে সে কি দেখতে পাবে। সে তার বদলে হাকিমের চোখের দিকে তাকায়। “কি হয়েছে?”

“সুলতান, আল্লাহতালা আমাদের প্রতি সদয় হয়েছেন। চিকিৎসক বিছানার কাছে এগিয়ে যায় এবং ওয়াজির খানের মুখ তার হাতের প্রদীপের ক্ষুদ্র আভায় আলোকিত হয়ে উঠে।

তাকিয়ায় ভর দিয়ে সে আধশোয়া হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। কাঁপুনি একেবারেই থেমে গেছে। টিকে থাকা এক চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল আর পরিষ্কার এবং ক্লান্ত মুখে বুঝি একটু হাসির আভাসও দেখা যায়। জ্বর ছেড়ে গেছে। বাবরের এক মুহূর্ত দেরি হয় চোখের সামনের দৃশ্যটার মর্ম অনুধাবন করতে। তারপরেই সে স্বস্তি আর শ্রদ্ধার বাণভাসি জোয়ারে আপ্লুত হয়ে বিছানার কাছে দৌড়ে গিয়ে ওয়াজির খানকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে।

“সুলতান, শান্ত হোন। আমার রোগী এখনও দুর্বল…” হাকিম প্রতিবাদের সুরে চেঁচিয়ে উঠে। তার কথা বাবর শুনতেই পায় না, সে কেবল প্রবল কতজ্ঞতায় ভারাক্রান্ত। ওয়াজির খানের জীবনের উপর থেকে বিপদ কেটে গিয়েছে…

তাকে বিশ্রাম করতে দিয়ে বাবর কক্ষ থেকে বাইরে আসে। শীতল বাতাস সুইয়ের মতো খোলা মুখে হামলে পড়ে কিন্তু সে পাত্তাই দেয় না। অসুস্থতা আর দুশ্চিন্তার মেঘ কেটে যেতে, সে নিজের ভেতরে আপন তারুণ্য আর শক্তির একটা জোয়ার অনুভব করে। আর সেই সাথে তরুণ এবং বেপরোয়া সঙ্গের জন্য সে উদগ্রীব হয়ে উঠে। পূর্ব দিগন্তে সকাল যদিও কেবল দিন শুরুর সব আয়োজন মাত্র আরম্ভ করেছে, সে তখনই বাবুরীকে ডেকে পাঠায়।

কয়েক মিনিট পরে, সদ্য ঘুমভাঙা চোখে ভেড়ার চামড়ার জারকিন বাঁধতে বাঁধতে সে এসে হাজির হয়। এত ভোরে ডেকে পাঠানোর কারণে স্পষ্টতই বিভ্রান্ত বাবর তার মুখ থেকে উষ্ণ নিঃশ্বাসের সাদা কুণ্ডলী নির্গত হতে দেখে। “এসো, অনেক ঘুমিয়েছো…আমরা একটু বাইরে যাচ্ছি।” বাবর তাকে ডেকে বলে।

“কি?…”

“আমার কথা তুমি ঠিকই শুনেছে- এবার চলো অলস কোথাকার…”

দশ মিনিট পরে, সবুজাভ-নীল তোরণদ্বারের নীচ দিয়ে তাদের ঘোড়া ছুটিয়ে বের হতে দেখা যায়। সূর্যের আলোয় রাতের তুষার গলতে শুরু করায় তাদের ঘোড়ার খুরের কারণে গুটি বসন্তের মত দাগ পড়ে মাটির বুকে। যা কিছুই হোক, বেঁচে থাকা আর তারুণ্যের চেয়ে মঙ্গলময় আর কিছুই হতে পারে না।

***

প্রথমে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না। বছরের এই সময়ে, ধুসর প্রায় নিপ্রভ আলো মানুষের চোখকে অনায়াসে প্রতারিত করতে পারে। কোলবা পাহাড়ের দিকে বাবর চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে থাকার মাঝেই সে ভাবে সে আরো লোক দেখতে পেয়েছে- হ্যাঁ: সে ঠিকই দেখেছে- দূরের কালো অবয়বগুলো ঘোড়সওয়ারের।

ওয়াজির খানও স্থির চোখে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

“উজবেক…?”

“আমারও তাই মনে হয়, সুলতান। সম্ভবত অগ্রগামী গুপ্তদূতের দল।”

বাবর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয়। গত তিন সপ্তাহ ধরে সমরকন্দে গুজব- প্রথম প্রথম অস্পষ্ট, ভিত্তিহীন তারপরে অনেক বিশদ বর্ণনা- ছড়াতে শুরু করেছে। সবাই দেখা যায় দুটো বিষয়ে একমত যে, সাইবানি খান সমরকন্দের পশ্চিমে বোখারায় অবস্থান করে ভাড়াটে বাহিনী গড়ে তুলছে আর শীতকালটা নিজের লোকদের সাথে একত্রে অতিবাহিত করা সব উজবেক যোদ্ধাকে মোটা পুরষ্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছেন।

বাবরের আদেশে সমরকন্দের অস্ত্র নির্মাতারা, পুরো শীতকালটা যারা কঠোর পরিশ্রম করেছে, এখন তাদের প্রয়াস বৃদ্ধি করে দিন-রাত নাগাড়ে কাজ করছে। বাতাসে এখন কেবল ধাতুর সাথে ধাতুর আঘাত করার শব্দ ভাসছে। তারা চুল্লীতে তীক্ষ্ণ প্রান্ত বিশিষ্ট ফলা আর বর্শার আকৃতি তৈরি করে সেটা নেহাইয়ে রেখে সেটাতে পান দিচ্ছে। অস্ত্রের কোনো কমতি তার নেই এবং সাধ্যমত চেষ্টা করেছে শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে। কিন্তু মানুষ কোথায় পাবে?

সে ভ্রূকুটি করে। শেষবার গণনা করার সময়ে সংখ্যাটা ছিল সাত হাজার। যার ভিতরে মাঙ্গলিঘ তীরন্দাজ বাহিনীও রয়েছে যারা পুরোটা শীতকাল শহরেই অতিবাহিত করেছে। উজবেকরা আক্রমণের পাঁয়তারা করছে জানার পরেই সে এই অঞ্চলের অন্য সর্দারদের কাছে দূত পাঠিয়েছে- এমন কি তামবাল আর জাহাঙ্গীরের কাছেও সে লোক পাঠিয়েছে। সমরকন্দের পতনের পরে তাদের সেনাবাহিনী আকশি ফিরে গিয়েছে- সম্মিলিতভাবে সাধারণ শত্রুকে প্রতিহত করার আবেদন জানিয়ে। এখন পর্যন্ত কারো কাছ থেকে কোনো উত্তর আসেনি।

“ওয়াজির খান, আমি উজবেকদের ফিরে আসতে দেখে মোটেই অবাক হচ্ছি না। আমি জানতাম তাদের ফিরে আসাটা কেবল সময়ের ব্যাপার। আপনি যখন অসুস্থ ছিলেন তখন বাবুরী আর আমি প্রায়ই বিষয়টা নিয়ে আলাপ করতাম…”

“আর সেই বাজারের ছোকরা কি বলতো?”

ওয়াজির খানের কণ্ঠের অপ্রত্যাশিত রুক্ষতায় বাবর অবাক হয়। “হতে পারে সে বাজারের ছেলে, কিন্তু তারপরেও তার কথায় যুক্তি আছে…এবং সে সমরকন্দ আর এর লোকদের ভালো করেই চেনে…”।

“সুলতান, তার ভুলে গেলে চলবে না সে কে, এবং আপনার ক্ষেত্রেও সেটা প্রযোজ্য…আপনি হলেন আমাদের সরতাজ…তার মতো একজন ভুইফোড়ের সাথে আপনি পরামর্শ করছেন বয়োজ্যেষ্ঠ, বিজ্ঞ আর অভিজাত-বংশীয় কাউকে। বিবেচনায় না এনে সেটা ভালো দেখায় না…আল্লাহতালা যদি আপনার পিতার হায়াত দরাজ করতেন তাহলে এসব কথা তিনিই আপনাকে বলতেন…”

বাবর পারলে ওয়াজির খানকে দৃষ্টি দিয়ে ভস্ম করে দেয়। সম্ভবত এসব তার জানের শত্রু সেই বুড়ির কাজ বাবুরীর প্রতি এসান দৌলত তার বিতৃষ্ণা বা বাবুরীর সাথে তার মেলামেশার ব্যাপারে নিজের আপত্তির কথা কখনও গোপন করার চেষ্টা করেননি। বাবরের তারপরেই মনে পড়ে ওয়াজির খানের কাছে সে নানাভাবে ঋণী আর সম্প্রতি বুড়ো লোকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। “তৈমূরের রক্তের উত্তরাধিকারী আর একজন সুলতান এই দুটো বিষয় আমি কখনও ভুলবো না। বাবুরীর সঙ্গ আমার ভালো লাগে…কিন্তু তার পরামর্শ আমি গ্রহণ করি কারণ সেগুলো যুক্তিসঙ্গত। আপনার মতোই আমি যা শুনতে চাই বলে সে বিশ্বাস করে সেরকম মন রাখা কথা বলে না…বরং সে নিজে যা বিশ্বাস করে সেটাই কেবল বলে। তার মানে এই না যে সবসময়ে আমি তার সাথে একমত হই… আমি নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেই…”।

“আপনার বয়োজ্যেষ্ঠ মন্ত্রণাদাতা হিসাবে আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। হতে পারে বাবুরী বিচক্ষণ, কিন্তু একই সাথে সে বদরাগী আর একটা হামবড়া ভাব তার মধ্যে রয়েছে। আপনি যদি তার সাথে আপনার বন্ধুত্বের ব্যাপারে এখনই সতর্ক না হন, অন্যরা তাহলে নিজেদের অবহেলিত মনে করে ঈর্ষান্বিত আর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতে পারে…আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই মাঝে মাঝে আমিও এর উর্ধ্বে উঠতে পারি না…”

ওয়াজির খানের চোখমুখের বিব্রতভাব লক্ষ্য করে বাবর আলতো করে তার কাঁধ স্পর্শ করে। “আপনি আমার সবচেয়ে বড় সহায় এবং অন্যসব ইচকিসের চেয়ে আমি আপনার পরামর্শ বেশি গুরুত্ব দেই। আমি সতর্ক থাকবো…এখন এসব নিয়ে আর শুধু শুধু বিব্রত হবেন না, মন্ত্রণা সভা আহ্বান করেন। তাদের জানা উচিত আমরা পাহাড়ের উপরে কি দেখেছি…”

পায়ের ব্যাথ্যা সত্ত্বেও ওয়াজির খান দ্রুত হেঁটে যায়। বাবর পুনরায় কোলবা পাহাড়ের দিকে তাকায়। কিন্তু কালো অবয়বগুলোকে আর দেখা যায় না। বাবুরীর ব্যাপারে তাকে সতর্ক করে ওয়াজির খানের বলা কথাগুলো কি যথার্থ, নাকি পুরোটাই কেবল তার যে নিজের বয়সী সঙ্গীর প্রয়োজন রয়েছে সেটা বুঝতে ওয়াজির খানের অপারগতা? ঘটনাপ্রবাহ ইতিমধ্যে তাকে দেখিয়েছে যে বাজারের ছেলের মতোই একজন সুলতানের জীবনও যথেষ্ট দৈবাধীন। তৈমূরের মতো সেও যদি সমৃদ্ধি আর সাফল্য অর্জন করতে চায়, তাহলে সবার সম্ভাব্য সাহায্য তার প্রয়োজন হবে। বর্তমানে, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা গুরুত্বপূর্ণ এবং সে ব্যাপারে বাবুরীর চেয়ে দক্ষ আর কেউ না…

বাবর দ্রুত তার দরবার কক্ষে প্রবেশ করে। সেখানে সে একটা নিচু টেবিলে তার আদেশে মাদার অব পার্ল দিয়ে সমরকন্দ আর তার আশেপাশের এলাকার মানচিত্র খোদাই করা দেখতে পায়। আধ ঘণ্টা পরে তার মন্ত্রণাদাতাদের সবাইকে টেবিলের চারপাশে বসে থাকতে দেখা যায়।

শহররক্ষা দেয়ালের ভিতরে আক্রমণের অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না। আমাদের বর্তমান লোকবল দিয়ে সাইবানি খানের হামলা প্রতিহত করা সহজ হবে না, বা দীর্ঘস্থায়ী কোনো অবরোধ আমরা সামলে উঠতে পারবো না। বসন্তের শুরুতে আমরা যদি তাকে গিয়ে আক্রমণ করি নিজের বাহিনী পুরোপুরি গুছিয়ে নেবার আগে, তাহলে আমাদের সফল হবার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা যদিও সংখ্যায় তখনও অনেক কম থাকবো। সে যখন একেবারেই আক্রমণের প্রত্যাশা করছে না তখন আমরা তাকে দ্রুত আর প্রবলভাবে আক্রমণ করতে পারি। সে যদি আমি যা ভেবেছি তাই করে, বোখারা থেকে সে সরাসরি আমাদের আক্রমণ করতে এগিয়ে আসে, তাহলে পূর্বদিক থেকে সমরকন্দের দিকে বহমান এই নদী বরাবর এগিয়ে আসলে সেটাই হবে তার দ্রুততম রাস্তা।” বাবর তার সোনার বাঁটযুক্ত খঞ্জরের ডগাটা দিয়ে প্রায় সোজা একটা পথ এঁকে দেখায়। “কিন্তু সমরকন্দে পৌঁছাবার আগে, তার অন্য বাহিনীর সাথে মিলিত হয়ে সর্বশক্তি নিয়ে আমাদের দিকে আসতে হলে তাকে কোথায় যাত্রাবিরতি করতে হবে…আর আমরা সেই সময়েই তাকে আক্রমণ করবো।”

তার মন্ত্রণাদাতারা সবাই বিড়বিড় করে সম্মতি প্রকাশ করে কেবল বাইসানগারকে উদ্বিগ্ন দেখায়।

“বাইসানগার, কি ব্যাপার…?”

“সাইবানি খানের মতিগতি বোঝা মুশকিল। আমরা তার বিষয়ে যা কিছু জানি তার ভিতরে এটা অন্যতম- সে জন্য আমাদের উপযুক্ত মূল্য দিতে হয়েছে। আমার মনে আছে কিভাবে বর্বরটা তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ভোজবাজির মতো পাহাড় থেকে নেমে এসে আপনার চাচাকে হত্যা করে, আমাদের বাহিনীকে কচুকাটা করেছিলো…”

“আর এজন্যই আমি বোখারায় গুপ্তচর পাঠাচ্ছি। আমি সাইবানি খানকে যেভাবে টোপ দিয়ে সমরকন্দের দেয়ালের ভেতর থেকে টেনে বের করেছিলাম- সেরকম কোনো ফাঁদে আমি নিজে পড়তে চাই না। কিন্তু আমি যখনই নিশ্চিত হবো সে আমাদের আক্রমণ করতে অগ্রসর হচ্ছে, আমি আমার সর্বশক্তি নিয়ে পশ্চিমে এগিয়ে গিয়ে তাকে চমকে দেবো। সে যদি নদীর তীর বরাবর এগিয়ে আসে, তাহলে আমি প্রস্তাব করছি আমরা এখানে তার জন্য ওঁত পেতে থাকবো।” মানচিত্রে সমরকন্দ থেকে ঘোড়ায় তিন দিনের দূরত্বে অবস্থিত একটা স্থানের উপরে বাবর তার খঞ্জরের ডগা রাখে। যেখানে সংকীর্ণ নিচু, পাথুরে পর্বতের মাঝ দিয়ে নদীটা প্রবাহিত হচ্ছে।

***

দশদিন পরে বাবরকে তার লোকদের একেবারে সামনে ঘোড়ায় চড়ে, মন্ত্রণা সভায় সে ঠিক যে জায়গাটার কথা বলেছিলো সেদিকে এগিয়ে যেতে দেখা যায়। এক সপ্তাহ আগে তার গুপ্তদূতের দল খবর নিয়ে আসে যে সাইবানি খান তার দলবল নিয়ে এগিয়ে আসছে। সাথে বিশাল অশ্বারোহী বাহিনী, নদীর দিকে সে এগিয়ে চলেছে। বাবর সমরকন্দে অপ্রত্যাশিত আক্রমণ প্রতিরোধের উপযুক্ত একটা বাহিনী রেখে, তার সেনাবাহিনীকে আদেশ দেয় অগ্রসর হতে। বাবর তার বাহিনী নিয়ে নদী থেকে দূরে অবস্থান করে এবং গুপ্তদূতের দল নদীর তীর ধরে উজবেকদের এগিয়ে আসার খবর তাকে নিয়মিত অবহিত করতে থাকে। সেদিন সকালে তারা খবর নিয়ে আসে যে উজবেক ইতিমধ্যে তাদের রাতের অস্থায়ী ছাউনি গুটিয়ে নিয়েছে এবং তারা যদি তাদের স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে আসা অব্যাহত রাখে তবে আজ দুপুর নাগাদ তারা সংকীর্ণ স্থানটার কাছে পৌঁছাবে।

বাবর, ওয়াজির খান, বাইসানগার আর আলী ঘোসত, তার অশ্বারোহী বাহিনীর তিন অধিকর্তাকে আদেশ দেয়। বাবর আর তার অগ্রগামী বাহিনী, বর্শার আকৃতিতে বিন্যস্ত হয়ে বল্পিত বেগে ঘোড়া ছোটায়। তারা পাশ থেকে এসে উজবেকদের যাত্রা পথের কেন্দ্রে আঘাত করবে এবং দ্বিখণ্ডিত করে বের হয়ে যাবার আগে যতোটা সম্ভব ক্ষতি সাধন আর বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করবে। তারপরে আবার বিপরীত দিক থেকে একই ভঙ্গিতে পুনরায় হামলা করবে। উজবেক বাহিনীর মাঝ দিয়ে তাকে তেড়েফুড়ে অতিক্রম করতে দেখামাত্র ওয়াজির খান তার মূল বাহিনী নিয়ে দ্রুত এগিয়ে এসো সৈন্যবাহিনীর সামনের অংশে আক্রমণ করবে। যখন বাইসানগার আরেকটা বাহিনী নিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরে এসে পেছন থেকে উজবেকদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আলী ঘোসতের অধীনে আরেকটা বাহিনী থাকবে অতিরিক্ত হিসাবে।

বাবর এখন তার সামনে অনুচ্চ ভূমিরেখা দেখতে পায় যেখান থেকে নদীটা দেখা। যায়। তার বাদামী আজদাহা ভূমিরেখার উপরে উঠে আসে এবং তার অগ্রগামী রক্ষীদলের সদস্যরা পাশে এসে দাঁড়াতে উজবেক অশ্বারোহী বাহিনীর লম্বা সারি সে দেখতে পায়। তার অবস্থান সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ দলটা নদীর তীর ধরে ধূলোর একটা মেঘ উড়িয়ে এগিয়ে চলেছে। এই ক্ষণটার জন্যই সে এতো প্রস্তুতি নিয়েছে। ঢাল বেয়ে প্রায় বারোশ গজ দূরে, শত্রুর দিকে ধেয়ে যাবার জন্য সে তার বাহিনীকে আদেশ দেয়। সে তার বাহনকে যখন সামনে এগোবার জন্য ইঙ্গিত করেছে ঠিক তখনই বাবর প্রথমবারের মতো এক নিঃসঙ্গ উজবেক অশ্বারোহী, মূল সারি থেকে সামান্য দূরে, সম্ভবত অনাহুত অতিথির উপস্থিতি সম্পর্কে আগেই সতর্ক করার জন্য নিয়োজিত প্রহরীকে দেখতে পায়। লোকটাও তাকে একই সাথে দেখে এবং সাথে সাথে নিরাপত্তার জন্য মূল বাহিনীর উদ্দেশ্যে ঘোড়া ছোটাবার আগে শিঙ্গায় ফুঁ দিয়ে বিপদ সঙ্কেত ঘোষণা করে।

শিঙ্গার আওয়াজ শোনার সাথে সাথে, উজবেক বাহিনীর গতি মন্থর হয়ে আসে, এবং অশ্বারোহী যোদ্ধারা ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয় বিপদের মোকাবেলা করতে। কেউ কেউ ধনুক নামিয়ে তীরের একটা ঝাপটা বইয়ে দেবার মতো সময় পায় এবং উজবেকদের কাছাকাছি পৌঁছাবার আগেই বাবরের অগ্রগামী রক্ষীদলের কয়েকজন যোদ্ধা মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে। বাবরের নেতৃত্বে বাকি যোদ্ধারা প্রচণ্ড বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে শত্রুর সারিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং চারপাশে এলোপাথাড়ি ঘাই দিতে শুরু করে। উজবেক যোদ্ধাদের সারি পিছু হটতে শুরু করে। মনে হয় যেন। প্রত্যাশিতভাবেই ভাঙছে আর বাবরের মনে হয় বিজয় নিশ্চিত।

কিন্তু তারপরেই উজবেকরা তার সামনে বিক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে ছিটকে সরে যাবার বদলে তাকে তার বাহিনীসহ ঘিরে ফেলতে শুরু করে। বাবর তার তরুণ নিশান বাহককে ঘোড়া থেকে সামনে ছিটকে পড়তে দেখে। বেচারার মাথা উজবেকদের নিজস্ব ধাতব পাতযুক্ত কস্তনীর আঘাতে ছাতু হয়ে গেছে। বাবর তার ঘোড়ার মাথা প্রচণ্ড শক্তি ঘুরিয়ে নিয়ে তরুণ নিশানবাহকের দেহটা এড়িয়ে যায় এবং হাতের বর্শা দিয়ে তার হত্যাকারীকে গেঁথে ফেলে। কিন্তু আরও উজবেক যোদ্ধা মারমুখী ভঙ্গিতে তার দিকে এগিয়ে আসে। বর্শা ফেলে দিয়ে বাবর এবার আলমগীর কোষমুক্ত করে। উজবেক যোদ্ধাদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা আর চাপ তাকে তার দেহরক্ষীদের কাছ থেকে ক্রমশ দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় এবং বুঝতে পারে সে আটকা পড়তে চলেছে। প্রাণে বাঁচতে হলে তাকে এই ব্যুহ ভেদ করে বের হতে হবে। আলগমীর ধরা ডান। হাত সোজা রেখে সে ঘোড়ার গলার উপরে ঝুঁকে আসে এবং তার চারপাশের উজবেক যোদ্ধাদের মাঝে যে সামান্য ফাঁক দেখতে পায় সেদিকে ঘোড়া ছোটায়।

মুহূর্ত পরে, ফাঁকা জায়গায় বেরিয়ে এসে সে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। কপালের উপরের এক কাটা স্থান থেকে রক্ত তার ডান চোখের উপরে গড়িয়ে পড়ে। এক উজবেক যোদ্ধা আরেকটু হলে বর্শা দিয়ে তার মাথা গেথে ফেলেছিল। বাবরের ক্ষিপ্রতা আর আঘাত পাশ কাটাবার দক্ষতা তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে এবং যদিও বর্শার। তীক্ষ্ণ মুখ সে এড়াতে পারেনি। কপাল থেকে রক্ত মুছে ফেলার অবসরে চোখে। ঝাপসা দৃষ্টি নিয়ে সে বুঝতে চেষ্টা করে কোনো দিকে গেলে মূল বাহিনীর সাথে মিলিত হতে পারবে।

কয়েক মিনিট পরে তার দৃষ্টি পরিষ্কার হয়ে আসতে শুরু করে। যদিও ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পড়া তখনও বন্ধ হয়নি। বাবর দ্রুত ঘোড়ার পর্যানের কাপড় থেকে একটা ফালি কেটে নেয় খঞ্জর দিয়ে এবং মাথায় সেটা দিয়ে শক্ত করে পট্টি বেঁধে নেয়। চারপাশে তাকিয়ে সে বুঝতে পারে তাদের চমকে দেবার অভিপ্রায়ে করা হামলা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে এবং আতঙ্কিত আজদাহা তাকে কোণাকুণি উজবেক আর তার সঙ্গের অবশিষ্ট যোদ্ধাদের মাঝে একটা খালি প্রান্তরে উড়িয়ে নিয়ে এসেছে। সে আবার একটা সম্ভাব্য বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি নিজেকে আবিষ্কার করে। তার বাদামী ঘোড়ার পেটে গুতো মেরে সে দ্রুত বল্পিত বেগে নিজের বাহিনীর দিকে এগিয়ে যায়। প্রতিটা মুহূর্ত পেছন থেকে তীর বা বর্শা এসে বিদ্ধ হবার আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে থাকে। কিন্তু তার আশঙ্কা অমূলক প্রতিপন্ন হয়।

আলি ঘোসত তার ধুসর ঘোড়ায় উপবিষ্ট হয়ে আদেশ অনুযায়ী নিজের অধিনস্ত অতিরিক্ত সৈন্যদের নিয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলো। বাবর সেখানে এসে যোগ দেবার পরে তার সেনাপতিদের সাথে নতুন কোনো পরিকল্পনা আলোচনার করার আর সুযোগ বা সময় কোনোটাই পায় না। বাবর তার পর্যদস্ত ঘোড়ার লাগাম টেনে থামার সময়েও পেছন থেকে ঢালের উপরে তরবারির আঘাতের আওয়াজ আর বুনো চিৎকার শুনতে পায়। আর কয়েক মুহূর্ত উজবেকরা তার বাহিনীর দফারফা করে ফেলবে। আমি এখানের নেতৃত্ব গ্রহণ করছি।” সে চেঁচিয়ে উঠে আলি ঘোসতকে বলে। “উজবেক যোদ্ধার সারি বরাবর ওয়াজির খান আর বাইসানগারের কাছে অশ্বারোহী বার্তাবাহক পাঠান। পূর্বের সব আদেশ তাদের ভুলে যেতে বলেন। উজবেকরা আমাদের তীরন্দাজদের আওতার ভিতরে আসা মাত্র তাদের উপরে নরক নামিয়ে আনতে আদেশ দেন। তারপরে, আমার নেতৃত্বে আমাদের পুরো বাহিনী আক্রমণে যাবে।”

তরবারি উঁচু করে ধরে বাবর ঘামে জবজব করতে থাকা ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয় উজবেকদের মুখোমুখি হবার জন্য। আদতে তাদের সামনে অগ্রগামী হবার বেগ হ্রাস পেয়েছে এবং এখন রেচিত বেগে তারা সামনে বাড়ছে। তাদের ঠিক কেন্দ্রে লম্বা দুটো বেগুনী ঝাণ্ডার মাঝে সে একজন অশ্বারোহীকে সনাক্ত করে, যে কেবল সাইবানি খানই হতে পারে। অনেক দূরে অবস্থান করায় বাবর তার চেহারা ভালো করে বুঝতে পারে না। কিন্তু তার স্পর্ধিত আচরণ তার স্থিরতার ভিতরে কিছু একটা রয়েছে যা চোখে পড়ে। ছয় মাস আগে ঠিক যেমন সমরকন্দ থেকে অবরোধের আশঙ্কায় নিজের বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে আক্রমণের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যাবার সময়ে সে দৃষ্টি কেড়েছিল। বাবর তাকিয়ে থাকার মাঝেই সাইবানি খান ধীরে ধীরে অনেকটা অভিবাদনের ভঙ্গিতে বাম হাত উঁচু করে এবং তার যোদ্ধাদের ভিতর থেকে রণহুঙ্কারের একটা তরঙ্গ ভেসে উঠে- এমন একটা শব্দ যা রক্ত শীতল করে ফেলে।

বাবরের যোদ্ধারা প্রত্যুত্তরে চেঁচিয়ে উঠে নিজেদের অবজ্ঞা প্রকাশ করে। কিন্তু তাদের অবজ্ঞা হুমকির মাত্রা লাভ করার আগেই নিজের তরবারির এক ঝাপটায় সাইবানি খান আক্রমণের সঙ্কেত দেয় এবং উজবেক খুরের দাপটে তারা বল্পিত বেগে সামনে এগিয়ে আসতে বাকি সব শব্দ চাপা পড়ে যায়। বাবরের চারপাশে তার লোকেরা একহাতে লাগাম ধরে ঘোড়া শান্ত রাখার পাশাপাশি ঢাল উঠিয়ে আকাশ অন্ধকার করে নেমে আসা তীরের বৃষ্টি ঠেকাতে হিমশিম খেয়ে যায়। বাবরের তীরন্দাজ বাহিনীও চুপ করে বসে না থেকে পাল্টা তীর ছোড়ে। আর সেগুলো লক্ষ্যভেদও করে। কিন্তু উজবেকদের ধেয়ে আসা কালো তরঙ্গের ছন্দময়তায় বিন্দুমাত্র ছেদ পড়ে না। এমনকি তীরের আঘাতে জিন থেকে ছিটকে ধাবমান খুরের নিচে যোদ্ধারা পিষে যেতেও গতির কোনো হেরফের হয় না।

উজবেক বাহিনী আরো কাছে এগিয়ে আসে। “সমরকন্দের জন্য!” বাবর চিৎকার করে উঠে এবং পাল্টা আক্রমণের জন্য ধেয়ে যেতে তার লোকেরা তাকে অনুসরণ করে। নিমেষ পরে, দু’দল যোদ্ধা ধেয়ে আসা দুটো স্রোতের মতো পরস্পরের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ধাতুর উপরে ধাতুর আপতনের শব্দের সাথে ঘোড়ার চিহি রব আর মানুষের আর্তনাদ, হুঙ্কার মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সম্মুখ সমরের চাপ আর বিভ্রান্তির কারণে বলা কঠিন- যে আসলেই কি ঘটছে। কিন্তু কচুকাটার মতো করে ডানে বামে তরবারি চালাবার সময়ে বাবরের মনে হয় তার যোদ্ধারা বুঝি উজবেকদের চেপে ধরছে। ভাবনাটা তার ভিতরে নতুন উদ্যমের জন্ম দিতে সে লম্বা, বর্ম-ধারী এক উজবেকের দিকে ধেয়ে গেলে, তাকে মোকাবেলা করার বদলে সে ঘোড়া নিয়ে পিছু হটে। তার বাহিনীর চেয়ে উজবেক বাহিনীর সংখ্যা অনায়াসে বেশি হবে। কিন্তু চারপাশের পরিস্থিতি দেখে মনে হয় তারা পিছু হটছে। বাবর আর তার অমিত সাহসী যোদ্ধার দল স্থির সংকল্পে সামনে এগিয়ে যেতে উজবেক বাহিনী ডানে বামে ছিটকে যাচ্ছে।

কিন্তু তারপরেও তাকে দেখতে হবে আসল পরিস্থিতিটা কেমন। বাবর তার বাদামী আজদাহার পাঁজরে গুঁতো দিয়ে তার সামনে সহসা উন্মুক্ত হওয়া ফাঁকের ভিতর দিয়ে তাকে ছুটিয়ে নিয়ে যায়। তার আশেপাশের যোদ্ধাদের অনুসরণ করতে বলে সে একটা নিচু আগাছাপূর্ণ টিলার দিকে ঘোড়া হাঁকায়, যা সে যতোটা দেখতে পাচ্ছে- খালি রয়েছে এবং ভালো পর্যবেক্ষণ স্থান হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। সেখানে পৌঁছে সে নিচের যুদ্ধ পরিস্থিতির দিকে তাকায়। লড়াকু, পলায়নপর যোদ্ধাদের মাঝে একটা বিন্যাস তার সামনে আকৃতি লাভ করতে থাকে। সহসা সবকিছু স্পষ্ট হয়ে উঠে এবং বাবর নিজের উপরে ক্ষোভে কটুকাটব্য করে উঠে। সে বুঝতে পারে উজবেকরা আসলে কি চাইছে। মোঙ্গলদের একটা প্রাচীন যুদ্ধরীতি তুলুগামার উপরে তারা নির্ভর করছে। সে কেবল পুস্তকে এর কথা পড়েছে কখনও চোখে দেখেনি।

বাবরের লোকদের আক্রমণের মুখে পিছু হটে যাবার ভান করে সাইবানি খানের যোদ্ধারা আসলে ডানে আর বামে দুটো আলাদা দলে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের ভিতরে তারা ঘুরে দাঁড়িয়ে বাবরের সেনাবাহিনীর বাম আর ডান বাহু আক্রমণ করে কেন্দ্রের সেনাদলকে অরক্ষিত এবং বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে। উজবেকরা এরপরে বাবরের বিচ্ছিন্ন দুই বাহিনী থেকে নিজেদের পৃথক করে নেবে কেন্দ্রে হামলা করার জন্য ব্যুহ তৈরি করতে। কেন্দ্র গুঁড়িয়ে দেয়ার পরে তারা তাদের সহযোদ্ধাদের সাথে পুনরায় যোগ দেবে, পূর্বে বিচ্ছিন্ন সেনাবাহিনীর ডান আর বাম বাহুকে নাশ করতে। ওয়াজির খানের অধীনস্ত যোদ্ধারা বাধ্য হবে নদীর দিকে এগিয়ে যেতে এবং তীরের ঢালু আর বালুময় ভূমিতে আটতে পড়বে। অন্যদিকে বাইসানগারের বাহিনী যদি এখনই পালাতে সক্ষম না হয় তবে তারা পুরোপুরি উজবেক বেষ্টনীর মাঝে আটকে যাবে।

বাবরের পেছন থেকে ভেসে আসা শিঙ্গা ধ্বনিতে যুদ্ধের ডামাডোল চাপা পড়ে যায়। সোয়া মাইল দূরে একটা পাহাড়ের পেছন থেকে উজবেক যোদ্ধাদের একটা বহর দুলকি চালে এগিয়ে আসছে। নেকড়ের পালটা সম্ভবত সেখানে লুকিয়ে অপেক্ষা করছিলো। দলটা নিকটবর্তী হতে কালো চামড়া মোড়া ঢালের উপরে রূপার গোলাকৃতি কারুকাজ দেখে বাবর চিনতে পারে তাদের: সাইবানি খানের দুর্ধর্ষ বাহিনী। তার নিজের গোত্রের, একই রক্ত বহন করা যোদ্ধার দল। বাইসানগারের অধীনস্ত বাহিনীর দিকে তারা এগিয়ে যায়। কোনো সন্দেহ নেই তাদের পালাবার শেষ সম্ভাবনাটুকুও তারা বন্ধ করে দিতে চায়।

বাবর সহসা উপলব্ধি করে ভূমির চড়াই উতরাইয়ের কারণে বাইসানগার শত্রু পক্ষের আগুয়ান বাহিনীকে দেখতে পাবে না। কিন্তু হামলাকারীদের চেয়ে সে নিজে বাইসানগারের নিকটে অবস্থান করছে। সে দ্রুত, ঘোড়া তাজা রয়েছে এমন এক যোদ্ধাকে নির্বাচিত করে। “বাইসানগারকে সতর্ক করে দাও- তাকে বল নিজের অবশিষ্ট বাহিনী নিয়ে সে যেনো সমরকন্দে ফিরে যাবার জন্য সর্বোচ্চ প্রয়াস নেয়। আমার কথা তুমি বুঝতে পেরেছো?”

তরুণ অশ্বারোহী ঢাল বেয়ে দ্রুত নেমে যায়। বার্তাবাহক আক্রমণরত উজবেক বাহিনীর নাগাল এড়িয়ে যেতে পারবে, এটা মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত বাবর সেখানে অপেক্ষা করে। তারপরে সে বাকিদের তার কাছাকাছি অবস্থান করতে বলে নদীর তীরের দিকে ধেয়ে যায় যেখানে ওয়াজির খানের বাহিনী নিজেদের প্রাণ বাঁচাবার মরণপণ লড়াইয়েরত।

আক্রমণকারী উজবেক যোদ্ধাদের সারি যেখানে দুর্বল, বাবর ঘুরে এসে সেখানে হামলা করে। তরবারির আঘাতে নিজের পথ করে নেয়। কিন্তু তার সাথে যে বিশজনের মতো যোদ্ধা ছিলো তাদের ভিতরে কেবল বারোজন ব্যুহ ভেদ করে বের হয়ে আসতে পারে। হতাশাব্যঞ্জক একটা পরিস্থিতি। ওয়াজির খানের বাহিনীকে আদতেই নদীর দিকে ঠেলে নিয়ে চলেছে উজবেকরা। তাদের কেউ ঘোড়ার পিঠে উপবিষ্ট অবস্থায় ক্রমাগত তীর নিক্ষেপ করছে, কেউ বালুময় নদী তীরে ঘোড়ার পায়ের নীচ থেকে সরে যাওয়া বালুর কারণে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেই হিমশিম খেতে থাকা মানুষ আর ঘোড়ার বিশৃঙ্খল টালমাটাল দঙ্গলের ভিতরে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাতের বাঁকানো তরবারির ধারের সদ্ব্যবহার করে। বাবর ওয়াজির খানকে ভীড়ের মাঝে সনাক্ত করতে পারে না।

বাবর সহসা অনুভব করে তার ঘোড়া থরথর করে কাঁপছে। বাদামী রঙের সুন্দর আজদাহা ব্যাথায় চিৎকার করে উঠে। দুটো তীর একইসাথে গলায় আর ঘাড়ে বিদ্ধ হতে এবং ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া শিরা থেকে তাজা লাল রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হয়ে আসতে বেচারী ইতিমধ্যে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাতে শুরু করে সজোরে মাটিতে আছড়ে পড়ে। বাবর সময়মত জিন থেকে লাফিয়ে পড়ে বিশাল প্রাণীটার নিচে চাপা পড়ার হাত থেকে বেঁচে যায়। বাবর টলমল করতে করতে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হাতে তখনও আলমগীরের বাঁট ধরা। কিন্তু খঞ্জর আর ঢাল কোথায় যেনো ছিটকে পড়েছে। মাতালের মতো টলতে টলতে এবং বাতাসে ক্রমাগত ছোবল দিতে থাকা তরবারির ফলা আর কস্তনীর মতো ঘোড়ার খুরের থাবা এড়িয়ে সে আরেকটা ঘোড়ার আশায় চারপাশে তাকায়।

“সুলতান।” বাবুরী ভূতের মত উদয় হয়, তার মুখ রক্তে আবৃত। চোখে বেপরোয়া দৃষ্টি। পর্যানের উপরে সামনে ঝুঁকে এসে, সে বাবরকে তার বিশাল ধূসর ঘোড়ার পিঠের পেছনে তুলে নেয়।

“নদীর দিকে চলো!” বাবর চিৎকার করে বলে। যতোজন সম্ভব যোদ্ধাকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে আরেকদিন যুদ্ধের জন্য বেঁচে থাকাটাই এখন তাদের একমাত্র আশা। তরবারি মাথার উপরে আন্দোলিত করার ফাঁকে সে চারপাশে তার বাকি সেনাপতিদের দিকে তাকায় এবং চিৎকার করে নিজ নিজ বাহিনীসহ নদীর দিকে পিছিয়ে যেতে বলে। ওয়াজির খানকে সে এখনও দেখতে পায় না।

পাহাড়ের বরফ গলতে শুরু করায় নদী এখন কানায় কানায় পূর্ণ। ঘোড়া নিয়ে নদীর পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লে দেখা যায় পানি প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর স্রোতও বেশ তীব্র। বাবুরীর ঘোড়া তাদের দুজনের ওজনের কারণে বেশ কষ্ট করে সাঁতার কাটে। তাদের দুজনকে নিয়ে বেচারা কখনও তীরে পৌঁছাতে পারবে না। আলমগীর কোষবদ্ধ করে বাবুরী কিছু করার আগেই সে পিছলে পানিতে নেমে যায়। কিন্তু মাত্র বিশ গজ দূরে অবস্থিত অপর পাড়ের উদ্দেশ্যে সাঁতার কাটতে আরম্ভ করলে একটা শক্তিশালী স্রোতের কবলে পড়ে সে ভাটির দিকে ভেসে যায়।

“সুলতান…” বাবর ওয়াজির খানের কণ্ঠস্বর চিনতে পারে। কিন্তু কানের কাছ দিয়ে বয়ে চলা হিমশীতল পানির স্রোত তাকে নিজের মাঝে টেনে নেবার হুমকি ক্রমাগত দিতে থাকলে সে চারপাশে তাকিয়ে দেখার মতো সময় পায় না। তারপরে সে পানিতে একটা পাতলা শক্তমতো কিছু অনুভব করে। সহজাতপ্রবৃত্তির বশে সে সেটা আঁকড়ে ধরে। জিনিসটা বর্শার হাতলের মতো অনেকটা। নদীর স্রোত এবার তাকে ধারালো পাথরের একটা দৃশ্যমান শিলাস্তরের মাঝে নিক্ষিপ্ত করতে সে বর্শার হাতল পাথরের সংকীর্ণ খাঁজে আটকে দেয়। বাবর এবার হাতলের উপরে ভর দিয়ে। নিজেকে পাথরের কাছে টেনে নিয়ে আসে এবং ক্ষতবিক্ষত আর রক্তাক্ত হাতে সে হাঁপাতে হাঁপাতে নিজেকে পানির উপরে উঠিয়ে নিয়ে আসে।

তার চারপাশের পানিতে বৃষ্টির মতো তীর এসে পড়তে থাকে। নদীর অপর পাড়ে উজবেক তীরন্দাজের দল সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে, পলায়নরত প্রতিপক্ষকে ধুয়ো দেয়, কেউ কেউ আবার তীর ছোঁড়ার মাঝে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করতে থাকে। সে একটা পাথরের পেছনে আড়াল নিতে গিয়ে ওয়াজির খানকে দেখতে পায়। বেচারা তখনও পানিতে নাস্তানাবুদ হচ্ছে। তার কালো ঘোড়ার পাঁজরে আর পাছার দাবনায় কয়েকটা তীর বিদ্ধ হয়েছে এবং আতঙ্ক আর যন্ত্রণায় বেচারার চোখ বড় বড় হয়ে আছে। ওয়াজির খান আপ্রাণ চেষ্টা করে ঘোড়াটাকে তীরের কাছে নিয়ে আসতে। কিন্তু এখনও অর্ধেক পথ বাকি। বাবরের প্রাণ বাঁচিয়েছে যে বর্শা, সেটা কি তারই ছুঁড়ে দেয়া? নিজের বিপদের কথা বিস্মৃত হয়ে, বাবর পাথরের আড়াল থেকে উঠে দাঁড়ায় এবং ওয়াজির খানের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকে। বুড়ো যোদ্ধা চোখ তুলে তাকায়।

তারপরেই বাবর দেখে অপর পাড়ে দাঁড়ানো এক তীরন্দাজ তার দিকে ধনুক তাক করে এবং ধনুকের ছিলা কানের পাশে টেনে নিয়ে আসে। শিকার লক্ষ্য করে উড়াল দেয়া বাজপাখির মতো কালো পালক শোভিত তীর ধনুক থেকে নিক্ষিপ্ত হয়ে বাতাস কেটে অমোঘ গতিতে এগিয়ে আসে। কোনো অজানা কারণে, ওয়াজির খান ঘুরে দাঁড়ায় এবং সেভাবে দাঁড়ানো অবস্থায়, তীরটা তার অরক্ষিত গলায় এমন জোরে এসে আঘাত করে যে তীরের ফলাটা তার ঘাড়ের পেছন দিয়ে বের হয়ে আসে। সে ঘোড়ার উপর থেকে ধীরে ধীরে কাত হয়ে প্রচণ্ড গর্জন করে বহমান খরস্রোতা পানিতে গড়িয়ে পড়ে। বাবরের বেপরোয়া, হতাশ চিৎকার তাকে অনুসরণ করে রক্তে লাল হয়ে উঠা পানিতে তার দেহ ধীরে বয়ে যায়।

আকশির দূর্গে তার আব্বাজানকে অতল খাদে আছড়ে পড়তে দেখে সে যেমন স্তম্ভিত, হতভম্ব হয়ে পড়েছিল আজও তার ঠিক সেই দশা হয়। সে মাটিতে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে চোখ বন্ধ করে।

“সুলতান, আমাদের এখান থেকে যেতে হবে…” বাবুরীর কণ্ঠস্বর তার কানে আসে। বাবর যখন কোনো উত্তর দেয় না, তখন সে রুক্ষভাবে তাকে ধরে দাঁড় করিয়ে দেয়। এভাবে বসে থাকলে চলবে না…সেটা মূর্খতার সামিল হবে…”

“ওয়াজির খান…ভাটিতে খুঁজে দেখার জন্য একটা অনুসন্ধানী দল আমি পাঠাতে চাই…সে হয়তো এখনও বেঁচে আছে।”

“তিনি মারা গিয়েছেন…এখন মৃতরাই তার দায়িত্ব নেবে। নিজেকে বাঁচানো ছাড়া আপনি এখন তার জন্য কিছুই করতে পারবেন না… বেঁচে থাকলে তিনিও তাই চাইতেন। আপনি সেটা জানেন…এখন চলুন…”

***

“সুলতান, শস্যভাণ্ডার প্রায় খালি হয়ে এসেছে।” বাবরের অভিজ্ঞ উজির অবরোধ আরম্ভ হবার পর থেকে সমরকন্দের শস্য পরিস্থিতি লিপিবদ্ধ করে এসেছে যে লাল রঙের চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা খেরো খাতায়, সেটার দিকে একবার তাকিয়ে তারপরে বলে।

“আর কতদিনের রসদ মজুদ রয়েছে?”

“পাঁচ দিনের মতো। খুব বেশি হলে এক সপ্তাহ চলবে।”

খাদ্যের পরিমাণ আরও কমাবার কোনো প্রশ্ন উঠে না। একজন সৈনিকের জন্য এখনই দৈনিক বরাদ্দ তিনকাপ শস্যদানা, পুরুষ নাগরিকের জন্য দুইকাপ এবং বাচ্চা আর মেয়েদের জন্য এক কাপ করে শস্য বরাদ্দ করা রয়েছে। শহরের অধিবাসীরা ইতিমধ্যে চোখের সামনে যা কিছু দেখছে তাই খেতে শুরু করেছে। গুলতি দিয়ে শিকার করা কাক থেকে আরম্ভ করে গাধা বা কুকুরের মাংস যেসব প্রাণী খাদ্যের অভাবে মারা গিয়েছে বা মাংসের জন্য তাদের জবাই করা হয়েছে। শাহী আস্তাবলের ভারবাহী প্রাণীদের অনেক আগেই সৈনিকদের মাংসের প্রয়োজনে হালাল করা হয়েছে। তার লোকেরা বাধ্য হয়ে এই সময়ের জন্য দারুণ মূল্যবান অশ্বারোহী বাহিনীর ঘোড়াগুলিকে গাছের পাতা আর কাঠের গুড়ো পানিতে গুলে খেতে দিচ্ছে ফলে প্রতিদিনই প্রাণীগুলোর অবস্থা আরও সঙ্গীন হয়ে উঠছে। শীঘ্রই এমন সময় আসবে যখন তারা বাধ্য হবে ঘোড়াগুলিকে হত্যা করতে। একবার ঘোড়ার পাল শেষ হয়ে গেলে তারা শহরের চারপাশের দেয়ালে উজবেক অবরোধ ছিন্ন করে ঝটিকা বাহিনী পাঠিয়ে রসদের অন্বেষণ করতে ব্যর্থ হবে।

গত তিন মাস ধরে প্রতিটা দিন বাবর কেবল একটা বিষয়ই চিন্তা করেছে সাইবানি খান কি আদৌ আক্রমণ করবে। কিন্তু সে কেন আক্রমণ করবে? বাবরের আত্মসমর্পন যখন সে জানে এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। নিদারুণ খাদ্যকষ্টে দিন অতিবাহিত করা শহরের লোকদের চোখের সামনে সে প্রতিদিন দেয়ালের কাছে নিজের লোকদের জন্য ভূড়িভোজের আয়োজন করে সে বোধহয় বিকৃত আনন্দ লাভ করছে এবং আশেপাশের গ্রাম থেকে লুট করে আনা খাদ্যশস্যের স্তূপ অবরুদ্ধ শহরবাসীর চোখের সামনে পুড়িয়ে দিয়ে সে যেনো তাদের বলতে চায়, “নষ্ট করার মতো যথেষ্ট খাবার আমার রয়েছে- তোমাদের অবশ্য কিছুই নেই।”

এসবের চেয়েও জঘন্য বিষয়, তিন সপ্তাহ আগে বাবরের সেনাবাহিনীর ছয়জন পক্ষত্যাগী সদস্য তার হাতে ধরা পড়েছিলো যারা শহরের দেয়াল টপকে পালাতে চেষ্টা করেছিলো এবং তার আদেশে শহর রক্ষাকারী দেয়ালের ঠিক সামনে তার আদেশে বেচারীদের বিশাল তামার পাত্রে তেলে সিদ্ধ করা হয়েছে। তাদের অন্তিম চিৎকারের একটা সুফল এসেছে আর কেউ এরপরে আর পালাবার চেষ্টা করেনি।

বাবর কাশিমকে বিদায় করে, সিঁড়ি দিয়ে আঙ্গিনায় নেমে এসে দেহরক্ষীসহ একটা ঘোড়া প্রস্তুত করতে বলে। ওয়াজির খানের মৃত্যুর শোক সে এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি- সে একজন বিশ্বস্ত বন্ধুর অভাবই কেবল অনুভব করে না, সেই সাথে এই হতাশাব্যঞ্জক বিষণ্ণ সময়ে সে তার মতো একজন অভিজ্ঞ পরামর্শদাতার শূন্যতা। আজকাল তার সাথে যারা ঘোড়া নিয়ে বের হয় তাদের ভিতরে বাবুরী প্রধান। গত কয়েক মাসের অভাবের ফলে তার চোখের নিচের হাড় আরও উঁচু হয়েছে। কি ঘটছে সে বিষয়ে সে ভালই মূল্যায়ন করতে পারে এবং খোলাখুলি কথা বলতেও সে প্রস্তুত।

রেজিস্তান চত্ত্বরে স্থাপিত, রেশমের চাদোয়ার নিচে পান্নাশোভিত হয়ে মঞ্চে উপবিষ্ট হয়েছিলো যখন বাবর- উৎসবমুখর সেসব দিন থেকে আজকের দিন কতো আলাদা। সমরকন্দের চিত্তাকর্ষক টাইলসেশোভিত চাকচিক্যময় ভবনগুলোকে সেদিন কেমন ম্লান মনে হয়েছিলো।

বাবর যে রাস্তা দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যায় সেখানে পূতিগন্ধময় জঞ্জাল আর আবর্জনা জমে স্তূপ হয়ে আছে যা সরাবার মতো লোক নেই। যদি না কেউ খাবারের সন্ধানে সেখানে হাতড়াতে না আসে। বাবুরি তাকে বলেছে ক্ষুধার জ্বালায় মরিয়া হয়ে কিছু নগরবাসী গোবর ঝাঁঝরিতে ফেলে চেলে দেখেছে সিদ্ধ করার মত শস্যদানা পাওয়া যায় কিনা। অন্যেরা হাতের কাছে লতা পাতা যা পাচ্ছে তাই পানিতে সিদ্ধ করছে। বাবর যেদিকেই তাকায় সে চুপসে যাওয়া মুখ আর কোটরাগত মলিন চোখ দেখতে পায়। যে লোকগুলো এক সময়ে তাকে দেখে উফুল্ল হয়ে উঠতো আজ তারা তাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়।”

“বাবুরি, লোকগুলো কি ভাবছে?”

“নিজের খিদে নিবারণ ছাড়া আর কিছুই তারা ভাবছে না। আর সামান্য যে কয়বার তারা অন্য কিছু ভাববার মতো ফুরসত পায় তখন সাইবানি খান শহর দখল করে কি করবে, সেটা ভেবে ভয় পায় যা তাদের ধারণা আসন্ন। উজবেকরা গতবার কোনো কারণ ছাড়াই হত্যা, ধর্ষণ আর ধবংসযজ্ঞে মেতেছিলো। সাইবানি খান এবার মনে রাখবে কিভাবে শহরের অধিবাসীরা আপনাকে স্বাগত জানিয়েছে, তার লোকদের উপর হামলা করেছে এবং সে নিশ্চিতভাবেই এর প্রতিশোধ নিতে চাইবে।”

“আমি তৈমূরের সমাধিতে যাবো…” বাবর সহসা ঘোষণা করে। বাবুরীকে বিস্মিত দেখায় কিন্তু সে কিছু বলা থেকে বিরত থাকে।

সমাধিপ্রাঙ্গণের প্রবেশ পথের সামনের আঙ্গিনায় ঘোড়ার চড়ে প্রবেশ করে বাবর। লাফিয়ে নেমে আসে এবং ইঙ্গিতে বাবুরীকে তার সাথে ভেতরে আসতে বলে। সমাধিপ্রাঙ্গণের খিদমতগারদের হাতের ইশারায় চলে যেতে বলে। সে দ্রুত ভেতরের প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে এবং তৈমূরের মরদেহ যেখানে শায়িত রয়েছে সেই ভূগর্ভস্থ কক্ষে প্রবেশ করে।

বাবর শীতল পাথরের উপরে হাত রাখে। “এখানেই শায়িত আছেন মহাবীর তৈমূর। আমি প্রথমবার যখন এখানে এসেছিলাম, তখন শপথ নিয়েছিলাম যে তার যোগ্য উত্তরসূরী বলে নিজেকে প্রমাণ করবো। সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার সময় হয়েছে। শহরের দেয়ালের বাইরে আমি একটা শেষ যুদ্ধে আমার লোকদের নেতৃত্ব দেবো। ভবিষ্যত প্রজন্ম যাতে বলতে না পারে, তৈমূরের শহর আমি কোনো ধরণের প্রতিরোধ গড়ে না তুলে বর্বরদের হাতে সমর্পণ করেছি…”

“তিল তিল করে ধুকে মরার চেয়ে যখন আমাদের তরবারি চালাবার মতো শক্তিও আর অবশিষ্ট থাকবে না, তারচেয়ে এ ধরণের মৃত্যুই ভালো…”

বাবর সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ে এবং আগেও যেমন করেছে এবারও শীতল পাথরের শবাধার চুম্বন করার জন্য নত হয়।

কিন্তু তারা কোক সরাইয়ে ফিরে আসবার সময়ে পথে বাবর কিছু একটা পরিবর্তন আঁচ করতে পারে। রাস্তায় আগের চেয়ে অনেক বেশি লোক দেখা যায় এবং সবাই উৎসুক ভঙ্গিতে হাত পা নেড়ে কথা বলছে, ভাবটা এমন যেনো আলাপ করার মতো সংবাদ তারা জানতে পেরেছে। সে যেদিকে চলেছে অনেকেই সেদিকে এগিয়ে যায়, চারপাশে একটা জনসমুদ্রের সৃষ্টি হতে তার দেহরক্ষীর দল বাবরকে ঘিরে একটা বেষ্টনী গড়ে তুলে এবং তাকে নির্বিঘ্নে অতিক্রমের সুযোগ দিতে তারা হাতের বর্শার হাতল ব্যবহার করে লোকজনকে ঠেলে পেছনে সরিয়ে দেয়।

তার এক সৈন্য বর্শা উঁচিয়ে তার দিকে ধেয়ে আসে। “সুলতান।” প্রহরী কথা বলার মতো দূরত্বে এসে হাজির হতে চেঁচিয়ে উঠে। “সাইবানি খান একজন বার্তাবাহক পাঠিয়েছে।”

দশ মিনিটের ভিতরে বাবর কোক সরাইয়ে ফিরে এসে মন্ত্রণা কক্ষে, যেখানে সভাসদরা তার জন্য অপেক্ষা করছে, দর্শন দেয়।

উজবেক দূত কালো পাগড়ি আর গাঢ় বেগুনী রঙের জোব্বা পরিহিত বেশ মোটাসোটা দীর্ঘকায় এক ব্যক্তি। এক রণকুঠার লোকটার পিঠে ঝোলানো, কোমরে ঝুলছে খাঁটো, বাঁকা, একধারি তলোয়ার এবং কমলা রঙের পরিকরে গোঁজা রয়েছে রূপার বাঁটযুক্ত খঞ্জর। বাবর মন্ত্রণা কক্ষে প্রবেশ করতে সে হাত দিয়ে বুক স্পর্শ করে।

“আপনি কি সংবাদ নিয়ে এসেছেন?”

“আমার প্রভু আপনার বিড়ম্বনার একটা সমাধান প্রস্তাব করেছেন।”

“আর সেটা কি?”

“তিনি চোরের মতো আপনার শহর দখল করার ব্যাপারটা মার্জনা করতে প্রস্তুত আছেন। তার ন্যায়সঙ্গত সম্পত্তি তাকে ফিরিয়ে দিলে আপনাকে, আপনার পরিবার আর সেনাবাহিনীসহ শহর ত্যাগ করতে দেয়া হবে। তিনি আপনাকে ফারগানা বা পশ্চিমে কিংবা দক্ষিণে আপনার যেখানে পছন্দ সেখানে নিরাপদে গমন করতে দেবেন। পবিত্র কোরান শরীফের নামে তিনি শপথ করছেন যে তিনি আপনাকে আক্রমণ করবেন না।”

“আর এই শহর আর এর লোকদের ভাগ্যে কি ঘটবে? তিনি কি মানুষের চামড়া দিয়ে আরও ঢাক প্রস্তুত করতে চান, যেমনটা তিনি আমার ভাই শাহজাদা মাহমুদের চামড়া দিয়ে তৈরি করেছিলেন?”

“আমার প্রভু বলেছেন তাকে অপমাণিত করার জন্য শহরের বাসিন্দাদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু সেটা হবে কর আরোপের মাধ্যমে। যে কোনো ধরণের রক্তপাত পরিহার করা হবে। তিনি এ বিষয়েও কোরান শরীফ সাক্ষী রেখে ওয়াদা করছেন।”

“এর সাথে কি আর কোনো শর্ত আছে?”

“একেবারেই না। কেবল একটাই কথা আগামী পূর্ণিমার আগে তার মানে এখন থেকে দু’সপ্তাহকালের ভিতরে আপনি সমরকন্দ ত্যাগ করবেন।” বিশালদেহী দূত তার ততোধিক বিশাল উদরের উপরে হাত ভাঁজ করে দাঁড়ায়।

“সাইবানি খানকে গিয়ে বলবেন, আমি তার প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখবো। আর আগামীকাল দুপুর নাগাদ আমার উত্তর জানাবো।”

“আর সেই অবসরে আমার প্রভুর তরফ থেকে আমি আপনার জন্য সামান্য উপহার নিয়ে এসেছি।” বিশালদেহী উজবেক দূত আঙ্গুলে তুড়ি বাজাতে তার একজন পরিচারক, যে একপাশে নিরবে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো এবার একটা বিশাল ঝুড়ি নিয়ে সামনে এগিয়ে আসে। ঝুড়ির মুখের মোচাকৃতি ঢাকনা খুলে সে ভেতরে জিনিস মঞ্চের নিচে পাতা গালিচার উপরে ঢেলে দেয়- সমরকন্দের বাইরে অবস্থিত ফলবাগানের সুপ, মধুর মতো মিষ্টি এবং সোনালী রঙের তরমুজ গড়িয়ে বের হয়ে আসতে তাদের মুখে পানি নিয়ে আসা সুগন্ধে কক্ষটা মম করতে থাকে। “আমি দুটো গাধার পিঠে বোঝাই করে নিয়ে এসেছি। ফিরোজা দরোজায় গাধাগুলো দাঁড়িয়ে আছে। আমার প্রভুর বিশ্বাস ফলগুলো আপনার রসনা তৃপ্ত করবে।”

“আপনি আপনার প্রভুকে গিয়ে বলবেন আমাদের এসব প্রয়োজন নেই। সমরকন্দের দেয়ালের অভ্যন্তরে অবস্থিত বাগানের ফলের গাছ পাকা ফলে নুয়ে পড়ছে। আমরা এগুলো আমাদের গাধাকে খাওয়াবো…” বাবর উঠে দাঁড়ায় এবং দূতের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময়ে সে ইচ্ছাকৃতভাবে একটা তরমুজ লাথি দিয়ে সরিয়ে দেয়। কক্ষের মেঝেতে গড়িয়ে গিয়ে সেটা পাথরের চৌকাঠে আঘাত করতে ভেতরে নরম সোনালী আঁশ চুঁইয়ে বের হয়ে আসে।

***

“আমরা কি তাকে বিশ্বাস করতে পারি?” সেদিন রাতে, মোমবাতির আলোতে আলোকিত মন্ত্রণা কক্ষে তারা মিলিত হতে, বাবরের চোখ তার মন্ত্রণাদাতাদের মুখের অভিব্যক্তি পড়তে চেষ্টা করে। তাদের মতামত শোনার আগে পুরো বিষয়টা নিয়ে তাকে ভালো করে ভেবে দেখতে হবে।

“সে একটা বর্বর এবং আমাদের জানের দুশমন। কিন্তু সে কথা দিয়েছে।” বাইসানগার অভিমত প্রকাশ করে।

“গরু চোরের কথার মূল্য…” বাবর কঠোর ভঙ্গিতে প্রত্যুত্তর দেয়।

“কিন্তু পবিত্র কোরান শরীফের নামে এভাবে প্রকাশ্যে শপথ নিয়ে সেটা ভঙ্গ করলে তার বদনাম হবে।”

“কিন্তু তার এমন প্রস্তাব পাঠাবার কারণ কি? আমাদের চেয়ে তার সেনাবাহিনী সংখ্যায় বিশাল এবং যখন জানে সে শহরে তুমুল খাদ্যাভাব বিরাজ করছে। অপেক্ষা করতে চাইছে না কেন? সাইবানি খানের ধৈর্যের অভাব আছে বলে তো জানতাম না?”

“সুলতান, আমার মনে হয় আমি প্রস্তাব পাঠাবার আসল কারণ কি বুঝতে পেরেছি।” বাবুরী, বাবরের মঞ্চের একপাশে যেখানে সতর্কাবস্থায় দাঁড়িয়েছিলো সেখান থেকে সামনে এগিয়ে আসে।

‘কারণ বলো।” বাবর তার চারপাশে তাকে ঘিরে বসে থাকা লোকদের সাথে তাকে বসতে ইঙ্গিত করে। একজন সাধারণ সৈনিককে সুলতান তাদের মাঝে বসতে আহবান করেছেন এজন্য কেউ কেউ বিস্মিত হলেও সেটা সে অগ্রাহ্য করে।

“বাজারে জোর গুজব রটেছে- যারা আজ সাইবানি খানের দূতের পরিচারকের সাথে কথা বলেছে তারাই গুজবটা ছড়িয়েছে- সাইবানি খান উজবেক গোত্রের ভিতর থেকে তার নেতৃত্বে প্রতি হুমকি অনুভব করছেন। তারা বলেছে যে তৃণভূমির অনেক অভ্যন্তরে বসবাসরত তার এক ভাস্তে, তার বিরুদ্ধে একটা সামরিক বাহিনী গড়ে তুলছে। সাইবানি খান উত্তরে গিয়ে এই বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠবার আগেই একে অঙ্কুরে বিনষ্ট করতে চায়। সে যদি শীঘ্রই রওয়ানা না দেয়, তাহলে আবহাওয়া বৈরী হয়ে উঠবে এবং আগামী বসন্তের আগে সে আর কিছুই করতে পারবে না…”

বাবর ভাবে, কথাটা যদি সত্যি হয়, তাহলে অবরোধ করে সময় নষ্ট করাটা সাইবানি খানের কাছে এখন বিলাসিতার সামিল। সে এখন যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব শহরটা পুনরায় দখল নিয়ে এর নিরাপত্তায় একটা সেনাবাহিনী মোতায়েন করে নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধির নিমিত্তে রওয়ানা হতে চাইবে। সে এখন তার লোকবল আর রসদ সামগ্রীর যে কোনো ধরণের ক্ষয়ক্ষতি এড়িয়ে যাবে। বাবরের পশ্চাদপসরণকারী বাহিনীকে হেনস্থা করে-তৈমূর বংশীয় অন্যান্য গোত্রপতি আর সুলতানদের ঘাটাতে চাইবে না।

“আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।” বাবর উঠে দাঁড়ায়। “আমি উজবেকদের শর্ত মেনে নেব- যদি তারা আমার লোকদের পুরোপুরি অস্ত্র সজ্জিত অবস্থায় এখান থেকে যেতে দিতে রাজি হয়। তারপরে সে তার কণ্ঠে যতোটা সম্ভব নিশ্চয়তার ছোঁয়া যোগ করে বলে, “জনগণও রক্ষা পাবে এবং ইনশাআল্লা- আল্লাহতালা যদি চান আমরা আবার ফিরে আসবো।”

পরের দিন ভোরবেলা বাবর কোক সরাইয়ের ছাদ থেকে, কাশিম তার বার্তাবাহী দূতকে, সমরকন্দের সবুজ নিশানাবাহী দুইজন সৈন্যসহ ধীরে ধীরে ফিরোজা দয়োজা অতিক্রম করে সাইবানি খানের শিবিরের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে।

সে তার লোকদের যতোই বোঝাতে চেষ্টা করুক এটা আসলে আত্মসমর্পণ- এমন একটা ব্যাপার যার মুখোমুখি সে জীবনে আগে কখনও হয়নি বা কখনও করবে বলে বিশ্বাসও করতো না। আর এই ব্যাপারটা ভাবলেই তার বমি বমি পায়। অবশ্য সে এই অভিযানের শুরু থেকেই জানে যে এবার তাকে প্রবল প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হবে। আর শেষ পর্যন্ত সাইবানি খানের শর্তে রাজি না হওয়া ছাড়া তার সামনে আর কোনো বিকল্পও ছিলো না। সমরকন্দের জনগণের স্বার্থে এটাই ছিলো একমাত্র পথ। কিন্তু পশ্চাদপসরণের ভাবনা- চরম ঘৃণিত এক শত্রুর হাতে শহর তুলে দেয়া- খুবানি বহুদিন গাছে থাকলে যেমন তিতে স্বাদ হয়, তেমনি তিক্ত স্বাদ তার মুখে সে টের পায়। অবশ্য আরেকদিক দিয়ে ভাবতে গেলে, এর ফলে সে নিজেও মুক্ত হবে এবং সুযোগ পাবে নিজের আর নিজের পরিবারের সমৃদ্ধি পুনঃনির্মাণের। তার আত্মবিশ্বাস আর একাগ্রতা বজায় থাকে, সে জানে সেটা বজায় থাকবে। সে এখনও বয়সে তরুণ এবং বিরাট সাফল্য অর্জনে ব্যর্থ হবে এমন শিক্ষা তাকে দেয়া হয়নি। সে তার নিয়তির লিখন সার্থক করবেই।

***

বাবর তার ঘোড়ার পিঠে চেপে বসে উঁচু কোক সরাইয়ের দিকে একবারও ফিরে না তাকিয়ে বের হয়ে আসে। তার দেহরক্ষী বাহিনী, যাদের ভিতরে বাবুরীও রয়েছে, তার পেছনেই রয়েছে এবং সারির একেবারে শেষে, অশ্বারোহী বাহিনী দ্বারা সুরক্ষিত এবং চামড়ার পর্দা দিয়ে আড়াল করা একটা গরুর গাড়িতে পরিচারিকাদের নিয়ে তার আম্মিজান, নানীজান আর বোন আসছে।

তার স্ত্রী আর অন্যান্য মেয়েদের আরেকটা গাড়িকে মাঙ্গলিঘ তীরন্দাজ বাহিনী, যারা এখন জামমীন ফিরে যাবে পাহারা দিয়ে নিয়ে আসছে। আয়েশা তার বাবার সাথে দেখা করার জন্য তাদের সাথে যেতে চাইলে বাবর সানন্দে সম্মতি দিয়েছে। এখন পর্যন্ত তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়ের এটাই একমাত্র উজ্জ্বল দিক বলে তার কাছে প্রতিপন্ন হয়েছে।

বাবরের অবশিষ্ট বাহিনী ইতিমধ্যে শহরের ভিতর দিয়ে উত্তরদিকে শেখজাদা দরোজার দিকে রওয়ানা দিয়েছে। সাইবানি খান আজ্ঞপ্তি জারি করেছে যে বাবরকে তার বাহিনী নিয়ে এই দরোজা দিয়ে শহর ত্যাগ করতে হবে। আর কয়েক ঘণ্টা পরে, সাইবানি খান তার গাঢ় আলখাল্লা সজ্জিত উজবেক যোদ্ধা পরিবেষ্টিত অবস্থায় মহিমান্বিত ফিরোজা তোরণদ্বার দিয়ে শহরে প্রবেশ করবেন।

পুরো শহরে একটা গুমোট আর স্থবির অবস্থা বিরাজ করে। বাবর আর তার বাহিনী এগিয়ে যেতে বেশিরভাগ বাড়ির দরোজা জানালার কপাট বন্ধ এবং হুড়কো দেয়া দেখা যায়। যদিও মাঝে মাঝে কাউকে উঁকি দিয়ে সশব্দে থুতু ফেলতে দেখা যায়। বাবর তাদের কোনো দোষ দেয় না। বাবর চাইলে ঘোষণা করতে পারে যে, এটা একটা সাময়িক ছন্দপতন, সে আবার ফিরে আসবে। যা কোনো রুচিহীন উজবেক অধীনে না, তৈমূর বংশীয় সুলতানের অধীনে সমরকন্দের জন্য একটা স্বর্ণালী যুগের সূচনা করবে। কিন্তু তার কথা শহরের লোকেরা কেন বিশ্বাস করবে? ঘোড়ায় বসে থাকার সময়ে বাবরের পিঠ যতোই সোজা হয়ে থাকুক, যতোই কঠোর হোক তার। মুখভাব, লোকদের চোখ তার দেহ ভেদ করতে পারে না এবং তার হৃদয়ে সাফল্যের ইস্পাত কঠিন প্রত্যয় দেখতে পায় না।

প্রায় দুপুর হয়ে এসেছে এবং সূর্য দোর্দণ্ডরূপ ধারণ করেছে। বাবর ভাবে আজকের দিনে তারা বেশিদূর যাবে না। তারা পূর্ব দিকে ঘুরে গিয়ে কোলবা পাহাড়ের দূরবর্তী প্রান্তে অস্থায়ী শিবির স্থাপন করবে। সেখান থেকে অন্তত সমরকন্দ তার চোখে পড়বে না। আগামীকাল সে তার মন্ত্রণাদাতাদের নিয়ে আলোচনায় বসবে, কোথায় গেলে ভাল হবে। এসান দৌলত ফারগানা ছাড়িয়ে পূর্বদিকে তার লোকদের কাছে যাবার জন্য তাকে অনুরোধ করেছে। বুড়ির কথাই সম্ভবত ঠিক। যদিও বাবরের সহজাত প্রবৃত্তি তাকে পাহাড়ের এখান থেকে বেশি দূরে না, এমন কোনো নির্জনস্থানে আত্মগোপন করে এবং সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করে…

সে এবার সামনে শেখজাদা তোরণের উঁচু বাঁকানো খিলান দেখতে পায়। সে তোরণদ্বারের দিকে রওয়ানা দিতে বাইসানগার তার দিকে এগিয়ে আসে। তাকে কঠোর আর যেতে অনিচ্ছুক দেখায়। সেটাই হবার কথা, কারণ এটা তার শহর সে যেখানে জন্ম গ্রহণ করেছে: সেই শহরটা উজবেকদের হাতে তুলে দিতে তার মোটেই ভালো লাগার কথা না। বাবরের চেয়ে কোনো অংশে কম না তার ক্ষতির মাত্রা।

“সুলতান, তোরণের পরে তৃণভূমিতে লোকদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করে রাখা হয়েছে এবং আরো ব্যাপার আছে। সাইবানি খানের দূত আপনার সাথে আরেকবার দেখা করতে চায়।”

“বেশ, ভালো। আমি আমার লোকদের সাথে যোগ দেয়ামাত্র তাকে আমার সামনে হাজির করবে।”

বাবরের বাহিনী- দু’হাজারের বেশি হবে না সংখ্যায়- যাদের নিয়ে সে সমরকন্দ জয় করেছিলো, তাদের তুলনায় নিতান্তই জরাজীর্ণ, শোচনীয় অবস্থা এখন। তাদের পেছন পেছন আসা মৃত্যু, ব্যাধি, পলায়ন আর খাদ্যাভাব তার দায় পুরো উসুল করে নিয়েছে। আজ আর কোনো উজ্জ্বল সবুজ বা হলুদ রঙের নিশান দেখা যায় না, যা দেখে তাদের সমরকন্দ বা ফারগানার সৈন্য বলে সনাক্ত করা যাবে। অবশ্য তাদের সে পরিচয়ও এখন ঘুচে গেছে।

বাবর তার লোকদের দিকে এগিয়ে যেতে তারা নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। শহরের বাইরে পৌঁছে যাবার পরে এদের ভেতরে কতোজন নিজের লোকদের কাছে ফিরে যাবে, বা তাদের আরো ভালভাবে পুরস্কৃত করতে পারবে এমন নৃপতির সন্ধান করবে?

রোদেপোড়া মাটির উপর দিয়ে ঘোড়া নিয়ে মোটাসোটা উজবেক দূতকে সে এগিয়ে আসতে দেখে। ব্যাটা আবার কি চায়? নিজের প্রভুর পক্ষে আত্মতৃপ্তি নিয়ে তাকিয়ে দেখতে?

“তো?”

“আপনার আর আমার প্রভুর মাঝে এই নতুন সমঝোতা স্মরণীয় করে রাখতে তিনি একটা দারুণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি আপনার বোন, মহামান্য শাহজাদীকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করবেন।”

“কি?” নিজের অজান্তে বাবরের হাত তরবারির বাঁট স্পর্শ করে। এক মুহূর্তের জন্য তার ইচ্ছে করে তরমুজে লাথি দিয়ে সে যেমন রস বের করে দিয়েছিলো তেমনিভাবে হোতকা ভাড়টার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন মাথা রক্ত ছিটাতে ছিটাতে গড়াতে থাকুক।

“আমি বলতে চাইছি আমার প্রভু সাইবানি খান ঠিক করেছেন আপনার বোন খানজাদাকে নিকাহ করবেন… তিনি এখন তাকে নিয়ে যাবেন…”

“সুলতান…” বাবর বাইসানগারের আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর শুনতে পায়।

বাবর মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে লোহার দরোজার দিক থেকে গাঢ় রঙের আলখাল্লা পরিহিত অশ্বারোহী বাহিনী ধনুক প্রস্তুত অবস্থায় ধেয়ে আসছে। নিমেষের ভেতরে বাবর আর তার লোকদের তারা তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। আরেকদিক আটকে রাখে শহরের পোক্ত দেয়াল। একটা ফাঁদ…

“এই তাহলে সাইবানি খানের কথা রাখার নমুনা…” বাবর ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে দূতকেও টেনে নামায় এবং লোকটার নধর গলায় খঞ্জর চেপে ধরে। উজবেক পাঠাটার গায়ে অসুরের মত শক্তি। সে তার বেষ্টনী থেকে ছুটতে চেষ্টা করে কিন্তু বাবরের হাতের খঞ্জরের ফলা তার চামড়া কেটে বসে। ঘন লাল রক্তের বিন্দু ক্ষতস্থানে দেখা দিতে তার লাফালাফি বন্ধ হয়।

“আমার প্রভু মোটেই ওয়াদার বরখেলাপ করেননি।” দূত ব্যাটা হাঁসফাস করে বলে। “তিনি আপনাকে নিরাপদে যেতে দেবেন বলে ওয়াদা করেছেন এবং আপনি। তাই যাবেন। তিনি কেবল নিজের জন্য একটা স্ত্রী খুঁজছেন।”

“কোন বর্বরের হাতে তুলে দেবার আগে আমি নিজ হাতে আমার বোনকে হত্যা করবো।” বাবর চিৎকার করে উঠে এবং দূতকে ছেড়ে দিলে সে হুড়মুড় করে। মাটিতে বসে পড়ে।

“আপনার বোনই তাহলে কেবল মারা যাবেন না।” দূত ব্যাটা পাগড়ির প্রান্ত দিয়ে গলার ক্ষতস্থান চেপে ধরে রাখে। “আপনি যদি আমার প্রভুর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন, তিনি তাহলে এটাকে ব্যক্তিগত অপমান বলে মনে করবেন এবং আপনারা সবাই আপনি, আপনার পুরো পরিবার, এবং আপনার নিধিরাম সেনাবাহিনী, তাহলে বেঘোরে মারা পড়বে। আর তিনি পুরো শহর জ্বালিয়ে দিয়ে শহরের অধিবাসীদের কঙ্কালের উপরে সেটা পুনঃনির্মাণ করবেন। এখন আপনি ঠিক করেন কি করবেন…”

বাবর, নিজের আর তার লোকদের দিকে তাক করা উজবেক তীরগুলোর দিকে তাকায়। সে বাইসানগার আর বাবুরীর ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকায়। বাবর দূতকে আক্রমণ করার সাথে সাথে তরবারি কোষমুক্ত করে তারা সামনে এগিয়ে এসেছে। সে যে ক্রোধ আর অসহায়তা অনুভব করে তারই প্রতিচ্ছবি সে তাদের মুখেও দেখতে পায়। এবারও তার পছন্দের কোনো সুযোগ নেই। শত্ৰু পরিবেষ্টিত অবস্থায় আকস্মিক এক গৌরবময় যুদ্ধে নিজের লোকদের নেতৃত্ব দেয়া এক কথা, আর তাদের অর্থহীন নিষ্ঠুরতার সামনে, খেদাড়ে লোকজন বনজঙ্গল পিটিয়ে শিকারের পশু যেমন বৃত্তের মাঝে শিকারীর ইচ্ছায় মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, সেরকম পরিস্থিতির মধ্যে তাদের ফেলে দেয়া আরেক ব্যাপার।

উজবেক সারি পর্যবেক্ষণ করে বাবর সাইবানি খানের কর্তৃত্বপূর্ণ অবয়বটা খুঁজতে চেষ্টা করে। তাকে দ্বৈরথে আমন্ত্রণের এক বুনো ভাবনা তার মনে খেলা করতে থাকে। অবশ্য উজবেক নেতাকে সেখানে কোথাও দেখা যায় নাঃ তিনি এখন সমরকন্দে প্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সালতানাহীন কোনো সুলতানের সাথে সাক্ষাৎ করাটা তার জন্য এখন অসম্মানের ব্যাপার।  দু’শো গজ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা গরুর গাড়ির দিকে বাবর হেঁটে যায়। যেখানে এসব ঘটনা সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ তার আদরের আম্মিজান আর নানীজানের সাথে বসে রয়েছে। সে এক মুহূর্ত ইতস্তত করে তারপরে চামড়ার ঝালর সরায় যা তাদের আড়াল করে রেখেছে। আতঙ্কিত চোখে তিনজন তার দিকে তাকায়। তারপরে, সে যা বলতে এসেছে সেটা শোনার পরে অবিশ্বাসে তারা চিৎকার করে উঠে। চোখে টলটল করতে থাকা অশ্রু নিয়ে সে ঘুরে দাঁড়ায়। কিন্তু অসভ্য উজবেকের কামনার কাছে তাকে বলি না দেবার জন্য খানজাদার আকুতি আর মেয়েকে বখশ দেবার জন্য আম্মিজান খুতলাঘ নিগারের কান্না তাকে বেত্রাহত কুকুরের মতো তাড়িয়ে নিয়ে যায়। “খানজাদা, কথা দিচ্ছি আমি তোমাকে নিতে আসবো। আমি ওয়াদা করছি…আমি আসবোই…” বাবর কাঁদতে কাঁদতে চেঁচিয়ে উঠে বলে। কিন্তু এসব কিছুই খানজাদা শুনতে পায় না।

২.৬ মুঠোয় সোনালী হাতি এক বৃদ্ধা

১২. মুঠোয় সোনালী হাতি এক বৃদ্ধা

ফেব্রুয়ারির এক সন্ধ্যাবেলা। বাবর তার সামনের বিশাল, খোলা অগ্নিকুণ্ডে প্রজ্জ্বলিত কাঠের টুকরো হাতের লাঠি দিয়ে খোঁচা দেয় সেখান থেকে আরেকটু বেশি উষ্ণতা পেতে। তার দেহের সামনের অংশ আর মুখমণ্ডল যদিও সরাসরি উত্তাপের কারণে উষ্ণ। কিন্তু তার পরণে বাদামী রঙের মোটা পশমের আলখাল্লা থাকা সত্ত্বেও মাটির-ইটের তৈরি বাড়িটার ছোট, চাকচিক্যহীন, কোনমতে বন্ধ করা জানালার উপরে ঝুলে থাকা পর্দার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত কনকনে শীতল বাতাসের কামড় পিঠে ঠিকই অনুভব করে। এই বায়ুপ্রবাহের ফলে অবশ্য একটা লাভ হয়েছে যে চিমনি দিয়ে কিছুটা হলেও কাঠের ধোঁয়া বের হয়ে যেতে পারছে। ধোয়াটা এত ঘন আর ঝাঝালো যে বাবরের চোখ জ্বালা করছে।

সে ভাবে যে গত শরতের সেই দিন যখন, চারপাশে বাতাসের দাপটে উড়তে থাকা তুষারের দাপটের ভিতর দিয়ে সে তার খুব বেশি হলে দুইশ লোকের বহরটা নিয়ে প্রশস্ত গিরিপথ অতিক্রম করে সেরামের এই ক্ষুদ্র বসতিতে উপস্থিত হয়েছিলো। তার পরে থেকে সে কেবল চোখের পানিই ফেলে চলেছে। সত্যি কথা বলতে, জায়গাটা আসলে একটা দেয়ালঘেরা ছোট পশুপালকদের গ্রাম। যেখানে দুটো কি তিনটা সরাইখানা রয়েছে কদাচিত উপস্থিত হওয়া আগন্তুকদের খিদমত করতে। কিন্তু দুটো কারণে স্থানটা বাবরকে আকৃষ্ট করেছে। গ্রামের গাট্টাগোট্টা সর্দার, হুসেন। মজিদ, সমরকন্দে মাহমুদের হাতে নিহত আলী মজিদ বেগের চাচাত ভাই এবং বাবরের একনিষ্ট অনুগত। আরেকটা ব্যাপার হল বসতিটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত। কাশগর থেকে আগত একটা মোটামুটিভাবে প্রচলিত বাণিজ্য পথের ধারে গ্রামটা অবস্থিত হলেও, ফারগানার সীমান্তচৌকী আর সাইবানি খানের বাহিনী দু’দলের কাছ থেকেই জায়গাটা অনেক দূরে।

বাবর জানে সমরকন্দ থেকে বিতাড়িত হবার পরে জাহাঙ্গীরের প্রস্তাবিত শরণ প্রত্যাখ্যান করে সে মোটেই ভুল করেনি। প্রথমত প্রস্তাবটার আন্তরিকতা বিষয়ে সে ভীষণভাবে সন্দিহান এবং দ্বিতীয়ত সে তার সৎ-ভাই আর তার নিয়ন্ত্রক তামবালের খপ্পড়ে গিয়ে পড়তে চায়নি। আর তাছাড়া, জাহাঙ্গীর আর তার ফন্দিবাজ মা, রোক্সানাকে একদা মৌন সহনশীলতা বলে সে মেনে নিয়েছিল। এখন সেই ভঙ্গুর সম্পর্ক সে ব্যবহার করতে চায় না।

বাবরের প্রত্যাখ্যান করার অর্থ হল সে তার পরিবারের মেয়েদেরও জাহাঙ্গীরের কাছে বিশ্বাস করে পাঠাতে পারবে না। তার নিজের উপস্থিতি ব্যাতীত তাদের পুনরায় সেই বন্দিদশার ভাগ্যই বরণ করতে হবে। সে যাই হোক, খুতলাঘ নিগার আর এসান দৌলত প্রস্তাবটা শোনার সাথে সাথে সেটা নিয়ে আলোচনা করতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তারা বাবরের বিপদসঙ্কুল ভবঘুরে জীবন আর তদজনিত অভাব হাসিমুখে সহ্য করতে রাজি আছেন।

তারা এখন অন্তত মাথার উপরে আবার ছাদের নিরাপত্তা পেয়েছে এবং এই বাসস্থানের শীতল পরিবেশে নিভৃতে থাকার জন্য ছোট হলেও একটা কামরা পেয়েছেন। কিন্তু তাদের অবিন্যস্ত দীঘল চুলের জট থেকে উকুনের ডিম বাছতে গিয়ে একটা মাত্র হাতির দাঁতের তৈরি চিরুনী তাদের পালাক্রমে ব্যবহার করতে দেখে বাবর চোখের জল চেপে রাখতে পারেনি। তাদের কেউই এটা বা বিছানার ছারপোকা নিয়ে একবারও অভিযোগ জানায়নি। বাসি বা অপ্রতুল খাবারের ব্যাপারেও তাদের কোনো আপত্তি নেই- রান্নাঘরে চর্বি আস্তরনযুক্ত একটা ঢাউস তামার পাত্র থেকে প্রতিদিন ঘোড়ার শক্ত মাংস আর শালগম খেতে দেয়া হয়। এসান দৌলত, তার শ্রদ্ধেয় পূর্বপুরুষ, চেঙ্গিস খানের এটা খুবই পছন্দের খাবার ছিল বলে জানিয়ে দিয়েছেন।

নিজের উপরেই নিজে ক্ষুব্ধ বাবর ভেবেছিল, খানজাদাকে সাইবানি খানের হাতে তুলে দেবার জন্য আম্মিজান বা নানীজান তাকে দোষারোপ করবে। কিন্তু বরাবরের মতোই। এসান দৌলত তাকে আবারও বিস্মিত করেছে। একদিন সকাল হবার অনেক পরে তিনি বাবরকে মাটির দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে রেখে ভ্রুণের অবস্থানে কুঁকড়ে নিজের কক্ষে শুয়ে নিরবে কাঁদতে দেখেন। “বাবরজান কি হয়েছে যে নিজের অবস্থান আর পৌরুষ ভুলে গিয়েছো?” তিনি জানতে চান। সে কোনো উত্তর না দিলে তিনি আবার জানতে চান। এবার অনেক কোমল তার কণ্ঠস্বর। “বাবরজান, বলবে না কি হয়েছে?”

সে কোঁকড়ানো অবস্থান থেকে সোজা হয় এবং নানীজানের দিকে জবাফুলের মতো লাল চোখে তাকায়। “আপনি কি জানেন না? অনুমান করতে পারছেন না? সমরকন্দ আরো একবার হাতছাড়া হয়েছে বলে আমি নির্বিঘ্ন কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা সাইবানি খানের কাছে এভাবে আপোষে খানজাদাকে সমর্পন করায়। আমার নিজের নিজেকে চাবকাতে ইচ্ছা করছে। পরিবার প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায়, আর ভাই হিসাবে নিজের একমাত্র বোনকে যাকে আমি এতো ভালোবাসি, তাকে রক্ষা করতে না পারায় আমি প্রচণ্ড অপমানিতবোধ করছি। তাকে উদ্ধার করার জন্য এখনও কিছুই করতে পারছি না। এতোটাই হীনবল আজ আমি ভাবতেই নিজেকে কেমন ক্লীব মনে হচ্ছে।”

এসান দৌলত বাবরের বিশাল হাতের পাঞ্জা এবার নিজের ছোট ছোট হাতের মুঠোয় আঁকড়ে ধরে। তারপরে তিনি তাকে চেঙ্গিস খানের প্রথম স্ত্রীর ভাগ্যে কি ঘটেছিলো সেটা তাকে মনে করিয়ে দেন। “সমুদ্রের মহান অধীশ্বর হবার অনেক আগে তিনি বোর্তে নামে কোনগ্রেট গোত্রের এক পৃথুলা সুন্দরী কিশোরীকে বিয়ে করেছিলেন এবং তার গোত্রের সমর্থন নিয়ে মারকিট নামে এক প্রতিবেশী গোত্রের সাথে সংঘাতের মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়াস পান। অবশ্য, তখন তিনি নিতান্তই অনভিজ্ঞ আর মারকিটরা ছিলো ভীষণ ধূর্ত। মারকিটরা তার ছাউনি একবার অপ্রত্যাশিতভাবে আক্রমণ করে বোর্তেকে উঠিয়ে নিয়ে যায় এবং চেঙ্গিসের অনুসারী যোদ্ধাদের হয় হত্যা করে বা ছত্রভঙ্গ করে দেয়। নিঃসঙ্গ একাকী অবস্থায় তিনি কেনতাই পাহাড়ে পালিয়ে যান যেখানে মারকিটরা তাকে খুঁজে পায় না। পাহাড়ের আড়াল তিনি ভালোই ব্যবহার করেন। চেঙ্গিস খান এরপরে যতদিন বেঁচে ছিলেন প্রতিদিন পাহাড়ের দেবতার পূজা করেছেন এবং প্রতিদিনই তার উদ্দেশ্যে বলি দিয়েছেন।

“পাহাড়ে আত্মগোপন করার মাত্র এক বছরের ভিতরেই কোনগ্রেট গোত্রের গঠন করা আরেকটা বাহিনীর সহায়তায় তিনি মারকিটদের পরাজিত করেন এবং বোর্তেকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেন। কয়েক মাস পরে সে যখন তার প্রথম পুত্রসন্তানের জন্ম দেয়, যার নাম রাখা হয় জর্চি, কারো সাহস হয়নি সেই ছেলের পিতৃত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন করে। বড় হয়ে এই ছেলে চেঙ্গিস খানের অন্যতম এক সেনাপতি হয়েছিলেন।

“খানজাদা আর বাবর তোমরা দুজনেই চেঙ্গিস খান আর বোর্তের রক্ত বহন করছো। কখনও হতাশ না হয়ে কঠোর বাস্তবের মোকাবেলা করে পরিণামে জয়ী হবার মতো তোমার সাহস।” এসান দৌলত এবার শক্ত করে তার হাত আঁকড়ে ধরে। “যতো কঠিন আর কষ্টকরই হোক নিজের মনোবল শক্ত কর। পেছনে না তাকিয়ে সামনের দিকে কেবল সামনে তাকাবার মতো ইস্পাত কঠিন করো নিজের মন।”

নানীজানের সেই সান্ত্বনাবাণী সত্ত্বেও, আজও সাইবানি খানের রুক্ষ্ম হাত তার বোনের কোমল দেহের গোপনতম প্রান্তরে বিচরণ করছে মনে হতেই বিতৃষ্ণা আর বিবমিষাবোধ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের তালুকে চেপে বসা নখে সে নিজের সমস্ত মানসিক শক্তি একত্রিত করে ভাবনাগুলোকে মন থেকে সরিয়ে দেয়। তারপরে সে আল্লাহতালার কাছে দোয়া করে, তার বোন যেনো বেঁচে থাকার মতো মানসিক শক্তি বজায় রাখতে পারে- যেমনটা বজায় রেখেছিলেন বোর্তে এবং সাইবানি খানের কথামত চলে। সে প্রতিবাদ করতে চাইলে সেটা তার মৃত্যুই ডেকে আনবে। তাদের দুই ভাইবোনের পক্ষে সে একাই সাইবানি খানের সাথে যুদ্ধ করবে তাকে পরাভূত করতে আর তাকে এবং পরিবারের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করবে।

এখন যদিও মধ্যরাত্রি প্রায় সমাগত এবং কামরার ভিতরে তার চারপাশে সবাই ঘুমে বিভোর। মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্ত নাসিকাগর্জন তার সাক্ষী। নিজের ভাবনা নানা কারণে বিক্ষিপ্ত। তার সাথে যা ঘটে গিয়েছে সেসব কারণে অসহায় আর অস্থির এবং সর্বোপরি ভবিষ্যতের গর্ভে তার আর তার পরিবারের জন্য আরও কি ভোগান্তি অপেক্ষা করছে ভেবে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ বাবর ঘুমাতে চেষ্টা করে। ঘুম পাবার বদলে ক্রুদ্ধ কিন্তু অক্ষম আক্রোশে রক্ত টগবগ করতে থাকলে, সে আলখাল্লাটা গায়ে চাপিয়ে নেয় এবং এলামেলোভাবে শুয়ে থাকা পরিচারকদের ঘুমন্ত শরীরের উপর দিয়ে নিজের ভাবনাগুলোকে গুছিয়ে নিতে, মনকে প্রশমিত আর শীতল করতে সে রাতের হাড় কনকনে শীতে ভেতর বাইরে বের হয়ে আসে।

বাইরে, আকাশে তারার মেলা, এবং একটু আগে যে তুষারপাত হয়েছে জমে বরফের কুচিতে পরিণত হয়েছে। কনকনে হিম বাতাস প্রাঙ্গণের উপরে ঝড়ের মতো বইছে। গ্রামটা ঘিরে রাখা মাটির দেয়ালের দিকে সে এগিয়ে যায়। মাটির এবড়োখেবড়ো ধাপ বেয়ে সে দেয়ালের উপরে উঠে এবং সামনের আবছা সাদা ভূপ্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকে। গিরিপথের উপরে পাহাড়ের চূড়ায় চাঁদের আলো পড়ে চমকায়। পুরো দৃশ্যপটের অনাবিল সৌন্দর্যের দিকে সে রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকে।

সহসা পশুর খোয়াড়ের দিক থেকে সে একটা নিঃসঙ্গ কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতে শুনে। তারপরে হট্টগোলের ভিতরে আরেকটা আওয়াজ ভেসে আসে। মিনিটখানেক পরে ঠিক তার নিচে বরফের উপর দিয়ে একটা কালো জন্তু ছুটে এসে দাঁড়ায় এবং বরফাবৃত মাটির উপর দিয়ে ছুটে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। প্রাণীটা পালিয়ে যেতে, পশুর খোয়াড়ের রক্ষীরা তাকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়তে থাকে। ধাওয়া দিয়ে তারা জন্তুটাতে তাড়িয়ে এনেছে। বাবর এখন দেখে প্রাণীটা একটা ধূসর বর্ণের বেশ লম্বা নেকড়ে, মুখে কিছু একটা কামড়ে ধরে রেখেছে- খুব সম্ভবত মুরগী।

“ব্যাটাকে মারতে পারলে…” দেয়ালের নিচ দিয়ে একজন প্রহরী দৌড়ে যেতে বাবর তার কাছে প্রশ্ন করে।

“না, সুলতান। গত কয়েক রাত ধরে আমাদের গৃহপালিত পশুদের আক্রমণ করছে এই ধূর্ত নেকড়েটা। প্রথমে ঘোড়ার আস্তাবলের দিকে সে ভেতরে প্রবেশের একটা রাস্তা খুঁজে বের করে এবং গত বছর জন্ম নেয়া একটা অশ্বশাবককে আক্রমণ করার চেষ্টা করে। সেটা অসুস্থ ছিলো বলে আমরা তাকে চিকিৎসা করার জন্য আলাদা করে রেখেছিলাম। ঘোড়ার দল তাদের পায়ের খুর দিয়ে ব্যাটাকে সে রাতের মতো তাড়িয়ে দেয়। গতকাল সন্ধ্যাবেলা সে ভেড়ার খোয়াড়ে ঢুকে আর আমরা তাকে তাড়িয়ে দেবার আগে একটা ছোট ভেড়ীকে এমন বাজেভাবে কামড়ে দেয় যে আমরা বাধ্য হই তাকে জবাই করতে- আজ রাতে আমাদের মাংসের সুরা ঘোড়ার মাংসের দিলে এটার মাংস দিয়েই তৈরি হয়েছিলো, স্বাদ পরিবর্তনের জন্য। কিন্তু আজ রাত নেকড়েটা মুরগীর খোয়াড়ে ঢুকে, আর মুরগীদের চিৎকারে আমরা আসবার আগেই একটা মুরগী নিয়ে হারামজাদা পালিয়ে যায়। নাছোড়বান্দার মতো লেগে থাকার পুরস্কার সে পেয়েছে।”

বাবর আবার সামনের অন্ধকার প্রান্তরের দিকে তাকায়, যেখানে বিজয়ী নেকড়েটা হারিয়ে গেছে। সম্ভবত তার জন্য এটা একটা ইঙ্গিত। বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে, চেঙ্গিস খানের তৈমূরের মতো- অটল থাকতে হবে। নিজের অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করো। লক্ষ্য আদায় না হওয়া পর্যন্ত হাল ছাড়বে না। নেকড়েটা ঘোড়া আর ভেড়ার খোঁয়াড়ে হামলা চালিয়ে ব্যর্থ হলেও মুরগীর খোয়াড় আক্রমণ করে ঠিকই সফলতা লাভ করেছে। সমরকন্দ আর ফারগানার প্রতি এই মুহূর্তে কম মনোযোগ দিয়ে তার উচিত সম্ভবত অন্যকোনো এলাকার কথা বিবেচনা করা, যেখানে সে নিজেকে শাসনকর্তা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে পারে, সালতানাৎ বাড়িয়ে তোলার আগে। তার নায়ক তৈমূর চীন থেকে ভারতবর্ষ এবং তুরস্ক পর্যন্ত উন্মত্তের মত হামলা করেছেন।

বাবর দেয়ালের উপর থেকে নেমে বাসার দিকে ফিরে আসবার সময়ে সে নিচু চালাযুক্ত মহিলা পরিচারিকাদের বাসস্থান অতিক্রম করে। বহুদিন পরে সে প্রথমবারের মতো তার বাবার বিশ্বাস জোরে জোরে নিজেকে আউড়াতে শোনে: “তৈমূরের রক্ত আমার শরীরে।” বাকি রাতটুকু সে নির্বিঘ্নে আর শান্তিতে ঘুমিয়ে কাটায়।

***

ধূসর ঘোড়াটা চকরাবকরাটার চেয়ে দ্রুতগামী…সবাই সেটা দেখতে পাবে।”

“বাবুরী, তুমি ভুল করছে। ববফ গলার পরে আমরা যখন আবার যাত্রা করবো তখন আমি তোমাকে সেটা দেখাবো।” হাত গরম করতে আগুনের উপরে রেখে সে বলে।

দরজা খোলার শব্দ আর বাতাসের একটা শীতল ঝাপটা অনুভব করে, বাবর ঘুরে তাকিয়ে হুসেন মজিদকে এগিয়ে আসতে দেখে। উচ্চতা আর কলেবরের কারণে তার পাশে পাশে এগিয়ে আসা গাঢ় সবুজ রঙের পশম দেয়া জ্যাকেট পরিহিত বৃদ্ধ মহিলার বেটে কুঁজো অবয়ব একটা মজাদার জুটি তৈরি করেছে। বয়স আর ভগ্নস্বাস্থ্য সত্ত্বেও একটা লাঠির উপরে ভর করে সে বেশ ভালোই হুসেন মজিদের সাথে তাল মিলিয়ে হেঁটে আসে।

অসম জুড়িটা বাবরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে তাকে প্রথা মাফিক অভিবাদন জানায়। “সুলতান, এর নাম রেহানা।” বাবরের বিস্ময় দেখে হুসেন মজিদ তাকে বলে। “আমি যখন বাচ্চা ছিলাম তখন সে আমার লালনপালন করেছিলো এবং এখনও আমার পরিবারের খিদমত করে আসছে। আজ খুব সকালে সে আমার কাছে আসে। সে আমাকে বলে যে গতরাতে মুরগীর খোঁয়াড়ে নেকড়ে হামলার গোলমালে ঘুম ভেঙে যেতে সে মেয়ে পরিচারিকাদের বাসস্থানের রান্নাঘরে চা গরম করছিলো। তখন আপনি পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময়ে তৈমূরের বিষয়ে কিছু বলছিলেন। সে আমাকে মনে করিয়ে দেয়- ছেলেবেলায় যা আমি বহুবার শুনেছি যে তার দাদাজান দিল্লী আক্রমণের সময়ে তৈমূরের সাথে ছিলো এবং প্রায়ই তাকে সেখানকার কথা বলতো। সে জানতে চায় আপনি তার গল্প শুনতে আগ্রহী কিনা। আমি তাকে বলেছি এক বৃদ্ধ সৈনিকের মুখে শোনা গল্প আরেক বৃদ্ধা মহিলার কাছে শুনতে আপনি আগ্রহী হবেন না। কিন্তু নাছোড়বান্দার মতো অনুরোধ করতে থাকলে বাধ্য হয়ে আমি তাকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছি।”

কথাটা বলার সময়ে রেহানা চোখ তুলে বাবরের দিকে তাকাতে সে বৃদ্ধার চোখে ঝলসাতে থাকা গর্ব দেখে মুগ্ধ হয়।

“পূর্বপুরুষের বীরত্বগাঁথা শুনতে আমার ভালোই লাগবে। রেহানাকে আগুনের পাশে আরাম করে বসার বন্দোবস্ত করে দিয়ে কাউকে বলেন আমাদের চা দিয়ে যেতে।” রেহানা ধীরে ধীরে তার বৃদ্ধ শরীরটা নিয়ে একটা টুলের উপরে বসে।

“বলেন কি বলতে চান।”

রেহানা এমন মর্যাদাসম্পন্ন শ্রোতাদের সামনে একট ভক্তিপূর্ণ সম্পর্কের ব্যাপারে তার কথা বলতে চাওয়ার অনুরোধ পূরণ হওয়ায় বুঝতে পারে না তার কোথা থেকে শুরু করা উচিত। সে বিড়বিড় করে কিছু বলতে গিয়ে আবার চুপ করে বসে থাকে। “আপনার দাদাজানের নাম কি ছিলো?” বাবর তাকে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করে।

“তারিক।”

“তৈমূরের বাহিনীতে তিনি কি ছিলেন?”

“তিনি ছিলেন একজন অশ্বারোহী তীরন্দাজ- শ্রেষ্ঠদের মধ্যে অন্যতম।”

“আর তৈমূরকে তিনি প্রথম কোথায় দেখেন?”

“১৩৯৮ সালের গ্রীষ্মকালে, সমরকন্দে, তিনি হিন্দুস্তান- উত্তর ভারত আক্রমণের প্রস্তুতি তখন মাত্র শুরু করেছেন। তার বাবা- তৈমূরের পূর্ববর্তী অভিযানের পোড় খাওয়া যোদ্ধা- আমার দাদাজানকে নিয়ে এসেছিলেন, সমরকন্দের দেয়ালের ঠিক বাইরে দিল খোশ বাগিচায়। তৈমূর নিজে সেবার যাদের নিয়োগ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন তিনি সেই দলে ছিলেন।”

“তৈমূর তখন দেখতে কেমন ছিলো সেটা কি তিনি বলেছিলেন?”

“তার বয়স তখন প্রায় ষাট বছর। আমার এখনকার বয়সের চেয়ে মাত্র বিশ বছরের ছোট,” রেহানা বলে, বয়সের বরাভয় অর্জন করা বৃদ্ধলোকদের প্রচ্ছন্ন গর্ব তার কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ে। সে চুপ করে থাকে যেন প্রশংসা আশা করছে। বাবর তাকে হতাশ করে না। আমি বুঝতে পারিনি এতগুলো ঋতু পরিবর্তন দেখার সৌভাগ্য আপনার হয়েছে।”

বৃদ্ধা এবার হাসেন। “কিন্তু আমার দাদাজান আমাকে বলেছিলেন ঘন সাদা চুলের তৈমূর তখনও লম্বা আর অনত। তার ছিলো চওড়া কপাল, মন্দ্র কণ্ঠস্বর আর প্রশস্ত কাঁধ। তরুণ বয়সে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যাবার কারণে আহত ডান পায়ের জন্য তখন তিনি বেশ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই হাঁটতেন। দূর্ঘটনার কারণে তার এক পা অন্য পায়ের চেয়ে বেশ খাটো হয়ে গিয়েছিলো…” ভীরুতা কেটে যেতে, সামান্য দুলতে দুলতে রেহানা পূর্ণোদ্যমে কথা বলতে থাকে। বাবর অনুমান করে বৃদ্ধা তার দীর্ঘ জীবনে অসংখ্যবার এই গল্পগুলো বলেছে।

“নিজের গিল্টি করা সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে তৈমূর তার লোকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়। আমরা হিন্দুকুশ অতিক্রম করে গিরিপথের ভিতর দিয়ে গিয়ে সিন্ধু অতিক্রম করে হিন্দুস্তানের সমৃদ্ধ রাজধানী দিল্লী আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়েছি। সিকান্দারও যে শহরে পৌঁছাতে পারেন নাই। কিংবা চেঙ্গিস খান তিনি কেবল সিন্ধু অববাহিকা পর্যন্ত গিয়েছিলেন। প্রাপ্তির সম্ভাবনা অসীম। হিন্দুস্তান- হীরা, পান্না আর চুনি পাথরে সমৃদ্ধ। সভ্য দুনিয়ার একমাত্র হীরক খনি সেখানে অবস্থিত। কিন্তু সেখানের অধিবাসীদের এসব রত্নে কোনো অধিকার নেই। সেখানকার কিছু শাসক যদিও আমাদের আল্লাহতা’লার অনুসারী, কিন্তু বেশিরভাগ লোকই অর্ধেক জন্তু আর অর্ধেক মানুষের বিকৃত মূর্তির পূজারী, ভীরু স্বভাবের কাফের। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যে শহীদ হবে আল্লাহতালা তাকে নিশ্চয়ই বেহেশত নসীব করবেন। প্রজাদের ভিতরে বিদ্যমান অবিশ্বাস দূর্বলচিত্তে মেনে নেয়া এসব শাসক আর তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহতালা অবশ্যই আমাদের বিপুল ভাবে বিজয়ী করবেন। আমরা বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ লাভ করবো।’

“কিছুদিন পরেই সেনাবাহিনী শহর ত্যাগ করে। নব্বই হাজার যোদ্ধা- বেশিরভাগই অশ্বারোহী- সমরকন্দের বাইরে রোদে পোড়া তৃণভূমির উপরে ধূলোর একটা মেঘের জন্ম দিয়ে, কাতারবন্দি হয়ে যুদ্ধ যাত্রা শুরু করে। তিন দিনের ভেতরে তারা সবুজ শহর, তৈমূরের জন্মস্থান শাখরিস অতিক্রম করে যায় এবং লোহার দরোজা নামে সুপরিচিত সুরক্ষিত গিরিন্দর দিয়ে লালচে করকটে মরুভূমি কিজিল খুমে নেমে আসে।

“বিরতীহীনভাবে এগিয়ে গিয়ে তারা অক্সাস, বালখ আর আন্দারাব অতিক্রম করে। এই পুরোটা সময় তারা তৈমূরের সাম্রাজ্যের সীমান্তের ভিতরের অবস্থান করেছিলো। এরপরে তৈমূর ত্রিশ হাজার যোদ্ধার একটা অগ্রগামী দল নিয়ে আমার দাদাজান এই বাহিনীতে ছিলো- খাওয়াক গিরিপথের ভিতর দিয়ে পৃথিবীর ছাদে উঠে আসেন এবং হিন্দুকুশে পৌঁছান। সেখানে তারা প্রথমবারের মতো শীতের মোকাবেলা করেন আর সমভূমির লোকদের কাছে অপরিচিত এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। বরফের উপরে তাদের ঘোড়ার পা পিছলে যেতে থাকে। আছাড় খেয়ে কিছু কিছু ঘোড়া আরোহীসহ মৃত্যুমুখে পতিত হয়। কোনো কোনো ঘোড়ার পা ভেঙে কেবল রান্নার পাত্রের উপযুক্ত হয়ে পড়ে।

“তৈমূর তার লোকদের দিনের বেলা বিশ্রাম নিয়ে রাতের বেলা যখন দিনের বেলায় বরফের উপরে জমে থাকা বরফগলা পানির স্তর শক্ত হয়ে কম পিচ্ছিল থাকে তখন যাত্রা করার আদেশ দেন। শীঘ্রই তারা একটা পাহাড়ী ঢালে পৌঁছে দড়ির সাহায্য ছাড়া যেখান থেকে অবতরণ করা অসম্ভব। তখন আমার দাদাজান আমাকে বলেছেন- তৈমূরের লোকেরা তাকে একটা খাঁটিয়ায় করে পাথুরে কিনারা থেকে একশ ফিট নিচে নামিয়ে আনে যেহেতু তার নিজের পক্ষে দড়ি বেয়ে নামা সম্ভব ছিলো না। এসময় ঠাণ্ডার ফলে তার ডান পায়ের পুরানো ক্ষতমুখ খুলে যায় এবং তিনি তার পুরো দেহের ভর এই পায়ের উপরে চাপাতে সাহস পান না। আর এই পুরোটা সময় তারা স্থানীয় উপজাতি আর কাফেরদের চোরাগোপ্তা হামলা প্রতিহত করে চলে। বরফ প্রায়ই উজ্জ্বল রক্তে সিক্ত হয়ে উঠত…

“কিন্তু অনেক পরিশ্রম করে তারা অবশেষে কাবুলে পৌঁছায়। আমার দাদাজান আমাকে বলেছেন, পাহাড়ের উপরে অবস্থিত একটা দূর্গ দ্বারা সুন্দর এই শহরটা গিয়ে বালিয়াড়ির আড়ালে আত্মগোপন করে থাকতে বলেন। অবশ্য পরে তিনি ফিরে এসে একটা কাঁটাযুক্ত ঝোপের নিচে তার দেহটা অর্ধেক ঢাকা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন যার আড়ালে সে আত্মগোপন করতে চেয়েছিল কিন্তু বেচারার মাথাটা দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে। আমার মনে আছে আমার দাদাজান সবসময়ে বলতেন সমরকন্দের বাজারে অর্ধেক কাটা পাকা তরমুজের মত দেখতে লাগছিলো মাথাটা এবং আশেপাশের ধবংসযজ্ঞের দিকে তাকিয়ে এবং দুর্গন্ধে তার মনে হতো তিনি বোধহয় কসাইয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

“তৈমূর আশা করেন এই হত্যাকাণ্ড হয়তো দিল্লীর সুলতানকে আরেকবার আক্রমণ করতে প্ররোচিত করবে এবং তিনি যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। সবচেয়ে ভীতিকর হাতির পালকে প্রতিহত করতে তিনি তার লোকদের- অশ্বারোহী বা পদাতিক, সেনাপতি বা সৈনিক নির্বিশেষে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থানের সামনে গভীর খাদ খুঁড়তে আদেশ দেন এবং খোঁড়া মাটি দিয়ে অস্থায়ী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বলেন। এরপরে তিনি তার কামারদের বলেন সবচেয়ে তীব্র আলো প্রজ্জ্বলিত করতে এবং তীক্ষ্ণ প্রান্তযুক্ত তিন-মাথা বিশিষ্ট দণ্ড তৈরি করে হাতির দলের যেখানে আক্রমণ করার সম্ভাবনা বেশি সেসব জায়গায় ছড়িয়ে দিতে বলেন। তিনি এবার মহিষের পালের মাথা আর পা চামড়ার দড়ি দিয়ে বাঁধার আদেশ দিয়ে পরিখার সামনে এবং সুচাল দণ্ডের পেছনে তাদের দাঁড় করিয়ে রাখেন। তিনি উটের পিঠে শুকনো কাঠ আর খড় বোঝাই করে তাদের একসাথে বেঁধে আলাদা করে রাখেন। সবশেষে তিনি তার তীরন্দাজ বাহিনীকে আদেশ দেন হাতির পিঠে কানের পেছনে উপবিষ্ট মাহুতকে লক্ষ্য করে কেবল তীর ছুঁড়তে বলেন। মাহুত মারা গেলে, হাতির পাল নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

“ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ- আমার দাদাজান বলতেন আকাশ ধূসর হয়ে উঠে এবং আবহাওয়া শীতল হতে- সুলতানের দল সত্যি সত্যি তৈমূরের ধারণা অনুযায়ী, হাতির পিঠে বাঁধা পিতলের বিশাল দামামা বাজিয়ে দূর্গ ছেড়ে আক্রমণ করতে বের হয়ে আসে, তাদের পায়ের নিচে মাটি যেনো কেঁপে কেঁপে উঠে।

“কিন্তু আমার দাদাজান তখন তৈমূরের পরিকল্পনার প্রজ্ঞা নিজের চোখের সামনে দেখতে পান। হাতির পাল তাদের অবস্থান পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারে না। লোহার কাঁটায় হোহাচট খেয়ে তারা মহিষের পালের সামনে এসে হুমড়ি খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। আর এরপরেই তৈমূর তার শেষ চালটা দেয়। উটের পিঠে রাখা শুকনো কাঠ আর খড়ের গাদায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে তিনি তাদের হাতির পালের দিকে দাবড়ে নিয়ে যেতে বলেন। বিশাল প্রাণীগুলো কাটার খোঁচা সামলে নিলেও এবার ধোয়ার আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠে এবং ভয়ে পালাবার সময়ে পিঠের সৈন্যদের ছুঁড়ে ফেলে আর পায়ের নিচে তাদের মাথা পিষ্ট করতে থাকে। বিজয় এসে তৈমূরকে বরণ করে। দিল্লী এখন তার অধীনস্ত।

“যদিও তৈমূরির শাহী ফরমান ছিলো যে অনুমতি ছাড়া কেউ দিল্লীতে প্রবেশ করতে পারবে না। কিন্তু তার সব আদেশের ভিতরে কেবল এই আদেশটাই কড়াকড়িভাবে সুরক্ষিত এবং ব্যস্ত বাণিজ্য পথের মিলনস্থলের উপরে অবস্থিত। সমরকন্দের চেয়ে ছোট আর কম চাকচিক্যময় অবশ্যই, কিন্তু তারপরেও আপন মহীমায় ভাস্বর।”

“নিশ্চয়ই, আমার বিশ্বাস সেটা এখনও তেমনই আছে।” বাবর বিড়বিড় করে বাবুরীকে বলে। “আমার বাবার এক ভাই শহরটার শাসনকর্তা।”

“সমরকন্দে আমার যেমন প্রতিটা দোকানে পরিচিত রয়েছে, তেমনি প্রতিটা মসনদে আপনার আত্মীয়রা অধিষ্ঠিত…”

“রেহানা, আমাদের কথায় কান না দিয়ে আপনি বলতে থাকেন।”

“সেপ্টেম্বর নাগাদ, তৈমূর চামড়ার ফালি দিয়ে বাঁধা নৌকা দিয়ে তৈরি করা একটা সেতুর সাহায্যে সিন্ধু নদী অতিক্রম করেন। দিল্লী থেকে তখন তারা মাত্র পাঁচশ মাইল দূরে। তার বাহিনী যখনই সুযোগ পেয়েছে মানুষজন বন্দি করেছে যাদের পরে সমরকন্দের দাসবাজারে বিক্রি করা হবে। কিন্তু তার আগে তারা সেইসব বন্দিদের বাধ্য করেছে তাদের কাজ করতে। আমার দাদাজানের ছিলো পাঁচজন বন্দি। রাভি নামের কালো চোখের ছোট একটা এতিম ছেলে তার খুব প্রিয় ছিলো।

“ডিসেম্বর মাসে, তৈমূরের অগ্রগামী গুপ্তদূতেরা দিল্লী শহরের দেয়ালের ভেতর অবস্থিত বিশাল গম্বুজ আর মিনার প্রথমবারের মতো দেখতে পায়। কিন্তু দিল্লীর সুলতানের ছিলো একটা শক্তিশালী সেনাবাহিনী। যার ভিতরে অন্তর্ভুক্ত ছিল তার সবচেয়ে ভীতিকর আয়ুধ দেড়শ রণহস্তীর একটা বাহিনী- ইস্পাতের চকচকে বর্ম, একটার উপরে আরেকটা বিন্যস্ত, পরিহিত হাতি যাদের লম্বা গজদন্তের সাথে বাঁকানো একধারী খাটো তরবারি সংযুক্ত।

“তৈমূর দেয়ালের নিকটে ব্যয়বহুল আর অনিশ্চিত যুদ্ধের সম্ভাবনা এড়িয়ে যেতে আগ্রহী ছিলেন এবং সুলতানের বাহিনীকে প্ররোচিত করেন দূর্গের নিরাপদ আশ্রয় ত্যাগ করে বেরিয়ে এসে আক্রমণ করতে। কিন্তু সুলতানের সেনাবাহিনী, যুদ্ধের ভেতরেই, যে দরোজা দিয়ে বের হয়ে এসেছিলো সেই একই দরোজা দিয়ে শহরে ফিরে যায়।”

রেহানা একটু চুপ করে দম নেবার জন্য। গল্পের এই অংশটা বিষাদময়। যুদ্ধবন্দির দল সুলতানের বাহিনীর সমর্থনে বিশাল জয়োধ্বনি দিলে। তাদের ধারণা ছিলো সুলতান জয়ী হলে তারা মুক্তি পাবে, তৈমূরের কানে সেটা পৌঁছে এবং আশঙ্কা করেন যে পরবর্তী আক্রমণের সময়ে আবেগের বশবর্তী হয়ে যুদ্ধবন্দির সংখ্যা ছিলো প্রায় এক লক্ষ তারা হয়তো বিদ্রোহ করে বসতে পারে।

“আবেগের বশবর্তী না হয়ে এবং দৃঢ়চিত্তে, তিনি সব যুদ্ধবন্দি হত্যা করার আদেশ দেন। তার চেয়েও বড় কথা, প্রত্যেককে নিজ নিজ যুদ্ধবন্দি হত্যা করতে হবে।

“তার লোকেরা অশ্রুসজল চোখে ঠাণ্ডা মাথায় বন্দিদের হত্যা করে। এমনকি প্রিয়পাত্রীতে পরিণত হওয়া মহিলা বন্দিদেরও রেহাই দেয়া হয় না এবং কেউ কেউ বলে থাকে তৈমূর তার হারেমের মেয়েদের বাধ্য করেছিলো তাদের খিদমতকারী। বন্দিদের হত্যা করতে। আমার দাদাজান তার প্রাপ্তবয়স্ক বন্দিদের আদেশ মতো হত্যা করলেও রাভির বেলায় তিনি আদেশ পালনে ব্যর্থ হন। তিনি তাকে পালিয়ে পালিত হয়নি। আমাদের সৈন্যরা লুটপাটের আশায়- আমার বলতে দ্বিধা নেই মেয়ে মানুষের খোঁজে শহরের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে। আমার দাদাজানও ছিলেন তাদের ভিতরে, পরিত্যক্ত সরাইখানায়, শহরের অধিবাসীরা তাদের কিছু সাথীকে খুন করেছে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়তে সেটার মালিক পালিয়ে গিয়েছিলো, মুফতে আকণ্ঠ সুরা পান করেছেন…

“প্রায় মাতাল অবস্থায়, সৈনিকরা এবার রাস্তায় নামে। মাথা ঝিম ধরে থাকার কারণে তারা তাদের চারপাশে কেবল শত্রু দেখতে পায় এবং সামনে যাকে পায় তাকেই হত্যা করে। শীঘ্রই তারা দোকানপাট আর বাসায় অগ্নিসংযোগ শুরু করে কেবল মজা দেখতে।

“মদের নেশা কেটে যেতে, আমার দাদাজান নিজের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত বোধ করেন এবং একটা সংকীর্ণ লম্বা বাসায় প্রবেশ করে। সেখানে তিনি প্রায় রাভির সমবয়সী এক ছেলেকে মার্বেলের তৈরি হাম্মামখানায় লুকিয়ে থাকা অবস্থায় খুঁজে পান। রাভি আর তার প্রায় দ্বিখণ্ডিত মাথার কথা মনে পড়তে আমার দাদাজান আরও ধাতস্থ হন। তিনি ছেলেটাকে ইশারা করে ঘরের এক কোণে রাখা একটা বিশাল সিন্দুকে লুকিয়ে থাকতে বলেন এবং ইশারা ইঙ্গিতে বলেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সে যেনো সেখানেই লুকিয়ে থাকে।”

রেহানা তার পরনের পুরু পশমের স্তর দেয়া কোটের পকেট হাতড়ে সোনালী জরির কাজ করা রেশমের কাপড়ে মোড়া কিছু একটা বের করে। কাপড়ের আবরণ সরাতে বাবর দেখে ভেতরে একটা ছোট সোনার তৈরি হাতির মূর্তি, যার চোখ দুটো রুবির। সে হাতিটা বাবরের দিকে এগিয়ে ধরে। “সেই বাচ্চা ছেলেটা আমার দাদাজানকে এটা দিয়েছিলো এবং তার অন্য আর কোনো নাতি জীবিত না থাকায় এটা আমাকে দিয়ে যান- বাকি সবাই আমার জন্মের আগে গুটি বসন্তে মারা গিয়েছিলো।

“ভবনটা ত্যাগ করার আগে আমার দাদাজান তূর্কী ভাষায় একটা ইস্তেহার লিখেন, যেখানে বলা হয় এই ভবনটা তল্লাশি করা হয়েছে মূল্যবান আর কিছু এখানে নেই। তিনি এটাও জানতেন পড়তে জানা গুটিকয় লোকদের ভিতরে একজন বিধায়, এবার তিনি একটা ছবি আঁকেন যেখানে লোকদের ভেতরে প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখা হয়েছে। তিনি দুটো কাগজই দরজায় লটকে দেন।

“দুদিন পরে তৈমূর হত্যাযজ্ঞ আর অগ্নিসংযোগ বন্ধ করার আদেশ দেন। আমার দাদাজানের ইস্তেহার আর ছবি ভালোই কাজ করে বোঝা যায়। কারণ দু’দিন পরে তিনি সেই বাসায় ফিরে এসে দেখেন বাসাটা অক্ষত রয়েছে আর সেই ছেলেটা বাড়ির সামনে সিঁড়ির ধাপে বসে রয়েছে…

“আমার দাদাজান- বাকি সব সৈন্যদের মতই- অনেক কিছু লুট করেছিলো।” সিদ্ধিলাভের অভিপ্রায়ে রেহানার চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। “সুলতানের প্রাসাদে তারা মাটির নিচে মূল্যবান রত্নে পরিপূর্ণ প্রকোষ্ঠ খুঁজে পেয়েছিলেন- মসৃণ দীপ্তিময় মুক্তা, আকাশের মতো নীল পান্না, দক্ষিণের খনিগর্ভে প্রাপ্ত ঝকঝকে হীরকখণ্ড- আর সোনা এবং রূপার মোহর। ঠিক যেমন প্রতিশ্রুতি তৈমূর তাদের দিয়েছিলেন। আমার দাদাজান তার প্রাপ্য অংশ বুঝে পেয়েছিলো। এছাড়াও তিনি অলংকৃত বর্ম আর একজোড়া সাদা টিয়াপাখি যা তিনি রাস্তার পাশে এক পরিত্যক্ত বাড়িতে খাঁচাবন্দি অবস্থায় খুঁজে পেয়েছিলেন, সাথে করে নিয়ে আসেন।

“সহসা, দিল্লীতে মাত্র তিনদিন অতিবাহিত করার পরে, তৈমূর তার বাহিনীকে শহর ত্যাগ করার আদেশ দেন। তার সেনাবাহিনী মন্থর গতিতে উত্তর আর পূর্বদিকে ফিরতি যাত্রা শুরু করে। কখনও কখনও দিনে চারমাইল পথ মাত্র অতিক্রম করে লুটের মালামালে এতোটাই ভারী হয়েছিলো বাহনগুলো। সমরকন্দ পৌঁছাবার অনেক আগেই আমার দাদাজান তার লুট করা সব ধনসম্পত্তি জুয়া খেলে হেরে যায়। কেবল সাদা টিয়াপাখি জোড়া আর এই হাতিটা শেষ পর্যন্ত তিনি নিয়ে আসেন।

“কিন্তু হিন্দুস্তানের কথা বলার সময় তার চোখ চকচক করতে থাকতো। যুদ্ধ আর নিজের কৃতিত্ব সম্বন্ধে তাকে খুব অল্পই বলতে শুনেছি। তিনি প্রায়ই পানি প্রবাহের কারণে সবুজ মাঠে চরে বেড়ানো মোটা গরু আর ভেড়ার পাল। মার্বেল আর বেলেপাথরে নির্মিত সুন্দর ভবনসমূহ আর হিন্দুস্তানের মূল্যবান পাথরের কথা বলতেন। তিনি বলতেন সেইস্থানের অফুরান প্রাকৃতিক সম্পদের কথা বলে শেষ করা যাবে না কখনও। বিশ্বাস করতে হলে নিজ চোখে সেসব দেখতে হবে…”।

রেহানার গল্প শেষ এবং তার জটিল রেখাসঙ্কুল মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে।

“তোমার কল্যাণে তৈমূরের জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন আমি আজ পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে জানতে পারলাম।” রেহানার ফুটিয়ে তোলা দৃশ্যপট বাবরকে অভিভূত করে। “তৈমূরের যুদ্ধ প্রণালী আর হিন্দুস্তান সম্পর্কে তুমি যা বলেছে তা এতোটাই অবিস্মরণীয় যে, আমি আমার মুনশিকে আদেশ দেবো পুরো বর্ণনাটা লিখে রাখতে যাতে অন্য লোকেরা তার শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে জানতে পারে। আর আমিও প্রয়োজন হলে এটা পুনরায় আলোচনা করতে পারি। ধন্যবাদ তোমাকে।”

রেহানা টুল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তার লাঠিতে ভর দিয়ে কক্ষ ত্যাগ করে। ফিরতি পথে তার পায়ের গতি বাবরের কাছে আগের চেয়ে অনেক চপল বলে মনে হয়।

“সুলতান।” হুসেন মজিদ কথা বলে। “তৈমূর হিন্দুস্তান তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করেননি কেন?”

“আমি জানি না। তৈমূরের হামলার বিষয়বস্তু নিয়ে লিখিত একটা কবিতার কয়েকটা পংক্তি আমার মরহুম আব্বাজান প্রায় বলতেন। হুবহু শব্দগুলো আমার মনে নেই, কিন্তু বিষয়বস্তু অনেকটা এরকম “দিল্লী লুণ্ঠিত হবার পরে দু’মাস আকাশে একটা পাখিও দেখা যায়নি, আর হিন্দুস্তানের ভিতর দিয়ে তৈমূরের যাত্রাপথের আশেপাশে বাতাস দূষিত করে তোলা লাশের স্তূপ কেবল দেখতে পাওয়া যেতো”। কবিরা প্রায়ই বাড়িয়ে বলে কিন্তু তৈমূরও সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন যেখানে তিনি এতো ধবংসযজ্ঞ সাধন করেছেন সেই অঞ্চল শাসন করাটা কঠিন হবে…সম্ভবত তিনি এটাও অনুধাবন করেছিলেন তার বয়স হচ্ছে এবং তখনও অনেক কাজ বাকি-অনেক অভিযান আর লুটপাট করা তখনও হয়নি। তাছাড়া দিল্লী থেকে ফিরে আসবার পরে তিনি সমরকন্দের কেবল চার মাস অবস্থান করেন। তারপরে পশ্চিমে ভূমধ্যসাগরের তীরে দামেস্ক আর আলেপ্পো দখল করে রওয়ানা দেন এবং আঙ্কারার। যুদ্ধে তিনি অটোমান তুর্কীদের মহান ম্রাট, বজ্রপাত বায়েজিদকে বন্দি করেন। তিনি তাকে আক্ষরিক অর্থেই একটা খাঁচায় বন্দি করে রাখেন, যা ভ্রমণের সময়ে। তাদের সাথেই থাকতো। সবাই বলে খাঁচায় বন্দি থাকা অবস্থায় মহামান্য সুলতান। নাকি বাচ্চাছেলের মত কাঁদতো…আর তৈমূর চীন অভিযানের সময়ে মৃত্যুবরণ করেন… হিন্দুস্তান তার বহু অভিযানের ভেতরে অন্যতম একটা অভিযান ছাড়া আর কিছুই না…”

“হিন্দুস্তানের বহুমূল্যবান রত্নরাজি সম্পর্কে রেহানার কথাই ঠিক। মাঝে মাঝে সওদাগরেরা সমরকন্দে নিয়ে আসে বিক্রি করতে এবং মূল্যবান পাথরগুলোর দীপ্তি অসাধারণ।” বাবুরী বলে। “আমি প্রায়ই কল্পনা করি দেশটা দেখতে না জানি কেমন।”

“তোমার আশা হয়তো পূরণ হবে।” বাবর চিন্তিত কণ্ঠে বলে। “গতরাতে আমি দেয়ালে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম সমরকন্দ ছাড়া অন্য কোথাও আমি আমার সাম্রাজ্যের ভিত্তি শুরু করতে পারি কিনা। তৈমূরের হিন্দুস্তান বিজয়ের কাহিনী রেহানা তার পূর্বপুরুষের বয়ানে বলে একটা আশীর্বাদের মতো কাজ করেছে।”

***

“অলস কোথাকার।” বাবর চিৎকার করে। তার খালি পায়ের নিচে লতাগুল্মহীন পাথুরে মাটি এবং ঢালটা বেশ খাড়া। কিন্তু সে তার প্রতিবাদ করতে থাকা দেহ নিয়ে উপরে উঠতে থাকে। বাবুরী বেশ চটপটে কয়েকগজ পেছনে সে বাবুরীর হাঁফাতে হাঁফাতে এগিয়ে আসা পায়ের শব্দ শুনতে পায়। কিন্তু সে তার চেয়ে দ্রুততর আর বিষয়টা তাকে প্রীত করে…বসন্তের আগমনের সাথে সাথে অভিযানে বেরিয়ে পড়ার আকাঙ্ক্ষা আবার তার মাঝে প্রবল হয়ে উঠেছে আর সেই সাথে ভবিষ্যতের যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত আরও চৌকষ করে তোলার সংকল্প। গত দুসপ্তাহ ধরে প্রতিদিন সে এই প্রত্যন্ত পার্বত্য এলাকার আর উপত্যকার উপর দিয়ে দৌড়ে এসে হিমশীতল নদীর পানিতে খালি গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। তার সাথে তখন কেবল বাবুরী থাকে। লম্বা শিংযুক্ত ছাগলের পাল ছাড়া হিংস্র আর কারো সাথে এখানে মুখোমুখি হবার সম্ভাবনা নেই।

সে নিজের মনে পরিকল্পনার ছক কষে। সাইবানি খানের সাথে তার বোঝাঁপড়া এখনও শেষ হয়নি- খানজাদাকে উদ্ধার না করা পর্যন্ত সেটা শেষ হবেও না। তারপরের কথা কে বলতে পারে? সমরকন্দ তার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। কিন্তু তুষারাবৃত পাথুরে চূড়া শোভিত হিন্দুকুশের অন্য পাশের সমৃদ্ধ আর বিচিত্র অঞ্চলের ভাবনা মন কিছুতেই সে দূর করতে পারছে না। তৈমূর যদি সেখানে অভিযান পরিচালনা করে থাকেন, তাহলে সেও যাবে?

২.৭ পলাতক জীবন

১৩. পলাতক জীবন

শিকার করে একদিন অতিবাহিত করার পরে বাবর ধীরে ঘোড়া নিয়ে সেরাম ফিরে আসছে। তার চারপাশের কৃষিজমিতে গ্রামের লোকেরা, উজ্জ্বল লাল,নীল আর সবুজ ঘাঘড়াচোলি পরিধান করে এই মওসুমের শস্য চাষ করার জন্য জমি প্রস্তুত করছে। বাবর সহসা সন্ধ্যার ম্লান সূর্য পেছনে রেখে সোনালী ধূলো উড়িয়ে তিনজন অশ্বারোহীকে বসতির দিক থেকে এগিয়ে আসতে দেখে। তারা এগিয়ে আসতে বাবর দু’জনকে তার দেহরক্ষী দলের সদস্য হিসাবে চিনতে পারে। তৃতীয়জন একজন অপরিচিত আগন্তুক। তিনজন ঘোড়া থামাতে, আগন্তুক ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে বাবরের সামনে শুকনো মাটিতে শুয়ে পড়ে শ্রদ্ধা জানায়।

“উঠে দাঁড়াও। কে তুমি?”

“আপনার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে আগত বার্তাবাহক। আমি আল্লাহতালার প্রতি কৃতজ্ঞ যে শেষ পর্যন্ত আপনাকে খুঁজে পেয়েছি। আমি আপনাকে বেশ কিছু দিন ধরে খুঁজছিলাম। আপনাকে খুঁজে পাওয়া খুব কষ্টকর।”

“সেটাই স্বাভাবিক। খুব কঠিন সময়ের ভিতর দিয়ে আমি অতিক্রম করছি। জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে কি বার্তা নিয়ে এসেছো? আমি সত্যি বলতে তার কাছ থেকে এই মুহূর্তে বিশেষ করে যখন ভাগ্য আমার প্রতি বিরূপ- তখন তার কাছ থেকে কোনো বার্তা প্রত্যাশা করিনি।”

“আমার প্রভুর প্রতিও ভাগ্য সমান বিরূপ বলে প্রতিপন্ন হয়েছেন। সাইবানি খান পশ্চিম দিক থেকে ফারগানা আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসছে। সুলতান জাহাঙ্গীর আপনাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছেন যতো দ্রুত সম্ভব আপনি আপনার সৈন্যবাহিনী নিয়ে যেনো ফারগানায় উপস্থিত হন।”

“আমি কেন সেখানে যাব? সমরকন্দ রক্ষার জন্য যখন আমি সাহায্যের আবেদন জানিয়ে ছিলাম সে কোনো সৈন্যবাহিনী পাঠায়নি।”

“সুলতান, আমি সেসব কিছুই জানি না। আমি কেবল এটুকুই জানি ফারগানার লোকেরা আতঙ্কিত হয়ে আছে এবং আপনার সাহায্য তাদের প্রয়োজন।”

বাবর সাথে সাথে কোনো উত্তর দেয় না। তারপরে সে বলে, “কারণটা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু উত্তর দেবার আগে আমাকে একটু ভাবতে হবে। ইত্যবসরে আমরা বসতিতে ফিরে যাই। সেখানে তুমি পরিষ্কার হয়ে ভালমতো খেয়ে নাও।” দু’ঘণ্টা পরে বাবর তার আম্মিজান আর নানীজানের কক্ষের দিকে এগিয়ে যায়। সে কক্ষের কাছাকাছি আসতে ভেতর থেকে এসান দৌলতের বীণার আওয়াজ শুনতে পায়। সে ভেতর প্রবেশ করলে তিনি বাদ্যযন্ত্রটা নামিয়ে রাখেন এবং খুতলাঘ নিগার তার সূচীকর্ম বন্ধ করেন। “জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে আগত বার্তার কথা আপনারা শুনেছেন?” সে জানতে চায়।

“অবশ্যই। তুমি কি প্রত্যুত্তর দেবে?”

“গত এক ঘণ্টা ধরে আমি সেটাই ভাবছি। আমার ন্যায়সঙ্গত মসনদ ছিনিয়ে নেয়ায় জাহাঙ্গীরের প্রতি আমার কোনো দুর্বলতা নেই আর তামবালের প্রতি আরও না। অবশ্য সম্মানিত একজন মানুষ হিসাবে আমি কেবল একভাবেই প্রতিক্রিয়া জানাতে পারি। আমার লোকদের জানের শত্রু- বর্বর উজবেকদের হাত থেকে আমি অবশ্যই ফারগানাকে রক্ষা করতে সাহায্য করবো। আমার জন্মস্থান আমি ভালোবাসি। সেখানেই আমার মরহুম আব্বাজান তার সমাধিতে শায়িত আছেন। তিনি যখন। জীবিত ছিলেন, তখন তার আর আম্মিজান আপনার সাথে সেখানে কাটানো অনেক আনন্দময় স্মৃতি আমার রয়েছে। আমার জন্মভূমি আক্রান্ত আর পরাভূত হবে আমি সেটা দাঁড়িয়ে দেখতে পারি না। আমার পক্ষে যতোজন লোক সংগ্রহ করা সম্ভব তাই নিয়ে আমি শীঘ্রই আকশির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবো।”

“আমি বা তোমার আম্মিজান এর চেয়ে কিছু কম তোমার কাছে প্রত্যাশা করিনি,” এসান দৌলত বলেন।

***

বেগুনী রঙের মেঘ গর্ভবতী মেয়ের মতো পেটভর্তি বৃষ্টি নিয়ে বেশতর পর্বতের তীক্ষ্ণ চূড়া মুকুটের মতো ঘিরে রেখেছে- বাবর তার শৈশবে এই দৃশ্য অসংখ্যবার দেখেছে। পূর্ব দিক থেকে একটা ঝড় ধেয়ে আসছে এবং ঘণ্টাখানেকের ভিতরে তাদের উপরে এসে ঝাঁপটে পড়বে। বাবর ভাবে তাদের কোথাও আশ্রয় নেয়া উচিত। আর তাছাড়া প্রায় দশ ঘণ্টা তারা ঘোড়ার পিঠে রয়েছে। এখন বিশ্রাম নেয়া দরকার। সে রেকাব থেকে পা বের করে এবং পা আলগাভাবে ঝুলতে দেয়। আড়ষ্ঠ উরু আর পায়ের ডিমের মাংসপেশী আরাম পায়। তার কালো বিশাল স্ট্যালিয়নটা অস্থিরভঙ্গিতে তার দুপায়ের ফাঁকে নড়াচড়া করতে সে এর ঘামে ভেজা গলায় আলতো করে চাপড় দেয়।

“আমরা ওখানে ছাউনি ফেলবো।” দুইশ গজ দূরে লাল বাকল বিশিষ্ট স্পিরাই গাছের ফুথের দিকে সে ইঙ্গিত করে। যা তাদের গুপ্তচর আর বৃষ্টি দুটোর হাত থেকেই আড়াল দেবে। সে যখন ছোট ছিলো ওয়াজির খান তখন ঘোড়া চালাবার জন্য ব্যবহৃত চাবুকের হাতল এই স্পিরাই গাছের কাঠ থেকে তৈরি করে দিয়েছিলো যা দেখতে অনেকটা খোলা চোয়ালের ভেতর থেকে জিহ্বা বের হয়ে থাকা শিয়ালের মুখের মতো দেখতে। কিন্তু মৃতদের বা অতীত নিয়ে নস্টালজিক হবার সময় এটা না। স্পিরাই গাছের নমনীয় কাঠ তীর তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। আর সামনের দিনগুলোতে এই কাঠ তাদের প্রচুর পরিমাণে প্রয়োজন হবে। “বাইসানগার সামনের ঐ পাহাড়ের উপরে প্রহরী নিয়োগ করেন।”

বাবর ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে সেটাকে চড়ে বেড়াবার সুযোগ দিয়ে আলগা করে একটা গাছের সাথে বেঁধে রাখে। তারা সেরাম এতো তাড়াহুড়ো করে ত্যাগ করেছে যে কোনো তাঁবু আনতে পারেনি। সে তার বেগুনী রঙের ঘোড়সওয়ারীর আলখাল্লাটা শক্ত করে। গায়ের সাথে জড়িয়ে নিয়ে একটা পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে বসে। তার লোকদের কেউ কেউ তীর ধনুক নিয়ে বনমোরগ বা ঘুঘু শিকার করতে বনের ভেতরে প্রবেশ করে বাকিরা আগুন জ্বালাবার জন্য কাঠ সংগ্রহ করে।

সে ভাবেনি এভাবে তাকে কখনও ফারগানায় ফিরে আসতে হতে পারে।

“সুলতান?”

বাবর চোখ তুলে তাকিয়ে বাবুরীকে দেখতে পায়।

“আপনাকে বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।”

“আমি আসলেই বিষণ্ণ বাবুরী, দু’দিনের ভেতরে আমরা আকশি পৌঁছাবো, কিংবা তারচেয়েও আগে। কিন্তু আমরা হয়তো ইতিমধ্যেই দেরি করে ফেলেছি।”

“আমরা যতো দ্রুত সম্ভব ঠিক ততোটাই দ্রুত এসেছি…”

“সেটা ঠিক আছে। কিন্তু এটা আমার জন্মভূমি। সমরকন্দের স্বপ্ন আমাকে এতটাই বিমোহিত করে রেখেছিল যে আমি আমার জন্মভূমির কথা বিস্মৃত হয়েছিলোম। আমি যদি বেপরোয়াভাবে উচ্চাভিলাষী না হতাম, তাহলে আজও হয়তো আমি এর সুলতান থাকতাম। আর সাইবানি খানও আমার বোনকে কুক্ষিগত করতে পারত না…”

“হাড়হারামী উজবেকদের কাছে কেউই নিরাপদ না। সাইবানি খান আপনার সাথে শত্রুতা করে যাবে যতদিন আপনি বা অন্যকেউ- বেজন্মাটার মাথা তার ধড় থেকে আলাদা না করছে…”

বাবর সম্মতি জানায়। বাবুরীর কথাই সম্ভবত ঠিক। এমন কিছু হয়তো ভিন্ন হতো না। দিগন্তের বুকে বেশতর পাহাড়ের পরিচিত, আঁকাবাঁকা আকৃতি চোখে পড়তে যে অপরাধবোধ আর বিষণ্ণতা নেমে এসেছিলো তা কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়।

বৃষ্টি শুরু হয়। বাবর উঠে দাঁড়িয়ে উপরের দিকে মুখ তোলে, টের পায় বৃষ্টির ফোঁটা তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। বৃষ্টি এভাবে পড়তে থাকলে আজ রাতে আর আগুন জ্বালানো যাবে না। ঝলসানো মাংসের বদলে, সেরাম থেকে আনা বাসি রুটি আর শুকনো কিন্তু মিষ্টি খুবানি, যা তাদের পর্যানে রয়েছে তাই খেয়ে তাদের ক্ষুধা নিবৃত্তি করতে হবে এবং ভেজা মাটিতে পেটের গুড়গুড় আওয়াজ শুনতে শুনতে ঘুমাবার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু একটাই শান্তি সে শীঘ্রই তার জন্মভূমি আবার দেখতে পাবে এবং তার সঙ্গের সামান্য লোকবল নিয়েই সাইবানি খানকে হামলা করার একটা সুযোগ পাবে।

***

বাবরের গুপ্তদূতেরা প্রথম জিনিসটা দেখতে পায়- আকশি থেকে চল্লিশ মাইল দূরে তিকান্ড বসতি থেকে আগুনের ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। গ্রামটা সে খুব ভালো করেই চেনে, বিশেষ করে আব্বাজানের সাথে শিকারে আসবার কথা তার ভালোই মনে আছে। যখন সে তার সাদা রঙের ছোট নাদুসনুদস টাটু ঘোড়াটা নিয়ে তৃণভূমির সাদা তিনপাতা বিশিষ্ট ক্লোভার গাছের মাঝে হরিণ তাড়া করতো, বা গ্রামের বাচ্চাছেলেদের সাথে মিরতিমুরি তরমুজের ক্ষেত থেকে লেজবিশিষ্ট নধর তিতির দাবড়ে দিত। তিকান্ড ছিলো সুন্দর, সমৃদ্ধ একটা গ্রাম, যার উর্বর জমিতে পানি সরবরাহের জন্য একটা জটিল সেচব্যবস্থা ছিলো।

কিন্তু এখনকার এই তিকান্ড একদম আলাদা। বাবর নিজেও একটু পরে আকাশে কালো আর ঝাঁঝালো ধোয়া আকাশে ভেসে উঠতে দেখে। চা গরম করবার জন্য। গোবরের ঘুঁটে দিয়ে এই আগুন জ্বালানো হয়নি বা দুপুরের খাবার রান্নার জন্যও না। পুরো গ্রামটাই সম্ভবত আগুনে পুড়ছে।

সে আর তার লোকেরা অস্ত্র হাতে সামনে এগিয়ে যায়, কোথাও কিছুই নড়াচড়া করে না, এমনকি কোনো পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দও ভেসে আসে না। তাদের সামনে সূর্যের আলো পড়তে একটা খালের পানি চিকচিক করে কিন্তু এর চারপাশের আপেল, নাশপাতি আর খুবানির একদা সুন্দর বাগানের গাছগুলো ধবংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। প্রতিটা গাছের কাণ্ড কেটে ফেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। তরমুজের ক্ষেতেও যেনো মত্ত মাতালের তাণ্ডব।

কিন্তু খারাপটা আরও সামনে ছিলো। একটা গাছ কেবল দাঁড়িয়ে আছে একটা হৃষ্টপুষ্ট আপেলের গাছ, যা শীঘ্রই সাদা গোলাপী ফুলে ভরে উঠবে ভালো ফলনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে। কিন্তু গাছটা ইতিমধ্যে ভরে উঠেছে পাঁচটা বাচ্চাছেলের লাশ এর শক্তপোক্ত ডাল থেকে ঝুলে আছে। তাদের রুক্ষভাবে কাটা চুল, পরণের মোটা সুতার টিউনিক, আর পায়ে পরিহিত আচ্ছাদন ছেলেবেলায় সে নধর তিতির। যাদের সাথে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতে সেইসব মসৃণ ত্বকের হাস্যোজ্জ্বল আর অন্তরঙ্গ ছেলের দলের মতো। কেবল একটাই পার্থক্য এদের মুখ ফুলে বেগুনী হয়ে আছে। কোটর থেকে চোখ বের হয়ে এসেছে এবং রুক্ষ্ম দড়ি তাদের কোমল ত্বকের যেখানে কামড় বসিয়েছে, গলার সেই জায়গাটায় রক্ত জমে আছে। জমাট বাঁধা রক্তের চারপাশে মাছি ভনভন করছে। বাবর এগিয়ে গিয়ে বাতাসে দুলতে থাকা একটা বাচ্চাছেলের গাল স্পর্শ করে। বেচারার ত্বক তখনও হাল্কা উষ্ণ রয়েছে।

“দড়ি কেটে এদের নামাও।”

“সুলতান, এদিকে দেখেন।” বাইসানগার, খাল থেকে পানি তুলে রাখার জন্য নির্মিত কাছের একটা ইঁদারার দিকে দেখায়।

ঘোড়া থেকে নেমে, বাবর উঁকি দিতে নিচে নারী আর পুরুষের দলা হয়ে পড়ে থাকা লাশের স্তূপ দেখতে পায়। সে যতোটুকু দেখতে পায়, বুঝতে পারে সবারই শিরোচ্ছেদ করা হয়েছে। পঞ্চাশ ফিট দূরে, বাজারে বিক্রির জন্য যেভাবে পাকা তরমুজ সাজিয়ে রাখা হয় তেমনিভাবে মাথাগুলো একটা নিখুঁত স্তূপে সজ্জিত। স্তূপের একেবারে উপরের মাথাটা উড়তে থাকা সাদা দাড়ির এক বৃদ্ধের। প্রপিতামহ না হলেও সম্ভবত একজন পিতামহ। তার কর্তিত রক্তাক্ত লিঙ্গ দুঠোঁটের মাঝে খুঁজে দেয়া হয়েছে আর চোখের কোটরে ঠাই পেয়েছে অণ্ডকোষ দুটি।

বাবর আর তার লোকেরা নিরবে টিকান্ডের কেন্দ্রস্থল পর্যন্ত এগিয়ে যায়। উজবেক বর্বরগুলো বাড়ি আর আস্তাবল পুড়িয়ে কেবল অগ্নিদগ্ধ একটা খোলস রেখে গিয়েছে। চারপাশে মৃতদেহ পড়ে আছে। কিছু কিছু লাশ এমন অশ্লীল ভঙ্গিতে বিন্যস্ত যেনো দেখে মনে হয় মৃত্যুর যন্ত্রণার মাঝেও তারা রমণে উদগত হয়েছিলো। উজবেকরা নিশ্চয়ই দ্রুত এগিয়ে গিয়েছে, তাই পশুর পাল নিয়ে যেতে পারেনি। সেজন্য তারা অবলা প্রাণীগুলোর অঙ্গহানি করেছে, তাদের পেশীত কেটে দিয়ে গিয়েছে। বাবর তার লোকদের বলে যেসব পশু তখনও বেঁচে আছে তাদের যেনো জবাই করা হয়।

আধ ঘণ্টা পরে, তার লোকেরা যখন আদেশমত নির্মম কাজটা পালন করতে ব্যস্ত, তার এক গুপ্তদূত- একজন সৈনিক, কাছের বারা কোহ পর্বতের পাদদেশে যারা পরিবার বসবাস করে, এবং এলাকাটা যে ভালো করেই চেনে- বল্পিত বেগে ঘোড়া হাঁকিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসে। তার চোখে মুখে একটা জরুরীভাব ফুটে রয়েছে।

“কি খবর?”

“আমরা উজবেকদের কাফেলার খোঁজ পেয়েছি। ঘোড়ার তাজা বিষ্ঠা দেখে বোঝা যাচ্ছে মাত্র দু’ঘণ্টা আগে তারা এখান থেকে রওয়ানা দিয়েছে এবং তাদের ঘোড়ার পায়ের ছাপ দেখে বোঝা যাচ্ছে লুটপাট ভালোই করেছে কারণ খুরের দাগ মাটিতে চেপে বসে আছে এবং ধীরে ধীরে অগ্রগামী হচ্ছে। তারা মনে হয় আকশির দিকেই এগিয়ে চলেছে।

“দারুণ। আমরা রওয়ানা দিচ্ছি।”

বাইসানগার, আর বাবুরীকে দুপাশে নিয়ে বাবর গুপ্তদূতদের অনুসরণ আরম্ভ করে। সে আর তার লোকেরা যদি উজবেক হানাদারদের অতিক্রম করে একবার এগিয়ে যেতে পারে,তাহলে সে এখানের এই নির্মমতার হিসাব তাদের কাছ থেকে কড়ায়গণ্ডায় উসুল করবে- রক্তের বদলে রক্ত, চিৎকারের বদলে চিৎকার। কৃষক যেভাবে কাক মেরে থাকে, ঠিক তেমনি তাচ্ছিল্যে হত্যা করা ঐসব বাচ্চাদের মৃত্যুর বদলা অবশ্যই নেয়া হবে।

তিকান্ড থেকে প্রায় পনের মাইল দূরে এক পাথুরে, আগাছাপূর্ণ ভূমি অতিক্রম। করতে গিয়ে তারা উজবেকদের পায়ের চিহ্ন হারিয়ে ফেলে। উচবেকরা সম্ভবত একপাশে সরে গিয়ে অন্য কোনো গ্রাম আক্রমণ করতে অগ্রসর হয়েছে কিন্তু তিকান্ড আর আকশির মাঝে হামলা করার মতো কোনো জনবসতি নেই। বাবর অপেক্ষা। করার সিদ্ধান্ত নেয়। উজবেকরা যদি টের পায় তাদের অনুসরণ করা হচ্ছে তাহলে, সেই হয়তো উল্টো ফাঁদে গিয়ে পড়বে। সে দু’জন গুপ্তদূত সামনে পাঠায় আর চারজনকে ঘুরে পেছনটা দেখতে বলে। দু’জন বামদিক দিয়ে আর দু’জন ডানদিক দিয়ে ঘুরে আসবে, তাদের দায়িত্ব দেয়া হয় উজবেকরা পেছন থেকে আক্রমণের পায়তারা করছে কিনা সেটা দেখার দায়িত্ব তাদের দেয়া হয়।

বাবর আর তার বাকি লোকেরা নিরবে, চোখ কান খোলা রেখে অপেক্ষা করতে থাকে। ঘোড়ার লাগাম শক্ত করে ধরা, যাতে প্রয়োজন হলে মুহূর্তের ভিতরে দৌড় শুরু করা যায়। বেশ কিছুক্ষণ পরে সামনে পাঠানো এক গুপ্তদূত ফিরে আসে।

“সুলতান, আমরা উজবেকদের খুঁজে পেয়েছি। ব্যাটারা জঙ্গলে ঢুকেছিলো।”

উজবেকদের রেখে যাওয়া সংকীর্ণ পথ দিয়ে ঘোড়া নিয়ে যাবার সময় বাবর ভাবতে থাকে এই ঘন অন্ধকার অরণ্যে ব্যাটারা কেন প্রবেশ করেছে। আকশি পৌঁছাবার এটা দ্রুততম পথ না। তারপরে বিদ্যুৎ চমকের মতো তার মনে পড়ে। বহু আগে, তার বাবার সাথে শিকারে আসলে, যা এখন বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছে, তিনি তাকে বনভূমির উত্তরে নিচু টিলার মাঝে অবস্থিত বিখ্যাত আয়না পাথর দেখিয়েছিলেন। অতিকায় পাথরটা দেখে সে বিমোহিত হয়েছিলো। প্রায় ত্রিশ ফিট লম্বা, এবং মাঝে মাঝে এক মানুষ সমান লম্বা পাথরটার ধূসর উপরিভাগ মোটা মোটা পাথুরে স্ফটিকের শিরায় শোভিত। যেখানে দুপুরবেলা সূর্যের আলো পড়তে পাথরটা আয়নার মতো চমকায়, উজ্জ্বল আলোর রশি বিকিরিত করে। বলা হয়ে থাকে পাথরটার অতিন্দ্রীয় ক্ষমতা রয়েছে…কোনো যোদ্ধা যদি পাথরটার ধারালো প্রান্তে নিজের তরবারির ফলা ঘষে নেয়, তবে যুদ্ধক্ষেত্রে কেউ তাকে পরাস্ত করতে পারবে না। উজবেকরা সম্ভবত তাদের রক্তের লালসা প্রশমিত হতে- এখন। পাথরটা দেখে এর শক্তি পরখ করতে চায়।

আধ ঘণ্টা পরে, বাবর আর তার লোকেরা বনের মাঝে একটা খোলা স্থানে বের হয়ে আসে। সেখানে আবার ঘোড়ার পায়ের ছাপ দেখতে পায় উত্তর দিকে এগিয়ে গিয়েছে। বাইসানগার আর বাবুরীকে পাশে ডেকে এনে বাবর তাদের আয়না পাথরের কথা বলে। “উজবেকরা যদি আসলেই সেখানে গিয়ে থাকে আমরা তাহলে তাদের বেকায়দায় ফেলতে পারি। তারা চিন্তাও করবে না কেউ তাদের অনুসরণ করতে পারে। কিন্তু আমাদের তবুও সতর্ক থাকতে হবে… আমার যদি ঠিক ঠিক স্মরণ থাকে, তবে পাথরটা এখান থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত। আমার লোকদের যতোটা সম্ভব নিরবতা পালন করে অস্ত্র হাতে প্রস্তুত থাকার আদেশ দেন…’

বাবর আর তার লোকেরা সন্তর্পণে এগিয়ে যেতে একটা নিচু টিলার শৈলপ্রান্তের উপর দিয়ে উজবেকদের হট্টগোল আর হাসির শব্দ ভেসে আসতে শুনে। বাবর তার লোকদের ঘোড়া থেকে নামার আদেশ দেয় এবং ছয়জন যোদ্ধাকে ঘোড়াগুলো আগলে রাখার দায়িত্বে রেখে যে টিলার পেছন থেকে কর্কশ কোলাহলের শব্দ ভেসে আসছে বাকি সৈন্যদের নিয়ে সেটার উপরে উঠে আসে। গুঁড়ি দিয়ে অবস্থান করে তারা ঝুঁকে নিচের দিকে তাকায়।

তখন প্রায় দুপুর হয়ে এসেছে এবং সূর্যের আলোয় আয়না পাথর এমন চমকাচ্ছে যে, বাবর চোখ বন্ধ করে নেয়। তারপরেও বন্ধ চোখের পাতার নিচে উষ্ণ সাদা বিন্দু নাচতে থাকে। পাথরটার উজ্জ্বলতার কথা সে ভুলে গিয়েছিলো। হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে, সে আবার নিচের দিকে তাকায়। পাথরের নিচে উজবেক দস্যুর দলটা অলস ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। চামড়ার তৈরি মদের মশক- কিছু ভর্তি, কিছু খালি- তাদের চারপাশে ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় পড়ে আছে। তাদের অস্ত্রশস্ত্রেরও একই দশা। তাদের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ জন হবে সব মিলিয়ে। পাথরের ডান দিকে গাছের সারির নিচে টিকান্ড থেকে লুট করা মালামাল বোঝাই অবস্থায় দড়ি দিয়ে বাধা।

সহসা বাম দিকে কোথাও থেকে উচ্চকণ্ঠের একটা চিৎকারের আওয়াজ ভেসে আসতে বাবর চমকে ফিরে তাকায়। দুই উজবেক অর্ধনগ্ন এক মহিলার দু’হাত ধরে টেনে তাকে পাথরের পাদদেশে নিয়ে আসছে। আরও চিৎকারের রোল উঠে উচ্চসুরে আর তীক্ষ্ণ- উজবেকরা নিশ্চয়ই পাথরের আড়ালে তাদের মহিলা বন্দিদের লুকিয়ে রেখেছিলো নিজেদের অবসর সময়ে তাদের সঙ্গ উপভোগ করবে বলে।

উজবেকরা আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করতে থাকা মহিলার পরণের কাপড় ছিঁড়ে তার কোমল ধুসর দেহ নগ্ন উন্মুক্ত করে। তারপরে একজন হাটু মুড়ে বসে তার কব্জি মাটিতে চেপে ধরে রাখে। আর আরো দু’জন তার দু’পা দু’পাশে টেনে ধরে তাকে অসহায় অবস্থায় চার হাতপা মেলে রাখা একটা প্রতিকৃতিতে পরিণত করে। তখন চতুর্থ একজন সেঁতো হাসি মুখে লটকে পাজামার বেল্ট খুলতে আরম্ভ করে। বাবরের মস্তিষ্কে খানজাদার কথা ঝলসে উঠে। সে লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দিনের প্রথম তীরটা শূন্যে ভাসিয়ে দেয়। লোকটা তখনও তার পরণের কাপড় নিয়ে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে, সেই অবস্থায় তীরটা তার কণ্ঠ বিদীর্ণ করে। চোখেমুখে একটা অবিশ্বাসের অভিব্যক্তি নিয়ে নিজের গোপনঅঙ্গ আকড়ে ধরে সে পেছনে উল্টে পড়ে।

বাবরের দ্বিতীয় তীরটা মেয়েটার কব্জি আঁকড়ে রাখা উজবেকের বাম চোখে বিদ্ধ হয়, যে তার সঙ্গির অবস্থা দেখে আহাম্মকের মতো সরাসরি বাবর পাহাড়ের উপরে আকাশের নিচে যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেদিকে তাকিয়েছিলো।

“ফারগানার জন্য!” হুঙ্কার তুলে বাবর তার লোকদের নিয়ে পাহাড়ের উপর থেকে নেমে আসে। তাদের সবার মনেই টিকান্ডের অধিবাসীদের হত্যাকাণ্ডের বদলা নেবার উদগ্র বাসনা।

***

“আমাদের কল্যাণে ভালই ভোজ হবে ব্যাটাদের।” বাবুরী আয়না পাথরের উপরে বাতাসে বৃত্তাকারে কালো ডানা মেলে উড়তে থাকা পাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে।

“আরও ভালো ভোজ হতো যদি বেশি থাকতো,” বাবর বিড়বিড় করে বলে। হানাদারদের এই দলটাকে নিশ্চিহ্ন করাটা মশার কামড়ের মতই নগণ্য ব্যাপার। সাইবানি খান তার ক্ষমতা আর শক্তি নিয়ে সামনে কোথাও অপেক্ষা করছে। তারপরেও সে তার নাম লিখে রেখে এসেছে: এক উজবেকের দাঁতের ফাঁকে রক্ত দিয়ে তার নাম লেখা কাগজ গুঁজে দিয়েছে। সাইবানি খান শীঘ্রই জানতে পারবে এটা কার কাজ।

“আমাদের একজন লোকও আহত হয়নি। আর তাদের সব ঘোড়া আর লুট করা সামগ্রী আমরা নিয়ে এসেছি।”

বাবর আড়চোখে দলের পেছনে আরোহীশূন্য ঘোড়ার সারির দিকে তাকায়। তার লোকেরা সাতজন মেয়েকে খুঁজে পেয়েছিলো- সবচেয়ে অল্পবয়স্ক যে, তার বয়স কোনোমতেই বারো বছরের বেশি হবে না- তারা এখন উজবেকরা টিকান্ড থেকে লুটের মালামাল বহন করার জন্য যে দুটো খচ্চরটানা গাড়ি নিয়ে এসেছিলো তাতে আলখাল্লা মুড়ে বসে রয়েছে। আরও এগিয়ে যাবার আগে তাদের একটা বন্দোবস্ত করতে হবে। এখান থেকে পূর্বে একটা বসতি রয়েছে যেখানে মেয়েরা আপাতত নিরাপদে থাকবে। সে তাদের সাথে লোক দিয়ে সেখানে পাঠিয়ে দেবে।

বাবুরী কথা বলার জন্য মরিয়া হয়ে থাকলেও, বাবর নিরবে এগিয়ে চলে। আকশির কাছাকাছি সে চলে এসেছে। কি অপেক্ষা করছে সেখানে তার জন্য? অন্য সর্দাররা কি জাহাঙ্গীরকে সহায়তা করবে? দূর্গ তোরণের সামনে সাইবানি খান হাজির হবার আগইে কি তারা তার সাহায্যে হাজির হবে? ওয়াজির খানের প্রজ্ঞার অভাব সে খুব বেশি করে অনুভব করে। তিনিও, ফারগানায় জন্ম নেয়া আর বেড়ে ওঠা একজন ছিলেন। বাবরের মনোকষ্ট তার চেয়ে ভালো আর কেউ বুঝতে পারতো না।

অন্ধকার নেমে আসতে তারা জাক্সারটাসের একটা শাখা নদীর তীরে রাতের মতো। অস্থায়ী ছাউনি স্থাপন করে। আকশির এতো কাছে তারা যেখানে আছে সেখান থেকে মাত্র দু’ঘণ্টার পথ- বাবর অনেক কষ্টে আরও এগিয়ে যাবার আকাক্ষা দমন করে। রাতের আঁধারে এগিয়ে যাওয়াটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হতো না। উজবেক প্রহরীরা যেকোনো স্থানে থাকতে পারে।

স্রোতস্বিনীর কিনারে বসে সে পানির বহমান ধারার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে বোকার মতো একটা কাজ করেছে। আয়না পাথরের নিচে উজবেকগুলোকে কচুকাটা করার আগে তাদের কাছ থেকে সাইবানি খানের অবস্থান তার সেনাবাহিনীর শক্তিমাত্রা সম্বন্ধে জেনে নেয়াটা উচিত ছিলো। তারবদলে, প্রতিশোধের আগুনে অন্ধ হয়ে সে কেবল তাদের মৃত্যু কামনা করেছিলো। নাহ্, তার আরও অনেক কিছু শেখার বাকি আছে…

“সুলতান, আমরা এই মেষপালককে তার ভেড়ার পালসহ কাছেই খুঁজে পেয়েছি। তার কথা আপনার শোনা উচিত।”

বাবর ঘুরে তাকিয়ে বাইসানগারকে দেখতে পায় এবং তার পেছনে দু’জন সৈন্যের মাঝে বছর চল্লিশের সর্তক অভিব্যক্তির এক লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। তাকে অস্থির দেখালেও বিস্মিত কোনোমতে বলা যাবে না। সে আশা করেনি এভাবে তাকে ধরে বাবরের ছাউনিতে নিয়ে আসা হতে পারে।

“আমার লোকদের কাছে যে গল্পটা বলেছো সেটা আবার বলো। কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করবে না।”

বাইসানগার লোকটার কাধ ধরে তাকে বাবরের মুখোমুখি দাঁড় করায়।

মেষপালক গলা পরিষ্কার করে। “সাইবানি খান পাঁচদিন আগে আকশি দখল করেছে।” বাবরের দিকে সে উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে থাকে। “সবাই বলাবলি করছে। সে সুলতান জাহাঙ্গীরের সাথে প্রতারণা করেছে। সে জাহাঙ্গীরকে নাকি বলেছিলো ফারগানা নয় কেবল উপঢৌকন পেলেই সে খুশি হবে। সুলতান যদি তাকে নিজের সম্রাট বলে স্বীকার করে নিয়ে জনসম্মুখে বাৎসরিক খাজনা দিতে সম্মত হয় তাহলেই তিনি তার সেনাবাহিনী নিয়ে সমরকন্দ ফিরে যাবেন…”

“বলে যাও।” বাবরের হাত পা সহসা শীতল হয়ে আসে।

“আমি অবশ্যই সেখানে ছিলাম না। আমি তাই যা শুনেছি কেবল সেটাই আপনাকে বলতে পারি… তারা বলছে দূর্গের নিচে জাক্সারটাসের তীরে অনুষ্ঠানটার আয়োজন করা হয়েছিলো। লাল রেশমের চাঁদোয়ার নিচে আমাদের সুলতান সাইবানি খানের সামনে নতজানু হয়ে বসে। তিনি তখন সোনার জরির কাজ করা চাদরে ঢাকা একটা নিচু আসনে উপবিষ্ট অবস্থায় ছিলেন, এবং তাকে “প্রভু” বলে সম্বোধন করেন। সুলতান নতজানু হয়ে বসে থাকা অবস্থায় সাইবানি খান উঠে দাঁড়িয়ে মুখে কুটিল হাসি নিয়ে তার বিখ্যাত বাঁকানো তরবারি কোষমুক্ত করে। হাসি মুখে তিনি সুলতানের দিকে এগিয়ে যান। “এখন তুমি যখন আমার অধীনস্ত প্রজা, আমি তোমার সাথে যা ইচ্ছা আচরণ করতে পারি।” কথাটা বলেই তিনি তার শিরোচ্ছেদ করেন। সুলতানের শিরোচ্ছেদ ঘটাবার সাথে সাথে মৃত সুলতানের দাঁড়িয়ে থাকা অমাত্যদের উপরে সাইবানি খানের যোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের হত্যা করে।

“তামবাল?” তাকেও কি হত্যা করা হয়েছে? আর বাকি বেগ, ইউসুফ আর অন্যান্যদেরই বা কি খবর?”

“সবাই মারা গেছে। আমি আরো শুনেছি- আকশি থেকে পালিয়ে আসা দুই আস্তাবল কর্মীর কাছে যে সাইবানি খান দূর্গে প্রবেশ করে হারেমের মহিলাদের বাধ্য করেছে তার সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে। কিছু মেয়েদের নিজের জন্য রেখে বাকিদের সে নিজের লোকদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছে। সবশেষে তিনি মৃত সুলতানের মা রোক্সানাকে ডেকে পাঠান। তারা বলেছে, মৃত সুলতানের কাটা মাথা তার সামনে তুলে ধরতে তিনি তাকে অভিশাপ দেন, আর তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বিলাপ করতে থাকেন। তখন তার বিলাপ বন্ধ করতে সাইবানি খান তার কণ্ঠনালী ছিন্ন করার আদেশ দেন। মেষপালক বলে।”

বাবরের মাথা চক্কর দিতে থাকে। তার সংবাদবাহকরা এসব কিছুই জানতে পারেনি, এবং গল্পটাও সম্ভবত অতিরঞ্জিত। কিন্তু গল্পের সারবস্তু সম্বন্ধে বাবরের মনে কোনো সন্দেহ নেই- যে সাইবানি খান চালাকি করে জাহাঙ্গীর, তামবাল আর সবাইকে খুন করে ফারগানা দখল করেছে। রোক্সানার ভাগ্য নিয়েও তার মনে কোনো দ্বিধা নেই এবং এক মুহূর্তের জন্য সে তার মরহুম আব্বাজানের রক্ষিতার প্রতি করুণা বোধ করে।

সারারাত নির্ঘম কাটাবার পরে, সকাল বেলা, বাবর তার ঘোড়ার বাঁধন খুলে একাকী খাড়া ঢালের দিকে এগিয়ে যায়। যেখান থেকে সে জানে আকশি দেখা যাবে। তারা চূড়ায় উঠে আসতে তার স্ট্যালিয়নটার দেহ ঘামে ভিজে যায়। অনেক নিচে, তার পূর্বপুরুষদের নির্মিত তাদের এতোদিনের আস্তানা, জাক্সারটাস নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকা দূর্গটা দেখতে পায়।

দূর্গের তোরণে পতপত করে একটা নিশানা উড়তে দেখা যায়। এতদূর থেকে বাবর রঙটা ঠিকমত চিনতে পারে না। কিন্তু সে জানে আর যাই হোক সেটা ফারগানার উজ্জ্বল হলুদ বর্ণ না। সেটা সাইবানি খানের কালো নিশান। যে সমরকন্দ দখলের মতো তার পূর্বপুরুষের ভূখণ্ডও চুরি করে নিয়েছে। বাবর তার দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া কান্নার বেগ রোধ করতে পারে না, বা যন্ত্রণায় ফুঁপিয়ে উঠাও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে না। কিন্তু সেটা কোনো ব্যাপার না। পাহাড়ের এই চূড়ায় কেউ তাকিয়ে নেই। কেবল মাথার উপরে বাজপাখির দল পাখা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে।

***

“আমাদের সামনে এটাই একমাত্র পথ।” এসান দৌলত কণ্ঠে গুরুত্ব ফুটিয়ে বলেন। জাহাঙ্গীর আর তোমার চাচাতো ভাই মাহমুদ খানকে সে যেভাবে হত্যা করেছে তোমাকেও সেভাবে সে হত্যা করবে। তৈমূরের বংশের প্রত্যেক শাহজাদাকে খুন করার শপথ সে নিয়েছে। আর আমি তোমাকে বলে রাখছি সে তার শপথ বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর।”

“আমি তার কাছ থেকে পালাবো না। আমি কাপুরুষ নই…”।

“তাহলে তোমাকে বোকাই বলতে হবে। তার নেতৃত্বে হাজারের উপরে যোদ্ধা রয়েছে। পুরোটা গ্রীষ্মকাল জুড়ে, সে সমরকন্দ আর ফারগানা দখল করার পরে উত্তরের তৃণভূমিতে বসবাসকারী গোত্রগুলো তার অধীনতা মেনে নিয়েছে। প্রতিদিন তার শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে আর তুমি হৃতশক্তি হচ্ছো।” এসান দৌলত আগুনে থুতু ফেলেন- বাবর তাকে আগে কখনও এমন করতে দেখেনি। “তোমার সমর্থনে কতোজন রয়েছে?” তিনি বলতে থাকেন। “পঞ্চাশজন? একশজন? বাকিরা সবাই নিজনিজ গ্রামে ফিরে গেছে। তোমার এমনকি কোনো স্ত্রী নেই…উত্তরাধিকারীর কথা বাদই দিলাম।”

এসান দৌলত তাকে সবকিছুর জন্য দোষারোপ করেন। কিন্তু বাবর কৃতজ্ঞ যে আয়েশা চিরতরে বিদায় নিয়েছে। ইবরাহিম সারুর কাছ থেকে পাঠানো কাঠখোট্টা বাতাটা যাতে তিনি বলেছেন যে, কোনো সালতানাত্তীন ভিখিরীর সাথে তিনি তার মেয়ের বিয়ে দিতে চাননি এবং বিয়ের বাধ্যবাধকতার পালা চুকে যাবার ফলে বাবর ততোটাই উৎফুল্ল হয়েছে, ঠিক যতোটা ক্রুদ্ধ হয়েছেন তার নানীজান। চিঠিটা নিয়ে এসেছিলো যে বার্তাবাহক তার ভাষ্য অনুযায়ী- সে বিয়েতে আয়েশাকে দেয়া বাবরের অলংকারও ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে- বাবরের পাঠানো বিয়ের প্রস্তাবের আগে আয়েশার সাথে তার নিজ গোত্রের যার বিয়ের কথা হয়েছিলো সেই লোকের সাথেই শীঘ্রই তার বিয়ে হবে। বাবর অবশেষে তার প্রতি আয়েশার নির্লিপ্ততার কারণ খুঁজে পেয়েছে বলে মনে করে কিন্তু তার কাছে যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল আয়েশার অন্য পুরুষের শয্যাশায়িনী হতে পারে- আয়েশাকে উষ্ণ করতে পারবে এমন যে কোনো পুরুষের প্রতি তার শুভেচ্ছা রইল।

“আমার এখন স্ত্রীকে দেবার মতো সময় নেই,” সে কাঠখোট্টা ভঙ্গিতে বলে। “আমার নিয়তি সুলতানের নিয়তি, আর আমি অবশ্যই হামলা করবো…”

“তুমি যদি সত্যিই তোমার ভাগ্যে বিশ্বাস করো তুমি কথা শুনবে। এখন পর্যন্ত সাইবানি খান তোমাকে খুঁজছে। সে জানে আয়না পাহাড়ের কাছে তার লোকদের তুমিই হত্যা করেছে এবং ইতিমধ্যে সে এটাও জেনে গিয়েছে যে তুমি এখানে, সেরামে ফিরে এসেছে। তার স্বর্ণমুদ্রার লোভে অনেকেই আছে যারা তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে দ্বিধা করবে না।”

“আমি খানজাদাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলোম…”

“সেটা তুমি রাখতে পারবে না, যদি সাইবানি হারামজাদা তোমার কাঁধের উপর থেকে মাথাটাই নাই করে দেয়। আর সাইবানি যখন রসিয়ে তোমার মৃত্যুর খবর তাকে বলবে, তখন কি খানজাদার কষ্ট কিছু কমবে?” বাবরের চোখে তিক্ততা দেখতে পেয়ে বৃদ্ধার কণ্ঠস্বর কিছুটা কোমল হয়। “তোমার বয়স এখনও কম। তোমাকে ধৈর্যশীল হতে হবে। আমার মতো যখন তোমার বয়স হবে তখন তুমি বুঝতে পারবে যে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়। কখনও কখনও সবচেয়ে সাহসী সবচেয়ে কষ্টকর বিষয় হলো- অপেক্ষা করা।”

খুতলাঘ নিগার মাথা নাড়েন। খানজাদাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবার পরে তিনি এতোটাই নিরব হয়ে পড়েছেন যে, তার মুখ থেকে কদাচিৎ কোনো শব্দ শোনা যায়। “তোমার নানীজান ঠিকই বলেছেন। এখানে থাকলে তোমার সামনে কোনো সুযোগই নেই। সে আমাদের সবাইকে তাহলে খুন করবে। আমি নিজের জন্য পরোয়া করি না। কিন্তু তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে…ভুলে যেও না তোমার ধমনীতে কার রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। মামুলি ডাকাতের মতো সাইবানি খান যেনো তোমাকে পরাস্ত করতে না পারে।”

খুতলাঘ নিগার তার ভারী নীল শালটা আরও ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নেন এবং ঝুড়িতে জ্বলতে থাকা আগুনের উপরে হাতটা মেলে ধরেন। শীতকাল আসতে আর বেশি দেরি নেই। সেরামের মাটির বাড়ি আর খিড়কী দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করা বাতাস সে কথাই জানান দিচ্ছে।

বাবর তার শীর্ণ গালে চুমু দেয়। “আমি তোমাদের দুজনের কথাই বিবেচনা করে দেখবো।”

এসান দৌলত পুনরায় তার বীণা তুলে নেন। বীণাটার অবস্থা বেশ সঙ্গীন। শুক্তি দিয়ে তৈরি নার্গিস ফুলের গোছার দৃশ্যের অনেকটাই খসে পড়েছে। কিন্তু তার আঙ্গুলের মৃদু টোকায় সৃষ্ট কোমল মধুর শব্দ বাবরকে আকশিতে তার বাল্যকালে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।

বাইরে বের হয়ে এসে সে আঙ্গিনার উপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে গ্রামের দেয়ালের উপরে উঠে দাঁড়ায় এবং ঘনিয়ে আসা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে নিজেই নিজের সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু মনে মনে সে জানে তার আম্মিজান আর নানীজান ঠিকই বলেছেন। তার এখন প্রধান বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত বেঁচে থাকা।

‘সুলতান।” সে তার পেছনে নিচে থেকে বাবুরীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে শুনে। তার কোমরের পরিকরে তিনটা নধর কবুতর পা বাঁধা অবস্থায় ঝুলছে- নির্ঘাত সে শিকারে গিয়েছিলো। সে সিঁড়ির ছোট ছোট ধাপ নিরবে উঠে এসে দেয়ালের উপরে বাবরের পাশে নিরবে দাঁড়িয়ে থাকে।

“বাবুরী, তুমি কখনও কি তোমার ভাগ্য নিয়ে সন্দিহান হয়েছে?”

“বাজারের ছেলের ভাগ্য বলে কিছু থাকে না। ভাগ্যে বিশ্বাসের বিলাসিতা কেবল সুলতানদের সাজে।”

“সারাটা জীবন আমি কেবল শুনে আসছি এই পৃথিবীতে আমার জন্ম হয়েছে কিছু অর্জন করতে। সেটা যদি সত্যি না হয় তাহলে কি হবে…”

“আপনি আমার কাছে কি শুনতে চান? যে আপনি চেঙ্গিস খান আর তৈমূরের বংশধর? যে কণ্টকহীন জীবনে কেবল আপনারই অধিকার?”

বাবুরীর কণ্ঠস্বর অধৈর্য, রুক্ষ আর আবেগবর্জিত। বাবর তার সাথে তাকে এভাবে আগে কখনও কথা বলতে শোনেনি। “আমার কপালটাই খারাপ।”

“না আপনার কপাল খারাপ না। জন্মের কারণেই আপনি ভাগ্যবান। আপনার সবকিছু আছে। আপনি এতিম নন। আপনাকে আমার মতো আস্তাকুড়ের খাবারের জন্য মারামারি করতে হয়নি।” সহসা বাবুরীর নীল চোখে ক্রোধ ঝলসে উঠে। “আকশি থেকে ফিরে আসবার পর থেকেই আমি আপনাকে খেয়াল করছি, কেমন আত্ম-বঞ্চনার একটা আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন। আশেপাশের কারো সাথে কোনো কথাই বলছেন না। আপনি কেমন বদলে গিয়েছেন। ইয়াদগার যখন আপনার কণ্ঠলগ্না থাকতো, বা আমরা যখন একসাথে ঘোড়া নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম, আপনি তখন এমন ছিলেন না। সেটা ছিলো বাঁচার মতো বেঁচে থাকা। আপনি ভুলেই গেছেন কেমন ছিলো সেই জীবনটা। বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলে আপনি যদি এভাবে মুষড়ে পড়েন, তাহলে সম্ভবত আপনি এই মহান নিয়তি’র- খোদামালুম সেটা কেমন যোগ্য নন, যা আপনি একটা বোঝার মতো বহন করে চলেছেন।”

কিছু বুঝে উঠার আগেই, বাবর বাবুরীকে লক্ষ্য করে সপাটে ধাক্কা দেয় এবং দুজনে জড়াজড়ি করে দেয়ালের উপর থেকে নিচের শক্ত মাটিতে আছড়ে পড়ে। দুজনের ভিতরে বাবর ওজনে ভারী এবং সে বাবুরীকে মাটিতে ঠেসে ধরে। কিন্তু বাইম মাছের মতো পিচ্ছিল বাবুরী একপাশে মোচড় দিয়ে সরে যেতে চায় এবং এক হাতের আঙ্গুল দিয়ে বাবরের চোখে একটা বেমক্কা খোঁচা দেয় আর অন্য হাতে মাথার পাশে একটা সিক্কা ওজনের ঘুসি বসিয়ে দেয়। ব্যাথায় গুঙিয়ে উঠে বাবর গড়িয়ে সরে গিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং বাবুরীর উপরে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে, জড়িয়ে ধরে। বাবুরীর মাথা এবার দু’হাতে শক্ত করে ধরে মাটিতে ঠুকতে শুরু করে। কিন্তু মুহূর্তের ভিতরে বাবুরী পা এসে তার উরুদ্বয়ের সন্ধিস্থলে নিজের সদম্ভ উপস্থিতি জানান দেয়। যন্ত্রণায় কোঁকাতে কোঁকাতে সে বাবুরীকে ছেড়ে দেয় এবং গড়িয়ে সরে যায়।

তাদের দু’জনেরই চুল উসকোখুসকো আর এলোমেলো পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবুরীর নাক দিয়ে দরদর করে রক্ত ঝরছে, এবং বাবর টের পায় কানের উপরের একটা কানা জায়গা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। আর বাবুরী বাম চোখে যে খোঁচাটা মেরেছিলো সে জন্য এখনই ওই চোখটা খোলা রাখতে সমস্যা হয়।

“আপনি দারুণ একজন পথিক রঙবাজ হতে পারতেন অনায়াসে।” বাবুরী বলে। “আপনাকে কখনও অনাহারে থাকতে হবে না- ভাগ্য সহায় থাকুক বা না থাকুক।” তাদের হাতাহাতির শব্দে সচকিত হয়ে, লোকজন দ্রুত দেয়ালের উপর দিয়ে তাদের দিকে দৌড়ে আসে। একেবারে সামনে রয়েছে উদভ্রান্ত চেহারার বাইসানগার, দু’জনের তার অভিব্যক্তির দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে উঠে।

*

বাতাস এতো ঠাণ্ডা যে বাবরের মুখে যেন খোঁচা মারছে। প্রতি দুই কি তিন পা সামনে এগোবার পরেই তার পায়ের চামড়ার বুট জুতো বরফে পিছলে যায়। কিন্তু তার পরেও ফারগানা থেকে দক্ষিণমুখী এই খাড়া গিরিপথটা সাইবানি খানের ধাওয়াকারী সৈন্যদের নাগালের বাইরে পালিয়ে থাকার জন্য একমাত্র ব্যবহারযোগ্য পথ এবং তার লোকেরা বাবরের দলবলকে শিয়ালের মতো তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে আর যেখানে পাচ্ছে নির্বংশ করে ছাড়ছে।

তাদের সাথে ঘোড়া না থাকার কারণে বাবরের নিজেকে কেমন নাঙ্গা মনে হয়। যদিও বরফাকীর্ণ পাহাড়ের এই উচ্চতায় কারো মুখোমুখি হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সে আর তার লোকেরা সবসময়েই অশ্বারোহী ছিলো কিন্তু এই মুহূর্তে নিজের সহ্য ক্ষমতার উপরেই তাদের নির্ভর করতে হবে। নিচের ঢাল বেয়ে যাত্রা শুরুর প্রথম কয়েকদিন বাবর তার সাথে করে যে চারটা খচ্চর নিয়ে এসেছিলো তার মালপত্র বহন করার জন্য তার দুটোতে খুতলাঘ নিগার আর এসান দৌলতকে উঠিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু ঢাল ক্রমশ খাড়া হতে শুরু করতেই আবহাওয়া আরও বিরূপ হয়ে উঠতে, বাবর খচ্চরগুলোকে জবাই করে তাদের মাংস সংরক্ষণের আদেশ দেয়।

তারপরে এসান দৌলত আর খুতলাঘ নিগারকে কখনও কখনও তার সবচেয়ে শক্তিশালী লোকদের কাঁধে করে বহন করা সম্ভব হয়েছে। আর বাকী সময়টা বাবরের সাথে তখনও যে জনা চল্লিশেক লোক রয়েছে তাদের মতোই নিজেদের দুজন পরিচারিকাসহ দুজনকেই হাঁটতে হয়েছে। জমে থাকা বরফের উপরে কাঠের লাঠিকে সম্বল করে উপর দিকে উঠতে হয়েছে। খুতলাঘ নিগার তার ভারসাম্যবোধ আর চটপটে ভাব দিয়ে নিজের ছেলেকে বিস্মিত করেছেন। নিজের দুর্বল মায়ের খাতির কোনো ধরণের সাহায্য তিনি নিতে চাননি। বাবর এখনও তাকে সামনে এগিয়ে যেতে দেখে। ভেড়ার চামড়ায় আপাদমস্তক ঢেকে থাকার কারণে তার কিছুই দেখা যায়। অনেক লোকের চেয়ে দ্রুত গতিতে পাথরের উপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে। কাশিমের চেয়েও তিনি ভালোই অগ্রসর হচ্ছেন। সে নিয়মিত বিরতিতে আছাড় খাচ্ছে আর দৃশ্যতই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

আশ্রয়ের জন্য তাদের সাথে কেবল চারটা পশমের আস্তরণ দেয়া তাবু রয়েছে। আর সামান্য কিছু ভেড়ার চামড়া একটা লাঠির সাথে মুড়িয়ে বাঁধা অবস্থায় আছে যা তার তিনজন লোক একজনের পেছনে আরেকজন দাঁড়িয়ে কাঁধে করে বহন করছে বহন করতে পারে। বাবর নিজেও লাঠিটা বহন করেছে, মাটির উপরে দাঁড়াতে কষ্ট হবার কারণে তার পিঠ বেঁকে যায়।

আরো একদিন পরে, তারা গিরিপথ অতিক্রম করবে। সামনের উপত্যকায় অবস্থিত গ্রামে তারা হয়তো আশ্রয় নিতে পারবে এবং পরে সেখান থেকে ঘোড়াও সংগ্রহ করতে হবে। সেদিন রাতে তার চারপাশে বাবুরী আর তার সঙ্গীদের চেপে থাকা শরীরের আকর উষ্ণতার মাঝে বাবর এই ভাবনাটা থেকে স্বস্তি পেতে চেষ্টা করে।

*

দিন দুই পরে, শীতে জমে বরফ হয়ে যাওয়া একটা নহরে জলবিয়োগরত অবস্থায় একটা বাচ্চা ছেলে বিস্ময়ে হাঁ করে গিরিপথের ভেতর দিয়ে একটা জবুথবু কাফেলাকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে। তারপরে সে ঘুরে দাঁড়িয়ে কোনো দিকে আর না তাকিয়ে আরও কয়েকশ গজ সামনে পাহাড়ের ঢালে তার নিজের গ্রামের দিকে ভো দৌড় দেয়। যাবার সময়ে বারকয়েক সে বরফে বুঝি আছাড়ও খায়।

‘সুলতান, আমি কি সামনের অবস্থা দেখে আসার জন্য লোক পাঠাব?” বাইসানগার জানতে চায়।

বাবর মাথা নাড়ে। ঠাণ্ডায় যদিও সে আড়ষ্ঠ হয়ে আছে, গর্ব আর স্বস্তিবোধ তাকে ধীরে ধীরে উজ্জীবিত করে তোলে। সে পেরেছে। সে তার পরিবার আর লোকদের পাহাড়ের ভিতর দিয়ে নিরাপদে পার করিয়ে এনেছে। যদিও তারা এখন সংখ্যায় নগণ্য কয়েকজন। একসময়ে সে বিশাল যে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিতে তার তুলনায় সংখ্যাটা কিছুই না। এই মুহূর্তে সেটা কোনো ব্যাপার না।

কয়েক মিনিট পরে, বাইসানগারের সৈন্যরা একজনকে ধরে নিয়ে আসে। যাকে দেখতে- কয়েক পরত পুরু জোব্বা আর মাথায় কালো রঙের পশমের কাপড় ভালো করে জড়ানো- একজন বয়স্ক লোকের মতো দেখায়। তারা নিশ্চয়ই তাকে আগে থেকে বলেছে যে। কে বাবর, কারণ সে সোজাসুজি এসে তার সামনে নতজানু হয়ে। পায়ের নিচে জমে থাকা তুষারে মাথা ঠেকায়।

“এসবের কোনো দরকার নেই।” বহুদিন পরে কেউ বাবরকে এভাবে শ্রদ্ধা দেখালো। সে লোকটার কাঁধ জড়িয়ে ধরে এবং আলতো করে তাকে দাঁড় করায়। “আমরা বহুদূর থেকে এসেছি এবং ভীষণ পরিশ্রান্ত। আর আমাদের সাথে শাহী হারেমের বাসিন্দারাও রয়েছেন। আপনি কি আমাদের আশ্রয় দেবেন?”

“বছরের শেষের দিকে গুটিকয়েকজন লোকই এখান দিয়ে যাতায়াত করে।” বৃদ্ধ লোকটা বলে। “আমি এখানকার সর্দার। আমাদের গ্রামে আমি আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।”

সেই রাতে বাবর সর্দারের বাহুল্যবর্জিত মাটির বাড়িতে আগুনের পাশে আড়াআড়ি পা রেখে বসে আছে। নিচের তলাটায় একটাই বড় ঘর। যার মেঝেতে ভেড়ার পশমের তাকিয়া রাখা শোবার জন্য- এসান দৌলত, খুতলাঘ নিগার আর সর্দারের স্ত্রী উপরের তলায় একটা ছোট ঘরে আছেন। বাইরে অবস্থিত কাঠের সিঁড়ি দিয়েই কেবল সেখানে পৌঁছানো যায়। বাবুরী তার পাশে একই ভঙ্গিতে বসে আছে এবং দু’জনেই গম্ভীর মুখে নিজেদের পায়ের ফোস্কা আর হিম-দংশ পরীক্ষা করছে।

“মাঝে মাঝে আমার মনে হয়েছে জীবনে বুঝি আর হাঁটতে পারবো না- প্রাণে যদি বেঁচেও যাই।” বাবুরী পায়ের একটা নাজুক ক্ষতস্থান স্পর্শ করে ব্যাথায় কুঁকড়ে ওঠে।

“আমাদের কপাল ভালো। আমরা অনায়াসে পাহাড়ে পথ হারাতে বা গিরিকন্দরে আছড়ে পড়তে পারতাম।”

“এটাকে কি ভাগ্য বলবেন, নাকি আপনার সেই অমিত পরাক্রমশালী ‘নিয়তি’?” বাবুরী হেসে বলে।

বাবরও হাসে, কিন্তু প্রশ্নটার কোনো উত্তর দেয় না।

*

সকালবেলার কুয়াশা থাকা সত্ত্বেও, বাবর একটা নিচু বরফাবৃত ঝোপের পেছন থেকে খরগোসটাকে মাথা বের করে, কান খাড়া করে রেখে একদম স্থির হয়ে বাতাস গন্ধ নিতে দেখে। খরগোসটার দিক থেকে বাতাস তার দিকে বয়ে আসছে খরগোসটার পক্ষে তার অবস্থানের কথা জানা সম্ভব না। সে যত্ন করে ধনুকের ছিলায় একটা তীর সংযোজন করে। খরগোসটার উপর থেকে নিমেষের জন্যেও চোখ না সরিয়ে নিয়ে, পরিস্থিতি নিরাপদ মনে করে যেটা এখন চকিত চোখে ইতিউতি দেখছে, ছিলাটা টেনে ধরে।

সহসা বাবরের পেছন থেকে ধাবমান পায়ের শব্দ ভেসে আসে এবং খরগোসটা নিমেষে উধাও হয়ে যায়। মেজাজ বিগড়ে যেতে সে ঘুরে তাকিয়ে দেখে তারই একজন লোক উত্তেজিত ভঙ্গিতে হাঁপাচ্ছে। “সুলতান, কাবুল থেকে একজন দূত এসেছে। গত দু’মাস ধরে, বরফ গলতে শুরু করার পরে থেকেই সে নাকি আপনাকে খুঁজছে। সর্দারের বাসায় সে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।”

বাবরের তিক্ত মেজাজ নিমেষেই প্রশান্ত হয়ে উঠে। বাবর তার নীরের মুখ বন্ধ করে। ধনুকটা কাঁধের উপর দিয়ে গলিয়ে দিয়ে মেঠোপথ ধরে গ্রামের উদ্দেশ্যে দৌড়াতে শুরু করে। কাবুলের সুলতান, তার মরহুম আব্বাজানের চাচাতো ভাইয়ের কাছ থেকে নিশ্চয়ই বার্তাটা পাঠানো হয়েছে… কিন্তু বাবরের যতোদূর মনে পড়ে দু’জন ভিন্ন জায়গায় ছিলো। আর তাদের মধ্যে কদাচিৎ যোগাযোগ হয়েছে।

ময়ূরকণ্ঠী নীল রঙের আলখাল্লা পরিহিত। দূতের চেয়ে কেতাদুরস্ত পোশাকে বাবর বহুদিন কাউকে দেখেনি। তার ঘন কালচে নীল পাগড়িতে ঝুলন্ত স্মারকছাপে পাথর বসানো কজায় পালক আটকানো রয়েছে এবং তার সাথের দু’জন পরিচারকের পরনে নীলের উপরে সোনার জরির কাজ করা পোশাক। তার লোকেরা তাকে খুঁজে বের করার ফাঁকে তারা নিশ্চয়ই পোশাক বদলেছে। বাবর মনে মনে হাসে। পাহাড়ী পথে কেউ এসব ধড়াচূড়া পরে ভ্রমণ করবে না… যাই হোক গত কয়েক মাসের ভিতরে এই প্রথম সে নিজেকে কেমন দেখাচ্ছে সে বিষয়ে কৌতূহলী হয়- তার কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল, হলুদ পশমের মামুলী জোব্বা আর ছাগলের নরম চামড়ার চোস্ত।

কিন্তু দূতের চেহারায় এসব নিয়ে কোনো হেলদোল দেখা যায় না। বাবর তার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে খেয়াল করে খোঁজার পালা শেষ হবার তার চোখেমুখে স্বস্তির একটা ছাপ ফুটে উঠেছে। দূত মাথা নিচু করে অভিবাদন জানায়। “সুলতান, আমার অভিবাদন গ্রহণ করুন।”

“তোমাকে স্বাগত জানাই। আমাকে বলা হয়েছে আপনি কাবুল থেকে আসছেন। আমার কাছে আপনি কি চান?”

“সুলতান, আমি বিষাদময় আবার একাধারে গৌরবান্বিত সংবাদ বহন করে এনেছি। আপনার মরহুম আব্বাজানের ভাই, আমাদের সুলতান, উলুঘ বেগ মির্জা, গত শীতে কোনো উত্তরাধিকারী না রেখে ইন্তেকাল করেছেন। তার ইন্তেকালের দু’মাস আগে তার শেষ বেঁচে থাকা পুত্রসন্তান জ্বরের কবলে পড়ে মারা যান। কাবুলের শাহী দরবার আমাকে এই বার্তাটা আপনাকে পৌঁছে দিতে বলেছে। আপনি যদি সেখানে যান, তবে সিংহাসনে আপনাকে অধিষ্ঠিত করা হবে। দরবারের অমাত্যদের ধারণা কাবুলের অধিবাসীরা তৈমূর বংশের আরেক সন্তানকে তাদের শাসক হিসাবে স্বাগত জানাবে। বিশেষ করে এমন কেউ যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে পরীক্ষিত সেনাপতি আর বয়সে তরুণ। শাহী দরবার আপনাকে সমর্থন জানালে, যা পবিত্র কোরানের নামে তারা শপথ করে বলেছে আপনার উপরে অর্পিত করবে। আপনি কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর সম্মুখীন হবেন না।”

বাবর তার বিস্ময় গোপন করতে হিমশিম খেয়ে যায়। কাবুলের সালতানাতের সে তার অসম্ভব, অবাস্তব কল্পনাতেও কখনও চিন্তা করেনি। বহু দূরে অবস্থিত একটা স্থান- পাঁচশ মাইলেরও বেশি হবে। সেখানে পৌঁছাতে হলে তাকে প্রশস্ত অক্সাস অতিক্রম করতে হবে আর হিন্দুকুশের আঁকাবাঁকা সর্পিল, ছুরির ফলার ন্যায় ধারালে গিরিপথের ভিতর দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তারপরেও পুরো ব্যাপারটাই কপালের উপরে নির্ভর করছে। সে সেখানে পৌঁছাবার মাঝে অনেক কিছুরই বদল হতে পারে। শাহী দরবারের অমাত্যরা যারা এখন তাকে সমর্থন করছে, আল্লাহতালাই ভাল বলতে পারবেন এর কারণ। তারাই হয়তো ক্ষমতাচ্যুতির ভয়ে বা প্রলোভনের বশবর্তী হয়ে অন্য প্রার্থীকে সমর্থন করে বসবে।

কিন্তু এটাও ঠিক একটা বছর হতে চলল, বাবর ক্রমশ উত্তেজিত আর উদ্দীপিত হয়ে উঠতে উঠতে ভাবে, সে এখানে বসে কেবল খরগোস আর খরগোসের ছানাপোনা শিকার করতে পারে না। হিংস্র সাইবানি খানের নাগালের বাইরে কাবুল অবস্থিত। সমৃদ্ধ আর শক্তিশালী একটা কেন্দ্র। আবারও তার চারপাশে যোদ্ধার দল ভীড় করবে। সেখানে সে তার ক্ষমতা পুনরায় মজবুত করবে তারপরে পরবর্তী পদক্ষেপ সম্বন্ধে ভাবা যাবে।

“ধন্যবাদ আপনাকে।” সে দূতকে উদ্দেশ্য করে বলে। “আমি শীঘ্রই আমার উত্তর আপনাকে জানাবো।” কিন্তু সে ইতিমধ্যে সেটা অনুধাবন করে ফেলেছে। তার পরবর্তী গন্তব্য হবে কাবুল।

২.৮ সৌভাগ্যের সূত্রপাত

১৪. সৌভাগ্যের সূত্রপাত

আমাদের রক্তের শত্রু বর্বর উজবেকদের প্রতি তোমাদের ঘৃণা এবং আমার প্রতি আনুগত্যের কারণে তোমরা বিপদ আর কষ্টকে আপন করে নিয়ে নিজেদের জন্মভূমি ত্যাগ করে আমাকে অনুসরণ করেছে। আমি তোমাদের উঁচু পাহাড় আর বরফাবৃত গিরিপথের ভিতর দিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছি। বাতাস যখন আমাদের উড়িয়ে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে, তখন তাঁবুর ভিতরে আমাদের শরীর পরস্পরকে উষ্ণতা দিয়েছে। আমরা আমাদের সামান্য খাবার ভাগ করে নিয়েছি। আমি সুলতান হবার পরে, গত নয় বছরে এতটা গর্বিত কখনও বোধ করিনি। হতে পারে তোমরা সংখ্যায় অল্প, কিন্তু তোমাদের ভিতরে রয়েছে সত্যিকারের বাঘের সত্ত্বা।” বাবর তার চারপাশে বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে থাকা মুখগুলির দিকে তাকাতে তার সবুজ চোখ চকচক করতে থাকে। তার লোকজনের সংখ্যা এতো নগণ্য যে সে তাদের সবার নাম, কে কোনো গোত্র থেকে এসেছে আর যুদ্ধে কবে কোথায় আহত হয়েছিলো, জানে। সে এতোক্ষণ কেবল সত্যি কথাই বলেছে। সে তার এই ছন্নছাড়া ক্ষুদে বাহিনী নিয়ে ভীষণ গর্বিত।

“আমি শীঘ্রই তোমাদের এই একনিষ্ঠতার প্রতিদান দিতে সক্ষম হব। আমার মরহুম আব্বাজানের ভাই, কাবুলের সুলতান, ইন্তেকাল করেছেন। আমার বংশপরিচয় আর খ্যাতি- তোমাদের সাহায্যে অর্জিত আমাকে একজন সাহসী আর অদম্য নেতা হিসাবে গড়ে তুলেছে। যাকে কাবুলের অধিবাসীরা তাদের নতুন সুলতান হিসাবে মনোনীত করেছে। যদি আমি সেখানে উপস্থিত হই। এবং আমি যাবোই- আমাকে যদি একা যেতে হয় তবুও আমি যাবই। কিন্তু আমি জানি তোমরা আমাকে আরো একবার বিশ্বাস করে আমার সাথেই যাবে। কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা তোমরা সবাই নিজ নিজ গ্রামে খবর পাঠাও, যাতে অন্যেরাও আমাদের সাথে যোগ দিতে পারে আমাদের সৌভাগ্যের অংশীদার হতে এবং আমাদের সবার যে জন্মগত অধিকার, সেই নিয়তির লিখন সম্পূর্ণ করতে পারে।” বাবর এখনও যেনো কোনো মহান বিজয় উদযাপন করছে এমন ভঙ্গিতে হাত উঁচু করে।

তার চারপাশ থেকে একটা মন্দ্র চিৎকার কণ্ঠ ত্যাগ করে। কে ভাবতে পেরেছিলো কয়েক ডজন কণ্ঠ থেকে এমন চিৎকার বের হতে পারে? বাবর আড়চোখে তাকিয়ে দেখে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাবুরী, বাইসানগার আর কাশিমও বাকিদের সাথে গলা মিলিয়েছে। সে নিজের ভেতর একটা নতুন শক্তির উদয় অনুভব করতে পারে…

*

একমাস পরের কথা। বাবর তার তাঁবুতে অবস্থান করছে। সূর্যের আলো আর তাজা উষ্ণ বাতাস যাতে ভেতরে প্রবেশ করতে পারে, সেজন্য তাঁবুর পর্দা খুলে দেয়া হয়েছে। সে যেমনটা আশা করেছিলো, তার ভাগ্য পরিবর্তনের খবর দ্রুত রাষ্ট্র হয়েছে। হতজীর্ণ যে দলটাকে নেতৃত্ব দিয়ে সে ফারগানা ত্যাগ করেছিলো, এখন সেটায় চার হাজারের বেশি যাযাবর মোঙ্গল যোদ্ধা এসে যোগ দিয়েছে। যাদের সর্দারেরা তুগ বা ইয়াকের-লেজের বৈশিষ্ট্যসূচক স্মারক নিজেদের ঘোড়ার লেজে বেঁধে রাখে যুদ্ধের সময়। সাইবানি খানের হাতে নিহত তৈমূরীয় সর্দারদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে তারা। তার প্রতি বা তার ন্যায়সঙ্গত অধিকারের প্রতি এদের অধিকাংশই আস্থাশীল এমনটা বিশ্বাস করার মতে নবিশ সে আর নেই। তারা তার দলে যোগ দিয়েছে কেবল প্রাপ্তির আশায়। কিন্তু সেই সাথে এতো দীর্ঘ ঝুঁকিপূর্ণ একটা যাত্রায় অংশ নেয়ার প্রস্তুতি একটা বিষয়ই প্রকাশ করে যে, সে সফল হবেই। তার সুনামই তার পক্ষে কথা বলবে।

কাবুলের শাহী দরবারের পাঠানো স্বর্ণমুদ্রা যা দূত নিয়ে এসেছিলো, সে ইতিমধ্যেই সেটা অস্ত্রশস্ত্র, শক্তিশালী ঘোড়ার পাল, নধর ভেড়ার দল আর ভেতরের দিকে পশমের আবরণ দেয়া নরম চামড়ার তৈরি তাঁবু, যা বাতাসের তীব্র ঝাপটা সামলে নিতে পারবে কিনতে ব্যয় করেছে। সে তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে প্রশস্ত আর শান্ত অক্সাস নদী ঘটনাবিহীনভাবে অতিক্রম করে। সমতল-তলদেশ বিশিষ্ট অল্প পানিতে ভাসতে পারে, এমন নৌকায় ঘোড়ার পাল, মালবাহী খচ্চর, উট আর মালবাহী গাড়িগুলো একে একে তোলা হয়। আর দক্ষ মাঝিরা তারপরে বালুময় তলদেশে তাদের হাতের লম্বা লগি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে তারা নৌকাগুলো ওপারে নিয়ে যায়। এভাবে নাগাড়ে দুই দিন দুই রাত ধরে তারা ক্রমাগত এপার ওপার আসা যাওয়া করে পুরো বহরটাকে ওপারে পৌঁছে দেয়। এসব মাঝিদেরই কেউ কেউ আবার বাবরের বহরের বিশালত্বে মুগ্ধ হয়ে হাতের লগি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তার বাহিনীর সাথে যোগ দেয়।

দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে তার যাত্রা বিজয়দীপ্ত একটা সফরের অনুভূতির মতো মনে হতে শুরু করে। কিন্তু তার উল্লাসে উদ্বেল হওয়া সাজে না। সাইবানি খান আর ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী যদিও পেছনে অনেক দূরে রয়েছে। তৈমূরের অভিযানের বিবরণ পড়ে আর বৃদ্ধা রেহানার গল্প শুনে। বাবর জানে কাবুল আর তার মাঝে অবস্থিত মূর্তিমান হিন্দুকুশের বরফাবৃত জমাট চূড়োর মাঝে অনেক অজানা বিপদ ওঁত পেতে রয়েছে। বাবর তার আম্মিজান আর নানীজানকে সৈন্যদের প্রহরায় কিশম দূর্গের শক্তপোক্ত দেয়ালের অভ্যন্তরে রেখে আসতে পেরে সন্তুষ্ট বোধ করে। দূর্গটা তার এক নতুন মিত্র তাকে ব্যবহারের জন্য দিয়েছে। সে একবার কাবুলের অধিকার বুঝে নিলে সে তাদের নিয়ে আসবার জন্য লোক পাঠাবে। কিন্তু আপাতত তারা নিরাপদে আছে। খানজাদার জন্যও যদি সে এমনটা ভাবতে পারতো, যার যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ স্বপ্নে সে প্রায়ই দেখতে পায়।

“সুলতান।” তার দেহরক্ষী দলের একজন তাঁবুর ভিতরে প্রবেশ করে। “দরবার আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।”

পুনরায় পরামর্শদাতা সম্বলিত দরবার ব্যাপারটাই তার কাছে কেমন অদ্ভুত মনে হয়। একটা ছাতিম গাছের ছড়ানো ডালপালার নিচে সবাই উপস্থিত হয়েছে কাশিমের পরণে উলের তৈরি লম্বা সবুজ আলখাল্লা। বাইসানগার আর বাবুরীর পরণে পশমের সূক্ষ্ণ বুননের নতুন জোব্বা। এছাড়াও সেরাম থেকে পঞ্চাশজন লোক নিয়ে আগত হুসেন মজিদ আর বাকী তিনজনের পরনেও নতুন পোশাক দেখা যায়। এদের ভিতরে দুজন মোঙ্গল সর্দার মাথায় ভেড়ার চামড়ার তৈরি গোলাকার টুপি। তাদের চকচকে দাড়িগোঁফবিহীন মুখে যুদ্ধের অসংখ্য স্মারক গিজগিজ করে। তৃতীয়জন বাবরের দূর সম্পর্কের ভাই মির্জা খান, বামচোখে পট্টি বাঁধা, হৃষ্টপুষ্ট মধ্যবয়সী এক লোক। উজবেকদের অভিযানের ফলে সে বাস্তচ্যুত হয়েছে এবং তার সাথে রয়েছে তিনশ অশ্বারোহীর সুসজ্জিত একটা দল। অতিরিক্ত ঘোড়ার পালসহ এবং গাড়ি ভর্তি শস্যদানা। নিজের এই ভাইয়ের বুদ্ধি বা সাহসিকতা সম্পর্কে বাবর খুব একটা আস্থাশীল না- নিজের ধনসম্পদ আর বংশ মর্যাদার কারণে তার আজকের সভায় ঠাই হয়েছে।

মাটিতে বিছানো গালিচায় বাবর ইঙ্গিতে সবাইকে বসতে বলে, সরাসরি কাজের। কথায় চলে আসে: “কাবুল পৌঁছাতে হলে আমাদের এখনও আরও দুইশ মাইল পথ অতিক্রম করতে হবে। আমাদের আর শহরটার ভিতরে বাধার মত দাঁড়িয়ে আছে হিন্দুকুশ। আমাদের ভিতরে কারও এই পাহাড় দেখবার অভিজ্ঞতা হয়নি- অতিক্রম করা দূরে থাক। আমরা কেবল মানসচোখেই সেটা দেখেছি। কিন্তু এই গ্রীষ্মকালেও সেটা জোরাল বাঁধার কারণ হবে…প্রশ্ন হলো আমরা কি পাহাড়ের ভিতর দিয়ে যাবো নাকি ঘুরপথে অন্যদিক দিয়ে পাহাড়টাকে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করবো…”

“আমাদের সামনে আর কোনো বিকল্প উপায় আছে?” মির্জা খান জানতে চায়।

নদীর তীর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে আমরা বৃত্তাকারে দূর্গম পাহাড়ের অংশগুলো এড়িয়ে যেতে পারি। রাজদূত আমাকে খুঁজবার সময়ে যেমনটা করেছিলেন…”।

“কিন্তু সেটা করতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে- সম্ভবত আমরা তখন তাহলে হয়তো সুযোগটাই হারাবো,” বাবুরী বলে। “পাহাড়ের চেয়ে দেরি করাটা এখন আমাদের জন্য অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হতে পারে…”।

বাইসানগার মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। আমিও তার কথার সাথে একমত। আমাদের উচিত পাহাড়ের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু সেজন্য আমাদের পথপ্রদর্শক প্রয়োজন। এমন মানুষ যারা গিরিপথগুলো হাতের তালুর মতো চেনে এবং আমাদের সবচেয়ে নিরাপদ আর ভালো গিরিপথ দিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। এমন মানুষ যাকে আমরা বিশ্বাস করতে পারি…”

মোঙ্গল সর্দারদের চেহারায় কোনো হেলদোল নেই যেনো। পৃথিবীর ছাদ হিসাবে। অভিহিত এই অঞ্চল দিয়ে হরহামেশাই তারা অতিক্রম করে। বাবরের মনে একটা ধারণা আছে, সেটা হলো তারা যদি আদৌ বিশ্বাস করেছে যে, লুটের মালের পরিমাণ প্রচুর হবে। তাহলে নরকের আগুনের ভেতরেও তারা তাকে অনুসরণ করবে কিন্তু যদি তারা আশাহত হয় যে লুট করার মতো তেমন কিছু পাওয়া যাবে না। তাহলে তারা তাকে সেখানেই পরিত্যাগ করবে…

বাবর তার দরবারে সমবেত লোকদের দিকে আরেকবার তাকায়। আরো দেরি করার কোনো মানে সে দেখতে পায় না। মনে মনে সে পুরো বিষয়টা বহুবার খতিয়ে দেখেছে। আর প্রতিবারই সে একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। সে যদি কাবুলের সুলতান হতে চায়, তবে তাকে দ্রুত যা করার করতে হবে।

“বেশ। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা হিন্দুকুশ অতিক্রম করবো। পাহাড়ের নিকটবর্তী হবার সাথে সাথে পথ দেখাবার জন্য আমরা পথপ্রদর্শক সন্ধান করবো আমরা যদি সেরকম কাউকে খুঁজে না পাই, তাহলে আমরা নিজেরাই এগিয়ে যাবো…আগামী ছত্রিশ ঘণ্টার ভিতরে আমরা যাত্রা আরম্ভ করবো। এই সময়টা সবাই নিজেদের অধীনস্ত লোকদের সরঞ্জামাদি আর রসদপত্র এবং ঘোড়ার যত্ন নেবে। বাইসানগার আমি চাই বাকি সর্দারদের আপনি নিজে সংবাদটা পৌঁছে দেন। এবং আমরা সাথে কেবল ঘোড়া আর মালবাহী খচ্চর নিয়ে যাবো মাংসের জন্য। কোনো প্রাণী আমাদের সাথে থাকবে না, এমনকি পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্তও না।

*

খাজকাটা আঁকাবাঁকা পাহাড়ের চূড়ো ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে আসতে থাকে। মাঝে মাঝে বাবরের মনে হয় সে তার মুখে তাদের জমাট হিম শ্বাস অনুভব করতে পারে। নিচের ঢালে কালচে সবুজের একটা স্রোত যেন আন্দোলিত হয়। অনেক উঁচুতে বরফাবৃত শৃঙ্গ হীরক দ্যুতিতে চকচক করছে। অনেকেই এই পাহাড়গুলোকে ধরণীর পাথুরে বেষ্টনী বলে অভিহিত করেন। কিন্তু বাবরের কাছে তারা স্ফটিক চূড়া ছাড়া আর কিছু না। বাবরের স্মৃতিতে এখনও উঁচু খাড়া পাহাড়ের পার্শ্বদেশ দিয়ে তৈমূরকে দড়ির সাহায্যে নামানোর কথা। তার ক্ষুধার্ত আর আড়ষ্ট সৈন্যদল, বরফের উপর আতঙ্কিত ঘোড়ার পা পিছলে আছাড় খাওয়া এবং বর্বর কাফেরদের চোরাগুপ্তা আক্রমণের কথা, ভাস্বর হয়ে আছে। আট মাস আগে ফারগানার দক্ষিণে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে তার নিজ পরিবার আর অনুগত মুষ্টিমেয় লোকদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসবার সাথে কোনোভাবেই বিশাল একটা বাহিনী আর তার পুরো সাজসরঞ্জামসহ উঁচু চূড়ার ভিতর দিয়ে কিংবদন্তী আছে সেগুলো নাকি আকাশ স্পর্শ করেছে, অতিক্রম করার কোনো তুলনা হয় না।

“আপনি কি ভাবছেন?” বাবুরীর ঘোড়াটা একটা তাম্রবর্ণের ঘোটকী, যেটা এই মুহূর্তে আপ্রাণ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে একটা ভনভন করতে থাকা ঘোড়া-মাছির হাত থেকে বাঁচতে চেষ্টা করছে।

“হিন্দুকুশ অতিক্রম করে তৈমূর দিল্লীতে তার বাহিনী কিভাবে নিয়ে গিয়েছিলেন সে সম্বন্ধে রেহানা যা বলেছে…”

বাবুরী অবজ্ঞার ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকায়। “সবগুলোই রঙচঙে গল্প, মনগড়া আর বানোয়াট। তার কাছে পুরোটাই আগাগোড়া সত্যি কাহিনী। কিন্তু তার কতোটুকু আসলেই সত্যি সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তার দাদাজানের কথাটাই ধরেন, যেখানে প্রাণ বাঁচাবার জন্য বাচ্চা ছেলেটা তাকে সোনার সেই হাতিটা দিয়েছিলো। আমি বাজি ধরে বলতে পারি, হাতিটা আসলে লুট করা হয়েছিলো এবং অন্য ছেলেটাকে পরিত্যাগ করার অপরাধী মনোভাব নাকচ করার জন্য পরে এই উদ্ধার অভিযানের কাহিনীর অবতারণা করা হয়েছে। যাই হোক, শীঘ্রই আমরা নিজেরাই জানতে পারবো উপরের দৃশ্যপট কেমন। আমরা একজন লোক পেয়েছি সে আমাদের পথপ্রদর্শক হতে রাজি হয়েছে।”

“আমি আশা করি সে যখন বলেছে যে, পাহাড়ের ভিতর দিয়ে যাবার রাস্তা চেনে তখন সে সত্যি কথাই বলেছে।”

“সে মিথ্যা কথা বলেছে প্রতিয়মান হলে তুমি বলেছে যে তাকে পাহাড়ের উপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।”

“আমি আসলেই তাই করবো।”

বাবর তার কাঁধের উপর দিয়ে দেহরক্ষী বাহিনীর দিকে তাকায় এবং তাদের পেছনে রুক্ষ্ম প্রকৃতির উপর দিয়ে অগ্রসরমান অশ্বারোহীদের লম্বা সারির দিকে তাকায়। যা আগস্টের দাবদাহে কেঁপে কেঁপে উঠে। তার কপাল থেকে দরদর করে ঘাম ঝরতে থাকে এবং পিঠের অংসফলকের মাঝ দিয়ে বয়ে যায়। সে তার পর্যানের সাথে বাঁধা চামড়ার তৈরি পানির থলেতে একটা ছোট চুমুক দেয়। তার ভাবতেই অবাক লাগে শীঘ্রই তুষার আর বরফের রাজ্যে তারা প্রবেশ করতে চলেছে।

“কাবুল শহরটা কেমন?” বাবুরী তার হাতের দাস্তানা দিয়ে সপাটে ঘোড়া-মাছিটাকে আঘাত করে এবং কঠিন মাটিতে বেচারার প্রাণহীন দেহ আছড়ে পড়তে দেখে সেদিকে সন্তুষ্ট চোখে তাকিয়ে থাকে।

“আমার মরহুম আব্বাজান যদিও নিজে কখনও সেখানে যাননি। কিন্তু তিনি বলেছিলেন, তিনি শুনেছেন দুটো ভিন্ন জগতের মাঝে আঁকা পড়া একটা বিচিত্র স্থান সেটা- দুটো জগতের একটা শীতল আর অন্যটা উষ্ণ। কাবুল থেকে একদিনের দূরত্বে এমন স্থান আছে, যেখানে কখনও তুষারপাত হয় না। আবার ভিন্ন দিকে মাত্র দু’ঘণ্টার দূরত্বে এমন স্থানও রয়েছে যেখানের বরফ সারা বছর কখনও গলে না…”

“আমি ভাবছি সেখানের মেয়েরা কেমন…” “তারা শীতল না উষ্ণ? আমরা যদি ভাগ্যবান হই তাহলে শীঘ্রই দেখতে পাবো।”

*

চারপাশের বাতাস অনেক হাল্কা। বাবরের শ্বাস নিতে রীতিমত কষ্ট হয় এবং স্বাভাবিকের চেয়ে তার হৃৎপিণ্ড অনেক দ্রুত স্পন্দিত হতে থাকে। ঘোড়াগুলোও বাতাসের অভাব বোধ করে এবং তারা উপরে উঠার সময়ে থেকে থেকেই নাক দিয়ে শব্দ করতে থাকে। শীতে অসাড় হয়ে আসা আঙ্গুলে, বাবর তার পশমের পরত দেয়া আলখাল্লার মস্তকাবরণ আরও ভালো করে টেনে দেয়। এক ঘণ্টা আগেও আকাশ পরিষ্কার ছিল। কিন্তু সহসা আগাম জানান না দিয়ে বরফ পড়তে শুরু করে। আর এখন তুষারের ভারী কণা তাদের চারপাশে বিষণ্ণ ভঙ্গিতে উড়ছে। পেছনে তাকিয়ে বাবর মানুষ আর পশুর গাঢ় অবয়বের আগুয়ান লম্বা সারি সে বহু কষ্টে আলাদা করে চিনতে পারে। কিছু লোক এখনও ঘোড়ায় চেপে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু অনেকেই তার মতো খাড়া বরফাকীর্ণ ঢাল বেয়ে ঘোড়ার লাগাম ধরে ঝড়ের মাঝে মাথা নিচু করে এগিয়ে চলেছে। তার নিজের ঘোড়া, কালো কেশর আর লেজ বিশিষ্ট ধূসর একটা স্ট্যালিয়ন, অস্বস্তিবোধ করাতে চিহিঁ আওয়াজ করে এবং বাবর তার লাগাম ধরে তাকে টেনে নিয়ে চললে সে প্রতিবাদ জানাতে চেষ্টা করে।

তীব্র শীতের সাথে তার ভালোই পরিচয় আছে। কিন্তু গ্রীষ্মকালের এই তুষারঝড়ের আকষ্মিকতা, বাতাসের তীব্রতা আর শীতলতা একটা সতর্কবাণী বলে মনে হয়। তার চারপাশে পাগলের মতো ছন্দে আন্দোলিত হতে থাকা তুষারকণার মাঝে সে যেনো তার কল্পনায় তৈমূরের যোদ্ধাদের বহু কষ্টে উপরে উঠার আবছা অবয়ব দেখতে পায়। তারা এই বিপর্যয় সহ্য করে টিকে ছিলেন, এই ভাবনাটা তাকে শক্তি জোগায়।

“সুলতান।” বাবর তার খুব কাছেই বাইসানগারের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। “পথ প্রদর্শক বলছে নাকের ঠিক সামনেই যখন দেখা অসম্ভব হয়ে উঠেছে, তখন এগিয়ে যাওয়াটা মারাত্মক বিপজ্জনক। সে একটা খাওয়াল পাহাড়ের ফাটলে একটা গুহা। চেনে, যা সামনেই কয়েকশ গজ দূরে অবস্থিত। ঝড় না থামা পর্যন্ত সে আপনাকে সেখানে আশ্রয় নিতে অনুরোধ করেছে এবং সে আমাদের বাকি সবাইকে শিখিয়ে দেবে কিভাবে নিজেদের আর প্রাণীর বহরকে সবচেয়ে ভালোভাবে রক্ষা করা যায়।” বাবর মাথা নেড়ে অসম্মতি প্রকাশ করে। “পথ প্রদর্শক যদি বলে থাকে যে আমাদের যাত্রা বিরতি করা উচিত, তবে আমরা তাই করবো।” সে বলে, “কিন্তু আমি আমার লোকদের বাইরের খোলা প্রান্তরে কষ্ট আর বিড়ম্বনার মাঝে রেখে নিজে গুহার ভেতরে লুকিয়ে থাকবো না। সে আমাদের অবশ্যই কি করতে বলেছে?”

“সুলতান, খুঁড়তে বলেছে। এই বাতাসে আমরা তাঁবু খাটাতে পারবো না। আর তাই আমাদের নিজেদের জন্য গর্ত খুঁড়তে বলেছে এবং সেই বরফ দিয়ে বাতাস আটকাতে দেয়াল তৈরি করতে বলেছে ঘোড়ার পালকে আড়াল করতে এবং তারপরে তুষারঝড় না থামা পর্যন্ত আমাদের আর কিছুই করার নেই…”

“বেশ তাই হবে। এবার আমাকে একটা শাবল এনে দাও…”

পরের দিন খুব সকালবেলা, তুষারের ভেতরে একটা গর্তে বাবরের ঘুম ভাঙে। বরফের একটা স্তর তাকে ঢেকে রেখেছে কিন্তু আপাদমস্তক কম্বলে মুড়ে সে কতোটা আরামে রাত কাটিয়েছে টের পেয়ে চমকে উঠে। গুঁড়ি দিয়ে গর্ত থেকে বের হয়ে সে গায়ের উপর থেকে বরফের কুচি ঝেড়ে ফেলার মাঝে, চারপাশে তাকিয়ে ঝড় থেমে গিয়েছে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেলে। আদিগন্ত বিস্তৃত পরিষ্কার নীল আকাশের নিচে সাদা দৃশ্যপট চোখ ঝলসে দেয়।

“সুলতান।” তাদের শক্তপোক্ত গড়নের লম্বা বছর পঁয়ত্রিশেক বয়সের পথপ্রদর্শক শীতের হাত থেকে বাঁচতে আপাদমস্তক সে বেশ ভালো করে মুড়ে রেখেছে। তার ছেলে- চৌদ্দ কি পনের বছর হবে বয়স- পাশে দাঁড়িয়ে দু’হাত আড়াআড়ি করে রেখে কব্জি পর্যন্ত বোগলের নিচে এঁজে রেখেছে বাড়তি উত্তাপ পাবার আশায়।

“আমরা কি যাত্রা আরম্ভ করতে পারি?”

“হ্যাঁ, কিন্তু এখন থেকে আমাদের আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে। পূর্বে দৃশ্যমান অনেক বিপদই তুষারের আবরণে এখন ঢেকে গিয়েছে।”

লোকটা ঠিকই বলেছে। বরফের পুরু স্তর চারপাশের দৃশ্যপট এখন অনেক কোমল আর ঝুঁকিহীন দেখাচ্ছে। কিন্তু সেই সাথে পাহাড়ের অসংখ্য ফাটলের উপরেরটাও ঢেকে দিয়েছে। পুরো বহরটা যাত্রা শুরু করতে বাবর তাকিয়ে দেখে পথপ্রদর্শক লোকটা কিভাবে সতর্কতার সাথে আগে আগে চলেছে। আর কিছুক্ষণ পরে পরেই আপাতদৃষ্টিতে কঠিন বরফের উপরে লম্বা লাঠি দিয়ে গুতো দিচ্ছে। সেটা সাথে সাথে ধ্বসে পড়ে নিচের অতলস্পর্শী গিরিখাদ উন্মুক্ত করে তুলছে। যেখানে একবার পড়লে আর দেখতে হবে না। বাবর যখন তার কাছে জানতে চায় এই জ্ঞান সে কিভাবে লাভ করেছে। তখন লোকটা জানায় বহু শতাব্দি ধরে তার পরিবার এই পাহাড় অতিক্রম করতে ভ্রমণকারীদের সাহায্য করে আসছে। তৈমূরের বাহিনীর সাথেও তাদের বংশের কেউ একজন পথপ্রদর্শক হিসাবে ছিলো ভেবে নেয়াটা কি খুব বেশি বাড়াবাড়ি হবে?

শীঘ্রই অলস গালগল্পে সময় কাটাবার শক্তি বা অবকাশ কোনোটাই থাকে না। তারা ধীরে ধীরে দুটো চূড়ার মাঝে ঘোড়ার পর্যানের মত দেখতে একটা উঁচু ভূখণ্ডের দিকে এগোতে থাকে। বরফের স্তর ধীরে ধীরে আরো উঁচু হয়ে উঠতে শুরু করে যে, প্রায়ই ঘোড়ার রেকাব পর্যন্ত এমনকি কখনও পর্যান বাঁধার কাপড়ের ফেটি পর্যন্ত বরফে ঢুবে যেতে থাকে…

“সুলতান…আমার এবার পায়ে বরফ-মাড়ানো লোক লাগবে।” পথপ্রদর্শক লোকটা নরম ঘন বরফে প্রায় কোমর পর্যন্ত ডুবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

কি?…

“বরফ মাড়াবার জন্য লোক লাগবে…গিরিখাদ আকীর্ণ এলাকাটা আমরা পার হয়ে এসেছি। সেসব নিয়ে আর ভীত না হলেও চলবে। এবার পনের কি বিশজন শক্তিশালী লোক আমার প্রয়োজন। সামনের লোকটার কাজ হবে বরফের মাঝে গায়ের জোরে এগিয়ে যাবার। আর তার পেছনের লোকেরা আলগা বরফ দাবিয়ে দিয়ে একটা গলি পথ তৈরি করতে পারবে। যার ভিতর দিয়ে বাকি লোকেরা আর ঘোড়ার পাল পেছন পেছন এগিয়ে যাবে। কেবল এভাবেই আমরা এখন গিরিপথে পৌঁছাতে পারি…”

এক ঘণ্টা পরে বাবরের ফুসফুসে কেউ যেনো আগুন ধরিয়ে দিয়েছে বলে মনে হয়। আর তার পা জোড়া আপনা থেকেই দেহের নিচে মুড়ে আসতে চায়। কিন্তু তাকেই সবার চেয়ে বেশি সহনশীলতা আর উদ্যম প্রদর্শন করতে হবে। সে নিজেই জোর করে বরফের ভিতর দিয়ে প্রথমে সামনে এগিয়ে যাবার দায়িত্ব নিয়েছে এবং অন্যরা যেখানে হাঁপিয়ে ওঠার আগে আট কি দশ গজ দূরত্ব অতিক্রম করতে পেরেছে যে, ঠিক করেছে তার দ্বিগুণ পথ সে পরিষ্কার করবে। যাতে ঠাণ্ডা সত্ত্বেও সে কুলকুল করে ঘামতে শুরু করে। কিন্তু প্রতিটা পদক্ষেপ তার ভিতরে একটা বুনো উল্লাসের জন্ম দেয় যে, প্রকৃতি নিজেও তাকে দমিয়ে রাখতে পারছে না।

দুপুর নাগাদ তারা বরফের প্রান্তর থেকে শেষ পর্যন্ত বের হয়ে শক্ত উঁচু জমিতে এসে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। তৈমূরের মত না, সে আর তার লোকেরা ভাগ্যবান। আবার তুষারপাত শুরু হয় না এবং তারা এখন বৈরী কিন্তু অপরূপ সুন্দর দৃশ্যপটের ভিতর দিয়ে অতি ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। বাবর সবসময়ে মনে করেছে যে, ববফ বোধহয় কেবল সাদা হয়। কিন্তু এখানে পৃথিবীর ছাদের উপরে উষ্ণ সূর্যালোকে ফিরোজা আর মহানীল মহিমায় এটা চকচক করছে।

“গিরিপথ আর কতো দূরে?”

পথপ্রদর্শক এক মুহূর্ত কি ভাবে। “সুলতান, আমরা যদি এই গতিতে এগিয়ে যেতে পারি, হুপিয়ান গিরিপথে আমরা আগামীকাল রাত হবার আগেই পৌঁছে যেতে পারবো।”

বাবর হাত তালি দেয়। পশমের পরত দেয়া দাস্তানা আর তার উপরে উলের কাপড় দিয়ে মুড়ে রাখা সত্ত্বেও জমে আছে এবং ব্যাথায় কুঁকড়ে যায়। নীল হয়ে ওঠা আঙ্গুলে পুনরায় রক্ত চলাচল শুরু হতে মনে হয় গনগনে সূঁচ দিয়ে কেউ যেনো খোঁচা দিচ্ছে। “তুমি ভালোভাবেই তোমার দায়িত্ব পালন করেছে। আমি ভেবেছিলাম আমাদের পশুর পালের অধিকাংশই আমরা হারাব।”

“আপনাকে আমি এ কারণেই হুপিয়ান গিরিপথে নিয়ে এসেছি। অন্য সব গিরিপথ, যেমন খাওয়াকের মতো এটার উচ্চতা বেশি না। আর এটা দিয়ে উপরে উঠাও খুব একটা ঝুঁকিপূর্ণ না- যদিও এইসব পাহাড়ের সব জায়গাতেই বিপদ ওঁত পেতে আছে… আপনাকে সবসময়ে সতর্ক থাকতে হবে-” লোকটা তখনও কথা বলছে। এমন সময় হিম বাতাস বিদীর্ণ করে একটা জান্তব, মড়মড় শব্দ ভেসে আসে। আঁতকে উপরের দিকে তাকিয়ে বাবর তাদের অনেক উপরে বরফাবৃত চূড়ার মসৃণ পৃষ্টদেশে মাকড়সার জালের মতো ফাটল জন্ম নিতে দেখে। প্রায় মানুষের মতো একটা আর্তনাদ করে ওঠে। নীলচে-সবুজ বরফের একটা আয়তাকার খণ্ড বিচ্যুত হয়ে মানুষ আর প্রাণীর লম্বা সারির শেষ প্রান্তে এসে আছড়ে পড়ে।

একই সাথে এমন বিকট একটা গর্জনের সৃষ্টি হয় যে, বাবরের মনে হয় সে বুঝি বধির হয়ে যাবে। সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে দু’হাতে কান চেপে ধরে। সে যখন কান নিয়ে ব্যস্ত এমন সময় কিছু একটা ভীষণ জোরে এসে তার বুকে আঘাত করে। আর মাথার পাশ দিয়ে অন্য কিছু একটা বের হয়ে যায়। তার চারপাশে বিক্ষিপ্ত কণা নিক্ষিপ্ত হতে থাকে। তার ঘোড়া আতঙ্কে চিহি শব্দ করতে থাকলে বাবর লাফিয়ে নিচে নেমে ঘোড়ার গলার দড়ি আঁকড়ে ধরে তার পেটের নিচে আশ্রয় নেয়। তুষার ধ্বস যতোটা আকস্মিকভাবে শুরু হয়েছিলো ঠিক ততোটাই আকস্মিকভাবে শেষ হয়। তাদের চারপাশের তুষার শৃঙ্গ আবার মৌন হয়ে উঠলেও আশেপাশে থেকে আতঙ্কিত মানুষ আর পশুর যুগলবন্দি ভেসে আসতে থাকে। বাবরের মাথাটা দপদপ করে এবং পাঁজরের হাড় আড়ষ্ট হয়ে থাকা অবস্থায় সে সন্তর্পণে ঘোড়ার নীচ থেকে বের হয়ে আসে। অবোধ জন্তুটা তখনও ছটফট করলেও অক্ষত রয়েছে মনে হয়।

“সুলতান, আপনি সুস্থ আছেন?” বাম হাত দিয়ে ডান হাতটা আগলে ধরে রেখে বাবুরী এগিয়ে এসে জানতে চায়। বেচারার মুখের একপাশে ইতিমধ্যে বীভৎস একটা কালসিটে জন্ম নিয়েছে।

বাবর মাথা নাড়ে। তার পরণের মোটা কাপড়ের জন্যই এযাত্রা সে বেঁচে গিয়েছে। কিন্তু বেচারা পথপ্রদর্শক তার পায়ের কাছে হাতপা ছড়িয়ে পড়ে আছে। লোকটার মাথার নেকড়ের চামড়ার টুপি তার মাথার পেছনে আছড়ে পড়া বরফ খণ্ডের প্রচণ্ডতা থেকে তাকে বাঁচাতে পারেনি। হতভাগ্য লোকটার রক্ত আর মগজ এখন বরফের উপরে বিক্ষিপ্তভাবে ছিটিয়ে আছে।

বাবরের এবার লোকটার সতর্কবাণীর কথা মনে পড়ে। “আপনাকে সবসময়ে সতর্ক থাকতে হবে…”

পৃথিবীতে সেগুলোই ছিলো হতভাগ্য লোকটার উচ্চারিত শেষ শব্দ। তাদের মাথার উপরে চূড়ার বরফ আবারও সূর্যের আলোয় চিকচিক করে। কিন্তু যেকোনো মুহূর্তে আবার মৃত্যুগ্রাসী তুষারখণ্ড নিক্ষিপ্ত করতে পারে আগাম ঘোষণা না দিয়ে। তার লোকদের এখনই এই মৃত্যুউপত্যকা থেকে সরিয়ে নিতে হবে।

“আহতদের একত্রিত করো।” সে মৃদু কণ্ঠে বলে। “আমাদের পক্ষে যতদ্রুত সম্ভব এই এলাকা ত্যাগ করতে হবে। আদেশটা সারির শেষপ্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেবার বন্দোবস্ত করো।”

সে এবার আবার তার পায়ের কাছে দলামুচড়ে পড়ে থাকা দেহটার দিকে তাকায়। আশেপাশে কোথাও সে লোকটার ছেলেটাকে দেখতে পায় না। আর এখন তাকে খোঁজার সময়ও নেই। “বাবুরী, আমাকে সাহায্য করো…”

পথপ্রদর্শক লোকটা বিশালদেহী ছিলো। আর বাবুরীর ঘোড়ার উপরে তাকে উঠাতে তারা দুজনে হিমশিম খেয়ে যায়। কিন্তু লোকটাকে এখানে রেখে যাওয়াটা অমানবিক হবে। একটা উপযুক্ত স্থানে তাকে সমাধিস্থ করতে হবে। সেটা তার প্রাপ্য। আর বাবর তার জন্য তেমনই একটা স্থান খুঁজে বের করবে- সম্ভবত গিরিপথের কোথায় যেখানে তার আত্মা শান্তিতে বিশ্রাম নেবে।

তারা যতোটা দ্রুত সম্ভব এগিয়ে যায়। পরিশ্রান্ত পা বরফাবৃত মাটিতে পিছলে যায় হোঁচট খায়। অবশেষে তারা একটা উপত্যকায় এসে উপস্থিত হয়। বাবর ভাবে, তুষারপাতের আক্রমণ থেকে তারা এখানে নিরাপদ থাকবে এবং ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নেবার আদেশ দেয়। সে যেমন ভয় পেয়েছিলো ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তেমন ব্যাপক না- আঠার জন লোক মারা গেছে। এর প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক আহত হয়েছে। বেশির ভাগেরই আঘাত তেমন গুরুতর নয়। এছাড়া ছয়টা ঘোড়া আর তিনটা মালবাহী খচ্চর মারা গেছে বা চলার অনোপযোগীভাবে আহত হয়েছে। বাবরের লোকেরা ইতিমধ্যে তাদের জবাই করে তাদের মাংস রান্নার বন্দোবস্ত করেছে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারতো….

“সুলতান…” একটা কিশোর কণ্ঠ তার ভাবনার জাল ছিন্ন করে। পথপ্রদর্শক লোকটার ছেলে। তার চোখ লাল, কিন্তু কণ্ঠস্বর সংযত। “সামনের রাস্তা আমি চিনি। আমি এখন আপনার পথপ্রদর্শকের দায়িত্ব পালন করতে প্রস্তুত আছি। আমার আব্বাজান বেঁচে থাকলে এটাই চাইতেন…”

“তোমার সাহসের আমি প্রশংসা করি। আর তোমার আব্বাজানের মৃত্যুর জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত।” বাবর মাথা নেড়ে বলে। যাত্রা শেষে তাকে উপযুক্তভাবে পুরস্কৃত করবে বলে ঠিক করে।

ভোরের ঠিক আগে তারা সেই কিশোর ছেলেটার নেতৃত্বে তারা হুপিয়ান গিরিপথ অতিক্রম করতে শুরু করে। দক্ষিণের আকাশে অনেক নিচুতে তখনও একটা নিঃসঙ্গ তারাকে জুলজুল করতে দেখা যায়।

বাবর তারাটার দিকে তাকিয়ে থাকে। “ওটা কি তারা? আমি আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।”

বাবুরী অজ্ঞতা প্রকাশ করে। কিন্তু বাইসানগার জানে। “সুলতান ওটাকে বলে ক্যানোপাস। সমরকন্দ কিংবা ফারগানার উত্তরের আকাশে এটা দেখা যায় না। কিন্তু সমরকন্দে তৈমূরের পৌত্র জ্যোতিষ উলুঘ বেগের লেখায় আমি এর কথা পড়েছি। সেখানে একটা বিখ্যাত কবিতার পংক্তি রয়েছে: ক্যানোপাস কততদূর বিস্তৃত তোমার উজ্জ্বলতা আর কোনো আকাশে তোমার উদয়? যাদের উপরেই তোমার রশ্মি নিঙড়ে পড়ে তাদের সবার জন্যই তোমার চোখের তারায় সৌভাগ্যের চিহ্ন অংকিত থাকে।

বাবরের চোখের সামনে ভোরের আলো ফুটে ওঠায় তারাটা বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু বার্তাটা ভালোই রেখে যায়। সৌভাগ্যের সূচক এমন একটা সংকেতই তার প্রয়োজন ছিলো এবং সে উদ্দীপ্ত বোধ করতে থাকে। আট ঘণ্টা পরে সে আরও উৎফুল্ল হয়ে ওঠে, যখন বরফাবৃত ভূখণ্ড তৃণভূমিতে রূপান্তরিত হয়। গত তিনদিনে এই প্রথম তারা তাঁবু খাটাতে পারে এবং গায়ের কাপড় আর পায়ের জুতো খুলে আরাম করে বসতে পারে।

বাবর, বাবুরী আর বাইসানগারকে সাথে নিয়ে তার লোকদের অবস্থা পরিদর্শন করতে বের হয়ে কারো কারো অবস্থা দেখে তারা আঁতকে উঠে। তারা আদেশ সত্ত্বেও অনেকেই পাহাড়ের জন্য উপযুক্ত প্রস্তুতি নিয়ে আসেনি। সূর্যের আলোয় মুখের চামড়া ফেটে গেলেও মোঙ্গলদের প্রাণবন্তই দেখায়। কিন্তু মীর্জা খানের সৈন্যদের অবস্থা শোচনীয়। বেশ কয়েকজনের অন্তত ডজনখানেক হবে তাদের সংখ্যা, যাদের হাত পা হিম-দংশের আক্রমণে কালো হয়ে ফুলে উঠেছে।

বাবর আগেও এমন তীব্র হিম-দংশের আক্রমণ দেখেছে। তার লোকদের বাঁচাতে হলে এখন কেবল একটা উপায়ই আছে। শীঘ্রই শিবিরে দাউদাউ করে আগুন। জ্বলতে থাকে। আর শান পাথরে ঘষে খঞ্জরে ধার দেয়া শুরু হয়। তাদের এই যন্ত্রণা কোনো মাদক দিয়েই নাকচ করা সম্ভব না। এই লোকগুলো যাদের হাত বা পায়ের আঙ্গুল সংক্রমণের শিকার হয়েছে, মুখের ভিতরে ভাঁজ করা কাপড়ের টুকরো রেখে যাতে তারা জিহ্বা কামড়াতে না পারে, কেটে ফেলা।

মীর্জা খানের নিশান বাহক- মোল বছরের সুদর্শন দেখতে এক তরুণ যার ডান হাত কালো হয়ে ফুলে ছোট একটা তরমুজের আকৃতি নিয়েছে এবং আঙ্গুলের নিচে দিয়ে হলুদ পুঁজ বের হয়ে আসছে। অনেক চেষ্টা করেও সৈন্যদের খঞ্জরের ধার। পরীক্ষা করতে দেখে নিজের কান্না চেপে রাখতে পারছিলো না।

“সাহস রাখো৷” বাবর তার পাশে হাঁটু মুড়ে বসে। “খুব দ্রুত এটা শেষ হবে আর তুমি অন্তত প্রাণে বেঁচে যাবে… আমার দিকে তাকিয়ে থাকো আর ভুলেও নিচের দিকে তাকিও না।” বাবর শক্ত করে তার কাঁধ চেপে ধরে এবং একজন তার। হিম-দংশে আক্রান্ত হাতটা কনুইয়ের উপরে চেপে ধরতে আরেকজন তার পায়ের উপরে চেপে বসে।

“এবার- দ্রুত করো!” বাবর আদেশ দেয়। ছেলেটার চোখ ভয়ে বড়বড় হয়ে উঠে, তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। খঞ্জরটা তার ডান কব্জি কেটে নেমে আসতে বেচারা ব্যাথায় মুচড়ে উঠে। কিন্তু দাঁতের মাঝে কাপড়ের টুকরো থাকায় সে কোনো শব্দ করতে পারে না। ছেলেটাকে তখনও ধরে রেখে বাবর একপাশে সরে এসে আরেকজন সৈন্যকে হাঁটু মুড়ে বসতে সুযোগ দেয় এবং আগুনে পুড়িয়ে লাল করা। একটা তরবারির পাত দিয়ে কব্জির কর্তিত স্থানের রক্তপাত বন্ধ করতে সেখানটা পুড়িয়ে দেয়। এইবার কাপড়ের কারণে চাপা শোনায় কিন্তু ছেলেটা অনেক কষ্ট করেও চেঁচিয়ে উঠা থেকে বিরত থাকতে পারে না।

মীর্জা খান আগ্রহী, কিন্তু ভাবাবেগশূন্য চোখে তাকিয়ে ছিলো। পাহাড়ের ভিতর দিয়ে সে নির্বিঘ্নেই এসেছে- তাকে এখনও প্রাণবন্ত দেখায়। কিন্তু এই লোকটার জন্য সে বিন্দুমাত্র পরোয়া করে না। বাবরের ইচ্ছা করে তার মুখটা গুঁড়িয়ে দেয়। এই ছেলেটার নাম কি?” সে জানতে চায়।

“সাইয়্যেদিন।”

“আমি তাকে আমার বাহিনীতে নিয়োগ করতে চাই।”

“যেমন আপনার অভিরুচি।” মীর্জা খান কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, যেন বলতে চায় “হাত কাটা নিশান বাহক আমার দরকার নেই।”

বাবর এবার দাঁড়িয়ে থেকে একটা আলখাল্লা ছিঁড়ে সেটা দিয়ে ক্ষতস্থানে পট্টি বাঁধা দেখে। “একে আমার তাঁবুতে নিয়ে যাও আর পুষ্টিকর কিছু খেতে দাও।” সে আদেশ দেয়। “আজ সে যথেষ্ট সাহসের পরিচয় দিয়েছে।”

*

আক সরাই তৃণভূমি, কাবুলের প্রেরিত দূত তাদের সালতানাতের সীমান্তের কাছে সাক্ষাতের স্থান হিসাবে মনোনীত করেছিলেন। সবুজ ঘাসে ছাওয়া একটা মনোরম স্থান। বাবরের শিবিরও দর্শনীয়ভাবে স্থাপন করা হয়। সারি সারি তাঁবু যার মাঝে তার নিজের বিশাল তাবুটা স্থাপিত। আশার কথা এই যে, পাহাড়ের পাদদেশের গ্রামের অধিবাসীরা তার বাহিনীর প্রতি কোনো ধরণের বিরূপতা প্রদর্শন করেনি এবং দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে তারা যখন উপত্যকার ভিতর দিয়ে এগিয়ে এসেছে তখনও আশেপাশের গ্রামবাসীরা কেবল পাহাড়ের উপর থেকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছে।

সেটা তখন সেপ্টেম্বর মাস। ফসল কাটা শেষ হয়েছে আর শস্যাগার পরিপূর্ণ থাকায় গ্রামবাসীরা তাদের কাছে ফসল বিক্রি করতেই বেশি আগ্রহী ছিল। রাতের বেলা আগুনের পাশে বসে নধর ভেড়ার মাংস দিয়ে আহার সেরে বাগান থেকে সদ্য সংগৃহীত পাকা আপেল আর নাশপাতি আর চাকভাঙা মধু খাবার স্বাদই আলাদা। গাছের ডালে ঘুঘু, তিতির আর অন্যসব গায়ক পাখির ডানা ঝাপটানো শোনা যায়। রাতের বেলা বাবর লালচে-বাদামী নাইটিংগেলের ডাক শুনতে পায়। সমৃদ্ধ আর উর্বর একটা স্থান। আর সে যখন এখানকার সুলতান হবে, সেও এটাকে সেভাবেই রাখবে।

কিন্তু তার আগে তাকে শিবিরে নিয়মশৃঙ্খলা স্থাপন করতে হবে। সে যদিও লুটপাট করতে মানা করেছে। কিন্তু ছয়জন লোক তার আদেশ অমান্য করে পাশের গ্রামে হামলা চালিয়ে নিজেদের গবাদি পশুর পাল রক্ষা করতে চেষ্টা করায় দু’জন কৃষককে হত্যা করেছে। বাবর দোষী ব্যক্তিদের সনাক্ত করে এবং মৃত কৃষকদের পরিবারের সামনে পাথুরে চোখে তাদের চাবকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করাটা পর্যবেক্ষণ করে। সে এরপরে তাদের চাবকানো মৃতদেহ যা তখন আর মানুষের বলে চেনা মুশকিল আগাছাপূর্ণ একটা স্থানে মাটিচাপা দিতে বলে। কাবুল থেকে বার্তাবাহক যতো দ্রুত এসে পৌঁছে ততই মঙ্গল। যতবেশি সময় তাকে অপেক্ষা করতে হবে, ততোই তার বাহিনীতে এমন সব কুকর্মের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।

তৃতীয় দিন সে তার তাঁবুর বাইরে বসে বাবুরীর তীর বাছাই করা দেখছে। এমন সময় তৃণভূমির উপর দিয়ে একটা ছোট অশ্বারোহী দলকে সে তার তাঁবুর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে।

“তোমার কি মনে হয়? দূত ফিরে এসেছে?” চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বাবর জিজ্ঞেস করে। লোকগুলো অনেক দূরে থাকায় তাদের ঠিকমতো চেনা যায় না। কিন্তু তার তাঁবুর দিকে খুব অল্প সংখ্যক লোকই সরাসরি এগিয়ে আসতে পারে। যার মানে তারা মিত্রই হবে। লোকগুলো আরো কাছে আসতে বাবর দূতের ময়ূরকণ্ঠী নীল রঙের আচকান আর তার পাগড়ীতে রত্নখচিত পিন দিয়ে সংযুক্ত লম্বা পালক চিনতে পারে।

“সুলতান আপনাকে স্বাগতম। আপনি নিরাপদে আসতে পেরেছেন দেখে আমি আনন্দিত এবং নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে একটা বিশাল বাহিনীও আপনি নিয়ে এসেছেন। শাহী দরবার আপনাকে অভিবাদন জানাচ্ছে।”

বাবর মাথা নাড়ে। “আমি কবে নাগাদ শহরে প্রবেশ করতে পারবো?”

দূতের বাদামী চোখ পিটপিট করে উঠে। “সুলতান একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। মোহাম্মদ মুকুইম আরগুন নামের এক জবরদখলকারী কাবুল আর কাবুলের উপরে অবস্থিত দূর্গপ্রাসাদ দখল করে নিয়েছে। শাহী দরবার শহরের বাইরে অল্প কিছু সংখ্যক অনুগত সৈন্য নিয়ে কারাবাগে পালিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তারা পুনরায় শহর দখল করতে পারবে না।”

“এই ভুইফোড়টা কে?”

“হাজারা গোত্রের এক সর্দার। সে তার দলবল নিয়ে জোর করে শহর দখল করেছে।”

“সে কি নিজেকে সুলতান হিসাবে ঘোষণা করেছে? তার নামে কি খুতবা পাঠ করা হয়েছে?”

“না, সুলতান এখনও হয়নি। তার নিজের গোত্রের ভিতরেই অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছে।”

“তার সাথে কতো সৈন্য আছে?”

“সুলতান সম্ভবত এক হাজার হবে, এর চেয়ে কিছু বেশি বা কমও হতে পারে।”

“আমার সাথে চার হাজার যোদ্ধা আছে যারা যুদ্ধের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। আপনার শাহী দরবারকে খবরটা গিয়ে জানান। না আমাকেই কারাবাগে নিয়ে চলুন। আমি হিন্দুকুশ অতিক্রম এখানে এজন্য আসিনি যে অন্য কেউ লাভবান হবে।”

“হ্যাঁ, সুলতান।” কাবুলের শাহীদূত এতক্ষণে তার সামনে নতজানু হয় এবং মাটিতে মাথা স্পর্শ করে। বাবর ভাবে, এই প্রথমবার সে তাকে সুলতান হিসাবে কুর্নিশ করলো।

***

“আ-আ-আমার পরামর্শ হলো আপনি অ-অ-অপেক্ষা করেন।” বাহলুল আইয়ুব উত্তেজনার কারণে তোতলাতে তোতলাতে বলে। রাশভারি বৃদ্ধ লোকটা নিজের বিশাল রেশমী দাড়িতে হাত বুলায়। কাবুলের গ্রান্ড উজির হিসাবে তার পদমর্যাদা আর বয়সের কারণেই তিনি সম্মানের অধিকারী। তার মতামতের গুরুত্ব না দিলেও, বাবর অসহিষ্ণু চিত্তে ভাবে, যদিও শাহী দরবারের অন্যসব গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, ওয়ালি গুল শাহী কোষাগারের রক্ষক, এবং হায়দার তকী, শাহী সীলমোহরের রক্ষক, তারাও তাদের সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ে।

“দেরি করলে কি লাভ হবে? এতে করে হাজারারা কেবল উৎসাহিত হবে এবং বিশ্বাস করবে যে আমি তাদের ভয়ে ভীত। শাহী দরবারের কর্তৃত্ব আমার রয়েছে। আমি রাজরক্তের অধিকারী। আমার সাথে একটা শক্তিশালী সেনাবাহিনী আছে। আর কি প্রয়োজন?”

“আ-আ-আমরা কাবুলের অধিবাসীদের নিয়ে চিন্তিত। মোহাম্মদ মুকুইম আরগুন শহরের অভিজাত কিছু অধিবাসীকে বন্দি করেছে আমাদের পরিবারের সদস্যও তার ভিতরে রয়েছে এবং দূর্গপ্রাসাদে তাদের আটকে রেখেছে।”

“সে যদি তাদের ক্ষতি করার মতো দুর্মতি দেখায় তবে তাকে সেজন্য মূল্য দিতে হবে। আমি তাকে সেটা পরিস্কার বুঝিয়ে দেবো। আমি তাকে আরও বুঝিয়ে দেবো যে, আমি কোনো ডাকাত নই। আমি কাবুলের নতুন সুলতান, যিনি নিজের সালতানাতের দখল বুঝে নিতে এসেছেন।“

তিন বৃদ্ধ এবার পালাক্রমে নিজেদের দিকে তাকায়। বাবর ভাবে, তার কথা বুড়ো লোকগুলোর মনে ধরেছে। সম্ভবত তারা ভুলে গিয়েছিলো কার সাথে তাদের পালা পড়েছে: এমন একজন- ভাগ্য যাকে বিড়ম্বনায় ফেললেও নিজের প্রতিভা আর সাহসের বলে ইতিমধ্যেই যিনি একজন সুলতান।

“সুলতান আমরা আপনার আ-আদেশের অনুবর্তী। আমরা সেটা মেনে নিয়েছি।”

শরতের উজ্জ্বল আলোয় কাবুলের চারপাশে অবস্থিত শহর রক্ষাকারী দেয়াল আখরোটের মতো গনগনে দেখায়। বেষ্টনীকৃত দেয়ালের পেছনে বাবর প্রাসাদ, বাড়ি, মসজিদ আর সরাইখানা দেখতে পায়। সমরকন্দের মতো মনোরম না। কিন্তু এখানকার সম্পদ ব্যবহার করে সে একেই সুন্দর আর জৌলুসপূর্ণ করে তুলবে। চীন, তুরস্ক, হিন্দুস্তান আর পারস্যের মাঝে অবস্থিত কাফেলা বহরের চলাচলের পথে একটা গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র হবার কারণে কাবুল বেশ সমৃদ্ধ শহর। শাহী দরবারের অমাত্যরা তাকে গর্ব করে বলেছে যে, প্রতিবছর বিশ হাজার ঘোড়া, উট আর অন্য মালবাহী প্রাণীর বহর এখান দিয়ে মশলা, চিনি, রেশম আর মূল্যবান পাথর নিয়ে এখান দিয়ে অতিক্রম করে।

শহরের উপরে উত্তরে, নিঃসঙ্গ পাথরের একটা স্তূপের মাথায় দূর্গপ্রাসাদ অবস্থিত। এর মসৃণ দেয়ালে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফাঁকা স্থান দেখা যায়। বাবর জানে এই মুহূর্তে অনেক চোখ- যাদের ভিতরে মোহাম্মদ মুকুইম আরগুনও রয়েছে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, আর সেও সেটাই চায়। সে তার লোকদের যতোটা সম্ভব সুসজ্জিত হতে বলেছে। তরবারি, বর্শা আর রণকুঠারের ফলা আলোয় ঝলসে উঠে। কাঁধের উপরে ধনুক ঝুলছে। আর পিঠে তীর ভর্তি তৃনীর। তার ইচ্ছা শত্রু যেনো তার সামর্থ্যের ব্যাপারে কোনো ভুল ধারণা না করে।

তার লোকেরা সমরসজ্জায় তার পেছনে বিন্যস্ত হয়, বাবর ধীরে ধীরে শহর অতিক্রম করে দূর্গপ্রাসাদের দিকে এগিয়ে যায় এবং তারপরে দাঁড়িয়ে পড়ে। নিজের। লোকদের শহর কিংবা দূর্গপ্রাসাদ থেকে আকস্মিক কোনো আক্রমণ মোকাবেলার। জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকতে বলে, সে কাশিমকে তার কাছে ডেকে পাঠায়। “আরো একবার আমার দূতের দায়িত্ব তোমাকে পালন করতে হবে। একদল প্রহরী নিয়ে দূর্গপ্রাসাদে গিয়ে মোহাম্মদ মুকুইম আরগুনকে আমার চুড়ান্ত হুঁশিয়ারী পৌঁছে দিয়ে এসো। সূর্যাস্তের ভিতরে সে যদি বন্দিদের মুক্তি দিয়ে শহর আর দূর্গপ্রাসাদ ত্যাগ করে, তাহলে সে নিরূপদ্রবে কোনো ক্ষতি স্বীকার না করেই ফিরে যেতে পারবে। সে যদি এটা মানতে রাজি না হয়, তবে আমি তাকে কোনো রেয়াত করবো না।”

বাবর চারজন সৈন্য নিয়ে কাশিমকে দূর্গপ্রাসাদের দিকে দুলকিচালে ঘোড়া ছুটিয়ে যেতে দেখে। দূতের দায়িত্ব পালন করা সব সময়েই ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু কাশিম এর আগেও এমন পরিস্থিতিতে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে এবং বাবর নিশ্চিত এই দফা তাকে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে না…আরগুনের সাহস হবে না তার কোনো ক্ষতি করার। ইত্যবসরে অন্য কিছু কাজ সম্পন্ন করতে হবে। সে বাইসানগারকে ডেকে পাঠায়। “আমি চাই শহরের লোকেরা আমার আদেশের কথা জানতে পারুক। আমার বার্তার প্রতিলিপি আমি লিপিকরদের তৈরি করতে বলেছি। আপনার সেরা ধনুর্ধরদের বলেন তীরের মাথায় বেঁধে সেগুলো শহরে ছুঁড়ে মারতে, যাতে লোকেরা পড়তে পারে তাতে কি লেখা রয়েছে।”

এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। একটাই অসুবিধা, বড্ড মাছি এখানে। তাদের কারণে তার ধূসর ঘোড়াটা অস্থির হয়ে উঠেছে এবং লেজ দিয়ে অনবরত পিঠের দুপাশে আঘাত করছে। সে জিন থেকে নেমে আসে এবং দুপায়ে বাঁধন জড়িয়ে দেয়। যাতে চড়ে বেড়াতে পারলেও দূরে সরে যেতে না পারে এবং আসনপিড়ি করে পাথুরে মাটিতে বসে পড়ে। মাথার অনেক উপর দিয়ে বকের একটা ঝাঁক উড়ে যায়, বেহেশতের পাখি। আল্লাহতালা তার সহায় তারই একটা সূচক।

“আপনার কি মনে হয়, সে কি করবে?” বাবুরী ঘোড়ার লাগাম ধরা অবস্থায় তার পাশে বসে পড়ে বলে।

“হাজারা দস্যুটা? সে সাইবানি খান না। আমার ধারণা নিজের লোকেরাই তাকে সমর্থন করে না। তার কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। আমি তাকে ছেড়ে দেবো বলে ঠিক করেছি।”

“আপনি বদলে গিয়েছেন। আপনার আমাদের ভিতরে সেই মারামারির কথা মনে আছে? যখন আমি আপনাকে আত্ম-করুণার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিলাম।”

“তুমি ঠিক কথাই বলেছিলে। আমার নিজের জন্য আসলেই করুণা হচ্ছিলো। তুমি আমাকে নিজের উপরে বিশ্বাস ফিরে পেতে সাহায্য করেছিলে- যে অনেক কিছুই ঘটতে পারে…রাস্তায় বড় হবার কারণে তুমি আমার চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞ। শাহজাদাদের তরুণ বয়সে ঘর থেকে বের করে দেয়া উচিত, যাতে তারা নিজেদের রক্ষা করতে শিখে…”।

“সম্ভবত অবশ্য আমি খাবারের কথা ঠিক বলতে পারছি না…বা বদ বুড়ো লোকগুলো যারা গলিপথে আপনাকে কুরুচিপূর্ণ প্রস্তাব দেবে।”

বাবর হাসে।

পশ্চিম আকাশে সূর্য তখন মাত্র এক বর্শা উপরে অবস্থান করছে এবং সময় প্রায় শেষ হয়ে এসেছে এমন সময় কাশেম ফিরে আসে। তার চেহারায় উফুল্লভাব ফুটে আছে। “হাজারারা নিজেদের ভিতরে ঝগড়া করছে কেউ মারামারিও আরম্ভ করেছে। কিন্তু মোহাম্মদ মুকুইম আরগুন আপনার প্রস্তাব মেনে নিয়েছে। সে তার লোকদের নিয়ে দূর্গপ্রাসাদ ত্যাগ করে উত্তরে ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে শহরে অবস্থানরত সৈন্যদেরও তার সাথে যোগ দেবার আদেশ দিয়েছে। তিনি আপনাকে দু’ঘণ্টা অপেক্ষা করতে বলেছেন। তারপরে আপনি শহর আর বন্দিদের দায়িত্ব। গ্রহণ করতে পারবেন…”

“আমি যা ভেবেছিলাম সে আমাকে তারচেয়েও বেশি ভয় পেয়েছে। তুমি ভালো কাজ করেছে।”

খবরটা বাবরের সৈন্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে তারা ঢালের উপরে তরবারি ঠুকে তুমুল উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং সেই সাথে আরো একটা শব্দও ভেসে আসে। যদিও অনেক দূর থেকে আর হাল্কাভাবে ভেসে আসছে। কিন্তু নির্ভুলভাবে বোঝা যায় শহরের ভিতরে থেকে একটা কোলাহল ভেসে আসছে। শহরবাসীরা নিশ্চিতভাবেই জানতে পেরেছে কি ঘটেছে।

বাবর আবার ঘোড়ায় চেপে বসে এবং নিজের লোকদের সামনে দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। “আমাদের দেখেই এই হঠকারী লোকটা নিজের প্রস্রাবে পিছলে পড়েছে। কিছুক্ষণের ভিতরেই মার খাওয়া কুকুরের মতো যে ডাকতেও ভয় পায়, সে আর তার লোকেরা শহর ত্যাগ করবে। পড়ন্ত আলোতে শহর ত্যাগ করার সময়ে সে যেনো ভালো করে আমাদের হৈহুল্লোড়ের শব্দ শুনতে পায়। তাদের তরবারি এখন উজ্জ্বল আর রক্তের দাগবিহীন, সম্মান ভূলুণ্ঠিত।

সেই রাতে, বেগুনী আর সোনালী আলখাল্লা পরিহিত অবস্থায় কাবুলের সুলতানের রঙ- শাহী দরবারের অমাত্যরা আর নিজের সেনাপতিদের সাথে নিয়ে বাবর কাবুলের প্রধান মসজিদে প্রবেশ করে। মিহরাবের ঠিক নিচে সুলতানের নামাজের স্থান নির্ধারিত রয়েছে যেখানে তৈমূর হিন্দুস্তান অভিযানের সময় নিশ্চয়ই নামাজ আদায় করেছিলেন। বাবর পাথুরে মেঝেতে কপাল ঠেকিয়ে মনে মনে ভাবে। শাহী মসজিদের ইমান তার নামে খুতবা পাঠ করতে তাকে সুলতান ঘোষণা করার পবিত্ৰক্ষণে- সে নিজের ভেতরে আশা আর গর্বের একটা উৎসরণ অনুভব করে। এখন আর সে গৃহহীন যাযাবর না।

ইমাম নতুন প্রার্থনা শুরু করতে, বাবর মনোযোগ দিয়ে শুনে:

পরম করুণাময়, আপনি যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দান করেন
যার কাছ থেকে ইচ্ছা সেটা কেড়েও নেন।
যাকে ইচ্ছা করেন তাকে সমৃদ্ধি দান করেন।
এবং যাকে ইচ্ছা করেন তাকে ধ্বংস করে দেন।
সকল পবিত্রতার উৎস কেবল আপনিই।
আপনিই সবশক্তিমান। আল্লাহতা’লা আসলেই সর্বশক্তিমান আর তিনি বাবরের প্রতি সদাশয়।

৩.১ তৃতীয় খণ্ড – তরবারির বরাভয়ে শাসন

তৃতীয় খণ্ড – তরবারির বরাভয়ে শাসন

১৫. ধনুর্ধর সর্দার

শহরের কোষাগার বাবর যেমনটা আশা করেছিলো তারচেয়েও বেশি সম্পদে পূর্ণ ছিলো। শহরদূর্গের আস্তাবলের নিচে পুঁতে রাখা সিন্দুক হাজারারা খুঁজে পাবে না

বলে ওয়ালি গুল যেমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো কার্যত তাই হয়েছে। “সুলতান, ব্যাটারা যদি কেবল ঘোড়ার লাদি সরিয়ে দেখতো, তাহলেই তারা হয়তো সিন্দুক দেখতে পেতো, কিন্তু এমন কাজ করাটা হাজারীদের মর্যাদার পক্ষে অচিন্তনীয়।” বৃদ্ধ লোকটা পুরোটা সময় আনন্দে খিলখিল করে হাসতে থাকে যখন ভৃত্যেরা হাঁটু পর্যন্ত গভীর তাজা ধোঁয়া উঠতে থাকা ঘোড়ার লাদি আর খড়কুটো সরিয়ে গোপন দরজা আর সিঁড়ির ধাপ উন্মোচিত করে যা আটটা ভূগর্ভস্থ কক্ষের দিকে নেমে গেছে। পুরু লোহা দিয়ে বাঁধানো ওক কাঠের দরজার পেছনে পর্যাপ্ত সোনা আর রূপার মোহর ছিল যা দিয়ে বাবর তার লোকদের ভালোমত পুরস্কৃত করতে পারে। নতুন লোক নিয়োেগ করতে পারে। আর তার নতুন সাম্রাজ্যের সৌন্দর্যবর্ধন করতে পারে।

সে পর্যালোচনা করতে থাকা বিশাল পরিকল্পনার ছকটা গুটিয়ে রাখে। নকশাটায় কাবুলের কেন্দ্রস্থলে সদ্যপ্রাপ্ত সম্পদের কিছুটা ব্যয় করে সে যে বিশাল গম্বুজযুক্ত মসজিদ নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছে। সেটা চারকোণা প্রকোষ্ঠের আকারে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাকে যদিও কাবুল আর এর চারপাশে বিশাল অঞ্চলে এখানকার সর্দারটা আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছে এবং তার নতুন প্রজারা তাকে স্বাগত জানিয়েছে সমতলে বসবাসকারী আইমাক, পাসাহিস, তাজিক, বারাকিস, এবং পাহাড়ের হাজারা আর নেগুডারিস, এবং কাবুলের বাসিন্দা- এদের ভিতর ফারগানার গোত্রগুলোর চেয়ে ঈর্ষা আর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ কার্যত বেশি। তাদের মনে করিয়ে দিতে কোনো ক্ষতি নেই- তার মতো সুন্নী মুসলমান- আল্লাহতালার ইচ্ছা যে সে তাদের শাসক হবে।

আর তাছাড়া শহরটায় তার নিজের একটা স্থায়ী ছাপ রেখে যাওয়ার অনুভূতিই আলাদা- এমন একটা সৌধ যা আগামী শাসকদের তার কথা মনে করিয়ে দেবে। সমরকন্দে যা তৈরি করার সুযোগ সে পায়নি। সেখানে সে দীর্ঘ সময় অবস্থান করতে পারেনি। আর তাছাড়া তৈমূরের দ্বারা আগেই সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তোলা শহর সে কিভাবে নতুন করে অলঙ্কৃত করতো। কাবুলে অবশেষে সে সুযোগ পেয়েছে। তৈমূরের উত্তরসুরী শাহজাদার মহিমায় শহরটাকে সাজিয়ে তোলার এমন একটা স্থান যেখানে শিল্পী আর সাহিত্যিকেরা এসে মিলিত হবেন।

এখন অবশ্য তাকে কিছু অপ্রিয় কাজ করতে হবে। একমাস আগে বাইসানগার তাকে বলেছিলো আলী ঘোসত- বাবরের অশ্বশালার প্রধান, যাকে সে সেনাবাহিনীর রসদের প্রধান ভারপ্রাপ্ত অমাত্য নিয়োগ করেছিলো- কাবুলে নির্দিষ্ট কিছু ঘোড়া আর ঘোড়ার খাদ্য সরবরাহকারীদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে তাদের প্রতি বেশি উদারতা দেখিয়েছেন। বাবরের প্রত্যক্ষ আদেশের বিরুদ্ধে এটা। সে স্থানীয় লোকদের কাছে বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, সে তাদের সাথে নায্য আচরণ করবে। এখন আলী ঘোসতের লোভের কারণে, সুলতান এতো সহজে তার কথার বরখেলাপ করেছেন বলে তারা যে ফিসফিস শুরু করেছিলো তার যথোপযুক্ত প্রমাণ পাবে…।

কোনো পদক্ষেপ নেবার আগে বাবর আরো প্রমাণ চেয়েছিলো- সে ছোটবেলা থেকেই আলী ঘোসতকে চেনে, এই লোকটার কাছেই সে ঘোড়ায় চড়া আর পোলো খেলা শিখেছিলো। কিন্তু বাইসানগার যখন আরো প্রমাণ হাজির করায়, তাকে এখন ব্যবস্থা নিতেই হবে। সে তার খিলানাকৃতি দরবার মহলের দিকে এগিয়ে যায়। যেখানে তার গিল্টি করা সোনার সিংহাসনের দুপাশে তার পারিষদবর্গ মর্যাদা অনুসারে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সবচেয়ে বয়স্ক আর মর্যাদাবান তার সিংহাসনের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সিংহাসনে উপবিষ্ট হয়ে। বাবর বাইসানগারকে ইঙ্গিত করে। “রসদের দায়িত্বপ্রাপ্ত অমাত্যকে নিয়ে আসা হোক।”

সে চোখেমুখে নির্বিকার অভিব্যক্তি নিয়ে তাকিয়ে দেখে, আলী ঘোসত তার পরিচিত প্রগতজানু হাঁটার ভঙ্গিতে এখন শিকলের কারণে অনেক বেশি প্রকট পা হেচড়ে হেচড়ে এগিয়ে আসে। তাকে আপাতদৃষ্টিতে অবজ্ঞাপূর্ণ দেখালেও বাবর জানে লোকটা ভেতরে ভেতরে শঙ্কিত। তার মুখে যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট এবং ভীতচকিত চোখে উপস্থিত অমাত্যদের দিকে তাকাতে তাকাতে সে সিংহাসনের দিকে এগিয়ে আসে। সে পুরোটা সময় একবারও বাবরের দিকে তাকায় না এবং তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরীরা তাকে তাদের বর্শার উল্টোদিক দিয়ে ধাক্কা দেবার আগেই সে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে।

“আপনি জানেন আপনার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ আনা হয়েছে…”

“সুলতান আমি-”

“আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।”

“হ্যাঁ, সুলতান।”

“আর সেটা কি সত্যি?”

“সবসময়ে এভাবেই বিষয়গুলো চলে এসেছে…”

“কিন্তু আমি আপনাকে পরিষ্কার করে বলেছিলাম, ঘোড়ার ব্যাপারীদের সাথে ন্যায্য আচরণ করতে। আপনি আমার কথা অমান্য করেছেন…”।

আলী ঘোসত মাথা তুলে তাকিয়ে শুকনো ঠোঁট জিহ্বা দিয়ে ভেজাতে চেষ্টা করে। “সুলতান, চেঙ্গিস খানের আমল থেকে আমার লোকদের মাঝে প্রচলিত প্রথা সম্পর্কে সুলতান আপনি জানেন। দরবারের সর্বোচ্চ অমাত্য নয় বার আদেশ অমান্য না করা পর্যন্ত শাস্তি পায় না।”

“আর আপনি কমপক্ষে বারোবার আমার আদেশ অমান্য করেছেন…আমার কাছে পুরো বিবরণ আছে।”

ঘোড়ার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত অমাত্য আরো নতজানু হয়ে যায়। বাবর তার নতজানু হয়ে থাকা মাথার দিকে তাকিয়ে থাকে মোটা পেষল গর্দানটা জল্লাদের খড়গের কাছে কেমন অরক্ষিত মনে হয়। আলী ঘোসতও নিশ্চয়ই জানেন পৃথিবীর বুকে তার অন্তিম মুহূর্ত ঘনিয়ে এসেছে। সে এখন কি ভাবছে?

দীর্ঘ মন্দ্র নিরবতায় বাবরের মনে হয় তার চারপাশের সব পারিষদবর্গ তাদের নিঃশ্বাস চেপে রেখেছেন।

“আপনাকে দরবারের কাজ থেকে বরখাস্ত করা হলো। আজ সূর্যাস্তের পরেও যদি আপনাকে কাবুলে দেখা যায়, তাহলে কেউ আপনার মৃত্যু ঠেকাতে পারবে না। আমার সামনে থেকে একে নিয়ে যাও।”

“আপনার উচিত ছিলো তাকে প্রাণদণ্ড দেয়া।” বাবুরী পরে বাজপাখি উড়াতে তারা শহরের অভ্যন্তরে অবস্থিত প্রাসাদ থেকে বের হলে বলে। বাবরের বাজপাখি একটা সোনালী শেকল দিয়ে তার দস্তানার কব্জির সাথে আটকানো, মাথায় পরানো হলুদ চামড়ার টোপরের নিচে অস্থিরভাবে পাখিটা মাথা নাড়ছে, বুঝতে পেরেছে শীঘ্রই আবার সে আকাশে উড়বার সুযোগ পাবে।

“তুমি কথাটা বলছো কারণ আলী ঘোসতকে তুমি অপছন্দ করতে…সে তোমাকে বেধড়ক পিটিয়েছিলো…”

“সে আমাকে আরো বলেছিলো ঘোড়ার লাদি পরিষ্কার করাই আমার পক্ষে উপযুক্ত কাজ…না, অবশ্যই আমি তাকে পছন্দ করি না। আপনি জানেন বুড়ো ছাগলটাকে ঘৃণাই করি। সে ছিলো একজন উদ্ধত, আত্মগর্বী শূরন্মন্য যে তার উধ্বতনদের তোষামদ করে, আর অধস্তনদের সবসময়ে তোপের মুখে রাখে। কিন্তু আমি কথাটা, সেজন্য বলিনি। আপনার নিজের লোকেরা আর কাবুলের বাসিন্দারা এর ফলে মনে করবে আপনি আবেগপ্রবণ আর দুর্বল।”

বাবর ঘোড়র উপরে ঝুঁকে বসে বাবুরীর কব্জি আঁকড়ে ধরে। “কেউ যদি এমনটা ভাবে তাহলে ভুল করবে। তাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়ে আমি বরং সাহসের পরিচয় দিয়েছি। তার প্রাণদণ্ডের আদেশ দেয়াটাই আমার পক্ষে সহজ ছিলো। আমার যখন মাত্র বারো বছর বয়স, তখন আমি আমার মরহুম আব্বাজানের কুচক্রী উজির কামবার আলীর গর্দান নিজে নিয়েছিলাম। কিন্তু আলী ঘোসত, আমি যখন সিংহাসনবিহীন অবস্থায় ভবঘুরে জীবনযাপন করেছি, তখন আমার প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছে এবং সেজন্য সে সামান্যই অর্জন করেছে। সে যাই হোক, ভবিষ্যতে আমার কোনো লোক যদি আমার আদেশ অমান্য করে- সে যেই হোক- নির্ঘাত মারা পড়বে।”

*

যদিও সেটা ছিলো বসন্তের শুরুর দিকে, কিন্তু কাবুলের লোকেরা উত্তরের হিমশীতল এই বাতাসকে পারওয়ান বলতো। শহরের আস্তানার নিচের হ্রদের গাঢ় সবুজ পানিতে তখনও সাদা বরফের ছিটেফোঁটা দেখা যেত আর লতাগুল্মের আড়ালে আশ্রয় নেয়া হাঁসের পালকে আলোড়িত হয়। কিন্তু বরফ এ বছরের মতো গলে গিয়েছে। তৃণভূমি আর পশুচারণভূমিতে আবার নতুন প্রাণের আগমনী ধ্বনিত হচ্ছে। পাহাড়ের পাদদেশ লাল টিউলিপ ফুলে ভরে উঠেছে আর জঙ্গলে বিরহকাতর বনমোরগ সঙ্গীর খোঁজে অনরবত ডেকে চলেছে। কৃষকরা গরম কাপড়ে দেহ। ভালমত আবৃত করে দ্রাক্ষাকুঞ্জের সারি সারি গাছের যত্ন নেয়। কয়েকমাসের ভিতরে যা সোনালী রঙের মিষ্টি আব-আরে ভরে উঠবে যা থেকে প্রস্তুত সুরা গ্রীষ্মকালে আর্মত্যরা পাহাড় থেকে নিয়ে এসে সংরক্ষণাগারে রক্ষিত বরফের। সাহায্যে উপভোগ করবেন।

বাবর নেকড়ের চামড়ার কম্বলের নিচে থেকে নিজের দেহ বের করে আনে। এখনও রাতেরবেলা উষ্ণতার জন্য কম্বলটা তার দরকার হয়। যদিও নেদারি মেয়েটা সে যেখান থেকে এসেছে সেই পাহাড়ে সংগৃহীত উজ্জ্বল তামাটে রঙের মধুর মত তার ত্বক- সকাল পর্যন্ত সে তার সাথে বিছানায় অবস্থান করে, রক্ত উষ্ণ রাখার জন্য যা যথেষ্ট। আজ পরে কোনো সময়ে সে হয়ত বাবুরীর সাথে শিকারে যাবে। যদিও অল্পই শিকার পাওয়া যায়। পাহাড়ী ভেড়ার পাল তাদের শীতকালীন আর গ্রীষ্মকালীন চারণভূমির মাঝে আনাগোনা করছে আর মাঝে মাঝে বন্য গাধার দেখা পেলে বেশ ভালোই আমোদ হয়।

অথবা সে সম্ভবত কাবুলের উপরে পাহাড়ের অবস্থিত তৃণভূমিতে তৈরি করা বাগান প্রদর্শনে যেতে পারে। পাটমুনিষের দল ইতিমধ্যে মাটি পরিষ্কার করতে শুরু করেছে এবং শীতল মাটি খুড়ে পানি সরবরাহের নালা, কেন্দ্রীয় জলাধার এবং কাছের নদী থেকে পানি এনে ঝর্ণা তৈরির কাজ শুরু করেছে। শীঘ্রই তার সাম্রাজ্যের পূর্বদিক থেকে নিয়ে আসা টক-চেরীর চারা, আপেল, ডালিম আর লেবুর চারার সাথে রোপিত হবে। উর্বর ভূমিতে গাছগুলো দ্রুত বেড়ে উঠবার কথা। তার আম্মিজান আর নানীজান তার কাছে এসে পৌঁছাবার আগেই আশা করা যায় দেখার মতো একটা বাগান তৈরি হবে।

বাবর কম্বলটা ছুঁড়ে ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙে। তার কক্ষের পূর্বদিকের চন্দনকাঠের দরজায় খোদাই করা জাফরির ভিতর দিয়ে সূর্যের আলো ভিতরে প্রবেশ করছে। দরজাটা খুলতে অন্যপাশে একটা পাথরের বারান্দা রয়েছে যেখান থেকে নিচের আঙ্গিনা দেখা যায়। বহু শতাব্দি ধরে কাবুলের সুলতানেরা উৎসবের সময়ে এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রজাদের দর্শন দিতেন। সেই অধিকার সেও লাভ করেছে ভাবতেই তার ভালো লাগে।

*

“আপনি কি করছেন? আমি এই নিয়ে তিনবার দেখলাম আপনি কাগজে কি হিবিজিবি দাগ কাটছেন।” বাবুরীর ছায়া বাবরের কাগজের উপরে পড়ে।

“এটা একটা দিনলিপি। আমি সমরকন্দ যখন সাইবানি খানের কাছ থেকে দখল করি, তখনই ঠিক করেছিলাম আমার জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখবো… কিন্তু শহরটার কর্তৃত্ব হারাবার পরে…আমি যখন প্রাণে ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম, আমি এই লেখার কাজটা তখন বন্ধ রেখেছিলাম…”

“আপনি কেনো বন্ধ করেছিলেন? আপনি হয়তো মনে শান্তি পেতেন…”

বাবর তার লেখনী নামিয়ে রাখে। “কিছু বিষয় আছে যার সাথে মানিয়ে নেয়াটা খুবই কষ্টকর ছিলো- খানজাদার পরিণতি, ওয়াজির খানের মৃত্যু…আর আমি যখন ভবঘুরে জীবনযাপন করছি তখন ব্যর্থতা ছাড়া, বেঁচে থাকবার প্রাণান্তকর প্রয়াস ছাড়া এবং ক্ষুধার্ত অবস্থায় আধবাটি বজরার গুড়ো কেমন মুখরোচক মনে হয়, এসব ছাড়া আমি আর কি লিখতাম? এসব কথা লিখে কোনো প্রশান্তি লাভ করা যায় না…কেবল লজ্জাই প্রকট হয়ে উঠে…কেবলই আত্ম-বঞ্চনা যা থেকে তুমি একবার আমাকে রক্ষা করেছিলে…”

“আর এখন?”

“আমি এখন আবার সুলতান হয়েছি…আমার মনে হয়েছে আমার স্মৃতিকথার এখন কিছুটা হলেও মূল্য রয়েছে…কিন্তু এর সাথে আরো কিছু আছে। হিন্দুকুশ পর্বতমালা অতিক্রম করে আসার সময় তোমার কি মনে আছে আমরা ক্যানোপাস তারা কেমন উজ্জ্বল হয়ে চমকাতে দেখেছিলাম। সেই মুহূর্তে, আমি শপথ নিয়েছিলাম আমি যদি কাবুল অধিকার করতে পারি। তাহলে আমি আর কখনও আমার অভিমন্ত্রণ হারাবো না। সাইবানি খানের মতো খুনী, উচ্চাকাঙ্ক্ষী সম্পর্ক আর বিদ্রোহী প্রজাদের আর কখনও আমার আশেপাশে ভিড়তে দেব না। আমি নিজের নিয়তির নিয়ন্ত্রক হবো। আমি এটা অর্জন করতে পারবো বলে আমার মনে হয়েছে…”

“আর আপনি কি এসবই লিখে রাখছেন?”

“একরকম সেটাই বলতে পারো…আমি চাই আমার সন্তান, তাদের সন্তানরাও যেন জানতে পারে আমার সাথে কি হয়েছিলো। আমার শক্তি আমার অর্জনের কথা সেই সাথে আমার ভুলের কথাও…আমার ব্যর্থতা…আমার ভাবনা…বেঁচে থাকার জন্য আমি কি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলোম…আজ থেকে আমি সবকিছু লিপিবদ্ধ করতে চাই- ভালো অথবা খারাপ- সতোর আর নিষ্ঠার সাথে…”

“গতরাতে আপনি নেদারি মেয়েটার সাথে কতবার মিলিত হয়েছেন সেটাও?”

“সেটাও…একটা মানুষ নানা কারণে গর্বিতবোধ করে থাকে…” বাবর খিকখিক করে হেসে উঠে। কিন্তু পরমুহূর্তে সে বিষণ্ণ হয়ে উঠে। সে তার উজিরের সাথে আজকের আলোচনার কথাটা কিছুতেই ভুলতে পারছে না। “বাহলুল আইয়ুব আজ আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন।”

“সেই বকরবাজ বৃদ্ধার মতো কথা বলতে থাকা লোকটা, সে-সে কি চায়?” বয়স বা মর্যাদার প্রতি বাবুরীর বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধাবোধ নেই। আর গ্রান্ড উজিরের তীক্ষ্ণ, কম্পিত কণ্ঠস্বর আর কথা বলার সময়ে হাত নাড়া নকল করতে সে পছন্দই করে। “সে খারাপ খবর নিয়ে এসেছে। যদিও সেটা অপ্রত্যাশিত ছিলো না। কাবুলে প্রবেশ আর নির্গমনের পথে সওদাগরী কাফেলা আক্রমণ করছে। হাজারারা- আমার নির্দেশ সত্ত্বেও যে কাফেলাগুলোকে কোনোভাবে বিরক্ত করা যাবে না। আর আমার জরিমানা বাবদ ধার্য করা মেষ আর ঘোড়ার পাল দিতেও তারা অস্বীকৃতি জানিয়েছে…মুহাম্মদ-মুকিম আরগুনের কাছে জরিমানা আদায়ের তাগাদা জানাতে ওয়ালি গুল গিয়েছিলো। সে আজ ফিরে এসেছে…তার কান কেটে দিয়ে হাজারারা আমার শাসনের প্রতি তাদের অনীহা জানিয়ে দিয়েছে…”

“তাহলে বলতেই হবে মুহাম্মদ-মুকিম আরগুন তাকে যেমন দেখায় তারচেয়েও মস্ত বড় আহাম্মক…”

“তার ঔদ্ধত্য তার মস্তিষ্কের চেয়েও বড় আর হাজারারা একটা শৃঙ্খলাহীন গোত্র। আমি যদি তাদের দ্রুত শায়েস্তা না করি, তাহলে অন্য আরো অনেক ক্ষেত্রে বিদ্রোহী হয়ে উঠবে। আমি ইতিমধ্যে আমার করণীয় ঠিক করেছি…বার্তাবাহকের কান কাটার অপরাধে বন্দি সব হাজারা যযাদ্ধাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। তৈমূর যতো বড় তৈরি করেছিলেন আমি তারচেয়েও বড় কর্তিত মুণ্ডের পিরামিড তৈরি করববা…”

“আমাকে আদেশ দিন একটা বাহিনী নিয়ে আমি নিজে যাই। আমি হারামজাদাদের পাহাড়ের কোটর থেকে তাড়িয়ে বের করে আনবো আর তাদের দেহ কবন্ধ করব…”।

বাবর তার বন্ধুর দিকে তাকায়। তার আন্তরিকতায় কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই: আবেগে তার কণ্ঠস্বর কাঁপছে আর চোখের পাতায় একটা উদগ্র দ্যুতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। সে একজন ভাল সৈন্য কিন্তু আগে কখনও নেতৃত্ব দেয়নি।

“তুমি ঠিক জানো নেতৃত্ব দিতে পারবে?”

অবশ্যই। কেবল আপনারই নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস নেই অন্য কারোও…”

বাবর কিছুক্ষণ চিন্তা করে। আরো অনেকে হয়তো বিড়বিড় করবে, অবাক হবে তাদের বাদ দিয়ে বাবুরীকে মনোনীত করায়। এমনকি বাইসানগারও হয়তো ব্যাপারটা মেনে নিতে চাইবে না। কিন্তু নিজের অনুভূতিকে প্রাধান্য দিয়ে বাবুরীকে সে যে সুযোগের জন্য মরীয়া হয়ে আছে দিতে আপত্তি কোথায়?

“ঠিকাছে। তুমিই যাবে।”

“আর আপনার আদেশ কোনো দয়া দেখানো চলবে না?”

“মুহাম্মদ-মুকীম আরগুন আর তার স্যাঙাতদের প্রতি কোনো ধরণের করুণা দেখাবে না। তবে মেয়েমানুষ আর বাচ্চাদের কোনো ক্ষতি কোরো না।”

“আমি আপনাকে নিরাশ করবো না।” বাবুরীর চোখের নিচের উঁচু হাড়ের জন্য তার চেহারায় একটা শিকারী নেকড়ের মতো অভিব্যক্তি ফুটে উঠে।

বাবুরী চলে যাবার পরেও বাবর চুপ করে অনেকক্ষণ ভাবে। তারপরে বাবুরী এসে বিঘ্ন ঘটাবার আগে সে যা লিখছিলো সেটা শেষ করার জন্য আবার লেখনী তুলে নেয়: “এই সাম্রাজ্য লেখনী না তরবারির সাহায্যে শাসিত হবে।”

*

শিকারীদের দণ্ড থেকে ইতিমধ্যে ছয়টা ছাল ছাড়ানো হরিণ ঝুলছে, কিন্তু নীলগাইটা হল বোনাস। বাবর এন্টিলোপের নীলচে-ধূসর চামড়া, কালো কেশর আর গলার নিচে লম্বা, পুরু, রেশমী লোমের আবরণ সম্পর্কে আগে পড়েছিলো, কিন্তু নিজে কখনও চোখে দেখেনি। তার সাম্রাজ্যের পূর্বদিকে ওক আর জলপাই গাছের ঘন অরণ্যে আত্মগোপন করে থাকা প্রাণীর দল- তীক্ষ্ণ কণ্ঠী ময়না, ময়ূর, বানর, আর জমকালো তোতাপাখি- তাকে বিমোহিত করে। বাবুরী হাজারা বিদ্রোহ দমন করে আসার পরে সে এই এলাকায় বিজয় উদযাপনের জন্য শাহী শিকারের আয়োজন করেছিলো বলে সে নিজের কাছেই কৃতজ্ঞ বোধ করে। পাঁচদিন আগে বাবুরী তার লোকদের নিয়ে কাবুলে ফিরে এসে বাবরের পায়ের কাছে আরগুনের কাটা মাথাটা অর্পণ করেছিলো। এখন সেও নীলগাইটার দিকে তাকিয়ে আছে।

‘তোমার পালা।” বাবর ফিসফিস করে বলে। সেটাই উপযুক্ত পুরষ্কার হবে।

বাবুরী জুনিপারের ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা নীলগাইটার দিকে নীলচোখে তাকিয়ে থাকার অবসরে ধনুকে তীর যুক্ত করে ছিলাটা কানের কাছে টেনে আনতে থাকে, যতক্ষণ না মনে হতে থাকে যে ধনুকটা ভেঙে যাবে।

বাবর তাকিয়ে দেখে সাদা পালকযুক্ত তীরটা অসন্দিগ্ধ এ্যান্টিলোপটার কোমল গলায় আমূল বিদ্ধ হয়, কোনো ধরণে শব্দ বা লম্বা পাপড়িযুক্ত চোখে কোনো পলক না ফেলে মাটিতে একপাশে কাত হয়ে উল্টে পড়ে। মুহূর্তের জন্য বাবর কোনো শরাহত প্রাণী দেখতে পায় না। তার চোখে ওয়াজির খান ভাসতে থাকে, গলায় উজবেক তীর বিদ্ধ হয়ে ঘোড়া থেকে খরস্রোতা নদীতে পিছলে পড়ছেন এবং চোখ ঘুরিয়ে নেয়। আবেগ আর স্মৃতি কখন মানুষকে তাড়িত করবে কিছু বলা যায় না। এই একটা বিষয় সে এতোদিনে ভালোই বুঝতে পেরেছে। “চমৎকার। তোমার নিশানভেদের দক্ষতা অসাধারণ।”

“বাজারের বালকের তুলনায় বলছেন…’

কাবুল বিজয় উদযাপনের পরে সেদিন রাতের ভোজসভাটা ছিলো সবচেয়ে জৌলুসময়। মশালের কমলা আলোতে, সাধারণ দূর্গ যেটাতে সে এবার শিকারের জন্য এসে উঠেছিলো, তার আঙ্গিনায় একটা পাইনকাঠের মঞ্চে বাবর উপবেশন করে তার পাশে ছিলো বাবুরী। বাবর শীঘ্রই উলুসের আদেশ দেবে- বিজয়ীর অংশ- বাবুরীকে প্রথম ভেড়াটা পরিবেশন করতে বলে। সে কাবুলের তীব্র লাল সুরা তার উদ্দেশ্যে পান করে বাবুরীকে কোর বেগী, যুদ্ধক্ষেত্রে তার পারদর্শিতার জন্য, ধনুকের সর্দার উপাধিতে ভূষিত করবে।

কিন্তু সেদিন গভীর রাতে, মোষের শিং আর রূপা দিয়ে তৈরি দুই হাতল যুক্ত পানাধার থেকে পান করতে করতে, মাঠের অন্যপ্রান্ত থেকে তার লোকদের হৈ-হুল্লোড়ের শব্দ আর বীরত্ব গাঁথার আওয়াজ এবং বিছানায় তাদের প্রবল নাক ডাকার শব্দের মাঝে, সে টের পায় নিজের ভেতর অসন্তোষ ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে। সুরার পরিমাণের সাথে ঠিক যখন অন্য শাসকরা সন্তুষ্টি বোধ করবে। বাবুরী হাজারাদের বিদ্রোহ দমন করেছে এবং পথের পাশে তাদের ছিন্ন মস্তকের যথেষ্ট বড় স্তূপ তৈরি করেছে, যা পথিকদের মনে ভয় আর ভবিষ্যত বিদ্রোহীদের প্রশমিত করতে সাহায্য করবে। কাবুল তার স্বর্গ তার সম্মানের শান্তি প্রলেপ-এখন নিরাপদ। তার রাজধানীকে সুশোভিত করতে সে নিত্য নতুন উদ্যান আর ভবনরে নকশা পরিকল্পনা করছে। কিন্তু তারপরেও সে কেন শান্তি পাচ্ছে না? কারণ উচ্চাশা তার অন্তরকে কুরে কুরে খাচ্ছে প্রতিনিয়ত, সুখ শান্তি সব হরণ করে নিচ্ছে।

সুরার পাত্রে আরেকটা লম্বা চুমুক দিয়ে, বাবর ভাবতে থাকে। আর কয়েকদিন পরেই তার আম্মিজান আর নানীজান কিশিম থেকে এখানে এসে পৌঁছাবেন। আম্মিজান তার সাথে মিলিত হতে পেরে যারপরনাই আনন্দিত হবেন সত্যি, কিন্তু তার মনে অব্যক্ত প্রশ্নটা তিনি ঠিকই বহন করে যাবেন-কবে বোনকে উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি সে পূর্ণ করবে। এসান দৌলতের তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টিতে সে একই প্রশ্ন দেখতে পাবে যা তাকে বিব্রত করছে: এর পরে কি? নতুন কোনো অভিযান? কখন এবং কোথায়? তৈমূর কিংবা তার পরম শ্রদ্ধেয় চেঙ্গিস খান কখনও একই স্থানে বেশিদিন কাটাননি। নিজের অর্জন কখনও তাদের সন্তুষ্ট করেনি, কোনো সন্দেহ নেই এসব কথাই বৃদ্ধা তাকে আবার মনে করিয়ে দেবেন…

“আপনাকে দেখে অভিযানের আগে কারো প্রিয় ঘোড়া খোঁড়া হয়ে গেলে যেমন দেখাবে, অবিকল সেই রকম দেখাচ্ছে।” বাবুরীর অস্থিসর্বস্ব মুখ সুরার প্রভাবে চকচক করছে এবং হাজারাদের বিরুদ্ধে সাহসিকতা আর চাতুর্য দেখাবার পুরষ্কার হিসাবে বাবরের দেয়া সোনার মালা তার গলায় লটকে আছে।

“আমি ভাবছিলাম… দশ বছর আগে আমি যখন একেবারেই ভাবিনি তখন আমি সুলতান হই। কিন্তু আমি সবসময়ে ভেবে এসেছি- সুলতান হবার আগে নিয়তি আমার ভাগ্যে বিশেষ কিছু রেখেছে…” বাবুরীর চিরাচরিত সন্দিহান অভিব্যক্তি বাবর অগ্রাহ্য করে। সে যেভাবে বেড়ে উঠেছে সেটা বেচারা কিভাবে বুঝবে, যেখানে তার প্রিয় জন্মদাতা যাকে তুমি ভালোবাস সে কেবল সম্ভাব্য মহত্ত্বের আর এখনও অর্জিত হয়নি সেই সম্ভাবনার কথা বলেন…

“সত্যি কথা হলো আমি অস্থির হয়ে উঠেছি- অসন্তুষ্ট। কাবুল ঠিকই আছে, কিন্তু আমি আরো চাই। প্রতিদিন আমি যখন ডায়েরী খুলে বসি কিছু লিখতে, আমি ভাবি ভবিষ্যতের পাতায় আমি কি লিখবো…সেখানে কি মহান কোনো গৌরব, মহান। কোনো বিজয়ের কথা লেখা হবে, নাকি সেগুলো ফাঁকাই থাকবে…? আমার বিশ্রাম নেবার সময় নেই, আমাকে শক্ত করে নিয়তির হাল ধরতে হবে। আমি আমার জীবনের সময়গুলো উল্লেখিত কিছু না করে বৃথাই নষ্ট করতে চাই না।”

“আপনি ঠিক কি করবেন বলে ভাবছেন…? সাইবানি খানকে আক্রমণ করবেন?”

“আমার সেনাবাহিনী আক্রমণের যোগ্য হয়ে উঠলে তোমার পরামর্শের জন্য অপেক্ষা করবো না। কিন্তু এখনই না। তাকে এখন আক্রমণ করলে আহাম্মকি করা হবে…”

“তাহলে আপনি কি করতে চান?”

বাবর আরেকটা লম্বা চুমুক দেয়, টের পায় সুরাটা ভেতরে প্রবেশ করে তার বাচন শক্তি আর কল্পনাকে মুক্ত করে। সহসা তার মনের গভীরে থাকা একটা ধারণা স্ফটিক স্বচ্ছ রূপ লাভ করে। “হিন্দুস্তান… আমি সেখানেই যেতে চাই। রেহানার গল্প তোমার মনে আছে? আমি যদি সম্পদ কুক্ষিগত করতে পারি, তৈমূর যেমন করেছিলেন। তাহলে সাইবানি খান বা পারস্যের শাহ্ কেউ আমার সামনে দাঁড়াতে পারবে না।” সে তার আসনে বসে উত্তেজনায় দুলতে থাকে। বাবুরী তার কাঁধে একটা হাত রেখে তাকে সুস্থির করতে চায়। কিন্তু সে এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে দেয়। সে তার কল্পনার চোখে রুবির চোখযুক্ত সোনার হাতিটা দেখতে পায়…

“আপনার উচিত হবে নিজের সহজাত অনুভূতি অনুসরণ করা।”

বাবর ঝাপসা চোখে তার দিকে তাকায়। “কি…?”

“আমি আপনাকে বলতে চেয়েছি নিজের অনুভূতির কথা শুনতে… আপনার তথাকথিত ভাগ্য যার কথা বলতে আপনি ভীষণ পছন্দ করেন সেটা আপনাকে কোথায় নিয়ে যায় দেখা যাক…”

বাবুরীর কণ্ঠস্বর যদিও অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে বলে মনে হয় এবং চারপাশের হট্টগোলের ভিতরে যা অনেকটাই হারিয়ে যায়। কিন্তু বার্তাটা পরিষ্কারভাবে বাবরের ভিতরে প্রবেশ করে। তার সুরার নেশা নিমেষে ঘুচিয়ে দেয়…হ্যাঁ, সে একটা বাহিনী নিয়ে কাবুল নদী বরাবর দক্ষিণে হিন্দুস্তানের দিকে এগিয়ে যাবে। সে প্রশস্ত সিন্ধুর দিকে তাকিয়ে দেখবে, অন্য তীরের অবিশ্বাস্য সম্পদের কথা বিবেচনা করবে, এবং সম্ভবত নিজের জন্য কিছু দখলও করতে পারে।

***

বাবরের অনুরোধে শাহী জ্যোতিষী গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান পর্যালোচনা করে দেখেন। রাতের পরে রাত তারা তাদের চার্ট পর্যবেক্ষণ করেন আর কাবুলের উপরের অন্ধকার আকাশ আলোকিত করে থাকা তারকারাজির অসম্ভব জটিল বিন্যাস পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করেন। জানুয়ারি মাসে, সূর্য যখন কুম্ভরাশিতে অবস্থান করছে তখন অভিযান শুরু করার একটা শুভ সময় তারা দাড়িতে টোকা দিতে দিতে। অবশেষে খুঁজে পান। বাবর ঠিক বুঝতে পারে না তাদের ভবিষ্যদ্বাণী সে নিজে বিশ্বাস করে কিনা, কিন্তু তার লোকেরা করে। অজানা অঞ্চলে তাদের অভিযানে গ্রহ-নক্ষত্রের বরাভয় রয়েছে এটা মনোবল বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। জ্যোতিষদের পরামর্শ অবশেষে তাকে অভিযান শুরুর প্রস্তুতি নিতে সহায়তা করবে: আগামী কয়েকটা মাস সে সেনাবাহিনী গঠন আর অভিযানের পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে।

*

শরতের শেষ ফলটাও কাবুলের চারপাশের বাগান থেকে সংগৃহীত হবার পরেই কেবল কিশম থেকে বাবরের আম্মিজান আর নানীজান এসে পৌঁছান। সে আরও আগেই তাদের আনতে লোক পাঠাতে চেয়েছিলো কিন্তু হাজারা বিদ্রোহের কারণে সে সতর্কতা অবলম্বন করে। কিন্তু তূর্যধ্বনি আর তোরণদ্বারের উপরে ঢাকের আওয়াজের মাঝে তারা তাদের দলবল নিয়ে দূর্গপ্রাসাদে প্রবেশ করতে তার মনটা গর্বে ভরে উঠে। খুতলাঘ নিগারের স্বাস্থ্য অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছে এবং দীর্ঘ ভ্রমণের ধকলের কারণে তাকে ক্লান্ত আর দুর্বল দেখায়- বাবর দেখে ফাতিমার উপরে তিনি ভীষণভাবে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন- কিন্তু এসান দৌলত বরাবরের মতোই প্রাণবন্ত রয়েছেন।

তারা নিজেদের কক্ষের অবস্থান গ্রহণ করা মাত্র তিনি দু’হাতে তার মুখ ধরে তাকিয়ে থাকেন। “আমার বাছা দেখছি পুরুষ হয়ে উঠেছে, তার মুখ ছেড়ে দিয়ে সন্তুষ্টির সাথে মাথা নেড়ে তিনি বলেন। “খুতলাঘ দেখো তোমার ছেলে গত কয়েক মাসে কেমন বদলে গিয়েছে- দেখো তার কাঁধ কেমন চওড়া হয়ে উঠেছে।” তিনি তার বুকে চাপড় দিয়ে তার বাহুর উধ্বাংশে আঙ্গুল দিয়ে খোঁচা দিয়ে দেখেন। যেনো কেনার আগে ঘোড়া খুটিয়ে পরখ করছেন। “সিংহের মত পেশী।”

খুতলাঘ নিগার তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু কিছু বলে না। তিনি আগের চেয়ে অনেক নিরব হয়ে গেছেন- আব্বাজানের আকস্মিক মৃত্যুর পরে তাকে যে মহিলা ফারগানার সিংহাসনের জন্য প্রস্তুত করে তুলেছিলেন সেই মানসিকভাবে শক্তিশালী মহিলা যেনো অন্য কেউ ছিলো- দু’বছর আগেও পাহাড়ে পাহাড়ে অবিশ্রান্ত ঘুরে বেড়ান সেই মহিলার চেয়ে এখন তিনি অনেক দুর্বল একজন।

“আপনাদের দুজনের সাথে আমার জরুরি কথা আছে। আসছে জানুয়ারি মাসে আমি কাবুল ত্যাগ করে দক্ষিণে আমার বাহিনী নিয়ে হিন্দুস্তানে আমার ভাগ্য পরীক্ষা করতে যাবো। আমার অবর্তমানে বাইসানগার রাজপ্রতিভূর দায়িত্ব পালন করবে…”

তার কথা শেষ হতে, এসান দৌলত সম্মতির সাথে মাথা নাড়েন। কিন্তু খুতলাঘ নিগারকে কিছু একটা বিচলিত করে তুলে। সোনালী জরির কারুকাজ করা তাকিয়া, যেখানে তিনি হেলান দিয়ে ছিলেন সেখান থেকে ধীরে ধীরে উঠে বসে, মাথা নাড়তে থাকেন, যেনো কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। তাকে কাঁদতে দেখে বাবর চমকে উঠে- তিনি কান্না মোছার কোনো চেষ্টাও করেন না। তার সামনে তিনি প্রবলভাবে কাঁপতে থাকেন এবং হাত দিয়ে নিজের মাথার লম্বা চুল মোচড়াতে থাকেন যেখানে এখন সাদার ছোপ দেখা দিয়েছে।

“মেয়ে…” এসান দৌলতের কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট অসন্তুষ্টি প্রকাশ পায়।

বাবর তার আম্মিজানের হাত ধরে তাকে প্রবোধ দিতে চেষ্টা করে। যেনো তিনি একটা বাচ্চা মেয়ে আর সে তার বাবা। “আমাকে বলেন কি হয়েছে?”

“খানজাদা- বাবর তুমি তোমার প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গেছো? তুমি কথা দিয়েছিলে তাকে উদ্ধার করবে। দক্ষিণে কেন তুমি তোমার সময় নষ্ট করছো…”

তিনি তাকে আঘাত করলেও হয়তো বাবর এতটা কষ্ট পেতো না। লজ্জা, হতাশা আর বেদনার একটা পরিচিত রঙে তার চেহার লাল হয়ে উঠে। তার কথা আমার সবসময়ে মনে আছে। আমি আমার প্রতিশ্রুতি রাখবো। কিন্তু এখনও সময় হয়নি। সাইবানি খানকে মোকাবেলা করতে হলে আমাকে আরও সৈন্য আরও অর্থ সংগ্রহ করতে হবে। এবারের অভিযানে হয়তো আমি সেটা অর্জন করতে পারবো। কিন্তু আমি শপথ করছি যতো শীঘ্রই সম্ভব আমি খানজাদাকে খুঁজে বের করবো…”

তার আম্মিজানের ফোঁপানি ধীরে ধীরে প্রশমিত হয়ে আসে এবং তার শরীর শান্ত হয়। বাবর তার কপালে আলতো করে চুমু দেয়। কিন্তু তিনি তার ভেতরে যে অশান্তির আগুন জ্বেলে দিলেন, সেটা প্রশমিত হতে অনেক সময় লাগবে…

আগামী সপ্তাহগুলোতে সে হিন্দুস্তান অভিযানের প্রস্তুতিতে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। সে একই পথ ধরে যাবে- কাবুল নদী বরাবর দক্ষিণ-পূর্ব দিকে এগিয়ে গিয়ে খাইবার গিরিপথ অতিক্রম করবে- এক শতাব্দি আগে তৈমূর যে পথ দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন।

বরফ পড়া শুরু হবার আগের স্বল্প সময়ে, তৃণভূমি সাদা হয়ে উঠতে আর দৃশ্যপট ঝাপসা হতে শুরু করতে, যখন বোঝা দুস্কর কোথায় পর্বতমালা শেষ হয়েছে, আর কোথায় ধূসর আকাশ শুরু হয়েছে। বাইসানগার আর বাবুরী লোকদের অভিযানের জন্য প্রশিক্ষিত করে তাদের নিজস্ব বাহিনী আর স্থানীয় উপজাতিগুলো থেকে সংগৃহীত নতুন সৈন্য। উপজাতি লোকগুলো খারাপ না… বাবর তাদের ঘোড়ার পিঠে সওয়ার অবস্থায় খড়ের নিশানায় তীর ছুঁড়তে বা বর্শা দিয়ে দ্রুত বেগে ঘোড়া দাবড়ে তরমুজ আর ভেড়ার মাথা বিদ্ধ করতে দেখে ভাবে…কিন্তু কে জানে তাদের ভাগ্যে কি অপেক্ষা করছে?

অনেক রাত বাবর ভ্রাম্যমাণ বণিকদের ঝুলেপড়া মুখের অবিশ্বাসী শ্রোতাদের সামনে বিচিত্রসব প্রাণীর গল্প বড়াই করে বলতে শুনেছে- এমনকি দানবের গল্প হিন্দুস্তানের বটগাছের অরণ্যে ঘুরে বেড়ায়। যাদের উধ্বমুখী শুড় অসতর্ক পথিকের গলা টিপে ধরে দম আটকে ফেলে। নগ্ন সাধু সন্ন্যাসীর দল, মুখে ছাই ভস্ম মাখা প্রতিমা পূজারীর দল, যারা অন্ধকার গুহায় বাস করে আর জীবনেই চুল দাড়ি কাটে না। বেশিরভাগটাই বালখিল্যসুলভ অর্থহীন…কিন্তু সে তারপরেও খারাপ কিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকতে চায়।

শেষ পর্যন্ত জানুয়ারী মাস আসতে সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। যদিও চারপাশে এখনও পুরু বরফ জমে আছে। কিন্তু শীতের ভয়ঙ্কর তুষারঝড় শেষ হয়েছে এবং তারা ঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারে।

ছয়দিন একটানা অগ্রসর হয়ে অগ্রসর হবার গতি নির্দিষ্ট করেছে ঢোলের শব্দ বাবর তার দু’হাজার সৈন্যের শক্তিশালী বহর নিয়ে খাইবার গিরিপথের মুখে এসে উপস্থিত হয়। কিন্তু সাতদিনের দিন, সূর্য যখন মাথার উপরে ক্রমশ রুক্ষ্ম হয়ে ওঠা ভূপ্রকৃতি থেকে রঙের স্পর্শ শুষে নিচ্ছে, বাবরের মনে হয় সে ঠিক তার সামনে ডানদিকের পাহাড়ে কিছু একটা নড়াচড়া দেখতে পেয়েছে। সে তীক্ষ্ণ চোখে সেদিকে তাকিয়ে থেকে থামবার নির্দেশ দেয়।

“কি ওটা?” বাবুরীর কথার মাঝেই পাহাড়ের নিচের ঢাল বেয়ে নুড়ি পাথর গড়িয়ে পড়ার শব্দ হয়।

“আমি জানি না। আমি সারির চারদিকে রক্ষামূলক বেষ্টনীতে প্রহরী নিয়োগ করেছি। তারপরেও গুপ্তঘাতক কিভাবে বেষ্টনীর ভিতরে প্রবেশ করেছে? চলো আমরা সামনের পাহাড়ে উঠে ভালো করে দেখি…”

বাবর তার ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নামে। “তোমরা তীর তৈরি রাখো, আর আমাদের রক্ষা করো।” সে তার দেহরক্ষীদের উদ্দেশ্যে বলে। বাকিরা সবাই আমাদের সাথে এসো।”

কয়েক মিনিট পরে, বাবর জনমানবহীন, বিরাম পাথুরে চূড়ার দিকে হতাশ চোখে তাকিয়ে থাকে। কিছু নেই, খালি ফাঁকা সব। মানুষ বা পশুর পাল যাই থাকুক পগাড় পাড় হয়ে গিয়েছে। তারপরে সে আবার দূরবর্তী কিনার থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ার আওয়াজ পায়। সে আড়াআড়ি দৌড়ে গিয়ে বাদামী জোব্বা আর ঢোলা পাজামা পরিহিত একজনকে নুড়ি পাথরের উপর দিয়ে পাগলের মতো পিছলে পালিয়ে নেমে যেতে দেখে। বাবর নিমেষে তার ধনুক নামিয়ে, লোকটাকে লক্ষ্য করে একটা তীর ছুঁড়ে মারে। লোকটা চিৎকার করে উঠে এবং পাহাড়ের পাদদেশে পাথুরে ভূমিতে কোনোমতে লুকিয়ে পড়ে।

পেছনে বাবুরী আর দেহরক্ষীর দলকে নিয়ে বাবর পাথরের উপর দিয়ে পিছলে নিজের শিকারের পেছনে ধাওয়া করে। পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছে বাবর লোকটা আধা দৌড়ে আধা হেচড়াতে হেচড়াতে পাথরের মাঝ দিয়ে এগিয়ে যেতে দেখে। তীরটা ডান বাহুতে কাঁধের ঠিক নিচে বিদ্ধ হয়েছে। দ্রুত দৌড়ে বাবর তার কাছে পৌঁছে একটা লাফ দিয়ে লোকটাকে নিয়ে পাথরের উপরে আছড়ে পড়ে। শীঘ্রই তার দেহরক্ষীর দল এসে উপস্থিত হয় এবং লোকটাকে বেঁধে ফেলে।

বাবর উঠে দাঁড়িয়ে নিজের আলখাল্লা থেকে ধূলো ঝাড়ে। “তুমি কে?”

“পিখী, গাগিয়ানিসদের সর্দার…” লোকটা হাঁফাতে হাঁফাতে বলে।

“তুমি এখানে কি করছিলে?”

পিখীর চোখ- পাহাড়ী বিড়ালের মতো অনেকটা দেখতে- পিটপিট করে। কিন্তু সে যদি মিথ্যা বলতে চেয়েও থাকে কিন্তু সেটা অবান্তর ভেবে বিরত থাকে। “গিরিপথের দিকে আপনাদের গতিবিধির উপর নজর রাখছিলাম।”

“আর সেটা তুমি কেনো করছিলে?”

“এখানে পাঠানরা থাকে যারা লুটপাটের মতো কাফেলার সন্ধান দিতে পারলে আমাকে আর আমার লোকদের পুরস্কৃত করে। গত বছর ফসল ভাল হয়নি। তার উপরে শীতকালটাও দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে…আমার লোকেরা কখনও সচ্ছল ছিল না। কিন্তু এবছর আমি যদি লুটপাটের সন্ধান না দিতে পারি তবে আমাদের সবাইকে না খেয়ে থাকতে হবে।”

“আমি একজন সুলতান, আমার সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছি… উটের বহর নিয়ে আসা কোনো হোতকা সওদাগর না।”

“আমি কি ব্যাটার গলা ফাঁক করে দেবো?” বাবুরী কোমর থেকে খঞ্জর বের করে গুপ্তচরদের স্বাভাবিক শাস্তি কার্যকর করতে প্রস্তুত।

“না…আমার মাথায় আরেকটা ভালো বুদ্ধি এসেছে।”

বাবর আবার পিখীর দিকে তাকায় যে সম্ভবত সর্দার হিসাবে মৃত্যুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছে। “তুমি এই পাহাড় ভালো করে চেনো আর তুমি বাঁচতেও চাও?”

“হ্যাঁ অবশ্যই দুটোই চাই- আর তাছাড়া আমি আপনার নিরাপত্তা বেষ্টনী অনায়াসে অতিক্রম করেছি, তাই না?”

“তোমার জীবন বাঁচাবার বিনিময়ে তুমি গিরিপথের আশেপাশে তোমার মিত্রদের খবর পাঠাবে যে, আমি সুলতান বাবর গিরিপথ দিয়ে আসছি। আমাকে যদি কোনো গোত্র আক্রমণ করার দুর্মতি দেখায় তবে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে…আর তুমি আমাদের পথপ্রদর্শক হবে। কোনো ধরণের ঝামেলা পাকাবার চেষ্টা করলে আগে তুমি মারা পড়বে। পরিষ্কার বোঝাতে পেরেছি?”

*

পিখীকে বখশ দেবার সিদ্ধান্ত লাভজনক প্রতিপন্ন হয়। তিনটা লম্বা যাত্রার মাধ্যমে সে পুরো বহরটাকে খাইবার গিরিপথের ববফাবৃত, জনশূন্য আঁকাবাঁকা পাথুরে খাঁজের ভিতর দিয়ে পার করে নিয়ে আসে। জামের মাটির তৈরি বসতবাটির বসতিতে তারা নেমে আসতে বাতাস ততক্ষণে উষ্ণ হয়ে উঠেছে এবং আরো তিনদিনের ক্রমাগত যাত্রা তাদের সিন্ধুর কাছে পৌঁছে দেয়। বাবর প্রশস্ত নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। বরফ গলা পানিতে এতটাই পূর্ণ হয়ে আছে যে, দু’তীর ছাপিয়ে তার স্রোতধারা বয়ে চলেছে। তার পৃথিবী আর হিন্দুস্তানের উষ্ণ রহস্যময় ভূমির মাঝে সীমানা চিহ্নিত করে এই নদীটা বয়ে চলেছে…

“এটাই তাহলে সিন্ধু নদী?” বাবুরী তার পাশে একটা গাট্টাগোট্টা খোঁজা করা ঘোড়ায় উপবিষ্ট। যা পানি খাবার জন্য অস্থির ভঙ্গিতে মাথা নাড়াচ্ছে।

“হ্যাঁ।” বাবর প্রমত্তা নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে থাকে তার মাঝের পূর্বেকার উল্লাস অনেকটাই কমে এসেছে। আমরা এখানে নদী অতিক্রম করতে পারবো না। আমাদের বেশিরভাগ ঘোড়া আর মালপত্রের দশা তাহলে আর দেখতে হবে না… আমরা সর্বসান্ত হব। পিখীকে আমার কাছে পাঠাও। আমার লোকদের লুটপাটের সামান্য সুযোগ অন্তত আমার দেয়া উচিত।”

দশ মিনিট পরে আদিষ্ট লোকটা তার সামনে হাজির হয়, মাথার খয়েরী মখমলের টুপি তার হাতে ধরা।

“আমরা এখানে নদী পার হতে পারবো না। আমাকে হয় পানি কমা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, নতুবা এমন একটা স্থান খুঁজে পেতে হবে যেখানে আমাদের ঘোড়াগুলো নিরাপদে সাঁতরে ওপারে যেতে পারবে।”

পিখী কাঁধ ঝাঁকায়। “নদী এ বছর বেশ প্রমত্তা, দেখতেই পাচ্ছেন। পানি কমতে কমতে তাও কয়েক সপ্তাহের ব্যাপার। ততোদিন অন্যকোনো জায়গা দিয়ে অতিক্রম করা অসম্ভব ব্যাপার।”

“নৌকার বন্দোবস্ত? নদীতে কোনো জেলে দেখছি না কেন?”

“মাঝি ছিলো, সুলতান কিন্তু গিরিপথ দিয়ে আপনার আগমনের সংবাদ পেয়ে দেখতেই পাচ্ছেন ব্যাটারা নৌকা নিয়ে ভেগে গিয়েছে…”

বাবর গালবকে। “নদীর পানি কমার অপেক্ষা থাকার সময়ে আমরা এপার দিয়ে আর কোথায় যেতে পারি?”

“কোহাট এখান থেকে দু’দিনের যাত্রা পথ। শস্য আর গবাদিপশুতে সমৃদ্ধ একটা বসতি।” পিখীকে ধূর্ত দেখায়। “সেখানের বাসিন্দারা আমার জাত শত্রু। গত বছর গ্রীষ্মে পাহাড়ে তারা আমার গ্রামে হামলা করেছিলো। আমার লোকদের খুন করে, মেয়েদের তুলে নিয়ে যাবার সময়ে আমাদের গবাদিপশুর পালও তাড়িয়ে নিয়ে যায়। তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারলে আমার ভালোই লাগবে।”

“আমাদের সেখানে নিয়ে চলো, তারপরে তুমি মুক্ত।”

*

এই নিয়ে দশবার, বাবর নিজের আহাম্মকির জন্য গাল দেয়। মাত্র এপ্রিল মাস, কিন্তু এখনই সূর্যের উত্তাপ তাকে আর তার লোককে পাগল করে তুলেছে। বাতাসের আর্দ্রতায় বৃষ্টির প্রতিশ্রুতি যা স্থানীয় লোকদের মতে কয়েকদিনের ভিতরে বৃষ্টি হয়ে ঝরতে শুরু করবে। বর্মের নিচে তারা ঘেমে অস্থির হতে থাকে।

এটা সত্যি, গত কয়েক সপ্তাহ পশ্চিমে ক্রমাগত আফগান উপজাতিদের পাহাড়ী এলাকা আর তাদের পাথরের তৈরি আশ্রয়স্থলে হামলা- সাঙগারস ঈগলের বাসার মতো যা তারা পাহাড়ের উঁচুতে সতর্কতার সাথে নির্মাণ করে সাফল্যজনক বলে প্রতিয়মান হয়েছে। কাটা মুণ্ডের কয়েকটা স্তূপ তৈরি হতেই বেশিরভাগ গোত্রের লড়াইয়ের শখ উবে গিয়েছে এবং অন্তত দশজন সর্দার তাদের প্রথা অনুযায়ী চার হাতপায়ে ভর দিয়ে, মুখে ঘাস নিয়ে তার প্রতি আনুগত্যের শপথ নিয়েছে। যার মানে “আমি এখন আপনার গরুর মতো। আমার সাথে আপনার যা ইচ্ছা আচরণ করতে পারেন।”

কিন্তু সে কেবলই ভেড়া, গরু, উট, চিনি, সুগন্ধি কন্দ আর কাপড়ের গাইট লুট করতে পেরেছে। তার লোকেরা আপাতদৃষ্টিতে সন্তুষ্ট। কিন্তু কাবুল থেকে এতো হ্যাপা সামলে কয়েক হাজার লোক আর অগণিত ভারবাহী পশু নিয়ে আসাটা বাবরের কাছে অপব্যয় বলে মনে হয়। তার আরও অসন্তুষ্টির কারণ ইত্যবসরে সিন্ধু নদীর পানি বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি। যার ফলে নদী অতিক্রম করে হিন্দুস্তানের গভীরে অভিযান শুরু করতে পারে। উত্তরের সীমানা বরাবর পাহাড়ী আর সমতলের লোকদের বশ মানানো তার কাছে মর্যাদাহানিকর বলে প্রতিয়মান হতে আরম্ভ করেছে। অবশ্য এসব সত্ত্বেও এবারের অভিযানে একটা উদ্দেশ্য অন্তত হাসিল হয়েছে, কপালের ঘাম চোখে গড়িয়ে পড়ার আগে মুছতে মুছতে বাবর ভাবে। তার সৈন্যদের একটা মহড়া হয়ে গেলো। সেই সাথে তার নিজেরও-একটা বড় অভিযানের প্রস্তুতি হিসাবে।

সে এখন তার লোকদের লম্বা সারি, পেছন পেছন আসা ভারবাহী ঘোড়া, গাধা আর উটের বহর গজনী নদী বরাবর উত্তর-পশ্চিম দিকে বেঁকে গিয়ে সওয়ারন গিরিপথের দিকে এগিয়ে চলেছে। যা তাদের পুনরায় পাহাড়ের মাঝ দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। আল্লাহতা’লা সহায় থাকলে তারা শীঘ্রই কাবুলের দেখা পাবে এবং উত্তরের পাহাড় থেকে বয়ে আসা শীতল বাতাসের পরশ তাদের শুষ্ক, রোদেপোড়া ত্বকে অনুভব করবে। সেখানে পৌঁছে সে আবার নতুন করে পরিকল্পনা করবে।

“ওটা কি?” বাবুরীর তীক্ষ্ণ চোখ দিগন্তের কাছে কিছু একটা দেখতে পায়। ঠিক তাদের মুখের সামনে একটা বিশাল কমলা রঙের গোলকের মতো। সূর্য অস্ত যাবার কারণে ঠিকমতো দেখা যায় না। কিন্তু বাবর তার ঘোড়ার লাগাম জিনের সাথে বেঁধে দু’হাত দিয়ে চোখের সামনে একটা আড়াল তৈরি করে। সেও কিছু একটা দেখতে পায়- আলো পড়ে খুব সম্ভবত ধাতব কিছু একটা চমকাচ্ছে। কিন্তু তারা আরও সামনে এগিয়ে আসতে দেখা যায় আকাশ আর দিগন্তের মাঝে ঝুলে থাকা পানির একটা বিশাল বিস্তার।

পানির উপরিভাগে লালচে আলো এই আছে এই নাই ভঙ্গিতে চমকায়। সম্ভবত অস্তমিত সূর্যের প্রতিফলন। না…বাবর তার পাশে বাবুরীকেও অসাধারণ দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থেকে আঁতকে উঠতে শোনে। হাজার হাজার লম্বা পায়ের লাল পালকের পাখি তাদের ডানা ঝাপটাচ্ছে, আকাশে উড়তে প্রাণবন্ত আকাশের গায়ে রক্তের একটা ঝাপটার মতো দেখায় তাদের। ভয়ঙ্কর সুন্দর একটা দৃশ্য।

গরমের তাণ্ডব সত্ত্বেও, বাবর উত্তেজনায় কেঁপে উঠে…দক্ষিণের ভূখণ্ডের চমক এখনও তার জন্য শেষ হয়নি। পাখিগুলোর মতোই, সেও এলাকাটা ত্যাগ করছে কিন্তু তাদের মতোই সে আবার ফিরে আসবে। আর মানুষ তখন সে দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠবে।

৩.২ এক সৌভাগ্যসূচক জন্ম

১৬. এক সৌভাগ্যসূচক জন্ম

গ্রীষ্মের দাবদাহ কাবুলের দূর্গপ্রাসাদের নিচে অবস্থিত তৃণভূমির ঘাস পুড়িয়ে সোনালী বর্ণে পরিণত করেছে। তার ক্লান্ত ঘোড়ার খুরের নিচের মাটি শক্ত হয়ে আছে। হ্রদের পানির পরিমাণ কমে গিয়েছে এবং কাদার ফাটা আস্তরণের মাঝে সবুজ শ্যাওলার শুকনো দাগযুক্ত একটা স্তর কিনারায় দেখা যাচ্ছে পানিতে কেমন একটা পচা গন্ধ। প্রায় পাঁচ মাস অনুপস্থিতির পরেও অবশ্য তার চিন্তার কেন্দ্রে কেবলই তার আম্মিজান আর নানীজানের ভাবনা ঘুরপাক খায়। তাদের কাছে হিন্দুস্তানের সীমান্তে তার অভিযানের অভিজ্ঞতার কথা শোনাতে সে ব্যাকুল হয়ে আছে। বাবর তার সেনাপতিদের ছাউনি ফেলার আদেশ দিয়ে ভারবাহী পশুগুলোর পিঠ থেকে বোঝা নামাতে বলে। সেসব বিতরণ না করা পর্যন্ত পাহারা দেবার। বন্দোবস্ত করে সে দূর্গের র‍্যাম্প দিয়ে দুলকিচালে ঘোড়া নিয়ে প্রাসাদের দিকে এগিয়ে যায়।

অন্ধকারাচ্ছন্ন তোরণদ্বারের নীচ দিয়ে আলোকিত আঙ্গিনায় উপস্থিত হতে, দূর্গ প্রাকারের উপর থেকে বাদ্যবাদকের দল প্রথা অনুসারে তাকে বাজনা বাজিয়ে ফিরে সুলতানের মতো অভিবাদন জানায়। বাবর তার রেকাব থেকে পা নামিয়ে নিয়ে। সন্তুষ্টির সাথে একটা শ্বাস নেয়। এখানে ফিরে আসতে পেরে তার ভালোই লাগছে। তারপরে সে হন্তদন্ত হয়ে বাইসানগারকে এগিয়ে আসতে দেখে তাকে অভিবাদন জানাতে। তার মুখের অভিব্যক্তি দেখেই বাবর বুঝতে পারে কোনো একটা দুঃসংবাদ তার জন্য অপেক্ষা করছে। “কি হয়েছে বাইসানগার? কি ব্যাপার?”

“সুলতান আপনার আম্মিজান অসুস্থ। এখানকার লোকেরা যাকে ছোপযুক্ত জ্বর বলে। পূর্বের সওদাগরদের সাথে এখানে এসেছে, তিনি সেই জ্বরে আক্রান্ত। শহরে রোগ একটা মহামারীর সৃষ্টি করেছে এবং প্রাসাদের জেনানামহলেও ছড়িয়ে পড়েছে। হাকিম তার রক্তপাত ঘটিয়েছে কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। এখন তরমুজের রস দিয়ে তার রক্ত শীতল করতে তিনি চেষ্টা করছেন, কিন্তু তার প্রাণসংশয়ের আশঙ্কা করছেন আমাদের হেকিম…তার দু’জন পরিচারিকা ইতিমধ্যে মারা গিয়েছে একজন কয়েক ঘণ্টা আগে।”

“এই রোগটা কখন ছড়িয়েছে?”

“প্রায় এক সপ্তাহ আগে। তিনি জ্বরের ঘোরে কেবল আপনার কথাই বলছেন। আমি গুপ্তদূত পাঠিয়েছিলাম আপনার খোঁজে। কিন্তু আপনি কেনদিক থেকে ফিরে আসবেন- কবে নাগাদ ফিরে আসবেন সে সম্বন্ধে কোনো ধারণা না থাকায়। আল্লাহতালার অশেষ মেহেরবানী আপনি ফিরে এসেছেন…”

একটা শীতল অসাড়তা বাবরের দেহ আর মনকে যেনো আড়ষ্ট করে তুলে। স্তম্ভিত। অবস্থায় সে ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে, লাগাম এক সহিসের হাতে ধরিয়ে দিয়ে আঙ্গিনা অতিক্রম করে ধীরে ধীরে জেনানামহলের দিকে এগিয়ে যায়। সে লম্বা রূপালী আস্তরণযুক্ত গাঢ় নীলকান্ত মণির কারুকাজ করা দুই দরজা বিশিষ্ট প্রবেশদ্বারের দিকে এগিয়ে যেতে যেখান দিয়ে তার আম্মিজানের কামরার দিকে যাওয়া যায়। বাবরের পুরো শরীর কাঁপতে থাকে এবং সে অসুস্থবোধ করে।

তার শৈশবের কথা মনে পড়তে থাকে। পোষা বেজীকে বিরক্ত করার জন্য খানজাদা তাকে মারায় খুতলাঘ নিগার তাকে তিরস্কার করছেন। আম্মিজান পালকযুক্ত ফারগানার মুকুট তার মাথায় পরিয়ে দিচ্ছেন আর তার সদ্যমৃত আব্বাজানের আলমগীর তার হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে তার নামে খুতবা পাঠ হবার অব্যবহিত আগে। কিন্তু এসব ছাপিয়ে তার মুখে ফুটে থাকা কষ্ট সে দেখতে পায়। যখন সে তাকে বলেছিলো খানজাদাকে সাইবানি খানের হাতে সমর্পিত করতে হবে। অসুস্থতার অনেক আগেই সেই ঘটনা তার মাঝ থেকে জীবনীশক্তি শুষে নিয়েছে… নিজের উপর ক্রোধে বাবর মাথা নিচু করে।

পরিচারিকার দল দরজা খুলে দিতে, অসুস্থ কামরার বদ্ধ, ভারী বাতাস- ঘামের সাথে চন্দনকাঠ, কর্পূরের মিশ্রিত গন্ধ- তার নাকে এসে ধাক্কা দেয়। সে ভেতর থেকে বীণার বিষাদময়, মিষ্টি সুর ভেসে আসছে শুনতে পায়। সে ভেতরে প্রবেশ করতে এসান দৌলতকে তার অসুস্থ মেয়ের পাশে বীণার উপর মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখে। “নানীজান…”

তিনি মুখ তুলে তাকান। কিন্তু বাজনা সাথে সাথে বন্ধ না করে রাগটা শেষ করে বীণাটা তার পাশে অধোমুখে, কষ্ট চেপে রাখা মুখের ফাতিমার হাতে দেন। “সঙ্গীত যেনো বেচারীকে কিছুটা স্বস্তি দেয়। আমি ভেবেছিলাম তোমার বোধহয় আসতে দেরি হয়ে যাবে। হাকিম নিদান দিয়ে দিয়েছে…”

বাবর তার আম্মিজানকে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে থাকতে দেখে। তার মুখে আর গলার কাছের যতোটুকু সে দেখতে পায় লাল রাগী চাকায় ভর্তি হয়ে আছে। সে তার কাছে এগিয়ে যেতে চাইলে এসান দৌলত হাত নেড়ে তাকে দূরে থাকতে বলে। “জ্বরটা মারাত্মক। বিশেষ করে অল্পবয়স্কদের ক্ষেত্রে। বাবর তার দিকে তাকায়। সে আরেক পা সামনে এগিয়ে আসলে, এসান দৌলত তার বয়সের তুলনায় অনেক ক্ষিপ্র গতিতে উঠে দাঁড়িয়ে তার দিকে ধেয়ে এসে বাবরের বাহু আঁকড়ে ধরে। “হাকিম তার সাধ্যমত চেষ্টা করছেন আর আমিও আছি। আমরা এখন কেবল অপেক্ষা আর দোয়া করতে পারি। এখন তুমিও যদি আক্রান্ত হও তবে কি কোনো লাভ হবে? তোমার আম্মিজান আর আমার জন্য তুমি যা করতে পারো, সেটা হলো বেঁচে থাকা, বহাল তবিয়তে।”

“কিন্তু আমি কি কিছুই করতে পারি না?”

“একটা জিনিস আছে করবার মতো। তোমার আম্মিজানের যখন জ্ঞান থাকে তখন সে সামান্যই কথা বলে। কিন্তু জ্বরের ঘোরে সে অনেক কিছুই বলে। জ্বরের ঘোরে সে কেবল আল্লাহতালার কাছে একটা কথা জানতে চেয়েছে, তার কোনো নাতি নেই কেন, কেন তোমার একজন উত্তরাধিকারী নেই। আমি তাকে বলতে চাই, তুমি আবার বিয়ে করবে এবং সুস্থ হয়ে সে তোমার আত্মজদের কোলে নিয়ে খেলতে পারবে। তার আত্মা হতাশায় ছেয়ে গেছে। লড়াই করার কোনো ইচ্ছাই তার ভিতরে কাজ করছে না। আমি তাকে কিছু একটা বলতে চাই যা তার ভিতরে বাঁচার আশা জাগিয়ে তুলবে…”

“আপনি তাকে বলবেন সে যা বলবে আমি করতে রাজি আছি। আম্মিজানকে বলবেন যে, তাকে অবশ্যই সুস্থ হয়ে উঠতে হবে, আমার বিয়ের ভোজসভায় নাচবার জন্য এবং তার অবশ্যই অসংখ্য নাতিনাতনি হবে… তাকে বলবেন আমার এখনও তাকে দরকার আছে…”

এসান দৌলত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপরে-সন্তুষ্ট হয়ে তার হাত ছেড়ে দেয়। “এখন যাও। আম্মিজানের শরীরের খবর আমিই তোমাকে জানাবো।”

অশ্রু দমন করে কোনোমতে বাবর নিজের কক্ষে ফিরে আসে। এসান দৌলত আর তার মায়ের কথায় যুক্তি আছে- সে তার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না। এখন সে যখন কাবুলে থিতু হয়ে বসেছে, তখন আরেকজন স্ত্রী গ্রহণ করতে বাধা কোথায়: তার প্রজারাও নিশ্চয়ই উত্তরাধিকারী দেখতে চায়। আর তাছাড়া বিয়ের ফলে মৈত্রী জোরদার হয়। কিন্তু সেসব এখন অপ্রাসঙ্গিক তার আম্মিজানের সুস্থ হয়ে উঠবার জন্য যদি তাকে দশটা স্ত্রী গ্রহণ করতে হয়, বিশটা সে তাই করবে…।

পরবর্তী কয়েকটা দিন মন্থর গতিতে কেটে যায়। বাবর সংবাদের অপেক্ষায় থাকে। সবসময়ে একই খবর সে শুনতে পায়- “অবস্থা অপরিবর্তিত আছে।” অভিযান থেকে ফিরে আসবার পরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তার মনোযোগ দাবি করেছিলো। উপজাতি সর্দার যারা তার সাথে অভিযানে গিয়েছিলো তারা নিজেদের প্রাপ্য ভাগ। নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছে এবং অভিযানে প্রাপ্ত সম্পদ ভাগ করে দেবার জন্য সে বাবুরীকে দায়িত্ব দিয়েছে। তার দরবারের মুনশীরা শীঘ্রই হিসাব রাখতে শুরু করবে, কতগুলো ভেড়া বা ছাগল, কত গাঁইট উলের কাপড় এবং কত বস্তা শস্য বিলিয়ে দেয়া হয়েছে।

বাবরকে অবশ্য এছাড়া নিজের লোকদের কথাও ভাবতে হবে। তাদের অবশ্যই মর্যাদা আর পদবী বাড়িয়ে পুরস্কৃত করতে হবে এবং সেই সাথে লুটের মালের ন্যায্য অংশ দিতে হবে।

সে বাবুরীকে অশ্বশালার নতুন আধিকারিক করেছে-আলী ঘোসতকে বরখাস্ত করার পরে থেকেই পদটা খালি ছিলো। তার রসিকতা আর গর্ববোধ দুটোই ভালোভাবে আলোড়িত হয়েছে এর ফলে। তার অবর্তমানে কাবুলের দায়িত্বে থাকা আর এতোদিন বিশ্বস্ততার সাথে দায়িত্বপালনকারী বাইসানগারকে নিয়ে সে কি করবে ভেবে পায় না। তার যদি নিজের মেয়ে বা ভাস্তি থাকত তাহলে সে তাদের মাঝ থেকে একজনকে খুশি মনে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে পারতো। সমরকন্দের এক প্রাচীন অভিজাত পরিবারের সন্তান বাইসানগার এবং বাবর যদি কখনও সেখানে ফিরে যেতে পারে তবে ব্যাপারটা সেখানকার লোকদের প্রীত করবে। সে যতোই বিষয়টা নিয়ে ভাবে ততোই সেটা তার মনে ধরে… বাইসানগারকে সে কদাচিত নিজের পরিবার সম্পর্কে বলতে শুনেছে এবং নিশ্চিতভাবেই তার পরিবারের কেউ সমরকন্দ থেকে তার সাথে আসেনি। অবশ্য তার মানে এই না যে, তার কেউ নেই। এতো ঝামেলা না করে জিজ্ঞেস করলেই ল্যাঠা চুকে যায়। বাইসানগারকে নিজের কামরায় ডেকে পাঠিয়ে সে সরাসরি কাজের কথা পাড়ে। “আমি আপনার কাছে বিশেষভাবে ঋণী। আপনি সমরকন্দে যে মুহূর্তে আমারে কাঁধ আঁকড়ে ধরেছিলেন তারপরে থেকে আপনি সর্বদা আমার প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছেন…”

‘সুলতান, আমি তৈমূরের বংশের প্রতি বরাবরই বিশ্বস্ত থেকেছি এবং আগামীতেও থাকবো।’

“আর এজন্যই আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাই। আমার আম্মিজানের ইচ্ছা আমি শীঘ্রই আবার বিয়ে করি। আমিও ঠিক করেছি তাই করবো- সেটা দেখে যাবার জন্য যদি তিনি বেঁচে নাও থাকেন। তারপরেও এবং বাইসানগার মেয়েটা যদি আপনার বংশের কেউ হয়, তবে আমি নিজেকে সম্মানিত মনে করবো। আমি এই কথাটা বলবার জন্যই আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম…”।

বাইসানগারকে বিস্মিত দেখায়। বাবর এই প্রথমবারের মতো তার ধীর-স্থির, আবেগবর্জিত, সামান্য রসকষহীন সেনাপতিকে- যে লোকটা, তার ডান হাত পঙ্গু হওয়া সত্ত্বেও বাম হাতের বরাভয়ে বিপক্ষের যোদ্ধাদের মাঝ দিয়ে অনায়াসে সাঁতার কাটার মতো পিছলে বের হয়ে যেতে সক্ষম- ডাঙায় তোলা মাছের মতো খাবি খেতে দেখা যায়।

“সুলতান, আমার একটা মেয়ে আছে, কিন্তু গত দশ বছর আমি তাকে দেখিনি। আমার স্ত্রী তাকে প্রসব করার সময়ে মারা যায়। সাইবানি খান আপনার চাচাজানকে হত্যা করার পরে এবং সমরকন্দের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত মনে হতে, আমি হিরাতে আমার ভাইদের কাছে নিরাপত্তার স্বার্থে মেয়েটাকে পাঠিয়ে দেই। তার এখন সতের বছর বয়স হয়েছে।”

“তার নাম কি?”

“সুলতান, তার নাম মাহাম।”

“আপনি কি তাকে আনবার জন্য লোক পাঠাবেন? আপনি কি আমার সাথে তার বিয়েতে সম্মতি দেবেন?”

“সুলতান, সেটা আমার সৌভাগ্য।”

“আমি তাকে আমার একমাত্র স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে পারবো না। মৈত্রীর বন্ধন গড়ে তোলার জন্য আমি বাধ্য হব আরও স্ত্রী গ্রহণ করতে। কিন্তু বাইসানগার আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি যে, তার সাথে সবসময়ে ভালো ব্যবহার করবো, আর সে আমার প্রথম স্ত্রীর মর্যাদা লাভ করবে।”

*

“সুলতান, উঠুন।” বাবর তার কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করতে সহজাত প্রবৃত্তির বশে বালিশের নিচে রাখা খঞ্জরের বাঁট আঁকড়ে ধরে। তারপরে বুঝতে পারে একটা নারী কণ্ঠ তার ঘুম ভাঙিয়েছে। মেয়েটার হাতে ধরা মোমের আলো থেকে নিজের চোখ আড়াল করে বাবর ফাতিমার গোলাকার সাদাসিধে মুখ দেখতে পায়।

প্রাসাদ রীতিনীতির-এবং নিরাপত্তার দিক থেকেও, একটা বিরল বিচ্যুতি বলতে হবে ঘটনাটাকে। তারপরে তার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন আরেকটু হলে বন্ধ হবার মতো উপক্রম হয়। ফাতিমা এতো রাতে নিশ্চয়ই আম্মিজানের কক্ষ থেকে আসছে। সে নিজের নগ্নতার ব্যাপারে একেবারে বেখেয়াল অবস্থায় বিছানা থেকে লাফিয়ে নামে। “কি হয়েছে? আম্মিজান কেমন আছেন…?”

ফাতিমা কাঁদছে, কিন্তু সেটা বেদনার না আনন্দের অশ্রু। “বিপর্যয় অবশেষে কেটে গেছে- হাকিম বলেছেন এ যাত্রা মালকিন বেঁচে যাবেন।”

বাবর এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে, আল্লাহতালার কাছে শুকরিয়া আদায় করে। তারপরে ফাতিমার রক্তিম বিভ্রান্তি খেয়াল করে এবং সে চোখ সরিয়ে রেখেছে দেখে। বাবর ত্রস্ত হাতে নিজের আলখাল্লা খুঁজে। সে আলখাল্লাটা কোনোমতে জড়িয়ে নিয়ে, সরু অলিন্দ দিয়ে দৌড়ে গিয়ে, দ্বাররক্ষীদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে, রূপার কারুকাজ করা দরজা হুড়মুড় করে খুলে মায়ের কক্ষে প্রবেশ করে। পক্ক কেশ হেকিম জিহ্বা দিয়ে প্রতিবাদসূচক শব্দ করে। কিন্তু বাবর তখন সেসব দেখার মতো অবস্থায় নেই। এসান দৌলত তার মেয়ের মুখ তখন একটা ভেজা কাপড় দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছিলেন এবং তিনি যখন তাকে সম্ভাষণ জানাবার জন্য ঘুরে তাকান, বাবর তার। চোখেমুখে স্বস্তির একটা অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে।

বাবর এবার তার আম্মিজানের দিকে তাকায়। তার একদা মসৃণ ত্বক বৃত্তাকার লাল দাগে ফেটে আছে এবং ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল এবং তার দিকে তাকাতে দৃষ্টির উজ্জ্বলতা আরো বৃদ্ধি পায়। খুতলাঘ নিগার দুহাত প্রসারিত করতে, বাবর তার শয্যার পাশে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাকে আলিঙ্গন করার সুযোগ আম্মিজানকে দেয়। টের পায় সে আবার তার সেই ছোট্ট বাবরে পরিণত হয়েছে এবং গভীর স্বস্তির একটা রেশ তাকে আপ্লুত করে তোলে।

*

পাঁচ হাজার উট আর দু’হাজার খচ্চরের কাফেলার কাছ থেকে যেমনটা প্রত্যাশিত ঠিক তেমনটাই ধূলোর মেঘ পশ্চিমাকাশে ঘনিয়ে উঠতে দেখা যায়। এই বিশাল জটলার মাঝেই কোথাও মাহাম আছে। হিরাত থেকে পূর্বে তার যাত্রা নিরাপদ করার লক্ষ্যে সে যদিও রক্ষীবাহিনী পাঠিয়েছিলো। কিন্তু সে পরে সিদ্ধান্ত নেয় বৃহত্তর নিরাপত্তার স্বার্থে রক্ষীবাহিনী কাফেলার সাথেই যোগ দেবে।

রাতের আগেই তার হবু স্ত্রীর দূর্গে পৌঁছে যাবার কথা। পুরু গালিচা পেতে, রেশমের পর্দা দিয়ে সজ্জিত করে, সবোকৃষ্ট গোলাপজল আর চন্দনকাঠের সুবাসে তার জন্য নির্ধারিত কক্ষ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সেই সাথে সেখানে রাখা হয়েছে তার বিয়ের উপহার- আয়েশাকে সে যে ভারী সোনার কণ্ঠহার আর বাজুবন্ধ দিয়েছিলো। এবং সে যেটা আবার ফেরত পাঠিয়েছিলো সেসব না। তার কোষাগারের সর্বোত্তম নমুনা। মূল্যবান পাথরখচিত সূক্ষ্ম কারুকাজ করা সোনার মণিহার আর মানতাসা। আচ্ছা মাহাম এখন কি ভাবছে? সে কল্পনা করতে চেষ্টা করে। নিজের বাবার সাথে, যাকে সে এতো বছর দেখেনি তার সাথে মিলিত হতে পারার কারণে উৎফুল্ল? শীঘ্রই যাকে স্বামী হিসাবে বরণ করতে হবে, সে বিষয়ে একটা শঙ্কা তার ভিতরে কাজ করছে…?

সূর্যাস্ত যাবার ঠিক আগে, বাবর পুনরায় দূর্গপ্রাকারে দাঁড়িয়ে গোধূলির ধূসর আলোয় তাকিয়ে দেখে, কাবুলের দূর্গপ্রাসাদের তোরণদ্বার অতিক্রম করে পাত্রীপক্ষ ভেতরের আঙ্গিনায় প্রবেশ করে। কাফেলাটার সাথে আগত বিশেষ যত্ন নিয়ে পর্দা দেয়া গরুর গাড়ির বহরের দিকে বাইসানগার উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে এগিয়ে যায়। যেখানে তার মেয়ে আর তার পরিচারিকার দল ভ্রমণ করছে। বাবর ভাবে সেও যদি দেখতে পেতো! কিন্তু বিয়ের অনুষঙ্গ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অগত্যা তাকে অপেক্ষা করতেই হবে…।

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেদিন থেকে এক সপ্তাহ পরে শাহী জ্যোতিষের গণনা করা শুভ দিনে শুরু হয়। একটা মখমলের চাঁদোয়ার নিচে বাবর আর মাহম পাশাপাশি এসে বসলে মোল্লার দল তাদের দাম্পত্যজীবন যেনো সুখের হয় সেজন্য মোনাজাত করে। নববধূ বেচারা হাঁসের নীল ডিমের মতো রঙের রেশমের কারুকাজ করা কয়েক পরত নেকাবের আড়ালে ঢাকা পড়ে রয়েছে। যেটা আবার মূল্যবান পাথর সজ্জিত সোনার ঝালর দেয়া টুপির নিচে থেকে বের হয়ে এসেছে। যা যখন সে মাথা নাড়ছে কাঁপছে আর ঝলসে উঠছে- বিয়েতে খুতলাঘ নিগারের উপহার। বাবর নববধূকে বিয়ের ভোজসভায় নিয়ে যাবার জন্য তার হাত ধরতে, কোনো ধরণের দ্বিধা, কোনো ধরণের অনীহা অনুভব করে না বরং একধরণের উৎসুক কাঁপুনী যা কামনাতাড়িত একটা অনুভূতিতে তাকে জারিত করে তোলে।

সেই রাতে, বাসরঘরে, বাবর পরিচারিকাদের দেখে তাকে নিরাভরণ করতে। বরাবরের মতো স্বল্পবাক আর অমায়িক, কিন্তু সেই মুহূর্তে বাবরের মনে হয় মিচকে শয়তান, বাইসানগার ইচ্ছে করেই কখনও বলেনি তার মেয়ে এতো সুন্দরী। কিন্তু পরমুহূর্তে তার মনে হয় আহা বেচারা (এখন বেচারা!) মেয়ে যখন ছোট ছিলো তখন ত কে দেখেছে তারপরে আর দেখেনি তিনি (?) কিভাবে জানবেন? নববধূর ডিম্বাকৃতি মুখে বাদামী বর্ণের পটলচেরা চোখই কেবল নজর কাড়ে। আর তার কালো চুলের ঢল কোমর ছাড়িয়ে নিতম্বের ভাঁজ স্পর্শ করেছে। তার দেহাবয়ব ক্ষুদ্রাকৃতি কিন্তু সুগঠিত। মুক্তার মত দীপ্তিময় বর্তুলাকার, উন্নত স্তনযুগল, সুরু কোমর আর কটিদেশের জটিল বাকের দখল বুঝে নিতে গিয়ে বাবর মালিকানার অচেনা আবেগ আর যেকোনো মূল্যে সেটা রক্ষা করার আকাঙ্ক্ষায় আপ্লুত হয়ে উঠে। নববধূকে কেউ আঘাত করতে পারে এই ভাবনাটার কল্পনা তাকে এতোটাই ক্রোধান্বিত করে তোলে যে সে বাধ্য হয় নিজেকে মনে করিয়ে দিতে যে তেমন কোনো সম্ভাবনার উদয় হয়নি আর কখনও হবেও না- তাকে আগলে রাখার জন্য সে সবসময়ে তার পাশে থাকবে…

পরবর্তী দিনগুলো যেনো আঙ্গুলের ফাঁক গলে গড়িয়ে পড়া পানির মতো বয়ে যায়। আয়েশার সাথে তার দৈহিক মিলনের পুরোটাই ছিলো শারীরিক চাহিদা নির্ভর। অন্য কোনো কিছুর কোনো ভূমিকা সেখানে ছিলো না। ফারগানার বাজারে আর বেশ্যালয়ে সে আর বাবুরী যখন বিচরণ করেছে তখন ইয়াদগারের মতো মেয়েদের সাথে তার ফষ্টিনষ্টি কখনও ভালো কোনো শিকার বা উপাদেয় খাবারের চেয়ে বেশি কিছু ছিলো না- কেবল ফুর্তিতে সময় কাটানোই তখন মূখ্য ছিলো।

মাহামের কাছে যাবার জন্য এসান দৌলতকে আজকাল আর চৌকিদারের ভূমিকা নিতে হয় না। আয়েশার কাছে তাকে পাঠাতে তিনি একটা সময়ে যে মূর্তি ধারণ করতেন। অবশ্য অনেক সময়ে এমনও হয়েছে, সদ্য মিলন শেষে, মাহামের নিখুঁত স্তনে কালো চুলের বাধভাঙা ঢল তাকে নিমেষেই কঠিন করে তুলেছে। তাকে তখন আলতো করে নিজের কাছে টেনে এনে, তার অরক্ষিত কটিদেশের মসৃণ বাঁকে হাত বুলিয়ে, দুষ্টু মেয়েটার অধীর আকুতি অনুভব করেছে এবং দ্রুত হয়ে উঠা নিঃশ্বাসের শব্দ তাকে বলে দিয়েছে আবেগের তাড়না দু’পক্ষেই প্রবল।

*

“নববধূ কেমন আছেন? হাকিমের কাছে আপনি এখনও যাননি দেখে আমি বেশ অবাক হয়েছি। আমি শুনেছিলাম জ্বালাপোড়া আর নববিবাহিতদের গোপন অঙ্গের ঘর্ষণজনিত ক্ষত নিরাময়ে ধন্বন্তরী একটা মলম তার কাছে আছে…”

“নববধূ ভালোই আছেন…”

“খোদা, আপনার কি শরীর খারাপ, কি প্রশ্নের কি উত্তর…?” বাবুরী কপট চোখ কপালে তুলে বলে।

“হ্যাঁ।” বিয়ের মাসখানেক হতে চলেছে, কিন্তু বাবর এখনও মাহামের প্রতি তার অনুভূতির কথা আলোচনা করতে অনীহা বোধ করে। এমন কি বাবুরী যার সাথে সে সবকিছু আলোচনা করে, তার সাথেও না। আলাপের মোড় ঘুরিয়ে দিতে আগে থেকেই তার মাথায় ঘুরতে থাকা বিষয়টা সে উত্থাপন করে। “কাবুলের অভিজাত মহল থেকে আমি আরেকজন স্ত্রী গ্রহণ করতে চাই। প্রজারা সেটাই চায় এবং এর ফলে তাদের সাথে আমার একটা আত্মীয়তার সম্পর্কের সৃষ্টি হবে।”

“আপনি কাউকে পছন্দ করেছেন?”

“আমি এসব ঝামেলায় নেই। আমি আম্মিজান আর সেই নাচুনে বুড়ির উপরে দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েছি। দু’জনে শাহী জেনানামহলে সম্ভাব্য উপযুক্ত পাত্রীদের ডেকে এনেছেন…”

“আর আপনার পক্ষ হয়ে পছন্দের ভীষণ দায়িত্ব পালন করছেন?”

“বাহ্, তোমার দেখি ভালোই বুদ্ধি খেলছে আজকাল। আর তারা অতঃপর সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন। গতরাতে নানীজান মেয়েটার নামও আমাকে বলেছিলো…কিন্তু বাবুরী এবার ধানাইপানাই ছাড়ো, চাঁদ? তোমারও বিয়ে করার সময় হয়েছে? তুমি কি সন্তানের পিতা হতে চাও না?”

“আট বছর বয়স থেকে আমি একা…বন্ধন, বিয়ে এসব ভাবনা আমাকে আকৃষ্ট করে না। আমি শয্যায় বৈচিত্র পছন্দ করি এবং সেই সাথে এটা পছন্দের যে স্বাধীনতা নিয়ে আসে।”

“তুমি তোমার যতোগুলো স্ত্রী চাও গ্রহণ করতে পারো। তুমি এখন আর সেই গরীব লোকটি নও…”

“আপনি বুঝতে পারবেন না। পরিবার, উত্তরাধিকার, সাম্রাজ্য- এসব আপনার জগতের অবিচ্ছেদ্য একটা অংশ। বহু আগে আরম্ভ হওয়া একটা গল্পের অংশ হিসাবে আপনি নিজেকে দেখতে অভ্যস্ত এবং আপনার মৃত্যুর পরেও যা চলতে থাকবে আর সেখানে আপনার ভূমিকা সবসময়ে স্মরণ করা হবে। মানুষ আমাকে মনে রাখলো কিনা, সেটা আমি খোঁড়াই পরোয়া করি। তারা কেন আমাকে মনে রাখবে?”

“সব মানুষই চায় পৃথিবীর বুকে নিজের ছাপ রেখে যেতে। উত্তরসূরীরা যাতে তার কথা বলার গর্ব অনুভব করে…এটা কেবল রাজার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য না…”

“তাই নয় কি? আমার মতো লোকেরা ইতিহাসের গর্ভে দ্রুতই হারিয়ে যায়। আমরা ইতিহাসের উপাদান হিসাবে তুচ্ছ। আমি একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করি…আপনার ঐ রোজনামচায় আপনি আমার বিষয়ে কি লিখেছেন…” সাম্প্রতিক সময়ে কি আমার কথা আদৌ উল্লেখ করেছেন?” বাবুরীর ঘন নীল চোখ ঝিকিয়ে ওঠে।

বাবর সহসা বুঝতে পারে রাজার ভাগ্য, গৌরব বা খ্যাতির কোনো সম্পর্ক নেই বিষয়টার সাথে। ব্যাপারটা তারচেয়ে অনেক সরল কিছু একটা। বাবুরী, বেচারা বাবুরী আসলে ঈর্ষান্বিত। সে ছিলো বাবরের ঘনিষ্ট সহচর, বিশ্বস্ত বন্ধু, একমাত্র ব্যক্তি যার কাছে বাবর কিছুই এতোদিন গোপন করেনি। মাহামের প্রতি বাবরের আবেগ সেটা বদলে দিয়েছে। সত্যি কথা বলতে, গত কয়েক সপ্তাহ বাবুরীর কথা তার সামান্যই মনে পড়েছে। আর বাবুরী- প্রাপ্তবয়স্ক একটা লোক, যুদ্ধক্ষেত্রে তার মতো পরীক্ষিত আর প্রশংসিত যোদ্ধা- এতে মনে কষ্ট পেয়েছে। বাজারের সেই অরক্ষিত বাচ্চা ছেলেটা, যে উচ্ছিষ্টের জন্য লড়াই করেছে এবং বাহুবলের উপরে নির্ভর করে বেঁচে থেকেছে। তর্জনগর্জন করা নিজের প্রতি অতি আস্থাবান লোকটার খোলসের নিচে আজও বেঁচে আছে।

বহুবছর আগে ওয়াজির খান বাবুরীর সাথে তার ক্রমবৃদ্ধিমান অন্তরঙ্গতার বিষয়ে তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন এবং সেই পোড়খাওয়া লোকটা নিজের ঈর্ষা আর অপাংক্তেয় অনুভূতির কথা অকপটে স্বীকার করেছিলেন। ওয়াজির খানের আহত অভিমান প্রশমিত করতে সে যে কথাগুলো বলেছিলো, বাবর দেখতে পায় আজও সে ঠিক সেই কথাগুলোই আবার বলছে। “তুমি আমার সবচেয়ে প্রধান ইচকিস, আমার নিকটতম, সবচেয়ে বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা আর আমার একমাত্র বন্ধু। এই কথাটা কখনও ভুলে যেও না।” সে আলতো করে বাবুরীর কাঁধ স্পর্শ করে।

বাবুরী কাঁধের হাতটার দিকে তাকায় কিন্তু সেটা স্পর্শ থেকে মোচড় খেয়ে সরে যায় না। বাবর ভাবে, ঠিক যেনো একটা গোয়াড় স্ট্যালিয়নকে বশ মানানো। বশ মানার যতো বছরই হোক বন্যতার সামান্য ছিটেফোঁটা সব সময়েই রয়ে যায়। কিন্তু বাবুরীর কোমল হয়ে চোখের দৃষ্টি বলে দেয় তার কথাগুলো মলম হয়ে জায়গামতো প্রলেপ দিয়েছে। “বেশ, এবার তাহলে আপনার পরবর্তী স্ত্রীর কথা বলেন। কে সেই ভাগ্যবতী?” এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বাবুরী জানতে চায়।

“বাহলুল আইয়ুবের নাতি, গুলরুখ। তার বয়স উনিশ বছর এবং আমার নানীজান আমাকে বলেছেন, আমার অনেক সন্তান সে গর্ভে ধারণ করতে পারবে।”

“আচ্ছা তাহলে সেই আহাম্মক গ্রান্ড উজির আপনার শ্বশুর হচ্ছেন।”

“হ্যাঁ।”

“বেশ তাহলে তো হয়েই গেলো বাবাজীর ক-কথার জ্বালায় আর টিকতে হবে না কাউকে। আর আপনিও তার কথা এড়িয়ে যাবার অ-অজুহাতও পাবেন না।”

“সে একটা প্রাচীন সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান। তৈমূরের সেনাবাহিনী যখন কাবুলে এসেছিল তখন তারই এক পূর্বপুরুষ কাবুলের গ্রান্ড উজিরের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো।”

“তাই তো বলি, তৈমূর কেনো বেশিদিন এখানে অবস্থান করেননি। তা হবুবধূ দেখতে কেমন?”

বাবর কাঁধ ঝাঁকায়। “গুলরুখ? আমি তাকে দেখিনি। সময় হলে আমি আমার দায়িত্ব পালন করবো। কিন্তু মাহাম সবসময়ে আমার প্রথম স্ত্রীর মর্যাদা পাবে…”

*

১৫০৮ সালের এক শীতের সন্ধ্যাবেলা। বাবর দূর্গপ্রাসাদের প্রাকার বেষ্টিত ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। তার নিঃশ্বাস অনবরত একটা কুয়াশার মেঘের জন্ম দিচ্ছে। সে তার পরণের আলখাল্লাটা আরও ভালো করে জড়িয়ে নেয়। কাবুলের আকাশ বছরের এই সময়ে প্রায়ই যেমন হয়ে থাকে- নির্মেঘ এবং তারার দল এমন উজ্জ্বলভাবে চমকায় যে তাকিয়ে থাকতে যেন কষ্ট হয়। এক ঘণ্টা আগে, সে ঠিক এখানে দাঁড়িয়ে থেকে শাহী জ্যোতিষের সাথে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো। “সন্তান যদি আজ রাতে ভূমিষ্ট হয়, গ্রহমণ্ডলী যখন মীনের বলয়ে অবস্থান করছে, সে আপনার বংশের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনবে।” বৃদ্ধ লোকটা বলে, গ্রহ-নক্ষত্রের মানচিত্রের গোছা আঁকড়ে ধরা তার বয়সের ছোপ পরা হাত ঠাণ্ডায় কাঁপতে থাকে। বাবর তাকে আর তার সব পরিচারকদের যেতে বলে- এমনকি বাবুরীকেও। কি হচ্ছে না জানা পর্যন্ত সে একা থাকতে চায়। ছাদের এই স্থানে তাকে অন্তত মাহামের যন্ত্রণাক্লিষ্ট আর্তনাদ শুনতে হচ্ছে না…তার প্রসব বেদনার পনের ঘণ্টা অতিক্রান্ত হতে চলেছে। নিজের সবটুকু আত্মসংযম খরচ করে সে তার কাছে ছুটে যাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখে। আর সেটা একজন পুরুষের জন্য শোভনীয় কোনো স্থানও না। তার নানীজান দূর্গ মাথায় তুলে তাকে ধমকে কামরা থেকে বেরিয়ে যেতে বলে, সবকিছু মেয়েদের হাতে ছেড়ে দিতে বলেন। সে মাহামের মুখটা, বিশাল দরজা তার মুখের উপরে বিকট শব্দে বন্ধ হয়ে যাবার আগে একঝলকের জন্য দেখতে পায়। ঘামে ভেজা, ব্যথায় কুঁচকে আছে, কামড়ে ধরা ঠোঁট রক্তাক্ত।

“ছেলে বা মেয়ে যাই হোক কোনো ব্যাপার না। কিন্তু মাহাম যেন বাঁচে,” সে নিজেকে প্রার্থনা করতে দেখে। “আর কাউকে যদি ত্যাগ স্বীকার করতে হয় তবে সেটা যেন মাহাম না হয়…” হেকিম বেশ কয়েকদিন ধরেই সতর্ক করে আসছে যে বাচ্চার আকৃতি বেশ বড়- সম্ভবত মাহামের ক্ষুদ্র অবয়বের তুলনায় একটু বেশিই বড়।

গুলরুখও গর্ভবতী। তার সন্তান ভূমিষ্ট হতে এখনও পাঁচ মাস বাকী। কিন্তু এখনই সে তরমুজের মতো ফুলে উঠেছে এবং তাকে চমৎকার স্বাস্থ্যবতী দেখায়। কিন্তু গর্ভধারণের ফলে মাহাম কেবল ক্রমাগত অসুস্থই হয়েছে। সে প্রথমদিকে কিছুই খেতে পারেনি এবং গুলরুখের মতো বিকশিত হবার বদলে তার মুখ ক্রমশ শুকিয়ে গিয়েছিলো। তার লম্বা-পাপড়িযুক্ত চোখের নিচের পেলব ত্বকে কালশিটে পড়ার মতো বৃত্তাকার কালো দাগ যেনো কেউ এঁকে দিয়েছে।

বাইসানগারও মাহামের অবস্থা দেখে শঙ্কিত হয়ে উঠেন। সেই তার একমাত্র জীবিত সন্তান। তার জন্যও কঠিন সময় গিয়েছে…

“সুলতান…দ্রুত আসেন…” মাহামের এক পরিচারিকা হাঁফাতে থাকে এবং দম ফিরে পাবার জন্য আকুপাকু করার ফাঁকে কোনোমতে কথা বলে। সে পাথরের চৌকাঠ-যার ভিতর দিয়ে সে উপস্থিত হয়েছে সেটা ধরে নিজেকে সুস্থির করতে চেষ্টা করে। বাবরের মনে হয় সে বুঝি এখানে নেই, অনেক দূর থেকে সবকিছু দেখছে…”সুলতান, আপনার একটা পুত্র সন্তান হয়েছে…”

“কি বললে তুমি…?”

“রাণীমা, আপনার স্ত্রী একটা পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছে…তিনিই আমাকে বলেছেন আপনাকে খুঁজে বের করতে…আর বলতে যে সব কিছু ঠিক আছে…”

“আর আমার স্ত্রী…সে কেমন আছে?”

“তিনি ভয়ানক ক্লান্ত। কিন্তু তিনি আপনাকে খুঁজছেন।” এই প্রথমবারের মতো পরিচারিকাটা তার মুখের দিকে তাকায় এবং সুলতানের চেয়ে একজন উদ্বিগ্ন পিতাকে দেখতে পেয়ে সে তার ভীরুতা ঝেড়ে ফেলে হাসে। “সুলতান, সত্যি বলছি, সব কিছু ঠিক আছে এবং আপনি রাণীমার কাছে যেতে পারেন।”

পরিচারিকাটা বাঁকানো সিঁড়ি বেয়ে জেনানামহলের দিকে দ্রুত হেঁটে যায়। কিন্তু বাবর সাথে সাথে তাকে অনুসরণ করে না। মুহূর্তের জন্য সে নির্মল আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে, সৌভাগ্যের প্রতীক ক্যানোপাস খুঁজে। হিন্দুকুশের বরফাবৃত গিরিপথের উপরে সে যে মুহূর্তে তারাটাকে আলোকবর্তিকার মতো চমকাতে দেখেছিলো, তখন থেকে নিশ্চিতভাবে প্রতি পদক্ষেপে তারাটা তাকে পথ দেখিয়ে চলেছে। বাবর তারাটা খুঁজে পেতে, নিরবে নিজের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।

***

সাদা পাগড়ী আর কালো আচকান পরিহিত মোল্লার দল তাদের প্রার্থনা শেষ করতে বাবর বাইসানগারের কোলে নীল মখমলের গালিচায় নিধিরাম সর্দারের মতো শুয়ে থাকা তার পাঁচদিনের পুত্র সন্তানের মাথার উপরে ধরে থাকা জেড পাথরের থালা থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বর্ণ আর রৌপ্য মুদ্রা ছিটিয়ে দেয়।

“তুমি আমার প্রথম ভূমিষ্ট আর প্রিয়তম পুত্র সন্তান। আমি তোমার নাম রাখলাম, হুমায়ুন, সৌভাগ্যবান একজন। আল্লাহতা’লার কৃপায় তোমার জীবন সৌভাগ্যপূর্ণ হোক, আর আমার বংশে তোমার হাত ধরে সম্মান আর মর্যাদার আগমন ঘটুক।” নিজের আত্মজের কুচকানো ত্বকের ক্ষুদে মুখের দিকে তাকিয়ে যে স্নেহপরায়ণতা তার ভিতরে জন্ম নেয়, যার সাথে বাবরের আগে কখনও পরিচয় ছিলো না। সে পুত্র সন্তান কামনা করে অনেক পুত্র সন্তান- বংশ পরম্পরায় যারা তার রক্ত বহন করবে। কিন্তু পিতৃত্বের স্বাদ কেমন সেটা ভাববার অবকাশ সে আগে পায়নি। সে ভাগ্যবান যে, তাকে এখন কোনো বক্তৃতা করতে হবে না- তার কণ্ঠস্বর হয়তো তার বশে থাকতো না, বা চোখের কোণে জমে উঠা অশ্রুও সে সংবরণ করতে ব্যর্থ হতো।

বাবর তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাবুরীর হাতে শূন্য থালাটা দিতে হুমায়ুনের ক্ষীণ কান্নার শব্দ শোনা যায়। বাচ্চাটাকে মখমলের গালিচা থেকে তুলে সে দু’হাতে উঁচু করে ধরে। যাতে তার সব অমাত্য আর সর্দাররা তাকে দেখতে পায় এবং তাদের নতুন শাহজাদাকে স্বীকার করে।

বাবরের দরবার হলের রাজকীয় মঞ্চের ডান দিকে দেয়ালের অনেক উঁচুতে মার্বেলের জাফরির ভিতর দিয়ে মাহাম, তার আম্মিজান আর নানীজান তাকিয়ে রয়েছে। তারা তাকে প্রথাগত উপহার সামগ্রী গ্রহণ করতে দেখে সৌভাগ্যের প্রতীক বলে কথিত রৌপ্য মুদ্রা, রেশমের বাণ্ডিল, অভিজাত লোকদের দেয়া ঘোড়া আর শিকারী কুকুরের দল। উপজাতি সর্দারদের নিয়ে আসা ভেড়া আর ছাগলের পাল।

হুমায়ূন মধ্যরাতে ভোজসভা আর আনন্দ উদযাপন শেষ হবার অনেক আগেই মাহাম আর তার দাই-মায়ের, উজ্জ্বল চোখের এক তরুণী যে সদ্য নিজের ছেলেকে দুধ ছাড়িয়েছে, তত্ত্বাবধায়নে ফিরে যাবে। তৈমূরের বংশের কারো দাইমা হতে পারার সম্মানই আলাদা, আর সেটা সবাই হতে চায়। সে তার নতুন প্রাপ্ত দায়িত্ব বেশ ভালোভাবেই পালন করবে।

পুরুষ অতিথিদের হাসির শব্দে তার কল্পনার রেশ ছিন্ন হয়। তখনও বাইসানগারের কোলে থাকা মখমলের নীল গালিচায়, হুমায়ূন প্রাণপণে মোচড়াতে মোচড়াতে হলুদ প্রস্রাবের একটা বৃত্তচাপ নির্গত করে।

“সে যেনো এভাবেই আমাদের সব শত্রুকে মুতে ভাসিয়ে দেয়!” তুমূল হৈচৈয়ের ভিতরে বাবর চেঁচিয়ে উঠে বলে। কিন্তু সে এর সাথে আরও কিছু বলতে চায়। ঠিক এখনই কথাগুলো বলবার তার ইচ্ছা ছিলো না, কিন্তু কেনো জানি একটা নতুন সংকল্প- তাকে তাড়িত করে। সে ইঙ্গিতে সবাইকে চুপ করতে বলে।

“আপনারা সবাই আজ এখানে সমবেত হয়েছেন আমার ছেলের সম্মানে, আমার বংশের শুভাকাক্ষি হিসাবে- যা তৈমূরের বংশ। আমার সময় হয়েছে তৈমূরের পাদিশাহ উপাধি, পৃথিবীর ঈশ্বর, গ্রহণ করবার। আমি, আমার ছেলে হুমায়ূন এবং আমার এখনও ভূমিষ্ঠ না হওয়া সন্তানেরা, আমাকে এর যোগ্য বলে প্রতিপন্ন করবে এবং আমাকে যারা সমর্থন জানাবে সবাই এই গৌরবের অংশীদার বলে গণ্য হবে।

৩.৩ চেঙ্গিসের যোগ্য তনয়া

১৭. চেঙ্গিসের যোগ্য তনয়া

ছয় মাস পরের কথা। বাবর তার সোনার গিল্টি করা সিংহাসনে নির্বিকার মুখে বসে আছে। তার চারপাশে সব অমাত্য অবিচল ভঙ্গিতে শক্ত হয়ে বসে আছে। এরই মাঝে বাবুরী তার বয়ে আনা বস্তাটা বাবরের সামনে রাখে।

“সবাইকে দেখাও।”

বাবুরী তার নীল রঙের পরিকর থেকে খঞ্জরটা বের করে, বস্তার সেলাই খুলে ভেতরে কি আছে দেখায়: রক্ত জমাট বাঁধা দুটো ছিন্ন মস্তক, এবং বেগুনী-নীল ছোপ ধরা। যার পচনক্রিয়া অনেক আগেই শুরু হয়েছে। পরিক্ষয়ের পূতিগন্ধে বমি উদ্রেককারী মিষ্টি মিষ্টি আর পচা- পুরো ঘরটা ভরে যায়। গলার কাছের এবড়োথেবড়ো পেশী, যেখানে একটা ভোঁতা কিছু দিয়ে গলা থেকে মাথাটা কেটে নেবার চিহ্ন স্পষ্ট বোঝা যায়, বলে যে মাথাগুলো যাদের তারা সহজে মৃত্যুবরণ করেনি। স্যাইয়েদিমের একদা সুদর্শন মুখাবয়ব, তরুণ নিশান-বাহক, বাবর নিজে যার হিমদষ্ট হাত কর্তনের সময়ে তাকে চেপে ধরে রেখেছিলো, তার ফুলে ওঠা মুখ কোনোমতে চেনা যায়। তার ফুলে টসটস করতে থাকা ঠোঁট বেঁকে গিয়ে পুঁজ জমে পেকে ওঠা মাড়িতে তখনও সন্নিবিষ্ট সাদা দাঁতের সারি দেখা যায়। অন্য মাথাটা যে কার বাবর সেটা ঠিক চিনতে পারে না- বাইসানগারের অধীনস্ত এক সৈনিক-কিন্তু স্যাইয়েদিমের মতো তার মৃত্যুরও বদলা নেয়া হবে।

মৃত সৈন্য দু’জনকে বাবরের একটা বার্তা খোরাসানের সুলতানের কাছে তার অনেক দূরের আত্মীয়, যার দরবার হিরাতে অবস্থিত। সেখানে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। সেই বছর কাবুলে সবচেয়ে বড় সওদাগরী কাফেলা নিয়ে আসা বণিকেরা বলাবলি করছিলো, হিন্দুকুশের অপর প্রান্তে সাইবানি খান আবার একটা বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করেছে। কেউ কেউ বলে কাবুলের পশ্চিমে সমৃদ্ধ খোরাসান তার লক্ষ্য। আবার কারো মতে সে কাবুলেই হামলা করবে। বাবর খোরাসানের সুলতানকে সতর্ক করে বার্তাটা পাঠালেও, তাতে তাদের মাঝে মৈত্রীর একটা ইঙ্গিতও দেয়া হয়েছিলো। মুশকিল হলো বার্তাটা আদতে কোথাও পৌঁছায়নি….

ভেড়া চোর কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত একটা নিয়মতান্ত্রিক অভিযানের সময় কপালগুণে বাবুরী বার্তাবাহকদের ভাগ্যে কি ঘটেছে সেটা জানতে পারে। তাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত গ্রামের মাটির বাড়িগুলো তল্লাশি করার সময়ে সে বার্তাবাহকদের ছিন্ন মুণ্ডগুলো একটা বিশাল মাটির পাত্রে নীল ডুমো মাছির ভনভন ভীড়ের মধ্যে খুঁজে পায়। তাদের সাথে দেয়া দশজনের রক্ষীবাহিনীর বাকি সবার মাথাও কাছেই পড়ে রয়েছে। গ্রামের মোড়লের কাছ থেকে বাবুরী যতোটুকু জানতে পারে, সেটা হলো কফুরীরা তাদের হত্যা করার আগে কেবল পৈশাচিক আনন্দ লাভ করতে তাদের উপরে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে। তাদের কারো কারো জিহ্বা কেটে ফেলা হয়, কিন্তু বার্তাবাহকদের একজনের সাথে তারা যা করেছে সেটা শুনে। সে কেঁপে উঠে। সেই বেচারা ধরা পড়ার সময়ে সংঘটিত যুদ্ধে পেটে তরবারির আঘাত পেয়েছিলো। কুফরী জানোয়ারগুলো এরপরে তার পেটে হাত ঢুকিয়ে ক্ষতস্থানটা আরো চিরে সেটার ফাঁক দিয়ে আংশিক নাড়ীভুড়ি বের করে আনে এবং সেই বার্তাবাহক যখন যন্ত্রণায় চিৎকার করছে তখন একটা খুটির সাথে তার সেই আংশিক বের হওয়া নাড়ীভুড়ি বেঁধে দিয়ে বেচারাকে বাধ্য করে খুঁটির চারপাশে ঘুরে ঘুরে নাচতে। সে ঘুরতে থাকলে বাকী নাড়ীভূড়িও পেট থেকে নাটাইয়ের সুতা খোলার মতো বেরিয়ে আসতে থাকে, যতক্ষণ না মৃত্যু এসে তার যন্ত্রণার নিবৃত্তি ঘটায়।

বাবুরী সর্দারকে সেখানে কবন্ধ করার উদগ্র বাসনা অনেক কষ্টে দমন করে। সর্দারের গোড়ালীর সাথে কব্জি দেহের পেছনে টেনে মুরগী বাঁধার মতো বাঁধে। আর বাকী কুফরী যাদের সে খুঁজে পায় সবাইকে খেদিয়ে নিয়ে কাবুলের দূর্গপ্রাসাদে। নিয়ে আসে। সে মাত্র কয়েকঘন্টা আগে এসে পৌঁছেছে। প্রাসাদের নিচের অন্ধকার কারাকক্ষে কে তাদের এমন নৃশংস কাজ করতে প্ররোচিত করেছিলো, সেটা তাদের। দিয়ে কবুল করাতে বেশি কসরত করতে হয়নি।

বাবর নির্বিকার কণ্ঠে তার অমাত্যদের উদ্দেশ্যে কথা বলে। “আমি আমার সামনে আপনাদের উপস্থিত হতে বলেছি একটা ষড়যন্ত্রের সাক্ষ্যপ্রমাণ শুনতে। এই ছিন্ন। মস্তকগুলো খোরাসানের সুলতানের কাছে পাঠানো আমার বার্তাবাহকদের। তাদের হত্যা করা হয়েছে এমন একজনের আদেশে যাকে আমি বিশ্বাস করতাম। যার ধমনীতে আমারই রক্ত বইছে…তাকে নিয়ে আসা হোক।”

প্রহরী পরিবেষ্টিত অবস্থায় মির্জা খানকে প্রবেশ করতে দেখে উপস্থিত সবাই আঁতকে উঠে। তৈমূরের বংশধর হিসাবে তাকে রেয়াত করে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়নি। তার পোশাক-পরিচ্ছদ বা অবয়বের ভিতরে ভীতিকর বা বিনয়ী কোনো কিছুই প্রকটিত নয়: তার গলায় একটা কলাই করা হার ঝুলছে এবং মুক্তার কারুকাজ করা পরিকরের সাহায্যে পরণের বেগুনী রঙের রেশমের জোব্বা দিয়ে তার গাট্টাগোট্টা শরীর বেশ ভালোভাবেই আবৃত। তার অভিব্যক্তি ঔদ্ধত্যপূর্ণ।

মির্জা খান গলিত মাথা দুটোর দিকে একবার তাকিয়ে দেখে, যেনো সেগুলো তার লাল নাগরায় লেগে থাকা ধূলিকণা ছাড়া কিছু না। নিজের হাত দিয়ে বুক স্পর্শ করে, কিন্তু আর কোনো কথা বলে না।

“আমার বার্তাবাহকদের যারা খুন করেছে পাহাড়ের কুফরী কুকুরের দল- তারা তাদের অপরাধের কথা কবুল করেছে। তারা আপনার নাম বলেছে মূল চক্রান্তকারী হিসাবে…”

“আমরা সবাই, কুচক্রী দলও বাদ যাবে না, নির্যাতনের মুখে অনেক কথাই স্বীকার করব…”

“কখনও কখনও সত্যি কথাটাও…তারা বলেছে বার্তাবাহকদের লাপাত্তা করার জন্য আপনি তাদের অর্থ দিয়েছেন- যাদের ভিতরে একজন কোনো এক সময়ে আপনার নিশান বাহক ছিলো- শিবার্তু গিরিপথে প্রবেশের পরে আপনি তাদের উপরে চড়াও হবার আদেশ দিয়েছিলেন এবং খোরাসানের সুলতানের কাছে আমার পাঠানো বার্তা যেটা তারা বহন করছিলো সেটা চুরি করতে বলেছিলেন। তাদের নাম খরচের খাতায় তুলে দিয়ে আপনি বলেছিলেন বন্দিদের সাথে তারা মর্জিমাফিক আচরণ করতে পারে। ব্যাটারা আহাম্মক বলেই নিজেদের অপকর্মের প্রমাণ হিসাবে কর্তিত মস্তকগুলো সংরক্ষণ করেছিলো…”

মির্জা খান অবজ্ঞার ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকায়। “কাফিররা মিথ্যা কথা আর ছলনার জন্য বিখ্যাত…”

“আমার অশ্বশালার প্রধান তাদের নগণ্য দ্রব্যাদির ভিতরে এটা খুঁজে পেয়েছে।” একজন পরিচারক বাবরের হতে ফুলের ছোপ তোলা রেশমের একটা বটুয়া ধরিয়ে দেয়। বটুয়াটার দড়ি খুলে বাবর ভেতর থেকে হাতির দাঁতের তৈরি টুকরো বের করে যার তলদেশে একটুকরো অনিক্স সংবদ্ধ রয়েছে। “আপনার সীলমোহর। মির্জা খান। যে শিল্পী আপনার নাম উৎকীর্ণ করেছে সে দারুণ একটা কাজ করেছে দেখেন কি পরিষ্কার করে আপনার নাম আর পদবী এখানে দেখা যাচ্ছে। ভাড়াটে গুণ্ডাদের কাছে ষড়যন্ত্রে নিজের সংযুক্তির প্রমাণ পাঠিয়ে আপনি বোকামী করেছেন। কিন্তু আমি সবসময়ে জানতাম আপনার ঘিলুতে হলুদ পদার্থ কম আছে…”

মির্জা খানের চেহারায় ভয়ের অভিব্যক্তি এবার ফুটতে শুরু করে। কুলকুল করে ঘাম তার সুগন্ধি মাখানো দাড়ি বেয়ে নামতে থাকে এবং বেগুনী রেশমের জোব্বার বগলের নিচে গাঢ় দাগ দ্রুত দৃশ্যমান হয়ে উঠে।

“আমি একটা ব্যাপার কেবল বুঝতে পারছি না, কেন?”

লাইলাকের একটা রুমাল দিয়ে মির্জা খান দ্রুত তার মুখ মুছে। কিন্তু কথা বলা থেকে বিরত থাকে।

“তুমি যদি আমার প্রশ্নের উত্তর না দাও, তবে আমি বাধ্য হব তোমাকে নির্যাতন করার আদেশ দিতে।”

“আপনি সেটা পারেন না- আমি তৈমূরের বংশধর, সম্পর্কে আপনার ভাই।”

“আমি পারি এবং প্রয়োজন হলে সেটা করবোও। তুমি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার সময়েই তোমার অধিকার হারিয়েছ।” বাবরের শীতল শব্দগুলো শেষ পর্যন্ত মনে হয় মির্জা খানের ঔদ্ধত্যপনা ঘুচিয়ে দেয়। সে বুঝতে পারে তার চারপাশে জাল ক্রমশ গুটিয়ে আসছে।

“সুলতান…” প্রথমবারের মত মির্জা খান তাকে এই উপাধিতে সম্বোধন করে।

“আমার সামনে আর কোনো পথ ছিল না। আমি যা করেছি বাধ্য হয়েই করেছি…”

“একজন মানুষের সামনে সবসময়েই বেছে নেবার সুযোগ থাকে। তুমি কার পক্ষের হয়ে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিলে?”

মির্জা খান সহসা বমি করতে শুরু করে। তার ঠোঁটের কোণে হলুদ বমির সরু একটা ধারা বের হয়ে এসে গড়িয়ে পড়তে শুরু করে, তার বেগুনী আচকানের দফারফা করে দেয়। সে মুখটা মোছে, মাথা তুলে করুণ দৃষ্টিতে বাবরের দিকে তাকায়। “আমরা একই রক্তের উত্তরাধিকারী, এটা ভুলে যাবেন না…”

“আমার সেটা মনে আছে আর আমি আজ সেজন্য লজ্জিত। আবার জানতে চাইছি কার কাছে নিজের মাথা বিক্রি করেছো?”

মির্জা খানকে দেখে মনে হয় সে আবার বমি করবে। কিন্তু সে বহুকষ্টে একটা ডোক গিয়ে এবং বিড়বিড় করতে থাকে।

“উত্তর দাও।”

“সাইবানি খান।”

বাবর নির্বাক তাকিয়ে থাকে। তারপরে সম্বিত ফিরে পেতে সে মঞ্চ থেকে লাফিয়ে নেমে এসে মির্জা খানের কাধ ধরে প্রচণ্ড ঝাঁকি দিয়ে তার মুখের উপরে চিৎকার করে ওঠে। “সেই উজবেক বর্বরটা, সাইবানি খানের সাথে তুমি হাত মিলিয়েছে আমাদের বংশের জানের শত্রু?”

“সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আমার যে জমিদারি সে দখল করেছে সেটা ফিরিয়ে দেবে। আপনার দরবারে শোভাবর্ধক হিসাবে না, সে আমাকে যথার্থ মর্যাদা দেবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। আমি তাকে জানিয়েছিলাম আপনি খোরাসানের সুলতানের সাথে মৈত্রী চুক্তি করার চেষ্টা করছেন। সে সেটা থামাতে চেয়েছিলো। সাইবানি খান প্রথমে খোরাসান, পরে আপনাকে আক্রমণ করবে বলে ঠিক করেছে, আমার সুলতান। সুলতান, আপনি আমাকে এখন তার বিরুদ্ধে গুপ্তচর হিসাবে নিয়োগ করতে পারেন…সাইবানি খান আমাকে বিশ্বাস করে। আপনার পছন্দমাফিক আমি যে কোনো বার্তা তাকে পাঠাতে পারবো…আমরা সম্ভবত তাকে এভাবে ফাঁদেও ফেলতে পারি।”

লোকটার এই নির্লজ্জ কাকুতি মিনতি তার নিঃশ্বাসের সাথে ভেসে আসা বমির গন্ধের মতোই বাবরের গা গুলিয়ে তোলে। সে তার কাঁধ ছেড়ে দিয়ে পেছনে সরে আসে। “এই বিশ্বাসঘাতককে আমার সামনে থেকে নিয়ে যাও এবং দূর্গ প্রকারের উপর থেকে মাথা নিচের দিকে করে তাকে ছুঁড়ে ফেলল। তাতেও যদি ব্যাটা না মরে, তবে আবার তুলে এনে আবার নিচে ছুঁড়ে ফেলবে। তারপরে তার শবদেহটা বাজারের আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবে যাতে চিল কুকুর তার লাশটা ভক্ষণ করে।”

“সুলতান বখশ দেন…” মির্জার পায়ের নরম চামড়ার নাগরা উষ্ণ হলুদ প্রস্রাবে ভিজে উঠে এবং ধীরে ধীরে পাথরের মেঝেতে একটা ছোটখাট জলাশয়ের জন্ম। দেয়। সে সহসা আবার বমি করে এবং বমির সাথে যোগ হওয়া নতুন আরেকটা গন্ধ বাবরকে বলে যে মির্জা খানের উদর আর তার নিয়ন্ত্রণাধীন নেই।

“বেল্লিকটাকে আমার সামনে থেকে নিয়ে যাও!” বাবর দরবারের প্রহরীকে চিৎকার করে আদেশ দেয়। “আমার আদেশ যেনো এখনই কার্যকর করা হয়।”

এক ঘণ্টা পরে, বাবর কাফিরদের প্রাণদণ্ডাদেশ কার্যকর করা দেখতে বের হয়। তার লোকদের সাথে হারামজাদারা এমন আচরণ করেছে যে, সে বিশ্বাসঘাতকদের জন্য সবচেয়ে পুরাতন আর ভীতিকর শাস্তি তাদের জন্য বরাদ্দ করেছে। শহরের দেয়ালের নিচে তাদের তীক্ষ্ণ কাঠের দণ্ড, যাকে অনেক স্থানে শূল বলে, তাতে বিদ্ধ করা হবে। নগরদূর্গে তাদের মরণ চিৎকার পৌঁছাবে না। সে এজন্যই কৃতজ্ঞ। মাহাম, খুতলাঘ নিগার বা তার নানীজান যেনো তাদের যন্ত্রণাক্লিষ্ট মরণ চিৎকার শুনতে না পায়। যদিও এখন সে ভাবে, এসান দৌলত সম্ভবত তার মতোই চোখের পলক না ফেলে পুরো ব্যাপারটা তাকিয়ে দেখতে পারবে।

মির্জা খানের প্রতি তার ক্ষোভ আর তার লোকদের সাথে এমন নির্মম নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনের জন্য কুফরীদের প্রতি তার ক্রোধের কারণে সে কোনো ধরণের করুণা প্রদর্শন করে না। সে তাকিয়ে দেখে সাজাপ্রাপ্ত লোকগুলোকে ন্যূনতম কাপড় পরিহিত অবস্থায় অপেক্ষমান শূলের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জল্লাদের দল তাদের জোব্বার উপরে চামড়ার তৈরি কালো আলখাল্লা জড়িয়ে রেখেছে- যা শীঘ্রই রক্তে লাল হয়ে উঠবে- মুরগী ধরার মতো একজন একজন করে বন্দিদের শূলে উঠাচ্ছে। কোনো কোনো বন্দির পায়ুপথে শূলের তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ প্রবিষ্ট করান হয়। আবার কাউকে শহরবাসীদের বুনো উল্লাসের ভিতরে শিককাবারের মতো আড়াআড়ি গাথা হয়। বাবর শহরবাসীর দোষ দেখে না- প্রতিবার যন্ত্রণাক্লিষ্ট দেহের নরম মাংসে তীক্ষ্ণ শূল গেথে গিয়ে রক্ত ঝিটকে বের হলে, সন্তুষ্টি ছাড়া সে আর কিছুই অনুভব করে না। সে মির্জা খানকেও একই শাস্তি পারলে দিতো- কেবল রাজপরিবারে জন্ম হওয়াতে বেজন্মাটা বেঁচে গেছে।

সেই রাতে বাবর একেবারে মনমরা হয়ে থাকে। হুমায়ূন আর তার সদ্য জন্ম নেয়া ভাই কামরানকে, যার মাথা ভর্তি ঝাড়র মতো কালো চুল একেবারে ড্যানডেলিয়ন ঔষধি গাছের পাতার মতো কোমল, পাশাপাশি শুয়ে থাকতে দেখেও-দু’মাস আগে গুলরুখের গর্ভে জন্ম নিয়ে এখনই বেশ শক্ত করে বাবরের বুড়ো আঙ্গুল আঁকড়ে ধরতে পারে- তার চিত্তচাঞ্চল্য ঘটে না। এমনকি মাহামের কামাতুর দেহের উষ্ণ আমন্ত্রণ সেদিন তার আসন্ন বিপদের পূর্বানুভব কাটাতে পারে না। সে প্রস্তুত থাকুক বা না থাকুক একটা ঝড় আসছে। গৌরবান্বিত বিজয় আর অমর খ্যাতি এবং পরাজয় আর বিস্মৃতির অতলে অখ্যাত মৃত্যু। কেবল তারই না তার পুরো পরিবারের, নির্ভর করছে তার সিদ্ধান্তের উপরে যা নিতে সে শীঘ্রই বাধ্য হবে…

*

এক মাস পরে, বাবরের পরিবারে বয়ে আসা দৈবদূর্বিপাক নিজের উপস্থিতি এমন এক আঙ্গিক থেকে জানান দেয় যা তার অসম্ভব কল্পনাতেও ছিলো না। শবযানের কাঠের পাটাতনে শুয়ে থাকা এসান দৌলতের মৃতদেহটা একেবারে বাচ্চা একটা মেয়ের মতো দেখায়। কর্পূর পানির তীব্র গন্ধ তার পরিচারিকার দল যা দিয়ে তাকে শেষবারের মতো গোসল করিয়েছে। তার মামূলী সুতির কাফন ভেদ করে যেনো উঠে আসে। বাবর ঝুঁকে তার নানীজানের মৃতদেহের দিকে তাকাতে, সে নিজের অশ্রু সংবরণ করতে পারে না। কিভাবে যেনো তার মনে হয়েছিলো নানীজানের মানসিক শক্তি আর একাগ্রতার বরাভয় বুঝি আজীবন সে লাভ করবে। কোনো শেষ ইচ্ছার কথা না বলে- না কোনো শেষ আদেশ, কোনো বিচক্ষণ পরামর্শ ছাড়াই ঘুমের ভিতরে সহসা এমন প্রশান্তিময় মৃত্যুর ধারণাটাই তার অগ্রহণযোগ্য অবাস্তব মনে হতে থাকে। কিন্তু গত কয়েক মাসের কথা চিন্তা করতে, এখন সে বুঝতে পারে অনেক আগে থেকেই তিনি তাকে ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছিলেন- অনিশ্চয়তা আর অস্পষ্টতা এবং এস্তব্যস্ততার একটা প্রবণতা যা আগে কখনও তার ভিতরে লক্ষ্য করা যায়নি। তার স্মৃতি কেমন যেনো বিক্ষিপ্ত আচরণ করছিলো- বাবরের শৈশবের কথা তিনি প্রাঞ্জল স্পষ্টভাবে বলতে পারতেন। কিন্তু কেউ যদি তাকে বেমক্কা প্রশ্ন করতে গতকাল তিনি কি করেছেন, তাহলেই অনিশ্চয়তার মেঘ এসে তাকে ঘিরে ফেলতো।

নানীজানকে ছাড়া জীবন সে কল্পনাই করতে পারে না। তাদের সবচেয়ে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে তিনিই পুরো পরিবারটার হাল ধরে ছিলেন। যুক্তি আর প্রজ্ঞা সর্বোপরি সাহস দিয়ে তিনি তাদের আগলে ছিলেন। শীঘ্রই সে তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রতিকূলতার মুখোমুখি হবে, আর এখনই তিনি চলে গেলেন। সে কিশোর বয়সে তার সাথে কথোপকথনের কথা ভাবে: “নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে কখনও ভয় পাবে না। সাহস নিয়ে তার মোকাবেলা করে, তাদের অর্জন করবে। মনে রাখবে, কোনো কিছুই অসম্ভব না…”।

বাবরের একটা ইশারায়, তার নানীজানের প্রিয় তিন পরিচারক- তিনজনের পরনেই তার মতো কালো শোকের আলখাল্লা- নিচু হয় এবং বাবরের সাথে, শবাধারের একটা পায়া কাঁধে নেয়। কাঁধের উপরে তুলে নিয়ে, তার মহলের অন্ধকার, বাঁকান সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে বয়ে নিয়ে খুতলাঘ নিগারের ফোঁপানির শব্দ, তাদের পেছন থেকে ভেসে আসে- উজ্জ্বল লাল কাপড়ে মোড়ানো ঘোড়ায় টানা গাড়ির সমতল পাটাতনে এনে রাখে। এসান দৌলত লাল রঙ পছন্দ করতেন, বলতেন এটা তার শ্রদ্ধেয় পূর্বপুরুষ: চেঙ্গিস খানের রঙ।

বাবর তার সেনাপতি, মোল্লার দল আর আমাত্যদের নিয়ে এসান দৌলতকে তার শেষ বিশ্রামের স্থলে বয়ে নিয়ে যাওয়া গাড়িটা অনুসরণ করে। সে তার আম্মিজানের সম্মতি নিয়ে তাকে পাহাড়ের ধারে তার ফুল, ফল আর ঝর্ণাধারায় সুশোভিত বাগানে সমাধিস্ত করবে বলে ঠিক করেছে। তাকে উর্বর অন্ধকার মাটির গর্ভে শেষবারের মতো শুইয়ে দিয়ে, তার আত্মার শান্তির জন্য মোনাজাত শেষ হতে বাবর অন্তেষ্টিক্রিয়ায় আগত লোকদের দিকে তাকায়। এখানে যিনি শায়িত আছেন, তিনি ছিলেন চেঙ্গিস খানের কন্যা। তার সাহসিকতা ছিলো প্রবাদপ্রতীম। যিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন হতাশা একটা পাপ। আমি তার কথা কোনোদিন ভুলব না। আর একদিন যখন আমি আমার শত্রুদের পরাস্ত করতে পারবো, সেদিন এখানে এসে তাকে শুনিয়ে যাবো আমি কি অর্জন করেছি, আর তার আশীর্বাদ চাইবো।”

***

এসান দৌলত, হিরাতে তাদের শাহী আত্মীয়ের উপরে আপতিত হওয়া ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের কথা জানবার আগেই ইহকালের মায়া ত্যাগ করেছেন। বাবর কয়েক সপ্তাহ পরে অবিশ্বাসের সাথে বাইসানগারের কথা শুনতে শুনতে ভাবে।

“সুলতান, এটাই বাস্তব। উজবেকরা হিরাত দখল করে নিয়েছে। ত্রিশ হাজার যোদ্ধার একটা বিশাল বহর নিয়ে সাইবানি খান মুখতার পাহাড়ের ঢালে তাণ্ডব সৃষ্টি করেছে। শাহী পরিবার আলা কোগরান দূর্গে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু সুলতানের ডেকে পাঠানো অতিরিক্ত সৈন্যবাহিনী তার সাহায্যে পৌঁছাবার আগেই তাদের পরাস্ত করা হয়েছে।”

“শাহী পরিবারের কি খবর?”

বাইসানগার উত্তর না দিয়ে ঠোঁট কামড়ে থাকে। “সাইবানি খান দূর্গ অবরোধ করেছিলো এবং দূর্গের কাছে অবস্থিত ঘোড়ার বাজার থেকে সিঁধ কাটার ফলে দেয়ালের অংশ বিশেষ ধ্বসে পড়ে। ফাটল দিয়ে উজবেক বর্বরের দল পিলপিল করে ভেতর প্রবেশ করেছিলো। তারা শাহী পরিবারের সব পুরুষ সদস্যদের, এমন কি তাদের জীঘাংসার হাত থেকে ছোট ছেলেটাও বাদ যায়নি, নির্বিচারে হত্যা করেছে। সাইবানি খান নিজে ছোট ছেলেটার গোড়ালী ধরে শস্য মাড়াইয়ের মতো শাহী কবরের পাথরের দেয়ালের উপরে তার মাথা আছাড় মেরেছে। মগজ ছিটকে পাথরের গায়ে লেগেছে। আর তারপরে তার প্রাণহীন দেহটা পরিবারের অন্য পুরুষ সদস্যদের লাশের স্তূপে ছুঁড়ে ফেলেছে। সে এরপরে লাশগুলো ভিতরে রেখে পুরো দূর্গ জ্বালিয়ে দেবার আদেশ দেয়…”

“আর মহিলাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে?”

“সবাই বলাবলি করছে আলা কোগরান দূর্গে যাদের লুকিয়ে থাকা অবস্থায় তারা খুঁজে পেয়েছিলো- হোক সে কিশোরী বা বয়সের ভারে কুঁজো হয়ে আসা বৃদ্ধা দাদীমা-সবাইকে জোর জবরদস্তি নগ্ন করে বিজয় উদযাপনের ভোজ সভায় মাতাল দখলদারদের সামনে এমন ভঙ্গিতে নাচতে বাধ্য করা হয়েছে, যে উজবেক সর্দাররা সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটার সান্নিধ্য পাবার জন্য নিজেদের মধ্যে কুকুরের মত খেয়োখেয়ি শুরু করেছিলো এবং কেউ কেউ নাকি ভূড়িভোজ শেষ হবার আগেই প্রকাশ্যে নিজেদের লালসা চরিতার্থ করতে আরম্ভ করে দিয়েছিলো।”

বাবর তার হাতের মুঠো এমন শক্ত করে বন্ধ করে যে মনে হয় তার গাঁটগুলো বুঝি ত্বক ফেটে বের হয়ে আসবে। “আর হিরাতের কি খবর?”

বাইসানগারের সচরাচর শান্ত মুখমণ্ডলে একটা কষ্টের অনুভূতি খেলে যায়। “উজবেকরা শহরে নির্বিচারে লুটপাট করেছে। সাধারণ নাগরিকদের হত্যা করে তাদের স্ত্রীদের ধর্ষণ করেছে এবং তাদের ছেলেমেয়েদের ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করেছে। আমার যে ভাইয়ের কাছে মাহাম মানুষ হয়েছিলো, তিনি মারা গেছেন। সাইবানি খানের নির্মমতার থাবা থেকে শহরের শিক্ষক আর লেখকরাও রেহাই পায়নি। হিরাতের মাদ্রাসার ভাগ্যবান কয়েকজন শিক্ষককে আজ যে কাফেলাটা এসে পৌঁছেছে, নিয়ে এসেছে। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন কবি- বলেছেন গ্রন্থাগারে রক্ষিত সব পাণ্ডুলিপি নষ্ট করে ফেলা হয়েছে এবং সাইবানি খানের নির্দেশে তার হাতে ধরা পড়া এক পণ্ডিতকে ছেঁড়া কাগজের টুকরো গিলতে বাধ্য করা হয়েছে যতক্ষণ না বেচারা শ্বাসরুদ্ধ হয়। আর পুরোটা সময় তাকে ক্রমাগত জিজ্ঞেস করা হয়েছে, “কবিতা খেয়ে বেঁচে থাকতে কেমন লাগছে?”

বাইসানগারের কথা যদিও বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না, কিন্তু বাবর অবাক হয় না। তার বার্তাবাহকদের বাধা দেয়া হয়েছে জানতে পারার পরে থেকেই সে জানতো এমন কিছু হওয়াটা এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। হীরাতে তার আত্মীয়কে যদি সময়মতো সতর্ক করা যেতো তাহলে কি হতো? তাদের পশ্চিম দিকে বিস্তৃত সংস্কৃতিবান, খোলামেলা অপূর্ব সুন্দর প্রাসাদ, প্রাচীন মসজিদ আর মাদ্রাসাগুলো সহসা যেনো একটা ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। বাবরের মরহুম আব্বাজান কখনও কখনও এইসব দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়দের ব্যাপারে আলাপ করতো, বহুদূরে বসবাস করার কারণে তিনি কখনও তাদের সাথে দেখা করতে যাননি। তাদের আরামপ্রীতি, সৌন্দর্যের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি, তাদের পুরুষসুলভ আগ্রাসী মনোভাব আর লড়াকু কুশলতার কমতি নিয়ে তিনি ব্যঙ্গ করতেন এবং তাদের সংস্কৃতিমনা দরবারের দৈন্যতা নিয়ে রসিকতা করতেন-যেখানে একজন দক্ষ যোদ্ধার চেয়ে লেখককে বেশি মর্যাদা দেয়া হয় এবং কবির দল যুদ্ধে জয়লাভ নিয়ে কাব্য রচনা না করে, রসাল সুপক্ক হাঁসের মাংস কিংবা “জীবন বারি” হিসাবে পরিচিত সুরা পানের আনন্দ নিয়ে সাহিত্য রচনায় ব্যস্ত।

কিন্তু তারা কি আসলেই এতোটাই মূর্খ ছিলো? বাবর ভাবে। এতদিন তারা তাদের কমনীয় জীবনযাপন বজায় রাখতে পেরেছিলো। সমরকন্দ, খোরাসান, ফারগানা, কুন্দজ উজবেকদের পদানত হবার পরে তৈমূর বংশীয় শাসকদের ভিতরে কেবল সেই এখন পর্যন্ত জীবিত রয়েছে ভেবে সে চমকে উঠে। একটা বিশাল দায়িত্ব একটা পবিত্র বিশ্বাস রক্ষার দায়িত্ব এখন তার উপরে অর্পিত হয়েছে। তার সেনাবাহিনীর অবস্থা যাই হোক, রসদের সরবরাহ থাকুক বা না থাকুক, তৈমূরের সাম্রাজ্যের টিকে থাকা অংশটুকু রক্ষা করতে বা সেটা করতে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে দেহরক্ষা করতে হলেও তাকে অবিলম্বে সাইবানি খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করতে হবে।

শাহী পরিবার, বিশেষ করে এর রমণীদের উপরে উজবেকদের- যা সম্ভবত সত্যি তাদের প্রকৃতির সাথে সেটা মিলে- অত্যাচারের বিষয়টা আবারও তাকে খানজাদার কথা ভাবতে বাধ্য করে। সে কি এখনও বেঁচে আছে? সে এতোদিন নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করেছে যে, মৃত খানজাদার চেয়ে জীবিত খানজাদা দরকষাকষির ক্ষেত্রে অনেক কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। আম্মিজানকে সাহস দিতে সে এই কথাটা তাকে বারবার বলেছে। নিজের মা মারা যাবার পরে, খুতলাঘ নিগার এখন পূর্বের চেয়ে আরও বেশি করে বিশ্বাস করতে চান যে, তিনি আবার খানজাদাকে দেখতে পাবেন। সে তাকে কখনও তার ভয়ঙ্কর ভাবনার কথা বলতে পারবে না যে ছেলেবেলায় সমরকন্দে সে যে নির্যাতন সহ্য করেছিলো, তার প্রতিশোধ নেবার স্পৃহা কখনও প্রশমিত হবার নয়। আর সে নির্যাতন করাটাকে গৌরবের বিষয় বলে মনে করে এবং তৈমূরের বংশের একজন শাহজাদীকে কলঙ্কিত করাটা সে বস্তুত পক্ষে উপভোগই করবে।

“সুলতান…” বাইসানগারের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বরে বাবরের বিক্ষিপ্ত ভাবনার জাল ছিন্ন হয়।

বাবর নিজেকে সংবরণ করে। “আমি সাইবানি খানের কাবুল আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবো না। আগামী সপ্তাহে আমরা আমাদের সেনাবাহিনী যে অবস্থায় আছে তাই নিয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করবো। আমাদের বর্তমান সৈন্য সংখ্যা এখন কতো?”

“প্রায় আট হাজার।”

উজবেক পঙ্গপালের সাথে কোনোমতেই তুলনীয় না সংখ্যাটা। কিন্তু এসান দৌলত সব সময়ে কি যেন বলতেন?: “যতক্ষণ শ্বাস নিতে পারছো ততক্ষণ হতাশ হয়ো না।”

“সাইবানি খানকে মোকাবেলা করার জন্য আমি এতোদিন ধরে মনে মনে যা ভেবে এসেছি সময় হয়েছে সেটাকে কার্যকরী করার। বার্তাবাহকদের এই মুহূর্তে রওয়ানা হতে বললা- আজ রাতেই সব গোত্রের কাছে, কাফিররাও বাদ যাবে না, তাদের পাঠাও। যারা আমার সাথে এই অভিযানে সামিল হবে তাদের আগামী পাঁচ বছর ফসল আর গবাদি পশুর জন্য কোনো খাজনা দিতে হবে না এবং আমিও তাদের ভালোই পারিশ্রমিক দেব। হিরাতে কি হয়েছে তাদের জানাবে এবং এটাও বলবে যে সাইবানি খান আমাদের সবার শত্রু। উজবেক না এমন সবার সে বিনাশ করবে…”

সেই রাতে, কেবল বাবুরীর সাহচর্যে সে দূর্গপ্রাকারের ছাদে আরোহন করে। স্থানটা তার খুব প্রিয় এবং সাধারণত তার মনকে প্রশান্ত করে তুলে। নিচের তৃণভূমি, যাযাবর পশুপালক আর বণিকের দল রাতের খাবার তৈরির প্রস্তুতি গ্রহণ করতে, রান্নার আগুনে অন্ধকারের মাঝে মাঝে লালচে আভা ফুটে রয়েছে। বাবর তাদের হাসি আর গল্পের আওয়াজ, ভেড়ার নাক ঝাড়া আর উটের কাশির শব্দ শুনতে পায়। দূরে, প্রতিরক্ষা দেয়ালের শক্তিশালী ব্যুহের পেছনে কাবুল শব্দহীন পড়ে আছে। শহরের নাগরিকদের মনে এই মুহূর্তে কি ভাব খেলা করছে? পশ্চিম থেকে আগত সওদাগরী কাফেলা নিশ্চয়ই বাণিজ্য দ্রব্যের সাথে সাথে গুজবও বয়ে আনছে। শহরের মানুষ এতোদিন খোরাসানের বিপর্যয়ের কথা জেনে গিয়েছে। আর এবার সাইবানি খান তাদের শহরের অভিমুখে এগিয়ে আসবে।

বাবুরীকেও বিষণ্ণ দেখায়।

“তোমার আবার কি হলো?” বাবর সহসা আগ্রহী হয়ে উঠে।

“আমি ভাবছিলাম আজ থেকে একমাস বা এক বছর পরে আমরা কি অবস্থায়। থাকবো…”।

“তার মানে তুমি বলতে চাইছো যে আমরা বেঁচেবর্তে থাকবে কিনা?”

“আংশিক, কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা কি ঘটবে আমাদের ভাগ্যে।”

“তুমি কি ভীত?”

“আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। আর সেটাও আমাকে ভাবিয়ে তুলছে…আপনি কি ভীত?”

বাবর এবার ভাবুক হয়ে পড়ে। “না, আমি ভীত নই। আমি উদ্বিগ্ন, কিন্তু দুটো এক জিনিস না। আমি চিন্তিত আমার পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে। আমি যে পরিবেশে জন্ম নিয়েছি। আমার বাবা, তার বাবা যে পৃথিবীকে চিনতো- তা দ্রুত বদলে যাচ্ছে। ফারগানার কর্তৃত্ব খোয়াবার পরের বছরগুলো, আমি মূলত ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়িয়েছি। এমনকি, এখানে আমি যদিও আবার সালতানাৎ ফিরে পেয়েছি। কিন্তু আমার সবকিছু, আমার সর্বস্ব একটা সুতোর উপরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি যদি সাইবানি খানকে পরাজিত করতে না পারি, তবে আমি এখন পর্যন্ত যা অর্জন করেছি সব নিরর্থক হয়ে পড়বে এবং যা কিছু আমি আগলে রাখতে চাই সেসব কিছুই লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে…”

“আপনি ভীত যে কেউ আপনাকে মনে রাখবে না?”

“না, ব্যাপারটা তারচেয়েও ব্যাপক। আমি উদ্বিগ্ন যে আমি হয়তো মানুষের স্মৃতিতে থাকবার যোগ্য নই…”

অন্ধকার আর গাঢ় হতে বাবর বাবুরীর মুখ দেখতে পায় না। কিন্তু অনুভব করে সে আলতো করে তার কাধ স্পর্শ করেছে। একটা বিরল আচরণ যা তার মস্তিষ্কে সিন্দাবাদের দানোর মতো চেপে বসা বোঝাটা হাল্কা করে দেয়। বাবুরী তাকে যেন বলতে চায় আসন্ন লড়াইয়ে সে নিজেকে একলা পাবে না…

*

বাবর মুখ থেকে ঘাম মুছে এবং রেকাব থেকে পা দুটো বের করে টান টান করে। আজ নিয়ে ছয়দিন তারা টানা ঘোড়ার পিঠে রয়েছে। সাথে যুদ্ধ উপকরণ বহনকারী ভারবাহী পশুর বহরের কারণে তাদের অগ্রসর হবার গতি বেশ শ্লথ ছিলো। শীঘ্রই অবশ্য তারা শিবারতু গিরিপথে প্রবেশ করবে, যা তাদের পাহাড়ের মাঝ দিয়ে। পশ্চিমে খোরাসানের দিকে নিয়ে যাবে। গিরিপথ একবার অতিক্রম করলে তারা যে অঞ্চলে প্রবেশ করবে, সেখানে উজবেক হানাদার বাহিনীর সাথে তাদের সংঘর্ষ, হবার সম্ভাবনা রয়েছে…কিন্তু তাকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। সাইবানি খানের সাথে সম্মুখ সমরে তার জয়লাভের কোনো সম্ভাবনা নেই। নিজের বাহিনীকে প্রথমে আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান করে তুলতে হবে এবং তার বয়ঃসন্ধিক্ষণে পাহাড় থেকে আকস্মিক নেমে এসে ঝটিকা আক্রমণের রণনীতি সাফল্যের সাথে ব্যবহার করে তাকে নতুন নতুন মিত্রের সাথে গাঁটছড়া বাঁধতে হবে। সে শত্রুবাহিনীর উপরে আচমকা আক্রমণ চালিয়ে তাদের বিপর্যস্ত করে। তারা সংঘটিত হয়ে প্রত্যাক্রমণ করার আগে নিজের বাহিনী নিয়ে পালিয়ে আসবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত দূর্গ দখল করে এবং সেখানে প্রাপ্ত মালামাল আর অস্ত্রশস্ত্র উপঢৌকন হিসাবে ব্যবহার করে অন্যদের বিশ্বস্ততা অর্জন করবে। যতক্ষণ না সে ধীরে ধীরে সাইবানি খানের বিশাল বাহিনীর মোকাবেলা করার মতো শক্তিশালী হয়ে উঠে।

নিজের ধূসর ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে বাবর থামবার আদেশ দেয়। ঢালু পাহাড়ের পাদদেশে তৃণভূমিতে আজ রাতের মতো তারা যাত্রা বিরতি করবে, পাহাড়ের কারণে সেদিক থেকে আচমকা আক্রমণের কোনো সম্ভাবনা নেই। সে ঘোড়া থেকে নেমে তার যুদ্ধ মন্ত্রকের সভা আহ্বান করে। সভায় আগমনকারী সবাই সমবেত হলে সেটা বিচিত্র একটা সমাবেশে পরিণত হয়-বাইসানগারের ন্যায় পোড়খাওয়া সেনাপতির পাশে এমন অনেক ভেড়ার চামড়ার আচকান পরিহিত উপজাতি সর্দার এসে আসন গ্রহণ করে। যারা কেবল একটা কি দুটো মাটির তৈরি বসতির উপরে কর্তৃত্ব করে থাকে। তার বাহিনীর লোকবল দশ হাজারের চেয়ে কম হওয়ায় সে চায়। তার প্রতিটা লোক যেনো স্বেচ্ছায় তার সাথে এই অভিযানে অংশ নেয়। উচ্ছল উপজাতির সদস্যরাও যেনো বাদ না যায়। আর সে চায় তারা সমস্ত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও যেনো তার উপরে আস্থা রাখতে পারে।

“আর কয়েকদিন, আমরা গিরিপথ অতিক্রম করবো। ভাগ্য ভাল হলে, উজবেক বদমাশগুলো আমাদের উপস্থিতি টের পাবে না। আমরা সেটার উপরেই ভরসা করে আছি। তারা ভাবতে থাকুক কসাইয়ের খোঁয়াড়ে বাঁধা ভেড়ার মত আমরা কাবুলে অসহায়ভাবে তাদের জন্য অপেক্ষা করছি। আমার গুপ্তদূতের দল আর গুপ্তচরেররা আরও তথ্য উপস্থাপন না করা পর্যন্ত হিরাতের দিকে এগিয়ে যাওয়াটা উচিত হবে না। কিন্তু ভুললে চলবে না আমরা পাহাড়ের লড়াকু যোদ্ধার দল, নেকড়ের মতো ধূর্ত যারা হরিণের পালের দিকে অন্ধের মতো ধেয়ে যায় না। আত্মগোপন করে অপেক্ষা করতে থাকে, জানে সে যদি ধৈর্য ধরে তাহলে পালের কমজোরী একটাকে থাবার ভিতরে পেয়ে রক্তের স্বাদ পাবে…আমাদেরও নেকড়ের মতো হতে হবে। তোমরাও তাই নিজেদের লোকদের অস্ত্রে শান দিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলো।”

ঘন ঘন মাথা নাড়া আর উৎসুক দৃষ্টি বিনিময় দেখে সে বুঝতে পারে তার কথা জায়গা মতো পৌঁছেছে। “আর পবিত্র কোরানের বাণী মনে রাখবে: ‘আল্লাহতালা সদয় হলে, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বাহিনীর পক্ষেও বিশাল শক্তিকে পরাস্ত করা সম্ভব।”

*

“সুলতান, প্রায় চারশো উজবেকের একটা দল, এখান থেকে তিন কি চার মাইল দূরে একটা নদীর অপর পাড়ে রয়েছে। দূর থেকে দেখে মনে হয়েছে তারা নদী পার হবে। সেজন্য তাদের ঘোড়া আর মালবাহী গাধার পিঠে মালপত্র সমানভাবে বিন্যস্ত করেছে তাদের এপারে সাঁতরে নিয়ে আসবে বলে…আমরা যদি দ্রুত এগিয়ে যাই তবে নদী অতিক্রম করার মাঝে আমরা তাদের আক্রমণ করতে পারি…” খবর নিয়ে আসা গুপ্তদূত ভীষণভাবে হাঁপাতে থাকে এবং তার খোঁজা করা বাদামী রঙের ঘোড়াটার দেহ ঘামে ভিজে জবজব করছে।

বাবুরী আর বাইসানগারের দিকে তাকিয়ে বাবর ক্রুর একটা হাসি হাসে। অবশেষে, প্রায় দু’সপ্তাহ পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত ঘন বনের আড়ালে পশ্চিম দিকে এগিয়ে যাবার পরে তারা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ পেয়েছে। উজবেক দলটা নদী পার হবার কাজে ব্যস্ত থাকবে, ঢাল পিঠে বাঁধা থাকবে আর তীর ধনুক পানির হাত থেকে বাঁচাতে চামড়া দিয়ে মোড়ানো থাকবে। আর তাদের অন্য অস্ত্রগুলো তরবারি, খঞ্জর আর রণকুঠার পানিতে কোনো কাজে আসবে না।

“বাইসানগার অগ্রগামী একটা বাহিনী প্রস্তুত করো।” বাইসানগারের পরামর্শে বাবর নিজের পাঁচশ শ্ৰেষ্ঠ যোদ্ধা নির্বাচিত করে এবং তাদের পঞ্চাশজনের একেকটা দলে বিভক্ত করে প্রতিটা দলকে নেতৃত্ব দেবার জন্য আলাদা আলাদা দলনেতা রয়েছে। উজবেক হানাদারদের মোকাবেলা করার জন্য যথেষ্ট। বাকি সৈন্য আর রসদপত্র এখানেই মজুদ থাকবে অধিকতর সৈন্য মোতায়েন প্রয়োজন না হওয়া পর্যন্ত।

দশ মিনিট পরে, গুপ্তদূত আরেকটা নতুন ঘোড়ায় চড়ে, বাবরের পাশে অগ্রগামী দলটার সাথে ভেড়া চলাচলের একটা ঢালু পথ ধরে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে নদীর দিকে এগিয়ে যায়। তাদের কপাল ভালো গত রাতে বৃষ্টি হয়েছে এবং মাটি ভেজা থাকায় আগুয়ান ঘোড়ার খুরের শব্দ শোনবার জন্য কেউ কান খাড়া করে থাকলেও তার পক্ষেও শব্দ আলাদা করে সনাক্ত করা মুশকিল হবে। আরো খুশির খবর, গুপ্তদূত তাদের উজবেক অবস্থান থেকে কয়েকশ গজ সামনে একটা অশ্বক্ষুরাকৃতি বাঁকের কাছে নিয়ে চলেছে যেখানে অবস্থিত ঘন উইলো গাছের জঙ্গল তাদের উপস্থিতি গোপন রাখবে।

বাবর কাবুলের কামারশালায় তার জন্য বিশেষভাবে তৈরি ইস্পাতের বর্মের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখে। তার ইস্পাতের জালির তৈরি আলখাল্লা মাপমতোই হয়েছে আর কোমরে রয়েছে আলমগীর। সে প্রস্তুত। তার ভিতরে টগবগ করতে থাকা আবেগ কণ্ঠ চিরে বের হয়ে আসতে চায়। যদিও সে জানে সেটা অসম্ভব…অন্তত এখনও সময় হয়নি…

আরো দু’মাইল এগিয়ে যাবার পরে মেঠো পথটা প্রশস্ত হতে শুরু করে- বাবরের ছয়জন অশ্বারোহী সৈন্য এখন পাশাপাশি এগিয়ে যেতে পারছে-কিন্তু আশেপাশে। গাছপালার আড়াল কমে এসেছে। বাবরের ভ্রু কুঁচকে উঠে সে গুপ্তদূতের সাথে। আলাপ করে এবং হাত তুলে নিজের লোকদের থামবার নির্দেশ দেয় এবং সম্প্রতি তার পথসঙ্গীর দায়িত্বে নিয়োগ পাওয়া, তার কিশোর কচিকে ডেকে পাঠায়।

“দ্রুত বহরের শেষপ্রান্তে ঘোড়া নিয়ে যাও। আমার সেনাপতিদের বলবে তীর ধনুক প্রস্তুত রেখে যে কোনো মুহূর্তে রওয়ানার অবস্থায় যেনো নিজেদের অধীনস্ত লোকদের তৈরি রাখে, আর কেউ যেনো কোনো কথা না বলে। আমরা নদীর বাঁকে পৌঁছে যাত্রাবিরতি করবো। আর সেই সময়ে গুপ্তদূতেরা সামনের পরিস্থিতি জরিপ করে আসবে। তারা যদি খবর নিয়ে আসে যে উজবেকরা এখনও নদী অতিক্রম করেনি, আমরা তাহলে হামলা করবো। বুঝতে পেরেছো?” ছেলেটা দ্রুত মাথা নাড়ে এবং ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে যায়।

তারা পুনরায় যাত্রা শুরু করতে বাবরের বুক উত্তেজনায় ধকধক করতে থাকে। সে টের পায় অনুভূতি অপার্থিব ধরণের সজাগ হয়ে উঠছে- ঘাসের ডগায় মোচড়াতে থাকা এক শুয়া পোকার খোঁচা খোঁচা কালো লোম সে খেয়াল করে এবং বেগুনী-গোলাপী রঙের নধর বুকের এক বন্য কবুতর গাছের ডালে বিশ্রামরত অবস্থায় তাকিয়ে রয়েছে। ঘামের গন্ধ- তার নিজের এবং তার ঘোড়ার আর তার আশেপাশের লোকদের আর তাদের ঘোড়ার জীবনের তীব্র নির্যাসের ইঙ্গিতময় একটা মেঘের মতো চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। মৃত্যুর সান্নিধ্য ছাড়া বোধহয় একজন মানুষ কখনও নিজেকে এতো বেশি জীবন্ত অনুভব করতে পারে না।

“সুলতান আপনি এখানে বিশ্রাম করেন আমি সেই ফাঁকে রেকী করে আসি।” গুপ্তদৃত বলে। আরো দু’শ গজ এগিয়ে যাবার পরে বুড়ো উইলো গাছের সুঠাম পালকের মতো শোভিত ডালের ফাঁক দিয়ে বাবর প্রথমবারের মতো পানির ঝলক দেখতে পায়।

“বেশ, তবে দ্রুত ফিরে আসবে।”

“হ্যাঁ, সুল-” কালো পালকের তৈরি একটা উজবেক তীর গুপ্তদূতের গালে বিদ্ধ হয় এবং আরেকটা তার কণ্ঠনালী বিদীর্ণ করলে বেচারা আর কিছু বলতে পারে না। তৃতীয় আরেকটা তীর নির্দোষ ভঙ্গিতে এসে মাটিতে আছড়ে পড়ে। বুদবুদের ন্যায় রক্ত বের হয়ে আসলে, লোকটার চোখ থেকে সব ভাব মুছে যায় এবং সে ঘোড়া থেকে উল্টে পড়ে কিন্তু তখনও একটা পা রেকাবে আটকে থাকে।

বাবরের চারপাশে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য শোরগোল শুরু হতে, সে ঝুঁকে তার ঘোড়ার গলা আঁকড়ে ধরে। প্রতি মুহূর্তে শত্ৰু তীরের শীতল ফলা নিজের দেহে বিদ্ধ হবার শঙ্কা করে। বাম হাতে ঘোড়ার লাগাম ধরে, ডান হাতে পিঠের উপর থেকে ধাতব পাত দেয়া ঢালটা টেনে নিরাপত্তার জন্য মাথার উপরে ধরে। কিন্তু আর কোনো তীর বাতাস কেটে ভেসে আসে না। বাবর সতর্কতার সাথে মাথা তুলে তাকায়। তার বাম দিকে, দুলতে থাকা সোনালী উইলো গাছের মাঝেযেদিক থেকে তীর ছোঁড়া হয়েছে- সে তিনজন উজবেক অশ্বারোহীকে নদী যেখানে তীক্ষ্ণ একটা বাঁক নিয়েছে তীর বরাবর সেদিকে এগিয়ে যেতে দেখে।

অশ্বারোহী তিনজন সম্ভবত উজবেক গুপ্তদূত, আশেপাশে নজর রাখছে অন্যেরা যখন নদী অতিক্রম করতে ব্যস্ত। সে অশ্বারোহী তিনজনকে ছেড়ে দিতে পারে না। তাহলে তারা ফিরে গিয়ে সবাইকে সতর্ক করে দেবে। ঘোড়ার পাঁজরে খোঁচা দিয়ে বাবর মাথা পেছনে নিয়ে চিৎকার করে আক্রমণের আদেশ দেয়।

উইলোর বনের ভিতর দিয়ে তীব্র বেগে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে যাবার সময় চাবুকের মতো উইলোর ডাল তার মুখে আছড়ে পড়তে থাকে এবং ঠোঁট কেটে গেলে সে মুখে রক্তের স্বাদ পায়। নদীর প্রশস্ত তীরে পৌঁছে, সে উজবেক অশ্বারোহীদের বাকের ওপাশে হারিয়ে যেতে দেখে এবং অভিশাপ দেয়। সে লাগাম ছেড়ে দিয়ে কাঁধ থেকে ধনুক নামিয়ে তূণ থেকে একটা তীর তুলে নেয়। রেকাবে অর্ধেক দাঁড়ানো অবস্থায় এবং দুই হাঁটু দিয়ে ঘোড়াটাকে স্থির রেখে সে ধনুকের ছিলায় তীর পরায় এবং গুণটা কান পর্যন্ত টেনে আনে। তীরটা সোজা আর দ্রুত ছুটে গিয়ে এক উজবেক ঘোড়ার পশ্চাদদেশে আমূল বিদ্ধ হয়। বাবর ঘোড়াটাকে চিহি সুরে আর্তনাদ করতে শোনে এবং পিঠের আরোহীসমেত পিছলে নদীতে আছড়ে পড়তে দেখে। বাবুরীও তীর ছুঁড়ে কিন্তু বাকি দুই উজবেক হাওয়ার মতো বেমালুম গায়েব হয়ে যায়।

বাবর আর তাকে ঘিরে থাকা অশ্বারোহী যোদ্ধারা বল্পিত বেগে তীক্ষ্ণ বাঁকটা পার হয়, মাথার চুল বাতাসে উড়তে থাকে এবং তার হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠে। বেঁচে যাওয়া দুই উজবেক অশ্বারোহী চিৎকার করে আশপাশ মাথায় তুলে এবং পাগলের মতো হাতপা নাড়তে থাকে কিন্তু উজবেক সহযোদ্ধারা তাদের মরিয়া ভাব খেয়াল করে না। একটা ছোট দল, তখনও দূরবর্তী পাড়ে অবস্থান করছিলো প্রথম কিছু একটা গড়বড় হয়েছে টের পায় এবং নিজেদের অস্ত্রের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে কিন্তু সেসব তখন অধিকাংশই পানিতে। বাকীরা নিজেদের ঘোড়া নিয়ে দ্রুত বহমান স্রোতস্বিনী অতিক্রম করে অন্যপাশে পৌঁছাতে চায়।

পানিতে ভিজে চুপচুপে অবস্থায় কয়েকজন মাত্র এপারে এসে পৌঁছেছে। ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় বাবর আর তার লোকেরা এক পশলা তীর নিক্ষেপ করলে অনেকে মুথ থুবড়ে পড়ে। বাবর তারপরে তার লোকদের ঘোড়া থেকে নেমে গাছ আর পাথরের আড়াল ব্যবহার করে তীর নিক্ষেপ করা অব্যাহত রাখতে বলে। নদীর অন্য পাড়ে অবস্থানরত অনেক উজবেকও তীরের আঘাতে ভূমিশয্যা নেয় এবং রক্তে লাল হয়ে উঠা নদীর পানিতে মৃত আর মৃতপ্রায় লোক আর তাদের বাহন একটা অনড় স্তূপের জন্ম দেয়, যা নদীর স্রোতও ভাসিয়ে নিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়।

“সুলতান।” আর্তনাদ আর গোঙানির আওয়াজ ছাপিয়ে বাবুরীর কণ্ঠস্বর পরিষ্কার শোনা যায়।

বাবর চারপাশে তাকালে একেবারে ঠিক সময়মতো দেখে যে সেই দুই অশ্বারোহী উজবেক গুপ্তদূতদের একজন, যাদের কথা সে ভুলে গিয়েছিলো তার দিকে ধেয়ে আসছে। লোকটার হাতে চকচকে কিছু একটা চমকায়-একটা রণকুঠার। লোকটা হাত পেছনে দিয়ে কুঠারটা এমন জোরে ছুঁড়ে মারে যে বাবর যেনো বাতাস কেটে সেটার ছুটে আসবার শব্দ শুনতে পায়। বাবর একপাশে কাত হলে তার ডান কান ছুঁয়ে কুঠারটা প্রচণ্ড বেগে পেছনের কাদামাটিতে গিয়ে আছড়ে পড়ে।

সে মেজাজ খারাপ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে কুঠারটা মাটি থেকে টেনে তুলে এবং ওজন পরখ করে দেখে-বেশ ভালোই ভারসাম্য রয়েছে। উজবেক যোদ্ধাটা এখন আর মাত্র কয়েক গজ দূরে। ইস্পাতের চূড়াকৃতি শিরোস্ত্রাণের নিচে কঠোর অভিব্যক্তি, আর হাতে বাঁকানো তরবারি নিয়ে সে জিনের উপরে ঝুঁকে রয়েছে। বাবুরী এবার সামনের দিকে ধেয়ে আসে।

“না আমার জন্য ছেড়ে দাও।” সে চিৎকার করে উঠে। হাতের ধনুক ফেলে দিয়ে, সে ডান হাতে কুঠারটা নিয়ে দাঁড়িয়ে মোক্ষম সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। তার থেকে যখন মাত্র কয়েক পা দূরে লোকটা, বাবর কুঠারটা তখন ছুঁড়ে মারে। ফলাটা বিদ্ধ না হয়ে কুঠারের হাতলটা গিয়ে তার মুখে আঘাত করে নাকটা থেতলে দেয়। কিন্তু সে তারপরেও কোনোমতে ঘোড়ার পিঠে বসে থাকে। উজবেক যোদ্ধা তার দিকে ধেয়ে আসতে বাবর তার ঘোড়ার উষ্ণ নিঃশ্বাস টের পায়। সে এবার সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে উজবেকটার বাম পা হাঁটুর কাছে আঁকড়ে ধরে। তার বর্মের ধাতব শৃঙ্খলে বাবরের আঙ্গুল কেটে যায়। কিন্তু তাতে শাপেবর হয় সে আরও জোরে আঁকড়ে ধরে গায়ের সব শক্তি দিয়ে নিজের দিকে টানে। উজবেকটার নাক থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে, উড়ে গিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে। কিন্তু কোনোমতে নিজের আগুয়ান ঘোড়ার ক্ষুরের নাগাল থেকে গড়িয়ে সরে যায়।

পায়ের গোড়ালির উপরে মল্লযোদ্ধার মতো দাঁড়িয়ে বাবর আর লোকটা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে। আঁচ করতে চেষ্টা করে প্রতিপক্ষের মতিগতি। রক্ত রঞ্জিত উজবেক যোদ্ধা কোনো ব্যথা অনুভব করলেও তার অভিব্যক্তিতে সেটা প্রকাশ পায় না। প্রতিপক্ষকে সে বরং চোখ কুঁচকে মাপতে চেষ্টা করে। বাবরকে তার পরণের পোশাক দেখে সুলতান বলে চেনার কোনো উপায় নেই- উজবেকটা তাকে কেবল। আরেকজন যোদ্ধা বলে ভেবে নিয়েছে।

বাম হাতে খঞ্জর আর ডান হাতে আলমগীর নিয়ে প্যাঁচ খেলার ভঙ্গিতে সামনে এগোবার ভান করে। তারপরে উজবেকটা ফাঁদে পা দিলে লঘু পায়ে লাফিয়ে আবার পেছনে সরে আসে। প্রতিপক্ষের চারপাশে বৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে বাবর দ্বিতীয়, তারপরে তৃতীয়বার একই চালাকি করে। উজবেকটা প্রতিবারই প্ররোচিত হয়ে তরবারি চালায় কিন্তু বাবর প্রতিবারই তাকে উত্যক্ত করে সরে আসে। দেহের প্রতিটা পেশী সতর্ক উত্তেজিত অবস্থায়, বাবর চতুর্থবারের মতো সামনে এগিয়ে যাবার ভান করে। উজবেকটা এবার ইতস্তত করে ভাবে এবারও বাবর পিছিয়ে যাবে- যে সে আসলে আক্রমণ করবে না। কিন্তু এবার পিছিয়ে যাবার পরিবর্তে, বাবর লোকটার অরক্ষিত গলা লক্ষ্য করে তরবারি চালিয়ে ডান পায়ে তার দুই উরুর সংযোগস্থলে বেমক্কা একটা লাথি বসিয়ে দেয়। উজবেকটা দুহাতে উরুর মধ্যবর্তী অংশ আঁকড়ে ধরে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে। গলা দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে।

কিন্তু বাবর তাকে শেষ করে দেবার অভিপ্রায়ে সামনে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতে নদীর তীরের আঠাল কাদায় তার পা পিছলে যায় এবং মাটিতে আছাড় খেলে হাত থেকে খঞ্জরটা ছিটকে যায়। আর আলমগীর তার দেহের নিচে চাপা পড়ে। আহত উজবেক নিজের টিকে থাকার সুযোগ ঠিকই চিনতে পারে। নিজেকে টেনে তুলে সে তার তরবারি খুঁজে নিয়ে সামনে এগিয়ে আসে আক্রমণ করতে। বাবর নিজেকে রক্ষা করতে বাম হাত উঁচু করে এবং সাথে সাথে তীব্র একটা যন্ত্রণা তাকে আচ্ছন্ন করে। নিচের দিকে তাকালে সে তার কলাচীর নিচের অংশে একটা গভীর ক্ষত দেখতে পায় এবং রক্ত গড়িয়ে পড়তে থাকার কারণে বাম হাত বেগুনী দেখায় আর দপদপ করতে থাকে।

সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে এবং সেটা করতে গিয়ে সে উজবেক যোদ্ধার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চেষ্টা করলে। নিজের ক্ষতস্থান থেকে রক্তপাতের ফলে দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে উজবেকটা মন্থর ভঙ্গিতে প্রতিক্রিয়া দেখায়। দেখে মনে হয় হাঁটু পর্যন্ত পানিতে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আলমগীর মুক্ত করে, বাবর এবার তরবারিটা গায়ের সব শক্তি দিয়ে উজবেকটার কণ্ঠনালী লক্ষ্য। করে চালায় এবং সেটা তার গলার পিছন দিয়ে বের হয়ে আসে। লোকটার ছিন্ন। হওয়া ধমনী থেকে ফিনকি দিয়ে বের হয়ে আসা রক্ত বাবরের গায়ে ছিটকে এসে তার নিজের রক্তের সাথে মিশে যায়।

বাবর এবার সুযোগ পেয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখে, লড়াই শেষ হয়ে গেছে। উজবেক হানাদার দলটার লোকেরা হয় মৃত বা পালিয়ে গেছে। রক্তপাত হ্রাস করার জন্য বাবর আহত বামহাত মাথার উপরে তুলে ধরে এবং ডান হাতে গলায় জড়ানো একটা সুতির কাপড় খুলে নিয়ে সেটা বাবুরীর হাতে দেয়। তারপরে সে বামহাতটা নিচে নামায় যা ইতিমধ্যে আড়ষ্ট হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছে। সে হাতটা তার দিকে এগিয়ে দেয়। “শক্ত করে বাঁধো…আজ আবার আমাদের যুদ্ধ করতে হতে পারে…” তার উল্লাস ইতিমধ্যে কমতে শুরু করেছে কিন্তু কেনো। খুব সম্ভবত এজন্য যে সাইবানি খানের কাছে তিনশ লোকের মৃত্যু রাতের বেলা মশার কামড়ের মতো নগণ্য একটা ব্যাপার…পুরো ব্যাপারটা নিষ্পত্তি হবার আগে বাবরকে এখনও অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হবে…

৩.৪ অনন্য ভৃঙ্গার

১৮. অনন্য ভৃঙ্গার

শুকনো লতাপাতা আর গোবরের আগুন থেকে উদ্ভূত ঝাঁঝালো ধোঁয়া, শিকে বেঁধানো নধর ভেড়ার মাংসের খুশবু, আর গরম পাথরে সেঁকা রুটির পরিচিত গন্ধে বাবর শ্বাস নেয়। সন্ধ্যে শেষে অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে, তার চারপাশে, সপ্তাহভর খণ্ডযুদ্ধের শেষে বিশ্রামের অবকাশ পেয়ে পরস্পরের সাথে গালগল্পে মেতে উঠে। রান্নার আয়োজন করে আর নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র পরিষ্কার করে তেল দেয়। তার সৈন্যবাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ষোল হাজার হয়েছে ভাবতেই তার মনটা ভালো হয়ে যায়। প্রতিদিনই উজবেকদের দ্বারা বিতাড়িত লোকজন আরও বেশি সংখ্যায় তার বাহিনীতে এসে যোগ দিচ্ছে।

হিরাতের পূর্বদিকে বারো দিনের দূরত্বে, ঘারজিস্তানের পর্বতমালার গহীনে এই তৃণভূমিতে আর বেশিদিন তারা অবস্থান করতে পারবে না। বাবরের গুপ্তদূতদের নিয়ে আসা সংবাদ অনুসারে, সাইবানি খান কয়েক সপ্তাহ আগেই শহর ত্যাগ করেছে। শহর ত্যাগের সঠিক সময় আর বিবরণ যদিও অস্পষ্ট কিন্তু একটা বিষয়ে। সবাই নিশ্চিত যে, কিপচাক তোরণের নীচ দিয়ে একটা বিশাল বাহিনী নিয়ে সে উত্তর-পশ্চিম দিকে রওয়ানা দিয়েছে। হতে পারে পুরোটাই প্রায় অরক্ষিত হিরাত আক্রমণে বাবরকে প্ররোচিত করার একটা টোপ? বা সাইবানি খান উত্তর-পূর্ব দিক থেকে ধেয়ে এসে বাবরকে পাশ থেকে ঘিরে ফেলতে চায়? উজবেক সেনাপতির এতোদিনে জেনে যাওয়া উচিত কাবুল থেকে পশ্চিমে অগ্রসরমান একটা বিশাল বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছে বাবর। তার এটাও জানা উচিত বাবরের বাহিনীকে আচমকা আক্রমণ করে সে সহজে তাকে পরাস্ত করতে পারবে। বা সম্ভবত সে বাবরকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। সম্ভবত সে এখন তার উজবেক বর্বরদের পাহাড়ের ভিতর দিয়ে নেতৃত্ব দিয়ে উত্তর দিকে বাবরের রাজধানী কাবুলের দিকে নিয়ে চলেছে।

বাবর তার তাঁবুর বাইরে ধাতব ঝুড়িতে রাখা জ্বলন্ত কয়লার দিকে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে সুনির্দিষ্ট সংবাদের অভাব কেমন অশুভ একটা অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে…ব্যাপারটা এমন, যেনো সাইবানি খান বেমালুম গায়েব হয়ে গিয়েছে… সে আগুনের উষ্ণতার উপরে হাত টানটান করে। বাম কব্জি নাড়াতে এখনও কষ্ট হয় দেখে সেদিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। তার কনুইয়ের কাছের ক্ষতস্থান দ্রুত আর সুন্দরভাবে সেরে উঠছে- পুরোটাই তার হেকিমের কৃতিত্ব- ক্ষতটা গম্ভীর হবার কারণে এর চারপাশের মাংসপেশী এখনও আড়ষ্ট হয়ে আছে। কব্জি সঞ্চালনে নমনীয়তা হ্রাস পাওয়ায় সে ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠে; এই হাতে সে খঞ্জর ধরে এবং তার কাছে সেটা খুবই গুরুত্ববহ।

সেই রাতে সাইবানি খান বাবরের স্বপ্নে হানা দিলে সে সারা রাত প্রায় নিদ্রাহীন কাটায়। পরদিন খুব ভোরে দিনের আলো বাবরের রাজকীয় তাঁবুর চামড়ার অভ্যন্তরভাগ মৃদু আলোকিত করে তুললে তখনও সে অস্থিরভাবে বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে। এমন সময় অস্থায়ী ছাউনির সীমারেখার কাছ থেকে ভেসে আসা উত্তেজিত কণ্ঠের চিৎকার আর হট্টগোলের শব্দে সে সজাগ হয়ে উঠে। গায়ের উপর থেকে এক ঝটকায় কম্বল সরিয়ে ফেলে সে লাফিয়ে দাঁড়ায় এবং তাঁবুর পর্দা সরিয়ে বের হয়ে আসে।

“কিসের এতো আওয়াজ…” সে তাঁবুর বাইরে প্রহরারত এক নিরাপত্তা রক্ষীকে ব্যাপারটা দেখতে আদেশ দেয়। সম্ভবত কিছুই না- ভেড়া বা ছাগলের মালিকানা নিয়ে মামূলি ঝগড়া। গতকালই সে পাঁচজন উপজাতীয় লোককে- দু’জন ঘিলজাইস, বাকী তিনজন পাসাইস- চাবকাতে আদেশ দিয়েছে। কিন্তু আজকেরটা অন্যকিছু। তাঁবুর সারির ভিতর দিয়ে প্রায় দৌড়ে ফিরে আসা প্রহরীর বিস্মিত অভিব্যক্তি দেখে বাবর বুঝতে পারে।

“সুলতান, বিশাল বহর নিয়ে…এক দূত এসেছে।”

“কোথা থেকে?”

“সুলতান, পারস্য, স্বয়ং শাহের তরফ থেকে…”

“তাকে আমার তাঁবুতে নিয়ে এসো।”

দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করে বাবর পোশাক পরে নেয়। কারুকাজ করা কাঠের পাদানির উপরে রাখা একটা ছোট চামড়া দিয়ে মোড়ানো সিন্দুক খুলে ভেতর থেকে একটা পাথরখচিত মালা গলায় দেয়। আর তৈমূরের সোনার ভারী আংটিটা আঙ্গুলে পরে। তার গালে কয়েকদিনের না কামানো দাড়ি কিন্তু এখন আর সেটার কিছু করা সম্ভব না। যাকগে, সে অভিযানে বের হওয়া এক যোদ্ধা- সে যে অবস্থায় আছে। পারস্যের দূতকে তাকে সেই অবস্থায় মেনে নিতে হবে…

পাঁচ মিনিট পরে, বাবরের দেহরক্ষীর দল রাজদূত আর তার চারজন পরিচারককে পথ দেখিয়ে তাঁবুর ভেতরে নিয়ে আসে। বাবর মুখ তুলে তাকিয়ে মাখন রঙের আলখাল্লা পরিহিত বছর চল্লিশেক বয়সের কালো চাপদাড়ির একজন লোককে দেখে। মাথায় উঁচু করে বাঁধা বেগুনী মখমলের পাগড়িতে সারসের সাদা একটা পালক নীলকান্তমণির কবচ দিয়ে আটকানো থাকায় তাকে স্বাভাবিকের চেয়ে আরো লম্বা মনে হয়। তার চার পরিচারকের পরণে লালচে বেগুনী রঙের জোব্বা এবং তাদের প্রভুর মতো মাথায় উঁচু পাগড়ি। একজন সোনার দড়ি দিয়ে বাঁধা বেগুনী মখমলের একটা বড় থলে ধরে রয়েছে।

রাজদূত সাবলীল ভঙ্গিতে মাথা নত করে সম্ভাষণ জানায়। “আমি পৃথিবীর অধিশ্বর, পারস্যের মহান শাহ্ ইসমাইলের শুভেচ্ছা বাণী আপনার কাছে নিয়ে এসেছি। তিনি আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করেছেন।”

বাবর তার মাথা সামান্য কাত করে। “আমি কৃতজ্ঞ এবং আল্লাহতালা যেনো তাকেও দীর্ঘায়ু দান করেন।”

“সুলতান, আপনাকে খুঁজে বের করতেই আমাদের অনেক দেরি হয়েছে।”

বাবর অপেক্ষা করে। পশ্চিমে এতো দূরে থেকে শাহ তার কাছে কি চায়?

“আমার প্রভু আপনার কাবুল ত্যাগ করে অভিযানে প্রবৃত্ত হবার কারণ জানেন। উজবেক বর্বরগুলো তার সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের সীমান্ত আক্রমণ করার স্পর্ধা। দেখিয়ে তাকেও ক্রুদ্ধ করে তুলেছে। সাইবানি খান ঔদ্ধত্যপনার চরমে পৌঁছে ছয় সপ্তাহ আগে হিরাত থেকে বের হয়ে এসে আমার প্রভুর ব্যবহারের জন্য আগত মালামালের একটা কাফেলাকে ইয়াজদ শহরের কাছে আক্রমণ করে। শাহ্ ইসমাইল তার মালপত্র ফেরত চাইলে, ক্রমাগত বিজয়ে উন্মাদ উজবেক নেতা তাকে একটা লাঠি আর ভিক্ষাপাত্র পাঠিয়ে দেয়। ভাবটা এমন যেনো আমাদের শাহ একজন ভিক্ষুক। শাহ ইসমাইল প্রত্যুত্তরে কিছু তুলা আর একটা চরকার সাথে একটা বার্তা পাঠান, যার বক্তব্য ছিল সাইবানি খান একজন ভেড়া-চোর। আর তার চেয়ে শ্রেষ্ঠদের অপমান না করে তার উচিত চরকা দিয়ে সূতা কাটা। কিন্তু উজবেকদের অজান্তে, আমার প্রভু এই বার্তা পাঠাবার সাথে সাথেই একদল সৈন্য পাঠান তাকে আরো একটা বার্তা পৌঁছে দেবার জন্য: মুখে ফেনা উঠা অবস্থায় বুনো কুকুর যখন উন্মাদ অবস্থায় ঘুরে বেড়ায়, তখন সেটার একটাই সমাধান আছে। কুকুরটাকে তখন মেরে ফেলতে হয়। আমার প্রভু, কার্যত যার সৈন্য সংখ্যা অগণিত, বুনো কুকুরটার বিহিত করেছেন আর তিনি সেটা আপনাকে জানাতে চান।”

“সাইবানি খান মৃত?”

“হ্যাঁ, সুলতান। হিরাত ফিরে আসবার সময়ে তার মূল বাহিনীকে পারস্যের সতের হাজার অশ্বারোহী আক্রমণ করে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।”

বাবরের মনে চিন্তার ঝড় বয়ে যায়। কথাটা যদি সত্যি হয়…সে দূতের মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। যার কালো বড় বড় চোখ তাকে আয়েশার গোত্র, মাঙ্গলিঘদের কথা মনে করিয়ে দেয়।

‘সুলতান।” লোকটা মাথা নত করে, কিন্তু বোঝা যায় আরও গুরুত্ত্বপূর্ণ কিছু সে বলতে চায়। আমার প্রভু এই উপহারটা আপনাকে পৌঁছে দিতে বলেছেন।” সে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পরিচারকের হাত থেকে বেগুনী মখমলের থলেটা নিয়ে সেটার ভেতর থেকে সোনা দিয়ে মোড়ানো একটা ডিম্বাকৃতি বস্তু বের করে আনে। “আমার প্রভু যতোটা নিখুঁতভাবে এটাকে কারুকার্যখচিত করতে চেয়েছিলেন সময়াভাবে সেটা করতে পারেননি। কিন্তু আপনার কাছে আশা করি উপহারটা গ্রহণযোগ্য বলে। মনে হবে।” সে দু’হাতে যত্ন করে ধরে জিনিসটা তার দিকে বাড়িয়ে ধরে।

বাবর আগ্রহের সাথে সেটা পরখ করে। জিনিসটাকে দেখতে একটা বিশাল, গোলাকার পানপাত্রের মতো মনে হয়। মসৃণ, চকচকে বাইরের দিকটা দেখে মনে হয় যেন গলিত সোনায় সেটা ডোবানো হয়েছিলো এবং নিচের দিকে চারটা ছোট ছোট সোনার পায়া রয়েছে যার উপরে পাত্রটা অবস্থান করতে পারে। পাত্রের ভেতরটা ম্লান ধূসর বর্ণের এবং বাবর ভেতরটা আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করে- শক্ত। সম্ভবত শিং দিয়ে প্রস্তুত। না, শিংএর উষ্ণতা আর পেলবতা নেই পাত্রটার। হাড়ের তৈরি…বাবর আবার খেয়াল করে এর আকৃতি আর আকার দেখে…মানুষের খুলির মত বড়…

“হ্যাঁ, সুলতান। সাইবানি খানের খুলিই এটা। সিদ্ধ করে মাংস ছাড়িয়ে নিয়ে পানপাত্রে রূপান্তরিত করা হয়েছে। খুলির চামড়াটাও নষ্ট করা হয়নি। আমার প্রভু সেটার ভিতরে খড় ভরে সেটা তার মিত্র অটোমান তুরস্কের সুলতান বায়েজিদকে শুভেচ্ছা স্বরূপ পাঠিয়েছেন।”

বাবরের নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। তার চরম শত্রু মারা গেছে এবং সে তার খুলি নিজের দু’হাতের মুঠোয় ধরে রয়েছে। বাবর আবার চোখ নামিয়ে পাত্রটার দিকে তাকায়। কিন্তু এইবার তার উল্লাস কিছুটা ম্লান হয়ে পড়ে। সে নিজ হাতে সাইবানি খানকে হত্যা করতে চেয়েছিলো। একেবারে কাছে থেকে কখনও দেখেনি যে চোখ, সেই শীতল চোখে ভয়ের রেশ জাগিয়ে তুলে হাতের খঞ্জর বা তরবারি তার উদরে আমূল বিদ্ধ করতে করতে খানজাদার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিলো। তার বদলে, অনেক শক্তিশালী, অনেক ধনবান এক শাসক সমস্যাটার সমাধান করেছেন…।

“আমি ইসমাইল খানের কাছে উপহারটার জন্য…কৃতজ্ঞ।”

“আমার প্রভু আপনার জন্য আরো কিছু উপহার পাঠিয়েছেন। বাইরে সেগুলো রাখা আছে। আপনি যদি আমাকে অনুগ্রহ করে অনুমতি দেন আমি তাহলে আপনাকে দেখাতে পারি।”

“চমৎকার, অনুমতি দিলাম।”

বাবরের দেহরক্ষী বাহিনী অস্ত্র প্রস্তুত রাখো, যদি পারসিক দূতের অন্য কোনো মতলব থাকে সেটা সামলাতে সতর্ক। দুপাশে সরে গিয়ে তাদের তাঁবুর বাইরে বের হয়ে আসবার পথ করে দেয়। তাঁবু থেকে তারা বের হয়ে আসলে, পারসিক দূতের আগমন সম্বন্ধে তখনও যারা জানে না-তাদের হাই তুলে, আড়মোড়া ভেঙে প্রাত্যহিক ক্রিয়াকর্ম সারতে দেখা যায়। অস্থায়ী ছাউনির কয়েকশ গজ দূরে, ওক গাছের একটা জটলার মাঝে পারসিক রাজদূতের বাকি লোকেরা অপেক্ষা করছে চমৎকার পোশাক আর অস্ত্রে সজ্জিত সবাই। তাদের পা বাঁধা ঘোড়ার পাল হয় ঘাস খাচ্ছে, বা কাছের স্রোতস্বিনী থেকে পানি পান করছে। অবশ্য, একটা ঘোড়া চকচকে কালো রঙের শক্তিশালী উঁচু একটা স্ট্যালিয়ন- দুই সহিসের মাঝে দাঁড়িয়ে অস্থির ভঙ্গিতে ছটফট করছে, বেচারারা বহু কষ্টে নাক ফুলিয়ে মাথা নাড়তে থাকা আজদাহাটা সামলে রেখেছে। বাবর এতো সুন্দর ঘোড়া আগে কখনও দেখেনি। “সোহরাব, আমার প্রভুর অশ্বশালার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট প্রজনন-স্ট্যালিয়ন, আপনাকে আর কাবুলের প্রজনন-ঘুড়ির জন্য তার একটা উপহার।”

“শাহকে তার উদারতার জন্য আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাবেন।” বাবর বিভ্রান্ত বোধ করে। সাইবানি খানের করোটি পাঠাবার কারণ সে না হয় বুঝতে পারে। কিন্তু শাহ এতো কষ্ট করে তাকে কেন এসব পাঠালেন? তিনি তার কাছে কি চান? পারস্য কেবল পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধশালী সাম্রাজ্যই না, সেখানকার সংস্কৃতির ধারা, কবি আর শিল্পীদের প্রয়াস সবাই কদর করে। সমরকন্দ বা ফারগানা এর সীমান্ত থেকে এতোটাই দূরে অবস্থিত ছিল যে, এর শাসকদের ভিতরে কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ সম্ভব ছিলো না। কিন্তু বাবর এখন কাবুলে আর দুটো স্থান পরস্পরের প্রায় প্রতিবেশী। শাহ্ ইসমাইল একজন শক্তিশালী নতুন নৃপতি। যিনি কয়েক বছর আগে পূর্ববর্তী সাম্রাজ্যের উৎখাত করে নিজের সাম্রাজ্য স্থাপন। করেছেন। একজন ধার্মিক মুসলিম, তিনি তার প্রজাদের উপরে শিয়া ধর্মমত জোর করে চাপিয়ে দিয়েছেন। শিয়াদের কেউ কেউ খারেজী বলে থাকে। কারণ শিয়ারা বিশ্বাস করে বেশিরভাগ মুসলমান এমনকি বাবর নিজেও যারা সুন্নী মতাবলম্বী, যার ঘোর বিরোধী যে হয়রত মুহাম্মদ (সাঃ) এর ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী তার চাচাতো ভাই আর জামাতা হয়রত আলী (রাঃ)…কিন্তু এসব উপহারের সাথে শাহ্’র উদ্দেশ্যের প্রাসঙ্গিকতা সে বুঝতে পারে না… বাবর নিজেকে কল্পনার মোহাবিষ্টতা থেকে বের করে আনে।

রাজদূত প্রায় রঙ্গময় একটা ভঙ্গিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এবং এটাও আমার প্রভুর তরফ থেকে একটা উপহার।” বাবর সোহরাবের পেছনে একটা বিশাল গরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখতে পায়। ছয়টা দুধসাদা ষাড়ের একটা দল গাড়িটা টেনে এনেছে। গাড়িটার চারপাশে উজ্জ্বল হলুদ রঙের পর্দা দেয়া রয়েছে, যার উজ্জ্বলতা ফারগানার কথা মনে করিয়ে দেয়। ফারগানা…

বাবর মন্থর পায়ে গরুর গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। সহসা অজানা আশঙ্কায় তার শ্বাসপ্রশ্বাসের বেগ খাপছাড়া হয়ে উঠেছে। বাতাস শীতল তবুও সে টের পায় কুলকুল করে ঘামছে। সে জানে গাড়িতে কে আছে- বা আশা করে তার ধারণাই সত্যি- কিন্তু তার সাতাশ বছরের জীবনে সে কখনও এমন আতঙ্কিত বোধ করেনি। গাড়িটার ভক্তিভরে নতজানু হয়ে থাকা চালকদের কাছে পৌঁছে বাবর থমকে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে সে পর্দার বাঁধন খোলার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়। তারপরে সে আবার থমকে গিয়ে ঘুরে তাকিয়ে তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের দিকে তাকায় তার নিজের লোকেরা, পারস্যের দূতের লোকেরা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে।

“পেছনে সরে যাও সবাই।” সে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে আদেশ দেয়। সবাই বেশ কয়েক পা পেছনে সরে না যাওয়া পর্যন্ত সে অপেক্ষা করে। তারপরে পর্দার বাঁধন সরিয়ে সে ভেতরে উঁকি দেয়। ছইয়ের একেবারে শেষ প্রান্তে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে একটা ভারী কালো ঘোমটার আড়ালে এক রমণী বসে আছে। সূর্যের আলো এসে তার উপরে পড়তে নেকাবের আড়ালে থাকা রমণী যেনো কেঁপে উঠে। “খানজাদা…?” বাবর অস্ফুট কন্ঠে কোনোমতে বলে।

সে লাফিয়ে গাড়িতে উঠে পর্দা টেনে দেয়। পাতলা রেশমের আবরণ চুঁইয়ে প্রবেশ করা আধোআলোতে সে দেখে মেয়েটা তার দিকে সামান্য এগিয়ে এসেছে। নিজেকে আর সামলাতে না পেরে বাবর হাত বাড়িয়ে নেকাবটা ধরে এক ঝটকায় সেটা সরিয়ে দেয়। খানজাদার বাদামী চোখ তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে…

*

পনের মিনিট পরে বাবর গাড়ির ভেতর থেকে আবার বের হয়ে আসে। গরুর গাড়ির ছইয়ের আড়াল থাকলেও, এতোগুলো উৎসুক দৃষ্টির সামনে এটা সুখ-দুঃখের আলাপ করার সময় না। বাবর অবশ্য জানেও না যে সে সেটা পারবে কিনা- পুরো ব্যাপারটাই এতো সহসা এতো অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটেছে যে সে এখনও পুরোপুরি ধাতস্থ হয়ে উঠতে পারেনি। সে রাজদূতকে নিজের কাছে ডেকে পাঠায়। “আপনার প্রভু আমার একটা বিরাট উপকার করেছেন।” সে আপাত নির্বিকার কণ্ঠে বলে।

“আমরা আপনার বোনের সাথে একজন শাহজাদীর মতোই আচরণ করেছি। দু’জন পরিচারিকা পুরোটা ভ্রমণে তাকে সঙ্গ দিয়েছে এবং আপনি চাইলে তারা তার সাথেই থাকবে।”

বাবর সম্মতি জানায়। “আপনি আমাদের সম্মানিত মেহমান। আমি আমাদের ছাউনির কেন্দ্রে আমার তাঁবুর পাশেই আপনার আর আপনার লোকদের জন্য তাঁবু টাঙাবার আদেশ দিচ্ছি।”

শাহের সৌজন্যের কারণে বাবর সাথে সাথে খানজাদার সাথে একাকী সময় না কাটিয়ে পারসিক মেহমানদের মেজবানিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তার বোন আর পারসিক মেহমানদের জন্য বাসস্থানের বন্দোবস্ত হতেই সে দশটা চামড়ার তাবু দিয়ে একটা বড় শিবির তৈরি করে। সেটার মেঝেতে ভেড়ার চামড়া বিছিয়ে দিতে বলে। যেখানে সে অতিথিদের উদ্দেশ্যে ভোজসভার আয়োজন করতে পারবে। রুচিশীল পারসিকদের চোখে তার আয়োজন নিশ্চিতভাবেই দরিদ্র প্রতিবেশীর আয়োজন বলে মনে হবে। কিন্তু পুরু গালিচা, কারুকার্যময় বাসনকোসন আর ভারী পর্দার অভাব সে তাদের অভিযানের সময় দখল করা নধর ভেড়ার মাংস, আর কড়া ওয়াইনের ব্যারেল দিয়ে ভালই পুষিয়ে দেবে।

ভোজসভা আরম্ভ হবার দু’ঘণ্টা পরে বাবর নিজেকে বাহবা দেয়। রাজদূত, ডালিমের মতো লাল গাল আর চকচক করতে থাকা চোখ বলে দেয় বাবাজির হয়ে গেছে। তার কালো দাড়ির আড়াল থেকে বিড়বিড় করে অনর্গল দ্বিপদী শের বলে চলেছে। শীঘ্রই তার মাথা ঝুঁকে আসতে থাকে, কালো চোখ বন্ধ হয়ে যায় এবং একটা সময়ে সে যে গালিচার উপরে বসে ছিলো সেখানেই গড়িয়ে পড়ে।

পুরো শিবিরে অনেক রাত অব্দি উৎসবের আমেজ বিরাজ করবে। সবার কাছেই উজবেকদের পরাজয় আর তাদের নেতা সাইবানি খানের মৃত্যু একটা স্বস্তির বাতাস বয়ে এনেছে। উজবেকদের প্রতি সাধারণ বিদ্বেষ অনেক বিরূপভাবাপন্ন গোত্রকে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হতে বাধ্য করেছিলো। কিন্তু বাবর অবশেষে একটা বিষাক্ত শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেয়েছে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাবর তার পেছনে সমবেত হওয়া রক্ষীদলকে হাতের ইশারায় নিরস্ত করে। সে মত্ত মাতাল লোকদের এড়িয়ে আর তাদের সাথে আগুনের পাশে যোগ দেবার উদাত্ত আহবানে কান না দিয়ে শিবিরের মাঝ দিয়ে দৌড়ে যায়।

তার অস্থায়ী শিবিরের একটা নির্জন স্থানে খানজাদার জন্য তাঁবুর ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং ভেতরে প্রবেশ করে সে তাকে একাকী একটা নিচু টেবিলের সামনে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে প্রদীপের আলোয় নিমগ্ন চিত্তে কিছু একটা লিখতে দেখে। তাকে ভেতরে দেখামাত্র লেখা ছেড়ে সে উঠে দাঁড়ায়। প্রদীপের কাঁপতে থাকা আলোয় নয় বছর আগের সেই তরুণীর মতোই তাকে মনে হয়। কিন্তু কাছে এগিয়ে আসতে সে তার মুখে বলিরেখার চিহ্ন দেখতে পায়, যার কথা সে স্মরণ করতে পারে না। আর তার ঠোঁটের ডান পাশ থেকে ডান কানের লতি পর্যন্ত উঠে যাওয়া সাদা ক্ষতচিহ্নটাও সে আগে খেয়াল করেনি।

“আমি আমাদের আম্মিজানের কাছে একটা চিঠি লিখছিলাম…এতগুলো বছরে এই প্রথম আমি তার কাছে চিঠি লিখতে পারছি। এসো আমার পাশে এসে বসো…”

“খানজাদা…” সে কতটা অনুতপ্ত বলার জন্য তার বুকটা ফেটে যেতে চায়। এতোগুলো বছর সে যখন অসহায় বন্দির জীবনযাপন করেছে তখনকার তিক্ত অনুভূতির কথা, নিজের অক্ষমতার কারণে অনুভূত অপরাধবোধের কথা সে বলতে চায়…কিন্তু এখন শেষ পর্যন্ত যখন সুযোগ পেয়েছে মনের ভার লাঘব করার, তখন সে কিছুই বলতে পারে না। খানজাদা হাত বাড়িয়ে তার মুখে আলতো করে বুলিয়ে। দিতে সে নিজেকে যেনো ফিরে পায়। “আমি তোমার যথাযোগ্য যত্ন নিতে পারিনি। আমি অপ্রাপ্তবয়স্ক আর উদ্ধত ছিলাম…নিজের মাথা খাটানো আমার উচিত ছিল…আমি তোমার কাছে অপরাধী যে বর্বরটার হাতে আমি তোমাকে তুলে। দিয়েছিলোম…”

“তোমার কিছুই করার ছিলো না। সেটাই ছিলো একমাত্র পথ নতুবা সেখানে সমরকন্দের দেয়ালের সামনে সে আমাদের সবাইকে হত্যা করতো। আমার সবচেয়ে বড় ভয় ছিলো যে, তুমি হয়তো তাই করবে আবেগের বশবর্তী হয়ে, শোচনীয় কিছু একটা করে বসবে…”

“আমার সেটাই করা উচিত ছিলো। তাহলে অন্তত আমি নিজের সম্মান রক্ষা করতে পারতাম।”

“না- তোমার দায়িত্ব ছিল বিচক্ষণতার সাথে পরিস্থিতির মোকাবেলা করা…অপেক্ষা করা…”

“তুমি ঠিক আমাদের নানীজানের মতো কথা বলছো।”

খানজাদার চোখ অশ্রুতে টলটল করতে থাকে। খানজাদা বাবরকে প্রথম সুযোগেই। তাদের আম্মিজান আর নানীজানের কথা জিজ্ঞেস করেছিলো এবং বাবরকে বলতে হয়েছে যে তাদের নানীজান আর ইহজগতে নেই। “আমার কথা যদি তার মতো শোনায়, তবে আমি নিজেকে সম্মানিত মনে করবো। এই পৃথিবীটার রীতিনীতি তিনি ভালোই বুঝতেন- আমরা যেমনটা পছন্দ করি ঠিক সেভাবে না এবং তিনিই শিখিয়েছেন সবাই আমাদের কাছে কেমন আচরণ প্রত্যাশা করে।”

“আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের যদি অন্য কোনো বংশে জন্ম হত…”

“মোটেই না। তুমি যদি আবার পছন্দ করার সুযোগ দেয়াও হয়, তুমি তাহলেও অন্য কোনো কিছুই পছন্দ করবে না- তুমি নিজের মনে সেটা খুব ভালো করেই জানো…”

খানজাদার মুখটা আবেগে কেঁপে উঠে।

বাবর হাত বাড়িয়ে বোনের গালের সাদা ক্ষতচিহ্নটা স্পর্শ করতে সেটা তার ত্বকের উপরে ফুলে উঠে। “কিভাবে হয়েছিলো? আমাকে কি বলবে…?”

“সে ছিলো একটা অদ্ভুত লোক। প্রচণ্ড খেয়ালী, অনেক সময় খামোখাই নিষ্ঠুর আচরণ করতো…তার আচরণ মোটেই…মার্জিত ছিলো বলা যাবে না, আর আমাকে আমার পক্ষে অপমানজনক কাজ করতে বাধ্য করতো…আমাকে অপদস্ত করতে, সে বলতো, সে চায় আমি যাতে ভুলে যাই যে আমি তৈমূরের বংশের একজন শাহজাদী। কেবল মনে রাখি যে আমি তার খেয়ালখুশির কাছে নতজানু একজন রমণী…আ-আমি তোমাকে সেসব কথা বলতে পারবো না। কিন্তু আমি খুশি যে সব পর্ব শেষ হয়েছে।” তার কণ্ঠস্বর কাঁপতে থাকে। কিন্তু আমি তার হারেমের অনেক মেয়েদের ভিতরে কেবল একজন ছিলাম। আর আমি ভাগ্যবান যে, সে আমাকে তার স্ত্রীদের একজন করেছিলো। আমাদের সবারই নির্দিষ্ট মর্যাদা ছিলো তার সব স্ত্রীই ছিলো সম্ভ্রান্ত বংশের…শোবার ঘরে সে আমাদের সাথে যতো নিষ্ঠুর আচরণ করুক না কেন ভালো পোশাক-পরিচ্ছদ, অলঙ্কার, ভালো খাবার আর পরিচারিকার কোনো অভাব আমাদের ছিলো না। আমরা ছিলাম তার ক্ষমতা আর বিজয়ের স্মারক…অভিযানে যাবার সময়ে সে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতো না বরং নিরাপদ স্থানে আমাদের রেখে যেতো। কেউ যদি আমাদের বন্দি করে অপমানিত করে তাহলে সেও অপমানিত হবে। শাহের লোকেরা সে কারণেই আমাকে হিরাতে খুঁজে পেয়েছিলো…”

“তার উপপত্নির দল…তাদের সংখ্যা কয়েক’শ হবে…তারা এতটা ভাগ্যবান ছিলো না। অভিযানে যাবার সময়ে সে তাদের ভেতর থেকে কয়েকজনকে সাথে নিয়ে যেতো রাতের বেলা শিবিরে তার সামনে নাচতে আর যুদ্ধে যারা পারদর্শীতা দেখাতো তাদের মনোরঞ্জনের জন্য। কেউ যদি তাকে অসন্তুষ্ট করতো তবে সে সাথে সাথে তাকে হত্যা করতো। একবার এক অভিযানের সময়ে একটা মেয়ে রাতের বেলা নাচতে গিয়ে হোঁচট খেলে সে তাকে সূর্যের নিচে বালিতে বোগল পর্যন্ত পুতে রেখে দিয়েছিলো। পানি পর্যন্ত পান করতে দেয়নি। সবাই বলে দু’দিন পরে তার বাহিনী শিবির গুটিয়ে চলে যাবার সময়েও মেয়েটা বেঁচে ছিলো। ঠোঁট আর গায়ের ত্বক অবশ্য কালো হয়ে খসে খসে পড়ছিলো…সাইবানি খানের কাছে এসব কিছুই না।”

খানজাদার শান্ত, আবেগহীন কণ্ঠস্বর- সেখানে কোন ক্রোধ বা তিক্ততার ছোঁয়া নেই- বাবরকে অভিভূত করে। সে কোথা থেকে নিজের এই বিপর্যয় মেনে নেবার শক্তি পেয়েছে।

“আমি বুঝতে পারছি না…” সে কথা শুরু করে কিন্তু খানজাদা নিজের ঠোঁটের উপরে আঙ্গুল রেখে তাকে চুপ করতে বলে। যেনো বাবর এখনও তার সেই আদরের ছোট ভাইটাই রয়েছে।

“তোমার যেমন কাজ ছিলো ধৈর্য ধারণ করা। আমার দায়িত্ব ছিলো কোনোমতে বেঁচে থাকা। আর আমি ঠিক সেটাই করেছি। আমি নিজের অনুভূতি আর ভাবনা সব লুকিয়ে রাখতাম। আমি কখনও প্রতিবাদ করতাম না। সবসময়ে আদেশ পালন করতাম- এমনকি কখনও কখনও দায়িত্ববান। মাঝে মাঝে তার প্রতি আমার করুণা হতো। তার ভেতরে কোনো সুখ, কোনো সন্তুষ্টি কাজ করতো না। কেবল চারপাশের পৃথিবীর প্রতি একটা অদম্য প্রতিশোধস্পৃহা যা তার সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করেছে বলে সে মনে করতো…”

“কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই আমাদের পরিবারকে প্রচণ্ড ঘৃণা করে এমন একটা লোকের সান্নিধ্যে সবসময়ে আতঙ্কিত থাকতে?”

“কখনও কখনও, অবশ্যই। তার মর্জিমতো চলা ছিলো এক কথায় অসম্ভব। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তার কাছ থেকে নিজের কোনো ক্ষতির শঙ্কা আমার কমে আসে…”

“তাহলে কে, কার কাছ থেকে…?”

খানজাদা চোখ নামিয়ে নিজের মেহেদী রাঙানো মুষ্টিবদ্ধ হাতের দিকে তাকায়। সে যখন বাচ্চা একটা মেয়ে, তখনও সে হাত আর পায়ে মেহেদী দিতে পছন্দ করতো। “অন্য মেয়েদের। সাইবানি খান যদিও ছিলো লাগামহীন নিষ্ঠুর, কিন্তু তারপরেও ঈর্ষা কাজ করতো। সে ছিল সুদর্শন, ক্ষমতাবান। যারা তাকে প্রীত করতে পারতো সে তাদের প্রতি উদার আচরণ করতো। মেয়েরা তার মনোযোগ পাবার জন্য মরিয়া থাকতো…একজন কোনো কারণ ছাড়াই আমাকে ঈর্ষা করতো…”

“কে?”

“সমরকন্দের গ্রান্ড উজিরের কন্যা আমাদের চাচাতো ভাই মাহমুদের স্ত্রী হবার জন্য যে তরুণীকে তুমি পাঠিয়েছিলে। সাইবানি খান মাহমুদকে হত্যা করার পরে তাকে সমরকন্দ নিয়ে আসে একজন উপপত্নী হিসাবে। সে চেয়েছিল তার স্ত্রী হতে এবং আমি তার স্ত্রী ছিলাম বলে আমাকে হিংসা করতো। কিন্তু সে আমাকে হিংসা করতো কারণ তুমি তার বাবাকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলে। সাইবানি খান আমাকে বন্দি করার ছয় মাস পরে সে আমাকে ছুরিকাহত করতে চেষ্টা করে…সে আমার চোখে আঘাত করতে চেয়েছিলো কিন্তু হেরেমের প্রহরী সময়মতো দেখে ফেলায় তার নিশানা ব্যর্থ হয়। কিন্তু তারপরেও তার খঞ্জরের ফলা আমার মুখে ঠিকই আঁচড় কাটে।” খানজাদা আলতো করে ক্ষতস্থান স্পর্শ করে।

বাবর কল্পনায় ছিপছিপে, ক্রুদ্ধ চোখের এক মেয়েকে নিজের অপদার্থ বাবার প্রাণ রক্ষার জন্য কাকুতি মিনতি করতে দেখে। “তার ভাগ্যে কি ঘটেছিলো?”

“সাইবানি খান সমরকন্দের কোক সরাইয়ের ভূগর্ভস্থ কক্ষে তাকে জীবন্ত সমাধিস্ত করেছে। সে বলতে ভালবাসতো যে সেই মানুষের জীবন মৃত্যুর নিয়ন্ত্রাতা। সে বলেছিলো উজির কন্যার ধৃষ্টতার জন্য সে তাকে শাস্তি দিয়েছে…”।

রাত ক্রমশ গম্ভীর হতে থাকে এবং খানজাদা তার অগ্নিপরীক্ষার কথা ধীরে ধীরে বলতে থাকলে, বাবর অল্প অল্প করে বুঝতে পারে সে কিভাবে পাগল না হয়ে বেঁচে থেকেছে। ব্যাপারটা এমন যেনো সে সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। নিজেকে আশ্বস্ত করেছে চারপাশে অনভিপ্রেত যা কিছু ঘটছে- তার সাথে ঘটছে সে সবকিছুই অন্য কারো সাথে ঘটছে। অনেকটা আয়েশার মতো মনোভাব। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি যুক্তিগ্রাহ্য, সে মনেপ্রাণে অন্য কোথাও নিজেকে কল্পনা করতে চেয়েছে এবং নিজের মনকে সে সেভাবেই ভাবতে শিখিয়েছে।

খানজাদার মুখের ম্লান হাসি দেখে তার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে। কিন্তু একই সাথে তার মানসিক শক্তি তাকে গর্বিত করে তোলে। তার নশ্বর দেহের সাথে যতোই অত্যাচার করা হোক, সেসব তার মনকে নতজানু করতে বা দমাতে পারেনি। এসান দৌলত যদি চেঙ্গিস খানের সত্যিকারের মেয়ে হয়ে থাকেন, তবে খানজাদাও তার যোগ্য উত্তরসুরী…তার অভিজ্ঞতা নিশ্চিতভাবেই ভীতিকর, কিন্তু সেসব তার অস্তি ত্বকে ধবংস করতে পারেনি। তার বয়স এখন প্রায় একত্রিশ বছর। আর জীবনের এক তৃতীয়াংশ সময় সে এক নিষ্ঠুর স্বেচ্ছাচারীর হাতের খেলার পুতুল ছিলো। কিন্তু পোষা বেজীর সাথে খুনসুঁটি করা সেই মেয়েটা কিভাবে যেনো আজও বেঁচে আছে। তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠতে চাইলে সে বহুকষ্টে নিজেকে প্রশমিত করে। আজ থেকে তার বোনের দুঃখের দিন শেষ….

*

“পৃথিবীর অধিশ্বর একটা প্রস্তাব পাঠিয়েছেন যা তিনি আশা করেন আপনার কাছে। গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।” উজ্জ্বল কমলা রঙের আরো জৌলুসময় একটা আলখাল্লা আজ পারস্যের রাজদূতের পরণে এবং কালো চাপদাড়ি সুন্দর করে সুগন্ধি দিয়ে আচড়ানো। মাথা ধরার কোনো লক্ষণ তার ভেতরে দেখা যায় না। যদিও বাবর খুব ভালো করেই জানে বেচারার মাথা এই মুহূর্তে যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। রাজদূতের আত্ম-সংযম, মুখের আপাত পৃষ্ঠপোষকতাময় অভিব্যক্তি দেখে বাবর বুঝতে পারে প্রস্তাবটা ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে রুটির টুকরোর মতোই গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হবে।

বাবর চোখ সরু করে তাকিয়ে থাকে, অপেক্ষা করে। অবশেষে সময় হয়েছে তাকে প্রীত করতে শাহ কেন এতো কষ্ট স্বীকার করেছে সেটা জানবার।

“শাহ ইসমাইল উজবেক হানাদারদের কোমর ভেঙে দিয়েছেন। তার ইচ্ছা ন্যায়সঙ্গত সুলতানরা এবার তাদের সালতানাতে ফিরে যাক, যাতে তার মহান। সাম্রাজ্যের সীমান্ত এলাকায় আরো একবার শান্তি ফিরে আসে। তৈমূরের বংশের জীবিত শেষ শাহজাদা হিসাবে তিনি আপনাকে সমরকন্দের শাসনভার নিতে অনুরোধ করেছেন…”

বাবর টের পায় তার পেটের ভেতর হঠাৎ শক্ত হয়ে উঠেছে। সমরকন্দ তার স্বপ্নের শহর, তৈ নূরের রাজধানী। “আপনার প্রভুর উদারতা অতুলনীয়।” সে সর্তকতার সাথে কথাটা বলে চুপ করে থাকে। তার আব্বাজানের মৃত্যুর পরে সে যদি কিছু শিখে থাকে তবে সেটা হলো ধৈর্য ধারণ করা। নিরবতা ভঙ্গ করার দায়িত্ব অন্যরা পালন করুক…

রাজদূত একটু কেশে উঠে গলা পরিষ্কার করে। বাবর ভাবে, ব্যাটা এইবার আসল। কথাটা বলবে।

“সাইবানি খানকে যদিও পরাস্ত আর হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু সমরকন্দ এখনও তার লোকেরা দখল করে রেখেছে। আমার সুলতান আপনার বাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য পারস্যের সেনাবাহিনী দিয়ে সহায়তা করতে চান।”

“এবং তারপরে?”

“আমার প্রভু আপনাকে শ্রদ্ধা করেন। তিনি ভালো করেই জানেন আপনার ধমনীতে বিজয়ীর রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। তিনি বিশ্বাস করেন আপনি তার অধীনস্ত একজন সামন্তপ্রভু হিসাবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করবেন।”

“অধীনস্ত সামন্ত প্রভু?” বাবর হতবাক হয়ে রাজদূতের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

রাজদূতও বাবরের অভিব্যক্তি পড়তে পেরেছে বোঝা যায়। আপনাকে কোনো রাজস্ব প্রদান করতে হবে না। আর আপনিই সমরকন্দের শাসকের দায়িত্ব পালন করবেন। আমার প্রভু কেবল আশা করেন আপনি তাকে আপনার অধিরাজ বলে মেনে নেবেন।”

“আর সমরকন্দ বিজয় সম্পন্ন হওয়ামাত্র পারস্যের সেনাবাহিনী দেশে ফিরে যাবে?”

“অবশ্যই।”

“এবং এর সাথে আর কোনো শর্ত নেই? “

“না, সুলতান।”

“আমি প্রস্তাবটা বিবেচনা করে দেখবো এবং আপনাকে সময়মতো আমার সিদ্ধান্ত জানাবো।”

রাজদূত আরো একবার মাথা নত করে অভিবাদন জানিয়ে তাঁবু থেকে বের হয়ে যায়। বোঝা গেলো দেড়েলটা কেন নিভৃত কক্ষে তার সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেছিলো। তার প্রস্তাবটা একেবারেই নজিরবিহীন। তৈমূরের বংশের কোনো সুলতান কোনো দিন পারস্যের অধীনতা স্বীকার করেনি…কিন্তু প্রস্তাবটা একই সাথে শাহ্ আর তার নিজের জন্য সুরক্ষাকবচ হিসাবে কাজ করবে। শাহের সীমান্ত বাবরের বন্ধুভাবাপন্ন। প্ৰাবর-সালতানাতের এলাকা দ্বারা সুরক্ষিত থাকবে এবং বাবর তার স্বপ্নের সমরকন্দ ফিরে পাবে। সেখানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে, বাবর নিজের সেনাবাহিনী প্রস্তুতের সাথে সাথে অনুকূল সময়ের জন্য অপেক্ষা করবে। ভবিষ্যত অভিযানের সুযোগের প্রতিক্ষা করবে, আর সম্ভবত যখন সময় হবে এই অধীনস্ত সামন্তরাজের ভূমিকা জলাঞ্জলি দেবে।

সে বাইরে থেকে কারো কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে শুনে এবং তার একজন প্রহরী তাঁবুর ভেতরে উঁকি দেয়। “অশ্বশালার আধিকারিক আপনার সাথে দেখা করতে চান।” বাবর মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। যুদ্ধ মন্ত্রকের সভা আহ্বান করার পূর্বে বাবুরীর সাথে এ বিষয়ে আলাপ করে নেয়াটা মন্দ না।

“বেশ, দেড়েল ব্যাটা কি চায়?” বাবরের পাশে রাখা একটা কাঠের টুলে বসতে বসতে বাবুরী বলে।

“স্ট্যালিয়নটা আর খানজাদাকে ফেরত পাঠানোটা ছিলো আসলে আমাকে নরম করার একটা কৌশল। পারস্যের শাহ আমাকে একটা প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। সমরকন্দ। থেকে বাকি উজবেকদের বিতাড়িত করতে এবং সেখানে আমার শাসন কায়েম। করতে তিনি আমাকে সৈন্য পাঠিয়ে সাহায্য করতে চান। কেবল তার একটা শর্ত আছে যে, তাকে আমার অধিরাজ হিসাবে মেনে নিতে হবে।”

বাবুরীর ইস্পাত নীল চোখে বিস্ময় ঝলসে উঠে। “সমরকন্দ শাহের এক্তিয়ারের ভিতরে পড়ে না…তার কি অধিকার আছে? আর কিভাবেই বা তিনি আপনাকে আজ্ঞাবাহক সামন্তরাজ হিসাবে আশা করেন?”

“তিনি পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী নৃপতি। তিনি সাইবানি খানের ভবলীলা সাঙ্গ করেছেন…যা করতে আমাদের হয়তো আরো কয়েক বছর লাগতো…যা হয়তো আমরা কখনও সম্পন্নও করতে পারতাম না…” বাবর মৃদু কণ্ঠে বলে।

“আপনি নিশ্চয়ই তার শর্ত মেনে নিতে চাইছেন না?”

“ক্ষতি কি? আমি সবসময়ে সমরকন্দ নিজের করে পেতে চেয়েছি- সবকিছুর চেয়ে তাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। আর একবার সমরকন্দ অধিকার করতে পারলে ফারগানা অধিকার করা তখন কেবল সময়ে ব্যাপার। সাথে কাবুলের সালতানা যোগ করলে আমি নিজেই নিজের সাম্রাজ্যের ভীত স্থাপন করতে পারবো…যা আমি আমার অনাগত বংশধরদের জন্য রেখে যেতে পারবো…”।

“শালা হাড়হারামী পারসিক বানচোত তার নরম নরম কথা, মিষ্টি মিষ্টি প্রতিশ্রুতি, আর চাটুকারীতা করে আপনাকে নির্ঘাত জাদুটোনা কিছু একটা করেছে। আমরা কি এজন্যই এতো কষ্ট করেছি এতোদিন? বরফাবৃত পাহাড়ে আমাদের পথ পরিক্রমা, ক্ষুধায় পরিশ্রান্ত সেইসব দিন যখন এক টুকরো রান্না করা মাংস অমৃত বলে মনে হয়েছে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করা… আমাদের রক্তক্ষরণ…আমাদের বিজয় এসব কি তবে অর্থহীন?”

“সব কিছুর বদলে আমরা কি এখন কিছু প্রতিদান আশা করতে পারি না? বিগত বছরগুলো আমাদের যেনো ঘূর্ণিঝড়ের ভেতরে কেটেছে। আমি যখনই কোথাও থিতু হতে চেষ্টা করেছি আমাকে সেখান থেকেই বিতাড়িত হতে হয়েছে। কিন্তু আমি এখনও বেঁচে আছি- আমার ভাই মাহমুদ খানের মতো আমার চামড়া ছাড়িয়ে ঢোল বানানো হয়নি বা হিরাতে আমার পুরুষ আত্মীয়দের ন্যায় জবাই হইনি, বা ফারগানায় আমার সৎ-ভাইয়ের মতো খুন হয়ে যাইনি…আমি অনুভব করছি অবশেষে সময় হয়েছে…”।

“তাহলে বোকার মতো কিছু করে বসবেন না। আপনার বোনের ফিরে আসার ফলে বোধগম্য কৃতজ্ঞতাবোধ যেনো আপনার বিচারবুদ্ধিকে প্রভাবিত না করে। আপনার এখন একটা সেনাবাহিনী রয়েছে- দক্ষ একটা সেনাবাহিনী। পারসিকদের পারস্যেই থাকতে বলেন। আমরা নিজেদের বাহুবলে সমরকন্দ অধিকার করতে পারবো। ফিরোজা দরোজা দিয়ে আমরা আপনার লোক হিসাবেই সমরকন্দে প্রবেশ করতে চাই অন্যের ভাড়াটে গোলাম হিসাবে না।”

“তুমি বুঝতে পারছো না…” বাবর ক্রমশ ক্রুদ্ধ হতে থাকে। বাবুরী সবসময়েই এমন একগুয়ে।

“আমি বুঝতে পারছি না। আরেকজন তৈমূর হবার উদগ্র আকাক্ষা আপনাকে অন্ধ করে তুলেছে- নির্বোধের মতো আপনি সংক্ষিপ্ত পথে সফল হতে চাইছেন।”

“তুমি সেটা কিভাবে বলছো?”

“কারণ আমি রাস্তা থেকে উঠে এসেছি? আপনি বোধহয় সেটাই বলতে চাইছেন?” বাবুরী উত্তেজনার বশে উঠে দাঁড়িয়ে টুলটা এক লাথিতে উল্টে ফেলেছে। আমি সে কারণেই দিবালোকের মতো স্পষ্ট সবকিছু দেখতে পাচ্ছি আপনার চেয়ে- আহাম্মক কোথাকার। আপনি যদি শাহের প্রস্তাব মেনে নেন, তাহলে ব্যাপারটা হবে অনেকটা কিছু দুবৃত্তের কুপ্রস্তাবে সাড়া দিয়ে আমার কানাগলি দিয়ে এগিয়ে যাবার মতো, যারা আমাকে এর বিনিময়ে পেটভরে খেতে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে…শাহ আপনাকে যে প্রজনন স্ট্যালিয়নটা পাঠিয়েছে, আপনি নিজের অজান্তে তার শাবক উৎপাদনের ঘোটকীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চলেছেন প্রভুর প্রতিটা আজ্ঞা পালন করে তাকে সন্তুষ্ট করতে বাধ্য…আমি কখনও এতোটা বেপরোয়া হতাম না। আপনার এমনটা করা উচিত হবে না…আপনি একবার তার প্রভাবের ভিতরে চলে আসলে সে আরো বড় কোনো শর্ত নিয়ে ফিরে আসবেই…”

“তুমি আহাম্মকের মতো কথা বলছে। আমাকে একলা থাকতে দাও।” বাবর উঠে দাঁড়ায় এবং মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। বাবুরী অন্য আর সবার মতো কেন তার পরিকল্পনায় সায় দিচ্ছে না?

বাবুরী তার আদেশ অমান্য করে। সে চলে যাবার বদলে বাবরের কাঁধ আঁকড়ে ধরে, গনগনে চোখে, তার মুখ নিজের দিকে ঘুরিয়ে দেয়। আপনি আপনার যে আব্বাজানের কথা এতো বলেন, তিনি বেঁচে থাকলে কি বলতেন? বা আপনার সেই জাদরেল নানীজান ইস্পাতের মতো তীক্ষ্ণ ছিলো যার বিচক্ষণতাবোধ? আপনাকে এতো সহজে কেনা যায় দেখে, অন্য লোকের অধীনস্ত করা যায় দেখে,– প্রভুর ইচ্ছায় পাছার কাপড় তুলে তার মর্জিমত যেকোনো কিছু করতে ইচ্ছুক… তারা মরমে মরে যেতেন।”

বাবুরীর ভাষাজ্ঞান দেখে ক্রোধে অন্ধ হয়ে বাবর নিজেকে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে, একপা পেছনে সরে আসে এবং বাবুরীর অবজ্ঞাপূর্ণ মুখে গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে একটা ঘুষি বসিয়ে দেয়। সে বন্ধুর নাক ভাঙার একটা ভোতা শব্দ শুনতে পায় এবং ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে দেখে।

মুহূর্তের জন্য, বাবুরী নিজের খঞ্জর আঁকড়ে ধরে আর বাবরও সহজাত প্রবৃত্তির বশে নিজের খঞ্জরের বাঁট স্পর্শ করে। কিন্তু খঞ্জর থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে সে ডান হাত তুলে নিজের নাক স্পর্শ করে এবং বাবরের চোখ থেকে চোখ না সরিয়ে সে তার বাম হাত দিয়ে রক্তে ভেজা জোব্বার কোমরের চারপাশে জড়ানো পরিকরের শেষপ্রান্তটা খুঁজে নেয়। সেটা খুঁজে পেতে আঁকড়ে ধরে চেষ্টা করে সেটা দিয়ে রক্তপাতের বেগ প্রশমিত করতে।

“বাবুরী…”

মুখ থেকে পরিকরের প্রান্তটা এক পলের জন্য সরিয়ে সে বাবরের পায়ের কাছে থুতু ফেলে। তারপরে ভেড়ার চামড়া দিয়ে মোড়া মেঝেতে চুনির মতো লাল রক্তের। ফোঁটার একটা ধারা ফেলতে ফেলতে সে ঝুঁকে তাঁবুর নিচু পর্দা সরিয়ে বের হয়ে যায়।

বাবর বহুকষ্টে তাকে অনুসরণ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখে। সে একজন। সুলতান এবং বাবুরীর উচিত ছিলো সেটা মনে রাখা। তাকে আঘাত করাটা তার। উচিত হয়নি কিন্তু বাবুরীও কম যায় না…ব্যাটা একটা মাথা গরম, গাড়ল। বেল্লিকটা ঠাণ্ডা মাথায়, যুক্তি দিয়ে পুরো বিষয়টা- তারমতো- ভাবলে বুঝতে পারবে বাবর। ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে… বাবর মাথা উঁচু করে, কোনোভাবে লজ্জিত না হয়ে ফিরোজা দরোজা দিয়ে শহরে প্রবেশ করবে।

“প্রহরী!” বাবর চেঁচিয়ে উঠে ডাকে। একটা লোকের মাথা তাঁবুর পর্দা সরিয়ে ভেতরে উঁকি দেয়। “আমার যুদ্ধ মন্ত্রকের সভা আহবান করো।”

*

বাবর পারস্যের রাজদূত আর তার লোকজনকে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিদায় জানায়। রাজদূতের ঘোড়ার পর্যানে বাবরের দস্তখত করা একটা চিঠি রয়েছে যেখানে সে শাহের কাছে নিজের বিশ্বস্ততা কবুল করেছে। আজ রাতে তার শিবিরে আরও বড় উৎসবের আয়োজন করা হবে। বাবর তার সেনাপতিদের কাছে আজ রাতে ঘোষণা করবে যে পারস্যের অতিরিক্ত সেনাবাহিনী এসে পৌঁছানো মাত্র তারা উত্তর-পূর্ব দিকে সমরকন্দের দিকে রওয়ানা দেবে। সেখানের উজবেকদের বিতাড়িত করে তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে। তার লোকেরা আরও ধনসম্পদ প্রাপ্তির সম্ভাবনায় চেঁচিয়ে উঠে নিজেদের সম্মতি প্রকাশ করবে। শাহের কাছে সে কি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেটা নিয়ে তর্কে যাবার সময় এটা না। শীঘ্রই সে আবার সমরকন্দের নীল-গম্বুজঅলা প্রাসাদ আর মসজিদের প্রভু বলে স্বীকৃত হবে। বিবেচনা করবে কিভাবে তার লোকদের কাছে বিষয়টা উপস্থাপন করবে। আর তারা এসব নিয়ে খামোখা কেন বিব্রত হবে? তৈমূর বংশীয় এক শাহজাদাই তাদের শাসন করছে, কোনো বর্বর পুরুষানুক্রমিক শত্রু না। পারসিকরা তাদের বহুদূরের আবাসস্থলে ফিরে যাবে। আর সেও অফুরন্ত সময় পাবে নিজের পরবর্তী অভিযান নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার।

বাবুরী গাধাটা নিশ্চয় কোথাও একাকী নিজের আহত নাক আর অহমিকার শুশ্রূষা করছে। এখন তার নিজের ক্রোধ প্রশমিত হতে আর চুক্তি সম্পাদিত হয়ে যাবার পরে এবং শাহের প্রতিনিধি দল বিদায় নিতে, বাবর তার বন্ধুর সাথে দেখা করে নিজেদের ভেতরকার ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে ফেলতে তৎপর হয়। বলা হয়নি এমন অনেক কথা আছে যা বলতে হবে। অনেক কিছু সে বলেছে অযথাই কঠোরভাবে… তার পরনে তখনও উজ্জ্বল সবুজ আলখাল্লা- সমরকন্দের স্মরণে সে সকালে পরিধান করেছিলো- যা পরেই সে পারস্যের প্রতিনিধি দলকে বিদায় জানিয়েছে। বাবর আনমনে অস্থায়ী শিবিরের ভিতর দিয়ে বাইসানগারের তাঁবুর দিকে হেঁটে যায় যার পাশেই বাবুরীর তাঁবু।

সে পর্দা সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। মেঝেতে রক্তের দাগযুক্ত কাপড়ের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে এবং মামুলি জিনিসপত্র যার বেশিরভাগই কাপড়চোপড় এদিক ওদিক ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে, যেনো কেউ তাবু ত্যাগ করার আগে সাথে কি নেবে আর নেবে না সেটা ঠিক তড়িঘড়ি করে ঠিক করেছে। তাঁবুর এককোণে একটা ভাঙা কাঠের মতো দেখতে কিছুর টুকরো পড়ে আছে। বাবর কাছে যেতে বুঝতে পারে সেটা আর কিছু না বাবুরীকে সে যেদিন, কোনো বেগী, ওস্তাদ ধনুর্ধর উপাধিতে ভূষিত করেছিলো সেদিন সে তাকে এই তীর আর সোনার কারুকাজ করা তূণ দিয়েছিলো। তীরটা ভেঙে দু’টুকরো করা এবং তূণটা তোবড়ানো, যেনো কেউ সেটা মাটিতে ফেলে তার উপরে লাফিয়েছে- কারুকাজ করা পাথরগুলো খুলে গিয়েছে। বাবর একটা পাথর মেঝে থেকে কুড়িয়ে নেয়। ছোট গোলাকার পাথরটা শীতল অনুভূত হয়।

বাবর দ্রুত তাঁবু থেকে বের হয়ে আসতে গিয়ে বাজপাখি উড়াবার সময়ে বাবুরীর ব্যবহৃত কালো চামড়ার দাস্তানায় আরেকটু হলে হোঁচট খেয়ে উল্টে পড়তো। বাইসানগার তাঁবুর বাইরে দু’জন প্রহরীকে কি সব নির্দেশ দিচ্ছে।

“বাবুরী কোথায়?”

“সুলতান, আজ সকাল থেকে আমি তাকে দেখিনি।”

“খুঁজে দেখো তার ঘোড়া আছে কিনা?”

বাইসানগার এক উজবেক সর্দারের কাছ থেকে বাবুরীর কেড়ে নেয়া বাদামী রঙের সুন্দর ঘোড়াটার খোঁজে লোক পাঠায়, কিন্তু বাবর ততক্ষণে উত্তর জেনে গিয়েছে। “গাধাটা চলে গেছে…”

“সুলতান?”

“বাবুরী- সে চলে গিয়েছে। তাকে খুঁজে ফিরিয়ে নিয়ে আসবার জন্য লোক পাঠান। এখনই পাঠান, এই মুহূর্তে!” বাবর এতোক্ষণে বুঝতে পারে সে চেঁচিয়ে কথা বলছে।

বাইসানগার চমকে উঠে এবং দ্রুত বাবরের কথামতো লোক পাঠাবার জন্য রওয়ানা হলে বাবর বাবুরীর তাঁবুর ভিতরে আবার প্রবেশ করে। সে ভাঙা ধনুকটা মাটি থেকে তুলে নেয়। বাইসানগারের লোকের ঘোড়া নিয়ে তাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও কোনো লাভ নেই। বাবুরী যদি হারিয়ে যেতে চায় তবে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

৩.৫ কিজিল-বাশ, টুপিতে লাল সালু

১৯. কিজিল-বাশ, টুপিতে লাল সালু

১৫১১ সালের শরৎকালের সেই উজ্জ্বল সূর্যালোকিত দিনটার কথা বাবর নামায় বিশেষ করে লিখতে হবে। বাবর ভাবে, যখন সে কালো উজবেক নিশানের বদলে ঝিরঝির বাতাসে পতপত করে উড়তে থাকা উজ্জ্বল সবুজ নিশানা সজ্জিত ফিরোজা দরোজার নীচ দিয়ে তার সেনাবাহিনী নিয়ে শহরে প্রবেশ করেছিলো। সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ এক তরুণ হিসাবে দশ বছর আগে সে শেষবারেরমতো সমরকন্দে একজন সুলতান হিসাবে প্রবেশ করেছিলো। আজ তার বয়স উনত্রিশ বছর, সেদিনের পর থেকে তার জীবনে যা কিছু ঘটেছে সবকিছুই তাকে অভিজ্ঞ আর পোড়খাওয়া এক যোদ্ধায় পরিণত করেছে।

কোনো সংঘর্ষ ছাড়াই শহরটার পতন হয়েছে। পারস্যের শাহের অশ্বারোহী বাহিনী এসে যোগ দেবার পরে বাবরের ঘোড়সওয়ারের সংখ্যা বিশ হাজারে উন্নীত হতে দখলদার উজবেকদের যুদ্ধ করার ইচ্ছা বেমালুম উবে গিয়েছিলো। বাবরের শক্তিশালী বাহিনীর মোকাবেলা করার বদলে তারা শহর ছেড়ে উত্তরের পাহাড়ে তাদের শক্তিশালী ঘাঁটি কারসিতে পালিয়ে যাওয়াকেই বাঞ্ছনীয় মনে করে। তাদের পলায়নের সংবাদ শুনে বাবর সাইবানি খানের করোটি রক্ত লাল সুরায় পূর্ণ করে তাতে একটা গভীর চুমুক দিয়ে তার সেনাপতিদের পর্যায়ক্রমে করোটিপাত্র থেকে পান করতে দেয়।

কাড়া-নাকাড়ার গমগমে আওয়াজের মাঝে, ঝকঝক করতে থাকা তোরণদ্বারের নিচে দিয়ে অতিক্রম করার সময়ে সে উৎফুল্ল চিত্তে ভাবে, অবশেষে আমার দিন বদলালো। আজ রাতে সে আর মাহাম- শাহী হারেমের অন্য মেয়েদের সাথে, সোনালী আর সবুজ টোপর দেয়া খচ্চরটানা গাড়িতে ভ্রমণ করছে। অনেক দিন পরে মিলিত হবে। শাহী জ্যোতিষবিদের গণনা অনুসারে, পুত্র সন্তান গর্ভধারণের জন্য গ্রহ-নক্ষত্র আজ তাদের সঠিক অবস্থানে রয়েছে। সে আরো একজন উত্তরাধিকারী লাভ করবে আর মাহামও হুমায়ুনের পরে আর কোনো সন্তান জন্ম। দিতে না পারার দুঃখ থেকে মুক্তি পাবে।

তোরণদ্বারের নিচের আবছা অন্ধকারের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে এসে সে শহরে প্রবেশ করতে, তার প্রজাদের উৎফুল্ল সমর্থন চিৎকারের মহিমায় গর্জে উঠে- উজ্জ্বল আলখাল্লার একটা জীবন্ত রংধনু- তার নাম আর তৈমূরের নাম এমন উদ্দীপনায় ধ্বনিত হয়, যেনো তার মহান পূর্বপুরুষ তার পাশেই রয়েছেন। দূর্গপ্রাসাদ এবং কোক সরাই অভিমুখী প্রশস্ত রাজপথ দিয়ে এগিয়ে যাবার সময়ে সে দেখে পথের দুধারে দোকানদারেরা তাদের দোকান সমরকন্দের বিখ্যাত রক্তলাল মখমল আর ভারী জরির কাজ করা পর্দা দিয়ে সাজিয়েছে। বাড়ির ছাদ আর জানালা থেকে অন্তপুরের মেয়েদের ছুঁড়ে দেয়া গোলাপের শুকনো পাপড়ি গোলাপী তুষারকণার মতো বাতাসে ভাসতে থাকে।

কিন্তু সহসা এই হাস্যোস্ফুল্ল আবহাওয়ায় ছেদ পড়ে। জনগণের ভেতর থেকে কর্কশ, ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর ভেসে আসে: “কিজিল-বাশ! কিজিল-বাশ!” লালসালু! লালসালু! বাবর ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখে ফিরোজা দরোজা দিয়ে প্রবেশ করা পারস্যের অশ্বারোহী বাহিনীর দিকে লোকেরা তাকিয়ে রয়েছে। একটা কণ্ঠস্বরের আওয়াজ এখন অসংখ্য কণ্ঠস্বর আপন করে নিয়েছে। সমবেত জনতা উত্তেজিত ভঙ্গিতে পার্সীদের মাথার চূড়াকৃতি পাগড়ি আর তার পেছনে ঝুলতে থাকা লাল কাপড়ের ফালির দিকে ইঙ্গিত করছে, যার মানে বাবর আর সমরকন্দের লোকদের মতো তারা সুন্নী মুসলমান না, বরং তাদের সম্রাট শাহের মতো তারাও শিয়া।

কোনো ব্যাপার না, বাবর নিজেকে প্রবোধ দিয়ে, গর্বিত ভঙ্গিতে সামনের দিকে তাকায়। সে শীঘই পারসিকদের দেশে ফেরত পাঠাবে আর তার প্রজারা তাহলে বুঝতে পারবে কেবল শিয়া হবার কারণে তাদের ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু তারপরেও সে তাদের বিক্ষুব্ধ চিৎকার আর বিড়ালের মাও ডাক ভুলতে পারে না।

তিন ঘণ্টা পরে, কোক সরাইয়ের আম দরবারে চিন্তিত মনে একাকী দাঁড়িয়ে ছাদের আর দেয়ালের চকচকে নীল, ফিরোজা, হলুদ আর সাদা টালির জ্যামিতিক নকশার দিকে তাকিয়ে থাকার সময়ে, যা প্রথমবার তাকে ভীষণ বিমোহিত করেছিলো, এই নতুন আশঙ্কা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এই মুহূর্তটার জন্য সে অনেকদিন প্রতীক্ষা করেছে, কিন্তু তারপরেও তার মনে হয় ফিরে আসবার গৌরব যেনো অনেকটাই ফিকে হয়েছে, ব্যর্থতার দাগ লেগেছে।

তার চারপাশের এই চমৎকারিত্ব ফিকে হয়ে সেখানে বাবুরীর মুখ ভেসে উঠে। বাবুরীর এখানে এখন নীল চোখে নিরব বিদ্রূপ নিয়ে তাকিয়ে থাকা উচিত ছিলো। কিন্তু সে উপস্থিত থাকলে এই মুহূর্তে কি মন্তব্য করতো? যে সেই আগাগোড়া ঠিক বলেছে, যে বাবর নিজেই এখন আর নিজের ভাগ্যনিয়ন্ত্রক না, অন্য কারো হাতের খেলার পুতুল? সে ভবিষ্যতের কথা ভাবলে যা কতোটাই না মহিমাময় হবে বলে সে ভেবেছিলো, বাবরের এবার সত্যিই নিজেকে একা মনে হয়…

***

“সুলতান তারা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।” বাইসানগারের কঠোর মুখের বলিরেখাগুলো আরো গভীর দেখায়। তৈমূরের আংটি নিয়ে ঘোড়া হাঁকিয়ে ফারগানা আসা সেই যোদ্ধার বলিষ্ঠতা তার আর নেই। বাবর ভাবে, তাকে গ্রান্ড উজিরের দায়িত্ব দিয়ে সে ভালোই করেছে। যোদ্ধা হিসাবে তার লড়াকু মনোভাব আর বিশ্বস্ত তা এমনই উপযুক্ত প্রতিদান আশা করে এবং মাহামও নিজের পিতাকে এভাবে সম্মানিত হতে দেখে খুশিই হয়েছে।

বাইসানগার কি আজকাল নিজের ভেতরে উঁকি দেয়া হতাশা টের পায়? মুখের উপরে শীতল বাতাসের ঝাপটা অনুভব করতে করতে চন্দ্রালোকিত রাতে পাহাড়ের উপর থেকে শত্রুর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে কি সে এখনও আগ্রহী? বা তারার কিংখাবের নিচে, তরবারি পাশে নিয়ে, যখন আগামীকালের গর্ভে কি আছে তা অজানা। কিন্তু আজকের চেয়েও তা বিপদসঙ্কুল আর অনিশ্চিত হবে সেটা নিশ্চিত জেনে, ঘুমাতে যাওয়া? বাবর জানে অভিযানে বেরিয়ে পড়ার জন্য তার এই হ্যাংলামোর কোনো মানে হয় না। কিন্তু সত্যি কথা হলো সমরকন্দে মাত্র ছয় সপ্তাহ কাটাবার পরেই সে আবার বেরিয়ে পড়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। সে কাবুলে ফিরে গিয়ে দেখতে চায় সেখানে সবকিছু ঠিক আছে। যদিও সেখানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সে যথেষ্ট সুরক্ষিত করেই এসেছে। সে ফারগানা পুনরুদ্ধার করতে চায়। উজবেকদের নাজেহাল দশা হবার পরে স্থানীয় গোত্রপতিরা, যাদের দলে যোদ্ধার চেয়ে কুকুরের সংখ্যা বেশি, যা নিজেদের ভিতরে সুবিধামত ভাগ করে নিয়েছে। সমরকন্দ ছেড়ে বের হতে পারলে সে একটা মোক্ষম আঘাতে তাদের রাজা হবার শখ মিটিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তার আগে তাকে শহরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শহরের অভিজাত নাগরিকদের সে ডেকে পাঠিয়েছিল কিভাবে সমরকন্দ আগামীতে শাসিত হবে, সেটা ঘোষণা করবে বলে এবং এখন তারা তার জন্য অপেক্ষা করছে- কোনো সন্দেহ নেই সবাই দায়িত্ববিহীন পদমর্যাদার পারিশ্রমিকের জন্য মুখিয়ে আছে।

বাবর তার দরবার মহলে প্রবেশ করে মঞ্চে উঠে দাঁড়ায়। বাইসানগারের নির্দেশে অপেক্ষমান প্রজারা সবাই নরম গালিচার উপরে নতজানু হয়ে কুর্নিশ করে। উজবেকরা পালিয়ে যাবার সময়ে তাড়াহুড়োর কারণে গালিচাগুলো নিয়ে যেতে পারেনি। বাবর যান্ত্রিকভাবে তাদের কুর্নিশের জবাব দেয়, অন্য কোনো একটা ভাবনা তার মন আচ্ছন্ন করে রেখেছে। পারস্যের অশ্বারোহী বাহিনীর এতোদিনে দেশে ফিরে যাওয়া উচিত ছিলো। বাবরকে সুলতান হিসাবে স্বীকার করে খুতবা পাঠ শেষ হওয়ামাত্র যদিও বেশিরভাগ সৈন্যই দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলো। সঁইপ্রস্তুতকারকদের দরোজার বাইরে তৃণভূমিতে এখনও হাজারখানেক ঘোড়সওয়ার তাঁবু খাঁটিয়ে অপেক্ষা করছে। সেখানে তাদের সাথে শাহের ব্যক্তিগত মাওলানা মোল্লা হুসেন অবস্থান করছেন। সে যখনই তার কাছে জানতে চেয়েছে পার্সীরা তাদের সেনাপতিকে- শাহের গাট্টাগোট্টা চেহারার কঠোর দর্শন এক চাচাতো ভাই নিয়ে কবে পারস্যে ফিরে যাবে। তাকে প্রতিবারই শুনতে হয়েছে তিনি নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছেন। আদেশ পাওয়ামাত্রই সে তার লোকদের নিয়ে ফিরে যাবে।

বাবর তাদের ফিরে যাবার আদেশ দিতে না পারলেও সমরকন্দের রাস্তায় তারা যাতে চলাফেরা না করে সে বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছে। জনগণের বিরূপতা এখনও হ্রাস পায়নি। বাবর শাহের আনুগত্য মেনে নিয়েছে জানাজানি হবার পরে তাদের ভিতরে, সে যেমন আশা করেছিলো যে একজন শক্তিশালী সম্রাটকে মিত্র হিসাবে লাভ করে তারা আশ্বস্ত হবে। উল্টো হয়েছে। একটা সন্দেহ শহরের নাগরিকদের মনে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। শহরের মোল্লারা ইতিমধ্যে কয়েকবার তার সাথে দেখা করে নিশ্চিত হতে চেয়েছে যে শাহ তাদের ধর্মের ব্যাপারে আদৌ নাক গলাবে না। শহরের মাদ্রাসার এক বয়োবৃদ্ধ মোল্লা, যার মুখ তার পরণের আলখাল্লার মতোই ফ্যাকাশে ধূসর, তিনি তো বাবরকে খারেজী পার্সীদের সাথে সন্ধি করায় তাকে রীতিমত তিরস্কার করেন। আর পার্সীদের শহর থেকে বের করে দিতে বলেন। “এমনকি উজবেকরা- যদিও আমাদের শহর তারা লণ্ডভণ্ড করেছে তারা আল্লাহতালার সত্যিকারের অনুসারী অন্তত ছিলো…” তিনি বলেন। “উজবেকরা…” বাবর স্বপ্নেও কল্পনা করেনি তাকে এই কথা কখনও শুনতে হতে পারে। পার্সীদের যেভাবেই হোক ফেরত পাঠাতে হবে।

“সুলতান।” বাইসানগারের কথায় তার চিন্তার জাল ছিন্ন হয়। “আপনার প্রজারা অপেক্ষা করছে আপনার বক্তব্য শোনার জন্য।”

বাবর তার হাতের কাগজের ভাঁজ খুলে যেখানে সর্বশেষ শাহী নিয়োগের তালিকা লেখা রয়েছে- ময়ূরকণ্ঠী নীল রঙের আলখাল্লা পরিহিত এক মোটাসোটা সওদাগর উৎসুক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু সে যখন কাগজের ভাঁজ খুলছে, তখন মখমল আবৃত গিল্টি করা সিংহাসন যে যাতে উপবিষ্ট সেটা একপাশে হেলে পড়ে। বাবর শেষ মুহূর্তে চেষ্টা করে নিজেকে আর সিংহাসন সোজা করতে কিন্তু তাতে ফল হয় বিপরীত সে আলুর বস্তার মতো সিংহাসন নিয়ে মেঝেতে আছড়ে পড়ে। বাতাসে মড়মড় শব্দ আর দরবারের সবকিছুই যেনো কেঁপে উঠে। উজ্জ্বল। টালিযুক্ত চুনসুড়কির একটা দলা তার পাশে আছড়ে পড়ে।

কটু-স্বাদের ধোঁয়ায় বাতাস আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে এবং বাবর টের পায় তার শ্বাস আটকে আসছে। কিন্তু সে মরীয়া হয়ে নিঃশ্বাস নিতে চেষ্টা করতে মুখ পাথরের কণায় ভরে উঠে। তার চোখ খুলে রাখতেও কষ্ট হয়। দু’হাতে মাথা ঢেকে সে অপেক্ষা করে এই বুঝি আরেক টুকরো চুনসুরকির দলা তার মাথায় ভেঙে পড়লো। কিন্তু উদ্বিগ্ন কয়েক মুহূর্ত কাটাবার পরে যেমন আকস্মিকভাবে কম্পন শুরু হয়েছিলো ঠিক সেভাবেই সব শান্ত হয়ে যায়। তার চারপাশে বাড়তে থাকা গোঙানির শব্দে বাবর সতর্কতার সাথে মাথা তুলে এবং অঝোরে পানি ঝরতে থাকা চোখ কোনোমতে সামান্য ফাঁক করে তাকায়। কয়েক স্থানের পাথর স্থানচ্যুত হলেও কোক সরাইয়ের ছাদ আর দেয়াল ভূমিকম্পের ধাক্কা সামলে নিয়েছে। তৈমূরের নির্মাতারা দারুণ কাজ করে গিয়েছে। কিন্তু চারপাশে ভালো করে তাকালে সে মেঝেতে বাইসানগারকে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে তার উজ্জ্বল সবুজ রঙের শাহী আলখাল্লা এখন ধূসর হয়ে গিয়েছে।

“প্রহরী!” বাবর চিৎকার করে। কিন্তু বুঝতে পারে না সাড়া দেবার মতো অবস্থায় কেউ আছে কিনা। অবশ্য তার আশঙ্কা অমূলক প্রমাণ করে সাথে সাথে সে ধাবমান পায়ের আওয়াজ শুনতে পায়। পাশের কক্ষে দায়িত্বরত দেহরক্ষী দলের দুজনকে সে উড়তে থাকা ধূলোর ভিতর দিয়ে দৌড়ে আসতে দেখে। “আমার ব্যক্তিগত হেকিমকে ডেকে পাঠাও। আর অন্য কাউকে খুঁজে পেলে তাকেও নিয়ে এসো। গ্রান্ড উজির সাথে আরও অনেকে আহত হয়েছেন।” বাবর নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। এবং টলোমলো পায়ে বাইসানগারের পাশে গিয়ে বসে তার গলার পাশে আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করে। যুদ্ধক্ষেত্রে বহুবার আহত সহযোদ্ধার গলায় সে এভাবে হাত রেখেছে। হ্যাঁ, গ্রান্ড উজির জীবিত- সে তার রক্তের ক্ষীণ কিন্তু ছন্দোবদ্ধ ধারা অনুভব করতে পারে। তার কপালে একটা বিশাল কালশিটে দাগ বেগুনী বর্ণ ধারণ করতে শুরু করেছে। বাইসানগারের চোখ পিটপিট করে এবং সে চোখ খুলে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে বাবরের দিকে তাকায়।

“ভূমিকম্প হয়েছিলো… হেকিম আসছে।” বাবর তার আলখাল্লার বাইরের অংশ ছিঁড়ে সেটা গোল করে মুড়ে একটা বালিশের মতো করে সেটা বাইসানগারের মাথার নিচে গুঁজে দেয়। “আমি জেনানামহলের অবস্থা দেখতে যাচ্ছি।”

দরবার কক্ষে তার চারপাশে বিভ্রান্ত লোকেরা উঠে দাঁড়িয়ে অপরকে দাঁড়াতে সাহায্য করছে। কিন্তু অনেকেই তখনও অনড় অবস্থায় পড়ে রয়েছে। চুনসুড়কির দলার উপর দিয়ে হড়বড় করতে করতে বাবর বের হয়ে এসে চওড়া সিঁড়ি দিয়ে উপরে জেনানামহলের দিকে দৌড়াতে শুরু করে। একেকবারে দুটো করে ধাপ টপকে যাবার ফাঁকে সে কালো পাথরের গায়ে চওড়া ফাটল খেয়াল করে এবং মশালসমূহ তাদের নির্ধারিত স্থান থেকে পড়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে- সে লাথি। মেরে তাদের একপাশে সরিয়ে দেয়। কিন্তু তৈমূরের দেয়াল এখানেও ভূমিকম্পের ধাক্কা সামলে নিয়েছে।

সিঁড়ির শেষ প্রান্তে সে লম্বা দ্বৈতদরোজা দেখতে পায়- কিশোর বয়সে বাবর আর তার লোকেরা দরজাটা ভাঙার পরে পুনরায় নতুন করে রূপার আস্তরণ আর টালি দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে- অক্ষতই দাঁড়িয়ে আছে। যদিও দরজার উপরের পাথরের সরদলে একটা ফাটল দেখা দিয়েছে এবং কারুকার্যময় টালির ছাদের অংশ বিশেষ খসে মেঝেতে প্রজাপতির ডানার মতো উজ্জ্বল টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। বাইরে অবস্থানরত পরিচারক দলের কাউকেই সে দেখতে পায় না। দায়িত্ব পালনে অবহেলার জন্য সে পরে তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেবে ভাবতে ভাবতে বাবর কাঁধ দিয়ে দরজার পাল্লায় ধাক্কা দেয় এবং খুলে ভেতরে প্রবেশ করে।

সে ভেতরে যে মুখটা প্রথম দেখতে পায় সেটা মাহামের, কোমর পর্যন্ত লম্বা চুল মাথার চারপাশে আলুথালু হয়ে ঝুলে আছে। বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে সে কামরার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে, উল্টে পড়া আসবাবপত্র, ভাঙা বাসনকোসন আর ছিটকে পড়া খাবার ছাড়া পুরো কামরাটা অক্ষতই আছে বলা চলে। ফোঁপাতে থাকা হুমায়ুনকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে মাহাম চকচকে চোখে তাকিয়ে রয়েছে।

“হুমায়ূন দেখেছো? আমি বলেছিলাম না, ভয় পাবার কিছু নেই… এক বোকা দৈত্য কেবল পা দাপিয়ে আমাদের ভয় দেখাতে চেষ্টা করেছিলো…আমি বলেছিলাম না তোমার আব্বাজান ঠিকই আসবেন।” বাবর মাহামের কপালে আলতো করে চুমু খায় এবং হুমায়ূনকে তার কোল থেকে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে তার দেহের উষ্ণতা অনুভব করে। তিন বছর বয়স হবার কারণে বেচারার নাদুসনুদুস ভাব অনেকটাই কমে এসেছে। ছেলেটার বাদামী চোখ- একেবারে তার মায়ের মতোই- বাবরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবী সুলতান কান্না থামিয়ে জুলজুল চোখে বাবরের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে।

*

“ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কততটা ভয়াবহ?”

“বেশ ভালোই ক্ষতি হয়েছে। অনেক বাসস্থান আর শস্যগোলার ক্ষতি হয়েছে, সুলতান। কোক সরাইয়ের মতো শক্ত ছিলো না সেগুলো। প্রায় একশজন মতো লোক ধবংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে মারা গেছে এবং আরও তিনশ জন লোক আহত হয়েছে।” বাইসানগারের মাথার বিশাল উজিরের পাগড়ির নিচে, তার মুখ এখনও বিশ্রীভাবে ফুলে রয়েছে যদিও সে দ্রুতই আরোগ্য লাভ করছে।

“পুনর্গঠনের জন্য শাহী কোষাগার থেকে সব ধরণের সুবিধা দেয়া হবে শহরবাসীদের সেভাবেই জানিয়ে দাও- আর কারো প্রয়োজন হলে তাকে আমাদের শস্যভাণ্ডার থেকে সাহায্য দাও…শীতকাল এসে পড়েছে। আমি চাই না আমার লোকেরা এসময় অভুক্ত থাকুক।”

“হ্যাঁ, সুলতান।”

বাইসানগার বিদায় নিতে বাবর তার অষ্টভূজাকৃতি সোনার পানি দিয়ে কারুকাজ করা ব্যক্তিগত সাক্ষাতের জন্য ব্যবহৃত কক্ষে চুপচাপ বসে থাকে। নিজেকে তার ভাগ্যবান বলে মনে হয়। তার দুই বেগমই- মাহাম আর গুলরুখ- আর তার দুই নয়নের মণি হুমায়ূন এবং কামরান সুস্থ আছে। খানজাদা, কাবুলে খুতলাঘ নিগারের সাথে নিরাপদে রয়েছে। কিন্তু তার শাসনকালের প্রারম্ভে এমন বিপর্যয় একটা অশুভ সংকেত হিসাবে বিবেচিত হবে। শহরের লোকজন ইতিমধ্যে ভূমিকম্পের জন্য পার্সীদের উপস্থিতিকে দায়ী করতে শুরু করেছে। জুম্মার নামাজের জন্য মুয়াজ্জিনের আযানের ধ্বনি বাবরের বিষণ্ণ ভাবনার জাল বারবার ছিন্ন করে। সে ভুলেই। গিয়েছিলো আজ শুক্রবার এবং বড় মসজিদে সবার সাথে তাকে নামাজ আদায় করতে হবে। শহরের লোকেরা এতে প্রীত হবে। আর সেও খানিকটা আধ্যাত্মিক স্বস্তি খুঁজে পাবে, যা হয়তো তার অস্থিরতা আর অস্বস্তি কাটাতে সাহায্য করবে।

বিশ মিনিট পরে, জরির কাজ করা সবুজ একটা জোব্বা, কোমরে গাঢ় সবুজ বেণী। করা পশমের পরিকর, আর তার উপরে নরম লোমের আস্তরণ দেয়া আলখাল্লা পরিহিত অবস্থায়, গলায় সোনার কলাই করা একটা কণ্ঠহার, পায়ের হরিণের হলুদ চামড়ার তৈরি নাগরা আর কোমরে আলমগীর ঝুলিয়ে রাজকীয় সাজে সজ্জিত হয়ে বাবর ঘোড়ার চেপে কোক সরাই থেকে বের হয়ে এসে তৈমূরের মসজিদের সুউচ্চ ধনুকাকৃতি খিলান, ইওয়ান, বরাবর এগিয়ে যায়। তার দেহরক্ষীর দল বর্শার ফলা দিয়ে সামনের জনাকীর্ণ সড়ক পরিষ্কার করতে থাকে। কিন্তু জুম্মার নামাজে ব্যস্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে যাওয়া নামাজীদের কলরবের বদলে আজ চারপাশে কেমন একটা নিরানন্দ বিষণ্ণতা বিরাজ করছে।

মসজিদের বাইরে আঙ্গিনায় পৌঁছে গাছের উড়তে থাকা সোনালী ঝরা পাতার মাঝে বাবর ঘোড়ার পিঠ থেকে নামে এবং অনুসরণরত দেহরক্ষী দল নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। ইমাম সাহেব- বৃদ্ধলোকটা যিনি পার্সীদের ব্যাপারে তাকে তিরস্কার করতে কোক সরাই গিয়েছিলেন- মেহরাবের কারুকাজ করা মার্বেলের বেদীর একপাশে দাঁড়িয়ে ওয়াজ নসিহত করছেন। মসজিদে নামাজীদের প্রথম সারির ঠিক মধ্যস্থলে সুলতানের জন্য নির্ধারিত স্থানে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে এবং মাথা নিচু করে সেজদা দেয়। ইমাম সাহেব মানব জীবনের নশ্বরতা নিয়ে আলোচনা করছেন এবং ভূমিকম্পে যারা ক্ষগ্রিস্থ হয়েছে তাদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন। বাবর টের পায়, অসংখ্য চোখ তার দিকে উৎসুক ভঙ্গিতে তাকিয়ে ইমাম সাহেবের কথা শুনছে।

ইমাম সাহেব সহসা কথা বন্ধ করেন। চমকে মাথা তুলে তাকিয়ে বাবর দেখে তিনি মসজিদের প্রবেশ পথের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে সে দরজায় শাহের ব্যক্তিগত মোল্লা ইমাম হুসেনের লম্বা, চাপদাড়িঅলা গাট্টাগোট্টা অবয়বটা দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখতে পায়। তার মাথায় চূড়াকৃতি লাল টুপি আর পরণে শিয়াদের আজানুলম্বিত লাল আলখাল্লা। তার অনুগামী ছয়জন পার্সী অশ্বারোহী সদস্যদের মাথাতেও লাল সালুর সুস্পষ্ট কিজিল-বাশ টুপি। মিম্বারে দাঁড়িয়ে থাকা বয়স্ক মোল্লার বিস্মিত দৃষ্টি উপেক্ষা করে তিনি তার দিকে এগিয়ে যান চারপাশে ক্রমশ বাড়তে থাকা অসন্তোষের শব্দে কর্ণপাত না করে।

হুসেন সরাসরি বাবরের চোখের দিকে তাকান। “আপনার অতিথি হিসাবে, শিয়া আর সুন্নী, সব মতাবলম্বী বিশ্বাসীদের কাছে পবিত্র বলে বিবেচিত এই দিনে আমি কি ওয়াজ করতে পারি?”

বহু কষ্টে নিজের ক্রোধ দমন করে যা অনায়াসে প্ররোচণা আর অভব্যতার নিদর্শন। হিসাবে গণ্য হতে পারে। বাবর কাঠখোট্টাভাবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় এবং বয়স্ক মোল্লাকে মিম্বার থেকে নেমে আসতে ইঙ্গিত করে।

হুসেন তার স্থানে গিয়ে দাঁড়ায়। “আমাকে কথা বলার সুযোগ দেবার জন্য আমি সুলতানের কাছে কৃতজ্ঞ। পরম করুণাময় আল্লাহতালার অপার করুণা তার উপরে বর্ষিত হোক। কয়েকমাস আগে, পৃথিবীর অধিশ্বর পারস্যের শাহ্ ইসমাইলের সহায়তায় আপনারা এক অশুভ শক্তির হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন। আপনাদের শত্রু উজবেকরা লেজ তুলে পালিয়েছে এবং আপনারা আপনাদের সুলতানকে ফিরে পেয়েছেন। শাহ্ এজন্য খুবই খুশি হয়েছেন। তিনি আর খুশি হয়েছেন যে মহামান্য সুলতান বাবর শাহ্ ইসমাইলকে অধিরাজ হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছেন…শাহ্ আপনাদের সুলতানকে নিজের ভাইয়ের মতো মনে করেন। কিন্তু, সে জন্য অবশ্য, ভাইদের একই বিশ্বাসে বিশ্বাসী হতে হয়। শাহ্ আমাকে আদেশ দিয়েছেন। আপনাদের সুলতানকে একজন বিশ্বাসী শিয়া হিসাবে স্বীকার করে নিতে। যাতে তার প্রজারাও একই বিশ্বাসের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠতে…” একটা সম্মিলিত আঁতকে উঠার শব্দ মসজিদে ভেসে উঠে…

“না!” বাবর লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। “আমি শাহের প্রতি আমার আনুগত্য ঘোষণা করেছি বটে, কিন্তু আমার ধর্মবিশ্বাস একান্তই আমার নিজস্ব ব্যাপার। আমি কখনও সেটা বদলাবো না বা আমার লোকদেরও জোর করে মত পরিবতনের শিকার হতে দেবো না। বহু শতাব্দি ধরে তৈমূরের বংশধর এখানে শাসক হিসাবে রয়েছে। তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে কোনো লাভ হয়নি। আমাকেও হবে না। তোমার প্রভুকে সেটা বলে দেবে…”।

হুসেনের কালো চোখের মণি ঝলসে উঠে, সে মিম্বারের রেলিং আঁকড়ে ধরে। বোঝাই যায়, সে কারো চড়া কণ্ঠস্বর, এমন সেটা সুলতানের হলে, শুনতে অভ্যস্ত না। “আমার প্রভু অনেক উদারতা দেখিয়েছেন। ভুলে যাবেন না আপনি আপনার সালতানাতের জন্য তার কাছে কৃতজ্ঞ।”

বাবর সতর্কতার সাথে তার বাক্য চয়ন করে। “আমি অনেক ব্যাপারেই শাহের কাছে কৃতজ্ঞ। আমি আরও জানি তিনি একজন বিচক্ষণ মানুষ, যিনি তার বিশ্বস্ত বন্ধুর উপরে অসম্ভব কিছু চাপিয়ে দেবেন না। স্পষ্টতই কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। আমি অবিলম্বে পারস্যে বার্তাবাহক পাঠাবো তা নিরসন করার অভিপ্রায়ে। আমি আপনাকেও পারস্যে ফিরে যাবার পরামর্শ দেবো। আপনার আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনার অভাব তিনি নিশ্চয়ই অনুভব করছেন এবং আপনার অনুপস্থিতির জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন।”

হুসেন তার চাপদাড়িঅলা বিশাল মাথাটা আক্ষেপে এপাশ ওপাশ করে। বাবর ভাবে, অনেক হয়েছে। নিজের দেহরক্ষীদের ইশারায় অনুসরণ করতে বলে সে মসজিদ থেকে বের হয়ে আসে। মসজিদের উপস্থিত নামাজীরা এতোক্ষণ পর্যন্ত চুপচাপ সব কিছু দেখছিলো আর শুনছিলো। কিন্তু এখন সে তার পেছনে একটা গুঞ্জন শুনতে পায়- ভীমরুলের ক্রুদ্ধ গর্জনের মতো সেটা বাড়তে থাকে। সে হেঁটে আঙ্গিনা অতিক্রম করে ঘোড়ায় চেপে বসতে, লোকজন পিলপিল করে মসজিদ থেকে বের হয়ে আসতে থাকে। কেউ কেউ শাহ আর তার মোল্লার বিরুদ্ধে ক্রুদ্ধ। কণ্ঠে কিছু বলছে এবং অন্যেরা বাবর বুঝতে পারে তাকে উদ্দেশ্য করে অপমানসূচক মন্তব্য করছে।

মসজিদ থেকে বের হয়ে আসা নামাজীদের সাথে শীঘ্রই কোলাহলের কারণ খুঁজতে আশেপাশের বাড়িঘর থেকে বের হয়ে আসা লোকজন যোগ দেয় এবং কি ঘটছে। জানতে আগ্রহী হয়ে উঠে। তার দেহরক্ষী দলের সর্বাত্মক প্রয়াস সত্ত্বেও এবং বাবরের কর্চির উঁচুতে ধরে থাকা সমরকন্দের সবুজ রঙের শাহী নিশানও। তারা কোক সরাইয়ের উদ্দেশ্যে ফিরতি পথ ধরলে মসজিদের উদ্দেশ্যে আগুয়ান লোকজনের চাপে প্রায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।

পুরো পরিস্থিতি একটা দাঙ্গার রূপ নিতে চলেছে। মসজিদের পার্সী গর্দভগুলোকে যেকোনোভাবে রক্ষা করতে হবে নতুবা সমরকন্দ আক্রমণ করতে শাহের কোনো অজুহাতের প্রয়োজন হবে না। “দ্রুত কোক সরাইয়ে গিয়ে বাড়তি লোকবল নিয়ে এসো। এখনই!” বাবর তার দু’জন লোককে আদেশ দেয়। তারপরে তরবারির বাঁটে হাত রেখে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ভীড়ের ভিতর দিয়ে মসজিদের দিকে এগিয়ে যাবার ফাঁকে, বাকিদের তাকে অনুসরণ করতে বলে। মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে সে উপস্থিত ক্রুদ্ধ লোকদের শান্ত করতে একটা বক্তব্য রাখে।

“পবিত্র কোরানের নামে কসম করে আমি বলছি যে একজনও নারী, পুরুষ বা শিশুকে জোর করে গোত্রান্তরিত করা হবে না!” সে গলার সর্বশক্তি দিয়ে বলে। কিন্তু কেউ তার কথায় কান দেয় না। বরং একটা ক্রুদ্ধ চিৎকারে চারপাশ গমগম করে উঠে। বাবর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে, মোল্লা হুসেন মসজিদের প্রবেশ দ্বার দিয়ে বের হয়ে আসছেন, পার্সী দেহরক্ষীর দল উদ্যত তরবারি হাতে তার ঠিক পেছনেই রয়েছে। একটা পচা তরমুজ বাতাসে ভেসে হুসেনের দিকে এগিয়ে গেলে সে সেটা কাটাবার কোনো চেষ্টাই করে না। তরমুজটা তার পায়ের কাছে আছড়ে পড়তে তার আলখাল্লায় কমলা রঙের আঁশ আর বিচি ছিটকে এসে লাগে। এর ঠিক পরপরই কিছু একটা উড়ে যায় যা দেখতে অনেকটা কাঁচা গোবরের মত। লোকদের সাহস বেড়ে গেলে একটা পাথরের টুকরো মোল্লার বাম কান ছুঁয়ে গিয়ে মসজিদের দেয়ালে আছড়ে পড়ে দেয়ালের কারুকাজ করা নীল টালির একটা চটা খসিয়ে দেয়।

লোকজন এবার আরও সাহসী হয়ে উঠে, হাতের কাছে যা পায় তুলে নিয়ে গালিগালাজের তুবড়ি ছুটিয়ে সামনে এগিয়ে আসে এবং ছুঁড়ে মারতে থাকে। ঘৃণায় তাদের মুখগুলো বিকৃত হয়ে আছে, ঠোঁট উল্টান আর চোখ যেনো ছিটকে বের হয়ে আসবে। তরবারি বের করে বাবর তার দেহরক্ষীদের পার্সী আর ক্রুদ্ধ শহরবাসীদের মাঝে একটা দেয়াল সৃষ্টি করতে বলে। তারপরে, তার ঘোড়ার পাজরে খোঁচা দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে এসে সে শেষবারের মতো চেষ্টা করে কুদ্ধ জনতাকে শান্ত করতে। কিন্তু তারা ততক্ষণে কোনো কথা শোনার অবস্থায় আর নেই। পার্সীদের পেড়ে ফেলতে বদ্ধপরিকর লোকগুলো তাকে পাত্তা না দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করে। কমলা পাগড়ি পরিহিত বিশালদেহী এক লোক তার ঘোড়ার লাগাম আঁকড়ে ধরে। লোকটা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলো নাকি তাকেই আক্রমণ করতে এসেছিলো বাবর পরিষ্কার বুঝতে পারে না। কিন্তু সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে খঞ্জর বের করে লোকটার বাহুতে আঘাত করে। ব্যাথায় কুঁকড়ে গিয়ে লোকটা লাগাম ছেড়ে দেয় এবং সামনে হোঁচট খেয়ে পড়ে। বাবরের ভীত ঘোড়াটা পেছনের পায়ে ভর দিয়ে লাফিয়ে উঠে এবং এক পায়ের খুর দিয়ে লোকটার মুখে ঘুষির মতো আঘাত করে। একটা পাথরের মতো টুপ করে সংজ্ঞাহীন লোকটা মাটিতে আছড়ে পড়ে।

অন্যেরা এতোক্ষণে তার ঘোড়ার লাগাম ধরে টানাটানি শুরু করেছে তাকে ঘোড়াসুদ্ধ মাটিতে আছড়ে ফেলার মতলব। তারা কি জানে তারা কাকে আক্রমণ করেছে? বাবর পাগলের মত চারপাশে তরবারি চালাতে থাকে। নিজের দেহরক্ষী দলের কাছে ফিরে যেতে চেষ্টা করে। কিন্তু তার আক্রমণকারীরা সংখ্যায় অনেক বেশি। তাদের একজনের হাতে কসাইয়ের চাপাতির মতো দেখতে কিছু একটা ঝলসায়। বাবরকে আঘাত করার বদলে সে চাপাতিটা দিয়ে তার ঘোড়ার গলায় একটা মোক্ষম কোপ বসিয়ে দেয়। বিশাল পশুটা সামনের পা মুড়ে একটা বিকট আর্তনাদের মতো থরথর শব্দ করে মাটিতে আছড়ে পড়ে।

বাবর রেকাব থেকে পা বের করে লাফিয়ে পাশে গড়িয়ে যায়। সে অসংখ্য কণ্ঠস্বরকে বলতে শুনে, “বিশ্বাসঘাতক!” এবং “খারেজী; নব্যতান্ত্রিক!” তারপরে লোকদের সাঁড়াশির মতো হাত নিজের দেহে অনুভব করতে সে মোচড় কেটে কোনোমতে পায়ের ভীড়ের ভিতর দিয়ে হামাগুড়ি দিতে থাকে যতক্ষণ না চারপাশে পায়ের দঙ্গলের চাপ পাতল। হয়ে আসে। বাবর তার দেহরক্ষীদের থেকে ক্রুদ্ধ জনতার চাপে আলাদা হয়ে পড়তে বুঝতে পারে যতো শীঘ্র সম্ভব তাকে কোক সরাইয়ে ফিরে যেতে হবে। একটা গভীর শ্বাস নিয়ে বাবর লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং মাথা নিচু করে দুহাতে উদ্যত অস্ত্র নিয়ে দৌড়াতে শুরু করে।

একটা বাঁক ঘুরে সে একটা ছোট ফাঁকা চত্বরে এসে উপস্থিত হয় এবং সে পেছনে যে হট্টগোল ফেলে এসেছে এখনও যার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে তার তুলনায় জায়গাটা অনেকটা শান্ত দেখায়। ভূমিকম্পের কারণে দু’পাশের বাড়িঘর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে; দোমড়ানে মোচড়ানো কজা থেকে লোহা থেকে বাঁধান দরজাগুলো হাস্যকর ভঙ্গিতে ঝুলছে এবং দেয়ালে ফাটল ধরছে কিছু কিছু এতোটাই বিশাল যে অনায়াসে প্রাপ্তবয়স্ক একজন লোক প্রবেশ করতে পারবে। বাড়ির মালিক তাদের পরিত্যাগ করেছে আর যেসব এখনও বাসযোগ্য অবস্থায় আছে সেগুলোর মালিকও ভয়ের কারণে সেখানে আপাতত বাস করছে না।

প্রাঙ্গনটার এক কোণে, একটা পুরাতন বাড়ির ছাদের প্রান্তভাগের কাছে পুরো বাড়িটাই বিধ্বস্ত হয়েছে- একটার উপরে আরেকটা ছাদ নিখুঁতভাবে ধ্বসে পড়েছে। একটা কুঁয়ো রয়েছে। বাবর দৌড়ে সেখানে যায় এবং চামড়ার মশকটা পানিতে ডুবিয়ে ঈষৎ লোনা পানি আজলা ভরে পান করে। মুখ মুছে সে চারপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। যুদ্ধক্ষেত্রে বা হামলার সময়ে যেমন আত্যন্তিক লক্ষ্যে সবকিছু বিবেচনা করতে থাকে, তেমনিভাবে এখনও তার মস্তিষ্ক কাজ করছে। তার ভাবতে অবাক লাগে বসে থেকে থেকে সে বিরক্ত হয়ে উঠেছিলো আর কিছু করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলো আর এতো তাড়াতাড়ি তার মনোবাসনা এভাবে পূর্ণ হবে।

তাকে দ্রুত এখান থেকে সরে পড়তে হবে। যেকোনো সময়ে চিৎকার করতে থাকা, ক্রুদ্ধ জনতা- পাশের কিংবা তার পাশের গলিপথ অতিক্রম করে তাকে খুঁজে পাবে। তার ডানপাশে প্রাঙ্গন থেকে একটা সরু গলিপথ এগিয়ে গেছে। সে গলিপথটা ধরে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখে যে ভূমিকম্পের ফলে সেটা ভেঙে পড়া বাড়িঘরের ধবংসস্তূপে একেবারে আটকে আছে।

“ঐ যে ওখানে- হারামজাদা আমাদের সবাইকে খারেজী করতে চেয়েছিলো।” গলির দেয়ালে হেলান দিয়ে বাবর পেছনে প্রাঙ্গনের দিকে ফিরে তাকায়, দেখে আটদশজন লোকের একটা দল, পরণের কাপড় ঘেঁড়া, মুখে রক্ত লেগে আছে। হাতের কাছে লাঠিসোটা যে যা পেয়েছে নিয়ে ছুটে আসছে। নিঃসন্দেহে বেচারারা প্রাণপণে দৌড়ে এসেছে কারণ সবার মুখেই বিক্ষুব্ধতা আর ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। সদ্য খুন করেছে এমন যোদ্ধার অভিব্যক্তি তাদের চোখেমুখে, বাবর বহুবার যা দেখেছে। দোকানদার বা কারখানার কারিগর এই লোকগুলো- যে পেশারই হোক না কেন খুন করেছে আর রক্তের স্বাদ পেয়েছে।

কিন্তু তারা তাকে দেখছে না। বস্তুত পক্ষে সে বুঝতে পারে তারা তাকে দেখেইনি। তারা বাবরের দৃষ্টিসীমার বাইরে এবং উঁচুতে কিছু একটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সতর্কতার সাথে সে প্রাঙ্গনের দিকে পিছিয়ে আসে। তারপরেই সে কেবল দেখতে পায় লোকগুলি কি দেখছে। তারা যে “হারামজাদা”কে ধাওয়া করছে তিনি আর কেউ নন, মোল্লা হুসেন, প্রাঙ্গনের একটা উঁচু অক্ষত ভবনের উপর তলা থেকে তিনি নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার লাল টুপি কোথায় যেনো পড়ে গেছে, কালো চাপদাড়ির উপরে মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে। কিন্তু ধাওয়াকারীদের দিকে চোখ পড়তেই তার কালো চোখের মণি ঠিকই ঝলসে উঠে।

“সব সুন্নীরাই খারেজী।” সে উপর থেকে গর্জে উঠে। “তোমাদের কেউই বেহেশতে যেতে পারবে না। তোমাদের আত্মা গোবরে পতিত হবে। সাহস থাকলে আমাকে হত্যা করতে পার। আমি শহীদের দর্জা পাব, আর আজ রাতে আমি বেহেশতে আমার শিয়া ভাইদের সাথে মিলিত হবো…”

লোকগুলোকে উসকানোর কোনো প্রয়োজন ছিলো না, তারা ভবনটার কাঠের প্রবেশদ্বারের দিকে এগিয়ে যায়। যা কেউ- সম্ভবত, হুসেন নিজেই বন্ধ করে রেখেছে। লোকগুলো দরজা ভাঙার জন্য যুতসই কিছু খুঁজতে থাকে। বাবর নিজেও মোল্লাকে ঘৃণা করে কিন্তু তারপরেও বেচারাকে সে খুন হতে দিতে পারে না। উপরের দিকে তাকিয়ে, সে দেখে যে চত্বরের দুপাশে যে বাড়িগুলো তখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে সেগুলোর ছাদ কাঠের পাটাতন দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত রয়েছে, যার উদ্ভব হয়েছিলো তৈমূরের সময়ে শহরের মেয়েরা যাতে আলো বাতাসে হাঁটবার পাশাপাশি লোকচক্ষুর অন্তরালে পরস্পরের সাথে দেখা করতে পারে।

দেয়ালের টিকে থাকা অংশের কাছাকাছি অবস্থান করে এবং ধবংসস্তূপের উপরে যাতে আছড়ে না পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রেখে, হুসেন যে বাড়ির উপরে দাঁড়িয়ে তখনও তড়পানো চালিয়ে গিয়ে তার নিজের কর্মকাণ্ডকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাখতে সাহায্য করছে, সেই বাড়ির ত্রিশ গজ দূরে বেড়ে উঠা একটা লম্বা গাছ বেয়ে সে উপরে উঠতে চেষ্টা করে। গাছটার ডানে বামে প্রসারিত ডালপালা সে রাখার অবলম্বন হিসাবে ব্যবহার করে এবং যদিও গাছটার লালচে সোনালী রঙের বেশির ভাগ পাতা ঝরে পড়েছে। তারপরেও যতোটুকু টিকে আছে সেগুলো তাকে ভালোই আড়াল করে রাখে। হাঁসফাঁস করতে করতে বাবর গাছ বেয়ে উঠতে থাকে এবং শীঘ্রই মোল্লা যেখানে দাঁড়িয়ে তখনও সমানে চেঁচিয়ে চলেছে তার পাশের বাড়িটার ছাদে উঠে আসে।

দুটো বাড়িকে যুক্ত করে রাখা কাঠের পাটাতনের উপর দিয়ে দোয়াদুরূদ পড়তে পড়তে যাতে সেটা তার ওজন নিতে পারে। বাবর দুলতে থাকা পাটাতনটা অতিক্রম করে। তারপরে আলতো পায়ে হেঁটে গিয়ে যাতে হুসেন তার উপস্থিতি টের না পায়। সে সামনের কাঠের পাটাতটা টেনে খুলে এবং সতর্কতার সাথে সেটার পেছনে অবস্থিত সংকীর্ণ সিঁড়ি দিয়ে সাদা রঙ করা একটা ছোট চিলেকোঠায় এসে উপস্থিত হয়। চিলেকোঠার এক কোণে আরেক প্রস্থ চওড়া সিঁড়ি, হুসেন সম্ভবত যেখানে রয়েছে সেদিকে নেমে গেছে। খঞ্জরটা হাতে নিয়ে বাবর বিড়ালের মতো আলতো পায়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গিয়ে নিচে নামতে থাকে। কয়েক ধাপ নামার পরে, সে নিচের দিকে উঁকি দেয়। মোল্লা বাবাজি একটা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে, ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে হাতপা নাড়ছেন। বাবর সামনে এগিয়ে যায় এবং তার হাতে ধরা খঞ্জরের অগ্রভাগ আলতো করে লোকটার পিঠে ঠেকায়।

“নিচের কেউ যেনো বুঝতে না পারে আমি এখানে রয়েছি।” সে ফিসফিস করে বলে। “ভালো মানুষের মতো জানালার কাছ থেকে সরে এসো- এখনই!” খঞ্জরটা এই উদ্ধত মূখের পাঁজরে আমূল গেঁথে দিতে পারলে বা তাকে নিচের লোকগুলোর মাঝে ছুঁড়ে ফেলে দিলেও তার রাগ কিছুটা কমতো- ব্যাটার সেটাই প্রাপ্য। কিন্তু সমরকন্দের স্বার্থে সেরকম কিছুই সে করতে পারবে না।

বাবরকে বিস্মিত করে হুসেন তার কথামতো জানালা থেকে সরে আসে।

“ঘুরে দাঁড়াও।”

মোল্লা ঘুরে দাঁড়িয়ে বাবরকে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে তার চোখে ক্ষণিকের জন্য স্বস্তি ফুটে উঠে। সম্ভবত একটু আগে শহীদের দর্জা নিয়ে বেহেশতে শিয়া ভাইদের সাথে খানাপিনা করার ব্যাপারে সে হয়তো ঠিক ততোটা উৎসুক না। এমন সময়ে, একটা প্রচণ্ড আঘাতের শব্দ, সাথে বুনো উল্লাস আর উৎসাহী চিৎকার বলে দেয় যে নিচের ক্রুদ্ধ জনতা দরজাটা প্রায় ভেঙে ফেলেছে।

“সিঁড়ি দিয়ে জলদি ছাদে যান- এখনই।”

মোল্লা তার আলখাল্লা সামলে নিয়ে আধা দৌড় আধা হোঁচট খেতে খেতে আদেশ অনুযায়ী কাজ করে।

বাবর তার পরিকরে খঞ্জরটা গুঁজে রাখতে রাখতে বুঝতে পারে মোল্লাকে সামলাতে তার আর কোনো ঝামেলা হবে না, সে তাকে অনুসরণ করে। ছাদে উঠে এসে কাঠের পাটাতন বন্ধ করার ফাঁকে সে চিন্তা করতে চেষ্টা করে কোনদিকে যাবে। গাছ বেয়ে নামবার চেষ্টা করলে আর দেখতে হবে না, আর সে ঠিক বুঝতেও পারে না মোল্লা গাছ বেয়ে নামতে পারবে কিনা।

বাবর ছাদের উপর দিয়ে দৌড়ে আরেক প্রান্তে যায় এবং নিচের দিকে তাকায়। নিচে একটা চওড়া রাস্তার দুপাশে সে সারি দিয়ে কামারশালার মতো কিছু দেখতে পায়- সম্ভবত শহরের অস্ত্রশালা এদিকেই। শুক্রবার হওয়াতে দোকানগুলো বন্ধ আর একেবারে নির্জন। ছাদ থেকে শান বাঁধানো রাস্তা কমপক্ষে পঁচিশ ফিট নিচে আর দুপাশের মাটির দেয়ালেও সে আশাব্যঞ্জক কিছু দেখতে পায় না। কিন্তু নীচ থেকে ভেসে আসা আরেকটা জোরালো আওয়াজ হলে সে বুঝতে পারে ভাববার জন্য তার হাতে বেশি সময় নেই। প্রবেশদ্বার আর বেশিক্ষণ উত্তেজিত জনতাকে আটকে রাখতে পারবে না। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। “আপনার পরিকর খুলেন এখনই।”

চোখ পিটপিট করে, মোল্লা তার কথা মতো কাজ করে। কোমর থেকে প্রায় নয় ফিট লম্বা ভারী জরির কাজ করা রেশমের মোটা পরিকর খুলে দেয়। বাবর এবার নিজের পরিকর থেকে খঞ্জরটা খুলে নিয়ে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা জুতোর ভেতরে খুঁজে রেখে, মোটা, শক্তিশালী উলের তৈরি বেশ ছোট সাত ফুট লম্বা পরিকরটা খুলে নেয়। তাদের এরপরেও লাফ দিতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে এরচেয়ে ভালো কিছু উপায় ভাবতে পারছে না…সে পরিকর দুটো একসাথে বেঁধে নিয়ে উলের দিকটা তার কাছে শক্তিশালী মনে হয়েছে- ছাদে স্থাপিত কপিকলের, শস্যদানা বা অন্য রসদ সংরক্ষণের জন্য ছাদে তোলার কাছে ব্যবহৃত, সাথে আটকায়। তারপরে অন্যপ্রান্তটা নিচের দিকে ছুঁড়ে দেয়।

“আপনি প্রথমে নামবেন। আমাদের দুজনের ভিতরে আপনার ওজন বেশি- আমি আপনার ওজন কিছুটা সামলাতে চেষ্টা করবো।”

মোল্লা কোনোরকম ইতস্তত করে না। বাবর কিনারার দিকে পিঠ করিয়ে নিজে দাঁড়ায় এবং পরিকরের অন্য প্রান্তটা ধরে তার পিঠের পেছন দিয়ে ঘুরিয়ে এনে ডান হাতে ধরে এবার শক্ত করে দাঁড়ায়। বাবর ইঙ্গিত করতে হুসেন সতর্কতার সাথে ছাদের কিনারা টপকে নিচে নামতে শুরু করে। জোড়া দেয়া পরিকর যেনো হাল ছেড়ে দিতে মরিয়া হয়ে ওঠে এবং গিঁটটা যেনো ছিঁড়ে যাবে।

“তাড়াতাড়ি!” বাবর চেঁচিয়ে ওঠে এবং টের পায় তার হাতে ধরা পরিকরটা সহসা ঢিলা হয়ে গিয়েছে। সে নিচের রাস্তায় উঁকি দিয়ে দেখে মোল্লা বাবাজি নিচের লাল আলখাল্লার স্তূপে জবুথবু ভঙ্গিতে পড়ে রয়েছে এবং কাঁধ ডলছে। ক্রুদ্ধ উত্তেজিত চিৎকার আর কাঠের পাটাতন খোলার শব্দ শুনে বাবর বুঝতে পারে তার হাতে আর বেশি সময় নেই। সে আবার পরিকর দুটো গিঁট দিয়ে বেঁধে শক্ত করে ধরে ভাগ্যের উপর ভরসা করে লাফ দেয়…সে লাফিয়ে নামার সময়ে পা দিয়ে দেয়ালের গায়ে ধাক্কা দেয় পতনের বেগ কমাতে চেষ্টা করে কিন্তু সহসা তার হাত পিছলে যায়।

নিচের একটা কাঠের স্তূপ সামান্য হলেও তার পতনের বেগ সামলে নেয়। মোল্লা যেখানে আছড়ে পড়েছিলো সেখানেই পড়ে থেকে কাতরাচ্ছে এবং ছাদের উপর থেকে উঁকি দেয়া মুখ তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। লোকগুলো কুৎসিত ভাষায় গালমন্দ করে চলেছে। যেকোনো মুহূর্তে তারা জোড়াতালি দেয়া দড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করবে। বাবর মোল্লাকে ধরে দাঁড় করাবার ফাঁকে পেছন থেকে ধাবমান ঘোড়ার খুরের আওয়াজ ভেসে আসতে শুনে। এক সারিতে বাবরের দেহরক্ষী বাহিনী রাস্তাটা দিয়ে ছুটে আসে। তাদের মধ্যে দু’জন ইতিমধ্যে ধনুকে তীর সংযোজিত করেছে, ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা আক্রমণকারীদের বাড়াবাড়ি করতে দেখলে ছুঁড়ে মারবে, তারা অবশ্য ততোক্ষণে পেছনে সরে গিয়ে দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে গেছে।

“সুলতান, বিচ্ছিন্ন হবার পরে থেকেই আমরা আপনাকে পাগলের মতো খুঁজছি। আমাদের দ্রুত করতে হবে। পুরো শহরে ক্রুদ্ধ জনতা পাগলের মতো ঘুরছে…” তার দেহরক্ষীর একজন ঘোড়া থেকে নেমে লাগামটা তার দিকে এগিয়ে দেয়। বাবর ক্লান্ত ভঙ্গিতে টলোমলো পায়ে উঠে দাঁড়ায় এবং ঘোড়ায় চেপে বসে। তার দুজন যোদ্ধা একটা ঘোড়ায় চাপে এবং তখনও কাতরাতে থাকা মোল্লা আরেকজনের পিছনে চেপে বসলে ছোট দলটা কোক সরাইয়ের নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে দ্রুত ঘোড়া ছোটায়।

*

“আমি আমার সৈন্যবাহিনী পশ্চিমে আমার নিজের সীমান্ত রক্ষার উদ্দেশ্যে সরিয়ে নিচ্ছি এবং আপনাকে আপনার কাঙ্ক্ষিত সহায়তা করতে অপারগ। বস্তুতপক্ষে আমি আপনাকে কেনই বা সহায়তা করবো? আপনি আমার উদারতার মুখে থুতু নিক্ষেপ করে আমার ধর্মবিশ্বাসকে অপমানিত করেছেন। সমরকন্দে কি হয়েছে মোল্লা হুসেন আমাকে সব খুলে বলেছে-কিভাবে তাকে অপমানিত, লাঞ্ছিত করে সেখানের রাস্তায় কুকুরের মতো তাড়া করা হয়েছে। তাকে আর তার সত্যিকারের ধর্মমত প্রত্যাখ্যান করে আপনি আর আপনার প্রজারা কার্যত আমাকেই প্রত্যাখ্যান করেছে। তার বিরুদ্ধে করা অন্যায়ের জন্য পরম করুণাময় আল্লাহতালা যেনো আপনাকে ক্ষমা করে দেন।”

বাবর শাহ্ ইসমাইলের চিঠির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মনে হয় বদ মোল্লাটা শাহকে বলেনি যে বাবর- নিজে ব্যক্তিগতভাবে তার মোটা গর্দানটা রক্ষা করেছে। ধীরে ধীরে, ইচ্ছাকৃতভাবে সে চিঠির নিচের সিংহ চিহ্নিত লাল মোমের শীলমোহরটা ছিঁড়ে নিয়ে শাহের ব্যক্তিগত স্মারক- টুকরো টুকরো করে। তারপরে টুকরোগুলো, শীতকালের মাঝামাঝি শহরের দেয়ালে মাথা কুটতে থাকা তুষারের ঝাপটার হিম ঠাণ্ডা, যা কোক সরাইয়ের পাথুরে দেয়াল ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করছে, প্রশমিত করতে তার কক্ষে দিন রাত প্রজ্জ্বলিত কাঠের আগুনের উষ্ণ সবুজ শিখায় ছুঁড়ে দেয়।

“সুলতান, আমরা এমন কিছুই আশা করছিলাম…” বাইসানগার মৃদু কণ্ঠে কথাটা বলে।

“আমি জানি। কিন্তু আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে শাহ্ উজবেকদের হামলার মুখে শহরটা অরক্ষিত রেখে দিচ্ছেন- আমি কল্পনাও করিনি তার জীঘাংসা এতোটা প্রবল হতে পারে…” বাবর তাকিয়ে মোম গলতে দেখে এবং আগুনের ভেতরে কাগজের টুকরো উজ্জ্বল হয়ে দপ করে জ্বলে উঠে তার সাথে সব আশাও ভষ্ম করে দেয়। “তিনি সব সময়ে তার আদেশ পালন হয়েছে দেখতেই অভ্যস্ত। তিনি একবার আপনার আনুগত্য পাবার পরে তাই আশা করেছিলেন আপনিও তার সব আদেশই পালন করবেন।”

“বাবুরী ঠিক এই কথাটাই আমাকে বলেছিলো… এতো সরল ছিলাম আমি। কিন্তু আমার বিশ্বাস হয়নি শাহের কোনো দুরভিসন্ধি আছে… তিনি একবারও বলেননি আমাকে বা আমার প্রজাদের জোর করে গোত্রান্তরিত করা হবে এবং তার জানা উচিত ছিলো বিনা রক্তপাতে তিনি তার অভীষ্ট সিদ্ধ করতে পারবেন না। মোল্লা হুসেনের ওয়াজের পরে শহরের উত্তেজনা প্রশমিত করতেই আমাদের একমাস সময়। লেগেছিলো।”

‘সুলতান, অন্তত মন্দের ভালো, পার্সীরা বিদায় হয়েছে…”।

“ঠিক আছে, কিন্তু তারা আমাদের বিপদে ফেলে গিয়েছে। আমি সুলতান হবার পরে পরেই তাদের দেশে পাঠিয়ে দেয়া উচিত ছিলো। আমার প্রজারা তাহলে আমার ব্যাপারে কম সন্দিহান বোধ করতো। কিন্তু আমি সেটা না করে তাদের জামাই খাতির করে সমরকন্দে রেখেছিলাম, যাতে আমার কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে এবং তারপরে ঠিক যখন তাদের সাহায্য আমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সমরকন্দ রক্ষা করতে তখন তারা দেশে ফিরে গিয়েছে। উজবেকরা ইতিমধ্যে বোখারা আবার দখল করে নিয়েছে। শীতকাল বিদায় নেয়া মাত্র তারা আমাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমার নিয়োগ করা গুপ্তদূতের দল যদিও খবর নিয়ে এসেছে যে, কাবুল পড়বে। আমার নিয়োগ করা ও আর তার আশেপাশের এলাকা শান্ত রয়েছে। কিন্তু আমি সেখান থেকেও অতিরিক্ত বাহিনী এখানে নিয়ে আসতে পারবো না। তাহলে প্রথমবার সমরকন্দ অধিকার করার পরে না ভেবেই আমি যেনো ফারগানাকে বিপদের মাঝে ঠেলে দিয়েছিলোম এবারও ঠিক সেভাবেই কাবুলকে বিদ্রোহ বা বহিঃশত্রুর আক্রমণের হুমকির ভিতরে ফেলে দেবো। আমি অবশ্য শহরটা সুরক্ষিত আর রসদ মজুদ করতে পারি। কিন্তু শহরের লোক কি আমাকে সমর্থন করে? শহর রক্ষাকারী দেয়ালের ভিতরে আর বাইরে একই সাথে আমি শত্রুর মোকাবেলা করতে পারব না।”

“সুলতান, এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই।”

“বাইসানগার, আমি নিজেও এর উত্তর জানি না…”।

*

পেছনে ফিরে তাকিয়ে কি লাভ? সূর্যাস্তের গোলাপী, বেগুনী আর কমলা আভা সমরকন্দের বিস্ময়কর, চমকপ্রদ দৃশ্যপট আড়াল করে ফেলেছে। প্রকৃতিই যেনো তার নিষ্ক্রমনে উল্লাস প্রকাশ করছে। কাল সকালে হয়তো আজকের সূর্যাস্তের মতোই আরেকটা মহিমান্বিত সকাল পাঁচ মাইল দূরে শিবির স্থাপনকারী উজবেকদের স্বাগত জানাতে বিকশিত হবে।

কে ভাবতে পেরেছিলো সাইবানি খান মারা যাবার পরে তারা আরেকজন যোগ্য নেতার অধীনে এতোদ্রুত নিজেদের সংঘটিত করবে? উজবেকরা আসলে পিঁপড়ের মতো একটা জাতি; কেউ যখন পায়ের নিচে পিষে যায় তখন পেছন থেকে অন্যেরা সামনে এগিয়ে আসে এবং তাদের নিরন্তর সামনে এগিয়ে চলার গতি বজায় থাকে…

কেবল শাহই তাকে- খারেজী সুলতানের তকমা দিয়ে সাহায্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেনি, সমরকন্দের লোকদের সে নিজে এরচেয়ে বেশি ক্রুদ্ধ করেছে। প্রায় একমাস আগে, বসন্তের প্রথম দিনে, পারস্যের বাহিনী বোখারার পশ্চিমে শীতকাল অতিবাহিত করার উদ্দেশ্যে স্থাপিত উজবেক শিবিরে হামলা করে। তাদের বন্দি করে পারস্যের বাহিনী প্রমাণ করতে চেয়েছে শাহ্ আর তার সাম্রাজ্যে অতীত আক্রমণের জন্য কেবল না, শিয়া আর সুন্নীদের ভিতরে মতভেদের জন্যও তাদের শাস্তি দিতে তারা এবার বদ্ধপরিকর। শাহ্ ইসমাইলের অনুরোধে, পারস্যের মসজিদে, মোল্লার দল এখন সব সুন্নীকে আল্লাহতালার শত্রু হিসাবে ঘোষণা করছে। আর উজবেকরা- বাবর আর সমরকন্দের অধিবাসীদের মতো সুন্নী মুসলমান। পারস্যের সেন্যবাহিনী বন্দি উজবেকদের শিয়া ধর্মমত গ্রহণের আদেশ দেয় এবং তারা মানতে রাজি না হলে নির্মমভাবে তাদের হত্যা করে।

সমরকন্দের অধিবাসীরা বাবরের প্রতি নিজের মনোভাব গোপনের কোনো চেষ্টাই করেনি। উজবেকরা যদি ফিরে আসতে চায় তবে তাদের আসতে দেয়া হোক। ধর্ম বিশ্বাসের শত্রুর চেয়ে রক্তের শত্রু অন্তত মন্দের ভালো। নির্মম সত্যটা হলো তারা শাহের হাত থেকে আর তার শিয়া ধর্মমত থেকে তাদের রক্ষা করার জন্য উজবেকদের বেশি বিশ্বাস করে- বাবরকে তারা একেবারেই বিশ্বাস করে না। শাহের সাথে পূর্ববর্তী সন্ধির জন্য বাবরকে চরম মূল্য শোধ করতে হয়েছে। বাবর। বৃথাই তাদের সাইবানি খানের নিষ্ঠুরতার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন কিন্তু দেখা গেছে তাদের স্মৃতিশক্তি বড়ই দুর্বল। শহরের ভিতরে প্রায় বিদ্রোহী পরিস্থিতি আর শহর ত্যাগ করার জন্য, উত্তরের কারশী এবং অন্যান্য শক্ত ঘাঁটি থেকে ধেয়ে আসা লক্ষাধিক উজবেক সৈন্যের মহড়ার সামনে বিপর্যস্ত বাবর, শহরের নাগরিকদের উদ্দেশ্যে চরমপত্র ঘোষণা করে: শহর আর আমাদের সভ্যতা এবং সংস্কৃতি রক্ষা করতে আমাকে সাহায্য করো- নতুবা আমাকে কাবুলে ফিরে যেতে হবে।” তার ডাকে শহরবাসী সাড়া দেয়নি।

কাবুলে তার শাসন অন্তত বলবৎ রয়েছে আর তার পরিবারও সেখানে নিরাপদেই আছে। সে মাহাম, গুলরুখ আর তার সন্তানদের, একটা শক্তিশালী অনুগামী দল সহকারে আগেই রওয়ানা করিয়ে দিয়েছে। এবার তারও যাবার সময় হয়ে এসেছে। গত কয়েক সপ্তাহ তার কেবলই বাবুরীর কথা মনে পড়েছে। তার বন্ধু ঠিকই বুঝতে পেরেছিলো। সমরকন্দের জন্য বাবরের মোহ- যা কখনই তার নিজের ছিলো না তাকে অন্ধ করে ফেলেছিলো। তাকে এবার তার নিজের নির্বুদ্ধিতার মূল্য পরিশোধ করতে হবে। সমরকন্দের কথা একেবারে ভুলে গিয়ে কাবুল থেকে অন্যান্য অঞ্চলে তার নিজের সাম্রাজ্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা নিবৃত্ত করার উপায় অনুসন্ধান করতে হবে।

কিন্তু একটা বিষয়ে সে অন্তত সন্তুষ্টিবোধ করতে পারে। সে শাহের প্রজনন স্ট্যালিয়নটা- নির্বীয করে ফেরত পাঠিয়েছে।

৪.১ চতুর্থ খণ্ড – হীরক আর ভষ্মের ভূখণ্ড

চতুর্থ খণ্ড – হীরক আর ভষ্মের ভূখণ্ড

২০. তূর্কী নাচ

১৫২২ সালের গ্রীষ্মকালের এক দাবদাহপূর্ণ দিন। বাবরের ছেলেরা কাবুল শহরের দেয়ালের বাইরে অবস্থিত তৃণভূমিতে খেলা করছে। চৌদ্দ বছরের হুমায়ূন- খুরের কাছে সাদা ফেট্টি দেয়া বাদামী রঙের চকচকে চামড়ার ঘোটকী- লম্বা সোনালী ঘাসের ভিতর দিয়ে দাবড়ে নিয়ে যাবার ফাঁকে পর্যানে বসা অবস্থায় খড়ের একসারি লক্ষ্যবস্তুকে স্থির করে নিশানা মকশো করে। পর্যানের উপরে নিখুঁত ভারসাম্য বজায় রেখে সে তূণীর থেকে একটার পরে একটা তীর বের করে হাতের দুই বাঁক বিশিষ্ট ধনুকে সন্নিবেশিত করে এবং বাতাসের বরাভয়ে ভাসিয়ে দেয়। প্রতিটা তীর লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে। কামরান তার ধূসর রঙের টাটুতে বসে চোখে ভক্তি নিয়ে তাকিয়ে দেখে। হুমায়ূন এক ঝটকায় আকাশের দিকে তাকিয়ে এবং কোনো ছন্দপতন না ঘটিয়ে তীর ছুঁড়ে অবলীলায় একটা উড়ন্ত পাখিকে বিদ্ধ করলে বাবর তাকে ঢোক গিলতে দেখে।

বাবর হেসে ফেলে। দূর্গপ্রাকারের এই সুবিধাজনক স্থান থেকে সে হুমায়ুনের ফুর্তি আর-ঘোড়ায় ঋজু ভঙ্গিতে বসে, সুদর্শন মাথাটা দেহের উপরে স্থির রেখে অনায়াসে ঘোড়ার লাগাম ধরে রেখে-নিজেকে জাহির করার প্রবণতা ঠিকই অনুভব করতে পারে। তাকে পুরোদস্তুর একজন শাহজাদা যোদ্ধা মনে হয়, আর সেটা সেও জানে। কিন্তু তার চেয়ে মাত্র পাঁচ মাসের ছোট কামরান বড় হচ্ছে। সৎ-ভাইয়ের মতো সেও লম্বাই হবে এবং তার মতো শক্তিশালী না হলেও সেটা পুষিয়ে দিয়েছে তার দুর্দান্ত সাহস- যার কারণে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার সে বড় ধরণের দুর্ঘটনার হাত থেকে কোনোমতে বেঁচে গেছে।

বাবর কৃতজ্ঞ যে তার আম্মিজান এই দুজনের বড় হওয়া পর্যন্ত আর খানজাদার সাথে মিলিত হওয়ার মত দীর্ঘায়ু মনে মনে তিনি ভালো করে জানতেন যা তাকে প্রায়শই হতাশ করে তুলতো- লাভ করেছিলেন। গ্রীষ্মের খাণ্ডবদাহনের পরে বৃষ্টিপাতে তৃণভূমি যেমন আবার সবুজ হয়ে উঠে, মেয়ে কাবুলে ফিরে আসতে খুতলাঘ নিগার তেমনই প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিলেন। সাইবানি খানের হাতে অত্যাচারিত হবার ব্যাপারে সে তাদের আম্মিজানকে কি বলেছিলো বাবর সেটা কখনও জানতে পারেনি। মাঝে কেবল তাকে বিষণ্ণ চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে সে দেখেছে। খানজাদারও নিশ্চয়ই সেটা দৃষ্টি এড়ায়নি। সে লক্ষ্য করেছে মায়ের কাছে থাকবার সময়ে খানজাদা ইচ্ছা করেই কেমন উছুল আর প্রাণবন্ত থাকতো। যেনো বোঝাতে চাইতো তার সাথে যাই ঘটে থাকুক, সেসব কিছু তার মানসিকতা বদলে দিতে পারেনি। কেবল একটা ব্যাপারেই সে খুতলাঘ নিগারকে কোনো ধরণের প্রশ্রয় দেয়নি। খুতলাঘ নিগার মনেপ্রাণে চাইতেন অতীতের ঘটনার সমাপ্তির স্মারক হিসাবে খানজাদা যেনো আবার বিয়ে করে। কিন্তু সে তার কোমল অনমনীয় ভঙ্গিতে, পাত্র যতোই ভালো মানুষ বা বংশ যতোই সম্ভ্রান্ত হোক, নাকচ করে দিয়েছে।

সাত বছর আগে খুতলাঘ নিগারও তার নানীজান এসান দৌলতের মতোই আকষ্মিকভাবে ইন্তেকাল করেন। তিনি তার কক্ষে বসে একটা সুতির আলখাল্লার পাড়ে কারুকাজ করছিলেন যখন খানজাদা তার পাশে বসে তাকে পড়ে শোনাচ্ছিল এবং সেই অবস্থায় তিনি একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে ঝুঁকে পড়েন। দেখা যায় সেটাই পৃথিবীর বুকে তার শেষ নিঃশ্বাস ছিলো। তার আত্মা দেহের খাঁচা ত্যাগ করেছে আর হেকিমকে কিছু করার কোনো সুযোগই তিনি দেননি। কয়েক ঘণ্টা পরে, বাবর কান্না দমন করে, কাবুলে প্রথমবার আগমনের পরে সে পাহাড়ের পাদদেশে যে উদ্যানটা তৈরি করেছিলো সেখানে এসান দৌলতের পাশে তাকে সমাহিত করে। সে শপথ নিয়েছে, কিভাবে তার সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন, সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়ে, তার নানীজান আর আম্মিজান কিভাবে তাকে সাহায্য করেছে, পথ দেখিয়েছে, এবং এই দুই নারীর সাহায্য ছাড়া সে আদৌ কোনো সিংহাসনে আসীন হতে পারতো না, এই ব্যাপারগুলো কখনও বিস্মৃত হবে না… তার পরের সন্তানদের তারা দেখে যেতে পারেননি এই বিষয়টা তাকে সবসময়ে বিষণ্ণ করে তোলে।

সে এবার সেদিক থেকে ছয় বছরের আসকারির দিকে দৃষ্টি ফেরায়। বিছুটা একটা চোখা লাঠি নিয়ে তার তিন বছরের সৎ-ভাই হিন্দালকে সমানে খুঁচিয়ে চলেছে। তাদের আয়া লাঠিটা কেড়ে নেবার চেষ্টা করছে এবং বাবর তাকিয়ে দেখে আসকারির টানাটানা ছোট মুখটা অনিচ্ছুক একটা চিৎকারে বেঁকেচুরে যায়, যা কেবল কানে একটা মৃদু টান ডেকে আনতে সে তার অস্ত্র সমর্পনে বাধ্য হয়। আর এবার তারস্বরে চিৎকার শুরু করে। হিন্দাল- তার আয়া তাকে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাতে ভাইয়ের নাকাল অবস্থা বেশ তার নাদুসনুদুস গোলাকার মুখে, উৎসাহের সাথে তাকিয়ে দেখছিলো।

বাবর ভাবে, তাকে ভাগ্যবানই বলা চলে। এতগুলো স্বাস্থ্যবান সন্তানের সে পিতা। এবং একটা সমৃদ্ধ, নিরাপদ সালতানাতের অধিকারী। সমরকন্দ পরিত্যাগের পরে গত দশ বছর, সে একনাগাড়ে কাবুল শাসন করেছে। বিদ্রোহের যেকোনো সম্ভাবনা দ্রুত দমন করে এবং কাবুলের চারপাশে উঁচু, সংকীর্ণ গিরিপথে- কোটাল সওদাগরী কাফেলায় রাহাজানি করে বেড়ানো উপজাতি গোষ্ঠীগুলোকে সাফল্যের সাথে দমন করে সে তার প্রজাদের শ্রদ্ধা অর্জন করেছে। খুগিয়ানী, খিরিজী, তুরী আর ল্যান্ডার ডাকাত গোষ্ঠীর সবাই নাকে খত দিয়ে ডাকাতি ছেড়ে দিয়েছে। গিরিপথে উঁচু দণ্ডের মাথায় সন্নিবিষ্ট তাদের শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা কর্তিত মস্তক অন্যদের জন্য সতর্কবাণী হিসাবে কাজ করেছে আর আগত বণিকদের আশ্বস্ত করেছে যে তারা এমন একটা রাজ্যে প্রবেশ করছে যেখানে সুলতানের শাসন বজায় আছে।

নিরব দক্ষ, বিশ্বস্ত কাশিম- শাহী কোষাগারের রক্ষক হিসাবে বয়স্ক ওয়ালি গুলের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। প্রতি চন্দ্রমাসের শুরুতে গর্বিত ভঙ্গিতে কোষাগারে প্রাচুর্য উপচে পড়ার কথা বাবরের কাছে ঘোষণা করে। কাবুলের ব্যবসায়ীরা, প্রতিবার নিরাপদে বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে ফেরত আসার পরে উটের ঝলসানো মাংস দিয়ে ভূড়িভোজ করে, নিজেদের নিরাপদ আর ধনবান ভাবে। তারা নিজেদের নিয়ে সুখী। কিন্তু সেও কি নিজেকে সুখী দাবি করতে পারে? এসান দৌলত- তাকে সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারতেন যিনি- সহজাত প্রবৃত্তির বশে উত্তরটা ঠিকই টের পেতেন যে সে মোটেই সুখী না।

নিজেদের ছেলেদের দিকে তাকিয়ে, বাবর এতদিন চাপা পড়ে থাকা তার অপূর্ণ আকাক্ষটার খোঁচা আবার নতুন করে অনুভব করে। ভবিষ্যতের গর্ভে তাদের জন্য কি রয়েছে? মানুষের নেতা হিসাবে, একজন যোদ্ধা হিসাবে সে অনেক কিছু শিখেছে। অনেক চড়াই উতরাই অতিক্রম করেছে। কখনও হতাশ না হতে, বিপর্যয়ের কারণে কখনও নিজেকে লক্ষ্যচ্যুত না হতে, তার অভিজ্ঞতা তাকে শিখিয়েছে। আর কাবুলের চেয়ে সেটা অনেক বড় কিছু একটা লক্ষ্য…তার সন্ত নিদের, এবং তাদের সন্তানদের জন্য চমকপ্রদ একটা স্মারক…

“সুলতান, পশ্চিম থেকে একদল আগন্তুক কাবুলের দিকে এগিয়ে আসছে বলে আমরা সংবাদ পেয়েছি।” বাবরের কল্পনাবিলাস বাইসানগারের কথায় ব্যাহত হয়। তাকে বরাবরের মতোই উদ্বিগ্ন দেখায়। ঘুমের ভেতরে বয়োবৃদ্ধ বাহলুল আইয়ুব মারা গেলে, বাবর বাইসানগারকে কাবুলের গ্রান্ড উজিরের পদে নিয়োগ দিতে বিন্দুমাত্র চিন্তা করেনি- ব্যাপারটা ছিলো সমরকন্দের গ্রান্ড উজির হিসাবে তার স্বল্পকালীন নিয়োগের একটা সান্ত্বনা।

“আগন্তুকের দলের পরিচয় জানা গেছে? বণিকের কাফেলা?”।

“সুলতান, আমি নিশ্চিত বলতে পারছি না। তারা কাফেলা চলাচলকারী পথ ধরে এগিয়ে আসছে। কিন্তু দলটার সাথে মালবহনকারী খচ্চরের সংখ্যা অনেক কম অস্থায়ী শিবির স্থাপন করতে প্রয়োজনীয় মালামাল বহনের জন্য যতোগুলো দরকার : ঠিক ততোগুলো। অবশ্য আমাদের গুপ্তদূতের দল বলেছে তাদের সাথে দুটো বিশাল বলদে টানা মালবাহী গাড়ি রয়েছে যা বিচিত্র দর্শন ধাতব অনুষঙ্গে বোঝাই। প্রতিটা গাড়ি ত্রিশটা বলদের পাল টেনে আনছে…”

“দলটাতে লোকজনের সংখ্যা কতো?”

“পঞ্চাশজন হবে সম্ভবত এবং তাদের পরণে রয়েছে বিচিত্ৰদৰ্শন চামড়ার জোব্বা। আর মাথায় উজ্জ্বল কমলা রঙের চূড়াকৃতি পাগড়ি…”

“তারা সম্ভবত ভ্রাম্যমাণ দড়াবাজের দল…”

“সুলতান, আমার কিন্তু তা মনে হয় না।”

“বাইসানগার, আমি ঠাট্টা করছিলাম। তাদের উপরে নজরদারি বজায় রাখেন। তারা কবে নাগাদ এখানে এসে পৌঁছাবে?”

“তিন দিনের ভেতরে, খুব বেশি দেরি হলে চারদিন।”

“তারা পৌঁছালে আমাকে খবর দেবেন।” রাজ্যের লোক কাবুলে এসে ভীড় করে, এখান দিয়ে অতিক্রম করে- রেশমের উপরে জরির কারুকাজ করা জোব্বা আর পিঠে সবুজ চামড়ার তূণীর এবং একই রঙের পর্যান, দুর্বিনীত অহংকারী খোঁচা খোঁচা দাড়ির চীনা বণিকের দল। আফগান উপজাতির লোকদের মতো নাকে মাছি বসতে দিতে নারাজ। আর যেকোনো ছুতোয় লড়াই বাধাতে ওস্তাদ। শ্যামবর্ণের নাদুসনুদুস পার্সী বণিকের দল, আর হিন্দুস্তানের একেবারে ভেতর থেকে মশলা আর চিনির পসরা নিয়ে আগত রঙচঙে পাগড়ী পরিহিত কৃষ্ণবর্ণের বণিক। নতুন আগত এই দলটা যদি কৌতূহল উদ্রেককারী হয়, তবে সে তাদের দূর্গপ্রাসাদে ডেকে পাঠাবে…বহুদূর থেকে আগত আগন্তুকদের দেখে কামরান আর হুমায়ূন হয়তো খুশিই হবে।

বাইসানগারের গণনা কার্যত ভুল প্রমাণিত হয়। দুদিন পরে, ঝিরঝির বৃষ্টির মাঝে, আগন্তুক দলটাকে তাদের রহস্যময় গাড়ির বহর নিয়ে কাবুলের দিকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। তারা শহরের দিকে না গিয়ে দূর্গপ্রাসাদ অভিমুখী খাড়া পথটা বেছে নেয়। বাবর তার ব্যক্তিগত কক্ষের বারান্দা থেকে বৃষ্টির ফলে ধূলোর স্তর থেকে সৃষ্ট কাদায় মালবাহী বিশাল গাড়ি দুটো পিছলে গিয়ে আটকে যেতে দেখে। আবহাওয়ার কারণে গাড়িতে নিয়ে আসা মালামাল মোটা চামড়া দিয়ে ভালো করে মোড়ানো। ভারী কাঠের জোয়ালের নিচে মাথা নিচু করে বলদের পাল প্রাণপণে চেষ্টা করছে গাড়িটা টেনে তুলতে। তাদের পেষল কাঁধ তিরতির করে কাঁপছে।

বৃষ্টির কারণে দলটার কালো কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকা, লম্বা চওড়া দেখতে দলপতি। ঘাড় ঘুরিয়ে পরিশ্রান্ত জন্তুগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখে। বাবর বারান্দা থেকে খেয়াল করে লোকটা হাত নাড়ছে। কোনো সন্দেহ নেই সে চেঁচিয়ে কিছু একটা বলেছে। কারণ তার আটজন তোক সাথে সাথে ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নামে এবং পেছন থেকে গাড়িটা ধাক্কা দিতে শুরু করে। তাদের একজন পা পিছলে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।

দলনেতা লোকটা যেনো ধৈর্যের শেষপ্রান্তে পৌঁছে যায়। সে তার ধূসর ঘোড়াটার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে এবং ঢাল বেয়ে উঠার জন্য সেটার পেটে খোঁচা দেয়। দূর্গপ্রাসাদের প্রবেশদ্বার পর্যন্ত উঠে যাওয়া খাড়া, পাথর দিয়ে বাঁধানো ঢালু পথটায় উঠে সে যেনো তার বাহনকে আরও দ্রুত এগিয়ে যাবার জন্য তাগাদা দেয়। দু’জন। তোরণ রক্ষী লাফিয়ে তার গতিরোধ করতে সে কেবল লাগাম টেনে তার বাহনকে সহসা টলতে টলতে দাঁড় করায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাবর নিচের কোনো কথা শুনতে পায় না। কিন্তু লোকটার সবকিছুই কেবল একটা বিষয়েই ইঙ্গিত করে যে, সে বণিক নয় একজন যোদ্ধা। প্রহরীর প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় তার মাথাটা স্পর্ধিত ভঙ্গিতে বাঁকানো থাকে এবং সে অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে তার বৃষ্টিতে ভেজা ঘোড়সওয়ারীর আলখাল্লী ঝটকা দিয়ে কাঁধের পেছনে সরিয়ে দিলে বাবর অদ্ভুত দর্শন ময়ানে কোষবদ্ধ তরবারির বাঁট এক ঝলকের জন্য দেখতে পায়- একধারি তরবারির মতো বাঁকানো কিন্তু আরো অনেক বেশি সরু।

“প্রহরী।” বাবর বারান্দা থেকে ডাক দেয়, “লোকটাকে এখনই আমার কাছে নিয়ে এসো।”

পাঁচ মিনিট পরে, সামনে চারজন আর পেছনে ছয়জন প্রহরী পরিবেষ্টিত অবস্থায় লোকটা তার কক্ষে প্রবেশ করে। তার পরণের আলখাল্লা খুলে নেয়া হয়েছে এবং তার ময়ানও শূন্য- কোমরে একটা সরু ধাতব শিকলের সাহায্যে আটকানো ইস্পাতের বাঁকানো শূন্য খাপটা ঝুলছে। কিন্তু লোকটার মুখের নিম্নাংশ তখনও কাপড় দিয়ে ঢাকা এবং তার মাথার চূড়াকৃতি পাগড়ী টেনে ভুরু পর্যন্ত নামান। প্রহরীরা তাকে বাবরের বিশ ফিটের বেশি কাছে যেতে দেয় না।

“সুলতানের সামনে হাঁটু মুড়ে বসো!”

লোকটা বাবরের সামনে কেবল নতজানুই হয় না সে মেঝেতে পূর্ণাঙ্গ, আনুষ্ঠানিক তৈমূরীয় অভিবাদন রীতি কুর্নিশের ভঙ্গিতে হাত পা ছড়িয়ে নিজেকে প্রণত করে।

“আগন্তুক তুমি এবার উঠে দাঁড়াতে পারো।” বাবর এবার আগের চেয়ে কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। যে লোকটা কিছুক্ষণ আগে দূর্গপ্রাসাদে প্রবেশ যেনো তার অধিকার এমন ভঙ্গিতে প্রহরীদের সাথে তর্ক করছিলো, সে নিজে থেকে কেনো এভাবে শ্রদ্ধা প্রকাশ করছে? এবং তার চেয়েও যেটা তাকে কৌতূহলী করে তোলে সেটা হলো এখনও কেন সে মুখ নিচে রেখে, বাহু প্রসারিত করে রেখেছে? সে কি বাবর যা। বলেছে সেটা বুঝতে পারেনি?

বাবরের এক দেহরক্ষী তার হাতের বর্শার হাতলের প্রান্তভাগ দিয়ে আগন্তুক লোকটাকে খোঁচা দিতে যাবে, কিন্তু বাবর তার আগেই হাত তুলে তাকে বিরত করে। হাত দিয়ে খঞ্জরের বাঁট স্পর্শ করে সে ধীরে ধীরে লোকটার দিকে এগিয়ে যায় এবং তার মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। “আমি এবার তোমাকে উঠে দাঁড়াতে আদেশ করছি।”

শায়িত দেহটার সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে। এক মুহূর্ত ইতস্তত করে, লোকটা হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে বসে কিন্তু তখনও সে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তারপরে ধীরে ধীরে সে মুখ তুলে তাকায় এবং নোংরা, ঘামের দাগ লাগা কাপড়টার উপরে বাবর দেখে একজোড়া নীল চোখ তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

“বাবুরী!” এতোবছর পরে তার যেন ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস হতে চায় না। সে। নিজে এবার ঝুঁকে তার কাঁধ জড়িয়ে ধরে এবং তাকে টেনে দাঁড় করায়। মুখটায় আগের চেয়ে অনেক বেশি পোড়খাওয়া বলিরেখা দেখা যায়। কিন্তু চোখের নিচের উঁচু হাড়, গাঢ় নীল চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি কোনোমতেই ভুলবার মতো না।

বাবর তার দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকলে, বাবুরী তার বৃষ্টিতে ভেজা পাগড়িটা এবার খুললে ধূসর ছোপধরা লম্বা কালো চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসে। “আমাকে ক্ষমা করেন…” শব্দগুলো বলতে বাবুরীর যেনো গলা ভেঙে আসে এবং তার চোখ চকচক করতে থাকে।

বাবর হাত তুলে তাকে বিরত করে। “অপেক্ষা করো…” সে ইঙ্গিতে তার দেহরক্ষীদের যেতে বলে এবং তারা বের হয়ে গিয়ে দুই পাল্লার ভারী ওক কাঠের দরজাটা বন্ধ করার পরে সে তার বিশ্বস্ত বন্ধুর দিকে ঘুরে তাকায়। “আমি তোমার কথা বুঝতে পারিনি…”।

বাবুরীর চোখমুখ লাল হয়ে উঠে। “আমি আপনার কাছে ক্ষমা ভিক্ষার জন্য ফিরে এসেছি। আমাকে যখন আপনার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিলো আমি সেই সময়ে। আপনাকে পরিত্যাগ করে চলে গিয়েছিলাম। প্রথম থেকেই আমি এটা জানতাম কিন্তু আমার অহংকার আমাকে ফিরে আসতে বাধা দিয়েছে…”

“না…” বাবর এবার আরো শক্ত করে বাবুরীর বাহু আঁকড়ে ধরে। “আমার উচিত তোমার কাছে ভুল স্বীকার করা। তুমিই ঠিক- তুমি যা বলেছিলে সব ঠিকই বলেছিলে। তুমি নও, আমিই ছিলাম গর্বিত গাধা। আমি ভেবেছিলাম সমরকন্দ আমার, ভেবেছিলাম এটাই আমার নিয়তি, যেকোনো মূল্যে, এমনকি শাহের কাছে নতজানু হয়ে হলেও, শহরটার শাসক হবার জন্য সেটা ধর্তব্যের ভিতরে পড়ে না। তোমার কথা শোনা আমার উচিত ছিলো… আমি এক বছরও শহরটা দখলে রাখতে পারিনি। শহরের লোকেরা আমার চেয়ে বর্বর উজবেকদের স্বাগত জানানটা মেনে নিয়েছিল,..”

“কিন্তু আমি ছিলাম আপনার বন্ধু… আমি জানতাম আমাকে আপনার তখন দরকার ছিলো এবং আমি সেটা থাকতে পারিনি। এই লজ্জাটা বিগত বছরগুলোতে আমাকে কুড়েকুড়ে খেয়েছে…” বাবুরীর কণ্ঠস্বর সামান্য কেঁপে যায়।

“তুমিই একমাত্র তোক যে সবসময়ে আমার প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছো তুমিই আমার সাথে সুলতান হিসাবে না, একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে আচরণ করেছে, আর আমিও যার সাথে অকপটে সবকিছু বলতে পারতাম… আর তোমাকে আমার প্রয়োজন ছিলো। আমি তোমাকে কতো খুঁজেছি… তোমার কথা কখনও ভুলিনি…আমি প্রথমদিকে সবসময়ে ভেবেছি তুমি একদিন ফিরে আসবে। কিন্তু আমার সেই আশা ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসে…তখন আমার ভয় হতো তুমি বুঝি আর বেঁচে নেই।”

“মাশুলের উপায় না খুঁজে বের করে আমি কিভাবে ফিরে আসি আপনার কাছে?”

বাবর তার কাঁধ ছেড়ে দেয়। “আমি তোমাকে কখনও বুঝতে পারিনি…”

“না। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সবসময়ে আলাদা ছিলো, আর সেরকমই থাকা বাঞ্ছনীয়।”

“তো, বদমাশ এবার বলল এতোদিন পরে হঠাৎ কেন ফিরে আসবার কথা মনে পড়লো?”

“কারণ এতোদিন পরে আপনাকে দেবার উপযুক্ত কিছু একটা আমি খুঁজে পেয়েছি। গত আটটা বছর আমি তুরস্কের সুলতানের সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলাম। সেনাবাহিনীতে আমি অনেক উপরে উঠেছিলাম আর তিনি একটা ব্যাপারে আমার কাছে কৃতজ্ঞ ছিলেন। যুদ্ধে আমি একবার শাহজাদার প্রাণ বাঁচিয়েছিলাম। তিনি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন কিভাবে তিনি আমাকে পুরস্কৃত করবেন। আর সেই সময়ে আমি বুঝতে পারি এবার আমার ফিরে যাবার সময় হয়েছে। শোনেন…” বাবুরীর চোখ যা একটু আগেও বিষণ্ণ দেখাচ্ছিলো তা এখন চকচক করতে থাকে। “তৃর্কীদের কাছে এমন একটা অস্ত্র আছে, যা আমাদের এই অঞ্চলে একেবারে অপরিচিত। সেই অস্ত্রের সাহায্যে আপনি যা ইচ্ছা করতে পারবেন। যাকে ইচ্ছা পরাজিত করতে পারবেন। আমি আপনার জন্য সেই অস্ত্র নিয়ে এসেছি। আর ভাড়াটে তূর্কী যোদ্ধার দল এসেছে আমার সাথে যারা আমার মতো এই অস্ত্র চালনায় পারদর্শী। আমরা আপনার সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষিত করে তুলব…যাতে আপনি জগদ্দল পাথরের মতো কাঁধে বয়ে নিয়ে বেড়ানো আপনার সেই নিয়তি পরিপূর্ণ করতে পারেন…” শেষ কথাগুলো বলার সময়ে বাবুরীর চোখেমুখে একটা সেঁতো হাসি ফুটে উঠে। আর বাবর তাকিয়ে দেখে তার কৃরিৎকর্মা বন্ধুর, যার উপস্থিত বুদ্ধির ঝলক দেখতে পারে, যা হতে পারে কাঁটাতারের মতো খোঁচা দেয়, কিন্তু তাকে উপেক্ষা করা অসম্ভব। “তোমার এই হামেহাল অস্ত্রটা আবার কি দ্রব্য?”

“আপনি কি বোমারু বা তারা মাঝে মাঝে যাকে কামান বলে, তার কথা কি শুনেছেন বা নিদেনপক্ষে ম্যাচলক মাস্কেট?”

বাবর মাথা নাড়ে অজ্ঞতা জানাতে।

“অস্ত্রটা এতোটাই শক্তিশালী যে আট বছর আগে আমি সুলতানের বাহিনীতে যোগ দেবার ঠিক আগে আগে- তার সেনাবাহিনী পারস্যের শাহ ইসমাইলের বাহিনীকে চালতানের যুদ্ধে এমন গো-হারান হারায় যে পারস্যের অধিকাংশ এলাকা তার হাতছাড়া হয়। আর সীমান্তের নকশা পর্যন্ত বদলে যায়। সেদিন যারা যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলো আমি তাদের সাথে পরে কথা বলেছি। তারা বলে শাহের কিজিল-বাশ- লাল পাগড়ী পরিহিত অশ্বারোহী বাহিনী সেদিন হাজারে হাজারে স্রেফ কচুকাটা হয়ে গিয়েছিলো। আমরা শহর অবরোধের সময়ে যে কালো গুড়ো ব্যবহার করি শহর রক্ষাকারী দেয়ালের নিচে মাইন স্থাপনের জন্য, এই অস্ত্রে সেই কালো গুড়োই ব্যবহার করা হয়। কিন্তু তূর্কীরা এর একটা ভিন্ন নাম দিয়েছে বারুদ’। আর সেই সাথে ব্যবহারের একটা নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। আপনি দেখলে বিস্মিত হবেন…”

কিন্তু এসব কিছুই বাবর শুনতে পায় না। এতগুলো বছর যে বন্ধুর অভাব সে অনুভব করেছে, তার অপরিবর্তনীয় সহযোদ্ধা সে ফিরে এসেছে, এই ব্যাপারটা এতোক্ষণে যেনো সে ধীরে ধীরে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। বাবুরীর দিকে তাকিয়ে, সুলতানের দায়িত্বের বোঝা, হতাশা আর নিরাশা সব যেনো নিমেষে দূরীভূত হয়। সবকিছু ছাপিয়ে একটা উদ্দাম আবেগ, বুনো উল্লাস তাকে আপুত করে যে, তার মনে হয় তাকে বুঝি শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলবে। বাবুরী কি বলছে বলতে থাকুক, সেটা পরে শুনলেও চলবে…

বাবরের মনের ভাব বুঝতে পেরেই যেনো বাবুরীও কথা বন্ধ করে। কিছুটা সময় তারা নির্বাক ভঙ্গিতে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপরে কখন যেনো আধো কান্না আর আধো হাসিতে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে। বাবরের আবার নিজেকে তরুণ মনে হয়। বর্তমানের প্রাচুর্যে চঞ্চল আর আগামীকালের কোনো ভাবনা সেখানে ঠাই পায় না।

***

“বাবুরী আমাকে বললো এতোগুলো বছর তোমার কেমন কেটেছে। তুমি কি বিয়ে করেছো…কোনো সন্তান?” সেদিন রাতে বাবরের ব্যক্তিগত কক্ষে একান্তে বসার পরে সে জানতে চায়। তার তখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে সত্যি সত্যি বাবুরীই তার পাশে বসে আছে। তার ভয় হয় যে চোখের পলক পড়লেই বুঝি বাবুরী মরিচীৎকার মতো মিলিয়ে যাবে।

“আমি আপনাকে বহু বছর আগে বলেছিলাম, স্ত্রী বা সন্তানের কোনো আকাঙ্ক্ষা আমার নেই…”

“কিন্তু তুমি কি চাও না যে তোমার পরেও তোমার বংশধরেরা পৃথিবীতে বেঁচে থাকুক? তুমি চলে যাবার পরে কে তোমার কথা স্মরণ করবে?”

“হয়তো, আপনার মত বন্ধুরা। সেটাই আমার জন্য যথেষ্ট…” বাবুরী কথা শেষ করে না। সে যাই হোক, কেউ যদি বিয়ে করে থিতু হতে চায় তবে তাকে আমার চেয়ে অনেক বেশি সুস্থির হয়ে অবস্থান করতে হবে।”

“কাবুল ত্যাগ করার পরে তুমি কোথায় গিয়েছিলে?”

“আমি ধারণা করেছিলাম আপনি আমাকে চোর খোঁজার মতো খুঁজবেন। আর তাই আমি এমন স্থানে গিয়েছিলাম যেখানে আপনি আমাকে খুঁজে পাবেন না। আমি একটা সওদাগরী কাফেলার সাথে পশ্চিমে ইস্পাহানে চলে যাই। সেটা ছিলো একটা দীর্ঘ, কষ্টকর আর কখনও বিপজ্জনক একটা ভ্রমণ- পদে পদে উজবেক আর যাযাবর ডাকাত দলকে আমাদের মোকাবেলা করতে হয়েছে। আমরা শেষ পর্যন্ত যখন ইস্পাহানে পৌঁছাই ততদিনে বণিক দলের অনেক মারা গিয়েছে। তাদের মালপত্রের একটা ভালো অংশ খোয়া গিয়েছে। কিন্তু যোদ্ধা হিসাবে আমার কুশলতা সবার নজর কেড়েছে। কাফেলা দলের সর্দার উত্তরে তাবরিজে পশম আর রেশমের পসরা নিয়ে যাবে এমন একটা কাফেলার সাথে আমাকে যেতে অনুরোধ করে। আমি সেখানে গিয়ে জানতে পারি আপনি সমরকন্দ হারিয়েছেন। আর পারস্যের শাহ্’র সাথে আপনার মৈত্রীর বন্ধন ঘুচে গিয়েছে। আমি ফিরেই আসতাম কিন্তু কিছু একটা আমাকে ফিরে আসতে বাধা দেয়… সম্ভবত আমি হয়তো ভীত ছিলাম আপনি আমাকে কিভাবে গ্রহণ করবেন সে বিষয়ে…সম্ভবত আমার গর্ব আমাকে ফিরে আসতে বাধা দিয়েছিলো…তারপরে আমার কানে আসে তুরস্কের সুলতান তার সেনাবাহিনীতে ভাল বেতনে লোক নিয়োগ করছে। আমি আমার মতো আরো কিছু ভাগ্যান্বেষীর সাথে যোগ দেই। যাদের কেউ কেউ উত্তরে কাস্পিয়ান হ্রদের তীর থেকে এসেছিলো। আর আমরা একসাথে ইস্তাম্বুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। ‘সুলতানে যুদ্ধযাত্রায় অংশ নেবার জন্য…”

“হ্যাঁ, যদিও আমার এখানে আপনার পাশে থাকা উচিত ছিলো… সমরকন্দ আর শাহের ব্যাপারে আমার ভবিষ্যদ্বাণী ফলে যেতে ব্যাপারটা আমাকে অস্থির করে তুলেছিলো। আমি প্রায়ই ভাবতাম সমরকন্দ পুনরায় আপনার হাতছাড়া হতে আপনি কতোটা কষ্ট পেয়েছিলেন…”।

“আমার সেটা প্রাপ্য ছিলো…”

তারা মাথা নত করে চুপচাপ বসে থেকে স্মৃতি রোমন্থন করে। তারপরে বাবুরী জোর করে মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে এর বাইরে বের করে আনে। “আমি শুনেছি আপনি আরো স্ত্রী গ্রহণ করেছেন এবং হুমায়ুন আর কামরান ছাড়া আরও দুটো স্বাস্থ্যবান সন্তানের জনক হয়েছেন?”

“ঠিকই শুনেছো।”

“আপনি দেখছি পুরোপুরি সংসারী মানুষে পরিণত হয়েছেন। গ্রামের নিষিদ্ধপল্লীতে দু’পায়ের মাঝে আগুন নিয়ে আমি আর আপনি যখন ঘোড়া নিয়ে দাবড়ে বেড়াতাম, সেটা কত যুগ আগের কথা বলে আজ মনে হয়…ইয়াদগারকে আপনার মনে আছে?”

“অবশ্যই।” বাবর মুচকি হেসে বলে। “আমি মাঝে মাঝে ভাবি সে এখন কোথায় আছে? আশা করি উজবেকদের হাতে সে ধরা পড়েনি।”

“মাহাম কি এখনও আগের মতোই সুন্দরী আছে?”

“সে আগের মতোই আছে- একটুও মোটা হয়নি- আর গুলরুখও তেমনই আছে। তুমি কি আশা করেছিলে…? আমি আজও মাহামকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি। তাকেই অন্যদের চেয়ে বেশি কামনা করি, কিন্তু…” বাবর ইতস্তত করে “…আমি প্রথমে যেমন আশা করেছিলাম, সে আমার তেমন সহচরীতে পরিণত হতে পারেনি। আমাদের দেহ আর কামনা মিলিত হয়, কিন্তু আমাদের মন সবসময়ে পরস্পরকে স্পর্শ করতে পারে না… আমি আমার নানীজান, আম্মিজান বা খানজাদার কাছে সবকিছু খুলে বলতে পারি- অভিযান, গুরুত্বপূর্ণ শাহী নিয়োগ- কিন্তু মাহামের সাথে না। সে আসলেই এসব কিছুই বোঝে না…মোটেই আগ্রহী নয় এসব নিয়ে…”

“আপনি সম্ভবত একটু বেশিই আশা করছেন। আপনার পরিবারের মেয়েরা এমন পরিস্থিতির মাঝেই বেড়ে উঠেছে।”

“এতো সহজ না ব্যাপারটা।”

“আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?”

“মাহাম অসুখী। হুমায়ুনের পরে তার আর কোনো সন্তান বাঁচেনি। পরবর্তীতে তিনবার গর্ভবতী হলেও, দুইবার গর্ভেই সন্তান মারা যায়। আর তৃতীয়বার-সেটাও ছেলে- হাকিম আমাকে মাহামের কক্ষে ডেকে পাঠাবার কয়েক মিনিটের ভিতরে আমার কোলে মারা যায়। মাহাম ক্লান্ত হয়ে শুয়ে ছিল। যে সন্তানের জন্ম আমরা গভীরভাবে কামনা করেছিলাম সে আমাদের দুজনের চোখের সামনে নিঃশ্বাসের জন্য হাঁসফাঁস করতে করতে স্তব্ধ হয়ে গেলে আমি মাহামের চোখ থেকেও ধীরে ধীরে দীপ্তি নিভে যেতে দেখি। আজ পেছনে ফিরে তাকিয়ে আমার মনে হয় সেই মুহূর্তে তার সত্ত্বার একটা অংশও মারা গিয়েছিলো।”

“তার হুমায়ুন বেঁচে আছে…”

“হ্যাঁ, কিন্তু তারপরেও তার মনে হয় সে ব্যর্থ…যদিও সে আমাকে আক্ষরিক অর্থেই ভালবাসে। আর আমিও মাহামকে খাতির করি। কিন্তু আমাদের দুজনের মাঝে এটা একটা অস্পষ্টতার আড়াল তৈরি করেছে।”

“আপনি কি এজন্যই আরও স্ত্রী গ্রহণ করেছেন? সঙ্গীর জন্য? আত্মার-সহচর খুঁজে পেতে?”

“আমার সেরকম কোনো প্রত্যাশা ছিলো না। আমার আবারও বিয়ে করার পেছনে বাস্তব বিষয়বুদ্ধি কাজ করেছে। একজন সুলতানের অনেক উত্তরাধিকারী থাকাটা উত্তম। আর বিশ্বস্ত অনুসারী এবং শক্তিশালী গোত্রের সাথে আত্মীয়তা করার জন্য এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”

“আপনার নতুন স্ত্রীরা কে কেমন?”

বাবর কাবুলের কাছে পাহাড়ী এলাকার ইউসুফজাই গোত্রের শক্তিশালী সর্দারের কন্যা দীর্ঘাঙ্গি, তন্বী দেখতে বিবি মুবারকের কথা ভাবে এবং ছোট চ্যাপ্টা নাকের নাদুসনুদুস দিলবার, যার বাবা উজবেক আক্রমণের কারণে হিরাত থেকে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে পালিয়ে কাবুলে এসে নিজের আনুগত্য ঘোষণা করেছিলেন। তুমি যদি জানতে চেয়ে থাকো তবে বলি, তারা কেউই অসাধারণ সুন্দরী না। কিন্তু ভালো মেয়ে…”।

“শয্যাসঙ্গিনী হিসাবে ভালো?”

“যথেষ্ট ভালো…”

“এরাই কি আপনার ছোট দুই ছেলের মা?”

“ছয় বছর আগে গুলরুখের গর্ভে কামরানের এক ভাই হয়েছে, পিচ্চি আসকারী। তারপরে তিন বছর পরে, দিলবারের একটা ছেলে হয়েছে।”

“আর মাহাম? তার জন্য এটা অবশ্যই কষ্টকর।”

বাবরের মুখটা শক্ত হয়ে যায়। বহু বছর আগে…নববধূ হিসাবে তার সামনে যখন পুরো জীবনটা পড়ে ছিলো, সে তখন কোনো প্রশ্ন না করেই গুলরুখের সাথে আমার বিয়েটা মেনে নেয়। কিন্তু আমি যখন অন্য স্ত্রী গ্রহণ করি তখন তার বিষাদময়তা অস্বাভাবিক। আমার নবপরিণীতা স্ত্রীরা গর্ভবতী হবার খবর চাউর হলে তার কষ্টের কোনো সীমাপরিসীমা থাকে না। বাইসানগার, তার নিজের বাবা, কিংবা খানজাদা তাকে শান্ত করতে পারেনি। একরাতে সে কাপের ভাঙা টুকরো দিয়ে সে নিজের কব্জি কাটতে চেষ্টা করে। আমার হেকিম মাদকদ্রব্য কামালি আর সুরার সাহায্যে। প্রস্তুত শক্তিশালী মিশ্রণ তৈরি করে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে…”

“আর সে এখনও অসুখী?”

“না…অবশ্য তার একটা কারণ আছে। চার বছর আগে, হিন্দুস্তানের সীমান্তের কাছে আমি একটা অভিযানে যাই, মাহাম তখন আমাকে চিঠি লিখে জানায় যে দিলবার সন্তানসম্ভবা। সে চিঠির শেষে লিখেছিলো, “তার ছেলে কি মেয়ে হবে, আমি জানি না। তার সন্তান আমাকে দিন, আমি নিজের সন্তানের মতো তাকে মানুষ করে আমার দুঃখ ভুলে থাকতে চাই।”

“আপনি কি বলেছিলেন?”

“সিদ্ধান্তটা নেয়াটা কঠিন ছিলো। আমি জানতাম দিলবারের সাথে আমি অন্যায় করছি। কিন্তু মাহাম খুশি হবে এমন কিছু একটা থেকে আমি তাকে কিভাবে না বলি? আমি তাকে লিখে পাঠাই দিলবারের সন্তান এখনও ভূমিষ্ঠ না হলেও, সেটা মাহামেরই সন্তান। আর যেমনটা সবাই ভেবেছিলো, সেবার দিলবারের ছেলেই হয়েছিলো…”।

“তার নাম কি?”

“হিন্দাল।”

বাবুরী বিস্ময়ে চোখ পিটপিট করে। তার মানে হিন্দুস্তানের বিজেতা।”

“মুহূর্তের উত্তেজনার বশে আমি নামটা রেখেছিলাম। আমি অভিযানে থাকাকালীন অবস্থাতেই আমি হিন্দালের জন্মের খবর পাই। হয়তো পুরোটাই আমার কল্পনা ছিলো, কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিলো যে সমস্ত সম্পদ আর সম্ভাবনা নিয়ে হিন্দুস্তানেই আমার ভাগ্য নিহিত আছে। কেবল আমি যদি একটা উপায় খুঁজে বের করতে পারি…”

“বহু বছর আগে আমি আর আপনি যখন হিন্দুস্তানের সীমান্তের কাছে অভিযান পরিচালনার সময়ে আলাপ করেছিলাম। আপনার কি সেই অনন্ত আকাশ আর কমলা রঙের তীব্র সূর্যের কথা মনে আছে?”

“অবশ্যই- আর আমাদের দেখা সেই হ্রদের কথা যেখানে লাল ডানার পাখির ঝাঁক দেখে মনে হয়েছিলো কেউ বুঝি সেটা রক্তে রাঙিয়ে দিয়েছে…সেসব স্মৃতি ভুলে যাওয়াটা বেশ কষ্টকর।” বাবর হলুদ জরির কারুকাজ করা তাকিয়ায় হেলান দেয়া অবস্থা থেকে উঠে খোলা জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। রাতের আঁধারে যেমনটা থাকার কথা, নিচের প্রাঙ্গনের দুপাশের প্রবেশপথে জ্বলতে থাকা মশালের আলোতে সবকিছু থমথম করছে। “কিন্তু মুশকিল হলো হিন্দালের এখন তিন বছর বয়স। আর আমি হিন্দুস্তান বা অন্য কোথাও আমার স্বপ্নের সাম্রাজ্য স্থাপনের কাজ কিছুই আরম্ভ করতে পারিনি…আমি জানি আমার যা আছে তাতেই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। আমার অভিজাত অমার্ত আর সেনাপতিরা যখন আমাকে দেখে- এমনকি বাইসানগার পর্যন্ত যে বহুদিন আমার সাথে রয়েছে আমার মাঝে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত এমন একজন সুলতানকে দেখতে পায় যাকে বিব্রত করার মতো তার কোনো প্রতিপক্ষ নেই। তারা কখনও আমাকে ঘিরে থাকা হতাশা বা অপূর্ণতা টের পায় না। আর তার টের পাবেই বা কিভাবে? আমি কখনও তাদের সেটা বলতে পারবো না…”

“খানজাদা এসব কিছু টের পায় না? আমার ধারণা আপনার বোনের চোখে এসব যাবে না।”

“সে আমার ভিতরের অস্থিরতা টের পায়- আমি নিশ্চিত। কিন্তু তার নিজের সেই ভাগ্য বিপর্যয়ের পরে আমি তাকে আমার আকাশচুম্বী স্বপ্ন আর স্বার্থপর ভাবনার বোঝা তার উপরে চাপিয়ে দিতে চাই না- তার নিজের সহ্য করা মানসিক কষ্টের সাথে এর কোনো তুলনাই চলে না…আর মাহামের সাথেও আমি এসব নিয়ে আলোচনা করতে পারবো না। তাহলে সে এমনই বিষণ্ণ হয়ে উঠবে যে, আমার তখন মনে হবে আমি বুঝি তারই সমালোচনা করছি। শুধু তুমি যদি এখানে থাকতে তাহলে সবকিছু হয়তো আলাদা হতো। তোমাকে আমি বোঝাতে পারবো না যে, আমার জীবনটা কেমন অসহনীয় হয়ে উঠেছে। আমি নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। এবং প্রাচুর্যের মাঝে জীবন কাটাচ্ছি, কিন্তু কখনও কখনও ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে এই একই ঈর্ষণীয় জীবনযাপন করতে দেখে একে কলুর বলদের মতো জীবনযাপন মনে হয়। মাঝে মাঝে নিজের হতাশার বোঝা লাঘব করতে আমি সুরাপানের আসর আয়োজন করি। সেখানে আমার অমাত্যদের সাথে মিলিত হয়ে আমরা আমার রাজ্যের বিভিন্ন শক্তিশালী সুরার স্বাদ পরখ করি- যেমন এই মুহূর্তে আমরা গজনীর লাল ওয়াইন পান করছি। আমরা ভোর পর্যন্ত পানাহারে মত্ত থাকি। যখন আমার পরিচারকের দল আমাকে বহন করে আমার কক্ষে পৌঁছে দেয় মাথা বিস্মৃতির অতলে ডুবে আছে। কখনও কখনও আমি আফিম আর ভাঙ- গাঁজা সেবন করি। তারা আমাকে একটা উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত সব সম্ভবের দুনিয়ায় নিয়ে যায়।”

“এতে লজ্জিত হবার কিছু নেই।”

“কিন্তু এই জীবনে কোনো মহত্ত্ব নেই। আমার আত্মা আজঅব্দি যে গৌরবের জন্য লালায়িত, সেটা কোথায়? আমার প্রায় দুই কুড়ি বয়স হতে চললো। আর আমিও আমার মরহুম আব্বাজান যেমন ফারগানায় আটকে গিয়েছিলেন ঠিক তেমনই নিয়তি বরণ করতে চলেছি। তার চেয়েও বড় কথা আমাদের চির পরিচিত সেই পুরাতন তৈমূরীয় জগত ধবংস হয়ে গেছে। উজবেক বর্বরের দল চিরতরে তা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। আমার জন্য তার কিছুই আর বেঁচে নেই।” বাবরের কণ্ঠস্বর কেঁপে যায়। সে বাবুরীর দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “আমি জানি আমার কথাগুলো স্বার্থপর, অকৃতজ্ঞের মতো শোনাচ্ছে… আমি এই কথাগুলো কখনও কাউকে বলিনি, আর তোমাকেও বলাটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না…তুমি সবসময়ে আমার দ্বিধাদ্বন্দ্বের মুহূর্তগুলো নিয়ে নির্মম রসিকতা করেছো…”

“না, আপনার দ্বিধা নিয়ে রসিকতা করিনি কখনও। কেবল আপনার আত্ম-বঞ্চনার অনুভূতি আমার অসহ্য মনে হয়। কিন্তু বিগত বছরগুলো আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। নিজের মতামতের উপরে আমার অশেষ আস্থা ছিলো, যা ঔদ্ধত্যের পর্যায়ে পড়ে। আমি আপনার চেয়েও অহংকারী ছিলাম। যদিও আপনিই ছিলেন আমাদের সুলতান, আমি নই। এখন আমি বুঝতে পারি…আমি এখন জানি মনেপ্রাণে কিছু কামনা করে সেটা অর্জনের পথ খুঁজে না পেলে কেমন কষ্টকর সেই অভিজ্ঞতা।”

“তুমি আবার কিসের মোহে পড়লে?”

“ফিরে আসবার…”

“তুমি থাকতে এসেছো?”

“হ্যা…একসাথে অন্তত আরেকটা যুদ্ধ লড়াই না করা পর্যন্ত…”

*

বাবুরী পাঁচ ফিট লম্বা একটা ব্রোঞ্জের নলের একপ্রান্তে আলতো করে চাপড় দেয়। “এটাকে ব্যারেল বলে। প্রথমে বারুদ ভর্তি কাপড়ের ব্যাগ আর গোলা এটার ভিতরে ঠেসে ভরা হয়। আর এটা,” সে ব্যারেলের শেষ প্রান্তে ফুলে থাকা একটা জায়গার দিকে ইঙ্গিত করে, “এটাকে বলে ব্রীচ। এই ছোট ফাটলটা খেয়াল করেছেন? তূর্কীরা এটাকে বলে স্পর্শ-র। এখানেই- আগুন দেবার ঠিক আগে গোলন্দাজের দল একটা তীক্ষ্ণ ধাতব শলাকা প্রবিষ্ট করায়- গোঁজ- বারুদের বস্তা ছিঁড়ে দিতে। তারপরে একজন একটা জ্বলন্ত মোম মাখানো শলাকা স্পর্শ-রন্ধ্রে প্রবিষ্ট করে ব্যারেলের ভিতরের মূল বারুদে অগ্নিসংযোগ করতে।”

“একটা গোলা কতদূরে নিক্ষেপ করা সম্ভব?”

“পুরো ব্যাপারটা ব্যারেলের দৈর্ঘ আর গহ্বরের ব্যাসের উপরে- যাকে বোর বলা হয়। ব্যারেল যত লম্বা আর বোর যতো বড় হবে, নিক্ষেপণ পাল্লা ততোবেশি হবে। তূর্কী সুলতানের অনেক কামান আছে যেগুলোর ব্যারেল দশফিট বা তারচেয়ে বেশি লম্বা এবং ওজন বিশ হাজার পাউন্ডের বেশি। কিন্তু ইস্তাম্বুল দখল করার সময়ে সত্তর বছর আগে যে অতিকায় তূর্কী বোমারু ব্যবহার করেছিলেন তার তুলনায় এগুলো সবই দুগ্ধপোষ্য। আপনি যদি সেটা একবার দেখতেন! ত্রিশ ইঞ্চি বোরের সতের ফুট লম্বা ব্যারেল। আর সেটা দিয়ে বারোশো পাউন্ডের গোলা এক মাইল দূরে নিক্ষেপ করা যায়। তারা বলে দশ মাইল দূর থেকে এর আওয়াজ শোনা যায়। কিন্তু সেটা দিয়ে দিনে মাত্র পনের বার গোলাবর্ষণ করা যায় আর দুইশ গোলন্দাজ প্রয়োজন হয় সেটা পরিচালনা করতে। এতই ভারী সেটা যে দশ হাজার লোক মিলে সেটা উত্তোলন করতে পারে এবং সত্তরটা শক্তিশালী আঁড় সেটা স্থানান্তরিত করতে পারে, এগুলোর মতো না।”

“আমাকে এর কেরামতি দেখাও…” বাবর অলৌকিক অস্ত্রটার কারিশমা দেখতে আগ্রহী হয়ে উঠে। তিনশ গজ দূরে বাবরের লোকদের তৈরি করা একটা দশ ফিট উঁচু স্তূপকে নিশানা হিসাবে নির্বাচন করা হয়।

মাথায় এঁটে বসা চামড়ার গোলাকার টুপি, চামড়ার জোব্বা আর চোগা পরিহিত পাঁচজন যোদ্ধাকে বাবুরী আদেশ দেয়। পোলো খেলার ম্যালেটের মতো অনেকটা দেখতে, একটাই পার্থক্য যে এর মাথার দিকটা ভেড়ার চামড়া দিয়ে মোড়া। একটা লম্বা লাঠির সাহায্যে একজন বারুদের থলে ব্যারেলের ভিতরে ঠেসে ভরে। তারপরে অন্য দু’জন হাঁফাতে হাঁফাতে একটা গোলাকার পাথরের খণ্ড উঁচু করে ব্যারেলে প্রবেশ করায় আবার সেই লাঠিটার সাহায্যে- ব্রীচের ভিতর দিয়ে সেটা গড়িয়ে দেয়। এদের কাজ শেষ হতে, চতুর্থ আরেকজন গোঁজ হাতে এগিয়ে আসে বারুদের থলে ফাটাতে সেটা ফাটলের ভিতরে প্রবিষ্ট করায় এবং স্পর্শ-রন্ধ্রের চারপাশে সামান্য আলগা বারুদ ছড়িয়ে দেয়- “নিশ্চিত হবার জন্য,” বাবুরী ব্যাখ্যা করে।

“পেছনে সরে দাঁড়ান।” বাবর নিরাপদ দূরত্বে এসে দাঁড়িয়েছে নিশ্চিত হবার পরেই কেবল সে কামানের দিকে এগিয়ে যায় এবং ব্যারেলের নতি পরীক্ষা করে। সন্তুষ্ট হয়ে সে পিছনে সরে এসে, পঞ্চম গোলন্দাজকে ইশারা করে। তার হাতে একটা অঙ্কুশের মত জিনিস। যেটার সাথে তেলে ভেজানো একটা সুতা লাগানো, যার একপ্রান্তে আগুন জ্বলছে। লোকটা বাবুরীর দিকে তাকায়।

“আগুন দাও!”

লোকটা তার হাতে ধরা প্রজ্জ্বলিত সলতে স্পর্শ-রন্ধ্রে খুঁজে দিয়েই লাফিয়ে পেছনে সরে যায়। মুহূর্ত পরে, একটা বিকট বুম শব্দের সাথে ব্যারেল থেকে পাথরটা নিক্ষিপ্ত হয়ে তৃণভূমির উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে আছড়ে পড়ে। একটা ধোঁয়ার মেঘের জন্ম হয় এবং সেটা কেটে যেতে, বাবর তাকিয়ে দেখে পাথরের চূড়াটা এখন একটা ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে।

“নমুনাটা একবার দেখুন!” বাবুরী গর্বিত কণ্ঠে বলে। “চালতানে, সুলতান সেলিম ঠিক এধরণের একসারি কামান, গরুর গাড়ির বহরের দ্বারা সুরক্ষিত অবস্থায়, ব্যবহার করেছিলেন ফলে পারস্যের সেনাবাহিনীর কিছুই করার ছিলো না…এরপরে তূর্কী পদাতিক সামনে এগিয়ে গিয়ে হাতের ম্যাচলক দিয়ে তখন প্রতিরোধ গড়তে ইচ্ছুক বাকী পার্সী সৈন্যদের ধরাশায়ী করে…”

বাবুরী হাততালি দিতে তার লোকেরা একটা লম্বা সরু কাঠের বাক্স বয়ে এসে তার পায়ের কাছে নামিয়ে রাখে। “আপনি বহুদিন আগে আমাকে তীরন্দাজির প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। আপনি আমাকে ওস্তাদ ধনুর্ধর, কোর বেগি, বানিয়েছিলেন। আমি এবার আপনাকে এটার সাহায্যে নিশানাভেদ করতে শেখাবো।” বাবুরী ঝুঁকে পড়ে বাক্স থেকে একটা লম্বা ধাতব বস্তু তুলে নেয়। “সর্বোৎকৃষ্ট ইস্পাত দিয়ে এটা নির্মাণ করা হয়েছে।”

“আকৃতি দেখে ছোট কামান বলে মনে হচ্ছে।”

“ঠিক তাই। এটাকে বলে মাস্কেট- ক্ষুদ্রাকৃতি কামান। ভাল করে খেয়াল করে দেখেন এর একটা লম্বা ব্যারেল রয়েছে ধাতব গোলা নিক্ষেপ করার জন্য। এর ম্যাচলক যান্ত্রিক ব্যবস্থা, এই নামেই এটাকে অভিহিত করা হয়। এটা অনেকটা এভাবে কাজ করে। আপনি এখানে বারুদ দেবেন, এই পাত্রে, তারপরে একটুকরো পাতলা দড়ির প্রান্তে অগ্নি সংযোগ করবেন। আগুনের শিখা বারুদ স্পর্শ করে সেটাকে প্রজ্জ্বলিত করবে এবং উৎপন্ন শক্তি ব্যারেল থেকে ক্ষুদ্র গোলকটা প্রচণ্ড বেগে নিক্ষেপে সাহায্য করবে।”

“কতো দূরে?”

“কমবেশি দুইশ গজ দূরত্বে। কিন্তু পঞ্চাশ গজের ভিতরে সবচেয়ে কার্যকরী এর নিশানা। পরীক্ষা করে দেখেন!”

তূর্কীদের একজন একটা দণ্ডের মাথায় লক্ষ্যবস্তু হিসাবে তরমুজ স্থাপন করতে, বাবুরী পাত্রে বারুদ ঢেলে গুলিটা ব্যারেলে প্রবেশ করায়। “ওজনের কারণে সৃষ্ট অসুবিধা নিশানা স্থির করার সময়ে এই হাতলের উপর আপনি ব্যারেলটা স্থাপন করবেন। বাবুরী চারফিট লম্বা একটা ধাতব দণ্ডের দিকে, যার মাথার দিকটা দুভাগ হয়ে অনেকটা অঙ্কুশের আকার নিয়েছে, সেদিকে ইঙ্গিত করে। দণ্ডটার একপ্রান্ত মাটিতে প্রোথিত করে সে বাবরকে দেখায় কিভাবে ব্যারেলটা সেটায় স্থাপন করতে হবে। “ব্যারেলের উপর দিয়ে সোজা নিশানার দিকে তাকান, এবং মনে রাখবেন যখন গুলি করবেন তখন একটা ধাক্কা অনুভব করবেন তাই সেজন্য প্রস্তুত থাকবেন।”

বাবর মাস্কেটটা নিয়ে সেটার বাট নিজের কাঁধে স্থাপন করে বাম চোখ বন্ধ করে ডান চোখে চকচকে ব্যারেলটা বরাবর তাকায়। সে তরমুজটা দৃশ্যপটে দেখতে পেয়েছে বোঝার পরে মাথা নেড়ে ইঙ্গিত করে। বাবুরী দড়ির প্রান্তে অগ্নিসংযোগ করে যা নিমেষে জুলতে শুরু করে।

“মাস্কেটটা স্থির রাখবেন…” বাবুরীর কথা শেষ হবার আগেই একটা তীক্ষ্ণ শব্দে ধাতব বলটা নিক্ষিপ্ত হয় এবং তরমুজের উধ্বাংশ নিমেষে কমলা রঙের ছাতুতে পরিণত হয়… “দারুণ। কিন্তু আমার অভিজ্ঞ বন্দুকবাজরা এর সাহায্যে কি ভেল্কি দেখাতে পারে সেটা আপনাকে দেখাই…” সে আরেকপ্রস্ত লক্ষ্যবস্তুর দিকে ইঙ্গিত করে: পঞ্চাশ গজ দূরে একটা কাঠের পায়ার উপরে স্থাপিত টেবিলে রাখা পনেরটা খড়ের পুতুল। বাবুরীর সমান সংখ্যক বন্দুকবাজ সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে নিশানা স্থির করে। মাস্কেটে বারুদ ভরে এবং একের পর এক নিখুঁত দক্ষতায় লক্ষ্যভেদ করে। তারপরে পিছিয়ে এসে চটপটে ভঙ্গিতে মাস্কেটে বারুদ ভরে এবং সাবধান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পনের জনের বারুদ ভরা শেষ হতে তারা একশ আশি ডিগ্রী ঘুরে দাঁড়িয়ে হাতলের উপরে ব্যারেল স্থাপন করে আরো দূরে স্থাপিত মাটির পাত্র লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এবারও প্রতিটা লোকই লক্ষ্যভেদ করে।

“অবশ্য যুদ্ধের ডামাডোলের মাঝে, আঙ্গুল কাঁপতে পারে, লক্ষ্যবস্তু নড়াচড়া করে কিন্তু আমি এই বন্দুক দিয়ে আগুয়ান সৈন্যদের সারি ছিন্ন ভিন্ন করতে দেখেছি।”

তার বন্ধুর প্রদর্শিত এই অলৌকিক অস্ত্রের ক্ষমতা পর্যবেক্ষণ করে বাবরের মনে ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে থাকা ভাবনা কথায় প্রকাশ করতে গিয়ে সে বাবুরীর কাঁধ জড়িয়ে ধরে নিজের শব্দ সতর্কতার সাথে নির্ধারণ করে। তার আর তার সাম্রাজ্যের উপরে যেনো আরো একবার উজ্জ্বল গনগনে ক্যানোপাস মেঘের আড়াল সরিয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে।

“তুমি কেবলই আমার বন্ধু নও। তুমি আমার প্রেরণা। তুমি অস্ত্রের চেয়েও বেশি কিছু আমার জন্য নিয়ে এসেছো…এখন পর্যন্ত, আমার, হিন্দুস্তানে একটা পুরোদস্তুর আক্রমণের আকাক্ষার কোনো বাস্তব ভিত্তি ছিল না। আমার না ছিলো লোকবল, না ছিলো কোনো বাড়তি সুবিধা। প্রতিপক্ষ ছিলো অগণিত আর শক্তিশালী। তাদের অধিরাজ দিল্লীর গর্বিত, অহংকারী ইবরাহিম লোদি। হিন্দুস্তান দখল করতে হলে আমাকে তার বিশাল সেনাবাহিনী আর যুদ্ধবাজ হাতির বহরকে পরাস্ত করতে হবে। এই নতুন অস্ত্রের সাহায্যে আমি দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি কিভাবে তাকে পরাজিত করা সম্ভব। আমার জন্মস্থানে আমি হয়তো তৈমূরের মতো মহান সম্রাটে পরিণত হতে পারবো না। কিন্তু এই কামান আর বন্দুকের সাহায্যে আমি তার সিন্ধু থেকে দিল্লী অভিযানের মাত্রা ছাপিয়ে যেতে পারবো। এতোগুলো বছর আমরা যে স্বপ্ন দেখেছি এবার সেটা পূর্ণ হবে।”

৪.২ রক্ত আর বজ্রের হুঙ্কার

২১. রক্ত আর বজ্রের হুঙ্কার

মহত্ত্বের স্বপ্ন দেখা সহজ। সেটা অর্জন করা কঠিন। কাবুলে নিয়ে আসা কামান আর মাস্কেট চালনায় দক্ষ একদল সৈন্যবাহিনী গঠনে বাবুরী আর তার ভাড়াটে তুর্কী যযাদ্ধাদের ছয় মাস লেগে যায়। ইত্যবসরে কাবুলের অধিবাসীরা যখন ধীরে ধীরে কামানের গর্জন আর মাস্কেটের তীক্ষ্ণ আলোর ঝলকানির সাথে পরিচিত হয়ে উঠছে তখন বাবর বাবুরীর একটা চিঠি আর স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে তার ব্যক্তিগত দূত তুরস্কের সুলতানের কাছে পাঠায় ইস্তাম্বুলের বন্দুক-নির্মাতা আর ঢালাই কারখানা থেকে আরো চারশ মাস্কেট আর ছয়টা কামান পাঠাবার অনুরোধ জানিয়ে।

বাবরের জন্য আরো সুখবর অপেক্ষা করছিলো। সে জানতে পারে বাবুরীর সাথে কাবুলে আসা ধূসর দাড়ি শোভিত ওস্তাদ তূর্কী গোলন্দাজ আলী কুলীর দক্ষ নির্দেশনায় তার নিজস্ব অস্ত্র নির্মাতারা নতুন অস্ত্র নির্মাণে দ্রুত কুশলতা অর্জন করছে। মাস্কেট আর কামানের ব্যাপারে তার অসাধারণ দক্ষতা- বিশেষ করে পাঁচ বছর আগে, ম্যাচলকের চিড় ধরা ব্যারেল বিস্ফোরিত হয়ে তার ডান হাতের দুটো আঙ্গুল উড়ে গিয়েছে।

রাতের পর রাত, বাবর বাবুরীর সাথে বসে কথা বলেছে, তাকে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে কামান আর ম্যাচলক ব্যবহৃত হয়েছে এমন সব যুদ্ধের ব্যাপারে সম্ভাব্য সবকিছু জানতে চেষ্টা করেছে। কোনো পরিস্থিতিতে এই আয়ুধ সবচেয়ে বেশি কার্যকর? সম্মুখ সমরে নাকি অবরোধ প্রয়াসে? ঘোড়সওয়ার বাহিনী আর তীরন্দাজদের হাত থেকে ম্যাচলক বন্দুকধারী আর গোলন্দাজদের কিভাবে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব? সনাতন আক্রমণের ধারায় এই অস্ত্র কি পরিবর্তন এনেছে? যুদ্ধে এই অস্ত্র ব্যবহারের আগে সে এদের বিষয়ে সবকিছু ভালোমতো জেনে নিতে চায়।

শহরের বিশাল খিলানাকৃতি সরাইখানা। যেখানে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত বণিকের দল খোলা প্রাঙ্গণের মাঝে অবস্থিত উঁচু পাথরের মঞ্চে পসরা সাজিয়ে বিক্রি করার পাশাপাশি গল্পগুজব করে থাকে। সেখানে বাবর তার লোকদের খবর সংগ্রহের জন্য পাঠায়। বাবরের লোকেরা মনোযোগ দিয়ে কথা শোনে কখনও কখনও বিচ্ছিন্ন প্রশ্ন করে। হিন্দুস্তান থেকে আগত বণিকদের কাছ থেকে ইবরাহিম লোদীর দরবারের জৌলুস, গোলাপী বেলেপাথর দিয়ে সজ্জিত বিশাল প্রাসাস নিয়ে বারফট্টাই করতে শোনা যায়। কিন্তু তিনি- বা হিন্দুস্তানের অন্য কোনো শাসক কামান বা ম্যাচলকের অধিকারী সে বিষয়ে তাদের কাছ থেকে সামান্যতম গল্পও তারা বের করতে পারে না।

কিন্তু, এখন জানুয়ারি মাসের এক ঝকঝকে শীতল দিনে, বাবর অবশেষে এসব অস্ত্রের ব্যাপারে একেবারেই অজ্ঞ এমন শত্রুর বিপক্ষে এর প্রতিক্রিয়া নিজের চোখে দেখবার জন্য বাবর একটা অভিযানে বের হয়। কাবুলের করদ রাজ্য, বাজারের নতুন সুলতানকে সে শত্রু হিসাবে বেছে নেয়। যে নতুন রাজত্ব পেয়ে যৌবনের উদ্দীপনায় বাবরকে প্রথা অনুসারে বাৎসরিক শস্য, ষাঁড় আর ভেড়ার পাল উপঢৌকন হিসাবে দিতে অসম্মতি জানিয়েছে।

পাহাড়ের অনেক উঁচুতে ওক, জলপাই আর সোমরাজ গাছের ঘন অরণ্যে, ময়না পাখির কলরবে মুখরিত স্থানে বসবাসরত, বাজাউরীরা বিচিত্র ধর্মবিশ্বাসের অধিকারী পৌত্তলিক সম্প্রদায়। কোনো বাজাউর রমণী মারা গেলে, তারা তার শবদেহ একটা খাঁটিয়ায় শুইয়ে দিয়ে সেটার চার পায়া ধরে উঁচুতে তুলে। মৃত রমণী যদি আচারনিষ্ঠ জীবনযাপন করে থাকে, বাজাউররা বিশ্বাস করে তাহলে লোকদের উঁচুতে তুলে ধরা খাঁটিয়া এমন ভীষণভাবে কেঁপে উঠবে যে শবদেহ মাটিতে নিক্ষিপ্ত হবে। তখনই কেবল তারা শোকের কালো লেবাস পরিধান করে বিলাপ করা শুরু করবে। কিন্তু যদি, মৃত রমণীর শবদেহ কোনো ধরণের কম্পন সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়। তারা সেটাকে অশুভ জীবনের ইঙ্গিত বলে বিবেচনা করে এবং মৃতদেহটা তখন দায়সারা ভঙ্গিতে আগুনে নিক্ষেপ করা হয় পুড়ে ছাই হবার জন্য।

অদ্ভুত এসব লোকদের শাসক তাকে একটা মোক্ষম সুযোগ দিয়েছে। বাবুরীকে পাশে নিয়ে, পদাতিক আর গোলন্দাজ বহরের একটা চৌকষ দলের নেতৃত্ব দিয়ে কাবুল থেকে বের হয়ে আসবার সময়ে বাবর ভাবে, সদ্য প্রশিক্ষিত দলটাতে ম্যাচলকধারী সৈন্য আর গোলন্দাজরা রয়েছে। যাদের প্রত্যেককে আলী কুলী নিজে আজকের অভিযানের জন্য মনোনীত করেছে। আর চারটা কামান রয়েছে। তারা উত্তরদিকে বাঁক নিয়ে পাহাড়ী এলাকার ভিতর দিয়ে বাজাউরের দিকে এগিয়ে যায়। আগেকার দিনে, এধরণের হামলার সময়ে বাবর আর তার অনুগত বাহিনী দ্রুত নির্মম ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে অতর্কিতে শত্রুর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তো। কিন্তু যাঁড়ের গাড়ির পেছনে বেঁধে গড়িয়ে নেয়া কামানের কারণে তাদের অগ্রসর হবার গতি হ্রাস পেয়েছে যা পর্যবেক্ষকদের সতর্ক সংকেত পাঠাবার সুযোগ খামোখাই বাড়িয়ে দিয়েছে।

বাবর ঘোড়ার পিঠে এগিয়ে যাবার সময়ে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যায়। মুখের উপরে এসে আছড়ে পড়া শীতল বাতাসে তার কোনো ভাবান্তর ঘটে না। কাবুল ত্যাগ করার ঠিক আগে আগে একটা দিনপঞ্জিকায় পাঠ করা অনুচ্ছেদের কথা তার মনে ঘুরপাক খেতে থাকে: “তৈমূর সাহসী আর পরাক্রমশালী যোদ্ধাদের বিশেষ খাতির করতেন। যাদের সাহায্যে তিনি আতঙ্ক আর বিভীষিকার ঝড় বইয়ে দিতেন এবং সিংহের মতো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতেন প্রতিপক্ষকে এবং এইসব যোদ্ধা আর যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের নৈপূণ্য ব্যবহার করে তিনি পর্বতপ্রমাণ প্রতিবন্ধকতা অনায়াসে টপকে যেতেন…” অনুচ্ছেদটায় কাপুরুষদের জন্য তৈমূরের তিরস্কারের কথাও বলা হয়েছে। কোনো যোদ্ধা, তার পদমর্যাদা যাই হোক, যুদ্ধ ক্ষেত্রে কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হলে তিনি তাদের মাথা মুড়িয়ে পুরো দেহ লাল রঙে রাঙিয়ে দিতেন। তারপরে তাদের মেয়েদের কাপড় পরিয়ে বেধড়ক পিটাতে পিটাতে সহযোদ্ধাদের গালিগালাজের মাঝে অস্থায়ী শিবিরের ভিতর দিয়ে টেনে হিঁচড়ে বধ্যভূমির দিকে নিয়ে যাওয়া হতো। তৈমূর ক্ষমা করতে জানতেন না।

বাবর নির্মমতার প্রয়োজনীয়তা বোঝে। মাত্র তিন রাত্রি আগের কথা। রাতের বেলা আকস্মিকভাবে শিবির পরিদর্শনে বের হয়ে সে প্রহরার দায়িত্বে নিয়োজিত পাঁচজনকে ঘুমাতে দেখে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবার আদেশ দেয়। তাদের বাম কান কেটে ফেলা হয় এবং সেটা গলায় ঝুলিয়ে বাবরের বাকি সৈন্যদের সামনে তারা রক্তাক্ত অবস্থায় হেঁটে যায়। কিন্তু তৈমূরের মতো একটা সাম্রাজ্য সৃষ্টি করে টিকিয়ে রাখতে সে যদি সফল হতে চায়, তাহলে তাকে আরো কঠোর হতে হবে। এবং নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা সফল করতে হলে দ্বিতীয়বার না ভেবেই তাকে কঠোরতম সিদ্ধান্ত নিতে অভ্যস্ত হতে হবে।

“সুলতান।” বাবরের একজন গুপ্তদূত, শীতের তীব্রতার হাত থেকে বাঁচতে ভেড়ার চামড়া দিয়ে ভালোমতো মোড়ান অবস্থায় তার দিকে এগিয়ে আসে। “আমাদের আগমনের সংবাদ পেয়ে এখান থেকে বিশ মাইল পূর্বদিকে পাহাড়ী এলাকায় বাজাউর নদীর তীরের এক দূর্গে সুলতান তার রাজধানী ত্যাগ করে পালিয়ে গিয়েছে।”

“তুমি নিশ্চিত জানো- এটা কোনো ফাঁদ না?”

“আমরা তাকে তার সৈন্যবাহিনী, সাথে শহরের লোকজন আর শিবিরে বসবাসকারীরাও রয়েছে, নিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখে পুরোটা পথ অনুসরণ করেছি।”

“আমাকে দূর্গটা কেমন বলো।” বাবর ঘোড়ার পর্যানের উপরে ঝুঁকে বসে, তার গালপাট্টার উপরে দেখা যাওয়া সবুজ চোখ ধকধক করে।

“দূর্গটা একটা বিশাল চতুর্ভূজাকৃতি মাটির তৈরি স্থাপনা। দোতলার সমান উঁচু, নদীর তীরে একটা গিরিসঙ্কটের পাশে অবস্থিত…আমি আপনাকে এঁকে দেখাই।”

গুপ্তদূত তার ঘোড়া থেকে নেমে, পায়ের কাছের মাটি পরিষ্কার করে এবং নিজের খঞ্জরের ডগা দিয়ে উত্তরের গিরিসঙ্কটের নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর পাশে একটা চারকোণা মিনারের নকশা আঁকে। “সুলতান, অনুগ্রহ করে দেখেন। বাকী তিনদিক উঁচু উঁচু করকট গাছের বন দিয়ে ঘেরা। দক্ষিণ দিকের দেয়ালে এই দরজাটাই ভেতরে প্রবেশের বা বাইরে বের হবার একমাত্র পথ…”

বাবর আর বাবুরী নিজেদের ভিতরে দৃষ্টি বিনিময় করে। এর চেয়ে ভালো সংবাদ আর হতে পারে না। সুলতান ভাবছে তিনি একটা দুর্ভেদ্য ঘাঁটিতে অবস্থান নিয়েছেন। আসলে তিনি একটা ফাঁদে আঁকা পড়েছেন।

*

চারদিন পরে, দূর্গ থেকে সামান্য দূরে যে সংক্ষিপ্ত সমতল ভূমি রয়েছে। সেখানে স্থাপিত সামরিক শিবিরে বাবর তার লাল রঙের সেনাপতির তাঁবুতে দাঁড়িয়ে হাতে চামড়ার দাস্তানা পরিধান করে। সে যেমন আশা করেছিলো, আগের দিন সন্ধ্যাবেলা সুলতান তার পাঠানো আত্মসমর্পন আর ক্ষমা ভিক্ষার সুযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। এবার সময় হয়েছে তাকে তার অবাধ্যতার জন্য শিক্ষা দেবার। রাতের আঁধারে তার লোকেরা ষাঁড়ের গাড়ির পেছনে বেঁধে নিয়ে আসা চারটা কামান দূর্গের প্রবেশদ্বার থেকে চারশ গজ দূরে স্থাপন করেছে। যতোটা নিরবে সম্ভব, আলী কুলীর লোকেরা মাটির ঢিবি তৈরি করে তাতে কামানগুলো স্থাপিত করে তারপরে সেগুলো লতাপাতা, ঝোপঝাড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছে যতোক্ষণ না আক্রমণের সময় হয়।

আক্রমণ শুরু করার সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। বাবরের সব সেনাপতিকে আলাদা আলাদা আদেশ দেয়া হয়েছে। দূর্গের দক্ষিণ দিকের সমভূমির উপর দিয়ে মূল বাহিনী এগিয়ে গিয়ে প্রথমেই সামনে থেকে আক্রমণ শুরু করবে। সেই ফাঁকে, ম্যাচলকধারী সৈন্যরা তাদের অনুসরণ করবে, দূর্গপ্রাকারের উপরে অবস্থানরত প্রতিরোধকারীদের নিষ্ক্রিয় করতে। অবশেষে বাবর যখন সময় হয়েছে বলে মনে করবে, সে কামানগুলোকে কার্যকরী করে তুলবে।

ইস্পাতের মতো ধূসর আকাশের নিচে, বাবর আক্রমণ শুরু করার নির্দেশ দেয়। দূর্গের পশ্চিম কোণের তিনশ গজ নিচে অবস্থিত একটা নতুন সুবিধাজনক স্থানের প্রান্তে, বাবর আর বাবুরী পাশাপাশি ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায়, পাথুরে ঢাল বেয়ে দূর্গের দিকে অশ্বারোহী তীরন্দাজদের ছুটে যেতে দেখে। আগুয়ান ঘোড়ার ছন্দের সাথে তাল মিলিয়ে তার ক্রমাগত তীর ছুঁড়ছে। দূর্গের দেয়ালের কাছে পৌঁছে, তারা সাথে নিয়ে আসা মইগুলো দূর্গের প্রবেশপথের বামদিকের দেয়ালে স্থাপন করে। তারা যখন এসব করছে, আলী কুলী আর তার ম্যাচলকধারীর দল দূর্গ প্রাকারের দেয়ালের উপরে প্রতিরোধী যোদ্ধাদের কেউ উঁকি দিলে তাদের লক্ষ্য করে গুলি করে।

দু’জন বাজাউরি যোদ্ধা সাথে সাথে ধরাশায়ী হয়। বাবর যেখানে অবস্থান করছে। সেখান থেকেই সে প্রতিরোধকারীদের হতাশা আর ক্ষোভ অনুভব করতে পারে। আরো অনেক যোদ্ধা ধরাশায়ী হয়। বাজাউরি যোদ্ধার দল যখন বুঝতে পারে গনগনে লাল ধাতব বলগুলো তাদের ঢাল আর বর্ম ভেদ করতে সক্ষম তখন দূর্গ প্রাকারের পেছন থেকে তারা টুপটাপ খসে পড়তে শুরু করে।

বাবরের লোকেরা ততোক্ষণে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাশাপাশি দুজন করে মই বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করেছে। মই আর দেয়ালের সাথে যতোটা সম্ভব নিজেদের চেপে ধরে রেখে তারা তাদের গোলাকৃতি ঢাল দিয়ে মাথা ঢেকে রাখে উপর থেকে নিক্ষিপ্ত পাথরের আঘাত থেকে বাঁচতে। আলী কুলী ইতিমধ্যে নিজের লোকদের গুলিবিদ্ধ হবার আশঙ্কায় ম্যাচলকধারীদের গুলি বন্ধ রাখার আদেশ দিয়েছেন। বাবা ইয়াসাভাল, হিরাত থেকে আগত অসীম সাহসী এক যোদ্ধা। প্রথমে দূর্গের ছাদে উঠে দাঁড়ায় এবং দ্বাররক্ষীর প্রকোষ্ঠের দিকে অমিত বিক্রমে এগিয়ে গিয়ে, প্রধান প্রবেশদ্বার আটকে রাখা কালো রঙের ধাতব বেষ্টনী সে তার সাথের যোদ্ধাদের নিয়ে গুটানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু মাস্কেটের তাণ্ডব বন্ধ হতে প্রতিরোধকারীরা এবার পুনরায় সাহসী হয়ে উঠে। বাবর তাদের দৌড়ে দূর্গপ্রাকারে উঠে এসে, বাবা ইয়াসাভালের সাথের মুষ্টিমেয় সংখ্যক যোদ্ধাদের উপরে কাঁটাওয়ালা গদা আর রণকুঠার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের দ্বাররক্ষীর প্রকোষ্ঠ থেকে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করে।

বাবর আড়চোখে বাবুরীর দিকে একবার তাকালে, সে সাথে সাথে বন্ধুর মনের কথা বুঝতে পেরে, ঢালের আরো কিছুটা সামনে লুকিয়ে রাখা কামান আর গোলন্দাজ বাহিনীর দিকে এগিয়ে যায়। বাবর তাদের কামানগুলোর চারপাশ থেকে লতাপাতার আড়াল সরিয়ে নিয়ে প্রতিটা ব্যারেলের নতি ঠিক করতে দেখে।

তারা তারপরে দ্রুত বারুদের থলে আর পাথরের গোলা ব্যারেলে ঠেসে ঢুকিয়ে দিয়ে স্পর্শ-রন্ধ্রে গোঁজ প্রবিষ্ট করিয়ে ফাটলের চারপাশে আরো কিছু বারুদ ছিটিয়ে দেয়। অবশেষে, গোলন্দাজ বাহিনীর ভিন্ন চারজন তোক সামনে এগিয়ে আসে সলতেতে আগুন ধরাবে বলে- বাবর এতোদূর থেকে কেবল তেলে ভেজানো দড়ির দৈর্ঘের মাথার অংশটুকু দেখতে পায়। বাবুরী এবার তার ফিরে তাকালে সে তরোয়াল মাথার উপরে তুলে বৃত্তাকারে আন্দোলিত করে, আগুন জ্বালাবার আদেশ দেয়। সহসা, যুদ্ধক্ষেত্রের পরিচিত শব্দ ছাপিয়ে বাজাউরবাসীদের অশ্রুতপূর্ব গমগমে তীক্ষ্ণ একটা আওয়াজ বাতাস চিরে ফালা ফালা করে দেয়।

প্রথম কামানের গোলাটা আগে থেকে নির্ধারিত দূর্গের প্রবেশপথের ডানপাশে দক্ষিণ-পূর্বদিকের বিশ ফিট উঁচু দেয়ালের নিম্নাংশে আছড়ে পড়ে। ভূমি সমতল থেকে প্রায় দশ ফিট উঁচুতে গোলাটা আঘাত হানলে ইটের ভাঙা টুকরো আর ধূলোর মেঘে চারপাশটা অন্ধকার হয়ে যায়। দ্বিতীয় গোলাটা প্রথমটার ঠিক নিচে, তৃতীয় আর চতুর্থটাও একই স্থানে আঘাত করে। ধোয়া আর ধূলোর মেঘ সরে গেলে, দেয়ালের একটা সামান্য অংশকে ভূপাতিত অবস্থায় এবং আশেপাশের দেয়ালে বিশাল সব ফাটলের জন্ম হয়েছে দেখা যায়। বাবরের সেনাবাহিনীর একটা অংশ, এতোক্ষণ যাদের নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিলো, তারা এবার ধ্বংসস্তূপের উপর দিয়ে হুড়মুড় করে দূর্গের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে শুরু করে।

হতভম্ভ প্রতিরোধকারীরা পালাতে শুরু করে। কেউ কেউ তাদের বোধাতীত আয়ুধ যা ইতিমধ্যে দূর্গের দেয়ালের একাংশ গুঁড়িয়ে দিয়েছে তা পুনরায় গর্জে উঠবার আগে, দূর্গের ছাদ থেকে দড়ির সাহায্যে দ্রুত নামতে গিয়ে তাড়াহুড়োর কারণে পিছলে যায় এবং নিচে আছড়ে পড়ে।

বাবরের তীরন্দাজ বাহিনীর নিক্ষেপ করা তীরের আড়াল আচ্ছাদনের মতো ব্যবহার করে ম্যাচলকধারীরা এগিয়ে গিয়ে তাদের অঙ্কুশ স্থাপন করে এবং পলায়নপর যোদ্ধাদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। বাবর দু’জন বাজাউর যোদ্ধাকে মুখ থুবড়ে পড়তে দেখে। একজনের কপালে মাস্কেটের ধাতব গোলক আঘাত করে তাকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিয়েছে। অন্যজন- হলুদ পাগড়ি পরিহিত এক দানব বুকের কাছটা খামচে ধরে আতঙ্ক আর যন্ত্রণায় ঝটফট করতে করতে চিৎকার করছে। তার কুঁকড়ে থাকা আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। কিন্তু বাকী অনেকেই হোঁচট খেতে খেতে দৌড়ে গিয়ে দূর্গের পূর্বদিকের দেয়াল টপকে নিচের ঢালে লাফিয়ে পড়ায় বাবরের ম্যাচলকধারী নিশানাবাজদের পক্ষে তাদের সবাইকে ঘায়েল করা সম্ভব হয় না।

“তাদের তাড়া করো!” বাবর তার রক্ষীবাহিনীর একাংশকে আদেশ দেয়। তারপরে, কোষমুক্ত তরবারি হাতে নিয়ে, সে দূর্গের প্রধান তোরণের ঢাল দিয়ে দুলকিচালে ঘোড়া ছোটায়। যেখানে তার লোকেরা ইতিমধ্যে দ্বাররক্ষীর প্রকোষ্ঠ সাফল্যের সাথে দখল করে নিয়েছে এবং লোহার বেষ্টনী তুলে দিয়েছে। সে প্রবেশপথের নিকটে পৌঁছালে বাবুরী তার সাথে এসে যোগ দিলে তারা একসাথে ভেতরে প্রবেশ করে।

“সুলতানের জয় হোক!” বাবর দূর্গ প্রাঙ্গনে উপস্থিত হলে, ঘামে ভেজা মুখ আর বাম কানের উপরে একটা আঁকাবাঁকা ক্ষতস্থান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়া অবস্থায় বাবা ইয়াসাভাল তাদের স্বাগত জানায়। “বাজাউরি’র সুলতান মৃত- দূর্গপ্রাকারের উপর থেকে তিনি গিরিসঙ্কটের অতলে লাফিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন। আমরা অসংখ্য লোককে বন্দি করেছি। আপনার পরবর্তী আদেশ কি?”

“তৈমূর আতঙ্কের সর্বগ্রাসী স্রোত বইয়ে দিয়ে পাহাড়সম প্রতিবন্ধকতা পর্যদস্ত করতেন…” শব্দগুলো- সম্ভবত নিষ্ঠুর, কিন্তু উদ্দেশ্য দিবালোকের মতো পরিষ্কার বাবরের মস্তিষ্কে অনুরণিত হয়। “শাহী মন্ত্রণা সভার সবাইকে হত্যা করো। তারা আত্মসমর্পণের সুযোগ পেয়েও সেটা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। বাকীদের গ্রেফতার করে নারী আর শিশুদেরও- কাবুলে প্রেরণ করো। তারা সেখানে আমার লোকদের দাস হিসাবে কাজ করবে।

“এবার বলেন? আপনার কি মনে হয়? আমরা কেমন দেখিয়েছি?” তারা অধিকৃত দূর্গ আর কামানের গোলায় তার ক্ষতিগ্রস্থ অংশ পর্যবেক্ষণকালে বাবুরী জিজ্ঞেস করে।

বাবর তার মনোভাব প্রকাশ করার মত শব্দ খুঁজে পেতে সময় নেয়। তার নতুন অস্ত্রের বরাভয়ে দূর্গটা কয়েকদিন, বা সপ্তাহ কিংবা মাসের বদলে মাত্র কয়েক ঘণ্টায় দখল করা সম্ভব হয়েছে। অসীম সম্ভাবনার একটা দ্বার যেনো খুলে গিয়েছে। সে বাবুরীর কাঁধ আঁকড়ে ধরে। “আজ আমরা এমন একটা রীতিতে যুদ্ধ করেছি যা আমার পূর্বপুরুষদের কাছে একেবারেই অজানা ছিলো। যা দেখে তারা হয়তো অভিভূত হতো…”

“বেশ কথা, কিন্তু আপনাকে তাহলে উফুল্ল দেখছি না কেনো?”

“প্রায়ই এমন হয়েছে যে আমি অসীম সম্ভাবনার আলোকে নিজেকে স্নাত করেছি যা কখনও অর্জিত হয়নি। তুমি নিজেও কি সেটা প্রায়শই বলো না? আমি যতোক্ষণ না নিশ্চিত হচ্ছি যে আমরা প্রস্তুত হয়েছি, তার আগে আমি তাড়াহুড়ো করে হিন্দুস্তান আক্রমণ করতে চাই না।”

“কিন্তু আজ সেই প্রস্তুতির সূচনা হয়েছে, তাই না?”

*

পরবর্তী সপ্তাহগুলো বাবরকে তার যুদ্ধাস্ত্র আর যুদ্ধ কৌশল শানিয়ে নেবার আরো সুযোগ দান করে। বিজিত আর নতজানু বাজাউর থেকে বাবর তার সেনাবাহিনী নিয়ে দক্ষিণ-পূর্বদিকে হিন্দুস্তানের সীমান্ত বরাবর বুনো, পাহাড়ি এলাকার দিকে এগিয়ে যায়। এবারও প্রতিপক্ষ তার কামানের হুঙ্কার কিংবা মাস্কেটের গর্জনের সামনে দাঁড়াতেই পারে না।

বস্তুতপক্ষে, বাবরের আগমনের সংবাদ পেতে, ভীতসন্ত্রস্ত গোত্রপতিরা নধর ভেড়া, মটকা ভর্তি শস্যদানা, তেজী ঘোড়া কিংবা সুন্দরী রমণীর সাথে তোষামদপূর্ণ আনুগত্যের বার্তা পাঠিয়ে নিজেদের বশংবদ প্রমাণের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে। তাকে তুষ্ট করে পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত নিজেদের গ্রাম আর মাটির দূর্গসমূহ রক্ষা করতে তাদের আগ্রহ দেখে বাবরের ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি ফুটে উঠে। কেউ কেউ এমনকি মুখে ঘাস নিয়ে তার সামনে উপস্থিত হয়- বাবর তার তরুণ বয়সে অন্যসব বুনো উপজাতির ভিতরে আত্মসমর্পণের এই অভিব্যক্তি লক্ষ্য করেছিলো।

কিন্তু এই সব তুচ্ছ সর্দারদের বশ মানাবার আকাঙ্ক্ষা তার মাঝে ইতিমধ্যেই কমতে শুরু করেছে। রাতের বেলা সে ঘুমাবার চেষ্টা করলে নানা দৃশ্যকল্প তার স্বপ্নে এসে হানা দেয়। এক বিজেতার চেহারা-”মোমবাতির মতো চোখ যেখানে কোনো উজ্জ্বলতা নেই”- তার আর তার উদ্দেশ্যের মাঝ দিয়ে বহমান সিন্ধু নদী পর্যবেক্ষণ করছে। মানুষকে পরাস্ত করতে তৈমূর সিদ্ধহস্ত ছিলেন। কখনও কোনো পার্থিব বাঁধা তার সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি কোনো পাহাড় বা নদী তাকে কখনও হতোদ্যম করতে পারেনি। বাবরও ঠিক তেমনই হবে। পনের বছর আগে, গ্রীস্মের প্রচণ্ড দাবদাহে, সে আর বাবুরী সিন্ধুর দিকে তাকিয়ে ছিলো। চমকে উঠে ঘুম ভেঙে গেলে সে আবারও নিজের ভেতরে সেই একই কাজ করার একটা উদগ্র বাসনা অনুভব করে। যা সে পরে কখনও ঠিকমতো ব্যাখ্যা করতে পারেনি- না বাবুরীর কাছে, না নিজের কাছে…কিন্তু বাসনাটা দিন দিন তার ভেতরে কেবল বেড়েই চলে। ভবিষ্যত অভিযানের ভাবনা মন থেকে সরিয়ে রেখে, বাবর তার সেনাবাহিনীকে পূর্বদিকে ঘুরিয়ে নেয় এবং মার্চ মাসের এক শীতের সকালে, প্রশস্ত, দ্রুত বহমান একটা নদীর দৃশ্যপট চোখের সামনে ভেসে উঠে। নিজের লোকদের অনুসরণের জন্য অপেক্ষা না করে সে ঠাণ্ডা, কঠিন জমির উপর দিয়ে তুড়গ বেগে ঘোড়া দাবড়ে যায়। তীরের কাছে পৌঁছে, সে তার ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নামে, পরণের কাপড় টেনে খুলে এবং বরফগলা নদীর পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে যা সুদূর তিব্বতের কোনো পাহাড়ের চূড়া থেকে বয়ে আসছে।

পানি প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হওয়াতে আগ্রহের প্রথম ঝাপটা তার নিমেষে কেটে যায় এবং বরফশীতল পানি কয়েক ঢোক গিলে ফেলতে তার মনে হয় গলায় বুঝি বরফ জমে গিয়েছে। তীব্র স্রোত তাকে ইতিমধ্যে অনেকদূর ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে এবং তীরে দাঁড়িয়ে থাকা তার লোকেরা আতঙ্কে চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। আরেকবার গভীর শ্বাস নিয়ে এবার সে মুখ পানির অনেক উপরে রাখে- সে তাকে ভাসিয়ে। নিতে চাওয়া প্রাকৃতিক শক্তি নাকচ করে দেহের পুরো শক্তি দিয়ে সাঁতার কাটতে শুরু করে। ভেসে যাওয়া থেমে গিয়ে পেছনের দিকে এগিয়ে যাওয়া শুরু হতে সে উফুল্ল হয়ে উঠে। সে বিজয়ী হয়েছে। কিছু একটা পানিতে আছড়ে পড়ে এবং বাবুরীর মাথা পানির নিচে থেকে তার পাশে ভেসে উঠে।

“মূর্খের বাদশা, এসব আপনি কি শুরু করেছেন?” বাবুরীর মুখ ঠাণ্ডায় প্রায় নীল হয়ে উঠেছে। “আর পাগলের মত হাসছেন কেন?”

“আমার সাথে সাঁতরে অপর পাড়ে চলো, সেখানে গিয়ে আমি তোমাকে খুলে বলবো।”

জলাবর্ত আর তীব্র স্রোতের ভিতর দিয়ে তারা একসাথে এগিয়ে যায় যতোক্ষণ না অপর পাড়ে গিয়ে পৌঁছে এবং রুক্ষ্ম, অনুজ্জ্বল ধুসর-হরিৎ বর্ণের ঘাসের গোছ দু’হাতে আঁকড়ে ধরে নিজেদের পানি থেকে টেনে তুলে। বাবর মাটিতে শুয়ে পড়ে, তখনও খিকখিক শব্দে হাসছে। যদিও তার পুরো দেহ শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে। এবং তার শীতল ত্বক কাটা কাঁটা হয়ে উঠেছে।

“এবার বলেন এসবের মানে কি?” মাথা ঝাঁকিয়ে চোখের উপর থেকে চুল সরিয়ে, বাবুরী ঘাড় নিচু করে তার দিকে তাকায় এবং দু’হাতে নিজেকে চাপড় মেরে উষ্ণ রাখতে চেষ্টা করে।

“গতরাতে আমি ভালো করে ঘুমাতে পারিনি। সিন্ধুর এতো কাছে রয়েছি এই ভাবনাটাই আমার কানে নদীর স্রোতের মতো রক্তের গর্জন সৃষ্টি করে। আমি একটা মানত করেছিলাম, আল্লাহতালা যদি হিন্দুস্তানে আমাকে বিজয়ী করেন তবে আমার নতুন সাম্রাজ্যের প্রতিটা নদী আমি সাঁতরে অতিক্রম করবো।”

“আপনি এতো তাড়াতাড়ি সাঁতার শুরু না করলেও পারতেন…কোনো কিছু জয় করা থেকে আপনি এখনও অনেক দূরে রয়েছেন।”

বাবর উঠে বসে। “আমাকে এটা করতেই হতো। আমি কিভাবে সিন্ধু নদী দেখে সেটা অতিক্রম না করে থাকতে পারি…? অবশ্য আমাদের এবার কাবুলে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু শীঘ্রই আবার আমরা ফিরে আসবো। আমি এবার যখন ফিরে আসবো তখন এই ভূখণ্ড জানবে যে আমি এটা অর্জন করেছি। এই অঞ্চল আমাকে স্বাগত জানাবে…”

“আর তার আগে আমার ধারণা আমাদের বোধহয় আবার সাঁতরে ফিরে যেতে হবে?”

“অবশ্যই।”

*

বরফশীতল সিন্ধু নদের পানিতে সাঁতার কাটবার আট মাস পরে একদিন ভোরের প্রথম প্রহরে, বাবর মাহামের কক্ষ থেকে বের হয়ে আসে। যেখানে সে শেষবারের মতো তার রেশম কোমল দেহের ভাঁজে আর তার চন্দন সুবাসিত দীঘল কেশের জটলায় নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চেয়েছে এবং সেখান থেকে একাকী সে নিজের নিভৃত কামরায় ফিরে আসে। কাবুলের দূর্গপ্রাসাদের নিচে অবস্থিত তৃণভূমি থেকে ভেসে আসা রণদামামার গুরুগম্ভীর আওয়াজ সে মনোযোগ দিয়ে শোনে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে ভোরের আধো- আলোতে জ্বলজ্বল করতে থাকা সেনাছাউনির অগ্নিকুণ্ডের দিকে তাকিয়ে থাকে। গতকাল, এই একই বারান্দা থেকে, বাবুরী পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়, সে তার লোকদের জন্য নিজের মহাপরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিলো।

“তৈমূরের হিন্দুস্তান আক্রমণের সময় থেকে তার উত্তরাধিকারীদের জন্য এটা একটা ন্যায়সঙ্গত সম্পত্তি। তার প্রধান উত্তরাধিকারী হিসাবে আমি আগামীকাল যাত্রা আরম্ভ করবো। যারা আমাকে আমার জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছে তাদের কবল থেকে সেটা উদ্ধারের নিমিত্তে। চারমাস আগে আমি হিন্দুস্তানের অধিকাংশ স্থানের স্বঘোষিত শাসকের- দিল্লীর ইবরাহিম লোদীর কাছে একটা বাজপাখি উপহার হিসাবে পাঠিয়েছিলাম। আমি তাকে বলেছিলাম, সে যদি আমাকে তার অধিরাজ হিসাবে স্বীকার করে নেয়, তবে আমার অধীনস্ত করদ রাজ্যের শাসক হিসাবে আমি তাকে মনোনীত করবো। সে বাজপাখিটার মাথা কেটে আমার কাছে ফেরত পাঠিয়েছে। সে এবার কাবুলের সুলতান এবং তৈমূরের বংশধরকে অপমানিত করার জন্য নিজের সিংহাসন খোয়াবে।”

বাবরের প্রজারা তার কণ্ঠের তেজোদীপ্ত স্বরের প্রতি গর্জে উঠে সম্মতি প্রকাশ করে। যদিও সুলতান ইবরাহিম কেবলই একটা তাদের কাছে এবং আগ্রা ও দিল্লীতে তার প্রাসাদ এবং দূর্গ সম্বন্ধে, তার বিপুল বৈভব এবং বিশাল সেনাবাহিনী কিংবা শাসকদের জোট- যাদের কেউ তারই মতো মুসলমান, কেউবা মূর্তি উপাসক- যারা তার অধীনস্ত সামন্তরাজ এসব কিছু সম্বন্ধেই তাদের কোনো ধারণাই নেই। বাবর তার বক্তব্যের প্রতি তাদের এইরকম কিছু ভাবনা চিন্তা না করেই সমর্থন করতে দেখে মনে মনে হাসে। একথা সত্যি যে হিন্দুস্তানের প্রতি তার একটা জন্মগত অধিকার রয়েছে। কিন্তু তার সত্যিকারের জন্মগত অধিকার ছিলো সমরকন্দ। সেখানকার স্মৃতি তাকে আপুত করে তোলে কিন্তু সে এটাও জানে সেখানে সে আর কখনও শাসন করতে পারবে না।

“সুলতান, আপনার বোন কথা বলতে চান আপনার সাথে।” একজন পরিচারক এসে বাবরের কল্পনায় ছেদ টেনে দেয়।

“অবশ্যই। তিনি কি আমাকে তার কাছে যেতে বলেছেন?”

“না, সুলতান। তিনি নিজেই এসেছেন।”

খানজাদা বারান্দা তার পাশে এসে দাঁড়ায়। বাবর আর সে সেখানে একা হওয়া মাত্র, খানজাদা নেকাবের আড়াল অপসারিত করে। দেয়ালের কুলঙ্গিতে রাখা মশালের আলো তার মুখের গড়ন আর ত্বকের বলিরেখা অনেকটাই কোমনীয় করে তোলে। বাবর যে রাতে আকশির দূর্গে ফারগানার সিংহাসনে নিজের অধিকার ঘোষণা ঘোষণা করেছিলো, সেদিন যে মেয়েটা ভাবগম্ভীর ভঙ্গিতে তার মরহুম আব্বাজানের তরবারি আলমগীর এনে তার হাতে তুলে দিয়েছিলো, সেই মেয়েটাকেই যেনো এখন আবার দেখতে পায়।

“আমি জানি তুমি একটু পরে জেনানামহলে আমার আর তোমার স্ত্রীদের কাছ থেকে বিদায় নিতে যাবে। কিন্তু আমি তোমার সাথে কিছুটা সময় একাকী কাটাতে চাইছিলাম। ফারগানায় আমাদের কৈশোরে জীবন যখন অনেক বেশি নিরাপদ আর প্রতিশ্রুতিপূর্ণ ছিলো, সেই সুখী দিনগুলো স্মরণ করতে কেবল আমরা দু’জনই আজ বেঁচে আছি। আমাদের উপর দিয়ে এরপরে অনেক ঝড়ঝাপটা বয়ে গিয়েছে, ভালো মন্দ দু’ধরণের…” সে দম নেবার জন্য থামে। “আমাদের জীবন হয়তো অনেক। সহজ আর ঘটনাহীন হতে পারতো, কিন্তু নিয়তির সেটা কাম্য না। তুমি হিন্দুস্তানে তোমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অভিযান শুরু করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। যা ইতিহাসের পাতায় আমাদের পরিবারের মর্যাদা নিষ্পন্ন করবে। আমাদের মরহুম। আব্বাজান, আম্মিজান আর নানীজান আজ বেঁচে থাকলে যেমনটা চাইতেন, আমি আশা করি এই অভিযানে তুমি সেসব কিছু অর্জন করো। আমরা যে জন্য বেঁচে আছি- বিজয় আর প্রভুত্ব স্থাপন তাকে ইঙ্গিতপূর্ণ করে তুলবে… কিন্তু আমার আদরের ছোট ভাই নিজের প্রতি যত্ন নিতে ভুলে যেও না। “ খানজাদার কিশমিশের মতো চোখ অনেকটা তাদের নানীজানের মতোই কিন্তু অনেক বেশি গাঢ়- অশ্রুতে টলটল করে।

“আমি, আমার প্রথম টাট্টু ঘোড়াটাকে আচমকা বাঁক নেওয়াতে গিয়ে পড়ে গেলে তুমি যেমন আমাকে বকুনি দিয়েছিলে সাবধান হতে। ঠিক সেভাবে, নিজের খেয়াল রাখবো।” বাবর তাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে। “আমার ভাগ্যে যাই ঘটুক একটা কথা আজ রাতে জেনে রাখো, আমি কেবল আমরা নিয়তি অনুসরণ করছি আর যে কারণে আমার জন্ম হয়েছে সেটা পরিপূর্ণ করতে চাইছি। গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান আমার পক্ষে রয়েছে। শাহী জ্যোতিষবিদ কি ভবিষ্যদ্বাণী করেননি যে নভেম্বরের শেষপ্রান্তে যদি আমি আমার অভিযান শুরু করি। সূর্য যখন ধনুরাশিতে অবস্থান। করছে তাহলে বিজয় আমার নিশ্চিত?”

খানজাদা দু’হাতে বাবরের মুখটা পলকের জন্য ধরে রেখে তার কপালে আলতো করে চুমু খায়। “আবার আমাদের দেখা না হওয়া পর্যন্ত বিদায়, আমার ভাই।”

“বিজয় অর্জিত হওয়ামাত্রই আমি তোমাকে নিয়ে যাবার জন্য লোক পাঠিয়ে দেবো।”

তারপরে সে বিদায় নেয়, দ্রুত জেনানামহলের দিকে ফিরে যায়। যেখানে বাবর জানে যে আগামী মাসগুলোতে নিজের দুশ্চিন্তা গোপন করে- সে সবাইকে আগলে রাখবে, সাহস যোগাবে। এবারের অভিযানে হুমায়ূন তার সাথে যাবে। আর সেজন্য কামরানকে সে কাবুলের রাজপ্রতিভূ নিয়োগ করেছে। বাইসানগার আর কাশিমের মতো অভিজ্ঞ ব্যক্তি, এবারের অভিযানে তারা অংশ নিচ্ছে না। দরবারে থাকবেন তাকে পরামর্শ দেবার জন্য। কিন্তু বাবর জানে তার অনুপস্থিতিতে কাবুলের নিরাপত্তা আর সুশাসনের নিশ্চয়তা, অনেকটাই খানজাদার বিজ্ঞ পরামর্শের উপর নির্ভর করবে। সে আরও জানে তার স্ত্রীদের ভিতরে ঈর্ষাজনিত কারণে উদ্ভূত নানা জটিলতা, এসান দৌলত বেঁচে থাকলে যেভাবে সামলে নিতেন, খানজাদাও ঠিক সেভাবে তাদের সাথে কথা বলে, সান্ত্বনা দিয়ে, আপোষ করিয়ে, সামলে নেবে।

অন্ধকার থেকে ভেসে আসা তূর্যধ্বনি আবারও স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দূর্গপ্রাসাদের নিচের তৃণভূমিতে দশ হাজার অশ্বারোহী অভিযান শুরু করার জন্য উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছে। অচিরেই তারা তাদের অস্ত্র আর সমরসজ্জা শেষবারেরমতো পরখ করে নিয়ে ঘোড়াগুলোকে যাত্রার জন্য প্রস্তুত করবে। নিশান-বাহকের দল বাবরের মনোনীত সবুজ আর হলুদ ডোরা কাটা- হলুদ রঙ তার জন্মভূমি ফারগানার, আর সবুজ তৈমূরের রাজধানী সমরকন্দের স্মারক- পটভূমিতে তিনটা জ্বলজ্বল করতে থাকা বৃত্ত, যা তৈমূর নিজের জন্মের সময়ে গ্রহসমূহের নিখুঁত অবস্থান প্রকাশ করার জন্য অংকন করতেন, সম্বলিত নিশানের ভাঁজ খুলে।

কঠোর আর নিবিড় প্রশিক্ষণের ফলে দক্ষ হয়ে ওঠা গোলন্দাজ আর ম্যাচলকধারীরাও, শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। কামান, মাস্কেট, বারুদের থলি, আর কামানের গোলা ইতিমধ্যে গাড়িতে তোলা শেষ হয়েছে। অস্থায়ী ছাউনি স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী- চামড়ার তৈরি ভারী তাঁবু, তবু স্থাপনের খুঁটি, বিশালাকৃতি রান্নার পাত্র- সবকিছুই মালবাহী গাড়িতে তোলা হয়েছে।

আকাশের ভোরের আলো ফোঁটার সাথে সাথে ষড়গুলো গাড়ির জোয়ালের সাথে বাধা হবে। মালবাহী পশুর বিশাল সারি- দুই কুজ বিশিষ্ট উট, গাধা আর খচ্চর খাদ্য শস্যের বস্তা, শুকনো মাংস, আর অন্যান্য রসদ সামগ্রী বহন করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। বাবরের সেনাবাহিনীকে অনুসরণ করবে বলে মনোনীত বণিকের দল যারা ছাউনিতে অস্থায়ী বাজার বসাবে তারাও তাদের মালপত্র আর তা বহনকারী পশুর পাল প্রস্তুত করে দীর্ঘ আর সফল অভিযান মানে বিপুল মুনাফার সম্ভাবনা। তাদের পেছন পেছন যাবে সেনা ছাউনি অনুসরণকারী সাধারণ মানুষের দল- দিনমজুর, মেথর, পানির্বাহক, শিশু সন্তান কোলে নিয়ে উদ্বিগ্ন স্ত্রী, যে তার অভিযানে অংশ নেয়া স্বামীর কাছাকাছি থাকতে আগ্রহী, বারবণিতার দল, দড়াবাজ, বাঈজি আর বাদ্যযন্ত্রীর দল যারা জানে সৈন্যদের মন যুদ্ধের ভাবনা থেকে সরিয়ে রাখতে পারলে বিপুল বখশিশ পাওয়া যাবে। একটা পুরো শহরই যেনো ভ্রমণ করছে সৈন্যবাহিনীর সাথে।

কয়েক ঘণ্টা পরে, দুপুরের ঠিক আগে আগে, শীতের সূর্য দৃশ্যপটের উপরে অকাতরে রূপালি আলো বিকিরিত করার মাঝে, বাবর আঙ্গুলে তৈমূরের সোনার অঙ্গুরীয়, কোমরে কোষবদ্ধ আলমগীর, আর উদ্দাম তূর্যনাদের মাঝে কাবুলের দূর্গপ্রাসাদ থেকে ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় বেরিয়ে আসে। শহরের উঁচু দেয়ালের বাইরে বের হয়ে আসার সময়ে তার পেটের ভেতরে কেমন দলা পাকিয়ে উঠে। আশঙ্কা, উত্তেজনা নাকি পূর্বাভাষ? তার বহু পরিচিত, বহুবার অনুভব করা অনুভূতি। কিন্তু এবারের ব্যাপারটা আলাদা। প্রচণ্ড একটা ঐকান্তিকতা তাকে আপুত করে রাখে। সত্যি সত্যি ভাগ্যদেবী এবার তার প্রতি প্রসন্ন হয়েছেন…তাকে কেবল সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে, আগে যা কিছু হয়েছে- ফারগানার সিংহাসনের দাবিতে তার লড়াই, উজবেকদের পরাস্ত করে সমরকন্দ দখলে রাখার প্রয়াস। তার কাবুল শাসন- সবই তার নিজের অপার ভাগ্য এবং তার ভাবী সাম্রাজ্যের ভিত্তিপ্রস্তর বলে পরিগণিত হবে…

*

“জ্যোতিষ ঠিকই বলেছিলো। ভাগ্য আমাদের সহায়।” বাবর চঞ্চল বেগে বহমান কাবুল নদীর উপরে বিশাল ভেলায় চামড়ার চাদোয়ার নিচে বিছিয়ে দেয়া গালিচার উপরে তার দু’পাশে বসে থাকা বাবুরী আর হুমায়ূনকে লক্ষ্য করে বলে। দাড়ির দল দাঁড় বেয়ে ভেলাটা পরিচালনা করছে। তাদের চারপাশে বিশাল সব নৌকার একটা বহর। কামানগুলো আর ভারী মালপত্রের অধিকাংশ বহন করছে। সেনাবাহিনীর মূল অংশ নদীর তীর ধরে এগিয়ে চলেছে।

“হুমায়ূন, উত্তরের যাযাবরদের মাঝ থেকে বিশাল একটা বাহিনী গড়ে তুলে তুমি দারুণ একটা কাজ করেছে। বাবর তার মূল বাহিনী নিয়ে কাবুল ত্যাগ করার দশ দিন পরে হুমায়ুন বখশানের বনভূমি এলাকা থেকে সংগৃহীত দু’হাজারের বেশি সৈন্যের একটা বাহিনী নিয়ে তার সাথে এসে যোগ দিয়েছে।

“আব্বাজান–আপনি আমাদের সাথে তাদের দেবার জন্য যতো স্বর্ণমুদ্রা পাঠিয়েছিলেন, সেটার কথা বিবেচনা করলে, ব্যাপারটা মোটেই কঠিন ছিলো না।” “বদখশানীরা ভাল যোদ্ধা, অবশ্য নিজেদের ভেতরে বা অন্যের সাথে ঝগড়া বাধাবার ব্যাপারেও তাদের দক্ষতা প্রশ্নাতীত।” পানির উপর দিয়ে প্রবাহিত শীতল বাতাসের হাত থেকে বাঁচতে পরনের নীল আলখাল্লাটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে বাবুরী বলে।

“আমাদের অগ্রসর হবার গতির সাথে তাল রাখতে গিয়ে তাদের লড়াই করার জন্য বাড়তি শক্তি থাকবে না।” বাবর মন্তব্য করে।

সবুজ পানির বহমান ধারা তার মনকে কলহপ্রিয় উপজাতির থেকে ভাটিতে হিন্দুস্তানের পানে ধাবিত করে এবং খুশিতে ভরিয়ে তোলে। শীঘ্রই সে আফিম মিশ্রিম ভাঙ দিয়ে যেতে বলে। বাস্তবতা থেকে পলায়নের একটা উপায় হিসাবে সে একসময়ে এটা ব্যবহার করতে। কিন্তু এখন এটা বর্তমানকে আনন্দে ভরিয়ে তুলে আর ভবিষ্যতকে আশাব্যঞ্জক করে। প্রতিবার সে এটা গ্রহণ করলে, তারা যে নিরস পাথুরে দৃশ্যপটের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলেছে, সেটাকে সোনালী আলোয় যেনো উদ্ভাসিত করে তোলে এবং এর প্রতিটা অনুষঙ্গ- প্রতিটা বৃক্ষ, প্রতিটা ফুল, নধর ভেড়ার পালের প্রতিটা ভেড়া- তাজা, মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যে ভরে উঠে। সে যখন চোখ বন্ধ করে, তখন অন্য সব অবয়ব তার মানসপটে ভিড় করে তার লোকেরা যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রু সেনার ভূপাতিত মৃতদেহের ভিতর দিয়ে উৎফুল্ল ভঙ্গিতে ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে। তাদের ধাবমান ঘোড়ার পা যেনো মাটি স্পর্শই করে না, অনন্ত আকাশের নিচে সে একটা সোনার সিংহাসনে উপবিষ্ট এবং মাথায় একটা হীরা পান্নাখচিত সোনার মুকুট চকচক করছে…

“কি পাগলের মতো মিটমিট করে হাসছেন?” বাবুরী জানতে চায়।

“আমি ভাবছি আগামী, আমাদের কপালে কি আছে। আজ থেকে এক বছর পরে আমরা কোথায় থাকবো।”

“আমি আশা করছি দিল্লীতে…”

“আর হুমায়ূন তোমার কি মনে হয় আমরা কোথায় থাকবো?”

“আব্বাজান আমি ঠিক জানি না…কিন্তু আল্লাহতা’লা চাইলে আমরা আপনার শত্রুদের পরাস্ত করে একটা সাম্রাজ্যের অধিকারী হবো।”

তার অকপট মন্তব্য শুনে বাবর আর বাবুরী নিজেদের মধ্যে উৎফুল্ল দৃষ্টি বিনিময় করে। কিন্তু পরমুহূর্তেই তারা তাদের চেহারা স্বাভাবিক করে তুলে। একজন তরুণের জন্য হতে পারে শব্দগুলো বেশ গালভরা, কিন্তু তাদের মনেও কি একই আবেগ খেলা করছে না?

*

“সুলতান, গুপ্তদূতের দল ফিরে এসেছে। তারা সিন্ধু নদ অতিক্রমের একটা উপযুক্ত জায়গার খবর নিয়ে এসেছে।”

বাবরের বুকটা ধক করে উঠে। কাবুল নদী ত্যাগ করার পরে থেকেই, খাঁ খাঁ নুড়ীপাথরে পূর্ণ খাইবার গিরিপথের ভিতর দিয়ে দক্ষিণ-পূর্বদিকে তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করে সে এই খবরটা শোনার জন্যই অপেক্ষা করছিলো। সে আর বাবুরী শিকারে যাবে বলে প্রস্তুত হয়েছিলো- পাশ্ববর্তী গ্রামের লোকেরা পাঁচ মাইল দূরে ওক বনের পরস্পর সংবদ্ধ ডালপালার মাঝে দুটো গণ্ডার চড়ে বেড়াচ্ছে। বলে খবর নিয়ে এসেছিলো। কিন্তু আপাতত তারা আরো কিছুদিন নিরূপদ্রবে ঘাস খেতে পারবে।

“আমার সাথে এসো!” বাবুরীকে অনুসরণ করতে বলে সে তার অভিযানের সময়ের লাল তাঁবুর বাইরে যেখানে গুপ্তদূতেরা অপেক্ষা করছে সেদিকে ঘোড়া হাঁকিয়ে এগিয়ে যায়।

“সুলতান, এখান থেকে একদিনের দূরত্বে একটা স্থান আছে। যেখানে ভেলা বানিয়ে আমরা ভারী জিনিসপত্র ভাসিয়ে ওপারে নিয়ে যেতে পারবো।” গুপ্তদূতদের দলপতি তাদের নিয়ে আসা খবর বয়ান করে।

“সেখানে স্রোত কিরকম?”

“নদীর একটা তীক্ষ্ণ বাঁকের পরে অতিক্রমের জন্য নির্ধারিত স্থানটা অবস্থিত। ফলে স্রোতের গতিবেগ এখানে অপেক্ষাকৃত কম- আমরা তিনটা মালবাহী খচ্চর পানিতে

নামিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছি। তারা বেশ ভালোমতোই ওপারে গিয়ে পৌঁছেছে। আর নদীর তীরের এই অঞ্চলটায় কোনো লোকবসতিও নেই। আমরা কোনো ধরণের বিঘ্ন ছাড়াই নদী অতিক্রম করতে পারবো।”

পরের দিন, বাবর আর বাবুরী তৃতীয়বারেরমতো সিন্ধু নদের দেখা পায়।

“দোহাই আপনার, আপনি নিশ্চয়ই এবারও সাঁতরে নদী অতিক্রমের মতলব ভাঁজছেন না?” কণ্ঠে কৃত্রিম উৎকণ্ঠা ফুটিয়ে বাবুরী জিজ্ঞেস করে। কারণ এবার আমি আর আপনার পেছনে লেজের মতো পানিতে লাফ দিচ্ছি না…”।

“আমি সাম্রাজ্য না পাওয়া পর্যন্ত সাঁতার কাটা বন্ধ। আমাদের কপাল ভালো আমরা শেষবার যেমন দেখে গিয়েছিলাম নদীতে পানির স্তর, এখন তার চেয়ে অনেক কম।” বাবর ঝুঁকে একটা শুকনো ডাল তুলে নিয়ে পানিতে ছুঁড়ে মারে। “গুপ্তদূতেরা ঠিক খবরই নিয়ে এসেছে। নদীর এই বাঁকটা আসলেই স্রোতের বেগ অনেক কমিয়ে দিয়েছে- ডালটা দেখো কেমন ধীরে সুস্থে ভেসে যাচ্ছে…”

“আপনার কণ্ঠস্বর কেমন হতাশ শোনাচ্ছে। আপনি কি রূপকাশ্রয়ী কোনো সংগ্রাম। আশা করছিলেন নদী অতিক্রম করবার সময়ে?”

“আমি চাইনি কিন্তু আশা করেছিলাম। আমরা এখানে ছাউনি স্থাপন করবো আর ছুতোরের দল পর্যাপ্ত ভেলা তৈরি করার পরে আমরা নদী অতিক্রম করবো।”

ভেলা বানাতে- গাছ কেটে, চিরে তক্তা করে, দড়ি দিয়ে বেঁধে এবং চামড়ার অতিরিক্ত তাঁবু কেটে উপরিভাগ আচ্ছাদিত করতে তিনদিন সময় লাগে। চতুর্থ দিন তারা নদী অতিক্রম করে। যদিও ঝিরঝির হিম বৃষ্টির একটা পাতলা চাদরে চারপাশ আবৃত থাকায়, নদীর তীরের মাটি চিটচিটে কাদায় রূপান্তরিত হয়েছিলো এবং ভেলার উপরিভাগ পিচ্ছিল করে তুলেছিলো তবুও বিপুল সংখ্যক মানুষ আর ভারবাহী পশুর পাল অন্যপাড়ে নিয়ে যেতে ভোরের আলো ফোঁটার পর থেকে দুপুর পর্যন্ত সময় লাগে। প্রথমে নদী অতিক্রম করে অগ্রগামী প্রহরীর দল, তারপরে ঘোড়া, মহিষ, উট আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কামান এবং মাস্কেটের বাক্সগুলো। এরপরে পদাতিক বাহিনীর সদস্যদের। সওদাগর আর অস্থায়ী শিবিরের মালপত্র ওপাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেনাবাহিনীকে অনুসরণ করতে থাকা লোকগুলোকে নিজেদের বন্দোবস্ত নিজেদেরই করতে হয়। পুরো বহরটা পার করতে গিয়ে কেবল তিনটা মালবাহী উট তারা হারায়। ভেলায় ভালোমতো বেঁধে না রাখার কারণে বেচারারা ভেলা নিয়ে উল্টে স্রোতের সাথে ভেসে যায়।

নদীর অপর পাড়ে পৌঁছানো মাত্র, বাবর একটা ছোট তাবু স্থাপন করার আদেশ দেয়। সে তাঁবুর ভেতরে একলা প্রবেশ করে এবং পর্দা টেনে বেঁধে দেয়। তারপরে সে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে এবং মাটিতে সেজদার ভঙ্গিতে অনেকক্ষণ মাথা ঠেকিয়ে রাখে। “আমি একবার তোমার আনুগত্য দাবি করেছিলাম এবং আমি আরো একবার সেই দাবি নিয়ে এসেছি।” সে ফিসফিস করে বলে। “আমি তৈমূরের দিব্যি, আমার আর আমার বংশধরদের দিব্যি দিয়ে বলছি এই মাটি আমি চাই।” সে গলায় চেনের সাথে ঝোলানো একটা আকিক পাথরের তাবিজ হাতে নিয়ে সেটার মুখটা খুলে এবং কোমর থেকে খঞ্জরটা বের করে সেটার ডগা দিয়ে খুব সাবধানে সামান্য পরিমাণ মাটি তুলে নিয়ে ভেতরে রাখে। তারপরে তাবিজের মুখটা ভালো করে বন্ধ করে সে আবার তার জোব্বার ভিতরে বুকের কাছে ঝুলিয়ে রাখে।

*

ফেব্রুয়ারি মাসের কোনো একদিন সন্ধ্যাবেলা, বাবরের স্থাপিত ছাউনির পাশ দিয়ে হলুদাভ একটা আভার জন্ম দিয়ে শতদ্রু নদী বয়ে চলে। হিন্দুস্তানের উত্তর-পশ্চিম অংশের সমভূমি আর সুলতান ইবরাহিম লোদির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর দিল্লীর মাঝে এটাই শেষ বড় নদী। বাবর ভাবে, এই পর্যন্ত তারা দ্রুতই অগ্রসর হয়েছে বলতে হবে। সিন্ধু নদ অতিক্রমের পরে, শীতের সেই ঝিরঝির বৃষ্টি তাদের কিছু দিন ভালোই ভুগিয়েছে। নরম মাটিতে ঘোড়া আর মালবাহী পশুগুলোর বিশেষ করে কামান বহনকারী ষাঁড়গুলোর বেশ কষ্ট হয়েছে সামনে এগিয়ে যেতে। কিন্তু তারপরে একটা সময়ে বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়েছে এবং তারাও সিন্ধুর বিভিন্ন শাখানদী অতিক্রম করে সাবলীল ভঙ্গিতে সামনে এগিয়ে গিয়েছে।

এতোদিন পর্যন্ত কেবল বন্য, আইন অমান্যকারী উপজাতির সাথেই তাদের সংঘর্ষ হয়েছে। একটা উপজাতি- গুজর- পাহাড়ের উপর থেকে নেমে এসে বাবরের লোকদের আক্রমণ করেছিলো যখন তারা একটা সংকীর্ণ গিরিপথ অতিক্রমে ব্যস্ত সেই সময়ে। কিন্তু তার পশ্চাতে অবস্থিত প্রহরীর দল তাদের একেবারে দাঁতভাঙা জবার দিয়েছে। গুজরদের কর্তিত মাথার একটা বেশ দর্শনীয় স্তূপ কার্যকরী প্রতিষেধকের কাজ করেছে এবং অন্য কোনো উপজাতি ভুলেও আর এদিকে নাক গলাতে আসেনি। একবার শত অতিক্রম করলে, পুরো ব্যাপারটা তখন একটা ভিন্ন মাত্রা গ্রহণ করবে। তারা তখন ইবরাহিম লোদীর শক্তিশালী সামন্ত রাজাদের অঞ্চলে প্রবেশ করবে। কয়েকদিন আগে সে নদীর অপর পাড়ে তাদেরই একজনকে ফিরোজ খান- দূতের হাতে চরমপত্র দিয়ে পাঠিয়েছিলো। দিল্লী যেতে হলে তার ভূখণ্ডের উপর দিয়েই যেতে হবে: “আপনার এলাকা এক সময়ে তৈমূরের সাম্রাজ্যের অংশ ছিলো এবং আমি আমার জন্মগত, ন্যায়সঙ্গত অধিকার দাবি করছি। আত্মসমর্পণ করে আমার প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। আপনি তাহলে আমার অধীনস্ত সামন্ত রাজা হিসাবে নিজের শাসন বজায় রাখতে পারেন এবং আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি কোনো ক্ষয়ক্ষতির শিকার আপনার রাজ্য হবে না।”

রাজাটা এর উত্তরে তাকে একটা ধূসর বাদামী রঙের মর্দা ঘোড়া আর সাথে একটা বার্তা পাঠায়: “আপনার দাবি কৃত্রিম। আমি দিল্লীর সুলতান ইবরাহিম লোদীর অনুগত, যিনি হিন্দুস্তানের ন্যায়সঙ্গত সম্রাট। নিজের ভূখণ্ড ছেড়ে এতোদূর ভ্রমণ করার কারণে বোধহয় আপনার ঘোড়া দুর্বল হয়ে পড়েছে। আমার পাঠানো এই ঘোড়াটা আপনাকে দ্রুত কাবুলে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।” বাবর লোকটার ঔদ্ধত্য দেখে কেবল হেসেছে আর ঘোড়াটা বাবুরীকে দিয়ে দিয়েছে।

বাবর তার সেনাপতির তাঁবুর দিকে হেঁটে যাবার সময়ে ভাবে, ফিরোজ শাহ নিজের অবিমৃষ্যকারীতার জন্য পস্তাবে। ফিরোজ খানের শক্তঘাঁটির উদ্দেশ্যে মূল বাহিনী এগিয়ে যাবার আগে শতদ্রর ওপাড়ের এলাকাটা গোপনে রেকী করার জন্য হুমায়ূন তার বদখশান যাযাবর বাহিনীর একটা ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে যেতে চাইলে বাবর অনুমতি দেয়। আল্লাহ সহায় থাকলে, শীঘ্রই নদী অতিক্রম করার পরে ছেলের সাথে তার দেখা হবে এবং ফিরোজ খানকে এমন কিছু অস্ত্র দেখাবে যা সে তার জীবনেও দেখেনি… সে নিজের তাঁবুতে অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করতে থাকে। সে ভালো করেই জানে তার বহু প্রতিক্ষিত উচ্চাকাঙ্ক্ষার ভাগ্য খুব শীঘ্রই নিষ্পত্তি হবে। মাঝরাতের দিকে, সে তার পরিচারককে আফিম মেশানো সুরা নিয়ে আসতে বলে। এটা তার অস্থিরতা প্রশমিত করবে। এমনকি সে একটু ঘুমিয়েও নিতে পারে- যা। কিছু দিন যাবত তার কাছে অধরা হয়ে উঠেছে।

কড়া পানীয়টা তার ক্রিয়া শুরু করে এবং বাবরের মতো প্রশান্তির রাজ্যে বিচরণ করতে থাকে…সে বলতে পারবে না কতক্ষণ সময় সে ঘোরের ভিতরে ছিলো। যখন সহসা তার স্বপ্নে বজ্রপাতের ধ্বনি এসে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিতে চায়। দিনটা বেশ গরম আর স্যাঁতস্যাঁতে। বৃষ্টি হলেই সম্ভবত এই গুমোট ভাবটা কাটবে। শীঘ্রই ভারী বৃষ্টি তার তাঁবুর ছাদে ঢাক বাজাতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পরে, চামড়ার মাঝের সেলাই দিয়ে চুঁইয়ে পানি পড়তে থাকে। সে গুনতে শুরু করে- এক, দুই, তিন, ঝপাস…এই, দুই, তিন, ঝপাস… তার চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসতে চায়। এমন সময় বাবুরীর কণ্ঠস্বর সে শুনতে পায় এবং টের পায় কেউ তাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে জাগাতে চাইছে। “নদীর তীর পানিতে উপচে পড়ছে! পুরো শিবির পানিতে সয়লাব হয়ে গিয়েছে।”

“কি?” আফিমের নেশায় বুদ, সে বাবুরীর কথা প্রথমে বুঝতে পারে না।

“আমরা পানির ভিতরে আটকে পড়েছি। পুরো নদী একটা হ্রদের রূপ নিয়েছে। আমাদের দ্রুত এই এলাকা ত্যাগ করতে হবে।”

আলমগীর তুলে নিয়ে সেটা কোমরে বাঁধতে বাঁধতে বাবর তাঁবুর বাইরে বের হয়ে আসে এবং চোখের সামনে যা দেখে তার সেটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়: পুরো শিবির ইতিমধ্যে এক ফিট ঘোলা পানিতে তলিয়ে গিয়েছে। চারদিক থেকে তার সেনাপতিরা পানি ভেঙে অনেক কষ্ট করে তার তাঁবুর দিকে এগিয়ে আসছে, আদেশের জন্য তাকিয়ে রয়েছে।

তার আফিমের নেশা এক লহমায় ছুটে যায়। “তাঁবু পরিত্যাগ করো এবং ভারী জিনিসপত্রও নেবার দরকার নেই। ঘোড়া আর মানুষদের উচ্চভূমিতে সরে যেতে বলো।” বৃষ্টির অঝোর ধারার মাঝে এত জোরে বৃষ্টি পড়ছে যে সূচের মত বিদ্ধ করে- সে তাদের পেছনে অবস্থিত নিচু টিলা দেখতে পায়। “তোমরা যতোগুলো সম্ভব মাস্কেটের বাক্স আর বারুদের থলি সাথে নিয়ে যাও। কামানগুলো নিয়ে ব্যস্ত হবার দরকার নেই- পানি তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। মালবাহী পশুগুলোর বাঁধন খুলে দাও। তারা নিজেরা বাঁচার পথ খুঁজে নেবে, ছাউনির সবাইকে এই একই কথা বলে দাও…আমাদের হাতে সময় খুব অল্প।”

বাবর অঝোর বৃষ্টির ভিতরে তার পরিচারকদের বলে তার আর বাবুরীর ঘোড়া নিয়ে আসতে। ক্রমশ বাড়তে থাকা পানির ভিতর দিয়ে তারা একসাথে ঘোড়া চালিয়ে যায়। লোকদের উৎসাহ দেয় সাধ্যমত যা কিছু পারে বাঁচাতে। কিন্তু তারপরে পানি ততোক্ষণে রেকাব স্পর্শ করেছে। তারা টিলার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। তাদের ভীতসন্ত্রস্ত ঘোড়া দু’টি, পানিতে প্রথমে আধা সাঁতারের ভঙ্গিতে ছটফট করে। বাবর আর বাবুরী তাদের কাঁধের উপরে ঝুঁকে এসে আলতো করে চাপড় দিয়ে কানে ফিসফিস করে সাহস জোগায়। শিবির থেকে ভেসে আসা নানা জিনিস তাদের চারপাশে ভাসতে থাকে-রান্নার পাত্র, ঘোড়ায় চড়ার জুতা, মৃত ভেড়া আর মুরগী। তারা অবশেষে যখন উঁচু জায়গায় পৌঁছে দেখে তার অধিকাংশ অশ্বারোহী আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছে। তাদের কেউ কেউ আবার নিজেদের সাথে অন্যদেরও নিয়ে এসেছে- নারী আর শিশুর দল গাছের নিচে পানিতে ভিজে চুপচুপে অবস্থায় তারা বসে আছে।

সকাল নাগাদ বৃষ্টি থেমে যায় এবং কয়েক ঘণ্টার ভিতরে বাণের জলও নেমে যায়। বাবর চোখ বন্ধ করে, শোকরানা জানায়। তার পুরো সেনাবাহিনীই বলা যায় অক্ষত রয়েছে। পানি নেমে যাওয়া মাত্র তারা শিবিরে ফিরে গিয়ে ফেলে আসা যা কিছু উদ্ধার করা যায় তার চেষ্টা করবে- কামানগুলো, তাদের বর্ম, অস্ত্রশস্ত্র, তাঁবুগুলো আর যা কিছু খাবার যোগ্য আছে। তারপরে মালবাহী পশুগুলোকে তাড়িয়ে আনতে হবে। হিন্দুস্তান বিজয় সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত আফিম আর না।  তার রোদে পোড়া গলায় একটা মশা গুনগুন করতে করতে এসে বসলে বাবর বিরক্ত হয় এবং এক চাপড়ে সেটা থেবড়ে দিলে রক্তের দাগ গলায় লেগে থাকে তার নিজের রক্ত। কিন্তু শীঘ্রই অন্যদের রক্তপাত শুরু হবে। শাহী জ্যোতিষের সাহায্য লাগবে না সেটা বোঝার জন্য। প্রথমে ফিরোজ খান তারপরে তাকে দিল্লী যেতে যারা বাধা দিতে চায়, তাদের সবাইকে রক্ত দিয়ে মূল্য শোধ করতে হবে। তার সামনে কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।

৪.৩ পানিপথ

২২. পানিপথ

দিল্লীর উত্তর-পশ্চিমের সমভূমিতে পানিপথের ছোট গ্রামটার কাছে বাবর তার বাহিনী নিয়ে দুদিন আগে শিবির স্থাপন করার সময়ে তার লোকেরা শিবিরের ঠিক মাঝখানে তার বিশাল লাল রঙের নিয়ন্ত্রক তাঁবুটা স্থাপন করেছে। বাবর আর তার চারপাশে সমবেত সামরিক পর্ষদের সদস্যদের এপ্রিল মাসের তীব্র দাবদাহের হাত থেকে তাবুটা সামান্যই স্বস্তি দান করতে পারছে। তাবুর পর্দা টেনে দেয়া হলে ভেতরের পরিবেশ নিমেষেই শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে উঠে। চামড়ার দড়ি দিয়ে বেঁধে পর্দা সরিয়ে দেয়া হলে তীব্র বাতাসের সাথে বয়ে আসা ধূলিকণা চোখে খোঁচা দিয়ে নাকে গুতো মেরে নিমেষেই অস্থির করে তোলে। বাতাসের গতি রোধ করতে তাবু থেকে কয়েক গজ দূরে স্থাপিত মোটা খয়েরী চাদরের বেড়া দিয়ে পরিবেশের সামান্যই উন্নতি হয়।

বাতাসের দিকে পিঠ দিয়ে বাবর তার নির্ধারিত সোনার গিল্টি করা আসনে উপবিষ্ট। স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন লেবুর সাথে পানি এবং পাহাড় থেকে নামবার সময়ে যত্নের সাথে সংরক্ষণ করে নিয়ে আসা বরফের বেঁচে থাকা অংশের কিছুটা মিশিয়ে তৈরি শরবতে চুমুক দেয়। বাবুরী বাবরের বামপাশে আসনপিড়ি হয়ে শরবতের পেয়ালা হাতে বসে আছে এবং প্রতিবার চুমুক দেবার আগে ধূলোর হাত থেকে বাঁচতে মুখের নিম্নাংশে সে যে পাতলা হলুদ কাপড়ের গালপাট্টা বেঁধে রেখেছে সেটা সাবধানে তুলে ধরে।

আঠারতম জন্মদিন পালনের মাত্র একমাস পরে হুমায়ূন তার বাবার ডানপাশে বসবার জন্য একটা টুল পেয়েছে। পাতলা তুলো দিয়ে তৈরি সুতির সবুজ রঙের কাপড়ে তৈরি একটা জোব্বা আর একই কাপড়ের তৈরি ঢোলা চোগা তার পরনে। তাঁবুতে উপস্থিত আরো অনেক সেনাপতিদের মতো তার মাথার উপরেও ময়ূরের পালকের তৈরি একটা বিশাল টানা পাখা, কোমর পর্যন্ত নগ্ন। কুলকুল করে ঘামতে ঘামতে টানতে থাকা পরিচারকের দল, অনবরত বাতাস করছে। “বাবুরী, আমাদের গুপ্তদূতেরা সুলতান ইবরাহিমের সেনাবাহিনীর অগ্রসর হবার কি খবর নিয়ে এসেছে?”

“তারা এখনও আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে কিন্তু বড় গদাইলস্করী চালে। একদিন অন্তর তারা তাঁবু গুটিয়ে নেয় কিন্তু তারপরেই পাঁচ কি ছয় মাইল পরে আবার শিবির স্থাপন করে। যার একটা কারণ হতে পারে তাদের মালপত্রের বিপুল পরিমাণ। কিন্তু আমার মনে হয় তারা আগ বাড়িয়ে আক্রমণ করতে খুব একটা ইচ্ছুক না। তাদের ইচ্ছা আমরা আমাদের রসদপত্র সব শেষ করে ফেলি কিংবা অস্থির হয়ে উঠে নিজেরাই তাদের আগে আক্রমণ করার নির্বুদ্ধিতা দেখাই।”

“আমি আশা করি সেরকম কোনো সম্ভাবনা নেই। আমরা তাদের প্রথমে আক্রমণ করতে প্ররোচিত করবো, যাতে কামান আর মাস্কেট দিয়ে সুরক্ষিত অবস্থান থেকে তাদের উপরে পাল্টা আক্রমণ করা যায়। আর তাদের সংখ্যাধিকের সুবিধা যতোটা সম্ভব হ্রাস করা যায়। আচ্ছা আলোচনা যখন হচ্ছে, তাদের সর্বশেষ লোকবলের পরিমান কত?” বাবর শরবতের গ্লাস নামিয়ে রেখে জানতে চায়।

“প্রায় এক লক্ষ- সত্তর হাজার অশ্বারোহী আর বাকি পদাতিক। পদাতিক সৈন্যরা যতোটা না লুটপাটে আগ্রহী, যুদ্ধ করতে ততোটা নয়। আর তাদের রণহস্তির কথা ভুলে গেলে চলবে না। আমাদের চরেরা বলেছে প্রায় এক হাজার হবে তাদের সংখ্যা, একেকটা পাহাড়ের মতো পাকাঁপোক্ত। সবগুলোই যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষিত আর বর্ম দ্বারা আবৃত। এদের নিয়েই আসল দুশ্চিন্তা। আমরা রক্ষণাত্মক অবস্থানে থাকলেও, আমাদের কাছাকাছি আসবার আগেই তাদের হামলা আমাদের প্রতিহত করতে হবে। অন্যথায়, তারা যদি আমাদের ভিতরে একবার এসে উপস্থিত হতে পারে, তাদের সামলে রাখাই তখন আমাদের লোকদের মুশকিল হয়ে পড়বে। আমাদের বেশিরভাগ লোকই জীবনে কখনও হাতি কি জিনিস দেখেনি, তার সাথে লড়াই করা তো দূরের কথা-”।

“আমরা কামানের সাহায্য নেবো, হুমায়ূন কথার মাঝে বলে উঠে।

“হ্যাঁ, কিন্তু আমরা যদি গোলাবর্ষণের পরে তাদের পুনরায় প্রস্তুত করতে চাইলে আর যুদ্ধক্ষেত্রে এর প্রভাব ফেলতে চাইলে কামানগুলোকেও আমাদের আগলে রাখতে হবে। কয়েক পশলা গোলা বর্ষণের পরেই যেনো সেগুলো বেহাত হয়ে না যায়।”

“নিরাপত্তার জন্য আমাদের ছাউনির ঠিক মাঝখানে, যেমন এই তাঁবুটা স্থাপন করা হয়েছে আমরা কামানগুলোকেও তেমনিভাবে আমাদের সমরসজ্জার একেবারে কেন্দ্রস্থলে স্থাপিত করতে পারি।” হুমায়ূন বলতে চেষ্টা করে।

“কিন্তু গোলা বর্ষণের জন্য পরিষ্কার নিশানা পথ প্রয়োজন…” বাবুরীও বলতে থাকে।

“আমার কথা শোনো।” বাবর বাবুরী আর হুমায়ূনকে ইঙ্গিতে চুপ করতে বলে। “বাবুরী তোমার সেই বৃদ্ধার কথা মনে আছে- রেহানা- বহু বছর আগে আমাদের কি বলেছিলো, যখন আমাদের বয়স হুমায়ুনের এখনকার বয়সের মতোই ছিলো, তৈমূরের দিল্লী বিজয়ের কৌশল সম্পর্কে? গত রাতে আমি আমাদের যুদ্ধ পরিকল্পনা আর আমার মহান পূর্বপুরুষ এমন পরিস্থিতিতে কি করতেন ভাবতে গিয়ে আমার রেহানার কথা মনে পড়ে এবং আমার সৌভাগ্য বলতে হবে আমি তার ভাষ্য লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলাম এবং আজও আমি যেখানে গুরুত্বপূর্ণ শাহী দস্তাবেজসমূহ আর আমার রোজনামচা রাখি সেই সিন্দুকে রাখা আছে…।

“সেটা আবার পড়তে গিয়ে আমি সেখানে হাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের মূল কৌশল খুঁজে পেয়েছি। তৈমূর পরিখা খনন করেছিলেন এবং সেই মাটি দিয়ে তার সৈন্যবাহিনীর সামনে মাটির গড় নির্মাণ করেছিলেন। তারপরে তিনি গাড়ি টানার বলদগুলোকে দড়ি দিয়ে বেঁধে আরেকপ্রস্থ নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ করেন। আমি ভেবেছি আমরাও পরিখা খনন করে সেই মাটি দিয়ে বেষ্টনী তৈরি করবো। কিন্তু গাড়ি টানার বলদগুলোকে না বেঁধে মালবহনের গাড়িগুলোকে দড়ি দিয়ে পরস্পরের সাথে বেঁধে দেবো। তবে মাঝে মাঝে ফাঁক থাকবে যেখানে দিয়ে আমাদের কামানগুলো তোমার পরামর্শ অনুযায়ী স্থাপন করা হবে, আমাদের অবস্থানের কেন্দ্রে গোলাবর্ষণ করতে পারবে। আর আমাদের অশ্বারোহী বাহিনীও প্রয়োজনের সময়ে হামলা করতে পারবে। এই মালবাহী গাড়ির মধ্যবর্তী শূন্যস্থানগুলো রক্ষা করার জন্য আমরা আমাদের কিছু মাস্কেটধারী সৈন্য আর অশ্বারোহী তীরন্দাজদের মোতায়েন করবো। ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে তারা তীর আর গুলিবর্ষণ করবে।”

সবাই মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় কিন্তু বাবুরী সন্তুষ্ট হয় না। “সবই বুঝলাম, কিন্তু আপনি কিভাবে নিশ্চিত হবেন যে ব্যাটারা আমাদের আক্রমণ করবেই। আমাদের সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে আমাদের পিছু হটতে বাধ্য করার পরিবর্তে।”

“আমরা একবার আমাদের অবস্থান সুসংহত করি। তারপরে কয়েকদিন অপেক্ষা করার পরে তারা যদি আক্রমণ না করে তবে তখন আমরা তাদের প্ররোচিত করবো। আমরা দু’পাশ থেকে তাদের শিবির বা সেখানের কোষাগার লক্ষ্য করে আপাত ভঙ্গিতে অগ্রসর হবো- তারচেয়েও ভালো হয়- সীমিত পরিসরে আক্রমণ করে তারপরে পিছিয়ে আসবার ভান করলে। আমরা তাদের ভাবতে বাধ্য করবো যে তারা আমাদের মনোবল ভেঙে দিয়েছে এবং এখন পাল্টা আক্রমণ করলে তারা অনায়াসে বিজয়ী হবে…”

*

পরবর্তী কয়েকটা দিন। বাবরের সৈন্যরা, ভোরের শীতল পরিবেশে কাজ আরম্ভ করে, দিনের উষ্ণতম অংশটায় এক নাগাড়ে কাজ করতে থাকে। যখন দাবদাহের কারণে দিগন্তে ঢেউ খেলে যায়। যততক্ষণ না সন্ধ্যা নেমে আসে, শুকনো মাটি কুপিয়ে পরিখার আদল তৈরি করে। আর সেই মাটি দিয়ে গড় নির্মাণ করে। মন্থর এবং পরিশ্রান্ত করে তোলা একটা কাজ। কেউ কেউ সূর্যের প্রকোপ সহ্য করতে না পেরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। অনেকেই প্রলাপ বকতে শুরু করে- জিহ্বা জড়িয়ে আসে, চোখ উল্টে যায়- যেখান থেকে তারা আর কখনও সুস্থ হবে না।

নিজের লোকদের মনোবল বৃদ্ধি করতে, বাবর আর হুমায়ূন দু’জনে কোদাল হাতে নিয়ে তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাটি কাটে। সেটা ঝুড়িতে ভর্তি করে সেই ঝুড়ি কাঠের জোয়ালের দুপাশে ঝুলিয়ে গড়ের উপরে উঠে যায়। তিনদিন পরে গড় সন্তোষজনক উচ্চতা লাভ করে। মাটির এই বেষ্টনীর পেছনে গাড়িগুলোকে পরস্পরের সাথে ভালো করে বাঁধা হয় এবং তাদের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গায় যত্ন করে নির্ধারিত অবস্থানে কামানগুলো ষাড় দিয়ে টেনে আনা হয়। প্রতিটা কামানের পাশে ভারী পাথরের গোলার একটা স্তূপ তৈরি করা হয় এবং তূর্কী গোলন্দাজের দল তাদের লোকদের নিয়ে গোলাবর্ষণের কুচকাওয়াজ করে। কামারের নেহাইয়ের আওয়াজ এবং অসংখ্য কণ্ঠস্বরের মিশ্রিত কোলাহল- শঙ্কিত আর উত্তেজিত শিবিরের চারপাশে গুঞ্জন তোলে।

বাবুরীকে পাশে নিয়ে বাবর ঘোড়ায় চেপে শিবির পরিদর্শনে বের হলে, কণ্ঠস্বরগুলো নিমেষের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় এবং সৈন্যরা মাথা নত করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। বাবুরী বাবরের দিকে ঝুঁকে আসে। “সর্বশেষ খবর অনুযায়ী দিল্লীর সেনাবাহিনী যদিও আর মাত্র তিন মাইল দূরে অবস্থান করছে। কিন্তু এখনও তাদের ভিতরে আক্রমণ করার কোনো আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।”

“কিন্তু নিদেন পক্ষে- আমাদের সংবাদদাতারা যদি ঠিক খবর নিয়ে এসে থাকে অসন্তোষ দানা বাঁধছে এবং ইবরাহিম তার সৈন্যদের বেতন দিতে কার্পণ্য করছে এই অভিযোগে প্রতিদিন শিবির ত্যাগের সংখ্যা বাড়ছে। আর ভবিষ্যত পুরষ্কারের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করতেও সে গড়িমসি করছে। একতাবদ্ধ বাহিনীর চেয়ে দ্বিধাবিভক্ত বাহিনীকে পরাস্ত করাটা সহজ এবং আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তাদের হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্ররোচিত করা সম্ভব।”

“সত্যি কথা।”

“ইবরাহিমের জানা উচিত যে আরো অপেক্ষা করলে মনোবল ভেঙে যাবে এবং অভিযোগ আর কোন্দলের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে এবং সম্ভবত তাতে শিবির ত্যাগের ঘটনাই কেবল বাড়বে।”

“কিন্তু আমরা বিলম্বের কারণ যতোই ব্যাখ্যা করি এবং আমাদের লোকেরা যতোই শৃঙ্খলাবদ্ধ হোক না কেন তাদের বেশিদিন আর সামলে রাখা যাবে না।”

“একটা ঝটিকা হামলার পরিকল্পনা করো, যাতে সে আমাদের আক্রমণ করে।”

“কবে?”

“আগামীকাল। সামরিক মন্ত্রণা সভা আহ্বান করো।”

*

পরের দিন সূর্যাস্তের ঘণ্টাখানেক আগে, বাবর তার বিশাল কালো ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায়, তার বাছা বাছা চারহাজার সৈন্যকে অর্ধেকই যার অশ্বারোহী তীরন্দাজ। জড়ো হতে দেখে এবং তারপরে সেনাপতিদের চিৎকার আর ঘোড়ার চিহি রব, নাক ঝাড়ার আওয়াজের মাঝে, যেনো ঘোড়াগুলোও তাদের আরোহীদের উত্তেজনা আর স্নায়বিক চাপ অনুভব করতে পারছে। তারা সারিবদ্ধ হয়ে নানা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপদলে বিভক্ত হয়ে রওয়ানা দেবার জন্য প্রস্তুত হয়। তারা প্রস্তুত হতেই বাবর পরিখা আর বেষ্টনীর ভিতর দিয়ে তার এই ক্ষুদ্র বাহিনীকে নিয়ে শিবির থেকে বের হয়ে এসে বৃত্তাকারে ঘুরে পশ্চিম দিক থেকে সুলতান ইবরাহিমের অবস্থানের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। বাবর অস্তমিত সূর্যের দিক থেকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যাতে ঘোড়ার খুরের ঘায়ে সৃষ্ট ধূলোর মেঘ আর সূর্যের শেষ রশ্মির আভা মিলেমিশে প্রতিপক্ষকে আক্রমণকারীদের সঠিক সংখ্যা অনুধাবন করতে বাধা দেয়। সুলতান ইবরাহিমের ছাউনির পশ্চিম দিকের সীমারেখার মাইলখানেকের ভিতরে উপস্থিত হতে, বাবর তার লোকদের দাঁড় করায় এবং বাবুরীর দিকে ঘুরে তাকায়। “তুমি কি কিছু শত্রুকে বন্দি করার জন্য সৈন্যদের দায়িত্ব দিয়েছো?”

“হ্যাঁ, আমি নিজে সেই দলের নেতৃত্ব দেবো।”

“তাহলে চলো শুরু করা যাক।”

“চুড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য নিজেকে হেফাজত করবেন।”

হাতের একটা ইশারায় বাবর আক্রমণ শুরু করার আদেশ দেয়। তার কালো ঘোড়ার পেটের চকচকে চামড়ায় গোড়ালী দিয়ে খোঁচা দিয়ে সে দ্রুত তার লোকদের থেকে সামনে এগিয়ে যায়। শীঘ্রই তাকে একশ গজ সামনে থেকে ঘোড়া দাবড়াতে দেখা যায়। সে বুঝতে পারে তার ভিতরে কোনো ভয় কাজ করছে না। কেবল ধাবমান ঘোড়ার গতিময়তার শিহরণ এবং এখনও যুবক বয়সের মতো বলশালী অনুভব করার আনন্দ। তারপরে বাবুরীর শেষ কথাগুলো তার মনে পড়ে: তার নিয়তি নির্ধারক চুড়ান্ত যুদ্ধ এটা না, কেবল তাকে ত্বরান্বিত করার জন্য একটা হামলা। তাকে নিজের অসহিষ্ণুতা আর উদ্দীপনার রাশ দমন করতে হবে এবং তাকে অনুসরণকারী যোদ্ধারা যাতে তার কাছ থেকে আদেশ গ্রহণ করতে পারে সেই সুযোগ তাদের দিতে হবে। সে ঘোড়ার গতি কমাবার ফাঁকে সামনে ইবরাহিমের বিভ্রান্ত লোকদের অস্ত্রের খোঁজে হুড়োহুড়ি করতে দেখে। কেউ কেউ ইতিমধ্যে ঘোড়ায় চড়ে বসেছে এবং তার সৈন্যদের লক্ষ্য করে তীরের প্রথম ঝাপটা উড়ে আসতে শুরু করেছে।

নিমেষের ভিতরে বাবরের কালো ঘোড়াটা তাকে শত্রুদের মাঝে নিয়ে হাজির করে এবং সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে যুদ্ধের উন্মাদনায় আলমগীর দিয়ে ডানে বামে নির্বিচারে আঘাত হানতে থাকে। যুদ্ধটা তার কাছে মুহূর্তের ভিতরে পরস্পর সংযুক্ত চিত্রকল্পের একটা ঝাপসা কোলাজে পরিণত হয়: নীল পাগড়ি পরিহিত এক হিন্দুস্তানী তার ঘোড়ার খুরের নিচে পিষ্ট হয়ে যায়। মুখের ক্ষতস্থান থেকে, যা দিয়ে ভেতরের দাঁত দেখা যায়। গলগল করে রক্ত ঝরে পড়ে; একটা বাদামী রঙের তাঁবু সহসা সামনে ভূতের মতো দেখা যেতে সে তাঁবুর সাথে যাতে তারা জড়িয়ে না যায় সেজন্য নিজের ঘোড়ার মুখ সরিয়ে নেয়; বাতাস কেটে একটা রণকুঠার উড়ে এসে তার পাশের একটা ঘোড়ার গলায় আমূল বিদ্ধ হতে, সেটা ধীরে তার আরোহীর দেহ নিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়তে একটা ভোঁতা শব্দ ভেসে আসে।

বাবর সহসা নিজের সামনে খানিকটা খোলা স্থান দেখতে পায়।

সে শত্রুপক্ষের প্রথম সারি অতিক্রম করেছে। তার লোকদের এখন আরও ভেতর প্রবেশ করার বদলে ফিরতি পথে ঘুরে যাওয়া উচিত। নতুবা প্রতিপক্ষের বেষ্টনীর ভিতরে আটকে পড়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। নিজের উত্তেজিত ঘোড়ার লাগাম বহুকষ্টে টেনে ধরে সে ফিরে যাবার জন্য। আগে থেকে নির্ধারিত সংকেত ঘোষণা করে এবং তাদের ঘোড়ার কারণে সৃষ্ট ধূলোর মেঘের ভিতর দিয়ে যা ইবরাহিমের লোকদের পুরোপুরি ঢেকে রেখেছে, দুলকিচালে ঘোড়া ছুটিয়ে ফিরে চলে।

বাবর জানে ফিরে যাবার জন্য ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয়াটা সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়। যখন তার ধাবমান সৈন্যরা ঘোড়ার মুখ ঘোরাতে গিয়ে একে অপরের সাথে ধাক্কা খেয়ে ইবরাহিমের তীরন্দাজদের সহজ নিশানায় পর্যবসিত হতে পারে। অবশ্য, আশার কথা, তার অশ্বারোহী বাহিনী যথেষ্ট প্রশিক্ষিত এবং দুই একজন যদিও আচমকা ঘোড়ার গতিমুখ পরিবর্তন করতে গিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে বেশিরভাগই সাফল্যের সাথে ঘোড়ার মুখ উল্টো দিকে ঘুরিয়ে নিতে সক্ষম হয় এবং বাবরকে অচিরেই ধূলো আর বিভ্রান্ত শত্রুসেনার মাঝ দিয়ে পেছনে ধেয়ে আসা তীরের ঝাপটাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজের ছাউনির দিকে ঘোড়া ছোটাতে দেখা যায়। আক্রমণ শুরু করার আগে সে যেমন আদেশ দিয়েছিলো, তার লোকেরা অনতিবিলম্বে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং আতঙ্কিত হবার ভান করে ঢাল ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এলোপাথাড়ি ঘোড়া ছোটায়।

সমভূমিতে যেমন হয়ে থাকে, বাবর তার ছাউনির গড়ের আড়ালে যখন ঘোড়া থেকে। নামে। ততক্ষণে দ্রুত চারপাশে অন্ধকার নেমে আসছে। তাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। বাবুরী সন্ধ্যার আঘো-অন্ধকারের ভেতর থেকে তার দিকে এগিয়ে আসে। তার বাম হাতের আঙ্গুলের গাঁটে একটা সাদা কাপড়ের ফালি শক্ত করে বাঁধা আর সেটাতে রক্তের দাগ ফুটে থাকায় স্পষ্টই বোঝা যায় বেচারা হিন্দুস্তানের তরবারির ধার পরখ করে এসেছে। অবশ্য সে সব পাত্তা না দিয়ে কান পর্যন্ত হাসি নিয়ে সে বাবরের দিকে এগিয়ে আসে।

“তুমি বন্দি নিয়ে এসেছো?”

“এরচেয়ে ভালো নির্ধারণ আর হতে পারে না- কোনো পানির্বাহক না আমি অশ্বারোহী যোদ্ধার একটা দল তাদের দলনেতাসহ নিয়ে এসেছি যাকে পরাস্ত করতে আমাদের ঘাম ছুটে গিয়েছিলো।”

“সেই তাহলে আমাদের বার্তাবাহকের দায়িত্ব পালন করবে। পাঁচ মিনিটের ভিতরে তাকে আমার তাঁবুতে হাজির করো। আর দেখো সে আর তার লোকদের চোখ যেনো বাঁধা থাকে। আমি চাই না ফিরে গিয়ে তারা আমার শিবিরের বর্ণনা দিয়ে বেড়াক।”

পাঁচ মিনিট পরে বাবুরী বন্দিকে বাবরের সামনে নিয়ে আসে। বন্দি কালো বর্ণের বিশাল আকৃতির পেষল দেহের একটা লোক। সে তার দিকে এগিয়ে আসতে, বাবর খেয়াল করে দেখে হিন্দুস্তানীদের প্রিয় ঝাকড়া গোফ রয়েছে লোকটার এবং ভাবে যে তার মাতৃভূমির অনেক লোকের যার ভেতরে সেও অন্তর্ভূক্ত- গোফ রাখার উপযুক্ত দাড়ি রয়েছে।

“তার চোখের বাঁধন অপসারিত করো। তোমার নাম কি?”

“আসিফ ইকবাল।”

“বেশ, আসিফ ইকবাল, আমাকে বলা হয়েছে যে তুমি ভাগ্যবান আর সেই সাথে সাহসীও বটে। সুলতান ইবরাহিমের কাছে একটা বার্তা তুমি বয়ে নিয়ে যাবে।” লোকটার ভেতরে কোনো হেলদোল দেখা যায় না। সে যে কথাটা বুঝেছে সেটা বোঝাবার জন্যও মাথা নত করে কি করে না।

“আজ আমরা যদিও আমাদের আক্রমণ থেকে পিছু হটে এসেছি এবং আমাদের অনেক হতাহত হয়েছে। কিন্তু তুমি তাকে বলবে যে আমরা তাকে সম্মুখ সমরে আহ্বান করছি। আমাদের কাছে সে একটা কাপুরুষ। কারণ সংখ্যায় আমাদের চেয়ে অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও আমাদের আক্রমণ করতে তার সাহস হয়নি। তার কাছে জানতে চাইবে সেনাপতিরা তার কথা শুনবে না বলেই কি তার এই আক্রমণে অনীহা- তুমি তাকে আরও বলতে পারো তার সেনাপতিদের অনেকেই পুরস্কারের বিনিময়ে আমার সাথে যোগ দিবে বলে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। নাকি সে জানে যে তার সেনাবাহিনীতে কাফেরের সংখ্যা প্রকৃত বিশ্বাসীদের চেয়ে বেশি হবার কারণে সে জানে যে আল্লাহতালা তার প্রতি সহায় হবে না? তাকে বলবে ‘হয় আক্রমণ করুক নতুবা আজীবন কাপুরুষ নামটা তাকে তাড়া করে ফিরবে।”

বন্দি সেনাপতির চোখে আবার কালো কাপড় বেঁধে দেয়া হয় এবং ইবরাহিমের ছাউনির কাছে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে এসে, বাবুরী বাবরের তাঁবুতে ফিরে আসে। “আশা করা যায় আমাদের আজকের হামলায় পালিয়ে আসবার ভনিতা করে আমরা যে দুর্বলতা অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে চেয়েছি, আর এই বার্তা ইবরাহিমকে আক্রমণে উৎসাহিত করে তুলবে।”

“দুটোতেই কাজ হবে। কেউ কাপুরুষ সম্বোধন শুনতে পছন্দ করে না। ইবরাহিম ভালো করেই নিজের সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ অসন্তোষের কথা জানে। আর তার সেনাপতিদের কেউ কেউ গোপনে পক্ষত্যাগ করতে চাইছে এই আভাস পাবার পরে সে তার সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ভেঙে সংখ্যাধিক্যের সুবিধা নাকচ হয়ে যাবার আগেই আক্রমণ করবে।”

“আমি মানছি সে কথা। আমার লোকদের সকালের আলো ফোঁটার একঘণ্টা আগে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলবে। ইবরাহিম আক্রমণ করলে দিনের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবার আগেই করবে।”

বাবুরী চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়ে, তারপরে কি মনে হতে সহসা বাবরকে আলিঙ্গন করে। “আগামীকাল আমাদের দুজনের জন্যই একটা ঘটনাবহুল দিন হবে। আমি অনুভব করতে পারছি।”

“ভালোমতো ঘুমিয়ে নাও। আমি নিশ্চিত, ভালোমতো বিশ্রাম নিলে ভাগ্য তাকে সহায়তা করে।”

বাবুরী কোনো উত্তর না দিয়ে তাঁবু থেকে বের হয়ে যায় এবং বাইরের অন্ধকারের ভিতরে হারিয়ে যায়।

*

ভোর হবার সাথে সাথে সুলতান ইবরাহিমের শিবিরে ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়- চিৎকার, হাতির ডাক আর ঘোড়ার চিঁহি রবে চারপাশ প্রকম্পিত হতে থাকে। কয়েক মিনিট আগেই ইবরাহিমের বাদক দল ঢাকে যুদ্ধের বোল তুলতে শুরু করেছে।

বাবর ভাবে, সে সত্যিই আক্রমণ করবে। যদি তাই হয়, তবে বাবরের জীবনে আজকের দিনটা হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। আর বিজয় লাভের জন্য সম্ভাব্য সব প্রস্তুতি সে নিয়েছে। রাতে সে সামান্যই ঘুমিয়েছে, সারা রাত জেগে নিজের যুদ্ধ পরিকল্পনার দুর্বলতা বা খুঁত খুঁজে বের করতে চেয়েছে। কিন্তু কিছুই পায়নি। তার আর কিছু করার নেই…।

সে বাবুরী আর হুমায়ুনের সাথে শেষবারেরমতো আলাপ করার জন্য তাদের ডেকে পাঠায়। হুমায়ূন আজকের যুদ্ধে ডানপাশের সমরসজ্জার সেনাপতির দায়িত্ব পালন করবে। আর বাবুরী থাকবে বামপাশের দায়িত্বে। যুদ্ধ একবার ভালোমতো শুরু হলে এবং ইবরাহিমের সৈন্যরা বাবরের নির্মিত মাটির প্রতিবন্ধকতা আর গাড়ির বহরের বাধা আক্রমণে ব্যস্ত হয়ে উঠলে তারা দু’পাশ থেকে বৃত্তাকারে তাদের ঘিরে ফেলার জন্য অগ্রসর হবে। তারপরে আল্লাহ সহায় থাকলে বিজয় তাদের নাগালের ভিতরে আসলে তারা তখন পলায়নপর সৈন্যদের নিরন্তর ধাওয়া করে তাদের পুনরায় সংগঠিত হতে বাধা দেবে।

তার সন্তান আর একমাত্র বান্ধব তাদের নিজনিজ অবস্থানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলে, বাবর মাটির দেয়াল রক্ষায় নিয়োজিত সৈন্য পরিদর্শনে বের হয় এবং তাদের ছোট ছোট দলের সাথে কথা বলে। সে সবাইকে একটা কথাই ভালো করে বোঝাতে চায়: “তোমাদের অবস্থানটা সবচেয়ে গৌরবের। তোমরাই যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করবে। মনে সাহস রাখো। নিজের উপরে আর নিজের সুলতানের উপরে বিশ্বাস রাখো। আমাদের নতুন অস্ত্র, কামান আর মাস্কেটের সামর্থ তোমরা দেখেছো। শত্রুর হাত থেকে তাদের সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব তোমাদের উপরে, যাতে সেগুলো ধ্বংস উগরে দিতে পারে।”

একবার সে একদল তরুণ বিচলিত অশ্বারোহী সৈন্যদের একটা জটলা লক্ষ্য করে নিজেদের ঘোড়ার পাশে দাঁড়িয়ে বারবার অস্ত্রশস্ত্র পরীক্ষা করছে। প্রথমবার যুদ্ধযাত্রার কালে নিজের অভিজ্ঞতার কথা আমার মনে আছে। সবচেয়ে জঘন্য ব্যাপার লিলা যুদ্ধ শুরু হবার জন্য অপেক্ষা করাটা। আমি জানি যখন সময় হবে তোমরা সবাই বীরের মতোই লড়বে। সামনের শত্রুর প্রতি মনোনিবেশ করবে, জানবে হযযাদ্ধারা পাশ থেকে তোমাকে ঠিকই আগলে রাখবে।”

প্রতিরক্ষা ব্যুহের আরেক স্থানে সে মাটির প্রতিবন্ধকতার একটা দেয়ালের পাশে ঘোড়া থেকে নামে এবং চুলবিহীন চাদিতে ক্ষতচিহ্ন যুক্ত শক্তপোক্ত দেখতে এক পোড়খাওয়া তীরন্দাজের ধনুকের ছিলা পরখ করে দেখে যে মাটির দেয়ালের পেছনে নিজের অবস্থানে প্রস্তুত রয়েছে। “এই ধনুক দিয়ে কতোদূরে তুমি তীর ছুঁড়তে পারো?”

“সুলতান, পাঁচশ গজ।”

“দারুণ, তোমার মতো পোড়খাওয়া যোদ্ধাকে আমার নিশ্চয়ই অপেক্ষা করার কথা মনে করিয়ে দিতে হবে না যে, শত্রু সেনা চারশ নিরানব্বই গজ কাছে আসবার পরে তুমি তাদের লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়বে। কিন্তু আমার বোধহয় তোমাকে মনে করিয়ে দেয়া উচিত যে, আমি শুনেছি ওখানে হাতির পাল প্রস্তুতি নিচ্ছে আর তাদের কানের পেছনে বসে থাকা আরোহীদের লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করে তুমি আমাকে দারুণ সহায়তা করতে পারো। লোকগুলো মারা গেলে, বিশালাকৃতি প্রাণীগুলো দিকভ্রান্ত হয়ে পড়বে আর নিজেদের লোকদেরই পিষে দিতে শুরু করবে।”

প্রতিবন্ধকতার কেন্দ্রে নিজের নির্ধারিত স্থানে সে ফিরে যাবার আগে তূর্কী গোলন্দাজদের সর্দার আলী কুলীর সামনে শেষবারেরমতো থামে। “নিজের মাতৃভূমি থেকে এতোদূরে ভ্রমণ করে এসে আমার পক্ষে লড়াই করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি জানি যতোই ভীতিকর দেখাক, প্রতিপক্ষের পঞ্চাশটা হাতির সমান আপনার একেকটা অস্ত্র। তাদের পরাস্ত করুন আর আমি আপনাকে যথাযথভাবে পুরস্কৃত করবো।”

বাবর নিজের অবস্থানে ফিরে এসে ঘোড়া থেকে নামে এবং তাঁবুতে প্রবেশ করে নফল নামাজ আদায় করে। নামাজ শেষ হতে, তার মরহুম আব্বাজান, আম্মিজান, নানীজান, এসান দৌলত, ওয়াজির খান, আর বাইসানগারের চেহারা তার মানসপটে ভেসে উঠে। কেবল এসান দৌলতের অভিব্যক্তিই তার কাছে যোদ্ধার উপযুক্ত মনে হয়। সে নিরবে প্রতিজ্ঞা করে, আজ আমি আপনাদের সবাইকে সম্মানিত করবো। আর প্রমাণ করবো আমি আপনাদের আর তৈমূর এবং চেঙ্গিস খানের উপযুক্ত বংশধর।”

“সুলতান, তারা নিশ্চিতভাবেই এবার আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছে।”

বাবরের নিশানবাহক কর্চি তার ভাবনায় ছেদ ঘটায় এবং নিজের নিয়তিকে বরণ করতে সে শান্ত আর আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়। তার পরিচারক তাকে ইস্পাতের বর্ম পরিয়ে, কোমরে তার মরহুম আব্বাজানের তরবারি ঝুলিয়ে দেয় এবং হাতে হলুদ আর সবুজ পুচ্ছযুক্ত গম্বুজাকৃতি শিরস্ত্রাণ ধরিয়ে দিয়ে চামড়ার খাপে মোড়ানো একটা খঞ্জর এগিয়ে দেয়। বাবর সেটা তার খয়েরী রঙের চামড়ার ঘোড়সওয়ারের জুতোর উপরের অংশে গুঁজে রাখে।

সে এবার সামনের দিকে তাকিয়ে ইবরাহিমের সৈন্যবাহিনীকে দ্রুত এগিয়ে আসতে দেখে। সে যেমনটা আশা করেছিলো, রণহস্তির দলকে সামনে নেতৃত্ব দিতে দেখে। বেশিরভাগই মনে হয় দুই মানুষ পরিমাণ উঁচু আর তাদের একপাশে প্রসারিত হয়ে অংশত আবৃত ইস্পাতের বর্ম সূর্যের আলোয় ঝকঝক করতে থাকে। বাঁকান তরবারির সারি- প্রতিটা ছয় ফিট লম্বা- লাল রঙ করা শুড়ের সাথে বাঁধা। তাদের পরিচালনাকারীরা হাতে ধরা লম্বা কাঠের লাঠিতে ফুঁ দিয়ে হাতিগুলোকে আরও দ্রুত অগ্রসর হবার তাগিদ দেয়। হাওদায় হাতির পিঠে স্থাপিত অনেকটা দূর্গের মতো দেখতে একটা স্থাপনা অবস্থানরত তীরন্দাজের দল ইতিমধ্যে তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করেছে। কিন্তু তীরগুলো লক্ষ্যবস্তু থেকে অনেক দূরে ভূপাতিত হয়। তারা এখনও পাল্লার বাইরে অবস্থান করছে।

বাবর আশা করে তার লোকেরা তার আদেশ মান্য করে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারার মতো দূরত্ব সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত তীর নিক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু তার আগে ইবরাহিমের লোকেরা আর পশুর পাল বাবরের পশ্চিম থেকে নিয়ে আসা নতুন অস্ত্রের প্রতিক্রিয়া অনুভব করবে: কামান। বাবর আলমগীর মাথার উপরে তুলে দু’বার আন্দোলিত করে- আলী কুলী আর তার লোকদের গোলা বর্ষণ শুরু করার জন্য এটা একটা পূর্বনির্ধারিত সংকেত। সে স্পর্শ-রন্ধের বারুদে গোলন্দাজ সেনাদের একজনকে ঝুঁকে জ্বলন্ত শলাকা স্পর্শ করাতে দেখে। তারপরে একটা ঝলক, একটা গর্জন এবং কামানের নল থেকে সাদা আলো বের হয়ে এসে কামানের গোলাটা শক্ত অবস্থানের দিকে ছুঁড়ে দেয়। বাকী কামানগুলো থেকে ক্রমান্বয়ে আলোর ঝলক দেখা যায় এবং মাটির তৈরি পুরো প্রতিবন্ধকতা মাঝ দিয়ে ধোয়ার একটা মেঘ ভাসতে থাকে।

বাবর ধোয়ার মেঘের মাঝ দিয়ে সামনের সারির একটা হাতিকে হাওদাসহ মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়তে দেখে এবং এর আরোহীরা মাটিতে হাত-পা ছড়িয়ে আছড়ে পড়ে। তারপরে আহত প্রাণীটা টলোমলো করতে করতে আবার সটান উঠে ঘুরে দাঁড়ায়, শুড়টা ব্যাথার তূরীর মতো শূন্যে তুলে ধরে এবং পাশের হাতির দিকে উন্মত্তের মতো ছুটে গিয়ে তাকে নিয়ে পুনরায় মাটিতে আছড়ে পড়ে। সামনের আহত পা থেকে গলগল করে রক্ত বের হয়ে আসছে। মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায় বিশাল মাথাটা যন্ত্রণায় আছড়াতে থাকলে এর শুড়ের সাথে আটকানো তরবারি। পেছন থেকে এগিয়ে আসা আরেকটা হাতিকে আঘাত করলে ভয়ে আর ব্যাথায় সেটা দ্বিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়াতে শুরু করে। কিন্তু যদিও আগুয়ান সারির প্রস্থ বরাবর এমন ঘটনা ঘটতে থাকে কিন্তু সুলতান ইবরাহিমের সেনাবাহিনী সামনের দিকে চাপ প্রয়োগ করা অব্যাহত রাখে।

বাবর সহসা মাস্কেটের গুলিবর্ষণের মড়মড় আওয়াজ শুনতে পায়। তার আরও শত্রু ভূমিশয্যা নেয়। এবার তার তীরন্দাজের দল তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করে। কেউ কেউ মাটির দেয়ালের আড়াল ছেড়ে লক্ষ্যবস্তুর কাছাকাছি এগিয়ে যায়- হাতির সাদা রঙ করা কানের পেছনে বসে থাকা চালকগুলো তাদের নিশানা। ইবরাহিমের সামনের সারি এবার এলোমেলো হয়ে পড়ে। ভয়ে আরও অনেক হাতি শুড় তুলে নিয়ে পেছনের দিকে ঘুরে দৌড়াতে শুরু করে এবং পেছনে থাকা লোকগুলোর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে তাদের থামিয়ে দিয়ে আরও আতঙ্কের সৃষ্টি করে এবং তারা পালাতে থাকলে তাদের বিশাল পায়ের চাপে নিজেদের লোকেরাই অসহায়ের মতো পিষে যেতে থাকে।

বাবর আরও অশ্বারোহী তীরন্দাজদের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসে দ্রুত পলায়নপর শত্রুদের লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করার আদেশ দেয়। সে যখন এই আদেশ দিচ্ছে। তখন তার খুব কাছেই সে একটা বিকট বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনতে পায় এবং তার চারপাশে ধাতুর উত্তপ্ত টুকরো এসে আছড়ে পড়ে আর তার মুখে নরম কিছু একটা আঘাত করে। বিভ্রান্ত আর আংশিক বধির অবস্থায়, সে বুঝতে পারে না ঠিক কি ঘটেছে। তারপরে সে টের পায় তার একটা কামান বিস্ফোরিত হয়েছে এবং আলী কুলী ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে। সে গালে হাত দিয়ে টের পায় সেটা ওস্তাদ গোলন্দাজের মাংসের টুকরো। পৃথিবীতে না, আলী কুলী বেহেশতে তার প্রাপ্য গ্রহণ করবে। কিন্তু সে তার কাজ ভালোমতোই সম্পন্ন করে গিয়েছে। মওকা বুঝে সুলতান ইবরাহিমের সৈন্যরা আরো আরো বেশি সংখ্যায় পালাতে শুরু করেছে। যাদের ভেতরে খালি পায়ের কোমরে কেবল একটা নেংটি পরিহিত পদাতিকদের সংখ্যাই বেশি। বর্শা ছাড়া আক্রমণের বা আত্মরক্ষার কোনো অবলম্বন তাদের নেই।

নিজেকে সুস্থির করে নিয়ে, বাবর তার সেরা অশ্বারোহীদের এবার অগ্রসর হবার ইঙ্গিত করে এবং নিজের কালো ঘোড়ার পাঁজরে গুতো দিয়ে ধূলো আর ধোঁয়ার মেঘের মাঝে তাদের নেতৃত্ব দিয়ে আধ মাইল দূরে আতঙ্কিত পলায়নপর লোকদের কোলাহলপূর্ণ জটলার দিকে ধেয়ে যায়।

ইবরাহিমের বাহিনীর কিছু অংশ অনেক বেশি প্রশিক্ষিত আর তারা নিজেদের রক্ষণাত্মক অবস্থানে সন্নিবেশিত করে সত্যিকারের বীরের মতো আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে। বাবর একটা টিলার উপরে এমনই একটা অশ্বারোহী দলকে সংখ্যায় শতাধিক হবে। সবার মাথায় সোনালী পাগড়ি- সাফল্যের সাথে সব আক্রমণ প্রতিহত করতে দেখে।

“ইবরাহিমের দেহরক্ষী বাহিনী। তার এক সৈন্য চিৎকার করে বলে। বাবর এবার সরাসরি তাদের মাঝে লম্বা এক যোদ্ধার দিকে এগিয়ে যায়। যাকে এই ক্ষুদে দলটার নেতৃত্ব দানকারী সেনাপতি বলে প্রতিয়মান হয়। শেষমুহূর্তে বাম পাশে সরে গিয়ে বাবর তাকে পাশ দিয়ে এগিয়ে যেতে দিয়ে, তার ডান হাত লক্ষ্য করে তরবারি চালায়। কিন্তু সোনালী পাগড়ি পরিহিত সেনাপতি সময়মতো ঢাল তুলে তার আঘাত প্রতিহত করে এবং অন্য হাতে ধরা তরবারি দিয়ে বাবরের কালো ঘোড়ার পাছায় একটা মোক্ষম কোপ বসিয়ে দেয়। ঘোড়াটা যন্ত্রণায় পিছনে সরে আসে এবং বাবরকে মাটিতে আছড়ে ফেলে। সে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করার ফাঁকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখতে পায় শত্রু সেনাপতি নিজের সাদা ঘোড়াটাকে এগিয়ে যেতে ইশারা করে সামনে ঝুঁকে রয়েছে বাবরকে শেষ করে দেবার অভিপ্রায়ে।

শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাবর অনড় দাঁড়িয়ে থাকে তারপরে লাফিয়ে একপাশে সরে যায় এবং একই সাথে তীব্র বেগে আলমগীর দিয়ে কোপ বসানোর ভঙ্গিতে আঘাত করে। সাদা ঘোড়ার গলার বাম পাশে তার তরবারি আড়াআড়িভাবে আঘাত করে এবং তারপরে তার আরোহীর উরুতে গভীর একটা ক্ষত তৈরি করে। বোঝাই যায় লোকটা আদতেই দক্ষ ঘোড়সওয়ার এবং আঘাতের ভয়াবহতা সত্ত্বেও সে জিনের উপরে অধিষ্ঠিত থাকে। ঘোড়াটাকে নিয়ন্ত্রণ করে মুখ ঘুরিয়ে নেয়- সাদা চামড়া এখন লাল রক্তে ভিজে উঠেছে- বাবরকে আরো একবার আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসে।

এই দফা, শত্রু সেনাপতি তাকে কবন্ধ করার অভিপ্রায়ে তরবারি চালাতে সে নিচু হয়ে আঘাতটা এড়িয়ে যায় এবং আলমগীর দিয়ে ধাবমান ঘোড়ার সামনের পায়ের শিরা কেটে দিতে চেষ্টা করে। সে তার নিশানা ভেদ করতে সমর্থ হয় এবং ঘোড়াটা তার আরোহীর উপরে আছড়ে পড়লে বেচারার মুঠি থেকে তরবারিটা ছুটে যায়। লোকটা তার তরবারির কাছে পৌঁছাবার জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকলে বাবর এগিয়ে এসে তার কব্জিতে পা রেখে আলমগীরের ডগা তার গলায় স্পর্শ করে। “আত্মসমর্পণ করো। তোমার সাহসিকতার জন্যই তুমি বেঁচে থাকার দাবিদার।” সে তার সাথে কথা বলার সময়ে বাবরের আরো লোক এসে তার পাশে দাঁড়ায়। সোনালী পাগড়ি পরিহিত যোদ্ধাদের অধিকাংশই হয় তাদের হাতে মারা পড়েছে। কিংবা পালিয়েছে। প্রতিরোধের চেষ্টা করা বৃথা বুঝতে পেরে, লোকটা চুপচাপ শুয়ে থাকে। “আমি কথা দিচ্ছি আমার তরফ থেকে আর যুদ্ধের কোনো প্রয়াস নেয়া হবে না।” সে বলে।

“তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করো… তুমি আর তোমার লোকেরা এতো মরিয়া হয়ে কি রক্ষা করতে চেষ্টা করছিলে?”

“সুলতাম ইবরাহিম লোদির মৃতদেহ। টিলার মাথায় রাখা আছে। আপনার নতুন অস্ত্রের ছোবলে তিনি শুরুতেই মারাত্মকভাবে আহত হন। সাহসিকতার কোনো মূল্যই নেই এর সামনে।”

“কোনো অস্ত্রই সেটা যে নিশানা করছে তার চেয়ে বেশি ক্ষমতাধর হতে পারে না।” তারা যখন কথা বলছে সেনাপতির সাদা ঘোড়াটা তখন যন্ত্রণায় ঝটফট করতে থাকে আর আর্তনাদ করে। গলার ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পড়ছে। সামনের পায়ে বাবরের আঘাতের ফলে সেখানকার শিরা কেটে যেতে বেচারা সামনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতেও পারছে না। এখন মুখ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়তে থাকলে এবং কথা বলটা ক্রমশ কষ্টকর হয়ে উঠতে- সম্ভবত নিজের ঘোড়ার নিচে চাপা পড়ার ফল সেনাপতি কোনোমতে বলে, “আমাকে আমার ঘোড়াটার যন্ত্রণা লাঘব করার অনুমতি দিন। আমার সাথে অনেক যুদ্ধে সে অংশ নিয়েছে। অনেক শান্তভাবে সে মৃত্যুকে বরণ করবে যদি সেটা আমার কাছ থেকে আসে।”

বাবর তার লোকদের একজনকে সেনাপতির তরবারি ফিরিয়ে দিতে বলে। সেনাপতি- উরুর ক্ষতের কারণে হাঁটতে তার নিজেরই কষ্ট হয় আর শ্বাস নিতে অপারগতার মাঝে- ঘোড়াটার কাছে এগিয়ে যায়। সোনার কারুকাজ করা চামড়ার লাগাম ধরে সে ঘোড়াটার নাকে আলতো করে চাপড় দেয়। মাথাটা আঁকড়ে ধরে এবং কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে সান্ত্বনা দেয়। তারপরে দ্রুত তরবারিটা গলার উপরে আড়াআড়িভাবে রেখে সে এক পোচে শ্বাসনালী আর ধমনী কেটে দিলে গলগল করে আরও রক্ত বের হয়ে আসে। ঘোড়াটা সাথে সাথে নেতিয়ে পড়ে এবং কিছুক্ষণের ভিতরেই নিথর হয়ে যায়। গলার কাটা জায়গা থেকে রক্ত বের হয়ে এসে ধূলোয় জমতে থাকে। অবশ্য সেনাপতির কাজ তখনও শেষ হয়নি। সে তার হাতের তরবারি দিয়ে এবার নিজের পেট চিরে দেয়। “আমার ঘোড়ার চেয়ে পঙ্গু অবস্থায় আমি বেঁচে থাকতে চাই না।”

“আল্লাহতালা তোমার বেহেশত নসীব করুন।”

“আমিও সেই দোয়াই করছি। কিন্তু মনে রাখবে হিন্দুস্তানকে পদানত করতে হলে তোমাকে আমার চেয়ে অনেক বেশি সাহসী লোকদের পরাভূত করতে হবে।”

তার গলায় রক্তের বুদবুদের মাঝে শেষ কথাগুলো অস্পষ্ট শোনা যায়। সেও মারা যায়। তার দেহটা বহুদিনের সঙ্গী ঘোড়াটার পাশে এলিয়ে পড়ে থাকে এবং সোনালী পাগড়ি পরিহিত মাথাটা রক্ত রঞ্জিত মাটিতে নুইয়ে আসে।

“সুলতান, যুদ্ধে আপনার জয় হয়েছে।”

নিশানবাহক কর্চির কথাগুলো বাবরকে তার সামনের দৃশ্যাবলীর সম্পর্কে গভীর ভাবনা থেকে বাস্তবে নিয়ে আসে। চারপাশে তাকিয়ে সে বুঝতে পারে, যুদ্ধক্ষেত্র নিরব হয়ে এসেছে। যুদ্ধ শেষ হয়েছে…সে বিজয়ী হয়েছে। “সব প্রশংসা আল্লাহ’র।” একটা স্বস্তির পরশ ঝড়ের মতো এসে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তারপরে নিজের জয়লাভের মাহাত্ব বুঝতে পেরে সে খুশিতে শূন্যে ঘুষি চালাবার ভঙ্গিতে হাত নাড়ায়। সে- তৈমূরের মতো- দিল্লীতে বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করতে পারবে…

নিজের মনকে আবার সে বর্তমানে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। বাবর তার চারপাশের অশ্বারোহীদের উদ্দেশ্যে নিজের প্রথম অভিব্যক্তি প্রকাশ করে। “আমরা দারুণ একটা কাজ করেছি। এখন আশা করি হুমায়ুন আর বাবুরীও ইবরাহিমের পলায়নপর সৈন্যদের আমূল বিনাশসাধন করে বা তাদের বন্দি করতে সক্ষম হবে। তাদের সুলতান মৃত হবার কারণে তারা সহসাই অন্য কারো নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে পারবে না। ইবরাহিম আর- এই সাহসী যোদ্ধাটাকে- যথাযথ মর্যাদায় সমাহিত করবে। আমি এবার শিবিরে ফিরে গিয়ে পিছু ধাওয়া করার ফলাফল জানবার জন্য অপেক্ষা করবো।”

বিজয় এত দ্রুত অর্জিত হয়েছে যে তখনও দুপুরই হয়নি। বাবর যখন নিজের ঘোড়ার মুখ শিবিরের উদ্দেশ্যে ঘুরিয়ে নেয় এবং অতিকায় পাথরের টুকরোর মতো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পড়ে থাকা হাতির পাল আর তাদের পিঠের উপরের হাওদার ধবংসাবশেষ আর তাদের পতনের ফলে পিষ্ট হয়ে যাওয়া সৈন্যদের মৃতদেহের একটা দঙ্গলের ভিতর দিয়ে সে শিবিরে ফিরে চলে। গরমের মাঝে, তার লোকেরা ইতিমধ্যে নিজেদের আহত যযাদ্ধাদের কোনোমতে তৈরি করা খাঁটিয়ায় শুইয়ে দিতে শুরু করেছে এবং পানি দিয়ে বা অন্য যেভাবে পারে তাদের শুশ্রূষা করার চেষ্টা করছে।

নিজের লাল তাঁবুর ভিতরে আরো একবার বাবর অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করতে থাকে। বাবুরী আর হুমায়ূনের কি খবর? সে নিজের পোড়খাওয়া বন্ধুর চেয়ে তার অনভিজ্ঞ ছেলের জন্যই বেশি উদ্বিগ্ন বোধ করে। হুমায়ূনের যদিও এর আগে খণ্ড যুদ্ধে লড়াই করার অভিজ্ঞতা রয়েছে, কিন্তু এবারই সে একটা বড় যুদ্ধে নিজে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করছে এবং প্রতিরক্ষা ব্যুহের ডানপাশের সৈন্যদের নেতৃত্ব দেয়াটা তার জন্য একটা বিশাল আর অনুপম দায়িত্ববোধ।

বাবর দুশ্চিন্তা ভুলে থাকবার জন্য আহতদের দেখতে যায় এবং বিশেষ সাহসিকতার সাথে লড়াই করেছে এমন যোদ্ধাদের পুরস্কৃত করে এবং একই সাথে ইবরাহিমের শিবির থেকে জব্দ করা মালামালের বিবরণ শোনে। এখনই মনে হচ্ছে স্বর্ণমুদ্রা আর মূল্যবান পাথরের একটা বিশাল সংগ্রহ তার কুক্ষিগত হয়েছে।

আরো ছয় ঘণ্টা উৎকণ্ঠায় কাটার পরে একজন প্রহরী ভিতরে প্রবেশ করে ঘোষণা করে, “ শাহজাদা হুমায়ূনের নিশান আর ঝাণ্ডা বহনকারী সৈন্যবাহিনী শিবিরের দিকে এগিয়ে আসছে।”

প্রহরীর কথা শেষ হবার আগেই পরিশ্রান্ত হুমায়ুন তাবুতে প্রবেশ করে, তার পিতার দিকে দৌড়ে গিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরে। “আমাদের বিজয় সম্পূর্ণ হয়েছে। আমরা এখন হিন্দুস্তানের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। আমরা দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় দশ মাইল ইবরাহিমের একটা বিশাল বাহিনীকে ধাওয়া করতে অবশেষে তারা নদীর তীরে একটা মাটির দূর্গে অবস্থান নিয়ে আমাদের মুখোমুখি হয়। এক ঘণ্টার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পরে আমরা তাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করি। আরো খানিকটা পশ্চিমে আমরা অভিজাতদের একটা দলের একসারি তাবু আবিষ্কার করি। মুষ্টিমেয় সংখ্যক প্রহরী বা পরিচারকের দল এর পাহারায় নিয়োজিত ছিলো। দেখতে ডাকাত বা লুটেরাদের মতো দেখতে কোনোভাবেই তাদের সৈন্যবাহিনীর সদস্য বলা যাবে না। এমন একদল ঠ্যাঙাড়ের মোকাবেলা করছে।

“আক্রমণকারীদের আমরা হত্যা করলে তাঁবুর ভিতর থেকে আমার আম্মিজানের বয়সী একজন মহিলাকে দুধসাদা রঙের আর ঘিয়ে এবং সোনালী কাপড়ের শামিয়ানা টাঙানো একটা তাঁবুর ভেতর থেকে বের হয়ে আসতে দেখি। তার পরনে হিন্দুস্তানীরা যাকে শাড়ি বলে তেমন একটা পরিধেয়। সেটা উত্তম রেশমের তৈরি আর অসংখ্য মুক্তা আর অন্যান্য দামী পাথর তাতে সেলাই করে লাগানো রয়েছে। তিনি জানতে চান কে নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং আমার নাম আর পরিচয় জানতে পেরে তিনি আমার কাছে তাকে নিয়ে যেতে বলেন। আমার কাছে এসে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন যে তিনি গোয়ালিয়রের, দিল্লীর দক্ষিণে অবস্থিত একটা সমৃদ্ধ রাজ্য, শাসকের মাতা। তিনি জানতে পেরেছেন ইবরাহিমের পক্ষে বীরের মতো লড়াই করে তার পুত্র মারা গিয়েছে।

“খবরটা শোনার পরে তিনি পালিয়ে না গিয়ে ছেলের অন্তেষ্টিক্রিয়া সুসম্পন্ন করার জন্য তার মৃতদেহ গ্রহণ করবেন বলে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন। তারা পৌত্তলিক, যারা বেদীর উপরে মৃতদেহ রেখে আগুনে পুড়িয়ে থাকে। তারপরে এক পলায়নপর সৈন্য তাদের শিবিরের পাশ দিয়ে পালিয়ে যাবার সময় বলে যায় যে আমাদের সৈন্যরা বন্দিদের হত্যা করছে। তখন মুষ্টিমেয় সাহসী কয়েকজন সৈন্য ছাড়া বাকিরা তাকে সেখানে ফেলে পালিয়ে যায়। এবং দস্যুর দল- তার ভাষায় ডাকাত- যাদের আমরা পরাজিত করেছি সুযোগ টের পেয়ে তার শিবির আক্রমণ করে। তিনি নিজের জীবন আর সম্ভ্রমের চেয়েও তার ছয় মাসের নাতি, আর তার তরুণী মাতা, মৃত শাসকের প্রিয়তমা স্ত্রী, যে তার সাথেই শিবিরে অবস্থান করছিলো, তাদের নিরাপত্তার জন্য বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েন।

“আমি তাকে ভয় পেতে মানা করি। বলি যে আমরা সুসভ্য, সংস্কৃতিবান মানুষ, এই ডাকাতদের মতো বর্বর নই। কৃতজ্ঞতার অশ্রুবিন্দুতে তার মুখ সিক্ত হয়ে উঠে এবং তিনি আমাকে এটা দেন যা আমি আপনাকে আমাদের মহান বিজয়ের স্মারক হিসাবে এখন আপনাকে দিচ্ছি।” কথার মাঝেই হুমায়ূন বাবরের দিকে লাল চামড়ার একটা থলি এগিয়ে দেয় যেটার মুখ সোনালী জরির কাজ করা চামড়ার দিয়ে বাঁধা। বাবর মুখের বাঁধনটা খুলে এবং ভেতর থেকে একটা বেশ বড় পাথর বের করে আনে, পাথরটা তাঁবুর আধো-অন্ধকারের ভিতরে অপরূপ বিভায় ঝলসে উঠে। “আব্বাজান এটা একটা হীরক খণ্ড এখান থেকে হাজার মাইল দক্ষিণে গোলকুণ্ডার খনিতে কেবল এই পাথর পাওয়া যায়। আমি এতো বড় হীরকখণ্ড আগে দেখিনি। গোয়ালিয়রের রাজপরিবারের রত্নাকর একবার এর মূল্য নির্ধারণ করতে গিয়ে বলেছিলো যে পুরো পৃথিবীর অর্ধদিনের ব্যয় নির্বাহ করা যাবে এটা দিয়ে। একে তারা বলে কোহ-ই-নূর, আলোর পর্বত…”

বাবর পাথরটার বিশুদ্ধতা আর উজ্জ্বলতা দেখে মুগ্ধ হয়। একটা নক্ষত্রের মতো পাথরটা থেকে আলো ঠিকরে আসছে। ঠিক যেনো ক্যানোপাস। বাবর ভাবে, নিজের ভাবনায় নিজেই হেসে ফেলে…তারপরেও পাথরটার তীব্র উজ্জ্বলতা দেখে একে বেহেশতের প্রস্তরখণ্ড বলে মনে হয়। পৃথিবীর মাটি খুঁড়ে এটা পাওয়া গেছে। বলে মনেই হয় না….

“বাছা, তুমি আসলেই তোমার সৌভাগ্যবান নামের সার্থকতা প্রমাণ করেছে। আশা করি আরো বহুদিন এই ধারা বজায় থাকবে-” বাবর তার কথার মাঝেই থেমে যায়। তাঁবুর উন্মুক্ত প্রবেশপথ দিয়ে সে দু’জন পরিচারককে সাদা কাপড়ে মোড়া একটা খাঁটিয়া তার তাঁবুর দিকে বয়ে নিয়ে আসতে দেখে। চারপাশ থেকে ভেসে আসা চিৎকার আর কোলাহলের শব্দে বোঝা যায় বাবুরীর বাহিনীও ফিরে এসেছে। কোথায় সে? বিজয়ের আনন্দ ভাগ করে নেয়ার জন্য সে নিজে কেন আসছে না? তারপরে তার চাদরের নিচে থেকে ধূলোতে লুটাতে থাকা হাতের সোনার ভারী কাজ করা রুবি বসানো আংটিটার দিকে তার দৃষ্টি আটকে যায়। বহুবছর আগে বাবুরিকে। সে এই আংটিটা দিয়েছিলো তাদের একটা অভিযানে জয়লাভের স্মারক হিসাবে। পরিচারক দুজন আলতো করে খাঁটিয়াটা মাটিতে নামিয়ে রাখার সময় বাবর তাদের বাবুরীর পরিচারক বলে চিনতে পারে।

বাবর যান্ত্রিক ভঙ্গিতে ঝুঁকে এসে কম্পিত হাতে রক্তে ভেজা চাদরটা সরিয়ে দিয়ে তার সহযোদ্ধা ভাইয়ের দলামোচড়ানো দেহটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

“আমরা সামনে পেছনে চল্লিশটা করে হাতির বহর নিয়ে দিল্লীর দিকে পলায়নপর ইবরাহিমের একটা বিশাল সুশৃঙ্খল বাহিনীর সম্মুখীন হয়েছিলোম। আমাদের প্রভু বাবুরী সাথে সাথে আক্রমণের আদেশ দেন। আর আমাদের দাপট সহ্য করতে না পেরে তারা যে যেদিকে পারে পালিয়ে যায়। কিন্তু যুদ্ধের একেবারে শেষ মুহূর্তে মুখে আমূল প্রোথিত হয়ে ক্রুদ্ধ আর আহত একটা হাতি তাকে ঘোড়া থেকে ফেলে দিয়ে পিষে ফেলে।” পরিচারকদের একজন বলে।

বাবুরীর মুখটা কেবল প্রাণহীন আর ফ্যাকাশে হয়ে আছে- অক্ষত রয়েছে। তার তীব্র নীল চোখের পাতা ভোলা অবস্থায় তখনও বাবরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আর ঠোঁটের কোণে একটা আলতো হাসি তখনও ফুটে আছে। বাবর নিজের কান্না চাপবার কোনো চেষ্টাই করে না, খাঁটিয়ার উপরে ঝুঁকে সে তার আধখোলা চোখের পাতা বন্ধ করে দেয় এবং কপালে আলতো করে চুমু খায়। “বিদায়, ভাই আমার…”

৪.৪ প্রথম মোঘল নৃপতি

২৩. প্রথম মোঘল নৃপতি

সূর্যের আলোর ধাতব দীপ্তি বাবরের চোখে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। বৃষ্টিহীন শুষ্ক ভূপ্রকৃতির উপর দিয়ে এগিয়ে যাবার সময়ে যেখানে ঝোপঝাড়ের উপরে ধূলোর ভারী প্রলেপ পড়ে আছে। বাবর তার চারপাশে চার অশ্বারোহীর হাতে ধরা সোনালী দণ্ডের উপরে স্থাপিত হলুদ আর সবুজ জরির কাজ করা শামিয়ানার ছায়ার জন্য সে, কৃতজ্ঞ বোধ করে। একটা তীব্র বাতাস মাটি থেকে চাবকে ধূলো তুলে- সে ইতিমধ্যে জেনেছে তার নতুন প্রজারা একে আন্ধি বলে আর এর মানে বৃষ্টি হতে বেশি দেরি নেই।

পানিপথের যুদ্ধ সমাপ্ত হবার সাথে সাথে, বাবর হমায়ুন আর তার চার সেনাপতিকে ভারী অস্ত্রশস্ত্র রেখে নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে দ্রুত গতিতে ইবরাহিমের আগ্রায় অবস্থিত রাজধানী অভিমুখে পাঠিয়ে দিয়েছে। শহরটা যমুনার তীরে দিল্লী থেকে একশ বিশ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। সেখানে অবস্থিত সেনাবাহিনী নিজেদের সংঘটিত করার আগেই দূর্গ আর রাজকোষ দখল করতে। এখন তিন দিন পরে, বাবর তার বিজয়ী বাহিনী নিয়ে দিল্লীর দক্ষিণে রওয়ানা দিয়েছে। সবশেষে, ধূলোর মেঘের আড়ালে প্রায় ঢাকা পড়ে আছে। রয়েছে রণহস্তীর দল- এখনও লাল রঙে রঞ্জিত- তার লোকজন যুদ্ধ শেষে প্রাণীগুলোকে আটক করেছে।

বাবরের যুদ্ধ জয়ের আনন্দ বাবুরীর মৃত্যুতে অনেকটাই মলিন হয়ে গিয়েছে। তার। মৃত্যু সংবাদ শোনার সাথে সাথে সে নিজের তাঁবুতে ফিরে গিয়ে একাকী বসেছিলো। হিন্দুস্তানের নতুন সম্রাট হিসাবে কারো সাথে দেখা করতে বা কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে সে অপারগতা প্রকাশ করে। বাবুরীর মৃত্যুতে সে কেবল একজন ভালো বন্ধুকেই হারায়নি- তার মনে হচ্ছে একটা যাপিত জীবনের যেনো সমাপ্তি ঘটেছে। সে আর কখনও কখনও তার মতো বন্ধু পাবে না যে তার যৌবনের সহচর, আর ভাগ্য বিড়ম্বনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং অংশীদার ছিলো।

বাবুরীর সাথে যখন তার প্রথম দেখা হয় তখন তার নিজের বয়স বিশ বছরও হয়নি। ফারগানার একটা ছোট অংশের শাসক, সুলতানের চেয়ে যার সাথে যুদ্ধবাজ সর্দারের মিল বেশি। এখন সে সন্তানের পিতা আর এক বিশাল সাম্রাজ্যের সম্রাট। যাকে সবসময়ে নিজের মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে এবং অন্যদের সাথে তার সামাজিক মর্যাদা যাই হোক সবসময়ে একটা দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। এখন। থেকে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী হবে তার সন্তানেরা। সে তাদের খুবই ভালোবাসে, কিন্তু বাবুরীর মতো সম্পর্ক তাদের সাথে হবে না। তাদের ভিতরে বয়স আর অভিজ্ঞতার পার্থক্য। তার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা আর সন্তানোচিত আনুগত্য। আর সেই সাথে তাদের আগলে রাখার জন্য তার অনবদ্য প্রয়াস এবং কিভাবে জীবনযাপন আর শাসন করতে হবে সেসব তাদের শিক্ষাদানের প্রয়াস এসবই তাদের সম্পর্কের ভিতরে অমোঘভাবে অবস্থান করবে। তারা কখনও তার বিরোধিতা করতে বা তাকে তাচ্ছিল্য করার তার সাথে রসিকতা করার সাহস পাবে না- যা বাবুরী প্রায়ই করতো…

বাবরের মনে সহস্র ভাবনা, অনুভূতি আর কল্পনার বেনোজলে প্লাবিত হয়ে উঠে। বাবুরীর কাটা কাটা চেহারা আর তীব্র নীল চোখ প্রথমবার দেখার সময় যখন সে বাবরের ধাবমান ঘোড়ার খুরে পিষ্ট হবার হাত থেকে একটা বাচ্চাছেলেকে বাঁচাতে লাফ দিয়েছিলো; বাবুরীর প্রথমবার ঘোড়ায় চড়ার চেষ্টা; তাদের যৌবনের প্রথম স্বাধীনতা; ফারগানার বেশ্যালয়ে তাদের বুনো মাতাল রাত কাটানো; বন্ধুত্ব আর সাহচর্যে কাটানো এতগুলো বছর। তাঁবুর ভেতরে শীতের বাতাসের তীব্রতার হাত থেকে বাঁচার জন্য পরস্পরকে জড়িয়ে থাকা, যুদ্ধ আর অভিযানের স্মৃতি যার কোনোটা সাফল্যমণ্ডিত আবার কোনোটা…

এসব ঘটনা এমন একটা প্রেক্ষাপটে ঘটেছে বাবুরী আর তার সেটা জন্মভূমি, শীতল, চঞ্চল, সর্পিল নদী, পরস্পরকে জড়িয়ে থাকা পাহাড়ের সারি, তীক্ষ্ণ-পার্শ্বদেশযুক্ত উপত্যকা এবং অবারিত সমভূমির দেশ। যেখানের বাতাস গ্রীষ্মকালে লবঙ্গের গন্ধ ভাসে আর শীতের সময়ে জমে ইস্পাতের মত শক্ত হয়ে থাকে। সবুজ আর ফিরোজা মিনার এবং গম্বুজে সমৃদ্ধ শহর। প্রাচীন মাদ্রাসা আর পাঠাগার যেখানে তৈমূরীয় রীতি সবাই বোঝে, আর শ্রদ্ধার চোখে দেখে। এখন বন্ধুহীন অবস্থায় বাবর এমন একটা নতুন জায়গায় উপস্থিত হয়েছে, যেখানে তাকে কেউ চেনে না। আর সেও এখানকার রীতিনীতি কিছুই বোঝে না। কেবল একটা বিষয়েই সে নিশ্চিত যে, এখানকার আবহাওয়া তার পছন্দ হয়নি। ঘামে মুখ সবসময়ে ভিজে থাকছে, আর ভারী বাতাসে শ্বাস নেয়াটাই একটা কষ্টসাধ্য প্রয়াস। তার পালকশোভিত পাগড়ীর নিচে মাথা দপদপ করে।

তারা এগিয়ে যাবার সময়ে অন্তত আর কোনো বিরূপতার মোকাবেলা করতে হয় না। মাঝে মাঝে বাবর তার অশ্বারোহী বাহিনী আর মালবাহী গাড়ির বিশাল বহর এগিয়ে চলার সময়ে দূরে ছোট ছোট দলকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। এখন চোখের উপরে হাত দিয়ে তারা যে চওড়া রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে তার একপাশে মাটির তৈরি বাড়িঘর দেখতে পায়। সূর্যের আলোয় গোবরের স্তূপ পড়ে আছে। লোমহীন, হাড্ডিসার কুকুরের দল সামান্য ছায়া খুঁজে নিয়ে বিশ্রাম করছে। এবং হাড্ডিসার মুরগীর দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাড়িগুলোতে বা আশেপাশের মাঠে কোনো লোকজন দেখা যায় না। সেখানে কেবল সরু পায়ের সাদা সারসের দলকে মহিষের পিঠ থেকে হলুদ ঠোঁট দিয়ে পোকামাকড় খুঁটে খেতে দেখা যায়।

আপাতদৃষ্টিতে একটা হতদরিদ্র গ্রাম। বাবর মুখ ঘুরিয়ে নেয়ার ঠিক আগমুহূর্তে সে নিচু দেয়াল পরিবেষ্টিত অবস্থায় একটা বিশাল বেলেপাথরের অদ্ভুতদর্শন ভবন দেখতে পায়। গ্রামের তুলনায় ভবনটাকে বিসদৃশ্য দেখায়। সে কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখে মূল ভবনের সামনের প্রান্ত হাত, পা আর অবয়বের পরস্পর সংবদ্ধ খোদাই। করা একটা নিদর্শন চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। পানিপথের দীর্ঘ পথে বহুবার সে এধরণের ভবন দেখতে পেয়েছে। কিন্তু তখন তার সময় বা ইচ্ছা কোনো ছিলো না কাছে গিয়ে ভালো করে দেখবার।

সে ইশারায় থামতে বলে। সে তার কচিকে বলে, “দেখে এসো ওটা কি?”

পনের মিনিট পরে তার কর্চি এক ছোটখাট লোককে নিয়ে ফিরে আসে, যার মুখটা আখরোটের মতো কুঞ্চিত আর ভাঁজপড়া এবং চোখে বয়সের ছাপ। তাদের সাথে রয়েছে বাবরের এক সেনাপতি জুনায়েদ বারলাস। কাবুলে বসবাসকারী এক হিন্দুস্তানী কার্পেট ব্যবসায়ীর কাছ থেকে জুনায়েদ তরুণ বয়সে হিন্দুস্তানী ভাষা শিখেছিলো। ভালো কাউকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত সে তাকেই তার দোভাষীর পদে নিয়োগ করেছে।

“সুলতান, এই লোকটা বলছে ওটা একটা হিন্দু মন্দির।” জুনায়েদ ব্যাখ্যা করে।

“আমার মনে হয় সে ঐ মন্দিরের একজন পুরোহিত।”

“আমি দেখতে চাই।” বাবর ঘোড়া থেকে নেমে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পুরোহিতের দিকে তাকায়। লোকটার কোমরে কেবল একটা নেংটি পরা রয়েছে যা তার কোমরে একটা দড়ি দিয়ে বাঁধা আর পুরো গায়ে কোনো কাপড়ের বালাই নেই। তার বাম কাঁধের উপর দিয়ে এসে ডান বাহুর নিচে দিয়ে একটা লম্বা সুতির সূতোর ফাঁস ঝুলছে। তার রুক্ষ্ম সাদা চুল আর দাড়ি লম্বা এবং জটপাকানো আর কপালে ছাইয়ের মতো কিছু একটা লেপটে রয়েছে। তার ডান হাতে একটা লাঠি ধরা আছে, তার মতোই গ্রন্থিযুক্ত।

পুরোহিত ধীর পায়ে তাকে ভেতর নিয়ে আসে। মূল ভবনটার মতো কিছু বাবর আগে কখনও দেখেনি। ভবনটার সামনের দিকটা সাত তলা বিশিষ্ট একটা কাঠামো, যার নিচের দিকটা ত্রিশ ফিট চওড়া আর উপরের দিকে উঠে সেটা একটা বর্গাকার চূড়ার আকৃতি নিয়েছে। খোদাই করা মানুষের নারী এবং পুরুষ- বিশালাকৃতি দেহ এবং বড় বড় চোখে তাকিয়ে রয়েছে। তাদের পরনে আপাতদৃষ্টিতে দেহের সাথে আঁটসাঁট অর্ধস্বচ্ছ পোশাক, কপালে, গলায় আর বাহুতে অলঙ্কার পুরো দেয়াল জুড়ে খোদাই করা। এসবের মাঝে মাঝে অদ্ভুত, ভয়ঙ্করদর্শন, আর যুদ্ধবাজ চরিত্র যাদের কেউ কেউ মনে হয় নাচছে আবার কেউ রমণে লিপ্ত- মূর্তি খোদাই করা। কারো কারো পশুর মাথা- বানর এবং হাতির।

বাবর তাকিয়ে থাকে। জীবন আর প্রাণশক্তির উপাদানবাহী ইঙ্গিত। কিন্তু এসবের মানে কি? একটা দরজা দিয়ে তারা ভবনের ভিতরে প্রবেশ করে। একপাশে একসারি সংকীর্ণ সিঁড়ি ওপরের তলায় উঠে গিয়েছে। ভেতরে অপরিচিত তীব্র একটা গন্ধ, চন্দনকাঠের চেয়ে তীব্র ভারী আর মিষ্টি একটা গন্ধ। পুরোহিত কাঁধের উপর দিয়ে পেছন দিকে তাকায়। বাবরকে পেছনেই দেখতে পেয়ে পাথরের উপরে হাতের লাঠি ঠুকতে ঠুকতে সে সামনের দিকে আবার এগিয়ে যেতে শুরু করে। বাবর তাকে অনুসরণ করে ভেতরের বর্গাকার আঙ্গিনায় এসে দাঁড়ায়। যার চারপাশ দিয়ে বেষ্টনী দেয়া বারান্দা রয়েছে। দেয়ালগুলোকে হিন্দু কিংবদন্তী বা লোকগাথার দৃশ্য খোদাই করা রয়েছে। বানরের মতো দেখতে যোদ্ধার দল, হাতে ধরা খাটো তরবারি আন্দোলিত করে একটা সেতু অতিক্রম করে যুদ্ধের জন্য একটা দ্বীপে গমন করছে।

বারান্দায় ধারণ করে থাকা বেলেপাথরের স্তম্ভে আরও সুগঠিত দেহের মূর্তি খোদাই করা রয়েছে- চার, ছয় কি আট হাতবিশিষ্ট। আঙ্গিনার একপাশে একটা সাদা পাথরের হাঁটু মুড়ে বসে থাকা ষাঁড়ের মূর্তি। গলায় গাঁদা ফুলের মালা ঝুলছে। আর সামনে রাখা পিতলের ধূপদানে ধূপ পোড়ার গন্ধ আসছে। কাছেই একটা মামুলি কালো পাথরের- সম্ভবত কষ্টিপাথর- স্তম্ভের চারপাশে মোমবাতি জ্বালানো রয়েছে যার উপরের দিকটা গোলাকার এবং কিছু কিছু স্থান এমন মসৃণ যে পাথরটা মার্বেলের দীপ্তি ছড়াচ্ছে। স্তম্ভটার সামনে তেল, খাবার আর পদ্মফুলের নৈবেদ্য সাজান রয়েছে।

“ওটা কি?” বাবর জানতে চায়।

জুনায়েদ বারলাস পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করে। কিন্তু স্পষ্টতই বোঝা যায় উত্তরটা বুঝতে তার নিজেরই কষ্ট হচ্ছে। অবশেষে সে বলে, “তারা এটাকে লিঙ্গম বলে থাকে, সুলতান। এটা দিয়ে পুরুষাঙ্গ বোঝানো হয় আর এটা উর্বরতার প্রতীক।” কিন্তু বাবরের দৃষ্টি ততোক্ষণে আঙ্গিনার অন্যপ্রান্তে একটা চাদোয়ার নিচে আসনপিড়ি অবস্থায় হাত উঁচু করে রেখে উপবিষ্ট এক শক্তিশালী লোকের প্রমাণ আকৃতির চেয়ে বড় মূর্তির দিকে আকৃষ্ট হয়েছে। তার অলঙ্কৃত মুকুটের নিচে কঠোর মুখের ভীষণদর্শন, স্থিরপ্রতিজ্ঞ চোখের দৃষ্টি সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

“এটা তাদের একটা দেবতা- তারা একে শিব বলে,” পুরোহিতের সাথে আরো একবার আলোচনা করে নিয়ে দোভাষী জানায়। কিন্তু দৃশ্যত পুরোহিতের আরো কিছু বলবার রয়েছে। কারণ সে তখনও বিড়বিড় করতে থাকে। জুনায়েদ বারলাস ঝুঁকে তার কথা শুনতে চেষ্টা করে। “পুরোহিত তাদের এক পবিত্র গ্রন্থে লিপিবদ্ধ কিছু শ্লোক আপনাকে বলতে চায়, সাবধান, আমি স্বয়ং প্রলয়। আমি শিব, ধ্বংসের বাহক…”

পুরোহিত আড়চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ব্যাটা কি বলতে চায়? বাবর ধবংসকারী যে এখানে তাদের মাঝে এসে হাজির হয়েছে নাকি হিন্দু আর তাদের দেবতারা তাকে ধ্বংস করবে…?”

সে ঘুরে দাঁড়িয়ে ভেতরের আঙ্গিনা থেকে প্রধান ভবনের ভিতর দিয়ে বাইরে বের হয়ে এসে মন্দিরের এলাকা ত্যাগ করে। সে ঘোড়ায় চেপে বসে তার পরিচারকের বাড়িয়ে ধরা পাত্র থেকে পানি পান করে ইশারায় জানায় পুনরায় যাত্রা শুরু করার জন্য সে প্রস্তুত। নিজের দেহরক্ষীদের পেছনে রেখে সে একবার পেছনের মন্দির বা তার রহস্যময় মূর্তির দিকে না তাকিয়ে সামনের দিকে রওয়ানা দেয়।

কয়েক গজ সামনে যাবার পরে তাদের ঠিক পথের উপরে একটা গরু মাটিতে থেবড়ে বসে রয়েছে দেখতে পায়। লম্বা পাপড়িযুক্ত চোখের চারপাশে ভনভন করতে থাকা মাছির দঙ্গলে তার খুব একটা অসুবিধা হয় না। লম্বা শিংযুক্ত একটা। প্রাণী এবং বাবরের মাতৃভূমির গরুর তুলনায় হাড্ডিসার, ফ্যাকাশে খয়েরী চামড়ার নিচে পাছা আর পাজরের হাড় পরিষ্কার গোনা যায়। বাবরের দেহরক্ষী দলের একজন সামনে এগিয়ে গিয়ে বর্শার হাতল দিয়ে তাকে একটা গুতো দেয়। গরুটা হাম্বা রবে প্রতিবাদ জানায় কিন্তু উঠে দাঁড়াবার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। লোকটা এবার বর্শাটা ঘুরিয়ে নেয় এবং তীক্ষ্ণ দিক দিয়ে খোঁচা দিতে চায় যাতে বেয়াদব গরুটা অবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে, এমন সময় বাবরের পেছন থেকে কুদ্ধ চিৎকারের শব্দ ভেসে আসে।

চারপাশে তাকিয়ে সে সেই বৃদ্ধ পুরোহিতকে তার হাড় জিরজিরে দেহের তুলনায় বিদ্যুৎ বেগে দৌড়ে আসতে দেখে। চিৎকার করার কারণে বুড়ো লোকটার মুখ বিকৃত হয়ে আছে। দৌড়াবার ফাঁকে লাঠি ধরা হাত তুলে প্রবল বেগে আন্দোলিত করছে। বাবরের দু’জন দেহরক্ষী লাফিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়ায় এবং বাবরের কাছাকাছি পৌঁছাবার আগেই তাকে আটকে দেয়।

বাবর জুনায়েদ বারলাসের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। “কি চায় সে?”

“সুলতান সে আপনাকে অভিশাপ দিচ্ছে।”

“তার এই স্পর্ধার জন্য আমি চাবকে তার পিঠের চামড়া তুলে নেবো।”

“সুলতান আপনি বুঝতে পারেননি, সে বলতে চাইছে হিন্দুরা গরুকে পবিত্র প্রাণী হিসাবে বিবেচনা করে যা যেখানে ইচ্ছা ঘুরে বেড়াতে পারে। সে ভয় পেয়েছে যে আপনি বোধহয় গরুটাকে আঘাত করবেন…”

বাবর বুড়ো লোকটার দিকে তাকায়। “ওকে ছেড়ে দাও। আর তাকে বলল যে আমি বুঝতে পারিনি। তাকে আরো বলো যে তার ধর্মকে অসম্মান করার কোনো ইচ্ছাই আমার নেই।”

জুনায়েদ বারলাসের ভাষান্তরিত কথা শুনে বৃদ্ধ লোকটার অভিব্যক্তি স্বাভাবিক হয়ে আসে। গরুটাও ততক্ষণে বিরক্ত হয়ে পড়েছে এবং অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে দাঁড়িয়ে দূরে একটা গাছের ছায়ার উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে। বাবরের সেনাবাহিনী তাদের সদ্য দখল করা ভূখণ্ডের উপর দিয়ে আবারও অবাধে এগিয়ে যেতে শুরু করে।

*

চারদিন পরে, বাবর আর তার বাহিনী দিল্লী পৌঁছালে সেখানের শাসনকর্তা কোনো প্রতিরোধ প্রদর্শন করে না। তার দেখা এটা সবচেয়ে জনবহুল আর বড় শহর। সমরকন্দ বা হিরাতের মতো আভিজাত্য নেই বটে শহরটার, কিন্তু কিছু কিছু অংশ দেখতে খারাপ না। সে বিশাল বেলেপাথরের তৈরি মসজিদ, সূক্ষ খিলানযুক্ত প্রাসাদ, এবং কৌতূহলকর খোদাইযুক্ত দুইশ চল্লিশ ফিট উঁচু উপরের দিকে ক্রমশ সরু হয়ে যাওয়া স্তম্ভ- কুতুব মিনার পরিদর্শন করে। শতাব্দি পূর্বে কোনো অজানা কারণে নির্মিত হয়েছিলো। রাজকীয় সমাধিস্থল- গম্বুজযুক্ত, খিলানসংবলিত, স্ত যুক্ত- সব জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে। এসব দেখে বাবর ভাবতে বাধ্য হয়- দিল্লীর সুলতানেরা যেমন জৌলুসপূর্ণ জীবনযাপন করেছিলেন, মৃত্যুর পরে তেমনি আড়ম্বরপূর্ণ সমাধিস্থলের ভক্ত ছিলেন। এখন মৃত্যু নগরীর কেবল বাসিন্দা হিসাবেই তারা স্মৃতিতে বেঁচে আছে…

বাবর শহরে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করে না- জুম্মা মসজিদে তার নামে খুতবা পড়ানো শেষ হতে সে শাহী কোষাগার পরিদর্শন করে। মণিমুক্তো আর মোহর ভর্তি সিন্দুকগুলো তার হিন্দুস্তানের অভিযানের সার্থকতা প্রতিপন্ন করে। অবশ্য দিল্লীতে ইবরাহিমের প্রাক্তন পরিচারকের ভীতসন্ত্রস্ত দল- বাবরের সামনে তাদের হাজির করা হলে- বাবরের ভাবনার সাথে তাল মিলিয়ে ব্যগ্র কণ্ঠে নিজেরাই বলে উঠে মূল কোষাগার আগ্রায় অবস্থিত। সে হুমায়ুনকে সেখানে পাঠিয়ে ভালোই করেছে। কোষাগারের হিসাব নেবার পরে নিজের একজন সেনাপতিকে শহরের নতুন শাসক হিসাবে নিয়োগ করে আগ্রায় হুমায়ুনের সাথে যোগ দেবার জন্য সে যমুনার তীর বরাবর দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রওয়ানা দেয়।

আবহাওয়ায় উষ্ণতা এতো বেশি যে বাবর অবাক হয় এই গরমে জীবিত কিছু চলাফেরা করে কি করে। অবশ্য তার যাত্রা অব্যাহত থাকলে ধীরে ধীরে লোকজন দেখতে পাওয়া যায়। শীঘ্রই রাস্তাঘাট আর মাঠে তাদের নির্ভীকভাবে চলাফেলা করতে আর তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়। সে যে কঠোর নিয়মশৃঙ্খলা আরোপ করেছে তার প্রভাব নিশ্চয়ই পড়েছে…তার নতুন প্রজারা- ছেলেদের পরনে নেংটির মতো কাপড় আর মেয়েদের পরনে রঙচঙে লম্বা কাপড় তাদের শরীরে পেচিয়ে মাথার উপর গিয়ে শেষ হয়েছে। আর কপালে লাল চিহ্ন আর নাকে সোনার নাকফুল- তাদের নিশ্চিতভাবেই ভীত মনে হয় না। সূর্যের দাবদাহে ঝলসে যাওয়া গ্রামের ভিতর দিয়ে বাবর তার বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যাবার সময়ে তারা কৌতূহলী ভঙ্গিতে চারপাশে এসে ভীড় করে। গ্রামগুলোতে শুকনো গোবর, মশলা আর ধূপের মিষ্টি সুগন্ধে ভরা। তারা বস্তা ভর্তি শস্য, ফলমূল আর সজি নিয়ে এসে বাবরের সৈন্যদের কাছে বিক্রিও করে।

দিন অতিক্রম করার সাথে সাথে সূর্যের অবিরাম আলোর নিচে সমতল, খয়েরী আর শুষ্ক ভূপ্রকৃতি আর তার গিজগিজ করতে থাকা লোকের ভীড় বাবরকে অস্থির করে তোলে। প্রাণশক্তি আর উদ্যমের অভাব সে অনুভব করতে থাকে। রাতের বেলাতেও স্বস্তি নেই। তখন শুরু হয় মশার গুঞ্জন এবং তার পরিচারকের দল শীতের দেশের জন্য নির্মিত তাঁবু আবহাওয়া কিছুতেই শীতল করতে পারে না। মন্থরগতি যমুনাও তার চোখকে বিন্দুমাত্র আনন্দ দিতে ব্যর্থ হয়। যমুনার তীরের শুকনো জমাট কাদার দিকে তাকিয়ে সিন্ধু নদের ওপাশে নিজের দেশের খরস্রোতা নদী আর বলকারী বাতাসের জন্য তার মনটা আনচান করতে থাকে।

ষষ্ঠদিন সন্ধ্যাবেলা। কাবুল থেকে আগত এক বার্তাবাহক একটা উপহার নিয়ে উপস্থিত হয়। ধাতব আস্তরণ দেয়া কাঠের বাক্সটার ভেতরে, যাত্রার শুরুতে নিশ্চিতভাবেই বরফ দিয়ে পূর্ণ করা হয়েছিলো। সে দেখে তরমুজ রয়েছে, খানজাদা তার প্রিয় ফল পাঠিয়েছে। নিজের তাঁবুর ভেতরে একাকী বসে সে তরমুজটা কেটে সেটার রসাল মিষ্টি শাশের স্বাদ নিতে তার চোখ জ্বালা করতে থাকে। নিজের দেশত্যাগের অনুভূতি তার ভিতরে প্রবল হয়ে উঠে। খানজাদা তাকে সামান্য আনন্দ দিতে চেয়েছিলো, কিন্তু তার পাঠানো উপহার কেবল তাকে আরও নিঃসঙ্গ করে তোলে।

বাবর হাত বাড়িয়ে কালি, কলম আর রোজনামচার খাতা তুলে নেয়। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সে লেখার সময়ই পায়নি। বাবর লিখতে শুরু করে:

হিন্দুস্তান দেশটায় কোনো বৈচিত্র নেই। এখানকার লোকজনও দেখতে সুদর্শন না…এখানে ভালো ঘোড়া, বা শিকারী কুকুর, মাংস, আঙ্গুর, সুস্বাদু তরমুজ বা অন্য কোনো স্বাদু ফল পাওয়া যায় না। এখানে নেই কোনো বরফের বা শীতল পানির বন্দোবস্ত। বা বাজারেও ভালোকিছু জিনিসের বড় অভাব। গরম পানির হাম্মাম বা মাদ্রাসাও নেই। তাদের নদী বা ছোট স্রোতস্বিনী, যেগুলো গিরিন্দর দিয়ে প্রবাহিত, এখানের বাগানে বা বাসস্থানে পানি প্রবাহের কোনো বন্দোবস্ত নেই…

সে লেখা থামায়। বাবুরী যে তাকে হিন্দুস্তান বিজয়ী উপাত্ত এনে দিয়েছিলো সে। তাকে কি বলতো? সে এই মাত্র যা লিখেছে তাতে কেবলই তিক্ততা আর ছিদ্রান্বেষণের অভিপ্রায় প্রকট। যেকোনো ধরণের আত্ম-করুণার লক্ষণের প্রতি বাবুরীর ছিল চরম বিতৃষ্ণা এবং শীঘ্রই সে এই লক্ষণ খুঁজে পেতো। সে থাকলে বাবরকে হয়তো বলতো এটা থেকে বের হয়ে আসতে…বলতো সে একটা দারুণ সুযোগ পেয়েছে এবং তার দায়িত্ব হলো এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করা। কিন্তু সম্ভবত বাবুরী এখন তার সাথে থাকলে সে হয়তো এমন বিষণ্ণ বোধ করতো না…।

নিজের জোব্বার ভেতর হাত ঢুকিয়েসে নরম চামড়ার থলিতে বন্দি কোহ-ই-নূর, আলোর পর্বত বের করে। তাবুর আধো আলোতেও পাথরটা চমকাতে থাকে। এই নতুন দেশের শক্তিশালী প্রতীক, যা তার মাঝে শক্তি আর প্রতিজ্ঞার নব ফরুধারা প্রবাহিত করছে। আক্ষেপ করার সময় এটা নয়। হিন্দুস্তান যদি সে যেমন দেশ পছন্দ করে তেমনটা না হয়েও থাকে, তবে সে আর তার সন্তানেরা তাকে তাদের মনের মতো দেশে পরিণত করবে। তারা এমন একটা সাম্রাজ্যের জন্ম দেবে যা নিয়ে মানুষ সম্ভ্রমের সাথে শতাব্দির পরে শতাব্দি আলোচনা করবে।

ডায়েরীর একটা নতুন পাতা খুলে বাবর আবার লিখতে শুরু করে:

কাবুলে আমি যখন প্রথমবার আসি সেই বছর থেকে আমি মনে মনে কেবল হিন্দুস্তানের জপ করেছি। এখন আল্লাহতালার পরম করুণায়, আমি পরাক্রমশালী প্রতিপক্ষ সুলতান ইবরাহিমকে পরাস্ত করেছি এবং আমার সাম্রাজ্যের জন্য একটা নতুন রাজত্ব জয় করেছি।

আরো কিছুক্ষণ চিন্তা করে সে লিখে।

হিন্দুস্তানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল দেশটার বিশালত্ব। সেই সাথে সোনা আর অন্য সম্পদের প্রাচুর্য…

একজন মানুষ ইচ্ছা করলে অনেক কিছুই এখানে করা সম্ভব…

*

দক্ষিণ-পূর্বদিকে ক্রমাগত অগ্রসর হওয়া অব্যাহত থাকলে বাবরের মেজাজ কিছুটা প্রফুল্ল হয়। সে এবার লক্ষ্য করে যে দেশটা সে যতটা বিরাণ ভেবেছিলো ততোটা বিরাণ না। শুষ্কতা আর উষ্ণ বাতাস সত্ত্বেও, এখানে দারুণ সব ফুল ফোটে, যেমন ডালিম ফুলের চেয়ে গাঢ় লাল রঙের গুদাল, এবং পীচ ফুলের মতো পাঁচ পাপড়িযুক্ত মৃদু কিন্তু অপূর্ব গন্ধযুক্ত করবী।

তার এই নতুন আশাবাদী মনোভাবের সাথে আরেকটা ভাবনা তাকে চিন্তিত করে তোলে- সে যদি সত্যিই নিজেকে এখানে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়- তাকে তাহলে এই নতুন দেশ আর তার রীতিনীতি বোঝার চেষ্টা করতে হবে। দোভাষী জুনায়েদ বারলাসের সহায়তায় সে রাস্তায় যাকে দেখতে পায় তাকেই ডেকে প্রশ্ন করতে শুরু করে। যা দেখে সে বিষয়ে কৃষক বা বণিককে প্রশ্ন করে। একদিন সে একটা জলাধারের উপরে রাখা একটা পিতলের তৈরি দুই আঙ্গুল পুরু বাসনে মস্তুর দিয়ে বেগুনী পাগড়ী পরিহিত এক লোকতে বাড়ি দিতে দেখে। সে জানতে পারে এদের বলা হয় ঘড়িয়ালী- সময়রক্ষক। বাবরের মাতৃভূমিতে প্রতিদিন চব্বিশ ঘণ্টায় বিভক্ত আর প্রতি ঘণ্টায় আছে ষাট মিনিট। কিন্তু সে খেয়াল করে দেখে হিন্দুস্তানে তার। নতুন প্রজারা দিনরাতকে ষাটটা অংশে–ঘড়িতে বিভক্ত করেছে, চব্বিশ মিনিটে এক ঘড়ি, দিনরাতে রয়েছে চারটা সময়ভাগ যাকে বলা হয় প্রহর। ঘড়িয়ালদের কাছে এক ধরণের পাত্র আছে যার নিচে ছিদ্র করা। প্রতিঘণ্টায় এটা পানিতে ভর্তি করা হয়। ঘড়িয়ালী এই পাত্রের পানির উপর নজর রাখে। পাত্র ভরা মাত্র সে ঘড়িয়ালের উপরে কাঠের ছোট মস্তুর দিয়ে বাড়ি দেয়, ক্রমে পানি পড়া শেষ হয়ে যায়। তারপরে পাত্রে আবার পানি দেয় এবং ঘড়িয়ালে বাড়ি দেয়। রাতের প্রথম প্রহর শেষ হলে ঘড়িয়ালী খুব দ্রুত কয়েকটা বাড়ি দিয়ে শেষে জোরে একটা বাড়ি দেয়। রাত দুই প্রহর হলে একইভাবে দ্রুত কয়েকটা আঘাত করে জোরে দুটা বাড়ি দেয়। এভাবে তিন প্রহর আর চার প্রহর ঘোষণা করা হয়।

একজন অর্থ-ব্যবসায়ীর কাছে থেকে বাবর বাজারে মুদ্রাগণনা হিসাব পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পায় হিন্দুস্তানীদের হিসাব করার সুস্পষ্ট নিয়ম আছে: একশ হাজারে তাদের এক লাখ; একশ লাখে এক কোটি; একশ কোটিতে এক অর্ব এভাবে গণনার মাত্রা বাড়তে থাকে। কাবুলে গণনার জন্য তাদের এমন সংখ্যারীতির প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু হিন্দুস্তানে, যেখানে সম্পদ- অন্তত তার শাসকদের কাছে মাত্রাহীন, সেখানে এটা চালু আছে। ভাবনাটা বেশ প্রীতিকর।

বাবর কৃষকদের শ্রমসাধ্য প্রয়াসে তাদের কৃষিজমিতে সেচ দিতে দেখে। কুঁয়ো থেকে ষাড় দিয়ে চামড়ার মশকে পানি টেনে উপরে তোলা হয় এবং খেজুর আর তাল গাছের মিষ্টি মাদকতাময় পানীয় সে পান করেছে, তাল গাছ সে আগে কখনও দেখেনি। সে সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করে হিন্দুস্তানের ধর্মের সারবস্তু বুঝতে। জানতে পারে হিন্দুরা পূর্ণজন্মে বিশ্বাস করে এবং তাদের ভীতিকর দেখতে অসংখ্য দেবতা যাদের ভিতরে বহুভূজা নারী রয়েছে। নরমুণ্ডে সজ্জিত রয়েছে জালার মতো পেটের হাতির মুখঅলা দেবতা- সবাই আসলে একটা কেন্দ্রীয় ত্রিমূর্তির বহিপ্রকাশ, ব্রহ্মা, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা; বিষ্ণু, ভারসাম্যের দেবতা আর শিব ধ্বংসের প্রতিভূ। কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই কেমন ঘোলাটে, বিভ্রান্তকর আর কেমন বিব্রতকর। সুলতান ইবরাহিম তার মতোই একজন মুসলমান- এসব থেকে কি বুঝেছিলেন? বাবর আবার সেই মন্দিরের পুরোহিতের কথা ভাবে: “আমিই সেই ধ্বংসকারী…”।

সে শীঘ্রই আবিষ্কার করে যে কেবল তার কাছেই হিন্দুস্তান বিব্রতকর বলে প্রতিয়মান হয়নি। একরাতে তাঁবুর বাইরে বাতাসের আশায় বসে আছে সে, বাবা ইয়াসাভালকে এগিয়ে আসতে দেখে।

“সুলতান।” তার সেনাপতি হাত দিয়ে বুক স্পর্শ করে ভক্তি প্রদর্শনপূর্বক দাঁড়িয়ে থাকে।

“কি ব্যাপার?”

বাবা ইয়াসাভালকে ইতস্তত করতে দেখা যায়।

“বলো।”

“সুলতান আমার লোকেরা অস্থির হয়ে উঠেছে…এই নতুন অঞ্চলটা তারা একেবারেই পছন্দ করছে না…এতো গরম আর বিরামহীন বাতাস এখানে…অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে…” সে দম নেবার জন্য থামে, তার মশার কামড়ে দগদগে মুখটা মশালের আলোতে চকচক করে। “আমরা কাপুরুষ নই যুদ্ধে কখনও আমরা পিছপা হই না। কিন্তু এই এলাকাটা আমাদের কাছে অপরিচিত…আমরা কাবুলে ফিরে যেতে চাই। আমি কেবল আমার নিজের কথাই বলছি না, অন্য সেনাপতিদের তরফ থেকে আমি কথা বলছি। তারা তাদের পক্ষ হয়ে আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে আপনার সাথে কথা বলতে।”

“সবাইকে এখনই এখানে আসতে বলো।”

বাবা ইয়াসাভাল নিজের মনে কথাই বলেছে। কয়েকদিন আগে বাবরের মনেও এই সব কথাই খেলা করতো। কিন্তু অন্য মানুষের মুখে নিজের মনের কথা উচ্চারিত হতে দেখে সে টের পায় কি গভীরভাবে সে যা দখল করেছে সেটা নিজের অধিকারে রাখতে চায়। অপেক্ষা করার সময়টায় সে মনে মনে গুছিয়ে নেয় কি বলবে। সেনাপতিরা তার তাঁবুর সামনে জড়ো হতে, কেউ কেউ তার চোখের দিকে সরাসরি তাকানো থেকে বিরত থাকে। সে ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের দিকে সরাসরি তাকিয়ে ধীরে ধীরে কথা বলতে থাকে।

“যুদ্ধের উপকরণ ছাড়া বিজয় ও সাম্রাজ্য অর্জন সম্ভব না। রাজপদ ও আমীর রঈস অধীনস্ত রাজা-প্রজা ছাড়া টিকতে পারে না। বহু বছরের সাধনায় বহু দুঃখ-কষ্ট সয়ে, বহু বিপদের সম্মুখীন হয়ে, বহু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে আমরা এক বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর। বুকের রক্ত দিয়ে যে সাফল্য আমরা অর্জন করেছি আজ কি এমন অঘটন ঘটেছে যে সেই পরম আরাধ্য বিজয় হেলায় ফেলে রেখে আমরা দেশে ফিরে যেতে এতো ব্যস্ত হয়ে উঠেছি? আমরা কি তবে মহত্ত্ব অর্জনের যোগ্য নই…” বাবর একটু থামে অপেক্ষা করে সময় দেয় কথাগুলো তাদের মর্মমূলে প্রবেশ করার। “যে কেউ চাইলে তার প্রাপ্য অংশ নিয়ে সিন্ধু অতিক্রম করে দেশে ফিরে যেতে পারে। আমি একটা কথা বলে রাখছি। যখন বৃদ্ধ অবস্থায় নাতি নাতনি পরিবেষ্টিত হয়ে আগুনের পাশে বসে থাকবে এবং তারা যখন তোমার কাছে জানতে চাইবে কি দুর্ধর্ষ যোদ্ধা তুমি ছিলে। তখন দেখবে বলার মতো কিছুই তোমার থলেতে জমা নেই। তুমি লজ্জিত হবে বলতে যে, তোমার সুলতানকে তুমি ত্যাগ করেছিলে- না, তোমার সম্রাটকে- যে তোমাদের সুযোগ দিয়েছিলো বিশ্ব জয় করার…তুমি তখন মাথা নিচু করে চুপ করে বসে থাকবে। আর তোমার নাতি নাতনিরা তোমার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে…”।

চোখে অস্বস্তি নিয়ে সেনাপতিরা একে অন্যের দিকে তাকায় এবং কিছুক্ষণ পুরো জটলাটায় নিরবতা বিরাজ করে। তারপরে বাবা ইয়াসাভালের নেতৃত্বে, একটা গুনগুনে গুঞ্জন শুরু হয়। এমন একটা গুঞ্জন ফারগানায় কিশোর সুলতান হিসাবে সেই দিনগুলোর পরে সে আর কখনও শোনেনিঃ “বাবর মির্জা! বাবর মির্জা!” গুঞ্জনটা ক্রমেই জোরালো হতে থাকে, ভারী বাতাস মথিত করে। তারা তৈমূরের উত্তরসূরী আর নিজেদের সুলতান হিসাবে তার প্রতি তাদের আনুগত্য ঘোষণা করছে। তারা তাকে ছেড়ে যাবে না। অন্তত এখনই না।

*

নিজের সেনাপতিদের পেছনে নিয়ে হুমায়ূন দূর্গপ্রাঙ্গনে তার জন্য অপেক্ষা করেছিলো। কয়েকদিন পরে যখন বাবর ঢালু পথটা দিয়ে শক্তিশালী আগ্রা দূর্গে প্রবেশ করে। সে ঘোড়া থেকে নামতে তার ছেলে আনুষ্ঠানিকভাবে তার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে। কিন্তু বাবর সাথে সাথে তাকে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে।

“আব্বাজান, কোষাগার সুরক্ষিত রয়েছে। হারেমে আমরা সুলতান ইবরাহিমের মা বুয়া, তার স্ত্রী আর উপপত্নীদের পেয়েছি। বুয়া আমাদের বর্বর বলেছে- সে বলেছে সে আমাদের ঘৃণা করে…” আমি তার অপমানজনক কথাবার্তা আমলে না নিয়ে তাকে আর হারেমের অন্য বাসিন্দাদের সাথে ভালো ব্যবহার করতে বলেছি…স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে কোনো প্রতিরোধের আমরা সম্মুখীন হইনি। বস্তুতপক্ষে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হতে দেখে তারা বরং স্বস্তির শ্বাস নিয়েছে। প্রথম যখন খবর আসে যে আপনার কাছে সুলতান ইবরাহিম পরাস্ত হয়েছে। ডাকাতের দল অবস্থার সুযোগ নিয়ে চেষ্টা করেছে গ্রামে লুটতরাজ চালাবার। তাদের মেয়ে, শস্য আর ভেড়ার পাল চুরি চেষ্টা করেছে। আমাদের হাতে কিছু ধরা পড়তে আমরা তাদের প্রকাশ্যে প্রাণদণ্ড দেই। এখানেই ঐ কুচকাওয়াজ ময়দানে, দূর্গের সকল অংশ থেকে যেনো সবাই ফাঁসি দেয়াটা দেখতে পায়।

“তুমি দারুণ কাজ দেখিয়েছে। রাজকোষে কি খুঁজে পেলে?”

হুমায়ুনের কান পর্যন্ত হাসিতে ভরে উঠে। “আমি কখনও এমন কিছু দেখিনি সবগুলো সিন্দুকই সোনার মোহর আর দামী পাথরে পরিপূর্ণ…এতো পাথর রয়েছে। যে আমার বিশ্বাসই হতে চায়নি যে পৃথিবীর মাটি খুঁড়ে এতো পাথর বের করা সম্ভব। সবকিছুর হিসাব নিয়ে নথীবদ্ধ করে ওজন করা হয়েছে…”

“বেশ। আমি কাবুলে আমার লোকদের তাহলে অকৃপণ হাতে উৎসব করার জন্য দান করতে পারবো। কয়েক দিনের ভিতরে আমরা বিজয় উপলক্ষে একটা ভূড়িভোজের আয়োজন করবে। কিন্তু তার আগে আপনাদের সাথে আমি কিছু আলোচনা করতে চাই এবং কিছু বিষয় জানতে চাই আপনাদের কাছে। দিল্লী আসবার পথে আমি ভাববার অনেক সময় পেয়েছি…আমাদের মতো আরো অনেক মহান যোদ্ধা, যারা হিন্দুস্তানে এসেছিলো আমি তাদের কথা ভেবেছি মেসেডোনিয়ার সিকান্দার, যিনি সিন্ধু অতিক্রম করে তার বাহিনী নিয়ে এপারে এসেছিলো কিন্তু পরে ফিরে যায় এবং তৈমূর যিনি দিল্লী আক্রমণ করেছিলেন কিন্তু সেখানে অবস্থান করেননি…আমি ভাবছি আমরা এখানে উন্নতি করতে পারবো কিনা…আমার অনেক সেনাপতি যাদের সাহস প্রশ্নাতীত। কিন্তু তাদের মনেও এই একই প্রশ্ন উদয় হতে শুরু করেছে…তারা এই অঞ্চলটা পছন্দ করছে না…আমরা এইসব সম্পদ মালবাহী খচ্চরের পিঠে চাপিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারি। কিন্তু আমরা যদি এখানে অবস্থান করি তাহলে অনেক বিপদ আর সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।

“পানিপথে আমরা বিশাল বিজয় অর্জন করেছি কিন্তু সেটা ছিলো কেবল সূচনা। এই অঞ্চলের কেবল সামান্য অংশ আমরা দখল করেছি- সত্যি বলতে দুইশ মাইল চওড়া এক ফালি ভূখণ্ডের চেয়ে বেশি কিছু না। যদিও এলাকাটা খাইবার গিরিপথ থেকে হাজার মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। পানিপথের যুদ্ধের পরে আমরা তেমন কোন প্রতিরোধের সম্মুখীন হইনি। কিন্তু তার কারণ অন্য কিছু না হিন্দুস্তানের বাকি সব ক্ষমতাবান নৃপতিরা নিজেদের শক্তিশালী দূর্গে ফিরে গিয়ে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে। তারা আমাদের বর্বর ডাকাতের দল বলে ভেবেছে যাযাবরের দল। যাদের শাসন ভোরের সূর্যালোকে শিশির বিন্দুর মতো উবে যাবে। তারা ইতিমধ্যেই আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিকল্পনার সাথে এখান থেকে আমাদের বিতাড়নের পাঁয়তারা কষতে শুরু করেছে। আজ আমি সবার সামনে একটা প্রশ্ন রাখতে চাই। আমাদের কি যুদ্ধে পর যুদ্ধ করার মানসিকতা রয়েছে, যার ফলে এক সময়ে আমরা নিজেদের এখানে নিরাপদ বলে মনে করতে পারি। আমার মতো এখানে উপস্থিত সবার ভিতরে সেই ইচ্ছা সেই দৃঢ়তা কি আছে?”

“আব্বাজান আমার আছে।” হুমায়ূন তার বাদামী চোখে অপলক দৃষ্টিতে বাবরের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে।

“তাহলে আমরা ব্যর্থ হবো না, আমি এই বিষয়ে নিশ্চিত। আমি আমাদের নতুন সাম্রাজ্য আর ভূখণ্ডের জন্য একটা নাম পছন্দ করেছি। দিল্লী আসবার পথে, পারস্যের শাহের লেখা একটা অবিবেচক বার্তা আমার হস্তগত হয়। বার্তাটা আমাদের পানিপথের বিজয় অর্জনের আগে লিখিত হয়েছিলো। তিনি তাতে লিখেছেন যে আমার অভিযানের কথা তিনি শুনেছেন তিনি একে ‘তস্করদের হামলা’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি আমাকে ‘মোঘল’ নামে অভিহিত করেছেন বার্তাটায়- ফার্সীতে শব্দটার মানে মোঙ্গল’- আমাকে অসভ্য হানাদার হিসাবে অপমান করার অভিপ্রায়ে। কিন্তু আমি তাকে লিখে পাঠাই যে চেঙ্গিস খানের, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মোঙ্গলের, বংশধর হিসাবে, যেমন আমি গর্ববোধ করি, তেমনি তৈমূরের বংশধর হিসাবেও আমি গর্বিত। মোঙ্গল’ সম্বোধনের ভিতরে কোনো অপমান নেই। আমি তাকে বলেছি যে আমি গর্বের সাথে এই সম্বোধনটা ধারণ করবো। আর আল্লাহতা’লার কৃপায় শীঘ্রই আমাদের নতুন সাম্রাজ্য তার নিজের সাম্রাজ্যকেও আকার আর সমৃদ্ধিতে ছাড়িয়ে যাবে।”

***

উদ্যত আনুষ্ঠানিক তরবারি হাতে দুই প্রহরীর পেছনে বাবর ধীরে ধীরে সোনার কারুকাজ করা চামড়া দিয়ে মোড়া দুই দরজাবিশিষ্ট প্রবেশদ্বারের দিকে এগিয়ে যায়। যা সুলতান ইবরাহিমের কামরা থেকে দরবার কক্ষে প্রবেশের একান্ত প্রবেশপথ। যেখানে যুদ্ধে জয়লাভের জন্য আয়োজিত ভূড়িভোজে অংশ নেবার জন্য তার সেনাপতিরা তার জন্য অপেক্ষা করছে। তার লোকেরা ইতিমধ্যে নদীর তীর বরাবর স্থাপিত তাঁবুগুলোতে আর নিচের আঙ্গিনায় উৎসব আরম্ভ করেছে। যুদ্ধে জয়লাভে সাহায্য করেছে এমন একজনও আজ রাতে বঞ্চিত হবে না।

মশালের আলোতে বাবরের পাগড়িতে সংবদ্ধ পান্না থেকে আলো ঠিকরে আসে। তার গলায় আরও মূল্যবান পান্নার সাথে মাঝে মাঝে মুক্তা দেয়া তিনছড়া বিশিষ্ট একটা মালা ঝুলছে এবং তার হাতে অবশ্যই তৈমূরের অঙ্গুরীয় শোভা পায়। তার জরির কারুকাজ করা সবুজ জোব্বাটা একপাশে মুক্তার ছড়া দিয়ে বাঁধা এবং একটা ভারী সোনার চেনের সাথে আটকানো আলমগীর তার কোমরে ঝুলছে। কয়েক মিনিট আগে নিজের ঝকঝকে অবয়বের দিকে সে সন্তুষ্ট চিত্তে তাকিয়ে ছিলো ক্ষমতা আর জৌলুসের মূর্তিমান প্রতিভূ।

তূর্যনাদের সাথে পরিচারকের দল দরজা খুলে দেয় এবং বাবর ভেতরে প্রবেশ করে। সাথে সাথে ভেতরে পিনপতন নিরবতা নেমে আসে। তার চৌকষভাবে সজ্জিত সেনাপতির দল মাটিতে শুয়ে পড়ে প্রথামাফিক আনুগত্য প্রকাশ কুর্নিশে আনত হয়। বাবরের ঠিক সামনে কামরাটার ঠিক মধ্যেখানে একটা স্তরবিশিষ্ট সাদা মার্বেলের বেদী দেখা যায়। একদম উপরের স্তরে সবুজ আর হলুদ চাদোয়ার নিচে রত্নখচিত সোনালী সিংহাসন শোভা পায়। তার সেনাপতিরা মঞ্চের সামনে সারিবদ্ধ অবস্থায় প্রণত হয়ে থাকে। বাবর তাদের মাঝ দিয়ে মাথা উঁচু করে, পিঠ সোজা রেখে, মঞ্চে আরোহন করে এবং নির্ধারিত আসনে উপবিষ্ট হয় এবং হুমায়ূনকে এক স্তর নিচে তার ডান পাশে নীল মখমলের একটা আসনে ইঙ্গিতে বসতে বলে।

“আপনারা এবার উঠে দাঁড়াতে পারেন।” সবার চোখ আবার নিজের উপর অনুভব না করা পর্যন্ত বাবর চুপ করে থাকে। “মহান আল্লাহতালা পানিপথে আমাদের প্রতি বিশেষ মেহেরবান ছিলেন। তিনি আমাদের বিজয়ী করেছেন। কারণ আমাদের যুদ্ধের কারণ ন্যায়সঙ্গত ছিল। হিন্দুস্তানের সিংহাসনে আমাদের জন্মগত অধিকার। সুলতান ইবরাহিম আমাদের বাধা দিতে চেষ্টা করে যুদ্ধে মারা গেছেন। আমরা সবাই আমার সব সেনাপতি, যারা আমাকে আগুন আর পানির মাঝ দিয়ে অনুসরণ করে এসেছেন। সবাই বিজয়ী। আমাদের ইতিহাসের এটা একটা নতুন অধ্যায়। আমার লোকদের নতুন নিয়তি যখন আমরা নিজেদের হিন্দুস্তানের প্রভু প্রতিপন্ন করেছি। কিন্তু এখনও আরও মহান গৌরব আমাদের সামনে হাতছানি দিচ্ছে। কিন্তু আজ রাতে আমরা সবকিছু ভুলে গিয়ে কেবল আমাদের বিজয়ের মধুর স্বাদ উপভোগ করবো…” বাবর উঠে দাঁড়িয়ে এক হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে মাথার উপরে তুলে ধরে এবং চিৎকার করে উঠলে, “আমাদের নতুন সাম্রাজ্যের উদ্দেশ্যে!” তার চারপাশে সম্মতির একটা গমগম আওয়াজ দরবারের দেয়াল ভেদ করে ছড়িয়ে পড়তে চায়।

সুলতান ইবরাহিম বেশ সৌখিন জীবনযাপন করতেন। কিছুক্ষণ পরে বাবর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চারপাশে তাকিয়ে ভাবে। নিখুঁতভাবে খোদাই করা লাল বেলেপাথরের স্তম্ভ, মাঝের ক্ষুদ্র গম্বুজ, লালচে-গোলাপী সিল্কের পর্দায় শোভিত এই কামরাটার মতো চমকপ্রদ কিছু সমরকন্দের বাইরে সে দেখেনি। মঞ্চের দুপাশে ময়ূরের মতো দেখতে দুটো সোনালী রঙের লম্বা ধূপদানি থেকে সুগন্ধি ধোয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে আসছে। ময়ুর দুটোর ছড়ানো পেখমে আবার পান্না আর নীলার কারুকাজ করা। বাবরের ডানপাশে একটা কারুকাজ করা চন্দনকাঠের বেষ্টনী পার্শ্ববর্তী হারেমকে দরবার থেকে পৃথক করেছে।

বাবর আর তার পরিশ্রান্ত বাহিনীর আগ্রায় আগমনের পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত বাতাস বইতে শুরু- সম্ভবত বৃষ্টি শুরু হবার আগে এমনই বাতাস বয়, অথবা এটা তাদের সৌভাগ্য। বাবর ঝুলন্ত রেশমের পর্দা মৃদু ভঙ্গিতে আন্দোলিত হতে দেখে।

তাকে আর তার অতিথিদের পাঙ্খ দ্বারা, কারুকাজ করা রেশমের আয়তাকার টুকরো লম্বা রেশমের দড়ির সাহায্যে ঝুলছে। দড়িটা আবার ছাদে স্থাপিত একসারি লোহার রিঙের ভিতর দিয়ে গিয়ে দেয়ালের উঁচুতে স্থাপিত একটা ফোকর গলে বের হয়ে গিয়েছে। পাঙ্খ ওয়ালারা দেয়ালের ওপাশে যারা অবস্থান করছে, তাদের টানবার জন্য, যাতে খাবার সময়ে কাপড়ের টুকরোটা ধীরে ধীরে আহাররত অতিথিদের মাথার উপরে ধীরে ধীরে আন্দোলিত হয়ে তাদের শীতল রাখতে পারে। বাবরের দেয়াল বরাবর স্থাপিত নিচু টেবিলে ঝলসানো ভেড়ার মাংস, রান্না করা মুরগী এবং চাপাটি স্তূপ করে রাখা। সবই তাদের মাতৃভূমির খাবার। কিন্তু এর সাথে আরো রয়েছে হিন্দুস্তানের ফলমূল: কমলা রঙের আশযুক্ত আম, রসে টইটুম্বর, আর নরম রসালো পেঁপে আর খেজুর।

তার মতো অনেকেই তৈমূর আর চেঙ্গিস খানের বংশধর। সবাই তাকে দারুণ সাহায্য করেছে। ভোজ শুরু হবার আগে, সে সবার মাঝে উপহার বিতরণ করে লাল রেশমের খিলাত, স্যাবেলের চামড়ার তৈরি জ্যাকেট যার সামনের দিকটা নীল রঙের, রত্নখচিত খঞ্জর, তরবারি, কারুকাজ করা সোনার পর্যান। বাবর তাদের চোখেমুখে সন্তুষ্টির ছায়া দেখতে পায়। সে দেখে বাবা ইয়াসাভাল হাতলে পান্না খচিত একটা বাঁকানো তরবারির হাতল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে।

তারা খেতে শুরু করতে বাবর আড়চোখে একবার তার ডানপাশের পর্দার দিকে তাকায়। সাধারণত রাজকীয় ভোজসভার সময়ে রাজপরিবারের মেয়েরা তার পেছনে। অবস্থান করেন। এবং নিজেরা খেতে খেতে জাফরীর ওপাশে কি ঘটছে সেদিকে লক্ষ্য রাখেন। বুয়া কি নিজের কক্ষে বসে তার মৃত সন্তানের কামরা থেকে ভেসে আসা এই আনন্দ উল্লাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে? বাবর কামনা করে যেনো না পায়। তার সাহস আর দুঃখবোধ আর সেই সাথে রক্তের কারণে সে তাকে সম্মান করে। তিনি হুমায়ুনকে যেসব কটুবাক্য বলেছেন সেজন্য তাকে শাস্তি দেবার কোনো মানে। হয় না। বাবর নিহত হলে এবং তার সিংহাসন অন্য কেউ দখল করলে এসান। দৌলতও কি একই আচরণ করতেন না। সে আদেশ দিয়েছে যে বুয়া তার অলংকার এবং পরিচারিকাদের রাখতে পারবে এবং সে তার জন্য একটা ভাতার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। সে আশা করে সময়ের সাথে তার এই উদারতা তাকে প্রশমিত করবে।

সেদিন সকালের দিকে, নদীর তীরে, বাবর সুলতান ইবরাহিমের হাতিশালার দুটো মর্দা হাতির, যাদের নাম যথাক্রমে পর্বতবিদারক আর অনন্ত সাহসী, মাঝে লড়াই উপভোগ করে। বিশেষভাবে নির্মিত মাটির ঢালু পথের উপরে বিশাল রঙ করা জন্তুগুলোর কানের পেছনে বসে থাকা মাহুত তাদের পরস্পরের দিকে ধাবিত হতে উৎসাহিত করলে, তারা শুড় আন্দোলিত করে ঝাঁপিয়ে পড়ে লড়াই ততোক্ষণই চলে। যতোক্ষণ না একটা হাতি পিছুহটে আসে। তার ভিন্ন কিছু উপভোগের সময় আসে বাবর হাততালি দিয়ে ইবরাহিমের প্রাসাদের নিয়মিত দড়াবাজ আর বাঈজিদের আসতে ইঙ্গিত করে।

দু’জন তরুণ, তাদের তেলচকচকে দেহে কেবল কমলা রঙের নেংটি রয়েছে, কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল মাথার উপরে চুড়ো করে বাঁধা বাবরের মঞ্চের সামনে পরিষ্কার করা। স্থানের দিকে দৌড়ে আসে। তারা দুজনে হলুদ রঙের একটা আয়তাকার বাক্স বয়ে আনে। বাক্সটা তিন ফিট লম্বা আঠার ইঞ্চি চওড়া এবং উভয়পাশে রহস্যময় একটা চোখ লাল রঙে আঁকা রয়েছে। তারা বাক্সটা রেখে চলে যায়। বাবরের লোকেরা। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে- বাক্সের ঢাকনিটা যেনো নিজে থেকেই খুলে যেতে শুরু করেছে। ভেতর থেকে একটা ছোট হাত বের হয়ে আসে। তারপরে আরেকটা এবং তারপরে এক ঝটকায় ঢাকনিটা পুরো খুলে গিয়ে ভেতর থেকে একটা ছেলে বের হয়ে আসে যার পা দুটো উল্টো করে কাঁধের উপরে আঁকড়ে রয়েছে। অবিশ্বাস্য একটা ব্যাপার যে কোনো মানুষের পক্ষে হোক না সেটা একটা বাচ্চা ছেলে নিশ্চিতভাবেই তার কোমরের কাছটা দু’ভাজ করা যায়- এত ছোট একটা স্থানে নিজেকে প্রবেশ করানো সম্ভব। নিজেকে বের করে এনে ছেলেটা বাক্স থেকে বের হয়ে দাঁড়ায় এবং অন্য দুই দড়াবাজ এবার তাদের কপালে, হাঁটুতে, হাতে আর পায়ের উপরে বল ঘোরাতে ঘোরাতে ঘরের ভিতরে ডিগবাজি খেতে থাকে। তাদের চিকন পা এতো দ্রুত আন্দোলিত হয় যে ঝাপসা একটা দৃশ্যকল্পের জন্ম হয়।

এরপরে একজন দড়াবাজ লাফিয়ে আরেকজনের কাঁধে উঠে পড়ে এবং ছেলেটা তারপরে আপেল গাছে উঠবার মতো অনায়াসে তাদের দেহ বেয়ে উঠে যায়। উপরের লোকটার মাথায় ভর দিয়ে সে নিজের মাথা পেছনের দিকে হেলিয়ে দিয়ে এবং মুখ থেকে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছুঁড়ে দেয়। বাবরের সেনাপতিরা চেঁচিয়ে নিজেদের সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। চোখের পলকে ছেলেটা আবার মাটিতে নেমে আসে। নিজেকে আবার গুটিয়ে নিয়ে সে বাক্সে ঢুকে পড়ে এবং বিদায় সম্ভাষণ জানাবার ভঙ্গিতে সে নিজেই বাক্সের ঢাকনিটা বন্ধ করে দেয়। বাকি দুজন দড়াবাজ বাবরের সামনে মাথা নত করে সম্মান জানালে সে তাদের দিকে সোনার মোহর ছুঁড়ে দেয়। তারপরে তারা বাক্সটা তুলে নিয়ে তুমুল হাততালির ভিতরে কামরা ত্যাগ করে।

ধিনিক তাতা আওয়াজ আর ছন্দোবদ্ধ পদাঘাতে নিজেদের আগমন ঘোষণা করে। পরিচারকদের প্রবেশের দরজা দিয়ে খালি পায়ে আটজন মেয়ে নাচতে নাচতে কামরায় প্রবেশ করে। আরেকটা প্রবেশ পথ দিয়ে বাদ্যযন্ত্রীর দল প্রবেশ করে। মেয়েরা বাবরের সামনে একটা বৃত্ত তৈরি করে। তাদের ঘন কালো চুল মিষ্টি গন্ধযুক্ত সাদা ফুল দিয়ে বেণী করে বাঁধা। লাল আর বেগুনী রঙের অনেক স্তর বিশিষ্ট ঘাঘড়ার উপরে তাদের উদরের অংশটা নগ্ন। আঁটসাঁটো রেশমের কাচুলি তাদের স্তনের অধিকাংশই ঢেকে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে এবং তাদের কব্জি আর পায়ের গোড়ালীতে ছোট ছোট ঘণ্টা সারিবদ্ধভাবে আটকানো। ঢোলা সাদা পাজামা আর বুক ভোলা সোনালী রঙের আটসাট বান্ডি পরিহিত ছয়জন বাদকের দল তাদের গলা। থেকে ঝোলানো সরু ঢোলে হাত দিয়ে বাড়ি দিতে দিতে তালে তালে দুলতে আর লাফাতে থাকে। বাঈজি মেয়েদের দেহ বাজনার সাথে সাথে আন্দোলিত হতে শুরু করে। শীঘ্রই তারা দ্রুত গতিতে ঘুরতে থাকে, ঘাঘড়া উঠে গিয়ে তাদের সুন্দর সুগঠিত পা উন্মুক্ত করে তুলে, আর হাত হেলান মাথার পিছনে দেয়া। নাচের তালে তালে তারা গান গাইতে থাকে। তাদের সুরেলা কিন্নরী কণ্ঠ ঢেউয়ের মতো উঠতে আর নামতে থাকে।

অন্য বাদ্যযন্ত্রীরা এবার বাদ্যযন্ত্র নিয়ে যোগ দেয়। এসব বাদ্যযন্ত্র বাবর কখনও দেখেনি- বীণার মত দেখতে। কিন্তু মাথার দিকটা এক মিটার লম্বা। বাবর শুনেছে একে তানপুরা বলা হয়। আরেকটা তারের বাদ্যযন্ত্র যার উপরে নিচে দুটো বোল লাগানো এর নাম রুদ্রবীণা। আরেকটা বাঁশির মত যন্ত্র দেখতে অনেকটা ছোটখাট সূর্যের মতো দেখতে, একে বলে সানাই। বাবর অনুভব করে সাবলীল, তরুণী নাচিয়ে, ছন্দোবদ্ধ ঢোলের আওয়াজ, সুরেলা তন্ত্রীর মূচ্ছনা, আর সুরেলা কণ্ঠের উত্থানপতন সব মিলিয়ে পুরো নাচটার আবেদন তার নান্দনিকতার মতো কোনো কিছু তার মাতৃভূমিতে সে দেখেনি।

বেশ কিছুক্ষণ পরে বাবর বুঝতে পারে যে তার লোকদের রক্তে কাঁপন ধরিয়েছে বাঈজির দল, তারা এবার নাচতে শুরু করেছে। কেউ কেউ তাদের ছেড়ে আসা পাহাড় আর তৃণভূমির গান হেড়ে গলায় গাইতে শুরু করে। বাকিরা উঠে দাঁড়িয়ে হাত হাত আঁকড়ে বুনো উদ্দাম নাচ শুরু করে পা দিয়ে তাল ঠুকে উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠে বিজয় আর আনন্দের মুহূর্ত উদযাপদ করতে থাকে। হুমায়ুন অনেকক্ষণ উসখুস করে শেষে সেও গিয়ে তাদের সাথে যোগ দেয়।

বাবর এসব এসব কিছু দেখে না। সে নিজের ভাবনার রাজ্যে হারিয়ে গিয়েছে। সে বিজয়ের চেয়েও বড় কিছু একটা উদযাপন করছে। আজ রাতে তার জীবনের একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। যখন সে এতোদিন যা কিছু শিখেছে, যা কিছু অর্জন করেছে। সবকিছুকে একটা চূড়ান্ত রূপ দান করছে। কিন্তু উল্লাসের মাঝে একটা বিষাদের সুর ধ্বনিত হয়। এই ভোজসভায় আরেকজনেরও উপস্থিত থাকবার কথা ছিলো। সবকিছু উপভোগ করার কথা ছিলো তার সত্যিকারের বন্ধু এবং সবচেয়ে অভিজ্ঞ সেনাপতি। বাবর তার হাতের পানপাত্রটা তুলে নিয়ে সেই অনুপস্থিত বন্ধুর স্মরণে নিরবে একচুমুক পান করে।

৪.৫ প্রতিহিংসাপরায়ণ বুয়া

২৪. প্রতিহিংসাপরায়ণ বুয়া

শুক্রবারের এক সন্ধ্যাবেলা আগ্রা দূর্গের প্রকারবেষ্টিত পর্যবেক্ষণ বুরুজের বেষ্টনীর ভিতর থেকে দাঁড়িয়ে বাবর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আকাশের গায়ে গাঢ় ধূসর, প্রায় বেগুনী মেঘের রাশি অবিরল ধারায় বৃষ্টি ধারা ঝরে পড়ছে। আঙ্গিনার শানবাঁধানো পাথরের উপরে বৃষ্টির ফোঁটা ছিটকে উঠে এবং বেলেপাথরের দেয়ালে কাটা গর্তের ভেতর দিয়ে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পড়ছে। দূর্গের উত্তর আর পূর্বদিকের দেয়ালের ফোকড় গলে নীচ দিয়ে পূর্ণবেগে প্রবাহিত যমুনা নদীতে ঝর্ণাধারার মতো আছড়ে পড়ছে। দক্ষিণ আর পশ্চিম দিকে পানি জমে ইতিমধ্যে বিলে পরিণত হওয়া কুচকাওয়াজ ময়দানে নৃত্যরত ভঙ্গিতে গিয়ে জমা হচ্ছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুচ্চমক নিচু হয়ে আসা, ধোঁয়াটে দিগন্তের বুকে আঁচড় কেটে দেয়। সাথে সাথে দূর থেকে বজ্রপাতের গুরুগম্ভীর ধ্বনি ভেসে আসে।

বাবর তাকিয়ে থাকার মাঝে টের পায় বাতাসে কেমন উষ্ণ আর আর্দ্রতার আতিশয্য। মধ্য এশিয়ায় বছরের এই সময়ে গ্রীষ্মকালে সূর্যের দাবদাহে অতিষ্ঠ হয়ে গরমের থেকে ভীষণ আলাদা। এখানে হিন্দুস্তানে বৃষ্টির কাল স্থানীয়রা যাকে মৌসুম বলে, ইতিমধ্যে তিন মাস স্থায়ী হয়েছে। সবকিছু স্যাঁতাসেতে করে তুলেছে। সুযোগ পেলে কাপড়চোপড় আর আসবাবপত্রও ক্ষয়কর ছত্রাকের প্রকোপ থেকে রেহাই পায় না। তাকে তার অমূল্য রোজনামচাও আগুনে শুকিয়ে নিতে হয় আর্দ্রতার হাত থেকে বাঁচবার জন্য। ধাতব আস্তরণ দেয়া সিন্দুকের ভেতরেও সেগুলো আর্দ্রতার প্রকোপ থেকে রেহাই পায় নাই।

যাই হোক, সে ভাবে, কিছুক্ষণের ভিতরেই নিজের কামরায় সে হুমায়ূনের সাথে আহারে বসবে। এটা অন্তত একটা সুসংবাদ- সে এই মুহূর্তে বেশি লোকের সঙ্গ পছন্দ করছে না। সে তার প্রধান রাঁধুনীকে নিজের প্রিয় পদ রান্না করতে বলেছে: কচি খরগোসের মাংস, অল্প আঁচে দারুচিনি, এলাচ আর কিশমিস দিয়ে রান্না করে পরিবেশনের আগে টকদই মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। সুলতান ইবরাহিমের হেশেল থেকে যে চারজন রাঁধুনিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সে তাদের বলেছে তার নতুন সাম্রাজ্যের স্বাদ উপস্থাপনকারী গুরুপাক মশলাযুক্ত, রসুন দেয়া পদ রান্না করতে। সে দ্রুত তাদের এই রান্নার ভক্ত হয়ে উঠছে। মুখরোচক খাবারের চিন্তা তার ক্রমাগত মাথাব্যাথা অনেকটাই দূর করে, যা এই বর্ষাকালে তাকে বেশ ভোগাচ্ছে। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে বুরুজ থেকে নেমে নিজের কামড়ার দিকে হাঁটা দেয়।

হুমায়ুন ইতিমধ্যে ফিরোজা রঙের চাদরে ঢাকা আর রূপার খাবার পাত্র সজ্জিত বিশাল নিচু টেবিলের সামনে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে আছে। টেবিলের মধ্যেখানে একটা বিরাট বারকোশের উপরে মাখন দিয়ে রান্না করা পোলাও। যাতে নানা পদের বাদাম দেয়া হয়েছে। বাবর কামরার ভেতরে প্রবেশ করতে হুমায়ূন উঠে দাঁড়িয়ে তাকে আলিঙ্গন করে। বাবরের চেয়ে সামান্য লম্বা, সে ইতিমধ্যেই চওড়া আর পেশল দেহের অধিকারী হয়ে উঠেছে হিন্দুস্তান অভিযান তাকে পরিণত করে তুলেছে। বাবর মৃদু হেসে তাকে বসতে ইঙ্গিত করে। তারপরে হাততালি দিয়ে আপাদমস্তক সাদা পোশাক পরিহিত দুই পরিচারককে সে বাকি খাবার পরিবেশনের অনুমতি দেয়। নিমেষের ভিতরে তারা আরো চারজনকে নিয়ে ফিরে আসে, সবার হাতে কাপড়ে আবৃত বিশালাকৃতি ধাতব পাত্র। কাপড় সরিয়ে নিতে ঘরের ভেতরটা সুস্বাদু মশলার গন্ধে ভরে উঠে।

“সুলতান এগুলো ইবরাহিমের রাঁধুনিদের রান্না করা গুড়ো ধনে আর বাটা সর্ষে, আদা, দারুচিনি আর এলাচের ঘন মিশ্রণে মাখা মাখা করে রান্না করা মুরগীর মাংস। হলুদ, পেঁয়াজ আর ডাল দিয়ে রান্না করা খাসির মাংস। তারপরে শাক দিয়ে রান্না করা মুরগীর আরেকটা পদ- আদা আর জায়ফল দিয়ে একটা পাত্রে আবদ্ধ করে আগুনের মাঝে সেটা পুঁতে রাখার কারণে কেমন ধোয়াটে একটা গন্ধ তৈরি হয়েছে। তারপরে রয়েছে বেগুন আর ওকরার ঝোল- প্রতিটা পদের স্বাদ অপূর্ব।

“সবগুলো পদই সুস্বাদু এবং মুখরোচক। কিন্তু আমার খরগোসের মাংস কোথায়?”

“আপনার পরিবেশনকারী সেটা নিয়ে আসছে।” পরিচারকের কথা শেষ হবার আগেই- লম্বা, মাথা ভর্তি ধুসর চুলের-এক পরিবেশনকারী একটা পাত্র বাবরের সামনে নিয়ে এসে সেটার উপর থেকে কাপড় সরিয়ে নেয়।

“আহমেদ, বরাবরের মতোই হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।”

“ধন্যবাদ, সুলতান।”

“আমার ছেলে হিন্দুস্তানী পদগুলো চেখে দেখুক, যাতে সে পরবর্তীতে আমাকে বলতে পারে কোনটা খেতে ভালো হয়েছে। কিন্তু আগে আমাকে আমার খরগোসের মাংস দাও।”

দু’জনে নিরবে খেতে শুরু করে। “আমাকে এবার বলো গুজরাটের সুলতানের কাছে দূত পাঠাবার জন্য কি বন্দোবস্ত করলে।” মুখ ভর্তি খরগোসের মাংস নিয়ে বাবর জানতে চায়।

“আমি বৃষ্টি থামবার সাথে সাথে যাতে তারা রওয়ানা দিতে পারে সেজন্য তাদের প্রস্তুত থাকতে বলেছি। আমাকে জানান হয়েছে অক্টোবরের আগে যাত্রা করা অসম্ভব। তখন হলে কি কোনো অসুবিধা হবে?”

“আমি দুঃখিত- তোমার শেষ কথাগুলো শুনতে পাইনি। আমার পেটের ভেতরটা আচমকা মোচড় দিয়ে ওঠাতে আমার মন গুজরাট থেকে একেবারে সরে গিয়েছিল।”

“আব্বাজান- আমি কি সুস্থ বোধ করছেন?”

বাবর মোটেই সুস্থ বোধ করছে না। তার সারা মুখ শীতল আর চটচটে ঘামে তার মুখটা ভিজে উঠেছে এবং তার পেটের ভেতরে গনগনে উত্তপ্ত একটা হাত যেনো আবার নাড়ীভুড়ি সব ধরে মুচড়ে দেয়। সে ব্যাথায় কুঁকড়ে যায় এবং হুমায়ুন আর এক পরিচারককে ইশারা করে তাকে তুলে দাঁড় করাতে বলে। তারা তাকে দাঁড় করাবার চেষ্টা করার সময়ে আরেকটা মোচড় তাকে কাঁপিয়ে দেয় এবং সে মুখে বমির টকটক স্বাদ অনুভব করে। সে বমিটা গিলে ফেলতে চেষ্টা করে তারপরে আবার তার অন্ননালী গুলিয়ে উঠতে সে আবার ঢোক গিলে। খাবার টেবিল থেকে তিনপাও এগিয়ে যেতে পারেনি সে পাকস্থলী মুচড়ে বমি করে। সদ্য খাওয়া খরগোসের মাংস, সাথে লাল ওয়াইন আর আগে খাওয়া মিষ্টান্ন গোলাপী আর বেগুনী রঙের গলিচায় ছিটকে পড়ে।

বাবর আরেকটা মোচড়ের সাথে সাথে আবারও ভেতরের সবকিছু উগড়ে দেয়। বমির সাথে এবার রক্ত আর শ্লেষ্ম এবং পাঁচকরস উঠে আসে। যন্ত্রণায় সে পেট চেপে ধরে। “আমাকে মার্জনা করবে। আমি বুঝতে পারছি না কি হলো। আমি কখনও এভাবে অসুস্থ হইনি- অত্যাধিক মদ্যপানও আমাকে অসুস্থ করতে পারেনি। আমাকে ঐ বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দাও।”

হুমায়ুন আর পরিচারক বাবরকে ধরে নিয়ে গিয়ে মাথার নিচে তাকিয়া দিয়ে শুইয়ে দেয় এবং হুমায়ূন হেকিম ডেকে পাঠায়। “আব্বাজান, পানিটা পান করেন।” বাবর সুবোধ বালকের মতো হুমায়ূনের হাতে ধরা পাত্র থেকে চুমুক দেয় কিন্তু পানি তার পাকস্থলীতে পৌঁছানো মাত্র আবার খিচুনী শুরু হয় এবং পিচকারীর মতো বাবর বমি করে।

“আমাকে শৌচাগারে নিয়ে চলো- আমার পেট যে কোনো মুহূর্তে জানান দেবে।” বাবর উঠে বসতে চেষ্টা করে। হুমায়ুন তার বাবাকে আধা পাঁজাকোলে করে, আধা ধরে শৌচাগারে নিয়ে যায়। যেখানে সে তার পেটের ভেতরের সব কিছু প্রচণ্ড শব্দে, দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী তরল হিসাবে নির্গত করে। পাঁচটা কষ্টকর মিনিটের পরে বাবর শৌচাগার থেকে বের হয়ে আসে। আগের চেয়ে সামান্য সুস্থির হয়ে দাঁড়াতে পারে। এখন কিন্তু মুখ এখনও ফ্যাকাশে হয়ে আছে, আর ঘামে ভেজা। “হুমায়ূন- ওদের বলো বমি যেনো পরিষ্কার না করে আমার ধারণা আমাকে বিষ দেয়া হয়েছে গালিচা থেকে বমি তুলে সেটা একটা কুকুরকে খেতে দাও। খরগোসের মাংস আরেকটা কুকুরকে খেতে দাও। রাধুনীদের, স্বাদপরখকারী আর অন্য পরিচারকদের পাহারায় রাখো। আমাকে এবার শুতে হবে। ভীষণ ক্লান্তবোধ করছি।”

*

পরের দিন সকালবেলা, হুমায়ূন তার বাবার শয্যাপাশে বসে আছে। বাবরের চেহারা তখনও ফ্যাকাশে এবং চোখের নিচে একদিনেই কালো দাগ পড়েছে। কিন্তু তাকে গতদিনের চেয়ে কিছুটা ভাল দেখায়।

“তিনি বমি না করে আজ কিছু তরল পান করতে পেরেছেন।” খয়েরী আলখাল্লা পরিহিত আবদুল মালিক কাবুল থেকে বাবরের সাথে আগত শক্তপোক্ত চেহারার, ধূসর চোখের হেকিম বলেন বাবরের পুরো পরিবারের বহুবছর যাবত সে চিকিৎসা করে আসছে।

“ আব্বাজান, আমরা আপনার কথামতো কাজ করেছি। বমিটা একটা কুকুরকে খেতে দিয়েছিলোম। আর খরগোসের মাংস আরেকটা কুকুরকে এবং সারারাত তাদের উপরে নজর রেখেছিলাম। প্রথম কুকুরটা অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং ভয়ঙ্কর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়- ঠিক আপনার মতো- তারপরে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠে। দ্বিতীয়টা নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকে এবং করুণ স্বরে ডাকতে থাকে, বেচারার পেট ফুলে উঠে। আমরা পাথর ছুঁড়ে তাকে মারলেও তাকে নড়াতে পারিনি বা একটা ডাকও তার গলা দিয়ে বের করতে পারিনি। তারপরে ঘণ্টাখানেক আগে-এই কুকুরটাও বমি করে এবং এখন ধীরে ধীরে চলেফিরে বেড়াচ্ছে। বিজ্ঞ হেকিমের দল সারারাত নিধুম কাটিয়েছে তাদের বইপুস্তক নিয়ে। তারা একমত হয়েছে যে, আপনার সাথে এই কুকুর দুটোর উপসর্গ নিঃসন্দেহে বিষ প্রয়োগের ফলাফল।

“আমিও তাই ভেবেছিলাম।”

“কিন্তু আপনাকে কিভাবে বিষ প্রয়োগ করা সম্ভব? আপনার নিজস্ব খাদ্য পরীক্ষাকারী রয়েছে আর রাঁধুনিদের উপরে সবসময়ে নজর রাখা হয়…”

“টাকা খুব দ্রুত আনুগত্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। আমাদের খুঁজে বের করতে হবে এর পেছনে কারা রয়েছে। আর তাদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে- এতো কঠোর আর নির্মম শাস্তি দিতে হবে যাতে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর না ঘটে। প্রথমে রাঁধুনি তারপরে খাদ্যপরীক্ষাকারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করো। কেউ বিন্দুমাত্র আমতা আমতা করলে তাকে নিপীড়ন করো। প্রথমে আহমেদকে জিজ্ঞেস করো, সে কাকে সন্দেহ করে। তাদের দিয়ে প্রথমে শুরু করো। আর তোমার প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত থামবে না। আমি অনেক কষ্ট সহ্য করেছি। এবার তাদের পালা।”

দু’ঘণ্টা পরে হুমায়ূন গম্ভীর মুখে ফিরে আসে। “আপনার কথাই ঠিক… আপনাকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিলো… অপরাধীরা দোষ স্বীকার করেছে এবং তাদের মূলহোতার নাম বলেছে।”

“বলো আমাকে।”

“আহমেদ বলেছিলো আমাদের প্রথমে হিন্দুস্তানী রাঁধুনিদের একজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত- ছোটখাট দেখতে এক লোক। ইবরাহিমের অধীনে দশ বছর ধরে রাঁধুনির কাজ করছে এবং আগামী কয়েকদিনের ভিতরে তার নিজের আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করতে যাওয়ার কথা ছিলো। লোহার গনগনে লাল শিক দেখে তাকে আর কিছু বলতে হয়নি। সে গড়গড় করে যা জানে সব বলে দিয়েছে। রোসান্নারা, ইবরাহিমের মা বুয়ার এক বৃদ্ধ পরিচারিকা। তার সাথে দেখা করেছিলো। সে তাকে বলে যে বুয়া বর্বরদের’, তিনি আমাদের এই নামেই সম্বোধন করে থাকেন। একটা শিক্ষা দিতে চান। তার ছেলের মৃত্যুর জন্য- রাঁধুনির পুরাতন প্রভু। আপনাকে বিষপ্রয়োগ করাটা একটা গর্বের আর অর্থকরী কাজ বলে বিবেচিত হবে এবং সে তাকে দুটো স্বর্ণ মুদ্রা দেয়। সে মোহর দুটো নেয় এবং বৃদ্ধা তখন তাকে একটা কাগজের পুটলিতে মোড়ানো বিষ দেয়।

“এই লোকটা ভীষণ চতুর। সে সময় ক্ষেপণ করে এবং আপনার একজন খাদ্যপরীক্ষাকারীকে হাত করে-আমাদের লোক যে নিজের দেশে ফিরে যাবার জন্য এত ব্যাকুল হয়ে ছিলো যে, সে তাকে সহজের ঘুষ দিয়ে হাত করে। যাতে সে আপনার খরগোসের মাংস পরীক্ষা না করে…ব্লাঁধুনী ধূর্ততার সাথে হিন্দুস্তানী পদে বিষ মেশায়নি, যাতে সন্দেহ এড়াতে পারে। তারপরে একেবারে শেষ সময়ে খরগোসের মাংসে বিষ মেশাবার সময়ে সে বাধাগ্রস্থ হয়েছিলো। সে কেবল উপরিভাগে বিষ ছড়াতে পারে এবং আগুনে ফেলে দেয়।

“আমরা খাদ্য পরীক্ষাকারী আর বৃদ্ধাকে প্রশ্ন করেছি। পরীক্ষাকারী অচিরেই করুণা ভিক্ষা চাইতে থাকে। কিন্তু বৃদ্ধা অনেক কঠিন চিড়িয়া। কিন্তু গরম লোহার শিক তাকে অচিরেই বশ মানায় যে, সে নিজের ভূমিকা স্বীকার করে। কিন্তু তাকে কে আদেশ দিয়েছিলো তার নাম জানবার জন্য তাকে আমাদের শেষপর্যন্ত পানিতে চোবাতে হয়েছে।”

“তুমি দারুণ কাজ করেছে।”

“আমরা এই বিশ্বাসঘাতকদের নিয়ে কি করবো?”

“তাদের জনসম্মুখে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।”

“বুয়াকেও?”

“না, সে শাহী পরিবারের সদস্য। তাকে আপাতত একটা পর্যবেক্ষণ বুরুজে আটকে রাখো। যেখান থেকে সে প্রাণদণ্ড কার্যকর করা চাক্ষুষ করতে পারে।”

“অন্যদের মৃত্যুদণ্ড কিভাবে কার্যকর করা হবে?”

“রাধুনীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিন্ন করো। খাদ্যপরীক্ষাকারী, বিশ্বাস ভঙ্গের কারণে তার অপরাধ সবচেয়ে বেশি। আর সর্বোপরি সে আমাদের নিজেদের লোক। চাবকে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে। এবং বৃদ্ধাকে হাতির পায়ের নিচে পিষে হিন্দুস্তানী রীতিতে প্রাণদণ্ড কার্যকর করবে। মৃত্যুদণ্ডাদেশ দুপুরবেলা কার্যকর করবে- আর দেখো হেঁশেলের রাঁধুনিরাসহ বেশ ভালো লোক যেনো জমায়েত হয় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা দেখতে। তোমাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। আমি এখনও ভীষণ দুর্বল।”

*

বৃষ্টি বন্ধ হয়েছে কিন্তু আকাশে তখনও মেঘ রয়েছে। হুমায়ূন যখন কুচকাওয়াজ ময়দানের কাদার ভিতরে লাল শামিয়ানার নিচে তড়িঘড়ি করে তৈরি করা মঞ্চে আসন গ্রহণ করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা পর্যবেক্ষণ করতে। রাধুনীর মৃত্যুদণ্ড দ্রুত কার্যকর করা হয় এবং তার কর্তিত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে যাওয়া হয় দূর্গের তোরণে প্রদর্শন করার জন্য। চাবুকের আঘাতে খাদ্যপরীক্ষাকারীর- মাটিতে হাতপা টানটান করে বাধা অবস্থায় শায়িত উচ্চকণ্ঠের আর্তনাদ প্রায় পাশবিক শোনায়। অনেকক্ষণ ধরে সে চিৎকার করতে থাকে। কিন্তু একটা সময়ে সে নিরব হয়ে পড়লে তার মৃতদেহ পায়ের গোড়ালী ধরে কাদার উপর দিয়ে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় দূর্গপ্রাকারে সেটা প্রদর্শিত করা হবে বলে। এবার রোশন্নারার পালা।

দূর্গের বুরুজের নিচে অবস্থিত একটা ছোট প্রবেশপথ দিয়ে চারজন প্রহরী তাকে বের করে নিয়ে আসে। তার পরনে একটা সাদা সুতির আলখাল্লা। তার সাদা চুল আর শান্ত অভিব্যক্তির জন্য তাকে দয়ালু দাদীমার মতো সম্ভবত সে আসলেও তাই- দেখায়। সমবেত জনগণের গঞ্ছনা উপেক্ষা করে সে মাথা উঁচু রেখে ধীর পায়ে হুমায়ূনের দশ গজ সামনে স্থাপিত সামান্য উঁচু পাথরের মঞ্চের দিকে এগিয়ে যায়। প্রহরীদের কেউ তাকে স্পর্শ করার আগেই পাথরের উপরে পিঠ দিয়ে শুয়ে পড়ে। প্রহরীর দল এবার পাথরে স্থাপিত চারটা লোহার আংটার সাথে তার চার হাতপা বাঁধে, আংটাগুলোর কাজই এটা। বিষাণের ধ্বনির সাথে সাথে লাল রঙে রঞ্জিত কুচকাওয়াজ মাঠের বিপরীত দিকে অবস্থিত হাতিশালা থেকে হেলেদুলে বের হয়ে আসে ভীড়ের মাঝে। প্রহরীরা তার জন্য রাস্তা পরিস্কার করে দেয়।

হাতিটা একটা বিশাল মর্দা- প্রাণদণ্ড কার্যকর করার জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত। ইবরাহিমের আমলে এমন শাস্তির বিধান একটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিলো। মাহুতের একটা সংকেতে, সে এখনও কানের পেছনেই বসে রয়েছে। হাতিটা তার বিশাল ডান পা তুলে সেটা বৃদ্ধার শরীরে উপরে রাখে। সে কোনো শব্দও করে না। তারপরে আরেকটা সংকেতের সাথে হাতিটা সুবোধ ভঙ্গিতে রোসান্নার উপরে পুরো পায়ের ভর চাপিয়ে দেয়। হুমায়ূন কোনো আর্তনাদ শুনতে পায় না। কেবল পায়ের চাপে একটা ভোতা শব্দ- সাথে রোসান্নার পেট ফেটে গিয়ে নাড়িভুড়ি বের হয়ে আসতে এবং পাজরের হাড় আর মেরুদণ্ড ভাঙার একটা মড়মড় শব্দ শোনা যায়। তারপরে সে প্রাণহীন আর অসাড় ভঙ্গিতে পড়ে থাকলে তার পরনের সাদা কাপড় রক্ত আর বিষ্ঠায় মেখে গেলে মাহুতের আদেশে হাতিটা ঘুরে দাঁড়িয়ে হতবাক লোকদের মাঝ দিয়ে আবার হাতিশালায় ফিরে চলে। সে বেশ ধীরেসুস্থে দেহের উপর থেকে রক্তাক্ত পা তুলে নেয়।

হাতিশালার দিকে পাঁচ পা ফিরে যাবার আগেই হুমায়ূন তার পেছনে দূর্গপ্রাকারে একটা গোলমালের আওয়াজ শুনতে পায়। সে ঘাড় ঘুরিয়ে তার উপর দিয়ে এক বৃদ্ধাকে চিৎকার করতে করতে দৌড়াতে দেখে, পরনের কালো কাপড় বাতাসে উড়ছে: “আমার প্রিয় ইবরাহিম, প্রিয় রোসান্নারা তোমরা শান্তিতে বেহেশতে বিশ্রাম নাও। বাবর আর তার সন্তানদের অভিশাপ দিয়ে আমিও তোমাদের সাথে মিলিত হতে আসছি। হিন্দুস্তান তার বশ কখনও হবে না। তার ছেলেরা একে অন্যের সাথে লড়াই করে ধ্বংস হবে। তারা সবাই ধূলোয় বিলীন হয়ে যাবে।”

বুয়া, হুমায়ূন বুঝতে পারে। সে তাকিয়ে দেখে, ধাওয়াকারী প্রহরীদের ফাঁকি দিয়ে সে ছাদের কিনারায় পৌঁছে এবং নিচের প্রমত্তা যমুনার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং পানির স্রোতে কালো চুলের জটলায় পেঁচিয়ে গিয়ে ভেসে যায়। পানিতে পুরোপুরি ডুবে যাবার আগে ঠিক তার মাথার উপরে বজ্রপাতের শব্দ শোনা যায়। বহু প্রতিক্ষিত ঝড় অবশেষে শুরু হয়েছে। মুষলধারে বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। কুচকাওয়াজ ময়দানের জমাট কাদার উপরে আছড়ে পড়তে থাকলে হুমায়ূন দ্রুত দূর্গের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।

সেই রাতে বুয়ার দূর্গের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ার দৃশ্য হুমায়ূনের স্বপ্নে বাবরের কাছে শোনা তার দাদাজানের আকশির দূর্গের দেয়ালের উপর থেকে কবুতরের চবুতরা নিয়ে নিচের গিরিকরে আছড়ে পড়ার দৃশ্যের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

*

“আমি এখন অনেকটা সুস্থ,” তিনদিন পরে বাবর হুমায়ূনকে বলে। “দুধের সাথে মিশিয়ে যে আফিম আমাকে আবদুল মালিক খেতে দিয়েছিলো পেটের ব্যাথা সেটা অনেকটাই প্রশমিত করেছে। এই প্রথমবারেরমতো আমার মনে হয়েছিলো যেনো মরতে বসেছি…অনেকবার এমন হয়েছিলো যে, আমি অনায়াসে মারা যেতে পারি এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে সে সব পরে কখনও আমার ভাবনায় আলোড়ন তুলেনি। এইবার আমি কৃতজ্ঞ যে এখন প্রাণে বেঁচে আছি। ছোটখাট ব্যাপারও আমাকে আনন্দিত করছে- গবাক্ষ দিয়ে দেখতে পাওয়া ফুলের সৌন্দর্য, পাখির কলতান, সবকিছু। আমি আমার রোজনামচায় আমার ভাবনার কথা লিখে রাখছিলাম- শোনো…

“আল্লাহতালা যতদিন আমার হায়াত রেখেছেন প্রতিটা দিনের জন্য আমি তার কাছে শুকরিয়া জানাই। জীবন এত মধুর আমি আগে এটা বুঝতে পারিনি। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েই কেবল একজন জীবনের স্বাদ অনুভব করতে পারে। আমাকে আর আমার সন্তানদের দীর্ঘ জীবন দান করার জন্য আমি আল্লাহতালার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই।”

৪.৬ জিহাদ

২৫. জিহাদ

কেন্দ্রে অবস্থিত একটা পানির হাউজে পানির নালাগুলো এসে মিলিত হবে, যেখানে ঝর্ণা আর পদ্মফুল থাকবে। আমি বাগানে আপেল, নাশপাতি গাছ লাগাই, যা আমাকে মাতৃভূমির কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। মালীরা আমাকে বলে যে, এসব গাছ বাঁচাতে হলে প্রতিদিন পানি দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আর এখানে মজুর প্রচুর পাওয়া যায় আর সহজলভ্যও বটে।

বাবর আর হুমায়ূন যমুনার উত্তর তীরে দাঁড়িয়ে যেখানে আগ্রা দূর্গ থেকে মাইলখানেক ভাটিতে নদীটার খয়েরী পানি সহসা ডানদিকে একটা তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়েছে। বাবর হুমায়ূনকে আগ্রায় তার আরম্ভ করা প্রথম বাগিচার অগ্রগতি দেখায়। “আর কি কি আপনি তৈরি করার পরিকল্পনা করেছেন?”

“সুগন্ধ ছড়াবে এমন অসংখ্য সুগন্ধি গাছপালা লাগাবো আমি- যাতে সন্ধ্যাবেলা উদ্যানে সময় কাটাবার আমার প্রিয় সময়ে জায়গাটা সুরভিতে ভরে থাকে। প্রধান মালী আমাকে বলেছে অনেক গাছ আছে যার ভিতরে রাতের বেলা ফোটো সাদা রঙের চম্পা আমার উদ্দেশ্যের পক্ষে বিশেষ উপযোগী। লোকটা কাজ বোঝে। আর আমি কি চাই সেটা চটপট ধরতে পারে। যদিও সে এক সময়ে সুলতান ইবরাহিমের প্রধান মালীর কাজ করেছে।” বাবর দম নিতে থামে। “আমার একটাই আশা আমাদের সীমান্তের ভিতরে আর বাইরে বসবাসকারী লোকেরা দ্রুত আমাদের হিন্দুস্তানের নতুন প্রভু হিসাবে স্বীকার করে নিক। সুলতান ইবরাহিমের সাথে যাদের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিলো তাদের বৈরীতার কারণ –যদিও আমি সেটা বরদাশত করতে মোটেই প্রস্তুত নই আমি বুঝি। তার মা যা করেছে সেজন্য আমি তাকে দোষ দেই না- আমার ধারণা সেটা তিনি এক ধরণের আনুগত্য থেকেই করেছিলেন। আমি এই মুহূর্তে পারস্যের শাহ’কে নিয়েও খুব একটা চিন্তিত নই। যদিও আফগানিস্তানে আমাদের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে তিনি সবসময়েই একটা ঘোঁট পাকাতে চেষ্টা করছেন, কোয়েটা আর কান্দাহারে নিজের সমর্থকের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে। আমাদের কাছে কৃপণ ইবরাহিমের উপচে পড়া রাজকোষে সঞ্চিত অর্থের জন্য এখন শাহের চেয়ে বেশি উৎকোচ দেবার ক্ষমতা রয়েছে অন্তত এখনকার মতো।”

“তাহলে আপনি কাদের নিয়ে বেশি চিন্তিত?”

“আগ্রার পশ্চিমে বসবাসকারী রাজপুতদের নিয়ে। পাহাড়ে অবস্থিত দূর্গ আর শক্তিশালী ঘাঁটি থেকে তারা ইবরাহিমের সাথে একধরণের সশস্ত্র নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছিলো। এমনকি মাঝে মাঝে তার অন্যসব অভিযানে তারা তাকে অর্থের বিনিময়ে সৈন্যও সরবরাহ করেছে। তারা ভীষণ, ভীষণ সাহসী সৈন্য- যোদ্ধার জাত যারা কখনও পরাভব স্বীকার না করা। আর যুদ্ধক্ষেত্রে পিছু না হটার বীরোচিত সাম্মানিক স্মারকে বিশ্বাস করে।”

বাবর আবার চুপ করে। “রাজপুত রাজ্যগুলোর ভিতরে সবচেয়ে সমৃদ্ধ আর শক্তিশালী উদয়পুরের শাসক রানা শঙ্ক গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তার ঔদ্ধত্যের খবর নিয়মিত আমার কাছে আসছে যে, সে আমাদের মত উঁইফোড় হামলাকারীদের হাত থেকে হিন্দুস্তানকে মুক্ত করে, তিনশ বছরের ভিতরে প্রথমবারের মতো একজন সত্যিকারের হিন্দুকে- সেটা অবশ্যই সে নিজেকে বুঝিয়েছে- এর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করবে।”

“বাকী রাজপুত রাজ্যগুলো কি তাকে এ ব্যাপারে সমর্থন করবে?”

“সম্ভবত না। তারা স্বাধীনচেতা, একই সাথে ঈর্ষাপরায়ণ মানুষ। নিজেদের সম্মানের ব্যাপারে যেমন খুঁতখুঁতে, তেমনি পরস্পরের ব্যাপারে সন্দেহপ্রবণ। আর আফগান সর্দারদের মতো যেকোনো ছুতোয় যুদ্ধ শুরু করতে ওস্তাদ। অন্য রাজপুত শাসকরা তাকে আরও শক্তিশালী দেখতে পছন্দ করবে না।”

“সে নিজে তাহলে কতটা ঝামেলা করতে সক্ষম?”

“প্রচুর। তার অধীনে একটা বিশাল আর সুদক্ষ সেনাবাহিনী রয়েছে। যদিও তার বয়স হয়েছে। কিন্তু এখনও সে ভালো কৌশলজ্ঞ আর দক্ষ যোদ্ধা, যে সবসময়ে নিজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পছন্দ করে। সে যতোবার যুদ্ধে আহত হয়, আর দেহের কোনো অংশ হারায়, সেটাকে সে পূণ্যের বিষয় হিসাবে বিবেচিত করে। আমি শুনেছি তার সভাকবি তার হয়ে বীরগাথা লিখেছে যে সে মানুষের একটা খণ্ডিতাংশ মাত্র, কিন্তু খণ্ডিতাংশই বটে। ভাইয়ের সাথে যুদ্ধে তার এক চোখ নষ্ট হয়েছে। সুলতান ইবরাহিমের সাথে যুদ্ধে সে এক হাত হারিয়েছে। এবং পায়ে ভয়াবহ ক্ষত হবার কারণে এখন খুঁড়িয়ে হাঁটে। তার হাড্ডিসার দেহের অবশিষ্টাংশে আশিটা ক্ষতচিহ্ন রয়েছে এবং তার সভাকবি লিখেছে যে প্রতিটা ক্ষতচিহ্নের জন্য বুড়ো পাঠাটা একজন করে পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছে।”

“আমিও সেটা শুনেছি। তার নিশ্চয়ই অসংখ্য স্ত্রী আছে- আর দৃশ্যত তার দেহের একটা অংশ এখনও অক্ষত রয়েছে। তাকে মোকাবেলা না করে কতোদিন আমরা তাকে এভাবে বড়াই করতে দেবো?”

“এই প্রশ্নটার উত্তরই আমি মনে মনে খোঁজার চেষ্টা করছি। মাত্র নয় মাস হয়েছে। আমরা ইবরাহিমকে পরাজিত করেছি। আমাদের বিজয় এখনও সুরক্ষিত হয়নি এবং হিন্দুস্তানে আমাদের সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ এখনও একটা দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে। আমি চাই তুমি, তোমার অন্য ভাইয়েরা আর তোমাদের সন্তানেরা যেনো এই উদ্যানের শোভা উপভোগ করতে পারো। আজ সকালেই আমি জানতে পেরেছি বিদ্রোহী তাড়া করবার ছলে রানা শঙ্ক আমাদের সীমান্তের অভ্যন্তরে আরেকদফা অনুপ্রবেশ করেছে। যদিও এক সপ্তাহের ভিতরেই সে নিজ রাজ্যে ফিরে গিয়েছে। কিন্তু এইবার সে আগেরবারের চেয়ে অনেক অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলো…”

“তার ইচ্ছামতো আমরা তাকে আমাদের এলাকায় বিচরণ করতে দিতে পারি না। আমরা যদি তাকে নিজের রাজ্যের মতো তাকে বিচরণ করতে দেই, তবে সেটা আমাদের দুর্বলতা হিসাবে বিবেচিত হবে। আর সেটাই স্বাভাবিক। তাকে একটা শিক্ষা দেবার সময় হয়েছে।”

“যুদ্ধের প্রতি তোমার মতো উষ্ণ আবেগ আমি হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু তোমার কথাই ঠিক। এক সময়ে না একসময়ে তাকে আমাদের মোকাবেলা করতেই হবে। নিজেদের যোদ্ধা খ্যাতি রক্ষার্থে সেটা যত তাড়াতাড়ি হয়, ততোই ভালো। আর তার চেয়েও বড় কথা হিন্দুস্তানে মাস্কেট আর কামান ব্যবহারে যতোদিন কেবল আমাদেরই একচেটিয়া অধিকার রয়েছে। অদ্ভুত আরেকটা অভিযান আমাদের নিজেদের তরুণ যোদ্ধাদের অস্থিরতা অনেকটা প্রশমিত করবে। যুদ্ধ আর লুটপাটের সম্ভাবনা তাদের অন্য কিছু ভাবা থেকে বিরত রাখবে। আমাদের প্রস্তুতি আরম্ভ করার জন্য আমি আগামীকাল সকালেই এক যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি সভার আহবান করবো…”

*

বাবর তার ঘোড়ার পর্যানে নড়েচড়ে বসে। হুমায়ুন যদিও ঠিক তার পেছনেই রয়েছে, কিন্তু তার নিজের দেহরক্ষীর দল বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়েছে। সে গরমে দরদর করে ঘামছে। আর তার চোখের চারপাশের উন্মুক্ত অংশের চারপাশে প্রতিটা রোমকূপ ধূলোয় ঢাকা পড়েছে। চুয়াল্লিশ বছর বয়সে মাত্র আড়াই দিনে দেড়শ মাইল পথ ঘোড়ায় পাড়ি দিতে পেরে এবং পাহাড়ের উপরে এই সুবিধাজনক স্থানে তাদের আগে ঘোড়া ছুটিয়ে হাজির হতে পেরে সে নিজেই নিজের কৃতিত্বে উৎফুল্ল হয়ে উঠে।

এই পাথুরে শিলাস্তর থেকে নিচে রাজস্থানের শুকনো মরুভূমির একটা বেশ ভালো দৃশ্য চোখে পড়ে। সেখানে প্রীত হবার মতো উপাদানের সংখ্যা বড়ই অল্প। সে দেড়শ মাইল ঘোড়া দাবড়ে এসেছে রানা শঙ্ককে ধাওয়া করে। কিন্তু তাকে বা তার লোকদের এমনকি দিগন্তে ধূলোর কোনো চিহ্নও এখনও পর্যন্ত সে দেখতে পায়নি। গত ছয় সপ্তাহ ধরে সে ধাওয়া করে চলেছে। পুরোটা সময়ে সে তার শত্রুপক্ষকে মুখোমুখি যুদ্ধে আবদ্ধ করতে পারেনি, যেখানে তার মাস্কেট বা কামান- বিশেষ করে তার নতুন তৈরি করা কামান, যার সাহায্যে পৌনে এক মাইল দূরত্বে গোলা নিক্ষেপ করা সম্ভব- দক্ষতার সাথে কাজে আসবে।

চতুর রানা বিচক্ষণতার সাথে দ্রুতগতির যুদ্ধ বেছে নিয়ে নিজের অধিক দ্রুতগামী বাহিনীর সহায়তায় বাবরের দূর্গ আর রসদ সরবরাহের পথে ঝটিকা আক্রমণ বজায় রেখেছে। অনেক দিন আগে বাবর যেমন আক্রমণ ফারগানার পাহাড়ী এলাকা থেকে তার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীরের লোকদের বিরুদ্ধে পরিচালনা করেছিলো। আক্রমণের ফলে বাবরের বাহিনীর মনোবল দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাদের অস্থির করে তুলেছে। এবং তারা এখন সবসময়ে আক্রমণের আশঙ্কায় তটস্থ থাকছে। ঝটিকা আক্রমণের ফলে বাবরকে ক্রমাগতভাবে তার শ্রেষ্ঠ বাহিনীর একটা বিশাল অংশকে মালামাল বহনকারী বহরের নিরাপত্তার জন্য নিয়োজিত করতে হয়েছে।

হুমায়ুন এখন তার পাশে এসে পৌঁছায়। “দশ বছর আগে তোমার সেই সাদা টাট্ট ঘোড়াকে আমি যেমন পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতাম, এখনও তোমাকে সেভাবে আমি হারিয়ে দিতে পারি…”

“আপনার ঘোড়াটা সেরা। আর ফলাফল ভিন্ন হতো যদি আমরা নিজেদের পায়ের উপরে ভরসা করতাম।” নিজের বাবার সাথে বয়ঃসন্ধিক্ষণের প্রতিযোগিতা আর পরাজয় উপলব্ধি করে এই বয়সের স্পর্শকাতরতায় প্ররোচিত হয়ে খেপে গিয়ে, হুমায়ুন উত্তর দেয়।

“আমি ঠাট্টা করছিলাম। যাই হোক, আমরা দুজনেই আপাতদৃষ্টিতে রানাকে পাকড়াও করতে ব্যর্থ হয়েছি। সে যদিও আমাদের চেয়ে বয়সে বড় আর পঙ্গু। নিচের ঐ সমভূমি জনমানবশূন্য। আমাদের পুনরায় ভাবতে হবে। আজ রাতে আমরা একাকী আহার করবো, যাতে খোলাখুলি আলোচনা করতে পারি।

*

সাদা জোব্বা আর ঢোলা পাজামা পরিহিত পরিচারক দু’জন খাবারের শেষ পদ নিয়ে আসবার জন্য তাঁবুর পর্দা উঠিয়ে বের হয়ে যায়- কমলা, বাদাম আর আঠাল মিষ্ঠান্ন। বাবর আর হুমায়ূন নিচু টেবিল থেকে পেছনে সরে এসে, একদা ইবরাহিমের দিল্লীর প্রাসাদের শোভাবর্ধন করতো এমন হাতি আর ময়ূরের নকশা করা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে। কাবুলের দক্ষিণে অবস্থিত গজনীর দ্রাক্ষাকুঞ্জ থেকে সদ্য আগত ওয়াইনে পূর্ণ দুটো সোনার পানপাত্র দুজনের হাতে।

“আমি ভাবছিলাম রানাকে কিভাবে আমরা যুদ্ধে প্রলুব্ধ করতে পারি।” হুমায়ূন তার পানপাত্র নামিয়ে রাখে। “আমরা দুজনেই জানি রাজপুতের কাছে সম্মানই- তার নিজের আর নিজের পরিবারের সম্মান- সবকিছু। আমরা রানার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোনো স্থান দখল করবো, যাতে সে ভাবতে বাধ্য হয় স্থানটা দ্রুত পূনর্দখল করতে না পারলে তার সম্মানহানি ঘটবে।”

“নীতিগতভাবে ভালো পরিকল্পনা। কিন্তু সেরকম কোনো স্থানের কথা কি তোমার জানা আছে?”

“আমি আমাদের স্থানীয় মিত্রদের ভিতরে বেশ কয়েকজন সর্দারের সাথে কথা বলেছি। তারা আমাকে বলেছে শঙ্কের মা আগ্রার উত্তর-পশ্চিমে তার এলাকা থেকে বিশ মাইল দূরে একটা ছোট গ্রাম খানুয়াতে জন্মেছিলেন- এখান থেকে জায়গাটা পঁচাত্তর মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। মায়ের সম্মানে সে সেখানে তাদের কূলদেবতার মন্দির নির্মাণ করেছে এবং এখনও বছরে একবার পূজো দিতে যায়।”

“তুমি নিশ্চিতভাবেই এ বিষয়ে ভালোমতো ভাবনাচিন্তা করেছে। আমি আগামীকাল সকালেই খানুয়া আর এখানের মধ্যবর্তী এলাকা রেকী করার জন্য গুপ্তদূত পাঠাবো এবং তাদের আরো দেখে আসতে বলবো এলাকা আমাদের লড়াইয়ের জন্য উপযুক্ত কিনা। সবকিছু ঠিক থাকলে আমি আমার সৈন্যদের কয়েক দিনের ভিতরে সেখানে জড়ো হবার আদেশ দেবো। কিন্তু তুমিই কেবল এ বিষয়ে চিন্তা করছে না। আমি চিন্তিত রানা শঙ্কের ঝটিকা আক্রমণের ফলে মনোবল দুর্বল হয়ে পড়া আমাদের যোদ্ধাদের কিভাবে চাঙ্গা করে তুলবো।”

“আপনি ভেবে কি ঠিক করেছেন?”

“আমার সিদ্ধান্তটা একটু উদ্ভটই শোনাবে হয়তো। অতীতে আমার সব অভিযানই ছিলো এমন শত্রুর বিরুদ্ধে, যাদের ভিতরে সামান্য সংখ্যক হলেও কিছু লোক ছিলো যারা আমার ধর্মমতে বিশ্বাসী। এইবার আমার প্রতিপক্ষের সবাই হিন্দু- মানে বলতে গেলে কাফের। আমরা একটা পবিত্র ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করবো- জিহাদ।”

“কিন্তু আমরা এখন হিন্দুস্তানে আর স্থানীয় শাসকদের ভিতরে আমাদের মিত্র যারা তাদের ভেতরে অনেকেই হিন্দু ধর্মাবলম্বী।”

“এইবারের যুদ্ধে তাদের মূল বাহিনী থেকে আগেই পৃথক করে ফেলতে হবে। আমি অবশ্য এখনকার মতো তাদের অনেকের আনুগত্য বা নিদেন পক্ষে, তার কার্যকারিতার বিষয়ে বেশি চিন্তিত। তারা পেছনের দিকে সৈন্য মোতায়েন করতে পারবে।”

“এতে কাজ হতে পারে।”

“এতে কাজ হবেই…আমি ভেবে রেখেছি কিভাবে এই পরিবর্তন প্রতীকীভাবে প্রকাশ করবো। গজনীর এই লাল ওয়াইনই আমার স্পর্শ করা শেষ এ্যালকোহল। আমার লোকদের সামনে আমি বাকি মদ আগামীকাল মাটিতে ফেলে দিয়ে তাদের আমি জিহাদের ডাক দেবো।”

“কিন্তু আমি আপনাকে সারা জীবন পান করতে দেখে এসেছি…”

“হ্যাঁ, আর আমি জানি মদ, ভাঙ আর পপিগাছের ফল আফিমও আমি পছন্দই করি। আমরা, যাদের ধমনীতে তৈমূরের রক্ত প্রবাহিত এবং চেঙ্গিসের মোল্লারা আমাদের কাছে সত্যিকারের ধর্ম প্রচার করার বহু আগে থেকেই কড়া পানীয় পানে অভ্যস্ত। গাঁজানো ঘোড়ার দুধ খাভাশ উঁচু তৃণভূমিতে চেঙ্গিসের লোকদের শীতকালে ঠাণ্ডার প্রকোপ থেকে বাঁচিয়ে রাখতো। কঠোর মোল্লারাও বুঝতে পেরেছিলেন যে মানুষকে পুরোপুরি আর সাথে সাথে বদলে ফেলাটা অসম্ভব। বিরত থাকাকে তারা আদর্শ বলে প্রচার করেন এবং ধার্মিক আর তপস্বীদের মদপান করা থেকে বিরত রাখতে সহায়তা করেন। কিন্তু একই সাথে ভোগবিলাসীদের পানাহারের প্রবণতা মেনেও নেন। তারা আমাদের সামান্য সময়ের জন্য বিরত থাকতে উৎসাহিত করেন- যেমন রমজানের পবিত্র মাসে এবং বৃদ্ধ হবার পরে যখন স্রষ্টার সাথে মিলিত হবার সময় ঘনিয়ে এসেছে।”

বাবর আরেক চুমুক পান করে। “হ্যাঁ, মদটা ভালো এবং আমি তৃপ্তি করে এটা উপভোগ করতেও জানি। আর সে কারণেই আমি মদ ত্যাগ করলে সেটা মনোবলের উপর বিরাট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। আমি সেজন্য চাই তুমিও পানাহারের অভ্যেস পরিত্যাগ করো।”

হুমায়ুন ঢোক গিলে।

“তুমি অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও…আমি কয়েকদিনের ভিতরেই মোল্লাদের সাথে আলোচনা করে নিয়ে আমার সৈন্যদের সামনে এই ঘোষণা দিবো এবং আমাদের হিন্দু মিত্রদের অন্য কাজে নিয়োগ করবো।”

*

একটা চতুস্কোণাকৃতি শূন্যস্থানের চারপাশে বাবরের সেনাবাহিনী সুসজ্জিত অবস্থায় সন্নিবেশিত করা হয়, যার মাঝের শূন্যস্থানে একটা কাঠের মঞ্চ স্থাপিত করা হয়েছে। পুরোটা সোনালী কাপড়ে মোড়ানো এবং এখন তাদের সম্রাট সেখানে সবুজ আলখাল্লা পরিহিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তার কোমরবন্ধে মুক্তাখচিত এবং গলায় আকাটা চুনি আর পান্নার গর্জেট শোভা পায়। তার মাথায় সোনার মুকুট আর কোমরে আলমগীর ঝুলছে। তার পাশে উপযুক্ত রাজকীয় পরিচ্ছদে সজ্জিত হয়ে হুমায়ূন দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বয়োজ্যেষ্ঠ মোল্লার দল। সবার পরনে কালো আলখাল্লা আর ডান হাতে কোরান শরীফ।

বাবর কথা বলতে আরম্ভ করে: “ভাইয়েরা, আমাদের এলাকায় অনুপ্রবেশের দুঃসাহস দেখিয়েছে উদয়পুরের যে উঁইফোড় রানা। আগামীকাল আমরা তার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত লড়াইয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবো। সে আমাদের ধর্মের অনুসারী না। সে সত্যিকারের এক আল্লাহ্র উপাসনা করে বহু দেবতার পূজা করে থাকে। ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে সে মনে করেছে পৃথিবীর বুকে বহুবার সে জন্ম লাভ করবে। আর এজন্যই বোধহয় সে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আমরা তাকে আমাদের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব এবং আমাদের সাহস প্রমাণ করে দেখাবো। আমরা আমাদের একমাত্র জীবন ত্যাগ করতে বিন্দুমাত্র ভীত নই। তার কারণ কাফেরের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হলে আমাদের বেহেশত নিশ্চিত। আমি আমাদের মোল্লাদের সাথে, আমার চারপাশে যেসব জ্ঞানী আর পূণ্যবানদের তোমরা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখছো, আলোচনা করে দেখেছি। তারা একমত হয়েছে যে, আমরা যেহেতু কাফেরদের সাথে লড়াই করছি, আমাদের আল্লাহর প্রেমে উজ্জীবিত সাহসের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের নিমিত্তে, এই যুদ্ধকে আমরা পবিত্র ধর্মযুদ্ধ বা জিহাদ ঘোষণা করতে পারি। আমরা আল্লাহর জন্য, আমাদের বিশ্বাসের জন্য যুদ্ধ করবো। তার নামের মহীমায় ইনশাল্লাহ আমরা বিজয়ী হবো। আল্লাহু আকবর! আল্লাহ মহান!”

সৈন্যবাহিনীর সামনের সারি থেকে উচ্চকণ্ঠে সম্মতির আওয়াজ ভেসে আসে এবং মাত্রা আর উদ্দীপনায় বৃদ্ধি পেয়ে ধীরে ধীরে পুরো বাহিনীর ভিতরে ছড়িয়ে পড়ে। সৈন্যরা শূন্যে তাদের তরবারি তুলে ধরে এবং উন্মত্তের মতো ঢালে আঘাত করতে থাকে।

কয়েক মিনিট পরে, বাবর হাতের তালু নিচের দিকে করে অনবরত আন্দোলিত করে সবাইকে আরো একবার চুপ করতে বলে। উপস্থিত সবাই চুপ করতে সে পুনরায় বলতে শুরু করে: “তোমরা সবাই জানো আমি এমন একজন মানুষ, যে এখনও আল্লাহর নির্দেশ পুরোপুরি পালন করতে সমর্থ হয়নি। আমরা সবাই যেমন আমিও দুর্বলতার কারণে রিপুর কাছে আত্মসমর্পণ করেছি। তোমরা জানো আমি মদ্যপান পছন্দ করি। তোমরা গজনীর সুরার কথা শুনে থাকবে- বছরের সেরা আঙ্গুর থেকে প্রস্তুত- যা কয়েক সপ্তাহ আগে আমি খাইবার গিরিপথের ভিতর দিয়ে নিজের ভোগস্পৃহা চরিতার্থের জন্য আনিয়েছি। পবিত্র যুদ্ধের প্রতি আমার নিষ্ঠা প্রকাশের নিমিত্তে আমি আজ থেকে মদ্যপান ত্যাগ করার কথা ঘোষণা করছি এবং আমার ছেলে হুমায়ূনও একই শপথ নিচ্ছে। আমার এই শপথের প্রতীকী প্রকাশ হিসাবে বহু কষ্টে হিন্দুস্তানে আমার নিয়ে আসা গজনীর সুরা আমরা এখন মাটিতে ঢেলে দেবো।”

বাবর কথা শেষ করার মাঝেই, সে আর হুমায়ূন মাথার উপরে কুঠার তুলে ধরে মঞ্চের সামনে সুরা রাখার কাঠের পিপেতে আঘাত করলে পিপে ফুটো হয়ে ভেতরের চুনির মতো লাল মদ বের হয়ে ধূলোর সাথে মিশে মাদকতাময় কাদার সৃষ্টি করে। এবারের উল্লাসের তীব্রতা প্রথমবারের চেয়েও বেশি। বাবরের অমাত্য আর সেনাপতিরা, সাথে অনেক সাধারণ সৈন্যও পরস্পরের সাথে চিৎকারে প্রতিযোগিতায় নামে যে তারাও নিজেদের বদলাতে ইচ্ছুক এবং মদপান থেকে বিরত থাকবে…যে পবিত্র আর পরিশুদ্ধ হয়ে তারা নিশ্চয়ই বিজয়ী হবে…

*

বাবর একটা নিচু টিলার উপরে দাঁড়িয়ে খানুয়ার নিকটবর্তী রাজস্থানের মরুভূমির লাল বালিরাশির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার ঠিক পেছনেই রয়েছে, মূলত মাটির ইটের তৈরি বাড়িঘরসমৃদ্ধ খানুয়া গ্রামটা। গ্রামের মধ্যেখানে মায়ের পূণ্য স্মৃতির উদ্দেশ্যে রানা শঙ্ক নির্মিত বেলেপাথরের উপরে জটিল কারুকার্যখচিত হিন্দুরীতির মন্দিরটা অবস্থিত। বাবর ন্যাড়া মাথার সাদা আলখাল্লা পরিহিত পুরোহিতদের দাঁড়িয়ে থেকে, মন্দির গায়ে রানা বা তার মায়ের স্মরণে খোদাই করা সব নিদর্শন তার লোকেরা গুঁড়িয়ে দিয়েছে বা বিকৃত করেছে, দেখতে বাধ্য করেছে। তারপরে সে পুরোহিতদের গ্রাম থেকে বের করে দিয়েছে। সে জানে যে তারা বেত্রাহত কুকুরের মতো সংবাদটা নিয়ে রানার কাছে ছুটে যাবে।

যেমন আশা করা হয়েছিলো, রানা শঙ্কের রাজপুত সম্মান এই অপমান বরদাশত করতে ব্যর্থ হয় এবং এই মুহূর্তে রানা বাবাজি নিচের সমতলে তিন মাইল দূরে এসে শিবির স্থাপন করে অবস্থান করছে। তার শিবির এখনও যদিও ভোরের প্রথম কুয়াশার চাদরে মোড়া। কিন্তু ভোররাতে পাঠানো গুপ্তদূতের দল একটু আগে ফিরে এসে বাবরকে জানিয়েছে যে তারা শত্রু শিবিরে আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণের সুনিশ্চিত দৃশ্য আর আওয়াজ শুনতে পেয়েছে- রান্নার আগুন নেভানো হয়েছে, তরবারিতে শেষ মুহূর্তের শান দেয়া চলছে, ঘোড়াগুলোতে জিন চাপান হয়েছে এবং সারিবদ্ধ হবার সংকেত ধ্বনি হচ্ছে।

বাবরের নিজস্ব সেনাশিবির কয়েকদিন আগে ঠিক- খানুয়ায় তার বাহিনী হাজির হবার অব্যবহিত পরেই আগের মতোই তার লাল তাঁবুটা কেন্দ্রস্থলে রেখে বিন্যস্ত হয়েছে।

“আমার ধারণা পানিপথের মতো একই যুদ্ধকৌশল আমাদের অবলম্বন করা উচিত।” সে কথা শুরু করে, “কিন্তু আমাদের উচিত হবে পাহাড়ের উচ্চতা ব্যবহার করে আমাদের অবস্থান আরো সমুন্নত করা। আমরা কামানগুলো পাহাড়ের মাথায় স্থাপন করতে পারি এবং পাহাড়ের চারপাশে পরিখা আর মাটির বেষ্টনী নির্মাণ করে তাদের সুরক্ষার বন্দোবস্ত করতে পারি।”

বাবরের বহুদিনের পুরাতন সেনাপতি সাধারণত মিতভাষী, হাসান হিজারী, বদখশান থেকে আগত এক তাজিক। প্রায় বিশ বছর সে বাবরের অধীনে সেনাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছে- তখন কথা বলে উঠে। “সেটা উত্তম প্রস্তাব, সুলতান, কিন্তু শঙ্কের কাছে আনুমানিক দুইশ’র মতো হাতি রয়েছে। আর সে মূলত তার অশ্বারোহী বাহিনীর উপরে নির্ভরশীল। পানিপথের চেয়ে এখানে আমাদের সেনাবিন্যাস অনেক লম্বা হবে। হিমবাহের মতো ধেয়ে আসা হাতির চেয়ে ঘোড়া অনেক বেশি দ্রুতগামী, যদিও কম ভীতিকর। কামানের গোলাতে রাজপুতদের অশ্বারোহী বাহিনী হতাহতের শিকার হলেও এর ফলে তাদের দমানো যাবে না। আমাদের সেনাবিন্যাসের কোথাও কোথাও তারা ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে, সেজন্য আমাদের প্রস্তুত থাকা দরকার।”

“আপনি ঠিকই বলেছেন। পাহাড়ের মাঝামাঝি তীরন্দাজ আর মাস্কেটধারীদের একটা সারি বাড়তি প্রতিরক্ষা ব্যুহ হিসাবে আমরা মোতায়েন করতে পারি।”

“আমাদের ওখানে অশ্বারোহী বাহিনীও প্রস্তুত রাখতে হবে। প্রতিরক্ষা ব্যুহের কোথাও যদি ফাটল দেখা দেয়, তবে সেটা সামলাবার জন্য।” হুমায়ুন মন্তব্য করে। “আমাকে সেটা সামলাবার দায়িত্ব দেয়া হোক।” বাবর তাকে নিষেধ করতে পারে না।

গত কয়েকদিন বাবরের সৈন্যরা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পরিশ্রম করতে থাকে। পরিখা খনন করে, কামানগুলোকে ষাঁড় দিয়ে টেনে পাহাড়ের মাথায় তোলে। তারা মালবাহী গাড়িগুলোর পাশে কাঠের তক্তা দিয়ে চাকা আড়াল করে সেগুলোকে স্থানান্তরযোগ্য প্রতিবন্ধকতায় রূপান্তরিত করে।

হুমায়ুন কয়েক মিনিট আগে বাবরের সাথে পুরো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে এসে সামান্য কিছু পরিবর্তন ছাড়া কোনো খুঁত খুঁজে পায় না। বাবাকে আলিঙ্গন করে পাহাড়ের সামান্য নিচে অবস্থিত অশ্বারোহী বাহিনীর সাথে যোগ দেবার জন্য নেমে যায়। পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে বাবর আসন্ন যুদ্ধে হুমায়ূনের কুশল কামনা করে। হুমায়ূনের প্রতিবাদ সত্ত্বেও সে যুদ্ধবাজ তরুণের নিরাপত্তা জন্য তার সাথে একটা শক্তিশালী দেহরক্ষী বাহিনী দিয়েছে- হাসান হিজারীর তাজিকদের ভেতর থেকে বাছাই করা চল্লিশ জন যোদ্ধা। সে এর বেশি আর কিছু করতে পারবে না। কিন্তু এরপরেও সে উদ্বিগ্ন থাকে- পানিপথের যুদ্ধের শেষে বাবুরীর মাটিতে ঘষটাতে থাকা হাতের স্মৃতি এখনও দগদগে হয়ে আছে…

কুয়াশার আবরণ কেটে যেতে শুরু করেছে এবং বাবর দেখতে পায় যে রাজপুতেরা পুরোপুরি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। সারির পরে সারি অশ্বারোহী বাহিনী দেখা যায়। বাবরের গুপ্তচরেরা হিসাব করেছে যে রানার সৈন্যদের সাথে তাদের বাহিনীর অনুপাত কমপক্ষে চারজনে একজন।

সহসা এক লম্বা রাজপুত অশ্বারোহী ঘোড়া ছুটিয়ে বাবরের সৈন্যবাহিনীর দিকে এগিয়ে আসে। তার পরণে কমলা রঙের পোশাক, তার ঘোড়ার জিন আর লাগামও একই রঙের টাসেল দিয়ে সজ্জিত। তার সাদা ঘোড়াটার মাথা একটা চকচকে ইস্পাতের শিরোস্ত্রান দিয়ে সুরক্ষিত করা, যা সকালের রোদে রীতিমত চমকাচ্ছে। বাবরের প্রতিরক্ষা ব্যুহ থেকে মাত্র একশ গজ দূরে সে ঘোড়াটা বৃত্তাকারে ঘোরাতে থাকে আর চিৎকার করে অনেকটা যুদ্ধ শুরুর ঘোষণার ভঙ্গিতে। বাবর তার মাস্কেটধারীদের অশ্বারোহীর ভবলীলা সাঙ্গ করার আদেশ দিয়ে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। তারা নির্দেশ পালন করে। লোকটা গুলির আঘাতে ঘোড়া থেকে পড়ে যায়। কিন্তু তার পা রেকাবে আটকে যায় এবং ঘোড়াটা তাকে সেই অবস্থায় ছেচড়াতে ছেচড়াতে রাজপুত অবস্থানের দিকে টেনে নিয়ে যায়। পাথুরে মাটিতে ক্রমাগত আছড়াতে থাকার কারণে কমলা পাগড়ি পরিহিত মাথা শীঘ্রই রক্তাক্ত মণ্ডে পরিণত হয়।

বাবর ঠিক যা আশা করেছিলো, প্রথাগত আক্রমণ শুরুর আহবানের প্রতি তার ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ রাজপুতদের মাঝে বিশৃঙ্খল হঠকারী একটা আক্রমণ প্রবণতার সৃষ্টি করে। তাদের অশ্বারোহী বাহিনী শীঘ্রই রানা শঙ্কের মোতায়েন করা একশ রণহস্তির থেকে অনেকটাই এগিয়ে সামনে চলে আসে। বাবর তার তরবারি নামিয়ে গোলন্দাজ বাহিনী, মাস্কেটধারী আর তিরন্দাজদের সংকেত দেয় শত্রুপক্ষ পাল্লার ভিতরে প্রবেশ করা মাত্র গুলিবর্ষণ করতে। পাহাড়ের উপরে তার অবস্থান থেকে, রাজপুত বাহিনীকে একটা বিশাল ঢেউয়ের মতো মনে হয় তার অবস্থান গ্রাস করার জন্য ধেয়ে আসছে। এখানে সেখানে একটা ঘোড়া কি দুইটা সৈন্য মাটিতে আছড়ে পড়ে। কখনও কখনও কামানের গোলা আপাতদৃষ্টিতে গদাই লস্করী কিন্তু আসলে দ্রুতগতিতে ধাবমান হাতির গতি রুদ্ধ করে। কিন্তু কিছুতেই তাদের সামনে এগিয়ে আসবার গতি থামবার লক্ষণ দেখা যায় না, যতক্ষণ না তারা পরিখা আর বেষ্টনীর উপরে আছড়ে পড়ে। যার আড়াল থেকে বাবরের তীরন্দাজের দল যান্ত্রিক ভঙ্গিতে তীর নিক্ষেপ করে চলেছে।

বাবর পাহাড়ের ঢাল থেকে মাস্কেটধারীদের নল থেকে ধোঁয়া নিঃসরিত হতে দেখে এবং তার কাছে কামানের মুখ থেকে তীব্র কটুগন্ধযুক্ত সাদা ধোয়া নির্গত হয়। তার প্রতিরক্ষা ব্যুহের পশ্চিমবাহুর এক স্থানে বাবর দেখতে পায় রাজপুত অশ্বারোহীদের একটা দল ভেতরে ঢুকে পড়েছে তার বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে এবং বেষ্টনীর। সামনে দিশেহারা হয়ে পড়ে পিছিয়ে যায় পুনরায় সংগঠিত হতে। অবশ্য পূর্বদিকের বাহুতে সে দেখে রাজপুত অশ্বারোহীদের একটা দল মাটির বেষ্টনীর উপরে লাফিয়ে অবতরণ করে বা, ঘোড়া দাবড়ে ঢালে উঠে এসে সেখানে অবস্থিত মাস্কেটধারী আর তিরন্দাজদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। বাবর বেশ কয়েকজনকে রাজপুতদের তরবারির ঘায়ে ভূমিশয্যা নিতে দেখে। যারা এরপরে কামানের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে।

বাবর সাথে সাথে, হুমায়ূনকে ইশারায় তার অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে এগিয়ে যেতে বলে। হুমায়ূন, তার তাজিক দেহরক্ষীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় তাড়াহুড়ো করে বিশৃঙ্খল ভঙ্গিতে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে রাজপুতদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হুমায়ূনের আক্রমণের দাপটের সামনে টিকতে না পেরে অনেক রাজপুত অশ্বারোহী ঘোড়ার পিঠ থেকে মাটিতে পড়ে যায়। অন্যরা তার সাথে হাতাহাতি যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং বেষ্টনীর পেছন থেকে প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত সৈন্যরা সরে যেতে সেখান দিয়ে লাফিয়ে আরো রাজপুত সৈন্য এসে যোগ দেয়। হুমায়ূন বীরত্বের সাথে লড়াই করে। কিন্তু ধোয়ার আড়াল সরে যেতে বাবর তাকিয়ে দেখে রাজপুত সৈন্যরা তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলছে। তারপরে আবার ধোয়া এসে তাকে আর তার দেহরক্ষীদের পুরোপুরি ঢেকে ফেলে।

বাবরের কাছে মনে হয় এক যুগ পরে যেনো আবার ধোয়ার আড়াল সরে যায়। কিন্তু বস্তুতপক্ষে ধোয়া কিছুক্ষণ পরেই সরে গিয়েছিলো। যখন সে দেখে যে রাজপুতরা পাহাড় বেয়ে পালিয়ে যাচ্ছে এবং বেষ্টনীর ওপাশে সরে পড়ছে। পাঁচ মিনিট পরে হুমায়ূন ঢাল বেয়ে তার কাছে উঠে আসে।

“এতো ধোয়া আমি ঠিকমতো বুঝতে পারিনি, কি ওখানে কি ঘটছে?”

“আমাদের প্রথম আক্রমণের ঝাপটা তাদের সামান্যই পিছু হটিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু তারা পুনরায় সংঘটিত হয় এবং আমাকে দলনেতা বুঝতে পেরে বাকিদের থেকে আলাদা করে দিতে চেষ্টা করে।”

“এই পর্যন্ত আমিও দেখেছি।”

“বেশ, আমার দেহরক্ষীরা তাদের প্রয়াস ব্যর্থ করে দেয়। আর আমি রাজপুতদের সুদে আসলে তাদের এই প্রয়াসের উত্তর দেই। আমরা জটলার ভেতর থেকে বের হয়ে এসে তাদের একজন সেনাপতিকে আক্রমণ করি- বিশাল কালো গোফঅলা এক যোদ্ধা যার পাগড়িতে ময়ূরের পালক গোঁজা ছিলো। আমি প্রথমে তার কাছে পৌঁছাই এবং তার গলা আর মুখ লক্ষ্য করে একবার তরবারি চালাতেই সে জিনের পিঠ থেকে উল্টে গিয়ে মাটিতে নিথর অবস্থায় পড়ে থাকে। বাকি যোদ্ধারা কার্যত এর ফলে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে এবং মাস্কেটধারীরা পাশে নতুন অবস্থান গ্রহণ করায় তাদের সহায়তায় আমরা তাদের পিছু হটিয়ে দেই। শীঘ্রই আমাদের ব্যুহ আবার সুরক্ষিত হয় এবং সামনের বেষ্টনীতে আবারও সৈন্যবিন্যাস করা হয়।”

“তুমি দারুণ দেখিয়েছে।”

“আমাদের কি এগিয়ে গিয়ে তাদের আক্রমণ করা উচিত না?”

“এখনও সময় হয়নি। তাদের উদ্যম বা শক্তি কোনোটাই এখনও প্রশমিত হয়নি। দেখো? তারা পুনরায় আক্রমণের জন্য একত্রিত হচ্ছে। আমার লোকদের কাছে পানির থলি আর তীর পৌঁছে দিতে সরবরাহকারীদের নির্দেশ পাঠাও। যুদ্ধ কেবল শুরু হয়েছে।”

বাবরের আশঙ্কাই ঠিক প্রমাণিত হয়। সারা দিন প্রচণ্ড গরমের ভিতরে রাজপুত বাহিনী থেকে থেকেই আক্রমণ চালাতে থাকে। প্রতিবারই প্রতিরক্ষা ব্যুহে ফাটল ধরাবার আগেই তাদের প্রতিহত করা হয়। বেষ্টনীর কাছে মৃত, আহত মানুষ আর ঘোড়ার স্তূপ জমে উঠে। বাবর আহত এক রাজপুত যোদ্ধাকে আধা হামাগুড়ি আধা পায়ে হেঁটে রাজপুত শিবিরের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে। ধীরে ধীরে প্রচণ্ড কষ্ট সহ্য করে সে সাতশ গজ পেছনের দিকে এগিয়েছে যখন, রাজপুত অশ্বারোহী বাহিনীর একটা নতুন ঝটিকা আক্রমণ তাকে অগ্রাহ্য করে ধেয়ে আসে এবং বেচারার লাশ পাথুরে মাটিতে দুমড়েমুচড়ে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পড়ে থাকে। তার মাথার পাগড়ি অর্ধেক খুলে গিয়ে যায় এবং মাঝে মাঝে বাতাসের আন্দোলনে একমাত্র সেটাকেই নড়াচড়া করতে দেখা যায়।

সূর্য যখন প্রায় অস্তমিত হয়ে আসছে এমন সময় হুমায়ুন তার বাবার পাশে দাঁড়িয়ে আরেকটা আক্রমণের প্রস্তুতির দিকে আঙ্গুল তুলে দেখায়। “তারা সম্ভবত আরেকটা আক্রমণের পাঁয়তারা করছে। হাতি আর অশ্বারোহী বাহিনী আগের মতোই সজ্জিত করা হয়েছে। কিন্তু তাদের মাঝে পদাতিক বাহিনীর একটা বিশাল অংশ সমবেত হয়েছে। এমন আজ সারাদিনে দেখা যায়নি। আর এবার আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে তারা সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়েছে। ভাব দেখে মনে হচ্ছে পরিচারক আর শিবিরে অস্ত্র ধরতে পারে এমন সবাই এসে জড়ো হয়েছে।”

“সম্ভবত তারা তাই। আমি শুনেছি মামুলি পানি বহনকারীও নাকি পরাজিত হয়ে ফিরে যাবার চেয়ে একটা শেষ আক্রমণ করে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে পছন্দ করে। তারা এই আক্রমণকে বলে জহর। আক্রমণের আগে তারা পূজো করে এবং তাদের সংকল্প দৃঢ় করতে দেবতার সামনে বলি দেয়।”

“আমাদের এক হিন্দু মিত্র আমাকে বলেছে এই ধরনের আক্রমণের আগে তারা আফিম খেয়ে নেয় ভয় আর আঘাতের যন্ত্রণা লাঘব করতে… “

“কোনো সন্দেহ নেই। ঐ তারা এগিয়ে আসছে…”

তূর্যধ্বনি, ঢোলের সম্মোহনী বোল আর খোল, করতালের বিকট শব্দে রাজপুত বাহিনী এগিয়ে আসতে থাকে। এবার তাদের অগ্রসর হবার বেগ অনেক শ্লথ সাথে পদাতিক সৈন্য রয়েছে বলে।

“সহিসকে আমার ঘোড়া প্রস্তুত রাখতে বলল।” চিৎকার করে হুমায়ূনকে বলে। “সময় হলে এবার আক্রমণের নেতৃত্ব আমিই দেবো।”

“আমিও আপনার পাশে থাকতে চাই।”

“কিন্তু তার আগে আমাদের বাদ্যযন্ত্রীদের বলো যে রাজপুত বাহিনীর চেয়ে বেশি আওয়াজ করতে এবং আমাদের সব সেনাপতিকে জানিয়ে দাও যে রাজপুতরা প্রতিবার রণ হুঙ্কার দেয়ার সাথে সাথে তারাও যেন উত্তরে, আল্লাহু আকবর’ বলে চেঁচিয়ে উঠে- এটা তাদের মনোবল বৃদ্ধি করবে।”

অগোছালো রাজপুত বাহিনী সামনে এগিয়ে আসে। বাবরের গোলন্দাজ বাহিনী কামানের গোলা বর্ষণ করে তাদের প্রভূত ক্ষতিসাধন করে। মাস্কেট আর তীরন্দাজের দল ঘোড়ার পিঠ খালি করতে থাকে। মাঝে মাঝে একটা হাতি হয়তো কাত হয়ে উল্টে পড়ে যায় বা আহত এবং আতঙ্কে ঘুরে দাঁড়িয়ে চারপাশের সবাইকে বিপর্যস্ত করে তোলে। রাজপুত বাদকের দল এখনও তাদের সম্মোহনী বাজনা অব্যাহত রেখেছে। সারির মাঝে সৃষ্ট ফাঁকা স্থান পূর্ণ হওয়া বজায় থাকে। বাবরের মাথায় “মেওয়ার” আর “আল্লাহু আকবর ধ্বনি তালগোল পাকিয়ে যায়। কামানের শব্দ আর আহতদের আর্তনাদ যেনো তার নিচে চাপা পড়ে।

বেষ্টনী থেকে মাত্র দুশো গজ দূরে যখন রাজপুত বাহিনী। তাদের অশ্বারোহী বাহিনী পূর্ববর্তী আক্রমণে নিহতদের লাশের উপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে ধেয়ে আসে। পদাতিক বাহিনী তাদের মৃত সহযোদ্ধাদের লাশ কোমল পাদানির মতো ব্যবহার। করে পরিখা অতিক্রম করতে এবং বেষ্টনী টপকে যেতে। পুরো প্রতিরক্ষা ব্যুহ জুড়ে ব্যক্তিগত আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু বাবর আর হুমায়ূন যেখানে দাঁড়িয়ে, ঠিক তার পাদদেশে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সংঘর্ষ শুরু হয়।

“আমরা ঐখানে আমাদের বাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বো।” কোষ থেকে আলমগীর টেনে বের করেবাবর তার অশ্বারোহী বাহিনীকে আরো একবার সামনে এগিয়ে যেতে আদেশ দেয়। তারপরে তাদের নেতৃত্ব দিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে অবশিষ্ট বেষ্টনী অতিক্রম করে সরাসরি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। এবার পাহাড়ের উপর থেকে তাদের ধেয়ে আসা আক্রমণের তোড়ের সামনে রাজপুত বাহিনী পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। তাদের ঘোড়া পেছনে সরে গিয়ে পদাতিক বাহিনীকে পিষ্ট করে। সে এগিয়ে যেতে যেতে খেয়াল করে এক রাজপুত তীরন্দাজ তাকে লক্ষ্য করে ধনুক উঠিয়েছে এবং সে এগিয়ে গিয়ে তাকে নিষ্ক্রিয় করার আগেই ধনুক থেকে নিক্ষিপ্ত তীর তার ঘোড়ার জিনের চামড়ার হাতলে এসে গেঁথে যায়। বাবর রাজপুত তীরন্দাজের অরক্ষিত দেহ লক্ষ্য করে তরবারি চালায়। অল্প সংখ্যক রাজপুত যোদ্ধাই সামর্থ থাকা সত্ত্বেও ইস্পাতের তৈরি মিহি বর্ম পরিধান করে এবং সে বাবরের ঘোড়ার পায়ের কাছে আছড়ে পড়ে।

রাজপুত বাহিনীর ভিতর থেকে বের হয়ে এসে বাবর তার ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। যখন হুমায়ূন আর অন্য যোদ্ধারা, বাবর উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে হুমায়ূনের শিরস্ত্রাণ কোথায় যেনো পড়ে গেছে। তারা পাশে এসে একত্রিত হয়। তারপরে তারা আবার রাজপুত বাহিনীর দিকে ধেয়ে যায়, অবশ্য এবার পেছন থেকে। যদিও তারা বীরেরমতোই যুদ্ধ করে। কিন্তু কমলা রঙের পোশাক পরিহিত যোদ্ধার দল শীঘ্রই বেষ্টনীর ভিতরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে আটকে পড়ে এবং নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে থাকে। পাঁচজনের একটা দলকে আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয়া হলে তারা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে একে অন্যকে তরবারি বিদ্ধ করে। কিন্তু সর্বত্রই যুদ্ধের তীব্রতা হ্রাস পেতে শুরু করেছে। বাবর এবার বুঝতে পারে বিজয় তার কুক্ষিগত হয়েছে।

তারপরে সে খেয়াল করে তার একশ গজ ডানে, হুমায়ূন মাটিতে পড়ে রয়েছে এবং তার তিনজন দেহরক্ষী তার দেহের নিম্নাংশের বস্ত্র কেটে সরিয়ে নিচ্ছে। সে সেদিকে এগিয়ে যেতে থাকলে পিতৃসুলভ আশঙ্কা নিমেষে বিজয়ের আনন্দ ম্লান করে দেয়। সে হুমায়ূনকে সজাগ দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। যদিও বেচারা ব্যাথায় কুঁচকে রয়েছে। “কিছু না উরু একটা তীর বিদ্ধ হয়েছে- পলাতক রাজপুতদের কারো ছোঁড়া একটা তীর কপালগুণে এসে লেগেছে।”

তীরটা এখনও তার ছেলের পায়ে থেকে বের হয়ে রয়েছে এবং রক্ত তীরটার ধাতব ফলা বেয়ে চুঁইয়ে বের হচ্ছে, যদিও কেবল অর্ধেকটা হুমায়ুনের দেহের ভিতরে প্রবেশ করেছে। দেখে মনে হচ্ছে খুব একটা গভীরে প্রবেশ করেনি। কিন্তু তারপরেও দ্রুত বের করতে হবে- বহু বছরের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে এটা আমি জেনেছি। আমি আমার ছেলের কাঁধ চেপে ধরছি।” বাবর হুমায়ূনের দেহরক্ষীদের বলে। “তোমাদের একজন তার গোড়ালি চেপে ধর। তোমাদের ভিতরে যে শক্তিশালী সে তীরটা বের করে আনবে। মনে রাখবে একদম সোজা টান দেবে কোনো ধরণের মোচড় দেবে না। হুমায়ূন শক্ত হও।”

বাবর তার ছেলের কাঁধ চেপে ধরে। সাথে সাথে আরেকজন তার পা চেপে ধরলে অন্যজন ঝুঁকে পড়ে দুহাতে তীরটার বাহু ধরে এবং একটানে বের করে আনে। রক্ত ফিনকি দিয়ে বের হয় কিন্তু শীঘ্রই বন্ধ হয়ে যায়।

“একটা কাপড় শক্ত করে ক্ষতস্থানে বেঁধে দাও। আল্লাহ মেহেরবান, সে আমাদের সাথে বিজয় উদযাপনের জন্য উপস্থিত থাকতে পারবে। একটা খাঁটিয়া তৈরি করে তাকে তাঁবুতে পৌঁছে দাও।”

“না আব্বাজান, পটি বাঁধা হতে আর পরিষ্কার পোশাক পরা হলে আমি আপনার সাথে আমাদের বাহিনীর অবস্থা পর্যবেক্ষণে বের হতে চাই।”

আধ ঘণ্টা পরে, সন্ধ্যার আলো আঁধারির ভিতরে বাবর আর হুমায়ূন যুদ্ধক্ষেত্রে ঘুরে বেড়ায়। মশালের আলোতে বাবরের খাঁটিয়া বাহকের দল নিজেদের লোকদের উপরে ঝুঁকে পড়ে আহতদের মৃত যোদ্ধাদের থেকে আলাদা করে। শিবির অনুসরণকারী আর মুদ্দাফরাসের দল ময়দানের চারপাশে আঁধারের আড়াল ব্যবহার করে মৃত রাজপুত যোদ্ধাদের লাশ থেকে মূল্যবান সামগ্রী খুলে নেবার জন্য হায়েনার মতো কামড়াকামড়ি করতে থাকে। বাবর আর হুমায়ূন তাদের দলবল নিয়ে হাজির হতে তারা আঁধারে মিলিয়ে যায়।

পিতা ও পুত্র নিরবে তাদের আহত যোদ্ধাদের যেখানে রাখা হয়েছে সেইসব তাঁবুর কাছে উপস্থিত হয়। কেউ কেউ অসাড় হয়ে শুয়ে আছে, কেউবা ক্ষতস্থান থেকে মাছি তাড়ায়, কেউ যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে, কেউ আর্তনাদ করা থেকে বিরত থাকতে হাত কামড়াচ্ছে এবং অন্যরা সাহায্য প্রার্থনা করছে।

“আব্বাজান এটা তাহলে সত্যি মারাত্মক আহত যারা, তারা হয় মায়ের জন্য নতুবা আল্লাহর জন্য কান্নাকাটি করে।”

“তাদের মায়েরাই তাদের জন্য নিঃশর্ত আর প্রশান্তিদায়ক স্থান এবং আল্লাহ তাদের পরবর্তী জীবনের জন্য বিরাট আশার স্থল।” বাবর চুপ করে থেকে কি ভাবে তারপরে আবার বলে, “আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত, এই লোকগুলোর সাহসিকতা আর আত্মত্যাগের কারণেই আমরা আজ হিন্দুস্তানের একচ্ছত্র অধিপতি হতে পেরেছি। আমরা তাদের এই বলিদানের বদলে তাদের পরিবার যেনো সুখে শান্তি তে থাকে তার ব্যবস্থা করবো এবং যারা বেঁচে আছে তাদের যথোপযুক্ত প্রতিদান দেবার ব্যবস্থা নেবো। সবচেয়ে বড় কথা আমরা এজন্য তাদের কাছে ঋণী এবং তাদের এই আত্মদান নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার আমাদের নেই। কিন্তু একই সাথে আত্মত্যাগ আর মৃত্যুর মাঝে আটকে থাকলে চলবে না। সবাই শাসক বা প্রজা নির্বিশেষে-সাম্রাজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে বেশি সচেতন হয়ে উঠবার অর্থ হল দুর্বল আর দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে উঠা। আজ রাতে আমরা আমাদের বিজয় উদযাপন করবো। আমরা আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রুকে পরাজিত করেছি। তার সমূলে ধ্বংস হবার খবর যখন অন্য শাসকরা জানতে পারবে, তখন তারা আমাদের। আক্রমণের কথা চিন্তাও করবে না। আমাদের সাম্রাজ্যের জন্য আজ আমরা একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিশ্চিত করেছি।”

*

পরের দিন দুপুর নাগাদ ছায়া দীর্ঘ হতে শুরু করলে, বাবর আরও একবার তার চারপাশে সৈন্যদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়। অনেকের শরীরে পট্টি বাঁধা, কেউ আবার লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

“ভাইয়েরা আল্লাহতালার কাছে হাজার শুকরিয়া। তিনি আমাদের ন্যায়সঙ্গত কারণের প্রতি তোমাদের বিশ্বাস আর তোমাদের সাহসের জন্য আমাদের মহান এক বিজয় দান করেছেন। আমরা আরো একবার তৈমূরের যোগ্য উত্তরসূরী হিসাবে নিজেদের যথার্থতা প্রমাণ করেছি এবং ইতিহাস আমাদের এভাবেই স্মরণ করবে গতরাতে আমরা বিজয়োল্লাস করেছি এবং আগ্রায় ফিরে যাবার পরে, যা কেবল চারদিনের দূরত্বে অবস্থিত, আমি আরো একবার আমার কোষাগার উলঙ্গ করে তোমাদের সবাইকে উপযুক্তভাবে পুরস্কৃত করবো।

আমি গতরাতে এক বন্দির কাছে জানতে পেরেছি যে, যুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যায় রানা শঙ্ক- আমাদের উদ্ধত প্রতিপক্ষ যে, আমাদের সামনে দাঁড়াবার সাহস দেখিয়েছিলো- পেটে মারাত্মক আঘাতপ্রাপ্ত হবার কারণে তাকে চারটা ঘোড়ার মাঝে একটা হাল্কা খাঁটিয়ায় করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। আজ গুপ্তদূতেরা, রাজপুতেরা আবার যুদ্ধের জন্য একত্রিত হচ্ছে কিনা দেখতে গিয়ে এখান থেকে দশ মাইল দূরে একটা রাজকীয় অন্তেষ্টিক্রিয়ার মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে দেখতে পায়। মাঠে কাজ করতে থাকা এক কৃষক তাদের জানায় যে, সেটা রানা। শঙ্কের জন্য নির্মিত হয়েছে। যিনি নিকটেই দেহত্যাগ করেছেন। আর তার দেহরক্ষীরা তার জন্য মঞ্চটা তৈরি করেছে। আমাদের গুপ্তদূতেরা ক্ষেতের ভিতরে লুকিয়ে থেকে দেখে যে, সত্যি সত্যি তার দেহ মঞ্চের উপরে স্থাপন করা হয়েছে। কাঠের স্তূপের নিচে আগুন জ্বালাবার পরেই কেবল তারা সে স্থান ত্যাগ করে। পেছনে তাকিয়ে তারা কমলা আগুনে আকাশ উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখেছে। রানা তার একাশিতম ক্ষতচিহ্ন উদযাপনের জন্য বেঁচে নেই। আগুনের শিখা আমাদের এই নতুন ভূমি থেকে উচ্ছেদের রাজপুতানা আশা ভষ্ম করে দিয়েছে।

“বাকি যারা বেঁচে আছে। যারা এখন আমাদের বিরুদ্ধে মনে মনে আমাদের সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করে। তারা আমাদের মোকাবেলা করার ফলে কি দুর্গতি হতে পারে এবার বুঝতে পারবে। আমরা আবারও তৈমূরের রীতি অনুসরণ। করবো। আমি শত্রুপক্ষের মৃত যোদ্ধাদের মাথা কর্তনের হুকুম দিয়েছি এবং এখান থেকে আগ্রা পর্যন্ত প্রতিটা চৌরাস্তায় একটা কর্তিত মুণ্ডের স্তূপ তৈরি করতে বলেছি। আশা করা যায় আমাদের শত্রুরা এর সাথে সাথে পচে মরবে।”

*

সেদিন সন্ধ্যাবেলা হুমায়ুন তার আব্বাজানের বিশাল লাল রঙের যুদ্ধের জন্য নির্ধারিত তাঁবু যেখানে তার ব্যক্তিগত কামরা অবস্থিত সেখানে প্রবেশ করে। যুদ্ধের স্মৃতি এখন তার মনে তাজা এবং নতুন সাম্রাজ্যে নিজের অবস্থান সম্পর্কে তার মনে উৎকণ্ঠা জন্ম নিয়েছে। তার উচিত আব্বাজানের উত্তরাধিকারী হওয়া। কারণ সে বড় ছেলে- যদিও তৈমূরীয় প্রথা অনুযায়ী বড় ছেলে সবসময়ে অধিকার বলে উত্তরাধিকারী হয় না এবং বাবরের প্রিয় স্ত্রীর সন্তান। এখন যুদ্ধক্ষেত্রেও সে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। এখন হয়তো সময় হয়েছে আব্বাজানের সাথে উত্তরাধিকারীর বিষয়ে আলাপ করার। নিদেনপক্ষে নতুন কোনো দায়িত্ব যেখানে সে নিজের যোগ্যতা আরও প্রমাণ করতে পারবে।

বাবরের কামরার সোনার কারুকাজ করা ভারী পর্দা সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে সে। দেখে তার পিতা একটা নিচু ডিভানে সোনার কারুকাজ বেগুনী আর সাদা তাকিয়ায়। মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। আর পাশেই একটা রূপার হুঁকো রাখা। হুমায়ূনের ভেতরে প্রবেশের শব্দ বা তাকে সে দেখতে পেয়েছে বলে মনে হয় না। ভাবলেশহীন চোখে সে তাকিয়েই থাকে। হুমায়ূন কাছে এসে দেখে বাবরের চোখের তারায় দৃষ্টিহীন অভিব্যক্তি এবং তার সবুজ চোখের মণি প্রসারিত হয়ে আছে। সে বাবরের কাঁধে হাত রেখে আলতো করে তাকে একটা ঝাঁকি দিলে তার চোখের পাতা পিটপিট করে উঠে এবং সেখানে ভাষা ফিরে আসে। “হুমায়ুন বেটা, তুমি কখন এলে?”

“কিছুক্ষণ আগে।”

“রাতের আহারের পরে আমি ভাঙ আর আফিম মিশ্রিত একটা হুঁকো টেনে থাকি, যা আমাকে এই পোড়া মাটির দেশ আর এর অসংখ্য মানুষের ভীড় থেকে আর সব ধরণের বিজয়ের আকাঙ্ক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। আমি আবার ফারগানার পার্বত্য এলাকায় ফিরে যাই। পান্নার মতো সবুজ ঘাসের দোলা, যার মাঝে মাঝে লাল টিউলিপ আর নীল আইরিস ফুটে আছে। আমি চঞ্চল নহরের স্বচ্ছ আর ঝকঝকে পানির ধারা বইতে দেখি- প্রতিটা ফোঁটায় একটা পৃথিবী ধারণ করে আছে। আমি আবারও তরুণ বয়সের মতো নির্ভার, আর বেপরোয়া হয়ে উঠি। আমার উপরে যেনো শান্তির বারিধারা বর্ষিত হয় এবং আমাকে সব ধরনের দায়িত্ব আর দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেয়। বাবর প্রশান্তিতে হাসে, সামান্য ক্লান্তির ছোঁয়া রয়েছে তার হাসিতে। “তুমি কি বলো? আমরা কি গোলাপপানির গন্ধযুক্ত সেই অসাধারণ মিষ্টি আরেকবার খেয়ে দেখবো?”

হুমায়ূন বুঝতে পারে তার স্বপ্নের কথা আলোচনার সময় এটা না। তার আব্বাজান এখন অতীত রোমন্থন করছেন। তারও হয়তো তাই করা উচিত। গজনীর লাল মদ আসলেও দারুণ। পুনরায় পান শুরু করার জন্য তাকে অন্তত বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। আমি কেবল বলতে এসেছিলাম আগামীকাল আগ্রার উদ্দেশ্যে যাত্রার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে আর অবশ্যই শুভরাত্রি জানাতে।”  তাঁবু থেকে বের হয়ে এসে বাবর তারকা খচিত রাতের আকাশের দিকে তাকায়। সে তাকিয়ে থাকলে বেহেশতের অন্যবদ্য নকশার জন্ম দিয়ে আরো তারা ফুটে উঠে। সহসা শিবিরের কোলাহল, মানুষ আর পশুর হাঁকডাক, আগুনের শিখার উজ্জ্বলতা আকাশের স্বর্গীর আলোর কাছে যাকে স্থূল মনে হয় তাকে অস্থির করে তোলে। সে তার ঘোড়া নিয়ে আসতে বলে এবং নিরবে তারা নিচে অন্ধকারে একাকী ভাবনার রাজ্যে হারিয়ে যাবে বলে ঘোড়ায় চেপে বসে।

৪.৭ রাজত্বের দায়ভার

২৬. রাজত্বের দায়ভার

গঙ্গার পানি বেশ উষ্ণ এবং বাবর তেত্রিশ স্ট্রোকে বেশ আনন্দেই নদীটা অতিক্রম করে। তার শপথের শেষ অংশ পালন করতে পেরে নিজেকে তার হাল্কা মনে হয়। ছয় বছর আগে বাবুরীকে নিয়ে বরফশীতল সিন্ধু নদে সে ঝাঁপ দিয়েছিলো এবং সেদিনই মনে মনে পণ করেছিলো তার নতুন সাম্রাজ্যের সব প্রধান নদী সে সাঁতরে অতিক্রম করবে। চোখ আর চুল থেকে পানির ফোঁটা ঝেড়ে ফেলে বাবর তীরে উঠে এসে সূর্যের নীচে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে। নদীর অপর তীরে একটা ঝাকড়া নিম গাছের নীচে সবুজ ঘাসের বুকে আগ্রা থেকে দেড়শ মাইল দূরে, কনৌজের কাছে অবস্থিত শিবির থেকে তার সাথে আগত দেহরক্ষী আর শিকারীর দল ঘোড়া নিয়ে অপেক্ষা করে। আজ রাতে অন্ধকার হলে সে আর তার লোকেরা পানির উপরে মোমবাতি ধরে মাছ মারতে যাবে। কোনো একটা অজানা কারণে ঝকঝকে আলোর মোহ মাছ কোনোমতেই এড়াতে পারে না, তাদের পানির উপরে তুলে আনে, যেখানে সহজেই তখন তাদের হাত দিয়ে ধরা যায়।

বাবর চোখ বন্ধ করে নদীটার কথা ভাবে। তার আদেশে বিদগ্ধজনেরা হিন্দুস্তানের যে মানচিত্র অংকন করেছে, সেখানে গঙ্গা পূর্বদিক থেকে প্রবাহিত হয়ে বাংলা মুলুকের উপর দিয়ে বয়ে গিয়ে বিশাল নীল সাগরে পতিত হয়েছে। একদিন বাবর নিজেকে প্রতিশ্রুতি দেয়, সে পানির বিশাল ঝকঝকে বিস্তার দেখতে যাবে, সে পুরো ব্যাপারটা ঠিকমতো কল্পনাই করতে পারে না… কেমন দেখতে সেটা, যেখানে পানির বুকে দিগন্ত নেমে এসেছে?

হিন্দুস্তান এখন তার কাছে বিস্ময়কর, বিভ্রান্তকর একটা স্থানের নাম। তার মাতৃভূমির সাথে তুলনা করলে এটা আসলেও যেনো ভিন্ন একটা জগৎ। এখানের পর্বত, নদী, বনাঞ্চল আর জনহীন প্রান্তর, এখানকার গ্রাম আর পরগনা, এর প্রাণী আর গাছগাছালি, মানুষ আর তাদের ভাষা, এমনকি বৃষ্টি আর বাতাসও একেবারেই আলাদা…কিন্তু সে যখন প্রথমবার সিন্ধু অতিক্রম করেছিলো, তখন সে হিন্দুস্তানকে অপরিচিত এমনকি নিপীড়ক বলে ভেবেছিলো। আর এখন সে এই জায়গাটা আদতেই উপভোগ করতে শুরু করেছে। রানা শঙ্ককে পরাজিত করার পরে থেকে, বেশিরভাগ সময়ই তার ভ্রমণ করে বেটেছে। ছোটখাট একটা শহরের আদলে তৈরি করা বিশাল সব শিবিরে, তার লাল তাবুটা সেইসব শিবিরের একেবারে কেন্দ্রস্থলে স্থাপিত- সমরকন্দ থেকে তৈমূর। যেমন একদা পরিদর্শনে বের হতেন। এইসব ভ্রমণের ফলে বাবর সুযোগ পেয়েছে নিজেকে প্রজাদের সামনে উপস্থাপনের, কিন্তু একই সাথে সে জানবার সুযোগও পেয়েছে।

রাতের বেলা সে অধিক আগ্রহের সাথে রোজনামচা লিখতে বসে। কৃষকদের মাঠে চাষ করার বিবরণ থেকে দেউতির দল, যারা তাদের লাউয়ের খোলসের পাত্রে ভর্তি তেল আর ধাতব তেপায়ায় সংযুক্ত মোটা সলতে দিয়ে শহর আর গ্রামের রাস্তায় আলো জ্বেলে বেড়ায়, সবকিছুই সে লিখে রাখে। সে যেসব প্রাণী তার কাছে নতুন দেখছে বলে মনে হয়, তার বর্ণনা লিখতে চেষ্টা, যেমন আনন্দোচ্ছল, লাফাতে পছন্দ করা নদীর শুশুক, হিন্দুস্তানের সব নদীতে এদের দেখা যায়। চোয়াল কুমীরের চোয়ালের মতো।

শীঘ্রই সে আগ্রায় ফিরে যাবে, যেখানের উদ্যানে তার লাগানো গাছগুলো বেড়ে উঠেছে এবং প্রথমবারের মতো কাবুল থেকে আগত মালীর দল আঙুর আর তরমুজ ফলিয়েছে। এছাড়া সাতশ হিন্দুস্তানী পাথরের কারিগর আগ্রায় রানা সঙ্ককে পরাস্ত করার খুশিতে যে মসজিদ নির্মাণ শুরু করেছে, সেটা নির্মাণে ব্যস্ত রয়েছে। মসজিদের উঁচু কুলুঙ্গিযুক্ত খিলান- ইউয়ান- মার্জিত ভঙ্গিতে ক্রমশ সরু হয়ে উঠে যাওয়া মিনার এবং তার প্রিয় ফুলের উদগত শিল্পকর্ম হিন্দুস্তানী কারিগরের দল এতোটাই নিখুঁতভাবে টিউলিপ আর আইসিস এঁকেছে, যে মনে হবে বাতাসের ঝোকায় পেলব ফুলগুলি বুঝি এখন মাথা নেড়ে উঠবে-একটা সুন্দর ভবন নির্মিত হতে চলেছে। সে আগ্রা আর কাবুলের ভিতরে চিঠি চালাচালির একটা ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে। প্রতি আঠার মাইল পরে পরে বিশ্রামের স্থান যুক্ত করা হয়েছে। পূর্বেই ভাড়া করা ঘোড়ার বহর আর তার চালককে সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তুত রাখা হয়। যাতে চিঠিপত্রগুলো হিন্দুস্তানে বাবরের রাজধানী এবং খাইবার গিরিপথের ওপাশে তার ভূখণ্ডে দ্রুত চিঠিপত্র আনা নেয়া করা যায়।

এতো কিছু অর্জিত হবার কারণে, আজকাল তার রোজনামচার আগের পাতাগুলো পুনরায় পড়ে দেখতে ভালোই লাগে, বিশেষ করে সালতানাহীন, আশাহীন অবস্থা এবং সমরকন্দের প্রতি দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা থেকে লেখা হতাশ বিষণ্ণ বিলাপধ্বনি। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস। সে তৈমূরের শহর এতোদিন দখল করে রাখতে পারেনি যাতে সেখানে স্থায়ী কিছু তৈরি করতে পারে। হিন্দুস্তানে সে টেকসই ইমারত তৈরিতে হাত দিয়েছে। মৃত্যুর সময়ে, আল্লাহ সহায় থাকলে সে তার সন্তানদের জন্য একটা সমৃদ্ধ সাম্রাজ্যই রেখে যাবে।

বাবর উঠে বসে পাশ দিয়ে প্রবাহিত নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। একটা সবুজ কাঠঠোকরা ঝোপঝাড়ের মাঝে ছোঁ দিতে তার ডানায় সূর্যের আলো পড়ে পান্নার রঙ ঝলসে উঠে। তার ছেলেদের ব্যাপারে কি করা যায়? বাবর মাহাম, গুলরুখ, খানজাদা, তাদের চাচী, কামরান, আকসারী আর হিন্দালের জন্য নিরাপদ ভেবে এখন তাদের আনতে লোক পাঠিয়েছে। অচিরেই তারা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে থেকে আগ্রায় উপস্থিত হবে। তাদের আগমন উপলক্ষে সে বিশাল এক যজ্ঞের আয়োজন করেছিলো এবং তার বড় দুই ছেলেকে চারকোব, ইয়াকের লেজের স্মারক, জয়ঢ়াক, উৎকৃষ্ট ঘোড়া, দশটা করে হাতি এবং অসংখ্য উট, খচ্চর দান করেছে।

সে তাদের পিতা হিসাবে গর্বিত। খানজাদা তাকে বলেছে যে, কামরান-এখন তার বিশ বছর বয়স এবং মুখে দাড়ি দেখা দিয়েছে তার আর বাইসানগারের কথামতো কাবুল ভালোই শাসন করেছে। বাইসানগার বহুদিন সেখানের রাজপ্রতিভূ হিসাবে দায়িত্বরত ছিলো। তেরো বছরের আসকারীও নিজের যোগ্যতা আর উচ্চাশার পরিচয় দিতে শুরু করেছে। আর কেনো হবে না? বাবর এই বয়সে ফারগানার সুলতান হয়েছিলো। তারা এসে পৌঁছাবার পরে বাবর তাদের উপযোগীতা ভরপুর ব্যবহার করছে। নিয়মিতভাবে এলাকা পরিদর্শনে আর বিক্ষিপ্ত বিদ্রোহ দমন করতে পাঠিয়েছে।

তাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত। কিন্তু হুমায়ুনের প্রতি তাদের আচরণ- বিশেষ করে কামরানের- দেখে বাবর মাঝে মাঝে মর্মাহত হয়। তাদের ক্ষুব্ধ এমনকি ঈর্ষান্বিত মনে হয়। কিন্তু এটাই স্বাভাবিক, সে নিজেকে বোঝাতে চায়। হিন্দুস্তান অভিযানে পুরোটা সময় হুমায়ুন বাবরের সাথে ছিলো। হুমায়ুন আর তার মাঝে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠতে দেখে কামরান, বয়সে যে হুমায়ুনের প্রায় সমবয়সী তার নিজেকে বঞ্চিত মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। বাবর বিষয়টা নিয়ে খানজাদার সাথে আলোচনা করেছে। তার পরামর্শ ছিলো, সে যেনো হুমায়ুনকে বলে নিজের ভাইদের সাথে একটু কুশলী আচরণ করে।

মাহামের চোখেও ব্যাপারটা ধরা পড়েছে এবং সে কামরান আর আসকারীর মা গুলরুখকে দোষী করেছে নিজের ছেলেদের হুমায়ুনের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার জন্য। হুমায়ুনকে তার ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী ঘোষণা করার জন্য মাহামের অনুরোধ দিন দিন বেড়েই চলেছে। কিন্তু কেবল সে নিজেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা রাখে। এবং সে নিজেকে যখন এ ব্যাপারে প্রস্তুত মনে করবে। নিজের ছেলেদের ভেতর থেকে নিজের ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী মনোনীত করার ব্যাপারটা রাজার অধিকারভুক্ত বাস্তবিকপক্ষে, প্রাচীনকালে তারা এজন্য পরস্পরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে বলে আশা করা হতো…কেবল সবচেয়ে শক্তিমানকে মনোনীত করা হতো। কারণ সেই নিজের গোত্রকে রক্ষা করতে পারবে। নিঃসন্দেহে হুমায়ুন ভালো যোদ্ধা, কিন্তু আজকাল একজন রাজাকে আনুগত্য অর্জন আর মিত্র তৈরির মতো গুণাবলীও প্রদর্শন করতে হয় সমরদক্ষতার পাশাপাশি। কোনো চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার আগে বাবর নিজের মনে সন্দেহের কোনো অবকাশ রাখতে চায় না।

একটাই বাঁচোয়া, দশ বছরের হিন্দাল ভাইদের ভিতরের এইসব প্রতিযোগিতার মাঝে নেই। মাহাম এখনও তাকে কাছে কাছেই রাখে। যদিও বাবর শীঘ্রই তার জন্য একজন শিক্ষক নিয়োগ করবে। হিন্দালের জন্মদাত্রী-মা, দিলবার আগ্রা আসেনি। সে অসুস্থ, আর কাবুলে হিন্দালের বোন গুলবদনের সাথে অবস্থান করছে। সে সুস্থ হয়ে উঠলে বাবর তাকে নিয়ে আসবার জন্য লোক পাঠাবে। আর তাহলে তার পুরো পরিবার আবার তার পাশে থাকবে। ঠিক যেমনটা হবার কথা।

বাবর উঠে দাঁড়ায়। আবার পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং গঙ্গার পানির ভিতর দিয়ে শক্তিশালী ভঙ্গিতে সাঁতার কেটে এগিয়ে যায়। এবার কেবল ত্রিশটা স্ট্রোক প্রয়োজন হয়- যেখানে তার লোকেরা ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে।

*

“আমি চাই তুমি এটা নাও।” বাবর তার রোজনামচার একটা প্রতিলিপি হাতির দাঁতের নকশা করা মলাট দিয়ে বাঁধানো এগিয়ে দেয়। “আমার জীবনের কথা এখানে লেখা আছে, যা বহু বছর ধরে আমি লিখে আসছি এবং ভবিষ্যতেও লিখে যাবো। আমি আমার অনুলিপিকারীকে আদেশ দিয়েছি প্রতিলিপি তৈরি করার জন্য…”

হুমায়ুন হাত বাড়িয়ে রোজনামচাটা নেয়। তার বাদামী চোখ- অবিকল মাহামের মতো- বিস্ময়ে বড়বড় হয়ে উঠেছে। “আব্বাজান এটা একটা বিশাল সম্মানের বিষয়।”

“তারচেয়েও বড় কথা, আমি আশা করবো তুমি এটা পড়ে শিক্ষা নেবে। অভিযান আর যুদ্ধটা তুমি ভালোই বোঝে। কিন্তু আমি যে অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে গিয়েছি সেসব সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই নেই… তোমার চেয়ে অর্ধেক যখন আমার বয়স, তখন আমি সুলতানের দায়িত্বপ্রাপ্ত হই। আমি আজও বেঁচে আছি আমি আমার গুটিকয় লোকের আনুগত্য, আমার আম্মিজান আর নানীজানের বিচক্ষণতা আর আমার উপস্থিত বুদ্ধির জোরে। একটা সময় ছিলো, যখন আমার কিছুই ছিলো না এবং একপাত্র মাংসের সুরা দেখে আমার চোখে খুশির বান ডাকতো…সেসব ছিলো নিরানন্দ দিন। কিন্তু আমাকে সাম্রাজ্য শাসনের জন্য দক্ষ আর যোগ্য করে তুলেছে আমার প্রতিজ্ঞাকে দৃঢ়তা দিয়েছে যে, আমি একটা সাম্রাজ্য গঠন করবোই… অনেকবেশি নিরাপত্তার মাঝে তুমি বেড়ে উঠেছে। তোমাকে দেখে রাখার জন্য তুমি তোমার পিতাকে পেয়েছো, ভাইদের পেয়েছো কৈশোরের উজ্জ্বলতা ভাগ করে নেবার জন্য…তোমার উচিত এসবের গুরুত্ব দেয়া…”

“আমি দেই আব্বাজান।” হুমায়ুনকে বিভ্রান্ত দেখায়।

বাবর চোখ সরিয়ে নেয়। ব্যাপারটা কঠিন। সে তার এই লম্বাচওড়া, পেশীবহুল ছেলেটাকে নিয়ে গর্বিত, যে নিজের সাহসিকতা আর দক্ষতার বেশ ভালোই পরিচয় দিয়েছে।

“ভাইদের প্রতি তোমার আচরণ কেমন উন্নাসিকতাপূর্ণ। কামরান তোমার চেয়ে মাত্র কয়েকমাসের ছোট। হিন্দুস্তান অভিযানে সে অংশ নেয়নি, এতে তার কোনো দোষ নেই। সে কাবুলে নিজের দায়িত্ব পালন করেছে, বেশ ভালোমত পালন করেছে। কিন্তু তারপরেও তুমি তার উপরে ছড়ি ঘোরাতে চেষ্টা করছে। তুমি আসকারীর সাথে একেবারে বাচ্চা ছেলের মতো আচরণ, যা সে আর নেই এবং সে এটা নিয়ে ক্ষিপ্ত। তোমাদের মাঝে সামান্য প্রতিযোগিতা স্বাস্থ্যকর, কিন্তু ভাইদের প্রতি তোমার আরও সহনশীল হওয়া উচিত…”

হুমায়ুন কোনো উত্তর দেয় না।

“এই নতুন ভূখণ্ডে আমাদের শক্তিই হলো আমাদের একতা। নতুবা আমাদের পতন ঘটবে। ভাইদের সাথে আরও সময় কাটাও, তুমি শিখেছো এমন কিছু তাদের সাথে ভাগ করে নাও…তুমি অনেকদিন একাকী কাটিয়েছে। অনেকদিন সন্ধ্যাবেলা আমি তোমাকে ডেকে পাঠালে জানতে পারতাম তুমি ঘোড়া নিয়ে একাকী বের হয়েছে…তোমার অনেক সেনাপতিও আমাকে অভিযোগ করেছে তোমার কাছে পরামর্শ চাইতে গিয়ে বা কোনো খবর জানাতে গিয়েও তারা তোমাকে পায়নি। এই একাকীত্বের কি প্রয়োজন?”

“আমি নির্বিঘ্নে একটু চিন্তা করার সুযোগ চেয়েছিলাম…নিজেকে আর নিজের চারপাশের এই পৃথিবী সম্পর্কে বোঝার জন্য। এসবের কি মানে, কেন আমাদের জন্ম হয়েছে…আমি বিশেষ করে বেহেশতের ধারণা বোঝার চেষ্টা করতাম। আর সেজন্যই আমি সন্ধ্যাবেলা আর রাতে একাকী বের হয়ে যেতাম।”

“আর তারার দিকে তাকিয়ে তোমার কি বোধোদয় হয়েছে?”

“আল্লাহতালার ইশারায় তারকারাজি আমাদের নিয়তি নির্ধারণ করে। আপনি আমাকে প্রায়ই তুষারাবৃত পাহাড়ের চূড়ার উপরে ক্যানোপাসকে জ্বলজ্বল করতে দেখার কথা বলেন এবং বুঝতে পেরেছিলেন সেটা একটা আলামত…?”

“আমি বিশ্বাস করি আল্লাহতালার মর্জি তারার মাঝে ফুটে উঠে। কিন্তু আমি এটাও বিশ্বাস করি যে, মানুষের নিজের ভাগ্য গড়ে নেবার সাধ্য রয়েছে। বেহেশতে সম্ভাব্য। পরিণামের ইঙ্গিত থাকে। কিন্তু সিদ্ধান্ত, পছন্দ করার দায়িত্ব আমাদের…” বাবরের কণ্ঠস্বর একটু বেশি কড়া শোনায়। কারণ হুমায়ুনকে দেখে সে বুঝতে পারে বেটার মাথায় তার কথা ঠিকমতো প্রবেশ করছে না।

“আব্বাজান, আমি আপনাকে কখনও বলিনি, কিন্তু পানিপথে লড়াইয়ের আগের রাতে আমার ব্যাক্তিগত জ্যোতিষ আমাকে বলেছিলো পরের দিন ঠিক দুপুর বেলা আকাশে যদি তিনটা বাজপাখি যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা যায়, আমরা একটা বিশাল বিজয় অর্জন করবো। ধূলো আর যুদ্ধের ডামাডোলের মাঝে, আমি আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকাই, কামার আর মাস্কেটের ধোঁয়ার উপরে আমি আমাদের মাথার উপরে তিনটা বাজপাখিকে নিশ্চল হয়ে ভেসে থাকতে দেখি। এখানেই শেষ না। আমার সেই জ্যোতিষি হিন্দুস্তানে মোঘলদের বিপুল সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন…এজন্যই আমি তারকারাজির দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করতাম পরবর্তীতে কি ঘটতে চলেছে।”

বাবর মৃদু হাসে। “আমাদের নিয়তির প্রতি তোমার বিশ্বাস দেখে আমি প্রীত হয়েছি। আমি অন্য কিছু আশাও করিনি। কিন্তু বেহেশতে সবকিছু নির্ধারিত হয় না। সে কি বলেছিল যে বুয়া আমাকে বিষপ্রয়োগের চেষ্টা করবে? আর তাছাড়া নতুন ভূখণ্ড দখলে। রাখতে হলে আমাদের নমনীয় আর দক্ষতার পরাকাষ্ঠা দেখাতে হবে। নেতৃত্ব আর একাগ্রতা এক্ষেত্রে তারকারাজির চেয়ে বেশি সাহায্য করবে…আমার রোজনামচার এই অনুচ্ছেদটা পড়ে দেখো…” বাবর ছেলের হাত থেকে প্রতিলিপিটা নিয়ে দ্রুত একটা পাতা খুঁজে বের করে: “একজন শাসককে সবসময়ে সতর্ক থাকতে হবে, তার অমাত্যদের কথা শুনতে হবে এবং বিশ্বাসঘাতকতা যে কোনো ঘটনা কঠোর হাতে দমন করতে হবে।”

“মনে রেখো, হুমায়ুন, শাসকের দায়িত্বের চেয়ে বড়ো দাসত্ব আর হতে পারে না। আমার ছেলে হিসাবে- এটা মনে রেখো- সব সময়ে সবাই তোমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। একাকী এতো সময় কাটানোটাকে তোমার দুর্বলতা হিসাবে বিবেচনা করা হবে। আমরা খোলাখুলি আলোচনা করি। আমি জানি তোমার মনে কি ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। কারণ, তোমার মুখে আমি সেই ছায়া সবসময়ে দেখতে পাচ্ছি। তুমি জানতে চাও আমি তোমাকে আমার উত্তরাধিকারী মনোনীত করবো কিনা। আমার উত্তর হলো আমি এখনও সেটা ঠিক করতে পারিনি…এখন পর্যন্ত আমি সিদ্ধান্ত নেইনি। তোমার সাহসিকতা নিয়ে আমার মনে কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু আমাকে দেখতে হবে নেতৃত্ব, দূরদৃষ্টি, একাগ্রতা আর দক্ষতার মতো মানসিক বৈশিষ্ট্য তোমার রয়েছে …আমার রক্তের মতো তোমার রক্তেও তৈমূর আর চেঙ্গিসের রক্তের তেজ আর নিষ্ঠা প্রবাহিত হচ্ছে, আমার কাছে সেটা প্রমাণ করো…”

*

“সুলতান, ঘোড়দৌড়ের প্রথম হিট এখন অনুষ্ঠিত হবে।”

আগ্রা দূর্গের ছাদের প্রাকারে দাঁড়িয়ে নদীর তীর বরাবর হলুদ আর সবুজ নিশান পোতা দেখতে পায়, যেখান থেকে ঘোড়দৌড় শুরু হবে। ছয় সারিতে দশ ফিট পর পর লাঠি পোতা হয়েছে। যা চারশ গজ পর্যন্ত বিস্তৃত– ঘোড়দৌড়ের সীমানা। প্রতিযোগীদের একেঁবেঁকে এর ভেতর দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে এবং শেষ প্রান্তে শেষ লাঠির আট ফিট পরে মাটিতে রাখা ভেড়ার কাটা মাথা বর্শার ডগায় গেথে তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়ে ঘুরে আবার একই পথে ফিরে আসতে হবে। বাঁক নেয়াটাই সবচেয়ে কঠিন আর দক্ষতা এবং ঠাণ্ডামাথা দরকার হবে দ্রুত বাঁক নিতে।

হিন্দুস্তানে বাবরের আগমনে চতুর্থ বার্ষিকী উদযাপনের জন্য তিনদিন ব্যাপী উৎসবের অংশ প্রতিযোগিতাটা। পরে মল্লযুদ্ধের আয়োজন করা হবে। তারপরে তার তিন ছেলের ভিতরে নিশানভেদের প্রতিযোগিতা হবে: বাবর সম্প্রতি তার দেহরক্ষীর কাছ থেকে একটা উন্নত মাস্কেট ক্রয় করেছে। সেটা দিয়ে যে প্রথমে মাটির ভাণ্ডে গুলি লাগাতে পারবে, সে একটা পান্নার আংটি পাবে। আংটির পাথরে তৈমূরের জন্মের সময়ে তারকারাজির কল্পিত অবস্থান বোঝাতে ব্যবহৃত তিনটা পরস্পর সংযুক্ত বৃত্ত খোদাই করা রয়েছে, যা বাবর তার নতুন সাম্রাজ্যের প্রতীক হিসাবে গ্রহণ করেছে।

হুমায়ুন, আসকারী আর কামরান, বাবরের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাদের কেউ ঘোড়দৌড়ে অংশ নিলে অনায়াসে জয়লাভ করতো। কিন্তু আজকের দৌড় কেবল বাবরের সেনাপতিদের জন্য নির্ধারিত। নিজেদের সম্রাটের কাছে আপন আপন যোগ্যতা প্রমাণের এটাই সুযোগ। পুরষ্কার হিসাবে রয়েছে সোনার কারুকাজ করা পর্যানে সজ্জিত একটা বিশাল সাদা স্ট্যালিয়ন এবং লাগামটা খাঁটি সোনার পাত দিয়ে মোড়া।

বাবা ইয়াসাভাল, সম্প্রতি তাকে বাবরের অশ্বশালার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। দৌড় শুরুর স্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শনার্থীদের ভিড়ে তাকে প্রায় দেখাই যায় না। সবাই ভালো করে দেখার জন্য নিজেদের ভেতরে গুতোগুতি করছে। সে তার হাতে ধরা বর্শা উঁচু করতে ধরতে প্রথম ছয়জন প্রতিযোগী এগিয়ে আসে। বাবরের দিকে তাকালে, সে ইশারায় শুরু করার ইঙ্গিত দিলে, ইয়াসাভাল হাতের বর্শা নামিয়ে নেয়। প্রতিযোগীরা তীব্র বেগে ঘোড়া ছোটায়। ঘোড়ার গলার প্রায় সমান্তরালে শুয়ে তারা কাঠের দণ্ডের ভিতর দিয়ে এঁকেবেঁকে ঘোড়া দাবড়ায়। বাবরের, কিশোর বয়সে ভেড়ার মাথা নিয়ে পোলো খেলার কথা মনে পড়ে এবং নস্টালজিয়ার একটা রাশ তাকে আপ্লুত করে।

প্রতিযোগীরা দণ্ডের শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেছে এবং হাতের বর্শা নীচু করেছে। প্রথমে এগিয়ে থাকা অশ্বারোহী- ধূসর দাড়িশোভিত তাজিক, হাসান হিজারী- বর্শার মাথায় নিপূনভাবে ভেড়ার মাথাটা গেঁথে নিয়ে নিখুঁতভাবে ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তার ঠিক পেছনের অশ্বারোহী তার মতো পারদর্শী না। তার বর্শার ডগা লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হয় এবং মাটিতে বিদ্ধ হয়, এবং দর্শকদের আমোদিত করে তাকে ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে তুলে নিয়ে বনবন করে পাক খাইয়ে পশ্চাদদেশের উপরে মাটিতে আছড়ে ফেলে। বাকি চারজন নিরাপদে ঘোড়া ঘুরিয়ে নেয়। একজন বাদে সবাই নিশানা ভেদ করতে পেরেছে।

প্রায় এক ঘণ্টা পরে বাকি পাঁচটা হিট শেষ হয় এবং বিজয়ীরা আবার পরস্পরের সাথে দৌড়াতে একজন বিজয়ী হিসাবে আবির্ভূত হয়। আর সে হাসান হিজারী না। বাবর যেমনটা ভেবেছিলো বরং কাবুলের এক তরুণ যোদ্ধা। সে তার বাদামী রঙের মাদী ঘোড়াটাকে বিদ্যুচ্চমকের মতো দাবড়েছে। আজ রাতে আয়োজিত ভোজসভায় বাবর তাকে পুরস্কৃত করবে। লাঠিগুলো এবার তুলে ফেলা হয় এবং বাবরের লোকের দৃর্গের দিকে তাড়াতাড়ি রওয়ানা দেয় মল্লযুদ্ধ দেখার জন্য। যেখানে দূর্গের প্রধান আঙ্গিনায় পাথরের মেঝের উপরে কয়েক পরত গালিচা পাতা হয়েছে।

“বাবা আমি মল্লযুদ্ধে অংশ নিতে চাই।” হুমায়ুন চমৎকার মল্লবিদ এবং সে সেটা জানে। বাবর সায় দিতে সে প্রস্তুতি নেয়ার জন্য বিদায় নেয়। কামরান আর আসকারীকে নিয়ে নীচের প্রাঙ্গনে নেমে এসে বাবর বিশেষভাবে নির্মিত কাঠের মঞ্চের উপর স্থাপিত একটা চেয়ারে আসন গ্রহণ করে।

শাহজাদা মল্লযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে। এটা জানাজানি হতে হুমায়ুনকে প্রথম পর্বেই যুদ্ধের জন্য মনোনীত করা হয়। সে আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাকী মোহসীন। হিরাতের অধিবাসী চওড়া আর চটপটে এক মল্লযোদ্ধা। যে নাকি প্রায়শই গর্ব করে বলে থাকে। সে একাই চার পাঁচজনের মহড়া নিতে পারে। মঞ্চের দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজ নিজ অভিবাদন জ্ঞাপন করে। দুই জনেরই পা খালি, কোমর পর্যন্ত উন্মুক্ত, এবং পরনে ডোরাকাটা আঁটসাট ব্রীচেস, যা হাঁটুর কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে। সাকী মোহসীনের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতচিহ্নযুক্ত, নিরেট স্বাস্থ্য দারুণ আকর্ষক দেখায়। কিন্তু হুমায়ুনকে দেখতে তার চেয়ে দারুণ লাগে। প্রতিপক্ষের চেয়ে অন্তত চার ইঞ্চি লম্বা বুক, পিঠ, পেট, কাঁধ আর বাহুর নিখুঁত তেল চকচকে- পেষল দেহ থরোব্রেড ঘোড়ার মতো সুষমা আর সৌন্দর্য মণ্ডিত। তার কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল পিঠের উপরে লাল কাপড় দিয়ে মোড়ানো।

বাবরের ইঙ্গিতে যুদ্ধ শুরু হয়। দু’জন বৃত্তাকারে পরস্পরকে ঘিরে ঘুরতে থাকে, হুমায়ুন পায়ের গোড়ালীর উপরে ফণা তোলা সাপের মতো দুলতে থাকে। তার চোখ প্রতিপক্ষের উপর স্থির। সহসা সাকী মোহসিন তার দিকে ধেয়ে আসে। হুমায়ুন এক লাফে সরে গিয়ে প্রতিপক্ষের হাটু নিজের পা দিয়ে আকড়ে ধরে তাকে আছড়ে মাটিতে ফেলে দেয়। মুহূর্তের ভিতরে হুমায়ুন তার প্রতিপক্ষের পিঠের উপরে চেপে বসে, একহাতে তার গলা পেচিয়ে ধরে মাথা পেছনের দিকে টানতে থাকে। অন্যহাতে সে প্রতিপক্ষের ডান হাত ধরে সেটা মোচড় দিয়ে প্রায় কাঁধ পর্যন্ত তুলে আনে। সাকী মোহসীনের ঘাম ছুটে যায়, আর তার মুখ ব্যাথায় বিকৃত হয়ে উঠে। “আমি হার মানছি…” সে কোনোমতে দম নিয়ে বলে।

হুমায়ুন পরবর্তী তিনটা লড়াইও জিতে, যার মানে সে প্রতিযোগিতা থেকে অপরাজিতের খেতাব নিয়ে সরে দাঁড়াতে পারে। বাবর আরো কিছুক্ষণ লড়াই দেখে। কিন্তু চোখের পেছনে একটা তীব্র আর দপদপ করতে থাকা ব্যাথা তাকে বেশ কষ্ট দেয়। সে নিজের কামরায় ফিরে গিয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবে বলে ঠিক করে। কামরান আর আসকারী তাকে তার কক্ষের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়, কথা দেয় তিনঘণ্টা পরে তারা এসে। তাকে হুমায়ুনের সাথে তাদের নিশানাবাজির প্রতিযোগিতা দেখার জন্য নিয়ে যাবে।

বাবর তার পরিচারকদের আফিম মেশানো দুধ নিয়ে আসতে বলে। সে ধূসর দেখতে মিষ্টি পানীয়টা পান করে এবং বিছানায় পিঠ ঠেকায়। মাথার ব্যাথা কমতে শুরু করলে, সে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের ভিতরে স্বপ্নে সে দেখে হুমায়ুন তার শক্তিশালী মার্জিত দেহের সাহায্যে প্রতিযোগীর পরে প্রতিযোগীদের পরাজিত করছে। দেখে সে নিজে আবার তরুণ হয়ে গিয়েছে এবং সবুজ আর হলুদ দণ্ডের ভিতর দিয়ে ঘোড়া দাবড়ে প্রতিযোগিতা জিতছে। প্রথমবার মাহামকে যেমন দেখেছিলো, অবিকল সে রকম রূপে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। আকশির দূর্গে খানজাদাকে মেহেদী রাঙানো খালি পায়ে পোষা বেজীর পেছনে দৌড়াতে দেখে। ওয়াজির খান তাকে ধৈর্যের সাহায্যে শিখাচ্ছে কিভাবে ধনুকে ছিলা পরাতে হয় এবং সবশেষে বাবুরী কাবুলের দূর্গ প্রাসাদের নীচের সমভূমিতে কামান আর ম্যাচলকের কৌশল তাকে দেখাচ্ছে।

বাবর ঘুম ভাঙতে দেখে সূর্যের আলো তখন কামরার জানালার মার্বেলের জাফরি দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। সন্ধ্যার আগে নিশানাবাজির প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে না। তাই তার হাতে এখনও প্রচুর সময় আছে। আড়মোড়া ভেঙে সে উঠে পড়ে এবং তার পরিচারক দিনে চারবার পানি বদলে দেয়। যে জেড পাথরের বোলের সেটার গোলাপজল দিয়ে মুখ ধোয়। শীতল পানিতে মুখ ধুতে ভালই লাগে এবং সে টের পায় তার মাথাব্যাথা সেরে গেছে।

সে পাশের অপেক্ষমানের জন্য নির্ধারিত কামরা থেকে মৃদু আলাপের আওয়াজ ভেসে আসতে শুনে। তার ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটাবার জন্য চাপা স্বরে কথা বলছে। পর্দার কাছে গিয়ে সে সেটা সরাতে যাবে কিন্তু ওপাশে কথাবার্তা শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে। নিশ্চিতভাবে কামরানের গলা সে শুনতে পায়। সে যদিও চাপা স্বরে কথা বলছে, কিন্তু তার মন্ত্র, উল্লসিত আওয়াজ কোনোমতেই ভুল হবার নয়।

“সাকী মোহসীন একটা আহাম্মক। আমি তাকে কতোবার বলেছিলাম হুমায়ুনকে মল্লযুদ্ধে হারাতে হলে বলদের মতো তার দিকে কখনও ধেয়ে যাবে না- হুমায়ুন অনেক বেশি চটপটে। হুমায়ুনের প্রথম আক্রমণের জন্য তার অপেক্ষা করা উচিত ছিলো। তাহলে আমরা একটা দারুণ লড়াই দেখতে পেতাম। হুমায়ুন চিত হয়ে পাছার উপরে ভর দিয়ে পড়ে আছে দেখতে পেলেও শান্তি… কিংবা তারচেয়েও ভালো লাগতো যদি ওর পাঁজরের হাড় ভাঙার আওয়াজ শুনতে পেতাম…’

“নিশানাবাজির প্রতিযোগিতার কি হবে?” ভাইয়ের চেয়ে উচ্চকণ্ঠে আসকারি এবার কথা বলে এবং তার কণ্ঠস্বর সামান্য উদ্বিগ্ন শোনায়। “সেই কি জিতবে নাকি আমাদের কোনো সুযোগ আছে?”

“ছোট ভাইটি, সেটার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।”

“কি বলতে চাও?”

“আমার একজন লোকের উপরে দায়িত্ব রয়েছে মাস্কেটে গুলি ভরার। আমি তাকে বলেছি হুমায়ুনের বন্দুকের বারুদে ভেজাল মেশাতে। যাতে সেটা থেকে ঠিকমতো গুলি না হয়। সে যদি আহত নাও হয় লক্ষ্যভেদ তাকে আজ করতে হচ্ছে না। আব্বাজানের পান্নার আংটি হুমায়ুনের ভাগ্যে নেই…”

বাবর পিছিয়ে আসে। এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হয় সে স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু সে যা শুনেছে সেটা পুরোপুরি বাস্তব। সে এবার ইচ্ছা করেই জেড পাথরের বোলের গোলাপজল মেঝেতে ফেলে দেয়। শব্দটার ফলে সে যা আশা করেছিলো তাই হয়। কামরান আর আসকারী পর্দা সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। “আমরা আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি আব্বাজান, তাই আপনার পরিচারকদের পাঠিয়ে দিয়ে আমরাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। নিশানাবাজির প্রতিযোগিতার সময় হয়ে এসেছে। নিশানা স্থাপন করা হয়েছে এবং মাস্কেটও তৈরি আছে। হুমায়ুন প্রস্তুত হয়ে দূর্গ প্রাঙ্গনে অপেক্ষা করছে।”

“কামরান আজ নিশানাবাজি হবে না, আমি মত পরিবর্তন করেছি।”

“কিন্তু আব্বাজান কেন…?”

“তুমি কি আমার কাছে কৈফিয়ত চাইছো?”

“অবশ্যই না আব্বাজান।”

“তোমরা দুজনেই এখন বিদায় হও। আর আমার পরিচারকদের পাঠিয়ে দাও। ভোজসভায় তোমাদের সাথে আমার দেখা হবে।”

সন্ধ্যাবেলার অনুষ্ঠানের জন্য তার পরিচারকরা তাকে প্রস্তুত করতে থাকলে, বাবর খেয়ালই করে না তারা তারা সোনালী প্রান্তযুক্ত গাঢ় নীল রঙের জোব্বা তার ডান কাঁধে ফিরোজা রঙের গিট দিয়ে আটকাচ্ছে বা হাঁটু পর্যন্ত লম্বা বুট জুতার সাথে সোনালী জরির কাজ করা পাজামা পরাচ্ছে। যান্ত্রিক ভঙ্গিতে সে গলার মালা, পাগড়ির অলংকার, পছন্দ করে দেয়। তার হাতের তৈমূরের আংটি যেটা সে কখনও খোলে না- চমকায়। দৃশ্যটা সাধারণত তাকে প্রীত করে কিন্তু সেটা অন্য রাতের কথা।

সে চার বছর ধরে হিন্দুস্তানে রয়েছে। আজ রাতে সে তার নিজের লোকদের সাথে আহার করবে। পরে যমুনার উপরের আকাশে সুদূর কাশগর থেকে সে যেসব জাদুগরদের নিয়ে এসেছে তারা আতশবাজি নামে একটা বস্তুর সাহায্যে আকাশে কৃত্রিম তারার সৃষ্টি করবে। সে ইতিমধ্যে নিজে একবার দেখেছে এবং চকচক করতে থাকা আলোর ঝর্ণা ধারা রাতের নিকষ আকাশে ছুটে বেড়াচ্ছে দেখে তার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এসেছিলো।

কিন্তু এখন সবকিছুই তার কাছে কলঙ্কপূর্ণ আর বেকার মনে হয়। তার ছেলেদের অপরিণত, নির্বোধ আর হঠকারী কথায় সে কষ্ট পায়নি তাদের কণ্ঠের বিষ তাকে ব্যথিত করেছে। সে যেটাকে ভাই ভাইয়ের ভিতরে স্বাভাবিক প্রতিযোগিতা ভেবেছিলো সেটা আসলে অন্য কিছু এবং সে নিজেই এর জন্য দায়ী। নিজের নতুন সাম্রাজ্যের প্রতি বেশি মনোযোগ দেবার কারণে সে খেয়ালই করেনি তার চারপাশে কি ঘটছে।

একজন শাসককে সবসময়ে সতর্ক থাকতে হবে।

এই কথাটা কি সে নিজের রোজনামচায় লিখেনি এবং এর কথাই কি সে হুমায়ুনকে বোঝাতে চেষ্টা করেনি। আর সে নিজেই কিনা নিজের উপদেশমতো কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে।

বাবরের চোয়াল কঠোর হয়ে উঠে। অনুষ্ঠান শেষ হবার সাথে সাথে, সে কামরান আর আসকারীকে হিন্দুস্তানের কোনো প্রদেশের শাসক নিয়োগ করবে। তাদের মস্তিষ্ক ব্যস্ত রাখার মতো প্রচুর কাজ আশেপাশে রয়েছে এবং সে নিজে তাদের এখন থেকে চোখে চোখে রাখবে। আর হুমায়ুনকে সে আগ্রার আশেপাশের এলাকার শাসকের দায়িত্ব দেবে যেখানে সে নিজে তাকে কাছে থেকে দেখতে পাবে। সে এখন থেকে তাকে তার সেইসব ক্লান্তিকর আধ্যাত্মিক আর নিঃসঙ্গতার প্রবণতা পরিহার করতে উৎসাহিত করবে এবং সাম্রাজ্যের কাজের দায়িত্ব নিতে বলবে। হুমায়ুন যদি নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারে, তবে সে প্রকাশ্য দরবারে তাকে তার উত্তরাধিকারী ঘোষণা করবে। কামরান আর আসকারীকে সেটা মেনে নিতে হবে। আর সেই সাথে ভাইয়ের সাথে খামোখা লড়াই করার প্রবণতাও তাদের পরিহার করতে হবে। হিন্দুস্তান অমিত সম্ভাবনার একটা দেশ। এর অধিকাংশ স্থানই এখনও জয়লাভ করা হয়নি। আর তারা এখানে হুমায়ুনের অনুগত হিসাবেই নিজেদের জন্য উপযুক্ত স্থান সৃষ্টি করতে পারবে। পিতলের বার্নিশ করা আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের সাজসজ্জার দিকে তাকিয়ে, বাবর ভাবে, ভাগ্য ভালো তার নিজের বয়স এখনও অল্প। ইনশাল্লা, আল্লাহতালার করুণায়, সে তার সন্তানদের মাঝে বিদ্যমান রেষারেষি দূর করতে পারবে এবং তাদের পরস্পর বিরোধী উচ্চাকাঙ্ক্ষার ভিতরে একটা সমন্বয় সাধন করতে পারবে।

৪.৮ নিভে আসা আলোর দীপ্তি

২৭. নিভে আসা আলোর দীপ্তি

বাবরের মাথার ভেতর কেউ যেনো অবিরাম হাতুড়ি পিটিয়ে চলেছে যা বর্ষাকালের শুরু থেকেই তাকে বিব্রত করছে। আজ নিয়ে তিনদিন মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। কিন্তু এখনও ভারী বাতাসে স্বস্তির কোনো খোঁজ নেই। কয়েকদিন এমনকি মাসব্যাপী নাগাড়ে বৃষ্টি পড়তে পারে। আগ্রা দূর্গে তার শয়নকক্ষে রেশমী তাকিয়ায় হেলান দিয়ে সে ফারগানার বেশতর পর্বতের রুক্ষ্ম চূড়ার উপর দিয়ে বয়ে আসা মিহি শীতল বৃষ্টির কথা ভাবতে চেষ্টা করে এবং ব্যর্থ হয়। তার মাথার উপরের পাঙ্খা দ্বারা সামান্যই বাতাস আলোড়িত হয়। গরম অনুভব না করার অনুভূতি কেমন সেটাই আজকাল কল্পনা করাটা কঠিন। তার নিজের হাতে তৈরি করা উদ্যানেও এখন আর বেড়াতে ভালো লাগে না। কাদায় প্যাঁচপেচে মাটি, পানিতে ভিজে ভারী হওয়া ফুল এবং নহর দিয়ে উপচে বইতে থাকা পানির স্রোত তাকে আরও বিষণ্ণ করে তোলে।

বাবর বিছানায় উঠে বসে এবং রোজনামচার পাতায় কিছু একটা লিখতে চেষ্টা করে। কিন্তু শব্দ খুঁজে না পেয়ে সে তার রত্নখচিত দোয়াতদানী অস্থির ভঙ্গিতে ঠেলে সরিয়ে দেয়। জেনানামহলে গেলে সে হয়তো একটু স্বস্তি পেতে পারে। সে মাহামকে গান গাইতে বলতে পারে। সে মাঝে মাঝে এসান দৌলতের বৃত্তাকার পেট আর মিহি গলা বিশিষ্ট বীণা বাজায়। মাহাম তার নানীজানের মতো দক্ষ না, কিন্তু তারপরেও তার হাতে বীণাটা থেকে মিষ্টি আওয়াজ ঠিকই বেরিয়ে আসে। আবার হুমায়ুনের সাথে এক হাত দাবাও খেলা যায়। তার এই ছেলেটা বিচক্ষণ আর তীক্ষ্ণধী- কিন্তু হলেও, সে গর্বিত বোধ করে, সেই বা কম কিসে এমন একটা ভাব তার ভিতরে কাজ করে এবং সে এখনও তাকে হারাতে সক্ষম। প্রথাগত ভঙ্গিতে শাহ মাত বলে সে যখন বিজয়ের ঘোষণা দেয়, তখন হুমায়ুনের চোখের বিভ্রান্ত দৃষ্টি দেখতে তার ভালোই লাগে। তারা খেলা শেষে বাংলার শাসকদের বিরুদ্ধে বৃষ্টি থামার পরে যুদ্ধ যাত্রার বিষয়ে আলোচনা করে। গাঙ্গেয় অববাহিকায় তাদের নদীবেষ্টিত ভূখণ্ডে থেকে তারা মনে করেছে যে মোঘল আধিপত্য তারা অস্বীকার করতে পারবে এবং বাবরের সর্বময় কর্তৃত্ব নাকচ করবে।

“আমার বেটা হুমায়ুনকে ডেকে পাঠাও, আর দাবার ছক নিয়ে আসতে বলো।” বাবর এক পরিচারককে ডেকে বলে। আলস্য দূর করার অভিপ্রায়ে সে উঠে দাঁড়ায় এবং নদী দেখা যায় এমন একটা গবাক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে প্রমত্তা যমুনার বুকে উপচে পড়া পলিমাটি মিশ্রিত পানি বয়ে যেতে দেখে। প্রায় উপচে পড়া নদীর পাড় দিয়ে এক কৃষক তার হাডিডসার গরুর পাল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে বাবর ঘুরে দাঁড়ায়, নিজের ছেলেকে দেখবে বলে আশা করে, কিন্তু সাদা জোব্বা পরিহিত পরিচারককে দেখতে পায়।

“সুলতান, আপনার ছেলে আপনার মার্জনা প্রার্থনা করে বলেছেন যে, তার শরীরটা খারাপ এবং তিনি নিজের কক্ষ ত্যাগ করতে অপারগ।”

“তার আবার কি হলো?”

“সুলতান আমি সঠিক জানি না।”

হুমায়ুন কখনও অসুস্থ হয় না। সেও সম্ভবত বৃষ্টির সাথে আগত অসাড়তা থেকে কষ্ট পাচ্ছে, যা প্রাণশক্তি শুষে নেয় এবং প্রচণ্ড প্রাণবন্ত লোককেও ক্লান্ত করে তোলে।

“আমি তাকে দেখতে যাবো,” বাবর গায়ে একটা হলুদ আলখাল্লা জড়িয়ে নিয়ে ছাগলের চামড়ার তৈরি একটা নাগরা পায়ে গলিয়ে নেয়। তারপরে সে নিজের কক্ষ থেকে স্তম্ভযুক্ত আঙ্গিনার উল্টোদিকে অবস্থিত হুমায়ুনের কামরার দিকে এস্ত পায়ে এগিয়ে যায়। আঙ্গিনায় পদ্মফুলের মতো আকৃতির মার্বেলের ভোলা বেসিনে স্থাপিত ঝর্ণা থেকে পানির ধারা চকচকে বৃত্তচাপ তৈরি করে নির্গত হচ্ছে না, যেমনটা হবার কথা বরং এখন বৃষ্টির তোড়ে কানা উপচে গড়িয়ে পড়ছে।

হুমায়ুন নিজের বিছানায় শুয়ে আছে। হাতটা মাথার উপরে দেয়া, চোখ বন্ধ, কপালে দানা দানা ঘাম জমে রয়েছে, ঠকঠক করে কাঁপছে। সে তার আব্বাজানের পায়ের শব্দে চোখ খুলে তাকায়। কিন্তু চোখ জবাফুলের মতো লাল হয়ে আছে। চোখের মণি জ্বরের ঘোরে ছলছল করছে। বাবর দূর থেকেই তার ভারী শ্বাসপ্রশ্বাসের আওয়াজ পায়। প্রতিবার নিঃশ্বাস নেবার সময় তাকে রীতিমত প্রাণান্তকর পরিশ্রম করতে হয়, যা তাকে প্রায় কুঁকড়ে ফেলে।

“কখন থেকে তোমার এই অবস্থা?”

“আব্বাজান, আজ সকাল থেকে।”

“আমাকে কেন জানানো হয়নি?” বাবর তার ছেলের পরিচারকের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চায়। “এখুনি আমার হেকিমকে ডেকে আনতে লোক পাঠাও!” তারপরে সে তার নিজের রেশমের রুমাল পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে হুমায়ুনের কপাল মুছে দেয়। কপাল সাথে সাথে ঘেমে উঠে- বস্তুতপক্ষে, ঘামে তার সারা মুখ ভিজে রয়েছে এবং এখন যেনো তার কাঁপুনি আগের চেয়ে আরও বেড়ে গিয়েছে এবং দাঁতে দাঁতে ঠকঠক করে বাড়ি খায়।

“সুলতান, হেকিম এসেছেন।”

আব্দুল-মালিক কোনো কথা না বলে সাথে সাথে হুমায়ুনের শয্যার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কপালে হাত রাখে, চোখের পাতা টেনে দেখে এবং নাড়ী পরীক্ষা করে। তারপরে তার ভ্রু কুঁচকে উঠে, সে হুমায়ুনের আলখাল্লার সামনের অংশটা খুলে, এবং ঝুঁকে নিজের নিখুঁতভাবে পাগড়ি বাঁধা মাথাটা তার বুকের উপরে রেখে হৃৎস্পন্দন মনোযোগ দিয়ে শোনে।

“তার কি হয়েছে?”

আব্দুল-মালিক চুপ করে থাকে। “সুলতান, এই মুহূর্তে বলা দুষ্কর। আমাকে আরো ভালো করে পরীক্ষা করতে হবে।”

“তোমাকে কেবল তোমার ঐ অলক্ষুণে মুখটা ফাঁক করে কথা বলতে হবে…”

“আমি আমার সহকারীকে ডেকে পাঠিয়েছি। সুলতান, অভয় দিলে বলি আপনি বরং এখান থেকে এখন যান। আমি শাহজাদাকে ভালোমতো পরীক্ষা করে আপনাকে গিয়ে জানাবো- কিন্তু ব্যাপারটা গুরুতর সম্ভবত প্রাণঘাতী। তার নাড়ী আর হৃৎস্পন্দন দুর্বল আর দ্রুত।” বাবরের সাথে আর কোনো কথা না বলে সে তার রোগীর দিকে ফিরে দাঁড়ায়। বাবর ইতস্তত করে এবং ছেলের ঘামে ভেজা কাঁপতে থাকা মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে যায়। পরিচারক তার পেছনে দরজা টেনে বন্ধ করে দিলে সে বুঝতে পারে সে নিজেও কাঁপছে।

একটা হিমশীতল অনুভূতি তার হৃৎপিণ্ডকে জড়িয়ে ধরেছে। হুমায়ুনের জন্য সে কতবার শঙ্কিত হয়েছে। পানিপথে ইবরাহিম লোদীর একটা হাতির পায়ের নীচে সে চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছিলো। খানুয়াতে সেই রাজপুত যোদ্ধার তরবারির কোপে তার প্রাণ সংহার হতে পারতো। কিন্তু সে কখনও ভাবেনি যে হুমায়ুন- এতো স্বাস্থ্যবান আর শক্তিশালী- অসুস্থতার কাছে পরাভব মানবে। তার প্রিয় ছেলে ছাড়া সে কিভাবে বেঁচে থাকবে? হুমায়ুন মারা গেলে হিন্দুস্তানের এই বিপুল বৈভব মূল্যহীন হয়ে যাবে। এই হাঁসফাঁস করা গরম আর বিষবৎ দেশে যেখানে কেবল বৃষ্টি আর বৃষ্টি এবং রক্তখেকো মশার ভনভনানি ছাড়া আর কিছু নেই। সে কখনও আসতো না, যদি একবার জানতে পারতো তাকে এভাবে এর মূল্যশোধ করতে হতে পারে।

পরবর্তী আধঘণ্টা বাবর ঝিরঝির বৃষ্টি পড়তে থাকা আঙ্গিনায় অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করে কাটায় এবং হেকিম হারামজাদার ঘাড় ধরে হিড়হিড় করে টেনে এনে তার মুখ থেকে কি হয়েছে শোনার আকাঙ্ক্ষা বহু কষ্টে দমন করে। কিন্তু আব্দুল-মালিকই শেষ পর্যন্ত এসে উপস্থিত হয়। বাবর বৃথাই তার মুখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করে।

“শাহজাদার প্রচণ্ড জ্বর আর তিনি প্রলাপ বকছেন…”

“কি হয়েছে? কেউ বিষ দেয়নি নিশ্চয়ই?”

“না, সুলতান, বমি হচ্ছে না। আমি অবশ্য কারণও বলতে পারবো না। আমরা কেবল ঘামের সাথে সংক্রমণটা বের করে দেবার চেষ্টা করতে পারি। আমি তার ঘরে আগুন জ্বালাবার আদেশ দিয়ে এসেছি এবং তার রক্তকে আরও উত্তপ্ত করে তোলার জন্য আমি বিভিন্ন মশলা দিয়ে একটা আরক তৈরি করবো…”

“আর কিছু করার নেই? আমি কি কাউকে ডেকে পাঠাবো?”

“না, সুলতান। আমাদের ধৈর্যধারণ করতে হবে। আল্লাহতালা যেমন আমাদের সবার ভাগ্য নির্ধারণ করেন, তেমনি কেবল তিনিই তার ভাগ্যের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।”

সারারাত ধরে, আব্দুল-মালিক আর তার সহকারীরা হুমায়ুনের শুশ্রূষা করে। কামরার ভেতরের প্রায় শ্বাসরোধকারী গরমের ভিতরে, বাবর বিছানার কাছে বসে দেখে তার জোয়ান মর্দ ছেলে এপাশ ওপাশ করছে, ছটফট করছে। হেকিমের নির্দেশে তার গায়ে সে ভারী কম্বল চাপানো হয়েছে সেটা ফেলে দিতে চেষ্টা করছে। হুমায়ুন থেকে থেকেই বিড়বিড় করে মাঝে মাঝে সেটা চিৎকারে পরিণত হয়। বাবর অবশ্য শব্দগুলো কিছুই বুঝতে পারে না।

ভোর হবার ঠিক আগে, পূর্বাকাশে হলুদাভ রূপালী আলোর আভা ফুটে উঠতে হুমায়ুনের চিত্তবৈকল্য আরো বৃদ্ধি পায়। তার খিচুনি শুরু হয়। যেনো প্রচণ্ড যন্ত্রণা পাচ্ছে এবং এতো জোরে কাঁপতে থাকে যে, আব্দুল-মালিকের সহকারী তাকে জোর করে চেপে ধরে না থাকলে, সে হয়তো বিছানা থেকে নীচে পড়ে যেতো। তার চোখ কোটর থেকে বের হয়ে এসেছে এবং তার জিহ্বা- হলুদ আর ফোলা ফোলা- শুকনো ঠোঁটের মাঝে বেরিয়ে রয়েছে।

আচমকা ছেলের কষ্টের এই দৃশ্য আর আর্তনাদ বাবরের সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যায়। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে আসে। বাইরের আঙ্গিনায় সে ঝর্ণার এটা পদ্মফুলের বেসিনের উপরে ঝুঁকে এবং পানির নীচে মাথা ডুবিয়ে দেয়। শীতল পানি তার নাক আর কানে প্রবেশ করতে, মনে হয় যেনো- অন্তত এক মুহূর্তের জন্য হলেও-সে পৃথিবীর যাবতীয় উৎকণ্ঠা আর যন্ত্রণা থেকে নিজেকে আড়াল করতে পেরেছে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে পানির ভেতর থেকে মাথা তুলে এবং চোখ থেকে পানি মোছে।

“সুলতান, মার্জনা করবেন…”।

বাবর ঘুরে তাকায়। হুমায়ুনের জ্যোতিষীর ছোটখাট অবয়ব পরণে মরিচা রঙের আলখাল্লা, যা তার আকৃতির তুলনায় বড় দেখায় তার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাবর মুখের উপর থেকে ভেজা চুল সরিয়ে দেয়। “কি বলতে চাও?”

“সুলতান, আমি গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান পর্যালোচনা করছিলাম, আমার প্রভুর ভাগ্যে বিধাতা কি লিখেছেন বোঝার জন্য। আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। আপনার ছেলের জীবন এখন আপনার হাতে। আপনি যদি তাকে জীবিত দেখতে চান আপনাকে অবশ্যই মহান আত্মত্যাগ করতে হবে…”

“তাকে বাঁচাবার জন্য আমি সব করতে রাজি আছি।” বাবর জ্যোতিষীর কথা ভালোভাবে না বুঝেই তার কব্জি চেপে ধরে।

“আপনার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ আপনাকে উৎসর্গ করতে হবে…”

“সেটা কি, কি সেটা?”

“সুলতান, সেটা কেবল আপনিই জানেন।”

বাবর ঘুরে দাঁড়ায় এবং মাতালের মতো টলতে টলতে দূর্গের মসজিদের দিকে এগিয়ে যায়। মিহরাবের খোদাই করে কারুকাজ করা কুলঙ্গির সামনের পাথরের মেঝেতে সে নামাজ পড়তে শুরু করে। চোখ বন্ধ নিজের সমস্ত একাগ্রতা একত্রিত করে সে। আল্লাহতা’লাকে প্রতিশ্রুতি দেয়: “আমার আত্মত্যাগ স্বীকার করো। আমার সন্তানের কষ্টের বোঝা আমাকে বহন করতে দাও। সে না, আমি, আমাকে মৃত্যুবরণ করতে দাও…আমার জীবন কবুল করো…”

*

তিন তিনটা দীর্ঘ দিন আর রাত, বাবর নিজের কামরা নিজেকে বন্দি করে রাখে। সব রাষ্ট্রীয় কাজ বাতিল করে জলপানি স্পর্শ না করে বসে থাকে সে জানে তার মাহামের কাছে যাওয়া উচিত। কিন্তু ছেলের জন্য তার দুশ্চিন্তার কথা ভেবে- বেচারীর একমাত্র ছেলে- নিজের উদ্বেগের উপরে সেটার কথা ভেবে সে বিহ্বল হয়ে পড়ে। কামরান আর আসকারীকে তাদের দূরতম প্রদেশেও সে খবর পাঠায় না। সে তাদের কি বলবে? হুমায়ুনের অসুস্থতার কথা, নাকি বলবে যে হেকিম সামান্যই আশা দিয়েছেন? সে যদি চিঠি পাঠায়ও তারা সময়মতো আগ্রায় উপস্থিত হতে পারবে না। আর তাছাড়া বাবরের কেন জানি একটা সন্দেহ হয়, যার কারণ সে বলতে পারবে না, যে কামরান আর আসকারী তাদের সৎ-ভাইয়ের অসুস্থতার খবর পেলে মোটেই ব্যাথিত হবে না।

আল্লাহতা’লা তার উৎসর্গ কেন গ্রহণ করছেন না? সে কেন এখনও শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছে, যখন হুমায়ুনের জীবন প্রদীপ নিভে আসছে…? সময় গড়িয়ে যেতে বাবর হতাশ হয়ে পড়ে। যে ধরণের হতাশার সাথে তার পরিচয় ছিলো না। সে মনে মনে যাই ভাবতে চেষ্টা করুক, সময় গড়িয়ে যাবার সাথে সাথে, তার জীবন প্রদীপ নিভুনিভু হবার কারণে তার মন ঘুরপাক খেয়ে। যদিও বাবুরীর মৃত্যুর পরে তার দেহের একটা অংশ মরে গিয়েছে বলে মনে হয়েছিলো, যেটা ছিলো ব্যক্তিগত শোক প্রস্তাব। হুমায়ুন যদি এখানে মারা যায়, তবে সেটা হবে একটা ব্যক্তিগত ক্ষতি- নিজের অন্য ছেলেদের চেয়ে হুমায়ুন তার সাথে অনেক ঘনিষ্ঠ- কিন্তু একই সাথে আরো বেশি কিছু। আল্লাহতালার এটার কুদরত এই যে লাঠির মাথাটা আজই বানিয়েছি, হুমায়ুন যদি মারা যায় সেটা হবে ব্যাক্তিগত অপূরণীয় ক্ষতি। আল্লাহতালার বলবার রীতিকে সবকিছু বলে, বাবর কায়মনোবাক্যে যা প্রার্থনা করছে, যা কিছু অর্জন করেছে সেসবের কোনই মূল্য নেই…সে জীবনেও হিন্দুস্তানে কোনো সাম্রাজ্য বা নিয়তি কোনোটার উপরেই ভরসা রাখতে পারবে না… তার এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে…বা নিদেনপক্ষে তৈমূরকে পেছনে ফেলার অভিপ্রায়ে এখানে থেকে গিয়ে ভুল করেছে। তার উচিত ছিলো অহঙ্কার না করে, নিজের দম্ভ প্রশমিত করে খাইবার গিরিপথের ওপারে নিজের ধূধূ করতে থাকা তেপান্তর নিয়ে সন্তুষ্ট থাকাটা উচিত ছিলো।

বাবর তার রোজনামচার পাতার দিকে তাকায়, নীচু টেবিলের উপরে খোলা পড়ে রয়েছে। কি আহাম্মকি না সে করেছিলো হুমায়ুনকে এটার প্রতিলিপি দেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে, যে একদিন এটা তাকে শাসনকার্যে সহায়তা করবে। তার মনেই হয়নি যে, সে শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করার মতো দীর্ঘ দিন জীবিতই থাকবে না। তার ইচ্ছা করে হুমায়ূনের কামরায় জ্বলতে থাকা গনগনে আগুনে রোজনামচাটা নিয়ে গিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়…কিন্তু হুমায়ুনের কামরায় যাবার মতো সাহস তার ভিতরে আর অবশিষ্ট নেই যে, সেখানে গিয়ে চিত্তবৈকল্যের যন্ত্রণায় কাঁপতে দেখে।

“সুলতান…”

বাবর ঘুরে দাঁড়ায়। হেকিমের এক সহকারী তার সাথে দেখা করতে এসেছে। লোকটাকে ক্লান্ত দেখায়, তার চোখের নীচের ত্বক এতোটাই কালো যেনো কালশিটে পড়েছে। “আমার প্রভু বলে পাঠিয়েছেন যে আপনার একবার যাওয়া উচিত…”

বাবর দৌড়ে হুমায়ুনের কামরায় যায়।

আব্দুল-মালিক কক্ষের দরজায় তার জন্য অপেক্ষা করছে। হাত পেটের উপর আড়াআড়ি করে রাখা। “সুলতান…আপনার ছেলে বিকট চিৎকার করেছিলো…এবং আমি ভেবেছিলাম- আমি সত্যিই ভেবেছিলাম-তার অন্তিম সময় ঘনিয়ে এসেছে…তারপরে সে চোখ খুলে তাকায় এবং আমাকে চিনতে পারে…এবং যেমন আকস্মিকভাবে জ্বর এসেছিলো, ঠিক তেমনি আকষ্মিকভাবে সেটা ছেড়ে গিয়েছে…” হেকিম তার মাথা নাড়ে, তাকে একাধারে বিস্মিত আর উফুল্ল দেখায়। “আমি আমার জীবনে এমন কিছু দেখিনি, সুলতান…এটা একটা অলৌকিক ঘটনা।”

*

আগ্রা দূর্গের পাদদেশে সূর্যালোকিত নদীর তীরে ঘোড়া ছোটায় হুমায়ুন। তার দাস্তানা পরিহিত হাতে লাল চামড়ার ঘোমটা মাথায় দিয়ে চুপ করে কালো বাজপাখিটা বসে রয়েছে। বাবর ভাবে পরে সে তার সাথে যোগ দেবে। বহুদিন হয় সে বাজপাখি উড়ায়নি। কিন্তু তার আগে সে যমুনার তীরে তার উদ্যান পরিদর্শনে যাবে। সেখানে সে মালিদের সাথে আখরোটের গাছ লাগাবার বিষয়ে শলাপরামর্শ করবে। সে ধীরে ধীরে হুমায়ুনের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। অসুস্থতা থেকে অলৌকিকভাবে সেরে ওঠার মাত্র চারমাস পরে তাকে আবার আগের মতো প্রাণবন্ত আর শক্তিশালী দেখাচ্ছে।

বাবর দূর্গের দেয়ালের পাদদেশে নেমে যাওয়া বেলে পাথরের বাঁকানো সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়। সিঁড়ির কয়েক ফিট দূরে, আরো কয়েকটা ছত্রাকে ছাওয়া এবং সংকীর্ণ ধাপের পরে সেটা নদীর ঘাটে গিয়ে মিশেছে। যেখানে তার সোনার পানি দিয়ে নকশা। করা বজরা অপেক্ষা করছে নদীর ওপারে তাকে পৌঁছে দেবার জন্য। হঠাৎ তার পেটে প্রচণ্ড একটা যন্ত্রণা হতে সে কুঁকড়ে যায় এবং হাত বাড়িয়ে পাথরের রেলিয়ের পরিক্ষেপ আঁকড়ে ধরে। ব্যাথা কমতে শুরু করলে, সে গভীরভাবে দম নিতে থাকলে ব্যাথাটা আবার ফিরে আসা ঢেউয়ের মতো তার পুরো শরীরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। সে মাতালের মতো টলতে থাকে…”আমাকে ধরো…’

শক্ত হাত তার বাহুর নীচে তাকে জড়িয়ে ধরে, টেনে তোলে। কে এটা? সে কৃতজ্ঞ চিত্তে মুখ তুলে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পায় না, কেবল চরাচরগ্রাসী একটা অন্ধকার।

*

“তার পেটে বায়ু চলাচল করছে না…তিনি প্রশ্রাবও করেননি…তিনি কিছু খাচ্ছেনও না। ছত্রিশ ঘণ্টা কেবল সামান্য পানি ছাড়া আর কিছুই তিনি মুখে দেননি…বুয়ার সেই বিষের ফলে এটা হচ্ছে কিনা আমি বলতে পারবো না…”।

বাবর তার চারপাশে উদ্বিগ্ন, চাপা কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। এরা কাকে নিয়ে কথা বলছে? তার মুখ আর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে…তার শুকনো ঠোঁটের মাঝে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে যায়। সে ঢোক গিলতে চেষ্টা করে, কিন্তু সেটা কষ্টকর বলে প্রতিপন্ন। হয়…সামান্য সময়ের জন্য তার চোখের পাতা মিটমিট করে। তার মুখের উপরে ঝুঁকে থাকা অবয়বগুলো ধোঁয়াটে আর অস্পষ্ট। সে আরও পানির স্বাদ অনুভব করে- কেউ একজন আলতো করে তার মুখে একটা চামচ প্রবেশ করায়…সে এবার বুঝতে পারে লোকটা কে, আর সে কোথায় আছে…সে একটা গুহার ভিতরে লুকিয়ে রয়েছে যেখানে শত্রুরা তাকে খুঁজে পাবে না। ওয়াজির খান হাঁটু মুড়ে তার পাশে বসে রয়েছে, ফোঁটা ফোঁটা পানি তার ঠোঁটে দিচ্ছে। সে সুস্থ হয়ে উঠলে তারা একসাথে ফারগানায় ফিরে যাবে…

“ওয়াজির খান…? সে কোনোমতে গুঙিয়ে উঠে। “ওয়াজির খান…” সে আবার চেষ্টা করে। এবার আগের চেয়ে স্পষ্ট বোঝা যায় তার কণ্ঠস্বর।

“না, আব্বাজান আমি হুমায়ুন।”

হুমায়ুন আবার কোথা থেকে এর ভেতর এলো, বাবর ঠিক বুঝতে পারে না।

“আপনার বেটা।”

এইবার সে বুঝতে পারে। অনেক কষ্টে বাবর নিজেকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনে। সবুজ চোখ খুলে এবং আতঙ্কিত ছেলেকে পাশে বসে থাকতে দেখে। “কি…আমার কি হয়েছে…?”

“আব্বাজান, আপনি অসুস্থ। আপনি চেতন অচেতনের মাঝে ঘোরাফেরা করছেন…অসুস্থ হবার পরে আপনার চারবার আক্রমণ হয়েছে। প্রতিটা আগেরটার চেয়ে ভয়ঙ্কর। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছি…কিন্তু দুশ্চিন্তা করবেন না…আব্দুল-মালিক এখনও আশাবাদী। তিনি তার সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন।”

কয়েক ঢোক পানি পান করে- সে এটাই কোনোমতে গিলতে পারছে- বাবর আবার বিছানায় এলিয়ে পড়ে, সে টের পায় অসম্ভব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু তার ইন্দ্রিয়ের সাড়া আবার ফিরে আসছে। সে নিশ্চয়ই মারাত্মক অসুস্থ… সম্ভবত এতোটাই যে, তার। মৃত্যুও হতে পারে… সম্ভাবনাটা তার মাঝে অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটা কাঁপুনির জন্ম দেয়। আসলেই কি অবস্থা এতোটাই খারাপ? তার বিকাশমান সাম্রাজ্যে যখন অনেক কাজ বাকি তখনই তাকে চলে যেতে হবে…জীবনটা উপভোগই করা হলো না। সে তার ছেলেদের পরিণত অবস্থায় দেখতে চায়। আল্লাহতা’লা নিশ্চয়ই তাকে সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবেন না…

তারপরে আরেকটা ভাবনা তার মনকে আপুত করে। আল্লাহতালা সম্ভবত হুমায়ুনের প্রাণের বিনিময়ে তার নিজের জীবন উৎসর্গের প্রতিশ্রুতির কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। সম্ভবত তার ধারণাই ঠিক, হুমায়ুনের অলৌকিক আরোগ্য লাভে স্বস্তি আর উল্লাসে ৰিক্ত হয়ে সে ভেবেছিলো আল্লাহ বোধহয় তার আকুল প্রার্থনা শুনেছেন…যদি তাই হয়ে থাকে তবে তার জীবনের সেরা কীর্তি বলে এটা বিবেচিত হবার যোগ্যতা রাখে। কারণ আল্লাহতালা হুমায়ুনের ভিতরেই সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত নিরাপদ বলে। বিবেচনা করেছেন। সম্ভবত এটা স্রষ্টার লীলাখেলার একটা মহিমা। অবশেষে তার জীবন একটা পরিণতি লাভ করলো। ভাবনাটা তাকে আবেগপ্রবণ করে তোলে। বাবর শুয়ে থাকে। অবজ্ঞা আজ্ঞায় রূপান্তরিত হতে থাকে, তার ক্লান্ত মনে একটা বিজয়ের অনুভূতিও মাঝে মাঝে উঁকি দেয়। সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপনের পরে তার মৃত্যুতে এখন আর কিছু আটকে থাকবে না।

তারপরে তার মনকে একটা নতুন ভাবনার দ্যোতনা সহসা আরো পরম মাত্রায় অসাড় করে ফেলে। ভাগ্যের লিখন বা প্রতিজ্ঞার পালন যেভাবেই তার মৃত্যু হোক, হুমায়ুনের অবস্থান তাকে সুরক্ষিত করে যেতে হবে। নতুবা মোঘল সাম্রাজ্য কুড়িতেই বিনষ্ট হবে। ঠিক তৈমূরের সাম্রাজ্যের মতো নিজের সন্তান আর অনুগত শাসকদের বিদ্রোহের ফলে। হুমায়ুনকে তার একমাত্র উত্তরাধিকারী ঘোষণা করতে হবে…তার সেনাপতি আর অমাত্যদের হুমায়ুনের প্রতি আনুগত্য নিশ্চিত করতে হবে…যতোটুকু সময় তার হাতে আছে এর ভেতরেই তাকে সম্ভব সব পরামর্শ দিয়ে যেতে হবে…।

বাবর আবার ঘামতে শুরু করে। তার নাড়ীর বেগ বাড়তে থাকে এবং ব্যাথার প্রকোপ পাল্লা দিয়ে বাড়তে শুরু করে। নিজের পুরোটা মানসিক দৃঢ়তা প্রয়োগ করে…যা কোনো যুদ্ধ জয়ের চেয়ে কম না…নিজের দেহের উপরে মনের আধিপত্য বিস্তার করা কিন্তু সে নিজেকে প্রবোধ দেয় তাকে কেউ কাপুরুষ বলবে না। সে বিছানার উপরে উঠে বসে। “আমার মন্ত্রণাসভা আহ্বান করো। তাদের সাথে আমাকে কথা বলতে হবে… একজন প্রতিলিপিকারীকে উপস্থিত থাকতে হবে। আমার প্রতিটা কথা লিপিবদ্ধ করার জন্য। কিন্তু তার আগে আমাকে খানজাদার সাথে নিভৃতে কথা বলতে হবে…তাকে দ্রুত আমার কাছে নিয়ে এসো।”

সে অপেক্ষা করার সময়ে কি বলবে মনে মনে গুছিয়ে নিতে চেষ্টা করে। কিন্তু তার মন বারবার বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠে।

“বাবর…” খানজাদার কণ্ঠস্বরে তার ঘোর কাটে।

“বোন, বহুবছর আগে তুমিই প্রথম আমার দোলনায় আমাকে সবার আগে আমাকে দেখেছিলে…তারপর থেকে আমরা অনেক কষ্ট সহ্য করেছি, আর অনেক কিছু অর্জনও করেছি। অনেক ভাইয়ের মতোই আমি কখনও তোমাকে বলিনি যে, আমি তোমাকে কতোটা ভালবাসি…পছন্দ করি…আমি এখন সেটা বলছি…এখন যখন আমার মনে হচ্ছে মৃত্যু খুব নিকটে ওঁত পেতে আছে। আমার জন্য দুঃখ কোরো না…মরতে আমি ভয় পাই না, আমি চিন্তিত আমার মৃত্যুর পরে এই সাম্রাজ্যের পরিণতি নিয়ে। আমার ইচ্ছা হুমায়ুন আমার উত্তরসূরী হোক। কিন্তু আমার মনে হয় তার ভাইয়েরা সেটা মেনে নেবে না…তারা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারে। আমার সব সন্তানদের কাছে তুমিই তাদের একমাত্র রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়। তারা তোমাকে শ্রদ্ধা করে…পরিবারের জন্য তোমার আত্মত্যাগের কথা বলে তোমাকে ছোট করবো না…আর তাই তারা তোমার কথা শুনবে…আমাকে যেমন একসময়ে দেখে রেখেছিলে, তাদেরও সেভাবে দেখে রেখো…তাদের ঐতিহ্যের কথা সবসময়ে তাদের স্মরণ করিয়ে দেবে। আর তাদের অবশ্যই তাদের কর্তব্যের কথাও…আর তাদের মায়েরা যেনো বিদ্রোহের উসকানি দিতে না পারে…”

বাবর ক্লান্ত হয়ে পড়লে, একটু চুপ করে।

“ছোট ভাইটি আমার আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি।” খানজাদা আলতো করে তার কপালে চুমু খেলে সে আর্দ্রতা টের পায়- খানজাদার অশ্রু- তার গালে স্পর্শ করছে।

“বোন, আমরা অনেকদূর পথ অতিক্রম করেছি, তাই না?” সে ফিসফিস করে বলে। দীর্ঘ আর কখনও কষ্টদায়ক পথ। কিন্তু সেটাই আমাদের পরিবারকে একটা মহিমান্বিত গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছে…এখন আমার পরিচারকদের বলো আমাকে দরবারের আনুষ্ঠানিক আলখাল্লা পরিয়ে দিতে। আমার হাতে সময় বড় অল্প। আমি তার আগেই আমার অমাত্যদের সাথে কথা বলতে চাই…”।

সোয়া ঘণ্টা পরে, অমাত্যরা যখন দরবারে প্রবেশ করে বাবরকে তার সবুজ আলখাল্লা পরিহিত অবস্থায় সিংহাসনে উপবিষ্ট দেখা যায়, তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে আছে। তারা ভেতরে প্রবেশ করতে বাবর চোখ বন্ধ করে এবং বহু কষ্টে নিজেকে সজাগ রাখে। তাকে পরিষ্কার করে চিন্তা করতে হবে। সে তার চারপাশে একটা গুঞ্জন শুনতে পায়। “আব্বাজান, সবাই এসেছে।”

চোখ খুলে তাকিয়ে বাবর বুঝতে পারে তার চোখের দৃষ্টি পুরোপুরি পরিষ্কার না…কোনো ব্যাপার না। ব্যাপার হলো তারা তার কথা যেনো পরিষ্কার শুনতে পায়। সে তার হাঁসফাঁস করতে থাকা বুক ভরে শ্বাস নেয় এবং শুরু করে: “আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন আমি অসুস্থ…আমার জীবন এখন আল্লাহর হাতে। আমি যদি মারা যাই, তাহলে আমাদের এই এতো পরিশ্রম যেনো উত্তাপ আর ধূলোতে বিলীন না হয়ে যায়…সেটা রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের উপরে থাকবে। আভ্যন্তরীণ কলহ পাত্তা না দিয়ে এখনকার মতোই সবাই একতাবদ্ধ থাকবে। সেটা অর্জন করতে হলে তোমাদের জানা উচিত কে আমার উত্তরাধিকারী হবে।”

বাবর দম নেবার জন্য একটু চুপ করে। “আমি কিছুদিন যাবৎ হুমায়ুনের সাহস আর তার প্রজ্ঞার জন্য তাকেই আমার উত্তরাধিকারী বলে মনে মনে ভাবছিলাম…কিন্তু নিজে প্রাণশক্তি, কামনা বাসনার কারণে প্রতারিত হয়ে সেটা আমি তোমাদের জানাতে পারিনি। আমি এখন সেটা বলছি। আমি হুমায়ুনকে আমার উত্তরাধিকারী মনোনীত করলাম। তোমাদের সামনে তার নাম সুপারিশ করছি। আমাকে যেমন আনুগত্য আর সাহসিকতার সাথে অনুসরণ করেছো, কথা দাও তাকেও সেভাবে অনুসরণ করবে। তার প্রতি অনুগত থাকার শপথ নাও।”

দরবার এক মুহূর্ত নিশ্চুপ থাকে তারপরে একটা সম্মিলিত কণ্ঠস্বর শোনা যায়: “সম্রাট আমরা আনুগত্যের শপথ নিলাম।”

“হুমায়ুন আমার হাত থেকে তৈমূরের আংটিটা খুলে নাও। এটা এখন তোমার। গর্বের সাথে এটা পরিধান করবে। আর কখনও নিজের প্রজা আর সাম্রাজ্যের প্রতি দায়িত্বের কথা বিস্মৃত হয়ো না। তোমরা সবাই আমার কথা শুনতে পেয়েছো?”

“হ্যাঁ, সম্রাট।”

“বেশ, আমাকে এবার হুমায়ুনের সাথে কিছুক্ষণ একলা থাকতে দাও। আমি আমার ছেলের সাথে একটু একা থাকতে চাই…”।

বাবর চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করে। সে গালিচার উপরে দ্রুত পায়ের শব্দ শুনতে পায় এবং তারপরে দরজা বন্ধ হবার শব্দে সবকিছু নিরব হয়ে যায়। তারা কি বিদায় নিয়েছে?”

“হ্যাঁ, আব্বাজান।”

“আমার কথা মন দিয়ে শোনো। আমি তোমাকে অন্য বিষয়ে কিছু বলতে চাই। প্রথমে নিজেকে ভালো করে জানতে চেষ্টা করবে এবং কিভাবে কোনো দুর্বলতা থাকলে সেটাকে অতিক্রম করা যায়…কিন্তু তারচেয়ে বড় কথা, যেকোনো মূল্যে সাম্রাজ্যের ঐক্য রক্ষা করবে। আমি বোকা নই, আমি জানি তোমার সৎ-ভাইরা ঈর্ষান্বিত হবে। তাদের প্রাপ্য তাদের দিবে এবং যতোক্ষণ সম্ভব তাদের সহ্য করবে তোমার পক্ষে যতটা সম্ভব। তাদের ভিতরে সমঝোতা তৈরির প্রয়াস নিবে, তাদের বড়ভাইয়ের মতো ভালোবাসবে। মনে রেখো তৈমূর যে আদি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছে, সেখানে শাহজাদাদের প্রাণ পবিত্র বলে গণ্য করা হয়…হুমায়ুন আমাকে কথা দাও…আমার কথা তুমি পালন করতে চেষ্টা করবে।”

বাবরের আবার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। সে হুমায়ুনের কোনো কথা শুনতে পায় না। “আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না।”

“আব্বাজান আপনি শান্ত হোন, আমি আপনাকে কথা দিলাম।”

বাবরের দেহ তাকিয়ার উপরে নেতিয়ে পড়ে। তার মুখে প্রশান্তির ভাব ফুটে উঠে। কিন্তু তারপরে সে আবার কথা বলতে থাকে। আর একটা বিষয়। আমাকে এখানে হিন্দুস্তানে সমাহিত করবে না। এটা তোমার আর তোমার সন্তানদের মাতৃভূমিতে পরিণত হবে। কিন্তু এটা আমার মাতৃভূমি না। আমার দেহ কাবুলে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে…আমি আমার রোজনামচায় আমার শেষ ইচ্ছার কথা লিখে গিয়েছি…”

হুমায়ুন এবার ফোঁপাতে শুরু করে।

“আমার জন্য দুঃখ কোরো না। তুমি যখন অসুস্থ হয়েছিলে আমি এটাই কামনা করেছিলাম। তোমার জ্যোতিষি আমাকে বলেছিলো কি করতে হবে- আমাকে আমার প্রিয় জিনিসটা উৎসর্গ করতে হবে। আমি তোমার জীবনের বদলে আল্লাহকে আমার জীবন সমর্পণ করেছি এবং এজন্য আমার মনে কোনো দ্বিধা নেই। আল্লাহ করুণাময়। তিনি তার কাছে আমাকে ডেকে নেবার আগে তোমার সাথে নিভৃতে সময় কাটাবার সুযোগ দিয়েছেন…”

হুমায়ুন তার বাবার ক্লান্ত মুখের দিকে তাকায়। সে তাকে কিভাবে বলবে যে জ্যোতিষি এটা বোঝাতে চায়নি। লোকটা পরে তাদের ভিতরের কথোপকথনের কথা হুমায়ুনকে বলেছে। লোকটা তাকে তার সম্পদ, কোহ-ই-নূর দান করার কথা বোঝাতে চেয়েছিলো তার নিজের জীবন উৎসর্গ করতে বলেনি…

কিন্তু তার আব্বাজানের শুকনো ঠোঁটে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠে এবং সে আবার কথা বলতে চায়। “দুঃখ কোরো না। এর মানে স্রষ্টা আমার কথা শুনেছেন…আমি কৃতজ্ঞ চিত্তে তার সান্নিধ্যে যাব… আমি এখন জানি আমার শুরু করা কাজ তুমি এগিয়ে নিয়ে যাবে। তারা সবাই, যারা আমার আগে মারা গিয়েছে, বেহেশতে আমার জন্য অপেক্ষা করছে…আমার বাবা-মা, নানীজান, ওয়াজির খান, আমার বন্ধু বাবুরী…এমনকি চোখে মোমবাতির আলোর মতো ম্লান আভা নিয়ে তৈমূরও অপেক্ষা করছে…তার সাথে আমার দেখা হলে তাকে আমাদের অর্জনের কথা। জানাবো…কিভাবে তারই মতো আমরা সিন্ধু অতিক্রম করে বিশাল একটা বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছিলাম…কিভাবে আমরা…”

বাবর অনুভব করে একটা উষ্ণ শান্তি তাকে আবৃত করে নেয়। সে ডুবতে শুরু করে, ভেসে যেতে থাকে, তার চেতনা লুপ্ত হতে শুরু করে। বাবর আর কি বলতে হুমায়ুন সেটা আর কখনও জানতে পারবে না। একটা মৃদু দীর্ঘশ্বাসের মাধ্যমে তার আব্বাজান হইধাম ত্যাগ করে এবং তার মাথাটা সামনে ঝুঁকে আসে।

হুমায়ুন নিজের মাথা নীচু করে দোয়া করতে থাকে: “আমার আব্বাজানকে দ্রুত বেহেশতের প্রশান্তিময় বাগিচায় পৌঁছে দাও। আমাকে তার আরাধ্য কাজ সমাপ্ত করার তৌফিক দান কর, যেনো উপর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে তিনি গর্ব অনুভব করেন…আমাকে শক্তি দাও…”

অবশেষে উঠে দাঁড়িয়ে হুমায়ুন শেষবারের মতো বাবরের দিকে তাকায়। তারপরে চোখ ফিরিয়ে নেয়। তার চোখে আবার অশ্রু টলটল করতে থাকে এবং সে বহু কষ্টে নিজের। কণ্ঠস্বর সংযত রাখে। “আব্দুল-মালিক,” সে ডাকে, “সম্রাট মারা গেছেন…সবাইকে খবর পাঠাও…”

*

দুইদিন পরে, হুমায়ুন কর্পূরে ধোয়া বাবরের মৃতদেহ নরম উলের কাপড়ে মুড়িয়ে রূপার কফিনে নানা সুগন্ধির সাথে ছয়জন সেনাপতি স্থাপন করলে দাঁড়িয়ে দেখে, কফিনটা বারোটা কালো ষাঁড়ে টানা গাড়ির উপরে রাখা। তারপরে ঢোলের মৃদু শব্দের সাথে হিন্দুস্তানের ধূধূ প্রান্তর, সিন্ধু নদ অতিক্রম করে খাইবার গিরিপথের আঁকাবাঁকা পথ অতিক্রম করে উত্তর-পশ্চিমে কাবুলের দিকে শববাহী বহরটা যাত্রা শুরু করে। হুমায়ুন জানে মৃত্যুর পরে তার বাবার নিজের প্রিয় পাহাড়ী এলাকায় ফিরে যাবার ইচ্ছার ভিতরে কোনো বিরোধ নেই।

বাবরের কথামতো, তার দেহ কাবুলে পৌঁছাবার পরে পাহাড়ের ধারে বাবরের নিজের তৈরি উদ্যানে একটা সাধারণ মার্বেলের ফলকের নীচে তার বন্ধু বাবুরীর পাশে যেনো তাকে সমাহিত করা হয়। সেখানেই তার আম্মিজান আর নানীজানের কবর। বাবরের ইচ্ছা অনুসারে তার কবরের উপরে কোনো বড় সমাধিসৌধ নির্মাণ করা হবে না। আকাশের বিশাল শামিয়ানার নিচে প্রথম মোঘল সম্রাটের সমাধি বাতাস আর বৃষ্টির মাঝে অবারিত থাকবে।

হুমায়ুন আড়চোখে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কামরান, আসকারী আর হিন্দালের দিকে তাকায়। তাদের বিষণ্ণ মুখ বলে দেয় তারাও তার মতো দুঃখী এবং এখনকার মতো তাদের ভিতরে কোনো বিভেদ নেই। কিন্তু এই একতার স্থায়িত্ব কতোদিন? তারা কি সাম্রাজ্য তাদের ভিতরে ভাগ না করে একা হুমায়ুনকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করে গিয়েছেন বলে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে না। উচ্চাশা অভিযানের আকাক্ষা আর তার ফলে প্রাপ্ত ক্ষমতার মোহ তাকে বহুদিন ধরেই তাড়িত করছে- সেই একই ক্ষুধা তাদের ভিতরেও জাগ্রত হবে। বিশেষ করে কামরানের মাঝে, যে বয়সে প্রায় তারই সমান। কামরানের স্থানে থাকলে কি সেও ক্ষুব্ধ হতো না? কিংবা আসকারী? এমনকি পিচ্চি হিন্দালও শীঘ্রই পৃথিবীকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করবে। সম্রাটের সব সন্তানই চাইবে নিজের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যকে নতুন মহিমায় সিক্ত করতে। বাবরের স্মৃতি আর ভাই ভাইয়ের ভিতরে বিদ্যমান ভ্রাতৃত্ববোধ কতোদিন বজায় থাকবে। তারা হয়তো মাংসের চারপাশে ঘুরঘুর করতে থাকা কুকুরের পালে পরিণত হবে। হুমায়ুন কি করছে বুঝতে পেরে সে সরে আসে। তখনও তার বাকি ভাইয়েরা শববাহী বহরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বহরটা একটা বাঁকের কাছে পৌঁছে আগ্রা শহরের ভিতর দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। পেছনে কেবল একটা কমলা রঙের ধূলোর মেঘ পড়ে থাকে।

“তোমার সৎ-ভাইদের বিরুদ্ধে কোনো ক্ষোভ পোষণ করবে না…তাদের ভালোবাসবে…তাদের ভিতরে সমঝোতা বজায় রাখবে…” হুমায়ুনের মাথার ভেতরে স্নেহপরায়ণ বাবার শেষ আদেশের কথা ঘুরতে থাকে। সে বাবরের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং সেটা সে বজায় রাখবে। সেটা বজায় রাখাটা একটা কঠিন কাজ হবে এবং তাকে সংযমের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে হবে। বাবরের কথাগুলো একভাবে দেখতে গেলে একটা সতর্কবাণী…পুরুষানুক্রমে তৈমূরের বংশধরেরা নিজেদের ভিতরে লড়াই করে শেষ হয়ে গিয়েছে। ভাই ভাইয়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে, এবং নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে তারা দুর্বল হয়ে পড়েছে। উজবেকদের মতো বহিঃশত্রুর সহজ শিকারে তখন তারা পরিণত হয়েছে। নতুন মোঘল সম্রাট হিসাবে সে হিন্দুস্তানে এই রীতির সূচনা করতে দিবে না। এটা তার পবিত্র দায়িত্ব।

হুমায়ুন তার হাতের তৈমূরের ভারী আংটিটা দেখে, একটা অনভ্যস্ত ওজন, যেখানে একটা বাঘের মূর্তি খোদাই করা রয়েছে। অনেক লড়াই, অনেক বিজয়, আংটিটা দেখেছে…তার হাতে আংটিটা আর নতুন কি দেখবে। তার হাতে থাকা অবস্থায় এটা কি বিপর্যয় নাকি গৌরবের অংশীদার হবে। সেটা তার এখনই জানবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যাই ঘটুক সে তার বাবার স্মৃতি বা তার সাম্রাজ্যের জন্য কখনও অসম্মান বয়ে আনবে না। আংটিটা ঠোঁটের কাছে তুলে এনে তাতে আলতো চুমু খেয়ে সে নিরবে একটা প্রতিজ্ঞা করে: “আমি নিজেকে আব্বাজানের যোগ্য উত্তরসূরীতে পরিণত করবো এবং সারা পৃথিবী আমাকে সেজন্য স্মরণ করবে।”

.

ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা

বাবরের জীবন ছিলো যুদ্ধের রক্তে রাঙানো এক মহাকাব্য। তার জীবনে এত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো যে তিনি স্বয়ং সবকিছু তার স্বরচিত বাবরনামায় লিপিবদ্ধ করতে পারেননি। বাবরনামা ছিলো ইসলামের ইতিহাসের প্রথম আত্মজীবনী। বাবরনামায় তার জীবনের বেশকিছু সময়ের ঘটনার অনুপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। এই সামান্য ত্রুটি বাদ দিলে বাবরের জীবনের সকল প্রধান ঘটনাই বাবরনামায় পাওয়া যায়। যেমন তিনবার সমরকন্দ দখল, উজবেকদের সাথে বাবরের সংঘাত, উত্তর-পশ্চিম ভারতে হিন্দু আধিপত্য খর্ব করে মোঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা। সবকিছুই বাবরনামা আর অন্যান্য ঐতিহাসিক উৎস থেকে জানা যায়। আমি এই সব উল্লেখযোগ্য ঘটনা, তাদের ঐতিহাসিক পর্যায়ক্রম, বিচার বিশ্লেষণ, সংযোজন, পরিমার্জন করে এই গ্রন্থে বর্ণনা করেছি।

বাবরের নানী ছিলেন- এসান দৌলত, যার উপদেশ বাবর তরুণ বয়সে মেনে চলতো। বাবরের আম্মিজান- খুতলাঘ নিগার, বোন খানজাদা, তার বৈমাত্রেয় ভাই জাহাঙ্গীর, সবার অস্তিত্বই পাওয়া যায়। বাবরের পিতা আসলেই কবুতরের চবুতরা ভেঙে পড়ে নিহত হন। বাবরের ঐতিহাসিক শত্রু পারস্যের শাহ ইসমাইল, সাইবানি খান, দিল্লীর ইবরাহিম লোদী এইসব ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে এই উপন্যাস লিখিত হয়েছে। গল্পের ঘটনা প্রবাহের খাতিরে আরো কিছু নতুন চরিত্র সৃষ্টি করেছি, বাবরের জীবনে প্রভাবশালী লোকদের আদলে। ওয়াজির খান, বাইসানগার, বাবুরী তেমনই সব চরিত্র। অবশ্য বাবরনামাতে বাবুরী নামে একটা বাজারের ছেলের কথার উল্লেখ পাওয়া যায়। সামাজিক আর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যতোটা সম্ভব এই উপন্যাসে উলেখ করা হয়েছে। যেমন সুন্নী মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও সুরা, চরস, ভাণ প্রভৃতির প্রতি তার আসক্তির বর্ণনা বাবরনামায় পাওয়া যায়। এই উপন্যাসে অটোমান সাম্রাজ্য হতে প্রাপ্ত অস্ত্র আর সেটা ব্যবহারে বাবরের দক্ষতার তথ্য সত্য ঘটনার উপরে প্রতিষ্ঠিত।

একটা সময় আমি বাবরের জীবনের সব উল্লেখযোগ্য স্থান ভ্রমণ করেছি। বাবরের আদি জন্মভূমি ফারগানা, যা বর্তমান উজবেকিস্তান আর কাজিকিস্তানে অবস্থিত। আজও এলাকাটা আপেল, নাশপাতি আর এ্যাপ্রিকটের বাগান শোভিত। এখনও সেখানে ফুটবল আকৃতির তরমুজ হয়। এখনও এই অঞ্চলের নারী পুরুষ গ্রীষ্মকাল শেষ হলে হাতে ধরা কাস্তে দিয়ে ফসল কাটে। এখনও ভোলা আকাশের নীচে ভেড়া, ইয়াক চড়ে বেড়ায়।

বাবরের কবর কাবুলে অবস্থিত। যা বর্তমানে ইউনেসকোর আর্থিক সহায়তায় নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে। আমি খাইবার গিরিপথ দিয়ে উত্তর ভারতের মালভূমির উপর দিয়ে দিল্লি, আগ্রা গিয়েছি।

আমার এই দীর্ঘ যাত্রায় আমি যা দেখেছি, উপলব্ধি করেছি তাই লিপিবদ্ধ করেছি বাবরের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার নিদর্শন হিসাবে। বাবরের প্রতি আমার এই ভালোবাসা যোদ্ধা হিসাবে মোঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার কারণেই না বরং তার লেখনী, তার উদ্যানপ্রীতি, শিল্পসংস্কৃতির প্রতি উৎসাহ সবকিছুকে অনুপ্রাণিত করেছে।

বাবর মুসলমান চান্দ্র মাসের দিনপঞ্জি ব্যবহার করলেও আমি সেগুলো খ্রিস্টান দিনপঞ্জিতে রূপান্তরিত করেছি কেবলই বোঝার সুবিধার্থে।

Exit mobile version