এবারে প্রতিক্রিয়া দেখলাম তার মাঝে
মাথা তুলে আমার দিকে তাকালো অ্যালিসিয়া। সম্ভব হলে দৃষ্টিবাণে সেখানেই ছারখার করে ফেলত। তবে চোখ সরিয়ে নিলাম না আমি। ওর খুনে দৃষ্টির দিকে নির্মোহ ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকলাম।
“অ্যালিসিয়া। এটাই আমাদের শেষ সুযোগ। প্রফেসর ডায়োমেডেস জানেন না, আমি এখানে এসেছি। এভাবে যদি একের পর এক নিয়ম ভাঙতে থাকি তাহলে চাকরি হারাতে হবে। সেজন্যেই আজকের পরে আমাদের আর দেখা হবে না। বুঝতে পারছেন কি বলছি?”
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে দেখেই কথাগুলো বললাম। অ্যালিসিয়ার কাছ থেকে কোন প্রতিক্রিয়া পাবার আশায় নয়। আসলে কানাগলিতে ঘুরপাক খেতে খেতে অতিষ্ঠ আমি। কিন্তু এসময়…
প্রথমে ভাবলাম হয়তো কল্পনা করছি বা ভুলভাল শুনছি। অবাক চোখে তাকাই অ্যালিসিয়ার দিকে। বুকের ভেতরে কেউ হাতুড়িপেটা করছে। মুখ শুকিয়ে কাঠ।
“আপনি-আপনি কি…কিছু বললেন?”
আবারো নীরবতা নেমে আসলো ঘরটায়। নিঃসন্দেহে ভুল হয়েছে আমার। পুরোটাই কল্পনা করেছি। কিন্তু তখনই…আবারো ঘটলো ব্যাপারটা।
খুব ধীরে ধীরে নড়ছে অ্যালিসিয়ার ঠোঁট, যেন কথা বলতে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে।
“কি…” ফিসফিসিয়ে বলল সে। এরপর চুপ করে থাকলে কিছুক্ষণ। “কি..কি-”
কয়েক মুহূর্ত একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম দু’জন। আমার চোখ ভিজে উঠেছে। এই অশ্রু অবিশ্বাসের, কষ্টের আর কৃতজ্ঞতার।
“কি চাই আমি? আমি চাই আপনি কথা বলুন…আমার সাথে কথা বলুন, অ্যালিসিয়া-”।
আমার দিকে তাকিয়েই রইলো অ্যালিসিয়া। কিছু একটা ভাবছে। এরপর সিদ্ধান্তটা নিয়েই নিল।
“ঠিক আছে,” খুব ধীরে মাথা নেড়ে বলল সে।
.
৪.১০
“কী বলেছে?”
বিস্ফোরিত নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন প্রফেসর ডায়োমেডেস। ক্লিনিকের বাইরে একসাথে ধূমপান করতে বেরিয়েছিলাম আমরা। তিনি যে যারপরনাই বিস্মিত, সেটা হাত থেকে চুরুট পড়ে যেতে দেখেই বুঝেছি। উত্তেজনায় রীতিমত টগবগ করে ফুটছেন। “কথা বলেছে সে? অ্যালিসিয়া আসলেও কথা বলেছে?”
“হ্যাঁ।”
“অসাধারণ! তাহলে তুমি ঠিকই ছিলে। ভুলটা হয়েছে আমার।”
“আরে নাহ, এভাবে বলবেন না। আপনার অনুমতি ছাড়া অ্যালিসিয়ার সাথে দেখা করাটা আমার উচিৎ হয়নি, প্রফেসর। মাফ করবেন। কেন যেন মনে হচ্ছিল-”
হাত নেড়ে আমার কথা উড়িয়ে দেন ডায়োমেডেস। “তোমার মন যেটা বলছিল, সেটাই করেছে। আমি হলেও এরকমটাই করতাম, থিও। নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস থাকাটাই সবথেকে জরুরি।”
এই অগ্রগতিকেই বিজয় ধরে নিতে রাজি নয় আমি। “আমাদের কাজ কিন্তু শেষ হয়নি। এটা ঠিক যে অ্যালিসিয়ার কথা বলাটা আসলেও বিশাল একটা অগ্রগতি। কিন্তু এই নিশ্চয়তা এখনও দেয়া সম্ভব নয় যে সে আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না।”
মাথা নেড়ে আমার কথার সাথে সম্মতি জ্ঞাপন করলেন ডায়োমেডেস। “ঠিক বলেছো। আমাদের অতিসত্বর একটা ফর্মাল রিভিউয়ের ব্যবস্থা করে ফেলতে হবে। এছাড়া জুলিয়ানের মত ট্রাস্টের কাউকে প্যানেলে নিয়ে অ্যালিসিয়ার সাথে যদি একটা বৈঠকের আয়োজন করা যায়, যেখানে-”
“একটু বেশি তাড়াতাড়িই সব ভেবে ফেলছেন, প্রফেসর। আমরা আরেকটু অপেক্ষা করে দেখি। এরপর নাহয় ঘোষণা দেয়ার কথা ভাববো। আপাতত ধৈৰ্য্য ধরা যাক।”
মাথা নাড়লেন ডায়োমেডেস। আমার কথা বুঝতে পারছেন। “সাব্বাশ থিও, তোমাকে নিয়ে গর্ব হচ্ছে আমার,” কাঁধে হাত রেখে একদম মন থেকে বললেন কিছুক্ষণ পর।
একজন বাবা তার ছেলেকে বাহবা দিলে যেরকম গর্ব অনুভব হয়, আমারো সেরকমই লাগছে এখন। আসলে অবচেতন মনে আমি নিজেও চাচ্ছিলাম আমার কাজের মাধ্যমে ডায়োমেডেসকে খুশি করতে, তার আস্থার প্রতিদান দিতে। তাই কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। সেটা ধামাচাপা দেয়ার জন্য অন্যদিকে তাকিয়ে সিগারেট ধরালাম। “এখন কি করবো?”
“যা করছে সেটা চালিয়ে যাবে। নিয়মিত দেখা করবে অ্যালিসিয়ার সাথে।”
“আর যদি স্টেফানি জানতে পারে?”
“স্টেফানিকে নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না, ওকে আমি সামলাবো। এখন তোমার একমাত্র লক্ষ্য অ্যালিসিয়া। সেদিকেই মনোযোগ দাও।”
গুরুর আদেশ শিরোধার্য।
***
পরবর্তী সেশনে অ্যালিসিয়ার সাথে অনর্গল কথা বললাম। আসলে, অ্যালিসিয়াই বলেছে যা বলার, আমি কেবল শুনে গেছি। এতদিনের মৌনতার পর অ্যালিসিয়ার মুখ থেকে কথা শুনতে আসলেও অদ্ভুত লাগছিল। প্রথমদিকে একটু ইতস্ততবোধ করলেও ধীরে ধীরে জড়তা একদম কেটে যায় তার। শুনলে মনেই হবে না, এই মানুষটাই এতদিন চুপ করে ছিল। অবশ্য এক অর্থে, মুখ কখনোই বন্ধ করেনি সে।
সেশন শেষে আমার অফিসে ফিরে এলাম। ডেস্কে বসে অ্যালিসিয়ার কাছ থেকে সদ্য শোনা কথাগুলো দ্রুত লিখে ফেললাম, যাতে পরে ভুলে না যাই। চেষ্টা করলাম যতটা সম্ভব নিখুঁতভাবে সবকিছু লিখতে।
গল্পটা যে অসাধারণ, সেটা নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। আপনারা নিজেরাও সেটা বুঝতে পারবেন।
তবে বিশ্বাস করা না করা আপনাদের মর্জি।
৪.১১ থেরাপি রুমে
৪.১১
থেরাপি রুমে আমার মুখোমুখি চেয়ারটায় বসে আছে অ্যালিসিয়া।
“শুরু করার আগে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাচ্ছিলাম। কিছু বিষয় এখনও পরিস্কার হয়নি…”
কোন জবাব দিল অ্যালিসিয়া। সেই অভিব্যক্তিহীন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
“আসলে, আমি আপনার এই দীর্ঘদিন মুখ বন্ধ রাখার ব্যাপারটা বুঝতে চাইছি। জানতে চাই যে কেন কথা বলা থামিয়ে দিয়েছিলেন।”