“সেদিন বিকেলে একাই ছিলাম বাসায়। প্রদর্শনীর জন্যে ছবি আঁকার কথা ছিল, কিন্তু প্রচণ্ড গরমের মধ্যে কাজ করতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। তবুও সিদ্ধান্ত নেই যে একবার চেষ্টা করে দেখবো। তাই ছোট ফ্যানটা নিয়ে বাগানের ভেতরে স্টুডিওতে চলে যাই, আর তখন…”
“আর তখন?”
“ফোন বেজে ওঠে। গ্যাব্রিয়েল কল করেছিল জানাতে যে শট থেকে ফিরতে দেরি হবে।”
“এরকমটা কি প্রায়ই করতেন তিনি? আগেই ফোন করে জানিয়ে দিতেন যে দেরি হবে?”
যেন অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করেছি এমন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায় অ্যালিসিয়া। “না, কেন?”
“এমনটাও তো হতে পারে, আপনি ঠিক আছেন কি না সেটা জানার জন্যে ফোন দিয়েছিলেন গ্যাব্রিয়েল। কারণ ডায়েরিটা পড়ে আমার মনে হয়েছে, তখন আপনার মানসিক অবস্থা খুব একটা সুবিধের ছিল না।”
“ওহ, কিছুক্ষণ কথাগুলো নিয়ে ভাবলো অ্যালিসিয়া, এরপর মাথা নাড়লো ধীরভঙ্গিতে। “হ্যাঁ, হতে পারে।”
“আপনার কথার মাঝে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত। গ্যাব্রিয়েল ফোন করেছিলেন আপনাকে। এরপর কি হলো?”
“তাকে দেখি আমি,” দ্বিধান্বিত স্বরে বলল অ্যালিসিয়া।
“তাকে?”
“মানে ঐ লোকটাকে। জানালায় দেখি তার প্রতিবিম্ব। স্টুডিওতে ঢুকে পড়েছিল সে। একদম আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল।”
চোখ বন্ধ করে ফেলে অ্যালিসিয়া। লম্বা একটা সময় কিছু বলে না।
“লোকটা দেখতে কেমন ছিল?” যতটা সম্ভব কোমল স্বরে বললাম। “মনে আছে আপনার?”
জবাব দেয়ার আগে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকে অ্যালিসিয়া। “বেশ লম্বা…শক্তপোক্ত শরীর। কালো মুখোশ পরে থাকায় চেহারাটা দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু চোখ দেখতে পাচ্ছিলাম। কি মনে হচ্ছিল জানেন? যেন কালো দুটো গর্তের দিকে তাকিয়ে আছি।”
“তাকে দেখার পর কি করলেন?”
“কিছুই না। আসলে এত ভয় পেয়েছিলাম যে…অনেকক্ষণ তাকিয়েই থাকি তার দিকে। হাতে একটা ছুরি ছিল লোকটার। জিজ্ঞেস করি, কি চায় সে। কোন জবাব দেয় না। তখন বলি যে রান্নাঘরের টেবিলে আমার ব্যাগে টাকা আছে। টাকার কোন দরকার নেই আমার’-হেসে বলে লোকটা। ওরকম জঘন্য কাঁচভাঙা হাসি আগে কখনো শুনিনি। ছুরিটা আমার গলায় চেপে ধরে সে, আরেকটু হলেই গলার চামড়ায় কেটে বসতো ধারালো ফলাটা। চুপচাপ কোন শব্দ না করে তার সাথে বাসার ভেতরে যেতে বলে।”
দৃশ্যটা মনে করার সময় আবারো চোখ বন্ধ করে ফেললো অ্যালিসিয়া। “আমাকে স্টুডিও থেকে লনে বের করে আনে সে। এসময় গেইটের দিকে চোখ যায় আমার। ভাবি যে কোনমতে যদি একবার গেইট পর্যন্ত পৌঁছুতে পারি, তাহলে হয়তো বেঁচে যাবো। সেটাই আমার বাঁচার একমাত্র পথ। তাই মনে সাহস জড়ো করে জোরে একটা লাথি কষাই লোকটার হাঁটু বরাবর, এরপর গেইটের উদ্দেশ্যে দৌড় দেই।” চোখ খুলল অ্যালিসিয়া, মুখে হাসি। “কয়েক সেকেন্ডের জন্যে আসলেও মুক্তি পেয়েছিলাম।”
এর পরেই হাসিটা মিইয়ে গেল।
“তখন…তখন পেছন থেকে আমার ওপরে লাফ দেয় লোকটা। মাটিতে পড়ে যাই আমরা। শক্ত করে এক হাতে চেপে ধরে আমার মুখ। ছুরির শীতল ফলার স্পর্শ টের পাই আবারো হুমকি দেয় যে টু শব্দ করলেও মেরে ফেলবে। কয়েক সেকেন্ড ওভাবেই থাকি। তার নিশ্বাস টের পাচ্ছিলাম মুখের ওপরে। এরপর আমাকে টেনে তুলে বাসার ভেতরে নিয়ে যায়।”
“এরপর? এরপর কি হলো?”
“দরজা বন্ধ করে দেয় সে। ভেতরে আটকা পড়ে যাই।”
ভারি হয়ে আসছে অ্যালিসিয়ার শ্বাস-প্রশ্বাস। দুই গালে রক্তিম আভা। বোধহয় একটু বেশিই চাপ দিয়ে ফেলছি তাকে।
“কিছুক্ষণের জন্যে বিরতি নেয়া যাক।”
মাথা ঝাঁকিয়ে মানা করে দিল অ্যালিসিয়া। “নাহ, দরকার নেই। কথাগুলো বলার জন্যে অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করে আছি আমি।”
“আপনি নিশ্চিত? কিছুক্ষণ বিরতি নিলে কিন্তু কোন সমস্যা হবে না।”
“একটা সিগারেট হবে আপনার কাছে?” কিছুক্ষণ ইতস্ততার পর জিজ্ঞেস করে সে।
“সিগারেট? আপনি ধূমপান করেন এটা তো জানতাম না।”
“নাহ, করি না। মানে…আগে করতাম। আছে আপনার কাছে?”
“আপনি কী করে বুঝলেন, আমি সিগারেট খাই?”
“গন্ধ পেয়েছি।”
“ওহ,” লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে উঠে দাঁড়াই। “ঠিক আছে। বাইরে চলুন তাহলে।”
.
৪.১৩
ক্লিনিকের চত্বরে রোগিদের ভিড়। অন্যান্য সময়ের মতনই দল বেঁধে আলাপ করছে অনেকে, সিগারেট খাচ্ছে। আবার অনেকে শীতের কারণে দুই হাত বকের ওপর ভাজ করে রেখেছে।
একটা সিগারেট নিয়ে মুখে দিল অ্যালিসিয়া। তার হয়ে আমি জ্বালিয়ে দিলাম ওটা। লম্বা একটা টান দিল সে, একদম লাল হয়ে উঠলো সিগারেটের মাথাটা। তার চোখজোড়া আমার দিকে, দৃষ্টিতে হালকা বিদ্রূপ।
“আপনি ধরাবেন না? নাকি রোগিদের সাথে সিগারেট খাওয়া মানা?”
আমার সাথে ঠাট্টা করছে সে, ভাবলাম। তবে এটা ঠিক যে গ্রোভের স্টাফ আর রোগিদের একসাথে ধূমপানের ব্যাপারে কোন বিধিনিষেধ নেই। তবুও স্টাফরা সাধারণত আড়ালেই ধূমপান করে। আজ অবধি রোগিদের সামনে কাউকে সিগারেট ধরাতে দেখিনি। এখন যদি আমি সিগারেট বের করে অনেকেই চোখ বাকাতে পারে। কেন যেন মনে হচ্ছে সবার দৃষ্টি আমাদের দিকে। হয়তো জানালা থেকে ক্রিস্টিয়ানও তাকিয়ে আছে। ওর বলা কথাটা মনে হল- বর্ডারলাইন রোগিদের একটা আলাদা আকর্ষণ থাকে। অ্যালিসিয়ার চোখের দিকে তাকালাম। আকর্ষণের ছিটেফোঁটাও নেই সেখানে, এমনকি কোন প্রকার আন্তরিকতারও ইঙ্গিত নেই। তীক্ষ্ণ দৃষ্টির আড়ালে অত্যন্ত বুদ্ধিমান একজন মানুষ লুকিয়ে আছে। অ্যালিসিয়া বেরেসনকে খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই।